Site icon BnBoi.Com

আমার সাইন্টিস মামা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

আমার সাইন্টিস মামা - মুহম্মদ জাফর ইকবাল

০১. শব্দটা হচ্ছে সায়েন্টিস্ট

০১.

আমার মামা হচ্ছেন একজন সাইন্টিস-জানি, জানি শব্দটা সাইন্টিস না, শব্দটা হচ্ছে সায়েন্টিস্ট-বাংলায় বৈজ্ঞানিক। কিন্তু বৈজ্ঞানিক বললে কেউ তার মানে বুঝতে পারে না, সায়েন্টিস্ট বললে সবাই ঘাবড়ে যায়। শর্টকাটে সাইন্টিস বললে সবাই বুঝতে পারে, মাথা নাড়ে, চোখ বড় বড় করে বলে, ‘ও, আচ্ছা! তাই নাকি। ইন্টারেস্টিং।’ সেই জন্যে কারো কাছে মামার পরিচয় দিতে হলে আমি সব সময় বলি সাইন্টিস।

যাই হোক, যারা কখনো সাইন্টিস কিংবা সায়েন্টিস্ট দেখে নাই তাদের কাছে মনে হতে পারে তারা হয় বুড়ো, তাদের মাথায় থাকে বড় বড় এলোমেলো পাকা চুল এবং বড় বড় গোঁফ। তাদের নাকের উপর থাকে গোল গোল চশমা, তারা হয় খুবই ভুললামনের এবং তাদের পরনে থাকে ভুসভুসে ময়লা কাপড়। শার্টের বোতাম লাগায় উল্টাপাল্টাভাবে, জুতোর ফিতা থাকে ভোলা এবং দুই পায়ের মোজা হয় দুই রংয়ের। কিন্তু আমার মামা মোটেও সেই রকম না, আমার মামার বয়স কম, গোঁফ নাই, স্টাইলের চুল এবং সব সময় জিন্স আর টি শার্ট পরে থাকে। তার পায়ে দামি কেডস। মামা মোটেও ভুলো মনের মানুষ না, তার সবকিছু মনে থাকে-এক কথায় একেবারে টনটনে ব্রেন। মামা হাসিখুশি মানুষ, সবাইকে নিয়ে মজা করে, গল্প করে, সখ করে খায়। মামার সমস্যা একটাই সেটা হচ্ছে বিজ্ঞান নিয়ে কিছু একটা প্রশ্ন করলেই মামা তখন নিজেকে সামলাতে পারে না। সেটা নিয়ে কথা বলতে বলতে কান ঝালাপালা করে দেয়। সেইজন্যে আমরা কখনো মামাকে বিজ্ঞান নিয়ে কোনো প্রশ্ন করি না, ভুলেও জিজ্ঞেস করি না মামা কী করে। তার কথাবার্তা থেকে বোঝার চেষ্টা করি মামা কী রকম সাইন্টিস বা সায়েন্টিস্ট।

কিন্তু কিছু সায়েন্টিস্ট আছে তারা ল্যাবরেটরির অন্ধকার ঘরের ভিতর কোনো একটা যন্ত্রের পিছনে পড়ে থাকে। দিনের পর দিন রাতের পর রাত কুঁজো হয়ে তারা সেই যন্ত্র নিয়ে কাজ করে। কোনো কোনো সায়েন্টিস্ট একটা কম্পিউটারের পিছনে বসে থাকে, রাগী রাগী চেহারা নিয়ে ভুরু কুচকে কম্পিউটারের মনিটরের ছোট ছোট বিন্দি বিন্দি লেখার দিকে তাকিয়ে থাকে। কী দেখে তারাই জানে। আবার কোনো কোনো সায়েন্টিস্ট (কিংবা সাইন্টিস!) কাগজ আর পেন্সিল নিয়ে বসে থাকে, কাগজে এক লাইন লিখে তারপর পেন্সিলের গোড়া চাবাতে থাকে, চাবাতে চাবাতে মাঝে মাঝে পেন্সিলের অর্ধেক খেয়েই ফেলে!

কিন্তু আমার মামা সম্পূর্ণ অন্যরকম সাইন্টিস (কিংবা সায়েন্টিস্ট!)। মামা একটা প্রজেক্ট থেকে বেশ কিছু টাকা পেয়েছে (প্রজেক্ট বিষয়টা কী, সেটা থেকে কেমন করে একজন টাকা পায় আমি সেটা জানি না। কাজকর্ম না করে সবাই প্রজেক্ট কেন করে না, টাকা কেন পায় না আমি সেটাও জানি না।) মামা কত টাকা পেয়েছে সেটা জিজ্ঞেস করলে মামা বলে অনেক টাকা (অনেক টাকা মানে কতো টাকা সেটাও আমি জানি না, মামা সেটা আমাদের পরিষ্কার করে কিছু বলে না।) সেই টাকা দিয়ে প্রথমে মামা বড় একটা মাইক্রোবাস কিনেছে, এর ভিতরে পনেরোজন আরাম করে বসতে পারে। রিকন্ডিশনড না, নতুন মাইক্রোবাস। কিন্তু মামা সেই মাইক্রোবাসে পনেরোজনকে কোনোদিন বসানোর চেষ্টা না করে সামনের দুইটা সিট রেখে পিছনের সব সিট খুলে ফেলে দিয়েছে। (আসলেই ফেলে দিয়েছে, ফেলে না দিয়ে আমাদের দিয়ে দিলে আমরা সেগুলো দিয়ে খেলতে পারতাম!) তখন মাইক্রোবাসের পিছনে যে একটা ঘরের মতো খালি জায়গা হয়েছে, সেখানে একটা টেবিল আর একটা ছোট বাথরুম ফিট করেছে। দেওয়ালে একটা ফোল্ডিং বিছানা রেখেছে, টান দিলেই ঘুমানোর জায়গা হয়ে যায়। গাড়ির দেওয়ালে একটা মাইক্রোওয়েভ ওভেন ফিট করেছে। গাড়ির বাকি জায়গায় অনেক রকম যন্ত্রপাতি, সেগুলো কী আমি জানি না। দেখে মনে হয় একটা সাইন্স ফিকশনের সিনেমার দৃশ্য। বসার জন্য ছোট ছোট চেয়ার আছে সেই চেয়ারে বসে মামা সেই সাইন্স ফিকশনের যন্ত্রপাতি দিয়ে কাজ করতে পারে। যন্ত্রপাতি চালানোর জন্য ইলেকট্রিসিটি লাগে, সেই ইলেকট্রিসিটির জন্য অনেকগুলো বড় বড় ব্যাটারি আছে, সেই ব্যাটারি চার্জ করার জন্য ছোট একটা জেনারেটর (সেই জেনারেটর যখন চালানো হয় তখন বিকট ভট ভট শব্দ হয়, এটা ছাড়া অন্য সব যন্ত্রপাতি নিঃশব্দ!) তবে মামা যখন কাজ করে তখন বড় বড় ব্যাটারির ইলেকট্রিসিটি দিয়ে কাজ করে তাই জেনারেটরের শব্দ শুনতে হয় না।

আমি জানি, যারা এইটুকু শুনেছে তারা মনে মনে ভাবছে, বাহ! কী অসাধারণ। কিন্তু আসল জিনিসটাই এখনো বলাই হয় নাই। আমার মামা সেই মাইক্রোবাসটা নিয়ে সারা দেশে ঘুরে বেড়ায়। মামার কোনো ড্রাইভার নাই, মামা নিজেই গাড়ি চালায়। মামা গাড়িতে থাকে, গাড়িতে ঘুমায়, গাড়িতে রান্না করে, গাড়িতে খায়। নির্জন কোনো নদীর তীরে গিয়ে গাড়িটা পার্ক করে তার যন্ত্রপাতি নিয়ে নেমে পড়ে, সেগুলো নিয়ে নদীর তীরে বালুর মাঝে বসিয়ে কী কী জানি করে। মাঝে মাঝে নদীর তীরে গর্ত করে সেখান থেকে বালু তুলে এনে গাড়িতে বসে বসে কী যেন পরীক্ষা করে। আমরা সেটা জানি না। ভয়ে ভয়ে এক দুইবার মামাকে জিজ্ঞেস করে দেখেছি মামা ঠিক করে বলে না। বিজ্ঞানের অন্য যে কোনো জিনিস জিজ্ঞেস করলে কথা বলতে বলতে মাথা খারাপ করে দেবে সেই জন্যে আমরা ভয়ের চোটে মামাকে বেশি কিছু জিজ্ঞেস করি না! দেশের নানান জায়গা ঘুরে ঘুরে মামা মাঝে মাঝে মানুষজনের মাঝে ফিরে আসে তখন মামার সাথে আমাদের দেখা হয়। তখন মামা কোথায় কোথায় গিয়েছে, কোথায় কোথায় থেকেছে সেগুলো নিয়ে গল্প করে। যন্ত্রপাতি নিয়ে কী করছে সেইটাও মাঝে মাঝে বলার চেষ্টা করে কিন্তু আমরা সেটা বুঝি না বলে শুনতে চাই না। অন্য কিছু নিয়ে আলাপ শুরু করে দিই!

মামা যখন আমাদের বাসায় আসে তখন আমাদের আম্মু ভালো ভালো খাবার রান্না করেন। পাহাড়ে, নদীতে, জঙ্গলে মামা ঠিক করে খেতে পারে না তাই মামা খুব সখ করে কয়েকদিন খায়। রাত জেগে তার কম্পিউটারে কাজ করে তারপর হতাশার মতো করে মাথা নাড়ে। মামার ভাব-ভঙ্গী দেখে মনে হয় মামা কিছু একটা সারা দেশে খুঁজে বেড়াচ্ছে সেটা পাচ্ছে না! মনে হয় গুপ্তধনের মতো কিছু একটা হবে কিন্তু গুপ্তধন খোঁজার জন্য কী আর এরকম সায়েন্স ফিকশানের যন্ত্রপাতি লাগে? সিনেমায় দেখেছি গুপ্তধন খোঁজার জন্য দরকার শুধু একটা ম্যাপ আর একটা পুরানা আমলের কম্পাস!

মামা শেষবার যখন এসেছে তখন একদিন ডাইনিং টেবিলে বসে বসে আমার আম্মু আর আব্বুর সাথে কথা বলছিল। আমরা ছোট বলে বড়দের কথা বলার সময় সেখানে থাকার নিয়ম নাই তাই আমি কাছাকাছি একটা সোফায় বসে গোপনে তাদের কথা শোনার চেষ্টা করছিলাম। আমার হাতে একটা বই, ভান করছি বই পড়ছি, আসলে পড়ছি না। বড়রা যখন কথা বলে তখন তার মাঝে অনেক ইন্টারেস্টিং কথা থাকে। অনেক সময় তারা আমাদের অন্য আত্মীয়স্বজন নিয়ে কূটনামি করে, খারাপ খারাপ কথা বলে, শুনতে বেশ মজা লাগে। (আমরা নিজেরা যদি অন্যদের নিয়ে খারাপ কথা বলি তখন কিন্তু তারা আমাদের বকাবকি করে।)

সোফায় বসে শুনলাম মামা বলছে, “বুঝলে আপা আর দুলাভাই, শেষবার যখন গিয়েছি একটা নদীর তীরে ক্যাম্প করে আছি, পূর্ণিমার রাত আকাশে একটা ইয়া বড় চাঁদ উঠেছে, জোছনায় চারিদিক থই থই করছে। একটা মানুষ নাই, শুধু দূর থেকে মাঝে মাঝে শিয়াল ডাকছে। আমি আমার কাউন্টারের পাশে বসে আছি, কুয়াশায় যেন ভিজে না যায় সেজন্য একটা পলিথিন দিয়ে ঢেকে রেখেছি। হঠাৎ শুনি পায়ের শব্দ। আমি চমকে উঠলাম, ভাবলাম এতো রাতে কে যায়? তাকিয়ে দেখি একটা মেয়ে একা একা হেঁটে হেঁটে নদীর দিকে যাচ্ছে। নদীর তীরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল, বাতাসে চুল উড়ছে, শাড়ীর আঁচল উড়ছে জোছনার আলোতে মনে হচ্ছে একটা অশরীরি প্রাণী! আকাশ থেকে নেমে আসা পরী!”

আম্মু বললেন, “সর্বনাশ! ভয় লাগে নাই তোর?”

মামা বলল, “ভয়? ভয় কেন লাগবে?”

“জীন ভূত কিছু যদি হয়।”

মামা হাসল, বলল, “না আপা! জীন ভূতে আমার কোনো ভয় নাই। একটা যদি পেয়ে যেতাম, ধরে বোতলে ভরে নিয়ে আসতাম এক ধাক্কায় ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি আর লাইফ সাইন্সে এক সাথে তিনটা নোবেল প্রাইজ।”

আব্বু বললেন, “তারপর কী করল সেই মেয়ে।”

“নদীর উঁচু তীর থেকে পানিতে ঝাঁপ দিল!”

আব্বু চমকে উঠলেন, “পানিতে ঝাঁপ দিল? সুইসাইড?”

মামা বলল, “প্রথমে আমিও তাই ভেবেছিলাম। ছুটে দিয়ে মেয়েটাকে পানি থেকে টেনে তুলব কি না চিন্তা করছিলাম, তখন শুনলাম মেয়েটা গান। গাইছে।”

“গান গাইছে?”

“হ্যাঁ। গভীর রাতে কনকনে ঠান্ডা পানিতে একটা মেয়ে নদীতে সাঁতার কাটছে আর গান গাইছে। একেবারে অলৌকিক একটা দৃশ্য।”

আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “তারপর কী হলো?”

“একসময় মেয়েটা পানি থেকে উঠে এলো। তারপর ভিজে শাড়িতে সপ সপ শব্দ করে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। আমার কী হলো কে জানে, জোছনা রাতের মনে হয় এক ধরনের এফেক্ট আছে, আমি মেয়েটার পথ আটকে দাঁড়ালাম।”

আম্মু বললেন, “তুই মাঝ রাতে একটা মেয়ের পথ আটকে দাঁড়ালি? তোর মাথা খারাপ?”

মামা বলল, “শোন না আগে, কী হলো। মেয়েটা ভয়ে না চিৎকার করে দেয় সেই জন্য বললাম, তুমি ভয় পেয়ো না মেয়েটা কী বলল জান?”

“কী বলল?”

“বলল, ভয় পাব কেন? আপনাকে ভয় পাবার কী আছে? আমি অবাক হয়ে বললাম, তুমি আমাকে চিন? মেয়েটা বলল, চিনব না কেন? রাত বিরাতে যন্তরের সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেন আপনারে চিনব না! তারপর কী বলল জান?”

আম্মু বললেন, “কী বলল?”

“বলল, একটা বিয়া করেন। তাহলে রাত বিরাতে বউয়ের সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে পারবেন। যন্তরের সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে হবে না।”

মামার কথা শেষ হবার আগেই আব্বু আর আম্মু শব্দ করে হেসে উঠল, আমিও হাসলাম কিন্তু গোপনে।

আমি যে তাদের কথা শুনছি না আপন মনে নিজের বই পড়ছি সেটা বোঝানোর জন্য গলা উঁচিয়ে বললাম, “কী হয়েছে আম্মু? তোমরা হাসছ কেন?”

আম্মু বললেন, “কিছু না, কিছু না।”

মামা বলল, “এই, এমনিই হাসছি।”

আমি আবার সহজ সরল বোকাসোকা মানুষের ভান করে বইয়ের দিকে তাকিয়ে কান খাড়া করলাম। শুনলাম, আম্মু বললেন, “মেয়েটা তো ভুল কিছু বলে নাই। ঠিকই বলেছে। তোর তো আসলেই একটা বিয়ে করা দরকার।”

মামা বলল, “আমাকে কে বিয়ে করবে?”

আব্বু বললেন, “পছন্দের কেউ থাকলে আমাদের বল আমরা প্রস্তাব নিয়ে যাই।”

“ঠিক আছে দুলাভাই, যদি থাকে আপনাদের জানাব।”

আমি আবার বইয়ের আড়ালে মুখ টিপে হাসলাম। বড়রা জানে না কিন্তু আমরা ঠিকই জানি আমার পছন্দের একজন মেয়ে আছে, নাম মেহরিন, ইউনিভার্সিটির টিচার। এইখানে আমাদের একটু খানি আপত্তি আছে, টিচার মানেই রাগী রাগী চেহারার কড়া টাইপ মহিলা। মামাকে যে বিয়ে করবে তার হওয়া উচিত হাসি খুশি মজার একটি মেয়ে। টিচার মানেই বিভীষিকা।

আমি আবার কান খাড়া করলাম। শুনলাম আব্বু বলছেন, “রাত বিরেতে রোমান্টিক সেটিংয়ের একটা মেয়ে ঠিক আছে কিন্তু তুমি কেমন করে জান কোনো একদিন একটা ক্রিমিনাল এসে হাজির হবে না, কিছু একটা করে ফেলবে না।”

মামা বলল, “না দুলাভাই ভয়ের কিছু নাই। আমাকে কেউ কিছু করবে না। আমি যখনই কোথাও যাই লোকাল অথরিটি সেটা জানে। আমাকে প্রটেকশন দেয়। আমি নিজেও রেডি থাকি।”

“তুমি কীভাবে রেডি থাক?”

মামা এবারে পিছনে ফিরে আমার দিকে তাকাল, আমি তাদের কথা শুনছি কি না সেটা লক্ষ করল। আমি তখন বইয়ের দিকে আরো বেশি নজর দিয়ে চেহারার মাঝে একটা ভ্যাবলা ভাব ফুটিয়ে একেবারে শুয়ে পড়ার ভান করে বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকি।

মামা গলা নামিয়ে বলল, “আমি সবসময় সাথে একটা হ্যান্ডগান। রাখি।” এবারে কথাটা শুনতে একটু কষ্ট হলো তারপরও শুনতে পেলাম।

আব্বু গলা নামিয়ে বললেন, “হ্যান্ড গান? মানে রিভলবার?”

“পিস্তল।”

আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “রিভলবার আর পিস্তলে পার্থক্য কী?”

মামা গলা নামিয়ে বলল, “রিভলবারে গুলির ম্যাগাজিনটা রিভলব করে, মানে ঘুরে। পিস্তলে ম্যাগাজিন আলাদা।”

আম্মু ভয়ে ভয়ে বলল, “সর্বনাশ! তুই অস্ত্র নিয়ে ঘুরিস, সন্ত্রাসীদের মতো?”

মামা হাসল, বলল, “সন্ত্রাসী হব কেন? লাইসেন্স করা হ্যান্ডগান। নিজের প্রটেকশনের জন্য রাখি।”

“কোথায় রাখিস?”

“আছে আমার সাথে।”

আম্মু বললেন, “দেখি।”

মামা এবং আব্বু আম্মু আবার পিছনে ফিরে দেখলেন আমি কী করছি। আমি এবারে প্রায় গড়িয়ে পড়ার ভান করে বইয়ে আরো বেশি মনোযোগ দিয়ে চোখের কোণা দিয়ে তাকালাম। সরাসরি না তাকিয়েও যে চোখের কোণা দিয়ে সবকিছু পরিষ্কার দেখা সম্ভব বড় মানুষেরা সেটা জানে না দেখে আমি খুবই অবাক হলাম! মানুষের জন্মের সময় মাথা ভরা বুদ্ধি থাকে, যতই বড় হয় সেই বুদ্ধি উড়ে উড়ে মানুষ বোকা হতে থাকে। যত বড় তত বোকা!

স্পষ্ট দেখলাম মামা খুব সাবধানে ডান হাত দিয়ে বাম হাতের নিচে কোথা থেকে একটা কালো রংয়ের পিস্তল বের করে টেবিলে রাখল। কী অসাধারণ একটা পিস্তল। ইশ! আমার যদি এরকম একটা পিস্তল থাকতো! এতোদিন মামাকে সায়েন্টিস্ট হিসেবে কোনো পাত্তা দেই নাই, সবসময়ই মনে হয়েছে অকাজের একটা মানুষ। কিন্তু যে মানুষ বগলের কাছে একটা পিস্তল নিয়ে ঘুরে তার থেকে অসাধারণ মানুষ আর কে হতে পারে? একেবারে সিনেমার নায়কের মতো।

আম্মু ফিসফিস করে বললেন, “গুলি বের হয়ে যাবে না তো।”

মামা বলল, “না, সেফটি ক্যাচ অন করা আছে।”

“কয়টা গুলি আছে?”

“আটটা।”

মামা মনে হয় পিস্তলটা খুলে গুলি বের করে দেখাল।

এবারে আব্বু ফিসফিস করে কিছু একটা বললেন, এতো আস্তে বললেন যে আমি শুনতে পারলাম না। বুঝতে পারলাম এখন আমার আবার কথা বলা দরকার। হঠাৎ করে সোজা হয়ে বসে বইটা নামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আম্মু! আব্বু!

মামা তখন রীতিমতো ঝাঁপিয়ে পড়ে তার পিস্তলটা দুই হাত দিয়ে ঢেকে ফেলল।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তোমরা কী নিয়ে কথা বলছ?”

আম্মু শক্ত গলায় বললেন, “আমরা যেটা ইচ্ছা সেটা নিয়ে কথা বলব। তোর সমস্যাটা কী?”

“না। সমস্যা নাই। কিন্তু–”

“কিন্তু কী?”

“তোমরা এতো ফিসফিস করে কথা বলছ তাই জানতে চাচ্ছিলাম কী নিয়ে কথা বলছ।”

আব্বু বললেন, “টোপন, তোর বড়দের কথা জানার কোনো দরকার নাই। যা, অন্যদের সাথে খেল গিয়ে।”

কাজেই আমি মুখে চরম একটা বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে বইটা হাতে নিয়ে ডাইনিং রুম থেকে বের হয়ে এলাম। বের হয়ে শুনলাম আম্মু আমাকে নিয়ে কোনো একটা মন্তব্য করলেন। কী মন্তব্য করলেন বুঝতে পারলাম না শুধু নিজের নামটা শুনতে পেলাম।

আমার নাম হচ্ছে টোপন। পৃথিবীতে নাকি সাতশ কোটি মানুষ, সাতশ কোটি মানুষের সাতশ কোটি নাম। এই সাতশ কোটি মানুষের সাতশ কোটি নামের ভিতরে খুঁজে খুঁজে আমার আব্বু আম্মু আমার জন্য এর থেকে ভালো কোনো নাম খুঁজে পেল না? টোপন একটা নাম হলো? যতদিন ছোট আছি টোপন নামটা সহ্য করা যায়। যখন বড় হব তখন যদি কেউ এই নামটা জেনে যায় তখন কী হবে?

আমি ঠিক করেছি মরে গেলেও বিয়ে করব না। (মানুষ কেমন করে বিয়ে করে কে জানে?) ভাগ্যিস কোনোদিন বিয়ে করব না, যদি করতাম তাহলে আমার ছেলে মেয়ে হতো, তারা জানতো তাদের বাবার নাম হচ্ছে টোপন। কী লজ্জার একটা ব্যাপার হতো।

.

আমি বিয়ে না করলেই যে বিপদ কেটে যাবে সেটা পুরোপুরি ঠিক না। আমার একটা বোন আছে, নাম রত্না এবং একটা ভাই আছে নাম মিঠুন তারা নিশ্চয়ই বিয়ে করে ফেলবে। তাদের নিশ্চয়ই বাচ্চা কাচ্চা হবে সেই বাচ্চা কাচ্চারা আমাকে হয় টোপন মামা নাহলে টোপন চাচা ডাকবে। যদি একটু নেকু টাইপ হয় তাহলে হয়তো টোপন চাচ্চু ডাকবে কী ভয়ংকর শোনাবে। সর্বনাশ!

যাই হোক এগুলো নিয়ে পরে দুশ্চিন্তা করা যাবে, আমি আপাতত বসার ঘরে ঢুকলাম। আপু সামনে টেবিলে পা তুলে সোফায় বসে আছে। আমি যদি কখনো টেবিলে পা তুলে বসি আপু মুখ শক্ত করে বলে, ‘এই টোপন। পা নামিয়ে বস। আপুর অবশ্যি মুখ শক্ত করতে বেশি কষ্ট করতে হয় না, এমনিতেই তার মুখটা শক্ত, দেখে মনে হয় পেট ব্যথা করছে না হয় কান পেকেছে। আমি ভাবলাম একবার বলি, “আপু পা নামিয়ে বস। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বললাম না। বড় বোনদের কারণে এমনিতেই ছোট ভাইদের জীবনে কতো রকম যন্ত্রণা, এই যন্ত্রণার মাঝে নূতন করে আগুন জ্বালিয়ে লাভ নাই। কিন্তু আরেকটা ইন্টারেস্টিং কাজ করা যায়!

আমি সোফায় বসে আপুর মতো টেবিলে পা তুলে দিলাম। আপু চোখের কোণা দিয়ে আমার দিকে তাকাল কিন্তু কিছু বলতে পারল না, নিজে টেবিলের উপর পা তুলে রেখে আমাকে কেমন করে পা নামাতে বলে। আমিও চোখের কোণা দিয়ে আপুর দিকে তাকালাম। হাতে একটা ইংরেজি বই কেন তার ভাব দেখানোর জন্য ইংরেজি বই নিয়ে বসতে হবে কে জানে।

আমি আমার বইটা খুলে বসলাম, এতক্ষণ বইটা খুলে বই পড়ার ভান করছিলাম এখন আসলেই পড়া যেতে পারে। ভয়ংকর একটা রহস্যোপন্যাস। প্রতি পৃষ্ঠায় একটা করে খুন হচ্ছে। আর কী বীভৎস সেই খুন পড়লেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠে। আমি পড়তে শুরু করলাম। বইটাতে যখন আরো দুইটা নতুন খুনের বর্ণনা শেষ করেছি তখন মিঠুন এসে ঢুকল। সে এই বাসার সবচেয়ে ছোট সেই জন্য তার আদর সবচেয়ে বেশি। বেশি আদরের কারণে সে ভয়ংকর একজন নেকু বাচ্চা হিসেবে বড় হচ্ছে। তার হাতে একটা খেলনা ব্যাটম্যান। আমার কাছে এসে তার নেকু নেকু গলায় বলল, “ভাইয়া, কে বেশি পাওয়ারফুল, ব্যাটম্যান নাকি স্পাইডারম্যান?”

ন্যাকামি দেখে মরে যাই! ইচ্ছা হলো কান ধরে একটা ঝাঁকুনি দেই কিন্তু আপুর কাছে বসে বসে সেটা তো আর করতে পারি না তাই মুখ গম্ভীর করে বললাম, “ব্যাটম্যানও না স্পাইডারম্যানও না। সবচেয়ে বেশি পাওয়ারফুল হচ্ছে চিকাম্যান।”

“চিকাম্যান?” মিঠুন অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল।

“হ্যাঁ। চিকা দেখিস নাই, চিকা? এই মোটা মোটা, ভোটকা ভোটকা? ইন্দুরের মতো। সেই চিকাম্যান।”

মিঠুন কেমন যেন অবাক হয়ে বলল, “চিকাম্যানের নাম কখনও শুনি নাই।”

“কীভাবে শুনবি। এটা থাকে কুড়িল বস্তিতে। এটা তো আর ব্যাটম্যান আর স্পাইডারম্যানের মতো আমেরিকায় থাকে না”।

গাধাটার কিছুক্ষণ লাগল বুঝতে যে আমি ইয়ারকি করছি। যখন বুঝল তখন আঁ আঁ করে কাঁদার মতো একটা ঢং করে গেল আপুর কাছে, গিয়ে নালিশ করল, “আপু দেখো ভাইয়া আমার সাথে ঠাট্টা করে। আঁ আঁ “

আমি বললাম, “ঠাট্টা? আমি কখন ঠাট্টা করলাম?”

মিঠুন বলল, “আঁ আঁ আঁ–”

আপু তখন তার কঠিন মুখটাকে আরেকটু কঠিন করার চেষ্টা করে বলল, “দেখ টোপন, কাজটা ভালো হচ্ছে না। মিঠুন ছোট একজন মানুষ তাকে নিয়ে এভাবে ইয়ারকি করছিস কেন? একটা প্রশ্ন করেছে ঠিক করে তার উত্তর দে”

‘“আমি ঠিক করেই উত্তর দিয়েছি। সবচেয়ে পাওয়ারফুল হচ্ছে চিকাম্যান। চিকা একটা ব্যাটকেও খপ করে কামড় দিতে পারে স্পাইডারকেও পারে”

“খবরদার টোপন ঢং করবি না। ছোট একজন বাচ্চাকে এভাবে টিজ করতে হয় না।”

“ছোট? মিঠুনের বয়স হয়েছে আট। আট বছর বয়সে আমি ওয়ার এন্ড পিস পড়েছি।”

আসলে পড়ি নাই, কিন্তু কথা বলার সময় একটু বাড়িয়ে চাড়িয়ে বলতে হয়। আপু সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকাল, চোখ ছোট ছোট করে বলল, “তুই ওয়ার এন্ড পিস পড়েছিস?

“পুরাটা শেষ করতে পারি নাই।” কথাটা একেবারে মিথ্যা না। আসলে মনে আছে বইটা উল্টে পাল্টে দেখে ভাবছিলাম কোন পাগল এরকম মোটা বই লিখতে পারে আর কোন বোকা এটা পড়তে পারে। কিন্তু সেটা আর বললাম না।

আপু হাল ছেড়ে দিয়ে মিঠুনকে আদর করে বলল, “আস ভাইয়া আমার কাছে। টোপন তোমার সাথে ঠাট্টা করছে। চিকাম্যান বলে কেউ নাই।”

“ভাইয়া সব সময় আমাকে জ্বালায়।”

“আমি জানি। টোপন হচ্ছে দুষ্টু, সেই জন্য জ্বালায়। তুমি কখনো দুষ্টু হবে না। তুমি হবে গুডি বয়।”

আমি বললাম, “গুডি বয় বলে কোনো শব্দ নাই। শব্দটা গুড বয়। আর তোমার বলা উচিত নেকু বয়। ন একারে নে ক উকারে কু। নেকু।”

আপু চোখ লাল করে বলল, “চুপ করবি তুই? আম্মুকে বলে দেব কিন্তু।” আমি বুঝলাম আমার আর এখানে বসে থাকা ঠিক হবে না। তাই উঠে পড়লাম। ঘর থেকে বের হওয়ার আগে বললাম, “আরেকটা কথা আপু। তুমি যে ইংরেজি বইটা নিয়ে পড়ার ভান করছ, সেটা বানান করে পড়তে পড়তে তোমার কমপক্ষে দুই বছর লাগবে। তখন তোমার বয়স হবে ষোলো। বিয়ের বয়স। এখন থেকে একটা ছাগল টাইপের জামাই ঠিক করে রাখ।”

আপু রেগে মেগে লাফ দিয়ে উঠে বলল, “তবে রে বদমাইশ–”

আমি তখন এক লাফে অদৃশ্য হয়ে গেলাম। মিঠুনকে কাঁদিয়ে এবং আপুকে রাগিয়ে মনের ভিতরে একটা ফুরফুরে আনন্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে। একটা কাজের কাজ করতে পেরেছি।

এটা হচ্ছে আমার দৈনন্দিন জীবন। খারাপ না।

 ০২. সায়েন্টিস্টকে কে পাত্তা দেয়

০২.

এতোদিন মামাকে বেশি পাত্তা দেই নাই। কেন দিব? একজন সায়েন্টিস্টকে কে পাত্তা দেয়? ক্রিকেট প্লেয়ার হলে একটা কথা ছিল কিংবা ব্যান্ডের গায়ক। পুলিশ কিংবা র‍্যাব হলেও কথা ছিল, হাতে রাইফেল নিয়ে ঘুরে বেড়াতো। সায়েন্টিস্টদের মতো শান্তশিষ্ট ঢিলেঢালা নিরীহ মানুষদের কে পাত্তা দেয়? কিন্তু যখন আমি আবিষ্কার করলাম মামা তার বগলের নিচে একটা পিস্তল নিয়ে ঘুরে বেড়ায় তখন এক লাফে আমার কাছে মামার সম্মান একশ গুণ বেড়ে গেল। প্রথমবার মামাকে পাত্তা দিতে শুরু করলাম।

মামা আমাদের বাসায় কয়েকদিন থাকবেন, আমি এখন তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলাম। মামা যেন টের না পায় সেভাবে তাকে চোখে চোখে রাখলাম। মামা কী করে, কার সাথে কথা বলে কী নিয়ে কথা বলে, কম্পিউটারে কী টাইপ করে, কাগজে কী লিখে, কী কাগজ পড়ে, কি দেখে খুশি হয়, কী দেখে রাগ হয়, কখন দাঁত কিড়মিড় করে কখন নিজে নিজে হাসে এই সব কিছু দেখে দেখে আমি বুঝে গেলাম মামা আসলে কী করছে।

মামার কথাবার্তা কাগজপত্র কম্পিউটার স্ক্রিনে সবচেয়ে বেশি যে শব্দটা পাওয়া গেল সেটা হচ্ছে ‘ইউরেনিয়াম’। আগে হলে ভাবতাম ফজলী আম ল্যাংড়া আমের মতো ইউরেনিয়াম একধরনের আম। এবারে সেটা ভাবলাম না, একটু ঘাটাঘাটি করে বুঝতে পারলাম যে ইউরেনিয়াম মোটেও আম না, এটা হচ্ছে এক ধরনের মৌলিক পদার্থ (খোদাই জানেন তার মানে কী!) যেটা দিয়ে এটম বোমা বানায়। তখন হঠাৎ করে বুঝে গেলাম মামা কী করছে, মামা পুরো দেশ চষে ফেলছে এই দেশে ইউরেনিয়ামের খনি আছে কীনা সেটা দেখার জন্য। কীভাবে মামা সেটা দেখছে সেই কায়দাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না, এই ব্যাপারে যে বৈজ্ঞানিক শব্দটা ব্যবহার করছে সেটা হচ্ছে ‘গামা রে স্পেকট্রোস্কোপি উচ্চারণ করতেই দাঁত ভেঙে যায়। গামা রে ব্যাপারটা কী ঠিক বুঝতে পারলাম না তবে কিছুদিন আগে একটা দুর্ধর্ষ বই পড়েছিলাম সেখানে যে ভিলেন ছিল সে শত্রুকে হত্যা করতে ডেথ-রে দিয়ে। গামা রে ডেথ রে এর মতো ভয়ংকর কিছু হতে পারে। মনে হয় এক ধরনের অদৃশ্য আলো যেটা শরীর ফুটো করে চলে যেতে পারে।

মামা কী করছে জানার পর মামার সম্মান আমার কাছে আরো একশ গুণ বেড়ে গেল। মামা যদি আসলেই ইউরেনিয়ামের খনি পেয়ে যায় আর আমি যদি সেখান থেকে কয়েক কেজি সরিয়ে ফেলতে পারি তাহলে কী মজা হবে। তাহলে স্কুলের সায়েন্স ফেয়ারে আমি ছোটখাটো এটম বোমা বানিয়ে দেখাতে পারি। সত্যিকারের এটম বোমা বানাতে পারলে নির্ঘাত ফার্স্ট সেকেন্ড হয়ে যাব জীবনেও কোনোদিন কোনো কিছুতে পুরস্কার পাই নাই, সায়েন্স ফেয়ারে পুরস্কার পেলে আমার সম্মানটাও বেড়ে যাবে। আপু কথায় কথায় বলতে পারবে না, অকম্মার ধাড়ী!

.

মামা কয়েকদিন আমাদের বাসায় থেকে আবার তার ভ্রাম্যমাণ ল্যাবরেটরি নিয়ে বের হওয়ার জন্য রেডি হলো। আম্মু কিছু খাবার রান্না করে দিচ্ছেন। মামা জামা কাপড় ধুয়ে পরিষ্কার করে নিচ্ছে, তখন শুনলাম আব্বু মামাকে বলছেন, “আমার কী মনে হয় জান?”

মামা জিজ্ঞেস করল, “কী?”

“আমার মনে হয় তোমার সাথে আরো একজন থাকা উচিত। একেবারে একা একা থাকাটা ঠিক না।”

মামা হা হা করে হাসল, বলল, “আমার সাথে কে থাকবে? বনে জঙ্গলে খেয়ে না খেয়ে থাকতে হয়। মশার কামড় খেতে হয় স্লিপিং ব্যাগে ঘুমাতে হয়, সপ্তাহে একদিন গোসল–

আব্বু বললেন, “সে যাই হোক, তবু একেবারে একা থাকা ঠিক না। আর কিছু না হোক, কথা বলার জন্যও তো একজন লোক দরকার।”

মামা এবারে মুখ গম্ভীর করে বলল, “আসলে আমি নিজেও বিষয়টা ভেবেছি। একজন এসিস্টেন্ট থাকলে খারাপ হতো না। আমার প্রজেক্টে তার জন্য বাজেটও আছে, মাসে মাসে ভালো বেতন দিতে পারব। কিন্তু আমি ঠিক মানুষ খুঁজে পাচ্ছি না। এটা তো আর অফিস স্টাফ না যে কাগজপত্র টাইপ করে দেবে। এই মানুষটা চব্বিশ ঘণ্টা আমার এক দুই হাতের ভিতর থাকবে, ঠিক মানুষ না হলে আমার লাভের বদলে ক্ষতি হবে।”

আব্বু মাথা নাড়লেন, বললেন, “তা ঠিক তোমার আবার সায়েন্টিফিক ব্যাপার স্যাপারের প্রজেক্ট। টেকনিক্যাল মানুষ দরকার, যে এই সায়েন্স জানে। সেটা কোথায় পাবে? এরকম মানুষ পাওয়া মুশকিল।”

মামা বলল, “না দুলাভাই, আমার টেকনিক্যাল মানুষ দরকার নাই, আমার দরকার একজন চালাক চতুর মানুষ যে আমার সাথে থাকবে। সায়েন্টিফিক ব্যাপার স্যাপারগুলো আমি নিজেই দেখব, একজন এসিস্টেন্ট শুধু সাথে থাকবে টুকটাক সাহায্য করবে।”

মামা এই কথাটা বলার সাথে সাথে আমার ব্রেনের মাঝে চিড়িক করে একটা শব্দ হলো, আমার মনে হলো আমি কেন মামার এসিটেন্ট হয়ে যাই না! আমার পরীক্ষা শেষ, এখন স্কুলে যেতে হবে না বহুদিন, আমি যথেষ্ট চালাক চতুর (যদিও বেশির ভাগ মানুষ সেটা জানে না তাদের ধারণা আমি হাবা টাইপের, আমি নিজেও সেরকম ভান করি। আমার জঙ্গলে থাকতে কোনো আপত্তি নাই, আমাকে মশা কামড়ায় না, কামড়ালেও আমি টের পাই না। সপ্তাহে একদিন গোসল আমার মনের মতো কাজ, সত্যি বলতে কী মাসে একদিন গোসল করলেও আমার কোনো আপত্তি নাই, (আপু সবসময় বলে বেড়ায় আমি খবিস, খবিস মানে কী আমি জানি না। ভালো কিছু না এইটুকু আন্দাজ করতে পারি।) স্লিপিং ব্যাগে ঘুমাতে আমার আপত্তি নাই, যে কোনো জায়গায় যে কোনো সময়ে আমি যতক্ষণ ইচ্ছা ঘুমাতে পারি। মামার টুকটাক কাজ আমার থেকে ভালো করে কে করতে পারবে? কিন্তু সেটা সবাইকে কে বোঝাবে? কেমন করে বোঝাবে?

কাজেই আমি ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে শুরু করলাম। প্রথমে মামাকে বোঝাতে হবে যে আমি মামার এসিস্টেন্ট হতে পারব। যদি কোনোভাবে মামাকে বুঝাতে পারি তাহলে আম্মু আব্বুকে বোঝানো খুব কঠিন হবে না। আম্মু আব্বু যদি বুঝতে না চায় তাহলে টানা ঘ্যান ঘ্যান করে যেতে হবে। দরকার হলে আমি খুব ভালো ঘ্যান ঘ্যান করতে পারি।

হাতে সময় বেশি নাই তাই সেদিন বিকেল বেলাতেই মামা যখন একা। তার কম্পিউটারের সামনে মুখ বাঁকা করে বসে আছে তখন আমি হাজির হলাম। কোনো ধানাই পানাই করা যাবে না তাই আমি সোজাসুজি কাজের কথায় চলে এলাম, বললাম, “মামা, তোমার সাথে একটা কথা আছে।”

মামা এক নজর আমাকে দেখল, তারপর আবার কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে তার হাতের চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে বলল, “কী কথা?”

“তুমি তোমার সাথে কাজ করার জন্য একটা এসিস্টেন্ট খুঁজছ না? আমি তোমার এসিস্টেন্ট হতে চাই।”

মামা তার চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়ে একটা বিষম খেলো। কাপটা টেবিলে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে কাশতে কাশতে বলল, “অ্যাঁ?”

আমি দ্বিতীয়বার কথাটা বললাম। মামা আমার দিকে তাকিয়ে রইল তার চোখে কেমন জানি অবিশ্বাস। তারপর বলল, “তুই আমার এসিস্টেন্ট হতে চাস?”

“হ্যাঁ।” আমার কথায় যেন কেননা কিছু অস্পষ্ট না থাকে সেইজন্য পরিষ্কার করে বললাম, “আমি তোমার এসিস্টেন্ট হতে চাই।”

মামা আরো কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে তাকিয়ে রইল এবং এবারে তার মুখে কেমন এক ধরনের হাসি ফুটে উঠল। হাসিটা মোটেও ভালো টাইপের হাসি না। মামা বলল, “তোর কেন ধারণা হলো আমি একটা গেন্দা বাচ্চাকে আমার এসিস্টেন্ট হিসেবে নেব?”

আমি মুখটা যতটুকু সম্ভব গম্ভীর করে বললাম, “তার প্রথম কারণ হচ্ছে আমি মোটেও গেন্দা বাচ্চা না। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে আমি শুনেছি তুমি আব্বুকে বলেছ তোমার এসিস্টেন্ট হওয়ার জন্য টেকনিক্যাল হওয়ার দরকার নেই, চালাক চতুর হলেই হবে। আমি যথেষ্ট চালাক চতুর। তিন নম্বর কারণ হচ্ছে আমাকে নিলে তোমার বেতন দিতে হবে না। তুমি। চাইলে দিতে পার কিন্তু না দিলেও আমি কাজ করব। চার নম্বর কারণ হলো_”

মামা আমাকে বলল, “দাঁড়া আগে এই তিনটা কারণ ভালো করে বুঝে নিই। তুই গেন্দা বাচ্চা না তাহলে তোর বয়স কতো?”

“বারো। আর একটা বছর হলেই আমি টিন এজার হব। টিন এজাররা যথেষ্ট বড়। মানুষেরা টিন এজারদের রীতিমতো ভয় পায়।”

মামা কষ্ট করে মুখের হাসিটা গোপন করল, তারপর বলল, “আর চালাক চতুর তুই চালাক চতুর?”

হ্যাঁ।”

“কীভাবে জানিস?”

“প্রমাণ চাও?”

মামা এবারে একটু অবাক হলো। বলল, “তুই প্রমাণ দিতে পারবি?”

“তোমার পছন্দ হবে কি না জানি না, কিন্তু দিতে পারব।”

মামার মুখে সেই খারাপ টাইপের হাসিটা আবার ফেরত এলো, বলল, “দে দেখি।”

আমি বললাম, “যদি দেখাতে পারি আমি চালাক চতুর তাহলে আমাকে নিবে?”

“আগে দেখা।”

আমি গলা পরিষ্কার করে বললাম, “ঠিক আছে। তুমি কাউকে জানাতে চাও না কিন্তু আমি জানি তুমি একটা পিস্তল নিয়ে ঘুরে বেড়াও। রিভলবার না, পিস্তল। ম্যাগাজিনে আটটা গুলি আঁটে।”

মামার মুখের সেই খারাপ টাইপের হাসিটা অদৃশ্য হয়ে চোয়ালটা কেমন জানি ঝুলে পড়ল। আমি না দেখার ভান করে বললাম, “তুমি ঠিক কী কর সেটাও কাউকে জানাতে চাও না কিন্তু আমি জানি তুমি সারা দেশে ইউরেনিয়ামের খনি খুঁজে বেড়াও।” (মামার চোয়াল এবারে আরো খানিকটা ঝুলে পড়ল।) আমি না দেখার ভান করে বলতে লাগলাম, “ইউরেনিয়াম খুবই মূল্যবান ধাতু। এর একটা আইসোটপ হচ্ছে ইউরেনিয়াম টু থার্টি ফাইভ– এটা দিয়ে বোমা বানায়। (মামার সাথে কথা বলার জন্য এই লাইনটা মুখস্ত করে এসেছি!) তুমি সেই ইউরেনিয়ামের আইসোটপ খুঁজে বের করেছ গামা রে স্পেকট্রোস্কোপি দিয়ে।”

আমি মামার চোখের দিকে না তাকিয়ে বললাম, “তুমি যদি চাও তাহলে আমি গভীর রাত্রে একটা মেয়ে যে তোমাকে বিয়ে করার উপদেশ দিয়েছিল সেই ঘটনাটার কথা বলতে পারি। কিংবা মেহরিন ম্যাডামের কথা বলতে পারি?

এইবারে ফটাশ শব্দ করে মামার স্কুলে পড়া চোয়াল বন্ধ হয়ে গেল। মামা শুকনো গলায় বলল, “তু-তু-তুই কেমন করে জানিস?”

“চোখ কান খোলা রাখলে যারা চালাক চতুর তারা সেগুলো জেনে যায়। আমি জেনে গেছি। সবার সামনে ভান করি কিছুই জানি না। হাবা গোবা একজন মানুষ।

মামা কেমন করে জানি আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, “এখন কী তিন নম্বর কারণটা সম্পর্কে বলব?”

মামা বলল, “না। দরকার নাই।”

‘তাহলে আমাকে নিবে, মামা?”

মামা কিছু বলল না। তখন আমি সর্বশেষ অস্ত্রটা ব্যবহার করলাম। একটু কাছে গিয়ে মামার হাত ধরে খুবই নরম গলায় বললাম, “প্লিজ মামা প্লি-ই-ই-জ। সব মামারা তাদের ভাগ্নেদের কতো আদর করে, তাদের জন্য কতো কিছু করে, তুমি আমার মামা, তুমিও করবে না? এসিস্টেন্ট বানানোর দরকার নাই, তুমি মনে করো আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছি। তোমার সাথে আমি বেড়াতে যাচ্ছি। তুমি আমাকে গল্প বলবে, আমি শুনব। আমি তোমাকে একটুও ডিস্টার্ব করব না।”

মনে হলো মামার মুখটা একটু নরম হলো। আমি তখন গলার স্বরকে আরো মোলায়েম করে বললাম, “মামা, আমি কাউকে কিছু বলব না। কিছু বলব না, খোদার কসম। আমার জন্য তোমার কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমি সব জায়গায় ঘুমাতে পারি, সবকিছু খেতে পারি। দরকার হলে জঙ্গলে বাথরুম করতে পারব। তোমার মাইক্রোবাস আমি পরিষ্কার-পরিছন্ন করে রাখব। তুমি আমাকে যেটা করতে বলবে সেটাই করব, তোমার যন্ত্রপাতি দেখে শুনে রাখব। প্লিজ মামা প্লিজ।”

মনে হলো মামার মুখটা আরো নরম হলো। আমি গলার স্বর প্রায় কাঁদো কাঁদো করে বললাম, “মামা, আমার জীবনে কোনো আনন্দ নাই, এই বাসায় কেউ আমাকে পাত্তা দেয় না (কথাটা মোটামুটি সত্যি), কেউ আদর করে না (কথাটা বানানো), সবাই সারাক্ষণ বকাবকি করে (কথাটা একটু সত্যি একটু বানানো), তোমার সাথে যদি যাই তাহলে কয়েকটা দিন জীবনে একটু আনন্দ হবে। জীবনে কখন কী হয় কে বলতে পারবে? একটু আনন্দ করতে দাও মামা। প্লিজ, মামা, প্লি-ই-ই-ই-ই-ই-জ।”

মামা প্রথমবার মুখ খুললো, বলল, “তোর আম্মু আব্বু যেতে দিবে?”

আমার মনে হলো আনন্দে একটা লাফ দেই। অনেক কষ্ট করে নিজেকে সামলে নিলাম। তারপর বললাম, “সেইটা তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও। আম্মু আব্বুকে রাজি করানোর দায়িত্ব আমার। শুধু তোমাকে যদি জিজ্ঞেস করে তুমি বলবে তোমার কোনো আপত্তি নাই।”

মামা একটা নিঃশ্বাস ফেলল, তারপর বলল, “ঠিক আছে, তোকে প্রথমে ছোট একটা ট্রিপে নেই, তিন চারদিনের ট্রিপ, দেখি তুই টিকতে পারিস কি না।”

“ঠিক আছে মামা।”

আমি সেই রাতের মাঝে আম্মু আর আব্বুকে রাজি করিয়ে ফেললাম। কিছু কথাবার্তা বানিয়ে বলতে হলো, কিছু বাড়িয়ে চাড়িয়ে বলতে হলো। এবং প্রচুর ঘ্যান ঘ্যান করতে হলো। কিন্তু সেটা তো করতেই হয়। আমার চাইতে ভালো ঘ্যান ঘ্যান পৃথিবীতে কেউ করতে পারে না।

.

ঘুমানোর আগে আমি যখন আমার ব্যাগটা গোছাচ্ছি তখন আপু একটু অবাক হয়ে বলল, “টোপন, তুই নাকি মামার সাথে যাচ্ছিস?”

আমি একটা টি শার্ট ভাঁজ করতে করতে বললাম, “মামা যেতে বলল তার এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য নাকি আরেকজন সায়েন্টিস্ট দরকার। আরেকজন কোথায় পাবে? তাই আমাকে বলেছে, আমি না করতে পারলাম না।”

আপু চোখ কপালে তুলে বলল, “তুই? সাইন্টিস্ট?”

“না। ঠিক সাইন্টিস্ট না। পার্টনার বলতে পার। মামা যখন আমাকে তার সাথে যেতে বলেছে আমি বললাম মামা, এতো জটিল এক্সপেরিমেন্ট, আমি কী পারব। মামা বলল, তুই না পারলে কে পারবে? তোর মতো চালাক চতুর ছেলে আর কে আছে? আমি ভাবছিলাম পরীক্ষা শেষ এখন কম্পিউটার প্রোগ্রামিংটা শিখব। নতুন একটা ল্যাংগুয়েজ বের হয়েছে নাম হচ্ছে সি শার্প। শেখার জন্য এখন দেরী হয়ে যাবে। যাই হোক অন্য অভিজ্ঞতাও হবে। সেটা খারাপ কী? তাই না আপু?”

আপু কথা বলতে পারে না, আমার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। আমি গলা নামিয়ে বললাম, “মামার প্রজেক্টে পার্টনারের জন্য অনেক টাকা রাখা থাকে। মামা আমাকে সেখান থেকে প্রতি মাসে বেতন দিতে চেয়েছিল। আমি রাজি হই নাই। নিজের মামার কাছ থেকে কেউ টাকা নিতে পারে? কী বল আপু?”

আমি দেখলাম আপুর চোয়ালটা ঝুলে পড়ল। সেটা দেখে আমার বুকটা ভরে গেল আনন্দে!

০৩. মামার মাইক্রোবাসে উঠছি

০৩.

ভোর বেলা যখন রওনা দেওয়ার জন্য আমি আমার ব্যাগ নিয়ে মামার মাইক্রোবাসে উঠছি তখন সবাই আমাকে বিদায় দেওয়ার জন্য নিচে নেমে এলো। মিঠুন তার অভ্যাসমতো কয়েকবার নাকী গলায় বলল, “আঁমিও যাব। ভাইয়ার সাথে আমিও যাব। আঁ অ্যাঁ।” কেউ তার কথাকে কোনো গুরুত্ব দিল না, তখন সে চুপ করে গেল। আপু কোনো কথা না বলে মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল। আমি যখন ঠিক মাইক্রোবাসে উঠব তখন আপু জিজ্ঞেস করল, “টোপন, বাথরুম করেছিস?”

আমি গম্ভীর মুখে বললাম, “করেছি।”

“ছোটটা না বড়টা?”

আমি না শোনার ভান করে মাইক্রোবাসে উঠে গেলাম। আম্মু এসে গাড়ির জানালা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে আমার মাথায় শরীরে হাত বুলিয়ে প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, “বাবা সাবধানে থাকিস। সহি সালামতে ফিরে আসিস।” তারপর হাত ধরে বললেন, “ফী আমানিল্লাহ। ফী আমানিল্লাহ।” সব শেষে আরো কিছু দোয়া দরুদ পড়ে আমাকে ফুঁ দিলেন।

আম্মুর কথা এবং ভাবভঙ্গী দেখে মনে হতে থাকে আমি বুঝি পাকিস্তানিদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছি। আব্বু আম্মুর মতো এতো কিছু করলেন না। শুধু গম্ভীর মুখে বললেন, “টোপন। তোর মামাকে বেশি জ্বালাবি না।”

আমি মাথা নাড়লাম, মামা ড্রাইভারের সিটে বসল তারপর হাত নেড়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মাইক্রোবাসটা স্টার্ট করে দিল। আমরা দেখতে দেখতে বাসার সামনের গলিটা পার হয়ে বড় রাস্তায় উঠে গেলাম। এখনো অনেক ভোর তাই রাস্তার দুই পাশের দোকানপাট বেশিরভাগ বন্ধ, রাস্তাও মোটামুটি ফাঁকা। বড় রাস্তা ধরে কিছুদূর এগিয়ে যখন হাইওয়েতে ওঠার জন্য রওনা দিয়েছি তখন আমি তলপেটে চাপ অনুভব করলাম, বুঝতে পারলাম আমার বাথরুম পেয়েছে। মাত্র বাথরুম করে আমি মাইক্রোবাসে উঠেছি কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি আবার বাথরুম পেয়ে গেল? কী আশ্চর্য! আমি জোর করে বাথরুম চেপে বসে রইলাম।

মামা যখন মাইক্রোবাসটা চালিয়ে হাইওয়েতে উঠেছে তখন আমি আবিষ্কার করলাম, শুধু যে বাথরুম পেয়েছে তা নয়। আমার খিদেও পেয়েছে। অথচ গাড়িতে ওঠার আগে আমি রীতিমতো জোর করে জেলি আর মাখন দিয়ে দুই টুকরা রুটি, একটা কলা, একটা ডিম পোচ আর আধ গ্লাস দুধ খেয়েছি। এতো কিছু খাওয়ার পর একজন মানুষের এতো তাড়াতাড়ি খিদে পায় কেমন করে? কী আশ্চর্য!

মামা গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে গাড়ি চালাচ্ছে। মামার গলায় কোনো সুর নাই গানের কথাগুলিও জানে না তাই তার গানের কোনো আগা মাথা নাই কিন্তু সেই জন্য মামার কোনো সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না, মামা বেশ মন দিয়েই গান গেয়ে যাচ্ছে। এক সময় গান থামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল “কী খবর টোপন? এতো চুপচাপ কেন?”

আমি তো আর বলতে পারি না, বাথরুম পেয়েছে এবং খিদে লেগেছে তাই একটু অস্পষ্ট শব্দ করে নড়েচড়ে বসলাম। মামা জিজ্ঞেস করল “বাসার জন্য মন খারাপ লাগছে? এখনো সময় আছে বল, গাড়ি ঘুরিয়ে নামিয়ে দিয়ে আসি।”

আমি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললাম, “না, না, মন খারাপ লাগছে না।”

“তাহলে প্যাঁচার মতো মুখ বন্ধ করে বসে আছিস কেন?”

প্যাঁচা আসলেই মুখ বন্ধ করে থাকে কী না সেটা নিয়ে কথা বলা যায় কিন্তু আমি লজ্জার মাথা খেয়ে শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললাম, “আসলে একটু বাথরুম পেয়েছে তো”

“বাথরুম পেয়েছে?” মামা যথেষ্ট অবাক হলো কিন্তু সেটা প্রকাশ করল না। জিজ্ঞেস করল, “ছোটটা না বড়টা?”

“এখন ছোটটা হলেই হবে।”

“ইমার্জেন্সি? গাড়ি থামাব? ঐ গাছের পিছনে করে আসবি?”

আমার যে অবস্থা যে গাছের পিছনে নয় সামনেই করে ফেলতে পারি কিন্তু মামা তখন নিজেই বলল “দাঁড়া, সামনে একটা পেট্রল পাম্প দেখা যাচ্ছে। আমার তেলও নিতে হবে। এক ঢিলে দুই পাখি।”

আমি চিঁ চিঁ করে বললাম, “তিন পাখিও হতে পারে।”

মামা অবাক হয়ে বলল, “তিন পাখি?”

“হ্যাঁ। কেন জানি খুব খিদে পেয়ে গেছে।

মামা চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকায়, কিছু বলল না।

মামা পেট্রল পাম্পে তার মাইক্রোবাস থামাল এবং তারপর যথেষ্ট হই চই করে তিনটা পাখি মারা হলো। মামা পেট্রোল নিল, আমি হিস্যু করলাম। তারপর আমি পেট্রোল পাম্পের পাশে ছোট রেস্টুরেন্ট থেকে ডিম পরটা খেলাম। আমার পেটের মাঝে কোথায় এতো জায়গা ছিল কে জানত?

এইবারে যখন আবার রওনা দিয়েছি তখন আমি যথেষ্ট চাঙ্গা। পেট ভরা এবং তলপেট খালি, কাজেই মন মেজাজ ভালো হতেই পারে। আমি রাস্তার দুই পাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে মামার সাথে গল্প করতে থাকি।

মামা তার বেসুরো গান গাইতে গাইতে হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল, “তোকে একটা জিনিস সাবধান করে দিই।”

“কী জিনিস মামা?”

“এই দেশের মানুষের কৌতূহল খুব বেশি। দেখবি সবাই একশ রকম জিনিস জিজ্ঞেস করবে। বাড়ি কই, কী করি, কতো টাকা কামাই করি, বিয়ে করেছি কি না- এরকম হ্যাঁনো ত্যানো হাবি জাবি একশ জিনিস। উত্তর দিতে কোনো সমস্যা নাই– শুধু একটা জিনিস বলা যাবে না।”

‘কী বলা যাবে না?”

“আমি আসলে কী করছি। ইউরেনিয়াম খুঁজছি এটা বলা যাবে না।”

“কেন মামা?”

“কারণ এটা সিক্রেট। ইউরেনিয়াম অসম্ভব স্ট্র্যাটেজিক এলিমেন্ট। সারা পৃথিবীর নজর ইউরেনিয়ামের জন্য। আসলেই যদি পেয়ে যাই আর জানাজানি হয়ে যায় সর্বনাশ হয়ে যাবে!”

এরকম একটা ভয়ংকর প্রজেক্টের আমি অংশ হয়ে গেছি চিন্তা করেই আমি উত্তেজিত হয়ে উঠি। নিজেকে হলিউডের সিনেমার নায়ক নায়ক মনে হতে থাকে। আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, “তুমি কোনো চিন্তা করো না মামা, আমি মরে গেলেও কাউকে কিছু বলব না।”

“তাহলে কী বলবি সেটা ঠিক করে রাখ।”

“কিছুই বলব না। চুপ করে থাকব। বলব সিক্রেট প্রজেক্ট।”

মামা মাথা নাড়লেন, বলল, “উঁহু। কিছু একটা বলতে হবে।”

আমি মাথা চুলকে বললাম, “বলব, গুপ্তধন খুঁজছি। একজন জলদস্যু মাটির নিচে সোনাদানা পুতে রেখেছিল সেটা খুঁজছি।”

মামা হাসল, বলল, “ইন্টারেস্টিং! কিন্তু তখন আরো একশ প্রশ্ন করবে। জলদস্যু পানিতে না রেখে শুকনার মাঝে কেন সোনাদানা পুতে রেখেছে? জলদস্যুর নাম কী? বাড়ি কোথায়? বউ কয়টা? ছেলেপিলে আছে? এই দেশের মানুষের কৌতূহলের কোনো মা বাপ নাই।”

আমি আবার মাথা চুলকালাম, তারপর বললাম, “তাহলে বলতে পারি ডাইনোসরের হাড্ডি গুড্ডি খুঁজছি।”

“হাড্ডি গুড্ডি? মানে ফসিল?”

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “হ্যাঁ ফসিল। বলব ডাইনোসরের ফসিল খুঁজছি।”

মামা মুখ সূচালো করে কিছু একটা চিন্তা করল, তারপর বলল, “উঁহু। এটা পলি মাটির দেশ, ডাইনোসরের ফসিল পাওয়ার কথা না। জানাজানি হলে পত্রিকায় আর্টিকেল উঠে যাবে। লিখবে, বিজ্ঞানের নামে অর্থের অপচয়। দুর্নীতিবাজ বিজ্ঞানীর প্রতারণা। বেইজ্জতি ব্যাপার হবে।”

আমি আবার মাথা চুলকালাম। কোনো একটা কিছু চিন্তা করতে কেন মাথা চুলকায় কে জানে। এটা নিয়েও নিশ্চয়ই গবেষণা হয়েছে। মাথা চুলকাতে চুলকাতে শেষ পর্যন্ত একটা আইডিয়া বের হলো। বললাম, “বলতে পারি যে পরিবেশ দূষণ নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। মাটি তুলে তুলে পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে এর ভিতরে আলতু ফালতু কেমিক্যাল আছে না নাই।”

মামা মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। এইটা বলা যায়। আজকাল পরিবেশ দূষণ খুব হট যাচ্ছে। গুড আইডিয়া।”

আমি একটা গুড আইডিয়া দিতে পেরেছি সেইজন্য আমার রীতিমতো অহংকার হতে লাগল। অহংকারের জন্যই কি না কে জানে, নাকি চিন্তা করার জন্য আমার একটু পরে আবার খিদে পেয়ে গেল। মামার নিজেরও একটু চা খাওয়ার ইচ্ছা করতে লাগল। তাই আমরা আবার থামলাম। মামা চা খেলো আর আমি আস্ত একটা হ্যামবার্গার খেয়ে ফেললাম।

আমরা এইভাবে যেতে থাকি। প্রতি দুই ঘণ্টা পর পর মামা তার মাইক্রোবাস থামিয়ে হাত পা নাড়িয়ে শরীরের আড়মোড়া ভাঙ্গে, তারপর কড়া লিকারের চা খায়। আমি অবশ্যি চা কফি খাই না সত্যিকারের খাবার খাই। একবার একটা ক্রিমরোল খেলাম, আরেকবার দই মিষ্টি আরেকবার গরম জিলাপি, আরেকবার চিকেন প্যাটিস মামা পর্যন্ত আমার খাওয়া দেখে অবাক হয়ে গেল। আমার মনে হতে লাগল বিজ্ঞানের গবেষণায় যখন এতো আনন্দ আমি বড় হয়ে বিজ্ঞানী হয়ে যাই না কেন?

.

মামা কোথায় যাবে আগে থেকে ঠিক করে রেখেছে। হাওড়ের একপাশে নদী, অন্য পাশে একটা টিলা, মোটামুটি নির্জন জায়গা তাই দিনের আলো থাকতে থাকতে মামা পৌঁছে যেতে চাইছে। মামা ঘড়ি দেখল, তার জিপিএস দেখল তারপর সময় বাঁচানোর জন্য মাইক্রোবাসের স্পিড বাড়িয়ে দিল। একটা ছোট শহর পার হয়ে আমরা পনেরো কুঁড়ি মিনিট গিয়েছি তখন হঠাৎ করে রাস্তার পাশে ছোট একটা ভীড় দেখতে পেলাম। জায়গাটা পার হওয়ার সময় দেখলাম রাস্তার পাশে একটা গাড়ি কাত হয়ে আছে। গাড়ির সামনের অংশটা দুমড়ে মুচড়ে গেছে। মনে হলো কয়েকজন রাস্তার পাশে মাটিতে শুয়ে বসে আছে। গাড়ি একসিডেন্ট।

মামা হঠাৎ করে তার মাইক্রোবাসে ব্রেক করল তারপর গাড়ি পিছিয়ে আনতে লাগল। যেখানে গাড়িটা কাত হয়ে পড়ে আছে সেখানে মাইক্রোবাসটা থামালো। মামা তার স্টার্ট বন্ধ করে নেমে আসে, আমিও মামার পিছু পিছু নেমে এলাম। মামা ভীড় ঠেলে ভিতরে ঢুকে গেল, আমিও ঢুকে গেলাম। একজন মানুষ গাছে হেলান দিয়ে বসে আছে, তার মাথার কোথায় জানি কেটে গেছে, হাত দিয়ে সেখানে ধরে রক্ত থামানোর চেষ্টা করছে। মানুষটার পাশে একজন মহিলা, মহিলার চোখে মুখে আতংক, রক্ত বন্ধ করার জন্য কিছু একটা করার চেষ্টা করছে। মিঠুনের বয়সী একটা বাচ্চা তার মাকে ধরে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। মাঝবয়সী একজন মানুষ মনে হয় গাড়ির ড্রাইভার, ছোটাছুটি করছে, কী করবে বুঝতে পারছে না। তাদের সামনে বেশ কিছু মানুষ, কয়েকজন ছোট বাচ্চাও আছে। সবাই মিলে পুরো দৃশ্যটা দেখছে কিন্তু কেউ কাছে যাচ্ছে না।

মামা কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করে গাছে হেলান দেওয়া মানুষটা এবং তার পাশের মহিলার কাছে এগিয়ে গেল, হাটু গেড়ে বসে জিজ্ঞেস করল, “কী অবস্থা?” কতক্ষণ আগে হয়েছে?”

মানুষটা কোনো কথা বলল না, কেমন যেন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মহিলাটা হাহাকারের মতো শব্দ করে বলল, “পাঁচ দশ মিনিট হয়েছে, ট্রাকটা থামে নাই, পালিয়ে গেছে।”

আমরা বুঝতে পারলাম একটা ট্রাক ধাক্কা মেয়ে পালিয়ে গেছে। পত্রিকায় এরকম ভয়ংকর খবর পড়ি, আজকে নিজের চোখে দেখছি।

মহিলাটা থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “হাসপাতালে নিতে হবে। হাসপাতালে

“মামা বলল, জ্বি, বুঝতে পারছি। নার্ভাস হবেন না। আমি ব্যবস্থা করছি।”

এতক্ষণ সবাই দাঁড়িয়ে মজা দেখছিল, কেউ কিছু করছিল না। মামা প্রথম তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে। মহিলাটা এতোক্ষণ কাঁদেনি এবারে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। মাকে কাঁদতে দেখে বাচ্চাটা আরো জোরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। ব্যথায় না ভয়ে বুঝতে পারলাম না।

মামা বলল, “নার্ভাস হবেন না ম্যাডাম। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আপনার কী অবস্থা? হাঁটতে পারবেন?”

মহিলা কান্না থামানোর চেষ্টা করে বলল, “পারব। তারপর উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে পড়ে যাচ্ছিল আমি দৌড়ে ধরে ফেললাম। মহিলা আমাকে ধরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে থাকে, আমি টের পেলাম মহিলার হাতে চটচটে রক্ত, আমার কাপড়ে লেগে যাচ্ছে। লাগুক।

মামা পকেট থেকে চাবিটা বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল, “টোপন। মাইক্রোবাসটার পিছনটা খুলে মেঝেতে তোর বিছানাটা বিছিয়ে ফেল। কুইক।”

আমি বললাম, “ঠিক আছে।”

মামা মহিলাকে ধরলেন, আমি চাবিটা নিয়ে মাইক্রোবাসের দিকে ছুটে গেলাম। আমার পিছু পিছু বেশ কিছু মানুষ মজা দেখার জন্য ছুটে এলো। মাইক্রোবাসের দরজা খুলতেই ভেতরে বিচিত্র সব যন্ত্রপাতি দেখে সবাই বিস্ময়ের শব্দ করে। তারা আরো কাছে গিয়ে দেখতে চায়, যাদের উৎসাহ বেশি তারা হাত ঢুকিয়ে ছুঁয়ে দেখতে চেষ্টা করল।

আমি হুংকার দিয়ে শক্ত গলায় বললাম, “খবরদার। কেউ ভিতরে হাত দিবে না। খবরদার।”

আমার হুংকারে কাজ হলো। সবাই দুই পা সরে গেল। আমি আমার বিছানা খুলে মাইক্রোবাসের নিচে বিছিয়ে দিলাম। মাথার কাছে বালিশ রেখে চাদর দিয়ে ঢেকে আমি অপেক্ষা করতে থাকি।

একটু পরে দেখতে পেলাম মামা আর ড্রাইভার মিলে আহত মানুষটাকে ধরে ধরে নিয়ে আসছে। মাইক্রোবাসের ভিতরে তাকে শুইয়ে দিয়ে মামা আমাকে বলল, “টোপন। তুই এখানে থাক।”

একজন আহত মানুষ, মাথা থেকে দরদর করে রক্ত পড়ছে। তার সাথে থাকতে আমার ভয় করছিল কিন্তু সেটা তো আর বলতে পারি না তাই মাথা নেড়ে বললাম, “ঠিক আছে মামা।”

মহিলা নিজেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে এসেছে, মামা তাকে বলল, “আপনি আপনার ছেলেকে নিয়ে সামনে বসেন।”

“আর জাহিদ? জাহিদ?” বুঝতে পারলাম আহত মানুষটার নাম জাহিদ।

“টোপন দেখবে। টোপন অনেক রেসপন্সিবল। চিন্তা করবেন না।”

মামা আমাকে ‘রেসপন্সিবল’ বলছে কাজেই আমাকে এখন দায়িত্ব নিতেই হবে। আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “আপনি চিন্তা করবেন না, আমি দেখে রাখব।”

মহিলা কাঁপা গলায় বলল, “অনেক ব্লিডিং হচ্ছে।”

“এক্ষুণি হাসপাতালে নিব। আমি একটা হাসপাতাল দেখে এসেছি। বেশ বড় মনে হলো। তবু একবার জিজ্ঞেস করে নিব। আপনি ওঠেন।”

ভদ্রমহিলা ছেলেকে নিয়ে সামনের সিটে বসলেন। বাচ্চাটা এখন কান্না বন্ধ করেছে। মাঝে মাঝে একটু পরে পরে শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠছে। মামা দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে জিজ্ঞেস করল, “এখানে কাছাকাছি হাসপাতাল কোথায়?”

কোন হাসপাতাল কাছে, কোনটা দূরে, কোনটা ভালো কোনটা খারাপ কোথায় টাকা বেশি লাগে কোথায় কম লাগে সেটা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেল। তখন একজন মাতবর টাইপের মানুষ মামাকে বলল, “আপনি কাজটা ঠিক করলেন না।”

মামা অবাক হয়ে বলল, “কোন কাজটা ঠিক করলাম না?”

“এই যে এসকিডেন্টের রোগী টানাটানি করতেছেন।” মানুষটা এক্সিডেন্ট বলতে পারে না, বলেছে এসকিডেন্ট!

“কী হয় এসকিডেন্টের রোগী টানাটানি করলে?” মামাও এক্সিডেন্ট না বলে বলছে এসকিডেন্ট, মাতবর অবশ্য এই ঠাট্টাটা বুঝতে পারল না।

“পুলিশের ঝামেলায় পড়বেন। পুলিশ আপনারে নিয়া টানাটানি করবে। আপনার জান শ্যাষ হইয়া যাইব।”

“তাই নাকি?”

মাতবর টাইপের মানুষটা বলল, “আর রোগী যদি মরে তাইলে আপনি মার্ডার কেইসের আসামী। হয় ফাঁসি নাহলে চৌদ্দ বছর জেল।”

মামা মাথা নাড়ল, বলল, “দোয়া করি আপনি একদিন একসিডেন্টে রাস্তার সাইডে হাত পা ভেঙে পড়ে থাকেন। মাথা ফেটে একটু ঘিলু বের হয়ে থাকে। তখন একজন যখন আপনারে হাসপাতালে নিতে আসবে তখন যেন অন্য মানুষেরা আপনারে হাসপাতালে নিতে না দেয়। আপনি রাস্তার সাইডে যেন পড়ে থাকেন। কেউ যেন আপনাকে সাহায্য করতে না আসে।”

মাতবর টাইপের মানুষটা কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। বলল, “এইটা আপনি কী বলেন?”

“সত্যি কথা বলি।”

মামা আর কোনো কথা না বলে ড্রাইভিং সিটে বসে মাইক্রোবাসটা ঘুরিয়ে উল্টো দিকে যেতে শুরু করল।

আমি হাঁটু গেড়ে বসে থাকি। মানুষটার মাথার রক্ত বন্ধ হচ্ছে না। হাতের ফাঁক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে বের হচ্ছে। আমি আমার ব্যাকপেক থেকে আমার একটা টিশার্ট বের করে সেটা দিয়ে মানুষটার মাথায় চেপে ধরলাম। মানুষটা আমার দিকে তাকিয়ে দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করল, তারপর শোনা যায় না এরকম গলায় বলল, “থ্যাংক ইউ।”

আমিও একটু হাসার চেষ্টা করলাম, বললাম, “আপনি চিন্তা করবেন না। মামা আপনাকে এক্ষুণি হাসপাতালে নিয়ে যাবে।”

মানুষটা বলল, “আমি আর চিন্তা করছি না। মানুষের যেরকম বিপদ আসে সেরকম বিপদের সময় সাহায্যও আসে। তোমরা যেরকম এসেছ।”

এরকম একটা জ্ঞানের কথা শোনার পর ঠিক কী বলতে হবে বুঝতে পারলাম না। তাই মুখটা একটু হাসি হাসি করে রাখার চেষ্টা করে বসে রইলাম।

কিছুক্ষণের মাঝেই আমরা হাসপাতালে পৌঁছে গেলাম। মামা দরজা খুলে নেমে প্রায় দৌড়ে হাসপাতালের ভিতরে ঢুকে গেল। কয়েক মিনিট পরে কয়েকজন মানুষ একটা ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে চলে এলো, সাথে একটা হুইল চেয়ার মাইক্রোবাসের দরজা খুলে আহত মানুষটাকে ধরাধরি করে ট্রলিতে শোয়ানো হলো। মহিলা হুইল চেয়ারে বসলেন, বাচ্চাটা তার কোলে বসে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বসে রইল। এতোক্ষণ চুপচাপ ছিল এখন আবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে।

একজন আমাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি যাবা না?”

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “আমার কিছু হয় নাই।”

“তোমার কাপড়ে এত রক্ত?”

“আমার রক্ত না।”

আরেকজন জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছিল?”

“আমি জানি না। এরা রাস্তার পাশে পড়েছিল আমরা তুলে হাসপাতালে এনেছি।”

মানুষটা শুনে মাথা বাঁকা করে মুখটাতে কেমন একটা ভঙ্গী করল। সেই ভঙ্গী থেকে কাজটা ভালো হয়েছে না খারাপ হয়েছে বুঝতে পারলাম না।

কিছুক্ষণ পর মামা ছোট বাচ্চাটার হাত ধরে বের হয়ে এলো। আমার কাছে এসে বাচ্চাটাকে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “টোপন তুই লিটনকে দেখে রাখ কিছুক্ষণ। আমি ইমার্জেন্সিতে আছি।”

“কী অবস্থা মামা?”

“ভালো। মনে হচ্ছে সিরিয়াস কিছু না। এক্সরে করছে।”

“ঠিক আছে।”

মামা পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নে, তোরা কিছু খেয়ে নে।”

আমি বললাম, “আমার কাছে টাকা আছে।”

“থাকুক। রাখ তোর কাছে।”

আমি টাকাগুলো নিয়ে পকেটে রাখলাম। মামা যেভাবে এসেছিল আবার সেভাবে হাসপাতালের ভিতর ঢুকে গেল।

আমি এবারে ছেলেটার দিকে তাকালাম, একটু আগে যেরকম ভয় পেয়েছিল এখন তার আর সেরকম লাগছে না। একটু সামলে নিয়েছে। ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার নাম লিটন?”

ছেলেটা মাথা নাড়ল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কী অনেক ভয় পেয়েছিলে?”

ছেলেটা আবার মাথা নাড়ল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ব্যথা পেয়েছিলে?”

ছেলেটা মাথা নাড়ল। তারপর হঠাৎ মাথা তুলে জিজ্ঞেস করল, “আমার আব্বু কী এখন মরে যাবে?”

আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, “না, মোটেও না।”

“তাহলে আম্মু?”

“না, তোমার আম্মুর তো কিছুই হয়নি। কেন শুধু শুধু মরে যাবে?”

ছেলেটা গম্ভীর মুখে বলল, “মানুষ যখন মরে যায় তখন তাকে হাসপাতালে নেয়। আমার নানুকে নিয়েছিল। আমি জানি।”

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “না। মানুষের যখন অসুখ হয় নাহলে একসিডেন্ট হয় তখন তাকে হাসপাতালে নেয়। আমার যখন ডেঙ্গু হয়েছিল তখন আমাকে হাসপাতালে নিয়েছিল। আমি কী মরে গেছি? আমি মরি নাই। বিশ্বাস না হলে আমাকে ছুঁয়ে দেখ।”

লিটনের কী মনে হলো কে জানে। সে সত্যি আমাকে ছুঁয়ে দেখল। তারপর মাথা নাড়ল। আমি বললাম, “তোমার খিদে পেয়েছে? কী খাবে বল।”

“আমি কিছু খাব না।”

“কিন্তু আমি তো খাব। তুমিও খাবে আমার সাথে।”

“তুমি কী খাবে?”

“দেখি কী পাওয়া যায়। আস আমার সাথে।”

আমি লিটনের হাত ধরে নিয়ে গেলাম, একটা দোকান থেকে একটা বিস্কুটের প্যাকেট, দুইটা চিপসের প্যাকেট আর দুইটা কোল্ড ড্রিংকের বোতল কিনে আমরা আবার হাসপাতালের সামনে ফিরে এলাম। তারপর হাসপাতালের বারান্দায় বসে খেতে লাগলাম।

খেতে খেতে লিটন হঠাৎ করে বলল, “ভুম করে শব্দ হয়েছিল।”

“কখন ভুম করে শব্দ হয়েছিল?”

“যখন একসিডেন্ট হয়েছিল।”

“তখন তুমি কী করেছিলে?”

“আমি ভেবেছি আমরা সবাই মরে গেছি।”

“মরে গেছ?”

“হ্যাঁ। সবাই মরে গেছি।”

“তারপর?”

“তারপর ভেবেছি শুধু আব্বু আর আম্মু মরে গেছে।”

“আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “আসলে কেউ মরে নাই।”

লিটন কিছু বলল না। চুক চুক করে কোল্ড ড্রিংক খেতে থাকল। একটু পর জিজ্ঞেস করল, “এখন আব্বু আর আম্মুকে কী করবে?”

“মাথায়, পায়ে মনে হয় ব্যান্ডেজ করে দেবে?”

“কিন্তু তোমার মামা যে বলেছে এক্সরে করবে?”

“এক্সরে তো ছবি তোলা। শরীরের ভিতরের ছবি তোলা। এক্সরে করে দেখবে শরীরের ভেতরে কিছু হয়েছে কী না।”

লিটন বলল, “ও।” আবার কিছুক্ষণ চুক চুক করে কোল্ড ড্রিংস খেয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার মামা কি ডাক্তার?”

“না। আমার মামা হচ্ছে ডক্টর।”

“ডক্টর?”

“হ্যাঁ।”

“ডাক্তার আর ডক্টরে পার্থক্য কী?”

“ডাক্তার হচ্ছে যে চিকিৎসা করে। আর ডক্টর হচ্ছে যে সায়েন্টিস্ট।”

“সায়েন্টিস্ট? ডক্টর মানে সায়েন্টিস্ট?”

আমি ঠিক করে জানি না শুধু সায়েন্টিস্ট হলেই ডক্টর হয় না কি অন্যরাও ডক্টর হতে পারে কি না। তাই আলোচনা ঘোরানোর চেষ্টা করলাম। বললাম, “আমার মামা সায়েন্টিস্ট।”

“সত্যিকারের সায়েন্টিস্ট?”

“হ্যাঁ সত্যিকারের সায়েন্টিস্ট।”

“সত্যিকারের সায়েন্টিস্টরা কী করে?”

“যন্ত্রপাতি দিয়ে কাজ করে।”

“তোমার মামার অনেক যন্ত্রপাতি আছে?”

“হ্যাঁ। দেখতে চাও?”

লিটন ভুরু কুচকে তাকাল। বলল, “হ্যাঁ দেখতে চাই।”

আমি তখন মাইক্রোবাসের পিছনের দরজাটা খুলে লিটনকে মামার যন্ত্রপাতি দেখালাম। সে দেখে একেবারে হা হয়ে গেল। একটু পর জিজ্ঞেস করল, “তোমার মামা এই সব যন্ত্রপাতি দিয়ে কাজ করে?”

“হ্যাঁ।”

“তুমি এই যন্ত্রগুলো চিনো?”

আমি কিছুই চিনি না, কিন্তু সেটা বলি কেমন করে? কয়েকদিন পর তো চিনেই যাব তাই না হয় একটু আগেই বলে ফেলি! বললাম, “যা, চিনি।”

লিটন বিস্ফোরিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর আঙুল দিয়ে একটা যন্ত্রকে দেখিয়ে বলল, “এইটা কী যন্ত্র?”

আমার কোনো ধারণা নেই কিন্তু মুখ গম্ভীর কার বললাম, “এইটা হচ্ছে গামা রে স্পেকট্রোস্কোপি।”

আরেকটা যন্ত্র দেখিয়ে বলল, “ঐটা কী যন্ত্র?”

“ঐটা হচ্ছে বিংগুটি বাঙ্গাট্রনিক।” বানিয়ে একটা শব্দ বললাম।

আরেকটা যন্ত্র দেখিয়ে বলল, “ঐটা কী?”

বানিয়ে বললাম, “পিন্টাসি মিন্টুস।” আমার জ্ঞানের বহর দেখে লিটন মুগ্ধ হয়ে গেল।

আরেকটা যন্ত্র দেখিয়ে বলল, “ঐটা কী?”

“ঐটা ক্রিটারিটন।”

“তুমিও ঐ যন্ত্র দিয়ে কাজ করো?”

“এখনও পুরোপুরি শুরু করিনি। একটু একটু করি।”

“তার মানে তুমি সায়েন্টিস্ট?”

“এখনও হই নাই, আস্তে আস্তে হয়ে যাব।”

লিটন কিছুক্ষণ চুপ করে রইল তারপর বলল, “আমি কী বড় হলে সায়েন্টিস্ট হতে পারব?”

“পারবে না কেন? চাইলেই পারবে।”

“আগে ভেবেছিলাম আমি বড় হয়ে পাইলট হব। এখন মনে হচ্ছে সায়েন্টিস্ট হয়ে যাই।”

আমি গম্ভীর মুখে বললাম, “ভেরি গুড।”

তারপর দুইজন আবার হাসপাতালের বারান্দায় বসে চিপস আর কোল্ড ড্রিংকস খেতে লাগলাম।

ঘণ্টা খানেক পরে মামা বের হয়ে এসে আমাদের ভিতরে নিয়ে গেল। তিন তলায় উঠে একটা ঘরে গিয়ে দেখি পাশাপাশি দুইটা বিছানায় লিটনের আব্রু আর আম্মু শুয়ে আছে। লিটনের আব্বুর চোখ বন্ধ এবং মাথায় ব্যান্ডেজ। লিটনের আম্মু বিছানায় পা তুলে বসে আছেন তার পায়ে প্লাস্টার। লিটন তার আম্মুর কাছে ছুটে গিয়ে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “আম্মু, আব্বু কী মরে গেছে?”

আম্মু আঁতকে উঠে বলেন, “কী বলে ছেলে? মারা যাবে কেন? তোর আব্বুকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছে, তাই ঘুমিয়ে আছে।”

লিটন বলল, “ও।”

আম্মু তার ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব বুঝতে পারছি না। একসিডেন্টের পর এতো ভয় পেয়েছি এতো ফ্রাস্ট্রেটেড লাগছিল তখন যেন আপনি এসেছেন একেবারে আশীর্বাদের মতো।”

লিটন আমাকে দেখিয়ে বলল, “আর টোপন ভাইয়াও এসেছে আম্মু।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, আর আপনার ভাগনে, এইটুকুন ছেলে কিন্তু কতত রেসপন্সিবল। থ্যাংক ইউ সো মাচ।”

মামা বললেন, “আপনার ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছে। উনি চলে আসছেন কয়েক ঘণ্টার মাঝে।”

“হ্যাঁ। আমিও কথা বলেছি। সে দল বল নিয়ে আসছে।”

“তাহলে আমাদের বিদায় দেন, আমরা যাই।”

“অবশ্যই, অবশ্যই। সাবধানে যাবেন। আর প্লিজ যোগাযোগ রাখবেন।”

আমি আর মামা বিদায় নিয়ে বের হয়ে এলাম। মামা মাইক্রোবাসে উঠে একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “বুঝলি টোপন, তুই একটা প্ল্যান করবি আর কোনো নোটিশ ছাড়া সবকিছু ওলট পালট হয়ে যায়।”

“তোমার কোনো ঝামেলা হবে না তো?”

“ঝামেলা হলেই আবার কী, না হলেই কী!”

“এখন আমরা কী করব মামা?”

দেখি আশেপাশে থাকার মতো কোনো হোটেল পাওয়া যায় কিনা, যদি পাওয়া যায় তাহলে একটা রাত হোটেলে থেকে যাব। ভালো করে গোসল করে খেয়ে একটা ঘুম দেওয়া যায় কিনা দেখি।”

আমি হাতে কিল দিয়ে বললাম, “গুড আইডিয়া।”

.

রাত্রে একটা হোটেলে মামা আমাদের রক্তমাখা জামা কাপড় বিছানার চাদর ভালো করে ধুয়ে ঘরের ভিতর ফ্যানের নিচে টানিয়ে দিল। আমরা দুইজনই গরম পানিতে রগড়ে রগড়ে গোসল করলাম। তারপর নিচের রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম। মামা ভাত, সবজি, চিকেন ঝাল ফ্রাই, বেগুন ভর্তা আর ডাল অর্ডার দিল। খাওয়ার পর দই মিষ্টি আর কড়া লিকারের দুধ চা। এর থেকে ভালো খাবার আর কী হতে পারে?

আমরা যখন খাবারের জন্য অপেক্ষা করছি তখন আমি মামাকে জিজ্ঞেস করলাম, “মামা, মনে আছে একসিডেন্টের পর যখন সবাইকে হাসপাতালে নিচ্ছিলাম তখন যে একজন মানুষ তোমাকে বলছিল”

মামা কথার মাঝখানে আমাকে থামাল, “ঐ ছাগলটা? যে বলছিল পুলিশ আমাদের ধরবে”

“হ্যাঁ। হ্যাঁ। ঐ মানুষটা কী সত্যি সত্যি বলছিল?”

মামা হা হা করে জোরে জোরে হাসল, বলল, “হতে পারে সত্যি বলেছিল, কেন? তোর ভয় লাগছে?”

“না না ভয় লাগবে কেন?”

“তোর ভয়ের কিছু নাই, আমরা যাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছি সে পুলিশের একজন এস পি! এখন গিয়ে দেখ, হাসপাতালে পুলিশ গিজ গিজ করছে।”

মামা পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে আমার হাতে দিল, বলল, “এই যে আমাকে তার কার্ড দিয়েছে। তোর কাছে রাখ, হারিয়ে ফেলিস না। ফোন করে খোঁজ নিতে হবে।”

আমি কার্ডটা হাতে নিলাম, মামা আসলেই দরকারি কাজে আমাকে ব্যবহার করতে শুরু করেছে। কার্ডটা আমার ডাইরিতে লাগিয়ে রাখতে হবে। আমার একটা ডাইরি আছে, সব সময় ভাবি প্রত্যেক রাতে ডাইরিতে সারাদিন কী হয়েছে সেটা লিখে রাখব। লেখা হয় না। আজ রাতে অবশ্যই সবকিছু লিখতে হবে, বাড়িয়ে চাড়িয়েই লিখব! অনেক কিছু লেখার আছে।

আমার ডাইরি পড়লে যে কেউ ভয় পেয়ে যাবে, কিন্তু কেউ পড়ার সাহস পাবে না। কারণ ডাইরির প্রথম পৃষ্ঠায় বড় বড় করে লেখা আছে :

“নিম্ন স্বাক্ষরকারীর অনুমতি ছাড়া এই ডাইরি পড়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যদি কেউ পড়িবার চেষ্টা করে তাহলে তাহার উপর অভিশাপ বর্ষিত হইবে। সেই অভিশাপ অত্যন্ত জ্বালাময়ী এবং তাহার কারণে যে পড়িবে তাহার হাত পা ভাঙ্গিয়া লুলা হইয়া যাইবে এবং শরীরের মাংস পচিয়া পচিয়া খসিয়া পড়িবে এবং পোকা কৃমি কিলবিল কিলবিল করিয়ে এবং চিরদিনের জন্য নরকবাসী হইবে।”

আমি অনেক চেষ্টা করে এটাকে সাধু ভাষায় লিখেছি, সাধু ভাষায় লিখলে পুরো জিনিসটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়।

০৪. সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে

০৪.

পরের দিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে রওনা দিয়ে দুপুর বেলা আমরা আমাদের জায়গায় পৌঁছে গেলাম। প্রথমে পাকা রাস্তা, তারপর ইটের রাস্তা তারপর কাঁচা রাস্তা, তারপর কোনো রাস্তাই নাই। সেই খানাখন্দ জঙ্গলের মাঝে মামা ঘটর ঘটর করে তার গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত একটা জংলা জায়গায় মামা তার মাইক্রোবাস থামিয়ে বলল, “আগামী কয়েকদিন এইটা আমাদের আস্তানা।”

মামা মাইক্রোবাস থেকে নেমে এদিক সেদিক তাকিয়ে বলল, “জায়গাটা কী সুন্দর দেখেছিস?”

এটা হচ্ছে বড় মানুষদের সমস্যা। দুই চারটা গাছপালা কিংবা একটা নদী কিংবা কয়েকটা গরু ছাগল দেখলেই তারা আহা উঁহু করতে থাকে, বলতে থাকে, কী সুন্দর! কী সুন্দর!

মামাকে খুশি করার জন্য আমিও বললাম, “হ্যাঁ মামা, খুব সুন্দর জায়গা।”

“এখানে নদী আছে, হাওড় আছে, জঙ্গল আছে এবং পাহাড় আছে। একসাথে কখনো এতোগুলো জিনিস পাওয়া যায় না।”

আমি মনে মনে বললাম, “নিশ্চয়ই মশাও আছে এবং জোকও আছে। জোরে জোরে বললাম, “এখন আমরা কী করব মামা?”

“প্রথমে লাঞ্চ করব তারপর কাজ শুরু করে দেব।”

ঠিক কী কারণ জানা নাই মামার সাথে রওনা দেওয়ার পর থেকে আমার খিদে বেড়ে গেছে। কী খাওয়া হবে সেটা নিয়ে এখন আমার অনেক আগ্রহ। জিজ্ঞেস করলাম, “কী লাঞ্চ করব মামা?”

“তোর মা কিছু রান্না করে দিয়েছিল। সেগুলো নিশ্চয়ই পচে গিয়েছে।”

“তাহলে?”

“পাউরুটি আছে।”

আমি শুকনো মুখে বললাম, “আর?”

“আর আরো পাউরুটি।” আমার মুখ দেখে মনে হলো মামার একটু মায়া হলো, বলল, “সাথে একটা ডিম সিদ্ধ করে নিতে পারিস।”

“ডিম?”

“হ্যাঁ।”

“কীভাবে সিদ্ধ করব?”

“মাইক্রোওয়েভ ওভেনে।”

মামা কোথা থেকে একটা পাউরুটির প্যাকেট বের করে সেখান থেকে এক স্লাইস রুটি নিয়ে মহানন্দে চাবাতে চাবাতে তার যন্ত্রপাতি টানাটানি করতে লাগল। আমিও এক স্লাইস রুটি চাবানোর চেষ্টা করলাম, চিবিয়ে নরম করার পরও সেটা গলা দিয়ে নামতে চায় না। কারণটা কী কে জানে?

মামা কাজ করতে করতে কোথা থেকে জানি একটা ডিম বের করে দিল। আমি সেটা মাইক্রোওয়েভ ওভেনে ঢুকিয়ে ওভেনটা চালু করে দিলাম। মামা কেমন জানি মুচকি হাসি হেসে আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করে এক দুই তিন করে গুণতে শুরু করল।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী গুণছ মামা?”

“দেখি কতোক্ষণ গুণতে হয়।”

“কতোক্ষণ কী গুণতে হয়?”

“তুই নিজেই দেখবি।”

পঁয়তাল্লিশ পর্যন্ত গুণার পর মাইক্রোওয়েভ ওভেনের ভিতর বোমা ফাটার মতো একটা প্রচণ্ড শব্দ হলো। মামা গোণা বন্ধ করে মাইক্রোওয়েভ ওভেনের দরজা খুলে বলল, “এই যে তোর সিদ্ধ ডিম। পুরা মাইক্রোওয়েভে লেপটে গেছে। খিমচে খিমচে খেয়ে নে।” তারপর আনন্দে হা হা করে হাসতে লাগল।

আমি বললাম, “তুমি জানতে ডিমটা বাস্ট করবে?”

“না জানার কী আছে? সবাই জানে।”

“তাহলে আমাকে না করলে না কেন?”

“না করলে কী এই মজাটা হতো?” মামা আমাকে এক টুকরা কাপড় দিয়ে বলল, “নে ওভেনটা পরিষ্কার কর। তা না হলে পচা গন্ধ বের হবে।”

আমাকে ঘষে ঘষে পুরো ওভেনটা পরিষ্কার করতে হলো। মামা তখন আরেকটা ডিম দিয়ে বলল, “নে, এইটা ঠিক করে সিদ্ধ কর।”

“ঠিক করে কীভাবে সিদ্ধ করব?”

“ভেঙে একটা পিরিচে রাখ, কুসুমটা গেলে দে। ইচ্ছা হলে একটা কাপের পানিতে ডিমটা ভেঙে কুসুমটা গেলে দিতে পারিস। যেভাবে ইচ্ছা।”

আমি একটা কাপে পানি রেখে ডিমটা ভেঙে সেখানে দিলাম, তারপর ভয়ে ভয়ে মাইক্রোওয়েভ ওভেন চালু করলাম।

এবারে ওভেনের ভেতর বিকট কোনো শব্দ হলো না। এক মিনিট পরে ওভেন খুলে দেখলাম কাপের ভিতর একটা এবড়োথেবড়ো সিদ্ধ ডিম। দেখে মনে হয় অক্টোপাসের বাচ্চা। দেখতে বিদঘুঁটে হলেও ডিমটা খেতে ঠিক সিদ্ধ ডিমের মতো!

আমি শুকনা রুটি আর বিদঘুঁটে সিদ্ধ ডিম খেয়ে কোনোমতে পেট ভরিয়ে মামাকে জিজ্ঞেস করলাম, “মামা, আমি এখন কিছু করব?”

“না। তোর এখন কিছু করতে হবে না। যখন করতে হয় বলব।”

“তাহলে কী করব?”

“জায়গাটা ঘুরে দেখতে পারিস। হারিয়ে যাবি না তো?”

“না মামা। এই জঙ্গলে বাঘ ভালুক আছে?”

“থাকার কথা না। থাকলেও তোকে খাবে না। তোর ভয় নাই।”

“আমাকে খাবে না কেন মামা?”

“তুই এতো রোগা পটকা। তোকে খেয়ে পোষাবে না।”

আমি তখন আমার পিঠে ব্যাকপেকটা ঝুলিয়ে ঘুরতে বের হলাম। ব্যাকপেকের ভিতর রাখলাম কিছু জামা কাপড়, একটা গল্প বই, কাগজ কলম আর অস্ত্র হিসেবে একটা পেন্সিল কাটার চাকু।

একটু হাঁটতেই আমি জংলা জায়গাটা থেকে বের হয়ে এলাম। সামনে উঁচু নিচু মাঠ, অনেক দূরে পানি চিক চিক করছে। সূর্যটা বেশ মাথার উপর, রোদটা ভালোই লাগছে। আমি আশপাশে দেখতে দেখতে পানির দিকে এগুতে লাগলাম। চারপাশে নির্জন। এর আগে আমি এরকম নির্জন জায়গা খুব বেশি দেখি নাই। নির্জন জায়গার মনে হয় এক ধরনের ভাব আছে, এখানে অন্য রকম লাগে। আমাকে কেউ দেখছে না তাই আমি যা খুশি তাই করতে পারি। ইচ্ছা করলে খালি গা হয়ে শার্টটা খুলে মাথায় বাঁধতে পারি। তাহলে রোদটাও কম লাগবে। আমি অবশ্য উল্টাপাল্টা কিছু না করে সামনের দিকে হাঁটতে থাকি। মাঝে মাঝে ঝোঁপ ঝাড় আছে। একটা ঝোঁপ থেকে মনে হলো একটা শেয়াল বের হয়ে খুব সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আরেকটা ঝোপে অদৃশ্য হয়ে গেল। একটা ছোট মতো জলা জায়গাও আছে সেখানে পৌঁছাতেই চারিদিক থেকে অনেকগুলো ব্যাঙ এক সাথে পানিতে লাফ দিল! আমি রীতিমতো চমকে উঠলাম। ব্যাঙরা যে এক সাথে লাফ দেয় আমি সেটাও জানতাম না। নানারকম পাখি দেখতে পেলাম, আমি অবশ্য কোনো পাখিকেই চিনি না। কিছু পাখি একেবারে লতাপাতার সাথে মিশে থাকে, দূর থেকে বোঝাই যায় না একেবারে কাছে গেলে ডানা ঝাঁপটিয়ে উড়ে যায়।

হেঁটে হেঁটে পানির কাছে পৌঁছানোর পর বুঝতে পারলাম জায়গাটা যেরকম পুরোপুরি নির্জন ভেবেছিলাম এটা সেরকম না। একটা ছোট নদী, পানিটা বেশ নিচুতে সেখানে বেশ কিছু নৌকা, একটা নৌকাতে একজন ছোটখাটো মানুষও আছে।

আমি নদীর তীরে দাঁড়িয়ে নৌকাটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। নৌকার মাঝি নৌকা থেকে নেমে পানিতে অদৃশ্য হয়ে গেল, একটু পরে ভুস করে ভেসে উঠল, তার হাতে একটা খাঁচার মতো কী যেন। সে খাঁচাটাকে নৌকার উপর রেখে তার ভেতর থেকে চকচকে মাছ বের করে একটা ঝুপড়ির মাঝে রাখে, তারপর আবার খাঁচাটা নিয়ে পানির নিচে অদৃশ্য হয়ে যায়। বেশ অনেকক্ষণ পর সে পানি থেকে ভেসে উঠে। একজন মানুষ যে নিঃশ্বাস না নিয়ে এতক্ষণ পানির নিচে থাকতে পারে আমি সেটাও জানতাম না।

মানুষটা যখন আবার তার নৌকায় উঠে একটা লগি দিয়ে ঠেলে নৌকাটা সামনে আনতে থাকে তখন আমি বুঝতে পারলাম যে মানুষটা আসলে আমার বয়সী একটা ছেলে! খালি গা, একটা লুঙ্গী মালকোচা মেরে পড়েছে। মাথায় একটা লাল গামছা, প্রত্যেকবার পানি থেকে উঠে গামছা দিয়ে শরীর মুছে নিচ্ছে।

নির্জন জায়গায় নদীর তীরে এসে মানুষের মনে নানারকম ভাব আসে। আমার ভিতরেও একটা গভীর ভাব এসে গেল। মনে হলো আহা, এই ছেলেটা আমার বয়সী কিন্তু আমি ভালো জামা কাপড় পরে স্কুলে লেখাপড়া করি কিন্তু এই ছেলেটাকে জীবন বাঁচানোর জন্য মাছ ধরতে হয়, পানিতে ডুবতে হয়। নিশ্চয়ই স্কুলে পড়ে না– আমার মতো সুযোগ পায় না। গভীর ভাবের কারণে আমি বড় মানুষের মতো একটা বিশাল দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।

ছেলেটা আমার কাছাকাছি এসে তার নৌকাটা থামাল, লগিটা পুতে নৌকাটাকে বেঁধে আবার পানিতে ডুবে গেল। আমি যখন প্রায় নিঃসন্দেহ হয়ে গেছি যে ছেলেটা আর ভেসে উঠবে না তখন সে আবার একটা মাছ ধরার খাঁচা নিয়ে ভুল করে ভেসে উঠল। ভেতরে অনেক মাছ কিলবিল করছে। ভালো করে দেখার জন্য আমি আরেকটু এগিয়ে গেলাম। ছেলেটা পিছন দিকটা খুলে হাত ঢুকিয়ে যখন মাছ বের করছে তখন আমি হঠাৎ করে দেখলাম ভিতরে একটা সাপ কিলবিল করছে। আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম, “সাপ! সাপ!”

ছেলেটা একটুও ভয় পেল না, আমার দিকে তাকিয়ে হাসল তারপর সাপটাকে খপ করে ধরে বের করে এনে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “এইটা সাপ না! এটা বাইম মাছ।”

“মাছ? এইটা মাছ?” আমি একটু অপ্রস্তুত হলাম, বললাম, “দেখতে একেবারে সাপের মতো।”

মাছটাকে ঝুড়ির ভেতর রাখতে রাখতে বলল, “সাপ আরো লম্বা হয়।”

ছেলেটা কিছু মাছ ঝুড়িতে রাখল, কিছু ছেড়ে দিল তারপর আবার পানিতে ডুবে গেল। এবারে আমি ভয় পেলাম না, আমি বুঝে গেছি এই ছেলে পানিতে অনেক সময় ডুবতে পারে। পানি থেকে বের হয়ে গামছা দিয়ে শরীর মুছতে মুছতে ছেলেটা আমার দিকে তাকালো, বলল, “তুমি কোথায় থাকো?”

আমি কোথায় থাকি বললে কী ছেলেটা সেটা চিনবে? তাই সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলল, “ঐ তো। অনেক দূর।”

ছেলেটা গামছাটা মাথায় বাঁধতে বাঁধতে বলল, “বলতে চাও না?” অনেক দূর মানে কত দূর? কোপেনহেগেন নাকি নিউইয়র্ক?”

আমি খাবি খেলাম। ছেলেটা আমাকে নিয়ে কী সহজে ঠাট্টা করল। দিল্লি নাকি দুবাই না বলে কোপেনহেগেন আর নিউইয়র্ক বলেছে। কোপেন হেগেনের নাম শুনেছি কিন্তু শহরটা কোথায় আমি নিজেও জানি না। আমি আমতা আমতা করে বললাম, “আমি এতদূর বলি নাই। মিরপুর। ঢাকা।”

“আমি মিরপুর গেছি। চিড়িয়াখানা আছে।”

“ও।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কোথায় থাক?”

ছেলেটা আমার মতো করে বলল, “ঐ তো। অনেক দূর।” তারপর হিহি করে হাসল, বলল, “একটু মজা করলাম। আমি কাছেই থাকি। মনে হয় চিনবা না। তিন বাঁক দূরে।”

“বাক? বাঁক মানে কী?”

“একটা নদী যখন একটু বেঁকে যায় সেইটাকে বলে বাক।”

“তার মানে একটা বাক এক কিলোমিটার হতে পারে আবার একশ কিলোমিটার হতে পারে।”

“পারে। তবে আমাদের নদী বাচ্চা নদী, এর বাঁক ছোট ছোট।”

বাহ! কী সুন্দর নদীটাকে বাচ্চা নদী বলল। কথা শুনেই বোঝা গেল নদীটাকে ছেলেটা আদর করে। আমি ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি স্কুলে পড়।”

“পড়ি।” সে তার লগি তুলতে তুলতে জিজ্ঞেস করল, “তুমি?”

“আমিও পড়ি।” তারপর বললাম, “আমার অবশ্য লেখাপড়া করতে ভালো লাগে না।”

“লেখাপড়া করতে কারো ভালো লাগে না।” ছেলেটা লগি দিয়ে নৌকাটাকে ধাক্কা দিতে গিয়ে থেমে গেল, বলল, “তুমি কোন ক্লাসে পড়?”

আমি বললাম, “সেভেন। তুমি?”

“এইট।”

আমি আরেকবার খাবি খেলাম। আমার থেকে এক ক্লাস বেশি। একটু আগে আমি ভেবেছিলাম ছেলেটা বুঝি লেখাপড়াই করে না।

ছেলেটা বলল, “সেভেন এইটে আসল লেখাপড়া শুরু হয় না। আসল লেখাপড়া শুরু হয় নাইন থেকে।”

“তুমি কেমন করে জান?”

“আমি নাইন টেনের বই দেখেছি। অনেক কিছু আছে। তবে মনে হয় ভুলভাল আছে।”

আমি আবার খাবি খেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, “ভুলভাল?”

“হ্যাঁ। নিউটনের সূত্রটা দেখছিলাম। লেখা হচ্ছে কোনো জিনিসের উপর বল প্রয়োগ করলে ত্বরণ হয়। এই নৌকাটারে লগি দিয়ে ঠেলা দিলে নৌকা নড়ে। ঠিক আছে। কিন্তু বড় একটা বজরাকে আমি কী লগি দিয়ে ঠেলে নড়াতে পারব? বল প্রয়োগ করলাম, ত্বরণ কই?”

ত্বরণ মানে কী আমি জানি না। তবে ছোট নৌকাকে লগি দিয়ে ঠেলা দিয়ে নাড়ানো যায়, বড় বজরাকে নাড়ানো যাবে না এর মাঝে কোনো ভুল নাই। নিউটন সাহেব যদি এইটাই বলে থাকেন তাহলে যে ভুল বলেছেন এর মাঝে কোনো সন্দেহ নাই। ছেলেটাতো ঠিকই বলছে। মনে হচ্ছে এই ছেলে নিজেও ছোটখাটো নিউটন।

আমি বললাম, “স্কুলের স্যারকে জিজ্ঞেস কর না কেন?”

“তুমি ভাবছ জিজ্ঞেস করি নাই?”

“স্যার কী বলেছে?”

“কিছু বলে নাই। কানের মাঝে একটা পাটকান দিয়েছে।”

পাটকান শব্দটা আগে শুনি নাই কিন্তু ছেলেটার কথার ধরন দেখে বুঝলাম চড় কিংবা ঘুষি জাতীয় কিছু হবে। আমি জিব দিয়ে চুক চুক শব্দ করে পৃথিবীর সব নিষ্ঠুর স্যারদের উপর বিতৃষ্ণা জানালাম।

ছেলেটা বলে, “তারপরও যখন জিজ্ঞেস করেছি তখন বাপ মা তুলে গালি দিয়ে বলল, তুই পড়িস ক্লাস এইটে নিউটনের সূত্র দিয়ে কী করবি? ধুয়ে পানি খাবি?”

আমি আবার জিব দিয়ে চুক চুক শব্দ করলাম। ছেলেটা যখন লগি দিয়ে আবার ঠেলা দিয়ে নৌকা দিয়ে চলে যাচ্ছিল তখন হঠাৎ আমার একটা কথা মনে হলো, বললাম, “তুমি একটা কাজ করতে পার। আমার মামা হচ্ছে সাইন্টিস” বলেই তাড়াতাড়ি শুদ্ধ করলাম, “মানে সায়েন্টিস্ট। তাকে জিজ্ঞেস করতে পার।”

“তোমার মামা কই?”

“আছে জঙ্গলের মাঝে?”

ছেলেটা অবাক হলো, ভুরু কুচকে জিজ্ঞেস করল, “জঙ্গলে কী করে?”

“গবেষণা করে।”

“জঙ্গলে গবেষণা করে?”

“হ্যাঁ। মামার একটা মাইক্রোবাসের মাঝখানে একটা ল্যাবরেটরি আছে। সেই মাইক্রোবাসে মামা থাকে, ঘুমায়, গবেষণা করে। আমিও থাকি।”

ছেলেটা এইবার যথেষ্ট কৌতূহলী হলো। লগি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে নৌকাটা নদীর তীরে লাগালো, তারপর লগিটা পুতে নৌকাটাকে আটকে নৌকা থেকে নেমে এলো। আমিও নদীর তীর থেকে নিচে নেমে এলাম, দুইজন কাছাকাছি দাঁড়ালাম। সে আমাকে খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল আমিও তাকে খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম।

ছেলেটা বলল, “তার মানে তুমি মনি কাঞ্চনে থাকো না?”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “মনি কাঞ্চন? সেটা আবার কী?”

“এটা রিসোর্ট।”

“রিসোর্ট মানে কী?”

“বড় লোকের হোটেল। এক রাতের ভাড়া পঞ্চাশ হাজার টাকা!”

“ধুর! এতো টাকা ভাড়া হয় কেমন করে।”

ছেলেটা গম্ভীর মুখে বলল, “হয়। এর থেকে বেশিও হয়।”

জিজ্ঞেস করলাম, “মনি কাঞ্চনটা কোথায়?”

“যদি হেঁটে যাও, দুই-তিন কিলোমিটার। নৌকাতে গেলে এক বাঁক পার হয়ে একটা হাওড়, হাওড়ের পাড়ে মনি কাঞ্চন। খুব কাছে।”

“তুমি কখনো গিয়েছ?”

ছেলেটা হা হা করে হাসল, তারপর বলল, “তুমি ভাবছ মনি কাঞ্চনে আমারে ঢুকতে দিবে? মনে হয় কাছে গেলেই আমারে গুলি করে দেবে।”

“গুলি করে দিবে?”

“মনে হয়। মনি কাঞ্চনের চারিদিকে দারোয়ানরা মেশিন গান নিয়ে ঘুরে।”

“মেশিন গান? ধুর।”

“বিশ্বাস কর না? তুমি একদিন গিয়ে দেখে আস।”

“আমি তো চিনি না।”

“ঠিক আছে আমি নিয়ে যাব। বেশি কাছে কিন্তু যাওয়া যাবে না। দূর থেকে দেখতে হবে।”

ছেলেটা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর বলল, “তাহলে তোমার মামা আমাকে নিউটনের সূত্র বোঝাতে পারবে? বকা দিবে না তো?”

“না। বকা দিবে না, কিন্তু অন্য ঝামেলা হতে পারে।”

ছেলেটা চিন্তিত মুখে বলল, “অন্য কী ঝামেলা?”

“তুমি জিজ্ঞেস করবে নিউটনের সূত্র। মামা নিউটন শেষ করে গ্যালেলিও, গ্যালেলিও শেষ করে আইনস্টাইন, আইনস্টাইন শেষ করে কাইনস্টাইন, কাইনস্টাইন শেষ করে টাইনস্টাইন সবার সূত্র বুঝিয়ে দেবে। তোমার বারোটা বেজে যাবে। সেইজন্য আমরা কখনো মামাকে সাইন্স নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করি না।”

ছেলেটা হি হি করে হাসল, বলল, “কানের উপর পাটকান না দিলেই হলো।”

“না। সেইটা কখনো দিবে না।”

“ঠিক আছে, আজকে বিকাল বেলা আসব।”

“খুঁজে পাবে?”

“জঙ্গলের মাঝে কী আর দশটা মাইক্রোবাসের ল্যাবরেটরি থাকবে? আমি খুঁজে বের করে ফেলব।”

“ঠিক আছে তাহলে।” আমি চলে যেতে যেতে থেমে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি এখন কী করবে?”

“আমার আরো দুইটা ঝাঁকা পানির তলা থেকে তুলতে হবে। তারপর বাড়ি যাব।” ছেলেটা হঠাৎ থেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“তুমি কী করবে?”

“আমি একটু জায়গাটা ঘুরে দেখব।”

“তুমি সাঁতার জান?”

“জানি।”

“তাহলে তুমি আমার সাথে নৌকায় একটু ঘুরতে পার।”

“সত্যি?” আমি খুশি হয়ে বললাম, “নিবে আমাকে?”

“নিব না কেন? আস।”

আমি ছেলেটার সাথে নৌকায় উঠলাম। নৌকাটা একটু দুলে উঠল, মনে হলো পড়ে যাব কিন্তু শেষ পর্যন্ত পড়লাম না। ছেলেটা লগি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে নৌকাটাকে নদীর মাঝে নিয়ে এসে বৈঠা হাতে নৌকা বাইতে শুরু করল।

আমি বললাম, “আমাকে নৌকা চালানো শিখাবে?”

“এর মাঝে শিখানোর কিছু নাই। চেষ্টা করবে শিখবে।”

“একটু চেষ্টা করি?”

“কর।” বলে সে নৌকার পিছনে বৈঠাটা রেখে সামনে চলে এলো, আমি সাবধানে পিছনে গিয়ে বৈঠা হাতে নিয়ে নৌকা বাওয়ার চেষ্টা করলাম। প্রথমে সেটা সামনে না গিয়ে ঘুরে যেতে লাগল। আমি বললাম, “কী হলো ঘুরে যায় কেন?”

ছেলেটা বলল, “আমি বলে দিতে পারি, কিন্তু তাতে লাভ হবে না। তোমার নিজের আবিষ্কার করতে হবে।”

কাজেই বেশ খানিকক্ষণ চেষ্টা করে আমি নিজে আবিষ্কার করলাম কেমন করে নৌকা বাইতে হয়। যখন সত্যি সত্যি শিখে ফেললাম তখন এতো আনন্দ হলো সেটা আর কী বলব। তবে বৈঠা বাইতে যে এতো পরিশ্রম সেটা আমি জানতাম না। একটু খানি যেতেই মনে হলো জান বের হয়ে যাচ্ছে।

আমার অবস্থা দেখে ছেলেটা হাসল, মাথা নেড়ে বলল, “তোমাদের শহরের ছেলেদের এই হচ্ছে সমস্যা। গায়ে কোনো জোর নাই।”

আমি বললাম, “দিনরাত ঘরের ভিতরে বসে থাকলে জোর হবে কেমন করে? আমাদের স্কুলে খালি বিল্ডিং- একটা খেলার মাঠও নাই!”

“আমাদের উল্টা। খালি মাঠ। বিল্ডিং নাই।”

আমি দাঁতে দাঁত চেপে আরো খানিকক্ষণ নৌকা বেয়ে নিলাম। তখন ছেলেটা বলল, “থামো এইখানে। আমার ঝাঁকাটা তুলি।”

আমি নৌকা থামালাম। ছেলেটা তার জায়গাটা খুঁজে বের করে নৌকাটাকে সেখানে নিয়ে গেল। লগিটা পুতে সে যখন পানিতে নামবে তখন আমি বললাম, “আমিও পানিতে নামি?”

“নামতে চাইলে নাম।”

“আমি দেখি পানির নিচে তুমি কী কর!”

“কিছুই দেখবে না। পানি ঘোলা আর পানির নিচে দেখা যায় না।”

“যেটুকু দেখা যায়!”

“ঠিক আছে।”

আমি শার্টটা খুলে ছেলেটার সাথে পানিতে নামলাম। নদীর পানি উপরে মোটামুটি কুসুম কুসুম গরম নিচে কনকনে ঠান্ডা। ছেলেটা মাথা নিচের দিকে দিয়ে তলিয়ে গেল আমি চেষ্টা করেও নিচে নামতে পারলাম না, যখনই চেষ্টা করি উপরের দিকে ভেসে উঠি। বুঝতে পারলাম পানির তলায় যাওয়া এতো সোজা না।

ছেলেটা মাছের খাঁচাটা তুলে আনল, ভেতরে বেশ কিছু মাছ। এবারে মাছের সাথে একটা কাঁকড়াও আছে। সাপের মতো দেখতে একটা মাছও ছিল কিন্তু এটাকে সে পানিতে ছেড়ে দিল। বাইম মাছের মতো দেখালেও এটা নাকি বাইম মাছ না, এটার নাম কুইচ্যা। কুইচ্যা মাছ নাকি খায় না! বাইম মাছ খাওয়া গেলে কুইচ্যা মাছ কেন খাওয়া যাবে না আমি বুঝতে পারলাম না।

নৌকায় উঠে আমিও ছেলেটার গামছা দিয়ে শরীর মুছে নিলাম। প্যান্টটা ভেজা তাই শার্ট না পরে ছেলেটার মতো খালি গায়ে বসে রইলাম। ছেলেটা আবার নৌকা ছেড়ে দিল। পরের ঝকার কাছে পৌঁছে সে আবার নৌকা থামাল। আমি বললাম, “এইবার আমি একা নামব। দেখি তোমার ঝকা তুলতে পারি কি না।”

ছেলেটা বলল, “ঠিক আছে। নামো।”

“জায়গাটা দেখিয়ে দাও।”

“এই লগিটা যেখানে পুতেছি, তার কাছে। যাও, নামো।”

আমি আগে আগে নামছিলাম সে আমাকে একটা ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিয়ে হি হি করে হাসতে লাগল। আমি তখন মাথা নিচে দিয়ে পানিতে ডুব দিলাম। যদি আমার বাসার কেউ দেখতে আমি নদীর পানিতে এভাবে ঝাঁপ দিয়ে পানির নিচে চলে যাচ্ছি তাহলে এতোক্ষণে নিশ্চয়ই ভয়ে চিৎকার করতে করতে হার্টফেল করে ফেলত! নিচে কনকনে ঠান্ডা পানি আমি বেশিদূর নামতে পারলাম না, ভুস করে ভেসে উঠলাম। বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে আবার নিচে নেমে গেলাম, এবার মনে হয় আরো নিচে নামতে পারলাম, হাত দিয়ে আঁকাটাকে খুঁজতে থাকি। নরম কাদার মাঝে হাত লাগল, মনে হলো পিছল মতন কিছু একটা হাতের উপর দিয়ে চলে গেল। অন্য কোনো সময় হলে নির্ঘাত ভয়ে চিৎকার করে উঠতাম, আজকে কিছুই করলাম না। হাতটা নাড়াতে থাকলাম, হঠাৎ করে একটা আঁকা হাতে লাগল। টেনে তোলার আগেই মনে হলো নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মরে যাব, তাই আঁকা ছাড়াই উপরে উঠে এলাম। ছেলেটা একটু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী অবস্থা? পারবে? নাকি আমি নামব?”

“পারব। আর একবার।” আমি বড় বড় করে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে আবার ডুবে গেলাম। এবারে সত্যি সত্যি খাঁচাটা একবারে পেয়ে গেলাম তারপর সেটা টেনে উপরে নিয়ে এলাম।

ছেলেটা আমাকে দেখে হাততালি দিয়ে বলল, “বাহ! বাহ্! এই তো শিখে গেছ!”

আমি খাঁচাটা নৌকার ওপর রেখে নিজেকে টেনে নৌকার ওপর তুলে খানিকক্ষণ নিঃশ্বাস নিয়ে বললাম, “দাও, আমি মাছগুলো বের করি।”

“পারবে?”

“কেন পারব না?”

“ছেলেটা ভেতরে উঁকি দিয়ে বলল, ভেতরে মনে হয় একটা শিং মাছ আছে। শিং মাছ ঘা দিলে কিন্তু খুব ব্যথা। বিষাক্ত।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কোনটা শিং মাছ?”

“ঐ যে কালো মাছটা। দুই পাশে বিষাক্ত কাটা। দাঁড়াও এইটা আমি বের করে দিই। তুমি অন্যগুলো বের করো।”

ছেলেটা খুব কায়দা করে শিং মাছটার মাথাটা কীভাবে জানি চেপে ধরে টেনে বের করে ঝুপড়ির ভেতর রেখে দিল। আমি অন্য মাছগুলো বের করলাম। একটা দুইটা মাছের রং কী সুন্দর। ছেলেটা বলল, এই মাছগুলোর বিয়ে হচ্ছে তাই নাকি তাদের এতো সুন্দর রং। কী আশ্চর্য, মাছদেরও বিয়ে হয়! গায়ে হলুদ হয়!

একদিনে কতো কী মজার জিনিস জেনে গেলাম।

সব মাছ বের করার পর ছেলেটা খাঁচাটা আবার পানির নিচে রাখার জন্য নদীতে ঝাঁপ দিল। আমি তার গামছা দিয়ে শরীরটা মোছার চেষ্টা করছি ঠিক তখন একটা মেয়ের গলা শুনতে পেলাম, “এই যে মাঝি।”

আমি চমকে উঠলাম, কে কথা বলে? নদীর তীরে তাকিয়ে দেখি সেখানে একটা নাদুসনুদুস ছেলে আর একটা টিসটাস মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনই আমাদের বয়সী কিংবা এক দুই বছর বড়। দুজনেই ফর্সা কিন্তু নিশ্চয়ই রোদে হাঁটাহাঁটি করার অভ্যাস নাই, তাই রোদে, গরমে, ঘামে লাল হয়ে আছে। আমি অবাক হয়ে তাকালাম, আমাকেই মাঝি বলে ডাকছে তাতে কোনো সন্দেহ নাই। আমার জীবনে আমাকে অনেক কিছু বলে ডাকা হয়েছে (যার বেশির ভাগই মোটামুটি অসম্মানজনক) কিন্তু এর আগে কখনোই কেউ আমাকে মাঝি বলে ডাকে নাই। আমি নিজের দিকে তাকালাম, সারা শরীরে কাদা, খালি গা, মাথায় শার্টটা বেঁধে রেখেছি, জামা কাপড় ভিজা। কাজেই কেউ যদি আমাকে মাঝি বলে ডাকে অবাক হবার কিছু নাই।

মেয়েটা আবার ডাকলো, “মাঝি, এই মাঝি।”

আমি বললাম, “আমাকে ডাকছ?”

নাদুসনুদুস ছেলেটা মুখ ভ্যাংচে বলল, “আর কাকে ডাকব? আর কে আছে এইখানে?”

খুবই সত্যি কথা। এইখানে অবশ্য আরো একজন আছে যে এই মুহূর্তে পানির নিচে খাঁচাটা বসাচ্ছে সেটা অবশ্য তাদের জানার কথা না। সেই মুহূর্তে ছেলেটা পানির নিচ থেকে ভুস করে ভেসে উঠল, নাদুসনুদুস ছেলে আর টিসটাস মেয়েটা একটু চমকে উঠল। পানির নিচে কেউ এতক্ষণ ডুবে থাকতে পারে সেটা তাদের জানার কথা না। আমি নিজেও আগে জানতাম না।

ছেলেটা ভেজা শরীরে নৌকায় উঠে একবার আমার দিকে তাকালো তারপর তীরে দাঁড়ানো নাদুসনুদুস ছেলে আর টিসটাস মেয়ের দিকে তাকাল, তারপর আবার আমার দিকে তাকাল। তারপর জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার?”

আমি বললাম, “এরা মাঝির সাথে কথা বলতে চায়।”

ছেলেটার চোখে কৌতুক ঝিলিক করে উঠল। নৌকাটায় উঠতে উঠতে নাদুসনুদুস ছেলে আর টিসটাস মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি হেড মাঝি।” আমাকে দেখিয়ে বলল, “এ হচ্ছে আমার এসিস্টেন্ট। বল, কী বলতে চাও।”

মেয়েটা বলল, “আমরা হারিয়ে গেছি।”

আমার কেন জানি হাসি পেয়ে গেল, কষ্ট করে হাসি থামিয়ে বললাম, “কে বলেছে তোমরা হারিয়ে গেছ? এই যে তোমরা আমাদের সামনে! স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।”

মোটাসোটা ছেলেটা গরম হয়ে বলল, “ঠাট্টা করবে না। আমরা মনি কাঞ্চন যাচ্ছিলাম এখন রাস্তা খুঁজে পাচ্ছি না।”

মনি কাঞ্চন শুনেই আমাদের হেড মাঝি তার মাথা মোছা বন্ধ করে আমার দিকে অর্থপূর্ণভাবে তাকাল। তার চোখের দৃষ্টির অর্থ যা কিছু হতে পারে, আমি ধরে নিলাম সে বলছে, “এরা হচ্ছে সেই বড়লোকের বাচ্চা যারা পঞ্চাশ হাজার টাকার হোটেলে থাকে। এদের শরীরের চামড়া মাখনের মতো নরম, জোছনার আলোতে সেই চামড়া পুড়ে যায়।

ছেলেটা অধৈর্য হয়ে বলল, “মনি কাঞ্চন কীভাবে যেতে হয় জান?”

“জানি। যদি হেঁটে যেতে চাও অনেক দূর। কমপক্ষে তিন চার কিলোমিটার। নৌকায় গেলে কাছে। এই বাঁকটা পার হলেই হাওড়, হাওড়ের পাড়ে।”

মেয়েটা বলল, “আমাদের নৌকা করে মনি কাঞ্চনে পৌঁছে দাও।”

আমি একটু অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকালাম, অনুরোধ নয় আবার আদেশও নয়। একটা দাবী। আমাদের উপর যেন তার একটা অধিকার আছে। আমি ভেবেছিলাম আমাদের হেড মাঝি সরাসরি না বলে দেবে কিন্তু সে না বলল না। আমার দিকে একবার তাকালো তারপর নাদুসনুদুস ছেলে আর টিসটাস মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল, “সাঁতার জান?”

মেয়েটা বলল, সুইমিং পুলে জানি।”

“নৌকা ডুবে গেলে সাঁতরাতে পারবে?”

নাদুসনুদুস ছেলেটা কেমন যেন ভয় পেয়ে বলল, “নৌকা কেন ডুবে যাবে?”

“আমি বলি নাই ডুববে, বলেছি যদি ডুবে যায়।”

মেয়েটা বলল, “কেন ডুবে যাবার কথা বলছ?”

“দেখ, আমার নৌকা ঘোট। তোমাদের যদি নৌকায় উঠার অভ্যাস না থাকে, ওঠে যদি নড়াচড়া করো নৌকা কাত হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া তোমাদের মনি কাঞ্চনের একটা বেয়াদব স্পিডবোট আছে, সেটাতে মাস্তানেরা ঘুরে বেড়ায়। সেটার বিশাল ঢেউ হয়, সেটা যদি নৌকার গা ঘেষে যায় তবে যা কিছু হতে পারে। সেই জন্য”

মেয়েটা কোনো কথা বলল না। নাদুসনুদুস ছেলেটা বলল, “আমরা খুব সাবধানে থাকব।”

ছেলেটা লগি দিয়ে নৌকাটাকে তীরের কাছে নিয়ে বলল, “নাও। উঠো নৌকায়।”

ছেলেটা আর মেয়েটা জুতা খুলে পানিতে পা ভিজিয়ে নৌকায় উঠল। তারা নৌকার মাঝামাঝি বসেছে, আমি পিছনে বসেছি।

ছেলেটা লগি দিয়ে ঠেলে নৌকাটাকে নদীর ভেতরে দিয়ে বৈঠা হাতে তুলে নিল। নৌকার গলুইয়ে আরো একটা বৈঠা ছিল আমি সেটা হাতে নিয়ে নৌকা বাইতে সাহায্য করতে লাগলাম।

একটু পরেই ছেলে আর মেয়েটি নিজেদের ভিতরে কথা বলতে শুরু করল। আমরা যেন বুঝতে না পারি সেইজন্য ইংরেজিতে বলছে, ছেলেটা বলল, “এদের কতো টাকা ভাড়া দিতে হবে?”

মেয়েটা বলল, “জানি না।”

“আগে থেকে ঠিক করে নেয়া উচিত ছিল। পরে অনেক বেশি চাইবে।”

“চাইলে চাইবে।”

আমি বললাম, “এই ছেলে আর মেয়ে। তোমরা ইংরেজি ছাড়া আর কোনো ভাষা জানো?”

মেয়েটা অবাক হয়ে বলল, “কেন?”

কারণ, “আমরা ইংরেজি জানি। তোমরা কী বলছ আমরা বুঝতে পারছি।”

নাদুসনুদুস ছেলে আর টিসটাস মেয়ে কেমন যেন চমকে উঠল, নৌকা বাইতে বাইতে আমাদের হেড মাঝি হা হা করে হেসে বলল, “তোমাদের কোনো টাকা দিতে হবে না। আমরা টাকার জন্য তোমাদের মনি কাঞ্চন নিয়ে যাচ্ছি না।”

নাদুসনুদুস ছেলেটা বলল, “তাহলে কী জন্যে নিয়ে যাচ্ছ?”

আমি বললাম, “হাওড়ের মাঝখানে নিয়ে তোমাদের ছিনতাই করার জন্য।”

মেয়েটা হেসে ফেলল, বলল, “যাও। ঠাট্টা করো না।”

আমাদের হেড মাঝি বলল, “তোমাদের নিয়ে যাচ্ছি কারণ তোমরা বিপদে পড়েছ সেইজন্য।”

ছেলেটা মুখ গোঁজ করে বসে রইল, মেয়েটা বলল, “থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।”

আমি বললাম, “আগেই এতো থ্যাংক ইউ দিও না। তোমাদের মনি কাঞ্চনের গার্ডেরা নাকি মেশিনগান হাতে নিয়ে পাহারা দেয়। দূর থেকে আমাদের দেখে মেশিনগান দিয়ে গুলি না করে দেয়।”

আমার কথা শুনে মেয়েটা আবার হি হি করে হাসল। মেয়েটা হাসিখুশি, ছেলেটা ভোতা। নৌকা করে যেতে যেতে মেয়েটা আমাদের সাথে কথাবার্তা বলল, আমরা যে আসলে মাঝি না তাদের মতো স্কুলে পড়ি ব্যাপারটা টের পেয়ে একটু লজ্জাও পেল। আমি এখন জঙ্গলে একটা মাইক্রোবাসের ভিতরে ল্যাবরেটরিতে থাকি শুনে খুব অবাক হলো। জায়গাটা ঠিক কোথায় জেনে নিল। বেশ কয়েকবার বলল, সে দেখতে আসবে। নাদুসনুদুস ছেলে অবশ্য কোনো উৎসাহ দেখাল না।

নদীর বাঁকটা ঘুরতেই আমি দূরে মনি কাঞ্চন দেখতে পেলাম। দূর থেকে একেবারে রাজপ্রাসাদের মতো মনে হয়। পুরো এলাকাটা ঘিরে মনে হয় অনেক রকম গার্ড, নিশ্চয়ই বাইনোকুলার দিয়ে দেখে। দূরে আমাদের নৌকাটা দেখামাত্র তারা সেই বেয়াদব স্পিডবোটে করে আমাদের দিকে রওনা দিল, স্পিডবোটে একজন একটা অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, দেখে মনে হয় সত্যিই গুলি করে দেবে। স্পিডবোটটা কাছাকাছি আসার আগেই তাদের ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল যেন ঢেউয়ের জন্য ঝামেলা না হয়। কাছাকাছি এসে গার্ডগুলো টিসটাস মেয়ে আর নাদুসনুদুস ছেলের খোঁজ খবর নিল। তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা জানতে চাইল। তারপর খুব সাবধানে তাদেরকে স্পিডবোটে তুলে নিল। আমাদের দুইজনের দিকে একবার ঘুরেও তাকালো না, আমাদেরকে দেখেছে কিনা সেটাও বুঝতে পারলাম না।

স্পিডবোটটা যাবার সময় পুরো ইঞ্জিন চালিয়ে গর্জন করে চলে গেল, তার ঢেউয়ে আমাদের ছোট নৌকা দুলতে লাগল, দুলতে দুলতে ডুবে গেলেও এখন তাদের আর সমস্যা নেই। তাদের মনি কাঞ্চনের গেস্টদের তারা তুলে নিয়েছে। ঢেউ কমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে আমরা আবার বৈঠা তুলে নিয়েছি। দূর থেকে স্পিডবোটের মেয়েটা একবার আমাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল, আমিও হাত নাড়লাম। হেড মাঝি ছেলেটা হাত নাড়ল না, চাপা গলায় বলল, “বড় লোক হওয়ার কত সমস্যা দেখছ?”

সমস্যাটা কী আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না, কিন্তু তারপর মাথা নেড়ে মেনে নিলাম যে বড় লোক হবার অনেক সমস্যা।

ঠিক যেখান থেকে আমি নৌকায় উঠেছিলাম ছেলেটা আমাকে সেখানে নামিয়ে দেল। আমি আবার ব্যাকপেকটা নিয়ে ঠিক চলে যাবার আগে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার নামটা জানা হয় নাই। হেড মাঝি ডাকব নাকি আরো নাম আছে?”

ছেলেটা হাসল, বলল, “হেড মাঝি ডাকতে পার, সমস্যা নাই। তবে আমাকে সবাই মাহবুব ডাকে। তোমার?”

“আমার নামটা খুবই জঘন্য। এসিস্টেন্ট মাঝিই ভালো।”

ছেলেটা আবার হাসল, তারপর বলল, “জঘন্য নামটাই শুনি।”

“টোপন।”

“টোপন? কী সুন্দর নাম, জঘন্য বলছ কেন?” আমি আর কিছু বললাম না। এইভাবে আমার সাথে হেড মাঝি মাহবুবের পরিচয় হলো।

 ০৫. বিকাল বেলা একটা ছেলে

০৫.

বিকাল বেলা একটা ছেলে মামার মাইক্রোবাসের কাছে হাজির হলো। ছেলেটার ফিটফাট পোশাক চোখে চশমা, চুল পরিপাটি করে আচড়ানো, পায়ে জুতো মোজা, পিঠে একটা ব্যাকপেক। জঙ্গলের ভিতরে খুঁজে খুঁজে সে মামার মাইক্রোবাসটা বের করে ফেলেছে। মামা মাইক্রোবাসটার ভিতরে কাজ করছে, আমি পিছনে পা ঝুলিয়ে বসে আছি। ছেলেটা আমার কাছে এসে হাসিমুখে দাঁড়াল, যেন সে আমার কত দিনের পরিচিত। সে কাকে চায় জিজ্ঞেস করতে গিয়ে আমি থেমে গিয়ে চিৎকার করলাম, “আরে হেড মাঝি!”

মাহবুব মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ আমি।”

“তোমাকে আমি চিনতে পারি নাই! চশমায় অন্যরকম লাগছে।” আসলে শুধু চশমা না সবকিছু মিলিয়ে অন্যরকম লাগছে! তাকে আর বলতে পারলাম না গ্রামের ছেলে হলেই লুঙ্গি পরে থাকবে, খালি গায়ে থাকবে এরকম একটা ধারণা হয়ে গিয়েছিল।

“মাছ ধরতে গেলে বাড়িতে চশমা রেখে যাই।”

মামা ভিতর থেকে বলল, “কে এসেছে, টোপন?”

আমি বললাম, “ঐ যে মাহবুবের কথা বলেছিলাম, যে আমাকে নৌকা চালাতে শিখিয়েছে।”

মামা বলল, “যে নিউটনের সূত্রের ভুল বের করেছে?

মাহবুব লজ্জা পেয়ে বলল, “না না, নিউটনের ভুল না, মনে হয় আমার বুঝতে ভুল।”

মামা তখন মাইক্রোবাসের ভেতর থেকে বের হয়ে এলো। মাহবুবের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার পিঠে এতো বড় ব্যাকপেকে কী?”

মাহবুব ব্যাকপেকটা ঘাড় থেকে খুলে বলল, “আমার মা আপনাদের জন্য একটু খাবার রান্না করে পাঠিয়েছেন।”

মামা চোখ বড় বড় করে বলল, “খাবার রান্না করে পাঠিয়েছেন, সত্যি?”

মাহবুব মাথা নাড়ল, বলল, “বেশি কিছু না। আজকে টোপন আর আমি যে মাছ ধরেছি তার একটু ঝোল। সবজি ডাল এইসব, সাথে একটু

মাহবুব ব্যাকপেকের ভেতর থেকে প্লাস্টিকের কৌটা বের করতে করতে কথা শেষ না করে থেমে গেল।

মামা জিজ্ঞেস করল, “সাথে একটু কী?”

“আপনারা খাবেন কি না জানি না, আমি না করেছিলাম, মা তবুও দিয়ে দিল।”

“কী না করেছিলে?”

“একটু চেপা ভর্তা।”

মামা আনন্দের মতো শব্দ করল, “চেপা ভর্তা! সত্যি?”

“আপনারা খান?”

“টোপনের কথা জানি না, সে তত ভদ্রলোকের বাচ্চা, আমি খাই। ঝাল দিয়ে লাল করে চেপা ভার্তা, আহা, বেহেশতি খাবার।”

মাহবুব হাসল, “তাহলে তো ভালো।”

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “মামা, যে খাবারে পচা গন্ধ সেইটা বেহেশতি খাবার হয়ে কেমন করে? বেহেশত কী দুর্গন্ধের জায়গা?”

মামা ধমক দিল, বলল, “যেটা বুঝিস না সেইটা নিয়ে কথা বলিস না।”

তাই আমি আর কথা বললাম না। মাহবুব মাইক্রোবাসের ভিতরে উঁকি দিয়ে একেবারে হতবাক হয়ে গেল। মাথা নেড়ে বলল, “ইয়া মাবুদ! এতো যন্ত্রপাতি? আপনি কী নিয়ে গবেষণা করেন?”

মামা উত্তর দেওয়ার আগেই আমি বললাম, “পরিবেশ দূষণ।”

মাহবুব ভুরু কুচকালো, “পরিবেশ দূষণ?”

“হ্যাঁ। বিভিন্ন জায়গার সেম্পল নিয়ে তারপর সেইগুলো পরীক্ষা করে দেখা হয় তার ভিতরে কী আছে।”

“সেইজন্য এতো যন্ত্রপাতি লাগে?” সে তখনো ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছে না।

মামা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ, অনেক সময় লাগে।”

মিথ্যা কথা বলতে বেশি ভালো লাগে না, মামাও স্বস্তি পাচ্ছিল না তাই কথা ঘোরানোর জন্য বলল, “নিউটনের সূত্র নিয়ে তোমার সমস্যাটা কী?”

মাহবুব একটু লাজুক মুখে বলল, “আমাদের ক্লাসে সেটা নাই আমি ক্লাস নাইনের বইয়ে দেখেছি। মনে হয় বুঝতে পারি নাই।”

“কী বুঝতে পার নাই?”

“সূত্রে লেখা আছে যে কোনো ভরে বল প্রয়োগ করলে তার ত্বরণ হয়। কিন্তু ভরটা যদি অনেক বড় হয়ে তাহলে কী আমি ধাক্কা দিলে ত্বরণ হবে? সেটা নড়বে? নড়বে না।”

মামা হাসি হাসি মুখে বলল, “নড়বে না?”

“না। আমি কী একটা ট্রাককে ধাক্কা দিয়ে নড়াতে পারি? কোনোদিন নড়াতে পারব না।

মামা হাসল, “ঠিকই পারতে যদি কোনো ফ্রিকশান না থাকতো। ট্রাকটা যদি পুরোপুরি পিছলে একটা জায়গায় থাকতো তাহলে তুমি ঠিকই নড়াতে পারতে।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ। সত্যি।”

তারপর মামা তার অভ্যাসমতো বকবক করা শুরু করে দিল। নিউটনের সূত্র বোঝায় তারপর হাত পা মাথা নেড়ে উদাহরণ দেয়। তারপর আরো কথা বলে। মাহবুব ছেলেটা এমনিতে চালাক চতুর কিন্তু সে মামার সামনে রীতিমতো বোকামি শুরু করল। শুধুমাত্র হু হা করে মাথা না নাড়িয়ে উল্টো প্রশ্ন করতে লাগল। মামাকে তখন পায় কে! আরো উত্তেজিত হয়ে আরো বেশি কথা বলতে লাগল।

মামাকে কেমন করে থামানো যায় যখন সেটা চিন্তা করছি ঠিক তখন আমি মানুষের গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম, মনে হলো তার মাঝে একটা মেয়ের গলার স্বরও আছে। আমি মাইক্রোবাস থেকে নেমে এদিক সেদিক তাকাচ্ছি তখন দেখলাম আজকে দুপুরে দেখা হওয়া টিসটাস মেয়ে আর ভোতা ছেলেটা এদিকে আসছে। তাদের পিছনে একজন বড় মানুষ, এই দুইজনের বা একজনের বাবা চাচা কেউ একজন হবে।

আমাদেরকে দেখে মেয়েটা একটা আনন্দের মতো শব্দ করল এবং তখন মামা তার বিজ্ঞান নিয়ে বকর বকর থামিয়ে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল।

মেয়েটা বলল, “এই তো পেয়ে গেছি। বলেছিলাম না, একটা মাইক্রোবাসের ভিতর ল্যাবরেটরি!

তারপর আমার আর মাহবুবের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল, “তোমরা? তোমাদেরকে চিনতে পারি নাই।”

আমি মুখ শক্ত করে বললাম, “কেন চিনতে পার নাই?”

“শার্ট পরে আছ তো সেইজন্য! আমি ভেবেছিলাম তোমরা সবসময় খালি গায়ে থাক!” তারপর হি হি করে হাসল। মেয়েটার মনে হয় হাসির রোগ আছে।

তাদের সাথের বড় মানুষটা বলল, “সব সময় ঠাট্টা করবি না। ডোরিন।”

মেয়েটার নাম ডোরিন। সে বড় মানুষটার দিকে তাকিয়ে বলল, “আব্বু, এই যে এরা দুইজন নৌকা করে আমাদের পৌঁছে দিয়েছিল।” তারপর আমাকে দেখিয়ে বলল, “এই যে ছেলেটা বলেছিল হাওড়ের মাঝখানে নিয়ে আমাদের ছিনতাই করবে। টনি সেটা বিশ্বাস করে যা ভয় পেয়েছিল!” মেয়েটা আবার হি হি করে হাসতে শুরু করে।

ভোতা ছেলেটার নাম নিশ্চয়ই টনি, সে মুখটা আরো ভোতা করে বলল, “আমি ভয় পাই নাই।”

“পেয়েছিলি। তোর মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল।”

“বোঝা যাচ্ছিল না–”

“এইখানে যে মাইক্রোবাসের ভিতরে ল্যাবরেটরি আছে তুই সেইটাও বিশ্বাস করিস নাই। এখন বিশ্বাস হয়েছে?”

মেয়েটার আব্বু একটু এগিয়ে এসে বলল, “ওয়েল ডোরিন, টনিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সেটা তো আমিও ঠিক বিশ্বাস করিনি! আসলেই তো এই মাইক্রোবাসের ভিতরে দেখি রীতিমতো হলিউডের সাইফাই ল্যাব।”

মামা তখন এগিয়ে এসে ডোরিনের আব্বুর সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল, “না না! সেরকম কিছু না। স্ট্যান্ডার্ড যন্ত্রপাতি। ছোট জায়গার মাঝে গাদাগাদি করে রাখা হয়েছে বলে এরকম লাগছে।”

তখন ডোরিনের বাবা নিজের পরিচয় দিল, মামা তার পরিচয় দিল। তারপর বড় মানুষেরা নিজেদের ভিতরে যেভাবে কথা বলে সেভাবে কথা বলতে লাগল। কে কী করে, কোথায় থাকে, কোথায় লেখাপড়া করেছে। এইসব বেদরকারি কথা। কিন্তু এমনভাবে মুখ গম্ভীর করে কথা বলে যে মনে হয় এই কথাগুলো বুঝি খুবই দরকারী কথা। আমরা একটু অধৈর্য হয়ে যাচ্ছিলাম, একটু সরে গিয়ে নিজেরা কথা বলব কী না চিন্তা করছিলাম, তখন মামা আর মেয়েটার বাবা একটু থামল। মেয়েটা তখন মামার মাইক্রোবাসের ভিতরে উঁকি দিয়ে বলল, “এত যন্ত্রপাতি!” তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি এই সব যন্ত্রপাতি চিনো?”

যদি আশেপাশে মামা না থাকতো তাহলে মুখ গম্ভীর করে বলতাম, ‘হ্যাঁ চিনি। তারপর কোন যন্ত্র কী কাজে লাগে সেটা বানিয়ে বানিয়ে বলতে শুরু করতাম। কিন্তু মামা কাছে দাঁড়িয়ে আছে আমি তো আর সেইটা করতে পারি না। কীভাবে উত্তর দেওয়া যায় চিন্তা করছি তখন মামা বলল, “হ্যাঁ টোপন সব চিনে। টোপন হচ্ছে আমার এসিস্টেন্ট, আমার অনেক যন্ত্র সে অপারেট করতে পারে।”

ডোরিন নামের মেয়েটা চোখ কপালে তুলে বলল, “ও মাই গড! তার মানে তুমিও একজন সায়েন্টিস্ট?”

আমি বললাম, “না, না, আমি সায়েন্টিস্ট না।”

মামা বলল, “আসলে টোপন ছোটখাটো একটা সায়েন্টিস্ট, আমার কাজকর্মে একজন এসিস্টেন্ট দরকার সেইজন্য টোপনকে নিয়ে এসেছি। টোপন খুবই স্মার্ট ছেলে”

আমি মামার দিকে তাকালাম, মামা কেন এভাবে বলছে বুঝতে পারলাম না। আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করছে কী না কে জানে! কিন্তু গলার স্বরে তো ঠাট্টা করার কোনো ভাব নেই।

মামা গম্ভীর গলায় বলল, “আসার সময় একটা রোড একসিডেন্ট ভিক্টিম ফেমিলি পেয়েছিলাম, সবাইকে আমরা হাসপাতালে নিয়েছি, টোপন খুবই দায়িত্বশীল মানুষের কাজ করেছে।”

ডোরিনের বাবা বলল, “হাউ নাইস!”

মামা থামল না, বলতে থাকল, “আজ দুপুরে টোপনকে পাঠিয়েছি এলাকাটা সার্ভে করে আসতে, সে ফিরে এসেছে ভিজে কাপড়ে! তার মানে পানিতেও নেমেছে। নৌকা চালানো শিখে এসেছে। শুধু তাই না, এলাকার ছেলে পিলেদের সাথে ফ্রেন্ডশিপ করে এসেছে। এমনই চমৎকার ফ্রেন্ডশিপ যে একজনের মা রান্না করে খাবার পাঠিয়েছেন। কমপ্লিট উইথ চেপা ভর্তা।”

ডোরিনের বাবা বলল, “চেপা ভর্তা? হাউ ওয়ান্ডারফুল!”

“তার মানে বুঝতে পারছেন? আজ রাতে আমাদের শুকনা রুটি আর ডিম সিদ্ধ খেতে হবে না! আমরা সত্যিকারের খাবার খাব। সব টোপনের সৌজন্যে।”

ডোরিনের বাবা বলল, “সময় পেলে আমাদের রিসোর্টে চলে আসবেন। আমরা এক সাথে লাঞ্চ কিংবা ডিনার করতে পারি।” তারপর আমার আর মাহবুবের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমরা দুইজন অবশ্যই আসবে। ভিতরে চমৎকার একটা ফ্যামিলি পুল আছে, তোমরা পছন্দ করবে!”

ডোরিন খুশিতে হাততালি দিল, টনি নামের ভোতা ছেলেটার মুখটা আরো একটু ভোলা হয়ে গেল! ডোরিন হাততালি দিতে দিতে বলল, “পুলের পাশে সন্ধ্যাবেলা বারবিকিউ করে, খুব মজার কাবাব তৈরি করে।”

ডোরিনের বাবা বললেন, “হ্যাঁ, তোমরা এসো। আমার ছেলেমেয়েরা রিসোর্টের ভেতর একা একা অধৈর্য হয়ে উঠছে। তোমাদের সাথে একটু সময় কাটালে ভালো লাগবে।”

ডোরিন হঠাৎ ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “টোপন তুমি এখন কী সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট করবে?”

আমি একটু থতমত খেয়ে বললাম, “সেটা তো এখনো জানি না। আমার মামা যেটা বলবে–”

ডোরিন তখন মামার দিকে তাকাল, বলল, “সায়েন্টিস্ট আংকেল, টোপন এখন কী এক্সপেরিমন্টে করবে?”

মামা খুবই সহজ গলায় বলল, “শুরু হবে সেম্পল কালেকশন দিয়ে। ভোরবেলা এই এলাকায় বের হয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে সেম্পল নিয়ে আসবে।”

“কী রকম সেম্পল?”

“অনেক রকম হতে পারে।” বালু, পানি, কখনো গাছ, গাছের পাতা, মাছ।”

“আমরা কী টোপনের সাথে সাথে সেম্পল কালেক্ট করতে পারি?”

“তোমরা?” মামা এবারে একটু অবাক হলো, তারপর বলল, “কাজটা মোটামুটি পরিশ্রমের, রোদে হেঁটে হেঁটে সেম্পল আনতে হবে। তোমরা শুধু শুধু কেন কষ্ট করতে চাচ্ছ?”

“আমাদের পরিশ্রম করতে কোনো আপত্তি নাই।”

টনি অনেকক্ষণ পর একটা কথা বলল, নাক দিয়ে ঘোঁৎ করে একটা শব্দ করে ভোতা মুখে বলল, “আমি রোদে হাঁটাহাঁটি করতে পারব না।”

ডোরিন মুখ শক্ত করে বলল, “তুই আসতে না চাইলে আসিস না। আমি আসব।”

মাহবুব বলল, “আমারও এখন স্কুল ছুটি। আমিও আসতে পারি।”

মামা বলল, “ভেরি গুড। তোমাদের গার্জিয়ানদের যদি আপত্তি না থাকে তোমরা এসে টোপনকে সাহায্য করতে পার।” মামা তখন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিক আছে টোপন? তোর কোনো আপত্তি নাই তো?”

মামা এমন ভান করল যেন আমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ মানুষ এবং আমি পারমিশন না দেওয়া পর্যন্ত কেউ আসতে পারবে না। আমি বললাম, “না, না, আমার কোনো আপত্তি নাই।”

ডোরিন আবার আনন্দে হাততালি দিল। এই মেয়েটা খুব অল্পতেই আনন্দ পায়। তার ভাইটা ঠিক তার উল্টো। সবকিছুতেই তার সমস্যা।

ডোরিন, টনি আর তার আব্বু আরো কিছুক্ষণ থাকল, তারপর কালকে কখন কোথায় কীভাবে আসবে সেটা ঠিক করে চলে গেল। মাহবুব আরো কিছুক্ষণ থাকল মামার সাথে। আরো কিছুক্ষণ কথা বলে গেল, সবই বিজ্ঞানের কথা। মামা সবাইকে চা বানিয়ে খাওয়ালো। কালো কুৎসিত চা, মুখে দিলে মনে হয় চা নয় বিষাক্ত আলকাতরা খাচ্ছি। সবাই অবশ্যি কোনো আপত্তি না করে মুখ বুজে খেয়ে নিল।

সবাই চলে যাবার পর যখন অন্ধকার নেমেছে আমি তখন মামাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা মামা! তোমাকে একটা প্রশ্ন করি?”

“কর।”

“তুমি আজকে সবার সামনে আমাকে নিয়ে বানিয়ে বানিয়ে এতো কথা কেন বলেছ?”

“কোনটা বানিয়ে বলেছি?”

“এই যে আমি হাফ সায়েন্টিস্ট। সব যন্ত্রপাতি চিনি, অপারেট করতে পারি এইসব।”

“তুই যন্ত্রপাতি চালাতে পারিস না? নিশ্চয়ই পারিস।”

“আমি কোন যন্ত্র অপারেট করতে পারি?”

“কেন, দুপুরবেলা মাইক্রোওয়েভ ওভেন চালিয়ে ডিম সিদ্ধ করেছিস মনে নেই?” সেইটা কী একটা যন্ত্র না?”

“যাও মামা, ঠাট্টা করো না।”

“মোটেও ঠাট্টা করছি না। আমার সাথে থাকলে তুই সবকিছু শিখে যাবি। আজকে তোকে ডাটা নেয়া শিখিয়ে দেব। এক ধাক্কায় দুই হাফ সায়েন্টিস্ট হয়ে যাবি। যেটা পরে হবি সেটা একটু আগে বলে দিলাম।”

“কেন?”

“একটা তোর বয়সী মেয়ে এসেছে। এইরকম বয়সে মেয়েদের সামনে একটু নিজেকে জাহির করার ইচ্ছা করে না? তোর পক্ষ হয়ে আমি করে দিলাম।”

আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। মামা মহা আজিব মানুষ।

.

রাত্রে আমরা মাহবুবের মায়ের রান্না করা খাবার খুব শখ করে খেলাম। মামা আমার থেকে বেশি শখ করে খেলো, চেপা ভর্তা জিনিসটা এতো শখ করে খাওয়া যায় কে জানত। মামা যে শুধু শখ করে খেলো তা নয় চেপার উপর একটা বিশাল বক্তৃতা দিল। এটা নাকি খাদ্য সংরক্ষণের একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ টেকনিক, নাম ফারমেন্টেশন টেকনিক। এই দেশের মানুষের আবিষ্কার, খাবারটা ব্যাক্টেরিয়া ধরতে পারবে না। কিন্তু রক্ষা পাবে! দেখে মনে হয় পচে ক্যাতক্যাতা হয়ে গেছে আসলে পচে নাই!

খাওয়া শেষ করে মামা তার গামা রে স্পেকট্রোমিটার দিয়ে কেমন করে ডাটা নিতে হয় শিখিয়ে দিল। পুরো ব্যাপারটা যথেষ্ট জটিল কিন্তু মামা আমাকে যত্ন করে শেখালো। আমি শেখার চেষ্টা করলাম, কী করতে হয় সেগুলো ডাইরিতেও লিখে রাখলাম। মনে হলো সত্যি সত্যি এক ধাক্কাতে আমিও হাফ সায়েন্টিস্ট হয়ে গেছি। কী মজা!

রাত্রে মাইক্রোবাসের মেঝেতে দুটি ক্যাম্প খাট পেতে সেখানে বিছানা করা হলো, খুবই আরামদায়ক বিছানা। সেখানে শুয়ে জঙ্গলে জন্তু জানোয়ার আর পশুপাখির ডাক শুনতে শুনতে আমি ঘুমিয়ে গেলাম। একটু যে ভয় ভয় করছিল না তা নয়, কিন্তু মামা আছে, তার পিস্তল আছে কাজেই ভয়টা আমাকে বেশি কাবু করতে পারল না।

০৬. পরদিন ভোরবেলা

০৬.

পরদিন ভোরবেলা ঘুম পুরোপুরি ভাঙার আগেই মামা বলল, “আজকে তোর তিনটা কাজ।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী কাজ?”

মামা বলল, “রেডি হয়ে নে, তারপর বলব।”

কাজেই আমি রেডি হতে শুরু করলাম। সকাল ঘুম থেকে উঠে রেডি হওয়ার প্রথম অংশটা হচ্ছে বাথরুম করা। বাসায় আমি শান্তিতে বাথরুম করতে পারি না। বাথরুমে ঢুকলেই আপু দরজা ধাক্কা দিয়ে বলতে থাকে, কী হলো টোপন? এতোক্ষণ লাগে? ঘুমিয়ে গেছিস নাকি? আর কত? বের হ। তাড়াতাড়ি।

এখানে আপু নাই, কিন্তু বাথরুমও নাই। (মাইক্রোবাসের ভিতরে যেটা আছে সেটা নাকি শুধুমাত্র সুপার ইমার্জেন্সির সময় ব্যবহার হবে। কাজেই আমাকে একটা “ইয়ে হাতে নিয়ে গভীর জঙ্গলের ভিতর ঢুকে যেতে হলো। শুধু তাই না পরিবেশ রক্ষা করার জন্য মামা আমার হাতে একটা ছোট খুরপি দিল, কি বেইজ্জতি ব্যাপার। কেউ যদি দেখে ফেলে কী সর্বনাশ হবে!

যাই হোক বাথরুমের পর খুবই অল্প পানি দিয়ে হাত মুখ ধুয়ে আমরা নাস্তা করতে বসলাম। মামা পাউরুটির সাইসের উপর জেলির মতো চেপা ভর্তা লাগিয়ে সেটা মহা আনন্দে খেতে লাগল। আমি শুকনো রুটি চিবিয়ে চিবিয়ে যখন অর্ধেক স্লাইস খেয়ে শেষ করেছি মামা ততক্ষণে চার সুইস খেয়ে ফেলেছে। আমাকে দেখে মামার মনে হলো একটু মায়া হলো, বলল, “দাঁড়া চা বানিয়ে দিই। চাতে ভিজিয়ে ভিজিয়ে খা, ভালো লাগবে।”

মামা তারপর আলকাতরার মতো কুচকুচে কালো চা বানিয়ে দিল। সেই চা তিতকুটে এবং বিস্বাদ, আমার মনে হয় ইঁদুর মারার বিষ খেতে এর থেকে ভালো। পাউরুটি ভিজিয়ে ভিজিয়ে খাওয়ার পর আমার মনে হলো পাউরুটির স্লাইসটা পেটের ভিতর কোন জায়গা থেকে কোন জায়গায় যাচ্ছে। সেটাও বাইরে থেকে বলে দেওয়া যাবে।

মামা খুব তৃপ্তি করে তার আলকাতরার মতো চা খেয়ে শেষ করে বলল, “ব্রেকফাস্টের সময় একটা ফল খাওয়া ভালো।”

আমি আশা নিয়ে বললাম, “কোনো ফল আছে, মামা?”

মামা বলল, “দেখি।” তারপর খুঁজে খুঁজে একটা ঝুড়ির ভেতর থেকে। কয়েকটা কলা বের করল। আমি এর আগে কখনো এরকম কুচকুচে কালো কলা দেখি নাই। মামাকে অবশ্যি সেইজন্যে খুব বেশি চিন্তিত দেখা গেল না, কলা ছিলতে ছিলতে বলল, “এর শুধু ছিলকেটা অক্সিডাইজড হওয়ার কারণে কালো হয়ে গেছে। ভিতরে ঠিক আছে।”

আমার অবশ্য ভিতরটাকেও বেশি ঠিক মনে হলো না কেমন যেন ক্যাতক্যাতা নরম। তবে মামাকে খুশি করার জন্য সেটা খেয়ে ফেললাম।

মামা দ্বিতীয় কাপ আলকাতরার মতো চা নিয়ে সেটা খেতে খেতে বলল, “টোপন, তোকে বলেছি আজকে তোর তিনটা কাজ।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী কী কাজ?”

“দুইটা রিসার্চ আর একটা ম্যানেজমেন্ট।”

আমি বাকিটা শোনার জন্য মামার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মামা বলল, “ম্যানেজমেন্টের কাজ হচ্ছে কাছাকাছি গ্রামের একটা দোকান খুঁজে বের করে ডেইলি সাপ্লাই কিনে আনা।”

“ডেইলি সাপ্লাই কী, মামা?”

“আমি যদি সেটা জানতাম তাহলে তোকে এসিস্টেন্ট বানালাম কী জন্য? তুই দেখ কী কী লাগবে। পারবি না?”

আমি একটু আঁ উঁ করে বললাম “পারব।”

“গুড। আর রিসার্চের কাজের প্রথমটা হচ্ছে একটা গাইগার কাউন্টার নিয়ে এই পুরো এলাকাটার ম্যাপিং করা।”

আমি মাথা চুলকে বললাম, “গাইগার কাউন্টার কী?”

“গাইগার কাউন্টার হচ্ছে এক ধরনের রেডিয়েশন মনিটর। কোথাও রেডিও একটিভিটি কিছু থাকলে সেটা সিগনাল দেয়।”

“কী রকম সিগনাল?”

“আমার কাছে যেটা আছে সেটা কট কট শব্দ করে। সেটা নিয়ে পুরো এলাকাটা চষে ফেলবি। দেখবি কোথাও বেশি রেডিও একটিভিটি আছে কি নেই।”

“কেমন করে বুঝব কোথায় বেশি কোথায় কম?”

“খুবই সোজা, বেশি রেডিও একটিভিটি হলে বেশি কটকট করবে কম হলে কম করবে।”

“যন্ত্রটা কতো বড় মামা?”

“দাঁড়া তোকে দেখাই।” বলে মামা ভেতরে একটা বাক্স খুলে একটা ছোট যন্ত্র বের করে আনল। একটা টিউবের মতো অংশের পেছনে একটা হাত দিয়ে ধরার জন্য তার উপরে একটা হ্যাঁন্ডেল। চারকোণা উপরে একটা পুরানা আমলের কাটাওয়ালা মিটার লাগানো। দেখে মনে হয় কেউ ঘরে বসে এটা তৈরি করেছে। একটা সস্তা মোবাইল ফোন পর্যন্ত এর থেকে বেশি মডার্ন। এররকম মান্ধাতা আমলের একটা যন্ত্র হাতে নিয়ে ঘুরতে হবে চিন্তা করে আমার একটু মন খারাপ হলো।

যন্ত্রটার নিচে একটা সুইচ ছিল, মামা সেটা অন করল, তখন যন্ত্রটা কট কট শব্দ করতে লাগল। আমি বললাম, “শব্দ করছে কেন? এইখানে তো কোনো রেডিওএকটিভ কিছু নাই।”

“আছে।” মামা বলল, “সব জায়গায় থাকে। আকাশ থেকে হাই এনার্জি মিউডন আসে। কসমিক রে আসে।”

আমি ভয়ে ভয়ে ছিলাম যে মামা হয়তো এক্ষুণি মিউডন জিনিসটা কী আর কসমিক রে কেমন করে আসে সেটা ব্যাখ্যা করা শুরু করে দেবে। কপাল ভালো সেটা শুরু করে দিল না। বলল, “তোর কাজ হচ্ছে এটা নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখা, কোথাও বেশি কট কট করে কি না।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “যদি করে তাহলে কী করব?”

“জায়গাটা চিনে রাখবি। পরে আমি ভালো করে দেখতে যাব। বুঝেছিস?”

“বুঝেছি।” আমি যন্ত্রটা হাতে নিয়ে বললাম, “এটার নামটা ফানি। গাইগার কাউন্টার। কী আজিব।”

মামা বলল, “এর মাঝে তুই আজিব কী দেখলি? যে সায়েন্টিস্ট এটা বানিয়েছে তার নাম ছিল গাইগার।”

আমি বললাম, “টাইগার শুনেছি, গাইগার কখনো শুনি নাই। বাপ মা আরেকটু ভালো একটা নাম দিলেই পারতো।”

“গাইগারের বাবা মায়ের সাথে দেখা হলে সেটা নিয়ে তাদের সাথে তর্ক করিস। এখন বের হবার জন্য রেডি হয়ে নে।”

“কিন্তু তিন নম্বর কাজটা কী সেইটা বললে না?”

“সেটা হচ্ছে সেম্পল নিয়ে আসা।”

“সেম্পল? মানে মাটি, পানি, গাছ, পাতা, মাছ।”

“না, না। এতো কিছু না, শুধু মাটি। আমি সবার সামনে গাছ, পাতা, পানি নিয়ে কথা বলেছিলাম যেন মনে করে আসলেই পরিবেশ দূষণ নিয়ে কাজ করছি।”

“কোথা থেকে মাটি আনব?”

“পাঁচশ মিটার পর পর। ল্যাটিচ্যুড লঙ্গিচ্যুড জানতে হবে। জিপিএসটা নিয়ে যাবি।”

জিপিএসটা কী ঠিক বুঝি নাই কিন্তু জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না। তাহলে মামা পুরো জিনিসটা বোঝাতে বোঝাতে মাথা খারাপ করে দেবে। যেটুকু দরকার মামা নিজেই নিশ্চয়ই বলে দেবে।

হলোও তাই, ঠিক যখন বের হব তখন কী কী করতে হবে মামা গুছিয়ে শুধু বলে দিল, একটা নোট বইয়ে লিখেও দিল। মামা যে আসলেই সায়েন্টিস্ট সেটা তার লেখা থেকে বোঝা যায়। মুখে যখন কথা বলে তখন একশটা কথা বলে। লেখার সময় দরকারি কথা ছাড়া একটা বাড়তি কথা লিখে না।

একটু পরেই আমি বের হওয়ার জন্য রেডি হলাম। এক হাতে গাইগার কাউন্টার রেডিওএকটিভিটি মাপার জন্য আরেক হাতে লম্বা একটা লাঠি (কেন আমি জানি না), মাথায় বেস বল ক্যাম্প, (রোদ থেকে বাঁচার জন্য।), পিঠে ব্যাকপেক (ডেইলি সাপ্লাই আনার জন্য), পায়ে টেনিস সু (কাদা মাটি থেকে পা বাঁচানোর জন্য), পকেটে মানি ব্যাগ (ডেইলি সাপ্লাই কেনার জন্য)। যে কেউ আমাকে দেখলে মোটামুটি অবাক হয়ে যাবে। ক্যামেরা থাকলে আপুকে দেখানোর জন্য আর আমার ক্লাসের হিংসুটে ছেলেগুলোকে দেখানোর জন্য একটা ফটো তুলে রাখা যেতো। কিন্তু আফসোস সাথে ক্যামেরা নেই।

আমি হাঁটতে হাঁটতে একটু চিন্তা করলাম। আমাকে যে কাজগুলো করতে হবে তার একটা হচ্ছে একটা দোকান খুঁজে বের করে সেখান থেকে ডেইলি সাপ্লাই কিনে আনা। এই কাজটা ভালো করে করা যাবে যদি মাহবুবকে সাথে নিয়ে যাই। আরেকটা কাজ হচ্ছে কয়েক কেজি করে মাটি তুলে আনা, সেই কাজটাও ভালো করে করা যাবে যদি সাথে মাহবুব, ডোরিন আর টনি থাকে। সবাই মিলে এক সাথে অনেক মাটি আনা যাবে। আমি একা একা যে কাজটা করতে পারব সেটা হচ্ছে গাইগার কাউন্টার দিয়ে এলাকাটা চষে ফেলা। কাজেই আপাতত আমি সেটাই করি। মাহবুব বলেছে সে দশটার দিকে আসবে, এখন বাজে আটটা। তার মানে আমার হাতে দুই ঘণ্টা সময়। দুই ঘণ্টা অনেক সময়, ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার করে হাঁটলে আমি দশ কিলোমিটার হেঁটে ফেলতে পারব।

তাই আমি বুকে ফুঁ দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। আমার হাতের গাইগার কাউন্টারটা মাঝে মাঝে কট কট শব্দ করতে লাগল। কোথাও যদি শব্দ বেশি হয় তাহলে আমাকে সেই জায়গাটা চিনে রাখতে হবে। আশা করতে লাগলাম যে কোনো সময় কট কট শব্দটা অনেক বেড়ে যাবে এবং সেই জায়গাটা মামাকে দেখিয়ে অবাক করে দেব।

আমি টানা আধঘণ্টা হেঁটে গেলাম কিন্তু গাইগার কাউন্টার শব্দ এতটুকু বাড়ল না। আমি আস্তে আস্তে অনুমান করতে শুরু করলাম যে গাইগার কাউন্টারে কট কট শব্দ বেড়ে যাওয়ার কোনো চান্স নেই, বিষয়টা নিশ্চয়ই গুপ্তধন পাওয়ার মতন। আসলে তো আর কেউ সত্যি সত্যি গুপ্তধন খুঁজে পায় না শুধু এর গল্প শোনা যায়, আমারও সেই অবস্থা আমি খালি খুঁজে বেড়াব। কে জানে মামা হয়তো সেটা আগে থেকেই জানে, আমাকে ব্যস্ত রাখার জন্য কোনো একটা ফালতু যন্ত্র আমার হাতে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। এটা হয়তো আসলে গাইগার কাউন্টারই না, অন্য কিছু। কিংবা কে জানে আসলে হয়তো গাইগার কাউন্টার বলে পৃথিবীতে কিছু নাই, মামা বানিয়ে বানিয়ে কিছু একটা বলে আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছে। পরে যখন বাসায় যাব তখন আমাকে কীভাবে বোকা বানিয়েছে সেটা নিয়ে সবার সাথে গল্প করে হাসাহাসি করবে। মামার অসাধ্য কিছু নাই।

যাই হোক, এখন সেটা নিয়ে কিছু করার নেই। হাঁটতে যখন বের হয়েছি তখন হেঁটেই যাই। কাজেই আমি হাঁটতে থাকলাম। হাতের গাইগার কাউন্টারটা শুরুতে হালকাই ছিল, কিন্তু যতই হাঁটছি এটা ততই ভারি হতে শুরু করেছে। যদি বেশি ভারি হয়ে যায় তাহলে আর হাতে করে টানা যাবে না। পিছনের ব্যাকপেকে রেখে দেব, সেখান থেকে যথেষ্ট স্পষ্টভাবে কটকট শব্দ শোনা যাবে। এটাকে যে হাতে রাখতেই হবে সেটা কে বলেছে? এর কটকট শব্দটা শুনতে পেলেই হলো।

শুধু যে গাইগার কাউন্টারটা আস্তে আস্তে ভারী হতে শুরু করেছে তা নয় রোদটাও কেমন যেন গরম হতে শুরু করেছে। প্রথম প্রথম মিষ্টি একটা রোদ ছিল। সেটা এখন আর যাই হোক মিষ্টি নেই, রীতিমতো ঝাল’ অর্থাৎ গরম!

আশেপাশে কেউ নেই তাই ইচ্ছে করলে শার্ট খুলে খালি গা হয়ে যেতে পারি। শুধু তাই না চিৎকার করে গানও গাইতে পারি কিন্তু আমি সেসব কিছু করলাম না, আমি ঘাড় গুঁজে হাঁটতে লাগলাম।

পুরো এলাকাটা ফাঁকা। মাঝে মাঝে কিছু অদ্ভুত জন্তু জানোয়ার দেখা যায়। ইঁদুরের মতো কিন্তু ইঁদুর নয় সেরকম একটা জন্তুকে তাদের বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখলাম। মোটাসোটা একটা গুই সাপ খুবই ধীরে সুস্থে আমার সামনে দিয়ে হেঁটে গেল, আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল কিন্তু ভয় পেল বলে মনে হলো না। পুঁইসাপ যে একটু পরপর জিব বের করে আমি সেটা জানতাম না। জলা জায়গা অনেক ব্যাঙ, কাছাকাছি গেলে এক সাথে পানির মাঝখানে ঝাঁপ দেয়। গাছে অনেক পাখি কিচিরমিচির করছে, তবে পাখি থেকে বেশি মজার জিনিস বানর, এদের হাবভাব এতো মানুষের মতো যে দেখে অবাক হয়ে যাই। একটা বানর আমার দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচি দিল, বানর যে পাজি ছেলেদের মতো মুখ ভেংচি দিতে পারে আমি জানতাম না।

আমি গরমে ঘামতে ঘামতে হাঁটতে থাকলাম। একটা বড় হাওড় পর্যন্ত গিয়ে আবার ঘুরে ফিরে আসতে লাগলাম। মোটামুটি অনেকটুকু জায়গা দেখে ফেলেছি, এর মাঝে কোনো রেডিও একটিভিটি নেই। আমি এখন মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেছি যে কোথাও কিছু পাওয়া যাবে না। সাইন্টিস্টদের জীবনে কোনো আনন্দ নেই, উত্তেজনা নেই, আছে শুধু রোদের মাঝে হাঁটা, কী আশ্চর্য।

আমি কতক্ষণ হেঁটেছি জানি না, রোদ থেকে বাঁচার জন্য বড় একটা গাছের নিচে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার জন্য যাচ্ছিলাম তখন একেবারে ভূতের মতো হঠাৎ করে কোথা থেকে জানি একজন মানুষ বের হয়ে এলো। আমি তাকে দেখে যত অবাক হয়েছি মনে হলো সে আমাকে দেখে তার থেকে বেশি অবাক হয়েছে। সে চমকে উঠে প্রায় চিৎকার করে বলল, “কে? কে তুমি?”

মানুষটাকে হঠাৎ করে দেখে আমি নিজেও চমকে উঠেছিলাম, কয়েক সেকেন্ড লাগল শান্ত হতে। মানুষটার মাথায় টুপি, থুতনির মাঝে একুশ বাইশটা দাড়ি। (যার দাড়ি এতো কম সে কেন দাড়ি রাখে সেটা একটা রহস্য)। মানুষটার কাছে একটা ছাতা, আমাকে দেখে ছাতাটা অস্ত্রের মতো ধরে রেখেছে। বোঝা যাচ্ছে দরকার হলে সে এই অস্ত্র নিয়ে আমাকে আক্রমণ করে ফেলবে। মানুষটার চোখে মুখে কেমন জানি ভয়ের চিহ্ন, আমি তার অর্ধেক সাইজ আমাকে দেখে ভয় পাওয়ার কী আছে বুঝতে পারলাম না। মানুষটা তার ছাতাকে বন্দুকের মতো করে আমার দিকে তাকিয়ে গলা উঁচিয়ে বলল, “বল, বল। কে তুমি? কোথা থেকে এসেছ? এখানে কী কর?”।

আমি একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। মানুষটা আমাকে যে প্রশ্নগুলো করেছে তাকে খুশি করার মতো সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমার জানা নেই। আমি যেটাই বলব এই মানুষটার কাছে তার কোনো অর্থ নেই। কিন্তু তবু কিছু একটা বলতে হবে, বললাম, “আমি এইখানে ঘুরতে এসেছি।”

মানুষটা উত্তর শুনে খুশি হলো কি না বুঝতে পারলাম না। ছাতাটা বন্দুকের মতো ধরে রেখে কেমন যেন কার্টুনের মতো ছোট ছোট লাফ দিয়ে বলল, “তোমার হাতে অস্ত্র কেন? খবরদার আমার দিকে অস্ত্র ধরবে না।”

আমি একবার খাবি খেলাম, আমার হাতে অস্ত্র? তখন বুঝতে পারলাম আমার হাতের গাইগার কাউন্টারের সামনে যেহেতু একটা টিউব আছে সেই জন্য এটাকে মানুষটা কোনো একটা অস্ত্রের নল ভাবছে। টিউবটা সামনের দিকে মুখ করে আছে তাই মানুষটা ভাবছে অস্ত্রটা তার দিকে তাক করে রেখেছি।

আমি গাইগার কাউন্টারের টিউবটা ঘুরিয়ে বললাম, “এইটা অস্ত্র না।”

“এইটা কী?”

“এইটার নাম গাইগার কাউন্টার।”

মানুষটা কী বুঝল কে জানে, আবার একটা ছোট লাফ দিয়ে বলল, “সর্বনাশ! কে তোমাকে এটা দিয়েছে? ফালাও নিচে ফালাও। এক্ষুণি নিচে ফালাও।”

মানুষটার কথা শুনে আমার এই মূল্যবান গাইগার কাউন্টার নিচে ফেলা ঠিক হবে না। কিন্তু তাকে কীভাবে শান্ত করব বুঝতে পারলাম না। বললাম, “এইটা নিচে ফেলা যাবে না। এইটা অনেক মূল্যবান যন্ত্র।”

“তুমি এই মূল্যবান যন্ত্র কোনখানে পেয়েছ? এইটা দিয়ে কী করে?”

একসাথে দুইটা প্রশ্ন, কীভাবে উত্তর দেব বুঝতে পারলাম না। প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যখন কঠিন হয় তখন তার উত্তর দিতে হয় প্রশ্ন করে। কাজেই আমি সেই টেকনিক শুরু করলাম, বললাম, “আপনি সাইন্টিস কী জানেন?”

“সাইন্টিস?”

“হ্যাঁ।”

“কেন? কী হয়েছে সাইন্টিসের?”

মানুষটা এখন আমার টেকনিক শুরু করেছে। আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে প্রশ্ন দিয়ে। কী মুশকিল! কিন্তু কিছু একটা উত্তর দিতে হবে, তাই বললাম, “আমার মামা হচ্ছে সাইন্টিস, তাই মামা আমাকে এই যন্ত্রটা দিয়েছে গবেষণা করার জন্য।”

মানুষটা আমার কথা বিশ্বাস করল না, বলল, “তুমি এতো ছোট মানুষ, তুমি কেমন করে গবেষণা করবা?” তারপর নাক দিয়ে বাতাস বের করে ঘোত করে একটা শব্দ করল। অবিশ্বাসের শব্দ।

আমি বুঝতে পারলাম এই মানুষটার সাথে কথা চালিয়ে যাওয়া খুব মুশকিল, তাই খামাখা চেষ্টা করে লাভ নাই। আমার এখন এই মানুষটির কাছ থেকে চলে যাওয়াটাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আমি তাই আর কিছু না বলে হাঁটা শুরু করলাম, সাথে সাথে মানুষটা চিৎকার করে বলল, “খবরদার। খামোশ। নড়বে না, তুমি নড়বে না।”

আমি বললাম, “নড়ব না?”

“না।”

“কেন?”

আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মানুষটা তার পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা লাল রংয়ের মোবাইল ফোন বের করে সেটাতে দুই একটা চাপ দিয়েই কথা বলতে শুরু করল। “হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো হ্যালো আক্কাইস্যা হ্যালো হ্যালো”।

কাউকে ফোন করলে কানেকশান হতে যে সময় লাগে এই মানুষটা সেটা জানে না, ডায়াল করেই সে আক্কাস মানুষটাকে ডাকাডাকি শুরু করেছে। যাই হোক শেষ পর্যন্ত আক্কাস নামের মানুষটা ফোন ধরল তখন একুশ দাড়ির মানুষটা কথা বলতে শুরু করল, “হ্যালো আক্কাইস্যা, ফোন ধরিস না কেন? কততক্ষণ থেকে ফোন করতেছি। শোন ভালো করে কী বলি, এক্ষুণি আয়, নদীর পাড়ে জঙ্গলের কিনারায় বড় বটগাছের নিচে। একটা ছেমড়া এক অস্ত্র নিয়ে ঘুরতেছে তারে ধরে বেন্ধে নিতে হবে”

আমার চোয়াল স্কুলে পড়ল। বলে কী এই মানুষ? আমাকে ধরে বেন্ধে নিতে হবে? কোথায় ধরে বেন্ধে নিতে হবে? আমি বুঝতে পারলাম আমার আর এই মানুষের কথাবার্তা শোনার দরকার নেই। আমি হাঁটা শুরু করলাম। যদি আসলেই আমাকে ধরার চেষ্টা করে তখন দেখা যাবে কী করা যায়। যদি সত্যি সত্যি দরকার হয় তখন এই মানুষের হাত থেকে বাঁচার জন্য গাইগার কাউন্টারটাকে অস্ত্রের মতো ব্যবহার করে ভয় দেখানো যেতে পারে।

আমি পিছনের দিকে না তাকিয়ে লম্বা পা ফেলে হাঁটতে থাকি। ঠিক তখন শুনতে পেলাম পেছন থেকে কে যেন ডাকলো, “টোপন! তুমি এখানে? আমরা তোমাকে কখন থেকে খুঁজছি।”

আমি পিছন ফিরে তাকালাম, দেখলাম, মাহবুব, ডোরিন আর টনি।

আমার বুকের মাঝে পানি ফিরে এলো। একুশ দাড়ির মানুষটার সাথে আমার আর একা ঝগড়াঝাটি করতে হবে না। আমরা চারজন মিলে এখন এই খ্যাপা মানুষের সাথে তর্ক বিতর্ক করতে পারব।

অবশ্য তার আর দরকার হলো না। আমার সাথে অন্য তিনজন একত্র হওয়ার সাথে সাথেই একুশ দাড়ির মানুষটার উত্তেজনা মিইয়ে গেল। মানুষটা কেমন যেন ম্যাদা মেরে গেল। আমাকে ধরে বেন্ধে ফেলার চেষ্টা না করে মাথা নিচু করে উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করে দিল।

০৭. মানুষটার আজব কাজকর্ম

০৭.

আমার কাছ থেকে সবকিছু শোনার পর প্রথমে একুশ দাড়ির মানুষটার আজব কাজকর্ম নিয়ে সবাই একটু হাসাহাসি করলাম, তারপর মাহবুব প্রথমে আমাদেরকে নিয়ে কাছাকাছি একটা বাজারে রওনা দিল। জায়গাটা বেশ দূরে কিন্তু দেখা গেল হাঁটতে কারো আপত্তি নাই। আশে পাশে মানুষ নেই তাই আমরা লাফাতে লাফাতে কিংবা গান গাইতে গাইতে যেতে পারব কেউ কিছু বলতে আসবে না। হাতের গাইগার কাউন্টারটি কী সেটা একটু ব্যাখ্যা করতে হলো। আমি বানিয়ে বানিয়ে বললাম এটা বাতাসের মাঝে কার্বন ডাই অক্সাইড কতোটুকু সেটা মাপার যন্ত্র। তবে নামটা শুনে তারা আমার সাথে একমত হলো যে গাইগার বেচারার বাবা মায়ের তার জন্য আরেকটু ভালো নাম দেওয়া উচিত ছিল। টনি অবশ্য বলার চেষ্টা করল যে গাইগার নিশ্চয়ই পারিবারিক নাম, তার বাবা মায়ের নামও নিশ্চয়ই গাইগার। আমরা সেটা শুনেও না শোনার ভান করলাম, একটা মজার বিষয়কে কেউ কাঠখোট্টা সত্যি তথ্য দিয়ে পানসে করে দিতে কেউ চায় না।

আমরা যখন হাঁটছি তখন আমি টনির দিকে তাকালাম, তার মুখটা যথেষ্ট ভোলা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি না আসতে চাইছিলে না, তাহলে আসলে কেন?”

টনি বলল, “আমি আসলেই আসতে চাই নাই। শুয়ে শুয়ে টিভি দেখব ভেবেছিলাম। কিন্তু

“কিন্তু কী?”

“হঠাৎ করে কাদের মামা চলে এসেছে।”

‘কাদের মামাটা কে?”

“আমার একজন মামা। খালি প্রশ্ন করে! খুবই যন্ত্রণা।”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “খালি প্রশ্ন করে? কী প্রশ্ন?”

টনি তার ভোতা মুখটা আরো ভোতা করে বলল, “দেখা হতেই প্রশ্ন করল একটা বিল্ডিংয়ের তিন তলায় একজন দাঁড়িয়ে আছে। সে যদি মাটি থেকে তিরিশ ফুট উঁচুতে থাকে তাহলে যে সাত তলা আছে সে কত উপরে আছে।”

“তুমি কী বলেছ?”

“কী বলেছি মানে?” টনি একটু বিরক্ত হয়ে বলল “যেটা উত্তর সেটা বলেছি।”

এবারে মাহবুব জিজ্ঞেস করল, “উত্তরটা কী?”

টনি বলল, “কেন? সত্ত্বর ফুট।”

আমি বললাম, “হয় নাই।”

টনি অবাক হয়ে বলল, “হয় নাই?”

“না।”

“তাহলে ঠিক উত্তর কতো?”

“জানি না।”

টনি একটু অবাক হয়ে বলল, “জান না? তাহলে বুঝলে কেমন করে যে আমার উত্তরটা হয় নাই?”

‘যদি উত্তরটা এতো সহজ হতো তাহলে তোমার মামা জিজ্ঞেস করতো না। এর মাঝে নিশ্চয়ই প্যাঁচ আছে।”

ডোরিন মাথা নাড়ল, বলল, “আছে। প্যাঁচ আছে।”

মাহবুবও মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ। প্যাঁচ আছে।”

আমি বললাম, “বড় মানুষেরা সব সময় ছোটদের প্যাঁচের মাঝে রাখে।”

টনি অবাক হয়ে বলল, “কিন্তু এতো সোজা একটা প্রশ্নের মাঝে প্যাঁচ থাকবে কেমন করে?”

আমি বললাম, “সোজা জিনিসের মাঝেই প্যাঁচ বেশি থাকে।”

কাজেই প্রশ্নটার মাঝে প্যাঁচটা কোনখানে সেটা চিন্তা করতে করতে আমরা হাঁটতে লাগলাম। মাহবুব সবার আগে প্যাঁচটা ধরতে পারল। আনন্দে চিৎকার করে বলল, ‘নব্বই ফুট, নব্বই ফুট!”

আমরা অবাক হয়ে বললাম, “নব্বই ফুট?”

“হ্যাঁ। সাত তলায় যে আছে সে নব্বই ফুট উপরে আছে। তারপর আমাদের বুঝিয়ে দিল সেটা কেমন করে বের করেছে। আমরা সবাই মাথা নাড়লাম, বুঝলাম মাহবুব সত্যিই প্যাঁচটা বুঝতে পেরেছে।

টনি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “মামাকে এর উত্তরটা বলে লাভ নাই। মামা তখন আরেকটা জিজ্ঞেস করবে। তারপর আরেকটা তারপর আরেকটা। যদি কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারি তাহলে হতাশ ভাব দেখিয়ে মাথা নাড়ে। খুবই যন্ত্রণা।”

আমরা সবাই স্বীকার করে নিলাম, বড় মানুষদের এই রকম ব্যবহারের জন্য ছোটদের জীবনে কোনো আনন্দ নাই। আমি বললাম, তুমি একটা কাজ করো না কেন?”

“কী কাজ?”

“তোমার মামা একটা প্রশ্ন করলে তুমি আরেকটা প্রশ্ন করবে।”

“আমি আরেকটা প্রশ্ন করব?”

“হ্যাঁ। বড় মানুষদের টাইট করার মতো প্রশ্ন আছে।”

“আছে নাকি?”

“হ্যাঁ। যেমন তুমি জিজ্ঞেস করতে পার আপনি কী প্রত্যেকদিন আপনার কান ধরে টানেন?”

টনিকে কেমন জানি বিভ্রান্ত দেখা গেল। বলল, “এটা জিজ্ঞেস করলে কী হবে?”

তোমার মামা বলবে, ‘না। তখন তুমি বলবে ও আচ্ছা, তার মানে আপনি প্রত্যেকদিন টানেন না, শুধু মাঝে মাঝে কান ধরে টানেন। তারপর জোরে জোরে হা হা করে হাসবে।”

আমার বুদ্ধি শুনে সবাই এখনই জোরে জোরে হা হা করে হাসল। আমরা তখন আরো অনেকগুলো এরকম পিছলে ধরনের প্রশ্ন টনিকে শিখিয়ে দিলাম একটা নাপিতের দাড়ি কাটা নিয়ে প্রশ্ন, একটা কেক ভাগ করা নিয়ে প্রশ্ন, একটা শেয়ালের ঘুমানো নিয়ে প্রশ্ন, একটা ভালুকের গায়ের রং নিয়ে প্রশ্ন। তখন খুব ধীরে ধীরে টনির ভোতা মুখটা একটু সহজ হলো।

কথা বলতে বলতে আর হাঁটতে হাঁটতে আমরা একটা বাজারে হাজির হলাম। খুবই ছোট বাজার মাত্র তিন চারটা দোকান। একটা চায়ের দোকানের সামনে দুইটা বেঞ্চ সেখানে কয়েকজন মানুষ বসে চা খাচ্ছে তারা খুবই সন্দেহের চোখে আমাদের দিকে তাকালো। এটা হচ্ছে বড় মানুষদের সমস্যা। তারা কোনো কাজকর্ম না করে দুপুর বেলা বসে বসে চা খাচ্ছে। আমরা ইচ্ছা করলেই খুবই সন্দেহের ভঙ্গীতে মানুষগুলোর দিকে তাকাতে পারতাম। আমরা তো তাকাচ্ছি না তারা কেন তাকাচ্ছে?

যাই হোক মাহবুব আমাদের একটা দোকানে নিয়ে গেল, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি এইখান থেকে জিনিসপত্র কিনতে পারবে।”

ডোরিন জিজ্ঞেস করল, “কী কিনবে?”

আমি বললাম, “ডেইলি সাপ্লাই।”

“তার মাঝে কী আছে?”

“আমি কেমন করে বলব?”

ডোরিন অবাক হয়ে বলল, “তাহলে কে বলবে?”

“আমি তোমাদেরকে নিয়ে এসেছি কেন? তোমরা বল ডেইলি সাপ্লাইয়ে কী কী থাকে?”

তারা সবাই একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল। তারপর ডোরিন বলল, “ডেইলি তোমরা কী কর?”

“সবাই যেটা করে আমরাও সেইটা করি।”

আবার সবাই একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল। মাহবুব বলল, “বুঝেছি। টোপন কিছুই জানে না। সারাদিনে যা যা লাগে সেগুলো কিনে দেই।”

“ঠিক আছে।” ডোরিন বলল, “একেবারে সকাল থেকে শুরু করে। ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করার জন্য টুথপেস্ট, টুথব্রাশ। কুলি করার জন্য গ্লাস আর পানি। মুখ ধোওয়ার জন্য সাবান, মুখ মোছার জন্য তোয়ালে। ঘুমের কাপড় বদলে পরার জন্য শার্ট প্যান্ট জুতা মোজা। তারপর ব্রেকফাস্ট করার জন্য”

আমি হাত তুলে বললাম, “থামো থামো ঠাট্টা না করে আসলে যা যা দরকার সেগুলো কিনে দাও। খাবার দাবার হলেই হবে।”

“শুধু খাবার দাবার?”

‘হ্যাঁ।”

ডোরিন মুখ সূচালো করে বলল, “তাহলে তো সোজা। ব্রেকফাস্ট থেকে শুরু করি। ব্রেকফাস্ট লাগবে রুটি, মাখন, জেলি, ডিম, কলা এবং চা না হয় কফি।”

দোকানদার জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “কলা ছাড়া আর কিছু নাই।”

আমরা দোকানে ঝুলে থাকা রোগা রোগা কয়েকটা কলা দেখতে পেলাম। মাহবুব জিজ্ঞেস করল, “ডিম? ডিমও নাই?”

দোকানদার মাথা চুলকালো, বলল, “ডিম কয়েকটা জোগাড় করা যেতে পারে।”

ডোরিন বলল, “লাঞ্চে দরকার কোনো এক ধরনের সুপ, নুডলস এবং ভেজিটেবল। নুডলসে চিকেনের টুকরো দেওয়া যেতে পারে।”

আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, “তোমরা বুঝতে পারছ না। বেশি ভালো খাবার দাবারের দরকার নাই, শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য যেটা না হলেই না সেটা ছাড়া আর কিছু লাগবে না। যদি খুব ভালো করে বাজার করে নেই তাহলে অন্য সমস্যা হতে পারে।”

“অন্য কি সমস্যা?”

“তাহলে মামা সব সময় আমাকে পাঠাবে বাজার করতে।”

সবাই প্রথমে হাসল তারপর মাথা নাড়ল। বড়দের নিয়ে কী কী সমস্যা হতে পারে আমরা সবাই সেটা জানি। টনি চিন্তিত মুখে জিজ্ঞেস করল, কিন্তু তুমি যদি খুব খারাপ বাজার করে নিয়ে যাও তাহলে সমস্যা হবে না?”

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “নাহ্! তাহলে কোনো সমস্যা নাই।”

“কেন?”

“কারণ বাজার যদি খুব খারাপ হয় আমি সব দোষ দিব তোমাদের। বলব তোমরা জোর করে আমাকে এগুলো কিনিয়েছ। আমি কিনতে চাই নাই।” বলে আমি দাঁত বের করে হাসলাম।

আমার কথা শুনে তিনজন প্রথমে চোখ পাকাল তারপর তিনজনই আমার মতো দাঁত বের করে হাসল। ডোরিন বলল, “তুমি আসলে একটা মিচকে শয়তান।”

আমি মাথা নেড়ে স্বীকার করে। নিলাম, “হ্যাঁ। আমি আসলেই একটা মিচকে শয়তান।”

সবাই মিলে আলাপ আলোচনা করে আমাকে ডেইলি সাপ্লাই কিনে দিল। আমি সেগুলো আমার ব্যাকপেকে ভরে নিলাম। ফিরে যাবার আগে মাহবুব বলল, “চল চা খাই।”

সাথে সাথে সবাই রাজী হয়ে গেল। চায়ের দোকানটার বাইরে রাখা বেঞ্চটা একটু খালি হয়েছে আমরা সেখানে বসে চায়ের অর্ডার দিলাম। যে ছেলেটা চা তৈরী করছে সে প্রায় আমাদের বয়সী। অনেক যত্ন করে সে আমাদের জন্য চা তৈরি করে দিল। চায়ে চুমুক দিয়েই ডোরিন বলল, এতো মজার চা সে জীবনেও খায় নাই।

টনি যতক্ষণ মুখ ভোলা করেছিল ততক্ষণ ডোরিনের একটা কথাও সে মেনে নেয় নাই কিন্তু তার কাদের মামাকে পিছলে প্রশ্ন করে টাইট করার বুদ্ধি দেওয়ার পর থেকে সে একটু সহজ হয়েছে। এখন মাঝে মাঝেই সে আমাদের কথাবার্তায় যোগ দিচ্ছে। ডোরিনের সাথে সাথে সেও স্বীকার করে নিল যে এই চা’টা অসাধারণ। তাদের মনি কাঞ্চনের চা এর তুলনায় বাসন ধোয়া পানি ছাড়া আর কিছু না!

চা খেয়ে আমরা রওনা দিলাম। মামা আমাকে তিনটা কাজ দিয়েছিল। একটা ছিল গাইগার কাউন্টার দিয়ে এই এলাকাটা ম্যাপিং করা, একুশ দাড়ি উৎপাত করার পরও সেটা অনেকখানি করেছি। আরেকটা ছিল ডেইলি সাপ্লাই কিনে আনা সেটাও কিনে ফেলেছি। এখন বাকী আছে মাটির সেম্পল নিয়ে আসা। যেহেতু আমরা চারজন আছি তাই চার জায়গায় সেম্পল নিতে পারব। আমি মামার জিপিএসটা বের করে মামা যেভাবে শিখিয়ে দিয়েছে সেভাবে লেটিচ্যুড লঙ্গিচ্যুড বের করে আমার নোট বইয়ে লিখে নিলাম। তারপর মাটি খুঁড়ে প্রায় দুই কেজি মাটি পলিথিনের ব্যাগে ভরে নিলাম।

দুই কেজি মাটি মোটেও বেশি না কিন্তু হাঁটা শুরু করার পর মাটির ওজন আস্তে আস্তে বাড়তে লাগল। আমাদের কাছে শুধু মাটি না; ডেইলি সাপ্লাই আছে, গাইগার কাউন্টারটাও আছে। কাজেই সব মিলিয়ে মোটামুটি পরিশ্রম হতে লাগল এবং আমরা মাঝে মাঝেই বসে বিশ্রাম নিতে লাগলাম।

আমি বললাম, “একটা রিকশা থাকলে খারাপ হতো না।”

মাহবুব বলল, “রিকশা চালানোর জন্য রাস্তা দরকার হয়। এখানে রাস্তা নাই, রিকশা চালাবে কোথায়?”

আমরা নদীর তীর ঘেঁষে হাঁটছিলাম, তখন ডোরিন বলল, “ঠিক আছে রিকশার বদলে নৌকা হলেও খারাপ হতো না।”

ঠিক তখন দেখলাম দূর থেকে একটা নৌকা আসছে। মাহবুব বলল, “দেখি এই নৌকাটাকে রাজি করাতে পারি কিনা।”

নৌকাটা কাছে আসতেই মাহবুব গলা উঁচিয়ে বলল, “মামা, যাত্রী নেবেন?”

“কই যাবা?”

“ঐ তো সামনে। হাওড়ের মুখে।”

“নাও ওঠো।”

মানুষটা নৌকাটাকে তীরের কাছে নিয়ে এলো, তখন আমরা সাবধানে উঠে গেলাম। এই নৌকাটা মাহবুবের নৌকার মতো ছোট নৌকা না তাই উঠতে কোনো ঝামেলা হলো না।

নৌকায় আরো দুইজন মানুষ বসেছিল তারা একটুখানি কৌতূহল নিয়ে আমাদের দিকে তাকালো। মাঝি জিজ্ঞেস করল, “তোমাদের বাড়ি কোনখানে?”

মাহবুব আমাদের হয়ে কথা বলল, “আমার বাড়ি এইখানে কাজী বাড়ি। এরা বাইরের। দুইজন মনি কাঞ্চন থাকে। আরেকজন তার মামার সাথে গাড়িতে থাকে।”

মনি কাঞ্চন নিয়ে মাঝির খুব কৌতূহল। সে নানা ধরনের প্রশ্ন করল। অনেকগুলো প্রশ্ন বিদেশি সাহেবদের নিয়ে। এইখানে এতো বিদেশি সাহেব কেন আসে, তারা কী করে। তারা কী খায়। মদ খায় নাকি ইত্যাদি ইত্যাদি নানা প্রশ্ন। ডোরিন আর টনি যেটুকু পারল সেটুকু উত্তর দিল।

নৌকায় বসে থাকা দুজন মানুষের একজন আমাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি গাড়িতে থাকো?”

আমি মাথা নাড়লাম।

“কেন? গাড়িতে কেন থাকো?”

আমি কিছু বলার আগে মাহবুব উত্তর দিল, “ওর মামা সায়েন্টিস্ট। গাড়িতে অনেক বড় ল্যাবরেটরি। গবেষণা করে সেইজন্য গাড়িতে থাকে।”

মানুষটা ঠিক বুঝল কি না কে জানে। আমার হাতের গাইগার কাউন্টারটা দেখে জিজ্ঞেস করল, “তোমার হাতে ঐটা কী যন্ত্র?”

আমি বললাম, “এইটার নাম গাইগার কাউন্টার।”

“এইটা দিয়ে কী করে?”

আবার আমি উত্তর দেবার আগে মাহবুব উত্তর দিল। “বাতাসের দূষিত পদার্থ মাপে।”

মানুষটার যথেষ্ট কৌতূহল, সে হাত বাড়িয়ে বলল, “দেখি যন্ত্রটা।”

আমি কী আর করি, তার হাতে গাইগার কাউন্টারটা দিলাম। সে এটা হাতে নিয়ে দেখল, তার টুকরির উপর রেখে মাথা ঘুরিয়ে পরীক্ষা করল তখন হঠাৎ আমি লক্ষ করলাম গাইনার কাউন্টারটার কট কট শব্দটা একটু বেড়ে গেছে। একটু ঘন ঘন শব্দ করছে। আমি ছাড়া আর কেউ ব্যাপারটা লক্ষ করল না।

মানুষটা একটু পরে আমার হাতে গাইগার কাউন্টারটা ফিরিয়ে দিল এবং আমি লক্ষ করলাম তখন কট কট শব্দটা আবার কমে গেল। কী আশ্চর্য!

কিন্তু আসলেই সত্যি সত্যি হচ্ছে নাকি এটা আমার মনের ভুল কে জানে। ব্যাপারটা আমার একটু পরীক্ষা করা দরকার। তাই আমি মানুষটাকে বললাম, এই যন্ত্রটা টানতে টানতে আমার হাত ব্যথা হয়ে গেছে। আপনার টুকরির উপর যন্ত্রটা একটু রাখি?”

মানুষটা বলল, “রাখ।”

আমি আবার টুকরির উপর রাখলাম এবং স্পষ্ট শুনতে পেলাম কট কট শব্দটা বেড়ে গেছে। কী রহস্যময় ব্যাপার।

আমি কয়েক মিনিট অপেক্ষা করলাম, তারপর জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার টুকরির ভিতর কী?”

মানুষটা হাসার ভঙ্গী করল, “কিছু না। হাওড়ের পাড় গিয়েছিলাম সেইখানে একটা যষ্ঠিমধু গাছের চারা পেয়েছি। নিয়া যাচ্ছি বাড়িতে লাগব।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “যষ্ঠি মধু গাছের চারা দেখতে কেমন?”

মানুষটা তার টুকরির ঢাকনা খুলল, আমি দেখলাম ভিতরে লতানো একটা গাছের চারা। গাছের নিচে খানিকটা মাটি। মনে হয় এই মাটিটা রেডিও একটিভ। একটু পরীক্ষা করে দেখতে পারলে হতো।

আমি আমার পিছলে বুদ্ধি ব্যবহার করার চেষ্টা করলাম, বললাম, “আমার গাছ খুব ভালো লাগে। এই গাছটা একটু দেখি?”

মানুষটা মনে হয় একটু অবাক হলো, কিন্তু স্বাভাবিক গলায় বলল, “দেখো।”

আমি এবারে হাত বাড়িয়ে তলায় লাগানো মাটিসহ গাছের চারাটাকে তুলে নিয়ে এসে চোখের সামনে ধরে দেখার ভান করলাম তারপর একেবারে গাইগার কাউন্টারের টিউবটার কাছে নিয়ে গেলাম। কটকট শব্দটা সত্যি সত্যি অনেক বেড়ে গেল। আমি আবার সরিয়ে নিলাম, শব্দটা সাথে সাথে কমে গেল। এবারে আর কোনো সন্দেহ নেই।

আমি যষ্ঠি মধু গাছটা আবার সাবধানে টুকরির মাঝে রেখে বললাম, ‘আপনি আমাকে ঠিক করে বলবেন এই চারাটা কোথায় পেয়েছেন?”

“কেন?”

“আমি যষ্ঠি মধু গাছের চারা অনেক দিন থেকে খুঁজছি কিন্তু পাচ্ছি না। ঐ জায়গায় দেখতাম আরো আছে কিনা।”

মানুষটা না সূচকভাবে মাথা নেড়ে বলল, “তোমারে যেতে দিবে না।”

“যেতে দিবে না?”

“না।”

“কে যেতে দিবে না।”

“কোম্পানির দারোয়ান।”

“কিসের কোম্পানি?”

‘মনে হয় সিমেন্ট কোম্পানি। কাউকে যেতে দেয় না। দারোয়ানরা বন্দুক নিয়ে পাহাড়া দেয়।”

আমি বেশ অবাক হলাম। যে সিমেন্ট কোম্পানি এখনো তৈরি হয়নি সেটা বন্দুক দিয়ে পাহাড়া দিতে হয়? তারপরও বললাম, “জায়গাটা একটু চিনিয়ে দেবেন? বলে দেখব যেতে দেয় কি না।”

মানুষটা তখন জায়গাটা চিনিয়ে দিল, আমি ঠিক চিনতে পারলাম না, মাহবুব সহজেই চিনতে পারল। জায়গাটাতে গিয়ে আমার মাটি পরীক্ষা করতে হবে। হাওড়ের কাছাকাছি এসে আমরা নৌকা থেকে নেমে গেলাম। সবাই মিলে আমরা মামার মাইক্রোবাসের দিকে হাঁটতে থাকি। মাহবুব, ডোরিন আর টনি নিজেদের ভিতরে কথা বলছে। আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে থাকলাম। যষ্ঠি মধু গাছের গোড়ার মাটি থেকে গাইগার কাউন্টারে অনেক বেশি সিগন্যাল দেয়, তার মানে এই মাটিতে রেডিওএকটিভিটি আছে। কী আশ্চর্য। মামা যখন জানবে তখন কী অবাক হয়ে যাবে। আমি মাহবুব, ডোরিন আর টনিকে সত্যি কথাটা বলতে পারছি না তাই মনটা খুঁত খুঁত করতে লাগল। সবকিছু জানলে তারা কতো উত্তেজিত হতে পারতো। মামাকে জিজ্ঞেস করতে হবে এই তিনজনকে আসল কথাটা বলা যায় কি না। এরা যেহেতু কাজকর্মে সাহায্য করছে তাদের নিশ্চয়ই সত্যি কথাটা জানার অধিকার আছে!

০৮. বেশি সিগন্যাল পাওয়ার ঘটনা

০৮.

আমি মামাকে গাইগার কাউন্টারে বেশি সিগন্যাল পাওয়ার ঘটনাটা বলতেই পারলাম না। সেটা বলার জন্য মামাকে একা পাওয়া দরকার কিন্তু মামাকে একা পাওয়া যাচ্ছিল না। আমার সাথে মাহবুব, ডোরিন আর টনি, তারা সব সময়েই আশে পাশে আছে।

আমাদেরকে ফিরে আসতে দেখে মামা খুশি হলো, বলল, “তোমরা ভালোয় ভালোয় ফিরে এসেছ। ভেরি গুড। তোমাদের দেরী দেখে একটু চিন্তা হচ্ছিল।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী চিন্তা হচ্ছিল মামা।”

“তোরা বাচ্চা মানুষ, আবার কোনো ঝামেলায় পড়িস কিনা।”

“না, মামা ঝামেলায় পড়ি নাই। আমরা চারজন একসাথে। আমাদের চারজনের বয়স যোগ করলে আমরা দুইজন বড় মানুষের সমান।”

ডোরিন বলল, “কিংবা একজন বুড়ো মানুষের সমান।”

মামা ডোরিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমাদের আব্বু কয়েকবার ফোন করেছিলেন।”

“আব্বু কী বলেছেন?”

“আমাকে বলেছেন তোমাদের সবাইকে নিয়ে মনি কাঞ্চনে যেতে। একসাথে লাঞ্চ করবেন।”

আমি আনন্দের মতো শব্দ করলাম। ডেইলি সাপ্লাই হিসেবে আমরা দুপুরে খাওয়ার জন্য যেটা এনেছি মনি কাঞ্চনের খাওয়া তার থেকে হাজার গুণ ভালো হওয়ার কথা। আমার সাথে সাথে ডোরিন অনেক জোরে এবং টনি আস্তে আস্তে হাততালি দিল। শুধু মাহবুব কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।

মামা মাহবুবের দিকে তাকিয়ে বলল, “কী হলো, তোমার যেতে আপত্তি আছে?”

“না, ঠিক নাই, কিন্তু

“কিন্তু কী?”

“এই রকম বড় বড় হোটেল রিসোর্টে কাটা চামুচ দিয়ে কিভাবে খেতে হয় জানি না তো“।

ডোরিন বলল, “তুমি কী ভেবেছ আমি ওসব জানি? আর হোটেলে এইগুলো কেউ মানে? দুই হাতে খাবলা দিয়ে গপ গপ করে খাব।”

মামা বলল, “আমি সব নিয়ম জানি। আমি শিখিয়ে দেব। একবার নিয়ম জানা থাকলে যত খুশি ভাঙতে পারবে। আধুনিক কবিতার মতো।”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “আধুনিক কবিতার মতো। খাওয়ার সাথে কবিতার কী সম্পর্ক?”

“তুই যদি ছন্দ দিয়ে কবিতা লিখতে পারিস শুধু তাহলেই ছন্দ ভেঙ্গে আধুনিক কবিতা লিখতে পারবি।”

“আমি ভেবেছিলাম তুমি সায়েন্টিস্ট”

মামা গরম হয়ে বলল, “সায়েন্টিস্ট হলে সে দুনিয়ার অন্য কিছু জানতে পারবে না?”

আমি আর কিছু বললাম না। বড় মানুষদের সাথে যুক্তি দিয়ে কথা বলার কোনো উপায় নাই।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আমরা কেমন করে যাব, মামা?”

“এই মাইক্রোবাসেই চলে যাই।”

এবারে অন্য সবাই আনন্দে হাততালি দিল।

মাহবুব মাইক্রোবাসের সামনে মামার পাশে বসল, তার নাকি বিজ্ঞান, নিয়ে অনেকগুলো প্রশ্ন আছে। আমরা বাকী তিনজন পিছনে ঢুকে গেলাম। কাজেই আমাকে একা পাওয়া গেল না। কিছু বলতেও পারলাম না।

সত্যিকারের রাস্তায় ওঠার আগে আমরা উঁচু নিচু জায়গা দিয়ে গাড়ির ভেতর উলট পালট খেতে খেতে যেতে লাগলাম। সত্যিকারের সিটে বসে এ রকম রাস্তায় মোটামুটি যাওয়া যায়, কিন্তু এখানে আমরা মাইক্রোবাসের ভিতরে উলট পালট হতে লাগলাম। সত্যি কথা বলতে কী তিনজন মিলে চিৎকার করে আহা উঁহু করে এমন অবস্থা করলাম যে মামা কয়েকবার তার মাইক্রোবাস থামিয়ে আমাদের খবর নিতে নেমে এলো। আমরা তখন বললাম যে আমাদের আসলে সেরকম কোনো সমস্যা নেই, চিৎকার দিতে আনন্দ হয় সেইজন্য চিৎকার দিচ্ছি। মামা ব্যাপারটা ঠিক ধরতে পারল বলে মনে হলো না। ধরতে না পারলে নাই, বড় মানুষদের কোনো কিছু সহজে বোঝানো যায় না, শুধু শুধু সময় নষ্ট করে লাভ নেই।

সত্যিকারের রাস্তায় উঠার পর কিছুক্ষণের মাঝেই আমরা মনি কাঞ্চন পৌঁছে গেলাম। গেটে আমাদের থামাল, মামার সাথে কথা বলল, লাঠির আগায় লাগানো আয়না দিয়ে গাড়ির নিচে দেখল, গাড়ির ভিতরে উঁকি দিল এবং রীতিমতো চমকে উঠল। তখন বার মামার সাথে কথা বলল, কোথায় জানি ফোন করল তখন আরো একজন মানুষ নেমে এলো, সে আবার মামার সাথে কথা বলল, তখন শেষ পর্যন্ত আমাদের ঢুকতে দিল।

মামা পার্কিং লটে তার মাইক্রোবাস পার্ক করে আমাদেরকে নিয়ে মনি কাঞ্চনের বড় গেট দিয়ে ভিতরে রওনা দিল। সেখানে মেটাল ডিটেকটর লাগানো গেট দিয়ে আমরা ভিতরে ঢুকলাম। আমি একটু দুশ্চিন্তায় ছিলাম, মামার পিস্তলটা নিয়ে নাকি আবার কোনো ঝামেলা হয়। কোনো ঝামেলা হলো না। মামা নিশ্চয়ই তার পিস্তলটা মাইক্রোবাসে রেখে এসেছে। পিস্তল রাখার জন্য মাইক্রোবাসে একটা গোপন বাক্স আছে। এটা খুলতে পাসওয়ার্ড লাগে, মামা জানে না, আমি গোপনে পাসওয়ার্ডটাও বের করে ফেলেছি।

লবিতে ডোরিন আর টনির আব্বু আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল, আমাদের দেখে এগিয়ে এল। ছেলে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বলল, “কী খবর? তোমাদের এডভেঞ্চার কেমন হলো?”

ডোরিন বলল, “তুমি চিন্তা করতে পারবে না আমরা কতো মজা করেছি।”

“দেখেই বোঝা যাচ্ছে। যাও বাথরুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে এসো।” আমাকে আর মাহবুবকে দেখিয়ে বলল, “তোমাদের বন্ধুদের নিয়ে যাও।”

কাজেই ডোরিন আর টনির সাথে আমরা লিফটে করে উপরে উঠে গেলাম। ডোরিন আর টনি তাদের আব্বু আম্মুকে নিয়ে যেখানে আছে সেটা রীতিমতো একটা বাসা। অনেকগুলি বেড রুম, বড় একটা লিভিং রুম, অনেকগুলো বাথরুম। না জানি এই রুমগুলোর ভাড়া কতো হাজার টাকা।

লিভিং রুমের ভিতর টনির বিখ্যাত কাদের মামা এবং তাদের মায়ের সাথে দেখা হলো। কাদের মামার চেহারাটা যেরকম কল্পনা করেছিলাম ঠিক সেরকম। মাথার চুল কম, অল্প যে কয়টা চুল আছে সেটা সারা মাথায় ল্যাপটে রাখা হয়েছে, নাকের নিচে নবাব সিরাজদ্দৌলার মতো গোঁফ, যখন মুখ খুলেছে দেখলাম পান খেয়ে তার দাঁত তরমুজের বিচির মতো কালো। ডোরিন আর টনির আম্মু ফর্সা গোলগাল, এবং হাসিখুশি। বড়লোক মহিলাদের চেহারা যেরকম হয়।

আমাদের দেখে ডোরিনের আম্মু বলল, “তোমরা এসেছ শেষ পর্যন্ত? আমি তো দুশ্চিন্তাই করতে শুরু করেছিলাম। যদিও তার চেহারা এবং গলায় দুশ্চিন্তার কোনো চিহ্ন ছিল না।

ডোরিন বলল, “না আম্মু, আমাদের সাথে মাহবুব আর টোপন ছিল, তারা সব সময় আমাদের দেখে শুনে রেখেছে।”

“ভেরি গুড।” তারপর আমাদের দুইজনের দিকে তাকিয়ে বলল, “বাচ্চারা, তোমরা দেখো আমার এই ছেলে মেয়ে দুজনকে একটু রিয়েল লাইফের এক্সপোজার দিতে পার কিনা। এরা বড়লোকের বাচ্চাদের মতো চব্বিশ ঘণ্টা প্রটেক্টেড লাইফে থাকে। আমি ভাবছিলাম একটু মাঠে ঘাটে ঘুরাঘুরি করে দেখুক সত্যিকারের লাইফটা কী রকম। কোনো কিছু বুঝে সুঝে না একটু দেখে শুনে রেখো

ডোরিন চোখ বড় বড় করে বলল, “কী বলছ মা, আমরা কিছু বুঝি সুঝি না!”

“ঠিক আছে। ঠিক আছে, তোরা সব কিছু বুঝিস।”

ডোরিন আর টনি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই তাদের কাদের মামা বলল, “আপা, এদেরকে পথে ঘাটে বেশি ঘুরতে ফিরতে দিয়ো না। এদের ব্রেনের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যাবে। আমি এতো সোজা একটা প্রবলেম দিয়েছি সেটাও করতে পারে নাই।”

টনি জিজ্ঞেস করল, “কোন প্রবলেম মামা?”

“ওই যে তিন তালা যদি তিরিশ ফুট উঁচু হয় তাহলে সাত তালা কতো ফুট উঁচুতে।”

“ও! সেইটা। কেন সেইটাতো সোজা।”

“তাহলে পারিস না কেন?”

“পারি নাই? টনি চিন্তা করার একটা অভিনয় করল খুবই কাঁচা অভিনয়, শুধু আমরা বুঝতে পারলাম। তারপর বলল, “নব্বই ফুট।” তারপর ভুরু কুচকে বলল, “হয়েছে?”

কাদের মামার মুখটা একটু কালো হয়ে গেল। কাদের মামা চায় কেউ তার প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারুক যেন সারাক্ষণ সেটা দিয়ে খোটা দিতে পারে। মুখ কালো করেই আমতা আমতা করে বলল, “যা। হয়েছে।”

টনি বলল, “মামা, তুমি সব সময় আমাদের ইন্টারেস্টিং প্রবলেম করতে চাও। এইবার আমি তোমাকে একটা প্রবলেম দিই।”

কাদের মামার মুখটা কেমন জানি বাঁকা হয়ে গেল। সেই বাঁকা মুখেই জিজ্ঞেস করল, প্রবলেম দিবি? দে।”

টনিকে আজকে সকালেই আমরা শিখিয়ে দিয়েছি। টনি মুখটা সূচালো করে বলল, “একটা গ্রামে একটা নাপিত শুধু তাদের দাড়ি শেভ করে দেয় যারা নিজেরা নিজেদের দাড়ি শেভ করে না।”

টনি থামল। কাদের মামা বলল, “তাহলে?”

টনি বলল, “নাপিত কী নিজের দাড়ি নিজে শেভ করে?”

কাদের মামা মুখটা আরো বাঁকা করে বলল, “এইটা তোর প্রবলেম?”

“হ্যাঁ।”

মামা মুখটা বাঁকা করে চিন্তা করতে শুরু করল। মামার বাঁকা মুখটা প্রথমে সোজা হয়ে গেল তারপর কেমন জানি ঝুলে গেল। তারপর মাছের মতো একবার খুলতে লাগল তারপর একবার বন্ধ হতে লাগল।

ডোরিনের আম্মু বলল, “অনেক হয়েছে। এখন যা বাথরুমে গিয়ে ভালো করে হাত মুখ ধুয়ে নিচে চল। লাঞ্চ করতে হবে। তোর আব্বু সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছে।

ডোরিন আর টনি আমাদের বাথরুমে নিয়ে গেল। অনেকগুলো বিশাল বড় বড় বাথরুম। মনে হয় বাথরুমের ভিতর ফুটবল খেলা না গেলেও ব্যাডমিন্টন খেলা যাবে। টনি টান দিয়ে ধবধবে সাদা টাওয়েল বের করে আমাদের হাতে দিয়ে সাবান লোশন এগুলো দেখিয়ে দিল।

আমরা একেকজন একেকটা বাথরুমে হাত মুখ ধুয়ে বের হয়ে এলাম। কাদের মামা তখনো একটুখানি হা করে চিন্তা করছে। টনি বলল, “বের করেছ মামা?”

কাদের মামা বলল, “না, মানে প্রবলেমটা ইন্টারেস্টিং

টনি বলল, না পারলে চেষ্টা করতে হবে না। তোমাকে আরেকটা প্রবলেম দিতে পারি, এবারে একটু সোজা দেখে–”।

ডোরিনের আম্মু এবারে তার ছেলেমেয়েদের ছোট একটা ধমক দিয়ে বলল, “অনেক হয়েছে। এখন নিচে যা, আমরা আসছি।”

আমরা তখন নিচে রওনা দিলাম। ঘর থেকে বের হয়ে টনি আনন্দে হি হি করে হাসতে লাগল। সারা জীবন কাদের মামা তাদেরকে জ্বালাতন করে গেছে, আজকে তার একটা প্রতিশোধ নেওয়া গেছে।

রেস্টুরেন্টে মাহবুব মামার পাশে বসল। মামা তখন মাহবুবকে ছুরি কাটা দিয়ে খাওয়া শিখিয়ে দিল। আমিও শিখে নিলাম। নিয়মটা খুবই সোজা, ছুরি যদি ব্যবহার করতেই হয় তাহলে সেটা ধরতে হবে ডান হাতে এবং সেটা দিয়ে কোনো খাবার মুখে ঢোকানো যাবে না। এছাড়া আর কোনো নিয়ম নাই যা ইচ্ছা তাই করা যাবে, যেভাবে খুশি খাওয়া যাবে।

মামা শিখিয়ে দেবার পর আমি চোখের কোণা দিয়ে এদিকে সেদিকে তাকালাম, বেশ কয়েকজন বিদেশি মানুষ আছে তারা সবাই মামার নিয়ম মানছে। দেশি বেশ কয়েকজন মানুষ আছে যাদের কথাবার্তা ভাব ভঙ্গী বিদেশিদের মতো, তারাও মামার নিয়ম মেনে খাচ্ছে।

তবে মামা নিয়ম কানুন শিখিয়ে দিলেও নিজে কিন্তু হাত দিয়ে মাখিয়ে গপগপ করে খাচ্ছে। তার দেখা দেখি আমরাও! খেতে খেতে মামা বলল, হাত দিয়ে মাখিয়ে না খেলে তার নাকি পেট ভরে না! বিয়ে বাড়ির মতো টেবিলে খাবার দিয়ে যাচ্ছে না। লাঞ্চ টেবিলে খাবার সাজিয়ে রেখেছে যার যেটা ইচ্ছা যত ইচ্ছা খাবার নিয়ে আসছে। আমি আর মামা আবার কবে ভালো করে খেতে পারব কে জানে তাই দুইজনই আচ্ছা মতন খেয়ে নিচ্ছিলাম। খাওয়া শেষ করে আমি টেবিলে রাখা দই মিষ্টি আনতে গেলাম। একটা বাটিতে করে বেশ খানিকটা দইয়ের উপর দুই দুইটা রসগোল্লা বসিয়ে আনছি, ঠিক যখন দুইজন বিদেশির টেবিলের পাশ দিয়ে হেঁটে আসছি তখন হঠাৎ করে একজন বিদেশির কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম, মানুষটা পরিষ্কার বলল, ইউরেনিয়াম’ এর আগে পিছে আরো অনেক কিছু বলছে কিন্তু শুধু এই শব্দটা আমি বুঝতে পেরেছি।

মানুষ দুইটা কি নিয়ে কথা বলছে আরেকটু ভালো করে শোনার জন্য আমি আমার হাতের চামুচটা ইচ্ছে করে নিচে ফেলে দিলাম। তারপর সেই চামুচটা তোলার জন্য নিচু হয়ে শোনার চেষ্টা করলাম মানুষ দুটো ইউরেনিয়াম নিয়ে কী বলছে। ব্যাটাদের উচ্চারণ বোঝা যায় না মনে হলো, টু থার্টি ফাইভ’ ‘রেডিও একটিভিটি’ এই দুটো শব্দও শুনতে পেলাম।

চামুচ তুলতে তো আর খুব বেশি সময় লাগে না, যদি দশ মিনিট ধরে হাতড়ে হাতড়ে চামুচ তুলতেই থাকি তাহলে শুধু এই দুজন মানুষ নয় অন্যরাও চিন্তায় পড়ে যাবে। তাই চামুচটা তুলে নিজের টেবিলে ফিরে এলাম। কিন্তু এই বিদেশি মানুষগুলো এখানে এসে ইউরেনিয়াম নিয়ে কেন কথা বলছে সেটা নিয়ে চিন্তার মাঝে পড়ে গেলাম।

আমার পাশে ডোরিন বসেছে। আমি গলা নামিয়ে তাকে বললাম, “ডোরিন তুমি কী বিদেশিদের ইংরেজি বুঝো?”

“বুঝি। কেন?”

“ঐ যে দুইটা সাদা চামড়ার বিদেশি বসে আছে দেখেছ?”

ডোরিন মাথা ঘুরিয়ে দেখে বলল, “হ্যাঁ দেখেছি। কেন, কী হয়েছে?”

“এই দুইটা মানুষ কী নিয়ে কথা বলছে শুনে আসতে পারবে?”

ডোরিন অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। বলল, “কেন?”

“দরকার আছে। তোমাকে পরে বলব। কিন্তু মানুষ দুইটা যেন বুঝতে না পারে। বুঝেছ?”

“বুঝেছি।” ডোরিন কয়েক সেকেন্ড কী যেন একটা চিন্তা করল, তারপর বলল, “ঠিক আছে। চেষ্টা করে দেখি।” তারপর সে তার আম্মুর দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল, “আম্মু, তোমার টেলিফোনটা একটু দেবে?”

“কেন?”

‘আমার ঈশিতাকে একটা ফোন করতে হবে। খুব জরুরি।”

“আগে খেয়ে নে তারপর ফোন করিস।”

“আমার খাওয়া শেষ। দাও ফোনটা।”

ডোরিনের আম্মু তার ফোনটা বের করে দিল। ডোরিন তখন উঠে দাঁড়িয়ে সেটা ডায়াল করার ভান করল। তারপর কানে লাগিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। তারপর কথা বলার ভান করে একটু এগিয়ে গেল। অনবদ্য অভিনয়। কথা বলার এবং শোনার ভান করতে করতে সে ইতস্তত হাঁটতে হাঁটতে বিদেশি মানুষ দুইটার টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল।

বিদেশি মানুষ দুইটা একবার আড়চোখে ডোরিনকে দেখল কিন্তু কোনো কিছু সন্দেহ করল না। ডোরিন কাছাকাছি দাঁড়িয়ে তার বন্ধু ঈশিতার সাথে কথা বলার অভিনয় করতে করতে মানুষ দুইটার কথা শোনার চেষ্টা করতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ কথা শুনে সে আবার আমাদের টেবিলে ফিরে এসে আমার পাশে বসে গেল। আমি গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কথা শুনেছ?”

“হ্যাঁ কিছু শুনেছি।”

“কী নিয়ে কথা বলছে?”

“সিমেন্ট ফ্যাক্টরি।”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “সিমেন্ট ফ্যাক্টরি?”

“হ্যাঁ। ট্রিপল স্টার সিমেন্ট ফ্যাক্টরি। কী একটা খনিজ সিমেন্টের বস্তায় করে নিয়ে যাবে।”

‘কীসের খনিজ?”

“ঠিক বুঝতে পারি নাই–কি যেন নাম খনিজটার।”

“ইউরেনিয়াম?”

ডোরিন মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। হ্যাঁ। ইউরেনিয়াম।”

আমি চোখ বড় বড় করে ডোরিনের দিকে তাকালাম, ডোরিন অবাক হয়ে বলল, “কী হয়েছে?”

আমি ফিসফিস করে বললাম, “বলব তোমাকে পরে বলব।”

০৯. লাঞ্চ খেয়েই মামা চলে গেল

০৯.

লাঞ্চ খেয়েই মামা চলে গেল। আমি আর মাহবুব রয়ে গেলাম মনি কাঞ্চনে। এখানে অনেক কিছু করার ব্যবস্থা আছে, ডোরিন আর টনি সেগুলো আমাদের দেখাবে। প্রথমে দেখালো ব্যায়াম করার জায়গা। সেখানে পাহাড়ের মতো বড় বড় সাদা চামড়ার মানুষ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দৌড়াচ্ছে, দেখে খুবই আজব লাগে যে একজন প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে কিন্তু নিজের জায়গা থেকে নড়ছে না। তারপর নিয়ে গেল বিলিয়ার্ড খেলার রুমে। আমি আগে শুধু সিনেমায় দেখেছি মানুষজন বিলিয়ার্ড খেলছে এবং তখন ডাকাতেরা গুলি করে সব লুটপাট করে নিচ্ছে। একটা টেবিল খালি ছিল ডোরিন আর টনি সেটা দখল করে নিয়ে বিলিয়ার্ড বলগুলি সাজিয়ে নিল। আমরা তখন বল দিয়ে খানিকক্ষণ ঠোকাঠুকি করলাম একদিকে মারলে বল অন্যদিকে ছুটে যায় আর আমরা সেটা দেখে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে লাগলাম। যারা অন্য টেবিলে বিলিয়ার্ড খেলছিল তারা আমাদের এই হাসাহাসি শুনে খুবই বিরক্ত হচ্ছিল কিন্তু আমরা তাদের পাত্তা দিলাম না।

তারপর আমরা রিসোর্টের বাইরে এলাম। প্রথমে ডোরিন আর টনি আমাদেরকে সুইমিংপুলে নিয়ে গেল। সুইমিংপুলটা খুবই সুন্দর, প্রথমে ভেবেছিলাম সেখানে বুঝি টলটলে নীল পানি কিন্তু পানির তো আর কোনো রং হয় না, তখন বুঝতে পারলাম সুইমিংপুলটা নীল রংয়ের টাইলস দিয়ে তৈরি করেছে তাই মনে হচ্ছে পানিটাই বুঝি নীল। সুইমিং পুলের এক পাশে ডাইভ দেওয়ার জায়গায় মোষের মতো বড় একটা মানুষ লাল রংয়ের ছোট আর টাইট একটা জাঙ্গিয়া পরে সেখান থেকে একটা ডাইভ দিল মনে হলো তার ধাক্কায় সুইমিংপুলের সব পানি বুঝি উপরে উঠে গেল। আমরা পানিটা হাত দিয়ে দেখলাম যথেষ্ট ঠান্ডা। মাহবুব পানিটা শুঁকে বলল ওষুধের গন্ধ। নদী আর হাওড়ের এতো সুন্দর পানি থাকতে মানুষ ঠান্ডা ওষুধের গন্ধে ভরা পানিতে লাল জাঙ্গিয়া পরে কেন সাঁতার কাটতে চায় কে জানে।

সুইমিং পুলটা দেখে আমরা মাঠে চলে এলাম। সেখানে পাশাপাশি অনেকগুলো টেনিস কোর্ট। টনি বলল, “চল টেনিস খেলি।”

আমি বললাম, “টেনিস কেমন করে খেলে আমি জানি না।”

ডোরিন বলল, “এর মাঝে জানার কী আছে? বলকে র‍্যাকেট দিয়ে পিটাবে।”

মাহবুব বলল, “তা ঠিক। আমরা তো কম্পিটিশনে খেলব না।”

ডোরিন বলল, “দাঁড়াও, আমি টেনিস র‍্যাকেট আর বল নিয়ে আসি।”

আমরাও ডোরিনের সাথে টেনিস বল আর র‍্যাকেট আনতে গেলাম। একটা আলমারীর ভিতর র‍্যাকেট আর বল সাজানো আছে। আমরা বেছে বেছে হালকা দেখে চারটা র‍্যাকেট আর কয়েকটা টেনিস বল নিয়ে এলাম।

টেনিস কোর্টে এসে আমরা খেলার চেষ্টা করতে থাকলাম। বলগুলিকে মারতে অনেক শক্তি লাগে। প্রায় সবগুলি বলই নেটে আটকে যেতে লাগল, কিন্তু তাতে আমাদের উৎসাহ মোটেও কমল না। টেনিস খেলতে খেলতে এক সময় আমরা টেনিস বল দিয়ে একজন আরেকজনকে মারতে গুরু করলাম এবং আবিষ্কার করলাম টেনিস খেলা থেকে এই খেলাতেই মজা অনেক বেশি। টেনিস কোর্টে র‍্যাকেট রেখে আমরা ছোটাছুটি করতে করতে এক সময় মনি কাঞ্চনের পিছনের দিকে চলে এলাম। জায়গাটা গাছপালা দিয়ে ঢাকা এবং অনেক নিরিবিলি। বড় বড় ঘাস এবং ঝোঁপ ঝাড়। সেখানে ডোরিন একবার তার টেনিস বল দিয়ে আমাকে মারল এবং বলটা মাটিতে ড্রপ খেয়ে লাফিয়ে উপরে উঠে একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেল! আমরা বলটা আর খুঁজেই পেলাম না। জলজ্যান্ত একটা বল কেমন করে চোখের সামনে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে আমরা বুঝতেই পারলাম না।

টনি বলল, “ছেড়ে দাও। আরেকটা টেনিস বল নিয়ে আসি চল।”

কিন্তু আমার কেন জানি চোখ চেপে গেল। আমি খুঁজতেই থাকলাম, খুঁজতেই থাকলাম। ঠিক যেখানে বলটা পড়েছে সেই জায়গাটা পাতি পাতি করে খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ এক জায়গায় একটা গোল গর্ত দেখতে পেলাম। গর্তটা বেশ গভীর, কিছু দেখা যায় না। আমি ভিতরে হাত ঢুকিয়ে হাতটা নাড়াচাড়া করতেই একপাশে একটা আংটার মতো জিনিস পেলাম। হাত দিয়ে সেটা নাড়াচাড়া করে বোঝার চেষ্টা করলাম এটা কী। ঠিক বুঝতে পারলাম না। তখন এটা ধরে টান দিতেই কিছু একটা নড়ে উঠল, কী নড়ল ঠিক বুঝতে পারলাম না। তখন আবার টান দিতেই উপরের মাটিটা নড়ে উঠল। মনে হলো এটা একটা ঢাকনার মতন, এর উপর মাটি জমেছে সেখানে ঘাস উঠেছে।

সবাই আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, মাহবুব জিজ্ঞেস করল, “কী পেয়েছ?”

“বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে একটা ঢাকনা। টান দিলে খুলে যাবে।”

“সত্যি?” বলে মাহবুবও আমার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে গেল। তারপর সেও হাত দিয়ে কড়াটা ধরল। তখন আমরা দুজন ধরে টান দিতেই ঢাকনা বেশ একটু উঠে এলো। ডোরিন আর টনিও তখন ঢাকনাটা ধরে ফেলল। আমরা চারজন মিলে তখন ঢাকনাটা টেনে খুলে ফেললাম। অবাক হয়ে দেখলাম নিচে একটা সিঁড়ি নেমে গেছে। এবং সিঁড়ির নিচে আমাদের টেনিস বলটা পড়ে আছে। এখন অবশ্য এই টেনিস বলটা নিয়ে আমাদের কোনো মাথা ব্যথা এবং আগ্রহ নেই। এই রহস্যময় সিঁড়িটা কোথায় গেছে সেটা নিয়ে আমাদের আগ্রহ।

আমরা নিঃশব্দে একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকালাম। তারপর এদিক সেদিক তাকালাম, বোঝার চেষ্টা করলাম কেউ আমাদের দেখে ফেলেছে কি না। আমরা ঝোঁপ ঝাড় দিয়ে আড়াল হয়ে আছি, কেউ আমাদের দেখছে না। চারজন আরো উবু হয়ে বসলাম যেন কেউ দেখতে চাইলেও দেখতে না পারে।

আমি সবার আগে কথা বললাম, “চল, নামি।”

মাহবুব সাথে সাথে রাজি হয়ে গেল, বলল, “হ্যাঁ, চল।”

ডোরিন ইতস্তত করে বলল, “নামবে? যদি কিছু হয়?”

আমি বললাম, “কী আর হবে? দেখে আসি সিঁড়িটা কোথায় গেছে।”

ডোরিন শেষ পর্যন্ত রাজি হলো। বলল, “ঠিক আছে।”

টনি ঠিক সাহস পাচ্ছিল না কিন্তু সবাই যদি নেমে যায় তখন একা একা থেকে যাওয়াটা কেমন দেখায়? তাই সেও রাজি হলো।

আমরা একজন একজন করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম। সবাই নেমে যাবার পর ঢাকনাটা আবার টেনে ঢেকে দিলাম যেন বাইরে হঠাৎ কেউ চলে এলেও বুঝতে না পারে এখানে কিছু আছে।

ঢাকনাটা টেনে দেবার পর প্রথমে সিঁড়িটা ঘুটঘুঁটে অন্ধকার হয়ে গেল তারপর আস্তে আস্তে অন্ধকারটা একটু কেটে গিয়ে আমরা আবছা আলো দেখতে পেলাম। মনে হলো সামনে একটা দরজা সেই দরজার নিচ দিয়ে একটু আলো বের হচ্ছে। আমরা কোনো কথা না বলে খুব সাবধানে নিচে নামতে থাকি। দরজার সামনে গিয়ে আমরা দাঁড়ালাম, দরজাতে হাত দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম কোনো হ্যাঁন্ডেল আছে কি না। সত্যি সত্যি একটা হ্যাঁন্ডেল পেলাম। হ্যাঁন্ডেলটা ঘোরালে দরজাটা খুলবে আমরা একেবারেই আশা করিনি। কিন্তু সত্যি সত্যি শক্ত হ্যাঁন্ডেলটা একটু জোর দিয়ে চাপ দিতেই খুট করে দরজাটা খুলে গেল। দরজার অন্য পাশে কি আছে আমরা জানি না তাই দরজাটা আগেই খুলে ফেললাম না। খুব সাবধানে একটু ফাঁক করে সেই ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলাম। মনে হলো সামনে একটু খানি ফাঁকা জায়গা তারপর আরেকটা দরজা। আমরা তখন সাবধানে ফাঁকা জায়গাটায় এসে দাঁড়ালাম। আগের দরজাটা খুলেছে বলে এটাও খুলবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই। এবং আমাদের সন্দেহ সত্যি হলো। আমরা নাটা ঘোরানোর চেষ্টা করে বুঝতে পারলাম এটা তালা মারা। কাজেই আর ভেতরে যাওয়ার উপায় নেই। টনি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “চল ফিরে যাই।”

আমরা ফিরেই যাচ্ছিলাম তখন ডোরিন চাপা গলায় বলল, “এই দেখ।”

আমরা দেখলাম দেওয়ালে একটা চাবির রিং ঝুলছে। সেখানে ছোট বড় কয়েকটা চাবি।

আমি আনন্দের চাপা একটা শব্দ করে চাবির রিংটা হাতে নিয়ে একটা একটা করে চাবিগুলো নবের ভেতর ঢোকানোর চেষ্টা করলাম। প্রথম দুটো কাজ করল না, তিন নাম্বারটা চাপ দিতেই ঢুকে গেল। আমি সাবধানে চাবিটা ঘোরালাম এবং দরজাটা খুট করে খুলে গেল। দরজায় ওই পাশে কী আছে আমরা জানি না তাই কয়েক সেকেন্ড নিঃশব্দে অপেক্ষা করলাম। যখন কিছুই হলো না তখন খুব সাবধানে দরজাটা ধাক্কা দিয়ে একটুখানি ফাঁক করে ভিতরে তাকালাম। সামনে ঝকঝকে একটা করিডোর, আলোতে ঝলমল করছে। আমি করিডোরের দুই দিকে তাকালাম, কোনো মানুষ নেই। শুধু যন্ত্রপাতির একটা চাপা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।

টনি বলল, “অনেক দেখা হয়েছে। এখন চল যাই।”

আমি বললাম, “একটু ভিতরে ঢুকি।”

টনি ভয় পাওয়া গলায় বলল, “না, প্লিজ না।”

আমি আর কথা না বাড়িয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে গেলাম। আমার পিছু পিছু মাহবুবও ঢুকে গেল। তার পিছনে ডোরিন এবং সবার শেষে টনি।

টনি ভয় পাওয়া গলায় বলল, “যদি কেউ দেখে ফেলে।”

“দেখে ফেললে দেখবে। আমরা কি চুরি করতে এসেছি?” আমাদের বলটা পড়ে গেছে সেটা খুঁজতে খুঁজতে এসেছি।”

মাহবুব মাথা নাড়ল, অন্যরা কিছু বলল না। আমরা করিডোর ধরে হাঁটতে থাকি। দুইপাশে বড় বড় ঘর, সেই ঘরের জানালা দিয়ে ভেতরে দেখা যায়। আমরা দেখতে দেখতে যেতে থাকি। নানা ধরনের যন্ত্রপাতি। মনে হয় বিশাল একটা ল্যাবরেটরি। আমরা আরেকটু এগিয়ে গেলাম, জানালা দিয়ে ভেতরে তাকিয়ে আমি চমকে উঠলাম, এখানে পাশাপাশি অনেকগুলো যন্ত্র এবং এই যন্ত্রগুলো আমি চিনি। মামার মাইক্রোবাসে একটা আছে, এটা হচ্ছে গামা রে স্পেকট্রোস্কোপি করার ডিটেক্টর শুধু তাই না, এক পাশে টেবিলের ওপর সারি সারি অনেকগুলো গাইগার কাউন্টার।

আমি একটা চাপা শব্দ করলাম, বললাম, “হায় খোদা!”

ডোরিন জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”

“তোমরা চিন্তাও করতে পারবে না”

“কি চিন্তাও করতে পারব না?”

“চল ফিরে যাই, বাইরে গিয়ে বলব।”

আমরা চলে যাবার জন্য মাত্র ঘুরেছি ঠিক তখন করিডোরের অন্য মাথায় দরজা খুলে একজন মানুষ ঢুকল। পাহাড়ের মতন একজন মানুষ, একটু আগে সুইমিংপুলে এই মানুষটা নেংটির মতো একটা জাঙ্গিয়া পরে লাফ ঝাঁপ করছিল। মানুষটা আমাদের দেখে পাথরের মতো জমে গেল, তারপর একটা গগন বিদারী চিৎকার দিল।

আমি ফিসফিস করে বললাম, “সবাই খুবই স্বাভাবিক থাক। ভাব দেখাবে আমরা মোটেও লুকিয়ে আসিনি। ঘুরতে এসেছি।”

আমরা নিজেরা নিজেরা কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেলাম। পাহাড়ের মতো মানুষটার কাছে গিয়ে ডোরিন তার দিকে হাসি হাসি মুখে বলল, “হ্যালো। গুড আফটারনুন।”

পাহাড়ের মতো মানুষটা শুভেচ্ছা বিনিময়ের ধারে কাছে গেল না, প্রায় হুংকার দিয়ে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, “তোমরা এখানে কীভাবে ঢুকেছ?”

“কেন? হেঁটে হেঁটে এসেছি।” ডোরিন একটু অবাক হওয়ার ভান করে বলল, “এখানে আসা কি নিষেধ?”

মানুষটা কোনো উত্তর দিল না, বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইল। আমাদের কথাবার্তা শুনে আরো কয়েকজন মানুষ এসে হাজির হলো। তাদের মাঝে ব্যায়ামের ঘরে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দৌড়ানো মানুষ দুইজনকেও দেখলাম। শোরগোল শুনে একজন বাঙালিকেও ছুটে আসতে দেখলাম। বাঙালি মানুষটা আমাদের দেখে চোখ কপালে তুলে বলল, “কে তোমাদের ঢুকতে দিয়েছে?”

“কেউ দেয় নাই। আমরা নিজেরা নিজেরা চলে এসেছি।”

বাঙালি মানুষটা একজনকে বলল, “নিশ্চয়ই শাহবাজ। নিশ্চয়ই লিফট খোলা রেখে দিয়েছে।”

আমি হঠাৎ করে বুঝে গেলাম আমরা যে গোপন একটা সিঁড়ি দিয়ে ঢুকে গেছি এই মানুষগুলো সেটা জানে না। তারা মনে করছে আমরা লিফট দিয়ে নেমে এসেছি। আমরা সেরকম ভান করে যাই। আমি অবাক হওয়ার ভঙ্গী করে বললাম, “এখানে আসলে কী হয়? কতো সুন্দর যন্ত্রপাতি, একটু দেখে যাই।”

মানুষগুলো একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকালো, মনে হলো কী বলবে বুঝতে পারল না। একজন সাদা চামড়ার মানুষ হড়বড় করে অনেক কিছু বলে গেল। আমাদের এভাবে আসা নিয়ে সে মোটেও খুশি হয় নাই সেটা আমি টের পেলাম কিন্তু ঠিক কী বলেছে সেটা বুঝতে পারলাম না। বাঙালি মানুষটা তার কথা অনুবাদ করে দেবার চেষ্টা করল। বলল, “স্যার খুব রাগ হয়েছেন যে তোমরা এখানে ঢুকে গেছ। এখানে বাইরের কারোর আসা নিষেধ।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কেন?”

মানুষটা একটু থতমত খেয়ে গেল। একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল। ডোরিন বলল, “আমরা এই রিসোর্টে থাকতে এসেছি। রুমের ভাড়া দিচ্ছি, এই রিসোর্ট থেকে বলেছে আমরা এখানে যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেতে পারব। আমরা আজকে জিমে গিয়েছি, বিলিয়ার্ড বল রুমে গেছি, সুইমিং পুলে গিয়েছি, টেনিস কোর্টে গিয়েছি, এখানেও এসেছি।”

মাহবুব বলল, “এখানে আসা যদি নিষেধ হয় তাহলে আমাদের কেউ থামালো না কেন? আমাদের না করলেই তো আসতাম না।”

আমি সাহস করে বললাম, “কোথাও লেখা পর্যন্ত ছিল না যে প্রবেশ নিষেধ।”

মানুষগুলো চুপচাপ থাকলো, নিজেদের ভিতরে কথা বলল, তারপর বাঙালি মানুষটাকে বলল, আমাদের বের করে দিতে। সেই মানুষটা রাগ রাগ মুখে আমাদেরকে নিয়ে একটা লিফটের সামনে দাঁড়াল। লিফটার ভেতর ঢুকিয়ে আমাদের উপরে নিয়ে বলল, “খবরদার আর কখনো এখানে ঢোকার চেষ্টা করবে না।”

আমি আমার পিছলে বুদ্ধি ব্যবহার করে জিজ্ঞেস করলাম, “আমার শুধু একটা প্রশ্ন। এখানে ঢোকা নিষেধ কেন? আপনারা কী কোনো বেআইনী কাজ করেন?”

মানুষটা আমার প্রশ্নের উত্তর পর্যন্ত দিল না, থমথমে মুখে লিফটে ঢুকে গেল।

মানুষটা চলে যাবার পর মাহবুব ডোরিন আর উনি আমার দিকে ঘুরে তাকালো। ডোরিন জিজ্ঞেস করল, “এখন বলবে এখানে কী হচ্ছে?”

“বলব। কিন্তু বলার জন্য আমাদের এমন একটা জায়গায় যেতে হবে যেখানে কেউ আমাদের কথা শুনতে পারবে না। আমি তোমাদের যে ব্যাপারটা বলব সেটা টপ সিক্রেট।”

টনি বলল, “চল তাহলে হাওড়ের পারে যাই।”

আমি বললাম, “চল।”

তখন সবাইকে নিয়ে আমরা হাওড়ের পারে রওনা দিলাম। সেখানে একটা গাছ বাঁকা হয়েছিল তার মোটা একটা ডালে আমি পা ঝুলিয়ে বসলাম। ডোরিন বলল, “বল, এখন।”

আমি বললাম, “আমার মামা কী নিয়ে গবেষণা করে তোমাদেরকে বলেছিলাম মনে আছে?”

মাহবুব বলল, “হ্যাঁ। পরিবেশ দূষণ।

“সেটা আসলে সত্যি না।”

সবাই একসাথে চমকে উঠল। বলল, “সত্যি না?”

না। মামা যেটা নিয়ে গবেষণা করে সেটা আমরা সবাইকে বলতে চাই না সেজন্য বলি পরিবেশ দূষণ। মামা আসলে দেশের সব জায়গা ঘুরে ঘুরে ইউরেনিয়াম খুঁজে বেড়াচ্ছে।”

মাহবুব রীতিমতো চমকে উঠল, বলল, “ইউরেনিয়াম! যেটা দিয়ে এটম বোমা বানায়?”

‘হ্যাঁ।” আমি সবার দিকে তাকিয়ে বললাম, “মনে আছে আমি একটা গাইগার কাউন্টার নিয়ে হাঁটছিলাম?”

“হ্যাঁ।”

“সেটা দিয়ে আসলে কার্বন ডাই অক্সাইড মাপে না। সেটা দিয়ে রেডিও একটিভিটি মাপে।”

সবাই চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকাল। আমি বললাম, “মনে আছে নৌকায় যষ্ঠি মধু গাছের চারা নিয়ে একটা মানুষ উঠেছিল। মানুষটা কোথায় সেই গাছটা পেয়েছে আমি বারবার জিজ্ঞেস করেছিলাম।”

ডোরিন বলল, “হ্যাঁ। মনে আছে। আমি ভাবছিলাম কী আজব!”

“আসলে সেই গাছের গোড়াতে যে মাটি ছিল সেটা ছিল রেডিও একটিভ। এটার কাছে গাইগার কাউন্টার নিতেই সেটা কটকট করছিল। তোমরা কেউ লক্ষ করনি।”

মাহবুব বলল, “করেছিলাম। আমি লক্ষ করেছিলাম। কিন্তু আমি পাত্তা দেই নাই।”

“তার মানে বুঝেছ?”

টনি জিজ্ঞেস করল, “মানে কী?”

“তার মানে ঐ জায়গাটাতে নিশ্চয়ই ইউরেনিয়ামের খনি আছে।”

“সত্যি?”

‘হ্যাঁ এইজন্য এই বিদেশি মানুষগুলো এখানে একত্র হয়েছে। মনি কাঞ্চনের নিচে গোপনে একটা ল্যাবরেটরি বানিয়েছে। মামার ল্যাবরেটরিতে যে যন্ত্রপাতি ছিল তাদেরও সেগুলো আছে। আমি দেখেই চিনেছি।

“কী আশ্চর্য!”

“হ্যাঁ। তারা ইউরেনিয়ামের খনি যেখানে আছে সেই পুরো জায়গাটা নিশ্চয়ই দখল করে নিয়েছে। মুখে বলছে সেখানে সিমেন্টের ফ্যাক্টরি বানাবে, আসলে মাটি খুঁড়ে ইউরেনিয়াম বের করে নিয়ে যাবে।”

“কী সর্বনাশ।”

‘হ্যাঁ। অনেক বড় সর্বনাশ।”

“তোমার মামা শুনে কী বলেছে?”

“আমার মামাকে এখনও বলার সময় পাই নাই। তাছাড়া মনি কাঞ্চনের গোপন ল্যাবরেটরিটার কথা তো আগে জানতাম না।”

“তোমার মামাকে কখন বলবে?”

আমি বললাম, “ভাবছিলাম, ইউরেনিয়ামের জায়গা থেকে মাটি তুলে নিয়ে এসে মামাকে দেই। তারপর মামাকে বলি।”

ডোরিন বলল, গুড আইডিয়া।”

মাহবুব বলল, “কখন যাবে?”

“কাল সকালে।”

ডোরিন বলল, “গুড আইডিয়া। আমরাও চলে আসব।”

মাহবুব বলল, “হ্যাঁ। আমিও চলে আসব। একসাথে যাব।”

টনি বলল, “কিন্তু আমাদের তো ঢুকতে দেবে না।”

আমি বললাম, “বুদ্ধি করে ঢুকতে হবে।”

ডোরিন বলল, “টোপনের অনেক পিছলে বুদ্ধি! তাই না?”

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “হ্যাঁ।”

মাহবুব বলল, “আমি আমার নৌকাটা নিয়ে আসব, তাহলে নৌকা থেকে নেমে যেতে পারব, আমাদের ধরতে পারবে না।”

ডোরিন আবার হাতে কিল দিয়ে বলল, “ভেরি গুড আইডিয়া।”

আমরা আরো কিছুক্ষণ কথা বললাম, তারপর আগামীকাল কীভাবে কোথায় দেখা করব সেগুলো ঠিক করে ফেললাম।

ফিরে যাবার সময় ডোরিন আর টনির আব্বু স্পিড বোটের ড্রাইভারের সাথে কথা বলল, তারা আমাদের দুজনকে হাওড়ের পাড়ে নামিয়ে দিল। মাহবুব তার বাসায় রওনা দিল আমি রওনা দিলাম মামার মাইক্রোবাসের দিকে।

.

অনেকদিন ডাইরি লেখা হয় না। রাত্রে ঘুমানোর আগে এখন পর্যন্ত কী হয়েছে সব কিছু লিখে ফেললাম। আমার ডাইরিটা এখন সারা পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং একটা ডাইরি। এই ডাইরিতে এখন মনি কাঞ্চনের নিচে গোপন ল্যাবরেটরির তথ্য আছে, ইউরেনিয়ামের খনির তথ্য আছে–মনে হয় এইটা এখন মিলিয়ন ডলারে বিক্রি করা যাবে।

আমি যখন ডাইরি লিখছি তখন মামা জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার? ডাইরি লিখছিস নাকি উপন্যাস লিখছিস?”

আমি বললাম, “অনেক কিছু লেখা জমা হয়ে গেছে।”

“পড়ে শোনাবি, কী লিখছিস?”

“উঁহু এটা টপ সিক্রেট।”

মামা চোখ বড় বড় করে নিজের কাজে ফিরে গেল। শুধু যে মনি কাঞ্চনের বিষয়টা টপ সিক্রেট তা নয়। ডোরিনকে নিয়ে কয়েক লাইন লিখেছি। সেটা আরো বেশি টপ সিক্রেট।

রাতের ঘুমটা খুব ভালো হলো না। মনে হলো মামা এক সময় তার মাইক্রোবাস থেকে নিচে নেমে গেল। কিছুক্ষণ বাইরে থেকে আবার ফিরে এসে অনেকক্ষণ জেগে রইল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে মামা?”

“কিছু না ঘুমা।”

আমি আবার ঘুমিয়ে গেলাম।

 ১০. ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে

১০.

ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে মামাকে একটু চিন্তিত দেখতে পেলাম। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করার পরও মামা পরিষ্কার করে উত্তর দিল না। তখন জিজ্ঞেস করলাম, “রাত্রে বাইরে গিয়েছিলে কেন মামা?”

প্রথমে ঠিক বলতে চাইল না তারপর বলল, “বাইরে মানুষের পায়ের শব্দ শুনে দেখতে গিয়েছিলাম।”

“কাউকে দেখেছ?”

‘না।”

“তোমার ভয় করে নাই?”

“না। ভয় করবে কেন?

“আমার কাছে লাইসেন্স করা পিস্তল আছে। তুই আছিস সেজন্য একটু চিন্তা হয়।”

“আমার জন্য কোনো চিন্তা করো না মামা।”

মামা আমার দিকে তাকাল, কোনো কথা বলল না। আমি একবার ভাবলাম মামাকে সবকিছু বলে দিই কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর বললাম না। ইউরেনিয়াম খনির খানিকটা মাটি নিয়ে এসে চারজন মিলে বলব। মাহবুব ডোরিন আর টনি কথা বলার সময় খুব করে থাকতে চাইছে।

আমি একটু পরে বের হয়ে গেলাম। বের হওয়ার আগে মামার কাছ থেকে চেয়ে গাইগার কাউন্টারটা নিলাম। সেটাকে আজকে হাতে না ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে ব্যাকপেকে ভরে নিয়েছি। রাতে মানুষের পায়ের শব্দ শোনা গেছে তাই আমি মাইক্রোবাসটার চারপাশে ঘুরে দেখলাম। একটা গাছের নিচে কয়েকটা সিগারেটের গোড়া পেলাম, বিদেশি সিগারেট। কেউ রাতে এখানে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেয়েছে। সিনেমায় দেখেছি ডিটেকটিভরা সিগারেটের গোড়া আঙুলের ছাপ বের করার জন্য ব্যবহার করে। আমিও গোড়াগুলো কাগজে মুড়ে নিয়ে নিলাম। হেঁটে হেঁটে নদীর তীরে গিয়ে দেখি এর মাঝে মাহবুব পৌঁছে গেছে। জিজ্ঞেস করলাম, “নৌকাটা এনেছ?”

“হ্যাঁ।”

“কোথায়?”

‘নদীর অন্য মাথায় রেখে এসেছি, তাহলে বেশি দূর নৌকা বাইতে হবে না।”

“ভালো বুদ্ধি।”

আমি আর মাহবুব নদীর তীরে ইতস্তত হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতে লাগলাম। মামা যখন পুরো ব্যাপারটা জানবে তখন মামা কী করবে সেটা নিয়ে কথা হলো। বিদেশিগুলো আমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে কিনা সেটা নিয়েও কথা হলো।

ডোরিন আর টনির আসতে বেশ দেরী হলো। স্পিডবোটটা আগের মতো তাদেরকে নদীটার গোড়ায় নামিয়ে দিয়েছে। আমি দেখলাম তাদের দুজনের মুখ একটু গম্ভীর। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করার আগেই ডোরিন বলল, মনি কাঞ্চন থেকে তাদের জানিয়েছে যে তাদের রিসোর্টে নাকি আজকের পর আর বুকিং নেই। আগে কখনো এরকম হয়নি তারা যতদিন ইচ্ছা থেকেছে। আমরা একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকালাম, আমরা তাদের গোপন ল্যাবরেটরিতে ঢুকে গেছি নিশ্চয়ই সেজন্য বদমাইশগুলো ডোরিনদের বুকিং ক্যান্সেল করে দিয়েছে।

টনি মুখ শক্ত করে বলল, “যাওয়ার আগে মনি কাঞ্চনে আগুন দিয়ে যাব।”

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “গুড আইডিয়া তাহলে এটা আর মনি কাঞ্চন না থেকে ছাই ভস্ম হয়ে যাবে।”

ডোরিন হি হি করে হাসল, বলল, “রিসোর্ট ছাই ভস্ম নামটা খারাপ না।”

মাহবুব বলল, “দেরি হয়ে যাচ্ছে। চল যাই।”

ডোরিন বলল, “দাঁড়াও দাঁড়াও। রওনা দেওয়ার আগে আমরা একটা সেলফি তুলে নিই।”

“সেলফি তুলবে? ক্যামেরা আছে?”

“আম্মুকে বলে তার মোবাইলটা নিয়ে এসেছি। ফিরে যাওয়ার সময় ফোন করার জন্য।”

আমরা নদীর তীরে চারজন দাঁড়ালাম। ডোরিন আমাদের চারজনের একটা সেলফি তুলল। প্রথমে স্বাভাবিক ভঙ্গী, তারপর দাঁত বের করে সবশেষে দুই আঙুল তুলে বিজয়ের ভি সাইন দেখিয়ে। বিজয়টা ঠিক কোথায় সেটা অবশ্য পরিষ্কার বোঝা গেল না।

নদীর তীর ধরে অনেকক্ষণ হেঁটে আমরা শেষ পর্যন্ত মাহবুবের নৌকাটা পেলাম। মাহবুব পানিতে নেমে নৌকাটাকে ঠেলে যতদূর সম্ভব তীরের কাছে নিয়ে এলো। আমরা জুতা খুলে পানিতে হেঁটে নৌকায় উঠে গেলাম।

মাহবুব লগি দিয়ে ঠেলে নৌকাটাকে সামনে নিতে থাকে। আমিও আরেকটা লগি দিয়ে মাহবুবকে সাহায্য করার চেষ্টা করলাম কিন্তু তাতে মাহবুবের কতোটুকু সাহায্য হলো ঠিক বুঝতে পারলাম না। একটু পর। নৌকাটা নদীর একটু গভীরে যাওয়ার পর মাহবুব লগি রেখে বৈঠা তুলে নিল। সে হাল ধরল, আমরা তিনজন বৈঠা বাইতে লাগলাম, দেখতে দেখতে আমাদের নৌকা গুলির মতো ছুটতে লাগল। আমরা হেইয়া হো হেইয়া হো করে চিৎকার করতে করতে বৈঠা বাইছি। তার মাঝে ডোরিন একটু পর পর তার আম্মুর মোবাইলে ছবি তুলতে লাগল।

মাহবুব একসময় হাত তুলে আমাদের থামাল। বলল, আমরা ইউরেনিয়াম খনির কাছাকাছি চলে এসেছি। আসলেই এটা ইউরেনিয়াম খনি কিনা আমরা জানি না কিন্তু সবাই জায়গাটাকে ইউরেনিয়াম খনি বলছি।

আমরা সবাই মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম হাতের বামপাশে একটা বড় জায়গা কাটা তার দিয়ে ঘেরাও করা। এক পাশে বড় একটা সাইনবোর্ডে লেখা :

থ্রি স্টার সিমেন্ট ফ্যাক্টরির জন্য নির্ধারিত স্থান
প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত

আমি আমার ব্যাকপেক থেকে গাইগার কাউন্টারটা বের করে সেটা জায়গাটার দিকে মুখ করে ধরে অন করলাম গাইগার কাউন্টারের কটকট শব্দ তুলনামূলকভাবে বেশি কিন্তু খুব বেশি তা নয়।

মাহবুব বলল, “আমরা এখানে নামব না। এখানে কয়েকটা গার্ড ঘোরাঘুরি করছে। আরো ভেতরে যাই।”

আমি বললাম, “ঠিক আছে।”

তারপর আবার সবাই মিলে বৈঠা বাইতে শুরু করলাম।

কিছুক্ষণের মাঝে একটা নির্জন জায়গায় পৌঁছালাম। এখানে নদীর তীরে বেশ কিছু ঝোঁপঝাড় আছে। কাঁটাতারের বেড়াটা নেই। আমরা নৌকা থামিয়ে নেমে যেতে পারব। আমি আবার গাইগার কাউন্টার বের করে পরীক্ষা করলাম। কটকট শব্দটা যথেষ্ট বেশি। সেটা হাতে নিয়ে আমি প্রথমে নৌকা থেকে নামলাম। আমার পিছু পিছু ডোরিন আর টনি এবং সবার শেষে মাহবুব নৌকা থেকে নেমে এলো।

আমি বললাম, “যদি গার্ড চলে আসে আমরা ভান করব যে আমরা জানতাম না এখানে ঢোকা নিষেধ। যদি আমাদের মাটি তুলতে না দেয় তাহলে সবাই জুতার ভেতরে মাটি ভরে নিয়ে যাবো।”

টনি অবাক হয়ে বলল, “জুতার ভিতরে?”

“হ্যাঁ, পায়ের আঙুল দিয়ে মাটি খুঁড়ে যতটুকু পার জুতার মাঝে ভরবে।”

আমরা তখন খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গী করে ঝোঁপঝাড়ের ভেতর দিয়ে যেতে থাকি এবং হঠাৎ আবিষ্কার করলাম আমার গাইগার কাউন্টারটা আগের মতো অনেক বেশি কট কট শব্দ করতে শুরু করেছে। জায়গাটা সত্যিই রেডিও একটিভ মাটি দিয়ে বোঝাই।

আমি আশে পাশে তাকিয়ে ব্যাকপেকটা নামিয়ে হাতের খুরপিটা দিয়ে মাটি খুঁড়ে ব্যাগে ভরতে থাকলাম। ডোরিন টনি আর মাহবুব আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রইল যেন কেউ আমাকে দেখতে না পায়।

আমি যখন মাটি তুলে আমার ব্যাকপেকটা প্রায় ভরে ফেলেছি তখন হঠাৎ দেখলাম একজন গার্ড একটা বন্দুক হাতে হাত নাড়তে নাড়তে চিৎকার করতে করতে ছুটে আসছে।

ডোরিন সাথে সাথে তার ক্যামেরাটা বের করে সেলফি তোলার ভান করতে লাগল। আমি দ্রুত কয়েকটা আগাছা ধরনের গাছ টেনে তুলে ব্যাকপেকে ভরে ফেললাম। মাটি কেন নিয়েছি জানতে চাইলে বলব মাটি নয়, গাছের চারা নিচ্ছি। এবং গাছের চারার সাথে একটু মাটি না থাকলে গাছের চারা বাঁচে না।

গার্ডটা হাঁপাতে হাঁপাতে আমাদের কাছে এসে তার বন্দুকটা রীতিমতো আমাদের দিকে তাক করে ধমক দিয়ে বলল, “তোমরা কে? এখানে কী করতে এসেছ?”

ডোরিন মধুর একটা ভঙ্গী করে হাসার চেষ্টা করে বলল, “কেন? আমরা বেড়াতে এসেছি! কী সুন্দর এই জায়গাটা।”

গার্ড গলার স্বর আরো উঁচু করে বলল, “এটা কী বেড়ানোর জায়গা? দেখো নাই এখানে প্রবেশ নিষেধ?”

“প্রবেশ নিষেধ? ডোরিন যেন রীতিমতো আকাশ থেকে পড়ল। আমাদের দিকে অবাক হয়ে তাকালো, রীতিমতো অনবদ্য অভিনয়, বলল, শুনেছ? এখানে নাকি প্রবেশ নিষেধ?”

আমি ব্যাকপেকটা ঘাড়ে নিয়ে বললাম, “কোথাও তো লেখা নাই প্রবেশ নিষেধ। বুঝব কেমন করে?”

মানুষটা হাত নেড়ে বলল, “এতো বড় সাইন বোর্ড, দেখ নাই?”

“সাইনবোর্ডে প্রবেশ নিষেধ লেখা নাই।”

“আছে।”

“নাই। লেখা আছে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত।”

“একই কথা।”

মাহবুব বলল, “এক কথা না। প্রবেশ অধিকার সংরক্ষিত মানে কেউ কেউ আসতে পারবে।”

ডোরিন আবার মধুর ভঙ্গীতে হাসার ভঙ্গী করে বলল, “মনে করেন আমরা হচ্ছি সেই কেউ কেউ।”

গার্ড মানুষটা কী করবে বুঝতে না পেরে ফোঁস ফোঁস করতে লাগল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার ব্যাগে কী ঢুকাচ্ছিলে?”

“কিছু ঢুকাচ্ছিলাম না।”

“আমি দেখেছি তুমি কী যেন ঢুকাচ্ছ।”

আমি আবার ব্যাগের দিকে তাকালাম, তারপর হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গী করে বললাম, “ও আচ্ছা! এগুলো! কয়েকটা গাছের চারা নিয়েছি। এগুলো হচ্ছে রাজাকার গাছের চারা।”

“কিসের চারা?”

“রাজাকার গাছ। সেভেন্টি ওয়ানে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, কোনো কাজে লাগে না শুধু কাটা। সেইজন্য বলে রাজাকার গাছ।”

“কী করবে এই গাছ দিয়ে?”

“স্কুলে দেখাব। সায়েন্স প্রজেক্ট।”

আলাপটা কোনদিকে যাবে বোঝা যাচ্ছিল না তাই ডোরিন তার মতো করে শেষ করার চেষ্টা করল, বলল, “আংকেল, আপনার সাথে একটা পিক তুলতে পারি?” ছবিকে কখন পিক বলতে হয় ডোরিন সেটা খুব ভালো করে জানে।

মানুষটা থতমত খেয়ে বলল, “আমার সাথে? পিক?”

“হ্যাঁ। আপনি বন্দুকটা এইম করে ধরবেন।”

“এইটা বন্দুক না। এইটাকে বলে রাইফেল।”

“ও আচ্ছা! আপনি রাইফেলটা এইম করে ধরবেন, আমরা দুই পাশে দাঁড়াব।”

গার্ড মানুষটা ছবি তোলার কথা শুনে মনে হয় একটু নরম হয়ে গেল। বলল, “ঠিক আছে। তুলতে চাইলে তুলো। তারপর তাড়াতাড়ি চলে যাও। বড় স্যার দেখলে অনেক ঝামেলা হতে পারে।”

কাজেই বড় স্যার দেখার আগেই আমরা কয়েকটা ছবি তুলে নৌকায় ফিরে এলাম। নৌকাটা মাঝ নদীতে নেওয়ার পর আমি গাইগার কাউন্টারটা ব্যাকপেক বোঝাই মাটির কাছে আনার সাথে সাথে সেটা বিকট স্বরে কট কট শব্দ করতে থাকে। আমি দাঁত বের করে বললাম, “মামা আজকে কী অবাক হবে আর কী খুশি হবে চিন্তা করতে পার?”

সবাই স্বীকার করল তারা সেটা চিন্তা করতে পারে না।

দূর থেকে মামার মাইক্রোবাসটা দেখেই আমার বুকটা কেমন জানি ছাৎ করে উঠল। ঠিক কেন বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল আমি নিজেও জানি না। ড্রাইভিং সীটের একটা দরজা খোলা ছিল এছাড়া আর কিছুই অস্বাভাবিক ছিল না।

আমি মাইক্রোবাসটার কাছে গিয়ে মামাকে ডাকলাম, “মামা।”

কেউ আমার কথার উত্তর দিল না। আমি আবার ডাকলাম এবারেও কেউ আমার কথার উত্তর দিল না। আমার কাছে মাইক্রোবাসের একটা চাবি তাকে, আমি সেটা বের করে মাইক্রোবাসের পিছনের দরজা খুলে ভিতরে উঁকি দিলাম। ভিতরে সবকিছু এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে কিন্তু মামার কোনো চিহ্ন নাই। মামার এক পাটি জুতা শুধু পড়ে আছে। এক পাটি জুতার মতো ভয়ংকর আর কিছু হতে পারে না। এক পাটি জুতা দেখলেই বুকটা কেমন জানি ধ্বক করে উঠে। কিছু একটা অস্বাভাবিক না হলে কখনোই এক পাটি জুতা পড়ে থাকে না।

আমি আবার গলা উঁচিয়ে ডাকলাম, “মামা। মামা।”

কেউ উত্তর দিল না, উত্তর দেবে আমি সেটা আশাও করি নাই, ভয়ে আমার বুকটা হিম হয়ে গেল।

মাহবুব জিজ্ঞেস করল, “কোথায়? তোমার মামা কোথায়?”

আমি শুকনো গলায় বললাম, “মনে হয় ওই বদমাইশগুলো ধরে নিয়ে গেছে।”

ডোরিন অবাক হয়ে বলল, “ধরে নিয়ে গেছে? কিডন্যাপ?”

“মনে হয়। রাত্রি বেলা এরা মাইক্রোবাসটার চারপাশে হাঁটাহাঁটি করছিল।”

“সর্বনাশ! এখন কী হবে?”

টনি জিজ্ঞেস করল, “ধরে কোথায় নিয়ে গেছে?”

“নিশ্চয়ই মনি কাঞ্চনের নিচতলায়। গোপন ল্যাবরেটরিতে।”

“কিন্তু সেইটা তো আর গোপন না, আমরা তো সেইটার কথা জেনে গেছি।”

আমি ঠিক করে চিন্তা করতে পারছিলাম না। অনেক কষ্টে মাথা ঠান্ডা করে বললাম, “আমাদের এখন সেই গোপন ল্যাবরেটরিতে গিয়ে খুঁজতে হবে। মামাকে খুঁজে বের করতে হবে।”

ডোরিন মাথা নাড়ল, বলল, “না না। আমাদের খুঁজতে হবে কেন? পুলিশ গিয়ে খুঁজবে। আমরা এক্ষুণি আমার আব্বুর কাছে গিয়ে সব কিছু বলব। আব্বু তখন পুলিশকে ফোন করে দিবে। পুলিশ এসে খুঁজবে।”

মাহবুব মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ আমাদের ছোটদের কথা কেউ শুনবে না। একজন বড় মানুষকে কথা বলতে হবে।”

ডোরিন বলল, “আমি এক্ষুণি যাচ্ছি। চল সবাই।”

আমি বললাম, “আমি এখানে থাকি। যদি মামা হঠাৎ চলে আসে।”

মাহবুব বলল, “টোপনের একা থাকা ঠিক হবে না, আমি টোপনের সাথে থাকি।”

ডোরিন বলল, “ঠিক আছে। তাহলে আমি আর টনি যাচ্ছি। তুমি কোনো চিন্তা করো না টোপন। টনি আর আমরা যাই।”

আমি বললাম, “শুধু একটা জিনিস।”

“কী”

“ইউরেনিয়ামের খনির কথাটা সোজাসুজি বলে দিও না।”

“তাহলে কী বলব।”

“জানি না। আমার মাথা কাজ করছে না, চিন্তা করে কিছু একটা বলে দিও।”

“ঠিক আছে।”

“আরেকটা ব্যাপার।”

‘কী?”

“আমরা যে মনি কাঞ্চনের পিছনে গোপন সিঁড়িটা পেয়েছি সেটার কথাও বলো না। এটা আমাদের কাছে গোপন থাকুক। যদি কাজে লাগে।”

“ঠিক আছে।”

“যাও তাহলে। ডোরিন তোমার আব্বুকে ভালো করে বুঝিও।”

“বোঝাব। টোপন, তুমি চিন্তা করো না।”

ডোরিন আর টনি চলে যাবার পর আমি আর মাহবুব একা একা কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। তারপর মাইক্রোবাসের চারপাশটা ভালো করে খুঁজে দেখলাম। মনে হয় মাটিতে একটু ধস্তাধস্তির চিহ্ন আছে। কাল রাতে যে রকম সিগারেটের গোড়া পেয়েছিলাম, আজকেও সেরকম কয়েকটা সিগারেটের গোড়া দেখলাম, একটু দূরে মনে হলো গাড়ির টায়ারের দাগও আছে।

আমরা আবার মাইক্রোবাসে ফিরে এলাম। ভেতরে যেগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেগুলো একটু গুছিয়ে রাখলাম। তখন মনে হলো শুধু শুধু বসে না থেকে আমরা যে মাটিটা এনেছি সেটা গামা রে স্পেকট্রোমিটারে বসিয়ে পরীক্ষা করতে শুরু করি। মামা যখন শিখিয়ে দিয়েছিল তখন পুরো ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করেছিলাম। আমার ডাইরিতেও লিখে রেখেছিলাম। নিজে নিজে এটা করব কখনো ভাবিনি, তাহলে আরেকটু ভালো করে শিখে নিতাম।

আমি আমার ব্যাকপেক বোঝাই মাটিটা গামা রে স্পেকট্রোমিটারে সোডিয়াম আয়োডাইড ক্রিস্টালের চারপাশের খালি জায়গাটাতে ঢেলে দিলাম। ডাইরিতে লেখা আছে এর পরে ডিসপ্লেটা অন করতে হবে। আমি ডিসপ্লে অন করতেই চ্যানেল নম্বর আর কাউন্টস দেখা যেতে লাগল। আমি এগুলো শুধু তোতা পাখির মতো মুখস্ত করে রেখেছি কোনটার কী অর্থ কিন্তু জানি না। এরপর ফটো মাল্টিপ্লায়ারের হাই ভোল্টেজ আস্তে আস্তে বাড়াতে লাগলাম সাথে সাথে কাউন্ট দেখা যেতে লাগল। আমি আস্তে আস্তে ভোল্টেজ বাড়িয়ে যতটুকু করা দরকার ততটুকু করে দিলাম এবং অবাক হয়ে দেখলাম কুটকুট করে কাউন্ট বাড়তে থাকে এবং বেশ কয়েকটা পিক বের হয়ে আসছে। মামা যখন আমাকে শিখিয়েছিল তখন অনেকক্ষণ কাউন্ট নেওয়ার পর একটুখানি করে কাউন্ট জমা হতো। এখন কতো তাড়াতাড়ি হচ্ছে।

মাহবুব আমার পাশে বসে আমি কী করছি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছিল। আমাকে জিজ্ঞেস করল, “এগুলো কী?”

“আমি জানি না।”

“তাহলে তুমি কী করছ?”।

“সেটাও জানি না। আমি গাড়ির দেওয়ালে স্কচ টেপ দিয়ে লাগানো একটা কাগজকে দেখিয়ে বললাম, “এই কাগজটাতে ইউরেনিয়াম খনি থেকে কী রকম স্পেকট্রাম হওয়ার কথা সেটা দেখানো আছে। আমাদের সিগন্যালটা যদি এরকম হয় তাহলে বুঝতে হবে এখানেও ইউরেনিয়াম আছে।”

মাহবুব কাগজে প্রিন্ট করা সিগন্যাল আর আমাদের ডিসপ্লের সিগন্যালটা মিলিয়ে দেখল তারপর মাথা নেড়ে বলল, “মিল আছে।”

“ক্যালিব্রেশান করা হয় নাই। ক্যালিব্রেশান করলে আরো মিল হবে।”

“ক্যালিব্রেশান মানে কী?”

আমি মাথা নেড়ে বললাম, “জানি না।”

মাহবুব অবাক হয়ে বলল, “জান না তাহলে বলছ কেমন করে?”

“সেইটাও জানি না।”

মাহবুব আর কিছু বলল না। আমি বললাম, “এখন কয়েক ঘন্টা ডাটা নিলে স্পেকট্রামটা সুন্দর হবে।”

কাজেই আমরা কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে থাকলাম।

ধীরে ধীরে দুপুর হয়ে গেল, এখনো মামার কোনো দেখা নেই। ডোরিন তার আব্বুকে ঠিকমতো বুঝিয়েছে কিনা কে জানে। তার আব্বু কী পুলিশকে ডাকিয়েছে? পুলিশ কী এসে নিচে ল্যাবরেটরিতে গিয়েছে? মামা কী সেখানে আছে? যদি মামাকে খুঁজে পাওয়া না যায় তাহলে কী হবে? বাসায় ফোন করে আব্বু আম্মুকে জানাতে হবে। কী জানাব? আব্বু আম্মুকে কী বলব আমি?”

দুপুর বেলার দিকে মাহবুব বলল, “আমাদের এখন কিছু খাওয়া দরকার।”

আমি বললাম, “ঠিকই বলেছ। খিদে লেগেছে। মানুষের শরীর খুবই আশ্চর্য, এতো বিপদের মাঝেও খিদে পেয়ে যাচ্ছে। আমি খুঁজে খুঁজে কয়েকটা নুডলসের প্যাকেট বের করলাম। একটা বাটির মাঝে পানি ঢেলে সেখানে নুডলসগুলো ভেঙে দিলাম, দুটি ডিমও ভেঙে সেখানে দিলাম, তারপর সবকিছু মাইক্রোওয়েভ ওভেনে ঢুকিয়ে সেটা পাঁচ মিনিটের জন্য চালিয়ে দিলাম। পাঁচ মিনিট পর মাইক্রোওয়েভ ওভেন খুলে দেখলাম নুডলসগুলো এখনো সিদ্ধ হয়নি। তখন সেগুলো আরও পাঁচ মিনিটের জন্য দিয়ে দিলাম। এভাবে বেশ কয়েকবার চালানোর পর মনে হলো নুডলসগুলো সিদ্ধ হয়েছে। তবে দেখতে খুবই ভয়ংকর।

তখন আমি আর মাহবুব দুইটা চা চামচ নিয়ে নুডলসগুলো খেতে শুরু। করলাম। পুরো জিনিসটা দেখতে যত ভয়ংকর হয়েছে খেতে কিন্তু তত খারাপ হয়নি। কিংবা কে জানে হয়তো বেশি খিদে লাগলে সবকিছুই খেতে ভালো লাগে। খাওয়া শেষ করার পর আমরা বাটি এবং চামচ ধুয়ে রেখে দিয়ে আবার অপেক্ষা করতে থাকি।

গামা রে স্পেকট্রোমিটারে সিগন্যালগুলো আস্তে আস্তে বেড়েছে। বেশ পরিষ্কার কয়েকটা পিক দেখা যাচ্ছে। মামা দেখলেই এই পিকগুলো চিনে ফেলতো। আমি কিছুই চিনলাম না। শুধু বুঝতে পারলাম সিগন্যালটা দেখতে গাড়ির দেওয়ালের কাগজের প্রিন্টটার মতো। সেটাই অনেক বড় ব্যাপার।

বাইরে যখন প্রায় অন্ধকার নেমে এসেছে তখন আমি কাউন্ট বন্ধ করে স্পেকট্রোমিটার একটা প্রিন্ট নিয়ে নিলাম। খুবই সুন্দর প্রিন্ট। মামা আমার কাজ দেখলে খুশি হতো। কিন্তু মামা নেই। আমি প্রিন্টটা আমার ডাইরিতে স্কচটেপ দিয়ে লাগিয়ে নিলাম। কোথায় আছে কে জানে। বেঁচে আছে কিনা সেটাই বা কে জানে। চিন্তা করেই আমার শরীর খারাপ লাগতে থাকে। মনে হলো হাউ মাউ করে কাঁদি।

ঠিক এরকম সময় আমি একটা গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ শুনতে পেলাম। একটু পরে গাড়ির হেড লাইটের আলোতে জায়গাটা আলোকিত হয়ে উঠল।

আমি আর মাহবুব মাইক্রোবাস থেকে নেমে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। একটু পরে দেখলাম একটা গাড়ি এসে থামল আর গাড়ি থেকে বেশ কয়েকজন মানুষ নামল। কাছে আসার পর চিনতে পারলাম মানুষগুলো পুলিশ। পিছনে আমরা ডোরিনের আলুকে দেখতে পেলাম। আমি ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আমার মামাকে পাওয়া গেছে?

ডোরিনের আব্বু মাথা নাড়ল, বলল, “না।”

“ভালো করে খুঁজে দেখেছে?”

“কোথায় ভালো করে খুঁজে দেখবে?”

“কেন? ডোরিন বলেনি? মনি কাঞ্চনের নিচে একটা গোপন ল্যাবরেটরি আছে, সেখানে?”

“গোপন কেন হবে? এটা মনি কাঞ্চনের বেসমেন্ট। খাবার স্টোরেজের জায়গা, কোয়ালিটি কন্ট্রোলের ল্যাব।”

আমি প্রতিবাদ করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু ঠিক তখন পুলিশদের একজন যে মনে হয় তাদের ভেতরকার অফিসার বলল, “আমরা দেখেছি। কোনো মানুষকে কেউ আটকে রাখে নাই। কে আটকে রাখবে? “এখানে তো সন্ত্রাসী থাকে না, সম্মানী মানুষজন থাকে। বিদেশ থেকে এসেছে সব বড় বড় ইঞ্জিনিয়ার।”

আমি প্রতিবাদ করে বললাম, “কিন্তু কিন্তু”।

পুলিশ অফিসারটা আমাকে কথা বলতে দিল না, বলল, “কোনো সার্চ ওয়ারেন্ট ছাড়া সার্চ করেছি এখন বিপদে না পড়ে যাই। আমরা করতে চাচ্ছিলাম না, কিন্তু স্যারের মেয়ে আর ছেলে এতো চেঁচামেচি শুরু করল যে আমাদের সার্চ করতেই হলো। খুবই লজ্জা পেয়েছি আমরা।”

আমার প্রায় চোখে পানি এসে যাচ্ছিল, ভাঙা গলায় বললাম, “মামা আমার মামা তাহলে কোথায়?”

“কোনো এক জায়গায় গিয়েছেন আবার চলে আসবেন।” পুলিশ অফিসার হঠাৎ গলার স্বর পাল্টে বলল, “তোমার মামা আসার পর আমাদের তার সাথে কথা বলতে হবে। আমাদের কাছে রিপোর্ট এসেছে এখানে নাকি ইয়াবা তৈরির গোপন ফ্যাক্টরি আছে”

আমি অবাক হয়ে মানুষটা দিকে তাকিয়ে রইলাম। কী বলছে এই মানুষটা? আমার মামা ইয়াবা তৈরি করছে? হঠাৎ করে আমি বুঝতে পারলাম এই পুলিশগুলোকে আসলে বিদেশি মানুষগুলো টাকা দিয়ে কিনে ফেলেছে। এরা আমার মামাকে খুঁজে বের করবে না। উল্টো দরকার হলে ‘ মামাকে ক্রসফায়ার করে ফেলবে। মামার ল্যাবরেটরিতে ইয়াবা প্যাকেট ফেলে রেখে মামাকে বিপদে ফেলে দেবে। মামাকে আমার খুঁজে বের করতে হবে।

পুলিশ অফিসার বলল, “যাই হোক, আমরা এসেছি তোমার মামার গাড়িটা নিয়ে যাবার জন্য। আজ রাতের মতো এটাকে মনি কাঞ্চনের পার্কিং লটে রাখব। কাল লোকাল থানায় নিয়ে যেতে হবে সার্চ করার জন্য।”

ডোরিনের আব্বু আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি আজ রাতটা আমাদের সাথে থাকো। তোমার বাসায় ফোন করে দেব, কাল ভোরে তোমার আব্বু আম্মু এসে তোমাকে নিয়ে যাবেন।”

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “না। আমি আমার মাইক্রোবাসেই থাকব। আমার মামা এসে আমাকে না পেলে চিন্তা করবে। মাইক্রোবাসে আমি থাকি। এখানে থাকার সব ব্যবস্থা আছে।”

পুলিশ অফিসার বলল, “একা একা কীভাবে থাকবে?”

মাহবুব পাশে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনছিল, সে হঠাৎ করে বলল, “আমি থাকব টোপেনের সাথে।”

পুলিশ অফিসার ভুরু কুঁচকে বলল, “তুমি কে? তোমার বাড়ি কোথায়?”

“আমার বাড়ি এখানেই।”

“তুমি এখানে থাকলে তোমার বাসায় চিন্তা করবে না।”

“আমি বাসায় ফোন করে বলে দেব। তাহলে চিন্তা করবে না।”

পুলিশ অফিসার কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “ঠিক আছে। তোমার ইচ্ছা। কিন্তু আমরা এই গাড়িটা এই জঙ্গল থেকে সরিয়ে নিচ্ছি। আজ রাতের মতো এটা থাকবে মনি কাঞ্চনের পার্কিং লটে।

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “ঠিক আছে।”

পুলিশের একজন ড্রাইভার যখন মামার মাইক্রোবাসটা ড্রাইভ করে মনি কাঞ্চনে নিয়ে যেতে থাকে তখন আমি মনে মনে ঠিক করে ফেলেছি আমি কী করব। আমার সাইন্টিস্ট মামাকে আর কেউ খুঁজে বের করবে না। আমাকেই খুঁজে বের করতে হবে।

আমিই মামাকে খুঁজে বের করব। যেভাবে হোক।

১১. আমি আর মাহবুব

১১.

আমি আর মাহবুব চুপচাপ মামার মাইক্রোবাসটাতে বসে আছি। ডোরিন আর টনি এসেছিল, অনেকক্ষণ আমাদের সাথে কথা বলে একটু আগে তাদের রুমে ফিরে গেছে। খাবারের প্যাকেট নিয়ে এসেছিল আমরা চারজন বসে সেগুলো খেয়েছি। খুবই মজার খাবার দাবার, মনমেজাজ ভালো থাকলে খাবারগুলো মজা করে খেতাম, কিন্তু এখন শুধু খাওয়ার জন্য খেয়েছি। মজাটা টের পাই নাই, পেটটা শুধু ভরেছে।

ডোরিন আর টনি চলে যাবার পর আমি তার মাহবুব আরো কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম। দেখলাম আস্তে আস্তে রিসোর্টটার লাইটগুলো একটা একটা করে নিভতে শুরু করেছে। যখন পুরো রিসোর্টটা মোটামুটি অন্ধকার হয়ে গেল তখন আমি আর মাহবুব আমাদের মাইক্রোবাস থেকে বের হলাম।

আমার ব্যাকপেকটা ঝেড়ে পরিষ্কার করেছি। সেখানে কয়েকটা জিনিস নিয়েছি, একটা টর্চলাইট, একটা চাকু, আমার ডাইরিটা (সেখানে যে পুলিশের এস পিকে আমরা গাড়ি একসিডেন্টের পরে উদ্ধার করেছিলাম তার ভিজিটিং কার্ডটা স্কচ টেপ দিয়ে লাগানো আছে)। তারপর খুব সাবধানে মামার গোপন বাক্সটা খুলে সেখানে থেকে মামার পিস্তলটা নিয়েছি। পিস্তলের ভিতরে একটা ম্যাগাজিন ভর্তি গুলি আর একটা বাড়তি ম্যাগাজিন। পিস্তলটা একটা তোয়ালে দিয়ে পেরিয়ে নিয়েছি। তারপর দুইজন খুব সাবধানে মাইক্রোবাস থেকে নেমে পা টিপে টিপে মনি কাঞ্চনের দেয়াল শেষে ঝোঁপ বাড়ের ভিতর দিয়ে প্রায় গুঁড়ি মেরে হেঁটে যেতে লাগলাম। মনি কাঞ্চনের পিছনে গিয়ে ঝোঁপ ঝাড়ের ভিতর দিয়ে আমরা খুব সাবধানে সেই গোপন সিঁড়িটার কাছে পৌঁছালাম। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে ঢাকনাটা বের করে আমরা সেটা টেনে তুলে ভিতরে ঢুকে গেলাম।

আমি আর মাহবুব তারপর সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলাম। আমি ব্যাকপেকটা খুলে মামার পিস্তলটা বের করে কোমরে গুঁজে নিলাম। সিনেমার সিক্রেট এজেন্টরা এইভাবে পিস্তল নেয়, কিন্তু এখন আমার আসলে সেই সব মাথায় নাই। ভয়ের চোটে রীতিমতো বাথরুম পেয়ে গেছে কিন্তু সেই কথাটা তো আর মাহবুবকে বলা যায় না। আমি ফিসফিস করে বললাম, “প্রথমে আমি ঢুকব, যদি আমি ধরা পড়ে যাই তাহলে তুমি আর ভিতরে ঢুকবে না।”

মাহবুব বলল, “প্রথমে আমিও ঢুকতে পারি।”

“না। প্রথমে আমি।” যদি ধরা পড়ে যাই তুমি বের হয়ে আমার ডাইরিটার শেষ পৃষ্ঠায় একটা ভিজিটিং কার্ড আছে। সেই কার্ডের মানুষটাকে ফোন করে সবকিছু বলবে।”

মাহবুব ফিসফিস করে বলল, “মানুষটা কে?”

“একজন পুলিশ অফিসার। তার পুরো ফ্যামিলিকে আমরা একসিডেন্ট থেকে বাঁচিয়েছিলাম।”

“ঠিক আছে।”

“তবে একটা কথা।”

“কি কথা?”

“তুমি ডাইরিটার কিছু পড়তে পারবে না। একটা শব্দও না। ঠিক আছে?”

“ঠিক আছে।”

“বল খোদার কসম।”

মাহবুব মনে হয় একটু অবাক হলো, তারপর বলল, “খোদার কসম।”

“ঠিক আছে। আমি তাহলে গেলাম।”

মাহবুব বলল, “যাও।”

আমি তখন খুব সাবধানে দরজাটা ফাঁক করে ভিতরে উঁকি দিলাম। আশেপাশে কেউ নেই। আমি তখন সাবধানে ভিতের ঢুকে মাত্র এক পা সামনে এগিয়েছে তখন হঠাৎ করে কোথা থেকে জানি বিশাল পাহাড়ের মতো একটা মানুষ হুংকার দিয়ে বলল, “হু ইজ দ্যাট?”

আমি চমকে উঠলাম। এতো বড় একটা মানুষকে আমি দেখতে পেলাম না কেন? তখন অবশ্য এতো কিছু চিন্তা করার সময় নাই, আমি জানটা হাতে নিয়ে একটা দৌড় দিলাম।

পাহাড়ের মতো মানুষটা একটা লাফ দিয়ে আমাকে ধরার চেষ্টা করল, একটুর জন্য তার হাত ফসকে গেল। কোথায় যাচ্ছি কোনদিকে যাচ্ছি আমি কিছুই জানি না শুধু নিজের জান বাঁচানোর জন্য ছুটে যাচ্ছি, কিন্তু বেশি দূর যেতে পারলাম না। পাহাড়ের মতো মানুষটা আরেকটা লাফ দিয়ে আমাকে ধরে ফেলল। তার লোহার মতো আঙুল মনে হলো আমার শরীরের মাংস কেটে ভিতরে ঢুকে হাড় পর্যন্ত গুড়ো করে ফেলল।

মানুষটা আমাকে একটা ময়লা ত্যানার মতো ধরে উপরে তুলে আছাড় দিয়ে নিচে নামালোলা। আমি কোনোমতে আমার কোমরে গুঁজে রাখা পিস্তলটা ধরে রাখলাম যেন বের হয়ে না যায় কিংবা মানুষটা দেখে না ফেলে।

মানুষটা আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “ইউ লিটল রাসকেল।”

চোখগুলো ভাটার মতো জ্বলছে মুখে বিকট গন্ধ মনে হচ্ছে এক্ষুণি আমার ঘাড় মটকে খেয়ে ফেলবে।

আমার হাতে সময় বেশি নাই, আমি বাঁচার শেষ চেষ্টা করলাম, ব্যাটা ছেলেদের যে জায়গায় মারলে সবচেয়ে বেশি ব্যথা লাগে আমি আমার ডান পা দিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সেখানে মারলাম। মানুষটা কোক করে করে একটা শব্দ করল তার বড় বড় চোখ দুটো মনি হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে পুরো চোখটা কেমন যেন সাদা হয়ে গেল, দাঁতগুলো বের হয়ে তাকে একটা ডাইনোসরের মতো দেখতে লাগল। (আমি ডাইনোসর কখনো দেখি নাই। কিন্তু দেখতে নিশ্চয়ই এরকম হবে।)

আমার লাথি খেয়ে মানুষটা আমাকে ছেড়ে দিয়ে তার দুই হাত দিয়ে ব্যথা পাওয়া জায়গাটা চেপে ধরে একটা গগন বিদারী চিৎকার দিল। আমি তখন আবার আমার জান নিয়ে ছুটে পালালাম। সামনে একটা ঘর, ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল। ভিতরে ঢুকে দেখি বের হওয়ার কোনো জায়গা নেই, তাই যত তাড়াতাড়ি ঢুকেছিলাম তার থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে এলাম। দৌড়াতে দৌড়াতে পিছনে তাকিয়ে দেখলাম পাহাড়ের মতো মানুষটা উঠে দাঁড়িয়ে আবার আমার পিছনে পিছনে ছুটে আসছে।

আমি দৌড়ে আরেকটা ঘরে ঢুকে যত তাড়াতাড়ি পারি ছিটকানি লাগিয়ে দিয়ে পালানোর একটা রাস্তা খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু বের হওয়ার কোনো রাস্তা নেই। কী করব যখন চিন্তা করছি ততক্ষণে মানুষটা এসে দরজা ধাক্কা দিতে শুরু করছে। তার প্রচণ্ড ধাক্কায় পুরো দরজা ভেঙে যাবার অবস্থা হলো। মানুষটা মনে হয় একটু দূরে গিয়ে ছুটে এসে দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। এর পরের বার ধাক্কা দেওয়ার সাথে সাথে আমি ছিটকানিটা খুলে ফেলে একটু সরে দাঁড়ালাম। মানুষটা এবারে যখন ছুটে এসে দরজা ধাক্কা দিল সাথে সাথে সে ভিতরে হুড়মুড় করে আছাড় খেয়ে পড়ে আবার একটা গগন বিদারী চিৎকার দিল। সেই ফাঁকে আমি লাফ দিয়ে বের হয়ে আবার জান নিয়ে দৌড়াতে লাগলাম।

মানুষটার চিৎকার এবং হইচই শুনে অনেক মানুষ বের হয়ে এসেছে। তারা এখনো বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে। অবাক হয়ে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে আমি তার মাঝে ছুটে যেতে লাগলাম। অন্য একজন মানুষ আমাকে ধরার চেষ্টা করল, ধরতে পারল না। আমি তার হাত থেকে ছাড়া পেয়ে একটা ঘরে ঢুকে ছিটকানি লাগিয়ে দিলাম। ঘরটা একটা ল্যাবরেটরি, ভিতরে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি। আমি টেবিল থেকে ধাক্কা দিয়ে মূল্যবান যন্ত্রপাতি নিচে ফেলে দিয়ে হাতে নেওয়ার মতো একটা কিন্তু খুঁজতে লাগলাম। শেষ পর্যন্ত একটা চকচকে সিলিন্ডার পেয়ে গেলাম। সেটা দুই হাতে ধরে আমি গায়ের জোরে কিছু যন্ত্রপাতি গুড়ো করে দিলাম। কেন দিলাম কে জানে। মনে হয় কোনো কারণে আমার অনেক রাগ উঠে গেছে।

তারপর ঘরের বাতি নিভিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইলাম ভেতরে কেউ ঢুকলেই তাকে মেরে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব। ইতস্তত ছোটাছুটি করার কারণে কোনদিকে কী আছে আর বুঝতে পারছি না, চেষ্টা করতে হবে যেদিক দিয়ে ঢুকেছি সেদিক দিয়ে বের হয়ে যেতে।

বাইরে কিছু মানুষের উত্তেজিত কথাবার্তা শুনতে পেলাম। এবারে মানুষগুলো আর ধাক্কা দিয়ে দরজা ভেঙে ঢোকার চেষ্টা করছে না। তারা চাবি এনে চাবি দিয়ে দরজার তালা খোলার চেষ্টা করছে। অন্ধকারে ভালো দেখা যায় না, তার মাঝে হঠাৎ করে তালা খুলে ভিতরে কয়েকজন মানুষ ঢুকে গেল। আমি অন্ধকারে তাদের ধাক্কা দিয়ে বের হয়ে যেতে চেষ্টা করলাম, পারলাম না। মানুষগুলো আমাকে জাপটে ধরে ফেলল, আমি তার ভেতরেই হাতের সিলিন্ডার ঘুরিয়ে কয়েকজনের নাক মুখ মোটামুটি থ্যাতলে দিলাম।

শেষ পর্যন্ত তারা আমাকে ধরে ফেলল, ঘরের লাইট জ্বালিয়ে তারা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি দেখলাম আমার সিলিন্ডারের আঘাতে একজনের নাক দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে আরেকজনের বাম চোখটা প্রায় বুজে এসেছে।

মানুষগুলো সবই বিদেশি। হড়হড় করে কিছু একটা বলছে, কী বলছে কিছুই বুঝতে পারছি না। তখন দেখলাম একজন বাঙালি মানুষ দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে। কাছে এসে সে আমাকে দেখে তোতলাতে তোতলাতে বললম, “তু-তু-তুমি? আবার?”

আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, “হ্যাঁ। আমি আবার।”

“কেন?”

আমি বললাম, “বুঝেন নাই কেন? আমার মামা কোথায়?”

মানুষটা বলল, “তোমার মামা এখানে নাই।” যদি সত্যি আমার মামা এখানে না থাকতো কিংবা মামার কথা না জানতো তাহলে মানুষটা অবাক হয়ে বলতো, মামা? কোন মামা? কার মামা? কিন্তু মানুষটা আমার মামার কথা খুব ভালো করে জানে।

আমি বললাম, “মিথ্যা কথা বলেন কেন? আমার মামাকে ধরে এনেছেন কেন?”

“আমরা তোমার মামাকে ধরে আনব কেন?” মানুষটা তার কথাগুলো খুব জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করল কিন্তু কথাটার মাঝে বেশি জোর বোঝা গেল না। বোঝাই গেল সে মিথ্যা কথা বলছে।

আমি বললাম, “আমি বলব কেন আপনারা আমাকে ধরে এনেছেন? বলব?”

মানুষটা মিনমিন করে বলল, “বল।”

“তার কারণ হচ্ছে আপনারা যে থ্রি স্টার সিমেন্ট ফ্যাক্টরি বানাচ্ছেন সেটা ভূয়া। পুরোপুরি ভূয়া।”

“ভূয়া?”

“হ্যাঁ। আসলে এটা হচ্ছে একটা ইউরেনিয়ামের খনি।”

এবারে সবগুলো মানুষের চোয়াল এক সাথে ঝুলে পড়ল। আমার একেবারে মনে হলো কটাশ করে একটা শব্দ হলো। আমি এতোক্ষণ বাংলায় যে কথাগুলো বলছিলাম তার কিছুই বিদেশিগুলো বুঝে নাই কিন্তু তারা থ্রি স্টার সিমেন্ট ফ্যাক্টরি আর ইউরেনিয়াম এই দুটা কথা বুঝতে পারছে এবং এক সাথে সবাই ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠেছে।

আমি দেখলাম সবগুলো মানুষের চোয়াল একবার বন্ধ হচ্ছে আরেকবার খুলছে, কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না। তারপর যে বিদেশিটার চোখ প্রায় বুজে গিয়েছে সে আমতা আমতা করে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, “হাউ ডু ইউ নো?”

আমি মুখের মাঝে খুবই উঁচু ধরনের ভাব ফুটিয়ে বললাম, “গামা রে স্পেকট্রোস্কোপি।”

মানুষটার চোয়াল আবার ঝুলে পড়ল। বলল, “গা-গা-গা–” পুরো গামা রে স্পেকট্রোস্কাপি বলতে পারল না। আমি মুখে আরো বেশি ভাব ফুটিয়ে বললাম, “সোডিয়াম আয়োডাইড ক্রিস্টাল উইথ ফটোমাল্টিপ্লায়ার।”

মানুষটার চোয়াল এবারে বন্ধ হয়ে গেল। আমি সিনেমার ভিলেনদের মতো মুখে একটা বাঁকা হাসি ফুটিয়ে ইংরেজিতে বলার চেষ্টা করলাম, “ইউ ওয়ান্ট দিস সিক্রেট সো ইউ হাইজ্যাক মাই সাইন্টিস মামা।” তোমরা এটা গোপন রাখতে চাও সেইজন্য মামাকে হাইজ্যাক করে এনেছ। ইংরেজিটা পুরোপুরি মনে হয় ঠিক হয় নাই কিন্তু মানুষগুলো আমার কথাগুলো ঠিকই বুঝতে পারল। তাদের লাল মুখ কালো না হয়ে কেমন যেন বেগুনি হয়ে গেল।

এরা নিজেরা নিজেরা কিছুক্ষণ কথা বলল, তারপর বাঙালি মানুষটাকে কিছু একটা বলে মুখ ভোলা করে দাঁড়িয়ে রইল।

বাঙালি মানুষটাকে কেমন যেন নার্ভাস মনে হলো। সে আমার হাত ধরে বলল, “আস।” তার ঠিক পিছনে লাল মুখের একটা মানুষ বুকের উপর দুই হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে রইল। ভঙ্গীটা খুবই স্পষ্ট, আমি যদি একটু খানি উল্টাপাল্টা কিছু করি তাহলে সে আমার মাথাটা টেনে ধর থেকে আলাদা করে ফেলবে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায়?”

“সব কথা তোমাকে বলতে হবে কেন?”

“কারণ আপনি তো বিদেশি না–আপনি এই দেশের।”

“তাতে কী হয়েছে?”

“বিদেশিদের পা চাটতে হয় না। খুব লজ্জার ব্যাপার।”

আমার কথা শুনে মানুষটা কেমন যেন লাল হয়ে উঠে। লজ্জায় না রাগে বুঝতে পারলাম না।

আমি ইচ্ছা করলেই ঝটকা মেরে নিজের হাত ছুটিয়ে নিতে পারি। পাহাড়ের মতো মানুষটার অসুবিধার জায়গায় যেভাবে কষে একটা লাথি দিয়েছিলাম ঠিক সেভাবে এই মানুষটাকেও অচল করে দিতে পারি। ঠিক কী কারণ জানি না হঠাৎ করে আমার সব ভয় ডর চলে গেছে, আমার মনে হতে থাকে যে এই মুহূর্তে কিছু করার দরকার নাই। দেখি কী করে। আমি এখন যা ইচ্ছা তাই করতে পারি। মনে হয় পেটের কাছে প্যান্টের ভিতর মামার পিস্তলটা খুঁজে রেখেছি সেইজন্য। শুধু তাই না পকেটে বুলেট ভরা একটা ম্যাগাজিনও আছে। সাথে পিস্তল আর বুলেট থাকলে মনে হয় ভয়। লাগে না।

বাঙালি মানুষটা আমাকে টেনে নিতে থাকে, পিছন পিছন লাল মুখের মানুষটা থপ থপ করে পা ফেলে ফেলে আসতে থাকে। হেঁটে হেঁটে একটা ঘুরে ঢুকে সেখানে একটা আলমারির সামনে মানুষটা দাঁড়িয়ে গেল। তখন লাল মুখের মানুষটা ধাক্কা দিয়ে আলমারিটা সরাতেই পিছনে একটা দরজা দেখা গেল। বাঙালি মানুষটা দরজা খুলে আমাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকল। ঘরের ভিতর দেওয়ালে হেলান দিয়ে একজন মানুষ বসে আছে, মানুষটির চেহারা না দেখেই আমি বুঝতে পারলাম, এটি আমার মামা।

আমি চিৎকার করে উঠলাম, “মামা!”

মামা ঘুরে আমার দিকে তাকালো, আমি তখন বুঝতে পারলাম, মামার হাত দুটো পিছনে বাঁধা শুধু তাই না আমি বুঝতে পারলাম মামাকে এই জানোয়ারগুলো মেরেছে। হঠাৎ করে আমার ভিতরে অসহ্য রাগ পাক খেয়ে উঠল, মনে হলো আমি বুঝি সবার চোখ খাবলে তুলে নিতে পারব।

মামা দুর্বল গলায় বলল, “তোকেও ধরে এনেছে!”

“হ্যাঁ মামা।”

“কী আশ্চর্য। তুই না একটা বাচ্চা ছেলে। দশ বছর বয়স।”

“বারো।”

“একই কথা।”

বাঙালি মানুষটা আমার গলায় ধাক্কা দিয়ে সামনে ঠেলে দিল। লাল মুখের মানুষটা তখন আমাকে খপ করে ধরে আমার হাত দুটো পিছনে নিয়ে বেঁধে ফেলে। তারপর আমাকে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দিয়ে বলল, “গো টু হেল। জাহান্নামে যাও।”

আমি মেঝেতে পড়ে থেকে সেই অবস্থায় চি চি করে বললাম, “ইউ গো টু হেল।” তুমি জাহান্নামে যাও।

মানুষটা আমার দিকে এগিয়ে এলো, রাগে তার মুখটা থম থম করছে। বুট পরে থাকা পা দিয়ে মানুষটা আমার পাঁজরে একটা লাথি দিল এবং আমি সেই লাথি খেয়ে প্রায় দশ হাত দূরে ছিটকে পড়লাম। আমার প্রথম মনে হলো আমি মরে গেছি। নিঃশ্বাস আটকে ছিল, অনেক কষ্টে বুক থেকে বের করে মনে হলো এখনো মরিনি কিন্তু আর দুই মিনিটের মাঝে মরে যাব। দুই মিনিট পরে মনে হলো এবারের মতো বেঁচে যেতে পারি। তখন চোখ খুলে তাকালাম। দেখলাম ঘরটা খালি, শুধু মামা আমার উপর ঝুঁকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

আমি চোখ খোলার পর মামা আমার দিকে তাকিয়ে দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করল, বলল, “অনেক ব্যথা লেগেছে?”

আমি বললাম, “মোটামুটি।”

“জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নে। তারপর উল্টো দিক দিয়ে একশো থেকে এক পর্যন্ত গুণে আয়।”

আমি হাসার মতো ভঙ্গী করে বললাম, “আমি এক থেকে একশ পর্যন্ত সোজা দিকেই কখনো গুণি নাই!”

মামা একটু নড়েচড়ে পিছনে সরে দেয়াল হেলান দিয়ে বসল। বলল, “তোকে আমার সাথে আনাটা ঠিক হয় নাই। অনেক বড় গাধামো হয়েছে।”

“না মামা, গাধামো কেন হবে?”

“হয়েছে। এরা খারাপ মানুষ। খুব খারাপ। দেখলি না তোর মতো বাচ্চা ছেলেকে কীভাবে মারল। অনেক ব্যথা লেগেছিল?”

“হ্যাঁ মামা। এখন ঠিক হয়ে যাচ্ছে।”

“ভয় পাস না, ঠিক হয়ে যাবে।”

মামাকে এখনো বলিনি যে আমি তার পিস্তলটা নিয়ে এসেছি। সেটা ব্যবহার করতে চাইলে তো আগে হাতের বাঁধন খুলতে হবে। সেটা আমার না, মামার দায়িত্ব। আমি মামাকে ডাকলাম, “মামা।”

“কী টোপন?”

“আমি তোমার জন্য একটা গিফট এনেছি।”

“কী গিফট? একটা নেইল কাটার?”

“না মামা। তোমার পিস্তলটা।”

মামা দেওয়ালে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে ছিল, আমার কথা শুনে হাত বাধা অবস্থায় প্রায় লাফ দিয়ে উঠে বসে গেল। প্রায় চিৎকার করে বলল, “কী বললি? পিস্তল? আমার পিস্তল?”

“হ্যাঁ মামা।” আমার প্যান্টে গুঁজে রেখেছি। পকেটে এক্সট্রা ম্যাগাজিন।”

“কিন্তু সেইটা ছিল সেফটি বক্সে। পাসওয়ার্ড দেওয়া সেফটি বক্সে।”

“হ্যাঁ মামা।”

“তুই তুই তুই আমার পাসওয়ার্ড জানিস?”

“না জানার কী আছে? তুমি যেভাবে পাসওয়ার্ড ঢোকাও সেইটা জানতে না চাইলেও আমি জেনে যাই।”

মামা খিকখিক করে হাসতে হাসতে বলল, “তুই আসলেই একটা মিচকি শয়তান।”

“কিন্তু মামা, তুমি পিস্তলটা ব্যবহার করবে কেমন করে? হাতগুলো যে বাঁধা।”

“হাতের বাঁধা খোলা কোনো ব্যাপারই না। কিন্তু তার আগে তোকে একটা জোক বলতে হবে।”

আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, “এখন তুমি জোক বলবে? আগে হাতের বাঁধা খুলে ফেলি।”

“এইটা কী কঠিন? তুই গড়িয়ে গড়িয়ে আমার কাছে আয়। আমার পিছনে তোর হাতগুলো দে, আমি তোর হাত খুলে দেই। তারপর তুই আমারটা খুলে দিবি।”

“এতো সোজা!”

“হ্যাঁ, এত সোজা। শুধু এর মাঝে কেউ চলে না আসলেই হলো।”

আমি তখন গড়িয়ে গড়িয়ে মামার কাছে চলে এসে মামার হাতের কাছে আমার হাতগুলো রাখলাম। মামা আমার হাতের বাঁধন খুলতে খুলতে বলল, “এবারে জোকটা শোন। এই মাথা মোটা মানুষগুলোর কাজ কর্ম দেখে আমার জোকটা মনে পড়ল। একবার একটা মানুষের বাসায় চোর এসেছে। মানুষটা চোরটাকে ধরে ফেলে তার খাটের সাথে বেঁধে গেছে থানায়, পুলিশ ডেকে আনতে। পুলিশ জিজ্ঞেস করল চোরটাকে ঠিক করে বেঁধেছ তো? মানুষটা বলল, হ্যাঁ খুব ভালো করে খাটের সাথে চোরের পা টা বেঁধে রেখেছি। পুলিশ চোখ কপালে তুলে বলল, শুধু পা? হাত বাঁধা নাই? মানুষটা, বলল, না হাতটাতো বাঁধি নাই। পুলিশ বলল তাহলে চোরটা এতক্ষণে তার হাত দিয়ে পায়ের বাঁধা খুলে পালিয়ে গেছে। মানুষটা কিছুক্ষণ চিন্তা করল তারপর বলল, মনে হয় পালায় নাই। চোরটা আমার মতো পাকিস্তানী! আমার মাথায় যখন এই বুদ্ধিটা আসে নাই, চোরের মাথায়ও আসবে না, সে নিশ্চয় পা বাঁধা নিয়ে বসে আছে–” মামা তার জোক শেষ করে হা হা করে হাসতে লাগল। নিজের জোক শুনে কাউকে আমি কখনো এভাবে হাসতে দেখি নাই।

আমিও হাসলাম। মামা হাসি থামিয়ে বলল, এই বিদেশি গুলির বুদ্ধি পাকিস্তানীদের মতো! যখন দুইজন মানুষের হাত বেঁধে একটা ঘরে রাখা হয় তখন তাদের একজন যে আরেকজনের বাঁধা খুলে ফেলতে পারে সেইটা তাদের মাথায় আসে নাই!”

মামা ততক্ষণে আমার হাত খুলে দিয়েছে, আমি হাত দুইটা একটু নাড়লাম তারপর মামার হাতের বাঁধনটা খুলে দিতে দিতে বললাম, “মামা, পাকিস্তানিরা কী আসলেই এত বোকা?”

“এরা একাত্তর সালে আমাদের অনেক জ্বালিয়েছে তাই পৃথিবীর যত খারাপ গল্প, বোকামীর গল্প, গাধামির গল্প সব তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।”

আমি পিস্তলটা নিয়ে আসার কারণে মামার মেজাজটা অনেক ভালো। মামা মনের খুশিতে বকবক করতে থাকে। বিদেশিটার লাথির কারণে বুকের মাঝে এখনো টন টন করছে তারপরেও আমার মেজাজটাও অনেক ভালো। আমিও মামার বকবকানী শুনতে লাগলাম।

শেষ পর্যন্ত মামার হাতের বাঁধনটা খুলে ফেলতে পারলাম। মামা তার হাত দুইটা কিছুক্ষণ ডলে ডলে রক্ত চলাচল করালো তারপর দাঁতের ফাঁক দিয়ে একটা ইংরেজি গালি দিল। মামাকে আগে কখনো কাউকে গালি দিতে শুনি নাই, তবে এখন মামা গালি দিতেই পারে। আমাকেই যখন এতো খারাপভাবে মেরেছে তখন মামাকে না জানি কত খারাপভাবে মেরেছে। আমি পিস্তলটা মামার কাছে দিলাম। মামা পিস্তলটাকে চুমু দিয়ে ছোট বাচ্চার মতো আদর করল। পিস্তলকে যে আদর করা যায় আমি সেটাও জানতাম না।

আমি মামাকে জিজ্ঞেস করলাম, “মামা, আমরা এখন কী করব?”

বাইরে তো অনেকগুলো মানুষ এখনই বের হওয়া ঠিক হবে না। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করি, দুই চারজন আসুক, সেগুলোকে বেঁধে ফেলি তারপর বাইরে যাব।”

“কেমন করে বাঁধবে?”

“কেন? যে নাইলনের দড়ি দিয়ে আমাদের বেঁধেছে সেইটা দিয়ে।”

“কিন্তু আগে ধরতে হবে না?”

“ধরব। আমার হাতে একটা পিস্তল, আমার হাতের টিপ মারাত্মক। শুটিংয়ে গোল্ড মেডেল পেয়েছি!”

“আসলেই গুলি করবে?”

“মনে হয় করতে হবে না। ভয় দেখিয়েই কাজ করে ফেলা যাবে।”

“কেউ কী আসবে?”

“আসবে। আসবে। নিশ্চয়ই আসবে।” মামা তারপর ঘরের দেওয়ালে হেলান দিয়ে গুনগুন করে একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে লাগল, “যদি তার ডাক শুনে কেউ না আসে…”

১২. একটু ঘুম এসে গিয়েছিল

১২.

আমরা কতোক্ষণ বসেছিলাম জানি না। আমার মনে হয় একটু ঘুম এসে গিয়েছিল। হঠাৎ মামা সোজা হয়ে বসে বলল, “কেউ একজন আসছে।”

আমিও সোজা হয়ে বসলাম। মানুষের গলার স্বর শোনা যাচ্ছে তার মানে একজন নয় একজনের বেশি মানুষ আসছে। মানুষ একা একা কথা বলে না।

মামা ফিসফিস করে বলল, “হাত দুটো পিছনে রেখে চুপচাপ বসে থাক। দেখে যেন মনে হয় তোর হাত দুটো এখনো বাঁধা।”

আমি তাড়াতাড়ি আমার দড়িটা লুকিয়ে ফেললাম। তারপর হাত দুটো পিছনে নিয়ে বসে পড়লাম। মুখে হতাশ একটা ভঙ্গী করে মাথাটা এক পাশে কাত করে রাখলাম। মামাও তার দড়িটা পিছনে সরিয়ে হাত দুটো পিছনে নিয়ে রাখল। এক হাতে পিস্তলটা ধরে রেখেছে। মামাও চোখে মুখে খুব একটা হতাশ ভাব ফুটিয়ে রাখল।

আমরা শুনতে পেলাম দরজার বাইরের আলমারিটা ঠেলে সরানো হচ্ছে তারপর দরজা খুলছে। তারপর দুইজন মানুষ ভিতরে ঢুকলো। দুইজন বিদেশি। আমাদের দুইজনের দিকে একবার দেখল, তারপর একটু সরে গিয়ে নিজেদের ভেতর নিচু গলায় কথা বলতে লাগল। আমি স্পষ্ট ক্রসফায়ার শব্দটা শুনতে পেলাম।

মামা খুব ধীরে ধীরে মাথাটা একটু তুলে খুবই ক্লান্ত গলায় ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, “আমাদের নিয়ে তোমাদের পরিকল্পনাটি কী?”

একজন খেঁকিয়ে উঠে বলল, “শাট আপ।”

মামা আস্তে আস্তে মাথা তুলে বলল, “তার মানে আমাদের নিয়ে তোমাদের কোনো পরিকল্পনা নাই?”

মানুষটা আবার খেঁকিয়ে উঠল, “আই সেইড শাট আপ।”

মামা মোটেও হাল ছেড়ে দিল না। খুবই নরম গলায় ইংরেজিও বলল, “তোমাদের যেহেতু কোনো পরিকল্পনা নেই, তাহলে আমাদের পরিকল্পনাটাই কাজে লাগাই। কী বল?”

মানুষ দুটো কেমন জানি চমকে উঠল। মামা তখন পিছন থেকে তার হাতটা বের করে সামলে নিয়ে আসে। তার হাতে চকচকে কালো একটা পিস্তল।

মানুষ দুটো কী করবে বুঝতে পারে না, তাদের মুখ পুরোপুরি হা হয়ে থাকে। একজন ফাঁসাসে গলায় বলল, “ইউ ইউ ইউ” কিন্তু কথা শেষ করতে পারল না।

মামা বলল, “তোমরা একটু খানি তেড়েবেড়ি করলে আমি গুলি করে দেব। আমার কথা বুঝেছ?”

মানুষ দুটি মাথা নাড়ল, মামা বলল, “শুধু মাথা নাড়লে হবে না, মুখে বল, বুঝেছি স্যার। স্যার এর উপর জোর।”

মানুষ দুটি বলল, “বুঝেছি স্যার।” স্যার এর উপর জোর।

মামা এবারে উঠে দাঁড়াল, তারপর বলল, “দুইজন দেওয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়াও। হাত উপরে তুলে।”

মানুষ দুইজন হাত উপরে তুলে ঘুরে দাঁড়াল।

মামা তখন বলল, “টোপন, যা এদের সার্চ কর।”

আমি ইতস্তত করে বললাম, “কেমন করে সার্চ করতে হয় আমি জানি না।”

“প্রথমে পকেটে যা আছে সব বের করে নিয়ে আয়। তারপর শরীরে হাত বুলিয়ে দেখ কোথাও কোনো অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছে কিনা। যা।”

আমি তখন পকেটে হাত দিয়ে মানি ব্যাগ, চাবির রিং, টেলিফোন, কাগজপত্র সবকিছু বের করে নিয়ে এলাম। বগলের তলায়, পেটে, পিঠে হাত দিয়ে দেখলাম সেখানে কোনো অস্ত্র লুকানো আছে কি না। কিছু লুকানো নেই।

মামা তখন আবার পিছনে সরে গিয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসল। আমিও গিয়ে মামার পাশে বসলাম। মামা পিস্তলটা তাদের দিকে তাক করে রেখে বলল, “এবারে বল দেখি তোমরা কারা। এখানে কেন এসেছ? তোমাদের মতলবটা কী? আমাকে কেন ধরে এনেছ? আমার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, এই বাচ্চা ছেলেটাকে কেন ধরে এনেছ?”

মানুষগুলো কোনো কথা বলল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

মামা ধমক দিয়ে বলল, “কী হলো? কথা বল না কেন?”

মানুষগুলো তবু কোনো কথা বলল না। মামা বলল, “আমি বুঝতে পারছি উত্তর দেওয়া খুব কঠিন। আমরা চোর, চুরি করতে এসেছি। এইসব কথা বলা কঠিন, কাজটা করে ফেলা সহজ।” মামা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, “তোমরা কী প্রফেশনাল চোর? কোথাও চুরি করা শিখেছ?”

এবারে একজন কথা বলল, অস্পষ্ট স্বরে বলল, “আমরা ইঞ্জিনিয়ার।”

“কিসের ইঞ্জিনিয়ার?”

“নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ার। আর আমার পার্টনার মেটালার্জির ইঞ্জিনিয়ার।”

মামা হা হা করে হাসল, বলল, “ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে কী শেখানো হয় কীভাবে অন্যদেশে গিয়ে তাদের সম্পদ চুরি করতে হয়?”

মানুষ দুটি কোনো কথা বলল না, ঠিক তখন আমাদের সামনে মেঝেতে রাখা একটা টেলিফোন শব্দ করে বেজে উঠল।

মামা জিজ্ঞেস করে উঠল, “এটা কার টেলিফোন।

নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ার বলল, “আমার।”

মামা টেলিফোনটা হাত দিয়ে ঠেলে মানুষটার কাছে পাঠিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কে টেলিফোন করেছে?”

মানুষটা উবু হয়ে দেখে বলল, “আমাদের টিম ম্যানেজার।”

“কোথা থেকে ফোন করছে?”

“উপরের বার থেকে।”

“মদ খাচ্ছে?”

মানুষটা এবারে কোনো উত্তর দিল না। মামা বলল, “তুমি ফোনটা ধরবে। ধরে কী বলবে সেটা আমি বলে দিব। যদি এর বাইরে একটা শব্দ বল আমি তোমার হাঁটুতে গুলি করব। মনে রেখো, মাথায় না, হাঁটুতে। বুঝেছ?”

মানুষটা মাথা নেড়ে জানাল সে বুঝেছে। মামা বলল, “তুমি বলবে, আমরা যে ছোট ছেলেটাকে ধরে এনে বুকে লাথি দিয়েছি তার অবস্থা খুব খারাপ। নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। কি করা যায় তার ডিসিশন নিতে হবে সবাই নিচে আস। এক্ষুণি। বুঝেছ?”

মানুষটা কোনো কথা বলল না। মামা ধমক দিয়ে বলল, “বুঝেছ?”

নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ার মানুষটা বলল, “বুঝেছি।”

মামা বলল, “ফোনটা ধরো।”

ফোনটা ধরা গেল না, কারণ বেজে বেজে থেমে গেছে। মামা বলল, “এক্ষুণি আবার ফোন আসার কথা, যদি না আসে তুমি ফোন করবে।”

মানুষটা মাথা নাড়ল। মামা বলল, “যদি আমার কথামতো কথা না বল আমি হাঁটুতে গুলি করব। ডান হাঁটু না বাম হাঁটু সেটা নিয়ে তোমার কোনো পছন্দ আছে? পছন্দ থাকলে এখনই জানিয়ে রাখ।”

মানুষটা চাপা গলায় বলল, “তার প্রয়োজন হবে না।”

মামা বলল, “ফ্যান্টাস্টিক। আমার রক্ত দেখতে ভালো লাগে না।”

সত্যি সত্যি মানুষটার ফোনটা আবার বাজল, এবারে সে ফোনটা তুলে নিয়ে কথা বলতে শুরু করল। মামা যেভাবে বলেছে ঠিক সেভাবে। কথা শেষ করে সে টেলিফোনটা নিচে রাখল। মামা তাকে ফোনটা নিজের দিকে ঠেলে দিতে বলল, মানুষটা ঠেলে দিল। মামা দেখে নিশ্চিত হলো যে লাইন কাটা হয়েছে তখন আবার কথা শুরু করল। বলল, “তোমরা দুইজন এখন দেওয়ালের সাথে গিয়ে দাঁড়াও, আর টোপন, তুই ঘরের মাঝখানে দুই হাত পিছনে রেখে উপরের দিকে মুখ করে শুয়ে থাক। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে এরকম অ্যাকটিং করতে পারবি?”

আমি বললাম, “পারব মামা।”

“গুড। শুরু করে দে।”

আমি দুই হাত বাঁধা সেরকম ভান করে ঘরের মাঝখানে শুয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস নিতে পারছি না সেরকম একটা অনবদ্য অভিনয় শুরু করে দিলাম।

কিছুক্ষণের মাঝেই ঘরের বাইরে অনেকগুলি মানুষের পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। আমার বুকটা ধ্বক ধ্বক করতে লাগল, মামা কী সত্যিই পারবে এগুলো মানুষকে আটকাতে? যদি না পারে তখন কী হবে? আমি জোর করে ভেতর থেকে চিন্তাটাকে ঠেলে দূর করে দিলাম।

হঠাৎ দরজাটা খুলে গেল। একসাথে বেশ কয়েকজন মানুষ ভিতরে ঢুকল, আমার দিকে তাকাল, একজন নিচু হয়ে আমার বুকের ওপর হাত রাখল, তারপর কী যেন একটা বলল। আমি চোখের কোণা দিয়ে দেখলাম, মামা হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। পিস্তলটা তাক করে চিৎকার করে বলল, “হ্যান্ডস আপ। এভরিবডি।”

মানুষগুলো পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে গেল। সবাই মাথা ঘুরিয়ে মামার দিকে তাকাল। আমিও তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দুই লাফে মামার পাশে এসে দাঁড়ালাম। আমার বুকটা ঢাকের মতো শব্দ করছে। কী হবে? এখন কী হবে?

মামা পরিষ্কার ইংরেজিতে বলল, “আমাকে কেউ খাটো করে দেখ না। আমার পিস্তলে আটটা গুলি আছে, আমি আটজনকে ফেলে দিতে পারব। একটা গুলিও মিস হবে না।”

মানুষগুলো যে যেখানে ছিল সেখানে দাঁড়িয়ে রইল। মামা বলল, “কেউ যদি আমার কথা বিশ্বাস না কর তাহলে চেষ্টা করে দেখতে পার। তোমাদের কারো কাছে যদি কোনো অস্ত্র থাকে সেটা নিয়ে আমাকে আক্রমণ করতে পার।”

আমার নিজের চোখকে বিশ্বাস হলো না, সত্যি সত্যি মোষের মতো একজন কোথা থেকে একটা বিশাল চাকু বের করে সেটা হাতে নিয়ে বিকট চিৎকার করে মামার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি ভয়ে চিৎকার করে চোখ বন্ধ করলাম।

আমি একটা গুলির শব্দ শুনতে পেলাম, সাথে সাথে মানুষের আর্ত চিৎকার। চোখ খুলে দেখি মোষের মতো মানুষটা নিজের হাত ধরে মেঝেতে পড়ে আছে। হাত থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। ভয়ংকর চাকুটা তার পাশে পড়ে আছে।

মামা খুবই শান্ত গলায় বলল, “আর কেউ?”

আর কেউ চেষ্টা করল না। মামা বলল, “চমৎকার। এবার তাহলে তোমরা সবাই ঘুরে দেওয়ালের দিকে তাকাও। তারপর দেওয়ালের কাছে গিয়ে দুই হাত ওপরে তুলে দেওয়াল ধরে দাঁড়াও।”

মানুষগুলো যন্ত্রের মতো দেওয়ালের দিকে গিয়ে হাত উঁচু করে দেওয়াল ধরে দাঁড়াল।

মামা বলল, “তোমরা সংখ্যায় সাতজন, যার মাঝে একজন এখন অচল। আমরা দুইজন, তার মাঝে একজন শিশু। তার মাথা ভর্তি পিছলে বুদ্ধি কিন্তু ফুঁ দিলে সে বাতাস উড়ে যাবে। কাজেই আমার ঝুঁকি নেবার উপায় নেই। আমাকে খুবই সতর্ক থাকতে হবে। সেজন্য তোমাদের বলছি তোমরা কেউ পিছন দিকে তাকাবে না। যদি কেউ তাকাও আমি সাথে সাথে তার পায়ে গুলি করব। আমার এই ম্যাগাজিনে আটটা বুলেট ছিল। তার মাঝে একটা খরচ হয়েছে, এখনো সাতটা আছে। সবাই কী বুঝেছ?”

কেউ কোনো শব্দ করল না। মামা বলল, “যদি আমার কথা বুঝে থাক মাথা নাড়াও।”

এবারে সবাই মাথা নাড়ল। মামা বলল, “চমৎকার। আমরা আমাদের প্রোগ্রামের একেবারে শেষের দিকে চলে এসেছি।” তারপর হঠাৎ ইংরেজি বন্ধ করে একেবারে পরিষ্কার বাংলায় বলল, “আমাদের মাঝে একজন একেবারে খাঁটি রাজাকার আছে যে বিদেশিদের পা চেটে নিজের দেশের সর্বনাশ করতে রাজি আছে।”

দেওয়াল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা বাঙালি মানুষটা ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, “মাপ করে দেন স্যার। ভুল হয়ে গেছে স্যার।”

মামা বলল, “আমার পিস্তলে সবার জন্য একটা করে গুলি রেখেছি শুধু তোমার জন্য রাখি নাই। আমার ধারণা আমি খালি হাতে তোমার কল্লা ছিঁড়ে নিতে পারব। ঠিক বলেছি কি?”

মানুষটা এবারে ভেউ ভেউ করে কেঁদে দিল, কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আপনার পায়ে পড়ি স্যার। মাপ করে দেন স্যার।”

“মাপ করার কথা পরে। তোমাকে আমি একটা কাজ দেই।”

“বলেন স্যার। আপনি যেটা বলবেন সেইটাই করব স্যার। খোদার কসম স্যার।”

“খোদাকে টানাটানি করো না, তোমার মতন রাজাকারদের জন্য খোদার কোনো সময় নাই।”

“কী করতে হবে বলেন স্যার।”

এইখানে যতগুলো মানুষ হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে প্রথমে তাদের সবার হাত এই দড়ি দিয়ে বাঁধবে। একসাথে কোরবানী ঈদের সময় গরু যেভাবে নেয় সেইভাবে।”

মানুষটা মনে হয় বুঝতে পারল না, মামা ধমক দিল, “বুঝেছ?”

“বুঝেছি।”

“নাও শুরু কর। টোপন তুই সাহায্য কর। শুধু গুলি খাওয়া মানুষটাকে বাধার দরকার নাই। তাকে বাইরে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে হবে।”

মামা দড়িটা ছুঁড়ে দিল, মানুষটা তখন দড়িটা নিয়ে বাঁধা শুরু করল। দড়ি দিয়ে একজনের বাম হাত তারপর ডান হাত তারপর পরের জনের বাম হাত তারপর পরেরজনের ডান হাত এইভাবে। সবাইকে এক দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলা হলো। এরা ইচ্ছা করলেই এই বাঁধন খুলে ফেলতে পারবে, কিন্তু এটা করতে একটু সময় লাগবে, ওই বাড়তি সময়টা পাওয়াই মামার উদ্দেশ্য।

দড়ি দিয়ে বাঁধা শেষ হবার পর মামা বলল, “এবারে সবার ট্রাউজার খুলে নাও।”

বাঙালি মানুষটা থতমত খেয়ে বলল, “কী খুলে নেব?”

“ট্রাউজার। মানে প্যান্ট।”

“প্যান্ট?”

“হ্যাঁ।”

“মানে ন্যাংটা করে ফেলব?”

“পুরোপুরি ন্যাংটা না, ভেতরে নিশ্চয়ই আন্ডার প্যান্ট জাঙ্গিয়া এইসব আছে।”

“কেন খুলে নিতে চাচ্ছেন স্যার?”

“তাহলে ওরা আমার পিছু পিছু আসতে একটু সংকোচ বোধ করবে। এটা খুবই স্ট্যান্ডার্ড টেকনিক। জাঙ্গিয়া পরে মানুষজন পাবলিক জায়গায় যেতে চায় না।”

“এরা একটু বেহায়া কিসিমের স্যার।”

“তবুও চেষ্টা করে দেখি।”

কাজেই বাঙালি মানুষটা সবার ট্রাউজার খুলে নিল। দেখা গেল একজনের জাঙ্গিয়া খুবই রঙিন, লাল নীল ফুল আঁকা। এরকম জাঙ্গিয়া হয় আমি তাই জানতাম না। মামা জাঙ্গিয়াটার খুব প্রশংসা করল কিন্তু সেই প্রশংসা শুনে মানুষটা খুব খুশি হয়েছে বলে মনে হলো না। মামা তারপর সবার প্যান্টের পকেট থেকে সব কিছু বের করে একত্র করল। সেখানে অনেক কিছু পাওয়া গেল, সিগারেটের লাইটার, সিগারেটের প্যাকেট, বিদেশি–যেটার গোড়া আমি বাঁচিয়ে রেখেছি। একজনের পকেটে একটা চ্যাপ্টা বোতল পাওয়া গেল, মামা বলল সেটা নাকি মদের বোতল। মামা ~ শুধু সিগারেটের লাইটারটা নিজের পকেটে ভরে নিল। তারপর সবাইকে ইংরেজিতে বলল, “আমি তোমাদের পকেটের ভিতর যা আছে সেগুলো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়ে যাব। তবে তোমাদের ট্রাউজারগুলোর মায়া ছেড়ে দাও। সেগুলো তোমরা ফেরত পাবে না।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “প্যান্টগুলো কী করবে মামা।”

মামা বলল, “একটু পরেই দেখবি।”

মামা ঘরটা ভালো করে দেখে সন্তুষ্টির মতো একটা শব্দ করল। তারপর বাঙালি মানুষটাকে বলল, “এই গুলি খাওয়া মানুষটাকে ধরে ধরে বাইরে নিয়ে যাও। আমরা এখন যাব।”

আমি বললাম, “মামা।”

“কী হলো?”

“যে মানুষটা আমাকে লাথি দিয়েছে তাকে আমি একটা লাথি দিয়ে যেতে পারি?”

মামা মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু সেলফ ডিফেন্সের জন্য ঠিক আছে কিন্তু বন্দী মানুষের গায়ে হাত তোলা যাবে না। তাছাড়া আমাদের কালচারে ছোটরা বড় মানুষের গায়ে হাত তুলে না।”

“তাহলে তুমি তোমার পিস্তলটা দিয়ে মানুষটাকে একটু ভয় দেখাবে? প্লিজ।”

“ঠিক আছে সেটা করা যেতে পারে।” বলে মামা ইংরেজিতে বলল, “এই যে লাল মুখের মানুষ, তুমি এই ছোট ছেলেটাকে লাথি দিয়েছিলে, কাজটা ঠিক কর নাই।”

লাল মুখের মানুষটা বলল, “আমি দুঃখিত। কাজটা আসলেই ঠিক হয় নাই।”

“আমার গায়ে যে হাত তুলেছে সে নিজের দোষে শাস্তি পেয়ে গেছে, গুলি খেয়ে পড়ে আছে। তোমার কোনো শাস্তি হয় নাই। তোমাকে একটা শাস্তি দেওয়া দরকার।”

লাল মুখের মানুষটা আবার বলল, “প্লিজ। আমাকে ক্ষমা করে দাও।”

“ছোট একটা এক্সপেরিমেন্ট করি তোমাকে দিয়ে। আমার হাতের নিশানা খুব ভালো। মনে হয় এখনো ভালোই আছে, তোমার উপর একটু প্র্যাকটিস করি?”

মানুষটা বলল, “না, প্লিজ না।”

মামা আমাকে চ্যাপ্টা মদের বোতলটা দিয়ে বলল, “যা এই বোতলটা এই মানুষটার মাথায় বসিয়ে আয়।”

আমি গিয়ে বোতলটা মাথার উপর বসিয়ে দিলাম। মামা মানুষটাকে বলল, “তুমি নড়বে না। একেবারেই নড়বে না। আমি গুলি করে এই বোতলটা ফুটো করে দেব।”

মানুষটা থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “না, প্লিজ না। এটা খুব বিপদজনক।”

“সেজন্যই করছি। তুমি একদম নড়বে না। রেডি! ওয়ান টু–”

আমি বললাম, “মামা থাক, থাক, ছেড়ে দাও। প্লিজ।”

“ছেড়ে দেব?”

“হ্যাঁ।”

“কেন? তুই না বললি শাস্তি দিতে।”

“শাস্তি হয়ে গেছে মামা। দেখ, সে ভয়ে হিস্যু করে দিয়েছে।”

সত্যি সত্যি তার পায়ের নিচে ঝরঝর করে হিস্যু পড়ছে। মামা মাথা নেড়ে বলল, “যা মদের বোতলটা নিয়ে আয়, আমাদের অন্য কাজে লাগবে।”

“কী কাজে লাগবে?”

“দেখবি একটু পরেই।”

আমরা ঠিক যখন বের হয়ে আসছি তখন ছয়জন মানুষের একজন ভারী গলায় বলল, “আমি কী একটা বিষয় জানতে পারি?”

“কী বিষয়?”

“তুমি এখানে এই পিস্তলটা কোথায় পেয়েছ?”

মামা হা হা করে হাসল, তারপর বলল, “আমার এই পুচকে ভাগ্নে এটা আমার জন্য নিয়ে এসেছে। তার শরীরে বিশেষ কিছু নাই কিন্তু মাথার ভিতরে ডাবল সাইজের মগজ।”

তারপর আমরা বের হয়ে এলাম। প্রথমে গুলি খাওয়া মানুষটাকে নিয়ে বাঙালি মানুষটা। তারপর মামা, হাতে পিস্তল নিয়ে খুবই সতর্ক। সবার পিছনে আমি। আমার ঘাড়ে ছয়টা বিদেশির ছয়টা প্যান্ট।

বের হয়েই মামা বাঙালি মানুষটাকে বলল, “এই গুলি খাওয়া মানুষটাকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। এক্ষুণি নিয়ে যাও।”

বাঙালি মানুষটা বলল, “জ্বি স্যার। নিয়ে যাচ্ছি স্যার।”

মামা বলল, “খবরদার আর কোনো দুই নম্বুরী কাজ করতে যেও না।”

মানুষটা বলল, “না স্যার। করব না স্যার। খোদার কসম।”

মামা বিরক্ত হয়ে বলল, “খবরদার খোদাকে নিয়ে টানাটানি করো না। যাও বের হও।” তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কোনদিকে বের হতে হবে তুই জানিস?”

“হ্যাঁ মামা। খুঁজে বের করে ফেলব।” বলে আমি সামনে হাঁটতে থাকি।”

মামা হাঁটতে হাঁটতে একটু পরপর উপরে ছাদের দিকে তাকাচ্ছিল। হঠাৎ উপরে কিছু একটা দেখে মামা দাঁড়িয়ে গেল। আমি উপরে তাকালাম, সেখানে গোল প্লাস্টিকের কিছু একটা লাগানো। আমি জিজ্ঞেস করলাম “এখানে এটা কী?”

মামা বলল, ‘স্মোক ডিটেক্টর।”

স্মোক ডিটেক্টরের ঠিক নিচে প্যান্টগুলো রেখে মামা সেগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিল। মদের বোতল থেকে সেখানে একটু মদ ঢেলে দেবার পর সেটা দপ করে জ্বলে উঠল।

আগুনটা খুব ভালো করে ধরানো গেল না কিন্তু তাতে কোনো সমস্যা হলো না। প্রচুর ধোয়া হলো এবং সেই ধোঁয়াতে স্মোক ডিটেক্টরটা থেকে বিকট স্বরে এলার্ম বাজতে থাকে। শুধু যে এই স্মোকে ডিটেক্টর থেকে এলার্ম বাজছে তা নয়, বিকট একটা এলার্ম পুরো মনি কাঞ্চনে বাজতে শুরু করেছে।

মামা দাঁত বের করে হেসে বলল, “পুরো রিসোর্টের সবাই এখন জেগে উঠবে। শুধু আমরা কেন মজা দেখব, সবাই দেখুক।”

মামা ঠিক কোন জিনিসটাকে মজা ভাবছে আমি জানি না, কিন্তু আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না।

আমি যখন গোপন সিঁড়িটা খুঁজে বেড়াচ্ছি তখন হঠাৎ একটা মেয়ের গলার চিৎকার শুনতে পেলাম, “টোপন!”

তাকিয়ে দেখি করিডোরের শেষ মাথায় ডোরিন দাঁড়িয়ে আছে। তার পিছনে মাহবুব, টনি, ডোরিনের বাবা এবং অনেকগুলো পুলিশ। এরা আগের পুলিশ না, অন্য পুলিশ! কারণ এই পুলিশের পিছনে মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা একজন মানুষ যাকে আমরা একসিডেন্ট থেকে বাঁচিয়েছিলাম। তার মানে মাহবুব ফোন করে তাকে সত্যি খবর দিতে পেরেছে।

কী চমৎকার!

.

শেষ কথা

এরপর যা হওয়ার কথা এবং যেভাবে হওয়ার কথা সবকিছু সেভাবে হলো। মামা গোপন ল্যাবরেটরির করিডোরে বিদেশিগুলোর প্যান্টগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়ার পর পুরো রিসোর্টে এলার্ম বাজতে লাগল এবং প্রায় ভোর রাতে সবাই লাফিয়ে ঘুম থেকে উঠে বের হয়ে এলো, চারিদিকে বিশাল হই চই এবং মনে হলো একটা মেলা বসেছে। সবাই জানতে চাইছিল কী হয়েছে এবং কীভাবে কীভাবে জানি খবর রটে গেল যে বিদেশি ডাকাত ধরা পড়েছে। তখন আর কেউ নিজেদের রুমে ফিরে যায় না, বিদেশি ডাকাত দেখার জন্য দাঁড়িয়ে রইল। শেষ পর্যন্ত যখন হাত বাঁধা অবস্থায় ছয়জন বিদেশিকে আমাদের গোপন সিঁড়ি দিয়ে বের করে আনা হলো তখন পাবলিকের ভেতর হুলুস্থুল পরে গেল। এই বেহায়া মানুষগুলো কেন জাঙিয়া পরে ঘুরে বেড়ায় সেটা নিয়ে নানা ধরনের জল্পনা শুরু হয়ে গেল। সবাই তাদের সাথে সেলফি তুলতে চায়, পাবলিকদের কন্ট্রোল করতে পুলিশের অনেক কষ্ট করতে হলো।

যে বাঙালি মানুষটা গুলি খাওয়া মাথা মোটা মানুষটাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল সে বিদেশিটাকে লবিতে পৌঁছে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। তাকে আর কোনোদিনই খুঁজে পাওয়া যায় নি। গুলি খাওয়া মানুষটাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।

আমাকে আর মামাকেও পরীক্ষা করার জন্য হাসপাতালে নিতে চেয়েছিল আমরা দুজনের কেউই রাজি হই নাই। ডাক্তার তখন রিসোর্টের লবিতে পরীক্ষা করে জানিয়ে দিল আঘাত সেরকম গুরুতর নয়, দুই চারদিন বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।

খবর পেয়ে মিঠুন আর আপুকে নিয়ে আব্বু আম্মু তখনই রওনা দিয়ে দিয়েছিল, পরের দিন সকালে যখন আমাদের সাথে দেখা হলো আমাকে ধরে আম্মু যেভাবে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল যে দেখে মনে হতে লাগল যে আমি আসলে মারা গেছি। যে আপু সারা জীবন আমাকে জ্বালাতন করে গিয়েছে সে পর্যন্ত মামার কাছে, মাহবুব, ডোরিন আর টনির কাছে আমার গল্প শুনে প্রায় কান্না কান্না হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখল। মিঠুন বার বার আমার মুখে পুরো গল্পটা শুনতে চাইল এবং বানিয়ে বানিয়ে আমাকে আরো অনেক কিছু যোগ করে পুরো গল্পটা বলতে হলো। পাহাড়ের মতো মানুষটার অসুবিধা জায়গায় লাথি দেওয়ার পর সে কীভাবে কোঁক করে শব্দ করে উঠেছিল এবং তার চোখ উল্টে গিয়েছিল মিঠুনকে অনেকবার অভিনয় করে দেখাতে হয়েছিল। তবে শুধু মিঠুন না অন্য সবাইকে যে অংশটা বারবার বলতে হয়েছে সেটা হচ্ছে ভয়ংকর বিদেশিটা যখন মারাত্মক একটা ছোরা নিয়ে মামার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আর মামা বিদ্যুৎবেগে তার হাতে গুলি করে তাকে নিচে ফেলে দিয়েছিল। পুরো সময়টাতে ভয়ে আমার পেটের ভাত চাউল হয়ে যাবার অবস্থা হয়েছিল কিন্তু আমি সেটা একবারও কাউকে বুঝতে দিলাম না। যখনই কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করেছে আমি ভয় পেয়েছিলাম কিনা তখনই আমি হা হা করে হেসে বললাম, ভয়? ভয় পাব কেন? ভয় পাওয়ার কী আছে? শরীরে যখন এড্রেনেলিন এসে যায় তখন বুকে ভয় ডর থাকে না। (এড্রেনেলিন কী জিনিস আমি জানি না, মামাকে একবার শব্দটা ব্যবহার করতে শুনেছি এরপর থেকে আমি যখন তখন এই শব্দটা ব্যবহার করি!)

তবে মামা সবচেয়ে বেশি প্রশংসা করেছেন আমাদের দুর্ধর্ষ টিমটার। আমি, মাহবুব, ডোরিন আর টনি। টনি প্রথম দিকে আমাদের ধারে কাছে আসতে চাইত না সেটা সে এখন আর ভুলেও কাউকে বলে না। (আমরা সেইজন্য কিছু মনে করি না)। থ্রি স্টার সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে যে অনেক বড় ইউরিনেয়াম রিজার্ভ আছে সেই খবরটা খুব যত্ন করে গোপন রাখা হলো। তবে মামার কাছে শুনেছি সরকার থ্রি স্টার সিমেন্ট কোম্পানির লিজ বাতিল করে পুরো জায়গাটা নিয়ে নিয়েছে। মামার মতে আমাদের কাজকর্মের মাঝে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছিল একসিডেন্টে আহত পুলিশের এসপিকে ফোন করে দেওয়া। হাসপাতাল থেকে মাত্র বাসায় গিয়েছিলেন কিন্তু আমাদের ফোন পেয়ে সাথে সাথে পুলিশ নিয়ে চলে আসার কারণে সব রকম ঝামেলা সামলে নেয়া হয়েছে। বিদেশি মানুষগুলো পরেরদিনই ছাড়া পেয়ে নিজের দেশে চলে গিয়েছে (তা না হলে নাকি যুদ্ধ লেগে যেত!) কিন্তু পুরো ষড়যন্ত্রটা থেমে গিয়েছে।

.

কেউ যেন মনে না করে পুরো ঘটনাটার মাঝে সবই ভালো। এই ঘটনার মাঝে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় বেইজ্জতীটা ঘটেছে, যদিও সেটা জানি শুধু আমি আর মাত্র একজন মানুষ! জিনিসটা ঘটেছে এভাবে।

আমি যখন গোপন সিঁড়ি দিয়ে মনি কাঞ্চনের নিচে গোপনে ল্যাবরেটরিতে যাচ্ছি তখন আমি মাহবুবের হাতে আমার ব্যাকপেকটা দিয়ে বলেছিলাম সেখানে আমার ডাইরির শেষ পৃষ্ঠার পুলিশ অফিসারের কার্ডটা স্কচটেপ দিয়ে লাগানো ছিল। আমি যদি ফিরে না আসি সে যেন এই মানুষটাকে ফোন করে। কিন্তু আমি মাহবুবকে দিয়ে খোদার নামে কসম খাইয়ে রেখেছিলাম সে যেন কোনোভাবেই আমার ডাইরিটা না পড়ে।

মাহবুব নিজে ফোনটা করে নাই, ডাইরিটা দিয়েছিল ডোরিনকে ফোন করার জন্য। কিন্তু আমি যেরকম মাহবুবকে কসম খাইয়ে রেখেছিলাম যে ডাইরিটা না পড়ে ডোরিনকে সেরকম কসম খাওয়ানো হয় নাই তাই ডোরিন পুরো ডাইরিটা পড়ে ফেলেছে। (শুরুতে নানানরকম ভয় দেখানো হয়েছে। অভিশাপ দেয়া আছে কিন্তু ডোরিন সেগুলোকে কোনো পাত্তা দেয় নাই, কি আশ্চর্য!)।

যাই হোক এমনিতে একজনের ডাইরি পড়ে ফেললে সেরকম ভয়ংকর কিছু হওয়ার কথা না কিন্তু আমার কেসটা অন্যরকম। মাত্র সেদিন রাত জেগে আমি এখানকার সব ঘটনা লিখেছি তখন ডোরিনকে নিয়েও একটা প্যারাগ্রাফ লিখে ফেলেছিলাম। ডোরিন সেইটাও পড়ে ফেলেছে, কী সর্বনাশ!

আমি কি লিখেছিলাম সেটা যদি বলি তাহলে সবাই বুঝতে পারবে কেন সেটা সর্বনাশ। আমি লিখেছিলাম: ‘আমি এতোদিন ধরে ঠিক করে রেখেছিলাম জীবনেও বিয়ে করব না। কিন্তু কয়দিন থেকে মনে হচ্ছে বড় হলে বিয়ে করেও ফেলতে পারি। তবে যে কোনো নেকু টাইপের ঘ্যানঘ্যানে মেয়েকে বিয়ে করব না, শুধু যদি ডোরিন রাজি থাকে তাহলে। ডোরিন মোটেও নেকু টাইপের না, খুবই হাসিখুশি এবং মাথায় বুদ্ধিও আছে। তবে বড় হলে কী অবস্থা হবে কে জানে। মানুষ ছোট থাকতে একরকম থাকে বড় হলে হয়ে যায় অন্যরকম।…

আমার এই ভয়ংকর লেখাটা ডোরিন পড়ে ফেলেছে। আমি আর মামা যখন গোপন ল্যাবরেটরি জ্বালিয়ে দিয়ে বের হয়ে এসেছি, ভিতরে কী হয়েছে সবকিছু সবাইকে বলছি তখন এক সময় ডোরিন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “টোপন তুমি আমাকে একটা গিফট দেবে?”

আমি বললাম, “কী গিফট?”

ডোরিন বলল, “তোমার ডাইরিটা।”

আমি বললাম, “কেন?”

ডোরিন বলল, “আমি পড়েছি। খুবই ইন্টারেস্টিং!” তারপর আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল। এর আগে আমি কোনোদিন কোনো মেয়েকে চোখ টিপতে দেখি নাই। কী ভয়ংকর।

যখন আশেপাশে কেউ নাই তখন গলা নামিয়ে বলল, “আমি তোমার থেকে এক ক্লাস উপরে পড়ি, তার মানে তুমি আমার থেকে এক বছর ছোট।”

আমি বললাম, “ইয়ে মানে কিন্তু

“আমার থেকে এক বছরের ছোট একজনকে বিয়ে করতে আমার কোনো আপত্তি নাই। কিন্তু–”

আমি কোনোমতে বললাম, “কিন্তু—“

“বিয়ের পর যদি তুমি কোনোদিন শব্দ করে হাঁচি দাও সাথে সাথে ডিভোর্স।”

আমি বললাম, “অ্যাঁ অ্যাঁ–”

ডোরিন তখন–

.

থাক, ডোরিন তখন কী করেছে সেটা আর না বললাম। আমার জন্য খুবই বেইজ্জতী। চরম বেইজ্জতী!

Exit mobile version