Site icon BnBoi.Com

হিমু রিমান্ডে – হুমায়ূন আহমেদ

হিমু রিমান্ডে

নাম কী? হিমু।

নাম কী?

হিমু।

ভালো নাম?

হিমালয়।

হিমালয়ের আগেপিছে কিছু আছে, না-কি শুধুই হিমালয়?

স্যার, হিমালয় এমনই এক বস্তু যার আগেপিছে কিছু থাকে না।

প্ৰশ্নকর্তা চশমার উপরের ফাঁক দিয়ে আমার দিকে তাকালেন। চশমা পরা হয় চশমার ভেতর দিয়ে দেখার জন্য। যারা এই কাজটা না করে চশমার ফাক দিয়ে দেখতে চান তাদের বিষয়ে সাবধান হওয়ার প্রয়োজন আছে। আমি খানিকটা সাবধান হয়ে গেলাম। সাবধান হওয়া ছাড়া উপায়ও নেই। আমাকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। রিমান্ড শব্দটা এতদিন শুধু পত্র-পত্রিকায় পড়েছি। অমুক নেতা রিমান্ডে মুখ খুলেছেন। অমুক শিল্পপতি গোপন তথ্য ফাঁস করেছেন –ইত্যাদি। রিমান্ডে হালুয়া টাইট করে দেয়া হয় এবং ব্ৰেইন হালুয়া করে দেয়া হয়। বিশেষ সেই অবস্থার শেষপর‍্যায়ে আসামি যে-সব অপরাধ সে করে নি তাও স্বীকার করে। উদাহরণ–

তুই মহাত্মা গান্ধিকে খুন করেছিস?

জি স্যার করেছি।

উনাকে কীভাবে খুন করলি?

কীভাবে করেছি এখন মনে নেই। একটু যদি ধরায়ে দেন তাহলে বলতে পারব। তবে খুন যে করেছি ইহা সত্য।

গলা টিপে মেরেছিস?

এই তো মনে পড়েছে। জি স্যার, গলা টিপে মেরেছি।

উনার যে ছাগল ছিল সেটা কী করেছিস?

ছাগলের কথা মনে নাই স্যার, একটু ধরায়ে দেন। ধরায়ে দিলেই বলতে পারব।

ছাগলটা কেটেকুটে খেয়ে ফেলেছিস কি-না বল। অবশ্যই খেয়েছি স্যার। কচি ছাগলের মাংস অত্যন্ত উপাদেয়। এই বিষয়ে একটা ছাড়াও আছে স্যার। বলব?

কচি পাঠা বৃদ্ধ মেষ
দধির অগ্র ঘোলের শেষ।

পাঠার জায়গায় হবে ছাগল।

 

আমাকে যিনি প্রশ্ন করছেন তার চেহারা অমায়িক। প্রাইভেট কলেজের বাংলা স্যার টাইপ চেহারা। তবে কাপড়াচোপড় দামি। হাফ শার্ট পরেছেন বলে হাতের ঘড়ি দেখা যাচ্ছে। ঘড়িটা যথেষ্টই দামি, একশ দেড়শ টাকার হংকং ঘড়ি না। ঘড়ি সবাই বাঁ-হাতে পারে, উনি পরেছেন ডান হাতে–এই বিষয়টা বোঝা যাচ্ছে না। আমার জায়গায় মিসির আলি সাহেব থাকলে চট করে কারণ বের করে ফেলতেন। প্ৰশ্নকর্তা গায়ে সেন্ট মেখেছেন, মাঝে মাঝে সেন্টের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।

রিমান্ডে যাদের নেয়া হয় তাদেরকে চোরকুঠুরি টাইপ ঘরে রাখা হয়। সেই ঘরের কোনো দরজা জানালা থাকে না। উচু সিলিং থেকে লম্বা একটা তার নেমে আসে। তারের মাথায় দিন-রাত চারশ পাওয়ারের লাইট জ্বলে। ইলেকট্রিক শাক দেয়ার ব্যবস্থা থাকে। ট্রেতে কোয়েলের ডিম থেকে শুরু করে রাজহাঁসের ডিম সাজানো থাকে। একটা পর‍্যায়ে সাইজমাফিক ডিমের ব্যবহার শুরু হয়। এ ধরনের কথাবার্তা শুনেছি। বাস্তবে তেমন দেখছি না। আমাকে যে ঘরে বসানো হয়েছে তার দরজা-জানালা সবই আছে। জানালায় রঙজুলা পর্দা আছে। মাঝে মাঝে পর্দা সরে যাচ্ছে, তখন জানালার ওপাশে শিউলি গাছ দেখা যাচ্ছে। গাছভর্তি ফুল। এতদিন জানতাম শিউলি ফুলের গন্ধ থাকে না। আমি কিন্তু মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছি। তবে এই গন্ধ আমার সামনে বসে থাকা স্যারের গা থেকে ভেসে আসা সেন্টেরও হতে

পারে।

কেউ যে আমাদের ঘরে ঢুকছে না, তাও না। কিছুক্ষণ আগেই এক ভদ্রলোক ঢুকে বেশ উত্তেজিত গলাতেই বললেন, কবীর ভাই, মাছ কিনবেন? আমি একটা বোয়াল মাছ কিনেছি, দশ কেজি ওজন। হাকালুকি হাওরের বোয়াল। এমন টাটকা মাছ, লোভে পড়ে কিনে ফেলেছি। খাওয়ার লোক নাই। রেহানা মাছ খায় না। মাছের গন্ধেই না-কি তার বমি আসে। আমি ঠিক করেছি। মাছটা চার ভাগ করে একভাগ আমি রাখব। বাকি তিনভাগ বিক্রি।

প্ৰশ্নকর্তা (অর্থাৎ কবীর সাহেব) বললেন, বোয়াল মাছ তো আমি খাই না। ংগাস মাছ হলে কিনতাম।

এটা কী কথা বললেন? শীতকালে মাছের রাজা হলো বোয়াল! পাংগাস এর কাছে দাঁড়াতেই পারে না। একভাগ নিয়ে খান, ভালো না লাগলে দাম দিতে হবে না।

কত করে ভাগ?

চার হাজার টাকা দিয়ে কিনেছি। এক হাজার করে ভাগ। দিব একভাগ? আপনার বাসায় পাঠিয়ে দেই? ভাবিকে টেলিফোন করে বলে দেন— বেশি করে ঝাল দিয়ে ঝোল ঝোল করতে। আমি একটা সাতকড়া দিয়ে দিব। বড় মাছ তো, সাতকড়ার গন্ধটা যে ছাড়বে!

দিন একভাগ।

কবীর সাহেব মানিব্যাগ খুলে পাঁচশ টাকার দুটা নোট দিলেন। তাকে খুব প্ৰসন্ন মনে হলো না। আমি তার দিকে খানিকটা ঝুকে এসে বললাম, কবীর ভাই! এক কাপ চা খাওয়াতে পারবেন?

ভদ্রলোক হতভম্ব হয়ে তাকালেন। যেন তিনি তার জীবনে এমন অদ্ভুত কোনো কথা শুনেন নি। রিমান্ডের লোকদের এ ধরনের কথা বলা হয়তো নিষিদ্ধ। উনাকে ভাই। ডাকাছি, এটাও মনে হয় নিতে পারছেন না।

চা খেতে চান?

জি। দুধ-চা। এক চামচ চিনি।

ভদ্রলোকের ভ্রূ কুঁচকে গেল। মনে হয় অল্পসময়ে জটিল কোনো চিন্তা-ভাবনা করলেন এবং নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই বললেন, চা খাওয়াচ্ছি। যা জিজ্ঞাস করব ধানাইপানাই না করে উত্তর দিবে।

অবশ্যই দিব।

আসল নাম কী?

আমার একটাই নাম হিমালয়, ওরফে হিমু।

তুমি আয়না মজিদ।

বলেন কী স্যার?

চা খেতে চেয়েছিলে চা খাওয়াচ্ছি। আরাম করে যেন চা খেতে পার তার জন্যে হ্যান্ডকাফও খুলে দেয়া হবে। শর্ত একটাই, চা খেয়ে আমার সঙ্গে যাবে। লম্বু খোকনের ঠিকানায় আমাকে নিয়ে উপস্থিত হবে। পারবে না?

লম্বু খোকনের ঠিকানাটা দিলে অবশ্যই নিয়ে যাব।

কবীর সাহেব বেল টিপলেন। দুকাপ চা এবং সিংগারা দিতে বললেন। তিনি নিজেই চাবি দিয়ে হ্যান্ডকাফ খুললেন।

বলুন্টু সাইজের যে ছেলেটা ঢুকল সে কিছুক্ষণ ভ্ৰ কুঁচকে এবং ঠোঁট উল্টে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। আমার জন্যে চা আনতে হচ্ছে এটা সে নিতে পারছে না। তার মানসিক সমস্যা হচ্ছে।

কবীর সাহেব হাই তুলতে তুলতে বললেন, আয়না মজিদ, তুমি যে সহজ চিজ না আমরা জানি। আমরাও কিন্তু সহজ চিজ না। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই তুমি মুখ খুলবে। হড়বড় করে কথা বের হতে থাকবে। ঝর্ণাধারার মতো। ঝর্ণাধারা চেনো?

আমি বললাম, চিনি স্যার। ঝর্ণা ঝর্ণা সুন্দরী ঝর্ণা। তরলিত চন্দ্ৰিকা চন্দন বর্ণা। সুন্দরী ঝর্ণা।

স্টপ ইট।

চা চলে এসেছে। দুজনের জন্যে এসেছে। রঙ দেখে মনে হচ্ছে চা ভালো হয়েছে। আমি চায়ে চুমুক দিলাম। চা যথেষ্টই ভালো। প্রথম চুমুক দেবার পরই মনে হয় এই চা পার পর দুকাপ খেতে পারলে ভালো হতো।

আয়না মজিদ।

জি স্যার।

কবীর সাহেব কৌতুহলী হয়ে তাকালেন। আয়না মজিদ ডাকতেই আমি সাড়া দিয়েছি, এটাই তার কৌতুহলের কারণ। তিনি হয়তো ভাবছেন— চিড়িয়া খাচায় ঢুকে গেছে।

তোমার শিষ্যরা কি সব দেশে আছে, না-কি দুএকজনকে ইন্ডিয়া পাচার করেছ?

আমি কাউকে পাচার করি নাই। যারা গেছে নিজের ইচ্ছায় গিয়েছে। ইন্ডিয়া বেড়ানোর জন্যে ভালো।

তোমার বান্ধবী সুষমা কোথায়?

কোথায় আমি জানি না। স্যার। সত্যই জানি না। সুষমা নামে আমার যে বান্ধবী আছে, এটাই জানি না। তবে আপনি যখন বলছেন তখন অবশ্যই বান্ধবী। স্যার, সে কি আমার প্রিয় বান্ধবী?

কবীর সাহেব তার চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মুখ বিকৃত করলেন। মনে হচ্ছে তার চা-টা কুৎসিত হয়েছে। একই ব্লটে বানানো দুকাপ চায়ের একটা এত ভালো হলে আরেকটা জঘন্য হবার কারণ দেখছি না। কবীর সাহেব চায়ের কাপ নামিয়ে শীতল গলায় বললেন, তুমি ধানাইপানাই শুরু করেছ। ডিলা ছাড়া মুখ খুলবে না, বুঝতে পারছি। ডিলা এখন দেব না। সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করব।

দুপুরে লাঞ্চ কি দেয়া হবে?

প্রশ্ন শুনে কবীর সাহেব মনে হলো ধাক্কার মতো খেলেন। ডিলা সন্ধ্যাবেলা শুরু হবার কথা। তার মুখের কঠিন ভঙ্গি দেখে ক্ষীণ সন্দেহ হচ্ছে— ডলার টাইম এগিয়ে আসবে।

কবীর সাহেব দাঁত কিড়ামিড় করে বললেন, লাঞ্চে বিশেষ কোনো ফরমাশ আছে? মোগলাই খানা কিংবা চাইনিজ?

আমি বললাম, যে বোয়াল মাছটা আজ দুপুরে ভাবি রান্না করবেন তার একটা পিস খেতে ইচ্ছা করছে। সাতকড়া দিয়ে মাংস খেয়েছি। বোয়াল খাই নি।

আমার স্পর্ধা দেখে কবীর সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন। কোনো কথা না বলে চায়ে পরপর তিনবার চুমুক দিলেন। প্রতিবারই মুখ বিকৃত করলেন।

বোয়াল মাছের পেটির একটা পিস কি স্যার খাওয়া যাবে?

একটা পিস কেন! আস্ত বোয়ালই খাওয়াবার ব্যবস্থা করছি।

স্যার অশেষ ধন্যবাদ।

ভদ্রলোক উঠে চলে গেলেন। ধড়াস করে শব্দ হলো। বাইরের দরজা লাগানো হলো। এখন রবীন্দ্রসঙ্গীতের সময়। ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে টাইপ সঙ্গীত। অসাধারণ প্ৰতিভার একজন মানুষ–সব পরিস্থিতির জন্যে গান লিখে রেখে গেছেন। ডায়রিয়া হয়ে কেউ বিছানায় পড়ে গেছে। নিজে নিজে ওঠার সামর্থ্য নেই। তার জন্যেও গান আছে— আমার এই দেহখানি তুলে ধর।

দরজায় তালা লাগানো হচ্ছে। তালা লাগানোর অর্থ বেশ কিছু সময় আমাকে এই ঘরে থাকতে হবে। ঘরের দেয়ালে সস্তা ধরনের ঘড়ি আছে। ঘড়িতে নয়টা চল্লিশ বাজে। যখন প্রথম এই ঘরে আমাকে ঢোকানো হয়, তখনো নয়টা চল্লিশ বাজছিল। এই ঘড়ি বেচারার জীবন নয়টা চল্লিশে আটকে গেছে।

টেবিলে লোকনাথ ডাইরেক্টরি পঞ্জিকা দেখতে পাচ্ছি। সময় কাটানোর জন্যে পঞ্জিকা পড়া যেতে পারে। গ্ৰহ-নক্ষত্রের অবস্থান। তিথি বিচার, লগ্ন বিচার। পঞ্জিকার নিচে ভালো রিডিং ম্যাটেরিয়াল পাওয়া গেল। টাইপ করা প্রতিবেদন। শিরোনাম আয়না মজিদ। কবীর সাহেব এই জিনিসই বারবার পড়ছিলেন। লাল কলম দিয়ে দাগ দিচ্ছিলেন। আয়না মজিদ পড়ে তার সম্পর্কে জানা কবীর সাহেবের জন্যে প্রয়োজন ছিল। আমার প্রয়োজন নেই। একটা ফাইল পাওয়া গেল। ফাইলে লেখা ৩৮৯৯, ভেতরে তিন-চারটা সাদা পাতা।

আয়না মজিদ-বিষয়ক লেখাতা ভাঁজ করে হাত নিয়ে নিলাম। কেন জানি মনে হচ্ছে এখানে বেশিক্ষণ থাকা হবে না। বের হব। কীভাবে তাও বুঝতে পারছি না। বাদলের সঙ্গে একবার একটা হলিউডের ছবি দেখেছিলাম। ছবিতে ভয়ঙ্কর এক ক্রিমিন্যালকে ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছে। তাকে কোর্টে নেয়া হবে না। দুজন পুলিশ অফিসার এই ঘরেই তাকে গুলি করে মারবে। ক্রিমিন্যালটা হুডনির মতো বঁধন খুলে ফেলল এবং ঘরের সিলিং ফ্যান ধরে ঝুলতে লাগল। দরজা খুলে দুজন পুলিশ অফিসার ঢুকল। ক্রিমিন্যালটা (নাম হ্যারি) সিলিং ফ্যান ধরে ঝুলতে ঝুলতে ফ্লাইং কিক লাগল। অফিসার দুজন একই সঙ্গে কুপোকাত। হ্যারি বাবু আকাশে একটা ডিগবাজি খেয়ে মেঝেতে ল্যান্ড করলেন। দুই অফিসারের কোমর থেকে দুই পিস্তল নিয়ে নিলেন এবং মিষ্টি করে বললেন, its a beautiful day. গুলি করতে করতে প্ৰস্থান করলেন। বাদল আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বাপকা ব্যাটা!! কী বলেন হিমুদা?

আমি বললাম, বাপক ব্যাটা বললে কম বলা হবে। একই সঙ্গে সে দাদাকা নাতি।

আমার পক্ষে বাপক ব্যাটা কিংবা দাদাক নাতি হওয়া একেবারেই অসম্ভব। তবে হলিউডি ব্যাপারটার একটা বাংলাদেশী রূপ দেয়া যেতে পারে। প্রথমে যা করতে হবে তা হলো টেবিলের উপর একটা চেয়ার তুলতে হবে। আমাকে থাকতে হবে দরজার পেছনে। দরজা খুললে চলে যেতে হবে দরজার পেছনে। কবীর সাহেব দরজা খুলে টেবিলের উপর চেয়ার দেখে হতভম্ব হয়ে এগিয়ে যাবেন সেদিকে। এই ফাঁকে আমাকে শান্তভঙ্গিতে হামাগুড়ি দিয়ে বের হতে হবে। মানুষ এবং বানর শ্রেণী তাকায় Eye level-এ, বাকি সব জন্তু তাকায় মাটির দিকে। এই তথ্য আমি পেয়েছি বাদলের কাছ থেকে। সে পেয়েছে। National Geography চ্যানেল থেকে। বাদলের কাছেই জেনেছি বেচারা শুয়োর জীবনে কখনো আকাশ দেখে না। উপরের দিকে তাকানোর ক্ষমতাই তার নেই। শুয়োরকে এই কারণেই কেউ যদি চিৎ করে ফেলে সে হঠাৎ আকাশ দেখে বিস্ময় এবং ভয়ে অস্থির হয়ে যায়।

দুই ঘণ্টার উপর (আনুমানিক) ঝিম ধরে বসে আছি। আমার অবস্থা হয়েছে ঘড়ির মতো। সময় আটকে গেছে। পঞ্জিকা পড়ে অনেক কিছু জািনছি, তবে এই জ্ঞান কোনো কাজে আসবে এরকম মনে হচ্ছে না। হিন্দু ললনাদের উমাচতুর্থী ব্ৰত পালন করা খুবই প্রয়োজন, এটা জানলাম। এই ব্ৰত পালন করতে হবে জ্যৈষ্ঠমাসের শুক্লা চতুর্থীতে। কারণ এই দিনে সতী উমার জন্ম হয়।

জ্যৈষ্ঠ শুক্ল চতুর্থ্যান্তু জাতা পূৰ্ব্বঝুমা সতী
তস্মাৎসা তপ্ৰ সংপূজ্য স্ত্রীভি : সৌভাগ্যদায়িনী

পঞ্জিকা পড়ে সময় কাটানো ভালো বুদ্ধি বলে মনে হচ্ছে না। বিরক্ত লাগছে। বিরক্তি কাটানোর জন্যেই টেবিলে চেয়ার তুললাম। প্রথমে একটা চেয়ার, তার উপর দ্বিতীয় চেয়ার। কাজটা করতে ভালো লাগছে। নিষিদ্ধ কিছু করার আনন্দ পাচ্ছি। এখান থেকে বের হওয়া সহজ কাজ বলেই মনে হচ্ছে। পুলিশ একটা ভুল করেছে, ঘরে ঢুকিয়ে হাতকড়া খুলে দিয়েছে। কেউ যে এই অবস্থা থেকে পালাবার চিন্তা করতে পারে এটাও তাদের মাথায় নেই। থানার ভেতরে পুলিশরা বেশ রিলাস্কড অবস্থায় থাকে। তারা চিন্তাও করে না। এখানে অপরাধমূলক কোনো কর্মকাণ্ড হতে পারে।

আমেরিকার বিখ্যাত (না-কি কুখ্যাত?) খুনি এডগার ইলেকট্রিক চেয়ারে বসার আগে ক্রিমিন্যাল ভাই বেরাদারদের উদ্দেশে বলে গিয়েছিল— নিখুঁত অপরাধ করতে হয় হালকা মেজাজে। সম্পূর্ণ টেনশনমুক্ত অবস্থায়। একটা দেয়াশলাই জ্বালানোতেও কিছু টেনশন কাজ করে। বারুদ ছিটকে পড়বে কি-না। একবারেই আগুন ধরবে কি-না। অপরাধ করবার সময় সেই টেনশন থাকলেও চলবে না। গুলি কখনো দূর থেকে করবে না। দূর থেকে গুলি করা মানেই টেনশন। গুলি লক্ষ্যভেদ করবে কি করবে না। তার টেনশন। এত ঝামেলার দরকার কী? বন্দুকের নল পেটে লাগিয়ে গুলি করো। একটা টিপস দিচ্ছি–বুকে গুলি করবে না। পাঁজরের হাড় যথেষ্ট শক্ত। রিভসে লেগে গুলি ফিরে এসেছে এমন নজির আছে।

আমি এডগার সাহেবের মতো টেনশনমুক্ত হবার চেষ্টা করলাম। প্রথম চেষ্টাতেই সফলতা। সম্পূর্ণ টেনশনমুক্ত অবস্থায় আমি দরজার পেছনে দাঁড়ানো। অপেক্ষার সামান্য টেনশন ছাড়া তখন আর আমার মধ্যে কোনো টেনশন নেই। আয়না মজিদ সাহেবের তথ্যাবলি সঙ্গে নিয়ে নিয়েছি। বের হতে পারলে বিছানায় শুয়ে আরাম করে পড়া যাবে। মহাপুরুষদের শিক্ষামূলক জীবনী পড়ায় আনন্দ নেই। আনন্দ ক্রিমিন্যালদের রঙিন জীবনীতে। মহাপুরুষরা কখনো ভুল করেছেন এমন পাওয়া যায় না। তাদের সমস্ত কাজকর্মই ডিসটিল ওয়াটারের মতো শুদ্ধ এবং স্বাদহীন।

তালা খোলার শব্দ হচ্ছে। আমি হামাগুড়ি পজিশনে চলে এলাম। তালা খোলার পরপর আমি যদি হামাগুড়ি দিয়ে কবীর সাহেবের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলি– হালুম! এতেও কিন্তু ভদ্রলোক লাফ দিয়ে উঠে ভীত গলায় বলবেন, এটা কী! কোনটা করব বুঝতে পারছি না। পালিয়ে যাবার চেষ্টা, না-কি হালুম গর্জন? সিদ্ধান্তে পৌঁছার আগেই দরজা খুলে গেল। কবীর সাহেব টেবিলের উপর ডাবল চেয়ার দেখে এসব কী? এসব কী? বলে সেদিকে ছুটে গেলেন। আমি হামাগুড়ি দিয়ে দরজার বাইরে চলে এলাম। করিডোরে কেউ নেই। আমি পাঞ্জাবি ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দাঁড়ালাম এবং অতি অল্প সময়েই পগার পার। (প্রিয় পাঠক! পগারপার জিনিসটা কী? পাগা নামক নদীর পার, না-কি পগার নামক বিশিষ্ট কোনো ব্যক্তির পাড়? তাই বাঁ কেমন করে হয়? ব্যক্তি তো শাড়ি না যে পার থাকবে।)

ক্রিমিনালজিতে বলে একজন ক্রিমিন্যাল অবশ্যই তার ক্রাইমের জায়গাটা দেখতে যাবে। শুধু একবার যে যাবে তা-না, একাধিকবার যাবে। আমার পক্ষে ক্রাইমের জায়গা দেখতে যাওয়া মানে থানায় যাওয়া। এটা সম্ভব না। তবে ওসি সাহেবকে টেলিফোন করা সম্ভব। তার কাছ থেকে একটা ঠিকানা বের করা প্রয়োজন— কবীর সাহেবের বাসার ঠিকানা। কবীর সাহেবের স্ত্রী দশ কেজি ওজনের বোয়াল মাছ রান্না করছেন। বোয়াল মাছের একটা পিস খেতে ইচ্ছা করছে।

ওসি সাহেব টেলিফোন ধরেই ধমক দিলেন, কে? কী চান?

আমি কণ্ঠস্বরে যতটুকু বিনয়ী হওয়া সম্ভব ততটুক বিনয়ী হয়ে বললাম, স্যার আমাকে চিনবেন না। আমি খুলনা থেকে এসেছি। আমার নাম খালেক। খুলনা খালেক বলতে পারেন।

আমার কাছে কী?

খুলনার ওসি সাহেব আপনার জন্যে কিছু জিনিস পাঠিয়েছেন। জিনিসগুলো থানায় নিয়ে আসব?

কী জিনিস?

এক বোতল মধু। জঙ্গলি ফুলের মধু আর সুন্দরবনের তিনটা বনমোরগ।

কী মোরগ?

স্যার তিনটা বনমোরগ। এইসব জিনিস আজকাল পাওয়া যায় না।

ওসি সাহেবের নাম কী?

মিজান।

চিনতে পারছি না তো। ব্যাচামেট মনে হয়। বনমোরগ কয়টা বললে?

স্যার তিনটা।

আমার ধারণা মোরগ পাঠিয়েছে চারটা। তুমি একটা গাপ করেছ। হাঁস মোরগ কেউ একটা তিনটা পাঠায় না। জোড়া হিসাবে পাঠায়।

স্যার, আপনার অসাধারণ বুদ্ধি। বনমোরগ চারটাই পাঠিয়েছিলেন, একটা পথে মারা গেছে।

আবার মিথ্যা! এইসব ধানাইপানাই পুলিশের সঙ্গে কখনো করবে না। বাসার ঠিকানা দিচ্ছি, বনমোরগ চারটা বাসায় তোমার ভাবির কাছে দিয়ে আসবে।

জি আচ্ছা স্যার। এই সঙ্গে কবীর সাহেবের বাসার ঠিকানাটা যদি দেন। উনার জন্যেও এক বোতল মধু পাঠিয়েছেন।

এস বি’র কবীর? ইয়েস স্যার। উনাকে কি একটু টেলিফোনে দেয়া যাবে?

তাকে এখন দেয়া যাবে না। সে আছে বিরাট ঝামেলায়। তার আসামি পলাতক। তার বাসার ঠিকানাও জানি না।

উনার বাসায় কোনো টেলিফোন কি আছে? টেলিফোন করে ঠিকানা নিয়ে নিতাম।

একটু ওয়েট করো। দেখি পাই কি-না। বনমোরগগুলির সাইজ কী?

মিডিয়াম সাইজ স্যার। বনমোরগ বেশি বড় হয় না। পা লম্বা হয়, মাংস হয় শক্ত, তবে খেতে অমৃত। ভাবিকে ঝোল করতে নিষেধ করবেন। ঝোল ভালো হয় না। কষানো মাংস ভালো। আর মাংসে যেন তরকারি না দেন। আলু, ফালু। দিলে স্বাদ নষ্ট হবে। মাংসের স্বাদ আলু খেয়ে ফেলবে।

 

একবার রিং হতেই কবীর সাহেবের স্ত্রী টেলিফোন ধরলেন এবং অস্বাভাবিক মিষ্টি গলায় বললেন, কে? টেলিফোনে আমরা প্রথম শব্দ শুনি হ্যালো। কিংবা আসসালামু আলায়কুম। সেখানে কেউ একজন টেলিফোন তুলেই যদি মিষ্টি স্বরে জানতে চায়, কে?—তখন অন্যরকম ভালো লাগে। আমি বললাম, কেমন আছেন। আপু? ভাবিও না, আপাও না, সরাসরি আপু।

আমি ভালো আছি। তুমি কে এখনো তো বললে না।

আপু, অনুমান করুন তো। দেখি আপনার অনুমান শক্তি।

ভাই, আমার অনুমান শক্তি খুবই খারাপ। আমার অনুমান শক্তি আবার খুবই ভালো। আজ আপনার বাসায় রান্না হয়েছে বিশাল সাইজের বোয়াল। সাতকড়া দিয়ে রেঁধেছেন।

সাতকড়া দেই নি তো! এই শোন, বলো তো তুমি কে? তুমি কবীরদের ফ্যামেলির কেউ?

উহু! কবীরদের ফ্যামেলির কেউ হলে আপনাকে ভাবি ডাকতাম। আপু ডাকলাম কেন?

তাও তো ঠিক। আমি এমন বোকা! এই শোন, কবীর তো বিশাল ঝামেলায় পড়েছে। একটু আগে টেলিফোন করেছে। কাঁদো কাঁদো গলা। তার কাস্টডি থেকে একজন আসামি পালিয়ে গেছে।

বলেন কী?

যে সে আসামি না— আয়না মজিদ। আয়না মজিদের নাম তো শুনেছি। তাকে ধরার জন্যে এক লাখ টাকার পুরস্কার ঘোষণা দেয়া আছে।

আয়না মজিদকে কি কবীর ভাই ধরেছিলেন?

হুঁ। পুলিশের অনেক সোর্স আছে তো। সোর্সের মাধ্যমে খবর পেয়ে সে হাতেনাতে ধরেছে। আমি কী যে খুশি হয়েছিলাম! এক লাখ টাকা পেলে কত বড় উপকার যে হতো। কবীর আয়না মজিদকে কীভাবে ধরেছে বলব?

বাসায় এসে শুনি।

অবশ্যই। দুপুরে তুমি খাবে। ছোট্ট একটা কাজ করতে পারবে? টক দৈ আনতে পারবে? তোমার ভাইয়ের অভ্যাস দুপুরে খাবার পর টক দৈ, খাওয়া। আমার ধারণা ছিল। ঘরে টক দৈ আছে। ফ্রিজ খুলে দেখি আছে ঠিকই, তবে ছাতা পড়ে গেছে।

আমি টক দৈ নিয়ে সাইক্লোন সিডরের গতিতে চলে আসছি। আপু ঠিকানাটা বলুন।

ঠিকানা জানো না?

না।

তুমি তো অদ্ভুত ছেলে। কাগজ-কলম আছে? ঠিকানা লেখো।

আমি ঠিকানা লিখলাম। টেলিফোনের কথাতেই বুঝতে পারছি অতি সরল একজন মহিলা। সরল না হলে যাকে চিনতে পারছেন না। তাকে অনায়াসে বলতেন না— টকা দৈ নিয়ে এসো।

টক দৈ-এর সন্ধানে আমি গোলাম হাবীব এন্ড সন্স মিষ্টির দোকানে। দোকানের মালিক হাবীব ভাই। ময়রারা নাদুসনুদুস হয়। এটাই আর্কিমিডিসের সূত্রের মতো ধ্রুব। ইনি রোগাপটকা। মাথায় চুল নেই। সারাক্ষণ বোজার মুখে থাকতে থাকতে গালে স্থায়ী বোজার ছাপ পড়ে গেছে। কোনো ছেলেপুলে নেই। বয়স পঞ্চাশ। এই বয়সে ছেলেপুলে হবে সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। তারপরেও মিষ্টির দোকানোর নাম হাবীব এন্ড সন্স। এখনো আশায় আছেন কোনো একদিন দুতিনটি ছেলে হবে। ছেলেদের নিয়ে ব্যবসা করবেন। মিষ্টি তৈরির যে বিদ্যা তিনি হালুইকর রমেশ ঠাকুরের কাছ থেকে শিখেছেন সেই বিদ্যা ছেলেদের দিয়ে যাবেন। পুত্রের আশায় তিনি করেন নি এমন কাজ নেই। স্বামী মেয়ে শিয়ালের মাংস এবং স্ত্রী পুরুষ শেয়ালের মাংস খেলে ছেলে।পুলে হয় শুনে গ্রামে গিয়ে এই চিকিৎসাও করিয়েছেন। দুজনেরই কঠিন ডায়রিয়া হয়েছে, এর বেশি কিছু হয় নি।

হাবীব ভাই গত পাঁচ বছর ধরে আমার প্রতি কঠিন অভিমান লালন করছেন। তার ধারণা আমি একটা ফু দিলেই তার সন্তান হবে। ফু দিচ্ছি না বলে সন্তান হওয়াটা আটকে আছে। কিছুদিন হলো তিনি আমার সঙ্গে কথাবার্তা বন্ধ করে দিয়েছেন। সরাসরি কথা বলেন না, অন্যদের মাধ্যমে কথা বলেন। আমাকে দেখে তিনি খবরের কাগজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এক কর্মচারীকে বললেন, মঞ্জ, কাস্টমার আসছে চোখে দেখ না? কাস্টমার কী চায় জিজ্ঞাস কর।

আমি বললাম, বাকিতে এক কেজি টক দৈ দরকার, তবে টাকা দিতে পারব না। টাকা নাই। কুড়ি টাকার একটা নোট ছিল, টেলিফোন করে খরচ করে ফেলেছি।

হাবীব ভাই খবরের কাগজ থেকে চোখ না তুলে বললেন, আমাকে বাকি শিখায়। মঞ্জ, উনারে দশ কেজি টকা দৈ দে।

আমি বললাম, দশ কেজি টক দৈ দিয়ে কী করব?

হাবীব ভাই বললেন, মঞ্জ, উনারে বল উনি যা ইচ্ছা করবেন। টক দৈ দিয়ে গোসল করবেন। সেটা তার ব্যাপার। আমার দৈ দেয়ার কথা, দৈ দিলাম। উনার ফু দেওয়ার কথা— দিলে দিবেন, না দিলে নাই।

বাঁ হাতে পাঁচ হাঁড়ি ডান হাতে পোচ হাঁড়ি দৈ নিয়ে চলে যাওয়া যায় না। ভদ্রতাসূচক কিছু বলতে হয় কিংবা একটা ফু দিতে হয়। আমি বেশ আয়োজন করেই ফুঁ দিলাম। হাবীব ভাইয়ের চোখে সঙ্গে সঙ্গে পানি এসে গেল। পৃথিবীর সবচে অগ্ৰীতিকর দৃশ্য হলো পুরুষমানুষের চোখের পানি। আমি দ্রুত বের হয়ে এলাম।

 

কবীর সাহেবের স্ত্রীর নাম শোভা। তার স্বামী তাকে আদর করে ডাকেন শু। তাদের নিয়ম হচ্ছে, প্রতি বুধবার একজন অন্যজনকে একটা চিঠি লিখবেন। কারণ বিয়ের আগের প্রেমপর্বে এই দিনে চিঠি চালাচালি হতো। নিয়মটা আমৃত্যু বজায় থাকতে হবে এরকমই তাদের প্রতিজ্ঞ। আজ বুধবার, চিঠি চালাচালির দিন। শোভা চিঠি লিখে ফেলেছেন। সেই চিঠি ড্রেসিং টেবিলে রাখা আছে। কবীর সাহেব দুপুরে খেতে এসে স্ত্রীর চিঠি নিয়ে যাবেন, নিজেরটা রেখে যাবেন। সমস্ত তথ্য আমি শোভা আপার সঙ্গে দেখা হওয়ার পাচ মিনিটের মধ্যে পেয়ে গেলাম। দশ মিনিটের মাথায় তিনি আমাকে তুই বলে ডাকতে শুরু করলেন। আমাকেও আপনি থেকে তুমিতে নেমে আসতে হলো।

তুই কী মনে করে দশ কেজি টক দৈ আনলি, এটা আমাকে বল।

তুমি না আনতে বললে?

আমি দশ কেজি আনতে বলেছি গাধা ছেলে? এত দৈ দিয়ে আমি কী করব!

গোসল করবে। দধিস্নান। দধিস্নান খুবই ভালো জিনিস। আমোঘা দধিস্নান করতেন।

আমোঘাটা কে?

মহর্ষি শান্তনুর স্ত্রী। দধিস্নান করে তিনি গর্ভবতী হন। সমস্যাটা কি জানো? সন্তান প্রসব করতে গিয়ে তিনি একগাদা পানি প্রসব করলেন। তার স্বামী সেই পানিকেই পুত্র হিসাবে গ্রহণ করলেন। পুত্রের নাম দিলেন ব্ৰহ্মপুত্র। আমাদের ব্ৰহ্মপুত্র নদের এটাই ইতিহাস।

চুপ কর গাধা! বানিয়ে বানিয়ে কথা বলেই যাচ্ছে। তুই কি ভাবছিস আমি বোকা?

অবশ্যই তুমি বোকা। অতিরিক্ত রূপবতীরা বোকা হয়, এটা জগতের স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম। তুমি যে বোকা তার আরেকটা প্রমাণ হচ্ছে রূপের প্রশংসা করায় তুমি আনন্দে আটখানার জায়গা এগারোখানা হয়ে গেছ। আরো প্রমাণ লাগবে?

লাগবে।

এতক্ষণ আমার সঙ্গে কথা বলছি, এখনো আমাকে চিনতে পার নি।

তোকে চিনেছি। চিনব না কেন! নামটা মনে আসছে না। নামটা বল তো?

বলব না।

টেলিফোন বেজে উঠল। শোভা আপু আনন্দে ঝলমল করতে করতে বললেন, ও টেলিফোন করেছে। ঠিক দুপুর বারোটায় সে একবার টেলিফোন করে!

তোমাদের প্রথম টেলিফোনে কথা হয়েছিল ঠিক দুপুর বারোটায়?

হয়েছে। তোর তো বুদ্ধি ভালো।

আপু, আমার কথা দুলাভাইকে বলবে না। আমি তাকে একটা সারপ্রাইজ দিতে চাই।

অবশ্যই বলব না। তুই আমাকে যতটা বোকা ভাবছিস তত বোকা আমি না। এই শোন, টেলিফোন নিয়ে আমি আড়ালে চলে যাব, তুই কিছু মনে করিস না।

বিয়ের পরেও প্ৰেম চালিয়ে যাচ্ছ?

হুঁ। শোভা আপুর টেলিফোন কথোপকথন দীর্ঘস্থায়ী হলো না। তিনি মুখ অন্ধকার করে আমার কাছে ফিরে এলেন। প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, তোর দুলাভাই তো বিরাট বিপদে আছে।

কেন?

আয়না মজিদকে সে অ্যারেক্ট করেছিল, তোকে বলেছিলাম না? সে পালিয়ে গেছে। তোর দুলাভাই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছিল। এই সময় পালিয়ে যায়। কেউ কেউ ধারণা করছে তোর দুলাভাই টাকা খেয়ে তাকে ছেড়ে দিয়েছে।

বলো কী?

তুই তো তোর দুলাভাইকে চিনিস। তুই বল সে কি টাকা খাওয়ার মানুষ?

প্রশ্নই ওঠে না।

টাকা খেলে তো অনেক আগেই সে আমার চিকিৎসা করত।

আপা, তুমি এখন কাঁদতে শুরু করবে না-কি?

অবশ্যই কাঁদব। তোর দুলাভাইকে ওরা সাসপেন্ড করেছে। তদন্ত কমিটিও না-কি হচ্ছে। সে বলেছে দুপুরে খেতে আসতে পারবে না।

তোমাকে যে চিঠি লেখার কথা সেটা কি লিখেছে?

লিখেছে নিশ্চয়ই। জিজ্ঞেস করি নি। টেলিফোন করে জিজ্ঞেস করব?

একটু পরে কর। পরিস্থিতি ঠান্ডা হোক। আর খাবার গরম কর। ক্ষিধে লেগেছে। স্বামীর শোকে তুমি ভাত খাবে না, এটা বুঝতেই পারছি।

গোসল করে আয় তারপর খাবি। বাথরুমে তোর দুলাভাইয়ের ধোয়া লুঙ্গি আছে। গামছা আছে।

শোভা বেচারি অসম্ভব মন খারাপ করেছে। তার মন ঠিক করার জন্যে ছোট্ট Tricks করলাম। এই ধরনের ট্রিকসে বোকা মেয়েরা অসম্ভব খুশি হয়। বুদ্ধিমতীরাও যে হয় না, তা না। আমি মুখ কাচুমাচু করে বললাম, আপু, খুব লোভ হচ্ছে তুমি দুলাভাইকে চিঠিতে কী লিখেছ সেটা পড়তে। পড়তে দেবে?

থাপপড় খাবি। (আপুর মুখে এখন আনন্দ।)

বিয়ের এত দিন পরেও কী ভালোবাসি করছ জানতে ইচ্ছা করছে।

চিঠি একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। তোকে পড়তে দেব কেন?

চিঠি পড়তে না দিলে কিন্তু আমি ভাত খাব না।

তুই কিন্তু এখন আমাকে রাগিয়ে দিচ্ছিস। (আপুর চোখে রাগের চিহ্নও নেই। তিনি আনন্দে ঝলমল করছেন।) তোর মতলবটা এখন বুঝতে পারছি। তুই চিঠি নিয়ে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিবি। আমার চিঠি যদি পানিতে ভিজে তাহলে কিন্তু তোর খবর আছে।

কী করতে হবে আপু বলে দিয়েছেন। আমি তাই করলাম। চিঠি নিয়ে অতি দ্রুত বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করলাম। আপু দরজায় ধাক্কা দিয়ে বললেন, চিঠির প্রথম চার লাইন পড়বি না। তোকে আল্লাহর দোহাই লাগে।

প্রথম চার লাইনে কী আছে?

যাই থাকুক, তুই কিন্তু পড়বি না।

আমি তো পড়ে ফেলেছি। তোমার চিঠির মূল হচ্ছে প্রথম চার লাইন।

তোর মাথা!

প্ৰথম চার লাইনে লেখা—

এই যে, বাবু সাহেব!
গুটগুটি মুটিমুট টেংটেং। শোন, তুমি কিন্তু ব্যাং। করো খ্যং খ্যাং। আমি রাগ করেছি। এত ছোট চিঠি কেন লেখা? আমি কি বাচ্চা মেয়ে? সাতদিন পর একটা চিঠি। ইকি মিকি পিকি। লেক্কা পেক্কা।

 

শোভা আপু আদর্শ বঙ্গ ললনাদের মতো যত্ন করে আমাকে খেতে দিলেন। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে, তারপরেও তিনি একটা খবরের কাগজ ভাঁজ করে হাতে নিয়ে আমার পাশে বসেছেন। খবরের কাগজ দিয়ে গরম ভাতে হাওয়া দিচ্ছেন। আমি বললাম, শোভা আপু, টেলিভিশনে তো খবর দিচ্ছে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় খবর প্রচার হয়। তারপরেও খবরের কাগজ টিকে থাকবে। কেন বলো তো?

জানি না, কেন? একটাই কারণ–খবরের কাগজ দিয়ে বাতাস দেয়া যায়। টেলিভিশন দিয়ে

বাতাস দেয়া যায় না।

শোভা আপু সামান্য রসিকতাতেই হাসতে হাসতে চেয়ার থেকে পড়ে যাবার উপক্রম করলেন। অতি কষ্টে হাসি থামিয়ে বললেন, তুই এত দুষ্ট কেন?

আমি বললাম, তুমিও তো দুষ্ট্র। প্রেমের চিঠিতে লিখছ— গুটিগুটি মুটিমুট টেংটেং। তোমার সব চিঠির শুরুই কি এরকম?

হুঁ। বাবু সাহেবের সঙ্গে ফাজলামি করি। ফাজলামি করলে ও রেগে যায়। ওকে ব্লাগাতে ভালো লাগে। রাগলে তোতলামি শুরু হয়। তখন আমাকে শোভা ডাকতে পারে না। আমাকে ডাকে–শো শো শো.। আমি আরো রাগাবার জন্যে বলি— কো কো কো।

শোভা আপু! আবার হাসতে শুরু করেছেন। এবারে হাসির পাওয়ার আগের বারের চেয়েও বেশি। মনে হচ্ছে চেয়ার থেকে পড়ে একটা দুর্ঘটনাই ঘটবেন। আমি বললাম, আমার খাওয়া শেষ পর‍্যায়ে। তুমি দুলাভাইকে টেলিফোনে ধরে দাও। তার সঙ্গে কথা বলে তাকে রাগিয়ে দিয়ে আমি বিদায় হব।

এখন চলে যাবি কেন? পান এনে দিচ্ছি। পান খেয়ে ঘুম দে। তোর দুলাভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে তারপর যাবি।

শোভা আপু, দুলাভাইয়ের সঙ্গে আরেক দিন দেখা করব। তবে তোমার সঙ্গে সবসময়ই টেলিফোনে যোগাযোগ থাকবে।

 

আমার হাতে টেলিফোন। ওপাশে কবীর সাহেব। আমি বললাম, কে দুলাভাই? গুটগুট মুটমুট টেংটেং?

কবীর সাহেব হতভম্ব গলায় বললেন, Who are you?

কে?

শোভা আপুর চিঠিটা কি লিখেছেন? আজি বুধবার, চিঠি দিবস।

গলা শুনে চিনতে পারছেন না? আমি আয়না মজিদ। বলেছিলাম না। দুপুরে বোয়াল মাছের এক টুকরা খেতে চাই। আপনার বাসায় এসে খেয়েছি–রান্না ভালো হয় নি। শোভা আপুর রান্নার হাত জঘন্য। বোয়াল মাছের আঁশটে গন্ধ একেবারেই যায় নি।

কবীর সাহেব আবার বললেন, Who are you?

বললাম না, আয়না মজিদ।

ঘটাং করে শব্দ হলো। তিনি টেলিফোন রেখে দিয়েছেন। তার ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ড চোখের সামনে স্পষ্ট দেখছি। তিনি চাচ্ছেন উড়াল দিয়ে নিজের বাড়িতে চলে আসতে। সেটা সম্ভব না হওয়ায় লাফ দিয়ে জিপে উঠেছেন। ড্রাইভারকে বলছেন, তাড়াতাড়ি চালাও, তাড়াতাড়ি। বারবার ঘড়ি দেখছেন। ঘাম হচ্ছে। ঘামে শার্ট ভিজে উঠেছে। তার হাটের সমস্যা থাকলে টেনশনে ছোটখাটো স্ট্রোকের মতো হয়ে যাবার কথা।

আমি পান মুখে দিয়ে শোভা আপুর কাছ থেকে বিদায় নিলাম। বিদায়ের আগে বললাম, আপু, তুমি এতক্ষণেও আমার নামটা মনে করতে পারলে না। দুঃখ নিয়ে বিদায় নিচ্ছি।

তুই তোর নামের প্রথম অক্ষরটা বল, তাহলেই মনে পড়বে।

নামের প্রথম অক্ষর হি।

হি দিয়ে কোনো নাম শুরু হয়? কেন আমার সন্সে ফাজলামি করছিস? হি দিয়ে কোনো নাম হয় না। হি দিয়ে হয় হিসাব। তোর নাম কি হিসাব?

হ্যাঁ, আমার নাম হিসাব।

তোর নাম হিসাব হলে আমার নাম নিকাশ, আমরা দুই ভাই বোন মিলে হিসাব নিকাশ।

শোভা আপু আমাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। তার চোখ ছলছল করছে। আমি বললাম, You are the sister I never had. নিচু হয়ে শোভা আপুর পা স্পর্শ করলাম। তিনি আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, আল্লাহপাক, আমার এই পাগলা ভাইটাকে সর্ব বিপদ থেকে রক্ষা করো।

কোথায় যাওয়া যায়। তাই ভাবছি। সরীসৃপের মতো গর্তে ঢুকে যেতে হবে। কয়েকদিনের জন্যে out of circulation হয়ে যাওয়া। মাজেদা খালার বাড়ি কিংবা বাদলদের বাড়ি। নিতান্ত অপরিচিত কোনো বাড়ির কলিংবেল টিপে ভাগ্য পরীক্ষা করা যেতে পারে। কলিংবেল টেপা হলো। গম্ভীর চেহারার এক ভদ্রলোক দরজা খুলে বললেন, কী চাই?

আমি বলব, স্যার, দুদিন আপনার বাড়িতে থাকতে পারি? দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী আয়না মজিদ বিষয়ে পড়াশোনা করব। আমার নিরিবিলি দরকার।

বাদলের বাড়িতে যাওয়া ঠিক হবে না। তার পরীক্ষা চলছে। আমার দেখা পেলে তার পড়াশোনা শুধু যে মাথায় উঠবে তা-না, মাথা ফুড়ে বের হয়ে যাবে। তারচে বড় কথা বাদলের বাবা, আমার খালু সাহেব, আমাকে কঠিন এক চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠি না বলে তাকে হাতবোমা বলাই ভালো।

(অতি জরুরি)
বরাবর
হিমু।
বিষয়; বাদলের পরীক্ষা। তোমার কর্তব্য।
হিমু,
তোমাকে কোনোভাবেই খুঁজে না পেয়ে এই চিঠি লিখছি। তোমার মতো ভবঘুরে মানুষকে চিঠি লিখতে রুচি হচ্ছে না। তারপরেও বাধ্য হয়ে লিখছি। কারণ প্রয়োজন বাধ্যবাধকতা মানে না।
বাদলের পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। তুমি নিশ্চয়ই চাও সে পাশ করুক। না-কি চাও না? আমি চাই। তোমার লেজ ধরে ঢাকা শহরে সে হেঁটে বেড়াক এটা আমি চাই না।
বাদলের পরীক্ষা পাশের ব্যাপারে। আমি এখন তোমার সাহায্য চাচ্ছি। তুমি আগামী তিন মাস বাদলের ৫০ হাজার গজের ভেতরে আসবে না। এটা আমার অনুরোধ না, আদেশ। কঠিন আদেশ। আদেশ অমান্য করলে গুলি করে। তোমাকে মেরে ফেলতেও আমি দ্বিধা করব না। তুমি জানো আমার লাইসেন্স করা পিস্তল আছে।…

কিছুক্ষণের জন্যে ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর

কিছুক্ষণের জন্যে ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর হয়ে গেলাম। তিনি স্ট্রিট ল্যাম্পের আলোয় পড়াশোনা করেছেন। আমিও এখন তাই করছি। ল্যাম্পের আলোয় আয়না মজিদের প্রতিবেদন নিয়ে বসেছি। পা ছড়িয়ে বসেছি। পাশেই রাস্তা-পরিবারের কিছু সদস্য। বাবা-মা এবং দুই ছেলে। কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। কম্বল দুটাই নতুন। ঢাকা শহরের কিছু মানুষ আছেন যারা রাস্তাবাসীদের কম্বল দিয়ে ঢেকে দিতে পছন্দ করেন। এরা কম্বল ছাড়া কিছুই দেন না। কেন দেন না সেটা একটা রহস্য।

আমার পাশে শুয়ে থাকা রাস্তা পরিবারের সদস্যদের একজন জেগে গেছে। চোখ বড় করে আমাকে দেখছে। এর বয়স আট নয় বছর। ভাবুক ধরনের চেহারা। নরম বিছানায় টেডি বিয়ার জড়িয়ে শুয়ে থাকলে একে খুব মানাতো। সে আমার দিকে তাকিয়ে কৌতূহলী গলায় বলল, কী করেন?

আমি বললাম, লেখাপড়া করি রে ব্যাটা।

লেখাপড়া করেন ক্যান?

লেখাপড়া না করলে গাড়ি ঘোড়ায় চড়া যাবে না। এই জন্যেই লেখাপড়া। তোর নাম কী?

মজিদ।

বাহ ভালো তো। তুই এক মজিদ আর আমার হাতে আরেক মজিদ।

ছোট্ট মজিদ গভীর কৌতূহলে আমাকে দেখছে, আমিও কৌতূহল নিয়েই পড়ছি আয়না মজিদ বৃত্তান্ত।

আয়না মজিদ
প্রতিবেদন

পাঁচ শীর্ষ সন্ত্রাসীর একজন। তাকে ধরিয়ে দেবার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ঘোষিত পুরস্কার মূল্য নগদ এক লক্ষ টাকা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থারাও পুরস্কারের জন্যে বিবেচিত হবেন। তার বিষয়ে প্রদত্ত সমস্ত তথ্য গোপন রাখা হবে।

আয়না মজিদের উত্থান

কারওয়ান বাজারে পাইকারি তরকারি বিক্রেতা আব্দুল হালিম সাহেবের সঙ্গে সাত বছর বয়সে হেল্পার হিসেবে কাজ শুরু করে। দশ বছর বয়সে টাকা চুরির দায়ে চাকরি চলে যায়। মাস তিনেকের মধ্যে সে চাকরি নেয় দোতলা লঞ্চ এম ভি যমুনায়। এম ভি যমুনা ঢাকা পটুয়াখালি রুটের লঞ্চ। লঞ্চের ভাতের হোটেলের অ্যাসিসটেন্ট বাবুর্চি। এই চাকরি সে দুই বছর করে। মূল বাবুর্চির সঙ্গে একদিন তার হাতাহাতি হয়। এক পর‍্যায়ে সে বাবুর্চিকে (রুস্তম মিয়া, বাড়ি পিরোজপুর) ধাক্কা দিয়ে লঞ্চ থেকে ফেলে দেয়। মজিদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এক বছর সে হাজত খাটে। উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণ না পাওয়ায় এবং রুস্তম মিয়ার ডেডবডি খুঁজে না পাওয়ায় মজিদ খালাস পেয়ে বের হয়ে আসে। শুরু হয় তার নতুন জীবন। গাড়ির সাইড ভিউ মিরর চুরি করা।

গাড়ির আয়না চুরিতে সে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করে। চলন্ত গাড়ির আয়নাও সে দৌড়ে এসে ভেঙে নিয়ে পালাতে পারত। আয়না চুরির কারণেই সে আয়না মজিদ নামে পরিচিতি লাভ করে।

ছিনতাইকারী সরফরাজ হাওলাদার তাকে আশ্রয় দেয়। সরফরাজের হাতেই তার অস্ত্ৰশিক্ষা শুরু হয়। মাত্র আঠারো বছর বয়সে সে সরফরাজকে হত্যা করে এই বাহিনীর সর্বময় কর্তা হয়ে বসে। তখন তার পরিচয় হয়। কারওয়ান বাজারের আরেক উঠতি সন্ত্রাসী লম্বু খোকনের সঙ্গে। লম্বু খোকন কারওয়ান বাজার এলাকার মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করত। লম্বু খোকনকে দলে টেনে নিয়ে সে মাদক ব্যবসার পুরো নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেয়।

সুষমা রানী ও তার স্বামী হেমন্তর হাতে ছিল মিরপুর এবং পল্লবীর হিরোইন, ফেনসিডিল ব্যবসা। আয়না মজিদ সুষমা রানীর সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে এবং এক রাতে হেমন্তকে গুলি করে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডটি করে সে প্রকাশ্যে এক চায়ের দোকানের সামনে। গুলি করার পর সে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে, আমার নাম আয়না মজিদ। কেউ আমারে ধরতে চাইলে ধরেন। কারো সাহস থাকলে আগায়া আসেন।

কেউ এগিয়ে আসে নি। সে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে একটি বেবিটেক্সিতে উঠে চলে যায়,

আওয়ামী লীগের আমলে সে যুবলীগের সদস্য হিসেবে আত্মপ্ৰকাশ করে। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মিটিং মিছিলে অংশগ্রহণ করে। আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর আশ্রয়ে নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সে বিএনপিতে যোগ দেয়। হাওয়া ভবনের নানান কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়। পুলিশের জনৈক সাব ইন্সপেক্টরকে হত্যার অপরাধে তাকে গ্রেফতার করা হয়। বিএনপির এক মন্ত্রীর হস্তক্ষেপে সে ছাড়া পায়।

গুলশান এলাকার একটা ফ্ল্যাট সে ভাড়া করে। এই ফ্ল্যাটে সে নানান পেশার গুরুত্বপূর্ণ মানুষকে নিয়ে আসত। ভুলিয়ে ভালিয়ে এদেরকে আনার কাজটা করত। সুষমা রানী। অসম্ভব রূপবতী এই তরুণীর ছলাকলায় অনেকেই পা দিয়েছেন। যারা পা দিয়েছেন তারাই বাধ্য হয়েছেন এই তরুণীর সঙ্গে নগ্ন ফটোসেশন করতে। এইসব ছবি ব্যবহৃত হতো। ব্ল্যাকমেইলিং-এর কাজে। ব্ল্যাকমেইলিং ছাড়াও এইসব ছবি রাজনৈতিক স্বার্থেও ব্যবহৃত হতো। বাংলাদেশের বিখ্যাত কিছু মানুষের সঙ্গে সুষমা রানীর পর্ণোছবি আছে।

গোপন খবরের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে পুলিশ এক রাতে অসংখ্য স্টিল ছবি এবং কিছু ভিডিও ছবিসহ সুষম রানীকে গুলশানের ফ্ল্যাট থেকে গ্রেফতার করে। তার বিরুদ্ধে পুলিশ চার্জশীট দেয়, কিন্তু বিচিত্র কারণে কোর্ট সুষমা রানীকে জামিন দিয়ে দেয়। জামিনের পর থেকেই সুষমা পলাতক।

আয়না মজিদের বিরুদ্ধে ঢাকা এবং চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় ১৪টি হত্যা মামলা আছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের দুই ভাই হত্যা মামলা মিডিয়ার কারণে বহুল আলোচিত।

আয়না মজিদের বর্তমান বয়স চল্লিশ থেকে পয়তাল্লিশ। সে সুদৰ্শন এবং মিষ্টভাষী। তার ব্যবহার ভদ্র। তার বাবা ছামসু মাস্টার গলাচিপা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। ঘূর্ণিঝড়ে বাড়িচাপা পড়ে তিনি এবং তার স্ত্রী জাহেদা খানম মারা যান। মজিদকে লালনপালন করেন তার দূরসম্পর্কের চাচা মোবারক মিয়া। কাকার আশ্ৰয় থেকে মজিদ মিয়া পালিয়ে যায় সাত বছর বয়সে।

কারওয়ান বাজার টোকাইদের স্কুলে আয়না মজিদ লেখাপড়া শিখেছে। শিক্ষকদের ভাষ্যমতে ছাত্র হিসেবে সে মেধাবী ছিল।

পড়াশোনার প্রতি আয়না মজিদের আগ্রহের কথা অনেক সূত্রেই জানা গেছে। ইংরেজি শেখার জন্যে সে তিন বছর গৃহশিক্ষক রেখেছিল। সে যে এক বছর জেল হাজতে ছিল সেই সময়ের প্রায় সবটাই জেল লাইব্রেরির বই পড়ে কাটিয়েছে।

বড় সন্ত্রাসীদের দান খয়রাত করার অনেক উদাহরণ থাকলেও আয়না মজিদের তা নেই। তবে সে একবার প্রায় পঞ্চশ হাজার টাকার বই জেল লাইব্রেরিতে পাঠিয়েছিল। বইয়ের তালিকা ঘেঁটে দেখা যায় সবই বিজ্ঞান, ইতিহাস এবং ধর্মতত্ত্ববিষয়ক। গল্প-উপন্যাস না।

আয়না মজিদ বিষয়ে বিশেষ তথ্য

ক) তার সানগ্রাস প্রীতি আছে। সারাক্ষণই সে সানগ্রাস পরে থাকে। রাতেও চোখে সানগ্লাস থাকে।

খ) তার রিকশা প্রীতি আছে। গাড়িতে বাঁ বেবিটেক্সিতে তাকে কমই চড়তে দেখা গেছে। বড় বড় অপারেশনে সে রিকশা করে গিয়েছে। অপারেশন শেষ করে রিকশা করে ফিরেছে। এই জাতীয় কাজের জন্যে তার নিজের কোনো রিকশা নেই। সবই ভাড়া করা রিকশা।

গ) তার সুখাদ্য প্রীতি আছে। ভালো ভালো রেস্টুরেন্টে তাকে আয়োজন করে খেতে দেখা যায়।

ঘ) বেশিরভাগ সময়ই তাকে একা চলাফেরা করতে দেখা যায়। বডিগার্ড ধরনের কাউকে তার আশেপাশে কখনো দেখা যায় নি।

ঙ) সুষমার দেওয়া তথ্য অনুসারে তার ভয়াবহ মাইগ্রেনের ব্যথা আছে। ব্যথার প্রকোপ উঠলে এক নাগাড়ে দুই থেকে তিনদিন সে ছটফট করে। নানান চিকিৎসাতেও এই ব্যথা সারে নি। সে না-কি ঘোষণা দিয়েছে, যে তার মাইগ্রেনের ব্যথা সারিয়ে দেবে প্রয়োজনে তার জন্যে সে জীবন দিয়ে দেবে।

চ) তার রহস্যপ্রিয়তা আছে। মানুষকে হতভম্ব করে সে মজা পায়। এই মজাটা বেশিরভাগ সময় সে করে পুলিশের সঙ্গে। সার্জেন্ট জহিরুলের কাহিনীটি উল্লেখ করা যেতে পারে।

সার্জেন্ট জহিরুল বিজয় সারণীর কাছে ডিউটিরত ছিলেন। এই সময় জনৈক সুদৰ্শন সানগ্লাস পরা ভদ্রলোক তাকে এসে বিনীত গলায় বললেন, মোটর সাইকেলে করে তাকে কি রাস্তা পার করে দেয়া সম্ভব? ট্রাফিকের জন্যে তিনি রাস্তা পার হতে পারছেন না। তার রাস্তার ওপাশে যাওয়া অসম্ভব জরুরি। ট্রাফিক সার্জেন্ট তাকে রাস্তা পার করে দেন। সানগ্রাস পরা ভদ্রলোক তখন তাকে

আন্তরিক ধন্যবাদ দেন। এবং বলেন, আমাকে কি আপনি চিনেছেন? আমি আয়না মজিদ। ইচ্ছা করলে আপনি আমাকে অ্যাপ্লেষ্ট করতে পারেন। অ্যারেক্ট করলেই এক লাখ টাকা পুরস্কার এবং প্রমোশন পাবেন।

ঘটনার আকস্মিকতায় ট্রাফিক সার্জেন্ট হতভম্ব হয়ে পড়েন। এই সুযোগে আয়না মজিদ ভিড়ের মধ্যে মিশে যায়।

আয়না মজিদ প্রসঙ্গে আরেকটি বিশেষ তথ্য। তার কুকুর ভীতি প্রবল। রাস্তার অনেক কুকুরকে সে গুলি করে হত্যা করেছে। কুকুর হত্যার মোটিভ সম্ভবত কুকুর ভীতি।

আয়না মজিদ নৌকায় থাকতে পছন্দ করে। বুড়িগঙ্গ্য তার নিজের নৌকা আছে। যেখানে সে রাতে বাস করে। অনেক চেষ্টা করেও নৌকা শনাক্ত করা যায় নি।

আমি আছি বাদলদের বাড়িতে

আমি আছি বাদলদের বাড়িতে।

এ বাড়িতে বাস করা দূরের কথা, বাদলের ৫০ হাজার গজের মধ্যে থাকাই আমার জন্যে নিষেধ ছিল। কোনো এক কারণে পরিস্থিতি ভিন্ন। খালু সাহেব আমাকে দেখে হাসিমুখে বলেছেন, আরো তুমি! কেমন আছ?

জি ভালো।

অনেকদিন পরে তোমাকে দেখলাম। এসেছ যখন কয়েকদিন থাক।

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, জি আচ্ছা।

খালু সাহেব আনন্দিত গলায় স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, এই শুনছ, হিমু। কিছুদিন থাকবে আমাদের সঙ্গে। গেষ্টরুমটা খুলে দাও। বাথরুমে সাবান, টাওয়েল আছে কি-না দেখা।

খালাও গালভর্তি করে হাসলেন।

যাকে বলে। লালগালিচা অভ্যর্থনা। আমি বাদলকে আড়ালে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপার কী রে! আমাকে নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে।

বাদল গলার স্বর কাঁপা কাঁপা অবস্থায় নিয়ে বলল, তুমি তো টানাটানি করার মতোই মানুষ। সাধারণ কেউ তো না।

তোর কাছে টানাটানির মানুষ। খালু সাহেব বাঁ খালার কাছে না। তাদের কাছে Father driven, Mother broomed.

এর মানে কী?

Father driven মানে বাপে খেদানো। Mother broomed মানে মায়ের ঝাড়ু দিয়ে বিতাড়ন।

বাদল বলল, মানে টানে নিয়ে আমি মাথা ঘামাচ্ছি না। তুমি গেষ্টরুমে থাকতে পারবে না। তুমি থাকবে আমার সঙ্গে। খাটে ঘুমাবে, আমি মেঝেতে কম্বল পেতে ঘুমাব। সারারাত গল্প করব। ছবি দেখব।

গুড।

তুমি যে কয়দিন থাকবে আমি ইউনিভার্সিটিতে যাব না। চব্বিশ ঘণ্টা তোমার সঙ্গে থাকব। আমাকে কেউ হাতি দিয়ে টেনেও তোমার কাছ থেকে সরাতে পারবে না।

কাঁঠালের আঠা হয়ে যাবি?

অবশ্যই।

আমাকে বিস্মিত করে খালা এসে জানতে চাইলেন, দুপুরে কী খাবি?

আমি বললাম, যা খাওয়াবে তাই খাব।

তোর কী খেতে ইচ্ছা করে বল? পথেঘাটে থাকিস, আত্মীয়স্বজনদের বাসায় এসে ভালোমন্দ খাবার ইচ্ছা হতেই পারে। হিমু, দশ পনেরো দিনের আগে নড়ার নামও নিবি না।

আমি বললাম, ঠিক করে বলে তো তোমাদের সমস্যাটা কী?

এর মধ্যে তুই সমস্যা খুঁজে পেয়ে গেলি? আমি তোর খালা না?

বাদলের ঘরে টেলিভিশন ছিল না। সে গেষ্টরুম থেকে টিভি নিয়ে এলো। আমার হাতে টিভির রিমোট ধরিয়ে বলল, শুয়ে শুয়ে টিভি দেখবে। টেবিলের উপর খবরের কাগজ।

আমি টিভি দেখি না। খবরের কাগজও পড়ি না।

এখন টিভি দেখবে, খবরের কাগজ পড়বে। অনেকদিন পর এই কাজটা করবে তো–আনন্দ পাবে। চা খাবে? চা দিতে বলি?

আমি বললাম, দে।

খবরের কাগজ পড়ে বিশেষ আনন্দ পেলাম। সেকেন্ড হেডলাইন— সর্ষেতে ভূত। পুলিশের হেফাজত থেকে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী আয়না মজিদের পালিয়ে যাওয়ার কাহিনীর চমৎকার বর্ণনা।

সর্ষেতে ভূত
(নিজস্ব প্রতিবেদক)

শীর্ষ সন্ত্রাসী আয়না মজিদ পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়েছে। তার পলায়ন নিয়ে নানান ধরনের রহস্য দানা বাঁধতে শুরু করেছে। পুলিশ যে ভাষ্য দিচ্ছে তা কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না।

পুলিশ বলছে, সকাল আটটা বিশ থেকে আয়না মজিদকে একটি বিশেষ কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে সে স্বীকার করে যে, সে-ই আয়না মজিদ। তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী লম্বু খোকন এবং তার কুকর্মের বান্ধবী সুষমা রানী বিষয়েও সে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়। তথ্যগুলি যাচাইবাছাইয়ের জন্যে তদন্তকারী কর্মকর্তা কিছুক্ষণের জন্যে জিজ্ঞাসাবাদের বিরতি নেন। আয়না মজিদকে হাতকড়া বাধা অবস্থায় ঘরে রেখে তিনি ঘর তালাবন্ধ করে দেন। ফিরে এসে দেখেন আয়না মজিদ হাতকড়া খুলে জানালার গ্রীল কেটে পালিয়ে গেছে।

আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, হাতকড়া খোলার চাবি সে কোথায় পাবে? চাবি কি তাকে গোপনে দেয়া হয়েছিল? গ্রীল কাটার জন্যেও যন্ত্র প্রয়োজন, এই যন্ত্র সে কোথায় পেয়েছে? গ্ৰীল কাটার শব্দ অবশ্যই হবে। থানায় এত লোকজন, কেউ শব্দ শুনতে পেল না! বিশেষ ক্ষণে সবাই একসঙ্গে বধির হয়ে গেল?

জিজ্ঞাসাবাদের সময় এক পর‍্যায়ে আয়না মজিদকে জামাই আদর করে চা গরম সিঙ্গারা খাওয়ানো হয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তাও এই তথ্য স্বীকার করেছেন। হাতকড়া দিয়ে হাত পেছনে বাঁধা। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, এই অবস্থায় আয়না মজিদ চা সিঙ্গারা খাবে কীভাবে? আমরা কি ধরে নেব। তদন্তকারী কর্মকর্তা মুখে তুলে তাকে খাইয়েছেন? দুর্ধর্ষ এক সন্ত্রাসীকে হঠাৎ জামাই আদর শুরু করা হলো কেন? কাদের নির্দেশে হঠাৎ আদর আপ্যায়ন?

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আয়না মজিদের পলায়নের পরপরই থানার ওসি সাহেব একটা টেলিফোন পান। টেলিফোনে তাকে জানানো হয় যে, তার জন্যে মধু এবং বনমোরগ আসছে। বনমোরাগের ংখ্যা নিয়ে দরকষাকষিও হয়। ওসি সাহেব চাচ্ছেন চারটা বনমোরগ, অপরপক্ষ দিতে চাচ্ছে তিনটা বনমোরগ। এই বনমোরগ কি আসলেই বনমোরগ? না-কি বনমোরাগের আড়ালে অন্যকিছু?

আমরা মনে করি বনমোরগ সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত। মধু কিংবা বনমোরগ কোনোটাই থাকা উচিত না। তদন্ত কর্মকর্তা এস কবীর সাহেবকে লোক দেখানো সাসপেন্ড করা হয়েছে। আমরা মনে করি বিষয়টির সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। পর্দার আড়ালের রাঘববোয়ালদের বের করা উচিত। বনমোরগ বনে থাকবে, মধু থাকবে মধুর চাকে। এটাই শোভন। আইন প্রয়োগকারী কর্তব্যক্তিদের চারপাশে বনমোরগ ঘুরবে এবং ক্ষণে ক্ষণে কোেকর কো করবে। এটা শোভন না। জাতি বনমোরগের হাত থেকে মুক্তি চায়। সর্ষের ভূতের স্বরূপ উদ্‌ঘাটন চায়।

দুপুরে হেভি খাওয়াদাওয়া হলো। খালু সাহেব অফিসে যান নি। সবাই মিলে একসঙ্গে খাওয়া। শুনলাম কয়েকদিন ধরেই তিনি অফিসে যাচ্ছেন না। তার যে শরীর খারাপ তাও না। তবে চোখে ভরসা হারানো দৃষ্টি। হড়বড় করে অকারণে কথা বলে যাচ্ছেন। পৃথিবীর সবচে স্বাদু খাবার কী— এই বিষয়ে দীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন। তাঁর মতে হরিয়াল পাখির মাংস পৃথিবীর সবচে স্বাদু খাবার। কারণ এই পাখি বটফল খায়, মাছ খায় না। হরিয়াল পাখি কীভাবে রান্না করতে হয় সেই রেসিপিও দিলেন। সব পাখির মাংসে রসুন বেশি লাগে, হরিয়ালের ক্ষেত্রে লাগে না। কারণ এই পাখির শরীরেই রসুনটাইপ গন্ধ। নার্ভাস মানুষরা নাৰ্ভাসনেস কাটাতে অকারণে কথা বলে। খালু সাহেব কোনো কারণে নার্ভাস। ঘটনা কিছু একটা অবশ্যই আছে, তা যথাসময়ে জানা যাবে।

দুপুরে খাবার পর বাদলকে নিয়ে ছবি দেখলাম। ছবির নাম Hostel. বাদলকে নিয়ে ছবি দেখা বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা। রানিং কমেট্রির মতো সে বলে। যাবে কোন দৃশ্যের পর কোন দৃশ্য আসছে।

হিমুদা, সুন্দর মেয়েটা দেখছে না, এক্ষুনি কাটা চামচ দিয়ে তার একটা চোখ তুলে ফেলা হবে। বাঁ চোখটা তুলবে।

কেন?

আনন্দ পাওয়ার জন্যে কাজটা করছে। অন্যকে কষ্ট দেয়ার মধ্যে আনন্দ আছে। আবার কষ্ট পাবার মধ্যে আনন্দ আছে। হিমুদা, তাকিয়ে থাক, এক্ষুনি চোখ তোলা হবে। ভয়ঙ্কর দৃশ্য।

চোখ তোলার ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল রাত আটটায়। বিকাল চারটা থেকে রাত আটটা। টানা চার ঘণ্টা ঘুম।

বাদল দ্বিতীয় একটা ছবি নিয়ে অপেক্ষা করছে। আমার ঘুম ভাঙলেই ছবি শুরু হবে। আমাকে বিছানায় উঠে বসতে দেখে বাদল বলল, তুমি যে ঘুমিয়ে পড়েছ এটা বুঝতে অনেক সময় লেগেছে। ছবি শেষ হবার পর তাকিয়ে দেখি তুমি গভীর ঘুমে। ওই ছবির শেষ অংশটা দেখবে, না-কি অন্য কোনো ছবি দেব?

নতুন একটা দে।

Horor?

হুঁ।

তিনটা হরর ছবি কিনেছি। একটার চেয়ে আরেকটা ভালো। চল তিনটা ছবিই আজ দেখে ফেলি। দেখবে?

চল দেখি।

হুট করে তুমি চলে যাবে, তোমাকে নিয়ে আর ছবি দেখা হবে না। ফ্লাস্কভর্তি চা নিয়ে বসব। তোমার ঘুম পেলেই তোমাকে চা খাওয়াব। রাত দশটার পর শুরু হবে ছবির অনুষ্ঠান।

দশটা না বাজা পর্যন্ত কী করব?

বাদল মনে হলো চিন্তায় পড়ে গেছে। দশটা না বাজা পর্যন্ত কী করা হবে ভেবে পাচ্ছে না।

খালু সাহেব বাদলকে বিপদমুক্ত করলেন। আমাকে ছাদে ডেকে পাঠালেন।

 

ছাদে শীতলপাটি বিছিয়ে খালু সাহেব আসর শুরু করেছেন। পানি, গ্লাস, বরফ এবং Teacher নামের হুইস্কির বোতল দেখা যাচ্ছে। খালু সাহেবের হাতে গ্লাস। ছাদ অন্ধকার বলে তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। তিনি আনন্দিত কি-না তাও বুঝতে পারছি না। তবে দুএক পেগ পেটে পড়লেই তিনি আনন্দময় ভুবনে প্রবেশ করবেন।

হিমু। বোস বোস। তোমার সঙ্গে প্ৰায় সময়ই দুর্ব্যবহার করি, কিছু মনে করো না। আন্মি চিন্তা করে দেখলাম, At the end of the day you are a good person.

থ্যাংক য়্যু।

থ্যাংক য়্যু দিতে হবে না। You deserve this. তুমি লোক ভালো। অবশ্যই ভালো। কেউ তোমাকে মন্দ বললে তার সঙ্গে আমি আর্গুমেন্টে যাব।

খালু সাহেব, কটা খেয়েছেন?

দুটা। তাও স্মল পেগ। হাতে আছে তিন নম্বর। খেয়ে কোনো আনন্দ পাচ্ছি। না। টেনশন নিয়ে খাচ্ছি।

কেন?

অ্যালকোহলের বিরাট ক্রাইসিস যাচ্ছে। জিনিস পাওয়াই যাচ্ছে না। প্রিমিয়াম হুইস্কির স্বাদ ভুলে গেছি। বাজারভর্তি নকল দুনম্বরি জিনিস। অনেকেই খেয়ে মারা গেছে।

বলেন কী!

পত্রিকা পড় না? অনেক নিউজ বের হয়েছে। তবে আসল নিউজ কেউ সাহস করে ছাপছে না।

আসল নিউজটা কী?

পেঁয়াজ কাচামরিচের দাম বেড়েছে। পাওয়া যাচ্ছে না, এই নিউজ আছে। কিন্তু অ্যালকোহল যে পাওয়াই যাচ্ছে না। এই নিউজ নাই। আমি চিন্তা করেছি বেনামে পত্রিকায় একটা চিঠি লিখব। লেখা উচিত কি-না তুমি বলে।

অবশ্যই উচিত।

হেডিং হবে বিষাক্ত নকল মদ থেকে জাতিকে রক্ষা করুন। হেডিংটা কেমন?

ভালো।

সেখানে কিছু সাজেশন থাকবে। যেমন, সরকারি পরিচালনায় ন্যায্যমূল্যের মদের দোকান। যে-কেউ সেখান থেকে মদ কিনতে পারবে না, শুধু লাইসেন্সধারীরা পারবে।

আপনার লাইসেন্স আছে?

অবশ্যই আছে। মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে দেয়া লাইসেন্স। দেখবে?

দরকার নেই।

অবশ্যই দরকার আছে। তুমি ভেবে বসে আছ আমি বিনা লাইসেন্সে মদ খাচ্ছি। তা-না। আমি যখন নিজের বাড়ির ছাদে বসে মদ খাই তখনো সঙ্গে লাইসেন্স থাকে।

ভালো তো।

খালু সাহেব হাতের গ্লাস দ্রুত শেষ করে চতুর্থটা নিলেন। তৃপ্তির একটা শব্দও করলেন–আহা! সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, তোমাকে ছোট্ট একটা কাজ করে দিতে হবে হিমু। পারবে না?

অবশ্যই পারব।

জটিল কোনো কাজও অবশ্যি না। একজনকে কিছু টাকা পৌঁছে দেয়া। দুই লাখ টাকা।

এখন দিয়ে আসব?

কাল সকালে নিয়ে যাও। ঠিকানা দিয়ে দেব। সেই ঠিকানায় যাবে। দরজায় টোকা দেবে। যে দরজা খুলবে তাকে বলবে, কাচাবাজারের খবর কী?

কিসের খবর কী?

কাচাবাজারের খবর কী কিংবা বাজারের খবর কী? বাজার শব্দটা থাকলেই হবে। যে দরজা খুলবে সে তোমাকে বসাবে। কিছুক্ষণ বসে থাকবে। পাঁচ মিনিট হতে পারে, আবার ধর এক ঘণ্টাও হতে পারে। যতক্ষণ উনি না। আসছেন। ততক্ষণ বসে থাকবে। উনি এলে তার হাতে প্যাকেটটা দেবে।

উনিটা কে?

উনি কে তোমার জানার প্রয়োজন নাই।

এতগুলি টাকা কাকে দিচ্ছি জানব না? তার কাছ থেকে রশিদ আনব না?

তোমাকে এইসব কিছু করতে হবে না। তুমি টাকা দিয়ে চলে আসবে। ঘরে ঢোকার password হলো বাজার। বাজার শব্দটা শুধু মনে রাখবে। বাজার না বলে তুমি যদি মার্কেট বলো তাহলে কিন্তু তোমাকে ঘরে ঢুকাবে না।

ডিটেকটিভ উপন্যাসের মতো মনে হচ্ছে। ব্যাপারটা কী খোলাসা করুন তো খালু সাহেব। ঝেড়ে কাশুন।

খোলাসা করব না। ঝেড়েও কাশব না।

খালু সাহেব এক টানে চতুর্থ শেষ করে পঞ্চমে গেলেন এবং হড়বড় করে পুরো ব্যাপারটা খোলাসা করলেন। কাকে টাকা দিতে হবে জানা গেল। কাকতালীয় হোক বাঁ কোকিলতালীয় হোক, ঘটনার মূল নায়ক আমাদের আয়না মজিদ। এই সন্দেহ আমার গোড়া থেকেই হচ্ছিল।

ঘটনা হলো।— দিন দশেক আগে দুপুরবেলা খালু সাহেব একটা টেলিফোন পেলেন। টেলিফোনের ওপাশ থেকে বিনয়ী গলায় কেউ একজন বলল, স্যার ভালো আছেন?

খালু সাহেব বললেন, ভালো আছি, আপনি কে?

আমাকে চিনবেন না। আমি আপনার প্রতিবেশী। নতুন গাড়ি কিনেছেন দেখে ভালো লাগল। আলফার্ভে না?

জি।

চমৎকার গাড়ি। এরচে ভালো মাইক্রোবাস হয় বলেই আমার মনে হয় না।

কালো রঙ পেলেন না?

খোঁজ করেছিলাম, পাই নি।

মেরুন রঙটাও খারাপ না।

খালু সাহেব বললেন, আপনাকে চিনতে পারছি না। আপনার পরিচয়টা?

আমার নাম মজিদ। সবাই আয়না মজিদ হিসেবে আমাকে চেনে। আপনিও নিশ্চয়ই চিনেছেন। স্যার, আমি সামান্য সমস্যায় পড়েছি। আমাকে একটু সাহায্য করতে হয়। একটা ঠিকানা লিখুন তো।

খালু সাহেব ভড়কে গেলেন। যন্ত্রের মতো ঠিকানা লিখলেন। আয়না মজিদ বলল, এই ঠিকানায় স্যার পরশুর মধ্যে এক লাখ টাকা পাঠিয়ে দেবেন। প্রতিবেশী যদি প্রতিবেশীকে না দেখে তাহলে কে দেখবে? প্রতিবেশী যদি প্রতিবেশীকে না। চেনে তাহলে কে চিনবে? বাইবেলে আছে know thy neighbours. স্যার রাখি?

হতভম্ব খালু সাহেবের ব্লাড প্রেসার আকাশে উঠে গেল। শরীর ঘামতে লাগল। মাথা চক্কর দিতে লাগল। তিনি পুলিশের কাছে পুরো ঘটনা বললেন। পুলিশ ঐ ঠিকানায় উপস্থিত হয়ে দেখে বিধবা এক স্কুল শিক্ষিকা দুই বাচ্চা নিয়ে ঐ বাড়িতে থাকেন। তিনি পুলিশের কাছে ঘটনা শুনে কেঁদেকেটে অস্থির।

খালু সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। তার ব্লাড প্রেসার স্বাভাবিক হলো। তিন দিন পর আবার আয়না মজিদের টেলিফোন।

স্যার, কেমন আছেন? চিনতে পারছেন তো? আমি আয়না। শুরুতে একটা ভুল ঠিকানা দিয়েছিলাম, কারণ আমি ধরেই নিয়েছিলাম। আপনি পুলিশের কাছে যাবেন। এখন আসল ঠিকানা দিচ্ছি। কাগজ-কলম নিন। পুলিশে খবর দিয়েছেন বলে এখন এক লাখ টাকা বেশি দিতে হবে। কাউকে দিয়ে দু লাখ টাকা যে ঠিকানা দিচ্ছি। সে ঠিকানায় পাঠাবেন। দরজায় সে কড়া নাড়বে। তার পাসওয়ার্ড হচ্ছে বাজার। বলবে বাজার। ঠিক আছে? আপনাকে সময় দিচ্ছি। সাত দিন। সাত দিন চিন্তা-ভাবনার সময় পাবেন।

সাতদিন তিনি এক নাগাড়ে চিন্তা-ভাবনা করেছেন। অফিসেও যান নি। এখন সিদ্ধান্তে এসেছেন দুলাখ টাকা দিয়ে ঝামেলামুক্ত হবেন।

 

হিমু, কটা খেয়েছি তোমার কি মনে আছে?

না।

সাতটা খেয়ে ফেললাম না-কি? বমিভাব হচ্ছে।

ভাব হলে বমি করে ফেলুন। আরাম পাবেন।

আমার আরামের দরকার নাই। আগামীকাল সাত দিন শেষ হবে, ওই চিন্তাতেই সব আরাম হারাম।

আমি বললাম, চিন্তার কিছু নাই। কাল ভোরে টাকা নিয়ে চলে যাব। কলিংবেল বাজিয়ে বলব, কাচা বাজার এনেছি।

থ্যাংক য়্যু। হিমু! At the end of the day you are a good person. তুমি যে good person এই সম্মানে লাষ্ট একটা খাওয়া যাক।

বমির ভাব হচ্ছে বলছিলেন।

হলে হবে। তুমি কি মনে কর আমি বমি ভয় পাই?

না, সেরকম মনে করছি না।

দুষ্ট প্রকৃতির মানুষকে আমরা ভয় করতে পারি। বমিকে কেন ভয় করব?

খালু সাহেব বমি শুরু করেছেন। তাকে অসহায় লাগছে। দেখে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে বমি প্রক্রিয়াটাকে তিনি যথেষ্ট ভয় পাচ্ছেন।

হিমু।

জি।

আজ মনে হয় বমি করতে করতেই মারা যাব। জঘন্য মৃত্যু কী জানো? ডায়রিয়ায় মারা যাওয়া হচ্ছে জগতের জঘন্যতম মৃত্যু। দ্বিতীয় জঘন্যতম মৃত্যু হচ্ছে বমি করতে করতে মারা যাওয়া।

 

রাত এগারোটা। খালু সাহেবের বাড়ি নীরব। তিনি শান্ত হয়ে ঘুমুচ্ছেন। বাদল horror ছবি নিয়ে তৈরি। ছবির নাম The Eye, আমি টেলিফোন হাতে বারান্দায় হাঁটহীটি করছি। শোভা আপুর সঙ্গে কথা বলছি। নগরীর ওই প্রান্তে কী হচ্ছে জানা দরকার।

শোভা আপু, ঘুমুচ্ছ?

ঘুমাবো কীভাবে? তুই মহা প্যাঁচ লাগিয়ে চলে গেলি। তোর সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করব তাও জানি না। ঠিকানা দিয়ে যাস নি। এদিকে কী হচ্ছে না হচ্ছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

ঘটনা। কী? কোথায় প্যাঁচ লেগেছে খুলে বলো, আমি প্যাঁচ খুলে দিচ্ছি। প্যাঁচ দেয়া কঠিন, খোলা সহজ।

তুই চলে যাবার পরপরই তোর দুলাভাই এসে উপস্থিত। চোখমুখ ফ্যাকাসে, ঘামে গায়ের শার্ট ভেজা। চেনা যায় না। এমন অবস্থা। আমাকে বলল, আয়না মজিদ কোথায়?

আমি বললাম, আয়না মজিদ কোথায় আমি কী জানি? তোর দুলাইভাই তোতলাতে তোতলাতে বলল, দুপুরে বাসায় কে খে। খে খে। খেয়েছে?

আমি বললাম, আমার ভাই খেয়েছে।

সে কোথায়?

সে খাওয়া দাওয়া করে চলে গেছে।

শোভা! তুমি এই পৃথিবীর সবচে বোকা মহিলা।

আমি কোন বোকামিটা করলাম?

তুমি যা কর সবই বোকামি।

এই বলে তোর দুলাভাই যা শুরু করল তারচে বড় বোকামি কিছু হতে পারে না। আয়না মজিদকে খোঁজা শুরু করল। খাটের নিচে খোঁজে। বাথরুমে খোঁজে। ছাদে গেল। সেখানে খুঁজল। ছাদের পানির ট্যাংকের ডালা খুলে সেখানে খুঁজল।

আমি বললাম, পাগলামি করছি কেন?

সে বলল, পাগলামি করছি কেন যদি বুঝতে তাহলে পৃথিবীর সবচে বোকা মহিলা টাইটেল পেতে না।

টাইটেল কে দিয়েছে?

আমি দিয়েছি। এখন আমার সামনে থেকে যাও। আমার সামনে ঘুরঘুর করবে না।

আমি শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। রাতে আরেক কাণ্ড।

কী কাণ্ড?

রাতে পুলিশের তদন্ত টিম এসে উপস্থিত। বলো কী?

তদন্ত করতে এসেছিলেন হামিদ সাহেব। তুই তো উনাকে চিনিস।

আমি কীভাবে চিনব?

উনিই তো বোয়াল মাছ পাঠিয়েছিলেন।

ও আচ্ছা।

উনার কী সব উল্টাপাল্টা প্রশ্ন। প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, ভাবি, আপনার বাসায় কি কেউ বনমোরগ দিয়ে গেছে?

আমি বললাম, না তো!

কেউ কিছু দিয়ে যায় নি? বনমোরগ, মধু, কিছু না?

আমার এক দূরসম্পর্কের ভাই এসেছিল। সে দশ হাঁড়ি টক দৈ নিয়ে এসেছে।

দশ হাঁড়ি টক দৈ? ও মাই গড়! জিনিস ওই টক দৈ-এর ভেতরে।

কী জিনিস?

ভাবি, আমার যতদূর ধারণা ক্যাশ টাকা। পলিথিন দিয়ে টাকা মুড়িয়ে তার উপর টক দৈ দিয়েছে। ওস্তাদ আদমি।

তারপর কী হলো শোন, প্রতিটি টক দৈায়ের হাঁড়ির দৈ বেসিনে ফেলে বিশ্ৰী কাণ্ড।

টাকা পাওয়া গেছে?

পাগলের মতো কথা বলিস কেন? তুই কি দৈ-এর হাঁড়িতে করে টাকা এনেছিস যে টাকা পাওয়া যাবে? ঘটনা এইখানেই শেষ না। হামিদ সাহেব কেচি দিয়ে তোষক বালিশ এইসব কাটা শুরু করলেন। বাড়ি ভর্তি হয়ে গেল তুলায়। আচ্ছা শোন, ঠিক করে বল তো তুই আয়না মজিদ না তো?

না।

বদ আয়না মজিদটাকে দেখতে ইচ্ছা করছে। সে আমার সংসার লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে।

দুলাভাইকে দাও তো, কথা বলি।

ওর সঙ্গে কী কথা বলবি! ওকে তো পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। জিজ্ঞাসাবাদ করবে।

শোভা আপু কাঁদতে শুরু করলেন।

সানগ্লাস চোখে পরেছি

বাদলের কাছ থেকে একটা সানগ্লাস নিয়ে চোখে পরেছি। আমার পৃথিবীর রঙ এখন খানিকটা বেগুনি। কাধে ঝুলছে চটের ব্যাগ। ব্যাগে লেখা— জন্ম নিবন্ধন করুন। জন্ম নিবন্ধনবিষয়ক কোনো সেমিনারে অতি সস্তা। এই ব্যাগ নিশ্চয়ই দেয়া হয়েছে। তারই একটা এখন আমার কাধে। ব্যাগে জন্ম নিবন্ধনের কাগজপত্রের আস্তানার দিকে।

বাদল বলল, হিমুদ, তোমাকে সানগ্রাসে অদ্ভুত লাগছে।

আমি বললাম, আরো অদ্ভুত লাগার জন্যে কী করা যায় বল তো?

মাংকি ক্যাপ পারবে? গরমের মধ্যে মাংকি ক্যাপ অদ্ভুত লাগবে।

দে একটা মাংকি ক্যাপ।

মাংকি ক্যাপ খুঁজে পাওয়া গেল না। তবে একটা উলের লাল টুপি এবং তার সঙ্গে মানানসই কটকটে লাল মাফলার পাওয়া গেল।

বাদল বলল, হাফপ্যান্ট পরবে? তুমি হাফপ্যান্ট পরে হাঁটছ— ভাবতেই কেমন যেন লাগছে।

আমি বললাম, বের কর হাফপ্যান্ট। আজ অদ্ভুত দিবস।

ঢাকা শহরের লোকজনের বিস্মিত হবার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে। বিচিত্র সাজে রাস্তায় নেমেছি, কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না। আমাদের এই শহর চরিত্রের দিক দিয়ে পৃথিবীর বড় শহরদের মতো হয়ে যাচ্ছে। কেউ কাউকে দেখবে না। ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাঁটবে। সবার মধ্যে ট্রেন ধরার তাড়া।

কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পারলেও একটা কুকুরের দৃষ্টি আমি আকর্ষণ করলাম। কুকুরটা ঘিয়া কালারের। তার বিশেষত্ব হলো লেজটা কাটা। রবীন্দ্রনাথ এরকম কুকুরকে দেখে লিখেছিলেন—

আত্মীয় কেহ নাই নিকট কি দূর
আছে এক লেজকাটা ভক্ত কুকুর।

লেজকাটা কুকুর মানুষের আশেপাশে থাকতে পছন্দ করে। আমি কুকুরটার নাম দিলাম। টাইগার। নামটা তার পছন্দ হলো। টাইগার বলে ডাকতেই সে মহাউৎসাহে তার কাটা লেজ নাড়াতে লাগল। আমি হাটছি, সে পেছনে পেছনে আসছে। তাকে দুটা এনার্জি বিস্কুট কিনে খাওয়ালাম। বিস্কুটের কারণে সে বডিগার্ড হিসেবে আমার সঙ্গে থাকা মহান দায়িত্ব হিসাবে নিয়ে নিল। ঘেউঘেউ করে কুকুরের ভাষায় সে কিছু কথাবার্তাও বলতে থাকল। কুকুরের ভাষা আমরা এখন বুঝতে পারছি না। বিজ্ঞান একদিন পশুপাখির ভাষা বোঝার যন্ত্র বের করবে। সব মানুষ হয়ে যাবে কিং সুলায়মান। পশুপাখি কীটপতঙ্গের সঙ্গে তার যোগাযোগ স্থাপিত হবে। আমার পেছনে পেছনে যে কুকুরটা আসছে তার সঙ্গে গল্পগুজব করতে করতে আমি এগুব।

স্যার, বিস্কুট দুটা যে আমাকে দিলেন, ভালো ছিল। খেয়ে আনন্দ পেয়েছি। আপনাকে ধন্যবাদ।

ওয়েলকাম।

আপনার জন্যে কিছু করতে ইচ্ছা করছে। আপনার অপছন্দের লোকজন কেউ থাকলে বলবেন, কামড় দিয়ে আসব।

তার দরকার নেই।

স্যার, আপনার কাছে একটা প্রশ্ন ছিল, অভয় দিলে বলি।

বলো।

আপনারা আমাদের নেড়ি কুত্তা বলেন কেন? নেড়ি শব্দটার অর্থ কী?

নেড়ির বুৎপত্তি জানতে চাও?

জি। কুকুর সমাজে প্রায়ই এটা নিয়ে আলোচনা হয়। গোল রাস্তা বৈঠক হয়। আপনারা করেন গোল টেবিল, আমরা টেবিল পাব কোথায়? আমরা গোল রাস্তা বৈঠক করি।

ভালো তো।

স্যার, যাচ্ছেন কোথায় জানতে পারি? ভাববেন না। আমার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে বলে জানতে চাচ্ছি। কোনো কষ্ট না। কৌতূহল।

টপ টেরর আয়না মজিদের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।

যদি আপনি চান আমি তাকে কামড়ে ধরি, আমাকে ইশারা দিবেন। ঝাপ দিয়ে পড়ব।

সামান্য দুটা বিস্কুটের জন্যে এতটা করবে?

বিস্কুট দুটা সামান্য, কিন্তু বিস্কুটের পেছনের মমতা অসামান্য। এইজন্যেই কবি বলেছেন—

ভালোবেসে যে সামান্য দেয়
তারে দিও তুমি শতগুণে।
বন্ধু সে তোমার অতি প্রিয় সে
এই কথা বলে মনে মনে।

কোন কবি বলেছেন?

আমাদের কুকুর সমাজের কবি। আমাদের সমাজে বড় বড় কবি-সাহিত্যিক আছেন। এই কবিতাটি যিনি লিখেছেন তার নাম পিঠপোড়া ভুলো। গরম মাড় ফেলে উনার পিঠ পুড়িয়ে দিয়েছিল। এটা নিয়েও তার কবিতা আছে—

পিঠ পুড়িয়েছ তাতে কী হয়েছে
মন পোড়াতে পেরেছ কি?

অসাধারণ কবিতা না স্যার?

হ্যাঁ। উনি থাকেন কাথায়?

কোথায় থাকেন কাউকে বলেন না। কবি-সাহিত্যিক তো, নির্কুকরতা পছন্দ করেন। আপনাদের যেমন নির্জনতা, আমাদের হলো নির্কুকরতা। যেখানে কোনো কুকুর নেই সেখানে দেখা যাবে উনি উদাস মনে বসে আছেন।

 

ঠিকানামতো উপস্থিত হয়েছি। একতলা বাড়ি। রেলিং আছে। দরজায় কলিংবেল নেই, পুরনো আমলের মতো আংটা লাগানো। দরজার কড়া নাড়া হয়েছে। দরজা খুলেছে। যিনি দরজা খুলেছেন তার হাতে ম্যাচের কাঠি। কাঠি দিয়ে দাঁত খোচাচ্ছেন। গায়ের রঙ আলকাতরার কাছাকাছি। ছয়ফুটের মতো লম্বা। অতিরিক্ত লম্বা মানুষ মেরুদণ্ড বাঁকা করে খানিকটা ঝুঁকে থাকে। উনি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে সবুজ রঙের লুঙ্গি। কালো স্যান্ডো গেঞ্জি। কালো মানুষের দাঁত ঝকঝকে সাদা হয়। ইনার দাঁত কুকুরের দাঁতের মতো হলুদ এবং চোখা ধরনের। তবে চোখের সাদা অংশ অতিরিক্ত সাদা।

আমি বললাম, ভাই সাহেব, ভালো আছেন? আপনি কি খোকন ভাই? লাম্বু খোকন?

তুমি কে?

আমার নাম হিমু। আর আমার সফরসঙ্গীর নাম টাইগার।

চাও কী?

আয়না ভাইকে টাকা দিতে এসেছি। দুই লাখ টাকা আছে আমার কাধের ব্যাগে। দরজা খুললে একটা পাসওয়ার্ড বলার কথা। পাসওয়ার্ড বললে আপনি ভেতরে নিয়ে বসাবেন। পাসওয়ার্ড ভুলে গেছি। কাজেই আপনার হাতে টাকা দিয়ে চলে যাই।

আসে ভেতরে।

টাইগার কি যাবে আমার সঙ্গে, না বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে?

তোমাকে আসতে বলেছি তুমি আসো। বাজে প্যাচাল বন্ধ।

 

অনেকক্ষণ হলো বসে আছি। আমার জন্যে চা এসেছে। গরম সমুচা এসেছে। সমুচা ঘরে তৈরি এবং সুস্বাদু। সাইজে ছোট। পুরোটা একসঙ্গে মুখে দেয়া যায়।

যে ঘরে আছি তার আসবাবপত্র বলতে চারটা প্লাষ্টিকের চেয়ার। এক কোনায় ডাবল তোষক বিছানো। তোষকের উপর কম্বল, একটা জাম্বু সাইজ কোলবালিশ। কোলব্যালিশের ওয়াড় লাল সিস্কের। কেউ একজন তোষকে রাত কাটিয়েছে। চাদর এলোমেলো। তোষকের পাশে চায়ের কাপে বেশ কিছু সিগারেটের টুকরা ভাসছে। পাশেই পিরিচে মুরগির হাড়গোড়। সেখানে পিপড়া এবং মাছির মহোৎসব। একটা পিরিচে আধখাওয়া নানরুটি। পিপড়া মাছি কেউ সেদিকে যাচ্ছে না।

ভাই সাহেব, টাইগারকে কিছু খেতে দিয়েছেন? সে সমুচা খুবই পছন্দ করে বলে আমার ধারণা।

লঘু ভাই জবাব দিলেন না। চোখভর্তি সন্দেহ নিয়ে তাকিয়ে রইলেন। আয়না মজিদের কি আসতে দেরি হবে? দেরি হলে শুয়ে রেষ্ট নেই। বিছানা তো করাই আছে।

কথা কম। NO Sound.

No sound কেন? sound অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছে sound থেকে। Big Bang. হিন্দু মিথলজি আবার এটাকে সাপোর্ট করছে। হিন্দু মিথলজিতে বলে ব্ৰহ্ম বিকট চিৎকার দিলেন। বিকট চিৎকার হলো নাদ। সেই নাদের কারণে ব্ৰহ্মাণ্ড তৈরি হলো।

চুপ।

আপনি চুপ বলে চিৎকার করলেন। লঘুনাদ করলেন। এর ফলে আমি চুপ করে গোলাম।

আর একটা কথা বললে থাবড়ায়ে দাঁত ফেলে দিব।

এই সময় লম্বু খোকনের একটা টেলিফোন এলো। তিনি কোনো কথা বললেন না। টেলিফোন কানে দিয়ে রাখলেন। কথাবার্তা শেষ হলে চিন্তিত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন, ঘর থেকে বের হলেন। দরজা বন্ধ করলেন। তালা লাগানোর আওয়াজ পেলাম। তার মানে বেশ কিছু সময়ের জন্যে আমাকে এখানে থাকতে হবে। এখন বিছানায় শুয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে কোনো বাধা নেই। আজকের দিনটাও ঘুমানোর জন্যে ভালো। মেঘলা আকাশ। বাতাসে হিম।

আমি আয়োজন করেই ঘুমুতে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম। অনেক দিন পর বাবা স্বপ্নে দেখা দিলেন। তার পরনে হাফপ্যান্ট। মাথায় নীল টুপি, গলায় মাফলার। কাধে জন্ম নিবন্ধনের ব্যাগ।

এই হিমু, তোর জন্ম নিবন্ধনটা করে ফেলি। ফরম ফিলাপ কর।

ফরম তুমি ফিলাপ করো। আমার বিষয়ে তো তুমি সবচে বেশি জানো।

বাবা বিছানায় বসে ব্যাগ থেকে কাগজপত্র বের করতে করতে বললেন, অসময়ে শুয়ে আছিস কেন? শরীর খারাপ?

না।

কুকুর নিয়ে ঘোরা শুরু করেছিস। এটাও তো ঠিক না। তোকে বলেছি না, বন্ধু পাতাবি না, শত্রু পাতাবি না। তোকে যা যা শিখিয়েছি তার কোনোটাই তো তুই পালন করছিস না। দুই লাখ টাকা ব্যাগে নিয়ে ঘুরছিস। why? তুই থাকবি কপর্দকশূন্য অবস্থায়। সরি বল।

সরি।

তোকে তালাবন্ধ করে রেখেছে না-কি?

হুঁ।

বুদ্ধি খেলে বের হয়ে যা। তালা খোলা তো কোনো ব্যাপার না। না-কি আমি খুলে দিয়ে যাব?

দাও।

ঠিক আছে, যাবার সময় তালা খুলে দিয়ে যাব। এখন ফরম ফিলাপ কর। Identification mark কী বল।

পাছায় কালো জন্মদাগ আছে। এটা দেয়া কি ঠিক হবে?

কেন ঠিক হবে না! সত্য যত কঠিনই হোক, সত্য সত্যই। তুই একটু সরে আমাকে জায়গা দে। শুয়ে শুয়ে ফরম ফিলোপ করি।

কিছু খাবে বাবা? টেবিলে সমুচা আছে।

সমুচা তো আমিষ খাবার। আমি আমিষ খাবার কেন খাব! আমি নিরামিষাষি না? তুই কি আমিষ খাওয়া ধরেছিস?

হুঁ।

হিমু, আমি আপসেট। ভেরি ভেরি আপসেট। কম্বলটা গায়ের উপর তুলে দে না। ঠাণ্ডা লাগছে তো।

আমি বাবার গায়ে কম্বল টেনে দিলাম।

কোলবালিশটা দে। অনেক দিন কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে ঘুমাই না।

আমি কোলবালিশ এগিয়ে দিলাম। বাবা কাগজপত্র ফেলে কোলবালিশ নিয়ে ঘুমুতে গেলেন। তাকে খুব ক্লাস্ত দেখাচ্ছে। মনে হয় অনেকদিন আরাম করে ঘুমান না। এখন কোলবালিশ জড়িয়ে সুখনিদ্ৰা।

 

ঘুম ভাঙল ঝমঝম বৃষ্টির শব্দে। পাকা দালানকোঠায় বৃষ্টির শব্দ শোনা যায় না। যখন শোনা যায়। তখন ধরে নিতে হবে আকাশ ফুটো হয়ে গেছে।

ঘর অন্ধকার। টেবিল ল্যাম্প জুলছে। সময় বোঝা যাচ্ছে না। এসেছি সকালে। এক ঘুমে রাত এনে ফেলব তা হয় না। প্লাষ্টিকের চেয়ারে পায়জামা পাঞ্জাবি পরা একজন সুপুরুষ মধ্যবয়স্ক মানুষ। হাতে সিগারেট। ভুরু কুঁচকে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। হাতের সিগারেট উঠানামা করছে। ইনি ভয়ঙ্কর আয়না মজিদ ভাবতেই কেমন যেন লাগে। আমি উঠে বসতে বসতে বললাম, আয়না ভাই! কয়টা বাজে?

আয়না ভাই আমার সম্বোধনে মোটেই চমকালেন না। যেন ধরেই নিয়েছেন তাকে এই প্রশ্ন করা হবে। তিনি নির্বিকার গলায় বললেন, তিনটা বাজতে সাত शिनि।

আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, লম্বা ঘুম দিয়ে দিয়েছি। অনেকদিন এ রকম আরামের ঘুম হয় না। আয়না ভাই, আপনার সামনের চেয়ারে যে ব্যাগ ঝুলছে সেই ব্যাগে দুই লাখ টাকা আছে। নিয়ে নিন। আমি চলে যাই। প্রচণ্ড ক্ষিধে লেগেছে। বাসায় যাব, খাওয়াদাওয়া করব।

খাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

থ্যাংক য়্যু। আমার কুকুরটাকেও খাওয়াতে হবে। কুকুরটা আছে, না চলে গেছে?

আছে।

আয়না মজিদ হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে দ্বিতীয় সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, আপনি ঘরের তালা কীভাবে খুললেন? তালা খুলে ঘরে শুয়ে থাকলেন কেন? চলে যান নি কেন? এই প্রশ্নগুলির জবাব চাই।

আমি খানিকটা হকচাকিয়ে গেলাম। তালা সত্যি সত্যি খোলা হয়েছে এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। জগতে রহস্যময় ব্যাপার ঘটে। তবে স্বপ্নে বাবা এসে তালা খুলে ছেলেকে বন্দিদশা থেকে উদ্ধার করে–এরকম রহস্যময় ঘটনা ঘটে না। স্বাভাবিক ব্যাখ্যা হচ্ছে, টেনশনে লম্বু খোকন ঠিকমতো তালাই লাগায় নি।

আপনি আমার প্রতিটি প্রশ্নের সরাসরি জবাব দেবেন। জবাব দিতে থাকুন।

আমি বললাম, জবাব দেব কেন? আমি কি রিমান্ডে?

হ্যাঁ রিমান্ডে।

আয়না ভাই শুনুন। আমি রিমান্ডে না। রিমান্ডে আপনি। আপনি আমার প্রশ্নের জবাব দেবেন।

আয়না মজিদের শরীর শক্ত হয়ে গেল। চোখে পলক পড়া বন্ধ। নিঃশ্বাসও মনে হয় বন্ধ। তিনি নিজেকে সামলানোর সময় নিচ্ছেন। তার ভেতরে ভয়ও মনে হয় কাজ করছে। তার মন বলছে প্ৰতিপক্ষ কঠিন। তাকে সাবধানে Handle করতে হবে। ভয়ঙ্কর মানুষ সবসময় ভয়ঙ্কর ভীতু হয়ে থাকে। তারা মানুষ ভয় পায় না, দৈবে ভয় পায়। ঘরের তালা খুলে যাওয়াটা আমার পক্ষে কাজ করছে। আয়না মজিদ সুপার ন্যাচারাল কিছু আশঙ্কা করছেন।

আপনার নাম হিমু?

আমার নাম একেকজনের কাছে একেক রকম। কেউ ডাকে হিমু। কেউ ডাকে হিমালয়। আবার কেউ কেউ আয়না মজিদও ডাকেন। এস বি ইন্সপেক্টর কবীর সাহেব আমাকে ডাকেন আয়না মজিদ।

আপনি সেই লোক যাকে পুলিশ আয়না মজিদ হিসাবে ধরেছে। এবং আপনি পুলিশ কাস্টিডি থেকে পালিয়ে এসেছেন?

হুঁ।

আপনার সঙ্গে আমার চেহারার মিল আছে, এটা কি আপনি জানেন?

জানতাম না। আপনাকে দেখে সেরকমই মনে হচ্ছে।

অবাক হচ্ছেন না?

আমি বললাম, না। প্রকৃতি একই চেহারার মানুষ সবসময় সাতজন করে তৈরি করে।

কে বলেছে?

সবাই জানে। আপনি জানেন না, কারণ আপনি পড়াশুনা করার সময় পান নি। খুন-খারাবিতে সময় চলে গেছে।

পুলিশ কাস্টিডি থেকে কীভাবে পালিয়েছেন?

জানতে চান কেন?

বিদ্যাটা শিখে রাখতে চাই।

শিখলেও কাজে লাগাতে পারবেন না।

আসুন ভাত খাই, তারপর কথা বলব।

ভাত খাওয়ার পর আমি কোনো কথাই বলব না। পান মুখে দিয়ে সিগারেট ফুকতে ফুকতে চলে যাব। আমাকে আটকে রাখার শেষ চেষ্টা করে দেখতে পারেন।

আটকে রাখার চেষ্টা করলে কী হবে?

আমার কুকুর আপনাকে কাচা খেয়ে ফেলবে। তাকে দেখে আপনি বিভ্রান্ত হয়েছেন। ভেবেছেন। নেড়ি কুকুর।

নেড়ি কুকুর না?

পাগল হয়েছেন? আয়না মজিদ নেড়ি কুকুর নিয়ে ঘোরে না। খাবার দিতে বলুন।

 

তোষকের উপর খবরের কাগজ বিছিয়ে আমাকে খেতে দেয়া হয়েছে। রাজসিক খাবার না, তামসিক খাবারও না; প্রায় সাত্বীক খাবার।

আলু ভাজি
বেগুন ভাজি
মাঝারি সাইজের চিংড়ি ভাজি
মুরগির পাতলা ঝোল
পোলাওয়ের চালের ভাত।

খেতে বসেছি আমি একা। আয়না মজিদ একা খান। তিনি আমার সামনে উপস্থিত আছেন। এখনো আগের মতোই প্লাষ্টিক চেয়ারে বসা। হাতে সিগারেট।

তৃপ্তি করে খাচ্ছি। প্রতিটি আইটেম অসাধারণ। যে বাবুর্চি এই রান্না রেঁধেছে মজিদ ভাই, খেয়ে খুবই আরাম পেয়েছি। যে বাবুর্চি রেঁধেছে তাকে রন্ধন শ্রেষ্ঠ পদক অনায়াসে দেয়া যায়। আমি আন্তরিকভাবেই বললাম, মজিদ ভাই, খেয়ে খুবই আরাম পেয়েছি। যে বাবুর্চি রেঁধেছে সে বাবুর্চি না। মহান শিল্পী— পিকাসো গোত্রের শিল্পী।

আয়না মজিদের মুখের কাঠিন্য অনেকখানি কমে গেল। আমি বললাম, আমার যদি ফাঁসির হুকুম হয় তাহলে শেষ খাবার হিসেবে আজ যা যা খেয়েছি তা-ই খেতে চাইব। বাবুর্চির নামটা জানতে পারি?

আমি রেঁধেছি।

আপনি?

লঞ্চের রেস্টুরেন্টে কাজ করার সময় রান্না শিখেছি। এখন বেশির ভাগ সময়ই আমাকে দরজা জানালা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকতে হয়। সময় কাটাবার জন্যে প্রায়ই রান্না করি।

লাস্ট সাপার হিসেবে আপনি কী খেতে চাইবেন? মনে করুন। আপনি জানেন আগামীকাল ভোরে আপনার মৃত্যু। রাতের খাবার আপনার জীবনের শেষ খাবার। আপনি কী খেতে চাইবেন?

আয়নী মজিদের চোখমুখ আবার কঠিন হয়ে গেল। চোখ তীক্ষ্ণ। বুঝতে পারছি এই প্রশ্নের জবাব পাব না।

আয়না ভাই! অনুমতি দিন, উঠি?

আয়না মজিদ কিছু বললেন না। বাইরে বৃষ্টি এখনো পড়ছে। লক্ষণ ভালো না। ঝড় হতে পারে। আবহাওয়া অফিস কোনো নম্বর ঝুলিয়ে দিয়েছে কি-না কে জানে! হয়তো বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসছে কোনো সর্বনাশ।

টাইগার তার জায়গাতেই আছে। তার সামনের টিনের থালা দেখে অনুমান করতে পারি তাকে খাওয়া দেয়া হয়েছে। সে আমাকে দেখে কাটা লেজ নাড়িয়ে নিচুস্বরে কিছুক্ষণ ঘেউঘেউ করল। যার অর্থ সম্ভবত— স্যার! কোথায় ছিলেন? টেনশান হচ্ছিল তো। আমরা কি এখন চলে যাব? সঙ্গে ছাতা দেখছি না। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে যাবেন? আমার অসুবিধা নাই। আপনাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা। ঠান্ডা বাধিয়ে বসেন কি-না।

আমি এগুচ্ছি। আমার পেছনে পেছনে টাইগার। টাইগারের পেছনে ছাতা মাথায় লম্বু খোকন। আমি কী করি, কোথায় যাই, এই বিষয়ে হয়তো তাকে রিপোর্ট করতে হবে। লম্বু খোকন আমাকে এখন সমীহ করছে। আগে তুমি তুমি করে বলছিল। এখন আপনি। আপনি, তুমি, তুই থাকায় আমাদের অনেক সুবিধা। সামাজিক অবস্থান এক সম্বোধনেই স্পষ্ট।

জাপানি ভাষায় আপনি, তুমি, তুই ছাড়াও আরো এক ধরনের সম্বোধন আছে– অতি আপনি। যারা বিশেষ সম্মানের তাদের জন্যে এই সম্বোধন।

লম্বু খোকন এগিয়ে এসে আমার পশিপাশি হাঁটতে লাগল। বিনয়ী স্বরে বলল, হিমু ভাই! একটা কথা বলব?

আমি বললাম, বলে শুনি।

সে আপনি শুরু করেছে, আমি নেমে গেছি তুমিতে।

আপনার ঘরের তালা আমি বন্ধ করেছিলাম। তালাবন্ধের কাজ তো আজ প্রথম করি নাই। অনেকবার করেছি। তালা দেওয়ার পর আমি কয়েকবার টেনে দেখি সব ঠিক আছে কি-না। সবই ঠিক ছিল। সেই তালা আপনি কীভাবে খুললেন?

মন্ত্র পড়ে খুলেছি।

মন্ত্রটা কী?

মন্ত্রটা হচ্ছে রবি ঠাকুরের গান। আবেগের সঙ্গে গাইতে হবে— ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে।

লঘু খোকন হতাশ গলায় বলল, ও!

আমি বললাম, তুমি আমার পেছনে পেছনে কেন আসছ? আমাকে follow করা তোমার ঠিক হবে না। আমি কিছু কাণ্ডকারখানা করব যা দেখে তুমি ভড়কে যাবে। রাতে ঘুম হবে না। শরীর খারাপ করবে।

আপনি কী করবেন?

প্রশ্নের জবাব দিলাম না। কারণ আমি কী করব নিজেই জানি না। ভেবেচিন্তে উদ্ভট কিছু বের করতে হবে। এমন কিছু করতে হবে যা লম্বু খোকনের মাথার ভেতর ঢুকে যায়। কিছু কিছু মানুষের মাথায় গানের লাইন ঢুকে যায়। দিনের পর দিন মাথার ভেতর সেই গান বাজতে থাকে। লম্বু খোকনের মাথায় আমি অদ্ভুত কোনো দৃশ্য ঢুকিয়ে দিতে চাচ্ছি।

ঝমঝম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে রমনা পার্কে ঢুকে পড়লাম। পার্ক জনশূন্য। বেঞ্চে পলিথিনের ওভারকোট ধরনের পোশাক পরা এক ঝালমুড়িওয়ালা বিরুস মুখে বসে আছে। বৃষ্টির দিনে ঝালমুড়ি উপাদেয় খাদ্য, কিন্তু কোনো খাদক দেখছি না।

অদ্ভুত দৃশ্যের আইডিয়া মাথায় এসে গেছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে উত্তপ্ত এবং উত্তেজিত মস্তিষ্কে এই দৃশ্য সহজেই ঢুকে যাবে। লম্বু খোকনের মস্তিষ্ক তালাবিষয়ক জটিলতায় যথেষ্ট উত্তেজিত। সেই উত্তেজনা আরো কিছুটা বাড়িয়ে কাজে নামতে হবে।

খোকন।

জি।

তোমার বাবা জীবিত না মৃত?

উনি মারা গেছেন। হার্ট অ্যাটাক।

কখন মারা যান?

সন্ধ্যার আগে আগে।

ঠিক এই সময়, তাই না?

জি।

সেদিনও বৃষ্টি বাদলা ছিল?

জি ছিল।

সেদিন দুপুরে তোমার বাবা তার জীবনের শেষ খাওয়াটি খান। ঠিক না?

জি।

কী খেয়েছিলেন তুমি নিশ্চয়ই জানো। মৃত্যুর পর শেষ খাওয়া নিয়ে অনেকবার আলোচনা হয়। জানা থাকার কথা।

কচুর লতি দিয়ে চিংড়ি মাছ।

খলসে মাছের টক সালুন।

পাটশাক ভাজি আর মাষের ডাল।

উনি যদি জানতেন এটাই হবে তার দীর্ঘজীবনের শেষ খাওয়া তাহলে তিনি কী খেতে চাইতেন?

সেটা তো জানি না।

তুমি তোমার জীবনের শেষ খাওয়া কী খেতে চাও? চিন্তা করে বের করা।

খোকন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। তার মস্তিষ্ক চিন্তা করতে শুরু করেছে। মস্তিষ্ককে একই সঙ্গে দুধরনের আবেগ নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। সুখাদ্যের সুখকর চিন্তার আবেগ এবং মৃত্যুর গভীর বেদনার আবেগ। মস্তিষ্ক দুই বিপরীত আবেগে উত্তেজিত হতে শুরু করেছে। এখন আমার জন্যে উপযুক্ত সময় কাজে নেমে যাওয়া। আমি কাজে নেমে গেলাম। মাঝারি আকৃতির একটা বকুল গাছকে ঘিরে চক্রাকারে হাটতে শুরু করলাম। টাইগার আমার পেছনে পেছনে হাঁটছে। কাজটায় সে আনন্দও পাচ্ছে।

সবকিছুই চক্রাকারে ঘোরে। পৃথিবী ঘোরে সূর্যের চারদিকে। ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসকে ঘিরে ঘোরে। আমি ঘুরছি বকুল গাছের চারদিকে। বৃষ্টি ঝরেই যাচ্ছে।

বাদলা দিনে মনে পড়ে ছেলেবেলার গান।
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এলো বান।

হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে লম্বু খোকন। তার ঠোঁট কাঁপছে। মনে হয় বিড়বিড় করে কিছু বলছে। ঝালমুড়িওয়ালা মনে হয়। ভয় পেয়েছে। সে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে যাচ্ছে। যাবার পথে একবার সে তাকাল, তার চোখে স্পষ্ট ভয়ের ছায়া।

লম্বু খোকন হাত ইশারা করে আমাকে ডাকছে। আমি এগিয়ে গেলাম। লঘু খোকন বিড় বিড় করে বলল, হিমু ভাই, ঘটনাটা কী?

আমি বললাম, কোনো ঘটনা জানতে চাচ্ছেন?

আপনার বিষয়ে জানতে চাই। আপনি কে?

আমি বললাম, বিরাট ফিলসফির প্রশ্ন করে ফেলেছেন— আমি কে? হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ চেষ্টা করেছে আমি কে? প্রশ্নের উত্তর বের করতে। পারে নি। একজন কেউ উত্তর বের করে ফেললেই সবার বেলায় সেটা খাটবে। আপনিও উত্তরের চেষ্টা করতে পারেন। বকুল গাছের চারপাশে চক্কর দেবেন এবং বলবেন, আমি কে? আমি কে? একদিনে হবে না। চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। বরাট ব্রুস টাইপ চেষ্টা। রবার্ট ব্রুস কে জানেন?

জি না।

নিজেকে জানলেই উনাকে জানবেন। লঘু ভাই বিদায়। আবার কোনো একদিন বকুলতলায় দেখা হবে।

আমি লম্বু খোকনকে হতভম্ব অবস্থায় রেখে চলে এলাম।

টাইগার এখন বাদলের হেফাজতে

টাইগার এখন বাদলের হেফাজতে। বাদল মহাউৎসাহে তার গায়ে লাক্স সাবান ঘষছে (লাক্স সুপার স্টাররা মন খারাপ করবেন না)। টাইগারের দাঁত ব্ৰাস করার জন্যে ব্ৰাস কেনা হয়েছে। স্মোকারস পেষ্ট কেনা হয়েছে। টাইগার সব যন্ত্রণা সহ্য করছে। কিছু যন্ত্রণা মনে হয় উপভোগও করছে, বিশেষ করে দাঁত মাজা পর্ব। পেস্টটা পছন্দ করে খাচ্ছেও।

বাদল লাইব্রেরি থেকে কুকুর বিষয়ে দুটা বই এনেছে। একটার নাম Dogs Life. এই বইয়ে একটা কুকুরের বড় হওয়া বিতং করে লেখা। অন্য বইটার নাম Training a Dog। বাদলের মতে দ্বিতীয় বইটা অসাধারণ। কুকুরকে ট্রেনিং দেয়ার জন্যে বিভিন্ন সাইজের বল এবং সাইকেলের চাকা আনা হয়েছে। সাইকেলের চাকা কোন কাজে লাগবে এখনো বোঝা যাচ্ছে না।

একজন কাঠমিস্ত্রিকে খবর দিয়ে আনা হয়েছে। প্লাইউড় কেনা হয়েছে। কাঠমিস্ত্রি কুকুরের ঘর বানাচ্ছে। সেই ঘরের ডিজাইনও বাদলের। ডিজাইনে বিশেষত্ব আছে। ছাদের একটা অংশ কাচের। যাতে ঘরে আলোর সমস্যা না হয়।

আমি সময় কাটাচ্ছি বই পড়ে। বাদলের আনা ভূতের DVD দেখে শেষ করে ফেলেছি। বই পড়া ছাড়া গতি নেই। এখন যে বইটা পড়ছি তার নাম impossibility লেখকের নাম জন ডি. বেরো। কঠিন বই। বইয়ের বিষয়বস্তু হলো জগতের অনেক রহস্যই আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব না; যত চেষ্টাই করা হোক না, বেশির ভাগ তথ্যই আমরা জানব না। যারা বিশ্বাস করেন বিজ্ঞান সব রহস্য ভেদ করে ফেলবে এই বই তাদের জন্যে বিরাট দুঃসংবাদ।

এক সপ্তাহের উপর হলো, খালু সাহেবের সঙ্গে আমার দেখা হচ্ছে না। তিনি বিচিত্র কারণে আমাকে এড়িয়ে চলছেন। ছাদের আসরেও আমার ডাক পড়ছে না। খালাও চাচ্ছেন আমি যেন বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যাই। যদিও মুখের উপর বলছেন না। ইশারা ইঙ্গিতে বলছেন। স্বল্পবুদ্ধির কারণে তার ইশারা ইঙ্গিত স্কুল ধরনের। উদাহরণ–

হিমু, তুই তো ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে শরীর নষ্ট করে ফেলেছিস। হেঁটে বেড়ানো যার অভ্যাস তার কি আর শুয়ে সময় কাটালে চলে? আমি তোর কষ্টটা বুঝতে পারছি। এই বাড়িতে থেকে তুই স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারছিস না। এক কাজ করা, আগে যেখানে ছিলি সেখানে চলে যা। নিজের মনে থাক।

খালা, এখানে ভালোই আছি। তবে তোমাদের অসুবিধা হলে ভিন্ন কথা। বাড়তি একজনকে তিন বেলা খাওয়ানো—

কী কথা বললি হিমু! ছিঃ! তুই মন মরা হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকিস, হাঁটাহাঁটি করতে পারিস না, এইজন্যে বলছি।

এখন থেকে তোমাদের বাড়ির ছাদে হাঁটাহাঁটি করব। হাসিখুশি থাকব।

খালা মুখ কালো করে বললেন, তাহলে তো ঠিকই আছে।

খালু সাহেব স্কুল বাঁ সূক্ষ্ম কোনো ইশারা ইঙ্গিতে গেলেন না। সরাসরি বললেন, বিদেয় হও। আমাকে তার ব্যক্তিগত বারে (ছাদ, পার্টি বিছানো, দুটা বালিশ।) ডেকে নিয়ে গেলেন।

গম্ভীর গলায় বললেন, হিমু, আমার এখানে কতদিন আছ?

দুমাস হতে চলল।

দুমাসের বেশি হয়েছে। এই দুমাসে বাদলের অবস্থা দেখেছি? পড়াশোনা নেই, ছবি দেখা আর রাত জাগা। এখন আবার কুকুর নিয়ে মেতেছে। এই কুকুরও তো তুমি এনেছ?

জি।

বিশেষ কোনো জাতের কুকুর?

জি-না। নেড়ি কুকুর। ডাস্টবিনে ডাস্টবিনে জীবন কাটাচ্ছিল, ডেকে নিয়ে চলে এসেছি।

জানতে পারি কেন?

বেচারাকে একটা বেটার লাইফ দেবার ইচ্ছা থেকে কাজটা করেছি। কুকুর হচ্ছে মানুষের বেষ্ট ফ্রেন্ড। তার এ-কী কুৎসতি জীবন! ডাস্টবিনে ডাস্টবিনে খাদ্যের অনুসন্ধান।

খালু সাহেব গ্রাসে পর পর কয়েকটা চুমুক দিয়ে বললেন, কুকুর এনেছি, কয়েকদিন পর বিড়াল আনবে, বোদর আনবে। বাসাটা হবে মিনি চিড়িয়াখানা। বাদল চিড়িয়াখানার মহাপরিচালক। আমি তো এটা এলাউ করব না। এখন আমি তোমাকে একটা কঠিন বাক্য বলব। কঠিন বাক্য কঠিনভাবেই বলা উচিত।

কঠিন বাক্যটা কী?

কাল সকালে তুমি চলে যাও। তুমি আমার একটা কাজ করে দিয়েছ, তার জন্যে থ্যাংকস। কাজটা এমন জটিল কিছু না। আমার অফিসের পিওনকে দিয়েও করতে পারতাম।

আমাকে চলে যেতে বলছেন?

হ্যাঁ। Tomorrow morning. নাশতা খেয়ে চলে যাবে। তোমার খালার কাছে আমি একশ টাকা দিয়ে রাখব, রিকশা ভাড়া।

আমি বললাম, আয়না মজিদের সঙ্গে আবার যদি যোগাযোগের দরকার পড়ে তখন কী করবেন? আমি একেক সময় একেক জায়গায় থাকি। প্রয়োজনের সময় আমাকে তো খুঁজে পাবেন না।

প্রয়োজন হবে না। আয়না মজিদের সঙ্গে দুলাখ টাকায় সেটেলমেন্ট হয়ে গেছে। সে আমাকে ঘাটাবে না।

কিন্তু খালু সাহেব, আয়না মজিদ বুঝে গেছে আপনি ভীতু প্রকৃতির। এবং আপনার কাছে টাকা আছে। আবার সে আপনার কাছে টাকা চাইবে। এবং চাইতেই থাকবে। আপনাকে মোটামুটি ছিবড়া করে ছাড়বে।

হিমু! তুমি আমাকে ভয় দেখিয়ে এ বাড়িতে পার্মানেন্ট থাকার ব্যবস্থা করার চেষ্টা চালাচ্ছ। আমার বুদ্ধিকে আন্ডার এষ্টিমেট করা তোমার ঠিক হয় নি। তোমাকে আগামীকাল ভোরে যেতে বলেছিলাম, আমি ডিসিশান চেঞ্জ করলাম।

থেকে যাব?

না! তুমি এখনই যাবে।

খালু সাহেব মানিব্যাগ খুলে একশ টাকার একটা নোট বের করলেন। থমথমে গলায় বললেন, এই নাও রিকশা ভাড়া।

আমি বললাম, বাদল কাটাবনে গেছে টাইগারের গলার বেল্ট কিনতে। সে ফিরুক। বাদলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাই।

তোমার কথার প্যাঁচে আমি পড়ব না। তুমি এখনই যাবে।

 

অনভ্যাসে বিদ্যা হ্রাস। শুয়ে বসে ঘুমিয়ে শরীর তবদা মেরে গেছে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। রিকশা বা সিএনজি নিতে ইচ্ছা করছে। হাত উচিয়ে রিকশা ডাকলাম। রিকশাওয়ালা কাছে এলো না। দূর থেকেই উদাস গলায় বললেন, যাইবেন কই আগে বলেন।

কোথায় যাব এখনো ঠিক করা হয় নি। রিকশায় উঠে ঠিক করব।

যামু না।

তুমি বরং ঠিক কর কোথায় যাবে। সেখানে আমাকে নামিয়ে দিয়ে আস। তুমি যেখানেই নামাবে। সেখানেই যাব।

বললাম তো যামু না।

একশ টাকা ভাড়া পাবে। যেখানেই নিয়ে যাও একশ টাকা।

রিকশাওয়ালা বিরক্ত মুখে চলে যাচ্ছে। সে আমার উপর ভরসা করতে পারছে না। সে ভাবছে আমি ঝামেলার মানুষ। সবাই ঝামেলার মানুষের কাছ থেকে দূরে থাকতে চায়।

হেঁটে হেঁটে বিজয় সরণি পর্যন্ত চলে এসেছি। ট্রাফিক সিগন্যালের লালবাতি জ্বলেছে। দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িকে ঘিরে নানান বাণিজ্যের চেষ্টা হচ্ছে। নতুন আইটেম পপকর্ন। প্যাকেট ভর্তি পপকর্ন, দাম দশ টাকা। অনেকেই পপকর্ননিয়ে ছোটাছুটি করছে। কেউ কিনছে না। ফুলের বাজারও মন্দা। রাত বাজে দশটা। এই সময় কেউ ফুল কিনে না। হ্যারি পটারের বই হাতে কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছে। তারা মুখে বলছে–পটার! পটার! শুনতে ভালো লাগছে।

মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোককে দেখলাম পারিবারিকভাবে ফুল বিক্রির চেষ্টা করছেন। তার চেহারা এবং গায়ের কাপড় স্কুল টিচার টাইপ। চোখে চশমা। তার হাতে গোলাপ ফুলের একটা তোড়া। তিনি প্রতিটি গাড়ির জানালার কাছে যাচ্ছেন। বিড়বিড় করে কী সব বলছেন। ভদ্রলোকের পেছনে তার স্ত্রী এবং ছয়সাত বছরের একটা মেয়ে। তারা মনে হচ্ছে লজ্জায় মরে যাচ্ছে। পারিবারিকভাবে ফুল বিক্রির চেষ্টা এই প্রথম দেখলাম। তারা মনে হয় সঙ্গে করে সংসারও নিয়ে এসেছেন। স্ত্রীর কাধে ব্যােগ। হাতে চামড়ার সুটকেস। মেয়ের হাতে ব্যাগ। ভদ্রলোকের এক কাধে ব্যাগ। এক হাতে বিশাল পুটলি। ভেতর থেকে বালিশ উঁকি দিচ্ছে।

সবুজ লাইট জ্বলছে। গাড়ি ইস ইস করে চলে যাচ্ছে। গোলাপের তোড়া বিক্রেতা ভদ্রলোক স্ত্রী-কন্যার সঙ্গে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তাদের দিকে এগিয়ে গেলাম।

গোলাপ ফুলের এই তোড়াটার দাম কত?

ভদ্রলোক আচমকা আমার কথা শুনে হকচকিয়ে গেলেন। চিন্তিত ভঙ্গিতে স্ত্রীর দিকে তাকালেন।

দাম কত জানেন না?

ভদ্রলোক বিড়বিড় করে বললেন, যা মনে চায় দিবেন।

একশ টাকা দিলে চলবে?

জি জনাব। অনেক শুকরিয়া।

আমি একশ টাকার নোটটা বের করে এগিয়ে দিলাম। গোলাপের তোড়া হাতে নিতে নিতে বললাম, ঢাকা শহরে কবে এসেছেন?

ভদ্রলোক জবাব দিলেন না।

থাকেন কোথায়?

এই প্রশ্নের জবাবও পাওয়া গেল না। ভদ্রলোক এবং তার স্ত্রী দুজনেই মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বাচ্চা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললাম, নাম কী?

পারুল।

তোমার বাবার নাম কী?

ফজলুর রহমান।

আমি ফজলুল রহমান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললাম, ফজলুর রহমান সাহেব, কাগজ কলম থাকলে একটা ঠিকানা লিখুন। ঢাকা শহরে যদি থাকা খাওয়া বিষয়ে বিরাট কোনো সমস্যায় পড়েন তাহলে এই ঠিকানায় চলে যাবেন। এটা একটা ভাতের হোটেলের ঠিকানা। মালিকের নাম মোল্লা। সবাই ডাকে মোল্লা মামু। তাকে বলবেন, হিমু পাঠিয়েছে। হিমু নাম মনে থাকবে?

থাকবে জনাব।

ভদ্ৰলোক পকেট থেকে বলপয়েন্ট কলম এবং নোট বই বের করলেন। ঠিকানা লিখছেন। তার চোখে পানি এসে গেছে। চোখের পানি চশমার ফ্রেমের নিচ দিয়ে গাল পর্যন্ত চলে এসেছে। ভদ্রলোক পাঞ্জাবির হাতায় চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন, এখন গেলে কি মোল্লা ভাইকে পাওয়া যাবে?

অবশ্যই যাবে। তার হোটেল রাত একটা পর্যন্ত খোলা থাকে। তাকে কী বলবেন মনে আছে তো?

জি জনাব, মনে আছে।

আমি ফুলের তোড়া নিয়ে চলে আসছি। তিনজন বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তাদের চোখে বিস্ময় এবং ভয়। বিস্ময়ের কারণ বুঝতে পারছি। ভয়ের কারণ স্পষ্ট না। একশ টাকার নোটটা বাচ্চা মেয়েটার হাতে।

 

হাবীব এন্ড সন্স মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের দরজা বন্ধ হচ্ছে। হাবীব ভাই ক্যাশ মিলছেন। একজন মিষ্টি ডিপফ্রিজে তুলছে। এক কর্মচারী মেঝে ঝাঁট দিচ্ছে। এই অবস্থায় ফুলের তোড়া হাতে আমার প্রবেশ। হাবীব ভাই টাকা গোনা বন্ধ রেখে তাকিয়ে আছেন। কিছুক্ষণ। এইভাবে কাটল। তিনি আবার টাকা গোনায় মন দিলেন।

দোকানের একজন কর্মচারী (নতুন অ্যাপয়েন্টমেন্ট, চেহারা অপরিচিত) আমার সামনে পিরিচা ধরে বলল, মিষ্টি খান স্যার।

পিরিচে একটা লালমোহন, একটা লাড়ু এবং নিমকি।

আমি বললাম, মিষ্টি কিসের রে?

স্যারের সন্তান হবে। আজি ডাক্তার বলেছে। এই কারণে মিষ্টি। যে কষ্টমারই আসছে তারেই মিষ্টি দিচ্ছি।

হাবীব ভাই বিরক্ত গলায় বললেন, উনাকে হিস্টরি বলার দরকার নাই। উনি জাইনা শুইনা ফুল নিয়ে আসছে। গাধা! কিছু বুঝস না।

মিষ্টি খেয়ে আমি হাবীব ভাইয়ের সঙ্গে রওনা দিলাম। রাতে তার বাসায় থাকব, খাওয়াদাওয়া করব। রাস্তায় নেমেই হাবীব ভাই বললেন, আপনি যে আসবেন জানতাম। এইজন্যে দোকান বন্ধ করতে দেরি করছি। অন্যদিন দোকান বন্ধ করি দশটায়, আইজ বাজে বারোটা। আপনার ভাবিকে বলে এসেছি আপনার পছন্দের রান্না ফোন করে।

আমার পছন্দের রান্না কী?

আমি জানি না। আপনার ভাবি জানে। খাইতে বইসা পছন্দের জিনিস না পাইলে দোকানে আগুন ধরায়ে দিব।

ভাবি কেমন খুশি?

নিজের চোখে না দেখলে বুঝবেন না কেমন খুশি। ডাক্তারের রিপোর্ট নিয়া যে কান্দন শুরু করেছে গিয়া দেখবেন এখনো মনে হয়। সেই কান্দন চলছে। মেয়েছেলে কান্দতেও পারে।

আপনি কেমন খুশি?

হিমু ভাই, এইটা একটা প্রশ্ন করলেন! আমি আকাশ-পাতাল খুশি।

আপনার চোখে পানি কই?

কথায় কথায় কানলে পুরুষ মানুষের চলে? এদিকে আবার হইছে ঝামেলা। আপনার ভাবির সঙ্গে ঝগড়া।

কী নিয়ে ঝগড়া?

নাম নিয়া। সে ঠিক করেছে তার দুই ছেলের নাম রাখবে আলাল-দুলাল। আমার মত নাই।

দুই ছেলে না-কি?

আপনে জানেন না? আমারে কেন জিগান? ফু যখন দিছেন। তখনই তো জানেন। আপনের কাজ কারবার আর কেউ না জানুক, আমি জানি, আপনের ভাবি জানে। কেউ কি আপনারে খবর দিছে যে আইজ ডাক্তারের রিপোর্ট আসছে?

না, খবর দেয় নি।

আইজ ফুল নিয়া আপনা আপনি চইলা আসলেন কী মনে কইরা। জিনিসটার মধ্যে রহস্য আছে না?

সামান্য রহস্য অবশ্য আছে।

এই তো পথে আসছেন। এখন বলেন আলাল-দুলাল নাম কি চলে? নাম শুনলেই মনে হয় ফকিরের পুলাপান। আজ। আপনার মোকাবিলায় নাম নিয়া ফয়সালা হবে। আপনের ভাবির ধারণা সে যেটা বলবে সেটাই ঠিক হবে। ইহা ভুল। সংসারের প্রধান আমি। আপনের ভাবি না।

হাবীব ভাইয়ের বাড়িতে পৌঁছলাম। ভাবির হাতে ফুলের তোড়া দিলাম। বিনীত গলায় বললাম, আজকের এই শুভ দিনে আপনার জন্যে লাল পেড়ে গরদের শাড়ি আনা উচিত ছিল। ভাবি, আপনি তো জানেন আমি গরিব মানুষ।

আমার কথায় হাবীব ভাই মহাবিরক্ত হয়ে বললেন, হিমু ভাই যে একেকটা কথা বলে, রাগে শরীর জুইলা যায়। বউ, কাগজ কলম দেও দেখি, হিমু ভাইরে আমি দোকান লেইখা দিব। এখন আমার দুই ছেলে আছে। ছেলে নিয়া ভিক্ষা করব। দুই ছেলে নিয়া ভিক্ষা করার মধ্যেও আনন্দ।

ভাবি শাড়ির আঁচলে চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন, আলালের বাপ! হাত-মুখ ধুইয়া খাইতে আসেন।

হাবীব ভাই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, কী নামে ডেকেছে শুনেছেন?

মেয়েছেলের ফিচকা বুদ্ধি! কী যে করি। একেকবার বনেজঙ্গলে চাইলা যাইতে মনে চায়। দুই ছেলে নিয়া যখন নিরুদ্দেশ হব। তখন টের পাইবা।

 

রাতের খাওয়া শেষ করে ঘুমুতে গেছি। ভাবি যত্বের চূড়ান্ত করেছেন। নিজের হাতে মশারি গুজে দিয়েছেন। টেবিলে পানির জগ, গ্লাস। ফ্লাস্কভর্তি চা। রাতে যদি ক্ষিধে লাগে তার জন্যে টিফিন কেরিয়ারের বাটিতে পাটিসাপটা পিঠা।

আমি মশারির ভেতর শুয়ে আছি। হাতে বই— Impossibility, টেবিল ল্যাম্পের আলোয় রহস্যময় বিজ্ঞানের বই পড়তে আরাম লাগছে। বৃষ্টি শুরু হয়েছে। হাবীব ভাইয়ের বাড়ির ছাদ টিনের। বৃষ্টির শব্দ শুনতে ভালো লাগছে।

বাদলা দিনে মনে পড়ে ছেলেবেলার গান
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুটুর নদেয় এলো বান।

বৃষ্টির কারণে বইয়ে মন বসছে না। আবার বই থেকে চোখ সরাতেও পারছি না–

অতি ক্ষুদ্র বস্তু অদ্ভুত আচরণ করে। ক্ষুদ্র বস্তুর অবস্থান এবং গতি একই সঙ্গে কখনোই জানা যায় না। একটা অনিশ্চয়তা থাকবেই। এই অনিশ্চয়তা প্রথম বের করেন Heisenberg. তার নাম অনুসারে এই সূত্রের নাম Heisenberg Uncertinily Principle. অনেক থিওফসিস্ট মনে করেন ঈশ্বরের অবস্থান এই অনিশ্চয়তায়।

কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। ঘুম ভাঙল কচকচ শব্দে। চেয়ারে বসে টিফিন কেরিয়ার খুলে অপরিচিত এক রাগী চেহারার বিদেশী কপি কপি করে পাটিসাপটা খাচ্ছেন। আমাকে দেখে তিনি বললেন, আমি এইগুলা কী খাচ্ছি?

পাটিসাপটা পিঠা খাচ্ছেন। আপনি কে জানতে পারি?

আমার নাম হাইজেনবাৰ্গ।

বলেন কী স্যার! আপনি তো বিখ্যাত লোক।

আইনস্টাইনের মতো বিখ্যাত না। অথচ আইনষ্টাইনকে আমি হিসাবের মধ্যেই ধরি না। মূল বিষয়গুলি আমরা সাজিয়ে দেই— সে এইটা ব্যবহার করে। বিরাট গাধা!

গাধা না-কি?

অবশ্যই। তার গাধামির নমুনা শোন— হঠাৎ একদিন বলল, ঈশ্বর পাশা খেলেন না। ভাবটা এরকম যেন ঈশ্বর তার ইয়ার বন্ধু। তাকে কানে কানে বলে গেছেন–আমি পাশা খেলি না।

উনি কি খেলেন?

অবশ্যই। ঈশ্বর স্বয়ং নিয়মের বাইরে যেতে পারবেন না।

স্যার, আপনি তো পিঠা সবগুলা খেয়ে ফেলছেন। ক্ষিধা লাগলে আমি কী খাব?

সরি। ফ্লাস্কে কি চা? এক কাপ চা দাও তো খাই।

আপনি নিজে ঢেলে নিয়ে খান। আরাম করে শুয়ে আছি, উঠতে পারব না।

হাইজেনবাৰ্গ সাহেব চা নিলেন। চায়ে চুমুক দিয়ে গভীর হয়ে গেলেন। আমি বললাম, কিছু চিন্তা করছেন স্যার?

হুঁ।

কী নিয়ে চিন্তা করছেন?

ল্যাপটপ নিয়ে নিয়ে চিন্তা করছি। আমার সময় এই বিষয়টা কেউ জানত না।

আপনারা সাইনটিস্টরা কি মৃত্যুর পরেও গবেষণা করে যাচ্ছেন?

এছাড়া কী করব! তবে আইনষ্টাইন মাঝে মধ্যে বেহালা টেহালা বাজায়। ভাব করে যেন বিরাট বেহালা বাদক— ইয়াহুদি ম্যানহুইল। অনেকে আবার বিরাট সমঝদারের মতো তার বেহালা শুনতে যায়। বেতালায় মাথা নাড়ে। যেমন মাক্স প্লাংক। বিরাট গাধা। প্রথম শ্রেণীর গাধা।

তাই না-কি।

অবশ্যই। বিজ্ঞানীরা যখন গাধা হয় প্রথম শ্রেণীর গাধা হয়। আইনষ্টাইন যখন অনিশ্চয়তা সূত্রে আমার বিপক্ষে চলে গেল তখন ম্যাক্স প্লাংকও চলে গেল। ভাবল বড়র সাথে থাকি। গাধামি করেছে কি-না তুমি বলো।

অবশ্যই গাধামি করেছে।

আমি তো তার সঙ্গে কথাই বলি না। তার সঙ্গে কথা বলা মানে সময় নষ্ট।

পরকালে সময় বলে তো কিছু নেই। কাজেই সময় নষ্ট হওয়ার প্রশ্ন উঠে না।

কথাটা মন্দ বলো নি। তুমি উঠে বসো–সময় কী এই নিয়ে আলোচনা করি।

স্যার, ঘুমে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। আপনি আজ চলে যান, অন্য একদিন আসুন। গল্প করব।

এখন তো যেতে পারব না। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি থামলে চলে যাব।

বাতিটা নিবিয়ে দিন না। স্যার। আপনার হাতের কাছে সুইচ।

ঘরের বাতি নিভে গেল। আমি চাদরে মাথা ঢেকে ঘুমুতে গেলাম।

হাবীব ভাইয়ের বাড়িতে

হাবীব ভাইয়ের বাড়িতে প্ৰথম প্রভাত। মশারির ভেতর থেকে এখনো বের হই নি। ঝিম ধরে বসে আছি। আয়োশি বিম, কাটতে সময় লাগবে। মশারির ভেতরেই আমাকে এক পিস বাখরখানি দিয়ে চা দেয়া হয়েছে। চারটা খবরের কাগজ দেয়া হয়েছে। এ বাড়িতে খবরের কাগজ রাখা হয় না। আমার জন্যে হাবীব ভাই কিনে এনেছেন। আমাকে জানিয়েছেন উন্নত মানের নাশতার ব্যবস্থা হচ্ছে। একটু সময় লাগবে। উন্নত মানের নাশতার বিবরণও শুনিয়েছেন—

পরোটা
নান রুটি
খাসির চাপ
পায়া

পরোটা ঘরে বানানো হচ্ছে। বাকি আইটেম পুরনো ঢাকার পালোয়ানের দোকান থেকে আসছে। এদের খাসির চাপ এবং পায়া না-কি বিশ্বসেরা।

চা খেতে খেতে খবরের কাগজ পড়ছি। হাতে যে কাগজটা আছে তারা মনে হয় বিশেষ ধর্ষণ সংখ্যা প্রকাশ করেছে। প্রথম পৃষ্ঠায় ধর্ষণ সংবাদ (সচিত্র), কলেজ ছাত্রী শিপ্রার গণধর্ষণবিষয়ক স্টোরি। শিপ্রার বক্তব্য। একজন ইউপি চেয়ারম্যানের বক্তব্য, ওসি সাহেবের বক্তব্য। শেষের পাতায় ধর্ষণ সংবাদ (সচিত্র)। ভেতরের পাতায় মফস্বল ধর্ষণ সংবাদ।

অন্য আরেকটি খবরের কাগজ হাতে নিয়ে ধাক্কার মতো খেলাম। প্রথম পাতায় বাদলদের বাড়ির ছবি। খবরের শিরোনাম— কুকুরের হাতে বন্দি।

খবর পড়ে জানা গেল টাইগার নামের একটি হিংস্র এবং প্রায় বন্য কুকুরের হাতে গৃহের সবাই বন্দি। গৃহের সকল সদস্য সারারাত ছাদে কাটিয়েছে। কুকুরটাই না-কি সবাইকে তাড়া করে ছাদে তুলেছে এবং নিজে ছাদের সিঁড়িতে ঘাটি গেড়েছে। ছাদ থেকে কাউকে নামতে দিচ্ছে না। কাউকে ছাদে উঠতেও দিচ্ছে না। ছাদে যারা বন্দি তাদের উদ্ধারের জন্য দমকল বাহিনীকে খবর দেয়া হয়েছিল। দমকল বাহিনীর লোকজন পানির পাইপ হাতে ছাদে উঠতে গেলে কুকুরের তাড়া খেয়ে দ্রুত নামার সময় দুজন পা পিছলে গুরুতর আহত হয়। এই দুজন পঙ্গু হাসপাতালে বর্তমানে চিকিৎসাধীন।

কুকুরের ছবি তোলার জন্যে একটি বেসরকারি টিভির ক্যামেরাম্যান কুকুরের কামড় খেয়েছেন এবং তার মূল্যবান ক্যামেরা হারিয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জুলজি বিভাগের একজন শিক্ষক ড. ফজলে আবেদ কুকুরের ছবি এবং তার কর্মকাণ্ডের বিবরণ শুনে মন্তব্য করেছেন যে, এটি কোনো সাধারণ কুকুর না। বিশেষ প্রজাতির এলসেশিয়ান কুকুর। এবং উচ্চতর ট্রনিংপ্রাপ্ত কুকুর। ড. ফজলে আবেদের ধারণা র‍্যাব তাদের ডগ স্কোয়াডে যে সব কুকুর রেখেছে। টাইগার তাদেরই একজন। ডগ স্কোয়াড থেকে পালিয়ে সে তার স্বাধীন কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছে।

ব্ল্যাবের প্রধান কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন। নাম না প্ৰকাশ করার শর্তে জনৈক র‍্যাব কর্মকর্তা বলেন, তাদের ডগ স্কোয়াডের একটি ডিগ গত এক মাস ধরে মিসিং। একটি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির কারণে দুর্ধর্ষ এক কুকুর জনজীবনে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অবহেলার কৈফিয়ত কে দেবে?

কঠিন প্রতিবেদন। এমন প্রতিবেদন পড়ে চুপ করে বসে থাকা যায় না। আমি হাবীব ভাইয়ের মোবাইল থেকে যোগাযোগ করলাম। প্রথম রিং-এ খালু সাহেব ধরলেন। ধরেই খ্যাক করে উঠলেন, কে?

আমি বললাম, আমি হিমু।

খালু সাহেবের গলায় হাহাকার ধ্বনি, তুমি খবর কিছু জানো?

কী খবর?

সারারাত হৈচৈ। মাতামতি। এখন সবগুলি টিভি চ্যানেলে খবর দেখাচ্ছে আর তুমি কিছু জানো না! আমরা তোমার ঐ ভয়ঙ্কর কুকুরের হাতে বন্দি। সবাই এখন ছাদে। রাতে কেউ ডিনার করতে পারে নি।

ব্রেকফাস্টের অবস্থা কী?

পাশের বাড়ির ছাদ থেকে পলিথিনের ব্যাগে নাশতা ভরে ছুড়ে ছুড়ে মারছে। তুমি টিভি খোল। টিভি খুললেই Live দেখতে পাবে। তোমার কাছে আমার অনুরোধ– খবর পরে দেখবে। এই খবর অনেকবার রিপিট করবে। তুমি এসে তোমার কুকুর নিয়ে যাও। আমার কোনো কারণে যদি তুমি আমার উপর অসন্তুষ্ট হয়ে থাক, Forgive me.. মানুষ মাত্রই ভুল করে। নাও বাদলের সঙ্গে একটু কথা বলো।

বাদল টেলিফোন হাতে নিয়েই ফিসফিস করে বলল, হিমুদা! বিরাট ড্রামা। সো এক্সাইটিং। আমার আনন্দে লাফাতে ইচ্ছা করছে। টিভি চ্যানেলে এর মধ্যে আমি একটা ইন্টারভ্যু পর্যন্ত দিয়েছি। চ্যানেলের লোেকরা কী বলছে জানো? আমাদের না-কি Air lift করা হবে। হেলিকপ্টার দিয়ে দড়ি বেঁধে এক ছাদ থেকে আরেক ছাদে নেয়া হবে। এতে ওদের বিরাট পাবলিসিটি। তুমি যেখানে আছ সেখানে টিভি আছে না? চ্যানেল আই ছাড়া। ওদের লাফালাফিই সবচে বেশি।

নাশতা খেতে খেতে টিভি দেখছি। ফর্সা, রোগা, মাথায় টাক এক যুবক উত্তেজিত ভঙ্গিতে কথা বলছে— সুপ্রিয় দর্শক! সামান্য একটা কুকুর কী পরিমাণ বিপর্যয়ের জন্ম দিতে পারে তা স্বচক্ষে দেখুন। কুকুরের হাতে বন্দি অসহায় একটি পরিবারের সাহায্যে এসেছে আপনাদের প্রিয় চ্যানেল— চ্যানেল আই। হৃদয়ে বাংলাদেশ। আমাদের ব্যবস্থাপনায় একটি হেলিকপ্টার কিছুক্ষণের মধ্যেই উপস্থিত হবে। আমরা মানবিক কারণে একটি অসহায় পরিবারকে উদ্ধার করব।

সুপ্রিয় দর্শক, আপনারা জানেন চ্যানেল আই সবসময় অসহায় মানবতার স্বার্থে কাজ করেছে। অতীতে করেছে, ভবিষ্যতেও করবে। আমি হেলিকপ্টারের শব্দ শুনতে পাচ্ছি— ঐ তো দেখা যাচ্ছে হেলিকপ্টার।

মোটামুটি মুগ্ধ হয়েই হেলিকপ্টারের উদ্ধার দৃশ্য দেখলাম। দড়িদাড়া নামছে, খালু সাহেব হাত পা ছুড়ে না না করছেন। টিভি ক্যামেরা হঠাৎ খালু সাহেবকে বাদ দিয়ে টাইগারকে ধরল। টাইগার এতক্ষণ ছাদে ছিল না। মজা দেখতে সেও চলে এসেছে।

টিভির কমেনটোটারের উত্তেজিত গলা শোনা যাচ্ছে— সুপ্রিয় দর্শক, উদ্ধার কাজে বিঘ্ন ঘটতে যাচ্ছে বলে আমরা ধারণা করছি। দুর্ধর্ষ হিংস্র টাইগারকে আপনারা দেখতে পাচ্ছেন। বিপর্যয়ের মূল হোতা যে টাইগার তাকে ছাদে দেখা যাচ্ছে। সে কী করবে। বোঝা যাচ্ছে না। এই মুহূর্তে ছাদে ছুড়ে ফেলা পলিথিনের প্যাকেট সে শুঁকে শুঁকে দেখছে।

এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি। উদ্ধার কাজে দমকল বাহিনীর সদস্যরা চলে এসেছেন। তাদের মই উঠে আসছে। দুমুখি উদ্ধার অভিযান শুরু হয়েছে।

সুপ্রিয় দর্শকমণ্ডলি, আমরা দমকল বাহিনীর উদ্ধার অভিযানের ভিডিও করতে গিয়ে উদ্ধার অভিযানের চরম সংকটময় মুহুর্ত কিছুক্ষণের জন্যে আপনাদের দেখাতে পারি নি। এখন দেখুন–দড়িতে করে যে ভদ্রলোককে হেলিকপ্টারে তোলা হচ্ছিল তার দড়িদাড়ায় কোনো একটা সমস্যা হয়েছে বলে তিনি উল্টো হয়ে অতি বিপজ্জনক ভঙ্গিতে ঝুলছেন। আমরা আশঙ্কা করছি, যে-কোনো মুহূর্তে একটা বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটবে। এই ভদ্রলোক ছিটকে পড়বেন ছাদে।

সুপ্রিয় দর্শক, কিছুক্ষণের বিজ্ঞাপন বিরতি। বিরতির পর আপনাদের আমরা আবার নিয়ে আসব রোমাঞ্চকর এই উদ্ধার অভিযানে।

বিজ্ঞাপন শুরু হলো। মনে হচ্ছে আজ আবুল হায়াত দিবস। প্রতিটি বিজ্ঞাপনই তার। প্ৰথমে লিপটন তাজা চায়ের গুণগান করলেন। তারপর তাকে দেখা গেল নাসির গ্লাসের গুনগান করতে। নাসির গ্লাসের পর সিংহ মার্কা শরিফ মেলামাইন। আবুল হায়াত দর্শকদের সাবধান করলেন কেউ যেন সিংহমার্কা না দেখেই শরিফ মেলামাইন না কেনে। সিংহমার্কার পরেই তিনি চলে এলেন গরু মার্কায়। গরুমার্কা ঢেউটিন বিশ্বমানের। জানা গেল গারুমার্ক ঢেউটিন ছাড়া অন্য কোনো ঢেউটিন তিনি ব্যবহার করেন না। টিন পর্ব শেষ হবার পরই সিমেন্ট পর্ব।

সিমেন্টের বিজ্ঞাপনটা দেখার শখ ছিল। দেখা হলো না। নাশতা খাওয়া শেষ হয়েছে, আমার উঠে পড়া দরকার। টাইগারকে উদ্ধার করতে হবে। তাকে যেখান থেকে এনেছি সেখানে ছেড়ে দিয়ে আসতে হবে। বাদলদের বাড়িতে রাখা যাবে না। ঐ বাড়ি এখন টাইগারের জন্যে অতি বিপদজনক স্থান। টাইগারকে উদ্ধার কীভাবে করব তাও বুঝতে পারছি না। টাইগারের জন্যে কোনো উদ্ধারকারী হেলিকপ্টার আসবে না। তার জন্যে আসবে মিউনিসিপালটির কুকুর ধরা গাড়ি। তার যে এখন জীবনসংশয় তা বুঝতে পারছি, তবে ভরসার কথা— বাদল আছে। বাদল তার নিজের জীবন থাকতে টাইগারের কিছু হতে দেবে না। তার পরেও কিছু বলা যায় না।

আমার বাবা (মহাপুরুষ গড়ার কারিগর) তাঁর উপদেশমালায় মৃত্যুবিষয়ক অনেক কথাবার্তা লিখে গেছেন। সেখানে অতি নিম্নশ্রেণীর প্রাণ জীবাণুর মৃত্যু বিষয়েও লেখা আছে—

জীবাণুর জন্ম মৃত্যু

জীবাণু অতি নিম্নপর‍্যায়ের প্রাণ। যেহেতু প্ৰাণ আছে কাজেই মৃত্যুও আছে। মুহুর্তেই লক্ষ কোটি জীবাণুর জন্ম হয়, আবার মুহুর্তেই মৃত্যু। অতি ক্ষণস্থায়ী জীবনকালে তাহারা কী ভাবে? তাহাদের চেতনায় চারপাশের জগৎ কী? এই বিষয়ে বাবা হিমু, তুমি কি কখনো চিন্তা করিয়াছ? আপাতদৃষ্টিতে মনে হইতে পারে জীবাণুর চিন্তা-চেতনা অর্থহীন। তাহাদের ক্ষণিক জীবনে চিন্তা-চেতনার স্থান নাই। এই যুক্তি মানিয়া মানব সম্প্রদােয় সম্পর্কে কিছু বলি। মহাকাল এবং বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের কাছে মানব সম্প্রদায়ের ক্ষণিক জীবনও তুচ্ছ। সেই বিবেচনায় তাহাদের চিন্তা-চেতনাও অর্থহীন।

মানব সম্প্রদায়ের উচিত নিজেদেরকে জীবাণুর মতোই চিন্তা করা। কিন্তু অহংবোধের কারণে তাহারা তা করে না। বরং অমরত্বের কথা ভাবে। পাবলো নেরুদার বিখ্যাত কবিতা Fin del mundo-র প্রতি তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি—

তাজ্জব, মোৎসার্ট কি-না লম্বাবুল তোফা ফ্রককোটে আমাদের শতকেও নাছোড়বান্দার মতো টিকে আছেন, এখনো বাহারি সাজে জমকালো, পরিপাটি পূর্ণাঙ্গ সঙ্গীতে; বিগত শতক জুড়ে, মনে হয়, আর কোনো আওয়াজও বুঝি বা কানে আসে নি।

 

এখন সন্ধ্যা।

আমি দাঁড়িয়ে আছি আয়না মজিদের বাসার সামনে। আমার সঙ্গে টাইগার। তাকে অনেক ঝামেলা করে উদ্ধার করতে হয়েছে। মিউনিসিপালটির কুকুর ধরা গাড়িতে তাকে ভরে ফেলা হয়েছিল। গাড়ির ড্রাইভার এবং তার অ্যাসিসটেন্টকে টাকা খাইয়ে বাদল কুকুর উদ্ধার করেছে। টাকার পরিমাণ কত বাদল বলছে না। মনে হয় বেশি। গাড়িতে টাইগার যে ভঙ্গিতে বসেছিল এখনো সিড়ির গোড়ায় সেই ভঙ্গিতে (হিজ মাস্টার্স ভয়েসের কুকুরের মতো) থাবা গেড়ে বসে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে মোৎসার্টের কোনো মহান সঙ্গীত শুনছে। সঙ্গীত ভেসে আসছে বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে। আমি খানিকটা দ্বিধাগ্ৰস্ত–দরজার কলিংবেলে। হাত রাখব কি রাখব না। কলিংবেল নতুন লাগানো হয়েছে। নতুন কলিংবেল বলে দেয় ভাড়াটে বদল হয়েছে।

আয়না মজিদ টাইপ লোকজন জলেভাসা কলমির মতো এক জায়গায় কখনো থাকবে না। তাদের ভাসতে হবে। কলিংবেলে হাত রাখতে হলো না, দরজা খুলে গেল। আয়না মজিদ বললেন, ভেতরে আসুন।

আমি ঘরে ঢুকলাম। টাইগারও আমার গা ঘেসে ঘরে ঢুকল। বেচারা ভালো ভয় পেয়েছে। এখন সে আমাকে ছাড়বে না। আয়না মজিদ বললেন, টেলিভিশনে যাকে দেখেছি। এই কি সে?

আমি হ্যা-সূচক মাথা নাড়লাম। ঘরের ভেতরটা অন্ধকার। বাতি জ্বালানো হয় নি। কোনো কিছুই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। এই অন্ধকারেও আয়না মজিদের চোখে কালো চশমা। সে কোনো দিকে তাকাচ্ছে না; বাঁ আদৌ তাকাচ্ছে কি-না বুঝতে পারছি না।

বসুন।

আমি বললাম, কোথায় বসব?

মেঝেতে বসুন।

আমি টাইগারের পাশে বসলাম এবং টাইগারের মতোই থাবা গেড়ে বসলাম। অন্ধকারে এই দৃশ্য রহস্যময় লাগার কথা। তবে কালো চশমার কারণে আয়না মজিদ কিছু দেখবে বলে মনে হয় না। আমি বললাম, ঘর অন্ধকার কেন?

কারেন্ট নাই এইজন্যেই অন্ধকার। আমি ঘর অন্ধকার করে লুকিয়ে বসে থাকার মানুষ না।

মোমবাতি নাই?

থাকার কথা। কোথায় আছে জানি না।

যে জানে। সে কোথায়?

আয়না মজিদ। জবাব দিল না। আমি আয়োজন করে কাধে ঝুলানো চটের ব্যাগ থেকে মোমবাতি এবং দেয়াশলাই বের করলাম। আমার ব্যাগে একেক সময় একেক জিনিস থাকে। আজি আছে মোমবাতি-দেয়াশলাই, এক কোটা গোলমরিচ, থােম্বার জয় নামের জনৈক পদার্থবিদের একটা বই, নাম Ultimate Nothing.

আমাকে ব্যাগ থেকে মোমবাতি বের করে জ্বালাতে দেখেও আয়না মজিদ কিছু বলল না। অন্য যে-কেউ প্রশ্ন করত— আপনি কি সব সময়ই ব্যাগে মোমবাতি দেয়াশলাই রাখেন?

আয়না মজিদ শান্ত গলায় বলল, আপনি কি আপনার এই কুকুরটা আমার কাছে বিক্রি করবেন?

করব।

দাম কত?

আমি বললাম, দামের ব্যাপারটা পরে আলোচনা করব। আগে ঠিক করুন এই বিপজ্জনক কুকুর আপনি চান কি-না। এই কুকুর সর্বক্ষণ আপনার সঙ্গে থাকবে। লোকজন তখন আপনাকে ডাকবে কুকুর মজিদ। আপনার জন্যে সম্মানহানীকর।

লোকে আমাকে কী ডাকল তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না। কুকুরটা আমি রাখতে চাই।

রেখে দিন।

মালিকানা বদল কি সে সহজে মানবে?

আমি বললেই মানবে।

এখনই বলুন।

টাইগারের দিকে তাকিয়ে আমি গম্ভীর গলায় বললাম, টাইগার, এখন থেকে আয়না মজিদ তোমার মাস্টার। যাও মাষ্টারের কাছে গিয়ে বসো।

টাইগার এই কাজটা করল। কেন করুল সে-ই জানে। কুকুর মানুষের কথা বুঝতে পারে না। বোঝার কোনো কারণ নেই। তবে জগতে অনেক কাকতালীয় ঘটনা ঘটে। ঘটে বলেই জগৎ এত রহস্যময়।

আয়না মজিদ বলল, এই কুকুর কি আপনার কথা বুঝতে পারে?

আমি জবাব দিলাম না। নৈঃশব্দ্য রহস্যময়। প্রকৃতিও রহস্যময়তা পছন্দ করে। আয়না মজিদ বলল, আপনি কি রাতে আমার সঙ্গে ডিনার করবেন?

হুঁ।

কী খেতে চান?

বিয়েবাড়িতে যেমন ঝোল ঝোল করে বড় বড় পিসের খাসির মাংসের

রেজালা করে সেরকম রেজাল।

সঙ্গে আলু থাকবে?

হ্যাঁ থাকবে। চাক চাক করে বড় বড় আলু।

রেজালা কী দিয়ে খাবেন? চিকন চালের ভাত, না পোলাও?

অবশ্যই পোলাও।

কলিজা দিয়ে আলুর চপের একটা প্রিপারেশন আছে। প্রচুর ধনে পাতা দিয়ে করা হয়। পোলাওয়ের সঙ্গে খেতে ভালো হয়। করব?

করুন।

বোরহানি করব?

না।

তাহলে সালাদ করি? টমেটো, কাচামরিচ, আর পেয়াজের সালাদ।

করুন। ঘরে নিশ্চয়ই বাজার নেই। টাকা দিন বাজার করে নিয়ে আসি। আমার সঙ্গে টাকা থাকে না।

আপনাকে বাজার করতে হবে না। ভালো মাংস আপনি চিনবেন না। আমার পরিচিত। কসাই আছে, মাংস দিয়ে যাবে।

আমি তাহলে হাঁটাহাঁটি করে ক্ষুধা চাগিয়ে আসি।

আসুন।

আপনি কি ইংরেজি পড়তে পারেন?

কেন জিজ্ঞেস করছেন?

আপনার জন্যে একটা ইন্টারেটিং বই নিয়ে এসেছিলাম। বইটা ইংরেজিতে লেখা, নাম Ultimate Nothing. ইংরেজি পড়তে পারলে বইটা আপনাকে দিতাম।

ইংরেজি পড়তে পারি। বইটার বিষয়বস্তু কী?

বিষয়বস্তু হচ্ছে বিশাল এই বস্তুজগৎ আসলে শূন্য। শূন্যের বেশি কিছু না।

তার মানে?

পড়ে দেখুন। আপনি বই পড়তে পছন্দ করেন এই তথ্য আমি জানি।

আমার বিষয়ে আর কী জানেন?

আপনি অতি ভয়ঙ্কর এই তথ্য জানি। তথ্যটা কি ঠিক আছে?

ঠিক আছে।

কে বেশি ভয়ঙ্কর— আপনি না। লম্বু খোকন?

প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে ইলেকট্রিসিটি চলে এলো। টাইগার বসেছিল। চারপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে গা ঝাকা দিল। আয়না মজিদ চোখ থেকে সানগ্লাস খুলল। তার চোখ ঝকঝকি করছে। প্রথম যখন দেখেছি তখন চোখ ঝকঝকে দেখি নি।

আমি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম, আমি কি রাতে খাবার সময় একজন গেস্ট নিয়ে আসতে পারি?

আয়না মজিদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, পারেন।

কাকে আনতে চাই জানতে চান?

না।

পুলিশের কাউকেও তো নিয়ে আসতে পারি। যেমন কবীর সাহেব। উনি ভালো খাওয়াদাওয়া পছন্দ করেন। তবে তার জন্যে খাবার শেষে টকা দৈ লাগবে।

আয়না মজিদ তাকিয়ে আছে। এর তোকানোয় বিশেষত্ব আছে। বিশেষত্বটা আগে ধরতে পারছিলাম না, এখন ধরলাম। আয়নী মজিদ যখন তাকায় তখন চোখে পলক ফেলে না। চোখে পলক ফেলার সময় হলে চোখ ফিরিয়ে নেয়। পলক ফেলার অংশটি সেই কারণে চোখে পড়ে না।

হিমু!

জি।

আপনার যাকে ইচ্ছা তাকে আনতে পারেন। আমি বুঝতে পারছি আপনি খেলা খেলতে চান। আপনি ভালো খেলোয়াড়। আমিও কিন্তু খারাপ না।

আমি বললাম, ডিনার কখন দেয়া হবে? কটায় কাটায় সেই সময় আসব। আগেও না পরেও না।

রাত দশটায়। যাকে আনবেন তার জন্যেই আমি তৈরি থাকব।

আয়না মজিদের কথাবার্তায় কাঠিন্য চলে এসেছে। কথাও বলছে দ্রুত। সে এক ধরনের টেনশন বোধ করছে। খেলার জন্যে সে তৈরি। ভয়ঙ্কর কোনো খেলাই সে আশা করছে। তাকে বঞ্চিত করা ঠিক হবে না।

 

পাঠক, অনুমান করুন তো আমি আয়না মজিদকে ভড়কে দেবার জন্যে কাকে নিয়ে ডিনার খেতে আসব? দেখি আপনাদের অনুমান শক্তি।

যেসব পাঠক নাটকীয়তা পছন্দ করেন তারা ধরেই নিয়েছেন আমি ডিএসবি ইন্সপেক্টর কবীর সাহেবকে নিয়ে আসব। এতে হাইড্রামা তৈরি হবে ঠিকই, তবে সম্ভাবনা একশ ভাগ যে এই ড্রামা হাতের মুঠো থেকে বের হয়ে যাবে। Out of COntrol Situation. তাছাড়া আয়না মজিদ। এই নাটকীয়তার জন্যে তৈরি থাকবে। কবীর সাহেবকে এনে তাকে চমকানো যাবে না।

 

অতিথির সন্ধানে বের হয়েছি। Guess who is coming to the dinner?

এক ঠেলাওয়ালা পেলাম। সে তার ঠেলা লাইটপোস্টের সঙ্গে তালাচাবি দিয়ে আটকাচ্ছে। ঠেলাওয়ালার চেহারা ইন্টারেস্টিং। অবিকল আমেরিকান প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন। জ্বলজ্বলে তীক্ষ্ণ চাখ, গাল ভাঙা। আব্রাহাম লিংকনের মতোই রোগা এবং লম্বা। আমি দরাজ গলায় বললাম, কেমন আছেন ভাই?

ঠেলাওয়ালা গভীর সন্দেহ নিয়ে আমাকে দেখছে। আব্রাহাম লিংকন এভাবে তাকাতেন না।

রাতের খাবার আমার সঙ্গে খাবেন? ভালো আয়োজন আছে।

না।

না, কেন?

পুলাপানে বইসা আছে, আমি মাংস পাকাব্য তারা খাইব।

মাংস কিনেছেন?

হুঁ।

ঠেলার ভেতরই খবরের কাগজে মোড়া মাংস। একটা তেলের শিশি। আরেকটা পোটলা দেখা যাচ্ছে, মনে হয় চাল।

আপনার পুলাপান কয়জন?

খামাখ্যা এত কথা জিগান ক্যান? আপনে কে?

ঠেলাওয়ালা দাঁড়াল না। হনাহন করে যাচ্ছে। আমি তার পেছনে পেছনে যাচ্ছি। মানুষের অদ্ভুত স্বভাবের একটি হলো অনুসরণ। ঠেলাওয়ালা দাঁড়িয়ে গেল। আমার দিকে তাকিয়ে তীব্র গলায় বলল, আপনের মতলব তো ভালো ঠেকতাছে না। পিছে পিছে আসেন ক্যান? আর এক পাও আইছেন কি ইটের চাক্কা দিয়া ঢেলা দিমু।

আমাকে দাঁড়িয়ে পড়তে হলো। ঘণ্টাখানিক হাঁটাহাটি করে একজন রাতের অতিথি পাওয়া গেল। চার থেকে পাঁচ বছর বয়েসী মেয়ে, নাম বকুল। সে তার দাদার সঙ্গে গান গেয়ে ভিক্ষা করে। বকুলের দাদা একটা গানই জানে, পীরিতি করবায় সুমনে। দাদার তিনদিন ধরে জুর। ভিক্ষায় যেতে পারে নি। বকুলের খাওয়া প্রায় বন্ধ। এ নিয়ে বকুলকে তেমন চিন্তিত মনে হচ্ছে না। সে তিন-চারটা পাথর যোগাড় করেছে, তাই নিয়ে নিবিষ্ট মনে খেলছে। পাশেই তার দাদা সারা শরীর চাদরে ঢেকে শুয়ে আছে। খোলা আকাশের নিচে যে শুয়ে আছে তা-না। মাথার উপর নীল পলিথিনের ছাদ। এক কোনে ইটের চুলা। কিছু হাঁড়িকুড়ি। লাল রঙের প্লাষ্টিকের বালতি। বকুল এবং বকুলের দাদা আমার পরিচিত। তাদের পলিথিনের ঘরে একবার ডালভর্তা দিয়ে ভাত খেয়েছিলাম।

বকুল, কী করো?

খেলি।

রাতে খাওয়া হয়েছে?

না।

চল আমার সঙ্গে, তোর দাওয়াত।

বকুল পাথর ফেলে সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। চাদরের ভেতর থেকে তার দাদা বলল, হিমু ভাইজান, এরে নিয়া যান। আমি আর পারতেছি না। অপারগ। আপনে অনেক দয়া করেছেন। আরেকটু করেন। আপনের পায়ে ধরি।

শরীর কি বেশি খারাপ?

জে। মরণ রোগে ধরেছে। মরণ রোগে ধরলে পানি তিতা লাগে। আমার লাগিতাছে। কলের পানি মুখে দিলে মনে হয় চিরতার পানি। হিমু ভাই, আপনার সাথে কি টেকা পয়সা কিছু আছে?

দশ টাকার একটা নোট আছে।

একটা গান গাই। গান শুইন্যা দশটা টেকা দিয়া যান।

গাও।

বৃদ্ধ চাদরের ভেতর থেকে গান ধরল—

পীরিতি করবায় সুমনে। ও সখী, পীরিতি করবায় সুমনে।

 

আয়না মজিদ বকুলকে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে উঠল। আমাকে বলল, এ আপনার গেষ্ট!

আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লাম।

আয়না মজিদ বকুলকে বলল, এই তোর নাম কী? বকুল সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমার নাম বকুল। আপনের নাম কী? বলেই সে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল টাইগারের উপর। যেন অনেক দিন পর সে তার পুরনো বান্ধবের দেখা পেয়েছে। ঝাঁপঝাঁপি আদর মনে হয়। টাইগারের পছন্দ হয়েছে। সে পেটের ভেতর থেকে ঘড়ঘড় শব্দ বের করছে। বকুল এখন ঘোড়ার মতো কুকুরটার পিঠে চড়ার চেষ্টা করছে। টাইগারের তাতে তেমন আপত্তি আছে বলেও মনে হচ্ছে না। আয়না মজিদ তাকিয়ে আছে বকুলের দিকে। তার চোখের দৃষ্টিতে পরিবর্তন লক্ষ করলাম। এখন সে ঘনঘন পলক ফেলছে।

বকুল আয়না মজিদের দিকে ফিরে বলল, এই কুত্তাটার নাম আছে?

মজিদ বলল, না। বকুল বলল, আমি এর নাম দিলাম ভুলু। এই ভুলু, গান শুনবি? ভুলু ঘোৎ জাতীয় শব্দ করতেই বকুল গান শুরু করল—

পীরিতি করবায় সুমনে
ও সখী, পীরিতি করবায় সুমনে!

মেয়েটির গলা তীক্ষা, ধরেছেও অনেক চড়ায়। সারা ঘর ঝনঝনি করছে। দুই লাইন গেয়েই বকুল খেলায় ফিরে গেল। এবার সে খেলছে আরব্য রজনীর রূপকথার খেলা। কুকুরের লেজ টেনে সোজা করার চেষ্টা। এই কাজ সে অসীম ধৈর্যের সঙ্গে করে যাচ্ছে।

আয়না মজিদ আমার দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, আপনি আসলে কী চাচ্ছেন পারিষ্কার করে বলুন।

আমি বললাম, কিছু তো চাচ্ছি না।

অবশ্যই চাচ্ছেন। অবশ্যই আপনি বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন। বেছে বেছে এমন একটা মেয়েকে নিয়ে এসেছেন যার নাম বকুল।

বকুল নামে কোনো সমস্যা আছে?

আমার একটা ছোট বোন ছিল, নাম বকুল। তার একটা পোষা কুকুর ছিল নাম ভুলু।

বাংলাদেশে অসংখ্যা বকুল নামের মেয়ে আছে। এ দেশের বাচ্চারা তাদের পোষা কুকুরের নাম হয় ভুলু রাখে কিংবা টাইগার রাখে।

বকুল নদীতে ড়ুবে মারা গিয়েছিল। নদীর যেখানে বোনের লাশ ভেসে উঠেছিল তার পোষা কুকুর ভুলু রোজ সেখানে যেত। ঘন্টার পর ঘণ্টা বসে शंনা!

পশুদের আবেগ ভালোবাসার প্রকাশ মাঝে মাঝে তীব্ৰ হয়।

আয়না মজিদ সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, আপনি পাশ কাটাবার চেষ্টা করবেন না। আপনি নির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছেন। লম্বু খোকন আপনার পরিকল্পনার অংশ। আপনি কি জানেন সে রোজ রাতে একটা বকুল গাছের চারপাশে ঘুরপাক খায়?

জানতাম না। এখন জানলাম।

এই ঘুরপাক খাওয়া আপনি তার মাথায় ঢুকান নি? সে বলেছে আপনাকে এই কাজ করতে দেখেছে বলেই সে করে।

মানুষ অনুকরণপ্রিয়। সে অনুকরণ করতে পছন্দ করে। একজন লম্বা মানুষের আশেপাশের সব মানুষ উঁচু হয়ে দাঁড়াতে চায়। কাউকে হাসতে দেখলে আমাদের মুখ হাসি হাসি হয়ে যায়। আপনার রাগী রাগী মুখ দেখে আমার মুখও খানিকটা রাগী রাগী হয়ে গেছে বলে আমার ধারণা।

আয়না মজিদের চোখ। আবার আগের মতো হয়ে গেছে। পালক পড়া বন্ধ। মানুষের এই অবস্থাকে বলে সৰ্প ভাব। সাপের চোখের পাতা নেই বলে সে পলক ফেলে না। বকুলের দিকে এখন সে ফিরেও তাকাচ্ছে না। ফিরে তাকালে মজা পেত। বকুল কুকুরের পিঠে চড়ে বসেছে। দুহাতে কুকুরের গলা জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। আমি বললাম, আপনার বোন বকুল কি তার কুকুরের পিঠে চড়তো?

হ্যাঁ চড়তো।

তাহলে এই দৃশ্য দেখে আপনার আনন্দ পাওয়া উচিত। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।

খাবার দিচ্ছি, খেয়ে মেয়ে নিয়ে বিদায় হয়ে যান।

টাইগারকে রেখে যাব?

হ্যাঁ।

ওর নাম এখন কী? টাইগার না-কি ভুলু?

আয়না মজিদ জবাব দিল না।

 

প্রচুর খাবার সাজিয়ে আমি আর বকুল বসেছি। বকুল চোখ বড় বড় করে খাবারগুলি দেখে হঠাৎ হাত গুটিয়ে বলল, খামু না।

আমি বললাম, খাবে না কেন?

বকুল জবাব দিল না। তার চোেখ মুখ শক্ত। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে ক্ষুধার্তা এই মেয়েটিকে ভুলিয়ে ভালিয়ে খাওয়ানো যাবে না। আমি বললাম, চল তাহলে উঠে পড়ি। তোকে ফেলে একা তো খেতে পারি না। এক যাত্রায় পৃথক ফল হওয়া শোভন না।

আয়না মজিদ শীতল গলায় বলল, খুব শিগগির আবার দেখা হবে।

আমি বললাম, কুকুরটা নগদ টাকায় কিনবেন বলেছিলেন। টাকা কি এখন দেবেন?

কত টাকা?

এক লাখ টাকা।

একটা নেড়ি কুত্তার দাম এক লাখ?

নেড়ি কুত্তা বলে তাকে অবহেলা করা ঠিক না। সে এখন টিভি স্টার।

আয়না মজিদ বলল, টাকা দিচ্ছি নিয়ে যান।

যে কুকুর নিয়ে বকুলের এত মাখামাখি, যাবার সময় বকুল তার দিকে ফিরেও তাকাল না। কুকুর বেচারা প্রচুর লেজ নাড়ল, দৃষ্টি আকর্ষণের নানান চেষ্টা করল। লাভ হলো না। পশুরা কখনোই বিচিত্ৰ মানব জাতিকে বুঝতে পারে না।

বকুলকে তার আস্তানায় নিয়ে গেলাম। তার দাদাজান সেখানে নেই। আরেক ভিক্ষুক পরিবার আস্তান দখল করে বসে আছে। ইটের চুলায় আগুন জ্বলছে। হাঁড়িতে কী যেন ফুটছে। বৃদ্ধা এক ভিক্ষুক দাঁত-মুখ খিচিয়ে বলল, চান কী?

আমি বললাম, এই জায়গাটা তো আমাদের।

বৃদ্ধা কঠিন গলায় বলল, আপনের নাম লেখা আছে? দেখান কোনখানে নাম লেখা?

বকুল উদাস গলায় বলল, জানি না।

বৃদ্ধা আবারো ঝাঁঝিয়ে উঠল, আপনেরা ফুটবেন? না ফুটলে খবর আছে।

আমি বকুলের হাত ধরে হাঁটা ধরলাম। কোথায় যাওয়া যায় তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না। সবার গন্তব্যই পূর্বনির্ধারিত। ক্লাসিকেল মেকানিক্স তাই বলে। কোয়ানটাম মেকানিক্স এসে সামান্য ঝামেলা করছে। ঝামেলা পাকিয়েছেন হাইজেনবাৰ্গ সাহেব। তিনি অনিশ্চয়তা নিয়ে এসেছেন। তাঁর কারণেই সর্ব গন্তব্যে কিছু অনিশ্চয়তা।

 

শোভা আপু চোখ কপালে তোলার চেষ্টা করতে করতে বললেন, তুই এত রাতে! সঙ্গে এই পিচ্চি কে? এই পিচ্চি তোর নাম কী?

আমার নাম বকুল, তোমার নাম কী?

শোভা আপু বিস্মিত হয়ে বললেন, এ দেখি টের টের করে কথা বলে।

আমি বললাম, শোভা আপু, আমরা দুজন ভাত খাব, ক্ষিধায় মারা যাচ্ছি।

তুই যে কী যন্ত্রণা করিস! (শোভা আপুকে অত্যন্ত আনন্দিত মনে হচ্ছে। আমার যন্ত্রণায় তিনি কিছুমাত্র বিচলিত এমন মনে হলো না।)

গরম ভাত, ঘি, আলুভাজি। ডালও লাগবে। ঘন ডাল।

আগে বল এই মেয়ে কে?

এর নাম বকুল; এখন থেকে তোমার সঙ্গে থাকবে। স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবে। দুলাভাই আপত্তি করলে তাকে সামলাবে।

আপত্তি করবে কেন?

দুলাভাই বাসায় আছে না?

আছে। ঘুমাচ্ছে। ডাকি?

না না। ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। আমাকে দেখলে অগ্ন্যুৎপাত হবে। ঝামেলা দরকার কী? শোভা আপু টাকাটা রাখ।

কী টাকা?

এখানে এক লাখ টাকা আছে। বকুলের এক আত্মীয়, দূরসম্পর্কের ভাই, টাকাটা দিয়েছে। মেয়ের লেখাপড়ার খরচ।

বলিস কী?

দুলাভাইকে এই টাকার কথা বলার দরকার নেই। পুলিশের লোক তো, নানান প্রশ্ন করবে। কী দরকার? আরেকটা কথা। আমি কিন্তু ভাত খেয়েই ফুটব।

ফুটব মানে কী? ফুটব মানে হাওয়া হয়ে যাব। Gone with the wind. বাতাসের সঙ্গে বিদায়।

শোভা আপু ঠোঁট টিপে হাসতে হাসতে বলল, এই মেয়েটার ভাগ্য ভালো।

কেন বলো তো?

আজ আমাদের ম্যারেজ ডে। তোর দুলাভাই এই জন্যে বাইরে থেকে নানান খাবারদাবার কিনে এনেছে। ফ্রিজ ভর্তি খাবার। গরম করব। আর তোদের দেব।

গরম করা শুরু কর। সাবধানে গরম করো। শব্দ যেন না হয়। দুলাভাইয়ের ঘুম যেন না ভাঙে।

ও মরণ ঘুম ঘুমায়। একবার ঘুমিয়ে পড়লে কানের কাছে ঢোল বাজালেও ঘুম ভাঙবে না। একবার কী হয়েছে শোন— চোর ঘরে ঢোকার জন্যে জানালার গ্রিল কাটছে। তোর দুলাভাই মারা ঘুম ঘুমাচ্ছে। আমি ঘুম ভাঙানোর জন্যে তাকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে মেঝেতে ফেলে দিয়েছি, তারপরেও ঘুম ভাঙে না। হিহিহি।

যে লোক মরণ ঘুম ঘুমায় শোভা আপুর হালকা হি হি হাসিতে তাঁর ঘুম ভাঙল। তিনি উঠে এলেন এবং হতভম্ব হয়ে তাকালেন। আমাকে বললেন, আপনি কে?

আমি বললাম, দুলাভাই আপনার সঙ্গে তো আমার পরিচয় হয়েছে। আমাকে রিমান্ডে নিয়ে গেলেন। ভালো আছেন? হ্যাপী ম্যারেজ ডে।

এইমাত্র ঘুম থেকে উঠে আসার কারণেই হয়তো বেচারা পুরোপুরি হকচাকিয়ে গেছেন। চোখের সামনে আয়না মজিদকে দেখেও কী করবেন বাঁ কী করা উচিত বুঝতে পারছেন না। তিনি আমার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বকুলের দিকে তাকালেন। চাপা গলায় বললেন, এই মেয়ে কে?

আমি বললাম, এর নাম বকুল। এ আয়না মজিদের বোনের মতো। আপনাদের ম্যারেজ ডে উপলক্ষে বকুল আপনাকে গান শোনাবে।

বকুল সঙ্গে সঙ্গে গান ধরল,

পীরিতি করবায় সুমনে
ও সখী, পীরিতি করবায় সুমনে!

গানের মাঝখানেই দুলাভাই বললেন, এই মেয়ে থাকে কোথায়?

শোভা আপু বললেন, তুমি পুলিশী জেরা বন্ধ করা তো। এরা ক্ষিধায় মারা যাচ্ছে। তুমি ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে গরম দাও।

শোভা! তুমি পৃথিবীর সবচে বড় গাধা মেয়ে বলে বুঝতে পারছি না। এরা কারা। দুজনই ভয়ঙ্কর।

আমার ভাই হয়ে গেল ভয়ঙ্কর?

তোমার ভাই? তোমার ভাই হয়েছে কবে? আমাকে ভাই শেখাও?

আজ আমাদের ম্যারেজ ডে, তুমি শুরু করেছ ঝগড়া?

শোভা! তুমি ভয়ঙ্কর একটা ঘটনার গুরুত্বই বুঝতে পারিছ না। তুমি জানো এ কে? এর নাম আয়না মজিদ।

আয়না মজিদ হোক বাঁ চিরুনি মজিদ হোক, এ আমার ভাই।

ভয়ঙ্কর একটা খুনির সঙ্গে ভাই পাতায়ে ফেললে?

পাতাতে হয় নি–আগে থেকেই পাতানো ছিল।

Oh my God!

গড তোমার একার না। আমাদের সবার। বলো On our God. বলে ফ্ৰিজ খুলে খাবার বের করা। যদি তা না কর আমি কিন্তু আগামী সাতদিন কিছুই খাবো না। পানি পর্যন্ত না। আমার ভাই খেয়েদেয়ে চলে যাবে। তারপর তোমার যা ইচ্ছা করবে।

দুলাভাই আরো হকচকিয়ে গেলেন। তারপর তাঁকে রান্নাঘরের দিকে যেতে দেখা গেল। শোভা আপুগলা নামিয়ে বললেন, আগে একবার রাগ করে চারদিন না খেয়ে ছিলাম। এতেই বাবুর শিক্ষা হয়ে গেছে। দেখিস আর ঝামেলা করবে: না। খেয়েদেয়ে পালিয়ে যাবি। তোর দুলাভাইয়ের মতলব সুবিধার মনে হচ্ছে না। পুলিশ টুলিশ এনে হুলুস্থুল করতে পারে।

বকুলকে নিয়ে খেতে বসেছি। প্রচুর খাদ্য। দেখতেও ভালো লাগছে। চার্লস ডিকেন্স বলেছিলেন, নগরীর এক প্রান্তে প্রচুর খাদ্য কিন্তু কোনো ক্ষুধা নেই। অন্য প্রান্তে প্রচুর ক্ষুধা কিন্তু কোনো খাদ্য নেই। কথায় ভুল আছে। যেখানেই খাদ্য সেখানেই ক্ষুধা।

শোভা আপু বকুলের পিঠে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। দুলাভাই শোভা আপুর পাশে। তাঁর দৃষ্টি আমার দিকে। সেই দৃষ্টিতে তীব্র ঘৃণা এবং কিছুটা ভয়। হাতের কাছে এত বড় ক্রিমিন্যাল অথচ তিনি কিছুই করতে পারছেন না।

আনন্দে হাবীব ভাইয়ের মাথা মোটামুটি খারাপ

আনন্দে হাবীব ভাইয়ের মাথা মোটামুটি খারাপই হয়েছে বলা যেতে পারে। ডাক্তার আলট্রাসনোগ্রাফি করে বলেছে তার স্ত্রীর যমজ বাচ্চা। ডাবল ফিটাস পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। খবর শোনার পর থেকে তিনি উপহার বিলাতে শুরু করেছেন। যমজ উপহার–যাকে পাঞ্জাবি দিচ্ছেন একই রকম দুটা পাঞ্জাবি। যে শাড়ি পাচ্ছে সেও একই শাড়ি দুটা পাচ্ছে।

আমার জন্যেও তিনি উপহার নিয়ে এলেন–ডাবল মোবাইল। কাচুমাচু মুখ করে বললেন, আপনাকে ভালো কিছু দিতে চাই। এরচে ভালো কিছু আমার মাথায় আসে নাই।

এই যন্ত্ৰ দুটা দিয়ে আমি করব কী?

একটা তো আপনি দুদিন পরেই হারিয়ে ফেলবেন, তখন অন্যটা দিয়ে কথা বলবেন। প্রতিমাসের এক তারিখে আমি দুটা মোবাইলে ফ্লেক্সিলোড করব।

ফ্লেক্সিলোড কী?

টাকা জমা দেবার ব্যবস্থা। আপনি তো দুনিয়ার কিছুই জানেন না। আপনার জানার দরকার নাই, আমরা আছি না? এই বিষয়ে আর কথা বলবেন না হিমু ভাই।

আচ্ছা মোবাইল বিষয়ে কথা শেষ। যমজ বাচ্চার নাম কি আলাল দুলাল ঠিক আছে?

হাবীব ভাই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আপনার ভাবির কথা বিবেচনা করে মেনে নিয়েছি। নয় মাস কষ্ট তো সে-ই করবে। তার একটা দাবি আছে না? তবে আমি আলাল দুলাল ডাকব না। আমার নিজের কথারও তো একটা সম্মান আছে।

আপনি কী ডাকবেন?

আমি বড়টাকে ডাকব আলী, ছোটটাকে দুলা। আলা-দুলা।

আলা-দুলাও ভালো নাম। নামের মধ্যেই আদর টের পাওয়া যায়।

হাবীব ভাই বললেন, আমি আদর একেবারেই দিব না। আদরে সন্তান নষ্ট হয়। আদর যা দিবার আপনার ভাবি দিবে। আমি শাসনে রাখব।

আমি বললাম, শাসনে রাখতে পারবেন না। আপনার দুই বাচ্চা এক মুহূর্তের জন্যেও আপনাকে ছাড়বে না। দুইজন দুই হাত ধরে থাকবে।

আপনি যখন বলেছেন তখন ঘটনা যে এইটাই ঘটবে তা জানি। ব্যবসাবাণিজ্য আমার লাটে উঠবে। দুই ভাই নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে দোকানে গিয়ে বসে।

তা তো থাকবেই।

হাবীব ভাইয়ের চোখে আনন্দে পানি এসে গেছে। তিনি চোখের পানি গোপন করার জন্যে অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, আপনার ভাবি মনটা সামান্য খারাপ করবে। হাজার হলেও মা! কী বলেন, হিমু ভাই?

হাবীব ভাই চোেখ মুছছেন। আমি অবাক হয়ে ভাবছি, অপূর্ব এইসব মুহূর্ত যিনি সৃষ্টি করেন, তিনি কি দেখেন? না-কি তিনি সব আনন্দ-বেদনার উর্ধে? যদি আনন্দ-বেদনার উর্ধে হন। তাহলে আনন্দ-বেদনা কেন তৈরি করেন?

হিমু ভাই!

বলুন।

মোবাইলটা দিয়ে একটা টেলিফোন করুন। আমি নিজের চোখে দেখে যাই। ব্যাটারি ফুল চার্জ দেওয়া।

আমি শোভা আপুকে টেলিফোন করলাম।

শোভা আপু! বকুল কেমন আছে?

শোভা আপু আনন্দিত গলায় বললেন, ওর বকুল নাম আমি বদলে দিয়েছি। ওর নাম রেখেছি কটকটি। সারাদিন কট কট করে কথা বলে আর গান শোনায়। এই মেয়েটার গানের গলা তো ভালো।

আপু, মেয়েটাকে গান শিখিও। একদিন এই মেয়ে গান গেয়ে খুব নাম করবে। দেশে-বিদেশে তার নাম ছড়াবে। বিদেশের বড় বড় রেকর্ড কোম্পানি তার রেকর্ড বের করবে। বিদেশে তাকে সবাই ডাকবে Song bird of Bengal নামে।

তুই এমনভাবে কথা বলছিস যেন সব জেনে বসে আছিস। তুই এত বোকা কেন?

আমি প্রসঙ্গ পাল্টালাম। গম্ভীর গলায় বললাম, আপু চিঠিটা পড়ে শোনাও। শোভা আপু বলল, কোন চিঠি পড়ে শোনাব?

দুলাভাইয়ের চিঠি। আজ বুধবার না? চিঠি দিবস। দুলাভাইয়ের চিঠি পাও নি?

না।

না কেন?

তোর দুলাভাই চিঠি কী লিখবে! ওর মনমেজাজ ভয়ঙ্কর খারাপ। তাকে নাইক্ষ্যংছড়িতে বদলি করে দিয়েছে।

সে-কী!

শাস্তিমূলক বদলি। সোমবার চলে যাবে। তার ডিমোশনও হয়েছে। আয়না মজিদ তার হাত থেকে পালিয়ে গেল, ডিমোশন তো হবেই। আচ্ছা সত্যি করে বল তো, তুই কি আয়না মজিদ? আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলবি না। আমি তোর বোন। সবার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলা যায়, বোনের সঙ্গে মিথ্যা বলা যায় না। কারণ জানতে চাস?

চাই।

কারণ সব সম্পর্কে হিসাব আছে। দেনা-পাওনা আছে। মা-ছেলের সম্পর্কে আছে, আবার বাপ-ছেলের সম্পর্কেও আছে। শুধু ভাই-বোনের সম্পর্কে হিসাব নাই। দেনা-পাওনা নাই।

শোভা আপু! আমি আয়না মজিদ না।

তাহলে তুই কে?

আমি তোমার ভাই।

তুই এমনভাবে কথা বলিস, চোখে পানি এসে যায়। আমি টেলিফোন রাখলাম।

 

হাতের কাছে পেন্সিল থাকলে আঁকিবুকি করতে ইচ্ছা করে। হাতে মোবাইল থাকলে কথা বলতে ইচ্ছা করে। আমি খালু সাহেবকে টেলিফোন করলাম। বাদলের খোঁজ নিতে হবে।

কে হিমু! এতদিন কোথায় ছিলে? আমি পাগলের মতো তোমাকে খুঁজছি।

কেন?

আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে হিমু। হারামজাদা আয়না মজিদ আবার টাকা চেয়েছে।

কত চেয়েছে?

বলেছে প্রতিমাসের প্রথম বুধবারে তাকে এক লাখ করে টাকা দিতে হবে। আমি কী করব বলো তো?

কী আর করবেন? টাকা দিয়ে যাবেন।

এত কষ্টের টাকা আমি দিয়ে যাব? এটা তুমি কোনো কথা বললে? হিমু, তুমি ঐ বদমাইশটার সঙ্গে আমার একটা নিগোসিয়েশন করে দাও। দুই লাখ দিয়েছি, প্রয়োজনে আরো এক লাখ দেবো। আমাকে যেন মুক্তি দেয়।

আমি বললেই সে আপনাকে মুক্তি দিবে?

হ্যাঁ দিবে। তোমার বিষয়ে তার কিছু সমস্যা আছে। বারবার তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছে। তোমাকে না-কি তার খুব দরকার। হিমু, হাতের কাছে কাগজ কলম আছে? একটা টেলিফোন নাম্বার লেখ। আয়না মজিদের নাম্বার। আমাকে বলেছে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ হওয়ামাত্ৰ যেন এই নাম্বার তোমাকে দেয়া হয়। হিমু, ফর গডস সেক এক্ষুণি টেলিফোন কর।

বাদল কেমন আছে?

বাদল কেমন আছে। পরের ব্যাপার, তুমি এক্ষুণি টেলিফোন কর। এক্ষুণি। এই মুহূর্তে। ফর গডস সেক। নাম্বারটা লেখ—

টেলিফোন করতেই ওপাশ থেকে ভারি শ্লেষাজড়িত গলায় বলল, আপনে কোড়া? কারে চান?

আমি বললাম, আয়না মজিদকে চাই। তাকে বলুন হিমু কথা বলবে।

আয়না মজিদ কেডা?

চিনেন না?

জে না। আমার নাম ফজলু। আমার রড সিমেন্টের দোকান। ভাইজান মনে হয় লম্বরে ত্রুটি করেছেন।

টেলিফোনের লাইন কেটে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আয়না মজিদ টেলিফোন করল। বুঝলাম এটাই সিস্টেম। মাঝখানের ফজলুর নাম্বার সিকিউরিটি সিস্টেমের অংশ!

হিমু!

হুঁ।

আপনাকে আমার অত্যন্ত প্রয়োজন। আমার নিজের জন্যে না। লম্বুটার জন্যে। আপনি তো জানেন সে গভীর রাতে এক বকুল গাছের চারপাশে ঘোরে।

আমি ওর চক্কর বন্ধ করব। আপনার সাহায্য দরকার। আপনি অবশ্যই আজ রাতে আসবেন। বকুল গাছের কাছে।

একা আসব, না-কি ঐ রাতের মতো কোনো অতিথি নিয়ে আসব?

আপনি একাই আসবেন। আজ রাতের পর আপনাকে আমার আর প্রয়োজন হবে না।

আয়না মজিদ লাইন কেটে দিল।

প্রকৃতির রিমান্ড

আকাশে নানান ধরনের চাঁদ ওঠে। কবি সুকান্তের বিখ্যাত ঝলসানো রুটি মার্ক চাদ। রবীন্দ্রনাথের মায়াবী চাদ, যে চাঁদের আলোয় সবাই মিলে বনে যেতে ইচ্ছা! করে। আজ উঠেছে জীবনানন্দ দাশের চাদ। মরা চাদ, কুয়াশামাখা জোছনা। যে চাদ লাশকাটা ঘরের কথা মনে করিয়ে দেয়।

স্থান : রমনা পার্ক। বকুলতলা। আমি, আয়না মজিদ এবং টাইগার দাঁড়িয়ে আছি। পাশাপাশি। আমাদের সামনেই লম্বু খোকন। সে দাঁড়িয়ে নেই। বকুল গাছকে ঘিরে চক্কর দিচ্ছে। লম্বু খোকনকে আজ আরো লম্বা লাগছে। সে শুধু যে চক্কর দিচ্ছে তা-না, বিড়বিড় করে কী সব যেন বলছে। দৃশ্যটায় গা ছমছমে ব্যাপার আছে।

আয়না মজিদ গলা খাকারি দিল। লম্বু খোকন চমকে তাকাল। ফিসফিসানি গলায় বলল,। বস!

কী করছ?

ঘুরতেছি বস।

কেন?

লম্বু খোকন এই প্রশ্নে থাতমতো খেয়ে গেল। যেন জবাব তার জানা নেই। আয়না মজিদ থমথমে গলায় বলল, চক্কর কেন দিচ্ছ বলো?

এক্সারসাইজ করি। এক্সারসাইজ করলে শরীর ভালো থাকে।

এক্সারসাইজ কতক্ষণ করো?

বেশি না, অল্প সময় করি।

গতকাল কতক্ষণ এক্সারসাইজ করেছ?

ইয়াদ নাই।

কে তোমাকে এক্সারসাইজ করতে বলেছে?

কেউ বলে নাই।

আয়না মজিদ আমাকে দেখিয়ে বলল, চক্কর দেয়ার ব্যাপারটা তোমাকে হিমু করতে বলে নাই?

লম্বু খোকন বেশকিছু সময় আমার দিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট গলায় বলল, ইনাকে চিনলাম না।

হিমুকে চিনতে পারছ না?

জে না।

সিগারেট খাবে? নাও একটা সিগারেট খাও।

জে না।

না কেন?

চক্কর দেওয়ার সময় বিড়ি সিগারেট খাওয়া নিষেধ।

নিষেধ কে করেছে?

কে নিষেধ করেছে বলতে পারব না। তবে বিড়ি—সিগারেট, মদ-গাজা সব নিষেধ।

তোমার যে মাথা খারাপ হয়ে গেছে এটা জানো?

জে না।

আমি এসেছি তোমার মাথা ঠিক করতে।

জি আচ্ছা।

লম্বু খোকন জি আচ্ছা বলে হাঁটতে শুরু করেছে। টাইগার তাকে অনুসরণ করছে। রহস্যময় দৃশ্য। লম্বু খোকন বিড়বিড় করছে, কুকুরটাও তার মতোই ঘড়ঘড় করছে।

আয়না মজিদ সিগারেট ধরাল। সিগারেট তার বাঁ হাতে। ডান হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকানো।

হিমু!

বলুন।

তুমি ঝামেলা তৈরি করেছ। খোকনকে পুরোপুরি কব্জা করেছ। আমাকেও কাজ করার চেষ্টা করছি। আমার বাঁ হাতে সিগারেট, ডান হাতে কী বলো?

ডান হাতে পিস্তল।

গুড।

আয়না মজিদ যেহেতু তুমিতে নেমে এসেছে আমিও তুমিতে নামলাম। গল্প বলার ভঙ্গিতে বললাম, তোমার ধারণা হয়েছে আমাকে গুলি করে মারলেই তোমরা দুজন সব ঝামেলা মুক্ত হবে।

আমার ধারণা কি সত্যি?

সত্যি হবার সম্ভাবনা আছে।

আয়না মজিদ বলল, ভয় পাচ্ছি না?

আমি বললাম, ভয় পাচ্ছি। ভয় তুমিও পাচ্ছি। আমার ভয় পাওয়ার ব্যাখ্যা আছে। তোমার ভয়ের ব্যাখ্যা নেই।

আয়না মজিদ বাঁ হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে পা সামান্য ফাক করে দাঁড়াল। মনে হয় এইভাবে দাঁড়ালে গুলি করা সহজ। আমি বললাম, যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানেই থাকব, না-কি আরেকটু কাছে আসব?

আয়না মজিদ জবাব দিল না। পকেট থেকে পিস্তল বের করল। আমি কয়েক পা কাছে এগিয়ে এলাম। আমার বাবা, মহাপুরুষ তৈরির কারিগর, ভয় বিষয়ে লিখেছেন–

সব জয় করা যায়। সুউচ্চ এভারেস্ট জয় সম্ভব, ভয় জয় করা সম্ভব না। একজন মহাপুরুষ এই অসম্ভবকে সম্ভব করবেন। যখন তিনি এই কাজটি পারবেন। সেদিন…

খুট করে শব্দ হলো। পিস্তলের সেফটি ক্যাচ খোলা হলো। লম্বু খোকন চক্রাকারে ঘোরা বন্ধ করে আয়না মজিদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মনে হয় তার ঘোর কেটে যেতে শুরু করেছে। কুকুরটা এখনো ঘুরছে। সে তার চক্র অনেক বড় করেছে। আমাদের সবাইকে চক্রের ভেতর নিয়ে নিয়েছে। তবে তার দৃষ্টি আয়না মজিদের দিকে। সে হঠাৎ মাথা উঁচু করে বিলাপের মতো ডাকল, সঙ্গে সঙ্গে আমার ভয় কেটে গেল। কেউ একজন পিস্তল নিয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, যে-কোনো মুহূর্তে গুলি হবে–এটা মনে থাকল না। বরং মনে হলো মরা চাঁদের আলোয় আমরা তিনজন এবং একটা কুকুর পার্কে বেড়াতে এসেছি। আমি সহজ গলায় বললাম, আয়না মজিদ, তুমি কি লক্ষ করেছ। কুকুরটা তার চক্র বড় করেছে? আমরা সবাই সেই চক্রের ভেতর। আমি চক্র থেকে বের হতে পারব, কিন্তু তুমি এবং তোমার সঙ্গী কখনো পারবে না। টাইগার তোমাকে চক্র থেকে বের হতে দেবে না।

আয়না মজিদ জবাব দিল না। পিস্তল সে এখনো আমার দিকে তাক করে নি। এর অর্থ কিছুক্ষণ সময় এখনো আমার হাতে আছে।

স্কোয়াডে যাদের মারা হয় তাদের শেষবারের মতো একটা সিগারেট খেতে দেয়া হয়। বহুদিনের পুরনো নিয়ম। এই নিয়মে আমি একটা সিগারেট কি পেতে পারি? দুই থেকে আড়াই মিনিট সময় নেব। অসুবিধা আছে?

আয়না মজিদ চাপা গলায় বলল, না। সে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট এবং লাইটার আমার দিকে ছুড়ে দিল।

আমি আয়োজন করে সিগারেট ধরলাম। হাতে আড়াই মিনিট সময় আছে। আড়াই মিনিট অতি দীর্ঘ সময়। কারণ আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি কাজ করতে শুরু করছে। টাইম ডাইলেশন হচ্ছে। আড়াই মিনিট এখন অনন্তকাল।

কথা শেষ হবার আগেই পার পর তিনবার গুলি হলো। আয়না মজিদ গুলিটা আমাকে করে নি, টাইগারকে করেছে। গুলি লাগে নি। টাইগার নির্বিকার। সে ঘুরেই যাচ্ছে, তবে তার গতি এখন অনেক বেশি। আমি সিগারেটে টান দিয়ে বললাম, আয়না মজিদ! আমার কী ধারণা জানো? আমার ধারণা পারুল নামের তোমার ছোটবোনকে তুমিই ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলেছি। সেটাই ছিল তোমার জীবনের প্রথম খুন। প্রকৃতি এই কারণেই পারুলকে এবং টাইগারকে তোমার কাছে ফেরত পাঠিয়েছে। তোমার পিস্তলে আরো তিনটা গুলি থাকার কথা। চেষ্টা করে দেখো। কুকুরকে লক্ষ্য করে গুলি করলে হবে না। একটু সামনে করতে হবে।

লম্বু খোকন বলল, বসের পিস্তলে তিনটার বেশি গুলি কোনোসময় থাকে না। তিন উনার জন্য লাকি। পিস্তল নিয়ে বস যখন বাইর হন— গুলি তিনটার বেশি থাকে না। বস, ঠিক বলেছি?

আয়না মজিদ। জবাব দিল না। সে ভীত চোখে কুকুরটার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে কথা সত্যি।

পিথাগোরাস বিশ্বাস করতেন সংখ্যাই ঈশ্বর। ঈশ্বর নিজেকে প্রকাশ করেন। সংখ্যায়। তিন সংখ্যায় তিনি আছেন। তিন অতি রহস্যময় সংখ্যা। তিন হলো মাতা, পিতা ও সন্তান। তিন হলো আমি, তুমি এবং সে। অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ।

বকুল গাছের নিচেও তিনজন। আয়না মজিদ, লম্বু খোকন এবং একটি কুকুর।

কুকুরটাকে কেন জানি খুবই ভয়ঙ্কর লাগছে। মরা চাঁদের আলোর অনেক ব্যাপার আছে। এই আলো দৃশ্য বদলে দেয়। স্বাভাবিক দৃশ্য অস্বাভাবিক করে দেয়।

আমি বললাম, কেউ তোমাদের ধরে রাখে নি। যেখানে ইচ্ছা চলে যাও। দুজন দুদিকে ঝেড়ে দৌড় দাও। কুকুরটা confused হয়ে যাবে। কাকে ধরবে ঠিক করতে পারবে না। এই সুযোগে পগারপার।

 

দুজনের কেউ নড়ছে না। নড়তে পারবে এরকমও মনে হচ্ছে না। আমি পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলাম। লম্বু খোকন বলল, ভাইজান কাকে টেলিফোন করেন? তার গলায় রাজ্যের হতাশা।

কে? দুলাভাই? ঘুম ভাঙালাম। আপনি ভালো আছেন?

শাট আপ।

কষ্ট করে একটু কি আসবেন? রমনা পার্ক। আগে যেখানে কালিমন্দির ছিল তার কাছেই। একটা বকুল গাছ আছে।

আই সে শাট আপ।

আয়না মজিদ এবং লম্বু খোকনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দিচ্ছি। এই সুযোগ দ্বিতীয়বার আসবে বলে মনে হয় না।

দুলাভাই কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলেন তার আগেই আমি টেলিফোন রেখে দিলাম। আয়না মজিদের দিকে তাকিয়ে বললাম, আমি চলে যাচ্ছি। যাবার আগে একটা কথা বলে যাই। দুই ধরনের রিমান্ড আছে। পুলিশের রিমান্ড এবং প্রকৃতির রিমান্ড। পুলিশের রিমান্ড থেকে পালানো যায়, প্রকৃতির রিমান্ড থেকে পালানোর উপায় নেই। তোমাদের দুজনকেই প্রকৃতি রিমান্ডে এনেছে।

ওদের পেছনে ফেলে। আমি এগুচ্ছি। জোছনার আলো হঠাৎ খানিকটা স্পষ্ট হয়েছে। প্রকৃতি রহস্যের ফুল ফোটাতে শুরু করেছে। গাছে গাছে পাখিরা ডানা ঝাপটাচ্ছে। তাদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা।

Exit mobile version