Site icon BnBoi.Com

ক্রান্তিকাল – প্রফুল্ল রায়

ক্রান্তিকাল - প্রফুল্ল রায়

 ০১. সবে নভেম্বরের শুরু

ক্রান্তিকাল – প্রফুল্ল রায়
অকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত উপন্যাস ২০০৩
দে’জ পাবলিশিং কলকাতা ৭০০ ০৭৩
KRANTIKAL A Bengali Novel by PRAFULLA ROY Published by Sudhangshu Sekhar Dey, Dey’s Publishing 13 Bankim Chatterjee Street, Kolkata 700 073
প্রথম প্রকাশ : কলিকাতা পুস্তকমেলা জানুয়ারি ১৯৯৮, মাঘ ১৪০৪
দ্বাদশ সংস্করণ : এপ্রিল ২০১৭, বৈশাখ ১৪২৪

.

সবে নভেম্বরের শুরু। কিন্তু এরই মধ্যে বিকেলের আয়ু ফুরোতে না ফুরোতে সীমান্তের এই শহরটিতে চিনির মিহি দানার মতো হিম ঝরতে থাকে। দূরে, আকাশ যেখানে ঝুঁকে অনেকখানি নেমে এসেছে ঠিক সেইখানটায় পাহাড়ের উঁচুনিচু, ঢেউখেলানো একটা লাইন স্থির দাঁড়িয়ে আছে। দিনের বেলা রোদের ঝকমকে আলোয় পাহাড়গুলোকে নীল মেঘপুঞ্জের মতো দেখায়। কিন্তু বেলা পড়ে এলে রোদের রং যত ফিকে হয়, ওগুলোও দ্রুত ঝাপসা হতে থাকে। পাহাড়ের রেঞ্জটাকে তখন আবছা একটা পেনসিল স্কেচের মতো মনে হয়।

সূর্য ডুবে গেছে কিছুক্ষণ আগে। যদিও হিম ঝরতে শুরু করেছে, তবু দিনের আলো একেবারে নিভে যায়নি। হঠাৎ লজ্জা-পাওয়া কিশোরীর আরক্ত মুখের মতো একটু আধটু লালচে আভা আকাশের গায়ে এখনও লেগে আছে। কিন্তু কতক্ষণ আর? খানিক পরেই ঝপ করে নেমে আসবে সন্ধে। কুয়াশা আর অন্ধকারে ডুবে যাবে সমস্ত চরাচর।

নভেম্বরের গোড়া থেকে সারাদিন সারারাত এখানে উত্তুরে হাওয়া বয়ে যায়। দিনের দিকটায় রোদের তাত থাকায় ততটা গায়ে লাগে না, কিন্তু বিকেলের পর থেকে চামড়া কুঁড়ে যেন হাড়ের ভেতর পর্যন্ত ছুরির ছুঁচলো ফলার মতো বিধে যায়।

সাতচল্লিশের আগে সীমান্তের এই শহরটা ছিল দেশীয় রাজ্য প্রতাপপুর স্টেটের রাজধানী। রাজ্যের নামেই রাজধানীর নাম। অর্থাৎ প্রতাপপুর স্টেটের ক্যাপিটাল প্রতাপপুর সিটি।

স্বাধীনতার আগে, শুধু আগেই বা কেন, তার পরেও বেশ কয়েক বছর প্রতাপপুর সিটিটা ছিল ছবির মতো, পিকচার পোস্টকার্ডে ঠিক যেমনটা দেখা যায়। চওড়া চওড়া অ্যাসফাল্টের মসৃণ রাস্তা, দু’ধারে বাগানওলা বাংলো ধরনের বাড়ি, পার্ক, ফোয়ারা, দুই রাস্তার ক্রসিংয়ে শ্বেতপাথরের পরি। এছাড়া ছোট একটা জু-গার্ডেন, স্টেট লাইব্রেরি, ঝকঝকে হাসপাতাল, নানা ধরনের স্পোর্টসের জন্য একটা স্টেডিয়াম ইত্যাদি। যেদিকেই তাকানো যাক, তখন এখানে প্রচুর গাছপালা, ফুলের বাগান আর নির্জনতা। শহরটা যত বড়, সেই তুলনায় মানুষজন ছিল অনেক কম।

স্বাধীনতার পর অ্যাকসেসন অফ নেটিভ স্টেটস’ অর্থাৎ দেশীয় রাজ্যগুলো যখন ভারতবর্ষের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হল, রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটল, তখন ক্রান্তিকাল থেকেই প্রতাপপুর সিটি তার পুরনো আভিজাত্য, সৌন্দর্য আর মর্যাদা খুইয়ে ফেলেছে।

দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে সেকালের পূর্ব পাকিস্তান থেকে মানুষের ঢল নেমেছিল সীমান্তের এপারে। তার ধাক্কা এই প্রতাপপুরেও এসে লাগে। স্বাধীনতার পর যে দু-চারটে বছর রাজতন্ত্র চালু ছিল, জনস্রোত ঠেকিয়ে রাখা গেছে। তারপর আর পারা গেল না। প্রতাপপুর সিটি আমূল বদলে যেতে লাগল। যেখানে যত বাগান, পার্ক বা ফাঁকা জায়গা ছিল, পূর্ব বাংলার শরণার্থীরা সমস্ত কিছু দখল করে তুলতে লাগল ছিরিছাঁদহীন, বেঢপ চেহারার বাড়িঘর। রাজাদের সময় ভিক্টোরিয়ান আমলের ধাঁচে সন্ধের পর রাস্তায় রাস্তায় গ্যাসের আলো জ্বলত। পরে মিউনিসিপ্যালিটি সেগুলো তুলে ফেলে লম্বা লম্বা ল্যাম্পপোস্ট বসিয়ে তার গায়ে একটা করে বা ঝুলিয়ে দিয়েছে। বাল্বগুলোর বেশির ভাগই জ্বলে না। রাস্তাগুলো খানাখন্দে বোঝাই। দু’ধারের নর্দমা কত কাল যে সাফাই হয় না। বছরের পর বছর সেগুলোতে থকথকে কালচে রঙের তরল অনড় দাঁড়িয়ে থাকে। এইসব নদৰ্মা হল যাবতীয় রোগের জীবাণু আর মশাদের মেটার্নিটি হোম। রাস্তার মোড়ের শ্বেতপাথরের যে পরীগুলি একদা এই শহরে অলৌকিক স্বপ্ন নামিয়ে আনত, কবেই তারা উধাও হয়ে গেছে। চারিদিকে আবর্জনার পাহাড়। চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগের পরিচ্ছন্ন, ঝকঝকে প্রতাপপুর সিটি এখন নোংরা, ঘিঞ্জি, দুর্গন্ধে-ভরা এক শহর।

রাজতন্ত্র নেই, তবু রাজা আর রানীদের নাম এখানকার অনেক কিছুর সঙ্গে এখনও জড়িয়ে আছে। যেমন, ‘রাজা বিক্রম সিংহ রোড’ বা ‘রানী স্বর্ণময়ী গার্লস কলেজ’ কিংবা ‘মহারাজা বীরেন্দ্র সিংহ হাসপাতাল’ ইত্যাদি। গণতন্ত্র পুরোমাত্রায় চালু হয়ে গেলেও প্রতাপপুর অদূর অতীতের রাজমহিমা একেবারে খারিজ করে দেয়নি, তার কিছু কিছু স্মৃতিচিহ্ন এখনও সযত্নে ধরে রেখেছে।

এই শহরে পা দিলে প্রথমেই যা চোখে পড়বে সেটা রাজবাড়ি, যার নাম ‘প্রতাপপুর প্যালেস’। সিটির দক্ষিণ দিকের শেষ মাথায় পাঁচ একর জমির মাঝখানে গথিক স্থাপত্যের এই বিশাল দোতলা বাড়িটা মধ্যযুগের ফ্রান্স বা ইংল্যান্ডের কোনও রাজপ্রাসাদের কথা মনে করিয়ে দেয়। লর্ড কার্জনের সময়ে তৈরি এই রাজবাড়িকে এখন ভগ্নস্তূপের মতো দেখায়। দেওয়ালে এবং ছাদে কত জায়গায় যে ফাটল ধরেছে, হিসেব নেই। পলেস্তারা খসে খসে দগদগে ঘায়ের মতো ইট বেরিয়ে পড়েছে। ভিতে আর কার্নিসে অশ্বথেরা শিকড় চালিয়ে ধ্বংসের কাজ। অনেকখানি এগিয়ে রেখেছে। সামনের দিকে একধারে ছিল চমৎকার টেনিস লন, আরেক পাশে ফুলের বাগানের মাঝখানে বসার জন্য পাথরের বেঞ্চ। ফুলবাগান আর টেনিস কোর্টের চিহ্নমাত্র নেই। সেখানে এখন শুধু আগাছার জঙ্গল। পেছন দিকে ছিল বাঁধানো দীঘি, সেটা কবেই মজে গেছে। জল শুকিয়ে যে তলানিটুকু পড়ে আছে তা আর দেখা যায় না, গুঁড়িপানা এবং ঢোলকলমির ঠাসবুনট চাদরের তলায় তা ঢাকা।

রাজবাড়ি, বাগান, দীঘি ইত্যাদি ঘিরে যে কম্পাউন্ড ওয়াল, নানা জায়গায় সেটা ভেঙেচুরে গেছে। রাস্তার দিকে মোটা গরাদওলা যে জমকালো লোহার গেটটা ছিল, রোদে জলে মরচে ধরে সেটার আয়ু প্রায় শেষ। গরাদগুলোর বেশ কয়েকটাই উধাও হয়ে গেছে। যেভাবে গেটটা হেলে আছে, যে কোনওদিন হুড়মুড় করে ঘাড় খুঁজে পড়ে যাবে।

আকাশের গায়ে যে ফ্যাকাসে আলোটুকু আটকে ছিল, চোখের পলকে কেউ যেন অদৃশ্য একটা ব্রাশ টেনে সেটা মুছে দিল। এই জায়গাটা এমনই, নভেম্বর মাসে সন্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার আর কুয়াশায় চারিদিক আচ্ছন্ন হয়ে যায়।

ঠিক এই সময় ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এর দোতলা থেকে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসছিল সুবর্ণা আর দেবী। ব্রিটিশ আমলে তৈরি এই সিঁড়ি আধখানা বৃত্তের আকারে একতলার বিশাল হলঘরের ঠিক মাঝখান থেকে দোতলা হয়ে ছাদের দিকে চলে গেছে। এক সময় সিঁড়ি এবং হল-ঘর দামি কাশ্মিরি কার্পেট দিয়ে মোড়া ছিল। সিঁড়ির কার্পেট পায়ের ঘষায় কবেই উঠে গেছে, তার একটি সুতোও এখন খুঁজে পাওয়া যাবে না। হলের কার্পেটটাও ছিঁড়ে খুঁড়ে বেশির ভাগটাই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। শুধু একধারে খানিকটা অংশ কোনওরকমে টিকে আছে। এক সময় ওটার রং ছিল টকটকে লাল, এখন শুকনো রক্তের মতো কালো, তার ওপর ইঞ্চিখানেক পুরু ধুলো।

হলঘরে সাবেক কালের ভারী ভারী আসবাব–সোফা, ডিভান, চেয়ার, পিয়ানো, আলমারি ইত্যাদি। সবই দামি মেহগনি কাঠের, কিন্তু কোনওটাই আস্ত নেই। পালিশও বহুকাল আগে নষ্ট হয়ে গেছে। রং-চটা, বিবর্ণ দেওয়ালগুলোতে রাজবংশের নানা প্রজন্মের কয়েকজনের বিরাট বিরাট অয়েল পেন্টিং। সিলিং থেকে যে প্রকাণ্ড ঝাড়লণ্ঠন ঝুলছে তার অগুনতি কাঁচের দীপাধারের মাত্র কয়েকটাই টিকে আছে। বাকিগুলো অনেক দিন আগে কখন ভেঙে পড়েছে, কেউ লক্ষ রাখেনি। ঝাড়লণ্ঠনটা এখন আর জ্বলে না। আলোর জন্য এধানের ওধারে ক’টা টিউব লাইট লাগানো হয়েছে। সেগুলো এই মুহূর্তে জ্বলছে, তবে বিশাল হলঘরটাকে পুরোপুরি আলোকিত করে তোলার পক্ষে যথেষ্ট নয়। টিউব লাইটগুলো থেকে দূরে হলের কোণে কোণে আবছা অন্ধকার।

এবার সুবর্ণা আর দেবীর দিকে তাকানো যেতে পারে। সুবর্ণার বয়স সাঁইত্রিশ আটত্রিশ। লম্বা, টানটান চেহারা। গায়ের রং এক সময় ছিল রৌদ্রঝলকের মতো, এখন তার ওপর পাতলা, কালচে সরের মতো কিছু পড়েছে। ডিম্বাকৃতি মুখ। চিবুকের গঠনটি দৃঢ়, ঠোঁট ঈষৎ পুরু। বড় বড় চোখের দৃষ্টি শান্ত, কিন্তু দুরভেদী। চমৎকার স্বাস্থ্য তার। সুবর্ণার দিকে এক পলক তাকালেই টের পাওয়া যায়, সে প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী এবং কোনওরকম বেচাল করে এর কাছে পার পাওয়া যাবে না।

সুবর্ণার পরনে হালকা রঙের কোটা শাড়ি আর বাদামি ব্লাউজের ওপর গরম পশমি চাদর জড়ানো, পায়ে পাতলা স্লিপার। বাঁ হাতের কবজিতে সরু ফিতেয় বাঁধা সুদৃশ্য ঘড়ি, ডান হাতে একটি মাত্র মোটা রুলি, গলায় লকেটওলা সোনার চেন।

দেবীর বয়স এগারো। সে সুবর্ণার একমাত্র মেয়ে। মায়ের পুরো আদলটি দেবীর চেহারায় বসানো। তেমনই চোখমুখ, নাক বা চিবুক। তার পরনে স্কার্ট আর ফুলহাতা জামার ওপর উলের পুলওভার। চুল হেয়ার-ব্যান্ড দিয়ে আটকানো, পায়ে মায়ের মতোই ঘরে পরার স্লিপার। তার হাতে বইভর্তি একটা ব্যাগ।

হলঘরের একধারে দশ ফুট উঁচু, ছ ফুট চওড়া নকশা-করা দরজা, যার মাথার দিকটা গোলাকার। দরজার কারুকাজ এখন আর বোঝা যায় না। বছরের পর বছর রোদে পুড়ে, জলে ভিজে এবং ধুলোময়লা জমে সেগুলো নষ্ট হয়ে গেছে।

রোজই এই সময় দরজাটা ভেজানো থাকে। হলের টিউব লাইটগুলো জ্বালিয়ে বাইরে থেকে পাল্লা দু’টো টেনে দিয়ে যায় হরেন। কেননা এই সন্ধেবেলায় দেবীর প্রাইভেট টিউটর পড়াতে আসেন। হলের ঠিক মাঝখানে ঝাড়লণ্ঠনের তলায় খানিকটা জায়গা পরিষ্কার করে চেয়ার-টেবিল পেতে তার পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

আজ কিন্তু দেখা গেল দরজাটা পুরোপুরি ভেজানো নেই, তার একটা পাল্লা খোলা। খুব সম্ভব হাওয়ায় খুলে গেছে। খোলা পাল্লার ফাঁক দিয়ে দূরে শহরের একটা দিক চোখে পড়ে। সেখানে আলো জ্বলছে। কুয়াশা এবং অন্ধকারে আলোগুলো রহস্যময় সংকেতের মতো মনে হয়।

‘প্রতাপপুর প্যালেস’ শহর থেকে খানিকটা দূরে। সামনের দিকের গেটের পর অনেকখানি ফাঁকা জায়গা, তারপর শহরের ঘরবাড়ি শুরু হয়েছে। সাধারণ মানুষজনের কাছ থেকে দূরত্ব বা স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার জন্য রাজবাড়িটা এভাবে তৈরি করা হয়েছিল। রাজা-রাজড়ারা যে রাম-শ্যাম-যদু-মধুদের থেকে আলাদা সেটা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়াটাই ছিল একমাত্র উদ্দেশ্য। আশ্চর্যের ব্যাপার, জনগণতন্ত্র চালু হওয়ার পরও মাঝখানের জায়গাটা ফাঁকাই পড়ে আছে। জবর দখল করে কেউ ওখানে কলোনি টলোনি বসায়নি। সারা দেশ জুড়ে প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে ডেমোক্রেসির হাওয়া বয়ে গেলেও মানুষের মনে রাজা মহারাজাদের সম্পর্কে খানিকটা সম্ভ্রম এখনও থেকে গেছে। হয়তো এটা সহজাত সংস্কার, মানুষের রক্তের মধ্যে আবহমানকাল অদৃশ্য শিকড়ের মতো ছড়িয়ে আছে। সেটা কাটিয়ে উঠতে আরও একশ বছর লেগে যাবে কিনা, কে জানে।

শহর দূরে থাকায় বাইরের শব্দ ট রাজবাড়িতে তেমন একটা ঢোকে না। তবে এই মুহূর্তে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে কোথায় যেন পুলিশ ভ্যানের আওয়াজ, মানুষজনের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর, অনেকের ছোটাছুটির শব্দ অস্পষ্টভাবে সুবর্ণার কানে ভেসে এল। ইদানীং কয়েক বছর প্রতাপপুর সিটি নানা ধরনের ক্রিমিনালদের প্রায় অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে। পুলিশ অ্যান্টি-সোশালদের দু-একটা দলকে মাঝে মধ্যে তাড়া করে কর্তব্য পালন করে এবং এভাবেই চাকরি বজায় রাখে। নেহাত রুটিন ব্যাপার। সুবর্ণা বিন্দুমাত্র কৌতূহল বোধ করল না। মেয়েকে নিয়ে যেমন নামছিল তেমনই নামতে লাগল। সিঁড়ির মাঝামাঝি জায়গায় ল্যান্ডিংয়ের কাছাকাছি যখন ওরা চলে এসেছে সেই সময় হল-ঘরের দরজার দ্বিতীয় পাল্লাটা ঝড়াং করে খুলে কেউ একজন ভেতরে ঢুকে বিদ্যুৎগতিতে ছিটকিনি আটকে খিল তুলে দিল। তারপর দরজার গায়ে ঠেসান দিয়ে জোরে জোরে হাঁফাতে লাগল। মনে হল, বহুদূর থেকে কারও তাড়া খেয়ে ছুটে আসছে সে।

সুবর্ণা আর দেবী থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। রাজবাড়ির প্রায় একশ বছরের ইতিহাসে কেউ কখনও এভাবে ঢুকে পড়েছে কিনা সুবর্ণার জানা নেই। দেবী ভীষণ ভয় পেয়েছিল। মায়ের একটা হাত খুব শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রইল সে।

সুবর্ণাও এমন একটা অভাবনীয় ঘটনায় একেবারে হকচকিয়ে গিয়েছিল। তবে সে খুবই সাহসী। দু-এক পলকেই নিজেকে সামলে নেয়। তারপর মেয়ের হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বুঝিয়ে দেয় ভয়ের কিছু নেই। লোকটার দিকে চোখ রেখে চাপা গলায় বলে, কথা বলিস না, চুপ করে থাক।

দরজার মাথায় টিউব লাইটটা দিন পনের আগে খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বেশ কয়েকবার হরেনকে ওটা পালটানোর কথা বলেছে সুবর্ণা। কিন্তু কথাটা তার এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে গেছে। টিউবটা পালটানো হয়নি। হরেন রাজবাড়ির দারোয়ান এবং বাজার সরকার। তাছাড়া টুকিটাকি নানা কাজ তার করার কথা। কিন্তু সে প্রচণ্ড রকমের ফাঁকিবাজ। এই যে অচেনা লোকটা আচমকা হল-ঘরে ঢুকে পড়েছে, সেটা আদৌ সম্ভব হত না যদি এই সময়টা সে গেটের কাছে থাকত। নিশ্চয়ই কোথাও আড্ডা টাড্ডা দিতে গেছে।

হল-ঘরে অন্য যে টিউবগুলো জ্বলছিল তার আলোয় লোকটাকে মোটামুটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। তার চোখে মুখে খানিকটা মঙ্গোলিয়ান ছাপ। ভাঙা গালে দাড়ির জঙ্গল। চোখের তলায় সিকি ইঞ্চি পুরু কালি। উসকো-খুসকো, রুক্ষ চুলে বহুদিন কাঁচি পড়েনি। পরনে রং-ওঠা ফ্যাকাসে জিনস, যেটার ডান পায়ের নিচের অনেকটা অংশ ছেঁড়া। এছাড়া হাফশার্টের ওপর রোঁয়াওলা মোটা উলের ময়লা সোয়েটার। পায়ে যে ফিতেওলা পুরনো স্পোর্টস শুটা রয়েছে তার রং একসময় ধবধবে সাদাই ছিল, এখন কালচে। সোলও অনেকটাই ক্ষয়ে গেছে। কপাল, গাল, কনুই থেকে হাতের নিচের দিকটা–অর্থাৎ শরীরের যেসব অংশ খোলা, সেগুলোর চামড়া কর্কশ এবং তামাটে। মনে হয় একদিন লোকটার গাত্রবর্ণ হলদেটে ছিল। রোদে পুড়ে। জলে ভিজে, প্রচণ্ড হিমে আর অসহ্য গরমে রংটা জ্বলে গেছে।

লোকটার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। সে যে মারাত্মক রকমের বেপরোয়া এবং নিষ্ঠুর, দেখামাত্র টের পাওয়া যায়। তার এক কাঁধে ক্রিকেটারদের কিট ব্যাগের মতো ক্যানভাসের ঢাউস একটা ব্যাগ। আরেক কাঁধে লম্বাটে একটা বাক্স যেটার নিচের দিক চওড়া, তবে ক্রমশ সরু হয়ে ওপর দিকে উঠে গেছে। তার ডান হাতের চওড়া কবজিতে স্টিল ব্যান্ডে আটকানো একটা চৌকো ঘড়ি।

লোকটা ফাঁকা হল-ঘরের এধারে ওধারে তাকাচ্ছিল। হঠাৎ তার চোখ এসে পড়ে সুবর্ণা আর দেবীর ওপর। মুহূর্তে তার দৃষ্টি স্থির হয়ে যায়।

সুবর্ণাও পলকহীন লোকটাকে লক্ষ করছিল। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর ধীরে ধীরে তিনটে সিঁড়ি পেরিয়ে ল্যান্ডিংটায় এসে দাঁড়ায়। সঙ্গে দেবীও রয়েছে।

সুবর্ণা তীব্র গলায় এবার বলে, কে আপনি? এ বাড়িতে কেন ঢুকেছেন?

লোকটা নিজের ঠোঁটের ওপর ডান হাতের তর্জনী রেখে সুবর্ণাকে নীরব থাকতে ইঙ্গিত করে। তারপর তার চোখে আগের মতোই চোখ রেখে অত্যন্ত সতর্ক ভঙ্গিতে পা ফেলে ফেলে সিঁড়ির তলায় এসে দাঁড়ায়।

লোকটার সাহস দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল সুবর্ণা। তাদের বাড়িতে ঢুকে তাকেই মুখ বুজে থাকতে বলছে। লোকটার সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। কেন যেন মনে হচ্ছে, থাকতে পারে। এ বাড়িতে দুজন অসুস্থ বৃদ্ধ, রান্নাবান্না এবং ছোটখাট ফাইফরমাস খাটার জন্য মাঝবয়সী একটি মেয়েমানুষ যার নাম মায়া আর সে এবং দেবী ছাড়া অন্য কেউ নেই এই মুহূর্তে। হরেনটাও কোথায় বেপাত্তা হয়ে আছে কে জানে। সুবর্ণা যদি চেঁচিয়ে গলার শির ছিঁড়েও ফেলে কেউ সাহায্য করতে আসবে না। কেননা তার চিৎকার শহর পর্যন্ত পৌঁছুবার আদৌ কোনও সম্ভাবনা নেই। লোকটাকে দেখে যা মনে হচ্ছে, নার্ভাস হয়ে হইচই বাধালে কিংবা রাগের মাথায় কিছু করে বসলে সে তাদের ছেড়ে দেবে না। তার চোখে মুখে যে ধরনের চিরস্থায়ী নিষ্ঠুরতা রয়েছে তাতে মারাত্মক কোনও দুর্ঘটনা তার পক্ষে। ঘটিয়ে ফেলা অসম্ভব নয়। কাজেই এখন মাথা ঠান্ডা রাখাটা ভীষণ জরুরি। সুকৌশলে বুঝিয়ে সুঝিয়ে লোকটাকে বাড়ি থেকে বের করতেই হবে।

সে যে বিন্দুমাত্র ভয় পায়নি সেটা বোঝানোর জন্য কঠোর স্বরে সুবর্ণা বলে, কী চান আপনি?

লোকটার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। সে বলে, আপনি কোনও প্রশ্ন করবেন না। আমি যা বলব, চুপচাপ শুনে যাবেন।

এই প্রথম লোকটা কথা বলল। তার কণ্ঠস্বর নিচু কিন্তু কর্কশ, একটু ঘষা ঘষা। নির্ভুল বাংলাতেই সে বলেছে, তবে উচ্চারণটা সঠিক নয়। নর্থ-ইস্ট ইন্ডিয়ার লোকজনদের কেউ বাংলা ভাষাটা রপ্ত করে বললে যেমন শোনায় অনেকটা সেইরকম।

লোকটার বলার ভঙ্গিতে প্রচণ্ড রকমের কর্তৃত্বের সুর রয়েছে; চাপা একটা হুমকিও। সুবর্ণার মতো সাহসী, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মেয়েও ভেতরে ভেতরে থমকে গেল। তার কী করা উচিত, ঠিক করে উঠতে পারছিল না। লোকটা এরপর কী বলে বা করে, সে জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। এই সময় হরেন বা দেবীর টিউটর, কেউ একজন এসে পড়লে তার মনোবল অনেকটা বাড়ত।

লোকটা এবার বলে, এ বাড়িতে কে কে আছে?’

বাইরে যতই স্বাভাবিক থাকতে চেষ্টা করুক, প্রবল উৎকণ্ঠা বোধ করছিল সুবর্ণা। জবাব না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, যে-ই থাক, সেটা জানা কি খুবই প্রয়োজন?

অবশ্যই।

আগে বলুন প্রয়োজনটা কিসের?

লোকটার দুচোখে আগুনের হলকার মতো কিছু খেলে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে সে বলে, ডোন্ট আস্ক মি এনি কোশ্চেন। আমি প্রশ্ন করব, আপনি জবাব দেবেন। একটু থেমে বলে, কারও প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি অভ্যস্ত নই। ইজ ইট ক্লিয়ার?

সুবর্ণা চুপ করে থাকে। লোকটা ফের বলে, আমার প্রশ্নটার উত্তর কিন্তু এখনও পাইনি। বলুন পরক্ষণে কী ভেবে দ্রুত বলে ওঠে, আপনি যদি আমার সঙ্গে সহযোগিতা করেন, আপনাদের এতটুকু ক্ষতি হবে না। নইলে স্পষ্ট একটা ইঙ্গিত দিয়ে সে থেমে যায়।

সুবর্ণা বুঝতে পারে, এখন এই লোকটার হুকুম মতোই তাকে চলতে হবে। ধীরে ধীরে সে জানায়, এ বাড়িতে তার নব্বই বছরের প্রায় অথর্ব দাদাশ্বশুর আছেন। তাঁর স্মৃতিশক্তি একরকম লোপ পেয়ে গেছে। এই মানুষটির কাছে অতীত এবং বর্তমান একাকার। হঠাৎ কখনও পুরনো দিনের কোনও ঘটনা বা মানুষের মুখ তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে কিন্তু তা পলকের জন্য। পরক্ষণে সে সব ছবি মুছে যায়। স্মৃতির অদৃশ্য পেটরা খুলে যে দু-একটা টুকরো বেরিয়ে পড়ে, ফের তারা কোথায় উধাও হয় তিনি বুঝতে পারেন না। সুবর্ণার শ্বশুরও এ বাড়িতেই থাকেন। তাঁর বয়স পঁয়ষট্টি, দু’দুবার স্ট্রোক হয়ে এখন তিনি প্রায় শয্যাশায়ী। কাজের লোক আছে দু’জন–হরেন আর মায়া। এরা ছাড়া সে নিজে এবং দেবী।

আগে সুবর্ণা ততটা লক্ষ করেনি, এবার তার মনে হল নিষ্ঠুরতার পাশাপাশি লোকটার চোখে মুখে চাপা একটা টেনসানও ছিল। সব শোনার পর সেটা যেন অনেকখানি কেটে গেছে। তবু পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে জিজ্ঞেস করে, আপনি ঠিক বলছেন?

লোকটা কী বোঝাতে চায়–সে মিথ্যেবাদী? তার স্পর্ধায় মাথায় আগুন ধরে যায় যেন। কিন্তু এই মুহূর্তে কোনওরকম হঠকারিতাকে প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হবে না। খুব শান্ত গলায় সুবর্ণা বলে, আপনাকে মিথ্যে বলতে যাব কেন?

লোকটা বলে, ধরে নিলাম আপনি ঠিকই বলছেন–

তার কথা শেষ হতে না হতেই বাইরের দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ পাওয়া গেল। সেই সঙ্গে কারও কণ্ঠস্বর, হরেন–হরেন, দরজা বন্ধ কেন? খুলে দাও।

লোকটার চেহারা মুহূর্তে পালটে গেল। কেমন একটা মরিয়া ভাব যেন ফুটে উঠেছে তার মধ্যে। গলা অনেকটা নামিয়ে বলে, লোকটা কে?

সুবর্ণা বলে, দেবীর মাস্টারমশাই। এই সময় পড়াতে আসেন। রোজই দরজা খোলা থাকে। আজ বন্ধ বলে ডাকাডাকি করছেন। লোকটাই যে দরজায় খিল আটকে দিয়েছে সেটা আর বলল না। তবে নিচে নামার জন্য পা বাড়াল।

কিন্তু সুবর্ণার নামা আর হল না। তার আগেই লোকটা গর্জে ওঠে, স্টপ। কোথায় যাচ্ছেন?

সুবর্ণা থেমে যায়। বলে, দরজা খুলে দিতে হবে না? মাস্টারমশাই কতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন?

হিংস্র চিতার মতো ক্ষিপ্র গতিতে সিঁড়ি টপকে টপকে সুবর্ণাদের কাছে চলে আসে লোকটা। উগ্র গলায় বলে, কোনওরকম চালাকি করার চেষ্টা করবেন না।

চালাকি মানে?

দরজা খুলে লোকটাকে ভেতরে এনে আমাকে ঝাটে ফেলতে চাইছেন?

দেবীর টিউটরই যে ডাকাডাকি করছেন, লোকটা তা নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেনি। হয়তো সে ভেবেছে টিউটরের নাম করে সুবর্ণা অন্য কাউকে ঢোকাতে চাইছে। তার ফলে সে বিপন্ন হয়ে পড়বে।

সুবর্ণা কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই লোকটা জিনসের পকেট থেকে বিদ্যুৎ গতিতে একটা পিস্তল বের করে শাসানির ভঙ্গিতে বলে, লুক ম্যাডাম, আমি অ্যাট অল ভায়োলেন্স চাই না। আমি কতদূর যেতে পারি, আপনার ধারণা নেই। লাস্ট টাইম আপনাকে ওয়ার্নিং দিচ্ছি, আমার সঙ্গে ডার্টি ট্রিক খেলতে চেষ্টা করবেন না।

দেবী মায়ের একটা হাত চেপে ধরে আছে। সুবর্ণা চোখের কোণ দিয়ে লক্ষ করল, পিস্তল দেখে মেয়েটার মুখ ভয়ে, আতঙ্কে রক্তশূন্য হয়ে গেছে। কপালে দানা দানা ঘাম জমেছে। তাকে আরেকটু কাছে টেনে নিয়ে লোকটাকে বলে, বিশ্বাস করুন, উনি সত্যিই আমার মেয়ের মাস্টারমশাই। খুবই ভাল মানুষ। নিরীহ এলডারলি পার্সন। ওঁর পক্ষে কারও এতটুকু ক্ষতি করা সম্ভব নয়।

লোকটা কয়েক পলক তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, অল রাইট, মেনে নিচ্ছি, উনি আপনার মেয়ের প্রাইভেট টিউটর। ওঁকে বলে দিন, আজ পড়াতে হবে না।

সুবর্ণা বলে, উনি অত্যন্ত রেসপেক্টেড টিচার। ওঁকে এভাবে চলে যেতে বলা যায় না।

কী একটু ভাবে লোকটা। তারপর বলে, ঠিক আছে, আপনি গিয়ে বলে আসুন। দরজা খুলবেন, কিন্তু আপনাদের টিউটরকে ভেতরে ঢুকতে দেবেন না।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও সুবর্ণাকে বলতে হয়, আচ্ছা দেবীকে নিয়ে সে পরের সিঁড়িটায় পা রাখতে যাবে, সঙ্গে সঙ্গে বাধা পড়ল। লোকটা দেবীকে প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে বলে, নো নো, আপনি একাই যান। আপনার মেয়ে আমার কাছে থাকবে।

লোকটার এক হাতে পিস্তল, আরেক হাতে দেবীর ডান হাতটা শক্ত করে ধরা। সুবর্ণা লক্ষ করল, দেবীর সমস্ত শরীর ভীষণ কাঁপছে। এবার সে সত্যিই ভয় পেয়ে যায়। বিমূঢ়ের মতো বলে, কিন্তু

তার মনোভাব বুঝতে পারছিল লোকটা। বলল, আপনি যদি গোলমাল না করেন, কোনও সমস্যাই নেই। আপনার মেয়ে আমার কাছে নিরাপদে থাকবে। তবে ওর সেফটি টোটালি ডিপেন্ড করছে আপনার অ্যাক্টিভিটির ওপর। যান–

ল্যান্ডিংয়ের পাশেই একটা গোল পিলার। দেবীকে নিয়ে সেটার আড়ালে চলে যায় লোকটা। তার উদ্দেশ্য বুঝতে পারছিল সুবর্ণা। ওখান থেকে বাইরের দরজার দিকে নজর রাখা যায়। কিন্তু দরজার বাইরে থেকে তাকে খুব সহজে দেখা যাবে না।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সুবর্ণার পা খুব কাঁপছিল। হঠাৎ কী মনে পড়তে লোকটা ডাকে, শুনুন–

সুবর্ণা ঘুরে দাঁড়ায়। লোকটা বলে, আপনাদের টিউটরের সঙ্গে ফিস ফিস করে কথা বলবেন না। এমনভাবে বলবেন যাতে এখান থেকে আমি শুনতে পাই। আমার সম্বন্ধে ওঁকে কিছু জানাবেন না, এমনকি ইঙ্গিতেও না। এক মিনিটের ভেতর ভদ্রলোককে বিদায় করে ফিরে আসবেন। যান–

সুবর্ণা কিছু না বলে তাকিয়ে থাকে।

লোকটা বলে, মাস্টারমশাইকে বলবেন, আপাতত এক উইক তার আসার দরকার নেই।

সুবর্ণা বিঢ়ের মতো বলে, এ আপনি কী বলছেন! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

আমি সিম্পল বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজে কথা বলছি। না বোঝার কোনও কারণ নেই ম্যাডাম। কিন্তু–

কী?

মাস্টারমশাইকে এক উইক আসতে বারণ করব কেন?

লোকটা বলে, কারণ একটা উইক আমাকে এখানে থাকতে হতে পারে। আমি চাই না এই সাতদিন বাইরের কেউ এসে আমাকে দেখতে পাক।

সুবর্ণা চমকে ওঠে, আপনি সাতদিন এ বাড়িতে থাকবেন।

দরকার হলে সাতদিন কেন, দু-এক মাসও থেকে যেতে পারি।

এই সময় কড়া নাড়ার আওয়াজ জোরাল হয়ে ওঠে। বোঝা যায় দেবীর টিউটর ক্রমশ অধৈর্য হয়ে উঠছেন। সুবর্ণা কী উত্তর দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই লোকটা বলে, আর দাঁড়িয়ে থাকবেন না।

হল-ঘরে নেমে দরজার দিকে যেতে যেতে একবার পেছন ফিরে তাকায় সুবর্ণা। একটু আগে লোকটার বাঁ-হাতে পিস্তলটা ঝুলছিল। এখন সেটা উঠে এসে দেবীর কপালের ডান পাশের রগের ওপর ঠেকে আছে। দৃশ্যটা এমনই ভয়ঙ্কর যে দেখতে দেখতে সুবর্ণার মনে হয়, শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে বরফের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। কোনওরকমে মুখটা ফিরিয়ে উতে টলতে সে দরজার দিকে এগিয়ে যায়।

.

০২.

লোকটার কথামতো দেবীর মাস্টারমশাইকে বিদায় করে দরজায় খিল তুলে ফের সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ের কাছে চলে আসে সুবর্ণা! ম ট,শাই মানুষটি অত্যন্ত প্রবীণ এবং অভিজ্ঞ শিক্ষক। প্রতাপপুর সিটির সবাই তাকে ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে। দুই জেনারেশন ধরে এই শহরের অসংখ্য ছেলেমেয়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তিনি নিজের হাতে তৈরি করে দিয়েছেন। তাদের কেউ এখন সধ্যা, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ আই.এ.এস বা আই.পি.এস, কেউ বিদেশে ভারতীয় রাষ্ট্র। কেউ আছে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কে, কেউ বা ইউনাইটেড নেশনসে। সারা পৃথিবী জুড়ে তার ছাত্রছাত্রীরা ছড়িয়ে রয়েছে। এমন একজন শ্রদ্ধেয় মানুষের সঙ্গে সুবর্ণা যে ব্যবহার আজ করেছে তা খুবই অসম্মানজনক। সে তাঁকে দরজার এধারে পা রাখতে দেয়নি, ওপার থেকেই সামান্য দু-একটা কথা বলে চলে যেতে বলেছে। ব্যাপারটা এমনই গ্লানিকর যে ভেতরে ভেতরে লজ্জায় অনুশোচনায় তার মরে যেতে ইচ্ছা করছিল। দেবীকে পড়াতে এসে তাকে এভাবে ফিরে যেতে হবে, এমন ঘটনা আগে আর কখনও ঘটেনি। শান্ত, সংযত, অন্তর্মুখী মানুষটি একটু অবাক হয়েছিলেন ঠিকই, তবে কোনও প্রশ্ন করেননি, নিঃশব্দে চলে গেছেন। কী কারণে, কোন পরিস্থিতিতে এমন একটা জঘন্য আচরণ সুবর্ণাকে করতে হয়েছে সেটা আজ জানানো সম্ভব হয়নি। সে ঠিক করে ফেলেছে, পরে সব জানিয়ে তার কাছে ক্ষ: চেয়ে নেবে। যতক্ষণ না ক্ষমাটা চাওয়া হচ্ছে, মানসিক অস্থিরতা, অস্বস্তি আর অপরাধবোধ কিছুতেই কাটবে না তার।

সুবর্ণার দিকে আগাগোড়া নজর রেখেছিল লোকটা! নির্বিঘ্নে এবং অক্ষরে অক্ষরে তার হুকুম পালিত হয়েছে দেখে সে মোটামুটি খুশি। দেবীর কপালের পাশ থেকে এবার পিস্তলের নলটা সরিয়ে আস্তে আস্তে পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে বলে, থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম।

সাহস বলতে কিছুই প্রায় অবশিষ্ট ছিল না সুবর্ণার মধ্যে। যে তলানিটুকু পড়ে আছে প্রাণপণে তা জড়ো করে সে বলে, সাতদিন মাস্টারমশাই আসবেন না। মাস দেড়েক বাদে দেবীর অ্যানুয়াল একজামিনেশন। ওর পড়াশোনার ভীষণ ক্ষতি হয়ে যাবে।

লোকটা উত্তর দিল না।

সুবর্ণা আবার বলে, আপনি তখন বললেন, এক উইক থাকবেন। দরকার হলে দু-একমাসও থেকে যেতে পারেন।

লোকটা আস্তে মাথা নাড়ে, হ্যাঁ।

উদ্বিগ্ন মুখে সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, যতদিন আপনি থাকছেন, মাস্টারমশাই কি আসতে পারবেন না?

লোকটা কয়েক পলক কী চিন্তা করে বলে, সেটা পরে ভেবে বলব।

সুবর্ণা চুপ করে থাকে।

লোকটা বলে, এভাবে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন? আপনার মেয়ের কষ্ট হচ্ছে। চলুন কোথাও বসা যাক। এমনভাবে কথাগুলো সে বলল যেন এ বাড়িটা তার খাস তালুক, সুবর্ণা মেয়েকে নিয়ে এখানে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।

এই মারাত্মক, সশস্ত্র লোকটাকে দোতলায় নিয়ে যাওয়া যায় না। এদিক সেদিক তাকিয়ে হল-ঘরের দিকে আঙুল বাড়িয়ে সুবর্ণা বলে, আসুন, ওখানে যাই।

দেবীর পড়াশোনার জন্য যে চেয়ার টেবিল পাতা রয়েছে সেখানে গিয়ে লোকটাকে বসায় সুবর্ণা। দেবী আর সে তার মুখোমুখি বসে।

লোকটা বলে, আপনার নামটা জানতে পারলে কথাবার্তা বলতে সুবিধা হত।

সুবর্ণা তার নাম জানিয়ে দিয়ে বলে, আপনার পরিচয়ও কিন্তু এখন পর্যন্ত জানান নি।

চোখ কুঁচকে কী ভেবে নেয় লোকটা। তারপর বলে, আমার নাম রাজীব।

লোকটা যে সঠিক নাম জানায়নি সেটা তার মুখের চেহারা এবং বলার ভঙ্গিতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। এই গোপনতার কারণ কী? তার হাতে পিস্তল টিস্তল দেখে সুবর্ণার স্নায়ুমণ্ডলীতে এমন চাপ পড়েছে যে মাথার ভেতর সব কিছু গুলিয়ে গিয়েছিল। বিদ্যুৎচমকের মতো হঠাৎ তার মনে পড়ে, এই লোকটা হল-ঘরে ঢোকার আগে সে রাস্তায় অস্পষ্টভাবে হইচই এবং পুলিশ ভ্যানের আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল। লোকটা কি পলাতক কোনও আসামী? যার চেহারা এমন উগ্র, ভয়ানক মারণাস্ত্র নিয়ে যে জোর করে অন্যের বাড়িতে ঢুকে পড়ে তার পক্ষে দু-চারটে খুন টুন করে আসা অসম্ভব নয়। একটা নৃশংস হত্যাকারী তাদের ঘাড়ের ওপর কতদিন চেপে বসে থাকবে কে জানে। কীভাবে, কোন পদ্ধতিতে তাকে এ বাড়ি থেকে তাড়ানো যায় তা-ই বা কে বলে দেবে! ক্ষীণ গলায় সুবর্ণা শুধু বলে, রাজীব কী?’ সারনেম বা পদবিটা জানতে পারলে নর্থ-ইস্ট ইন্ডিয়ার কোন অঞ্চলের মানুষ সেটা বোঝা যেত।

লোকটা কিন্তু সেদিক দিয়েই গেল না। বলল, ডাকাডাকি, কথা বলা–এ সব কাজ চালিয়ে নেবার জন্যে রাজীব নামটাই যথেষ্ট। সারনেমের কী প্রয়োজন?

আর কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস হয় না সুবর্ণার।

লোকটা অর্থাৎ রাজীব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে হল-ঘরের চারপাশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে একবার দেখে নেয়। যেদিকটায় দরজা, সেটা ছাড়া অন্য তিন ধারে হল-ঘরটা ঘিরে সবসুদ্ধ পাঁচটা বেডরুম, যার চারটেতেই ঢাউস ঢাউস তালা লাগানো। তালাগুলোতে মরচে ধরে গেছে। বহুকাল যে ওগুলো ব্যবহার করা হয় না, সেটা বলে না দিলেও চলে। তবে ডান পাশের শেষ ঘরটায় তালা নেই; বাইরে থেকে পাল্লা দু’টো টেনে বন্ধ করা। দরজাটা মোটামুটি পরিষ্কার। বোঝা যায়, ওই ঘরটায় কেউ থাকে।

রাজীব বলে, আমার কয়েকটা ইনফরমেশন দরকার মিসেস সিংহ।

সুবর্ণা বলে, কী জানতে চান বলুন।

রাজীব জিজ্ঞেস করে, আপনি হরেন নামে একটা লোকের কথা বলেছিলেন। সে আপনাদের গেটকিপার ছাড়া আরও কী কী যেন করে। লোকটা কি এ বাড়িতে থাকে?

হ্যাঁ। যে ঘরটায় তালা নেই সেদিকে আঙুল বাড়িয়ে সুবর্ণা বলে, ওখানে—

আমি যে ক’দিন থাকব, হরেনকে ছুটি দিন।

সুবর্ণা হকচকিয়ে যায়। বলে, তা কী করে সম্ভব?

রাজীব রুক্ষ গলায় বলে, মিসেস সিংহ আপনাকে আগেই ওয়ার্নিং দিয়েছিলাম, আমি যা বলব চুপচাপ তাই করবেন। কোনওরকম প্রোটেস্ট বা বিরুদ্ধতা করবেন না। আমাকে যেন আর তা মনে করিয়ে দিতে না হয়। একটু থেমে কী ভেবে জিজ্ঞেস করে, হরেনকে ছুটি দেওয়া সম্ভব নয় কেন?

সুবর্ণা অনুনয়ের সুরে বলে, প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড আওয়ার ফ্যামিলি প্রবলেম। আমার শ্বশুর হার্ট অ্যাটাকের পেশেন্ট; দাদাশ্বশুরের মেমোরি নষ্ট হয়ে গেছে। এসব আপনাকে জানিয়েছি। ডাক্তার ডাকা, ওষুধ কেনা, বাজার করা, গেট পাহারা দেওয়া থেকে অনেক কিছুই হরেন করে থাকে। ওকে ছাড়া আমাদের ফ্যামিলি একেবারে অচল। এই অবস্থায়–’বলতে বলতে চুপ করে যায় সে।

সুবর্ণাদের পারিবারিক সমস্যাগুলো হয়তো রাজীবকে সামান্য নাড়া দেয়। সে বলে, হরেন থাকতে পারে একটা কন্ডিশনে–

কী কন্ডিশন?

আমার কথা তাকে বলা চলবে না। আর—

আর কী?

তার সঙ্গে আমার কোনওভাবেই দেখা হওয়া চলবে না।

সুবর্ণা বলে ইমপসিবল!’

রাজীবের চোখের দৃষ্টি তীব্র হয়ে ওঠে। সে বলে, ইমপসিবল কেন?’

সুবর্ণা বুঝিয়ে দেয়, রাজীব এ বাড়িতে থাকলে একতলার এই হল-ঘরের তিন দিকে যে তালাবন্ধ ঘরগুলো রয়েছে তার একটা খুলে সাফ টাফ করে বাসযোগ্য করে দেওয়া হবে। আর এই একতলাতেই হরেন থাকে। তার সঙ্গে উঠতে বসতে চলতে ফিরতে রাজীবের দেখা হওয়াটাই তো স্বাভাবিক।

রাজীব মুখ নামিয়ে কিছুক্ষণ কী চিন্তা করে। তারপর বলে, আমি কোথায় থাকব, পরে ঠিক করব।

লোকটা হাবেভাবে কথায়বার্তায় প্রতি মুহূর্তে বুঝিয়ে দিচ্ছে সে-ই যেন এই ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এর মালিক। এ বাড়ির কোথায় কোন অংশে রাজীব থাকবে সেটা তার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। সুবর্ণার মতামতের তোয়াক্কা করাটা সে প্রয়োজন বোধ করে না।

সুবর্ণা কী উত্তর দেবে, ভেবে পায় না। বিমূঢ়ের মতো শুধু তাকিয়ে থাকে।

রাজীব জিজ্ঞেস করে, হরেন ছাড়া এ বাড়ির আর কাকে কাকে বাইরে বেরুতে হয়?

সুবর্ণা বলে, আমাকে আর দেবীকে।

কী ভেবে রাজীব বলে, দেবীর স্কুল থাকে। তাকে তো বেরুতেই হবে। দেবীর দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে বলে, ইউ আর আ গুড গার্ল। আমি তোমার আঙ্কল। ক’দিন তোমাদের কাছে থাকব। আমি যে এখানে আছি সেটা বাইরের কাউকে, এমনকি তোমার বেস্ট ফ্রেন্ডকেও জানাবে না। কথাটা মনে থাকবে?

দেবী দারুণ বুদ্ধিমতী। হাসিমুখে খুব নরম গলায় বললেও যার সঙ্গে পিস্তলের মতো একটা মারণাস্ত্র রয়েছে তার কথা সারাক্ষণ, অন্তত যে কদিন রাজীব ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ আছে সেটা যে মাথায় রাখতে হবে তা সে ভাল করেই জানে। নিঃশব্দে মাথা হেলিয়ে দেয় দেবী।

আদরের ভঙ্গিতে তার গালে আঙুল ছুঁইয়ে রাজীব বলে, ফাইন। পরক্ষণে তার চোখ সুবর্ণার দিকে ফিরে আসে। বলে, আপনার সম্বন্ধে কিছুই আমার জানা নেই। আপনাকে বেরুতে হয় কেন?

কোনও মানুষ সারাদিন একটা বাড়িতে বন্দি হয়ে থাকতে পারে?

ধরুন, ভীষণ অসুস্থ হয়ে আপনি স্যানাটোরিয়ামে এসেছেন। আপনার ঘরের বাইরে যাওয়া বারণ।

সেটা কি আপনার সুবিধার জন্যে?’ নিজের অজান্তে সুবর্ণার মুখ ফসকে কথাগুলো বেরিয়ে আসে।

রাজীব কিন্তু রেগে যায় না। শান্ত গলায় বলে, এজাক্টলি।

কিন্তু–

বলুন—

আমি একটা কলেজে পড়াই। বাড়ি থেকে না বেরুলে ক্লাস নেব কী করে?

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে রাজীব। ভুরুদু’টো ক্রমশ কুঁচকে যেতে থাকে। এক সময় বলে, ইটস আ প্রবলেম। কয়েকটা দিন আপনি ছুটি নিন।

সুবর্ণা বলে, কী করে নেব? আমার ডিপার্টমেন্টে সবসুদ্ধ তিনজন টিচার। একজন ছুটিতে আছেন। আরেকজনের অপারেশন হবে। তিনি কলকাতায় গিয়ে নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছেন। আমাকে একা ডিপার্টমেন্ট চালাতে হচ্ছে।

রাজীব উত্তর না দিয়ে পলকহীন তাকিয়ে থাকে। হয়তো বুঝতে চেষ্টা করে সুবর্ণা তাকে ধোঁকা দিতে চাইছে কিনা।

সুবর্ণা ফের বলে, আমি কলেজে না গিয়ে যদি বাড়ি বসে থাকি, প্রিন্সিপ্যাল লোক পাঠাবেন। যদি বলি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছি, সারা কলেজ আমাকে দেখার জন্যে ছুটে আসবে।

রাজীবের মুখচোখের চেহারা মুহূর্তে পালটে যায়। যে হিংস্র, উগ্র ভাবটা অল্পক্ষণের জন্য সে লুকিয়ে রেখেছিল সেটা চামড়ার তলা থেকে ফের বেরিয়ে আসে। দাঁতে দাঁত ঘষে বলে, আমার সঙ্গে চালাকি করতে চেষ্টা করবেন না মিসেস সিংহ।

সুবর্ণা বুঝতে পারে, তার কথার একটি বর্ণও বিশ্বাস করেনি রাজীব। হয়তো ভেবে নিয়েছে, বাইরে গিয়ে তোকজন জুটিয়ে, থানায় খবর দিয়ে সে তাকে ফাঁদে ফেলবে। সুবর্ণা ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। সামনের দিকে ঝুঁকে শ্বাস-টানা গলায় বলে, আপনাকে আগেও বলেছি আমি মিথ্যে বলি না। ইচ্ছে হলে আমাদের। প্রিন্সিপালের সঙ্গে কথা বলে জেনে নিতে পারেন, আমার একজন কলিগ। কলকাতায় গিয়ে নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছেন কিনা; আরেক জন

হাত তুলে তাকে থামিয়ে দেয় রাজীব। ধীরে ধীরে তার মুখের হিংস্রতা মুছে যেতে থাকে। হয়তো সুবর্ণার কথা বিশ্বাস করেছে। বলে, আপনাদের বাড়িতে টেলিফোন আছে?

আছে।

সেটা কোথায় থাকে?

আমার বেডরুমে।

রাজীব কী বলতে যাচ্ছিল, সেই সময় বাইরের দরজায় জোরে জোরে কড়া নাড়ার আওয়াজ শোনা যায়। সেই সঙ্গে কেউ গলা উঁচুতে তুলে ডাকছে, দেবী দিদি–দেবী দিদি-মায়া–এ সময় দরজা বন্ধ করল কে?

রাজীব চমকে উঠেছিল। সে বুঝতে পারছে, এই সন্ধেবেলাটা বাইরের দরজা খোলা থাকে। সতর্ক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে, কে ডাকছে?

সুবর্ণা বলে, হরেন। কী বলব ওকে?

দ্রুত কিছু ভেবে নিয়েছিল রাজীব। বলে, ওকে দু’ঘন্টা পর আসতে বলুন।

সুবর্ণা আপত্তি করে না। করেও লাভ নেই। চেয়ারে বসেই যান্ত্রিক নিয়মে রাজীবের শোনানো কথাগুলো আওড়ে যায়।

হরেন দরজার বাইরে থেকে একটু অবাক হয়েই যেন বলে, দু’ঘণ্টা পরে কেন বৌদিদি? বাড়িতে ঢের কাজ পড়ে রয়েছে যে–

সুবর্ণা বলে, তোমাকে যা বলছি তাই করো।

ঠিক আছে বৌদিদি।

এরপর আর হরেনের সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। খুব সম্ভব দু’ঘণ্টার জন্য সে শহরের দিকে চলে গেছে।

অনেকক্ষণ চুপচাপ।

তারপর রাজীব বলে, আপনাকে যখন কলেজে যেতেই হবে তখন আর জোর করে আটকাব না। কিন্তু দেবীকে যা বলেছি সেটা আপনাকেও সবসময় মনে রাখতে হবে। আমার কথা কাউকে বলা চলবে না।

সুবর্ণা উত্তর দেয় না। ভাবতে চেষ্টা করে, এই হুঁশিয়ারিটা রাজীব আগেও দিয়েছিল কিনা।

রাজীব বলে, আপনাদের একজন কাজের মেয়ের কথা বলেছিলেন না–

হ্যাঁ, মায়া।

সে কি বাড়ির বাইরে বেরোয়?

প্রশ্নটার পেছনে যে উদ্দেশ্যটা রয়েছে সেটা খুবই পরিষ্কার। মায়া বাইরে বেরুলে রাজীবের এ বাড়িতে লুকিয়ে থাকার খবর চারিদিকে চাউর হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। তাই সব দিক থেকে সে সতর্ক থাকতে চায়। সুবর্ণা বলে, না। ওর বেরুবার দরকার হয় না। তবে–

রাজীব বলে, তবে কী?

মায়ার এক ভাইপো এই শহরেই থাকে। দু উইক পরপর সে তাকে দেখতে যায়। সকালে যায়, সন্ধের আগে আগে ফিরে আসে।

এ বাড়িতে ভিজিটর টিজিটর কেমন আসে? খুব বেশি কি?

বেশি না হলেও কিছু তো আসেই। ছুটির দিনে দেবীর বন্ধুরা কেউ না কেউ এসে সারাদিন কাটিয়ে যায়। আমার কলিগরাও আসে। আর

সুবর্ণার কথা শেষ হতে না হতে রাজীব বলে ওঠে, আর কে?

সুবর্ণা বলে, আমি একটা উইমেন্স ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশনের সঙ্গে যুক্ত। ওর মেম্বাররা অনেকেই মাঝে মাঝে নানা ব্যাপারে আসে।

এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্ন করে না রাজীব। শুধু বলে, এবার চলুন, আপনাদের পুরো বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখাবেন।

কেন রাজীব বাড়ি দেখতে চাইছে, বুঝতে না পেরে দ্বিধান্বিতভাবে তাকিয়ে থাকে সুবর্ণা। তবে কিছু জিজ্ঞেস করে না।

তার মনোভাব আন্দাজ করে নেয় রাজীব। বলে, এ বাড়ির ঠিক কোন জায়গাটা আমার পক্ষে সবচেয়ে সেফ সেটা দেখে নিতে হবে না? এ কী, আর বসে থাকবেন না। উঠুন–

দেবীকে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় সুবর্ণা। ভেতরে ভেতরে অস্বস্তি আর দুশ্চিন্তা চলছিলই। সেটা কয়েক গুণ বেড়ে যায়।

চেয়ারে বসার আগে কাঁধ থেকে ঢাউস ব্যাগ আর লম্বাটে বাক্সটা মেঝেতে নামিয়ে রেখেছিল রাজীব। সে দু’টো ফের তুলে নিয়ে উঠে পড়ে সে।

.

০৩.

একতলার হল-ঘর এবং সেটাকে ঘিরে যে বেডরুমগুলো রয়েছে, আগেই দেখা হয়ে গিয়েছিল। ডানধারের শেষ ঘরটার পাশ দিয়ে একটা চওড়া প্যাসেজ সোজা যেখানে গিয়ে ঠেকেছে সেটা একটা দরজা। সেখানে অল্প পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছিল। বাটার ওপর ধুলোময়লা জমেছে। ফলে যে ম্যাড়মেড়ে আলোটুকু পাওয়া যাচ্ছে তাতে কোনও কিছুই স্পষ্ট নয়, সব কেমন যেন ঝাপসামতো।

দরজাটা দেখে চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছিল রাজীবের। জিজ্ঞেস করে, আপনাদের বাড়িতে ঢোকার জন্যে তা হলে দু’টো দরজা?’

সুবর্ণা আর দেবী রাজীবের পাশাপাশি আসছিল। সুবর্ণা মাথাটা সামান্য হেলিয়ে বলে, হ্যাঁ।

আগে তো বলেননি।

আপনি কি জিজ্ঞেস করেছিলেন?

অল্প একটু থতিয়ে যায় রাজীব। তার একটু ভুল বা বোকামিই হয়ে গেছে। গোগাড়া থেকে সে শাসিয়ে আসছিল, তার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ছাড়া বাড়তি কথা যেন না বলে সুবর্ণা। এ বাড়িতে যে দু’দিক দিয়ে ঢোকা যায়, আগে সেটা তার মাথায় আসেনি। সুবর্ণার কথার জবাব না দিয়ে সে জানতে চায়, দরজার ওধারে কী আছে?

সুবর্ণা বলে, ওপাশটা বাড়ির পেছন দিক। দেখবেন?

হ্যাঁ। রাজীব দরজাটার কাছে এগিয়ে গিয়ে নিজের হাতে খিল খুলে ফেলে। চৌকাঠের ওধার থেকে শ্বেতপাথরের নিচু সিঁড়ি নেমে গেছে। স্টেপগুলোর একটা পাথরও অক্ষত নেই–সব ফাটা, ভাঙা। সিঁড়ির তলা থেকে কঁকা জমি। কুয়াশা আর অন্ধকারে কিছুই প্রায় চোখে পড়ে না। তবু বোঝা যায়। বাউন্ডারি ওয়ালের গা ঘেঁষে টালির শেড-দেওয়া টানা অনেকগুলো ঘর গা ঘেঁষাঘেঁষি করে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

রাজীব জিজ্ঞেস করে, এদিকে আলো টালো আছে?

সুবর্ণা বুঝতে পারছিল, এ বাড়ি তার পক্ষে কতটা নিরাপদ সেটা যাচাই করে নিতে চাইছে রাজীব। সে বলে, একটা ছিল। ক’দিন আগে খারাপ হয়ে গেছে। পালটানো হয়নি।

ওই ঘরগুলোতে কারা থাকে?

কেউ না। এক সময় অবশ্য ড্রাইভার, বেয়ারা, চাকর বাকর মিলিয়ে ষোল সতেরজন কাজের লোক থাকত। পাশেই বিরাট গ্যারেজ। সেখানে থাকত পাঁচ ছ’টা দামি গাড়ি। এখন দু’টো ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে আছে, কোনও কাজে লাগে। না। আনইউজেবল। একটা অবশ্য চলে; তবে সেটার হালও ভাল নয়–

দরজাটা বন্ধ করতে করতে হঠাৎ এই বিশাল বাড়ি, তার পরিবেশ এবং সুবর্ণার একটু আগের কথাগুলো রাজীবকে কিছু একটা মনে করিয়ে দেয়। খিল লাগিয়ে; ঘুরে দাঁড়িয়ে সামান্য হালকা গলায় সে বলে, আমি কি কোনও পুরনো রাজা-মহারাজার বাড়িতে ঢুকে পড়েছি?

সুবর্ণা বলে, ঠিক তাই।

বেশ অবাক হয়ে সুবর্ণার পা থেকে মাথা পর্যন্ত এক পলক দ্রুত দেখে নেয় রাজীব। সে কিছু বলার আগে সুবর্ণা ফের বলে, এটা রাজবাড়িই। প্যালেস। যদিও ইন্ডিপেনডেন্সের পর রাজতন্ত্রের আর অস্তিত্ব নেই।

রাজীব বলে, জানা রইল। গ্রাউন্ড ফ্লোর দেখা হয়ে গেছে। এবার দোতলায় যাওয়া যাক।

পা বাড়াতে গিয়ে থমকে যায় সুবর্ণা। ভয়ে ভয়ে বলে, দোতলায় আমরা থাকি। সেখানে আপনাকে একটা ইঙ্গিত দিয়ে চুপ করে যায় সে।

এক দৃষ্টে তাকে লক্ষ করছিল রাজীব। বলল, প্রাইভেসির কথা বলছেন?

সুবর্ণা জবাব দেয় না।

রাজীব বলে, আমার সঙ্গে কিছু ডেডলি ওয়েপন আছে। তার একটা আপনি দেখেছেন। আপনাকে জানিয়ে রাখি এসব ঘাঁটতে ঘাঁটতে আমার অনেকগুলো হিউম্যান ফিলিংস নষ্ট হয়ে গেছে। বিউটিফুল ইয়ং উইমেন দেখলে পুরুষের যে গ্ল্যান্ডগুলো এক্সাইটেড হয়ে ওঠে, আমার সেই গ্ল্যান্ড মরে, শুকিয়ে গেছে। একেবারে স্টোনডেড। আমার আর ঠান্ডা পাথরের মধ্যে কোনো ডিফারেন্স নেই।

সুবর্ণা বলে, আমি সে কথা বলছি না।

তবে?

সুবর্ণা স্পষ্টাস্পষ্টি না বললেও বুঝিয়ে দেয় দোতলায় দেবী, সে এবং মায়া ছাড়া স্মৃতিভ্রষ্ট দাদাশ্বশুর এবং শয্যাশায়ী শ্বশুরমশাই রয়েছেন। রাজতন্ত্র কবেই শেষ হয়ে গেছে কিন্তু তাদের শিরায় শিরায় রাজরক্ত এখনও বয়ে চলেছে। অনেক কিছুই তারা হারিয়েছেন কিন্তু পুরনো দিনের রাজকীয় রুচি, মেজাজ এবং দাম্ভিকতার রেশ তাঁদের অস্তিত্বের মধ্যে তলানির মতো থেকে গেছে। নিজেদের পারিবারিক কোড অফ কনডাক্ট প্রতাপপুর রাজবংশ বহু কাল আগে তৈরি করে নিয়েছিল। তার অনেকগুলো আজও টিকে আছে। বাড়ির অন্তঃপুর সম্পর্কে এঁরা ভীষণ রক্ষণশীল এবং স্পর্শকাতর। সেখানে অচেনা, উটকো কোনও লোককে নিয়ে গেলে প্রচণ্ড সমস্যার সৃষ্টি হবে। দাদাশ্বশুরের বোধবুদ্ধি কিছুই প্রায় অবশিষ্ট নেই কিন্তু শ্বশুরমশাইয়ের স্মৃতিশক্তি খুবই প্রখর। পূর্বপুরুষের তৈরি যাবতীয় পারিবারিক রীতি-নীতি ধ্যান-ধারণা তিনি যখের মতো আগলে আছেন। রাজীবকে দোতলায় দেখলে খুবই অসন্তুষ্ট হবেন।

রাজীব ঠান্ডা গলায় বলে, আপনার শ্বশুরমশাইয়ের ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দিন।

ভয়ে ভয়ে সুবর্ণা বলে, দেখুন, উনি প্রায় বেড-রিডন–’

এই ইনফরমেশনটা আমার কাছে নতুন নয়। আগেও দু-একবার বলেছেন, তাঁর বার কয়েক হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে–এই তো?

সুবর্ণা চুপ করে থাকে।

রাজীব বলে, এই টাইপের পেশেন্টদের সঙ্গে কী ধরনের ব্যবহার করতে হয় আমার জানা আছে। আপনার প্রবলেম যাতে না হয় সেটা মাথায় রাখতে চেষ্টা করব। একটু থেমে বলে, তবে একটা পয়েন্ট ক্লিয়ার করে দিই। আমার ধৈর্য কিন্তু খুব কম।

সুবর্ণা প্রায় একটি ঘণ্টা এই মারাত্মক লোকটার সঙ্গে কাটিয়ে দিয়েছে। এ তো বন্ধুদের সঙ্গে হালকা মেজাজে আড্ডা দেওয়ার মতো আনন্দের ব্যাপার নয়। প্রতিটি মুহূর্তে তাকে মনে রাখতে হয়েছে, কোনওরকম হঠকারিতা করা চলবে না। দাবার চতুর চাল দেবার ভঙ্গিতে রাজীবের সঙ্গে অঘোষিত একটা যুদ্ধ চালিয়ে গেছে সে। ক্রমাগত উপস্থিত বুদ্ধি আর সাহসের পরীক্ষা দিতে হয়েছে। মাঝে মাঝে ভয় যে পায়নি তা নয়। অসীম মনোবলে লোকটার মুখোমুখি নিজেকে এতক্ষণ দাঁড় করিয়ে। রেখেছে। কিন্তু টান টান স্নায়ুগুলো এবার কেমন যেন আলগা হয়ে আসছে। রাজীব বলেছে তার ধৈর্য কম। ওদিকে শ্বশুরমশাই অসম্ভব বদরাগী, তার পছন্দমতো কিছু না হলে তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে ছাড়েন। এর পরিণতি কী ঘটতে পারে সেটা আন্দাজ করতে অসুবিধা হয় না সুবর্ণার, আর সেই কারণে মনে হয় সে যেন আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না, হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। কিন্তু না, যুদ্ধের তো সবে শুরু। প্রথম রাউন্ডটা এখনও শেষ হয়নি। এরপর কতদিন ধরে লড়াইটা চলতে থাকবে, কে জানে। যতদিনই চলুক, তার ভেঙে পড়লে চলবে না। নিজের ভেতরকার শক্তিকে অটুট রেখে অনবরত রণকৌশল ঠিক করে যেতে হবে।

রাজীব এবার বলে, চলুন, দোতলায় গিয়ে আপনার শ্বশুরমশাইদের দেখা যাক।

ঝাপসা গলায় সুবর্ণা বলে, আসুন–

হল-ঘরে ফিরে এসে কাঠের সেই অর্ধবৃত্তাকার সিঁড়ি দিয়ে নিঃশব্দে আগে আগে উঠতে থাকে সুবর্ণা আর দেবী। তাদের পেছন পেছন অনিবার্য নিয়তির মতো রাজীব। হঠাৎ থমকে ঘুরে দাঁড়ায় সুবর্ণা। অগত্যা রাজীবকেও থামতে হয়। একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, কী হল?

শ্বশুরমশাই যদি জানতে চান, আপনাকে এ বাড়িতে থাকতে দিচ্ছি কেন? তাকে কি বলব আপনি জোর করে থাকতে চাইছেন, তাই বাধ্য হয়ে–

না।

আপনার থাকার কারণটা কী বলব, বুঝতে পারছি না। আপনি কি বলে দেবেন?

এই প্রথম একটু থতিয়ে যায় রাজীব। খানিকক্ষণ ভেবে বলে, বলবেন আমি আপনার আত্মীয়। মামাতো ভাই, পিসতুতো ভাই, কাকা, মেসোর শালা–এনি ড্যাম থিং বলতে পারেন। বহুদিন বাইরে-কঙ্গো, ঘানা, আমস্টারডাম, সিয়েরা লিওন, বুরকিনা ফাসো কি প্যারাগুয়েতে ছিলাম। আপনার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। হঠাৎ খোঁজ পেয়ে চলে এসেছি।

অদ্ভুত চোখে খুব আস্তে আস্তে রাজীবের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখতে থাকে সুবর্ণা।

রাজীব এভাবে তার তাকানোর উদ্দেশ্যটা বুঝে নিয়ে বলে, আমাকে অবশ্য আপনার আত্মীয় বলে কেউ বিশ্বাস করবে না। আমার যা চেহারা তাতে হার্ড-ফিচারড অ্যান্টিসোশাল বলে মনে হবে। এনিওয়ে, আমার ব্যাগে শেভিং সেট আর পরিষ্কার দু-একটা জামাপ্যান্ট আছে। শেভ টেভ করে পোশাক চেঞ্জ করলে খানিকটা ভদ্র দেখাতে পারে। হঠাৎ কী খেয়াল হতে চিন্তিতভাবে বলে, কিন্তু

সুবর্ণা উত্তর দেয় না। স্থির চোখে রাজীবকে লক্ষ করতে থাকে। রাজীব বলে, আপনার আত্মীয়স্বজন, মানে আপনার বাপের বাড়ির দিকের রিলেটিভরা এ বাড়িতে এলে তাদের চোখে ধূলো দেওয়া যাবে না তখন ঝাট হতে পারে।

সুবর্ণা বলে, আমার মা-বাবা নেই। একমাত্র দাদা থাকে দিল্লিতে। বছরে একবার এসে আমাকে দেখে যায়। মাস দুই আগে এসেছিল, ফের আসবে নেক্সট ইয়ারে।

অন্য রিলেটিভরা?’

আমার শ্বশুরমশাই তাদের একেবারেই পছন্দ করেন না। তাই তাদের এ বাড়িতে যাতায়াত নেই।

লোকটার নিজের সুরক্ষা বা নিরাপত্তা ছাড়া অন্য কোনও ব্যাপারে বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই। সুবর্ণার বাপের বাড়ির দিকের আত্মীয়স্বজনরা এখানে আসে না, কাজেই তার ধরা পড়ার সম্ভাবনা নেই। এতে সে খুশি। তার চোখেমুখে কিছুটা স্বস্তির ছাপ ফুটে বেরোয়। বলে, ঠিক আছে, ওপরে যাওয়া যাক।

যন্ত্রচালিতের মতো ফের আগে আগে সিঁড়ি ভাঙতে থাকে সুবর্ণা আর দেবী। তাদের দু’ধাপ পেছনে রাজীব। আচ্ছাদনহীন কাঠের সিঁড়িতে তিন জোড়া নানা ধরনের জুতোর ভারী এবং হালকা আওয়াজ ছাড়া এ বাড়িতে এখন আর কোনও শব্দ নেই।

দোতলার নকশাটা হুবহু একতলার মতোই। তেমনই বিশাল হল-ঘরের তিন দিক ঘিরে লাইন দিয়ে ঘর। তবে সবগুলোই কিন্তু বেড র নয়। একটা ঘরকে কিচেন হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

নিচের তুলনায় ওপরে আলোটালো অনেক বেশি। চারিদিক পরিচ্ছন্ন, ঝকঝকে। একতলার মতো সিলিং থেকে এখানেও একটা বিশাল ঝাড়লণ্ঠন ঝুলছে, সেটা অবশ্য জ্বলছে না। নিচে একটা ছাড়া বাকি ঘরগুলোতে তালা লাগানো। এখানে সবগুলো ঘরেই আলো দেখা যাচ্ছে, দরজাও খোলা। অর্থাৎ প্রতিটি ঘরেই এখানে লোকজন থাকে।

নিচের কার্পেটটা ছিঁড়ে খুঁড়ে সামান্যই অবশিষ্ট আছে। কিন্তু দোতলার হল-ঘরে যেটা পাতা রয়েছে সেটা বহুদিনের পুরনো, রংও নষ্ট হয়ে গেছে, তবু তার হাল নিচেরটার মতো অত খারাপ নয়। মোটামুটি অটুটই আছে বলা যায়।

চারপাশের দেওয়াল থেকে দু ফুটের মতো বাদ দিয়ে কার্পেটটা হল-ঘরের মেঝে ঢেকে রেখেছে। নিচের মতোই এখানে তিন সেট ভারী ভারী সোফা, সেগুলোর ওপর দামি কাপড়ের কভার। একধারে রঙিন টিভি, আরেক ধারে লম্বা ধাঁচের অ্যাকোয়ারিয়াম। ডানদিকের গোটা দেওয়াল জুড়ে উঁচু নিচু কাঁচে ঢাকা ক্যাবিনেটের ভেতর অজস্র বই। ক্যাবিনেটের নিচু অংশগুলোতে নানা ধরনের পেতল এবং মার্বেলের সুদৃশ্য সব শিল্পকর্ম। আর আছে বিচিত্র চেহারার অনেকগুলো ক্যাকটাস। আরেক দেওয়ালের উঁচুর দিকটায় পনের কুড়িটা বাঘ, হরিণ এবং শিংওলা বুনো মোষের মাথা সারিবদ্ধভাবে সাজানো। প্রতাপপুর রাজবংশের পূর্বপুরুষদের কেউ হয়তো দুর্ধর্ষ শিকারি টিকারি ছিলেন। বাঘটাঘের মুণ্ডুগুলো সেই স্বর্ণযুগের স্মৃতিচিহ্ন। হল-ঘরের শেষ মাথায় কিচেনের কাছাকাছি বিরাট লম্বাটে ডাইনিং টেবিলের দু’পাশে বাবোটা করে চব্বিশটা চেয়ার। ঠিক মাঝখানে ঝাড়লণ্ঠনের তলায় মস্ত একটা গ্র্যান্ড-ফাদার ক্লক।

দোতলায় এসে হল-ঘরটা দ্রুত একবার দেখে নিয়ে রাজীব বলে, বেড-রুম, কিচেন টিচেনগুলো এবার দেখিয়ে দিন।

সুবর্ণা সবে রাজীবকে নিয়ে বাঁদিকে পা বাড়িয়েছে, হঠাৎ কিচেন থেকে মায়া বেরিয়ে এসে অচেনা একটা লোককে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে যায়। লোকটার পোশাক এবং চেহারা এই রাজপ্রাসাদের পক্ষে এতই বেমানান যে তাকে যতই দেখছিল ততই অবাক হয়ে যাচ্ছিল সে।

মায়ার বয়স চল্লিশ বেয়াল্লিশ। মাঝারি মাপের শক্তপোক্ত, চালাক চতুর চেহারা। মুখটা চৌকো ধরনের। গায়ের রং ময়লা। চওড়া কাধ এবং ছড়ানো চোয়াল এবং হাতের মোটা মোটা হাড়ের দিকে তাকালে বোঝা যায় মেয়েমানুষটি অসীম শক্তির অধিকারিণী। পরনে একটু খাটো ধরনের সবুজ সবুজ খোপ-কাটা শাড়ি, আর ডগডগে লাল রঙের ব্লাউজ। দু’হাতে কয়েক গাছা করে রুপোর চুড়ি, গলায় সোনার সরু চেন হার। নাকের পাটায় সাদা পাথর বসানো একটা বেঢপ নাকছাবি।

কিছু বলার জন্য ঠোঁটদু’টো ফাঁক করতে যাচ্ছিল মায়া, চোখের ইশারায় তাকে থামিয়ে দেয় সুবর্ণা। বলে, তুমি এখন রান্নাঘরে যাও। দরকার হলে ডাকব।

সন্দিগ্ধ চোখে রাজীবের দিকে তাকাতে তাকাতে কিচেনে চলে যায় মায়া। তার তাকানোর ভঙ্গিটা বুঝিয়ে দেয়, রাজীবকে তার পছন্দ হয়নি।

সুবর্ণা বাঁ ধারের যে বিশাল বেড-রুমটার সামনে রাজীবকে নিয়ে এল সেটার। ভেতর একটা ডিভানে যে বৃদ্ধটি বসে আছেন তাঁর মাথায় মরা ঘাসের মতো সামান্য ক’টি চুল। দু’পাটির একটা দাঁতও আর অবশিষ্ট নেই। গাল তুবড়ে ভেতরে ঢুকে গেছে। হাত দু’টো গাছের শুকনো ডালের মতো কাঁধ থেকে ঝুলছে। চামড়া কুঁচকে কুঁচকে একেবারে জালি জালি। থুতনির হাড় এবং হনু দু’টো অস্বাভাবিক বেরিয়ে এসেছে। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। পরনে সরু পাজামার ওপর ঢলঢলে সোয়েটার। যৌবনে তার চেহারা কেমন ছিল, প্রবল কল্পনাশক্তি দিয়েও এখন আর তা আন্দাজ করার উপায় নেই।

বৃদ্ধটি সুবর্ণাদের দিকে তাকিয়ে হাবলার মতো নিঃশব্দে হাসছিলেন। বার্ধক্য তার শারীরিক সৌষ্ঠব এবং ক্ষমতা, বোধবুদ্ধি, সব কিছু শুষে নিয়ে ছিবড়েটুকু ফেলে রেখেছে।

সুবর্ণা এঁর কথা আগেই জানিয়েছিল। দেখামাত্রই চিনে নিতে পারল রাজীব। চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, আপনার গ্র্যান্ড ফাদার ইন-ল?

হ্যাঁ–শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ সিংহ। আস্তে মাথা নাড়ে সুবর্ণা, আসুন–’

শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের পরের চমৎকার সাজানো ঘরটা সুবর্ণা আর দেবীর। তারপরের বেড-রুমটায় নকশা-করা, প্রকাণ্ড মেহগনির খাটে কাত হয়ে, লেপ গায়ে, শুয়েছিলেন একজন বয়স্ক মানুষ। মাথা, নাক এবং গালের খানিকটা দেখে বোঝা যায় এঁরও বয়স হয়েছে, তবে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের মতো অতটা নয়। বাইরে থেকে রাজীবের মনে হল, তার চোখ দুটি বোজা। বালিশ থেকে মাথা না তুলে জিজ্ঞেস করলেন, কে, বৌমা?

নিচু গলায় সুবর্ণা সাড়া দিল, হা, বাবা। রাজীবের দিকে ফিরে কণ্ঠস্বর আরও নামিয়ে বলে, আমার শ্বশুরমশাই সংগ্রামনারায়ণ সিংহ।

মাথা সামান্য ঝাঁকিয়ে রাজীব জানায়, সে বুঝতে পেরেছে। চাপা গলায় বলে, এবাড়ির সবারই দেখছি মিলিটারি মার্কা নাম। শৌর্যে–সংগ্রাম–

সুবর্ণা উত্তর দিল না।

সংগ্রামনারায়ণ আগের মতো শুয়ে শুয়ে সুবর্ণাদের দিকে মুখ না ফিরিয়ে এবার বলেন, তিনরকম পায়ের শব্দ কানে আসছে। একজোড়া তোমার, একজোড়া দেবী দিদিভাইয়ের, আরেক জোড়া অচেনা লাগছে। হরেন বা মায়ার তো নয়।

সুবর্ণা হকচকিয়ে যায়। দ্রুত একবার রাজীবকে দেখে নেয়। রাজীবের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে। মুখ ফিরিয়ে ভীতভাবে সুবর্ণা বলে, না। আমার এক আত্মীয় এসেছেন। তিনি আমার দাদার–

তার কথা শেষ হতে না হতেই সংগ্রামনারায়ণ বলে ওঠেন, অনেক বছর পর, অ্যাবাউট থারটিন ইয়ারস, তোমার দাদাকে বাদ দিলে তোমার বাপের বাড়ির দিকের অন্য কোনও রিলেটিভ এ বাড়িতে এলেন। তাই না?

আবছা গলায় সুবর্ণা বলে, হ্যাঁ বাবা—

আমি তোমার আত্মীয়স্বজনদের এ বাড়িতে আসতে বারণ করে দিয়েছিলাম, তবু যখন একজন এসেই পড়েছেন, আদরযত্নের ক্রটি যেন না হয়।’

কথা বলছিল ঠিকই, তবু সুবর্ণা টের পাচ্ছিল তার শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। বুকের ভেতর থেকে আবদ্ধ বাতাস ধীরে ধীরে বের করে সে বলে, আচ্ছা।

ডাক্তার এবার যে ওষুধটা দিয়েছে সেটা ভীষণ কড়া। বিকেলের ট্যাবলেটটা খাওয়ার পর থেকে খালি ঘুম পাচ্ছে, চোখ আর মেলতে পারছি না। কাল তোমার আত্মীয়ের সঙ্গে আলাপ করব।

সুবর্ণা আপাতত বেঁচে গেল। ঘাড়ের ওপর চেপে বসা উগ্র চেহারার লোকটাকে সংগ্রামনারায়ণের কাছে হাজির করতে হলে তাঁর প্রতিক্রিয়া কী হত, ভাবতে পারে না সে। চোখের ইশারায় রাজীবকে তার সঙ্গে এগিয়ে যেতে বলল।

সংগ্রামনারায়ণের পাশের ঘরটা হল প্রতাপপুর রাজপরিবারের পুরনো অস্ত্রশস্ত্রের সংগ্রহশালা। সেখানে এসে রাজীব বলে, আপনার শ্বশুরমশাইয়ের কান তো সাঙ্ঘাতিক। পায়ের আওয়াজ শুনে বলে দিতে পারেন কোনটা কার–

সুবর্ণা বলে, শুধু কানই না, সবগুলো ইন্দ্রিয়ই ওঁর ভয়ানক রকমের প্রখর।

উনি বলেছিলেন আপনার আত্মীয়স্বজনদের এ বাড়িতে ঢোকা নিষেধ। কারণটা–’বলতে বলতে থেমে যায় রাজীব।

এই প্রথম রাজীব কোনও ব্যাপারে কৌতূহল প্রকাশ করল। ঠান্ডা চোখে তার দিকে তাকিয়ে সুবর্ণা বলে, আপনি নিজের নিরাপত্তার জন্যে একটা শেলটার খুঁজছেন। সেটা ছাড়া অন্য সব কিছুই কিন্তু অবান্তর।

একটু চমকে ওঠে রাজীব, আর কোনও প্রশ্ন করে না।

অস্ত্রশালার পরের ঘরটা চেয়ার টেবিল এবং নানা রেফরেন্স বই-টই দিয়ে সাজানো। এটা সুবর্ণার নিজস্ব লাইব্রেরি। এখানে বসেই সে পড়াশোনা করে, পরীক্ষার খাতা দেখে।

সুবর্ণার পড়ার ঘরের গায়েই কিচেন। সেদিকে পা বাড়াতে গিয়ে তার চোখে পড়ল দরজা সামান্য ফাঁক করে মায়া তাদের লক্ষ করছে। চোখাচোখি হতে চট করে সরে গেল সে।

কিচেনের পাশ দিয়ে যেতে যেতে সুবর্ণা বলে, এটা আমাদের রান্নাঘর। রাত্তিরে মায়া এখানেই শোয়।

রাজীব কিছু বলল না।

কিচেনের পাশ দিয়ে একতলার মতোই একটা প্যাসেজ দোতলার শেষ মাথায় চলে গেছে। ওদিককার দরজা খুললে একটা বিরাট ঝোলানো ব্যালকনি।

যেভাবে কোনও প্রদর্শনী বা দর্শনীয় স্থান ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখানো হয়, অবিকল তেমনি প্রতাপপুর প্যালেসের একতলা এবং দোতলা দেখানো হলে ফের ওরা হল-ঘরে ফিরে আসে।

সুবর্ণা লক্ষ করল, দেবী আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। এমনিতে সে খুবই নরম ধরনের মেয়ে। অচেনা, সশস্ত্র লোকটার ভয়ে তার মুখ একেবারে শুকিয়ে গেছে।

সুবর্ণা মনে মনে খানিকটা সাহস এনে বলল, দেবীর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ওর কি এখানে থাকার আর দরকার আছে?

রাজীব তক্ষুণি বলে, না না, ও যেতে পারে।

সুবর্ণা দেবীকে তাদের ঘরে যেতে বলে। সাময়িক মুক্তি পেয়ে দেবী পা বাড়াতে যাচ্ছিল, রাজীব বলে ওঠে, তোমার মাকে যে কথাটা বলেছিলাম সেটা মনে আছে তো? আমার সম্বন্ধে কাউকে কিছু বলবে না।

আস্তে মাথা হেলিয়ে দেবী জানায়-মনে আছে। তারপর হল-ঘর পেরিয়ে নিজেদের বেডরুমে চলে যায়।

সুবর্ণার হঠাৎ কিছু মনে পড়ে যাওয়ায় জিজ্ঞেস করে, আমি কি একবার নিচে যেতে পারি?

রাজীবের দৃষ্টি সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে। সে বলে, কেন?

সুবর্ণা বলে, হরেন ফিরে আসবে। বাইরের দরজাটা বন্ধ রয়েছে। ওটা খুলে দিয়ে আসি।

ওর তো দু’ঘণ্টা পর ফেরার কথা। গ্র্যান্ড ফাদার ক্লকটার দিকে তাকিয়ে সময় হিসেব করে নেয় রাজীব। বলে, মাক্সিমাম চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিট কেটেছে।

সুবর্ণা বলে, ফিরে এসে ডাকাডাকি করলে কাউকে না কাউকে তো দরজা খুলতে হবে। মায়াকে পাঠাতে পারি কিন্তু ও যদি ফস করে আপনার সম্পর্কে কিছু বলে বসে। একটু ভেবে বলল, ওর চোখমুখ দেখে তখন মনে হচ্ছিল আপনাকে আমার রিলেটিভ বলে হয়তো বিশ্বাস করেনি।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে রাজীব। তারপর বলে, ঠিক আছে, খুলে দিয়ে আসুন। মায়াকে বলবেন কোনওরকম বজ্জাতি করার চেষ্টা যেন না করে।

পরে আমি বুঝিয়ে দেবো।

সুবর্ণা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যায়। রাজীব তার সঙ্গে সঙ্গে ল্যান্ডিং পর্যন্ত এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার পকেটে নিঃশব্দে একটা হাত ঢুকে গেছে। তবে অস্ত্রটা এবার। আর বের করেনি সে।

দরজা খোলা হলে সুবর্ণাকে সঙ্গে করে ফের দোতলায় উঠে আসে রাজীব।

সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, আমাকে এখন কী করতে হবে?

তার প্রশ্নটা যেন শুনতেই পায়নি রাজীব। জবাব না দিয়ে বলে, আপনাদের গোটা বাড়িটা দেখার পর মনে হয়েছে, দোতলাটাই আমার পক্ষে সবচেয়ে সেফ।

অর্থাৎ এই লোকটা সর্বক্ষণ দোতলায় একটা দম বন্ধ-করা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করে রাখবে। কিন্তু তাকে ঠেকানোর কোনও উপায় নেই। সুবর্ণা বলে, এখানে লাইব্রেরি আর যে ঘরে পুরনো অস্ত্রশস্ত্র থাকে সে দু’টোয় রাতে কেউ থাকে না। ওর একটায় আপনার জন্যে ব্যবস্থা করে দিতে পারি।

নো, নো ম্যাডাম। জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাতে থাকে রাজীব।

রীতিমত অবাক হয়ে সুবর্ণা বলে, কেন, ও দু’টো আপনার পছন্দ নয়? বেশ বড় বড় রুম। শোওয়ার জন্যে ডিভান টিভান পেতে দিলে–

হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিতে দিতে রাজীব বলে, আমাকে কি আপনার স্টুপিড মনে হয়?

মানে?

ওই ঘর দু’টোর কোনও একটায় থাকলে আপনাদের খুবই সুবিধে হয়, তাই না? সারা রাত তো জেগে থাকতে পারব না। ঘুমিয়ে পড়লে বাইরে থেকে তালা দিয়ে আমাকে ফাঁদে ফেলবেন, সেটা কোনওভাবেই হাতে দিচ্ছি না।

এমন একটা চিন্তা ঘুণাক্ষরেও সুবর্ণার মাথায় আসেনি। দেখা যাচ্ছে লোকটা খুবই প্যাচালো। তার মানসিক প্রক্রিয়া স্বাভাবিক নয়, অত্যন্ত জটিল। রাজীব সম্পর্কে সুবর্ণা কিছুই জানে না। হয়তো তার জীবনে এমন কিছু ঘটে গেছে যাতে কাউকে সে বিশ্বাস করে না, পৃথিবীর সবার সম্বন্ধেই সে সন্দেহপরায়ণ। হয়তো তার ধারণা, চেনা-অচেনা প্রতিটি মানুষ তার বিরুদ্ধে গভীর কোনও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।

সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, তা হলে কোথায় থাকতে চান?

ওই যে ওল্ডেস্ট মেম্বার অফ ইয়োর ফ্যামিলি, আপনার গ্র্যান্ড ফাদার-ইন-ল, আমি ওঁর ঘরে ওঁর সঙ্গে থাকতে চাই। বলে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের বেড-রুমটার দিকে আঙুল বাড়িয়ে দেয় রাজীব।

বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থাকে সুবর্ণা। একজন জড়ভরত মার্কা নব্বই বছরের বৃদ্ধের সঙ্গে কেউ থাকতে চাইছে, শুনেও তার বিশ্বাস হয় না।

রাজীব সুবর্ণার প্রতিক্রিয়া লক্ষ করছিল। বলল, মনে হচ্ছে, বুঝতে পারছেন না।

আস্তে মাথা নাড়ে সুবর্ণা।

রাজীব এবার যা বলে তাতে আতঙ্কে গলা পর্যন্ত শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায় সুবর্ণার। একটা অর্থ বুড়ো যার বোধবুদ্ধি একেবারে লোপ পেয়ে গেছে, ওয়ার্ল্ডে যার কোনও প্রয়োজন নেই, তবু পরিবারের লোকজনের কাছে তার জীবন অবশ্যই মূল্যবান। সেটা সেন্টিমেন্টাল আর ইমোশনাল কারণে। রাজীবের মধ্যে এই সব আবেগ টাবেগের ছিটেফোঁটাও নেই। যদি দেখা যায় তাকে বিপাকে ফেলার চক্রান্ত চলছে, বৃদ্ধটির আয়ু তৎক্ষণাৎ শেষ হয়ে যাবে। তার সঙ্গে যে মারণাস্ত্র রয়েছে। সেটার ট্রিগারে আঙুলের একটা চাপই যথেষ্ট।

শ্বাসরুদ্ধের মতো সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, এই জন্যেই বুড়ো লোকটার ঘরে থেকে ওঁকে আপনার হাতের মুঠোয় রাখতে চান?

এগজ্যাক্টলি। আশা করি বুঝতে পারছেন আমার সিকিউরিটির জন্যে এটা খুবই প্রয়োজন। ওল্ড ম্যান আমার জিম্মায় থাকলে আপনারা তেমন কোনও ঝুঁকি নিতে সাহস করবেন না।

সুবর্ণা চুপ করে থাকে। হঠাৎ কিছু মনে পড়ায় রাজীব বলে ওঠে, আপনাদের বাড়িতে একটা টেলিফোন আছে বলেছিলেন না?

হ্যাঁ—

সেটা ডিসকানেক্ট করে দিতে হবে।

সুবর্ণা চমকে ওঠে, না না, আমার শ্বশুরমশাই ভীষণ অসুস্থ। প্রায়ই ডাক্তার ডাকতে হয়। টেলিফোন না থাকলে ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করব কী করে?

কিছুক্ষণ চিন্তা করে রাজীব বলে, ওটা ছাড়া আর কোনও ফোন নেই তো? যেমন ধরুন কর্ডলেস টেস–’

না। ওই একটাই।

ওটা খুলে আপনার দাদাশ্বশুরের ঘরে এনে লাগিয়ে দেবেন।

অর্থাৎ নিরাপত্তার দিক থেকে কোনওরকম ত্রুটি থাকতে দেবে না রাজীব। টেলিফোনটাও নিজের হেপাজতে রাখতে চাইছে সে। সুবর্ণা বলে, ঠিক আছে।

রাজীব এবার বলে, আমি ভীষণ টায়ার্ড আর হাংগ্রি। দু’টো দিন এক মিনিটের জন্যেও ঘুমোতে পারিনি, ক’টা বিস্কুট আর কয়েক কাপ চা ছাড়া কিছু জোটেনি।

এই প্রথম সুবর্ণা লক্ষ করল, লোকটার চোখে মুখে উগ্রতা থাকলেও সে সত্যিই খুব ক্লান্ত। তার কথা মেনে নিলে ক্ষুধার্তও। সুবর্ণা বলল, আসুন–

কোথায়?

আপনিই তো আমার দাদাশ্বশুরের বেড-রুমটায় থাকার জন্যে ঠিক করে ফেলেছেন। সেখানে যাওয়া যাক।

রাজীব উত্তর দেয় না। হল-ঘর পেরিয়ে দু’জনে চুপচাপ শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে চলে আসে। আগের মতোই তিনি ডিভানে বসে ছিলেন। সুবর্ণা বলল, দাদাভাই, ইনি আমার আত্মীয়। দিনকয়েক আপনার সঙ্গে থাকবেন। বলে রাজীবকে দেখিয়ে দেয়।

কথাগুলো বৃদ্ধের মাথায় ঢুকলো কিনা কে জানে। কোনওরকম প্রতিক্রিয়াই হল না তার। ফ্যাল ফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন তিনি। তারপর শব্দহীন বোকাটে হাসি তার মুখে ফুটে ওঠে।

একধারে একটা চামড়ায়-ঢাকা আর্ম চেয়ার রয়েছে। কাঁধের ব্যাগ দু’টো মেঝেতে নামিয়ে রেখে রাজীব বলে, আমি একটু বসছি। আপনি টেলিফোনটা খুলে এখানে নিয়ে আসুন।

বোঝা যাচ্ছিল অসীম ক্লান্তিতে রাজীব আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। সে আর্মচেয়ারে শরীরের ভার ছেড়ে দেয়। নিজের ঘর থেকে টেলিফোন নিয়ে এসে এ ঘরের প্লাগ পয়েন্টে লাগিয়ে দেয় সুবর্ণা।

রাজীব বলে, আমি স্নান করব। বাথরুম কোথায়?

ডানপাশের দেওয়ালে একটা বন্ধ দরজা দেখিয়ে সুবর্ণা বলে ওখানে—

ভালই হল, এখানে অ্যাটাচড বাথরুমও রয়েছে। স্নানটানের জন্যে বাইরে বেরুতে হবে না।

এখানকার গিজারটা কিন্তু নষ্ট হয়ে গেছে। গরম জল পাওয়া যাবে না।

নো প্রবলেম।

আমি কি এখন যেতে পারি? আপনার খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে—

ঠিক আছে।

সুবর্ণা চলে যাচ্ছিল, রাজীব পেছন থেকে ডাকে, মিসেস সিংহ—

সুবর্ণা ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়।

রাজীব বলে, বাড়তি একটা লোক কিছুদিন থাকলে আপনাদের ওপর প্রেসার পড়বে। আমি সেটা চাই না।–

বুঝতে না পেরে সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, কীসের প্রেসার?

আমি আর্থিক ব্যাপারের কথা বলছি। আমার কাছে কিছু টাকা আছে—

রাজীবকে থামিয়ে দিয়ে সুবর্ণা বলে, আপনাকে আগেই বলেছি এটা একটা প্যালেস। প্রতাপপুর রাজবংশের লোকেরা একসময় বহু মানুষকে খাইয়েছে। জোর করে এ বাড়িতে ঢুকে পড়লেও আপনি আমাদের গেস্ট। পয়সা নিয়ে অতিথিকে খাওয়ানোর কথা আমরা ভাবতে পারি না।

কয়েক পলক সুবর্ণার দিকে তাকিয়ে থাকে রাজীব। তারপর বলে, আপনার। যেমন ইচ্ছে।

তার কথা যেন শুনতে পায়নি, এমনভাবে সুবর্ণা বলে, ইন্ডিয়ান হসপিটালিটি বলে একটা কথা আছে। এই পরিবার তার রীতিনীতিগুলো মেনে চলে। তা। ছাড়া–

কী?

রাজত্ব বা রয়ালটি কোনওটাই আর নেই। মর্যাদা, অর্থ, বংশগৌরব, সবই প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে। তবু একটা লোককে কয়েকদিন খাওয়ানোর ক্ষমতা আমাদের এখনও আছে।

রাজীব উত্তর দেয় না।

সুবর্ণা চলে যায়। রাজীব দরজার পাল্লা দু’টো টেনে ভেতর থেকে ছিটকিনি আটকে দেয়। পুরনো জং-ধরা কজার আওয়াজে নিজের ঘরের দিকে, যেতে যেতে একবার মুখ ফেরায় সুবর্ণা। লোকটা যে নিজস্ব নিরাপত্তার ব্যাপারে অত্যন্ত হুঁশিয়ার সেটা আগে বহুবার বুঝিয়ে দিয়েছে। পাছে বাথরুমে ঢুকলে সুবর্ণা কিছু করে বসে তাই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করেছে। রাজীব।

.

০৪.

নিজের ঘরে এসে সুবর্ণা দেখল, খাটের এক কোণে জড়সড় হয়ে বসে আছে দেবী। ভয়ার্ত চোখে মায়ের দিকে তাকায় সে। মুখটা মাত্র এক-দেড় ঘন্টার মধ্যে শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। ঠোঁট দু’টো ভীষণ কাগছে।

মেয়ের গা ঘেঁষে বসে পড়ে সুবর্ণা। এতক্ষণ একটা মারাত্মক আততায়ীর সঙ্গে প্রাণপণে স্নায়ুযুদ্ধ চালিয়ে গেছে সে। এখন মনে হচ্ছে হাত-পায়ের জোড়গুলো শিথিল হয়ে যাচ্ছে। তার শরীর এবং মনের যাবতীয় শক্তি আর সাহস লোকটা যেন প্রায় শুষেই নিয়েছে। সুবর্ণা টের পাচ্ছিল, তার রক্ত হঠাৎ অনেক কমে গেছে। মাথার ভেতরটা ভীষণ টলছিল।

দেবী বলল, মা, লোকটার কাছে পিস্তল আছে। আমাদের সবাইকে কি খুন করে ফেলবে?’

দেবীর কাঁধে একটা হাত রেখে সুবর্ণা ম্লান একটু হাসে। বলে, আরে না না, এমনি ভয় দেখাচ্ছিল। আমি তো আছি, ও কিছু করতে পারবে না।

দেবী কতটা ভরসা পায় সে-ই জানে। ভয় তার এক ফোঁটাও কমেছে বলে মনে হয় না। ভীরু চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে সে।

সুবর্ণা বলে, স্কুলে গিয়ে ওই লোকটা সম্বন্ধে কাউকে কিছু বলবি না।

দেবী খুবই ভাল মেয়ে। মা যা বলে, অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। কোনওদিন অবাধ্য হয় না। সে মাথাটা সামান্য হেলিয়ে বলে, বলব না। ওই লোকটাও বারণ করে দিয়েছে।

দেখা গেল, রাজীবের হুঁশিয়ারি ভুলে যায়নি দেবী। সুবর্ণা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, এ নিয়ে আর একদম ভাববি না। সব ঠিক হয়ে যাবে।

লোকটা আমাদের বাড়ি ক’দিন থাকবে মা?’ দেবী জিজ্ঞেস করে।

সুবর্ণা বুঝতে পারছিল রাজীব যতদিন তাদের বাড়িতে থাকবে হাজার বললেও দেবীর ভয় বা আতঙ্ক কোনওটাই কাটবে না। ব্যাপারটা হালকা করে দেওয়ার জন্য বলে, ক’দিন আর? পাঁচদিন, সাতদিন, কি দশদিন।’ বলছিল আর ভাবছিল, দশটা দিনও যদি রাজীব এ বাড়িতে থাকে এবং পিস্তলের একটি কার্তুজও খরচ না করে, আতঙ্কে তাদের আয়ু প্রায় শেষ সীমায় পৌঁছে যাবে।

দেবী এবার বলে, মাস্টারমশাইকে তো আসতে বারণ করে দিলে। আমার। পড়াশোনার কী হবে?

আমি তোকে পড়িয়ে দেবো। বলতে বলতে উঠে পড়ে সুবর্ণা। রাজীবকে খেতে দিতে হবে। রান্নাবান্নার কতদূর কী হয়েছে খোঁজ নেওয়া দরকার। না হলে মায়াকে তাড়া দিতে হবে।

এ বাড়িতে দু’বেলাই রান্না হয়। দুপুরের তৈরি খাবার রাতে কেউ মুখে তোলে না।

কিচেনে আসতেই সুবর্ণার চোখে পড়ল মায়া লুচির জন্য ময়দা মাখছে। সে। জিজ্ঞেস করল, রান্নার কত বাকি?’

মায়া জানায়, ভাত, ছোলার ডাল, মাংস, আলু-কপির তরকারি আর বেগুনভাজা হয়ে গেছে। খাওয়ার সময় গরম গরম লুচি ভেজে দেবে।

সুবর্ণা মনে মনে হিসেব করে নিল, দাদাশ্বশুরের ঘর থেকে সে আধ ঘণ্টা আগে চলে এসেছে। এর ভেতর নিশ্চয়ই রাজীবের স্নান হয়ে গেছে। কিচেনের দরজার কাছে গিয়ে হল-ঘরের ওধারে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের বেড-রুমের দিকে তাকায় সে। ওই ঘরটার দরজা এখন খোলা। ভেতরে রাজীবকে দেখা যাচ্ছে, সে বৃদ্ধকে বোধহয় কিছু বলছে। তার একটা কথাও এখান থেকে অবশ্য শোনা গেল না।

সুবর্ণা মায়ার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে, লুচি পরে ভেজো। যা রান্না হয়েছে, একটা থালায় করে দাদাভাইয়ের ঘরে নিয়ে এসো। আমি ওখানে যাচ্ছি।’ বলে হল পেরিয়ে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে চলে যায় সে।

রাজীব একটা গদি-মোড়া চেয়ারে বসে ছিল। বলল, আপনার গ্র্যান্ডফাদার-ইন-ল কি কথা বলতে পারেন না?

সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, হঠাৎ আপনার এরকম মনে হল?

এক ঘরে পাশাপাশি থাকব। তাই ওঁর সঙ্গে একটু আলাপ করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু যাই জিজ্ঞেস করি না কেন, উনি শুধু হাসেন। কোনও উত্তর দেন না।

ওঁর কথা প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে বলতে পারেন।

খুব বেশিদিন বাঁচলে এরকম হয়, তাই না? ওল্ড এজ হাজার্ড।

সুবর্ণা বলে, সবার কি একরকম হয়? নব্বই বছরের বেশ কয়েকজন বৃদ্ধকে। জানি যাঁদের চমৎকার হেলথ, মস্তিষ্কের সেলগুলো পুরোপুরি অ্যাক্টিভ, রোজ দু মাইল মর্নিং ওয়াক করেন, গুছিয়ে সুন্দর কথা বলেন। আমার দাদাশ্বশুর যে কথা বলতে পারেন না, তাঁর স্মৃতিশক্তি যে নষ্ট হয়ে গেছে, সেটা আমাদের দুর্ভাগ্য।

কী একটু ভেবে রাজীব চোখ কুঁচকে বলে, এই যে হাবা সেজে থাকা, এটা আপনার গ্র্যান্ড ফাদার-ইন-ল’র কোনও ধান্ধা নয় তো?

সুবর্ণা কয়েক পলক অবাক তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, হাবা সাজা, ধান্ধা–এসব কী বলছেন আপনি!

রাজীব বলে, হয়তো ওভাবে অ্যাক্টিং করে আমার ওপর উনি নজর রাখবেন।

প্রচণ্ড রাগে মাথায় আগুন ধরে যায় যেন। কিন্তু লোকটা যে মারাত্মক খুনে ধরনের সেটা এক মুহূর্তের জন্যও ভোলার উপায় নেই। যতটা সম্ভব নিজেকে সংযত রেখে সুবর্ণা বলে, হি ইজ মোস্ট রেসপেক্টেড মেম্বার অফ আওয়ার ফ্যামিলি। ওঁর সম্পর্কে আপনি যা বললেন সেটা কিন্তু একেবারেই সম্মানজনক নয়। তাছাড়া আপনি যখন এ বাড়িতে ঢুকলেন আমি আর দেবী নিচেই ছিলাম। ওঁকে অ্যাক্টিং করতে বলার সুযোগ কিন্তু পাইনি। সে যাক, আপনার খাবার নিয়ে। মায়া আসছে। কোথায় বসে খাবেন? এই ঘরে, না ওখানে?’ বলে হল-ঘরের এক কোণে বিশাল ডাইনিং টেবলটা দেখিয়ে দেয় সে।

কয়েক পলক চুপ করে থাকে রাজীব। পরে বলে, চলুন, ওখানেই যাওয়া যাক। বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায়।

ডাইনিং টেবলে এসে রাজীব এমন একটা চেয়ারে বসে যেখান থেকে পুরো দোতলাটা তো বটেই, একতলায় সিঁড়ির ল্যান্ডিং পর্যন্ত দেখা যায়। অর্থাৎ কোনও দিক থেকে বিপদের সম্ভাবনা দেখা দিলে সে তক্ষুণি সতর্ক হয়ে যাবে।

সুবর্ণা আন্দাজ করল, সেই পিস্তলটা রাজীবের প্যান্টের পকেটেই রয়েছে। এক মুহূর্তের জন্যও খুব সম্ভব সে নিরস্ত্র থাকে না।

সুবর্ণা আগে ততটা খেয়াল করেনি। এবার লক্ষ করল, রাজীবের গালে দাড়িটাড়ি তেমনই রয়েছে। স্নান করার পর ভাল করে মাথাটাথা মোছে নি। তাই ভেজা চুলদাড়ি থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে জল ঝরছে।

রাজীবের চোখও সুবর্ণার দিকেই ছিল। তার তাকানোটা লক্ষ করে নিজের গালে হাত দিল রাজীব। বলল, এত টায়ার্ড লাগছিল যে আজ আর দাড়িটা কামানো হয়ে উঠল না। কাল শেভটেভ করে খানিকটা ভদ্র হওয়ার চেষ্টা করব। অন্তত আপনার আত্মীয় বলে যাতে মনে হয় সেদিকে আমার লক্ষ্য থাকবে। আপনি। শেলটার দিয়েছেন। যাতে শ্বশুর মশাইয়ের কাছে বিপন্ন হয়ে না পড়েন সেটা আমি দেখব।’ বলে অল্প একটু হাসল।

এই প্রথম রাজীবকে হাসতে দেখল সুবর্ণা, সে কিছু বলল না।

একতলা থেকে হঠাৎ হরেনের গলা ভেসে আসে, বৌদিদি, আমি ফিরে এসেছি। ওপরে আসব কি?’ এ বাড়ির কাজের লোকেরা, অনুমতি না নিয়ে কখনও দোতলায় উঠত না। সেই রেওয়াজ এখনও চালু রয়েছে।

সুবর্ণার নজরে পড়ল, রাজীবের শিরদাঁড়া মুহূর্তে টান টান হয়ে গেছে এবং চোখের দৃষ্টি তীব্র হয়ে উঠেছে। সর্বক্ষণ যারা আক্রমণের আশঙ্কা করে, তাদের বোধহয় এমনটাই হয়ে থাকে। সিঁড়ির দিকে মুখ ফিরিয়ে সুবর্ণা বলে, এখন আসার দরকার নেই।

হরেন বলে, কিন্তু বৌদিদি, বড়বাবাকে খাওয়াতে হবে, জামাকাপড় বদলে ঘুম। পাড়াতে হবে। বেশি রাত করলে–

হরেনের ওপর বড়বাবা অর্থাৎ শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের খানিকটা দায়িত্ব দেওয়া আছে। সকালে তার মুখ ধোয়ানো, ব্রেকফাস্ট করানো, দুপুরে কলেজে বেরুবার আগে স্নান করিয়ে ভাত খাওয়ানো–এ সবই নিজের হাতে করে সুবর্ণা। কিন্তু টানা চার পাঁচটা বড় ক্লাস এবং দু-তিনটে স্পেশাল ক্লাস নেবার পর শরীর এত ক্লান্ত হয়ে পড়ে যে বাড়ি ফিরে আর কিছু করতে ইচ্ছে হয় না। তাছাড়া পরের দিন ক্লাস নেবার জন্য রাতে কিছুক্ষণ পড়াশোনা করতে হয়। অন্য ফাঁকিবাজ অধ্যাপকদের মতো প্রস্তুত না হয়ে দায়সারাভাবে সে পড়াতে পারে না। ছাত্রছাত্রীদের ঠকানোটা সে অন্যায় মনে করে। তাই সন্ধের পর হরেন এসে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে খাইয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে যায়। কিন্তু আজকের দিনটা অন্য সব দিনের থেকে আলাদা।

হরেনকে থামিয়ে দিয়ে সুবর্ণা বলে, আমিই আজ দাদাভাইকে খাওয়াব।

হরেন বলে, ঠিক আছে বৌদিদি–

মায়া কিচেন থেকে স্টেনলেস স্টিলের বিরাট থালায় ভাত এবং বাটিতে বাটিতে ডাল তরকারি মাংস ইত্যাদি সাজিয়ে নিয়ে আসে; খাদ্যবস্তুগুলো রাজীবের সামনে রেখে খানিক দূরে গিয়ে আড় হয়ে দাঁড়ায়। তার চোখে তখনকার মতোই ভীত, সন্দিগ্ধ দৃষ্টি।

সুবর্ণা মায়ার মনোভাব আন্দাজ করতে পারছিল। একটুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে বলল, ইনি কয়েকদিন আমাদের বাড়িতে থাকবেন। আমি কলেজে বেরিয়ে গেলে ওঁর যখন যা দরকার হয় দিও।

এ বাড়িতে কাজের লোকদের প্রশ্ন করার রীতি নেই। মায়া আস্তে মাথা নাড়ল শুধু।

এদিকে ভাতের থালাটার ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রাজীব। সে যে কতটা ক্ষুধার্ত, তার গোগ্রাসে খাওয়া দেখে সেটা টের পাওয়া যাচ্ছে।

মায়া বার তিনেক আরও ভাত, আরও তরকারি এবং মাংস টাংস এনে দিল। সেগুলো যখন ফুরিয়ে এসেছে সেই সময় একতলার হল-ঘর থেকে হরেনের কণ্ঠস্বর ভেসে এল, বৌদিদি, শীগগির নিচে আসুন–

তার গলায় এমন এক আতঙ্ক, ব্যগ্রতা আর উৎকণ্ঠা মেশানো ছিল যাতে ভীষণ চমকে ওঠে সুবর্ণা। বলে, কী হয়েছে হরেনদা?’

থানা থেকে দারোগাবাবু এসেছেন। আপনার সঙ্গে কথা বলবেন।

নিজের অজান্তেই সুবর্ণার চোখ দু’টো রাজীবের দিকে ঘুরে যায়। রাজীবও একদৃষ্টে তাকেই লক্ষ করছে। খাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তার। ডান হাতটা মুঠো পাকিয়ে গেছে। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে। বাঁ হাতটা নিঃশব্দে পকেটের ভেতর কখন ঢুকে গেছে, টের পাওয়া যায়নি। দাঁতে দাঁত চেপে রুদ্ধশ্বাসে বসে আছে সে। প্রবল উত্তেজনায় কণ্ঠমণিটা দুরন্ত গতিতে ওঠানামা করছে।

মায়া টেবলের ওধারে দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে রান্নাঘরে পাঠিয়ে খুব চাপা গলায় সুবর্ণা বলে, থানার ওসি’র সঙ্গে দেখা না করে উপায় নেই। আমাকে নিচে যেতে হবে।

গলার স্বর অনেকখানি খাদে নামিয়ে রাজীব বলে, হ্যাঁ যাবেন। নইলে ওসিই ওপরে উঠে আসবে।

সুবর্ণা সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতে যাবে, রাজীব ফের বলে, ওসি কী জিজ্ঞেস করবে, আমি জানি না। ইউ আর সাফিসিয়েন্টলি ইনটেলিজেন্ট। পুলিশের কথার কী জবাব দেবেন সেটা মনে মনে ঠিক করে নিন। ভুলে যাবেন না, আপনার হোল ফ্যামিলি দোতলায় রয়েছে, সেই সঙ্গে আমিও আছি। আর আমার পকেটে কী আছে, ইউ নো দ্যাট ভেরি ওয়েল।

সুবর্ণা উত্তর না দিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়। তার শরীর ভীষণ কাঁপছে।

০৫. প্রতাপপুর থানার ওসি

০৫.

প্রতাপপুর থানার ওসি রামেশ্বর বসাককে নিচের হল-ঘরে একটা সোফায় বসিয়ে সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে সুবর্ণার জন্য অপেক্ষা করছিল হরেন। খানিক দূরে বাইরের দরজার কাছে তিনজন আমর্ড কনস্টেবল দাঁড়িয়ে আছে। ওরা ওসি’র সঙ্গে এসেছে।

সুবর্ণা একতলায় নেমে আসতেই রামেশ্বর বসাক উঠে দাঁড়ালেন। প্রায় ক্ষমা প্রার্থনার সুরে বললেন, অসময়ে আপনাদের বিরক্ত করতে আসতে হল। কিছু মনে করবেন না ম্যাডাম।

রাজতন্ত্র কবেই শেষ হয়ে গেছে, তবু প্রতাপপুরের সাধারণ মানুষজন থেকে শুরু করে প্রশাসন, পুলিশ, সবাই রাজবাড়ির অধিবাসীদের যথেষ্ট সমীহ করে। সুবর্ণা রামেশ্বরকে বসতে বলে তার মুখোমুখি অন্য একটা সোফায় বসতে বসতে বলে, বলুন আপনার জন্যে কী করতে পারি। টের পেল, সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে যে কাঁপুনিটা শুরু হয়েছিল সেটা এখন কয়েক গুণ বেড়ে গেছে।

রামেশ্বরের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। হাইট প্রায় ছ’ফুট। মোটা মোটা হাড়ের ফ্রেমে দারুণ মজবুত চেহারা। গায়ের রং তামাটে। মাথাভর্তি কোঁকড়া কোঁকড়া চুলের বেশির ভাগটাই অবশ্য কালো। তবে রগ এবং সিঁথির দু’পাশে অনেকটা জায়গা জুড়ে বেশ পাক ধরেছে। পুরু কালচে ঠোঁট তার, ছড়ানো চোয়াল, থ্যাবড়া গোছের থুতনি, ঘন জোড়া ভুরুর তলায় তীব্র, সন্দিগ্ধ চোখ দু’টো সর্বক্ষণ চরকির মতো ঘোরে। আজীবন ঘের..ডাকাত ঘেঁটে ঘেঁটে পৃথিবীর কাউকেই বোধহয় বিশ্বাস করেন না। তার কাছে বেশির ভাগ লোকই ঠক, দাগাবাজ, জোচ্চোর কিংবা খুনী। তার ধারণা দুনিয়া থেকে সব ভালমানুষ প্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে।

রামেশ্বরের চেহারায় এমন একটা ভীতিকর ব্যাপার আছে যাতে যত বড় ক্রিমিনালই হোক না, তার মুখোমুখি পড়লে ভয়ে তাদের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। একজোড়া পাকানো গোঁফ তার ভয়ঙ্করত্ব অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতাপপুর শহরে অ্যান্টি-সোশালদের যম হিসেবে রামেশ্বরের সুনাম এবং দুর্নাম দুইই আছে। একবার একটা রেপিস্ট অর্থাৎ ধর্ষণকারীকে থানায় এনে এমন মার নাকি দেওয়া হয়েছিল যার ফলে মুখে রক্ত উঠে লোকটা মারা যায়। এই নিয়ে হিউম্যান রাইটসের ব্যাপারে যারা আন্দোলন করে তারা তুমুল হইচই বাধিয়ে দিয়েছিল। সেবার অনেক কষ্টে চাকরিটা বাঁচাতে পেরেছিলেন তিনি। অবশ্য লোকটার মৃত্যুতে তার বিন্দুমাত্র অনুতাপ হয়নি। তাঁর মতে খুনী এবং নারীধর্ষকদের পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার নেই। তাদের যেভাবে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সাবাড় করে ফেলা উচিত। মানবাধিকার ওনারা কেন যে এদের প্রতি এত সহানুভূতিশীল, তিনি সেটা ভেবে উঠতে পারেন না।

ক্রিমিনালদের কাছে রামেশ্বর যত.নির্মমই হন, এমনিতে লোকটা মোটামুটি ভদ্র, হৃদয়বান। সেটা অবশ্য চট করে বোঝা যায় না। তার চরিত্রে নিষ্ঠুরতার সঙ্গে সহৃদয়তার অদ্ভুত একটা মিশ্রণ ঘটেছে।

রামেশ্বর বললেন, একটা মারাত্মক ধরনের টেরোরিস্ট নর্থ-ইস্ট ইন্ডিয়া থেকে এক উইক আগে আমাদের শহরে এসে ঢুকেছে। ওখানকার পুলিশ আর মিলিটারি থেকে আমাদের অ্যালার্ট করে দেওয়া হয়েছে। কদিন নানা জায়গায় লুকিয়ে থাকার পর খুব সম্ভব খাবার দাবার কিনতে টেরোরিস্টটা আজ সন্ধেবেলায় বেরিয়ে পুলিশের একটা প্যাট্রোল ভ্যানের সামনাসামনি পড়ে যায়। তারপর তাড়া খেয়ে আপনাদের এদিকে চলে আসে। যারা প্যাট্রোল দিচ্ছিল তাদের ধারণা লোকটা আপনাদের প্যালেসে ঢুকে থাকতে পারে। অবশ্য কুয়াশা আর অন্ধকারে ওরা ভাল করে দেখতে পায়নি।

সুবর্ণার চোখের সামনে অদৃশ্য টিভি স্ক্রিনে রাজীবের চেহারাটা ফুটে ওঠে। গাল ভর্তি দাড়ি থাকলেও তার চোখেমুখে মঙ্গোলিয়ান একটা ছাপ রয়েছে যা উত্তর-পূর্ব ভারতেই দেখা যায়। রামেশ্বর যে এর সম্বন্ধেই বলছেন, তা নিয়ে এতটুকু সংশয় নেই সুবর্ণার। প্রথমটা তার মনে হয়েছিল, নোকটা সাধারণ একটা খুনী বা ডাকাত কিংবা জেল-পলাতক কোনও জঘন্য অপরাধের আসামী। এখন দেখা যাচ্ছে সে একজন উগ্রপন্থী।

অনিবার্য কোনও নিয়মে সুবর্ণার চোখদু’টো দোতলার দিকে খানিকটা ঘুরে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হল, ওপরে তাকালে রামেশ্বরের মতো ধুরন্ধর পুলিশ অফিসারের সন্দেহ হতে পারে। তাই আর মুখ তোলার চেষ্টা করল না; সোজা রামেশ্বরের দিকে চোখ রেখে আড়ষ্ট হয়ে বসে রইল।

রামেশ্বর ফের বললেন, লোকটার আসল নাম জানা যায়নি। আইডেন্টিটি গোপন করার জন্যে সে একেক সময় একেকটা নাম নেয়। সে মিলিটান্টদের একটা বড় আউটফিটের লিডার। তার নামে সত্তর আশি জন পুলিশ, মিলিটারি জওয়ান আর সাধারণ সিভিলিয়ান খুনের অভিযোগ আছে। বিরাট বিরাট কোম্পানির ডিরেক্টর বা একজিকিউটিভদের জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে, আটকে রেখে কোটি কোটি টাকা ব্যানসম হিসাবে আদায় করেছে। ওর সঙ্গে সব সময় এ কে-৫৬ রাইফেল, পিস্তল থাকে। আর থাকে এমন কিছু অস্ত্র যা দিয়ে আপনাদের এই প্যালেসের মতো পঞ্চাশটা বাড়ি উড়িয়ে দেওয়া যায়।

শুনতে শুনতে হৃৎপিণ্ডের উত্থান-পতন থমকে গিয়েছিল সুবর্ণার। সে চুপচাপ নিজীবের মতো তাকিয়ে থাকে।

রামেশ্বর থামেননি, লোকটা এই শহরের পক্ষে একেবারেই নিরাপদ নয়। ধরা পড়ার সম্ভাবনা দেখলে কখন কী ধরনের ব্লাস্ট ঘটিয়ে মানুষ, বাড়িঘর ধ্বংস করে ফেলবে, জানি না। যতক্ষণ ও প্রতাপপুর সিটিতে থাকবে, আমাদের কারও শান্তি নেই। একটু থেমে বলেন, আচ্ছা ম্যাডাম–

সুবর্ণা কিছু না বলে তাকিয়েই থাকে।

রামেশ্বর এবার জিজ্ঞেস করেন, আজ সন্ধের পর কোনও আউটসাইডার কি প্যালেসে ঢুকেছে?

সুবর্ণার কানের কাছে রাজীবের সেই হুঁশিয়ারিটা অদৃশ্য অডিও সিস্টেমে বেজে ওঠে। ধীরে ধীরে মাথাটা ডাইনে এবং বাঁয়ে হেলিয়ে দুর্বল স্বরে সে বলে, না।

দেখুন, আপনাদের এত বড় বাড়ি। অন্ধকারে কেউ কোনও দিক দিয়ে ঢুকে লুকিয়ে থাকলে বোঝা মুশকিল।

ওভাবে ঢোকাটা একেবারেই সম্ভব নয়। অন্তত আজ—

এত জোর দিয়ে বলছেন কী করে?

সুবর্ণা জানায় এ বাড়িতে ঢুকতে হলে একতলার হল-ঘরের সামনের দরজা দিয়ে ঢুকতে হবে। পেছন দিকেও একটা দরজা অবশ্য আছে, সেটা ভেতর থেকে বন্ধ থাকে। দোতলায় যেতে হলেও নিচের তলার হল-ঘরের সিঁড়ি ভেঙেই যেতে হবে। সেখানেও শেষ মাথায় একতলার মতো যে দরজাটা আছে সেটাতেও সারাক্ষণ খিল দেওয়া থাকে। আজ সন্ধেবেলায় সুবর্ণা নিচের তলাতেই ছিল, কেউ ঢুকলে সে নিশ্চয়ই দেখতে পেত।

একটু চিন্তা করে রামেশ্বর বললেন, ঠিক আছে, আমরা এখন যাচ্ছি। খুব সাবধানে থাকবেন। আপনাদের এত বড় প্যালেস বলেই বলছি, এখানে কেউ কোথাও লুকিয়ে থাকলে সহজে চোখে পড়বে না। কাল দিনের বেলায় কাজের লোকদের দিয়ে ছাদ টাদগুলো দেখিয়ে নেবেন।

আচ্ছা–

সন্দেহজনক, অচেনা কাউকে চোখে পড়লে দয়া করে থানায় ফোন করে দেবেন।

দেবো।

তাহলে এখন চলি–’ সোফা থেকে উঠে পড়তে পড়তে রামেশ্বর বলেন, আপনার অনেকটা সময় নিলাম। নমস্কার।

নমস্কার। সুবর্ণাও উঠে দাঁড়ায়। তার হাত-পায়ের কাঁপুনি এখনও থামেনি। এরই মধ্যে মনে পড়ল, বাড়িতে কেউ এলে তাকে আপ্যায়ন করাটা রাজপরিবারের দীর্ঘকালের রীতি। এখানে এসে কেউ চা, মিষ্টি কি শরবত খেয়ে যায়নি, এমনটা কখনও হয়নি। আজই প্রথম আতিথেয়তায় ত্রুটি ঘটল। সে যে মায়াকে ডেকে কফি, বিস্কুট টিস্কুট আনতে বলবে, তেমন সাহস হয়নি। ওপরে রাজীব রয়েছে। মায়া এসে কী বলতে কী বলে বসবে, তার ফলে গোটা পরিবারটাই শেষ হয়ে যাবে। তবু রামেশ্বরদের যে সামান্য এক কাপ চা-ও দেওয়া গেল না, সে জন্য মনটা খচখচ করতে থাকে সুবর্ণার।

রামেশ্বররা চলে যাবার পর দরজা বন্ধ করে ফিরে আসে হরেন। সুবর্ণা তখনও দাঁড়িয়ে ছিল।

হরেন মানুষটা খুবই ভাল এবং সৎ। দোকান বাজার থেকে শুরু করে বেশির ভাগ খরচপত্র তার হাত দিয়েই হয় কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ বলতে পারবে না, একটা পয়সাও এদিক ওদিক হয়েছে। কাজে একটু আধটু ফাঁকি যে দেয় না তা নয়। কিন্তু সে সব ধর্তব্যের মধ্যে নয়। দীর্ঘদিন রাজ-পরিবারে থেকে সুখে দুঃখে এদেরই একজন হয়ে গেছে। ঝামেলা ঝঞ্জাট একেবারেই পছন্দ করে না। পুলিশ এবং আদালত টাদালত সম্পর্কে তার অকারণ একটা ভীতি আছে যার কোনও স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই।

হরেন চাপা, ভীরু গলায় বলে, বৌদিদি আপনি তো দারোগাকে বললেন, আমাদের বাড়ির সব দরজা বন্ধ ছিল। খুনেটা ঢুকতে পারেনি। কিন্তু যদি বাইরের পাইপ বেয়ে ছাদে উঠে লুকিয়ে থাকে?

বোঝা গেল, রেন ওয়াটার পাইপের কথা বলছে হরেন। সুবর্ণা বলল, এই রাত্রিবেলা কিছু করার নেই। কাল সকালে ছাদে উঠে একবার দেখে আসব।

ব্যস্তভাবে হরেন বলে, আপনি আবার অতগুলো সিঁড়ি ভেঙে ছাদে উঠবেন কেন? আমি যাব।

সুবর্ণা সচকিত হয়ে ওঠে। সে চায় না, হরেন কোনও কারণে ওপরে উঠুক। বলে, না না, তোমার যাবার দরকার নেই। ধর, লোকটা ছাদে লুকিয়ে আছে, আর তার সঙ্গে যদি অস্ত্রস্ত্র থাকে–

হরেনকে এবার ম্রিয়মাণ দেখায়। ঢোক গিলে কিছু বলার চেষ্টা করে, পারে না।

সুবর্ণা বলে, রাত হচ্ছে। এবার রান্না চাপিয়ে দাও। আমি ওপরে যাচ্ছি।

হরেন এ বাড়িতে থাকে ঠিকই, তবে তার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা আলাদা। নিজের রান্না সে নিজেই করে নেয়।

সুবর্ণা আর দাঁড়ায় না, সিঁড়ি ভেঙে ক্লান্ত পায়ে ওপরে উঠতে থাকে। কিন্তু ল্যান্ডিংয়ের কাছাকাছি আসতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হয়। পাশ দিয়ে যে বিশাল, গোলাকার পিলারটা একতলার হল-ঘর থেকে সোজা ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে সেটার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে রাজীব। তার ডান হাতটায় ভাত আর মাংসের ঝোল লেগে বেআছে। বাঁ হাতে সেই পিস্তলটা। চোখাচোখি হতেই একটু হাসল সে। বলল, গুড। খুব ইনটেলিজেন্টলি ওসি’র প্রশ্নগুলোর জবাব দিয়েছেন।

সুবর্ণা আন্দাজ করল, সে নিচে নামার সঙ্গে সঙ্গে রাজীব ডাইনিং টেবিল থেকে উঠে এসে পিলারের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশ অফিসারের সঙ্গে তার যা কথাবার্তা হয়েছে, সবটাই শুনেছে। সুবর্ণা তাকে ধরিয়ে দিতে চাইছে কিনা, নিশ্চয়ই সেদিকে লক্ষ্য রাখছিল। ওসি’র কাছে বেস কিছু বলে ফেললে রাজীব কি গুলি করত?

সুবর্ণা তাকিয়েই ছিল, কিছু বলল না।

রাজীব বলে, চলুন, ওপরে যাওয়া যাক।

সিঁড়ি ভেঙে দোতলার দিকে উঠতে উঠতে রাজীব বলে, দু-ঘণ্টা আগে আমি এ বাড়িতে ঢুকেছি। এর মধ্যেই বুঝতে পেরেছি ইউ আর অ্যান এক্সট্রা-অর্ডিনারি লেডি। আই অ্যাম সিওর, আমি যা বলেছি তার বাইরে আপনি কিছু করবেন না। কারণ এ বাড়ির এতগুলো মানুষের লাইফ অ্যান্ড ডেথ আমার ওপর নির্ভর করছে। তবু হয়তো ভাবতে পারেন, কেন লুকিয়ে আপনাদের কথা শুনছিলাম?

সুবর্ণা উত্তর দেয় না। রাজীব বলে, আসলে কি জানেন, মানুষের সাইকোলজি একটা অদ্ভুত জটিল ব্যাপার। পুলিশ দেখে হঠাৎ যদি ডেসপারেট হয়ে কিছু করে বসেন, তাই

সুবর্ণা রাজীবের চোখ থেকে চোখ না সরিয়ে বলল, আপনি কাউকে পুরোপুরি বিশ্বাস করেন না, তাই না?

রাজীব বলে, এগজ্যাক্টলি। আপনাকে বোধহয় আগেও বলেছি, বিশ্বাস রেসপেক্ট স্নেহ সিমপ্যাথি, এইসব দারুণ দারুণ সব হিউম্যান কোয়ালিটির কোনওটাই আমার মধ্যে নেই। আমাকে বিপদে ফেলার মতো সামান্য চান্সও কাউকে দেব না।’

সুবর্ণা বলে, একটা কথা জিজ্ঞেস করব? অবশ্য আগেই ওয়ার্নিং দিয়েছেন, আপনিই শুধু প্রশ্ন করবেন আর আমি উত্তর দিয়ে যাব। তবু–

তাকে থামিয়ে দিয়ে রাজীব বলে, কী জিজ্ঞেস করতে চাইছেন?

অসীম দুঃসাহসে সুবর্ণা বলে, আপনার হাতে যেমন ওয়েপন আছে, অন্যের হাতেও তা থাকা অসম্ভব নয়। অস্ত্রের ব্যবহার তারাও জানে। কতদিন এভাবে চালাতে পারবেন?

রাজীবকে অসহিষ্ণু দেখায়। তীক্ষ্ণ গলায় সে বলে, যতদিন সম্ভব।

সুবর্ণা চুপ করে থাকে।

খাওয়া শেষ না করেই ল্যান্ডিংয়ের কাছে নেমে গিয়েছিল রাজীব। দোতলায় এসে আবার খেতে বসে যায় সে।

সুবর্ণা অবশ্য বসে না, ডাইনিং টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।

এক টুকরো মাংস মুখে পুরে রাজীব এবার বলে, পুলিশ অফিসারের কাছে আমার পরিচয়টা তো জেনে গেছেন।

সুবর্ণা কাঁপা গলায় উত্তর দেয়, হ্যাঁ। উনি বলেছিলেন আপনি–আপনি–বলতে বলতে থেমে যায়। বাকিটা শেষ করে না।

মাংস চিবুতে চিবুতে খুব সহজ ভঙ্গিতে রাজীব বলে, একজন ড্রেডেড টেরোরিস্ট। আরও একটা ইনফরমেশন উনি আপনাকে দিতে ভুলে গেছেন কিংবা জানেন না।

ক্ষীণ গলায় সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, কী ইনফরমেশন?

রাজীব বলে, আমার মাথার দাম পঞ্চাশ লাখ টাকা–ফাইভ মিলিয়ন। জীবিত বা মৃত, যে অবস্থায় থোক না আমাকে ধরিয়ে দিতে পারলে এই রিওয়ার্ডটা গভর্নমেন্ট থেকে দেওয়া হবে।

সুবর্ণা চোখ নামিয়ে নেয়, কিছু বলে না।

সামনের দিকে অনেকটা ঝুঁকে রাজীব বলে, টাকার অঙ্কটা হিউজ। মানুষের লোভকে খুঁচিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। যে কোনও লোককে, এমনকি ওয়ার্ল্ডের সবচেয়ে হদ্দ কাওয়ার্ডও এর জন্য মরিয়া হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু সেটা হবে ভয়ঙ্কর রকমের ঝুঁকি। নতুন আরেকটা সতর্কবাণী উচ্চারণ করে পলকহীন স্থির চোখে সে তাকিয়ে থাকে।

সুবর্ণা বিশাল অঙ্কের পুরস্কার সম্পর্কে বিন্দুমাত্র কৌতূহল প্রকাশ করে না। নিস্পৃহ গলায় বলে, আমার শ্বশুরমশাইকে ওষুধ খাওয়াতে হবে, দাদাশ্বশুরের ডিনার খাওয়ার সময় হয়েছে, দেবীর কালকের পড়াগুলো দেখিয়ে দেওয়া দরকার। আমি কি এখন যেতে পারি?

রাজীব সুবর্ণার দিক থেকে চোখ ফেরাল না। ধীরে ধীরে বলল, হ্যাঁ, যান।

.

০৬.

হল-ঘরের মাঝখানে গ্র্যান্ড ফাদার ক্লকটায় এখন সাতটা বেজে পঁয়ত্রিশ। সেতারের ঝংকার তুলে সেটা বেজে যাচ্ছিল।

ঘড়িটার পাশ দিয়ে প্রথমে নিজের ঘরে চলে আসে সুবর্ণা।

দেবী বিছানায় বসে বই-টই নাড়াচাড়া করছিল। রাজীবকে দেখার পর যে প্রাথমিক ভয়টা পেয়েছিল তার খানিকটা কেটে গেলেও মেয়েটার চোখেমুখে এখনও আতঙ্কের ছাপ লেগে আছে। পড়ায় মন বসাতে পারছিল না সে।

দেবীর পাশে বসে তার পিঠে একটা হাত রেখে সুবর্ণা বলে, কাল স্কুলে কী কী পড়া আছে?

দেবী ইংরেজি গ্রামার, ভূগোল, এরিথমেটিক, বাংলা কবিতা, বিজ্ঞান আর ইতিহাসের বই খুলে পাঠ্য বিষয়গুলো দেখিয়ে দেয়।

সুবর্ণা পাঁচটা অঙ্ক কষতে দিয়ে দেবীকে বলে, এগুলো করে ফেল। আমি ক’টা কাজ সেরে আসি। তারপর বাকি পড়াগুলো করিয়ে দেব।

দেবী আস্তে মাথা নাড়ে।

সুবর্ণা এবার শ্বশুরের ঘরে আসে। সংগ্রামনারায়ণ বিকেলে যে নতুন ট্যাবলেটটা খেয়েছিলেন তার মধ্যে কড়া সিডেটিভ ধরনের কিছু রয়েছে। কিছুক্ষণ আগে যখন রাজীবকে নিয়ে ওঁর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে গিয়েছিল, তিনি চোখ মেলতে পারছিলেন না। এখন গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছেন। অথচ ফুসফুসকে সতেজ রাখার জন্য একটা ক্যাপসিউল রাত আটটার ভেতর খাওয়ানো দরকার। ডাক্তার স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন, সময়ের এতটুকু এদিক-ওদিক যেন না হয়। সেটা সংগ্রামনারায়ণের পক্ষে ক্ষতিকর হবে।

সুবর্ণা খাটের পাশে দাঁড়িয়ে ডাকে, বাবা–বাবা–

সংগ্রামনারায়ণের সাড়াশব্দ নেই। শুধু শ্বাস টানা আর শ্বাস ফেলার তালে তালে বুকটা ধীরে ধীরে ওঠানামা করছে। কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর সংগ্রামনারায়ণ অস্ফুটে বললেন, উঁ–

একটু উঠুন। ওষুধ খেতে হবে।

দাও–

খাটের পাশেই একটা নিচু সাইড টেবলে নানা আকারের শিশি আর স্ট্র্যাপের ভেতর বহু রকমের ওষুধ। সারা দিনে ষোলো সতেরোটা ট্যাবলেট এবং ক্যাপসিউল খেতে হয় সংগ্রামনারায়ণকে। গাদা গাদা ওষুধ তার নির্জীব হৃৎযন্ত্রকে খানিকটা সচল রেখেছে।

টেবলটায় ক্যাপসিউল ট্যাপসিউল ছাড়াও রয়েছে বড় ওয়াটার বটলে ফোঁটানো বিশুদ্ধ জল আর কয়েকটা কাঁচের গেলাস, চামচ, প্লেট ইত্যাদি। এক গেলাস জল। আর একটা ক্যাপসিউল নিয়ে সংগ্রামনারায়ণের কাছে এসে দাঁড়াল সুবর্ণা। তিনি চোখ খুললেন না, ঘুমের আচ্ছন্নতার মধ্যে মাথাটা সামান্য তুলে হাঁ করলেন।

ওষুধ এবং জল খাইয়ে মুখ মুছিয়ে দিতেই সংগ্রামনারায়ণের মাথাটা ফের নরম বালিশের ভেতর ডুবে গেল। সুবর্ণা জিজ্ঞেস করল, রাতে কী খাবেন বাবা?

ঘুমন্ত গলায় সংগ্রামনারায়ণ বললেন, কিছু না। আমাকে ঘুমোতে দাও।

মানুষটা ভয়ানক বদরাগী এবং জেদী। রাজত্ব না থাকলে কী হবে, উগ্র রাজকীয় মেজাজটা এখনও তার মধ্যে থেকে গেছে। দেড়শ বছরের প্রাচীন রাজবংশের দুর্বিনীত রক্ত যে তার শিরায় শিরায় বয়ে চলেছে, এক মুহূর্তের জন্য তিনি তা ভুলতে পারেন না এবং চারপাশের মানুষজনকে ভুলতে দেনও না। তার অহংকার, ক্রোধ আর প্রতাপ যে কতটা বিধ্বংসী সেটা সুবর্ণার চেয়ে কে আর ভাল জানে। তিনি যা স্থির করবেন সেটাই চূড়ান্ত, তার ওপর আর কথা নেই।

সুবর্ণা বেরিয়ে যাচ্ছিল, জড়ানো গলায় সংগ্রামনারায়ণ বললেন, তোমার সেই আত্মীয়টির থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছ তো?

ওষুধের ঘোরের মধ্যেও তার মস্তিষ্ক পুরোমাত্রায় সক্রিয়। দু’টো স্ট্রোক সংগ্রামনারায়ণকে প্রায় পঙ্গু করে দিয়েছে। তবু মাথাটা তার পরিষ্কার, কিছুই ভোলেন না। এমন কি কড়া ওষুধের কারণে এখন এই আচ্ছন্নতার মধ্যেও রাজীবের কথা তার মনে আছে। সুবর্ণা বলল, হ্যাঁ, বাবাঘর থেকে বেরিয়ে সে সোজা কিচেনের দিকে চলে গেল। লক্ষ করল, রাজীব হল-ঘরে নেই। খাওয়া শেষ করে কখন যেন শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে চলে গেছে।

রান্নাঘরে পা দিতেই হাতের ইশারায় সুবর্ণাকে তার কাছে যেতে বলল মায়া।

সুবর্ণা ক’পা এগিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার?

মায়া চুপচাপ বসে ছিল। উঠে দাঁড়িয়ে চাপা, ভয়ার্ত গলায় বলল, এ আপনি কাকে বাড়ির ভেতর নিয়ে এসেছেন বৌদিদি?

একটু চমকে ওঠে সুবর্ণা। বলে, কেন, কী হয়েছে?

লোকটা ভাল নয়।

কী করে বুঝলে?

চেহারাটা ডাকাতদের মতো। মায়ার চোখে চোখ রেখে সুবর্ণা বলে, চেহারা দেখে কি সবসময় ভালমন্দ বোঝা যায়?

মায়া বলল, শুধু চেহারাই না–’

তাহলে?

ওর কাছে একটা পিস্তল আছে।

সুবর্ণার খানিক আগের চমকটা এবার বদলে গিয়ে দ্রুত মাথার ভেতর প্রবল দুশ্চিন্তার সৃষ্টি করে। রাজীবের সঙ্গে যে মারণাস্ত্র রয়েছে সেটা দেবী আর সে ইতিমধ্যেই জেনে ফেলেছে। বাড়ির অন্য কেউ, বিশেষ করে কাজের লোকেরা জানুক, তা একেবারেই বাঞ্ছনীয় নয়। ঘাবড়ে গিয়ে তারা কিছু করে বসলে গোটা পরিবারের পক্ষে প্রচণ্ড ক্ষতির সম্ভাবনা।

সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, পিস্তল যে আছে, তুমি জানলে কী করে?

আপনি যখন দারোগাবাবুর সঙ্গে কথা বলতে গেলেন ওই লোকটা খাওয়া ফেলে সিঁড়ির পাশের মোটা থামটার আড়ালে গিয়ে পিস্তল বের করে দাঁড়িয়ে ছিল।

এ বাড়ির কাজের লোকেরা কোনও ব্যাপারেই কৌতূহল প্রকাশ করে না। কিন্তু রাজীবকে দেখার পর থেকেই মায়া তার সম্পর্কে সন্দিগ্ধ হয়ে আছে। সুবর্ণা ভাবল, সে যখন নিচে ওসি’র সঙ্গে কথা বলছে, মায়া ওর ওপর নিশ্চয়ই লক্ষ রাখছিল। বলল, কোনও ভয় নেই। যেমন কাজ করছিলে করে যাও। শুধু ওর সম্বন্ধে কাউকে কিছু বলবে না।

মায়ার গলার কাছ’টা উৎকণ্ঠায় ভীষণ কাঁপছিল। বলল, আমাদের বিপদ হবে না তো?

ঠিক এই প্রশ্নটা দেবীও করেছিল। ভঙ্গুর একটু হেসে সুবর্ণা মায়ার ভীতিটা উড়িয়ে দেবার সুরে বলল, না না, কীসের বিপদ। বলল বটে, মনে মনে সে কিন্তু জানে তার এই ভরসা দেওয়াটা কতখানি দুর্বল আর অর্থহীন।

মায়া তবু কী বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে দিয়ে সুবর্ণা ফের বলে, আমি দাদাভাইয়ের ঘরে যাচ্ছি। তুমি ওঁর রাতের খাবারটা নিয়ে এস। ওই সঙ্গে এক ডেকচি গরম জল আর তোয়ালে। বলেই চলে যায়।

শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে একটা সোফায় কাত হয়ে বসে ছিল রাজীব। দু’দিন পর স্নান করে, প্রচুর পরিমাণে ভাত মাংস টাংস খেয়ে ক্লান্তি অনেকখানি কেটে গিয়েছিল তার। পেটে ভাত পড়লে যা হয়, চোখে ঢুল আসছিল কিন্তু নিজেকে। ঘুমিয়ে পড়তে দিচ্ছিল না সে। রাত্রিবেলা নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত তার পক্ষে ঘুমনো সম্ভব নয়। চোখ মেলে রেখে অন্যমনস্কর মতো সে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে লক্ষ করছিল।

সেই আগের মতোই ডিভানে বসে বিহ্বলের মতো তাকিয়ে আছে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ। মুখে সেইরকমই শব্দহীন, অবোধ হাসি।

সুবর্ণা ঘরে ঢুকতেই সোজা হয়ে বসল রাজীব। তার দিকে একপলক তাকিয়ে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের পাশে গিয়ে দাঁড়াল সুবর্ণা। বলে, রাত হয়েছে। এবার খেয়ে শুয়ে পড়তে হবে। রাজীবকে দেখিয়ে বলল, ইনিও এই ঘরে শোবেন। আপনার অসুবিধা হবে না।

কোনওরকম প্রতিক্রিয়াই দেখা গেল না। গাছ, পাথর বা অচেতন বস্তুর সঙ্গে কথা বললে যেমন উত্তর পাওয়া যায় না, এখানেও ঠিক তা-ই। মুখে সেই অদ্ভুত হাসিটি নিয়ে একইভাবে তাকিয়ে রইলে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ।

হঠাৎ রাজীব বলে ওঠে, আই উইদড্র মিসেস সিংহ।

তার কথাটা বুঝতে না পেরে সুবর্ণা একটু অবাকই হল।

রাজীব বলে, তখন বলেছিলাম, আপনার গ্র্যান্ডফাদার-ইন-ল’র হাসি এবং তাকানোটা অ্যাক্টিং হতে পারে। এখন দেখছি, না, ওটা রিয়াল।

সুবর্ণা উত্তর দিল না।

রাজীব ফের বলে, ওল্ড এজে পঙ্গু, অকর্মণ্য, স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে বেঁচে থাকাটা হরিবল ব্যাপার।

একজন নিষ্ঠুর উগ্রপন্থী, যার কাছে মৃত্যু বা হত্যা চাঞ্চল্যকর কোনও ঘটনাই নয়, যার মাথার ওপর পঞ্চাশ লক্ষ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে, যার কাছে বাঁচা এবং মরার মাঝখানে পার্থক্যটা বড়ই ক্ষীণ, বড়ই সূক্ষ্ম শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের এই পরিণতিতে সে যে বিচলিত হতে পারে, সেটাই অবাক করার মতো ব্যাপার।

মায়া গরম জল এবং দুধ খইটই নিয়ে আসে।

সুবর্ণা তোয়ালের একটা প্রান্ত গরম জলে ভিজিয়ে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের হাত পা মুখ সযত্নে মুছিয়ে ধরে ধরে তার খাটে নিয়ে বসিয়ে দেয়।

শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের জন্য জল এবং খাবার দিয়ে মায়া পালাতে চাইছিল। যেখানে একজন বিপজ্জনক আগন্তুক বসে আছে তার ধারে কাছে থাকাটা নিরাপদ নয়। কিন্তু তক্ষুণি আর যাওয়া হল না।

সুবর্ণা বলে, আমাদের স্টোরে বড় আলমারিতে বাড়তি লেপ তোষক মশারি টশারি আছে। সেগুলো এনে এ ঘরের ডিভানে বিছানা করে দাও।

আচ্ছা–

মায়া চলে যেতেই শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে খাওয়ানোর তোড়জোড় শুরু করে সুবর্ণা। গরম দুধে খই ঢালতেই সঙ্গে সঙ্গে মিইয়ে যায়। তার সঙ্গে চিনি মিশিয়ে চামচে করে মুখে দিতে থাকে সে।

এই বয়সে, বিশেষ করে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের মতো মানুষের ক্ষুধাতৃষ্ণার বোধটাই মরে যায়। অন্যমনস্কর মতো মুখের ভেতর খই দুধ নাড়াচাড়া করতে । থাকেন তিনি। অবিকল বাচ্চাদের মতো। খানিকটা পেটে যায়, খানিকটা কষ বেয়ে। গড়িয়ে পড়ে। নরম পাকের পুরো একটা সন্দেশও খাওয়ানো যায় না, অর্ধেকের বেশিটাই পড়ে থাকে।

শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের খাওয়ার পালা চুকতে আধ ঘণ্টা লেগে যায়। তারপর তাকে শুইয়ে, খাটের মশারি ফেলে, চারপাশে গুঁজে দিয়ে সুবর্ণা বলে, দাদাভাই ঘুমিয়ে পড়ুন।

এদিকে ডিভানে বিছানা পেতে মশারি খাঁটিয়ে দিয়ে গিয়েছিল মায়া। রাজীবের দিকে ফিরে সুবর্ণা বলে, আমি এবার যাব। ইচ্ছা করলে আপনি শুয়ে পড়তে পারেন।

রাজীব বলে, হ্যাঁ, শুয়েই পড়ব। ঘুম পাচ্ছে।

কী ভেবে সুবর্ণা বলে, দরজা ভেতর থেকে নিশ্চয়ই বন্ধ করে দেবেন?

রাজীব বলে, তা তো দিতেই হবে। আমার সেফটির ব্যাপার আছে না?

তার ইঙ্গিতটা বুঝতে পারল সুবর্ণা। দরজা খুলে ঘুমিয়ে পড়লে সে লোজন ডাকতে পারে, পুলিশকে খবর দিতে পারে। অর্থাৎ নিজের নিরাপত্তার চিন্তাটা এক মুহূর্তের জন্য ভোলে না রাজীব। সুবর্ণা একটু হেসে বলে, আমি কিন্তু আপনার কথা ভাবিনি। দাদাভাই রাত্তিরে ঘুমিয়ে পড়লে আমরা বাইরে থেকে দরজার শেকল তুলে দিই। তবু নজর রাখতে হয়। কেননা হঠাৎ হঠাৎ উঠে ঘুমের ঘোরে ঘুরে বেড়ানো ওঁর অভ্যাস।

নাইট ওয়াকার?

হ্যাঁ। একবার শেকল লাগাতে ভুলে গিয়েছিলাম। অন্ধকারে উনি ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির মুখ পর্যন্ত চলে গিয়েছিলেন। নেহাত সেই সময় আমার ঘুমটা ভেঙে যায়, নইলে সর্বনাশ হয়ে যেত।

আপনি কি রোজ রাত্তিরে উঠে উঠে ওল্ড ম্যানটিকে দেখে যান?

তা তো দেখতেই হয়। আমি একটু কষ্ট করলে একটা মানুষ যদি আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারে, সেটা করব না?’ বলে বেরিয়ে যায় সুবর্ণা।

অবাক রাজীব ধীরে ধীরে উঠে দরজায় ছিটকিনি এবং খিল, দু’টোই লাগিয়ে দেয়।

.

০৭.

নিজের ঘরে এসে ঘণ্টাদেড়েক ধরে দেবীর কালকের স্কুলের পড়াগুলো করিয়ে দেয় সুবর্ণা। কাল তার নিজেরও অনার্সের দু’টো ক্লাস আছে। দেবীকে পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে কিছু রেফারেন্সের বই দেখে নেয় সে। ভাল পড়ায়, ভাল নোট দেয়। তাই তার কাছে ছাত্রছাত্রীদের দাবি অনেক। তাদের প্রত্যাশা কখনও অপূর্ণ রাখে না সুবর্ণা।

পড়াটড়া হয়ে গেলে তাড়াতাড়ি খাওয়ার পালা চুকিয়ে শুয়ে পড়েছিল তারা। মস্ত খাটে সে আর দেবী পাশাপাশি শোয়। তাদের লেপ আলাদা। কাউকে জড়িয়ে। ধরে ঘুমোতে অস্বস্তি হয় দেবীর। আজ কিন্তু তার লেপের ভেতর ঢুকে মাকে আঁকড়ে ধরে, গায়ের সঙ্গে লেপটে শুয়েছে মেয়েটা। ঘুমের মধ্যেও মাঝে মাঝে। কেঁপে উঠছে। কারণটা অনুমান করতে পারছিল সুবর্ণা। রাজীবের জন্য তার সুস্থ, স্বাভাবিক মেয়েটা ফিয়ার সাইকোসিস অর্থাৎ ভয়ে মানসিক রোগের শিকার না হয়ে পড়ে। দেবী তার জীবনের অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে। স্বামী বিক্রমের সঙ্গে সুবর্ণার আদৌ কোনও সম্পর্ক নেই। সে এ বাড়ি ছেড়ে দশ বছর আগে চলে গেছে, কোনওদিনই আর ফিরবে না। দাম্পত্যজীবন মেয়েদের কাছে বুঝিবা সবচেয়ে মূল্যবান ঐশ্বর্য। সেদিক থেকে সুবর্ণা একেবারে নিঃস্ব। বিক্রমের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর সেই শূন্যতার বেশির ভাগটাই ভরাট করে দিয়েছে দেবী। কলেজে তার একটা ভাল চাকরি আছে, থাকার জন্য বিশাল প্রাসাদ আছে, আছে অসংখ্য গুণমুগ্ধ ছাত্রছাত্রী, বহু মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব। কিন্তু এসব দিয়ে কি দাম্পত্য জীবনের রিক্ততা পূরণ হয়? ভেতরে ভেতরে কবেই ক্ষয়ে ক্ষয়ে সে শেষ হয়ে যেত। হয় যে নি, তার কারণ দেবী। মেয়েটা নিজের অজান্তে অবিরল তার বেঁচে থাকার শক্তি জুগিয়ে চলেছে। সে সুবর্ণার আশ্রয়, অবলম্বন। শ্বাসবায়ুর মতো অপরিহার্য। রাজীবের জন্য দেবীর যদি কিছু হয়ে যায় সে বাঁচবে না।

আজ সন্ধের পর থেকে কয়েকটা ঘণ্টা এ বাড়িতে যে সব ভীতিকর, চমকপ্রদ আর দমবন্ধ করা ঘটনা ঘটে গেল তার চাপে স্নায়ুগুলো টান টান হয়ে গিয়েছিল সুবর্ণার। এখন, বিছানায় দামী লেপের আরামদায়ক উষ্ণতার ভেতর শরীর ঢেলে দেবার পর সেগুলো শিথিল হয়ে আছে। একটানা দীর্ঘ সময় উত্তেজনা এবং আতঙ্কের অসহনীয় চাপ আজকের মতো খানিকটা কেটে গেলেও ঘুম আসছে না। বার বার রাজীবের চিন্তাটা ঘুরে ঘুরে তার মস্তিষ্কে হানা দিতে থাকে। সেই সঙ্গে কোনও কার্যকারণ ছাড়া হঠাৎ অদৃশ্য মঞ্চের পর্দা সরে গিয়ে তার নিজের জীবনের নানা দৃশ্য ফুটে উঠতে লাগল। অলৌকিক নাটকের মতো। অলৌকিক হয়েও কিন্তু রিয়াল।

রাজীবের মতো সেও ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ চোদ্দ বছর আগে ঢুকে পড়েছিল। তবে ওর মতো গায়ের জোরে, আতঙ্কের একটা পরিবেশ তৈরি করে নয়। সে এখানে এসেছিল ভয়ে ভয়ে, সসঙ্কোচে, বিক্রমের পেছনে পেছনে রুদ্ধশ্বাসে।

.

সুবর্ণাদের বাড়ি শিলিগুড়িতে। বাবা ছিলেন পি ডর ডি’র সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। আই. এ পাশ মা নেহাতই হাউসওয়াইফ, ঘর-সংসারে আবদ্ধ আর দশজন মহিলার মতো আদ্যোপান্ত সুগৃহিণী।

সুবৰ্ণারা দুই ভাইবোন। দাদা গৌতম অল ইন্ডিয়া ব্যাঙ্কিং সারভিসের পরীক্ষা দিয়ে একটা নাম-করা শিডিউল্ড ব্যাঙ্কে ঢুকেছিল। পোমোশন পেয়ে পেয়ে ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হয়েছে। আপাতত আছে দিল্লিতে। আর সে নিজে হিস্ট্রিতে ভাল রেজাল্ট করে প্রতাপপুরের রানী স্বর্ণময়ী কলেজ’-এর লেকচারার হয়ে এসেছিল পনের বছর আগে। থাকত কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতর অধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের জন্য নির্দিষ্ট হস্টেলে। সে এই শহরে আসার সঙ্গে সঙ্গে তার পড়ানোর এবং সৌন্দর্যের খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

যদিও রাজতন্ত্র আর নেই, গভর্নমেন্টের শিক্ষা বিভাগ ফি বছর বিরাট অঙ্কের গ্রান্ট দেয়, তবু প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে রানী স্বর্ণময়ী কলেজ’-এ রাজবংশের মর্যাদা অপরিসীম। তাছাড়া কলেজের নামে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের বাবা অর্থাৎ বিক্রমের প্রপিতামহ রাজা বিজয়েন্দ্রনারায়ণ পঁচিশ লক্ষ টাকার একটা ফান্ড করে গিয়েছিলেন। সেই টাকার ব্যাঙ্ক ইন্টারেস্ট থেকে কলেজের যাবতীয় খরচের অনেকটাই উঠে আসে।

নেটিভ স্টেটগুলো ভারতীয় প্রজাতন্ত্রে মিশে যাবার সময় ঠিক হয়েছিল রাজবংশের কেউ একজন সব সময়ই কলেজের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান হবেন। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকার রাজপরিবারের সঙ্গে এই চুক্তিটিকে কখনও অমর্যাদা করেনি। সুবর্ণা যখন লেকচারশিপ নিয়ে আসে, বিক্রম ছিল চেয়ারম্যান।

স্বাভাবিক কারণেই সুবর্ণার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বিক্রমের। তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় গুঁজে পড়েছিল সে। যখন তখন হস্টেলে চলে আসত। সুবর্ণাকে তার টু-সিটার স্পোর্টস-কারে তুলে নিয়ে শহর থেকে হাইওয়ের দিকে চলে যেত। কোনওদিন বা পঞ্চাশ মাইল দূরে পাহাড়ের গায়ে ছবির মতো একটা লেকের ধারে, যেটা চমৎকার টুরিস্ট স্পট। ছোট্ট মোটরবোটে দুরন্ত স্পিড তুলে লেকের জল তোলপাড় করে তারা যেন উড়তে থাকত।

আভাসে ইঙ্গিতে কলিগদের কেউ কেউ বিক্রম সম্পর্কে সুবর্ণাকে সতর্ক করে দিয়েছিল। কিন্তু বিক্রম দুশ্চরিত্র, লম্পট, প্লে-বয় টাইপের ছেলে–এসব সতর্কবার্তা তার এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে যেত। তখন সবে তেইশে পা দিয়েছে সুবর্ণা। একজন সত্যিকারের সুপুরুষ তরুণ রাজপুত্র তার জন্য উন্মাদ হয়ে উঠেছে, এটা তার যুবতী হৃদয়ের অহংকারকে যেন শতগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। অল্প বয়সে প্রিন্স অ্যান্ড আ স্ট্রিট গার্ল’ নামে একটা সিনেমা দেখেছিল সে, কিংবা ওই নামের বইও পড়ে থাকতে পারে। সেখানে এক রাজকুমার পথের এক গরিব অনাথ মেয়েকে ভালবেসে বিয়ে করেছিল। এও তেমনই এক অবিশ্বাস্য কাহিনী। সে রাস্তার মেয়ে নয়, সাধারণ মিডল ক্লাস ফ্যামিলিতে তার জন্ম। একেবারেই কমোনার-অনভিজাত। তার বেলায় কাহিনীর নামটা একটু বদলে দেওয়া যেতে পারে–প্রিন্স অ্যান্ড আ কমন গার্ল। একটি কৌলিন্যহীন, অখ্যাত মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ের পক্ষে একজন রাজপুত্রকে জয় করে নেওয়ার মধ্যে প্রচণ্ড উন্মাদনা থাকে। ব্যাপারটা প্রায় রূপকথার মতো। সুবর্ণা যেন রঙিন বাতাসে স্বপ্নের ঘঘারে ভেসে বেড়াচ্ছিল।

পরিচয়ের একমাসের মাথায় বিক্রম বলেছিল, তোমাকে ছাড়া বাঁচব না সুবর্ণা। আমি একটা ডিসিসান নিয়ে ফেলেছি।

সুবর্ণা জিজ্ঞেস করেছিল, কীসের ডিসিসান?’

এক উইকের ভেতর আমরা বিয়ে করছি। তবে

তবে কী?

আমার বাবাকে তা জানানো যাবে না। তুমি অবশ্য তোমাদের বাড়িতে জানাতে পারো।

সুবর্ণা চমকে উঠেছিল, তোমার বাবাকে জানানো যাবে না কেন?

বিক্রম জানিয়েছে, দেড়শ বছরের ইতিহাসে তাদের বংশের ছেলেমেয়েদের ভারতবর্ষের অন্য রাজপরিবারে ছাড়া আর কোথাও বিয়ে হয়নি। সুবর্ণাকে সে বিয়ে করলে সেটা হবে ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এর পক্ষে পৃথিবীকে রসাতলে পাঠানোর মতো একটা দুর্ঘটনা। দেড়শ বছর ধরে বিভিন্ন প্রজন্মের মধ্যে যে রক্তধারা বয়ে চলেছে তা বিশুদ্ধ থাকুক, সেদিকে তার বাবা সংগ্রাম নারায়ণের তীক্ষ্ণ নজর। রাজত্ব নেই, রাজতন্ত্র নেই, তবু আত্মম্ভরিতাকে যখের মতো আগলে রেখেছেন তিনি। তুচ্ছ, হেজিপেজি ঘরের ছেলেমেয়েকে বিয়ে করে প্রতাপপুর রাজ-পরিবারের বংশধরেরা নিষ্কলঙ্ক রাজরক্তের সঙ্গে কমোনারের রক্ত মিশিয়ে দূষিত করে ফেলুক সেটা তিনি কিছুতেই হতে দেবেন না। পুত্রবধূ হিসেবে সুবর্ণাকে মেনে নেওয়া তার পক্ষে অসম্ভব।

শুনতে শুনতে গলা শুকিয়ে গিয়েছিল সুবর্ণার। এস্ত ভঙ্গিতে সে জিজ্ঞেস করেছে, তা হলে?

বিক্রম হেসেছে, বাবা মেনে নেবেন না বলে আমি পিছিয়ে যাব? রয়ালটি নেই। ইন্ডিয়ান ডেমোক্রেসিতে মুদি, মাছওলা, সুইপারের ভোটের যা দাম, আমাদেরও তাই। এক্স রাজা-মহারাজাদের জন্যে স্পেশাল কোনও খাতিরের ব্যবস্থা নেই কনস্টিটিউশনে। রাজা টাজা আর কমোনাররা একদিন একাকার হয়ে যাবে। আমাদের বংশে সেই প্রসেসটা আমিই শুরু করব তোমাকে বিয়ে করে। এটা একরকম রেভোলিউশনই বলতে পার। প্রতাপপুর রয়াল ফ্যামিলিতে আমিই প্রথম রেবেল।

সুবর্ণা জানতে চেয়েছে, তোমার বাবা মেনে না নিলে বিয়েটা হবে কী করে?

গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া অ্যাডাল্ট ইয়াং ম্যান আর ইয়াং গার্লদের জন্যে প্রচুর সুবিধা করে দিয়েছে। ইনডিপেনডেন্সের পর এই প্রতাপপুর সিটিতে মিনিমাম এক ডজন ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন অফিস হয়েছে। এখন বিয়ে করাটা কি কোনও প্রবলেম? তবে–

কী?

এবার বিক্রম যা উত্তর দিয়েছিল তা এইরকম। তার বাবার বিয়ে হয়েছিল সাউথ বেঙ্গলের এক রাজবাড়িতে। ঠাকুরদা বিয়ে করেছিলেন মধ্যপ্রদেশের এক নেটিভ স্টেটের প্রিন্সেসকে। একমাত্র পিসিমার বিয়ে হয় উদয়পুর স্টেটে। ঠাকুরদার বাবা কি তার বাবা আর ঠাকুরদাদের কথা না হয় বাদই দেওয়া হল। কারণ প্রতাপপুর স্টেটের তখন বিপুল অর্থ, প্রচণ্ড প্রতাপ এবং দেশ জুড়ে খ্যাতি। অন্য দেশীয় রাজ্যগুলো এই বংশের ছেলেমেয়েদের জামাতা বা বন্ধু হিসেবে পাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকত। ফলে পূর্বপুরুষদের যে সব বিয়ে হয়েছে তার জাঁকজমক শুধু স্বপ্নেই দেখা যায়। ঠাকুরদার আমলে কিংবা তার পরে কিছুকাল রাজতন্ত্র চালু থাকলেও নানা কারণে রাজবংশের গৌরব অনেকটাই পড়তির দিকে। তবু তার বাবা এবং পিসির বিয়েতে দশ মণ করে বাজি পুড়েছিল। ইন্ডিয়ার নাইনটি পারসেন্ট নেটিভ স্টেটের রাজা বা প্রিন্সরা নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন। আর । এসেছিলেন গভর্নর জেনারেল, হাইকোর্টের চিফ জাস্টিস, আর্মি কমান্ডার, বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা, ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট থেকে দেশের বিখ্যাত সব পার্সোনালিটি। কলকাতা থেকে নাম করা সানাইওয়ালারা আর দশটা মিলিটারি ব্যান্ডপার্টি এসে। দু’সপ্তাহ ধরে বাজিয়ে গিয়েছিল। স্টেটের কোনও বাড়িতে সাতদিন রান্না চড়েনি। সমস্ত প্রজা রাজবাড়িতে ভোজ খেয়েছে। প্রতাপপুর সিটি ফেরারি টেলসের কোনও শহরের মতো অজস্র রং আর আলোয় সেজে উঠেছিল। গেস্টদের হাতির পিঠে রুপোর ছত্রির তলায় বসিয়ে চারিদিকে ঘোরানো হয়েছিল। তাদের কেউ কেউ লেকের ওধারের জঙ্গলে শিকার খেলতে গিয়েছিলেন।

বিক্রম একটানা বলে যাচ্ছিল, আলো, সানাই, ব্যান্ডপার্টি, হাতি, ঘোড়া, রোলস রয়েস গাড়ির মিছিল, শিকার, হীরে, মুক্তো, পান্না, সোনার মোহর, দামী দামী পোশাক, প্যালেস জুড়ে বিলিতি পারফিউমের সুগন্ধ আর সারাদিন ভোজ সব মিলিয়ে সেই গ্র্যাঞ্জার সেই পেজেন্ট্রি তুমি ভাবতেও পারবে না। কিন্তু—

নিঃশ্বাস বন্ধ করে যেন অলীক এক রূপকথার গল্প শুনে যাচ্ছিল সুবর্ণা। এবার জিজ্ঞেস করেছে, কিন্তু কী?

বিক্রম বলেছে, আমাদের বিয়েতে এসব কিছুই হবে না। রাজত্ব টাজত্ব চলে যাবার পর অত খরচ করার ক্ষমতা আমাদের নেই। যেটুকু আছে, তোমাকে বিয়ে করলে বাবা একটা পয়সা তো বার করবেনই না, বরং যতভাবে বাধা দেওয়া সম্ভব দেবেন। আড়াইশো টাকা খরচ করে ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন অফিসে কাজটা চুকিয়ে ফেলতে হবে।

এমন সাদামাঠা, গোপন বিয়েতে মন একেবারেই সায় দিচ্ছিল না সুবর্ণার।. একটু তরুণীর জীবনে বিয়েকে ঘিরে অনেক আশা, অনেক স্বপ্ন থাকে। কিন্তু তার কতটুকুই বা পূরণ হবে? মনে হচ্ছিল, নিঃশব্দে চুরি করে সে কিছু একটা পেতে চলেছে। কিন্তু বিক্রমকে নিয়ে সুবর্ণা এমনই আচ্ছন্ন যে এসব তাকে বলা যায়নি। শুধু ঝাপসা গলায় জিজ্ঞেস করেছে, ঠিক আছে, তুমি যা বললে তাই হবে। কিন্তু বিয়ের পর আমরা কোথায় থাকব?’

কোথায় আবার, আমাদের বাড়িতে।

কিন্তু তোমার বাবা?

সুবর্ণার দ্বিধা বা ভীতিটা কী কারণে সেটা বুঝতে পারছিল বিক্রম। তার কাঁধে একটা হাত রেখে বলেছিল, যুদ্ধটা কি আমার একার? আমাদের বংশের ট্র্যাডিশনটা আমার সঙ্গে তুমিও তো ভাঙছ। বিয়ে যখন হচ্ছেই, লিগালি তুমি প্রতাপপুর রয়াল ফ্যামিলির বৌ হবে। ইউ মাস্ট এস্টাব্লিশ ইওর রাইটস। কী, পারবে না?

বিক্ৰম কথা বলত চমৎকার। একেবারে মুগ্ধ হয়ে শোনার মতো। একজন। কমোনারকে রাজবাড়িতে তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে, সুবর্ণার কাছে হঠাৎ এটা দারুণ উত্তেজক অ্যাডভেঞ্চারের মতো মনে হয়েছিল। ভয়টা খানিক কাটিয়ে সে বলেছিল, চেষ্টা করব।

দ্যাট শুড বি দা স্পিরিট।

বিয়ের ব্যাপারে শিলিগুড়িতে গিয়ে মা, বাবা এবং দাদার সঙ্গে কথা বলেছিল সুবর্ণা। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি মেয়ে আর রাজবংশের একটি ছেলে–পার্থক্যটা এত বিশাল যে সে সুখী হতে পারবে কি না, কিংবা তার। বিবাহিত জীবন শেষ পর্যন্ত অটুট থাকবে কি না–এ নিয়ে বাড়ির সবার ভীষণ। দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল উন্মাদনার বশে বিয়ের এই সিদ্ধান্তটা খুবই হঠকারী। তারপর যখন শুনলেন, ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন অফিসে গিয়ে চুপচাপ বিয়েটা। সারতে হবে তখন মা-বাবা আর দাদার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়।

অবশ্য মা-বাবা চিরদিনই যথেষ্ট লিবারাল। ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে, তারা সুশিক্ষিত। সন্তানদের ওপর নিজেদের মতামত, পছন্দ-অপছন্দ বা ইচ্ছা অনিচ্ছা কখনও চাপিয়ে দেননি। শুধু শুভাকাঙ্ক্ষীর মতো পরামর্শ দিয়েছিলেন, ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন অফিসে যাবার আগে সমস্ত দিক যেন ভাল করে ভেবে নেয় সুবর্ণা।

বাড়ির সবার প্রচণ্ড সংশয় আর দুর্ভাবনা থাকলেও বিয়েটা কিন্তু হয়ে গিয়েছিল। ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন অফিস থেকে বিক্রমের সঙ্গে সোজা ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ চলে গেছে সুবর্ণা। দোতলায় উঠে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে তারা প্রথমে প্রণাম করেছিল। তখন তাঁর স্মৃতি নষ্ট হতে শুরু করেছে। বিমূঢ়ের মতো তিনি তাকিয়ে ছিলেন শুধু। প্রণামের কারণটা বুঝে উঠতে পারছিলেন না।

সংগ্রামনারায়াণ কিন্তু প্রণাম করতে দেননি। বিয়ের কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তার মুখচোখ অসহ্য ক্রোধে লাল হয়ে উঠেছিল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে শরীরের সব রক্ত যেন সেখানে গিয়ে জমা হয়েছে। মনে হচ্ছিল তিনি ফেটে পড়বেন, কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে সিঁড়ির দিকে আঙুল বাড়িয়ে সুবর্ণাকে বলেছিলেন, নিচে নেমে যাও কক্ষণো দোতলায় উঠবে না। বিক্রমকে বলেছেন, শুয়ার, স্কাউড্রেল, রাস্তার একটা মেয়েকে ধরে এনে রাজবংশের এক গালে চুন, আরেক গালে কালি লাগালি? গেট আউট অফ মাই সাইট।’ বলে পা থেকে শুড়-তোলা এক পাটি চটি খুলে ছুঁড়ে মেরেছিলেন। সেটা সোজা বিক্রমের নাকে লেগে দরদর করে রক্ত ঝরতে শুরু করেছিল।

বিক্রম আগেই পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল, সংগ্রামনারায়ণ তাকে কোনওভাবেই গ্রহণ করতে চাইবেন না। কিন্তু অভ্যর্থনাটা এমন মারাত্মক অপমানজনক হবে, সুবর্ণা ভাবতে পারেনি। তার চোখের সামনে সমস্ত দৃশ্যাবলী ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল, পায়ের তলায় নরম কার্পেটে-মোড়া হল-ঘরটা ঢেউয়ের মতো দুলছিল, টলতে টলতে হুড়মুড় করে সে পড়েই যেত, বিক্রম হাত বাড়িয়ে। তার কাঁধটা ধরে ধীরে ধীরে একতলায় নামিয়ে এনেছিল। বিক্রমের স্পর্শের মধ্যে সহানুভূতি ছিল, ভরসা ছিল, ছিল গভীর মমতা।

বিক্রম বলেছিল, ফার্স্ট রাউন্ডটা বাবা জিতে গেলেন। উনি যে এতটা অফেন্সিভ হয়ে উঠবেন, ভাবতে পারিনি। নার্ভাস হয়ো না। আমাদের ম্যারেড লাইফ প্যালেসে সুদ হবে না, সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ। তবে ফাইট এক রাউন্ডেই শেষ হয় না, এটা একটা প্রোট্রাকটেড ওয়ার। আমাদের স্ট্র্যাটেজি ঠিক করে নিতে হবে।

সুবর্ণা উত্তর দেয়নি। অঝোরে কেঁদে যাচ্ছিল। তারই মধ্যে একটা কাজের লোককে দিয়ে তুলো, ডেটল এবং ব্যান্ড-এড আনিয়ে বিক্রমের ফাস্ট-এডের ব্যবস্থা করেছে সে। আর ভেবেছে দাম্পত্য জীবনের প্রথম দিনটি থেকে যে অসম্মান শুরু হল তা আদৌ শেষ হবে কি না। বিক্রম স্ট্র্যাটেজির কথা বলেছে। কিন্তু ভয়ঙ্কর ক্রোধী, হঠকারী, আত্মম্ভরী একটি মানুষ, যিনি প্রতাপপুর রাজবংশের প্রাচীন গৌরবের মধ্যে যক্ষের মতো বাস করেন, কমোনারদের সম্পর্কে যাঁর প্রবল ঘৃণা তাকে জয় করার মতো পৃথিবীতে কোনও রণকৌশল আছে কি না সুবর্ণার জানা নেই। ভেতরে ভেতরে সে ভীষণ ভেঙেচুরে যাচ্ছিল।

বিক্রম ফের বলেছে, আসলে রাজত্ব চলে যাওয়াটা বাবা গ্রেসফুলি মেনে নিতে পারেননি। যেদিন রাজতন্ত্র অ্যাবলিশড হল সেদিন থেকে তিনি খেপে আছেন। তার বিশ্বাস আমাদের সর্বস্ব গায়ের জোরে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। পৃথিবীর সবার ওপর, বিশেষ করে ইন্ডিয়ান ডেমোক্রেসির ওপর তার প্রচণ্ড রাগ। ক্রোধ ছাড়া তার মধ্যে আর কোনও ফিলিংই নেই। নাথিং লেফট একসেপ্ট ভায়োলেন্ট অ্যাঙ্গার। এত কাল ওঁর রাগের ধাক্কাটা বাড়ির সবাই সামলেছে। এখন থেকে তুমি হলে নতুন টার্গেট।

সুবর্ণা চুপ করে থেকেছে।

জুতোর বাড়িতে নাক ফেটে গেলেও সংগ্রামনারায়ণের প্রতি বিক্রমের মনোভাব ছিল সহানুভূতিশীল। বাবার আচরণ সম্পর্কে সে যা বলেছে তা মোটামুটি যুক্তিপূর্ণ। দেড়শ বছরের এক প্রাচীন রাজ-পরিবারের প্রতিপত্তি, মর্যাদা এবং স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়াটা তার বংশধরদের পক্ষে প্রচণ্ড ক্ষোভের ব্যাপার। অবিরল সেই ক্ষোভ থেকে সংগ্রামনারায়ণের মধ্যে ক্রোধের সৃষ্টি হয়েছে। নিজেকে সর্বক্ষণ তিনি একটা আগ্নেয়গিরি বানিয়ে রেখেছেন।

বিক্রম থামেনি, জঙ্গল থেকে বাঘ ধরে এনে ট্রেনিং দিয়ে বশ করা হয়, সেটা নিশ্চয়ই জানো?

প্রশ্নটার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ধরতে পারেনি সুবর্ণা। বিহ্বলের মতো জিজ্ঞেস করেছে, হাঁ জানি, কিন্তু হঠাৎ একথা?’

সিলিংয়ের দিকে আঙুল বাড়িয়ে মজার গলায় বিক্রম বলেছে, ওপরে যে ব্যাঘ্রটি আছেন তাকে বাগে আনার ওপর আমাদের ম্যারেড লাইফের পিস, হ্যাপিনেস অনেকটা নির্ভর করছে। টাইগার ট্রেনারের রোলটা নিতে পারবে কি? বাবা তোমাকে যেভাবে ইনসাল্ট করেছে তার একটা জবাব দেওয়া তো দরকার।

সংগ্রামনারায়ণ সম্পর্কে রণকৌশলের কথা বলেছে বিক্রম, বাঘ বশ করার দৃষ্টান্ত দিয়েছে, কিন্তু এসব কিছুই মাথায় ঢুকছিল না সুবর্ণার। সে শুধু ভেবেছিল, এখন থেকে সংগ্রামনারায়ণের সঙ্গে এক বাড়িতে তাকে থাকতে হবে। দোতলায় যাতে না যায় সে জন্য তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। কোনওদিন ওপরে যাবেও না সুবর্ণা। কিন্তু সংগ্রামনারায়ণ তো নিচে নেমে আসতে পারেন। কখন যে তিনি কী করে বসবেন তাই বা কে জানে। ভয়ে, আশঙ্কায় সে সিটিয়ে গিয়েছিল।

বিয়ের সময় কলেজ থেকে একমাস ছুটি নিয়েছিল সুবর্ণা। আগেই বিক্রমের কাছে জেনেছে, এ বাড়িটা পুরোপুরি পুরুষতান্ত্রিক। তার শাশুড়ি এবং দিদিশাশুড়ি কেউ জীবিত নেই, অনেকদিন আগে মারা গেছেন। বিক্রমের পিসিমার যখন বিয়ে হয় তখন ওর জন্মই হয়নি। ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এর সমস্ত কিছু কাজের লোকেরাই চালায়। রাজবাড়ির বৌ হিসেবে সংসারের দায়িত্ব সে নিজের হাতে তুলে নেবে তেমন দুঃসাহস সুবর্ণার হয়নি। নিজেকে সে একতলাতেই গুটিয়ে রেখেছিল। মায়া আর হরেন তখনও এ বাড়িতে কাজ করত। সকাল, দুপুর এবং রাত্তিরে ওপর থেকে খাবার এনে তাকে খাইয়ে যেত মায়া। সুবর্ণার মনে হত সে যেন শ্বশুরবাড়িতে নয়, কোনও একটা হোটেলে এসে উঠেছে। সংগ্রামনারায়ণের সেদিনের নিষ্ঠুর ব্যবহারে নিজেকে এখানে অবাঞ্ছিত মনে হল সুবর্ণার। তবে কাজের লোকেদের, বিশেষ করে হরেন আর মায়ার সহানুভূতি প্রথম থেকেই পেয়েছিল।

রাজবংশের ছেলের সঙ্গে মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি মেয়ের বিয়ের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল নানাভাবে–প্যালেসের ভেতরে যেমন, তেমনি বাইরেও। খবরটা জানাজানি হওয়ার পর উদয়পুর স্টেট থেকে বিক্রমের পিসিমা সংগ্রামনারায়ণকে কড়া চিঠি লিখেছিলেন। দেশের পুরনো দেশীয় রাজ্যগুলোতে যেসব আত্মীয়স্বজন ছড়িয়ে রয়েছেন, চিঠি লিখে বা ফোন করে ধিক্কার জানিয়েছিলেন। সবারই বক্তব্য, এই বিয়েটা প্রতাপপুর রাজ-পরিবারকে কলঙ্কিত করেছে, তার মর্যাদা রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছে। এ বিয়ে কোনওভাবেই মেনে নেওয়া উচিত হয় নি সংগ্রামনারায়ণদের।

এদিকে মা, বাবা এবং দাদা শ্বশুরবাড়িতে সুবর্ণা কেমন আছে, স্বচক্ষে দেখার জন্য শিলিগুড়ি থেকে ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ এসেছিলেন। মেয়ে জামাইয়ের সঙ্গে কথা বলে তারা যখন দোতলায় যেতে চাইলেন, বিক্রম বিব্রতভাবে বারণ করেছিল। কিন্তু শিষ্টাচার বলে একটা কথা আছে। এতদূর এসে কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে মেয়ের শ্বশুর এবং দাদাশ্বশুরের সঙ্গে দেখা না করে যাওয়াটা অভদ্রতা। তারা দোতলায় উঠতেই কুকুর বেড়ালের মতো তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। বাবা-মা এরপর আর কখনও এ বাড়িতে আসেননি।

সংগ্রামনারায়ণ মায়াকে দিয়ে সুবর্ণাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তার বাপের বাড়ি থেকে কেউ যেন ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ না আসে। মা-বাবা বা অন্য আত্মীয়স্বজন না এলেও দাদা কিন্তু মাঝে মাঝে এসে দেখা করে যেত। নিষেধাজ্ঞা সে মানে নি। দাদার কাছেই জানা গেছে মা-বাবা তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভীষণ শঙ্কিত; তারা একেবারে ভেঙে পড়েছেন।

এই দুঃসময়ে বিক্রম কিন্তু সারাক্ষণ সুবর্ণাকে আগলে আগলে রেখেছে। বিয়েটা ঘিরে যে উত্তেজনা এবং অশান্তি চলছিল তার কোনওরকম আঁচ যাতে তার গায়ে না লাগে সেদিকে বিক্রমের তীক্ষ্ণ নজর ছিল। সুবর্ণার দাম্পত্য জীবনের এটাই ছিল সবচেয়ে সেরা সময়।

ছুটির মধ্যে অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটেছিল। একদিন দুপুরবেলায় খাওয়ার পর সে ঘুমোচ্ছে, বিক্রম বাড়ি নেই, হঠাৎ মুখের ওপর কীসের স্পর্শ এসে যেন লাগল। পাখির পালকের মতো কিছু একটা আলতোভাবে তার গাল, কপাল, গলা এবং চোখের ওপর চলে ফিরে বেড়াচ্ছে। মুহূর্তে ঘুমটা ভেঙে যায়, ধড়মড় করে উঠে বসে হকচকিয়ে যায় সুবর্ণা। খাটের পাশে দাঁড়িয়ে হাসছেন শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ। তখনও দু’পাটিতে কয়েকটা দাঁত অবশিষ্ট ছিল, সেগুলো বেরিয়ে পড়েছে। হাসির জন্য হনু দু’টো ঠেলে উঠে চোখজোড়া প্রায় বুজে গেছে। সুবর্ণা বুঝতে পারছিল, তিনিই তার মুখে হাত বুলোচ্ছিলেন।

শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ এর আগে কখনও নিচে নামেন নি। সুবর্ণা শুনেছে তিনি যাতে সিঁড়ি দিয়ে পড়ে না যান, সে জন্য সব সময় তাঁকে চোখে চোখে রাখা হয়। হয়তো পাহারাদারিটা শিথিল ছিল, সেই ফাঁকে একতলায় চলে এসেছেন।

শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ মিহি, ভাঙা ভাঙা স্বরে জিজ্ঞেস করছিলেন, কে তুমি? তখনও একটু আধটু কথা বলতে পারতেন তিনি।

বিহ্বলের মতো তাকিয়ে ছিল সুবর্ণা। বলেছে, আমি—আমি–আমাকে চিনতে পারছেন না?

উত্তর না দিয়ে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ বলেছেন, আমাদের বাড়ি বেড়াতে এসেছ বুঝি?

সুবর্ণা বুঝতে পারছিল, তাকে চিনতে পারেননি শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ। বলেছিল, আপনার নাতির সঙ্গে ক’দিন আগে দোতলায় গিয়ে প্রণাম করে এলাম। মনে নেই?

হতভম্বের মতো তাকিয়ে ছিলেন শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ। তার স্মৃতি পুনরুদ্ধারের জন্য সুবর্ণা বলেছে, আমি আপনার নাতবৌ–

কিন্তু প্রতিক্রিয়া কিছুই হয় নি। শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আগের মতো হেসে যাচ্ছিলেন।

এই সময় ছুটতে ছুটতে মায়া এসে হাজির। হাঁপাতে হাঁপাতে বলেছিল, দেখুন দিকি বৌদিদি, আমি রান্নাঘরে কাজ করছিলাম, সেই ফাঁকে কখন সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসেছেন। পড়ে গেলে কী সর্বনাশটা যে হয়ে যেত!–চলুন–চলুন ওপরে–হাত ধরে টানতে টানতে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে সিঁড়ির দিকে নিয়ে গিয়েছিল।

যদিও বিক্রমের কাছে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের স্মৃতি নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা শুনেছে সুবর্ণা এবং তার নিজের কাছেও লক্ষণগুলো ধরা পড়েছে; তবু পেছন থেকে হঠাৎ কী ভেবে মায়াকে ডেকেছিল সে, শোন–

মায়া ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেছে, কিছু বলবেন বৌদিদি?

শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে দেখিয়ে সুবর্ণা বলেছে, ওঁর এই অবস্থা হয়েছে কতদিন?

আমি তিন বছর রাজবাড়িতে কাজ করছি। ওঁকে একইরকম দেখছি। শুনেছি আমার আসার অনেক আগে থেকেই নাকি কিছু মনে রাখতে পারেন না।

চিকিৎসা করানো হয়নি?

হয় আবার নি? কলকাতা থেকে বড় বড় ডাক্তার কোবরেজ এনে গুলে খাওয়ানো হয়েছে। কিন্তু কিছু হয়নি। দিনকে দিন বরং আরও খারাপ হচ্ছে।

আচ্ছা তুমি যাও।

বিয়ের জন্য একমাস ছুটি কাটিয়ে কলেজে যেতেই কলিগরা সুবর্ণাকে ঘিরে একেবারে হুলস্থূল বাধিয়ে দিয়েছিল। ছাত্রছাত্রীরাও যথেষ্ট হইচই করেছে, তবে তারা কাছে আসেনি।

কলেজে সুবর্ণার শুভাকাঙ্ক্ষীদের একজন হলেন মাধুরী সান্যাল–সবার মাধুরীদি। মধ্যবয়সী মাধুরী ইংরেজির সিনিয়র প্রফেসর। দারুণ আমুদে আর হাসিখুশি। মানুষ হিসেবে চমৎকার। শ্যামবর্ণ, কিন্তু দেখতে ভারি সুশ্রী। এমন কেউ কেউ আছে, সারাজীবন যাদের মধ্যে শৈশবের সারল্য অটুট থাকে। পৃথিবীর কোনও মালিন্য তাদের স্পর্শ করতে পারে না। মাধুরী এদের মধ্যে পড়েন। পঞ্চাশ পেরুলেও তার মুখমণ্ডলে আশ্চর্য এক পবিত্রতা মাখানো। বললেন, এমন একটা রয়াল ম্যারেজ হল। না ধুমধাম, না গ্র্যান্ড ওয়েডিং ফিস্ট। আমাদের একটু জানালে। না পর্যন্ত।

ফিলসফির অধ্যাপক নিরুপম সান্যাল মাধুরীর স্বামী। রানী স্বর্ণময়ী কলেজ’-এ পড়াতে এসে দু’জনের আলাপ, ভালবাসা এবং বিয়ে। স্ত্রীর স্বভাবের মাধুর্য এবং সারল্যের অনেকটাই তার ভেতরও চুঁইয়ে চুঁইয়ে প্রবেশ করেছে। এক সঙ্গে জীবন কাটাতে হলে যা হয় আর কি। একজনের ভালমন্দ আরেক জনের মধ্যে ঢুকে যায়।

মজার গলায় নিরুপম বলেছেন, আরে ভাই, তোমার মাধুরীদি আর আমিও চুটিয়ে প্রেম করে বিয়েটা করেছিলাম। আর সেটা গলা ফাটিয়ে কাউকে জানাতে বাকি রাখিনি। কিন্তু তোমরা এত লুকোচুরি খেললে কেন, মাথায় ঢুকছে না। আরে ভাই, ভালবাসার বিয়েটা ইন্ডিয়ান পেনাল কোডে কোনও দণ্ডনীয় অপরাধ নয়। নো পানিশেবল অফেন্স। কথায় কথায় আরে ভাইটা তাঁর মুদ্রাদোষ।

ভীষণ বিব্রত বোধ করেছে সুবর্ণা। বলেছে, কী অবস্থায় আমাদের বিয়েটা হয়েছে, পরে শোনাব। তবে এটুকু বলতে পারি, কাউকে আগে জানাবার উপায় ছিল না।

পলিটিক্যাল সায়েন্সের আদিনাথ বসুমল্লিকের জীবনে খাওয়াটা টপ প্রায়োরিটি। সাতচল্লিশ আটচল্লিশ বছরের এই প্রৌঢ়টি সম্পর্কে জনরব, স্ত্রী এবং ছেলেপুলেদের ভাল ভাল সুখাদ্যের ভাগ দিতে হবে বলে বিয়েটাই আর করলেন না। আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন, কত জায়গায় নেমন্তন্ন খেয়েছি কিন্তু রাজবাড়ির ভোজ কখনও খাওয়া হয়নি। সুবর্ণা, চান্সটা হাতে এসেও ফসকে গেল।

সুবর্ণা খুব লজ্জা পেয়ে গিয়েছিল। একবার ভেবেছিল বলে, বিক্রমের সঙ্গে পরামর্শ করে ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ কলিগদের আমন্ত্রণ জানাবে। কিন্তু পরক্ষণে সংগ্রামনারায়ণের ক্রুদ্ধ, নির্দয় মুখটা মনে পড়ায় তার সব উৎসাহ এক ছুঁয়ে নিভে গিয়েছিল।

বেয়াল্লিশ বছরের বেজায় কালো, বেঢপ, ধুমসী থাইরয়েডের পেশেন্ট মৃন্ময়ী বড়াল ভূগোল পড়ায়। তার চেহারাটা বিয়ের অনুকূল নয়, তাই চিরকুমারী। মুখে সারাক্ষণ হাসি লেগে আছে, কিন্তু ভেতরটা একেবারে বিষের পাত্র। সুন্দর, মহৎ, মনোগ্রাহী–এই ধরনের কোনও কিছুই সহ্য করতে পারে না সে। এমন কুচুটে, হিংসুটে মহিলা ক্কচিৎ চোখে পড়ে। হেসে হেসে বলেছিল, লুকিয়ে বিয়ে না করে উপায় ছিল? প্রতাপপুর স্টেটের প্রিন্স মিডল ক্লাস ফ্যামিলির মেয়েকে কুলবধূ করে প্যালেসে নিয়ে আসবে, আগে জানতে পারলে সংগ্রামনারায়ণ সিংহ ঘাড় থেকে মুণ্ডু নামিয়ে দিত না? তা সুবর্ণা, শ্বশুরবাড়ির আদর টাদর কেমন লাগছে?

রানী স্বর্ণময়ী কলেজ’-এর অধ্যাপক অধ্যাপিকাদের বেশির ভাগই এসেছে বাইরে থেকে। মৃন্ময়ী কিন্তু এই শহরেরই মেয়ে। রাজবাড়ির যাবতীয় খুঁটিনাটি খবর থেকে রাজ-পরিবারের কে কেমন মানুষ, তাঁদের স্বভাবচরিত্র, সব তার জানা।

মৃন্ময়ীর কথায় তীক্ষ্ণ একটা খোঁচা ছিল। বিশাল স্টাফ রুমটায় হঠাৎ স্তব্ধতা নেমে এসেছে। মুখচোখ দেখে মনে হচ্ছিল, সবাই ভীষণ অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিলেন।

ইকনমিকসের বিমলেশ ভট্টাচার্য ছিল সুবর্ণার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। তার থেকে বছর তিনেকের বড়। একই দিনে তারা রানী স্বর্ণময়ী কলেজ’-এ চাকরি নিয়ে এসেছিল। মাধুরীর মতো বিমলেশও একজন পরিচ্ছন্ন মানুষ–উদার, সহৃদয়, ভদ্র। অযাচিতভাবে সবাইকে সাহায্য করে। সুবর্ণার সত্যিকারের একজন বন্ধু। স্টাফ রুমের গুমোট আবহাওয়াটাকে হালকা করে দেবার জন্য বলে উঠেছিল, মৃন্ময়ীদি, প্লিজ ওসব কথা বলবেন না। আসুন, সুবর্ণাকে আমরা সকলে শুভেচ্ছা জানাই। শাদি মুবারক।

অধ্যাপক-অধ্যাপিকারা এবার একসঙ্গে গলা মিলিয়ে বলেছিলেন হা হা, নিশ্চয়ই। কনগ্রাচুলেশন সুবর্ণা। মৃন্ময়ী কিন্তু কিছু বলেনি, সে শুধু হাসছিল, আর হাসতে হাসতে তার চোখ দু’টো কুঁচকে যাচ্ছিল। হয়তো হিংসায়, হয়তো বিদ্বেষে।

বাংলার কেতকী ধর আর ফিজিক্সের নবনীতা পুরকায়স্থ সুবর্ণার চেয়ে তিন চার বছরের বড়। তারাও যে এ বিয়েতে খুশি হয়নি, সেটা খুব ভাল করেই জানত সুবর্ণা। বিক্রমের সঙ্গে যখন তার উতরোল প্রেম-পর্ব চলছে তখন প্রায়ই তাদের চোখে আগুনের ঝলক দেখা দিয়ে মিলিয়ে যেত। তার কারণ যে হতাশা কিংবা অন্য কোনও তীব্র প্রতিক্রিয়া, বুঝতে অসুবিধা হত না। সুবর্ণা যেন হঠাৎ প্রতাপপুরে এসে তাদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পত্তি ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নিয়েছে।

যতই ঈর্ষাকাতর হোক, কেতকী আর নবনীতা ছিল খুবই চতুর। নিজেদের মনোভাব তারা গোপন রাখতে জানত। এমনকি যখন স্টাফ-রুমে সবাই সুবর্ণাকে বিয়ের জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছে, তারাও হেসে হেসে, আহ্লাদে আটখানা হয়ে তাতে যোগ দিয়েছিল।

মজার গলায় বিমলেশ এরই মধ্যে জিজ্ঞেস করেছে, রাজবাড়ির বৌ হলে। এবার থেকে কি হার হাইনেস বলতে হবে?

সুবর্ণা মিষ্টি করে ধমক দিয়ে বলেছিল, ইয়ার্কি কোরো না বিমলেশ।

শুধু রাজবাড়ি বা কলেজেই না, এই বিয়েটা প্রতাপপুর সিটিকেও যে তোলপাড় করে ফেলেছে, সেটা টের পাওয়া যাচ্ছিল। অফিসে, চায়ের দোকানে, বার লাইব্রেরিতে, পাড়ার ক্লাবে, মেয়ে মহলে–সর্বত্র এই নিয়ে তুমুল হইচই। এও শোনা যাচ্ছিল, বিয়েটা টিকবে না। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ‘প্রতাপপুর প্যালেস’ থেকে সুবর্ণাকে বার করে দেওয়া হল বলে।

উত্তেজনা, গুজব, গসিপ–চিরকাল এসব একই রকম চড়া তারে বাঁধা থাকে না। তার আঁঝ ক্রমশ কমে আসে। সুবর্ণার বেলাতেও তাই হয়েছিল। মাসখানেক পর থেকে তার ব্যাপারে কেউ আর মাথা ঘামাতো না। নতুন নতুন উত্তেজনা এসে তাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল।

বিয়ের পর তিনটে বছর চোখের পাতা পড়তে না পড়তেই যেন উড়ে গেছে। এতটা সময় কেটে গেল কিন্তু একবারও সে দোতলায় ওঠে নি। সংগ্রামনারায়ণও। যেতে বলেননি। আগের মতোই যেন হোটেলে দিন কাটিয়ে যাচ্ছিল। এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিল সুবর্ণা।

এই তিন বছরে দু’টো বড় ঘটনা ঘটেছিল তার জীবনে। বাবার মৃত্যু এবং দেবীর জন্ম। মৃত্যু সংবাদটা পেয়েই তাকে নিয়ে শিলিগুড়ি গিয়েছিল বিক্রম। শ্রাদ্ধের পর প্রতাপপুর ফিরে আসে। বাবা মারা যাবার বছরখানেক বাদে দেবী হয়েছিল। তার জন্মের দু’মাস আগে সে আবার শিলিগুড়িতে যায়। এবার ফেরে দু’মাসের মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে। দ্বিতীয় বার গিয়ে মায়ের কাছে চার মাস কাটিয়ে এসেছিল সে। ফিরে আসার পর এমন দু’টো ব্যাপার ঘটল যা তার জীবনকে আগাগোড়া বদলে দেয়। প্রথমটা দারুণ চমকপ্রদ।

দু’মাসের বাচ্চাকে একা রেখে কলেজে যাওয়া যায় না! দেবীর দেখাশোনার ভার দেওয়া হয়েছিল আধাবয়সী চপলাকে। অল্প বয়সে স্বামী হারিয়ে ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ কাজ নিয়েছিল সে। অত্যন্ত দায়িত্বশীল, নম্র এবং বিশ্বাসী। দেবীকে খুব যত্ন করত। ঘড়ি ধরে তার খাওয়া, স্নান, ঘুম–এসব নিয়ে সুবর্ণার বিন্দুমাত্র দুশ্চিন্তা। ছিল না। সে জানত উপযুক্ত মানুষের হাতেই মেয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

চপলা এমনিতে ধীর, স্থির কিন্তু একদিন কলেজ থেকে ফেরার পর সুবর্ণা লক্ষ করল, তাকে ভীষণ চঞ্চল দেখাচ্ছে, চোখে মুখে প্রবল উত্তেজনার ছাপ। এদিক সেদিক ভাল করে দেখে, সুবর্ণার হাত ধরে ঘরের কোণে টেনে নিয়ে চাপা গলায় সে বলেছিল, আজ কী হয়েছে জানেন বৌদিদি?

চপলার এ জাতীয় আচরণ তার স্বভাবের সঙ্গে মেলে না। খুব অবাক হয়ে সুবর্ণা জিজ্ঞেস করেছে, কী হয়েছে?

ছোট বাবা দুপুরবেলায়, আপনি যখন কলেজে, একতলায় এসে দেবী মাকে দেখে গেছেন।

এ বাড়িতে কাজের লোকেরা সবাই শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে বড় বাবা, সংগ্রামনারায়ণকে ছোট বাবা, আর বিক্রমকে দাদা বলত।

খবরটা এতটাই বিস্ময়কর যে অনেকক্ষণ বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে ছিল সুবর্ণা। তারপর বলেছে, কী বলছ তুমি!

সংগ্রামনারায়ণের সঙ্গে তার সম্পর্কটা কী ধরনের সেটা প্রতাপপুর । প্যালেস’-এর কাজের লোকেদের জানতে বাকি নেই। চপলা বলেছিল, সত্যিই বৌদিদি। দেবী মা তখন ঘুমোচ্ছিল। কম করে আধ ঘন্টা খাটের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে দেখলেন। চোখের পাতা পড়ছিল না গো। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে ওপরে চলে গেলেন।

সুবর্ণার মনে হয়েছিল, আগ্নেয়গিরির উত্তাপ হয়তো জুড়াতে শুরু করেছে। কিংবা এমনও হতে পারে, মিডল ক্লাস কমোনার বলে তাকে মেনে না নিলেও। দেবীকে অস্বীকার করা তাঁর পক্ষে বুঝিবা সম্ভব হয়নি; কেননা মেয়েটার শরীরে রাজবংশের রক্তধারা বয়ে চলেছে যে।

প্রথমটা যদি মোটামুটি আনন্দদায়ক হয়, দ্বিতীয় ঘটনাটি সুবর্ণার জীবনকে তছনছ করে দিয়েছিল। দেবীকে নিয়ে শিলিগুড়ি থেকে ফেরার পর বিক্রম সম্পর্কে উড়ো কিছু খবর তার কানে আসছিল। এমনকি বেশ ক’টা বেনামী চিঠি পেয়েছিল সে। বিক্রম নাকি অন্য একটা মেয়েকে নিয়ে ভীষণ মাতামাতি করছে। মেয়েটা কে, কষ্ট করে খোঁজখবর নিতে হয়নি। মৃন্ময়ীই যেচে তাকে জানিয়ে দিয়েছিল। প্রতাপপুর সিটিতে একটা নামকরা ফরেন ব্যাঙ্কের নতুন যে ব্রাঞ্চ ম্যানেজারটি এসেছেন, মেয়েটা তার শালীনাম রুবি। যেমন স্মার্ট, তেমনি দুর্ধর্ষ ফিগার তার, সারা শরীরে চুম্বকের মতো সেক্স অ্যাপিল। দিল্লিতে থাকে, সবে এম. এ পরীক্ষা দিয়েছে, রেজাল্ট বেরুবে তিন মাস পর। সময় কাটাতে দিদি-জামাইবাবুর কাছে এসেছিল। সুবর্ণাকে দেখে একদিন যেমনটা হয়েছিল, রুবিকে দেখে অবিকল তেমনই ঘাড় গুঁজে পড়েছিল বিক্রম।

মৃন্ময়ী তীব্র, নিচু গলায় বলেছে, রাজপুত্রকে বিয়ে করলে কিছু দাম তো দিতেই হয়। এসব গায়ে মেখো না সুবর্ণা। তার মুখে জ্বালা-ধরানো হাসিটি লেগেই ছিল।

কেতকী আর নবনীতা অবশ্য অমন চাছাছোলা ভাষা ব্যবহার করেনি। মুখখানা করুণ করে বলেছিল, কী যে সব শুনছি! বড্ড খারাপ লাগছে। তাদের আক্ষেপের পেছনে চাপা খুশি যে লুকনো ছিল, টের পেতে অসুবিধা হয়নি।

তবে সত্যিকারের যারা হিতাকাঙ্ক্ষী, যেমন নিরুপম, মাধুরী বা বিমলেশরা কিন্তু খুবই দুঃখ পেয়েছিল। তারা আন্তরিকভাবে পরামর্শ দিয়েছে, সুবর্ণা যেন ভেঙে না পড়ে। যেমন করে থোক, রুবির কাছ থেকে বিক্রমকে ফিরিয়ে আনে।

কিন্তু রুবির কথা তুলতে গোড়ার দিকে হেসে হেসে উড়িয়ে দিয়েছে বিক্রম। সুবর্ণা তাকে ছাড়েনি। ক্রমাগত চাপ দিতে হঠাৎ একদিন তার একটা হাত ধরে টানতে টানতে হল-ঘরের দেওয়ালে সাজানো অয়েল পেন্টিংগুলোর কাছে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। সেগুলো দেখাতে দেখাতে বলেছে, এঁরা কারা নিশ্চয়ই তুমি জানো?’

ছবির এই গ্যালারিতে কেন তাকে ধরে আনা হয়েছে, বুঝতে না পেরে সুবর্ণা প্রথমটা হতবাক হয়ে গিয়েছিল। তারপর বলেছে, জানব না কেন? এঁরা তোমার সব পূর্বপুরুষ–

রাইট, রাইট, রাইট। এঁদের ক্যারেক্টার কেমন ছিল, সেটা বোধহয় তোমাকে বলা হয়নি।

সুবর্ণা উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে ছিল।

বিক্রম হেসে হেসে বলেছে, আমার এই লেট ল্যামেন্টেড গ্রেট, গ্রেট, গ্রেট গ্র্যান্ড ফাদারেরা ছিলেন একেকটি স্কাউন্ট্রেল। এদের মতো বিখ্যাত লম্পট হোল ইন্ডিয়াতে খুব বেশি ছিল না। কলকাতা, দিল্লি, বেনারসে কত বাঈজি আর রক্ষিতা যে পুষতেন তার হিসেব নেই। সেক্সি, বিউটিফুল ইয়াং উইমেনের শরীর ছাড়া জীবনে আর কিছু বুঝতেন না। তাদের একমাত্র প্যাসন ছিল মেয়েমানুষ। আমার ঠাকুরদা আর বাবা কিন্তু একেবারে অন্য টাইপের। রাজবংশের প্রাইড নিয়ে একটা অদ্ভুত মেক-বিলিভ ওয়ার্ল্ড তৈরি করে তার ভেতর লাইফ কাটিয়ে দিচ্ছেন। ঠাকুরদার বোধবুদ্ধি, মেমোরি অবশ্য নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি যেভাবে বেঁচে আছেন তার কাছে বংশগৌরব টৌরব টোটালি মিনিংলেস।

পলকহীন বিক্রমের দিকে তাকিয়ে শুনে যাচ্ছিল সুবর্ণা।

বিক্রম থামেনি, বংশের কিছু কিছু ব্যাপার থাকে যেগুলো ঘুরে ঘুরে পরের জেনারেশনের মধ্যে ফিরে আসে। ঠাকুরদার আগে ফোর-ফাদারদের সেই প্যাসনটা দু’টো জেনারেশনকে টপকে আমাকে ধরে ফেলেছে।

সুবর্ণার মুখ শক্ত হয়ে উঠেছিল। এমন নির্লজ্জ স্বীকারোক্তি যে কেউ করতে পারে, সেটা শুনেও যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। এই লোকটাই কি একদিন প্রেমিক ছিল, তাকে পাগলের মতো ভালবেসেছিল, তার জন্য রাজবংশের ট্র্যাডিশন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল? বিক্রমের চোখে চোখ রেখে সে বলেছে, তুমি নিজেকে তোমার পূর্বপুরুষদের মতো লম্পট মনে কর?

বিক্রম হেসে হেসে বলেছে, মেয়েদের সম্বন্ধে একটু বেশি ইন্টারেস্ট দেখালে যদি লম্পট বলা হয়, ধর আমি তা-ই। আমি যে দেবশিশুর মতো নিষ্পাপ নই সেটা বিয়ের আগে তোমার কলিগদের কেউ কেউ শুনিয়ে দেয়নি?

শুনিয়েছে। তবে আমি গ্রাহ্য করিনি। পাস্ট নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। তোমাকে বিয়ের পর তিন বছর দেখেছি। অভিযোগ করার মতো কিছু পাইনি। বলে একটু থেমে ফের শুরু করেছে সুবর্ণা, আমার কথা বাদ দিলেও তোমার একটা বাচ্চা আছে। নিজেকে কন্ট্রোল কর। রুবির সঙ্গে মেলামেশাটা তোমাকে বন্ধ করতে হবে।

বিক্রমের চোখে আগুনের একটা ঝলক চকিতের জন্য দেখা দিয়েই মিলিয়ে গিয়েছিল। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলেছে, কাকে কী বলছ তুমি বোধহয় জানো না। লিমিট ছাড়াবার চেষ্টা করো না।

তার কণ্ঠস্বরে এমন একটা ঠান্ডা কাঠিন্য ছিল যে চমকে উঠেছে সুবর্ণা। রাজতন্ত্র শেষ হয়ে গেলেও সে যে একজন কমোনার নয় সেটা বুঝিয়ে দিয়েছিল বিক্রম। তার মধ্যে লুকনো রাজবংশের দম্ভটা রক্তের ভেতর থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল যেন। ভয়ে ভয়ে সুবর্ণা বলেছে, রুবিকে জড়িয়ে তোমার কত স্ক্যান্ডাল রটছে সেটা কি তুমি জানো?

এই ধরনের স্ক্যান্ডাল রয়াল ফ্যামিলির একটা ইনএভিটেবল কোয়ালিটি। অর্ডিনারি পিপলের কাছে হয়তো মারাত্মক ক্রাইম। এ নিয়ে মাথা ঘামিও না।

ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল সুবর্ণার। কিছুক্ষণ বিমর্ষ হয়ে থাকে সে। তারপর বলে, আমার কী হবে?

বিক্রম বলেছে, কী আবার হবে। তুমি যেমন আছ তেমনি থাকবে।

একটা কথা জিজ্ঞেস করব? নিশ্চয়ই।

রুবির সঙ্গে তোমার রিলেশানটা কতদূর এগিয়েছে?

বিক্রম ঠান্ডা গলায় বলেছিল, যতদুর এগুলে স্ক্যান্ডালের স্টেজে পৌঁছে যায় ঠিক ততটাই। একটু থেমে ফের বলেছে, তোমার মাথায় মিডল ক্লাসের কিছু ট্যাবু এখনও অ্যাক্টিভ রয়েছে। ওগুলো মাথা থেকে বার করে দিতে পারলে দেখবে আর কোনও প্রবলেম নেই।

সুবর্ণা বলেছিল, এটা ঠিক, জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মধ্যে পূর্বপুরুষের কিছু কিছু সংস্কার ঢুকে যায়। সেগুলো তার সহজাত; মুখের কথায় এসব কাটিয়ে ওঠা যায় না। সে আরও বলেছে, তুমি বললে তোমাদের বংশের লাম্পট্যের সাইকেলটা তোমার মধ্যে ফিরে এসেছে। রাজত্ব নেই কিন্তু লেচারিটা আছে। ওটা এমন কিছু মহৎ ব্যাপার নয় যে চিরকাল আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে।

বিক্রম স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, উত্তর দেয়নি।

সুবণা থামেনি, আমি মিডল ক্লাস ফ্যামিলির মেয়ে জেনেই কিন্তু তুমি বিয়েটা করেছিলে।

বিক্রম এবার প্রায় চেঁচিয়ে উঠেছে, প্লিজ স্টপ ইট।

গলা চড়িয়ে তুমি আমাকে থামাতে পারবে না। হিন্দু কোড রিল অনুযায়ী আমি তোমার লিগাল ওয়াইফ। তা হলে রুবির স্টেটাসটা কী হবে–তোমার রক্ষিতা? নাকি আমাকে ডিভোর্স করে তাকে বিয়ে করতে চাও?

রুবিকে নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। তোমাকে তো বলেছি, যেমন আছ তেমনি থাকবে।

সুবর্ণা উত্তেজনায় ফেটে পড়েনি। শান্ত গলায় এবার বলেছে, তোমার বাবা আমাকে এখনও মেনে নেননি। তুমি হঠাৎ রুবিকে নিয়ে মেতে উঠেছ। তার মানে অসম্মান আর উপেক্ষার মধ্যে আমাকে এ বাড়িতে পড়ে থাকতে হবে।

বিক্রম চুপ।

সুবর্ণা সমানে বলে যাচ্ছিল, আমি আমার মা-বাবা দাদাকে ছেড়ে সবার আপত্তি সত্ত্বেও তোমার জন্যে এ বাড়িতে চলে এসেছিলাম। হিন্দু কোড বিল আমার মতো মেয়েদের কিছু শক্তি দিয়েছে। আমি কিন্তু সহজে তোমাকে ছাড়ব না।

বিক্রম চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেবার ভঙ্গিতে বলেছিল, তা হলে শক্তিটা পরীক্ষা করে দেখতে পার।

এরপর রুবিকে ফোন করে বোঝাতে চেষ্টা করেছে সুবর্ণা। অন্য একটি মেয়ের দাম্পত্য জীবন, স্বামী এবং সন্তান নিয়ে তার সংসার সে যেন ভেঙে চুরমার করে না দেয়। রুবি হা না কিছুই বলেনি, চুপচাপ শুনে গেছে শুধু। সুবর্ণা বুঝতে পারছিল মেয়েটা বিক্রমের ব্যাপারে এমনই মোহাচ্ছন্ন যে কার কতটা ক্ষতি হবে তা নিয়ে ভাবার মতো সময় নেই তার। কিংবা এতে তার কিছুই আসে যায় না। সুবর্ণার একবার মনে হয়েছিল, বিক্রম যে কত বড় লম্পট, দুশ্চরিত্র একদিন তার মতো রুবিকেও ছিবড়ে করে ছুঁড়ে ফেলে দেবে-এসব জানিয়ে দেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অপ্রিয় কথাগুলো আর বলেনি।

ফোনের খবরটা রুবির কাছ থেকে পেয়ে গিয়েছিল বিক্রম। সে প্রচণ্ড খেপে গেলেও বাইরে তার প্রকাশ ছিল না। শীতল কণ্ঠস্বরে শুধু বলেছিল, শেম! তোমার মতো একজন তেজী, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মহিলার পক্ষে স্বামীর প্রেমিকার কাছে করুণা ভিক্ষে করাটা সম্মানজনক নয়।

অপমানে, রাগে মুখ লাল হয়ে উঠেছিল সুবর্ণার। কিছু একটা রূঢ় জবাব দিতে চেয়েছিল সে, কিন্তু গলায় স্বর ফোটেনি।

মানসিক দিক থেকে সুবর্ণা যখন সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত তখন হঠাৎ একদিন রুবিকে নিয়ে বিক্রম উধাও হয়ে যায়। এমন খারাপ সময় তার জীবনে আগে আর কখনও আসেনি।

দাদা অভিজিৎ কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দিয়ে ব্যাঙ্কে জুনিয়র অফিসার হিসেবে ঢুকেছিল। তার প্রথম পোস্টিং ছিল শিলিগুড়িতে। সুবর্ণার যখন দুঃসময় শুরু হল, তার কিছুদিন আগে তাকে দিল্লিতে ট্রান্সফার করে দেওয়া হয়। শিলিগুড়ির বাড়ি ভাড়া দিয়ে মা, বৌদি আর দু’বছরের ছেলে টুপাইকে নিয়ে সে সেখানে চলে যায়।

দাদা এবং বৌদি দু’জনেই ভাল মানুষ–উদার, সহৃদয়, স্নেহপ্রবণ। সুবর্ণা একবার ভেবেছিল দেবীকে নিয়ে সেখানে চলে যাবে। ওরা কখনও তাদের অবাঞ্ছিত ভাববে না। তাছাড়া একসঙ্গে থাকলেও নিজেদের ব্যবস্থা সুবর্ণা করে নিতে পারবে। ইউনিভার্সিটিতে তার যা রেজাল্ট সেই জোরে দিল্লির কোনও কলেজ বা কমার্শিয়াল ফার্মে একটা কাজ জুটিয়ে নেওয়া অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু চিরকাল অন্যের কাঁধে, সে যত আপনজনই হোক, ভর করে থাকাটা অস্বস্তিকর। তার সঙ্গে আত্মসম্মানের প্রশ্নও রয়েছে। তাছাড়া, মা, দাদা তার বিয়েতে প্রবল আপত্তি জানিয়েছিল। বার বার ওরা সতর্ক করে দিলেও সুবর্ণা কানে তোলেনি। এখন দাম্পত্য জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ওদের কাছে গিয়ে মুখ দেখাবে কী করে? হঠাৎ নিজের মনকে খুবই দৃঢ় করে নিয়েছিল সে। প্রতাপপুর থেকে পালিয়ে যাবে না; সব কিছুর শেষ দেখে ছাড়বে।

হিংসুটে কলিগরা কিন্তু সুবর্ণার বিবাহিত জীবনের বিপর্যয়ে দারুণ খুশি। সামনাসামনি তারা কিছু বলেনি, এমনকি মৃন্ময়ী বড়ালের মতো পরশ্রীকাতর মহিলাও নয়। তবে তাদের চোখেমুখে যে চাপা বিদ্রূপ এবং উল্লাস ফুটে বেরিয়েছিল তা ছুরির ফলার মতো বুকের ভেতর পর্যন্ত বিধে গেছে। বাইরের রক্তপাত চোখে পড়ে কিন্তু ভেতরের রক্তক্ষরণ কেউ কি দেখতে পায়? হিতাকাঙ্ক্ষীরা অবশ্য তার যন্ত্রণাটা ঠিকই বুঝতে পেরেছিল। অপার সহানুভূতি আর সমবেদনায় তারা সর্বক্ষণ সুবর্ণার পাশে থেকেছে। বিশেষ করে বিমলেশ। সে তাকে ভেঙে পড়তে দেয়নি। বুঝিয়েছে জীবনটা এক বা দুই রাউন্ডের লড়াই নয়, দীর্ঘস্থায়ী এক যুদ্ধ। তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সুবর্ণা ঝাড়া হাত-পা মহিলা নয়। তার একটি মেয়ে আছে। তাকে মানুষ করতে হবে। সে জন্য নিজেকে সারাক্ষণ সতেজ, সজীব এবং তৎপর রাখা দরকার। একটি লম্পটের কারণে নিজেকে চুরমার করে ফেলার মানে হয় না। নিজের এবং মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য শরীর এবং মনের সবটুকু শক্তি সংরক্ষণ করাটা খুবই জরুরি। তা ছাড়া সুবর্ণা কোনও অপরাধ করেনি। অন্যায়, ইতরাম, বজ্জাতি, যা করার করেছে বিক্রম। সঙ্কোচে, লজ্জায়, সুবর্ণার মুখ লুকিয়ে রাখার কারণ নেই। কে কী মন্তব্য করল, কে ব্যঙ্গের হাসি হাসল, এসব পরোয়া করতে হবে না।

বিক্রমের চলে যাওয়াটা দোতলায় কী প্রতিক্রিয়া ঘটিয়েছিল, নিচে থেকে ঠিক টের পায়নি সুবর্ণা। শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে এই ঘটনা এতটুকু নাড়া যে দেবে না সেটা সে জানত। তবে সংগ্রামনারায়ণ এটাকে কীভাবে নিয়েছেন, বোঝা যাচ্ছিল না। সে জন্য বেশ খানিকটা উৎকণ্ঠায় ছিল সুবর্ণা। অন্য দিক থেকেও মানসিক একটা চাপ ছিল। বিক্রম নেই, অবাঞ্ছিত পুত্রবধুকে সংগ্রামনারায়ণ বাড়িতে থাকতে দেবেন কি না কে জানে। মায়ার কাছে এইটুকুই শুধু জানা গিয়েছিল, তিনি একেবারে গুম হয়ে গেছেন, সর্বক্ষণ নিজের ঘরে চুপচাপ বসে থাকেন।

মনে পড়ে, মাসখানেক এভাবে কাটার পর একদিন দুপুরের কিছু আগে, তখন সাড়ে দশটা কি এগারটা হবে, নিজের বেডরুমে শুয়ে শুয়ে খবরের কাগজ পড়ছিল সুবর্ণা। কলেজের ফাউন্ডেশন ডে থাকায় সেদিনটা তার ছুটি। দেবীও বাড়ি নেই, একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে তাকে ভর্তি করা হয়েছে। চপলা তাকে পৌঁছে দিতে গিয়েছিল, তখনও ফিরে আসেনি।

সুবর্ণার বেডরুমের হল-ঘরের দিকের দরজাটা পুরো খোলা ছিল। হঠাৎ তার চোখে পড়ল, হরেনের সঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছেন সংগ্রামনারায়ণ। প্রায় চার বছরের মতো এ বাড়িতে কেটে গেছে সুবর্ণার, কিন্তু ক্কচিৎ তাকে প্যালেসের বাইরে যেতে দেখেছে সে। গেলেও বিকেলের দিকে। এ সময় কখনই নয়। সুবর্ণা বেশ অবাকই হয়ে গিয়েছিল।

তখনও এ বাড়িতে তিনটে গাড়ি ছিল। একটা পুরনো মডেলের ফোর্ড, একটা স্টুডিবেকার, অন্যটা দিশি অ্যামবাসাডর। স্টুডিবেকার আর ফোর্ডটা কখনও সখনও বার করা হত। সংগ্রামনারায়ণ বাইরে বেরুলে অ্যামবাসাডারটাই চড়তেন। বিক্রম যতদিন ছিল, সে-ও ওটাই চালাত। বাড়িতে গাড়িতে দু-চার বারের বেশি চড়েনি সুবর্ণা। বিক্রম জোর করেছে বলে চড়তে হয়েছে। যেখানে তার অধিকারটাই অনেকখানি অনিশ্চিত কিংবা সীমাবদ্ধ সেখানে থাকাটুকু ছাড়া গাড়ি চড়ার মতো আরামের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়াটা তার স্বভাববিরুদ্ধ। সে লোভী নয়।

সুবর্ণা লক্ষ করেছে, নিচে নেমে কোনও দিকে না তাকিয়ে সোজা বাইরে চলে গিয়েছিলেন সংগ্রামনারায়ণ। কিছুক্ষণ পর গাড়ির আওয়াজ শুনে মনে হয়েছিল সেটা গেটের বাইরে বেরিয়ে গেছে।

ঘন্টাখানেকও কাটেনি, সংগ্রামনারায়ণ ফিরে এসেছিলেন। তাকে খুবই অস্বাভাবিক দেখাচ্ছিল। মুখ থমথমে, চোখ দু’টো টকটকে লাল। হাঁটতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল তার। অস্থির পা দু’টো এত টলছিল যেন হুড়মুড় করে পড়ে যাবেন। হরেন ধরে ধরে, খুব সন্তর্পণে তাকে ওপরে নিয়ে গিয়েছিল।

দোতলায় উঠেই ফেটে পড়েছিলেন সংগ্রামনারায়াণ। তার একটানা, উত্তেজিত চিৎকারে গোটা ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এর ভিত পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল যেন। দুর্বোধ্য, জড়ানো গলায় তিনি সমানে কী বলছিলেন তার একটি বর্ণও বুঝতে পারছিল না সুবর্ণা। নিজের অজান্তেই যেন সিঁড়ির তলা পর্যন্ত ছুটে এসেছিল সে কিন্তু নিষেধাজ্ঞা তার মাথায় ছিল, তাই ওপরে ওঠেনি। অজানা ভয়ে, শঙ্কায় ভেতরে ভেতরে সে কুঁকড়ে গেছে।

যেমন হঠাৎ শুরু হয়েছিল তেমনি হঠাৎই দোতলায় সংগ্রামনারায়ণের তর্জনগর্জন, চেঁচামেচি থেমে যায়। অদ্ভুত স্তব্ধতা নেমে আসে গোটা বাড়িটায়। তারপরই ওপর থেকে কাজের মেয়েদের ছোটাছুটি এবং ভয়ার্ত গলার হইচই ভেসে আসে। এক সময় দেখা যায়, ঊর্ধ্বশ্বাসে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে নেমে আসছে মায়া। তার উদ্ভ্রান্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠেছিল সুবর্ণা।

ল্যান্ডিংয়ের মাঝামাঝি এসে তাকে দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল মায়া। সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে বলেছে, আপনাকে ডাকতে যাচ্ছিলাম বৌদিদি। শীগগির ওপরে চলুন।

ভয়ঙ্কর কিছু যে ঘটে গেছে, সেটা বুঝতে পারছিল সুবর্ণা। মায়ার উৎকণ্ঠা এবং ত্রাস তার মধ্যেও দ্রুত চারিয়ে যাচ্ছিল। কঁপা গলায় সে জিজ্ঞেস করেছিল, কী হয়েছে?

ছোট বাবা অজ্ঞান হয়ে গেছেন।

এটা ভাবা যায়নি। কিছু একটা যে এখনই করা উচিত সেটা বুঝতে পারছিল সুবর্ণা কিন্তু দোতলায় ওঠাটা ঠিক হবে কিনা, সে সম্পর্কে তার যথেষ্ট দ্বিধা ছিল। বে মায়া ফের তাড়া দিয়েছিল, এখন আর পুরনো কথা মনে করে রাখবেন না। বৌদিদি। আসুন–

সংগ্রামনারায়ণের সঙ্গে তার সম্পর্কটা কী, শুধু মায়া কেন, এ বাড়ির সবাই জানত। সুবর্ণা আর দাঁড়িয়ে থাকেনি; বিয়ের চার বছর পর একসঙ্গে দু-তিনটে করে সিঁড়ি টপকে দোতলায় চলে গিয়েছিল।

ওপরের হল-ঘরে, সংগ্রামনারায়ণ তার বেডরুমের সামনে চিত হয়ে পড়ে ছিলেন। চোখ দু’টো বোজা, সারা শরীর ঘামে ভেজা, গালের কষ বেয়ে ফেনা বেরিয়ে আসছিল। শ্বাসক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেছে কি না বোঝা যাচ্ছিল না।

হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণগুলো সুবর্ণার খুবই চেনা। কয়েক বছর আগে সে যখন কলেজে পড়ে, তার এক মামা তাদের শিলিগুড়ির বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। একদিন রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর সবার সঙ্গে গল্প করতে করতে হঠাৎ তার ম্যাসিভ স্ট্রোক হয়। সংগ্রামনারায়ণের মতোই তারও গা বেয়ে ঘামের ধারা নেমেছিল, গালের পাশে অবিকল এইরকম গাঁজলা।

সংগ্রামনারায়ণ সুবর্ণার সঙ্গে নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছেন, বিন্দুমাত্র মর্যাদা কখনও দেননি। তবু অচেতন, অসহায় মানুষটির দিকে তাকিয়ে তার সারা শরীরে শিহরন খেলে যায়–সেটা উৎকণ্ঠায় এবং ভয়ে। দ্রুত সংগ্রামনারায়ণের নাকের সামনে হাতটা নিয়ে আসে সে। না, সব শেষ হয়ে যায়নি, তির তির করে নিঃশ্বাস পড়ছে।

এবার কাজের মেয়েদের সঙ্গে ধরাধরি করে সংগ্রামনারায়ণকে তার বেডরুমে নিয়ে শুইয়ে দেয় সুবর্ণা, তারপর ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এর হাউস-ফিজিসিয়ান ডাক্তার দত্তরায়কে ফোন করে। তাকে সে চিনত। কেননা উইকে তিনদিন তিনি এসে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ আর সংগ্রামনারায়ণকে দেখে যেতেন। নিয়মিত যাতায়াতের। কারণে এ বাড়িতে সুবর্ণার স্টেটাসটা কী, সেটা তারও অজানা ছিল না।

ডাক্তার দত্তরায়ের বয়স তখন পঞ্চাশের কাছাকাছি। মাথায় কাঁচাপাকা চুল। মোটাসোটা ভারী চেহারা, মাঝারি হাইট, রং টকটকে ফর্সা, মুখ নিখুঁত কামানো। পরনে সারাক্ষণ কালো ঢোলা ট্রাউজার্স আর ডবল-কাফওলা সাদা ধবধবে ফুলশার্ট যার হাতার বোতাম কখনও লাগানো থাকত না। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। তিনি এসে দোতলায় সুবর্ণাকে দেখে অবাক হয়েছিলেন কিন্তু এ নিয়ে কিছু বলেননি। তবে পেশেন্টকে পরীক্ষা করতে করতে তাঁর মুখচোখের চেহারা পালটে গিয়েছিল। খুবই চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছিল তাকে। জিজ্ঞেস করেছিলেন, পরশু ওঁকে দেখে গেছি; বেশ ভাল ছিলেন। হঠাৎ এরকম হল কী করে? কোনও কারণে হঠাৎ এক্সাইটেড হয়ে পড়েছিলেন কি?

সংগ্রামনারায়ণের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া এবং ফিরে আসার পর যা যা ঘটেছে সব বলে গিয়েছিল সুবর্ণা। তিনি ভয়ঙ্কর ক্ষিপ্ত হয়ে চিৎকার করতে করতে অজ্ঞান হয়ে যান। তবে তার ক্রোধ বা উত্তেজনার কারণটা সুবর্ণার জানা নেই।

এ বাড়ির পুরুষ কাজের লোকেদের বিনা হুকুমে দোতলায় ওঠা বারণ। তবে হরেনকে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, ডাক্তার দত্তরায় এলে সে তার ব্যাগ বয়ে ওপরে নিয়ে আসবে। সেদিনও সে এসেছিল এবং সুবর্ণাদের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল।

সংগ্রামনারায়ণের আকস্মিক উত্তেজনা সম্পর্কে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে যাচ্ছিল হরেন; কী ভেবে চুপ করে যায়। পরে অবশ্য সুবর্ণাকে একা পেয়ে যা জানিয়েছিল তা এইরকম। রাজ-পরিবারের চারটে শিডিউল্ড এবং একটা বিদেশী। ব্যাঙ্কে যত অ্যাকাউন্ট ছিল–সেভিংস এবং ফিক্সড সবই জয়েন্ট; এক সঙ্গে সংগ্রামনারায়ণ আর বিক্রমের নামে। ব্যবস্থা এমন করা হয়েছিল, যে কেউ একজন চেক সই করে টাকা তুলতে পারত। সংগ্রামনারায়ণ ব্যাঙ্কে যাওয়া পছন্দ করতেন না। বিক্রমই দরকারমতো যেত। তবে রুবিকে নিয়ে সে পালিয়ে যাবার পর হাতের টাকা ফুরিয়ে এলে সংগ্রামনারায়ণকে সেদিন একটা ব্যাঙ্কে ছুটতে হয়েছিল। সেখানে গিয়ে তিনি একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে যান। তাকে না জানিয়ে সেভিংস অ্যাকাউন্ট থেকে তো বটেই, ফিক্সড ডিপোজিট ভেঙেও প্রচুর টাকা তুলে নিয়েছে বিক্রম। সন্দেহ হওয়ায় অন্য ব্যাঙ্কগুলোতেও গিয়ে খোঁজ নিয়েছিলেন সংগ্রামনারায়ণ। সব জায়গাতেই এক অবস্থা। সব মিলিয়ে কয়েক লাখ টাকা। তুলেছে বিক্রম। তাছাড়া লকার থেকে প্রচুর দামী দামী জুয়েলারি এবং তার নামে। বড় বড় মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানির যেসব শেয়ার কেনা হয়েছিল সেগুলো নিয়েও চলে গেছে। এ সবের প্রতিক্রিয়ায় বাড়ি এসে ফেটে পড়েছিলেন সংগ্রামনারায়ণ এবং সঙ্গে সঙ্গে হার্ট-অ্যাটাক।

পেশেন্টকে দেখা হয়ে গেলে ডাক্তার দত্তরায় বলেছিলেন, এখনই ওঁকে নার্সিংহোমে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ভর্তি করতে হবে।

বিক্রম নেই, শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ থেকেও না থাকার মতোই। সিদ্ধান্ত যা নেবার, সুবর্ণাকেই নিতে হবে। এক মুহূর্ত না ভেবে সে বলেছে, আপনি ব্যবস্থা করুন।

তক্ষুণি ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স আনিয়ে প্রতাপপুর সিটির সব চেয়ে নামকরা নার্সিংহোমে সংগ্রামনারায়ণকে নিয়ে গিয়েছিলেন ডাক্তার দত্তরায়। তিনি এর সঙ্গে বহুকাল যুক্ত আছেন। নিজেও একজন বড় হার্ট-স্পেশালিস্ট। ওঁদের সঙ্গে সুবর্ণা আর হরেনও গিয়েছিল।

ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে রোগী আর ডাক্তার ছাড়া অন্য কারও প্রবেশ নিষেধ। ডাক্তার দত্তরায় এবং আরও দু’জন স্পেশালিস্ট সংগ্রামনারায়ণকে নিয়ে ভেতরে ঢুকেছিলেন। সুবর্ণারা বাইরে অপেক্ষা করছিল। ঘণ্টাখানেক বাদে ওঁরা বেরিয়ে এসে জানিয়েছিলেন বাহাত্তর ঘন্টা না কাটলে পেশেন্ট সম্পর্কে কোনওরকম ভরসা দেওয়া সম্ভব হবে না।

সেদিনই আরও কয়েকজন ডাক্তারকে নিয়ে একটা মেডিকেল বোর্ড বসানো হয়েছিল। তাঁরা সংগ্রামনারায়ণের ব্লাড টেস্ট, ইসিজি, ওষুধ এবং ইঞ্জেকশনের যে লিস্ট দিয়েছিলেন তার জন্য অনেক টাকা দরকার। ব্যাঙ্ক থেকে বিক্রম বিরাট অ্যামাউন্ট সরিয়ে নিলেও ওদের অ্যাকাউন্টে তখনও প্রচুর রয়েছে। কয়েক লাখ। টাকা সরালে একটা দেড়শ বছরের পুরনো রাজবংশের সঞ্চয় শেষ হয়ে যায় না। কিন্তু সুবর্ণার পক্ষে সেখান থেকে একটা পয়সাও তোলা সম্ভব নয়, কেননা তার নামে তো কিছু নেই। তবে কয়েক বছর কলেজে পড়াচ্ছে সে, মাইনের প্রায় সবটাই ব্যাঙ্কে জমিয়ে রেখেছে। অগত্যা নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে মোটা টাকা তুলতে হয়েছিল।

ডাক্তাররা বাহাত্তর ঘণ্টার কথা বলেছিলেন কিন্তু তার আগেই জ্ঞান ফিরে এসেছিল সংগ্রামনারায়ণের। ওষুধ এবং ইঞ্জেকশনের আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছিল। হার্ট ক্রমশ স্থিতিশীল হতে শুরু করেছিল। চারদিনের মাথায় তাঁকে ইনটেনসিভ কেয়ার থেকে এয়ার-কন্ডিশনড কেবিনে নিয়ে আসা হয়েছিল।

কলেজ থেকে লম্বা ছুটি নিয়ে রোজ দু’বেলা নার্সিংহোমে গিয়ে কয়েক ঘন্টা করে কাটিয়ে আসত সুবর্ণা। প্রথমে তিনটে রাত হরেন আর সে তো সারা রাতই ছিল। কখন কী দরকার হবে, কে জানে। পরে সুবর্ণা যেত কিন্তু কেবিনে ঢুকত না। তাকে দেখলে সংগ্রামনারায়ণের প্রতিক্রিয়া কী হবে, এবং তার হার্টের পক্ষে সেটা ফের কতটা হানিকর হয়ে উঠবে বুঝতে পারছিল না সে। তবে ডাক্তার দত্তরায় তাকে লক্ষ করে যাচ্ছিলেন। সংগ্রামনারায়ণ পুরোপুরি বিপন্মুক্ত হলে একদিন সুবর্ণার হাত ধরে তাঁর কেবিনে নিয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এই মেয়েটার জন্যে এবার প্রাণে বেঁচে গেলেন। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে সুবর্ণা কী কী করেছে, সব জানিয়ে দিয়েছিলেন।

ডাক্তার দত্তরায়ের হয়তো অভিপ্রায় ছিল, সুবর্ণাকে সংগ্রামনারায়ণ এরপর উপযুক্ত মর্যাদা দেবেন; তাকে দূরে সরিয়ে রাখবেন না। সুবর্ণা কিন্তু এসব নিয়ে একেবারেই ভাবেনি। সংগ্রামনারায়ণ সম্পর্কে তার বিশেষ শ্রদ্ধা ছিল না। দীর্ঘদিন উপেক্ষিত থেকে থেকে তাতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল সে। সংগ্রামনারায়ণের ব্যাপারে যা যা সে করেছে পরিচিত অন্য কেউ অসুস্থ হলে ঠিক তাই করত। মানুষ হিসেবে স্বাভাবিক কিছু কর্তব্য তো থাকে। সংগ্রামনারায়ণের কাছে তার কোনও প্রত্যাশা ছিল না।

ডাক্তার দত্তরায়ের কথাগুলো চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলেন সংগ্রানারায়ণ কিন্তু একটি কথাও বলেননি। তবে বারবার তার চোখ চলে যাচ্ছিল সুবর্ণার দিকে। কিন্তু তার মনোভাব বোঝা যাচ্ছিল না।

পরের দিন নার্সিংহোমে কাটিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন সংগ্রামনারায়ণ। স্ট্রেচারে করেই তাকে দোতলায় নিয়ে যেতে হয়েছিল। কেননা উঁচু উঁচু সিঁড়ি ভাঙা তাঁর দুর্বল হার্টের পক্ষে হানিকর।

হরেনকে সঙ্গে নিয়ে নার্সিংহোমে শ্বশুরকে আনতে গিয়েছিল সুবর্ণা। ডাক্তার দত্তরায়ও তাঁকে পৌঁছে দিতে এসেছিলেন। একতলায় সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিল সে। সজ্ঞানে মোটামুটি সুস্থ অবস্থায় সংগ্রামনারায়ণ তার ওপরে ওঠাটা পছন্দ করবেন কি না বুঝতে পারছিল না। কিন্তু স্ট্রেচারে শোওয়া অবস্থাতেই তিনি সুবর্ণাকে বলেছিলেন, ওপরে এসো।

নিঃশব্দে সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করেছিল সুবর্ণা।

দোতলায় এসে সংগ্রামনারায়ণকে তার বেডরুমে শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল। ডাক্তার দত্তরায় জানিয়েছিলেন, বড় ধাক্কাটা সামলে উঠেছেন তিনি, তবে এখন বেশ কিছুদিন শয্যাশায়ী থাকতে হবে। নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে। কোনওভাবেই উত্তেজিত হওয়া চলবে না। একজন নার্সও ঠিক করে দিয়েছিলেন ডাক্তার দত্তরায়। সে সারাদিন থেকে ঘড়ি ধরে সংগ্রামনারায়ণকে ওষুধ খাওয়ানো স্নান করানো থেকে শুরু করে সন্ধের পর রাতের খাওয়া খাইয়ে ছুটি পাবে। তবে নার্সের ওপর ভরসা করলেই চলবে না, তাঁর যত্নের দিকে বাড়ির লোকদেরও লক্ষ রাখতে হবে।

ডাক্তার দত্তরায় চলে যাবার পর সংগ্রামনারায়ণ সুবর্ণাকে বলেছিলেন, আমার অসুখে প্রচুর খরচ হয়েছে। ডাক্তার বলছিল সব টাকাটাই তুমি দিয়েছ। কাল ব্যাঙ্কের লোকদের ডেকে তোমার টাকা দেবার ব্যবস্থা করব।

সুবর্ণা উত্তর দেয়নি, মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। বুঝতে পারছিল, সংগ্রামনারায়ণ কারও কাছে ঋণী থাকতে চান না। সেটা তার রাজকীয় দম্ভে বাধবে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ।

তারপর সুবর্ণা মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করেছে, আমি কি এখন যাব?’

সংগ্রামনারায়ণ বলেছেন, হ্যাঁ, যাও।সুবর্ণা যখন দরজার কাছাকাছি গেছে সেই সময় পেছন থেকে হঠাৎ ডেকেছিলেন, শোন–

সুবর্ণা ঘুরে দাঁড়িয়ে উৎসুক চোখে তাকিয়েছিল।

সংগ্রামনারায়ণ বলেছেন, আজ থেকে দেবী আর তুমি আমার পাশের ঘরে থাকবে। হরেনকে পাঠিয়ে দাও। ওকে দিয়ে সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

সুবর্ণা ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে নামতে নামতে অবাক যে হয়নি তা নয়। পরে ভেবে দেখেছে, মুখ ফুটে না বললেও বিয়ের চার বছর পর তাকে দোতলায় গিয়ে থাকতে বলাটা তার কৃতজ্ঞতার প্রকাশ। কিংবা এমনও হতে পারে হার্ট-অ্যাটাকটা সংগ্রামনারায়ণের মনোবল অনেকটাই নষ্ট করে দিয়েছিল। পাশে তখন এমন একজনকে দরকার যার ওপর নির্ভর করা চলে। হয়তো ভেবেছিলেন, যে সুবর্ণা। তার প্রাণ বাঁচিয়েছে তার হাতে নিজের দায়িত্ব তুলে দেওয়া যায়।

সেদিনই দেবীকে নিয়ে দোতলায় চলে গিয়েছিল সুবর্ণা। কৃতজ্ঞতা, নির্ভরতা, বিশ্বাসের সঙ্গে পুরনো রাগ এবং বিদ্বেষ আর রাজকীয় দম্ভ-সব মিলিয়ে তার সম্পর্কে সংগ্রামনারায়ণের মনোভাবটা ছিল অদ্ভুত রকমের জটিল। ক্রমশ ধীরে ধীরে এটা মেনে নিয়েছিল সুবর্ণা। বিক্রম নেই, কিন্তু রয়েছেন অসহায় দুটি মানুষ। একজন স্মৃতিভ্রষ্ট শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ, অন্যজন রুণ, প্রায়-পঙ্গু সংগ্রামনারায়ণ। অদৃশ্য এক শৃঙ্খল যেন এবং বাড়ির সঙ্গে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছে। এ এক আশ্চর্য বন্ধন।

সুবর্ণা নিজে থেকে কোনওদিন কৌতূহল প্রকাশ করেনি। তবে মেজাজ ভাল থাকলে মাঝে মাঝে টুকরো টুকরোভাবে সংগ্রামনারায়ণ প্রতাপপুর স্টেটের কিছু কিছু খবর তাকে শুনিয়েছেন। দেশীয় রাজ্যগুলো ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে মিলেমিশে যখন একাকার হয়ে গেল তখন ক্ষতিপূরণ হিসেবে পুরনো রাজা-মহারাজা এবং নবাবদের পরিবারগুলিকে বার্ষিক বিরাট অঙ্কের রাজন্যভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা হল। শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ তখন সুস্থ ছিলেন, বোধবুদ্ধি সম্পূর্ণ অটুট। তার কাছে এটা অত্যন্ত অপমানজনক মনে হয়েছিল। প্রায় স্বাধীন রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নিয়ে সামান্য বকশিস তিনি মেনে নিতে পারেননি। এ যেন গরু মেরে জুতো দানের মতো ঘটনা। নেহরু এবং প্যাটেলকে এ জন্য সর্বাংশে দায়ী করেছিলেন তিনি। তাঁদের নাম শুনলে খেপে যেতেন। ফলে প্রতাপপুর স্টেট বার্ষিক ভাতা ফিরিয়ে দিয়েছিল।

বাবার মতো সংগ্রামনারায়ণের কাছেও রাজত্বের মর্যাদা ছিল সবার চেয়ে মূল্যবান। নেহরু প্যাটেলের প্রতি বিদ্বেষটা উত্তরাধিকার সূত্রে তিনিও। পেয়েছিলেন। ইন্ডিয়ান ডেমোক্রেসির একজন সামান্য ভোটার হয়ে বেঁচে থাকাটা তাঁর কাছে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর মতো ঘটনা। জীবনে তিনি কখনও ভোট দেননি এবং ভারত সরকারের গ্রান্টও স্পর্শ করেননি।

পূর্বপুরুষদের মতো উড়নচণ্ডে নন সংগ্রামনারায়ণ। ঠাকুরদা, তার বাবা কিংবা তার বাবাদের মতো দশ হাতে খোলামকুচির মতো টাকা ওড়াননি। পারিবারিক যা সঞ্চয় ছিল, তা থেকে বিক্রম কয়েক লাখ সরিয়ে নিয়ে গেলেও যেটুকু অবশিষ্ট আছে, আগেকার মতো রাজকীয় মেজাজে না হলেও বেশ ভালোভাবেই কাটিয়ে দেওয়া যায়। তবু আর্থিক ব্যাপারে তার হয়তো চাপা দুশ্চিন্তা ছিল। তাই খরচ কাটছাঁট করতে শুরু করেছিলেন। তখনও সব মিলিয়ে দশ বারোজন কাজের লোক ছিল। হরেন আর মায়াকে রেখে বাকিরা ভবিষ্যতে যাতে কষ্টে না পড়ে, তাই মোটা টাকা পয়সা দিয়ে বিদায় করা হয়েছিল। গাড়ি ছিল তিনটে। পুরনো, দামী স্টুডিবেকার আর ফোর্ডটা বেচে দিয়েছিলেন।

এর মধ্যে আরও একটা ঘটনা সুবর্ণাকে বড় রকমের ধাক্কা দিয়ে গেছে। সেই যে বিক্রম রুবিকে নিয়ে উধাও হয়েছিল, অনেকদিন তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। মাঝে মাঝে উড়ো খবর ভেসে আসত, সে নাকি লখনৌতে আছে। কখনও বা শোনা যেত, লখনৌ নয়–কলকাতায়। হঠাৎ একদিন বিক্রমের তরফ থেকে ল-ইয়ারের একটা নোটিশ এসেছিল। সে ডিভোর্স চায়। কারণ দাম্পত্য জীবনে বনিবনার অভাব, ইত্যাদি। নোটিশ থেকে বিক্রমের ঠিকানাও পাওয়া গিয়েছিল। সে তখন দিল্লিতে থাকত।

দু’টো দিন দারুণ অস্থিরতার মধ্যে কেটেছে সুবর্ণার। তারপর মনস্থির করে উকিলের চিঠিটা সংগ্রামনারায়ণকে দেখতে দিয়েছিল। হার্ট-অ্যাটাকের পর ডাক্তারের নির্দেশে চুপচাপ, শান্তই থাকতেন তিনি, কিন্তু সেদিন আবার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন, হারামজাদা চোরটাকে ডিভোর্স দিও না বৌমা। সেই প্রথম সুবর্ণাকে তার বৌমা বলা। হয়তো এইভাবেই তিনি তাকে প্রতাপপুর রয়্যাল ফ্যামিলিতে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।

কয়েক বছর আগে হলে মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েটি আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে যেত। কিন্তু এখন তেমন কোনও প্রতিক্রিয়াই হয়নি। উদাসীনভাবে সংগ্রামনারায়ণের কথাগুলো শুনে গেছে সে, কিন্তু নিজের সিদ্ধান্ত থেকে এক চুলও নড়েনি। বিক্রমের ল-ইয়ারকে জানিয়ে দিয়েছিল, বিবাহ বিচ্ছেদে সে রাজি।

ছ’মাস পর বম্বে থেকে কোর্টের রায় এসে গিয়েছিল। সম্পূর্ণ আইনসঙ্গতভাবে ডিভোর্সটা হয়ে গেছে। বহুকাল যোগাযোগ নেই বিক্রমের সঙ্গে, তবু মানসিক দিক থেকে যে সূক্ষ্ম, পলকা সম্পর্কটা তখনও অস্পষ্টভাবে থেকে গিয়েছিল সেটুকুও চিরকালের মতো ছিন্ন হয়ে গেল। বুকের মধ্যে কোথাও কি শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল? আসলে অভাববোধটা মানুষের নিজেরই তৈরি। সুবর্ণার ক্ষেত্রে তেমন কিছু একটা হয়ে থাকবে। কিন্তু ভ্যাকুয়াম চিরকাল বুঝিবা থাকে না, ধীরে ধীরে তা পূর্ণ হয়ে যায়।

শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ এবং সংগ্রামনারায়ণের সেবাযত্ন, দেখাশোনা, দেবীর পড়া, কলেজ, পরীক্ষার পেপার দেখা–এসবের পরও আচমকাই মেয়েদের একটা অর্গানাইজেশনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে সুবর্ণা। প্রথম প্রথম এত দিক সামলাতে হিমশিম খেয়ে যেত। এখন আর অসুবিধা হয় না। তার দৈনন্দিন যা রুটিন তাতে একটা দিন আরেকটা দিনের হুবহু জেরক্স কপি। সমস্ত কিছুই গতানুগতিক, খানিকটা বা যান্ত্রিক। কখনও কখনও সুবর্ণার মনে হয়, ভাবাবেগের চেয়ে দায়িত্বপালনই তার কাছে ক্রমশ বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে।

এইভাবেই চলছিল। দেবীকে বড় করে তোলা ছাড়া ভবিষ্যতের নির্দিষ্ট আর কোনও বড় লক্ষ্য সুবর্ণার সামনে আপাতত নেই।

এর মধ্যেই আজ সশস্ত্র, সাঙ্ঘাতিক এক হত্যাকারী যার বিরুদ্ধে গণ্ডা গণ্ডা খুনের চার্জ, ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ ঢুকে সমস্ত পরিবেশটা অসীম ত্রাস এবং উৎকণ্ঠায় ভরে দিয়েছে। …

অন্ধকারে উঁচু সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল সুবর্ণা। বাইরে হল-ঘরে গ্র্যান্ড ফাদার ক্লকটা সুরেলা ঝংকার তুলে জানিয়ে দিল বারোটা বাজে।

অন্যদিন এর মধ্যে দু-তিনবার শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে দেখে আসে সুবর্ণা। আজ সমস্ত অতীতটা অজস্র পুরনো ঘটনার মধ্যে তাকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যে ওঁর কথা খেয়াল ছিল না। যদিও রাজীব ভেতর থেকে দরজায় খিল তুলে ছিটকিনি আটকে দিয়েছে তবু শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের খবর নেওয়া দরকার। দেবী তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোচ্ছে। খুব সন্তর্পণে সুবর্ণা তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে মশারি তুলে বিছানা থেকে নেমে পড়ল। নিঃশব্দে দরজা খুলে বাইরে এসে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। এ ঘরের দরজা বন্ধ আছে ঠিকই, তবে হল-ঘরের দিকের জানালার একটা পাল্লা খানিকটা ভোলা। ভেতরে নীলাভ নাইট ল্যাম্প জ্বলছে।

জানালার ফাঁকে চোখ রেখে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে আবছা আলোয় দেখতে চেষ্টা করল সুবর্ণা। লেপ মুড়ি দিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমোচ্ছেন তিনি। কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে নিজের বেডরুমের দিকে যাবে, অন্ধকারে পায়ে কী একটা লেগে সামান্য শব্দ হল। সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে রাজীবের তীক্ষ্ণ চাপা গলা ভেসে এল, কে? পরক্ষণে হুড়মুড় করে বিছানা থেকে নেমে জানালার ওধারে এসে দাঁড়াল সে। তার হাতে সেই পিস্তলটা সুবর্ণার দিকে তাক করা।

ঘুমের মধ্যেও লোকটার স্নায়ু কতখানি সজাগ, মুহূর্তে টের পেয়ে যায় সুবর্ণা। সংগ্রামনারায়ণের ইন্দ্রিয়ও খুব সতর্ক কিন্তু এতটা নয়। আগেও তার মনে হয়েছে, এখন আরও একবার টের পেল আক্রমণের আশঙ্কা রাজীবকে সর্বক্ষণ তাড়া করে বেড়ায়। তাই ঘুমন্ত বা জাগ্রত, যে কোনও অবস্থাতেই তার স্নায়ুগুলো টান টান হয়ে থাকে।

কাঁপা গলায় সুবর্ণা সাড়া দেয়, আমি–’

ধীরে ধীরে পিস্তলসুদ্ধ হাতটা নামিয়ে নেয় রাজীব। বলে, ও, আপনি। আমি ভেবেছিলাম অন্য কেউ।

সুবর্ণা চুপ করে থাকে।

রাজীব থামেনি। সে বলে, আরেকটু হলে কী বিশ্রী একটা ব্যাপার হয়ে যেত বলুন তো। অন্ধকারে আপনাকে চিনতে পারিনি। ট্রিগারে চাপ পড়লে আচমকা একটা বুলেট বেরিয়ে যেতে পারত। এভাবে না জানিয়ে রাত্রিবেলা চলে আসবেন না। মনে থাকবে?

সুবর্ণা আস্তে মাথা হেলিয়ে দেয়, বলে, থাকবে। তার কণ্ঠস্বরের কাঁপুনি একই রকম রয়েছে।

রাজীব জিজ্ঞেস করে, আপনি বোধহয় আপনার গ্র্যান্ড ফাদার-ইন-ল’কে দেখতে এসেছিলেন?

হ্যাঁ।

আপনাকে তো বলেছি, আমি যতদিন আছি, গ্র্যান্ড ওল্ড ম্যানটি রাত্তিরে ঘর থেকে বেরুতে পারবে না। এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।

ঠিক আছে।

শুতে চলে যান। অনেক রাত হয়ে গেছে।

সুবর্ণা তার ঘরের দিকে যাচ্ছিল, রাজীব ডাকে, শুনুন—

সুবর্ণা ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়।

রাজীব কর্কশ সুরে বলে, যে কোনও জন্তুর চেয়ে আমার নার্ভগুলো বেশি অ্যালার্ট। যদি ঘুমিয়েও পড়ি কোনওরকম সুযোগ নেবার চেষ্টা করবেন না। সেটা আপনাদের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠবে।

লোকটার ইঙ্গিত মোটামুটি স্পষ্ট। ঘুমন্ত অবস্থায় সুবর্ণা তাকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করতে পারে, সেটাই হয়তো বোঝাতে চাইছে। ত্রস্ত ভঙ্গিতে সে বলে, বিশ্বাস করুন, বুড়ো মানুষটাকেই দেখতে এসেছিলাম। কয়েক বছর ধরে রাতে তিন চার বার ওঁকে দেখে যাচ্ছি। এটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। আমার অন্য কোনও উদ্দেশ্য ছিল না।

অন্ধকারে অনেকক্ষণ স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে রাজীব। তারপর নরম গলায় বলে, বিশ্বাস করলাম।

সুবর্ণা আর দাঁড়ায় না, নিঃশব্দে নিজের ঘরে ফিরে এসে শুয়ে পড়ে।

 » ০৮. ভোরবেলায় ঘুম থেকে ওঠা

০৮.

ভোরবেলায় ঘুম থেকে ওঠা সুবর্ণার চিরকালের অভ্যাস। সূর্যোদয় হয়ে গেছে, অথচ সে বিছানায় শুয়ে আছে, খুব অসুস্থ হয়ে পড়া ছাড়া এমনটা কখনও ঘটেনি।

আজকের দিনটা কিন্তু ব্যতিক্রম।

মায়ার ডাকে ধড়মড় করে উঠে সুবর্ণা দেখল, বেশ বেলা হয়েছে। পুব দিকের দুই জোড়া জানালা দিয়ে নভেম্বরের ঠান্ডা সোনালি রোদের ঢল নেমেছে ঘরের ভেতর। সকালের দিকে অন্যদিন অনেকটা সময় কুয়াশায় চারিদিক ঝাপসা হয়ে থাকে। আজ কিন্তু প্রতাপপুর সিটির বাড়িঘর, রাস্তা, গাছপালা–সব কিছু স্পষ্ট। কোথাও কুয়াশার চিহ্নমাত্র নেই।

দেবী তার আগেই উঠে পড়তে বসে গেছে। ওকে কোনওদিনই পড়ার জন্য তাড়া দিতে হয় না।

মায়া খাটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। সুবর্ণা বলল, এত বেলা হয়ে গেছে। আগে ডাকো নি কেন?

মায়া বলে, তিন-চার বার ডেকে গেছি। ভাবলাম কাল ওইরকম একটা ধকল গেছে। নিশ্চয়ই ঘুমোতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। তাই আর জোর করে জাগাই। নি।

মায়া ধকলের কথা বলতে রাজীবের মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে বুকর ভেতর ভয়ের ছায়া পড়ে। যতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল, একরকম কেটে গেছে। এই সকাল থেকে আবার দীর্ঘ, একটানা উৎকণ্ঠার শুরু। কিন্তু কিছুই করার নেই সুবর্ণার; অদ্ভুত এক মরণফাঁদে তারা আটকে গেছে। স্নায়ুমণ্ডলী কতকাল এই চাপ সহ্য করতে পারবে কে জানে।

বিছানা থেকে নামতে নামতে সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, দেবীকে খেতে দিয়েছ?

হ্যাঁ দেবী মা’র খাওয়া হয়ে গেছে।

বাবা?

উনি শুধু চা আর দু’খানা বিস্কুট খেয়েছেন। আপনাকে খুঁজছিলেন।

মুখ টুখ ধুয়ে যাচ্ছি। বাথরুমের দিকে যেতে যেতে সুবর্ণা বলল, দাদুরও তো কিছু খাওয়া হয়নি।

মায়া বলে, কী করে হবে? আপনি জোর করে না খাওয়ালে তো খেতেই চান না।

সুবর্ণা জিজ্ঞেস করল, কাল যিনি আমাদের বাড়ি এসেছেন, তাকে চা দিয়েছ?

ত্রস্ত স্বরে মায়া বলে, না।

বাথরুমের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়ে যায় সুবর্ণা। বলে, কেন?

লোকটার কাছে যেতে আমার হাত-পা কাঁপে। তাই—

ঠিক আছে, তুমি সবার খাবার গুছিয়ে রাখো। আমি আসছি।

মায়া চলে গেল।

কিছুক্ষণ পর মুখ ধুয়ে বাসি কাপড় বদলে কিচেনে চলে এল সুবর্ণা। একটা মস্ত ট্রেতে তিনজনের মতো ব্রেকফাস্ট সাজিয়ে অপেক্ষা করছিল মায়া। সংগ্রামনারায়ণের ফ্যাটওলা খাবার খাওয়া বারণ। তার জন্য রয়েছে নরম করে সেঁকা দু-স্লাইস পাঁউরুটি, কলা, ছানা আর এক গ্লাস ঠুট জুস। শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের দুই মাড়িতে একটাও দাঁত নেই, তিনি চিবোতে পারেন না। তাই তার জন্য ছানা, ফলের রস আর পাতলা সুজি। তবে রাজীবের জন্য কড়া বাটার টোস্ট, কলা, ওমলেট এবং চা।

ট্রেটা হাতে তুলে নিয়েছিল মায়া। সুবর্ণা তার হাত থেকে সেটা নিয়ে বলল, তোমাকে যেতে হবে না। আটটা বেজে গেছে। রান্না চড়িয়ে দাও।

মায়া বলল, হরেনদা নিচ থেকে জিজ্ঞেস করছিল বাজারে যেতে হবে কিনা।

ফ্রিজে মাছ-মাংস আনাজ যা আছে, আজ চলে যাবে না?

যাবে।

তাহলে বাজারে যাওয়ার দরকার নেই।

হরেনদা ফের ডাকলে তাই বলে দেব।

কী রান্না হবে তা আর জানতে চাইল না মায়া। অনেক বছর সে এখানে আছে। চারবেলা কে কী খাবে, সব তার মুখস্থ।

মিনিট পনেরো পর আমার চাটা আমার ঘরে দিয়ে যেও। বলে সোজা সংগ্রামনারায়ণের বেডরুমে চলে এল সুবর্ণা। বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে প্রতাপপুরের লোকাল বাংলা কাগজ দৈনিক দিনকাল’ পড়ছিলেন তিনি। বিকেলে এ বাড়িতে আসে কলকাতার একটা ইংলিশ ডেইলি। স্বাধীনতার পর শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে একটা ছোট এয়ারপোর্ট করা হয়েছে। ট্রেন আর দূর পাল্লার বাস ছাড়াও প্লেনে কলকাতার সঙ্গে এখন প্রতাপপুরের নিবিড় যোগাযোগ। দুপুরের ফ্লাইটে প্যাসেঞ্জার এবং নানা মালপত্রের সঙ্গে কলকাতার যেসব কাগজ আসে, বিকেলে সেগুলো বাড়ি বাড়ি বিলি হয়। সকালবেলা দৈনিক দিনকাল’ ছাড়া আর কোনও কাগজ নেই। স্থানীয় পত্রিকা বলে এখানকার মানুষজনের আলাদা একটা আবেগ রয়েছে। কলকাতার কাগজগুলোর মতো ছাপাটাপা বা লেখা অত ভাল না হলেও, চোখ ধাঁধানো রঙিন ছবি না থাকলেও সবাই ভাবে এটা তাদের একান্ত নিজস্ব পত্রিকা। তাই প্রতাপপুর সিটিতে দৈনিক দিনকাল’-এর প্রচুর কাটতি। প্রায় সব বাড়িতেই কাগজটা রাখা হয়।

পায়ের আওয়াজ শুনেও কাগজ থেকে চোখ সরালেন না সংগ্রামনারায়ণ। বললেন, মায়া বলছিল আজ সকালে ঘুম ভাঙতে তোমার বেশ দেরি হয়েছে। শরীর কি খুব খারাপ হয়েছিল?

সুবর্ণা ট্রে থেকে খাবারের প্লেট আর ফুট জুসের গ্লাস খাটের পাশের একটা নিচু সাইড টেবলে নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, না।

হাতের কাগজটা একপাশে রেখে এবার সুবর্ণার দিকে তাকালেন সংগ্রামনারায়ণ। বললেন, তোমাকে দেখে কিন্তু ভাল লাগছে না। চোখ-টোখ বসে গেছে।

অন্যদিন মুখ ধুয়ে ড্রেসিং টেবলের সামনে দাঁড়িয়ে চিরুনি দিয়ে চুল ঠিক করে নেয় সুবর্ণা। আজ বাথরুম থেকে বেরিয়েই কিচেনে চলে গিয়েছিল। আয়নায় নিজেকে দেখা হয়নি। না দেখলেও সংগ্রামনারায়ণ যখন বলছেন, নিশ্চয়ই তার চোখেমুখে কিছু একটা ছাপ পড়েছে। রাজীব এ বাড়িতে ঢোকার পর থেকে যে ভয় আর উৎকণ্ঠা শুরু হয়েছিল এটা তারই চিহ্ন।

খাবারের প্লেট নামানো হয়ে গিয়েছিল। সংগ্রামনারায়ণের খাটের আরেক ধারে উঁচু একটা টেবলে নানা আকারের সারি সারি ওষুধের শিশি আর প্যাকেট সাজানো রয়েছে। সেগুলো থেকে গোল, চৌকো, লম্বা, লাল, সবুজ, হলুদ-সব মিলিয়ে পাঁচটা ক্যাপসিউল আর ট্যাবলেট বের করে খাবারের প্লেটগুলোর পাশে রাখতে রাখতে সুবর্ণা বলল, না না, আমি ঠিক আছি।

বিয়ের পর সে যখন নিচে থাকত, সংগ্রামনারায়ণ তার সঙ্গে একটি কথাও বলেননি। কখনও সখনও একতলায় নামলে তার দিকে তাকাতেন না পর্যন্ত। তিনি নার্সিংহোম থেকে ফেরার পর দেবীকে নিয়ে সুবর্ণা দোতলায় উঠে এল। তখন অবশ্য কথা বলতেন, কিন্তু খুবই কম। যেটুকু না হলে নয়, ঠিক ততটুকুই। তবে দেবীর ব্যাপারটা বরাবরই আলাদা। সুবর্ণারা নিচে থাকার সময়ও রোজই মায়াকে পাঠিয়ে তাকে ওপরে নিয়ে যেতেন সংগ্রামনারায়ণ। রুক্ষ, কর্কশ, উগ্র একটি মানুষের ভেতর থেকে স্নেহপ্রবণ, কোমল আরেকটি মানুষ বেরিয়ে আসত। আসলে প্রতিটি মানুষের মধ্যে কত ধরনের মানুষ যে লুকানো থাকে! নানা সময়ে নানা চেহারায় বিদ্যুৎচমকের মতো তারা বেরিয়ে পড়ে।

বিক্রমের সঙ্গে ডিভোর্সের পর সংগ্রামনারায়ণ কিছুটা বদলে গিয়েছিলেন। মুখ ফুটে সেভাবে প্রকাশ না করলেও সুবর্ণার প্রতি তার হয়তো চাপা সহানুভূতি ছিল। আগের সেই উদাসীনতা, উপেক্ষা বা রূঢ়তা ক্রমশ কমে আসছিল। তাছাড়া সর্বক্ষণ যার সেবাযত্নের ওপর নির্ভর করতে হয় তার প্রতি স্বাভাবিক একটা কৃতজ্ঞতা থাকেই। বিবাহ বিচ্ছেদের পর থেকে সুবর্ণাকে কাছে বসিয়ে প্রায়ই অনেক গল্প-টল্প করেন। এটাই হয়তো তাঁর সমবেদনা প্রকাশের পদ্ধতি। আজ যে তার জন্য সংগ্রামনারায়ণকে উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে, কয়েক বছর আগে তা ভাবাও যেত না।

সংগ্রামনারায়ণ বললেন, ঠিক আছি বললে তো হবে না। আজ কলেজে না গিয়ে রেস্ট নাও।

সুবর্ণা জানাল আজ তার বেশ কয়েকটা ইমপর্ট্যান্ট ক্লাস আছে; কলেজে না গেলেই নয়। তারপর বলল, আপনি খান। দাদাভাইয়ের এখনও খাওয়া হয়নি। আমি যাচ্ছি–

হঠাৎ কিছু মনে পড়ে যাওয়ায় সংগ্রামনারায়ণ বললেন, তোমার সেই আত্মীয়টি ব্রেকফাস্ট করেছেন?

এখনও করেন নি। আমি তার খাবার নিয়ে যাচ্ছি।

কাল রাত্তিরে আলাপ হয়নি। ব্রেকফাস্ট হয়ে গেলে ওঁকে আমার ঘরে নিয়ে এসো।

একটু চুপ করে থেকে সুবর্ণা বলল, আচ্ছা—

বাকি খাবারসুদ্ধ ট্রেটা তুলে নিয়ে ঘর থেকে সে বেরুতে যাবে, ব্যস্তভাবে সংগ্রামনারায়ণ বললেন, একটু দাঁড়াও বৌমা–

উৎসুক চোখে তাকায় সুবর্ণা।

এই দেখ কাগজে কী সাঙ্ঘাতিক খবর বেরিয়েছে। বিছানার ওপাশ থেকে দৈনিক দিনকাল’-এর কপিটা তুলে নিয়ে আঙুল দিয়ে সংগ্রামনারায়ণ দেখাতে থাকেন, এই যে-’

খাটের কাছে এগিয়ে আসে সুবর্ণা। খবরের কাগজের প্রথম পাতায় নিচের দিকে বড় বড় হরফে পাঁচ কলমের হেডলাইন চোখে পড়ে। প্রতাপপুর সিটিতে উত্তর-পূর্ব ভারতের ভয়ঙ্কর এক সন্ত্রাসবাদীর প্রবেশ। সঙ্গে দাড়ি-টাড়িসুদ্ধ রাজীবের তিন কলমের ছবি আর স্টাফ রিপোর্টারের দীর্ঘ প্রতিবেদন।

ছবিটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে হৃৎপিণ্ড যেন জমাট বেঁধে গিয়েছিল। মাথাটা এত টলছিল যে হুড়মুড় করে সুবর্ণা পড়েই যেত, কোনওরকমে সামলে নিল।

সংগ্রামনারায়ণ বলছিলেন, কাগজে লিখেছে টেরোরিস্টটা পুলিশের তাড়া খেয়ে কাল আমাদের প্যালেসের দিকে চলে এসেছিল। এত বড় বাড়ি, কোথাও ঢুকে-টুকে বসে আছে কিনা কে জানে। একটু থেমে বললেন, কাল রাত্তিরে পুলিশ নাকি তার খোঁজে আমাদের বাড়িতে এসেছিল?

চমকে ওঠে সুবর্ণা। শ্বাসরুদ্ধের মতো জিজ্ঞেস করে, কে বললে?

সংগ্রামনারায়ণ বললেন, এই তো, রিপোর্টটায় বেরিয়েছে।

আস্তে মাথা হেলিয়ে দেয় সুবর্ণা। বলে, হ্যাঁ।

আমাকে ডাকোনি কেন?

আপনার শরীর ভাল না। ডাকলে টেনসন হত। সেটা হার্টের পক্ষে ক্ষতিকর। তাই–

চোখ কুঁচকে সংগ্রামনারায়ণ বললেন, এই যে ব্রেকফাস্ট নিয়ে এলে, এখনও তো পুলিশের খবরটা দাওনি।

ভেতরে ভেতরে একটু থমকে যায় সুবর্ণা। তারপর বলে, ভেবেছিলাম দাদাভাইকে খাইয়ে এসে বলব।

সংগ্রামনারায়ণ তার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কাল পুলিশ এসে কী করল? বেহ সুবর্ণা বলল, একতলাটা ঘুরে ঘুরে দেখল। আমাদের সাবধানে থাকতে বলল। আর টেরোরিস্টটার ডেসক্রিপশান দিয়ে অনুরোধ করল, এমন কাউকে দেখলে তক্ষুণি যেন থানায় ফোন করি।

ঠিক আছে।

সুবর্ণা আর দাঁড়াল না। স্তব্ধ হৃৎপিণ্ডটা এখন প্রবল বেগে ওঠানামা করছে।

রোজ খুব ভোরে হকার তাদের কাগজ দিয়ে যায়। মায়া একতলা থেকে সেটা তুলে প্রথমে তার কাছে নিয়ে আসে। সকালে খুঁটিয়ে কাগজ পড়ার সময় নেই; দ্রুত পাতা উলটে উলটে হেডলাইনগুলো দেখে শুধু, তারপর সংগ্রামনারায়ণের ঘরে পৌঁছে দেয়। অবশ্য বড় রকমের চাঞ্চল্যকর কোনও খবর থাকলে পুরোটা পড়ে ফেলে। আজ দেরি করে তার ঘুম ভাঙার জন্য খুব সম্ভব মায়া কাগজটা সংগ্রামনারায়ণকে দিয়ে গিয়েছিল। আগে সুবর্ণার হাতে পড়লে ওটা সে সরিয়ে ফেলত। খবরের কাগজ না পড়লে সংগ্রামনারায়ণের পেটের ভাত যে হজম হয় না, এমন নয়। পরে যদি চাইতেন কোনও একটা অছিলা খাড়া করে এড়িয়ে যাওয়া যেত। সুবর্ণা বলত, আজ কাগজ দেয়নি বা অন্য কিছু। দৈনিক দিনকাল’-এর প্রিন্টিং মেশিনটা অনেক কালের পুরনো। মাঝে মাঝেই গোলমাল করে, তখন দু-একদিন কাগজ বেরোয় না। এই অজুহাতটা দিলে অবিশ্বাস করতেন না সংগ্রামনারায়ণ। অবশ্য কাগজটা আগে ওঁর হাতে গেলেও ততটা দুশ্চিন্তার কারণ হত না, কিন্তু রিপোর্টের সঙ্গে রাজীবের ছবিটা ছাপা হয়ে মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। রাজীবকে দেখামাত্র সংগ্রামনারায়ণ চিনে ফেলবেন। তখন যে তার কী প্রতিক্রিয়া হবে ভাবতেও শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে বরফের মতো ঠান্ডা একটা স্রোত বইতে থাকে। প্রবল উৎকণ্ঠায় তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। মনে হচ্ছে রক্তচাপ হঠাৎ বিপজ্জনকভাবে কমে গিয়ে চোখের সামনের সমস্ত কিছু ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।

উদ্ভ্রান্তের মতো টলতে টলতে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে এসে একেবারে হকচকিয়ে গেল সুবর্ণা। বৃদ্ধটির ঘুম ভেঙে গেছে। তিনি মশারির ভেতর চুপচাপ বসে আছেন। অন্যদিন মায়া তাকে বিছানা থেকে তুলে মুখ ধুইয়ে পোশাক পালটিয়ে সোফায় বা ডিভানে বসিয়ে দিয়ে যায়। পরে এসে সুবর্ণা খাইয়ে দেয়। তার চমকটা শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের জন্য নয়। এই ঘরে আর যার থাকার কথা তার বদলে আরেক জন চেয়ারে বসে আছে। লোকটার মুখ নিখুঁত কামানো, চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো, পরনে অ্যাশ কালারের পরিষ্কার ট্রাউজার আর সাদা শার্টের ওপর লাল উলের পুল-ওভার। বিহ্বলের মতো তাকিয়ে লোকটাকে। দেখছিল সুবর্ণা। লোকটা বলল, আমাকে চিনতে পারছেন না মিসেস সিংহ! আমি রাজীব।

মুখ থেকে দাড়ির জঙ্গল নির্মূল করলে চেহারা যে এতটা বদলে যেতে পারে ভাবা যায়নি। তাছাড়া সুবর্ণার মস্তিষ্ক গভীর উৎকণ্ঠায় ঠাসা। খুঁটিয়ে লক্ষ করার মতো মনের অবস্থা তার ছিল না। থাকলে ঠিকই চিনে ফেলত। সামান্য যুক্তিবুদ্ধি প্রয়োগ না করলে বুঝতে পারত, এ ঘরে রাজীব ছাড়া বাইরের আর কারও থাকা সম্ভব নয়। বুকের ভেতর শ্বাস যেন আটকে গিয়েছিল সুবর্ণার। আবদ্ধ বাতাসটা। ধীরে ধীরে বাইরে বের করে দিয়ে বলল, ও, আপনি!

রাজীব বলল, আজ আপনার শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে আমাকে ফর্মালি ইনট্রোডিউস করিয়ে দেবেন। কাল আমার যে ওয়াইল্ড চেহারাটা দেখেছিলেন সেই অবস্থায় তো যাওয়া যায় না। ভাববেন মোস্ট সার্টেনলি আমি একটা ক্রিমিনাল। তাই সকালে উঠেই দাড়িটাড়ি সাফ করে, কাঁচি দিয়ে মাথার পেছন দিকের চুলের গোছা কেটে, স্নান সেরে, প্যান্ট-জামা চেঞ্জ করে আপনার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।

প্রচণ্ড টেনসনের মধ্যেও সামান্য আরাম বোধ করল সুবর্ণা। কাগজে যে ছবিটা বেরিয়েছে তার সঙ্গে আপাতদৃষ্টিতে রাজীবের চেহারার হয়তো তেমন মিল খুঁজে পাবেন না সংগ্রামনারায়ণ। যেহেতু সুবর্ণা আত্মীয় হিসেবে তার পরিচয় দেবে তাই মিল খোঁজার চেষ্টা করবেন না। দাড়ি থাকা এবং না থাকার মধ্যে তফাত বেঅনেকটাই। কলকাতার বাইরের শহরগুলো থেকে যেসব কাগজ বেরোয়। সেগুলোর ছাপাটাপা বেশ খারাপ। রাজীবের যে ছবিটা দৈনিক দিনকাল’-এ বেরিয়েছে সেটা খুব একটা স্পষ্ট নয়। তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ শক্তি না থাকলে দাড়িওলা আর দাড়ি কামানো, ফিটফাট রাজীব যে একই লোক, ধরা মুশকিল।

রাজীব এবার বলল, আমাকে এখন আপনার আত্মীয় বলে পরিচয় দেওয়া যেতে পারে, তাই না?

তার কণ্ঠস্বরে হয়তো একটু মজা বা শ্লেষ ছিল। সুবর্ণা উত্তর দিল না। ট্রেটা একটা টেবলে নামিয়ে রেখে ক্ষিপ্র হাতে মশারি খুলে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে বাথরুমে নিয়ে গেল। তার মুখ ধুইয়ে, পোশাক বদলে একটা সোফায় এনে বসাল। রাজীবকে ব্রেকফাস্ট দিয়ে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে খাওয়াতে খাওয়াতে চাপা গলায় বলল, একটা খারাপ খবর আছে।

খেতে খেতে চমকে সুবর্ণার দিকে তাকায় রাজীব। খুব আস্তে জিজ্ঞেস করে, কী খবর?

সুবর্ণা বলল, লোকাল একটা ডেইলিতে আজ বেরিয়েছে, নর্থ-ইস্টের একজন মারাত্মক টেরোরিস্ট প্রতাপপুর সিটিতে এসে ঢুকেছে। তার ছবিও ছাপা হয়েছে। কাল আপনার যে চেহারা দেখেছিলাম তার সঙ্গে ছবিটার খানিকটা মিল আছে।

চোখের দৃষ্টি অনেকক্ষণ স্থির হয়ে রইল রাজীবের। তারপর সে জিজ্ঞেস করল, পেপারটা কোথায়?

আমার শ্বশুরমশাইয়ের কাছে।

ওটা কি দেখা যায়?

পরে দেখাব। এখন চাইতে গেলে সন্দেহ করতে পারেন।’ বলে একটু থামল সুবর্ণা। তারপর কী ভেবে বলল, কিন্তু–

রাজীব বলল, কিন্তু কী?

ওটা বেঙ্গলি ডেইলি। বাংলা পড়তে অসুবিধে হবে না?

এক সময় আমি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ আর সায়েন্স কলেজের ছাত্র ছিলাম। বাংলাটা আগেই জানতাম। কলকাতায় থাকার সময় আরও ভাল করে শিখে নিয়েছি।

সুবর্ণা চুপ করে থাকে।

রাজীব জিজ্ঞেস করে, রিপোর্টটায় কী লিখেছে?

সুবর্ণা বলল, আমি ডিটেলে পড়িনি। শুধু হেডলাইন আর ছবিটাই দেখেছি। কিছুক্ষণ ভেবে রাজীব বলল, আপনার শ্বশুরমশাই আমাকে দেখলে কি কোনওরকম প্রবলেম হতে পারে?

কোন ধরনের প্রবলেমের কথা রাজীব বলছে, বুঝতে পারছিল সুবর্ণা। সে বলল, আপনি কতটা ট্যাক্টফুল হতে পারেন, তার ওপর সব নির্ভর করছে। আমার রিকোয়েস্ট, অ্যাপিলও বলতে পারেন–এমন কোনও ঘটনা যেন না ঘটে যাতে একজন হার্ট-পেশেন্টের ক্ষতি হয়।

এটা বোধহয় কালও আপনি বলেছিলেন।

হ্যাঁ।

আপনাকে যেটুকু দেখছি, মনে হয় শ্বশুর দাদাশ্বশুর, সবাইকে খুব ভালবাসেন।

ভেতরে ভেতরে কেমন যেন থমকে যায় সুবর্ণা। সে বলে, কতটা ভালবাসি বলতে পারব না। তবে আমি সামনে থাকতে কারও ক্ষতি হোক, কিংবা একটু যত্ন করলে কেউ যদি আরও কিছুদিন ভালভাবে বেঁচে থাকে, সেটা দেখতেই হবে। মানুষ হিসাবে এটুকু করতেই হয়।

এইসব শব্দপুঞ্জ একজন উগ্রপন্থীকে, যার কাছে হত্যাটা নেহাতই জলভাতের মতো ব্যাপার, আদৌ নাড়া দেয় কি না বোঝা যায় না। রাজীব কী বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ টেলিফোন বেজে ওঠে। ধীরে ধীরে সেটা তুলে নিয়ে সুবর্ণা হ্যালো’ বলতেই ওধার থেকে গম্ভীর, ভারী কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, কে বলছেন?

সুবর্ণা নিজের পরিচয় দেয়।

নমস্কার ম্যাডাম। আমি রামেশ্বর বসাক।

প্লিজ একটু ওয়েট করুন। মাউথপিসে হাত চাপা দিয়ে সুবর্ণা রাজীবকে খুব নিচু গলায় বলে, ওসি।

কী জন্যে ফোন করেছে?

এখনও বলেননি।

আমার কথা উঠলে আপনাকে কী বলতে হবে, ইউ নো প্রেটি ওয়েল।

ফোনের মুখ থেকে হাত সরিয়ে সুবর্ণা বলে, বলুন মিস্টার বসাক। আমার কাছে কি কিছু দরকার আছে?

রামেশ্বর বললেন, কাল আপনাদের প্যালেসের গ্রাউন্ড ফ্লোরটা শুধু দেখে এসেছিলাম। আজ দিনের আলোয় দোতলা আর ছাদটায় যদি ভাল করে খুঁজে দেখেন–

দ্বিধান্বিতভাবে সুবর্ণা বলে, দেখেছি। কেউ নেই।

আমাদের কাছে খবর আছে, টেরোরিস্টটা প্যালেসের কাছাকাছি কোথাও আছে। কাল সন্ধে থেকেই আপনাদের ওদিকটায় প্লেন ড্রেসে পুলিশ ওয়াচ রাখছে। লোকটা অন্য কোথাও গেলে তাদের চোখে পড়ত।

ও।

আজকের কাগজটা দেখেছেন?

উত্তর দিতে গিয়ে সুবর্ণা লক্ষ করল, স্থির চোখে পলকহীন তার দিকে তাকিয়ে আছে রাজীব। সে বলল, ভাল করে দেখা হয়নি।

রামেশ্বর বললেন, ওতে টেরোরিস্টটার ছবি বেরিয়েছে। দেখে নেবেন। তা হলে লোকটাকে চিনতে সুবিধা হবে।

আচ্ছা।

পরে আবার আপনাকে ফোন করব।

ঠিক আছে।

সুবর্ণার জবাবগুলো শুনে রাজীব মোটামুটি আন্দাজ করতে পেরেছিল রামেশ্বর কী ধরনের প্রশ্ন করেছেন। তবু জিজ্ঞেস করল, ওসি অত কী বলছিল?

টেলিফোন নামিয়ে রেখে তার সঙ্গে রামেশ্বরের যা কথাবার্তা হয়েছে, সব জানিয়ে দিল সুবর্ণা। তারপর আবার শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে খাওয়াতে লাগল।

হঠাৎ ফোন আসায় খাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল রাজীবের। ফের খেতে খেতে বলল, তার মানে এই প্যালেসের ওপর পুলিশ নজর রাখছে। দেখা যাচ্ছে খুব সহজে এখান থেকে বেরুনো যাবে না।

সুবর্ণা উত্তর দিল না।

ব্রেকফাস্ট করার পর রাজীব যখন চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে সেই সময় শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের খাওয়া শেষ হল। সুবর্ণা বলল, আমার শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে এখন আলাপ করতে যাবেন কি?

হা হা, নিশ্চয়ই। দ্রুত বাকি চাটুকু খেয়ে উঠে দাঁড়ায় রাজীব। সুবর্ণাও উঠে পড়েছিল। রাজীবকে সঙ্গে নিয়ে সে সংগ্রামনারায়ণের বেডরুমে চলে আসে।

ব্রেকফাস্ট শেষ করে, ক্যাপসিউল আর ট্যাবলেট খেয়ে ফের খবরের কাগজ পড়ছিলেন সংগ্রামনারায়ণ। সুবর্ণা ভয়ে ভয়ে বলল, বাবা, ওঁকে নিয়ে এসেছি। সে টের পাচ্ছিল, পা দু’টো ভীষণ কাঁপছে।

কাগজ থেকে চোখ তুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ রাজীবকে লক্ষ করেন সংগ্রামনারায়ণ। তারপর সামান্য দূরে একটা ডিভান দেখিয়ে বলেন, বসুন–

বসতে বসতে রাজীব বলে, আমি রাজীব। বয়সে আপনার থেকে অনেক ছোট। আপনি করে বললে অস্বস্তি হবে।

বেশ, তুমি করেই বলব। সংগ্রামনারায়ণ বললেন, কাল বৌমা যখন তোমার কথা বলল, ওষুধের রি-অ্যাকসানে চোখ মেলে তাকাতে পারছিলাম না।

হ্যাঁ, শুনেছি।

তুমি বৌমার কিরকম যেন আত্মীয় হও?

রাজীব উত্তর দেওয়ার আগেই, চোখকান বুজে মানুষ যেমন সমুদ্রে ঝাঁপ দেয়, অবিকল সেইভাবে সুবর্ণা বলে ওঠে, উনি আমার বৌদির পিসতুতো দাদা।

তার বলার ভঙ্গিটা এতই অস্বাভাবিক এবং সন্ত্রস্ত যে মুখ ফিরিয়ে একবার তাকে দেখে নিলেন সংগ্রামনারায়ণ। তারপর ফের রাজীবের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোথায় থাকো?

রাজীবের মধ্যে কিন্তু কোনওরকম চাঞ্চল্য নেই। অবিচলিত সুরে বলল, দিল্লিতে।’

চাকরি করো?

না।

তা হলে?

আপাতত কিছুই প্রায় করি না। একটা কলেজে পড়াতাম, ছেড়ে দিয়েছি।

এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্ন করা হয়তো অশোভন মনে হল সংগ্রামনারায়ণের। তাই অন্য কথায় চলে গেলেন, দিল্লি থেকে সোজা আমাদের এখানেই এসেছ?

হ্যাঁ। আস্তে মাথা নাড়ে রাজীব। বলে, জরুরি একটা কাজে আমাকে আসাম যেতে হবে। আমার বোন আর ভগ্নিপতি বলল, আপনার বৌমার সঙ্গে দেখা করে যেতে। তাই

ভালই করেছ। তোমার এখানে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো?

না।

একটু চুপ করে থেকে সংগ্রামনারায়ণ বললেন, রয়ালটি চলে গেছে। জওহরলাল-প্যাটেলরা জোর করে প্রতাপপুর স্টেট কেড়ে নিয়ে আমাদের ভিখিরি করে দিলে। তোমার আদরযত্ন কতটুকু আর করব! যখন রাজত্ব ছিল তখন যদি আসতে–একটু থেমে ফের বললেন, তখন আর আসবে কী করে? তোমার হয়তো সে সময় জন্মই হয়নি।

সুবর্ণা অবাক হয়ে যাচ্ছিল। উগ্র, ক্ষিপ্ত, রগচটা সংগ্রামনারায়ণ অনেকটা বদলে গেছেন ঠিকই কিন্তু এমন আন্তরিকভাবে রাজীবের সঙ্গে কথা বলবেন, ভাবতে পারেনি।

রাজীব জানাল, আদরযত্নের বিন্দুমাত্র ত্রুটি হচ্ছে না, সে বেশ আরামেই আছে।

কী উত্তর দিতে গিয়ে দৃষ্টিটা স্থির হয়ে গেল সংগ্রামনারায়ণের। ধীরে ধীরে এবার বললেন, জানো রাজীব, কাল অদ্ভুত একটা কো-ইন্সিডেনস ঘটেছে।

রাজীব উৎসুক সুরে জিজ্ঞেস করে, কীসের?’

কাল তুমিও এসেছ। এদিকে প্রায় একই সময়ে নর্থ-ইস্টের একজন ভয়ঙ্কর টেরোরিস্টকে আমাদের প্যালেসের কাছে দেখা গেছে। পুলিশ তার খোঁজে প্যালেসে ঢুকেও পড়েছিল। তাকে অবশ্য পায়নি। তবে বৌমাকে সাবধান করে দিয়ে গেছে।

সুবর্ণা চমকে ওঠে। রাজীব কি ধরা পড়ে গেল? দাড়িটাড়ি কামিয়েও কি সংগ্রামনারায়ণের চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি? এর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, ভাবতেও সাহস হচ্ছিল না সুবর্ণার। নিঃশ্বাস বন্ধ করে সে দাঁড়িয়ে থাকে।

সংগ্রামনারায়ণ টেরোরিস্ট বা পুলিশের কথা বললেও রাজীবের চোখে মুখে বিন্দুমাত্র অস্থিরতা দেখা গেল না। খুব শান্ত গলায় সে বলল, আপনার বৌমার কাছে আমিও তা শুনেছি।

একটু চুপচাপ।

তারপর সংগ্রামনারায়ণ বললেন, দিল্লি থেকে এতটা রাস্তা এসেছ। নিশ্চয়ই শরীরের ক্লান্তি কাটেনি। রেস্ট নাও গিয়ে। পরে আবার দেখা হবে।

সুবর্ণা একধারে দাঁড়িয়ে দু’জনকেই লক্ষ করছিল। ধীরে ধীরে তার বুকের ভেতর থেকে আবদ্ধ বাতাস বেরিয়ে আসে। যাক, সংগ্রামনারায়ণ রাজীবকে সন্দেহ করেননি। আপাতত দুর্ভাবনাটা অন্তত কাটল।

রাজীব চলে গিয়েছিল। সুবর্ণা ঘর থেকে বেরুতে যাবে, সংগ্রামনারায়ণ বললেন, বৌমা, একটু পরে যেও–’

সুবর্ণা থেমে যায়।

সংগ্রামনারায়ণ বলেন, রাজীবকে তুমি আগে কখনও দেখেছ?

বুকের ভেতরকার ধকধকানি হঠাৎ যেন বেড়ে যায় সুবর্ণার। তাহলে কি সংগ্রামনারায়ণ রাজীবের ব্যাপারে পুরোপুরি নিঃসংশয় নন? কাঁপা গলায় সুবর্ণা বলে, না।

সংগ্রামনারায়ণ জিজ্ঞেস করেন, ও-ই যে তোমার বৌদির পিসতুতো দাদা, বুঝলে কী করে?

প্রায় মরিয়া হয়ে সুবর্ণা বলে, আমার দাদার চিঠি নিয়ে উনি এসেছেন।

আর কোনও প্রশ্ন করলেন না সংগ্রামনারায়ণ। শুধু বললেন, আচ্ছা যাও।

সংগ্রামনারায়ণের সন্দেহ সম্পূর্ণ কেটেছে কি না বোঝা গেল না। সুবর্ণা আর দাঁড়াল না, সোজা নিজের ঘরে চলে এল।

মায়া তার জন্য অনেকক্ষণ আগে চা এবং দু স্লাইস টোস্ট রেখে গিয়েছিল। কাপটা তুলে ঠোঁটে ঠেকাতেই দেখা গেল চা জুড়িয়ে একেবারে জল। মাখন লাগানো টোস্ট ঠান্ডা হয়ে জুতোর চামড়ার মতো শক্ত হয়ে গেছে। মায়াকে বললে পাঁচ মিনিটের ভেতর আবার করে এনে দেবে।

সুবর্ণার চোখ দ্রুত হল-ঘরে গ্র্যান্ড ফাদার ক্লকটার দিকে চলে গেল। ন’টা বাজতে মিনিট পাঁচেক বাকি। সে ঠিক করে ফেলল, এখন আর কিছু খাবে না।

একবারে ভাত খেয়ে সওয়া দশটায় দেবীকে নিয়ে বেরিয়ে যাবে।

দেবীর ক্লাস এগারোটায় শুরু। বাড়ি থেকে মোটরে মিনিট পাঁচেকের পথ। দশটা পঁয়তাল্লিশ কি পঞ্চাশে বেরুলেও অসুবিধা নেই। অন্যদিন হরেনই তাকে স্কুলে পৌঁছে দেয়, ছুটির পর বাড়ি নিয়ে আসে। কিন্তু রাজীব ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ ঢোকার পর দেবী এত ভয় পেয়ে গেছে যে মাকে ছাড়তে চাইছে না। তাই সুবর্ণা ওকে স্কুলে পৌঁছে তো দেবেই, ছুটির পর সঙ্গে করে নিয়েও আসবে।

দেবীকে খানিকক্ষণ পড়িয়ে সুবর্ণা তাকে বাথরুমে পাঠাল। তারপর নিজেও স্নান করে নিল। সোয়া দশটায় খাওয়া-দাওয়া সেরে বাড়ি থেকে বেরুবার আগে মায়াকে বলল, বাবাকে ঠিক বারটায় খেতে দিয়ে দাদাভাইকে নিজে খাইয়ে দেবে। আমি বিকেলে এসে বাবাকে ওষুধ খাওয়াব।’ কলেজে বেরুবার আগে রোজ এই কথাগুলো মায়াকে মনে করিয়ে দেয় সে, যদিও এর কোনও প্রয়োজন নেই। কেননা মায়ার দায়িত্ববোধ যথেষ্ট। সে থাকতে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ এবং সংগ্রামনারায়ণের এতটুকু অযত্ন হবে না।

মায়া চাপা, ভীরু গলায় জিজ্ঞেস করল, আর ওই লোকটা?’

সুবর্ণা বলল, উনি যখন আমাদের বাড়িতে এসেছেন তখন অতিথিই। না খাইয়ে তো রাখা যাবে না। উনি কখন খান জানি না, জিজ্ঞেস করে এসে বলছি।

রাজীব সংগ্রামনারায়ণের ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের বেডরুমে চলে গিয়েছিল। একটা চেয়ারে এখন চুপচাপ বসে আছে। সুবর্ণা তার কাছ থেকে জেনে এসে মায়াকে বলল, বাবা আর দাদাভাইয়ের খাওয়া হলে ওঁকে খেতে দেবে। ঘরে দিতে হবে না, খাওয়ার টেবলে দিও।

মায়া এবার কী বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেল। তার মনোভাব বুঝতে পারছিল সুবর্ণা; ওর কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, কোনও ভয় নেই। আমি যেভাবে বলেছি সেভাবে চলবে। তা হলে ওই ভদ্রলোক কোনও ঝামেলা করবেন না। আরেকটা কথা–’

মায়া জিজ্ঞেস করে, কী?

ওর কাছে যে পিস্তল-টিস্তল আছে, বাবাকে বলবে না।

আচ্ছা–

.

০৯.

সুবর্ণা বাড়ির গাড়ি কখনও ব্যবহার করে না। প্রতাপপুর সিটিতে প্রচুর সাইকেল রিকশা আর অটো। সামনে যেটা পাওয়া যায় সেটা ধরেই সে কলেজে যাতায়াত করে। অন্য কোনও দরকারে বেরুলেও সেই অটো কিংবা রিকশা।

প্যালেস থেকে বেরিয়ে একটা সাইকেল রিকশা নিল সুবর্ণা আর দেবী। কাল ওসি রামেশ্বর বসাক বলেছিলেন, তাদের বাড়ির চারপাশে নজরদারি করার জন্য প্লেন ড্রেসের পুলিশ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন রাস্তায় প্রচুর লোকজন। সর্বত্র ব্যস্ততা। দোকানপাট, পোস্ট অফিস, ব্যাঙ্ক, যেদিকেই তাকানো যাক, উপচে পড়া ভিড়। তীক্ষ্ণ চোখে এধারে ওধারে লক্ষ করতে লাগল সুবর্ণা কিন্তু বিশাল জনতার মধ্যে কারা সাদা পোশাকের পুলিশ, জানা অসম্ভব। ভিড়ের ভেতর তারা নিশ্চয়ই মিশে আছে। কীভাবে এই অদৃশ্য পুলিশ বাহিনী রাজীবের জন্য গোপন ফাঁদ পেতে রেখেছে কে জানে।

দেবীদের রানী রাজেশ্বরী গার্লস হাই স্কুল’টা আগে পড়ে। তাকে গেটের সামনে নামিয়ে দিয়ে সুবর্ণা যখন তার কলেজে পৌঁছল, ঘড়িতে এগারোটা বেজে নয়। আজ তার প্রথম ক্লাস এগারটা দশে। হাতে একটুও সময় নেই।

রিকশা ভাড়া মিটিয়ে সোজা স্টাফ রুমে এসে ছাত্রছাত্রীদের অ্যাটেন্ডান্স রেজিস্টারটা নিয়ে উধ্বশ্বাসে উঁচু উঁচু সিঁড়ি ভেঙে তেতলায় ক্লাস রুমে চলে এল সুবর্ণা। চোদ্দ পনেরো বছর এই কলেজে পড়াচ্ছে সে, একদিনও এক মিনিট দেরিতে সে ক্লাসে ঢোকেনি। আজ কিন্তু প্রচণ্ড তাড়াহুড়ো করেও ঠিক সময়ে পৌঁছুনো গেল না।

রানী স্বর্ণময়ী কলেজ’ এক সময় ছিল শুধু মেয়েদের জন্য সংরক্ষিত। পরে কো-এড করা হয়। ক্লাসের মাঝখান দিয়ে সরু প্যাসেজ। সেটার একধারে মেয়েদের বসার জন্য সারি সারি বেঞ্চ, আরেক দিকের বেঞ্চগুলো ছেলেদের। মাঝখানের প্যাসেজটাকে ডিমার্কেশন লাইন বা সীমান্তরেখা বলা যেতে পারে।

সুবর্ণার পড়ানোর স্টাইল, ব্যক্তিত্ব আর চমৎকার ব্যবহার–সব মিলিয়ে এমন দারুণ একটা আকর্ষণ রয়েছে যে, পারতপক্ষে ছেলেমেয়েরা তার ক্লাস কামাই করে না। তাছাড়া সে যেসব নোট দেয় সেগুলো পরীক্ষার পক্ষে খুবই জরুরি। ক্লাসে অ্যাবসেন্ট থাকা মানে নোটগুলো পাওয়া যাবে না, তাতে তাদেরই ক্ষতি।

সুবর্ণা ক্লাসে ঢুকে ঝড়ের গতিতে রোল কল করে রেজিস্টারটা টেবলের একধারে রেখে দিল। মেয়েদের ভেতর থেকে কে একজন বলে উঠল, দিদি আজ আপনি ছ’মিনিট লেটে ক্লাসে এসেছেন।

সুবর্ণা এক পলক মেয়েটির দিকে তাকিয়ে একটু হাসল শুধু।

রোল কলের পর এক মিনিটও সময় নষ্ট করল না সে। অন্যদিনের মতো পড়ানো শুরু করল। ক্লাস লেকচার, নোট দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে বার বার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল সুবর্ণা। এই ক্লাস-রুম, পঞ্চাশ জন ছাত্রছাত্রী এবং জানালার বাইরে প্রতাপপুর সিটির নানা দৃশ্যাবলী আর শব্দপুঞ্জকে পেছন দিকে ঠেলে দিয়ে সিনেমার ক্লোজ শটের মতো রাজীবের মুখটা ক্রমশ চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। বাড়িতে এখন কী হচ্ছে কে জানে। মায়া যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। নিশ্চয়ই এমন কিছু করবে না যাতে তার নিজের ক্ষতি হয়। কিন্তু হঠাৎ ঘাবড়ে গিয়ে যদি হইচই বাধিয়ে বসে? সুবর্ণার মনে হয়েছে, সংগ্রামনারায়ণ রাজীবকে পুরোপুরি বিশ্বাস। করেননি। সন্দেহ মেটাতে যদি তিনি উঠে গিয়ে তার আসল আইডেন্টিটি জানার জন্য চাপ দিতে থাকেন? সুবর্ণা আর ভাবতে পারছিল না।

বছরের পর বছর সিলেবাসে কোনও পরিবর্তন নেই। পড়াতে পড়াতে সব তার মুখস্থ হয়ে গেছে। যান্ত্রিক নিয়মে ক্লাসটা শেষ করে স্টাফ রুমে চলে আসে সুবর্ণা। তার ভেতরে যে প্রচণ্ড আলোড়ন চলছিল, ছেলেমেয়েরা টের পায়নি।

স্টাফরুমের বড় ওয়াল ক্লকটায় বারটা বেজে পাঁচ। এখন পর পর দু’টো পিরিয়ড তার অফ। পরের ক্লাসটা সেই একটা চল্লিশে।

স্টাফ রুমটা মোটামুটি ফাঁকাই। অধ্যাপক অধ্যাপিকারা পরের ক্লাস নিতে চলে গেছেন। যাঁদের অফ-পিরিয়ড তারাই শুধু ছড়িয়ে ছিটিয়ে এধারে ওধারে বসে আছেন। ফিজিক্সের নবনীতা পুরকায়স্থ, ভূগোলের বেঢপ মোটা মৃন্ময়ী বড়াল, ইকনমিকসের বিমলেশ ভট্টাচার্য এবং হিস্ট্রির আদিনাথ বসুমল্লিক ছাড়া এখন আর কেউ নেই।

মৃন্ময়ীর যথেষ্ট বয়স হয়ে গেছে। দু-তিন বছরের মধ্যে রিটায়ার করবে। শেষ পর্যন্ত বিয়েটা আর করে উঠতে পারেনি। এ জীবনে সেটা আর সম্ভব নয়। সুবর্ণার। প্রতি চিরদিনই তার প্রচণ্ড ঈর্ষা। সুবর্ণা সুন্দরী, অসম্ভব জনপ্রিয় অধ্যাপিকা, ডিভোর্স হয়ে গেলেও সে রাজবংশের বউ–এসব মৃন্ময়ীর মাথায় আগুন ধরিয়ে দেয়। আগে চাঁছাছোলা ভাষায় বিশ্রীভাবে তাকে বিধিয়ে বিধিয়ে কথা বলত। তার আচরণ, অঙ্গভঙ্গি ছিল খুবই দৃষ্টিকটু। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আগেকার উদ্যম আর ঝঝ অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে। এখন ভেতরে তার যা-ই থাক, বাইরে একেবারে চুপচাপ। সুবর্ণার সঙ্গে বহুদিন সে কথা বন্ধ করে দিয়েছে। নবনীতাও এক সময় ছিল প্রচণ্ড ঈর্ষাকাতর। তবে মৃন্ময়ীর মতো অসভ্যতা কখনও করেনি। একটা বর জুটিয়ে ফেলার পর একেবারে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। সুবর্ণার সঙ্গে এখন তার। ব্যবহার যথেষ্ট আন্তরিক। কোনওদিন যে হিংসে করত, বোঝাই যায় না।

আদিনাথ বসুমল্লিকেরও মৃন্ময়ীর মতো রিটায়ারমেন্টের সময় হয়ে এসেছে। তিনি একেবারে ঝাড়া হাত-পা মানুষ। কলেজ এবং খাওয়া ছাড়া আর কিছুই। বোঝেন না।

স্টাফ রুমে চতুর্থ যে মানুষটি বসে আছে, সেই বিমলেশের মতো হিতাকাঙ্ক্ষী মা-বাবাকে বাদ দিলে সুবর্ণার জীবনে আর একজনও আসেনি। এমন মালিন্যহীন, স্বচ্ছ মানুষ আগে কখনও দেখেনি সে। ডিভোর্সের পর যখন ভেঙে পড়েছিল, বিমলেশই তাকে আগলে আগলে রেখেছে। তার দীর্ঘ ভবিষ্যতের কথা ভেবে একবারই শুধু বলেছিল, সুবর্ণা রাজি হলে সে তাকে বিয়ে করতে চায়। বুঝিয়েছিল, এই সোসাইটিতে তার এবং দেবীর নিরাপত্তার প্রয়োজন আছে। এমন একজন পাশে থাকা চাই যার ওপর নির্ভর করা চলে, যাকে বিশ্বাস করা যায়।

সুবর্ণা রাজি হয়নি। প্রতাপপুর রাজবংশের প্রতি তার বিন্দুমাত্র মোহ ছিল না। বিক্রম যে শূন্যতার সৃষ্টি করে গ্লিয়েছিল তা ক্রমশ ভরাট হয়ে আসছিল। একটি হৃদয়হীন বিশ্বাসঘাতকের জন্য তার মনে যা জমা হচ্ছিল তার নাম ঘৃণা। তবু দু’টি অসহায় বৃদ্ধকে ফেলে চলে যেতে পারেনি সে।

বিমলেশ দ্বিতীয় বার বিয়ের কথা বলেনি। সুবর্ণাকে পায়নি, তবু সর্বক্ষণ অপার সহানুভূতি এবং গভীর মমতায় সে তাকে ঘিরে আছে। কাম্য নারীটি তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে, সে জন্য তার মনে হয়তো দুঃখ আছে, আছে আক্ষেপ এবং তীব্র, গোপন কাতরতা। বাইরে কিন্তু তার প্রকাশ নেই। সুবর্ণাকে ছাড়া অন্য মেয়ের কথা সে ভাবতেই পারে না। একটা জীবন কাছাকাছি থেকেও তারা দূরেই রয়ে গেল।

অ্যাটেন্ডান্স রেজিস্টারটা টেবলের এক ধারে রেখে বিমলেশের কাছে এসে বসে পড়ল সুবর্ণা।

আদিনাথের নিত্যকর্মপদ্ধতির মধ্যে রয়েছে কলেজে এসে দু’বার টিফিন খাওয়া। দশটায় ভরপেট ভাত খেয়ে দু’টো টিফিন বাক্স বোঝাই করে খাবার নিয়ে আসেন। বারটায় এবং চারটেয় তাঁর টিফিনের সময়। নিয়মানুযায়ী প্রথম বাক্সটা খুলে খেতে শুরু করেছিলেন। সুবর্ণার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী ব্যাপার বল তো? কাগজে দেখলাম একটা মারাত্মক টেরোরিস্ট তোমাদের ওদিকে নাকি কাল ঘোরাঘুরি করছিল। পুলিশ চেজ করাতে ভ্যানিশ হয়ে যায়। তোমাদের প্যালেসে ঢুকে পড়েনি তো?

নবনীতা বিশাল টেবলের শেষ প্রান্ত থেকে বলে উঠল, রিপোর্টটা আমিও দেখেছি। লোকটার যে ছবি ছাপা হয়েছে, মনে হয় রুথলেস মার্ডারার। তোমাদের জন্যে এত ভয় করছিল যে বলে বোঝাতে পারব না। ভেবেছিলাম তোমাকে ফোন করব।’

না না, আমাদের বাড়িতে টেরোরিস্টটা ঢোকেনি। এমন ত্রস্তভাবে সুবর্ণা কথাগুলো বলল যে তার নিজের কানেই কেমন যেন বেখাপ্পা ঠেকল।

নবনীতা আবার বলে, আমার হাজব্যান্ড সকালে বাজারে গিয়েছিল। সে দেখে এসেছে প্রতাপপুর সিটিটা ভীষণ প্যানিকি হয়ে উঠেছে। লোকটার কাছে ডেডলি ওয়েপন রয়েছে। সে নাকি এত ডেসপারেট, যা খুশি করতে পারে।

রাজীব যে কতটা সাঙ্ঘাতিক এবং বেপরোয়া, প্রতাপপুর সিটিতে সুবর্ণার মতো সেটা আর কেউ জানে বলে মনে হয় না। গোটা বাড়িটাকে তার পিস্তলের নলের মুখে রেখে সে আজ কলেজে এসেছে। সেখানে এখন কী হচ্ছে কে জানে।

প্রচণ্ড অস্থিরতা বোধ করছিল সুবর্ণা। গলাটা প্রবল মানসিক চাপে শুকিয়ে যাচ্ছে। ভাল করে বসতে পারছিল না সে। স্টাফ রুমের একধারে একোয়া গার্ড লাগানো আছে। একবার সেখানে গিয়ে জল খেয়ে এল। কিন্তু কণ্ঠনলীর শুষ্ক, খসখসে ভাবটা কিছুতেই কাটছে না।

আদিনাথ বসুমল্লিক, যাঁর কাছে খাওয়াটাই একমাত্র প্যাসন, এছাড়া অন্য কোনও ব্যাপারে যার এতটুকু কৌতূহল নেই, তিনিও যে বেশ বিচলিত হয়ে পড়েছেন সেটা এবার বোঝা গেল। বললেন, তোমাদের অত বড় প্যালেস, ঢুকে কোথাও লুকিয়ে আছে কিনা কে জানে। কাগজে লিখেছে পুলিশ কাল রাতে তোমাদের ওখানে গিয়েছিল। ভাল করে চারদিক খুঁজে দেখেছিল তো?

কাঁপা গলায় সুবর্ণা বলল, হ্যাঁ।

যে মৃন্ময়ী বড়াল বহু বছর তার সঙ্গে কথা বলে না, সেও হঠাৎ বলে উঠল, রাতের অন্ধকারে ওই বিশাল বাড়িতে খোঁজাখুঁজি করা মুশকিল। পুলিশ ডেকে দিনের আলোয় আগাগোড়া সার্চ করাও। লোকটা কোথাও লুকিয়ে থাকলে তোমরা বিপদে পড়বে।

মৃন্ময়ীকে কথা বলতে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল সুবর্ণা। যে মহিলা তাকে। চিরকাল হিংসে করে এসেছে তার এই উদ্বেগটুকু কিন্তু খুবই আন্তরিক যা সুবর্ণার বুকের ভেতর কোনও একটা সূক্ষ্ম, গোপন জায়গায় ঝঙ্কার তুলে গেল। কিন্তু তাকে জানানো গেল না, বিপজ্জনক লোকটা জোর করে ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এর দখল নিয়ে বসে আছে। ফ্যাকাসে একটু হেসে শুধু বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন মৃন্ময়ীদি।

এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি বিমলেশ। চুপচাপ সে শুধু সুবর্ণার অস্থিরতা লক্ষ করছিল। এবার খুব নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, তোমার কী হয়েছে বল তো সুবর্ণা?

সুবর্ণা চমকে ওঠে। বলে, কী আবার হবে? কিছু না বলতে বলতে হঠাৎ তার মনে হয় বাড়ির একটা খবর নেওয়া দরকার। স্টাফ রুমের একধারে একটা টিপয়ের ওপর টেলিফোন রয়েছে। সুবর্ণা সোজা সেখানে গিয়ে ওটা তুলে নিয়ে ডায়াল করল। সে জানে ফোনটা রাজীবই ধরবে। তার সঙ্গে কথা বলে বাড়ির পরিস্থিতিটা নিশ্চয়ই জানা যাবে।

ওধার থেকে রাজীবের গলা ভেসে এল, হ্যালো, কে বলছেন?

কণ্ঠস্বর শুনে মনে হল নোকটা অতি মাত্রায় সতর্ক হয়ে আছে। ফোন করে কেউ তাকে ফাঁদে ফেলতে চায় কিনা, সেটা যেন বুঝে নিতে চাইছে। সুবর্ণা বলল, আমি–-আমি মিসেস সিংহ।

কোত্থেকে ফোন করছেন?

কলেজ থেকে।

এবার যেন অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে গেল রাজীব। বলল, কোনও দরকার আছে?

সুবর্ণার মতো স্মার্ট, শিক্ষিত মেয়েও বেশ খতিয়ে গেল। একটু ভেবে বলল, আপনার কোনওরকম অসুবিধা হচ্ছে না তো?’

টেলিফোনের ওপ্রান্তে হাসির শব্দ শোনা যায়। হাসতে হাসতে রাজীব বলে, আমার সুবিধা-অসুবিধা জানার জন্যে আপনি কিন্তু ফোনটা করেননি ম্যাডাম।

বিমূঢ়ের মতো সুবর্ণা জিজ্ঞেস করল, তবে কী জন্যে করেছি?

আপনি জানতে চাইছিলেন, আমি ম্যাসাকার ট্যাসাকারের মতো কোনও কাণ্ড ঘটিয়ে বসে আছি কিনা।বলে জোরে জোরে, প্রবল শব্দ করে হেসে ওঠে রাজীব।

লোকটা কি থটরিডার? মুখ না দেখেও, শুধু গলা শুনেই অন্যের মনের কথা জেনে যায়? হতচকিত সুবর্ণা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর যেন ধড়ফড় করতে করতে বলে ওঠে, না না, বিশ্বাস করুন এসব আমি কিছুই ভাবিনি। সে টের পাচ্ছিল এই নভেম্বরেও তার কপালে দানা ঘাম জমে উঠেছে।

রাজীব তার কথার জবাব না দিয়ে বলল, আপনি চলে যাবার পর যা যা ঘটেছে সংক্ষেপে জানিয়ে দিচ্ছি। চুপচাপ তো বসে থাকা যায় না। আপনার জড়ভরত দাদামশাইয়ের সঙ্গে আলাপ করার চেষ্টা করেছি। বাট দ্যাটস অ্যাবসোলুটলি ইমপসিবল। উনি অবশ্য দু-একবার রেসপন্ড করতে চাইছিলেন কিন্তু গলা দিয়ে মিহি ঘোড়ার ডাকের মতো সামান্য একটু আওয়াজ ছাড়া আর কিছু বেরোয়নি। মায়া সকালে ব্রেকফাস্ট দিয়ে সেই যে চলে গিয়েছিল, আর তাকে দেখিনি। খুব সম্ভব এ বাড়িতে আমার প্রেজেন্সটা সে পছন্দ করছে না কিংবা আমাকে ভয় পাচ্ছে। আপনার শ্বশুরমশাই বার দুই হল-ঘরে এসে আমার দিকে তেরছা চোখে তাকাতে তাকাতে ফের নিজের বেডরুমে ঢুকে গেছেন। আমি যে আপনার দাদার পিসতুতো শালা সেটা খুব সম্ভব উনি বিশ্বাস করেননি। আপনার দাদা, বৌদি বা তাদের ছেলেমেয়েদের নাম আমার জেনে নেওয়া হয়নি। শ্বশুরমশাই জেরা করলে মুশকিল হত। বাড়ি ফিরে ওঁদের তো বটেই, অন্য ক্লোজ আত্মীয়স্বজনদের নামও জানিয়ে দেবেন। ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা তো চাই।

দুর্বোধ্য গলায় কিছু একটা বলতে চাইল সুবর্ণা, পারল না।

রাজীব থামেনি, এর মধ্যে একজন মহিলা ফোন করেছিলেন। খুব সম্ভব আপনি যে উইমেন্স অর্গানাইজেশনটার সঙ্গে যুক্ত উনি তার সেক্রেটারি কিংবা ওইরকম কেউ হবেন। নামটা বলেছিলেন কিন্তু মনে করতে পারছি না। ভেরি সরি।

সুবর্ণা বলল, কে, মনোরমাদি?

হা হা, রাইট–মনোরমা অধিকারী। ওঁর ধারণা ছিল, আজ আপনার ক্লাস দেরিতে। বললেন, যদি সম্ভব হয় আজই সময় করে একবার যেন অর্গানাইজেশনের অফিসে যান। না যেতে পারলে সন্ধের পর উনি আবার বাড়িতে ফোন করবেন।

অনেক ধন্যবাদ।

তরল গলায় এবার রাজীব বলে, আপনার প্রাইভেট সেক্রেটারির কাজটা আশা করি ভালই করেছি, কী বলেন?

উত্তর না দিয়ে সুবর্ণা বলল, আচ্ছা এখন তা হলে ছাড়ি। আপনার যখন যা দরকার, মায়াকে বলবেন। ও দিয়ে যাবে।

সুবর্ণা টেলিফোন নামিয়ে রাখতে যাচ্ছিল, ব্যস্তভাবে রাজীব বলে উঠল, ছাড়বেন না, ছাড়বেন না। সব চাইতে ইমপর্টান্ট খবরটাই তো আপনাকে দেওয়া হয়নি।

কী?

কিছুক্ষণ আগে পুলিশের ফোন এসেছিল।

বুকের মধ্যে হিমের স্রোত বয়ে যায় সুবর্ণার। গলার ভেতর থেকে প্রতিধ্বনির মতো দু’টো শব্দ বেরিয়ে আসে, পুলিশের ফোন!

রাজীব বলল, হ্যাঁ। আপনাকে চাইছিল, বললাম কলেজে গেছেন। আমি কে জানতে চাইল, বলেছি আপনাদের কাজের লোক। আরও বলল, আজ খবরের কাগজে একটা দাড়িওলা ভয়ঙ্কর লোকের খবর বেরিয়েছে। তার মতো কাউকে দেখলে তক্ষুণি যেন থানায় জানিয়ে দেওয়া হয়। পরে ওরা আপনাকে কন্ট্যাক্ট করবে।

ঠিক আছে। শুকনো, ঝাপসা গলায় বলতে বলতে শিথিল হাতে ফোন নামিয়ে রেখে সুবর্ণা ফের বিমলেশের কাছাকাছি সেই চেয়ারটিতে এসে বসে। এই মুহূর্তে নিজের চেহারা দেখতে পাচ্ছিল না সে। সামনে একটা আয়না থাকলে বুঝতে পারত, তাকে কতটা বিপর্যস্ত দেখাচ্ছে।

পুলিশের লোকেরা ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এর সবাইকে চেনে। কাজের লোক বলে পার পেয়ে গেছে রাজীব। যদি ওরা তার নামটা জানতে চাইত? নিজের নাম অবশ্যই জানাতো না সে। তবে কী বলত? যাই বলুক, পুলিশ সন্দেহের বশে বাড়ি চলে এলে কী পরিস্থিতির সৃষ্টি হত কে জানে।

বড় হ্যান্ডব্যাগ থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছে নিল সুবর্ণা। চুল এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। ক্লান্তভাবে হাত দিয়ে চেপে চেপে সেগুলো ঠিক করতে লাগল।

সুবর্ণা লক্ষ করেনি, যে স্টাফ রুমে ঢোকার পর থেকে বিমলেশ তার দিকে তাকিয়ে আছে। এক মুহূর্তের জন্যও চোখ অন্য দিকে সরায়নি। খুব আস্তে করে সে ডাকে, সুবর্ণা–

সুবর্ণা মুখ ফেরায়।

বিমলেশ বলল, তোমাকে আজ ভীষণ রেস্টলেস দেখাচ্ছে।

সুবর্ণা কষ্ট করে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল, কই না, আমি ঠিক আছি।

গলার স্বর অনেক নিচে নামিয়ে বিমলেশ জিজ্ঞেস করে, বাড়িতেকাল পুলিশ এসেছিল, আজ ফোন করেছে–

তাকে থামিয়ে দিয়ে সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, পুলিশের ফোনের কথা তোমাকে কে বললে?

তুমি এতক্ষণ টেলিফোনে যা যা বলেছ, আমি সব শুনেছি। পুরোটা বুঝতে পারিনি। কেননা ওধার থেকে যে বলছিল তার কথা আমারপক্ষে শোনা সম্ভব নয়। তবে অনেকটাই বুঝতে পেরেছি।

সুবর্ণা উত্তর দিল না। বিমলেশ স্টাফ রুমের চারপাশ একবার দেখে নিল। আদিনাথ, নবনীতা বা মৃন্ময়ী যাতে শুনতে না পায়, সেইভাবে বলল, তোমার চোখমুখ বুঝিয়ে দিচ্ছে, ভীষণ টেনসনে আছ।

সুবর্ণা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল।

বিমলেশ সুবর্ণার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, সত্যি কথাটা কি এবার বলবে?

বিহ্বলের মতো সুবর্ণা বলে, কী জানতে চাইছ?

বিমলেশ বলল, আমার ধারণা, টেরোরিস্টটা তোমাদের বাড়িতেই ঢুকে আছে। সে এমন অবস্থার সৃষ্টি করেছে যে ভয়ে, আতঙ্কে তুমি মুখ খুলতে পারছ না। অ্যাম আই রাইট?

সুবর্ণা চোখ নামিয়ে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে বসে থাকে। এই পৃথিবীতে এখন বিমলেশকেই সবচেয়ে বিশ্বাস করে সে। কিন্তু রাজীব বার বার সতর্ক করে দিয়েছে কোনওভাবেই তার কথা কাউকে বলা চলবে না। নিষ্ঠুর এই হত্যাকারী যদি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারে তার সম্বন্ধে বিমলেশের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, তার পরিণতি সহজেই অনুমান করা যায়। কিন্তু কাল সন্ধে থেকে প্রচণ্ড চাপে সুবর্ণার স্নায়ুমণ্ডলী ভেঙে চুরমার হচ্ছে। তার সহ্যশক্তিও শেষ সীমায় পৌঁছেছে। মনের মধ্যে যে দ্বন্দ্বটা চলছিল, এক সময় মরিয়া হয়েই তা কাটিয়ে ওঠে সুবর্ণা। আস্তে আস্তে মাথা হেলিয়ে বলে, তুমি যা বললে সেটাই ঠিক। আমি কী যে করব, বুঝতে পারছি না।

আমাকে সব খুলে বলল। দেখি সমস্যার কোনও সলিউসন বার করা যায় কিনা।

কিন্তু এই স্টাফ রুমে বসে বলাটা রিস্কি হয়ে যাবে। কেউ না কেউ শুনে ফেলতে পারে।

ঠিক। এক কাজ করা যাক—

বল।

তোমার ক’টা পর্যন্ত ক্লাস আছে?

লাস্ট ক্লাসটা তিনটে কুড়িতে শেষ হবে।

আমারও তাই। তারপর আমার ফ্ল্যাটে চল। সেখানে বসে সব শুনব।

একটু ভেবে সুবর্ণা বলে, আজ তোমার ওখানে যাওয়া সম্ভব নয়। দেবীর ছুটির পর ওকে স্কুল থেকে বাড়ি নিয়ে যেতে হবে। তাছাড়া ফিরতে দেরি হলে লোকটা কিছু সন্দেহ করতে পারে। অবশ্য ও জানে আমি আমাদের উইমেন্স অর্গানাইজেশনের অফিসে কলেজের পর যেতে পারি।

ভালই হল। আমরা দু’জনে লাস্ট ক্লাসটা অফ করে আগে আগে যদি বেরিয়ে পড়ি কোনও প্রবলেম হবে না। আমাকে সবটা বলার পর দেবীকে নিয়ে তুমি ঠিক সময়ে বাড়ি যেতে পারবে।

.

১০.

প্রতাপপুর সিটির মাঝামাঝি মহারাজা সমরেন্দ্রনারায়ণ অ্যাভেনিউতে একটা মাল্টি-স্টোরিড বাড়ির দোতলায় বিমলেশের ফ্ল্যাট। তার সংসার পুরোপুরি ভূততান্ত্রিক। দু’টো কাজের লোক পবন আর হরিলাল সব কিছু চালায়। পবন দুবেলা রান্না করে। হরিলাল বাজার করা, বাসন মাজা, ফাইফরমাশ খাটা–এইসব করে থাকে। দু’জনেই মাঝবয়সী।

এখানে আরও অনেক বার এসেছে সুবর্ণা। তিন কামরার এই ফ্ল্যাটের বেডরুম, ড্রইংরুম, কিচেন, বিমলেশের পড়ার ঘর–কোথায় কী আছে তার সব মুখস্থ।

বিমলেশ আর সুবর্ণা ড্রইংরুমে এসে বসল। বিমলেশ বলল, আগে একটু কফি খেয়ে নেওয়া যাক, কী বল?

সুবর্ণা বলল, ঠিক আছে।

পবনকে ডেকে কফি করে আনতে বলল বিমলেশ।

পবন কাজেকর্মে খুবই চৌকস। পাঁচ মিনিটের মধ্যে শুধু কফিই না, সেই সঙ্গে কেক আর কাজু বাদামও এসে গেল।

কফিতে চুমুক দিয়ে বিমলেশ বলল, শুরু করো।

কাল সন্ধে থেকে এখন পর্যন্ত যা যা ঘটেছে, একটানা বলে গেল সুবর্ণা। সমস্ত ব্যাপারটা এতটাই ভীতিকর যে ড্রইমরুমটায় দম বন্ধ করা আবহাওয়ার সৃষ্টি করল। চমকপ্রদ রহস্য কাহিনীতেও এমন শ্বাসরোধী ঘটনাপ্রবাহ থাকে না।

অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বিমলেশ জিজ্ঞেস করল, নর্থ-ইস্ট ইন্ডিয়া থেকে লোকটা কী জন্যে এই প্রতাপপুর সিটিতে পালিয়ে এল, কিছু বলেছে? ওখানকার বেশির ভাগ স্টেটেই আর্মি আর প্যারামিলিটারি ফোর্স নামানো হয়েছে। তাদের তাড়া খেয়েই কি?

সুবর্ণা বলল, কিছুই বলতে পারব না। লোকটা শুরুতেই শাসিয়ে রেখেছে তার সম্বন্ধে কোনওরকম কৌতূহল প্রকাশ বা প্রশ্ন করা চলবে না। যার সঙ্গে ডেডলি ওয়েপন আছে, তাকে কিছু জিজ্ঞেস করার মতো দুঃসাহস আমার নেই।

বিমলেশ বলল, এখন পর্যন্ত ঠান্ডা মাথায় যা যা করেছ, প্রচণ্ড নার্ভের জোর আর ইনটেলিজেন্স না থাকলে তা করা সম্ভব নয়।

প্রশংসার কথাগুলো শুনেও যেন শুনল না সুবর্ণা। শেষ রক্ষা না হওয়া পর্যন্ত তার বুদ্ধিমত্তা বা স্নায়ুর জোর প্রমাণিত হবে কীভাবে? মাত্র কয়েক ঘণ্টা তো কেটেছে। যদি রাজীব কয়েক দিন থেকে যায়, স্নায়ুমণ্ডলী কি অক্ষত থাকবে? মনের জোর বা সঠিকভাবে মস্তিষ্ক খাটানোর কাজটা কি অটুট রাখা সম্ভব হবে? সে বলে, কাল সন্ধে ছ’টা থেকে আজ বিকেল তিনটে পর্যন্ত, মাত্র একুশটা ঘন্টা তো কাটল। লোকটা কতদিন আমাদের হোস্টেজ করে বাড়িতে থেকে যাবে জানি না। কেউ ভয়ে হঠাৎ কিছু করে বসলে আমরা একজনও বেঁচে থাকব না। এদিকে ওসি-কে বলেছি, আমাদের বাড়িতে কেউ ঢোকেনি। তিনি কতটা বিশ্বাস করেছেন জানি না। মাঝে মাঝেই ফোন করছেন। প্যালেসের ওপর ওয়াচ রাখার জন্য প্লেন ড্রেসের পুলিশ লাগিয়ে দিয়েছেন। এই অবস্থায় আমার কী করা উচিত বলতে পারো?

তোমার একার না, বাড়ির প্রতিটি লোকের একমাত্র কাজ হল সারাক্ষণ মাথা ঠান্ডা রাখা। টেরোরিস্টটাকে খুব কেয়ারফুলি হ্যান্ডল করতে হবে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ।

তারপর বিমলেশ বলল, কাগজে দেখলাম লোকটা সেসেসানিস্ট–বিচ্ছিন্নতাবাদী। ভারতবর্ষ থেকে ওরা আলাদা হয়ে ইন্ডিপেনডেন্ট স্টেট করতে চায়। ওর সঙ্গে আলাপ করতে আগ্রহ হচ্ছে।

সুবর্ণা আঁতকে ওঠে, কেন?

বিমলেশ বলল, দেখ, ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় উগ্রপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলাম। সেসব তোমাকে বলেছি। স্বপ্ন দেখেছিলাম দেশ শোষণ থেকে মুক্তি পাবে, সমাজ ব্যবস্থা পুরোপুরি বদলে যাবে। বিশ্বাস করতাম, রাইফেলের নল ছাড়া এসব কিছুই করা যাবে না। এক্সপ্লয়টেশনের অধিকার কেউ, সহজে ছাড়তে চায় না। আমার এখনও ধারণা, সোশাল সিস্টেমকে পালটাতে হলে ভায়োলেন্স ছাড়া অন্য কোনও রাস্তা বোধ হয় নেই।’

সুবর্ণার মনে পড়ল, বেশ কয়েক বছর আগে তাদের বন্ধুত্বটা যখন শুধু আড্ডা আর ফাজলামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, নির্ভরতা এবং আস্থার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে সেই সময় একদিন বিমলেশ তার জীবনের অনেক কথাই বলেছিল। সে একজন বড় মাপের স্বপ্নদর্শী, একজন আইডিয়ালিস্ট। ভাল রেজাল্ট করে কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দিয়ে আই. এ. এস, আই. পি. এস হব, বা মাল্টিন্যাশনাল কোনও কোম্পানির টপ একজিকিউটিভের পোস্ট বাগাব, কিংবা আমেরিকা অস্ট্রেলিয়া কি জার্মানিতে গিয়ে বিশাল কেরিয়ার তৈরি করব–এসব তার ভাবনার মধ্যে কখনও ছিল না স্বাধীনতার পর কিছু লোকের ঘরে টাকার পাহাড় জমতে লাগল, দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেল দেশের শতকরা ষাট ভাগ মানুষ, ভ্রষ্টাচারে ছেয়ে গেল সারা ভারতবর্ষ, আদর্শবাদ আর মানবিক মূল্যবোধগুলোকে গলা টিপে শেষ করে দেওয়া হল। পচা, গলা, দুর্গন্ধওলা সোশাল সিস্টেম দেশকে ধ্বংসের কাছাকাছি যখন পৌঁছে দিয়েছে সেই সময় বিমলেশ এবং তার মতো অসংখ্য তরুণ হাতে বন্দুক তুলে নিয়েছিল। তাদের ধারণা সশস্ত্র আন্দোলন ছাড়া সিস্টেমকে। ভাঙা যাবে না। তারপর অনেক দিন কেটে গেল। তাদের স্বপ্নপূরণ হয়তো হয়নি। তবু সেদিনের রাজনৈতিক বিশ্বাসের অনেকখানি এখনও তার মধ্যে থেকে গেছে। তবে এখন আর সে অ্যাক্টিভিস্ট নয়, সক্রিয়ভাবে কিছুই করে না। বিশ্বাসটুকু বাদ দিলে ছাত্রছাত্রীই তার কাছে সব। সুবর্ণা ছাড়া তার মতো জনপ্রিয় অধ্যাপক রানী স্বর্ণময়ী কলেজ’-এ আর একজনও নেই।

বিমলেশ বলল, আমার সঙ্গে লোকটার আলাপ করিয়ে দাও না–

জোরে জোরে প্রবলবেগে মাথা নেড়ে সুবর্ণা বলল, অসম্ভব। রাজীব কাউকে বিশ্বাস করে না। তোমাকে হঠাৎ নিয়ে গেলে তার রি-অ্যাকসন মারাত্মক হবে। ভাববে তোমাকে দিয়ে তাকে ট্র্যাপে ফেলতে চেষ্টা করছি।

হঠাৎ নিয়ে যাবে কেন? আগে ওর কনসেন্ট নেবে।

এক্ষুণি তোমাকে কথা দিতে পারছি না। কিছুদিন যাক, লোকটার মতিগতি বুঝতে চেষ্টা করি। যদি দেখি খানিকটা সফট হয়েছে, আমাকে তেমন অবিশ্বাস করছে না, তখন তোমার কথা বলব।

বেশ। তাই বলো—

কিন্তু–

কী?

তুমি ওই লোকটার সঙ্গে আলাপ করতে চাইছ কেন?

দু’টো কারণে। প্রথমত বুঝতে চেষ্টা করব পুলিশ যদি হঠাৎ কোনও কু পেয়ে ওকে ধরার জন্য প্যালেসে হানা দেয়, ও তোমাদের কতটা ক্ষতি করতে পারে। দ্বিতীয় কারণটা তাত্ত্বিক বলতে পার। আমরা নিজেদের দেশের মধ্যে থেকেই সিস্টেম বদলের কথা ভেবেছিলাম। ওরা ইন্ডিয়া থেকে কেন বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে চায় সেটা জানতে চাইব।

একটু চুপচাপ।

তারপর বিমলেশ আবার বলল, ইন ফ্যাক্ট, আগে কখনও কোনও বিচ্ছিন্নতাবাদীর সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি। ওদের সম্পর্কে আমার যথেষ্ট কৌতূহল আছে।

কৌতূহল কতটা মিটবে জানি না। এখন বলো আমি কী করব?

কিছুক্ষণ ভেবে বিমলেশ বলল, আপাতত ক’টা দিন যেমন চলছে চলুক। আমিও ভাবি, তুমিও চিন্তা কর। ওর হাত থেকে মুক্তির একটা পথ নিশ্চয়ই বেরিয়ে যাবে।

 ১১. বিমলেশের ফ্ল্যাট থেকে

১১.

বিমলেশের ফ্ল্যাট থেকে সোয়া চারটেয় বেরিয়ে পড়ল সুবর্ণা। দেবীর স্কুল এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। একটা ফাঁকা সাইকেল রিকশা থামিয়ে উঠে পড়ল সে। দেবীকে নিয়ে এই রিকশাতেই সোজা বাড়ি ফিরে যাবে। আজ আর মেয়েদের অর্গানাইজেশনে যাওয়া হবে না! কাল সময় করে একবার যাওয়ার চেষ্টা করবে।

বিমলেশ তাকে রাজীবের হাত থেকে মুক্তির কোনও রাস্তা দেখিয়ে দিতে পারেনি। শুধু ধৈর্য ধরে তার ওপর লক্ষ রাখতে বলেছে। এছাড়া উপায়ই বা কী? ধৈর্য, অন্তহীন ধৈর্য। তার সঙ্গে সুকৌশলে মেশাতে হবে যাবতীয় বুদ্ধিমত্তাকে। অপরিসীম দুর্ভাবনার মধ্যেও ক্ষীণ আশার চকিত একটা রেখা যেন দেখা দিল। বিমলেশের সঙ্গে রাজীবের যোগাযোগ ঘটিয়ে দিতে পারলে হয়তো কাজের কাজ কিছু একটা হতে পারে। বিমলেশ অত্যন্ত দুঃসাহসী, মস্তিষ্ক আশ্চর্য রকমের ঠান্ডা। প্রতিপক্ষের ভাবগতিক বুঝে হাসি মুখে পালটা গলে তাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসতে পারে। সুবর্ণাদের পরিবারের স্বার্থে দু’জনের আলাপ হওয়া একান্ত জরুরি। কিন্তু কীভাবে?

অল্পবয়সী রিকশাওলাটা গাড়ি চালাতে চালাতে কল, বৌদি–

এই শহরের বেশির ভাগ রিকশা, অটো আর টাকা সুবর্ণাকে চেনে। চোদ্দ বছরে এদের সবার গাড়িতে কতবার যে সে চড়েছে তার হিসেব নেই। ওরা যেমন তাকে চেনে, সে-ও তেমনি ওদের সবাইকে চেনে, এমনকি অনেকের নামও তার। জানা।

সুবর্ণা একটু চমকে উঠে বলে, কি রে ভানু?

আপনাদের রাজবাড়িতে নাকি একটা খুনী ঢুকে আছে?

কে বলল?

সবাই। কাগজে খবরটা বেরিয়েছে; খুনীর একটা ছবিও ছাপা হয়েছে। আপনি দেখেননি বৌদি?

বিচ্ছিন্নতাবাদী নয়, হত্যাকারী হিসেবেই তা হলে রাজীবের নামটা সারা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে! একটু চুপ করে থেকে সুবর্ণা বলল, দেখেছি।

প্যাডল করতে করতে আঁতকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ভানু, দেখেছেন!

হ্যাঁ, ছবিতে। সুবর্ণা বলল, আমাদের বাড়িতে ওরকম কেউ ঢোকেনি।

বিহ্বলের মতো কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে ভানু বলল, কিন্তু সবাই যে বলছে।

সুবর্ণা বলল, সত্যিই যদি ঢুকত আমি কি বেঁচে থাকতাম?

এবার যেন বিশ্বাস হল ভানুর। তা তো ঠিকই–’বলতে বলতে ফের সামনের দিকে তাকায়।

দেবীর স্কুলে গিয়ে দেখা গেল, সবে ছুটি হয়েছে। ওকে রিকশায় তুলে বাড়ি পৌঁছুতে পৌঁছুতে পাঁচটা বেজে গেল।

গেটের সামনে হরেন দাঁড়িয়ে ছিল। সাইকেল রিকশা থেকে নেমে দেবীকে নিয়ে সুবর্ণা যখন বাড়ির দিকে যাচ্ছে, সে-ও ওদের পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। তার চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ।

সুবর্ণার মনে হল, হরেন কিছু বলতে চায়। সে কোনও প্রশ্ন করল না। তার ইচ্ছা হরেন নিজের থেকে বলুক। তার চোখ মুখের চেহারা সুবর্ণাকে ভেতরে ভেতরে উদ্বিগ্ন করে তুলল।

দরজার কাছাকাছি এসে নিচু গলায় হরেন বলে, বৌদি, একটা কথা বলবার ছিল।

সুবর্ণা বলল, হ্যাঁ, বলো না—

দুপুরে দোতলায় অচেনা লোকের গলা শুনতে পেলাম।

সুবর্ণা থমকে দাঁড়িয়ে গেল। একটু চিন্তা করে জিজ্ঞেস করল, তুমি ওপরে গিয়েছিলে নাকি?

হরেন বলল, না না। নিচে বসেই কানে এল। কাগজে একটা খবর বেরিয়েছে, তাছাড়া যেখানে যাচ্ছি, লোকজন বলাবলি করছে একটা সাঙ্ঘাতিক খুনী নাকি কাল রাত্তিরে আমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়েছে। গলাটা তারই কিনা–বলতে বলতে থেমে যায় সে।

একজন সন্ত্রাসবাসী হত্যাকারীর ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ কাল রাত্তিরে ঢুকে পড়ার গুজব চারিদিকে যে চাউর হয়ে গেছে সেটা রিকশাওলা ভানু আর কলেজের কলিগদের নানা প্রশ্নে টের পাওয়া গিয়েছিল।

বিমলেশ ছাড়া অন্য সবার কাছেই ঘটনাটা পুরোপুরি অস্বীকার করেছে সুবর্ণা। কিন্তু হরেন এ বাড়িতে থাকে। সে নিশ্চয়ই রাজীবের গলা শুনেছে। হঠাৎ কখনও ওকে দেখেও ফেলতে পারে। হরেনের কাছে ব্যাপারটা গোপন রাখা ঠিক হবে না। তাকে খোলাখুলি সব জানিয়ে সাবধান করে দেওয়াটা খুবই জরুরি।

সুবর্ণা চাপা গলায় বলল, তোমার সঙ্গে আমার কিছু দরকারি কথা আছে। বলুন বৌদিদি’। এখন না, রাত্তিরে খাওয়া-দাওয়ার পর বলব। আমি কি ওপরে যাব?

না। আমিই নিচে আসব।

সুবর্ণা আর দাঁড়াল না, দেবীকে নিয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে দেখতে পেল শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ তার ঘরে বাচ্চাদের মতো টলমল করতে করতে হাঁটছেন আর সিঁড়ির দিকে মুখ করে সোফায় বসে কী একটা বই পড়ছে রাজীব। পায়ের শব্দে দ্রুত চোখ তুলে তাকাল সে। ততক্ষণে দোতলায় চলে এসেছে সুবর্ণারা। ওদের দেখেও সে কিছু বলল না।

সুবর্ণা দেবীকে বলল, ঘরে গিয়ে স্কুল ড্রেসটা চেঞ্জ করে হাতমুখ ধুয়ে নাও। আমি মায়াকে খাবার দিতে বলে আসি। মেয়েকে বেডরুমে পাঠিয়ে সে কিচেনে চলে গেল।

রোজই এই সময় বিকেলের খাবার তৈরি করে মায়া। একেক দিন একেক রকম। কোনওদিন পরটা, আলুর দম। কোনও দিন টোস্ট, ঘুগনি। কোনও দিন লুচি, পায়েস। বিকেলে সংগ্রামনারায়ণ আর শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ হরলিকস আর বিস্কুট ছাড়া কিছু খান না, ডাক্তারের বারণ। খাবার যা হয় সবই সুবর্ণা আর দেবীর জন্য। অবশ্য মায়াও খায়।

কিচেনে এসে সুবর্ণা দেখল, কচুরি ভাজার তোড়জোড় করছে মায়া। সতর্কভাবে চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, কোনও গোলমাল হয়নি তো?

প্রশ্নটার উদ্দেশ্য মায়ার কাছে পরিষ্কার। সে বলল, না, তবে ছোট বাবা বার কয়েক হল-ঘরে এসে লোকটাকে দেখে গেছেন।

সুবর্ণার মনে পড়ল, কলেজ থেকে যখন সে ফোন করেছিল তখন রাজীবও এই কথাগুলো জানিয়েছিল।

মায়া ফের বলল, একবার ছোট বাবা খানিকক্ষণ কথাও বলল লোকটার সঙ্গে। সুবর্ণা চমকে উঠল, কী কথা?

বলতে পারব না। আমি রান্নাঘরের দরজা ফাঁক করে বসেছিলাম। এতদূর থেকে কি শোনা যায়?

বাবা রাগারাগি চেঁচামেচি করেননি তো?

না।

দুশ্চিন্তা একটু কাটল ঠিকই, তবে মনের ভেতর সামান্য খিচ থেকে গেল। সুবর্ণা বলল, তুমি তাড়াতাড়ি সবার খাবার নিয়ে এসো।

নিজের ঘরে আসতেই তার চোখে পড়ল, দেবীর মুখটুখ ধোয়া হয়ে গেছে। সুবর্ণাও দ্রুত শাড়িটাড়ি পালটে, বাথরুম থেকে চোখে মুখে জল দিয়ে এল।

কিছুক্ষণ পর ট্রেতে করে খাবার নিয়ে এল মায়া। দেবীকে খেতে দিয়ে, নিজের কচুরি তরকারি ঢাকা দিয়ে রেখে প্রথমে সংগ্রামনারায়ণের বেডরুমে গেল সুবর্ণা। হরলিকসের গ্লাস, বিস্কুট, চারটে ট্যাবলেট আর জল খাটের পাশের একটা সাইড টেবলে গুছিয়ে দিয়ে বলল, বাবা, খেয়ে নেবেন। আমি যাচ্ছি—

সংগ্রামনারায়ণ তাঁর খাটের মাঝখানে চেক-বই নিয়ে বসে ছিলেন। প্রতি মাসের প্রথম এবং তৃতীয় সপ্তাহে দু’বার খরচের জন্য চেক লিখে তিনি সুবর্ণাকে দেন। সে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে নিয়ে আসে। বললেন, বৌমা, তোমার সঙ্গে কিছু আলোচনা আছে।

দাদাভাইকে খাইয়ে আসছি। খাবার নিয়ে সংগ্রামনারায়ণের বেডরুমে এসে কচুরির প্লেটটা রাজীবকে দিয়ে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে ধরে জোর করে ডিভানে বসিয়ে হরলিকস খাওয়াতে শুরু করল সুবর্ণা। জিজ্ঞেস করল, আমার কি আর কোনও ফোন এসেছিল?’

রাজীব বলল, হ্যাঁ। থানা থেকে আরও কয়েক বার খোঁজখবর নিয়েছে। আর আপনাদের অর্গানাইজেশনের সেই মনোরমা অধিকারীও খানিকক্ষণ আগে আবার ফোন করেছিলেন। আপনি কলেজ থেকে ফিরলেই কনট্যাক্ট করতে বলেছেন।

সুবর্ণা বলল, ঠিক আছে।

রাজীব হাতের বইটা সোফার একধারে রাখতে রাখতে বলল, আপনার পারমিসন না নিয়ে একটা কাজ করে ফেলেছি মিসেস সিংহ।’ বলে অল্প হাসল।

সুবর্ণা নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বলল, কারও পারমিসন নেওয়া কি আপনি প্রয়োজন মনে করেন?

তার কথার মধ্যে যে তীব্র ধাক্কাটা ছিল সেটা লক্ষই করল না রাজীব। সোফায় যে বইটা রেখেছিল সেদিকে আঙুল বাড়িয়ে বলল, সময় কাটছিল না বলে আপনার লাইব্রেরি থেকে এটা নিয়ে এসেছি। ভেরি ইন্টারেস্টিং বুক–’মেনি ফেসেস অফ কলোনিয়ালিজম। এমন বই আগে কখনও পড়িনি। বইটা সবার পড়া উচিত।

ইংরেজরা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এদেশে কলোনিয়ালিজমও শেষ। এ নিয়ে মাথা ঘামানোর আর দরকার আছে বলে আমি মনে করি না।

স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে রাজীব। তারপর জিজ্ঞেস করে, ইন্ডিয়ায় কলোনিয়ালিজম শেষ হয়ে গেছে বলে আপনি বিশ্বাস করেন?

উত্তর না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করল সুবর্ণা, আপনি কি বিশ্বাস করেন না?

একটু চুপ করে থেকে রাজীব বলল, সারাদিন কলেজ করে এসেছেন। নিশ্চয়ই ভীষণ টায়ার্ড। তার ওপর শ্বশুর আর দাদাশ্বশুরের সেবা করতে হচ্ছে। পরে কোনও একদিন কলোনিয়ালিজম ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।

সুবর্ণা জবাব দিল না। শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের খাওয়া শেষ হলে মনোরমা অধিকারীকে ফোন করল।

মনোরমা তাদের মহিলা সমিতি নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর অফিসেই ছিলেন। বললেন, তোমাকে আজ দু’বার ফোন করেছি, পাইনি।

সুবর্ণা বলল, শুনেছি। কিন্তু ওই সময় তো আমি কলেজে থাকি। বাড়িতে পাবেন কী করে?

আরে তাই তো, আমার একেবারেই খেয়াল ছিল না। শোন, তোমার সঙ্গে খুব জরুরি কিছু কথা আছে।

বলুন না—

মনোরমা বললেন, ফোনে বলা যাবে না। তুমি কি কাল কলেজ ছুটির পর নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর অফিসে আসতে পারবে? অসুবিধা থাকলে আমিও তোমাদের বাড়ি যেতে পারি।

মনোরমার ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ চলে আসাটা ঠিক হবে না। এখানে এলে রাজীবের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবার যথেষ্ট সম্ভাবনা। কেননা বাইরের যে কয়েক জন। সংগ্রামনারায়ণের আগাম অনুমতি না নিয়ে সোজা দোতলায় উঠতে পারে, মনোরমা তাদের মধ্যে পড়েন। যদি সত্যিই তিনি আসেন আর বুঝতে পারেন রাজীব সুবর্ণাদের বন্দুকের নলের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখেছে, তিনি ছাড়বেন না। আসলে মহিলা অত্যন্ত তেজী এবং খানিকটা বেপরোয়াও। যেভাবে হোক রাজীবের হাত থেকে তাদের মুক্ত করতে চাইবেন। কিন্তু তার ফলাফল ভয়াবহ হতে বাধ্য।

সুবর্ণা ত্রস্তভাবে বলল, না না, আপনাকে আসতে হবে না। আমিই যাব। তবে–

মনোরমা জিজ্ঞেস করলেন, তবে কী?

কাল যেতে পারব কিনা, বুঝতে পারছি না। কবে যাব, আপনাকে ফোন করে জানিয়ে দেবো।

আসলে রাজীবের সঙ্গে কথা না বলে সুবর্ণার পক্ষে আপাতত কথা দেওয়া সম্ভব নয়। তার স্বাধীনতা বলতে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। পুতুলনাচের পুতুলের মতো তার হাতে পায়ে অদৃশ্য সুতো বাঁধা রয়েছে। আর সেই সুতোর ডগাগুলো রয়েছে রাজীবের আঙুলে জড়ানো। সে যেভাবে তাকে চালাবে, অবিকল সেভাবেই তাকে চলতে হবে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজের কলেজ আর দেবীর স্কুলে যাওয়া এবং ছুটির পর বাড়ি ফিরে আসা-এর মধ্যেই তার গতিবিধি সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে রাজীব। তাকে না জানিয়ে ছুটির পর নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এ গিয়ে যদি দেরি হয়ে যায়, রাজীব তার মধ্যে ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত পেতে পারে। ভাবতে পারে তাকে বিপদে ফেলার জন্য কিছু একটা হোড়জোড় করছে সুবর্ণা। লোকটা এতই সন্দেহপ্রবণ যে সে কলেজে আছে কি না সে খোঁজও দু-তিন বার ফোন করে আজ নিয়েছে।

মনোরমা ব্যস্তভাবে বললেন, দেরি করলে চলবে না। কালই তোমার সঙ্গে দেখা হওয়াটা খুব আর্জেন্ট।

মিনিট পনের বাদে আপনাকে ফোন করছি। মনোরমাকে কিছু বলার সময় না দিয়ে লাইন কেটে দেয় সুবর্ণা।

আগাগোড়া তাকে লক্ষ করে যাচ্ছিল রাজীব। খুব আস্তে জিজ্ঞেস করল, মনে হচ্ছে আপনার মনোরমাদি আপনাকে কোনও একটা সমস্যায় ফেলে দিয়েছেন।

ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে সুবর্ণা, হ্যাঁ।

রাজীবের চোখেমুখে ঔৎসুক্য ফুটে ওঠে, প্রবলেমটা কী?

মনোরমা কী বলেছেন তা জানিয়ে দিল সুবর্ণা।

কিছুক্ষণ চুপচাপ কিছু ভাবল রাজীব। তারপর বলল, ঠিক আছে, কাল কলেজ ছুটির পর নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এ গিয়ে আপনার মনোরমাদির সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। আশা করি, আপনাদের পারিবারিক নিরাপত্তার ব্যাপারে যে ওয়ার্নিংগুলো কাল থেকে বার বার দিয়ে আসছি সেগুলো ভুলে যাবেন না।

সংগ্রামনারায়ণ এবং শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ যে তার হোস্টেজ হয়ে আছেন; সুবর্ণা মনোরমার সঙ্গে দেখা করে তার বিরুদ্ধে কোনওরকম গোলমাল পাকানোর চেষ্টা। করলে এঁদের পরিণতি কী হতে পারে, সেটাই আরেক বার মনে করিয়ে দিল রাজীব। স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে সুবর্ণা বলল, না, ভুলব না। আমি তা হলে মনোরমাদিকে ফোন করে কাল দেখা করার কথাটা বলে দিচ্ছি।

বলুন।

সুবর্ণা মনোরমাকে আরেক বার ফোন করল। কথা শেষ করে ফোন নামিয়ে রাখতে রাখতে রাজীবকে বলল, আমি এখন যাচ্ছি। কলেজ থেকে ফেরার পর এক কাপ চাও খাওয়া হয় নি। বলে একটু হাসল।

রাজীব ব্যস্তভাবে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, যান।

নিজের ঘরে চলে এল সুবর্ণা। কচুরি তরকারি ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। কোনওরকমে খেয়ে সংগ্রামনারায়ণের বেডরুমে এল।

চেক লেখা হয়ে গিয়েছিল। সুবর্ণার হাতে সেটা দিয়ে সংগ্রামনারায়ণ বললেন, বসো বৌমা–

একটা পুরু গদিওলা মোড়া খাটের কাছে টেনে এনে সুবর্ণা বসে পড়ল।

সংগ্রামনারায়ণ সামনের বিশাল জোড়া জানালা দিয়ে কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে রইলেন। সন্ধে হতে খুব বেশি দেরি নেই। সূর্য পশ্চিম দিকের উঁচু উঁচু গাছপালার মাথায় ফ্রিজ শটের মতো স্থির হয়ে রয়েছে। যে নিস্তেজ আলোটুকু এখনও আকাশের গায়ে আবছাভাবে লেগে আছে তার আয়ু আর কতক্ষণ? দেখতে দেখতে সূর্য ডুবে যাবে, ঝুপ করে নেমে আসবে অঘ্রাণের সন্ধে। অন্ধকারে ছেয়ে যাবে চোখের সামনে দৃশ্যমান প্রতাপপুর সিটির বাড়িঘর, রাস্তা, পার্ক।

একটু লক্ষ করলে এখন চোখে পড়ে, দূরে মিহি সিল্কের মতো কুয়াশা নামতে শুরু করেছে। হাওয়া দ্রুত ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।

সুবর্ণা বুঝতে পারল, জরুরি কথাটা বলার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছেন সংগ্রামনারায়ণ। সে অপেক্ষা করতে লাগল। মনে মনে কিছুটা টেনসন যে হচ্ছিল না তা নয়। কী বলবেন সংগ্রামনারায়ণ? রাজীব সম্পর্কেই কি কিছু?

একসময় সুবর্ণার দিকে মুখ ফিরিয়ে সংগ্রামনারায়ণ বললেন তোমার যে আত্মীয়টি এসেছে তার সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানি না।

যা আন্দাজ করা গিয়েছিল তা-ই। শ্বাসক্রিয়া যেন পলকের জন্য বন্ধ হয়ে গেল সুবর্ণার। নিঃশব্দে সে সংগ্রামনারায়ণকে লক্ষ করতে থাকে। রাজীব সম্পর্কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইলে তাকে খুবই সমস্যায় পড়তে হবে।

সংগ্রামনারায়ণ জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের আত্মীয়টি তোমার বৌদির কিরকম যেন ভাই হয়?

সংগ্রামনারায়ণ কি তাকে পরীক্ষা করতে চাইছেন? একটু হকচকিয়ে গেলেও সুবর্ণা টের পায় তার স্মৃতিশক্তি এখনও যথেষ্ট সক্রিয়। চাপা গলায় বলল, পিসতুতো ভাই।

সংগ্রামনারায়ণ বললেন, তোমার বৌদির পিসিমার কি আসাম বা নর্থ-ইস্টের অন্য কোনও স্টেটের লোকের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল?

সুবর্ণা চমকে ওঠে, এ কথা জানতে চাইছেন কেন বাবা?’

সংগ্রামনারায়ণ বললেন, তুমি রাজীবের চেহারা আর বাংলা উচ্চারণ লক্ষ করেছ?

তিনি কী ইঙ্গিত দিয়েছেন তা বুঝতে পারছিল সুবর্ণা। তবু বলল, হ্যাঁ, মানে–কেন বলুন তো?

সংগ্রামনারায়ণ বললেন, ওর মুখেচোখে একটা মঙ্গোলিয়ান ছাপ রয়েছে না? বাংলা প্রোনানসিয়েসনও পারফেক্ট নয়। তাই মনে হচ্ছে তোমার বৌদির পিসিমার বিয়েটা হয়তো নর্থ-ইস্টেই হয়েছে।

সুবর্ণার গলা শুকিয়ে আসছিল। সংগ্রামনারায়ণ রাজীব সম্পর্কে পুরোপুরি সংশয় মুক্ত হতে পারেন নি, সন্দেহটা তার মনে বদ্ধমূল হয়ে আছে। খুবই অস্বস্তি হচ্ছিল সুবর্ণার। ক্ষীণ স্বরে বলল, আমি অত ভাল জানি না। তবে এরপর কী বলবে, ভেবে নেওয়ার জন্য থেমে গেল সে।

তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে ছিলেন সংগ্রামনারায়ণ। বললেন তবে কী?

ভীষণ ঘাবড়ে যায় সুবর্ণা। এক রকম মরিয়া হয়েই বলে, আমি অত ভাল জানি না। বৌদির মুখে শুনেছিলাম, ওর পিসিমার ওদিকেই কোথায় যেন বিয়ে হয়েছে।

এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্ন করলেন না সংগ্রামনারায়ণ। শুধু বললেন, আজ দুপুরে তুমি যখন কলেজে, রাজীবের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্পটল্প করলাম। এমনি বেশ ভদ্র। ওকে বললাম, নতুন জায়গায় এসেছ, সারাক্ষণ ঘরে বসে আছ কেন? আমাদের ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি, সে তোমাকে গাড়িতে করে প্রতাপপুর সিটি, লেকটেক ঘুরিয়ে দেখাবে। রাজীব রাজি হল না। বলল, ভীষণ টায়ার্ড। দু-একদিন রেস্ট নিয়ে নিজেই ঘুরেটুরে দেখবে। পায়ে হেঁটে না ঘুরলে নাকি কোনও নতুন জায়গা ভাল করে দেখা হয় না। আমি বললাম, তবে তাই দেখো–’

শ্বাস আটকে গিয়েছিল সুবর্ণার। কোনওভাবেই স্বাভাবিক হতে পারছে না সে।

সংগ্রামনারায়ণ বললেন, বাবার ঘরে আমাদের টেলিফোনটা দেখলাম।

তিনি যে এটাও লক্ষ করবেন ভাবতে পারেনি সুবর্ণা। কাঁপা গলায় কোনওরকমে জানাল, সে নিজে সারাক্ষণ বাড়িতে থাকে না, কলেজে বেরুতে হয়। এদিকে রাজীবের কটা জরুরি ফোন আসার কথা আছে। তাই ওটা শেীর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে রেখে এসেছে।

সংগ্রামনারায়ণ কয়েক পলক কী ভেবে বললেন, ভালই করেছ।

কথায় কথায় সন্ধে নেমে গিয়েছিল। সুবর্ণা ধীরে ধীরে উঠে পড়ল। নিজের ঘরে এসে দেবীকে পড়তে বসিয়ে দিল। আর তখনই মনে পড়ে গেল, নিচে গিয়ে হরেনের সঙ্গে রাজীব সম্পর্কে কথা বলতে হবে। কিন্তু তার আগে রাজীবকে সেটা জানানো দরকার। ওই সশস্ত্র টেরোরিস্টটা এ বাড়িতে ঢোকার পর থেকে সুবর্ণার ইচ্ছা-অনিচ্ছা বলতে কিছুই আর কাজ করে না। নিজের থেকে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাই তার নেই। সে কোথায় যাবে, কেন যাবে, কার সঙ্গে কী কথা বলবে–সমস্ত কিছুই নির্ভর করছে ওই লোকটার অনুমতির ওপর। সর্বক্ষণ তার মনে হয়, অদৃশ্য রিমোট কন্ট্রোলে সে তার গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। তুই পড়। আমি এক্ষুণি একটা কাজ সেরে আসছি।’ এক নিঃশ্বাসে দেবীকে কথাগুলো বলে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে চলে এল সুবর্ণা।

কলোনিয়ালিজমের ওপর সেই বইটা পড়ছিল রাজীব। সুবর্ণাকে দেখে উৎসুক চোখে তাকাল।

সুবর্ণা বলল, তখন একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।

রাজীব জিজ্ঞেস করল, কী কথা?

হরেনের ব্যাপারটা জানিয়ে সুবর্ণা বলল, ওকে এখন গিয়ে বোঝাতে হবে আপনার সম্পর্কে যেন চুপচাপ থাকে, কারও কাছে মুখ না খোলে।

ঠিক আছে। আপনারা যখন কথা বলবেন আমি কিন্তু ল্যান্ডিংয়ের পিলারটার আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনব।

আচ্ছা।

কিছুক্ষণ নীরবতা।

তারপর রাজীব বলল, আমার মাথার ওপর পঞ্চাশ লাখ টাকার পুরস্কার রয়েছে। টাকার মতো খারাপ জিনিস আর নেই। লোভে পড়ে হরেন ডেসপারেটলি কিছু করে বসবে না তো?

সুবর্ণা বলল, হরেন খুবই বিশ্বাসী, কিন্তু ওর মতো ভীরু আর একটাও পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। তবু ভাল করে বুঝিয়ে দেবো, টাকার জন্যে বেপরোয়া হলে তার ফল কী হবে।

রাজীব উত্তর দিল না।

.

১২.

পরদিন কলেজ ছুটির পর একটা সাইকেল রিকশা নিল সুবর্ণা দেবীকে তার স্কুল থেকে তুলে সোজা নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর সামনে এসে থামল।

মহারানী হেমপ্রভা অ্যাভেনিউতে মনোরমা অধিকারীদের বিশাল তেতলা বাড়ি। গোটা বাড়ি জুড়েই নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর অফিস এবং কর্মশালা। দুঃস্থ, স্বামী পরিত্যক্ত, ধর্ষিত বা নানাভাবে নির্যাতিত যে মেয়েদের আবর্জনার মতো ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে, তাদের সযত্নে তুলে বাড়িতে নিয়ে এসেছেন মনোরমা। তিনিই এদের শেষ আশ্রয়।

বাড়িটার পেছন দিকে অনেকখানি কঁকা জায়গা। অসহায় মেয়েগুলো যাতে স্বাবলম্বী হতে পারে, ভাত-কাপড়ের জন্য তাদের কারও মুখাপেক্ষী হতে না হয়, সে জন্য ওখানে বড় বড় টিনের শেড তুলে কোনওটায় তাঁত বসানো হয়েছে। কোনওটায় বেত, বাঁশ, কোনওটায় বা চামড়ার কাজের জন্য রয়েছে ওয়ার্কশপ। এখানকার মেয়েদের তৈরি শাড়ি, নকশা-করা চাদর, টেবল ক্লথ, বেতের মোড়া বা চেয়ার, চামড়ার ব্যাগ, ঘর সাজানোর নানা জিনিস আর বটুয়ার বিরাট চাহিদা। শুধু প্রতাপপুরেই নয়, শিলিগুড়ি, কলকাতা, এমন কি সুদূর দিল্লি থেকেও ভাল অর্ডার আসে। ফলে আর্থিক দিক থেকে মেয়েরা অনেকখানি নিশ্চিন্ত। তাদের আত্মবিশ্বাস ক্রমশ বাড়ছে।

রিকশার ভাড়া মিটিয়ে দেবীকে নিয়ে একতলায় নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর অফিসে চলে এল সুবর্ণা।

মনোরমা টেবলের ওপর ঝুঁকে কিছু লিখছিলেন। পায়ের শব্দে মুখ তুলে একটু হেসে বললেন, তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। আরে দেবীকেও এনেছ!’

মনোরমার বয়স পঞ্চাশ বাহান্ন। সময় এলোপাথাড়ি ব্রাশ চালিয়ে তার চুল আধাআধি সাদা করে দিয়েছে। শরীর কিছুটা ভারী। চেহারায় যৌবনের পেলবতা মুছে গিয়ে রুক্ষতা ফুটে উঠেছে। তবু ডিম্বাকৃতি মুখ, ধারাল নাক, বড় বড় উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, অনেকটা মলিন হয়ে গেলেও ফর্সা রং, সব মিলিয়ে বলা যায় একসময় তিনি খুবই সুন্দরী ছিলেন।

একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে সুবর্ণা বলল, আসার সময় পথে ওর স্কুলটা পড়ল, তাই সঙ্গে করে নিয়ে এলাম। মনোরমার সঙ্গে একটু মিথ্যাচারণই করল সে। রাজীবের জন্য ইদানীং যে দেবীকে স্কুলে পৌঁছে দিচ্ছে এবং ছুটির পর নিয়ে আসছে সেটা আর বলল না।

বাড়ির পেছন দিকের ওয়ার্কশপগুলোতে এখন প্রচণ্ড কর্মব্যস্ততা। দু শিফটে ওখানে মেয়েরা কাজ করে। প্রথম শিফটটা সকালে সাতটায় শুরু, শেষ একটায়। দুপুর দু’টো থেকে আটটা পর্যন্ত যে শিফট, এখন সেটা চলছে। বাঁশ চেরাইর আওয়াজ, পেরেক ঠোকার আওয়াজ, তাতে চলার আওয়াজ, সব মিলিয়ে বিচিত্র অর্কেস্ট্রার মিশ্রিত শব্দ সেখান থেকে ভেসে আসছে। সেই সঙ্গে মেয়েদের টুকরো টুকরো কণ্ঠস্বর।

মনোরমা দেবীকে কাছে টেনে নিজের পাশে বসিয়ে আদর করতে করতে সস্নেহে বললেন, তুমি এসেছ, আমি খুব খুশি হয়েছি। কী খাবে বল?

দেবী লাজুক মুখে বলল, দুপুরে টিফিন খেয়েছি। এখন আর কিছু খাব না।

খাব না বললে শুনছি না। একটি মেয়েকে ডেকে দোকান থেকে সন্দেশ আর কাজু বাদাম কিনিয়ে এনে দেবীকে দিতে দিতে বললেন, তুমি খাও। আমি মায়ের সঙ্গে দরকারি কথা বলি- সুবর্ণার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, তোমাকে যে জন্যে কাল অত বার ফোন করেছিলাম সেটা শোন–

বলুন–উৎসুক চোখে তাকাল সুবর্ণা।

মনোরমা জানালেন, প্রতাপপুর সিটির বেশ কিছু মহিলা নন-ক্রিমিনাল লুনাটিক অর্থাৎ নিরপরাধ পাগলকে দীর্ঘ দশ পনের বছর জেলে আটকে রাখার পর আসছে সপ্তাহে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। এদের কারও মা-বাবা নেই। আত্মীয়-স্বজন যারা আছে তারা কেউ মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষগুলোর দায়িত্ব নিতে চায় না। খবরটা পাওয়ার পর ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়েছেন মনোরমা। বললেন, এই হেল্পলেস মেয়েগুলোর জন্যে আমাদের কিছু একটা করা দরকার।

সুবর্ণা মনোরমাকে যত দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। সে শুনেছে তার মা-বাবা দু’জনেই ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। ইংরেজের জেলে তাঁদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়টাই কেটে গেছে। স্বাধীনতার পর ইচ্ছা করলে তারা অনেক কিছুই পেতে পারতেন। তাম্রপত্র, অর্থ, মন্ত্রিত্ব এবং আরও অজস্র সুযোগ সুবিধা। কিন্তু তারা কিছুই নেন নি; রাজনীতি থেকে দূরে সরে গিয়ে বাকি জীবন সমাজসেবা করেই কাটিয়ে দিয়েছেন। মা-বাবার সততা আর আদর্শবাদকে উত্তরাধিকার হিসেবে পেয়েছেন মনোরমা। তিনি ওঁদের একমাত্র সন্তান। কলেজে পড়ার সময় থেকেই সমাজকল্যাণে, বিশেষ করে লাঞ্ছিত মেয়েদের জন্য কাজ করে চলেছেন। এম. এ পাশ করার পর কয়েক বছর রানী স্বর্ণময়ী কলেজে’-এ পড়িয়ে ছিলেন কিন্তু নির্যাতিত মেয়েদের সংখ্যা এত দ্রুত গতিতে বেড়ে যাচ্ছিল যে চাকরিটা শেষ পর্যন্ত ছেড়েই দিতে হল। মা-বাবার মৃত্যুর পর নিজেদের বাড়িতেই নারী বিকাশ কেন্দ্র গড়ে তুললেন। এই সংগঠনটার জন্য শেষ পর্যন্ত বিয়ে করারও সময় পান নি।

নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর জন্য নিজের যা কিছু সবই দিয়েছেন মনোরমা। গভর্নমেন্ট থেকে কিছু গ্রান্ট পাওয়া যায়, বিদেশ থেকেও ডোনেশন আসে। বড় বড় বিজনেস হাউস তাদের সোশাল ওয়েলফেয়ার ফান্ড থেকে কিছু টাকা দেয়। এ ছাড়া সাধারণ মানুষের ছোট ছোট দান তো আছেই। এই সব গ্রান্ট ট্রান্ট জোগাড় করতে কত জায়গায়, কত প্রভাবশালী লোকের কাছে যে ছোটাছুটি করতে হয়েছে তার হিসেব নেই।

এই বিশাল কাজ তো একা করা সম্ভব নয়। তাই সুবর্ণার মতো আরও অনেককেই নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এ টেনে এনে নানা দায়িত্ব দিয়েছেন।

এতদিন নির্যাতিত মেয়েদের জন্য জীবনের সব কিছু অর্থাৎ ব্যক্তিগত সুখ, আরাম, স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়েছেন। এখন নতুন করে যুক্ত হল নিরপরাধ পাগল মেয়েরা। ওদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে না পারলে যেন জীবনটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে মনোরমার।

সুবর্ণা বলল, নিশ্চয়ই কিছু করতে হবে।

মনোরমা বললেন, কিন্তু একটা সমস্যা আছে। সেই জন্যেই তোমাকে কাল ফোন করেছিলাম।

সমস্যাটা কী?

এত মেয়ে কোথায় রাখব? নারী বিকাশ কেন্দ্র’ তো বোঝাই। এখানে আর জায়গা নেই।

সুবর্ণাকে চিন্তিত দেখায়। সে বলে, তা হলে কী করবেন?

মনোরমা বলল, একটাই সলিউসন রয়েছে। তবে সেটা পুরোপুরি তোমার ওপর নির্ভর করছে।

উৎসুক সুরে সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, আমি কী করে সলভ করব?

তোমাদের প্যালেসের একতলায় অনেকগুলো ঘর ফাঁকা পড়ে আছে। যতদিন না অন্য কোনও ব্যবস্থা হচ্ছে ওখানে যদি ওদের থাকতে দাও’ বলতে বলতে চুপ করে গেলেন মনোরমা।

সুবর্ণা হকচকিয়ে যায়। কিছুক্ষণ ভেবে বলে, আমার নিজের আপত্তি নেই কিন্তু শ্বশুরমশাইয়ের পারমিসন ছাড়া তো কিছুই করা যাবে না মনোরমাদি।

মনোরমা বললেন, খুব বেশিদিন ওরা থাকবে না। ম্যাক্সিমাম একমাস। তার মধ্যেই ওদের জন্যে একটা বাড়ি ঠিক করে ফেলব। খাওয়া টাওয়ার যা খরচ, আমাদের অর্গানাইজেশনই দেবে। রান্নার লোকও আমরা পাঠাব। তুমি শ্বশুরমশাইকে একটু বুঝিয়ে বলো। তুমি বললে আশা করি উনি না’ বলবেন না।

আচ্ছা বলব।’বলতে বলতে রাজীবের মুখ চোখের সামনে ফুটে ওঠে সুবর্ণার। সঙ্গে সঙ্গে একটা প্রচণ্ড দুর্ভাবনা তাকে গ্রাস করে। শুধু সংগ্রামনারায়ণের অনুমতি নিলেই চলবে না, রাজীবের মতামতই সব থেকে জরুরি। তার আপত্তি থাকলে একটা মাছিকেও ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ ঢোকানো যাবে না। সে মনস্থির করে ফেলল, প্রথমে রাজীবকে বুঝিয়ে বলবে। তারপর সংগ্রামনারায়ণের কাছে যাবে।

বাড়ি ফিরে দেবীকে নিজেদের বেডরুমে পাঠিয়ে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে চলে এল সুবর্ণা।

রাজীব ইজি চেয়ারে শরীর এলিয়ে বই পড়ছিল। ধীরে ধীরে উঠে বসে জিজ্ঞেস করল, নিশ্চয়ই আপনার মনোরমাদির সঙ্গে দেখা করে এসেছেন।

হ্যাঁ।

কী জন্যে উনি আপনাকে ডেকেছিলেন?

মনোরমার সঙ্গে তার যা কথা হয়েছে, সব জানিয়ে ছিল সুবর্ণা। তারপর বলল, কী যে করব, বুঝে উঠতে পারছি না। বলে রাজীবের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করতে লাগল।

রাজীব তক্ষুণি উত্তর দিল না। মিনিটখানেক চুপ করে থেকে বলল, আপনার সমস্যাটা বুঝতে পারছি। উইমেন্স অর্গানাইজেশনের অ্যাক্টিভ মেম্বার হিসেবে আপনি মনোরমা দেবীকে না বলতে পারেন না। হিউম্যানিটারিয়ান গ্রাউন্ডে ওই হেল্পলেস মানুষগুলোকে শেলটার দেওয়াই উচিত। কিন্তু আপনার দুশ্চিন্তা আমাকে নিয়ে নিয়ে–তাই তো?’

সুবর্ণা আগেও লক্ষ করেছে, লোকটা অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন থট রিডার। কেউ মুখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে তার মনের কথা জেনে যায়। কিছু না বলে আস্তে মাথা নাড়ল সে। তবে আবছাভাবে এই প্রথম তার মনে হল, রাজীব শুধু একটা নিষ্ঠুর হননকারী নয়, তার মধ্যে দয়ামায়া সহানুভূতির মতো কোমল কিছু কিছু ব্যাপার এখনও থেকে গেছে।

রাজীব বলল, এক উইক পর মেয়েরা ছাড়া পাবে। এখনও অনেক সময় আছে। দু-একদিন ভেবে আপনাকে বলব।

সুবর্ণা আন্দাজ করল, নিজের নিরাপত্তা সম্পর্কে সব দিক খুঁটিয়ে দেখার জন্য সময় নিল রাজীব। যদি বোঝে মেয়েরা এলে তার ক্ষতির আশঙ্কা নেই, সে সম্পূর্ণ। সুরক্ষিত থাকতে পারবে, তা হলে হয়তো আপত্তি করবে না।

সুবর্ণা বলল, তাই বলবেন। আপনার মতামত জানতে পারলে মনোরমাদিকে ফোন করব। আমি এখন যাচ্ছি। নিজের বেডরুমের দিকে চলে গেল সে।

.

১৩.

আরও তিনটে দিন কেটে গেল।

এর মধ্যে বিপজ্জনক বা চমকে দেবার মতো কিছুই ঘটেনি। যান্ত্রিক নিয়মে সুবর্ণা রোজ যা যা করে তাই করে গেছে। ঘুম থেকে উঠে শ্বশুর এবং দাদাশ্বশুরের সেবা, মেয়েকে পড়ানো, রাজীবের প্রতি আতিথেয়তা, কোথাও এতটুকু ত্রুটি হয়নি। তারপর স্নান করে, খেয়ে, মেয়েকে তার স্কুলে নামিয়ে, কলেজে চলে গেছে। ফিরে এসেও প্রায় একই রুটিন।

এর মধ্যে ওসি রামেশ্বর বসাক যথারীতি টেরোরিস্টের খোঁজে দিনে দু’বার করে ফোন করেছেন। বিমলেশ রাজীবের সঙ্গে দেখা করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। রোজই সে এ জন্য তাড়া দিয়ে চলেছে। সংগ্রামনারায়ণ রাজীব সম্বন্ধে আর কোনও প্রশ্ন করেননি। তিনি সন্দেহমুক্ত হতে পেরেছেন কি না, মুখচোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে না।

রাজীব ঘর থেকে প্রায় বেরোয়ই নি। সুবর্ণার লাইব্রেরি থেকে একের পর এক বই এনে পড়ে পড়ে সময় কাটিয়ে দিয়েছে। এ বাড়ি থেকে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালানোর ছকটা সে ঠিক করে ফেলতে পেরেছে কি না টের পাওয়া যায়নি। তবে তার চেহারায় বা কথাবার্তায় আগের সেই উগ্রতা ততটা নেই। হয়তো ভেবেছে, ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ তার নিরাপত্তার ব্যাঘাত ঘটবে না। কেউ তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেবার চেষ্টা করবে না।

মায়া অবশ্য একটা খবর দিয়েছিল। একদিন দুপুরে নাকি রাজীব ছাদে উঠে কী সব দেখে এসেছে।

এই ক’দিন সামান্যই একটা পরিবর্তন হয়েছে। আগে রাজীবের ঘরে চার বেলাই তার খাবার টাবার দিয়ে আসতে হত। তার অনুরোধে দু’দিন ধরে রাতের খাওয়াটা হল-ঘরের ডাইনিং টেবলে বসে এক সঙ্গে খাচ্ছে সুবর্ণা।

.

আজ রাতেও তারা খেতে বসেছিল। পাশাপাশি নয়, মুখোমুখি। টেবলের দু’ধারে বসলে কথা বলতে সুবিধা হয়।

মায়া দু’জনের প্লেটে এবং বাটিতে বাটিতে রুটি, ছোলার ডাল, মুরগির মাংস, তরকারি ইত্যাদি সাজিয়ে দিয়ে কিচেনে চলে গিয়েছিল। রাজীবের সামনে পারতপক্ষে সে থাকতে চায় না। কিছু দরকার হলে তাকে ডাকতে হবে।

চুপচাপ খেতে খেতে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল সুবর্ণা। মানসিক ভারসাম্যহীন সেই নিরপরাধ মহিলারা ঠিক তিনদিন পর মুক্তি পাবে। অথচ তাদের থাকার ব্যবস্থা এখনও করা হয়নি। মনোরমাদি অনবরত ওদের এ বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য চাপ দিচ্ছেন। রাজীব বলেছিল, দু-একদিনের মধ্যে এ ব্যাপারে তার মতামত জানিয়ে দেবে। কিন্তু কিছুই জানায়নি। সুবর্ণা যে সাহস করে জিজ্ঞেস করবে, তাও পারেনি। লোকটা খুবই সন্দিগ্ধ ধরনের। যার খোঁজে পুলিশ খ্যাপা কুকুরের মতো চারিদিকে হন্যে হয়ে ঘুরছে তার এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। জিজ্ঞেস করলে যদি ভেবে বসে এর মধ্যে কোনও অভিসন্ধি আছে, সেই ভয়ে এ ব্যাপারে মুখ বুজে থাকতে হয়েছে।

রাজীব টেবলের উলটো দিকে বসে বোধহয় লক্ষ করছিল। হঠাৎ বলল, মিসেস সিংহ, কী হয়েছে বলুন তো–

সুবর্ণা চমকে ওঠে, কই, কিছু না। আপনাকে খুব আনমাইন্ডফুল দেখাচ্ছে।

হ্যাঁ, মানে–

কী?

সুবর্ণা এবার ঠিক করে ফেলল, রাজীব যা ভাবার ভাবুক, সে এখনই মেয়েগুলো সম্বন্ধে তার মত জেনে নেবে। বলল, সেদিন নন-ক্রিমিনাল লুনাটিক ক’টা মেয়ের কথা বলেছিলাম। আপনি কিন্তু এখনও আমাকে কিছু জানাননি। তিন দিন পর ওরা ছাড়া পাচ্ছে। মনোরমাদি ভীষণ তাড়া দিচ্ছেন।

রাজীব বলল, ওদের কথা আমি যে ভাবিনি তা নয়। সেদিনই আপনাকে বলেছি হেল্পলেস মেয়েগুলোকে শেলটার দেওয়া উচিত।’ বলে একটু থামল। কী চিন্তা করে ফের বলল, ঠিক আছে, ওদের নিয়ে আসবেন। কিন্তু–

কিন্তু কী?

ওরা এলে আপনাদের অর্গানাইজেশনের অন্য ওয়ার্কাররাও নিশ্চয়ই আসবেন।

তা তো আসবেনই।

তারা কিংবা নন-ক্রিমিনালরা, কেউ কিন্তু দোতলায় উঠতে পারবে না।

দেখুন, মনোরমাদি বন্দনাদি এমনি আরও যাঁরা নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর সঙ্গে জড়িত তারা এ বাড়িতে এলে ওপরে উঠে শ্বশুরমশাই আর দাদাশ্বশুরকে দেখে যান। আমার শ্বশুরমশাই বাইরের কেউ দোতলায় উঠলে ভীষণ রেগে যান। ওয়ান্স হি ওয়াজ আ কিং, এখনও নিজেকে রাজাই মনে করেন। কমোনারদের সম্পর্কে তার ভয়ঙ্কর ঘৃণা। কিন্তু আমাদের নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর অ্যাক্টিভিস্টদের, বিশেষ করে মনোরমাদিকে খুব পছন্দ করেন। লাঞ্ছিত মেয়েদের জন্যে সারাটা জীবন যেভাবে ডেডিকেট করেছেন, সম্ভবত সেই কারণে। ওঁরা এলে কীভাবে আটকাবো?

স্থির দৃষ্টিতে সুবর্ণার দিকে তাকিয়ে থাকে রাজীব। হয়তো বুঝতে চেষ্টা করে মনোরমাদের এ বাড়িতে আসার ভেতর কোনওরকম সূক্ষ্ম চাল রয়েছে কিনা। সুবর্ণা সেটা আঁচ করে নিয়ে দ্রুত বলে ওঠে, আমাদের অ্যাক্টিভিস্টদের সম্পর্কে একটা কথা জোর দিয়ে বলতে পারি, টরচার্ড ডিসকার্ডেড মেয়েদের বেঁচে থাকা আর ওদের বাঁচিয়ে রাখা, এর বাইরে ওঁরা আর কিছু ভাবতে পারেন না। আপনি মনোরমাদিদের সম্পর্কে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।

রাজীব বলল, ঠিক আছে। শুধু ওঁরা দোতলায় ওঠার আগে আমাকে জানিয়ে দেবেন। আমি অন্য কারও চোখে পড়তে চাই না।

আচ্ছা।

এখন পর্যন্ত যেটুকু দেখেছি তাতে আপনাকে অবিশ্বাস করার কারণ ঘটেনি। যে ক’দিন আছি, আশা করি, তেমন কিছু ঘটবে না।

রাজীব যে ক্রমশ তার প্রতি আস্থা রাখতে শুরু করেছে, এতে কিছুটা স্বস্তি বোধ করল সুবর্ণা। এই সশস্ত্র সন্ত্রাসবাদীর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক একটা বিপজ্জনক বিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছে। সর্বক্ষণ ভয় আর আতঙ্ক। রাজীব যদি মনে করে, সুবর্ণারা কোনওরকম ক্ষতি করবে না, ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ সে নিরাপদে থাকতে পারবে, তাহলে তার উগ্রতা কমে আসবে। সুবর্ণার প্রচণ্ড টেনসনও অনেকটাই হালকা হয়ে যাবে। হঠাৎ বিমলেশের মুখটা মনে পড়ল। এই হচ্ছে সুযোগ। তার সম্পর্কে রাজীবের সংশয় কেটে যেতে শুরু করেছে। এখনই বিমলেশের কথাটা বলা যেতে পারে।

খানিক নৈঃশব্দের পর সুবর্ণা বলল, আপনি যদি ভরসা দেন, একটা অনুরোধ করব।

রাজীব বলল, করুন।

আমার এক কলিগ একসময় উগ্রপন্থী আন্দোলনের একজন লিডার ছিল। দারুণ অনেস্ট আর আইডিয়ালিস্ট। এখন অবশ্য কোনওরকম মুভমেন্টের সঙ্গে জড়িত নেই। সে আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চায়। যদি–

হোয়াট? সুবর্ণার কথা শেষ হতে না হতেই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় রাজীব। চাপা, ক্রুদ্ধ স্বরে বলে, আমি যে এ বাড়িতে আছি, সে জানলে কী করে? আপনি বলেছেন?

বসুন। খুব শান্ত গলায় সুবর্ণা বলল, আমার সব কথা শুনলে বুঝতে পারবেন আপনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করিনি।

তার কণ্ঠস্বরে এমন এক দৃঢ়তা ছিল যাতে রাজীবের রাগ এবং উত্তেজনা অনেকটাই কমে আসে। সুবর্ণার চোখে চোখ রেখে ধীরে ধীরে ফের বসে পড়ে সে।

সুবর্ণা বলে, বিমলেশ অত্যন্ত ইনটেলিজেন্ট। আপনি এ বাড়িতে আসার পরদিন খবরের কাগজে যে রিপোর্ট বেরিয়েছিল সেটা পড়ে ও সিওর হয়ে যায়, আপনি আমাদের বাড়িতেই আছেন। আমাকে তার ধারণার কথা বলে। আমি প্রথমে স্বীকার করিনি। পরে এমনভাবে বোঝায় যে আমাদের বাড়ি ছাড়া আপনার পক্ষে অন্য কোথাও থাকা সম্ভব নয়। আমাকে শেষ পর্যন্ত মেনে নিতেই হয়। না থেমে এক নিঃশ্বাসে সে বলে যায়, বিমলেশ আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু, হিতাকাঙ্ক্ষী। আমাকে যদি বিশ্বাস করতে পারেন, ওকেও পারবেন।

রাজীব উত্তর দিল না।

একটানা বলতে বলতে হাঁফিয়ে পড়েছিল সুবর্ণা। জোরে শ্বাস টেনে ফের শুরু করে, একটা কথা ভেবে দেখুন, চারদিন আগে বিমলেশ আপনার খবরটা পেয়ে গেছে। ওর লোভ থাকলে পুলিশকে জানিয়ে দিতে পারত। তারা প্যালেস ঘিরে ফেললে আমরা হয়তো শেষ হয়ে যেতাম কিন্তু আপনিও রক্ষা পেতেন না। বিমলেশ ইনফরমেশনটা দেবার জন্য পঞ্চাশ লাখ টাকা পেয়ে যেত।

এতক্ষণে রাজীবের দৃষ্টি নরম হয়ে আসে। মাংসের ঝোলে রুটির একটা টুকরো ডুবিয়ে মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে সে জিজ্ঞেস করে, আপনার বন্ধু আমার সঙ্গে আলাপ করতে চান কেন?

খুব সম্ভব কোনও বিষয়ে আলোচনা করতে চায়।

কী বিষয়?

সেটা ও-ই বলবে।

রাজীব বলল, মনে হচ্ছে বিমলেশবাবু আমার সঙ্গে আলাপ করেন সেটা আপনিও চান। ঠিক আছে, ওঁকে নিয়ে আসবেন।

এত সহজে রাজীব রাজি হয়ে যাবে, ভাবতে পারেনি সুবর্ণা। বলল, কবে আনব?’

কাল কলেজ ছুটির পর আনতে পারেন।

চুপচাপ কিছুক্ষণ দু’জনে খেয়ে যায়। চারদিন রুদ্ধশ্বাসে কাটানোর পর এই প্রথম অনেকটা সহজভাবে বাইরের হাওয়া ফুসফুসে টানতে পারছে সুবর্ণা। ইদানীং সারারাত প্রায় জেগে জেগেই কেটে যায়। আজ খুব সম্ভব ভাল করে ঘুমোতে পারবে সে।

রাজীব ডাকল, মিসেস সিংহ–

বলুন।

আপনি আমাকে শেলটার দিয়েছেন, আপনার হসপিটালিটির তুলনা হয় না। একই বাড়িতে আমরা আছি, অথচ আপনার সম্বন্ধে কিছুই প্রায় জানি না।

আমিও তো একই কথা বলতে পারি। আপনার সম্পর্কে খবরের কাগজের রিপোর্টটা ছাড়া আর কিছুই আমারও জানা নেই।

রিপোের্টটা তো হাজার হাজার পাঠক পড়েছে। কিন্তু আমি যে কতটা ভীতিকর লোক, আমার মধ্যে কী ধরনের নিষ্ঠুরতা রয়েছে সে অভিজ্ঞতা শুধু আপনারই হয়েছে। সেটা কিন্তু কম জানা নয়। তবু যদি আরও জানতে চান, পরে কখনও বলা যাবে। আজ কিন্তু আপনার কথা শুনব।

সুবর্ণা চুপ করে থাকে।

রাজীব টেবলের ওপর সামান্য ঝুঁকে বলে, এ বাড়িতে আসার পর আপনার শ্বশুর, দাদাশ্বশুরকে দেখছি। কিন্তু আপনার স্বামী–মানে তিনি কি বাইরে থাকেন?

সুবর্ণা আস্তে মাথা নাড়ে, না। আমি ডিভোর্সি। সে অন্য একজনকে বিয়ে করে যতদূর জানি দিল্লিতে ছিল। এখন কোথায় আছে বলতে পারব না। এ বাড়ির সঙ্গে বহু বছর তার কোনও সম্পর্ক নেই।

রাজীব অবাক হয়ে যায়; কিছু বলে না।

তার মনোভাবটা মুহূর্তে বুঝে নেয় সুবর্ণা। এই সন্ত্রাসবাদী লোকটা তার ভেতরকার কোনও একটা স্পর্শকাতর জায়গায় যেন হাত দিয়ে ফেলেছে। সে বলে, ডিভোর্সের পর কেন এখানে পড়ে আছি, তাই জানতে চান তো?

রাজীব আস্তে মাথা নাড়ে, হ্যাঁ।

শুধু এটুকু বললে বুঝবেন না। পুরো ব্যাকগ্রাউন্ডটাই তাহলে শুনুন।

রাজীব উদ্‌গ্রীব তাকিয়ে থাকে।

সুবর্ণার ওপর হঠাৎ কী যেন ভর করে বসে। ঘোরের মধ্যে সে বলতে শুরু করে।

কখনও কখনও মানুষ নিজের অতীতকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে চায়। রাজীব উপলক্ষ মাত্র। অচেনা এই লোকটাকে সামনে বসিয়ে সুবর্ণা যেন নিজেকেই নিজের কথা শোনাতে থাকে। অনেকটা স্বগতোক্তির মতো। তবে মনে মনে নয়, স্পষ্ট উচ্চারণে।

সমস্ত শোনার পর মুখটা শক্ত হয়ে উঠেছিল রাজীবের। সে বলল, সংগ্রামনারায়ণ আর বিক্রম, দুজনেই দেখছি জঘন্য টাইপের স্কাউড্রেল। একজন বিশ্বাসঘাতকতা করে আপনাকে ফেলে পালিয়ে গেছে। কমোনার হওয়ার জন্যে। আরেক জনের কাছ থেকে ঘৃণা ছাড়া অন্য কিছু পাননি। তবু আপনি এখানে পড়ে আছেন?

মৃদু হাসির একটা রেখা সুবর্ণার মুখে ফুটে উঠেই মিলিয়ে যায়। সে বলে, একজন বোধবুদ্ধিহীন বুড়ো মানুষ, আরেক জন অসহায় হার্ট পেশেন্টকে ফেলে কি যাওয়া যায়?

মানবিকতা?

সুবর্ণা উত্তর দিল না।

অদ্ভুত হেসে রাজীব বলল, আপনি দেখছি পৃথিবীর মতো সর্বংসহা। ঘৃণা, বিশ্বাসভঙ্গ–কোনও কিছুই আপনাকে বিচলিত করে না।

সুবর্ণা এবারও কিছু বলল না; নিঃশব্দে খেতে লাগল।

রাজীব ফের বলল, মিসেস সিংহ, আপনি আমাকে অবাক করে দিয়েছেন। সকাল থেকে শ্বশুর, দাদাশ্বশুরের সেবা, মেয়েকে পড়ানো, কলেজ, সোশাল ওয়ার্ক, এত সব কী করে যে সামলান ভেবে পাই না। ইউ আর আ লেডি এক্সট্রা-অর্ডিনারি। আপনার মতো মহিলা আমি আগে কখনও দেখিনি।

ভয়ঙ্কর এক বিচ্ছিন্নতাবাদী যে ‘প্রতাপপুর প্যালেস’কে সর্বক্ষণ চরম আতঙ্কের মধ্যে রেখেছে, নিজের নিরাপত্তা ছাড়া অন্য কিছু যে ভাবে না, তার মুখ থেকে উচ্ছ্বসিত প্রশংসাবাক্য শোনার পরও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। সুবর্ণা চুপ করে থাকে।

রাজীব থামেনি, আপনার সম্বন্ধে একটা কথা যে কতবার ভেবেছি তার ঠিক। নেই।

সুবর্ণার চোখেমুখে ঔৎসুক্য ফুটে ওঠে। তার সম্পর্কে রাজীব যে কিছু ভাবতে পারে–সেটা খুবই চমকপ্রদ ব্যাপার। সে জিজ্ঞেস করে, কী ভেবেছেন?

আপনি ইচ্ছা করলে দেবীকে নিয়ে বেরিয়ে গিয়ে পুলিশে খবর দিতে পারতেন। তারা বাড়ি কর্ডন করলে আপনার শ্বশুর আর দাদাশ্বশুর নিশ্চয়ই বেঁচে থাকত না। পুলিশের গুলিতে আমিও হয়তো ঝাঁঝরা হয়ে যেতাম কিংবা ব্লাস্ট করে এই প্যালেস উড়িয়ে নিজেও মরতাম। পুলিশকে ইনফরমেশন দেবার জন্য মাঝখান থেকে পঞ্চাশ লাখ টাকা তো পেতেনই, যে ব্লাডি সোয়াইন শ্বশুর আপনাকে এত অপমান করেছে, যে হ্যাঁজব্যান্ড চরম বিট্রে করেছে তাদের বংশকে ভাল রকম শিক্ষা দিতে পারতেন। এত বড় সুযোগ পেয়েও কাজে লাগালেন না।

সুবর্ণা চমকে ওঠে, এ আপনি কী বলছেন! আপনাকে তো আগেই জানিয়েছিলাম, এই বংশের অজস্র অপরাধ আর ত্রুটির মধ্যে একটা আউটস্ট্যান্ডিং কোয়ালিটি রয়েছে। এরা যাকে আশ্রয় দেয় তার ক্ষতির কথা চিন্তা করে না। এ বাড়ি থেকে আমি কিছুই পাইনি, কোনওরকম প্রত্যাশাও নেই। তবে ওদের এই গুণটাকে শ্রদ্ধা করি। মনে করি–আশ্রয় প্রার্থীর, সে যেমনই হোক, সর্বনাশের কথা ভাবা অন্যায়। একটু থেমে বলল, আর সংগ্রামনারায়ণদের শিক্ষা দেবার কথা বললেন তো? রিভেঞ্জ বা ভেনডেটা, এসব গল্পেই পড়েছি, ফিল্মেও দেখেছি। নিজের জীবনে? ইমপসিবল। প্রতিহিংসা শব্দটাকে আমি ঘৃণা করি। আই হেট ইট।

নিষ্ঠুর ভাবাবেগহীন এক বিচ্ছিন্নতাবাদীর চোখে মুখে শ্রদ্ধা কিংবা মুগ্ধতার মতো কিছু একটা ফুটে উঠেই মিলিয়ে যায়। রাজীব বলে, সেই জন্যেই তো বললাম ইউ আর আ লেডি এক্সট্রা-অর্ডিনারি।’

এমন অনর্গল প্রশংসার উত্তরে স্বাভাবিকভাবে ধন্যবাদ জানানোই নিয়ম। সুবর্ণা কিন্তু কিছু বলল না।

খানিক নৈঃশব্দের পর রাজীব ফের শুরু করে। যেন আপন মনে বলে যায়, কতদিন এ বাড়িতে থাকতে পারব জানি না। রাতে আপনারা ঘুমিয়ে পড়লে রোজ ছাদে গিয়ে পালানোর চেষ্টা করি। চোখে পড়ে চারদিকে প্লেন ড্রেসের পুলিশ ফাঁদ পেতে রেখেছে। রাজবাড়ি বলে, কিংবা আপনার কথা বিশ্বাস করে পুলিশ এখানে সেভাবে হানা দেয়নি। তবে ওরা মনে করে এদিকেই কোথাও আমি লুকিয়ে আছি।

রাজীব ঠিক কী বলতে চাইছে বুঝতে না পেরে মুখ তুলে তার দিকে তাকায় সুবর্ণা।

রাজীব থামেনি, খুব বেশিদিন আমি আপনাদের এখানে থাকব না। এ বাড়ি থেকে বেরুলে পুলিশ বা মিলিটারি, যাদের সঙ্গেই হোক, এনকাউন্টারে আমার মৃত্যু অনিবার্য। যতদিন বাঁচি, আপনার কথা আমার মনে থাকবে মিসেস সিংহ। শেষ দিকে তার কণ্ঠস্বর গাঢ় হয়ে আসে।

১৪. পরদিন কলেজ ছুটির পর

১৪.

পরদিন কলেজ ছুটির পর একটা ট্যাক্সি করে বিমলেশকে বাড়ি নিয়ে এল সুবর্ণা। অবশ্য দেবীকেও তার স্কুল থেকে তুলে এনেছে।

সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে বাড়ির একটা কাজে সকালেই হরেনকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিল সে। রাত ন’টার আগে তার ফেরার সম্ভাবনা নেই। রাজীব সম্পর্কে আগেই তাকে সব জানিয়ে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে। তবু বিমলেশের সঙ্গে রাজীবের দেখা হওয়ার ব্যাপারটা সে জানুক, সুবর্ণা তা একেবারেই চায় না। একতলায় বিমলেশকে বসিয়ে বলল, প্লিজ, তুমি এখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর। দু-একটা কাজ সেরে আমি ওকে নিয়ে আসছি।

দেবীকে সঙ্গে করে দোতলায় চলে গেল সুবর্ণা। ওপরে বাইরের কাউকে নিয়ে যাবার আগে সংগ্রামনারায়ণকে জানাতে হয়। বিমলেশের কথা বললে হাজার রকমের কৈফিয়ত দিতে হত। আসলে একজন প্রাক্তন উগ্রপন্থীর সঙ্গে একজন বিচ্ছিন্নতাবাদীর সাক্ষাৎকারটা সংগ্রামনারায়ণের চোখের সামনে ঘটুক, এটা কোনও ক্রমেই বাঞ্ছনীয় নয়।

আজ কলেজে বেরুবার সময় বিমলেশের কথাটা মাথায় রেখে মায়াকে বেশি করে খাবার আর বড় ফ্লাস্ক বোঝাই করে কফি করে রাখতে বলেছিল সুবর্ণা । ওপরে এসে দ্রুত শাড়িটাড়ি পালটে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে খাইয়ে, সংগ্রামনারায়ণ আর দেবীর খাওয়ার ব্যবস্থা করে, ট্রেতে তিনজনের মতো খাবার, জলের গেলাস আর কফির ফ্লাস্কটা সাজিয়ে নিয়ে রাজীবকে বলল, বিমলেশ এসেছে।

রাজীব জিজ্ঞেস করল, কোথায়?

একতলায়।

সঙ্গে আর কেউ নেই তো?

না।

চলুন—

রাজীব সারাক্ষণ তার পিস্তলটা কাছেই রাখে। সেটা পকেটে পুরে সুবর্ণার সঙ্গে নিচে নেমে এল।

ওদের দেখে বিমলেশ উঠে দাঁড়িয়েছিল। টেবলে ট্রে নামিয়ে রেখে সুবর্ণা দু’জনের পরিচয় করিয়ে দিল।

নমস্কারের পর্ব চুকলে রাজীবরা বসে পড়ে। বিমলেশ বলে, আপনার কথা সুবর্ণার কাছে শোনার পর থেকে আলাপ করার খুব ইচ্ছা হয়েছিল। আপনি যে আপত্তি করেননি, সে জন্যে অনেক ধন্যবাদ।

রাজীব উত্তর দিল না; একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। সুবর্ণা বলা সত্ত্বেও বিমলেশ কতটা বিশ্বাসযোগ্য, সেটাই যেন মেপে নিতে চাইছে সে।

সুবর্ণা এই সময় বলে ওঠে, খেতে খেতে গল্প করা যাক। দু’জনকে খাবারের প্লেট দিয়ে নিজেও একটা তুলে নিল সে।

নিঃশব্দে কিছুক্ষণ খাওয়ার পর রাজীব বলল, বিমলেশবাবু, মিসেস সিংহের ওপর আমার খানিকটা আস্থা হয়েছে বলে আপনার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয়েছি। আপনাকে উনি বিশ্বাস করেন। আশা করি আপনি তার মর্যাদা রাখবেন।

ইঙ্গিতটা বুঝতে পারছিল বিমলেশ। হেসে হেসে বলল, আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, আমার কোনও খারাপ উদ্দেশ্য বা অভিসন্ধি নেই।

রাজীব বলল, এবার বলুন আমার মতো মারাত্মক একটা লোকের সঙ্গে আলাপ করার শখ হল কেন?

আপনাকে সুবর্ণা বলেনি?

সেভাবে কিছু বলেন নি। আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই।

বিমলেশ বলল, এক সময়, ধরুন চব্বিশ পঁচিশ বছর আগে, উগ্রপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। আমার এবং আমার মতো হাজার হাজার যুবকের বিশ্বাস ছিল, আমর্ড রেভোলিউশন ছাড়া সমাজ ব্যবস্থা বদলানো যাবে না।

রাজীব বলল, আপনাদের আন্দোলনের কথা আমি জানি। সেই সময় সমস্ত দেশ এর ধাক্কায় তোলপাড় হয়ে গিয়েছিল।

হ্যাঁ। স্বাধীন ভারতে এটা ছিল নতুন ধরনের মুভমেন্ট।

কিন্তু—

বলুন–

আন্দোলনটা থেমে গেল কেন?

থামে নি তো। তীব্রতা হয়তো কমে গেছে কিন্তু সারা ভারতবর্ষের দিকে তাকালে বুঝতে পারবেন এখনও ওটা চলছে। অবশ্য নানা কারণে আমার মতো অনেকেই আর অ্যাক্টিভলি জড়িত নেই।

রাজীব উত্তর দিল না।

বিমলেশ বলতে লাগল, সোশাল সিস্টেম একদিন দু’দিনে বদলানো যায় না। আন্দোলনটা হল অন্তহীন একটা প্রসেস। আমাদের প্রসঙ্গ থাক, আপনার কথা। শুনতে চাই।

রাজীব জিজ্ঞেস করল, আমার কী কথা?

দেখুন, আমরা ভারতবর্ষের মধ্যে থেকেই এখানকার সমাজ ব্যবস্থা পালটাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কাগজে যেটুকু পড়েছি কিংবা অন্যান্য সোর্স থেকে যা জানতে পেরেছি তাতে মনে হয়েছে, আপনারা ইন্ডিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চান।

আপনার কথার নিশ্চয়ই উত্তর দেবো। তার আগে ইন্ডিয়া ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে দিন।

বিমলেশ বলল, কোটি কোটি মানুষের বিশাল এক দেশ। আ সভারেন, ইনডিপেনডেন্ট কান্ট্রি।

রাজীব বলল, এ তো ক্লাস ফোরের পাঠ্য বইতে পাওয়া যাবে। আপনার মতো অত্যন্ত শিক্ষিত, রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে এক সময় যুক্ত মানুষের কাছ থেকে এত সরল উত্তর আশা করিনি।

রাজীব ঠিক কী জানতে চাইছে, বুঝতে না পেরে বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থাকে বিমলেশ।

একটু ভেবে রাজীব এবার বলল, স্টুডেন্ট লাইফ থেকে একটা প্রশ্ন আমার মাথায় পার্মানেন্টলি ভর করে আছে। বলতে পারেন, ওটা আমাকে হন্ট করে বেড়াচ্ছে। দেশ নিয়ে যাঁরা ভাবেন–পলিটিশিয়ান, এডুকেশনিস্ট, সোশাল সায়েন্টিস্ট, এমন অনেককে জিজ্ঞেস করেছি কিন্তু কারও কাছ থেকেই পরিষ্কার উত্তর পাইনি। সবাই গোঁজামিল দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন। বাট আই অ্যাম নট রিয়ালি স্যাটিসফায়েড। প্রশ্নটা আপনাকে কি করতে পারি?

বিমলেশ বলল, বেশ তো, করুন না। উত্তর জানা থাকলে নিশ্চয়ই দেবো।

রাজীব বলল, ইন্ডিয়াননেস, মানে ভারতীয়ত্ব বস্তুটা আসলে কী?

বিমলেশ লক্ষ করল, গলার স্বরে চাপা বিদ্রূপ মিশিয়ে বস্তু’ শব্দটা উচ্চারণ করেছে রাজীব। বলার ভঙ্গিটা খট করে কানে লাগল তার। ধীরে ধীরে বলল, হাজার হাজার বছর ধরে নানা ধরনের মানুষের তৈরি কালচার, জীবনদর্শন, আমাদের ইতিহাস, আমাদের সিভিলাইজেশন–সব মিলিয়ে–

তাকে শেষ করতে দিল না রাজীব। তার আগেই অসহিষ্ণুভাবে বলে উঠল, ছেলেবেলা থেকে এসব শুনতে শুনতে কান পচে গেছে বিমলেশবাবু। বিবিধের মাঝে মহান মিলন, ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি, নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান সত্ত্বেও ঐক্যের অটুট বন্ধন–এই বস্তাপচা বুলিগুলো দশ বছরের বাচ্চাও জানে। আমি আপনার কাছে অন্য কিছু শুনতে চেয়েছিলাম।

বিমলেশ কী বলবে ভেবে পেল না; তাকে খানিকটা দিশেহারার মতো দেখাচ্ছিল।

হঠাৎ উঠে দাঁড়াল রাজীব। পেছনে দুই হাত রেখে অস্থিরভাবে হল-ঘরে মিনিট খানেক পায়চারি করার পর ফিরে এসে আবার বসল। তারপর নিজের মতো করে বলতে লাগল, বিমলেশবাবু, ইংরেজরা আসার আগে কী ছিল ইন্ডিয়া? বিশাল ভৌগোলিক বাউন্ডারির ভেতরে ছোট বড় কাউন্টলেস নাম্বার অফ স্টেটস। একটার সঙ্গে অন্যটার সম্পর্ক নেই। যুদ্ধ, শত্রুতা লেগেই থাকত। ব্রিটিশ রুল চালু হওয়ায় ইন্ডিয়া যে একটা নেশন সেটা বোঝা গেল–নানা ল্যাংগুয়েজ, নানা রিলিজিওন, নানা ফুড হ্যাবিট, নানা সোশাল প্যাটার্ন সত্ত্বেও। তখন হিন্দু মুসলিম শিখ, সবার সামনে একটা লক্ষ্য ছিল–স্বাধীনতা। মুক্তির জন্য সারা দেশ সেই বোধ হয় প্রথম ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু সেকেন্ড গ্রেট ওয়ারের পর ইংরেজরা যখন যাই যাই করছে তখন কী দেখলাম আমরা? কমিউনালিজম দাঁত নখ বার করে ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়ে মাথা চাড়া দিয়েছে। ফর্টি

সেভেনে টু নেশন থিয়োরির ধাক্কায় ইন্ডিয়া দু ভাগ হয়ে গেল। এক নেশন ভেঙে দু’টো নেশল হল। জওহরলালরা অবশ্য জানালেন, আমাদের ভাগে যেটুকু পড়েছে সেটা হবে ধর্মনিরপেক্ষ। সেটা নিশ্চয়ই খুব বড় ব্যাপার।

বিমলেশ বলল, এসব ভারতবর্ষের সবাই জানে। আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন বুঝতে পারছি না।

একটু ধৈর্য ধরুন। আমি যা বলতে চাই, সেখানে পৌঁছুবার আগে ব্যাকগ্রাউন্ডটা শুধু মনে করিয়ে দিচ্ছি। স্বাধীনতার পর সেকুরালিজমের আদর্শ কতটুকু টিকে আছে? রিলিজিয়াস ফান্ডামেন্টালিজম কীভাবে বাড়ছে, নিশ্চয়ই আপনি জানেন। সেই সঙ্গে বেড়েছে প্রাদেশিকতা, জাতপাতের সমস্যা। বম্বে প্রেসিডেন্সি দু’ভাগ হয়ে হল মহারাষ্ট্র আর গুজরাট, মাদ্রাজ ভেঙে হল অন্ধ্র আর। তামিলনাড়ু, নর্থ-ইস্ট এখন সাত টুকরো, যদিও তাদের বলা হয় সেভেন সিস্টার্স। তা হলে স্বাধীনতার পর আমরা কী দেখতে পাচ্ছি? সাম্প্রদায়িকতা, প্রাদেশিকতা, জাতপাতের সমস্যা–সব মিলিয়ে পিপলের মধ্যে ডিভিসন কিন্তু হয়েই চলেছে। হিন্দু মুসলমান শিখ খ্রিস্টান বাঙালি বিহারী তামিল বা মারাঠি, ব্রাহ্মণ রাজপুত ক্ষত্রিয় বা যাদব–এসবের বাইরে কেউ আর কিছু ভাবতে চায় না। এর মধ্যে ভারতীয়ত্বটা কোথায় বলতে পারেন?

বিমলেশ আর সুবর্ণা চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল। বিমলেশ বলল, হ্যাঁ, এগুলো ভীষণ সিরিয়াস ব্যাপার। দেশের মানুষের মধ্যে এই বিভাজন নেশন হিসেবে আমাদের চরম ক্ষতি করছে।

রাজীব বলল, আরেকটা মারাত্মক দিক লক্ষ করছেন?

কী?

ইন্ডিয়ার কয়েকটা অঞ্চল হাইলি ডেভলাপড। সে সব জায়গায় বিপুল ইনভেস্টমেন্ট হচ্ছে; দেশের বেশির ভাগ ওয়েলথ ওখানে জমা হচ্ছে। বাকি জায়গাগুলো আন্ডার-ডেভলাপড। সেখানে কোনওরকম ইনভেস্টমেন্ট নেই। হলেও খুব সামান্য। বিশেষ করে ইস্টার্ন আর নর্থ-ইস্টার্ন ইন্ডিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখুন, এ দু’টো অঞ্চল কীভাবে পিছিয়ে পড়ছে। আর্থিক সচ্ছলতা সব জায়গায় যদি সমানভাবে না আসে, ক্ষোভ জমা হতে হতে বিস্ফোরণের চেহারা নেয়। নিচ্ছেও। যারা হাতে বন্দুক তুলে নিয়েছে তাদের কিছু কিছু ঘুষ অবশ্য দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এটা হবে কেন?

বিমলেশ উত্তর দিল না।

রাজীব বলতে লাগল, এবার নিজের কথা বলা যাক। আমি যেখান থেকে আসছি সেখানে স্বাধীনতার পর কতটুকু ইনভেস্টমেন্ট হয়েছে? প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। তাছাড়া সাঙ্ঘাতিক একটা সমস্যা হল, আমাদের এথনিক আইডেনটিটি অত্যন্ত বিপন্ন।

বিমলেশ জিজ্ঞেস করল, কীরকম?

রাজীব বলল, আপনারা তো জানেনই নর্থ-ইস্টে কী বিপুল পরিমাণে ন্যাচারাল রিসোর্সের্স রয়েছে–টি, ফরেস্ট, পেট্রোলিয়াম। ইংরেজরা তো লুট করেছেই। তারপরও এক্সপ্লয়টেশন চলছে। ব্রিটিশ আমলে ইন্ডিয়ার নানা জায়গা থেকে হাজার হাজার লোক চাকরি বাকরি নিয়ে ওখানে সেটল করেছিল। পার্টিশনের পর এসেছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। এখন চলছে ইনফিলট্রেশন। রোজ কত ফ্যামিলি যে লুকিয়ে চুরিয়ে ঢুকে পড়ছে তার হিসেব নেই। এর রেজাল্ট কী হতে পারে ভাবতে পারেন?

কী?

রাজীব জানাল, আর কিছুদিন এরকম চললে তারা সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে। তাদের জাতি-পরিচয়, সংস্কৃতি, ভাষা, বাইরের মানুষের চাপে ধ্বংস হয়ে যাবে। সেটা তারা কোনওভাবেই মেনে নিতে পারে না।

বিমলেশ বলল, এর সমাধান কি দিল্লির সঙ্গে আলোচনা করে হতে পারে না?

রাজীব বলল, আলোচনা, অ্যাকর্ড, কত কিছুই তো হল। খবরের কাগজে সেসব আপনারা পড়েছেন। কিন্তু কাজের কাজ কি কিছু হয়েছে?

সমস্যাটা এত জটিল আর বিরাট এবং দীর্ঘকালের যে তার সমাধান খুব তাড়াতাড়ি হওয়া কি সম্ভব? ধৈর্য তো ধরতে হবে।

ধৈর্য ধরতে ধরতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আর দেরি করলে আমরা সন্স অফ দা সয়েল, পুরোপুরি শেষ হয়ে যাব।

বিমলেশ সতর্ক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে, এই জন্যেই কি হাতে বন্দুক তুলে নিয়েছেন?

রাজীব এক পলক তাকাল শুধু; উত্তর দিল না।

বিমলেশ এবার বলল, আপনাদের যা মুভমেন্ট, গভর্নমেন্ট সেটা কোনওভাবেই মেনে নেবে না। তারা কড়া—

রাজীব হাত তুলে উত্তেজিত সুরে বলল, মিলিটারি অ্যাকসনের কথা বলছেন তো? প্রতি মুহূর্তে সেটা টের পাচ্ছি। কত যুবক মারা গেছে ভাবতে পারবেন না।

হ্যাঁ, প্রচুর প্রাণহানি, রক্তক্ষয়–’

দিস ইজ ইনএভিটেবল বিমলেশবাবু।

বিমলেশ বলল, একটা কথা আমার জানতে ইচ্ছে করছে–’

রাজীব জিজ্ঞেস করল, কী?

শুধু নর্থ-ইস্টেই না, ইন্ডিয়ার আরও কয়েক জায়গায় সেসেসানিস্ট মুভমেন্ট চলছে। ধরুন ছোট ছোট কয়েকটা অংশ আলাদা হয়ে বেরিয়ে গেল। ইনডিপেনডেন্ট স্টেট হিসেবে সেগুলো টিকে থাকা কি সম্ভব?

রাজীব বলল, আপনার মতো পণ্ডিত মানুষের কাছে এই ধরনের ওয়র্থলেস প্রশ্ন আশা করিনি। ইওরোপ, সাউথ আমেরিকা, কি কাছাকাছি মিডল ইস্টের ছোট স্টেটগুলোর কথা ভুলে গেছেন? এই সেদিন সোভিয়েট রাশিয়া, যুগোস্লাভিয়া ভেঙে কতকগুলো নেশন তৈরি হল? তারা টিকে নেই?

আবার দুই জার্মানি তো এক হয়ে গেছে। তার পেছনে অন্য কারণ ছিল। ওদের ধর্ম এক, ভাষা এক। সেকেন্ড গ্রেট ওয়ারের পর জোর করে জার্মানিকে দু’ভাগ করা হয়েছিল। প্রবল জাতীয় আবেগ ওদের রিইউনাইট করেছে।

কিছুক্ষণ নীরবতা।

তারপর বিমলেশ বলল, বিচ্ছিন্নতাবাদী মিলিটান্সি তা হলে চলতেই থাকবে? রাজীব এই প্রথম একটু হাসল। বলল, আপনি খুব বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন দেখছিঃ বিরাট বিরাট একান্নবর্তী পরিবারও সুখের জন্য, স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য ছোট ছোট ইউনিটে ভাগ হয়ে যায়। এটাকে সেভাবে ভাবতে অসুবিধা কোথায়?

বিমলেশ বলল, আপনার কাছে এবার একটা বিষয়ে জানতে চাইব।

বলুন কী জানতে চান—

শুনলে আপনি নিশ্চয়ই রেগে যাবেন। তবু ঝুঁকি নিয়েই প্রশ্নটা করছি।

চোখের দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল রাজীবের। বলল, আগে শুনি। রাগের কথা তো পরে–

বিমলেশ বলে, কাগজে প্রায়ই দেখি, আমাদের দেশে যেসব বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হচ্ছে তার সবগুলোই বিদেশি রাষ্ট্রের উসকানিতে। ইন্ডিয়াকে দুর্বল করার এ এক আন্তর্জাতিক চক্রান্ত। এমনকি ডেসট্রাক্টিভ অ্যাক্টিভিটির জন্য মিলিটান্টদের বাইরে নিয়ে ট্রেনিংও দেওয়া হচ্ছে। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র স্মাগল করে ঢোকানো হচ্ছে দেশের ভেতর। এ বিষয়ে আপনি কি কিছু বলবেন?

মুখটা শক্ত হয়ে ওঠে রাজীবের। সে বলে, আপনি বোধহয় ঘুরিয়ে জানতে চাইছেন, আমরা বিদেশি রাষ্ট্রের এজেন্ট হিসেবে এখানে কাজ করছি কি না? খুব সংক্ষেপে বলছি–না। এর বেশি আর কিছু এখন আর জানতে চাইবেন না। ভবিষ্যতে যদি কখনও দেখা হয়, সে সম্ভাবনা নেই বললেই হয়–আপনার সঙ্গে ডিটেলে আলোচনা করা যাবে। শুধু একটাই অনুরোধ–

বিমলেশ দু চোখে অসীম আগ্রহ নিয়ে তাকাল।

রাজীব থামেনি, ভাসা ভাসা কিছু ইনফরমেশনের ভিত্তিতে নয়, আমাদের সমস্যাগুলো গভীরভাবে বুঝতে চেষ্টা করুন। বলতে বলতে হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়, আচ্ছা নমস্কার।

বিমলেশ আর সুবর্ণাও উঠে পড়ে। রাজীব বুঝিয়ে দিয়েছে সে আর কথা বলতে ইচ্ছুক নয়।

.

১৫.

সেই যে বিমলেশ এসেছিল তার দু’দিন পর ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেল।

কাল জেল থেকে মানসিক ভারসাম্যহীন মেয়েরা মুক্তি পেয়ে বিকেলের দিকে সোজা এখানে চলে আসবে। রাজীব শেষ পর্যন্ত আপত্তি করেনি, সংগ্রামনারায়ণের অনুমতিও পাওয়া গেছে।

একতলার ঘরগুলো খুলিয়ে ধুলো ময়লা সাফ করার জন্য সকাল থেকেই লোক লাগানো হয়েছে। সুবর্ণা আজ আর কলেজে যাবে না, দেবীকেও স্কুলে পাঠাবে না। মোট বারোজন মহিলা আসছে। সুষ্ঠুভাবে তাদের থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। বাড়িতে যে বাড়তি লেপ-তোষক বালিশ-টালিশ আছে তাতে কুলোবে না। ডেকরেটরদের কাছ থেকে কয়েক সেট বিছানা ভাড়া করা দরকার। অবশ্য খাওয়ানোর দায়িত্ব তাদের নয়। নারী বিকাশ কেন্দ্র থেকে সে বন্দোবস্ত করা হবে। কাল ভোরে মনোরমাদি রান্নার লোকের সঙ্গে চাল ডাল মাছ আনাজ তেল নুন, যা যা প্রয়োজন সব পাঠিয়ে দেবেন। নিজে তখন আসবেন না, আসবেন সেই বিকেলবেলায় মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে।

সকাল থেকে নানা কাজের ফাঁকে ফাঁকে একতলায় এসে খোঁজ খবর নিয়ে গেছে সুবর্ণা। যদিও হরেনকে লাগিয়ে রেখেছে, তবু নিজের চোখে না দেখলে যেন স্বস্তি হচ্ছিল না।

অঘটনটা ঘটল দুপুরবেলায়। শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে তখন তার ঘরে খাওয়াচ্ছিল সুবর্ণা। একধারে সোফায় বসে বই পড়ছিল রাজীব। হঠাৎ সংগ্রামনারায়ণের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল, বৌমা–বৌমা, তাড়াতাড়ি একবার এখানে এসো। তো–

রাজীব এবং সুবর্ণা দু’জনেই চমকে ওঠে। সুবর্ণা হাতের প্লেটটা খাটের পাশের সাইড টেবলে নামিয়ে রেখে একরকম দৌড়েই সংগ্রামনারায়ণের বেডরুমে চলে আসে।

সংগ্রামনারায়ণ খাটের মাঝখানে বসে ছিলেন। তাঁর হাতে একটা খবরের কাগজ। সেটা সুবর্ণার দিকে বাড়িয়ে একটা ছবিতে আঙুল রেখে বললেন, লুক হিয়ার–এ কে?

কাগজটা কয়েকদিন আগের দৈনিক দিনকাল’-এর সেই কপি, যার প্রথম পাতায় রাজীবের ছবিসুদ্ধ বিরাট রিপোর্ট বেরিয়েছিল। রাজীবের ছবিতে এখন দাড়ি নেই, হোয়াইট ইংক দিয়ে সেটা মুছে দেওয়া হয়েছে।

পায়ের তলায় শ্বেত পাথরের মসৃণ মেঝে দুলে উঠল সুবর্ণার। মনে হল মাথার ভেতর আগুনের চাকার মতো কিছু একটা ঘুরে যাচ্ছে।

সংগ্রামনারায়ণ দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, একে চিনতে পারছ?

হোয়াইট ইংক লাগানোর পর রাজীবের এখনকার নিখুঁত কামানো মুখটা বেরিয়ে পড়েছে। নির্জীব স্বরে কিছু বলতে চেষ্টা করল সুবর্ণা, তার একটা শব্দও বোঝা গেল না।

সংগ্রামনারায়ণ আবার বললেন, এই তোমার আত্মীয়-বৌদির পিসতুতো ভাই? প্রথম থেকেই সন্দেহ হয়েছিল, লোকটার সঙ্গে তোমাদের কোনওরকম সম্পর্ক নেই। জোর করে এখানে ঢুকে পড়েছে। একটু থেমে কী ভেবে বললেন, বৌমা, একটা সত্যি কথা বল তো, লোকটা তোমাকে ভয় দেখিয়ে আমাদের সবাইকে কি হোস্টেজ করে রেখেছে?

সংগ্রামনারায়ণ দাম্ভিক, রুক্ষ, রগচটা হলেও খুবই চতুর। তার ইন্দ্রিয়গুলো ভীষণ প্রখর। তাঁর চোখে ধুলো দিয়ে কিছু হওয়ার উপায় নেই। হোয়াইট ইংক লাগিয়ে রাজীবের আসল মুখটা যে তিনি বার করে ফেলবেন, আগে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি সুবর্ণা। নিজের অজান্তেই মাথাটা খুব আস্তে হেলিয়ে দেয় সে।

সাঙ্ঘাতিক হার্ট অ্যাটাকের কারণে তার যে উত্তেজিত হওয়া বারণ, স্নায়ুমণ্ডলীকে সব সময় যে শান্ত রাখা উচিত, সে সব আর মনে থাকে না সংগ্রামনারায়ণের। লাফ দিয়ে খাট থেকে নিচে নামতে নামতে গর্জে ওঠেন, রাসকেলের এত বড় সাহস, থ্রেটনিং দিয়ে প্যালেসে ঢুকে আছে। আমি ওকে লাথি মেরে–

ভয়ে শ্বাস যেন আটকে যায় সুবর্ণার। হাত বাড়িয়ে সংগ্রামনারায়ণের একটা হাত ধরে ফেলে সে, বাবা, যাবেন না, যাবেন না। ও যে কী ডেঞ্জারাস লোক আপনার ধারণা নেই।

এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে সংগ্রামনারায়ণ বলেন, অনেক ডেঞ্জারাস লোক আমার দেখা আছে–’ তিনি দরজা দিয়ে বেরিয়ে। শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরের দিকে দৌড়ে যান।

আতঙ্কিত সুবর্ণার চোখের সামনে সব যেন অন্ধকার হয়ে যাচ্ছিল। তবু তারই মধ্যে সংগ্রামনারায়ণের পেছন পেছন সে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটতে থাকে।

ইউ স্কাউন্ড্রেল–শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে এসে গলার শির ছিঁড়ে উন্মত্তের মতো চিৎকার করে ওঠেন সংগ্রামনারায়ণ, তোমার এত বড় স্পর্ধা যে–শরীরের সব রক্ত যেন তার মুখে উঠে এসেছে। চোখ দু’টো বুঝিবা ফেটে পড়বে। গালের কষ বেয়ে ফেনার মতো কিছু বেরিয়ে আসছে।

সংগ্রামনারায়ণ চেঁচাতে চেঁচাতে রাজীবের ওপর প্রায় আঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিলেন; সুবর্ণা পেছন থেকে প্রাণপণ শক্তিতে দু’হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে। ভীত, দুর্বল গলায় বলে, বাবা শান্ত হোন, শান্ত হোন, আপনার ঘরে চলুন—

কিছুই শুনতে পাচ্ছিলেন না সংগ্রামনারায়ণ। দুর্বোধ্য, জড়ানো গলায় সমানে চিৎকার করে যাচ্ছিলেন।

এদিকে সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে রাজীব। তার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে। দুই চোখের ভেতর থেকে ফুটে বেরুচ্ছে ভীতিকর এক হিংস্রতা। একটা হাত মুঠো পাকানো। আরেকটা হাত ট্রাউজারের পকেটে। সে তীব্র, চাপা গলায় বলল, স্টপ মিস্টার সিংহ, স্টপ–

হইচই শুনে কিচেনের দিক থেকে মায়া ছুটে এসেছিল। চোখের ইশারায় তাকে চলে যেতে বলল সুবর্ণা।

হুমকি সত্ত্বেও সংগ্রামনারায়ণ কিন্তু থামেননি। তাঁর মাথায় যেন হিস্টিরিয়া ভর করেছে। কণ্ঠস্বর আরও উঁচুতে তুলে তিনি বলে যাচ্ছিলেন, খুনি হোক, ডাকু হোক-রাজবাড়িতে যে শেলটার নেয় তার ক্ষতি আমরা করি না। তোমাকে আমরা পুলিশের হাতে তুলে দেবো না। তবে এখানে আর এক মুহূর্তও থাকতে পারবে না। নাউ গেট আউট–’

তাঁর কথা শেষ হবার আগেই পিস্তল বের করে সংগ্রামনারায়ণের বুকের দিকে তাক করল রাজীব। খুব ঠান্ডা গলায় বলল, আই রিপিট–স্টপ।

প্রতিক্রিয়া হল ভয়ানক। সংগ্রামনারায়ণ যতটা ক্রুদ্ধ আর উত্তেজিত হয়েছিলেন; এখন ঠিক ততটাই আতঙ্কিত। পিস্তলের দিকে তাকিয়ে তার চোখের তারা দু’টো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে লাগল। মুহূর্তে সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে গেল। গোঙানির মতো অদ্ভুত ঘড়ঘড়ে আওয়াজ করে তিনি মেঝেতে পড়ে যাচ্ছিলেন, সুবর্ণা পড়তে দিল না। মূৰ্ছিত সংগ্রামনারায়ণকে কোনওরকমে ধরে রাখল। রাজীবকে বলল, এ আপনি কী করলেন?

পিস্তলটা পকেটে পুরে রাজীব বলল, ওটা না দেখালে ভদ্রলোক যেভাবে চেঁচাচ্ছিলেন, একতলা থেকে লোকজন ছুটে আসত। আমাকে কত রাউন্ড গুলি ছুঁড়তে হত, ভেবে দেখুন। চিন্তা করবেন না, আমি আপনাকে সাহায্য করছি।

শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ ধন্দ-লাগা, বিহ্বল মানুষের মতো তাকিয়ে ছিলেন। তার অসাড় মস্তিষ্কে দৃশ্যটা হয়তো সামান্য ধাক্কা দিয়ে থাকবে। কিছু বলতে চাইলেন, গলা দিয়ে স্বর বেরুল না। ঠোঁট দু’টো অল্প নড়ল শুধু। রাজীব আর সুবর্ণা ধরাধরি করে সংগ্রামনারায়ণকে তার ঘরে এনে শুইয়ে দিল।

তিন-চার মিনিটের মধ্যে প্রচণ্ড বিপর্যয় ঘটে গেছে যেন। দিশেহারার মতো সুবর্ণা বলল, এখন আমি কী করি বলুন তো? বাবার বোধ হয় আরেকটা অ্যাটাক হয়ে গেল। ডাক্তারকে এখনই খবর দিতে হবে। কাল থেকে অতগুলো মহিলা এসে থাকবে। আমি যে কী করব!

রাজীব বলল, হয়তো ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছেন। মায়াকে বলুন জল দিয়ে যেতে। যদি দেখি জ্ঞান ফিরছে না তখন ডাক্তার ডাকবেন। । সুবর্ণা দৌড়ে গিয়ে রান্নাঘর থেকে জলের জগ নিয়ে এল। তার হাত থেকে। সেটা নিয়ে সংগ্রামনারায়ণের চোখে মুখে জলের ঝাঁপটা দিতে লাগল রাজীব। মিনিট পাঁচেক পর চোখ মেলে ঘোর-লাগা মানুষের মতো তাকালেন সংগ্রামনারায়ণ। এই প্রকাণ্ড বেডরুমের কোনও কিছুই যেন তার কাছে পরিষ্কার নয়। সব ঝাপসা, ঘোলাটে। ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন ভাবটা কেটে এল। চারপাশের দৃশ্যগুলি ক্রমশ স্পষ্ট হতে লাগল। খাটের এক ধারে উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে সুবর্ণা। আরেক ধারে সংগ্রামনারায়ণ রাজীবকে দেখতে পেলেন। সে অনেকখানি ঝুঁকে তাকে লক্ষ করছে। আবার সেই আতঙ্কটা তার চোখে মুখে ফিরে এল। ভয়ার্ত স্বরে বললেন, আমি-–আমি–’

সংগ্রামনারায়ণের একটা হাত ধরে খুব সহৃদয় ভঙ্গিতে রাজীব বলল, আপনারা আমাকে শেলটার দিয়েছেন। আমি আপনাদের কোনওরকম ক্ষতি করব না। দয়া করে চুপচাপ থাকুন। আমার কথা কাউকে বলবেন না। একটু থেমে বলল, জানি, আপনাদের ভীষণ বিপদে ফেলেছি। কিন্তু খুব বেশিদিন না, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে চলে যাব।

সংগ্রামনারায়ণ তাকিয়ে রইলেন শুধু; কিছু বললেন না।

সুবর্ণা অবাক হয়ে রাজীবকে দেখছিল। খানিক আগের সেই হিংস্রতা আর নেই। তার ভেতর থেকে একজন হৃদয়বান, সহানুভূতিসম্পন্ন মানুষ যেন বেরিয়ে এসেছে।

সংগ্রামনারায়ণের বালিশের পাশে সবসময় একটা ভাঁজ-করা ধবধবে তোয়ালে থাকে। সেটা তুলে নিয়ে রাজীব সযত্নে তার ভেজা চুল, মুখ মুছিয়ে দিয়ে পাশে বসে বলল, বুকে কি পেইন হচ্ছে?

যে লোকটা কিছুক্ষণ আগে পিস্তল তাক করেছিল সে যে কয়েক মিনিটের ভেতর এতটা বদলে যেতে পারে, এমন অভাবনীয় দৃশ্য নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না সংগ্রামনারায়ণ। বিহ্বলভাবে আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন–যন্ত্রণা হচ্ছে না।

রাজীব জিজ্ঞেস করল, অন্য কোনওরকম অস্বস্তি?

নিচু গলায় সংগ্রামনারায়ণ বললেন, না।

রাজীব সুবর্ণার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, আপনি আশঙ্কা করছিলেন তেমন কোনও সিম্পটম দেখা যাচ্ছে না। আপাতত ডাক্তার ডাকার দরকার নেই।

সুবর্ণা চুপ করে রইল।

রাজীব বলল, আমি ওঁর কাছে বসছি। আপনার দাদাশ্বশুরের খাওয়া শেষ হয়নি; তাকে খাইয়ে আসুন।

সুবর্ণা দ্বিধান্বিতের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। রাজীবের হাতে সংগ্রামনারায়ণকে ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারে না।

রাজীব তার মনোভাব আন্দাজ করে নিয়ে বলে, আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে চলে যান। আমার কোম্পানি ওঁর খারাপ লাগবে না।

সুবর্ণা খানিকটা নিরুপায় হয়েই যেন দু’জনের দিকে তাকাতে তাকাতে চলে যায়। শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে এসে ফের ভাতের প্লেট তুলে নিয়ে তাকে দ্রুত খাইয়ে, মুখটুখ ধুইয়ে রাজীবদের কাছে ফিরে যায়। আসলে প্রচণ্ড উৎকণ্ঠা বোধ করছিল সে। যদিও সংগ্রামনারায়ণ অজ্ঞান হওয়ার পর শুশ্রূষা করে তাঁকে মোটামুটি সুস্থ করে তুলেছে রাজীব, তবু একা ঘরে একজন ভয়াবহ সশস্ত্র উগ্রপন্থীর সঙ্গ তার কতটা ভাল লাগছে, ভাবতে পারছিল না সুবর্ণা। সংগ্রামনারায়ণের ঘরে পা দিয়ে সে দারুণ অবাক হয়ে যায়।

রাজীব একটা চেয়ার খাটের কাছে টেনে নিয়ে বসে বসে কথা বলছিল। সংগ্রামনারায়ণ এখন আর শুয়ে নেই; খাটের মাঝখানে রাজীবের দিকে মুখ করে বসে আছেন। তার চোখে মুখে আতঙ্ক বা বিহ্বলতার চিহ্নমাত্র নেই। খুব স্বাভাবিক আর সুস্থ দেখাচ্ছে তাকে।

রাজীব বলছিল, মিসেস সিংহ, মানে আপনার পুত্রবধুর কাছে শুনেছি ইন্ডিপেনডেন্সের পর নেটিভ স্টেটগুলো যখন ইন্ডিয়ান ইউনিয়নে ঢুকে গেল আপনারা তা মেনে নিতে পারেননি।

সংগ্রামনারায়ণের দৃষ্টি প্রখর হয়ে ওঠে। তিনি বলে ওঠেন, তোমার হৃৎপিণ্ড যদি কেউ উপড়ে নেয়, তুমি সেটা মেনে নেবে? জওহরলাল প্যাটেলরা জোর করে আমাদের স্টেট ছিনিয়ে নিল। ছিলাম স্বাধীন রাজা, একটা রাজ্যের সর্বময় অধীশ্বর। এখন আমাদের স্টেটাসটা কী? রিকশাওলা, ঠেলাওলা, রাস্তার হকার, কেরানি–এদের সঙ্গে আমাদের তফাতটা কোথায়? রাজবংশের মর্যাদা, স্বাধীনতা, গৌরব, সর্বস্ব গেছে। রাস্তার ধুলোয় আমাদের মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। ক্ষোভ নয় রাজীব, যতদিন বেঁচে থাকব আমার রাগ যাবে না।

একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না—

কী?

ত্রিবাঙ্কুরের মহারাজা, হায়দ্রাবাদের নিজাম তো অ্যাকসেসন মেনে নিতে চাননি। তারা আপত্তি করেছিলেন। আপনারাও করতে পারতেন।

ত্রিবাঙ্কুর, হায়দ্রাবাদ অত বড় স্টেট। তারাই কিছু করতে পারল না। প্রতাপপুরের মতো ছোট রাজ্য কী আর করতে পারে।

একটু চিন্তা করে রাজীব বলল, ইন্ডিয়ায় তিনশ’র মতো নেটিভ স্টেট ছিল। সবাই জয়েন্টলি রুখে দাঁড়ালে অ্যাকসেসন কি হতে পারত?

হঠাৎ ভীষণ বিমর্ষ হয়ে পড়লেন সংগ্রামনারায়ণ। নির্জীব সুরে বললেন, সকলে ইউনাইটেড আর হতে পারল কোথায়? বেশির ভাগ স্টেটই তো ইন্ডিয়ার পেটের ভেতর ঢুকে যাবার জন্যে হুড়োহুড়ি শুরু করে দিল। জওহরলালদের গুড বুকে থাকার জন্যে সে যে কী র‍্যাটরেস বলে বোঝাতে পারব না। দু-একটা স্টেটের যাও আপত্তি ছিল, কংগ্রেস, কমিউনিস্ট, আর অন্য পলিটিক্যাল পার্টির ওয়ার্কাররা এমন তুলকালাম কাণ্ড বাধাল যে কিছুই করা গেল না। সর্বগ্রাসী এক হতাশা যেন সংগ্রামনারায়ণের ওপর ভর করে।

সুবর্ণা ঘরে ঢুকে চুপচাপ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ রাজীবের চোখ এসে পড়ে তার ওপর। বলে, কতক্ষণ এসেছেন?

সুবর্ণা বলে, এই মিনিট পাঁচেক।

ওখানে দাঁড়িয়ে কেন?

আপনাদের কথা শুনছিলাম। রাজীব সামান্য হেসে বলল, তখন টেনান নিয়ে এ ঘর থেকে গেলেন। জিজ্ঞেস করে দেখুন আমার কোম্পানি আপনার শ্বশুরমশাইয়ের খুব খারাপ লাগছে না।

সুবর্ণা উত্তর দিল না। রাজীব নামে এই সন্ত্রাসবাদীর মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু একটা ম্যাজিক আছে, নইলে সংগ্রামনারায়ণের মতো সন্দিগ্ধ, সর্বক্ষণ ক্ষিপ্ত একটি মানুষকে কী করে বশ করল?

রাজীব বলল, মিসেস সিংহ, আপনাদের বাড়ির ডেইলি রুটিন আমার জানা হয়ে গেছে। আপনার শ্বশুরমশাইয়ের লাঞ্চের সময় হয়েছে। প্লিজ মায়াকে বলুন, ওঁর আর আমার ভাত যেন এখানে দিয়ে যায়। মিস্টার সিংহর সঙ্গে গল্প করতে খুব ভাল লাগছে।

সংগ্রামনারায়ণও সায় দিয়ে বললেন, হ্যাঁ, এখানেই দিতে বল।

সুবর্ণা চলে যায়। মায়া নয়, নিজেই সংগ্রামনারায়ণদের জন্য খাবার নিয়ে আসে। ভাত, ডাল, তরকারি আর মাছের পাত্রগুলো যখন সে সাজিয়ে দিচ্ছে সেই সময় সংগ্রামনারায়ণ বলছিলেন, কাগজে তোমাদের মিলিটান্ট অ্যাক্টিভিটির কথা অনেক পড়েছি। এজাক্টলি তোমরা কী চাও?

রাজীব বলল, আমরা এক্সপ্লয়টেড হচ্ছি; এটা বন্ধ করতে চাই। আমাদের এথনিক আইডেনটিটি ধ্বংস হতে বসেছে; সেটা কিছুতেই হতে দেবো না।

তোমরা কি ইন্ডিয়া থেকে আলাদা হতে চাও?

এই প্রশ্নটা সেদিন বিমলেশও করেছিল। খাদ্যবস্তুগুলো সাজাতে সাজাতে চকিতে একবার মুখ তুলে রাজীবের দিকে তাকায় সুবর্ণা।

রাজীব বলল, মিস্টার সিংহ, আপনারা নিজেদের আইডেনটিটি যে কোনও কারণেই তোক হারিয়েছেন। আমরা হারাতে চাই না। এর জন্যে যতদূর যেতে হয় যাব। তারপর দেখা যাক–

১৬. সুবর্ণার কলেজে যাওয়া হল না

১৬.

পরদিনও সুবর্ণার কলেজে যাওয়া হল না। তবে রাজীবকে জানিয়ে হরেনের সঙ্গে দেবীকে স্কুলে পাঠিয়ে দিল। হরেনই তাকে ছুটির পর বাড়ি নিয়ে আসবে।

বিকেলের দিকে তিনটে ট্যাক্সিতে করে বারজন মানসিক ভারসাম্যহীন নিরাশ্রয় মহিলা ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ চলে এল। তাদের নিয়ে এসেছেন মনোরমা। অধিকারী এবং বন্দনা সাহা। দু’জনে প্রায় সমবয়সী। মনোরমার মতো বন্দনাও ঝাড়া হাত-পা মানুষ, কোনওরকম পিছুটান নেই। প্রতাপপুর মিউনিসিপ্যালিটিতে ভাল। চাকরি করতেন। সেটা ছেড়ে দিয়ে এখন নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর ডেপুটি সেক্রেটারি। নারী কল্যাণ ছাড়া আর কিছু বোঝেন না।

প্রথমে খবর দেওয়া হয়েছিল এগারো জন আসবে। পরে জেল থেকে জানানো হয় সংখ্যাটা এগারো নয়, বারো। অর্থাৎ একজন বেশি। যা ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাতে বাড়তি একটি মহিলার জন্য অসুবিধা হবে না।

দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর নিচে নেমে অপেক্ষা করছিল সুবর্ণা। মনোরমাদি মহিলাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। ছবি মালাকার, সন্ধ্যা ভট্টাচার্য, মালতী রায়, নলিনী সেন, পদ্মা কর্মকার, জবা মণ্ডল, গোপালীবালা সাহা, তারা সর্দার, লতিকা মৈত্র, বিন্দুবাসিনী দাস, পার্বতী বর্মন এবং পারুল দে। এদের বয়স তিরিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে।

তিনজন বাদে অন্যদের মোটামুটি সুস্থই মনে হল সুবর্ণার। তবে কেমন যেন জড়সড়, উদ্বিগ্ন, ভীত। অদৃশ্য খোলের ভেতর নিজেদের গুটিয়ে রেখেছে তারা। বিনা অপরাধে দীর্ঘকাল জেলে কাটিয়ে মুক্তি পাওয়ার পর নিরাপত্তাহীনতায় হয়তো ভুলছে। হয়তো ওরা শুনেছে মাসখানেক ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ আশ্রয় পাবে। তারপর কোথায় যাবে জানে না। যাদের সামনে শুধুই অন্ধকার, তাদের চোখে মুখে এইরকম নৈরাশ্য, উৎকণ্ঠা আর আড়ষ্টতা বুঝি সর্বক্ষণই লেগে থাকে। বাকি তিনজনকে একেবারেই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। বিশেষ করে পারুল দে নামের মহিলাটিকে। বছর চল্লিশেক বয়স হলেও বেশ সুশ্রী এবং স্বাস্থ্যবতী। চোখের দৃষ্টিতে একটা অদ্ভুত উগ্রতা। সে মাথাটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারিদিক দেখছিল।

একতলার চারটে বেডরুমে খাট পেতে রাখা হয়েছিল। তিনটে ঘরে চারজন করে মহিলা থাকবে। নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর যে দু-তিনজন কর্মী এই মহিলাদের দেখাশোনা করবে বাকি ঘরটা তাদের জন্য। রান্নার দু’জন লোক থাকবে বাড়ির পেছন দিকে যে পড়ো সার্ভেন্টস কোয়ার্টারগুলো রয়েছে তার একটা ঘরে। নীচের তলাটা সাফ করার সময় ওটাও সামান্য মেরামত করে বাসযোগ্য করে তোলা হয়েছে।

এক মাসের অতিথিদের জন্য আগেই পরটা আর আলু ভাজা করে রেখেছিল রান্নার লোকেরা। তাদের চা করতে বলে মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট ঘরগুলো ঘুরিয়ে দেখাল সুবর্ণা।

মনোরমা এবং বন্দনা, দু’জনেই বললেন, চমৎকার ব্যবস্থা হয়েছে। ওঁরাই ঠিক করে দিলেন আশ্রিতারা কে কোন ঘরে থাকবে।

মহিলারা কাপড়ের ব্যাগে বা টিনের সুটকেসে জামাকাপড় এবং টুকিটাকি কিছু জিনিস নিয়ে এসেছিল। ব্যাগ-ট্যাগগুলো তারা গুছিয়ে রাখল।

প্রতিটি ঘরের সঙ্গেই অ্যাটাচড বাথরুম। সুবর্ণা প্রতিটি ঘরে গিয়ে মহিলাদের সেগুলো দেখিয়ে বলল, আপনারা হাত-মুখ ধুয়ে নিন। চা-খাবার আসছে।

কিছুক্ষণ পর হল-ঘরে রান্নার লোকেরা মেয়েদের চা আর খাবার দিয়ে গেল। ওদের সঙ্গ দেবার জন্য মনোরমা, বন্দনা আর সুবর্ণা এক কাপ কার চা নিল।

কাপে চুমুক দিয়ে সুবর্ণা জিজ্ঞেস করল, মেয়েদের সব সময় দেখাশোনার জন্য কারা আসবে মনোরমাদি?

মনোরমা বললেন, নমিতা আর তাপসী।

নমিতা সান্যাল আর তাপসী বসু নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর সক্রিয় কর্মী। দু’জনেই চাকরি করে। সুবর্ণা বলল, কিন্তু নমিতার স্কুল আর তাপসীর অফিস আছে। ওরা। কি টানা একমাস এখানে পড়ে থাকতে পারবে?

না না, অতদিন ওদের পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। ওরা দশদিনের ছুটি নিয়েছে।

তারপর?

মনোরমা জানালেন নমিতা আর তাপসীর পর দশদিনের জন্য আসবে পরমা এবং মমতা, তারপর সুরভি আর অঞ্জলি। তিনি যাদের নাম করলেন তারাও চাকরি-বাকরি করলেও নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর সঙ্গে আন্তরিকভাবে যুক্ত। প্রতাপপুর সিটির এরকম বহু মেয়ের মধ্যেই সমাজসেবার বীজ বুনে দিয়েছেন মনোরমা।

সুবর্ণা বলল, কই, নমিতা আর তাপসী তো এখনও এল না?

হাতের ঘড়ি দেখে মনোরমা বললেন, এখন পৌনে পাঁচটা বাজে। ছ’টার ভেতর ওরা চলে আসবে।

কথা বলছিল ঠিকই, তবে সুবর্ণার চোখ ছিল মহিলাদের দিকে। সে লক্ষ করল, পারুল ছাড়া বাকি সবাই খাচ্ছে। পারুল পরটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে মেঝেতে ফেলছে, পরক্ষণে তুলে থালায় রাখছে। কখনও বা চায়ের কাপে জল ঢেলে দিচ্ছে। তার মুখে পাগলাটে, শব্দহীন হাসি।

সুবর্ণা পারুলকে কী বলতে যাচ্ছিল, মনোরমা থামিয়ে দিয়ে বললেন, ও যা করছে, করতে দাও। বাধা দিও না, কিছু বোলোও না। জেল থেকে বলে দিয়েছে যখন খিদে পাবে, ঠিক খেয়ে নেবে। ওর কোনও ব্যাপারে বাধা দিলে ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠে।

এমন একটা মহিলাকে বাড়িতে রাখা প্রচণ্ড ঝুঁকির ব্যাপার। কখন, কী কারণে হঠাৎ খেপে উঠবে, কে জানে। ভেতরে ভেতরে একটু ভয়ই পেয়ে গেল সুবর্ণা।

মনোরমা তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ভেবো না, ওকে তোমার দেখতে হবে না। তাপসী আর নমিতাকে বুঝিয়ে দিয়ে যাব; ওরা ঠিক সামলে নেবে।

সুবর্ণা মনে মনে আরাম বোধ করল। মাথা হেলিয়ে দিয়ে বলল, আচ্ছা

মনোরমা এবার বললেন, ওরা খেতে থাক। চল, তোমার শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করে আসি।

রাজীবকে আগেই জানানো হয়েছিল চারটে নাগাদ মেয়েদের নিয়ে মনোরমা এ বাড়িতে আসবেন এবং দোতলায় গিয়ে সংগ্রামনারায়ণের সঙ্গে কথা বলবেন। রাজীব বলেছিল, মনোরমা দোতলায় ওঠার আগে তাকে যেন জানিয়ে দেওয়া হয়। সুবর্ণা বলল, আপনি একটু বসুন। বাবা দুপুরে ঘুমোন তো। দেখে আসি জেগেছেন। কিনা। মনোরমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ওপরে উঠে গেল সে।

রাজীব শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে এলোমেলো পায়চারি করছিল। শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ তাঁর খাটে ঘুমোচ্ছিলেন। আর সংগ্রামনারায়ণ অন্য দিনের মতো তার বেডরুমের জোড়া জানালার কাছে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখছিলেন।

সুবর্ণা নিঃশব্দে, পা টিপে টিপে রাজীবের কাছে এসে চাপা গলায় বলল, ওরা এসে গেছে।

রাজীব বলল, হ্যাঁ, অনেকের গলা শুনতে পাচ্ছি।

মনোরমাদি এখন দোতলায় আসবেন।

ঠিক আছে, আসুন না’

চিন্তিতভাবে সুবর্ণা জিজ্ঞেস করল, আপনি—মানে–

রাজীব একটু হেসে বলল, সেটা ভেবে রেখেছি। আপনাদের যে অস্ত্রশালা আছে সেখানে ঢুকে দরজা বন্ধ করে থাকব।

সেই ভাল।

আপনার মনোরমাদি কতক্ষণ থাকবেন?

কতক্ষণ আর, ম্যাক্সিমাম কুড়ি পঁচিশ মিনিট।

ঠিক আছে, ওঁকে নিয়ে আসুন।

যেভাবে এসেছিল তেমনি চুপিসারে নিচে নেমে গেল সুবর্ণা। মিনিট তিন-চারেক বাদে মনোরমাকে সঙ্গে করে ফের যখন ওপরে উঠল শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে রাজীবকে দেখা গেল না। চোখের কোণ দিয়ে লক্ষ করল, ডান পাশে রাজবংশের প্রাচীন অস্ত্রশালার দরজা ভেতর থেকে আটকানো।

সুবর্ণা হল-ঘর পেরিয়ে সংগ্রামনারায়ণের ঘরের কাছে এসে ডাকল, বাবা–

শীতের সূর্য দূরের গাছপালার আড়ালে অনেকখানি নেমে গেছে। শুধু মাথার দিকের সামান্য একটা রক্তিম ফালি চোখে পড়ছে।

সন্ধের আগে আগে এই সময়টায় অঘ্রাণের মিহি কুয়াশা বিষাদের মতো নেমে আসছিল প্রতাপপুর সিটির ওপর।

সুবর্ণার কণ্ঠস্বর কানে যেতে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ালেন সংগ্রামনারায়ণ। তার পাশে মনোরমাকে দেখে খুশি হলেন। কয়েক পা এগিয়ে এসে বললেন, বাইরে দাঁড়িয়ে কেন, ভেতরে এসো। প্রতাপপুর সিটির এই একটি মাত্র মানুষ, বয়সে ছোট হলেও, তাকে মনে মনে শ্রদ্ধা করেন তিনি। মনোরমাকে দেখলে তার দুচোখ স্নিগ্ধ, নরম হাসিতে ভরে যায়।

মনোরমাকে বসতে বলে সংগ্রামনারায়ণ খাটে বসলেন। সুবর্ণাকে বললেন, ওকে চা মিষ্টি টিষ্টি দিয়েছ বৌমা?’

মনোরমা বললেন, আপনি ব্যস্ত হবেন না মেসোমশাই। আমার চা খাওয়া হয়ে গেছে। আপনি কেমন আছেন বলুন।

সংগ্রামনারায়ণ হাসলেন, দু-তিনটে হার্ট-অ্যাটাকের পর যেমন থাকা উচিত তার চেয়ে অনেক ভাল আছি। সুবর্ণাকে দেখিয়ে বললেন, বৌমা সেবাযত্ন করে আমার আয়ু বাড়িয়ে দিয়েছে।

একসময় প্রচণ্ড ক্রোধে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে সুবর্ণাকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। এখন প্রশংসা করে তার কিঞ্চিৎ ক্ষতিপূরণ করতে চাইছেন কি সংগ্রামনারায়ণ? বিয়ের পর চোদ্দ বছর কেটে গেছে। এই প্রথম ওঁর মুখে এ ধরনের কথা শুনল সুবর্ণা।

মনোরমা সস্নেহে বললেন, হ্যাঁ। ওর মতো মেয়ে হয় না। একটু চুপ করে থেকে ফের গম্ভীর গলায় শুরু করলেন, মেসোমশাই, আপনার কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

কীসের কৃতজ্ঞতা?

আপনি নন-ক্রিমিনাল মেয়েগুলোকে আশ্রয় না দিলে ওদের নিয়ে খুব মুশকিলে পড়ে যেতাম।

আমাদের একতলাটা ফাঁকা পড়ে আছে। ক’টা নিরাশ্রয় মেয়ে না হয় থাকলই। সংগ্রামনারায়ণ বলতে লাগলেন, আমার লজ্জাটা কোথায় জানো? মেয়েরা এখানে থাকছে আর তোমরা তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করছ। আমাদের প্যালেসে এমন ঘটনা আগে আর কখনও ঘটেনি।

মনোরমা বিব্রত বোধ করলেন, এ নিয়ে মন খারাপ করবেন না মেসোমশাই। আমরা মেয়েদের জন্যে নানা জায়গা থেকে সাহায্য পাই। নিজেদের পয়সা তো খরচ করতে হয় না।

সংগ্রামনারায়ণ বিষণ্ণ একটু হাসলেন; কিছু বললেন না। মেয়েদের আশ্রয় দেবেন, অথচ খাওয়াতে পারবেন না–তার রাজকীয় মর্যাদায় প্রচণ্ড আঘাত লেগেছে।

আরও কিছুক্ষণ পর মনোরমা বিদায় নিলেন। সুবর্ণা তার সঙ্গে নিচে নেমে এল। নমিতা আর তাপসী ছ’টার মধ্যে চলে এসেছিল। মনোরমা তাদের সঙ্গে মহিলাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, এখন থেকে তোমরা এদের দেখাশোনা করবে। সুবর্ণা তো আছেই। আশা করি কোনও প্রবলেম হবে না। রোজ না পারলেও দু-একদিন পরপর আমি বা বন্দনা এসে দেখে যাব।

সুবর্ণাদের হাতে বারোটি মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলার দায়িত্ব তুলে দিয়ে মনোরমা আর বন্দনা চলে গেলেন।

তারপরও কিছুক্ষণ একতলায় কাটিয়ে ওপরে উঠে গেল সুবর্ণা। তার চোখে পড়ল, রাজীব শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে বসে আছে। অর্থাৎ মনোরমা নিচে নামার পর সে অস্ত্রাগার থেকে বেরিয়ে এসেছিল।

রাতে দেবীকে পড়িয়ে, সংগ্রামনারায়ণ এবং শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে খাইয়ে অন্য দিনের মতো আজও ডাইনিং টেবলে খেতে বসেছিল রাজীব আর সুবর্ণা।

খেতে খেতে রাজীব বলল, আপনার রেসপনসিবিলিটি অনেক বেড়ে গেল মিসেস সিংহ। বাড়ির এতগুলো ডিউটি রয়েছে, কলেজ আছে, তার ওপর এই মহিলারা এসেছে। কী করে যে সামলাবেন ভেবে পাচ্ছি না।’

সুবর্ণা একটু হেসে বলল, একটা মাস তো। দেখতে দেখতে কেটে যাবে।

আশ্রিতা মহিলাদের সম্বন্ধে আবার কী বলতে যাচ্ছিল রাজীব, তাকে থামিয়ে সুবর্ণা বলল, আমার কথা তো সবই বলেছি, নিজের চোখেও অনেকটাই দেখেছেন। আপনার সম্পর্কে এখনও প্রায় কিছুই জানা হয়নি আমার।

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল রাজীব। তারপর যেন মনস্থির করে বলল, খুব কৌতূহল হচ্ছে?

সুবর্ণা বলল, সেটা স্বাভাবিক কিনা আপনিই বলুন। এক সঙ্গে কয়েক দিন আছি। নিজেই বলেছেন, আমাকে আর অবিশ্বাস করেন না। আপনার দ্বিধা থাকার কথা নয়।

ঠিক আছে। হয়তো বুঝতে পেরেছেন রাজীব আমার আসল নাম নয়। সেটা আর নর্থ-ইস্টের কোথায় আমাদের বাড়ি–এই দু’টো ছাড়া আর সবই বলছি।

অর্থবান বলতে যা বোঝায় রাজীবরা আদৌ তা নয়। মোটামুটি উচ্চ মধ্যবিত্ত বলা যেতে পারে। তার বাবা একটা স্টেট গভর্নমেন্টের ডেপুটি সেক্রেটারি ছিলেন, কয়েক বছর আগে রিটায়ার করেছেন। মা ছিলেন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের অ্যাসিস্টান্ট হেড মিস্ট্রেস। তিনি বেঁচে নেই, প্যাংক্ৰিয়াসে ক্যানসার হয়ে মারা গেছেন।

রাজীবরা দুই ভাই, এক বোন। সে সবার ছোট। দাদা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, স্ত্রী আর এক ছেলেকে নিয়ে দিল্লিতে থাকে। সে ওখানকার একটা বড় ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে বেশ উঁচু পোস্টে আছে। দিদি থাকে বাঙ্গালোরে। জামাইবাবু ব্যাঙ্ক অফিসার। ওদের এক ছেলে, এক মেয়ে। দিদিও একটা মাল্টিন্যাশনাল ফার্মে চাকরি করে।

রাজীবদের বাড়ির প্রায় সবারই হায়ার এডুকেশন কলকাতায়। বাবা স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়ে ইংরেজিতে এম. এ করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। দাদা যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ত। মা এবং দিদি ছিলেন লেডি ব্রাবোর্নের ছাত্রী। পরে কলকাতা থেকেই এম. এ পাস করেছে। মা হিস্ট্রিতে, দিদি বাবার মতোই ইংরেজিতে।

মা-বাবা দাদা-দিদির মতো রাজীবও পড়ত কলকাতায়–প্রেসিডেন্সি এবং সায়েন্স কলেজে। ওখান থেকে ফিরে গিয়ে কয়েক বছর একটা কলেজে পড়িয়েছে। সে। আগে থেকেই নর্থ-ইস্টের প্রতি বৈষম্য এবং ঔদাসীন্য ওই অঞ্চলে একটা অগ্নিগর্ভ পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। অসংখ্য যুবক তখন হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। সর্বত্র বাতাসে বারুদের গন্ধ। সমস্ত এলাকা নিদারুণ অস্থিরতার মধ্যে চলছে। এই সময় রাজীবের মনে হয়েছিল তারও কিছু একটা করা দরকার। কলেজ ছেড়ে সে একদিন সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ল।

প্রায় গোটা নর্থ-ইস্ট জুড়ে পুলিশ তো বটেই, আর্মি প্যারা মিলিটারি আর বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল অনেক আগেই। হত্যা, মৃত্যু, অজস্র, রক্তপাত, ধরপাকড় এবং প্রবল উত্তেজনা–সব মিলিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারত প্রতিদিন উত্তাল, প্রতিদিন খবরের কাগজের শিরোনামে।

তিন চার বার আরও কয়েকজন মিলিটান্টের সঙ্গে ধরা পড়েছিল রাজীব। প্রতিবারই তারা পুলিশ বা আর্মির হাত থেকে পালিয়ে যায়। তবে খুব সহজে নয়, মুখোমুখি মারাত্মক লড়াইয়ের পর। দু’পক্ষই বেপরোয়া গুলি চালিয়েছে। কনফ্রনটেসনে মারা গেছে অনেকে। একবার হাতে, একবার পায়ে, আরেক বার কাঁধে বুলেট লেগেছিল রাজীবের। তিনবারই দু-একমাস করে বিছানায় পড়ে থাকতে হয়েছে। এছাড়া পুলিশ বা জওয়ানদের গুলি তার মাথা, বুক বা কানের পাশ দিয়ে কতবার যে বেরিয়ে গেছে, তার হিসেব নেই। যে কোনও মুহূর্তে তার মৃত্যু হতে পারত।

দিন কুড়ি আগে রাজীব এবং তার কয়েক জন সঙ্গী পাহাড় আর জঙ্গল-ঘেরা যে জায়গাটায় থাকত, আর্মি সেখানে একটা বড় রকমের অপারেশন চালায়। ওরা ছত্রভঙ্গ হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। জওয়ানদের একটা জিপ তাকে দেখতে পেয়ে পিছু নেয়। রাজীব ঘন জঙ্গলে ঢুকে উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়ুতে থাকে। তিনটে জওয়ান জিপ থেকে নেমে এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে চালাতে তার পিছু নেয় কিন্তু কিছুক্ষণ পর ওরা আর তাকে খুঁজে পায় নি।

জঙ্গল আর পাহাড় ডিঙিয়ে পথ হারিয়ে ক’দিন আগে রাজীব প্রতাপপুর সিটিতে ঢুকে পড়েছিল। কিন্তু সে এখানে আসার আগেই খুব সম্ভব স্থানীয় থানাকে তার ছবি পাঠিয়ে সতর্ক করে দেওয়া হয়। সেদিন প্রতাপপুর পুলিশের তাড়া খেয়ে সে প্যালেসে জোর করে ঢুকে পড়েছিল।

একটানা সব বলে জোরে শ্বাস টানল রাজীব। একটু হেসে বলল, এই হল আমার লাইফ হিস্ট্রি।

একটা চমকপ্রদ দমবন্ধ-করা কাহিনী যেন শুনছিল সুবর্ণা। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে সে। একসময় অবরুদ্ধ গলায় জিজ্ঞেস করে, আপনার মা তো নেই। বাবা, দাদা বা দিদির সঙ্গে দেখা হয়?

ইমপসিবল। বছর খানেক আগে বাবাকে লাস্ট দেখেছিলাম। দাদা আর দিদিকে কতদিন যে দেখি না!

সুবর্ণা কিছু বলল না।

রাজীব বলে, বুঝতেই পারছেন নানা হাইড-আউটে লুকিয়ে থাকতে হয়।

পুলিশ আর জওয়ানরা ব্লাড হাউন্ডের মতো আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। দাদা আর দিদি অনেক দূরে থাকে। তাদের সঙ্গে দেখা হওয়া মুশকিল কিন্তু বাড়ি গিয়ে বাবাকে যে দেখে আসব, সেটাও ভীষণ রিস্কি।

সুবর্ণা বলল, ওঁদের জন্যে কষ্ট হয় না?

রাজীব বিষণ্ণ হাসে, হা, হয়। আপনার কি ধারণা, আমার সব হিউম্যান ফিলিংস নষ্ট হয়ে গেছে।

প্রথম যেদিন আমাদের বাড়ি ঢুকেছিলেন, আপনি কিন্তু বলেছিলেন মানবিক কোনও অনুভূতি আপনার নেই।

রাজীব চমকে ওঠে, খুব অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বলে, হ্যাঁ, বলেছিলাম। তখন প্রাণ বাঁচানোর জন্যে একটা শেলটারের দরকার ছিল। তাই

তার কথাগুলো যেন শুনতে পাচ্ছিল না সুবর্ণা। হঠাৎ বলে ওঠে, আপনি কখনও কোনও জওয়ান, পুলিশ বা অন্য কাউকে–মানে–’বলতে বলতে থেমে যায়।

তীক্ষ্ণ চোখে সুবর্ণাকে লক্ষ করতে করতে রাজীব বলে, মার্ডার করেছি কিনা? যদি হিউম্যান ফিলিংস থাকে, করলাম কী করে? এটাই জানতে চাইছেন তো?’

সুবর্ণা উত্তর দেয় না।

রাজীব বলে, আপনি যদি কোনও একটা বড় লক্ষ্যের জন্যে যুদ্ধ করেন আর হাতে যদি রাইফেল থাকে তখন কত কী-ই তো ঘটে যেতে পারে। তবে সেন্সলেস কিলিং আমি পছন্দ করি না।

সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, তেমন কিছু কি ঘটছে না? খবরের কাগজে দেখি মুক্তিপণ আদায়ের জন্যে কত লোককে কিডন্যাপ করা হচ্ছে। এসব লক্ষ্যে পৌঁছুতে কতটা সাহায্য করে?

স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে রাজীব। বেশ কিছুক্ষণ বাদে বলে, এত বড় একটা ব্যাপার; দু-চারটে ভুল হতেই পারে।

সুবর্ণা কী বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই একতলায় প্রচণ্ড হইচই শোনা গেল। পরক্ষণে সিঁড়িতে দুপদাপ আওয়াজ। কারা যেন ঝড়ের বেগে ওপরে উঠে আসছে। সেই সঙ্গে নমিতা আর তাপসীর চিৎকার ভেসে এল, সুবর্ণাদি-সুবর্ণাদি, ওকে ধরুন, ধরুন–

চমকে রাজীব এবং সুবর্ণা মুখ ফিরিয়ে তাকায়। এক সঙ্গে দু’টো করে সিঁড়ি টপকাতে টপকাতে ল্যান্ডিংয়ের কাছে চলে এসেছে সেই মহিলাটি যার নাম পারুল। তার মুখে শব্দহীন, খ্যাপাটে হাসি, চোখে ঘোর-লাগা, হিংস্র দৃষ্টি। পারুলকে ধরার জন্য তার পেছন পেছন দিশেহারার মতো উঠে আসছে নমিতারা।

সুবর্ণা এতটাই হতবুদ্ধি হয়ে পড়ছিল যে কী করবে ভাবতে পারছিল না। রাজীব কিন্তু বসে থাকল না, নিজের অজান্তেই যেন লাফ দিয়ে উঠে সিঁড়ির দিকে ছুটল। পারুল দোতলায় আসার আগেই তাকে ধরে টানতে টানতে নিচে নামিয়ে নিয়ে গেল।

এদিকে হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে উঠছিল সুবর্ণা। সেও ঊর্ধ্বশ্বাসে একতলায় নেমে এসেছে। ততক্ষণে রাজীব জোর করে পারুলকে একটা সোফায় বসিয়ে দিয়েছে। নমিতা আর তাপসী একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। অন্য মহিলারা ধারে কাছে নেই। নিজেদের ঘরের দরজার আড়াল থেকে শঙ্কাতুর চোখে পারুলদের দেখছে। হরেনকেও হল-ঘরের একধারে দেখা গেল।

সুবর্ণা তাপসীদের দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন সুরে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? এত চেঁচামেচি কীসের?’ পারুলকে দেখিয়ে বলল, এ হঠাৎ দোতলার দিকে যাচ্ছিল কেন?

তাপসী খুবই সাহসী মেয়ে। তবু চিন্তিতভাবে বলল, জানি না। ভীষণ ভায়োলেন্ট হয়ে উঠছিল। একবার বাইরের দরজা খুলে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল, আমরা যেতে দিইনি। একে কী করে সামলাব, বুঝতে পারছি না। হরেনকে দেখিয়ে বলল, উনি আমাদের হেল্প করতে এসেছিলেন, আঁচড়ে কামড়ে রক্ত বার করে দিয়েছে।

হরেন নিঃশব্দে তার দু’হাত সামনে বাড়িয়ে ধরল। সে দু’টো সত্যিই রক্তাক্ত। কনুই থেকে হাতের পাতা পর্যন্ত অনেকগুলো ক্ষতচিহ্ন চোখে পড়ল।

তাপসী থামেনি, কোনওরকমে তিনজনে ধরে তো নিয়ে এলাম। তারপর হঠাৎ দোতলার দিকে দৌড় দিল–’

এই সময় অন্য যে মেয়েরা ঘরের ভেতর ছিল তাদের মধ্যে দু-তিনজন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

চকিত হয়ে সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, কী ব্যাপার, ওরা কাঁদছে কেন?

নমিতা বলল, জানি না। তখন আপনি চলে গেলেন, তারপর মাঝে মাঝেই কেঁদে উঠছে। জানতে চাইলে কিছু বলে না।

সুবর্ণা বলল, এ তো ভারি সমস্যার ব্যাপার।

এদিকে পারুল আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে বাইরের দরজার দিকে দৌড় লাগাল। তাপসীরা চেঁচিয়ে ওঠে, পালিয়ে যাচ্ছে, পালিয়ে যাচ্ছে–

কেউ কিছু করে ওঠার আগেই রাজীব বিদ্যুৎগতিতে ছুটে গিয়ে পারুলকে ধরে নিয়ে আসে। জোর করে বসিয়ে দিতে দিতে বলে, কেন সবাইকে এত হয়রান করছেন?

পারুলের পরনের শাড়িটা আলুথালু, চুল উসকো-খুসকো। চোখে মুখে অদ্ভুত পাগলাটে একটা হাসি ফুটে উঠেছে। মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে সে চিৎকার করতে থাকে, বেশ করছি–বেশ করছি–

প্রচণ্ড জোরে ধমকে ওঠে রাজীব, চুপ, একদম চুপ। ফের অসভ্যতা করলে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখব।

হঠাৎ ভীষণ কুঁকড়ে যায় পারুল, ভয়ার্ত গলায় বলে, না না, আমাকে বেঁধে না।

খাওয়া হয়েছে?

পারুল উত্তর দেয় না। তাপসী জানায়, ফেলে ছড়িয়ে সামান্য কিছু খেয়েছে।

রাজীব পারুলকে বলল, যান, শুয়ে পড়ুন গিয়ে—

বাধ্য মেয়ের মতো নিজের জন্য নির্দিষ্ট ঘরটিতে চলে যায় পারুল।

হঠাৎ সুবর্ণার মনে হল, রাজীব সম্পর্কে তাপসীদের নিশ্চয়ই কৌতূহল হওয়া স্বাভাবিক। তারা প্রতাপপুর রাজবংশ সম্পর্কে সব জানে। শুনেছে, এ বাড়িতে কেউ বিশেষ আসে না। সুবর্ণার দু-একজন কলিগ বা নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর কর্মীরা এলে নিচে থেকে তার সঙ্গে দেখা করে চলে যায়। মনোরমা আর বন্দনা ছাড়া অন্য কারও ওপরে যাওয়ার হুকুম নেই। যেখানে এ জাতীয় অলিখিত, কঠোর নিয়ম চালু রয়েছে সেখানে অপরিচিত একটি নোক কবে এ বাড়িতে এল, সুবর্ণাদের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক–তাপসীদের মনে এ নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। কথায় কথায় ওরা বাইরের কাউকে যদি রাজীবের কথাটা বলে ফেলে তা নিয়ে সমস্যা দেখা দেবে। সুবর্ণার হঠাৎ মনে হল, তাপসীদের তো বটেই, কাল মনোরমাদি আর বন্দনাদি এলে ওঁদেরও জানিয়ে দেবে। কেননা রাজীব সম্পর্কে মনোরমাদিদের কাছে গোপনীয়তা শেষ পর্যন্ত রাখা যাবে না। পারুলের মতো অস্বাভাবিক, খ্যাপা মেয়েকে সামলে যে তাদের দুশ্চিন্তা কমিয়ে দিয়েছে তার কথা না বলে পারা যাবে না।

হঠাৎ যেন মরিয়া হয়ে উঠল সুবর্ণা। রাজীবের ব্যাপারে তার স্নায়ুমণ্ডলী ক’দিন ধরে প্রচণ্ড একটা চাপের মধ্যে রয়েছে। যে কোনও মুহূর্তে সেগুলো ছিঁড়ে পড়বে। সুবর্ণা যেন ক্রমশ অথৈ জলে ডুবে যাচ্ছে। উৎকণ্ঠা, ভয়, অস্বাচ্ছন্দ্য–সব মিলিয়ে এমন একটা অবস্থা যে সে আর পেরে উঠছে না। প্রাণপণে হাতের মুঠি শক্ত করে তার ভেতর রাজীবকে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিল। মুঠিটা ক্রমশ আলগা হয়ে যাচ্ছে।

রাজীব সম্পর্কে তাপসীরা যাতে বাড়তি কৌতূহল প্রকাশ করে না বসে বা মনে কোনওরকম সংশয় না রাখে সে জন্য ওদের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিল সুবর্ণা।

তাপসী রাজীবকে বলল, আপনাকে কী বলে যে কৃতজ্ঞতা জানাব ভেবে পাচ্ছি না। আপনি না থাকলে আমরা ভীষণ বিপদে পড়ে যেতাম।

রাজীব বলল, কী আর এমন করেছি। এর জন্যে আবার কৃতজ্ঞতা কেন?

নমিতা বলল, সুবর্ণাদি, আমি অন্য একটা কথা ভাবছি।

সুবর্ণা জানতে চাইল, কী?

রাত বেশি হয়নি, আপনারা জেগে ছিলেন, তাই রাজীবদা পারুল দে’কে সামলাতে পেরেছে। কিন্তু মাঝরাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সে যদি আবার ঝামেলা করে?

এমন একটা সম্ভাবনার কথা ভেবে দেখেনি সুবর্ণা। তাকে চিন্তিত দেখায়। বলে, ও যে ধরনের মহিলা–করতে পারে।

তখন কী হবে?

রাজীব এই সময় বলে ওঠে, আপনাদের আপত্তি না থাকলে আমি রাত্তিরে এখানে থাকতে পারি। কড়া না হলে ওর খ্যাপামি বন্ধ করা যাবে না।

নমিতা এবং তাপসীর দুশ্চিন্তা অনেকখানি কেটে যায়। একসঙ্গে তারা বলে ওঠে, তা হলে তো আমরা বেঁচে যাই। আপনি থাকলে পারুল দে আর গোলমাল করতে সাহস পাবে না। আপনার ধমক ধামক শুনে ভীষণ ঘাবড়ে গেছে।

রাজীব বলল, আমি হল-ঘরে সোব। হরেনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, একটা তালা পাওয়া যাবে?

যাবে। হরেন দৌড়ে গিয়ে নিজের ঘর থেকে তালা চাবি নিয়ে এল। অবাক হয়ে রাজীবকে লক্ষ করছিল সুবর্ণা। বলল,তালা দিয়ে কী হবে? রাজীব বলল, আমি সারা রাত অ্যালার্ট থাকতে চেষ্টা করব। যদি ঘুমিয়ে পড়ি আর সেই ফাঁকে মহিলাটি পালানোর চেষ্টা করে তাই বাইরের দরজাটা ভেতর থেকে তালা দিয়ে রাখতে চাই। চলুন, ওপর থেকে আমার বিছানা নিয়ে আসি।

সিঁড়ি ভেঙে পাশাপাশি দোতলায় উঠতে উঠতে সুবর্ণা বলল, আপনার এত বড় একটা রিস্ক নেওয়া উচিত হয়নি।

কীসের রিস্ক?

পারুল যখন ওপরে উঠে আসছিল তখন দৌড়ে গেলেন কেন?

আমি না গেলে ওকে কি ঠেকানো যেত?

কিছু একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হয়ে যেত। এখন অনেকেই আপনাকে দেখে ফেলল। মানে–

রাজীব বলল, আমার সিকিউরিটির কথা নিশ্চয়ই ভাবছেন? আস্তে মাথা নাড়ল সুবর্ণা। রাজীব বলল, লুনাটিক মেয়েগুলোর মানসিক যা অবস্থা তাতে আমার সম্বন্ধে মাথা ঘামাবে না। দুই সোশাল ওয়ার্কার নমিতা আর তাপসী বিশ্বাস করেছে আমি আপনাদের আত্মীয়। তাছাড়া দরজা ভেতর থেকে তালা দেওয়া থাকবে। আমার ধারণা কোনওরকম প্রবলেম হবে না। একটু থেমে বলল, আসলে–

কী?

সমস্ত দিন কত ব্যস্ততার মধ্যে থাকেন। তবু এতগুলো মহিলার দায়িত্ব নিয়েছেন। ভাবলাম, চুপচাপ তো বসেই থাকি। যে ক’দিন এখানে আছি, আপনাকে যদি একটু সাহায্য করতে পারি–

সবিস্ময়ে রাজীবের দিকে তাকায় সুবর্ণা। একজন ভয়াবহ বিচ্ছিন্নতাবাদী যে বেতাদের নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর কাজে স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসবে, ভাবা যায়নি।

গভীর, আন্তরিক গলায় সে বলল, মোস্ট ওয়েলকাম–

দু’জনে সিঁড়ি পেরিয়ে দোতলায় চলে আসে।

.

১৭.

নিরপরাধ, মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলারা ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ আসার পর রাজীবের নির্দেশমতো একতলার বাইরের দিকের দরজাটা ভেতর থেকে তালা দিয়ে রাখা হচ্ছে। কেউ এসে ডাকাডাকি করলে বা কড়া নাড়লে নাম জিজ্ঞেস করে হরেন তালা খোলে। মনোরমাদি বা বন্দনাদি ছাড়া বাইরের অন্য কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয় না। এই সতর্কতামূলক ব্যবস্থাটা মহিলাদের জন্য তো বটেই, তার চেয়েও অনেক বেশি করে রাজীবের জন্য।

সুবর্ণা লক্ষ করেছে, প্রথম দুদিন শুধু রাতটাই একতলায় কাটিয়ে এসেছে। রাজীব। পরে খাওয়ার সময়টুকু ছাড়া দিনরাত ওখানেই থাকছে। ক্রমশ আশ্রিতা

মহিলাগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছিল সে। বুঝতে পারছিল দীর্ঘকাল অনিশ্চয়তা এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা আর অকারণে জেল খাটার ফলে অদ্ভুত মানসিক রোগ এদের সমস্ত অস্তিত্বের মধ্যে ছড়িয়ে গেছে। এরা কেউ সারাক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকে। কেউ অবসাদগ্রস্ত, কেউ ধন্দ-ধরা বা অত্যন্ত বিমর্ষ, কেউ চাপা করুণ সুরে কেঁদে যায়। পারুলের মতো দু-একজন আছে যারা মাঝে মাঝেই খেপে ওঠে। এদের সঙ্গ দিয়ে, মজার মজার গল্প বলে, নতুন নতুন আশার কথা শুনিয়ে স্বাভাবিক করে তুলতে চেষ্টা করছে রাজীব।

মনোরমাদি আর বন্দনাদির সঙ্গে এর মধ্যে তার আলাপ হয়েছে। রাজীব সুবর্ণাদের আত্মীয়, এটুকু জেনেই তারা সন্তুষ্ট। সে রোগগ্রস্ত মেয়েদের জন্য দিবারাত্রি পরিশ্রম করছে, সে জন্য কৃতজ্ঞও। খবরের কাগজে যে সন্ত্রাসবাদীর ছবি বেরিয়েছে সেটার সঙ্গে গোয়েন্দাদের মতো তার চেহারা মিলিয়ে দেখার চিন্তাও করেন নি ওঁরা। আসলে নারী কল্যাণ ছাড়া মনোরমাদিদের অন্য কোনও দিকে নজর নেই।

সুবর্ণা রাজীবকে যত দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। যে নিষ্ঠুর, বিচ্ছিন্নতাবাদী একদিন জোর করে ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ ঢুকে পড়েছিল তার সঙ্গে এখানকার হৃদয়বান, সেবাপরায়ণ রাজীবের কোনও মিল নেই। আগাগোড়া সে বদলে যাচ্ছে।

সকালের দিকে ততটা সময় পায় না সুবর্ণা। কিন্তু বিকেলে কলেজ থেকে ফিরে সংগ্রামনারায়ণ, দেবী আর শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের খাওয়ার ব্যবস্থা করে, দেবীকে পড়তে বসিয়ে নীচে নেমে আসে। বিকেলে চা খাবার টাবার সে একতলায় রাজীব এবং আশ্রিতা মহিলাদের সঙ্গে বসে খায়। তারপর কাজ শুরু হয়ে যায়। রাজীব আর সে নানাভাবে মহিলাগুলোকে আনন্দে রাখতে চেষ্টা করে।

যা সুবর্ণার বলার কথা, মাঝে মাঝে সেটাই বলে ফেলে রাজীব, মিসেস সিংহ, আপনার শ্বশুর আপনাকে একদিন চরম অপমান করেছে। আপনার হাজব্যান্ড জঘন্যভাবে বিট্রে করেছে। জীবনে অলমোস্ট কিছুই পাননি। আপনার মধ্যে রাগ ছাড়া আর কিছুই থাকার কথা নয়। তবু মানুষের জন্যে এত মায়া রয়েছে কী করে?

সুবর্ণা সামান্য হেঁসে বলে, এটা তো আমিও আপনার সম্বন্ধে বলতে পারি।’

একটু হকচকিয়ে যায় রাজীব। বলে, কীরকম?

উত্তর না দিয়ে সুবর্ণা যেন দূরমনস্কর মতো বলে যায়, আসলে এ এমন এক দেশ, যতই ঘৃণা বা ক্ষোভ থাক, কেউ বোধহয় কাউকে ফেলে চলে যেতে পারে না। অদৃশ্য এক বন্ধন তাদের জড়িয়ে ধরে রাখে। একটু থেমে বলে, করুণা, মমতা, উদারতা, যাই বলুন এটাই ভারতবর্ষের আসল দিক।

রাজীব উত্তর দেয় না।

.

মহিলারা আসার পর এক সপ্তাহ কেটে গেছে।

তারপর একদিন মাঝরাতে নিচে প্রচণ্ড হইচই শুনে দোতলা থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে নেমে এল সুবর্ণা।

হল-ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে রাজীব, তার হাতে হ্যান্ড-কাফ। তাকে ঘিরে রয়েছে দশ পনেরো জন আর্মড পুলিশ। প্রতাপপুর থানার ওসি রামেশ্বর বসাক এবং পারুল দে-কে একধারে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে। অপ্রকৃতিস্থ, খ্যাপাটে পারুল এখন আশ্চর্য রকমের স্বাভাবিক। অন্য মহিলারা পুলিশ দেখে ভয়ে, আতঙ্কে ঘরে খিল দিয়ে চেঁচামেচি করছে। নমিতা, তাপসী এবং হরেন। বিহ্বলের মতো রামেশ্বরদের দেখছে।

স্তম্ভিত সুবর্ণা সিঁড়ির তলায় এসে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। তার দিকে নজর পড়তে এগিয়ে এলেন রামেশ্বর। বললেন, মিসেস সিংহ, আমার প্রথম থেকেই ধারণা ছিল ওই মিলিটান্টটা প্রতাপপুর প্যানে’-এ শেলটার নিয়ে আপনাদের হোস্টেজ করে রেখেছে। কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। পারুলকে দেখিয়ে বললেন, তাই আমাদের এই অফিসারটিকে নন-ক্রিমিনাল লুনাটিকদের সঙ্গে এখানে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। সামনের দিকের দরজায় সারাক্ষণ তালা লাগানো থাকে কিন্তু মিলিটান্টটা পেছন দিকের দরজার কথাটা মাথায় রাখেনি। কিছুক্ষণ আগে পারুল দে ওটা খুলে দিয়েছিল। তখন মিলিটান্টটা ঘুমোচ্ছে। পাঁচ মিনিটের ভেতর আমাদের কাজ শেষ করলাম। একেবারে পিসফুল, ব্লাডলেস অপারেশন। একটা গুলিও খরচ হয়নি।’ বলে সগর্বে হাসলেন!

সুবর্ণা রুদ্ধশ্বাসে দাঁড়িয়ে থাকে, কিছু বলে না।

রামেশ্বর এবার জিজ্ঞেস করলেন, ওর জিনিসপত্র, মানে ব্যাগ বা সুটকেশ টুটকেশ কোথায়? আমার বিশ্বাস, সেগুলোর ভেতর প্রচুর ওয়েপন পাওয়া যাবে।

ধীরে ধীরে অসাড় একটা আঙুল তুলে দোতলাটা দেখিয়ে দিল সুবর্ণা।

রামেশ্বর বললেন, দোতলার কোথায়?

কাঁপা গলায় সুবর্ণা বলল, বাঁ দিকের শেষ বেডরুমটায়; আমার দাদাশ্বশুর যেখানে থাকেন।

রামেশ্বর একজন কনস্টেবলকে সঙ্গে নিয়ে নিজেই ওপরে উঠে গেলেন এবং রাজীবের সেই ঢাউস ব্যাগ এবং বাদ্যযন্ত্র রাখার মতো লম্বা খাপটা নিয়ে এসে বললেন, মিসেস সিংহ, এত রাতে আপনাদের বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত। বুঝতেই পারছেন, অনিচ্ছা সত্ত্বেও পুলিশকে অনেক অপ্রিয় কর্তব্য পালন করতে হয়। আচ্ছা চলি, নমস্কার–

রামেশ্বররা রাজবাড়িতে ঢুকেছিলেন পেছনের দরজা দিয়ে, বেরুলেন সামনে দিয়ে।

নিজের অজান্তেই তাদের সঙ্গে নিঃশব্দে দরজার কাছে চলে আসে সুবর্ণা। বাইরে তারের জাল-বসানো একটা কালো ভ্যান দাঁড়িয়ে ছিল। রামেশ্বরদের সঙ্গে সেটায় উঠতে উঠতে একবার পেছন ফিরে তাকায় রাজীব। বলে, চললাম মিসেস সিংহ। জীবনে আর হয়তো আপনার সঙ্গে দেখা হবে না।

একটু পর শীতের কুয়াশা এবং অন্ধকারে ভ্যানটা অদৃশ্য হয়ে যায়। তার পরও আচ্ছন্নের মতো অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে সুবর্ণা। রাজীবের জন্য কী অপেক্ষা করে আছে–ফাঁসি, না আমৃত্যু কারাদণ্ড? যদি কোনও দিন সে মুক্তি পায় আবার কি হাতে অস্ত্র তুলে নেবে? যার মধ্যে এই সর্বংসহ ভারতবর্ষের মতো এত করুণা, মায়া আর সহানুভূতি রয়েছে সে কি এ দেশ থেকে ছিন্ন হওয়ার কথা আবার নতুন করে ভাববে?

শীতের ঠান্ডা হাওয়া মুখের ওপর আছড়ে পড়ছে। কিন্তু কিছুই যেন টের পাচ্ছিল না সুবর্ণা।

Exit mobile version