Site icon BnBoi.Com

অশরীরী আতঙ্ক – মানবেন্দ্র পাল

অশরীরী আতঙ্ক - মানবেন্দ্র পাল

১.১ অন্ধকার সিঁড়ি

ভূমিকা

ভূত অনেকেই বিশ্বাস করেন না। কিন্তু ভূতের গল্প পড়তে ছোটো বড়ো কে না ভালোবাসে।

ভালোবাসার কারণ, মানুষ গল্প শোনার মধ্যে দিয়ে একটু ভয় পেতে চায়।

সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্রে নটি স্থায়ী ভাব আর শৃঙ্গার, হাস্য, করুণ, রৌদ্র, বীর, আনক, বীভৎস, অদ্ভুত, শান্ত–এই নটি রস আছে। প্রকৃত কাব্য বা সাহিত্যের মর্যাদা পেতে হলে রচনাকে যে কোনো একটি রসকে অবলম্বন করতে হয় তবেই সেটি হয়ে ওঠে রসোত্তীর্ণ সাহিত্য।

ভূতের গল্পের স্থায়ীভাব হচ্ছে ভয় আর রস হচ্ছে ভয়ানক। তাই যখনই কোনো ভূতের গল্প স্থায়ীভাব ভয়কে অবলম্বন করে ভয়ানক রসে জারিত হয়ে বেরিয়ে আসতে পারলে তখনই তা সাহিত্য-পর্যায়ে উন্নীত হল।

নানা রকমের ভূতের গল্প লেখা হলেও ভয়ই ভূতের গল্পর প্রধান আকর্ষণ। এই ভটুকু না থাকলে ভূতের গল্প জমে না। র

অনেকে ভূতের গল্পর মধ্যে অবাস্তব গাঁজাখুরি ঘটনা দেখে নাসিকা কুঞ্চন করেন। তাঁদের জানা উচিত–ভূতের গল্প বাস্তব জীবনের কাহিনী নয়। ভূত নামক চরিত্রটি অন্য এক রহস্যময় জগতের বাসিন্দা–যে জগৎ মানুষের জ্ঞানের বাইরে। কাজেই বাস্তব জগতের চরিত্রের সঙ্গে তাদের কার্যকলাপের মিল খুঁজতে গেলে ভৌতিক চরিত্রের ওপর অবিচার করা হবে। ভৌতিক গল্প যে অলৌকিক কিছু, এটা মেনে নিয়েই পাঠককে অগ্রসর হতে হবে। তা না হলে তিনি ভৌতিক কাহিনীর রস উপভোগ করতে পারবেন না।

ভৌতিক কাহিনী–তা যতই অবাস্তব হোক পাঠককে আকর্ষণ করতে পারে লেখকের লেখার গুণে। ড্রাকুলার মতো অতি গাঁজাখুরি গল্পও শুধু লেখার গুণে তাবৎ পৃথিবীর পাঠককে কাঁপয়েছে।

বিদেশী সাহিত্যে এইরকম ভালো ভালো ভূতের গল্প বিস্তর আছে। ওসব দেশের সাহিত্যিকরা ভূতের গল্প লেখা সহজ অথবা অগৌরবের মনে করে না। শেক্সপীয়রই বোধ হয় সর্বপ্রথম অতিপ্রাকৃত উপাদানকে সাহিত্যে টেনে এনেছিলেন। হ্যামলেট কিংবা ম্যাকবেথ তার দৃষ্টান্ত। কোলরিজের হাতে অতিপ্রাকৃত উপাদান কিভাবে কাব্যের মধ্যে দিয়ে রসমূর্তি লাভ করেছে তা আমরা জানি। এডগার অ্যালান পোর গা-ছমছম-করা ভৌতিক গল্পর সঙ্গে অনেকেই পরিচিত। আমাদের দেশে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অতিপ্রাকৃত বিষয় নিয়েই লিখেছেন তার কয়েকটি স্মরণীয় গল্প–সম্পত্তি সমর্পণ, কংকাল, মাস্টারমশাই, ক্ষুধিত পাষাণ, নিশীথে, মণিহার। এগুলির মধ্যে মণিহারই যে যথার্থ ভৌতিক গল্প সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

এবার আর একটি প্রশ্ন-ভূতের গল্প সবই কি লেখকের কল্পনা?

তা নয়। লেখকের নিজের অভিজ্ঞতা না থাকলেও অনেক সময়ে নিজের আত্মীয়-বন্ধুর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লেখককে সাহায্য করে। আমার নিজের ব্যক্তিগত জীবনে তেমন অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু আমার অনেক গল্পের পিছনে পরিচিত জনের বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রেরণা যুগিয়েছে। এই উপন্যাসের মূলেও একটি,, আছে। নাম-ধাম গোপন রেখে সেই সূত্রটুকু জানিয়ে রাখি।—

আমার দেশেরই একটি মেয়ে আমার খুব অনুগত ছিল। আমি প্রায়ই তাদের বাড়ি যেতাম। মেয়েটি তখন এম. এ. ক্লাসের ছাত্রী। আমি গেলে মাঝে মাঝে সে আমার কাছে পড়া বুঝে নিত। তাকে কথায় কথায় প্রায়ই আমি কুসংস্কারমুক্ত হবার ব্যাপারে উৎসাহ দিতাম। সে শ্রদ্ধাভরে আমার কথা শুনত। মানবার চেষ্টাও করত।

তারপর একদিন তার ভালো ঘরে সুপাত্রের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের বছর দেড়েক পরে ওরা কলকাতায় উল্টোডিঙ্গির কাছে একটা ফ্ল্যাটে এসে ওঠে। তিন তলায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ফ্ল্যাটটি। তখন ওর একটি বাচ্চাও হয়েছে।

এখানে আসার কিছুদিন পরেই গভীর রাত্রে তার ওপর অশরীরী থানা শুরু হয়। সে আতংকে অস্থির হয়ে ওঠে। তার স্বামী ডাক্তার। তিনি স্ত্রীর কথা বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু একদিন রাত্রে একলা থাকার সময়ে কিছু না দেখলেও তিনি ভয় পেয়েছিলেন।

সেই অশরীরী আত্মাটি মেয়েটিকে ফ্ল্যাট ছেড়ে দেবার জন্যে হুমকি দিত। এমন কি ফ্ল্যাট ছেড়ে না দিলে ছেলের ক্ষতি করবে বলেও শাসাতো। একদিন মেরে ফেলতেও গিয়েছিল। তখন বাধ্য হয়ে তাদের ফ্ল্যাট ছাড়তে হয়।

এই ঘটনা মেয়েটি আমাকে নিজে বলেছে। তার সব কথাই উড়িয়ে দিতে পারিনি।

এই সত্যটুকুর জোরেই এই উপন্যাসের সৃষ্টি। এর পরেও আরো একটু ঘটনা ছিল। বেশ কিছুকাল পর মেয়েটি কলকাতায় আর একজনদের বাড়িতে আলাপ করতে গিয়েছিল। সেখানে টেবিলের ওপর একজন মৃত ব্যক্তির ছবি দেখে সে চমকে ওঠে। এ তো সেই অশরীরী আত্মার আবছা মুখের মতোই মুখ!

কি করে এই মিল সম্ভব হল তার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। যায়ও না।

আমার এই উপন্যাসে অবশ্য শেষের ঐ ঘটনাটা লিখিনি।

এই সব প্রায় মোলো-সতেরো বছর আগের ঘটনা। এর অনেক পরে এই ঘটনা নিয়ে আবির্ভাব নামে একটি গল্প লিখি। পরে নবকল্লোল সম্পাদক এবং নিউবেঙ্গল প্রেসের কর্ণধার প্রবীরবাবুর (প্রবীরকুমার মজুমদার) উৎসাহে এটিকে উপন্যাস করি। তারই আগ্রহে ও সহযোগিতায় উপন্যাসটি নবকল্লোল পত্রিকায় ধারাবাহিক ছাপা শুরু হয় কার্তিক ১৩৯৮ থেকে।

আমি আনন্দিত যে এখন লেখাটি বই আকারে প্রকাশ করছেন দেব সাহিত্য কুটির। ধন্যবাদ দিই মাননীয় অরুণচন্দ্র মজুমদারকে। আমার কাজটিকে তিনি সাফল্যের দিকে এগিয়ে দিতে সাহায্য করলেন।

বইটি পড়ে পাঠক যদি ভূতের গল্পর অতিরিক্ত সাহিত্যরস লাভ করেন তা হলেই আমার উদ্যম সার্থক হবে।

মানবেন্দ্র পাল
আশ্বিন ১৪০২ ৫২, মহাত্মা গান্ধী রোড
কলকাতা ৭০০ ০০৯

.

.

প্রথম পর্ব

০১.

অন্ধকার সিঁড়ি

এলাকাটা কলকাতার কালিন্দি-বাঙ্গুর-বরাটের কাছাকাছি। যশোর রোড থেকে একফালি রাস্তা হঠাৎ যেন ছুরির বাঁকা ফলার মতো ভেতরে ঢুকে গেছে।

বড়ো রাস্তার দুপাশে যথেষ্ট পরিবর্তন হলেও ফালি রাস্তার ভেতরে এই যে বিস্তীর্ণ জায়গাটা পড়ে আছে সেখানে তেমন পরিবর্তন হয়নি। এখনো সেখানে ঝোপ-ঝাঁপ, জলা, ডোবা দেখতে পাওয়া যায়। হঠাৎ দেখলে কে বলবে–জায়গাটা কলকাতার মধ্যেই।

এখানে কয়েকটা টালির ঘর ছাড়া একটা বিশেষ বাড়ি দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

চুন-বালি-খসা জীর্ণ তেতলা বাড়ি। পাঁচিল-ঘেরা কম্পাউন্ড। জায়গায় জায়গায় পাঁচিল ভেঙে পড়েছে। তা পড়ুক। তা নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই।

কম্পাউন্ডে ঢোকার মুখে লোহার গেট। নামেই গেট। সে-গেট বন্ধ করা। যায় না। একদিকের পাল্লাই নেই।

সেই ভাঙা গেট দিয়ে একদিন একটা ট্রাক এসে ঢুকল। ট্রাকভর্তি মাল। সঙ্গে এল একজন ভদ্রলোক, একজন মহিলা, একজন প্রৌঢ়া আর কোলে একটি শিশু।

বাড়ির সামনে পাথরের ভাঙা নারীর নগ্নমূর্তি। তার চারিদিকে খানকয়েক লোহার বেঞ্চি।

তখন বিকেল। এ-বাড়ির বৃদ্ধেরা বেঞ্চিতে বসে গল্প করছিল। ট্রাক ঢুকতে তারা অবাক হয়ে তাকালো।

–নতুন ভাড়াটে বোধহয়।

–হু। তিনতলাটা তো খালি ছিল।

–ভালোই হল। আমরা দলে ভারী হলাম।

–তা হয়তো হলাম। কিন্তু কেমন ফ্যামিলি সেটাই বড়ো কথা।

–দেখে তো মনে হচ্ছে ছোটোখাটো ভদ্র পরিবার। ওরা বোধহয় স্বামী-স্ত্রী।

–বোধহয় কেন, নিশ্চয়ই। আর ওটা ওদের বাচ্চা।

–কিন্তু বুড়িটা?

–হয় মেয়ের শাশুড়ি, নয় ছেলের শাশুড়ি।

বুড়িটাকে ছন্দপতন বলে মনে হচ্ছে। নইলে ছোটো পরিবার সুখী পরিবার-এর আদর্শ দৃষ্টান্ত।

প্রৌঢ়ের সরস মন্তব্যে সকলেই হেসে উঠল।

তরুণ ভদ্রলোকটির বোধহয় ভয় ছিল বাড়িটা স্ত্রীর পছন্দ হবে কিনা। তাই সসংকোচে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাতে তাকাতে এগিয়ে আসছিল। কিন্তু মহিলাটি কম্পাউন্ডে ঢুকেই বলে উঠল-বাঃ! কতখানি জায়গা! বিকেলে এখানেই বেশ বেড়ানো যাবে। ওমা! কী চমৎকার বুনো ফুল! বলেই ছুটে গেল পাঁচিলের দিকে।

–এই! এসো এদিকে।

প্রৌঢ়া মাল-পত্তর আগলে হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। ভদ্রলোক বাচ্চা কোলে করে স্ত্রীর কাছে গেল।

–এগুলো কী ফুল বলো তো? চোখের ভঙ্গি করে জিজ্ঞেস করল মহিলা।

–জানি না।

ঢোলকলমী। আমাদের দেশের বাড়ির পুকুরের ধারে গাদা ফুটত। ওমা! কেমন একটা পুকুর!।

ভদ্রলোক হেসে বলল–পুকুর তো তোমার কি? চান করবে নাকি?

–দেশের বাড়ি হলে করতাম। ওটা দেখেছ?

বলে ছাতের দিকে আঙুল তুলে দেখালো। কিরকম অদ্ভুত, না?

হ্যাঁ, গম্বুজের মতো। সেকালের বাড়ি তো।

মহিলাটি মুগ্ধ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ গম্বুজটার দিকে তাকিয়ে রইল। বিকেলের পড়ন্ত রোদ গম্বুজটার মাথায় তখন কেমন যেন বিষাদের আলপনা এঁকে যাচ্ছে।

চলো, ওপরে যাই। জিনিসপত্তর গুছিয়ে নিতে হবে। ভদ্রলোকটি তাড়া দিল।

মহিলাটি যেন কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। সামলে নিয়ে বলল, চলো। আসুন পিসিমা।

ওরা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল। উচিত ছিল ভদ্রলোকেরই আগে আগে যাওয়া। কেননা ভদ্রলোক এর আগে এসেছে। কিন্তু ভদ্রমহিলারই উৎসাহ বেশি। সে এগিয়ে এগিয়ে চলেছে যেন তার চেনা বাড়িতে ঢুকছে।

সিঁড়িটা অন্ধকার। দেওয়ালে হাজার ফাঁক-ফোকর। সিঁড়িগুলোও যেন দাঁত খিঁচিয়ে আছে।

সিঁড়িটা যেন গোটা বাড়ির বুক চিরে ওপরে উঠে গেছে। দুপাশে ঘর। দরজায় দরজায় পর্দা ফেলা। বুঝতে পারা যায় সব ঘরেই ভাড়াটে আছে। কোনো ঘরে রেডিও বাজছে, কোনো ঘরে কিশোরীকন্যার গানের রেওয়াজ চলেছে, কোথাও বা দুরন্ত ছেলেকে মা তারস্বরে ধমকাচ্ছে। ঘরে ঘরে জীবনের লক্ষণ।

–অন্ধকার। আস্তে আস্তে ওঠো। ভদ্রলোক স্ত্রীকে সাবধান করে দিল। চার ধাপ ওপরে দাঁড়িয়ে ভদ্রমহিলা ঘাড় ফিরিয়ে হেসে বলল, ভয় নেই। পড়ব না।

বলেই দু ধাপ উঠে গেল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আর্তনাদ করে উঠল–পড়ে গেলাম!

.

০২.

সূত্রপাত

রীণা মফস্বলের মেয়ে।

ওখানকার কলেজ থেকেই বি. এ. পাস করে বর্ধমান ইউনিভার্সিটিতে এম. এ পড়ছিল। পড়তে পড়তেই বিয়ে হয়ে গেল। স্বামী ডাক্তার। শশুরবাড়ি বহরমপুরে। কিন্তু ডাক্তারিসূত্রে সঞ্জয়কে প্রথমেই আসতে হল কলকাতায়। রীণা খুব খুশি। কলকাতায় সংসার পাতবে এতখানি সৌভাগ্য কল্পনাও করেনি কখনো। তাছাড়া এখানে তার একটি বান্ধবীও আছে–মান্তু। তার সঙ্গেও দেখা হবে।

কলকাতায় চাকরি পাওয়া যদিও-বা সম্ভব, বাড়ি পাওয়া সহজ নয়। অনেক চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত এই বাড়িটা . পাওয়া গেল। পুরনো বাড়ি। জায়গাটাও গলির মধ্যে। তবুও কলকাতায় সংসার পাতার আনন্দে রীণা খুঁতখুঁত করল না।

তিনতলায় সিঁড়িটা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে একফালি বারান্দা। তিনতলাটা একেবারেই ফঁকা।

সামনের ঘরটাকে রীণা করে নিল ড্রয়িংরুম। একটা টেবিল, খান-দুই স্টিলের চেয়ার, একটা মোড়া আর একটা ডিভান–এই নিয়েই ড্রয়িংরুম সাজাল। এরই পিছনে আর একখানা ঘর। সেটা হল ওদের বেডরুম। বিছানায় শুয়ে দুঘরের মধ্যের খোলা দরজা দিয়ে তাকালে সিঁড়ি পর্যন্ত দেখা যায়।

দরজা জানলাতে রীণা রঙিন পর্দা লাগাল। টেবিলে পাতল ওরই হাতে তৈরি সুন্দর টেবিল-ক্লথ। ওপরে রাখল পেতলের ফ্লাওয়ার ভাস।

দেওয়ালে ঝুলিয়ে দিল রবীন্দ্রনাথের একখানি ছবি, আর সুদৃশ্য একখানি ক্যালেন্ডার।

রীণা খুব খুশি। সকালে সঞ্জয় বেরিয়ে যায় হাসপাতালে। দুপুরটা কাটে ঘুমিয়ে। বিকেলে সঞ্জয় ফিরলে ওরা দুজনে বেরিয়ে পড়ে।

পিসিমা এসেছিলেন ওদের নতুন সংসার গুছিয়ে দিতে। গোছানো হয়েছে। এবার তিনি দেশে ফিরে যেতে চাইছেন। রীণা ওঁকে আটকে দিল।

–এখুনি যাবেন কি? কালীঘাট দেখলেন না, দক্ষিণেশ্বর দেখলেন না—

ওর আন্তরিকতা অকৃত্রিম। তবু কিছু স্বার্থও আছে। পিসিমা থাকলে পুপুকে রেখে একটু বেরোন যায়।

প্রথম কদিন রীণার কাটল সিনেমা দেখে। একদিন থিয়েটারও দেখল।

তারপরই একদিন ছোটোখাটো একটা অঘটন ঘটল।

সঞ্জয় একদিন বলল, মহাজাতি সদনে দারুণ ম্যাজিক শো হচ্ছে।

রীণা বলল, তুমি যাও। ম্যাজিক আমার ভালো লাগে না।

সঞ্জয় অবাক। সে কী! ম্যাজিক ভালো লাগে না।

রীণা বলল, ছোটোবেলায় একবার ম্যাজিকে নররাক্ষসের খেলা দেখে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। সেই থেকে আর ম্যাজিক দেখি না।

সঞ্জয় হেসে উঠল, ওসব নৃশংস খেলা এখন আর হয় না।

রীণা তবু মাথা নাড়ল, না বাপু, ম্যাজিক দেখে কাজ নেই।

সেদিন আর কথা হল না। তারপর একদিন সঞ্জয় কিছু না বলে দুখানা টিকিট কেটে বাড়ি ঢুকল। রীণা খুশি হল না। তবু যেতে হল।

রবিবার। বেলাবেলি খাওয়া-দাওয়া সেরে পুপুকে পিসিমার কাছে রেখে দুজনে বেরিয়ে পড়ল।

রীণার উৎসাহ একেবারেই ছিল না। তাকে যেন জোর করে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কেমন অন্যমনস্ক। তার তখন ছোটোবেলার কথা মনে পড়ছিল। সেই অন্ধকার টিনের ছাউনি দেওয়া হলঘর। কালো পর্দা। পর্দা উঠল। স্টেজে মিটমিটে আলো। কালো পোশাক পরা কী ভয়ংকর মানুষটা! চুলগুলো পাননা, দুচোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছিল। সে পাগলের মতো স্টেজের মধ্যে দাপাদাপি করছিল। তার কোমরে দড়ি বেঁধে তিনজন তোক টেনে ধরেছিল।

তারপর রাক্ষসটা যখন জ্যান্ত মুরগীটাকে ধরল–মুরগীটা পাখা ঝাঁপটাতে লাগল….মুরগীটা মরণডাক ডেকে উঠল। উঃ! তারপর আর মনে নেই। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।….

সেই ম্যাজিক দেখা, তারপর এই যাচ্ছে। এখন অবশ্য ঐসব ভয়ানক খেলা আর হয় না। তবু ভয় করছে। কিসের যে ভয় রীণা তা ঠিক বুঝতে পারছে না।

শো আরম্ভ হল। হলভর্তি দর্শক। ম্যাজিসিয়ান হাসতে হাসতে পায়ে ছন্দ তুলে স্টেজে ঢুকলেন। খেলা শুরু হল।

কি একটা খেলা দেখাবার পর ম্যাজিসিয়ান তার কালো টুপিটা শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে আবার নিজের হাতে ধরতে গেলেন, ঠিক তখনই রীণা একটা অস্ফুট শব্দ করে সঞ্জয়ের বুকের ওপর ঢলে পড়ল।

অবশ্য বেশিক্ষণ অজ্ঞান হয়ে থাকেনি। জ্ঞান ফিরতেই সঞ্জয় তাড়াতাড়ি ওকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল। একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে রীণা চোখে-মুখে জল দিল। একটা কোল্ড ড্রিংক খেল।

–এখন কেমন? সঞ্জয় জিজ্ঞেস করল।

–ভালো। এবার বাড়ি চলো।

সঞ্জয় একটা ট্যাক্সি নিল। ট্যাক্সিতে গা এলিয়ে বসেছিল রীণা। দুচোখ বন্ধ। সঞ্জয় ওর হাতটা তুলে নিল। হাতটা ঠাণ্ডা।

–তুমি আচ্ছা ভীতু তো! সঞ্জয় হেসে রীণার দিকে তাকাল।

রীণা উত্তর দিল না।

–কিন্তু কিসে এত ভয় পেলে? কোনো ভয়ের খেলা তো দেখায়নি।

রীণা এবার মাথাটা একটু নাড়ল। ক্লান্ত গলায় বলল, জানি না।

ট্যাক্সি যখন কম্পাউন্ডে ঢুকল তখন সন্ধে সাড়ে সাতটা। গলিপথটা নির্জন হয়ে গেছে। কম্পাউন্ডেও বুড়োরা কেউ বসে নেই।

আকাশে কৃষ্ণা চতুর্থীর চাঁদ। রীণা হঠাৎ চমকে ট্যাক্সি থেকে মুখ বাড়াল।

–কি হল?

দ্যাখো দ্যাখো গম্বুজটা!

গম্বুজটার ওপর হালকা চাঁদের আলো পড়ে কেমন রহস্যময় লাগছিল। তার চেয়েও রহস্যময়ী লাগছিল রীণাকে। তার মুখটা মনে হচ্ছিল যেন কাগজের তৈরি অন্য একটা যেন মুখ। সে একদৃষ্টে তাকিয়েছিল গম্বুজটার দিকে।

–কি হল? নামো। সঞ্জয় বলল।

রীণা চমকে উঠল। তারপর সঞ্জয়ের হাতটা আঁকড়ে ধরে ধীরে ধীরে নামল।

.

০৩.

শেষ-দুপুরে আগন্তুক

ভাই মান্তু, শেষ পর্যন্ত কলকাতায় এলাম। তুই তো জানিস এ আমার কতদিনের সাধ! সেই সাধ এতদিনে পূর্ণ হল। এবার আশা করছি তোর সঙ্গে প্রায়ই দেখা হবে। বাসাটা বেশ দূরে হল-বাঙ্গুর-কালিন্দির কাছে। তবু তো কলকাতা। এখান থেকে হাওড়া এমন আর কি দূর? রাস্তাটা চিনে নিলে যে কোনো সময়ে তার কাছে চলে যেতে পারব।

দুসপ্তাহ হল এসেছি। এখনো ঠিকমতো গুছিয়ে বসতে পারিনি। পিসিমা এসেছিলেন। তিনি ছিলেন বলে পুপুকে তার কাছে রেখে কদিন খুব সিনেমা-থিয়েটার দেখে নিলাম। কিন্তু গোল বাধল ম্যাজিক দেখতে গিয়ে। ম্যাজিক দেখায় আমার বড় ভয়। শুনে ডাক্তার খুব হাসে। কিন্তু ওকে বোঝাই কি করে ম্যাজিসিয়ানদের দেখলেই আমার বুকের মধ্যে কেমন করে। কারণ আর কিছুই নয় ছোটবেলায় নররাক্ষস দেখার বীভৎস অভিজ্ঞতা। এই এতদিন পরে ম্যাজিক দেখতে গিয়ে আবার অজ্ঞান হয়ে যাই। ভাবতে পারিনি ম্যাজিক দেখতে গিয়ে এই বয়েসে অজ্ঞান হয়ে যাব। তারপর থেকে শরীরটা দুর্বল। মনটাও অকারণে বিষণ্ণ হয়ে আছে। কেবলই মনে হচ্ছে কি যেন ঘটবে–এমন কিছু যা মোটেই শুভ নয়। এরকম মনে হবার কোনো কারণ খুঁজে পাই না।

যাই হোক বাড়িটার কথা বলি। পুরনো বাড়ি। তিনতলা। বাড়িটা একটা গলির ভেতর। এখানে বড়ো রাস্তার ধারে, আশেপাশে প্রচুর নতুন বাড়ি উঠেছে। আমাদের কপালেই পুরনো বাড়ি জুটল। যাক, তবু তো জুটেছে। একতলায়, দোতলায় মোট চার ঘর ভাড়াটে। আমরা তিনতলায়। তিনতলাটা দেখলেই বোঝা যায় incomplete। কবে কোনকাল থেকে কেন যে এরকম অসম্পূর্ণ হয়ে আছে কে জানে! ছাদের ওপর একটা ভাঙা গম্বুজমতো আছে। সেটাই আমার কাছে কেমন অদ্ভুত লাগে। ঠিক যেন সেকালের রাজা-রাজড়াদের দুর্গ! সেদিন ম্যাজিক দেখে ফেরার সময়ে চাঁদের আলোয় গম্বুজটাকে দেখেও কেন জানি না বেশ ভয় পেয়েছিলাম।

তবু মন্দ লাগে না। শান্ত পরিবেশ। বাড়ির পিছনে সার সার দেবদারু গাছ। কম্পাউন্ডের মধ্যে অনেকগুলো সুপুরিগাছও আছে। বাড়ির পিছনের দিকটা যেন রহস্যপুরী। এই কলকাতা শহরেও রাত্তিরবেলায় ঝিঁঝি ডাকে!

তুই একদিন চলে আয়। ও হাসপাতালে চলে গেলে সারা দুপুর বড্ড একা লাগে। পিসিমা চলে গেছেন। আমার সঙ্গী শুধু পুপু। ঘুমোতে চেষ্টা করি। ঘুম হলে বেশ ভালো থাকি। ঘুম না হলে কেমন ভয় করে। চোর-ডাকাতের ভয় নয়। আবার বলছি–কিসের ভয় জানি না।

ও হ্যাঁ। একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। প্রথম যেদিন মনের আনন্দে সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছিলাম, তখন ডাক্তার আমায় সাবধান করে দিল যেন তড়বড়িয়ে না উঠি। পড়ে যেতে পারি। আশ্চর্য! ঠিক তখনই মাথাটা কিরকম করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে গড়িয়ে চার ধাপ নিচে পড়ে গেলাম। ভাগ্যি ও ধরে ফেলেছিল।

কিন্তু তোকে সত্যি কথা বলি। পড়বার আগের মুহূর্তেও ভাবতে পারিনি আমি পড়ে যাব! কি করে পড়লাম কে জানে!

কলকাতায় এসে এরই মধ্যে দুটো ধাক্কা খেলাম। প্রথম সিঁড়ি থেকে পড়া। দ্বিতীয় ম্যাজিক দেখতে গিয়ে….

চিঠি লেখায় বাধা পড়ল। শুনতে পেল সিঁড়িতে জুতোর অস্পষ্ট শব্দ। ওপরে কেউ আসছে। অবাক হল। কেউ তো আসে না।

ঠিক এই সময়ে পুপু ঘুমোতে ঘুমোতে হঠাৎ কেঁদে উঠল।

চিঠি ফেলে রেখে রীণা বিছানায় গিয়ে পুপুর পিঠে হাত রাখল। কিন্তু কান্না থামল না।

কি হল? কিছু কামড়ালো নাকি? রীণা তাড়াতাড়ি পুপুকে তুলে নিয়ে বিছানা ওলোট-পালোট করে ফেলল। নাঃ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বিছানা। কোথাও একটা পিঁপড়ে পর্যন্ত নেই।

পুপুকে কোলে নিয়ে অনেক কষ্টে ঘুম পাড়িয়ে রীণা আবার বাইরের ঘরে এসে বসল। ঘড়ির দিকে তাকাল। পৌনে তিনটে।

যাক, বিকেল হয়ে এল। এর মধ্যে চিঠিটা শেষ করে ফেলতে হবে।

সবেমাত্র একটি শব্দ লিখেছে, অমনি দেখল স্যুটপরা কেউ একজন যেন সিঁড়ির দিকের জানলার পাশ থেকে চকিতে সরে গেল।

–কে?

সাড়া নেই।

রীণা আবার ডাকল–কে?

এবারও উত্তর নেই।

রীণা ভাবল জানাশোনা কেউ দেখা করতে এসেছে। লুকিয়ে একটু মজা করছে।

রীণা উঠে দরজার কাছে গেল। ঠিক তখনই পুপু আবার কেঁদে উঠল। তবু রীণা দরজা খুলে দিল।

না, কেউ নেই। শুধু জ্যৈষ্ঠের একফালি রোদ দেওয়ালের একটা জায়গায় বর্শার ফলার মতো এসে পড়েছে।

রীণা ঝুল-বারান্দায় এসে দাঁড়াল। নিচের কম্পাউন্ড ফাঁকা। জনপ্রাণী নেই। অল্প দূরে যশোর রোডের ওপর দিয়ে সশব্দে বাস, ট্যাক্সি, লরি ছুটে চলেছে।

রীণা অবাক হল। কে এল এই অসময়ে? গেলই-বা কোথায়?

কিন্তু বেশিক্ষণ ভাবতে পারল না। পুপু তখনও কাঁদছে। তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে ঘরে ঢুকে পড়ল।

না, আর কাঁদছে না। বিছানার চাদরটা মুঠো করে ধরে ঘুমিয়ে পড়েছে।

রীণা আবার বাইরের ঘরে এসে বসল। চিঠিটা শেষ করল কোনোরকমে। কিন্তু চিঠি লিখতে লিখতেও ভাবনাটা কিছুতেই সরিয়ে ফেলতে পারছিল না। কেবলই মনে হচ্ছিল–কে ঐ স্যুটপরা ভদ্রলোক? তার মুখ দেখতে পায়নি। দেখেছে শুধু কোটের একটা প্রান্ত। কেনই-বা অসময়ে এল! কেনই-বা চুপচাপ। চলে গেল!

ভদ্রলোক কে হতে পারে, রীণা সম্ভব-অসম্ভব অনেকের কথাই মনে করার চেষ্টা করছিল, এমনি সময়ে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ।

রীণার হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠল।

–কে?

এইটুকু উচ্চারণ করতেই গলার স্বর কেঁপে উঠল।

–আপনার টেলিফোন।

–আমার টেলিফোন!

রীণা দরজা খুলে দিল। দেখল দোতলার নিখিলবাবুর মেয়ে বন্দনা। বদনা। বলল, আমাদের ঘরে আপনার ফোন এসেছে।

রীণা একে চেনে।

–কে ফোন করছে? অন্যমনস্কভাবে কথা কটা উচ্চারণ করেই রীণা তাড়াতাড়ি নেমে গেল। ঘরটা খোলাই পড়ে রইল।

কে তাকে হঠাৎ ফোন করতে পারে? ডাক্তার ছাড়া আর তো কেউ এ বাড়ির নম্বর জানে না। ডাক্তারই বা শুধু শুধু ফোন করতে যাবে কেন? তাহলে নিশ্চয় ডাক্তার কাউকে ফোন নম্বর দিয়েছে জরুরি কোনো খবর জানাবার জন্যে। কি সে জরুরি খবর? তবে কি ওর কিছু হয়েছে? অ্যাকসিডেন্ট? হাসপাতাল থেকে করছে? স্যুটপরা ভদ্রলোক কি সেই খবর দেবার জন্যেই এসেছিলেন? নিজে মুখে খবরটা দিতে না পেরে ফোন করছেন? রীণা ঘামতে ঘামতে রিসিভার হাতে তুলে নিল।

–হ্যালো-হ্যালো–আমি রীণা বলছি। রীণা গুপ্ত–ডাক্তার সঞ্জয় গুপ্তর স্ত্রী ওপার থেকে হাসি শোনা গেল।

তুমি যে আমারই স্ত্রী, তোমার কাছ থেকে এই প্রথম শুনতে পেলাম।

ডাক্তারেরই গলা। রীণার বুকটা হালকা হল।

–ও তুমি! বাবাঃ! বাঁচলাম।

–কেমন অবাক করে দিলাম।

উঃ! যা ভয় পেয়েছিলাম!

–ভয়! কিসের ভয়?

–সে অনেক কথা। তুমি এলে বলব।

–আমার আজ ফিরতে দেরি হবে। চিন্তা কোরো না।

–দেরি? না-না, মোটেই আজ দেরি কোরো না। লক্ষ্মীটি।

–একটা জরুরি কাজ আছে যে।

–তা থাক। আমারও বিশেষ দরকার আছে।

ওপার থেকে এবার চট্‌ করে উত্তর এল না।

–হ্যা-লো

ডাক্তার মৃদু ধমক দিল।–অত চেঁচাচ্ছ কেন? আস্তে বলল।

সে কথায় কান না দিয়ে রীণা আবার চেঁচিয়ে উঠল–তাড়াতাড়ি আসছ তো?

–আচ্ছা, চেষ্টা করব। ছেড়ে দিচ্ছি।

রীণাও ফোনটা রেখে দিল। বন্দনার দিকে তাকিয়ে সলজ্জ একটু হেসে বলল, চলি।

বন্দনাও একটু হাসল, খুব ভয় পেয়েছিলেন?

—হ্যাঁ। হঠাৎ টেলিফোন পেলে রীণার মুখটা একটু লাল হল।–চলি। সময় পেলে এসো। কেমন?

রীণা তিনতলায় উঠতে লাগল। উঠতে উঠতে কি মনে হওয়ায় আবার নেমে এল।

–এই শোনো।

বন্দনা ফিরে দাঁড়াল।

–দুপুরে তুমি বাড়ি ছিলে?

–হ্যাঁ, ইস্কুলের ছুটি।

–কি করছিলে? ঘুমোচ্ছিলে?

–দুপুরে আমি ঘুমোই না। সেলাই করছিলাম।

–কোন ঘরে?

–এই ঘরে।

–আচ্ছা, কেউ একটু আগে–এই তিনটে নাগাদ তিনতলায় গিয়েছিল?

কই? না তো।

তুমি তো দরজা বন্ধ করে সেলাই করছিলে। কি করে দেখবে?

বন্দনা বলল, কেউ সিঁড়ি দিয়ে উঠলে জুতোর শব্দ শুনতে পেতাম।

রীণা মুহূর্তখানেক কী ভাবল। জুতোর শব্দ বন্দনা শুনতে পায়নি। কিন্তু সে নিজে পেয়েছিল। তাহলে ব্যাপারটা কি? ভাবতে ভাবতে বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল। কেমন যেন একটা চাপা ভয়–তারপর আচ্ছা চলি বলে তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে এল। বেশ বুঝতে পারল বন্দনা অবাক হয়ে তাকে দেখছে। তারপরই হঠাৎ মনে পড়ল তাড়াতাড়িতে দরজা খুলে রেখেই এসেছে। ঘরে একা পুপু। তখনই রীণা হুড়মুড় করে ঘরে এসে ঢুকল।

না, পুপু নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে।

রীণা তবু ঘুমন্ত ছেলেকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইল।

আবার মনে মনে সেই চিন্তা–এই যে পুপু একা আছে বলে পড়িমরি করে ছুটে এলকিসের ভয়ে? শুধু তো কধাপ নেমে দোতলায় গিয়েছিল। এর মধ্যে এমন কি আর ঘটতে পারত? চোর-টোর? তাহলেও তো দোতলার ঘর থেকেই দেখতে পেত।

তাহলে?

তাহলেও সেই এক প্রশ্ন–বেলা পৌনে তিনটে নাগাদ সে যে জুতোর শব্দ শুনেছিল, চকিতের জন্য যার পরনের স্যুট চোখে পড়েছিল সে কে? কেন এসেছিল? কেনই-বা দেখা না করে মুহূর্তে কোথায় চলে গেল?

.

সন্ধে হবার আগেই সঞ্জয় ফিরল। কম্পাউন্ডের মধ্যে ঢুকে ওপরের দিকে তাকাল। দেখল রীণা পুপুকে নিয়ে ব্যালকনিতে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। যেন তার জন্যেই অপেক্ষা করছে।

সঞ্জয় ডাক্তার মানুষ। স্বাভাবিক নিয়মেই একটু কঠিন। ভয়, ভাবনা, ভাবাবেগ কম। তবু আজ টেলিফোনে রীণার গলার স্বরটা শুনে একটু চিন্তায় পড়েছিল। কেমন যেন ভয়-পাওয়া গলা। কিন্তু কিসের ভয় বুঝতে পারছিল না। এখন হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিশ্চিন্ত হল। সেই সঙ্গে একটু রাগও।

ঘরে ঢুকেই তাই বিরক্ত মুখে জিজ্ঞেস করল কি ব্যাপার বলো তো?

বলছি। আগে চা খাও।

সঞ্জয় লক্ষ্য করল রীণার চোখে-মুখে সত্যিই ক্লান্তির ছাপ। কিছু যে ঘটেছে তা বুঝতে পারল।

একটু পরেই রীণা ফিরল দুকাপ চা আর বিস্কুট নিয়ে। সঞ্জয়কে কাপ এগিয়ে দিয়ে নিজেও একটা কাপ তুলে নিল।

–হ্যাঁ, বলো কী ব্যাপার? সঞ্জয়ের স্বরে কৌতূহল।

রীণা তখন দুপুরের সমস্ত ব্যাপারটা খুলে বলল। শুনে সঞ্জয় খুব খানিকটা হাসল।

–এই কথা শোনাবার জন্যে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে বললে?

রীণা মাথা নিচু করে বলল কথাটা কি ভাববার মতো নয়?

–পাগল হয়ে গেলে নাকি? বলেই সঞ্জয় উঠে শার্ট খুলে ফ্যানটা জোরে চালিয়ে দিল।

রীণার মুখ লাল। সে বলল, পাগল বৈকি! আমি নিজে কানে জুতোর শব্দ শুনলাম। নিজে চোখে দেখলাম।

–কি দেখলে? কালো স্যুটপরা এক সুদর্শন পুরুষ বারান্দার জানলার সামনে দাঁড়িয়ে তোমায় নীরবে নিরীক্ষণ করছেন।

রীণা ধমকে উঠে বলল-বাজে বোকো না তো! আমি কচি খুকি নই যে আজে-বাজে বকব। আমার কথা হেসে উড়িয়ে দিও না।

বেশ, এই আমি চুপ করলাম। বলেই ছেলেকে কোলে টেনে নিল।

–এসো তো পুপু সোনাতোমায় একটু আদর করি। বড়ো হলে তোমায় আমি কালো স্যুট তৈরি করে দেব। তোমার মামণি কালো স্যুট খুব ভালবাসে। বলেই রীণার দিকে তাকাল।

রীণ ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, ঠাট্টা হচ্ছে? বলে হঠাৎ উঠে গিয়ে বিছানায় মুখ এঁজে শুয়ে পড়ল।

–আরে! এই দ্যাখো! রাগ করে একেবারে শয্যাশায়ী! বলতে বলতে ছেলেকে কোলে নিয়ে উঠে এল সঞ্জয়।

সঞ্জয় পুপুকে শুইয়ে দিয়ে রীণার গা ঘেঁষে বসল। ওর ওপর ঝুঁকে পড়ে দুহাত দিয়ে মুখটা তুলে ধরবার চেষ্টা করল।

আঃ! বিরক্ত কোরো না। বলে রীণা ছিটকে উঠে বসল।

–ঠিক আছে। আমি কাছে থাকলে এতই যখন বিরক্তি তখন বাইরের জরুরি কাজটা সেরেই আসি।

বলে সঞ্জয় উঠে পড়ল। রীণা ছুটে গিয়ে দরজা বন্ধ করে পথ আগলে দাঁড়াল, যাবে বৈকি!

সঞ্জয় হেসে বলল, তাহলে কুমড়োর মতো একটা গোমড়া মুখের সামনে বসে কি করব?

কুমড়োর মতো মুখ বৈকি! এই মুখের জন্যেই তো একদিন–পুপুকে দ্যাখো। আমি জলখাবার নিয়ে আসি। বলেই তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল।

সঞ্জয় একটা জিনিস লক্ষ্য করল রীণা যেন আজ একটুতেই রেগে যাচ্ছে। ঠাট্টাটুকুও বুঝতে চাইছে না।

তখনকার মতো শান্তি। কিন্তু জের চলল রাত্রে ঘুমোবার আগে পর্যন্ত।

চুপচাপ শুয়েছিল রীণা। একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল পাখার দিকে। কেমন উন্মনা দৃষ্টি। অথচ অন্যদিন ওর সারাদিনের যত গল্প–সব শোনায় এই সময়। সে সব গল্প এ বাড়ির অন্য ভাড়াটেদের নিয়ে।

–এখনো রাগ পড়েনি?

–কিসের রাগ?

–ঐ যে তখন পাগল-টাগল বললাম কুমড়োর মতো মুখ।

রীণা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশ ফিরে শুলো–নাগো, রাগের কথা নয়। তুমি আমার কথা বিশ্বাস করলে না। কিন্তু–আমি কী করে বোঝাব–

–তুমি কি সেই আবির্ভাবটিকে এখনো ভুলতে পারনি?

–কি করে ভুলব? প্রথমে ভেবেছিলাম আত্মীয়দের কেউ দেখা করতে এসেছে। একটু মজা করছে। কিন্তু দরজা খুলে যখন দেখলাম কেউ নেই তখন

বাধা দিয়ে সঞ্জয় বলল, আরে বাবা, নিশ্চয়ই কেউ ভুল করে তিনতলায় উঠে এসেছিল। তারপর নিজের ভুল বুঝে চুপি চুপি নিচে চলে গেছে। এই তো ব্যাপার। এই নিয়ে

রীণা এ উত্তরে নিশ্চিন্ত হল না। বলল, ব্যাপারটা অত সহজ নয়। লোকটা সিঁড়ি দিয়ে নামেনি। আমি এক মুহূর্তের জন্যে লোকটাকে জানলার সামনে দিয়ে বাঁ দিকে যেতে দেখেছি। আর ফিরতে দেখিনি। তুমি নিশ্চয় জান ওদিকটা একেবারে ব্লাইন্ড। ওদিক দিয়ে চলে যাবার উপায় নেই।

সঞ্জয় চুপ করে শুনল।

তাছাড়া আমি বন্দনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ও সারা দুপুর সিঁড়ির সামনের ঘরে বসেছিল। কাউকে উঠতে দেখেনি বা জুতোর শব্দ পায়নি।

রীণার এত কথার পর সঞ্জয় শুধু একটা প্রশ্ন করল, বন্দনা আবার কে?

রীণা বিরক্ত হয়ে বলল, দোতলার নিখিলবাবুর মেয়ে বন্দনাকে চেন না? কত বার এসেছে। দেখেছ।

–আমি নিজের স্ত্রী ছাড়া অন্য মেয়ের দিকে তাকাই না।

–ওঃ! ভারি সাধু–পুরুষদের চিনতে আমার বাকি নেই।

বলে পাশ ফিরে শুলো।

ঘরের মধ্যে হালকা নীল আলো। মাথার ওপর পাখার ঝড়। বাইরে অন্ধকার আকাশে লক্ষ তারার চোখ-টেপা হাসি।

–ঘুমোলে? গাঢ়স্বরে সঞ্জয় জিজ্ঞেস করল।

–ঘুম আসছে না।

সঞ্জয় পাশ ফিরে ডান হাতটা ঝুলিয়ে দিল রীণার বুকের ওপর। একটু আকর্ষণ করল। রীণার হালকা দেহটা এসে পড়ল তার নিশ্বাসের মধ্যে।

–এবার ঘুমোও।

অমন করলে ঘুম হয়? বলে রীণা সঞ্জয়কে আঁকড়ে ধরল।

.

০৪.

রাত তখন গভীর

নতুন জায়গায় নতুন সংসারে রীণা কিছুটা খাপ খাইয়ে নিয়েছে। তবু বেলা তিনটে বাজলেই ও একটু উৎকর্ণ হয়ে থাকে। একদিন যে এসেছিল সে কি আবার কোনদিন আসবে? কিন্তু না, বেশ কিছুদিন তো হয়ে গেল আর কাউকে দেখা যায়নি, জুতোর শব্দটুকুও না।

রীণা এখন বেশ নিশ্চিন্ত। কিন্তু ভারি লজ্জা করে সেদিনের কথা ভাবতে। কী যে হয়েছিল–শুধু শুধু ভয় পেয়ে গেল। ছিঃ।

গত রবিবার প্রফেসার রুদ্র এসেছিলেন। ইনি ডাক্তারের হোটোকাকার বন্ধু। মেডিকেল কলেজে পড়ার সময়ে ওঁর কাছে ওকে প্রায়ই যেতে হতো। তাই সম্পর্কটা খুব ঘনিষ্ঠ।

প্রফেসার রুদ্র কলকাতার এক নম্বর ডাক্তারদের মধ্যে একজন। মানসিক রোগের চিকিৎসা করেন। কলকাতায় এসে পর্যন্ত ডাক্তার ওঁর সঙ্গে দেখা করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল। তারপর হঠাৎই গত রবিবার ও প্রফেসারকে নিয়ে এল।

বেশ ভালোই লাগছিল। এই প্রথম একজন চেনাশোনা বিশিষ্ট লোক তাদের বাড়িতে এল। কিন্তু ডাক্তার যখন খুব মজা করে সেদিনের ঘটনাটা প্রফেসার রুদ্রকে বলছিল রীণার তখন লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল।

প্রফেসার অবশ্য কোনো ঠাট্টা করলেন না। হাসলেন একটু।

এখন তাই সেদিনের কথা মনে হলে রীণার ভারি অস্বস্তি হয়।

কিন্তু সেদিন যা দেখেছিল তা কি ভুল? চোখ কি এত বিশ্বাসঘাতকতা করে? হবেও বা। ইংরিজিতে ইলিউসান নামে যে একটা কথা আছে তা বোধহয় এইই।

.

সেদিন হাসপাতাল থেকে ফিরতে সঞ্জয়ের বেশ রাত হয়ে গেল।

ওরা বেশি রাত জাগে না। সাড়ে নটার মধ্যেই রাতের খাওয়া শেষ করে শুয়ে পড়ে। এদিন ওর ফিরতে রাত হওয়ায় রীণা ভয় পাচ্ছিল। হাসপাতাল থেকে ফিরতে সঞ্জয়ের প্রায়ই রাত হয়। কিন্তু কোনোদিন ভয়-টয় করত না। আজ হঠাৎই কেমন ভয় করল। সে কথাটা আর বলল না। খেয়েদেয়ে ওরা শুয়ে পড়ল। রীণা পুপুকে নিয়ে খাটে শোয়। ডাক্তার শোয় মেঝেতে।

অনেক রাত্রে হঠাৎ রীণার ঘুম ভেঙে গেল। কেন যে ঘুম ভাঙল রীণা ঠিক বুঝতে পারল না। শুনতে পেল যশোর রোড দিয়ে একটা মাতাল চেঁচাতে চেঁচাতে যাচ্ছে। মাতালটা বোধহয় রোজই এই সময়ে যায়। এর আগেও শুনেছে। উদ্দেশ্যহীনভাবে অশ্রাব্য গাল দিতে দিতে যায়। পরিচিত পরিবেশ। তবু কিরকম যেন গা-ছমছম্ করতে লাগল। মনে হল ঘরে বুঝি সে একা! সঞ্জয় বুঝি রুগী দেখে এখনও ফেরেনি। ঘোরটা কেটে যেতেই মনে পড়লনা, সঞ্জয় অনেকক্ষণ ফিরেছে। ঐ তো মেঝেতে শুয়ে আছে।

এমনি সময় পুপু হঠাৎ কেঁদে উঠল। ঠিক এইরকম ভাবেই কেঁদেছিল সেই সেদিন বেলা তিনটের সময়ে! কাঁদতে কাঁদতে পুপু ককিয়ে গেল। রীণা তাড়াতাড়ি পুপুকে কোলে তুলে নিয়ে টর্চ জ্বেলে বিছানা, বালিশের তলা দেখে নিল। না, কিছু নেই।

রীণা তখন পুপুকে বুকে চেপে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করল। পুপু ঘুমের মধ্যেও মাঝে মাঝে কাঁদছে। রীণা তখন ওকে শুইয়ে চাপড়াতে লাগল। তখনি হঠাৎ রীণার মনে হল কোথায় যেন কিসের শব্দ হচ্ছে। অস্পষ্ট শব্দ। মনে হল নিচের তলার কোনো ঘরে কেউ যেন দেওয়ালে পেরেক পুঁতছে।

হবেও বা। হয়তো মশারির দড়ি পেরেক উঠে এসেছে কারো ঘরে। তাই পেরেক ঠুকছে। রীণা পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করল। কিন্তু একটু পরেই আবার শব্দ–এবার সেই হালকা পেরেক পোঁতার শব্দটা ভারী হয়ে উঠছে। কেউ যেন কাঠের জুতো পরে একটা একটা পা ফেলে গুনে গুনে সিঁড়ি ভেঙে তেতলায় উঠে আসছে। রীণা কান খাড়া করে রইল। এত রাতে কে আসছে অমন করে?

হঠাৎ শব্দটা থেমে গেল।

শব্দটা কোথায় এসে থামল দেখার জন্যে ঘাড় ফেরাতেই রীণার শরীরটা হিম হয়ে গেল। দেখল আবছা একটা মূর্তি তাদের বসার ঘরে টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পরনে যেন কালো কোট, কালো প্যান্ট।

রীণা শুয়ে শুয়েই মানুষটাকে বোঝবার চেষ্টা করতে লাগল। না, চোখের ভুল নয়। একটা মানুষই। কিন্তু এত আবছা কেন? লোকটা কে হতে পারে?

পুপু আবার কেঁদে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে রীণা সচেতন হয়ে উঠল।

–ওগো, শুনছ! রীণা চাপা গলায় সঞ্জয়কে ডাকল। ওঠো না। তোমায় বোধহয় কেউ ডাকতে এসেছে।

–আমায়? কোথায়?

–ঐ যে বাইরের ঘরে। টেবিলের কাছে।

অন্ধকারের মধ্যে যতদূর সম্ভব দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে সঞ্জয় তাকাল, কই? কেউ তো নেই।

রীণা বিরক্ত হয়ে বলল, ঐ তো দাঁড়িয়ে রয়েছে।

সঞ্জয় তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে কিসে যেন ধাক্কা খেল। মশারির দড়িটা ছিঁড়ে গেল। অন্ধকারে দেওয়াল হাতড়ে সুইচ নামিয়ে দিল। আলো জ্বলল না। লোডশেডিং।

সঞ্জয় বিছানা থেকে বড়ো টটা নিয়ে জ্বালল। আর ঠিক তখনই কি যেন পড়ে ঝনঝন করে ভেঙে গেল।

টর্চের আলো অন্ধকার দুফাঁক করে সোজা সিঁড়ির মুখে গিয়ে পড়ল।

কই? কোথায়?

–ঐ যে বাথরুমের দিকে। ঐ যে ঢুকছে রীণা চিৎকার করে উঠল।

সঞ্জয় টর্চ হাতে সেই দিকে ছুটল।

–যেয়ো না, যেয়ো না

সে কথায় কান না দিয়ে সঞ্জয় দৌড়ে বাথরুমে ঢুকল।

কিন্তু কোথায় কে? শুধু ফ্ল্যাশের পুরনো ট্যাঙ্ক চুঁইয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় জল পড়ে যাচ্ছে।

–তোমার যত আজগুবি কাণ্ড! বলতে বলতে সঞ্জয় ঘরে ফিরে এল।

কী আজগুবি কাণ্ড? কেমন একরকম তীব্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রীণা তাকাল। সে দৃষ্টি অস্বাভাবিক। সঞ্জয় সতর্ক হল। আর কিছু বলল না।

সে রাত্তিরে দুজনের কারোরই ভালো করে ঘুম হল না। সঞ্জয় খুবই বিরক্ত। বিরক্ত হবার কারণও আছে। সারাদিন হাসপাতালে ডিউটি গেছে। ডিউটির পরও রুগী দেখতে ছুটতে হয়েছে। তারপর আবার এই ব্যাপার। রাত্তিরটুকুতেও যদি ঘুম না হয় তাহলে তো আর পারা যায় না। অন্ধকারেই কোনরকমে মশারির দড়ি ঠিক করে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, ঠিক কি দেখেছ বলো তো?

রীণা তখন অনেকটা স্বাভাবিক। সব ব্যাপারটা বলল।

সঞ্জয় কিছুটা বিরক্তি, কিছুটা বিদ্রুপের সুরে বলল, আবার সেই ব্ল্যাক স্যুট! কি করে ভাবতে পারলে রাত দুপুরে একজন লোক এসে বাইরের ঘরে ঢুকেছে? এটা কি সম্ভব? দরজাটাও তো তুমি নিজে বন্ধ করেছিলে। ঐ দ্যাখো, দরজা এখনো বন্ধ। বলেই মশারির ভেতর থেকেই দরজার ওপর টর্চ ফেলল।

রীণা চুপ করে রইল। তারপর শুকনো গলায় বলল, কি একটা পড়ে ভেঙেছে।

সঞ্জয় বলল, সেও তোমার উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা। কই আমি তো ভাঙার চিহ্নমাত্রও দেখতে পেলাম না।

রীণা কোনো একটিরও উত্তর দিতে পারল না। বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ল।

সঞ্জয় হেসে বলল, নাঃ, তোমার দেখছি নার্ভ ফেল করছে। এরপর মাথাটা একেবারে যাবে।

–বিশ্বাস করো

রীণা মিনতির স্বরে আরো কি বোঝাতে যাচ্ছিল, সঞ্জয় বলল, ও সব কথা থাক। এখন একটু ঘুমোও তো। বলে নিজেই পাশবালিশ আঁকড়ে শুয়ে পড়ল।

.

সকালের রোদ খাটের ওপর পর্যন্ত উঠে এসেছে। সঞ্জয় তখনো ঘুমোচ্ছে। হয়তো আরো কিছুক্ষণ ঘুমোত। কিন্তু রীণার ডাকে ঘুম ভেঙে গেল।

–এ-ই শুনছ?

–উ।

–একবার এসো না।

দূর বাবা, ওখান থেকেই বলো না।

–বললে হবে না। তাড়াতাড়ি এসো।

উঃ! জ্বালালে! সকাল থেকেই

ঘুম জড়ানো চোখে সঞ্জয় উঠে এল।

–এসো এইখানে। এটা কি? রীণা আঙুল দিয়ে মেঝেটা দেখাল।

সঞ্জয় দেখল টেবিলের নিচে একটা গেলাস ভেঙে পড়ে আছে।

রীণা দুহাত কোমরে রেখে বলল, খুব তো বলেছিলে আমি পাগল হয়ে গেছি। এখন নিজের চোখেই দ্যাখো।

সঞ্জয় হেঁট হয়ে কাচগুলো পরীক্ষা করতে লাগল। গেলাসটা উঁচু জায়গা থেকেই পড়ে ভেঙেছে। কেউ যেন টেবিল থেকে গেলাসটা ইচ্ছে করে ফেলে দিয়েছে।

এখন বুঝছ?

সঞ্জয় বাসি মুখেই একটা সিগারেট ধরাল। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, বলতে চাও ভূতে গেলাস ভেঙেছে?

–আমি আর কি বলব? তুমি নিজেই দ্যাখো।

–টেবিলের ধারে গেলাসটা রেখেছিলে, টিকটিকি-ফিটিকিতে ফেলে দিয়েছে।

না কক্ষণো ধারে রাখিনি। গেলাস কেউ টেবিলের ধারে রাখে না।

সঞ্জয় কোনো উত্তর দিল না। খোলা দরজা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে সিগারেট খেতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে হেসে বলল, এতে মাথা ঘামাবার কিছু নেই। বেড়ালের কাজ। যাও, এখন বেশ ফাস্ট ক্লাস করে চা করো দিকি। মেজাজটা আসুক। আমি ততোক্ষণ আর একটু শুই। বলে সঞ্জয় আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।

রীণা দাঁড়িয়ে রইল জানলার সামনে। উদ্ভ্রান্ত মন। শহর কলকাতা জেগেছে। অতি পরিচিত সকাল। কিন্তু দিনের শুরু থেকেই মনটা ভারী হয়ে রইল।

.

০৫.

একখানি ছবি

হাসপাতালে বেরোবার সময়ে রীণা বলল, সন্ধের মধ্যে ফিরবে কিন্তু।

সঞ্জয় হেসে বলল, বাইরে বেশিক্ষণ থাকার তেমন কোনো আকর্ষণ এখনো পর্যন্ত নেই।

ঠাট্টা রাখো। সন্ধেবেলা লোডশেডিং হলে আমার খুব ভয় করে।

জুতোর ফিতে বাঁধতে বাঁধতে সঞ্জয় বলল, খাস কলকাতা শহরে থেকেও ভয়? তাও তো তিনতলার ওপর।

উত্তরের অপেক্ষা না করে তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছিল, রীণা বলল, আমার জিনিসগুলো আনতে ভুলো না।

–না, ভুলব না। তবে তুমিও একটা কথা মনে রেখো, রাত্তিরের ব্যাপারগুলো যেন তোমার বান্ধবীটিকে বলো না। এক কান থেকে পাঁচ কানে চলে যাবে। লজ্জায় মুখ দেখাতে পারব না।

–আমার আবার বান্ধবী কে? রীণার কপালে সুন্দর ভাঁজ পড়ল।

–ঐ যে নিচে বলে সঞ্জয় আঙুল দিয়ে দোতলার ঘরটা দেখিয়ে দিল।

–ওঃ! বন্দনার মা। রীণা একটু হাসল, বান্ধবী হতে যাবেন কেন? বয়েসে ঢের বড়ো। তবু ওঁরা কাছে থাকেন বলে গল্প করে বাঁচি।

–গল্প যত পারো করো। শুধু ভূতের গপ্প ছাড়া।

বলতে বলতে সঞ্জয় তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল।

.

সন্ধের আগেই সঞ্জয় ফিরল। হাতে কিছু জিনিসপত্তর ছিল বলে ট্যাক্সি করে ফিরতে হয়েছিল। ট্যাক্সি থেকে নামতেই মহিমারঞ্জনবাবু নমস্কার করে সামনে এসে দাঁড়ালেন। সঙ্গে আরো কয়েকজন। এঁরা সবাই এ বাড়িরই ভাড়াটে। সকলের সঙ্গে আলাপ নেই। আলাপ করার সময়ও নেই। একজনের সঙ্গেই মাঝেমধ্যে কথাবার্তা হয়। তিনি দোতলার নিখিলবাবু-বন্দনার বাবা। এঁদের মধ্যে সঞ্জয় তাকে দেখতে পেল না।

–কিছু বলবেন? সঞ্জয় প্রতি-নমস্কার করল।

কাল রাত্তিরে আপনার ঘরে একটা যেন গোলমাল শুনলাম!

সঙ্গে সঙ্গে আর একজন বললেন, আমরাও শুনেছিলাম। ভেবেছিলাম সকালেই জিজ্ঞেস করব কিন্তু এত ব্যস্ত হয়ে আপনি বেরিয়ে গেলেন যে

মহিমাবাবু কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, আমার ওয়াইফ তো রাত্তিরেই খোঁজ নিতে যাচ্ছিলেন। বললেন, একই বাড়ির বাসিন্দে। বিপদ-আপদ হলে পাশে দাঁড়াতে হয়। তা আমি বারণ করলাম–এখুনি যেও না। আগে দ্যাখো গুরুতর কিছু কি না। তা ওয়াইফ আর গেলেন না। আমরা দুজনেই অনেকক্ষণ জেগে রইলাম। আর কিছু শুনতে পেলাম না। তখন নিশ্চিন্তে ঘুমুলাম।

সঞ্জয় একটু হাসল। ধন্যবাদ। ব্যাপার কিছুই নয়। একটা বাজে স্বপ্ন দেখে আমার স্ত্রী ভয় পেয়েছিলেন।

–তাও ভালো। আমরা ভাবলাম বুঝি চোর ডাকাত। যা দিনকাল পড়েছে।

আর একজন বললেন, কিন্তু ঝনঝন্ করে একটা কাচের জিনিস ভাঙার শব্দ পেলাম যেন।

-ও কিছু নয়। সঞ্জয় তাড়াতাড়ি এড়িয়ে যেতে চাইলটেবিলে গেলাসটা ছিল। হুলো বেড়াল লাফিয়ে উঠতে গিয়ে

ভদ্রলোক যেন আকাশ থেকে পড়লেন, হুলো বেড়াল! বলেন কি!

মহিমাবাবু মাথা নাড়লেন, এ বাড়িতে তো এতদিন রয়েছি। বেড়াল তো দেখিনি। বিভূতিবাবু কি বলেন?

বিভূতিবাবু সিগারেট খাচ্ছিলেন। একমুখ ধোয়া ছেড়ে বললেন, হুলো বেড়াল! আজ পর্যন্ত একটা বেড়ালছানাও তো চোখে পড়েনি, বেড়াল থাকলে তো বেঁচে যেতাম। ইঁদুরের জ্বালায় অস্থির।

সঞ্জয় এঁদের অহেতুক কৌতূহলে বিরক্ত হচ্ছিল। কোনোরকমে পাশ কাটিয়ে বলল, তাহলে হয়তো ইঁদুরেই ভেঙে থাকবে। আচ্ছা, আমি এখন যাই। আমার স্ত্রী অপেক্ষা করছেন।

বলেই সিঁড়ির দিকে চলে গেল। মহিমাবাবুরা কেমন একটু অবাক হয়ে সঞ্জয়কে দেখতে লাগল।

–ভদ্রলোক বড়ো অহংকারী।

আর একজন বললে-ডাক্তার কিনা।

খুবই বিরক্ত হয়েছিল সঞ্জয়। কাল রাত্তিরের ব্যাপারটা তাহলে জানাজানি হয়ে গেছে। ব্যাপারটা যে নিতান্তই তুচ্ছ তা ওঁরা যেন মানতে চাইছেন না। আসলে এক শ্রেণীর মানুষ আছে যারা যুক্তির ধার ধারতে চায় না। ভয় পেতে আর ভয় পাইয়ে দিতে ভালোবাসে।

পরক্ষণেই সঞ্জয়ের মনে হল, একটা গোঁজামিল কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। সেটা ঐ গেলাস ভাঙা নিয়ে। সত্যিই তো এখানে এসে পর্যন্ত একটা বেড়ালও কোনোদিন চোখে পড়েনি। তাহলে কাল রাত্তিরে হঠাৎ বেড়াল এল কোথা থেকে? এলই যদি তো গেল কোথায়? আর এল এমন সময়ে যখন নাকি রীণা দেখছিল কিছু একটা! নাঃ, এর কোনো মীমাংসা নেই দেখছি।

বাবাঃ! কী এত গল্প হচ্ছিল ওঁদের সঙ্গে? হাসতে হাসতে রীণা এসে দাঁড়াল দরজার সামনে।

যাক, রীণাকে বেশ স্বাভাবিক লাগছে। মুখে বললে, গল্পই বটে। কাল রাত্তিরের ব্যাপারটা সব জানাজানি হয়ে গেছে। চেঁচামেচি করে যা একটা কাণ্ড করলে!

কাণ্ড তো আমিই করেছি! গেলাসটাও আমি ভেঙেছি না?

আবার সেই গেলাস! সঞ্জয় বিষয়টা ঝেড়ে ফেলবার জন্যে হেসে বলল, খুব খোশ মেজাজ দেখছি। আজ আর বুঝি তিনি দর্শন দেননি?

মুহূর্তে রীণার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

–দোহাই তোমার! আর মনে করিয়ে দিয়ো না। হাত মুখ ধুয়ে নাও। আজ কি জলখাবার করেছি বল দিকি?

–ঘুগনি-স্পেশালিস্টের হাতে ঘুগনি ছাড়া আর কি হবে?

–আহা! ঘুগনি ছাড়া আর যেন কিছু করি না? নিন্দুক আর কাকে বলে?

বলতে বলতে রীণা রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল।

একদিন রীণার কথাবার্তা শুনে, মুখ চোখের অবস্থা দেখে সঞ্জয় দুশ্চিন্তায় পড়েছিল। আজ ওর এই হাসিখুশি ভাব দেখে যেন নিশ্চিন্ত হল।

পুপু শুয়ে শুয়ে খেলা করছিল। সঞ্জয় কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে লাগল।

গত রাত্তিরের আতঙ্ক ভোলার জন্যে আজ রীণা সারা দুপুর নানা কাজে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছিল। কিছুক্ষণ দোতলায় নেমে গিয়ে নিখিলবাবুর স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করেছে। মহিলাটিকে রীণার খুব ভালো লাগে। ওপরে এসে কিছুক্ষণ নতুন-কেনা টেপটা বাজিয়েছে। মেশিনে পুপুর জন্যে একটা জামা সেলাই করতে বসেছিল। সাড়ে তিনটে নাগাদ রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকেছিল কেক তৈরি করার জন্যে।

কেক খেয়ে সঞ্জয় ভারি খুশি।

–আঃ! দারুণ! দাঁড়াও, আমিও কিছু এনেছি তোমার জন্যে। বলে ব্যাগ থেকে কতকগুলো প্যাকেট বার করল। এই নাও তোমার ডালমুট।

খুশিতে রীণার দুচোখ নেচে উঠল। ঝাল নয় তো? পুপু আবার খেতে শিখেছে।

–খেয়েই দ্যাখো। আর–এই পুপুর দুধ। এই চা। এবার খুব ভালো ফ্লেভারওলা চা এনেছি। এই তোমার সার্টিফিকেটের জেরক্স কপি।

যাক বাঁচলাম। কি ভাগ্যি সার্টিফিকেটগুলো হারাওনি।

—আমি সময়ে সময়ে হার মানি, কিন্তু চট করে কিছু হারাই না।

–থাক। হয়েছে। আজ পর্যন্ত কটা ছাতা, কটা টর্চ, কটা পেন হারিয়েছ তার হিসেব দেব? ওটা আবার কি? ব্যাগের মধ্যে!

–ঐ দ্যাখো, একদম ভুলে গেছি। অবশ্য এমন-কিছু নয়। একটা ছবি।

.

গত কাল হাসপাতাল থেকেই সঞ্জয় গিয়েছিল এক বৃদ্ধ রুগীকে দেখতে। বৃদ্ধ সঞ্জয়ের চিকিৎসায় ক্রমশ উন্নতি করছে।

রুগী দেখা হয়ে গেলে তার বাড়ির লোক অনুরোধ করল এক কাপ কফি খাবার জন্যে। সঞ্জয় খুব টায়ার্ড ছিল। খেতে রাজী হল।

বাইরের ঘরে বসে বৃদ্ধের ছেলের সঙ্গে সঞ্জয় গল্প করছিল। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে সে বাড়িটা দেখছিল। পুরনো বাড়ি। সামনে অনেকখানি উঠোন। ওদিকে ভাঙা পুজোদালান। বাড়ির একদিকটা ভেঙে পড়েছে।

সঞ্জয় জিজ্ঞেস করল, গোটা বাড়িটাই আপনাদের?

ভদ্রলোক একটু হেসে বললেন, হ্যাঁ।

–পুজোটুজো হতো দেখছি।

–হ্যাঁ, সে-সব বহুকাল আগে। দুর্গাপুজো, কালীপুজো দুইই হতো। শুনেছি একবার বলি বেধে যাওয়ার পর থেকে পুজো বন্ধ হয়ে যায়।

বাড়িটা কবে তৈরি হয়েছিল?

ভদ্রলোক বললেন, তা বলতে পারি না। ঠাকুর্দা কিনেছিলেন জলের দরে, সেই বম্বিং-এর সময়ে।

সঞ্জয় কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, আচ্ছা, আগে তখন এই-সব জায়গা কিরকম ছিল? :

ভদ্রলোক হাঙ্গলেন। বললেন, আমি ঠিক বলতে পারব না।

সঞ্জয় একটু লজ্জিত হল। বলল, তা ঠিক। আপনি আর কি করে বলবেন? আসল কথা কি জানেন, এইরকম পুরনো বাড়ি দেখলে আমার কেমন কৌতূহল হয় এর অতীতকে জানার জন্যে।

ভদ্রলোক বললেন, সে-সব জানতে হলে বাবার কাছে চলুন।

সঞ্জয় একটু ইতস্তত করল। রুগীর কাছে. ডাক্তার একই সময়ে দু বার গেলে রুগী ঘাবড়ে যেতে পারে।

ভদ্রলোক বললেন, আপনি ভাববেন না। আমি বাবাকে বলে আসছি।

ভদ্রলোক ওপরে চলে গেলেন। একটু পরে এসে বললেন, আসুন।

বৃদ্ধ খাতির করে সঞ্জয়কে বসালেন। বললেন, আপনি কি এ বাড়িটা সম্বন্ধেই কিছু জানতে চান?

সঞ্জয় বলল, না, শুধু এ বাড়িটাই নয়। এরকম বোধ হয় আরো অনেক পুরনো বাড়ি আছে। এই ধরুন আমি যে বাড়িটায় ভাড়া আছি

–সেটা কোথায়?

যশোর রোডের ওপরে বাঙ্গুরের কাছে। সে বাড়িটাও খুব পুরনো। তিনতলা বাড়ি। তিনতলাটা ইনকমপ্লিট। ওপরে আবার একটা ভাঙা গম্বুজের মতো আছে।

বৃদ্ধ বললেন, পুরনো বাড়ি সম্বন্ধে আপনার কৌতূহল আছে জেনে খুব ভালো লাগল। কলকাতায় বিশেষ করে মারাঠা ডিচের ওপাশের জায়গাগুলো একশো-দেড়শ বছর আগে কী ছিল তা কল্পনাই করা যায় না। এ বিষয়ে আমি একজনের নাম জানি, গোটা উল্টোডিঙি এলাকার অর্থাৎ আজ যাকে বলে লেকটাউন, কালিন্দী, বাঙ্গুর, বরাট এ-সব জায়গার ঠিকুজি-কুষ্ঠী তাঁর কণ্ঠস্থ। তাঁর নাম শিবানন্দ ভট্টাচার্য। থাকেন বাগুইহাটিতে। বয়েস একশো তিন। ইচ্ছে করলে তার কাছে যেতে পারেন।

–একশো তিন বছর বয়েস! সঞ্জয় অবাক হল।

–হ্যাঁ, এখনো তেতলা-একতলা করেন। সারাজীবন জ্যোতিষচর্চা নিয়ে থেকেছেন- জপ-তপ-ব্রহ্মচর্য—-ওসব মশাই আলাদা স্তরের মানুষ। দাঁড়ান, ওঁর ছবি দেখাচ্ছি।

এই বলে ছেলেকে ইশারা করলেন। ভদ্রলোক তখনই ভেতরে চলে গেলেন। একটু পরেই ফিরে এলেন। হাতে জীর্ণ একটা খাম। বৃদ্ধ খাম থেকে জীর্ণতর বিবর্ণ একটা ফটোগ্রাফ বের করলেন।

–এই হলেন শিবানন্দ ভট্টাচার্য। আর তাঁর পদতলে আমি।

সঞ্জয় ছবিটা দেখল। পিছনে লেখা রয়েছে–পরম স্নেহাস্পদ শ্রীমান কপিলেশ্বর চৌধুরীকে মেহোপহার। নিচে তার স্বাক্ষর। সেই সঙ্গে ঠিকানা।

–ছবিটা আপনি নিয়ে যান। বয়েসের জন্যে ওঁর মেজাজটা এখন রুক্ষ হয়ে গেছে। যদি আপনি দেখা করতে যান তাহলে এই ছবিটা দেখিয়ে বলবেন আমি পাঠিয়েছি। তা হলে উনি বোধহয় আপনাকে ফিরিয়ে দেবেন না।

.

ছবিটা কাল রাত্তিরে আর বের করা হয়নি। বাইরের ঘরে ব্যাগের মধ্যেই ছিল।

ছবিটা রীণা খুব মনোযোগের সঙ্গে দেখছিল। সঞ্জয় চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বলল, কি এত দেখছ?

–এত বয়েস কিন্তু চোখ দুটো দ্যাখো যেন জ্বলছে। মনে হচ্ছে যেন ত্রিকালদশী কোনো সাধক।

বলতে বলতে রীণার দু চোখও যেন কেমন অস্বাভাবিক হয়ে উঠল।

সঞ্জয় অবাক হয়ে বলল, অমন করে দেখছ কেন?

–এঁকে কোথায় যেন দেখেছি। কোথায়

–এঁকে আবার দেখবে কি করে? বহুকাল কলকাতার বাইরে যাননি। তুমিও বড়ো একটা কলকাতায় আসনি।

রীণ কোনো উত্তর দিল না। হঠাৎ উঠে বিছানায় শুয়ে পড়ল।

কী হল?

–মাথার ভেতরটা কিরকম করছে!

১.২ আবার রহস্য

০৬. আবার রহস্য

আবার সেই নিঃসঙ্গ দুপুর।

সকালবেলায় সঞ্জয় চলে গেছে। তারপর রীণা পুপুকে স্নান করাল, খাওয়ালো, ঘুম পাড়াল। এক ফাঁকে নিজের নাওয়া-খাওয়াও সেরে নিল। সব চুকতে ঢুকতে বেলা একটা। এই পর্যন্ত বেশ কাটে। এর পরের চারটে ঘণ্টাই এখন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত দুপুরে একটু ঘুমোত কিংবা বন্দনার মায়ের সঙ্গে গল্প করত। কিন্তু এখন ঘুম তেমন আসে না। দোতলায় যেতেও ইচ্ছে করে না। বন্দনার মা মানুষটি খুবই ভালো। সরল সাদাসিধে। অনেক মহিলার যেমন পরের সংসারের ব্যাপারে অহেতুক কৌতূহল থাকে এঁর সেরকম কিছু নেই। যে যা বলে শুনে যান। নিজের সংসারের সাধারণ ব্যাপার অকপটে বলেন। তাই এঁকে ভালো লাগে। মনে প্যাঁচ নেই। কিন্তু ইদানীং তার কাছেও আর যাচ্ছে না। সঞ্জয় বলে দিয়েছে, সাবধান, ওসব কথা যেন বলে ফেলো না। রীণার ভয়, কথায় কথায় যদি বলে ফেলে।

ফলে দুপুরটা কাটানো এখন সমস্যা হয়ে উঠেছে। অবশ্য নতুন একটা অবলম্বন পেয়েছে শিবানন্দ ভট্টাচার্যের সেই ছবিখানা।

ইচ্ছে ছিল ওটা বাঁধিয়ে রাখবে। কিন্তু পরের জিনিস। হয়তো ফেরত দিতে হবে। তাই বাঁধাতে পারেনি।

না বাঁধালেও ছবিটা টেবিলের কাছে একটা তাকের ওপর রেখে রোজ দুপুরে ফুল-পাতা দিয়ে পুজো করে। কেন পুজো করে তা ও জানে না। তবে ওর কেমন মনে হয় এ মানুষ সাধারণ লোক নয়।

এই নিয়েও সঞ্জয় তাকে খুব ঠাট্টা করে। রীণা চুপ করে থাকে। পুরুষমানুষের সব কথায় কান দিলে চলে না।

কিন্তু নির্বাক ছবি নিয়েই বা কতক্ষণ ভুলে থাকা যায়? এক সময়ে শ্রান্তি আসে। তখনই আবার মনটা চঞ্চল হয়ে ওঠে।

আজও তেমনি হল। হঠাৎই একটা অস্থিরতা মনের ভেতর যেন কিরকম করছে। মনে হচ্ছে কিছু বুঝি ঘটতে চলেছে। বুঝি এখনই কারো জুতোর শব্দ পাওয়া যাবে সিঁড়িতে। কেউ বুঝি ভারী পা ফেলে ফেলে উঠে আসবে।

রীণা তখনই নিজেকে ঝটকা মেরে ঠিক করে নিতে চায়। এ সব কি আবোলতাবোল চিন্তা? কবে একদিন কী দেখেছিল সেই ভুলটাই শেষ পর্যন্ত পেয়ে বসল নাকি? শেষ পর্যন্ত একটা মানসিক ব্যাধির শিকার হয়ে দাঁড়াবে?

তখনই মনে পড়ল সেদিন রাত্তিরের ব্যাপারটা। সেটাও কি ভুল? সেটাও কি মানসিক বিকার?

ভাবতে ভাবতে রীণার হাত দুটো কিরকম ঠাণ্ডা হয়ে এল। কপালে চিনচিনে ঘাম। ও তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল।

সামনেই যশোর রোড। শে আষাঢ়ের মেঘলা আকাশ। বাস ছুটছে ঊর্ধ্বশ্বাসে। লোক হাঁটছে ফুটপাথ উপচে।

একটা নীল রঙের বাস চলে গেল। ওটা বোধহয় কোনো ইস্কুলের বাস। বাচ্চা ছেলেমেয়েদের কলকাকলি। আঃ! রীণা যেন নিশ্বাস নিয়ে বাঁচল। বাচ্চারাই সংসার ভরে রাখে, একমাত্র ওরাই পারে শোক-দুঃখ ভুলিয়ে দিতে। তার পুপুসোনাও একদিন এমনি করে বাসে চেপে ইস্কুলে যাবে।

এমনি সময়ে দরজায় শব্দ হলো–টুক-টুক। কে যেন অতি সন্তর্পণে দরজার কড়া নাড়ছে। রীণা চমকে উঠল।

কে? বলে সাড়া দিতে গেল। কিন্তু প্রথমে গলা থেকে স্বর বেরোল না।

তারপর অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ আর্তস্বরে চেঁচিয়ে উঠল–কে?

–আমি বন্দনা।

তাও ভালো। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল হঠাৎ বদনা কেন? ও তো বড়ো-একটা ওপরে আসে না। তবে কি কোনো ফোন–কোনো খারাপ খবর

রীণা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল।

–আপনার চিঠি।

চিঠি। চিঠি আবার এখানে কে দেবে? কেন দেবে?

চিঠি নিতে গিয়ে হাত কেঁপে উঠল।

–কার চিঠি?

কথাটা স্বগতোক্তি। কিন্তু বন্দনার মনে হল যেন তাকেই জিজ্ঞেস করছে। সে অবাক হয়ে রীণার দিকে একবার তাকাল। তারপর নিচে নেমে গেল।

এবার চিঠি খোলার পালা। কিছুতেই আর রীণা চিঠিটা খুলতে পারছিল না। কেবলই মনে হচ্ছিল কে লিখেছে? কী লিখেছে?

শেষ পর্যন্ত চিঠিটা খুলল। প্রথমেই দেখে নিল নামটা।–ও মান্তু! বাবাঃ। যা ভয় করেছিল।

চিঠিটা নিয়ে দরজা বন্ধ করে বিছানায় এসে বসল।

ভাই রীণা,
তোর চিঠি পেয়ে কী যে খুশি হয়েছি তা লিখে বোঝাতে পারব না।
কিছুদিনের জন্যে আমরা সকলে পুরী বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেইজন্যে চিঠির উত্তর দিতে দেরি হয়ে গেল। জানি আমার এই অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্যে কিছু মনে করবি না।
যাক, শেষ পর্যন্ত তুই কলকাতায় এলি। অনেক দিন পর আবার আমাদের দেখা হবে। অনেক গল্প জমে আছে।
কিন্তু তোর চিঠির শেষ দিকটার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারলাম না। কলকাতার মতো জায়গায় নির্জন দুপুরে কিসের এত ভয়? এ তো আর আমাদের দেশের বাড়ি নয়! তবু তো বাঙ্গুরের মতো জায়গায় চট করে বাড়ি পেয়ে গেছিস। ভাগ্য ভালো বলতে হবে।
একটা ভয় অবশ্য আছে, চোর-ডাকাতের। তার চেয়েও ভয় ঠগ-জোচ্চোরদের। কত ছুতো করেই-না ওরা বাড়ি বাড়ি ঢোকে। এসব ভয় এখন সব জায়গাতেই। খুব সাবধান। দরজা সব সময়ে বন্ধ করে রাখবি। সাড়া না নিয়ে দরজা খুলবি না। দরজায় আই-হোল নেই? না থাকলে ব্যবস্থা করে নিবি।
হ্যাঁ, তারপর লিখেছিস ম্যাজিক দেখতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলি। সেটা নিশ্চয় স্বাভাবিক কোনো কারণে। হয়তো তোর লো প্রেসার আছে। কিংবা অন্য কিছু। সে তো ভালো বলতে পারবে তোর নিজের ডাক্তার।
ছোটোবেলায় ম্যাজিক দেখতে গিয়ে নররাক্ষসের কথা হঠাৎ এতদিন পর মনে পড়ল কেন? নররাক্ষসের খেলা তো আমিও দেখেছিলাম। সত্যিই বীভৎস খেলা…

এই পর্যন্ত পড়েই রীণা আর পড়তে পারল না। শরীরটা কিরকম করে উঠল। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল।

.

সেই দিনই

মাঝরাতে হঠাৎ পুপু কেঁদে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে চমকে জেগে উঠল রীণা। এ সেই কান্না। যেন কিছুতে কামড়েছে।

রীণা তাড়াতাড়ি পুপুকে বুকে টেনে নিল। মায়ের বুকে নির্ভয় আশ্রয়ে থেকে কান্নাটা একটু কমল কিন্তু একেবারে থামল না।

রীণা পুপুকে চাপড়াতে চাপড়াতে ঘুম পাড়াতে লাগল বটে কিন্তু কান ছিল সজাগ। প্রতি মুহূর্তে একটা কিছুর প্রতীক্ষা।

কিসের প্রতীক্ষা?

একটু পরেই সেই শব্দ! নিচে কোথায় যেন কার ঘরের দেওয়ালে কে পেরেক পুঁতছে ঠকঠকঠক্‌–

ক্রমশ সেই শব্দটা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠল। কে যেন পেরেক নয়–কিছু একটা পুঁততে পুঁততে ওপরে উঠে আসছে।…

তারপরেই সব চুপ।

কিন্তু মিনিট পাঁচেক পরেই পরিষ্কার শুনতে পেল জুতোর শব্দ। বাইরের বন্ধ দরজার কাছে এসে শব্দটা থামল। সঙ্গে সঙ্গে পুপু আবার চিৎকার করে কেঁদে উঠল।

আজ কিন্তু রীণা এতটুকু আত্মহারা হয়ে যায়নি। পুপুর এই যে কান্না এটা যে স্বাভাবিক নয় তা সে বুঝে নিয়েছে। যে এসেছে তার সঙ্গে এই কান্নার যোগ আছে। সে এও জানে বাইরে যে এসে দাঁড়িয়েছে বাইরে থেকেই সে চলে যাবে না। সে ভেতরে আসবেই।

রীণা তাই পুপুর কান্না শুরু হওয়ার পর থেকেই প্রতিটা মুহূর্ত অনুভব করতে পারছিল।

এবার রীণা দুরু দুরু বুকে ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকাল। অন্ধকার বাইরের ঘরে প্রথমেই যেটা নজরে পড়ল সেটা হচ্ছে দুটো জ্বলন্ত চোখ। অন্ধকারে ভাসছে।

রীণা চেঁচাল না–কিংবা চেঁচাতে পারল না। এক হাতে পুপুকে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে অন্য হাতে বিছানার চাদর শক্ত করে চেপে রইল।

রীণা দেখছে তো দেখছেই। সেই জ্বলন্ত চোখ দুটো থেকে নিজের চোখ সরিয়ে নেবার উপায় নেই।

একটু পরেই অন্ধকারের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম শরীর ভেসে উঠল। ক্রমে সেই শরীরের ওপর দেখা দিল কোট প্যান্ট। কালো পোশাকটা অন্ধকারে যেন মিশে ছিল। এতক্ষণে ফুটে উঠল। …।

এই অবস্থাতেও–আশ্চর্য রীণা তুলনা করছিল আগের রাতে দেখার সঙ্গে আজকের এই দেখা। সেদিন যেন সবই বড়ো তাড়াতাড়ি। সবই যেন অতর্কিতে। আর আজ? আজ যা ঘটছে সব ধীরে ধীরে সময় মেপে মেপে।

কিন্তু এ দেখাও কি চোখের ভুল?

না, সে স্বপ্ন দেখছে না। জেগে আছে। এই তো পুপু বুকের মধ্যে মুখ গুঁজেও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এই তো মশারি টাঙানো। মেঝেতে মশারির মধ্যে পুপুর বাবা শুয়ে। ঐ তো রাস্তায় শরীর শব্দ…কোনোটাই তো ভুল নয়। তাহলে?

হঠাৎই দেখল মূর্তিটা টেবিলের কাছে পাক খাচ্ছে। এক বার, দুবার, তিন বার। তারপরেই জ্বলন্ত চোখ দুটো শূন্যে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে আসতে লাগল। রণা আর চুপ করে থাকতে পারল না। চিৎকার করে উঠল–ওগো! শু-ন-ছ–

ধড়মড় করে উঠে বসল সঞ্জয়।

–আঁ, কি হয়েছে?

–আবার এসেছে-আবার এসেছে।

বলতে বলতে রীণা কেঁদে উঠল। পুপুও ঠিক তখনই ককিয়ে কাঁদতে লাগল।

মুহূর্তমাত্র।

সঞ্জয় টর্চ হাতে মশারি তুলে বাইরের ঘরে ছুটে গেল। সুইচ অন করার সময়ও পেল না।

অন্ধকারের মধ্যে ডাক্তারের হাতের পাঁচ ব্যাটারির টর্চের আলো ছিটকে পড়ল।

-না, কেউ কোথাও নেই।

এবার সঞ্জয় সব ঘরের সুইচ অন করে দিল। দুখানা ঘর আলোয় ভরে গেল। দেখা গেল দরজা যেমন ভেতর থেকে বন্ধ ছিল তেমনই বন্ধ রয়েছে।

কই? কোথায় কে? বিরক্তির সঙ্গে বিদ্রূপ ঝলকে উঠল সঞ্জয়ের গলায়। রোজ রোজ এইভাবে Scene create করবে? ঘুম নষ্ট তাছাড়া লোকেই বা কী বলবে? তোমার বোঝা উচিত

রীণা শুধু ক্লান্ত স্বরে বলল–ও এসেছিল গো–সত্যিই এসেছিল। তুমি বিশ্বাস করো। উঃ! বুকের মধ্যে এখনো কিরকম করছে।

বলতে বলতে রীণা হঠাৎ মেঝেতে শুয়ে পড়ল।

কী হল? রীণা-রীণা—

রীণার বুকের ভেতর থেকে একটা ঘড়ঘড়ে স্বর বেরিয়ে এল। তারপর সঞ্জয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কি যেন ইশারা করল।

সঞ্জয় তাড়াতাড়ি কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে নিয়ে এল। রীণা কোনোরকমে সঞ্জয়কে আঁকড়ে ধরে উঠে বসে গেলাস নিঃশেষ করে জল খেল। তারপর দেহ এলিয়ে খনখনে গলায় বলল, আমি মরে যাব। ও আমাকে মারবে। বেশ বুঝতে পারছিলাম লোকটা চোখে ইশারা করে আমাকে ডাকছিল। আমি জানি ওটা হচ্ছে মরণডাক। আমাকে বোধহয় মরতে হবে।

সঞ্জয় ধমক দিয়ে বলল, কী যা তা বকছ! এরকম করলে কালই তোমায় হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে আসব।

–তোমার যা ইচ্ছে তাই করো, যেখানে খুশি পাঠাও, আমি এখানে আর টিকতে পারব না।

–বেশ, তাই হবে। এখন বলো তো ঠিক কি দেখেছিলে।

সঞ্জয় একটা সিগারেট ধরাল।

রীণা সব ঘটনা বলে গেল।

ধৈর্য ধরে সঞ্জয় সব শুনে গেল। কথার মধ্যে নিজে একটি কথাও বলেনি।

রীণার কথা শেষ হলে বলল, টেবিলের কাছে ঘুরছিল?

-হ্যাঁ। টেবিল থেকে দেওয়াল। একবার মনে হল যেন দেওয়ালের মধ্যে মিশে গেল। তারপরেই দেখি আবার বেরিয়ে এসেছে। তারপরেই আমার দিকে চোখের ইশারা করতে করতে তাড়া করে এল।

শেষের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে সঞ্জয় শুধু জিজ্ঞেস করল, আগের দিনও টেবিলের কাছে ঘুরছিল না?

হ্যাঁ

আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। নিঃশব্দে পায়চারি করতে লাগল।

দুটো ঘরেই এমনকি বাথরুমেও আলো জ্বলছিল। ভাড়াটেদের ঘুম ভেঙে থাকলে হয় তো ছুটে আসবে। সঞ্জয় তাই তাড়াতাড়ি সব আলো নিভিয়ে দিল। অন্ধকারে শুধু জ্বলতে লাগল সঞ্জয়ের সিগারেটের আগুন।

মনে মনে বলল, নাঃ, একেবারে Psychopathic Patient হয়ে গেল! একই জনকে একজনেই প্রায় দেখছে। অথচ আমি দেখতে পাচ্ছি না। শেষ পর্যন্ত কি আমাকে অলৌকিক কিছুতে বিশ্বাস করতে হবে?

পরের দিন সকালে বেশ একটু বেলাতেই ঘুম ভাঙল সঞ্জয়ের। দেখল রীণা তখনো ঘুমোচ্ছ। জানলা দিয়ে রোদ এসে পড়েছে মশারির ওপর। এত বেলা পর্যন্ত রীণা কখনো ঘুমোয় না।

কিন্তু এই কি ঘুমন্ত চেহারা?

মেয়েদের স্বাভাবিক ঘুমের মধ্যেও একটা সুন্দর আকর্ষণী শক্তি থাকে। শোয়ার ভঙ্গিটি, শরীর জড়িয়ে শাড়ির বিন্যাস, শান্ত স্নিগ্ধ মুখের ওপর বন্ধ চোখের নিবিড় পাতা দুটি–কেমন যেন মোহ সৃষ্টি করে। গভীর রাতে এই রীণাই যখন ক্লান্ত, পরিতৃপ্ত হয়ে ঘুমোয় তখন কতদিন সঞ্জয় অন্ধকারে টর্চের আলো ফেলে নিঃশব্দে লোভীর মতো দেখেছে। আত্মপ্রসাদ লাভ করেছে।

আর আজ? সেই রীণাই ঘুমোচ্ছ। কিন্তু পাণ্ডুর মুখের ওপর কিসের যেন ছায়া। হঠাৎ দেখলে মনে হবে রীণা যেন তার দেহটা ফেলে কোথায় কত দূরে চলে গেছে।

সঞ্জয়ের বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। ঠিক করল আজই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে ডাঃ রুদ্রের সঙ্গে পরামর্শ করবে।

পুপু তখন জেগে। বিছানায় শুয়ে বেচারি একাই খেলা করছিল। তাকে একটু আদর করে সঞ্জয় মুখ ধুতে গেল।

মুখ ধুয়ে এসে চায়ের জল চড়িয়ে দিল। পুপুর জন্যেও দুধ তৈরি করল।

বেলা যখন সাড়ে আটটা-সঞ্জয় যখন হাসপাতালে যাবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে, তখন রীণা আলিস্যি ভেঙে পাশ ফিরল।

ঘুম ভাঙল? আজ বেশ অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছ। বলে সঞ্জয় এক পেয়ালা চা নিয়ে এল।

–ইস্! কত বেলা হয়ে গেছে! বলে রীণা ধড়মড় করে উঠে বসল।

–চা তুমি করলে?

তাছাড়া আর কে করবে? ভূতে আর যাই পারুক চা করতে পারে না। দ্যাখো, চিনি ঠিক হয়েছে কি না।

রীণা ধীরে ধীরে গরম চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিল।

–তোমার আজ দেরি হয়ে যাবে। আমি এখুনি যাচ্ছি।

সঞ্জয় কাছে বসে একটা সিগারেট ধরাল। বলল, ব্যস্ত হবার কিছু নেই। আমি এদিকের সব গুছিয়ে নিয়েছি। তুমি বরং হাত মুখ ধুয়ে আর একটু শুয়ে থাকো।

–হ্যাঁ। শরীরটাও যেন কেমন লাগছে।

–ও কিছু নয়। রাত্তিরে একটা ধকল গেছে। স্নানটান করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

কী জানি? বলে চোখ নিচু করে অন্যমনস্কভাবে চা খেতে লাগল।

আধ ঘণ্টা পরে নিচে নেমে সঞ্জয় একবার এদিক ওদিক দেখল। নাঃ, ভাড়াটেরা কেউ চড়াও করতে আসছে না। তখনকার মতো নিশ্চিন্ত হয়ে হাসপাতাল রওনা হলেও মনে মনে অস্বস্তি থেকেই গেল। বিকেলে নিশ্চয় ওরা এসে বলবে, কাল রাত্তিরেও আপনার ঘরে গণ্ডগোল হচ্ছিল ডাক্তারবাবু!

সঞ্জয়ের মনটা কুঁকড়ে গেল। সত্যি! রোজ রাত্তিরে রীণা যা কাণ্ড করতে আরম্ভ করেছে!

বিকেলে সঞ্জয় কম্পাউন্ডের মধ্যে ঢুকল চোখ কান বুজে। না তাকিয়েও বুঝতে পারছিল মহিমাবাবু-বিভূতিবাবুরা রোজকার মতো লোহার বেঞ্চিতে পা তুলে বসে গল্প করছে। বোধহয় তাকে দেখেছে। তারপর এখনই হয়তো মধুর সম্ভাষণ করবে—ডাক্তারবাবু, নমস্কার। ভালো আছেন তো?

সেই সম্ভাষণটুকু কানে পৌঁছবার আগেই সঞ্জয় মুখ নিচু করে হহ করে সিঁড়িতে গিয়ে উঠল।

যাক, আজকের মতো ফাঁড়া কাটল।

সঞ্জয় জোরে জোরে পা ফেলে ওপরে উঠতে লাগল। রীণা কেমন আছে? আজ দুপুরে আর ভয় পায়নি তো?

ফেরার পথে ডাক্তার রুদ্রের সঙ্গেও দেখা করে এসেছে। উনি ঠিকই বলেছেন–অ্যাডজাস্ট করার স্বাভাবিক শক্তির অভাব থেকেই এটা হচ্ছে। মফস্বল থেকে শহরে কিংবা শহর থেকে মফস্বলে নতুন পরিবেশে এসে পড়লে সে পরিবেশ যদি মনের মতো না হয় তা হলে বিশেষ করে মেয়েদের নার্ভের ওপর চাপ পড়ে। তা থেকেই এইরকম অনেক কিছু হয়। পরে জায়গাটা অভ্যস্ত হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যায়।

–কিন্তু বাড়িটা তো ওর প্রথম থেকেই পছন্দ হয়েছিল।

ডাক্তার রুদ্র হেসেছিলেন। ওটা তোমাকে খুশি করার জন্যে।

সঞ্জয় চুপ করে ছিল। কথাটা তার মনঃপূত হয়নি।

ওপরে দরজার মুখেই পুপুকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল রীণা।

–কেমন আছ?

রীণা তার উত্তর না দিয়ে একটু ভারী গলায় বলল, কম্পাউন্ডে ঢুকে ওপরে তাকালে না যে?

কথাটার মানে সঞ্জয় প্রথমে বুঝতে পারেনি। যখন বুঝল তখন মনে মনে খুশিই হল। অনেকদিন পর যেন সেই কুমারী রীণাকে দেখছে। সে-সব সময়ে নবদ্বীপে মামার বাড়ি এলে রীণার সঙ্গে একদিনও চোখের দেখাটুকু না হলে চলত না। মফস্বল শহরে খুব স্বাভাবিক কারণেই রীণার বাড়িতে এই অনাত্মীয় যুবকটির কারণে-অকারণে যাওয়া, গল্প করার কিছুটা বাধার সৃষ্টি হয়েছিল। অগত্যা রাস্তার ধারে দোতলার জানলায় দাঁড়িয়ে থাকতে হতো রীণাকে। কখন সঞ্জয় রাস্তা দিয়ে যাবে।

ওই রাস্তা দিয়েই যখন-তখন কারণে-অকারণে সঞ্জয়কেও যেতে-আসতে হতো। তখনই হতো মিষ্টি হাসি-বিনিময়ের সঙ্গে চার চক্ষের গোপন মিলন। নিরুপায় নীরব প্রেমের এই মুষ্টি-ভিক্ষাটুকুই তখন ছিল যথেষ্ট।

একদিন ঠিক ঐ বিশেষ মুহূর্তেই সামনে এসে পড়েছিল পাড়ার চক্রবর্তীমশাই। সঞ্জয় ওপরের দিকে আর তাকাতে পারেনি।

পরের দিন গঙ্গায় স্নান করতে গিয়ে মুহূর্তের জন্যে রীণার সঙ্গে নিরিবিলিতে দেখা হয়েছিল। সঞ্জয় স্বভাবমতো হেসেছিল। রীণা কিন্তু হাসেনি। অভিমানক্ষুব্ধ স্বরে শুধু বলেছিল–কাল তাকালে না যে বড়ো?…

এ-সব অনেক দিনের কথা। তখন রীণা স্কুলে পড়ছে। সঞ্জয় পড়ছিল ডাক্তারি। সেই রীণা বহুদিন পর আজ সেই একই সুরে জিজ্ঞেস করল, ওপরে তাকালে না যে?

সঞ্জয় হেসে বলল, তাকাবার ফুরসত পেলাম কই? নিচে তখন মহিমাবাবুরা আমাকে পাকড়াবার তালে। ধরতে পারলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করত, ডাক্তারবাবু, কাল রাত্তিরে আপনার ঘরে কিসের চেঁচামেচি হচ্ছিল? আগের দিন বেড়ালের ওপর দোষ চাপিয়েছি। আজ আর হাতের কাছে তেমন কিছু খুঁজে পেতাম না। তাই অধোবদনে কোনোরকমে পালিয়ে এসেছি।

বলেই রীণার কোল থেকে পুপুকে কেড়ে নিল।

রীণার মুডটা ভালো দেখে সঞ্জয় খুশি হয়েছিল। কিন্তু তার এমন সরস বাচনভঙ্গী শুনে রীণা না হেসেই রান্নাঘরে চলে গেল। সঞ্জয়ের ঠিক ভালো লাগল না।

চা-জলখাবারের পাট চুকল একরকম নিঃশব্দেই। মন-মেজাজ ভালো থাকলে এই সময়ে রীণা বেশ গল্প করে। ও একাই বকে যায়। শ্রোতাকে শুধু মাঝে-মধ্যে হু হা বলে সাড়া দিয়ে গেলেই হল। সেটাও খারাপ লাগে না।

কিন্তু আজ কেমন ব্যতিক্রম। রীণার হঠাৎ এরকম বাংযম দেখে সঞ্জয় অবাক হল।

কথা না বললেও রীণার মুখে কিন্তু এক টুকরো হাসি লেগেই ছিল। গল্প করছিল না, কিন্তু পুপুকে আদর করার মাত্রাটা একটু অস্বাভাবিক হচ্ছিল। আদরের সঙ্গে হাসি। শিশুর সঙ্গে এই রকম হাসির অর্থ কী? এই হাসির অন্য মানে আছে। এ একরকম উপেক্ষা।

রীণার এই উপেক্ষা-নীতির সঙ্গেও সঞ্জয়ের পরিচয় ছিল।

মান্তু রীণার বন্ধু। নবদ্বীপে একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়ত। সঞ্জয়ের মামা থাকত রীণাদের বাড়ির কাছাকাছি। সঞ্জয় মাঝেমাঝেই মামার বাড়ি নবদ্বীপে আসত। এই আসা-যাওয়ার সুযোগেই রীণা আর রীণার বান্ধবীটির সঙ্গে আলাপ, ঘনিষ্ঠতা।

বাড়িতে কথা বলার সুযোগ হতো না। তাই রীণাই একদিন সঞ্জয়কে মান্তুর বাড়ি যাবার জন্যে বলেছিল।

রীণা গিয়েছিল যথাসময়ের অনেক আগে। সঞ্জয়ের যেতে দেরি হয়েছিল। এই হলো তার অপরাধ! ব্যাস! শ্রীমতী রীণা হলেন ভীষণ ক্রুদ্ধ। রাগটা অবশ্য মুখে প্রকাশ করল না। করল বিচিত্রভাবে। চৌকিতে বসে দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে অনর্গল কথা বলে গেল মান্তুরই সঙ্গে। সামনে যে আর একজন বসে আছে যাকে নাকি বিশেষ করে ডেকে আনা হয়েছে–তাকে যেন চিনতেই পারল না।

রীণার আজকের আচরণটাও অনেকটা সেইরকম। সঞ্জয় যেন কেউ না।

-কী ব্যাপার? আজ যে আমার সঙ্গে বড়ো কথা বলছ না? রীণার মুখে ফুটে উঠল আবার বিচিত্র হাসি।–আমি রুগী, তুমি ডাক্তার। ডাক্তারের সামনে রুগীকে রুগীর মতোই থাকতে হয়। তাই না? কথাগুলো রীণা বলল যেন দাঁতে কেটে কেটে।

যা বাবাঃ! আজ হল কী?

–হাসপাতালে–মানে মেন্টাল হসপিটালে কোনো বেডটেডের ব্যবস্থা করতে পারলে নাকি?

রীণার কথায় যেন বিদ্যুৎ ঝলকে উঠল।

সঞ্জয় অবাক হয়ে বলল, কার জন্যে?

–সে কি! এরই মধ্যে ভুলে গেলে? তোমার স্ত্রীর জন্যে গো! যার মাথার ব্যামো হয়েছে, নার্ভ ফেল করে। বলেই পুপুকে রেখে রীণা হঠাৎ উঠে চলে গেল।

এক-একটা সময়ে এই-সব মান-অভিমান স্বামীদের ভালোই লাগে। কিন্তু তাই বলে সারাদিন পরিশ্রমের পর বাড়ি ফিরে এই মানসিক কসরৎ আর ভালো লাগে না।

সঞ্জয় একটু রাগ করেই পুপুকে কোলে তুলে নিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোল।

–কোথায় যাচ্ছ?

–পুপুকে নিয়ে একটু ঘুরে আসি।

–এই সন্ধেবেলায়?

–কি করব? রুগীর সামনে বসে থাকতে থাকতে সুস্থ মানুষও রুগী হয়ে যায়।

রীণা আবার একটু হাসল। সেই কেমন-কেমন হাসি। নিচে যাবে তো? কিন্তু মহিমাবাবুরা এখনও বসে আছেন।

–মাই গড! সঞ্জয় এক লাফে সিঁড়ি থেকে ঘরে এসে ঢুকল।

কফি খাবে?

–আবার কষ্ট করে করবে?

–আমিও খাবো। বলেই রীণা চলে গেল।

বেশ কিছুক্ষণ পর দু কাপ কফি নিয়ে এসে বসল। একটা কাপ যেন একটু অতিরিক্ত যত্নে সঞ্জয়ের দিকে এগিয়ে দিল। চোখাচোখি হল।

তখন থেকে তুমি অমন ঠোঁট টিপে টিপে হাসছ কেন বলো তো।

রীণা হেসেই বলল, বাঃ রে! রুগী বলে কি হাসতেও মানা নাকি?

–তা নয়। হাসিটা যেন কেমন-কেমন লাগছে।

রীণা চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে উদাস সুরে বলল, তা হবে। মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণ।

কফিতে আরাম করে একটা চুমুক দিয়ে সঞ্জয় সিগারেট ধরাল।

না, ও হাসি আর যাই হোক মাথা খারাপের লক্ষণ নয়।

তবে? রীণা খুব হালকা করে কফিতে চুমুক দিল।

–মনে হয় তুমি কিছু বলতে চাইছ। এমন-কিছু যা শুনে আমি অপ্রস্তুতে পড়ি।

–ও মা! সে কী কথা! ইস্! কফিতে চিনি কম হয়েছে। আমার সত্যি মাথার ঠিক নেই। বলে রীণা হঠাৎই উঠে গেল। তারপর বেশ একটু দেরি করে সুগার-পটটা এনে টেবিলে রাখল। তা থেকে সামান্য একটু চিনি তুলে কফিতে মিশিয়ে নিয়ে বলল, তুমি ডাক্তারমানুষ! তোমায় আমি অপ্রস্তুতে ফেলতে পারি? না হয় আমি মানসিক রুগীই। তা বলে নিজের স্বামীকে অপ্রস্তুতে ফেলা। ছিঃ!

সঞ্জয়ের পক্ষে ধৈর্য ধরা অসম্ভব হয়ে উঠল। বলল, দোহাই তোমার। আর রহস্য কোরো না। ব্যাপারটা কি আমায় খুলে বলো।

ব্যাপার আবার কি? যথা পূর্বং তথা পরম্।

–সারা দুপুর কি করলে?

রীণা আবার একটু হাসল।–অ-নে-ক কাজ। তুমি চলে গেলে দরজায় ভালো করে খিল দিলাম। তারপর পুপুকে চান করালাম, খাওয়ালাম। নিজে চান করলাম, খেলাম। একটু ঘুমোলাম।

–ঘুম হল?

—হু-উ। বলে আদুরে মেয়ের মতো মাথা দোলাল। তারপর ঘুম থেকে উঠে ট্রানজিস্টারটা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করলাম।

–ভয়টয় পাওনি তো?

–ভয়? কি জানি। মনে নেই।

–ভেরি গুড! মনে না থাকাই ভালো।

–ততক্ষণে পুপু উঠে পড়েছে। ওকে নিয়ে ঘরে তালা দিয়ে দোতলায় গেলাম। বন্দনার মায়ের সঙ্গে একটু গল্পও করলাম। তারপর ওপরে এসে জলখাবার করতে বসলাম। জলখাবার হয়ে গেলে পুপুকে নিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর তুমি এলে। ব্যস্! আমার কথাটি ফুরল, নটে গাছটি মুড়ল। ও হ্যাঁ, এর মধ্যে মান্তুকে একটা চিঠিও লিখলাম।

–কি লিখলে?

–সে-সব আমাদের প্রাইভেট কথা। তোমায় বলব কেন? বলে কফির পেয়ালাটা সরিয়ে রাখল।

–অবশ্য তোমার কথাও ছিল। হাসপাতালের ডিউটির পর পেশেন্ট দেখতে গিয়েছিলে। মহিলা পেশেন্ট বোধহয়, নইলে রাত নটা পর্যন্ত থাকবে কেন? বুক, পেট, তলপেট ভালো করে দেখতে হয়েছিল তো।

-ইস! এইসব বাজে কথা লিখেছ?

–হু-উ। তারপর লিখেছি, কে একজন তোমাকে একটা বুড়োর ছবি দিয়েছিল। সেই ছবির কথাও লিখেছি। সাংঘাতিক চোখ, যেন ত্রিকালদর্শী তান্ত্রিক!

–সেই ছবিটা পুজো করছ লিখেছ নাকি?

–ইস্! অ্যাসট্রে রয়েছে তবু কাপে ছাই ফেলছ! কী যে বদ অভ্যেস! বলে তাড়াতাড়ি কাপটা সরিয়ে নিল।

–সরি।

-হ্যাঁ, পুজো করছি, ফুলের মালা পরাচ্ছি সবই লিখেছি। বন্ধুর কাছে কিছুই লুকনো উচিত নয়।

–তা বেশ করেছ। কিন্তু ছবিটা নিয়েও তুমি একটু বাড়াবাড়ি শুরু করেছ। কি এমন আছে ছবির মধ্যে?

–তা দেখার চোখ তোমার নেই। থাকলে একথা বলতে পারতে না।

–ছবিটা নিয়ে এসো তো। ভালো করে দেখি. একবার।

–কি হবে দেখে?

–নিয়েই এসো না।

রীণা চেয়ারে দুপা তুলে হাঁটুর মধ্যে মুখ লুকলো।

–তুমি নিয়ে এসো।

–আমি ছুঁলে ছবিটা অশুদ্ধ হবে না তো? বলে সঞ্জয় হাসতে হাসতে উঠে গেল। রীণা কোনো উত্তর দিল না। হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে বসে রইল।

বাইরের ঘর থেকে সঞ্জয় জিজ্ঞেস করল, ছবিটা কোথায়?

রীণা উত্তর দিল না।

–এই শুনছ? ছবিটা তো তুমি তাকের ওপর রেখেছিলে। দেখছি না তো।

–তাহলে নেই।

–নেই মানে? অন্য কোথাও রেখেছ?

–জানি না।

সঞ্জয় যেন হোঁচট খেল–জানি না মানে?

রীণা এবার চেয়ার থেকে নেমে ধীরে ধীরে বাইরের ঘরে গেল–বলো কী বলছ?

–ছবিটা কোথায় গেল?

রীণা উত্তর না দিয়ে স্থিরদৃষ্টিতে সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, ওটা আর পাওয়া যাবে না। হারিয়ে গেছে।

সঞ্জয় অবাক হয়ে বলল, হারিয়ে গেছে মানে?

রীণা ধীর স্থিরভাবে বলল, হারিয়ে গেছে মানে হারিয়েই গেছে।

–অসম্ভব। আগের দিন ছবিটা তাকের ওপর রাখলে, এরই মধ্যে হারিয়ে গেল? আর হারাবেই বা কোথায়?

রীণা গম্ভীর গলায় বলল, তাহলে চুরি গেছে।

–চুরি! কে চুরি করল? বাড়িতে কে-ই বা আসে? কেনই-বা চুরি করবে? রীণা হালকা মেজাজে টেবিল থেকে ট্রানজিস্টারটা তুলে নিয়ে কাটা ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, গেলাসটা সেদিন কে ভাঙল? কি করে ভাঙল?

সঞ্জয় যেন অন্ধকারে চলতে চলতে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে থমকে গেল।

মিনিট কয়েক দুজনেই চুপচাপ। তারপর রীণা ট্রানজিস্টারটা রেখে দিয়ে যেন আপন মনেই বলল, শুধু একটা গেলাস ভাঙা বা ছবি চুরি যাওয়া নয়। আরো কিছু যাবে। তার মধ্যে আমার প্রাণ একটি। অবশ্য তাতে তোমার কিছু এসে যাবে না। পুপুটারই কষ্ট হবে।

বাজে কথা ছাড়ো তো। ছবিটা কি সত্যিই কেউ নিল?

-আমায় জিজ্ঞেস করছ? রীণা এবার পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে সঞ্জয়ের দিকে তাকাল।

–হ্যাঁ হ্যাঁ তোমাকে। তুমি ছাড়া এখানে আর কে আছে?

–তাহলে আমি বলছি–হ্যাঁ, ছবিটা সত্যিই কেউ নিল। যে নিতে এসেছিল সে নিয়ে গেল।

–কিন্তু কেন নিয়ে গেল?

রীণার ঠোঁটের কোণে একটু হাসি। –কে নিয়ে গেল ভাবছ না?

সঞ্জয় কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, না হয় ধরেই নিলাম ভূতে নিয়েছে। কিন্তু কেন? এত জিনিস থাকতে শিবানন্দর ছবিটার ওপরই তেনার দৃষ্টি পড়ল!

রীণা বলল, তুমি বোধহয় ভুলে যাওনি আমি বলেছিলাম–আগের দিনও সে টেবিলের কাছে ঘুরছিল। অসাবধানেই হোক বা ভয় দেখাবার জন্যেই হোক সেদিন গেলাসটা ভেঙেছিল।

এই পর্যন্ত বলে রীণা একটু থামল। সঞ্জয়ও চুপ করে রইল।

–তুমি কি বলতে চাইছ সেদিনও ছবিটা নেবার জন্যেই এসেছিল।

–হ্যাঁ।

–নিল না কেন?

–বোধহয় ওটা টেবিলে বা টেবিলের কাছে ছিল না।

–হ্যাঁ, ওটা ভুল করে ব্যাগেই থেকে গিয়েছিল।

সঞ্জয় আবার কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বিরক্ত হয়ে বলল, বেশ। না হয় প্রেতাত্মাটি ছবিটার জন্যেই এসেছিল। কিন্তু কেন? নিশ্চয় বৃদ্ধের প্রেমে পড়েনি?

রীণা কষ্টে একটু হাসল। বলল, এখনো রসিকতা করতে পারছ! ভাবতে পারছ না, কী সর্বনাশ এগিয়ে আসছে।

সঞ্জয় হাসল না। বলল–আমি যা জানতে চাইলাম ওটা তার উত্তর হল।

রীণা বলল, ঠিক উত্তর আমিই বা কি করে জানব?

–আচ্ছা, ছবিটার পেছনে কি যেন লেখা ছিল? সঞ্জয় জিজ্ঞেস করল।

–পরম স্নেহাস্পদ শ্রীমান কপিলেশ্বর চৌধুরীকে স্নেহোপহার।

–আরও যেন কিছু লেখা ছিল মনে হচ্ছে।

–হ্যাঁ, শিবানন্দর স্বাক্ষর।

—-আর কিছু ছিল না?

—-ছিল। শিবানন্দ ভট্টাচার্যর ঠিকানা।

সঞ্জয় হঠাৎ বলে উঠল তাহলে কি ঠিকানার জন্যেই? কিন্তু ঠিকানা নিয়ে ও কি করবে? শিবানন্দর সঙ্গে দেখা করবে! বলে একটু হাসবার চেষ্টা করল।

রীণা শান্ত গলায় বলল–অন্যরকমও হতে পারে। তুমি যেন দেখা করতে না পার।

সঞ্জয় বিছানায় একটা ঘুষি মেরে বলল–দেখা করি এটাই বা চায় না কেন? তোমার ঐ প্রেতাত্মাটির সঙ্গে শিবানন্দর সম্পর্ক কী?

রীণ কোনো কথা বলল না। একটা রহস্যময়ী ছায়ার মতো ধীরে ধীরে নিঃশব্দে ভেতরের ঘরে চলে গেল।

.

০৭.

ঝড় হাওড়ার পঞ্চাননতলা-কদমতলার মধ্যে ক্ষীরোদতলা। মনেই হয় না এটা কলকাতার লাগোয়া জায়গা। জীবন এখানে ধীরে-সুস্থে, জিরিয়ে, ঢিমেতালে চলেছে। বাসিন্দারা সকলেই প্রায় সকলের পরিচিত।

এই ক্ষীরোদতলাতেই একতলা একটা বাড়ি। দরজায়, জানলায় চমৎকার রঙীন পর্দা, গেটের ওপরে মাধবীলতার বাহার। একনজর দেখলেই বোঝা যায় অন্য আর সব বাড়ির মধ্যে এ বাড়িটি একটা উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। আর এটা সম্ভব হয়েছে রুচি আর যত্নের গুণে। বাড়ির গৃহিণী স্বয়ং অক্লান্ত পরিশ্রমে বাড়িটিকে সুন্দর করে রেখেছেন।

বেলা তখন প্রায় সাড়ে চারটে। কাজের লোকের সঙ্গে সে-বাড়ির ছোট্ট মেয়েটি ইস্কুল থেকে গুটিগুটি ফিরল। বইয়ের ব্যাগটা বিছানায় ফেলে দিয়ে বললে, মা, আজ সন্ধের পর ভয়ানক ঝড় হবে।

মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে মা বললে, অসময়ে ঝড়!

কে বললে?

মেয়েটি চোখ বড়ো বড়ো করে বলল-শ্যামলীদি।

শ্যামলীদি বলেছে! মা কৃত্রিম গাম্ভীর্যের সঙ্গে বললে, তবে তো সাংঘাতিক কথা। ঝড় হবেই।

–হ্যাঁ, শ্যামলীদি রেডিওতে শুনেছেন। বলে দিলেন, খবরদার কেউ সন্ধের পর বাড়ি থেকে বেরিও না।

ঠিকই তো। ঝড় এলে কেউ কি বেরোয়? আচ্ছা যাও, এখন হাত-মুখ ধুয়ে খেয়ে নাও গে।

মেয়ে পাশের ঘরে চলে গেল।

মেয়েটির বাবা ইজিচেয়ারে শুয়ে টাইমটেবল দেখছিলেন। বয়েস বেশি নয়, কিন্তু ভারিক্কি চাল। তার ওপর একটু মোটা আর ধুতির সঙ্গে গোল গলা ঢিলে-হাতা পাঞ্জাবি পরেন বলে একটু বেশি বয়েস মনে হয়। টাইমটেবল ওঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী। ভ্রমণের ভারি নেশা। প্রতি বছরই কোথাও-না-কোথাও বেরোন। মাস কয়েক হল সপরিবারে পুরী ঘুরে এসেছেন। এখনই বেরোবার আর সম্ভাবনা নেই। তবুও নতুন কোথাও যাবার জন্যে এখন থেকেই প্ল্যান-পরিকল্পনা করছিলেন।

কলকাতায় ওঁর পৈত্রিক ব্যবসা মদের। এ এমন ব্যবসা যার মার নেই। মদের ব্যবসা কিন্তু জীবনে কখনো উনি ও জিনিসটি আস্বাদন করেননি।

ভদ্রলোক টাইমটেবলটি মুড়ে রেখে বললেন, কই? তোমার বান্ধবীটি তো এখনো এলেন না?

মান্তু মেয়ের ব্যাগ থেকে বইগুলো বের করে গুছিয়ে রাখছিল। বললে, আসবে। বলে ঘড়ির দিকে তাকাল।

কিন্তু তোমাকে আজ অন্য ঘরে শুতে হবে বলে রাখছি। আমি রীণার সঙ্গে শোব।

ভদ্রলোক যেন বিষণ্ণভাবে বললেন, উনি কি আজ থাকবেন?

–আমি তো থাকার জন্যে বলেছি। ও বলেছে, থাকতে পারবে না। তবু যদি থেকে যায়–তাছাড়া সত্যিই যদি ঝড় ওঠে, ফিরবে কি করে?

ভদ্রলোক বিরক্তির ভান করে বললেন, বুঝতে পারছি, মাঝে-মাঝেই এখন তোমার আমার মধ্যে এই তৃতীয় জনটি বাধা হয়ে দাঁড়াবেন।

মান্তু হেসে বলল, তা ঠিক। ওকে এখন প্রায়ই এখানে এনে রাখব।

ভদ্রলোক গাম্ভীর্যের ভান করে বললেন, বোধহয় পারবে না। ওঁরও তো একজন দাবীদার আছেন। তিনি আবার ডাক্তার! ডাক্তারদের অনেক এক্সট্রা সুবিধে আছে। বৌকে তাই তাঁরা চট করে কাছছাড়া করতে চান না।

শেষ কথাটার প্রচ্ছন্ন রসিকতা এড়িয়ে গিয়ে মান্তু বলল, থাকুক দাবীদার। ওকে মাঝে-মাঝে এনে না রাখলে ওর মনটা ঠিক হবে না।

ললিতবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ওঁর ব্যাধিটা কী?

কে জানে! ছোটোবেলা থেকে তো ওকে জানি। একেবারে সুস্থ, হাসিখুশি। কোনোদিন ভারী অসুখ হতে দেখিনি। সেই মেয়েরই কী যে হল!

অসুখ-বিসুখের কথা শুনতে ললিতবাবুর ভালো লাগে না। তিনি আমোদপ্রিয় মানুষ। মদ না খেয়েও সদাই ফুরফুরে। পাছে মান্তু তার বান্ধবীর রোগের জের টানে তাই তিনি প্রসঙ্গ বদলাবার জন্যে তাড়াতাড়ি বললেন, আর এক কাপ চা sanction করো না!

মান্তু মৃদু ধমক দিয়ে বললে, একটু আগেই চা খেয়েছ। এখন আর নয়। রীণা তো এখুনি এসে পড়বে। তখন পাবে। হা, কি বলছিলাম যেন? রীণার কথা। ওর মনটা কিরকম ছিল বলি। একদিন কী একটা উপলক্ষে রীণা, রীণার মা, ঠাম্মার সঙ্গে আমিও যাচ্ছিলাম গঙ্গাস্নান করতে। হঠাৎ আমার দাদাও এসে জুটল। রীণা ছিল আমার দাদার খুব ভক্ত। দাদা পাটি করত। পড়াশোনাও ছিল খুব। কিছু মানত না। বলত, বুঝলি রীণা, লেখাপড়া শিখছিস, সংস্কারমুক্ত হবি। ঠাকুর-দেবতা, গুরু-পুরোহিত, ভূত-প্রেত স্রেফ বোগাস।

শুনে রীণার ঠাম্মা চটতেন। বলতেন, নীরেনই মেয়েটার মাথা খেল।

শ্মশানের পাশ দিয়েই স্নানের ঘাটে যেতে হয়। না তাকালেও বুঝতে পারছিলাম মড়া পুড়ছে। বিশ্রী চামসিটে গন্ধ। তার সঙ্গে ফটফট শব্দ বাবারে! ভাবলে এখনও গা কিরকম করে।

তা দাদা হঠাৎ রীণাকে বলল, পাঁচিলের গায়ে ঐ ছাইগুলো কিসের বলতে পারিস?

রীণা একনজর দেখে নিয়ে বলল, চিতাভস্ম।

–পারিস ঐ ছাই এক মুঠো নিয়ে আসতে?

সবাই চমকে উঠল।

–এ আবার কী কথা! ছিঃ!

দাদা নেহাৎ মজা করেই কথাটা বলেছিল। কিন্তু রীণা করল কি–সবাইকে হকচকিয়ে দিয়ে ছুটে গিয়ে এক মুঠো ছাই নিয়ে এল।

দাদা যে দাদা, সেও তাজ্জব হয়ে গেল। রীণার সাহস দেখে বলল-সাবাস! এই তো চাই।

দাদা তো খুব বাহবা দিল। কিন্তু আর সবার মুখ হাঁড়ি। গঙ্গাস্নানের আনন্দ মাথায় উঠল। রীণা সেদিন সবার কাছে খুব বকুনি খেল। দাদা লজ্জায় পালালো।

ভাবতে পারা যায় সেই মেয়েই এখন নাকি বোজ ভূত দেখছে! শুধু ভূত দেখাই নয়–ভূতের ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালাতে চাইছে!

শুনে ললিতবাবু মন্তব্য করলেন, কলকাতা শহরে ভূত!

–বোঝো, তাহলে ওর মানসিক অবস্থাটা কিরকম হয়েছে। আমি ওকে একটার পর একটা চিঠি দিয়ে, নিজে ওর সঙ্গে দেখা করে বুঝিয়েছি। কিন্তু ওর ঐ এক কথা–না, ভুল দেখি না। মানসিক রোগও নয়। এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার!

মান্তু একটু থামল। তারপর বলল–এই কমাসের মধ্যে মূর্তিটা বেশ কয়েকবার নাকি দেখা দিয়েছে। দেখা দেওয়াই শুধু নয়, নাকি হুমকিও দিয়েছে।

–আবার হুমকিও দিয়েছে। বাবাঃ! ললিতবাবু হাসলেন।

মান্তু রাগ করে বলল, ওর হাজব্যান্ডের মতো তোমারও দেখছি অবিশ্বাস। মেয়েটার জন্যে তোমাদের কারো এতটুকু ভাবনা হয় না!

স্ত্রীর এই তিরস্কার ললিতবাবু নিঃশব্দে হজম করতে পারলেন না। বললেন, ও-সব ভয়ের কোনো মানে হয় না। তাছাড়া যে মেয়ে হাসতে হাসতে মড়ার ছাই মুঠোয় ভরে আনতে পারে সে আবার নররাক্ষস দেখে অজ্ঞান হয় কি করে?

মান্তু বলল, দুটো আলাদা ব্যাপার না? একটা বীভৎস জিনিস সহ্য করতে না পারা। আর একটা কুসংস্কার না মানা। দুটোয় গুলিয়ে ফেললে কি করে হবে?

–কি জানি। তোমার বান্ধবীর মনস্তত্ত্ব বুঝি না। আমার মনে হয় স্রেফ মানসিক ব্যাধি।

বেশ! মানসিক ব্যাধি হলেও তো তার প্রতিকার করতে হবে।

–স্বামী যখন ডাক্তার তখন ব্যবস্থা তিনিই করছেন।

–ছাই করছে। শুধু ঠাট্টা আর বিদ্রূপ।

ললিতবাবু আলিস্যি ভেঙে উঠে পড়লেন, যাই একটু ঘুরে আসি।

ওমা! যাবে কী! এখুনি রীণা এসে পড়বে।

ললিতবাবু উঠছিলেন, বসে পড়লেন। টাইমটেবলটা আবার তুলে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলেন। একসময়ে বললেন, এবার আমরা রাজস্থানের দিকে যাব। কি বলো?

মান্তু বললে, তার তো এখনো ঢের দেরি। পরে ভাবলেও চলবে। বলে আবার জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। নিজের মনেই বলল, সাড়ে পাঁচটা বাজতে চলল। এখনো এল না!

এমন সময়ে পিওন এসে লেটার-বক্সে চিঠি ফেলে গেল।

মান্তু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গিয়ে লেটার-বক্স খুলে চিঠিটা বের করে নিয়ে এল। খামে চিঠি। অপরিচিত হাতে ইংরিজিতে ঠিকানা লেখা।

কার চিঠি?

মান্তু খামটা ললিতবাবুর হাতে দিয়ে পাশে বসল।

চিঠি পড়ে ললিতবাবু নড়েচড়ে বসলেন। খুশি-খুশি গলায় বললেন, মিস থাম্পিকে মনে আছে?

-খুব আছে। কেন?

–তিনি কলকাতায় আসছেন।

–ওমা! কবে?

পড়ে দেখো।

মান্তু চিঠিটা নিয়ে এক নিশ্বাসে পড়ে ফেলল। মিস থাম্পি লিখছেন, আগামী ২৭ নভেম্বর ম্যাড্রাস মেলে কলকাতা পৌঁছচ্ছেন। সেখান থেকে সোজা ললিতবাবুর বাড়ি চলে আসবেন। দু-তিন-দিন থাকবেন। কলকাতায় থিওফিক্যাল সোসাইটি এবং আরও কয়েকটি জায়গায় ঘুরবেন। সেসময়ে এদের সাহায্য দরকার হবে। কেন-না কলকাতার রাস্তাঘাট তাঁর ভালো জানা নেই।

মান্তু আনন্দে লাফিয়ে উঠল–মিস থাম্পি তাহলে কথা রেখেছেন।

তারপর ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে বলল, ২৭শে নভেম্বর মানে সামনের বুধবারের পরের বুধবার। ওদিন তোমার কোথাও বেরোনো হবে না।

ললিতবাবু হেসে বললেন, বেরোতে হবে না মানে? বেরোতে আমায় হবেই, অন্তত হাওড়া স্টেশনে ওঁকে রিসিভ করতে।

মান্তু রসিকতাটা বুঝল। এরপর দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ। দুজনেই মিস থাম্পির কথা ভাবছিলেন। অনেক কথাই মনে পড়ছিল।

দুবছর আগে তিরুপতির পাহাড়ে এই মহিলার দর্শন পান ওঁরা।

তিরুপতি পাহাড়টা ছিল বেশ উঁচু। দীর্ঘ পিচঢালা বাস-রাস্তাটা ওপরে উঠে গেছে পাহাড়টাকে ঘিরে ঘিরে–মেয়েরা যেমন পাক দিয়ে শাড়ি পরে তেমনিভাবে। রাস্তার দুধারে পাহাড়ে ঝোপ-জঙ্গল। সে-সব জঙ্গলে কেউ বোধহয় কোনদিন যায় না। যাবার দরকারও হয় না।

কিন্তু পাহাড়ের ওপর উঠে মান্তুরা অবাক হয়ে গিয়েছিল। একেবারে শহর! ঝকঝকে তকতকে রাস্তা। দু পাশে হালফ্যাশানের বাড়ি, বাজার, দোকান। এমনকি বিখ্যাত একটি ব্যাঙ্ক পর্যন্ত।

দু-একদিন আগে কী একটা বিশেষ উৎসব হয়ে গিয়েছে বলে তিরুপতির মন্দিরে তেমন ভিড় ছিল না। তাই তিরুপতি দর্শন হয়ে গেল বেলা তিনটের মধ্যেই। পাহাড় থেকে নামার লাস্ট বাস পাঁচটায়। পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগে নিচে নামতে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে মান্তুদের বাস। সেটা ছাড়বে সন্ধে ছটায়। কাজেই হাতে যথেষ্ট সময়।

মান্তুদের সঙ্গে আরো যারা ছিলেন তাঁরা পাহাড়ের ওপরে কেনাকাটা করতে লাগলেন। মান্তুরা সামান্য কিছু কিনে জায়গাটা ঘুরতে বেরোল। ললিতবাবুর কি খেয়াল হল টাউন ছেড়ে নেমে এলেন পাহাড়ের ধারে। বললেন, লোকে তো এদিকে বড়ো একটা আসে না, চলো আমরা ওদিকটা দেখে আসি।

একটু নেমেই ওঁদের নজরে পড়ল একটা ছোটোখাটো আশ্রম।

এখানে আবার আশ্রম কিসের!

কৌতূহলী হয়ে ওঁরা একটু এগোতেই যে দৃশ্য চোখে পড়ল তাতে ওঁরা ভয় পেয়ে গেলেন। দেখলেন আশ্রমের পিছনে একটা গাছের ডালে অনেকগুলো মড়ার মাথার খুলি ঝুলছে। খুলিগুলো নানা আকারের। সবচেয়ে ছোটোটা হাতের মুঠোয় ধরা যায়। আর সবচেয়ে বড়োটা যে মানুষের মাথা তা ভাবা যায় না।

এঁরা যখন অবাক হয়ে খুলিগুলো দেখছেন তখনই একজন মহিলা আশ্রম-কুটির থেকে বেরিয়ে এলেন। তাঁকে দেখে মান্তু আঁতকে উঠেছিল। কালো লম্বা চেহারা। একটা দাঁত ঠোঁট থেকে সামান্য একটু বেরিয়ে। পুরু ঠোঁট। ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা এক মাথা পাকা চুল। পরনে গেরুয়া লুঙ্গি, গায়ে কালো সোয়েটার। গলায় লাল পাথরের মালা। মোটামোটা আঙুলে দামী পাথর। সবচেয়ে যেটা নজর কাড়ে তা হচ্ছে তার ঝকঝকে চোখ দুটো।

মিস থাম্পি ওদের সাদর অভ্যর্থনা করলেন। এইভাবেই আলাপ হল।

ভদ্রমহিলা ইংরিজিতেই কথা বললেন। জানা গেল, উনি সেখানে আছেন চল্লিশ বছর। একাই থাকেন।

কী করেন জিজ্ঞাসা করলে প্রথমে একটু হেসেছিলেন মাত্র। শেষে তিনি যা বললেন তার অর্থ হলো প্রেতচচা!

শুনে তো মান্তুর বাকরোধ হবার যোগাড়। সে থিওজফিস্টদের কথা শুনেছে বটে কিন্তু কখনো থিওজফিস্ট চোখে দেখেনি। তারা কোথায় থাকে, কীভাবে থাকে, বা তাদের চর্চার বিষয় ঠিক কি জিনিস, সে সম্বন্ধে তার কোনো স্পষ্ট ধারণাই ছিল না। এই প্রথম একজন থিওজফিস্ট-এর সঙ্গে আলাপ হলো।

দেখতে যেমনই হোক, ক্রিয়াকলাপ যাই হোক, মানুষটি ভাল। খুবই অতিথিপরায়ণ। তিনি তাঁদের সাদরে ঘরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে আসন পেতে বসালেন। কফি খাওয়ালেন। মান্তুর ইচ্ছে ছিল প্রেতচর্চার ব্যাপারটা একটু শোনে। কিন্তু সাহস করে জিজ্ঞেস করতে পারল না। ললিতবাবুও অবশ্য দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে কেবলই উঠি-উঠি করছিলেন। তারা কলকাতায় থাকেন জেনে ভদ্রমহিলা বললেন, আমার একবার কলকাতা যাবার দরকার হবে।

মান্তু তখনই ঠিকানা লিখে দিয়ে বলল, যদি যান তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের বাড়ি উঠবেন। আমরা খুশি হব।

ধন্যবাদ। বলে মিস থাম্পি ঠিকানাটা রেখে দিলেন।

ব্যস এই পর্যন্ত। তারপর আর যোগাযোগ নেই। অমন একজন বিচিত্র মহিলার সঙ্গে কে আর যোগাযোগ রাখতে চায়!

প্রায় আড়াই বছর পর সেই মিস থাম্পি কলকাতায় আসছেন। আর আসছেন কিনা তাদেরই বাড়ি! এ খবরে যেমন আনন্দ পেল তেমনি কেমন ভয়-ভয়ও করল। ভূত-প্রেত নিয়ে কারবার তো মহিলাটির!

মান্তুদের এক বিশেষ প্রতিবেশীবন্ধু আছে। দক্ষিণভারত থেকে ফিরে এসে মান্তু তাদের কাছে মিস থাম্পির গল্পও করেছিল। মিস থাম্পি সম্বন্ধে তাদেরও খুব কৌতূহল। বলেছিল, কোনোদিন উনি কলকাতায় এলে যেন তাদেরও জানানো হয়। তারা দেখা করবে।

মান্তু ঠিক করল খবরটা ওদের কালই দেবে।

মিস থাম্পি আসছেন। কিভাবে তাকে অভ্যর্থনা করা হবে, কোন ঘরে থাকার ব্যবস্থা করবে–ওঁর খাবার ব্যবস্থাই-বা কিরকম হবে এই নিয়ে অনেকক্ষণ স্বামী-স্ত্রীতে আলোচনা হল। কিছুক্ষণের জন্যে রীণার কথা ভুলেই গিয়েছিল। তারপর হঠাৎই মনে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে মান্তুর দুর্ভাবনা বাড়ল রীণা তো এখনো এল না!

ললিতবাবু বললেন, উনি একাই আসবেন?

–হ্যাঁ, ভালো করে ডিরেকশান দিয়ে দিয়েছি। অসুবিধে হবে না।

–পথ হারিয়ে ফেলবেন না তো?

-নাঃ। খুব চালাক-চতুর মেয়ে। তাছাড়া একই বাসে বাঙ্গুর থেকে টানা হাওড়া। তারপর আবার একটা বাসে হাওড়া স্টেশন থেকে টানা ক্ষীরোদতলা। ভুল হবার তো কোনো কারণ নেই।

ললিতবাবু বললেন, তবে হয়তো কাজে আটকে গেছেন। কিংবা বাচ্চাটার শরীর খারাপ।

মান্তু আর কিছু বলল না। আবার জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। দাঁড়িয়েই রইল। তারপর যখন মনে হল আসার আর কোনো সম্ভাবনাই নেই তখন ধীরে ধীরে সোফায় এসে বসল।

ললিতবাবু পরিবেশটা হালকা করার জন্যে বললেন, মাঝখান থেকে আমার বেরোনো হল না।

পাশের ঘরে মেয়ে পড়ছিল। বললে, বেরোবে বৈকি। এখুনি না ঝড় উঠবে!

কথা শেষ হতে-না-হতেই হঠাৎ দিদিগন্ত কাঁপিয়ে প্রচণ্ড একটা ঝড় শহরের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। রাজ্যের ভেঁড়া কাগজ আর রাস্তার ধুলো যেন মুহূর্তে তাণ্ডব নৃত্যে মেতে উঠল।

.

০৮.

রাত নটায় ফোন

হাসপাতাল থেকে ফিরে কম্পাউণ্ডে ঢুকেই সঞ্জয় অভ্যাসমতো ওপর দিকে তাকাল।

না, রীণা আজ আর পুপুকে নিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে নেই। ঘরে আলোও জ্বলছে না।

এখনো ফেরেনি নাকি?

সঞ্জয় ওপরে উঠে এল। দরজায় তালা ঝুলছে। ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকল।

অন্ধকার ঘরে ঢুকতেই এই প্রথম হঠাৎ ওর গা ছমছম করে উঠল। অন্য কোনো কিছুর ভয়ে নয়, রীণা ফেরেনি বলে।

সুইচ অন করে জামা প্যান্ট না ছেড়েই বিছানায় গিয়ে বসল। মিনিট কয়েক চুপ করে বসে রইল। হিসেব করে দেখল বেলা একটা নাগাদ বেরিয়ে থাকলে আর মিনিট পনেরোর মধ্যে নিশ্চয়ই এসে পড়বে।

সঞ্জয় খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে নিজেই চায়ের জল চড়িয়ে দিল। মিটসেফ খুলে দেখল রীণা দুখানা পরোটাও করে রেখে গেছে।

ধীরে সুস্থে চা খেতে খেতে সঞ্জয়ের মনে হল কলকাতায় এসে পর্যন্ত এই প্রথম রীণা ঘরে নেই। একটা মানুষের মাত্র কয়েক ঘণ্টার অনুপস্থিতি যে এতখানি শূন্যতা সৃষ্টি করতে পারে সঞ্জয়ের সে অভিজ্ঞতা ছিল না। সে যেন হাঁপিয়ে উঠল।

সাতটা বাজল! রীণার দেখা নেই।

সঞ্জয় মনকে বোঝাতে লাগল–এত ভাবনা কিসের? হাওড়া তো বিদেশ-বিভুঁই। নয়। বাসের নম্বর জানা থাকলে—

তবু অস্বস্তি যায় না। যে কথাটা বার বার তাকে খোঁচাচ্ছিল তা এই যে, রণা কলকাতায় নতুন। সঙ্গে আবার বাচ্চা। পথ ভুল করতে পারে, এক বাসে উঠতে অন্য বাসে উঠতে পারে। অবশ্য তাতেই-বা এমন আর কি বিপদ হতে পারে। ট্যাক্সি নয় যে ভুলিয়ে কোথাও নিয়ে যাবে। ট্রামে, বাসে কেউ পথ হারায় না। লোককে জিজ্ঞেস করলেই ঠিক রুট দেখিয়ে দেবে। কাজেই বাড়ি ফিরে আসা কঠিন নয়। ভয় একটাই–অ্যাক্সিডেন্টের। রাস্তা পার হওয়ার অভ্যেস নেই—-ভিড় বাসে ওঠা-নামা করতেও অনভ্যস্ত। ভয়টা সেইজন্যেই।

সঞ্জয় সময় দেখল–সাড়ে সাতটা। সকালে বেরোবার আগে সে রীণাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিল–তোমার বন্ধু আটকে দেবে না তো?

–আটকালেও থাকব না। সন্ধের আগেই ফিরে আসব।

সন্ধে তো কখন উৎরে গেছে!

সঞ্জয় আর ঘরে বসে থাকতে পারছিল না। একবার ভাবল বাস-স্টপেজে গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু স্টপেজে গিয়ে দাঁড়ালেই কি রীণা তাড়াতাড়ি এসে পড়বে? তা তো নয়। আসলে মানুষ দুশ্চিন্তায় যখন ছটফট করে তখন আর হাত-পা গুটিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। সঞ্জয় দরজায় তালা বন্ধ করে নামতে যাচ্ছে এমনি সময়ে ঝড় উঠল।

প্রথমে সঞ্জয় বুঝতেই পারেনি ঝড় উঠছে। নভেম্বরের এই পরিষ্কার আকাশ খুঁড়ে এমন ঝড় উঠবে এ যে কল্পনার বাইরে! একটা গোঁ গোঁ শব্দের পরই ধুলোয় ধুলোয় চারিদিক ছেয়ে গেল। ব্যালকনি থেকেই দেখতে পেল রাস্তার লোক ছুটছে। আশ্রয় খুঁজছে। বাড়ির দরজা জানালা ফটাফট বন্ধ হচ্ছে।

এবার সত্যিই ভয় হল। রীণা এই মুহূর্তে কোথায় আছে কে জানে! যদি বাসে থাকে তো একরকম। তাও সমস্যা–এই ঝড়ে ঠিক স্টপেজে নামতে পারবে কি না। নামবেই বা কি করে? পুপুটাই বা কি করবে?

আর যদি রাস্তায় থাকে

সঞ্জয় আর ভাবতে পারল না। ঘরে ঢুকে সিগারেট ধরিয়ে পায়চারি করতে লাগল।

ঝড়ের তাণ্ডব নৃত্য চলল প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে। ঝড় যখন থামল রাত তখন নটা। ভাগ্য ভালো। বৃষ্টি নামেনি।

ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সঞ্জয় দেখল যশোর রোড একদম ফাঁকা। খাঁ-খাঁ করছে। লোক চলাচল তো নেইই, বাস-ট্যাক্সিও চোখে পড়ল না।

দারুণ দুর্ভাবনায় পড়ল সঞ্জয়। নিশ্চয় রীণার কিছু বিপদ হয়েছে। আর পুপুটা? ভাবতে ভাবতে সঞ্জয় অস্থির হয়ে উঠল।

এখন কি করবে? কোথায় খবর নেবে? পরামর্শ করে এমন কেউ কাছের মানুষ নেই। একবার ভাবল দোতলায় গিয়ে খবর নেয় নিখিলবাবু ফিরেছেন কিনা। এবাড়িতে যত ভাড়াটে আছেন তাদের মধ্যে নিখিলবাবুই একমাত্র সিরিয়াস লোক। ওঁর সঙ্গেই কথা বলা চলে। তবু সঞ্জয় গেল না। কে জানে ভদ্রলোক কী মনে করবেন!

অনেক ভেবে সঞ্জয় ঠিক করল মান্তুদের বাড়িই যাবে। হয়তো ওকে আটকে দিয়েছে।

কিন্তু মান্তুদের বাড়ি তো চেনে না। ঠিকানা? না, ঠিকানাও জানা নেই।

কি মনে হল উঠে ড্রয়ার টেনে মান্তুর চিঠিগুলো খুঁজতে লাগল।

একটা চিঠি পেল।–ভাই রীণা….।

নাঃ, ঠিকানা নেই। শুধু ক্ষীরোদতলা, হাওড়া।

শুধু ক্ষীরোদতলা বললে কি এই রাত্তিরে কারো বাড়ি খোঁজ করা যায়? অসম্ভব।

সঞ্জয় আবার চিঠি খুঁজতে লাগল।

আরো একটা চিঠি।

ভাই রীণা….।

আহা, ঠিকানা ছিল কিন্তু খাম খুলতে গিয়ে ঐ জায়গাটা ছিঁড়ে গেছে।

সঞ্জয় পাগলের মতো ড্রয়ার টেনে খুলে সব কাগজ হাতড়াতে লাগল।

এই যে আরো চিঠি রয়েছে।….

নাঃ–কোনোটাতেই পুরো ঠিকানা নেই।

সঞ্জয় যখন একেবারে হতাশ তখন ড্রয়ারের কোণ থেকে বেরোল দুমড়োনো একটা খাম। তাড়াতাড়ি চিঠিখানা বের করল। এইটে বোধহয় মান্তুর প্রথম চিঠি।

হ্যাঁ, এই যে ঠিকানা রয়েছে।

ঠিকানা লিখে নেবার ধৈর্য তখন আর নেই। চিঠিটা পকেটে পুরেই সঞ্জয় ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

দরজায় তালা লাগাচ্ছে, মনে হল কেউ দ্রুত পায়ে ওপরে আসছে।

সঞ্জয় শিরদাঁড়া খাড়া করে দাঁড়াল। নিশ্চয় কোনো বিপদের

কাকু, আপনার ফোন।

সঞ্জয় দৌড়ে নেমে গেল।

.

০৯.

রীণা কি ফেরেনি

সকাল হতে না হতেই মান্তু কাপড় পরে নিল। কাল সারা রাত রীণার কথা ভেবে ঘুমোতে পারেনি। অমন তো কত জনেই আসবে বলে আসে না বা। আসতে পারে না। তখন মোটেই ভাবনা হয় না। রীণা বলেই এত দুর্ভাবনা। প্রথমত, ও কলকাতায় নতুন। কে জানে কোন বাসে চড়তে কোন্ বাসে চড়ল। কোথায় আসতে কোথায় গিয়ে পড়ল। দ্বিতীয়ত, ও যেন ঠিক সুস্থ নয়। আর যে-মানুয মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে তার সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না।

অথচ একথাটা আগে মনে হয়নি। মনে হলে নিশ্চয় একা আসতে বলত না।

ভাবতে ভাবতে মান্তু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কী যে হলো মেয়েটার!

ললিতবাবু বললেন, চা খেয়ে যাবে না?

-না। বলেই মান্তু তখনই বেরিয়ে পড়ল। ওর শরীরের ওপর যেন অসময়ে ভারী গরম কোট চাপানো রয়েছে। খুলে ফেললেই আরাম। কিন্তু খুলব বললেই খোলা যাচ্ছে না। মনের মধ্যে কেবলই খারাপ চিন্তা ঘুরে ফিরে আসছে। গিয়ে কি দেখবে! কি শুনবে!

যদি দেখে, রীণা বাড়ি নেই? যদি শোনে রীণা কাল দুপুরে সেই যে হাওড়া যাবে বলে বেরিয়েছিল এখনো পর্যন্ত ফেরেনি?

তাহলে কি করবে?

যদি দেখে বাড়ির সামনে পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে? লোকে ভিড় করে আছে থমথমে মুখে?

তাহলে কি বুঝবে?

কী বুঝবে তা আর কল্পনা করতে হয় না।

মান্তুর বুকের মধ্যে কিরকম করতে লাগল।

একবার ভাবল–গিয়ে দরকার নেই। ফিরেই যাবে। প্রিয়জনের কোনো মর্মান্তিক খবর সামনাসামনি দাঁড়িয়ে শোেনার শক্তি তার নেই।

তারপরেই ভাবল রীণা না হয়ে যদি তার বাড়ির কেউ হতো তাহলে কি পারত পালিয়ে থাকতে?

না, পারত না। কাজেই এখানেও তাকে মুখোমুখি হতেই হবে, যত খারাপ ঘটনাই ঘটে থাকুক না কেন।

মান্তু এবার যেন মনে জোর পেল।

ক্ষীরোদতলার মোড়ে আসতেই বাস পেয়ে গেল। মিনিট দশেকের মধ্যেই ময়দানে এসে পৌঁছল। বঙ্গবাসী সিনেমাহলের কাছ থেকে নাগেরবাজারের টানা বাস ছাড়ছিল। বাসটা কালিন্দি, লেকটাউন, বাঙ্গুর হয়ে যাবে। ছুটে এসে হাত তুলে বাস থামিয়ে কোনোরকমে উঠে পড়ল।

এক ঘণ্টার পথ। এত সকাল বলেই বাসে ভিড় ছিল না। জানলার ধারে ভালো সীট পেয়ে গেল। অন্য সময় হলে এইরকম সীটের জন্যে খুশি হতো। কিন্তু আজ মনটাই অন্যরকম হয়ে আছে।

…লেকটাউন, বরাট পার হয়ে গেল। পরের স্টপেজটাই রীণাদের। মান্তু রড ধরে উঠে দাঁড়াল। পা দুটো তখন ওর কাঁপছে।

বড়ো রাস্তা পার হয়ে সরু রাস্তা। মিনিট পাঁচেক পরেই দেখা গেল ওদের বাড়ির গম্বুজটা। মান্তু সমস্ত শক্তি নিয়ে হনহন করে কম্পাউন্ডের মধ্যে ঢুকল।

.

১০.

 অদৃশ্য মানুষ-দৃশ্য চোখ

সঞ্জয়ের ইচ্ছে ছিল না মান্তুদের বাড়ি রীণা একা যায়। মান্তু অবশ্য দুজনকেই যাবার কথা বলেছিল। কিন্তু সঞ্জয়ের তো সপ্তাহে একটি দিনই ছুটি। আর সপ্তাহে এই একটি দিন সঞ্জয় কোথাও নড়তে চায় না। তাই ছমাসের বেশি হল ওরা এখানে এসেছে, অথচ একদিনও মান্তুর কাছে যাওয়া হয়নি। শেষে মান্তুই একদিন সকালে এসে রীণাকে নিয়ে গিয়ে সেদিনই সন্ধ্যায় পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল। দুই সখীতে ঠিক করেছিল–এরপর রীণা একাই যাবে-আসবে। মান্তুও মাঝে-মাঝে আসবে।

এই প্রস্তাব শুনে সঞ্জয় মান্তুকে হেসে বলেছিল–বেশ তো আপনি এসে নিয়ে যাবেন। শুনে রীণা ফোঁস করে উঠেছিল–আহা, আমি কচি খুকি! যেন একা যেতে পারি না।

হয়তো পারে কিন্তু মহাজাতি সদনে সেই ঘটনার পর রীণার সম্বন্ধে সঞ্জয় খুব সতর্ক। একা ছেড়ে দিতে ভরসা পায় না। আবার একটু-আধটু ছেড়ে না দিলে মনটাও ঠিক হবে না। এইসব ভেবে শেষ পর্যন্ত একা ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছিল।

সকালে বেরোবার সময়ে সঞ্জয় রীণাকে বার বার করে বলল, সাবধানে যেও। বাসের নম্বর ভালো করে দেখে উঠো। কোলে বাচ্চা। তাড়াহুড়ো করে উঠো না। ভিড় থাকলে সে বাস ছেড়ে দেবে। বাস থেকে নামার সময়ে পেছন দিকে তাকিয়ে নামবে। সাবধানে রাস্তা ক্রশ করবে। আচ্ছা, দাঁড়াও। টাকা কটা রেখে দাও। দরকার হলে ট্যাক্সি করবে। তবে ফেরার সময়ে করো না। তখন সন্ধে হয়ে যাবে। ট্যাক্সিতে–একা–অচেনা–

উত্তরে রীণা মুখ টিপে একটু হাসল। বলল, আমি বোধহয় একেবারে গেঁয়ো মেয়ে নই। লেখাপড়াও জানি একটু-আধটু।

.

বেরোতে বেরোতে শেষ পর্যন্ত বেলা দেড়টা হয়ে গেল।

নভেম্বর মাস। অল্প অল্প শীত পড়েছে। বেলা দুপুরেও রোদের তাত তেমন। অসহ্য নয়। ফিরতে ফিরতে যদি সন্ধে হয়ে যায় ভেবে ব্যাগের মধ্যে পুপুর একটা সোয়েটার আর নিজের একটা শালও ভাঁজ করে নিয়েছে।

রীণা বড়ো রাস্তায় এসে দাঁড়াল। ওর বেশ ভালো লাগছিল। বন্ধুর কাছে যাচ্ছে বলেই নয়, বাড়িটা থেকে বেরোতে পারলেই যেন বাঁচে।

রীণা ফুটপাথ থেকে নেমে বাস-স্টপেজের দিকে চলল। হঠাৎ একেবারে পিছনে গাড়ির শব্দ শুনে এক লাফে ফুটপাথে উঠে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে একটা মিনিবাস শাড়ির আঁচল ছুঁয়ে আর-একটা বাসকে ওভারটেক করে বেরিয়ে গেল।

উঃ! হয়েছিল এখুনি! আশ্চর্য, বাসটা হর্ন পর্যন্ত দেয়নি।

ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন পথচারী দাঁড়িয়ে পড়েছে। রীণাকে বললে, খুব বেঁচে গেলেন দিদি! কাউকে কিছু বলার নেই। নিজে সাবধানে যাবেন।

রীণা কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইল। মনটা খচ্চ্ করতে লাগল–কেন এমন হল?

তারপরেই নিজেকে বোঝাল সাবধানে না চললে দুর্ঘটনা তো ঘটতেই পারে। ফুটপাথ থেকে নামা উচিত হয়নি।

একজন মহিলা স্টপেজে দাঁড়িয়েছিলেন। রীণার হাবভাব দেখে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাবেন?

–হাওড়া।

–এই তো চলে গেল হাওড়ার বাস। লক্ষ্য করেননি।

অন্য রুটের একটা বাস এসে পড়ায় ভদ্রমহিলা তাতে উঠে চলে গেলেন।

রীণার মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভদ্রমহিলা তাকে লক্ষ্য করছিলেন কেন? তবে কি সে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে? কিছু অস্বাভাবিকতা চোখে পড়েছে?

ঘড়ির দিকে তাকাল। সোয়া দুটো। অর্থাৎ আধঘণ্টারও বেশি দাঁড়িয়ে আছে। একশো উনিশ নম্বর বাসও এসেছিল। খেয়াল করেনি।

মনটা ঠিক করে নিয়ে রীণা বাসের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। একটু পরেই আর একটা একশো উনিশ নম্বর এল। বেশ ভিড়। তবু রীণা উঠল। লেডিজ সীট একটাই খালি ছিল। রীণা বসে পড়ল।

বাস চলেছে। লোক নামছে, উঠছে। যত লোক নামছে তার চেয়ে ঢের বেশি উঠছে। রীণা জানলা দিয়ে দেখতে দেখতে যাচ্ছিল। এসব রাস্তা সে চেনে না। বাসটা কোন কোন জায়গা দিয়ে যাচ্ছে তাও জানে না। শুধু এটুকুই জানে বাসটা হাওড়া ময়দান পর্যন্ত যাবে।

পুপু এতক্ষণ বেশ শান্ত হয়েছিল। এখন দুষ্টুমি শুরু করেছে। তার আর দোষ কী? মায়ের কোলে আড়ষ্ট হয়ে শুয়ে থাকা কতক্ষণ আর সম্ভব? একবার ও হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে কোল থেকে পড়ে যায় আর কি! রীণা জানলা থেকে মুখ ফিরিয়ে সোজা হয়ে পুপুকে জোর করে কোলে তুলে নিল।

সামনে লোক সার সার দাঁড়িয়ে। লেডিজ সীটের সামনেই রড ধরে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্যাসেঞ্জাররা। বাসের ওদিকেও একই অবস্থা।

বাবাঃ! সবাই হাওড়া ময়দান পর্যন্ত যাবে নাকি? তাহলে ঐ ভিড় ঠেলে পুপুকে নিয়ে নামবে কি করে?

তারপরেই ভাবল অসুবিধে আর কি? সবাই নেমে গেলে ধীরে সুস্থে নামবে।

হঠাৎ রীণা দেখল বাসের সামনের দিকে যারা দাঁড়িয়ে আছে তাদের মধ্যে একজন তাকে লক্ষ্য করছে।

কয়েকবারই চোখ পড়েছিল, তখন বুঝতে পারেনি। এখন স্পষ্ট বুঝতে পারলা, তাকেই দেখছে। কিন্তু লোকটিকে পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে না। ভিড়ে আড়াল পড়ে গেছে। এমন-কি মাথা মুখও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন চোখের ভাষায় বলতে চাইছে–আমায় চিনতে পারছ না?

রীণারও মনে হল ঐ চোখ যেন তার খুব পরিচিত। কোথায় যেন দেখেছে।

রীণা কয়েক বার তাকাল। তারপর চোখ ফিরিয়ে নিয়ে ভাবতে চেষ্টা করল লোকটি কে হতে পারে? ঐ চাউনি যে তার খুবই চেনা।

বাসটা প্রথমে বেশ জোরেই চলছিল। তারপর ক্রমশ কেমন টিকিয়ে টিকিয়ে চলতে লাগল। প্যাসেঞ্জারেরা তো চেঁচামেচি শুরু করে দিল।বাস চলছে, না গোরুর গাড়ি?

বাসটা একটা বড়ো ক্রসিং-এর স্টপেজে এসে থামল। অনেক প্যাসেঞ্জার নামল, উঠল। কন্ডাক্টার দুবার ঘন্টি বাজাল। কিন্তু হঠাৎই বাসটার ইঞ্জিন থেমে গেল। আর স্টার্ট নিল না।

কন্ডাক্টার বলল, গাড়িটা ঠেলার দরকার।

কয়েকজন প্যাসেঞ্জার নেমে গিয়ে কন্ডাক্টরের সঙ্গে গাড়ি ঠেলতে লাগল। গাড়ি একবার স্টার্ট নিল। তারপর আবার থেমে গেল।

গতিক সুবিধে নয় দেখে অনেকেই নেমে পড়ে অন্য বাস ধরতে গেল। কেউ কেউ কন্ডাক্টারের কাছে টিকিটের পয়সা ফেরত চাইতে লাগল। বাস খালি হয়ে গেল। শুধু রীণা চুপ করে বসে রইল। বুঝতে পারছিল না–কি করবে?

কন্ডাক্টার এসে বলল, আপনি বসে আছেন কেন? বাস যাবে না।

রীণা তাড়াতাড়ি পুপুকে কোলে নিয়ে উঠে পড়ল।

কন্ডাক্টারটি বোধহয় হৃদয়বান। বলল, টিকিটের পয়সা ফেরত নিন।

বলে টিকিটটা নিয়ে পয়সা ফেরত দিল। জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবেন?

ক্ষীরোদতলা।

–সেটা আবার কোথায়?

–হাওড়ায়।

পিছনে তখন অনেকগুলো বাস এসে পড়েছিল। কন্ডাক্টার ঝুঁকে পড়ে একটা বাস দেখিয়ে দিয়ে বলল, ঐ বাসে চলে যান।

রীণা তাড়াতাড়ি নেমে পড়ল। এক বার সেই লোকটিকে খুঁজে দেখার কথা মনে হল। চারদিকে তাকাল। কিন্তু এমন কাউকে দেখতে পেল না যে তাকে দেখছে। বুঝল–যে দেখছিল সে এতক্ষণে নেমে অন্য বাসে চলে গেছে।

কাছেই বাসটা দাঁড়িয়ে ছিল। রীণা তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল।

এ বাসটাতেও ভিড় কম ছিল না। কিছুক্ষণের মধ্যে ভিড় আরো বেড়ে গেল। সেই ঠাসাঠাসি ভিড়।

বাস যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। পথ যেন আর শেষ হয় না। বসে বসে রীণার ঘুম এল। দু একবার ঢুলুনি। তার পর কখন একসময়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল ঠিক নেই। পুপুর কান্নায় ঘুম ভেঙে গেল। রীণা পুপুকে বুকের ওপর টেনে নিয়ে সামনে তাকাতেই দেখতে পেল সেই অদৃশ্য মানুষটার চোখ। আগের মতোই দূর থেকে তাকে একদৃষ্টে দেখছে। এবারও তার মুখ বা দেহ কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ভিড়ের আড়ালে অদৃশ্য।

রীণা খুব অবাক হল। লোকটা এ গাড়িতেও উঠেছে। তাহলে আগের বাসটা খারাপ হলে সে যখন নেমেছিল তখন লোকটাকে দেখা গেল না কেন?

রীণা চোখ সরিয়ে নিয়ে জানলার বাইরে দেখতে লাগল।

একটু পরে বাসটা এক জায়গায় এসে থামল। রাস্তাটা আগের মতো চওড়া নয়। খুব ঘিঞ্জি। একপাশে দোকানপাট। অন্য পাশে বোধহয় মিনিবাস, সাইকেল-রিকশার স্ট্যান্ড। লোকজন ব্যস্ত হয়ে চলাফেরা করছে। মিনিবাসের কন্ডাক্টার কর্কশ গলায় হাঁকছে–ঢাকুরিয়া–পার্কসার্কাস–সল্টলেক। সাইকেল-রিকশওয়ালা ঘন ঘন হর্ন বাজিয়ে সোয়ারি ডাকছে।

বাস এখানে থামতেই প্যাসেঞ্জাররা নেমে গেল। এখানে সবাই নামল কেন? এই কি হাওড়া ময়দান? যাই হোক পুপুকে কোলে নিয়ে রীণাও নামল।

নেমেই হকচকিয়ে গেল। না, এ তো হাওড়া ময়দান নয়, হাওড়া স্টেশনও নয়।

তাহলে?

তাহলে কোথায় এল?

ওরই মধ্যে একবার সেই চোখ দুটোকে খুঁজল। না, কেউ তাকে দেখছে না।

রীণার কিরকম ভয় করতে লাগল। সেই অদৃশ্য মানুষটার জন্যে নয়, তার মনে হতে লাগল নিশ্চয় ভুল বাসে উঠে পড়েছিল। নিশ্চয় অন্য কোথাও এসে পড়েছে।

কিন্তু জায়গাটা কি?

ভাবল কাউকে জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু যাকে-তাকে জিজ্ঞেস করতে লজ্জা করল। তাছাড়া আনাড়ি মেয়ে ভেবে যদি কেউ তাকে ফলো করে? রীণা ঠিক করল কোনো প্রবীণ মানুষ দেখতে পেলে তাকে জিজ্ঞেস করবে।

এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে সে দেখতে পেল একটা দোকানের বোয়াকে বসে একজন বৃদ্ধ খবরের কাগজ পড়ছেন।

রীণা পায়ে পায়ে তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বৃদ্ধ চোখ তুলে তাকালেন। রীণা জিজ্ঞেস করল, এটা কোন জায়গা?

বৃদ্ধ বললেন, যাদবপুর।

যাদবপুর! রীণা থমকে গেল।

রীণার মুখের অবস্থা লক্ষ্য করে বৃদ্ধ বললেন, তুমি কোথায় যাবে মা?

রীণা লজ্জায় সংকোচে ইতস্তত করতে লাগল। বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করলেন, এটা যাদবপুর স্টেশন রোড। এখানেই কোনো নম্বর খুঁজছ?

রীণা মাথা নাড়ল।

–তবে?

রীণা একটু চুপ করে থেকে বলল, আমি হাওড়া যাব।

–হাওড়া যাবে! আসছ কোথা থেকে?

রীণা বলল, বাঙ্গুর থেকে।

-বাঙ্গুর মানে?

লেকটাউন, বাঙ্গুর।

–সেখান থেকে এখানে!

রীণা তখন সব ঘটনা বলল।

শুনে বৃদ্ধ বললেন, তুমি কি হাওড়া স্টেশনেই যাবে?

না, হাওড়া ময়দান।

–তাহলে তো তুমি অনেকটা এগিয়ে এসেছ মা। যেখানে নেমেছিলে সেখানেই বাস পেতে। তুমি ওখানেই চলে যাও।

রীণা একটু ভেবে বলল, আমি বাঙ্গুরেই ফিরে যাব ভাবছি।

বৃদ্ধ বললেন, সেই ভালো। তুমি নতুন। সন্ধের পর হয়তো জায়গা চিনতে পারবে না। অবশ্য এখান থেকে বাঙ্গুর যাবার টানা বাসও নেই। বাস চিনে বদলাতে পারবে?

রীণা মাথা নাড়ল।

বৃদ্ধ বললেন, আমারও তাই মনে হয়।

একটু ভেবে বললেন, তুমি এক কাজ কর। সামনেই যাদবপুর স্টেশন। ওখান থেকে শিয়ালদা চলে যাও। তিনটে স্টেশন–ঢাকুরিয়া, বালিগঞ্জ, পার্কসার্কাস। যেখানে নামবে সেটা সাউথ স্টেশন। সেখান থেকে নর্থ স্টেশনে এসে যে কোনো গাড়িতে উঠলেই উল্টোডিঙ্গি পৌঁছে যাবে–একটাই স্টেশন। তারপর ওখান থেকে একটা রিকশা নিয়ে নেবে–আমার ধারণা উল্টোডিঙ্গি থেকে বাঙ্গুর রিকশা যায়।

রীণা খুশি হয়ে বৃদ্ধকে নমস্কার করে যাদবপুর স্টেশনে গেল। দুদিকে প্ল্যাটফর্ম।

তখন সন্ধে হয়ে গিয়েছে। চারিদিকে আলো জ্বলে উঠেছে। পুপুকে কোলে নিয়ে রীণা আর চলতে পারছিল না। কোনোরকমে শিয়ালদার একটা টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াল।

একটু পরেই একটা ট্রেন এল। রীণা গাড়িতে উঠে পড়ল। গাড়িতে এত ভিড় যে রীণা বসার জায়গা পেল না। দাঁড়িয়ে থাকতে হল। একে মানসিক উদ্বেগ,কত দূরে শেয়ালদা স্টেশন, সেখান থেকে কোন ট্রেনে উল্টোডিঙ্গি; তারপর কোথায় পাবে বাঙ্গুর যাবার রিকশা! এসব চিন্তা তো আছেই, তার ওপর পরিশ্রম। রীণার শরীর ঝিমঝিম্ করতে লাগল। তবু অনেক কষ্টে এক হাতে পুপুকে জড়িয়ে নিয়ে অন্য হাতে রড ধরে দাঁড়িয়ে রইল।

ট্রেন ছুটছে। কোন স্টেশন কখন যাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। বৃদ্ধ ভদ্রলোক বলেছিলেন, মাত্র তিনটে স্টেশন পরেই শিয়ালদা। তিনটে স্টেশন কি এখনও যায় নি? একজনকে জিজ্ঞেস করতে গেল কিন্তু গলায় ভালো করে স্বর ফুটল না। ট্রেনের মধ্যে গোলমালে কেউ তার কথা শুনতে পেল না। ট্রেনটা একটা স্টেশনে থেমেই আবার চলতে শুরু করল। কেমন একটা দম-আটকানো কষ্ট হচ্ছে। পুপুকেও আর কোলে রাখতে পারছে না। পুপু যেন কোল থেকে পড়ে যাচ্ছে। রীণা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। রড ধরে মেঝেতেই বসে পড়ল…

এক সময়ে তার কানে এল কে যেন বলছে–আপনি কোথায় যাবেন?

রীণা অতিকষ্টে চোখ মেলে তাকাল। দেখল সে একটা বেঞ্চিতে শুয়ে আছে।

–পুপু! বলে ধড়মড় করে উঠে বসল।

একজন ভদ্রলোক সম্ভবত তাঁর স্ত্রীকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, এই যে এঁর কোলে।

–আমি কোথায়?

–এটা মল্লিকপুর স্টেশন।

–মল্লিকপুর!

–হ্যাঁ, ডায়মন্ড হারবার লাইনে। এর পরেই বারুইপুর। আপনি কোথায় যাবেন?

–শেয়ালদা।

শেয়ালদা! তো এদিকে এলেন কি করে?

রীণা কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, জানি না।

–আপনি তো উল্টোদিকে এসে পড়েছেন।

রীণা বিহ্বলদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

ভদ্রলোকের স্ত্রী পুপুকে রীণার কোলে তুলে দিয়ে বললেন, আজ আপনি আমাদের বাড়ি চলুন। আমরা এখানেই থাকি। কাল সকালে উনি না হয় আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেবেন।

রীণা একটু চুপ করে থেকে ছেলেমানুষের মতো বললে–আমি বাড়ি যাব।

বাড়ি কোথায়?

বাঙ্গুর।

তখন ভদ্রলোক বললেন, ঠিক আছে চলুন, আপনাকে বালিগঞ্জ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসি।

পরের ট্রেনে ভদ্রলোক রীণাকে নিয়ে বালিগঞ্জ স্টেশনে এলেন। এই সময়ে উঠল প্রচণ্ড ঝড়।

ভদ্রলোক এমনও ভেবেছিলেন রীণাকে না হয় বাঙ্গুর পৌঁছে দিয়েই আসবেন। কিন্তু প্রচণ্ড ঝড় ওঠায় এত দেরি হয়ে গেল যে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হল না। তিনি রীণাকে নিয়ে এলেন বালিগঞ্জ থানায়।

সেখানে পুলিশ রীণাকে অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করল। স্বামীর নাম, ঠিকানা। রীণার তখন ঘোর কেটে গিয়েছিল। সব কিছুই বলতে পেরেছিল।

ভদ্রলোক ও. সি.কে বললেন, যদি আপনারা অনুগ্রহ করে এঁকে বাড়িতে পোঁছে দেন।

ও. সি. বললেন, অনুগ্রহ কেন বলছেন, এ তো আমাদের কর্তব্য। তবে একটু দেরি হবে। পুলিশ ভ্যানগুলো–

বলেই রীণাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার বাড়িতে ফোন আছে?

রীণা বললে, দোতলায় এক ভদ্রলোকের ঘরে আছে।

নম্বর?

নম্বর! রীণা মনের মধ্যে হাতড়াতে লাগল।

–মনে নেই?

রীণা চোখ বুজিয়ে একটু ভাবল। তারপর ভেবে ভেবে খুব আস্তে গুনে গুনে ঢিল ছোঁড়ার মতো একটি একটি সংখ্যা বলে গেল।

ও. সি. তখনই রিসিভার তুললেন।

.

মান্তু দারুণ উদ্বেগে কড়া নাড়তে লাগল। ভেতর থেকে পুরুষের সাড়া পাওয়া গেল।

কে?

–আমি মান্তু

ব্যাকুল কণ্ঠস্বর যেন বন্ধ দরজার ওপরে আছড়ে পড়ল।

দরজা খুলে দিল সঞ্জয়। হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল মান্তু। রীণা কোথায়? ভালো আছে তো?

উত্তর পাবার দরকার ছিল না। মান্তু দেখল স্লান ক্লান্ত মুখে বিহ্বলদৃষ্টিতে রীণা তাকিয়ে আছে।

সঞ্জয় হেসে বলল, আসুন, কাল অনেক রাত্তিরে আপনার বান্ধবীকে উদ্ধার করে এনেছি।

১.৩ মিস থাম্পি

সাতাশে নভেম্বর।

মিস থাম্পি এসেছেন। রীণাও এসেছে। রীণাকে মান্তুই নিজে গিয়ে নিয়ে এসেছে। একদিন থাকবে।

আসল উদ্দেশ্য মিস থাম্পির মতো মানুষ যখন আসছেন তখন রীণাকে একবার দেখিয়ে নেওয়া। মিস থাম্পি তো সারাজীবন প্রেতচর্চাই করছেন। রীণাকে দেখলে, তার মুখ থেকে সব শুনলে হয়তো মিস থাম্পি বলতে পারবেন মানসিক ব্যাধি না অন্য কিছু। মান্তুর উদ্দেশ্যটা রীণাও জানতো না। এখানে এসেই শুধু এক পেয়ালা কফি খেয়ে বেরোবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন মিস থাম্পি। রীণার সঙ্গে আলাপ করার আগ্রহ দেখালেন না। মান্তু তবু এক নিশ্বাসে পরিচয়টুকু মাত্র দিতে পারল। তাও তিনি ভালো করে শুনলেন। বলে মনে হল না।

–চলুন মিস্টার চৌধুরী, আগে পার্ক স্ট্রীটের সিমেট্রিটা দেখে আসি।

বলে তখনই ললিতবাবুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।

পার্ক স্ট্রীটের সেই দেড়শো বছরেরও বেশি পুরনো কবরখানাটা মিস থাম্পি অনেকক্ষণ ঘুরে ঘুরে দেখলেন। বড়ো বড়ো গাছের ছায়ায় জায়গাটা বেশ ঠাণ্ডা। মিস থাম্পির খুব ভালো লাগল।

কয়েক জায়গায় কয়েকটা কবর পরীক্ষা করলেন। ব্যাগ থেকে একটা শিশি বের করে খানিকটা কবরের মাটি পুরে নিলেন। একটা পুরনো কবরের পাশে উপুড় হয়ে শুয়ে কান পেতে কী যেন শুনলেন। এমনি করে সারা সকাল কাটালেন।

মিস থাম্পি বেরিয়ে গেলে মান্তু দুপেয়ালা কফি নিয়ে রীণার কাছে এসে বসল।

কী রে! মুখ অমন ভার কেন? মন কেমন করছে বুঝি?

রীণা ম্লান হাসল। বলল, মন বলে বোধহয় আর কিছু নেই। তাঁরে, আমায় কি রাত্তিরে থাকতেই হবে?

মান্তু হেসে বলল, বরকে ছেড়ে বুঝি একটা রাত্তিরও থাকতে ইচ্ছে করে না?

রীণার ফ্যাকাশে মুখে লালচে আভা ফুটে উঠল।–তা নয়। ঐ বাড়িতে একা থাকা–

দূর! তুই একটা পাগল! বলে মা রান্নাঘরের দিকে উঠে গেল।

রাত্তিরে সঞ্জয় বাড়িতে একা থাকবে এ দুর্ভাবনা তো রীণার ছিলই, তাছাড়া এখানেও তার ভালো লাগছে না। সে এসেছিল নিরিবিলিতে বন্ধুর সঙ্গে গল্প করতে। কিন্তু এদিনই একজন ভি. আই. পি. এসে হাজির। এই মহিলাটিকে রীণার মোটেই ভালো লাগছিল না। যেন কেমন ধারা! একে তো অবাঙালী, চালচলন আলাদা। কথাও কম বলেন। তাছাড়া কিসব প্রেতচর্চা করেন। নিজের ঘরেই নিত্য ভূতের আতঙ্ক তারপর এখানে এসেও

চিন্তায় বাধা পড়ল। একজন মহিলাকে নিয়ে মান্তু ঘরে ঢুকল। রীণার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল।

ভদ্রমহিলা মান্তুদের প্রতিবেশিনী। মিসেস লাহিড়ি। ছোটোখাটো হাসিখুশি মানুষটি। ফর্সা রঙ। গোল মুখ। কপালে বড়ো একটা টিপ।

মিসেস লাহিড়ি আলাপ করতে আসেননি। এসেছিলেন অন্য উদ্দেশ্যে। তাই রীণার সঙ্গে আলাপটা হল দায়সারা গোছের।

তারপরেই মান্তুকে বলল, তাহলে বিকেলে ওঁকে নিয়ে যাবেন।

রীণা ভেবেছিল বুঝি তাকেই নিয়ে যাবার কথা বলছেন। না, তা নয়। নেমন্তন্নটা ঐ মাদ্রাজী মহিলাকে।

মান্তু বলল, হ্যাঁ, নিয়ে যাব। উনি ফিরে এলে বলব আপনি নেমন্তন্ন করতে এসেছিলেন।

.

বেলা দুটো নাগাদ মিস থাম্পিকে নিয়ে ললিতবাবু ফিরলেন। খাওয়া-দাওয়া সেরে মিস থাম্পি বসলেন লিখতে।

বিকেল সাড়ে তিনটের সময় এক কাপ কফি খেলেন। তখন মান্তু খুব বিনীতভাবে মিসেস লাহিড়ির কথা বলল।

আপনার কখন সুবিধে হবে?

মিস থাম্পি প্রথমে একটু অনিচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। এর ওর বাড়ি যাবার ইচ্ছে তার ছিল না। শেষে মান্তুর বিশেষ অনুরোধে রাজি হলেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেন–

–সাড়ে চারটেয়।

ইতিমধ্যে মিস থাম্পির সঙ্গে রীণার অনেকবারই দেখা হল, কিন্তু তিনি কোন কথা বলেননি। কোনো আগ্রহই যেন নেই।

মিস থাম্পির এই ব্যবহারে মান্তু বেশ অস্বস্তিতেই পড়ল। ওঁর কাছে ধীরে সুস্থে বসে রীণা কথা বলবে এইজন্যেই তো রীণাকে আনা। কিন্তু সবই যেন ভেস্তে যাচ্ছে। যাই হোক ঠিক সাড়ে চারটের সময়ে মিস থাম্পিকে নিয়ে মান্তু মিসেস লাহিড়ির বাড়ি চলল। রীণা যেতে চায়নি। মান্তু জোর করেই নিয়ে গেল।

মান্তুদের দুখানা বাড়ির পরেই মিসেস লাহিড়ির বাড়ি। বাড়ির সামনে উঁচু বোয়াক। দুপাশে খুবই সাধারণ ফুলের বাগান।

মিস থাম্পি এখানে নতুন অতিথি, তবু তিনি লম্বা লম্বা পা ফেলে আগে আগে হাঁটছিলেন। যেন নিজের পরিচিত জায়গাতে যাচ্ছেন। নিজেই গেট খুলে খোশ মেজাজে বাগান দেখতে দেখতে ভেতরে ঢুকলেন।

রোয়াকে দাঁড়িয়েছিলেন কর্তা-গিন্নি অতিথিকে অভ্যর্থনা করার জন্যে। পাশে ওঁদের ছেলে, বছর তেরো বয়েস।

মিস থাম্পি বোয়াকে উঠে একটু দাঁড়িয়ে পড়লেন। কপালে যেন একটু ভাঁজ পড়ল। কিন্তু তা কয়েক মুহূর্তের জন্যে।

মিসেস লাহিড়িই অভ্যর্থনা করলেন, আসুন। ইনি আমার হাজব্যান্ড

ভদ্রলোক নিজেই বাকি পরিচয়টুকু দিলেন।

নির্মল লাহিড়ি।

মিস থাম্পি গভীর আন্তরিকতায় হ্যান্ডসেক করলেন।

–আমার ছেলে দেবল। ক্লাস এইটে পড়ছে।

মিস থাম্পি হেসে তার চুলের ওপর একটু আদর করে দিলেন।

নির্মলবাবু সবাইকে নিয়ে ভেতরের ঘরে বসালেন। মিসেস লাহিড়ি অস্বস্তিতে পড়লেন কোন কথা দিয়ে কিভাবে আলাপ শুরু করবেন। বাংলায় বলতে পারলে সুবিধে হতো।

নির্মলবাবুই কথা শুরু করলেন। তার ইচ্ছে ছিল প্রেততত্ত্ব নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু আমল পেলেন না। তিনি একবারই শুধু জিজ্ঞেস করেছিলেন, সত্যি কি আপনি অশরীরী কিছুতে বিশ্বাসী?

মিস থাম্পি একটু হেসেছিলেন। উত্তর দেননি। এতে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ভারি লজ্জিত হয়েছিলেন।

এরপর খাওয়া। কফি আর কেক। সঙ্গে পোটাটো চিপস। মিস থাম্পি বেশ তৃপ্তি করেই খেলেন। খেতে খেতেই মিস থাম্পি জিজ্ঞেস করলেন, লোডশেডিং হয় কিনা, হলে কি করেন? তারপর হঠাৎই মান্তুকে ইশারায় বললেন, ছেলেটিকে বাইরে পাঠিয়ে দিতে।

মান্তু হতভম্ব।

মিসেস লাহিড়িও প্রথমে ঠিক বুঝতে পারলেন না তার ছেলেকে ঘর থেকে চলে যেতে হবে কেন? ও তো চুপচাপ একপাশে বসে আছে। কোনোরকম অভদ্রতা করেনি। কিন্তু মিস থাম্পি আবার চোখের ইশারা করতেই দেবলকে উনি বাইরে পাঠিয়ে দিলেন। একটা অজানা আশঙ্কায় স্বামী-স্ত্রীর বুক কাঁপতে লাগল। মিস থাম্পি গৃহকর্তাকে লক্ষ্য করে হেসে বললেন, মিস্টার লাহিড়ি, আপনি কিন্তু আপনার ফ্যামিলির সকলের কথা বলেননি।

লাহিড়িবাবু মুখ কাঁচুমাচু করে বললেন, আমি তো সকলের সঙ্গেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছি। সকলে বলতে–আমার মিসেস আর ঐ ছেলে।

মিসেস লাহিড়ি যোগ করলেন, শুধু মেয়েটা এখানে নেই। মামার বাড়ি গেছে।

মিস থাম্পিও হেসে বললেন, কিন্তু আপনাদের সঙ্গেই আছেন এমন একজনকে আপনারা বাদ দিয়েছেন।

স্বামী-স্ত্রী দুজনেই অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে মিস থাম্পির দিকে তাকালেন।

মিস থাম্পি বললেন, আমি কিন্তু আপনাদের বাড়ি ঢুকেই তাঁকে দেখতে পেয়েছি। বলে হাসতে লাগলেন।

অবাক নির্মল লাহিড়ি বললেন, আরও একজনকে দেখেছেন?

–হ্যাঁ, আপনারা যখন আমায় রিসিভ করছিলেন, তিনিও পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ছুটে ঘরের মধ্যে চলে গেলেন। আমি ঘরে ঢুকেই তাকে খুঁজেছিলাম। কিন্তু তখন আর দেখতে পেলাম না। দেখলাম পরে খাবার সময়ে। টেবিলের অল্প দূরে দাঁড়িয়েছিলেন। ভারি shy type-এর soft ভদ্রমহিলা।

মিস থাম্পি থামলেন।

সারা ঘর জুড়ে কেমন একটা অস্বস্তি। কেউ সেই মুহূর্তে কোনো কথা বলতে পারল না।

–এখন বলুন ইনি কে?

স্বামী-স্ত্রী একেবারে বোবা হয়ে গেলেন। নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। নির্মলবাবু একটু সামলে নিয়ে বললেন, আর তো কেউ নেই মিস থাম্পি।

–নেই, কিন্তু এক সময়ে ছিলেন। একজন মহিলা। বয়েস বছর কুড়ি-বাইশ। পাতলা গড়ন। শ্যামবর্ণা। লম্বা চুল–একটু যেন কুঁজো হয়ে হাঁটেন

শুনতে শুনতে লাহিড়িবাবুর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

বলুন মিস্টার লাহিড়ি, এইরকম কেউ কি কখনো ছিলেন এ বাড়িতে? মিস থাম্পির গলার স্বরটা কেমন যেন অস্বাভাবিক শোনাল।

কয়েক মিনিট নিরেট স্তব্ধতা। তারপর নির্মল লাহিড়ি অস্ফুটস্বরে বললেন, আপনি যে রকম বর্ণনা দিচ্ছেন তাতে মনে হচ্ছে আপনি আমার ফাস্ট ওয়াইফের কথা বলছেন। কিন্তু সে তো অনেকদিন হল–

কথা শেষ হল না। হঠাৎ মিসেস লাহিড়ি কাঁপতে কাঁপতে চেয়ারে বসে পড়লেন। তারপরই অচৈতন্য।

বিমূঢ় নির্মল লাহিড়ি দু হাতে মিসেস লাহিড়ির দেহটা ধরে রইলেন।

Dont worry! মিস থাম্পি বললেন।একটু পরেই উনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। ওঁকে বলবেন–nothing to fear. এই মহিলা যখন জীবিত ছিলেন তখন আপনাকে খুব ভালবাসতেন। এখনো ভালবাসেন। আর জেনে রাখুন যে spirit ভালবাসতে পারে সে কারো ক্ষতি করে না।

বলে দুহাত তুলে নমস্কার করে বেরিয়ে এলেন।

বাড়ি ফিরে মান্তু ললিতবাবুকে সব ব্যাপারটা বলল। ললিতবাবু স্তম্ভিত হয়ে শুনলেন। মিস থাম্পি হঠাৎই যেন এদের কাছে সাধারণ সম্মানীয় অতিথি থেকে ভয়-বিস্ময়-শ্রদ্ধার পাত্রী হয়ে উঠলেন। এও একরকম অস্বস্তি। এই-সব মানুষের কোথায় কিসে তুষ্টি কিসে বিপত্তি বোঝা দায়। তাছাড়া অন্য অস্বস্তিও রয়েছে মান্তুর। যে জন্যে রীণাকে আনা তা আর কিছুতেই হচ্ছে না। ওকে নিয়ে যে নিরিবিলিতে মিস থাম্পির কাছে বসবে, মিস থাম্পি তার ফুরসতটুকুও দিচ্ছেন না। মিসেস লাহিড়ির বাড়ি থেকে ফিরে এসে আবার খাতাপত্র নিয়ে বসেছেন উনি। হয় তো আরো দুএকদিন থাকবেন। কিন্তু রীণা আর কিছুতেই থাকবে না। ওকে কাল সকালেই পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে।

রীণার ওপরই মান্তুর রাগ হল। ও যদি নিজে মিস থাম্পির কাছে গিয়ে সোজাসুজি ওর বিপদের কথা বলত, তাহলে হাঙ্গামা চুকে যেত। কিন্তু ও তো ত্রিসীমানায় ঘেঁষছেই না।

রাত নটা বাজল। মিস থাম্পি তার খাতা নোটবই ব্যাগে পুরে বেরিয়ে এলেন।

–আপনার খাবার ব্যবস্থা করি? মান্তু বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করল।

করুন। আজ তাড়াতাড়ি শোব। খুব টায়ার্ড। খাওয়াদাওয়া চুকে গেল খুব তাড়াতাড়ি আর নিঃশব্দে। যা সচরাচর হয় না। কারণ যাঁর সঙ্গে ওরা গল্প করবে ভেবেছিলেন, তিনিই তো অতিশয় গম্ভীর।

মান্তু দেখল আর সময় নেই। খাওয়ার পরই মিস থাম্পি শুয়ে পড়বেন। আর রীণাও কাল সকালে চলে যাবে। কাজেই খাওয়ার পরই রীণাকে নিয়ে ওঁর ঘরে ঢুকতে হবে।

মান্তুকে দুর্ভাবনার হাত থেকে বাঁচালেন মিস থাম্পিই।

খাওয়া শেষ করে রীণা থালায় আঙুল দিয়ে আঁক কাটছিল। হঠাৎ মিস থাম্পি জিজ্ঞেস করলেন-Why you look so pale? রাত্রে ভালো ঘুম হয় না?

রীণা চমকে মিস থাম্পির দিকে তাকাল।

-Are you a victim of any nightmare? রাত্রে কোন দুঃস্বপ্ন দ্যাখ?

রীণা প্রথমে কি উত্তর দেবে ভেবে পেল না। তার পরই সংকোচ কাটিয়ে বলল, Not dream madam! Something else.

মিস থাম্পি ভুরু কুঁচকে চোখ ছোটো করে তাকালেন।

রীণা বলল, Not only at night-constantly haunted by a feeling of an unknown fear.

মান্তু এই সুযোগে বন্ধুর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, শুধু রাত্তিরেই নয়, দিনেও খুব ভয় পায়।

-What is that fear?

–That I do not know myself ভয়টা কি ম্যাডাম, আমি নিজেও তো জানি না।

মিস থাম্পি কিছুক্ষণ কী ভাবলেন। তারপর বললেন, আজ আমি খুব টায়ার্ড। কাল সকালে আপনার সঙ্গে কথা বলব। ঠিক সকাল ছটায়।

.

১২.

ডাক্তার রুদ্র

বাড়িতে রীণা নেই, কাজেই ফেরার তাড়া নেই। রীণাকে ছেড়ে দিতে খুব একটা ইচ্ছে ছিল না ওর। তার কারণ, রীণা যেন ক্রমশ মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে উঠছে। এ বিষয়ে সঞ্জয়ের বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এ অবস্থায় রীণাকে চোখের আড়াল করার এতটুকু ইচ্ছে ছিল না সঞ্জয়ের। অবশ্য মান্তু কথা দিয়েছে সে যেমন নিজে রীণাকে নিয়ে যাচ্ছে রাত পোহালেই তেমনি নিজেই পৌঁছে দিয়ে যাবে। মান্তু আড়ালে ওকে মিস থাম্পির কথাও বলেছে। অসাধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন মহিলা, প্রেতচর্চাই তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত। মান্তুর ইচ্ছে রীণাকে একবার তাঁর সঙ্গে কথা বলিয়ে দেয়। এসব হাস্যকর কথা। মহিলাটি কি ঝাড়ফুঁক করে রীণাকে সুস্থ করে তুলবেন? তবু সঞ্জয় বাধা দেয়নি। ভেবেছে মান্তুর বাড়িতে এক রাত্তির থাকলে রীণার হয়তো ভালোই লাগবে। মান্তুও তাকে বোঝাতে পারবে।

সারাদিন হাসপাতালে কাজের মধ্যে কেটে গেল। রীণা যে বাড়ি নেই এ কথা একবারও মনে হল না। মনে পড়ল বিকেলে হাসপাতাল থেকে বেরোবার পর। ভাবল এখনই গিয়ে কি করবে? বাড়ি তো খালি।

সঞ্জয়ের অবশ্য হুটহাট যাওয়ার মতো জায়গা একটা আছে। সেটা ডাক্তার রুদ্রর বাড়ি। সঞ্জয় ঠিক করল ওখানেই যাবে। রীণার ব্যাপারে একটু কথা বলা দরকার।

ডাঃ অবিনাশ রুদ্রের বাড়ি বেলগাছিয়ায়। গেটের ভেতর মোরাম বিছানো পথ। দক্ষিণ দিকে গ্যারেজ। নিচের ঘরে চেম্বার। সকালে রুগী দেখেন। সন্ধেবেলায় বসেন না। ঐ সময়টা মিটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। মিটিং না থাকলে বই পড়েন।

ডাঃ রুদ্রের এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে লন্ডনে ডাক্তারি পড়ছে। বাড়িতে শুধু স্ত্রী। নির্ঞ্ঝাট সংসার।

সঞ্জয় কলকাতায় এসেই ভেবেছিল রীণাকে নিয়ে ডাঃ রুদ্রের বাড়িতে বেড়াতে আসবে। কিন্তু তখন রীণাকে নিয়ে সিনেমা থিয়েটার দেখাতেই দিন কেটে গেল। তারপরই রীণা ভয় পেতে আরম্ভ করল। আর বেরোন হল না। শেষ পর্যন্ত ডাঃ রুদ্রকেই আসতে হল রীণাকে দেখতে। রীণার সঙ্গে সেই তাঁর প্রথম পরিচয়। যাবার সময়ে তিনি বার বার করে বলেছিলেন–সঞ্জয় যেন রীণাকে একদিন নিয়ে যায় তার বাড়িতে। কাকীমা দেখবে।

সঞ্জয় একদিন নিয়ে গিয়েছিল রীণাকে। রীণার মনে অস্বস্তি ছিল ডাঃ রুদ্র হয়তো কাকীমার সামনেই তাকে ঠাট্টা করবেন। কিন্তু ডাঃ রুদ্র ওসব কোনো কথাই তোলেননি। রীণার খুব ভালো লেগেছিল।

মুখে চুরুট, সোফায় গা এলিয়ে ডাঃ রুদ্র বই পড়ছিলেন। সঞ্জয়কে আসতে দেখে বই মুড়ে রেখে সহাস্য অভ্যর্থনা করলেন, এসো এসো।

সঞ্জয় সামনের কোচে বসল।

–কি খবর বলো। রীণা কেমন আছে? বলেই ভেতরের দরজার পর্দা সরিয়ে হাঁকলেন, ওগো, সঞ্জয় এসেছে।

একটু পরেই ডাঃ রুদ্রের স্ত্রী হাসিমুখে এসে দাঁড়ালেন। রীণাকে নিয়ে এলে না কেন?

সঞ্জয় ইতস্তত করে বলল, আজ আমি হাসপাতাল থেকে আসছি। ছুটির দিনে নিয়ে আসব।

বোসো। আমি আসছি। বলে তিনি ভেতরে চলে গেলেন।

সঞ্জয় তখন রীণার কথা বলল। প্রথম দিনের ঘটনা ডাঃ রুদ্রের জানা ছিল। সঞ্জয় পরের দিকের সব ঘটনা খুলে বলল। গেলাস ভাঙা, ছবি চুরি থেকে আরম্ভ করে মান্তুর বাড়ি একা বেড়াতে যাওয়া পর্যন্ত সব। বলল না শুধু মান্তুর সঙ্গে আজকে যাওয়ার কথাটা। লুকোবার তেমন কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু মিস থাম্পির কথায় উনি হয়তো রাগ করবেন, কিংবা হাসবেন।

সব শুনে ডাক্তার রুদ্র গম্ভীর হয়ে রইলেন।

সঞ্জয় জিজ্ঞেস করল, কেসটা আপনার কিরকম মনে হয়? মানসিক ব্যাধিই?

ডাঃ রুদ্র বললেন, ওর সঙ্গে ভালো করে কথা না বললে বুঝতে পারব না।

সঞ্জয় বলল, মানসিক ব্যাধি ছাড়া আর কি হতে পারে? আপনি কি মনে করেন ও সত্যিই কোনো অশরীরী আত্মাকে দেখে?

ডাঃ রুদ্র কিছুক্ষণ কি ভাবলেন। তার পর বললেন, দ্যাখো, এ সম্বন্ধে চটু করে কিছু বলা ঠিক নয়, আমি অলৌকিক ব্যাপার নিজে দেখিনি। তবে রুগী দেখেছি।

–তারা কেউ সেরেছে?

–হ্যাঁ, সবাই। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবন চালাচ্ছে।

–নিশ্চয় ঝাড়-ফুঁক করে নয়?

ডাক্তার রুদ্র বললেন, না। চিকিৎসা করেই। তবে সে চিকিৎসা ওষুধ-ইনজেকশান দিয়ে নয়, পেশেন্টের মনস্তত্ত্ব স্টাডি করে কিংবা জায়গা বদল করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অন্য উপায়ও নিতে হয়েছে।

ডাঃ রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমার মনে হচ্ছে তোমার ধারণাই ঠিক। রীণা সাইকোপ্যাথিক পেশেন্ট হয়ে পড়েছে।

সঞ্জয় এতেও সন্তুষ্ট হল না। জিজ্ঞেস করল, হঠাৎ সাইকোপ্যাথিক পেশেন্ট হয়ে পড়ল কেন? তারও তো কারণ থাকবে।

-হ্যাঁ, কারণ তো থাকবেই।

–কিন্তু আমি তো কোনো কারণ দেখছি না।

ডাঃ রুদ্র একটু হাসলেন। বললেন, তুমি আর কত দিন ওকে দেখছ? তিন বছর? চার বছর? তার আগেও তো কোনো ঘটনা ঘটতে পারে যা তুমি জান না। এমনকি ওর মা-বাবাও জানে না। এমনও হতে পারে ব্যাপারটা ওর নিজেরও মনে নেই!

সঞ্জয় অবাক হয়ে বলল, সে আবার কী?

–হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। খুব অল্প বয়েসে হয়তো কোনো কিছুতে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিল। সেই ভয়ের কারণ বা স্বরূপ আজ আর মনে নেই। কিন্তু ভয়ের। তীব্র অনুভূতিটা থেকে গিয়েছে সাব-কনসাস মাইন্ডে।

ডাঃ রুদ্র একটু থামলেন। তারপর সোজা হয়ে বসে বললেন, ছোটোবেলায় একবার নররাক্ষসের জ্যান্ত মুর্গি খাওয়া দেখে ভয় পেয়েছিল, সেদিন তুমি বলছিলে না?

—হ্যা। এবারও মহাজাতি সদনে ম্যাজিক দেখতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল সে কথাও আপনাকে বলেছি। কিন্তু তার সঙ্গে এখনকার মানসিক

এই পর্যন্ত বলে সঞ্জয় একটু থামল। ডাক্তার রুদ্রের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, একটা কারণ খুঁজে পেয়েছি কাকাবাবু। রীণা যাকে দেখে তার পরনে কালো কোটপ্যান্ট। রীণা ছোটোবেলায় যে নররাক্ষসকে দেখেছিল সেও আসলে ম্যাজিসিয়ান। আমার বিশ্বাস সেও কালো পোশাক পরত।

ডাঃ রুদ্রের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, ভালো কথা বলেছ। রীণাকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখো দিকি, সেই ম্যাজিসিয়ানের পোশাকটা মনে আছে কিনা।

করব।

এই সময়ে ডাঃ রুদ্রের স্ত্রী দুজনের জন্য চা, টোস্ট আর ওমলেট নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। প্লেট নামিয়ে কাজ সারতে মিসেস রুদ্র ভেতরে চলে গেলেন।

ডাঃ রুদ্র সোফায় আধ-শোওয়া হয়ে খেতে খেতে বললেন, তবে আমার মনে হয় ওটা ঠিক কারণ নয়। ধরো, সেই ম্যাজিসিয়ানের কালো পোশাকটাই যদি ভয়ের কারণ হয় তাহলে তো যে কোনো কালো কোট-প্যান্ট পরা লোক দেখলেই ভয় হবে। মহাজাতি সদনে ম্যাজিক দেখার আগে কি কখনো কালো পোশাক পরা লোক দেখেনি?

সঞ্জয় চুপ করে গেল। নিঃশব্দে দুচুমুক চা খেয়ে বলল, ধরেই নিলাম না হয় ছোটোবেলার স্মৃতি থেকেই মহাজাতি সদনে ম্যাজিক দেখতে গিয়ে কিংবা ম্যাজিসিয়ানকে দেখে ভয় পেয়েছিল। তার সঙ্গে বাড়িতে ভয় পাবার কারণ কি? আর কলকাতায় এসেই বা এতদিন পর ভয় পেতে লাগল কেন? সব যেন কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে কাকাবাবু।

ডাঃ রুদ্র চা শেষ করে একটা চুরুট ধরালেন। বললেন, গোলমাল কিছুই নয়। ব্যাপার একটাই–ভয় পাওয়া। সেই সঙ্গে একটা-কিছু দেখা।

সঞ্জয় একটু উত্তেজিত হয়ে বলল, আপনিও বিশ্বাস করেন ও কিছু দেখে?

-আমি তো আগেই বলেছি, ও বিষয়ে চট করে কিছু বলা যাবে না। রোগের বিকারে মানুষ নিজে থেকেই বকে। কিন্তু যা বকে তা ভুল বকা। মানসিক রোগে লোকে নানা কারণে ভয় পায়-কখনো কোনো শব্দ শুনে, কখনো কোনো বিশেষ গন্ধ পেয়ে, কখনো বা কিছু দেখে। অথচ সেই শব্দ, গন্ধ বা বস্তু হয়তো আদপেই কিছু নেই।

–তাহলে আপনি সেই আমার কথাতেই আসছেন রীণা সাইকোপ্যাথির পেশেন্ট?

–হ্যাঁ, তাই।

সঞ্জয় নিজেই কত বার রীণাকেই বলেছে, তুমি মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে পড়েছ। আর আজ ডাঃ রুদ্রের মুখে ঐ একই কথা শুনে তার মুখটা শুকিয়ে গেল। ম্লান মুখে জিজ্ঞাসা করল, তাহলে ট্রিটমেন্ট?

–আমিই করব। অবশ্য যদি বুঝি সত্যিই ওর মানসিক রোগ হয়েছে।

এই বলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। সঞ্জয়ের পিঠ চাপড়ে বললেন, শুনে অবাক হবে, আমি এখন মেমেরিজম নিয়ে কিছু পড়াশোনা করছি। বলতে বলতে সামনের র‍্যাক থেকে কতকগুলো ফাইল বের করে টেবিলের ওপর রাখলেন। বললেন, একসময়ে ওদেশের ডাক্তার ফিসার (Dr Fisher), রিচার (Richer), বিনেট (Binet), ফেরি (Fere), বিখ্যাত ফরাসী বিজ্ঞানবিদ ডাক্তার লুই আর স্বয়ং মেসমার যিনি মেসমেরিজমের আবিষ্কর্তা এঁরা সকলেই মেমেরিজমের সাহায্যে কঠিন কঠিন রোগ সারাতে পারতেন। সেই সব খবরের কাটিং এই ফাইলে আছে। কৌতূহল থাকলে একটা ছুটির দিনে এসে পড়ে দেখতে পার। একটু থেমে বললেন এখনও এদেশে বহু জটিল রোগ মেমেরিজমের সাহায্যে সারানো যায়। আমাদের দেশে ঝাড়-ফুঁক করে রোগ সারানো হতো। এখনও পল্লীগ্রামে ঝাড়-ফুঁকের ব্যবস্থা চলে। এই ঝাড়-ফুঁকও এক ধরনের মেসূমেরিজ। তুমি কখনো দেখেছ কি না জানি না ওঝারা রুগীর কাছে বসে রুগীকে না ছুঁয়ে কিংবা তার দেহের ওপর দিয়ে খুব আগ্মভাবে হাত চালায়। একে বলে পাস দেওয়া। মাথা থেকে পা পর্যন্ত এইরকম কয়েকবার পাস দিলেই রুগী ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ভাঙলে দেখা যায় সে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছে। অনেক মহাপুরুষই তো রোগীর গায়ে হাত বুলিয়ে তাদের রোগমুক্ত করতেন। এটা অস্বাভাবিক বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আসলে তারা প্রচণ্ড মানসিক শক্তির অধিকারী। ঐ শক্তির বলেই তারা রোগীকে রোগমুক্ত করতে পারতেন। আর মেমেরিজমের গোড়ার কথাই হচ্ছে প্রচণ্ড মানসিক শক্তি। বুঝতেই পারছ মানসিক রোগের ক্ষেত্রে এই মেসমেরিজম্ কত শক্তিশালী চিকিৎসা।

সঞ্জয় বলল, তাহলে কি আপনি রীণাকে হিপনোটাইজ করে সারাবেন?

ডাঃ রুদ্র হেসে বললেন, তাহলে তো খুব ভালোই হতো। কিন্তু হিপনোটাইজ করি সে শক্তি আমার কই? আজকের দিনে কজনারই বা সে শক্তি আছে? তবে এবিষয়ে আমার ইন্টারেস্ট আছে বলেই তোমাকে এত কথা বললাম।

সঞ্জয় একটু অধৈর্য হয়ে বলল, তাহলে আপনি কিভাবে সারাবেন?

সঞ্জয় না হয়ে অন্য কেউ এ কথা জিজ্ঞেস করলে ডাঃ রুদ্র হয়তো বিরক্ত হতেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি শুধু একটু হাসলেন। বললেন, প্রথমে রোগের সঠিক কারণ খুঁজে বের করতে হবে। দেখতে হবে চাপা কোনো ভয়ের স্মৃতি আছে কিনা? কোনো মানসিক আঘাত পেয়েছে কিনা। অনেক মানসিক আঘাত নিঃশব্দে সহ্য করতে হয়, তার প্রভাবই সবচেয়ে বেশি। এছাড়া অতৃপ্ত যৌন-কামনারও একটা প্রভাব আছে। বিশেষ করে যারা উগ্রবিকৃত যৌন-কামনায় কাতর তাদের মানসিক বিকার জন্মাতেই পারে। বিকৃত যৌন-কামনায় কাতর এমন একটি পেশেন্ট আমিই পেয়েছিলাম।

সঞ্জয় অধৈর্য হয়ে বলল, রীণার ক্ষেত্রে এসবের কোনো প্রভাবই নেই। কলকাতায় আসার আগে পর্যন্ত সে সবদিক দিয়েই সুখী ছিল। এখনও তার কোনো কিছুরই অভাব নেই।

ডাঃ রুদ্র স্নিগ্ধ হেসে বললেন, তা হয়তো ঠিক। তবু তুমি নিজে ডাক্তার। এই ধরনের মনস্তাত্ত্বিক ঘটনা জেনে রাখা ভালো। সেই পেশেন্টটির কথা শোনোনা।

ডাঃ রুদ্র একটু থামলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন, স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবন। দুটি সন্তানও হয়েছে। স্বামীটি সুদর্শন, ভদ্র, মার্জিতরুচি, সলজ্জ প্রকৃতির। স্ত্রীটি মোটামুটি সুন্দরী। পাতলা গড়ন। গাল দুটি একটু বসা। কিন্তু ঝকঝকে চোখ। মোটেই মুখরা নয়, বরঞ্চ স্বল্পভাষী। তাকে দেখেই মনে হয়েছিল তার জীবনের অনেক সুখ-দুঃখের কথা সে যেন ঠোঁটে কুলুপ এঁটে আছে। দশ বছর শান্ত দাম্পত্য জীবন কাটাবার পর স্ত্রীটি হঠাৎ কিরকম অস্বাভাবিক হয়ে উঠল। কোনো কিছুতেই আনন্দ নেই, উৎসাহ নেই, কারো সঙ্গেই কথা বলতে ভালো লাগে না, এমনকি–এমনকি রাত্রে স্বামীর পাশে শুয়েও পাশ ফিরে থাকত। স্বামীর মনে হতো যেন একতাল বরফ তার পাশে পড়ে আছে। অগত্যা স্বামী তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করল। প্রথমে স্ত্রী চিকিৎসা করাতে রাজি হয়নি। বিরক্ত হয়ে বলত–আমার কি হয়েছে যে চিকিৎসা করাব?

শেষে অবশ্য রাজি হয়েছিল। গোপন সাক্ষাৎকারের সময় হিতৈষী ডাক্তারের কাছে সে যা বলেছিল তা এই–প্রথম কৈশোর কালেই সে একটা ছেলের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। ছেলেটি শুধু যে উপভোগ করত তা নয়, উপভোগের সময়ে নানা রকম খারাপ কথা বলত, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করত। তাতে মেয়েটি রাগ তো করতই না, বরঞ্চ তার ভালো লাগত। পরবর্তী জীবনে স্বামীর কাছ থেকেও ঐ রকম আচরণ আশা করত। কিন্তু স্বামীর কাছ থেকে সেরকম ব্যবহার পেত না। শেষ পর্যন্ত–মানে দশ বছর পর তার হঠাৎ এমন অবস্থা হল যে, পাগলের মতো সেই ছেলেটার খোঁজ করতে লাগল। ছেলেটি এই পরিবারের এতই পরিচিত ছিল যে তাকে কেউ সন্দেহ করত না। মেয়েটি এই ব্যাধিরই শিকার।

এই পর্যন্ত বলে ডাঃ রুদ্র একটু থামলেন।

সঞ্জয় জিজ্ঞেস করল–মহিলাটির শেষ পর্যন্ত কি হল?

–চিকিৎসা শুরু হল। চিকিৎসা কি জান? চিকিৎসা আর কিছুই নয়, মাস ছয়েকের জন্যে তাকে তাদেরই অতি সাধারণ এক গৃহস্থ যৌথ পরিবারে পাঠিয়ে দেওয়া হল। তার স্বামীকে বলা হল–এই ছমাসের মধ্যে সে যেন স্ত্রীর কাছে না যায়। শুধু তখনই যাবে যখন তার স্ত্রী তাকে চিঠি লিখে আসতে বলবে। সেই যৌথ পরিবারে গিয়ে বধূটি প্রথম সুস্থ স্বাভাবিক ব্যস্তসমস্ত জীবনের আস্বাদ পেল। তারপর থেকেই তার পরিবর্তন। এখন সে সম্পূর্ণ সুস্থ স্বাভাবিক।

সঞ্জয় কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, রীণার ট্রিটমেন্ট তাহলে কিভাবে করবেন?

ডাঃ রুদ্র হেসে বললেন, রীণার ক্ষেত্রে কোন ধরনের ট্রিটমেন্ট করব তার সঙ্গে কথা বলার পর ঠিক করব। অবশ্য রীণা যদি সত্যিই সাইকোপ্যাথিক পেশেন্ট হয়।

বড়ো ঘড়িটায় ঢং ঢং করে নটা বাজল। সঞ্জয় উঠে পড়ল। এখন তাকে হোটেলে ছুটতে হবে।

.

রাত সাড়ে দশটা শহর কলকাতায় এমন কিছু নয়। কিন্তু যশোর রোডের ধারে এই অঞ্চলটা এরই মধ্যে নিঝুম হয়ে গেছে। বিশেষ করে এই বাড়ির একতলা দোতলার ভাড়াটেরা দশটার আগেই খাওয়া সেরে শুয়ে পড়ে। একমাত্র গরমকালে লোড শেডিং হলে অনেক রাত পর্যন্ত বাইরে এসে বসে।

সঞ্জয় ওপরে উঠে এল। প্যাসেজটা অন্ধকার। বাড়িতে কে আছে যে আলো জ্বেলে রাখবে?

অন্ধকারেই সঞ্জয় তালা খুলে ঘরে ঢুকল। ঢুকতেই গা-টা কেমন ছমছম করে উঠল। এর আগেও একদিন এরকম হয়েছিল, যেদিন রীণা একা মান্তুদের বাড়ি যাবার জন্যে বেরিয়েছিল। তবে সেদিনের অস্বস্তিটা অন্য কারণে। রীণার জন্যে দুর্ভাবনায়। দুর্ভাবনা আর গা ছমছ করা এক নয়।

কিন্তু আজই বা গা ছমছম করল কেন?

সঞ্জয় তাড়াতাড়ি আলো জ্বালল। আলোয় ঘর ভরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে গা-ছমছমানি থেমে গেল। নিজেকে ধমক দিল–ডাক্তার মানুষের অন্ধকারে ভয়? তাও তেতলার নিজের ঘরে ঢুকতে?

দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে সঞ্জয় বিছানায় এসে বসল। হোটেলে খেয়ে এসেছে। কাজেই শোওয়া ছাড়া এখন আর অন্য কাজ নেই। কিন্তু শুতে ইচ্ছে করল না। শুলেও ঘুম আসবে না। অগত্যা একটা সিগারেট ধরালো।

ডাঃ রুদ্রের কথাগুলো তার মনে পড়ছিল। আচ্ছা, রীণার প্রসঙ্গে হঠাৎ উনি ঐ মহিলাটির কথা টানলেন কেন? তিনি কি রীণার ক্ষেত্রেও সেরকম কিছু সন্দেহ করেন? মান্তুর দাদার সঙ্গেও ওর খুব ভাবছিল নাকি কী জানি বাবা! পরক্ষণেই অবশ্য সঞ্জয় সে কথা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে পাশ ফিরে শুল। কিন্তু কিছুতেই ঘুম এল না।

তার কেবলই সেইসব রাতগুলোর কথা মনে হতে লাগল যেসব রাতে রীণা ভয় পেয়েছিল। ঐ তো বসার ঘরে টেবিলটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ঐ টেবিলের কাছেই রীণা কী যেন দেখেছিল। ঐ টেবিল থেকেই গেলাস পড়ে ভেঙেছিল। আচ্ছা–সেই ছবিটার কি হল? সত্যিই কি কেউ নিয়ে গেছে? কিন্তু কে নেবে? এঘরে তো বাইরের কেউ আসে না।

ভাবতে ভাবতে সঞ্জয়ের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। সে জোর করে অন্য দিকে মন সরাবার চেষ্টা করল। কিন্তু মনটা সেই অশরীরী আত্মার মতো টেবিলটার চারদিকেই ঘুরতে লাগল।

কী মুশকিল! ভয় পাচ্ছে নাকি? সঞ্জয় জোর করে নিজেকে সচেতন করার চেষ্টা করল।

কই? অন্য দিন তো ভয় পায় না। ঘরে সঙ্গী তো শুধু রীণা। তাও সে তো নিজেই ভয়ের শিকার!

আশ্চর্য! আজ সেই একটা ভীতু মানুষই কাছে না থাকাতে সঞ্জয়ের মতো ডাক্তারও কেমন ভয় পাচ্ছে।

সঞ্জয় উঠে পায়চারি করতে লাগল। হঠাৎ ও চমকে উঠল। ঘরে কি আর কেউ আছে? তার পিছনে!

নাঃ, ওটা ওর নিজেরই ছায়া।

আশ্চর্য! মেঝেতে নিজের ছায়া দেখেই বুকের মধ্যে কিরকম করে উঠেছিল। বুঝতে পারল, এই জন্যেই মানুষ বোধহয় জায়গা-বিশেষে একা থাকতে পারে না। সঙ্গী চায়। ঘরে একটা কুকুর থাকলেও যেন অনেক নিশ্চিন্ত।

নাঃ, ঘুমনো যাক। সঞ্জয় মশারি টাঙিয়ে নিল। বিছানায় ঢুকে বেডসুইচ টিপে আলো নিভোতে যাচ্ছিল, কি মনে হল, আবার উঠে দরজাটা দেখে নিল ঠিক মতো বন্ধ হয়েছে কি না। সিঁড়ির দিকের জানলাটা অন্য দিন খোলা থাকে। আজ বন্ধ করে দিল।

বিছানার কাছে আসছিল–ফিরে গিয়ে একবার বাথরুমটা দেখে নিল। তারপর খাটের তলা।

নাঃ, কেউ কোথাও নেই। নিশ্চিন্ত। মনকে বোঝাল–অন্য কিছুর জন্যে নয়, চোর-ডাকাতের জন্যেই এত সাবধানতা!

বিছানায় শুয়ে বেডসুইচ অফ করে দিল।

তবু ঘুম আসছে না। তখন সঞ্জয় ডাঃ রুদ্রের সঙ্গে যে কথা হল তাই নিয়ে আবার ভাবতে লাগল। ডাঃ রুদ্র যে কী বলতে চাইলেন সঞ্জয়ের কাছে তা মোটেই পরিষ্কার নয়। উনি কি এই বয়েসে এখন মেসমেরিজ শিখে চিকিৎসা করবেন? পাগল নাকি!

উনি রীণার সঙ্গে ভালো করে কথা বলবেন। তা তিনি হাজার বার বলুন। কিন্তু রীণাকে কোথাও চিকিৎসার জন্যে পাঠানো যাবে না। ও কিছুতেই রাজি হবে না।

তাছাড়া ডাঃ রুদ্র যদিও বলছেন মানসিক রোগ, তবু প্রতিবারই বলেছেন, যদি সত্যিই মানসিক রোগ হয়।

উনি কি তবে মানসিক রোগ ছাড়া অন্য কিছু আশঙ্কা করছেন? ডাঃ রুদ্রের মতো একজন বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্টও কি অলৌকিক কিছুতে বিশ্বাসী?

এক ঘুমেই রাত শেষ।

ঘুম ভাঙার পরই সঞ্জয়ের মনে পড়ল রীণা নেই। কাজেই চা নিয়ে কেউ আজ মুখের সামনে ধরবে না।

বিছানা থেকে উঠে পড়ল ও। মনটা খুশি খুশি, কাল রাতে কিছু হয়নি। সত্যি কিছু থাকলে তো হবে।

চা খেয়ে, শেভিং-এর কাজ সেরে স্নানের ঘরে যখন ঢুকল তখন বেলা আটটা। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই রীণা এসে পড়বে, তবু আজ আর বাড়ির ভাত জুটবে না। ক্যান্টিনেই খেয়ে নিতে হবে। তার আগে সকালে পেটে কিছু পড়া দরকার। সঞ্জয় একটা ডিম সেদ্ধ করে নিল। তারপর কোথায় নুন, কোথায় গোলমরিচ খুঁজতে খুঁজতে হাঁপিয়ে উঠল।

বেলা সাড়ে আটটা। হাসপাতালে যাবার জন্যে সঞ্জয় তৈরি। কিন্তু রীণার পাত্তা নেই। অথচ সকালেই ওর আসার কথা। মান্তুই পৌঁছে দিয়ে যাবে। কই?

পৌনে নটা হতে চলল।

নাঃ, আর দেরি করা যায় না। সঞ্জয় ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তালা লাগালো। এমনি সময়ে সিঁড়ির মুখে বন্দনা এসে দাঁড়ালো।

-আপনার ফোন।

–ফোন! সঞ্জয় চমকে উঠল। কার ফোন হতে পারে? সেদিন রাতে ফোন এসেছিল থানা থেকে। আজ? আজ নিশ্চয়ই মান্তু

বন্দনাদের বসার ঘরে ঢুকে সঞ্জয় রিসিভারটা তুলে নিল।

–হ্যালো!

–কি মশাই! কাল রাত্তিরে ভালো ঘুম হয়েছিল তো?

মহিলা কণ্ঠস্বর। কিন্তু কেমন অস্পষ্ট।

-কে বলছেন?

–ও বাবা! এত মিষ্টি করে বললাম, তবু চিনতে পারলেন না? ডাক্তাররা এমনি ভোতাই হয়।

সঞ্জয় এবার হেসে উঠল।

-ওঃ শ্ৰীমতী মান্তু! বলুন কি খবর? বেরোবার মুখে এমন একটি মধুর স্বর উপহার পাব ভাবতে পারিনি।

-চুপ করুন মশাই! বেশি গলে যাবেন না। পাশেই আপনার অর্ধাঙ্গিনী আছেন। শুনতে পাবেন।

সঞ্জয় জোরে হেসে উঠল।

–হাসিটা এখন তুলে রাখুন। শুনুন–এবেলা যাচ্ছি না। ওবেলা। দুজন নয়, তিন জন। পুপুকে যদি ধরেন তা হলে সাড়ে তিন জন।

–তিন, জন?

না না এখন কিছু বলব না। ভয় নেই, পুরুষ নন। মহিলাই। একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে চেষ্টা করবেন। জমিয়ে আড্ডা দেব। ছাড়বেন না। রীণা কথা বলবে।

সঞ্জয় রিসিভারটা কান বদল করে নিল।

–হ্যালো! আমি রীণা। কাল ভয়টয় পাওনি তো?

–ভয়? কিসের ভয়? ধুৎ?

তাড়াতাড়ি ফিরছ তো?

-দেখি। বলে রিসিভারটা রেখে বন্দনার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে তাড়াতাড়ি নেমে গেল। বড্ড দেরি হয়ে গেছে।

.

১৩.

মিস থাম্পির অভিজ্ঞতা

সন্ধেবেলা বাসায় ফিরে সঞ্জয় দেখল বাড়ি সরগরম। হাসি-গল্পে ভরপুর। একে মান্তু এসেছে সেই সঙ্গে এসেছেন সেই ম্যাড্রাসি মহিলা। তিনিও যে আসকেন, মান্তু ফোনে না বললেও, সঞ্জয় অনুমান করেছিল। রীণা তো এই মহীয়সী অতিথিটির আপ্যায়নে মহা ব্যস্ত।

আজ ওকে দেখলে কে বলবে এই রীণাই এই বাড়িতে এত দিন ভূতের ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে ছিল। এমনকি ওঁর মুখের ওপর যে ফ্যাকাশে ভাবটা ছিল সেটাও যেন আজ আর নেই। রীণা ঠিক আগের মতোই প্রাণচঞ্চল, উচ্ছল হয়ে উঠেছে।

দেখে সঞ্জয়ের ভালো লাগল। কিন্তু দূর থেকে ঐ মহিলাটিকে দেখে মোটেই ভালো লাগল না। বরঞ্চ তাঁর মুখখানা দেখে কেমন অস্বস্তি হতে লাগল।

সঞ্জয়কে সিঁড়ির মুখে প্রথম দেখল মান্তু। হাসতে হাসতে এগিয়ে এল সে।

–খুব তাড়াতাড়ি তো এসেছেন মশাই! এদিকে আমরা হোস্টের অপেক্ষায় বসে আছি। আসুন এঘরে। বলে সঞ্জয়কে একরকম টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে গেল।

মিস থাম্পির সঙ্গে আলাপের পর্বটা মাই সেরে দিল।

মিস থাম্পি হ্যান্ডশেক করে হেসে বললেন, আপনি ছিলেন না, আপনার বাছিত সম্ভবত আমার অনধিকার-প্রবেশ হয়ে গেছে।

সঞ্জয় সসংকোচে বলল, সে কী কথা! আমি না থাকলেও আমার স্ত্রীকে তো আপনার হাতেই দিয়ে গেছি। আপনি অনুগ্রহ করে এদের সঙ্গে এসেছেন এ আমার সৌভাগ্য।

মিস থাম্পি বললেন, আজ সকালে আপনার মিসেসের মুখে সব ব্যাপারটা শুনলাম। শুনে খুব কৌতূহল হল। ভাবলাম জায়গাটা একবার দেখেই আসি।

–ভালোই করেছেন। রীণা, চা-টা দিয়েছ তো?

রীণা ভ্রূভঙ্গি করে বলল, তুমি কি মনে করেছ, তুমি ছিলে না বলে হোস্টের কর্তব্য করতে পারব না?

মিস থাম্পি উত্তরটা শুনে খুব হাসলেন।

মান্তু, রীণা দুজনেই লক্ষ্য করল এবাড়িতে এসে মিস থাম্পি যেন অন্য মানুষ হয়ে গেছেন। এমন করে প্রাণখোলা হাসতে দেখা যায়নি। ভালোই লাগল।

–নিন মশাই, গরম চা। খেয়ে দেখুন আমার হাতে কিরকম লাগে। আর এটা কি বলুন তো?

–পাঁউরুটি তো দেখতেই পাচ্ছি। তাছাড়া নিশ্চয় ঘুগনি।

–আশ্চর্য! এতও বোঝেন!

–তা আর এত দিনে বুঝব না? আপনার বান্ধবীটি তো ঘুগনি-স্পেশালিস্ট। সারা জীবনে ঐ একটিই জলখাবার শিখে রেখেছেন।

উঃ কী মিথ্যুক! রীণা যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল–সেদিন অমন নিজে হাতে কেক করলাম! কী বেইমান!

সঞ্জয় ততক্ষণে চামচে করে মুখে দিয়েছে। না, ঘুগনি নয়–মাংসের কিমা। সঞ্জয় আর কোনো মন্তব্য না করে চুপচাপ খেয়ে গেল।

মিস থাম্পি একটা শাল ভালো করে জড়িয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

–আপনারা গল্প করুন। আমি একটু ঘুরে আসি।

মান্তু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল-সন্ধে হয়ে গেছে। এখন কোথায় যাবেন এই ঠাণ্ডায়?

মিস থাম্পি টটা নিয়ে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, নিচটা একবার দেখে আসি।

রীণা বলল, একাই যাবেন? ওঁকে বলব?

মিস থাম্পি তাড়াতাড়ি বললেন, না না, কাউকে লাগবে না। আমি এই কম্পাউন্ডের মধ্যেই আছি।

আধ ঘন্টার মধ্যেই মিস থাম্পি ফিরে এলেন। সঞ্জয় হেসে বললে, কিছু পেলেন?

মিস থাম্পি দাঁতের ফাঁকে একটু হাসলেন। ছেলেমানুষের মতো বললেন, বলব কেন?

কিন্তু সবাই লক্ষ্য করল ওঁর হাতে একটু শুকনো মাটি।

.

খেতে বসতে একটু রাত হল। একসঙ্গেই সবাই বসল। খেতে খেতে গল্প হচ্ছিল। রীণা মান্তুকে বলল, মিসেস লাহিড়ির বাড়ির ঘটনাটা একবার ওকে ব। বলে সঞ্জয়কে দেখিয়ে দিল।

সঞ্জয় মুর্গির হাড় চিবুতে চিবুতে নিস্পৃহ সুরে বলল, কি বলবেন? গল্প? তা বলুন শুনি।

–গল্প নয়, ঘটনা মশাই। আমরা দুজনেই তা স্বচক্ষে দেখলাম। বলে ঘটনাটা রুদ্ধ নিশ্বাসে বলে গেল।

সঞ্জয় শুনে যে কোনো মন্তব্য করল না, মিস থাম্পি তা লক্ষ্য করলেন। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, আপনার এই ঘরে শুনলাম মাঝে মাঝে কারো আবির্ভাব হয়। আপনি ভয়টয় পান না তো?

সঞ্জয় হেসে বলল, না ম্যাডাম, ভয়টা আমার এমনিতেই কম। ভূত-প্রেতের ভয় তো জীবনে কোনোদিন করিনি। ওসব আমি মানিও না।

একটু থেমে বলল, তাছাড়া আমি ডাক্তার। বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ছাড়া–

–বিজ্ঞানই কি শেষ কথা? বিজ্ঞানের এক্তিয়ারের বাইরে কি কিছু থাকতে পারে না?

–থাকতে পারে। তবে তা নিয়ে অকারণে মাথা ঘামাবার মতো যথেষ্ট সময় আমার নেই।

মিস থাম্পি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি কি মনে করেন এ বাড়িতে ও-সব কিছু নেই? সবটাই আপনার ওয়াইফের মনের ভুল?

সঞ্জয় সেই দৃষ্টির সামনে তাকাতে পারল না। চোখ নিচু করে উত্তরটা এড়িয়ে গিয়ে বলল, এই তত গতকালই সারারাত এঘরে আমি একা ছিলাম। দিব্যি ছিলাম। কোনো কিছুই দেখিনি, কোনো শব্দও না।

মিস থাম্পি বললেন, আপনার সঙ্গে তো তার ব্যাপার নয়। কাজেই আপনাকে শুধু শুধু দেখা দেবে কেন?

সঞ্জয় হেসে অবিশ্বাসের সুরে বলল, তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন আমার স্ত্রীর সঙ্গেই শুধু তার কিছু ব্যাপার আছে। তাই সে তাকে ভয় দেখায়।

–হয়তো তাই।

—কিন্তু আমি তা বিশ্বাস করব কি করে? বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ কই?

মিস থাম্পি একটু যেন কঠোর সুরে বললেন, এসব জিনিস জনসমক্ষে প্রমাণ করা সম্ভব নয়।

রীণা ইশারায় সঞ্জয়কে চুপ করতে বলল। সঞ্জয় চুপ করে গেল।

মিস থাম্পি তার কথার জের ধরে বললেন, প্রমাণ দিতে আমিও পারব না, হয়তো প্রতিকারও আমার পক্ষে সম্ভব নয়, তবে আজ রাত্রে একবার পরীক্ষা করে দেখব বলেই এলাম।

সঞ্জয় বলল, ভালো কথা। আপনি নিজে থেকে দেখুন কোনো পাওয়া যায় কিনা।

তারপর রীণার দিকে তাকিয়ে বলল, তাহলে আজই আঁ কিংবা না হয়ে যাচ্ছে। কি বল?

রীণ কোনো উত্তর দিল না।

সঞ্জয় কথাটা বলল বটে কিন্তু বিশ্বাস না করেই। মিস থাম্পি যদি পরদিন সকালে কফি খেতে খেতে গল্প দেন যে তিনিও সেই কালো-সুট-পরা লোকটিকে স্বচক্ষে দেখেছেন তা হলেও সে বিশ্বাস করবে না। কেননা তা বিশ্বাস করা যায় না।

.

খাওয়া অনেকক্ষণ হয়ে গিয়েছিল। শীতের রাতও গম্ভীর হয়ে উঠছিল।

হঠাৎই মিস থাম্পি রীণাকে জিজ্ঞেস করলেন–আচ্ছা, সিঁড়িটা সম্বন্ধে আপনার অভিজ্ঞতা কিরকম? তার মানে আমি বলতে চাইছি সিঁড়ি দিয়ে যখন আপনি ওঠা-নামা করেন তখন কি কিছু ফিল করেন?

রীণা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল, না তো!

সঞ্জয় হেসে বলল, রীণার মনে নেই-ওর একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল। প্রথম দিনই বেচারি উঠতে গিয়ে আচমকা গড়িয়ে পড়ে গিয়েছিল।

মিস থাম্পি এক মুহূর্ত যেন থমকে গেলেন। কিন্তু কিছু বললেন না।

.

রাত সাড়ে দশটা বাজল। তবু কেউ শোবার নাম করছে না। মিস থাম্পিও না। তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কলকাতার হালচাল জিজ্ঞাসা করছিলেন।

একসময়ে মান্তু বলল, মিস থাম্পি, আপনি যদি আপনার অভিজ্ঞতা থেকে দুএকটা গল্প শোনান তাহলে শীতের রাতে বেশ জমবে।

একথায় মিস থাম্পি গম্ভীর হয়ে গেলেন। একটু যেন বিরক্ত হয়ে বললেন, দেখুন আপনারা যাকে গল্প বলেন, আমি দুঃখিত, সেরকম কিছু আমার জানা নেই। আমি সারাজীবন দেশ-বিদেশ ঘুরে যেসব তথ্য সংগ্রহ করেছি তা গল্প নয়। তা নিয়েই আমার সাধনা। সেসব আমার নিজস্ব সম্পদ!

মান্তুর মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। বলল, excuse me! আমি দুঃখিত।

মিস থাম্পি আর কিছু বললেন না। কিন্তু পরিবেশটা ভারী হয়ে গেল।

কিছুক্ষণ কাটল। তার পর নীরবতা ভাঙলেন মিস থাম্পি নিজেই। হাসতে হাসতে বললেন, আমার কথায় আপনারা ক্ষুণ্ণ হলেন বুঝতে পারছি। আচ্ছা, একটা সত্য ঘটনা বলছি শুনুন, যার মীমাংসা এখনো হয়নি।

মিস থাম্পি একটু থামলেন। সকলেই নড়েচড়ে বসলেন। কেবল সঞ্জয়ের মধ্যে তেমন কোনো চাঞ্চল্য দেখা গেল না।

কলকাতা থেকে কাল আমার ভুটান যাবার কথা। ওখানে একটা ঘটনা ঘটেছে বলে খবর পেয়েছি। বলে মিস থাম্পি থামলেন। সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, ডাঃ গুপ্ত, ঘটনাটা আপনার বিশ্বাসযোগ্য না হলেও এঁদের শোনাচ্ছি। অলৌকিক শব্দটা আমরা প্রায়শই শুনে থাকি এবং নানা প্রসঙ্গে ব্যবহারও করে থাকি। অলৌকিক অর্থাৎ এমন-কিছু যা বাস্তবজীবনে সচরাচর ঘটে না বা যা বিজ্ঞানসম্মত নয়। কিন্তু আমাদের দেশের অনেক সাধকই তাঁদের কঠোর সাধনালব্ধ বিভূতি বা অলৌকিক ক্ষমতার পরিচয় দিয়ে গেছেন। তন্ত্রমন্ত্রের কথা আপনারা সবাই শুনেছেন। আমাদের দেশের বৌদ্ধ আর হিন্দু তান্ত্রিকেরা নির্জনে এমন অনেক কিছু করতেন যা সাধারণ মানুষের জ্ঞানের বাইরে।

মিস থাম্পি একটু থামলেন। তারপর বলতে লাগলেন, অনেকের বিশ্বাস বৌদ্ধরাই আদি তান্ত্রিক।

এ নিয়ে মতভেদ থাকলেও একটা কথা মনে রাখবেন–এই তন্ত্রশাস্ত্রের উৎপত্তি হিমালয় অঞ্চলে। অর্থাৎ কৈলাস, চীন, নেপাল, তিব্বত প্রভৃতি জায়গায়।

আমার এইসব কথা বলার উদ্দেশ্য অলৌকিকতত্ত্বে বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা বোধহয় নেপাল, তিব্বত, ভুটানেই বেশি। এই অলৌকিকতত্ত্বের মধ্যে প্রেততত্ত্বও জড়িয়ে আছে।

দুঃখের বিষয় অলৌকিকতত্ত্ব ও প্রেততত্ত্ব এখন ভয়-পাওয়ানো গাঁজাখুরি গল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারও একটা কারণ বোধহয় এই যে, মানুষ ভয় পেতেও চায়। অশরীরী আত্মা আর তথাকথিত ভূত-প্রেত এক কথা নয়। কিন্তু সেকথা সাধারণ মানুষকে বোঝান যায় না। অশরীরী আত্মার অস্তিত্ব আছে। অনেকেই তা প্রত্যক্ষ করেছে। এমনকি তাদের কথা বলতেও শুনেছে। আশ্চর্য নয় কি? দ্বন্দ্ব এখানেই, আমি বলব আত্মা শরীর ধারণ করতে পারে–যে শরীর দেখা যাবে কিন্তু স্পর্শ করা যাবে না–যে শরীর কোনো চিহ্ন রেখে যেতে পারে না। ডাঃ গুপ্ত বলবেন, অসম্ভব। কিন্তু মিসেস গুপ্ত যাঁকে প্রায়ই দেখেন তিনিও যে ঐরকম কোনো শরীরী আত্মা তা আমি বিশ্বাস করি। কেননা ঐ ধরনের শরীরী আত্মার আমি প্রত্যক্ষদর্শী।

একটু থেমে বললেন, শরীর ধারণ ছাড়াও এই আত্মার আবার অন্যরকম প্রক্রিয়াও আছে। জানেন কি যোগীরা তাঁদের অসাধারণ ক্ষমতায় নিজেদের দেহ থেকে আত্মাকে কিছুকালের জন্যে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে পারতেন? সেও এক অলৌকিক ব্যাপার বিজ্ঞান যার ব্যাখ্যা করতে পারেনি।

মিস থাম্পি রীণার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, ঘুম পাচ্ছে?

রীণা তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে বসে বলল, না। আপনার কথা শুনতে বেশ ভালোই লাগছে।

মিস থাম্পি হেসেই বললেন, ধন্যবাদ।

বেশ, তাহলে প্রথমে যোগীদের দেহ থেকে আত্মাকে সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন করার একটা গল্প বলি। বলে সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন।

সঞ্জয় চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বললে, চালিয়ে যান।

–অনেক দিন আগের কথা। এক ইংরেজ দম্পতি ভারতে কার্যরত থাকাকালীন বায়ুপরিবর্তনের জন্যে সিমলা পাহাড়ে গিয়েছিলেন। ইংরেজ ভদ্রলোক ছিলেন বৃটিশ-ভারতের একজন উচ্চপদস্থ অফিসার। দেশ তার ইংলন্ডে।

সিমলায় আসবার আগেই মেমসাহেবের শরীর খারাপ হয়েছিল। অল্প অল্প জ্বর হতো। সেটা খুব খারাপ লক্ষণ। সিমলাতে চেঞ্জে এসেও শরীর ঠিকমতো সারল না।

এই সময়েই আবার এক দুঃসংবাদ এল, সাহেবের বাবা লন্ডনে মারা গেছেন। সেই খবর পেয়েই সাহেব চলে গেলেন। মেমসাহেব শরীর খারাপের জন্যে যেতে পারলেন না।

লন্ডনে পৌঁছে সাহেব নিয়মিত চিঠি দিয়ে স্ত্রীর খবর নিতেন। প্রতি চিঠিতেই আশ্বাস শীগগিরই যাচ্ছি।

মেমসাহেব পথ চেয়ে থাকেন। কিন্তু বেশ কিছুকাল হয়ে গেল–স্বামী আর ফেরেন না। চিঠিপত্রও পান না। তার মন খুব খারাপ।

একদিন ভোর রাত্রে মেমসাহেব ঘুমের মধ্যে কেঁদে উঠলেন। ঘরে তাঁর যে খাস-পরিচারিকা ছিল সে ইংরেজ রমণী। তাড়াতাড়ি মেমসাহেবের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে?

মেমসাহেব পরিচারিকার সামনে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করে ফেলার জন্যে লজ্জিত হলেন। বললেন, স্বপ্ন দেখছিলাম সাহেব কঠিন রোগে মৃত্যুশয্যায়। তাই তিনি আসতে পারছেন না।

মেমসাহেব খাঁটি ইংরেজ মহিলা। তাই স্বপ্নকে স্বপ্ন বলেই মেনে নিলেন। গুরুত্ব দিলেন না।

কিন্তু গুরুত্ব না দিলেও তার মনটা অত্যন্ত ভার হয়ে রইল।

মেমসাহেবের অন্য যে দাসী, সে ছিল তিব্বতীয়। মনিবের মন খারাপ তারও দৃষ্টি এড়ায়নি। রোজই দেখে–আর ভাবে মেমসাহেবকে জিজ্ঞেস করবে কি হয়েছে। কিন্তু জিজ্ঞেস করতে সাহস পায় না। শেষে খাস পরিচারিকাকে জিজ্ঞেস করে কারণটা জানতে পারল। তখন সে সসংকোচে তাকে বলল, মেমসাহেব যদি চান তাহলে সাহেবের খবর আজকের মধ্যেই আনিয়ে দিতে পারি।

খাস-পরিচারিকা অবাক হয়ে বলল, কি করে?

তিব্বতী দাসী তখন তাকে তার উপায়ের কথা জানাল।

ইংরেজ দাসী তা পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও এ দেশের অনেক ভোজবাজির কথা ছোটোবেলা থেকে শুনেছে। তাই তিব্বতীর কথা একেবারে উড়িয়ে না দিয়ে মেমসাহেবকে বলল। মেমসাহেব তখনই তিব্বতী দাসীকে ডেকে পাঠালেন। দাসী এলে তাকে বললেন, তুমি যে লোকটির কথা বলছ সে কি করে? কোথায় থাকে?

দাসী বিনীতভাবে জানালো যে, যাঁর কথা সে বলছে তিনি একসময়ে লামা সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। কি কারণে যেন তিনি সেই পদ ছেড়ে দিয়ে এখন লোকচক্ষুর অন্তরালে একটা পাহাড়ের নিচে আত্মগোপন করে থাকেন।

মেমসাহেব সকৌতূহলে জিজ্ঞেস করলেন, আত্মগোপন করে কেন?

দাসী বললে, তিনি এক বিশেষ সাধনায় সিদ্ধ বলে ঈর্ষাকাতর অন্য দল তাকে মেরে ফেলতে চায়।

শুনে মেমসাহেব স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।

—সত্যিই তিনি এত গুণী লোক?

— মেমসাহেব, আমি নিজে চোখে তার সেই গুণ দেখেছি।

–কিন্তু তুমি যা বলছ তাতে তো মনে হচ্ছে তাকে খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। আর–পেলেও হয়তো আসতে চাইবেন না।

দাসী অন্যমনস্কভাবে বলল, আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি। যদি পাওয়া যায় তাহলে আজই উনি সাহেবের খবর এনে দেবেন।

মেমসাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় কত দূরে–কোন পাহাড়ের নিচে উনি থাকেন?

দাসী বলল, এখান থেকে ক্রোশ তিন দূরে–ঐ যে ধোঁওয়ার মতো তিনচূড়ো পাহাড়টা দেখা যাচ্ছে ওরই কাছে উনি থাকেন।

মেমসাহেব বললেন, উনি যদি তোমার কথায় আসতে না চান–আমি কি গিয়ে request করব?

দাসী বলল, তার দরকার হবে না। তাছাড়া পথ দুর্গম। গাড়ি চলবে না। আপনার পক্ষে হেঁটে যাওয়াও সম্ভব নয়।

মেমসাহেব চুপ করে রইলেন। দাসী বলল, আর তার কাছে যেতে হলে যেতে হবে গোপনে। কেননা তার শত্রুরা তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

শুনে মেমসাহেব হতাশ হয়ে পড়লেন। তখন দাসী বলল, আপনি অনুমতি করলে আমি নিজে গিয়ে একবার চেষ্টা করতে পারি।

মেমসাহেব সানন্দে অনুমতি দিলেন।

পরের দিন ভোরবেলায় তিব্বতীয় দাসীটি লামার খোঁজে বেরিয়ে গেল। আর সন্ধেবেলা ফিরল লামাকে নিয়ে।

লামা এসেছে শুনে মেমসাহেব খুশি মনে দোতলা থেকে নেমে এলেন। কিন্তু লামার চেহারা দেখে তার ভক্তি হল না। যেমন আমাকে দেখে আপনাদের হয়েছে। বলে মিস থাম্পি একটু হাসলেন।

–যাক, যে কথা বলছিলাম। মেমসাহেব দেখলেন লোকটি বৃদ্ধ। মাথায় দীর্ঘ পাকা চুল, পাতলা পাকা গোঁফ দাড়ি। হাত, পা শীর্ণ। দেহ তো নয়, যেন একখানা কংকাল। দুই চোখ কোটরাগত। চোখের নিচে কালি পড়েছে। তার সারা মুখের চামড়া কুঁচকানো। গলায় নীল পাথরের একটা মালা। অমন গাঢ় নীল পাথর মেমসাহেব কখনো দেখেননি।

লোকটি এমন ক্ষীণ স্বরে জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলছিল যে মেমসাহেব তার একবর্ণও বুঝতে পারছিলেন না। যাই হোক সেই তিব্বতী দাসীর সাহায্যে কথাবার্তাটা এইরকম হল

মেমসাহেব বললেন, শুনেছি আপনার নাকি এমন ক্ষমতা আছে যে আপনি এখানে বসেই বহুদুরের খবর এনে দিতে পারেন। তাই যদি হয় তাহলে আপনি দয়া করে আমার স্বামীর খবর জানান। তিনি এখন লন্ডনে আছেন। বেশ কিছু দিন খবর পাচ্ছি না। স্বপ্নে দেখলাম তিনি নাকি শয্যাশায়ী। আমি খুবই দুশ্চিন্তায় আছি।

লামা পথশ্রমে ক্লান্ত বলে সেদিনটা বিশ্রাম করে পরের দিন খবর এনে দেবার প্রতিশ্রুতি দিলেন।

কিন্তু মেমসাহেব আর এক দণ্ডও অপেক্ষা করতে চাইলেন না। অগত্যা বৃদ্ধ লামাকে সম্মত হতে হল। তখন শ্রাবণ মাসের বেলা প্রায় শেষ। লামা প্রথমে আনুষঙ্গিক কতকগুলি কাজ শেষ করে নিয়ে সাহেবের ঠিকানা জেনে নিলেন। আর তার একটা ছবি দেখে নিলেন। তারপর খালি গায়ে মাটিতে শুয়ে পড়ে বললেন, আমি আপনার স্বামীর খবর আনতে চললাম। আমার দেহ এখানে পড়ে রইল। যদি বাধা-বিঘ্ন না ঘটে তাহলে এক ঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসব। তবে একটা অনুরোধ–আমার জীবন-মরণের সব দায়িত্ব আপনাকে নিতে হবে।

মেমসাহেব চমকে উঠলেন।-কেমন করে?

লামা বললেন, আমার দেহ যেন কেউ স্পর্শ না করে, এইটুকু দেখবেন।

–নিশ্চয় দেখব। মেমসাহেব প্রতিশ্রুতি দিলেন।

–আরও একটি কথা–আমি যখন এখানে আসছিলাম, বুঝতে পারছিলাম আমার শত্রুরা আমায় অনুসরণ করছে। তারা হয়তো একটু পরেই এখানে এসে হানা দেবে। আমার দেহটা কেড়ে নিয়ে যেতে চাইবে। আপনি দয়া করে বাধা দেবেন। কথা দিন–পারবেন তো?

মেমসাহেব ইংরেজরমণী। অসুস্থ হলেও তাঁর মনের জোর ছিল অসাধারণ। সব দিক ভেবে নিয়ে বললেন, ঠিক আছে। দায়িত্ব নিলাম। আপনি নিরুদ্বেগে গিয়ে আমার স্বামীর খবর নিয়ে আসুন।

এই অঙ্গীকার পেয়ে লামা যোগনিদ্রায় সমাহিত হলেন। সকলেই দেখলেন লামার অসাড় দেহটা মাটিতে পড়ে আছে যেন বহুকালের পুরনো শুকনো একটা মৃতদেহ।

এই সময়ে তিব্বতী দাসীর খেয়াল হল নিচের দরজাটা বোধহয় ভোলাই থেকে গিয়েছে। সে নিজেই দেখতে যাবে ভাবছিল কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক লামার দেহ ছেড়ে নিচে যেতে মন চাইল না। তখন সে দরজা বন্ধ করার কথা ইংরেজ পরিচারিকাটিকে নিচু গলায় বলল।

ইংরেজ পরিচারিকা যাচ্ছি বলেও সকৌতূহলে লামার নিঃসাড় দেহের দিকে তাকিয়ে রইল। যাবার কথা ভুলে গেল।

আধঘণ্টাও হয়েছে কি না সন্দেহ হঠাৎ নিচে একটা গোলমাল শোনা গেল। কারা যেন দারোয়ান-বেয়ারা-বাবুর্চিদের ঠেলে জোর করে ওপরে উঠে আসতে চাইছে।

মেমসাহেব বিচলিত হলেন। কিসের এত গোলমাল? তিনি ইংরেজ দাসীকে ব্যাপারটা কি জেনে আসবার জন্যে পাঠালেন। ইংরেজ দাসী ব্ৰস্তপদে নিচে নেমে গেল। কিন্তু পাঁচ মিনিট যেতে-না-যেতেই ছুটতে ছুটতে এসে জানালো একদল জংলী জোর করে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েছে। তারা লামাকে চায়।

-কেন? মেমসাহেবের ভুরুতে ক্রোধের প্রকাশ ফুটে উঠল।

ইংরেজ দাসী উত্তর দেবার আগেই মেমসাহেব দেখলেন কয়েকজন তিব্বতী জংলী দোতলায় উঠে হৈ হৈ করে ঘরের দিকে এগিয়ে আসছে।

মেমসাহেব রাগে কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করে উঠলেন–Who are you? What makes you to come here?

তারা মেমসাহেবের কথা বুঝল না। বুঝতে চাইলও না। তাদের সকলের দৃষ্টি তখন লামার দেহের ওপর। বাড়িতে তেমন লোকজন নেই যে সেই উন্মত্ত লোকগুলোকে বাধা দেয়। জংলী লোকগুলো বোধহয় তা বুঝতে পেরেছিল। তাই তারা নির্ভয়ে ঘরের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।

ইংরেজ দাসী তখন ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। সে পুলিশ ডাকার জন্যে জানলার দিকে ছুটে যাচ্ছিল, মেমসাহেব তাকে আটকালেন। কঠিন স্বরে বললেন, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো।

তারপর এক মিনিটের মধ্যে ছুটে গিয়ে ড্রয়ার থেকে গুলিভরা রিভলভারটা এনে দুবার ফায়ার করলেন। সঙ্গে সঙ্গে লোকগুলো যে যেদিকে পারল পালালো।

-যাও! দরজা লাগিয়ে এসো। বলে মেমসাহেব ইজিচেয়ারে বসে হাঁপাতে লাগলেন। তার শরীর একেই দুর্বল, তার ওপর এই উত্তেজনা। রিভলভারটা কিন্তু তখনো তার হাতের মুঠোয়।

তিব্বতী দাসী তখনও লামার দেহের ওপর–তাকে স্পর্শ না করে দুহাত দিয়ে আগলে বসে ছিল।

এবার সে উঠে নিজের জায়গায় গিয়ে বসল।

আরো আধঘণ্টা পরে লামার দেহটা একটু নড়ল। তারপর ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালেন।

মেমসাহেব আনন্দে লামার ওপরে ঝুঁকে পড়লেন। লামা ইশারায় একটু জল খেতে চাইলেন। মেমসাহেব তিব্বতী দাসীকে জল দিতে বললেন।

জল খেয়ে সেই লামা যোগী আস্তে আস্তে উঠে বসলেন। তারপর তার সেই ক্ষীণ স্বরে বললেন, আপনার স্বামী ভালোই আছেন। দেখলাম জিনিসপত্র গোছগাছ করছেন। বোধহয় আজ-কালের মধ্যেই এখানে আসার জন্যে রওনা হবেন।

শুনে মেমসাহেব আনন্দে কিছুক্ষণ চোখ বুজিয়ে রইলেন।

তারপর লামা ধীরে ধীরে তাঁর ঘরের বর্ণনা দিলেন। শুনতে শুনতে মেমসাহেব তো অবাক। শেষে লামা বললেন, তবে আপনার বাড়ির দক্ষিণদিকে যে সুন্দর বাগানটা ছিল সেটা সম্প্রতি ঝড়ে তছনছ হয়ে গেছে।

বাগানটাও যোগীর চোখে পড়েছে তা হলে! মেমসাহেব মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।

লামা সেই রাত্তিরেই চলে যেতে চাইলেন। কিন্তু মেমসাহেব যেতে দিলেন না। পরের দিন অতি প্রত্যূষে যাবার সময়ে লামা মেমসাহেবের দিকে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। মেমসাহেবও চোখ নামাতে পারেননি।

মিনিট দুয়েক পরে লামা বললেন, আপনি এখন রোগমুক্ত। বলে দরজার দিকে পা বাড়ালেন। মেমসাহেব তাঁকে পুরস্কৃত করতে চাইলেন। কিন্তু তিনি কিছুই নিলেন না।

মেমসাহেব নিজের মনেই শুধু বললেন- am grateful to you Indian yogi–I am grateful.

পরের দিনই সাহেবের চিঠি এল। লিখছেন–একটা মিথ্যে মামলায় জড়িয়ে পড়েছিলাম। যাই হোক ঈশ্বরের কৃপায় এখন আমি বিপন্মুক্ত। রওনা হচ্ছি।

পুনশ্চ দিয়ে লিখেছেন-খুব আশ্চর্য ব্যাপার হঠাৎ কাল আমার ঘরের সামনে একজন ইন্ডিয়ান যোগীকে দেখলাম। তারপরেই অদৃশ্য। সম্ভবত আমার চোখেরই ভুল।

মিস থাম্পি তার কথা শেষ করে একটু থামলেন। তার পর জল খেয়ে রুমালে মুখ মুছলেন।

–এ কাহিনী আপনাদের শোনাবার উদ্দেশ্য এটাই বোঝানো যে, এও এক ধরনের অলৌকিক ক্রিয়া। কিন্তু এটা ম্যাজিক বা যাদু নয়। এ যোগসাধনা। এই যোগের দ্বারাই আপনি এই মুহূর্তে কী ভাবছেন তা বলে দেওয়া যায়। এই যোগের দ্বারাই আগামী চাব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আপনার জীবনে উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা ঘটবে কি না জানানো যায়। কঠিন ব্যাধির কারণ ও উৎপত্তিস্থল ধরা যায়।

এই যোগ যাঁর আয়ত্ত তিনি তেমন-তেমন বাড়িতে ঢুকেই বলতে পারেন সেখানে কোনো অশরীরী আত্মার আবির্ভাব ঘটে কিনা। বিজ্ঞানে কিন্তু এর ব্যাখ্যা মেলে না।

অশরীরী আত্মার টের পাওয়া যায়–মিস থাম্পির এই কথায় সকলেই যেন একটু বিচলিত হল।

একটু থেমে মিস থাম্পি বললেন, এরকম অনেক তথ্য রবার্ট ডাল আওয়েল-এর Foot falls on the Boundary of Another World বইটিতে পাওয়া যায়। পুরনো কোনো বড়ো লাইব্রেরিতে খোঁজ করে দেখতে পারেন–of course should you be so interested.

মিস থাম্পি থামলেন। ঘড়ির দিকে তাকালেন। সাড়ে বারোটা।

গল্পে গল্পে অনেক রাত হয়ে গেছে। মিস থাম্পি বললেন, তাহলে এবার শুতে যাওয়া যাক?

মান্তু বলল, কিন্তু আপনি ভুটানে কেন যাচ্ছেন বললেন না তো?

–শুনতে চান?

–নিশ্চয়ই। মান্তু আর রীণা দুজনেই উৎসাহে বলে উঠল।

–আপনি? মিস থাম্পি সহাস্যে সঞ্জয়ের দিকে তাকালেন।

সঞ্জয় সলজ্জভাবে বলল, আমার বড় ঘুম পাচ্ছে। কাল সকালেই তো আবার ছুটতে হবে।

রীণা বলল, তুমি তবে ওঘরে গিয়ে শোও গে।

সঞ্জয় অবশ্য গেল না। আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে চোখ বুজে বসে রইল।

মিস থাম্পি বললেন, বিস্তৃত করে বলতে গেলে রাত শেষ হয়ে যাবে। সংক্ষেপে বলি।ভুটানে যাচ্ছি সেখানকার একটি মেয়েকে স্টাডি করতে। ডাঃ কুমার আমার খুব পরিচিত। তিনি সম্প্রতি সাদার্ন ভুটানের ডিস্ট্রিক্ট টাউন সারভং-এ গিয়েছেন সেখানকার হাসপাতালের এম. ও. হয়ে। ওখান থেকে তিনি আমায় কয়েকখানা চিঠি লিখেছেন।

ডাঃ কুমার ওখানে কোয়ার্টারে একা থাকেন। রাঁধা-বাড়া করার জন্যে উনি একটি লোক খুঁজছিলেন। অনেক কষ্টে একটি মেয়ে পান। মেয়েটির নাম সুখমতী। বয়েস উনিশ-কুড়ি। মেয়েটি কথা বলে না। কিন্তু সে বোবা নয়। কেননা সে শুনতে পায়। মেয়েটির কোনো অভিব্যক্তি নেই। শুধু যন্ত্রের মতো কাজ করে যায়। সে সারাদিন কোয়ার্টারে থাকে। কিন্তু ঠিক রাত নটা বাজলেই সে বাড়ি চলে যায়। ব্যতিক্রম হয় না।

ডাঃ কুমার হুঁশিয়ার লোক। তিনি যখনই কোনো কাজের লোক লাগান তখনই তার ঠিকানা নিয়ে রাখেন। সুখমতীরও ঠিকানা নিয়েছিলেন।

এদিকে সুখমতী কাজে লাগার দু দিন আগে পাহাড়তলীতে একটা জিপ অ্যাকসিডেন্ট হয়। সেটাও নাকি অদ্ভুত ঘটনা। যাই হোক, জিপে যে-সব লোক ছিল তারা সবাই ঘেঁৎলে মরে যায়। ওদের মধ্যে একটি যুবতী মেয়ে ছিল। তার লাশ কিন্তু পাওয়া যায়নি। অথচ সেই নিদারুণ অ্যাকসিডেন্ট থেকে কেউ যে বেঁচে পালাবে তাও নাকি অসম্ভব।

যাই হোক, সেদিনের মতো লাশ তিনটে হাসপাতালের ল্যাবরেটরি-ঘরের কাছে রাখা হয়।

একদিন হাসপাতালের দারোয়ান দীন বাহাদুর ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ডাঃ কুমারকে বলল, সাব, বক্সী!

–ওদেশে ভূতকে বক্সী বলে।

ডাঃ কুমার অবাক হয়ে বললেন, বক্সী! কোথায়?

দীন বাহাদুর বলল, ল্যাবরেটরির পাশে যে ঘরে লাশ ছিল সেখানে।

তার বক্তব্য–রাত্রে পাহারা দিতে দিতে ও একটা শব্দ শুনে লাশ-ঘরের দিকে যায়। সেখানে একটা গোঙানি শুনতে পায়। কৌতূহলী হয়ে জানলার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে যেখানে তিনটে লাশ ছিল সেখানে একটা মেয়ে শোবার জায়গা করে নিতে চাইছে। কিন্তু যেন কিছুতেই জায়গা পাচ্ছে না। মেয়েটার গায়ে জামা-কাপড় কিছুই ছিল না।

তারপর যে কথাটা দীন বাহাদুর নাকি এতটুকু ইতস্তত না করেই বলে ফেললে তা এই যে–সে মেয়েটি সুখমতী ছাড়া আর কেউ নয়।

ডাক্তার কুমার তো চমকে উঠলেন। তিনি অবিশ্বাস করলেন। দীন বাহাদুর হলপ করে বলল, সে খুব ভালো করে নজর করে দেখেছে সে সুখমতীই।

ডাক্তার কুমার তবু যখন বিশ্বাস করতে চাইলেন না তখন দীন বাহাদুর বলল, ঠিক আছে আজই দেখা যাক, সুখমতী রাত্তিরে কি করে।

সেদিনও সুখমতী ঠিক রাত নটায় কাজ সেরে চলে গেল। দীন বাহাদুর তখন ডাক্তার কুমারের কোয়ার্টারে। সুখমতী যখন চলে যাচ্ছে দীন বাহাদুর তখন ফি ফিস্ করে বলল, সাব, দেখুন ওর হাঁটাটা কি রকম।

ডাঃ কুমার এতদিন লক্ষ্য করেননি। আজ দেখলেন–হ্যাঁ, হাঁটাটা একটু অস্বাভাবিক। কেমন যেন লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে। আর সেই সঙ্গে তার লম্বা হাত দুটো যেন বড্ড বেশি দুলছিল।

রাত দুটোয় ডাক্তারকে নিয়ে দীন বাহাদুর সুখমতীর ঠিকানা খোঁজ করতে বেরোল। বেরোবার আগে একটুকরো ন্যাকড়া ডাক্তারের হাতে দিয়ে বলল, এটা সঙ্গে রাখুন সাব। অনিষ্ট করতে পারবে না।

অনেক খোঁজাখুঁজির পর যে ঠিকানাটা ওরা খুঁজে পেল সেটা একটা ভাঙা ঘর, একেবারে লোকালয়ের বাইরে।

সুখমতী–সুখমতী করে ডাক্তার ডাকাডাকি করলেন। কিন্তু কারো সাড়া পেলেন না। তখন দুজনে দুটো টর্চ জ্বেলে ভেতরে ঢুকলেন। কেউ কোত্থাও নেই। শুধু সুখমতীর ছাড়া কাপড়টা পড়ে আছে।….

এই পর্যন্ত বলে মিস থাম্পি থামলেন।

–খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার। এ বিষয়ে আপনার কি মনে হয়? মান্তু জিজ্ঞেস করল।

–আগে ভুটানে গিয়ে সুখমতাঁকে দেখি। নিজে না দেখে, না কথা বলে আমি কোনো কমেন্ট করব না। তবে আমার শুধু একটাই জানার আছে–সুখমতী কেন চাকরি নিল? কেন ডাক্তার কুমারের কাছেই? কিন্তু আর নয়। এবার সবাই শুয়ে পড়ুন।

.

শীতের রাত। গোটা শহর যেন কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছে। সামনে যশোর রোড যেন দেহ প্রসারিত করে একটু বিশ্রাম নিচ্ছে। ওদিকে সঞ্জয় বসে বসেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। মাথাটা হেলে পড়েছে চেয়ারে। শুধু এরা তিন জনই জেগেছিল এতক্ষণ।

এই সময়ে হঠাৎ পুপু কেঁদে উঠল। সেই মর্মান্তিক যন্ত্রণায় কেঁদে ওঠা। রীণা চমকে উঠে ছুটে গিয়ে পুপুকে বুকে তুলে নিল। ঘুম ভেঙে গেল সঞ্জয়ের। লাফিয়ে ছুটে গেল পুপুর বিছানায়। এ কান্না যে তাদের চেনা।

মান্তু কি হল? কি হল? বলে রীণার কাছে গিয়ে বসল। শুধু মিস থাম্পি স্থির হয়ে বসে পুপুর দিকে তাকিয়ে রইলেন।

কান্না থামে না। দেখতে দেখতে পুপুর সমস্ত মুখটা যেন কি রকম হয়ে গেল। রীণা আর্তস্বরে বলে উঠল কী হবে? কান্না থামছে না যে?

রীণা জানে, এ কান্না থামাবার সাধ্য ডাক্তারের নেই।

মিস থাম্পি উঠে দাঁড়ালেন। একবার ভুরু কুঁচকে খোলা দরজা দিয়ে সিঁড়ির দিকে তাকালেন। তারপর গায়ের চাদরটা ফেলে দিয়ে পুপুর কাছে এগিয়ে গেলেন। পুপু তখন কাঁদতে কাঁদতে ধনুকের মতো বেঁকে যাচ্ছে। রীণা পাগলের মতো মিস থাম্পির হাত দুটো চেপে ধরে কেঁদে উঠল। কী হবে? এমন করে তো ও কখনো কাঁদে না।

সেই অশরীরীর আবির্ভাব হলেই যে পুপু কেঁদে ওঠে, মিস থাম্পি আগে তা শুনেছিলেন। তিনি একদৃষ্টে কিছুক্ষণ পুপুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার পর আস্তে আস্তে একবার তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিলেন। রীণাকে বললেন, তুমি এবার ওকে বুকে তুলে নাও।

–ও ঘুমোত পারবে না। দেখছেন না–

–আমি বলছি, ঘুমোবে। তুমি বুকে নাও। আদেশের সুরে বললেন মিস থাম্পি।

রীণা পুপুকে বুকের কাছে টেনে নিতেই পুপুর কান্না আস্তে আস্তে থেমে গেল। তারপর পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল।

এবার মিস থাম্পি উঠে দাঁড়ালেন। স্থির গম্ভীর স্বরে বললেন, সে বোধহয় এসেছে। আপনারা তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ুন।

সঞ্জয়ও কেমন যেন চঞ্চল হয়ে উঠল। কিন্তু সে যে আজ কোথায় শোবে ভেবে পেল না।

মিস থাম্পি বললেন, শোবার ব্যবস্থা আমিই করে দিচ্ছি।

-বাইরের ঘরে এই ডিভানে মিসেস গুপ্ত যেমন বাচ্চাকে নিয়ে শুয়েছেন শোন। আপনি শোন মেঝেতে এইখানে। বলে মান্তুকেও জায়গা নির্দেশ করে দিলেন।

–ডাঃ গুপ্ত, আপনি প্লিজ চলে যান ভেতরের ঘরে। নিশ্চিন্তে ঘুমোন গিয়ে।

–আপনি?

মিস থাম্পি একটু হাসলেন।–আমি শোব না। বসে থাকব সিঁড়ির মুখে। আজকের রাতের মতো আমার কথা অনুগ্রহ করে শুনবেন। বলে নিজেই একটা চেয়ার টেনে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

অনেকক্ষণ পর্যন্ত কেউই ঘুমোত পারল না। কিসের যেন দুঃসহ প্রতীক্ষা। তারপর একসময়ে সকলেই ঘুমিয়ে পড়ল।

.

সবার আগে ঘুম ভাঙল মান্তুর। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রীণার। দুজনেই একবার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। রাত্তিরটা তাহলে নিরাপদেই কেটেছে।

সঞ্জয় তখনো ঘুমোচ্ছ। কিন্তু মিস থাম্পি? তিনি কি এখনও বাইরে বসে আছেন?

তাড়াতাড়ি এরা দুজনে বাইরে বেরিয়ে এল। দেখল মিস থাম্পি নেই। শূন্য চেয়ারটা শুধু পড়ে রয়েছে।

দুজনের মুখ শুকিয়ে গেল।

–উনি কোথায় গেলেন? মান্তুর গলার স্বর ভয়ে কাঁপছে।

–তাই তো। বলেই রীণা সঞ্জয়কে ঘুম থেকে তুলে সব কথা বলল। সঞ্জয় ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে এল।

তখনো ভোর হয়নি। শীতের কুয়াশায় চারিদিক পর্দাটাকা। বাড়ির অন্যান্য ভাড়াটেরা তখনো সুখনিদ্রায় নিশ্চিন্ত।

সঞ্জয় কি করবে ভাবছে। এমনি সময়ে সিঁড়িতে হালকা চটির শব্দ। মিস থাম্পি ওপরে উঠে আসছেন।

বাবাঃ! এই কুয়াশায় কোথায় গিয়েছিলেন?

মিস থাম্পি হেসে বললেন, প্রাতঃভ্রমণে। কম্পাউন্ডের মধ্যেই ঘুরছিলাম। বেশ পুরনো আমলের বাড়ি। ফোয়ারার সামনে যে স্ট্যাচুটা–সেটা কোনো অবস্থাপন্নরই কীর্তি। তাঁর রুচিটা পবিত্র ছিল না। চলুন ভেতরে গিয়ে বসি। একটু গরম কফি খাব।

কফি খেতে খেতে সকলেই উদগ্রীব হয়ে মিস থাম্পির দিকে তাকিয়ে রইল কিছু শোনার অপেক্ষায়। কিন্তু মিস থাম্পি একটি কথাও বললেন না।

কফি খাওয়া শেষ হলে মাকে বললেন, এবার আমাদের যেতে হবে।

সঞ্জয় আর থাকতে পারল না। বলল, কিন্তু কাল রাত্তিরের experience তো কিছু বলছেন না।

বললে কি আপনি বিশ্বাস করবেন?

মিস থাম্পি একটু হাসবার চেষ্টা করলেন।

–শুনতে দোষ কি?

–তবে শুনুন। একটা প্রতিহিংসাপরায়ণ হিংস্র আত্মা এ বাড়িতে আছেই। সে ক্ষতি না করে যাবে না। এর চেয়ে বেশি কিছু জানতে চাইবেন না। প্রমাণ দিতে পারব না।

–তাহলে, আপনি বলছেন রীণা যা দেখে তা ঠিক?

–হ্যাঁ। অবশ্যই।

—প্রকিার?

–আমার মনে হয় বাড়িটা ছেড়ে দেওয়াই ভালো।

সঞ্জয় মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু সে কি করে সম্ভব? আমি নিজে ডাক্তার। বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ছাড়া অশরীরী আত্মার অস্তিত্ব মানতে পারি না।

মিস থাম্পি তার বিশেষ হাসিটি একটু হাসলেন। কিছু বললেন না।

আধ ঘণ্টার মধ্যেই মান্তু আর মিস থাম্পি প্রস্তুত হয়ে নিল। যাবার সময়ে মিস থাম্পি বললেন, ডাঃ গুপ্ত, আপনার সংস্কারমুক্ত মন আর সাহসের প্রশংসা করি। কিন্তু আমার একটা কথা মনে রাখবেন–যদি দেখেন আপনার ছেলেটি ক্রমশই অসুস্থ হয়ে পড়ছে তা হলে তদ্দণ্ডেই বাড়ি ছেড়ে দেবেন। লে হাতে ব্যাগটা তুলে নিয়ে নিচে নামতে লাগলেন।

রীণা বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

.

১৪.

সঞ্জয়ের চ্যালেঞ্জ

কদিন হল মিস থাম্পি চলে গিয়েছেন। মান্তুর সঙ্গেও যোগাযোগ নেই। রীণার মনটা তাই একটু খারাপ ছিল। দুঃসময়ে নিজের লোক ছাড়াও প্রকৃত বন্ধুর সান্নিধ্য যে কত দরকার হয় মান্তুকে পেয়ে রীণা তা বুঝতে পেরেছে।

বেলা তখন চারটে। পুপুটা কদিন ধরে ঘ্যানঘ্যান করছে। শীতটাও বেশ জোরে পড়েছে। বিকেলবেলায় কখনো কখনো পুপুকে নিয়ে রীণা নিচে কম্পাউন্ডে নেমে আসে। কম্পাউন্ডে বেশি ভিড় থাকলে নিচে নামে না। সংকোচ হয়। তার যেন মনে হয় সবাই তাকে একরকমভাবে দেখছে। তাই নিজেকে মনে হয় যেন তাদের কাছে অতিপ্রাকৃত জগতের কেউ। তাই সে অনেক সময়ে পুপুকে নিয়ে তিনতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকে।

এদিনও দাঁড়িয়ে ছিল। মিনিট দশেক হল লোডশেডিং শুরু হয়েছে। এই এক অসহ্য ব্যাপার। রীণার কাছে আবার শুধুই অসহ্য ব্যাপার নয়, ভীতির কারণ।

নিচে ছেলেরা খেলা করছে, বৃদ্ধরা বেঞ্চিতে বসে নিশ্চিন্ত মনে সম্ভবত সাংসারিক বিষয় নিয়ে গল্প করছে। বন্দনার মা কোথায় বেরিয়েছিলেন, কিছু জিনিস কিনে রিকশা থেকে নামলেন।

আচ্ছা, মিস থাম্পি যে এসে এক রাত এখানে কাটিয়ে গেলেন বন্দনা বা বন্দনার মা কি তা জানেন?

জানলেও এঁদের সেরকম গায়ে-পড়া কৌতূহল নেই। এটা অবশ্য ভালোই।

বড়ো অদ্ভুত মহিলা মিস থাম্পি। প্রথম যেদিন রীণা ওঁকে দেখে সেদিন ভালো লাগেনি। কিন্তু এ বাড়িতে তাঁকে খুবই ভালো লাগল।

মিস থাম্পি এ বাড়ি সম্বন্ধে কি যেন বললেন? ছেড়ে দেওয়াটাই উচিত। একদিক দিয়ে সে খুশি। আর যাই হোক তার মানসিক রোগ হয়নি। এত দিন তাহলে যা দেখেছে, যা বলেছে সব সত্যি। সঞ্জয় কি এবার তা বুঝতে পেরেছে? তাহলে কি আর একদিনও এ বাড়িতে থাকা উচিত? মিস থাম্পির কথায়–evil spint আছে যে দুরাত্মা হিংস্রকুটিল। শাসিয়ে যায়।

রীণার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ঠিক তখনই হঠাৎ পুপু কেঁদে উঠল আবার।

রীণা ভোলাতে লাগল, না না, কান্না কেন বাবুসোনা? ওই দ্যাখো ছেলেরা কেমন বল খেলছে। তুমিও বড়ো হয়ে বল খেলবে। তোমার বাপী তোমায় বল কিনে দেবে–সুন্দর লাল বল–

পুপুর কান্না তবু থামল না। দ্বিগুণ জোরে কাঁদতে লাগল।

রীণা মনে মনে সঞ্জয়ের জন্যে ব্যস্ত হচ্ছিল। সন্ধ্যের সময়ে লোডশেডিং হলে কিছুতেই একলা থাকতে ভালো লাগে না।

কিন্তু পুপু ডুকরে ডুকরে কাঁদছে কেন? বেঁকে বেঁকে যাচ্ছে। এ কান্নাটা যেন…।

রীণার বুক কাঁপতে শুরু করল। তাহলে কি এই সন্ধেবেলাতেই….

তখনই রীণার মনে হল ঘরের মধ্যে যেন কিসের চাপা শব্দ! তারপরই হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ায় ঘরের জানলাগুলো সশব্দে খুলে গেল।

ঘরের দিকে তাকাতেই রীণার মেরুদণ্ডের মধ্যে দিয়ে একটা হিমস্রোত বয়ে গেল। দেখল ঘরের মধ্যে একটা ধোঁয়ার কুণ্ডলি মেঝে থেকে ক্রমাগত ওপরে উঠছে! মনে হচ্ছে নিচের তলায় যেন আগুন লেগেছে। মেঝে খুঁড়ে তারই ধোঁয়া সমস্ত ঘরটাকে গ্রাস করে ফেলছে। ধোঁয়াটা কিসের বুঝতে বুঝতেই ধোঁয়ার মধ্যে থেকে ফুটে বেরোল একটা মূর্তি। সে মূর্তি ওর চেনা। সেই কালো প্যান্ট, কোট আর টুপি। টুপিটা নেমে এসেছে আধখানা কপাল পর্যন্ত। তারপরেই মূর্তিটা দুরন্ত গতিতে ঘুরপাক খেতে লাগল।

রীণা ভয়ে কাঠ হয়ে সেই দিকে তাকিয়ে রইল।

ক্রমে মূর্তির চোখে মুখে একটা হিংস্রভাব ফুটে উঠল। রীণা স্পষ্ট বুঝতে পারল মূর্তিটা দাঁতে দাঁত চেপে কি যেন বলছে!

রীণার শুনতে ইচ্ছে করছিল না। তার এত ভয় করছিল যে সে থরথর করে কাঁপছিল। তবু ইচ্ছার বিরুদ্ধেই শোনার জন্যে কান পাততে হল। কেউ যেন হুকুম করছে–আমি যা বলি শোনো!

একটা চাপা হিসহিস্ শব্দের ভেতর দিয়ে ছেঁড়া ছেঁড়া কয়েকটা কথা বেরিয়ে এল–আগামী শনিবার…রাত দুটো…আমি আসব। তুমি যাবে…নইলে…বলেই মূর্তিটার মর্চে-ধরা লোহার শাবলের মতো দুখানা অদ্ভুত সরু সরু হাত এগিয়ে আসতে লাগল পুপুর দিকে!

পুপু তখন নেতিয়ে পড়েছে রীণার কাঁধে। মুখ দিয়ে লালা ঝরছে। কদবার শক্তিও বুঝি আর নেই।

পালাবার উপায় নেই। সামনেই মূর্তিটা দাঁড়িয়ে। রীণা ব্যালকনির ওপর ঝুঁকে পড়ল। দেখল নিচে ছেলেরা তখনো খেলা করছে, বয়স্করা গল্প করছে।

রীণা চিৎকার করে ডাকতে চাইল, কিন্তু গলা থেকে স্বর বেরোল না।

এদিকে অন্ধকার ঘরের মধ্যে থেকে সেই অদ্ভুত বিকৃত দুখানা হাত ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। হাতের চেটো দুটো অস্বাভাবিক হোট!

ঠিক সেই সময়ে একটা ট্যাক্সি এসে ঢুকল কম্পাউন্ডের মধ্যে। সঞ্জয় নামল ট্যাক্সি থেকে। ভাড়া চুকিয়ে ওপর দিকে তাকালো। লোডশেডিং। তিনতলাটা অস্পষ্ট। তবুও যা দেখতে পেল তাতেই সঞ্জয় চমকে উঠল। পুপুকে কোলে নিয়ে রীণা যেন ব্যালকনি থেকে ঝাঁপ দেবার চেষ্টা করছে! আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠল সঞ্জয়। রীণা! পড়ে যাবে–পড়ে যাবে

রীণা বুঝি মুহূর্তের জন্যে থমকে গেল। নিচে যারা ছিল সঞ্জয়ের চিৎকারে তারাও ওপর দিকে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে সকলেই চেঁচিয়ে উঠল–গেল–গেল–গেল!

সঞ্জয় ছুটল সিঁড়ির দিকে। তিনতলায় উঠতে তিন মিনিটও লাগল না। সিঁড়ির মুখে এসে থমকে দাঁড়াল। ঘরের দরজা খোলা কেন? এমন তো কোনোদিন থাকে না।

কিন্তু সেদিকে মন দেবার সময় নেই। দৌড়ে গেল ব্যালকনির দিকে। জাপটে ধরল রীণাকে–এ কি করছিলে?

পুপুকে বুকের মধ্যে দু হাতে আঁকড়ে ধরে সেখানেই বসে পড়ল রীণা। কোনোরকমে বলল, এসেছ?

–হ্যাঁ, লোডশেডিং-এ ভয় পাবে বলে ট্যাক্সি নিয়ে চলে এলাম।

–সেটা কোথায় গেল?

–কে? কার কথা বলছ?

রীণা আর কথা বলতে পারল না। তার অচৈতন্য দেহটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। চেঁচামেচি শুনে বন্দনার মাও উঠে এসেছিলেন। তিনি তাড়াতাড়ি পুপুকে কোলে তুলে নিলেন।

আর চাপাচাপি রইল না কিছুই। সঞ্জয়ের পিছু পিছু সকলেই ওপরে উঠে এসেছে। ঘরভর্তি লোক। অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে আছে রীণা। সঞ্জয় ওর জ্ঞান ফেরাবার চেষ্টা করছে। সকলের মুখেই চাপা প্রশ্ন–কি হল? সুইসাইড করতে যাচ্ছিলেন নাকি? কিন্তু খামোক আত্মহত্যা করতেই-বা যাবে কেন? দুটি মানুষের সংসার। অশান্তি তো কিছু নেই।

প্রায় পনেরো মিনিট পরে রীণা ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো। কিন্তু সে দৃষ্টি বড়ো স্তিমিত।

-কেমন আছ? সঞ্জয় ঝুঁকে পড়ল রীণার মুখের ওপরে। কি হয়েছিল?

ঘরসুদ্ধ সবাই রীণার দিকে তাকিয়ে।

রীণ কোনো উত্তর দিতে পারল না। কেমন একরকম শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

সঞ্জয় কিছুক্ষণ রীণাকে লক্ষ্য করল। তারপর পাল্স দেখতে লাগল। এক বার-দুবার-তিন বার। শেযে ঘড়ির কাটার সঙ্গে পা-বিট মেলাতে লাগল। ওর মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল।

একজন জিজ্ঞেস করলেন, কেমন দেখলেন?

–ভালো না। বলেই সঞ্জয় উঠে পড়ল।

বন্দনার মা দূরে দাঁড়িয়ে পুপুকে ভোলাচ্ছিলেন। সঞ্জয় বলল, বৌদি, আপনি এখানে একটু থাকুন। আমি আপনার ঘর থেকে একটা ফোন করে আসি।

সঞ্জয়ের উদ্বেগ দেখে এবার ভিড় কমতে লাগল। সঞ্জয় নিচে নামতেই দেখল বন্দনা মুখ শুকনো করে দাঁড়িয়ে।

-কাকীমা?

–ভালো নয়। এখুনি আমায় একটা ফোন করতে হবে।

ভাগ্য ভালো। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই লাইন পাওয়া গেল। শুধু লাইন নয়, ডাক্তার রুদ্রকেও।

সংক্ষেপে সব ব্যাপার জানিয়ে সঞ্জয় বলল, কাকাবাবু, আপনি এখুনি চলে আসুন। আমি একা ভরসা পাচ্ছি না।

.

আধ ঘণ্টার মধ্যেই ডাঃ রুদ্র এসে পড়লেন। রীণা তখনো মাটিতে চোখ বুজে পড়ে আছে।

ডাক্তার রুদ্র নাড়ী দেখলেন, প্রেসার চেক করলেন। চোখের পাতা ফাঁক করে টর্চ ফেললেন। তারপর সঞ্জয়কে জিজ্ঞেস করলেন ব্রান্ডি আছে?

সঞ্জয় মাথা নাড়ল।

–গরম দুধ?

বন্দনার মা বললেন, আমি এনে দিচ্ছি। বলে তিনি পুপুকে নিয়ে দোতলায় চলে গেলেন।

ডাঃ রুদ্র ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালেন।

–তুমি বলছ রীণা এখান থেকে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছিল?

–হ্যাঁ। তখন লোডশেডিং–আবছা অন্ধকার, তবু আমি স্পষ্ট দেখেছি।

–কি দেখেছ?

–রীণা পুপুকে এক হাতে বুকে চেপে ধরে রেলিং-এর ওপর উঠছে।

–তুমি ঠিক জান ঝাঁপ দিতেই যাচ্ছিল? ঝুঁকে কিছু দেখছিল না?

–হ্যাঁ, ঠিক জানি। শুধু আমি কেন নিচে যাঁরা বসেছিলেন তারা সবাই গেল গেল বলে চেঁচিয়ে উঠেছিল।

–তারপর?

তারপর আমি তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে এলাম।

–ঘরে ঢুকলে?

–হ্যাঁ।

দরজা বন্ধ ছিল না?

না। এটাই আশ্চর্য লাগল।

–কেন?

রীণা কখনো দরজা খুলে রাখে না।

–হুঁ, তারপর?

–আমি ছুটে ব্যালকনিতে গেলাম।

–কি অবস্থায় দেখলে?

–ও তখন রেলিং ধরে কাঁপছিল। আমি ওকে ধরলাম।

ডাঃ রুদ্র আরও কয়েক মিনিট ব্যালকনিতে রইলেন। তারপর বললেন, ঘরে এসো।

এরই মধ্যে বন্দনার মা গরম দুধ নিয়ে এসেছেন। সঞ্জয় বাটিটা হাতে করে রীণার কাছে গিয়ে বসল।

–দেখি, দুধটা খেয়ে নাও।

ডাঃ রুদ্র বললেন, উঠে বোসো।

রীণা মাথা নাড়ল।

ডাঃ রুদ্র বললেন, ঠিক পারবে। উঠে বোসো।

রীণা দুহাতে ভর দিয়ে কোনোরকমে উঠে বসল।

ডাঃ রুদ্র বললেন, তুমি নিজে হাতে বাটিটা ধরো।

রীণার হাত কাঁপছিল তবু কোনোরকমে বাটিটা ধরল।

–খাও।

বীণা বলল, খেতে ইচ্ছে করছে না।

–তবুও খেতে হবে।

রীণা ধীরে ধীরে বাটিতে চুমুক দিল।

খাওয়া হলে বাটিটা মাটিতে রাখল।

ডাক্তার রুদ্র বললেন, এবার উঠে দাঁড়াতে হবে।

রীণা করুণ চোখে সঞ্জয়ের দিকে তাকাল।

একটু চেঁচিয়ে ডাঃ রুদ্র বললেন, ওঘরে গিয়ে বিছানার শুতে হবে তো।

রীণা বলল, পড়ে যাব।

পড়ে যাব সামান্য দুটি কথা। কিন্তু ঐ কথা দুটিতেই ডাঃ রুদ্রের দু চোখ ঝকঝক করে উঠল। যেন সঞ্জয়কে লক্ষ্য করেই নিচুগলায় বললেন–তাহলে দ্যাখো, পেশেন্ট পড়ে যেতে ভয় পায়। তারপর রীণাকে বললেন, না, পড়বে না। চেষ্টা করো। ওঠো বলছি।

–সঞ্জয়, help her বলে ডাঃ রুদ্র নিজেই রীণার পিছনে এসে দাঁড়ালেন। সঞ্জয়ের কাঁধে ভর দিয়ে রীণা গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল।

দশ মিনিট পর ডাক্তার রুদ্র সঞ্জয়কে একটা ইনজেকশান দিতে বললেন। ইনজেকশান ডাক্তার রুদ্রর কাছেই ছিল। সঞ্জয় ইনজেকশান দিল।

ডাঃ রুদ্র বললেন, এসো। বাইরের ঘরে ঘণ্টাখানেক বসা যাক। ও এখন ঘুমোক।

দুজনে বাইরের ঘরে এসে বসলেন।

–কি রকম বুঝলেন?

না, সিরিয়স কিছু নয়। হঠাৎ ভয় পেয়েছে। ইনজেকশান দেওয়া হল, ঠিক হয়ে যাবে।

সঞ্জয়ের মুখে তবু হাসি ফুটল না।

–কেন যে বার বার এমন হচ্ছে বুঝতে পারছি না।

–তোমার স্ত্রী তো আগে এমন ভয় পেত না?

–কোনোদিন তো শুনিনি।

ডাক্তার রুদ্র চুপ করে রইলেন। একটু পরে বললেন, বাড়িটা না হয় ছেড়েই দাও।

সঞ্জয়ের ভুরুতে অসহিষ্ণুতার চিহ্ন ফুটে উঠল–আপনিও একথা বলছেন। শেষে ভূতের ভয়ে বাড়ি ছাড়ব!

ডাঃ রুদ্র একটু হাসলেন। বললেন, তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি। ভূত না অলৌকিক কিছু, নাকি মানসিক ব্যাধি, এসব তর্কে আজ আর যেতে চাই না। এখানে থাকলে যদি ওঁর ক্ষতি হয় তাহলে এখান থেকে যাওয়াটাই যুক্তিসঙ্গত নয় কি?

কিন্তু সেদিন তো আপনিও বললেন, ও সাইকোপ্যাথিক পেশেন্ট?

ডাঃ রুদ্র একটা চুরুট ধরালেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, এসব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত বলে কিছু নেই। আজ লক্ষণ শুনে যা মনে হবে, কাল রুগীকে দেখে অন্যরকম মনে হতে পারে।

সঞ্জয় অসহিষ্ণু ভাবে বলল, তাহলে কি মানতে হবে এ বাড়িতে আসার পরই কোনো একটি অশরীরী আত্মা কেবলমাত্র রীণার ক্ষতি করতে চাইছে। সে রীণাকে তার সঙ্গে যেতে বাধ্য করবে। But how is it possible and why? একটা অশরীরী আত্মা একটা জীবন্ত মানুষকে….

বাধা দিয়ে ডাঃ রুদ্র বললেন, না, জীবন্ত মানুষকে সে চায় না।

তার মানে ওকে মেরে ফেলবে?

–হয় তো তাই। তার সূচনাও তো আজ কিছুক্ষণ আগে দেখতে পেলে।

সঞ্জয় চুপ করে কি যেন ভাবতে লাগল।

ডাঃ রুদ্র বললেন, তুমি কি মনে কর রীণা আত্মহত্যাই করতে যাচ্ছিল?

না, কখনোই না।

ডাঃ রুদ্র একটু ভেবে বললেন, আমারও তাই মনে হয়। ওর মতো সুখী মেয়ে সুইসাইড করতে যাবে কেন?

সঞ্জয় বলল, তবে ফ্রাস্টেশানে ভুগতে ভুগতে নিজেকে অসহায় বলে মনে হলে মানুষ বাধ্য হয়ে আত্মহত্যা করে শাস্তি পেতে চায়।

ফ্রাস্টেশান বলছ কেন?

–ঐ যে ওর কথা আমরা কেউ বিশ্বাস করছি না। তাছাড়া পুপুকে নিয়ে রেলিং থেকে ঝুঁকে পড়াটা আত্মহত্যার চেষ্টাই বোঝায়।

ডাঃ রুদ্র মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। তারপর অল্প হেসে বললেন, কিন্তু আমি প্রমাণ পেয়েছি ও আত্মহত্যা করতে যায়নি।

অবাক চোখে সঞ্জয় ডাক্তার রুদ্রর দিকে তাকালো।

–হুঁ, অকাট্য প্রমাণ পেয়েছি। মনে আছে, রীণাকে যখন উঠে দাঁড়াতে বলেছিলাম তখন ও ভয় পেয়ে বলেছিল পড়ে যাব। যে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে পড়ে যাবার ভয় পায় সে কি দেড়ঘন্টা আগে স্বেচ্ছায় তিন তলা থেকে ঝাঁপ দেবার চেষ্টা করতে পারে?

সঞ্জয় থমথমে মুখে ডাঃ রুদ্রের দিকে তাকিয়েই রইল। কোনো উত্তর দিতে পারল না।

ডাঃ রুদ্র বলতে লাগলেন–এই থেকেই প্রমাণ হয় রীণা যা বলেছে তা সত্যি। ভয়ংকর কিছু দেখেছিল যার জন্যে বারান্দার শেষ প্রান্তে গিয়ে অমন সাংঘাতিকভাবে ঝুঁকে পড়ে তার হাত থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবার এমন শেষ চেষ্টা করছিল।

সঞ্জয় একটু ভেবে বলল, আচ্ছা, রীণা কি হিস্টিরিয়ায় ভুগছে? হিস্টিরিয়ার রুগীকে লোকে ভূতে-পাওয়া বলে। এইসব রুগীদের শক্তি নাকি এতদূর হয় যে জলভর্তি ঘড়া দাঁতে করে তুলে উঠোনের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। কাজেই হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হলে…

ডাঃ রুদ্র বাধা দিয়ে বললেন, তুমি বলতে চাইছ রীণা হিস্টিরিয়ার পেশেন্ট। আচ্ছা, তোমার স্ত্রী তো সারাদিন দরজা বন্ধ করেই থাকে, তাই না? তাহলে আজ হিস্টিরিয়ার প্রকোপ যখন তার বাড়ল, তখন বুঝি সে তোমার আসার জন্যে দরজা খুলে রেখে ঝাঁপ দিতে গেল?

সঞ্জয় চুপ করে রইল।

দরজাটা তা হলে খুলল কে?

সঞ্জয় তখনও নিরুত্তর।

নিভে-যাওয়া চুরুটটা আবার দুটো কাঠি ধ্বংস করে ধরালেন ডাঃ রুদ্র। বললেন, উত্তরটা আমিই দিচ্ছি। দরজা খুলেছিল সে, যে একদিন রাত্রে ঐ টেবিলের কাছে ঘুরতে ঘুরতে কাচের গ্লাসটা ভেঙেছিল, যে কুলুঙ্গি থেকে শিবানন্দ ভট্টাচার্যের ছবিখানা চুরি করেছিল। সে-ই রীণাকে ওয়ার্নিং দিয়ে দরজা খুলে রেখে গেল।

একটু থেমে বললেন, অবশ্য তুমি জিজ্ঞেস করতে পার–অশরীরী আত্মাকেও কি দরজা খুলে যেতে-আসতে হয়? তাহলে অবশ্যই আমি চুপ করেই থাকব। কেননা তার উত্তর জ্ঞানের বাইরে।

সঞ্জয় মন দিয়ে সব শুনল। কোনো উত্তর দিল না।

কয়েক মিনিট দুজনেই চুপচাপ বসে রইলেন। পাশের ঘরে রীণা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছ। বাইরের দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন বন্দনার মা ট্রেতে দুকাপ চা আর কিছু নোনতা বিস্কুট নিয়ে।

সঞ্জয় একটা কাপ এগিয়ে দিল ডাঃ রুদ্রর দিকে। নিজে নিল অন্যটা। বিস্কুটে কামড় দিয়ে সঞ্জয় বলল, কিন্তু শিবানন্দের ছবি চুরি করার উদ্দেশ্য?

আত্মাটির ক্রিয়াকলাপ দেখে মনে হচ্ছে তোমার এই প্রশ্নের উত্তর সোজা। তুমি বলেছিলে ছবির পিছনে ঠিকানা লেখা ছিল। স্পিরিট চায় না শিবানন্দর সঙ্গে তোমার যোগাযোগ হয়। তাই সে ছবিটা সরিয়ে ফেলেছে।

সঞ্জয় চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বলল, তবে তো শিবানন্দর কাছে আমায় যেতেই হবে। অশরীরী আত্মাটি অনেক কিছুই জানেন, জানেন না যে, ছবি নিয়ে গেলেও ঠিকানাটি আমার মুখস্থ হয়ে আছে।

ডাঃ রুদ্র পেয়ালা নামিয়ে রেখে বললেন, তবে আর কি? একদিন চলে যাও ওঁর কাছে। তবে তার আগে কিন্তু বাড়িটা ছাড়বে।

–এত তাড়াতাড়ি বাড়ি পাব কোথায়?

–এখনি বাড়ি না পাও আমার ওখানে উঠবে। মোট কথা সামনের শনিবারের আগেই তোমরা এ বাড়ি ছাড়বে।

সঞ্জয় ছেলেমানুষের মতো জেদ ধরে বলল, শনিবার পর্যন্ত তো আমি থাকবই।

ডাঃ রুদ্রের মুখটা কঠিন হয়ে উঠল। তিনি বললেন, তুমি থাকতে চাও থাকো। আমি ওদের নিয়ে যাব।

সঞ্জয় বলল, না। তা হয় না কাকাবাবু। রীণা না থাকলে তিনি তো আসবেন। ঐ শনিবার আমি সারা দিন রীণাকে পাহারা দেব। দেখব কি করে ওর ক্ষতি করে?

–তাহলে যা ভালো বোঝ করো। এরপর আমার আর কিছু বলার নেই।

তিনি উঠে রীণাকে পরীক্ষা করতে গেলেন। মিনিট পাঁচেক পরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।–ভালোই আছে। ওর যদি ঘুম ভাঙে তাহলে রাতের খাবার খাবে। ঘুম যেন ভাঙিও না।

বলে বেরোতে যাচ্ছেন এমনি সময়ে বন্দনার মা পুপুকে কোলে নিয়ে চিন্তিত মুখে ঢুকলেন।–পুপুর জ্বর হয়েছে দেখছি।

–জ্বর! সঞ্জয় চমকে উঠে পুপুর কপালে হাত দিল।বেশ জ্বর। বলে ডাঃ রুদ্রের দিকে তাকালো। ডাঃ রুদ্র পালস্ দেখলেন। কিছু বললেন না।

সঞ্জয় চিন্তিতভাবে তাকালো, কি করব?

ডাঃ রুদ্র হাসলেন, তুমি নিজে ডাক্তার। ছেলের একটু জ্বর হয়েছে। তাতেই ঘাবড়ে যাচ্ছ? বলে সঞ্জয়ের কাঁধে হাত রাখলেন।

–আজকের রাতটা দ্যাখো। কাল জ্বর না ছাড়লে ভাবা যাবে।

ডাঃ রুদ্র ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। সঞ্জয় বন্দনার মাকে বলল, আপনি একটু থাকুন। আমি এঁকে এগিয়ে দিয়ে আসছি।

বন্দনার মা বললেন, আমি থাকছি। আপনি একটু বন্দনাকেও পাঠিয়ে দেবেন।

ডাঃ রুদ্র গাড়িতে উঠে ইঞ্জিনের চাবি ঘোরালেন।কাল সকালেই তাহলে একটা খবর দেবে। কী এত ভাবছ?

–হ্যাঁ, নিশ্চয় খবর দেব। ভাবছিলাম–আপনিও বাড়ি ছাড়ার কথা বললেন, আর একজনও বলছিলেন।

–কে তিনি?

সঞ্জয় ইতস্তত করে বলল, আপনাকে বলা হয়নি গত সপ্তাহে মিস থাম্পি নামে একজন ম্যাড্রাসি মহিলা আমার এখানে এসেছিলেন রীণার এক বান্ধবীর সঙ্গে। রীণার কথা সব শুনলেন। তিনিও বলছিলেন–

ডাঃ রুদ্র গাড়ির চাবি বন্ধ করে বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, ব্যাঙ্গালোরের বিখ্যাত স্পিরিচুয়ালিস্ট মিস থাম্পি নাকি?

–হ্যাঁ। আপনি চেনেন?

ডাঃ রুদ্র চাবি ঘুরিয়ে ফের ইঞ্জিন চালু করে বললেন, ওঁর সঙ্গে দেখা হলে খুশি হতাম। নেক্সট ডে যখন আসব ওঁর কথা বলব। গুড নাইট।

১১. মিস থাম্পি

সাতাশে নভেম্বর।

মিস থাম্পি এসেছেন। রীণাও এসেছে। রীণাকে মান্তুই নিজে গিয়ে নিয়ে এসেছে। একদিন থাকবে।

আসল উদ্দেশ্য মিস থাম্পির মতো মানুষ যখন আসছেন তখন রীণাকে একবার দেখিয়ে নেওয়া। মিস থাম্পি তো সারাজীবন প্রেতচর্চাই করছেন। রীণাকে দেখলে, তার মুখ থেকে সব শুনলে হয়তো মিস থাম্পি বলতে পারবেন মানসিক ব্যাধি না অন্য কিছু। মান্তুর উদ্দেশ্যটা রীণাও জানতো না। এখানে এসেই শুধু এক পেয়ালা কফি খেয়ে বেরোবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন মিস থাম্পি। রীণার সঙ্গে আলাপ করার আগ্রহ দেখালেন না। মান্তু তবু এক নিশ্বাসে পরিচয়টুকু মাত্র দিতে পারল। তাও তিনি ভালো করে শুনলেন। বলে মনে হল না।

–চলুন মিস্টার চৌধুরী, আগে পার্ক স্ট্রীটের সিমেট্রিটা দেখে আসি।

বলে তখনই ললিতবাবুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।

পার্ক স্ট্রীটের সেই দেড়শো বছরেরও বেশি পুরনো কবরখানাটা মিস থাম্পি অনেকক্ষণ ঘুরে ঘুরে দেখলেন। বড়ো বড়ো গাছের ছায়ায় জায়গাটা বেশ ঠাণ্ডা। মিস থাম্পির খুব ভালো লাগল।

কয়েক জায়গায় কয়েকটা কবর পরীক্ষা করলেন। ব্যাগ থেকে একটা শিশি বের করে খানিকটা কবরের মাটি পুরে নিলেন। একটা পুরনো কবরের পাশে উপুড় হয়ে শুয়ে কান পেতে কী যেন শুনলেন। এমনি করে সারা সকাল কাটালেন।

মিস থাম্পি বেরিয়ে গেলে মান্তু দুপেয়ালা কফি নিয়ে রীণার কাছে এসে বসল।

কী রে! মুখ অমন ভার কেন? মন কেমন করছে বুঝি?

রীণা ম্লান হাসল। বলল, মন বলে বোধহয় আর কিছু নেই। তাঁরে, আমায় কি রাত্তিরে থাকতেই হবে?

মান্তু হেসে বলল, বরকে ছেড়ে বুঝি একটা রাত্তিরও থাকতে ইচ্ছে করে না?

রীণার ফ্যাকাশে মুখে লালচে আভা ফুটে উঠল।–তা নয়। ঐ বাড়িতে একা থাকা–

দূর! তুই একটা পাগল! বলে মা রান্নাঘরের দিকে উঠে গেল।

রাত্তিরে সঞ্জয় বাড়িতে একা থাকবে এ দুর্ভাবনা তো রীণার ছিলই, তাছাড়া এখানেও তার ভালো লাগছে না। সে এসেছিল নিরিবিলিতে বন্ধুর সঙ্গে গল্প করতে। কিন্তু এদিনই একজন ভি. আই. পি. এসে হাজির। এই মহিলাটিকে রীণার মোটেই ভালো লাগছিল না। যেন কেমন ধারা! একে তো অবাঙালী, চালচলন আলাদা। কথাও কম বলেন। তাছাড়া কিসব প্রেতচর্চা করেন। নিজের ঘরেই নিত্য ভূতের আতঙ্ক তারপর এখানে এসেও

চিন্তায় বাধা পড়ল। একজন মহিলাকে নিয়ে মান্তু ঘরে ঢুকল। রীণার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল।

ভদ্রমহিলা মান্তুদের প্রতিবেশিনী। মিসেস লাহিড়ি। ছোটোখাটো হাসিখুশি মানুষটি। ফর্সা রঙ। গোল মুখ। কপালে বড়ো একটা টিপ।

মিসেস লাহিড়ি আলাপ করতে আসেননি। এসেছিলেন অন্য উদ্দেশ্যে। তাই রীণার সঙ্গে আলাপটা হল দায়সারা গোছের।

তারপরেই মান্তুকে বলল, তাহলে বিকেলে ওঁকে নিয়ে যাবেন।

রীণা ভেবেছিল বুঝি তাকেই নিয়ে যাবার কথা বলছেন। না, তা নয়। নেমন্তন্নটা ঐ মাদ্রাজী মহিলাকে।

মান্তু বলল, হ্যাঁ, নিয়ে যাব। উনি ফিরে এলে বলব আপনি নেমন্তন্ন করতে এসেছিলেন।

.

বেলা দুটো নাগাদ মিস থাম্পিকে নিয়ে ললিতবাবু ফিরলেন। খাওয়া-দাওয়া সেরে মিস থাম্পি বসলেন লিখতে।

বিকেল সাড়ে তিনটের সময় এক কাপ কফি খেলেন। তখন মান্তু খুব বিনীতভাবে মিসেস লাহিড়ির কথা বলল।

আপনার কখন সুবিধে হবে?

মিস থাম্পি প্রথমে একটু অনিচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। এর ওর বাড়ি যাবার ইচ্ছে তার ছিল না। শেষে মান্তুর বিশেষ অনুরোধে রাজি হলেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেন–

–সাড়ে চারটেয়।

ইতিমধ্যে মিস থাম্পির সঙ্গে রীণার অনেকবারই দেখা হল, কিন্তু তিনি কোন কথা বলেননি। কোনো আগ্রহই যেন নেই।

মিস থাম্পির এই ব্যবহারে মান্তু বেশ অস্বস্তিতেই পড়ল। ওঁর কাছে ধীরে সুস্থে বসে রীণা কথা বলবে এইজন্যেই তো রীণাকে আনা। কিন্তু সবই যেন ভেস্তে যাচ্ছে। যাই হোক ঠিক সাড়ে চারটের সময়ে মিস থাম্পিকে নিয়ে মান্তু মিসেস লাহিড়ির বাড়ি চলল। রীণা যেতে চায়নি। মান্তু জোর করেই নিয়ে গেল।

মান্তুদের দুখানা বাড়ির পরেই মিসেস লাহিড়ির বাড়ি। বাড়ির সামনে উঁচু বোয়াক। দুপাশে খুবই সাধারণ ফুলের বাগান।

মিস থাম্পি এখানে নতুন অতিথি, তবু তিনি লম্বা লম্বা পা ফেলে আগে আগে হাঁটছিলেন। যেন নিজের পরিচিত জায়গাতে যাচ্ছেন। নিজেই গেট খুলে খোশ মেজাজে বাগান দেখতে দেখতে ভেতরে ঢুকলেন।

রোয়াকে দাঁড়িয়েছিলেন কর্তা-গিন্নি অতিথিকে অভ্যর্থনা করার জন্যে। পাশে ওঁদের ছেলে, বছর তেরো বয়েস।

মিস থাম্পি বোয়াকে উঠে একটু দাঁড়িয়ে পড়লেন। কপালে যেন একটু ভাঁজ পড়ল। কিন্তু তা কয়েক মুহূর্তের জন্যে।

মিসেস লাহিড়িই অভ্যর্থনা করলেন, আসুন। ইনি আমার হাজব্যান্ড

ভদ্রলোক নিজেই বাকি পরিচয়টুকু দিলেন।

নির্মল লাহিড়ি।

মিস থাম্পি গভীর আন্তরিকতায় হ্যান্ডসেক করলেন।

–আমার ছেলে দেবল। ক্লাস এইটে পড়ছে।

মিস থাম্পি হেসে তার চুলের ওপর একটু আদর করে দিলেন।

নির্মলবাবু সবাইকে নিয়ে ভেতরের ঘরে বসালেন। মিসেস লাহিড়ি অস্বস্তিতে পড়লেন কোন কথা দিয়ে কিভাবে আলাপ শুরু করবেন। বাংলায় বলতে পারলে সুবিধে হতো।

নির্মলবাবুই কথা শুরু করলেন। তার ইচ্ছে ছিল প্রেততত্ত্ব নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু আমল পেলেন না। তিনি একবারই শুধু জিজ্ঞেস করেছিলেন, সত্যি কি আপনি অশরীরী কিছুতে বিশ্বাসী?

মিস থাম্পি একটু হেসেছিলেন। উত্তর দেননি। এতে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ভারি লজ্জিত হয়েছিলেন।

এরপর খাওয়া। কফি আর কেক। সঙ্গে পোটাটো চিপস। মিস থাম্পি বেশ তৃপ্তি করেই খেলেন। খেতে খেতেই মিস থাম্পি জিজ্ঞেস করলেন, লোডশেডিং হয় কিনা, হলে কি করেন? তারপর হঠাৎই মান্তুকে ইশারায় বললেন, ছেলেটিকে বাইরে পাঠিয়ে দিতে।

মান্তু হতভম্ব।

মিসেস লাহিড়িও প্রথমে ঠিক বুঝতে পারলেন না তার ছেলেকে ঘর থেকে চলে যেতে হবে কেন? ও তো চুপচাপ একপাশে বসে আছে। কোনোরকম অভদ্রতা করেনি। কিন্তু মিস থাম্পি আবার চোখের ইশারা করতেই দেবলকে উনি বাইরে পাঠিয়ে দিলেন। একটা অজানা আশঙ্কায় স্বামী-স্ত্রীর বুক কাঁপতে লাগল। মিস থাম্পি গৃহকর্তাকে লক্ষ্য করে হেসে বললেন, মিস্টার লাহিড়ি, আপনি কিন্তু আপনার ফ্যামিলির সকলের কথা বলেননি।

লাহিড়িবাবু মুখ কাঁচুমাচু করে বললেন, আমি তো সকলের সঙ্গেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছি। সকলে বলতে–আমার মিসেস আর ঐ ছেলে।

মিসেস লাহিড়ি যোগ করলেন, শুধু মেয়েটা এখানে নেই। মামার বাড়ি গেছে।

মিস থাম্পিও হেসে বললেন, কিন্তু আপনাদের সঙ্গেই আছেন এমন একজনকে আপনারা বাদ দিয়েছেন।

স্বামী-স্ত্রী দুজনেই অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে মিস থাম্পির দিকে তাকালেন।

মিস থাম্পি বললেন, আমি কিন্তু আপনাদের বাড়ি ঢুকেই তাঁকে দেখতে পেয়েছি। বলে হাসতে লাগলেন।

অবাক নির্মল লাহিড়ি বললেন, আরও একজনকে দেখেছেন?

–হ্যাঁ, আপনারা যখন আমায় রিসিভ করছিলেন, তিনিও পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ছুটে ঘরের মধ্যে চলে গেলেন। আমি ঘরে ঢুকেই তাকে খুঁজেছিলাম। কিন্তু তখন আর দেখতে পেলাম না। দেখলাম পরে খাবার সময়ে। টেবিলের অল্প দূরে দাঁড়িয়েছিলেন। ভারি shy type-এর soft ভদ্রমহিলা।

মিস থাম্পি থামলেন।

সারা ঘর জুড়ে কেমন একটা অস্বস্তি। কেউ সেই মুহূর্তে কোনো কথা বলতে পারল না।

–এখন বলুন ইনি কে?

স্বামী-স্ত্রী একেবারে বোবা হয়ে গেলেন। নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। নির্মলবাবু একটু সামলে নিয়ে বললেন, আর তো কেউ নেই মিস থাম্পি।

–নেই, কিন্তু এক সময়ে ছিলেন। একজন মহিলা। বয়েস বছর কুড়ি-বাইশ। পাতলা গড়ন। শ্যামবর্ণা। লম্বা চুল–একটু যেন কুঁজো হয়ে হাঁটেন

শুনতে শুনতে লাহিড়িবাবুর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

বলুন মিস্টার লাহিড়ি, এইরকম কেউ কি কখনো ছিলেন এ বাড়িতে? মিস থাম্পির গলার স্বরটা কেমন যেন অস্বাভাবিক শোনাল।

কয়েক মিনিট নিরেট স্তব্ধতা। তারপর নির্মল লাহিড়ি অস্ফুটস্বরে বললেন, আপনি যে রকম বর্ণনা দিচ্ছেন তাতে মনে হচ্ছে আপনি আমার ফাস্ট ওয়াইফের কথা বলছেন। কিন্তু সে তো অনেকদিন হল–

কথা শেষ হল না। হঠাৎ মিসেস লাহিড়ি কাঁপতে কাঁপতে চেয়ারে বসে পড়লেন। তারপরই অচৈতন্য।

বিমূঢ় নির্মল লাহিড়ি দু হাতে মিসেস লাহিড়ির দেহটা ধরে রইলেন।

Dont worry! মিস থাম্পি বললেন।একটু পরেই উনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। ওঁকে বলবেন–nothing to fear. এই মহিলা যখন জীবিত ছিলেন তখন আপনাকে খুব ভালবাসতেন। এখনো ভালবাসেন। আর জেনে রাখুন যে spirit ভালবাসতে পারে সে কারো ক্ষতি করে না।

বলে দুহাত তুলে নমস্কার করে বেরিয়ে এলেন।

বাড়ি ফিরে মান্তু ললিতবাবুকে সব ব্যাপারটা বলল। ললিতবাবু স্তম্ভিত হয়ে শুনলেন। মিস থাম্পি হঠাৎই যেন এদের কাছে সাধারণ সম্মানীয় অতিথি থেকে ভয়-বিস্ময়-শ্রদ্ধার পাত্রী হয়ে উঠলেন। এও একরকম অস্বস্তি। এই-সব মানুষের কোথায় কিসে তুষ্টি কিসে বিপত্তি বোঝা দায়। তাছাড়া অন্য অস্বস্তিও রয়েছে মান্তুর। যে জন্যে রীণাকে আনা তা আর কিছুতেই হচ্ছে না। ওকে নিয়ে যে নিরিবিলিতে মিস থাম্পির কাছে বসবে, মিস থাম্পি তার ফুরসতটুকুও দিচ্ছেন না। মিসেস লাহিড়ির বাড়ি থেকে ফিরে এসে আবার খাতাপত্র নিয়ে বসেছেন উনি। হয় তো আরো দুএকদিন থাকবেন। কিন্তু রীণা আর কিছুতেই থাকবে না। ওকে কাল সকালেই পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে।

রীণার ওপরই মান্তুর রাগ হল। ও যদি নিজে মিস থাম্পির কাছে গিয়ে সোজাসুজি ওর বিপদের কথা বলত, তাহলে হাঙ্গামা চুকে যেত। কিন্তু ও তো ত্রিসীমানায় ঘেঁষছেই না।

রাত নটা বাজল। মিস থাম্পি তার খাতা নোটবই ব্যাগে পুরে বেরিয়ে এলেন।

–আপনার খাবার ব্যবস্থা করি? মান্তু বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করল।

করুন। আজ তাড়াতাড়ি শোব। খুব টায়ার্ড। খাওয়াদাওয়া চুকে গেল খুব তাড়াতাড়ি আর নিঃশব্দে। যা সচরাচর হয় না। কারণ যাঁর সঙ্গে ওরা গল্প করবে ভেবেছিলেন, তিনিই তো অতিশয় গম্ভীর।

মান্তু দেখল আর সময় নেই। খাওয়ার পরই মিস থাম্পি শুয়ে পড়বেন। আর রীণাও কাল সকালে চলে যাবে। কাজেই খাওয়ার পরই রীণাকে নিয়ে ওঁর ঘরে ঢুকতে হবে।

মান্তুকে দুর্ভাবনার হাত থেকে বাঁচালেন মিস থাম্পিই।

খাওয়া শেষ করে রীণা থালায় আঙুল দিয়ে আঁক কাটছিল। হঠাৎ মিস থাম্পি জিজ্ঞেস করলেন-Why you look so pale? রাত্রে ভালো ঘুম হয় না?

রীণা চমকে মিস থাম্পির দিকে তাকাল।

-Are you a victim of any nightmare? রাত্রে কোন দুঃস্বপ্ন দ্যাখ?

রীণা প্রথমে কি উত্তর দেবে ভেবে পেল না। তার পরই সংকোচ কাটিয়ে বলল, Not dream madam! Something else.

মিস থাম্পি ভুরু কুঁচকে চোখ ছোটো করে তাকালেন।

রীণা বলল, Not only at night-constantly haunted by a feeling of an unknown fear.

মান্তু এই সুযোগে বন্ধুর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, শুধু রাত্তিরেই নয়, দিনেও খুব ভয় পায়।

-What is that fear?

–That I do not know myself ভয়টা কি ম্যাডাম, আমি নিজেও তো জানি না।

মিস থাম্পি কিছুক্ষণ কী ভাবলেন। তারপর বললেন, আজ আমি খুব টায়ার্ড। কাল সকালে আপনার সঙ্গে কথা বলব। ঠিক সকাল ছটায়।

.

১২.

ডাক্তার রুদ্র

বাড়িতে রীণা নেই, কাজেই ফেরার তাড়া নেই। রীণাকে ছেড়ে দিতে খুব একটা ইচ্ছে ছিল না ওর। তার কারণ, রীণা যেন ক্রমশ মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে উঠছে। এ বিষয়ে সঞ্জয়ের বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এ অবস্থায় রীণাকে চোখের আড়াল করার এতটুকু ইচ্ছে ছিল না সঞ্জয়ের। অবশ্য মান্তু কথা দিয়েছে সে যেমন নিজে রীণাকে নিয়ে যাচ্ছে রাত পোহালেই তেমনি নিজেই পৌঁছে দিয়ে যাবে। মান্তু আড়ালে ওকে মিস থাম্পির কথাও বলেছে। অসাধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন মহিলা, প্রেতচর্চাই তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত। মান্তুর ইচ্ছে রীণাকে একবার তাঁর সঙ্গে কথা বলিয়ে দেয়। এসব হাস্যকর কথা। মহিলাটি কি ঝাড়ফুঁক করে রীণাকে সুস্থ করে তুলবেন? তবু সঞ্জয় বাধা দেয়নি। ভেবেছে মান্তুর বাড়িতে এক রাত্তির থাকলে রীণার হয়তো ভালোই লাগবে। মান্তুও তাকে বোঝাতে পারবে।

সারাদিন হাসপাতালে কাজের মধ্যে কেটে গেল। রীণা যে বাড়ি নেই এ কথা একবারও মনে হল না। মনে পড়ল বিকেলে হাসপাতাল থেকে বেরোবার পর। ভাবল এখনই গিয়ে কি করবে? বাড়ি তো খালি।

সঞ্জয়ের অবশ্য হুটহাট যাওয়ার মতো জায়গা একটা আছে। সেটা ডাক্তার রুদ্রর বাড়ি। সঞ্জয় ঠিক করল ওখানেই যাবে। রীণার ব্যাপারে একটু কথা বলা দরকার।

ডাঃ অবিনাশ রুদ্রের বাড়ি বেলগাছিয়ায়। গেটের ভেতর মোরাম বিছানো পথ। দক্ষিণ দিকে গ্যারেজ। নিচের ঘরে চেম্বার। সকালে রুগী দেখেন। সন্ধেবেলায় বসেন না। ঐ সময়টা মিটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। মিটিং না থাকলে বই পড়েন।

ডাঃ রুদ্রের এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে লন্ডনে ডাক্তারি পড়ছে। বাড়িতে শুধু স্ত্রী। নির্ঞ্ঝাট সংসার।

সঞ্জয় কলকাতায় এসেই ভেবেছিল রীণাকে নিয়ে ডাঃ রুদ্রের বাড়িতে বেড়াতে আসবে। কিন্তু তখন রীণাকে নিয়ে সিনেমা থিয়েটার দেখাতেই দিন কেটে গেল। তারপরই রীণা ভয় পেতে আরম্ভ করল। আর বেরোন হল না। শেষ পর্যন্ত ডাঃ রুদ্রকেই আসতে হল রীণাকে দেখতে। রীণার সঙ্গে সেই তাঁর প্রথম পরিচয়। যাবার সময়ে তিনি বার বার করে বলেছিলেন–সঞ্জয় যেন রীণাকে একদিন নিয়ে যায় তার বাড়িতে। কাকীমা দেখবে।

সঞ্জয় একদিন নিয়ে গিয়েছিল রীণাকে। রীণার মনে অস্বস্তি ছিল ডাঃ রুদ্র হয়তো কাকীমার সামনেই তাকে ঠাট্টা করবেন। কিন্তু ডাঃ রুদ্র ওসব কোনো কথাই তোলেননি। রীণার খুব ভালো লেগেছিল।

মুখে চুরুট, সোফায় গা এলিয়ে ডাঃ রুদ্র বই পড়ছিলেন। সঞ্জয়কে আসতে দেখে বই মুড়ে রেখে সহাস্য অভ্যর্থনা করলেন, এসো এসো।

সঞ্জয় সামনের কোচে বসল।

–কি খবর বলো। রীণা কেমন আছে? বলেই ভেতরের দরজার পর্দা সরিয়ে হাঁকলেন, ওগো, সঞ্জয় এসেছে।

একটু পরেই ডাঃ রুদ্রের স্ত্রী হাসিমুখে এসে দাঁড়ালেন। রীণাকে নিয়ে এলে না কেন?

সঞ্জয় ইতস্তত করে বলল, আজ আমি হাসপাতাল থেকে আসছি। ছুটির দিনে নিয়ে আসব।

বোসো। আমি আসছি। বলে তিনি ভেতরে চলে গেলেন।

সঞ্জয় তখন রীণার কথা বলল। প্রথম দিনের ঘটনা ডাঃ রুদ্রের জানা ছিল। সঞ্জয় পরের দিকের সব ঘটনা খুলে বলল। গেলাস ভাঙা, ছবি চুরি থেকে আরম্ভ করে মান্তুর বাড়ি একা বেড়াতে যাওয়া পর্যন্ত সব। বলল না শুধু মান্তুর সঙ্গে আজকে যাওয়ার কথাটা। লুকোবার তেমন কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু মিস থাম্পির কথায় উনি হয়তো রাগ করবেন, কিংবা হাসবেন।

সব শুনে ডাক্তার রুদ্র গম্ভীর হয়ে রইলেন।

সঞ্জয় জিজ্ঞেস করল, কেসটা আপনার কিরকম মনে হয়? মানসিক ব্যাধিই?

ডাঃ রুদ্র বললেন, ওর সঙ্গে ভালো করে কথা না বললে বুঝতে পারব না।

সঞ্জয় বলল, মানসিক ব্যাধি ছাড়া আর কি হতে পারে? আপনি কি মনে করেন ও সত্যিই কোনো অশরীরী আত্মাকে দেখে?

ডাঃ রুদ্র কিছুক্ষণ কি ভাবলেন। তার পর বললেন, দ্যাখো, এ সম্বন্ধে চটু করে কিছু বলা ঠিক নয়, আমি অলৌকিক ব্যাপার নিজে দেখিনি। তবে রুগী দেখেছি।

–তারা কেউ সেরেছে?

–হ্যাঁ, সবাই। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবন চালাচ্ছে।

–নিশ্চয় ঝাড়-ফুঁক করে নয়?

ডাক্তার রুদ্র বললেন, না। চিকিৎসা করেই। তবে সে চিকিৎসা ওষুধ-ইনজেকশান দিয়ে নয়, পেশেন্টের মনস্তত্ত্ব স্টাডি করে কিংবা জায়গা বদল করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অন্য উপায়ও নিতে হয়েছে।

ডাঃ রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমার মনে হচ্ছে তোমার ধারণাই ঠিক। রীণা সাইকোপ্যাথিক পেশেন্ট হয়ে পড়েছে।

সঞ্জয় এতেও সন্তুষ্ট হল না। জিজ্ঞেস করল, হঠাৎ সাইকোপ্যাথিক পেশেন্ট হয়ে পড়ল কেন? তারও তো কারণ থাকবে।

-হ্যাঁ, কারণ তো থাকবেই।

–কিন্তু আমি তো কোনো কারণ দেখছি না।

ডাঃ রুদ্র একটু হাসলেন। বললেন, তুমি আর কত দিন ওকে দেখছ? তিন বছর? চার বছর? তার আগেও তো কোনো ঘটনা ঘটতে পারে যা তুমি জান না। এমনকি ওর মা-বাবাও জানে না। এমনও হতে পারে ব্যাপারটা ওর নিজেরও মনে নেই!

সঞ্জয় অবাক হয়ে বলল, সে আবার কী?

–হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। খুব অল্প বয়েসে হয়তো কোনো কিছুতে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিল। সেই ভয়ের কারণ বা স্বরূপ আজ আর মনে নেই। কিন্তু ভয়ের। তীব্র অনুভূতিটা থেকে গিয়েছে সাব-কনসাস মাইন্ডে।

ডাঃ রুদ্র একটু থামলেন। তারপর সোজা হয়ে বসে বললেন, ছোটোবেলায় একবার নররাক্ষসের জ্যান্ত মুর্গি খাওয়া দেখে ভয় পেয়েছিল, সেদিন তুমি বলছিলে না?

—হ্যা। এবারও মহাজাতি সদনে ম্যাজিক দেখতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল সে কথাও আপনাকে বলেছি। কিন্তু তার সঙ্গে এখনকার মানসিক

এই পর্যন্ত বলে সঞ্জয় একটু থামল। ডাক্তার রুদ্রের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, একটা কারণ খুঁজে পেয়েছি কাকাবাবু। রীণা যাকে দেখে তার পরনে কালো কোটপ্যান্ট। রীণা ছোটোবেলায় যে নররাক্ষসকে দেখেছিল সেও আসলে ম্যাজিসিয়ান। আমার বিশ্বাস সেও কালো পোশাক পরত।

ডাঃ রুদ্রের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, ভালো কথা বলেছ। রীণাকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখো দিকি, সেই ম্যাজিসিয়ানের পোশাকটা মনে আছে কিনা।

করব।

এই সময়ে ডাঃ রুদ্রের স্ত্রী দুজনের জন্য চা, টোস্ট আর ওমলেট নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। প্লেট নামিয়ে কাজ সারতে মিসেস রুদ্র ভেতরে চলে গেলেন।

ডাঃ রুদ্র সোফায় আধ-শোওয়া হয়ে খেতে খেতে বললেন, তবে আমার মনে হয় ওটা ঠিক কারণ নয়। ধরো, সেই ম্যাজিসিয়ানের কালো পোশাকটাই যদি ভয়ের কারণ হয় তাহলে তো যে কোনো কালো কোট-প্যান্ট পরা লোক দেখলেই ভয় হবে। মহাজাতি সদনে ম্যাজিক দেখার আগে কি কখনো কালো পোশাক পরা লোক দেখেনি?

সঞ্জয় চুপ করে গেল। নিঃশব্দে দুচুমুক চা খেয়ে বলল, ধরেই নিলাম না হয় ছোটোবেলার স্মৃতি থেকেই মহাজাতি সদনে ম্যাজিক দেখতে গিয়ে কিংবা ম্যাজিসিয়ানকে দেখে ভয় পেয়েছিল। তার সঙ্গে বাড়িতে ভয় পাবার কারণ কি? আর কলকাতায় এসেই বা এতদিন পর ভয় পেতে লাগল কেন? সব যেন কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে কাকাবাবু।

ডাঃ রুদ্র চা শেষ করে একটা চুরুট ধরালেন। বললেন, গোলমাল কিছুই নয়। ব্যাপার একটাই–ভয় পাওয়া। সেই সঙ্গে একটা-কিছু দেখা।

সঞ্জয় একটু উত্তেজিত হয়ে বলল, আপনিও বিশ্বাস করেন ও কিছু দেখে?

-আমি তো আগেই বলেছি, ও বিষয়ে চট করে কিছু বলা যাবে না। রোগের বিকারে মানুষ নিজে থেকেই বকে। কিন্তু যা বকে তা ভুল বকা। মানসিক রোগে লোকে নানা কারণে ভয় পায়-কখনো কোনো শব্দ শুনে, কখনো কোনো বিশেষ গন্ধ পেয়ে, কখনো বা কিছু দেখে। অথচ সেই শব্দ, গন্ধ বা বস্তু হয়তো আদপেই কিছু নেই।

–তাহলে আপনি সেই আমার কথাতেই আসছেন রীণা সাইকোপ্যাথির পেশেন্ট?

–হ্যাঁ, তাই।

সঞ্জয় নিজেই কত বার রীণাকেই বলেছে, তুমি মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে পড়েছ। আর আজ ডাঃ রুদ্রের মুখে ঐ একই কথা শুনে তার মুখটা শুকিয়ে গেল। ম্লান মুখে জিজ্ঞাসা করল, তাহলে ট্রিটমেন্ট?

–আমিই করব। অবশ্য যদি বুঝি সত্যিই ওর মানসিক রোগ হয়েছে।

এই বলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। সঞ্জয়ের পিঠ চাপড়ে বললেন, শুনে অবাক হবে, আমি এখন মেমেরিজম নিয়ে কিছু পড়াশোনা করছি। বলতে বলতে সামনের র‍্যাক থেকে কতকগুলো ফাইল বের করে টেবিলের ওপর রাখলেন। বললেন, একসময়ে ওদেশের ডাক্তার ফিসার (Dr Fisher), রিচার (Richer), বিনেট (Binet), ফেরি (Fere), বিখ্যাত ফরাসী বিজ্ঞানবিদ ডাক্তার লুই আর স্বয়ং মেসমার যিনি মেসমেরিজমের আবিষ্কর্তা এঁরা সকলেই মেমেরিজমের সাহায্যে কঠিন কঠিন রোগ সারাতে পারতেন। সেই সব খবরের কাটিং এই ফাইলে আছে। কৌতূহল থাকলে একটা ছুটির দিনে এসে পড়ে দেখতে পার। একটু থেমে বললেন এখনও এদেশে বহু জটিল রোগ মেমেরিজমের সাহায্যে সারানো যায়। আমাদের দেশে ঝাড়-ফুঁক করে রোগ সারানো হতো। এখনও পল্লীগ্রামে ঝাড়-ফুঁকের ব্যবস্থা চলে। এই ঝাড়-ফুঁকও এক ধরনের মেসূমেরিজ। তুমি কখনো দেখেছ কি না জানি না ওঝারা রুগীর কাছে বসে রুগীকে না ছুঁয়ে কিংবা তার দেহের ওপর দিয়ে খুব আগ্মভাবে হাত চালায়। একে বলে পাস দেওয়া। মাথা থেকে পা পর্যন্ত এইরকম কয়েকবার পাস দিলেই রুগী ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ভাঙলে দেখা যায় সে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছে। অনেক মহাপুরুষই তো রোগীর গায়ে হাত বুলিয়ে তাদের রোগমুক্ত করতেন। এটা অস্বাভাবিক বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আসলে তারা প্রচণ্ড মানসিক শক্তির অধিকারী। ঐ শক্তির বলেই তারা রোগীকে রোগমুক্ত করতে পারতেন। আর মেমেরিজমের গোড়ার কথাই হচ্ছে প্রচণ্ড মানসিক শক্তি। বুঝতেই পারছ মানসিক রোগের ক্ষেত্রে এই মেসমেরিজম্ কত শক্তিশালী চিকিৎসা।

সঞ্জয় বলল, তাহলে কি আপনি রীণাকে হিপনোটাইজ করে সারাবেন?

ডাঃ রুদ্র হেসে বললেন, তাহলে তো খুব ভালোই হতো। কিন্তু হিপনোটাইজ করি সে শক্তি আমার কই? আজকের দিনে কজনারই বা সে শক্তি আছে? তবে এবিষয়ে আমার ইন্টারেস্ট আছে বলেই তোমাকে এত কথা বললাম।

সঞ্জয় একটু অধৈর্য হয়ে বলল, তাহলে আপনি কিভাবে সারাবেন?

সঞ্জয় না হয়ে অন্য কেউ এ কথা জিজ্ঞেস করলে ডাঃ রুদ্র হয়তো বিরক্ত হতেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি শুধু একটু হাসলেন। বললেন, প্রথমে রোগের সঠিক কারণ খুঁজে বের করতে হবে। দেখতে হবে চাপা কোনো ভয়ের স্মৃতি আছে কিনা? কোনো মানসিক আঘাত পেয়েছে কিনা। অনেক মানসিক আঘাত নিঃশব্দে সহ্য করতে হয়, তার প্রভাবই সবচেয়ে বেশি। এছাড়া অতৃপ্ত যৌন-কামনারও একটা প্রভাব আছে। বিশেষ করে যারা উগ্রবিকৃত যৌন-কামনায় কাতর তাদের মানসিক বিকার জন্মাতেই পারে। বিকৃত যৌন-কামনায় কাতর এমন একটি পেশেন্ট আমিই পেয়েছিলাম।

সঞ্জয় অধৈর্য হয়ে বলল, রীণার ক্ষেত্রে এসবের কোনো প্রভাবই নেই। কলকাতায় আসার আগে পর্যন্ত সে সবদিক দিয়েই সুখী ছিল। এখনও তার কোনো কিছুরই অভাব নেই।

ডাঃ রুদ্র স্নিগ্ধ হেসে বললেন, তা হয়তো ঠিক। তবু তুমি নিজে ডাক্তার। এই ধরনের মনস্তাত্ত্বিক ঘটনা জেনে রাখা ভালো। সেই পেশেন্টটির কথা শোনোনা।

ডাঃ রুদ্র একটু থামলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন, স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবন। দুটি সন্তানও হয়েছে। স্বামীটি সুদর্শন, ভদ্র, মার্জিতরুচি, সলজ্জ প্রকৃতির। স্ত্রীটি মোটামুটি সুন্দরী। পাতলা গড়ন। গাল দুটি একটু বসা। কিন্তু ঝকঝকে চোখ। মোটেই মুখরা নয়, বরঞ্চ স্বল্পভাষী। তাকে দেখেই মনে হয়েছিল তার জীবনের অনেক সুখ-দুঃখের কথা সে যেন ঠোঁটে কুলুপ এঁটে আছে। দশ বছর শান্ত দাম্পত্য জীবন কাটাবার পর স্ত্রীটি হঠাৎ কিরকম অস্বাভাবিক হয়ে উঠল। কোনো কিছুতেই আনন্দ নেই, উৎসাহ নেই, কারো সঙ্গেই কথা বলতে ভালো লাগে না, এমনকি–এমনকি রাত্রে স্বামীর পাশে শুয়েও পাশ ফিরে থাকত। স্বামীর মনে হতো যেন একতাল বরফ তার পাশে পড়ে আছে। অগত্যা স্বামী তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করল। প্রথমে স্ত্রী চিকিৎসা করাতে রাজি হয়নি। বিরক্ত হয়ে বলত–আমার কি হয়েছে যে চিকিৎসা করাব?

শেষে অবশ্য রাজি হয়েছিল। গোপন সাক্ষাৎকারের সময় হিতৈষী ডাক্তারের কাছে সে যা বলেছিল তা এই–প্রথম কৈশোর কালেই সে একটা ছেলের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। ছেলেটি শুধু যে উপভোগ করত তা নয়, উপভোগের সময়ে নানা রকম খারাপ কথা বলত, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করত। তাতে মেয়েটি রাগ তো করতই না, বরঞ্চ তার ভালো লাগত। পরবর্তী জীবনে স্বামীর কাছ থেকেও ঐ রকম আচরণ আশা করত। কিন্তু স্বামীর কাছ থেকে সেরকম ব্যবহার পেত না। শেষ পর্যন্ত–মানে দশ বছর পর তার হঠাৎ এমন অবস্থা হল যে, পাগলের মতো সেই ছেলেটার খোঁজ করতে লাগল। ছেলেটি এই পরিবারের এতই পরিচিত ছিল যে তাকে কেউ সন্দেহ করত না। মেয়েটি এই ব্যাধিরই শিকার।

এই পর্যন্ত বলে ডাঃ রুদ্র একটু থামলেন।

সঞ্জয় জিজ্ঞেস করল–মহিলাটির শেষ পর্যন্ত কি হল?

–চিকিৎসা শুরু হল। চিকিৎসা কি জান? চিকিৎসা আর কিছুই নয়, মাস ছয়েকের জন্যে তাকে তাদেরই অতি সাধারণ এক গৃহস্থ যৌথ পরিবারে পাঠিয়ে দেওয়া হল। তার স্বামীকে বলা হল–এই ছমাসের মধ্যে সে যেন স্ত্রীর কাছে না যায়। শুধু তখনই যাবে যখন তার স্ত্রী তাকে চিঠি লিখে আসতে বলবে। সেই যৌথ পরিবারে গিয়ে বধূটি প্রথম সুস্থ স্বাভাবিক ব্যস্তসমস্ত জীবনের আস্বাদ পেল। তারপর থেকেই তার পরিবর্তন। এখন সে সম্পূর্ণ সুস্থ স্বাভাবিক।

সঞ্জয় কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, রীণার ট্রিটমেন্ট তাহলে কিভাবে করবেন?

ডাঃ রুদ্র হেসে বললেন, রীণার ক্ষেত্রে কোন ধরনের ট্রিটমেন্ট করব তার সঙ্গে কথা বলার পর ঠিক করব। অবশ্য রীণা যদি সত্যিই সাইকোপ্যাথিক পেশেন্ট হয়।

বড়ো ঘড়িটায় ঢং ঢং করে নটা বাজল। সঞ্জয় উঠে পড়ল। এখন তাকে হোটেলে ছুটতে হবে।

.

রাত সাড়ে দশটা শহর কলকাতায় এমন কিছু নয়। কিন্তু যশোর রোডের ধারে এই অঞ্চলটা এরই মধ্যে নিঝুম হয়ে গেছে। বিশেষ করে এই বাড়ির একতলা দোতলার ভাড়াটেরা দশটার আগেই খাওয়া সেরে শুয়ে পড়ে। একমাত্র গরমকালে লোড শেডিং হলে অনেক রাত পর্যন্ত বাইরে এসে বসে।

সঞ্জয় ওপরে উঠে এল। প্যাসেজটা অন্ধকার। বাড়িতে কে আছে যে আলো জ্বেলে রাখবে?

অন্ধকারেই সঞ্জয় তালা খুলে ঘরে ঢুকল। ঢুকতেই গা-টা কেমন ছমছম করে উঠল। এর আগেও একদিন এরকম হয়েছিল, যেদিন রীণা একা মান্তুদের বাড়ি যাবার জন্যে বেরিয়েছিল। তবে সেদিনের অস্বস্তিটা অন্য কারণে। রীণার জন্যে দুর্ভাবনায়। দুর্ভাবনা আর গা ছমছ করা এক নয়।

কিন্তু আজই বা গা ছমছম করল কেন?

সঞ্জয় তাড়াতাড়ি আলো জ্বালল। আলোয় ঘর ভরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে গা-ছমছমানি থেমে গেল। নিজেকে ধমক দিল–ডাক্তার মানুষের অন্ধকারে ভয়? তাও তেতলার নিজের ঘরে ঢুকতে?

দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে সঞ্জয় বিছানায় এসে বসল। হোটেলে খেয়ে এসেছে। কাজেই শোওয়া ছাড়া এখন আর অন্য কাজ নেই। কিন্তু শুতে ইচ্ছে করল না। শুলেও ঘুম আসবে না। অগত্যা একটা সিগারেট ধরালো।

ডাঃ রুদ্রের কথাগুলো তার মনে পড়ছিল। আচ্ছা, রীণার প্রসঙ্গে হঠাৎ উনি ঐ মহিলাটির কথা টানলেন কেন? তিনি কি রীণার ক্ষেত্রেও সেরকম কিছু সন্দেহ করেন? মান্তুর দাদার সঙ্গেও ওর খুব ভাবছিল নাকি কী জানি বাবা! পরক্ষণেই অবশ্য সঞ্জয় সে কথা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে পাশ ফিরে শুল। কিন্তু কিছুতেই ঘুম এল না।

তার কেবলই সেইসব রাতগুলোর কথা মনে হতে লাগল যেসব রাতে রীণা ভয় পেয়েছিল। ঐ তো বসার ঘরে টেবিলটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ঐ টেবিলের কাছেই রীণা কী যেন দেখেছিল। ঐ টেবিল থেকেই গেলাস পড়ে ভেঙেছিল। আচ্ছা–সেই ছবিটার কি হল? সত্যিই কি কেউ নিয়ে গেছে? কিন্তু কে নেবে? এঘরে তো বাইরের কেউ আসে না।

ভাবতে ভাবতে সঞ্জয়ের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। সে জোর করে অন্য দিকে মন সরাবার চেষ্টা করল। কিন্তু মনটা সেই অশরীরী আত্মার মতো টেবিলটার চারদিকেই ঘুরতে লাগল।

কী মুশকিল! ভয় পাচ্ছে নাকি? সঞ্জয় জোর করে নিজেকে সচেতন করার চেষ্টা করল।

কই? অন্য দিন তো ভয় পায় না। ঘরে সঙ্গী তো শুধু রীণা। তাও সে তো নিজেই ভয়ের শিকার!

আশ্চর্য! আজ সেই একটা ভীতু মানুষই কাছে না থাকাতে সঞ্জয়ের মতো ডাক্তারও কেমন ভয় পাচ্ছে।

সঞ্জয় উঠে পায়চারি করতে লাগল। হঠাৎ ও চমকে উঠল। ঘরে কি আর কেউ আছে? তার পিছনে!

নাঃ, ওটা ওর নিজেরই ছায়া।

আশ্চর্য! মেঝেতে নিজের ছায়া দেখেই বুকের মধ্যে কিরকম করে উঠেছিল। বুঝতে পারল, এই জন্যেই মানুষ বোধহয় জায়গা-বিশেষে একা থাকতে পারে না। সঙ্গী চায়। ঘরে একটা কুকুর থাকলেও যেন অনেক নিশ্চিন্ত।

নাঃ, ঘুমনো যাক। সঞ্জয় মশারি টাঙিয়ে নিল। বিছানায় ঢুকে বেডসুইচ টিপে আলো নিভোতে যাচ্ছিল, কি মনে হল, আবার উঠে দরজাটা দেখে নিল ঠিক মতো বন্ধ হয়েছে কি না। সিঁড়ির দিকের জানলাটা অন্য দিন খোলা থাকে। আজ বন্ধ করে দিল।

বিছানার কাছে আসছিল–ফিরে গিয়ে একবার বাথরুমটা দেখে নিল। তারপর খাটের তলা।

নাঃ, কেউ কোথাও নেই। নিশ্চিন্ত। মনকে বোঝাল–অন্য কিছুর জন্যে নয়, চোর-ডাকাতের জন্যেই এত সাবধানতা!

বিছানায় শুয়ে বেডসুইচ অফ করে দিল।

তবু ঘুম আসছে না। তখন সঞ্জয় ডাঃ রুদ্রের সঙ্গে যে কথা হল তাই নিয়ে আবার ভাবতে লাগল। ডাঃ রুদ্র যে কী বলতে চাইলেন সঞ্জয়ের কাছে তা মোটেই পরিষ্কার নয়। উনি কি এই বয়েসে এখন মেসমেরিজ শিখে চিকিৎসা করবেন? পাগল নাকি!

উনি রীণার সঙ্গে ভালো করে কথা বলবেন। তা তিনি হাজার বার বলুন। কিন্তু রীণাকে কোথাও চিকিৎসার জন্যে পাঠানো যাবে না। ও কিছুতেই রাজি হবে না।

তাছাড়া ডাঃ রুদ্র যদিও বলছেন মানসিক রোগ, তবু প্রতিবারই বলেছেন, যদি সত্যিই মানসিক রোগ হয়।

উনি কি তবে মানসিক রোগ ছাড়া অন্য কিছু আশঙ্কা করছেন? ডাঃ রুদ্রের মতো একজন বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্টও কি অলৌকিক কিছুতে বিশ্বাসী?

এক ঘুমেই রাত শেষ।

ঘুম ভাঙার পরই সঞ্জয়ের মনে পড়ল রীণা নেই। কাজেই চা নিয়ে কেউ আজ মুখের সামনে ধরবে না।

বিছানা থেকে উঠে পড়ল ও। মনটা খুশি খুশি, কাল রাতে কিছু হয়নি। সত্যি কিছু থাকলে তো হবে।

চা খেয়ে, শেভিং-এর কাজ সেরে স্নানের ঘরে যখন ঢুকল তখন বেলা আটটা। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই রীণা এসে পড়বে, তবু আজ আর বাড়ির ভাত জুটবে না। ক্যান্টিনেই খেয়ে নিতে হবে। তার আগে সকালে পেটে কিছু পড়া দরকার। সঞ্জয় একটা ডিম সেদ্ধ করে নিল। তারপর কোথায় নুন, কোথায় গোলমরিচ খুঁজতে খুঁজতে হাঁপিয়ে উঠল।

বেলা সাড়ে আটটা। হাসপাতালে যাবার জন্যে সঞ্জয় তৈরি। কিন্তু রীণার পাত্তা নেই। অথচ সকালেই ওর আসার কথা। মান্তুই পৌঁছে দিয়ে যাবে। কই?

পৌনে নটা হতে চলল।

নাঃ, আর দেরি করা যায় না। সঞ্জয় ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তালা লাগালো। এমনি সময়ে সিঁড়ির মুখে বন্দনা এসে দাঁড়ালো।

-আপনার ফোন।

–ফোন! সঞ্জয় চমকে উঠল। কার ফোন হতে পারে? সেদিন রাতে ফোন এসেছিল থানা থেকে। আজ? আজ নিশ্চয়ই মান্তু

বন্দনাদের বসার ঘরে ঢুকে সঞ্জয় রিসিভারটা তুলে নিল।

–হ্যালো!

–কি মশাই! কাল রাত্তিরে ভালো ঘুম হয়েছিল তো?

মহিলা কণ্ঠস্বর। কিন্তু কেমন অস্পষ্ট।

-কে বলছেন?

–ও বাবা! এত মিষ্টি করে বললাম, তবু চিনতে পারলেন না? ডাক্তাররা এমনি ভোতাই হয়।

সঞ্জয় এবার হেসে উঠল।

-ওঃ শ্ৰীমতী মান্তু! বলুন কি খবর? বেরোবার মুখে এমন একটি মধুর স্বর উপহার পাব ভাবতে পারিনি।

-চুপ করুন মশাই! বেশি গলে যাবেন না। পাশেই আপনার অর্ধাঙ্গিনী আছেন। শুনতে পাবেন।

সঞ্জয় জোরে হেসে উঠল।

–হাসিটা এখন তুলে রাখুন। শুনুন–এবেলা যাচ্ছি না। ওবেলা। দুজন নয়, তিন জন। পুপুকে যদি ধরেন তা হলে সাড়ে তিন জন।

–তিন, জন?

না না এখন কিছু বলব না। ভয় নেই, পুরুষ নন। মহিলাই। একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে চেষ্টা করবেন। জমিয়ে আড্ডা দেব। ছাড়বেন না। রীণা কথা বলবে।

সঞ্জয় রিসিভারটা কান বদল করে নিল।

–হ্যালো! আমি রীণা। কাল ভয়টয় পাওনি তো?

–ভয়? কিসের ভয়? ধুৎ?

তাড়াতাড়ি ফিরছ তো?

-দেখি। বলে রিসিভারটা রেখে বন্দনার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে তাড়াতাড়ি নেমে গেল। বড্ড দেরি হয়ে গেছে।

.

১৩.

মিস থাম্পির অভিজ্ঞতা

সন্ধেবেলা বাসায় ফিরে সঞ্জয় দেখল বাড়ি সরগরম। হাসি-গল্পে ভরপুর। একে মান্তু এসেছে সেই সঙ্গে এসেছেন সেই ম্যাড্রাসি মহিলা। তিনিও যে আসকেন, মান্তু ফোনে না বললেও, সঞ্জয় অনুমান করেছিল। রীণা তো এই মহীয়সী অতিথিটির আপ্যায়নে মহা ব্যস্ত।

আজ ওকে দেখলে কে বলবে এই রীণাই এই বাড়িতে এত দিন ভূতের ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে ছিল। এমনকি ওঁর মুখের ওপর যে ফ্যাকাশে ভাবটা ছিল সেটাও যেন আজ আর নেই। রীণা ঠিক আগের মতোই প্রাণচঞ্চল, উচ্ছল হয়ে উঠেছে।

দেখে সঞ্জয়ের ভালো লাগল। কিন্তু দূর থেকে ঐ মহিলাটিকে দেখে মোটেই ভালো লাগল না। বরঞ্চ তাঁর মুখখানা দেখে কেমন অস্বস্তি হতে লাগল।

সঞ্জয়কে সিঁড়ির মুখে প্রথম দেখল মান্তু। হাসতে হাসতে এগিয়ে এল সে।

–খুব তাড়াতাড়ি তো এসেছেন মশাই! এদিকে আমরা হোস্টের অপেক্ষায় বসে আছি। আসুন এঘরে। বলে সঞ্জয়কে একরকম টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে গেল।

মিস থাম্পির সঙ্গে আলাপের পর্বটা মাই সেরে দিল।

মিস থাম্পি হ্যান্ডশেক করে হেসে বললেন, আপনি ছিলেন না, আপনার বাছিত সম্ভবত আমার অনধিকার-প্রবেশ হয়ে গেছে।

সঞ্জয় সসংকোচে বলল, সে কী কথা! আমি না থাকলেও আমার স্ত্রীকে তো আপনার হাতেই দিয়ে গেছি। আপনি অনুগ্রহ করে এদের সঙ্গে এসেছেন এ আমার সৌভাগ্য।

মিস থাম্পি বললেন, আজ সকালে আপনার মিসেসের মুখে সব ব্যাপারটা শুনলাম। শুনে খুব কৌতূহল হল। ভাবলাম জায়গাটা একবার দেখেই আসি।

–ভালোই করেছেন। রীণা, চা-টা দিয়েছ তো?

রীণা ভ্রূভঙ্গি করে বলল, তুমি কি মনে করেছ, তুমি ছিলে না বলে হোস্টের কর্তব্য করতে পারব না?

মিস থাম্পি উত্তরটা শুনে খুব হাসলেন।

মান্তু, রীণা দুজনেই লক্ষ্য করল এবাড়িতে এসে মিস থাম্পি যেন অন্য মানুষ হয়ে গেছেন। এমন করে প্রাণখোলা হাসতে দেখা যায়নি। ভালোই লাগল।

–নিন মশাই, গরম চা। খেয়ে দেখুন আমার হাতে কিরকম লাগে। আর এটা কি বলুন তো?

–পাঁউরুটি তো দেখতেই পাচ্ছি। তাছাড়া নিশ্চয় ঘুগনি।

–আশ্চর্য! এতও বোঝেন!

–তা আর এত দিনে বুঝব না? আপনার বান্ধবীটি তো ঘুগনি-স্পেশালিস্ট। সারা জীবনে ঐ একটিই জলখাবার শিখে রেখেছেন।

উঃ কী মিথ্যুক! রীণা যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল–সেদিন অমন নিজে হাতে কেক করলাম! কী বেইমান!

সঞ্জয় ততক্ষণে চামচে করে মুখে দিয়েছে। না, ঘুগনি নয়–মাংসের কিমা। সঞ্জয় আর কোনো মন্তব্য না করে চুপচাপ খেয়ে গেল।

মিস থাম্পি একটা শাল ভালো করে জড়িয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

–আপনারা গল্প করুন। আমি একটু ঘুরে আসি।

মান্তু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল-সন্ধে হয়ে গেছে। এখন কোথায় যাবেন এই ঠাণ্ডায়?

মিস থাম্পি টটা নিয়ে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, নিচটা একবার দেখে আসি।

রীণা বলল, একাই যাবেন? ওঁকে বলব?

মিস থাম্পি তাড়াতাড়ি বললেন, না না, কাউকে লাগবে না। আমি এই কম্পাউন্ডের মধ্যেই আছি।

আধ ঘন্টার মধ্যেই মিস থাম্পি ফিরে এলেন। সঞ্জয় হেসে বললে, কিছু পেলেন?

মিস থাম্পি দাঁতের ফাঁকে একটু হাসলেন। ছেলেমানুষের মতো বললেন, বলব কেন?

কিন্তু সবাই লক্ষ্য করল ওঁর হাতে একটু শুকনো মাটি।

.

খেতে বসতে একটু রাত হল। একসঙ্গেই সবাই বসল। খেতে খেতে গল্প হচ্ছিল। রীণা মান্তুকে বলল, মিসেস লাহিড়ির বাড়ির ঘটনাটা একবার ওকে ব। বলে সঞ্জয়কে দেখিয়ে দিল।

সঞ্জয় মুর্গির হাড় চিবুতে চিবুতে নিস্পৃহ সুরে বলল, কি বলবেন? গল্প? তা বলুন শুনি।

–গল্প নয়, ঘটনা মশাই। আমরা দুজনেই তা স্বচক্ষে দেখলাম। বলে ঘটনাটা রুদ্ধ নিশ্বাসে বলে গেল।

সঞ্জয় শুনে যে কোনো মন্তব্য করল না, মিস থাম্পি তা লক্ষ্য করলেন। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, আপনার এই ঘরে শুনলাম মাঝে মাঝে কারো আবির্ভাব হয়। আপনি ভয়টয় পান না তো?

সঞ্জয় হেসে বলল, না ম্যাডাম, ভয়টা আমার এমনিতেই কম। ভূত-প্রেতের ভয় তো জীবনে কোনোদিন করিনি। ওসব আমি মানিও না।

একটু থেমে বলল, তাছাড়া আমি ডাক্তার। বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ছাড়া–

–বিজ্ঞানই কি শেষ কথা? বিজ্ঞানের এক্তিয়ারের বাইরে কি কিছু থাকতে পারে না?

–থাকতে পারে। তবে তা নিয়ে অকারণে মাথা ঘামাবার মতো যথেষ্ট সময় আমার নেই।

মিস থাম্পি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি কি মনে করেন এ বাড়িতে ও-সব কিছু নেই? সবটাই আপনার ওয়াইফের মনের ভুল?

সঞ্জয় সেই দৃষ্টির সামনে তাকাতে পারল না। চোখ নিচু করে উত্তরটা এড়িয়ে গিয়ে বলল, এই তত গতকালই সারারাত এঘরে আমি একা ছিলাম। দিব্যি ছিলাম। কোনো কিছুই দেখিনি, কোনো শব্দও না।

মিস থাম্পি বললেন, আপনার সঙ্গে তো তার ব্যাপার নয়। কাজেই আপনাকে শুধু শুধু দেখা দেবে কেন?

সঞ্জয় হেসে অবিশ্বাসের সুরে বলল, তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন আমার স্ত্রীর সঙ্গেই শুধু তার কিছু ব্যাপার আছে। তাই সে তাকে ভয় দেখায়।

–হয়তো তাই।

—কিন্তু আমি তা বিশ্বাস করব কি করে? বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ কই?

মিস থাম্পি একটু যেন কঠোর সুরে বললেন, এসব জিনিস জনসমক্ষে প্রমাণ করা সম্ভব নয়।

রীণা ইশারায় সঞ্জয়কে চুপ করতে বলল। সঞ্জয় চুপ করে গেল।

মিস থাম্পি তার কথার জের ধরে বললেন, প্রমাণ দিতে আমিও পারব না, হয়তো প্রতিকারও আমার পক্ষে সম্ভব নয়, তবে আজ রাত্রে একবার পরীক্ষা করে দেখব বলেই এলাম।

সঞ্জয় বলল, ভালো কথা। আপনি নিজে থেকে দেখুন কোনো পাওয়া যায় কিনা।

তারপর রীণার দিকে তাকিয়ে বলল, তাহলে আজই আঁ কিংবা না হয়ে যাচ্ছে। কি বল?

রীণ কোনো উত্তর দিল না।

সঞ্জয় কথাটা বলল বটে কিন্তু বিশ্বাস না করেই। মিস থাম্পি যদি পরদিন সকালে কফি খেতে খেতে গল্প দেন যে তিনিও সেই কালো-সুট-পরা লোকটিকে স্বচক্ষে দেখেছেন তা হলেও সে বিশ্বাস করবে না। কেননা তা বিশ্বাস করা যায় না।

.

খাওয়া অনেকক্ষণ হয়ে গিয়েছিল। শীতের রাতও গম্ভীর হয়ে উঠছিল।

হঠাৎই মিস থাম্পি রীণাকে জিজ্ঞেস করলেন–আচ্ছা, সিঁড়িটা সম্বন্ধে আপনার অভিজ্ঞতা কিরকম? তার মানে আমি বলতে চাইছি সিঁড়ি দিয়ে যখন আপনি ওঠা-নামা করেন তখন কি কিছু ফিল করেন?

রীণা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল, না তো!

সঞ্জয় হেসে বলল, রীণার মনে নেই-ওর একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল। প্রথম দিনই বেচারি উঠতে গিয়ে আচমকা গড়িয়ে পড়ে গিয়েছিল।

মিস থাম্পি এক মুহূর্ত যেন থমকে গেলেন। কিন্তু কিছু বললেন না।

.

রাত সাড়ে দশটা বাজল। তবু কেউ শোবার নাম করছে না। মিস থাম্পিও না। তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কলকাতার হালচাল জিজ্ঞাসা করছিলেন।

একসময়ে মান্তু বলল, মিস থাম্পি, আপনি যদি আপনার অভিজ্ঞতা থেকে দুএকটা গল্প শোনান তাহলে শীতের রাতে বেশ জমবে।

একথায় মিস থাম্পি গম্ভীর হয়ে গেলেন। একটু যেন বিরক্ত হয়ে বললেন, দেখুন আপনারা যাকে গল্প বলেন, আমি দুঃখিত, সেরকম কিছু আমার জানা নেই। আমি সারাজীবন দেশ-বিদেশ ঘুরে যেসব তথ্য সংগ্রহ করেছি তা গল্প নয়। তা নিয়েই আমার সাধনা। সেসব আমার নিজস্ব সম্পদ!

মান্তুর মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। বলল, excuse me! আমি দুঃখিত।

মিস থাম্পি আর কিছু বললেন না। কিন্তু পরিবেশটা ভারী হয়ে গেল।

কিছুক্ষণ কাটল। তার পর নীরবতা ভাঙলেন মিস থাম্পি নিজেই। হাসতে হাসতে বললেন, আমার কথায় আপনারা ক্ষুণ্ণ হলেন বুঝতে পারছি। আচ্ছা, একটা সত্য ঘটনা বলছি শুনুন, যার মীমাংসা এখনো হয়নি।

মিস থাম্পি একটু থামলেন। সকলেই নড়েচড়ে বসলেন। কেবল সঞ্জয়ের মধ্যে তেমন কোনো চাঞ্চল্য দেখা গেল না।

কলকাতা থেকে কাল আমার ভুটান যাবার কথা। ওখানে একটা ঘটনা ঘটেছে বলে খবর পেয়েছি। বলে মিস থাম্পি থামলেন। সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, ডাঃ গুপ্ত, ঘটনাটা আপনার বিশ্বাসযোগ্য না হলেও এঁদের শোনাচ্ছি। অলৌকিক শব্দটা আমরা প্রায়শই শুনে থাকি এবং নানা প্রসঙ্গে ব্যবহারও করে থাকি। অলৌকিক অর্থাৎ এমন-কিছু যা বাস্তবজীবনে সচরাচর ঘটে না বা যা বিজ্ঞানসম্মত নয়। কিন্তু আমাদের দেশের অনেক সাধকই তাঁদের কঠোর সাধনালব্ধ বিভূতি বা অলৌকিক ক্ষমতার পরিচয় দিয়ে গেছেন। তন্ত্রমন্ত্রের কথা আপনারা সবাই শুনেছেন। আমাদের দেশের বৌদ্ধ আর হিন্দু তান্ত্রিকেরা নির্জনে এমন অনেক কিছু করতেন যা সাধারণ মানুষের জ্ঞানের বাইরে।

মিস থাম্পি একটু থামলেন। তারপর বলতে লাগলেন, অনেকের বিশ্বাস বৌদ্ধরাই আদি তান্ত্রিক।

এ নিয়ে মতভেদ থাকলেও একটা কথা মনে রাখবেন–এই তন্ত্রশাস্ত্রের উৎপত্তি হিমালয় অঞ্চলে। অর্থাৎ কৈলাস, চীন, নেপাল, তিব্বত প্রভৃতি জায়গায়।

আমার এইসব কথা বলার উদ্দেশ্য অলৌকিকতত্ত্বে বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা বোধহয় নেপাল, তিব্বত, ভুটানেই বেশি। এই অলৌকিকতত্ত্বের মধ্যে প্রেততত্ত্বও জড়িয়ে আছে।

দুঃখের বিষয় অলৌকিকতত্ত্ব ও প্রেততত্ত্ব এখন ভয়-পাওয়ানো গাঁজাখুরি গল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারও একটা কারণ বোধহয় এই যে, মানুষ ভয় পেতেও চায়। অশরীরী আত্মা আর তথাকথিত ভূত-প্রেত এক কথা নয়। কিন্তু সেকথা সাধারণ মানুষকে বোঝান যায় না। অশরীরী আত্মার অস্তিত্ব আছে। অনেকেই তা প্রত্যক্ষ করেছে। এমনকি তাদের কথা বলতেও শুনেছে। আশ্চর্য নয় কি? দ্বন্দ্ব এখানেই, আমি বলব আত্মা শরীর ধারণ করতে পারে–যে শরীর দেখা যাবে কিন্তু স্পর্শ করা যাবে না–যে শরীর কোনো চিহ্ন রেখে যেতে পারে না। ডাঃ গুপ্ত বলবেন, অসম্ভব। কিন্তু মিসেস গুপ্ত যাঁকে প্রায়ই দেখেন তিনিও যে ঐরকম কোনো শরীরী আত্মা তা আমি বিশ্বাস করি। কেননা ঐ ধরনের শরীরী আত্মার আমি প্রত্যক্ষদর্শী।

একটু থেমে বললেন, শরীর ধারণ ছাড়াও এই আত্মার আবার অন্যরকম প্রক্রিয়াও আছে। জানেন কি যোগীরা তাঁদের অসাধারণ ক্ষমতায় নিজেদের দেহ থেকে আত্মাকে কিছুকালের জন্যে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে পারতেন? সেও এক অলৌকিক ব্যাপার বিজ্ঞান যার ব্যাখ্যা করতে পারেনি।

মিস থাম্পি রীণার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, ঘুম পাচ্ছে?

রীণা তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে বসে বলল, না। আপনার কথা শুনতে বেশ ভালোই লাগছে।

মিস থাম্পি হেসেই বললেন, ধন্যবাদ।

বেশ, তাহলে প্রথমে যোগীদের দেহ থেকে আত্মাকে সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন করার একটা গল্প বলি। বলে সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন।

সঞ্জয় চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বললে, চালিয়ে যান।

–অনেক দিন আগের কথা। এক ইংরেজ দম্পতি ভারতে কার্যরত থাকাকালীন বায়ুপরিবর্তনের জন্যে সিমলা পাহাড়ে গিয়েছিলেন। ইংরেজ ভদ্রলোক ছিলেন বৃটিশ-ভারতের একজন উচ্চপদস্থ অফিসার। দেশ তার ইংলন্ডে।

সিমলায় আসবার আগেই মেমসাহেবের শরীর খারাপ হয়েছিল। অল্প অল্প জ্বর হতো। সেটা খুব খারাপ লক্ষণ। সিমলাতে চেঞ্জে এসেও শরীর ঠিকমতো সারল না।

এই সময়েই আবার এক দুঃসংবাদ এল, সাহেবের বাবা লন্ডনে মারা গেছেন। সেই খবর পেয়েই সাহেব চলে গেলেন। মেমসাহেব শরীর খারাপের জন্যে যেতে পারলেন না।

লন্ডনে পৌঁছে সাহেব নিয়মিত চিঠি দিয়ে স্ত্রীর খবর নিতেন। প্রতি চিঠিতেই আশ্বাস শীগগিরই যাচ্ছি।

মেমসাহেব পথ চেয়ে থাকেন। কিন্তু বেশ কিছুকাল হয়ে গেল–স্বামী আর ফেরেন না। চিঠিপত্রও পান না। তার মন খুব খারাপ।

একদিন ভোর রাত্রে মেমসাহেব ঘুমের মধ্যে কেঁদে উঠলেন। ঘরে তাঁর যে খাস-পরিচারিকা ছিল সে ইংরেজ রমণী। তাড়াতাড়ি মেমসাহেবের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে?

মেমসাহেব পরিচারিকার সামনে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করে ফেলার জন্যে লজ্জিত হলেন। বললেন, স্বপ্ন দেখছিলাম সাহেব কঠিন রোগে মৃত্যুশয্যায়। তাই তিনি আসতে পারছেন না।

মেমসাহেব খাঁটি ইংরেজ মহিলা। তাই স্বপ্নকে স্বপ্ন বলেই মেনে নিলেন। গুরুত্ব দিলেন না।

কিন্তু গুরুত্ব না দিলেও তার মনটা অত্যন্ত ভার হয়ে রইল।

মেমসাহেবের অন্য যে দাসী, সে ছিল তিব্বতীয়। মনিবের মন খারাপ তারও দৃষ্টি এড়ায়নি। রোজই দেখে–আর ভাবে মেমসাহেবকে জিজ্ঞেস করবে কি হয়েছে। কিন্তু জিজ্ঞেস করতে সাহস পায় না। শেষে খাস পরিচারিকাকে জিজ্ঞেস করে কারণটা জানতে পারল। তখন সে সসংকোচে তাকে বলল, মেমসাহেব যদি চান তাহলে সাহেবের খবর আজকের মধ্যেই আনিয়ে দিতে পারি।

খাস-পরিচারিকা অবাক হয়ে বলল, কি করে?

তিব্বতী দাসী তখন তাকে তার উপায়ের কথা জানাল।

ইংরেজ দাসী তা পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও এ দেশের অনেক ভোজবাজির কথা ছোটোবেলা থেকে শুনেছে। তাই তিব্বতীর কথা একেবারে উড়িয়ে না দিয়ে মেমসাহেবকে বলল। মেমসাহেব তখনই তিব্বতী দাসীকে ডেকে পাঠালেন। দাসী এলে তাকে বললেন, তুমি যে লোকটির কথা বলছ সে কি করে? কোথায় থাকে?

দাসী বিনীতভাবে জানালো যে, যাঁর কথা সে বলছে তিনি একসময়ে লামা সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। কি কারণে যেন তিনি সেই পদ ছেড়ে দিয়ে এখন লোকচক্ষুর অন্তরালে একটা পাহাড়ের নিচে আত্মগোপন করে থাকেন।

মেমসাহেব সকৌতূহলে জিজ্ঞেস করলেন, আত্মগোপন করে কেন?

দাসী বললে, তিনি এক বিশেষ সাধনায় সিদ্ধ বলে ঈর্ষাকাতর অন্য দল তাকে মেরে ফেলতে চায়।

শুনে মেমসাহেব স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।

—সত্যিই তিনি এত গুণী লোক?

— মেমসাহেব, আমি নিজে চোখে তার সেই গুণ দেখেছি।

–কিন্তু তুমি যা বলছ তাতে তো মনে হচ্ছে তাকে খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। আর–পেলেও হয়তো আসতে চাইবেন না।

দাসী অন্যমনস্কভাবে বলল, আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি। যদি পাওয়া যায় তাহলে আজই উনি সাহেবের খবর এনে দেবেন।

মেমসাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় কত দূরে–কোন পাহাড়ের নিচে উনি থাকেন?

দাসী বলল, এখান থেকে ক্রোশ তিন দূরে–ঐ যে ধোঁওয়ার মতো তিনচূড়ো পাহাড়টা দেখা যাচ্ছে ওরই কাছে উনি থাকেন।

মেমসাহেব বললেন, উনি যদি তোমার কথায় আসতে না চান–আমি কি গিয়ে request করব?

দাসী বলল, তার দরকার হবে না। তাছাড়া পথ দুর্গম। গাড়ি চলবে না। আপনার পক্ষে হেঁটে যাওয়াও সম্ভব নয়।

মেমসাহেব চুপ করে রইলেন। দাসী বলল, আর তার কাছে যেতে হলে যেতে হবে গোপনে। কেননা তার শত্রুরা তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

শুনে মেমসাহেব হতাশ হয়ে পড়লেন। তখন দাসী বলল, আপনি অনুমতি করলে আমি নিজে গিয়ে একবার চেষ্টা করতে পারি।

মেমসাহেব সানন্দে অনুমতি দিলেন।

পরের দিন ভোরবেলায় তিব্বতীয় দাসীটি লামার খোঁজে বেরিয়ে গেল। আর সন্ধেবেলা ফিরল লামাকে নিয়ে।

লামা এসেছে শুনে মেমসাহেব খুশি মনে দোতলা থেকে নেমে এলেন। কিন্তু লামার চেহারা দেখে তার ভক্তি হল না। যেমন আমাকে দেখে আপনাদের হয়েছে। বলে মিস থাম্পি একটু হাসলেন।

–যাক, যে কথা বলছিলাম। মেমসাহেব দেখলেন লোকটি বৃদ্ধ। মাথায় দীর্ঘ পাকা চুল, পাতলা পাকা গোঁফ দাড়ি। হাত, পা শীর্ণ। দেহ তো নয়, যেন একখানা কংকাল। দুই চোখ কোটরাগত। চোখের নিচে কালি পড়েছে। তার সারা মুখের চামড়া কুঁচকানো। গলায় নীল পাথরের একটা মালা। অমন গাঢ় নীল পাথর মেমসাহেব কখনো দেখেননি।

লোকটি এমন ক্ষীণ স্বরে জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলছিল যে মেমসাহেব তার একবর্ণও বুঝতে পারছিলেন না। যাই হোক সেই তিব্বতী দাসীর সাহায্যে কথাবার্তাটা এইরকম হল

মেমসাহেব বললেন, শুনেছি আপনার নাকি এমন ক্ষমতা আছে যে আপনি এখানে বসেই বহুদুরের খবর এনে দিতে পারেন। তাই যদি হয় তাহলে আপনি দয়া করে আমার স্বামীর খবর জানান। তিনি এখন লন্ডনে আছেন। বেশ কিছু দিন খবর পাচ্ছি না। স্বপ্নে দেখলাম তিনি নাকি শয্যাশায়ী। আমি খুবই দুশ্চিন্তায় আছি।

লামা পথশ্রমে ক্লান্ত বলে সেদিনটা বিশ্রাম করে পরের দিন খবর এনে দেবার প্রতিশ্রুতি দিলেন।

কিন্তু মেমসাহেব আর এক দণ্ডও অপেক্ষা করতে চাইলেন না। অগত্যা বৃদ্ধ লামাকে সম্মত হতে হল। তখন শ্রাবণ মাসের বেলা প্রায় শেষ। লামা প্রথমে আনুষঙ্গিক কতকগুলি কাজ শেষ করে নিয়ে সাহেবের ঠিকানা জেনে নিলেন। আর তার একটা ছবি দেখে নিলেন। তারপর খালি গায়ে মাটিতে শুয়ে পড়ে বললেন, আমি আপনার স্বামীর খবর আনতে চললাম। আমার দেহ এখানে পড়ে রইল। যদি বাধা-বিঘ্ন না ঘটে তাহলে এক ঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসব। তবে একটা অনুরোধ–আমার জীবন-মরণের সব দায়িত্ব আপনাকে নিতে হবে।

মেমসাহেব চমকে উঠলেন।-কেমন করে?

লামা বললেন, আমার দেহ যেন কেউ স্পর্শ না করে, এইটুকু দেখবেন।

–নিশ্চয় দেখব। মেমসাহেব প্রতিশ্রুতি দিলেন।

–আরও একটি কথা–আমি যখন এখানে আসছিলাম, বুঝতে পারছিলাম আমার শত্রুরা আমায় অনুসরণ করছে। তারা হয়তো একটু পরেই এখানে এসে হানা দেবে। আমার দেহটা কেড়ে নিয়ে যেতে চাইবে। আপনি দয়া করে বাধা দেবেন। কথা দিন–পারবেন তো?

মেমসাহেব ইংরেজরমণী। অসুস্থ হলেও তাঁর মনের জোর ছিল অসাধারণ। সব দিক ভেবে নিয়ে বললেন, ঠিক আছে। দায়িত্ব নিলাম। আপনি নিরুদ্বেগে গিয়ে আমার স্বামীর খবর নিয়ে আসুন।

এই অঙ্গীকার পেয়ে লামা যোগনিদ্রায় সমাহিত হলেন। সকলেই দেখলেন লামার অসাড় দেহটা মাটিতে পড়ে আছে যেন বহুকালের পুরনো শুকনো একটা মৃতদেহ।

এই সময়ে তিব্বতী দাসীর খেয়াল হল নিচের দরজাটা বোধহয় ভোলাই থেকে গিয়েছে। সে নিজেই দেখতে যাবে ভাবছিল কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক লামার দেহ ছেড়ে নিচে যেতে মন চাইল না। তখন সে দরজা বন্ধ করার কথা ইংরেজ পরিচারিকাটিকে নিচু গলায় বলল।

ইংরেজ পরিচারিকা যাচ্ছি বলেও সকৌতূহলে লামার নিঃসাড় দেহের দিকে তাকিয়ে রইল। যাবার কথা ভুলে গেল।

আধঘণ্টাও হয়েছে কি না সন্দেহ হঠাৎ নিচে একটা গোলমাল শোনা গেল। কারা যেন দারোয়ান-বেয়ারা-বাবুর্চিদের ঠেলে জোর করে ওপরে উঠে আসতে চাইছে।

মেমসাহেব বিচলিত হলেন। কিসের এত গোলমাল? তিনি ইংরেজ দাসীকে ব্যাপারটা কি জেনে আসবার জন্যে পাঠালেন। ইংরেজ দাসী ব্ৰস্তপদে নিচে নেমে গেল। কিন্তু পাঁচ মিনিট যেতে-না-যেতেই ছুটতে ছুটতে এসে জানালো একদল জংলী জোর করে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েছে। তারা লামাকে চায়।

-কেন? মেমসাহেবের ভুরুতে ক্রোধের প্রকাশ ফুটে উঠল।

ইংরেজ দাসী উত্তর দেবার আগেই মেমসাহেব দেখলেন কয়েকজন তিব্বতী জংলী দোতলায় উঠে হৈ হৈ করে ঘরের দিকে এগিয়ে আসছে।

মেমসাহেব রাগে কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করে উঠলেন–Who are you? What makes you to come here?

তারা মেমসাহেবের কথা বুঝল না। বুঝতে চাইলও না। তাদের সকলের দৃষ্টি তখন লামার দেহের ওপর। বাড়িতে তেমন লোকজন নেই যে সেই উন্মত্ত লোকগুলোকে বাধা দেয়। জংলী লোকগুলো বোধহয় তা বুঝতে পেরেছিল। তাই তারা নির্ভয়ে ঘরের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।

ইংরেজ দাসী তখন ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। সে পুলিশ ডাকার জন্যে জানলার দিকে ছুটে যাচ্ছিল, মেমসাহেব তাকে আটকালেন। কঠিন স্বরে বললেন, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো।

তারপর এক মিনিটের মধ্যে ছুটে গিয়ে ড্রয়ার থেকে গুলিভরা রিভলভারটা এনে দুবার ফায়ার করলেন। সঙ্গে সঙ্গে লোকগুলো যে যেদিকে পারল পালালো।

-যাও! দরজা লাগিয়ে এসো। বলে মেমসাহেব ইজিচেয়ারে বসে হাঁপাতে লাগলেন। তার শরীর একেই দুর্বল, তার ওপর এই উত্তেজনা। রিভলভারটা কিন্তু তখনো তার হাতের মুঠোয়।

তিব্বতী দাসী তখনও লামার দেহের ওপর–তাকে স্পর্শ না করে দুহাত দিয়ে আগলে বসে ছিল।

এবার সে উঠে নিজের জায়গায় গিয়ে বসল।

আরো আধঘণ্টা পরে লামার দেহটা একটু নড়ল। তারপর ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালেন।

মেমসাহেব আনন্দে লামার ওপরে ঝুঁকে পড়লেন। লামা ইশারায় একটু জল খেতে চাইলেন। মেমসাহেব তিব্বতী দাসীকে জল দিতে বললেন।

জল খেয়ে সেই লামা যোগী আস্তে আস্তে উঠে বসলেন। তারপর তার সেই ক্ষীণ স্বরে বললেন, আপনার স্বামী ভালোই আছেন। দেখলাম জিনিসপত্র গোছগাছ করছেন। বোধহয় আজ-কালের মধ্যেই এখানে আসার জন্যে রওনা হবেন।

শুনে মেমসাহেব আনন্দে কিছুক্ষণ চোখ বুজিয়ে রইলেন।

তারপর লামা ধীরে ধীরে তাঁর ঘরের বর্ণনা দিলেন। শুনতে শুনতে মেমসাহেব তো অবাক। শেষে লামা বললেন, তবে আপনার বাড়ির দক্ষিণদিকে যে সুন্দর বাগানটা ছিল সেটা সম্প্রতি ঝড়ে তছনছ হয়ে গেছে।

বাগানটাও যোগীর চোখে পড়েছে তা হলে! মেমসাহেব মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।

লামা সেই রাত্তিরেই চলে যেতে চাইলেন। কিন্তু মেমসাহেব যেতে দিলেন না। পরের দিন অতি প্রত্যূষে যাবার সময়ে লামা মেমসাহেবের দিকে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। মেমসাহেবও চোখ নামাতে পারেননি।

মিনিট দুয়েক পরে লামা বললেন, আপনি এখন রোগমুক্ত। বলে দরজার দিকে পা বাড়ালেন। মেমসাহেব তাঁকে পুরস্কৃত করতে চাইলেন। কিন্তু তিনি কিছুই নিলেন না।

মেমসাহেব নিজের মনেই শুধু বললেন- am grateful to you Indian yogi–I am grateful.

পরের দিনই সাহেবের চিঠি এল। লিখছেন–একটা মিথ্যে মামলায় জড়িয়ে পড়েছিলাম। যাই হোক ঈশ্বরের কৃপায় এখন আমি বিপন্মুক্ত। রওনা হচ্ছি।

পুনশ্চ দিয়ে লিখেছেন-খুব আশ্চর্য ব্যাপার হঠাৎ কাল আমার ঘরের সামনে একজন ইন্ডিয়ান যোগীকে দেখলাম। তারপরেই অদৃশ্য। সম্ভবত আমার চোখেরই ভুল।

মিস থাম্পি তার কথা শেষ করে একটু থামলেন। তার পর জল খেয়ে রুমালে মুখ মুছলেন।

–এ কাহিনী আপনাদের শোনাবার উদ্দেশ্য এটাই বোঝানো যে, এও এক ধরনের অলৌকিক ক্রিয়া। কিন্তু এটা ম্যাজিক বা যাদু নয়। এ যোগসাধনা। এই যোগের দ্বারাই আপনি এই মুহূর্তে কী ভাবছেন তা বলে দেওয়া যায়। এই যোগের দ্বারাই আগামী চাব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আপনার জীবনে উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা ঘটবে কি না জানানো যায়। কঠিন ব্যাধির কারণ ও উৎপত্তিস্থল ধরা যায়।

এই যোগ যাঁর আয়ত্ত তিনি তেমন-তেমন বাড়িতে ঢুকেই বলতে পারেন সেখানে কোনো অশরীরী আত্মার আবির্ভাব ঘটে কিনা। বিজ্ঞানে কিন্তু এর ব্যাখ্যা মেলে না।

অশরীরী আত্মার টের পাওয়া যায়–মিস থাম্পির এই কথায় সকলেই যেন একটু বিচলিত হল।

একটু থেমে মিস থাম্পি বললেন, এরকম অনেক তথ্য রবার্ট ডাল আওয়েল-এর Foot falls on the Boundary of Another World বইটিতে পাওয়া যায়। পুরনো কোনো বড়ো লাইব্রেরিতে খোঁজ করে দেখতে পারেন–of course should you be so interested.

মিস থাম্পি থামলেন। ঘড়ির দিকে তাকালেন। সাড়ে বারোটা।

গল্পে গল্পে অনেক রাত হয়ে গেছে। মিস থাম্পি বললেন, তাহলে এবার শুতে যাওয়া যাক?

মান্তু বলল, কিন্তু আপনি ভুটানে কেন যাচ্ছেন বললেন না তো?

–শুনতে চান?

–নিশ্চয়ই। মান্তু আর রীণা দুজনেই উৎসাহে বলে উঠল।

–আপনি? মিস থাম্পি সহাস্যে সঞ্জয়ের দিকে তাকালেন।

সঞ্জয় সলজ্জভাবে বলল, আমার বড় ঘুম পাচ্ছে। কাল সকালেই তো আবার ছুটতে হবে।

রীণা বলল, তুমি তবে ওঘরে গিয়ে শোও গে।

সঞ্জয় অবশ্য গেল না। আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে চোখ বুজে বসে রইল।

মিস থাম্পি বললেন, বিস্তৃত করে বলতে গেলে রাত শেষ হয়ে যাবে। সংক্ষেপে বলি।ভুটানে যাচ্ছি সেখানকার একটি মেয়েকে স্টাডি করতে। ডাঃ কুমার আমার খুব পরিচিত। তিনি সম্প্রতি সাদার্ন ভুটানের ডিস্ট্রিক্ট টাউন সারভং-এ গিয়েছেন সেখানকার হাসপাতালের এম. ও. হয়ে। ওখান থেকে তিনি আমায় কয়েকখানা চিঠি লিখেছেন।

ডাঃ কুমার ওখানে কোয়ার্টারে একা থাকেন। রাঁধা-বাড়া করার জন্যে উনি একটি লোক খুঁজছিলেন। অনেক কষ্টে একটি মেয়ে পান। মেয়েটির নাম সুখমতী। বয়েস উনিশ-কুড়ি। মেয়েটি কথা বলে না। কিন্তু সে বোবা নয়। কেননা সে শুনতে পায়। মেয়েটির কোনো অভিব্যক্তি নেই। শুধু যন্ত্রের মতো কাজ করে যায়। সে সারাদিন কোয়ার্টারে থাকে। কিন্তু ঠিক রাত নটা বাজলেই সে বাড়ি চলে যায়। ব্যতিক্রম হয় না।

ডাঃ কুমার হুঁশিয়ার লোক। তিনি যখনই কোনো কাজের লোক লাগান তখনই তার ঠিকানা নিয়ে রাখেন। সুখমতীরও ঠিকানা নিয়েছিলেন।

এদিকে সুখমতী কাজে লাগার দু দিন আগে পাহাড়তলীতে একটা জিপ অ্যাকসিডেন্ট হয়। সেটাও নাকি অদ্ভুত ঘটনা। যাই হোক, জিপে যে-সব লোক ছিল তারা সবাই ঘেঁৎলে মরে যায়। ওদের মধ্যে একটি যুবতী মেয়ে ছিল। তার লাশ কিন্তু পাওয়া যায়নি। অথচ সেই নিদারুণ অ্যাকসিডেন্ট থেকে কেউ যে বেঁচে পালাবে তাও নাকি অসম্ভব।

যাই হোক, সেদিনের মতো লাশ তিনটে হাসপাতালের ল্যাবরেটরি-ঘরের কাছে রাখা হয়।

একদিন হাসপাতালের দারোয়ান দীন বাহাদুর ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ডাঃ কুমারকে বলল, সাব, বক্সী!

–ওদেশে ভূতকে বক্সী বলে।

ডাঃ কুমার অবাক হয়ে বললেন, বক্সী! কোথায়?

দীন বাহাদুর বলল, ল্যাবরেটরির পাশে যে ঘরে লাশ ছিল সেখানে।

তার বক্তব্য–রাত্রে পাহারা দিতে দিতে ও একটা শব্দ শুনে লাশ-ঘরের দিকে যায়। সেখানে একটা গোঙানি শুনতে পায়। কৌতূহলী হয়ে জানলার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে যেখানে তিনটে লাশ ছিল সেখানে একটা মেয়ে শোবার জায়গা করে নিতে চাইছে। কিন্তু যেন কিছুতেই জায়গা পাচ্ছে না। মেয়েটার গায়ে জামা-কাপড় কিছুই ছিল না।

তারপর যে কথাটা দীন বাহাদুর নাকি এতটুকু ইতস্তত না করেই বলে ফেললে তা এই যে–সে মেয়েটি সুখমতী ছাড়া আর কেউ নয়।

ডাক্তার কুমার তো চমকে উঠলেন। তিনি অবিশ্বাস করলেন। দীন বাহাদুর হলপ করে বলল, সে খুব ভালো করে নজর করে দেখেছে সে সুখমতীই।

ডাক্তার কুমার তবু যখন বিশ্বাস করতে চাইলেন না তখন দীন বাহাদুর বলল, ঠিক আছে আজই দেখা যাক, সুখমতী রাত্তিরে কি করে।

সেদিনও সুখমতী ঠিক রাত নটায় কাজ সেরে চলে গেল। দীন বাহাদুর তখন ডাক্তার কুমারের কোয়ার্টারে। সুখমতী যখন চলে যাচ্ছে দীন বাহাদুর তখন ফি ফিস্ করে বলল, সাব, দেখুন ওর হাঁটাটা কি রকম।

ডাঃ কুমার এতদিন লক্ষ্য করেননি। আজ দেখলেন–হ্যাঁ, হাঁটাটা একটু অস্বাভাবিক। কেমন যেন লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে। আর সেই সঙ্গে তার লম্বা হাত দুটো যেন বড্ড বেশি দুলছিল।

রাত দুটোয় ডাক্তারকে নিয়ে দীন বাহাদুর সুখমতীর ঠিকানা খোঁজ করতে বেরোল। বেরোবার আগে একটুকরো ন্যাকড়া ডাক্তারের হাতে দিয়ে বলল, এটা সঙ্গে রাখুন সাব। অনিষ্ট করতে পারবে না।

অনেক খোঁজাখুঁজির পর যে ঠিকানাটা ওরা খুঁজে পেল সেটা একটা ভাঙা ঘর, একেবারে লোকালয়ের বাইরে।

সুখমতী–সুখমতী করে ডাক্তার ডাকাডাকি করলেন। কিন্তু কারো সাড়া পেলেন না। তখন দুজনে দুটো টর্চ জ্বেলে ভেতরে ঢুকলেন। কেউ কোত্থাও নেই। শুধু সুখমতীর ছাড়া কাপড়টা পড়ে আছে।….

এই পর্যন্ত বলে মিস থাম্পি থামলেন।

–খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার। এ বিষয়ে আপনার কি মনে হয়? মান্তু জিজ্ঞেস করল।

–আগে ভুটানে গিয়ে সুখমতাঁকে দেখি। নিজে না দেখে, না কথা বলে আমি কোনো কমেন্ট করব না। তবে আমার শুধু একটাই জানার আছে–সুখমতী কেন চাকরি নিল? কেন ডাক্তার কুমারের কাছেই? কিন্তু আর নয়। এবার সবাই শুয়ে পড়ুন।

.

শীতের রাত। গোটা শহর যেন কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছে। সামনে যশোর রোড যেন দেহ প্রসারিত করে একটু বিশ্রাম নিচ্ছে। ওদিকে সঞ্জয় বসে বসেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। মাথাটা হেলে পড়েছে চেয়ারে। শুধু এরা তিন জনই জেগেছিল এতক্ষণ।

এই সময়ে হঠাৎ পুপু কেঁদে উঠল। সেই মর্মান্তিক যন্ত্রণায় কেঁদে ওঠা। রীণা চমকে উঠে ছুটে গিয়ে পুপুকে বুকে তুলে নিল। ঘুম ভেঙে গেল সঞ্জয়ের। লাফিয়ে ছুটে গেল পুপুর বিছানায়। এ কান্না যে তাদের চেনা।

মান্তু কি হল? কি হল? বলে রীণার কাছে গিয়ে বসল। শুধু মিস থাম্পি স্থির হয়ে বসে পুপুর দিকে তাকিয়ে রইলেন।

কান্না থামে না। দেখতে দেখতে পুপুর সমস্ত মুখটা যেন কি রকম হয়ে গেল। রীণা আর্তস্বরে বলে উঠল কী হবে? কান্না থামছে না যে?

রীণা জানে, এ কান্না থামাবার সাধ্য ডাক্তারের নেই।

মিস থাম্পি উঠে দাঁড়ালেন। একবার ভুরু কুঁচকে খোলা দরজা দিয়ে সিঁড়ির দিকে তাকালেন। তারপর গায়ের চাদরটা ফেলে দিয়ে পুপুর কাছে এগিয়ে গেলেন। পুপু তখন কাঁদতে কাঁদতে ধনুকের মতো বেঁকে যাচ্ছে। রীণা পাগলের মতো মিস থাম্পির হাত দুটো চেপে ধরে কেঁদে উঠল। কী হবে? এমন করে তো ও কখনো কাঁদে না।

সেই অশরীরীর আবির্ভাব হলেই যে পুপু কেঁদে ওঠে, মিস থাম্পি আগে তা শুনেছিলেন। তিনি একদৃষ্টে কিছুক্ষণ পুপুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার পর আস্তে আস্তে একবার তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিলেন। রীণাকে বললেন, তুমি এবার ওকে বুকে তুলে নাও।

–ও ঘুমোত পারবে না। দেখছেন না–

–আমি বলছি, ঘুমোবে। তুমি বুকে নাও। আদেশের সুরে বললেন মিস থাম্পি।

রীণা পুপুকে বুকের কাছে টেনে নিতেই পুপুর কান্না আস্তে আস্তে থেমে গেল। তারপর পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল।

এবার মিস থাম্পি উঠে দাঁড়ালেন। স্থির গম্ভীর স্বরে বললেন, সে বোধহয় এসেছে। আপনারা তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ুন।

সঞ্জয়ও কেমন যেন চঞ্চল হয়ে উঠল। কিন্তু সে যে আজ কোথায় শোবে ভেবে পেল না।

মিস থাম্পি বললেন, শোবার ব্যবস্থা আমিই করে দিচ্ছি।

-বাইরের ঘরে এই ডিভানে মিসেস গুপ্ত যেমন বাচ্চাকে নিয়ে শুয়েছেন শোন। আপনি শোন মেঝেতে এইখানে। বলে মান্তুকেও জায়গা নির্দেশ করে দিলেন।

–ডাঃ গুপ্ত, আপনি প্লিজ চলে যান ভেতরের ঘরে। নিশ্চিন্তে ঘুমোন গিয়ে।

–আপনি?

মিস থাম্পি একটু হাসলেন।–আমি শোব না। বসে থাকব সিঁড়ির মুখে। আজকের রাতের মতো আমার কথা অনুগ্রহ করে শুনবেন। বলে নিজেই একটা চেয়ার টেনে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

অনেকক্ষণ পর্যন্ত কেউই ঘুমোত পারল না। কিসের যেন দুঃসহ প্রতীক্ষা। তারপর একসময়ে সকলেই ঘুমিয়ে পড়ল।

.

সবার আগে ঘুম ভাঙল মান্তুর। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রীণার। দুজনেই একবার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। রাত্তিরটা তাহলে নিরাপদেই কেটেছে।

সঞ্জয় তখনো ঘুমোচ্ছ। কিন্তু মিস থাম্পি? তিনি কি এখনও বাইরে বসে আছেন?

তাড়াতাড়ি এরা দুজনে বাইরে বেরিয়ে এল। দেখল মিস থাম্পি নেই। শূন্য চেয়ারটা শুধু পড়ে রয়েছে।

দুজনের মুখ শুকিয়ে গেল।

–উনি কোথায় গেলেন? মান্তুর গলার স্বর ভয়ে কাঁপছে।

–তাই তো। বলেই রীণা সঞ্জয়কে ঘুম থেকে তুলে সব কথা বলল। সঞ্জয় ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে এল।

তখনো ভোর হয়নি। শীতের কুয়াশায় চারিদিক পর্দাটাকা। বাড়ির অন্যান্য ভাড়াটেরা তখনো সুখনিদ্রায় নিশ্চিন্ত।

সঞ্জয় কি করবে ভাবছে। এমনি সময়ে সিঁড়িতে হালকা চটির শব্দ। মিস থাম্পি ওপরে উঠে আসছেন।

বাবাঃ! এই কুয়াশায় কোথায় গিয়েছিলেন?

মিস থাম্পি হেসে বললেন, প্রাতঃভ্রমণে। কম্পাউন্ডের মধ্যেই ঘুরছিলাম। বেশ পুরনো আমলের বাড়ি। ফোয়ারার সামনে যে স্ট্যাচুটা–সেটা কোনো অবস্থাপন্নরই কীর্তি। তাঁর রুচিটা পবিত্র ছিল না। চলুন ভেতরে গিয়ে বসি। একটু গরম কফি খাব।

কফি খেতে খেতে সকলেই উদগ্রীব হয়ে মিস থাম্পির দিকে তাকিয়ে রইল কিছু শোনার অপেক্ষায়। কিন্তু মিস থাম্পি একটি কথাও বললেন না।

কফি খাওয়া শেষ হলে মাকে বললেন, এবার আমাদের যেতে হবে।

সঞ্জয় আর থাকতে পারল না। বলল, কিন্তু কাল রাত্তিরের experience তো কিছু বলছেন না।

বললে কি আপনি বিশ্বাস করবেন?

মিস থাম্পি একটু হাসবার চেষ্টা করলেন।

–শুনতে দোষ কি?

–তবে শুনুন। একটা প্রতিহিংসাপরায়ণ হিংস্র আত্মা এ বাড়িতে আছেই। সে ক্ষতি না করে যাবে না। এর চেয়ে বেশি কিছু জানতে চাইবেন না। প্রমাণ দিতে পারব না।

–তাহলে, আপনি বলছেন রীণা যা দেখে তা ঠিক?

–হ্যাঁ। অবশ্যই।

—প্রকিার?

–আমার মনে হয় বাড়িটা ছেড়ে দেওয়াই ভালো।

সঞ্জয় মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু সে কি করে সম্ভব? আমি নিজে ডাক্তার। বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ছাড়া অশরীরী আত্মার অস্তিত্ব মানতে পারি না।

মিস থাম্পি তার বিশেষ হাসিটি একটু হাসলেন। কিছু বললেন না।

আধ ঘণ্টার মধ্যেই মান্তু আর মিস থাম্পি প্রস্তুত হয়ে নিল। যাবার সময়ে মিস থাম্পি বললেন, ডাঃ গুপ্ত, আপনার সংস্কারমুক্ত মন আর সাহসের প্রশংসা করি। কিন্তু আমার একটা কথা মনে রাখবেন–যদি দেখেন আপনার ছেলেটি ক্রমশই অসুস্থ হয়ে পড়ছে তা হলে তদ্দণ্ডেই বাড়ি ছেড়ে দেবেন। লে হাতে ব্যাগটা তুলে নিয়ে নিচে নামতে লাগলেন।

রীণা বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

.

১৪.

সঞ্জয়ের চ্যালেঞ্জ

কদিন হল মিস থাম্পি চলে গিয়েছেন। মান্তুর সঙ্গেও যোগাযোগ নেই। রীণার মনটা তাই একটু খারাপ ছিল। দুঃসময়ে নিজের লোক ছাড়াও প্রকৃত বন্ধুর সান্নিধ্য যে কত দরকার হয় মান্তুকে পেয়ে রীণা তা বুঝতে পেরেছে।

বেলা তখন চারটে। পুপুটা কদিন ধরে ঘ্যানঘ্যান করছে। শীতটাও বেশ জোরে পড়েছে। বিকেলবেলায় কখনো কখনো পুপুকে নিয়ে রীণা নিচে কম্পাউন্ডে নেমে আসে। কম্পাউন্ডে বেশি ভিড় থাকলে নিচে নামে না। সংকোচ হয়। তার যেন মনে হয় সবাই তাকে একরকমভাবে দেখছে। তাই নিজেকে মনে হয় যেন তাদের কাছে অতিপ্রাকৃত জগতের কেউ। তাই সে অনেক সময়ে পুপুকে নিয়ে তিনতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকে।

এদিনও দাঁড়িয়ে ছিল। মিনিট দশেক হল লোডশেডিং শুরু হয়েছে। এই এক অসহ্য ব্যাপার। রীণার কাছে আবার শুধুই অসহ্য ব্যাপার নয়, ভীতির কারণ।

নিচে ছেলেরা খেলা করছে, বৃদ্ধরা বেঞ্চিতে বসে নিশ্চিন্ত মনে সম্ভবত সাংসারিক বিষয় নিয়ে গল্প করছে। বন্দনার মা কোথায় বেরিয়েছিলেন, কিছু জিনিস কিনে রিকশা থেকে নামলেন।

আচ্ছা, মিস থাম্পি যে এসে এক রাত এখানে কাটিয়ে গেলেন বন্দনা বা বন্দনার মা কি তা জানেন?

জানলেও এঁদের সেরকম গায়ে-পড়া কৌতূহল নেই। এটা অবশ্য ভালোই।

বড়ো অদ্ভুত মহিলা মিস থাম্পি। প্রথম যেদিন রীণা ওঁকে দেখে সেদিন ভালো লাগেনি। কিন্তু এ বাড়িতে তাঁকে খুবই ভালো লাগল।

মিস থাম্পি এ বাড়ি সম্বন্ধে কি যেন বললেন? ছেড়ে দেওয়াটাই উচিত। একদিক দিয়ে সে খুশি। আর যাই হোক তার মানসিক রোগ হয়নি। এত দিন তাহলে যা দেখেছে, যা বলেছে সব সত্যি। সঞ্জয় কি এবার তা বুঝতে পেরেছে? তাহলে কি আর একদিনও এ বাড়িতে থাকা উচিত? মিস থাম্পির কথায়–evil spint আছে যে দুরাত্মা হিংস্রকুটিল। শাসিয়ে যায়।

রীণার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ঠিক তখনই হঠাৎ পুপু কেঁদে উঠল আবার।

রীণা ভোলাতে লাগল, না না, কান্না কেন বাবুসোনা? ওই দ্যাখো ছেলেরা কেমন বল খেলছে। তুমিও বড়ো হয়ে বল খেলবে। তোমার বাপী তোমায় বল কিনে দেবে–সুন্দর লাল বল–

পুপুর কান্না তবু থামল না। দ্বিগুণ জোরে কাঁদতে লাগল।

রীণা মনে মনে সঞ্জয়ের জন্যে ব্যস্ত হচ্ছিল। সন্ধ্যের সময়ে লোডশেডিং হলে কিছুতেই একলা থাকতে ভালো লাগে না।

কিন্তু পুপু ডুকরে ডুকরে কাঁদছে কেন? বেঁকে বেঁকে যাচ্ছে। এ কান্নাটা যেন…।

রীণার বুক কাঁপতে শুরু করল। তাহলে কি এই সন্ধেবেলাতেই….

তখনই রীণার মনে হল ঘরের মধ্যে যেন কিসের চাপা শব্দ! তারপরই হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ায় ঘরের জানলাগুলো সশব্দে খুলে গেল।

ঘরের দিকে তাকাতেই রীণার মেরুদণ্ডের মধ্যে দিয়ে একটা হিমস্রোত বয়ে গেল। দেখল ঘরের মধ্যে একটা ধোঁয়ার কুণ্ডলি মেঝে থেকে ক্রমাগত ওপরে উঠছে! মনে হচ্ছে নিচের তলায় যেন আগুন লেগেছে। মেঝে খুঁড়ে তারই ধোঁয়া সমস্ত ঘরটাকে গ্রাস করে ফেলছে। ধোঁয়াটা কিসের বুঝতে বুঝতেই ধোঁয়ার মধ্যে থেকে ফুটে বেরোল একটা মূর্তি। সে মূর্তি ওর চেনা। সেই কালো প্যান্ট, কোট আর টুপি। টুপিটা নেমে এসেছে আধখানা কপাল পর্যন্ত। তারপরেই মূর্তিটা দুরন্ত গতিতে ঘুরপাক খেতে লাগল।

রীণা ভয়ে কাঠ হয়ে সেই দিকে তাকিয়ে রইল।

ক্রমে মূর্তির চোখে মুখে একটা হিংস্রভাব ফুটে উঠল। রীণা স্পষ্ট বুঝতে পারল মূর্তিটা দাঁতে দাঁত চেপে কি যেন বলছে!

রীণার শুনতে ইচ্ছে করছিল না। তার এত ভয় করছিল যে সে থরথর করে কাঁপছিল। তবু ইচ্ছার বিরুদ্ধেই শোনার জন্যে কান পাততে হল। কেউ যেন হুকুম করছে–আমি যা বলি শোনো!

একটা চাপা হিসহিস্ শব্দের ভেতর দিয়ে ছেঁড়া ছেঁড়া কয়েকটা কথা বেরিয়ে এল–আগামী শনিবার…রাত দুটো…আমি আসব। তুমি যাবে…নইলে…বলেই মূর্তিটার মর্চে-ধরা লোহার শাবলের মতো দুখানা অদ্ভুত সরু সরু হাত এগিয়ে আসতে লাগল পুপুর দিকে!

পুপু তখন নেতিয়ে পড়েছে রীণার কাঁধে। মুখ দিয়ে লালা ঝরছে। কদবার শক্তিও বুঝি আর নেই।

পালাবার উপায় নেই। সামনেই মূর্তিটা দাঁড়িয়ে। রীণা ব্যালকনির ওপর ঝুঁকে পড়ল। দেখল নিচে ছেলেরা তখনো খেলা করছে, বয়স্করা গল্প করছে।

রীণা চিৎকার করে ডাকতে চাইল, কিন্তু গলা থেকে স্বর বেরোল না।

এদিকে অন্ধকার ঘরের মধ্যে থেকে সেই অদ্ভুত বিকৃত দুখানা হাত ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। হাতের চেটো দুটো অস্বাভাবিক হোট!

ঠিক সেই সময়ে একটা ট্যাক্সি এসে ঢুকল কম্পাউন্ডের মধ্যে। সঞ্জয় নামল ট্যাক্সি থেকে। ভাড়া চুকিয়ে ওপর দিকে তাকালো। লোডশেডিং। তিনতলাটা অস্পষ্ট। তবুও যা দেখতে পেল তাতেই সঞ্জয় চমকে উঠল। পুপুকে কোলে নিয়ে রীণা যেন ব্যালকনি থেকে ঝাঁপ দেবার চেষ্টা করছে! আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠল সঞ্জয়। রীণা! পড়ে যাবে–পড়ে যাবে

রীণা বুঝি মুহূর্তের জন্যে থমকে গেল। নিচে যারা ছিল সঞ্জয়ের চিৎকারে তারাও ওপর দিকে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে সকলেই চেঁচিয়ে উঠল–গেল–গেল–গেল!

সঞ্জয় ছুটল সিঁড়ির দিকে। তিনতলায় উঠতে তিন মিনিটও লাগল না। সিঁড়ির মুখে এসে থমকে দাঁড়াল। ঘরের দরজা খোলা কেন? এমন তো কোনোদিন থাকে না।

কিন্তু সেদিকে মন দেবার সময় নেই। দৌড়ে গেল ব্যালকনির দিকে। জাপটে ধরল রীণাকে–এ কি করছিলে?

পুপুকে বুকের মধ্যে দু হাতে আঁকড়ে ধরে সেখানেই বসে পড়ল রীণা। কোনোরকমে বলল, এসেছ?

–হ্যাঁ, লোডশেডিং-এ ভয় পাবে বলে ট্যাক্সি নিয়ে চলে এলাম।

–সেটা কোথায় গেল?

–কে? কার কথা বলছ?

রীণা আর কথা বলতে পারল না। তার অচৈতন্য দেহটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। চেঁচামেচি শুনে বন্দনার মাও উঠে এসেছিলেন। তিনি তাড়াতাড়ি পুপুকে কোলে তুলে নিলেন।

আর চাপাচাপি রইল না কিছুই। সঞ্জয়ের পিছু পিছু সকলেই ওপরে উঠে এসেছে। ঘরভর্তি লোক। অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে আছে রীণা। সঞ্জয় ওর জ্ঞান ফেরাবার চেষ্টা করছে। সকলের মুখেই চাপা প্রশ্ন–কি হল? সুইসাইড করতে যাচ্ছিলেন নাকি? কিন্তু খামোক আত্মহত্যা করতেই-বা যাবে কেন? দুটি মানুষের সংসার। অশান্তি তো কিছু নেই।

প্রায় পনেরো মিনিট পরে রীণা ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো। কিন্তু সে দৃষ্টি বড়ো স্তিমিত।

-কেমন আছ? সঞ্জয় ঝুঁকে পড়ল রীণার মুখের ওপরে। কি হয়েছিল?

ঘরসুদ্ধ সবাই রীণার দিকে তাকিয়ে।

রীণ কোনো উত্তর দিতে পারল না। কেমন একরকম শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

সঞ্জয় কিছুক্ষণ রীণাকে লক্ষ্য করল। তারপর পাল্স দেখতে লাগল। এক বার-দুবার-তিন বার। শেযে ঘড়ির কাটার সঙ্গে পা-বিট মেলাতে লাগল। ওর মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল।

একজন জিজ্ঞেস করলেন, কেমন দেখলেন?

–ভালো না। বলেই সঞ্জয় উঠে পড়ল।

বন্দনার মা দূরে দাঁড়িয়ে পুপুকে ভোলাচ্ছিলেন। সঞ্জয় বলল, বৌদি, আপনি এখানে একটু থাকুন। আমি আপনার ঘর থেকে একটা ফোন করে আসি।

সঞ্জয়ের উদ্বেগ দেখে এবার ভিড় কমতে লাগল। সঞ্জয় নিচে নামতেই দেখল বন্দনা মুখ শুকনো করে দাঁড়িয়ে।

-কাকীমা?

–ভালো নয়। এখুনি আমায় একটা ফোন করতে হবে।

ভাগ্য ভালো। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই লাইন পাওয়া গেল। শুধু লাইন নয়, ডাক্তার রুদ্রকেও।

সংক্ষেপে সব ব্যাপার জানিয়ে সঞ্জয় বলল, কাকাবাবু, আপনি এখুনি চলে আসুন। আমি একা ভরসা পাচ্ছি না।

.

আধ ঘণ্টার মধ্যেই ডাঃ রুদ্র এসে পড়লেন। রীণা তখনো মাটিতে চোখ বুজে পড়ে আছে।

ডাক্তার রুদ্র নাড়ী দেখলেন, প্রেসার চেক করলেন। চোখের পাতা ফাঁক করে টর্চ ফেললেন। তারপর সঞ্জয়কে জিজ্ঞেস করলেন ব্রান্ডি আছে?

সঞ্জয় মাথা নাড়ল।

–গরম দুধ?

বন্দনার মা বললেন, আমি এনে দিচ্ছি। বলে তিনি পুপুকে নিয়ে দোতলায় চলে গেলেন।

ডাঃ রুদ্র ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালেন।

–তুমি বলছ রীণা এখান থেকে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছিল?

–হ্যাঁ। তখন লোডশেডিং–আবছা অন্ধকার, তবু আমি স্পষ্ট দেখেছি।

–কি দেখেছ?

–রীণা পুপুকে এক হাতে বুকে চেপে ধরে রেলিং-এর ওপর উঠছে।

–তুমি ঠিক জান ঝাঁপ দিতেই যাচ্ছিল? ঝুঁকে কিছু দেখছিল না?

–হ্যাঁ, ঠিক জানি। শুধু আমি কেন নিচে যাঁরা বসেছিলেন তারা সবাই গেল গেল বলে চেঁচিয়ে উঠেছিল।

–তারপর?

তারপর আমি তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে এলাম।

–ঘরে ঢুকলে?

–হ্যাঁ।

দরজা বন্ধ ছিল না?

না। এটাই আশ্চর্য লাগল।

–কেন?

রীণা কখনো দরজা খুলে রাখে না।

–হুঁ, তারপর?

–আমি ছুটে ব্যালকনিতে গেলাম।

–কি অবস্থায় দেখলে?

–ও তখন রেলিং ধরে কাঁপছিল। আমি ওকে ধরলাম।

ডাঃ রুদ্র আরও কয়েক মিনিট ব্যালকনিতে রইলেন। তারপর বললেন, ঘরে এসো।

এরই মধ্যে বন্দনার মা গরম দুধ নিয়ে এসেছেন। সঞ্জয় বাটিটা হাতে করে রীণার কাছে গিয়ে বসল।

–দেখি, দুধটা খেয়ে নাও।

ডাঃ রুদ্র বললেন, উঠে বোসো।

রীণা মাথা নাড়ল।

ডাঃ রুদ্র বললেন, ঠিক পারবে। উঠে বোসো।

রীণা দুহাতে ভর দিয়ে কোনোরকমে উঠে বসল।

ডাঃ রুদ্র বললেন, তুমি নিজে হাতে বাটিটা ধরো।

রীণার হাত কাঁপছিল তবু কোনোরকমে বাটিটা ধরল।

–খাও।

বীণা বলল, খেতে ইচ্ছে করছে না।

–তবুও খেতে হবে।

রীণা ধীরে ধীরে বাটিতে চুমুক দিল।

খাওয়া হলে বাটিটা মাটিতে রাখল।

ডাক্তার রুদ্র বললেন, এবার উঠে দাঁড়াতে হবে।

রীণা করুণ চোখে সঞ্জয়ের দিকে তাকাল।

একটু চেঁচিয়ে ডাঃ রুদ্র বললেন, ওঘরে গিয়ে বিছানার শুতে হবে তো।

রীণা বলল, পড়ে যাব।

পড়ে যাব সামান্য দুটি কথা। কিন্তু ঐ কথা দুটিতেই ডাঃ রুদ্রের দু চোখ ঝকঝক করে উঠল। যেন সঞ্জয়কে লক্ষ্য করেই নিচুগলায় বললেন–তাহলে দ্যাখো, পেশেন্ট পড়ে যেতে ভয় পায়। তারপর রীণাকে বললেন, না, পড়বে না। চেষ্টা করো। ওঠো বলছি।

–সঞ্জয়, help her বলে ডাঃ রুদ্র নিজেই রীণার পিছনে এসে দাঁড়ালেন। সঞ্জয়ের কাঁধে ভর দিয়ে রীণা গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল।

দশ মিনিট পর ডাক্তার রুদ্র সঞ্জয়কে একটা ইনজেকশান দিতে বললেন। ইনজেকশান ডাক্তার রুদ্রর কাছেই ছিল। সঞ্জয় ইনজেকশান দিল।

ডাঃ রুদ্র বললেন, এসো। বাইরের ঘরে ঘণ্টাখানেক বসা যাক। ও এখন ঘুমোক।

দুজনে বাইরের ঘরে এসে বসলেন।

–কি রকম বুঝলেন?

না, সিরিয়স কিছু নয়। হঠাৎ ভয় পেয়েছে। ইনজেকশান দেওয়া হল, ঠিক হয়ে যাবে।

সঞ্জয়ের মুখে তবু হাসি ফুটল না।

–কেন যে বার বার এমন হচ্ছে বুঝতে পারছি না।

–তোমার স্ত্রী তো আগে এমন ভয় পেত না?

–কোনোদিন তো শুনিনি।

ডাক্তার রুদ্র চুপ করে রইলেন। একটু পরে বললেন, বাড়িটা না হয় ছেড়েই দাও।

সঞ্জয়ের ভুরুতে অসহিষ্ণুতার চিহ্ন ফুটে উঠল–আপনিও একথা বলছেন। শেষে ভূতের ভয়ে বাড়ি ছাড়ব!

ডাঃ রুদ্র একটু হাসলেন। বললেন, তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি। ভূত না অলৌকিক কিছু, নাকি মানসিক ব্যাধি, এসব তর্কে আজ আর যেতে চাই না। এখানে থাকলে যদি ওঁর ক্ষতি হয় তাহলে এখান থেকে যাওয়াটাই যুক্তিসঙ্গত নয় কি?

কিন্তু সেদিন তো আপনিও বললেন, ও সাইকোপ্যাথিক পেশেন্ট?

ডাঃ রুদ্র একটা চুরুট ধরালেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, এসব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত বলে কিছু নেই। আজ লক্ষণ শুনে যা মনে হবে, কাল রুগীকে দেখে অন্যরকম মনে হতে পারে।

সঞ্জয় অসহিষ্ণু ভাবে বলল, তাহলে কি মানতে হবে এ বাড়িতে আসার পরই কোনো একটি অশরীরী আত্মা কেবলমাত্র রীণার ক্ষতি করতে চাইছে। সে রীণাকে তার সঙ্গে যেতে বাধ্য করবে। But how is it possible and why? একটা অশরীরী আত্মা একটা জীবন্ত মানুষকে….

বাধা দিয়ে ডাঃ রুদ্র বললেন, না, জীবন্ত মানুষকে সে চায় না।

তার মানে ওকে মেরে ফেলবে?

–হয় তো তাই। তার সূচনাও তো আজ কিছুক্ষণ আগে দেখতে পেলে।

সঞ্জয় চুপ করে কি যেন ভাবতে লাগল।

ডাঃ রুদ্র বললেন, তুমি কি মনে কর রীণা আত্মহত্যাই করতে যাচ্ছিল?

না, কখনোই না।

ডাঃ রুদ্র একটু ভেবে বললেন, আমারও তাই মনে হয়। ওর মতো সুখী মেয়ে সুইসাইড করতে যাবে কেন?

সঞ্জয় বলল, তবে ফ্রাস্টেশানে ভুগতে ভুগতে নিজেকে অসহায় বলে মনে হলে মানুষ বাধ্য হয়ে আত্মহত্যা করে শাস্তি পেতে চায়।

ফ্রাস্টেশান বলছ কেন?

–ঐ যে ওর কথা আমরা কেউ বিশ্বাস করছি না। তাছাড়া পুপুকে নিয়ে রেলিং থেকে ঝুঁকে পড়াটা আত্মহত্যার চেষ্টাই বোঝায়।

ডাঃ রুদ্র মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। তারপর অল্প হেসে বললেন, কিন্তু আমি প্রমাণ পেয়েছি ও আত্মহত্যা করতে যায়নি।

অবাক চোখে সঞ্জয় ডাক্তার রুদ্রর দিকে তাকালো।

–হুঁ, অকাট্য প্রমাণ পেয়েছি। মনে আছে, রীণাকে যখন উঠে দাঁড়াতে বলেছিলাম তখন ও ভয় পেয়ে বলেছিল পড়ে যাব। যে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে পড়ে যাবার ভয় পায় সে কি দেড়ঘন্টা আগে স্বেচ্ছায় তিন তলা থেকে ঝাঁপ দেবার চেষ্টা করতে পারে?

সঞ্জয় থমথমে মুখে ডাঃ রুদ্রের দিকে তাকিয়েই রইল। কোনো উত্তর দিতে পারল না।

ডাঃ রুদ্র বলতে লাগলেন–এই থেকেই প্রমাণ হয় রীণা যা বলেছে তা সত্যি। ভয়ংকর কিছু দেখেছিল যার জন্যে বারান্দার শেষ প্রান্তে গিয়ে অমন সাংঘাতিকভাবে ঝুঁকে পড়ে তার হাত থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবার এমন শেষ চেষ্টা করছিল।

সঞ্জয় একটু ভেবে বলল, আচ্ছা, রীণা কি হিস্টিরিয়ায় ভুগছে? হিস্টিরিয়ার রুগীকে লোকে ভূতে-পাওয়া বলে। এইসব রুগীদের শক্তি নাকি এতদূর হয় যে জলভর্তি ঘড়া দাঁতে করে তুলে উঠোনের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। কাজেই হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হলে…

ডাঃ রুদ্র বাধা দিয়ে বললেন, তুমি বলতে চাইছ রীণা হিস্টিরিয়ার পেশেন্ট। আচ্ছা, তোমার স্ত্রী তো সারাদিন দরজা বন্ধ করেই থাকে, তাই না? তাহলে আজ হিস্টিরিয়ার প্রকোপ যখন তার বাড়ল, তখন বুঝি সে তোমার আসার জন্যে দরজা খুলে রেখে ঝাঁপ দিতে গেল?

সঞ্জয় চুপ করে রইল।

দরজাটা তা হলে খুলল কে?

সঞ্জয় তখনও নিরুত্তর।

নিভে-যাওয়া চুরুটটা আবার দুটো কাঠি ধ্বংস করে ধরালেন ডাঃ রুদ্র। বললেন, উত্তরটা আমিই দিচ্ছি। দরজা খুলেছিল সে, যে একদিন রাত্রে ঐ টেবিলের কাছে ঘুরতে ঘুরতে কাচের গ্লাসটা ভেঙেছিল, যে কুলুঙ্গি থেকে শিবানন্দ ভট্টাচার্যের ছবিখানা চুরি করেছিল। সে-ই রীণাকে ওয়ার্নিং দিয়ে দরজা খুলে রেখে গেল।

একটু থেমে বললেন, অবশ্য তুমি জিজ্ঞেস করতে পার–অশরীরী আত্মাকেও কি দরজা খুলে যেতে-আসতে হয়? তাহলে অবশ্যই আমি চুপ করেই থাকব। কেননা তার উত্তর জ্ঞানের বাইরে।

সঞ্জয় মন দিয়ে সব শুনল। কোনো উত্তর দিল না।

কয়েক মিনিট দুজনেই চুপচাপ বসে রইলেন। পাশের ঘরে রীণা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছ। বাইরের দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন বন্দনার মা ট্রেতে দুকাপ চা আর কিছু নোনতা বিস্কুট নিয়ে।

সঞ্জয় একটা কাপ এগিয়ে দিল ডাঃ রুদ্রর দিকে। নিজে নিল অন্যটা। বিস্কুটে কামড় দিয়ে সঞ্জয় বলল, কিন্তু শিবানন্দের ছবি চুরি করার উদ্দেশ্য?

আত্মাটির ক্রিয়াকলাপ দেখে মনে হচ্ছে তোমার এই প্রশ্নের উত্তর সোজা। তুমি বলেছিলে ছবির পিছনে ঠিকানা লেখা ছিল। স্পিরিট চায় না শিবানন্দর সঙ্গে তোমার যোগাযোগ হয়। তাই সে ছবিটা সরিয়ে ফেলেছে।

সঞ্জয় চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বলল, তবে তো শিবানন্দর কাছে আমায় যেতেই হবে। অশরীরী আত্মাটি অনেক কিছুই জানেন, জানেন না যে, ছবি নিয়ে গেলেও ঠিকানাটি আমার মুখস্থ হয়ে আছে।

ডাঃ রুদ্র পেয়ালা নামিয়ে রেখে বললেন, তবে আর কি? একদিন চলে যাও ওঁর কাছে। তবে তার আগে কিন্তু বাড়িটা ছাড়বে।

–এত তাড়াতাড়ি বাড়ি পাব কোথায়?

–এখনি বাড়ি না পাও আমার ওখানে উঠবে। মোট কথা সামনের শনিবারের আগেই তোমরা এ বাড়ি ছাড়বে।

সঞ্জয় ছেলেমানুষের মতো জেদ ধরে বলল, শনিবার পর্যন্ত তো আমি থাকবই।

ডাঃ রুদ্রের মুখটা কঠিন হয়ে উঠল। তিনি বললেন, তুমি থাকতে চাও থাকো। আমি ওদের নিয়ে যাব।

সঞ্জয় বলল, না। তা হয় না কাকাবাবু। রীণা না থাকলে তিনি তো আসবেন। ঐ শনিবার আমি সারা দিন রীণাকে পাহারা দেব। দেখব কি করে ওর ক্ষতি করে?

–তাহলে যা ভালো বোঝ করো। এরপর আমার আর কিছু বলার নেই।

তিনি উঠে রীণাকে পরীক্ষা করতে গেলেন। মিনিট পাঁচেক পরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।–ভালোই আছে। ওর যদি ঘুম ভাঙে তাহলে রাতের খাবার খাবে। ঘুম যেন ভাঙিও না।

বলে বেরোতে যাচ্ছেন এমনি সময়ে বন্দনার মা পুপুকে কোলে নিয়ে চিন্তিত মুখে ঢুকলেন।–পুপুর জ্বর হয়েছে দেখছি।

–জ্বর! সঞ্জয় চমকে উঠে পুপুর কপালে হাত দিল।বেশ জ্বর। বলে ডাঃ রুদ্রের দিকে তাকালো। ডাঃ রুদ্র পালস্ দেখলেন। কিছু বললেন না।

সঞ্জয় চিন্তিতভাবে তাকালো, কি করব?

ডাঃ রুদ্র হাসলেন, তুমি নিজে ডাক্তার। ছেলের একটু জ্বর হয়েছে। তাতেই ঘাবড়ে যাচ্ছ? বলে সঞ্জয়ের কাঁধে হাত রাখলেন।

–আজকের রাতটা দ্যাখো। কাল জ্বর না ছাড়লে ভাবা যাবে।

ডাঃ রুদ্র ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। সঞ্জয় বন্দনার মাকে বলল, আপনি একটু থাকুন। আমি এঁকে এগিয়ে দিয়ে আসছি।

বন্দনার মা বললেন, আমি থাকছি। আপনি একটু বন্দনাকেও পাঠিয়ে দেবেন।

ডাঃ রুদ্র গাড়িতে উঠে ইঞ্জিনের চাবি ঘোরালেন।কাল সকালেই তাহলে একটা খবর দেবে। কী এত ভাবছ?

–হ্যাঁ, নিশ্চয় খবর দেব। ভাবছিলাম–আপনিও বাড়ি ছাড়ার কথা বললেন, আর একজনও বলছিলেন।

–কে তিনি?

সঞ্জয় ইতস্তত করে বলল, আপনাকে বলা হয়নি গত সপ্তাহে মিস থাম্পি নামে একজন ম্যাড্রাসি মহিলা আমার এখানে এসেছিলেন রীণার এক বান্ধবীর সঙ্গে। রীণার কথা সব শুনলেন। তিনিও বলছিলেন–

ডাঃ রুদ্র গাড়ির চাবি বন্ধ করে বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, ব্যাঙ্গালোরের বিখ্যাত স্পিরিচুয়ালিস্ট মিস থাম্পি নাকি?

–হ্যাঁ। আপনি চেনেন?

ডাঃ রুদ্র চাবি ঘুরিয়ে ফের ইঞ্জিন চালু করে বললেন, ওঁর সঙ্গে দেখা হলে খুশি হতাম। নেক্সট ডে যখন আসব ওঁর কথা বলব। গুড নাইট।

১.৪ কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে

শীতের বিকেল।

কম্পাউন্ডের মধ্যে লাঠি হাতে বার পাঁচেক পাক দিয়ে অমৃতবাবু বেঞ্চিতে এসে বসলেন।

ওপাশে আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে বেঞ্চির ওপর পা তুলে বসেছিলেন বিভূতিবাবু। পাশে মহিমাবাবু। গায়ে পুরনো একটা অলেস্টার। মাথায় মাংকি-ক্যাপ।

অমৃতবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, পৌষ সংক্রান্তিটা কবে?

ওদিকের বেঞ্চিতে শচীনবাবু বিকেলের ম্লান আলোতেও কাগজ পড়বার চেষ্টা করছিলেন। বয়েস এঁদের চেয়ে কিছু কম। রসিকতা করে তিনি বললেন, পৌষ সংক্রান্তিটা পৌষ মাসের শেষ দিন।

–আহা তা তো জানি। ইংরিজির কত তারিখ?

এবার আর শচীনবাবু উত্তর দিতে পারলেন না।

তা সংক্রান্তির খোঁজ কেন? পিঠে খেতে ইচ্ছে করছে নাকি? অমৃতবাবুর দিকে মন্তব্য ছুঁড়ে দিয়ে মহিমাবাবু হা-হা করে হাসলেন।

-হ্যাঁ, কত দিন যে পিঠে খাইনি!

—তা গিন্নিকে বলবেন। পিঠে ভেজে দেবেন।

–তা হলেই হয়েছে। ওসব পাট বহুকাল চুকে গিয়েছে। বৌমাও পিঠে করতে জানেন না।

–যা বলেছেন। বিভূতিবাবু নড়ে চড়ে বসলেন।

–এমন শীতে বেগুন পোড়া কঁচা লংকা দিয়ে খাব তার উপায় নেই। বৌমাকে বললাম, তো উনি বললেন, গ্যাসের উনুনে বেগুন পোড়াব কি করে?

শচীনবাবু বললেন, আমি তো এই জন্যেই গ্যাসের উনুন নিইনি।

বিভূতিবাবু বললেন, বেগুন পোড়ানো যাবে না বলেই গ্যাস-উনুন নেননি।

-না, ঠিক তা নয়। তবে অন্যতম কারণ বটে।

–তা বাকি কারণগুলি কি? অ্যাকসিডেন্ট?

–নিশ্চয়। প্রায়ই তো শুনি গ্যাস লিক করে আগুন ধরে গেছে।

–তা কয়লার উনুনে কি অ্যাকসিডেন্ট হয় না? এখন কি-সব শাড়ি উঠেছে–সিন্থেটিক না কি ছাইভস্মতা সেই সিন্থেটিক শাড়ির আঁচলটি একবার উনুনে পড়লেই

অমৃতবাবু হাসলেন। ঠিক বলেছেন। একবার আঁচল ধরলেই আর দেখতে হবে না। সঙ্গে সঙ্গে বধূহত্যার দায়ে বাড়িসুদ্ধ সকলের কোমরে দড়ি। তা পুত্রবধূই হন আর নিজের বৃদ্ধা বধূই হন।

–তা বটে। কোনটে যে অ্যাকসিডেন্ট আর কোনটে যে আত্মহত্যার প্ররোচনা, কে বিচার করবে? বাড়ির বৌ মরল তো ধর ছেলেকে আর ছেলের বাপকে।

অ্যাকসিডেন্ট কি শুধু আগুনে পুড়েই হয়? এ বাড়িতেই সেদিন কী কাণ্ডটা হতে যাচ্ছিল ভাবুন তো। সে তো আমরা চোখের সামনেই দেখলাম।

–হ্যাঁ। ভাগ্যি ঠিক সময়ে ডাক্তারবাবু এসে পড়েছিলেন?

–কিন্তু ছেলেকে নিয়ে ঝাঁপ?

–অশান্তিটা বোধহয় খুবই গুরুতর। নিচুগলায় বললেন বিভূতিবাবু।

–একে ডাক্তার তার ওপর যোয়ান বয়েস। আবার হাসপাতালে নার্সদের নিয়ে কাজ-করবার…!

-কিন্তু উনি কি সত্যিই আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলেন?

তাছাড়া কি?

তাছাড়াও ব্যাপার আছে মশাই, ব্যাপার আছে। আমার ওয়াইফ তো সঙ্গে সঙ্গে ওপরে গিয়েছিলেন। নিজে কানে শুনেছেন কিছু-একটা দেখে ভয় পেয়ে নাকি ঝাঁপ দিতে গিয়েছিল।

মহিমাবাবুর কথায় হঠাৎ যেন সবাই থমকে গেলেন। অমৃতবাবু আরও কাছে সরে এসে বললেন, তাঁ, ব্যাপার যে কিছু আছে সে বিষয়ে আমারও সন্দেহ নেই। মনে আছে মাস দেড়েক আগে অনেক রাত্তিরে ওপরের ঘরে চেঁচামেচি?

–হ্যাঁ, গেলাস ভাঙার শব্দ?

ডাক্তার তো বলে দিলেন বেড়ালে ভেঙেছে। কিন্তু আমার খটকা যায়নি।–তা তো বটেই। অবশ্য আর কী-বা হতে পারে? চোর-ডাকাত হলে ধরা পড়ে যেত।

যাই হোক ব্যাপারটা রহস্যজনক।

রহস্যজনক বলে রহস্যজনক। পুরনো বাড়ি। কী দোষ আছে কে জানে!

–তুমি থামো বিভূতিবাবু! সন্ধেবেলা আর ভয় ঢুকিয়ে দিয়ো না। মনে রেখো আমরাও এক বাড়িতে থাকি।

-কিন্তু একটা মীমাংসা হওয়ার তো দরকার।

–কিসের মীমাংসা?

—বাড়িতে যদি কোনো দোষ থাকে–

–দোষ থাকলেই কি আমরা বাড়ি ছাড়তে পারব?

সবাই একটু থমমত খেয়ে শচীনবাবুর দিকে তাকিয়ে রইলেন।

শচীনবাবু কাগজটা ভাঁজ করতে করতে বললেন, আমি তো পারব না। এত কম ভাড়ায়, সেলামী ছাড়া আর কোথায় বাড়ি পাব?

যুক্তি অকাট্য। সত্যিই তো। যতই ভূতের উপদ্রব হোক এ বাড়ি ছাড়া যাবে না। ভূতের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, কিন্তু একটা বাড়ি ছেড়ে দিলে বাড়ি পাওয়া দায়।

শাস্তি-স্বস্ত্যয়ন তো করা যায়।

–তা যায়। তবে তার আগে আসল ব্যাপারটা জানা দরকার।

–তাহলে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করতে হয়।

—ডাক্তার কিছু বলবে মনে করেছ? দেখছ না লোকটা কারো সঙ্গে মেশে না।

তা হোক, তবু একবার সবাই মিলে–ঐ তো ডাক্তার ফিরছেন। চলোচলো-খুব উৎসাহে বিভূতিবাবু সবাইকে বললেন বটে কিন্তু আর নাড়তে চাইলেন না। শেষ পর্যন্ত শচীনবাবু একাই এগিয়ে গেলেন।

-নমস্কার, ডাক্তারবাবু।

নমস্কার, ভালো আছেন?

–এই চলছে আর কি! আপনার কথাই এতক্ষণ আমরা আলোচনা করছিলাম। আপনার স্ত্রী এখন কেমন আছেন?

–ভালোই আছেন। কেন বলুন তো?

–যাক। নিশ্চিন্ত হলাম। সেদিন যা দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল–খুব সময়ে আপনি এসে পড়েছিলেন। তারপরই উনি আবার অজ্ঞান হয়ে গেলেন।

হ্যাঁ, নার্ভাস ব্রেকডাউন। সঞ্জয় সংক্ষেপ করতে চাইল।

ইতিমধ্যে সকলেই এসে দাঁড়িয়েছেন সঞ্জয়কে ঘিরে। মহিমাবাবু বললেন, এমনি-এমনি কি নার্ভাস ব্রেকডাউন হয় ডাক্তারবাবু? নিশ্চয়ই কোনো কিছুতে ভয় পেয়েছিলেন।

ভয়! না না, ভয় কিসের? কলকাতার মতো জায়গায় আমরা সকলে মিলে মিশে রয়েছি–একবার চেঁচিয়ে উঠলে পাঁচজনে ছুটে আসবে। এখানে চোর-ডাকাতের সাধ্য কি ঢোকে। না-না, কোনো ভয় নেই। নিশ্চিন্তে থাকুন। বলতে বলতে সঞ্জয় সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল।

মহিমাবাবুরা কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, দেখলেন তো। আমাদের কিছু বলতেও দিলে না।

ও দিকে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বিরক্ত সঞ্জয় মনে মনে বলল, এদের জন্যেই দেখছি বাড়িটা ছাড়তে হবে। প্রেস্টিজ বলে কিছু আর রইল না।

.

১৬.

মিস থাম্পির জীবনকথা

পুপুর জ্বর ছেড়ে গেছে–খবরটা ডাক্তার রুদ্র আগেই ফোনে পেয়েছেন। তবু এদিন সন্ধ্যায় এলেন। এসে রীণাকে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছ?

রীণা ম্লান হেসে বলল, ভালো। কি খাবেন বলুন, চা না কফি?

কফিই করো।

রীণা রান্নাঘরে ঢুকল।

ঘরে ছিলেন বন্দনার মা। রীণা অসুস্থ হবার পর থেকে উনি প্রায়ই আসেন। তিনিও উঠে রীণার সঙ্গে রান্নাঘরে গেলেন। রীণা এখন বেশ সুস্থ। তবু তার চোখের চাউনিতে একটা উদভ্রান্তভাব। ডাঃ রুদ্রের তা লক্ষ্য এড়ায়নি।

বন্দনার মা রীণাকে বললেন, আপনি গল্প করুন, আমি কফি করছি।

কলকাতায় মান্তু ছাড়া রীণা এই একজন মানুষকে কাছে পেয়েছে। বাড়ির অন্য ভাড়াটেদের স্ত্রীরা কিন্তু ভিন্ন প্রকৃতির। কারো পরের সংসারের ওপর মাত্রাতিরিক্ত কৌতূহল, কেউ-বা ঈর্ষাকাতর। বন্দনার মা-ই ব্যতিক্রম। অল্প কথা বলেন, রীণার ওপর তাঁর যেন সত্যিকারের মেহ, রীণাও যেন একজন দিদি পেয়েছে।

কফির পেয়ালার চুমুক দিয়ে ডাক্তার রুদ্র বললেন, তোমরা তো মিস থাম্পিকে দেখলে। আমার দুর্ভাগ্য তাঁকে দেখতে পেলাম না। খবর পেলে নিম্ম আসতাম। বলে সঞ্জয়ের দিকে তাকালেন।

সঞ্জয় অপরাধীর মতো বলল, আপনি যে ওঁর সম্বন্ধে এত ইন্টারেস্টেড কি করে জানব বলুন। জানলে নিশ্চয় খবর দিতাম।

–আবার যদি কখনো আসেন তাহলে খবর দিতে ভুল না। ইংরিজি একটা ম্যাগাজিনে ওঁর লাইফহিস্ট্রি পড়ে অবাক হয়েছিলাম। ওঁর মতো spiritualist এখন সারা ভারতে নেই। অথচ মজার কথা প্রথম জীবনে উনি ছিলেন নামকরা সম্মোহনবিদ। ওঁর জীবনটাই ইনটারেস্টিং। সম্মোহনবিদ থাকার সময়ে তরুণী বয়েসে তিনি একবার তার সেই শক্তির অপব্যাবহার করেছিলেন। অবশ্যই তার একটা কারণ ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওঁর অনুশোচনা হয়। অনুশোচনা থেকেই আসে পরিবর্তন। তিনি হিপনোটিজ ছেড়ে দেন। শুরু হয় জীবনের আর এক নতুন অধ্যায় স্পিরিচুয়ালিজমের সাধনা।

ডাঃ রুদ্র একটু থামলেন। তারপর বললেন, সঞ্জয় তুমি তো জান মেসমেরিজম্ নিয়ে আমিও কিছু পড়াশোনা করছি। কাজেই ও সম্বন্ধে আমি যদি কিছু বলি তাহলে নিশ্চয় অনধিকারচর্চা হবে না।

বলে তিনি একটু হাসলেন।

রীণা জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, হিপনোটিজম্ আর মেসূমেরিজম্ কি এক?

বন্দনার মা চলে যাচ্ছিলেন, রীণা তার হাত ধরে বলল, বসুন না।

বন্দনার মা বসলেন।

ডাঃ রুদ্র বললেন, হ্যাঁ, একই। বাংলায় এর নাম সম্মোহন।

সঞ্জয় বলল, তা হলে ম্যাজিসিয়ানরা যে হিপনোটিজমের খেলা দেখায় সেও কি এই সম্মোহন?

ডাক্তার রুদ্র বললেন, কতকটা। তবে প্রকৃত সম্মোহনবিদরা কিন্তু একটু তাকিয়েই অপরকে সম্মোহিত করতে পারেন। এমন কি গল্প করতে করতেও এ বিদ্যা প্রয়োগ করতে পারেন। এমনও দেখা গেছে, এক জন পাকা সম্মোহনবিদ অনেক দূরের কোনো মানুষকে সম্মোহিত করেছেন। আমাদের দেশের কাঁপালিক বা ডাইনিরা কতকটা এই জাতীয় একটি বিদ্যায় পটু ছিলেন। তাকে বলে বশীকরণ। মানুষ বশ করতে ওস্তাদ ছিলেন তাঁরা। তবে তার জন্যে যে সাধনার প্রয়োজন তা অনেকের পক্ষেই করা সম্ভব হতো না। অল্পস্বল্প যেটুকু শক্তি তারা অর্জন করতেন তার বেশির ভাগটাই প্রয়োগ করতেন ব্যক্তিগত স্বার্থে। এখন তাদের কথা থাক। আমার বক্তব্য মেসমেরিজ।

ফ্রেডারিক অ্যান্টনী মেমার এই সম্মোহিনী শক্তির আবিষ্কার। তিনি অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকের লোক। এক বার জাহাজডুবি হয়ে এই জার্মান ভদ্রলোক ভাঙা মান্তুল আঁকড়ে ভাসতে ভাসতে অজানা জঙ্গলভরা এক তীরে এসে ঠেকলেন। রাতে আশ্রয় নিলেন একটা গাছে। সকাল হলে দেখেন গাছের নিচে এক বিরাট অজগর মড়ার মতো পড়ে আছে। বুদ্ধিমান মেমার তখনি গাছ থেকে নামলেন না। তিনি লক্ষ্য করতে লাগলেন। একসময়ে দেখলেন সাপটা পিটপিট করে তাকাচ্ছে আর আকাশ থেকে উড়ন্ত পাখি এসে পড়ছে তার মুখে। মেম্বার অবাক হলেন–এ কি করে সম্ভব? সাপের চোখের চাউনিতে এমন কোন শক্তি আছে যাতে আকাশের পাখি ছুটে এসে পড়ছে তার মুখে?

এই ভাবনা থেকে শুরু হল সাধনা। সেই সাধনার ফলশ্রুতি সম্মোহন-বিদ্যা। তাই এই সম্মোহন-বিদ্যার একটা নাম মেসমেরিজ। কিন্তু এ তো অষ্টাদশ শতাব্দীর ব্যাপার। তার ঢের আগে তিব্বত, চীন, ভারতে এই মহাবিদ্যার চর্চা শুরু হয়েছিল। পশ্চিমী দেশগুলি এই বিদ্যাকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে চিকিৎসার কাজে লাগিয়েছিল। প্রাচ্যের দেশগুলি ত পারেনি।

এই পর্যন্ত বলে ডাঃ রুদ্র একটু থামলেন। একটা চুরুট ধরিয়ে আবার শুরু করলেন, মিস থাম্পি প্রথম জীবনে এই সম্মোহনবিদ্যার চর্চা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। তাঁর বয়স যখন মাত্র দশ বছর, তখন তাকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল এক জাদুকরী। জাদুকরীটি ঝাড়ফুঁক করত, সম্মোহনশক্তিও ছিল অসাধারণ। তার বোধহয় ইচ্ছা ছিল থাম্পিকে সে উত্তরাধিকারিণী করে যাবে। তাই সেই বালিকা বয়স থেকেই তাকে সম্মোহনবিদ্যায় তালিম দিতে থাকে। বেশ কিছুকাল পরে পুলিশ যখন জাদুকরীর হাত থেকে থাম্পিকে উদ্ধার করে তখন সে একজন পাকা সম্মোহনবিদ।

বাড়ি ফিরে আসার পর মিস থাম্পি পড়াশুনা শুরু করেন পুরোদমে। তিনি যথেষ্ট মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। কিন্তু তার চেয়েও বেশি পরিচিত ছিল ধনীকন্যা বলে। আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো মিস থাম্পির মনটাও ছিল সংসারী। তিনিও চাইতেন একজন দায়িত্বশীল মমতাময় স্বামী। মিস থাম্পি ভালো করেই জানতেন যে তিনি সুশ্রী নন। তবু তিনি মনে মনে অপেক্ষা করতেন এমন কারও জন্যে যিনি শুধু তার বাইরের চেহারাটাই দেখবেন না, যাঁর উদার হৃদয়ে তার জন্যে ভালোবাসার আসন পাতা থাকবে। কিন্তু বহুদিন অপেক্ষা করেও এমন কাউকেই পেলেন না যিনি স্বেচ্ছায় ভালোবেসে তাকে ঘরে নিয়ে যাবেন। ধনী পিতার কন্যা হিসেবে বিবাহের সম্বন্ধ তাঁর অনেক এসেছিল। কিন্তু সে সবই তিনি নাকচ করে দিয়েছিলেন। পাত্রপক্ষের লক্ষ্য যে তাঁর বাপের টাকা তা তিনি বুঝতেন।

এমনি সময়ে মিস থাম্পি এক অধ্যাপকের সান্নিধ্যে আসেন। দর্শনের অধ্যাপক। সুদর্শন, ধীর, স্থির, জ্ঞানদীপ্ত মানুষটি। এই প্রথম মিস থাম্পি দুর্বল হয়ে পড়লেন। কিন্তু অপর পক্ষে তেমন চাঞ্চল্য নেই, অথচ তিনি যে একটু বিশেষ চোখে তাঁকে দেখেন, তাঁকে একটু বিশেষ যত্ন নিয়ে পড়াতে চান থাম্পি তা বেশ বুঝতে পারেন।

থাম্পি যখন বুঝলেন–এই সুপুরুষটির সব গুণই আছে নেই শুধু এগিয়ে আসার সাহস, তখন তিনি নিজেই অধ্যাপকের কাছে বিয়ের ইচ্ছা জানালেন।

অধ্যাপক সস্নেহে তার মাথায় হাত রেখে বললেন, তুমি আমার ছাত্রী। আমাদের সম্পর্ক সেইরকম হওয়াই উচিত। তা ছাড়া আমার বিয়ে অন্যত্র স্থির হয়ে আছে।

এ কথায় থাম্পির দুচোখ জ্বলে উঠল। তিনি অধ্যাপকের কথা বিশ্বাস করলেন না। যদি অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে বিয়ে ঠিকই হয়ে থাকত, তা হলে তার হাবভাব অন্যরকম হত। সেরকম তো কিছু লক্ষ্যে পড়েনি।

মিস থাম্পি ক্ষুব্ধ অভিমানে বললেন, মিথ্যে কথা বলে আমায় ভোলাচ্ছেন কেন? বললেই তো পারেন আমাকে আপনার পছন্দ নয়।

অধ্যাপক লজ্জিত হয়ে বললেন, বিশ্বাস কর অন্য একজনের সঙ্গে আমি engaged.

মিস থাম্পি উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, একথা আগে আমাকে বলেননি কেন? একটা মেয়ের জীবন নিয়ে ছেলেখেলা?

অধ্যাপক বললেন, তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে, শান্ত হয়ে ভাবার চেষ্টা করো। আমার দিক থেকে তোমার সঙ্গে এমন কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি বা এমন কোনো কথা বলিনি যাতে তোমাকে ঠকানো হয়।

কিন্তু মিস থাম্পির ধৈর্য ধরে ভাবার অবস্থা ছিল না। তার শুধু একটা কথাই মনে হল অধ্যাপক তাকে পছন্দ করেননি। যদি পছন্দ করতেন তা হলে অন্য মেয়েকে ছেড়ে তার কাছেই আসতেন। এনগেজড় তো কি হয়েছে? তাকে তো আর তিনি বিয়ে করেননি। পুরুষের জীবনে অমন কত মেয়ে রঙীন স্বপ্নচোখ নিয়ে আসে তার পর একদিন সে স্বপ্ন ছুটে যায়।

এরপর মিস থাম্পি আর অধ্যাপকের সামনে আসেন নি। দূরে দূরে রইলেন। কিন্তু চুপ করে বসে রইলেন না। চেষ্টা করতে লাগলেন অধ্যাপককে জব্দ করবার।

একদিন অধ্যাপক ক্লাস নিতে ঢুকছেন। হঠাৎ তার মাথাটা কিরকম টলে উঠল। চোখে যেন ধোঁয়া ধোঁয়া দেখলেন। তবু ক্লাস করতে গেলেন। কিন্তু লেকচার দিতে গিয়ে সব ঘুলিয়ে ফেললেন। ছাত্ররা তো অবাক। তারা বলল, স্যার, আপনার বোধহয় শরীর খারাপ। চলুন, আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।

বাড়ি এসেই অধ্যাপক শুয়ে পড়লেন। ঘুমে দুচোখ জড়িয়ে এল।

এরপর থেকে রোজই তার লেকচার এলোমেলো হতে লাগল। ছাত্ররা বিরক্ত হয়ে প্রিন্সিপ্যালকে জানাল। প্রিন্সিপ্যাল শেষ পর্যন্ত একদিন আড়ালে দাঁড়িয়ে তাঁর লেকচার শুনলেন। বুঝলেন অধ্যাপক ঠিক সুস্থ মস্তিষ্কে নেই। তিনি তখন তাঁকে ছুটি নিতে বাধ্য করালেন।

এরই মধ্যে একদিন রাত্তিরে হঠাৎ অধ্যাপক মিস থাম্পির বাড়ি গিয়ে হাজির।

মিস থাম্পি কিছুমাত্র অবাক না হয়ে শ্লেষের সুরে বললেন, হঠাৎ কি মনে করে আমার কাছে?

অধ্যাপক ঘুমের ঘোরে উত্তর দিলেন, তুমি যে আমায় ডাকলে।

–আমি ডাকলাম? মিস থাম্পি হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, যদি ডেকেই থাকি তাহলেও কি আমার মতো নগণ্য একটা মেয়ের বাড়িতে এই রাত্তিরে আপনার মতো এক জন বিশিষ্ট অধ্যাপকের আসা উচিত?

অধ্যাপক এর উত্তর দিতে পারেন নি। তাঁর দুচোখ তখন ঘুমে জড়িয়ে আসছিল।

এমনিভাবেই মিস থাম্পি এক নিরীহ অধ্যাপককে সম্মোহিত করে নিষ্ঠুর খেলায় মেতে উঠলেন। প্রায় প্রতিদিন গভীর রাত্রে অধ্যাপককে ডেকে নিয়ে আসেন। এক বিকৃত ভোগের খেলায় মেতে থাকেন তিনি। তাকে খুশি করেই অধ্যাপক ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুম ভাঙলে তার আর কিছুই মনে থাকে না। তিনি শুধু অবাক হয়ে যান। মিস থাম্পির বিছানায় শুয়ে আছেন দেখে তিনি ভীষণ লজ্জা পান। ছিঃ ছিঃ এ কী করে সম্ভব বলতে বলতে ছুটে পালিয়ে যান।

মিস থাম্পি এতে এক ধরনের আনন্দ পান বটে কিন্তু ঠিক সুখ পান না। এ যেন জোর করে কৃত্রিম উপায়ে পুরুষসঙ্গ আদায় করা। তা তো তিনি চান নি। তিনি চেয়েছিলেন ভালোবাসা।

তবু তিনি অধ্যাপককে ছাড়তে পারেন নি। বেঘোর অবস্থাতেও যদি মানুষটা দুটো ভালোবাসার কথা বলেন, যদি কাছে টানেন তাহলে সেইটুকুই লাভ। রক্তমাংসের ঐ দেহটা যে কিছুক্ষণের জন্যেও তাঁরই–অন্য কারও নয়–এইটুকু মনে করেই তাঁর আনন্দ।

একদিন মিস থাম্পি একটা ফন্দি আঁটলেন। অন্য দিনের মতোই অলক্ষ্যে থেকে হিপনোটাইজ করে অধ্যাপককে ডেকে আনলেন। সম্মোহিত অধ্যাপক যখন মিস থাম্পির হাতটা নিজের হাতে নিয়ে প্রেমের কথা বলে যাচ্ছিলেন তখন থাম্পি অধ্যাপকের হাতে একটা কাগজ আর কলম গুঁজে দিয়ে বললেন, আপনি যেসব কথা বলছেন, তা এই কাগজে লিখুন।

সঙ্গে সঙ্গে অধ্যাপক লিখলেন–I love you dearly and want to have you as my life-partner by marriage.

লেখাটুকু পড়ে মিস থাম্পির বৃথাই রোমাঞ্চ হল। তবু বললেন, নিচে সই করুন।

অধ্যাপক সই করলেন।

তারিখ দিন।

অধ্যাপক তারিখ বসালেন।

মিস থাম্পি কাগজটি যত্ন করে রেখে দিলেন।

মাস ছয় পর।

মিস থাম্পি লক্ষ্য করলেন দিন দিন অধ্যাপকের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছে।

তা তো পড়বেই। অমন সম্মানের চাকরিটা গেল। বেকার জীবন। লোকে তাকে দেখলে হাসাহাসি করে। বলে–পাগলা প্রফেসার।

এ যন্ত্রণা কে আর কতদিন সহ্য করতে পারে?

এদিকে যে মেয়েটির সঙ্গে তার বিয়ের কথা–মিস থাম্পি খবর নিয়ে জানলেন সেই মেয়েটির বাড়ির লোকরাও পাগলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজী নন। মেয়েটি কান্নাকাটি করছে।

অধ্যাপকের শরীর আর মনের অবস্থা দেখে মিস থাম্পি চিন্তায় পড়লেন। সম্মোহনের সাহায্যে তাকে আবার চাঙ্গা করা যায়। কিন্তু সে তো সাময়িক। তাছাড়া একজনের ওপর বার বার সম্মোহন প্রয়োগ করলে বিশেষ ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা।

তখন একদিন তিনি প্রফেসারকে ডেকে বললেন, আপনি কি রকম লোক যে একটা কলেজ থেকে চাকরি গেছে বলে অন্য কোথাও চেষ্টা করছেন না?

অধ্যাপক ম্লান হেসে বললেন, সবাই যে বলে আমি অসুস্থ। অসুস্থ লোককে কেউ চাকরি দেয়?

মিস থাম্পি বললেন, না, আপনি অসুস্থ নন। আমি বলছি আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ। লোকে শত্রুতা করে আপনার বিরুদ্ধে লেগেছিল।

অধ্যাপক বললেন, চাকরি করেই-বা কি হবে? আমার জীবনে আর কোনো আনন্দ নেই। আমার সব আশা শেষ হয়ে গেছে।

মিস থাম্পি বললেন, না, কিছুই শেষ হয় নি। আমি বলছি সব ঠিক আছে।

এই বলে শহরের বাইরে একটা কলেজের ঠিকানা দিলেন। এখানে একজন ফিলজফির প্রফেসার দরকার। আপনি অ্যাপ্লাই করুন।

মিস থাম্পির প্রেরণায় অধ্যাপক দরখাস্ত করলেন। তারপর দুমাসের মধ্যে সেই কলেজে চাকরি পেয়ে গেলেন। আর সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর পাণ্ডিত্যে আর অধ্যাপনার গুণে ছাত্ররা মুগ্ধ হয়ে গেল। কিছুদিনের মধ্যেই অধ্যাপক তার সুনাম আর সম্মান ফিরে পেলেন। অধ্যাপক সুস্থ হয়ে উঠলেন।

মিস থাম্পি সব খবরই রাখেন। যেদিন শুনলেন তাঁর প্রাণপ্রিয় অধ্যাপককে সম্বর্ধনা দেওয়া হচ্ছে সেদিন তিনি গোপনে একটু হাসলেন। কিন্তু তিনি আর কোনো দিন প্রফেসারকে সম্মোহন করে ডাকেন নি।

না ডাকলেও একদিন অধ্যাপক নিজেই হাসিমুখে মিস থাম্পির সঙ্গে দেখা করতে এলেন। এলেন প্রায় এক বছর পর। তবে একা এলেন না। সঙ্গে সুন্দরী একটি মেয়ে। অধ্যাপক আলাপ করিয়ে দিলেন–এরই নাম এলিশ। এর সঙ্গেই আমি engaged ছিলাম। সামনের মাসে আমাদের বিয়ে।

মিস থাম্পি এলিশকে সাদর অভ্যর্থনা করলেন। ওরা চলে যাবার সময়ে মিস থাম্পি প্রফেসারকে বললেন, আপনার সঙ্গে আমার বোধহয় আর দেখা হবে না।

প্রফেসার অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেন?

–আমি সব ছেড়ে এখান থেকে চলে যাচ্ছি।

–কোথায়?

–তা এখনো ঠিক করি নি।

–তুমি যেখানেই থাক আমায় চিঠি দিও।

মিস থাম্পি তার কোনো উত্তর দেন নি। শুধু একটু হেসেছিলেন।

তারপর সুযোগমতো প্রফেসারকে আলাদা করে ডেকে তাঁর হাতে একটা খাম দিয়ে বললেন, এটা পড়ে দয়া করে ছিঁড়ে ফেলে দেবেন। দেখবেন যেন অন্য কারো হাতে না পড়ে।

চিঠিতে মিস থাম্পি সব কথাই খুলে লিখেছিলেন। অকপটে স্বীকার করেছিলেন তাঁর অপরাধের কথা। শেষ দুটি ছত্র এইরকম–কোনো প্রত্যাখ্যাতা মেয়ের মর্মযন্ত্রণা উপলব্ধি করার ক্ষমতা যদি আপনার থাকে তাহলে নিশ্চয়ই তাকে আপনি ক্ষমা করবেন।

এই চিঠির সঙ্গেই ছিল আলাদা আর একটুকরো কাগজ। তাতে লেখা ছিল–I love you dearly and want to have you as my life-partner by marriage….

ডাক্তার রুদ্র থামলেন। ঘড়িতে তখন নটা বেজে পনেরো মিনিট। ডাঃ রুদ্র উঠে পড়লেন।

তারপর থেকে মিস থাম্পি আর সম্মোহন করার চেষ্টা করেননি। ঐ লাইনটা ছেড়েই দিলেন। তিনি ঘুরতে লাগলেন দেশ-বিদেশ-পাহাড়-জঙ্গল-মঠ-মন্দির-গির্জা। যেখানেই প্রাচীন পুঁথি পান সেখানেই ছোটেন। বিশেষ কোনো মানুষকে চেয়েছিলেন বড় আপন করে। তা তিনি পাননি। তাই শেষ পর্যন্ত খুঁজে বেড়াতে লাগলেন অলৌকিক রহস্য- জীবন-মরণের সীমানা ছাড়িয়ে কোনো কিছু অদৃশ্য অস্তিত্বের সন্ধান।

.

ডাক্তার রুদ্রকে এগিয়ে দিতে যাচ্ছিল সঞ্জয়। ওরা যখন সিঁড়ির কাছে গিয়েছে তখন হঠাৎই রীণা ব্যস্ত হয়ে সঞ্জয়কে ডাকল, শুনে যাও।

ডাঃ রুদ্র থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। সঞ্জয় ঘরে এসে ঢুকল।

–পুপুর চোখ দুটো দ্যাখো কিরকম বসে গেছে না?

সঞ্জয় টর্চ জ্বেলে ভালো করে দেখল। হ্যাঁ, চোখের নিচে কালি। চোখ দুটো হঠাৎ যেন বসে গেছে।

–কি হল? বলে ডাঃ রুদ্রও এসে দাঁড়ালেন। তিনিও দেখলেন। অনেকক্ষণ ধরেই দেখলেন।

রীণা জিজ্ঞেস করল, ওরকম হলো কেন?

ডাক্তার রুদ্র বললেন, ও কিছু নয়।

গাড়িতে ওঠার সময়ে ডাঃ রুদ্র জিজ্ঞেস করলেন, ওর কি পেটের অসুখ কিংবা বমি হয়েছিল?

সঞ্জয় বলল, বিকেলেও এরকম দেখিনি।

আচ্ছা, লক্ষ্য রেখো। আমায় জানিও। ডাক্তার রুদ্রের গাড়ি কম্পাউন্ড ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

সঞ্জয় ওপরে উঠতে লাগল। তাকে কেমন চিন্তাচ্ছন্ন মনে হচ্ছিল। হঠাৎ চোখ বসে যাওয়াটা কেমন যেন অস্বাভাবিক।

.

১৭.

সংকেত

বৃহস্পতিবার। বেলা তখন তিনটে।

সঞ্জয় একটু আগে রাউন্ড দিয়ে নিজের চেম্বারে এসে বসেছে। হঠাৎ টেলিফোন। সঞ্জয় রিসিভারটা তুলে নিল।

হ্যালো!

ওপার থেকে ব্যাকুল কণ্ঠস্বর শোনা গেল–ডাঃ গুপ্ত? আমি বন্দনার মা–

কী ব্যাপার?

–আপনি শিগগির চলে আসুন। আপনার স্ত্রী হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেছেন।

–এখনি যাচ্ছি। বলে ফোন রেখে সঞ্জয় বেরিয়ে পড়ল।

কম্পাউন্ডে ঢুকে ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে সঞ্জয় প্রায় দৌড়ে তিনতলায় উঠল। দেখল বিছানায় শুয়ে আছে রীণা। মুখটা একেবারে সাদা। মাথার কাছে বসে আছেন বন্দনার মা। পুপুকে কোলে নিয়ে ঘুরছে বন্দনা।

রীণার জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু তাকাচ্ছে না। তাকাতে গেলেই কষ্ট হচ্ছে। সঞ্জয় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইল। একবার ডাঃ রুদ্রকে ফোন করার চেষ্টা করল। লাইন পেল না।

বিকেলের দিকে রীণা একটু একটু কথা বলল। কিন্তু কেন যে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে তা বলতে পারল না।

–আজও কিছু দেখেছিলে নাকি?

রীণা অতিকষ্টে বলল, মনে নেই। ভাবতে গেলেই সব যেন কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।

–আচ্ছা, তুমি ঘুমোও।

বলামাত্রই রীণা অতি ধীরে পাশ ফিরে শুলো।

সঞ্জয় আবার ডাক্তার রুদ্রকে ফোন করল। এবারে পেয়ে গেল। ডাঃ রুদ্র সব শুনলেন। একটি কথাও বললেন না। শুধু বললেন,যাচ্ছি।

সন্ধের সময়ে ডাঃ রুদ্র এলেন। রুগীকে দেখে মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। সঞ্জয়ের তা লক্ষ্য এড়ালো না। তবু জিগ্যেস করল, কিরকম বুঝছেন?

–বিশেষ ভালো না।

একটু থেমে বললেন, আমি তো তোমাকে বার বার বাসা বদলাতে বলেছি। এখনি বাসা না পাও, আমার বাড়িতে নিয়ে যেতে বলেছিলাম। তা তো শুনলে না। জেদ ধরে রইলে। মনে রেখো, আর একদিন পরেই সেই শনিবার।

নিরুপায় সঞ্জয় বলল, এখন যদি নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় তো

ডাঃ রুদ্র মাথা নাড়লেন–না, এ অবস্থায় ওকে আর নিয়ে যাওয়া যাবে না।

ডাঃ রুদ্রের একটা মিটিং ছিল। তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন। বলে গেলেন মিটিঙের পর আবার আসবেন। যাবার সময়ে জিজ্ঞেস করলেন, পুপু কেমন আছে?

সঞ্জয় অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিল, ভালো।

–চোখ বসাটা?

পুপুকে নিয়ে বন্দনা বাইরে ঘুরছিল। সঞ্জয় ডাকল। বন্দনা পুপুকে নিয়ে এল। ডাঃ রুদ্র পুপুকে ভালো করে দেখলেন।

–চোখটা কিন্তু তেমনি বসে আছে। চোখের কোণে কালো দাগটা যেন আরো prominent হয়েছে। দেখেছ?

সঞ্জয় নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিল, তাঁ। তবু ও ভালোই আছে। হাসছে খেলছে।

–কিন্তু চোখের নিচে কালিটা কিসের, ওটা এখনো আমরা ধরতে পারিনি। বলতে বলতে তিনি নেমে গেলেন।

.

১৮.

 শেষ ছোবল

শনিবার।

সেই শনিবার। বিশ্বাস করুক না করুক, তবু একটা অজানা ভয়ে সকাল থেকেই সঞ্জয় যেন বিশেষ চিন্তিত। তার ওপর রীণার শরীর মোটেই ভালো নয়। বিছানা থেকে ওঠার শক্তিটুকুও নেই। কেন যে এমন হল সঞ্জয় কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না। তার ওপর কাল রাত্তির থেকে হঠাৎই পুপুর জ্বর হয়েছে। এবার শুধু চোখ নয়, বুড়োদের মতো গাল দুটোও বসে গেছে।

সঞ্জয় কদিন বেরোচ্ছে না। সকালেই একবার ডাঃ রুদ্রকে ফোন করেছিল। পায়নি। একটু আগে ফের ফোন করল। এবার পেল। ডাঃ রুদ্র বললেন, সন্ধের সময়ে যাচ্ছি। আর দ্যাখো, আজ যে শনিবার এটা রীণাকে জানিও না।

শেষ বিকেল।

পশ্চিমের জানলা দিয়ে একফালি রোদ দেওয়ালে এসে পড়েছে। কেমন যেন ফ্যাকাশে রোদ। এ যেন এক মন-খারাপ-করা বিকেল। এরকম সময়ে অন্যদিন সে বাড়ি থাকে না। তাই নির্জন ঘরে শীতের বিকেল যে এমন ভারাক্রান্ত হয় সঞ্জয় তা জানত না। এই-সব বিকেলে বেচারি রীণা কি করে যে একা থাকে তাই ভেবে সঞ্জয় আজ বিচলিত হল।

রীণার বিছানার কাছে একটা চেয়ারে বসে সিগারেট খাচ্ছিল। ভাবনাটা এবার অন্যদিকে মোড় নিল। আজ রাত্তিরে যদি সত্যিই তেমন কিছু ঘটে তা হলে সাবধানতার জন্যে যা যা ব্যবস্থা ইতিমধ্যে করেছে তা যথেষ্ট কি না আর একবার যাচাই করে দেখতে চাইল।

নিজের ছোটো টর্চ ছাড়াও নতুন একটা বড়ো টর্চ কিনে রেখেছে। ছোটো বড়ো দুটো টর্চেই নতুন ব্যাটারি। রুগীর হার্ট ঠিক রাখার মতো প্রয়োজনীয় ওষুধ মজুত রেখেছে। ঘরে কুঁজো-ভর্তি খাবার জল, চা, কফি, দুধ, এক টিন বিস্কুট–তাছাড়া এক বোতল ব্রান্ডি-রাত জাগার জন্যে এসবেরই দরকার। সব কিছুরই ব্যবস্থা হয়ে আছে।

সারা রাত তাকে একাই জেগে থাকতে হবে। একবার ভেবেছিল বন্দনার মা-বাবাকে ডাকবে। কিন্তু ভেবে দেখল, কি জন্যে ডাকবে? তাঁদের তো বলা যাবে না যে, আজ রাত্রে অশরীরীটি হানা দেবে তার ঘরে।

একমাত্র রীণার কিছুটা বাড়াবাড়ি হওয়া ছাড়া আর যে কিছুই ঘটবে না সঞ্জয় সে সম্বন্ধে নিশ্চিত। কেন না সে জানে ঘরে লোক জেগে থাকলে তেমন-কিছু হয় না।

সঞ্জয় ঘড়ি দেখল। ছটা বাজে। পুপুকে ওষুধ খাওয়ালো। কেন কে জানে, ও আজ বড় ঘুমোচ্ছ। এবার রীণাকে দুধ খাওয়াতে হবে। ও তো কিছুই খেতে চাইছে না। শুধু চোখ বুজিয়ে পড়ে আছে। তবু গরম দুধ একটু না খাওয়ালেই নয়।

সঞ্জয় উঠে দুধ গরম করতে গেল।

একটু পরেই রীণার ক্ষীণ ব্যাকুল স্বর শোনা গেল।

–তুমি কোথায়?

–এই যে দুধ গরম করছি।

–শুনে যাও।

যাচ্ছি।

হিটার থেকে দুধের সসপ্যানটা নামিয়ে রেখে সঞ্জয় রীণার কাছে গেল। দেখল রীণা চারিদিকে তাকিয়ে কী যেন দেখছে।

-কি হল?

কিছু না। তুমি আমার কাছে বোসো।

–দুধটা আনি?

–পরে এনো। তুমি এখন বোসো।

–দুধ জুড়িয়ে যাবে। ফের গরম করতে হবে। বলে সঞ্জয় বসল।

দ্যাখো, আমি যেন কিছুই ভালো করে মনে করতে পারছি না। সব যেন কেমন ঘুলিয়ে যাচ্ছে।

–কিরকম? রীণার হাতটা সঞ্জয় তুলে নিল নিজের হাতে। একটু চমকালো। হাত দুটো ঠাণ্ডা।

–মনে হচ্ছে আমি যেন কত যুগ ধরে ঘুমোচ্ছি। কখনো মনে হচ্ছে আমি যেন আর এই পৃথিবীতে নেই। কত দূরে চলে গেছি। তারপরেই বুঝতে পারছি না, কোথাও তো যাইনি। এই তো আমার ঘর–এই তত আমার বিছানা–এই তো পুপু সোনা–পুপু কোথায়?

বন্দনা নিয়ে গেছে।

রীণা একটু থামল। তারপর চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে ফিসফিস্ করে বলল, আচ্ছা, সেই লোকটা কি আর এসেছিল?

–কোন লোকটা?

–সেই যে ম্যাজিসিয়ানের মতো দেখতে। কালো প্যান্ট-কোট কালো টুপি

না তো, কোনো লোকই আসেনি। একটু হেসে আবার বলল, তাঁকে দেখার সৌভাগ্য তো আমাদের হয় না। উনি কেবল তোমাকেই দেখা দেন।

হ্যাঁ। আমাকেই যে তার দরকার। কি দরকার গো বলল না।

রীণা একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল সঞ্জয়ের চোখের দিকে।

উঃ! কী সাংঘাতিক গেছে সেদিনের সেই বিকেলটা। আমি পুপুকে কোলে নিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। হঠাৎ দেখি ঘরের মধ্যে কী যেন ঘুরছে তো ঘুরছেই। ধোঁওয়া–শুধু ধোঁওয়া….

বলতে বলতে রীণা হঠাৎ ছিটকে উঠে বসল। দ্রুত নিশ্বাসে তার বুক ওঠা-পড়া করতে লাগল। দুচোখে ভয়ের কালো ছায়া।

–কি হল? অমন করে উঠে বসলে কেন?

–আজ–আজ সেই শনিবার না?

শনিবার! না, না, শনিবার তো কাল গেছে। আজ রবিবার।

রীণা প্রবলভাবে মাথা নাড়ল। কক্ষণো না। আজই শনিবার।

সঞ্জয় হাসল–পাগল! শনিবার হলে আমি বাড়ি থাকি?

রীণার তবু যেন বিশ্বাস হল না। এদিক ওদিক তাকাল।

–এখানে যে ক্যালেন্ডারটা ছিল?

–পেরেকটা খসে গেছে। ওঘরে টাঙিয়ে রেখেছি।

রীণা আর বসে থাকতে পারল না। শুয়ে পড়ল।

কী জানি, আমার মনে হচ্ছে তুমি আমায় লুকোচ্ছ।

–শুধু শুধু লুকোব কেন?

–আর ভাবতে পারছি না। বলে পাশ ফিরে শুলো। একটু পরে পাশ ফিরেই বলল, সন্ধে হয়েছে?

না।

–তবু আলোটা জ্বেলে দাও। একটু অন্ধকার হলেই ভয় করে।

সঞ্জয় আলো জ্বেলে দিল। রীণার চোখদুটো হঠাৎ ঝকঝক করে উঠল।

–এবার তোমার দুধ গরম করে আনি?

–পুপু খেয়েছে?

–হুঁ। বন্দনাই দুধ খাইয়ে নিয়ে গেছে।

মনে হচ্ছে ছেলেটাকে যেন কত দিন দেখিনি। ওকে একবার নিয়ে এসো না।

-আগে তুমি দুধ খেয়ে নাও। তারপরে আনব।

সঞ্জয় উঠে দুধ আনতে যাচ্ছিল রীণা আবার ডাকল, তুমি বলছ আজ রবিবার?

–হ্যাঁ। কতবার বলব?

শনিবারের সেই ফাড়া তাহলে কেটে গেছে?

সঞ্জয় ধমক দিয়ে বলল–ফাড়া আবার কি? কিছুই হয়নি। সবই মনের ভুল।

রীণা হঠাৎ আবার উঠে বসার চেষ্টা করল।

–শোনো শোনো বলে দুহাত বাড়িয়ে সঞ্জয়ের হাত দুটো চেপে ধরল–আচ্ছা, মিস থাম্পি যেমন সেই প্রফেসারকে হিপনোটাইজ করেছিল তেমনি আমাকেও কেউ করছে না তো?

হিপনোটাইজ! শুধু শুধু তোমায় কেউ হিপনোটাইজ করবে কেন? তাছাড়া ওসব গালগল্প। বলে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দুধ আনতে গেল।

.

সন্ধের একটু পরে ডাঃ রুদ্র এলেন। মমম্ করে ঢুকলেন রীণার ঘরে।

-কেমন আছ?

–ভালো নয়। মোটেই ভালো নয়। তবু আপনাকে দেখলে যেন ভরসা পাই।

ডাক্তার রুদ্র একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন। তারপর রীণার হাতটা টেনে নিলেন।

লেপের বাইরে হাত রেখে শুয়েছিলে বুঝি?

রীণা বলল, কী জানি। খেয়াল নেই।

ডাক্তার রুদ্র প্রেসার মাপতে লাগলেন। এক বার বার তিন বার। সঞ্জয় ঝুঁকে পড়ল।

-কত? রীণা জিজ্ঞেস করল।

—-ঠিক আছে।

রীণা সঞ্জয়কে বলল, ওঁকে কফি দাও।

ডাঃ রুদ্র বললেন, আজ অনেকবার চা-কফি হয়েছে। আর নয়। বরঞ্চ রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা করো। বলে রীণার দিকে তাকিয়ে হাসলেন।

রীণা উৎফুল্ল হয়ে বলল, আপনি রাত্তিরে এখানে খাবেন? কী সৌভাগ্য! কিন্তু আমি তো রান্না করে খাওয়াতে পারব না।

কথার শেষে হতাশ ভাব ফুটে উঠল রীণার মুখে।

–ঠিক আছে। তুমি সুস্থ হয়ে উঠলে আবার একদিন না হয় খাব।

রীণা ম্লান হাসল। মনে রাখবেন কিন্তু।

হ্যাঁ, নিশ্চয়। বলে ডাঃ রুদ্র চুরুট ধরালেন।

.

নটা বাজল।

ডাঃ রুদ্র নিচু গলায় বললেন, খুব ভাগ্য এক চান্সেই আমার বাড়ির লাইন পেয়ে গেলে। নইলে বাড়ি ফিরব না এই খবরটুকু দেবার জন্যে আবার বাড়ি ছুটতে হত।

সঞ্জয় কিছু বলল না। অন্যমনস্ক হয়ে কি যেন ভাবছিল।

–কি হল? অমন করে রয়েছ যে?

–ওর অবস্থা কি খুবই খারাপ?

খারাপ বলব না। তুমি নিজে ডাক্তার। প্রেসার তো দেখলে। ফল্স করছে। তাই ভাবলাম রাত্তিরে যদি আরো কিছু হয় তুমি একা নার্ভাস হয়ে পড়বে। সেজন্যেই থেকে গেলাম। তাছাড়া বলা যায় না যদি আজ রাত্রে ও কিছু দেখেটেখে? দুর্বল শরীর

পাশের ঘর থেকে রীণা ডাকল–একবার আসবে?

সঞ্জয় তাড়াতাড়ি উঠে গেল।

মৃদু আলো জ্বলছে। ধবধবে বিছানায় গলা পর্যন্ত সাদা ওয়াড় পরানো লেপ ঢাকা দিয়ে রীণা শুয়ে আছে। সঞ্জয় কাছে আসতেই রীণা তাকালো–

-কি বলছ?

–উনি খেয়েছেন তো?

-হুঁ।

–কিই বা খেলেন! ভারি লজ্জা করছে আমার।

–লজ্জার কি! তুমি সেরে উঠলে ভালো করে খাওয়াব।

রীণা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু একটা জিনিস বুঝতে পারছি না উনি রাত্তিরে এখানে থাকবেন কেন? সত্যি বলো আমার অবস্থা কি খারাপের দিকে যাচ্ছে?

সঞ্জয় হেসে উঠল। আরে না–না। আগের চেয়ে অনেক ভালো আছ।

–তা হলে উনি থাকছেন কেন?

–এমনিই। বললেন, বাড়িতে কেউ নেই। বাড়ি যেতে আর ইচ্ছে করছে না।

রীণা অবিশ্বাসের সুরে বলল, বাড়িতে কেউ না থাকলে লোকে কি বাইরে রাত কাটায়? ডাক্তারের বাড়ি বলে তো চোর-ডাকাতে খাতির করবে না।

সঞ্জয় হাই তুলে বলল, তা হয়তো ঠিক। তবে এও ওঁর একটা খেয়াল। হয়তো স্টকে নতুন কোনো গল্প জমেছে। রাত জেগে শোনাবেন।

কথাটা রীণার মনে ধরল না। বলল, আমার ধারণা নিশ্চয় কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে উনি এখানে থাকতে চাইছেন।

রীণা একটু চুপ করল। সঞ্জয় কিছু বলার আগেই বলল, আমার মনে হয় আজই শনিবার। সত্যি করে বললো না গো!

–দূর! তোমার কেবল সেই এক কথা–শনিবার–শনিবার–সাড়ে নটা বাজল। একটু ঘুমোও তো।

–এত তাড়াতাড়ি ঘুমোব? যদি মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়?

–ভাঙবে না। তুমি ঘুমোও।

রীণা ঘুমোবার জন্যে পাশ ফিরল। তারপরেই জিজ্ঞেস করল, পুপু কি করছে?

–ঘুমোচ্ছে।

–মশারি টাঙিয়ে দিয়েছ তো?

–হ্যাঁ, হ্যাঁ। তোমার কোনো চিন্তা নেই। এবার তুমি একটু ঘুমোও।

বলে সঞ্জয় তাড়াতাড়ি বাইরের ঘরে চলে এল।

.

রাত সাড়ে দশটা।

বাইরের ঘরে সঞ্জয় আর ডাক্তার রুদ্র। ডিভানের ওপরে ডাক্তার রুদ্র র‍্যাগ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছেন। মাটিতে শুয়েছে সঞ্জয়।

ডাক্তার রুদ্র জিজ্ঞেস করলেন, কী ভাবছ? তুমি অবশ্য আমার সামনে স্বচ্ছন্দে স্মোক করতে পার।

সঞ্জয় সে কথায় সাড়া না দিয়ে বলল, ও তত বেশ সামলে উঠেছিল। হঠাৎ এমন হল কেন?

ডাঃ রুদ্র বললেন, আমি তো তোমায় বলেছি এবাড়ি না ছাড়লে ও কখনন একেবারে সুস্থ হবে না। পুপুও ভালো নেই। কেমন Pale হয়ে যাচ্ছে। কেন?

সঞ্জয়ের বুকটা কেঁপে উঠল। উত্তর দিতে পারল না।

–সত্যি হোক মিথ্যে হোক এবাড়ির সঙ্গে ওর মানসিকতার সম্পর্ক এমন একটা পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে ওর subconscious মনে সবসময় একটা আতঙ্ক দানা বেঁধে রয়েছে। তার থেকে ওর নিষ্কৃতি নেই। ওষুধ দিয়ে ওকে আর সুস্থ করা যাবে না।

–আমি ভাবছি, এত দুর্বল হয়ে পড়ল কেন? সন্ধের সময়ে বলছিল–কিছুই মনে করতে পারছে না। সব যেন খেই হারিয়ে ফেলছে।

ডাঃ রুদ্র বললেন, শুধু শরীর নয়, মনও অসুস্থ হলে দুর্বল হয়ে পড়বেই।

একটু থেমে বললেন, আচ্ছা, আজ যে শনিবার ও জানে না তো?

সঞ্জয় বলল, না। তবে আজই শনিবার কিনা বার বার জিজ্ঞেস করছিল। ক্যালেন্ডার দেখতে চাইছিল। আমি আগেই সরিয়ে রেখেছিলাম।

ডাঃ রুদ্র বললেন, ভালো করেছ। ও যদি জানতে পারে আজ সেই শনিবার তাহলে একেবারে ভেঙে পড়বে।

–কিন্তু ক্যালেন্ডার সরিয়ে রেখেও নিস্তার নেই। আমায় অনেক জেরা করল।

–কিরকম?

–জানতে চাইল আপনি রাত্তিরে হঠাৎ এখানে থাকছেন কেন? বললাম কাকীমা এখানে নেই-বাড়ি খালি। তাই যেতে চাইলেন না। ও বিশ্বাস করল না। ওর ধারণা হয় ওর অবস্থা ভালো নয়, না হয় নিশ্চয় আজ সেই শনিবার বলে আপনি রাতে এখানে থাকছেন।

ডাক্তার রুদ্র গম্ভীর হয়ে গেলেন। একটু চুপ করে থেকে বললেন, এসব চিন্তা ওর মাথায় ঢুকলে তো মুশকিলের কথা।

সঞ্জয়ের মুখটা শুকিয়ে গেল।–মুশকিল কেন বলছেন?

–জান তো ওর হার্ট কিরকম দুর্বল। প্রেসারও অনেক কম। তার ওপর যদি হঠাৎ ও ভয় পায়–

সঞ্জয় ব্যাকুল হয়ে বলল, তাহলে

আমরা তো ওর পাশেই রয়েছি। সব রকম ব্যবস্থাই করে রেখেছ। দেখা যাক।

ঘড়িতে এগরোটা বাজল।

ডাক্তার রুদ্র টেবিল-লাইট জ্বেলে একটা বই পড়ছিলেন। বইটা মুড়ে রেখে বললেন, যদি আজ রাত্রে সত্যিই কেউ আসে তাহলে হাতে অন্তত ঘণ্টা তিনেক সময়।

সঞ্জয় মাটিতে মশারি টাঙিয়ে পুপুকে নিয়ে শুয়েছিল। বলল, ততক্ষণ একটু ঘুমিয়ে নেবেন ভাবছেন?

–না, এখনই ঘুমনো নয়। আগে রীণার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। বলে ব্যাগটা নিয়ে ডাক্তার রুদ্র ভেতরে গেলেন।

মিনিট দশেক পরে বাইরে এসে বসলেন। সঞ্জয়কে বললেন, একটা ইনজেকশান দিলাম। গভীর ঘুমের মধ্যে থাকুক। তেমন কিছু ঘটলেও জানতে পারবে না।

.

বারোটা বাজল।

ডাক্তার রুদ্র বইটা মুড়ে চেয়ারের ওপর রাখলেন। টেবিল থেকে প্রেসার মাপার যন্ত্রটা নিয়ে রীণার ঘরে ঢুকলেন।

পুপু উসখুস করছিল। পিঠ চাপড়ে ওকে আবার ঘুম পাড়িয়ে সঞ্জয় যখন বিছানা থেকে বেরিয়ে এল ডাঃ রুদ্র তখন রীণাকে পরীক্ষা করে ফিরে এসেছেন।

-কেমন দেখলেন?

–একই রকম। তবে ঘুমোচ্ছ। আচ্ছা, এবার তুমি ওর ঘরের আলোটা নিভিয়ে দাও।

–একেবারেই নিভিয়ে দেব, না নীল বালবটা

–না, একেবারে অন্ধকার করে দাও।

সঞ্জয় একটু অবাক হল। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করল না। আলো নিভিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এল।

–এবার চলো আমরা বাইরে গিয়ে বসি।

–বাইরে? কেন?

–শোনো সঞ্জয়, আজ যখন রাত্তিরটা এখানে থেকেই গেলাম তখন একটু বিশেষ করে লক্ষ্য করতে চাই, সত্যিই কিছু ঘটে কি না!

এত মানসিক দুশ্চিন্তার মধ্যেও সঞ্জয় একটু হাসল। বলল, কিছু ঘটলেও তো আপনি আমি দেখতে পাব না।

–কি করে জানছ? এর আগে যখনই ঘটনা ঘটেছে তখন তোমরা ঘুমোও। জেগে থাকলে হয়তো কিছু দেখতে না পাও, বুঝতে পারতে।

সঞ্জয় আবার হাসল।তার জন্যে আমরা রীণাকে, পুপুকে একলা ফেলে বাইরে যাব? সেটা কি উচিত হবে?

হু, এ ঘরটাও খালি রাখতে হবে।

–এই শীতে আমরা বাইরে কোথায় বসব?

–ব্যালকনিতে, ঐখানেই আমরা বসব। বলে নিজেই একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বাইরে চলে এলেন। অগত্যা সঞ্জয়কেও আর একটা চেয়ার নিয়ে বসতে হল।

যাক, সিঁড়ি থেকে রীণার ঘর পর্যন্ত সব ফঁকা। ডাঃ রুদ্র যেন বেশ খুশি হলেন।

–আপনি কি ভেবে রেখেছেন তিনি এলে আমরা সিঁড়ির মুখেই জাপটে ধরব?

সঞ্জয়ের বলার ভঙ্গিটা বিদ্রপের মতো শোনাল।

–না, তা নয়। spirit যাতে বিনা বাধায় রীণার কাছে যেতে পারে তার জন্যেই এই ব্যবস্থা।

সঞ্জয় গরম চাদরে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে বলল, spirit যদি সত্যি আসতে চায় সে কি কোনো বাধা মানবে? রীণা যখন তাকে দেখেছিল ঘরের দরজা কি ভেতর থেকে বন্ধ ছিল না?

রুদ্র বললেন, সে বাধা অন্য। আমি বলছি ঘরের মধ্যে একাধিক লোক জেগে বসে থাকলে স্পিরিট কিছুতেই আসে না। আমার মনে হয়, মানুষ যেমন প্রেতের ভয় পায়–প্রেতরাও তেমনি মানুষকে ভয় পায়। দুর্বল একাকী মানুষই তাই প্রেতের শিকার হয়। যাক, টচটা নিয়েছ তো?

–হ্যাঁ। বলে বড়ো টর্চটা রুদ্রের হাতে দিল।

কয়েক মিনিট দুজনেই চুপচাপ। ডাঃ রুদ্র একটা চুরুট ধরালেন। বললেন, এখনকার মতো একটা চুরুট খেয়ে নিই। এরপর আর খাওয়া যাবে না। চুরুটের আগুন এমনকি গন্ধও হয়তো স্পিরিটের আসার পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

–আচ্ছা, spirit-এর আসার জন্যে আমরা ব্যাকুলই বা হচ্ছি কেন? সে তো আমাদের আনন্দদান করতে আসবে না।

ডাঃ রুদ্র বললেন, spirit যদি সত্যিই তার কথা রাখে তা হলে যা ঘটবার তা আজই ঘটে যাক। নইলে তো আবার অনিশ্চিন্তে আর একটা দিনের অপেক্ষা করতে হবে।

আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ। হঠাৎ ঘরের ভেতরে মনে হল রীণা জেগে উঠেছে।

ও কি ডাকছে? সঞ্জয় গায়ের র‍্যাগ ফেলে রেখে ছুটল। পিছনে ডাক্তার রুদ্র।

সঞ্জয় আলো জ্বালল। দেখল রীণা উসখুস করছে আর মুখে অস্বস্তির একরকম শব্দ। লেপটা মাটিতে পড়ে গেছে।

সঞ্জয় লেপটা তুলে ভালো করে গায়ে ঢাকা দিয়ে কিছুক্ষণ রীণার কাছে বসে রইল।

–এবার এসো।

সঞ্জয় উঠে এল।

–আলোটা নিভোও।

অগত্যা সঞ্জয়কে আলো নিভিয়ে দিতে হল। বাইরের ঘরে এসে মশারির মধ্যে টর্চ ফেলে একবার পুপুকে দেখে নিল সঞ্জয়। না, পুপু নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে।

দুজনে আবার বসল।

নিশুতি শীতের রাত থমথম করছে। পরিষ্কার নীল আকাশের গায়ে তারাগুলোর রহস্যময় নিঃশব্দ হাসি।

সঞ্জয় বলল, আমি এখনো এসব বিশ্বাস করি না। সত্যি কথা বলতে কি থ্রিল অনুভব করলেও জানি না এমন কেন মনে হচ্ছে যে, আমরা বড়োই অসহায়। তার ওপর নিরস্ত্র।

ডাক্তার রুদ্র হেসে বললেন, অশরীরীদের মোকাবিলা করতে রিভলভার কোনো কাজে লাগে না–এই টই একমাত্র অস্ত্র।

.

আরও কতক্ষণ কেটে গেল। নিচে কারো ঘরে দেওয়াল-ঘড়িতে ঠং করে শব্দ হল। সঞ্জয় চমকে উঠল। কটা বাজল? একটা না দেড়টা?

–দেড়টা। বলে ডাক্তার রুদ্র হাতের আড়াল দিয়ে আলগা করে টর্চের বোতাম টিপে রিস্টওয়াচটা দেখে নিলেন।

–দেড়টা! তা হলে একটা বাজল কখন?

ডাক্তার রুদ্র বললেন, তুমি তখন ঘুমিয়ে পড়েছিলে।

সঞ্জয় লম্বা আলিস্যি ভাঙল।

–সত্যি আমি আর পারছি না। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। শুধু শুধু

সঞ্জয় কথা আর শেষ করল না। ডা

ক্তার রুদ্র গম্ভীর স্বরে বললেন, হোক শুধু শুধু। এছাড়া উপায়ও ছিল না। আজ এই শনিবারের রাত্রিটা ছিল রীণার পক্ষে মারাত্মক। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে রীণার এতক্ষণ কী হত বলতে পারি না।

–তা হলে আপনি বলছেন, আমরা পাহারা দিচ্ছি বলে আজ আর কিছু হবে না?

–না হওয়াই স্বাভাবিক। যদি হয়ও মারাত্মক কিছু হবার আগেই আমরা গিয়ে পড়ব।

এমনি সময়ে দূরে বড়ো রাস্তায় একটা খ্যানখেনে বিকৃত গলার চিৎকার শোনা গেল।

ডাক্তার রুদ্র চমকে উঠলেন।

সঞ্জয় হেসে বলল, ও কিছু নয়। একটা মাতাল যাচ্ছে। রোজই এই সময়ে যায়।

বলে ব্যালকনির ধারে গিয়ে দাঁড়াল।

ডাক্তার রুদ্র হেসে বললেন, কি দেখছ? রাতের কলকাতার শোভা?

সঞ্জয় বলল, না। মাতালটার গলা শুনেছি, দেখিনি কখনো। তাই

–দেখতে পেলে?

–হ্যাঁ, ঐ যে যাচ্ছে–ঠিক যেন একটা ছায়ামূর্তি।

মাতালটা চলে গেল। সঞ্জয় তবু দাঁড়িয়ে রইল।

নিস্তব্ধ রাত। বাড়ির পিছনে কম্পাউন্ডের গায়ে বনঝাপের মধ্যে রাতকানা একটা পাখির পাখা ঝাঁপটানো। ও দিকে যশোর রোডের মসৃণ দেহের ওপর দিয়ে গর্জন করতে করতে মাঝেমধ্যে ছুটছে লরি। স্ট্রীট-লাইটের আলোয় ঝলমল করছে রাস্তাটা।

গোটা বাড়িটা গভীর রাতে একটা রহস্যপুরীর মতো দাঁড়িয়ে। কত নিশ্চিন্তে নিচের তলায় মহিমাবাবু, অমৃতবাবুরা ঘুমোচ্ছেন। দোতলার ঘরে উদ্ভিন্নযৌবনা কিশোরীটি কি কোনো সুখস্বপ্ন দেখছে?

–আচ্ছা সঞ্জয়, বাড়িটার ওপর ওরকম মধ্যযুগীয় গম্বুজটা কেন ভেবেছ কখনো?

না। ও আর ভাবব কি? বাড়িওয়ালার শখ।

সঞ্জয় চেয়ারে বসল।

–কিন্তু কোন যুগের মানুষের এইরকম শখ ছিল?

–তা বলতে পারব না।

-সঠিক বলতে না পারলেও অনুমান করা যায় এ তল্লাটে এত পুরনো বাড়ি আর নেই। যদিও পরে অনেক অল্টারেশান হয়েছে।

–হ্যাঁ, তা হয়েছে। তবে তিন তলাটা এখনো ইনকমপ্লিট। আর সিঁড়িটা

সঞ্জয় প্রচণ্ড জোরে নিজের গালে একটা চড় মেরে বলে উঠল–উঃ! মশায় অস্থির করে দিল। এ অঞ্চলের মশা! এদের কামড়ই আলাদা।

–আচ্ছা, মিস থাম্পি বাড়িটা সম্বন্ধে কিছু বলেননি?

সঞ্জয় ইতস্তত করে বলল, হ্যাঁ বলেছেন। তাঁর মতে এখানে কিছু আছে।

উনি এ কথা বলেছেন?

সঞ্জয় হাই তুলে হালকা মেজাজে বলল, হ্যাঁ, উনি যেখানেই যান সেখানেই কিছুর সন্ধান পান বোধ হয়। মার এক বান্ধবীর বাড়ি গিয়েছিলেন। সেখানেও অশরীরী আত্মা দেখেছিলেন।

–তাই নাকি?

–হ্যাঁ। তবে এখানে কিছু দেখার ভাগ্য তার হয়নি। বুঝতে পেরেছিলেন।

ডাক্তার রুদ্র চোখ বুজিয়ে কিছু ভাবতে লাগলেন। হঠাৎ একসময়ে তিনি চমকে উঠলেন।

–কিছু শুনতে পাচ্ছ? ডাঃ রুদ্রর স্বরটা কেমন চাপা।

মশার ঐকতান ছাড়া আর তো কিছু শুনছি না।

ডাক্তার রুদ্র চুপ করে রইলেন। সঞ্জয়ও আর কিছু বলল না। জোর করে একটা হাই তুলল।

আরো কিছুক্ষণ কাটল। ডাক্তার রুদ্র হঠাৎ র‍্যাগটা খুলে ফেললেন।

–কি হল? এই ঠাণ্ডায় র‍্যাগ খুললেন কেন?

কেমন একটা গরম হাওয়া বইছে না?

সঞ্জয় চোখ বুজিয়ে নির্লিপ্ত স্বরে বলল, গরম বা ঠাণ্ডা কোনো হাওয়াই তো পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে যেন পৃথিবীটা হাওয়াশূন্য হয়ে গেছে।

–কিন্তু, আমার মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।

যা ঘটছে তা শুধু রাত্রিজাগরণ।

ডাক্তার রুদ্র এবার হাই তুললেন। বললেন, তা বটে। আমারও এখন ঘুম পাচ্ছে।

সঞ্জয় ব্যালকনির পাঁচিলে দু পা তুলে চেয়ারে শরীরের আধখানা বিছিয়ে দিয়ে বলল, ঘুমোন তবে। ঘুমেই আরাম ঘুমেই শান্তি। ঘুমের তুল্য জিনিস নেই।

–আশ্চর্য, এত মনের জোর করেও ঘুম আটকাতে পারছি না। এমন কখনো হয় না। কিন্তু ঘুমোলে চলবে না। কটা বাজল? নিজেকে যেন নিজেই প্রশ্ন করলেন রুদ্র। সাবধানে টর্চের আলোয় ঘড়িটা দেখলেন।

–just two, কিন্তু নিচের ঘড়িতে দুটো বাজল না তো?

সঞ্জয় চোখ বুজিয়েই বলল–বোধহয় শুনতে পাইনি।

–কিন্তু–এইটেই সময়। ঠিক দুটোতেই তো—

রুদ্র উঠে দাঁড়ালেন।

রীণাকে একবার দেখে আসি।

সঞ্জয়ও উঠে পড়ল।

ঠিক সেই সময়ে ঘরের মধ্যে পুপু ককিয়ে কেঁদে উঠল। সেই কান্না শুনে সঞ্জয়ের রক্ত হিম হয়ে গেল। চিৎকার করে উঠল কাকাবাবু, শীগগির–

বলে দৌড়ে ঘরের দিকে গেল।

দুটো ঘরই অন্ধকার। সঞ্জয় যখন বসার ঘরের সুইচ হাতড়াচ্ছে ডাক্তার রুদ্র ততক্ষণে ভেতরের ঘরে ঢুকে পড়েছেন।

ঢুকেই তিনি সুইচে হাত দিলেন। আলো জ্বলল না। দেওয়ালে ধাক্কা লেগে টচটা হাত থেকে কোথায় ছিটকে পড়ল।

–লোডশেডিং! সঞ্জয়, টচটা–শীগগির

সঙ্গে সঙ্গে সঞ্জয়ের হাতের টর্চের আলো ঝলকে উঠল। সেই আলো গিয়ে পড়ল রীণার বিছানায়। দেখল রীণার মাথা থেকে পিঠ পর্যন্ত ঝুলছে খাট থেকে। লেপটা পড়ে আছে মাটিতে।

কয়েক মুহূর্ত….।

সঞ্জয়ের পা দুখানা যেন মেঝের সঙ্গে আটকে গিয়েছে।

সঞ্জয়ের হাত থেকে টর্চটা ছিনিয়ে নিয়ে রুদ্র ছুটে গেলেন রীণার কাছে। এক হাতে টর্চ। অন্য হাতে কোনোরকমে তুলে ধরলেন মাথাটা।

তাড়াতাড়ি এসো।

সঞ্জয় এগিয়ে এল। ওর হাত দুটো তখন কাঁপছে।

–পা দুটো ধরো। ওদিক থেকে ধরো–dont get nervous.

সঞ্জয় বিছানার ওপর উঠে রীণার পা দুটো ধরল।

–এবার লম্বালম্বিভাবে শোওয়াতে হবে। দাঁড়াও-বালিশটা দিই-উঃ! আলোটাও এই সময়ে গেল! না, আলো তো দেখছি শুধু এ বাড়িতেই গেছে–ও কী! তুমি ওরকম করছ কেন? সরো। বলে ধমকে উঠলেন।

রীণাকে বিছানায় ঠিকমতো শুইয়ে দিয়ে রুদ্র নিজেই লেপটা তুলে রীণার গায়ে দিয়ে দিলেন।

লণ্ঠনটা জ্বালো। কী হল? দাঁড়িয়ে রইলে কেন?

–ও বোধহয় আর নেই।

কী যা-তা বকছু! ধমকে উঠলেন রুদ্র। আমার স্টেথস্কোপটা–লণ্ঠনটা জ্বালো না।

লণ্ঠনটা কোনোরকমে জ্বেলে দিয়ে সঞ্জয় বাইরের ঘরে গিয়ে পুপুর কাছে বসে রইল।

পুপু তখনো ফুলে ফুলে কাঁদছে।

ডাঃ রুদ্র স্টেথস্কোপ নিয়ে ঝুঁকে পড়লেন।

মিনিটের পর মিনিট কাটতে লাগল। রুদ্ধনিঃশ্বাসে সঞ্জয় বসে রইল অন্ধকারে।

রীণা কি বেঁচে আছে?

এটুকু বুঝতে কত সময় লাগে? এত দেরি হচ্ছে কেন?

তবু সঞ্জয় উঠে গিয়ে জানতে পারল না রীণা বেঁচে আছে কিনা।

–সঞ্জয়-please help me! ডাক্তার রুদ্র চেঁচিয়ে উঠলেন।

–আমার ব্যাগটা—

সঞ্জয় একঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলের ওপর থেকে ব্যাগটা নিয়ে ডাক্তার রুদ্রের কাছে গেল।

কী দেখলেন ডাক্তারবাবু?

Thank God! হার্ট বীট পাওয়া যাচ্ছে। তোমার ছেলে কি করছে?

–ঘুমিয়েছে।

–যাক, অল্পর ওপর দিয়ে গেছে। সঞ্জয় বিছানায় বসে পড়ে রীণার হাত দুটো কোলের ওপর টেনে নিল।

–হাত যে একেবারে ঠাণ্ডা।

–ও ঠিক হয়ে যাবে। তুমি একটু সেঁক দাও।

–হসপিটালে নিয়ে যাব?

না, এখনই দরকার নেই। তেমন বুঝলে আমি বলব। গাড়ি তো রয়েছেই। উঃ! আর একটু দেরি হলেই শেষ হয়ে যেত।

.

সকালবেলা।

দুজনে দুকাপ গরম কফি নিয়ে বসেছে। দরজায় শব্দ।

সঞ্জয় চমকে উঠল। এত সকালে কে? তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুলে দিল। দেখল মান্তু আর ললিতবাবু শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে।

-কি ব্যাপার?

–সকালেই চলে এলাম। মিস থাম্পি টেলিগ্রাম করেছিলেন। টেলিগ্রামটা পেতে একদিন দেরি হয়েছে। বলে টেলিগ্রামটা সঞ্জয়ের হাতে দিল।

টেলিগ্রামের বক্তব্য–যে কোনো প্রকারে আজকেই মিসেস গুপ্তকে আপনাদের কাছে এনে রাখুন। জীবন বিপন্ন।

সঞ্জয় টেলিগ্রামটা ললিতবাবুর হাতে ফেরত দিয়ে বলল, ভেতরে আসুন।

 ২. ডাঃ রুদ্রের ছবিপ্রীতি

০১. ডাঃ রুদ্রের ছবিপ্রীতি

মাস তিনেক পর।

অনেক চেষ্টায় মানিকতলার কাছে ওরা দুখানা ঘর পেয়েছে। মান্তুদের বাড়িতে কিছুদিন থেকে এখন ওরা এই নতুন বাড়িতে এসেছে।

এখানে এসে ওরা নিশ্চিন্ত। রীণা সম্পূর্ণ সুস্থ। ভয়টয় আর পায় না। শুধু তাই নয়, রীণার এখন মনে হয়– যা-সব এতদিন ঘটেছে সব যেন স্বপ্ন। সে বিশ্বাসই করতে পারে না কোনোদিন তার ওপর অশরীরী আক্রমণ হত। পুপুও সুস্থ আছে। হাসিখুশি প্রাণচঞ্চল শিশু।

শুধু সঞ্জয় মাঝে মাঝে ভাবে শেষ পর্যন্ত অলৌকিক কিছুর কাছে তাকেও আত্মসমর্পণ করতে হল! হ্যাঁ, আত্মসমর্পণ বইকি। বাড়ি তো বদলাতে হল!

তখনই অবশ্য অন্য যুক্তি দাঁড় করায়–পুপুর শরীর ওখানে টিকছিল না। অন্তত ওর দিকে তাকিয়েও তাকে বাড়ি বদলাতে হত। তাছাড়া নিচের তলার ভাড়াটেদের সঙ্গে বেশিদিন আর মানিয়ে চলতে পারত না। কেবল রীণার দুঃখ বন্দনাদের জন্যে। বন্দনার মাকে ওর খুব ভালো লেগেছিল। অবশ্য এর মধ্যেই বন্দনারা দুবার ঘুরে গেছে। মান্তু তো প্রায়ই আসে। বলে–এবার অনেকটা কাছে হয়েছে।

রীণা হাসে।–কই আর কাছে? কোথায় মানিকতলা আর কোথায় হাওড়ার ক্ষীরোদতলা।

মান্তু বলে, তবু তো যশোর রোড থেকে কাছে।

ডাক্তার রুদ্র প্রায় আসেন। সব মিলিয়ে রীণা এখন বেশ ভালোই আছে।

জুলাই মাস।

একদিন বিকেলে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। ডাক্তার রুদ্র এসেছেন। সঞ্জয়ও রয়েছে। গরম সিঙ্গাড়া আর কফির পেয়ালা সামনে নিয়ে আসর বেশ জমেছে রীণাদের বসার ঘরে।

ডাক্তার রুদ্র কথায় কথায় বললেন, আচ্ছা, সেই ছবিটার কি হল?

–কোন ছবি?

–সেই যে বুড়ো ভদ্রলোকের–যেটা হারিয়ে গেল।

–ওঃ! শিবানন্দ ভট্টাচার্যর?

ডাক্তার রুদ্র মাথা দোলালেন।

–এখানে আসার পর তাঁর কাছে গিয়েছিলে নাকি?

সঞ্জয় বলল, না। যাওয়া হয়নি।

–একেবারে ছেড়ে দিলে?

সঞ্জয় হাসল–আপনার দেখছি বেশ আগ্রহ রয়েছে।

–তা রয়েছে। রহস্যটা কি জানতে না পারা পর্যন্ত কৌতূহল মিটছে না।

রুদ্র একটু থামলেন। তারপর বললেন, কয়েকটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছ? প্রথমত আত্মার আবির্ভাব হত শুধু তিনতলার ঘরেই। এতদিন ধরে এত কাণ্ড হয়ে গেল কিন্তু বাড়ির একতলা-দোতলায় সবাই নিশ্চিন্ত। তাদের গায়ে আঁচটুকুও লাগেনি।

দ্বিতীয়, আক্রমণ শুধু রীণার ওপরেই। রীণা ছাড়া আর কাউকে দেখা দিত না।

–দেখা দিত না, না রীণা ছাড়া আর কেউ দেখতে পেত না? কথার মাঝখানে সঞ্জয় মন্তব্য করল।

Thats also the point. দেখা দেওয়া আর দেখা পাওয়া এই ব্যাপারটার সমাধান হলে আশা করি অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যাবে।

এই বলে ডাঃ রুদ্র চুপ করে ভাবতে লাগলেন।

সঞ্জয় বলল, কিন্তু আপনি কি মনে করেন শিবানন্দর কাছে গেলেই রহস্যের সমাধান হবে?

ডাক্তার রুদ্র থুতনিতে হাত বুলিয়ে একটু ভেবে বললেন, সমাধান হবেই এ কথা জোর করে বলতে পারি না। অলৌকিকতার রহস্য কখনো ভেদ করা যায় না। তবে তুমি বলছিলে না বৃদ্ধটি কলকাতার অনেক পুরনো বাড়ির ইতিহাস জানেন?

–হ্যাঁ, আমার সেই পেশেন্টের বাড়িতে তো তাই শুনেছিলাম।

তবে চলোই-না একদিন বৃদ্ধের সন্দর্শনে যাই।

–আপনি সত্যিই interested দেখছি।

–Yes, I am. ঠিকানাটা তোমার মনে আছে তো?

–একেবারে কণ্ঠস্থ। অশরীরী আত্মাটি এখানেই আমার কাছে হেরে গেছেন।

তবে একটা দিন ঠিক করে ফেলল। দেরি করা উচিত হবে না। বুঝতেই পারছ বৃদ্ধের বয়েস হয়েছে। যে কোনোদিন পৃথিবীর মায়া কাটাতে পারেন।

সঞ্জয় ক্যালেন্ডারের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, সামনের রবিবার হলে আপনার অসুবিধে হবে?

ডাক্তার রুদ্র ডায়রিটা খুললেন।

না, কোনো অসুবিধে নেই। একটা মিটিং আছে সকালে। তা আমরা না হয় বিকেলে যাব।

-তুমিও যাবে নাকি? সঞ্জয় হেসে রীণাকে জিজ্ঞেস করল।

–গেলে হতো। বৃদ্ধটিকে আমারও দেখবার খুব কৌতূহল হচ্ছে।

ডাক্তার রুদ্র বললেন, তোমার আর গিয়ে কাজ নেই।

দেওয়ালে ঝুলছিল ওদের একটা ছবি। ডাঃ রুদ্র যেন আজই প্রথম ওটা দেখলেন।

-ওটা কি তোমাদের বিয়ের ছবি?

সঞ্জয় হাসল। হ্যাঁ। এর আগে দেখেননি?

–হয়তো দেখেছি। খেয়াল হয়নি।

তিনি ছবিটার দিকে এগিয়ে গেলেন।

–তোমাদের একটা ছবি রাখতে ইচ্ছে করে।

সঞ্জয় রীণার দিকে তাকিয়ে বলল, বেশ তো নেবেন। আমাদের সম্প্রতি তোলা একটা

ডাক্তার রুদ্র বাধা দিয়ে বললেন, না না, সম্প্রতি নয়। পুরনো, যত পুরনো হয়। বিশেষ করে রীণারটা।

রীণা অবাক হল।

–পুরনো কেন?

ডাঃ রুদ্র হেসে বললেন, বুঝতে পারছ না কম বয়েসের ছবির আকর্ষণই আলাদা।

সঞ্জয় হো হো করে হেসে উঠল।

–আর এখন বুঝি বুড়ি হয়ে গেছি? রীণা মুখ লাল করে প্রতিবাদ করল।

ডাঃ রুদ্র তাড়াতাড়ি নিজের কথা শুধরে নিয়ে বললেন, না না, সেকথা বলিনি। আমি বলেছি আকর্যণ–attraction-এর কথা। আমার আজকের ছবির চেয়ে দশ বছর বয়েসের ছবি কি বেশি attractive নয়?

রীণা যেন কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে বলল, কিন্তু সেরকম ছবি কি এখানে আছে? আপনি বরং আমাদের বিয়ের ছবিরই এক কপি নিয়ে যান। বলে উঠে ভেতরে চলে গেল।

.

০২.

একশো তিন বছরের সেই বৃদ্ধ

পলেস্তারা-ছাড়ানো দোতলা বাড়িটা। দোতলার জানলায় জানলায় বিবর্ণ পর্দা। পাঁচিলভাঙা ছাদে ফুলগাছের টব।

বেলা চারটে নাগাদ ডাঃ রুদ্র আর সঞ্জয় সেই বাড়ির দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন।

দরজা খোলাই ছিল। ডাঃ রুদ্র কয়েকবার কড়া নাড়লেন। কিন্তু কারো সাড়া পাওয়া গেল না।

হতাশ হয়ে সঞ্জয় বলল, শুধু শুধুই আসা হল।

–কেন?

–কারো তো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।

–ভেতরে ঢুকে দেখা যাক। দরজা যখন খোলা তখন আশা করি অনধিকার-প্রবেশ ঘটবে না।

সঞ্জয়ের ঢোকার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু ডাঃ রুদ্র যখন ঢুকে পড়লেন তখন অগত্যা সঞ্জয়কেও ঢুকতে হল। ঘরে ঢুকতেই ধুলোর গন্ধ। সঞ্জয় তাড়াতাড়ি রুমাল বের করে নাকে চাপা দিল। বলল, ঘরে দেখছি ঝটও পড়ে না।

ঘরটা বেশ বড়ো। বৈঠকখানা ঘরের মতো। ঢুকতেই ডান দিকে একটা চৌকি। চৌকির ওপর শতছিন্ন শতরঞ্জি পাতা। শতরঞ্জির প্রায় সর্বত্র দোয়াত-ওল্টানো কালির দাগ। ময়লা ওয়াড়-জড়ানো একটা তাকিয়া দেওয়াল ঘেঁষে পড়ে আছে। ঘরের বাঁ দিকে পাশাপাশি তিনখানা বড়ো আলমারি। মান্ধাতার আমলের, বইতে ঠাসা। আলমারির বেশির ভাগ কাচই ভাঙা। তবে সবগুলোই তালা লাগানো। যদিও সে তালা বড়ো একটা ভোলা হয় না বলেই মনে হয়।

এবার? কারো নাম ধরে ডাকতে হয়। কিন্তু কার নাম ধরে ডাকবে? ভট্টাচার্যমশাই। আছেন? একশো তিন বছর বয়েসের বৃদ্ধকে হাঁক দিয়ে ডাকা শোভন নয়। বাবু বলেও সম্বোধন করা যায় না।

অস্বস্তির ব্যাপার আরো ছিল। কপিলেশ্বরবাবু বলে দিয়েছিলেন ভট্টাচার্যমশাইয়ের মেজাজ খারাপ। হয়তো দেখাই করবেন না। তখন যেন ছবিটা দেখানো হয়। ছবির নিচে প্রেরকের নাম দেখলেই তিনি খুশি হবেন। কিন্তু সে ছবি তো হারিয়ে গেল। তাহলে?

সঞ্জয়ের ইচ্ছে ছিল না। তবু চৌকির ওপর বসতে হল। আর একবার ঘরটা ভালো করে দেখল। দেওয়ালে তিনটে বড়ো বড়ো ছবি। বহু পুরনো। সম্ভবত শিবানন্দ ভট্টাচার্যের নিকট আত্মীয়দের। ফ্রেমের মধ্যে তিন জনেরই নাম আর জন্ম-মৃত্যুর সাল তারিখ লেখা আছে। কিন্তু অত উঁচুতে টাঙানো বলে পড়া গেল না।

ওদিকের দেওয়ালে ঝুলছে পুরনো কলকাতার একটা ম্যাপ। ডাঃ রুদ্র কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেলেন। দেখলেন ম্যাপটি ১৭৯৪ সালে A. Upjohn-এর করা। এতে ১৭৪২ সালের আদি কলকাতা আর ১৭৫৬ সালের বৃহত্তর কলকাতার নকশা করা রয়েছে। এতে উত্তরে বাগবাজারের খাল থেকে দক্ষিণে Govermapur (গোবিন্দপুর) পর্যন্ত এবং পুবে মারাঠা ডিচ থেকে পশ্চিমে গঙ্গা পর্যন্ত অঞ্চলকে কলকাতা বলে দেখানো হয়েছে।

ডাঃ রুদ্র কৌতূহলী হয়ে দেখলেন ম্যাপে মাত্র একটি রাস্তারই নাম রয়েছে– Avenue leading to the Eastward। রাস্তাটি পশ্চিমে বর্তমান চিৎপুর রোড থেকে আরম্ভ করে পুব দিকে মারাঠা ডিচ পর্যন্ত চলে গেছে। এইটেই নাকি বর্তমানে বৌবাজার স্ট্রীট!

অন্যদিকে একটি তালিকা। কলকাতায় তখনকার দিনে পাকা বাড়ির সংখ্যা। যেমন–১৭০৬ খ্রীঃ–৮টি, ১৭২৬ খ্রঃ–৪০টি, ১৭৪২ খ্রীঃ–১২১টি, ১৭৫৬ খ্রীঃ–৪৯৮টি।

কাকে চাইছেন?

ভেতর থেকে গেঞ্জি গায়ে এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। বছর পঞ্চাশ বয়েস। সৌম্যদর্শন। মাথার চুল ছোটো করে কাটা।

ডাক্তার রুদ্র নমস্কার করলেন।

–কিছু মনে করবেন না, সাড়া না পেয়ে ঢুকে পড়েছি।

ভদ্রলোক নরম সুরে বললেন, কোথা থেকে আসছেন?

কপিলেশ্বরবাবুর কাছ থেকে।

কপিলেশ্বরবাবু! ভদ্রলোক নামটা মনে করবার চেষ্টা করলেন।

ডাক্তার রুদ্র সঞ্জয়ের দিকে তাকালেন। সঞ্জয় তাড়াতাড়ি বলল, বাগুইহাটির কপিলেশ্বরবাবু।

-ও আচ্ছা! দাদামশাই! হ্যাঁ, বসুন। ঠাকুর্দার সঙ্গে দেখা করবেন বোধহয়?

–হুঁ, শিবানন্দ ভট্টাচার্যমশাই

ভদ্রলোক একটু কি ভাবলেন। তারপর বললেন–ঠাকুর্দার সঙ্গে কি দেখা করার একান্ত দরকার?

ডাক্তার রুদ্র বিনীতভাবে বললেন, একটা বিশেষ দরকারেই আসছি। একটা পুরনো বাড়ির ইতিহাস জানার জন্যে।

মনে হল ভদ্রলোক খুশি হলেন। বললেন, এ কথা শুনলে ঠাকুর্দা খুবই খুশি হবেন। উনি এখনো আমাদের ডেকে ডেকে পুরনো বাড়ির ইতিহাস শোনান। কিন্তু মুশকিল কি জানেন? ওঁর বয়েস একশো তিন। বেশি কথা বলা বারণ। তার পর একটুতেই চটে যান। হয়তো আপনাদের দুটো কথা শুনিয়ে দিতেও পারেন।

–তাতে আমাদের কিছু মনে হবে না। বয়োবৃদ্ধ মানুষ

–ঠিক আছে। একটু বসুন। ওঁকে খবর দিই। তারপর আপনাদের ওপরে নিয়ে যাব।

এই বলে ভদ্রলোক ভেতরে ঢুকছিলেন, ফিরে দাঁড়ালেন।

–আচ্ছা, কিরকম ইতিহাস জানতে চান? বাড়িটা কোন জায়গায়?

ডাক্তার রুদ্র বললেন, কালিন্দি-বরাটের কাছে। একটা পুরনো বাড়ি। Haunted house. বাড়িটার বিষয় উনি কিছু জানেন কিনা।

বুঝেছি। বলে ভদ্রলোক ভেতরে চলে গেলেন। একটু পরেই কাশির শব্দ পাওয়া গেল। মাঝে মাঝে কাশতে কাশতে কেউ নেমে আসছেন।

উনি বোধহয় নিজেই নেমে আসছেন। সঞ্জয় কান খাড়া করে রইল।

–বোধহয়। বলে ডাঃ রুদ্র উঠে দাঁড়ালেন।

মিনিট পাঁচ-সাতের মধ্যে আগের ভদ্রলোকটি একজন বৃদ্ধের হাত ধরে ঢুকলেন। পিছনে পিছনে এল একটি মেয়ে। বছর চোদ্দ বয়েস।

বৃদ্ধ এবার নিজেই চৌকির ওপর বসে তাকিয়াটা টেনে নিলেন। মেয়েটি দাঁড়িয়ে রইল ভদ্রলোকের পাশে।

বৃদ্ধের শরীর শীর্ণ। গাল ঢুকে গেছে। না-কামানো পাকা দাড়ি। কণ্ঠনালী ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। গায়ে ফতুয়া। তার ওপর একটা চাদর। ছোটো ছোটো চোখ দুটো এ বয়েসেও কী তীক্ষ্ণ! চোখের দিকে তাকালে মনে হয় বয়েসকালে ভদ্রলোক বোধহয় অনেক নিষ্ঠুর কাজ করেছেন।

বৃদ্ধ একবার কাশলেন। তারপর বিনা ভূমিকায় বললেন, কপিল পাঠিয়েছে?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

হঠাৎ?

বৃদ্ধ আবার কাশতে লাগলেন।

ডাঃ রুদ্র বললেন, তার আগে পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি ডাঃ সঞ্জয় গুপ্ত। ডাক্তারি করা ছাড়াও পুরনো বাড়ির ইতিহাস সংগ্রহের বাতিক আছে।

বাতিক! বৃদ্ধ যেন আঘাত পেলেন। রূঢ়স্বরে বললেন বাতিক বলছেন কেন? ইতিহাস সংগ্রহ করা কি বাতুলের কাজ?

বৃদ্ধের নাতি এই সময়ে ইশারায় ডাঃ রুদ্রকে কিছু মনে না করতে অনুরোধ করলেন। বৃদ্ধ তখন বলে চলেছেন–আজকালকার ছেলেদের এই এক দোষ–কোনো সৎকাজকেও গুরুত্ব দেয় না।

তা কটা বাড়ির ইতিহাস পেয়েছেন? খাতাপত্র করেছেন?

ডাঃ রুদ্র পাচে পড়লেন।

সঞ্জয় সসংকোচে বলল, না, সেরকম কিছু করা হয়নি।

–তাহলে আর কি হল? শুধু লোকমুখে গল্প শোনা? না মশাই, ওতে কোনো কাজ হবে না। এসব ছেলেখেলা নয়। চলুন ওপরে। দেখাব আমি কিভাবে কাজ করেছি।

বৃদ্ধের নাতি তাড়াতাড়ি বললেন, দাদু, এঁরা বিশেষ একটা বাড়ি সম্বন্ধে জানতে চান। বলে তিনি সঞ্জয় আর রুদ্রের দিকে তাকালেন।

ডাঃ রুদ্র বললেন, ইনি কালিন্দির কাছে একটা বাড়িতে ভাড়া এসেছেন

শিবানন্দ ভুরু তুলে বললেন, কে ভাড়া এসেছেন?

ডাঃ গুপ্ত। বলে রুদ্র সঞ্জয়কে দেখিয়ে দিলেন।

কতদিন?

বছরখানেক হল। এখন অবশ্য ছেড়ে দিয়েছি।

—কেন?

–সেই কথাই বলতে এসেছি।

কতদিন ছেড়েছেন?

মাস তিনেক হল।

কতদিন ও বাড়িতে ছিলেন?

মাস নয়েক।

–আচ্ছা, তারপর বলুন।

সঞ্জয় তখন কলকাতায় বাসা নেওয়া থেকে শেষদিন পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা বলে গেল।

বৃদ্ধের নাতি আর সম্ভবত নাতির মেয়েটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনল।

শিবানন্দ কিছুক্ষণ চোখ বুজিয়ে রইলেন। তারপর বললেন—কালিন্দি-বরাট?

–আজ্ঞে হ্যাঁ।

–গোলবাড়ি চেনেন?

সঞ্জয় মাথা নাড়ল।–আজ্ঞে না।

–সে কী! কালিন্দি-বরাটে থাকেন গোলবাড়ি চেনেন না? গম্বুজওয়ালা পুরনো একটা বাড়ি। যুদ্ধের সময়ে আমেরিকান সোলজাররা থাকত। এখন কী অবস্থায় আছে জানি না।

সঞ্জয় বলল, গম্বুজওয়ালা বাড়ি! ঐ বাড়িটার কথাই তো বলছি।

–তাই বলুন।

বৃদ্ধ একটু থেমে কাশির দমক সামলে বললেন, তখন মানে, আমাদের ছোটোবেলায় ঐ বাড়িটাকে গোলবাড়ি বলত। একসময়ে জমিদারবাড়ি ছিল। তারপর এক নীলকর সাহেব ওটা দখল করে। কিন্তু সেও ভোগ করতে পারেনি।

এই পর্যন্ত বলে শিবানন্দ একটু থামলেন। তারপর বললেন, তা শেষ পর্যন্ত বাড়িটা ছাড়তেই হল?

আজ্ঞে হ্যাঁ। প্রথমে ছাড়তে চাইনি। কিন্তু সবই তো শুনলেন, না ছেড়ে উপায় ছিল না।

বৃদ্ধ কী ভেবে বললেন, আমি যার কথা ভাবছি তার আত্মার তাহলে আজও সদগতি হয়নি। কিন্তু

কথা আটকে গেল। বৃদ্ধ কাশতে লাগলেন। কাশি থামতে বললেন, একটা কথাই ভাবছি। সে তো মরেছে তা পঞ্চাশ-ষাট বছর হল। এত বছরের মধ্যে নিশ্চয় অনেক ভাড়াটে এসেছে। তাদের ওপর কি অত্যাচার হয়নি? বলে সঞ্জয়ের দিকে তাঁর সেই অদ্ভুত দৃষ্টি মেলে তাকালেন।

–ঠিক বলতে পারব না।

–পারব না, বললে তো হয় না। খোঁজখবর নিয়ে আসতে হয়। বৃদ্ধ বিরক্ত হয়ে অন্যদিকে মুখ ফেরালেন।

ধমকানি শুনে কিশোরীটি ফিক্‌ করে হাসল।

বৃদ্ধ একটু ভেবে বললেন, বোধহয় আর কেউ ভুক্তভোগী নয়। কেননা বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া দুরাত্মারাও চট করে মানুষের পেছনে লাগে না। আত্মারও কষ্ট হয় জানবেন।

ডাঃ রুদ্র আর সঞ্জয় বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

–আমার কথাটা বুঝতে পারলেন কি?

–আজ্ঞে হ্যাঁ। ডাঃ রুদ্র বললেন।

না, কিছুই বোঝেননি।

কিশোরীটি মুখ ঢাকা দিয়ে হাসতে লাগল।

–আমি মনে করি, বিশেষ কোনো কারণে কোনো দুষ্ট আত্মা বিশেষ কোনো একজনের ওপর প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে। এখন দেখতে হবে কার আত্মা, উদ্দেশ্যটাই বা কি?

বৃদ্ধর আবার কাশি উঠল। তিনি বুক চেপে ধরে জোরে জোরে কাশলেন। তারপর বললেন, আচ্ছা, আপনি কি সপরিবারে ওবাড়িতে থাকতেন? বৃদ্ধ ডাঃ রুদ্রের দিকে তাকলেন।

–আমি না, ইনিই সপরিবারে থাকতেন।

বৃদ্ধ তাঁর সেই অদ্ভুত দৃষ্টিতে এবার সঞ্জয়ের দিকে তাকালেন।

–কি যেন আপনার নাম?

—-সঞ্জয় গুপ্ত।

–আপনিই তো ডাক্তার?

উনিও। বলে সঞ্জয় ডাঃ রুদ্রকে দেখিয়ে দিল।

–একসঙ্গে জোড়া ডাক্তার! বৃদ্ধ ঠোঁট ফাঁক করে বোধহয় একটু হাসবার চেষ্টা করলেন।

–আপনি তাহলে সপরিবারে থাকতেন?

–হুঁ।

–আপনি কোনোদিন কিছু দেখেছিলেন, বা অনুভব করেছিলেন?

না।

–যে কমাস ঐ বাড়িতে ছিলেন তার মধ্যে আপনার বাড়িতে আর কেউ রাত কাটিয়েছেন?

-হ্যাঁ।

কারা তারা? আপনার আত্মীয়?

–না, একজন আমার স্ত্রীর বান্ধবী আর একজন মহিলা মাদ্রাজ থেকে এসেছিলেন।

–তাঁদের অভিজ্ঞতা কি?

-আমার স্ত্রীর বান্ধবী কিছু দেখেননি বা অনুভব করেননি। তবে মিস থাম্পি করেছিলেন।

বৃদ্ধের দু চোখ কুঁচকে উঠল। বললেন–তিনি কী অনুভব করেছিলেন?

–তার মতে ওবাড়িতে কিছু আছেই।

–কিছু না দেখেই বললেন?

উনি একজন থিওজফিস্ট। সারাজীবন প্রেততত্ত্ব নিয়ে চর্চা করেছেন।

বৃদ্ধ শিবানন্দ চুপ করে কী ভাবতে লাগলেন। তারপর বললেন, এবার আমি নিশ্চিত যে ঐ বাড়িতে যে আত্মাটি আছে তার লক্ষ্য একমাত্র আপনার স্ত্রী।

সঞ্জয় বলল, লক্ষ্য যে আমার স্ত্রী তা আমরাও বুঝেছি। কিন্তু কেন? সত্যিই কি ও বাড়িতে কোনোদিন তেমন কোনো ঘটনা ঘটেছিল যাতে আমার স্ত্রী কোনো আত্মার প্রতিহিংসার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল?

শিবানন্দ ভট্টাচার্য একটু চুপ করে রইলেন। তারপর চোখ বুজিয়ে বললেন, হ্যাঁ, ঘটেছিল। আর সে ঘটনার সঙ্গে আমারও কিছু যোগ ছিল। কেননা আমিও তখন থাকতাম গোলবাড়ির কাছেই। হাঁ, তা প্রায় ষাট বছর আগের কথা। ঘটনাস্থল ঐ গোলবাড়ি। সেসময়ে কলকাতায় এক বিখ্যাত যাদুকর ছিল।

যাদুকর! সঞ্জয় চমকে উঠল।

–হা হা, যাদুকর। আপনারা ইংরিজিতে যাকে বলেন–ম্যাজিসিয়ান।

লোকটা কি কালো কোট, কালো প্যান্ট, কালো টুপি পরত?

শিবানন্দ ধমকে উঠে বললেন, আপনারা যদি কথার মধ্যে কথা বলেন তা হলে আমি আর একটি কথাও বলব না।

ডাক্তার রুদ্র হাত জোড় করে বললেন, ক্ষমা করুন। আমরা অধৈর্য হয়ে পড়েছিলাম, কেননা ঘটনার শুরুতেই এমন অদ্ভুত মিল–

–আরো মিলবে। ধৈর্য ধরুন। বলে বৃদ্ধ কাশতে লাগলেন।

একটু সামলে নিয়ে বললেন, ম্যাজিসিয়ান কালো কোট, কালো প্যান্ট ছাড়া তো ধুতি পাঞ্জাবি পরবে না। কাজেই ওটা নতুন কিছু নয়। পরনে কালো পোশাক, স্টেজের পিছনে কঙ্কাল আঁকা কালো পর্দা, টেবিলের ওপর কালো রুমাল ঢাকা মড়ার মাথা, হাতে কালো একটা লাঠি-ম্যাজিসিয়ান সারা কলকাতায় ম্যাজিক দেখিয়ে দুহাতে পয়সা লুঠত। তার বেশির ভাগ দর্শক ছিল সাহেব-মেম। অবিনাশ বক্সীর খেলা হচ্ছে শুনলে সাহেব-পাড়া থেকে জুড়িগাড়ি ছুটিয়ে ওরা দলে দলে আসত।

কথার মাঝখানে এবার বাধা দিলেন নাতি ভদ্রলোক। তিনি হেসে বললেন, দাদু, রাগ কোরো না। মাঝে একটা কথা বলে নিই। বলেই ডাঃ রুদ্রর দিকে তাকালেন।

দাদু একটা কথা কিন্তু বাদ দিয়ে যাচ্ছেন। সাহেবরা যেমন অবিনাশ বক্সীর খেলা দেখতে ছুটত তেমনি দাদুর কাছে আসত হাত দেখাতে। দাদু তখন ছিলেন গোটা কলকাতা শহরের মধ্যে নামকরা জ্যোতিষী। শুধু হাতই দেখতেন না–লোকের কপালের দিকে তাকিয়েই তার ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারতেন।

কিন্তু উনি তো শহরের পুরনো বাড়ির ইতিহাস সংগ্রহ করতেন বলেই জানি।

–হ্যাঁ, জ্যোতিষী ছিল তার জীবিকা আর ইতিহাস সংগ্রহ ছিল তার জীবন।

কি দাদু, তাই তো?

শিবানন্দ সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলেন, তাঁ। তাই বটে।

একটু থেমে বললেন, কি জানেন, আপনারা গোলবাড়ির কথা জানতে এসেছেন, তার মধ্যে আমার কথা বলা নিষ্প্রয়োজন।

নাতি বললেন, কী যে বল! তোমাকে বাদ দিয়ে কি গোলবাড়ির কথা শেষ হয়? বিশেষ করে অবিনাশ বক্সীর ঘটনা? সে ঘটনা তো এর আগেও তুমি আমাদের বলেছিলে।

শিবানন্দ উদাসীনের মতো চুপ করে বসে পায়ের চেটোয় হাত বোলাতে লাগলেন।

ডাক্তার রুদ্র মিনতি করে বললেন, সব ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার করে না বললে আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না।

নাতি ভদ্রলোক এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। এবার চৌকির ওপর এসে বসলেন। কিশোরীটি কিন্তু দাঁড়িয়েই রইল। সে মাঝে মাঝেই গোপনে তাকাচ্ছিল সঞ্জয়ের দিকে। চোখোঁচাখি হলেই চোখ নামিয়ে নিচ্ছিল।

ভদ্রলোক বললেন, দাদুই সব কথা শোনাবেন। আমি শুধু একদিনের কথা বলি। সেটা দাদুর নিজস্ব ব্যাপার বলে উনি হয়তো বলতে চাইবেন না।

এই বলে ভদ্রলোক একটু থামলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন।

–অবিনাশ বক্সী ছিলেন ম্যাজিসিয়ান। আর দাদু ছিলেন জ্যোতিষী। না, অবিনাশ বক্সীর আরও একটা পরিচয়, তিনি জমিদারপুত্র। বর্ধমান জেলার কোনো গ্রামে তাদের জমিদারি ছিল। অবিনাশ বক্সী অবশ্য বেশির ভাগ সময়ই থাকত তাদের পূর্বপুরুষদের এই গোলবাড়িতে। কলকাতা তখন ধনীদের ফুর্তির আখড়া। এই সময়ে নিজেরই পরিবারের একটি কুমারী মেয়েকে নষ্ট করায় অবিনাশের বাবা ওকে ত্যাজ্যপুত্র করেন। চন্দননগরে একজন ফরাসী ম্যাজিসিয়ান বক্সীর বন্ধু ছিল। তার কাছ থেকে ম্যাজিক দেখানো শিখে বক্সী নিজেই একটা দল খুলে ফেলল। ম্যাজিক দেখানোই হল তখন তার জীবিকা।

যদিও এক পাড়াতে বাস, তবু দাদুর সঙ্গে বক্সীর কোনো সম্পর্ক ছিল না। না থাকারই কথা। কেননা বক্সী করত পাবলিক শো। আর দাদু ঘরে বসে লোকের হাত দেখতেন, কুষ্ঠী বিচার করতেন। কিন্তু দুজনেই দুজনের খ্যাতির কথা জানতেন। দাদুর খ্যাতিটা অবিনাশ যে বিশেষ পছন্দ করত না, তা অবশ্য দাদুর অজানা ছিল না। একদিনের একটা সামান্য ঘটনায় অবিনাশের ঈর্ষা যেন ফেটে পড়ল।

একবার দাদুর কাছে এক মেমকে নিয়ে আসেন দাদুর এক অনুরাগী ব্যক্তি। মেমসাহেব এদেশের অ্যাসট্রোলজারদের নিয়ে একটা বই লিখছে। তাই দাদুর ছবি তুলল। দাদুর জীবনী নিতে চাইল। তার পর হঠাৎ দাদুর সামনে হাত মেলে ধরে বলল, দেখুন তো আমার কস্তুগাল লাইফ কেমন যাবে?

নিতান্তই হালকা প্রশ্ন। দাদু কিন্তু সিরিয়াসলি মেমের হাতটা তুলে নিয়ে দেখতে লাগলেন। মিনিট তিনেক পরেই হাতটা ছেড়ে দিলেন।

–কি দেখলেন? মেম হেসে জিজ্ঞেস করল।

দাদু বললেন, বিয়ের পর তোমাদের দাম্পত্য জীবন ভালোই হবে।

মেমসাহেব কিছু বলার আগেই অনুগত ভদ্রলোকটি যেন আকাশ থেকে পড়লেন।

–বলছেন কী ভট্টাচার্যমশায়! উনি বিবাহিতা বলেই তো দাম্পত্য জীবনের কথা জানতে চাইছেন।

দাদু হেসে মাথা নাড়লেন। বললেন, না, ওঁর কররেখায় এখনো বিবাহযোগ ফোটেনি। কাজেই বিয়ে হতে পারে না। হবে কিছুদিন পরে।

মেমসাহেব কোনো কথা না বলে লজ্জিত মুখে গাড়িতে গিয়ে উঠল।

মেম চলে গেলে অনুগত লোকটি বলল, কিন্তু উনি যে স্বামী-স্ত্রীর মতো একসঙ্গে থাকেন।

দাদু বললেন, স্বামী-স্ত্রীর মতো থাকলেই কি স্বামী-স্ত্রী হয়? বিবাহ অন্য জিনিস।

–তবে ওঁরা বিয়ে করেননি কেন?

দাদু বললেন, তার উত্তর আমি কী দেব? নিশ্চয় কোনো বাধা আছে। আর সে বাধা কাটিয়ে উঠতে আরো কিছু সময় লাগবে।

আড়াই মাস পরে সেই মেমসাহেব একজন সাহেবকে নিয়ে হাসতে হাসতে এসে হাজির। সঙ্গে এক বাক্স কেক। কি দাদু, তাই তো? আমি বাবার কাছ থেকে যা শুনেছি তাই বললাম।

বৃদ্ধ একটু হেসে মাথা দোলালেন।

তারপর এই মেমসাহেবের দৌলতে সাহেব-পাড়ায় দাদুর নাম ছড়িয়ে পড়ল। তারা দলে দলে দাদুর কাছে হাত দেখাতে আসতে লাগল।

অবিনাশ ভেবেছিল সেইই একমাত্র বাঙালি যে সাহেবদের কাছে খুব পপুলার। এখন চোখের সামনে দাদুর প্রতিপত্তি দেখে হিংসেয় জ্বলতে লাগল।

একদিন এক সাহেব অবিনাশ বক্সীর বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নামল। অবিনাশ ভাবল, বোধহয় ম্যাজিক দেখাবার বায়না করতে এল। সাহেবকে খুব খাতির করে অভ্যর্থনা করল। কিন্তু সাহেব তাকে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে দাদুর বাড়ি কোন দিকে জানতে চাইল।

এতেই অবিনাশ একেবারে খাপ্পা হয়ে গেল। বলল, সাহেব, আমি বুঝতে পারি না তোমরা কি করে ওর বুজরুকিতে ভুলে যাও।

সাহেব হেসে বলল, বক্সী, তোমারও যে এত খ্যাতি শুনতে পাই সেটাও কি তোমার বুজরুকির জন্যে নয়?

অবিনাশ তার কী উত্তর দিয়েছিল জানা নেই। কিন্তু তারপর থেকেই দাদুকে পাড়া-ছাড়া করার জন্যে উঠে-পড়ে লাগল। কিন্তু দাদুও খুব নির্জীব মানুষ ছিলেন না। নিজের জেদে জাঁকিয়ে প্র্যাকটিস করতে লাগলেন। কি দাদু, তাই না?

শিবানন্দ সগর্বে মাথা দোলালেন।

কারো ক্ষতি না করে, এমনকি কারও সাতে-পাঁচে না থেকেও কেমন করে যে নির্বিবাদ মানুষও শত্রু হয়ে পড়ে আমার জীবনে সেই প্রথম অভিজ্ঞতা। বলে শিবানন্দ কাশতে লাগলো।

–এইবার বক্সীকে জব্দ করার জন্যে দাদুও উঠে পড়ে লাগলেন।

বাধা দিয়ে শিবানন্দ বললেন, না, জব্দ করার জন্যে নয়। আসল কথা হচ্ছে,আপনারাও জেনে রাখুন, কেউ শত্রু হয়েছে বুঝতে পারলেই লোকটাকে পুরোপুরি জানবার চেষ্টা করা উচিত। অর্থাৎ লোকটার অর্থবল, লোকবল কি রকম, বে-আইনি কোনো কাজ করে কিনা, তার কোনো দুর্বল দিক আছে কিনা, সর্বোপরি তারও কোনো শত্রু আছে কিনা। কেননা শত্রুর শত্রু মানেই বিরুদ্ধপক্ষের মিত্র। মোটামুটি এই ব্যাপারগুলো জেনে নিতেই হয়।

শিবানন্দ একটু থামলেন। তারপর বলতে লাগলেন, যখন দেখলাম বক্সী আমায় সুনজরে দেখছে না তখনই বুঝলাম ও শত্রুতা করবে। তার পরিণতি কী হবে তাও ভেবে নিলাম। পুলিশকে ঘুষ দিয়ে বা গুণ্ডা লাগিয়ে ও আমার ক্ষতি করতে পারে। তাই তার কোথায় উইকপয়েন্ট আছে গোপনে আমি সন্ধান করতে লাগলাম। আর এইভাবে খোঁজ করতে করতেই

শিবানন্দ কথা শেষ করতে পারলেন না। দমকা কাশিতে স্বর আটকে গেল।

ওঁর নাতি তখন দাদুর কথার জের ধরে বলতে লাগলেন, খোঁজ করতে করতে দাদু জানতে পারলেন ওর টুপে যে সুন্দরী যুবতী মেয়েরা কাজ করে তারা শুধু চাকরিই করে না, বক্সীর সঙ্গে তাদের অন্য সম্পর্কও আছে।

এই সময়ে কিশোরী মেয়েটি হঠাৎ ভেতরে চলে গেল।

–দাদু ভালো করে খোঁজ খবর নিয়ে জানলেন, এই মেয়েরা একসময়ে সকলেই দূর দূর গ্রামের দরিদ্র ভদ্রঘরের ছিল। বক্সী তাদের চাকরির নাম করে নিয়ে এসে তাদের এমন অবস্থা করে দিয়েছে যে তারা আর ফিরে যেতে পারে না।

না না, সব ক্ষেত্রে চাকরির নাম করেও নয়, জোর করে, বলপ্রয়োগ করে ধরে আনত, যেমন সুনয়নীর কেস। বাধা দিয়ে এইটুকু বলেই শিবানন্দ হাঁপাতে লাগলেন।

ওঁর কষ্ট দেখে ডাঃ রুদ্র বললেন, আজ না হয় থাক। আর একদিন–

না না, আর একদিন নয়। আজই শুনে যান। সুনয়নীর কথা আপনাদের জানা দরকার। এই বলে শিবানন্দ নাতির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ায় মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লেন।

এরপর শিবানন্দ ভট্টাচার্যর নাতি যা বললেন তা এইরকম—

নাম, যশ, অর্থ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইদানীং নতুন মেয়ে সংগ্রহের পদ্ধতিটা বক্সী বদলেছিল। এখন আর মিথ্যে কথা বলে বা ধাপ্পা দিয়ে মেয়ে যোগাড় করত না। যখনই গ্রামেগঞ্জে খেলা দেখাতে যেত তখনই নিরীহ, গ্রাম্য কোনো সুন্দরী তার ফাঁদে পড়তই। আর ফাঁদটা অবিনাশ পাতত শেষ খেলার দিন।

শিবানন্দ যেদিন থেকে এই খবরটা জানতে পারলেন সেদিন থেকেই অবিনাশ যখনই বাইরে টুপ নিয়ে যেত তখনই তাকে লুকিয়ে অনুসরণ করতেন হাতে-নাতে ধরার জন্যে। কিন্তু ধরতে পারেননি।

সেবার কলকাতা থেকে প্রায় পঁয়ত্রিশ মাইল দূরে ত্রিবেণীতে খেলা দেখাতে গিয়েছে। সরস্বতী নদীর ধারে অবিনাশের তাঁবু পড়েছে। শিবানন্দও তাকে অনুসরণ করে ত্রিবেণীতে হাজির।

সকাল থেকে ঘোড়ার গাড়িতে বসে ড্রাম বাজাতে বাজাতে ম্যাজিক-পার্টির লোকেরা শহর থেকে গ্রামে হ্যান্ডবিল বিলি করতে লাগল। মুখে টিনের চোঙা লাগিয়ে চেঁচাতে লাগল–আসুন দেখুন যাদুকর অবিনাশ বক্সীর অসাধারণ খেলা! কাচ ভক্ষণ! ছাগলের কাটা মুণ্ডুর ডাক! মুখের মধ্যে জ্বলন্ত আগুন! এর সঙ্গে আছে কঙ্কালের অট্টহাসি! লাস্যময়ী তরুণীদের নৃত্য! কুমারী বালিকার দ্বিখণ্ডিত লাশ! ইত্যাদি।

যথাসময়ে দলে দলে লোকে ম্যাজিক দেখতে এল। মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। প্রচুর টাকার টিকিট বিক্রি হল। কিন্তু

অবিনাশ বক্সী শুধু টাকা পেয়েই খুশি নয়। তার শরীরে যে উচ্ছঙ্খল জমিদার বংশের রক্ত! নিত্য নতুন মেয়ে চাই তার! একবার কোনোরকমে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে গোলবাড়িতে তুলতে পারলেই হল।

সুযোগের জন্যে প্রতিবারের মতো এবারও বক্সীকে অপেক্ষা করতে হল খেলার শেষ দিনের শেষ শো পর্যন্ত।

আজ থেকে প্রায় যাট বছর আগের কথা। গ্রামাঞ্চলে সেসময়ে রাত নটা মানে অনেক রাত। শেষ খেলাটি দেখালেন বিখ্যাত যাদুকর অবিনাশ বক্সী। হাততালিতে তবু কেঁপে উঠল। অবিনাশ বক্সীকে লাগছিল সাহেবের মতো। পরনে কালো কোট-প্যান্ট, মাথায় ফেল্টের টুপি। খেলার শেষে তিনি হাত জোড় করে বিদায় চাইলেন।

আবার তুমুল হাততালি।

এবার তাঁবু থেকে বেরোবার পালা। দলে দলে পুরুষরা বেরোচ্ছে পুরুষদের গেট দিয়ে। মেয়েরা বেরাচ্ছে অন্য পথ দিয়ে। হঠাৎ স্টেজের মধ্যে ভৌতিক চিৎকার! আসলে এও একটা খেলা। কিন্তু লোকে তা বুঝতে পারল না। তারা ভয় পেয়ে দৌড়ে পালাতে লাগল। আর ঠিক তখনই মেয়েদের দিকের ডে-লাইটটা কে যেন সরিয়ে নিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার। মেয়েরা চিৎকার করে উঠল–আলো–আললা–

কিন্তু কে কার কথা শোনে! মেয়েরা পড়িমরি করে তাঁবুর বাইরে এসে পড়ল। তখন সেখানে ভিড়ে ভিড়। যে যেদিকে পারছে ছুটছে।

মেয়েদের মধ্যে যারা গ্রাম থেকে এসেছিল তারা ত্রিবেণীর পথঘাট কিছুই চেনে না। বাড়ির পুরুষদেরও অন্ধকারে খুঁজে পাচ্ছে না। দিশেহারা হয়ে এক রাস্তা থেকে অন্য রাস্তায় ছুটোছুটি করতে লাগল। মাঝে মাঝে বাড়ির লোকেরা মেয়েদের নাম ধরে ডাকছে। চেঁচামেচির মধ্যেও যে কোননারকমে শুনতে পাচ্ছে সে সাড়াও দিচ্ছে, কিন্তু তাদের মিহি গলা পুরুষদের কানে পৌঁছচ্ছে না।

এমনি সময়ে টর্চের জোরালো আলো এসে পড়ল মেয়েদের মুখে। কে টর্চ ফেলে কাকে খুঁজছে বোঝা গেল না। শুধু টর্চের আলো এক মুখ থেকে অন্য মুখে সরে সরে যেতে লাগল। যেন কেউ টর্চের আলো ফেলে বিশেষ কাউকে খুঁজছে। শেষে একটি মেয়ের মুখের ওপর আলোটা এসে থেমে গেল।

–এদিকে এসো। তোমার বাড়ির লোকেরা তাঁবুতে তোমার জন্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

সরল বিশ্বাসে তরুণী নববধূটি এগোল। সঙ্গে সঙ্গে টর্চের আলোও নিভে গেল।

তারপর?

তারপর আর কেউ কিছু জানতে পারল না। শুধু একটা মোটরের গর্জন। মুহূর্তে হেডলাইটের আলোয় দুপাশের অন্ধকার ফঁক করে গাড়ি ছুটল ত্রিবেণী থেকে কলকাতার দিকে।

শিবানন্দ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সবই দেখলেন। পরের দিন সকালে তাঁবু গুটিয়ে অবিনাশ বক্সীর ম্যাজিক পাটি কলকাতায় ফিরে গেল। এদিকে মহা হৈহৈ কাণ্ড। সকলেই শুনলেন ম্যাজিক দেখতে এসে একটি অল্পবয়সী বৌ হারিয়ে গেছে। কেউ কেউ মন্তব্য করলেন, হারাবে আর কোথায় সুযোগ পেয়ে নাগর জুটিয়ে পালিয়েছে। মেয়েটির স্বামী দুদিন খোঁজাখুঁজি করল। তারপর হতাশ হয়ে গ্রামে ফিরে গেল।

এই পর্যন্ত বলে ভদ্রলোক একটু থামলেন। তারপর আবার বলতে লাগলেন–দাদু সন্ধান করে করে শেষে মগরায় গেলেন। তারপর যে বাড়ির বৌ হারিয়েছিল খোঁজ করে সেই বাড়িতে গিয়ে গৃহকর্তার সঙ্গে দেখা করলেন। কিন্তু দাদু আশ্চর্য হলেন যখন দেখলেন গৃহকর্তা অর্থাৎ মেয়েটির শ্বশুরমশাইটি একেবারে নির্বিকার।

–পুত্রবধূ সম্বন্ধে আপনি কি ভাবছেন? দাদু জিজ্ঞেস করলেন।

–কি আর ভাবব? তার যদি মতিভ্রম হয়ে থাকে তো কে কি করবে?

দাদু বললেন, মতিভ্রম বলছেন কেন? তাকে তো দুবৃত্তে ধরে নিয়ে গেছে।

শ্বশুরমশাই কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তাহলেই বা কি করতে পারি? তাকে কি আর খুঁজে পাব?

–হু, পাবেন। আমি জানি তাকে কে অপহরণ করে কোথায় নিয়ে গেছে।

এ কথা শুনেও গৃহকর্তা কিছুমাত্র উৎসাহ দেখালেন না। চুপ করে রইলেন।

দাদু বললেন, আপনি আমার সঙ্গে চলুন। থানায় ডায়েরি করবেন। আমি নিজে চোখে যা দেখেছি থানায় তা বলব।

গৃহকর্তা অবাক হয়ে দাদুর দিকে তাকিয়ে রইলেন।

–হ্যাঁ, আমি সত্যি কথাই বলছি। এই দেখুন আমি ব্রাহ্মণ। এই পৈতে ছুঁয়ে বলছি–আপনি আমার সঙ্গে থাকুন আমি আপনার পুত্রবধূকে উদ্ধার করে শয়তানটাকে জেলে পুরব।

গৃহকর্তা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, না মশাই, থানা-পুলিশ আমি করতে পারব না।

দাদু রেগে উঠে বললেন, কেন মিছিমিছি ভয় পাচ্ছেন? আমি তো রয়েছি। তাছাড়া আপনার একটি পয়সাও খরচ হবে না। সব দায়িত্ব আমার।

এবার গৃহকর্তা বিরক্ত হয়ে বললেন, আপনি তো অনেক উপদেশ বর্ষণ করলেন। কিন্তু আমি স্পষ্ট কথাই বলছি, তাকে আর ঘরে তোলা সম্ভব হবে না।

দাদু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, তাহলে আমার আর বলার কিছু নেই। নিরপরাধ একটা মেয়েকে আপনি পাপের পথেই ঠেলে দিচ্ছেন। দেখবেন ধর্মে সইবে না। বলে দাদু তখনই বেরিয়ে এলেন।

মাত্র কিছুদূর গিয়েছেন, পিছন থেকে কে ডাকলঠাকুরমশাই!

দাদু ফিরে তাকালেন। দেখলেন একটি যুবক হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে। যুবকটিকে দাদু গৃহকর্তার ঘরেই দেখেছিলেন। গৃহকর্তার সঙ্গে দাদু যখন কথা বলছিলেন, যুবকটি তখন একপাশে দাঁড়িয়ে শুধু শুনছিল।

আপনি? দাদু জিগ্যেস করলেন।

যুবকটি হাত জোড় করে বললেন, আজ্ঞে যে নিখোঁজ হয়েছে সে আমারই স্ত্রী। আমি সব শুনলাম। আপনি যদি ওকে উদ্ধার করে দিতে পারেন তাহলে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব।

দাদু কাছে এগিয়ে এসে যুবকের কাঁধে হাত রেখে বললেন, আমি সন্ধান জানি মাত্র। যে দুবৃত্ত আপনার স্ত্রীকে ভুলিয়ে নিয়ে গেছে তাকেও আমি চিনি। সে ঐ ম্যাজিসিয়ান। থাকে কলকাতায় আমার বাড়ির কাছে। কিন্তু আপনার স্ত্রীকে উদ্ধার করতে হলে থানার সাহায্য চাই। আর তার জন্যে আপনাকে গিয়ে ডায়েরি করতে হবে।

যুবকটি মাথা নিচু করে কী চিন্তা করতে লাগল।

দাদু ক্ষোভের হাসি হেসে বললেন, বুঝেছি, আপনার বাবার মতের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস আপনার নেই। তাছাড়া উদ্ধার করেই বা কি হবে? তাকে তো আর ঘরে তুলতে পারবেন না।

এবার যুবকটি নিচু গলায় বলল, দেখুন, থানা-পুলিশ করতে পারব না। কিন্তু সুনয়নীকে পেলে আমি তাকে গ্রহণ করবই।

দাদু আবার একটু হাসলেন। বললেন, কি করে?

দরকার হলে বাড়ি থেকে আমি আলাদা হয়ে যাব। দাদু খুশি হয়ে যুবকের পিঠ চাপড়ে বললেন, ঠিক আছে। আমি একাই চেষ্টা করে দেখি। তবে মনে রাখবেন তাকে উদ্ধার করতে পারলে আপনি কিন্তু ত্যাগ করতে পারবেন না। কথা দিয়েছেন। দরকার হলে কলকাতায় এসে আমার বাড়িতে থাকবেন।

যুবকটি অঙ্গীকার করে কৃতজ্ঞচিত্তে বাড়ি ফিরে যাচ্ছিল, দাদু ফের ডাকলেন। বললেন, বৌমার কোনো ছবি আছে?

যুবকটি একটু ভেবে বলল, বোধহয় আছে।

–তাহলে আমি এখানে দাঁড়াচ্ছি। আপনি নিয়ে আসুন। থানায় ছবি দেখাতে হবে।

দাদু দাঁড়িয়ে রইলেন। একটু পরে যুবকটি একটা ছবি কাগজে মুড়ে দাদুকে এনে দিল।

নাতি ভদ্রলোক একটু থামলেন।

ডাক্তার রুদ্র ব্যস্ত আগ্রহে বললেন, তারপর?

দাদু এবার তুমি বলবে?

না, তুমিই বেশ বলছ। বলে যাও ভুল হলে শুধরে দেব।

–তারপর দাদু একাই ত্রিবেণী থানায় গেলেন। থানা অফিসারকে সব কথা। বললেন। থানা অফিসার সব শুনলেন। তারপর বললেন, ঘটনাটা আমার থানায় ঘটলেও সেই ম্যাজিসিয়ানের বাড়ি সার্চ করতে পারে একমাত্র কলকাতার পুলিশ। আপনি ওখানকার থানায় জানান। আমিও তাদের রিকোয়েস্ট করছি।

দাদু ভেবে দেখলেন কথাটা ঠিক। তিনি কলকাতায় ফিরে এসে নিজেই থানায় সব জানালেন।

কিন্তু তার ফল যে উল্টো হবে দাদু তা ভাবতে পারেননি।

ঠিক দুদিন পর।

সকালে দাদু একটা বই পড়ছিলেন। এমনি সময়ে বাড়ির সামনে একটা হুড-খোলা গাড়ি এসে দাঁড়ালো।

নিশ্চয় কোনো সাহেবসুবো এসেছে ভেবে তাড়াতাড়ি গায়ে ফতুয়াটা চড়িয়ে নিলেন। ঠিক তখনই দাদুকে হতচকিত করে সদর্পে ঘরে ঢুকল অবিনাশ বক্সী। পকেট থেকে পিস্তল বের করে বলল, তুমি তো অন্যের ভাগ্যগণনা কর–বলো তো আজ তোমার ভাগ্যে কি ঘটতে যাচ্ছে?

দাদু কোনো উত্তর দিলেন না। একটু হাসলেন।

–হাসছ? শেষ হাসি হেসে নাও। তারপরেই আমার শত্রুতা করার চরম ফল ভোগ করবে। বলে পিস্তলটা উঁচু করে ধরল।

দাদু তখনও অবিনাশের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন।

–তোমার এত বড়ো স্পর্ধা তুমি থানায় জানিয়ে এসেছ ত্রিবেণী থেকে আমি একটি মেয়েকে ধরে নিয়ে এসেছি! তাঁ, এনেছি। সে এখন আমার ঘরে। পুলিশের বাবার সাধ্য নেই তাকে উদ্ধার করে। তারা আমার কেনা। শুধু কেনাই নয়, থানায় যে অফিসারটিকে তুমি জানিয়েছ, সুনয়নীকে প্রথম সেই ভোগ করবে। কিন্তু তুমি যখন জেনেছ তখন তোমার মুখ বন্ধ করতেই হয়। বলতে বলতে দরজার কাছ থেকে দাদুর দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।

ঠিক সেই সময়ে একটা গাড়ি এসে বাড়ির সামনে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে নামল একজন সাহেব আর মেম। অবিনাশ চট করে পিস্তলটা লুকিয়ে ফেলল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল–সাত দিন সময় দিলাম। এর মধ্যে কলকাতা ছেড়ে চলে যাবে। সাত দিন পর আবার আসব। সেদিনও যদি দেখি তুমি রয়েছ তাহলে

কথা শেষ না করেই অবিনাশ গাড়িতে গিয়ে উঠল।

দাদু এগিয়ে গেলেন দরজা পর্যন্ত। হেসে বললেন, বক্সী সাহেব, সাত দিন কেন আরও অনেক দিন পর্যন্ত এখানেই আমি থাকব। কিন্তু সাত দিন পর তুমি আর থাকবে না। চরম মুহূর্তে চেষ্টা কোরো আমার ভবিষ্যদ্বাণী স্মরণ করতে।

বক্সী হা হা করে হেসে উঠল। বলল, আচ্ছা দেখা যাবে কে থাকে। বলেই গাড়িতে স্টার্ট দিল।

শিবানন্দ ভট্টাচার্যের নাতি এই পর্যন্ত বলে থামলেন।

-তারপর? সঞ্জয় জিজ্ঞেস করল।

ভদ্রলোক এবার যেন চাইলেন বাকি ঘটনাটা দাদু বলেন। তিনি শিবানন্দর দিকে তাকালেন।

শিবানন্দ তাকিয়ায় হেলান দিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন। এবার দুই কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে দেহটাকে কোনোরকমে ঠেলে তুললেন।

এবার আমিই বলব। যে উদ্দেশ্যে আপনারা এসেছেন এবার তা জানতে পারবেন।

শিবানন্দ কয়েকবার কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিলেন। তারপর ভাঙা ভাঙা গলায় বলতে লাগলেন–

–মগরার এই মেয়েটির নাম সুনয়নী তা আপনারা জেনেছেন। সেই সুনয়নী একরাত্রি আমার পরিবারের সঙ্গে ছিল। আমি তাকে আশ্রয় দিয়েছিলাম। ত্রিবেণী থেকে তুলে আনার পর থেকে যা যা ঘটেছিল তা ও আমায় বলেছিল। সেই ঘটনাটা বলি।

.

০৩.

সুনয়নী-উপাখ্যান

গভীর রাত্রে সুনয়নীর মুখ কাপড় দিয়ে বেঁধে অবিনাশ আর তার এক সঙ্গী তাকে মোটর থেকে নামিয়ে বিরাট কম্পাউন্ডওয়ালা বাড়ির দোতলার একটা ঘরে আটকে রাখল।

সুনয়নী পড়ে পড়ে গোঙাতে লাগল। কিন্তু কথা বলতে পারল না। মুখ বাঁধা।

সুনয়নী দেখল ঘরটা বেশ বড়ড়া। কিন্তু অন্ধকার। ঘণ্টাখানেক পরে রাত তখন ঠিক কত জানে না, মনে হল কেউ একজন দরজার বাইরে এসে দাঁড়াল। তারপর ঝনাৎ করে শেকল খুলে ঘরের ভেতর এসে ঢুকল।

কালো কোট-প্যান্ট-পরা সেই ম্যাজিসিয়ান। হাতে তার খাবার।

ম্যাজিসিয়ান থালা বাটি একটা টেবিলের ওপর রেখে সুনয়নীর মুখের বাঁধন খুলে দিল। সুনয়নী তার দুপা জড়িয়ে ধরল।

ম্যাজিসিয়ান পা দিয়েই তাকে ঠেলে দিয়ে বলল, খাবার রইল। কুঁজোয় জল আছে। না খেলে লাভ নেই। কেননা তোমাকে এখন নতুন করে বেঁচে থাকতে হবে। কাল রাত্তিরে আবার দেখা হবে।

বলেই ঘরের বাইরে বেরিয়ে গিয়ে দরজার শেকল তুলে দিল।

পরের দিন সকাল, দুপুর, বিকেল কেটে গেল। ম্যাজিসিয়ান আর আসেনি। ঝি আবার খাবার দিয়ে গেল।

–ও মা! সব খাবারই যে পড়ে আছে। কিছুই তো খাওনি। না খেয়ে লাভ নেই বাছা। এসে যখন পড়েছ–

বলে আর এক থালা রেখে দিয়ে গেল।

অনেক রাত্তিরে বাড়ির সামনে মোটর গাড়ির শব্দ। একটা গাড়ি যেন কম্পাউন্ডের মধ্যে ঢুকল। তারপর গাড়ির দরজা খোলার আর বন্ধ করার শব্দ।

সুনয়নী ভাবল–নিশ্চয় পুলিশ এসেছে তাকে উদ্ধার করতে। এই মনে করে রুদ্ধ নিশ্বাসে অপেক্ষা করতে লাগল।

একটু পরেই দরজার শেকল খোলার শব্দ। সুনয়নী চমকে উঠল। দেখল দরজা খুলে ঢুকছে অবিনাশ বক্সী। সঙ্গে পুলিশের পোশাক-পরা একজন ফিরিঙ্গি সাহেব।

–উঠে এসো। অবিনাশ বক্সী কঠিন স্বরে যেন আদেশ করল।

–উঠে এসো বলছি।

–না। বলে চিৎকার করে সুনয়নী ভয়-বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল।

তখন অবিনাশ বক্সী এগিয়ে গিয়ে ওর হাত ধরে টানতে গেল। কাছেই ছিল টেবিলটা। সুনয়নী প্রাণপণে টেবিলের পায়া আঁকড়ে ধরে রইল। তার দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। –আমায় দয়া করে ছেড়ে দিন। এই আমি আপনাদের পায়ে পড়ছি।

অবিনাশ বক্সী লাথি মেরে বলল, হ্যাঁ, ছাড়ছি। নিচে চল।

সুনয়নী হাত জোড় করে বলল, দোহাই আপনাদের। আমি বিবাহিতা। আমার স্বামী আছেন। তিনি এখনও পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছেন।

অবিনাশ বলল, তোমার স্বামী তোমাকে নিশ্চয় ফিরে পাবে। তবে সাত দিন পর।

এই সময়ে ফিরিঙ্গি পুলিশ অফিসার বললেন, আজ না হয় থাক মিঃ বক্সী। আগে ও পোষ মানুক।

-না না, এ-সব মেয়ে কোনোদিনই পোয মানবে না। আজই—

বলে সুনয়নীকে জোর করে টেনে তুলতেই সুনয়নী মরিয়া হয়ে আচমকা অবিনাশকে একটা ধাক্কা মারল। অবিনাশ হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল। আর সেই ফাঁকে সুনয়নী খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে খাড়া সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল।

অবিনাশ তখনই উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল–সাবধান!

সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে পিস্তল বের করে ফায়ার করল।

উঃ মাগো! বলে সুনয়নী সিঁড়িতে লুটিয়ে পড়ল।

ঠিক তখনই তিনতলা থেকে একটি স্ত্রীলোক ছুটে নেমে এল।

–এ কী করলে! মেয়েটাকে মেরে ফেললে!

সামনে যে একজন ফিরিঙ্গি পুলিশ অফিসার রয়েছে স্ত্রীলোকটি তা গ্রাহ্যও করল না।

–না, মারিনি। ভয় দেখিয়েছি শুধু। এমন জিনিস কি মেরে ফেলা যায়? কিন্তু ঘর থেকে তুমি বেরিয়ে এলে যে? তোমায় না বারণ করেছিলাম, আমি না ডাকলে তুমি বেরোবে না।

স্ত্রীলোকটি চেঁচিয়ে উঠে বলল, হ্যাঁ জানি। শুধু সাহেব-মেমদের সামনে তোমার স্ত্রী হয়ে দেখা দেওয়া ছাড়া আমার বের হওয়া তুমি চাও না। কিন্তু কিন্তু কি করব? অসহায় এক-একটি মেয়েকে ধরে এনে তুমি তাদের সর্বনাশ করবে এ আর আমি কতদিন সহ্য করব?

–আঃ পদ্মা! চলে যাও বলছি।

যাচ্ছি। তার আগে দেখব মেয়েটি বেঁচে আছে কিনা। যদি মরে গিয়ে থাকে তাহলে আমিই তোমায় পুলিশে দেব। আর তুমিই বা কিরকম পুলিশ-সাহেব, চোখের সামনে নিরীহ মেয়েটাকে গুলি করল তবু হাঁ করে দেখছ?

ফিরিঙ্গি পুলিশ অফিসার তাড়াতাড়ি সুনয়নীর কাছে এগিয়ে গেল। দেখল গুলি লাগেনি।

কোনো কথা না বলে ফিরিঙ্গি অফিসার মাথা নিচু করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। অবিনাশ ছুটে গেল। হাত জোড় করে বলল–স্যার, আপনি চলে যাচ্ছেন?

–হ্যাঁ, আজ থাক। পরে একদিন

বলতে বলতে ফিরিঙ্গি পুলিশ গাড়িতে গিয়ে উঠল।

সেদিনের মতো সুনয়নী বেঁচে গেল।

.

পরের দিন।

গভীর রাত্রি। অন্ধকার ঘরে দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে নিজের ভাগ্যের কথা সুনয়নী ভাবছিল। একদিন ভাগ্যক্রমে রক্ষা পেয়েছে। আজ না জানি কি হয়!

তার মনে পড়ছিল বাড়ির কথা। না জানি তার স্বামী কি করছে? কোথায় খুঁজে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আর বুড়ো শ্বশুর? সুনয়নী নইলে যাঁর একবেলা চলত না? না জানি কেঁদে কেঁদে বোধহয় অন্ধ হয়েই গেলেন!

চিন্তায় বাধা পড়ল। দরজায় ঠুকঠুক শব্দ। সুনয়নী চমকে উঠল। নিজের অজ্ঞাতসারেই আর্তনাদ করে উঠল–না না না

নিচু গলায় বাইরে থেকে কে যেন বলল, সুনয়নী, ভয় নেই। দরজা খোলো।

ভয় নেই! তবু ভয়ে ভয়েই সুনয়নী দরজা খুলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে একটা ছায়ার মতো ঘরে এসে ঢুকল অবিনাশের স্ত্রী।

–আপনি!

পদ্মা ঠোঁটের ওপর আঙুল চেপে ইশারায় বলল, চুপ! শীগগির পালাও।

সুনয়নী যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারল না। অস্ফুটস্বরে বলল, পালাব!

–হ্যাঁ, হ্যাঁ, পালাবে। পালাবে না তো কি মরবে? ছেলেমানুষ তুমি। তোমায় আমি নষ্ট হতে দেব না।

সুনয়নী হাত জোড় করে বলল, কি করে যাব?

পদ্মা গলার স্বর যতটা সম্ভব নিচু করে বলল, সিঁড়ির দরজা খুলে রেখেছি। একটু সাহস করে বেরিয়ে পড়ো।

–কিন্তু তারপর? এই রাতে যাব কোথায়?

পদ্ম বিরক্ত হয়ে বলল, যমের বাড়ি। তোমার কি এখান থেকে যেতে ইচ্ছে নেই?

সুনয়নী কান্না-জড়ানো স্বরে বলল, আমি এখুনি যাচ্ছি। পথ-ঘাট চিনি না। তাই

বলেই সুনয়নী ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, পদ্মা হাত চেপে ধরল।

দাঁড়াও। পাগলের মতো যেও না। যা বলি মন দিয়ে শোনো। এইটে রাখো। বলে কাপড়ের ভেতর থেকে একটা পিস্তল বের করে সুনয়নীর হাতে দিল।

–এটা কি? আঁৎকে উঠল সুনয়নী।

–গুলিভরা পিস্তল। এইটে টেনে দিলেই গুলি ছুটে যাবে। অনেক কষ্টে সরিয়ে রেখেছি। এটা আমার জন্যেই সরিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি তোমার দরকার বেশি।

–কিন্তু

–না, কিন্তুটিন্তু নয়। ধরো এইভাবে। শক্ত করে ধরো। যদি ও টের পায়–তোমায় ধরতে যায় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে মারবে। আর তুমি যদি ধরা পড়ে যাও তা হলে আত্মঘাতী হবে। বুঝলে?

সুনয়নী কোনোরকমে মাথা নেড়ে সায় দিল।

–যাও।

পদ্মাকে প্রণাম করে সুনয়নী চলে যাচ্ছিল, পদ্মা পিছু ডাকল। –শোনো। কাল দেখেছিলাম আমাদের পাড়ার জ্যোতিষী শিবানন্দ ভট্টাচার্য কয়েকজনকে নিয়ে বাড়ির সামনে ঘোরাফেরা করছিল। লোকটি ভালো। তোমার সৌভাগ্য হলে আজও হয়তো পথে ওঁকে পাবে। যদি পথে দেখা না পাও তাহলে ওঁর বাড়িতে চলে যাবে। পথের ও পাশে বেলগাছওলা যে একতলা বাড়ি–ওটাই শিবানন্দ ঠাকুরের বাড়ি। যাও। জয় মা শঙ্করী! বলে পদ্মা দুহাত কপালে ঠেকাল।

সবই হল–শুধু পদ্মাদেবী যদি সঙ্গে একটা টর্চ দিতে পারতেন।

খুব তাড়াতাড়ি সরু আঁকাবাঁকা সিঁড়ি দিয়ে নামছিল সুনয়নী। পা দুটো কাঁপছিল থরথর করে। হঠাৎই কিসে পা বেধে হোঁচট খেল। সঙ্গে সঙ্গে সেটাও শব্দ করে সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ল।

সেই শব্দে ঘুম ভাঙল অবিনাশের। নিজের ঘর থেকেই চেঁচিয়ে উঠল–কে?

তারপরই শোনা গেল ভারী পায়ের শব্দ। তিনতলা থেকে নেমে আসছে অবিনাশ বক্সী। দুচোখ জ্বলছে হিংস্র পশুর মতো।

–সু-নয়-নী—

মূর্তিমান বিভীষিকা তাড়া করে আসছে। সুনয়নী তখনো দরজার কাছে পৌঁছতে পারেনি। হোঁচট খেয়ে সেও গড়িয়ে পড়েছিল সিঁড়ি থেকে। অবিনাশ তিন ধাপ উঁচু সিঁড়ি থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল সুনয়নীর ওপর।

–এইবার

–ছাড়ো, ছাড়ো বলছি

— ছাড়ছি। বলে অবিনাশ আঁচল চেপে ধরতেই সুনয়নীর হাতের পিস্তল গর্জে উঠল।…

.

শিবানন্দ ভট্টাচার্য থামলেন। দুবার কেশে নিয়ে বললেন, এইভাবেই পিশাচ অবিনাশ বক্সী সুনয়নীর হাতে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করল। আগের রাত থেকে আমার লোকেরা অবিনাশের বাড়ির ওপর লক্ষ্য রাখছিল। তারা উদ্ভ্রান্ত সুনয়নীকে আমার কাছে নিয়ে এল। আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম সুনয়নীকে নষ্ট হতে দেব না। তার স্বামীর কাছে ফিরিয়ে দেবই। আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা হয়েছে।

বলে বৃদ্ধ শিবানন্দ কঁপা কাঁপা দুই হাত তুলে ভগবানের উদ্দেশে প্রণাম জানালেন।

-তারপর?

–তারপর কি হতে পারে আপনারা অনুমান করে নিন। অবিনাশের অতৃপ্ত আত্মা নিশ্চয় ঐ গোলবাড়িতে অপেক্ষা করেছিল বছরের পর বছর, কবে সুনয়নীকে পাবে। সে বোধহয় এমনই ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিল যে এত বছর পরেও আকর্ষণ করে এনেছিল নতুন প্রজন্মের সুনয়নীকে। কিন্তু সৌভাগ্য–এবারেও চরম ক্ষতি করতে পারল না।

সঞ্জয় আশ্চর্য হয়ে বলল, আপনার মতে কি রীণাই সে সুনয়নী?

–তাই তো মনে হয়। রহস্যময় জন্মান্তরবাদের ওপর কে শেষ কথা বলবে?

–আমি বিশ্বাস করি না।

শিবানন্দর চোয়াল শক্ত হল। উত্তেজিত গলায় বললেন, সেটা আপনার অভিরুচি। এ ব্যাপারে আমি আপনার সঙ্গে তর্ক করব না। আপনারা একটা পুরনো বাড়ির খবর জানতে এসেছিলেন আমি খবরের সঙ্গে একটা বিশেষ ঘটনাও জানিয়ে দিলাম। যে ঘটনার সঙ্গে আমিও জড়িয়ে ছিলাম।

একটু থেমে বললেন, তবে আপনার স্ত্রীকে দেখতে পেলে অন্তত নিজের কাছে নিজে পরিষ্কার হয়ে যেতাম।

ডাক্তার রুদ্র পকেট থেকে সঞ্জয় আর রীণার ছবিটা বের করে বললেন, দেখুন তো এই ছবিটা।

শিবানন্দ ছবিটা হাতে নিয়ে চোখের খুব কাছে ধরে দেখতে লাগলেন। তার পর নাতিকে বললেন, আমার তেরো নম্বর কাগজের বাণ্ডিলটা নিয়ে এসো তো!

ভদ্রলোক তখনি ভেতরে চলে গেলেন। শিবানন্দ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রীণার ছবিটা দেখতে লাগলেন।

মিনিট দশেক পরে নাতি পুরনো দড়ি দিয়ে বাঁধা একটা ফাইল নিয়ে এলেন।

ধুলো ঝেড়ে শিবানন্দ সেটা খুলে একগাদা কাগজপত্রের মধ্যে থেকে বের করলেন আর এক দম্পতির ফটো। ফটোটার রঙ হলদেটে হয়ে গেছে। চারিদিকে পোকায় কেটেছে।

ছবিটা একবার দেখে নিয়ে শিবানন্দ দুখানি ছবিই ডাক্তার রুদ্রের হাতে দিয়ে বললেন, এইটে সুনয়নী আর তার স্বামীর ফটো। থানায় যদি দরকার হয় মনে করে সুনয়নীর স্বামীর কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিলাম। এবার দুটো ছবিই আপনারা ভালো করে দেখুন।

ডাক্তার রুদ্র ছবি দুখানা দেখলেন। স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কি ভাবতে ভাবতে ছবিটা সঞ্জয়ের হাতে দিলেন।

কিশোরী মেয়েটি এসে দাঁড়াল দরজার কাছে। চকিতে একবার সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে শিবানন্দকে বলল, সন্ধে হয়ে গেছে: খাবে চলো।

–হ্যাঁ, চলো।

শিবানন্দ উঠে বসলেন। নাতি এসে কাছে দাঁড়ালেন।

–তবু যদি আপনাদের সন্দেহ থাকে আপনার স্ত্রীকে একদিন নিয়ে আসবেন। তাঁকে কিছু বলবেন না। দেখবেন তিনি আমায় চিনতে পারেন কি না। তা হলেই সত্যাসত্য প্রমাণ হয়ে যাবে। নমস্কার।

বলে নাতির হাত ধরে কাশতে কাশতে ভেতরে চলে গেলেন।

.।

ট্যাক্সিতে সারাক্ষণ দুজনে একটি কথাও বলেননি।

ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল বাড়ির সামনে।

নামবার সময়ে সঞ্জয় বলল, তাহলে কালই কি রীণাকে নিয়ে শিবানন্দবাবুর কাছে যেতে বলেন?

কখনোই না।

সঞ্জয় থমকে গেল।

–কেন? একটা মীমাংসা হয়ে গেলে হতো না? যদিও ছবিতে দুজনের খুবই মিল তবু আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না।

ডাঃ রুদ্র হেসে বললেন, কি দরকার বিশ্বাস করে? ও নিয়ে আর মাথা ঘামিও না। এমনকি, আমার বিবেচনায় রীণার কাছেও এ-সব কথা বলার দরকার নেই। ঐ যে রীণা আমাদের দেখতে পেয়েছে। হাত নাড়ছে।

সঞ্জয়ও ওপরে তাকালো। হেসে হাত নাড়ল।

–আমি এই ট্যাক্সিতেই বাড়ি চলে যাই।

সঞ্জয় বলল, তা কি করে হয়? একটু কফি খাবেন না? ঐ দেখুন রীণা আপনাকে ডাকছে।

ডাঃ রুদ্র হাসতে হাসতে ট্যাক্সি থেকে নেমে এলেন।

Exit mobile version