Site icon BnBoi.Com

এক ডজন একজন – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

এক ডজন একজন – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

১. যখন একটি বাসা

যখন একটি বাসা দেখতে খুবই সাধারণ কিন্তু আসলে সেটি অসাধারণ

বাসাটা দেখে প্রথমে কেউই বুঝতে পারবে না যে এটা অত্যন্ত বিচিত্র একটা বাসা। বাইরে থেকে দেখতে এটা খুবই সাধারণ। হালকা হলুদ রঙের চারতলা একটা বিল্ডিং, পাশে বেশ খানিকটা খালি জায়গা, সেখানে নানা সাইজের গাছ। কিন্তু কেউ যদি একটু খুঁটিয়ে দেখে তাহলেই তার মনের ভিতরে নানারকম খটকা লাগতে শুরু করবে। যেমন বাসার গেটের পাশে কালো রঙের গ্রানাইট পাথরে রূপালি অক্ষরে খুব সুন্দর করে লেখা আছে, খা খা খা বক্কিলারে খা! একটা বাসার সামনে কেন এই কথাগুলো লেখা থাকবে সেটা নিয়ে যে কোনো মানুষের মনে সন্দেহ হতে পারে। আসলে এটা এই বাসার নাম।

মানুষ বাসার নাম রাখে নাহার মঞ্জিল কিংবা চৌধুরী ভিলা। যারা আধুনিক তারা নাম রাখে ব্ল্যাকবেরী কিংবা সানথিলা। যাদের ভেতরে একটা কবি কবি ভাব আছে তারা নাম রাখে নিশীথে কিংবা বনলত। তাই বলে খা খা খা বৰ্কিলারে খা? এটা কী কখনো একটা বাসার নাম হতে পারে? এই বাসার মানুষগুলোর সাথে সেটা নিয়ে কথা বলে লাভ নেই, একটা বাসার নাম যে খা খা খা বৰ্কিলারে খা হতে পারে না সেটা তারা জানেই না। বাংলার একজন প্রফেসর তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে বকিলা বলে কোনো শব্দ নেই, শব্দটা বখিল বা কৃপণ। সাপুড়েরা সাপের খেলা দেখানোর সময় যারা পয়সা দিতে চায় না তাদেরকে ভয় দেখানোর জন্য এটা বলে। কিন্তু এই বাসার মানুষগুলোর শব্দের অর্থ বা উচ্চারণ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই, একটা কথা তাদের পছন্দ হয়েছে, ব্যাস, সেটা দিয়েই তাদের বাসার নাম রেখে ফেলেছে।

বাসাটা যদি কেউ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তাহলে তার ভেতরে আরো কিছু বিষয় নিয়ে খটকা লাগতে পারে। যেমন ধরা যাক সবচেয়ে বড় গাছের ওপরে কাঠ, বাঁশ প্লাইউড এবং প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি ঘরটার কথা। কেন। একটা গাছের উপর ঘর সেটা এমনিতে কেউ বুঝতে পারবে না, কিন্তু যারা এই বাসা আর বাসার মানুষজনকে চিনে তারা জানে এই বাসার একজন একবার ঠিক করেছিল যে সে তার বাকি জীবন গাছের উপর কাটিয়ে দিবে। এবং সেজন্যে গাছের উপর এই ঘরটা তৈরি করা হয়েছিল। অন্য কোনো কারণ নয় গাছের উপর থেকে বাথরুম করার অসুবিধের জন্যে শেষ পর্যন্ত এই অসাধারণ পরিকল্পনাটা বাতিল করতে হয়েছিল।

যদি কেউ আরেকটু এগিয়ে এসে আরেকটু ভালো করে লক্ষ্য করে তাহলে দেখবে দোতালা থেকে একটা মোটা দড়ি একটা গাছের মগডালে বেঁধে রাখা হয়েছে। বাইরের মানুষজন কোনোদিন কল্পনাও করতে পারবে না এই বাসার সবচেয়ে দুষ্টু ছেলেটা এই দড়ি ধরে ঝুলে গাছের মগডালে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। সত্যি সত্যি সে পৌঁছেও গিয়েছিল কিন্তু নিজেকে সামলাতে না পেরে প্রচণ্ড বেগে সে গাছের ডালে ধাক্কা খেয়েছিল। সেই ধাক্কায় তার সামনের দুটো দাঁত এবং নাকের হাড়টা ভেঙ্গে গিয়েছিল। সামনের দুটো দাঁত আবার উঠেছে কিন্তু নাকের হাড়টা আর জোড়া লাগেনি বলে তার নাকটা একটু বাঁকা। সেটা নিয়ে কেউ খুব বেশি দুশ্চিন্তা করে না। কারণ সবাই জানে সে যখন আস্তে আস্তে আরো বড় হবে তখন নাকের হাড় থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ভেঙ্গেচুরে যাবে, কেটে-কুটে যাবে, ঝলসে এবং পুড়ে যাবে। এই বাসার মানুষজন জানে যে এই অসাধারণ দুষ্টু, ছেলেটির দুষ্টুমির ঘটনাগুলো ছবি তুলে কিংবা ভিডিও করে রাখা দরকার, কারণ এরকম অকাট্য প্রমাণ না দিলে ভবিষ্যতে কেউ বিশ্বাস করবে না যে একজন মানুষের মাথা থেকে এরকম বিচিত্র দুষ্টুমির আইডিয়া বের হতে পারে। পৃথিবীতে গণিত কিংবা বিজ্ঞানের অলিম্পিয়াড হয় দুষ্টুমির অলিম্পিয়াড হলে এই দুষ্টু বাচ্চাটি দেশের জন্যে অনেকগুলো গোল্ড মেডেল নিয়ে আসতে পারতো।

কেউ যদি এই বিচিত্র বাসাটা আর তার এক পাশের ফাঁকা জায়গাটা আরো ভালো করে লক্ষ্য করে তাহলে সে আরো বিচিত্র কিছু জিনিস দেখতে পাবে। যেমন ফাঁকা জায়গাটার মাঝামাঝি একটা বিদঘুটে গর্ত দেখে সে অবাক হয়ে ভাবতে পারে কেন এটা করা হয়েছিল। এটাও একটা পরিত্যক্ত প্রজেক্ট, একটা কুমিরকে পোষার জন্যে এখানে একটা পুকুর খোদাই করার চেষ্টা করা হয়েছিল। সেই পুকুরে প্রচুর পানি আর লবণ ঢালা হয়েছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত কুমিরের বাচ্চা জোগাড় করা যায়নি বলে এই প্রজেক্টটা বাতিল করতে হয়েছিল। এই গর্তটাকে কী কাজে লাগানো যায় সেটা নিয়ে এই বাসার মানুষজন মাঝে মাঝেই চিন্তা ভাবনা করে। এখন পর্যন্ত যতগুলো প্রস্তাব এসেছে তার মাঝে সবচেয়ে ভালো প্রস্তাবটি দিয়েছেন এই বাসার সবচেয়ে বয়স্ক মানুষটি। তার নাম রাহেলা খাতুন কিন্তু তাকে এই নামে ডাকার মতো কেউ নেই। তার ছেলে মেয়ে এবং ছেলের বউ আর মেয়ের জামাইরা তাকে মা বলে ডাকে। তার নাতি নাতনিদের তাকে দাদি কিংবা নানি ডাকার কথা, কিন্তু তারা নানি দাদি ডাকার পাশাপাশি মাঝে মাঝেই তাকে মা ডেকে ফেলে। যদিও রাহেলা খাতুনের অনেক বয়স হয়েছে কিন্তু তার চেহারায় মোটেও বয়সের ছাপ পড়েনি, তার মাথার চুল এখনো কালো, মুখের চামড়া মসৃণ এবং দাঁতগুলো ঝকঝকে। যারা তাকে চেনে না তারা তাকে তার ছেলে মেয়ের বড়বোন বলে সন্দেহ করে।

বাসার সামনে এই বিদঘুটে গর্তটাকে কী কাজে লাগানো যায় সেটা নিয়ে যখন আলোচনা হচ্ছিল তখন রাহেলা খাতুন তার নাতি নাতনিদের বলেছিলেন, আমি মরে গেলে তোরা এই গর্তে আমাকে পুতে ফেলিস।

রাহেলা খাতুন হাল্কা পাতলা হাসি খুশি মানুষ তার শরীরে কোনো রোগ বালাই নেই। তার নাতি নাতনিরা তাকে অসম্ভব পছন্দ করে, রাহেলা খাতুন কোনো একদিন মরে যাবেন সেটা তারা কল্পনাও করতে পারে না। তারপরেও তারা গজ ফুট ফিতে দিয়ে তাকে মেপে দেখে বের করেছে যে রাহেলা খাতুন যদি তার পাগুলো ভাঁজ করে উত্তর পূর্ব থেকে দক্ষিণ পশ্চিমে কোনাকোনি ভাবে কবরস্থ হতে রাজি থাকেন তাহলে তাকে বাসার পাশে এই গর্তে পুতে ফেলা সম্ভব। রাহেলা খাতুন একশর্তে হাসিমুখে পা ভাঁজ করে কোনাকুনি ভাবে কবরস্থ হতে রাজি হয়েছেন, শর্তটি হলো তার কবরের ভেতর একটা টিউব লাইট লাগিয়ে দিতে হবে। অন্ধকার কবরের কথা চিন্তা করলেই তার নাকী ভয়ে বুক ধ্বক ধ্বক করতে থাকে। রাহেলা খাতুনের নাতি নাতনিরা বলেছে শুধু টিউব লাইট নয় তারা চার্জার সহ একটা মোবাইল টেলিফোনও কবরের ভিতরে দিয়ে দেবে। রাহেলা খাতুন ইচ্ছে করলেই কবরের ভেতর থেকে তার নাতি নাতনিদের মিসকল দিতে পারবেন, এবং তখন তারা ফোন করে তার খোঁজ খবর নেবে।

বাইরের মানুষের অবশ্যি এই ভেতরের খবরগুলো জানার কথা না, তাই তারা এই গর্তটা দেখে বড়জোর একটু অবাক হতে পারে তার বেশি কিছু নয়। তবে তারা যদি আরেকটু ভালো করে লক্ষ্য করে তাহলে অবাক হবার মতো আরো কিছু বিষয় পেতে পারে। যেমন খোলা জায়গাটার এক কোনায় অনেকটুকু জায়গা জুড়ে যে পোড়া দাগটা আছে, তাদের মনে সন্দেহ হতে পারে এটা কোথা থেকে এসেছে! এই বাসার যে বাচ্চাটির মাথায় বৈজ্ঞানিক আইডিয়া গিজগিজ করছে সে তার রকেট তৈরি করার জন্যে যে জ্বালানী আবিষ্কার করেছিল সেটার প্রথম পরীক্ষাটি এখানে করার চেষ্টা করা হয়েছিল। তখন সেখানে দাউ দাউ করে যে আগুন লেগেছিল সেটা এই এলাকার মানুষজন অনেকদিন মনে রাখবে।

মানুষজন যদি কৌতূহলী হয়ে আরো ভালো করে লক্ষ্য করে তাহলে তারা দেখবে একটা গাছের ডাল থেকে একটা মরা কাক ঝুলছে। কেন্দ্র একটা মরা কাক গাছ থেকে ঝুলছে সেই কারণটা কেউ জানে না, যে ঝুলিয়েছে সে নিজেও জানে না। তবে এটা ঝোলানোর পর দুইদিন এই এলাকার মানুষ কাকের কা কা চিৎকারে এক মুহূর্তের জন্যেও শান্তিতে থাকতে পারে নাই।

ভালো করে লক্ষ্য করলে মানুষজন এখানে দুটি ছাগলকে ঘুরে বেড়াতে দেখবে, একটির রং সবুজ অন্যটির গোলাপি। ছাগলের রং কখনোই সবুজ বা গোলাপি হতে পারে না তাই এটা অনুমান করা মোটেও কঠিন নয় যে এই দুটো ছাগলকে রং করা হয়েছে। কোরবানীর জন্যে ছাগল দুটো কেনা হয়েছিল কিন্তু বাচ্চাদের এই ছাগল দুটোর জন্যে মায়া পড়ে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত সেগুলোকে জবাই করা হয়নি। এই অংশটুকু বোঝা সম্ভব কিন্তু কেন ছাগল দুটোকে রং করতে হলো সেটা কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। একটু ভালো করে লক্ষ্য করলে একটা বাঘের বাচ্চাকেও ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়, এই বাসার গাছ গাছালীর ভেতর একটা আস্ত রয়েল বেঙ্গল টাইগার ঘুরে বেড়াচ্ছে সেটা দেখে যে কেউ অবাক হয়ে যেতে পারে। কিন্তু একটু ভালো করে লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় এটা মোটেও বাঘ নয়, এটা একটা বিড়াল। হলুদের উপর কালো ডোরাকাটা দাগ দেখে এটাকে প্রথমে বাঘের বাচ্চা মনে হলেও এটা মিউ মিউ করে ডাকে এবং এর ভেতরে বাঘের কোনো তেজ নেই। এই বাসার মানুষজন কেন একটা বিড়ালকে ধরে রং করে বাঘের বাচ্চা বানানোর চেষ্টা করেছে সেটা কেউ কখনো বুঝতে পারে নাই।

বিকেল বেলার দিকে এলে বাচ্চা কাচ্চাদের চেঁচামেচি এবং হই চই শুনে যে কেউ চমৎকৃত হবেন। শুধু এই বাসার বাচ্চারা নয়, তখন পাড়ার সব বাচ্চারা এখানে এসে হাজির হয়। এই ভোলা জায়গায় নানারকম খেলা চলতে থাকে, তবে সবচেয়ে দর্শনীয় হয় ফুটবল খেলা। মানুষজন সাধারণত ফাঁকা মাঠে ফুটবল খেলে কিন্তু এখানে ছোট বড় অনেক গাছের ফাঁকে ফাঁকে ফুটবল খেলা হয়। এখানে ফুটবল খেলার উত্তেজনা অনেক বেশি কারণ, খেলার সময় ফুটবল যে কোনো সময় যে কোনো গাছে লেগে সম্পূর্ণ উল্টো দিকে চলে যেতে পারে। কেউ যদি এই মাঠের ফুটবল খেলাটা ভালো করে লক্ষ্য করে তাহলে তারা অবাক হয়ে আবিষ্কার করবে যে এখানে মানুষের পায়ে লেগে যত গোল হয়েছে তার থেকে অনেক বেশি গোল হয়েছে গাছের গুঁড়িতে বল লেগে। শুধু যে বল গাছে ধাক্কা খায় তা নয়, যারা ফুটবল খেলছে তারাও যে কোনো সময় যে কোনো গাছে ধাক্কা খেয়ে উলটে পড়তে থাকে। যারা গোলকিপারের দায়িত্বে থাকে তারা সুবিধেজনক উত্তেজনায় গোলকিপাররা মাঝে মাঝে মাঠের মাঝখানে চলে যায় তখন হঠাৎ করে বল চলে এলে তারা কাছাকাছি যে কোনো দুটো গাছ দিয়ে গোলপোস্ট তৈরি করে নেয়। যারা ফুটবল খেলে তারা এসব ছোটখাটো খুঁটিনাটি নিয়ে মাথা ঘামায় না। মাঠের দুই পাশে দুটো গোলপোস্ট নিয়ে খেলা শুরু হলেও একবার মাঠের একই দিকে দুটো গোলপোস্ট চলে এসেছিল সেরকম উদাহরণও আছে। এখানে ছেলেরা এবং মেয়েরা সমান ভাবে ফুটবল খেলে। ছোট বড় মাঝারী যে কোনো সাইজের প্লেয়ার চলে এলেও তাকে নিয়ে নেয়া হয়। এখানে যারা খেলে এবং যারা খেলা দেখে সবাই সমানভাবে আনন্দ পায়। খেলার মাঠের দিকে মুখ করে থাকা চারতলা দালানের একতালার জানালার সবগুলো কাঁচ যে ভাঙা তার সাথে এই ফুটবল খেলার একটা সম্পর্ক আছে।

যারা শুধু বাইরে থেকে এই বাসাটি দেখে চোখ কপালে তুলে চলে যায় তারা অবশ্য কল্পনাও করতে পারবে না বাসার ভেতরে কী ঘটছে। তবে তারা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারবে, ভেতরের মানুষগুলো নিশ্চয়ই খুব বিচিত্র। তা না হলে একটা বাসায় এরকম ঘটনা কেমন করে ঘটতে পারে। তাদের ধারণা সত্যি, এই বাসার ভেতরের মানুষগুলো বাসাটির মতোই বিচিত্র।

এই বাসায় রাহেলা খাতুন তার ছেলেমেয়ে আর নাতি নাতনিদের নিয়ে থাকেন। জমিটা তার স্বামী বহু বছর আগে কিনে রেখে গিয়েছিলেন। কোনোদিন এখানে ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকতে পারবেন ভাবেননি। তার প্রধান কারণ জমিটা যখন প্রথম কেনা হয় তখন সেটা ছিল সাতফুট পানির নিচে। কোনো একদিন সেটা ভরাট করা হবে এবং সেখানে বাড়িঘর করা হবে কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। রাহেলা খাতুনের স্পষ্ট মনে আছে তিনি কীভাবে তার এই জমিটা দেখতে গিয়েছিলেন।

রাহেলা খাতুনের স্বামীর নাম ছিল আসাদ রহমান, সরকারি ব্যাংকে ছোট একটা চাকরি করতেন। তাদের খুব টানাটানির সংসার, বিয়ের পর দেখতে দেখতে তিনটা বাচ্চা হয়ে গেছে। এর মাঝে আসাদ ব্যাংক থেকে টাকা ধার করে কোন দুনিয়ায় একটা জমি কিনে ফেললেন। জমি কেনার পর থেকে তার উৎসাহে মাটিতে পা পড়ে না। তাই একদিন রাহেলা খাতুনকে সেই জমি দেখাতে নিয়ে গেলেন। রাহেলা খাতুন তার একমাত্র সিল্কের শাড়ি পরে সেজে গুঁজে জমি দেখতে গেলেন। সাথে তার তিন ছেলে মেয়ে। বড়জন ছেলে, নাম মাসুদ, তার বয়স পাঁচ, দ্বিতীয়জন মেয়ে, নাম মিলি, তার বয়স তিন এবং ছোটজন ছেলে, নাম মতিন, বয়স মাত্র এক।

প্রথমে বাসে করে যেতে হলো এবং বাসে বমি করতে করতে বড় ছেলেটি নেতিয়ে গেল। বাস থেকে নেমে রিকশা, রিকশা থেকে নেমে পায়ে হেঁটে যেতে হলো আরো কয়েক কিলোমিটার। রাহেলা খাতুনের কোলে ছোট জন, বড় দুইজন আসাদের সাথে, একজন ঘাড়ে আরেকজন কোলে। কাদামাটির রাস্তায় পিছল খেতে খেতে হেঁটে একটা বিশাল জলাভূমির সামনে দাঁড়িয়ে আসাদ বললেন, এই যে আমাদের জমি।

রাহেলা খাতুন বললেন, জমি কোথায়? এইটা তো দেখি পানি।

আসাদ বললেন, সেই জন্যেই তো সস্তায় পেয়ে গেলাম। শুকনা হলে কী আমার মতন মানুষ জমি কিনতে পারে?

রাহেলা খাতুন মাথা নাড়লেন, আসাদ এই কথাটা সত্যি বলেছে। জিজ্ঞেস করলেন, কোনখানে আমাদের জমি?

আসাদ মাথা চুলকে বললেন, শীতের সময় যখন পানি নেমে যাবে তখন দেখা যাবে। এখন পানির নিচে।

তবুও তো জায়গাটা দেখি। কোন জায়গায় পানির নিচে?

আসাদ আবার মাথা চুলকালেন, তারপর হাত তুলে দেখিয়ে বললেন, ঐ যে মাদারগাছটা দেখছো, মনে কর তার কুড়ি গজ দক্ষিণে।

রাহেলা খাতুন মাদারগাছ চিনেন না, কুড়ি গজ কতটুকু সেটা আন্দাজ করতে পারেন না, উত্তর দক্ষিণ কোন দিকে হয় সেটাও জানেন না কাজেই কিছুই বুঝলেন না। তবুও স্বামীকে খুশি করার জন্য বললেন, ও! বুঝেছি।

ঠিক তখন সেই পানির উপর দিয়ে একটা কাক উড়ে যাচ্ছিল এবং উড়ে যেতে যেতে সেই কাক পানিতে বাথরুম করে ফেললো। আসাদ তখন মহা উৎসাহে বললেন, দেখেছ? দেখছ? কাকটা যে বাথরুম করেছে দেখেছ?

রাহেলা খাতুন মাথা নাড়লেন, বললেন, দেখেছি।

যেখানে বাথরুম হয়েছে সেখানে আমাদের জমি।

আসাদ হাসি হাসি মুখে সাতফুট পানির নিচে তার জমির দিকে তাকিয়ে রইলেন। রাহেলা খাতুনকে বললেন, বুঝলে রাহেলা, নিজের এক টুকরা জমি থাকতে হয়। সেই মাটির উপর একটা ছাদ তৈরি করে এক ছাদের নিচে সবাইকে থাকতে হয়।

রাহেলা খাতুনের একবার মনে হলো আসাদকে মনে করিয়ে দেন যে মাটির কোনো নিশানা নাই, পুরোটাই পানির নিচে কিন্তু তিনি সেটা করলেন না। মানুষটা এত উৎসাহ নিয়ে দেখাচ্ছে এখন এই সব ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানো ঠিক হবে না। আসাদ কাকের বাথরুম করা পানির দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, একদিন আমি এইখানে বাড়ি তুলবো। সাত তালা বাড়ি। সেই সাত তালার নিচ তলায় থাকব তুমি আর আমি। দুই বুড়াবুড়ি। আর একেক তালায় থাকবে আমাদের একেক ছেলে মেয়ে।

রাহেলা খাতুন ভয়ে ভয়ে বললেন আমাদের ছেলে মেয়ে তো তিনজন।– আসাদ এক গাল হেসে বললেন, এখন তিনজন বলে সবসময় তিনজনই থাকবে নাকী? আমাদের আরো বাচ্চা কাচ্চা হবে না?

আরো হবে?

হ্যাঁ। কম পক্ষে ছয় জন। ঘর ভর্তি বাচ্চা কাচ্চা না হলে ভালো লাগে না।

ঠিক এই সময় তাদের বড় ছেলে মাসুদ রাহেলা খাতুনের শাড়ির আঁচল টেনে বলল মা।

রাহেলা খাতুন বললেন, কী হয়েছে?

মিলি-

মিলি তার মেয়ের নাম। জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে মিলির?

মিলি নাই।

রাহেলা খাতুন চমকে তাকিয়ে দেখেন সত্যি সত্যি মিলি নাই। তার মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল, আতংকে চিৎকার দিয়ে বললেন, কোথায় মিলি?

মাসুদ বরাবরই শান্ত স্বভাবের। সে খুবই শান্তভাবে পানির দিকে তাকিয়ে বলল, ঐ যে।

রাহেলা খাতুন দেখলেন, সামনে খোলা পানি সেখানে মিলি ডুবে যাচ্ছে। রাহেলা খাতুন সাথে সাথে পানিতে ঝাঁপ দিলেন।

তার কোলে ছিল ছোট ছেলে মতিন, তাকে মাটিতে রেখে নাকী তাকে নিয়েই পানিতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন তার মনে নাই। তার চেয়ে বড় কথা তিনি যে সাঁতার জানেন না তখন সেটাও তার মনে ছিল না। ভাগ্যিস সেখানে বেশি পানি ছিল না তাই মিলিকে টেনে তুলে ফেলেছিলেন, আসাদ তখন তাদের দুজনকে টেনে তুললেন। মিলি খক খক করে কাশতে লাগলো, রাহেলা খাতুন তার চুলের মুঠি ধরে ঝাকুনী দিয়ে বললেন, পাজি মেয়ে, তোকে পানির কাছে যেতে কে বলেছে?

রেগে একটা চড় দিতে যাচ্ছিলেন, আসাদ মেয়েটাকে টেনে সরিয়ে নিয়ে বললেন, আহা-হা-মারছ কেন?

মারব না তো মাথায় তুলে রাখব? আদর দিয়ে দিয়ে তুমি বাচ্চাগুলোকে নষ্ট করেছ।

আসাদ দুর্বল ভাবে হেসে বললেন, বাচ্চাদের আদর না করলে কাদের আদর করব?

সেদিন গভীর রাতে কাদামাখা অবস্থায় সবাই বাসায় ফিরে এসেছিলেন। রাহেলা খাতুন তার কাদামাখা সিল্কের শাড়িটা ধুয়ে পরিষ্কার করতে চেষ্টা করেছিলেন। খুব লাভ হয় নাই, তার সখের একমাত্র সিল্কের শাড়িটার রং উঠে বিতিকিচ্ছি হয়ে গিয়েছিল। আসাদ তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন চিন্তা করো না রাহেলা। ঈদের বোনাসটা পেলেই তোমাকে নতুন একটা সিল্কের শাড়ি কিনে দেবো।

সেই শাড়ি আর কিনে দেয়া হয় নাই। তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে টানাটানির সংসার, দুই বেলা খাওয়ার জোগাড় করতেই হিমশিম অবস্থা সিল্কের শাড়ি কেনার সময় কোথায়? তার মাঝেই আসাদ তার সাত তালা বাড়ির স্বপ্ন দেখতেন। কীভাবে সেই বাড়ি হবে কেউ জানে না, কিন্তু স্বপ্ন দেখতে তো দোষ নেই। নিজের এক টুকরো জমি সেখানে নিজের একটা বাড়ি, সেটা কীভাবে কীভাবে জানি তার মাথায় মাঝে ঢুকে গেল।

.

নিজের জায়গা ব্যাপারটা আসাদ যে কতো গুরুত্ব দিয়ে নিয়েছিলেন সেটা বোঝা গেল একাত্তর সালে। যখন যুদ্ধ শুরু হলো তখন একদিন রাত্রে আসাদ বলল, বুঝলে রাহেলা, নিজের জায়গা না হলে জীবনের কোনো দাম নাই। সবার আগে দেশ স্বাধীন করতে হবে, তারপরে অন্য কথা।

রাহেলা খাতুন ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন করে দেশ স্বাধীন হবে?

যুদ্ধ করে।

রাহেলা খাতুনের বুক কেঁপে উঠল, যুদ্ধ করে?

হ্যাঁ।

কে যুদ্ধ করবে?

সবাই করবে। আমিও করব।

রাহেলা খাতুন ফ্যাকাসে মুখে বললেন, তুমি কেমন করে করবে? তুমি তো নিজে থেকে একটা মুরগিও জবাই করতে পার না।

আসাদ মুখ শক্ত করে বললেন, মুরগি জবাই করা এক জিনিস আর যুদ্ধ করা অন্য জিনিস।

রাহেলা খাতুন ফ্যাকাসে মুখে বললেন, তুমিও যুদ্ধে যাবে?

আসাদ মাথা নাড়লেন। রাহেলা খাতুন বললেন, আমাদের কী। হবে?

অন্য সবার যা হয় তোমাদের তাই হবে।

কিন্তু

কিন্তু কী?

রাহেলা খাতুন মাথা নিচু করে বললেন, আমার যে পেটে বাচ্চা।

আসাদের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, হাতে কিল দিয়ে বললেন, আমার একটা ছেলের জন্ম হবে স্বাধীন দেশে।

রাহেলা খাতুন অবাক হয়ে আসাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সেই আসাদ সত্যি সত্যি একদিন যুদ্ধে চলে গেলেন।

.

একদিন দেশ স্বাধীন হলো, একজন একজন করে সবাই ফিরে এল শুধু আসাদ ফিরে এলেন না। রাহেলা খাতুন ঘরের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকতেন, খুট করে শব্দ হলেই ছুটে যেতেন দেখার জন্যে, ভাবতেন আসাদ এসেছেন। আসাদ আর কোনো দিনই ফিরে এলেন না। মানুষটা একেবারেই হারিয়ে গেল, যেন আসাদ নামে এই পৃথিবীতে কেউ কখনো ছিল না।

রাহেলা খাতুনের আসাদের জন্যে যতটুকু দুঃখ হয়েছিল তার থেকে অভিমান হয়েছিল অনেক বেশি, কেন মানুষটা তাকে এভাবে একা ফেলে রেখে চলে গেল? কেন কোনোদিন ফিরে এল না?

একদিন ছোট ছেলেটার জন্ম হলো, আসাদ যেরকম কল্পনা করেছিলেন ঠিক সেরকম স্বাধীন একটা দেশে। দেশটা স্বাধীন কিন্তু সেই দেশে বেঁচে থাকা খুব কঠিন। নূতন বাচ্চাটার নাম রেখেছেন জয়, ফুটফুটে একটা বাচ্চা কিন্তু তার মুখের দিকে তাকানোর সময় পান না। চারটা ছোট ছোট বাচ্চাকে নিয়ে বেঁচে থাকার জন্যে রাহেলা খাতুন যুদ্ধ শুরু করলেন। যে বাসায় থাকতেন সেই বাসাটা ছেড়ে বস্তির মতো একটা জায়গায় উঠে এলেন। এক ঘরে সবাই গাদাগাদি করে থাকেন বড় ছেলেটা মাঝে মাঝে বলে মা, লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে টেম্পোর হেলপার হয়ে যাই।

রাহেলা খাতুন বলতেন, খবরদার। তোর বাপ তোদের টেম্পোর হেলপার হওয়ার জন্যে জন্ম দেয় নাই।

রাহেলা খাতুন তার হাতের গয়না একটা একটা করে বিক্রি করে দিলেন। পুরানো একটা সেলাইয়ের মেশিন কিনলেন। দিনরাত সেটা দিয়ে ঘটর ঘটর করে কাপড় সেলাই করতেন। তখন কাপড়ের কী অভাব, তিনি খুঁজে পেতে ছোট ছোট কাপড়ের টুকরো জোগাড় করতেন, সেগুলো জোড়া দিয়ে শার্ট বানাতেন, জামা বানাতেন। সেগুলো বিক্রি করতেন। সবাই কম কম করে খেত, তিনি খেতেন আরো কম। কত রাত গিয়েছে যখন রাহেলা খাতুন শুধু এক গ্লাশ পানি খেয়ে শুয়ে পড়েছেন। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্যে সবকিছু বিক্রি করে দিয়েছিলেন- শুধু একটা জিনিস বিক্রি করেন নাই। সেইটা হচ্ছে সাতফুট পানির নিচে ডুবে থাকা জমিটা। সেই জমির দলিলটা একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটের মাঝে রাখতেন, পোকায় না কেটে ফেলে সেজন্যে সেখানেই দুইটা ন্যাপথলিন রাখতেন। মাঝে মাঝে খুলে দেখতেন দলিলটা ঠিক আছে কী না।

.

একদিন ছেলে মেয়েরা বড় হলো। রাহেলা খাতুন নিজে কিংবা আসাদ যেটা করতে পারেন নাই তার ছেলেমেয়েরা সেইটা করলো। মাটি দিয়ে জমি ভরাট হলো। আসাদ যেটুকু জমি কিনেছিল তার পাশে আরো খানিকটা জমি কেনা হলো। জমিটার একপাশে সাত তালার জায়গায় চারতলা একটা বাসা হলো। নিচ তালাটা রাখা হলো রাহেলা খাতুনের জন্যে। ছোট ছেলে জয় এখনো বিয়ে করেনি (কিন্তু বিয়ে হয়ে যাবে হয়ে যাবে এরকম একটা আভাষ আছে), সে থাকে রাহেলা খাতুনের সাথে। উপরের তিনটা ফ্ল্যাটে রাহেলা খাতুনের তিন ছেলে মেয়ে থাকে। চার তলার ছাদে আরেকটা ফ্ল্যাট তৈরি হওয়ার কাজ শুরু হয়ে থেমে গেছে সেখানে একটা বড় খালি রুম এই বাসার পাঁচ নাতি নাত্নির দখলে। রাহেলা খাতুনের চার ছেলেমেয়ের তিন বউ জামাই মিলে সাতজন, নাতি নাত্নি পাঁচজন, এই নিয়ে এক ডজন। রাহেলা খাতুনকে নিয়ে হলো এক ডজন একজন। এই নিয়ে এক ডজন একজন কাহিনীর শুরু হয়েছে এখান থেকে।

০২. যখন পাঁচ নাতি-নাত্নী

সময়টা হচ্ছে ২০০৫ সালের মাঝামাঝি। প্রত্যেকদিন সকালে জোবেদা খাতুন পত্রিকাটা খুলেই ওয়াক থু! ওয়াক থু! করে চেঁচামেচি শুরু করেন। তার স্বামী আসাদ রহমান এই দেশটার জন্যে যুদ্ধ করে মরেই গেছেন, শুধু যে মরে গেছেন তাই না একেবারে হারিয়েই গেছেন মানুষটা, মাটি পেয়েছেন কী না সেইটাও কেউ জানে না। সেই দেশে দুইজন রাজাকার এখন মন্ত্রী, পত্রিকায় তাদের ছবি ছাপা হলে রাহেলা খাতুন ওয়াক থু। বলতেই পারেন।

এমনিতে রাহেলা খাতুন খুবই হাসি খুশি মানুষ। কিন্তু আজকাল মাঝে মাঝেই মন খারাপ করে ফেলেন, কিছুতেই বুঝতে পারেন না এই দেশে কেমন করে রাজাকাররা মন্ত্রী হয়ে যাবে। তার ছেলে মেয়েরা এই বিষয়টা নিয়ে মায়ের সাথে কথা বলতে চায় না, বলার কিছু নাই সেটা হচ্ছে প্রধান কারণ। তবে তার নাতি নাতনিরা তাকে নানাভাবে ভরসা দিয়ে যাচ্ছে, তারা একেবারে কসম কেটে বলেছে একটু বড় হয়েই তারা দেশটাকে পরিষ্কার করে ফেলবে। কীভাবে কাজটা করা হবে সেটা নিয়ে কারোই কোনো ধারণা নাই কিন্তু সে জন্যে তাদের কোনো সমস্যা আছে বলে মনে হয় না।

রাহেলা খাতুনের পাঁচ নাতি নাতনির মাঝে সবচেয়ে বড় জনের নাম রিতু। তার বয়স এখন চৌদ্দ এবং সে ক্লাশ নাইনে পড়ে। আমাদের সাথে জমি দেখতে যাবার সময় মিলি নামে রাহেলা খাতুনের যে মেয়েটি পানিতে ডুবে গিয়েছিল রিতু তার বড় মেয়ে। এক কথায় রিতুর পরিচয় দিতে হলে বলা যায় সে হচ্ছে তার মায়ের মতো তেজী একজন মেয়ে। এই তেজের জন্যে মাঝে মাঝেই সে বড় বড় ঝামেলায় পড়ে যায় কিন্তু সেজন্যে তার তেজ কখনো কমে নাই, বরং বেড়েছে।

যেমন ধরা যাক কয়েকদিন আগে তাদের স্কুলের পদার্থবিজ্ঞান স্যারের কথা। এই স্যার নতুন এসেছেন, ক্লাশে পড়ানোর সাথে সাথে ছাত্রীদের নানারকম উপদেশ দেন, ঠিক কী কারণ জানা নেই উপদেশের সুরটা রিতুর বেশি পছন্দ না। সেদিন ক্লাসে এসে প্যাস্কেলের সূত্র পড়াতে পড়াতে থেমে গিয়ে দেশের কথা বলতে শুরু করলেন। গলা কাঁপিয়ে বললেন দেশ হচ্ছে দেশ মাতৃকা! আমাদের সবার দায়িত্ব হচ্ছে মায়ের সেবা করা, দেশও যেহেতু মা আমাদের সবার দেশের সেবা করতে হবে। বুঝেছ?

খুবই ভালো কথা তাই সবার সাথে সাথে রিতুও মাথা নাড়ল। প্যাস্কেলের সূত্র নিয়ে একটা প্রশ্ন রিতুর মাথায় মাঝে কুট কুট করছে কিন্তু যখন দেশ মাতৃকার কথা হচ্ছে সেখানে প্যাস্কেলের সূত্র নিয়ে কথা বলাটা ঠিক হবে না বলে রিতু চুপ করে রইল। কিন্তু স্যারের পরের কথাটা শুনেই তার ভুরু কুঁচকে উঠল। স্যার বললেন, দেশকে এগিয়ে নিতে হলে সবাইকে নিয়ে একসাথে এগিয়ে যেতে হয়। সকল রকম ভেদাভেদ ভুলে যেতে হয়। সেই কবে দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু তখন কে কী করেছিল সেটা নিয়ে এখনো দেশের মানুষের মাঝে বিভাজন, সেটা কী দেশের জন্যে মঙ্গল?

রিতু বলল, জী স্যার, মঙ্গল।

স্যার চমকে উঠলেন, এদিক সেদিক তাকিয়ে বললেন, কে? কে কথা বলেছে?

রিতু হাত তুলে বলল আমি স্যার।

স্যারের মুখটা কঠিন হয়ে উঠল, তুমি বলছ দেশের মানুষের মাঝে বিভাজন মঙ্গল?।

আমি বলতে চাইনি স্যার আমি আসলে প্যাস্কেলের সূত্র নিয়ে একটা প্রশ্ন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু-

কিন্তু কী?

আপনি যেহেতু একটা প্রশ্ন করেছেন তাই বললাম।

তাই কী বললে?

রিতু এবার দাঁড়িয়ে গেল, বলল, আপনি ঠিক কী বলছেন পরিষ্কার বুঝি নাই। কিন্তু যদি রাজাকার আর মুক্তিযোদ্ধার কথা বলে থাকেন তাহলে বিভাজন তো থাকতেই হবে। রাজাকারদের বিচার করতে হবে স্যার। মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের বিচার করবে। বিচার করে ফাঁসি দিতে হবে। সবগুলোকে ফাঁসি দিতে হবে।

স্যারের মুখটা জানি কেমন হয়ে গেল, বললেন ফাঁ -ফাঁ- সি?

ক্লাশের বেশির ভাগ মেয়ে হঠাৎ কুট কুট করে হাসতে শুরু করল কয়েকজন টেবিলে থাবা দিয়ে শব্দ করল। স্যার ধমক দিয়ে বললেন, চোপ!

রিতু আগেও লক্ষ্য করেছে, শব্দটা হচ্ছে চুপ কিন্তু চুপ না বলে চোপ বলা হলে সেখানে অনেক বেশি জোর দেওয়া যায়। বেশি করে জোর দেওয়ার জন্য মেয়েরা সবাই চুপ করে গেল। স্যার বিষ দৃষ্টিতে রিতুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। কেউ সরাসরি তাকিয়ে থাকলে তার দিকে পাল্টা তাকিয়ে থাকা অস্বস্তির ব্যাপার, তাই রিতু এদিক সেদিক তাকাতে লাগল। একটু পরে বলল, প্যাস্কেলের সূত্রের প্রশ্নটা করব স্যার?

স্যার এবারে হুংকার দিলেন, চোপ। বেশি আঁতেল হয়েছ? আমারে মুক্তিযোদ্ধা শেখাও?

মুক্তিযোদ্ধা শব্দটা বলার সময় স্যার কেমন জানি মুখটা বিকৃত করে ফেললেন। রিতু কিছু না বলে বেশ শান্ত ভাবে চুপ করে রইল। সেটা দেখে স্যার মনে হয় আরো খেপে উঠলেন। জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী বেয়াদপ মেয়ে?

চুপ করে থাকাটা কীভাবে বেয়াদপি রিতু বুঝতে পারল না, কিন্তু সেটা নিয়ে সে মাথা ঘামাল না। সে নিজের নাম বলল এবং স্যার দাঁড়িয়ে কেমন জানি ফোঁস ফোঁস করতে লাগলেন। প্যাস্কেলের সূত্র নিয়ে প্রশ্নটা আর করা হলো না।

পরের পিরিওডে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম রিতুকে ডেকে পাঠালেন। রিতু বলল আজকে তার খবর আছে, কিন্তু সে সাহসে ভর করে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের ঘরে গেল। পর্দা ঠেলে যখন রিতু প্রিন্সিপাল ম্যাডামের বিশাল ঘরটায় ঢুকল তখন সেখানে আরো কয়েকজন স্যার আর ম্যাডাম বসেছিলেন। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি এই মেয়েটার সাথে একা কথা বলতে চাই, আমাকে দুই মিনিট সময় দিবেন?

সব স্যার, ম্যাডাম তখন ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। প্রিন্সিপাল ম্যাডামকে ছাত্রীরা যেরকম বাঘের মত ভয় পায় স্যার ম্যাডামরাও মনে হয় সেরকম ভয় পান। রিতু নিজেকে সাহস দেওয়ার চেষ্টা করল, এখন তাকে খুব গুছিয়ে কথা বলতে হবে, তা না হলে বিপদ আছে।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম চশমার ফাঁক দিয়ে রিতুর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি ক্লাসে রাজ্জাক স্যারের সাথে বেয়াদপি করেছ?

পদার্থ বিজ্ঞান স্যার হচ্ছেন রাজ্জাক স্যার। রিতু বলল, না ম্যাডাম।

কিন্তু রাজ্জাক স্যার আমার কাছে তোমার নামে কমপ্লেন করেছেন। একজন স্যার যখন মনে করেন তার সাথে বেয়াদপি করা হয়েছে তখন বুঝতে হবে আসলে বেয়াদপি হয়েছে। বুঝেছ?

কিন্তু ম্যাডাম-।

এর মাঝে কোনো কিন্তু নেই। বুঝেছ?

আসলে কী হয়েছে আপনি শুনবেন না ম্যাডাম?

না। আমি শুনতে চাই না। তুমি রাজ্জাক স্যারের কাছে গিয়ে মাপ চাইবে। বুঝেছ?

রিতুর ভিতরে কেমন যেন সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। হঠাৎ করে সে মুখ তুলে বলল, না ম্যাডাম। আমি স্যারের কাছে এইটার জন্যে মাপ চাইতে পারব না।

ম্যাডাম ভুরু কুঁচকে রিতুর দিকে তাকালেন, শীতল গলায় বললেন, কী বললে?

রিতুর চোখে পানি চলে আসছিল, কিন্তু সে পানি আটকে রেখে বলল, যে স্যার মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে টিটকারী করেন আমি তার কাছে মাপ চাইতে পারব না। রিতু এক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, আমার নানা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।

ম্যাডাম রিতুর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, রিতুর চোখে পানি চলে আসছিল তবুও সে চোখ নামাল না। একটু পরে বলল, আমি যাই ম্যাডাম?

যাও।

রিতু যখন দরজা পর্যন্ত গিয়েছে তখন প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ডাকলেন, বললেন, শোনো।

রিতু দাঁড়াল, ম্যাডাম বললেন, কাছে এসো।

রিতু ম্যাডামের কাছে এল। ম্যাডাম রিতুর হাত ধরে বললেন, আই এম সরি, আমি তোমার মনে কষ্ট দিয়েছি। আসলে সময়টা খুব খারাপ। বদরবাহিনীর দুইজন কমান্ডার এখন দেশের মন্ত্রী। সবাইকে এখন খুব সাবধান থাকতে হবে। আমরা সবাই এখন খুব বিপদে আছি। দুঃসময়ে টিকে থাকাটাই হচ্ছে বিজয়। বুঝেছ?

রিতু হাসল বলল, ম্যাডাম। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমরা যখন বড় হব, তখন সব রাজাকারকে ফিনিস করে দেব।

রিতুর কথা শুনে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম চোখ বড় বড় করে রিতুর দিকে তাকালেন। এই হচ্ছে আমাদের রিতু। যখন তেজ দেখালে বিপদ হতে পারে সেখানেও সে তেজ দেখায়।

.

রিতুর একজন ছোট ভাই আছে। রিতুর নামের সাথে মিল রেখে তার নাম রাখা হয়েছে তিতু, এই মিল ছাড়া দুইজনের ভেতর আর কোনো মিল নাই। রিতুর বয়স চৌদ্দ, তিতুর বারো। তিতুকে দেখলে অবশ্য মনে হয় তার বয়স আরো অনেক কম। রিতু যেরকম তেজী এবং জেদি এবং ছটফটে তিতু ঠিক সেরকম নরম এবং মোলায়েম এবং শান্ত। কেউ কখনো তাকে কোনো কিছু নিয়ে অস্থির কিংবা রাগ হতে দেখেনি। তার মুখে সবসময়েই একটা মিষ্টি হাসি, সবকিছু নিয়েই সে খুশি। সে কারো মনে কষ্ট দিতে পারে না, সেটি মানুষই হোক আর বিড়ালই হোক।

এই বাসার যতগুলো বিদখুটে প্রজেক্ট হাতে নেওয়া হয়েছে, শুধুমাত্র তিতু সেই প্রজেক্টগুলো নিয়ে একটু আপত্তি করেছে। এই বাসায় যে সবুজ এবং গোলাপি ছাগল দুটো ঘুরে বেড়ায় তারা যদি জানতো তাহলে তিতুর কাছে ছাগলগুলো আজীবন কৃতজ্ঞ থাকতো। কারণ তিতুর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার কারণে কোরবানী ঈদের আগের রাতে তারা প্রাণে বেঁচে গেছে। বাসার বিড়ালটাকে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মতো রং করার আগেও তিতু বিড়ালটাকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু অন্য সবার প্রবল আগ্রহের কারণে বিড়ালটাকে এই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে। বাসার সামনে কুমির পালার জন্যে যে গর্ত করা হয়েছিল এবং যেখানে রাহেলা খাতুনকে কোনোকুনি কবর দেওয়ার আলোচনা হয়েছে সেটা তিতু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি। যেদিন প্রথম এটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে তখনই সে সারাক্ষণ মাথা নেড়ে আপত্তি করে গেছে। সবাই চলে যাবার পর সে তার নানি রাহেলা খাতুনের কাছে গিয়ে একেবারে তার গলা জড়িয়ে ধরে ফিস ফিস করে বলেছে, মা।

রাহেলা খাতুন যদিও বাচ্চাদের নানি কিংবা দাদি কিন্তু বাচ্চারা মাঝে মাঝেই তাকে মা ডেকে ফেলে। রাহেলা খাতুন তিতুর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললেন কী হয়েছে সোনা।

তোমাকে যে কবর দেবে বলেছে সেটা তো সত্যি সত্যি বলেনি, তাই না মা?

রাহেলা খাতুন মুচকি হাসলেন বললেন, কিন্তু একদিন তো বুড়ি হয়ে মারা যেতেই হবে, কবর দিতেই হবে?

তিতু রাহেলা খাতুনের মুখে হাত দিয়ে বলল, না না না। তুমি মারা যাবে না, মা। তুমি কখনো মারা যাবে না।

রাহেলা খাতুন তিতুকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ঠিক আছে সোনা, আমি কখনো মারা যাব না।

সবাই যে বলেছে তোমাকে কোনাকুনি কবর দেবে সেটা কিন্তু ঠাট্টা করে বলেছে। বুঝেছ?

হ্যাঁ বুঝেছি।

আমরা কিন্তু কেউ আসলে তোমাকে মারা যেতে দেবো না। বুঝেছ মা? সবাই তোমার সাথে ঠাট্টা করেছে। কিন্তু মা, ঠাট্টা করেও এগুলো বলতে হয় না। এগুলো খুব খারাপ কথা।

ঠিক আছে সোনা।

তুমি মন খারাপ করো নাই তো? কেউ কিন্তু আসলে আসলে বলে নাই, সবাই ঠাট্টা করে বলেছে।

রাহেলা খাতুন হাসি গোপন করে মাথা নাড়লেন, বললেন, না, মন খারাপ করি নাই।

তুমি মন খারাপ করো না, প্লিজ। তাহলে আমারও অনেক মন খারাপ হবে।

ঠিক আছে আমি মন খারাপ করব না।

তিতু তখন আবার তার নানির গলা জড়িয়ে ধরল।

এই হচ্ছে তিতু। তিতুকে নিয়ে সবাই অল্পবিস্তর দুশ্চিন্তা করে, এরকম নরম একজন মানুষ, বড় হলে যখন চারপাশের সবগুলো মানুষ হবে ডাকাতের মতো তখন সে না জানি কোন ঝামেলায় পড়বে।

.

তিতুর বয়স বারো এবং এই বাসায় ঠিক তিতুর বয়সী আরেকজন ছেলে আছে তার নাম টিটন। টিটন হচ্ছে রাহেলা খাতুনের বড় ছেলে, মাসুদের বড় ছেলে। টিটনের মাথায় চুল এলোমেলো এবং চেহারাটা ভাবুকের মতো। বেশিরভাগ সময় সে শান্ত হয়ে বসে থাকে, মনে হয় সে বুঝি কিছুই করছে না। কিন্তু কেউ যদি তার মাথায় ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখতে পারত তাহলে আবিষ্কার করতো সেটা মোটেও শান্ত হয়ে নাই, সেখানে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। হাজার রকম বৈজ্ঞানিক ভাবনা সেখানে কিলবিল কিলবিল করছে। মাঝে মাঝেই সেই সব বৈজ্ঞানিক ভাবনা কাজে লাগান হয়। কোনো কোনো সময় সেটা কেউ লক্ষ্য করে না আবার কোনো কোনো সময় সেটা একটা কেলেংকারি হয়ে যায়। এই বাসায় সবাই সবকিছু সহ্য করে বলে টিটন তার বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজ চালিয়ে যেতে পারছে অন্য যে কোনো বাসা হলে অনেক আগেই বিছানার নিচে এবং চারতলায় ছাদের বিভিন্ন কোনায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তার ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি নালায় ফেলে দেয়া হতো।

যেমন ধরা যাক বাসার কাছে গাছের উপর ঝুলে থাকা মরা কাকটার কথা। একদিন দেখা গেল টিটন স্কুল থেকে আসার সময় হাতে একটা মরা কাক ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে বাসায় আসছে এবং রাজ্যের কাক তার পিছু পিছু কা কা করে চিৎকার করে সবার কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। দৃশ্যটি দেখে রাস্তার লোকজন বেশ অবাক হলেও এই বাসার কেউ সেরকম অবাক হলো না। তার মা জিজ্ঞেস করলেন এই কাক কই পেলি?

ডাস্টবিনে।

ও। কী করবি এটা দিয়ে?

গাছে ঝুলাব।

ও। যা, গাছে ঝুলিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে খেতে আয়।

টিটন তখন মরা কাকটা গাছে ঝুলিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে খেতে এল। গাছে ঝোলানোর কাজটা খুব সহজ হল না, অনেক কাক তাকে রীতিমতো আক্রমণ করার চেষ্টা করল। কিন্তু বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্যে টিটন সবরকম বাধা বিপত্তি সহ্য করতে রাজি আছে।

কাকের চিৎকারের কারণে পুরো দুই দিন এই এলাকার মানুষের প্রায় পাগল হয়ে যাবার অবস্থা হলো কিন্তু তারপর হঠাৎ করে সকল কাক এই এলাকা ছেড়ে অন্য কোনো জায়গায় দেশান্তরী হয়ে গেল।

বাসার পাশে খোলা জায়গাটার পোড়া দাগটার ইতিহাস অবশ্য মরা কাকের ইতিহাসের মতো এত নিরীহ নয়। একেবার ছোট বাচ্চাও জানে যে রকেট তৈরি করতে হলে তার জন্যে জ্বালানী দরকার, সেই জ্বালানি কীভাবে তৈরি করা যায় সেটা নিয়ে গবেষণা করা রীতিমতো সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই টিটন একটা শর্টকাট পদ্ধতি বেছে নিল। সে ঠিক করল, বিভিন্ন জিনিস মিশিয়ে সেখানে আগুন ধরিয়ে দেখবে সেটা রকেটের জ্বালানি হিসেবে কাজ করে কিনা। টিটন অনুমান করেছিল তার এই গবেষণাটা সবাই খুব সহজে মেনে নাও নিতে পারে। তাই যখন কেউ লক্ষ্য করছে না তখন রান্নাঘর থেকে লোহার কড়াইটা নিয়ে সে বাসার বাইরে চলে এল। সেখানে ছিল তিনশ একান্নটা ম্যাচের কাঠি, দেড় লিটার কেরোসিন, দুই চামুচ ভিনেগার, আব্বর আধ বোতল আফটার শেভ লোশন, আম্মুর সবচেয়ে পছন্দের একুশ ফোঁটা পারফিউম, ছয়টা ন্যাপথলিন, এগারোটা মোমবাতি, আধ লিটার পোড়া মোবিল, চারটা অ্যাসপিরিন এবং এক প্যাকেট সাদা গুড়ো- এই সাদা গুড়োটা টিটন রাস্তার পাশে খুঁজে পেয়েছে, ভিতরে কী আছে কেউ জানে না।

লোহার কড়াইয়ে সবকিছু ভালো করে ঘুঁটে ঠিক যখন আগুন লাগাবে তখন কোথা থেকে মিঠুন এসে হাজির হলো। মিঠুনের পরিচয় সময় মতো দেওয়া হবে। আপাতত বলে দেয়া যায় মানুষটা মিঠুন না হয়ে অন্য কেউ হলে জ্বালানীর এই গবেষণাটা অগ্রসর নাও হতে পারত, কিন্তু মিঠুনের প্রবল উৎসাহের কারণে টিটন সেখানে আগুন লাগিয়ে দিল। আগুনটা লাগতে চাইছিল না, প্রথমে ধিকি ধিকি করে জ্বলল, তারপর হঠাৎ করে আগুনটা ছড়িয়ে পড়ল। প্রথমে নীল রঙের একটা আগুন তারপর একটা ভয়াবহ বিস্ফোরণ করে দাউ দাউ করে সেই আগুন জ্বলে উঠল। কড়াই থেকে আগুনের গোলা এদিকে সেদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, একটুর জন্যে টিটন। আর মিঠুন বেঁচে গেল। আগুনের শিখা একেবারে বাসার ছাদ পর্যন্ত উঠে গেল তার সাথে কুচকুচে কালো ধোঁয়া। আশেপাশের কিছু গাছের গুঁড়িতেও আগুন লেগে গেল, এবং এই এলাকার লোকজন মজা দেখার ভিড় করে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। রাহেলা খাতুনের একেবারে ছোট ছেলে জয় ঘুমিয়েছিল, হৈ চৈ শুনে সে বের হয়ে দেখে চারিদিকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। কী হচ্ছে বুঝতে একটু সময় লাগল। যখন বুঝতে পারল এটা টিটন এবং মিঠুনের আরো একটি কীর্তি তখন সে বাসার ভেতর থেকে বালতি ভর্তি করে পানি এনে কোনোভাবে আগুনটা নিভিয়ে দিল।

অন্য যে কোনো বাসা হলে এরপর টিটনের সব রকম গবেষণা বন্ধ হয়ে যেতো কিন্তু এই বাসায় তার গবেষণা বন্ধ হলো না। শুধুমাত্র নতুন একটা নিষেধাজ্ঞা জারি হলো যে যদি কখনো কোনো গবেষণায় আগুন জ্বালানোর দরকার হয় তাহলে আগে কোনো একজন বড় মানুষকে সেটা জানিয়ে রাখতে হবে।

.

টিটনের কথা বলার সময় যেহেতু মিঠুনের নামটি ব্যবহার করা হয়ে গেছে তাই বয়স অনুযায়ী সবচেয়ে ছোট হওয়ার পরেও তার কথাই আগে বলে নেয়া যাক। তার বয়স মাত্র আট এবং সে রাহেলা খাতুনের তিন নম্বর ছেলে মতিনের সন্তান। মতিন এবং তার স্ত্রী দুজনেই ডাক্তার এবং তাদের বিয়ের কিছুদিন পরেই তারা বুঝতে পারল স্বাভাবিকভাবে তাদের বাচ্চা হতে পারবে না। তারা হাল ছেড়ে না দিয়ে দেশ বিদেশ ঘুরে টেস্ট টিউব বেবী হিসেবে মিঠুনের জন্ম দিয়েছে। বাসার সবারই ধারণা টেস্ট টিউবে বেবী বড় করার সময়ে কোনো একটা গোলমাল হয়ে যাবার কারণে মিঠুন এতো দুষ্টু হিসেবে জন্ম নিয়েছে। এই বাসার একমাত্র বিজ্ঞানী টিটন সবাইকে বুঝিয়ে গেছে যদিও এরকম বাচ্চাদের টেস্টটিউব বেবী বলে কিন্তু তাদের মোটেও টেস্টটিউবে বড় করা হয় না, কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয় নাই। সবারই বদ্ধমূল ধারণা সে একটা ছোট ব্যাঙ্গাচির মতো টেস্টটিউবের ক্যামিকেলে সাঁতার কেটে কেটে বড় হয়েছে। মিঠুল নিজেও এটা বিশ্বাস করতে পছন্দ করে যে সে ছোট থাকতে একটা টেস্টটিউবের ভেতর ব্যাঙ্গাচির মতো সাঁতার কাটত।

মিঠুনের দুষ্টুমির বর্ণনা দিতে হলে শুধু তাকে নিয়েই মোটা একটা বই লিখতে হবে। একজন মানুষের মাথা থেকে কীভাবে এতো দুষ্টু বুদ্ধি বের হতে পারে সেটা একটা রহস্য। শুরুতে যে দুষ্টুমির কথাগুলো বলা হয়েছে তার সবগুলোর নায়ক (কিংবা ভিলেন) হচ্ছে মিঠুন। একেবারে জন্মের পর থেকে সে দুষ্টু। ছোট বাচ্চার যখন জন্ম হয় তারা আস্তে আস্তে সবকিছু করতে শিখে। মিঠুন সবকিছু শিখেছে আগে আগে। যখন গড়াগড়ি দেওয়ার কথা তখন সে হামাগুড়ি দিয়েছে। যখন হামাগুড়ি দেওয়ার কথা তখন হাঁটাহাঁটি করেছে, যখন হাঁটাহাঁটি করার কথা তখন দৌড়াদৌড়ি করা শুরু করেছে। শুধু দৌড়াদৌড়ি করে শান্ত থাকলে একটা কথা ছিল সে একটা মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে বাসায় ঘুরে বেড়িয়েছে। তার প্রিয় কাজ ছিল টেবিলক্লথ ধরে টান দিয়ে টেবিলের সবকিছু নিচে ফেলে দেওয়া। এক মুহূর্তে চোখের আড়াল হলেই সে এরকম কিছু একটা অঘটন করে ফেলতো।

মিঠুনের আপু রাণী দাবী করেন মিঠুনের জন্মের আগেই বুঝে গিয়েছিলেন সে খুবই দুষ্টু একটা বাচ্চা হবে। পেটের ভেতরেই সে নাকি সারাক্ষণ এদিক সেদিক ঢুশঢাশ করত। জন্ম হবার পর যখন ন্যাপি বদলানোর সময় হতো তখন হিস্যু করে সবাইকে ভিজিয়ে দিয়ে সে মাঢ়ি বের করে হাসতো! যখন একটু বড় হয়েছে কেউ তাকে কোলে নিলেই সে খামচি দিয়ে মুখের চামড়া খাবলে নিত। চোখে চশমা থাকলে তো কথাই নেই খপ করে চশমাটা ধরে টান দিয়ে নাক থেকে খুলে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিত।

এখন স্কুলে ভর্তি হয়েছে, প্রায় প্রত্যেকদিন সেখান থেকে বাসায় একটা নালিশ আসে। নালিশের ধরনটাও বিচিত্র, সে যে শুধু দুষ্টুমি করছে তা না, ক্লাশের যতগুলো শান্ত শিষ্ট বাচ্চা ছিল তাদেরকেও দুষ্টুমি শিখিয়ে দিয়েছে এখন পুরো ক্লাস মিলে দুষ্টুমি করে! সেই দুষ্টু দলের লিডার হচ্ছে মিঠুন।

সেই তুলনায় বাসাতেই সে বরং একটুখানি শান্ত হয়ে থাকে। বাকি চার ভাই বোন মিলে তাকে মোটামুটি নিয়ন্ত্রণের মাঝে রাখতে পারে। মিঠুন জানে তার চার ভাই বোন তাকে শুধু যে সামলে রাখে তা নয় যখন কোনো বিপদের মাঝে পড়ে তখন তারাই তাকে সেই বিপদ থেকে রক্ষা করে।

সেদিন তার আব্দুর টেলিফোন বেজেছে, দেশে নূতন মোবাইল ফোন এসেছে সবারই সেটা নিয়ে কৌতূহল, সবচেয়ে বেশি কৌতূহল মিঠুনের। তার আলু বা আম্মু আশেপাশে নেই তাই সে লাফ দিয়ে টেলিফোনটা ধরে ফেলল, বলল, হ্যালো।

অন্য পাশ থেকে জিজ্ঞেস করল, ডক্টর মতিন বাসায় আছেন?

মিঠুন খুবই ভদ্রভাবে বলল, জী, বাসায় আছেন।

তার সাথে কী কথা বলা যাবে?

জী বলা যাবে।

তাকে টেলিফোনটা দিতে পারবে?

পারব।

ভেরি গুড।

মিঠুন টেলিফোনটা রেখে খেলতে চলে গেল। রাত্রে যখন মতিন মিঠুনকে জিজ্ঞেস করল কেন তাকে টেলিফোনটা দিল না মিঠুন দাঁত বের করে হেসে বলল, আমাকে দিতে বলে নাই আব্দু। আমাকে খালি জিজ্ঞেস করেছে দিতে পারব কী না। আমি বলেছি পারব। ভুল তো বলি নাই!

অকাট্য যুক্তি, সেই যুক্তি শুনে মিঠুনের বাবা পারলে নিজের চুল ছিঁড়ে ফেলেন। এই হচ্ছে আমাদের মিঠুন।

.

বাসার পাঁচজন ছেলে মেয়ের চার নম্বর হচ্ছে টিয়া। সে হচ্ছে রাহেলা খাতুনের বড় ছেলে মাসুদের ছোট মেয়ে। বয়সে সে দুষ্টু মিঠুন থেকে দুই বছর বড় এবং বিজ্ঞানী টিটন কিংবা মহাপুরুষ তিতুর থেকে দুই বছরের ছোট। তবে তাকে চোখ বুজে এই বাসার সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষ বলা যায়। টিয়ার জন্ম হবার পর তার আম্মু কোনো একটা লেখায় পড়লেন যে ছোট বাচ্চাদের বই পড়ে শোনালে তারা নাকি নিজেরা নিজেরা পড়তে শিখে যায়। বিষয়টা সত্যি কিনা পরীক্ষা করার জন্য টিয়াকে তার আম্মু বই পড়ে শোনাতে শুরু করলেন এবং দেখা গেল টিয়া গভীর মনোযোগ দিয়ে বই পড়া শুনতে লাগল। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, টিয়ার যখন বয়স তিন বৎসর তখন সে বই পড়া শিখে গেল। টিয়াকে বই পড়তে দেখে মিঠুনের আম্মুও মিঠুনকে বই পড়ে শোনাতে চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু মিঠুন বই পড়ার থেকে বইয়ের পৃষ্ঠা ছিঁড়ে সেটা মুখে ঢুকিয়ে চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে বেশি আগ্রহ দেখানোর কারণে মিঠুনের আম্মু আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন!

চার বছর বয়সে টিয়া বাসায় ছোটদের সব বই পড়ে শেষ করে ফেলল। পাঁচ বছর বয়সে সে তার দাদি রাহেলা খাতুনকে ভোরবেলা পত্রিকা পড়ে শোনাতে লাগল। এখন তার বয়স দশ, সে এর মাঝেই এই বাসার পড়ার মতো সব বই পড়ে শেষ করে ফেলেছে, তার জন্যে এখন লাইব্রেরি থেকে বই আনতে হয়। টিয়া যে শুধু বড় বড় মোটা মোটা বই পড়ে তা নয় সে খুব তাড়াতাড়ি বই পড়তে পারে। সবাই একটা লাইনের সবগুলো শব্দ আলাদা আলাদা করে পড়ে কিন্তু টিয়া পুরো লাইনটা এক সাথে পড়ে। তাই সে যখন একটা বই পড়ে তখন দেখে মনে হয় সে বুঝি কিছু না পড়ে শুধু চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে। প্রথম প্রথম কেউ বিশ্বাস করতো না যে সে পড়ছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবাইকে বিশ্বাস করতে হয়েছে যে আসলেই সে পুরোটুকু খুবই মনোযোগ দিয়ে পড়ে।

মাত্র কিছুদিন আগে তাদের স্কুলে একজন নতুন ম্যাডাম এসেছেন। ক্লাশের ছেলে মেয়েদের ব্যস্ত রাখার জন্যে সবাইকে তাদের বইয়ের একটা গল্প পড়তে দিয়েছেন। সবাই যখন পড়ছে তখন টিয়া পড়া শেষ করে বইটা বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। ম্যাডাম ভুরু কুঁচকে টিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই মেয়ে আমি সবাইকে পড়তে বলেছি না?

আমি পড়েছি ম্যাডাম।

মিথ্যা কথা বলবে না। তুমি পড় নাই। আমি দেখেছি তুমি শুধু পৃষ্ঠা উল্টে গেছ।

না ম্যাডাম, আমি পড়েছি।

ম্যাডাম এবারে ধমক দিলেন, তুমি পড় নাই।

টিয়া কী করবে বুঝতে পারছিল না তখন টিয়ার পাশে বসে থাকা ছেলেটা তাকে সাহায্য করল, সে ম্যাডামকে বলল, ম্যাডাম, টিয়া পড়েছে। টিয়া খুব তাড়াতাড়ি পড়তে পারে।

তাড়াতাড়ি পড়তে পারে?

ছেলেটা চোখ বড় বড় করে বলল, জী ম্যাডাম, টিয়া এই মোটা মোটা বই এক টানে পড়ে ফেলতে পারে!

ম্যাডাম আবার ভুরু কুঁচকে তাকালেন, কিন্তু ততক্ষণে ক্লাশের অন্য ছেলে মেয়েরাও কথা বলতে শুরু করেছে। তারা বলতে লাগল, জী ম্যাডাম, টিয়া খুব তাড়াতাড়ি পড়তে পারে। আমরা যখন এক লাইন পড়ি সে তখন এক পৃষ্ঠা পড়ে ফেলে। বিশ্বাস না করলে তাকে পড়তে দেন ম্যাডাম! পড়তে দেন।

ম্যাডাম তখন তার ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে বইটার একটা পৃষ্ঠা বের করে টিয়ার হাতে দিয়ে বললেন, পড় দেখি এই পৃষ্ঠাটি।

টিয়া বইটি হাতে নিল পৃষ্ঠাটার উপর চোখ বুলিয়ে বইটা ফিরিয়ে দিল। ম্যাডাম অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে টিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, তুমি তো পড় নাই, শুধু চোখ বুলিয়েছ।

না ম্যাডাম পড়েছি। ভালো করে পড়েছি।

বল দেখি কী লেখা আছে এখানে।

টিয়া প্রায় দাড়ি কমাসহ কী লেখা আছে বলে দিতে শুরু করল এবং পৃষ্ঠার মাঝামাঝি আসার পর ম্যাডাম বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে, আর বলতে হবে না। আমি বিশ্বাস করেছি।

টিয়ার জন্যে পুরো ক্লাস এবার আনন্দে চিৎকার করে উঠল, যেন টিয়া নয় তারাই ম্যাডামকে চমৎকৃত করেছে।

ম্যাডাম অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, কী আশ্চর্য! কী চমৎকার! কী অসাধারণ! তারপর টিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কীভাবে এটা করতে শিখেছ?

টিয়া লাজুক মুখে বলল, পড়তে পড়তে হয়ে গেছে ম্যাডাম।

তুমি কী অনেক বই পড়?

জী ম্যাডাম।

কার কার বই পড়েছ?

সবার বই পড়েছি। এখন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই পড়ছি।

ম্যাডাম একটু খাবি খেলেন, মা-মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়?

জী ম্যাডাম। শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ শেষ করেছি।

রবীন্দ্রনাথ?

শুধু গল্পগুচ্ছ পড়েছি। আর নৌকাডুবি।

ম্যাডাম চোখ বড় বড় করে টিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন ক্লাশের ছেলে মেয়েরা আনন্দে চিৎকার করতে লাগল। তাদের চিৎকার শুনে মনে হতে লাগল, শুধু টিয়া নয় যেন তারা সবাই গল্প গুচ্ছ আর নৌকাডুবি পড়ে শেষ করে ফেলেছে!

.

এই হচ্ছে রাহেলা খাতুনের পাঁচজন নাতি নাতনির পরিচয়। সবচেয়ে বড় জন হচ্ছে রিতু, রীতিমতো তেজী একজন নেতা। টিটন একজন খাঁটি বিজ্ঞানী, সবচেয়ে ভালো ছাত্র হওয়ার পরেও রোল নম্বর সব সময় পনেরো না হয় ষোলো। কারণ অঙ্ক আর বিজ্ঞান ছাড়া আর সব সাবজেক্টে তাকে টেনে টুনে পাস করতে হয়! তিতু হচ্ছে ছোট একটা শরীরে আটকে থাকা একজন মহাপুরুষ। টিয়া হচ্ছে জ্ঞানতাপস, পাঁচজনের ভেতর একমাত্র মানুষ যার চোখে চশমা এবং সবচেয়ে ছোট জন হচ্ছে মিঠুন, পৃথিবীর সেরা দুষ্টুদের একজন। যার সম্পর্কে যত কম কথা বলা যায় তত ভালো। একদিন বিকেলে দেখা গেল রাহেলা খাতুনের এই পাঁচ নাতি-নাতনি একটা জরুরি মিটিংয়ে বসেছে।

০৩. যখন জরুরি মিটিং

চার তালার ছাদে অর্ধসমাপ্ত ঘরটা বাচ্চাদের দখলে, সেখানেই মিটিংটা বসেছে। ঘরের এক কোনায় একটা বইয়ের শেলফ, এক কোনায় টিটনের কিছু বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি। এছাড়া এই ঘরে আর কোনো ফার্নিচার নাই তাই সবাই মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসেছে। মিটিংটা ঠিক করে চালানোর জন্য রিতুর হাতে দুধের একটা খালি কৌটা এবং একটা বড় চামুচ। রিতু চামুচ দিয়ে কৌটার ওপর ঘটাং ঘটাং করে দুই ঘা মেরে বলল, অর্ডার। অর্ডার।

রিতুর অর্ডার অর্ডার শুনে কোথা থেকে জানি মিঠুন দুই দিকে দুই হাত মেলে প্লেনের ইঞ্জিনের মতো গর্জন করতে করতে ছুটে এসে সবার মাঝখানে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ব্যাপারটি নিয়ে কেউ অবাক হলো না বরং এরকম কিছু না করলেই সবাই অবাক হতো। শুধু রিতু গম্ভীর গলায় বলল, মিঠুন, আমি যে অর্ডার অর্ডার বলেছি সেই কথাটা কানে যায় না?

মিঠুন উঠে বসে গা ঝাড়া দিয়ে বলল, অর্ডার দাও। আমি কি না করেছি? কী অর্ডার দেবে? পিজা নাকি ফ্রায়েড চিকেন?

ফাজলামো করবি না মিঠুন, ভালো হবে না কিন্তু।

আমি কখন ফাজলামো করলাম? তুমিই না বলেছ অর্ডার, অর্ডার।

অর্ডার মানে হচ্ছে শান্ত হয়ে বসা। গাধা কোথাকার।

রিতুর পাশে টিটন বসেছিল সে রিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, আপু, তুমি কেন খামাখা মিঠুনকে শান্ত হয়ে বসতে বলেছ? মিঠুন কোনোদিন শান্ত হয়ে বসতে পারবে? মিঠুন জীবনেও কোনোদিন শান্ত হয়ে বসেছে?

তিতু মিঠুনকে ধরে আদর করে বসাতে বসাতে বলল, মনে নাই মামি বলেছে মিঠুন যখন মামির পেটের ভিতরে ছিল তখনো সে শান্ত হয়ে থাকে নাই। সব সময় পেটের ভিতরে ঢুশ ঢাশ মারতো!

মিঠুন তিতুর পাশে ঠেলাঠেলি করে বসতে বসতে জিব বের করে তিতুর কনুইয়ের খানিকটা চেটে ফেলল। সেটা দেখেও কেউ খুব অবাক হলো না শুধু তিতু বলল, কী করলি তুই? আমাকে চাটলি কেন?

মিঠুন দাঁত বের করে হেসে বলল, তোমার নাম তো তিতু তাই তোমাকে চেটে দেখলাম তুমি কী আসলেই তিতা কী না।

কী দেখলি?

তুমি তিতা না। তুমি হচ্ছ নোতা। তোমার নাম রাখা উচিৎ ছিল নোনতু।

মিঠুনের কথা শুনে টিটনের বৈজ্ঞানিক ভাব চাড়া দিয়ে উঠল। সে বলল, মিঠুন, যে কোনো মানুষকে চাটলে নোনতা লাগবে। তার কারণ সব মানুষ ঘামে আর ঘামের সাথে শরীর থেকে লবণ বের হয়। লবণের টেস্ট হচ্ছে নোনতা। বুঝেছিস?

মিঠুন মাথা নাড়ল, বলল, বুঝেছি।

কী বুঝেছিস?

মানুষের ঘাম হচ্ছে নোতা। আর যাদের ডায়াবেটিস তাদের হিসি হচ্ছে মিষ্টি।

টিটন বলল, আমি মোটেও হিসির কথা বলি নাই-

রিতু মুখ বিকৃত করে তার কৌটায় চামুচ দিয়ে ঘটাং করে মেরে বলল, তোরা এখন চুপ করবি? কী সব নোংরা কথা বলছিস? ঘাম খেতে কেমন, হিসি খেতে কেমন! ছিঃ!

টিটন একটু খানি আপত্তি করে বলল, আমি কিন্তু কোনো নোংরা কথা বলি নাই, আমি শুধু সায়েন্টিফিক কথা বলেছি।

রিতু ধমক দিয়ে বলল, সায়েন্টিফিক কথার খেতা পুড়ি। চুপ করবি এখন?

টিটন চুপ করে গেল। সে আসলে বেশির ভাগ সময় চুপ করে থাকে তবে বৈজ্ঞানিক বিষয় নিয়ে কেউ ভুল কথা বললে সে আপত্তি না করে পারে না। রিতু সবার দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা তাহলে মিটিং শুরু করি?

সবাই বলল, কর। শুধু টিয়া কোনো কথা বলল না। তার কারণ যদিও সে সবার আগে মিটিংয়ে এসে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসেছে কিন্তু সে আসলে গভীর মনোযোগ দিয়ে একটা বই পড়ছে। তার আশে পাশে কী হচ্ছে সে জানে পর্যন্ত না। রিতু এবারে গলা উঁচিয়ে রিয়াকে বলল, টিয়া তোর বইটা বন্ধ করবি?

টিয়া মুখ না তুলে বলল, আর মাত্র দশ পৃষ্ঠা আপু!

রিতু কঠিন মুখে বলল, না, আর এক লাইনও না। বই বন্ধ কর।

টিয়া মুখ গোঁজ করে পৃষ্ঠা মুড়ে বই বন্ধ করল। হাত দিয়ে চশমাটাকে ঠেলে ওপরের দিকে তুলে বলল, ঠিক আছে। শুরু কর মিটিং।

রিতু সবার দিকে তাকালো, তারপর মুখটা হাসি হাসি করে বলল, ভাইসব-

টিয়া সাথে সাথে হাত তুলে বলল, দাঁড়াও দাঁড়াও আপু, তোমার বলা উচিৎ ভাইসব এবং বোনসব। এখানে আমিও আছি, আমি মোটেও ভাই না। আমি বোন।

টিটন মাথা নেড়ে বলল, বোন সব বলে কোনো শব্দ নাই।

তিতু বলল, ইংরেজিতে সিবলিং বলে একটা শব্দ আছে। সিবলিং মানে ভাই বোন। বাংলায় সেরকম কোনো শব্দ নাই।

মিঠুন চিৎকার করে বলল, গুলগুলি, গুলগুলি।

রিতু চোখ পাকিয়ে বলল, গুলগুল্লি, আবার কী?

মিঠুন বলল, গুলগুলি মানে ভাই বোন। যেহেতু বাংলায় কোনো শব্দ নাই সেইজন্যে একটা শব্দ তৈরি করে দিলাম। আজকে থেকে গুলগুল্লি মানে ভাইবোন। আপু, তুমি বল, প্রিয় গুগগুলি-

রিতু গরম হয়ে বলল, ফাজলেমি করবি না মিঠুন। আমি বসেছি একটা জরুরি মিটিং করতে আর তোরা সারাক্ষণ বকর বকর করে যাচ্ছিস। চুপ করবি একটু?

মিঠুন বলল, ঠিক আছে চুপ করলাম।

রিতু রাগী রাগী গলায় বলল, আর যদি কেউ একটা কথা বলেছিস তাহলে এই চামুচ দিয়ে মাথার মাঝে দিব একটা বাড়ি।

মিঠুন লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, আমার কাছে দাও আপু, আমি বাড়ি দিয়ে দিই। তুমি খালি বলবে কাকে দিতে হবে আমি দিয়ে দেব।

সবার আগে তোর মাথায় একটা বাড়ি দেওয়া দরকার। চুপ করে বসবি এখন?

ধমক পেয়ে মিঠুন মুখটা বেজার করে বসে পড়ল। রিতু ঠিক যখন কথা বলবে তখন হঠাৎ টিয়া হাত তুলে বলল, আপু তুমি শুরু করার আগে আমি একটা কথা বলতে পারি?

কী কথা?

খুবই জরুরি কথা, অনেকদিন থেকে বলতে চাচ্ছিলাম কিন্তু সবাইকে এক সাথে পাই না। তাই বলতে পারি না। আজকে পেয়ে গেলাম।

ঠিক আছে বল, তাড়াতাড়ি।

টিয়া বলল, এটা শুধু বললে হবে না। এটা সবাইকে দেখাতে

হবে।

দেখা তাহলে।

টিয়া কোনো কথা না বলে পাশে রাখা তার ব্যাগ থেকে একটা খাতা বের করে সেটা খুলে ধরল। টিটন জিজ্ঞেস করলাম, এটা কী?

পরীক্ষার খাতা।

কী হয়েছে পরীক্ষার খাতায়?

দেখো কত পেয়েছি।

মিঠুন আনন্দে চিৎকার করে বলল, মাত্র তিরিশ পেয়েছ? তার মানে তুমি ফেল! হা হা! ফেল! ফেল! কী মজা।

ভালো করে দেখ গাধা।

সবাই ভালো করে দেখল, কিন্তু আসলেই খাতার ওপরে বড় বড় করে লাল কালিতে তিরিশ লেখা। রিতু ইতস্তত করে বলল, তিরিশই তো পেয়েছিস, এতো কম-

টিয়া মাথা নেড়ে বলল, আপু ভালো করে দেখো!

টিয়া কী দেখতে বলেছে টিটন সেটা প্রথম দেখতে পেল। অবাক হয়ে বলল, মাইনাস তিরিশ?

টিয়া মাথা নাড়লো, বলল, হ্যাঁ। মাইনাস তিরিশ। শূন্য থেকেও তিরিশ কম।

রিতু টিয়ার হাত থেকে খাতাটা নিয়ে দেখে, সেখানে আমার পরিবার নামে একটা রচনা লেখা। টিয়া বেশ সুন্দর করে লিখেছে কিন্তু লেখার মাঝখানে মাঝখানে স্যার লাল কলম দিয়ে দাগ দিয়ে বড় বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে রেখেছেন। রিতু একটু অবাক হয়ে বলল, স্যার তোকে মাইনাস তিরিশ কেন দিয়েছেন? ভালোই তো লিখেছিস।

টিয়া এবারে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, গত সোমবার বাংলা স্যার ক্লাশ এসে বললেন, সবাই আজকে রচনা লিখ। ছেলে মেয়েরা জিজ্ঞেস করল, কীসের ওপর লিখব? নিরক্ষরতার অভিশাপ? স্যার বললেন, না। তখন সবাই জিজ্ঞেস করল, তাহলে কী বাংলাদেশের গ্যাস সম্পদ? স্যার বললেন, না। তখন আরেকজন জিজ্ঞেস করল, তাহলে কী জাতীয় জীবনের শিক্ষার গুরুত্ব? স্যার বললেন, না। তোরা যেগুলো মুখস্ত করে এসেছিস সেগুলো না। নিজে থেকে লিখতে হবে। সবাই রচনা লেখ আমার পরিবারের উপর। যারা মুখস্তের এক্সপার্ট তারা একটু গাঁই ছুঁই করল, তারপর লিখতে শুরু করল। আমিও লিখলাম।

টিয়া এবার একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, পরেরদিন স্যার খাতা দিতে এসেছেন। যে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে তাকে প্রথমে দিলেন। তারপরে তার পরের জন, তারপরে তার পরের জন। এইভাবে দিতে দিতে দেখি সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। ক্লাশের দুইজন সবচেয়ে বড় ফাঁকিবাজ ছেলেদের খাতাও দেওয়া হলো, একজন পেয়েছে দুই আরেকজন গোল্লা। শুধু আমার খাতা দেওয়া হয় নাই। আমি দেখলাম স্যারের হাতে তখন মাত্র একটা খাতা বাকি, বুঝতে পারলাম সেইটা নিশ্চয়ই আমার খাতা! চিন্তা করো আমি পুরো ক্লাশে সবচেয়ে লাড্ড গাড্ডা! আমি একেবারে টাশকি মেরে গেলাম।

টাশকি মারার মতোই ব্যাপার, ঘটনাটা ছিল রীতিমতো হৃদয় বিদারক। তার কারণ স্যার সবার খাতা দেয়া শেষ করে টিয়ার খাতাটা হাতে নিয়ে বললেন, ক্লাসে কেউ আশি পেয়েছে কেউ তিরিশ পেয়েছে। খুবই দুঃখের কথা, একজন পেয়েছে দুই আরেকজন শূন্য। কিন্তু সবচেয়ে আজব ব্যাপার হচ্ছে এই খাতাটা- স্যার তখন টিয়ার খাতাটা ওপরে তুলে ধরে বললেন, এই যে খাতাটা আমার কাছে, আমি তাকে শূন্য দিতে পারি নাই। তাকে দিতে হয়েছে শূন্য থেকেও কম। দিয়েছি মাইনাস তিরিশ। ক্লাসে কেউ পাস করেছে কেউ ফেল করেছে, এই মেয়েটার ফেল করা নিয়েও টানাটানি!

টিয়ার তখন মনে হলো লজ্জায় টেবিলের নিচে ঢুকে পড়ে। একজন বলল, কেন স্যার? ফেল করা নিয়েও কেন টানাটানি?

সেটা জানতে চাস? তাহলে আমি একটু পড়ে শোনাই, স্যার তখন টিয়ার খাতাটার মাঝখানে থেকে মাঝখান থেকে পড়ে শোনালেন, আমাদের পরিবারে আমরা পাঁচ ভাই বোন। এখানেই শেষ নয় আছে দুইটা ছাগল একটার রং সবুজ অন্যটার গোলাপি।

স্যার এই টুকুন বলতেই সবাই উচ্চ স্বরে হেসে উঠল। স্যার বললেন, এই খানেই শেষ না, আরো শোন। এই মেয়ে লিখেছে, আরও আছে একটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার, কিন্তু হলে কী হবে সেটা ডাকে মিউ মিউ মিউ।

আবার পুরো ক্লাস আনন্দে হো হো করে হেসে উঠল। স্যার বললেন, এই খানেই শেষ না। এখানে লেখা আছে তারা পুরো পরিবার একটা বাসায় থাকে, সেই বাসার নাম বক্কিলারে খা! আবার পুরো ক্লাশ হাসিতে ফেটে পড়ল। স্যার নিজেও হাসলেন- হাসতে হাসতে বললেন, এই মেয়ে লিখেছে তাদের বাসার সামনে একটা গর্ত আছে সেইখানে তার দাদি বলেছেন তিনি যখন মারা যাবেন তখন যেন কোনাকুনি ভাবে তাকে সেখানে কবর দিয়ে ফেলে। তারা ঠিক করেছে তাদের দাদি অন্ধকারে ভয় পাবেন বলে সেখানে একটা টিউব লাইট আর মোবাইল ফোন রেখে আসবে! তাদের দাদি তখন মাটির নিচে থেকে মিসকল দিবে!

ক্লাসের সবাই এবারে টেবিলে থাবা দিয়ে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায়।

কিন্তু মজার জিনিস জানিস?

কী স্যার?

দাদিকে এই মেয়ে মাঝে মাঝে ডাকে মা! এটা শুনে সবাই অবাক হয়ে মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল।

খাতাটা পুরো ক্লাশকে পড়ে শুনিয়ে স্যার টিয়াকে দাঁড়াতে বললেন। টিয়া মাথা নিচু করে দাঁড়াল। স্যার বললেন, তুই তো ক্লাশের ভালো ছাত্রীদের একজন। তুই খাতায় পাগলের মতো আবোল তাবোল কেন লিখেছিস?

টিয়া ভাবল একবার বলে, এগুলো আবোল তাবোল না। এগুলো সব। সত্যি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলল না।

স্যার বললেন, আমি চাই তোরা কোনো কিছু মুখস্ত করে নিজের মতো করে লিখতে শেখ। কিন্তু তার মানে এই না খাতায় আবোল তাবোল গাঁজাখুরি জিনিস লিখে বসে থাকবি। এটা তো পরীক্ষার খাতা, এটা তো হাসির গল্প লেখার কম্পিটিশান না। এই পরীক্ষার খাতা দেখে স্যার ম্যাডামরা মার্কস দেবে, সেই মার্কস পেয়ে তোরা পরীক্ষায় পাস করবি। এই সব লিখলে তো পাস হবে না। বুঝেছিস?

টিয়া মাথা নাড়ল, বলল, বুঝেছি।

কথাটা যেন মনে থাকে সেই জন্যে তোকে দিয়েছি মাইনাস তিরিশ। তোর লেখার স্টাইল ভালো, পড়তে ভালো লাগে পড়ে মনে হয় বুঝি সত্যি কথা! কিন্তু খবরদার পরীক্ষার খাতায় উল্টো পাল্টা জিনিস লেখা যাবে না।

টিয়া তার পুরো ক্লাসের বর্ণনা দিয়ে শেষ করার পর সবাই চুপচাপ বসে রইল, শুধু মিঠুন হাতে কিল দিয়ে বিকট স্বরে চিৎকার করে উঠল, জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো।

কে কোথায় আগুন জ্বালবে কেউ সেটা মিঠুনের কাছে জানতে চাইল না, কারণ সবাই জানে জানতে চাইলেই মিঠুন আরো একশ কথা বলতে শুরু করবে। তাকে যত কম উৎসাহ দেওয়া যায় ততই ভালো।

টিটন একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, শুধু টিয়া না, আমাদের সবার এক অবস্থা।

মিঠুন ছাড়া অন্যেরাও মাথা নাড়ল- তাদের সবারই কখনো না কখনো টিয়ার মতো অবস্থা হয়, কখনো সেটা হয় মজার ঘটনা কখনো হয় দুঃখের ঘটনা। মিঠুন দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, টিয়া আপু তুমি একটা পচা ডিম নিয়ে ক্লাশে যাবে, তোমার স্যারের চেয়ারে রাখবে। যেই তোমার স্যার।

টিয়া বলল, আমি খামাখা স্যারকে শাস্তি দিব কেন? স্যার খুবই সুইট মানুষ। আমি অনেক বই পড়ি সেই জন্যে আমাকে খুব আদর করেন। আমাকে নিয়ে শুধু একটু মজা করেছেন।

টিটন বলল, তোর স্যার তো সুইট, আমার ঠিক উল্টা। স্যার পুরা রাজাকার। ক্লাশে আমাকে যা তা ভাবে অপমান করার চেষ্টা করেছে। আমার বন্ধুরা ছিল বলে সুবিধা করতে পারে নাই।

কী করেছে তোর স্যার?

টিটনের স্যার কী করেছে টিটন সেটার বর্ণনা দিল, বর্ণনাটা এরকম :

টিটনের ক্লাশে বাংলা পড়ান যে স্যার সেই স্যার রাজাকার টাইপের। আধুনিক রাজাকারদের মতো শার্টপ্যান্ট পরে, গালে সূক্ষ্ম এক ধরনের দাড়ি। তাদের বইয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে কবিতাটা আছে সেটা কখনোই পড়ান না। একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ, পয়লা বৈশাখ বা ষোলই ডিসেম্বরের আগে তার খুবই মেজাজ খারাপ থাকে। ক্লাসের কেউ তাকে দুই চোখে দেখতে পারে না, স্যারও কাউকে দুই চোখে দেখতে পারেন না। সেই রাজাকার স্যার একদিন ক্লাশে এসে টিটনের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই ছেলে। তুই নাকি তোর দাদিকে মা ডাকিস?।

কয়েকদিন আগে টিটনের কয়েকজন বন্ধু তার বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল, সারাদিন থেকে সবাই খুব মজা করে এসেছে। ক্লাসে সবার মাঝে টিটনদের বাসার ব্যাপারগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে তখন কীভাবে কীভাবে জানি রাজাকার স্যারও তাদের বাসার একটা দুইটা ব্যাপার জানতে পেরেছেন। সেইজন্যে রাজাকার স্যার ক্লাশে টিটনকে ধরেছেন। টিটন কী বলবে বুঝতে পারছিল না তখন স্যার আবার খেঁকিয়ে উঠলেন, কথা বলিস না কেন? ডাকিস?

টিটন থতমত খেয়ে বলল, সব সময় ডাকি না, কখনো কখনো ডাকি।

তাহলে তোর মাকে তখন কী ডাকিস? দাদি?

টিটন বলল, মাকে ডাকি আম্মু।

স্যার মুখ খিঁচিয়ে বললেন, এটা কোন ধরনের ঢং? দাদিকে ডাকিস মা? বাবার স্ত্রী হচ্ছে মা। আর বাবার মা হচ্ছে দাদি। তার মানে তুই তোর বাবার মাকে বলছিস তার স্ত্রী। ছি ছি ছি!

টিটন একেবারে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল, ছোট থেকে সে দেখে এসেছে তার বাবা মা চাচা চাচি ফুপু ফুপা সবাই রাহেলা খাতুনকে মা ডাকে, তাদের দেখাদেখি তারা সব ভাই বোনই মাঝে মাঝে তাকে মা ডেকে এসেছে এর মাঝে যে কোনো প্যাঁচ আছে সেটা তো সে জানতো না।

টিটনদের ক্লাসে আশিকের খুব সাহস, সে দরকার হলেই রাজাকার স্যারের সাথে মুখে মুখে তর্ক করে। আজকেও সে তড়াক করে দাঁড়িয়ে গেল, বলল, স্যার, নানি আর দাদির ইংরেজি হচ্ছে গ্র্যান্ড মাদার। মাদার মানে হচ্ছে মা। ইংরেজিতে যদি নানি দাদিকে মা ডাকা যায় তাহলে বাংলায় ডাকলে দোষ কী?

রাজাকার স্যার কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। যখন তার এরকম অবস্থা হয় তখন স্যার সব সময় যা করেন এবারেও তাই করলেন, বিকট একটা ধমক দিয়ে বললেন, ইংরেজি আর বাংলা কী এক জিনিস? ইংরেজি ভাষার কী কোনো মা বাপ আছে? ছারপোকার ইংরেজি করেছে বাঘ!

আশিকের সাহস আছে, সে শুদ্ধ করে দিয়ে বলল, স্যার বাঘ না, বাগ। বি ইউ জি বাগ।

রাজাকার স্যার হাত নেড়ে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বললেন, একই কথা!

কেমন করে একই কথা হলো সেটা কেউ বুঝতে পারল না কিন্তু সেটা নিয়ে আর কেউ তর্ক করার সাহস পেল না। তখন সুব্রত দাঁড়িয়ে বলল, স্যার আমরা তো ইংরেজিতে কথা বলি না আমরা তো বাংলায় কথা বলি। আমরা তো দাদি-নানিকে ঠাকুরমা দিদিমা বলি! সেটাও তো মা।

স্যার এমনভাবে সুব্রতের দিকে তাকালেন যেন সে মানুষ না, সে হচ্ছে একটা তেলাপোকা কিংবা কেঁচো। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, তোদের কথা আর কী বলব? তোরা তো মাটি দিয়ে একটা মূর্তি বানিয়ে সেটাকেও মা ডাকিস। ডাকিস না?

সুব্রত ভ্যাবেচেকা খেয়ে বসে গেল, টিটন দেখল বেচারা সুব্রতের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। রাজাকার স্যারের সবচেয়ে প্রিয় কাজ হচ্ছে ক্লাসের যে কয়জন হিন্দু ছাত্র আছে তাদেরকে নানাভাবে ধর্ম নিয়ে খোটা দেওয়া। টিটনের তখন একটু রাগ উঠে গেল, বলল, স্যার মা শব্দটা আসলে অন্য রকম। মানুষ যেটাকে ভালোবাসে সেটাকেই মা ডাকে। কাজেই কাকে মা ডাকা যাবে কাকে মা ডাকা যাবে না এরকম কোনো আইন নাই। মানুষ দেশকেও মা ডাকে। ভাষাকেও মা ডাকে।

টিটনদের ক্লাসে আলতাফ একটু কবি টাইপের, কয়দিন আগে সে টিটনদের বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছে। সে দাঁড়িয়ে দুই হাত নেড়ে চোখ ঢুলুঢুলু করে সুর করে বলল, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরিয়সী ….

চুপ কর বেকুব। বলে রাজাকার স্যার ধমক দিয়ে আলতাফকে থামিয়ে দিলেন। মুখ বাঁকা করে বললেন, জননী জন্মভূমিশ্চ! হা! তারপর হায়েনার মতো খা খা করে হাসতে লাগলেন। রাজাকার স্যারের মাড়ি কালো রঙের, হাসির সময় ঠোঁটগুলো উপরে উঠে কালো মাঢ়ি বের হয়ে যায় তখন তাকে দেখায়ও হায়েনার মতো। ক্লাসের সবাই এই বীভৎস স্যারের বীভৎস হাসি বসে বসে শুনতে লাগল।

হাসি শেষ করে রাজাকার স্যার আবার টিটনের দিকে তাকালেন, বললেন, তুই যখন তোর দাদিকে মা ডাকিস তখন তোর বাবা মা আপত্তি করে না? আমি হলে তো চাবকে ছাল তুলে দিতাম।

টিটন মুখ শক্ত করে বলল, না স্যার। আপত্তি করে না।

কেন করে না?

টিটন কিছু বলার আগেই তার পাশে বসে থাকা পিয়াস দাঁড়িয়ে উঠে বলল, স্যার ওদের বাসা অন্যরকম। ওদের বাসায় কেউ রাগে না, বকে না ধমক দেয় না। সারা রাত টিভি দেখলেও কেউ না করে না। সবাই দিন রাত মজা করে।

পিয়াস মজার কয়েকটা উদাহরণ দিতে যাচ্ছিল কিন্তু রাজাকার স্যার ধমক দিয়ে তাকে থামিয়ে মুখ খিঁচিয়ে বললেন, মজা করে? দিন রাত মজা করে? ফাজলেমীর জায়গা পাস না?

তারপর রাজাকার স্যার কেন জীবনে কখনো মজা করতে হয় না এবং আনন্দ করতে হয় না এবং করলে কী সর্বনাশ হবে এবং যারা জীবনে খালি মজা করেছে আর আনন্দ করেছে তাদের কী বিপদ হয়েছে তার উপর বিশাল একটা লেকচার দিতে শুরু করলেন।

রাজাকার স্যারের গল্প শেষ করে টিটন ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, যখন আরো ছোট ছিলাম তখন বুঝি নাই এখন বুঝতে পারছি আমাদের বাসাটা আসলে অন্য রকম।

মিঠুন হাত ওপরে তুলে চিৎকার করে উঠল, রাজাকারের চামড়া তুলে নিব আমরা।

রিতু ধমক দিয়ে বলল, মিঠুন তুই থামবি। সারাক্ষণ কানের কাছে ভ্যাদর ভ্যাদর করিস।

আমি মোটেই ভ্যাদর ভ্যাদর করছি না আপু।

তাহলে কী করছিস?

স্লোগান দিচ্ছি। মিটিংয়ের মাঝে সব সময় স্লোগান দেয়। তুমি টেলিভিশনে কোনোদিন দেখ নাই? একজন বক্তৃতা দেয় তখন অন্য সবাই স্লোগান দেয়?

এখানে কেউ বক্তৃতা দিচ্ছে না আর কাউকে স্লোগানও দিতে হবে না।

টিটন বলল, আপু ছেড়ে দাও। টেস্টির সাথে কথা বলে তুমি পারবে না। শুধু শুধু সময় নষ্ট।

মিঠুন বলল, টিটন ভাইয়া, ভালো হবে না কিন্তু। আমাকে টেস্টি ডাকবে না। মিঠুনের চোখে মুখে কিন্তু ভালো না হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না, বরং টেস্টি ডাক শুনে তার চোখ মুখ আনন্দে ঝলমল করে ওঠে।

টিয়া বলল, কেন? তোকে টেস্টি ডাকলে সমস্যা কী? তোর জন্ম হয়েছে টেস্টটিউবের ভিতরে, তোকে টেস্টি ডাকব না তো কী ডাকব? যাদের জন্ম টেস্টটিউবের ভিতরে তারা সবাই হচ্ছে টেস্টি।

মিঠুনের চোখ কৌতূহলে চক চক কার ওঠে, সত্যি সত্যি আমার জন্ম হয়েছিল টেস্টটিউবে? তুমি দেখেছিলে?

দেখব না কেন? আমরা সবাই দেখেছিলাম। ছোট চাচি সিঙ্গাপুর থেকে তোকে এনেছেন। ছোট টেস্টটিউবের ভেতর পানি সেইখানে তুই ব্যাঙাচির মতো সাঁতার কাটছিস।

আর কী করছিলাম টিয়া আপু?

টেস্টটিউবের ভিতরে মিঠুন আরো কী কী দুষ্টুমি করেছিল টিয়া তার বর্ণনা দিতে যাচ্ছিল কিন্তু রিতু দুধের কৌটায় চামুচ দিয়ে ঘটাং করে একটা বাড়ি দিয়ে তাদের থামিয়ে দিল, ধমক দিয়ে বলল, তোরা থামবি? একটা কাজের কথা নিয়ে আলাপ করছি, তার মাঝে সারাক্ষণ শুধু ভ্যাদর ভ্যাদর।

রিতুর ধমক খেয়ে সবাই একটু শান্ত হয়ে নড়ে চড়ে বসে, মিঠুন আরেকটা শ্লোগান দিতে গিয়ে থেমে গেল। রিতু বলল, একটু আগে টিটন ঠিকই বলেছে, সে আমাদের বাসার মানুষগুলো একটু অন্যরকম।

মিঠুন জানতে চাইল, সেটা কী ভালো বা খারাপ?

কোনো কোনো সময় ভালো, কোনো কোনো সময় খারাপ। যেমন মনে কর আমার যখন পরীক্ষার ফর্ম ফিলআপ করতে হবে তখন সেখানে আমার ঠিকানা লিখতে হবে। সেই ঠিকানায় যদি বাসায় নাম লিখি খা খা খা বক্কিলারে খা তাহলে সবাই নিশ্চয়ই ভাববে আমি পাগল।

মিঠুন ছাড়া অন্য সবাই মাথা নাড়ল। মিঠুন জিজ্ঞেস করল, কেন? পাগল কেন ভাববে?

কেউ তার প্রশ্নর উত্তর দিল না। তার কারণ উত্তর দেওয়ার কিছু নেই। রিতু বলল, ভালোই হলো আমি আজকে যে জন্যে মিটিং ডেকেছি সেটা নিয়ে কথা বলার আগে এই বিষয়টা নিয়ে কথা হয়ে গেল। আমরা সবাই স্বীকার করে নিলাম আমাদের বাসাটা হচ্ছে অন্য রকম। সবার থেকে আলাদা।

টিয়া মাথা নাড়ল, ভালো না খারাপ জানি না, কিন্তু অবশ্যই আলাদা।

হ্যাঁ, অবশ্যই আলাদা। কাজেই আমরা যেটাই করতে চাই সেটা হতে হবে আলাদা। সেটা হতে হবে আজিব!

আজিব বলে কোনো শব্দ নেই কিন্তু কেউ সেটা রিতুকে মনে করিয়ে দিত না। তিতু জিজ্ঞেস করল, আমরা কী করতে চাই আপু?

বলছি। সেটা বলার জন্যেই এই মিটিং ডেকেছি।

সবাই এবার নড়ে চড়ে বসল। মিঠুন যে মিঠুন সেও নড়াচড়া বন্ধ করে এই প্রথম শান্ত হয়ে বসল।

রিতু বলল, সামনের নভেম্বর মাসের একুশ তারিখ আমাদের নানির জন্মদিন।

মিঠুন হাততালি দিয়ে বলল, কী মজা! কী মজা!

রিতু মিঠুনের হাততালি শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল তারপর বলল, নানির এই জন্মদিনটা অনেক স্পেশাল।

টিটন জিজ্ঞেস করল, কেন এটা স্পেশাল, আপু?

এটা হচ্ছে নানির ষাট নম্বর জন্মদিন। যার মানে এটা হচ্ছে ডায়মন্ড জুবিলি। হীরক জয়ন্তী।

সবাই ছোট বড় কিংবা মাঝারি বিস্ময়ের শব্দ করল। মিঠুন মুখ শুকনা করে বলল, মায়ের বয়স ষাট বছর হয়ে যাবে? সেটা তো থুরথুরে বুড়ি। মরে যাবে এখন?

রিয়া ধমক দিল, বলল, ধুর থুরথুরে বুড়ি কেন হবে? ষাট বছর কোনো বয়সই না। আমি সেই দিন দেখেছি একজন ষাট বছর বয়সে বিয়ে করেছে।

এবারে মিঠুনকে আরো দুশ্চিন্তিত দেখালো, বলল, তাহলে দাদি কী আবার বিয়ে করবে?

সবাই হাসতে শুরু করল। টিটন মিঠুনের মাথায় চাটি দিয়ে বলল, ধুর গাধা! তুই তো দেখি এক নম্বর বেকুব।

মিঠুন বুঝতে পারল কথাটা একটু বেকুবের মতো হয়ে গেছে তাই আপাতত কিছুক্ষণের জন্যে সে চুপ করল।

রিতু বলল, যেহেতু এটা নানির ষাট নম্বর জন্মদিন তাই সেটা ঠিক করে করতে হবে। যাকে বলে ফাটাফাটি।

সবাই মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ, ফাটাফাটি।

তাই আমি মিটিং ডেকেছি, কীভাবে জন্মদিনটা করা যায় সেইটা আলোচনা করার জন্য।

মিঠুন বলল, ষাট কেজি কেক, তার মাঝে ষাটটা মোমবাতি।

রিতু বলল, গুড।

টিয়া বলল, ডায়মন্ড জুবিলি হলে দাদির জন্য কিনতে হয়ে একটা ডায়মন্ডের নেকলেস।

রিতু নিশ্বাস ফেলে বলল, ডায়মন্ডের অনেক দাম। আমরা এত টাকা কই পাব?

টিটন বলল, আজকাল নতুন মোবাইল ফোন বের হয়েছে সেগুলো দিয়ে অনেক সুন্দর ফটো তোলা যায়।

তিতু অবাক হয়ে বলল, সত্যি? ফোন দিয়ে ফটো তোলা যায়? আজিব।

রিতু বলল, এইগুলোরও অনেক দাম হবে। তাছাড়া এই সব ফোন ক্যামেরা এই গুলোতে নানির কোনো উৎসাহ নাই।

টিয়া বলল, বই, আমরা ভালো বই দিতে পারি।

রিতু মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ, বই একটা ভালো গিফট। কিন্তু আমি আরো স্পেশাল কিছু ভাবছিলাম। যেটা আমাদের আজব ফেমিলির সাথে মিলবে।

তিতু বলল, নানিকে নিয়ে আমরা কক্সবাজার বেড়াতে যেতে পারি।

হ্যাঁ। রিতু মাথা নাড়ল। এটাও একটা ভালো গিফট হতে পারে। দেখি আর কোনো আইডিয়া আছে কী না।

রিতু একটা কাগজ আর কলম নিয়ে বসল, এবং যে যেটা বলছিল সেটাই লিখে ফেলল। সব মিলিয়ে তেরোটা আইডিয়া পাওয়া গেল সে গুলো এরকম :

১. ষাট কেজি কেক, তার মাঝে ষাটটা মোমবাতি।

২. ডায়মন্ডের নেকলেস।

৩. ফটো তোলা যায় এ রকম মোবাইল ফোন।

৪. বই।

৫. সবাইকে নিয়ে কক্সবাজার বেড়াতে যাওয়া।

৬. ষাটটা কলম।

৭. ষাটটা সন্দেশ না হলে চমচম।

৮. দামি রেস্টুরেন্টে গিয়ে সবাইকে নিয়ে ডিনার।

৯. জন্মদিন উপলক্ষে একটা ওয়াল ম্যাগাজিন।

১০. জম্মদিন উপলক্ষে একটা নাটক লিখে নিজেরা নিজেরা অভিনয় করে দেখানো।

১১. জামদানি শাড়ি।

১২. জন্মদিন উপলক্ষে মিঠুনের ষাট দিন কোনো দুষ্টুমি না করা।

১৩. জন্মদিন উপলক্ষে সবাই মিলে ষাটটা রবীন্দ্রনাথের কবিতা মুখস্ত করা।

মিটিং শেষে ঠিক করা হলো তারা সবাই মিলে এটা নিয়ে আরো চিন্তা করবে, নতুন নতুন আইডিয়া বের করার চেষ্টা করবে, তার মাঝে যেটা সবচেয়ে ভালো হবে সেটাই হবে মায়ের কিংবা নানির কিংবা দাদির ষাট নম্বর জন্মদিনের উপহার।

.

রাত্রিবেলা তিতু বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাহেলা খাতুনের জন্মদিনে তাঁকে কী দেওয়া যায় সেটা চিন্তা করছিল। চিন্তা করতে করতে সে প্রায় ঘুমিয়েই গিয়েছিল হঠাৎ করে তার মাথায় ঝিলিক করে একটা চিন্তা খেলে গেল। সে লাফ দিয়ে উঠে বসল, রাহেলা খাতুনের জন্মদিনে তাকে সবচেয়ে ভালো কী উপহার দেওয়া যায় সেটা তার মাথায় এসেছে। তাদের নানির জন্যে এর চাইতে ভালো আর কোনো গিফট হতে পারে না। সে প্রায় চিৎকার করে উঠল, আপু?

পাশের বিছানায় রিতু শুয়েছিল সে প্রায়ে ঘুমিয়েই গিয়েছিল, চমকে উঠে বলল, কী হয়েছে?

পেয়েছি!

কী পেয়েছিস?

নানিকে জন্মদিনে আমরা কী গিফট দিতে পারি!

কী?

এখন বলব না।

কখন বলবি?

সবাইকে এক সাথে বলব।

এক সাথে বলবি?

তিতু মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। নানি যে কী খুশি হবে চিন্তাও করতে পারবে না।

কী জিনিস, বলে ফেল।

উঁহু। সবাইকে এক সাথে বলব।

রিতু একটু রেগে বলল, যদি আমাকে এখন বলবি না তাহলে ঘুম থেকে ডেকে তুললি কেন?

তিতু কাচুমাচু হয়ে বলল, সরি আপু সরি। বুঝতে পারি নাই তুমি ঘুমিয়ে গেছ। রিতু নরম গলায় বলল, ঠিক আছে। ঘুমা এখন। রিতু নিজেও ঘুমানোর চেষ্টা করল, তিতুর ওপর রাগ করা খুবই কঠিন!

০৪. যখন অসাধারণ আইডিয়া

চার তলার ছাদে অর্ধসমাপ্ত ঘরটিতে আজকে আবার মিটিং বসেছে। এই মিটিংয়ে তিতু সবাইকে বলবে রাহেলা খাতুনের জন্য সবচেয়ে ভালো জন্মদিনের উপহার কী হতে পারে। শোনার জন্য সবাই আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে, এমন কী টিয়া পর্যন্ত তার বই পড়া বন্ধ করে তিতুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

তিতু সবার দিকে তাকিয়ে একটু লাজুক মুখে বলল, আমি চিন্তা করে বের করেছি মাকে- মানে নানিকে জন্মদিনে কী গিফট দিলে নানি সবচেয়ে বেশি খুশি হবে।

রিতু বলল, বলে ফেল, আমরা শুনি।

গিফটটা একটু কঠিন কিন্তু আমরা নানির জন্যে একটু কঠিন কাজ তো করতেই পারি। পারি না?

টিটল বলল, হ্যাঁ পারি। এখন বল সেটা কী জিনিস।

এটা কোনো জিনিস না, এটা একটা কাজ।

টিয়া বলল, কী কাজ। বল তিতু ভাইয়া।

বলছি। তিতু একটা বড় শ্বাস নিয়ে বলল, আমরা তো সবাই নানির সাথে কথা বলেছি। বল দেখি নানি সবচেয়ে বেশি কী চায়?

রিতু বলল, তুই যেহেতু চিন্তা করে বের করেছিস তুইই বল।

নানি সবচেয়ে বেশি কার কথা বলে?

মিঠুন বলল, মানে হয় আমার কথা।

তিতু মাথা নাড়ল, বলল, উঁহু। তোর কথা না। অন্য আরেক জনের কথা।

সবাই একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকালো। টিটন একটু অধৈর্য হয়ে বলল, এতো ধানাই পানাই না করে তুই সোজাসুজি বলে ফেল দেখি।

তিতু বলল, নানি সবচেয়ে বেশি বলে নানার কথা। বলে কী না? সবাই একটু থতমত খেয়ে যায়। কেউ ভাবেনি তিতু আসাদ রহমানের কথা বলবে। তিতু এখন কী বলবে কেউ অনুমান করতে পারে না কিন্তু সবাই একটু ইতস্তত করে মাথা নাড়ল।

তিতু বলল, নানি সব সময় বলে, ইশরে মানুষটা মাটি পেল কী না সেইটাই জানলাম না। যদি কোথায় মাটি দিয়েছে জানতাম তাহলে সেইখানে মাথার কাছে বসে কোরান শরীফটা খতম দিতাম। বলে কী না?

সবাই মাথা নাড়ল, এমন কী মিঠুন পর্যন্ত গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল।

তিতু বলল, সেইজন্যে আমি মনে করি নানির জন্মদিনের জন্যে আমরা নানার কবরটা কোথায় সেটা খুঁজে বের করি। তারপর নানিকে সেইখানে নিয়ে যাই।

সবাই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। তারপর সবাই অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। প্রথম কথা বলল রিতু, কিন্তু, কিন্তু আমরা তো কিছুই জানি না। ত্রিশ-বত্রিশ বছর আগে কোথায় নানা যুদ্ধ করেছে- কোথায় মারা গেছে।

তিতু বলল, সেইটা ঠিক।

তাহলে আমরা কীভাবে তার কবর খুঁজে বের করব?

তিতু মাথা নাড়ল, সেইটা আমি জানি না।

তাহলে?

তাহলে কী?

তাহলে মানে- তাহলে আমরা কীভাবে খুঁজে বের করব?

তিতু বলল, সেইটা চিন্তা করে ঠিক কর।

মিঠুন হঠাৎ করে হাসি হাসি মুখে বলল, একটা খুব সোজা উপায় আছে।

সবাই অবাক হয়ে মিঠুনের দিকে তাকালো, সোজা উপায়?

হ্যাঁ। আমরা এমনি এমনি একটা জায়গায় নিয়ে দাদিরে বলব, এইটা দাদার কবর-দাদি কোনোদিন টের পাবে না!

টিটন যথেষ্ট জোরে মিঠুনের মাথায় একটা চাটি মেরে বলল, চুপ কর ছাগল কোথাকার।

মিঠুন মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, আমি কী ভুল কিছু বলেছি? দাদি কেমন করে বুঝবে এইটা আসল না ভূয়া?

টিটন আরেকবার চাটি মেরে বলল, চুপ কর গাধা কোথাকার।

মাথায় চাটি মেরে একটা একটা করে প্রাণীর নাম বলতে থাকলে অনেকক্ষণ ধরে বলা যাবে। মিঠুন মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে চুপ করে গেল।

কিছুক্ষণ অন্য সবাইও চুপ করে রইল। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে টিয়া বলল, আসলে তিতু ভাইয়া ঠিকই বলেছে আমরা যদি দাদিকে দাদার কবরের কাছে নিতে পারি সেটা আসলেই খুবই ভালো জন্মদিনের গিফট হবে। কিন্তু আমরা তো জানি পর্যন্ত না দাদা কোথায় যুদ্ধ করেছে, কীভাবে মারা গেছে।

টিটন বলল, আচ্ছা, এটা কী কখনো কেউ খোঁজ নিয়েছে?

তিতু বলল, একটু একটু নিয়েছে।

রিতু জিজ্ঞেস করল,তুই কেমন করে জানিস?

নানিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, নানি বলেছে। যুদ্ধের পর নানি খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছিল কিন্তু বেশি খোঁজ নিতে পারে নাই। দেশের অবস্থা খুব খারাপ ছিল, নানিও অনেক ঝামেলার মাঝে ছিল।

সবাই মাথা নাড়ল, তারা সবাই তাদের আব্ব আম্মুর কাছ থেকে গল্প শুনেছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা খুব কষ্টের মাঝে ছিল। তখন দুই বেলা খাওয়া জোগাড় করতেই রাহেলা খাতুনের জান বের হয়ে যেত। কাজেই তখন রাহেলা খাতুন ভালো করে তার স্বামীর খোঁজ নিতে পারেন নাই।

টিয়া জিজ্ঞেস করল, যখন আমাদের আব্ব চাছু ফুপুরা বড় হয়েছে। তখন তারা খোঁজ নেয় নাই?

তিতু বলল, নিতে চেষ্টা করেছে লাভ হয় নাই।

তুমি কেমন করে জান?

নানি বলেছে। সবাই জানে তিতুর সাথে রাহেলা খাতুনের একটা অন্যরকম সম্পর্ক, অনেক সময় সে নানির পায়ের কাছে বসে তার গল্প শুনে। এতো বড় হয়েছে এখনো মাঝে মাঝে নানির গলা জড়িয়ে ধরে বসে থাকে।

সবাই আরো কিছুক্ষণ বসে থাকে, তারপর রিতু সোজা হয়ে বসে বলল, ঠিক আছে। আজকের মিটিং তাহলে এখন শেষ। তিতু যেটা বলেছে সেটা ঠিক, আমরা যদি আসলেই নানার কবরটা খুঁজে বের করতে পারি সেটা হবে অসাধারণ। শেষ পর্যন্ত পারি আর নাই পারি একটু চেষ্টা করে দেখব। ঠিক আছে?

সবাই মাথা নাড়ল, এমন কী মিঠুনও। রিতু একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, শুধু বুঝতে পারছি না কোথা থেকে শুরু করব। এখন দেশের গভমেন্টটাও রাজাকারের গভমেন্ট!

কেউ কোনো কথা বলল না, শুধু মিঠুন হাত তুলে চিৎকার, করল, রাজাকারের চামড়া, তুলে নিব আমরা।

মিঠুনের সাথে চিৎকারে আর কেউ যোগ দিল না কিন্তু সবাই মনে মনে ভাবল কাজটা করতে পারলে আসলে খারাপ হতো না।

.

বাচ্চা কাচ্চারা প্রথমে তাদের আব্ব আম্মুর সাথে কথা বলল। তাদের কাছ থেকে তারা বিশেষ কিছুই জানতে পারল না। বাসায় আসাদ রহমানের সেরকম কোনো ছবি পর্যন্ত নেই। বিয়ের পর রাহেলা খাতুনের সাথে স্টুডিওতে তোলা একটা ছবি আছে সেটাই একমাত্র ছবি। কীভাবে তারা আসাদ রহমান নিয়ে খোঁজ-খবর শুরু করবে সেটাই যখন তারা বুঝতে পারছিল না তখন হঠাৎ করে রিতু শুরু করায় একটা পথ খুঁজে পেলো। পথটা দেখালেন এমন একজন যার কথা রিতু কখনো কল্পনা করেনি। মানুষটা হচ্ছে তাদের প্রিন্সিপাল ম্যাডাম।

স্কুলে টিফিনের ছুটিতে সবাই দৌড়াদৌড়ি করে খেলছে। প্রত্যেক দিন রিতুও খেলে আজকে তার শরীরটা ভালো লাগছে না বলে বারান্দায় পা ঝুলিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে বসেছিল। আজকাল রিতু যখনই একা একা বসে সে তার নানার কথা চিন্তা করে, একটা মানুষ এভাবে পুরোপুরি পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে সেটা কেমন করে হতে পারে?

রিতু খেয়াল করেনি যে তাদের প্রিন্সিপাল ম্যাডাম সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন এবং রিতুকে বসে থাকতে দেখে দাঁড়িয়ে গেছেন। স্কুলে শত শত ছেলে মেয়ে, প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আলাদাভাবে তাদের মনে রাখতে পারেন না কিন্তু এই তেজী মেয়েটার কথা তার মনে আছে। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম খুব বেশি হাসেন না কিন্তু আজকে হাসি হাসি মুখে বললেন, কী হলো? তুমি একা একা বসে আছ কেন?

রিতু প্রিন্সিপাল ম্যাডামের গলার স্বর শুনে লাফ দিয়ে ওঠার চেষ্টা করল এবং নিজের পায়ের সাথে নিজের পা বেঁধে একেবারে হুড়মুড় করে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের ওপর পড়ে গেল, প্রিন্সিপাল ম্যাডাম তাকে খপ করে ধরে ফেললেন, বললেন, আরে! কী হলো! কী হলো!

রিতু লজ্জায় প্রায় মরে যাচ্ছিল, কোনোমতে বলল, সরি ম্যাডাম! সরি সরি সরি!

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, আমি সরি, তোমাকে এভাবে চমকে দেওয়ার জন্য! এতো মনোযোগ দিয়ে কী ভাবছিলে?

কিছু না ম্যাডাম কিছু না বলে হঠাৎ করে সে থেমে গিয়ে বলল, আসলে আমার নানার কথা ভাবছিলাম। আমার মুক্তিযোদ্ধা নানা।

প্রিন্সিপাল ম্যাডামের মুখটা এবারে একটু গম্ভীর হলো, শান্ত গলায় বললেন, ও।

জী ম্যাডাম।

এরপর একেবারে কিছু না বললে কেমন দেখায়? তাই প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, কী ভাবছিলে?

আসলে আমার নানা কখনো ফিরে আসেন নাই। নানা কোথায় যুদ্ধ করেছেন কোথায় মারা গেছেন কেউ জানে না।

সত্যি?

জী ম্যাডাম। এই জন্যে কয়েকদিন থেকে ভাবছিলাম কেমন করে আমার নানার খোঁজ পাওয়া যায়। কোনো উপায় আছে কিনা।

কিছু ঠিক করেছ?

নানার অনেক পুরানো একটা ছবি আছে, তার বিয়ের পর নানির সাথে তোলা ছবি। তাই ভাবছিলাম সেটা দিয়ে পত্রিকায় কোনো বিজ্ঞাপন দেয়া যায় কিনা, কেউ যদি কিছু জানে সেটা জানানোর জন্য। আপনার কী মনে হয় এটা কাজ করবে?

গুড আইডিয়া। ম্যাডাম কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলেন, তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, সময়টা খারাপ, বুঝেছ। মুক্তিযযাদ্ধারা কথা বলতে চায় না। ওদের ভিতরে এক ধরনের অভিমান।

রিতু কী বলবে বুঝতে পারল না তাই কয়েকবার মাথা নেড়ে দাঁড়িয়ে রইল। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম মাথা ঘুরিয়ে রিতুর দিকে তাকালেন তারপর বললেন, আমার পরিচিত একজন আছেন, উনি হচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের গবেষক। ওনার কাজই হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করা। যে মুক্তিযোদ্ধারা খুব খারাপ অবস্থায় আছে তাদের বের করে সাহায্য করা। তুমি তার সাথে দেখা করে দেখতে পার, তোমাকে হয়তো সাহায্য করতে পারেন।

সত্যি ম্যাডাম? সত্যি?

হ্যাঁ, আমার অফিসে একবার এসো দেখি তার ঠিকানা ফোন নম্বর খুঁজে পাই কিনা।

কী নাম উনার?

মুশতাক। মুশতাক আহমেদ।

থ্যাংক ইউ ম্যাডাম থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম মাথা নাড়লেন তারপর অন্যমনস্ক ভাবে হেঁটে হেঁটে চলে গেলেন।

.

দুইদিন পর বিকাল বেলা দেখা গেল পাঁচ ভাই বোন জামা কাপড় পরে বাইরে যাওয়ার জন্যে রেডি হয়েছে। আশেপাশের বাসা থেকে যে বাচ্চা কাচ্চারা ফুটবল খেলতে এসেছে তারা একটু মন খারাপ করে অন্য কিছু খেলার কথা চিন্তা করলে লাগল। পাঁচজনের দলটি তাদের বড় চাচার (কিংবা বড় মামার) সাথে দেখা করল। বড় চাচা মাসুদ ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষ ঠাণ্ডা গলায় বললেন, কী চাই? পঞ্চ তাণ্ডব কোথায় রওনা দিয়েছে?

টিটন বলল, আব্ব, আমরা মোটেও পঞ্চ তাণ্ডব না। আর কোথায় যাচ্ছি সেটা বলা যাবে না। সেইটা সিক্রেট।

বেআইনী কোনো কাজে না তো?

রিতু বলল, না বড় চাচ্চু।

ভেরি গুড। বলে মাসুদ তার বইয়ে ফিরে গেলেন, কিন্তু পাঁচজন চলে না গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল দেখে বললেন, কী ব্যাপার?

টিয়া বলল, রিকশা ভাড়া শর্ট পড়েছে?

কত রিকশা ভাড়া?

জানি না।

তাহলে?

মিঠুন বলল, বেশি করে দিয়ে দাও। যদি বেঁচে যায় আমরা ফুচকা খেয়ে নিব।

আর যদি কম পড়ে?

এমনভাবে দিবে যেন কম না পড়ে।

মাসুদ মিঠুনের বাস্তব বুদ্ধি দেখে চমৎকৃত হলেন। তিনি সত্যি সত্যি মানি ব্যাগ বের করে একটু বেশি করে কিছু টাকা দিয়ে বললেন, ফুচকা খাওয়ার পর পেট খারাপ হলে খাওয়ার জন্য খাবার স্যালাইনের টাকাও দিয়ে দিচ্ছি।

মিঠুন বলল, খাবার স্যালাইন কিনে টাকা নষ্ট করা ঠিক হবে না। দরকার হলে বাসায় খাবার স্যালাইন বানিয়ে নিব। এক চিমটি লবণ এক মুঠ গুড় যায় এক গ্লাস পানি।

মাসুদ মিঠুনের বাস্তব বুদ্ধি দেখে দ্বিতীয় বার চমৎকৃত হলেন।

.

মুক্তিযুদ্ধ গবেষকের বাসার গেটে দারোয়ান তাদের আটকে দিল, কোথায় যাচ্ছ?

রিতু বলল, মুশতাক আহমেদের বাসায়।

উনি জানেন?

মিঠুন বলল, এখন জানবেন।

দারোয়ান ভুরু কুঁচকে মিঠুনের দিকে তাকাল, তারপর বলল, দাঁড়াও।

পাঁচ ভাই বোন দাঁড়িয়ে রইল এবং দারোয়ানটা একটু পরে ফিরে এসে বলল, যাও উপরে। দুই তালা বাম দিকে।

পাঁচজন সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেল। দরজায় শব্দ করার আগে রিতু মিঠুনের দিকে তাকিয়ে বলল, খবরদার কোনো উল্টা পাল্টা কথা বলবি না।

টিয়া বলল, তার চাইতে বল, খবরদার কোনো কথা বলবি না। মিঠুন কথা বললেই সেটা হবে উল্টা পাল্টা কথা।

মিঠুন মুখ শক্ত করে বলল, কোনও দিন না।

রিতু বেল টিপল এবং সাথে সাথে বিশ একুশ বছর বয়সের একজন। ছেলে দরজা খুলে দিয়ে বলল, আস, ভিতরে আস।

ঘরের এক পাশে একটা বড় টেবিল, টেবিলের পিছনে একজন একটা চেয়ারে বসে আছেন। মানুষটার উশখু খুশকু চুল এবং উশখু খুশকু দাড়ি। নাকের ডগায় চশমা। চশমার ওপর দিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ও! তোমরা তাহলে সেই আন্ডাবাচ্চার দল। দারোয়ান ভুল বলে নাই।

বিশ বছরের যে ছেলেটা দরজা খুলে দিয়েছে সে বলল, না স্যার ভুল বলে নাই।

উশখু খুশকু চুল দাড়ির মানুষটা, যিনি নিশ্চয়ই মুশতাক আহমেদ হবেন। গবেষক বললে ঠিক এরকম একজন মানুষের চেহারা চোখে ভেসে ওঠে। মুশতাক আহমেদ বললেন, তা, তোমরা কী মনে করে? বেড়াতে নাকি কোনো কাজে।

রিতু বলল, কাজে।

অন্য সবাই রিতুর কথাটা সমর্থন করে জোরে জোরে মাথা নাড়ল।

মুশতাক আহমেদ বললেন, কী কাজ? শুনি।

রিতু বলল, আমাদের প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আমাকে আপনার ঠিকানা দিয়েছেন। বলেছেন আপনি মুক্তিযুদ্ধের গবেষক।

ইন্টারেস্টিং।

ম্যাডাম বলেছেন আপনি নাকী মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করেন।

চেষ্টা করি। আজকাল মুক্তিযোদ্ধাদের পাওয়া কঠিন, কেউ নিজেদের পরিচয় দিতে চায় না। সব রাজাকার লাফিয়ে লাফিয়ে সামনে চলে আসে।

রিতু বলল, আমার নানা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।

মিঠুন রিতুকে থামিয়ে বলল, আপুর নানা কিন্তু আমার দাদা। ব্যাপারটা যথেষ্ট পরিষ্কার হয়েছে কী না সেটা নিশ্চিত করার জন্য বলল, আমাদের তিনজনের দাদা আর দুইজনের নানা। আপন দাদা আর নানা। এক্কেবাওে পুরাপুরি আপন।

মুশতাক আহমেদ মিঠুনের কথা শুনে মুচকি হাসলেন, যদিও তার দাড়ি গোঁফের কারণে সেটা বোঝা গেল না। মুখে বললেন, বুঝতে পেরেছি।

রিতু চোখ পাকিয়ে মিঠুনের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাকে একটু কথা বলতে দিবি?

মিঠুন বলল, বল আপু। বল।

আমাদের নানা কিংবা দাদা যেটাই বলেন, যুদ্ধে গিয়ে আর ফিরে আসেন নাই।

মুশতাক আহমেদ তার দাড়ির মাঝে হাত ঢুকিয়ে বললেন, ভেরি ফেমিলিয়ার স্টোরি।

আমরা আপনার কাছে এসেছি একটা জিনিস জানার জন্য- রিতু কথার মাঝখানে থেমে গেল।

মুশতাক আহমেদ একটু ঝুঁকে বললেন, কী জিনিস?

আপনি কী, আপনি কী-বলতে পারবেন নানার কী হয়েছিল? নানা কোথায় কী ভাবে মারা গেছেন কিংবা তার কবরটা কোথায়?

মুশতাক আহমেদ তাদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, বস। তোমরা বস।

ঘরে অনেকগুলো চেয়ার কিন্তু বেশির ভাগ চেয়ারের ওপরেই কিছু না কিছু আছে, বই, খাতা কিংবা কাগজপত্র। তারা কেমন করে বসবে বুঝতে পারল না। তখন মুশতাক আহমেদ চেয়ারগুলো খালি করার জন্যে চেয়ারটা ধাক্কা দিয়ে যখন একটু সামনে এলেন তখন সবাই বুঝতে পারল, মুশতাক আহমেদ আসলে চেয়ারে নয় একটা হুইল চেয়ারে বসে আছেন এবং তার হাঁটুর ওপর থেকে দুটি পা নেই।

মিঠুন প্রায় আর্তনাদ করে বলল, হায় হায়! আপনার পা নাই!

সাথে সাথে সবাই একসাথে মিঠুনের ঘাড় ধরে ঝাঁকিয়ে বলল, চুপ করবি তুই? চুপ করবি ছাগল কোথাকার?

মুশতাক আহমেদ বললেন, ওকে ছেড়ে দাও, ও তো ভুল বলে নাই। আমার তো আসলেই পা নাই।

মুশতাক আহমেদের কথা শুনে মিঠুন একটু সাহস পেলো। জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছিল আপনার পায়ের?

সবাই আবার মিঠুনের ঘাড় চেপে ধরল। রিতু চাপা গলার হিস হিস করে বলল, তুই আরেকবার যদি মুখ খুলিস তোর গলা টিপে ধরব।

মুশতাক আহমেদ রিতুর কথাটা না শোনার ভান করে মিঠুনকে বললেন, যুদ্ধের সময় একটা শেল পড়েছিল, পা উড়ে গেছে। আমি জানে বেঁচে গেছি, আমার প্রাণের বন্ধু বাঁচে নাই। খুব মিস করি ওকে।

বিশ একুশ বছরের ছেলেটাও এগিয়ে এল, মুশতাক আহমেদ আর ছেলেটা মিলে কয়েকটা চেয়ার খালি করে দিল। সবাই তখন চেয়ার গুলোতে ভাগাভাগি করে বসল। টিটন মিঠুনকে নিজের চেয়ারে বসাল, আবার মুখ খুললে সময় মতো তার মুখ টিপে ধরার জন্য।

সবাই বসার পর মুশতাক আহমেদ সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা কী খাবে? চা না কফি?

রিতু বলতে যাচ্ছিল কিছুই লাগবে না, তার আগেই মিঠুন বলল, কফি। বেশি করে দুধ আর চিনি।

টিটন ফিস ফিস করে বলল, বাসায় কোনদিন তোকে কফি খেতে দেয় তুই যে এখানে কফি খেতে চাচ্ছিস?

মিঠুন ফিস ফিস করে বলল, সেই জন্যেই তো দেখতে চাই খেতে কী রকম।

রিতু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনল, বলল, আমাদের কিছু লাগবে না স্যার। আমরা এখনো চা কফি খাওয়া শিখি নাই।

ঠিক আছে যদি না শিখে থাকো তাহলে আমি শিখাতে চাই না।

মিঠুন একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলল এবং সবাই সেটা না শোনার ভান করল।

মুশতাক আহমেদ কিছুক্ষণ তার আঙুলগুলো পরীক্ষা করলেন, তারপর সেই আঙুল দিয়ে টেবিলে কিছুক্ষণ টুক টুক করে শব্দ করলেন, তারপর বললেন, আমি ঠিক কী ভাবে তোমাদের বলব বুঝতে পারছি না, তোমরা এত ছোট। আমাদের মুক্তিযুদ্ধটাই হচ্ছে একটা খুব দুঃখের ইতিহাস। এত মানুষ এত আপনজনকে হারিয়েছে যে সেটা বলে বোঝানো যাবে না। তোমার নানার মতো মানুষের কিন্তু শেষ নেই। কত মুক্তিযোদ্ধা যে দেশের জন্যে যুদ্ধ করে প্রাণ দিয়ে একেবারে সবার অজান্তে হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে মানে হারিয়েই গেছে।

তোমার নানা-

মিঠুন মনে করিয়ে দিল, এবং দাদা।

মুশতাক আহমেদ হাসলেন, বললেন, হ্যাঁ নানা এবং দাদা তবুও তো তোমাদের স্মৃতিতে বেঁচে আছেন। তোমরা তাকে খুঁজে বের করতে চাইছ, দেখে আমার খুব ভালো লাগছে। আমি চেষ্টা করব তাকে খুঁজে বের করতে। কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন, কার সাথে যুদ্ধ করেছেন, কী হয়েছে আমি বের করার চেষ্টা করব। কিন্তু-

বলে মুশতাক আহমেদ থেমে গেলেন। বাচ্চারা কোনো কথা না বলে ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করে। মুশতাক আহমেদ একটু পরে আবার শুরু করলেন। বললেন, কিন্তু আমি তোমাদের জোর দিয়ে বলতে পারছি না যে। আমরা তাকে খুঁজে পাবই পাব। এতোদিন আগের ব্যাপার, কতো তথ্য হারিয়ে গেছে। তাছাড়া সময়টা খুব খারাপ, গভমেন্ট হচ্ছে রাজাকারের গভমেন্ট, মাঝে মাঝে গভমেন্ট এমন ভাব করে যেন মুক্তিযুদ্ধ করাটাই যেন অপরাধ। রাজাকারে রাজাকারে দেশ ভরে গেছে।

মিঠুন গলা নামিয়ে বলল, রাজাকারের চামড়া তুলে নেব আমরা।

মুশতাক আহমেদ ঠিক শুনতে পেলেন না, জিজ্ঞেস করলেন, কী বললে?

মিঠুন বলল, রাজাকারের চামড়া, তুলে নেব আমরা।

মিঠুনের কথা শুনে মুশতাক আহমেদ হা হা করে হাসলেন। বললেন, ভালোই বলেছ। ঠিকই বলেছ, রাজাকারের চামড়া তুলেই নেওয়াই দরকার। যাই হোক, আমরা যদি তোমার নানা কিংবা দাদাকে খুঁজে বের করতে চাই তাহলে সবার আগে কিছু তথ্য দরকার। তোমার নানা সম্পর্কে যা কিছু জান সব বলতে হবে। আমরা একটা ফর্ম তৈরি করে রেখেছি সেটা সবার আগে ফিলআপ করতে হবে। ইচ্ছে করলে এখন ফিলআপ করতে পার, ইচ্ছা করলে বাসায় নিয়ে যেতে পার, ফিলআপ করে পাঠিয়ে দিতে পার। তোমাদের ইচ্ছা।

রিতু বলল, আমরা আসলে কাগজে সব লিখে এনেছি এখনই ফর্মটা ফিলআপ করে যেতে পারব।

ভেরি গুড। তাহলে এখনই সব লিখে দাও। যত বেশি তথ্য দিতে পারবে তত ভালো। তোমাদের কাছে যেটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হবে না সেটাও লিখবে। বুঝেছ?

সবাই মাথা নাড়ল, বলল, বুঝেছি।

রিতু তার ব্যাগ থেকে কাগজ বের করল, আর টিয়া বসে বসে লিখতে শুরু করল। সবাই তাকে ঘিরে দাঁড়ালো, দেখতে লাগল যেন কোনো কিছু লিখতে গিয়ে ভুলে না হয়ে যায়।

আসাদ রহমানের সবকিছু লিখে দেবার পর রাহেলা খাতুনের সাথে বিয়ের সময় ভোলা ছবিটি ফর্মের এক কোনায় লাগিয়ে দিল। মুশতাক আহমেদ তখন ফর্মটা হাতে নিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন, তারপর সন্তুষ্টির মতো শব্দ করে বললেন, ভেরি গুড। আমরা যদি পজিটিভ কোনো খবর পাই তোমাদের আল্লু আম্মু কারো কাছে ফোন করে জানাব-

সবাই এক সাথে চিৎকার করে উঠল, না, না, না-

মুশতাক আহমেদ অবাক হয়ে বললেন, না? না কেন?

তিতু লাজুক মুখে বলল, আসলে এটা গোপন। আমরা যদি আসলেই নানার কবরটা পেয়ে যাই, তাহলে আমাদের নানিকে সেখানে নিয়ে অবাক করে দেব।

টিটন বলল, আমার নানির ষাট নম্বর জন্মদিন তো-এটা হবে আমাদের জন্মদিনের গিফট।

রিতু বলল, সেইজন্যে এইটা আমরা এখন বাসার কাউকে জানাতে চাই না।

মুশতাক আহমেদ বললেন, কিন্তু যদি তোমাদের খবর দিতে হয় কেমন করে দিব?

সবাই একজন আরেকজনের দিকে তাকালো, টিটন বলল, আপনি একটা এস.এম.এস করে বলবেন, আর্ট ক্লাশ ক্যান্সেল আমরা তাহলে বুঝে নিব।

সবাই মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ, তাহলেই আমরা বুঝে যাব।

রিতু বলল, তখন আমরা আপনার সাথে যোগাযোগ করব।

মুশতাক আহমেদ বললেন, ঠিক আছে। তারপর বিশ একুশ বছরের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললেন, রঞ্জু তুমি মনে রেখো। যদি পজিটিভ কোনো খবর পাই তাহলে একটা এস.এম.এস পাঠাতে হবে, আর্ট ক্লাস ক্যানসেলড!

সবাই যখন বিদায় নিয়ে বের হয়ে আসছে তখন টিয়া হঠাৎ করে মুশতাক আহমেদের কাছে গিয়ে বলল, স্যার। একটা কথা জিজ্ঞেস করি?

কর।

যুদ্ধের শুরু যুদ্ধের শেষ বইটা কী আপনি লিখেছেন?

মুশতাক আহমেদ একটু অবাক হয়ে টিয়ার দিকে তাকালেন, তারপর বললেন, হ্যাঁ। আমি লিখেছি। তুমি কেমন করে বুঝলে?

আমি বইটা পড়েছি। পড়ে আমি-আমি-

তুমি কী?

আমি অনেক কেঁদেছি। খুব কষ্টের বই।

মুশতাক আহমেদ তার হুইল চেয়ারটা চালিয়ে টিয়ার কাছে এলেন। এসে টিয়ার মাথায় হাত রেখে বললেন, তুমি এত ছোট মেয়ে এত মোটা বই পড়ে ফেলেছ?

তিতু বলল, আমাদের টিয়া অনেক বই পড়ে।

টিয়া বলল, কিন্তু এই বইটা বেশি কষ্টের।

মুশতাক আহমেদ বললেন, বইটা লিখতেও আমার অনেক কষ্ট হয়েছে। লিখার সময় আমিও কেঁদেছি।

টিয়া বলল, এর পরের বার আমি বইটা নিয়ে আসব, আপনি একটা অটোগ্রাফ দিয়ে দিবেন?

অবশ্যই। অবশ্যই দিব।  বাসায় ফিরে আসার সময় কারোরই ফুচকা খাওয়ার কথা মনে পড়ল না।

০৫. যখন সমস্যার শুরু

ছয়দিন পর সকাল বেলা রিতু তিতু তার আম্মু আব্দুর সাথে নাস্তা করছে তখন তার আব্ব তার টেলিফোনটা দেখতে দেখতে হঠাৎ থেমে গিয়ে বললেন, রিতু তোর জন্যে একটা এস.এম.এস।

রিতু খাওয়া থামিয়ে তার আব্দুর দিকে তাকালো, আমার জন্যে?

হ্যাঁ, মুশতাক নামে একজন লিখেছে আর্ট ক্লাস ক্যান্সেলড।

রিতু এবং তিতু এক সাথে গগন বিদারী চিৎকার করে উঠল, আর্ট ক্লাশ ক্যান্সেলড!

রিতুর আম্মু আব্ব খুবই অবাক হলেন। আর্ট ক্লাশ বাতিল হওয়ার জন্যে তারা আগে কখনো কাউকে এত উত্তেজিত হতে দেখেননি। জিজ্ঞেস করলেন, কী হলো?

রিতু লাফ দিয়ে তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে, আর্ট ক্লাশ ক্যান্সেলড, আর্ট ক্লাশ ক্যান্সেলড বলে চিৎকার করতে করতে ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল, আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাচ্ছিস?

অন্যদের বলে আসি। বলে রিতু ঘর থেকে বের হয়ে গেল, পিছন পিছন তিতু।

আম্মু আর আব্ব কিছুই বুঝতে পারলেন না। শুধু যে রিতু তিতুর আম্মু আব্ব কিছু বুঝতে পারলেন না তা নয় রাহেলা খাতুনের জন্য ছেলে মেয়েরাও কিছু বুঝতে পারলেন না, শুধু অবাক হয়ে দেখলেন আর্ট ক্লাস বাতিল হয়ে গেছে শুনে বাসার সবগুলো বাচ্চা চিৎকার করে ছোটাছুটি করতে লাগল। তারা কারণটা কী জানার জন্যে চেষ্টা করতে পারত কিন্তু এই বাসার এতরকম বিচিত্র ঘটনা ঘটে যে এটাকে সে রকম একটা বিচিত্র ঘটনা বোঝার কোনো কারণ নাই।

.

বিকেল বেলা আবার পাঁচ ভাই বোনকে রাহেলা খাতুনের মেয়ে মিলির কাছে দেখা গেল। রিতু বলল, আম্মুআব্দুর বাসায় আসতে দেরী হবে সেই জন্যে তোমার কাছে এসেছি।

মিলি পরীক্ষার খাতা দেখছিল, চশমাটা ঠেলে নাকের উপরে তুলে বলল, কী ব্যাপার? এক সাথে একেবারে পাঁচজন হাজির?

মিঠুন বলল, থ্যাংকু।

কেন? মিলি জানতে চাইল, থ্যাংকু কেন?

তুমি আমাদের পঞ্চ তাণ্ডব বল নাই সেই জন্যে। আমরা যখন বড় চাচ্চুর কাছে গিয়েছিলাম, বড় চাচ্চু আমাদেরকে পঞ্চ তাণ্ডব বলেছিল।

নিশ্চয়ই টাকা পয়সার জন্যে এসেছিস। কত চাই এবং কেন চাই? টিটন বলল, কত চাই বলা যাবে কিন্তু কেন চাই বলা যাবে না।

মিলি বলল, কেন টাকা দিতে হবে না জানা পর্যন্ত আমি টাকা পয়সা দিতে রাজী না।

রিতু বলল, ঠিক আছে, রিকশা ভাড়া।

মিঠুন বলল, আর ফুচকা।

রিকশা করে কই যাবি?

সেটা বলা যাবে না।

গন্তব্য না জানা পর্যন্ত রিকশা ভাড়া দেওয়া যাবে না।

তিতু বলল, আম্মু, আমরা খুবই ভালো একটা জায়গায় যাব, তুমি যদি শোনো তাহলে অবাক হয়ে যাবে।

গুন্ডা। আমি শুনতে চাই, আমি অবাক হতে চাই।

কিন্তু এটা এখন সিষ্ট্রেট। আমরা কাউকে বলছি না। বড় মামা না শুনেই রিকশা ভাড়া দিয়েছিল দিয়েছিল না?

সবাই জোরে জোরে মাথা নাড়ল। মিলি তবুও নরম হলো না, বলল ভাইজান বোকা সোকা মানুষ, সবকিছু বিশ্বাস করে। আমি এতো বোকা না।

রিতু বলল, আম্মু আমরা এক সময় তোমাদের সবাইকে বলব। তখন যদি তোমাদের মনে হয় আমরা ভুল জায়গায় গিয়েছি তখন তুমি তোমার টাকা ফেরৎ চাইতে পার। কিংবা আমাদেরকে যা ইচ্ছা শাস্তি দিতে পারবে।

মিঠুন বলল, ফাঁসি দিতে পারবে।

মিলি বলল, শুধু আমাকে বল, জায়গাটা কী সেফ?

একশ ভাগ সেফ। আমাদের প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আমাকে এই জায়গাটার কথা বলেছেন।

মিলি এবারে নরম হলো। তারপর জোর করে মুখ শক্ত করে বলল, অন্ধকার হওয়ার আগে ফিরে আসতে হবে। যদি এক মিনিট দেরি হয় তাহলে এর পর থেকে সব সিক্রেট প্রজেক্ট বন্ধ।

ঠিক আছে আম্মু। রিতুর কথার সাথে সাথে সবাই জোরে জোরে মাথা নাড়তে লাগল।

বাসা থেকে বের হওয়ার সময়, টিয়া একটা বই নিয়ে বের হলো, মিলা দেখলো, বইটার নাম যুদ্ধের শুরু যুদ্ধের শেষ। টিয়ার হাতে সব সময়েই কোনো-না-কোনো বই থাকে, কিন্তু এত মোটা একটা বই নিয়ে বের হতে দেখে মিলা কিছু একটা আন্দাজ করার চেষ্টা করল, খুব একটা লাভ হলো না।

.

মুশতাক আহমেদের বাসার দারোয়ান আজকে তাদের থামাল না। বরং হাসি হাসি মুখে বলল, যাও, স্যার বাসাতেই আছেন। মনে আছে তো, দুইতলা বাম দিকে।

বাচ্চারা বলল, জী, মনে আছে। থ্যাংকু।

দরজায় বেল বাজানোর পর আজকে একটা মেয়ে দরজা খুলে দিল। দেখে মনে হয় কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। টেবিলে মোশতাক আহমেদের সামনে বিশ একুশ বছরের একটা ছেলে বসে আছে, মুশতাক আহমেদ কিছু একটা বলছিলেন ছেলেটা শুনছিল। সবাইকে ঢুকতে দেখে মুশতাক আহমেদ কথা বন্ধ করে ওদের দিকে তাকালেন।

রিতু বলল, স্যার, আপনার এস.এম.এস পেয়ে চলে এসেছি।

গুড। কী খবর তোমাদের?

ভালো স্যার। আপনার এস.এম.এস পাওয়ার পর আরো অনেক বেশি ভালো।

আগেই বেশি আশা করে বসে থেকো না, দেখা যাক কী হয়। তোমরা একটু অপেক্ষা করো আমি এর সাথে একটা জরুরি কথা সেরে নিই।

ঠিক আছে স্যার। বলে সবাই খালি চেয়ারগুলোতে ভাগাভাগি করে বসল। মুশতাক আহমেদ ছেলেটার সাথে মামলা মোকদ্দমা নিয়ে কথা বলতে থাকলেন। কোথায় উকিল পাওয়া যাবে, কম টাকায় কীভাবে কাজ করা যায় এরকম কথাবার্তা।

কথা শেষ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে মুশতাক আহমেদ বাচ্চাদের দিকে তাকালেন।

রিতু জিজ্ঞেস করল, স্যার, আমাদের জন্যে কোনো খবর আছে?

একটু খানি খবর আছে, কিন্তু ঠিক তোমরা যেভাবে চাইছ সেরকম খবর এখনো নেই।

মানে?

তোমার নানা-কিংবা দাদা, যে এলাকাতে যুদ্ধ করেছেন আমরা সেই জায়গাটা মোটামুটি বের করেছি, কিন্তু ঠিক কোথায় মারা গেছেন বা তাকে কোথায় কবর দেওয়া হয়েছে, কিংবা আসলে কবর দেওয়া হয়েছেই কিনা সেটা এখনো বের করতে পারিনি।

টিটন জিজ্ঞেস করল, দাদা কোথায় যুদ্ধ করেছেন?

পঞ্চগড় জগদল রৌমারী ঐ এলাকায়।

মিঠুন টিয়ার পেটে চিমটি কেটে জিজ্ঞেস করল, এই জায়গাগুলো কোনখানে? পাকিস্তানে নাকি?

টিয়া পেটে হাত বুলাতে বুলাতে ফিসফিস করে বলল, ধুর গাধা। পাকিস্তানে কেন হবে? নর্থ বেঙ্গলে।

রিয়া জিজ্ঞেস করল, আপনি কেমন করে জায়গাটা বের করলেন?

মুক্তিযোদ্ধাদের লিস্ট আছে, কে কোথা থেকে ট্রেনিং নিয়েছে কে কোথায় যুদ্ধ করেছে। সেখানে নাম দিয়ে খুঁজেছি। অনেকে তালিকায় আছে, অনেকে তালিকায় নাই। যারা ঐ এলাকায় যুদ্ধ করেছে তাঁদের অনেকে যুদ্ধে মারা গেছে, অনেকে বয়স হয়ে মারা গেছে, অনেকে রোগে শোকে মারা গেছে, অনেককে আবার পরে মেরে ফেলেছে। যারা বেঁচে আছে তাঁদের সাথে আমাদের ভলান্টিয়াররা কথা বলেছে। সেই কথাবার্তা থেকে আমরা জেনেছি সেখানে আসাদ নামে একজন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ছিল- তাই অনুমান করছি।

দুর্ধর্ষ যোদ্ধা? আমার নানা দুধর্ষ যোদ্ধা ছিলেন?

মুক্তিযোদ্ধা মানেই দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। তোমার নানা-

মিঠুন বাধা দিয়ে বলল, এবং দাদা।

হ্যাঁ এবং দাদা তার মাঝে আলাদাভাবে সাহসী যোদ্ধা ছিলেন। যার নাম আসাদ সে তো সাহসী হবেই। আসাদ নামের মানে জানো তো?

টিয়া মাথা নাড়ল, জী, সিংহ।

হ্যাঁ। কাজেই তাঁর সিংহের মতো সাহস ছিল। এখন পর্যন্ত আমরা যেটুকু জানি সেটা হচ্ছে তোমার নানার দলটা সেখানে অক্টোবরের শুরু থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি যুদ্ধ করেছে। প্রচণ্ড যুদ্ধ। পাকিস্তানি আর্মিকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে। তারপর দলটা দক্ষিণে সরে এসেছে। আমরা ডিটেল্স এখনো জানি না।

তিতু জিজ্ঞেস করল, কীভাবে জানব আমরা? কীভাবে জানব?

এই জায়গাটা একটুখানি ট্রিকি। ঐ এলাকাতে গিয়ে খোঁজাখুজি করতে হবে। একজন মুক্তিযোদ্ধার খোঁজ পেয়েছি, তার নাম হচ্ছে ইদরিস। ইদরিস মিয়া। তাকে খুঁজে বের করতে হবে। সে তোমার নানার সাথে ছিল। সে তোমার নানার খবর দিতে পারবে। কিন্তু মুশকিল হলো- মুশতাক আহমেদ মুশকিলের কথাটা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন।

সবাই ধৈৰ্য্য ধরে অপেক্ষা করল এবং মুশতাক আহমেদ শেষ পর্যন্ত বললেন, মুশকিল হচ্ছে ইদরিস মিয়াকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সে ঐ এলাকাতেই আছে, কিন্তু কোথায় আছে কেউ জানে না। কয়েকটা গ্রাম আছে সেখানে, তার মাঝেই থাকার কথা। কোনো কিছু নিয়ে তার ভিতরে অনেক বড় ক্ষোভ কিংবা দুঃখ তাই সে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছে। সবার চোখের আড়ালে চলে গেছে। তাকে যদি খুঁজে বের করতে পারি আমার ধারণা আমরা তোমাদের নানার,–কিংবা দাদার খোঁজ পেয়ে যাব।

টিটন জানতে চাইল, আমরা কেমন করে ওনার খোঁজ পাব?

ওখানে যেতে হবে। আমাদের ভলান্টিয়ার টিম সেখানে গিয়ে খুঁজে বের করবে?

কখন যাবে তারা?

সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন। আমাদের অনেক ভলান্টিয়ার। স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটির ছেলে মেয়েরাই বেশি। তারা নানারকম কাজ করে। মুশতাক আহমেদ তার ঘরের ছেলেটিকে এবং মেয়েটিকে দেখিয়ে বললেন, এই যে, এই দুইজন ভলান্টিয়ার। একটু পরে আরো কয়েকজন আসবে। সবাই কাজ করে যাচ্ছে। এরকম একটা টিম যাবে, ওখানে থেকে খুঁজে বের করবে। কিন্তু

রিতু সোজা হয়ে বসে বলল, কিন্তু কী?

কিন্তু এই মুহূর্তে সবাই ব্যস্ত। এই সরকার এসে আমাদের বিপদে ফেলে দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে মামলা মোকদ্দমা দিয়ে তাদের জীবনটা নষ্ট করে দিচ্ছে। অনেককে জেলে পাঠিয়েছে। অনেকের চাকরি বাকরি নেই। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ। কাজেই তাদেরকে সাহায্য করতে করতে পুরো এনার্জী চলে যাচ্ছে। আমাদের কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। মাস দুয়েক পরে আমরা একটু ফ্রি হব। তখন মনে হয় ইদরিস মিয়াকে খুঁজে বের করতে পারব।

বাচ্চারা সবাই একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল। রাহেলা খাতুনের জন্মদিন ততদিনে পার হয়ে যাবে। তারা ঠিক করে রেখেছিল এটা হবে নানির জন্মদিনের ওপরে।

ছেলেমেয়েদের মুখ দেখে মুশতাক আহমেদ বুঝতে পারলেন, জিজ্ঞেস করলেন, ততদিনে তোমার দাদির জন্মদিন চলে আসবে?

জি, জি- সবাই জোরে জোরে মাথা নাড়ল।

রিতু বলল, দাদির জন্মদিন সামনের মাসের একুশ তারিখ। আমরা এর আগে বের করতে চাচ্ছিলাম।

মুশতাক আহমেদ চেয়ারে হেলান দিয়ে দাড়ির ভেতর আঙুল দিয়ে বিলি কাটতে কাটতে চিন্তা করতে লাগলেন। ঠিক তখন টিয়া বলল, রিতু আপু?

কী হলো?

আমরা কী ঐ জায়গাতে গিয়ে ঐ মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজে বের করতে পারি না?

রিতু অবাক হয়ে বলল, আমরা?

হ্যাঁ। আমরা।

মিঠুন হাত ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ইয়েস।

টিটন বলল, টিয়া ঠিকই বলেছে, আমরা ঐ গ্রামে গিয়ে খুঁজে খুঁজে বের করে ফেলব।

শুধু তিতু লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, দিবে না! আমাদের যেতে দিবে না।

টিয়া বলল, আমরা স্যারের ভলান্টিয়ার হয়ে যাব। বাসায় গিয়ে বলব, আমরা মুক্তিযুদ্ধের ওপর গবেষণা করব।

রিতু চুপ করে চিন্তা করল, তারপর বলল, সেটা একটা আইডিয়া হতে পারে। তারপর মুশতাক আহমেদের দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার, আমরা কী ভলান্টিয়ার হতে পারি?

মুশতাক আহমেদ বললেন, যে কেউ ভলান্টিয়ার হতে পারে। তোমরা বয়সে একটু ছোট, কিন্তু কে বলেছে বয়স কমে হলে মুক্তিযুদ্ধের ভলান্টিয়ার হতে পারবে না। কম বয়সে যদি মুক্তিযুদ্ধ করা যায় তাহলে ভলান্টিয়ারও হওয়া যায়।

টিয়া বলল, আমরা শুধু স্যারের কাছ থেকে একটা চিঠি নিয়ে যাব। স্যার লিখে দিবেন আমরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণার ভলান্টিয়ার।

মুশতাক আহমেদের ঘরে যে মেয়েটি তাদের দরজা খুলে দিয়েছিল, সে বলল, স্যার যদি রাজি থাকেন তাহলে আমি তোমাদের ভলান্টিয়ার কার্ড তৈরি করে দিতে পারি।

সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠল। মুশতাক আহমেদ হেসে বললেন, অবশ্যি তৈরি করে দাও। লেমিনেটিং করে দিও যেন দরকার হলে গলায় ঝুলিয়ে ঘুরতে পারে। সবাই দেখুক আমাদের কত ছোট ছোট ভলান্টিয়ার আছে।

বাসায় ফিরে আসার আগে টিয়া তার বইটিতে মুশতাক আহমেদের অটোগ্রাফ নিয়ে এল।

.

সেদিন রাত্রি বেলাতেই পাঁচ ভাইবোনের দলটি তাদের গলায় ভলান্টিয়ারের লেমিনেটিং করা কার্ড নিয়ে তাদের বাবা মা চাচা চাচি মামা মামির কাছে। যাওয়া শুরু করল।

প্রথমে গেল রাহেলা খাতুনের সবচেয়ে বড় ছেলে মাসুদের কাছে, বাচ্চাদের এই বড় চাচা কিংবা বড় মামাকে তাদের নানা ধরনের আবদার খুব সহজে মেনে নেন। সেইজন্যে তাকে নিয়ে তারা শুরু করল। কোনো এক প্রত্যন্ত গ্রামে কোনো এক মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজে বের করে তার ইন্টারভিউ নেওয়ার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা দায়িত্ব পেয়েছে বিষয়টা খুব ভালো করে বোঝানোর পর তারা এক সপ্তাহের জন্যে সেই গ্রামে থাকার অনুমতি চাইল।

কারো বাবা, কারো বড় চাচা এবং কারো বড় মামা মাসুদ সব কিছু শুনে গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বলল, কাজটি খুবই মহৎ সন্দেহ নাই, কিন্তু এটি তোদের উপযোগী কাজ নয়। তাছাড়া একজন মানুষের ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য পাঁচজন যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তোরা কী প্রশ্ন করতে চাস একটা কাগজে লিখে দে, আমি অফিস থেকে একজনকে পাঠিয়ে দেই, সে উত্তরগুলো লিখে আনবে।

টিটন বলল, কিন্তু আব্ব কিন্তু কিন্তু

তারপর কী বলবে বুঝতে পারল না। টিয়া বলল, আগে সেই মুক্তিযোদ্ধাটাকে খুঁজে বের করতে হবে।

একটা গ্রামে কাউকে চিনিস না জানিস না সেইখানে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে তোরা খুঁজে বের করবি? তোরা?

খুবই সহজ একটা বাক্য কিন্তু বড় চাচা এমনভাবে সেটা বলল যে শুনে মনে হলো আসলেই এটা বুঝি খুবই অবাস্তব এবং হাস্যকর একটা কাজ।

বড় চাচা মাসুদের সাথে কথা বলার সময় বড় চাচি সীমা এসে এক সাথে সবাইকে দেখে বলল, কী হচ্ছে এখানে? কীসের ষড়যন্ত্র?

টিয়া মুখ গম্ভীর করে বলল, মোটেই ষড়যন্ত্র না আম্মু। আমরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করতে চাচ্ছি।

টিয়ার মুখ থেকে সবকিছু শুনে সীমা ফিক করে হেসে ফেলল। তারপর বলল, তোরা একা একা গ্রামে গিয়ে থাকবি? রাত্রে শেয়ালের ডাক শুনে যখন ভয়ে চিৎকার করতে থাকবি, তখন তোদের দেখে রাখবে কে?

টিটন গম্ভীর হয়ে বলল, আমরা মোটেও শেয়ালের ডাক শুনে ভয়ে চিৎকার করব না।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা কত গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার তবুও বড় চাচি পুরো ব্যাপারটা নিয়ে খিল খিল করে হাসতে থাকলেন, কোনো গুরুত্বই দিলেন না।

বড় চাচা এবং বড় চাচির সাথে কথা বলাটা পুরোপুরি বৃথা যাওয়ার পর তারা উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। তারপরেও তারা অন্যদের সাথে একটু চেষ্টা করল কিন্তু কোনো লাভ হলো না। রিতু তিতুর আম্মু মিলা বলল, এর চাইতে আমি প্লেনের টিকেটের ভাড়া দিই, ঐ মুক্তিযোদ্ধাকে এখানে নিয়ে আয়। বাসায় থাকবে, যত খুশি ইন্টারভিউ নিতে পারবি।

রিতু তিতুর আব্ব বলল, আমি খুবই হতাশ হলাম যে তোরা ভাবিস আমাদের কোনো দায়িত্ববোধ নেই, আমরা তোদেরকে এক সপ্তাহের জন্যে এভাবে একটা গ্রামে একা একা ছেড়ে দেব।

এরপর আর কারো সাথে কথা বলার আর কোনো উৎসাহ থাকার কথা না। তারপরও তারা মিঠুনের আব্ব আম্মুর সাথে একটু চেষ্টা করল। দুইজনেই ডাক্তার, দুইজনই ব্যস্ত তারপরও তারা একটা গ্রামে এক সপ্তাহ থেকে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজে বের করে তার ইন্টারভিউ নেওয়ার বিষয়টা শুনল। মিঠুনের আব্দু গম্ভীর হয়ে বলল, যখন তোরা আরো বড় হবি, নিজের দায়িত্ব নিজেরা নিতে পারবি তখন দেখা যাবে।

মিঠুনের আম্মু বলল, মাথাটা খারাপ হয়েছে?

তখন বাকি থাকল শুধু ছোট চাচা কিংবা ছোট মামা তাকে পেতেই অনেক সময় লাগল। যখন তাকে পাওয়া গেল, তখন সে খুবই মনোযাগ দিয়ে একটা মোটা ইংরেজি বই পড়ছে। সবকিছু শুনে সে বলল, ও আচ্ছা, ভেরি গুড। ভেরি গুড।

তারপর আবার বইটা পড়তেই শুরু করল। যার মানে তারা কী বলছে সেটা ছোট চাচা কিংবা ছোট মামা ভালো করে শুনে নাই পর্যন্ত। অন্য সময় হলে যতক্ষণ ঠিক করে না শুনছে ততক্ষণ চেষ্টা করে তারা শুনিয়ে ছাড়তো, কিন্তু আজকে তাদের এতটাই মন খারাপ হলো যে তাদের সেটা করারও ইচ্ছা করল না।

পাঁচজন তাদের গলা থেকে লেমিনেটেড করা ভলাটিয়ার কার্ড খুলে মুখ কালো করে বসে রইল।

 ০৬. যখন একটা কাণ্ড

সকাল বেলা কেউ টের পায় নাই দিনটা এই বাসার ইতিহাসের সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ একটা দিন হয়ে যাবে! দিনটা শুরু হয়েছে খুবই শান্তভাবে। সকালে সবাই ঘুম থেকে উঠেছে, হাত মুখ ধুয়েছে তারপর নাস্তা করতে বসেছে। মতিনের সকাল বেলা একটা জরুরি অপারেশন করতে হবে সে তাড়াতাড়ি নাস্তা করতে করতে মিঠুনকে ডাকল, এই মিঠুন। তাড়াতাড়ি আয় নাস্তা করবি।

মিঠুন ধীরে সুস্থে এসে গম্ভীর মুখে বলল, আমি নাস্তা করব না।

মতিন কথাটা ভালো করে বুঝল না। বলল, কী করবি না?

নাস্তা করব না।

মতিন ডিমপোচটা মুখে দিয়ে বলল, নাস্তা করবি না মানে?

নাস্তা করব না মানে, নাস্তা করব না।

ততক্ষণে মিঠুনের আম্মু রাণীও ডাইনিং টেবিলে এসেছে, জিজ্ঞেস করল, কী হচ্ছে এখানে?

মতিন পানি খেয়ে কেটলি থেকে কাপে চা ঢালতে ঢালতে বলল, তোমার ছেলে বলছে সে নাস্তা করবে না।

নাস্তা করবে না তো কী করবে?

মতিন বলল, আমি জানি না। তোমার ছেলেকে জিজ্ঞেস করো।

রাণী মিঠুনকে জিজ্ঞেস করল, মিঠুন, তুই নাস্তা করবি না? শরীর খারাপ?

না শরীর খারাপ না।

তাহলে নাস্তা করবি না কেন?

আমি অনশন করছি।

মতিন তার চায়ে বিষম খেলো। রাণী জিজ্ঞেস করল, কী করছিস?

অনশন। তারপর অনশনের গুরুত্বটা বোঝানোর জন্য হেঁটে হেঁটে নিজের ঘরের দিকে রওনা দিল।

মতিন চায়ের কাপ টেবিলে রেখে বলল, তুই অনশন করছিস?

হ্যাঁ।

কেন?

কারো দাবি মেনে না নিলে সবসময় অনশন করে।

তোর দাবি মানা হয় নাই?

না।

কোন দাবি মানা হয় নাই?

আমরা মুক্তিযোদ্ধার ইন্টারভিউ নিতে চাচ্ছিলাম তোমরা যেতে দাও নাই।

মতিন কিছুক্ষণ হা করে মিঠুনের দিকে তাকিয়ে রইল। আম্মু হঠাৎ হি হি করে হেসে উঠল, তারপর বলল, তোমার ছেলেকে আমি যতই দেখি ততই অবাক হই।

মতিন বলল, আমার ছেলে বল না। অর্ধেক ক্রমোজম তোমার।

রাণী বলল, আই ডি এফ করার সময় মনে হয় উল্টাপাল্টা হয়ে গিয়েছিল।

মিঠুন মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল। মতিন বলল, কতক্ষণ অনশন করবি?

এটা আমরণ অনশন।

আমরণ?

মিঠুন মাথা নাড়ল, হ্যাঁ দাবি মানা না হলে আমরণ।

মতিন তার ঘড়ি দেখল, তারপর রাণীকে বলল, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। তুমি দেখো কী করতে পার।

রাণী বলল, দেখছি। তারপর নিজের প্লেটে টোস্ট নিতে নিতে গলার স্বর নরম করে বলল, আয় একটু খেয়ে নে। তারপর ভালো করে অনশন করতে পারবি।

মিঠুন মুখ শক্ত করে বলল, কেউ কখনো খেয়ে অনশন করে না।

ঠিক আছে দুধটা খেয়ে নে। দুধ খেলে অনশন ভাঙ্গে না। অনশন করলে লিকুইড খাওয়া যায়।

শুধু পানি খাওয়া যায়। আমি জানি। মিঠুন মুখ শক্ত করে বলল, আমার যখন পানি খাওয়ার ইচ্ছা করবে তখন পানি খাব। আর কিছু খাব না। অনশন।

কথা শেষ করে সে সত্যি সত্যি হেঁটে নিজের রুমে চলে গেল।

রাণী তার প্লেটে দুই টুকরো টোস্ট নিয়ে বসে রইল। তার এখন রেগে উঠার কথা কিন্তু রাগতে পারছে না।

.

রিতুকে মিলি ঘুম থেকে ডেকে তুলল, বলল, এই রিতু, ওঠ।

রিতু চোখ মুছতে মুছতে বলল, কী হয়েছে?

রাণী একটু আগে এসেছিল, বলে গেছে মিঠুন নাকি অনশন করছে। তার কোনো কথা শুনছে না। আমাকে বলেছে তোকে পাঠাতে। তুই গিয়ে একটু বুঝিয়ে বললে মনে হয় খাবে।

কিসের জন্য অনশন- জিজ্ঞেস করতে গিয়ে রিতু থেমে গেল। হঠাৎ করে সে বুঝে গেল মিঠুন কেন অনশন করছে, এবং সাথে সাথে তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। ঠিক কী কারণ জানা নেই মিঠুন অনশন করছে জেনে তার মনে হলো সে ঠিকই করছে। তাদের সবারই অনশন করা উচিৎ।

রিতু বিছানা থেকে উঠে বসল। আজকে ছুটির দিন, ছুটির দিনে সে একটু দেরি করে ঘুমায়। কিন্তু এরকম একটা ঘটনার পর সে নিশ্চয়ই আর ঘুমাতে পারে না।

তিতু পাশেই ছিল রিতু বলল, চল তিতু মিঠুনকে দেখে আসি।

তিতু বলল, চল।

দুজন উপর তলায় গিয়ে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল। প্রথমে রাণী বিষয়টাকে হালকা ভাবে নিয়েছিল কিন্তু আস্তে আস্তে তার মেজাজ গরম হতে শুরু করেছে। রিতুকে ঢুকতে দেখে বলল, রিতু দেখ দেখি মিঠুনকে বোঝাতে পারিস কিনা। সকালে উঠেই ঢং শুরু করেছে, অনশন!

রিতু মিঠুনের রুমে ঢুকল। সে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে আছে, একটা চাদর দিয়ে বুক পর্যন্ত ঢাকা। রিতু জিজ্ঞেস করল, মিঠুন, কী করছিস?

মিঠুন গম্ভীর গলায় বলল, আমরণ অনশন।

আমরণ?

হ্যাঁ।

মামি কিন্তু রেগে যাচ্ছে।

রাগুক।

কতক্ষণ না খেয়ে থাকবি।

যতক্ষণ দাবি মানা না হবে।

সত্যি?

খোদার কসম।

রিতু বলল, মামি বলেছে তোকে বোঝাতে।

কেউ আমাকে বোঝাতে পারবে না। যেই আমাকে বোঝাতে আসবে সেই হচ্ছে রাজাকার। রাজাকারের চামড়া তুলে নিব আমরা।

রিতু আরো কিছুক্ষণ বসে থেকে বের হয়ে এল, রাণী জিজ্ঞেস করল, রাজি করাতে পেরেছিস?

নাহ।

রাণী নিজের চুল ঘামচে ধরে বলল, এই ছেলের যন্ত্রণায় আমার জীবনটা একদিন শেষ হবে।

রিতু কিছু বলল না, বলার কিছু নাই, কারণ কথাটা সত্যি। তিতু হঠাৎ করে ফিসফিস করে বলল, আপু।

কী হলো।

মনে হয় আমিও অনশন করে ফেলি।

রিতু অবাক হয়ে বলল, কি বললি?

তিতু বলল, আমিও অনশন করে ফেলব।

রিতু চোখ কপালে তুলে বলল, তুইও অনশন করে ফেলবি?

হ্যাঁ।

রাণী চোখ বড় বড় করে তিতুর দিকে তাকালো বলল, তুইও অনশন করবি?

হ্যাঁ মামি। মিঠুন একলা একলা অনশন করছে, দেখে খারাপ লাগছে।

দেখে খারাপ লাগছে?

হ্যাঁ মামি। যাই মিঠুনকে বলে আসি।

বলে তিতু মিঠুনের ঘরে গেল, মিঠুনের কাছে দাঁড়িয়ে বলল, এই মিঠুন আমিও তোর সাথে অনশন করব।

মিঠুন লাফ দিয়ে উঠে বসল, চোখ বড় বড় করে বলল, সত্যি?

সত্যি।

আমরণ অনশন?

হ্যাঁ। আমরণ।

মিঠুন হাত ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ইয়েস! তারপর একটু সরে বিছানার জায়গা করে দিয়ে বলল, এইখানে শুয়ে পড় তিতু ভাইয়া।

শুয়ে পড়ব?

হ্যাঁ, অনশন করলে শুয়ে থাকতে হয়।

তিতু মিঠুনের পাশে শুয়ে পড়ল। মিঠুন গম্ভীর গলায় বলল, অনশন করলে শুধু পানি খাওয়া যায়। আমি পানি এনে রেখেছি। তোমার পানি তেষ্টা পেলে বল।

ঠিক আছে।

একটু পরে রাণী আর রিতু এসে দেখল, বিছানায় মিঠুন আর তিতু গম্ভীর হয়ে শুয়ে আছে। চাদরটা তাদের বুক পর্যন্ত টেনে রেখেছে। রাণী হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না কিন্তু রিতু হাসি হাসি মুখে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল।

.

কিছুক্ষণের মাঝেই খবরটা নিচের তলায় টিটন আর টিয়ার কাছে পৌঁছে গেল। তারা মাত্র নাস্তা করতে বসেছিল, নাস্তা না করেই তারা তিতু এবং মিঠুনকে দেখতে গেল। তাদেরকে দেখে নিচে গিয়ে টিয়া তার আম্মু সীমাকে বলল, আম্মু মিঠুন আর তিতু ভাইয়া অনশন করছে। আমরণ অনশন।

এই বাসায় কেউ কোনো কিছু শুনে অবাক হয় না তাই সীমা বেশি অবাক হলো না। জিজ্ঞেস করল, কেন?

মুক্তিযোদ্ধার ইন্টারভিউ নিতে দেয় নাই সেই জন্যে।

তাই নাকি?

টিয়া মাথা নাড়ল, বলল, আমিও অনশন করব আম্মু।

সীমা শীতল গলায় বলল, তুই কী করবি?

অনশন। অনশন ধর্মঘট।

সীমা কোনো কথা না বলে কিছুক্ষণ টিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, কতক্ষণ করবি?।

যতক্ষণ দাবি মানা না হয়।

সীমা আবার কোনো কথা না বলে কিছুক্ষণ টিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, আমাকে রাগাবি না। সকালে উঠেই একটা ঢং।

টিয়া বলল, আম্মু আমি তোমাকে রাগাতে চাইছি না। কিন্তু মিঠুন আর তিতু ভাইয়া যদি অনশন করে তাহলে আমাদের করা উচিৎ।

কেন?

সব সময় সবকিছু এক সাথে করতে হয়।

সীমা টিটনের দিকে তাকিয়ে বলল, আর তুই? তুই অনশন করবি না?

টিটন মাথা চুলকালো, বলল, সবাই যদি করে ফেলে তখন তো আমাকেও করতে হবে।

করতে চাইলে এখনই বলে ফেল, আমি টেবিল থেকে নাস্তা তুলে ফেলি।

টিটন কোনো কথা না বলে আবার মাথা চুলকালো। তিতু আর সে সমবয়সী। একজন অনশন করছে আরেকজন করছে না, ব্যাপারটা কেমন দেখায়?

সীমা মুখ শক্ত করে বলল, তোরা যদি মনে করে থাকিস আমি তোদের খাওয়ার জন্য সাধাসাধি করব তাহলে কিন্তু অনেক ভুল করছিস। আমি কিন্তু একবারও সাধাসাধি করব না। যদি খাওয়ার ইচ্ছা করে নিজেরা খাবার রেডি করে খেতে হবে। বুঝেছিস?

টিটন আর টিটু এক সাথে মাথা নাড়ল, বলল, বুঝেছি।

ঠিক তখন মাসুদ বাথরুম থেকে বের হয়ে একটা তোয়ালে দিয়ে হাত মুখ মুছতে মুছতে ডাইনিং টেবিলে এসে বসল। আশেপাশে কী হচ্ছে সে এখনো কিছু জানে না। একটা প্লেট নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলল, সবাই কোথায়? নাস্তা করবে না?

সীমা পাথরের মতো মুখ করে বলল, না। তোমার ছেলে আর মেয়ে অনশন ধর্মঘট করছে।

মাসুদ মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, বলল, অনশন ধর্মঘট?

হ্যাঁ।

কেন?

সীমা বলল, সেটা তুমি তোমার ছেলে মেয়ের কাছ থেকে শুনে নাও।

মাসুদ টিটন আর টিয়ার দিকে তাকালো। টিটন ইতস্তত করে বলল, আসলে মিঠুন আর তিতু করছে তো, এখন আমরাও যদি না করি সেটা কেমন দেখাবে।

মিঠুন আর তিতু কী জন্যে অনশন করছে?

ঐ যে কাল রাতের ব্যাপারটা। আমরা যে সবাই যেতে চাচ্ছিলাম একজন মুক্তিযোদ্ধার ইন্টারভিউ নিতে।

মাসুদ এবারে বুঝতে পারল। বলল, ও আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি।

মাসুদকে দেখে মনে হলো বিষয়টা বুঝতে পারার কারণে তার অনেক আরাম হয়েছে। সে মুখ কুঁচালো করে তার প্লেটে রুটি এবং সবজি নিল, তারপর খেতে শুরু করল।

সীমা মুখ শক্ত করে বলল, তুমি কিছু বলবে না?

কী আর বলব? মাসুদ ঘুরে টিটন আর টিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, শুধু কী অনশন নাকি আরো কোনো কর্মসূচি আছে?

টিয়া মাথা নাড়ল, বলল, না নাই।

মানব বন্ধন, গাড়ি ভাংচুর-

না। নাই।

ঠিক আছে। বলে মাসুদ আবার খেতে শুরু করে।

টিটন আর টিয়া একটু অপ্রস্তুত হয়ে নিজেদের ঘরে চলে গেল। সীমা মুখ শক্ত করে বলল, তুমি লাই দিয়ে এরকম বানিয়েছ।

আমি? আমি কখন লাই দিলাম?

এই যে এখন দিলে।

এখন?

হ্যাঁ, একটা ধমক দেবে তা না করে ঠাট্টা করলে।

মাসুদ হাসি হাসি মুখে বলল, বাচ্চা কাচ্চারা ছেলেমানুষী করছে। করতে দাও। যখন খিদে লাগবে তখন নিজেই এসে খেয়ে যাবে।

সীমা কঠিন মুখে দাঁড়িয়ে রইল।

.

কিছুক্ষণের মাঝেই উপরে খবর পৌঁছে গেল যে টিটন এবং টিয়াও অনশন শুরু করেছে। বাকী আছে শুধু রিতু। সে ঘোষণা দিয়ে অনশন করল না সত্যি কিন্তু কিছু খেল না। মিলি যখন জিজ্ঞেস করল, রিতু বলল, সবাই না খেয়ে আছে, আমি কেমন করে খাই?

মিলি বলল, সবাই কতক্ষণ না খেয়ে থাকবে?

রিতু বলল, কতক্ষণ আর থাকবে? দেখো একটু পরেই যখন খিদে লাগবে অনশন ভেঙ্গে ফেলবে।

.

কিন্তু কেউ অনশন ভাঙ্গলো না। নাস্তার সময় পার হয়ে দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেল, সবাই চুপচাপ বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে রইল। রিতু উপর নিচ করতে লাগল। সে নিজেও না খেয়ে আছে। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে কিন্তু অনশন বলে কথা।

তাদের আব্ব আম্মুরা প্রথমে বোঝালেন, তারপর আদর করলেন, তারপর রাগ হলেন, তারপর আবার আদর করলেন। তারপর চেঁচামেচি করলেন তারপর হাল ছেড়ে দিয়ে নিজেরাই কান্না কান্না হয়ে গেলেন।

রাহেলা খাতুন সন্ধেবেলা খবর পেলেন, তারপর যা একটা কাণ্ড শুরু হলো সেটা বলার মতো না। সাথে সাথে উপরে ছুটে গেলেন, মিঠুন আর তিতুকে দেখলেন, তাদের সব কথা শুনলেন, তাদের আদর করলেন, তারপর তাদের নিয়ে নিচে নেমে এলেন টিটন আর টিয়ার কাছে। তাদের দেখলেন তারপর আদর করে সবাইকে একেবারে নিচে নিজের ঘরে নিয়ে এলেন। তারপর রিয়াকে পাঠালেন তার সব ছেলে মেয়ে ছেলের বউ মেয়ের– জামাই সবাইকে ডেকে আনতে। রিয়া কিছুক্ষণের মাঝে সবাইকে ডেকে নিয়ে এল।

রাহেলা খাতুন তার চেয়ারটিতে বসে আছেন অন্যেরা কেউ বসে কেউ দাঁড়িয়ে রইল। রাহেলা খাতুন থমথমে মুখে জিজ্ঞেস করলেন, আমার সব নাতি নাতনিরা অনশন করছে ব্যাপারটা কী?

মিঠুন চিঁ চিঁ করে বলল, আমরণ অনশন।

আমরণের দরকার নাই। শুধু অনশনই যথেষ্ট। তারপর অন্যদের জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপারটা কী? বাসায় এত বড় একটা ব্যাপার ঘটে যাচ্ছে আমি জানি না।

রাহেলা খাতুনের ছেলে মেয়ে এবং বউ জামাইয়েরা ইতস্তত করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত মাসুদ বলল, না মা, আমরা আসলে বুঝি নাই এরা এরকম পাগলামি শুরু করবে।

পাগলামো? রাহেলা খাতুন কেমন যেন রেগে উঠলেন। বললেন, এই বাসায় পাগলামো নিয়ে এর আগে তো কোনো সমস্যা হয় নাই। বাসার নাম দিয়ে রেখেছিস বকিল্লারে খা। এইটা পাগলামো না? দুইটা ছাগল ঘুরে বেড়ায় একটা সবুজ আরেকটা লাল এইটা পাগলামো না? বিড়ালকে রং করে রয়েল বেঙ্গল টাইগার বানিয়েছিস এইটা পাগলামো না? তাহলে এদের পাগলামোতে তোদের সমস্যাটা কী?

মিলি মিন মিন করে বলল, শুধু পাগলামো তো না, একটু রিস্কি। একলা কোন গ্রামে গিয়ে থাকবে বিপদ আপদ হতে পারে।

রাহেলা খাতুন ধমক দিয়ে বললেন, বিপদ আপদ যেন না হয় সেই ব্যবস্থা করবি।

মতিন মাথা চুলকে বলল, না, মানে, ইয়ে-

বাচ্চাগুলো একটা মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজে বের করার জন্য একটা গ্রামে যেতে চায় আর তোরা সেই জন্যে সাহায্য করবি না? তোরা জানিস তোদের বাপ যে মুক্তিযোদ্ধা ছিল? যুদ্ধ করতে গিয়ে মানুষটা যে মরেই গেছে সেটা জানিস না ভুলে গেছিস?

সব ছেলে মেয়ে এক সাথে কথা বলে উঠে, কী বলছ মা, তুমি এটা কী বলছ? বাবার কথা ভুলে যাব-

নাকি পুরা দেশ রাজাকারের দেশ হয়ে গেছে সেই জন্যে এখন সেইটা স্বীকার করতে ভয় পাস?

মিঠুন চি চি করে বলল, রাজাকারের চামড়া, তুলে নিব আমরা।

মতিন বলল, মা তুমি ঠিক বুঝতে পারছ না। কোন গ্রামে যাবে চিনি জানি না, সময়টাও ভালো না। কোথায় থাকবে, কোথায় ঘুমাবে, কীভাবে যাবে কীভাবে আসবে, মানে পুরা ব্যাপারটার তো একটা প্ল্যানিং দরকার।

রাহেলা খাতুন বললেন, যদি প্ল্যানিং নাই তাহলে প্ল্যানিং করবি। দরকার হলে সাথে যাবি। নিজে যেতে না পারলে একটা ব্যবস্থা করে দিবি। তোদের এখন অভাবটা কীসের? আছে কোনো অভাব?

না, তা নাই।

তাহলে?

তারপরেও মানে হুট করে বললেই তো সব হয়ে যায় না- কাউকে করতে হয়।

রাহেলা খাতুন হঠাৎ রেগে উঠলেন, ঠিক আছে তোদের কিছু করতে হবে না। আমি করব। আমি ওদের গ্রামে নিয়ে যাব, ওদের সাথে থাকব। তারপর তাদের নাতি নাতনির দিকে তাকিয়ে বললেন, নে তোরা তোদের ব্যাগ রেডি কর। আমি নিয়ে যাব তোদের। তার আগে খেয়ে নে অনশন ভাঙ।

বাচ্চারা অন্য সময় হলে আনন্দে চিৎকার করত কিন্তু এখন যেহেতু রাগারাগি হচ্ছে মান অভিমান হচ্ছে, বাসার বড় মানুষেরা কথা বলছে তাই কেউ কোনো কথা বলল না, একজন আরেক জনের মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসল।

রাহেলা খাতুনের বড় ছেলে বলল, তুমি নিয়ে যাবে কেন মা?

তোরা নিয়ে যাবি না সেই জন্যে আমি নিয়ে যাব। কী ভাবছিস, আমি পারব না?

না না, পারবে না কেন। তুমি চাইলে অবশ্যই পারবে।

হ্যাঁ, সেইটা মনে রাখিস। আমি চাইলে সব পারি। আমি একা তোদের চারজনকে বড় করেছি। খেয়ে না খেয়ে বড় করেছি। আর তোরা বড় হয়ে আমার নাতি নাতনিগুলোকে কষ্ট দিবি সেটা হবে না। সারাদিন থেকে না খেয়ে আছে, কী আশ্চর্য!

মতিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, মা, তুমি যখন আমাদের বড় করেছ আমরা খুবই ভালো ছেলে মেয়ে ছিলাম। তারপর নিজেদের ছেলে মেয়েগুলোকে দেখিয়ে বলল, আর এরা কী ভয়ংকর দুষ্টু তুমি চিন্তাও করতে পারবে না। এই অনশনের ব্যাপারটা দেখো, সারা পৃথিবীতে তুমি এই বয়সী কোনো বাচ্চা পাবে যে এইভাবে তাদের বাপ মাকে ব্ল্যাকমেইল করতে পারবে?

টিয়া নিচু গলায় বলল, এইটা তো ব্ল্যাকমেইল না, নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন ছিল।

সীমা বলল, মা দেখেছেন? আপনি দেখেছেন? কতো বড় ফাজিল দেখেছেন? আমাদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন শেখায়?

টিয়া একটু বিপদের লক্ষণ দেখে তাড়াতাড়ি রাহেলা খাতুনের কাছে চলে এল। অন্যরাও টের পেলো এখন এটাই সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা তাই তারাও গুটিগুটি তাদের নানি কিংবা দাদি রাহেলা খাতুনের আশে পাশে জায়গা নিল।

মাসুদ বলল, ঠিক আছে মা, তোমাকে যেতে হবে না। আমরা ব্যবস্থা করছি। এক দুইদিন সময় দিতে হবে। আমি একজনকে এদের সাথে পাঠাব দেখে শুনে রাখবে। তবে- বলে মাসুদ থেমে গেল।

রাহেলা খাতুন বলল, তবে কী?

তবে ওদেরকে বল এরা যা ইচ্ছা তাই করতে পারবে কিন্তু জীবনেও যেন অনশন না করে।

রাহেলা কিছু বলার আগেই বাচ্চারা চিৎকার করে বলল, করব না। করব না। আর করব না।

মনে থাকে যেন।

রাহেলা খাতুন বলল, আয় এখন সবাই। কী খাবি বল?

মিঠুনের মা রাণী বলল, জিজ্ঞেস করবেন না মা, তাহলে বলবে পিজা না হলে ফ্রায়েড চিকেন। আমি খাবার নিয়ে আসছি।

.

বাচ্চারা খেতে খেতে টের পেল সারাদিন অনশন করলে খেতে যে কী ভালো লাগে সেটা কাউকে বলে বোঝানো যাবে না।

০৭. যখন গ্রামে হাজির

দুই দিন পর সকাল বেলা পাঁচ ভাই বোনকে সেই উত্তর বঙ্গের এক প্রত্যন্ত এলাকার মেথিকান্দা গ্রামের রাস্তায় হেঁটে হেঁটে যেতে দেখা গেল, তাদের পিছনে পিছনে মাঝবয়সী একজন মানুষ। মানুষটির নাম মোহম্মদ ইব্রাহীম, সবাই তাকে ইব্রাহীম চাচা ডাকে। রাহেলা খাতুনের বড় ছেলে মাসুদ ইব্রাহীম নামের মানুষটাকে এই পাঁচজনের দায়িত্ব দিয়েছে। মাসুদ সার্টিফিকেট দিয়েছে মানুষটি খুবই কাজের মানুষ এবং দেখা গিয়েছে সে আসলেই খুবই কাজের মানুষ। সে মেথিকান্দা গ্রামের কাছে একটা এনজিও অফিস খুঁজে তাদের গেস্ট হাউজটা বের করেছে। সেই গেস্টহাউজ এক সপ্তাহের জন্য ভাড়া নিয়েছে, শুধু তাই নয় গ্রামের একজন মহিলাকে খুঁজে বের করে তাকে প্রত্যেক দিন তিনবেলা রান্না করার দায়িত্ব দিয়েছে।

তারা গত রাত্রে এখানে পৌচেছে, রাত্রে ঘুমিয়ে সকালে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে নাস্তা করেছে। তারপর মেথিকান্দা গ্রামটা দেখতে বের হয়েছে। ইব্রাহীম চাচা মানুষটা খুবই কাজের সেটা সবাই বুঝতে পেরেছে তার সাথে সাথে তারা তার সবচেয়ে বড় সমস্যাটাও টের পেয়েছে। সেটা হচ্ছে মানুষটা কোনো কথা বলে না। একেবারেই কথা বলে না-তার ফলে অবশ্য একটা লাভ হয়েছে যখন সে কোনো কথা বলে সেটা হয় লক্ষ টাকা দামের কথা।

যে রকম পাঁচজন গ্রামের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করে একটা গরু দেখতে পেল। টিটন যখন নাদুস নুদুস গরুটা একটু কাছ থেকে দেখতে যাচ্ছে তখন ইব্রাহীম চাচা বলল, এরকম লাল শার্টটা পরে এত কাছে যাওয়া ঠিক না।

টিটনের টি-শার্টটা আসলেই টকটকে লাল এবং গরুরা লাল রং দেখে এরকম উত্তেজিত হয়ে যায় কে জানতো? ইব্রাহীম চাচা তার কথাটা শেষ করার আগেই নাদুস নুদুস গরুটা মাথা নিচু করে শিং উঁচিয়ে টিটনকে ধাওয়া করে এল- টিটন জান নিয়ে কোনো মতে পালিয়ে এসেছে, ভাগ্যিস গরুটা দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল তা না হলে কেলেঙ্কারি হয়ে যেত।

ইব্রাহীম চাচা একটু পরে আবার একটা লক্ষ টাকা দামের কথা তিতুকে লক্ষ্য করে বলল, তোমার পায়ের গোছাতে কালো মতন জিনিসটা একটা জোক।

তিতু না হয়ে এটা রিতু হলে সে তখনই হার্টফেল করে ফেলত, কিন্তু তিতু বেশি ব্যস্ত হলো না। সবাই মিলে তখন জোকটাকে টেনে আলাদা করল। জোঁককে ধরে টানলে সেটা যে রাবার ব্যান্ডের মতো লম্বা হয় সেটাও তারা আজকে প্রথম আবিষ্কার করল।

পাঁচজন মিলে হাঁটতে হাঁটতে যখন বড় একটা বটগাছ পেয়েছে এবং এই বিশাল বটগাছের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে আহা উঁহু করছে তখন ইব্রাহীম চাচা ঠাণ্ডা গলায় বলল, এই গাছের নিচে থেকো না। অনেক পাখি। মাথায় ইয়ে করে দেবে।

কথা শেষ করার আগেই কোনো একটা ফাজিল পাখি রিতুর মাথায় ইয়ে করে দিল! কী কেলেঙ্কারি! ঘেন্নায় তিতু প্রায় বমি করে দেয় সেই অবস্থা! তবে ইব্রাহীম চাচা তার সবচেয়ে মূল্যবান কথাটা বলল মিঠুনকে লক্ষ্য করে। গ্রামের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তারা একটা পুকুর পাড়ে পৌঁছালো এবং সেই পুকুর পাড়ে বেশ কিছু রাজহাঁস দাঁড়িয়ে নিজেদের ভেতর আড্ডা মারছিল। মিঠুন বলল, দেখেছ কী সুন্দর রাজহাঁস?

আসলেই রাজহাঁস দেখতে খুব সুন্দর তাদের বিশাল লম্বা গলা নাড়িয়ে নাড়িয়ে তারা এদিক সেদিক দেখে। মিঠুন যখন রাজহাঁস গুলোকে একটু আদর করার জন্য এগিয়ে যাচ্ছিল তখন ইব্রাহীম চাচা বলল, রাজহাঁস খুব ডেঞ্জারাস।

এত সুন্দর লক্ষ্মী রাজহাঁস কেমন করে ডেঞ্জারাস হতে পারে মিঠুন বুঝতেই পারল না এবং সে ইব্রাহীমের কথা বিশ্বাস না করে এগিয়ে গেল। তখন হঠাৎ করে রাজহাঁসগুলো তাদের লম্বা লম্বা গলাকে সাপের ফণার মতো নাড়িয়ে ফোঁস ফোঁস করে মিঠুনকে আক্রমণ করল। এত যে দুষ্ট মিঠুন সে কোনো মতে জান নিয়ে পালানোর চেষ্টা করল এবং দৌড়ে একটা খালের মাঝে লাফিয়ে পড়ে জান বাঁচালো। রাজহাঁসগুলো খালের পাড়ে দাঁড়িয়ে মিঠুনের উদ্দেশ্যে ফোঁস ফোঁস করতে লাগল।

এরপর থেকে পাঁচজনের এই ছোট দলটা ইব্রাহীমের কথাগুলোকে খুব গুরুত্ব দিয়ে শুনতে থাকল।

বাচ্চাগুলো সারা জীবন মোটামুটি শহরেই বড় হয়েছে। তাই তাদের জন্য গ্রামটি খুবই বিচিত্র একটা অভিজ্ঞতা। তারা মাটির রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। এবং একবারও পিছন থেকে একটা বড় ট্রাক বিকট হর্ন দিয়ে ছুটে আসছে না। গ্রামের মানুষেরা আস্তে আস্তে হেঁটে কাজে যাচ্ছে এবং প্রায় সবাই তাদের থামিয়ে তাদের সাথে কথা বলছে। কথাবার্তাগুলো হচ্ছে এরকম: একজন হয়তো বড় বড় কয়েকটা গরু নিয়ে যাচ্ছে সে তার গরুগুলোকে আপন মনে হেঁটে যেতে দিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, তুমরা কোনখান থেকে আইছ?

যেহেতু রিতু কিংবা টিয়া গুছিয়ে কথা বলতে পারে তাই সাধারণত তারাই প্রশ্নের উত্তর দেয় বলেন, জী আমরা ঢাকা থেকে এসেছি।

কুন বাড়িতে আইছ?

জী আমরা এখানে কারো বাড়িতে আসি নাই।

তাইলে কী বেড়াতে?

আসলে আমরা একজনকে খুঁজতে আসছি। উনার নাম ইদরিস মিয়া।

ইদরিস? ইদরিস মিয়া?

জী, উনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।

সাধারণত তখন মানুষগুলো বিভ্রান্ত হয়ে যায়। তারা শুধু একজন ইদরিসকে চিনে। পুরো নাম ইদরিস আলী, বয়স কম, দোকানে চাকরি করে। সে মুক্তিযোদ্ধা নয়। তারা যখন জিজ্ঞেস করে, ইদরিস মিয়াকে কেন খুঁজো?

আমরা উনার ইন্টারভিউ নিব।

ও। বলে মানুষগুলো এই কম বয়সী ছেলেমেয়েগুলোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। রিতু তখন জিজ্ঞেস করে, আপনি কী জানেন মুক্তিযোদ্ধা ইদরিস মিয়াকে কোথায় পাওয়া যাবে?

মানুষগুলো তখন ঠিক করে উত্তর দিতে পারে না। ইদরিস মিয়া নামে কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে তারা চেনে না। এই গ্রামে একজন মুক্তিযোদ্ধা চেয়ারম্যান ছিলেন, ইলেকশানের পরপর তাকে খুন করে ফেলেছে। তার নাম ছিল ফজলু। সবাই ডাকতো ফজলু চেয়ারম্যান। এছাড়া তার কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে চিনে না।

বাচ্চারা গ্রামের এক মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত হেঁটে গেল। অনেকের সাথে তাদের কথা হলো, সবাইকেই তারা ইদরিস মিয়ার কথা জিজ্ঞেস করল কিন্তু কেউই তার খোঁজ দিতে পারল না। এক জায়গায় একটা গাছের নিচে তারা একটা ছোট দোকান পেয়ে গেল। দোকানের সামনে বাঁশ দিয়ে মাচার মতো করে বসার জায়গা করা হয়েছে এবং দোকানের সামনে একটা চুলার মাঝে তোবড়ানো একটা কেতলিতে পানি গরম হচ্ছে। কেউ চা খেতে চাইলে কেতলির গরম পানি দিয়ে চা তৈরি করে দেওয়া হয়। চায়ের এই আয়োজন দেখে সবার চা খাওয়ার ইচ্ছা হলো। তখন বাঁশের মাচার মাঝে বসে তারা চায়ের অর্ডার দিলো। দোকানি তাদের নানা খোঁজ খবর দিতে দিতে তাদের জন্য চা বানিয়ে দিল। পায়েশের মতো বেশি করে দুধ এবং চিনি দিয়ে তৈরি চা, খেয়ে তারা মুগ্ধ হয়ে গেল।

এই দোকানির কাছে তারা কিছু মূল্যবান খবর পেল। সংগ্রামের সময় এইখানে নদীর তীরে পাকিস্তান মিলিটারির ক্যাম্প ছিল এবং তখন অনেক যুদ্ধ হয়েছে। অনেকদিন আগের ঘটনা তাই কেউ বিশেষ কিছু জানে না। দোকানি কিছু বয়স্ক মানুষের নাম বলল, যারা সংগ্রামের সময় ছিল এবং তারা হয়তো খবর দিতে পারবে। টিয়া তার নোট বইটা বের করে তাদের নাম লিখে নিল।

বাচ্চাদের সাথে আরো কয়েকজন বাঁশের মাচায় বসে চা খাচ্ছিল তারা উঠে যাবার পর দোকানি এদিক সেদিক তাকিয়ে গলা নামিয়ে তাদেরকে আরো একটা খবর দিল। মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বেশি খবর দিতে পারবে যে মানুষটা তার নাম আজহার আলী। সে সংগ্রামের সময় রাজাকার কমান্ডার ছিল। এতদিন চুপচাপ ছিল, ২০০০ সালের ইলেকশানের পর তার তেজ বেড়েছে, কয়েকদিন থেকে সে হম্বি তম্বি করে বেড়ায়। তবে তাকে না ঘাটানোই ভালো।

বাচ্চারা যখন ফিরে আসছিল তখন নিজেদের ভেতর কথা বলে নিজেরাই ঠিক করে নিল যে তারা রাজাকার আজহার আলীকে ঘাটাবে না। এই দেশে যেহেতু আলবদর কমান্ডার মন্ত্রী হয়ে গেছে রাজাকার কমান্ডার একটু হম্বিতম্বি করতেই পারে।

তবে বাচ্চারা জানতো না তারা যে এই গ্রামে এসে ইদরিস মিয়া নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা খুঁজে বেড়াচ্ছে সেই খবরটা এর মাঝে আজহার আলীর কাছে পৌঁছে গেছে। রাজাকার কমান্ডার আজহার আলী খবরটা পেয়ে খুবই বিরক্ত হয়েছে এবং তাদের মোটামুটি নিরিবিলি গ্রামে পোলাপানদের এই উৎপাত কীভাবে বন্ধ করা যায় সেটা নিয়ে তার বিশ্বস্ত দুইজন মানুষের সাথে কথা বলতে শুরু করেছে।

বাচ্চারা যখন হেঁটে হেঁটে তাদের এনজিও গেস্ট হাউজে ফিরে আসছে, ঠিক তখন আজহার আলী তার বাড়ির উঠানে একটা জলচৌকিতে বসে তার দুইজন সাগরেদের সাথে কথা বলছে। সাগরেদ দুইজনের নাম মতি এবং খলিল। তাদের মাঝে যে কথাবার্তা হয়েছে সেগুলো এরকম :

আজহার আলী তার হুঁকোর নলে মুখ দিয়ে গুড়ুক গুড়ুক করে টান দিয়ে বলল, ঢাকা শহর থেকে পোলাপান এসে নাকী মুক্তিযোদ্ধা তালাশ করে? ব্যাপারটা কী সত্যি?

মতি বলল, জি হুজুর সত্যি?

কারণটা কী? এতদিন পর পোলাপানদের মুক্তিযোদ্ধা তালাশ করার দরকার কী?

হুজুর ইলেকশানে আমরা জেতার পর শুরু হইছে। যেইখানে যাই সেইখানেই মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, মহা যন্ত্রণা! কেউ তো চিন্তা করে নাই। আমরা ইলেকশানে জিতে ক্ষমতায় আসমু সেইটা হচ্ছে তাদের জ্বালা। সবাই খালি তড়পায়।

হুঁকোয় আরো দুইটা টান দিয়ে আজহার আলী বলল, তড়পাইতে চায় তড়পাউক। তাদের না করছে কেডা? তয় আমাগো গেরামে কেন? তড়পানোর জায়গা ঢাকা শহর। এই গ্রামে ঝামেলা পাকায় কেন?

মতি বলে, যেখানেই সুযোগ পায় সেইখানেই একটা ফাল পাড়ে।

খলিল এতক্ষণ চুপ করে ছিল, এখন বলল, হুজুর এই পোলাপান ঢাকা থাকে, এই গাও গেরামে বেশিদিন থাকব না। কাইল হোক পরশু হোক চইলা যাইব। দুই চাইরদিন একটা বেহুদা মুক্তিযোদ্ধারে খুঁজলে সমস্যা কী? খুঁজুক।

আজহার আলী বলল, বুঝস না? সংগ্রামের কথা হইল নেশার মতন! একজন সংগ্রামের কথা কইলে হলের মনে পড়ে। তখন হপ্পলেই সংগ্রামের কথা কয়। তখন একাত্তর সালের কথা মনে পড়ে। পাকিস্তানি মিলিটারির কথা মনে পড়ে। আমাগো কথা মনে পড়ে।

আপনা গো কথা, মানে রাজাকারের কথা?

আজহার আলী কায় আরো দুইটা টান দিয়ে বলল, হু।

তাতে সমস্যা কী? এখন তো আমাগো সরকার।

আজহার আলী ধমক দিয়ে বলল, আরে ছাগলের বাচ্চা, সরকার আমাগো হইছে তো কী হইছে, পাবলিক কী আমাগো? পত্র পত্রিকা কী আমাগো? টেলিভিশন কী আমাগো? বেবাক মানুষ কে সুযোগ পাইলেই আমাগো গাইল পাড়ে, দেখস না?

মতি আর খলিল মাথা নাড়ল, বলল, তা ঠিক। কিছু একটা হইলেই গাইল পাড়ে, কয় রাজাকারের বাচ্চা রাজকার।

আজহার আলী গলা নিচু করে ষড়যন্ত্রীর মতো বলল, ফজলু চেয়ারম্যান খুন হইছে তাই ঠিক করছিলাম চেয়ারম্যান ইলেকশান করুম। এই হচ্ছে সুযোগ। কিন্তু হঠাৎ করে হলের যদি মনে পড়ে সংগ্রামের সময় আমি রাজাকার কমান্ডার ছিলাম পাবলিক আমারে ভোট দিব?

মতি বলল, সেইটা অবশ্য সঠিক কথা কইছেন।

এখন ঢাকার চার পাঁচটা পোলাপান যদি গেরামে ঘুরে আর একজন মুক্তিযোদ্ধারে খুঁজে তা হইলে আবার কী হবে কবে কেডা? এক মুক্তিযোদ্ধা থেকে আরেকজন, তার থেকে আরেকজন। হঠাৎ এক চ্যাংড়া সাংবাদিক আইসা পত্রিকায় নিউজ করব, কিছু বুঝার আগে দেখবি সবাই লাফায় আর কয় রাজাকারের বাচ্চার কল্লা চাই। তখন আমি যামু কই? আমার ইলেকশানের বারোটা বাজব।

মতি বলল, তার মানে হুজুর বইলছেন এই পোলাপানরে গেরাম থেকে বিদায় করন দরকার?

আজহার আলী হুঁকায় টান দিয়ে বলল, করতে পারলে ভালো। এই গেরামে ঘোঁট পাকানোর দরকার কী? অন্য গেরামে যাউক।

মতি কিছুক্ষণ চিন্তা করল। তারপর বলল, এইটা আর কঠিন কী। একটু ডর দেখাই, বাপ বাপ কইরা পালাইব।

খলিল বলল, ডর কেমনে দেখাইবি?

একটারে ধইরা এক রাইত আটকায়া রাখুম। বসে তা হইলেই পরের দিন বিদায়। আর জন্মে এই দেশে আসব না।

আজহার আলী জিজ্ঞেস করল, আটকায়া রাখবি কোনখানে?

মতি এক মুহূর্ত চিন্তা করল, তারপর বলল, বাড়িতে রাখা ঠিক হইব না। বড় গাঙে আপনার মহাজনী নৌকায়। কাকপক্ষীও টের পাইব না।

আজহার আলী কিছুক্ষণ হুঁকায় টান দিয়ে চিন্তা করল, তারপর বলল, বুদ্ধিটা খারাপ না। তয় কেউ যেন টের না পায় আমরা করাইছি। তাহলেই বিপদ।

কেউ টের পাইব না। খলিল জিজ্ঞেস করল, কিন্তু ধরবি কেমন করে? চিল্লাফাল্লা করব না?

মতি হে হে করে হাসল, বলল, হেইডা আমার উপর ছাইড়া দে। আল্লাহ আমারে বিশেষ কিছু দেয় নাই, খালি মগজে একটু বুদ্ধি দিচ্ছে।

খলিল বলল, তয় আল্লাহ তোরে কুনো ভালো বুদ্ধি দেয় নাই। খালি বদ বুদ্ধি দিছে।

মতি আবার হে হে করে হাসল। খলিলের কথাটা সে তার প্রশংসা হিসেবে ধরে নিয়েছে।

.

পাঁচজন ছেলে মেয়ে যখন হেঁটে হেঁটে এনজিও অফিসের গেস্টহাউজে হাজির হয়েছে তখন তারা কল্পনাও করতে পারে নাই এককালীন রাজাকার কমান্ডার তাদের একজনকে কিডন্যাপ করার পরিকল্পনা পাকা করে ফেলেছে।

 ০৮. যখন ভূতের গল্প

বাসায় যতবার মাছ রান্না করা হয় টিটন খাওয়ার সময় একবার হলেও নাক কুঁচকায়, যতবার সবজি খেতে হয় মিঠুন শুধু নাক কুঁচকায় না এমন ভান করে যে সেটা খেতে গিয়ে তার গলায় সবজি আটকে যাচ্ছে এবং দম বন্ধ হয়ে মারা যাচ্ছে। কিন্তু এই গেস্ট হাউজে তারা একবারও নাক কুঁচকালো না, গ্রামের মহিলার রান্না করা মাছের ঝোল এবং মিষ্টিকুমড়া ভাজি সবাই খুব সখ করে খেল।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে বাসার সবার সাথে টেলিফোনে কথা বলে, ঘুমের কাপড় পরে সবাই যখন গভীর রাতে ঘুমাতে গেল তখন আবিষ্কার করল মাত্র নয়টা বাজে। কেমন করে রাত নয়টার সময় নিশুতি রাত হয়ে যায় সেটা কেউ বুঝতে পারল না।

রিতু বলল, মাত্র নয়টা বাজে বিছানায় শুয়ে থেকে লাভ নেই। ঘুম আসবে না। তার থেকে আয়, বারান্দায় বসে গ্রাম দেখি।

সবাই এক কথায় রাজি। তারা হুটোপুটি করে বাইরে গিয়ে বারান্দায় বসল, ভালো করে লক্ষ্য করে নাই বলে দেখতে পেলো না তাদেরকে দেখে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মানুষ শুট করে একটা গাছের আড়ালে সরে গেল।

বারান্দায় বসতেই প্রথমে তাদের চোখে পড়ল বিশাল একটা চাঁদ। রিতু বলল, দেখ দেখ, কী সুন্দর চাঁদ।

টিটন জিজ্ঞেস করল, কে বলতে পারবে এটা শুক্লপক্ষ না কৃষ্ণ পক্ষ?

মিঠুন জিজ্ঞেস করল, সেটা আবার কী জিনিস?

টিয়া বলল, চাঁদটা যখন বড় হতে থাকে সেটা হচ্ছে শুক্লপক্ষ আর যখন ছোট হতে থাকে সেটা হচ্ছে কৃষ্ণপক্ষ।

মিঠুন বলল, কী আজিব। চাঁদ আবার ছোট বড় হয়!

টিয়া বলল, এর মাঝে আবার আজিব কোনটা? তা ছাড়া শব্দটা মোটেও আজিব না। শব্দটা আজব।

একই কথা।

মোটেও একই কথা না।

রিতু বলল, হয়েছে এখন ঝগড়াঝাটি না। টিটন যেটা জিজ্ঞেস করেছে তার উত্তর দে, এটা কী শুক্লপক্ষ নাকী কৃষ্ণপক্ষ!

টিয়া বলল, পঞ্জিকা দেখে বলতে হবে। এমনি বলা যাবে না।

টিটন বলল, উঁহ পঞ্জিকা লাগে না। চাঁদ দেখলেই বোঝা যায়।

রিতু জিজ্ঞেস করল, কীভাবে?

দেখছ, চাঁদের একটা সাইড গোল, অন্য সাইডটা এবড়ো থেবড়ো?

সবাই মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ দেখেছি।

গোল অংশটা যখন ডান দিকে তখন সেটা হচ্ছে শুক্লপক্ষ। গোল অংশটা যখন বাম দিকে তখন সেটা কৃষ্ণপক্ষ।

রিতু অবাক হয়ে বলল, তাই নাকি! কী আশ্চর্য, আমি কখনো জানতাম না।

তিতু বলল, আপু তুমি কেমন করে জানবে? ঢাকায় কখনো চাঁদ উঠে না।

টিয়া বলল, উঠে কিন্তু কেউ দেখে না।

তিতু বলল, হ্যাঁ। কেউ দেখে না।

রিতু বলল, আমরা গ্রামে না আসলে কেউ কোনোদিন জানতাম না চাঁদ এত সুন্দর।

সবাই মাথা নাড়ল। টিয়া বলল, ঐ গাছে জোনাকি পোকাগুলো দেখছ? এক সাথে জ্বলছে এবং নিভছে? কী সুন্দর!

টিটন এটার একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে যাচ্ছিল কিন্তু সবাই সৌন্দর্য দেখে এত মুগ্ধ টিটনের মনে হলো, এখন কেউ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা শুনতে চাইবে না, তাই শেষ পর্যন্ত আর ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করল না।

তিতু বলল, বাতাসে নারকেল গাছের পাতাগুলো নড়ছে আর কী সুন্দর শব্দ হচ্ছে দেখেছ? শির শির এক রকম শব্দ!

সবাই মাথা নাড়ল, টিয়া বলল, পাখির ডাকগুলো শুনছ? কী রকম অদ্ভূত পাখির ডাক! মনে হয় অন্য দুনিয়া থেকে ডাকছে।

টিটন বলল, বাতাসটা একদম পরিষ্কার। পিওর অক্সিজেন। একবার শ্বাস নিলেই ফুসফুস পরিষ্কার হয়ে যায়।

রিতু বলল, আর দেখেছিস কী সুন্দর একটা বাতাস আসছে। বাতাসের মাঝে কেমন যেন একটা ফুলের গন্ধ।

তিতু বলল, চারিদিক একেবারে নীরব। কোনো শব্দ নাই। গ্রামের সব মানুষ মনে হয় সন্ধ্যা হলেই ঘুমিয়ে যায়।

এরকম সময় মিঠুন বলল, রিতু আপু। একটা ভূতের গল্প বলবে?

রিতু বলল, ভূতের গল্প? এখন?

হ্যাঁ। এখন।

টিয়া বলল, অনেক ভয় করবে।

মিঠুন বলল, ভয় পাওয়ার জন্যই তো ভূতের গল্প। বল না আপু। প্লিজ।

তিতু আর টিটন বলল, হ্যাঁ আপু, বল।

রিতু কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলল, আমি যখন আরো ছোট, তোদের জন্ম হয় নাই কিংবা জন্ম হলেও তারা খুবই ছোট তখন নানি একটা গল্প বলেছিল। সেই গল্পটা বলি?

হ্যাঁ হ্যাঁ বল।

এইটা নানি শুনেছিল তার মামার কাছ থেকে। অনেকদিন আগের কাহিনি তখন রেডিও টেলিভিশন ছিল না, ইলেকট্রিসিটি ছিল না গাড়ি ঘোড়া ছিল না, মানুষেরা একটা গ্রামে থাকত, গ্রামের বাইরে কিছু আছে কিনা সেইটাও গ্রামের মানুষেরা জানত না। এইটা সেই সময়ের গল্প।

মিঠুন উৎসাহ নিয়ে বলল, বল রিতু আপু বল।

গেস্ট হাউজের সিঁড়িতে অন্ধকারে পাঁচজন বসে আছে, চাঁদের আলোতে সবাইকে আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। চারিদিকে সুনশান নীরবতা, শুধু মাঝে মাঝে রাত ডাকা পাখির শব্দ। হঠাৎ হঠাৎ বহু দূর থেকে শেয়ালের ডাক শোনা যায়। এর মাঝে রিতু নানির কাছ থেকে শোনা গল্পটা বলতে শুরু করল, ঠিক নানি যেভাবে বলেছিল সেভাবে:

আমার ছোট মামা মফিজের বয়স তখন বেশি না। সেই সময় স্কুল কলেজ ছিল না তাই কেউ লেখাপড়া করত না। মফিজ ও লেখাপড়া করে নাই। বাবার জমি ছিল সেখানে চাষবাস করে দিন কেটে যেত। মফিজের খুব মাছ ধরার সখ। যেই সময়ের কথা বলছি তখন কেউ বাজার থেকে মাছ কিনতো না। বাড়িতে পুকুরে মাছ থাকত, খালে মাছ থাকত, নদীতে মাছ থাকত আর সবচেয়ে বেশি মাছ থাকত বিলে। যার মাছ খাওয়ার সখ থাকত তারা খাল বিল নদী কিংবা পুকুর থেকে মাছ ধরে আনতো।

মফিজের একজন বন্ধু ছিল সুলতান। সে মফিজ থেকে এক দুই বছর বড়। মফিজের মতো সুলতানেরও খুব মাছ ধরার সখ। দুই বন্ধু মিলে মাঝে মাঝেই বিলে মাছ ধরতে যেত। সেবার খুব শীত পড়েছে, এই শীতের মাঝে দুই বন্ধু সুলতান আর মফিজ ঠিক করল তারা বিলে মাছ মারতে যাবে। তবে তারা যাবে গোপনে।

গোপনে যাওয়ার একটা কারণ আছে, তারা ঠিক করল তারা মাছ মারবে বাঘামারি বিলে। বাঘামারি বিল বাড়ি থেকে অনেক দূরে, নৌকা করে যেতেই ঘণ্টাখানেক লেগে যায়। দুইজন জোয়ান মানুষ ঘণ্টাখানেক নৌকায় যাওয়া তাদের জন্য কোনো ব্যাপার না। কিন্তু এই বিলটার দোষ আছে, রাত্রিবেলা অনেক দূর থেকে এই বিলে মানুষের কান্না শোনা যায়। অমাবস্যার সময় বিলের মাঝে হালকা সবুজ রঙের আলো দেখা যায়, আলোগুলো বিলের মাঝে ঘুরে বেড়ায়। এই বিলে দিনের বেলাতেই মানুষ যেতে ভয় পায়, রাতের বেলা তো প্রশ্নই আসে না।

কিন্তু সুলতান আর মফিজ দুইজনেরই অনেক সাহস। দুইজন একসাথে থাকলে জীন ভূত কোনোটাই তারা ভয় পায় না। তবে বাড়ির মুরব্বিরা শুনলে তাদের যেতে দিবে না। তাই তারা ঠিক করলো কাউকে না জানিয়ে গোপনে যাবে। মফিজ ঠিক করল, এই রাতে সে বাইরের বাংলা ঘরে ঘুমাবে। মাঝরাতে সুলতান এসে ঘরের দরজায় শব্দ করলেই সে উঠে যাবে। তারপর দুই বন্ধু রওনা দিবে বাঘামারি।

যেভাবে ঠিক করেছিল ঠিক সেভাবে মফিজ বাংলা ঘরের চৌকিটাতে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়েছে। অনেক শীত পড়েছে। সাথে কুয়াশা। এক কাঁথাতে শীত মানে না। তাই মফিজ মাটির মালসাতে একটু আগুন করে নিয়েছে। আগুনে হাত পা সেঁকে একটু গরম হয়ে সে ঘুমাতে গেছে। কাছেই মালসাটা রেখেছে, তুষের আগুন সেখানে ধিকি ধিকি করে জ্বলছে।

সেই সময় কোনো ঘড়ি ছিল না। রাত দুপর হয়েছে না ভোর রাত হয়েছে পুরোটাই অনুমানের উপর। আকাশে চাঁদ থাকলে চাঁদটা দেখে সময়ের আন্দাজ করা যেত কিন্তু রাতটা অমাবস্যার তাই আকাশে চাঁদ নাই।

ভোর রাতে দরজায় শব্দ হলো, মফিজ বুঝল সুলতান এসে গেছে। মফিজ বিছানা থেকে নেমে বলল সুলতান ভাই, আসছ?

বাইরে থেকে সুলতান একটা অস্পষ্ট শব্দ করল। চাদর মুড়ি দিয়ে থাকলে কথাবার্তা ভালো বোঝা যায় না তাই মফিজ বেশি অবাক হলো না।

মফিজ দরজা খুলে দিল, বাইরে অন্ধকারে সুলতান দাঁড়িয়ে আছে, অনেক শীত, তাই চাদর মুড়ি দিয়ে চোখ মুখ মাথা সব ঢেকে রেখেছে। অন্ধকারের কারণেই কিনা কে জানে সুলতানকে দেখতে অনেক খাটো লাগছে কিন্তু মফিজ সেটা নিয়ে মাথা ঘামালো না। বলল, সুলতান ভাই, হুঁকোটা ধরিয়ে দুটো টান দিয়ে যাই। শরীরটা গরম হোক।

সুলতান কিছু বলল না। মফিজ হুঁকো ধরিয়ে গুড়ক গুড়ক করে। কয়েকটা টান দিয়ে শরীরটা গরম করে নিয়ে সেটা সুলতানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নাও সুলতান ভাই। কয়টা টান দিয়ে নাও।

সুলতান হুঁকোটা দেখে আরো পিছিয়ে গেল হুঁকো খেতে চাইল না। তখন মফিজ খুব অবাক হলো, এই শীতের রাতে একজন হুঁকোয় দুটো টান দিতে চাইবে না সেটা বিশ্বাস করা শক্ত। কিন্তু যদি কেউ হুঁকো খেতে চায় না তখন তো আর জোর করা যায় না।

মফিজ মাছ মারার সরঞ্জামগুলো নিয়ে নেয়। একটা গোল জাল, একটা কোচ আর মাছ ধরার জন্য পলো। কোচ হচ্ছে বর্শার মতো, তবে বর্শার ফলা থাকে একটা, কোচের ফলা অনেকগুলো।

ঘরের দরজা বন্ধ করে মফিজ বের হয়ে আসে। সুলতান সাথে সাথে হাঁটতে শুরু করে, মফিজ পিছু পিছু হটে। নিশুতি রাত কুয়াশায় ঢাকা। গ্রামের পথ দিয়ে দুজন হেঁটে যাচ্ছে দুই পাশে গাছ গাছালি, উপরে তারা ঢাকা একটা আকাশ। মফিজ জোরে জোরে হাঁটে কিন্তু সুলতানকে ধরতে পারে না। সে সামনে দিয়ে আরো জোরে হাঁটে, কিছুতেই তাকে ধরা যায় না। সবচেয়ে আশ্চর্য হচ্ছে সুলতান যে এত জোরে হাঁটছে তার পায়ের কোনো শব্দ নেই, সে একেবারে নিঃশব্দে হেঁটে যাচ্ছে।

যাই হোক দুজনে হেঁটে খালের ধারে পৌঁছেছে। সেখানে নৌকাটা বাধা আছে। সুলতান নৌকার গলুইয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে বসল। মফিজ মাছ ধরার সরঞ্জাম নৌকার মাঝখানে রেখে নৌকাটাকে ধাক্কা দিয়ে পানির ভিতর নামিয়ে লাফিয়ে নৌকার উঠে বৈঠা বাইতে শুরু করল।

শীতের রাত ছপাৎ ছপাৎ করে বৈঠা বেয়ে মফিজ খাল বেয়ে নৌকা নিয়ে যায়। খাল থেকে নৌকা নদীতে পড়ল, নদী থেকে বাঘমারা বিলে। বিলের ভেতর নৌকা ঢুকিয়ে মফিজ লগি দিয়ে নৌকা নিয়ে যায়। নৌকার গলুইয়ে সুলতান চুপচাপ বসে আছে, সে কোনো কথা বলে না, কোনো শব্দ করে না।

বিলের মাঝখানে নৌকাটা নিয়ে মফিজ মাছ ধরতে শুরু করল। জাল ফেলে সেটা টেনে তুলতে পারে না। জালে এতো মাছ ধরেছে। মাছগুলো নৌকায় পাটাতনে ফেলে সে আবার জাল ফেলল। তারপর আবার। দেখতে দেখতে নৌকা প্রায় মাছে বোঝাই হয়ে যাবার অবস্থা।

এরকম সময় মফিজ কেমন যেন খচমচ শব্দ শুনতে পায়, মনে হতে থাকে মাছগুলো যেন কেউ কচমচ করে খাচ্ছে। নৌকার মাঝে মাছ কে খাবে? মফিজ বেশি গুরুত্ব দিল না সে মাছ মেরেই চলল।

তখন হঠাৎ করে তার মনে হলো আশেপাশে কেমন যেন ফিস ফিস শব্দ, মনে হচ্ছে কেউ ফিস ফিস করে কথা বলছে। সে মাথা ঘুরিয়ে সুলতানের দিকে তাকাল এবং সাথে সাথে তার শরীর হিম হয়ে গেল। সে দেখল চাদর মুড়ি দেওয়া মানুষটি, যাকে সে এতক্ষণ সুলতান ভেবে আসছে। সে মোটেও সুলতান নয়। সে তার লম্বা কালো হাত বাড়িয়ে এক সাথে অনেকগুলো মাছ ধরে মুখের কাছে নিয়ে যাচ্ছে। অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা যায় না কিন্তু সেই প্রাণীটার অনেক বড় একটা মুখ, সেই মুখে মাছগুলো ঢুকিয়ে কচমচ করে চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে।

এতক্ষণ চাদর দিয়ে মুখ মাথা ঢেকে রেখেছিল, এখন চাদর খসে পড়েছে, প্রাণীটার মাথা দেখা যাচ্ছে। এমনিতে অন্ধকার কিন্তু তারার আলোতে আবছা দেখা যায় প্রাণীটার বড় একটা মাথা। চোখগুলো লাল অঙ্গারের মতো জ্বলছে। নাক নেই সেখানে দুটো গর্ত, আর অনেক বড় একটা মুখ। মুখের ভিতর থেকে লকলকে একটা জিব বের হয়ে আসছে সেই জিব টান দিয়ে মাছগুলোকে মুখের ভিতর নিয়ে যাচ্ছে। যখনই মুখ খুলছে একটা পচা গন্ধ বের হয়ে আসছে, পুরো নৌকায় পচা একটা গন্ধ।

মফিজ যত মাছ ধরেছিল প্রাণীটা সব মাছ খেয়ে ফেলে মুখ দিয়ে এক ধরনের শব্দ করছে। মনে হচ্ছে আরো মাছ খেতে চায়। কিন্তু মফিজের তখন আর মাছ ধরার ক্ষমতা নাই। সে বিস্ফারিত চোখে প্রাণীটার দিকে তাকিয়ে আছে। তার সমস্ত শরীর কুল কুল করে ঘামছে। অন্ধকার নির্জন বিল তার মাঝে সে একা।

প্রাণীটা হঠাৎ উঠে দাঁড়াল, শরীর থেকে চাদরটা খসে পড়েছে। বড় মাথা, মাথায় কোনো চুল নাই, লম্বা লম্বা হাত, উঁচু কাঁধ। পাগুলো খাটো। প্রাণীটা থপ থপ করে পা ফেলে মফিজের দিকে এগিয়ে আসে। মফিজ বুঝতে পারে মাছ খেয়ে প্রাণীটার খিদে মিটেনি, সে এখন আরো খাবে।

মফিজ তখন হাত বাড়িয়ে কোচটা তুলে নেয়। তারপর সেটা হাতে নিয়ে প্রাণীটার দিকে তাকিয়ে থাকে। জান্তব একটা শব্দ করে প্রাণীটা দুলতে দুলতে এগিয়ে আসতে থাকে, যখন আরেকটু কাছে এসেছে তখন মফিজ কেঁচটা তুলে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রাণীটাকে সেখানে গেঁথে ফেলল।

প্রাণীটা অমানুষিক একটা চিৎকার করে ছটফট করতে থাকে, কোচ থেকে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে, কিন্তু মফিজ সেটাকে ছাড়ল না, কোচের মাথায় ধরে রেখে প্রাণীটাকে নৌকায় পাটাতনে ঠেসে ধরে রাখল।

কতক্ষণ ধস্তাধস্তি করছিল মনে নেই হঠাৎ মনে হলো কা কা করে একটা কাক ডাকছে, মফিজ অবাক হয়ে দেখল কোচের আগায় কোনো ভয়ংকর প্রাণী নেই, একটা বড় দাঁড়কাক সেখানে গেঁথে আছে। কা কা শব্দ করতে করতে কাকটা মরে গেল।

মফিজ অবাক হয়ে কাকটার দিকে তাকিয়ে রইল। ভয়ে আর আতংকে তার শরীর থর থর করে কাঁপতে থাকে। এরপর তার আর কিছু মনে নেই।

পরদিন মানুষজন বাঘমারা বিল থেকে মফিজকে উদ্ধার করল। আসল সুলতান মাছ মারার জন্য মফিজের বাড়ি গিয়ে দেখে মফিজ নাই। তখনই তার কিছু একটা সন্দেহ হয়েছে। দিনের আলো হলে লোকজন নিয়ে বাঘমারা বিলে গিয়ে দেখে সত্যিই একটা নৌকা ভেসে বেড়াচ্ছে। নৌকার পাটাতনে মফিজ অজ্ঞান হয়ে আছে। মুখে ফেনা, সারা শরীর থেকে পিচ্ছিল এক ধরনের তরল বের হচ্ছে। মফিজ তখনো কোচটা ধরে রেখেছে, কেঁচের মাঝে গেঁথে রেখেছে একটা মরা কাক।

মফিজ কিছু দিন পাগলের মতো হয়েছিল। তাবিজ কবজ ঝাড়ফুঁক দিয়ে শেষ পর্যন্ত ভালো হয়েছে। আর কোনোদিন সে বাঘামারা বিলে মাছ ধরতে যায়নি।

.

রিতু গল্প শেষ করতেই সবাই ভয় পাওয়ার মতো শব্দ করল। কেউ আর উঠতে সাহস পায় না। অনেকক্ষণ পর টিটন বলল, আপু তোমার গল্পের মাঝে কিছু লজিকের সমস্যা আছে। যেমন মনে করো।

টিয়া বাধা দিয়ে বলল, থাকুক। এখন আর এইটা নিয়ে কোনো কথা বলো না প্লিজ।

কাজেই কেউ আর কোনো কথা বলল না। সবাই উঠে একজন আরেকজনকে ধরে জড়াজড়ি করে ভেতরে ঢুকে গেল।

তারা যদি বাইরে তাকাতো, তাহলে দেখতে একজন মানুষ গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে গেস্টহাউজটার দিকে তাকিয়ে আছে।

০৯. যখন মুক্তিযোদ্ধা ইদরিস মিয়া

যখন সবাই মিলে মুক্তিযোদ্ধা ইদরিস মিয়াকে খোঁজ করতে শুরু করেছে

সকাল বেলা বাচ্চারা যখন নাস্তা করতে বসেছে তখন ইব্রাহীম তাদের সাথে এসে বসল। এর আগে তারা যতবার খেতে বসেছে তখন ইব্রাহীম কাছে আসে নাই। মানুষটা যেহেতু কথা বলে না তাহলে সাথে না বসলেই ভালো। একটা মানুষ সাথে বসে আছে, সবার কথা শুনছে কিন্তু কোনো কথা বলছে না ব্যাপারটা জানি কী রকম। কাল রাত্রেই এইটা নিয়ে আলাপ হয়েছে, টিয়া বলেছে অন্যদের থেকে ইব্রাহীম চাচা আলাদা। যেহেতু ইব্রাহীম চাচা কোনো কথাই বলে না তাই সে বসে থাকলে কোনো সমস্যা হয় না, ইব্রাহীম চাচা একটা ফার্নিচারের মতো, কিংবা ফুলদানির মতো, চুপ চাপ বসে থাকে। কোনো শব্দ করে না।

কাজেই সকাল বেলা যখন ইব্রাহীম চাচা সবার সাথে নাস্তা করতে বসল তাদের টিয়ার কথা মনে পড়ল। তারা পরীক্ষা করতে চাইল আসলেই ইব্রাহীম চাচাকে ফুলদানি হিসেবে চালানো যায় কিনা।

তারা আজকে কীভাবে মুক্তিযোদ্ধা ইদরিস মিয়াকে খুঁজবে সেইটা নিয়ে আলোচনা শুরু করল। মিঠুন বলল, একটা রিকশা ভাড়া করে সেখানে একটা মাইক লাগাব। তারপর সেই মাইকে বলতে থাকব ভাইসব, ইদরিস মিয়া নামে একজনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। তার সন্ধান পেলে যোগাযোগ করুন

সবাই না সূচক ভাবে মাথা নাড়ল। তারপর চোখের কোনা দিয়ে ইব্রাহীম চাচার দিকে তাকাল। সে গভীর মনোযোগ দিয়ে পরটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে, মিঠুনের কথা শুনছে বলে মনে হলো না। টিয়ার ফুলদানি থিওরিটি সত্যি হতেও পারে।

রিতু বলল, ছোট বাচ্চা হারিয়ে গেলে মাইকে ঘোষণা দেওয়া যায়। একজন বড় মানুষকে মাইক দিয়ে খোঁজা ঠিক না।

টিটন বলল, মাইকে কথা বলতে হলে পুলিশের পারমিশন নিতে হয়।

টিয়া বলল, রাস্তা এত খারাপ রিকশা যাবে না। তার চাইতে আমরা বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নিতে পারি।

তিতু বলল, সবার বাড়িতে যেতে হবে না। যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিল শুধু তাদের বাসায় গেলেই হবে।

রিতু বলল, আমরা পাঁচজন পাঁচটা ভাগে ভাগ হয়ে যাই। তাহলে অনেক তাড়াতাড়ি হবে।

টিয়া বলল, চার ভাগ। মিঠুনকে আলাদা ছাড়া যাবে না। সে একা একা কারো বাড়িতে গেলে ঝামেলা হতে পারে।

মিঠুন গরম হয়ে বলল, কী ঝামেলা।

টিটন বলল, কী না কী বলে ফেলবি। কী না কী করে ফেলবি।

তিতু বলল, আমরা মুক্তিযুদ্ধ গবেষণার ভলান্টিয়ার কার্ড গলায় ঝুলিয়ে যেতে পারি, তাহলে সবাই গুরুত্ব দেবে।

রিতু বলল, গুড আইডিয়া।

টিটন বলল, ইদরিস মিয়ার ছবি থাকলে খুব ভালো হতো। তাহলে সবাইকে দেখাতে পারতাম।

মিঠুন বলল, তোমরা আমার কোনো কথা শুনতে চাও না। আসলে মাইক দিয়ে বলাই সবচেয়ে ভালো। এক সাথে সবাইকে জানানো যাবে। তার সাথে আরেকটা জিনিস করতে পারি।

রিতু ভুরু কুঁচকে বলল, কী জিনিস?

আমরা মাইকে বলতে পারি ইদরিস মিয়া মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজে পেলেই আকর্ষণীয় পুরস্কার।

আকর্ষণীয় পুরস্কার?

হ্যাঁ। মনে করো একটা মোবাইল ফোন। না হলে একটা টেলিভিশন। সবাই যখন একটু অবাক হয়ে মিঠুনের দিকে তাকিয়ে আছে ঠিক তখন ফুলদানী হয়ে বসে থাকা ইব্রাহীম চাচা মুখ খুলল, বলল, ইদরিস মিয়াকে খুঁজে পাওয়া গেছে।

পাঁচজন এক সাথে চিৎকার করে উঠল, খুঁজে পাওয়া গেছে? এরপরেই তারা জিজ্ঞেস করতে চাইছিল, তাহলে এতক্ষণ বললেন না কেন? কিন্তু সেটা জিজ্ঞেস করল না কারণ তারা জানে এটা জিজ্ঞেস করলে ইব্রাহীম চাচা কোনো উত্তর দিবে না।

সবাই ইব্রাহীম চাচার দিকে তাকিয়ে রইল এরপর কী বলে শোনার জন্য, কিন্তু ইব্রাহীম চাচা কিছু বলল না, গভীর মনোযোগ দিয়ে পরোটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে মুগডাল দিয়ে খেতে লাগল। শেষ পর্যন্ত রিতু জিজ্ঞেস করল, ইদরিস মিয়াকে কেমন করে খুঁজে বের করেছেন?

ইব্রাহীম চাচা রিতুর প্রশ্নের উত্তর দিল না, বলল, তোমরা সবাই রেডি হও। জায়গাটা বেশ দূর। মনে হয় বেশির ভাগ জায়গা হেঁটে যেতে হবে।

রিতু মুখ শক্ত করে বলল, কিন্তু কিভাবে উনাকে খুঁজে পেলেন বললেন না।

ইব্রাহীম চাচা রিতুর দিকে তাকাল, তখন রিতু আবার বলল, কীভাবে খুঁজে পেয়েছেন?

ইব্রাহীম চাচা বুঝতে পারল রিতু উত্তর না শোনা পর্যন্ত লেগেই থাকবে। তাই মুখ খুলল, বলল, মানুষটাকে কেউ চিনে না। তাই বুঝেছি স্থানীয় মানুষ না, বাইরের মানুষ। বাইরের মানুষ কারা হতে পারে খোঁজ নিলাম, রিকশাওয়ালা, ভ্যান ড্রাইভার, মাটি কাটার ডেইলি লেবারার এরকম কিছু মানুষ বাইরের। তাদের মাঝে খোঁজ নিলাম। তখন জানতে পারলাম সেখানে একজনের নাম ইদরিস মিয়া। খুব গরীব কিন্তু অসম্ভব তেজ। কারো সাথে কথা বলে না। লোকজন ভাসা ভাসা শুনেছে সগ্রামের সময় যুদ্ধ করেছে। জানো তো, গ্রামের মানুষ মুক্তিযুদ্ধকে বলে সংগ্রামের সময় না হলে বলে গণ্ডগোলের সময়।

সবাই মাথা নাড়ল, বলল জানি।

কাজেই বুঝে গেলাম এই ইদরিস মিয়াই আমাদের ইদরিস মিয়া।

টিয়া জিজ্ঞেস করল, উনি কী করেন?

ঠিক নাই। কখনো রিকশা চালান। কখনো মাটি কাটেন। নদীর পাড়ে ছোট একটা চালা ঘরের মতো তৈরি করে সেখানে থাকেন। বিকাল বেলার দিকে বের হয়ে জঙ্গলের দিকে যান।

কেন?

কেউ জানে না। এক দুইজন বলেছে সেখানে গিয়ে একটা গাছের নিচে বসে থাকেন। পাগল কিসিমের মানুষ।

সবাই চুপ করে রইল। ইব্রাহীম চাচা আগে কখনো কথা বলে নাই। এখন যখন শেষ পর্যন্ত তার মুখ খুলানো গেছে কথা বলতেই থাকল, বলল, তার সাথে যারা থাকে তারা বলেছে ইদরিস মিয়া কথা বলে খুব কম কিন্তু যখন কথা বলে খুব শান্তভাবে ধীরে সুস্থে কথা বলে। সুন্দর ভাষায় কথা বলে। এই জায়গা ছেড়ে কোথাও যায় না। মাঝে মাঝে কয়েকদিনের জন্য যদি যায় তাহলে আবার ফিরে আসে।

বাচ্চারা নিজেদের ভিতর এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করে। এখনো কাউকে বলে নাই যে তারা আসলে এসেছে তাদের দাদা কিংবা নানার খোঁজ নিতে। সেটা তারা গোপন রাখতে চায়। যখন তারা ইদরিস মিয়ার সাথে কথা বলবে তখন চেষ্টা করবে ইব্রাহীম চাচা যেন আশে পাশে না থাকে।

ইব্রাহীমের মনে হয় হঠাৎ করে কথা বলার রোগ হয়েছে। সে মুগের ডাল দিয়ে পরটা খাওয়া বন্ধ করে আবার কথা বলা শুরু করল, যার সাথেই যোগাযোগ করেছি, সেই বলেছে ইদরিস মিয়া কারো সাথে কথা বলতে চায় না। একবার নাকী একজন সাংবাদিক তার সাথে কথা বলতে এসেছিল, ইদরিস মিয়া একটা কথাও বলে নাই।

তিতু ভয়ে ভয়ে বলল, আমাদের সাথেও কথা বলবেন না?

ইব্রাহীম চাচা বলল, জানি না। গিয়ে তোমাদের নিজেদের চেষ্টা করতে হবে।

রিতু জিজ্ঞেস করল, আমরা কখন যাব?

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। আমি এক কাপ চা খেয়ে নেই। তোমরা জামা কাপড় পরে আস।

বাচ্চারা যখন জামা কাপড় পরে নেমে এসেছে তখন তারা যদি ভালো করে লক্ষ্য করতো তাহলে দেখতে গেস্টহাউজের সামনে একটা বড় গাছে হেলান দিয়ে বসে থাকা একজন মানুষ তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে সাইকেল চালিয়ে গ্রামের দিকে ছুটে যাচ্ছে।

সবাই মিলে তিনটা রিকশা করে রওনা দিয়েছে। প্রথম রিকশায় রিতু আর মিঠুন। মিঠুনকে সামলানোর জন্য রিতুকে সব সময় আশেপাশে থাকতে হয়। পরের রিকশাতে টিটন রিতু আর টিয়া। সবার শেষে একটা রিকশায় ইব্রাহীম।

রিকশা করে মিনিট দশেক যাওয়ার পর মিঠুন চলন্ত রিকশা থেকে তড়াক করে লাফ দিয়ে নিচে নেমে গেল। বলল, রিকশাতে ঝাঁকুনির চোটে তার ইয়ে ঢিলে হয়ে যাচ্ছে। ইয়েটা কী জিজ্ঞেস করার পরও সেটা সে ব্যাখ্যা করতে রাজি হলো না দেখে কেউ আর চাপাচাপি করল না। কখন কী বলতে গিয়ে মিঠুন কী বলে ফেলে সেটা নিয়ে সবাই ভয়ে ভয়ে থাকে। মিঠুন বলল, সে রিকশায় পাশে পাশে হেঁটে হেঁটে যাবে। রাস্তা এত খারাপ যে সত্যি সত্যি রিকশায় না গিয়ে হেঁটে হেঁটেই তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে।

তখন অন্যরাও বলল যে তারাও হেঁটে হেঁটে যাবে। এই পুরো পথ রিকশায় গেলে হয় রিকশা ভেঙ্গেচুরে যাবে না হয় তাদের হাড়গোড় ভেঙ্গেচুরে যাবে। তখন রিকশা ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে সবাই হেঁটে হেঁটে যেতে লাগল।

এভাবে যখন তারা আরো কিছুদূর গিয়েছে তখন হঠাৎ ইব্রাহীমের ফোন বেজে উঠল। ইব্রাহীম ফোনটার দিকে তাকাল একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে কেউ তাকে ফোন করেছে। সে ফোনটা কানে লাগাল অন্য পাশ থেকে কেউ কথা বলল এবং সেটা শুনে তার ভুরু কুঁচকে উঠল, বলল, কে দেখা করতে চাইছে? অন্যপাশ থেকে কিছু একটা বলল এবং ইব্রাহীমের ভুরু আরো কুঁচকে উঠল, বলল, এখনই? সন্ধ্যাবেলা হলে হয় না?

ইব্রাহীম আরো কিছুক্ষণ কথা বলে ফোনটা বন্ধ করে অন্যদের দিকে তাকালো। বলল, আমার একটু গেস্টহাউজে যেতে হবে।

রিতু জিজ্ঞেস করল, কেন?

লোকাল পুলিশ থেকে একজন এসেছে সে কথা বলতে চায়।

কী নিয়ে কথা বলবে?

জানি না। খুবই নাকী জরুরি। আমি একটু শুনে আসি।

আমরা তাহলে আস্তে আস্তে হাঁটি?

ইব্রাহীমকে একটু বিভ্রান্ত দেখাল, তারপর বলল, ঠিক আছে তোমরা এই রাস্তা ধরে আস্তে আস্তে হাঁটো আমি যাব আর আসব।

ইব্রাহীম পা চালিয়ে গেস্টহাউজের দিকে রওনা দিল। গেস্টহাউজে পৌঁছতে তার মিনিট দশেক লাগল। গিয়ে দেখে সেখানে কেউ নেই। গেস্টহাউজের কেয়ারটেকার জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল তারা মোটেও তাকে ফোন করেনি। পুলিশ থেকেও কেউ আসে নাই। কেউ তার সাথে কথা বলতে চায় নাই। হঠাৎ করে ইব্রাহীম দুশ্চিন্তিত হয়ে যায়। কোনো একজন তাকে বাচ্চাদের থেকে সরিয়ে নিয়েছে। তাহলে কী তারা বাচ্চাদের কিছু করতে চায়? সময়টা ভালো না, এখানে আজহার আলী নামে একজন রাজাকার কমান্ডার থাকে, মুক্তিযুদ্ধ শব্দটাতেই তার অ্যালার্জি। সে কী বাচ্চাদের কোনো ক্ষতি করতে চায়? হতে পারে এই সরকার রাজাকারের পক্ষের সরকার তাই বলে ছোট বাচ্চাদের কিছু করার দুঃসাহস তাদের হবে? ইব্রাহীম পা চালিয়ে বাচ্চাদের কাছে ফিরে যেতে থাকে।

সে অবশ্যি তখনো জানে না যে যা হবার তা এর মাঝে হয়ে গেছে।

.

ইব্রাহীম চলে যাবার কিছুক্ষণ পরেই একজন মানুষ ছেলেমেয়েদের কাছে। এল। বলল, আমাকে ইব্রাহীম সাহেব পাঠিয়েছেন।

রিতু জানতে চাইল, কেন?

ইব্রাহীম সাহেব বলেছেন মিঠুনকে নিয়ে যেতে।

রিতু অবাক হয়ে বলল, মিঠুন? মিঠুনকে কেন নিয়ে যেতে হবে?

মানুষটা মাথা নাড়ল, বলল, জানি না। ইব্রাহিম সাহেব অপেক্ষা করছেন।

টিয়া বলল, চাচি মনে হয় ঢাকা থেকে ফোন করেছেন।

তিতু বলল, হ্যাঁ হতে পারে। মিঠুনুকে নিয়ে সবাই সব সময় চিন্তা করে।

রিয়া বলল, ঠিক আছে, মিঠুন যা। একা যাবি না, টিটন তুইও সাথে যা।

এবারে মানুষটা খুব ব্যস্ত হয়ে বলল, না,না, একা যেতে বলেছে।

রিতু বলল, একা যেতে বলেছে মানে কী? টিটন সাথে যাক। মিঠুন কোনদিক যেতে কোনদিকে চলে যাবে।

মিঠুন চিউয়িংগাম চিবুচ্ছিল, মুখ থেকে বের করে সেটাকে টেনে লম্বা করে আবার মুখে ঢুকিয়ে বলল, আমি একা যেতে পারব।

তোকে একা যেতে হবে না। আর মুখ থেকে হাত দিয়ে এইভাবে চিউয়িংগাম বের করবি না। ছিঃ।

মিঠুন জিজ্ঞেস করল, কেন? মুখ থেকে চিউয়িংগাম বের করলে কী হয়?

টিয়া বলল, দেখে ঘেন্না লাগে।

মিঠুন বলল, এর সাথে ঘেন্না লাগার কী আছে?

সেইটা যদি না জানিস তোকে মনে হয় আর শেখানো যাবে না।

মানুষটা বলল তাড়াতাড়ি। দেরি হয়ে যাচ্ছে।

রিতু ভুরু কুঁচকে তাকালো, দেরি হয়ে যাচ্ছে মানে কী? ভাবল মানুষটাকে জিজ্ঞেস করবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করল না। মিঠুন আর টিটনকে বলল তোরা যা। ইব্রাহীম চাচা কী বলে শুনে আয়। সাবধানে যাবি।

মিঠুন মুখের চিউয়িংগামটা আবার টেনে লম্বা করতে করতে হাঁটতে থাকে। টিয়া বলল, ছিঃ মিঠুন! ছিঃ!

মিঠুন আর টিটন মানুষটায় সাথে কিছুদূর হেঁটে যাবার পরই মানুষটা একটা জংলা মতন জায়গার দিকে দেখিয়ে বলল, এখন এইদিকে?

টিটন অবাক হয়ে বলল, কোনদিকে?

এই যে। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে।

জঙ্গলের ভিতর দিয়ে কেন?

শর্ট কাট। বলে মানুষটা দুইজনকে প্রায় টেনে জঙ্গলে ঢুকিয়ে ফেলল এবং কিছু বোঝার আগে হঠাৎ করে দুই পাশ থেকে দুইজন মানুষ তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। প্রথমেই তাদের মুখ চেপে ধরল যেন চিৎকার করতে না পারে। দুইজন হুটোপটি করতে থাকে কিন্তু মানুষগুলোয় গায়ে মোষের মতো জোর টিটন আর মিটুন নড়তেই পারল না।

.

ওদিকে রিতু কেমন যেন দুশ্চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, জিনিসটা ভালো লাগছে না।

তিতু জিজ্ঞেস করল, কোন জিনিসটা?

এইযে হঠাৎ করে ইব্রাহীম চাচাকে ডেকে পাঠাল। ঠিক তখন আরেকজন এসে বলল, মিঠুনকে ডাকছে। পুরো ব্যাপারটা জানি কেমন।

টিয়া বলল, কেমন আবার কী?

মিঠুন আর টিটনকে যেতে দেওয়া ঠিক হয় নাই।

কেন?

জানি না। কিন্তু মনে হচ্ছে কাজটা ঠিক হয় নাই।

টিয়া বলল, আপু তুমি শুধু শুধু বেশি চিন্তা করো।

কিন্তু কয়েক মিনিটের মাঝে দেখা গেল রিতু শুধু শুধু বেশি চিন্তা করে না, তার চিন্তা করার সত্যিকারের একটা কারণ আছে। ছোট একটা ছেলে একটা লজেন্স খেতে খেতে কোথা থেকে জানি তাদের কাছে হাজির হলো। ছেলেটা লজেন্স চুষতে চুষতে বলল, ঐ স্যার আমারে এই লজেন্সটা দিছে।

একজন স্যার তাকে একটা লজেন্স দিয়েছে সেটা কেন ছেলেটা তাদেরকে বলছে রিতু বুঝতে পারল না। তখন দেখল তার হাতে ভাজ করা একটা কাগজ। ছেলেটা কাগজটা তাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, স্যার বলছে তোমাগো এই কাগজটা দিতে।

রিতুর বুকটা ধ্বক করে উঠল। সে কাগজটা হাতে নিয়ে ভাঁজ খুলে তাকালো, সেখানে খুবই খারাপ হাতে লেখা:

এই চিঠি পাওয়ার সাথে সাথে তুমরা আমাগো গেরাম তেকে বিদায় হও। যদি বিদায় হও তাইলে তুমাদের ভাইগো ছেড়ে দিমু।
যদি বিদায় না হও তাহলে পরতি ঘণ্টায় একটা করে আঙুল কাটি ফেলমু।
–তুমাগো আজরাইল।

রিতুর হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল।

তিতু বলল, আমরা কেন এই গ্রাম থেকে বিদায় হব? আমরা কী করেছি?

টিয়া বলল, এইটুকু চিঠিতে আটটা বানান ভুল।

 ১০. যখন সবাই আতংকিত

১০যখন টিটন আর মিঠুনকে কিডন্যাপ করে সবাইকে আতংকিত করে ফেলেছে

রিতু মনে মনে আশা করেছিল যে মিঠুন আর টিটন আসলে ইব্রাহীম চাচার সাথেই আছে, অশিক্ষিত একটা মানুষ মিছি মিছি তাদের ভয় দেখাতে চেষ্টা করছে। কিন্তু যখন সে দেখল গেস্টহাউজ থেকে ইব্রাহীম চাচা একা লম্বা লম্বা পা ফেলে প্রায় ছুটে আসছে তখন সে বুঝল আসলে তারা সত্যি সত্যি বড় বিপদে পড়েছে। তাদের আল্লু আম্মুরা যে তাদের প্রথমে আসতে দিতে চাননি তার কারণটা এখন সে হঠাৎ করে বুঝতে পারে।

ইব্রাহীম রিতু তিতু আর টিয়ার কাছে এসে তাদের কাছ থেকে খবর নিল, তারপর ভুল বানানে লেখা অশিক্ষিত মানুষের চিঠিটা কয়েকবার পড়ল। রিতু দেখতে পেলো দেখতে দেখতে ইব্রাহীমের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে। গ্রামের রাস্তায় মানুষজন খুব কম, যে কয়জন এসেছে ইব্রাহীম তাদের সবাইকে জিজ্ঞেস করল তারা আট বছর আর বারো বছরের দুইজন কমবয়সী ছেলেকে দেখেছে কী না। কেউ দেখেনি। কথা শেষ করে কোনো মানুষই চলে গেল না, তারা সবাই দাঁড়িয়ে রইল এবং দেখতে দেখতে গ্রামের অনেক মানুষের ভীড় হয়ে গেল। দুইজন বাচ্চাকে কিডন্যাপ করে অন্যদেরকে গ্রাম ছেড়ে চলে দেওয়ার জন্য হুমকি দিয়েছে ব্যাপারটা গ্রামের কোনো মানুষ মেনে নিতে পারছে না। গ্রামের মানুষেরা এটা তাদের গ্রামের জন্য একটা কলংক হিসেবে মনে করছে।

তখন তখনই কম বয়সী অনেকেই গ্রামের এদিকে সেদিকে গিয়ে টিটন আর মিঠুনকে খোঁজাখুজি শুরু করল। তবে বেশিরভাগ মানুষই কী করা উচিৎ ছিল সেই ব্যাপারে বড় বড় লেকচার দিতে থাকল। বয়স্ক কয়েকজন মানুষ এখন কী করা উচিৎ সেটা নিয়ে নিজেদের মাঝে কথা বলে ঠিক করল সবার আগে তাদের মাস্টার সাহেবের সাথে পরামর্শ করা দরকার। মাস্টার সাহেব এই গ্রামের মান্যগণ্য মানুষ, কাছাকাছি একটা প্রাইভেট কলেজে বাংলা পড়ান। তখন তখনই একজন মাস্টার সাহেবকে খবর দেওয়ার জন্য ছুটে গেল। অন্যরা রিতুদের নিয়ে মাস্টার সাহেবের বাড়ির দিকে রওনা দিল।

গাছের নিচে চায়ের দোকান এবং যেটা একই সাথে একটা মনোহারী দোকান। সেখানে গিয়ে দেখা গেল মাস্টার সাহেব এর মাঝে দোকানটাতে পৌঁছে গেছেন। মাস্টার সাহেবের চোখে চশমা এবং চুলে পাক ধরেছে। দোকানের বাঁশের মাচায় বসেছিলেন, রিতুদের দেখে উঠে এলেন। এর মাঝে তিনি পুরো ঘটনাটি শুনেছেন এবারে রিতুর মুখ থেকে আরেকবার শুনলেন, তারপর মুখ কঠিন করে বললেন, এইটা রাজাকার কমান্ডার আজহার আলীর কাজ।

ভীড় করে থাকা মানুষগুলো নিজেদের মাঝে কথা বলছিল হঠাৎ করে সবাই একেবারে চুপ করে গেল। মনে হয় একটা মশা উড়ে গেলেও শোনা যাবে। মাস্টার সাহেব চোখ থেকে চশমা খুললেন, তার পাঞ্জাবির কোনা দিয়ে চশমা পরিষ্কার করলেন তারপর থমথমে গলায় বললেন, আমি যখন কালকে খবর পেয়েছি ঢাকা থেকে কয়েকজন ছেলে মেয়ে এসে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজছে ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য তখনই মনে হয়েছে এই আজহার আলী এইটা নিশ্চয়ই পছন্দ করবে না। এই লোক আমাদের গ্রামে কিছু করতে দেয় না, কেউ একটা গান গাইলে ও বলে ইসলাম গেল ইসলাম গেল।

ভীড়ের অনেকে মাথা নাড়ল। কয়েকজন বিড় বিড় করে কিছু একটা বলল, কী বলল ঠিক বোঝা গেল না।

মাস্টার সাহেব আবার গম্ভীর গলায় বললেন, কালকেই আমার মনে হয়েছিল এই বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলারে একটু সাহায্য করি, গ্রামের মানুষ তাদের সাথে থাকি যেন কেউ কিছু করতে না পারে। কিন্তু তার আগেই দেখো কী হয়ে গেল।

রিতু অনেক কষ্টে চোখের পানি আটকে রেখে বলল, এখন কী হবে?

মাস্টার সাহেব রিতুর মাথায় হাত রেখে বললেন, তুমি চিন্তা করো না মা। আমরা আছি। গ্রামের মানুষ মিলে আমরা তোমার ভাইদের খুঁজে বের করব।

ভীড় করে থাকা মানুষেরাও মাথা নাড়ল। গলা উঁচিয়ে বলল, খুইজা বার করুম। খোদার কসম।

মাস্টার সাহেব বললেন, মাথা গরম করে লাভ নাই। সবাই বের হয়ে যাও, ভাগাভাগি করে খুঁজতে থাকো। এই গ্রামের এক ইঞ্চি জায়গা বাকি রাখবা না। যদি খুঁইজা না পাই তখন আজহার আলীর বাড়িতে যাব। সবাই রেডি থেকো।

রেডি। আমরা রেডি।

যাও। খুঁজতে থাকো। দেরি করো না।

.

ততক্ষণে অবশ্য দেরি হয়ে গেছে। মতি আর খলিল মিলে মিঠুন আর টিটনকে আজাহার আলীর চিনির বস্তা বোঝাই মহাজনী নৌকার মাঝে আটকে ফেলেছে। গ্রামের মানুষ পুরো গ্রাম তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে কারো মাথায় আসে নাই নদীর মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা বড় বড় মহাজনী নৌকার মাঝে খুঁজে দেখা।

তবে কাজটা মোটেও সহজ হয় নাই। প্রথমত কথা ছিল শুধু মিঠুনকে নিয়ে আসা হবে। ভয় দেখানোর জন্য একটা বাচ্চাই যথেষ্ট। কিন্তু রিতু জোর করে মিঠুনের সাথে সাথে টিটনকে দিয়ে দেওয়ার জন্য মতি আর খলিলের হিসাবে একটু গোলমাল হয়ে গেছে। যে মানুষটা মিঠুন আর টিটনকে ইব্রাহীমের কথা বলে ডেকে নিয়ে গেছে সে এই গ্রামের কেউ না। এই গ্রামের মানুষ হলে তাকে চিনে ফেলতে পারে সেইজন্য অন্য গ্রাম থেকে মানুষ আনা হয়েছে।

যখন জঙ্গলের ভেতর শর্টকাট মারার কথা বলে প্রায় জোর করে টিটন আর মিঠুনকে রাস্তার পাশে জংলা জায়গায় ঢুকিয়ে দেওয়া হলো তখন মতি খপ করে মিঠুনকে আর খলিল টিটনকে ধরে ফেলল। তারা যেন শব্দ করতে পারে সেইজন্য প্রথমেই তাদের মুখ চেপে ধরা হলো। টিটন বেশি ছটফট না করলেও মিঠুন মতিকে ছেড়ে দিল না। লাথি কিল ঘুষি থেকে শুরু করে খামচি কিংবা টান মেরে লুঙ্গি খুলে ফেলা থেকে শুরু করে কামড় দিয়ে কবজি থেকে এক খাবলা গোশত তুলে ফেলা কিছুই বাকি থাকল না। হুটোপুটির সময় মিঠুন যে তার মুখের চিউয়িংগামটা মতির চুলে লাগিয়ে দিয়েছে মতি সেটা তখনো জানে না। শেষ পর্যন্ত খলিল একটা রামদা বের করে টিটনের বুড়ো আঙুল কোপ দিয়ে ফেলে দেবে ভয় দেখানোর পর মিঠুন শান্ত হলো।

মতি তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় হাত বুলাতে বুলাতে পাশের গ্রামের ভাড়া করে আনা মানুষটাকে বলল, তোরে না কইলাম একজনরে আনতে, দুইজন আনলি কোন আক্কেলে?

আমি কী আনতে চাইছি? হেই মাতবর মেয়ে জোর করে পাঠাইছে।

খলিল ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল। একদিক দিয়া তো ভালোই হইছে। এইটার আঙুল কাইটা ফালামু বলার পর ইবলিশটারে ঠাণ্ডা করানো গেছে।

মতি তার কনুইয়ের ছাল ওঠা জায়গায় হাত বুলাতে বুলাতে মিঠুনের দিকে বিষ দৃষ্টিতে তাকাল। বলল সেইটা খুব ভুল কথা কইস নাই।

খলিল জিজ্ঞেস করল, এখন কী করুম?

আগে একটা চিঠি লেখ। সেই চিঠিটা ঐ ছেমড়ির হাতে দিতে হইবে। কে লিখব চিঠি?

খলিল বলল, আমার লেখাপড়া হয় নাই, চিঠিপত্র লেখার পারি না।

মতি বলল, একটা চিঠি লিখতে আর কতো লেখাপড়া জানতে হবে?

খলিল বলল, তয় তুমি লিখো না কেন?

মতি বলল, লেখাপড়া করলে তো লিখেই ফেলতাম।

মিঠুন বলল, কাগজ দেন আমি লিখে দেই।

মানুষগুলো মিঠুনের কথা শুনে চোখ কপালে তুলে বলল, এই ছেমড়া তুমি যদি আবার মুখ খুলো দাঁত ভাইঙ্গা দিমু।

মিঠুনের আরো কিছু বলার ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু বলল না। পাশের গ্রামের মানুষটা বলল, ঠিক আছে কাগজটা দেও, আমি লিখে দেই।

তখন সে চিঠিটা লিখল, মিঠুন এবং টিটন বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনলো চিঠিতে কি লিখছে। লিখা শেষ হলে মিঠুন বলল, আমারে একটা কাগজ দিবেন? আমিও একটা চিঠি লিখি।

মতি আবার খেঁকিয়ে উঠল, বলল, খবরদার। কইছি না মুখ খুলবি না।

পাশের গ্রামের মানুষটা চিঠি এবং একটা লজেন্স নিয়ে চলে যাবার পর মতি আর খলিল টিটন এবং মিঠুনকে নিয়ে রওনা হলো। জংগলের ভিতর দিয়ে নদীর তীরে এসে ছোট একটা নৌকাতে মতি প্রথমে মিঠুনকে তুলে রওনা দিল। তাকে বলা হয়েছে সে যদি একটু চিৎকার করে সাথে সাথে টিটনের একটা বুড়ো আঙুল কেটে ফেলা হবে। টিটনের বুড়ো আঙুলের জন্যে মায়া করে মিঠুন চুপচাপ রইল। তা নাহলে সে মোটেও চুপ করে থাকার মানুষ না। মিঠুনকে আজহার আলীর মহাজনী নৌকায় শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে মতি নৌকা নিয়ে ফিরে এল, টিটনকে নৌকায় নিয়ে যাওয়া মোটামুটি সহজ হলো, তাকে ভয় দেখানো হলো একটু খানি শব্দ করা হলে মহাজনী নৌকায় মিঠুনের একটা আঙ্গুল কোপ দিয়ে কেটে ফেলা হবে। যদি কোনো গোলমাল না করে চুপচাপ বসে থাকে তাহলে ঘণ্টাখানেকের মাঝে তাদের দুজনকে ছেড়ে দেওয়া হবে এবং তখন সবাই মিলে ঢাকা চলে যেতে পারবে।

মহাজনী নৌকাতে দুইজনকে শক্ত দড়িতে বেঁধে পাটাতনের নিচে শুইয়ে রাখল। মুখ কাপড় দিয়ে বেঁধে রেখেছে যেন চিৎকার করতে না পারে। তারপর মতি আর খলিল ছোট নৌকাটাতে করে তীরে নেমে গেল।

যখন মতি বৈঠা বেয়ে তীরে যাচ্ছে তখন খলিল বলল, মতি তোর মাথায় কী?

মতি মাথায় হাত দিয়ে মিঠুনের চটচটে চিউয়িংগামটা আবিষ্কার করে। এটাকে টেনে সরানোর চেষ্টা করল এবং যতই চেষ্টা করতে থাকল সেটা ততই ছড়িয়ে যেতে থাকল। নদীর পানিতে ধোওয়ার চেষ্টা করার পর সেটা আরও পাকাপাকি ভাবে চুলে লেগে গেল। তীরে নামার পর খলিল সেটাকে কেরোসিন তেল দিয়ে সরানোর বুদ্ধি দিল। একটু কেরোসিন তেল দেওয়ার পর মাথা থেকে এক ধরনের দুর্গন্ধ বের হওয়া ছাড়া অন্য কোনো লাভ হলো না। খলিল তখন তাকে একটা নাপিতের কাছে নিয়ে গেল। নাপিত পরীক্ষা করে বলল, চুল কেটে ফেলা ছাড়া এটাকে সরানোর কোনো উপায় নেই এবং যত দেরী করা হবে সেটা ততই তার মাথায় ছড়িয়ে যেতে থাকবে। মতি কেন তার মাথায় এই জিনিসটি লাগিয়েছে নাপিত দুর্বল ভাবে সেটা জানতে চেয়েছিল কিন্তু মতির প্রচণ্ড ধমক খেয়ে সে চুপ করে গেল।

মাথা থেকে এক খাবলা চুল চেছে ফেলার পর মতিকে অত্যন্ত অদ্ভুত দেখাতে থাকে। মতি মাথার অন্য অংশ থেকে চুল এনে এই অংশটা ঢেকে রাখার চেষ্টা করল কিন্তু কোনো লাভ হলো না। মতির ধমক খাওয়ার কারণে নাপিত আর কোনো পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করল না। তখন খলিল নিজেই বলল, মতি তুই বরং মাথাটা কামিয়েই ফেল।

মাথা কামিয়ে ফেলব?

এক খাবলা চুল নাই, দেখে মনে হয় চুরি করে ধরা পড়েছিস সেইজন্য কেউ জোর করে চুল কেটে দিয়েছে।

মতি শুনে মেঘ স্বরে বলল, চুপ কর হারামজাদা।

গ্রামের লোকেরা সারা গ্রাম খুঁজেও টিটন আর মিঠুনকে খুঁজে না পেয়ে আবার মাস্টার সাহেবের বাড়িতে একত্র হয়েছে। তার বাড়ির সামনে বড় পুকুর সেই পুকুরের ঘাটে রিতু তিতু এবং টিয়াকে নিয়ে দুশ্চিন্তিত মুখে বসে আছে। কিছুক্ষণ হলো টিয়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে। টিয়াকে দেখে তিতুর চোখে পানি টলটল করছে এবং তাদের দুজনকে এভাবে ভেঙ্গে পড়তে দেখে রিতুও কী করবে বুঝতে পারছে না। ঢাকায় তাদের বাবা মাকে জানানো উচিৎ কী না রিতু ঠিক বুঝতে পারছে না। মাস্টার সাহেব তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বলছেন, গ্রামের মানুষেরা মিলে টিটন আর মিঠুনকে বের করে ফেলবে, তার কথার উপর ভরসা করে রিতু এখনো তাদের আবু আম্মুদের জানায়নি।

গ্রামের মানুষদের কথা শুনে মাস্টার সাহেব বললেন, সবাই চল, আমরা আজহার আলীর বাড়ি যাই।

গ্রামের মানুষ বলল, চলেন।

তখন প্রায় শখানেক মানুষ দল বেধে আজহার আলীর বাড়িতে রওনা দিল। মিনিট দশেকের মাঝেই তারা আজহার আলীর বাড়ি পৌঁছে যায়।

.

বাড়ির সামনে শদুয়েক মানুষের হই চই শুনে আজহার আলী বের হয়ে এল এক সাথে এত মানুষ দেখে সে ঘাবড়ে যায় কিন্তু মুখে সে সাহসের একটা ভাব ধরে রেখে বলল, কী ব্যাপার, এইখানে এত চিল্লাফাল্লা কিসের?

মাস্টার সাহেব কঠিন মুখে বলল, আপনি খুব ভালো করে জানেন চিল্লাফাল্লা কিসের। উল্টাপাল্টা কথা না বলে সোজাসুজি বলেন ছেলে দুইটারে কোথায় রাখছেন?

আজহার আলী অবাক হবার ভান করল, ছেলে পিলে? কোন ছেলে পিলে? কার ছেলে পিলে?

আপনি জানেন কোন ছেলে পিলে। কার ছেলেপিলে।

আজহার আলী বলল, না আমি কিছু জানি না।

রিতু হাতের চিঠিটা সামনে এগিয়ে দিয়ে বলল, এই চিঠিটা কে লিখেছে?

আজহার আলী চিঠিটাতে চোখ বুলিয়ে বলল, আমি জানি না, এই চিঠি কে লিখেছে।

রিতু হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিয়ে নিল, তখন আজহার আলী বলল, চিঠি যেই লেখুক অনায্য কথা তো লেখে নাই। আমাগো গেরামে ঝামেলা পাকানোর দরকার কী? অন্যগ্রামে যায় না কেন?

উপস্থিত মানুষেরা চাপা স্বরে প্রতিবাদ করল। মাস্টার সাহেব বললেন, ঝামেলা? এইখানে কোন জিনিসটা ঝামেলা?

আজহার আলী বলল, চিঠিতে লিখেছে পোলাপান চলে গেলেই ছেলে দুইটারে ছেড়ে দিবে। তাহলে পোলাপান যায় না কেন? আমাগো গেরামে কী এমন মধু যে এইখানে থাকতে হবে?

টিয়া তখন হঠাৎ তার রিনরিনে গলায় বলল, আপনি তো চিঠিটা পড়েন নাই, খালি হাতে নিয়ে ফেরত দিয়েছেন। চিঠিতে কী লেখা আছে সেইটা কেমন করে জানলেন?

গ্রামের লোক হই হই করে উঠল, বলল, এই মেয়েতো সত্যি কথাই বলেছে। চিঠি তো পড়েই নাই কেমন করে জানে এইখানে কী লেখা? কেমন করে জানে?

আরেকজন বলল, নিজে লিখেছে জানবে না কেন?

আরেকজন বলল, লেখাপড়া জানে কিনা দেখো। মনে হয় লিখতেও জানে না পড়তেও জানে না।

মানুষজন এতো জোরে হই চই করতে থাকে যে আজহার আলী ভয় পেয়ে যায়। মাস্টার সাহেব হাত তুলে সবাইকে শান্ত করলেন, তারপরে মেঘ স্বরে বললেন, এক্ষুণি বলেন, ছেলে দুইটা কোথায়?

আজহার আলী বলল, আমি জানি না।

তাহলে কে জানে?

গ্রামের একজন বলল, এর দুইজন সাঙ্গাত আছে মতি আর খলিল, তাগো ডাকেন। তারা নিশ্চয়ই জানে।

মাস্টার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ। মতি আর খলিল কই?

আজহার আলী বলল, মতি আর খলিল কই আমি কেমন করে জানুম। হেরা থাকে তাদের মতন।

আজহার আলী কথা শেষ না করতেই ভীড় ঠেলে মতি আর খলিল এগিয়ে আসে। গলা উঁচিয়ে মতি আজহার আলীকে জিজ্ঞেস করল হুজুর কুনো সমস্যা? এইখানে ফালতু মানুষের ভীড় কিসের লাইগা?

মতির বেয়াদপের মতো কথা শুনে সবাই আরো রেগে ওঠে। একজন হুংকার দিয়ে কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল তখন হঠাৎ আরেকজন হি হি করে হেসে উঠে বলে, আরে মইত্যা তুই কী চুরি কইরা ধরা পড়ছস নাকী? খালি চুলের গোছা কাটছে নাকী ধইরা মাইরও দিছে?

মতি চোখ পাকিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই তিতু চিৎকার করে বলল, চিউয়িংগাম! চিউয়িংগাম! মিঠুন নিশ্চয়ই এর মাথায় চিউয়িংগাম লাগিয়ে দিয়েছে! মিঠুন সব সময়ে এই ভাবে মাথায় চিউয়িংগাম লাগিয়ে দেয়।

সাথে সাথে রিতু আর টিয়াও চিৎকার করতে লাগল, নিশ্চয়ই এরা মিঠুনকে ধরে নিয়ে গেছে। মিঠুন তখন চিউয়িংগাম খাচ্ছিল, এর মাথায় চিউয়িংগাম লাগিয়েছে! এরা মিঠুন আর টিটনকে ধরেছে!

মিঠুন আর টিটনকে ধরার মাঝে মাথার এক খাবলা চুল না থাকার কী সম্পর্ক কেউ ভালো করে বুঝতে পারল না কিছু সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামালো না। গ্রামের লোক ঝাঁপিয়ে পড়ে মতি আর খলিলকে ধরে ফেলল।

এরপর কী হতো কেউ জানে না, কিন্তু পৃথিবীর সপ্তমাশ্চর্যের এক আশ্চর্য ঘটে যাওয়ার কারণে সবাই থেমে গেল। সবাই অবাক হয়ে দেখল মিঠুন আর টিটন হেলতে দুলতে আসছে। মিঠুনের ঘাড়ে একটা বন্দুক। তাদের বয়সী একটা ছেলে পথ দেখিয়ে মিঠুন আর টিটনকে আজহার আলীর বাড়িতে আনছে।

আজহার আলী মিঠুনের ঘাড়ের বন্দুকটা চিনতে পারল এটা তার বেআইনী অস্ত্র। তাই বাড়িতে রাখে না, তার মহাজনী নৌকায় ছইয়ের নিচে লুকানো থাকে। এই ছেলে দুইটা যেহেতু বন্দুকটা খুঁজে পেয়েছে তার সাথে আরো অনেক কিছু নিশ্চয়ই খুঁজে পেয়েছে। সর্বনাশ!

আজহার আলী ঘামতে থাকে। গ্রামের মানুষজন যে হঠাৎ করে ভয়ংকর উত্তেজনায় চিৎকার শুরু করেছে সেটাও সে ভালো করে শুনতে পায় না।

হঠাৎ করে আজহার আলীর বাথরুম পেয়ে যায়।

টিটন এবং মিঠুন তার মহাজনী নৌকায় কী করে এসেছে সেটা জানলে সে নিশ্চিত ভাবেই বাথরুম করেই ফেলতো।

১১. যখন এ্যাডভেঞ্চারের গল্প

১১যখন মিঠুনের কাছ থেকে সবাই তাদের এ্যাডভেঞ্চারের গল্প শুনেছে

মাস্টার সাহেবের পুকুর ঘাটে সবাই বসেছে। মাস্টার সাহেব রীতিমতো জোর করে রিতু এবং তার ভাইবোনদের তার নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছেন। মাস্টার সাহেবের স্ত্রী নিজে অনেক কিছু রান্না করেছেন, সবাই সেগুলো হই চই করে খেয়েছে (মাংস অনেক ঝাল ছিল কিন্তু বাচ্চারা সেটা কাউকে বুঝতে দেয় নাই।) খাওয়ার পর সবাই পুকুরের ঘাটে এসে বসেছে। টিটন এবং মিঠুন তারা কীভাবে পালিয়ে এসেছে সবার কাছে সেই গল্প করছে। গল্পটা অবশ্যি এর মাঝে কয়েকবার করা হয়ে গেছে কিন্তু প্রত্যেকবার যেহেতু গল্পের ডালপালা ছড়াতে থাকে তাই নূতন করে শুনতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সবাই আগ্রহ নিয়ে শুনছে। পুকুরঘাটে মিঠুন এবং টিটন যেভাবে ঘটনাটা বর্ণনা দিয়েছে সেটার বিশ্বাসযোগ্য অংশটা এরকম :

মিঠুনকে ইব্রাহীম ডেকে পাঠিয়েছে বলে একটা মানুষ প্রথমে তাদের কাছে এসেছিল, সেই মানুষটা বুঝতে পারে নাই রিতু মিঠুনের সাথে টিটনকেও পাঠিয়ে দেবে। দুইজন হওয়ার কারণে মানুষগুলোর একটু যন্ত্রণা বেশি হয়েছে। তাদেরকে জঙ্গলের ভিতরে ঠেলে ঢুকিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে দুইজন মানুষ তাদেরকে ধরে ফেলেছে। তারা যেন চিৎকার দিতে না পারে সেইজন্য মানুষগুলো প্রথমেই তাদের মুখ চেপে ধরেছে টিটন ভদ্র ছেলে কিছু করে নাই, কিন্তু মিঠুন মুখ থেকে চিউয়িংগামটা বের করে মানুষটার হাত কামড়ে তার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। মিঠুনকে চিৎকার করতে দেয় নাই কিন্তু মানুষটা নিজে যন্ত্রণায় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেছে। মিঠুন তাকে কিল ঘুষি মেরেছে, খামচি দিয়ে চোখে গুলো তুলে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। অসুবিধা জায়গায় লাথি মেরেছে এক কথায় মানুষটার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। শুধু তাই না, হুটোপুটি করার সময় তার মাথার চুলে চিউয়িংগাম লাগিয়ে দিয়েছে।

মিঠুন একটুও ভয় পায় নাই এবং সে খুব ভালো করে জানে সে তাদের নাস্তানাবুদ করে ছেড়ে দিবে। শুধু টিটুনের বুড়ো আঙ্গুল রামদা দিয়ে কোপ দিয়ে আলাদা করে দেবে বলার পর সে একটু শান্ত হয়েছে। মিঠুন বলেছে বুড়ো আঙ্গুল খুবই জরুরি আঙুল, এই আঙুল না থাকলে কিছু করা যায় না, সেইজন্য সে ছেড়ে দিয়েছে। অন্য কোনো আঙুলের ভয় দেখালে সে শান্ত হতো না। (গল্পের এই অংশে টিটন খুবই বিরক্ত হয়েছে যে মিঠুন তার অন্য যে কোনো আঙুল কেটে ফেলে দেওয়া নিয়ে মোটেও চিন্তিত ছিল না।)

যাই হোক মানুষগুলো তাদেরকে আজহার আলীর মহাজনী নৌকায় তুলেছে, তাদের হাত বেঁধে পাটাতনের নিচে রেখে নেমে গেছে। মানুষগুলো নৌকা থেকে নামার আগেই মিঠুন তার হাত পায়ের বাঁধন খুলে ফেলেছিল। মিঠুন কীভাবে সেটা করেছে সেটা সবাইকে করে দেখালো। মানুষগুলো যখন তাকে বাঁধে তখনই সে তাদেরকে শক্ত করে বাঁধতে দেয় নাই, হাত পা গুলো জোর করে ছড়িয়ে রেখেছে, যখনই বাঁধতে চেষ্টা করেছে সে অনেক জোরে চিৎকার করেছে। মানুষগুলো ধারণা করেছে তারা এত জোরে বেঁধেছে যে ব্যথায় চিৎকার করছে।

মানুষগুলো চলে যাবার পর সে প্রথমে একটা হাত ছুটিয়ে এনেছে, সেটা দিয়ে হাতের বাঁধন খুলেছে, তারপর পায়ের বাঁধন খুলেছে। মিঠুন নিজেকে ছোটানোর পর টিটনকে ছুটিয়েছে তারপর মাথার উপর ঢেকে রাখা কাঠ সরিয়ে পাটাতন থেকে বের হয়ে এসেছে। পাটাতন থেকে বের হয়ে দুইজন মিলে নৌকাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে। নৌকাটা চিনির বস্তা দিয়ে বোঝাই। ছইয়ের কাছে একটা চাটাই দিয়ে ঢাকা একটা জায়গায় একটা বন্দুক এবং কয়েকটা কার্তুজ খুঁজে পেয়েছে। মিঠুন বন্দুকে একটা কার্তুজ ঢুকিয়ে আকাশের দিকে একটা ফাঁকা গুলি করতে চেয়েছে কিন্তু টিটন তাকে সেটা করতে দেয় নাই।

নৌকার ভিতরে অনেক রকম জঙ্গিদের বই ছিল, বেশ কয়েকটা দা এবং চাইনিজ কুড়াল। কাগজপত্র এবং চিঠি, চিঠিতে অনেক বানান ভুল সেইজন্য তারা পড়ার আগ্রহ দেখায় নাই। নৌকায় মাঝে লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, গামছা এইরকম কিছু কাপড় জামা এবং একটা লম্বা নল লাগানো হুঁকো খুঁজে পেয়েছে। কোটা দেখে মিঠুনের কিছু মনে হয় নাই কিন্তু টিটন আনন্দে লাফাতে লাগল। সে নাকী হুঁকোর লম্বা নল দিয়ে কীভাবে এই মহাজনী নৌকাটা ডুবিয়ে দেবে।

মিঠুন মোটেও টিটনের কথা বিশ্বাস করে নাই কিন্তু সত্যি সত্যি হুঁকোর নলটা পানিতে ভরে নদীতে এক মাথা আর নৌকার ভিতরে আরেক মাথা রেখে টিটন কী যেন করে ফেলল তখন নদীর পানি নৌকার ভিতর এসে পড়তে নাগল।

(গল্পের এই জায়গায় টিটন সবাইকে বলল, এইভাবে উঁচু জায়গা থেকে নিচু জায়গায় পানি ফেলার পদ্ধতির নাম সাইফন এবং সাইফন কীভাবে কাজ করে সে সেইটাও বোঝানোর জন্যে রেডি ছিল কিন্তু যারা শুনছে তাদের কারোই বিজ্ঞান নিয়ে কোনো আগ্রহ ছিল না বলে সেটা সে বোঝানোর সুযোগ পেল না।)।

নৌকাটা অনেক বড় এবং কোর নল দিয়ে অল্প করে পানি এসে ঢুকছে, কাজেই পুরো নৌকাটা পানিতে ভরে ডুবে যেতে একটু সময় নেবে। টিটনের কোনো তাড়াহুড়ো ছিল না, এতক্ষণে নিশ্চয়ই নৌকাটা ডুবে গেছে। তবে নৌকাটা ডুবে গেলে নৌকাতে রাখা চিনির বস্তাগুলো যখন নদীর পানিতে গলে যাবে তখন পুরো নদীর পানি নিশ্চয়ই মিষ্টি হয়ে যাবে। আজহার আলীর নিশ্চয়ই অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে কিন্তু এগুলো নাকী চোরাচালানি করে আনা চিনি, এভাবেই এগুলোর নদীর পানিতে গলে যাওয়াই উচিৎ।

মহাজনী নৌকাটা প্রায় নদীর মাঝখানে নোঙর করে রেখেছিল। সেখান থেকে তীরে আসতে তাদের খুব বেশি ঝামেলা হয় নাই। নদীতে অনেক নৌকা চলাচল করে তাদের হাত তুলে ডেকে অনুরোধ করতেই তাদের তীরে নামিয়ে দিয়েছে। তারা টাকা দিয়ে নৌকার ভাড়া দিতে পারে নাই তবে টাকার বদলে মাঝিকে দুই গামলা চিনি দিয়েছে।

তীরে এসে একটু খোঁজখবর করতেই একজন জানিয়েছে রিতু তিতু আর টিয়া মাস্টার সাহেবের সাথে আজহার আলীর বাড়িতে গেছে তখন একজন তাদেরকে আজহার আলীর বাড়ি নিয়ে গেছে।

মিঠুনের খুব সখ ছিল, বন্দুকটা যেহেতু সে খুঁজে পেয়েছে সে এটা নিজের কাছে রেখে দেবে। কিন্তু মাস্টার সাহেব রাজী হন নাই। বন্দুকটা মিঠুনের হাত থেকে নিয়ে থানায় পাঠিয়ে দিয়েছেন।

টিটন আর মিঠুন কিডন্যাপ হয়েছে আবার ছাড়াও পেয়েছে, আজহার আলী অনেক বিপদের মাঝে আছে, মতি আর খলিল রীতিমতো গ্রামের মানুষের পা ধরে কান্নাকাটি করছে, আজহার আলীর চোরাচালানি করে আনা চিনি বোঝাই মহাজনী নৌকা নদীতে ডুবে গেছে, নদীর পানি সরবতের মতো মিষ্টি, এক কথায় বলা যেতে পারে সবকিছু একেবারে ম্যাজিকের মতো ঘটে যাচ্ছে। আনন্দ এবং উত্তেজনায় সবাই প্রায় ভুলেই গিয়েছিল যে তারা এখানে এসেছে ইদরিস মিয়াকে খুঁজে বের করে তার সাথে কথা বলতে। সকালবেলা গেস্টহাউজ থেকে বের হয়েছে ইদরিস মিয়ার সাথে দেখা করতে, এখন দুপুর গড়িয়ে গেছে।

তিতু সবার আগে অন্যদের সেটা মনে করিয়ে দিল। মিঠুন যখন রংচং চড়িয়ে তার গল্পটা আবার শুরু করতে যাচ্ছিল তখন তিতু ইব্রাহীম চাচাকে বলল, ইব্রাহীম চাচা আমরা মুক্তিযোদ্ধা ইদরিস মিয়ার সাথে কথা বলতে যাব না?

ইব্রাহীম চাচা বলল, তোমরা যদি যেতে চাও। আজকে এতো কিছু হয়েছে।

সবাই একসাথে বলল, যাব। যাব। আমরা যাব। এখনই যাব। শুধু তাই না যাওয়ার জন্য কয়েকজন লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর মাস্টার সাহেবের বাসায় মানুষজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তারা ইসদিও মিয়ার খোঁজে রওনা দেয়।

.

ইব্রাহীম চাচা এবারে সবাইকে নিয়ে নদীর তীর ঘেঁষে হাঁটতে লাগল। সবাই আজহার আলীর নৌকাটা কোথায় ছিল দেখতে চাইছিল। কিন্তু তখন সেখানে কিছু নাই, নৌকার মাস্তুলটা চেষ্টা করলে একটুখানি দেখা যায়। নদীর তীরে ঠিক হাঁটার রাস্তা নেই। জায়গাটা উঁচু নিচু, মাঝে মাঝে ছোট খাল, গাছপালা, ঝোঁপঝাড়। মাঝে মাঝে গরু ছাগল উদাস মুখে দাঁড়িয়ে আছে না হয় মনোযোগ দিয়ে ঘাস খাচ্ছে। নদীর তীরে ছোট ছোট গ্রাম, সেখান থেকে মহিলারা থালাবাসন কাপড় নিয়ে নদীর দিকে যাচ্ছে না হয়, নদী থেকে ফিরে আসছে। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা নদীর পানিতে লাফালাফি করছে। তাদের আনন্দ দেখে সবারই মনে হলো তারাও যেন পানিতে গিয়ে লাফিয়ে পড়ে!

হাঁটতে হাঁটতে রিতু বলল,আমরা কী বাঁচা বেঁচে গেছি। যদি মিঠুন না হলে টিটুনের কিছু একটা হতো তাহলে আমাদের কী হতো।

টিটন বলল, কী আর হতো? ওরা ভয় দেখাবে চাইছিল আমরা ভয় পেতাম।

তিতু বলল, আমি অনেক ভয় পেয়েছি।

টিয়া বলল, আমিও।

মিঠুন বলল, আমি একটুও ভয় পাই নাই।

রিতু হাসল, বলল এই প্রথম দুষ্টু হওয়ার একটা উপকারিতা দেখতে পেলাম, যখন ভয়ের ব্যাপার হয় তখনও ভয় পায় না।

রিতুর কথা শুনে মিঠুন দাঁত বের করে হি হি করে হাসল।

১আরো মিনিট ত্রিশেক হাঁটার পর ইব্রাহীম চাচা বলল, আমরা এসে গেছি।

এসে গেছি?

ইব্রাহীম চাচা উত্তর দিল না। ইব্রাহিম চাচা তার আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। দরকার না হলে এখন আর একটা কথাও বলবে না।

ইব্রাহীম চাচা আরো খানিকদূর হেঁটে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল। তারপর একটু দূরে একটা ঝপড়া গাছ দেখিয়ে বলল, গাছের নিচে একটা চালাঘর দেখেছ? ইদরিস মিয়া এখানে থাকেন।

ইব্রাহীম চাচা এটাকে চালাঘর বলছে কিন্তু এটা চালাও না ঘরও না। কার্ডবোর্ডের বাক্স, পলিথিনের ব্যাগ, কাঠ-কুটো, বাঁশের কঞ্চি এইসব দিয়ে কোনোমতে একটা কিছু দাঁড় করানো হয়েছে। বৃষ্টি হলে সরাসরি মাথায় বৃষ্টি পড়বে না, এছাড়া এই চালাঘরটির আর কোনো কাজে আসার কথা না। চালাঘরটির নিচে একটা বিছানা, কয়েকটা হাঁড়িকুড়ি। একটি দড়ি থেকে একটা লুঙ্গি এবং একটা রং ওঠা পাঞ্জাবী ঝুলছে। জায়গাটা নির্জন এবং ফাঁকা। আশে পাশে কেউ নেই।

রিতু জিজ্ঞেস করল উনি কোথায়?

ইব্রাহীম কোনো উত্তর দিল না। টিটন বলল, আমরা তো আর অ্যাপয়ন্টমেন্ট করে আসি নাই। উনাকে থাকতে হবে কে বলেছে?

রিতু মাথা নাড়ল বলল, তা ঠিক।

তিতু বলল, আমরা অপেক্ষা করি। জায়গাটা কী সুন্দর।

মিঠুন নিজের ঘাড়ে থাবা দিয়ে একটা মশা মেরে বলল, খালি মশাগুলো একটু রাজাকার টাইপ!

টিটন বলল, মশাকে দোষ দিবি না। মা মশাদের বাচ্চা জন্ম দেওয়ায় জন্য রক্ত খেতে হয়। কাজেই যতবার একটা মশা মারবি জেনে রাখিস তুই একটা মাতৃহন্তা।

রিতু বলল, হয়েছে। এখন মশার জন্য দালালি করতে হবে না।

ঠিক এই সময় ইব্রাহীম বলল, ঐযে, ইদরিস মিয়া আসছেন।

কোথায়? কোথায়?

ইব্রাহিম নিশ্চয়ই কথার উত্তর দিবে না তাই সবাই এদিক সেদিক তাকাতে থাকে। তখন দেখল পিছনে জঙ্গলের ভিতর থেকে একজন লম্বা মানুষ হেঁটে হেঁটে আসছে। মানুষটা এমনভাবে হাঁটছে যে দেখে মনে হয় সে বুঝি মাটিতে পা দিয়ে হাঁটছে না শূন্যের উপর ভাসতে ভাসতে আসছে। শুধু তাই না মানুষটাকে দেখে মনে হয় তার চারপাশে কী হচ্ছে সে কিছুই জানে না।

মিঠুন সবার আগে এবং তার পিছু পিছু অন্য সবাই মানুষটার দিকে এগিয়ে গেল। মানুষটা কাউকে দেখল বলে মনে হলো না। সে অনেকটা আপন মনে হেঁটে হেঁটে তার বিচিত্র চালাঘরটার নিচে গিয়ে বিছানাটা টেনে বিছিয়ে দিল। একটা চাটাইয়ের উপর একটা কথা তার ওপর একটা তেল চিটচিটে বালিশ। মানুষটা সেখানে পিঠ সোজা করে বসল যেন সে কোনো একটা ধ্যান করতে বসেছে।

বাচ্চারা কাছাকাছি গিয়ে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। মানুষটা তাদের দিকে তাকায় কিন্তু তাদের দেখছে কী না সেটা বোঝা গেল না। রিতু গলা পরিষ্কার করে বলল, আমরা ঢাকা থেকে এসেছি।

মানুষটা হ্যাঁ না কিছু বলল না, তাদের দিকে এক ধরনের শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। রিতু বলল, আমরা সবাই ভাইবোন। কাজিন বলতে পারেন।

মানুষটা এবারেও কিছু বলল না। রিতু বলল, আপনি নিশ্চয়ই ইদরিস মিয়া, মুক্তিযোদ্ধা?

এবারে মানুষটা একটু ভুরু কুঁচকে, তারপর শুকনো গলায় বলল তোমাদের কোনো একটা ভুল হয়েছে। আমি কেউ না।

তিতু অবাক হয়ে বলল, কেউ না?

মিঠুন হি হি করে হাসল, বলল, কেউ না কখনো হয় না। হাত দিয়ে ইদরিস মিয়াকে দেখিয়ে বলল, এই যে আপনি কেউ।

টিটন পিছন থেকে মিঠুনের কাঁধে ধরে একটা ছোট ধাক্কা দিয়ে বলল, মিঠুন, তুই চুপ করবি?

মিঠুন চুপ করল। রিতু বলল, আমরা ঢাকা থেকে এসেছি। আমরা আপনার সাথে একটু কথা বলতে চাই।

মানুষটা বিচিত্র একটা দৃষ্টিতে রিতুর দিকে তাকিয়ে রইল, যখন মনে হলো কিছু বলবে না তখন হঠাৎ করে বলল, আমি কারো সাথে কথা টথা বলি না। তোমরা অন্য কোনোখানে যাও।

তিতু বলল, কিন্তু আমরা তো আপনার সাথেই কথা বলতে চাই। অন্য কারো সাথে না।

মানুষটা তিতুর কথার উত্তর দিল না। এতক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়েছিল এবারে একটা নিশ্বাস ফেলে দূরে নদীর দিকে তাকিয়ে রইল। বোঝাই যাচ্ছে সে আর কথা বলবে না।

টিয়া প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আপনি আমাদের সাথে কথা বলবেন না?

মানুষটা কোনো কথা না বলে স্থির দৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকিয়ে রইল। ইব্রাহীম চাচা কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল, এবারে সে বলল, উনি আজকে মনে হয় কথা বলতে চাচ্ছেন না। চল, আমরা যাই।

রিতু বলল, আপনি যান। আমরা আর কিছুক্ষণ থাকি।

ইব্রাহীম চাচা বলল, উনাকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না।

রিতু বলল, আমরা বিরক্ত করব না। আমরা একটু বসে থাকি। আপনি যান।

ঠিক আছে। আমি অপেক্ষা করি। বলে ইব্রাহীম চাচা হেঁটে হেঁটে নদীর দিকে এগিয়ে গেল। ইব্রাহীম চাচা বেশ খানিকটা দূরে যাবার পর রিতু ইদরিস মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক আছে, আপনি যদি শুধু আমাদের কথা একটু শুনেন।

ইদরিস মিয়া নামের মানুষটা এবারে নদী থেকে চোখ ফিরিয়ে ওদের দিকে তাকালো। রিতু বলল, আমার নানার নাম ছিল আসাদ রহমান।

ছেলেমেয়েরা সবাই দেখতে পেলো ইদরিস মিয়ার পুরো শরীরটা কেমন যেন ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। রিতু শান্ত গলায় বলতে লাগল, আমার নানা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর আমার নানা কখনো ফিরে আসেন নাই। আমরা কেউ জানি না আমার নানার কী হয়েছে।

হঠাৎ করে মনে হলো ইদরিস মিয়ার শরীরটা অল্প অল্প কাঁপতে শুরু করেছে। রিতু একটু অবাক হলেও কথা থামাল না, বলতে থাকল, আমরা জানতে পেরেছি আমার নানা আসাদ রহমান এই এলাকায় যুদ্ধ করেছিলেন। আপনিও এই এলাকায় যুদ্ধ করেছেন। আমরা তাই আপনার কাছে জানতে এসেছি, আপনি কী যুদ্ধের সময় আমার নানাকে কখনো দেখেছেন, নানার কী হয়েছে আপনি জানেন?

ছেলেমেয়েরা অবাক হয়ে দেখল, ইদরিস মিয়ার সমস্ত শরীর কাঁপছে, তার দুই চোখ পানিতে ভরে উঠেছে। মানুষটা নিজের ঠোঁট কামড়ে তার চোখের পানি আটকানোর চেষ্টা করছে। পারছে না।

তিতু সামনে এগিয়ে মানুষটার হাত ধরে ফেলল, বলল, আপনি আমার নানাকে চিনেন? নানার কী হয়েছে আপনি জানেন। তাই না? তাই না?

মানুষটার চোখ থেকে ঝর ঝর করে পানি ঝরতে থাকে। ইদরিস মিয়া ভাঙা গলায় বলল, হ্যাঁ। আমি চিনি। আমি চৌত্রিশ বছর থেকে আসাদ ভাইয়ের কবরটা পাহারা দিচ্ছি। তোমাদের জন্য।

টিটন বলল, আমার দাদার কবরটা কোথায় আপনি জানেন? আপনি জানেন?

হ্যাঁ জানি। ইদরিস মিয়া একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, তোমাদের দাদা, আসাদ ভাই মারা যাওয়ার পর তার পকেটে আমি একটা ফাটো আর একটা চিঠি পেয়েছিলাম। সেই চিঠি কাকে দিব আমি জানি না। তাই আমি তোমাদের দাদার কবরের কাছে বসে আছি। আমি জানি একদিন না একদিন তোমরা আসবে।

তিতু জিজ্ঞেস করল, আছে সেই চিঠিটা আপনার কাছে। হ্যাঁ, আছে। তোমাদের দিব।

টিয়া বলল, দাদার কবরটা দেখাবেন আমাদের?

দেখাব। আস আমার সাথে।

ইদরিস মিয়া উঠে দাঁড়ালেন। তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে থাকেন। মিঠুন গিয়ে তার হাত ধরে বলল, আমরা কী আপনাকে দাদু ডাকতে পারি?

মানুষটা মিঠুনের দিকে তাকালো, তার মাথায় হাত রাখল, তারপর বলল, হ্যাঁ ভাই। তুমি আমারে দাদু ডাকতে পার। তোমার দাদু আমার মায়ের পেটের ভাই থেকেও বড় ভাই ছিল।

ইদরিস মিয়া ছেলেমেয়েদের নিয়ে জঙ্গলের মতো জায়গাটাতে ঢুকলেন, গাছপালার ভেতর দিয়ে ছোট একটা হাঁটা পথ। হেঁটে হেঁটে খানিকদূর যেতেই জঙ্গলটা একটু হালকা হয়ে গেল, তারপর বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা। ফাঁকা জায়গাটায় নানা রকম ঝোঁপঝাড়। তার মাঝে খানিকটা জায়গা কেউ যেন ঝেড়ে মুছে রেখেছে। একটা বকুল ফুলের গাছ তার নিচে ঘন সবুজ ঘাসের একটা গালিচা। কেউ বলে দেয়নি কিন্তু তারা সবাই বুঝে গেল এটাই আসাদ রহমানের কবর। তাদের দাদার কবর। তাদের নানান কবর।

ইদরিস মিয়া কবরটার পাশে উবু হয়ে বসে সেখানে হাত রেখে ফিসফিস করে বলল, ভাইজান। আপনার নাতি নাতনিরা আপনারে দেখতে আসছে। আমি আপনারে বলছিলাম না, একদিন আসবেই না আসব? রিতু দেখল বোকা তিতুটা ভেউ ভেউ করে কাঁদতে শুরু করেছে। তার না হয় মনটা নরম, সে কাঁদতেই পারে। কিন্তু অন্যদের চোখও কেন ঝাপসা হয়ে আসছে?

১২. যখন যুদ্ধের গল্প

১২যখন ইদরিস মিয়ার কাছ থেকে সবাই যুদ্ধের গল্প শুনেছে

ইদরিস মিয়ার চালাঘরের সামনে ছোট একটা আগুন জ্বলছে। সবাই আগুনটাকে ঘিরে বসেছে। আগুনের শিখা লকলক করছে, তার লালাভ আলোতে সবাইকে কেমন জানি অবাস্তব দেখায়। মিঠুন একটা কাঠি দিয়ে একটু পর পর জ্বলন্ত কাঠকুটোতে খোঁচা দিচ্ছে এবং তখন আগুনের ফুলকি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।

ইদরিস মিয়া একটু উবু হয়ে বসেছে, আগুনের জ্বলন্ত শিখায় তার এলোমেলো চুল, খোঁচা খোঁচা দাড়ি গোঁফ আর মুখে। বয়সের ছাপ যেন আরো অনেক বছর বেড়ে গেছে। দূর থেকে ভেসে আসা নদীর ঢেউয়ের শব্দ, এলোমেলো বাতাস আর আগুনের শিখার শব্দের মাঝে ইদরিস মিয়া আসাদ রহমানের জীবনের শেষ কয়টা দিনের কথা বলছে। সবাই নিশ্বাস বন্ধ করে সেই অবিশ্বাস্য দিনগুলোর কথা শুনছে।

ইদরিস মিয়া বলছে, এই এলাকায় তখন পাকিস্তানি মিলিটারির খুব উৎপাত। ওরা বাংকারে থাকে। বাংকারগুলো অনেক শক্ত। প্রথম আস্তরে মাটি আর টিনের দেওয়াল। তারপর ছয় ইঞ্চি পরপর লোহার বিম, সেইখানে কংক্রিটের আস্তর। বাংকারের কাছে কেউ যেন যেতে না পারে সেইজন্য সামনে মাইন, বুট্র্যিাপ আর বাঁশের কঞ্চি।

পাকিস্তানিরা দিনের বেলা অনেক এলাকা মিলিয়ে ডিফেন্স নিয়ে থাকতো। রাতের বেলা দূরের বাংকারগুলো ছেড়ে সেকেন্ড লাইন অফ ডিফেন্সে চলে যেত। সেকেন্ড লাইন অফ ডিফেন্স ঘন, অনেক কাছাকাছি। সেখানে অনেকগুলো ভারী মেশিন গান সবসময় রেডি থাকে।

আমাদের কুড়ি জনের একটা দল তৈরি হয়েছে। এইটা একটা স্পেশাল প্লাটুন। আমাদের কাজ হচ্ছে সবসময় পাকিস্তানিদের আশেপাশে থাকা আর সুযোগ পেলেই তাদের ওপর একটা হামলা করা। সারাক্ষণ ওদের ওপর হামলা করার জন্য ওরা ব্যস্ত থাকে, মনের দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন যখন রেগুলার বাহিনী সামনাসামনি আক্রমণ করে ওরা সহজে ঘায়েল হয়ে যায়।

আসাদ ভাই আমাদের দলটার কমান্ডার। অসম্ভব সাহসী মানুষ। একেবারে সিংহের মতো সাহস।

টিয়া বলল, আসাদ মানে সিংহ। সিংহের মতো সাহস তো হবেই।

ইদরিস মিয়া মাথা নাড়লেন, বললেন, ঠিকই বলেছ বোন। যার নাম সিংহ তার কাম তো সিংহের মতন হবেই। যাই হোক একদিন আমাদের কাছে জরুরি অর্ডার এসেছে এই পাকিস্তানিদের ঘাঁটিতে একটু হামলা করার। আজকে রাতেই হামলা করতে হবে। মাঝ রাতের আগে। হামলা করে কমপক্ষে তিন ঘন্টা যুদ্ধ করতে হবে। কারণটা কী আমরা তখনও জানি না। কিন্তু অর্ডার যখন হয়েছে আমরা হামলা করার জন্য রেডি হয়ে গেলাম।

যাই হোক আমরা সন্ধ্যাবেলা রওনা দিয়েছি। পরনে লুঙ্গি আর শার্ট। খালি পা। পিঠে চাইনিজ লাইট মেশিন গান আর দুইটা ম্যাগাজিন। ম্যাগাজিন দুইটা খুব ভারী। কোমরে চারটা গ্রেনেড। ঘুটঘুটে অন্ধকার, বৃষ্টি হয়েছে। পথে ঘাটে কাদা। আমরা শব্দ না করে হাঁটার চেষ্টা করছি। তবু দেখি প্যাঁচপ্যাঁচে শব্দ হয়। আমরা পাকিস্তানিদের কাছাকাছি আসার পর আসাদ ভাই যার যার পজিশনে বসিয়ে দিলেন। তারপর নিজে বাংকারগুলো রেকি করতে গেলেন। সামনের বাংকারগুলো খালি দেখে আসাদ ভাই আরেকটু এগিয়ে গেলেন। ঠিক তখন দুইজন পাকিস্তানি মিলিটারি মনে হয় পেট্রোলিং করে ফিরে আসছে, একেবারে আসাদ ভাইয়ের মুখোমুখি।

অন্ধকারে পাকিস্তানি মিলিটারি বুঝে নাই আসাদ ভাইকে, মনে করেছে তার দলের কেউ। জিজ্ঞেস করে, কৌন হো?

আসাদ ভাই তার রাইফেলের বাট দিয়ে ব্যাটার মুখে মেরে বলল, তোমহারা বাপ হো।

তারপর ঝটকা মেরে পাকিস্তানি মিলিটারিটার রাইফেলটা কেড়ে নিয়ে চিৎকার করে বলল, ফায়ার! আর আমরা সাথে সাথে গুলি করতে শুরু করলাম। মিলিটারি লাফিয়ে একটা বাংকারে ঢুকে গেল আর আসাদ ভাই একটা বাড়তি জি থ্রি রাইফেল নিয়ে ক্রলিং করে ফিরে এলেন।

ঘুটঘুটে অন্ধকার, ঝম ঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে। তার মাঝে আমি আন্দাজের উপর গুলি করছি। পাকিস্তানিদের মাঝে হৈ চই শুরু হয়ে গেল। তারা অবশ্য খুব এক্সপার্ট। জন্ম থেকে খালি যুদ্ধই করে আসছে তাই আমাদের এটাক সামলে নিয়ে পাল্টা এটাক শুরু করল। হঠাৎ দেখি সামনের বাংকার থেকে প্রচণ্ড শব্দ করে ভারী মেশিনগান থেকে গুলি হতে শুরু করেছে। একেবারে মাথার কাছ দিয়ে গুলি ছুটতে লাগল। এর মাঝে দেখলাম আসাদ ভাই ক্রলিং করে আমার কাছে এসেছেন। গুলির শব্দে কিছু শোনা যায় না, তার মাঝে চিৎকার করে বললেন, মেশিনগানটা থামাতে হবে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কীভাবে?

আসাদ ভাই বললেন, কভার দাও। আমি যাচ্ছি।

আমি বললাম, যাবেন না। এই ভাবে যাবেন না।

আসাদ ভাই বললেন, আমার গায়ে লাগাতে পারে সেই গুলি ইয়াহিয়া খানের বাপের কাছেও নাই!

আমি কভার দিলাম। আর সত্যি সত্যি আসাদ ভাই কাছে গিয়ে একটা গ্রেনেড চার্জ করলেন আর সাথে সাথে মেশিনগান থেমে গেল।

কতক্ষণ গুলি চলেছে খেয়াল নাই। একসময় আসাদ ভাই আমাদের ফিরে যাওয়ার সংকেত দিয়েছেন। বৃষ্টিও কমে আসছে। আমরা ক্রলিং করে পিছিয়ে এসেছি। একদিনের জন্য যথেষ্ট হয়েছে।

ফিরে এসে খবর পেলাম যে জন্যে এটাক করতে অর্ডার দিয়েছিল সেটা ঠিক ঠিক হয়েছে। আশপাশের গ্রাম থেকে অনেক মেয়েদের ধরে এনেছিল। আমরা যখন এটাক করেছি তখন মেয়েগুলো পেছন দিয়ে পালিয়ে গেছে। আগেই খবর দেওয়া ছিল, তাই তারা রেডি হয়ে ছিল। আমাদের মিশন কমপ্লিট।

পরের দিন আমরা দেখলাম মিলিটারি আর রাজাকার মিলে সকাল থেকেই অত্যাচার শুরু করে দিয়েছে। গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে, লুটতরাজ করছে, মানুষের চিৎকার কান্নাকাটি। একেবারে ভয়ংকর অবস্থা। তারপর দুইটা নৌকা বোঝাই করে লুট করা মালামাল নিয়ে এই নদী দিয়ে রওনা দিয়েছে। খবর পেলাম বিশ পঁচিশ জন নৌকার ছইয়ের ওপর অস্ত্র নিয়ে বসেছে। আসাদ ভাই বলল, বদমাইশদের অ্যামবুশ করতে হবে। আমরা নদীর তীরে পজিশন নিয়ে অপেক্ষা করছি। নৌকার জন্য অপেক্ষা করছি হঠাৎ শুনি বুটের ধুপ ধাপ শব্দ।

পাকিস্তান মিলিটারির একটা দল নৌকা করে রওনা দিয়েছে, অন্য আরেকটা দল নদীর তীরে ধরে হেঁটে আসছে। আমাদের মাথায় বাজ পড়ল, আমরা এই জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। তা ছাড়া আমাদের পজিশনটা খুবই খারাপ।

আসাদ ভাই একটুও ঘাবড়ালো না। আমাকে ডেকে বলল, আমি এদের আটকে রাখব, তুমি সবাইরে নিয়ে সরে যাবে!

আমি বললাম, এইটা হয় না। মরলে সবাই মরব।

আসাদ ভাই বলল, কেউ মরবে না। আগে নৌকার মিলিটারিগুলারে শেষ করি।

আমরা গুলি শুরু করতে লাগলাম, মুহূর্তের মাঝে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। নৌকার ওপরে যেগুলো ছিল সেগুলো পাখির মতো পানিতে পড়ে মারবেলের মতো ডুবে যেতে লাগল। যে মিলিটারিগুলো আসছিল তারা আমাদের জন্য রেডি ছিল না, তারপরেও নদীর পাড়ে পজিশন নিয়ে ফায়ার শুরু করতে লাগল।

আসাদ ভাই একটা মাটির ঢিবির পিছনে কভার নিয়ে তার এল এম জিটা দিয়ে গুলি করতে করতে আমাদের বলতে লাগলেন, তোমরা যাও। যাও।

আমরা যখন পিছিয়ে যাচ্ছি তখন আসাদ ভাই গুলি খেলেন। আমরা দেখলাম তার মুখ থেকে রক্ত পড়তে লাগল তখনও তিনি থামলেন না। গুলি করতেই থাকলেন, গুলি করতেই থাকলেন।

পাকিস্তানি মিলিটারি হঠাৎ পিছিয়ে যেতে শুরু করল। কিছুক্ষণের মাঝেই তারা পিছনে সরে গেল, গোলাগুলি বন্ধ হয়ে গেল। আমরা তখন আসাদ ভাইকে উদ্ধার করার জন্য ছুটে এসেছি। তখনো তার জ্ঞান আছে। বুকের ডান পাশে কাঁধ দিয়ে গুলি ঢুকে পেটের ভিতর দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। রক্তে শরীর ভেসে যাচ্ছে। শীতে থর থর করে কাঁপছেন। আমরা আমাদের নিজেদের কাপড় খুলে তাকে ঢেকে শরীরটা গরম করার চেষ্টা করলাম।

আসাদ ভাই আমার হাতটা ধরে বললেন, ইদরিস আমি আর বাঁচবো না।

আমি বললাম, এইভাবে বলবেন না আসাদ ভাই।

আসাদ ভাই বললেন, আমি স্বাধীন দেশটা দেখতে পারলাম না। তুমি দেখবা। আমার ছেলেমেয়ে দেখব। নাতি-নাতনি দেখব। দেখব না?

আমি বললাম, দেখবে আসাদ ভাই। অবশ্যই দেখবে।

আমার পকেটে একটা চিঠি আছে। আমি আমার বউকে লিখেছি। তুমি তার কাছে পৌঁছায়া দিও।

আমি বললাম, দিব আসাদ ভাই।

তারপর আসাদ ভাই চোখ বন্ধ করে আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে গেলেন। আমি আসাদ ভাইয়ের হাত ধরে রাখলাম কিন্তু আসাদ ভাই আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন।

ইদরিস মিয়া তার কাহিনী শেষ করে কিছুক্ষণ চুপ কওে বসে রইল। তারপর তার পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে ওদের দিকে এগিয়ে ধরলেন। বললেন, এই যে চিঠিটা। চৌত্রিশ বছর থেকে আমি বাঁচায়ে রাখছি। চিঠির সাথে কোনো ঠিকানা ছিল না তাই আসাদ ভাইয়ের পরিবারের কাছে পৌঁছাতে পারি নাই। অনেক চেষ্টা করেছিলাম কাউরে খুঁজে পাই নাই। তোমরা তোমাদের নানির কাছে কিংবা দাদির হাতে দিও।

রিতু চিঠিটা হাতে নিল, বলল, দিব।

ইদরিস মিয়া বলল, আমার দায়িত্ব আজকে শেষ হলো।

১৩. যখন জন্মদিনের উপহার

১৩. যখন রাহেলা খাতুনকে তার জন্মদিনের উপহার দেওয়া হলো।

রাহেলা আমার আদরের রাহেলা

তুমি এই চিঠি পড়ছ তার মানে কী জান? তার মানে হচ্ছে আমি আর বেঁচে নাই। তার মানে হচ্ছে এই পৃথিবীতে তুমি একলা। দেশটা কী স্বাধীন হয়েছে? মনে হয় হয়েছে। এই দেশ স্বাধীন না হয়ে যায় না। তোমার পেটে যে বাচ্চাটা ছিল তার কী জন্ম হয়েছে? তার কী নাম রেখেছ?

মাসুদ, মিলি আর মতিন কতো বড় হয়েছে? মিলিটা কিন্তু খুবই দুষ্টু, তারে একটু দেখে শুনে রেখো।

তোমার নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট হচ্ছে। একলা একলা তুমি কেমন করে সংসার চালাবে? আমার ছেলেমেয়েগুলোরও নিশ্চয়ই কষ্ট হচ্ছে। ওদেরকে বলো এই দেশের মানুষের অনেক কষ্ট হয়েছে। রাহেলা তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না আমি কী দেখেছি। ছেলেমেয়েগুলোর তুমি মানুষ করো ওদেরকে বলল ওরা যেন তার বাপকে মাপ করে দেয়। আমি জানি কষ্ট হলেও তুমি আমার ছেলেমেয়েগুলোর মানুষ করবা। তোমার অনেক তেজ আছে আমি জানি। ছেলেমেয়েরা যখন বড় হবে তাদের বিয়েশাদী হবে বাচ্চা কাচ্চা হবে তাদের আর কষ্ট করতে হবে না। তখন দেশ স্বাধীন থাকবে। থাকবেই থাকবে।

রাহেলা গো রাহেলা। তোমার কথা খালি মনে হয়। আমি ভুলতে পারি না। খালি মনে হয় যদি এক হাতে বাচ্চাগুলোরে আরেক হাতে তোমারে একবার ধরতে পারতাম তাহলে আর কিছুর দরকার নাই। কিছুর দরকার নাই।

খোদা আমারে আগে নিয়া গেল। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব। তুমি আস। ধীরে সুস্থে আস। বাচ্চাগুলোরে বড় করো। নাতি-নাতনিদের সাথে থাকো। তারপর যখন সময় হবে তখন আসো আমার কাছে। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব। তোমার সাথে আমার কতো কী বলার আছে। তোমারও নিশ্চয়ই আমারে কতো কী বলার আছে। আছে না?

ভালো থেকো ভালো থেকো ভালো থেকো।

সবাইরে নিয়ে ভালো থেকো।

দেশটারে নিয়ে ভালো থেকো। দেশের মাটিটারে নিয়ে ভালো থেকো।

আসাদ

.

রাহেলা খাতুন চিঠিটা পড়ে সেটা খুব সাবধনে সেটার ওপর হাত বুলালেন, যেন এটা একটা জীবন্ত মানুষ। যেন এটাকে আদর করা যায়। বুকে চেপে ধরা যায়। চিঠির এক কোণায় কালচে রং। একসময় এটা নিশ্চয়ই রক্তের দাগ ছিল এতদিনে বিবর্ণ হয়ে কালচে হয়ে গেছে। রাহেলা খাতুন সেই রক্তের চিহ্নটার ওপর হাত বুলালেন। তারপর খুব সাবধানে চিঠিটা ভাজ করলেন, প্লাস্টিকের প্যাকেটের ভেতর ঢোকালেন। তারপর খুব সাবধানে আসাদ রহমানের কবরের সবুজ ঘাসের উপর রাখলেন। তারপর শাড়ির আঁচলটা টেনে এনে নিজের সুখ ঢাকলেন তারপর আকুল হয়ে কাঁদতে লাগলেন।

তার পাঁচ নাতি-নাতনি তার চারপাশে বসে আছে। তারা কখনো তাদের দাদিকে তাদের নানিকে কাঁদতে দেখে নাই। তাদের হাসি খুশি দাদি, হাসি খুশি নানির চোখে যে পানি আছে তারা কখনো সেটা জানতো na। রিতু তিতু টিটন টিয়া আর দুষ্টু মিঠুন শক্ত করে রাহেলা খাতুনকে ধরে রাখল।

নদীর তীরে তখন অনেক মানুষ। অনেক অনেক মানুষ। তারা সবাই আসতে চায়। মাস্টার সাহেব তাদের ঠেকিয়ে রেখেছেন। এখন শুধু তার আপন জনেরা এখানে। রাহেলা খাতুন তার ছেলেমেয়ে, তার বউ জামাই তার নাতি-নাতনি।

আসাদ রহমানের কবরের ওপর একটা বকুলগাছ। বাতাসে তার পাতাগুলো নড়ছে। টুপ করে একটা ফুল কবরের ওপর ঝরে পড়ল। যেন একজনের এক ফোঁটা চোখের পানি। কার চোখের পানি?

Exit mobile version