Site icon BnBoi.Com

দহনকালের শেষে – প্রফুল্ল রায়

দহনকালের শেষে - প্রফুল্ল রায়

১. স্কুল ছুটির পর

দহনকালের শেষে — উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

০১.

স্কুল ছুটির পর অন্য দিনের মতো সামনের বিশাল গেটটা খুলে দেওয়া হয়েছে। এক ১লহমাও কারও তর সইছিল না। আগে বেরুবার জন্য এখন তুমুল হুড়োহুড়ি, ধাক্কাধাক্কি।

এই নামকরা কো-এড স্কুলটায় ক্লাস ওয়ান থেকে টুয়েলভ পর্যন্ত তেরশোরও বেশি ছাত্রছাত্রী। তারা ঢলের মতো হুড় হুড় করে বেরিয়ে আসছিল। চারপাশ কলরবে মুখর।

ক্লাস চলার সময় বিশাল কমপাউন্ডের ভেতর প্রকাণ্ড দুটো চারতলা বাড়িতে টু শব্দটি শোনা যায় না। এখানে ডিসিপ্লিনের ভীষণ কড়াকড়ি। কিন্তু ছুটির বেল বাজলে তার লেশমাত্র থাকে না। তখন কে কী করল, এই নিয়ে প্রিন্সিপ্যাল আদৌ মাথা ঘামান না।

ভিড়ের ভেতর পথ করে করে ক্লাস টুয়েলভের একটা দঙ্গল বেরিয়ে এসেছিল। বাইরের ফুটপাতে ছেলেমেয়েদের নিয়ে যাবার জন্য অনেক মা, বাবা কি বাড়ির লোক ভিড় করে আছে। রাস্তার ধার ঘেঁষে বিরাট বিরাট স্কুল-বাস দাঁড়ানো। প্রায় ডজন খানেক। সেগুলোর সামনে লম্বা লাইন পড়ে গেছে। তা ছাড়া, একের পর এক আসছে কত না প্রাইভেট কার। মারুতি, ফিয়াট, অ্যামবাসাডর, সান্ত্রো।

রাস্তায় এসে ক্লাস টুয়েলভের সেই দঙ্গলটা ভেঙে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। ইলেভেনে ওঠার পর স্কুল-বাসের সুযোগ নেই। ধরেই নেওয়া হয়, তখন ছাত্রছাত্রীরা যথেষ্ট প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠেছে। নিজেদের যাতায়াতের ব্যবস্থা তাদেরই করে নিতে হয়। অনেকের বাড়ি থেকেই গাড়ি আসে। যারা কাছাকাছি থাকে, হেঁটেই চলে যায়। বাকি সবাই বাস, মিনিবাস কি অটোতে।

টুয়েলভের দুটি মেয়ে–শিঞ্জিনী আর স্বর্ণালী–ডান দিকের ফুটপাত ধরে একটু জোরে জোরেই হাঁটছিল।

গরমের লম্বা ছুটির পর আজই স্কুল খুলেছে। অন্য স্কুলে ভ্যাকেশনের পর প্রথম দিনটা একটু ঢিলেঢালা ভাব থাকে। দু-তিনটে পিরিয়ডের পর ছুটি দেওয়া হয়। কিন্তু এই স্কুল যেদিন খোলে সেদিন থেকেই পুরো ক্লাস।

জুন মাস শেষ হয়ে এল। আবহাওয়া দপ্তরের ঘোষণা অনুযায়ী, এর মধ্যে পুরোদমে বর্ষা নেমে যাবার কথা। কিন্তু সেভাবে আরম্ভই হয়নি। মেঘের আনাগোনা অবশ্য চলছেই। তবে তেমন জমাট বাঁধছে না। মাঝে মাঝে দু-এক পশলা হালকা বৃষ্টি হয়। ব্যস, এই পর্যন্ত।

এখন, এই বিকেলবেলায় পশ্চিম আকাশে বেশ মেঘ জমেছে। রোদের রং মলিন হয়ে যাচ্ছে। তবু ভাবগতিক দেখে মনে হয়, খুব তাড়াতাড়ি বৃষ্টি নামবে না। নামলেও সন্ধের পর।

শিঞ্জিনী আর স্বর্ণালী প্রায় একবয়সি। সতেরো থেকে আঠারোর মধ্যে। দুজনেরই সুশ্রী, ঝকঝকে চেহারা। তবু শিঞ্জিনীই বেশি করে চোখ টানে। সতেরো-পেরুনো এই সদ্য যুবতীর শরীর সবে ভরে উঠেছে। লম্বা ধাঁচের মুখ উজ্জ্বল চোখে গভীর দৃষ্টি। গায়ের রঙে পাকা গমের আভা। মসৃণ ত্বক। ঘন চুল কাঁধ পর্যন্ত ছাঁটা। হাইটও বেশ ভালো। সাড়ে পাঁচ ফিটের কাছাকাছি। হাত-পা-গলা, সব কিছু ক্রমশ নিখুঁত হচ্ছে। তবে একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, মেয়েলি নরম ভাবটা তার মধ্যে কম। কোথায় যেন একটা গোপন রুক্ষতা রয়েছে।

দুজনের পরনে স্কুল ড্রেস। প্লিট-দেওয়া নেভি-ব্ল রঙের হাঁটু ঝুল স্কার্ট আর ধবধবে সাদা জামা। পায়ে কালো জুতো, সাদা মোজা। বুকে-আঁটা পেতলের গোল প্লেটে স্কুলের নামটা মিনে-করা।

স্কুল পেছনে ফেলে ডান পাশে মিনিটখানেক হাঁটলে একটা সরু গলি। গলিটা তিনটে পাক খেয়ে ট্রামরাস্তায় গিয়ে পড়েছে। ওখান থেকে ছুটির পর রোজই বাস বা মিনিবাস ধরে শিঞ্জিনীরা। দুজন একই দিকে থাকে, তবে এক এলাকায় নয়। স্বর্ণালীদের বাড়ি গোলপার্কের পাশে, ফার্ন রোডে। শিঞ্জিনীদের আরও এগিয়ে টিভি সেন্টারের কাছাকাছি।

স্বর্ণালীদের ইমপোর্ট-এক্সপোর্টের বড় বিজনেস। ভারতবর্ষের নানা প্রভিন্সের হ্যাঁন্ডিক্রাফট অর্থাৎ হস্তশিল্পের নানা জিনিস ওরা বিদেশে পাঠায়। জাপান, থাইল্যান্ড এবং ইউরোপের নানা দেশ থেকে কী সব আনিয়ে এখানকার বাজারে বিক্রি করে।

স্বর্ণালীদের অঢেল টাকা। বাড়িতে তিন-চারটে দামি গাড়ি। সাম্রো, সিয়েলো, মারুতি-থাউজেন্ড ইত্যাদি। যে কোনও একটায় সে স্কুলে যাওয়া-আসা করতে পারত। কিন্তু ওর বাবা অন্য ধাতের মানুষ। দেশভাগের পর সর্বস্ব খুইয়ে এপারে চলে এসেছিলেন। কপর্দকশূন্য। প্রথম জীবনে খুব কষ্ট করতে হয়েছে। কটা বছর ভালো করে খাওয়া পর্যন্ত জোটেনি। কিন্তু জেদ ছিল অদম্য, লক্ষ্য অভ্রান্ত। যেভাবে হোক, দাঁড়াতেই হবে। এই কলকাতা শহরে কত মানুষ রাস্তা থেকে উঠে এসে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছেছে। তিনিই বা পারবেন না কেন? বিপুল পরিশ্রমে ধীরে ধীরে নিজের ভবিষ্যৎ তৈরি করে নিয়েছেন। এখন তাঁর বিরাট ব্যাঙ্ক ব্যালান্স, গাড়ি বাড়ি। ব্যবসাতে লাখ-লাখ টাকা খাটছে। কিন্তু অতীত ভোলেননি। তার দুই মেয়ে–স্বর্ণালী আর তার দিদি সুদীপ্তা। তিনি চান না, মেয়েরা সারাক্ষণ আরামে ডুবে থাকুক। একটু কষ্ট করতে শিখুক ওরা। তাই স্বর্ণালীর স্কুলে বা সুদীপ্তার কলেজে তিনি গাড়ি পাঠান না। ট্রামে-বাসেই গাদানো ভিড়ে ওদের যাতায়াত করতে হয়। এই নিয়ে দুই বোনেরই কোনও ক্ষোভ নেই। নিজেদের গাড়ি এলে হুস করে বাড়ি পৌঁছে যাবে। এখন বরং বন্ধুদের সঙ্গে অনেকটা বেশি সময় কাটানো যায়।

গলিতে ঢুকে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বারবার শিঞ্জিনীর দিকে তাকাচ্ছিল স্বর্ণালী। চোখাচোখি হলেই মুখ অন্য দিকে সরিয়ে নিচ্ছে সে।

শিঞ্জিনীর কপালে সামান্য ভাঁজ পড়ল। এতক্ষণ সমানে কলকল করছিল স্বর্ণালী। গরমের ছুটিতে কী কী করেছে, কোথায় কোথায় গেছে, কোন কোন আত্মীয়স্বজন তাদের বাড়িতে এসেছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর হঠাৎ চুপ করে গিয়ে তাকে দেখছে। দেখেই যাচ্ছে। এভাবে তার তাকানোর কারণ কী?

কী ভেবে শিঞ্জিনী জিগ্যেস করে, তুই কি আমাকে কিছু বলবি?

একটু দ্বিধান্বিত দেখাল স্বর্ণালীকে। তারপর মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

আর কোনও প্রশ্ন না করে অপেক্ষা করতে লাগল শিঞ্জিনী।

ওরা বড় রাস্তায় চলে এসেছিল। বাসস্ট্যান্ডের গা ঘেঁষে যে শেডটা, তার তলায় মোটামুটি ভিড় রয়েছে। শেডের দিকে না গিয়ে স্বর্ণালী শিঞ্জিনীকে নিয়ে খানিক দূরে একটা বড় বাড়ির ঝুল বারান্দার নীচে এসে দাঁড়াল। এখানে অন্য লোকজন নেই।

শিঞ্জিনী বেশ অবাক হয়ে গেছে। ভেতরে ভেতরে কিছুটা উদ্বিগ্নও ক্লাস ফাইভ থেকে একই স্কুলে, একই ক্লাসে তারা পড়ছে। স্বর্ণালী তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। আগে কখনও তো এমনটা করেনি।

স্বর্ণালী বলল, তুই যদি কিছু মনে না করিস, কথাটা বলব।

মনে করার মতো কি কিছু?

ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে তোর কিন্তু জানা দরকার।

তা হলে তো শুনতেই হয়।

গলার স্বর অনেকখানি নামিয়ে স্বর্ণালী বলল, তুই তো জানিস, আমার বাবা নাটক দেখতে ভীষণ ভালোবাসে।

স্বর্ণালী ছাড়া অন্য কোনও বন্ধুর বাড়িতে একেবারেই যায় না শিঞ্জিনী। ওর বাবা দেবকুমার আঙ্কল তাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন। নাটকপাগল মানুষ। গ্রুপ থিয়েটারের ভালো নাটক থাকলে, যত ব্যস্ততাই থাক, সময় বার করে বাড়ির সবাইকে নিয়ে দেখতে ছুটবেনই। একাডেমি কি শিশির মঞ্চে।

শিঞ্জিনী বলল, জানি– সে ভেবে পেল না, দেবকুমার আঙ্কলের নাটক দেখার মধ্যে এমন কী আছে যা তার মন খারাপ করে দিতে পারে!

স্বর্ণালী বলল, এবার গরমের ছুটি পড়ার দিন সাতেক পর বাবা আমাকে, দিদিকে আর মাকে নিয়ে একাডেমিতে একটা নাটক দেখতে গিয়েছিল। হঠাৎ চোখে পড়ল, আমরা যে রোটায় বসেছি তার উলটো দিকের রোয়ের একেবারে শেষে মৃদুলা আন্টি আর এক ভদ্রলোক পাশাপাশি বসে আছেন। তখনও নাটক শুরু হয়নি। হল-এ আলো জ্বলছিল। ভাবলাম আন্টির সঙ্গে কথা বলে আসি। কিন্তু শেষ না করে সে চুপ করে গেল।

মৃদুলা শিঞ্জিনীর মায়ের নাম। সে জিগ্যেস করল, কিন্তু কী?

স্বর্ণালী বলে, আন্টি পাশের ভদ্রলোকটির সঙ্গে হেসে হেসে খুব গল্প করছিল। আমি গেলে ওদের ডিসটার্ব করা হত। তাই যাইনি।

মৃদুলা নাটক দেখতে গেছে, এটাই চমকে দেবার মতো খবর। শিঞ্জিনী আঠাবোয় পা দিয়েছে। কিন্তু এতগুলো বছরে কোনওদিন মনে হয়নি, নাটক সম্পর্কে মায়ের বিন্দুমাত্র আগ্রহ আছে। কখনও তার মুখে কোনও নাটকের নামও শোনেনি শিঞ্জিনী। তবে সিনেমা খুব দেখে মৃদুলা। হল-এ গিয়ে নয়, বাড়িতে বসে; রাত্তিরে টিভি চালিয়ে। বাংলা হিন্দি বা ইংরেজি, সব রকমের ছবি। সেই মা রাতারাতি নাটকের এমন সমঝদার হয়ে উঠল যে একাডেমিতে ছুটেছে। সেন্টিমেন্টে বোঝাই, সস্তা, প্যানপেনে বাংলা ড্রামা নয়। গ্রুপ থিয়েটারের খটমট, জটিল নাটকের অনুরাগিণী! আশ্চর্য!

মা কখনও তার কাছে কিছু লুকোয় না। সারাদিন অফিসে কী করেছে, সিনিয়র অফিসারের সঙ্গে কোন বিষয়ে তার মতে মেলেনি, সহকর্মীদের মধ্যে যারা একটু ফাজিল তারা কী ধরনের মজা করেছে–সব শিঞ্জিনীকে বলা চাই। কিন্তু এই নাটক দেখার ব্যাপারটা একদম গোপন করে গেছে। তার চেয়েও বড় ব্যাপার মায়ের ওই সঙ্গীটি। মনের প্রান্তসীমায় মেঘ জমতে থাকে শিঞ্জিনীর।

তিন-চার মাস ধরে মায়ের কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে সে। আগে অফিস ছুটি হলে এক মুহূর্তও বাইরে সময় নষ্ট করত না মৃদুলা। চার্টার্ড বাসে পার্ক স্ট্রিট থেকে বাড়ি আসতে ঘন্টাখানেক। ছটার ভেতর পৌঁছে যেত। ট্র্যাফিক জ্যাম থাকলে আরও তিরিশ-চল্লিশ মিনিট বেশি লাগত। সাতটার পর বাড়ি ফিরেছে, এমনটা কখনও হয়নি। কিন্তু গত তিন-চার মাস ফিরতে ফিরতে নটা, সাড়ে নটাও হয়ে যাচ্ছে। জিগ্যেস করলে বলে, অফিসে ভীষণ কাজের চাপ। ওভারটাইম খাটতে হচ্ছে।

মায়ের দেরি করে ফেরার সঙ্গে ওই ভদ্রলোকটির কি কোনও সম্পর্ক আছে? শিঞ্জিনীর বুকের ভেতর ধারালো শালার মতো কী যেন বিধে যায়।

স্বর্ণালী বলল, আন্টি আর ওই ভদ্রলোককে এই ছুটিতে আমি আরও দুজায়গায় দেখেছি।

শিঞ্জিনী অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। চমকে উঠে বলল, কোথায় কোথায়?

স্বর্ণালী জানায়, বাবার সঙ্গে তারা সবাই একদিন সন্ধেবেলায় নামকরা একটা রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছিল। সেখানে মৃদুলাদের দেখেছে। অন্য একদিন এয়ার-কন্ডিশনড মার্কেটে।

শিঞ্জিনী উত্তর দিল না। দমবন্ধ করে তাকিয়ে রইল।

স্বর্ণালী এবার বলে, তিনবারই একটা ব্যাপার আমার নজরে পড়েছে। যেভাবে আন্টিরা হাসছিল, কথা বলছিল, মনে হয়েছে দুজনে খুব ইন্টিমেট।

সেই শলাটা বুকের গভীরে আরও অনেকটা ঢুকে যায়। অদ্ভুত এক কষ্ট বুক থেকে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।

স্বর্ণালী বন্ধুর দিকে সামান্য ঝুঁকে জিগ্যেস করে, তুই চিনিস ভদ্রলোককে?

গলার কাছে লোহার বলের মতো কী যেন আটকে আটকে যাচ্ছে। কোনওরকমে শিঞ্জিনী বলল, কীরকম দেখতে বল তো?

স্বর্ণালী প্রায় নিখুঁত একটা বর্ণনা দিল। মৃদুলার সঙ্গীটি রীতিমতো সুপুরুষ। বয়স চল্লিশ-বেয়াল্লিশ। টান টান শরীর। রং বাদামি। হাইট বেশ ভালো। ছফিটের আশেপাশে। চওড়া বুক, মজবুত কবজি। জুলপিতে সামান্য পাক ধরেছে। চুল ব্যাক ব্রাশ করা। সরু শৌখিন গোঁফ। পরনে দামি সাফারি স্যুট। চোখে রিমলেস চশমা।

শিঞ্জিনী ভেবে পেল না, লোকটা কে হতে পারে। তাদের কোনও আত্মীয়স্বজন? নাকি পারিবারিক কোনও বন্ধু? কিন্তু কবছর ধরেই আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্কের বাঁধনগুলো ভীষণ আলগা হয়ে গেছে। বন্ধুবান্ধবরা কবেই তাদের বাড়ি যাওয়া-আসা বন্ধ করে দিয়েছে।

তবে কি মায়ের কোনও কলিগ? মৃদুলার সহকর্মীদের অনেককেই চেনে শিঞ্জিনী। ফি বছর অফিসের অ্যানুয়াল ফাংশানে মা তাকে নিয়ে যায়। সেখানেই তার এই কলিগদের সঙ্গে শিঞ্জিনীর আলাপ হয়েছে। ওদেরই কি কেউ? আকাশ-পাতাল হাতড়েও স্বর্ণালীর বর্ণনার সঙ্গে তাদের কারও চেহারার মিল খুঁজে পেল না সে।

অবশ্য মায়ের সব সহকর্মীকেই যে শিঞ্জিনী চেনে, তা নয়। লোকটা কি ওই অপরিচিতদের মধ্যে পড়ে?

স্বর্ণালীর চোখ শিঞ্জিনীর মুখের ওপর স্থির হয়ে ছিল। সে বলে, কী রে, চিনতে পারলি?

আস্তে মাথা নাড়ে শিঞ্জিনী, না। একটু থেমে জিগ্যেস করে, আর কিছু বলবি?

না।

চল। দেরি হয়ে যাচ্ছে। সাড়ে পাঁচটার ভেতর বাড়ি না ফিরলে দাদু অস্থির হয়ে উঠবে।

গল্ফ গ্রিনের একটা মিনিবাস পেয়ে দুজনে উঠে পড়ল। মোটামুটি ফঁকা। বসার জায়গাও পাওয়া গেল। জানালার ধারে বসেছে শিঞ্জিনী। পাশে স্বর্ণালী।

শিঞ্জিনীর মুখ জানালার বাইরে ফেরানো। উলটোদিক থেকে সাঁ, সাঁ, ছুটে আসছে বাস, ট্যাক্সি, জিপ, ভ্যান, নানা ধরনের ঝকঝকে প্রাইভেট কার। ওধারের উঁচু উঁচু বাড়িগুলো ছিটকে ছিটকে পিছিয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় প্রচুর লোকজন। চারদিক থেকে গাড়ির শব্দ, মানুষের কোলাহল উঠে আসছে।

শিঞ্জিনী কিছুই দেখতে বা শুনতে পাচ্ছিল না। সব কেমন ঝাপসা ঝাপসা। যেন এক আধ-চেনা অবাস্তব শহরের মাঝখান দিয়ে সে চলেছে। যার সঙ্গে তার আদৌ যোগ নেই। আসলে সেই চিন্তাটা অদৃশ্য পোকার মতো মাথায় হুল ফুটিয়ে চলেছে। বিরতিহীন।

শিঞ্জিনী নিজেকে প্রাণপণে বোঝাতে চাইল, মা যদি কারও সঙ্গে হঠাৎ একদিন থিয়েটার দেখতে গিয়েই থাকে, মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড খান খান হয়ে মাথার ওপর ভেঙেও পড়বে না। পরক্ষণে মনে হয়, যুক্তিগুলো বড় পলকা, ভঙ্গুর। একদিন না হয় একাডেমিতে গেছে, কিন্তু তার পরও একই লোকের সঙ্গে তাকে আরও নানা জায়গায় দেখা যাবে কেন?

এটা তো পরিষ্কার, দুজনের মধ্যে চোখে পড়ার মতো যে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে তা স্বর্ণালীর চোখ এড়ায়নি। একজন অনাত্মীয় পুরুষের সঙ্গে একজন মহিলার পরিচয় হতেই পারে। তাদের মধ্যে সাধারণ ভদ্রতার সম্পর্কও গড়ে উঠতে পারে। তেমন শোভন ব্যাপার মা আর ওই লোকটার ভেতর যদি থাকত, স্বর্ণালী নিশ্চয়ই তাকে এত কথা বলত না।

এই লোকটা সম্পর্কে মায়ের কেন এমন গোপনীয়তা? বুকের ভেতরটা ক্রমশ ভারী হয়ে উঠতে থাকে শিঞ্জিনীর।

স্বর্ণালী বন্ধুর দিক থেকে লহমার জন্যও চোখ ফেরায়নি। অস্বস্তি বোধ করছিল সে। যথেষ্ট অপ্রস্তুতও। নীচু গলার ডাকল, এই রূপা–

শিঞ্জিনীর ডাকনাম রূপা। স্বর্ণালীর ডোনা। দুজনে ছেলেবেলার বন্ধু। পরস্পরকে তারা ডাকনামেই ডেকে থাকে।

শিঞ্জিনী দুরমনস্কর মতো সাড়া দেয়, কী বলছিস?

আমার দিকে তাকা–

শিঞ্জিনীর মুখ ফেরায়। স্বর্ণালী বলে, আমার হয়তো দেখার ভুল হয়েছে। কী বলতে কী বলে ফেলেছি। তুই এই নিয়ে আন্টিকে কিন্তু কিছু বলিস না। ফরগেট ইট।

স্বর্ণালী খুব সিরিয়াস মেয়ে। আলগা কোনও মন্তব্য করে না। ঠিকমতো না জেনে, না বুঝে আলটপকা কিছু বলে বসে না। শিঞ্জিনী বুঝতে পারছে, তার মন খারাপ দেখে ব্যাপারটা লঘু করে দিতে চাইছে স্বর্ণালী। সে উত্তর দিল না।

স্বর্ণালী উতলা হল, কী রে কিছু বললি না যে?

কী বলব?

ওই যে আন্টিকে জানাতে বারণ করলাম।

ওটা এমনই এক প্রসঙ্গ, অপ্রিয় এবং অস্বস্তিকর, মায়ের সামনে কোনও মেয়ের পক্ষে উত্থাপন করা অসম্ভব। বরং কিছু দিন অপেক্ষা করে মায়ের মতিগতির দিকে লক্ষ্য রাখা যাক। তারপর কী করবে বা করা উচিত, এই মুহূর্তে ভাবা যাচ্ছে না।

অনেকক্ষণ নীরব থেকে শিঞ্জিনী বলল, ঠিক আছে, জানাব না।

প্রমিস?

শিঞ্জিনী যান্ত্রিক সুরে বলল, প্রমিস।

গোলপার্কে স্বর্ণালী নেমে গেল। আবার মিনিবাসের দৌড় শুরু হয়েছে। দুধারের দৃশ্যাবলি কিছুক্ষণ আগের মতোই ফের ঝাপসা। চতুর্দিকের শব্দপুঞ্জ কান ছুঁয়ে ছুঁয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, ভেতরে প্রবেশ করছে না।

শিঞ্জিনী একতাল তলতলে মোম নয় যে একটুতেই গলে যাবে। কিংবা শো-কেসে সাজানো ঠুনকো বাহারি পুতুল নয় যে টোকা দিলেই ভেঙে শতখান হবে। তার বন্ধুদের, বা তার বয়সি অন্য দশটা মেয়ের থেকে সে আলাদা। অল্প বয়সের কথা তেমন মনে নেই। জ্ঞান হবার পর থেকে এলোপাতাড়ি ঘা খেতে খেতে সে বড় হয়ে উঠেছে। একের পর এক আঘাত। সবই মনের ওপর। সে যে কী নিদারুণ যাতনা।

এই তো সেদিন কৈশোর পেরুল। কিন্তু এই বয়সেই তার সবটুকু কমনীয়তা কেউ যেন নিঙড়ে বার করে নিয়েছে। ভেতরটা তার রীতিমতো রুক্ষ। কঠিন। সহজে সে কাতর হয় না।

কিন্তু স্বর্ণালী আজ যে খবরটা দিল তাতে বুকটা দুমড়ে মুচড়ে ভেঙেচুড়ে যাচ্ছে। মা-ই তার সব। মাকে ঘিরেই তার বিশ্বব্রহ্মাণ্ড! পরস্পরকে জড়িয়ে বেশ তো ছিল তারা। হঠাৎ কোত্থেকে অচেনা ওই লোকটা তার আর মৃদুলার মাঝখানে এসে যে জুড়ে বসল।

নিজের অজান্তে শিঞ্জিনীর দুচোখ বাষ্পে ভরে যেতে থাকে।

.

০২.

কনডাক্টরের হাঁকডাকে হঠাৎ সম্বিত ফিরে আসে শিঞ্জিনীর। মিনিবাস তাদের বাড়ির কাছাকাছি এসে থেমেছে।

টের পায়নি, কখন যেন চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল গালে গড়িয়ে এসেছিল। মিনিবাসে এত মানুষের ভেতর সে কেঁদেছে। একটু লজ্জা পেল শিঞ্জিনী। দ্রুত রুমাল দিয়ে চোখ মুছে চারদিকে তাকাল। না, কেউ তাকে লক্ষ্য করেনি।

বাসে উঠে স্কুলব্যাগটা কোলে নামিয়ে রেখেছিল। সেটা ফের পিঠে ঝুলিয়ে নানা বয়সের পাঁচ-ছটি পুরুষ এবং মহিলার সঙ্গে নেমে এল শিঞ্জিনী।

বাসরাস্তার উলটো দিকে, কোনাকুনি যে রাস্তাটা সোজা চলে গেছে, ওটার প্রায় শেষ মাথায় তাদের বাড়ি। কবছরে জায়গাটা পুরোপুরি বদলে গেছে। ছেলেবেলায় এখানে কটাই বা বাড়ি-টাড়ি দেখেছে! কিছু কিছু একতলা কি দোতলা। সেগুলো পুরোনো, দেওয়ালে শ্যাওলার পুরু ছোপ, কার্নিস ভাঙা। টিন বা টালির চাপ-বাঁধা বস্তিই বেশি। প্রচুর ফাঁকা জায়গা। সেখানে খাড়া খাড়া তাল গাছ, বেঁটে বেঁটে খেজুর। বেশ কটা আঁশফলের বাগান। ঝোঁপঝাড়। প্রায় সারাদিনই ঝিঁঝির ডাক। তক্ষকের ডাক। রাতের দিকে গম্ভীর, কর্কশ গলায় পেঁচারা ডেকে যেত।

আচমকা প্রোমোটারদের নজর এসে পড়ল জায়গাটার ওপর। লহমায় বস্তি উধাও। বেশিরভাগ পুরোনো পাকা বাড়ি উধাও। ফাঁকা মাঠ উধাও। আঁশফলের বাগান উধাও। পানাপুকুরগুলো ঝটিতি বুজিয়ে ফেলা হল। একের পর এক উঠতে লাগল হাইরাইজ। সেগুলো ডানা মেলে আকাশ ছুঁতে চায়। কী সব আর্কিটেকচার! যেদিকেই তাকানো যাক, চোখ ধাঁধিয়ে যায়।

কয়েকটা সেকেলে বাড়ি এখনও কোনওরকমে টিকে আছে। তবে আয়ু আর কদিন? এক বছর, দুবছর, তিন বছর। তারপরেই ওগুলো গুঁড়িয়ে দিয়ে মাথা তুলবে আকাশছোঁয়া অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং।

তাদের রাস্তাটার ভোলও পালটে গেছে। কবছর আগেও ছিল খানাখন্দে বোঝাই। এখন দশ ইঞ্চি অ্যাসফাল্টে মোড়া। মসৃণ পথের ওপর দিয়ে ঝকঝকে নতুন মডেলের গাড়িগুলো যেন উড়তে থাকে।

সমস্ত তল্লাট জুড়ে তখন সারাদিন কেমন একটা ঝিমুনিভাব। নির্জীব আলস্য গায়ে জড়িয়ে নিঝুম পড়ে থাকত জায়গাটা। এখন সকাল থেকে মাঝরাত পর্যন্ত চারদিক সরগরম।

বড় রাস্তা পেরিয়ে ওপারে চলে এল শিঞ্জিনী। কোনাকুনি রাস্তাটার মোড়ে সাইকেল রিকশার জটলা। সেটার গায়ে পাড়ার একটা ক্লাব। তরুণ সমিতি। আগে ছিল টিনের চালা। এখন প্রোমোটারদের কাছ থেকে জবরদস্তি টাকা আদায় করে বেশ বড় একতলা বাড়ি তোলা হয়েছে।

সমিতির কটা ছেলে, চোয়াড়ে চেহারা, পঁচিশ-ছব্বিশের মতো বয়স, ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে হই হই করে গজল্লা করছিল। ক্লাবটা ওদের স্থায়ী গুলতানির আখড়া। শীত-গ্রীষ্ম বারো মাস, যখনই এ পথে আসা যাক, ক্লাবের সামনে ওদের পাওয়া যাবেই।

শিঞ্জিনী ক্লাবের পাশ দিয়ে এগিয়ে যায়। ওকে দেখে ছোকরাগুলোর হল্লা থেমে গিয়েছিল। ওদের দিকে কখনও তাকায় না সে, আজও তাকাল না। তবু হাঁটতে হাঁটতে টের পেল, পাঁচ-ছজোড়া চোখ তার পিঠে ফলার মতো বিধছে। আগে অস্বস্তি হত, ভীষণ ভয় লাগত। এখন আর সে গ্রাহ্য করে না।

শুধু ওরাই কি, রাস্তায় বেরুলেই অসংখ্য চোখ তাকে গিলতে থাকে। এমনকী, বন্ধুদের বাড়ি গেলেও নিস্তার নেই। ওদের দাদাদের, কাকাদের কিংবা অন্য আত্মীয়দের তার সম্পর্কে একটু বেশি রকমের উৎসাহ। গেলে সারাক্ষণ তার সঙ্গে লেপটে থাকতে চায়। কারও কারও বাবা পর্যন্ত আদরের ছলে গায়ে-মাথায় এমনভাবে হাত বুলোয় যে শরীর কুঁকড়ে যায়। কোনটা আদর, কোনটা স্নেহ, আর কোনটা এসবের বাইরে অন্য কিছু, তা না-বোঝার মতো নাবালিকা শিঞ্জিনী নয়। তার চোখে এই লোকগুলোর মুখ আর মানুষের মুখ থাকে না, জন্তুর মুখ হয়ে যায়। আর এই জন্তুদের লকলকে জিভ থেকে সর্বক্ষণ লালা ঝরতে থাকে।

স্বর্ণালীদের বাড়িটাই একমাত্র জায়গা যেখানে সে নির্ভয়ে যেতে পারে। ওখানে কেউ তাকে উত্যক্ত করবে না। দেবকুমার আঙ্কল চমৎকার মানুষ। সহৃদয়। স্নেহপ্রবণ। স্বর্ণালীর মা অনুপমা আন্টি, ওর দিদি সুদীপ্তাও তা-ই। নিজের বাবাকে নিয়ে শিঞ্জিনীর বিরাট একটা দুঃখ আছে। সে জন্য তার প্রতি স্বর্ণালীদের অপার সহানুভূতি। ওদের বাড়িতে গেলে তার গোপন যন্ত্রণা অনেকখানি জুড়িয়ে যায়। তাই সময় পেলেই সে ওদের কাছে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আসে।

লম্বা রাস্তাটা ফুরিয়ে এসেছিল। শিঞ্জিনী বাড়িতে পৌঁছে গেল।

অনেকখানি জায়গার মাঝখানে ওদের বুড়োটে, সেকেলে বাড়িটা নেহাতই সাদামাটা। ছিরিছাঁদহীন। কবছর আগে গোলাপি রং করা হয়েছিল। বর্ষার জলে ধুয়ে ধুয়ে রংটা ফিকে হয়ে গেছে। চারদিকের সীমানা ভাঙাচোরা বাউন্ডারি ওয়াল দিয়ে ঘেরা।

রাস্তার দিকে কাঠের গেট। সেটা খুলে ভেতরে ঢুকলে ফুলের বাগান। পরিচর্যার অভাবে ফুলগাছগুলো ম্রিয়মাণ হয়ে আছে। বাড়ির পেছন দিকে দু-চারটে ফলের গাছ। পেয়ারা, নারকেল, বাতাবি আর গন্ধরাজ লেবু। বাকি সবই আগাছা।

বাগান পেরিয়ে কলিংবেল টিপতেই মালতী দরজা খুলে দিল।

মালতী শিঞ্জিনীদের কাজের মেয়ে। বয়স চল্লিশের আশে-পাশে। পেটানো, মজবুত স্বাস্থ্য। চেহারায় শক্ত, পুরুষালী ভাব। চৌকো মুখ। খর চোখ। কপালের মাঝখানে মস্ত সিঁদুরের টিপ। সিঁথিতে চওড়া করে সিঁদুর।

অনেক আগেই পাঁড় মাতাল, রগচটা স্বামীর সঙ্গে মালতীর কাটান ছাড়ান হয়ে গেছে। তবু বিলুপ্ত দাম্পত্য জীবনের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে কেন যে সে সিঁদুরটা ধারণ করে, সেই জানে।

মালতী সকালে শিঞ্জিনীদের বাড়িতে আসে। রান্নাবান্না, কাপড়-কাঁচা, ঘর ধোয়া-মোছা থেকে সারাদিন যাবতীয় কাজকর্ম দশভুজা হয়ে সামলায়। সন্ধের পর রাতের রুটি-তরকারি, মাংস-টাংস বেঁধে নিজের খাবার বেঁধে নিয়ে চলে যায়। ওরা থাকে বেশ খানিকটা দূরে, একটা বড় গোরস্থানের পাশের বস্তিতে। সেখানে তার সঙ্গে থাকে তার একমাত্র ছেলে আর ছেলের বউ। ছেলে রিকশা চালায়।

মালতী বলল, কী গো রূপাদিদি, তোমার আজ এত দেরি যে? দাদু কতবার যে তোমার কথা বলেছে?

এটাই ভেবেছিল শিঞ্জিনী। মালতীর পাশ দিয়ে ভেতরে যেতে যেতে বলল, আমি আগে দাদুর কাছে যাচ্ছি। তুমি দরজা বন্ধ করে দাও।

এ-বাড়িতে সবসুদ্ধ ছখানা ঘর। একতলায় তিনটে। দোতলাতেও তা-ই। নীচের তলার দুটো ঘরে রান্না এবং খাওয়ার ব্যবস্থা। বাকিটায় রাজ্যের অকেজো বাতিল জিনিসের পাহাড়।

দোতলায় একটা ঘর মৃদুলার, একটা শিঞ্জিনীর, একটা তার দাদু ইন্দ্রনাথের। ইন্দ্রনাথ তার দাদামশায়। মা তার একমাত্র সন্তান।

ত্বরিত পায়ে সিঁড়ি টপকে টপকে ওপরে উঠে এল শিঞ্জিনী। বাইরের প্যাসেজে জুতো খুলে ইন্দ্রনাথের ঘরে ঢুকল।

দাদুর ঘরটা বেশ বড়। পনেরো ফিট বাই কুড়ি ফিট। মাঝখানে পেল্লায় ভারী খাট। নকশাদার ছত্রির মাথায় আধময়লা মশারি গুটিয়ে রাখা হয়েছে।

দেওয়াল ঘেঁষে তিনটে ঢাউস আলমারি। একটা মস্ত ওয়ার্ডরোব, ড্রেসিং টেবল। কটা বেতের মোড়া। সব সেকেলে ডিজাইনের আসবাব। পালিশ উঠে উঠে কবেই ভেতরকার কাঠ বেরিয়ে পড়েছে। সিলিং থেকে চার ব্লেডের আদ্যিকালের একটা ফ্যান ঝুলছে। ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজ তুলে ওটা আস্তে আস্তে ঘুরে চলেছে। ভালো মালমশলা দিয়ে তৈরি, তাই এখনও নিষ্ঠাভরে সারভিস দিয়ে যাচ্ছে। দুই দেওয়ালে মোটা মোটা শিক বসানো জোড়া জানালা। সেগুলোর পাল্লা খোলা রয়েছে।

খাটের মধ্যিখানে ফ্যানের তলায় উঁচু উঁচু দুটো বালিশে মাথা রেখে কাত হয়ে শুয়ে আছেন ইন্দ্রনাথ। তাঁর দুপাশে দুটো কোলবালিশ। মাথার দিকে একটা মাঝারি টেবলে ডাঁই-করা ওষুধ। হার্টের সুগারের। রক্তচাপের। এবং আরও নানা রোগের। আর আছে রামায়ণ এবং মহাভারত। মূল সংস্কৃত থেকে রাজশেখর বসুর চমৎকার অনুবাদ। একটা টেলিফোনও রয়েছে। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে এই যন্ত্রটা দিয়েই তার যেটুকু যোগাযোগ।

ইন্দ্রনাথের চোখ দুটো বোজা। পরনে হাফহাতা পাতলা পাঞ্জাবি এবং পাজামা। শিঞ্জিনীর পায়ের শব্দ তার কানে যায়নি।

ঘুমোচ্ছন কি? তাকে জাগানো ঠিক হবে? একটু ইতস্তত করল শিঞ্জিনী। তারপর নীচু গলায় ডাকল, দাদু

এক ডাকেই চোখ মেললেন ইন্দ্রনাথ। নাতনিকে দেখে দুই কনুইতে ভর দিয়ে উঠে বসতে চাইলেন।

শিঞ্জিনী ব্যস্তভাবে বলে উঠল, উঠো না, উঠো না। শুয়ে থাকো

নাতনির আপত্তি কানে তুললেন না ইন্দ্রনাথ। রীতিমতো কষ্ট করেই পিঠে বালিশ রেখে খাটের বাজুতে হেলান দিয়ে বসলেন। এই সামান্য পরিশ্রমেই হাঁফ ধরে গিয়েছিল। জোরে জোরে শ্বাস টেনে খানিকটা ধাতস্থ হলেন।

রং মাটি খসে গেলে প্রতিমার যে কাঠামোটা পড়ে থাকে, ইন্দ্রনাথ অবিকল তা-ই। শীর্ণ, নিজীব। হাড়ের ওপর খোলসের মতো ঢিলে চামড়া জড়ানো। মুখটা শুকিয়ে সরু হয়ে গেছে। সারা শরীর জুড়ে অজস্র ভাঙচুর। চোখের তলায় কালি। মাংস ঝরে যাওয়ায় চোখ থুতনি ঠেলে বেরিয়ে এসেছে।

বছর দুয়েক আগে একটা বড় রকমের স্ট্রোক হয়েছিল। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। তারপরই সেরিব্রালের ছোবলে বাঁ দিকটা অসাড় হয়ে যায়। তারপর শয়ে শয়ে ট্যাবলেট, ইঞ্জেকশন। নিয়মিত ই সি জি। টি এম টি। করোনারি এনজিওগ্রাফি। ডাক্তার। আয়া। অবিরাম শুশ্রূষা। ইন্দ্রনাথের শিয়রে বসে মৃদুলা আর শিঞ্জিনীর রাত জাগা। এমনি কত কী। আশা ছিল না, নেহাত আয়ুর জোরে টিকে গেলেন ইন্দ্রনাথ। পক্ষাঘাতে অবশ দিকটাকে সচল, সক্রিয় করার জন্য কী করা হয়েছে।

অ্যাটাকের ধাক্কা খানিকটা সামলানোর পর ফিজিওথেরাপিস্ট ডাকা হয়েছিল। প্রথমদিকে রোজ এসে সে ম্যাসাজ এবং এক্সারসাইজ করাত ইন্দ্রনাথকে। এখন সপ্তাহে তিন দিন করাচ্ছে। মাস দুয়েক হল সাড় অনেকটাই ফিরে এসেছে। কোমর থেকে পা পর্যন্ত ভালোই নাড়াতে পারেন ইন্দ্রনাথ। ধরে ধরে দুবেলা কয়েক মিনিট করে তাঁকে হাঁটানোও হয়। আর কিছুদিন পর অন্যের সাহায্য ছাড়াই খুব সম্ভব হাঁটতে পারবেন। অবশ্যই ঘরের মধ্যে। বাড়ির বাইরে ডাক্তাররা কবে বেরুতে দেবেন, কে জানে।

ইন্দ্রনাথ বললেন, স্কুল ড্রেস এখনও ছাড়োনি দেখছি। সোজা আমার ঘরে চলে এসেছ বুঝি?

আস্তে মাথা নাড়ে শিঞ্জিনী।

ইন্দ্রনাথ বললেন, ঠিক আছে, দুমিনিট বসে যাও। পরে গিয়ে চেঞ্জ করে নিও। আঙুল বাড়িয়ে খাটের একটা কোনা দেখিয়ে দিলেন।

রুগ্‌ণ, অশক্ত, তাড়াতাড়ি বুড়িয়ে যাওয়া এই মানুষটির মধ্যে কোথায় যেন ব্যক্তিত্বের সামান্য একটু তলানি এখনও পড়ে আছে। তার অনুরোধ বা হুকুম কিছুই অমান্য করা যায় না। পিঠের ব্যাগটা নামিয়ে জড়সড় হয়ে বসল শিঞ্জিনী। ইন্দ্রনাথ এবার কী বলবেন, সেটা তার জানা। কঁচুমাচু মুখে বলল, ছুটির পর বড় রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি। অনেকক্ষণ বাদে মিনিবাস এল। সবগুলো ক্রসিংয়ে ভীষণ জ্যাম। তাই বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গেছে। স্বর্ণালীর কথা শুনতে শুনতে খানিকটা সময় নষ্ট হয়েছে তা তো আর দাদুকে বলা যায় না।

নিস্তেজ চোখে কয়েক লহমা নাতনির দিকে তাকিয়ে রইলেন ইন্দ্রনাথ। বললেন, তুমি যতক্ষণ না ফিরে আসো, আমার কী উৎকণ্ঠা যে হয়। সেটা কি তুমি বোঝ?

রোজই তো ঠিক সময়ে ফিরে আসি। যেদিন যেদিন কোচিং ক্লাসে যাই, ফিরতে দেরি হয়। রাস্তায় জ্যাম হলে আমি কী করতে পারি?

জ্যামের দোহাই দিতে হবে না। খবরের কাগজে পড়ি, পরিবেশ ভীষণ নোংরা হয়ে গেছে। তোমাদের বয়সি মেয়েদের পদে পদে বিপদ।

ইন্দ্রনাথ কি তার কথা বিশ্বাস করেননি? একটু জোর দিয়ে শিঞ্জিনী বলল, তুমি তো বাড়ি থেকে বেরোও না। কলকাতার ট্রাফিকের কী অবস্থা হয়েছে, তোমার ধারণা নেই।

ইন্দ্রনাথ বললেন, আচ্ছা আচ্ছা। এখন গিয়ে হাতমুখ ধোও। কিছু খেয়ে রেস্ট নাও। পরে তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে।

উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে শিঞ্জিনী বলল, কী কথা?

তাড়াহুড়োর কিছু নেই। মালতাঁকে দিয়ে তোমাকে ডাকিয়ে আনব। তখন শুনো।

দোতলায় পাশাপাশি তিনটে ঘর। সামনে দিয়ে রেলিং-ঘেরা টানা বারান্দা চলে গেছে।

শিঞ্জিনীর ঘরটা বারান্দার শেষ মাথায়। ইন্দ্রনাথের ঘর থেকে বেরিয়ে জুতোজোড়া ফের পায়ে গলিয়ে সেখানে চলে এল সে।

একধারে সিঙ্গল-বেড় খাটে ধবধবে, নিভাজ বিছানা! আরেক পাশে লেখাপড়ার জন্য টেবল-চেয়ার। জামাকাপড়ের একটা আলমারি। বইরের র‍্যাক। মাথার ওপর মান্ধাতা আমলের সেই চার ব্লেডওলা ফ্যান।

স্কুলের জুতোমোজা খুলে দেওয়ালের গা ঘেঁষে রেখে দিল শিঞ্জিনী। বইয়ের ব্যাগটা রাখল পড়ার টেবলে। আলমারি থেকে লম্বাঝল স্কার্ট আর ঢোল্লা জামা বার করে চানঘরে ঢুকে গেল। সেকেলে বাড়ি হলেও দোতলার প্রতিটি বেডরুমেই অ্যাটাচড বাথ।

মিনিট পনেরো বাদে স্নান সেরে পোশাক পালটে চানঘর থেকে শিঞ্জিনী যখন বেরিয়ে এল, নিজেকে অনেকখানি তাজা লাগছে। বছরের এই সময়টা দিনের বেলা ভ্যাপসা গরমে গায়ের চামড়া যেন সেদ্ধ হয়ে যায়। স্কুল থেকে ফিরে আরেকবার স্নান না করতে পারলে ভীষণ অস্থির অস্থির লাগে।

তোয়ালে দিয়ে ভালো করে মাথা মুছে, চুলে বারকয়েক চিরুনি টেনে, ফ্যান চালিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল শিঞ্জিনী। তার মাথায় দিকে মস্ত জোড়া জানালা। ডান ধারের দেওয়ালেও অবিকল তেমনই আরেক জোড়া।

কিছুক্ষণ চোখের ওপর দুই হাত আড়াআড়ি রেখে চুপচাপ পড়ে রইল শিঞ্জিনী। তারপর বুকে বালিশ চেপে মাথার দিকের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। তাদের বাড়ির বাউন্ডারি ওয়ালের পর খানিকটা পোতো জমি। নানা ধরনের ঝোঁপঝাড় আগাছায় বোঝাই। এই জমিটার গা ঘেঁষে কচুরিপানায় ঠাসা বেশ বড় একটা জলা। ওগুলো এই অঞ্চলের এক সময়ের জমিদার সরকার-বাবুদের। সরকারদের কাউকে কোনওদিন চোখে দেখেনি শিঞ্জিনী। সে শুনেছে ওই ফাঁকা জমি আর জলা নিয়ে বহুদিন ধরে মামলা চলছে।

জলার ওধারে চার-পাঁচটা উঁচু উঁচু নতুন বাড়ি উঠেছে। আরও কয়েকটার কাজ চলেছে। কবছরে ডানধারেও ছ-সাতটা ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরি হয়েছে।

যেভাবে একের পর এক স্কাইস্ক্রেপার হচ্ছে তাতে কঁকা জমি বলতে এই এলাকায় কিছু থাকবে না।

নেহাত মামলা চলছে, তাই শিয়রের দিকের মাঠ আর জলাটা টিকে আছে। নইলে কবেই হাইরাইজে হাইরাইজে ছেয়ে যেত। আকাশ দেখা যেত না। ওদিক থেকে হুহু করে যে হাওয়া আসে তাও বন্ধ হয়ে যেত। শিঞ্জিনী আগে অনেকবার ভেবেছে, সরকারদের মামলাটা চিরকাল চলুক। তাদের বাড়ির ওধারটা বরাবর ফাঁকা থাকুক।

স্কুল ছুটির পর শিঞ্জিনীর চোখে পড়েছিল, পশ্চিম আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছে। কিন্তু এখন সেই মেঘ ছিঁড়ে ছিঁড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। আপাতত বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই।

মেঘ, অদূরে ফাঁকা জমি, জলা, বা বড় বড় আকাশছোঁয়া বাড়ি-কিছুই যেন দেখতে পাচ্ছিল না শিঞ্জিনী। সেই চিন্তাটা তার মাথায় আবার ফিরে এসেছে। মায়ের সঙ্গী ওই লোকটি কে? তার সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক কতখানি গভীর? নতুন করে পরিচিত লোকজনদের মুখ ভাবতে চেষ্টা করল। কিন্তু না, স্বর্ণালীর বর্ণনার সঙ্গে এবার কাউকে মেলানো যাচ্ছে না।

সূর্য ডুবে গেছে। যে বিষণ্ণ আলোটুকু চারপাশে গুটিসুটি মেরে পড়ে ছিল, একটানে কেউ যেন সেটা টেনে নিয়েছে। বাইরে আবছা আঁধার নেমে এসেছে। অবশ্য চারপাশের বাড়িগুলোতে হাজার আলো জ্বলে উঠেছে।

খুট করে সুইচ টেপার শব্দ কানে এল। সেই সঙ্গে মালতীর গলা, সন্ধে হয়ে গেল। অমন চুপ করে শুয়ে আছ যে! শরীর খারাপ লাগতেছে?

আলোয় ঘর ভরে গেছে। ধড়মড় করে উঠে বসল শিঞ্জিনী। বলল, এমনি শুয়ে ছিলাম। শরীর ঠিক আছে।

এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্ন করল না মালতী। তার হাতে সাদা প্লেটে দুখানা পরোটা, আলুর তরকারি আর একটা বড় সন্দেশ এবং জলের গেলাস। একটা ছোট নীচু সাইড টেবল শিঞ্জিনীর খাটের কাছে টেনে এনে তার ওপর প্লেট এবং গেলাসটা রেখে বলল, খাও। আমি চা নিয়ে আসছি।

সকালে দুধ খায় শিঞ্জিনী, বিকেলে এক কাপ চা। খিদে পেয়েছিল, প্লেটটা তুলে নিয়ে খেতে শুরু করল সে। সেই চিন্তাটা কিন্তু চলছেই। নাছোড়বান্দা বিষাক্ত পোকার মতো মাথা ভেতর কামড় দিয়ে বসে আছে।

মিনিট দশেক বাদে মালতী চা নিয়ে এল। বলল, চা খেয়ে দাদুর ঘরে যেও। উনি যেতি বুলেছেন। অনেক বছর কলকাতায় আছে মালতী। কিন্তু তার কথায় এখনও গেঁয়ো টান। দাদুর খবরটা দিয়ে সে চলে গেল।

শিঞ্জিনীর মনে পড়ল, ইন্দ্রনাথ তখন বলছিলেন কী একটা জরুরি কথা বলবেন। কী বলবেন? দেরি করে ফেরার জন্য বকুনি তো দিয়েছেনই। তারপর আর কী বলার থাকতে পারে?

চা খেয়ে ইন্দ্রনাথের ঘরে চলে এল শিঞ্জিনী। দাদু আগের মতোই বিছানায় শুয়ে আছেন। জোরালো আলোয় ঘর ভরে রয়েছে। নিশ্চয়ই মালতী জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে।

পয়সার জন্য খাটতে এসেছে বলে তার কাছে কিন্তু দায়সারা ভাবটা নেই। এ বাড়ির মানুষগুলোকে সত্যিই সে ভালোবাসে। সবার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে তার তীক্ষ্ণ নজর। কখন কী করতে হবে, তাকে বলে দিতে হয় না। নিঃশব্দে নিজের কাজটি সে করে যায়। বেশিরভাগ সময় চোখ বুজে শুয়ে থাকেন ইন্দ্রনাথ। এখন কিন্তু তাকিয়েই আছেন। নাতনির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তখনকার মতো বালিশে ঠেসান দিয়ে বসে শিঞ্জিনীকে কাছে বসালেন। কোমল গলায় বললেন, জলখাবার খেয়েছ?

আস্তে মাথা কাত করল শিঞ্জিনী, হ্যাঁ।

দেওয়ালে টাঙানো একটা ওয়াল ক্লকের দিকে তাকিয়ে বললেন, ছটা চল্লিশ। এবার তো পড়তে বসবে।

হ্যাঁ।

তার আগে এক কাজ করো, মাথার কাছের সেই টেবলটা দেখিয়ে ইন্দ্রনাথ বললেন, আমার ওই ডায়েরিটা দাও তো

ওষুধপত্র, রামায়ণ-মহাভারত এবং টেলিফোনের পাশে ইন্দ্রনাথের একটা নীল মলাটওলা ডায়েরি আর কলমও থাকে। সেটা তুলে এনে তাঁকে দিল শিঞ্জিনী। ইন্দ্রনাথ সরু সরু, রোগা আঙুলে পাতা ওলটাতে লাগলেন।

শিঞ্জিনী জানে, রোজই দু-চার লাইন কী যেন লেখেন ইন্দ্রনাথ। ডায়েরি লেখাটা তার বহুকালের অভ্যাস। অবশ্য তিনি কী লেখেন সে সম্পর্কে শিঞ্জিনীর বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই।

পাতা ওলটাতে ওলটাতে এক জায়গায় এসে থামলেন ইন্দ্রনাথ। নাতনির হাতে ডায়েরিটা দিয়ে বললেন, এখান থেকে পর পর পাতাগুলো দেখে যাও

শিঞ্জিনী সামান্য উত্তেজনা বোধ করল। নিজের গোপন দিনলিপি যে দাদু পড়তে দেবেন, সে ভাবতে পারেনি। কিন্তু ডায়েরির পাতার দিকে তাকাতেই তার চক্ষুস্থির। তারিখটা আট এপ্রিল। দাদু লিখেছেন, আজ খুকু অফিস ছুটির পর সাড়ে ছটার মধ্যে বাড়ি আসে নাই। সে ফিরিল আটটা বাজিয়া বত্রিশ মিনিটে। জিজ্ঞাসা করায় বলিল, অফিসে ওভারটাইম চলিতেছে। তাই ফিরিতে দেরি হইয়াছে।

খুকু মৃদুলার ডাকনাম। শিঞ্জিনী পাতার পর পাতা উলটে যেতে লাগল। কোনওদিন মা ফিরেছে পৌনে নটায়, কোনওদিন নটা পাঁচে, কোনওদিন দশটা বেয়াল্লিশে। কবে, কখন ফিরেছে, ইন্দ্রনাথ সমস্ত লক্ষ্য করেছেন এবং তাঁর দিনলিপিতে লিখে রেখেছেন।

শিঞ্জিনীর সারা শরীরে তড়িৎ প্রবাহ খেলে গেল। কোনও কিছুই অসুস্থ, রোগজৰ্জর মানুষটার নজর এড়িয়ে যায় না।

কালকের তারিখ পর্যন্ত দেখার পর ডায়েরিটা বন্ধ করে ধন্ধ-ধরা মানুষের মতো ইন্দ্রনাথের দিকে তাকিয়ে রইল শিঞ্জিনী। আজকের পাতাটা ফাঁকা। খুব সম্ভব মা ফিরে এলে ঘড়ি দেখে সময়টা লিখে রাখবেন।

শিঞ্জিনীর মনে হয়েছিল, তার সম্বন্ধে হয়তো আরও অভিযোগ আছে দাদুর। কিন্তু দুম করে তিনি যে মায়ের প্রসঙ্গ তুলে বসবেন, ভাবতে পারেনি।

নাতনির হাত থেকে ডায়েরিটা নিয়ে পাশে রাখলেন ইন্দ্রনাথ। বললেন, কী বুঝলে রূপাদিদি?

ইন্দ্রনাথ সঠিক কী জানতে চান, বুঝতে না পেরে চুপ করে থাকে শিঞ্জিনী।

ইন্দ্রনাথ বললেন, লক্ষ্য করেছ, এপ্রিল মাসের সেকেন্ড উইক থেকে খুকু সাড়ে আটটার আগে কোনওদিন বাড়ি ফেরেনি?

আস্তে মাথা নাড়ে শিঞ্জিনী করেছে।

স্বর্ণালী একদিনই মায়ের নাটক দেখার কথা বলেছিল। হঠাৎই একাডেমিতে ওদের দেখে ফেলেছে। তাছাড়া একদিন দেখেছে হোটেলে আর একদিন মার্কেটে। মা আরও কতদিন ছুটির পর সেই লোকটার সঙ্গে নাটক বা সিনেমা দেখতে গেছে, কিংবা ডিনার খেতে গেছে কোনও হোটেলে, বা বেড়াতে গেছে অন্য কোথাও, স্বর্ণালীর জানার কথা নয়। সে তো সর্বক্ষণ ওদের পেছনে ফেউয়ের মতো লেগে নেই। ইভনিং শোয়ে গেলে বা বাইরে রাতের খাওয়া সারলে দশটা সাড়ে-দশটার আগে বাড়ি ফেরা আদৌ সম্ভব নয়।

শিঞ্জিনী নীরবে বসে থাকে।

ইন্দ্রনাথ বললেন, জিগ্যেস করলে খুকু বলে, অফিসে নাকি ওভারটাইম চলছে

দেরি করে আসার কৈফিয়ৎ হিসেবে একই কথা শিঞ্জিনীকেও বলেছে মৃদুলা। সে উত্তর দেয় না।

ইন্দ্রনাথ এবার বলেন, কাজের বেশি প্রেশার থাকলে অফিসে দু-চার দিন ওভারটাইম হয়। কিন্তু তাই বলে দিনের পর দিন? তোমার কী মনে হয়?

শিঞ্জিনী বলে, কী মনে হবে। আমি কি চাকরি করি যে অফিসে কী হয় না-হয় আমি জানব!

কিছুক্ষণ চুপচাপ।

তারপর ইন্দ্রনাথ বলেন, কী এমন বয়স তোমার মায়ের। মাত্র একচল্লিশ। এখনও যথেষ্ট সুশ্রী। যতক্ষণ না ফেরে, বিছানায় এপাশ-ওপাশ করি। মনে হয়, দম আটকে আসছে। তোমাদের দুজনকে নিয়ে আমার যে কী দুশিন্তা!

শিঞ্জিনী একটু ভয়ে ভয়ে বলল, এত টেনশন করো কেন? আজকাল কোনও মেয়ে বাড়িতে বসে থাকে! কত কাজে তাদের বেরুতে হয়। অত চিন্তা করলে চলে! বলল বটে, কিন্তু টের পাচ্ছে, মাকে নিয়ে নিজের দুর্ভাবনা একেবারেই কাটছে না। মাথার ভেতর সেই অদৃশ্য পোকাটা অবিরাম দাঁত বসিয়ে যাচ্ছে।

ইন্দ্রনাথ বললেন, সে তুমি বুঝবে না। শরীরের যা হাল, কবে আছি কবে নেই। যেদিন থাকব না সেদিন তোমাদের যে কী হবে, ভাবতেও সাহস হয় না। মানুষ আর মানুষ নেই। শকুন, শেয়াল কি নেকড়ে হয়ে গেছে।

দাদু বাড়ি থেকে বেরুতে পারেন না। কেউ সাহায্য না করলে বিছানা থেকে নামার শক্তিও নেই। প্রায় পঙ্গু, শীর্ণ, রোগকাতর। কিন্তু মাথাটা এখনও পরিষ্কার। ভাবনাচিন্তার মধ্যে এতটুকু জড়তা নেই। বিছানায় শুয়ে শুয়েই তিনি টের পান, কলকাতার মানুষ অনেক বদলে গেছে। রাস্তাঘাটে মেয়েরা আর ততটা নিরাপদ নয়।

ইন্দ্রনাথের ধারণা সবটাই যে অমূলক তা নয়। বাইরে বেরুলে শিঞ্জিনী টের পায় মানুষ কতটা নোংরা হয়ে গেছে।

হঠাৎ একটা ব্যাপার খেয়াল হতে অদ্ভুত এক ভয় ঠান্ডা স্রোতের মতো শিঞ্জিনীর শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে বয়ে গেল। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল তার।

এই তো আর কিছুক্ষণ বাদে রাতের খাবার তৈরি করে দিয়ে মালতী চলে যাবে। মা কখন ফিরবে ঠিক নেই। ইন্দ্রনাথের আচমকা যদি কিছু হয়ে যায়, মালতী তত আর তাকে বসে বসে পাহারা দেবে না। মা না ফেরা পর্যন্ত শিঞ্জিনীকে এত বড় বাড়িতে একা একা থাকতে হবে। শকুনের পাল কি তা লক্ষ্য করবে না? কৈশোর-পেরুনো একটি মেয়ের পক্ষে তাদের ঠেকানো কি সম্ভব? মা-ও যদি থাকে, হানাদার বাহিনীর সঙ্গে কতটা যুঝতে পারবে?

যতই রোগাভোগা হোক, শরীর যতই জীর্ণ হয়ে যাক, তবু একজন পুরুষমানুষ তো! দাদু যেন মাথার ওপর মস্ত এক দোয়া, সব ঝড়ঝাঁপটা থেকে আগলে আগলে রাখছেন। তিনি মারা যাবেন, ভাবতেও পারে না শিঞ্জিনী।

ইন্দ্রনাথ বললেন, দেরি করে ফেরা নিয়ে মায়ের সঙ্গে তোমার কোনও কথা হয়েছে?

শিঞ্জিনী বলল, আমি নিজে থেকে কিছু জিগ্যেস করিনি। মা তোমাকে যা বলেছে, আমাকেও ঠিক তাই বলেছে।

মায়ের জবাবদিহিতে ইন্দ্রনাথ যে সন্তুষ্ট নন, তার মনে যে সংশয়ের কুয়াশা জমেছে তা টের পাওয়া যাচ্ছিল।

ইন্দ্রনাথ বললেন, আমি খুকুর অফিসে ফোন করে জেনে নিতে পারতাম কবে কঘণ্টা সে ওভারটাইম খেটেছে। কিন্তু এখনও ফোনটা করিনি। কেন জানো?

নিজের অজান্তেই যেন শিঞ্জিনী জিগ্যেস করে, কেন?

ভয়ে।

কীসের ভয়?

হয় ওর অফিস থেকে এমন খবর দেবে, যাতে আমার আরেকবার স্ট্রোক হয়ে যাবে।

দেখাই যাচ্ছে, ওভারটাইমের ব্যাপারটা ইন্দ্রনাথ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেননি। তার মনে হয়েছে, এটা ছুতো। তবু মেয়ের দেরি করে ফেরার অজুহাতটা যাচাই করে দিতে সাহস হয় না। যদি জানতে পারেন, মৃদুলা মিথ্যে ওজর দিয়ে চলেছে, উৎকণ্ঠা শতগুণ বেড়ে যাবে। জানার উপায় আছে, অথচ জানতে পারছেন না। বুড়ো মানুষটার কী যে চাপা কষ্ট!

শিঞ্জিনী কী উত্তর দেবে, ভেবে পেল না। মায়ের ওভারটাইমের রহস্যটা আজই স্বর্ণালীর কাছে মোটামুটি জেনেছে সে। দাদুর মানসিক যাতনা অনেকদিন ধরেই চলেছিল। আজ থেকে তারও শুরু হয়েছে।

ইন্দ্রনাথ বললেন, তুমি এ নিয়ে মাকে কিছু বলতে যেও না। আর কিছুদিন দেখি। তারপর যা বলার, আমিই বলব।

স্বর্ণালী যখন খবরটা দেয় শিঞ্জিনী ভেবেছিল, মাকে সোজাসুজি সেই লোকটার কথা জিগ্যেস করবে। পরে ঠিক করেছে, আপাতত চুপচাপ থাকাই ভালো। মৃদুলার গতিবিধি আর কিছুদিন লক্ষ্য করা যাক। তারপর কিছু একটা করা যাবে।

শিঞ্জিনী বলল, ঠিক আছে।

ইন্দ্রনাথ বললেন, অনেকক্ষণ আটকে রেখেছি। পড়ার ক্ষতি হচ্ছে। এবার যাও।

.

০৩.

নিজের ঘরে ফিরে এসে সামনের জোড়া জানালার মোটা শিক ধরে তাকিয়ে রইল শিঞ্জিনী। তাদের বাড়ির পেছনের অংশ, আধভাঙা বাউন্ডারি ওয়ালের পর ঝোঁপঝাড়ে বোঝাই অনেকটা জমি, জলা-সব এখন ঘন আঁধারে ডুবে আছে। জলার ওধারে উঁচু উঁচু বাড়িগুলোতে আলো জ্বলছে। মনে হয় একেকটা অলীক স্বপ্নপুরী।

নিঝুম ফাঁকা মাঠ আর জলার দিক থেকে একটানা ঝিঁঝির ডাক উঠে আসছে। অদৃশ্য এই পোকাগুলো কোথায় যেন মাইফেল বসিয়ে দিয়েছে। রাতচরা পাখিদের ডানা ঝাঁপটানোর আওয়াজও মাঝে মাঝে ভেসে আসে।

কবছর আগেও ওই জলার দিকটায় সন্ধের পর থেকে শিয়ালেরা কোরাসে ডেকে উঠত। ওধারের হাইরাইজগুলো আকাশে মাথা তোলার পর প্রাণীগুলো তল্লাট ছেড়ে উধাও হয়েছে।

সেই অজানা লোকটা আর মাকে ঘিরে দুশ্চিন্তাটা এক লহমাও পিছু ছাড়ছে না। মাথার ভেতর অবিরল পাক দিয়ে চলেছে।

কতক্ষণ দূরে তাকিয়ে ছিল খেয়াল নেই। মালতী ডাকল, রূপাদিদি।

একটু চমকে ঘুরে দাঁড়ায় শিঞ্জিনী। দরজার ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে আছে মালতী। সে বলল, কী গো, এখনও পড়তে বসোনি!

মালতী বেশ অবাকই হয়েছে। অন্যদিন স্কুল থেকে ফিরে কিছু খেয়েই পড়তে বসে যায় শিঞ্জিনী। এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করে না। তীক্ষ্ণ চোখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে লক্ষ্য করতে লাগল মালতী।

শিঞ্জিনী জানালার পাশ থেকে সরে এল, এইবার বসব।

মালতী একদৃষ্টে তাকিয়েই ছিল। বলল, তোমার কী হয়েছে, বলো দিকিন?

কী হবে?

ইস্কুল থিকে আসা অব্দি দেখছি, সব্বেক্ষণ কী ভেবেই চলেছ।

তার মুখেচোখে ভেতরকার উদ্বেগ বা মানসিক চাপ যে ফুটে বেরিয়েছে, তা মালতীর নজর এড়িয়ে যায়নি। একটু হেসে শিঞ্জিনী বলল, ধুৎ, কী আবার ভাবব।

দেখো রূপাদিদি, তোমার য্যাখন চার বছর বয়স সেই ত্যাশন থিকে এ বাড়িতে কাজে লেগিচি। কোলে পিঠে করে তোমায় মানুষ করিচি। তোমার ধাত আমার জানা আছে। মুখ দেখল পেটের কথা টের পাই।

শিঞ্জিনী উত্তর দিল না।

মালতী বলল, আমাকে য্যাখন বলতে চাইছ না, বলো নি। শোনো, আমার রান্না হয়ে গ্যাছে। পরোটা, ছোলার ডাল আর মাংস। খাবার টেবিলে সব গুছিয়ে রাখা আছে। য্যাখন খাবে গরম করে নিও। বাবাকে খই-দুধ খাইয়ে দিয়েছি। এবার বাড়ি ফিরব। আমার সনগে নীচে চলো। বাইরের দোরটা বন্ধ করে দেবে।

অন্যদিনের মতো একটা কানা-উঁচু স্টেনলেস স্টিলের বড় থালায় মালতীর খাবার গুছিয়ে রাখা ছিল। সেটা গামছা দিয়ে বাঁধা। থালাটা নিয়ে চলে গেল সে। আর শিঞ্জিনী রাস্তার দিকের দরজায় খিল দিয়ে ফের ওপরে উঠে সোজা নিজের পড়ার টেবলে গিয়ে বসল।

আগস্টে প্রি-টেস্ট। নভেম্বরের শেষে টেস্ট। পরের বছর মার্চের গোড়ায় ফাইনাল। পর পর এতগুলো পরীক্ষা। পড়ায় মন না দিলে রেজাল্ট ভালো করা যাবে না। একরকম জোর করেই মা আর সেই লোকটার চিন্তা মাথা থেকে বার করে দিয়ে বইয়ের মধ্যে ডুবে গেল শিঞ্জিনী। তারপর আর কোনওদিকে খেয়াল নেই।

সেই ক্লাস সেভেন-এইটে পড়ার সময় থেকেই নিজের জীবনের একটা লক্ষ্য ঠিক করে নিয়েছিল শিঞ্জিনী। আজকাল মেয়েরা চোখ-ধাঁধানো কেরিয়ারের দিকে ঝুঁকছে। কেউ হচ্ছে ডাক্তার। কেউ ইঞ্জিনিয়ার। কেউ চাটার্ড অ্যাকাউনটেন্ট। কেউ আর্কিটেক্ট। কেউ আই এ এস। কেউ বা যাচ্ছে ফরেন সারভিসে। কিন্তু শিঞ্জিনীর ইচ্ছা, নামকরা কোনও কলেজে পড়াবে। এই স্বপ্নটা কীভাবে তার মাথায় ঢুকে গিয়েছিল, কে জানে। কিন্তু মুখের কথায় তত কলেজের চাকরি হয় না। সে জন্য ইউনিভার্সিটির সবগুলো পরীক্ষায় দারুণ রেজাল্ট করা চাই। শিঞ্জিনী লেখাপড়ায় যথেষ্ট ভালো। মেধাবী। কোনওরকম বিঘ্ন না ঘটলে তার ইচ্ছাপূরণ না হওয়ার কারণ নেই।

কখন যেন একসময় নীচে কলিংবেল বেজে ওঠে। চমকে বই থেকে মুখ তোলে শিঞ্জিনী। মা বোধ হয় ফিরে এল। নিজের অজান্তে, স্বয়ংক্রিয় কোনও নিয়মে তার চোখ টেবল ক্লকের দিকে চলে যায়। নটা বেজে আটত্রিশ।

চেয়ার থেকে উঠে নীচে নেমে এল শিঞ্জিনী। এ সময় মা ছাড়া আর কারও আসার সম্ভাবনা নেই। তবু নিশ্চিত হবার জন্য আই-হোলে চোখ রেখে নিল সে। হ্যাঁ, মা-ই। দরজা খুলতেই মৃদুলা ভেতরে ঢুকে পড়ে। একটু কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে বলে, আজও ফিরতে দেরি হয়ে গেল। এত কাজের প্রেশার

শিঞ্জনী উত্তর দিল না।

দরজার ভেতর দিকে এক জোড়া কড়া লাগানো আছে। পাশের কুলুঙ্গিতে তালা চাবি থাকে। মৃদুলা সেগুলো বার করে দরজায় খিল দিয়ে, কড়ায় তালা লাগিয়ে চাবিটা জায়গামতো রেখে দিল। শুধু গ্রিলের ওপর তারা ভরসা করে না। বাড়তি নিরাপত্তার জন্য তাই ভেতর থেকে তালার ব্যবস্থাও করা হয়েছে।

সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতে উঠতে শিঞ্জিনী লক্ষ্য করল, মায়ের পরনে মেরুন রঙের দামি সিল্ক। পায়ে নতুন ডিজাইনের বাহারি স্ট্র্যাপ লাগানো জুতো। প্লাক করা ভুরু। মুখটা তেলতেলে, মসৃণ। খুব সম্ভব হালকা করে স্নো মেখেছে। মুখ ডিম্বাকৃতি। নখ ম্যানিকিওর করা। কাঁধ পর্যন্ত শ্যাম্পু করা ফাপানো চুল। কপালে মেরুন রঙের টিপ। তার শাড়ি-টাড়ি থেকে মৃদু সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ছিল।

মৃদুলার বয়স একচল্লিশ। কিন্তু বত্রিশ-তেত্রিশের বেশি মনে হয় না। মেদহীন, ঝকঝকে চেহারা। বাদামি, নিভাজ ত্বক। তার মধ্যে কোথায় যেন একটা লুকনো চুম্বক রয়েছে। যার আকর্ষণ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা খুব কম পুরুষেরই আছে। মৃদুলার যে একটি বড় মেয়ে আছে, এবং সে আসছে বছর হায়ার সেকেন্ডারি দেবে, ভাবাই যায় না। ইন্দ্রনাথের দুশ্চিন্তা অকারণে নয়।

আগে সাজগোজের দিকে মৃদুলার লক্ষ্য ছিল না। সাধারণ সিনথেটিক শাড়িতে যাতায়াতের সুবিধা। তাই পরত সে। চুলে দ্রুত বারকয়েক চিরুনি চালিয়ে নিত। দুই ভুরুর মাঝখানে ছোট একটি টিপ, সামান্য পাউডার বা স্নো, হাতে একটা চৌকো ঘড়ি। ব্যস, এটুকুই। কিন্তু ইদানীং সাজের মাত্রটা হঠাৎ বেড়ে গেছে। শিঞ্জিনীর অনভ্যস্ত চোখে কেমন যেন খোঁচা দেয়।

ছেলেবেলা থেকেই শিঞ্জিনী দেখে এসেছে, মা সুন্দরী, বয়সও তেমন কিছু নয়, তবু তার ছিল প্রবল ব্যক্তিত্ব। নিজের চারপাশে সারি সারি অনেকগুলো কাঁচের দেওয়াল তুলে রেখেছিল মৃদুলা। সে সব ভেদ করে তার খুব কাছে ঘেঁষার সাহস কারও হয়নি। তার সেই মা কি বদলে গেছে?

সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে চোরা চোখে মৃদুলার দিকে বারবার তাকাচ্ছিল শিঞ্জিনী। সারাদিন ট্রান্সপোর্ট কোম্পানিতে একটানা কাজ, তারপর ওভারটাইম। এত পরিশ্রমের নিট ফল কী? ক্লান্তি, অবসাদ, দুচোখ ঘুমে জড়িয়ে আসা। কিন্তু মায়ের চেহারায় তার চিহ্নমাত্র নেই। চুল পরিপাটি আঁচড়ানো। শাড়ির ভঁজে এতটুকু হেরফের হয়নি। ঘামে নষ্ট হয়ে যায়নি স্নো-পাউডারের প্রলেপ। বরং এত রাতেও তার চোখেমুখে আশ্চর্য তরতাজা ভাব। মনে গোপন আনন্দ থাকলে তার দ্যুতি বাইরে বেরিয়ে আসে। তেমনই কিছু একটা মায়ের সর্বাঙ্গে মাখানো।

মৃদুলা বলল, তুই খেয়ে নিয়েছিস তো?

শিঞ্জিনী বলে, না! তুমি না ফিরলে আমি কখনও খাই?

কতদিন বলেছি, আমার জন্যে ওয়েট করবি না। নটা পর্যন্ত দেখে খেয়ে নিবি।

একা একা খেতে আমার ভালো লাগে না।

সামান্য বিরক্ত হল মৃদুলা, এর কোনও মানে হয়।

শিঞ্জিনী চুপ করে থাকে।

মৃদুলা বলে, ধর, অফিসের কাজে বা অন্য কোনও কারণে কদিনের জন্যে আমাকে বাইরে যেতে হল। তখন কী করবি? খাবি না?

শিঞ্জিনী চকিত হয়ে ওঠে, তুমি বাইরে যাবে নাকি?

মৃদুলা বলল, ওটা একটা কথার কথা। যদি যাই

শিঞ্জিনী আর কোনও প্রশ্ন করল না।

দোতলায় উঠলেই প্রথম ঘরটা ইন্দ্রনাথের। সেখান থেকে তার দুর্বল স্বর ভেসে এল, খুকু এলি? পায়ের আওয়াজ শুনে তিনি টের পান কোনটা মেয়ের কোনটা নাতনির আর কোনটা মালতীর। বিছানায় শুয়ে থেকে থেকে তার ইন্দ্রিয়গুলো প্রখর হয়ে উঠেছে।

রাত্তিরে ইন্দ্রনাথের ঘরের দরজা ভেজানো থাকে। নিজের খাট থেকে নেমে খিল আটকে যে আবার বিছানায় উঠবেন, সে শক্তি তাঁর নেই। মৃদুলা পাশের ঘরেই থাকে। মাঝে মাঝে উঠে এসে বাবাকে দেখে যায়।

মৃদুলা সাড়া দিল, হ্যাঁ। ইন্দ্রনাথের ঘরের দরজাটা সামান্য ঠেলে মুখ বাড়িয়ে জিগ্যেস করল, তুমি এখনও জেগে আছ? ঘুমের ওষুধটা খাওনি?

ইন্দ্রনাথের রাতের খাওয়া হয়ে গেলে মালতী একটা অল্প পাওয়ারের নীলাভ আলো জ্বালিয়ে দিয়ে যায়। ওটা ভোর পর্যন্ত জ্বলে।

মৃদু আলায় মশারির ভেতর আবছাভাবে ইন্দ্রনাথের শীর্ণ কাঠামোটা দেখা যাচ্ছে। তিনি বললেন, খেয়েছি তো। কিন্তু তুই না ফেরা পর্যন্ত চোখে ঘুম যে আসে না।

আমি কি বাচ্চা মেয়ে? মৃদুলা বলল, কাজ থাকলে দেরি তো হবেই। কেন এত চিন্তা করো?

মেয়ের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ইন্দ্রনাথ বললেন, আর কত দিন তুই আমাকে এমন কষ্ট দিবি?

মৃদুলা থতমত খেয়ে যায়। পরক্ষণে সামলে নিয়ে বলে, অনেক রাত হয়েছে। এবার ঘুমিয়ে পড়ো। আর জেগে থাকলে শরীর খারাপ হবে। ইন্দ্রনাথকে আর কোনও অভিযোগ তোলার সুযোগ না দিয়ে বাইরে থেকে দরজাটা টেনে দেয় সে।

মাঝখানের ঘরটা মৃদুলার। সেখানে এসে সে বলল, তুই নিশ্চয়ই পড়ছিলি?

আস্তে মাথা নাড়ে শিঞ্জিনী, হ্যাঁ।

একটানা পড়লে চোখে খুব স্ট্রেন হয়। ভালো করে চোখ ধুয়ে নীচে খাবার ঘরে চলে আয়। আমিও বাইরের শাড়ি-টাড়িগুলো পালটে আসছি। বেশি দেরি করিস না।

নিজের ঘরে এসে নিঃশব্দে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে শিঞ্জিনী। যে বইটা পড়তে পড়তে মাকে দরজা খুলে দিতে নীচে নেমে গিয়েছিল, সেটা টেবলে খোল পড়ে আছে। এক সময় বইটা বন্ধ করে চোখে জল ছিটিয়ে, ভালো করে মুছে একতলায় নেমে এল সে।

মৃদুলা তার আগেই চলে এসেছে। তার পরনে এখন বাহারি নাইটি। কিচেনে খাবার গরম করছিল। মেয়ের পায়ের শব্দে মুখ ফিরিয়ে বলল, বস।

মালতীর কাজে কোনও খুঁত নেই। টেবলের মাঝখানে প্লেট, ফাঁকা জলের গেলাস, জলভর্তি স্টেনলেস স্টিলের জগ ইত্যাদি গুছিয়ে রেখে গেছে। ক্যাসেরোলে পরোটা রয়েছে। আর আছে প্ল্যাস্টিকের কৌটোয় কটা ক্ষীরের পানতুয়া।

শিঞ্জিনী একটা চেয়ারে বসে প্রথমে গেলাসে জল ভরল তারপর মৃদুলা এবং তার নিজের জন্য দুটো বড় প্লেট এবং সেগুলোর পাশে ছোট ছোট কটা গোল পোর্সিলিনের বাটি সাজিয়ে রাখল।

খাবার গরম হয়ে গেছে। মৃদুলা কিচেন থেকে এসে মেয়েকে পরোটা, ছোলার ডাল, মাংস ইত্যাদি দিয়ে নিজেও নিল।

কিছুক্ষণ চুপচাপ খাওয়ার পর মৃদুলা জিগ্যেস করল, তোর প্রি-টেস্ট যেন কবে?

পরোটার কোনা ছিঁড়ে চামচে করে ছোলার ডাল তুলে একসঙ্গে মুখে পুরে চিবোচ্ছিল শিঞ্জিনী। বলল, বেশি দেরি নেই।

পড়াশোনা ঠিকমতো হচ্ছে?

হচ্ছে।

এখন অন্য কোনও দিকে মন নয়। হায়ার সেকেন্ডারিটা খুব ইমপর্টেন্ট ব্যাপার। ভালো রেজাল্ট না করলে বড় কলেজে চান্স পাবি না।

জানি। নীরস গলায় শিঞ্জিনী বলল, অন্য কোনও দিকে মন দেবার মতো সময় আমার নেই।

একটু থমকে গেল মৃদুলা। আন্দাজ করতে চেষ্টা করল, মেয়ের কথায় সূক্ষ্ম কোনও ইঙ্গিত আছে কিনা। কিন্তু সেরকম কিছু বোঝা গেল না। তবে বেশ গম্ভীর আর অন্যমনস্ক মনে হল। সে বলল, টিচাররা কেমন ক্লাস নিচ্ছেন?

শিঞ্জিনী বলল, কোনও প্রবলেম নেই। আমাদের টিচারদের মধ্যে কেউ ফাঁকিবাজ নন।

কোচিং ক্লাস কেমন চলছে।

ভালো।

একটু চিন্তা করে মৃদুলা বলল, তোদের ফাইনালও এসে গেল। মাত্র কটা মাস বাকি। টিউটোরিয়ালে একসঙ্গে অনেক ছেলেমেয়েকে পড়ানো হয়। তোর কি মনে হয়, বাড়িতে এসে আলাদা করে পড়াবে, এমন দু-একজন টিউটর দরকার?

শিঞ্জিনী মাথা নাড়ে, না। লাগবে না।

এরপর অনেকটা নীরবে খেয়ে যায় দুজনে। শিঞ্জিনীর কেন যেন মনে হয়, মৃদুলা তার পড়াশোনা সম্পর্কে যা বলল তা নেহাতই দায়সারা। আগে প্রতিদিন খাবার টেবলে বসে কোন মিস কী পড়ালেন, কী নোট দিলেন, সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিগ্যেস করত। খুব ভালো ছাত্রী ছিল মৃদুলা। শুধু মেয়ের পড়া সম্পর্কেই খোঁজখবর নিত না, ক্লাস আর টিউটোরিয়ালের নোটগুলো খাতা খুলে দেখত। সেগুলো মেয়ে ঠিকমতো রপ্ত করেছে কিনা, নজর রাখত। শিঞ্জিনী আর ইন্দ্রনাথের জন্য অনেকটা সময় দিত সে।

খাওয়া শেষ হয়ে এসেছিল। নতচোখে কিছুক্ষণ ইতস্তুত করার পর হঠাৎ মুখ তুলে মেয়ের দিকে তাকায় মৃদুলা। ভেতরে ভেতরে কী একটা দ্বিধা তাকে স্বস্তি দিচ্ছিল না। দ্বিধাটা কাটিয়ে সে ডাকে, রূপা-।

শিঞ্জিনীর চোখও ছিল নিজের প্লেটের দিকে নামানো। মায়ের ডাকে চোখ তোলে সে, কিন্তু কোনও প্রশ্ন করে না।

তোর সঙ্গে আমার কথা আছে।

বলো।

এক ভদ্রলোক তোর সঙ্গে আলাপ করতে চান।

হৃৎস্পন্দন পলকের জন্য থমকে গেল শিঞ্জিনীর। স্বর্ণালী মায়ের সঙ্গে তিনবার যাকে দেখেছিল সেই লোকটাই কী? মায়ের মুখের ওপর দৃষ্টি স্থির রেখে সামান্য চাপা গলায় জিগ্যেস করল, কে ভদ্রলোক?

মৃদুলা বলল, ওপরে গিয়ে সব বলব। এখন খেয়ে নে।

.

০৪.

মিনিট পনেরো আগে ওপরে উঠে এসেছে শিঞ্জিনী। ভেবেছিল, খাওয়া-দাওয়ার পর ঘন্টা দুই পড়বে। হায়ার সেকেন্ডারির বিশাল কোর্স। তার ওপর পরীক্ষার পর পরীক্ষা। রাত্তিরে বারোটা, সাড়ে বারোটা পর্যন্ত না পড়লে থই পাওয়া যাবে না।

শুতে শুতে রোজই মাঝরাত পার হয়ে যায় শিঞ্জিনীর। এখন সবে দশটা সতেরো। কিন্তু পড়ায় একেবারেই মন বসছে না। খাটের কোনায় বসে সামনের দিকের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে সে। মৃদুলা কখন আসবে এবং কী ধরনের বিস্ফোরণ ঘটাবে, সে জন্য দমবন্ধ করে অপেক্ষা করছে।

ঝিঁঝিরা সেই বিকেল থেকেই ডেকে চলেছে। অদৃশ্য এই পোকাগুলোর এনার্জি আছে। মুহূর্তের জন্য থামে না। এখন ঝিল্লিস্বরের সঙ্গে জলার দিক থেকে ব্যাঙেদের কনসার্টও ভেসে আসছে। সূর্যাস্তের ঠিক আগে পশ্চিম আকাশে মেঘ জমেছিল। এখন দক্ষিণ দিকটাও মেঘে ঢাকা পড়ে গেছে। তারা বা চাঁদ কিছুই চোখে পড়ে না। মাঝে মাঝে আকাশটাকে কোনাকুনি চিরে বিদ্যুৎ ঝিলিক দিয়ে যায়। অনেকক্ষণ বৃষ্টিটা গড়িমসি করেছে। এবার বোধহয় মনস্থির করে ফেলেছে। যে-কোনও সময় দিগদিগন্ত ভাসিয়ে নেমে আসবে।

রাতের খাওয়া চুকলে মৃদুলার কিছু কাজ থাকে। এঁটো প্লেট এবং অন্যান্য বাসন রান্নাঘরের সিঙ্কে ঠিক করে গুছিয়ে রাখে। পরদিন মালতী এসে মাজবে।

বাসন-কোসন রাখা হলে, আঁচিয়ে, একতলার প্রতিটি ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে ওপরে উঠে আসে মৃদুলা। দোতলায় সিঁড়ির মুখে কোলাপসিবল গেট বসানো আছে। সেটা টেনে ঢাউস তালা লাগায়। এত সব করতে বেশ খানিকটা সময় লাগে। নীচের দরজায় তালা, দোতলায় তালা। নিরাপত্তার বন্দোবস্ত যতটা জোরদার করা যায় আর কী।

অন্যদিন এসব সারা হলে নিজের ঘরে চলে যায় মৃদুলা। আজ সোজা মেয়ের ঘরে এল। শিঞ্জিনী খাটের যে দিকটায় বসেছে, তার উলটো দিকে বাজুতে হেলান দিয়ে বসল।

দুবেলাই খাওয়ার পর ভাজা মৌরি খায় মৃদুলা। মৌরির স্বাদটা তার খুব ভালো লাগে। ফুরিয়ে যাবার পরও অনেকক্ষণ সেটা যেন জিভে জড়িয়ে থাকে।

চোখের কোণ দিয়ে মেয়েকে একবার লক্ষ্য করল মৃদুলা। তার ভঙ্গিটা বেশ সতর্ক। সতেরো-পেরুনো তরুণী মেয়েকে কীভাবে কথাটা বলবে, মনে মনে তার মহড়া দিয়ে নিচ্ছে যেন।

সেই বিকেল থেকে ভীষণ উতলা হয়ে আছে শিঞ্জিনী। মাকে কাছাকাছি বসে থাকতে দেখে উকণ্ঠটা হঠাৎ শতগুণ বেড়ে যায়।

মৃদুলা জানালার বাইরে তাকাল। মেঘে ফাটল ধরিয়ে বিদ্যুৎ চমকেই যাচ্ছে। দূরে কোথায় যেন বাজ পড়ল।

যেন মেয়েকে নয়, বাইরের অদৃশ্য কারও উদ্দেশে মৃদুলা বলল, খেতে বসে যে ভদ্রলোকের কথা বলছিলাম তাঁর নাম বিমলেশ বসুমল্লিক।

শিঞ্জিনী উত্তর দিল না।

মৃদুলা বলতে লাগল, ওঁরা লেদার গুডসের খুব বড় ম্যানুফ্যাকচারার। জুতো, সুটকেস, বড় বড় ব্যাগ, এমনি নানা জিনিস ওঁদের কারখানায় তৈরি হয়।

কোনওরকম আগ্রহ বোধ করল না শিঞ্জিনী। শুধু বলল, ও–

মৃদুলা বলল, ওঁদের একটা বিরাট ফ্যাক্টরি আছে পানিহাটিতে। খুব শিগগিরই বি টি রোডে নতুন আরেকটা কারখানা খুলবেন। লেদারের আরও কী কী জিনিস সেখানে তৈরি হবে।

আগের মতোই একটি মাত্র শব্দ শিঞ্জিনীর মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ও-

হোল ইন্ডিয়ায় ওঁদের প্রোডাক্টের বিরাট ডিমান্ড। প্রতি সপ্তাহে মহারাষ্ট্র, গুজরাট, তামিলনাড়ু থেকে অসম, মণিপুর পর্যন্ত ট্রাক বোঝাই হয়ে ওঁদের মাল যায়। বিদেশেও ওঁদের বড় মার্কেট। প্রচুর এক্সপোর্ট করে।

ও।

উদ্দীপ্ত মুখে মৃদুলা বলে, নামকরা অ্যারিস্টোক্রাট ফ্যামিলির ছেলে। শোভাবাজারে ওঁদের প্রকাণ্ড বাড়ি। একশ বছরের পুরোনো। তবে বিমলেশ সল্ট লেকে আলাদা তিনতলা বাড়ি করেছেন। উনি সেখানেই থাকেন।

এই মধ্যরাতে আকাশ যখন মেঘাচ্ছন্ন, বৃষ্টি প্রায় পড় পড়, সারা শহর নিঝুম, সেই সময় একজন চূড়ান্ত সফল, অর্থবান মানুষের জীবনকাহিনি যেভাবে মা ফেঁদে বসেছে, সহজে তা থামবে বলে মনে হয় না। শিঞ্জিনী ক্লান্তি বোধ করছিল। মনে মনে বেশ বিরক্তও। আজ আর পড়াশোনার আশা নেই। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে পারলে কাল ভোর ভোর উঠে বই নিয়ে বসা যেত। মায়ের ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে না, সেটা আদৌ সম্ভব।

মৃদুলা থামেনি। সে আরও জানায়, মানুষ হিসেবে বিমলেশ চমৎকার। অমায়িক। সহৃদয়। এত যে পয়সা, কিন্তু তিলমাত্র অহমিকা নেই।

মায়ের মুখে কোনও অনাত্মীয় পুরুষের এমন ঢালাও স্তুতি আগে কখনও শোনেনি শিঞ্জিনী। এত উচ্ছ্বসিত হতেও দেখেনি। অবাক বিস্ময়ে সে শুধু মাকে দেখেই যাচ্ছিল। পলকহীন। বুঝতে পারছিল, আসল প্রসঙ্গে আসার আগে মৃদুলা জমি তৈরি করে নিচ্ছে।

মৃদুলা এবার জানায়, একবার বিয়ে হয়েছিল বিমলেশের, স্ত্রী জয়তী ছিল সুন্দরী, শিক্ষিতা। হিষ্ট্রির এমএ। একটা বড় কলেজে পড়াত। ম্যারেড লাইফটা ওদের বেশ সুখেরই ছিল। কিন্তু হঠাৎই জয়তীর ব্রেন ক্যানসার ধরা পড়ল। খুবই অ্যাডভান্সড স্টেজে। তখন আর কিছু করার ছিল না। মাত্র তিন মাসের ভেতর জয়তীর মৃত্যু ইল। এমন একটা শোকাবহ ঘটনার একেবারে ভেঙে পড়েছিল বিমলেশ। দুঃখটা সামলে নিতে অনেক সময় লেগেছে তার। ওরা নিঃসন্তান। একটা ছেলে বা মেয়ে হলে তবু একটা সান্ত্বনা থাকত। তাকে আঁকড়ে ধরে বাকি জীবনটা কাটিয়ে নিতে পারত। কিন্তু তার উপায় নেই। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সে সম্পূর্ণ একা।

এত সব কথা জানার পরও টু শব্দটি করে না শিঞ্জিনী। তার কাছে এগুলোর কোনও গুরুত্ব নেই। একেবারেই অর্থহীন। অনাবশ্যক। তবু শুনতে হচ্ছে। এ যে কী মানসিক যাতনা!

বিমলেশকে নিয়ে মৃদুলার উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। ভদ্রলোকের নাকি নানা মহলে দারুণ ইনফ্লুয়েন্স। পুলিশ, প্রশাসন, পলিটিক্যাল পার্টি তো আছেই। এমনকী বেশ কজন মন্ত্রীর সঙ্গেও যথেষ্ট দহরম মহরম। বিগ বিজনেস বা ইন্ডাস্ট্রি চালাতে গেলে বিভিন্ন লেভেলের ক্ষমতাবান লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখলেই নয়।

ধৈর্যের শেষ প্রান্তে পৌঁছে যায় শিঞ্জিনী। এতক্ষণ ঠোঁট টিপে বসে ছিল। এবার তীব্র, ঝাঝালো গলায় বলে, আমাকে পড়তে দিলে না। যাকে চিনি না, জানি না, দেখিনি, তার লাইফ হিষ্ট্রি কি সারারাত শুনিয়ে যাবে?

মৃদুলা হতচকিত। মেয়ের দিক থেকে এমন বাধা আসবে, ভাবতে পারেনি। সে প্রায় বোবা হয়ে যায়।

শিঞ্জিনী থামেনি। আগের মতোই কটু স্বরে বলল, লোকটা সম্পর্কে কেন এত কথা বলছ? তার প্রচুর টাকা, বিরাট বিজনেস, অ্যারিস্টোক্রাট ফ্যামিলিতে জন্ম–এসব শুনে আমার কী লাভ?

এর মধ্যে অনেকটা সামলে নিয়েছে মৃদুলা। একটু হেসে বলল, ভদ্রলোক সম্পর্কে তোর যাতে পরিষ্কার একটা ধারণা হয়, সেই জন্যেই এত কথা বলা।

সোজাসুজি মায়ের চোখে চোখ রেখে শিঞ্জিনী জিগ্যেস করে, এই ভদ্রলোক আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন কেন?

আমি তোর কথা বলেছি। তাই ওঁর ভীষণ ইচ্ছে, তোর সঙ্গে আলাপ করেন।

আমার সঙ্গে আলাপ করার কারণটা কী?

কারণ আবার কী? ওঁর ইচ্ছে হয়েছে। তাই

কী আশ্চর্য, কলকাতায় আমার বয়সি হাজার হাজার মেয়ে আছে। তাদের বাদ দিয়ে আমার সম্বন্ধে তার এত ইন্টারেস্ট কেন?

যে সুরে, যে ভঙ্গিতে শিঞ্জিনী কথা বলছে তাতে ধৈর্যচ্যুতি ঘটতেই পারে। কিন্তু নিজেকে সংযমে বেঁধে রাখে মৃদুলা। শান্ত মুখে বলে কারণ তুই আমার মেয়ে।

এবার থতমত খেয়ে যায় শিঞ্জিনী, তোমার মেয়ে বলেই আমার সঙ্গে আলাপ করতে চান! স্ট্রেঞ্জ! আর কোনও পারপাস নেই?

প্রহেলিকার আবরণে নিজেকে মুড়ে রাখে মৃদুলা। হেসে হেসে বলে, হয়তো আছে। হয়তো আমি জানি। তবে যা বলার তিনিই তোকে বলবেন।

শিঞ্জিনী বুঝতে পারে, বিমলেশ বসুমল্লিকের উদ্দেশ্যটা মায়ের কাছ থেকে কিছুতেই জানা যাবে না। তাকে খুঁচিয়ে লাভ নেই।

কিছুক্ষণ চুপচাপ।

তারপর শিঞ্জনী বলে, একটা ব্যাপার আমি কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না।

কী?

তুমি একটা ট্রান্সপোর্ট কোম্পানিতে ছোটখাটো অফিসার। বিমলেশ বসুমল্লিকের মতো একজন ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টের সঙ্গে তোমার কীভাবে পরিচয় হল?

ওঁদের কোম্পানির বহু জিনিস আমরা ট্রাকে করে ইন্ডিয়ার নানা সিটিতে পাঠাই। দুবার দুটো গোলমাল হয়েছিল। একবার মাল ঠিক সময়ে জায়গামতো পোঁছয়নি। আরেকবার রাস্তায় সব জিনিস লুঠ হয়ে যায়। দুবারই মিস্টার বসুমল্লিক আলোচনার জন্য আমাদের ডেকে পাঠান। কোম্পানির তরফ থেকে আমি ওঁর অফিসে গিয়ে দেখা করি। এইভাবেই আলাপ হয়েছিল।

শিঞ্জনী উত্তর দিল না।

একটু চিন্তা করে মৃদুলা জিগ্যেস করল কী বলব ভদ্রলোককে? দেখা করবি?

শিঞ্জিনী অনুমান করে নেয়, বিমলেশের সঙ্গে পরিচয় করতে যতক্ষণ না রাজি হচ্ছে, মা তাকে ছাড়বে না। নাছোড়বান্দা হয়ে পেছনে লেগে থাকবে। কদিন পর প্রি-টেস্ট। এসময় উটকো ঝঞ্ঝাট তার ভালো লাগছে না। আবার কৌতূহল যে হচ্ছিল না, তা নয়। এই লোকটার সঙ্গেই যে মাকে স্বর্ণালী কলকাতায় তিন জায়গায় দেখেছে, এ নিয়ে তার সংশয় নেই। বিমলেশ সম্পর্কে একদিকে তার বিতৃষ্ণা, অন্যদিকে আগ্রহ। কিছুক্ষণ দুইয়ের টানাপোড়েন চলল। তারপর নীরস গলায় শিঞ্জিনী বলল, ঠিক আছে, তোমার যখন এত ইচ্ছে, মিস্টার বসুমল্লিককে আমাদের বাড়ি আসতে বলো। আমার সঙ্গে পরিচয় হবে দাদুর সঙ্গেও।

মৃদুলা চমকে ওঠে, না না

কী না?

উনি এখন এ বাড়িতে আসবেন না?

শিঞ্জিনী অবাক, কেন?

মৃদুলা বলল, আগে তোর সঙ্গে কথা বলবেন। তারপর যদি মনে হয়, আমাদের বাড়িতে আসা যায়, তখন আসবেন। সমস্ত কিছু তোর ওপর নির্ভর করছে।

আমার ওপর নির্ভর করছে মানে?

সেটা ওঁর সঙ্গে দেখা হলেই বুঝতে পারবি।

আমাদের বাড়ি উনি আসবেন না। তা হলে দেখাটা হবে কী করে?

তার ব্যবস্থা আমি করব। অনেক রাত হয়ে গেছে। এবার শুয়ে পড়। বলতে বলতে উঠে পড়ল মৃদুলা।

.

০৫.

মৃদুলা চলে যাবার পর জোরালো টিউবলাইট নিভিয়ে সবুজ রঙের নাইট ল্যাম্প জ্বেলে দিল শিঞ্জিনী। তারপর দরজায় ছিটকিনি আটকে বিছানায় চলে এল। বুকে বালিশ চেপে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে সে।

কখন দুর্যোগ শুরু হয়েছিল, খেয়াল নেই। অঝোরে বৃষ্টি ঝরে যাচ্ছে। ছাঁটটা উলটো দিক থেকে আসছে বলে জানালা দিয়ে জল ঘরে ঢুকছে না। উঁচু বাড়িগুলোর বেশিরভাগ ঘরেরই আলো নিভে গেছে। দু-একটা যা-ও জ্বলছে কেমন যেন অলৌকিক মনে হয়। আকাশ ঝলসে দিয়ে কড় কড় শব্দে বাজ পড়ছে। ব্যাঙের ডাক বন্ধ। ঝিঁঝিদের অর্কেস্ট্রা থেমে গেছে। ঝড়ো হাওয়া সাঁই সাঁই ঘোড়া দাবড়ে চলেছে দিগ্বিদিকে। আর বড় বড় গাছগুলোর ঝুঁটি ধরে ঝাঁপিয়ে যাচ্ছে অবিরল। হঠাৎ যেন কলকাতায় এই অঞ্চলটাকে ভূতে পেয়েছে।

মৃদুলার কথাই ভাবছিল শিঞ্জিনী। একদিন মা-ই ছিল তার সর্বস্ব। মাকে ঘিরেই ছিল তার বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে। তাকে ছাড়া মা-ও আর কিছু ভাবতে পারত না। পরস্পরকে নিয়েই তারা এতকাল বিভোর হয়ে ছিল।

কিন্তু আজ বিকেলে স্বর্ণালীর কাছে যা শুনেছে এবং কিছুক্ষণ আগে মৃদুলা যা বলে গেল, তাতে একটা সংকেতই রয়েছে। মা আর আগের মা নেই। শিঞ্জিনীর কাছ থেকে অনেকটা দূরে সরে গেছে। কেমন অচেনা অচেনা লাগছে তাকে। এতদিন দুজনে একসঙ্গে বসলে তাদের যত কথা হত নিজেদের নিয়েই। আজ তাদের ভেতর আরেক জন ঢুকে পড়েছে। বিমলেশ বসুমল্লিককে চোখে দেখেনি শিঞ্জিনী, কিন্তু তার অস্তিত্ব প্রবল ভাবেই টের পাওয়া যাচ্ছে।

শিঞ্জিনী অবাক হয়ে ভাবে, মৃদুলা একদিন তার জন্য কী করেছে। তাকে কাছে পাওয়ার জন্য দাঁতে দাঁত চেপে তিনটে বছর শ্বশুরবাড়ির, বিশেষ করে অনির্বাণের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিল। সে এক নিদারুণ সংঘাত। তখন দিনরাত আতঙ্কের মধ্যে কাটত মৃদুলার। ঘুমত না, ঠিকমতো খেত না, কেমন যে পাগল পাগল অবস্থা। একটা দুঃস্বপ্ন সর্বক্ষণ তাকে তাড়া করে বেড়াত। অনির্বাণ তখনও তার স্বামী। তার ভয়, এই বুঝি শিঞ্জিনীকে অনির্বাণরা ছিনিয়ে নিয়ে গেল।

বৃষ্টি ঝরেই চলেছে। বিরতিহীন। ঝড়ের মাতামাতি আরও বেড়েছে। বাইরের মতোই শিঞ্জিনীর বুকের ভেতরটা এখন উথালপাথাল।

নিজের অজান্তে কখন যেন হঠাৎ একটা টাইম মেশিন শূন্য থেকে নেমে এসে তাকে তুলে নিয়ে সেই কোন ছেলেবেলায় পৌঁছে দেয়।

.

তখন শিঞ্জিনীর কত আর বয়স। চার কি পাঁচ। ওরা থাকত বেলগাছিয়া ট্রাম ডিপোর পেছন দিকের একটা রাস্তায়। সেখানে অনির্বাণদের মাঝারি ধরনের তেতলা বাড়ি। টাকাপয়সার সমস্যা নেই। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করত সে। পোস্টটা বেশ উঁচুর দিকে। তার বাবাও অনেক টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করে রেখে গেছেন। ব্যাঙ্ক থেকে ভালো ইন্টারেস্ট পাওয়া যেত।

বাড়িতে সবসুদ্ধ পাঁচটি মানুষ। অনির্বাণ, তার বিধবা মা রত্নময়ী, এক তরুণী বিধবা বৌদি যার নাম তরুলতা, মৃদুলা আর শিঞ্জিনী। তরুলতা অবশ্য মাঝে মাঝে তার বাপের বাড়ি পাতিপুকুরে চলে যেত। কখনও পনেরো-কুড়ি দিন, কখনও বা এক-দুমাস কাটিয়ে আবার ফিরে আসত। যখনই ফিরত, মৃদুলার সঙ্গে তুলকালাম শুরু হয়ে যেত। শিঞ্জিনী লক্ষ্য করেছে, প্রতিটি সংঘর্ষে রত্নময়ী আর অনির্বাণ তরুলতার পক্ষে। অন্যদিকে মা একা। কুৎসিত কলহে, তুমুল চিঙ্কারে সারা বাড়ি নরক হয়ে উঠত। এই মহাযুদ্ধের কারণ কী, সেটা বোঝার বয়স তখনও হয়নি শিঞ্জিনীর।

এসব অনেক পরের কথা। সে শুনেছে, মৃদুলা আর অনির্বাণের বিয়েতে প্রেমের নামগন্ধও ছিল না। ঘটকালিটা করেছিল খবরের কাগজ। ম্যাট্রিমোনিয়াল কলমে বিজ্ঞাপন দেখে ইন্দ্রনাথ যোগাযোগ করেছিলেন। মৃদুলাকে দেখে, তার সঙ্গে কথা বলে খুবই পছন্দ হয়েছিল অনির্বাণদের। বিশেষ করে তরুলতার। যেদিন মৃদুলাকে ওরা দেখতে আসে, সেদিনই নাকি মা আঁচ করেছিল, অনির্বাণ বা রত্নময়ী নন, ওদের বাড়ির আসল কী তরুলতা। ও বাড়িতে তার কথাই শেষ কথা। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ টু শব্দটি করে না।

তরুলতা মৃদুলার কানে কানে নাকি বলেছিল, আমিই তোমাকে পছন্দ করে নিয়ে যাচ্ছি। এই কথাটা সবসময় মনে রেখো।

বিয়ের খুঁটিনাটি সব ব্যাপারে আগ বাড়িয়ে তরুলতা কথা বলেছিল। এটা করতে হবে, ওটা না করলে চলবে না। অমুকটা চাই, টমুকটা চাই। অতজন বরযাত্রী আসবে। ইত্যাদি ইত্যাদি। রত্নময়ী আর অনির্বাণ নীরবে ঘাড় কাত তার প্রতিটি কথায় সায় দিয়ে গিয়েছিল।

মৃদুলার মা অন্নপূর্ণা তখনও বেঁচে। তরুলতার এই কর্তালি তার পছন্দ হয়নি। বরং খারাপই লেগেছে। যেখানে রত্নময়ী মাথার ওপর রয়েছেন, বিধবা পুত্রবধূ কেন এত ফরফর করে।

অন্নপূর্ণার এই খুঁতখুঁতুনিকে আমল দেননি ইন্দ্রনাথ। একরকম তুড়ি মেরেই উড়িয়ে দিয়েছেন। এমনিতে তার এবং অন্নপূর্ণার কারও স্বাস্থই ভালো নয়। দুজনেই পাল্লা দিয়ে ভুগতেন। বেঁচে থাকতে থাকতে একমাত্র মেয়ের বিয়েটা চুকিয়ে ফেলতে চেয়েছেন ইন্দ্রনাথ। কখন কার কী হয়ে যাবে, কে বলতে পারে। এটাই ছিল তাদের জীবনের শেষ বড় দায়িত্ব।

তরুলতাকে নিয়ে অন্নপূর্ণার মনে সামান্য একটু খিচ যে রয়েছে তা বোধহয় আন্দাজ করতে পেরেছিলেন রত্নময়ী। তার একটা যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যাও পেশ করেছিলেন। তরুলতা তার বড় ছেলে সুকুমারের স্ত্রী। কবছর আগে রাস্তা পার হতে গিয়ে বেপরোয়া বাসের ধাক্কায় সুকুমারের মৃত্যু হয়। কী আর এমন বয়স তরুলতার! সবে একত্রিশ। ছেলেপুলে হয়নি। ইচ্ছা করলে বাপের বাড়ি চলে যেতে পারত। লেখাপড়া জানা মেয়ে, একটা চাকরি জুটিয়ে নেওয়া অসম্ভব ছিল না। এমনকী, ফের বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করতে পারত। তার সামনে অফুরান ভবিষ্যৎ। রত্নময়ী অনেকবার বুঝিয়েছেন, ফের তার বিয়ে করা উচিত। কিন্তু কোনও কথাই কানে তোলেনি। শ্বশুরবাড়িতে থেকে শোককাতর শাশুড়ি এবং দেওরটিকে আগলে আগলে রেখেছে। ধীরে ধীরে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তরুলতার ওপর নির্ভর না করে উপায় নেই। তাদের সংসারের রক্তমাংসে সে জড়িয়ে গেছে।

একমাত্র মেয়ের বিয়ে। শিঞ্জিনী শুনেছে, রীতিমতো ধুম-ধাম করেই সেটা দিয়েছিলেন ইন্দ্রনাথ। লং প্লেয়িং রেকর্ডে সানাই, চোখধাঁধানো আলো, গোলাপ আর রজনীগন্ধা দিয়ে সাজানো ছাঁদনাতলা এবং বাসরঘর, নামকরা কেটারারদের দিয়ে ভোজের ব্যবস্থা। সব কিছুই নিখুঁত।

ইন্দ্রনাথ মেয়েকে দিয়েছিলেনও প্রচুর। দুসেট গয়না, খাট, ওয়ার্ডরোব, ড্রেসিং টেবল, রঙিন টিভি, ওয়াশিং মেশিন, ডিভান, এমনি কত কী। মৃদুলার জন্মের পর থেকেই তার বিয়ের জন্য মাসে মাসে ব্যাঙ্কে টাকা জমিয়ে গেছেন ইন্দ্রনাথ। বিয়ের সময় সুদে আসলে সেটা কয়েক লাখে দাঁড়িয়ে ছিল। সবটাই তিনি খরচ করেছেন।

শ্বশুরবাড়িতে যাবার পর কিছুদিন কোনও গোলমাল নেই। সব মসৃণ নিয়মেই চলছিল। যেমন অন্য দশটা মেয়ের জীবনে ঘটে, অবিকল তা-ই।

প্রথমটা লক্ষ্য করেনি মৃদুলা। বিয়ের পর পর যে-কোনও তরুণীর শরীরে এবং মনে ঘোর লেগে থাকে। সেই ঘোরটা কেটে গেলে এমন কিছু কিছু ব্যাপার চোখে পড়তে লাগল যা ভীষণ চোখে পড়ে। তার ভুরু কুঁচকে যেতে লাগল।

তরুলতা মাঝে মাঝে অনির্বাণের দিকে কেমন করে যেন তাকায়। ঠোঁট টিপে নিঃশব্দে অদ্ভুত হাসে। তার চাউনি আর হাসির মধ্যে কীসের যেন সংকেত থাকে। তাছাড়া, একটু আড়াল হলেই অনির্বাণকে জড়িয়ে ধরে নাকটা তার গালে কি গলায় ঘষতে থাকে। চাপা, ফিসফিস গলায় কী যেন বলে।

ততদিনে শিঞ্জিনী পেটে এসে গেছে। দেখেশুনে অদ্ভুত শঙ্কায় মন ভরে যেত মৃদুলার। সারাক্ষণ বুকের ভেতর থির থির কাঁপুনি। এক ঝাক বিষাক্ত পোকা যেন মাথায় অবিরাম হুল ফুটিয়ে চলেছে। কী যে কষ্ট! কী যে নিদারুণ যাতনা!

মৃদুলা একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। কী করবে, কী করা উচিত, প্রথম দিকে ভেবে পাচ্ছিল না। একবার ভেবেছিল, মা-বাবাকে সব জানায়। পরক্ষণে মনে হয়েছে, তাঁরা ভেঙে পড়বেন। সে মনস্থির করে ফেলেছিল, অনির্বাণের সঙ্গে বোঝাঁপড়াটা নিজেই করে নেবে। এর মধ্যে আপাতত অন্য কাউকে জড়াবে না।

একদিন রাত্তিরে খাওয়া-দাওয়া চুকে যাবার পর শোওয়ার হতাড়জোড় চলছে, মৃদুলা বলেছিল, তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। বসো খাটের এক কোনায় নিজে বসে অন্য প্রান্তটা দেখিয়ে দিয়েছিল সে।

মৃদুলার স্বরে চাপা কাঠিন্য মেশানো। একটু অবাক হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকাতে তাকাতে খাটের অন্য কোনায় বাজুতে আলগা করে পিঠ ঠেকিয়ে বসেছিল অনির্বাণ। জিগ্যেস করেছে, কী কথা?

আমি যা বলব, তোমার কিন্তু ভালো লাগবে না।

ঠিক আছে। বলো–

একটু চুপচাপ।

তারপর পরিবেশটা লঘু করার জন্যই হয়তো অনির্বাণ বলেছে, আমি গর্দান দেবার জন্যে প্রস্তুত।

থমথমে মুখে মৃদুলা বলেছে, হাসিঠাট্টার ব্যাপার নয়। যা বলব তার সঙ্গে তোমার আমার ভবিষ্যৎ অনেকখানি জড়িয়ে আছে।

দৃষ্টি স্থির হয়ে গিয়েছিল অনির্বাণের। সে কোনও প্রশ্ন করেনি।

তরুলতার সঙ্গে অনির্বাণকে কবে কখন, কোন অবস্থায় দেখেছে, তাদের টুকরো টুকরো কী কথা কানে এসেছে, এবার তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়ে গেছে মৃদুলা। খুঁটিনাটি কিছুই বাদ দেয়নি। তারপর জিগ্যেস করেছে, অস্বীকার করতে পারো?

হতচকিত অনির্বাণ কী উত্তর দেবে, ভেবে পায়নি।

মৃদুলা গলায় স্বর উঁচুতে তুলে বলেছে, এ সবের মানে কী?

সরাসরি আক্রমণ এবং অতর্কিত। বর্ম পরে সেটা ঠেকাবার মতো যথেষ্ট সময় পায়নি অনির্বাণ। তবু খানিকটা সামলে নিয়ে বলেছে, তুমি ভুল বুঝেছ

মৃদুলার কপাল কুঁচকে গেছে, মানে?

তুমি যা ভাবছ তা নয়। বৌদি আমাকে নিজের ছোট ভাইয়ের মতো মনে করে। দিদি কি তার ভাইকে আদর করতে পারে না?

আমি যথেষ্ট সাবালিকা। দিদির আদর কী, সেটা আমাকে বোঝাতে হবে না। একটা কথা তোমাকে স্পষ্ট বলে দিচ্ছি। এ ধরনের ব্যাপার আমি পছন্দ করি না।

অনির্বাণ বলেছিল, তুমি একটা ভুল ধারণা তৈরি করে মনে মনে কষ্ট পাচ্ছ। এর কোনও মানে হয় না।

মৃদুলা উত্তর দেয়নি।

পরদিন তরুলতা মৃদুলার একটা হাত ধরে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে কাছে বসিয়েছিল। মাথায় পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে গলার স্বরে অপার স্নেহ ঢেলে দিয়ে বলেছে, কী পাগল মেয়ে রে তুই! অনির্বাণ খুব দুঃখ পেয়েছে। মাথা থেকে ওই সব চিন্তা বার করে দে।

মৃদুলা চুপ। সে বুঝতে পারছিল, আগের রাতে সে যা যা বলেছে, অনির্বাণ সবই তরুলতাকে জানিয়ে দিয়েছে।

তরুলতা ফের বলেছে, তোকে এ বাড়িতে নিয়ে এসেছিল কে? আমি তো? আমার মত না থাকলে তুই কি এ বাড়ির বউ হয়ে আসতে পারতিস?

তরুলতা কী ইঙ্গিত দিতে চাইছে, মোটামুটি আঁচ করতে পারছিল মৃদুলা। কী চাইছিল সুন্দরী বিধবা তরুণীটি? যেহেতু তার পছন্দের জোরে বিয়েটা হয়েছে তাই মৃদুলাকে মুখ বুজে তার সব কিছু মেনে নিতে হবে?

মৃদুলা ফুঁসে উঠতে যাচ্ছিল তার আগেই হেসে হেসে ফের তরুলতা বলেছে, তুই দুঃখ পাস, এমন কিছু কি আমি করতে পারি? সন্দেহ আর দুশ্চিন্তাকে যদি প্রশ্রয় দিস, নিজের তো বটেই, পেটে যে বড় ইচ্ছে তারও ক্ষতি। এসময়টা মেয়েদের আনন্দে থাকতে হয়।

তরুলতা মিষ্টি মিষ্টি কথায় তাকে বোঝাতে চেয়েছে ঠিকই, কিন্তু বুকের ভেতর সন্দেহের সে কাটাবন মাথা তুলতে শুরু করেছিল তা নির্মূল হয়নি।

রত্নময়ীর সঙ্গেও এই নিয়ে কথা হয়েছে মৃদুলার, তিনিও অন্যরকম কিছু বলেননি, তরুলতা যখন বউ হয়ে এ বাড়িতে এল, অনির্বাণ তখন সদ্য যুবক। মাত্র সতেরো কি আঠারো বছর বয়স। নিজের ভাইবোন নেই, স্বামীর ভাইটিকে বড় মায়ায় জড়িয়ে নিয়েছিল তরুলতা। দুজনের সম্পর্কটা বড় মধুর। তার মধ্যে বিন্দুমাত্র নোংরামি বা আবিলতা নেই। ইত্যাদি।

এরপর তরুলতা আর অনির্বাণ অনেকটা সতর্ক হয়ে গিয়েছিল। এমন কিছু চোখে পড়েনি যা আপত্তিকর। কিন্তু কোনও কোনও দিন রাত্তিরে ঘুম ভেঙে গেলে মৃদুলা দেখতে পেত, পাশের জায়গাটা খালি, অনির্বাণ নেই। কখন যে উঠে গেছে, টের পাওয়া যায়নি।

চকিতে অ্যাটাচড বাথরুমের দিকে তাকিয়েছে মৃদুলা। সেটার দরজা খোলা। ভেতরে কেউ নেই। তড়িৎপ্রবাহের মতো কিছু একটা খেলে গেছে তার। বিছানা থেকে নামতে যাবে, তখনই ফিরে এসেছে অনিবার্ণ। জিগ্যেস করলে সে বলেছে, ঘুম আসছিল না, তাই বাইরের বারান্দায় গিয়ে পায়চারি করতে করতে সিগারেট খাচ্ছিল।

অনির্বাণের অজুহাতে খুঁত নেই। তবু বুকের সেই কাটাবনটা ক্রমশ ডালপালা ছড়িয়ে যাচ্ছিল।

আর একদিন অনির্বাণকে বিছানায় না দেখে, দোতলায় শেষ মাথায় তরুলতার ঘরের সামনে গিয়েছিল মৃদুলা। বারান্দার দিকের জোড়া জানালার একটা পাল্লা ছিল ভোলা। ভেতরে অল্প পাওয়ারের নাইট ল্যাম্প জ্বলছে। কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছিল না।

মৃদুলা জানালার কাছ থেকে সরে গিয়ে দরজার পাল্লায় কান রেখে দাঁড়িয়েছিল। ঘরটা নিঝুম। সেখানে কোনও সাড়াশব্দ নেই।

সে যখন নিজেদের বেডরুমে ফিরে আসবে, হঠাৎ তরুলতার ঘরে বেশি পাওয়ারের আলো জ্বলে উঠেছে এবং দড়াম করে দরজাটা খুলে গেছে। ফিরে আসা হয়নি মৃদুলার। পা দুটো কেউ পেরেক ঠুকে বারান্দায় গেঁথে দিয়েছে!

বিচিত্র হেসে তরুলতা বলেছিল কী রে, এখানে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছিস!

মৃদুলা এতটাই হকচকিয়ে গেছে যে উত্তর দিতে পারেনি।

আয়, ভেতরে আয় মৃদুলার হাত ধরে নিজের খাটে বসিয়ে তরুলতা জিগ্যেস করেছে, তারও কি অনির্বাণের মতো ইনসমনিয়ার ধাত নাকি?

অনির্বাণ বরাবরই অনিদ্রার ভোগে কিনা, মৃদুলার জানা ছিল না। তরুলতার কথাগুলোর মধ্যে কোনও ইঙ্গিত আছে কি? মৃদুলা বলেছিল, না। হঠাৎ আপনার এটা মনে হল কেন?

রহস্যময় হাসি লেগেই ছিল তরুলতার মুখে। সে বলেছে, ইনসমনিয়া বোধ হয় ছোঁয়াচে রোগ। এক ঘরে থাকা, এক বিছানায় শোওয়া। স্বামীর হলে স্ত্রীরও হতে পারে, তাই না রে?

মৃদুলা এক পলক তরুলতার দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়েছিল।

হঠাৎ তরুলতার মুখ কঠিন হয়ে উঠেছে। হাসছিল ঠিকই, কিন্তু সে হাসি থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে বিষ ঝরতে শুরু করেছিল। মৃদুলা কিছু বোঝার আগেই এক টানে তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তরুলতা। খাটের চাদর বালিশ ওলটপালট করে, ড্রেসিং টেবলের দেরাজ আর আলমারির পাল্লা খুলে, এমনকী মৃদুলাকে জোর করে মেঝেতে বসিয়ে খাটের তলাটা দেখিয়ে জিগ্যেস করেছিল, পাওয়া গেল? তার গলায় সাপের শিসের মতো চাপা আওয়াজ। দুই চোখ জ্বলছিল।

মৃদুলা ভয় পেয়ে গেছে। তরুলতার মধ্যে এমন একটা হিংস্র চেহারা লুকনো ছিল, সে ভাবতে পারেনি। আড়ষ্ট হতে হতে বলেছে, কী পাওয়া যাবে?

যাকে খোঁজার জন্যে মাঝরাতে আমার ঘরের সামনে দাঁড়িয়েছিলি।

কারা যেন খড়ি পেতে ভূ-ভারতের সব খবর আগাম জেনে যায়, তরুলতা কি তাদের কেউ? রাতদুপুরে মৃদুলা যে এখানে হানা দেবে, তা কি সে টের পেয়ে গিয়েছিল? অনির্বাণকে হাতেনাতে ধরতে এসে চূড়ান্ত নাকাল হতে হয়েছে। না, তরুলতা ছাড়া এ-ঘরে আর কেউ নেই। মৃদুলার জবাব দেবার কিছু ছিল না। নতচোখে সে দাঁড়িয়ে থেকেছে।

যে হিংস্রতা আগুনের হলকার মতো বেরিয়ে এসেছিল, লহমায় অদৃশ্য খাপের ভেতর সেটা পুরে ফেলেছে তরুলতা। ফের তাকে আগের মতোই দেখাচ্ছিল। মুখে স্নিগ্ধ হাসি, দুচোখে অপার মায়া। মৃদুলার কপালে চুমু খেয়ে, স্নেহতরল গলায় বলেছিল, এত রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে নেই। বাচ্চাটার কথা একটু ভাববি তো? চল মৃদুলার কাঁধটা হাতে জড়িয়ে নিয়ে বারান্দার আধাআধি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গিয়েছিল তরুলতা।

কোনও মানুষ যে চকিতে এতটা বদলে যেতে পারে, কে জানত। এই ফণা-তোলা সাপিনী, পরক্ষণে মমতাময়ী নারী। পৃথিবীর সেরা নাট্যসম্রাজ্ঞীও বোধ হয় এতটা পেরে উঠত না।

ঘরে আসতেই চোখে পড়েছিল, সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে অনির্বাণ শুয়ে আছে। চোখের তারা জ্বলে উঠেছিল মৃদুলার। জিগ্যেস করছিল, কোথায় গিয়েছিল?

মধ্যরাতে মৃদুলা কেন ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল তা জানাতে চায়নি অনির্বাণ। শুধু বলেছে, ছাদে গিয়েছিলাম

চাঁদ দেখতে?

সেদিন ছিল পূর্ণিমা। মহাশূন্য থেকে হলুদ বর্ণের গোলাকার চাঁদ নীচের পৃথিবীতে জ্যোৎস্না চেলে যাচ্ছিল অবিরাম। অপার্থিব আলোয় ভরে যাচ্ছিল কলকাতা নামে খানাখন্দে আবর্জনায় বোঝাই, ভাঙাচোরা, কুৎসিত এই মহানগর।

অনির্বাণ যে ডাহা মিথ্যে বলেছে, সেটা তার মুখচোখের চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছিল। মৃদুলা শ্লেষের সুরে বলেছিল, এক বছরের ওপর আমাদের বিয়ে হয়েছে। এর ভেতর কতবার পূর্ণিমা এসেছে। আগে কখনও চঁদ দেখতে ছাদে উঠেছ বলে তো মনে পড়ে না।

আগে উঠিনি বলে, কোনওদিন উঠব না, তার কি কোনও মানে আছে? আজ ইচ্ছে হয়েছিল তাই ছাদে গিয়েছিলাম।

হঠাৎ এই প্রকৃতিপ্রেম চাড়া দিয়ে উঠল যে? কারণটা কী?

কোনও কারণ নেই।

তীব্র, কটু গলায় মৃদুলা বলেছে, আছে, আছে। লায়ার–মিথ্যেবাদী।

আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। ভ্যাজর ভ্যাজর থামাও- বলে পাশ ফিরে শুয়েছিল অনির্বাণ।

অসহ্য ক্রোধে কপালের দুপাশের রগগুলো যেন ছিঁড়ে পড়বে। জ্বলন্ত চোখে অনির্বাণের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেছে মৃদুলা। এই পুরুষটির বেশিরভাগটাই দখল করে নিয়েছে এক কুহকময়ী নারী। তার ভাগে পড়েছে ছিটেফোঁটা। যার ষোল আনা প্রাপ্য সে কণিকা পরিমাণ নিয়ে খুশি থাকবে কেন?

মৃদুলা পরিষ্কার টের পাচ্ছিল, ওরা দুজনে বজ্জাতিটা চালিয়ে যাচ্ছে সঙ্গোপনে। সুকৌশলে। কিন্তু কিছুতেই ধরা যাচ্ছে না।

মৃদুলার মাথায় দুরন্ত এক জেদ চেপে গিয়েছিল। যেভাবে হোক, অনির্বাণকে তরুলতার মুঠি থেকে বার করে আনবে।

এসব শিঞ্জিনীর জানার কথা নয়। সে তখন মায়ের গর্ভে জ্বণের আকারে। জন্মের বহুকাল পরে সে যখন বেশ বড় হয়েছে, মৃদুলা ধারাবাহিক তাকে সমস্ত জানিয়েছিল।

সেই যে সেদিন মাঝরাতে অনির্বাণের খোঁজে মৃদুলা তরুলতার ঘরে হানা দেয়, তার মাস তিনেক বাদে সে মা-বাবার কাছে চলে এসেছিল। মেয়ের প্রথম সন্তান জন্ম নিতে চলেছে, তার যাবতীয় ব্যবস্থা করেছিলেন ইন্দ্রনাথ। বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে একটা ভালো নার্সিংহোম ঠিক করা হয়েছিল।

বাপের বাড়ি এসেছিল ঠিকই, কিন্তু তার মনটা পড়ে থাকত বেলগাছিয়ায়। সর্বক্ষণ উৎকণ্ঠা। তার সামনে প্রকাশ্যে অনির্বাণ আর তরুলতা নষ্টামি করত না। হয়তো চক্ষুলজ্জায়, হয়তো সাহসের অভাবে। এখন তো ওবাড়ি ওদের কাছে মুক্তাঞ্চল। যা ইচ্ছা করে বেড়াতে পারে। বাধা দেবার কেউ নেই। শাশুড়ি দেখেও দেখবেন না। শুনেও শুনবেন না। অন্ধ ও বধির হয়ে থাকবেন।

একেকবার মৃদুলার মনে হয়েছে, মা-বাবাকে সব খুলে বলে। পরক্ষণে তার অহংবোধে ধাক্কা লেগেছে। কী নেই তার? সৌন্দর্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যৌবন।একটি পুরুষকে মুগ্ধ করার মতো সমস্ত কিছু। এ যুদ্ধটা তারই। যা করার সে নিজেই করবে। এর ভেতর অন্য কাউকে টেনে আনবে না। কোনও ভাবেই নয়।

নার্সিংহোমে ভর্তির আগে এবং পরে অনির্বাণ আর তরুলতা মাঝে মাঝেই মৃদুলাকে দেখতে আসত। বেশিরভাগ সময় আলাদা আলাদা, কখনও কখনও একসঙ্গে। রত্নময়ীর যথেষ্ট বয়স হয়েছিল। তিনি বেশি আসতে পারতেন না।

অনির্বাণ আর তরুলতাকে একসঙ্গে দেখলে মাথায় আগুন ধরে যেত মৃদুলার, মুখ শক্ত হয়ে উঠত। ওদের সঙ্গে কথা বলত ঠিকই, তবে খুবই নীরস গলায়।

তার মনোভাব হয়তো বুঝতে পারত তরুলতা। কানের কাছে মুখ ঠেকিয়ে ফিসফিস করত, বোকা মেয়ে, অত ভাবিস কেন? তোর স্বামী তোরই আছে।

দাঁতে দাঁত চেপে মৃদুলা বলত, না, নেই।

হেসে হেসে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিতে চাইত তরুলতা, কী যে বলিস!

ঠিকই বলি। আর সেটা আপনি নিজেও ভালো করে জানেন।

তোর পাগলামিটা আর কাটল না। অকারণে কী যে সন্দেহ?

অহেতুক কি সে সন্দেহ?

অহেতুক?

চোখের তারায় নিষ্ঠুরতা ঝিলিক দিয়েই মিলিয়ে গেছে তরুলতার। খুব নরম গলায় বলেছে, নয়তো কী? আমার লঘুগুরু জ্ঞান নেই?

বিদ্রুপের সুরে মৃদুলা বলেছে, আছে বুঝি!

তরুলতা উত্তর দেয়নি।

মৃদুলা ভেবেছে, সে অনির্বাণের বৈধ স্ত্রী, তার সন্তানের জননী হতে চলেছে। তার জোর অনেক বেশি। শেষ দেখে তবে ছাড়বে। অন্য একটা চিন্তাও পাশাপাশি তার মাথায় ভর করত। একটা পোকায়-খাওয়া, দুশ্চরিত্র মানুষের জন্য শক্তিক্ষয় করার মানে হয় না। সঙ্গে সঙ্গে সেই গোঁ-টা তাকে পেয়ে বসত। একটা পুরুষকে সে জয় করে নিতে পারবে না?

.

শিঞ্জিনী শুনেছে তার জন্মটা মসৃণ নিয়মে হয়নি। মৃদুলার কী একটা শারীরিক সমস্যার কারণে দু-তিনটে বড় অপারেশন করতে হয়েছিল। স্বাভাবিক ডেলিভারি হলে যে সময় প্রসূতি আর বাচ্চাকে ছেড়ে দেবার কথা, তারও পর পঁচিশ-ছাব্বিশ দিন নার্সিং হোমে থাকতে হয়েছিল মৃদুলাকে।

ইন্দ্রনাথ তাকে বাড়িতে নিয়ে আসার পর পুরোপুরি সুস্থ হতে আরও অনেকদিন লেগেছে। এর মধ্যে যথারীতি তরুলতা আর অনির্বাণ তাকে এবং শিঞ্জিনীকে দেখতে এসেছে। রত্নময়ীও তিন-চার দিন নাতনিকে দেখে গেছেন।

হ্রদের ওপর দিকটা প্রশান্ত হলেও জলতলে প্রবল চোরা ঘূর্ণি থাকে। অনির্বাণদের দেখামাত্র নিজের মধ্যে তেমন কিছু তীব্রভাব অনুভব করত মৃদুলা।

শিঞ্জিনীর যখন সাত মাস বয়স, শ্বশুরবাড়ি ফিরে গিয়েছিল মৃদুলা। তার দিন সাতেকের মধ্যে সংসারে বড় রকমের একটা বিস্ফোরণ ঘটাল সে।

মৃদুলা আগেই লক্ষ্য করেছে, প্রতিবেশীদের সঙ্গে অনির্বাণদের কোনওরকম মাখামাখি ছিল না। মাখামাখি দূরের কথা, কেউ তাদের বাড়ি আসত না, তারাও কারও বাড়ি যেত না। তবে ঝগড়াঝাটি ছিল না। উদাসীনভাবে পরস্পরকে তারা এড়িয়ে চলত।

আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সম্পর্কটা কেমন যেন আলগা আলগা। কারও বাড়িতে কোনও কাজ থাকলে–বিয়ে, শ্রাদ্ধ, মুখেভাত-~~কেউ এসে নেমন্তন্ন করে যেত। ব্যস, এই পর্যন্ত। বেশির ভাগ জায়গায় অনির্বাণরা যেত না। কাউকে দিয়ে উপহার পাঠিয়ে দিত।

সেদিন মধ্যমগ্রামে অনির্বাণের এক মামাতো ভাইয়ের বিয়ে। সম্পর্কটা খুব কাছের। না গিয়ে উপায় নেই। অনির্বাণ রত্নময়ী আর মৃদুলাকে নিয়ে একটা গাড়ি ভাড়া নিয়ে বিয়েবাড়ি গিয়েছিল। তরুলতাকে বারবার বলা সত্ত্বেও যায়নি। শিঞ্জিনীকে নিয়ে বাড়িতেই থেকে গিয়েছিল। আত্মীয়-পরিজনের বাড়িতে রত্নময়ী আর অনির্বাণ কদাচিৎ গেলেও তরুলতা কখনও যেত না।

বিয়েবাড়িতে গিয়ে একটা ব্যাপার নজরে পড়েছে মৃদুলার। আত্মীয়দের অনেকেই, বিশেষ করে মহিলারা তাকে লক্ষ্য করছিল। তাদের দৃষ্টিতে এমন কিছু ছিল যাতে সে আদৌ স্বস্তি বোধ করছিল না।

এদিকে রত্নময়ী মৃদুলার কাছছাড়া হচ্ছিলেন না। প্রায় তার গায়ে গা ঠেকিয়ে বসে ছিলেন। এবং সারাক্ষণ তাকে আগলে আগলে রাখছিলেন। কেউ তাকে কিছু জিগ্যেস করলে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ছিলেন। মৃদুলাকে মুখ খুলতেই দিচ্ছিলেন না। নিজেই সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলেন। শাশুড়ির এই আচরণ খুবই দৃষ্টিকটু লেগেছে মৃদুলার। অত্যন্ত অস্বাভাবিকও।

একসময় কে যেন রত্নময়ীকে অন্য একটা ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। মৃদুলাকে একা রেখে যাবার ইচ্ছা একেবারেই ছিল না তার। কিন্তু বিষয়টা এমন জরুরি যে না গিয়েও উপায় ছিল না।

যে ঘরে মৃদুলা আর রত্নময়ীকে বসানো হয়েছিল সেটা প্রমীলা রাজ্য। শুধু মহিলা আর মহিলা। হাসি-ঠাট্টা-গল্পে তারা আসর জমিয়ে রেখেছিল। বিয়েবাড়িতে যেমন হয় আর কী। এরা সবাই অনির্বাণদের আত্মীয়। এখানে এসেই তাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে মৃদুলার। হয়তো তার বৌভাতে এরা গিয়েও ছিল। সেই কবে অল্পক্ষণের জন্য এদের দেখেছে। যাতায়াত না থাকায় তাদের মুখ ভুলেও গিয়েছিল।

রত্নময়ী চলে যাবার পর হঠাৎ একটি মহিলা–বেশ সুন্দরী, চল্লিশের কাছাকাছি বয়স, মেদহীন ছিপছিপে চেহারা, হাতে গোছ গোছ সোনার চুড়ি, গলায় হীরের নেকলেস, কপালে মস্ত সিঁদুরের টিপ, নাম লতিকা উঠে এসে মৃদুলার পাশে ঘন হয়ে বসেছিল। খানিক আগেই তার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। সম্পর্কে অনির্বাণের কীরকম বৌদি। কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করে সে বলেছে, রত্নময়ী মাসি তোমাকে পাহারা দিচ্ছিলেন, তাই ভালো করে কথা বলতে পারিনি। তুমি দেখতে এত সুন্দর। শুনেছি, খুবই শিক্ষিত। মা-বাবার একমাত্র সন্তান। কলকাতায় বাড়ি আছে। বাবার টাকা-পয়সার অভাব নেই। দেশে তোমার মতো মেয়ের জন্য কোনও সৎ পাত্র পাওয়া যাচ্ছিল না? তোমার বাবা ভালো করে খোঁজখবর না নিয়েই বিয়েটা দিয়ে দিলেন।

লতিকা কী ইঙ্গিত দিয়েছে, বুঝতে অসুবিধা হয়নি। তবু চকিত হয়ে উঠেছে মৃদুলা মানে!

লতিকা বলেছিল, অনির্বাণের কথা বলছি। তরুলতার সঙ্গে ওর সম্পর্কটা কী, টের পাওনি? জঘন্য, নোংরা মেয়েমানুষ। ওর জন্যে অনির্বাণের দাদা সুকুমার বাসের নীচে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে। রত্নময়ী মাসিরা অবশ্য অ্যাকসিডেন্টও বলে চালায়। একটু চুপ করে থেকে তীব্র, চাপা গলায় বলেছে, অ্যাকসিডেন্টও নয়, আত্মহত্যাও নয়। ওটা খুন। সুকুমার ছিল সরল, ভালোমানুষ। তরুলতা আর অনির্বাণ ওর ওপর এমন মানসিক নির্যাতন শুরু করেছিল যে শেষ পর্যন্ত চরম পথটাই বেছে নিয়েছে। সুকুমারের জন্যে এত কষ্ট হয় যে বলে বোঝাতে পারব না।

সুকুমারের মৃত্যুরহস্য এতদিনে পরিষ্কার হয়েছিল। মৃদুলা জিগ্যেস করেছে, সুকুমারদা আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত তো একদিনে নেননি। দিনের পর দিন নিজের স্ত্রী আর ভাইয়ের আচরণে কষ্ট পেতে পেতে তবেই না ভেবেছিলেন বেঁচে থাকার অর্থ নেই।

নিশ্চয়ই।

আত্মহত্যা, বা অ্যাকসিডেন্ট বা খুন, যাই হোক না, আমার শাশুড়ি কি তার কারণটা বুঝতে পারেননি? তা হলে মুখ বুজে ছোট ছেলে আর বড় বউর কুকীর্তি সহ্য করে গেছেন কেন?

আমার কাছে এ প্রশ্নের উত্তর নেই। মনে হয়, রত্নময়ী মাসি তরুলতাকে ভীষণ ভয় পায়।

একটু নীরবতা।

তারপর লতিকা বলেছে, নিশ্চয়ই অনির্বাণ আর তরুলতার নানা ব্যাপার তোমার চোখে পড়েছে। ব্যাপার বলতে কী বোঝাতে চাইছি, আশা করি বুঝতে পারছ।

অবশ্যই বুঝতে পেরেছে মৃদুলা। লতিকা ঠিক কী বলতে চায়, শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিল সে।

লতিকা এবার বলেছে, এমন একটা জঘন্য মেয়েমানুষের সঙ্গে এক বাড়িতে আছ কী করে? ও যে ধরনের নোংরা চরিত্রের মহিলা তাতে একদিন তোমার অবস্থা ঠিক সুকুমারের মতো করে ছাড়বে। যে করে থোক, ওকে তোমাদের বাড়ি থেকে তাড়াও। পারলে

এই সময় রত্নময়ী ফিরে এসেছিলেন। লতিকা আর এক মুহূর্তও বসে থাকেনি। ঝটিতি উঠে গিয়ে খানিক দূরে অন্য মহিলাদের জটলায় মিশে গিয়েছিল।

কপাল কুঁচকে সন্দিগ্ধ চোখে কয়েক পলক লতিকার দিকে তাকিয়ে থেকেছেন রত্নময়ী। তবে লতিকা সম্পর্কে সেই মুহূর্তে মৃদুলাকে কোনও প্রশ্ন করেননি।

লতিকা উঠে যাবার আগে মৃদুলার মাথায় কোনও বারুদের স্তূপে আগুন ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ আগেই সে জেনেছে, সুকুমারের জীবনটা অনির্বাণ আর তরুলতা নষ্ট করে দিয়েছে। তাকেও তিল তিল করে ধ্বংস করে দিচ্ছে। মৃদুলা তখনই মনস্থির করে ফেলেছিল, কোনওভাবেই আর বরদাস্ত করবে না।

বিয়েবাড়ি থেকে বেড়া আগুনের ভেতর দিয়ে পুড়তে পুড়তে যখন রত্নময়ীদের সঙ্গে ফিরে এসেছিল, তখন মাঝরাত পার হয়ে গেছে। ফিরেই তরুলতার দিকে তোপ দাগতে শুরু করেছিল, এ-বাড়িতে আপনার আর জায়গা হবে না। কাল সকালে উঠেই চলে যাবেন।

মৃদুলা তখন অগ্নিমুর্তি। তাকে এমন চেহারায় আগে কখনও দেখেনি তরুলতারা। তারা ভয় পেয়ে গিয়েছিল।

তরুলতা তোতলাতে তোতলাতে বলেছে, কী-কী বলছ তুমি! এর–এর মানে কী?

প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে নিয়ে অনির্বাণ আর রত্নময়ী পালটা আক্রমণের জন্য ততক্ষণে নিজেদের প্রস্তুত করে নিয়েছেন।

রত্নময়ীর মাথায় খুন চলে গিয়েছিল, এত সাহস তোমার! বড় বৌমাকে তাড়াতে চাইছ! যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা! মাথা নীচু করে যদি থাকতে হয় তো এ বাড়িতে থাকবে। নইলে দরজা খোলা আছে। চিৎকার করতে করতে তাঁর গলার স্বর চিরে বিকৃত হয়ে যাচ্ছিল, ওর সম্বন্ধে তোমার কানে বিষ ঢালল কে? নিশ্চয়ই লতিকা?

বিয়েবাড়িতে লতিকাকে তার পাশে দেখে কিছু একটা সন্দেহ যে রত্নময়ী করেছেন, তখনই আন্দাজ করা গিয়েছিল। একবার কামানের গোলা ছোঁড়া হয়ে গেছে। আর পিছু হটার উপায় নেই। গলার স্বর আরও চড়িয়ে মৃদুলা বলেছে, অন্যের বিষ ঢালতে হবে কেন? জানেন না, আপনার বড় বৌমাটি কত বড় বদমাশ, দুশ্চরিত্র। নিজের স্বামীকে তো শেষ করেছেই—

বাধা দিয়ে অনির্বাণ গর্জে উঠেছে, বৌদি সম্পর্কে আর একটা বাজে কথা বললে তোমাকে এক্ষুনি ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বার করে দেব।

মৃদুলা খুব ঠান্ডা গলায় বলেছে, তোমার এত ক্ষমতা!

হ্যাঁ, হ্যাঁ। এটা আমাদের বাড়ি। যখন–।

তোমাদের বাড়ি! মানে তোমার আর ওই বজ্জাত মেয়েমানুষটার।

বিদ্রুপে মুখ কুঁচকে গেছে মৃদুলার। গলার স্বর শাণিত করে, টেনে টেনে এবার সে বলেছে, তোমাদের কীর্তির কথা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কারও জানতে বাকি নেই। ধরো, কাল পাড়ার লোজন আর তোমার আত্মীয়দের ডাকিয়ে আনলাম। বিয়ের পর যা আমার চোখে পড়েছে, দিনের পর দিন যেভাবে মানসিক টরচার সহ্য করেছি- সব তাদের বললাম। তারপর জিগ্যেস করলাম, এই নোংরা ব্যাপারগুলোর প্রতিবাদ করেছি বলে তুমি আমাকে বাড়ি থেকে বার করে দিতে চাইছ। তাদের জিগ্যেস করব, আপনারা কী বলেন?

রত্নময়ীদের মুখ ছাইবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। মৃদুলাকে থামিয়ে দিয়ে ত্রস্ত সুরে অনির্বাণ বলেছে, সত্যিই তুমি ওদের ডাকবে নাকি?

তার কথা কানেই তোলেনি মৃদুলা। একটানা সে বলে যাচ্ছিল, তারপর ধরো, একদিন তোমার অফিসে গিয়ে তোমাদের জেনারেল ম্যানেজার, ডাইরেক্টরস বোর্ডের মেম্বার আর কলিগদের সঙ্গে দেখা করে তোমাদের গুণকীর্তন করলাম

বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল অনির্বাণকে। কাঁপা গলায় সে জিগ্যেস করেছে, আমাদের অফিসেও যাবে?

মৃদুলা বলেছে, কী মনে হয় তোমার? বাড়ি থেকে যখন বার করে দিতে চাইছ, আর মুখ বুজে আমি যদি তোমার এই হুকুমটা তামিলই করি, লোকে কী বলবে? ভাববে দোষটা আমার। যাবার আগে সবার সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া দরকার কিনা, তুমিই বলো

বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থেকেছে অনির্বাণ। কী উত্তর দেবে, ভেবে পায়নি।

মৃদুলা এবার তরুলতা আর রত্নময়ীর দিকে তাকিয়েছে, আমি এতক্ষণ যা বললাম সেটা ঠিক না? আপনারা কী করতে বলেন?

দুই রমণী একেবারে বোবা হয়ে গিয়েছিল।

মাথাটা আস্তে আস্তে ডাইনে-বাঁয়ে নাড়তে নাড়তে মৃদুলা এবার বলেছে, আমি কারও কাছেই যাচ্ছি না। একটা কথা পরিষ্কার করে আপনাদের বুঝিয়ে দিতে চাই। আমি কিন্তু সুকুমার দত্তের মতো দুর্বল নই। কোনওদিন গাড়ির তলায় লাফ দিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করতে পারব না। লোকজন জুটিয়ে সিন ক্রিয়েটও করব না। কারও সাহায্যেরও আমার দরকার নেই। যা করার আমি নিজেই করব।

বড় হবার পর এই ব্যাপারটা নিয়ে শিঞ্জিনীর সঙ্গে মৃদুলার অনেকবার কথা হয়েছে। উত্তেজিত শিঞ্জিনীর একটাই প্রশ্ন বা অভিযোগ। কেন মা তার বাপের বাড়ি ফিরে আসেনি? ওই রকম একটা কদর্য পরিবেশে একটা বদ, নোংরা লোকের সঙ্গে কেন অনেক আগেই সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলেনি?

মৃদুলা মেয়েকে প্রতিবারই এক উত্তর দিয়ে গেছে। অনিবার্ণকে ভালোবেসে সে শ্বশুরবাড়িতে পড়ে থাকেনি। এটা হল অহংবোধ এবং অধিকারের প্রশ্ন। একটা নষ্ট মেয়েমানুষ তার নিজস্ব পুরুষটিকে ছিনিয়ে নেবে, সেটা মেনে নেওয়া অসম্ভব। তাই বেলগাছিয়াতেই থেকে নিদারুণ শক্তি পরীক্ষায় নেমেছিল সে।

বিয়েবাড়ি থেকে ফিরে সেদিন মৃদুলা যে বিস্ফোরণটা ঘটিয়েছিল তার ফল কিন্তু হাতেনাতেই ফলেছিল। পরদিন পাতিপুকুরে বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিল তরুলতা। মৃদুলা শুনেছে, সেখানে তার শয্যাশায়ী বৃদ্ধা মা আর তাকে দেখাশোনার জন্য দু-তিনটে কাজের লোক ছাড়াও দূরসম্পর্কের এক পিসি ছিল। পিসি বিধবা। জগৎ-সংসারে তার কেউ নেই। তরুলতাদের বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও যাবার জায়গা ছিল না তার। টাকা-পয়সার অভাব অবশ্য ছিল না। মৃত্যুর আগে তরুলতার বাবা ব্যাঙ্কে প্রচুর রেখে গেছেন। সেখান থেকে যথেষ্ট ইন্টারেস্ট পওয়া যেত।

যাবার আগে তরুলতা বলেছিল, আমি চললাম। এবার শান্তিতে থাকতে পারবি তো?

তরুলতা কী ইঙ্গিত দিয়েছিল, তখন বুঝতে পারেনি মৃদুলা। আশ্চর্য, অত কাণ্ডের পরেও দিন কুড়ি-বাইশ বাদে পাতিপুকুর থেকে ফিরে এল সে। মৃদুলার একটা হাত ধরে অনুনয়ের সুরে বলেছিল, রূপাটার জন্যে মন ভীষণ খারাপ লাগছিল। তাই চলে এলাম। রাগ করিস না– শিঞ্জিনীর ডাকনাম রূপা তারই দেওয়া।

কয়েকটা দিন মোটামুটি ভালোই কাটল। তারপর সেই আগের মতোই লুকিয়ে-চুরিয়ে নষ্টামি শুরু হল। মেয়েমানুষ একবার খারাপ হয়ে গেলে তার স্বভাব কি সহজে শোধরায়? শিঞ্জিনীর টানে তরুলতা বেলগাছিয়ায় এসেছে, পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি মৃদুলা। ওদের নজরে নজরে রেখেছিল। একদিন ধরেও ফেলেছে দুজনকে। তারপর ফের অশান্তি। আবার তরুলতাকে পাতিপুকুরে পাঠিয়ে দিয়েছে মৃদুলা। কিন্তু দু-চার মাস পর আবার সে ফিরে এসেছে।

পাতিপুকুর আর বেলগাছিয়া, এই করেই কবছর কাটিয়ে দিয়েছে তরুলতা। অনিবার্ণকে অনেক বুঝিয়েছে মৃদুলা, একটা নষ্ট মেয়েমানুষের দখল থেকে তাকে বার করে আনতে শতভাবে চেষ্টা করেছে। কিন্তু কিছুতেই সম্ভব হয়নি।

হঠাৎ মৃদুলা জানতে পারল, তরুলতা যখন পাতিপুকুরে থাকে সেই সময় মাঝে মাঝেই অফিসে যাবার ছুতো করে সেখানে চলে যায় অনির্বাণ। ওর যা কাজ তাতে কয়েক মাস পর পর দু-চার দিনের জন্য দিল্লি, চেন্নাই কি হায়দ্রাবাদে টুরে যেতে হয়। অফিস থেকেই পাঠায়। অনেক সময় এই সব ট্যুরে তরুলতাকে গোপনে সঙ্গে নিয়ে যায় সে। তরুলতার অথর্ব পঙ্গু মায়ের সাধ্য নেই তাদের ঠেকান। এই খবরগুলো পাওয়ার পরই মৃদুলা মনস্থির করে ফেলে। মেয়েকে নিয়ে সোজা চলে আসে মা-বাবার কাছে।

তারপর আইন-আদালত। ডিভোর্সের মামলা। একমাত্র মেয়ের বিবাহিত জীবনের এমন শোকাবহ পরিণামের ধাক্কাটা সামলাতে পারেননি অন্নপূর্ণা। আগেই নানা রোগে শরীর ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল। মৃদুলা পাকাপাকি তাদের কাছে চলে আসার চার মাসের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়।

ইন্দ্রনাথের শরীর-স্বাস্থ্যের হাল ভালো ছিল না। অসুখে-বিসুখে তিনিও যথেষ্ট কাহিল। কিন্তু মনের জোর ছিল প্রচণ্ড। মামলার সময় সর্বক্ষণ মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে সাহস যুগিয়েছেন। নিজের সঞ্চয় ভেঙে জলের মতো টাকা খরচ করেছেন।

ডিভোর্সের কেসটা প্রায় একতরফাই হয়েছিল। পাছে জেরার মুখে পারিবারিক কেচ্ছা-কেলেঙ্কারির পচা দুর্গন্ধ বেরিয়ে পড়ে তাই অনিবার্ণরা কোর্টে কদাচিৎ এসেছে। তবে শিঞ্জিনীকে ওরা সহজে ছাড়তে চায়নি। তাকে পাওয়ার জন্য তিন বছর মামলা চালিয়ে গেছে। বেলগাছিয়ার পরিবেশটা কেমন সবিস্তারে কোর্টকে জানিয়ে মৃদুলার আর্জি ছিল, ওখানে থাকলে মেয়ের সর্বনাশ হয়ে যাবে। শিঞ্জিনীর জীবন যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য মৃদুলার কাছেই তার থাকা দরকার। আদালত তার পক্ষই রায় দিয়েছিল। তবে ইচ্ছা করলে অনির্বাণ সপ্তাহে একদিন মেয়েকে তার দাদামশাইয়ের বাড়িতে গিয়ে দেখে আসতে পারে।

অনির্বাণ কিন্তু কোনওদিনই প্রাক্তন শ্বশুরবাড়িতে মেয়েকে দেখতে আসেনি। প্রথম দিকে বছরখানেক মাঝে মাঝে ফোন করত। তারপর কবেই তা বন্ধ হয়ে গেছে।

বিয়ের আগেই এম.এটা পাশ করেছিল মৃদুলা। মামলা-টামলা চুকে যাবার পর কম্পিউটারের কী একটা ট্রেনিং নিয়ে বিরাট ট্রান্সপোর্ট কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছে সে। ইচ্ছা করলে অনেক আগেই ফের বিয়ে করতে পারত কিন্তু অনির্বাণের সঙ্গে কটা বছর কাটিয়ে পুরুষ সম্পর্কে তার শ্রদ্ধা, বিশ্বাস সব নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় বার বিয়ের কথা সে ভাবতেও পারত না। শিঞ্জিনীই ছিল তার সর্বস্ব।

যে মৃদুলা মেয়েকে পাওয়ার জন্য কটা বছর দাঁতে দাঁত চেপে অবিরল যুদ্ধ করে গেছে, পুরুষ জাতিকে যে চরম ঘৃণা করে, আজ তার মুখে বিমলেশ বসুমল্লিকের নাম শোনা গেল। বিদ্বেষ নয়, অশ্রদ্ধা নয়, অচেনা শিল্পপতিটি সম্পর্কে তার প্রতিটি কথা থেকে বেরিয়ে আসছিল চাপা উচ্ছ্বাস। নাকি স্তুতি?…

….জানালার বাইরে বৃষ্টি ঝরেই চলেছে। আজ রাতে থামবে বলে মনে হয় না। মেঘ ডাকার বিরাম নেই। কাছে-দূরে সমানে বাজ পড়ছে।

শিঞ্জিনীর খেয়াল হল, তার দুচোখ জলে ভরে গেছে।

 ২. কোচিং ক্লাসে

০৬.

স্কুল ছুটির পর সপ্তাহে তিন দিন কোচিং ক্লাসে যায় শিঞ্জিনী। একদিন দেবারতি মিসের বাড়ি, বাকি দুদিন অন্য দুজায়গায়। হায়ার সেকেন্ডারির যে বিশাল কোর্স তাতে ভালো রেজাল্ট করতে হলে প্রাইভেট টিউশন ছাড়া গতি নেই। এই তিন দিন বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যায় তার। কোচিং ক্লাসের ব্যাপারটা ইন্দ্রনাথের জানা। তাই এই কটা দিন নাতনী দেরিতে ফিরলে তার দুশ্চিন্তা হয় না।

শিঞ্জিনীর সঙ্গে স্বর্ণালীও ওই তিনটে কোচিং ক্লাসে পড়তে যায়। ইচ্ছা করলে ওর বাবা বাড়িতে পড়িয়ে যাবার জন্য কয়েক গণ্ডা টিউটর রাখতে পারেন। কিন্তু তিনি চান তার মেয়েরা অন্য দশটা সাধারণ ফ্যামিলির মেয়েদের মতো একটু কষ্ট করে মানুষ তোক।

আজ দেবারতি মিসের ক্লাস। স্কুল ছুটির পর শিঞ্জিনী আর স্বর্ণালী ছুটতে ছুটতে বড় রাস্তায় চলে এসেছিল। এখন চারটে বেজে পঁচিশ। পাঁচটায় দেবারতি মিসের ক্লাসে তাদের পৌঁছুতেই হবে। তিনি ইংরেজি পড়ান। কঁটায় কাঁটায় পাঁচটা থেকে সাড়ে ছটা। তারপর অন্য ব্যাচ পড়তে আসবে।

দেবারতি মিস একটা বিখ্যাত মিশনারি স্কুলে সিনিয়র টিচার ছিলেন। কিন্তু সারাদিন বাড়িতে ব্যাচের পর ব্যাচ হায়ার সেকেন্ডারির ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে স্কুলে যাবার সময় পেতেন না। তাই বছর দুই হল চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। নটা বাজতে না বাজতে এখন নাকেমুখে গুঁজে বাস কি ট্যাক্সি ধরতে হয় না। দশটায় স্কুলে হাজিরা দেবার হাঙ্গামা নেই। নিজের ফ্ল্যাটে বসে পড়িয়ে গেলেই হল। ফাঁকে ফাঁকে স্নান, খাওয়া, রেস্ট। তাছাড়া, স্কুল থেকে যা মাইনে পেতেন, প্রাইভেট টিউশন করে এখন তার পাঁচগুণ রোজগার। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, সময়কে তিনি নিজের ইচ্ছামতো কাজে লাগাতে পারেন।

খুব ছোট্ট পরিবার ওঁদের। দেবারতি মিস আর একমাত্র ছেলে রজত। রজত শিবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। খুব সম্ভব, থার্ড ইয়ারে। ওখানেই হোস্টেলে থাকে। ছুটিতে মায়ের কাছে আসে।

দেবারতি মিস দারুণ পড়ান। এমন তৈরি করে দেন যে হায়ার সেকেন্ডারির ছেলেমেয়েরা চোখ বুজে এইটি-এইটি ফাইভ পারসেন্ট মার্কস পেয়ে যায়। যে দেড় ঘণ্টা তিনি ক্লাস নেন তার মধ্যে এতটুকু ফাঁকি নেই। বাজে গল্প করে সময় নষ্ট করা নেই। পৌঁছুতে পাঁচ-দশ মিনিট দেরি হলে নিজেদেরই ক্ষতি। তাই শিঞ্জিনীদের এমন তাড়াহুড়ো, এমন ঊর্ধ্বশ্বাস দৌড়।

দেবারতি মিসেস ফ্ল্যাট শিঞ্জিনীদের স্কুল থেকে অনেকটা দূরে। বাসে কি অটোয় যেতে হয়। বাস থেমে থেমে, লোক তুলতে তুলতে যায়। তাই সময় বেশি লাগে। তাই ওরা অটোই ধরে।

ছুটির পর ভীষণ খিদে পায়। কিন্তু ফাস্ট ফুড মিষ্টির দোকানে খেতে গেলে কম করে পনেরো-কুড়ি মিনিট লাগবে। সময় বাঁচাবার জন্য শিঞ্জিনী আর স্বর্ণালী প্যাটিস কি কেক-টেক কিনে অটোয় বসে খেতে খেতে যায়।

দেবারতি মিসদের বাড়িটা এগারোতলা বিশাল এক হাইরাইজ। নাম আকাশ দীপ। বাড়িটার তিনতলায় ওঁদের তিন কামরার মস্ত ফ্ল্যাট।

আকাশ দীপ-এর সামনে অটো থেকে শিঞ্জিনীরা যখন নামল, পাঁচটা বাজতে তখনও দশ মিনিট বাকি। ভাড়া মিটিয়ে বাড়িটার দিকে পা বাড়াতে যাচ্ছে, স্বর্ণালী চাপা গলায় বলল, ওপর দিকে তাকিয়ে দ্যাখ

আগেই লক্ষ্য করেছিল শিঞ্জিনী। দেবারতি মিসদের রাস্তায় দিকের চওড়া ব্যালকনিতে রজত দাঁড়িয়ে আছে। কিছুদিন ধরেই তার চোখে পড়ছে, যেদিন এখানে সে পড়তে আসে, রজতকে ওই ব্যালকনিটায় দেখা যায়। প্রতি সপ্তাহে না হলেও, প্রায়ই। এখন ওদের কলেজ পুরোদমে চলছে। কোনওরকম ছুটি-ছাটা নেই। নিশ্চয়ই কিছু একটা ছুতো তৈরি করে শিবপুর থেকে চলে আসে। দেবারতি মিসকে হুটহাট চলে আসার কী কারণ দেখায়, শিঞ্জিনী জানে না। হয়তো মায়ের ধারণা, তাঁকে বেশিদিন না দেখলে ছেলের মন খারাপ হয়ে যায়, তাই না এসে পারে না। কিন্তু তার বাড়ি আসার কেন এত গরজ, আকর্ষণটা কোথায়, শিঞ্জিনী তা খুব ভালো করেই জানে। আর জানে স্বর্ণালী।

দেড় বছর দেবারতি মিসের কাছে পড়ছে শিঞ্জিনী। প্রথম যেদিন রজত তাকে দেখে তখন থেকেই মুগ্ধ হয়ে আছে। ঘোরটা কিছুতেই আর কাটছে না। আগে আগে দূর থেকেই তাকিয়ে থাকত। পরে সাহস বাড়ছিল। দেবারতি মিসের ক্লাস শেষ হলে রাস্তায় তার সঙ্গে দেখা করত। এমনিতে খুব ভদ্র, মার্জিত। স্বর্ণালীর সামনেই সাধারণ দু-একটা কথা হত। পড়াশোনা কীরকম চলছে, হায়ার সেকেন্ডারির পর কোন সাবজেক্টে অনার্স নেবে, বাড়িতে কে কে আছে, ইত্যাদি। আপত্তিকর একটি শব্দও রজতের মুখ থেকে বেরুত না। কথাবার্তা এবং আচরণ কখনও শালীনতার সীমা ছাড়া না।

সপ্তাহ তিনেক আগে স্বর্ণালীর সামনেই একটা মুখ-আঁটা সাদা খাম তাকে দিয়ে রজত বলেছিল, এটা বাড়িতে গিয়ে পড়ো। যা লিখেছি তোমার বন্ধু স্বর্ণালীকেও জানাতে পারো।

সতেরো-পেরুনো এক তরুণীর কাছে এক ঝকঝকে অনাত্মীয় যুবকের প্রথম চিঠি। হৃৎস্পন্দন কয়েক মুহূর্তের জন্য শতগুণ বেড়ে গিয়েছিল শিঞ্জিনীর। তারপর চিঠিটা বইয়ের ব্যাগে পুরে খুব স্বাভাবিক গলায় বলেছিল, আপনি কী লিখেছেন, বুঝতে পারছি। তবু পড়ব, বন্ধুকেও পড়াব।

এই সময় অটো এসে গিয়েছিল। শিঞ্জিনীরা আর দাঁড়ায়নি, চটপট উঠে পড়েছিল।

যা ভাবা গিয়েছিল তা-ই। রজতের চিঠিটা নিছকই প্রেমপত্র। উচ্ছ্বাস আবেগ প্রতিটি লাইন থেকে যেন গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছিল।

চিঠিটা স্বর্ণালীকেও পড়িয়েছে শিঞ্জিনী। সে খুশিই হয়েছিল, দেবারতি মিসের ছেলে। দারুণ স্টুডেন্ট। তোকে তো চিনি। যা মাথা গরম! না বলে দিস না।

শিঞ্জিনী উত্তর দেয়নি। জীবনে প্রথম যে পুরুষটিকে সে দেখে সে অনির্বাণ। এই নোংরা, জঘন্য লোকটা মৃদুলার মতো তার মনেও পুরুষদের সম্পর্কে চিরস্থায়ী ঘৃণা আর সন্দেহ সৃষ্টি করে রেখেছে। এর বাইরে বেরিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব।

স্বর্ণালী সেই চিঠির ব্যাপারে আরও অনেকবার জানতে চেয়েছে, কী রে, কী করবি?

শিঞ্জিনীর জবাব খুবই সংক্ষিপ্ত, দেখি–

সেই যে রজত চিঠি দিয়েছিল, তারপর মাঝখানে দুসপ্তাহ শিবপুর থেকে আসেনি। আজ আবার তাকে দেখা গেল।

বন্ধুর হাতে আঙুলের আলতো খোঁচা দিয়ে স্বর্ণালী বলল, ওপরে তাকা একবার।

তাকাবার কিছু নেই। শিঞ্জিনী বলল, রজত দাঁড়িয়ে আছে তো?

ও বাবা, এর মধ্যে দেখা হয়ে গেছে!

শিঞ্জিনী উত্তর দিল না।

স্বর্ণালী বলল, কীরকম চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে দ্যাখ—

শিঞ্জিনী বলল, থাক তাকিয়ে। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে না থেকে এখন চল তো–

আকাশ দীপ-এর বিশাল গেটের দিকে দুজনে পা বাড়িয়ে দেয়। এ-বাড়ির সিকিউরিটির ভীষণ কড়াকড়ি। মস্ত গোবদা একখানা খাতায় খোপ-কাটা ঘরে ভিজিটরদের নাম, ঠিকানা, কার সঙ্গে দেখা করবে, ইত্যাদি লিখতে হয়। কিন্তু শিঞ্জিনীরা দেড় বছর এখানে আসছে। সিকিউরিটি গার্ডরা সবাই তাদের চেনে। ওদের বেলা নিয়মটা শিথিল। ভিজিটরস বুকে কিছুই লিখতে হয় না।

যে মাঝবয়সি ইউনিফর্ম-পরা লোকটা খাতা-কলম নিয়ে গেটের কাছাকাছি বসে আছে, শিঞ্জিনীদের দেখে সে একটু হাসল। শিঞ্জিনীরাও হেসে তার পাশ দিয়ে সিঁড়ির দিকে চলে গেল। একজোড়া লিফট আছে। কিন্তু সে দুটো সদাব্যস্ত। সারাক্ষণ ওঠা-নামা করছে। হয়তো গ্রাউন্ড ফ্লোরে নামছিল, হঠাৎ ওপরে উঠে গেল। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা না করলে চড়া যায় না।

শিঞ্জিনীরা কোনওদিনই লিফটে করে ওপরে যায় না। তিনটে তো মোটে ফ্লোর। টকাটক সিঁড়ি দিয়ে উঠে যায়।

সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে স্বর্ণালী বলল, আজ তোকে নিশ্চয়ই ধরবে।

শিঞ্জিনী আস্তে মাথা নাড়ে, হ্যাঁ। শুধু শুধু কি আর শিবপুর থেকে চলে এসেছে?

চিঠিতে যা লিখেছে তার কী উত্তর দিবি?

কিছু তো একটা দিতেই হবে। দেখা যাক—

একসময় ওরা তেতলায় পৌঁছে গেল।

.

শিঞ্জিনীরা ছাড়াও লোরেটো, গোখেল আর সাউথ পয়েন্টের আরও তিনটি মেয়ে এই ব্যাচটায় রয়েছে। সাড়ে ছটায় ছুটির পর পাঁচজন বিল্ডিংয়ের বাইরে চলে আসে। শিঞ্জিনী আর স্বর্ণালী রাস্তার ওপারে চলে যায়। ওদিক থেকেই তাদের অটো বা মিনিবাস ধরতে হবে। অন্য তিনজন যাবে উলটো দিকে। তারা এধারের ফুটপাতে বাস-টাসের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।

যতই উদাসীন থাকতে চেষ্টা করুক, ভেতরে ভেতরে স্নায়ুগুলো কিন্তু টান টান হয়েই আছে। নিজের অজান্তেই চোরা দৃষ্টিতে এধারে-ওধারে তাকাল শিঞ্জিনী। যা ভাবা গিয়েছিল, তা-ই। ডান পাশে, খানিক দূরে একটা প্রাইভেট টেলিফোন বুথ। সেটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রজত আর হাত নেড়ে নেড়ে ইশারায় ওখানে যেতে বলছে।

স্বর্ণালীও রজতকে লক্ষ্য করেছিল। বলল, চল, ডাকছে

শিঞ্জিনী আপত্তি করল না। নীরবে স্বর্ণালীকে নিয়ে রজতের কাছে চলে এল।

রজত বলল, কোথাও বসে কথা বলতে পারলে ভালো হয়। ওখানে একটা রেস্তোরাঁ আছে। চলো– রাস্তাটা যেখানে মোড় ঘুরে বাঁয়ে বেঁকে গেছে, সেদিকে আঙুল বাড়িয়ে দিল সে।

শিঞ্জিনী বলে, না। সম্ভব নয় বলেই মনে হল, কথাটা বেশ রূঢ়ই হয়ে গেছে। পরক্ষণে সুর নরম করে বলল, এখন রেস্তোরাঁয় গেলে বাড়ি ফিরতে দেরি হবে। আমার দাদু ভীষণ চিন্তা করবেন।

.

প্রথমটা খতিয়ে গিয়েছিল রজত। শিঞ্জিনীদের রেস্তোরাঁয় না যাবার কারণটা এবার যুক্তিসঙ্গত মনে হল। সে বলল, তা হলে

যা বলার এখানেই বলুন।

এই রাস্তায়!

শিঞ্জিনী জবাব দিল না।

রজত বলে, ঠিক আছে। অনেকে আমাদের লক্ষ্য করছে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবে না। চলো, হাঁটতে হাঁটতে বলা যাক। স্বর্ণালীকে বলল, আমরা একটু আগে আগে হাঁটছি। তুমি পেছন পেছন এসো স্বর্ণালীর সামনে সে কথাটা বলতে চায় না।

ফুটপাত ধরে শিঞ্জিনী আর রজত পাশাপাশি ওধারের মোড়ের দিকে চলেছে ধীর গতিতে। তাদের দশ-বারো ফিট পেছনে স্বর্ণালী।

প্রচুর বাংলা-ইংরাজি লাভ স্টোরি পড়েছে স্বর্ণালী। কিন্তু কোনও প্রেমকাহিনিতেই এমন দৃশ্য আছে কিনা, তার মনে পড়ল না। ভীষণ মজা লাগছিল। কুল কুল করে পেটের ভেতর থেকে হাসি উঠে আসছে। ঠোঁট টিপে হাসিটাকে রুখে দিল সে।

রজত নীচু গলায় বলছিল, কিছু ভাবলে?

শিঞ্জিনী চকিতে ঠিক করে নিল, রজত অসন্তুষ্ট হয়, এমন কিছু করা বা বলা ঠিক হবে না। রজত খুব ভদ্র, কিন্তু চটে গেলে মানুষের কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। দেবারতি মিসের কাছে তার নামে সত্যি-মিথ্যে মিশিয়ে লাগাতেও পারে। তখন দেবারতি মিস যদি পড়াতে না চান? এমন একজন ভালো টিচার কোথায় পাওয়া যাবে?

শিঞ্জিনী চোখের কোণ দিয়ে একবার রজতকে দেখে নিল। তারপর বলল, দেখুন, ফাইনাল পরীক্ষার বেশি দেরি নেই। এখন অন্যদিকে মন গেলে পড়াশোনার ক্ষতি হবে। আমি ভালো রেজাল্ট করতে চাই।

রজত একটু বিব্রত হল, মায়ের কাছে শুনেছি, তুমি ভালো স্টুডেন্ট রেজাল্ট তোমার ভালো হবেই।

পড়ায় কনসেনট্রেট করতে পারলে, তবেই না? তা ছাড়া

কী?

আমার লাইফের একটা এইম আছে। আমি ভালো কেরিয়ার করতে চাই।

নিশ্চয়ই করবে।

এম.এ. পাশ না করতে পারলে সেটা সম্ভব নয়।

নিজের পায়ে দাঁড়াতে আমারও তিন-চার বছর লেগে যাবে। তোমার এম.এ. পর্যন্ত আমি ওয়েট করতে রাজি। তুমি কী বলো?

একটু নীরবতা।

তারপর শিঞ্জিনী বলল, আমার মা আছেন, দাদু আছেন। আমার সম্বন্ধে যা ভাবার তারাই ভাবেন। ওঁদের লুকিয়ে আমি কিছু করি না।

রজত হকচকিয়ে গেল, না, না, লুকোবার প্রশ্নই নেই। তুমি যদি বলো, আমি ওঁদের সঙ্গে দেখা করব।

শিঞ্জিনী চমকে ওঠে, না, না, একেবারেই না।

কেন বলো তো?

আমার দাদু এখন এসব পছন্দ করবেন না।

তা হলে?

শিঞ্জিনী বলল, আমার পরীক্ষা-টরীক্ষা হয়ে যাক। তারপর কী করা যায়, ভাবা যাবে। তার ইচ্ছা, ব্যাপারটাকে পরের বছরের মার্চ পর্যন্ত টেনে দিয়ে যাওয়া। পরীক্ষা হয়ে গেলে রজতকে পাত্তাই দেবে না। পরিষ্কার জানিয়ে দেবে, তার জন্য অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই।

রজতকে হতাশ দেখায়। সে বলে, ঠিক আছে। পরীক্ষাটা হয়েই যাক। দু-তিন মাস পর আমারও একটা পরীক্ষা রয়েছে। এর মধ্যে বাড়ি আসা সম্ভব নয়। তোমার সঙ্গে দেখা হবে না। খুব খারাপ লাগছে।

শিঞ্জিনী মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। কোনও উত্তর দেয় না।

রজত বলল, তোমাদের ফোন নাম্বারটা লিখে দাও।

সচকিত শিঞ্জিনী বলল, কেন বলুন তো?

দেখা না হোক, মাঝে মাঝে আমরা কথা বলতে পারব।

ত্রস্ত সুরে প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে শিঞ্জিনী, না না—

রজত অবাক। জিগ্যেস করে, না কেন? ফোনে কথা বললে, দোষের কী আছে?

শিঞ্জিনী জানায়, তাদের টেলিফোনটা আছে দাদুর ঘরে, তার মাথার কাছে একটা টেবলের ওপর। বাইরে থেকে যার ফোনই আসুক, তিনিই প্রথমে সেটা ধরেন।

দাদু কড়া ধাতের সেকেলে মানুষ, ভীষণ রক্ষণশীল। অনাত্মীয় যুবক নাতনির সঙ্গে ফোনে গল্প করতে চাইছে, কিছুতেই তা বরদাস্ত করবেন না। এতে শিঞ্জিনী ভীষণ বিপদে পড়ে যাবে। রজত সম্পর্কে জেরা করে করে দাদু তাকে নাজেহাল তো করবেনই। এমনকী স্কুলে এবং কোচিং ক্লাসে যাবার সময় পাহারাদারও সঙ্গে দেবেন। বানিয়ে বানিয়ে ইন্দ্রনাথ সম্বন্ধে রজতের মাথায় একটা ভীতিকর ধারণা তৈরি করে দিল।

রজত বেশ মুষড়ে পড়ে। খানিকক্ষণ কী ভেবে বলে, আমার একটা কথা রাখবে?

কী?

আমাকে তো ফোন করতে বারণ করলে। তুমিই বরং রাস্তায় কোনও বুথ থেকে আমার হোস্টেলে ফোন করো। সকালের দিকে এগারোটা পর্যন্ত আর বিকেলে পাঁচটার পর আমাকে হোস্টেলে পাবে।

রজত একেবারে নাছোড়বান্দা। মনে মনে শিঞ্জিনী ঠিক করে ফেলল, কোনওদিনই রজতকে ফোন করবে না। মুখে অবশ্য বলল, ঠিক আছে। তবে রোজ আমার ফোন এক্সপেক্ট করবেন না।

না, না, মাঝে মাঝে করলেই খুশি হব। শিঞ্জিনীর কাছ থেকে কাগজ-কলম নিয়ে বিপুল উৎসাহে হোস্টেলের ফোন নাম্বারটা লিখে দিল রজত।

কলম-টলম ব্যাগে পুরতে পুরতে ব্যস্তভাবে শিঞ্জিনী বলল, অনেক দেরি হয়ে গেছে। এবার কিন্তু আমাকে বাড়ি ফিরতেই হবে। রজতকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলন্ত একটা অটো থামিয়ে স্বর্ণালীকে ডেকে চোখের পলকে উঠে পড়ল। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে রইল রজত।

অটো ফের ছুটতে শুরু করেছিল। বন্ধুর দিকে তাকিয়ে চোখ কুঁচকে, ঠোঁট টিপে মজাদার একটা ভঙ্গি করল স্বর্ণালী। তারপর শিঞ্জিনীর কানে মুখ ঠেকিয়ে ফিস ফিস করে বলল, দুজনে দারুণ জমে গিয়েছিলি।

তেরছা চোখে স্বর্ণালীকে দেখতে দেখতে রুক্ষ গলায় শিঞ্জিনী বলল, জমে গিয়েছিলাম। তোর তা-ই মনে হল।

বন্ধুকে নিয়ে একটু মজা করতে ইচ্ছা হয়েছিল স্বর্ণালীর। কিন্তু তার মেজাজ দেখে দমে গেল। জিগ্যেস করল, কী কথা হল তোদের?

সিটের ধার ঘেঁষে বসেছিল শিঞ্জিনী। কিছুক্ষণ চুপচাপ বাইরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর মুখ ফিরিয়ে ধীরে ধীরে সমস্ত বলে গেল।

স্বর্ণালী বলল, কিছু লুকোচ্ছিস না তো?

শিঞ্জিনী বলল, তোর কাছে আমি কিছু লুকোই?

স্বর্ণালী জবাব দিল না।

শিঞ্জিনী ফের বলে, আমাদের ফ্যামিলির সব কথা তোকে জানিয়েছি। পুরুষদের আমি ঘৃণা করি। আই হেট দেম।

স্বর্ণালী চমকে ওঠে, রজতকে এসব বলেছিস!

পাগল! আরও কটা মাস দেবারতি মিসের কাছে পড়তে হবে না? ছেলেকে খেপিয়ে দিলে মা কি আমাকে কোলে বসিয়ে আদর করে পোলাও-মাংস খাওয়াবে? এই খাবার দুটো শিঞ্জিনীর খুবই প্রিয়।

স্বর্ণালী বলল, ট্যাক্টফুলি ম্যানেজ করতে চাইছিস?

কখনও কখনও ট্যাক্টফুল তো হতেই হয়। হায়ার সেকেন্ডারিটা হয়ে যাক। আই শ্যাল টোটালি ফরগেট ইট।

.

০৭.

যেদিন রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর শিঞ্জিনীর ঘরে এসে মৃদুলা বিমলেশ বসুমল্লিকের কথা বলেছিল, তারপর দিন দশেক কেটে গেছে।

আজ রবিবার। ছুটির দিন।

কালই মৃদুলা জানিয়ে দিয়েছিল, আজ বিমলেশের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেবে। এগারোটা নাগাদ বাড়ি থেকে শিঞ্জিনীকে নিয়ে বেরুবে। সে যেন তার মধ্যেই তৈরি হয়ে নেয়। লাঞ্চের ব্যবস্থা বাইরে করা হয়েছে।

ইন্দ্রনাথকে বিমলেশের কথা ঘুণাক্ষরেও জানায়নি মৃদুলা। তাকে শুধু বলেছে, দুপুরে এক কলিগের বাড়িতে তার আর শিঞ্জিনীর নেমন্তন্ন। উপলক্ষ, সহকর্মীটির ছেলের পৈতে।

কাঁটায় কাঁটায় এগারোটায় মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল মৃদুলা। বাড়ির সামনে একটা খালি ট্যাক্সি পেয়ে যাওয়ায় সুবিধাই হল। নইলে মোড় পর্যন্ত হেঁটে যেতে হত। কেননা ট্যাক্সি-স্ট্যান্ডটা ওখানেই।

গাড়িতে উঠে মৃদুলা ড্রাইভারকে বলল পার্ক স্ট্রিট চলুন—

রবিবার। তাই রাস্তা আজ প্রায় কঁকাই। ট্যাক্সি প্রায় ডানা মেলে উড়তে লাগল।

ব্যাক সিটের এক জানালার পাশে বসেছে মৃদুলা অন্য জানালার ধারে শিঞ্জিনী। মায়ের মুখে পার্ক স্ট্রিট শুনেই সে বুঝে গেছে ওখানেই কোথাও বিমলেশ তাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। ভদ্রলোক কেন তার সঙ্গে আলাপ করতে চান, কী বলবেন তিনি, কিছুই আন্দাজ করা যাচ্ছে না। বিতৃষ্ণা, বিরক্তি, সেই সঙ্গে অনেকখানি কৌতূহল। সব মিলেমিশে মনের ভেতরটা তোলপাড় হচ্ছে। অন্যমনস্কর মতো জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল শিঞ্জিনী।

তিন ফুট দুরত্বে বসে মৃদুলা মেয়েকে লক্ষ্য করছিল। লহমার জন্যও চোখ অন্য কোনও দিকে সরায়নি।

ট্যাক্সি দু-তিনটে রাস্তা ঘুরে এখন টালিগঞ্জ রেলব্রিজের কাছে চলে এসেছে। মৃদুলা শিঞ্জিনীর দিকে এগিয়ে এসে ঘন হয়ে বসল। কোমল স্বরে ডাকল, রূপা

সামান্য চমকে উঠে মুখ ফেরায় শিঞ্জিনী, কী বলছ?

খুব টেনশন হচ্ছে?

শিঞ্জিনী উত্তর দিল না।

মৃদুলা এবার বলল, বিমলেশ বসুমল্লিকের সঙ্গে আলাপ হলে বুঝবি, পৃথিবীতে এমন মানুষ খুব বেশি হয় না।

এমন স্তুতিবাক্য আগেও মায়ের মুখে শুনেছে। শিঞ্জিনী চুপ করে থাকে।

মৃদুলা থামেনি, আমার কথা বিশ্বাস কর, ওঁকে দেখলে তোর খুব ভালো লাগবে। দেখবি তোকে কত স্নেহ করবেন। রিল্যাক্স

শিঞ্জিনীর এবারও জবাব নেই।

মৃদুলাও আর কিছু বলল না।

একসময় ট্যাক্সি পার্ক স্ট্রিটের একটা নামকরা এয়ার-কন্ডিশড রেস্তোরাঁর সামনে আসতে মৃদুলা ড্রাইভারকে থামতে বলে। তারপর ভাড়া মিটিয়ে মেয়েকে নিয়ে রেস্তোরাঁর ভেতরে চলে আসে।

এয়ার-কন্ডিশনড হওয়ায় ভেতরটা বেশ আরামদায়ক। নরম আলোয় চারদিক ভরে আছে।

রেস্তোরাঁটা দোতলা। এখানে বার নেই। শুধুই খাওয়ার ব্যবস্থা। একতলার বিশাল হলঘরে অসংখ্য টেবল পাতা। তার একপাশে ক্যাশ কাউন্টার।

এখনও লাঞ্চ টাইম শুরু হয়নি। অল্প কিছু লোকজন এধারে-ওধারে, নানা টেবলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে।

হলঘরটার মাঝখানে থেকে টাইলস-বসানো ঘোরানো সিঁড়ি ওপরে উঠে গেছে।

এ ধরনের দামি রেস্তোরাঁয় আগে কখনও আসেনি শিঞ্জিনী। তার অবাক এবং মুগ্ধ হবার কথা। কিন্তু কিছুই ভালো করে লক্ষ্য করছিল না সে। ভেতরে ভেতরে সেই টেনশনটা দ্রুত বেড়েই চলেছে। এই হলঘরে কোন লোকটা বিমলেশ বসুমল্লিক, কে জানে। মৃদুলা যথেষ্ট গুণকীর্তন করলেও আসলে তিনি ঠিক কেমন মানুষ?

মৃদুলা কিন্তু একতলার কোনও টেবলের সামনেই গেল না। সিঁড়ি দিয়ে মেয়েকে নিয়ে দোতলায় উঠে এল। এখানেও নীচের তলার মতোই মস্ত হল। তেমনই সারি সারি টেবল এবং চেয়ার পাতা। চারপাশ চমৎকার সাজানো। এখানেও ভিড়-টিড় নেই। নানা বয়সের কয়েক জোড়া পুরুষ এবং মহিলা কটা টেবলে বসে নীচু গলায় গল্প করছে। চার-পাঁচটা স্মার্ট চেহারার উর্দি-পরা বেয়ারা একধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গুলতানি করছে। এই মুহূর্তে তাদের বিশেষ তাড়া নেই। এখন সমস্ত কিছুই ঢিলেঢালা, আলস্য-জড়ানো।

হলঘরের শেষ মাথায় চৌকো পিলারের পাশে একটা টেবলে যিনি একা বসে ছিলেন, সোজা তার কাছে শিঞ্জিনীকে সঙ্গে করে চলে এল মৃদুলা।

আগে এঁকে না দেখলেও স্বর্ণালীর নিখুঁত বর্ণনাটা মস্তিষ্কের কোনও অদৃশ্য কম্পিউটারে ধরা ছিল। হুবহু সেই চেহারা। পরনে দামি ট্রাউজার্স আর শার্ট। চওড়া কবজিতে নামকরা কোম্পানির চৌকো ঘড়ি। শিঞ্জিনী শুনেছে, সফল মানুষদের চোখে-মুখে আলাদা দ্যুতি থাকে। এই মানুষটিকে ঘিরে তেমনই উজ্জ্বলতা।

বিমলেশ শিঞ্জিনীদের দেখে উঠে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

মৃদুলা বলল, আগে পরিচয় করিয়ে দিই।

বিমলেশ হাত তুলে মৃদুলাকে থামিয়ে দিতে দিতে বললেন, কিচ্ছু করাতে হবে না। ওটা আমরা নিজেরাই করে নিচ্ছি। হাসিমুখে শিঞ্জিনীকে বললেন, ইউ মাস্ট বি শিঞ্জিনী-মানে রূপা। আমি বিমলেশ। আশা করি, আমার নামটা মায়ের মুখে শুনেছ।

নিজের মধ্যে কাঠিন্য অনুভব করল শিঞ্জিনী! একদৃষ্টে বিমলেশকে লক্ষ্য করতে লাগল সে। কোনও উত্তর দিল না।

বিমলেশের হঠাৎ যেন খেয়াল হল, শিঞ্জিনীরা দাঁড়িয়ে আছে। শশব্যস্ত বললেন, বসো-বসো-প্লিজ শিঞ্জিনীর হাত ধরে সামনের চেয়ারে বসিয়ে নিজে তার মুখোমুখি বসলেন।

একেকটা টেবল ঘিরে চারটে করে চেয়ার। মৃদুলা কিন্তু বসল না। বলল, পরিচয় তো হয়েই গেছে। আমি কাছেই একটা কাজ সেরে আসি। ম্যাক্সিমাম হাফ অ্যান আওয়ার।

শিঞ্জিনী বুঝতে পারল, বিমলেশ যখন তার সঙ্গে কথা বলবে, মৃদুলা তখন কাছে থাকতে চায় না। মায়ের একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরে সে। মৃদুলা তার কাঁধে হালকা একটু চাপ দিয়ে মৃদু হাসে। ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেয়, কোনও ভয় নেই। ধীরে ধীরে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে একতলার সিঁড়ির দিকে চলে যায় সে।

যতক্ষণ মাকে দেখা যায়, তাকিয়ে থাকে শিঞ্জিনী। মৃদুলা একতলায় নেমে গেলে বিমলেশের দিকে সে চোখ ফেরায়। সদ্যপরিচিত একটি লোকের সামনে সে এখন একেবারে একা। শিরদাঁড়ায় অদ্ভুত এক শিহরন খেতে গেল তার। সেটা কি ভয়ে? তীব্র অস্বস্তিতে? অনুভূতিটা যে ঠিক কী, শিঞ্জিনী বুঝিয়ে বলতে পারবে না। কয়েক লহমা মাত্র। তারপরেই নিজেকে দৃঢ় করে নিল। নিজের অজান্তেই বুঝিবা এক মহাযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে সে।

বিমলেশ বললেন, লাঞ্চের এখনও দেরি আছে। কী খাবে বলো। কফি? সফট ড্রিংক?

শিঞ্জিনী বলল, কিছু দরকার নেই।

তাই কখনও হয়? বিমলেশ একটা বেয়ারাকে ডেকে সফট ড্রিংক নিয়ে আসতে বললেন।

মুহূর্তে নকশা-করা কাঁচের গেলাসে ঠান্ডা পানীয় এসে গেল। অনিচ্ছাসত্ত্বেও একটা গেলাস তুলে নিল শিঞ্জিনী।

বিমলেশ গল্প শুরু করে দিলেন। প্রায় একতরফা। শিঞ্জিনীর পড়াশোনা কেমন চলছে, স্কুলের মিসরা কেমন পড়ান, হায়ার সেকেন্ডারিতে কত পারসেন্ট মার্ক সে আশা করছে, গ্র্যাজুয়েশনটা কোন কলেজ থেকে করতে চায়, কোন সাবজেক্টে অনার্স নেবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।

শিঞ্জিনী বুঝতে পারছিল, এসব ধানাইপানাই বকে জমি তৈরি করে নিচ্ছে বিমলেশ। আসল বক্তব্যটা কখন ঝুলি থেকে বেরুবে, সে জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে সে। নীরস গলায়, খুব সংক্ষেপে উত্তর দিতে লাগল সে।

লেখাপড়া ছেড়ে এবার শিঞ্জিনীর শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে পড়লেন বিমলেশ। এখন ভীষণ পড়ার চাপ চলছে। শরীরের বিশেষ ভাবে যত্ন নেওয়া উচিত। তিনি মৃদুলাকে বলবেন, বড় ডাক্তারকে দিয়ে শিঞ্জিনীর জন্য একটা ডায়েট চার্ট যেন করিয়ে নেয়। এনার্জি বাড়ে এমন ট্যাবলেট বা টনিকেরও খুবই প্রয়োজন।

শিঞ্জিনীর পর ইন্দ্রনাথের অসুখ-বিসুখের প্রসঙ্গ টেনে আনলেন বিমলেশ। তিনি কেমন আছেন, ঠিকমতো ওষুধ-টোষুধ খান কিনা, ফিজিওথেরাপিতে কতটা কাজ হচ্ছে, পরম শুভাকাঙ্ক্ষীর মতো এসব জানতে চাইলেন।

তাদের বাড়ির যাবতীয় খবরই যে বিমলেশ রাখেন, শিঞ্জিনী বুঝতে পারছিল। মৃদুলা ছাড়া আর কেই-বা এই সব খবরের সোর্স হতে পারে?

বিমলেশের আবোল-তাবোল বকা অসহ্য লাগছিল শিঞ্জিনীর। এক পলক ঘড়ি দেখে সে বলল, মা আধঘণ্টা সময় দিয়েছিল। চোদ্দ মিনিট কেটে গেছে। আমার সঙ্গে কেন আলাপ করতে চেয়েছেন, তা কিন্তু এখনও জানা হয়নি।

বিমলেশের মতো বয়স্ক, অভিজ্ঞ, সফল মানুষও সামান্য থতিয়ে গেলেন। একটু নার্ভাসও কি? তিনি যে শিঞ্জিনীদের কত বড় শুভার্থী, সাতকাহন ফেঁদে তা বোঝাবার পর আসল প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মেয়েটার অন্য কোনও ব্যাপারেই আগ্রহ নেই। মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বিমলেশ বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেটা তো বলতেই হবে।

সুস্বাদু, শীতল পানীয়ের গেলাসে দু-তিনটে হালকা চুমুক দিয়েছিল শিঞ্জিনী। এখন গেলাসটা হাতের ভেতর আস্তে আস্তে ঘুরিয়ে চলেছে। বিমলেশের দিকে তাকিয়ে সে নীরবে অপেক্ষা করতে লাগল।

বিমলেশ বললেন, আমার সম্বন্ধে তোমার মায়ের কাছে নিশ্চয়ই সব শুনেছ?

শিঞ্জিনী বলল, সব নয়। খানিকটা। আপনি একজন বড় ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট। বনেদি ফ্যামিলিতে জন্ম। প্রচুর টাকা আপনার। সল্টলেকে বিরাট বাড়ি। উইডোয়ার। ব্যস, এই পর্যন্ত।

মেয়েটার মধ্যে নরম ভাব কম। কথাবার্তা চঁছাছোলা। চোখেমুখে, আচরণে, কথা বলার ভঙ্গিতে ছুরির ফলার মতো কী যেন আছে। এর সামনে সারাক্ষণ সতর্ক না থাকলে মারাত্মক অস্বস্তিতে পড়তে হবে।

বিমলেশ বললেন, এটা কি তোমার মা বলেছে, আমি একজন দুঃখী, নিঃসঙ্গ মানুষ।

কী চায় লোকটা? তার সহানুভূতি? কিন্তু কেন? শিঞ্জিনী বলল, বলে থাকতে পারে। মনে পড়ছে না।

বিমলেশ বললেন, তোমাদের কথাও শুনেছি। দুজনে অনেক দুঃখ পেয়েছ।

পৃথিবীতে বদ, লম্পট স্বামীর জন্যে অনেক ম্যারেড লাইফ ধ্বংস হয়ে গেছে। ভবিষ্যতেও হবে। এই টাইপের পুরুষদের স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েরা দুঃখই পেয়ে থাকে। আমরাও পেয়েছি। তার মধ্যেই বেঁচে থাকতে চেষ্টা করছি।

গুড। দ্যাট শুড বি দা স্পিরিট।

শিঞ্জিনী উত্তর দিল না।

বিমলেশ বললেন, আমার একটা কথা বিশ্বাস করবে রূপা?

শিঞ্জিনী একটু অবাক হল। বিমলেশের দিকে সতর্ক চোখ রেখে বলল, কী কথা?

হঠাৎ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন বিমলেশ, আমি তোমাদের সুখী করতে চাই রেস্তোরাঁর মৃদু আলোয় তার গলার স্বর কাঁপতে লাগল।

শিঞ্জিনী ইঙ্গিতটা মোটামুটি ধরতে পারছিল। তবু ঈষৎ রূঢ় গলায় জিগ্যেস করল, ওয়ার্ল্ডে দুঃখী মানুষের অভাব নেই। কিন্তু বেছে বেছে আমাদের সুখী করার জন্যে আপনি এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন কেন?

এমন মেয়ে আগে কখনও দেখেননি বিমলেশ। কত আর বয়স! মৃদুলার কাছে শুনেছেন, মাস তিনেক আগে সতেরো পেরিয়েছে। এই ধরনের সদ্যতরুণীরা বয়স্ক লোকেদের কাছে নিজেদের অনেকখানি গুটিয়ে রাখে। সঙ্কোচে। লজ্জায়। বিশেষ করে সবেমাত্র পরিচয় হয়েছে, এমন কারও সামনে। কিন্তু শিঞ্জিনী অন্য ধাতুতে তৈরি। সে যেন অস্ত্র উঁচিয়েই রেখেছে।

শিঞ্জিনীর প্রশ্নটা নিছক প্রশ্ন নয়। এর মধ্যে লুকনো রয়েছে তীব্র আক্রমণ। প্রস্তুত ছিলেন না বিমলেশ। মনে মনে তিন পা পিছিয়ে গেলেন। একটু চুপ করে থেকে দ্রুত রণ-কৌশলটা ভেবে নিলেন। তরল আবেগের ঢল নামিয়ে এই মেয়েকে ভাসিয়ে নেওয়া যাবে না। যা বলার সোজাসুজিই বলতে হবে।

বিমলেশ বললেন, তুমি বড় হয়েছ। তোমাকে কথাটা বলা যেতে পারে। হয়তো শুনেছ, আমাদের তৈরি বহু প্রোডাক্ট তোমার মায়ের ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি ইন্ডিয়ার নানা সিটিতে পাঠায়। এই সূত্রেই তার সঙ্গে আলাপ। তারপর কখন যে আমাদের ভেতর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, বুঝতে পারিনি। বুঝতেই পারছ, সম্পর্কটা শুধুমাত্র বন্ধুত্ব নয়। তার চেয়ে অনেক বেশি।

শিঞ্জিনী কিছু বলে না। পলকহীন তাকিয়ে থাকে।

বিমলেশ থামেননি, আমার ইচ্ছা এই সম্পর্কটা পার্মানেন্ট হোক।

শিঞ্জিনী এবারও জবাব দেয় না।

বিমলেশ ব্যগ্রভাবে বললেন, চুপ করে আছ কেন?

শিঞ্জিনীর চারপাশের সৌরলোক দুলতে শুরু করেছিল। বুকের ভেতর দমাদ্দম হাতুড়ি পেটার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল সে। মনে হচ্ছিল, সব আলো নিভে গেছে, বাতাস আর বইছে না।

নিজেকে ধাতস্থ করতে খানিকটা সময় লাগল শিঞ্জিনীর। বিমলেশের সঙ্গে আজকের এই সাক্ষাৎকার নিতান্ত আলাপ-পরিচয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, সেটা আগেই আঁচ করা গিয়েছিল। কিন্তু ওঁরা যে এতদূর এগিয়েছেন, এবং সেটা তাকে জানানোর জন্য এই রেস্তোরাঁয় টেনে আনা হয়েছে তা ভাবতে পারেনি শিঞ্জিনী।

ব্যাপারটা এমনই অতর্কিত যে প্রথমটা দিশেহারা হয়ে পড়েছিল সে। এবার খুব ঠান্ডা গলায় বলল, আপনার কথাগুলো খুব মন দিয়ে শুনছিলাম।

বিমলেশ বললেন, আমি যা চাই, তোমাকে বোঝাতে পেরেছি?

নিশ্চয়ই পেরেছেন। কিন্তু

বলো—

আমার মা-ও কি তা-ই চায়?

নিশ্চয়ই।

শিঞ্জিনী বলতে লাগল, আমার মা পুরুষদের ঘৃণা করত। তার কাছে পুরুষমানুষ মাত্রেই স্কাউন্ডেল। আপনি যে তার ধারণা পালটে দিতে পেরেছেন, সেটা বিরাট অ্যাচিভমেন্ট।

মেয়েটার কথায় কি শ্লেষ মেশানো রয়েছে? ঠিক বোঝা গেল না। ব্যাপারটা গায়ে মাখলেন না বিমলেশ। হেসে হেসে বললেন, তা বলতে পারো।

একটু নীরবতা।

তারপর বিমলেশ বললেন, কী, তুমি তো কিছুই বললে না?

শিঞ্জিনী বলল, আপনারা ডিসিশন নিয়েছেন। ফর্মালি আমাকে শুধু জানালেন। এ নিয়ে আমার কী বলার থাকতে পারে?

বিমলেশ সচকিত। বললেন, কে বললে, আমরা ডিসিশন নিয়ে ফেলেছি? আমরা কী চাই, সেটা শুধু বলেছি। এখন সব কিছুই তোমার ওপর নির্ভর করছে।

মানে?

তোমার পারমিশান পেলে এই ব্যাপারটা নিয়ে আমরা এগুতে পারি।

তীক্ষ্ম গলায় শিঞ্জিনী বলে, যে স্টেজে আপনারা পৌঁছেছেন, সেখানে আমার পারমিশানের কি কোনও দরকার আছে?

বিমলেশ বললেন, সেটাই সবচেয়ে বেশি আর্জেন্ট। তা না হলে অনেক আগেই তো আমরা ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের কাছে চলে যেতে পারতাম। আসলে

আসলে কী?

তুমি কি বুঝতে পারছ না, মৃদুলাকেই শুধু নয়, আমি তোমাকে চাই মা–

ভদ্রলোক কথা বলেন চমৎকার। এবার কণ্ঠস্বরে আরও বেশি করে আবেগ ঢেলে দিয়েছেন। তবে তিনি কতটা আন্তরিক বোঝা যাচ্ছে না। শিঞ্জিনী চুপ করে রইল।

বিমলেশ বলতে লাগলেন, তুমি যতদিন না রাজি হচ্ছ, আমরা কোনও সিদ্ধান্ত নেব না। ব্যাপারটা যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে ঠিক সেইখানেই আটকে থাকবে।

বিমলেশের চোখের দিকে তাকিয়ে শিঞ্জিনী বলল, আপনার কাছে কটা প্রশ্ন আছে।

সোজা হয়ে বসলেন বিমলেশ, কী প্রশ্ন?

শিঞ্জিনী বলল, আপনি এত বড় একজন ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট। প্রচুর টাকা আপনার ইচ্ছা করলে আপনাদের লেভেলের বিরাট কোনও ফ্যামিলির ভার্জিন মেয়েকে বিয়ে করতে পারতেন। তা না করে আমার মায়ের মতো একজন ডিভোর্সিকে পছন্দ করলেন কেন? যার আবার আঠারো বছরের একটি মেয়ে আছে–

বিমলেশ আস্তে মাথা নাড়লেন, খুব সঙ্গত প্রশ্ন। উত্তরটা হল, হিসেব কষে তো সব কিছু হয় না। হৃদয় একটা ভীষণ জটিল ব্যাপার রূপা। কার যে কাকে ভালো লেগে যায় সেটা ব্যাখ্যা করা মুশকিল।

আমার সেকেন্ড প্রশ্ন হল, আমার মাকে না হয় আপনার ভালো লেগেছে। তার সঙ্গে আমায় জড়াচ্ছেন কেন?

তুমি কি জানো, তোমার মায়ের জীবনে তুমি কতখানি অংশ জুড়ে আছ?

কথাটা ঠিক বুঝলাম না।

মৃদুলার সঙ্গে আলাপের পর থেকে একটা কথাই সে বারবার জানিয়েছে, তোমাকে ছাড়া তার জীবন ইনকমপ্লিট। তোমাকে বাদ দিয়ে সে কিছুই ভাবতে পারে না।

মায়ের জন্যেই তা হলে আপনার কাছে আমার এত ইমপর্টান্স?

তোমার জন্যেই তোমার ইমপর্টান্স। আমি একটা মেয়ে পেয়ে যাব। সেটা কি মস্ত প্রাপ্তি নয়?

যেভাবে বিমলেশ তাকে ভজাতে চাইছেন তাতে মনে হয়, লোকটা যথেষ্ট আন্তরিক কিংবা অত্যন্ত চতুর। কোনটা যে ঠিক, নিশ্চিতভাবে ধরা যাচ্ছে না। শিঞ্জিনী নিজের স্নায়ুমণ্ডলীকে সজাগ রেখে বলে, আমার থার্ড প্রশ্নটা হল, আপনি তো জানেন আমাদের মাথার ওপর দাদু আছেন?

বিমলেশ বললেন, নিশ্চয়ই জানি।

আমাকে এখানে ডাকিয়ে না এনে তার সঙ্গেই ত আপনার কথা বলা উচিত ছিল। কেননা, আমার মা তারই মেয়ে।

নিশ্চয়ই তার সঙ্গে কথা বলা দরকার। কিন্তু সবার আগে যা চাই সেটা হল তোমার অনুমতি। যেদিন পারমিশন দেবে সেদিনই তোমার দাদুর সঙ্গে দেখা করব।

কিছুক্ষণ চুপচাপ।

তারপর শিঞ্জিনী বলল, আমার সম্বন্ধে আপনি কতটা জানেন?

বিমলেশ বললেন, তোমার মায়ের মুখে যা শুনেছি, ততটুকুই। হঠাৎ এ প্রশ্ন?

মা কি বলেছে দু-একটা একসেপশন বাদে আমি পুরুষমানুষদের বিশ্বাস করি না, ভীষণ ঘৃণা করি?

বলেছে। অবিশ্বাস আর ঘৃণা করাটাই তোমার পক্ষে স্বাভাবিক।

স্বাভাবিক কেন?

বিমলেশের ব্যাখ্যাটা এইরকম। জন্মের পর থেকে শিঞ্জিনী তার বাবার যে কুৎসিত চেহারাটা দেখেছে সেটা তার মনে চিরস্থায়ী, ভীতিকর ছাপ রেখে গেছে। তার ধারণা, সব পুরুষই এক ধাঁচের। লম্পট। নোংরা। বদমাশ।

বিমলেশ বললেন, কি, আমি ঠিক বললাম?

অর্থাৎ অনির্বাণ সম্পর্কে মৃদুলার কাছে সব শুনেছেন বিমলেশ। উত্তর না দিয়ে শিঞ্জিনী বলল, আমার দাদু আর দেবকুমার আঙ্কল ছাড়া অন্য কারও সম্বন্ধে আমার শ্রদ্ধা নেই।

দেবকুমার আঙ্কল কে?

আমার বন্ধুর বাবা।

বিমলেশ হাসতে হাসতে বললেন, যে দুজন একসেপশনের কথা বললে, মানে তোমার দাদু আর আঙ্কল, তাদের জায়গায় পৌঁছুতে আমার কতদিন লাগবে?

আজই তো সবে আপনাকে দেখলাম। একদিনেই আপনার এই প্রশ্নের উত্তর চান? বিমলেশের চোখের দিকে চোখ রেখে পালটা প্রশ্ন করে শিঞ্জিনী।

বিমলেশ বিব্রত বা অপ্রতিভ হননি। আস্তে আস্তে মাথা নাড়তে লাগলেন, ঠিক। বেশ কিছুদিন না দেখলে, না মিশলে তুমি বুঝবে কী করে, আমি মানুষটা কেমন? বেশ, আমি অপেক্ষা করতে রাজি।

লাঞ্চ টাইম শুরু হয়ে গিয়েছিল। ডাইনিং হলের একটা টেবলও এখন আর ফাঁকা নেই। স্টুয়ার্ড এবং বেয়ারারা ব্যস্তভাবে এ-টেবল সে-টেবলে ছোটাছুটি করছে। এই ধরনের দামি, অভিজাত রেস্তোরাঁয় কেউ চিৎকার করে কথা বলে না। যত নীচু গলায় বলুক, চারপাশ থেকে গুঞ্জন উঠে আসছিল।

এই সময় মৃদুলা ফিরে এল। শিঞ্জিনীর ডান পাশের চেয়ারটায় বসতে বসতে লহমায় দুজনকে একবার দেখে নিয়ে হাসিমুখে জিগ্যেস করল, কাজটা সেরে আসতে আসতে আমার একটু দেরি হয়ে গেল। তা তোমাদের আলাপ-টালাপ কীরকম হল?

শিঞ্জিনী উত্তর দিল না।

বিমলেশ বললেন, ফাইন। শি ইজ আ নাইস ইয়াং লেডি। ভেরি স্ট্রেটফরোয়ার্ড। তুমি যা বলেছ, তার চেয়ে ওর পার্সোনালিটি অনেক বেশি।

শিঞ্জিনী সম্পর্কে একটি অপ্রিয় শব্দও উচ্চারণ করেননি বিমলেশ। বরং যা বলেছেন তার সবটাই প্রশংসা। তবু কোথায় যেন একটা খটকা লাগছে মৃদুলার। নিজের মেয়েকে তার চেয়ে কে আর বেশি চেনে!

স্টুয়ার্ড টেবলের সামনে এসে দাঁড়াল। হাতে ছোট নোট বই।

টেবলে সুদৃশ্য মেনু-কার্ড পড়ে ছিল। সেটা শিঞ্জিনীকে দিয়ে বিমলেশ জিগ্যেস করলেন, দেখে বলো, কী কী অর্ডার দেব?

কার্ডটা ফিরিয়ে দিয়ে শিঞ্জিনী বলল, আপনার যা ভালো মনে হয় বলে দিন। তবে চিকেন ছাড়া আমি অন্য মাংস খাই না—

ও কে মৃদুলার সঙ্গে পরামর্শ করে অর্ডার দিলেন বিমলেশ। পোলাও ক্রিম-ভেটকি, প্রন কাটলেট, স্যালাড এবং আইসক্রিম। নোটবুকে টুকে নিয়ে চলে গেল স্টুয়ার্ড।

যান্ত্রিক নিয়মে কিছুক্ষণের ভেতর টেবলে লোভনীয় খাদ্যগুলো পৌঁছে গেল। খেতে খেতে নানারকম গল্প হতে লাগল। এলোমেলো, পারম্পর্যহীন। যে কারণে এই রেস্তোরাঁয় আসা, সে সম্বন্ধে কিন্তু একটি কথাও নয়।

মৃদুলা খাচ্ছে ঠিকই, তবে ভেতরে ভেতরে বেশ উতলা হয়ে আছে।

তার অনুপস্থিতিতে ওদের দুজনের মধ্যে কী কথা হয়েছে, জানার জন্য ভীষণ অস্থির অস্থির লাগছে। বাইরে অবশ্য তার কোনও প্রকাশ নেই।

শিঞ্জিনী এমন বালিকা নয় যে মায়ের মনোভাব বুঝতে পারছে না। সে কিন্তু ওদিক দিয়েই গেল না। প্রায় নিঃশব্দে খেতে লাগল।

উলটো দিকের টেবলে বসে প্লেট থেকে মাঝে মাঝে মুখ তুলে মৃদুলাকে লক্ষ্য করছেন বিমলেশ। তার ঠোঁটে চাপা হাসি। দুই চোখ কৌতুকে চিক চিক করছে। মৃদুলার মনের গতিক তিনিও আঁচ করে নিয়েছেন। বললেন, ডোন্ট বি রেস্টলেস। পৃথিবীতে সব কিছুই সুলভ নয়। আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে।

ইঙ্গিতটা হয়তো বুঝতে পেরেছে মৃদুলা। সে হকচকিয়ে গেল, আমাকে দেখে কি রেস্টলেস মনে হচ্ছে?

উত্তর না দিয়ে ছুরি দিয়ে প্রন কাটলেট কেটে টুকরো করতে লাগলেন বিমলেশ।

.

লাঞ্চ শেষ হলে বিমলেশ তার গাড়িতে সল্টলেকে চলে গেছেন। আগে দু-একবার মৃদুলাকে বাড়ি পর্যন্ত লিফট দিতে চেয়েছেন তিনি। মৃদুলা রাজি হয়নি। তাদের এলাকায় কখন কার চোখে পড়ে যাবে, ইন্দ্রনাথের কানে খবরটা পৌঁছুবে। সব মিলিয়ে অশান্তি। স্ক্যান্ডল। এসব আদৌ পছন্দ নয় মৃদুলার। ফিরতে দেরি হলে সে ট্যাক্সি নেয়। তাছাড়া মিনিবাস-টাস তো আছেন।

শিঞ্জিনীকে নিয়ে ট্যাক্সিতেই বাড়ি ফিরছিল মৃদুলা। পার্ক স্ট্রিটে যাবার সময় যেমন, এখনও ঠিক তেমনি দুই জানালার পাশে দু-জনে বসে আছে।

ভবানীপুর পর্যন্ত কেউ একটি কথাও বলেনি। তারপর হঠাৎ মৃদুলা ডাকল, রূপা—

শিঞ্জিনী মায়ের দিকে তাকাল।

মৃদুলা বলল, বিমলেশকে কেমন লাগল?

শিঞ্জিনী বলল, শিক্ষিত কালচার্ড মানুষ। সুন্দর কথা বলেন–

মৃদুলা যে প্রশ্নটা করেছে তার দুটো জবাব হতে পারে। ভালো বা মন্দ। কিন্তু শিঞ্জিনী তার ধার দিয়ে যায়নি।

উতলা ভাবটা কিছুতেই কাটছে না মৃদুলার। বিমলেশের সঙ্গে কী কথা হল, সবিস্তারে না জানা পর্যন্ত তার স্বস্তি নেই। এ এমন এক বিষয়, মেয়ের সঙ্গে আলোচনা করতে সঙ্কোচ হয়। শিঞ্জিনী যে বিমলেশের সঙ্গে বেয়াড়াপনা করেছে কিংবা তার ওপর খেপে উঠেছে, বিমলেশের কথায় তার এতটুকু আভাস পাওয়া যায়নি। শিঞ্জিনী প্রায় চুপচাপ ছিল ঠিকই, তবে খাবার টেবলে তাকে বিমর্ষ, বিরক্ত, ক্রুদ্ধ বা উত্তেজিত, কিছুই মনে হয়নি। বরং মহার্ঘ খাদ্যবস্তুগুলো সে বেশ তৃপ্তি করেই খেয়েছে।

মৃদুলা মনে মনে কৌশল ঠিক করে নেয়। সরাসরি নয়, ঘুরিয়ে অন্যভাবে তাকে সব জেনে নিতে হবে। কাল অফিসে গিয়ে কিংবা আজই শিঞ্জিনীকে বাড়িতে রেখে কোনও একটা ছুতো করে বাইরে বেরিয়ে প্রাইভেট টেলিফোন বুথ থেকে বিমলেশের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। লহমায় সে সব জেনে যাবে। কিন্তু তার তর সইছিল না।

মদুলা জিগ্যেস করল, বিমলেশ তোকে কী বলল?

এক পলক মাকে দেখে নিল শিঞ্জিনী। ভারি সরল মুখ। তার প্রশ্নটার মধ্যে যেন কোনওরকম অভিসন্ধি বা উদ্দেশ্য নেই। নেহাতই শিশুসুলভ অপার কৌতূহল।

মায়ের চাতুরি ধরে ফেলেছে শিঞ্জিনী। কিন্তু নিজে সে ধরা দিল না। বলল, কী আর বলবেন? আমার পড়াশোনা কেমন চলেছে, পরীক্ষার প্রিপারেশন কেমন হল, দাদুর শরীর কেমন যাচ্ছে–এই সব।

এতক্ষণে সামান্য অসহিষ্ণু হয়ে উঠল মৃদুলা, আর কিছু বলেনি?

হ্যাঁ। খুব শান্ত গলায় জবাব দেয় শিঞ্জিনী।

শ্বাস-আটকানো, চাপা স্বরে মৃদুলা জিগ্যেস করে, কী বলেছে?

কী বলতে পারেন, সেটা কি তুমি জানো না? সোজা মায়ের চোখের দিকে তাকায় শিঞ্জিনী।

মৃদুলা চমকে ওঠে। কিছু একটা উত্তর দিতে চায়, কিন্তু গলায় স্বর ফোটে না।

একটু চুপচাপ।

শিঞ্জিনী মায়ের চোখ থেকে চোখ সরায়নি। এবার বলল, মিস্টার বসুমল্লিক দাদুর সঙ্গে দেখা করার জন্যে আমার পারমিশান চাইছিলেন–

তুই কী বললি?

মায়ের প্রশ্নটা যেন শুনতেই পায়নি শিঞ্জিনী। সে বলল, মিস্টার বসুমল্লিক তোমাকে তখন কী বলেছেন, মনে আছে?

মৃদুলা বলল, কী বলেছে?

ধৈর্য ধরতে।

মেয়ের সঙ্গে কী আলোচনা হয়েছে, মোটামুটি আন্দাজ করে নিল মৃদুলা। সে আর কিছু জিগ্যেস করল না।

.

০৮.

মা-বাবার বিবাহবিচ্ছেদের পর ইন্দ্রনাথের কাছে এসে দিনগুলো মোটামুটি একই নিয়মে কেটে যাচ্ছিল। জীবনের আহ্নিক গতি বা বার্ষিক গতির মধ্যে বিশেষ হেরফের ঘটেনি। বড় হবার পর রাস্তায় বেরুলে লোকজনের নোংরা চোখের দৃষ্টি তীরের মতো গায়ে এসে বিধত। প্রথম প্রথম ভীষণ অস্বস্তি হত। পরে সয়ে গিয়েছিল। স্বর্ণালীদের বাড়ি ছাড়া অন্য বন্ধুদের বাড়ি গেলে তাদের কাকা-দাদারা আদর করার ছলে যা করত তাতে শরীর কুঁকড়ে যেত। ফলে তাদের বাড়ি যাওয়া ছেড়েই দিয়েছিল।

হঠাৎ কদিন হল দুদিক থেকে দুটো সমস্যা দেখা দিয়েছে। এক দিকে রজত, অন্যদিকে বিমলেশ। রজত কথা দিয়েছে, আপাতত হোস্টেল থেকে আসছে না, শিঞ্জিনীর পড়া শোনায় যাতে বিঘ্ন না হয় সেটা মনে রাখবে। বিমলেশ জানিয়েছেন, তার অনুমতি ছাড়া মায়ের ব্যাপারে এগুবে না। কিন্তু মৌখিক এই প্রতিশ্রুতি কতটা বিশ্বাস করা যায়?

পরীক্ষার বেশিদিন দেরি নেই। প্রাণপণে ওই সব উটকো দুশ্চিন্তা মাথা থেকে বার করে দিয়ে পড়ায় মন বসাতে চাইছে শিঞ্জিনী। রেজাল্ট তাকে ভালো করতেই হবে।

.

আজ অন্যদিক থেকে নতুন এক সংকট দেখা দিল। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো।

শনি ও রবি সপ্তাহের এই দুদিন শিঞ্জিনীদের স্কুল ছুটি থাকে।

আজ শনিবার। পড়া শেষ করে ইন্দ্রনাথের ঘরে এসে তার সঙ্গে গল্প করছিল শিঞ্জিনী। সারাদিন একা একা শুয়ে থাকেন। সঙ্গ দেবার লোক নেই। লেখাপড়ার ফাঁকে সময় পেলেই দাদুর কাছে এসে বসে সে।

শনিবার মৃদুলার হাফ-ডে অফিস। সে বাড়ি নেই। এখন এগারোটার মতো বাজে। হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠল।

ইন্দ্রনাথ বললেন, দেখ তো দিদি-

ফোনটা তুলে শিঞ্জিনী বলল, কাকে চাইছেন? শিঞ্জিনীদের টেলিফোন নাম্বারটা বলে ওধার থেকে কেউ ভারী গলায় জানতে চায়, নাম্বারটা সঠিক কিনা।

কণ্ঠস্বরটা অচেনা। আগে আর কখনও শুনেছে কি? শিঞ্জিনী মনে করতে পারল না। আসলে খুব কম লোকজনই এ বাড়িতে ফোন করে। যারা করে তাদের গলা ভালো করেই সে চেনে। বেশ অবাক হয়েই বলল, হ্যাঁ।

লোকটা বলল, গলা শুনে মনে হচ্ছে তোমার বয়স কম। তুমি কি মৃদুলাদেবীর মেয়ে?

বিস্ময়টা সহস্র গুণ বেড়ে যায় শিঞ্জিনীর। অপরিচিত লোকটা তার মাকে তো চেনেই, গলা শুনেই আন্দাজ করে নিয়েছে সে অল্পবয়সি মেয়ে এবং মৃদুলা তার মা। এ বাড়িতে মৃদুলা আর সে ছাড়া অন্য কোনও মহিলা বা কম বয়সের মেয়ে যে নেই, সেটা তার জানা।

শিঞ্জিনী বলল, হ্যাঁ কিন্তু আপনি কে বলছেন?

উত্তর না দিয়ে লোকটা বলল, তোমার দাদু এখন কেমন আছেন? মাঝখানে তো ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন

দেখা যাচ্ছে, লোকটা এ বাড়ির নাড়িনক্ষত্রের খবর রাখে। শিঞ্জিনী বলল, আগের থেকে অনেকটা ভালো। কিন্তু আপনার পরিচয় এখনও জানতে পারিনি।

পারবে, পারবে। তাড়া কীসের?

ইন্দ্রনাথ তিন-চারটে বালিশের ওপর মাথা রেখে আধশোওয়া মতো হয়ে ছিলেন। এবার সোজা হয়ে বসলেন। তাঁর চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা। চাপা, নীচু গলায় বললেন, কার সঙ্গে এত কথা বলছ?

হাতের ইশারায় ইন্দ্রনাথকে থামিয়ে দিয়ে শিঞ্জিনী লোকটাকে বলল, আপনি কি দাদুর সঙ্গে কথা বলতে চান?

লোকটা বলল, না। শুনেছি, তিনি বেড রিডন। তাকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না। আমি মৃদুলা দেবীর সঙ্গে কথা বলব।

কিন্তু মা তো এখন অফিসে।

আমার ধারণা ছিল উইকে পাঁচ দিন ওঁর অফিস। শনি-রবি ছুটি।

একটু চুপচাপ।

তারপর লোকটা বলল, ঠিক আছে, মাকে বোলো কাল সকাল নটায় তোমাদের বাড়ি আসব। মৃদুলাদেবীর সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।

শিঞ্জিনী বলল, মা ওই সময় বাড়িতে থাকবে কিনা, আমার জানা নেই। বাইরে কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকতে পারে।

যে অ্যাপয়েন্টমেন্টই থাক, ক্যানসেল করতে বলবে। এবার পরিচয়টা দেওয়া যাক। আমার নাম সুরেশ্বর ভৌমিক। আবার বলছি, কাল ঠিক নটায় আসব। এতক্ষণ ভারী গলায় কথা বললেও সুরটা ছিল নরম। এবার তার স্বরে হুকুমের মতো কিছু একটা ফুটে বেরুল।

শিঞ্জিনী কী বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই খুট করে শব্দ হল। সুরেশ্বর ওধার থেকে লাইন কেটে দিয়েছে।

নাতনির দিকে তাকিয়ে ছিলেন ইন্দ্রনাথ। পলকহীন। শিঞ্জিনী টেলিফোনটা নামিয়ে রাখতেই তিনি বললেন, কে ফোন করেছে দিদিভাই?

শিঞ্জিনী বলল, সুরেশ্বর ভৌমিক নামে একটা লোক

নামটা চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু ঠিক ধরতে পারছি না। কী চায় সে?

তা কিছু বলেনি। কাল নটায় আসবে। মাকে বাড়িতে থাকতে বলল।

খুকুর সঙ্গে তার কী দরকার?

আমি কী করে বলব?

ইন্দ্রনাথ বিরক্ত হলেন, জিগ্যেস করবে তো?

শিঞ্জিনী বলল, করতে যাচ্ছিলাম। লোকটা সময় দিলে না। ফোন নামিয়ে রাখল। কিছুক্ষণ চুপচাপ।

কপাল কুঁচকে, চোখ আধবোজা করে কী ভাবতে লাগলেন ইন্দ্রনাথ। তারপর স্বগতোক্তির টংয়ে বললেন, কে হতে পারে লোকটা? কে?

ইন্দ্রনাথ যে বেশ বিচলিত হয়ে পড়েছেন, বোঝা যাচ্ছে। অচেনা একটা লোক আচমকা ফোন করে অসুস্থ, শয্যাশায়ী মানুষটার শান্তি নষ্ট করে দিয়েছে। শিঞ্জিনী কী করবে, ভেবে পেল না।

অনেকক্ষণ পর ইন্দ্রনাথ নাতনিকে বললেন, কাল আসুক, তখন লোকটার মতলব বোঝা যাবে। অনেক বেলা হয়ে গেছে। যাও চান-টান করে খেয়ে নাও

শিঞ্জিনী উঠে পড়ল।

.

অন্যদিনের মতো আজও রাত করে বাড়ি ফিরল মৃদুলা। অফিস ছুটির পর কার সঙ্গে এতটা সময় কাটিয়ে এসেছে, শিঞ্জিনীর এখন আর অজানা নেই।

সন্ধের পর মালতী রুটি আলুর দম, বেগুনভাজা, অড়হর ডাল করে টেবলে গুছিয়ে রেখে গেছে। একটা বড় কাঁচের প্লেটে কটা বড় রাজভোগ ঢাকা দিয়ে রেখেছে। রাতে সন্দেশ, রাজভোগ বা পান্তুয়া, যা-ই হোক না, কোনও একটা মিষ্টি শিঞ্জিনীদের চাই-ই। শেষ পাতে মিষ্টি না থাকলে রাতের খাওয়াটা যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

রাতে বাড়ি ফিরে দ্রুত হাতমুখ ধুয়ে বাইরের পোশাক পালটিয়ে মেয়েকে নিয়ে খেতে বসে যায় মৃদুলা। আজও তার হেরফের হল না।

সেদিন পার্ক স্ট্রিটে বিমলেশের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবার পর থেকে প্রায় রোজ রাতেই খাওয়ার টেবলে বসে সতর্কভাবে শিঞ্জিনীকে লক্ষ্য করতে করতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটা প্রশ্ন করে সে, বিমলেশ আমাদের বাড়ি আসতে চাইছে। তুই কি এ ব্যাপারে কিছু ভেবেছিস?

কোনওদিন জবাবটা এড়িয়ে গেছে শিঞ্জিনী। কোনওদিন বলেছে, আমাকে আরেকটু ভাবতে দাও। আসলে এর মধ্যেই সে মাকে অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে। তার ভয়, বাকিটুকুও তার হাতে থাকবে না। বিমলেশ বসুমল্লিককে তার খারাপ লাগেনি। সুন্দর কথা বলেন। চমৎকার ব্যবহার। ঘণ্টা দেড়েকের মতো একসঙ্গে কাটিয়েছিল। এই অল্প সময়ের ভেতর তাকে বেশ স্নেহপ্রবণ মনে হয়েছে। তার প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীলও। সবচেয়ে যা ভালো লেগেছে, তার মতামত ছাড়া মায়ের ব্যাপারে তিনি এগুতে চান না। সবই ঠিক, কিন্তু মৃদুলার সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাবার পর ওপরকার মায়াবী খোলসের ভেতর থেকে বিমলেশের অন্য কোনও ভয়ঙ্কর স্বরূপ বেরিয়ে পড়বে কিনা, সে সম্বন্ধে শিঞ্জিনীর মনে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। মাকে পুরোপুরি হারালে সে বাঁচবে না।

খেতে খেতে টুকরো টুকরো কথা হচ্ছিল। ছুটির পর বিমলেশের সঙ্গে যে খানিকটা সময় কাটায়, আজকাল আর তা গোপন করে না মৃদুলা। বিমলেশের সঙ্গে শিঞ্জিনীর আলাপ হবার পর লুকোচুরির আর দরকার নেই।

আজ কোথায় গিয়েছিল, শিঞ্জিনীকে বিমলেশ কতটা ভালোবাসেন-এমনি নানা গল্প ফঁদতে যাচ্ছিল মৃদুলা, কিন্তু বাধা পড়ল।

শিঞ্জিনী হঠাৎ জিগ্যেস করল, সুরেশ্বর ভৌমিক বলে তুমি কাউকে চেনো?

যা বলতে যাচ্ছিল তা আর বলা হল না। কপাল কুঁচকে মৃদুলা জিগ্যেস করল, কে সুরেশ্বর ভৌমিক? কী করে?

নামটাই শুধু জেনেছি। কী করে বলতে পারব না। আজ এগারোটা-সাড়ে এগারোটায় ফোন করে তোমার খোঁজ করছিল।

কেন?

তা জানায়নি। কাল নটায় সে আসবে। তোমাকে বাড়িতে থাকতে বলেছে।

কে একটা উটকো লোক বলেছে বলে আমাকে থাকতে হবে? কাল আমার অন্য কাজ আছে। সকালে বেরুতে হবে। আমি লোকটার আর্দালি নাকি যে কঁঝিয়ে উঠতে গিয়ে থমকে গেল মৃদুলা। লহমায় চেহারাই পালটে গেল তার। মুখটা ফ্যাকাসে। কেমন যেন ভীত, আতঙ্কগ্রস্ত।

মায়ের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেল শিঞ্জিনী। ব্ৰস্তভাবে জিগ্যেস করে, কী হল মা?

ভয়ার্ত ভাবটা কাটিয়ে উঠতে পারছিল না মৃদুলা। কাঁপা গলায় বলল, এই সুরেশ্বর ভৌমিক নিশ্চয়ই প্রোমোটার। ভীষণ নোটোরিয়াস

কী জন্যে তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে, বুঝতে পারছ?

না-আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে মৃদুলা।

.

০৯.

পরদিন সকালে বেরুতে সাহস হয়নি মৃদুলার। বাড়িতেই থেকে গেল।

রোজ ভোরে উঠে মুখ-টুখ ধুয়ে পড়তে বসে শিঞ্জিনী। আজ বইয়ে মন বসাতে পারছিল না। বারবার পড়ার টেবল থেকে উঠে মায়ের কাছে চলে আসছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মৃদুলার টেনশন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আর সেটা শিঞ্জিনীর মধ্যেও ছড়িয়ে যাচ্ছে।

কাঁটায় কাটায় নটায় এয়ারকন্ডিশনড় মারুতি সুজুকিতে চেপে সুরেশ্বর ভৌমিক এসে গেল। মালতাঁকে বলা ছিল। সে সুরেশ্বরকে একতলার ড্রইংরুমে বসিয়ে ওপরে খবর দিয়ে গেল।

মৃদুলা একা ওইরকম একটা লোকের কাছে যাবে, এটা ভাবতে পারছিল না শিঞ্জিনী। সে তার সঙ্গে সঙ্গে চলল।

মৃদুলা বলল, তুই আসছিস কেন? পড়তে যা—

জেদের সুরে শিঞ্জিনী বলল, না, আমি তোমার সঙ্গে থাকব।

মৃদুলা আর আপত্তি করল না। মেয়ে পাশে থাকায় খুব সম্ভব সে খানিকটা সাহস পাচ্ছে।

একতলায় বসার ঘরে চলে এল দুজনে। সুরেশ্বর একাই সেখানে বসে ছিল। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স। ভারী, মজবুত চেহারা। চওড়া কাঁধ। চৌকো ধরনের মুখ। ভারী চোয়াল। থুতনিতে গভীর খাঁজ। গালের মাঝামাঝি পর্যন্ত জুলপি। কোকড়া চুলে পাক ধরেছে। চোখে নীলচে চশমা। পরনে দামি সাফারি স্যুট। বাঁ হাতের কবজিতে সোনার ব্যান্ডে নামকরা কোম্পানির ঘড়ি।

মৃদুলাদের দেখে উঠে দাঁড়াল সুরেশ্বর। বিগলিত সুরে বলল, আসুন আসুন– ভাবখানা এমন, যেন এ বাড়িটা তারই। সম্মানিত অতিথিদের সে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে।

মৃদুলা বলল, বসুন—

বশংবদ ভঙ্গিতে সুরেশ্বর বলল, না, না, আগে আপনারা।

নিঃশব্দে বসে পড়ল মৃদুলা। তার পাশে শিঞ্জিনী। মুখোমুখি সুরেশ্বরও বসল।

ঘরে ঢোকার পর সুরেশ্বরের দিক থেকে লহমার জন্য চোখ সরায়নি মৃদুলা। বাইরের দিকটা কঠিন আবরণে মুড়ে রাখলেও ভেতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছিল তার। সে কি ভয়ে? স্নায়বিক চাপে? মৃদুলা টের পাচ্ছিল, হৃৎস্পন্দন শতগুণ বেড়ে গেছে।

সুরেশ্বর হেসে হেসে জিগ্যেস করল, আমার নামটা কি আপনার মনে আছে?

নিশ্চয়ই আছে। আপনি একজন বিখ্যাত ব্যক্তি।

সুরেশ্বর লঘু সুরে বলল, কুখ্যাত বলুন।

তার কথা যেন শুনতে পায়নি মৃদুলা। বলল, কাল রাতে বাড়ি ফিরে শুনলাম, আপনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। আজ আসবেন। কোনও দরকার আছে?

আছে বইকি। না হলে ফর নাথিং আপনাকে বিরক্ত করতে আসব কেন?

মৃদুলা এবার আর কিছু বলে না। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

সুরেশ্বর বলল, আপনার সঙ্গে একটা ব্যাপারে আলোচনা করতে হবে। শিঞ্জিনীকে দেখিয়ে বলে, মামণি ছেলেমানুষ, ওর সামনে

ইঙ্গিতটা ধরতে পারে মৃদুলা। বলে, আলোচনাটা ওর সামনেই হোক।

একটু ভেবে সুরেশ্বর বলল, বেশ। আপনি যখন তাই চাইছেন—

মৃদুলা উত্তর দিল না।

মনে মনে বক্তব্যটা গুছিয়ে নিয়ে সুরেশ্বর শুরু করল, দু-আড়াই বছর আগেই আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করব ভেবেছিলাম, কিন্তু হঠাৎ আপনার বাবা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন, তাই আর করিনি।

মৃদুলা বলল, আমার বাবা এখনও বেড-রিডন। অতি কষ্টে উঠে বসতে পারেন মাত্র। না ধরলে বিছানা থেকে নামতে পারেন না।

জানি। আশা করি, উনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবেন। সুরেশ্বর বলতে লাগল, এবার কাজের কথায় আসা যাক। নিশ্চয়ই শুনেছেন আমি একজন প্রোমোটার। আপনাদের বাড়ির সামনের রাস্তাতে তো বটেই, চারপাশের নানা এরিয়ায় আমি চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশটা হাই রাইজ তুলেছি। বেশ কয়েকটার কাজ চলছে। অনেকগুলো প্রাইমারি স্টেজে রয়েছে। যেমন ধরুন, যে সব জায়গায় বাড়ি উঠবে সেই জমিগুলোর মালিকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছি, কারও কারও সঙ্গে ডিডস হয়ে গেছে, বেশ কটার প্ল্যান কর্পোরেশনে জমা দিয়েছি।

ও।

একটু চুপচাপ।

তারপর সুরেশ্বর আচমকা জিগ্যেস করে, আপনাদের এই বাড়িটা তো সাড়ে সাত কাঠা জায়গার ওপর।

সঠিক মাপই বলেছে সুরেশ্বর। রীতিমতো চমকে ওঠে মৃদুলা। এমন নির্ভুল তথ্য কোত্থেকে যোগাড় করল সুরেশ্বর?

মৃদুলা পুরোপুরি স্বীকার করল না, হয়তো হবে। কেন বলুন তো?

এখানে রাস্তা বেশ চওড়া। কর্পোরেশন চোখ বুজে এই ল্যান্ডে সাততলা বিল্ডিংয়ের প্ল্যান পাস করে দেবে।

এ বাড়িতে সুরেশ্বরের আবির্ভাবের হেতুটা আগেই আঁচ করেছিল মৃদুলা। এবার উদ্দেশ্যটা তার মুখ থেকেই সরাসরি জানা গেল।

মৃদুলা শুনেছে, সুরেশ্বর যদি কোনও জমি-টমির দিকে হাত বাড়ায়, কারও ক্ষমতা নেই তাকে রোখে। তার শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে শিহরণ খেলে গেল।

সুরেশ্বর থামেনি, আপনাদের সঙ্গে আমি খুব তাড়াতাড়ি ডিল করতে চাই। দুটো সাড়ে বারোশ স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট আপনারা পাবেন। বেস্ট কোয়ালিটির মেটিরিয়াল দিয়ে তৈরি করে দেব। তিনটে বেডরুম, বিরাট ড্রইং-কাম-ডাইনিং হল, কিচেন, স্টোর। প্রত্যেকটা বেডরুমের গায়ে অ্যাটচড বাথ, ব্যালকনি। বাথরুমে আর কিচেনে টাইলস বসিয়ে দেব। তাছাড়া- বলে থেমে গেল সে।

মৃদুলা জিগ্যেস করে, তাছাড়া কী?

সুরেশ্বর হাসল, একটু ভাবুন না?

অত চিন্তাশক্তি আমার নেই।

ব্ল্যাক আর হোয়াইট মিলিয়ে নগদ দশ লাখ টাকাও পাবেন। যদি বলেন কালো টাকা স্পর্শ করবেন না, নো প্রবলেম। অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেকেই পে করব।

মৃদুলা উত্তর দিল না।

সুরেশ্বর বলল, আরও একটা কথা আছে

কী?

যতদিন না এখানে নতুন বাড়ি কমপ্লিট হচ্ছে, আপনাদের থাকার জন্য কাছাকাছি একটা বড় ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করব। তার ভাড়া আমি দেব। বিল্ডিং তৈরি হতে ম্যাক্সিমাম দেড় বছর। তারপর আপনারা নিজেদের ফ্ল্যাটে চলে আসবেন।

মৃদুলা চুপ করে রইল।

সুরেশ্বর বলল, তা হলে পেপার-টেপারগুলো আমাদের লইয়ারকে দিয়ে তৈরি করে ফেলি। ধরুন ব্যাপারটা আট-দশ দিনের মধ্যে হয়ে যাবে। তবে হ্যাঁ, আপনাদের বাড়ির দলিলের ফোটোকপি লাগবে

এবারও জবাব নেই মৃদুলার।

সুরেশ্বর কী বলতে গিয়ে থমকে গেল। কয়েক মুহূর্ত মৃদুলাকে তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ্য করে বলল, কী, আপনি তো কিছুই বলছেন না?

কী বলব?

এই যে এতক্ষণ আমি বকে গেলাম, সে সম্বন্ধে আপনার তো কিছু বক্তব্য থাকতে পারে

মৃদুলা বলল, আপনি কি ধরেই নিয়েছেন, আমাদের বাড়িটা আপনার হাতে তুলে দেব?

সুরেশ্বরের কপালে সামান্য ভাঁজ পড়েই মিলিয়ে যায়। অন্য কোনও প্রোমোটার কি আপনাদের সঙ্গে ডিল করতে চাইছে?

মৃদুলা বলল, এই এরিয়ায় এসে ল্যান্ড যোগাড় করে হাই রাইজ তুলবে, এমন কোনও প্রোমোটার এখনও জন্মায়নি। ঠিক বলছি?

সুরেশ্বরের মুখে আত্মপ্রসাদের হাসি। সে বলল, আপনি কী ইঙ্গিত দিচ্ছেন, ধরতে পারছি। ব্যাপারটা হল, এই অঞ্চলের লোকজন আমাকে ভালোবাসে। পুরোনো বাড়ি জমি আমাকে দেয়। আমিও তাদের ঠকাই না। কথা যা দিই তা রাখি।

কিছুক্ষণ চুপচাপ।

তারপর সুরেশ্বর ফের শুরু করে, আমার অফারটা কি আপনার পছন্দ হয়নি? যদি বলেন ক্যাশ টাকাটা আরও একটু বাড়িয়ে দেব। দশের জায়গায় পনেরো। আশা করি, এবার আর অসুবিধা নেই। বলতে বলতে উঠে পড়ে সে, বলুন দলিলের ফোটো কপিটা নিতে কবে আসব?

মৃদুলার মাথায় অপার্থিব কোনও শক্তি যেন ভর করে। সুরেশ্বরের চেয়ারটার দিকে আঙুল বাড়িয়ে বলে, আর মিনিট পাঁচেক বসে যান।

একটু অবাকই হয়েছিল সুরেশ্বর, কিন্তু মৃদুলার বলার ভঙ্গিতে এমন কিছু রয়েছে, হয়তো তার ব্যক্তিত্ব কিংবা সাহস, যা ঠিক অমান্য করা যায় না। আস্তে আস্তে সে বসে পড়ে।

মৃদুলা বলে, আমার বক্তব্যের কথা বলছিলেন না, সেটা কিন্তু জানাবার সুযোগ পাইনি।

ভেতরে ভেতরে সামান্য হলেও অস্বস্তি বোধ করে সুরেশ্বর। বাইরে অবশ্য তার প্রকাশ নেই। হেসে বলল, ঠিক আছে, বলুন

আপনি আমাদের অনেক খবরই রাখেন। নিশ্চয়ই জানেন, বাড়িটা আমার বাবার। দলিল-টলিল তার নামেই।

জানি।

বুঝতেই পারছেন, এই বাড়ির ব্যাপারে কারও সঙ্গে ডিল করার ক্ষমতা আমার নেই।

সুরেশ্বর বলল, আমি আরও কিছু জানি মৃদুলা দেবী

মৃদুলা সতর্ক ভঙ্গিতে বলে, কী?

আপনি যা বলবেন, এ-বড়িতে সেটাই শেষ কথা। আমার সঙ্গে যখন ডিল করবেন, ইন্দ্রনাথবাবু চোখ বুজে সই করে দেবেন।

এখানেই আপনার ভুল হচ্ছে।

মানে?

বাবা শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেও তার মতামত ছাড়া এ-বাড়িতে কিছুই হয় না। তিনি যখন থাকবেন না, তখন অবশ্য আলাদা কথা। তাছাড়া

কী?

এই বাড়িটা তৈরি করিয়েছিলেন আমার বাবার ঠাকুরদা। বাড়িটার সঙ্গে বাবার ইমোশান, সেন্টিমেন্ট জড়িয়ে আছে। আমি জানি, উনি চান, বাড়িটা যেমন আছে তেমনই থাক।

এর কোনও মানে হয় না।

কীসের কথা বলছেন?

সুরেশ্বর বলল, ওই সব ইমোশান, সেন্টিমেন্ট। হার্ড রিয়ালিটির দিকটা ভাবুন। কার্পোরেশনের ট্যাক্স দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। আপনাদের এতটা জমি। তার মাঝখানে ছোট পুরোনো একটা বাড়ি। নিজেরা বাস করা ছাড়া জমিটা ফালতু পড়েই আছে। কোনও কাজেই লাগছে না। আজকাল কেউ এভাবে ল্যান্ড ফেলে রাখে না। আমি যা বলছি করুন। যে দুটো ফ্ল্যাট পাবেন তার একটায় আরামে থাকবেন। ইচ্ছা করলে অন্যটা ভাড়া দিতে পারবেন। মিনিমাম সাত-আট হাজার টাকা ভাড়া পাবেন। ক্যাশ যা পাবেন সেটা ব্যাঙ্কে ফিক্সড ডিপোজিট করলে মান্থলি দশ-বারো হাজার পেয়ে যাবেন। ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা থাকবে না। কত দিক থেকে লাভ, ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখুন। পরম শুভাকাঙ্ক্ষীর মতো একটানা কথাগুলো বলে সে থামল।

খুব শান্ত মুখে মৃদুলা জিগ্যেস করল, আমাদের লাভের কথা ভেবেই তা হলে অফারটা দিতে এসেছেন?

একদৃষ্টে কিছুক্ষণ মৃদুলাকে লক্ষ্য করল সুরেশ্বর। তার মুখে অদ্ভুত ঠান্ডা হাসি ফুটে ওঠে, আমি প্রোমোটারি করি। ফিলানথ্রপিস্ট নই। আমারও কিছু লাভ থাকবে বইকি। নইলে পেট্রোল খরচা করে আপনাদের কাছে আসব কেন? মৃদুলার মুখ থেকে চোখ না সরিয়ে বলে যেতে লাগল, আমাদের মতো সাধারণ পার্থিব মানুষ দুটো পয়সার আশা থাকে বলেই না চারদিকে ছুটে বেড়ায়?

একটু চুপচাপ।

তারপর মৃদুলা বলল, আপনার অফারটা শুনতে ভালো লাগছে, কিন্তু বাবা রাজি হবেন বলে মনে হচ্ছে না।

সুরেশ্বর বলল, বৃদ্ধ মানুষদের নিয়ে এই এক সমস্যা। পুরোনো সমস্ত কিছুই তারা আঁকড়ে থাকতে চান। টোটালি মিনিংলেস।

মৃদুলা উত্তর দিল না।

সুরেশ্বর বলল, ম্যাডাম, আপনাকে আমার বিশেষ অনুরোধ, বাবাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করান।

যদি রাজি না হন?

হবেন, হবেন। একমাত্র সন্তান আপনি। আপনার কথায় রাজি না হয়ে পারেন?

মৃদুলা বলল, কিন্তু

তাকে থামিয়ে দিয়ে সুরেশ্বর বলল, এর মধ্যে কিন্তু টিন্তু কিছু নেই। আপনাদের অনেকটা সময় নষ্ট করেছি। এবার চলি–

উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে জিগ্যেস করল, ডিলের কাগজপত্র নিয়ে কবে আপনার সঙ্গে দেখা করব?

মৃদুলা আর শিঞ্জিনীও উঠে দাঁড়ায়। মৃদুলা বলে, আপনি ধরেই নিয়েছেন, বাবা আপনার অফারটা মেনে নেবেন?

আমার তো সেই রকমই ধারণা। এখন পর্যন্ত যাকে যাকে অফার দিয়েছি, সবাই তা মেনে নিয়েছে। কবে দেখা করছি?

বাবার সঙ্গে কথা না বলে কী করে বলব?

সে তো বটেই। আপনাকে দিন পাঁচেক সময় দিচ্ছি। আশা করি, এর ভেতর সব ঠিক হয়ে যাবে। আসার আগে আপনাকে ফোন করব।

সুরেশ্বর চলে যাবার পর দোতলায় উঠতে উঠতে শিঞ্জিনী বলল, দাদু যদি রাজি না হয়, কী হবে মা? তার চোখেমুখে ভয়ের ছাপ।

সুরেশ্বর খুব ভদ্রভাবেই কথা বলেছে কিন্তু তার মধ্যে ছিল একটা চাপা হুমকির সুর। মৃদুলাকে খুব উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল। সে বলল, দেখি বাবা কী বলে। তবে

কী?

শনির দৃষ্টি যখন এসে পড়েছে, কিছু করা যাবে বলে মনে হয় না।

ওপরে আসতেই চোখে পড়ল, বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে ইন্দ্রনাথ খোলা দরজা দিয়ে বাইরের রেলিং-ঘেরা টানা বারান্দার দিকে তাকিয়ে আছেন। সুরেশ্বর ভৌমিকের সঙ্গে মৃদুলাদের কী কথা হয়েছে শোনার জন্য তিনি খুবই ব্যগ্র। হয়তো উল্কণ্ঠিতও।

শিঞ্জিনীকে তার ঘরে পাঠাতে চাইল মৃদুলা। সে কিছুতেই যেতে রাজি হল না। মায়ের সঙ্গে ইন্দ্রনাথের ঘরে চলে এল। এক কোনা থেকে দুটো চেয়ার টেনে এনে ইন্দ্রনাথের খাটের কাছাকাছি বসল।

শ্বাস-টানা গলায় ইন্দ্রনাথ জিগ্যেস করলেন, লোকটা বিদেয় হয়েছে?

হ্যাঁ আস্তে মাথা হেলিয়ে দিল মৃদুলা।

কী চায় সে?

সুরেশ্বরের সঙ্গে যা যা আলোচনা হয়েছে তার অনুপুঙ্খ বিবরণ দিল মৃদুলা, খুঁটিনাটি কিছুই বাদ দিল না।

রুগণ, শয্যাশায়ী ইন্দ্রনাথের জীর্ণ শরীরে তীব্র উত্তেজনা চারিয়ে যায়। অসহ্য ক্রোধে তিনি ফেটে পড়েন, এটা মগের মুল্লুক? কী ভেবেছে লোকটা?

মৃদুলা বলল, কিন্তু বাবা, তুমি তো জানো, সুরেশ্বর ভৌমিক কী ডেঞ্জারাস টাইপের লোক।

জানি, জানি ইন্দ্রনাথের দুচোখ থেকে আগুনের ফুলকি বেরুতে থাকে, আমার জমি, আমার বাড়ি। সেটা দেব কি দেব না, তা কি ও ঠিক করবে?

মৃদুলা বলল, বাবা, তুমি এত রাগারাগি করো না। শান্ত হও। শরীরের তো এই হাল। এক্সাইটমেন্ট তোমার পক্ষে ভীষণ ক্ষতিকর।

মেয়ের কোনও কথাই কানে গেল না ইন্দ্রনাথের। তীব্র গলায় তিনি বলতে লাগলেন, এই বাড়ি আমার ঠাকুরদা বানিয়েছিল। রূপাকে ধরলে পাঁচ জেনারেশন আমরা এখানে আছি। বংশের কত স্মৃতি এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। সুরেশ্বর ভৌমিক এসে শাসাল, আর অমনি ভয়ে ভয়ে আমি সব তার হাতে তুলে দিলাম। দেশে আইন-কানুন নেই, পুলিশ নেই?

ইন্দ্ৰনাথ শুনেছেন, সুরেশ্বর ভৌমিক লোকটা ভীষণ খারাপ। কিন্তু কতটা বিপজ্জনক, তার স্পষ্ট ধারণা নেই। মৃদুলা জানে, সুরেশ্বর আইন-কানুন এবং পুলিশ-টুলিশের ঊর্ধ্বে। বাবাকে কী বলবে, সে ভেবে পেল না।

শিঞ্জিনীও সুরেশ্বর সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছে। এজাতীয় লোকেরা নাকি বন্দুকবাজ পোষে। জমি-টমি দখল করার জন্য দরকার হলে তাদের লেলিয়ে দেয়।

সুরেশ্বর ভৌমিককে দেখার পর থেকে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল শিঞ্জিনীর। এই প্রথম সে কথা বলল, দাদু, লোকটা মাকে পাঁচদিন সময় দিয়েছে। তারপর ফোন করবে। তুমি যদি আমাদের বাড়ি তাকে দিতে রাজি না হও, কী যে করবে, বুঝতে পারছি না।

রোগা, শীর্ণ একখানা হাত নাতনির কাঁধে রেখে ইন্দ্রনাথ বললেন, ফোন তো আমার ঘরেই আসবে। যা উত্তর দেবার আমিই দেব। চিন্তা কোরো না। এসব নিয়ে মাথা ঘামিও না। তোমার পরীক্ষা সামনে। পড়াশোনার দিকে ভালো করে নজর দাও।

মৃদুলা আর শিঞ্জিনী, দুজনেই জানে, ইন্দ্রনাথ ভীষণ একগুঁয়ে ধরনের মানুষ। শরীর ভেঙেচুরে গেছে, প্রায় পঙ্গু। তবু জেদটা প্রবল। যদি কোনও সিদ্ধান্ত নেন, সেখান থেকে তাকে সহজে টলানো যায় না। সুরেশ্বরকে তিনি কী বলবেন, তার প্রতিক্রিয়া কী হবে, কে জানে।

.

১০.

বিমলেশ বসুমল্লিককে নিয়ে টেনশন তো ছিলই। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন এক সমস্যা। সুরেশ্বর ভৌমিক।

মারাত্মক উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটছে শিঞ্জিনীর। স্কুলে যাচ্ছে ঠিকই, ক্লাস করছে, টিউটোরিয়ালেও যাচ্ছে, বাড়ি ফিরে পড়ার টেবলেও বসছে। কিন্তু মন দারুণ বিক্ষিপ্ত। বইয়ের পাতার কালো কালো হরফগুলো কেমন যেন ঝাপসা, দুবোধ্য হয়ে যায়। এই উদ্বেগ আরও কিছুদিন চললে পরীক্ষায় ভালো রেজাল্টের আশা নেই।

তবে একটা ব্যাপার শিঞ্জিনী আজকাল লক্ষ্য করছে, অফিস ছুটির পর সোজা বাড়ি চলে আসছে মা। মাঝখানে যে ফিরতে ফিরতে আটটা নটা দশটা হচ্ছিল সেটা বন্ধ হয়েছে।

সুশীলা বালিকার মতো মৃদুলা যে বাড়ি ফিরছে তার কারণ হয়তো এইরকম। সুরেশ্বর ভৌমিক তার মাথায় আতঙ্ক ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে। পাঁচদিন যদিও সময় দিয়েছে, তবু কেন যেন লোকটাকে বিশ্বাস করতে পারছে না। যদি হুট করে এর ভেতর ফোন করে বসে? ইন্দ্রনাথ হয়তো এমন কিছু বলে বসবেন যাতে সমস্যা আরও ঘোরালো হয়ে উঠবে। তাই বাবাকে আগলে আগলে রাখতে চাইছে সে।

অবশ্য মৃদুলার পক্ষে সর্বক্ষণ বাড়িতে বসে থাকা সম্ভব নয়। তাকে অফিসে বেরুতে হয়। সেই ফাঁকেও তো সুরেশ্বরের ফোন আসতে পারে। তা হলে অবশ্য কিছু করার থাকবে না। তবু বাবার কাছে যতক্ষণ থাকা যায়।

এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার ইন্দ্রনাথ বলেছেন, একটা অ্যাম্বুলেন্স যোগাড় করে তাকে যেন মৃদুলারা থানায় নিয়ে যায়। সুরেশ্বর ভৌমিকের নামে তিনি একটা ডায়েরি করবেন।

মৃদুলা বুঝিয়েছে, সুরেশ্বর এখনও তাদের কোনও ক্ষতি করেনি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে থানা গ্রাহ্যই করবে না।

ইন্দ্রনাথ মেয়ের ওপর বিরক্ত হয়েছেন তার মানে যতদিন না ক্ষতি করছে, মুখ বুজে বসে থাকব? আগে থেকে কোনও প্রিকশান নেব না?

এখনই থানায় ছুটলে তার প্রতিক্রিয়া যে মারাত্মক হতে পারে, ইন্দ্রনাথকে তা বোঝানো মুশকিল। মৃদুলা এবং শিঞ্জিনী দুজনেই চুপ করে থাকে।

সুরেশ্বর ভৌমিকের কথার যে নড়চড় হয় না সেটা টের পাওয়া গেল। পাঁচদিন সময় দিয়েছিল সে। এর মধ্যে একবারও যোগাযোগ করেনি।

রবিবার সশরীরে এসে মৃদুলার সঙ্গে কথা বলে গেছে সুরেশ্বর। আজ শনিবার। গতকাল তার দেওয়া সময়সীমা পার হয়েছে।

একটা দিন এ-বাড়ির লোকজনের, বিশেষ করে মৃদুলা আর শিঞ্জিনীর প্রতিটি লহমা তীব্র উৎকণ্ঠায় কেটেছে। আজ ঘুম ভাঙার পর থেকে উদ্বেগটা শতগুণ বেড়ে গেছে। তাদের ধারণা, যে-কোনও মুহূর্তে সুরেশ্বরের ফোন আসবে।

শনিবার শিঞ্জিনীর স্কুলে পুরো ছুটি। এই দিনটা তার কোচিং ক্লাসও থাকে না। কাজেই বাড়ি থেকে বেরুবার প্রশ্ন নেই। শনিবার মৃদুলার হাফ-ডে অফিস। কিন্তু সেও আজ ছুটি নিয়েছে, এবং সকাল থেকে ইন্দ্রনাথের ঘরে বসে আছে। শিঞ্জিনী তার ঘরে পড়ায় মন বসাতে পারছে না। মাঝে মাঝেই অস্থির পায়ে উঠে এসে ইন্দ্রনাথের ঘরে ঘুরে যাচ্ছে।

সারাদিন কেটে যাবার পর যখন সন্ধে কমতে শুরু করেছে সেই সময় সুরেশ্বরের ফোন এল। ইন্দ্রনাথ হাত বাড়াতে যাচ্ছিলেন, তাকে থামিয়ে দিয়ে নিজেই ফোনটা তুলে নিল মৃদুলা।

আমি সুরেশ্বর বলছি।

বুঝতে পারছি। বলুন

কবে ডিলের কাগজপত্র নিয়ে আসব?

আপনি কি ধরেই নিয়েছেন, আমার বাবা রাজি হয়ে গেছেন?

এমন একটা চমৎকার অফার দিয়েছি। রাজি হওয়াই তো উচিত।

শিঞ্জিনীর কান এদিকেই ছিল। টেলিফোন বাজার সঙ্গে সঙ্গে সে দৌড়ে এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়েছে। ওদিকে ইন্দ্রনাথ খাটের বাজুতে ঠেসান দিয়ে বসেছেন। সুরেশ্বর অন্য প্রান্ত থেকে কী বলছে শোনা না গেলেও মৃদুলার উত্তর শুনে বোঝা যাচ্ছে সে কী চায়।

উত্তেজিত ইন্দ্রনাথ ক্ষীণ, দুর্বল কণ্ঠস্বর যতটা সম্ভব উঁচুতে তুলে চিৎকার করছেন, ফোনটা আমাকে দে খুকু। রাসকেলটাকে মজা দেখিয়ে ছাড়ছি।

টেলিফোনটা ইন্দ্রনাথকে দিল না মৃদুলা। নিজেই কথা বলতে লাগল, বাবা রাজি হননি। পোমোটারের হাতে তিনি নিজের বাড়ি-জমি কিছুতেই তুলে দেবেন না।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে সুরেশ্বর। তারপর বলে, কিন্তু ওই বাড়ি আর ল্যান্ড যে আমার চাই ম্যাডাম

মৃদুলা যেন নিজের অজান্তেই বলে ওঠে, না দিলে আপনি কি জোর করে কেড়ে নেবেন?

প্রশ্নটার জবাব না দিয়ে সুরেশ্বর বলল, আমি আপনাকে আরও দুদিন সময় দিলাম। এর মধ্যে যেভাবে হোক, বাবাকে রাজি করাবেন। তাকে বলবেন, সুরেশ্বর ভৌমিক যখন ঠিক করেছে এখানে একটা হাই রাইজ উঠবে তখন সেটা উঠবেই। দুদিন পর আবার কথা হবে। সেটাই হবে আমার লাস্ট ফোন।

বাবা যদি তখনও রাজি না হন?

সে ব্যাপারও ভেবে রেখেছি। তবে আজই তা বলছি না। দুটো দিন ধৈর্য ধরে থাকব। আচ্ছা নমস্কার।

মৃদুলাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে লাইন কেটে দিল সুরেশ্বর। এতক্ষণ ফোনে সে কী বলেছে, তা জানাতেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন ইন্দ্রনাথ। কিছুক্ষণ চেঁচামেচি করলেন, তারপর ভীষণ কাহিল হয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে ক্লান্তিতে চোখ বুজে এল তার।

.

১১.

আরও যে দুদিন সময় পাওয়া গেছে, তার মধ্যেও ইন্দ্রনাথের মনোভাবের তিলমাত্র পরিবর্তন হয়নি। তার শীর্ণ শরীরের কাঠামোটার ভেতর একটি অনমনীয় জেদি মানুষ আছে। তাকে টলানো প্রায় অসম্ভব। একটা বদ লোক বড় বড় দুটো ফ্ল্যাট এবং প্রচুর নগদ টাকার লোভ দেখাচ্ছে, আর তিনি নাচতে নাচতে তার ফাঁদে পা দেবেন, তেমনি বান্দাই নন ইন্দ্রনাথ। ঠাকুরদার তৈরি বাড়ি ভেঙে সেই জায়গায় হাই-রাইজ তুলে চড়া দামে ফ্ল্যাট বিক্রি করবে। বিহারি পাঞ্জাবি মারাঠি মারোয়াড়ি গুজরাটি এমনি নানা জাতের কুড়ি-বাইশটা ফ্ল্যাট-মালিকের সঙ্গে বাস করতে হবে–এই চিন্তাটা তাকে খেপিয়ে তুলেছে। প্রশ্নটা অধিকারবোধের। আমার বাড়ি যেমনই হোক–সেকেলে, সাদামাঠা, রঙচটা কার্নিসভাঙা-সেটা আমারই। তার কোনও ভাগীদার অবাঞ্ছনীয়।

এ হল একটা দিক। অন্য দিকটা আরও অসহ্য। সুরেশ্বর বুঝিয়ে দিয়েছে, জমি-বাড়ি না পেলে কী একটা ব্যবস্থা করবে। মতলবটা পরিষ্কার। যেনতেন প্রকারে বাড়ি-টাড়ি দখল করবে। এটাই ইন্দ্রনাথের মাথায় একটা বারুদের স্তূপে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।

.

ঠিক দুদিন পর আবার সুরেশ্বরের ফোন এল, কী ডিসিশন নিলেন?

মৃদুলা বলল, আপনাকে আগে যা বলেছিলাম, এখনও তাই বলছি। বাবা রাজি নন। তিনি চাইছেন, বাড়িটা যেমন আছে তেমনি থাক।

আপনি নিজে কী চাইছেন?

বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাব না।

এটাই আপনাদের শেষ কথা?

হ্যাঁ।

ধন্যবাদ।

ওধারে ফোন নামিয়ে রাখার শব্দ হল।

.

১২.

আট-দশদিন কেটে গেল।

এর ভেতর আর কোনওরকম যোগাযোগ করেনি সুরেশ্বর। এ-বাড়িতে আসেওনি, ফোনও করেনি। স্পষ্টাস্পষ্টি না বলে দেবার পর সে কি তা হলে হাত গুটিয়ে নিয়েছে? লোকটা যে ধরনের সাঙ্ঘাতিক তাতে আদৌ বিশ্বাস হয় না। গোপনে কী ফন্দি আঁটছে, বোঝারও উপায় নেই।

তবে এটা ঠিক, লোকটা চুপচাপ হয়ে যাওয়ায় ইন্দ্রনাথদের টেনশন কমতে শুরু করেছে।

.

আজ বুধবার। স্কুল ছুটির পর কোচিং ক্লাসে গিয়েছিল শিঞ্জিনী। সপ্তাহের এই দিনটা জয়ব্রত স্যারের বাড়ি স্বর্ণালী আর সে ইকনমিকস পড়তে যায়। দেবারতি মিসের মতো জয়ব্রত স্যারও পাঁচ-ছজনের একেকটা ব্যাচ করে পড়ান। শিঞ্জিনীদের ব্যাচে সে আর স্বর্ণালী ছাড়া অন্য স্কুলের আরও চারজন ছেলেমেয়ে আছে।

যেদিন কোচিং ক্লাস থাকে, বাড়ি ফিরতে দেরি হয় শিঞ্জিনীর। প্রায় আটটা বেজে যায়।

আজ যখন ফিরল, আটটা বাজতে বারো মিনিট বাকি। সে বাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে মালতী জানাল মৃদুলা এখনও ফেরেনি। ইন্দ্রনাথ মেয়ের জন্য ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন। খবরটা দিয়ে আর সে দাঁড়াল না। তার রাতের খাবার গোছগাছ করাই ছিল। সেটা নিয়ে তাদের বস্তিতে চলে গেল।

সুরেশ্বর যেদিন প্রথম এ-বাড়িতে এল, তারপর থেকে অফিস ছুটির পর বাইরে এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করে না মৃদুলা। চার্টার্ড বাস ধরে ছটা-সোয়া ছটার ভেতর ফিরে আসে। মাকে আরও বেশি করে নিজের কাছে পাচ্ছিল শিঞ্জিনী। ইন্দ্রনাথ পাচ্ছিলেন তাঁর মেয়েকে।

কিন্তু আজ মৃদুলার দেরি করার কারণ কী? মা কি ফের তার সেই পুরোনো অভ্যাসে ফিরে গেছে? যেমনটা চার মাস ধরে করে আসছিল? অর্থাৎ বিমলেশ বসুমল্লিকের সঙ্গে নাটক বা সিনেমা দেখা বা দামি হোটেলে খাওয়া বা মোটরে করে কাছাকাছি কোথাও বেড়াতে যাওয়া–এই সব?

একদিন বিমলেশ বসুমল্লিকের কথা স্মৃতি থেকে মুছে গিয়েছিল। মস্তিষ্কের অদৃশ্য কুঠুরি থেকে সে যেন আবার বেরিয়ে আসে। বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথার মতো একটা কষ্ট হতে থাকে তার।

দোতলায় এসে বাইরের বারান্দায় জুতো খুলে প্রথমে ইন্দ্রনাথের ঘরে চলে এল শিঞ্জিনী। যেদিন যেদিন কোচিং ক্লাস থাকে, নাতনি দেরি করে ফেরে। সেটা তার জানা আছে। আজ শিঞ্জিনীর জন্য নয়, আজ তিনি মেয়ের জন্য ভীষণ উতলা। বললেন, কদিন ধরে তোমার মা ঠিক সময়ে ফিরছিল। আটটা বাজতে চলল। আজ এত দেরি করছে কেন বলো তো? একটু থেমে জিগ্যেস করলেন, তোমাকে কি কিছু বলে গেছে?

শিঞ্জিনী আস্তে মাথা নাড়ে, কই, না! বিমলেশ বসুমল্লিকের নামটা তার মুখে প্রায় এসে গিয়েছিল। দ্রুত সামলে নিল। বিমলেশের কথা এখনও তাকে জানানো হয়নি। জানালে উৎকণ্ঠা শতগুণ বেড়ে যাবে।

ইন্দ্রনাথ বললেন, সেই প্রোমোটারটা কোনও শয়তানি করল কি?

বিমলেশের চিন্তাটাই মাথায় পাক খাচ্ছিল শিঞ্জিনীর। সুরেশ্বর ভৌমিকের কথা এই মুহূর্তে ঘুণাক্ষরেও সে ভাবেনি। মায়ের সঙ্গে কী ধরনের শয়তানি করতে পারে লোকটা? মা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী, প্রচণ্ড সাহসী। তবু সংশয় থেকেই যাচ্ছে। সুরেশ্বর সাধারণ মাপের ক্রিমিনাল নয়। অত্যন্ত ধুরন্ধর এবং নিষ্ঠুর। নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সে না পারে এমন কোনও কাজ নেই। খুনখারাপি, ঘরে আগুন থেকে যাবতীয় দুষ্কর্ম। একটি মহিলার পক্ষে তাকে ঠেকানো কতটা সম্ভব?

অন্যমনস্কর মতো ইন্দ্রনাথ বললেন, সেই নটায় বেরিয়েছ। স্কুল, কোচিং ক্লাস করে, নিশ্চয়ই খুব টায়ার্ড। যাও, আগে হাতমুখ ধুয়ে রেস্ট নিয়ে কিছু খেয়ে নাও। তারপর পড়তে বসো।

ইন্দ্রনাথের খাট থেকে বইয়ের ব্যাগ নিয়ে মেঝেতে নামাতে নামাতে শিঞ্জিনী বলল, কদিন মা ঠিক সময়ে বাড়ি ফিরছে। তার আগে তো বেশ দেরি করত। হয়তো কোনও

কারণে আটকে গেছে। তুমি এত ভেবো না।

ইন্দ্রনাথের চোখ বুজে আসছিল। নিশ্চয়ই বস্তিতে যাবার আগে মালতী তাকে রাতের খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে গেছে।

শিঞ্জিনী নিজের ঘরে গিয়ে বাথরুম থেকে ঘুরে এসে পোশাক পালটে ফেলল। মালতী তার ঘরে খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে গিয়েছিল। ভীষণ খিদে পেয়েছে। খাওয়া চুকিয়ে কিছুক্ষণ বিছানায় শরীর ছেড়ে দিয়ে জিরিয়ে নিল। তারপর পড়ার টেবলে গিয়ে টেবলল্যাম্প জ্বেলে পড়তে বসে গেল।

.

কতক্ষণ বইয়ের ভেতর ডুবে ছিল, খেয়াল নেই। হঠাৎ রাতচরা কোনও পাখির কর্কশ ডাকে চমকে উঠল শিঞ্জিনী। সমস্ত এলাকা এখন নিঝুম। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবাই ঘুমের আরকে ডুবে আছে। দক্ষিণ দিকের আগাছায় ভরা মাঠ, পানাপুকুরে ঠাসা জলাটার ওধারে উঁচু উঁচু বাড়িগুলোর প্রায় সব বাতি নিভে গেছে। দু-একটা জানালায় ক্ষীণ আলোর রেখা চোখে পড়ে।

আকাশে ছাড়া ছাড়া কিছু মেঘ আছে। তবে ঝড়-বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। মহাশূন্যে লক্ষ কোটি তারার মেলা। ক্ষীণ একটি চাঁদও দেখা যাচ্ছে।

স্বয়ংক্রিয় কোনও নিয়মে শিঞ্জিনীর চোখ সামনের দেওয়াল ঘড়িতে আটকে যায়। একটা বেজে সতেরো। চমকে উঠল সে। মা তো এখনও ফিরে আসেনি! এলে নীচে কলিংবেল বাজাত।

বিমলেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হবার পর বাড়ি ফিরতে দেরি হয়েছে ঠিকই কিন্তু দশটা-সাড়ে দশটার মধ্যে চলে এসেছে মৃদুলা। এখন একটা বেজে সতেরো। এ তো ভাবাই যায় না। কী হতে পারে মায়ের? মারাত্মক কোনও অ্যাকসিডেন্ট?

মাথার ভেতরটা গুলিয়ে যেতে থাকে শিঞ্জিনীর। দিশেহারার মতো সে দৌড়ে ইন্দ্রনাথের ঘরে চলে আসে। দাদু ওষুধ খেয়ে অসাড়ে ঘুমোচ্ছে।

কোচিং থেকে ফিরে যখন শিঞ্জিনী এ-ঘরে আসে, বেশি পাওয়ারের বাল্বটা জ্বলছিল। সেটা নিভিয়ে নাইট ল্যাম্প জ্বেলে দিতে ভুলে গিয়েছিল সে।

অন্যদিন মা থাকে। আজ একটি রুগণ ঘুমন্ত বৃদ্ধ ছাড়া এ-বাড়িতে আর কেউ নেই। শিঞ্জিনীর গা ছম ছম করতে লাগল। একতলায় খাবার টেবলে রুটি বা পরোটা, ডাল, তরকারি, মাংস-টাংস গুছিয়ে রেখে গেছে মালতী। মায়ের জন্য মন যেভাবে তোলপাড় হচ্ছে, খাওয়ার কথা তার মাথাতেই এল না। একা একা নিজের ঘরে সে চলে যাবে, সে সাহসটুকুও আর অবশিষ্ট নেই। শিঞ্জিনীর গা ছম ছম করতে লাগল।

যতই অথর্ব পঙ্গু হোক, যতই ঘুমিয়ে থাকুক, একটা জীবন্ত মানুষ তো। শিঞ্জিনী এতটুকু শব্দ না করে ঘরের কোণ থেকে একটা চেয়ার টেনে এনে দাদুর খাটের পাশে বসে রইল।

এ-ঘরে ইন্দ্রনাথের শিয়রের দিকের টেবলে একটা পুরোনো ঘড়ি আছে। মাঝে মাঝেই সেটার দিকে শিঞ্জিনীর চোখ চলে যাচ্ছে। দেড়টা বাজল, দুটো বাজল, তিনটে বাজল। ঘড়ির কাটা যান্ত্রিক নিয়মে ঘুরেই চলেছে।

স্নায়ুগুলো টান টান করে বসেই রয়েছে শিঞ্জিনী। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে, এই বুঝি মা এল, এই বুঝি নীচে কলিং বেলবেজে উঠল।

.

একসময় সকাল হল।

কখন সূর্য উঠেছে, খেয়াল করেনি শিঞ্জিনী। খোলা-দরজা-জানালা দিয়ে অঢেল বোদ এসে পড়েছে ইন্দ্রনাথের ঘরে।

সারা রাত লহমার জন্যও ঘুমোয়নি শিঞ্জিনী। কপালের দুপাশের শিরাগুলো দপ দপ করছে। যন্ত্রণায় মাথা যেন ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। আয়নার সামনে গিয়ে এখন যদি সে দাঁড়াত, দেখতে পেত, তার চুল উষ্কখুষ্ক। চোখ দুটো লাল টকটকে। গালে চোখের জলের শুকনো দাগ।

এদিকে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল ইন্দ্রনাথের। চোখ মেলে নাতনিকে খাটের পাশে বসে থাকতে দেখে অবাক হলেন। তারপর ভালো করে লক্ষ্য করতেই চমকে উঠলেন, এ কী, তুমি এখানে বসে আছ! রাত্তিরে ঘুমোওনি?

না। আস্তে মাথা নাড়ল শিঞ্জিনী।

কেন?

ধরা ধরা, ভাঙা গলায় কারণটা জানাল শিঞ্জিনী।

কনুইয়ে ভর দিয়ে ধড়মড় করে নিজের জরাজীর্ণ শরীরটা টেনে তুললেন ইন্দ্রনাথ। লহমায় একটা মানুষের চেহারা এতটা ভেঙেচুরে যেতে পারে, ভাবা যায় না। এমনিতেই রোগে রোগে শরীরে প্রায় কিছুই ছিল না। চামড়া আর হাড়ের কাঠামো মাত্র। সেটা এখন একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে।

রুদ্ধশ্বাসে ইন্দ্রনাথ জিগ্যেস করলেন, সারা রাত খুকু ফেরেনি। ফোনও করেনি?

না।

আমাকে জানাওনি কেন?

ঘুম ভাঙালে তোমার শরীর খারাপ হত।

উদ্ভ্রান্তের মতো ইন্দ্রনাথ এবার বললেন, কেন এল না মেয়েটা? কেন? কী হল ওর?

তিনটে সম্ভাবনার কথা আগেই মাথায় এসেছিল শিঞ্জিনীর। এক, দুর্ঘটনা। দুই, বিমলেশের সঙ্গে বাইরে কোথাও গিয়ে হয়তো আটকে পড়েছে মৃদুলা। তিন, সুরেশ্বর ভৌমিক এমন কিছু করেছে যাতে তার পক্ষে ফেরা সম্ভব হয়নি।

অস্থির অস্থির ভাবটা খানিক কাটিয়ে উঠে ইন্দ্রনাথ বললেন, মালতী তো এখনও আসেনি?

শিঞ্জিনী বলল, সে কি এত তাড়াতাড়ি আসে?

এক কাজ করো। আমাকে ধরে ধরে বাথরুমে নিয়ে যাও। মুখ-টুখ ধুয়ে বাসি পোশাক পালটে নেব। আমার হলে তুমিও মুখ ধুয়ে জামাকাপড় বদলে এসো!

মালতী রোজ সকালে এসে দাদুকে বাথরুমে ঘুরিয়ে এনে ফিটফাট করে বিছানায় শুইয়ে দেয়। সে যতক্ষণ না আসে, ইন্দ্রনাথ অপেক্ষা করেন। আজ তার কেন এত তাড়া, বোঝা যাচ্ছে না।

ইন্দ্রনাথ আবার বললেন, তুমি এসে অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করবে। ওরা স্ট্রেচারে করে আমাকে থানায় নিয়ে যাবে। তুমিও সঙ্গে থাকবে।

কয়েক পলক অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে শিঞ্জিনী। তারপর বলে, থানায় যাবে কেন?

একটা মেয়ে সারারাত বাড়ি ফিরল না। থানায় খবর দিতে হবে না? ওরাই নানা জায়গায় খোঁজ করে–

ইন্দ্রনাথের কথা শেষ হতে না হতেই টেলিফোন বেজে ওঠে। ইন্দ্রনাথ ব্যগ্র সুরে বলেন, দেখো তো দিদি

টেলিফোন তুলে হ্যালো বলতেই একটা অচেনা ভারীমতো গলা ভেসে এল, আমি মৃদুলাদেবীর মেয়ে শিঞ্জিনীর সঙ্গে কথা বলতে চাই।

বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে শিঞ্জিনীর। ভয়ে ভয়ে সে বলে, আমিই শিঞ্জিনী। আপনি কে বলছেন?

আমাকে তুমি চিনবে না। তোমার মা আমাদের কাছেই আছেন। তার জন্যে চিন্তা কোরো না। নিজেদের দিদির মতো সম্মান দিয়ে তাকে আমাদের কাছে রেখেছি।

মাকে ফোনটা দিন। আমি তার সঙ্গে কথা বলব। সারা রাত আমি ঘুমোতে পারিনি।

খুব স্বাভাবিক। তোমাদের আগেই ফোন করা উচিত ছিল। ভুল হয়ে গেছে।

আমার দাদু ভীষণ অসুস্থ। মায়ের কিছু হলে তিনি বাঁচবেন না। ব্যাকুলভাবে শিঞ্জিনী বলতে লাগল, আমরা আপনাদের কোনও ক্ষতি করিনি। প্লিজ, মাকে ছেড়ে দিন। নইলে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে দিন।

এখন কোনওটাই সম্ভব নয়। দাদুকে টেনশন করতে বারণ করো। তোমাকে তো আগেই বলেছি, মৃদুলাদেবীকে খুব যত্ন করে, মর্যাদা দিয়ে আমাদের কাছে রেখেছি।

মাকে আটকে রাখার কারণটা কী? আমরা তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

কারণ একটাই। আমরা তোমাদের দারুণ একটা অফার দিয়েছিলাম। তোমার দাদু রাজি হলেন না। তাই বাধ্য হয়ে লোকটা বলতে লাগল, সে যাক। কাল এই সময় আবার ফোন করব। তোমার দাদুকে কাগজপত্র পাঠিয়ে দেব। তিনি সই করে দিলে এক ঘণ্টার ভেতর মৃদুলা দেবী বাড়ি পৌঁছে যাবেন।

সুরেশ্বরই যে এই লোকটাকে দিয়ে ফোন করাচ্ছে, আগেই টের পাওয়া গেছে। শিঞ্জিনী উত্তর দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই লাইন কেটে দিল লোকটা।

দম বন্ধ করে তাকিয়ে ছিলেন ইন্দ্রনাথ। নাতনির মুখে সব শোনার পর আতঙ্কগ্রস্তের মতো বললেন, ওরা নিয়ে যাক আমার জমি-বাড়ি। যা লেখাতে চায়, লিখিয়ে নিক। শুধু আমার খুকুকে ফিরিয়ে দিক। তাঁর মনোবল, সুরেশ্বর ভৌমিকের সঙ্গে যুদ্ধ করার সাহস, সব চুরমার হয়ে গেছে।

কিন্তু লহমায় বদলে গেল শিঞ্জিনী। ভয়, শঙ্কা, উৎকণ্ঠা–সব যেন উধাও হয়ে যায়। একটা লোক মাকে আটকে রেখে, চাপ দিয়ে সর্বস্ব লিখিয়ে নিতে চাইছে, কিছুতেই তা মেনে নিতে পারছে না সে। ইন্দ্রনাথের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ। চব্বিশ ঘণ্টা সময় পাওয়া গেছে। যা করার এর মধ্যেই তাকে করতে হবে। হঠাৎ দুর্জয় সাহস যেন তার মাথায় ভর করেছে।

শিঞ্জিনী বলল, দাদু, আমি এখন একটু বেরুব। তুমি না বলো না

নির্জীব সুরে ইন্দ্রনাথ জিগ্যেস করলেন, কোথায় যাবে?

দু-একজনের সঙ্গে দেখা করব। যদি বাড়ি-টাড়ি বাঁচানো যায় আর মাকে উদ্ধার করে আনতে পারি।

চকিত হয়ে উঠলেন ইন্দ্রনাথ, তোমার মতো একটা বাচ্চা মেয়ের পক্ষে ওই রকম বদমাশ ক্রিমিনালদের বিরুদ্ধে কতটুকু কী করা সম্ভব? ওরা যদি টের পায়, তুমি কিছু একটা করতে যাচ্ছ, তোমার মায়ের বিপদ তো বাড়বেই, তোমারও ভীষণ ক্ষতি হয়ে যাবে?

শিঞ্জিনী বলল, কেউ কিছু জানতে পারবে না।

বাধা দেবার ক্ষমতাও শেষ হয়ে গিয়েছিল ইন্দ্রনাথের। বললেন, দেখো, যদি কিছু করতে পারো। কিন্তু খুব সাবধান

.

কী করবে মোটামুটি তার একটা পরিকল্পনা ঠিক করে নিয়েছিল শিঞ্জিনী। মালতী এলে তার হাতে ইন্দ্রনাথ এবং বাড়ির দায়িত্ব দিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে।

বড় রাস্তার মোড়ে একটা টেলিফোন বুথ রয়েছে। সেখান থেকে প্রথমে শিবপুরে রজতের হোস্টেলে ফোন করল শিঞ্জিনী। তার গলা শুনে রজতের মনে হল, আকাশের চাঁদ যেন হাতের মুঠোয় নেমে এসেছে।

তুমি যে আমাকে ফোন করবে, ভাবতে পারিনি। উঃ, কী ভালো যে লাগছে!

শতধারায় রজতের উচ্ছ্বাস ফেটে বেরিয়ে আসছিল। তাকে থামিয়ে দিয়ে শিঞ্জিনী বলল, আমি একটা ভীষণ বিপদে পড়েছি। আপনি কি সাহায্য করবেন?

তার কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যাতে থমকে গেল রজত। একটু চুপ করে থেকে বলল, কী বিপদ? কী ধরনের সাহায্য?

বিপদের বিবরণ শুনিয়ে শিঞ্জিনী বলল, আপনার মায়ের বহু পুরোনো ছাত্র অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের বড় বড় পোস্টে রয়েছেন। তাদের ব্যাপারটা জানালে আমাদের প্রবলেমটা হয়তো

আগেই দমে গিয়েছিল রজত। বলল, পোমোটার, কিডন্যাপিং–এ সব ব্যাপারে নিজেকে জড়ালে মা বাড়ি থেকে বার করে দেবে। আচ্ছা, রাখছি।

.

রজতের কাছ থেকে সাহায্যের কোনওরকম আশাই নেই। শিঞ্জিনী টেলিফোন বুথ থেকে সোজা চলে এল থানায়। অফিসার-ইন-চার্জকে তার সমস্যার কথা সবিস্তার জানাল।

খুব মনোযোগ দিয়ে অফিসার শিঞ্জিনীর কথা শুনলেন। সহৃদয় সুরে বললেন, ব্যাপারটা সাঙ্ঘাতিক। কাল একটা কিডন্যাপিংয়ের খবর পেয়েছি। তবে কে কিডন্যাপড হয়েছে, কারা এই নোংরা কাজটা করেছে, এখনও কিছুই জানা যায়নি। তোমার টেনশনটা বুঝতে পারছি মা। আমরা খোঁজখবর নিয়ে নিশ্চয়ই ব্যবস্থা করব। তোমাদের ঠিকানা রেখে যাও। তোমার মায়ের সন্ধান পেলেই যোগাযোগ করব। একটু থেমে বললেন, সুরেশ্বর ভৌমিক বিরাট প্রোমোটার। সলিড প্রমাণ ছাড়া তার গায়ে তো হাত দেওয়া যায় না।

.

শিঞ্জিনীর মাথায় জেদ চেপে গেছে। পুলিশ অফিসার যে এড়িয়ে গেলেন তা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না।

দুজায়গায় ব্যর্থ হবার পর ফার্ন রোডে স্বর্ণালীদের বাড়ি চলে এল শিঞ্জিনী। স্বর্ণালীর বাবা দেবকুমার আঙ্কল বাড়িতেই ছিলেন। তাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন। তাদের বাড়ির সবার প্রতি ওঁর গভীর সহানুভূতি।

সব শুনে দেবকুমার সিঁটিয়ে গেলেন। সুরেশ্বর ভৌমিকের নাম এবং তার কার্যধারা সম্বন্ধে যাবতীয় খবরই রাখেন। বুঝিয়ে দিলেন, এমন লোকের বিরুদ্ধে একটা আঙুল তোলার ক্ষমতা তার নেই।

.

বিপর্যস্ত, হতাশ শিঞ্জিনী কী করবে, ভেবে পাচ্ছিল না। স্বর্ণালীদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে উদ্দেশ্যহীনের মতো হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বিমলেশের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। মা বলেছিল, এই লোকটার পুলিশ, প্রশাসন এবং মন্ত্রিমহলে প্রচুর যোগাযোগ এবং প্রভাব।

বিমলেশ সম্পর্কে শিঞ্জিনীর মনে যা পুঞ্জীভূত হয়ে আছে তা হল প্রচণ্ড আক্রোশ। সেই সঙ্গে বিদ্বেষ। তার অফিসের ঠিকানাটা মায়ের মুখে শুনেছিল। আশ্চর্য, সেটা মনেও আছে। কখন যে ট্যাক্সি নিয়ে সেখানে পৌঁছে গিয়েছিল, খেয়াল নেই।

একটা বিশাল হাইরাইজের তিনটে ফ্লোর জুড়ে বিমলেশের পিকক ইন্ডাস্ট্রিজ-এর বিশাল অফিস। তাঁর সঙ্গে সহজে দেখা করা গেল না। রিসেপশানের স্মার্ট ঝকঝকে সুন্দরী তরুণীটি তাকে রুখে দিল। চেয়ারম্যান অর্থাৎ বিমলেশ আজ ভীষণ ব্যস্ত। শিঞ্জিনী যেন অন্য দিন আসে।

ফিরে যাবার জন্য শিঞ্জিনী আসেনি। একটা শ্লিপ লিখে রিসেপশনিস্ট মেয়েটাকে দিয়ে কঠোর সুরে বলল, এটা আপনাদের চেয়ারম্যানকে পাঠিয়ে দিন। নইলে আপনি অসুবিধায় পড়বেন।

কয়েক লহমা শিঞ্জিনীর দিকে তাকিয়ে রইল মেয়েটি। তারপর নিজেই স্লিপটা নিয়ে চলে গেল।

কয়েক মিনিটের ভেতর প্রায় ছুটতে ছুটতে চলে এলেন বিমলেশ। তার চোখে-মুখে অপার বিস্ময়, তুমি!

শিঞ্জিনী বলল, বিশেষ দরকারে আপনার কাছে আসতে হল। আমরা খুব বিপদে পড়েছি।

রিসেপশানে আরও লোজন রয়েছে। তাদের সামনে কোনও প্রশ্ন করলেন না বিমলেশ। শিঞ্জিনীকে চমৎকার-সাজানো বিশাল এক চেম্বারে এনে বসালেন। নিজে তার সামনে বসলে বসতে বললেন, কী হয়েছে, বলো

শিঞ্জিনী যা যা ঘটেছে, কাল রাতটা কী নিদারুণ উল্কণ্ঠায় তাদের কেটেছে, সব জানাল। সেই সঙ্গে সুরেশ্বর ভৌমিকের ক্রমাগত চাপ এবং হুমকির ব্যাপারটাও।

সমস্ত শোনার পর মুখটা থমথমে হয়ে যায় বিমলেশের। বললেন, ভেবো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন বলো, কী খাবে?

কিচ্ছু না। দাদু বাড়িতে খুব ভাবছে। এখনই আমাকে ফিরে যেতে হবে।

বিমলেশ অনুমান করে নিলেন, এখন খাওয়ার মতো মনের অবস্থা নয় শিঞ্জিনীর। তিনি জোর করলেন না। বললেন, ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি। সে তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে।

বিমলেশের গাড়িতে ওঠার ইচ্ছা ছিল না। অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হল শিঞ্জিনী।

.

১৩.

সকালে শিঞ্জিনী যখন বাড়ি থেকে বেরোয়, ঘড়িতে তখন সোয়া আটটা। বিমলেশের সঙ্গে দেখা করে বাড়ি ফিরেছিল সাড়ে বারোটায়। এতক্ষণ কোথায় কোথায় ঘুরেছে, কার কার সঙ্গে দেখা করেছে, সব ইন্দ্রনাথকে বলেছে সে। শুধু বিমলেশের সঙ্গে মৃদুলার সম্পর্কটাই জানায়নি।

সেই বারোটা থেকে ইন্দ্রনাথ আর শিঞ্জিনী উৎকণ্ঠিত হয়ে আছে। এমনকী মালতী। সে-ও সব জেনে গেছে।

সন্ধের খানিক আগে, তখনও মরা মরা একটু রোদ চারদিকে আলগাভাবে জড়িয়ে আছে, সেই সময় কলিংবেল বেজে ওঠে। সেই সঙ্গে মৃদুলার ডাক ভেসে আসে, রূপা রূপা-মালতী।

রূপা ঊর্ধ্বশ্বাসে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে নীচে এসে দরজা খোলে। মালতীও দৌড়ে এসেছে।

মাকে দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে শিঞ্জনী। তারপর দুহাতে তাকে জড়িয়ে ধরে। ভাঙা ভাঙা, জড়ানো গলায় বলে, কাল কী হয়েছিল তোমার মা? সুরেশ্বর ভৌমিকরা তোমাকে কীভাবে ধরে নিয়ে গেল?

মৃদুলাও কাঁদছিল। বলল, সুরেশ্বরের গানম্যানরা বন্দুক দেখিয়ে আমাকে জোর করে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। পরে সব শুনিস। রাস্তার দিকে আঙুল বাড়িয়ে বলল, উনি না বাঁচালে কী যে হত!

ফুটপাতের ধার ঘেঁষে একটা এয়ার-কন্ডিশনড টোয়েটা। সেটার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন বিমলেশ। শিঞ্জিনীর সঙ্গে চোখাচোখি হতে নরম গলায় বললেন, তোমার মাকে দিয়ে গেলাম। সুরেশ্বর আর কোনও গোলমাল করবে না। আচ্ছা, চলি–

হঠাৎ অদ্ভুত এক আবেগ শতধারায় বুকের ভেতর থেকে উঠে এসে গলার কাছে ডেলা পাকিয়ে যেতে লাগল শিঞ্জিনীর। বিমলেশ গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিলেন, মাকে ছেড়ে দৌড়ে তার কাছে চলে আসে সে, প্লিজ, যাবেন না

দাদু পঙ্গু মানুষ। নির্জীব, শয্যাশায়ী। কবে আছেন, কবে নেই। এদিকে শকুনের পাল, হাঙরের দঙ্গল তাদের ছিঁড়ে খাবার জন্য দাঁত-নখ শানিয়ে রেখেছে। মাথার ওপর বিমলেশের মতো একজন শক্তিমান মানুষ না থাকলে তারা বাঁচবে না।

বিমলেশ বললেন, যেতে বারণ করছ?

হ্যাঁ। ধরা গলায় শিঞ্জিনী বলল, আসুন

এই ডাকটার জন্য কতদিন অপেক্ষা করে আছেন বিমলেশ। তাঁর মুখে ধীরে ধীরে হাসি ফুটে ওঠে। আশ্চর্য সুন্দর। মায়াময়। বললেন, তুমি যখন যেতে বলেছ, নিশ্চয়ই তোমাদের বাড়ি যাব–

দুচোখ বাষ্পে ভরে যেতে থাকে শিঞ্জিনীর।

(সত্য ঘটনা অবলম্বনে এই উপন্যাস রচিত। স্থান এবং চরিত্রগুলির নাম বদলে দেওয়া হয়েছে। বহু ক্ষেত্রে নেওয়া হয়েছে কল্পনার আশ্রয়।)

Exit mobile version