এবার যেতে হবে রসুল।
হেঁটে ফিরতে পারবে? আমিনা বলেন।
না, হাঁটতে হবে না! গাড়ির ব্যবস্থা করেছি।
আবদুলেরও ঘুম হয় নি, তার চোখ দুটিও টকটকে লাল হয়ে উঠেছে। সে চোখের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে ঘুমন্ত শহরের শেষরাত্রির স্তব্ধতা যেন প্রশ্ন হয়ে ওঠে আমিনার কাছে : তোর কি শুধু একটি ছেলে?
কে নিজের ছেলে কে পরের ছেলে ভাববার ক্ষমতা নিজের ছেলেই তার লোপ পাইয়ে এনেছে ক্রমে ক্রমে। অজানা অচেনা অসংখ্য ছেলে তার রসুলের সঙ্গে হতাহত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে তার বুকের মধ্যে। আর এমন এক বন্ধুকে সঙ্গে এনেছে রসুল, দুদণ্ড যার মুখখানা দেখে মনে হচ্ছে, রসুলের মতোই সে তার চেনা-জানা, নিজের বুকের রক্ত ঢেলে মানুষ করা সন্তান!
সুধাই বাইরের দরজা খুলে দেয় প্রতি রাতের মতো। মুখ খুলে ব্যথিত ভসনার দৃষ্টিতে আজ আর তাকায় না অন্য দিনের মতত। পাশে সরে দাঁড়িয়ে পথ ছেড়ে দিয়ে মাথা হেঁট করে থাকে।
অক্ষয় উৎফুল্ল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ঘুমিয়ে পড়েছে সবাই?
কি জানি। চেঁচামেচি জুড়োনা।
তোমার হল কি?
সুধা জবাব দেয় না। মাথাও সে হেঁট করেই রাখে। অক্ষয় চৌকাঠ পার হয়ে ভেতরে এলে নিঃশব্দে সদর দরজা বন্ধ করে ভেতরে চলে যায়। অক্ষয়ের অনুভূতি হয় দুরকম। তার নেশা করার জন্য সুধা কষ্ট পায় সে জানত, কিন্তু কত তীব্র, কি অসহ্য যে হত সে কষ্ট তা সে শুধু আজকে, এখন, সুধাকে চোখে দেখবার পর, প্রথম পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পেরেছে। আজ অবশ্য সুধার মনে আঘাত লেগেছে চরম, আজকের লজ্জা দুঃখ হতাশার তার সীমা নেই, মনে মনে আজ সে মরে গেছে। আজ অক্ষয় শুধু মদ খেয়ে আসে নি, আর কোনোদিন ও-জিনিস স্পর্শ করবে না এই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে খেয়ে এসেছে। আজ তার বিশেষ দুঃখ, বিশেষ হতাশা, কিন্তু আগেও কি কম ছিল? অধঃপতন শুরু হয়ে গিয়েছে স্বামীর, দিন দিন বাড়ছে তার নেশা, কোথায় গিয়ে শেষ হবে তা কি ভাবতে পারত সুধা? আগে এতটা অনুমান করতে পারে নি বলে, অনুমান করতে চায়ও নি বলে, অক্ষয়ের সমবেদনা ছিল জলো খেয়াল। হালকা মেঘের মতো সে সমবেদনা খুশিমতো মনে ভেসে আসত, দরকার মতো উপে যেত। পশুত্র মতো কিভাবে সুধাকে সে নির্যাতন করে এসেছে, এতকাল পরে আজ প্রথম পশুর মতো জমজমাট নেশা না করে বাড়ি ফিরে হঠাৎ সেটা অনুভব করে আজ প্রথম আন্তরিক অনুতাপ দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। তবু তারই মধ্যে সে বুঝতে পারে যে এ অনুতাপের তীব্র মধুর জ্বালা লেগেছে শুধু এইজন্য যে আজ সে মদ খেয়ে আসে নি, আজ তাকে মদ না খেয়ে আসার নেশায় ধরেছে। কাল যদি ওজন মতো, আজ বাদ গেছে বলে খানিকটা বেশি খেয়ে আসে, সুধাকে পশুর মতোই নির্যাতন করবে। তার কালকের কাণ্ডের জন্যই সুধা আজ বেশি রকম ভয়ার্ত হয়ে আছে। কাল বাড়ি ফিরেই সে ফতোয়া দিয়েছিল : ঝুলো মাই, বুড়ি মাগী, শাড়ি সেমিজ পরে কচি বৌ সাজতে লজ্জা করে না? খোল, খোল, শিগগির খোল!
সুধা তা ভুলতে পারে নি। সুধা আজো আশঙ্কা করছে ওই রকম একটা ভয়ঙ্কর মাতলামির। শুধু সেটা কিভাবে আসবে ঠাহর করে উঠতে পারছে না।
প্ৰায়শ্চিত্ত বাকি আছে তার, অনেক প্ৰায়শ্চিত্ত। নিজেকে অনেক দিন ধরে দলে পিষে ছিঁড়ে ধুনে চলতে হবে। নেশা করার দুরন্ত, অবাধ্য দৈহিক মানসিক সর্বাঙ্গীণ সাধ শুধু নয়, সে যে মাতাল হওয়া বরবাদ করেছে এ বিষয়ে বহুকাল ধরে ঘরে বাইরে সকলের অবিশ্বাসের পীড়ন। মাথাটা আজ যেন আশ্চর্য রকম সাফ মনে হয় অক্ষয়ের। জগতের যাবতীয় সমস্যার মর্ম যেন তার আজ মদ খাওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও না খাওয়ার এবং এ নেশা যে ভাবেই হোক ত্যাগ করার প্রতিজ্ঞার বিদ্রোহে অকস্মাৎ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে জীবনে–কঠিন, কঠিন এ কাজ।
কিন্তু অন্য এক ভয়ঙ্কর নেশাতে একেবারে সচেতন অচেতন মন নিয়ে মশগুল হওয়ার মজাও টের পেয়েছে অক্ষয়, বাঁচার জন্য বাঁচাবার জন্য গুলির সামনে বুক পেতে দিয়ে মরা। এই প্রথম ও নতুন নেশা এত সাফ করে দিয়েছে তার মাথা যে সে জেনে গিয়েছে মদ হয়তো সে খাবে দু-একবার নিজের দুর্বলতায় কিন্তু সেটা দু-একবারের বেশি আর খাবে না, কারণ ফেনিল গ্লাসে চুমুক দিতে গেলে তার মনে হবে সে জীবন্ত তাজা ছেলের রক্ত খাচ্ছে–গেজানো রক্ত।
এমনিভাবে উদ্ভট প্রক্রিয়া চলে অক্ষয়ের মনের। … তবে পরম মুক্তির, মহান আত্মজয়ের, দুঃস্বপ্নের অবসানের বাস্তব, কাৰ্যগত জীবন্ত অনুভূতিও আজ খুব প্রবল অক্ষয়ের। মিথ্যা ধারণা ভেঙে দিয়ে সুধার মৃত্যু-স্নান মুখে জীবনের জ্যোতি, আশার আলো ফুটিয়ে তোলার কল্পনা তার হৃদয়কে উৎসুক, উফুল্ল করে রেখেছে–প্রথম প্রেমে প্রিয়াকে পাওয়ার সম্ভাবনা আবিষ্কার করে ফেলার মতোই রসালো সে আনন্দ। জামাকাপড় ছাড়তে ছাড়তে সে সুধাকে দেখতে থাকে। খাটে। বসে মেঝেতে চোখ বিধিয়ে রেখেছে সুধা। বিছানায় উঠে কেন সে শুয়ে পড়ছে না দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে, অক্ষয় তা বুঝতে পারে। রাতদুপুরে মাতাল অক্ষয়কে সামলাবার দায়িত্ব সুধা পালন করে এসেছে বরাবর রাতদুপুরে বাড়ি ফিরে সে যাতে নেশার কেঁকে হৈচৈ কেলেঙ্কারি কিছু না করে। অক্ষয় না শুয়ে পড়লে সে শোয় না, অক্ষয় না ঘুমোলে সে ঘুমায় না। আজ সে মরে গেছে। অক্ষয়ের কাণ্ডে, তবু আজো তার সে দায়িত্ব পরিহার করতে সে পারছে না। হৃদয়-মনে কোটি বসন্ত আসে অক্ষয়ের। তার মনে হয়, আজ সে নেশা করার অপরাধ করে নি জানিয়ে কয়েক বছরের পুরোনো বৌকে সে খুশি করবে না, আমি তোমায় ভালবাসি বলে এই আশাহীনা লজ্জিতা অপমানিতা মেয়েটিকে সে আজ পুলকিতা রোমাঞ্চিতা করে তুলবে। আজ তাদের আবার বিয়ে হবে নতুন করে।