Site icon BnBoi.Com

ভূমিকা – প্রফুল্ল রায়

ভূমিকা - প্রফুল্ল রায়

 ১. নারী-জাগরণ-এর অফিসে

০১.

নারী-জাগরণ-এর অফিসে আজ প্রবল উত্তেজনা। শ-পাঁচেক মেম্বারের প্রায় সবাই দুপুর একটার মধ্যে চলে এসেছে। আশা করা যাচ্ছে, দুটোর ভেতর বাদবাকিরা এসে পড়বে। কেননা সভাপতি অমিতাদি তিনদিন আগেই বোর্ডে নোটিশ টাঙিয়ে কড়া নির্দেশ দিয়েছিলেন, আজ যার যত জরুরি কাজই থাক, সব ফেলে প্রতিটি মেম্বারকে দুটোর মধ্যে অফিসে হাজির হতে হবে। শুধু টাইপ-করা নোটিশ লাগিয়েই বসে থাকেননি অমিতাদি, প্রতিটি সদস্যকে আলাদা আলাদা করে আসতে বলেছেন। যাদের এ-কদিন অফিসে দেখা যায়নি, তাদের বাড়ি বাড়ি লোক পাঠিয়ে খবর দিয়েছেন।

নারী-জাগরণ মেয়েদের একটি সমিতি। সমাজের সকল স্তরে নারীর মর্যাদা এবং সম্মান রক্ষার জন্য এরা কাজ করে চলেছে। নারী প্রগতি, নারী স্বাধীনতায় এরা বিশ্বাসী। মেয়েদের ওপর যেখানেই অন্যায় বা নির্যাতন চলে সমিতি তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। মেয়েরা পারিবারিক এবং সামাজিক দিক থেকে কোন লেভেলে পড়ে সেই সম্বন্ধে মানুষকে সচেতন করে তোলার দায়িত্ব এরা নিয়েছে।

নারী-জাগরণ-এর মেম্বার প্রধানত মহিলারাই। তবে সমধর্মী কিছু পুরুষ, যারা ভারতবর্ষের মতো পিছিয়ে-থাকা দেশে মেয়েদের হাজার রকম সমস্যা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করে–এই সমিতির সভ্য হয়েছে। এরা সমাজের সকল স্তরে মেয়েদের সমানাধিকার দাবি করে। পুরুষের পাশাপাশি মেয়েরা একইরকম মর্যাদা নিয়ে চলবে, এটাই তাদের কাম্য।

নারী-জাগরণ-এর অফিসটা দক্ষিণ কলকাতার নিরিবিলি এক রাস্তায়। বড় কম্পাউন্ডওলা একতলা বাড়ি, সামনে অনেকটা খোলামেলা জায়গা জুড়ে সবুজ ঘাস। চারদিকে প্রচুর গাছপালা এবং অসংখ্য পাখি। কলকাতার মতো শহরে যেখানে প্রতিদিন পপুলেশন এক্সপ্লোশান অর্থাৎ জনবিস্ফোরণ ঘটে চলেছে, মানুষ বাড়ছে হু-হুঁ করে, মাথাপিছু যেখানে দশ স্কোয়ার ফিটও বরাদ্দ নেই সেখানে এরকম একটা জায়গার কথা ভাবা যায় না।

অফিসবাড়িটায় সবসুদ্ধ সাতখানা ঘর। দুটো ঘর নিয়ে চমৎকার একখানা লাইব্রেরি। অন্য ঘরগুলোতে নারী-জাগরণ-এর নানা ডিপার্টমেন্ট। এইসব ঘরের দেয়াল জুড়ে উঁচু উঁচু আলমারি। আলমারিগুলো নানারকম এবং ফাইলপত্রে ঠাসা। মেয়েদের নিয়ে সারা ভারতে যেখানে যা যা ঘটনা ঘটে চলেছে, এবং খবরের কাগজে এ-বিষয়ে যেসব রিপোর্ট বেরুচ্ছে। ফাইলগুলোতে তার কাটিং সাজানো রয়েছে। এছাড়া প্রতিটি ঘরেই রয়েছে টেবিল-চেয়ার, টাইপরাইটার ইত্যাদি।

আজ অমিতাদি সবাইকে জরুরি তলব করে যে ডেকে এনেছেন তার কারণ এইরকম। দুদিন আগে বালিগঞ্জের এক দামি, অভিজাত পাড়ায় দাবি অনুযায়ী পণ দিতে না পারায় একটি বধূকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। বধূ-হত্যার প্রতিবাদে আজ দুটোয় নারী-জাগরণ মিছিল বার করবে। সদস্যরা না এলে মিছিল হবে কী করে?

একসঙ্গে এতজন মেম্বার এসে পড়ায় অফিসে জায়গা হয়নি। বেশিরভাগই বাইরের সবুজ জমিতে বসে আছে। মিছিলে নিয়ে যাবার জন্য কয়েকজন পোস্টারে স্লোগান লিখছে। বাকিরা দুদিন আগের বউ-পোড়ানোর ঘটনা নিয়ে তুমুল চেঁচামেচি করেছে। টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরির শেষের দিকে এরকম জঘন্য ঘটনা যে ঘটতে পারে-~এর চাইতে লজ্জার কী হতে পারে! এই কলকাতায়, যেখানে একশো-সোয়াশো বছর আগেই নারীমুক্তির জন্য আন্দোলন হয়েছে, আজ সেখানেই কিনা পুত্রবধূ পোড়ানো হচ্ছে! ভাবা দরকার সোসাইটি সামনের দিকে কতটা এগিয়েছে, নাকি মধ্যযুগের বর্বরতায় ফিরে যাচ্ছে? এর প্রতিকার এখনই করা দরকার, ইত্যাদি।

অফিসের সামনের বড় ঘরটায় গ্লাস-টপ অর্ধবৃত্তাকার একটি টেবলের ওধারে বসে ছিলেন নারী-জাগরণ-এর প্রেসিডেন্ট অমিতাদি-অমিতা সরকার। তিনি মুখে মুখে ডিটেশন দিয়ে যাচ্ছেন।

তাঁর মুখোমুখি টেবিলের ধারে বসে মুখ নীচু করে নোট নিয়ে যাচ্ছে একটি মেয়ে–অদিতি।

এঘরে আরও কয়েকটি তরুণ-তরুণীকেও দেখা যাচ্ছে। তাদের কেউ ফাইল ঠিক করে রাখছে, কেউ খবরের কাগজের কোনো দরকারি রিপোর্ট কাঁচি দিয়ে কাটছে, কেউবা সামনের আলমারি থেকে লাল শালুর ফেস্টুন বার করছে। ফেস্টুনটায় বড় বড় হরফের লেখা আছে-নারী-জাগরণ।

অমিতাদি যে ব্যাপারে ডিকটেশন দিচ্ছেন সেটা হল একটা মেমোরেন্ডাম অর্থাৎ স্মারকলিপি মিছিলটা দক্ষিণ কলকাতা ঘুরে শেষপর্যন্ত রাইটার্স বিল্ডিংসে যাবে। সেখানে মুখ্যমন্ত্রীর হাতে এই স্মারকলিপি দেওয়া হবে।

এবার অমিতাদির দিকে ভালো করে তাকানো যেতে পারে। তার বয়েস পঞ্চান্নছাপ্পান্ন। কাঁচা-পাকা চুল ছেলেদের মতো ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা।

বাঙালি মেয়েদের তুলনায় তাঁকে লম্বাই বলা যায়। হাইট পাঁচ ফিট ছয় কি সাত। গায়ের রং বাদামি, নাক-মুখ কাটা কাটা, ধারালো চিবুক। চোখে ভারী ফ্রেমের চশমা, পুরু লেন্সের ওধারে ঝকঝকে তীক্ষ্ণ চোখ। বাঁ হাতে চওড়া স্টিল ব্যান্ডের চৌকো ইলেকট্রনিকস ঘড়ি ছাড়া সারা শরীরে গয়না-টয়না বলতে কিচ্ছু নেই।

অমিতাদির পরনে পুরুষদের মতো ট্রাউজার্স আর হাতা গোটানো ফুলশার্ট, পায়ে চপ্পল। পুরুষ এবং নারীর কোনোরকম পার্থক্য তিনি মানেন না। এমনকি পোশাকের বেলাতেও না।

তাঁর হাতে এই মুহূর্তে রয়েছে একটি জ্বলন্ত সিগারেট। সামনের অ্যাশট্রেটা পোড়া সিগারেটের টুকরোয় প্রায় বোঝাই।

অমিতাদি চেইন স্মোকার। তাঁর হাতে সিগারেট নেই, এমন দৃশ্য আদৌ চোখে পড়ে না।

তিনি ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতি পড়ান। পুরু চশমা, শার্ট-ট্রাউজার্স, সিগারেট, মাথায় বয়েজ-কাট চুল–সব মিলিয়ে অমিতাদিকে ঘিরে রয়েছে প্রচণ্ড এক ব্যক্তিত্ব।

অমিতাদির জীবনের গ্রাফটি বিচিত্র। সেখানে প্রচুর বাঁক এবং উত্থান-পতন। সতেরো বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়। পৈতৃক পদবি সরকার পালটে তিনি হয়েছিলেন অমিতা দত্ত। কিন্তু সেই বিয়েটা তিন বছরের বেশি স্থায়ী হয়নি।

যে ফ্যামিলিতে তিনি বধু হয়ে যান সেটা ছিল বেজায় গোঁড়া, প্রচণ্ড রক্ষণশীল এবং তেমনি তাদের শুচিবাই। উত্তর কলকাতার যেটা তাঁর শ্বশুরবাড়ি সেটা মুঘল হারেমের চাইতেও দুর্ভেদ্য। ছোট ছোট জানলায় একদিকে থাকত তারের জাল, আরেক দিকে মোটা পর্দা। যেদিকে তাকানো যাক, দরজায় জানলায় শুধু পর্দা আর পর্দা।

বাড়ি থেকে এক-পা বেরুবার উপায় ছিল না, এমনকী বাপের বাড়িতেও পুজোয় আর জামাইষষ্ঠীতে এই দুবারের বেশি যেতে দেওয়া হত না। একা স্বামীর সঙ্গে বেরুনোও নিষিদ্ধ। সিনেমা থিয়েটারে যেতে হলে পাহারাদার হিসেবে যেত শাশুড়ি কি খুড়শাশুড়ি কিংবা বিধবা বড় এক ননদ। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা অমিতাদিকে বাড়িঘর এবং আসবারের মতো একটা পারিবারিক সম্পত্তি মনে করতেন। তাঁর আলাদা যে এক অস্তিত্ব আছে, এটা কেউ ভাবতেও চাইতেন না।

তিন বছর সেই দুর্গে আটকে থেকে যখন অমিতাদির দম বন্ধ হয়ে আসছে সেই সময় একদিন মরিয়া হয়ে বাপের বাড়ি পালিয়ে এসেছিলেন। আর কোনোদিন স্বামীর কাছে ফিরে যাননি। আশ্চর্য, স্বামী বা শ্বশুর তাঁর খোঁজখবর করতে একবারও বাবার কাছে আসেননি। শেষপর্যন্ত বাবা ডিভোর্সের জন্য অ্যাপিল করেন। কিন্তু এবারও স্বামী বা শ্বশুরকে কোর্টে দেখা যায়নি। একতরফা মামলা চালিয়ে জিতে যান অমিতাদিরা এবং মসৃণভাবে তাঁর বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে যায়। আসলে স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে আর বিনা অনুমতিতে যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। তাকে ফিরিয়ে নেবার মতো বিন্দুমাত্র আগ্রহবোধ করেননি শ্বশুরবাড়ির লোকেরা।

এরপর অমিতাদির বাবা আবার তাঁর বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তিনি রাজি হননি। প্রথম বিয়ের আগে ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন। নতুন করে এই ঝঞ্ঝাটে না গিয়ে তিনি সোজা কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, বাবা চিরকাল থাকবেন না, বাবার কিছু ঘটলে কে তাঁকে আশ্রয় দেবে? কোথায় পাবেন নিরাপত্তা?

পরের মুখাপেক্ষী না-হয়ে বেঁচে থাকতে হলে তাঁর প্রয়োজন সম্মানজনক কোনো চাকরি-বাকরি। কিন্তু সামান্য একজন ম্যাট্রিকুলেটকে কে কাজ দেবে?

চার বছর কলেজে এবং দু-বছর ইউনিভার্সিটিতে মোট ছটা বছর চোখের পলকে যেন কেটে গিয়েছিল। ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়েই অমিতাদি কলেজে লেকচারারশিপ পেয়ে যান। সেখানে বছর সাতেক পড়াবার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেয়ে চলে আসেন। এই সময় তাঁর জীবনে আসে আরেকটি পুরুষ–বিমলেশ।

বিমলেশের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে অমিতাদির বিয়ে হয়নি। স্বামী-স্ত্রীর মতো তাঁরা একসঙ্গে কিছুদিন কাটিয়েছেন কিন্তু সম্পর্কটা একেবারেই স্থায়ী হয়নি। কেন না তখন তিনি জানতেন না বিমলেশ বেজায় অলস এবং প্রচণ্ড মাতাল। পাকস্থলীতে হুইস্কিটা বেশি পরিমাণে ঢুকে গেলে সে ভায়োলেন্ট হয়ে উঠত। তার ওপর একসঙ্গে মাস তিনেক কাটাবার পর সে দুম করে চাকরি ছেড়ে দেয় এবং অমিতাদির কাঁধে চড়ে বসে। তার ধারণা ছিল চিরকাল অমিতাদি তাকে পুষবেন আর মদের পয়সা যোগাবেন। অতিষ্ঠ অমিতাদি একদিন তাকে বাড়ি থেকে বার করে দেন। সেই থেকে পুরুষ সম্পর্কে তাঁর ধারণা আগাগোড়া পালটে যায়। বিশেষ করে বিবাহিত এবং অবিবাহিত দাম্পত্য জীবন সম্বন্ধে তাঁর কোনোরকম মোহ বা আকর্ষণ থাকে না। এ ব্যাপারে তাঁর পুরোপুরি স্বপ্নভঙ্গ ঘটে যায়।

আজকাল অমিতাদি যে অনবরত সিগারেট খান, শার্ট-ট্রাউজার্স পরেন~-এ-সবই এক ধরনের প্রোটেস্ট। নারী জাগরণ-এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি পুরুষের প্রভুত্ব, স্বার্থপরতা আর নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে যুদ্ধই ঘোষণা করেছেন বলা যায়।

অমিতাদি প্রেসিডেন্ট হলেও টেবিলের ওধারে বসে যে মেয়েটি (অর্থাৎ অদিতি) ডিকটেশন নিচ্ছে সে-ই এই কাহিনির প্রধান চরিত্র।

অদিতি নারী-জাগরণ-এর একজন অত্যন্ত সক্রিয় কর্মী। তার বয়েস পঁচিশ-ছাব্বিশ। গায়ের রং ডিমের ভেতরকার কুসুমের মতো। টান টান সতেজ চেহারা। লম্বাটে মুখ, নাক সটান কপাল থেকে নেমে এসেছে। উজ্জ্বল চোখ তার, রাজহাঁসের মতো গলা, নিটোল হাতে কোথাও এতটুকু ভাঁজ নেই। দীর্ঘ ঘন চুল এলোমেলোভাবে একটি খোঁপায় আটকানো।

পরনে হালকা রঙের তাঁতের শাড়ি এবং হলুদ ব্লাউজ। অমিতাদির মতোই তার হাতে একটি ঘড়ি ছাড়া আর কোনো গয়না-টয়না নেই। এতেই তাকে অলৌকিক মনে হয়। তার চেহারায় অভিজাত্যের সঙ্গে ব্যক্তিত্ব মিশে আছে।

অদিতি একটা কলেজে ইংরেজি পড়ায়। এমন এক পরিবার থেকে সে এসেছে, যার ইতিহাস রীতিমতো জটিল। কিন্তু সেকথা এখন না, পরে বিস্তৃতভাবে বলতে হবে।

একসময় ডিকটেশন নেওয়া শেষ হয়।

.

অমিতাদি বলেন, কৃষ্ণাকে মেমোরেন্ডামটা টাইপ করতে দাও। খুব তাড়াতাড়ি যেন করে দেয়। দশ মিনিটের ভেতর আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে।

অদিতি একটি মেয়েকে ডেকে স্মারকলিপির খসড়াটা তার হাতে দেয়। সে পাশের ঘরে টাইপ করতে চলে যায়।

অমিতাদি এবার অন্য একটি মেয়েকে বলেন, ইন্দ্রাণী, তুমি বাইরে গিয়ে একটু দেখো তো, ওদের পোস্টার লেখা হয়ে গেছে কিনা।

একটি তেইশ-চব্বিশ বছরের তরুণী ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, এবং কিছুক্ষণ বাদে ফিরে এসে খবর দেয় পোস্টার লেখা শেষ করে সবাই অপেক্ষা করছে।

কৃষ্ণার টাইপ হয়ে গিয়েছিল। সে নারী-জাগরণ-এর একটা খাম এবং মেমোরেন্ডমটা নিয়ে এসে অমিতাদির হাতে দেয়। অমিতাদি দ্রুত একবার টাইপ-করা জায়গাটা দেখে, খামে পুরে মুখটা বন্ধ করে দেন। তারপর বলেন, অদিতি, কৃষ্ণা–এবার ওঠা যাক। অনেকটা রাস্তা আমাদের যেতে হবে। একজন গিয়ে দারোয়ানকে বলো, সে যেন অফিস বন্ধ করে দেয়।

নারী-জাগরণ-এর অফিসে একজন দারোয়ান এবং দুটি বেয়ারা রয়েছে। কম্পাউন্ডের পেছনদিকে যে সার্ভেন্টস্ কোয়ার্টাস আছে, তারা সেখানে বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকে।

উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে অদিতি বলল, আমি কিন্তু আপনাদের সঙ্গে মিছিলে যাচ্ছি না অমিতাদি।

অমিতাদি রীতিমতো অবাকই হন। বলেন, কেন?

আজ ঢাকুরিয়ার বস্তিতে যাবার প্রোগ্রাম আগে থেকেই কিন্তু ঠিক করা আছে। ওখানে খবরও পাঠানো হয়েছে। বস্তির মেয়েরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে।

আপাতত নারী-জাগরণ-এর একটা বড় কাজ হল, কলকাতার বস্তিতে বস্তিতে ঘুরে সেখানকার মেয়েদের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে তথ্য যোগাড় করা। অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পারিবারিক দিক থেকে তারা কোন লেভেলে পড়ে আছে সে ব্যাপারে পুত্থানাপুঙ্খ খবর সংগ্রহ করে মোটা মোটা ফাইল তৈরি করা হচ্ছে। পরে এদের সমস্যা কীভাবে সমাধান করা যায় তার জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। বস্তিবাসী মেয়েদের সমস্যা এতই জটিল, বিশাল এবং সুদূরপ্রসারী যে নারী-জাগরণ-এর মতো একটি ছোট প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কিছুই প্রায় করা সম্ভব নয়। এ জন্য সরকারি আর বে-সরকারি সাহায্য একান্ত জরুরি।

নারী-জাগরণ-এর তরফ থেকে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট আর মিনিস্ট্রির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। অমিতাদি, অদিতি এবং আরও কয়েকজন চারটি চেম্বার অফ কর্মাসের প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারির সঙ্গে দেখা করেছেন। সব জায়গাতেই ভালো সাড়া পাওয়া গেছে। সকলেই অসহায় মেয়েদের সম্পর্কে সহানুভূতি জানিয়ে বলেছেন, সঠিক প্রস্তাব পাওয়া গেলে তাঁরা অবশ্যই সাহায্য করবেন।

অমিতাদির মনে পড়ে যায়। তিনি বলেন, বউ পোড়ানোর এই ঘটনাটা নিয়ে এতই ডিসটার্বড় হয়ে ছিলাম যে ঢাকুরিয়ার প্রোগ্রামটার কথা মনে ছিল না। ঠিক আছে, তুমিই যাও। তোমার সঙ্গে আর কে কে যাবে?

ঘরের কোণে একটি ঝকঝকে চেহারার যুবক বই থেকে কিছু নোট করছিল। সে মুখ তুলে বলে, আমি অদিতির সঙ্গে যাব।

অমিতাদি হেসে বললেন, জানি বিকাশ। অদিতি যেখানে যাবে, তুমিও সঙ্গে থাকবে। তাঁর হাসিতে প্রশ্রয় এবং মজা দুই-ই রয়েছে।

বিকাশ বিব্রত মুখে বলে, না, মানে

অমিতাদি এবার জিগ্যেস করলেন, দুজনে তো হবে না। তোমাদের সঙ্গে কৃষ্ণা, রমেন আর এষা যাক। বলেই গলা তুলে ডাকতে লাগলেন, রমেন, এষা, এ ঘরে এসো

পাশের ঘর থেকে রমেন এবং এষা এঘরে চলে আসে। দুজনেরই বয়েস তিরিশের নীচে।

রমেন একটা ব্যাঙ্কে জুনিয়র গ্রেডের অফিসার। গোলগাল ভালোমানুষ চেহারা। এই মুহূর্তে তার পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি।

এষা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে উঁচু ক্লাসে ফিজিক্স পড়ায়। পোশাকের ব্যাপারে সে বেপরোয়া। তার পরনে জিন্স এবং টি-শার্ট, পায়ে পুরুষদের চম্পল। চুলে বয়েজ-কাট। পোশাকে এবং চালচলনে পুরুষদের সঙ্গে কোনোরকম পার্থক্যই সে রাখতে চায় না। দারুণ স্মার্ট আর ঝকঝকে চেহারা। অমিতাদির মতো চেইন স্মোকার না হলেও সিগারেটটা একটু বেশিই খায়। অবশ্য এই মুহূর্তে তার হাতে সিগারেট নেই।

অমিতাদি এষা এবং রমেনকে বললেন, আজ ঢাকুরিয়া বস্তিতে আমাদের একটা প্রোগ্রাম আছে। অদিতি আর বিকাশের সঙ্গে তোমাদের দুজনকে সেখানে যেতে হবে।

দুজনেই জানায়, বস্তিতে যেতে তাদের আপত্তি নেই।

অদিতি এষাকে লক্ষ্য করতে করতে হঠাৎ বলে ওঠে, এষা না গেলেই ভালো হয়।

অমিতাদি ভুরু কুঁচকে জিগ্যেস করলেন, কেন?

অদিতি যা উত্তর দেয় তা এইরকম। তারা যেখানে যাচ্ছে, এষার মতো পুরুষালি পোশাক এবং চুলের ছাট সেখানে একেবারেই খাপ খায় না। বস্তির মেয়েরা এতে একেবারেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে না। শামুকের মতো নিজেদের গুটিয়ে রাখবে। তারা যদি সহজভাবে কাছে এগিয়ে না আসে, তাদের সমস্যার কথা জানা যাবে কী করে?

এষা বিরক্ত হচ্ছিল। সে কিছুটা তীক্ষ্ণ গলায় বলে, ওরা শুধু আমার চুলের কাট আর জিন্স-টিন্স নিয়েই মাথা ঘামাবে? ওদের সম্পর্কে আমার সিম্প্যাথি আর সিনসিয়ারিটির কথা ভাববে না?

অদিতি কোনো কারণেই সহজে উত্তেজিত হয় না। শান্ত মুখে সে বলে, বস্তি নিয়ে আমি বছরখানেক কাজ করছি। ওখানকার মেয়েদের সাইকোলজি খানিকটা বুঝি। এমনভাবে ওখানে যাওয়া উচিত যাতে ওরা মনে করে আমরা ওদেরই লোক। না হলে কাজের কাজ কিছুই হবে না।

এষা ঝাঁঝালো মুখে কিছু বলতে যাচ্ছিল, হাত তুলে তাকে থামিয়ে দেন অমিতাদি। অদিতি কী বলতে চেয়েছে, বুঝতে অসুবিধে হয়নি তাঁর। বলেন, ঠিক আছে, এষা আমাদের সঙ্গে চলুক। চিফ-মিনিস্টারের হাতে মেমোরান্ডমটা ও-ই দেবে। অদিতি, তুমি যাকে সুটেবল মনে করো, নিয়ে যাও।

.

মিনিট পনেরো পর অমিতাদি বিরাট মিছিল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। একেবারে সামনের দিকে লাল শালুর ফেস্টুনের দুই প্রান্ত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে দুজন মাঝবয়সি মহিলা সদস্য।

পাশাপাশি দুটি লাইন করে রাস্তার বাঁ ধার ঘেঁষে মিছিলটা চলছে। অনেকের হাতেই পোস্টার। যেগুলোতে নারী-স্বাধীনতা, নারী-নির্যাতন ইত্যাদি নানা বিষয়ে বড় বড় হরফে অনেক কথা লেখা আছে। দুই লাইনের মাঝখানে অনিমেষ আকাশের দিকে হাত ছুঁড়ে ছুঁড়ে স্লোগান দিতে দিতে যাচ্ছে। কণ্ঠস্বরে নানারকম উত্থান-পতন ঘটিয়ে স্লোগানটা সে চমৎকার দিতে পারে। তার কথা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে গোটা মিছিলটা গলা মিলিয়ে চিৎকার করে উঠছে।

পণপ্রথা–
বন্ধ করো, বন্ধ করো।
বধু হত্যা—
চলবে না, চলবে না।
বন্ধু হত্যাকারীদের
শাস্তি চাই, শাস্তি চাই।
নারীর মর্যাদা-
রক্ষা করুন, রক্ষা করুন।

স্লোগান দিতে দিতে মিছিল গোল পার্কের দিকে এগিয়ে যায়। এদিকে অদিতিও বেরিয়ে পড়েছিল। তার সঙ্গে রয়েছে বিকাশ, রমেন এবং অন্য একটি মেয়ে, বিশাখা। ওরাও ফেস্টুন এবং তিন-চারটে পোস্টার একটা বড় প্যাকেটে করে নিয়ে এসেছে। আর এনেছে নোটবুক, ক্যামেরা, টেপ-রেকর্ডার ইত্যাদি।

নারী-জাগরণ-এর অফিস থেকে ঢাকুরিয়ার বস্তি দু-আড়াই কিলোমিটার দূরে। ওরা খানিকটা বাসে, খানিকটা হেঁটে যখন সেখানে পৌঁছুল, বিকেল হয়ে গেছে।

.

০২.

ঢাকুরিয়ার এই বস্তি প্রায় মাইলখানেক জায়গা জুড়ে। ভাঙাচোরা টালি বা ফুটিফাটা টিনের চালার লাইন এঁকেবেঁকে নানা দিকে গেছে। প্রতিটি চালায় একটি করে ফ্যামিলি থাকে। মুখোমুখি দুই লাইনের মাঝখানে সঁতসেঁতে সরু গলি। সেগুলো একই সঙ্গে পায়ে চলার পথ এবং নর্মা। দু-ধারের ঘরগুলো থেকে থুতু, কফ, মাছের আঁশ, যাবতীয় আবর্জনা ওখানে ছুঁড়ে ফেলা হয়। এখানে-ওখানে বাচ্চাদের প্রাকৃতকর্মের কিছু চিহ্নও আকছার চোখে পড়বে। এখানকার বাতাসে একটা ঘন চাপ-বাঁধা দুর্গন্ধ সারাক্ষণ অনড় হয়ে থাকে।

এখানকার বাসিন্দাদের বেশির ভাগই বাঙালি। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা আর সুন্দরবন থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ভূমিহীন চাষি কাজকর্ম না পেয়ে এই বস্তিতে এসে উঠেছে। কলকাতায় এসে রোজগারের একটা-না-একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে এই ভরসায়। যাদের সামান্য জমিজমা ছিল, ঋণের দায়ে সেসব খুইয়ে তাদের অনেকেই চলে এসেছে। তারা এসেছে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, ওড়িষা, মধ্যপ্রদেশ আর অন্ধের গরিব হাভাতে কিছু মানুষ। এদের সবারই বিশ্বাস, কলকাতা কাউকে ফেরায় না। কোনো-না-কোনোভাবে পেটের দানার ব্যবস্থা করে দেয়।

এখানকার পুরুষমানুষেরা অনেকেই সাইকেল-রিকশা চালায়, কেউ ঠেলাওলা, কেউ গ্যারেজে বাস-লরির ক্লিনার, কেউ হকার, কেউ চোর, কেউ বে-আইনি চোলাই বানিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে বিক্রি করে। এইভাবে নানারকম উঞ্ছবৃত্তি করে তারা পেট চালায়।

বস্তিটার ডানদিকে ঝকঝকে চওড়া একটা রাস্তার ওপারে পশ্চিমবঙ্গ আবাসন পর্ষদের বিশাল হাউসিং কমপ্লেক্স। সেখানে রয়েছে হাজার দেড়-দুই নানা টাইপের ফ্ল্যাট।

হাউসিং কমপ্লেক্সটার বাঁ-দিকে সাউথ ক্যালকাটার পশ লোকালিটি। ওখানে নিও রিচ বা নতুন বড়লোকদের একটা পাড়া স্বাধীনতার পর গজিয়ে উঠেছে। সেখানে অদ্ভুত অদ্ভুত আর্কিটেচারের দারুণ দারুণ সব বাড়ি। কিছু মানুষের হাতে কী পরিমাণ টাকা জমেছে, এখানে এলে টের পাওয়া যায়। বস্তি এবং বড়লোকদের পাড়ার মাঝখানে বাউন্ডারি লাইন হল সেই ঝকঝকে অ্যাসফাল্টের রাস্তাটা।

বস্তির পুরুষদের একার রোজগারে সংসার চলে না। তাই মেয়েদেরও হাউসিং কমপ্লেক্স আর পশ পাড়ায় কাজে বেরুতে হয়। বস্তিটা মেইড সারভেন্ট সাপ্লাইয়ের প্রকাণ্ড একটা আড়ত।

বস্তিটার ঠিক মুখেই পাশাপাশি দুটো জলের কল এবং একটা ল্যাম্পপোস্ট। বছর তিনেক আগে নির্বাচনের সময় কর্পোরেশন থেকে এখানে রাস্তার আলো এবং জলের ব্যবস্থা করা হয়। এই বস্তিবাসীরা সরকারি খাস জমিতে জবরদখল করে বসে গেছে কিন্তু এদের বেশির ভাগেরই বৈধ রেশনকার্ড এবং ভোট আছে। ভোট পেতে হলে একটু কিছু তো করতেই হয়।

জলের কল এবং ল্যাম্পপোস্টের ধার ঘেঁষে একটা নীচু টালির চালার তলায় চায়ের দোকান। দোকানটার সামনে দু-তিনটে নড়বড়ে বেঞ্চ পাতা। সেখানে আট-দশটা লোক চায়ের গেলাস হাতে নিয়ে বসে আছে।

ভেতরে উঁচু তক্তপোষে মাঝবয়সি পেটানো চেহারার একটি লোককে দেখা যাচ্ছে। তার সামনে ছোট টিনের ক্যাশবাক্স এবং অনেকগুলো কাঁচের বোয়েম সাজানো রয়েছে। সেগুলোতে রয়েছে শস্তা বিস্কুট, লজেন্স, মোয়া, বাদাম, হজমিগুলি ইত্যাদি। বাঁ-পাশে খেলো কাঠের র‍্যাকে রয়েছে গাদা গাদা বিড়ির বান্ডিল, চিড়ে-মুড়ি এবং বাজে বেকারির পাউরুটি।

দোকানটার এক কোণে প্রকাণ্ড উনুন জ্বলছে। সেটার পাশে বসে আছে বয়স্কা একটি মেয়েমানুষ। তার কপালে এবং সিঁথিতে ডগডগে সিঁদুর। তার সামনে একটা সিলভারের বড় পরাতে অনেকগুলো খালি চায়ের গেলাস, ডিশ-টিশ রয়েছে। পাশেই সারি সারি জলের বালতি। একটি কমবয়সি মেয়ে সেখানে এঁটো গেলাস-টেলাস ধুচ্ছে।

মধ্যবয়সি লোকটার নাম যুধিষ্ঠির, এই চায়ের দোকানটা তার। বয়স্কা মেয়েমানুষটি তারই স্ত্রী। গেলাস-টেলাস যে ধুচ্ছে সে তারই মেয়ে।

রাস্তার একটা বাঁক ঘুরে অদিতিরা চায়ের দোকানের সামনে চলে আসে। যুধিষ্ঠির তাদের জন্যই যেন অপেক্ষা করছিল। তক্তাপোষ থেকে নেমে একরকম দৌড়েই বাইরে বেরিয়ে এল সে। উৎসুক মুখে বলে, এসেছেন দাদাবাবুরা, দিদিমণিরা–আসুন আসুন-বলে নিজেই টানা-হাচড়া করে চায়ের দোকানের একটা বেঞ্চ, একটা পুরোনো চেয়ার এবং উঁচু প্যাকিং বাক্স বার করে আনে, বসুন, বসুন–

এর আগেও বারচারেক এই বস্তিতে মেয়েদের সম্বন্ধে তথ্য যোগাড় করতে এসেছে অদিতিরা। প্রথম দু-বার কাজের কাজ কিছুই হয়নি। হুট করে এসে তারা মেয়েদের ডেকে ডেকে খোঁজখবর নিতে শুরু করেছিল। এতে সবাই ভয়ানক ঘাবড়ে যায়। অদিতিরা অতিথিদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে এতই সন্দিন্ধ হয়ে ওঠে যে কেউ মুখ খোলেনি। এরা যদি কিছুই না-জানায় এখানে আসার মানে হয় না। যে বিপুল সমস্যার কেন্দ্রে তারা যেতে চায়, এরা কিছু না

দু-বার ফিরে যাবার পর তৃতীয় দিন এসে অদিতিরা যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে ভালো করে আলাপ জমিয়ে নেয়। তারা আগেই খবর পেয়েছিল যুধিষ্ঠির এই বস্তির একজন নেতাগোছের লোক। তার কথা মোটামুটি সবাই মেনে চলে। এখানে তার প্রচণ্ড দাপট।

স্থানীয় কারো সহযোগিতা না পেলে বস্তিতে আসা-যাওয়া সার হবে। অদিতিরা গোপনে যুধিষ্ঠিরকে কিছু টাকা দিয়ে জানিয়েছিল, তাদের সাহায্য করলে আরও প্রাপ্তির আশা আছে। কিছু না পেলে অকারণে পরোপকার করতে কে-ই বা চায়?

কাজেই অদিতিদের ব্যাপারে উৎসাহ বেড়ে গেছে যুধিষ্ঠিরের। অদিতিরা কবে আসবে, আগে থেকেই জানিয়ে যায়। সেদিন বিকেল-হতে-না হতেই সে তাদের জন্য অস্থির হয়ে থাকে।

বলামাত্রই বসে না অদিতিরা। প্রথমে লাল শালুর ফেস্টুন টাঙিয়ে দেয়। পোস্টারগুলোর সঙ্গে কাঠের খুঁটি আটকানো রয়েছে, সেগুলো মাটিতে পুঁতে দেয়। পোস্টারগুলোতে লেখা রয়েছে, নারী নির্যাতন বন্ধ করো, নারীকে সম্মান দিতে হবে, নারীর স্বাধীনতা চাই-ইত্যাদি ইত্যাদি।

যুধিষ্ঠির হইচই বাঁচিয়ে স্ত্রীকে দিয়ে চার কাপ ইস্পেশাল চা বানিয়ে আনে। প্লেটে আটখানা নোনতা বিস্কুট নিয়ে আসে তার মেয়েটা। সসম্ভমে বলে, দাদাবাবু, দিদিমণিরা, কাজ শুরুর আগে একটুস চা খেয়ে ল্যান-

অদিতিরা লক্ষ করেছে, টাকাপয়সা পাওয়ার পর থেকে যুধিষ্ঠিরের খাতিরের মাত্রাটা আচমকা বেড়ে গেছে। চা না খেলে রেহাই নেই। বাজে সময় নষ্ট না করে অদিতিরা চা-বিস্কুট নেয়। খেতে খেতে বলে, যুধিষ্ঠিরদা, দেরি করতে পারব না। আমরা এখনই কাজ শুরু করতে চাই।

যুধিষ্ঠির জানে, এবার তাকে কী করতে হবে। বস্তির মেয়েদের একজন একজন করে নিয়ে আসতে হবে। ঠিক করা আছে, রোজ পঁচিশ-তিরিশজন মেয়ের ইন্টারভিউ টেপ করা হবে এবং ক্যামেরায় তাদের ছবিও ভোলা হবে। যুধিষ্ঠির বলল, ঠিক আছে, আমি পাঁচ মিনিটের ভেতর একজনকে হাজির করে দিচ্ছি। বলে আর দাঁড়ায় না, লম্বা লম্বা পা ফেলে বস্তির মধ্যে ঢুকে যায়।

ভোটারদের লিস্ট দেখে অদিতিরা আগেই জেনে নিয়েছে, এই বস্তিতে সবসুদ্ধ তিন হাজার দুশো বাইশজন অ্যাডাল্ট মেয়েমানুষ রয়েছে। একদিনে তিরিশ-বত্রিশ জনের সঙ্গে কথাবার্তা বললে অন্তত একশো বার তাদের এখানে আসতে হবে।

প্রথম দু-দিন কোনো কাজ হয়নি। তার পরের দুদিনে চল্লিশ জনের ইন্টারভিউ নেওয়া হয়েছে। নতুন জায়গায় শুরু করতে হয়েছে বলে প্রথম প্রথম বেশি মেয়ের সঙ্গে কথা বলা যায়নি। তাদের আড়ষ্টতা এবং সন্দেহ ঘোচাতে বেশ খানিকটা সময় নষ্ট হয়েছে। তবে আজ থেকে সংখ্যাটা বাড়াতেই হবে।

চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। অদিতি বলে, এবার রেডি হয়ে নাও। যুধিষ্ঠিরদা এখনই ফিরে আসবে। বলতে বলতে একমাত্র চেয়ারটায় বসে পড়ে।

চেয়ারের সামনে উঁচু প্যাকিং বক্স। ওটা টেবিলের কাজ করবে। প্যাকিং বক্সের পর নড়বড়ে বেঞ্চটায় ভাগাভাগি করে বাকি তিনজন বসে পড়ে। তারপর ব্যাগ থেকে ক্যামেরা, নোটবুক এবং টেপ রেকর্ডার সাজিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।

অদিতিরা যেখানে বসে আছে সেখান থেকে বিশ-বাইশ ফুট দূরত্বে কর্পোরেশনের কদুটোতে এখন বিকেলের জল এসে গেছে। ওখানে এখন বিরাট লাইন। দেড়শো দুশো পুরুষ এবং মেয়েমানুষ বালতি হাঁড়ি ডেকচি পর পর বসিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অন্য সময় হলে লাইনে দাঁড়ানো নিয়ে এতক্ষণ তুলকালাম হয়ে যেত কিন্তু এখন কারো জলের দিকে নজর নেই, অপার কৌতূহল এবং বিস্ময় নিয়ে তারা অদিতিদের লক্ষ করছে।

যারা লাইন দেয়নি, এমন কিছু লোকজন একধারে দাঁড়িয়ে অদিতিদের দেখতে দেখতে জটলা করছিল। ফিসফিসিয়ে তারা এভাবে বলাবলি করছে।

একজন বলে, এই দাদাবাবু-দিদিমণিরা দু-চারদিন পর পর কী জন্যি আসছে?

নারী-স্বাধীনতার জন্যে। ওই তো লেখা আছে, নারী নিয্যাতন বন্ধ করো। নারীর মুক্তি চাই। বলে কিছুটা লেখাপড়া জানা একটি লোক আঙুল বাড়িয়ে একটা পোস্টার দেখিয়ে দেয়।

ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বল দিকিন।

ওই যে আমরা ঘরের মেয়েমানুষদের ঠেঙাই, সেটা বোধহয় এরা বন্ধ করতে চায়।

হাই ভগবান, মেয়েমানুষকে না ঠেঙালে কি বশে থাকে? হাতের মুঠো থেকে বেরিয়ে যাবে না?

যা বলেছ। বড়লোকের ছেলেমেয়েদের তো কাজ নেই। মাথায় পোকা নড়ে উঠেছে, অমনি বস্তির মেয়েমানুষদের জন্যে দরদ উথলে উঠেছে।

নেই কাজ তো খই ভাজ।

অদিতিদের ঘিরে এই মুহূর্তে বস্তির শ-খানেক ল্যাংটো-আধাল্যাংটো কাচ্চাবাচ্চা অপার কৌতূহল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এদের বয়স তিন থেকে পাঁচের ভেতর। ইন্ডিয়াতে পপুলেশন এক্সপ্লোশান কী ধরনের হয়েছে তার কিঞ্চিৎ নমুনা ঢাকুরিয়ার এই বস্তিতে এলে টের পাওয়া যায়।

যদিও অদিতি চূড়ান্ত আশাবাদী এবং তার মধ্যে একটি অদম্য জেদ রয়েছে তবু চারপাশের এই অস্বস্তিকর পরিবেশে বসে নারী স্বাধীনতার ব্যাপারে কতটা কী করতে পারবে, ভাবতেই খানিকটা হতাশ বোধ করে। পরক্ষণেই সব নৈরাশ্য ঝেড়ে ফেলে নিজেকে সজীব করে তোলে। এর মধ্যেই তাকে কাজ করতে হবে।

অদিতি বিকাশদের কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই দেখা যায় যুধিষ্ঠির বস্তির ভেতর থেকে একটি অবাঙালি মেয়েমানুষকে সঙ্গে করে তাদের কাছে নিয়ে এসেছে।

যুধিষ্ঠির অদিতিকে বলল, দিদিমণি, লছিমাকে নিয়ে এলাম। এখন একে দিয়েই শুরু করুন। পরে অন্যদের নিয়ে আসছি। অদিতিকে বলার কারণ আছে। কদিন লক্ষ করে যুধিষ্ঠির টের পেয়েছে, এই ছোট টিমটার সে-ই নেত্রী।

অদিতি বেশ সমাদর করেই লছিমাকে বলে, বসুন দিদি, বসুন—

বিকাশরা সরে গিয়ে গিয়ে অনেকটা জায়গা করে দেয়। লছিমা জড়সড় হয়ে বেঞ্চের একধারে অদিতির মুখোমুখি বসে পড়ে।

লছিমার বয়স বোঝার উপায় নেই। তাবে পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশের কম নয়। শক্ত গড়নের চেহারা তার, হাত-পায়ের হাড় মোটা মোটা। গাল খানিকটা ভেঙেছে, হনু দুটো বেশ উঁচু, গায়ের চামড়ায় যৌবনের উজ্জ্বলতা নেই, পেনসিলের অল্প টানের মতো সরু সরু দাগ পড়তে শুরু করেছে। চোখের কোলে হালকা কালির ছোপ। তবু তার মধ্যে লাবণ্যের সামান্য একটু তলানি এখনও অবশিষ্ট রয়েছে।

মুখটি সারল্যে মাখানো। ঘোমটাটা কপালের আধাআধি নেমে এসেছে। দুই ভুরুর মাঝামাঝি এবং হাতের পাতার পিছন দিকে অনেকগুলো উল্কি–তার কোনোটা পদ্ম, কোনোটা শঙ্খ, কোনোটা হরিণ বা পাখি। পরনে বিহার বা উত্তরপ্রদেশের দেহাতী ঢংয়ে রঙিন শাড়ি। হাতে রুপোর কাংলা, আঙুলে চাঁদির আংটি।

যদিও লাজুক, লছিমার চোখেমুখে কৌতুকের একটি হাসি যেন আটকে আছে।

চোখের ইশারায় বিকাশকে টেপ রেকর্ডার চালাতে বলে অদিতি সোজা লছিমার দিকে তাকায়, দিদি, আপনি বাংলা জানেন তো?

লছিমা মৃদু গলায় বলে, জরুর। দশ বরষ কলকাত্তা শহরে কেটে গেল। আর বাংলা বুলি জানব না?

আপনাকে পনেরো-বিশ মিনিট একটু কষ্ট দেব। আমরা কটা কথা জানতে চাই। যদি দয়া করে বলেন

হাঁ হাঁ, পুছ করুন না।

অদিতি জিগ্যেস করে, আপনার নাম?

লছিমা দুসাধ।

স্বামীর নাম?

গালের পাশে ঘোমটা টেনে দ্রুত অন্য দিকে মুখ ফেরায় লছিমা। বলে, শরমকি বাত। মরদের নাম কেউ মুখে আনে?

ওধার থেকে যুধিষ্ঠির বলে ওঠে, বদরী দুধ।

এদিকে লছিমার ইন্টারভিউ শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের লোকজন অদিতিদের দিকে এগিয়ে এসেছে। লছিমাকে এমন অনেক প্রশ্ন করতে হবে, এত লোকজনের সামনে সেসবের উত্তর দেওয়া প্রায় অসম্ভব। অদিতি যুধিষ্ঠিরকে ডেকে তার কানে নীচু গলায় বলে, এরকম ভিড় হলে তো আমাদের পক্ষে কাজ করাই যাবে না। ওদের চলে যেতে বলুন যুধিষ্ঠিরদা–

আগের দুদিনও লোকজন সরিয়ে দেবার জন্য অনুরোধ করেছে অদিতি। মুহূর্তে যুধিষ্ঠিরের ভেতর থেকে একজন জবরদস্ত নেতা বেরিয়ে আসে। সে ভিড়ের দিকে তাকিয়ে দাপটের গলায় বলে, এই, তোমরা এখানে কী করছ? সংয়ের মতো দাঁড়িয়ে না-থেকে যে যার কাজে যাও। একদম ঝামেলা করবেন।

লোকগুলো বস্তির দিকে অনেকটা পিছু হটে। তবে একেবারে চলে যায় না। দূর থেকেই অদিতিদের লক্ষ করতে থাকে। খানিকটা অন্তত নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, পঞ্চাশ গজ তফাত থেকে ওরা কেউ তাদের কথা শুনতে পাবে না।

অদিতি এবার যুধিষ্ঠির, বিকাশ এবং রমেনকে চায়ের দোকানে গিয়ে বসতে বলে। কেননা তার প্রশ্নের উত্তরে এমন সব তথ্য লছিমাকে জানাতে হবে যা স্বামী ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের সামনে মুখে আনা যায় না।

ব্যাটারি সেটের টেপ রেকর্ডার চালু করাই ছিল। অদিতি জিগ্যেস করে, আপনার স্বামী কী কাজ করেন?

লছিমা বলে, রিকশা গাড়িয়া চালায়।

নিজের রিকশা?

নহী দিদিজি। রিকশা কেনার পাইসা কোথায়?

মাসে কীরকম আয় হয়?

মালিককে গাড়িয়ার জন্যে রোজ পাঁচ রুপাইয়া দিতে হয়। সেসব দিয়ে দু থেকে ঢাই শ (আড়াইশো) রুপাইয়া থাকে।

আপনি কিছু করেন?

হাঁ। পাঁপড় বানিয়ে বিক্রি করি।

লাভ কেমন থাকে?

হর মহিনা একশো-দেড়শো। তবে সমসারের সব কাম সেরে সময় তো বেশি পাই না। তা হলে আরও কিছু কামাই হত।

আপনাদের সংসারে কত লোক?

সাত। আমি, আমার মরদ আউর পাঁচ বাচ্চা। আউর বলতে বলতে থেমে যায় লছিমা।

আর কী?

আমার বুডটী সাসও (শাশুড়ি) থাকে আমাদের সঙ্গে।

সবসুদ্ধ আপনারা আটজন। আয় মোটে সাড়ে তিনশো-চারশো টাকা। এতে সংসার চালানো তো মুশকিল।

হাঁ। বহোত মুসিবত-তৎক্ষণাৎ ঘাড় কাত করে সায় দেয় লছিমা।

অদিতি বলে, এত ছেলেপুলে হওয়া ভালো না। তাদের মানুষ করে তোলা কি সোজা কথা!

চোখের কোণ দিয়ে অদিতিকে লক্ষ করতে করতে ঠোঁট কামড়ে হাসতে থাকে লছিমা। ঝপ করে গলার স্বর অনেকটা নীচে নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, এ আপনি কী বলছেন দিদিজি! শাদি হয়েছে, মরদের পাশে শুয়ে রাত কাটাচ্ছি। মরদ বুকের ওপর তুলে আমাকে আধি রাত পর্যন্ত আটার মতো ডলছে। আর বাচ্চা হবে না বলে সামনের দিকে অনেকখানি বুকে অদিতির সিঁথি এবং কপাল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে।

তার চাউনির মধ্যে এমন কিছু আছে যাতে অস্বস্তি বোধ করতে থাকে অদিতি। বিব্রতভাবে বলে, কী দেখছেন।

কপালে সিনুর (সিঁদুর) নেই। আপনার শাদি হয়নি–তাই না দিদিজি?

হ্যাঁ, কেন?

শাদি হলে দেখতেন, আপনার মরদ কীভাবে সুহাগ করত! বলতে বলতে কণ্ঠস্বর আরও নামিয়ে আনে, আর সুহাগ পেলে দেড়-দো সাল পর পর একটা করে বাচ্চা পয়দা করে ফেলতেন। দুনিয়ার এই নিয়ম দিদিজি।

বস্তিবাসী এই মেয়েমানুষটির মুখে কিছুই আটকায় না। কান লাল হয়ে ওঠে অদিতির। নাকমুখ ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকে। ওধারে বেঞ্চে বসে ঠোঁটে ঠোঁট টিপে রয়েছে বিশাখা। বোঝা যায়, অবরুদ্ধ হাসির তোড় গলার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। প্রাণপণে সে সেটা আটকে রেখেছে। ফলে তার চোখমুখও লাল হয়ে উঠেছে।

আচমকা বিশাখার দিকে ফিরে লছিমা বলে, দিদিজি, আপনিও রেহাই পাবেন না। বুঝবেন মরদের সুহাগ কাকে বলে!

এরকম অভাবিত আক্রমণে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়ে বিশাখা। বিপন্ন মুখে বলে, কী আজেবাজে বলছেন!

আজেবাজে নহী দিদিজি, জিওনের এই হল আসলি বাত। শাদিটা একবার হোক না আপনার, তখন

লছিমাকে থামিয়ে দিয়ে অদিতি বলে, ও-সব আলোচনা থাক। কাজের কথা হোক। একটু আগের বিব্রতভাবটা কাটিয়ে উঠেছে সে। গাম্ভীর্য এবং ব্যক্তিত্ব ফিরে এসেছে তার চোখে-মুখে এবং কণ্ঠস্বরে।

লছিমা সোজা হয়ে বসে, শান্ত চোখে তাকায় অদিতির দিকে। তার চাউনির মধ্যে একটু আগের চটুলতার চিহ্নমাত্র নেই।

অদিতি এবার বলে, একটা কথা জিগ্যেস করব। ঠিক ঠিক জবাব দেবেন—

হাঁ, জরুর।

আপনার সঙ্গে আপনার স্বামীর সম্পর্ক কেমন?

গালের ভেতর জিভটা ঘোরাতে ঘোরাতে লছিমা বলে, নফা আর হবে! দুনিয়ার সব আদমি আর জেনানাদের মধ্যে যেমন হয় আমাদেরও তেমনি।

অদিতি জিগ্যেস করে, আপনার স্বামী আপনাকে ভালোবাসে?

এই একটি প্রশ্নে আবার লছিমার চটুলতা ফিরে আসে। নীচু তারে কণ্ঠস্বরকে বেঁধে রেখে রিন রিন করে সে হেসে ওঠে, এ কী বলছেন দিদিজি, সুহাগই যদি না করবে, পাঁচ-পাঁচটা বাচ্চা পয়দা হল কী করে!

এই খোলা জায়গায়, যেখানে লোকজন থিক থিক করছে, এ-জাতীয় ইন্টারভিউ নেওয়া খুবই অস্বস্তিকর। বিশেষ করে লছিমার মতো মুখ-আলগা হালকা টাইপের মেয়েমানুষদের! অদিতি দ্রুত ভেবে নেয়, ইন্টারভিউগুলো অন্যভাবে নিতে হবে। সে বলে, আপনার স্বামী কখনও খারাপ ব্যবহার করে না?

হে রামচন্দজি, করে আবার না! দুই হাত প্যাকিং বাক্সের ওপর লম্বা করে ছড়িয়ে দিয়ে লছিমা বলে, না করলে এই দাগগুলো কীসের দিদিজি?

লছিমার দুই হাতের উলটো পিঠ থেকে ব্লাউজের হাতা পর্যন্ত খোলা জায়গায় চামড়ার ওপর অগুন্তি কালশিটে পড়ে আছে। কোনো কোনোটা পুরোনো, কিছু কিছু একেবারে তাজা।

অদিতি এবং বিশাখা শিউরে ওঠে। একইসঙ্গে বলে, এভাবে মেরেছে আপনাকে!

বা-রে মারবে না! এখানে এত্তে আদমি দাঁড়িয়ে আছে। নইলে জামাকাপড় খুলে দেখিয়ে দিতাম সারা গায়ে কত দাগ। অনেক জায়গায় চামড়া ফেটে ঘা হয়ে রয়েছে।

এভাবে মারে, আর আপনি কিছু বলেন না!

কী বলব দিদিজি! মরদ সুহাগও করবে, আবার পিটাইও লাগাবে। পিটাই না দিলে আওরতকে কি মুঠির ভেতর রাখা যায়! বলতে বলতে একটু থামে লছিমা। দম নিয়ে পরক্ষণে আবার শুরু করে, আমার মরদটা যখন দারু খেয়ে ঘরে ফেরে তখন কি তার হোশ থাকে। হাতের কাছে যা পায় তা-ই পিটাই করে।

অদিতি লক্ষ করল, লছিমা এক নাগাড়ে এই যে বলে গেল, এতে বিন্দুমাত্র অভিযোগের সুর নেই। স্বামীর হাতে মার খাওয়ার বিবরণ এমন নিস্পৃহ ভঙ্গিতে সে দিয়েছে যাতে মনে হয় এটাই দৈনন্দিন জাগতিক নিয়ম।

অদিতি কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই বস্তির ভেতর থেকে মেয়ে-গলার একটানা তীক্ষ্ণ চিৎকার ভেসে আসে। সে এবং বিশাখা চমকে সেদিকে তাকায়।

কিছুক্ষণ পর দেখা যায়, বস্তি থেকে বেরিয়ে একটি মেয়ে উদভ্রান্তের মতো ছুটতে ছুটতে এবং চিৎকার করতে করতে এদিকে আসছে। তার খোলা চুল বাতাসে উড়ছে, পরনে শাড়ি এলোমেলো, আঁচল বুক থেকে খসে মাটিতে লুটোচ্ছে।

অদিতি বুঝতে পারে, এই মেয়েটিরই গলা একটু আগে তাদের কানে ভেসে এসেছিল।

বিমূঢ়ের মতো মেয়েটিকে দেখছিল অদিতি। তার এভাবে ছুটে আসার কারণ কিন্তু একেবারেই বোঝা যাচ্ছে না।

মেয়েটি কোনোদিকে না-কিয়ে সোজা এসে অদিতির সামনে লুটিয়ে পড়ে। তার দুই পা বুকের ভেতর আঁকড়ে ধরে বলে, আমাকে বাঁচান দিদি

মেয়েটির বয়স বাইশ-তেইশ, বিবাহিত। কপালে সিঁদুর লেপটে আছে। মাথা থেকে চুলের ভেতর দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত গড়িয়ে আসছে, হাতে ঘাড়ে এবং কণ্ঠায় চাপ চাপ রক্ত। থুতনির কাছে মাংসের একটা রক্তাক্ত জেলা প্রায় ঝুলছে। তার গায়ে যে এলোপাথাড়ি কোনো ধারালো অস্ত্র-টস্ত্র চালানো হয়েছে, বুঝতে অসুবিধে হয় না। সমানে কেঁদে চলেছে। সে। চোখের জল এবং রক্তে তার মুখ প্রায় মাখামাখি।

ঘটনাটা এতই আকস্মিক এবং অভাবনীয় যে প্রথমটা হকচকিয়ে যায় অদিতি। পরক্ষণেই মেয়েটির সারা গায়ে আঘাতের দগদগে দাগগুলি দেখে শিউরে ওঠে। বিহুলের মতো সে বলে, ওঠো, ওঠো। তোমার এ অবস্থা কী করে হল?

মেয়েটি পা ছাড়ে না। কান্না-ভেজা বিকৃত গলায় বলে, সব বলব, আগে বলুন আমাকে বাঁচাবেন।

এমন অদ্ভুত পরিস্থিতিতে আগে আর কখনও পড়েনি অদিতি। কোন বিপদ থেকে মেয়েটিকে উদ্ধার করতে হবে, সেটা তার পক্ষে আদৌ সম্ভব কিনা, আগে না-জেনে কথা দেওয়া যায় না। হাত ধরে তাকে পায়ের কাছ থেকে তুলে সামনের বেঞ্চে বসিয়ে দিতে দিতে ব্যস্তভাবে বলে, আগে একজন ডাক্তার দেখানো দরকার। যুধিষ্ঠিরদা, যুধিষ্ঠিরদা বলতে বলতে সে চায়ের দোকানটার দিকে মুখ ফেরায়।

সেখান থেকে যুধিষ্ঠির, রমেন, বিকাশ এবং আরও দু-চারজন বেরিয়ে আসে। জলের কলের ওধারে যে ভিড়টা সিনেমার ফ্রিজ শটের মতো অনড় দাঁড়িয়েছিল, এবার তারা পায়ে পায়ে এগিয়ে আসতে থাকে।

অদিতি যুধিষ্ঠিরকে বলে, যত তাড়াতাড়ি পারেন একজন ডাক্তার ডেকে আনুন যুধিষ্ঠিরদা

নিরাসক্ত ভঙ্গিতে যুধিষ্ঠির জিগ্যেস করে, কেন, ওই চাঁপার জন্যে? বলে আঙুল বাড়িয়ে মেয়েটির ক্ষতবিক্ষত মুখের দিকে আঙুল বাড়িয়ে দেয়।

হ্যাঁ। দেখছেন না, কী হাল হয়েছে এর

অদিতির উৎকণ্ঠাকে এতটুকু গুরুত্ব দেয় না যুধিষ্ঠির। বলে, এ নিয়ে ভাববেন না দিদিভাই। রোজ বস্তিতে এরকম ঠেঙানোর ঘটনা বিশ-পঞ্চাশটা করে ঘটছে। রাত দশটা পর্যন্ত একদিন এখেনে থাকলে নিজের চোখেই দেখতে পাবেন কতগুলোন মেয়েছেলে জখম হল। ডাক্তার ডেকে কি কূল পাবেন। তা হলে এখেনে হাসপাল বসিয়ে দিতে হয়।

দেখা গেল, চারধারের লোকজনের মধ্যেও কোনোরকম চাঞ্চল্য নেই। বস্তিতে মেয়েমানুষ-পেটানো রোজকার রুটিনের একটা আইটেম। এসব বিচলিত হবার মতো ঘটনাই নয়।

অদিতি বলে, না না, এগুলো কোনো কাজের কথা নয়। এখন ডাক্তারকে খবর দিন।

আপনি পয়লা দিন দেখলেন তো, তাই ঘেবড়ে গেছেন। ডাক্তার ডেকে গুচ্ছের পয়সা লষ্ট করে লাভ নেই। চাঁপা রোজ জখম হচ্ছে, রোজ ঘা শুকিয়ে যাচ্ছে

যুধিষ্ঠিরের অবিচলিত অটল মনোভাব অদিতির স্নায়ুকে ধাক্কা দিয়ে যায়। সে কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই মোটা কর্কশ গলায় চেঁচাতে চেঁচাতে বস্তির দিক থেকে মাংসল ঘাড়ে গদানে-ঠাসা মধ্যবয়সি একটা লোক বেরিয়ে আসে। তার রুক্ষ চুল ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে। রক্তবর্ণ চোখ, থ্যাবড়া থুতনি, গোল মুখ, মোটা মোটা হাড়ের ফ্রেমে মজবুত শরীর সবকিছুর মধ্যেই রয়েছে মারাত্মক নিষ্ঠুরতা।

লোকটার হাতে রয়েছে একটা ভোঁতা নিরেট কাটারি। তাকে দেখে লোকজন সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে সরে সরে পথ করে দিল। সে ক্রুদ্ধ কর্কশ গলায় পেঁচিয়েই যাচ্ছে, কোথায় গেলি খানকী মাগী, আজ তোর বাপের বিয়ে দেখিয়ে ছাড়ব।

সামনের বেঞ্চ থেকে উঠে দ্রুত অদিতির পাশে গিয়ে দাঁড়ায় চাপা। ভয়ে একেবারে কুঁকড়ে গেছে সে। আড়ষ্ট গলায় বলে, দিদি, ও আমাকে নিঘুঘাত মেরে ফেলবে।

বোঝা গেল, হাতের ওই কাটারিটা দিয়ে কিছুক্ষণ আগে এই লোকটাই নির্দয়ভাবে চাঁপাকে মারধোর করেছে। অদিতি জিগ্যেস করে, লোকটা কে?

ওধার থেকে যুধিষ্ঠির নীচু গলায় জানায়, ও লগা লগেন দাস। হেভি মস্তান দিদিভাই। চাঁপা লগার তিন নম্বর ওয়াইভ।

যদিও যুধিষ্ঠির এই বস্তির একজন মান্যগণ্য নেতাগোছের লোক তবু অদিতি টের পেল নগেনকে যথেষ্টই ভয় পায় সে। আরও জানা গেল, লোকটার তিন-তিনটে স্ত্রী রয়েছে। তবে তিনজনই জীবিত কিনা, বোঝা যাচ্ছে না। থাকলে, ধরে নেওয়া যায়, হিন্দু কোড বিলকে একেবারেই পরোয়া করে না নগেন।

এরকম মারাত্মক একটা ব্যাপার যে ঘটতে পারে, বস্তিতে আসার আগে ভাবতেই পারেনি অদিতি। তার মতো স্মার্ট সাহসী মেয়েও প্রথাটা রীতিমতো ভয় পেয়ে যায়। বিমূঢ়ের মতো নগেনের দিকে তাকিয়ে থাকে সে।

চারপাশের জনতা সিনেমার ফ্রিজ শটের মতো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নগেন এলোমলো পা ফেলে এধারে-ওধারে তাকাতে তাকাতে এগিয়ে আসে। সে ভিড়ের মধ্যে চাঁপাকে খুঁজছে।

এদিকে আতঙ্কে অদিতির পিঠে একেবারে লেপটে গেছে চাঁপা। অদিতি বুঝতে পারে, মেয়েটা ভীষণ কাঁপছে। পেছন থেকে ভয়ার্ত ঝাপসা গলায় চাঁপা বলে, আমাকে বাঁচান দিদি

চাঁপার কথা যেন শুনতেই পায় না অদিতি। তার দুই চোখ নগেনের ওপর স্থির হয়ে আছে।

শেষ পর্যন্ত চাঁপাকে দেখতে পায় নগেন। তার চোখে-মুখে অদ্ভুত এক হিংস্রতা যেন ঝিলিক দিয়ে যায়। লম্বা লম্বা লালচে চুলগুলো এক ঝটকায় পেছন দিকে সরিয়ে অদিতিদের দিকে এগিয়ে আসে সে। বাঁ-হাতে কাটারিটা বাগিয়ে ধরা। ডানহাতের আঙুল নাচাতে নাচাতে বলে, বেরিয়ে আয় মাগী, আভূভি-আভি

হঠাৎ স্বয়ংক্রিয় কোনো নিয়মে অদিতির মাথার ভেতর কিছু একটা ঘটে যায় যেন। নিজের অজান্তেই শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে চিৎকার করে ওঠে, চুপ কর জানোয়ার

এক ধমকেই কিছুটা কাজ হয়। নগেন প্রথমটা হকচকিয়ে যায় এবং প্যাকিং বক্সটার ওধারে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার মুখ থেকে ভক ভক করে গন্ধ বেরিয়ে আসছে। এখনও অনেকটা বেলা রয়েছে, চারদিকে রোদের ছড়াছড়ি। এরই মধ্যে সে কিন্তু প্রচুর পরিমাণে দিশি মদ গিলেছে।

ধাতস্ত হতে খানিকটা সময় লাগে নগেনের। সে চোখ ছোট করে অদিতিকে লক্ষ করতে থাকে। নেশা-টেশা করলেও বুঝতে পারে, বস্তির লোকজনের ওপর যে মেজাজ চালানো যায়, এর কাছে সেটা চলবে না। অদিতিকে কিছু না বলে নগেন চাঁপাকে ডাকতে থাকে, ভালো চাস তো চলে আয় চাঁপা–চাঁপা উত্তর দেয় না, অদিতির শরীরের সঙ্গে নিজেকে প্রায় মিশিয়ে দেয় সে।

অদিতি বুঝতে পারছিল, ভয় পেলে নগেন একেবারে মাথায় চড়ে বসবে। কোনোভাবেই সেটা হতে দেওয়া যায় না। রুক্ষ গলায় সে বলে, চাঁপা এখন যাবে না। তুমি এখান থেকে চলে যাও—

কেউ যে নগেনের মুখের ওপর এভাবে বলতে পারে, বস্তির লোকজনের কাছে তা ছিল অভাবনীয়। তারা একেবারে হাঁ হয়ে যায়।

দাঁতে দাঁত চেপে নগেন ভেংচে ওঠে, অর্ডার দিচ্ছেন নাকি মেমসাহেব?

অদিতি বলে, অর্ডার নয়। কোথাও গিয়ে মাথা ঠান্ডা করে ভদ্রলোকের মতো এসো। তখন কথা হবে।

ভদ্রলোক। বস্তিতে ভদ্দরলোক থাকে বলে শুনেছেন! মাতাল ফোরটোয়েন্টি, খচ্চর হারামি ছাড়া এখানে কেউ থাকে না মেমসাহেব। আমি তাদের ভেতর আবার সব চাইতে ওঁচা মাল। অনেক ভ্যানতাড়া হয়েছে। এবার মাগীটাকে পিঠের কাছ থেকে টেনে বার করে দিন। শালীর চুলের কুঁটি ধরে টেনে নিয়ে যাই।

মেয়েটার কী হাল হয়েছে–দেখছ?

মরে তো যায়নি।

তুমি মানুষ, না কী?

একটু আগে যা বলেছেন তাই জানোয়ার।

মাথার ভেতর রক্ত ফুটতে শুরু করেছিল অদিতির। উত্তেজিত ভঙ্গিতে সে বলে, চাঁপা না তোমার স্ত্রী!

নগেন বলে, সেই জন্যেই তো ঠেঙাতে পারছি। অন্য মেয়েমানুষের গায়ে হাত তুললে ঝামেলা হয়ে যেত। মেলাই ভ্যাজর ভ্যাজর করছেন মেমসাহেব, আমার মাল আমার হাতে তুলে দিন। কেটে পড়ি।

না দেব না।

যুধিষ্ঠির বকের মতো গলা বাড়িয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে, চাঁপাকে দিয়ে দ্যান দিদিমণি। লগেন খুব হারামি লোক–

যুধিষ্ঠিরের কথার জবাব দেয় না অদিতি, স্থির চোখে নগেনের দিকে তাকিয়ে থাকে।

যেন প্রচণ্ড অবাক হয়েছে, এমন একটা ভঙ্গি করে নগেন বলে, আমার বউকে আটকে রাখবেন! এ তো গা-জোয়ারি কারবার হল মেমসাহেব! বলতে বলতে সে এগিয়ে আসে। তার চোখে-মুখে ধীরে ধীরে আগের সেই বেপরোয়া হিংস্রতা ফের ফুটে উঠতে থাকে।

বিপজ্জনক কিছু একটা আঁচ করে রমেন এবং বিকাশ দ্রুত মাঝখানে চলে এসে অদিতিকে আড়াল করে দাঁড়াতে চায়। অদিতি তাদের সরিয়ে দিয়ে তীব্র চাপা গলায় নগেনকে বলে, এক পা-ও আর এগুবে না।

নগেন থমকে যায়। বলে, আমাকে অত ধমকাবেন না মেমসাহেব, আমি আপনার বাবার চাকর লই। ভালো কথায় আমার বউকে ছেড়ে দ্যান।

না।

নগেন বলে, ভদ্দরলোকের বাড়ির মেইয়ে বলে এতক্ষণ খাতির করে কথা কইছি। এরপর কিন্তু ঝামেলা হয়ে যাবে। বলতে বলতে নগেনের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠতে থাকে। কদিন ধরেই খবর পাচ্ছি, আপনারা বস্তির মেয়েমানুষদের খেপিয়ে যাচ্ছেন। আমায় ঘটাননি, তাই কিছু বলিনি। এবার কিন্তু সাপের ল্যাজে পা দিয়ে ফেলেছেন। আপনাকে আমি ছাড়ছি না।

মস্তিষ্কের মধ্যে কোথায় যেন বিস্ফোরণ ঘটে যায় অদিতির। হিতাহিত জ্ঞানশূন্যের মতো সে চিৎকার করে ওঠে, স্কাউলে, এতবড় সাহস তোমার। তোমাকে আমি পুলিশে দেব।

পুলিশের নামে খানিকটা দমে যায়। পরক্ষণেই তেরিয়া হয়ে ওঠে, আমাকে পুলিশের ভয় দেখাবেন না মেমসাহেব। বছরে বিশবার ধরা পড়ি। এক ঘণ্টার বেশি কেউ আমাকে ধরে রাখতে পারেনি। পুলিশ মাকড়াদের আমার বহোতবার দেখা আছে।

অদিতি নগেনের চোখ থেকে চোখ সরায়নি। অত্যন্ত শান্ত গলায় বলে, বছরে যাতে বারো মাস জেলে কাটাতে পারো তার ব্যবস্থা করে দেব।

হইচই উত্তেজনায় নগেনের নেশা অনেকটা ফিকে হয়ে এসেছিল। অদিতি তার কতটা ক্ষতি করতে পারে ঠিক বুঝতে পারছিল না। সাপের মতো শীতল দৃষ্টিতে অদিতিকে কিছুক্ষণ লক্ষ করে সে, তারপর বলে, আপনার মতলবটা কী?

চাঁপাকে নিয়ে আমি সোজা এখান থেকে থানায় যাব।

যেখানে খুশি নিয়ে যান। শুধু দুটো কথা মন দিয়ে শুনে রাখুন। এক লম্বর লগেন দাসকে এখনও আপনি চেনেননি। দু-লম্বর, এই মাগীকে আমার কাছে ফিরে আসতে হবে। তখন কোন বাপ ওকে বাঁচায় দেখব বলে আর দাঁড়ায় না, ভিড়ের ভেতর দিয়ে বস্তির গোলকধাঁধায় অদৃশ্য হয়ে যায়।

যুধিষ্ঠির পাশ থেকে বলে, কাজটা ভালো হল না দিদিমণি।

বস্তির আরও দু-চারজন বয়স্ক লোক এগিয়ে এসে বলে, দিদিমণি, চাঁপাকে লগেনের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দিন। সোয়ামি-ইস্তিরির কারবার। এখন গেলে লগা ঠেঙাবে ঠিকই, আবার মিটমাটও হয়ে যাবে।

একটু দ্বিধান্বিতই হয়ে পড়ে অদিতি। এই বস্তিতে দাম্পত্য জীবনের প্যাটানটা কীরকম, সে-সম্বন্ধে তার পরিষ্কার ধারণা নেই। চাঁপার দিকে ফিরে বলে, তুমি কি ঘরে ফিরে যাবে?

চাঁপা ভয়ে সিঁটিয়ে ছিল। বলে, না না, ওর কাছে আর যাব না। আমাকে পেলে একেবারে খুন করে ফেলবে। আপনি আমাকে বাঁচান দিদি।

এক মুহূর্ত কী ভাবে অদিতি, তারপর বলে, ঠিক আছে, আপাতত আমাদের সঙ্গে চলো। তারপর ভেবে কিছু একটা ঠিক করা যাবে। যুধিষ্ঠিরকে বলে, আজ আর কোনো মহিলাকে ডাকার দরকার নেই। বিকাশ এবং রমেনকে পোস্টারগুলো তুলে ফেস্টুনটা খুলে নিতে বলে। এরপর যুধিষ্ঠিরকে একধারে ডেকে নিয়ে গোটাকয়েক টাকা দেয়।

এটা তার কাজের মজুরি। যুধিষ্ঠির টাকাটা পকেটে পুরতে পুরতে বলে, চাঁপাকে সগে করে না-নিয়ে গেলেই পারতেন দিদিমণি।

এই সৎ পরামর্শটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সে এবং বস্তির কয়েকজন কিছুক্ষণ আগেই একবার দিয়েছে। অদিতি হাসে। তারপরেই হঠাৎ কিছু মনে পড়তে সে বলে, চাঁপার ছেলেমেয়ে আছে?

না।

ভালোই হল। বাচ্চাকাচ্চা থাকলে অসুবিধে হত।

গলা অনেকখানি নামিয়ে যুধিষ্ঠির বলে, দিদি, একটা কথা বলব?

অদিতির কপাল সামান্য কুঁচকে যায়। সে জিগ্যেস করে, কী?

এট্টু সাবধানে থাকবেন। লগা কেমন হারামজাদা, নিজের চোখেই দেখলেন। তাছাড়া পাট্টির লিডাররা আছে ওর পেছনে।

পাট্টি মানে পলিটিক্যাল পা.। এতক্ষণে বোঝা যায়, রাজনৈতিক নেতাদের মদতেই নগেদ দাস এমন বেপরোয়া হয়ে উঠতে পেরেছে। অন্যমনস্কর মতো সে বলে, জানা রইল।

এখন কিছুদিন বস্তিতে আসবেন না।

যুধিষ্ঠির তার সত্যিকারের হিতাকাঙ্ক্ষী। বস্তিতে এলে নগেন ঝাট বাধাতে পারে, সেই ভয়ে সে আসতে বারণ করছে। তার মানে, দারিদ্রসীমার নীচে ক্যালকাটা মেটোপলিসের বস্তিবাসী মেয়েদের সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহের যে বিপুল পরিকল্পনা তারা নিয়েছে, সেটা স্থগিত রাখতে হবে। একটু চিন্তা করে অদিতি বলে, দেখা যাক।

কিছুক্ষণ পর দেখা যায়, অদিতিরা চাঁপাকে নিয়ে সামনের গলিটা দিয়ে বড় রাস্তার দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। পেছনে বস্তির লোকজন বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকে।

.

০৩.

আগে আগে হাঁটছে রমেন বিশাখা এবং চাঁপা। তাদের পেছনে অদিতি আর বিকাশ।

বিকাশ নীচু গলায় অদিতিকে বলে, এটা তুমি কী করলে?

দূরমনস্কর মতো হাঁটছিল অদিতি। চমকে উঠে বলে, কোনটা?

চাঁপাকে দেখিয়ে বিকাশ বলে, এই যে মেয়েটাকে নিয়ে এলো বলতে বলতে সে থেমে যায়।

তার ইঙ্গিতটা বুঝতে অসুবিধে হয় না অদিতির। সে বলে, না নিয়ে এলে মেয়েটার অবস্থা কী হত, নিশ্চয়ই তোমাকে বলে দিতে হবে না।

তোমার কি মনে হয়, ওই মাস্তানটা ওকে খুন করে ফেলত! খুনটা এত সোজা ব্যাপার না।

আজকাল ওটাই বোধহয় সবচেয়ে সোজা হয়ে গেছে। নগেন হয়তো একেবারে শেষ করে ফেলত না, তাবে মারাত্মক টরচার করত।

এরকম বউ-পেটানোর ঘটনা রোজ হাজারটা ঘটছে। তুমি সবাইকে বাঁচাতে পারবে?

একজনকেও যদি পারি সেটাই কম নাকি?

চাঁপাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসাটা আদৌ পছন্দ হয়নি বিকাশের। সে কিছুক্ষণ গুম হয়ে থাকে। তারপর বলে, সব ব্যাপারে তুমি নিজেকে বড় বেশি ইনভলভূ করে ফেলো

অদিতি-

চোখের কোণ দিয়ে বিকাশকে লক্ষ করতে করতে ঈষৎ তীক্ষ্ণ গলায় অদিতি বলে, সোশাল ওয়ার্ক করতে নেমেছি অথচ এতটুকু দায়দায়িত্ব নেব না, তাই কখনও হয়?

আমাদের কাজ হল, মেয়েদের সম্বন্ধে ইনফরমেশন জোগাড় করে সেগুলো নানা মিডিয়ার হেল্প নিয়ে দেশের মানুষ আর গভর্নমেন্টকে জানানো। আই মিন, এই সোসাইটিতে মেয়েরা কীভাবে জেনারেশনের পর জেনারেশন কী ভয়ঙ্কর জীবন কাটাচ্ছে, সে সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করা।

তার মানে নিজেদের চামড়া বাঁচিয়ে যেটুকু করা যায়–তাই না?

অদিতির চোখেমুখে এবং কণ্ঠস্বরে চাবুকের মতো এমন কিছু শ্লেষ ছিল যাতে চমকে ওঠে বিকাশ। কিছু বলতে গিয়ে সে থেমে যায়।

খানিকক্ষণ চুপচাপ।

তারপর বিকাশ বলে, মেয়েটাকে তো নিয়ে এলে। এখন ওর কী ব্যবস্থা করবে? কোথায় রাখবে?

অদিতি বলে, নারী জাগরণ-এর অফিসে আগে যাই। অমিতাদির সঙ্গে আলোচনা করে একটা কিছু করতে হবে।

বিকাশ আর কোনো প্রশ্ন করে না। তবে চাঁপার ব্যাপারে সে যে ভীষণ চিন্তাগ্রস্ত এবং বিচলিত, তার চোখমুখ দেখেই তা টের পাওয়া যায়।

.

নারী জাগরণ-এর অফিসে যখন অদিতিরা এসে পৌঁছোয়, সন্ধে নেমে গেছে। রাস্তায় রাস্তায় কর্পোরেশনের তেজি আলোগুলো জ্বলে উঠেছে।

দক্ষিণ কলকাতার এই নিরিবিলি পাড়ায় সন্ধেবেলাতেও লোকজন খুব বেশি দেখা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে দু-একটা স্কুটার, অটো রিকশা বা প্রাইভেট কার এখানকার অগাধ শান্তিকে তোলপাড় করে হুস হুস শব্দে বেরিয়ে যাচ্ছে।

নারী-জাগরণ-এর অফিসটা দুপুরের মতো অতটা জমজমাট না হলেও বেশ কিছু মেম্বার এ-ঘরে উত্তেজিতভাবে গলা চড়িয়ে কথা বলছে। অমিতাদিকেও সামনের ঘরে তাঁর নির্দিষ্ট চেয়ারটিতে বসে থাকতে দেখা গেল।

বোঝা যায়, বধূ হত্যার প্রতিবাদে দুপুরে মিছিল করে নারী-জাগরণ-এর মেম্বাররা যে বেরিয়ে পড়েছিল, নানা রাস্তা ঘুরে মুখ্যমন্ত্রীর হাতে মেমোরান্ডাম জমা দিয়ে তারা ফিরে এসেছে। এখন সেই বিষয়েই তাদের আলোচনা চলছে।

অদিতি ভেতরের একটা ঘরে চাঁপাকে বসিয়ে সামনের ঘরে এসে অমিতাদির মুখোমুখি বসে পড়ে। বিকাশ, রমেন এবং বিশাখা আগেই থেকে গিয়েছিল। তারা আর ভেতরে যায়নি।

অমিতাদি বললেন, যে মেয়েটিকে ও-ঘরে রেখে এলে সে কে?

অদিতি দ্রুত একবার বিকাশদের দেখে নেয়। বুঝতে পারে, ওরা চাঁপার সম্পর্কে এখনও কেউ কিছু অমিতাদিকে বলেনি। অদিতি সংক্ষেপে চাঁপার ব্যাপারটা বলে, কী পরিস্থিতিতে তাকে এখানে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে জানিয়ে দেয়।

শুনতে শুনতে কপালে ভাঁজ পড়ে অমিতাদির। একটা সিগারেট ধরিয়ে বলেন, তাইতো, এখানে ওকে নিয়ে এলে–

না এলে উপায় ছিল না অমিতাদি। আপনি আমার জায়গায় থাকলে কী করতেন?

ডিফিকাল্ট কোশ্চেন। যাই হোক, এনেই যখন ফেলেছ তখন ওর সম্পর্কে আমাদের একটা দায়িত্ব এসে গেছে। চাঁপাকে নিয়ে কী করবে, কিছু ভেবেছ?

না। আপনি কী করতে বলেন?

একটু চিন্তা করে অমিতাদি বলেন, প্রথমে যেটা সব চাইতে জরুরি তা হল, থানায় ওর সম্পর্কে একটা রেকর্ড করিয়ে রাখা। নইলে পরে ওর স্বামী–মানে হুলিগান টাইপের সেই লোকটা গোলমাল বাঁধাতে পারে।

উত্তর দিতে গিয়ে হঠাৎ কী মনে পড়ে যেতে ব্যস্তভাবে অদিতি বলে, অমিতাদি, আজ আমাকে এখনই বাড়ি যেতে হবে। বাবা বলে দিয়েছিল, সন্ধের আগে আগেই যেন ফিরে যাই। ঘড়ি দেখতে দেখতে বলে, ভীষণ দেরি হয়ে গেছে।

তাহলে আজ বাড়িই যাও। দারোয়ান আর তার বউকে বলে যাচ্ছি, চাঁপা রাত্তিরে এখানে থাকবে। কাল এসেই কিন্তু থানায় চলে যাবে। আশা করি নগেন ওকে যেভাবে মারধোর করেছে, নিজে থেকে আজকেই থানায় যেতে সাহস করবে না।

আমারও তাই মনে হয়।

অদিতি উঠে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে বিকাশও উঠে দাঁড়ায়।

অমিতাদি চোখ সরু করে মজার গলায় বলেন, অদিতি যথেষ্টই সাবালিকা-সাফিসিয়েন্টলি অ্যাডাল্ট। ও নিজের সামর্থেই বাড়ি চলে যেতে পারবে। তোমার পৌঁছে না দিলেও চলবে।

ঘরের অন্য সবাই হাসতে থাকে। অদিতির সঙ্গে বিকাশের সম্পর্ক কতটা গভীর, নারী-জাগরণ-এর প্রতিটি মেম্বার তা জানে।

বিব্রত মুখে বিকাশ বলে, না, অদিতির সঙ্গে আমার দরকারি কিছু কথা আছে। তাই তার মুখ লাল হয়ে ওঠে।

অমিতাদি হেসে হেসে খানিকটা প্রশ্রয়ের ঢংয়েই বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে, তোমাকে আনাড়ি প্রেমিকদের মতো অত লজ্জা পেতে হবে না।

অদিতিরা থাকে বালিগঞ্জের পুরোনো পাড়ায়, বিকাশরা ভবানীপুরে।

খানিকটা হাঁটতেই একটা ফাঁকা ট্যাক্সি পেয়ে যায় দুজনে। ঠিক হয় বিকাশ অদিতিকে তাদের বাড়ির কাছে নামিয়ে দিয়ে ভবানীপুরে চলে যাবে।

ট্যাক্সিতে ওঠার পর কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটে। তারপর হঠাৎ বিকাশই শুরু করে, আমি কিন্তু গলফ গ্রিনে একটা ফ্ল্যাট বুক করে ফেলেছি। নেক্সট উইকে পজেশান পেয়ে যাব।

কই, আমাকে আগে কিছু বলেনি তো।

তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম।

কবে বুক করলে?

দিন কুড়ি আগে।

এত টাকা পেলে কোথায়?

ভবানীপুরে আমাদের বাড়িতে আর জায়গা হচ্ছিল না। আমার অংশটা দাদাকে লিখে দিলাম। দাদা প্রফিডেন্টফান্ড থেকে লোন নিয়ে আমাকে দিল। তাই দিয়েই

বিকাশদের বাড়ির যাবতীয় খবরই অদিতির জানা। সে বলল, ও—

বিকাশ অদিতির দিকে ঘুরে বসে প্রচণ্ড উৎসাহে বলতে থাকে, জানো, ফ্ল্যাটটা দারুণ। থ্রি বেড রুমস, দুটো বাথ, ড্রইং-কাম-ডাইনিং হল, তিনটে ব্যালকনি। সব মিলিয়ে কার্পেট এরিয়া সাড়ে বারোশো স্কোয়ারফিট। তিনটে দিক ভোলা-সাউথ, ইস্ট আর ওয়েস্ট। কবে দেখতে যাবে বলো–

যাব একদিন

একদিন-ট্যাকদিন না, নেক্সট রবিবারই তোমাকে নিয়ে যাব।

একটু চুপ করে থেকে অদিতি বলে, আচ্ছা–ফ্ল্যাটের কথায় সে খুশি হয়েছে কিনা বোঝা যায় না।

অদিতি খুবই চাপা ধরনের। বাইরে থেকে তাকে সমান্যই বোঝা যায়, তার স্বভাবের বেশির ভাগটাই গোপন। বিকাশ বলতে থাকে, ফ্ল্যাটটা কিন্তু খুব ভালো করে সাজাতে হবে।

অদিতি উত্তর দেয় না।

বিকাশের উদ্দীপনা ক্রমশ বাড়তেই থাকে। সে বলে, ইন্টেরিয়র ডেকরেটরদের হাতে ছেড়ে দেব, না নিজেরাই সাজাব?

অতিদি বলে, তুমি যা ভালো বুঝবে।

জানো, অকশনে দুর্দান্ত সব জিনিস-খাট কার্পেট মিক্সি আলমারি শসোফা ক্ৰকারি–খুব শস্তায় পাওয়া যায়। এ সপ্তাহেই তোমাকে অকশন হাউসগুলোতে নিয়ে যাব।

ঠিক আছে।

প্রায় রোজই এই সময়টা ট্রাফিক জ্যাম থাকে। আজ কোথাও বাস মিনিবাস ট্যাক্সি বা প্রাইভেট কার জট পাকিয়ে সবকিছু অচল করে দেয়নি। মসৃণ গতিতে ট্যাক্সিটা পুরোনো বালিগঞ্জে চলে আসে।

বিকাশ বলে, ফ্ল্যাট তো হল। সাজাবার ব্যবস্থাও হয়ে যাবে কিন্তু আসল কাজটাই এখনও হল না। সেটা ছাড়া এইসব ফ্ল্যাট-ট্যাট একেবারে মিনিংলেস–একটু থেমে গাঢ় গলায় এবার বলে, ভবানীপুরে ভাঙাচোরা বাড়ি, সেখানে অনেক অসুবিধে ছিল কিন্তু এখানে সেসব ব্যাপার নেই। কীরকম সময় আমরা ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন অফিসে যেতে পারব?

শেষের এই কথাটা আগে বেশ কয়েকবার বলেছে বিকাশ। তবে এতটা জোর দিয়ে কখনোই নয়। অদিতির নিজের দিক থেকে এখনও কিছু দ্বিধা আছে, বাড়ির দিক থেকে বেশ খানিকটা বাধাও। কিন্তু সেসব কথা পরে।

অদিতি বলে, আমাকে কিছুদিন ভাববার সময় দাও।

অনেক ভেবেছ। আর সময় পাবে না। ফ্ল্যাটটা সাজানো হয়ে গেলে আমি কিন্তু কোনো কথা শুনব না। বিকাশের গলায় অসহিষ্ণুতা ফুটে বেরোয়।

অদিতি বলে, এত অধৈর্য হলে চলে! ট্যাক্সি তাদের বাড়ির কাছে এসে গিয়েছিল। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে একপলক দেখেই সে ট্যাক্সিওলাকে বলল, সর্দারজি, এখানে একটু থামান।

শিখ ড্রাইভার ব্রেক কষতেই ঘ্যাস্-স্-স্ করে চাকার ঘষ্টানির আওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে ট্যাক্সি থেমে যায়। দরজা খুলে রাস্তায় নামতে নামতে অদিতি বলে, চলি। কাল নারী-জাগরণ-এর অফিসে আসছ তো? চাঁপাকে নিয়ে থানায় যেতে হবে।

বিকাশ বলে, আসব। আমার কথাটা মনে রেখো। একমাসের বেশি সময় কিন্তু দিচ্ছি না।

অদিতি হাসে, উত্তর দেয় না।

ট্যাক্সিটা আর দাঁড়াল না, বিকাশকে নিয়ে চলে গেল।

তারপর কিছুক্ষণ রাস্তার ধারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে অদিতি। একটা কথা ভেবে তার ভীষণ খারাপ লাগে। প্রায় রোজই তাকে বাড়ির গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে যায় বিকাশ কিন্তু বিকাশকে সে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে না। কেননা বাড়ির কেউ তাকে একেবারেই পছন্দ করে না। হঠাৎ বিকাশকে তার সঙ্গে আসতে দেখলে বাড়িতে অশান্তি এবং উত্তজেনা এতই বেড়ে যাবে যে অদিতির পক্ষে একটা দিনও এখানে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠবে।

ট্যাক্সিটা অদিতিদের বাড়ি ছাড়িয়ে খানিকটা দূরে এসে থেমেছিল। একসময় অদিতি ঘুরে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে।

২. ছড়ানো কম্পাউন্ডের মাঝখানে

০৪.

ছড়ানো কম্পাউন্ডের মাঝখানে অদিতিদের বিশাল তেতলা বাড়ি। লোহার গেটের দুটো পাল্লা অনেক আগেই ভেঙে গিয়েছিল। জায়গাটা হাট করে করে খোলা। গেট পেরিয়ে অদিতি ভেতরে চলে আসে।

এ বাড়িটা ষাট-সত্তর বছর আগে তৈরি করিয়েছিলেন অদিতির ঠাকুরদা শিবপ্রসাদ ব্যানার্জি। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ আমলের একজন নামকরা স্টিভেডর। জাহাজি ব্যবসাতে প্রচুর টাকা করেছিলেন।

গথিক স্ট্রাকচারের এই বাড়িটায় বিরাট বিরাট পিলার, চওড়া চওড়া শ্বেত পাথরের সিঁড়ি। খাঁটি বার্মা টিক আর মেহগনির ওপর কারুকাজ-করা ভারী ভারী আসবাব দিয়ে বাড়ি সাজিয়েছিলেন শিবপ্রসাদ। ড্রেয়িং-টেবিল আর আলমারির গায়ে যেসব লাইফসাইজ আয়না লাগানো ছিল সেগুলো আনানো হয়েছে ইতালি থেকে। দু-হাজার বর্গফিটের প্রকাণ্ড ড্রইংরুমটা ন-ইঞ্চি পুরু কাশ্মীরি কার্পেটে মোড়া থাকত। খাস লন্ডন থেকে জমকালো আটটা ঝাড়লণ্ঠন আনিয়ে সেখানে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন শিবপ্রসাদ।

দুর্দান্ত বিলিতি আর জার্মান গাড়ি ছিল চার-পাঁচটা। চাকর-বাকর শোফার কুক ইত্যাদি নিয়ে ডজনখানেক। বাড়ির পেছনে অ্যাসবেস্টসের ছাউনি দেওয়া নীচু সার্ভেন্টস কোয়ার্টাসে তারা থাকত।

এ-সব পুরোনো দিনের ইতিহাস। এখন এগুলো সুখকর অলীক স্মৃতি মাত্র।

অদিতির জন্মের অনেক আগেই তাদের পরিবারের গোল্ডেন পিরিয়ড বা স্বর্ণযুগ শেষ হয়ে গেছে। বিলিতি গাড়ি, ফার্নিচার, শ্যান্ডেলিয়ার, কার্পেট, গন্ডা-গন্ডা চাকর-বাকর–এ সবের কথা সে শুনেছে মা-বাবা পিসিমা কিংবা অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের মুখে।

স্বাধীনতার ঠিক দশ বছর বাদে অদিতির জন্ম। জ্ঞান হবার পর থেকে সে যা দেখে আসছে তা এইরকম।

প্রথমে বাড়িটায় কথাই ধরা যাক। ঠাকুরদার আমলে নাকি তিনটে মালি বছরের পর বছর অক্লান্ত খেটে বাড়ির সামনে এবং পেছনে চমৎকার মরশুমি ফুল আর ফলের বাগান আর সবুজ ঘাসের লন বানিয়েছিল। সে-সবের চিহ্নমাত্র নেই। বিশ-পঁচিশ বছর ধরে বাড়িটাকে ঘিরে শুধু আগাছার জঙ্গল। শ্বেতপাথরের সিঁড়ির কোনোটাই প্রায় অক্ষত নেই। পিলার এবং দেওয়ালগুলোর গা থেকে পলেস্তারা খসে দগদগে ঘায়ের মতো দেখায়। ছাদের কার্নির্স এবং আলসে ভেঙেচুরে বিপজ্জনকভাবে ঝুলছে। দেওয়াল আর ছাদ ফাটিয়ে নানা জায়গায় অশ্বখ গজিয়ে গেছে। ঘুলঘুলিতে বংশপরম্পরায় পায়রা আর চড়ুইয়েরা তাদের সংসার বাড়িয়ে চলেছে। বাড়িভর্তি ইঁদুর আরশোলা এবং ছুঁচোর রাজত্ব।

স্বাধীনতার পর থেকে এ-বাড়িতে আর রং-টং করানো হয়নি। জানলার রঙিন কাঁচ বা খড়খড়ি বলতে কিছু নেই। ভাঙা জায়গাগুলোতে চট বা পুরোনো খবরের কাগজ গুঁজে দেওয়া হয়েছে। মোট কথা, বাড়িটার ধ্বংসের কাজ অনেকটাই এগিয়ে আছে। আর বড়জোর কুড়ি-পঁচিশ বছর, তারপর হুড়মুড় করে হয়তো একদিন ভেঙে পড়বে। চার-পাঁচটা দামি গাড়ির একটাও আর নেই। পুরোনো আসবাব, কার্পেট, শ্যাভেলিয়ার, এ-সব কিছুই খুঁজে পাওয়া যাবে না। সব ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেছে। বর্মা টিকের আসবাবের বদলে ঘরে ঘরে এখন খোলা কাঠের টেবিল-চেয়ার তক্তাপোষ আলমারি ইত্যাদি।

নিজেদের বংশলতা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেই অদিতির। শিবপ্রসাদের আগে তাদের পরিবারের সব ইতিহাসই কুয়াশায় ঢাকা। অর্থাৎ আঁক করে বলার মতো তখন কিছুই ছিল না। তাদের বংশে যে ক্ষণস্থায়ী সুখের দিন এসেছিল তা একমাত্র শিবপ্রসাদের জন্যই।

শিবপ্রসাদ মারা গেছেন স্বাধীনতার কয়েকমাস আগে। তারপর আটত্রিশ বছর কাটতে-না-কাটতেই মাত্র দুটো জেনারেশনের মধ্যে বাড়িটার হাল কেন এরকম গেল সেটা বুঝতে হলে অদিতির বাবা এবং দাদাদের জীবনচরিত জানা একান্ত জরুরি। কিন্তু সেসব কথা পরে।

.

গেট দিয়ে ঢুকলেই এবড়ো-খেবড়ো খোয়ার রাস্তা। অদিতির ছেলেবেলায় এই পথটাতে বাদামি রঙের নুড়ি বিছানো থাকত। তারপর কবে যে নুড়িগুলো উধাও হয়ে তার জায়গায় খোয়া ফেলা হয়েছিল, এখন আর মনে পড়ে না।

দু-ধারে আগাছার ঝাড়। পুরোনো দিনের সুখস্মৃতির মতো মাঝে মধ্যে দু-একটা সিলভার পাম এখনও কোনোরকমে টিকে আছে।

কম্পাউন্ডের ভেতর চার-পাঁচটা ল্যাম্পপোস্ট রয়েছে। কিন্তু ইলেকট্রিকের খরচ বাঁচাতে আট-দশ বছর ধরে আলো জ্বালানো হয় না। ফলে এই সন্ধেবেলাতেই চারদিকে ঝুপিসি অন্ধকার। আলোর ছুঁচের মতো সেই অন্ধকারকে ফুড়ে ফুড়ে অগুন্তি জোনাকি উড়ছে। সিলভার পামের মাথা থেকে পাখিদের ডাকাডাকি আর ডানা ঝাঁপটানোর আওয়াজ ভেসে আসছে।

অন্যমনস্কের মতো খোয়া মাড়িয়ে মাড়িয়ে বাড়ির সামনে এসে পড়ে অদিতি। দশটা শ্বেতপাথরের সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠলেই বিশাল লাউঞ্জ।

লাউঞ্জ পেরিয়ে বিরাট দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চওড়া প্যাসেজ। সেটার বাঁ-দিকে বিশাল ড্রইংরুম, ডানদিকে ওপরে যাবার সিঁড়ি। দু-ধারে বসার ঘর আর সিঁড়ি রেখে প্যাসেজটা সোজা বাড়ির পেছন দিকে চলে গেছে। সেখানে কিচেন, স্টোর, ডাইনিংরুম। যে দু-একটি কাজের লোক এখনও রয়েছে, তারা ওখানেই থাকে।

প্যাসেজে একটা কম পাওয়ারের টিমটিমে আলো জ্বলছে। সেখানে পা দিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল অদিতি। নিজের অজান্তেই তার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে।

অদিতি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে ড্রইং রুমটা খুব বেশি হলে সাত-আট ফুট দূরে। ঘরের ভেতর দুই দেওয়ালে দুটো জোরালো টিউব লাইট জ্বলছে।

অদিতি দেখতে পায়, বেতের সোফায় তেলচিটে গদির ওপর বসে আছে সিতাংশু সিতাংশু ভৌমিক। তার মুখোমুখি দুই দাদা-বরুণ আর মৃগাঙ্ক। পাশে একটা সোফায় কাত হয়ে আছেন রমাপ্রসাদ। রমাপ্রসাদ ব্যানার্জি অদিতির বাবা।

রমাপ্রসাদের আর্থারাইটিসের কষ্টটা আজ নিশ্চয়ই খুব বেড়েছে, নইলে ওভাবে আড় হয়ে থাকতেন না।

সিতাংশু হাত-টাত নেড়ে ভারিক্কি চালে বাবা আর দাদাদের কী যেন বোঝাচ্ছে।

কেন বাবা বার বার সন্ধের আগে তাকে বাড়ি ফিরতে বলেছিলেন, এতক্ষণে বুঝতে পারে অদিতি। দুপুরে সে যখন বেরোয়, ঘুণাক্ষরেও জানাননি, আজ সিতাংশু আসবে! জানালে সে কিছুতেই ফিরত না।

সিতাংশু যে তার জন্য সেই বিকেল থেকে ঝাড়া দু-তিন ঘণ্টা বসে আছে, এ ব্যাপারে অদিতি পুরোপুরি নিশ্চিত। লোকটার অসীম ধৈর্য।

সিংতাশুকে দেখতে দেখতে অদম্য ক্রোধ অদিতিকে পেয়ে বসে। মাথায় প্রবল রক্তচাপ টের পায় সে। একটি চড় মেরে লোকটাকে বাড়ি থেকে বার করে দেবে কিনা যখন ভাবছে, সেই সময় হঠাৎ রমাপ্রসাদ তাকে দেখতে পান। কাত করা শরীরটা টেনে-হিঁচড়ে খাড়া করতে করতে ব্যস্তভাবে বলেন, বুবু তুই! ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভেতরে আয়। অদিতির ডাক নাম বুবু।

অদিতি উত্তর দিতে যাচ্ছিল, আচমকা তার চোখে পড়ে একটু দূরে সিঁড়ির মুখে তাদের কাজের মেয়ে দুর্গা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাতের ইশারায় তাকে ডাকছে। পায়ে পায়ে সেদিকে এগিয়ে যায় সে।

ড্রইংরুম থেকে রমাপ্রসাদের গলা ভেসে আসে, কী হল রে, কোথায় যাচ্ছিস? এখানে এলি না?

একটু পরে আসছি।

দুর্গার কাছাকাছি আসতেই চাপা গলায় সে বলে, পিসিমা তোমাকে এক্ষুনি একবার ওপরে যেতে বলেছে ছোটদি।

দুর্গার বয়েস সতেরো-আঠারো। কালো সুশ্রী চেহারা। মেয়েটা অদিতির খুবই অনুগত।

অদিতি রীতিমতো অবাকই হল। সে যে এই মুহূর্তে ফিরে আসবে, তেতলার ঘরে শুয়ে শুয়ে পিসিমা কী করে টের পেলেন, কে জানে! জিগ্যেস করল, কেন রে?

দুর্গা বলল, জানি না।

একটু ভেবে অদিতি বলে, তুই পিসিমাকে গিয়ে বল, বাবা দাদারা আর এক ভদ্রলোক আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে ওপরে যাচ্ছি।

সিতাংশুবাবু এসেছে তো?

অদিতি চমকে ওঠে। দুর্গা এমনিতে খুবই চালাক চতুর। তার দুটোর জায়গায় দশটা করে চোখ, দশটা করে কান। তার চোখ-কান এড়িয়ে এ বাড়িতে কিছু হবার উপায় নেই। বোঝা গেল, সিতাংশু যে কিছুদিন ধরে এখানে হানা দিচ্ছে, দুর্গা তা জানে। কোন উদ্দেশ্যে সিতাংশুর যাতায়াত, সেটাও হয়তো তার অজানা নেই।

অদিতি বলে, হ্যাঁ। তুই সিতাংশুবাবুকে চিনলি কী করে?

চোখ দুটো চিকচিকিয়ে ওঠে দুর্গার। ঠোঁট কুঁচকে মজার একটা ভঙ্গি করে বলে, বা রে, চিনব না! তিন মাস ধরে সকাল নেই বিকেল নেই আসছে তো আসছেই। বড়বাবু আর দাদাবাবুদের সঙ্গে বাইরের ঘরে বসে গুজুর-গুজুর কী পরামর্শ যে করে!

এ খবরটা নতুন এবং খানিকটা চাঞ্চল্যকরও। অদিতির ধারণা ছিল তিন-চার বারের বেশি এ বাড়িতে আসেনি সিতাংশু। কিন্তু দুর্গা যা বলছে তাতে মনে হয় নিয়মিতই সে হাজিরা দিচ্ছে।

অদিতি জিগ্যেস করল, আমি যখন থাকি না তখনও আসে?

তখনই তো বেশি আসে গো ছোটদি।

তুই আমাকে বলিসনি তো?

তুমি আমার কাছে জানতে চেয়েছ?

দুর্গার স্বভাবই হল, গায়ে পড়ে কোনো কথা বলে না। সে শুধু দেখে আর শুনে যায়। অদিতি এ নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন করে না।

দুর্গা এবার তাড়া লাগায়, ওপরে চলো ছোটদি। পিসিমা বলে দিয়েছে বড়বাবু, সিতাংশুবাবু আর দাদাবাবুদের কথা কইবার আগে তার সঙ্গে দেখা করতে। খুব দরকার।

আচ্ছা চল।

সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে দোতলার বড় বারান্দায় হেমলতাকে দেখতে পায় অদিতি। হেমলতা তার মা। রোগা পাতলা চেহারা। একসময় দুর্দান্ত সুন্দরী ছিলেন। এখন টকটকে রং জ্বলে গেছে। চোখের কোলে কালির ছোপ। মুখটা ভেঙেচুরে কণ্ঠা আর গালের হাড় বেরিয়ে পড়েছে। চুল উঠে উঠে কপালটা চওড়া মাঠের মতো দেখায়। হাতের দিকে তাকালে ফর্সা কোঁচকানো চামড়ার তলায় নীল শিরাগুলো দেখা যায়। শরীরে সারাংশ বলতে বিশেষ কিছু নেই। চারদিকে শুধু ধ্বংসের ছাপ।

হেমলতা একটা আধ-ছেঁড়া মোড়ায় বসে খানিকটা ঝুঁকে কী যেন সেলাই করছিলেন। গোল বাইফোকাল চশমাটা নাকের নীচের দিকে নেমে এসেছে।

পায়ের শব্দে মুখ তুললেন হেমলতা। সিঁড়িতে অদিতিকে দেখতে পেয়ে আবছা গলায় বললেন, এই ফিরলি বুবু? তাঁর কণ্ঠস্বর এর বেশি কখনোই ওঠে না।

অদিতি থেমে যায়। বলে, হ্যাঁ, মা

সিতাংশু এসেছে।

দেখেছি।

তোর বাবা, রাজা আর বাবলু তাকে নিয়ে বাইরের ঘরে বসে ছিল।

রাজা এবং বাবলু বরুণ আর মৃগাঙ্কর বাড়ির ডাক নাম।

অদিতি বলে, ওরা এখনও বসে আছে।

ওদের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে?

না। আগে পিসিমার সঙ্গে দেখা করে আসি।

ভয়ে ভয়ে হেমলতা বলেন, ওদের সঙ্গে কথা বলে এলেই পারতিস।

সেই ছেলেবেলা থেকে অদিতি দেখে আসছে মা সারাক্ষণ শঙ্কিত এবং তটস্থ হয়ে থাকেন। গলা চড়িয়ে তাঁকে কেউ কোনোদিন কথা বলতে শোনেনি। এ বাড়িতে তিনি যে আছেন সেটা প্রায় বোঝাই যায় না। নিজেকে সম্পূর্ণ আড়ালে রেখে নিঃশব্দে ছায়ার মতো চলাফেরা করেন। সবসময় কী একটা অজানা দুর্বোধ্য ভয় তাঁকে তাড়া করে নিয়ে চলেছে।

অত ভেবো না মা। দশ মিনিট পরে ওখানে গেলে এমন কিছু মারাত্মক অপরাধ হয়ে যাবে না।

যা ভালো বুঝিস কর। পরে যেন এ নিয়ে আবার অশান্তি না হয়।

অদিতি বলে, অশান্তি হবেই মা। ভেবে ভেবে তুমি মাথা খারাপ করে ফেললেও ওটা কেউ ঠেকাতে পারবে না। এই বলে সে আর দাঁড়ায় না। দ্রুত সিঁড়ি ভাঙতে-ভাঙতে তেতলার কোণের দিকে একটা ঘরে চলে আসে।

একধারে দেওয়াল ঘেঁষে একটা তক্তাপোষে শুয়ে আছেন মৃণালিনী। ঘরের মাঝখানে একটা টিমটিমে বাল্ব জ্বলছে। এধারে-ওধারে দু-তিনটে পাল্লা-ভাঙা আলমারি। উলটোদিকের অন্য একটা দেওয়ালে গোল আয়না, সেটার তলায় কাঠের তাকে চিরুনি চুলের কাঁটা, একটা খোলা পাউডারের কৌটো, নেইল কাটার, ইত্যাদি। বর্ষার জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে গোটা ঘরটায় কালচে কালচে দাগ ধরে আছে। সিলিং থেকে পলেস্তারা খসে খসে ভেতরকার লোহার ফ্রেম বেরিয়ে পড়েছে।

মৃণালিনীর বয়স পঁয়ষট্টি ছেষট্টি। বাঙালি মেয়েদের তুলনায় তাঁর হাইট রীতিমতো ভালোই-পাঁচ ফিট সাত-আট ইঞ্চির মতো। চওড়া চওড়া হাড়ের ফ্রেমে একসময় দুর্দান্ত স্বাস্থ্য ছিল তাঁর। খুবই সুন্দরী ছিলেন যৌবনে। হেমলতাও অসাধারণ রূপসি। কিন্তু দুজনের রূপ দুই ধরনের। হেমতলার দৈহিক সৌন্দর্যের সঙ্গে মিশে থাকত ভীরুতা। কিন্তু মৃণালিনীকে ঘিরে যা ছিল তা দৃঢ়তা এবং ব্যক্তিত্ব। এমন তেজি মহিলা খুব বেশি দেখেনি অদিতি।

অবশ্য এই পঁয়ষট্টি-ছেষট্টি বছর বয়েসে রূপ এবং স্বাস্থ্যের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। হেমলতার মতোই তাঁর সবকিছু শেষ গেছে। তার ওপর পাঁচ বছর ধরে পক্ষাঘাতে ডানদিকটা পড়ে গেছে। হেমলতা তবু চলে ফিরে বেড়ান, সংসারের টুকিটাকি নানা কাজকর্ম করেন। মৃণালিনীর সে সামর্থ্যটুকুও নেই। আমৃত্যু তাঁকে শয্যাশায়ী হয়ে থাকতে হবে।

মৃণালিনী বললেন, আমার কাছে আয়।

অদিতি এগিয়ে গিয়ে মৃণালিনীর পাশে বসে পড়ে বলে, আমি যে এখন আসব, জানলে কী করে?

দুর্গাকে জানলার কাছে বসিয়ে রেখেছিলাম। তোকে দেখলেই যেন ধরে নিয়ে আসে।

কেন?

তোর বাবা, রাজা, বাবলু আর সেই লোকটা কী যেন নাম?

সিতাংশু ভৌমিক।

হ্যাঁ সিতাংশু। ওদের হাতে পড়ার আগে তোকে অনেক কথা জানাবার আছে।

বলো।

স্বার্থসিদ্ধির জন্যে তোর বাবা আর ভাইরা তোকে সিতাংশুর সঙ্গে বিয়ে দিতে চায়। তবে এটাকে বিয়ে বলে না।

রমাপ্রসাদ, বরুণ আর মৃগাঙ্ক তার বিয়ে যে সিতাংশুর সঙ্গে দিতে চায়, সেটা অনেক আগেই টের পেয়েছে অদিতি। কিন্তু এর সঙ্গে তাদের স্বার্থসিদ্ধির কী সম্পর্ক, বোঝা যাচ্ছে না।

বিমূঢ়ের মতো সে বলে, বিয়ে বলে না!

না।

তাহলে এটা কী?

মৃণালিনীর শরীরের যে অংশটা সুস্থ, সেখানে কোনো অদৃশ্য বৈদ্যুতিক প্রবাহ খেলে যায়। প্রবল উত্তেজনায় সে দিকটা কাঁপতে থাকে। বাঁ হাতটা তুলে তিনি বলেন, তোকে ওরা বেচে দিতে চায়।

এবার হকচকিয়ে যায় অদিতি, মানে।

কিছুই কি তুই টের পাসনি বুবু?

কী টের পাব?

আশ্চর্য, আমি এই বিছানায় শুয়ে শুয়ে সব জানতে পারি আর তোর যে এতবড় সর্বনাশ হতে যাচ্ছে সে খবরটুকুও রাখিস না! বলে একটু থামেন মৃণালিনী। পরক্ষণেই তীব্র গলায় আবার শুরু করেন, তোর বাপ আর দাদারা ওই লোকটার কাছ থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা ধার নিয়েছে। সেসব শোধ করার ক্ষমতা এ জন্মে ওদের হবে না। এদিকে সিতাংশুর নজর পড়েছে তোর ওপর। বিয়ে হলে টাকাটা আর তাকে ফেরত দিতে হবে না।

বাবা আর দাদারা যে এতটা নীচে নেমে গেছে, ভাবতে পারেনি অদিতি। পক্ষাঘাতে-অসাড় মানুষের মতো সে বসে থাকে।

মৃণালিনী বলেন, নারী-জাগরণ নারী-জাগরণ করে তো খাওয়া-দাওয়া ঘুম-বিশ্রাম সব প্রায় ছেড়েছিস, দিন রাত সারা শহর তোলপাড় করে বেড়াচ্ছিস কিন্তু নিজের জাগরণটা কবে হবে?

অদিতি আস্তে আস্তে মৃণালিনীর দিকে তাকায়। তবে কোনো উত্তর দেয় না।

মৃণালিনী সস্নেহে তাঁর বাঁ হাতটি অদিতির কাঁধে রেখে বলেন, ভয় পাস না, আমি তোর পেছনে আছি।

বাবা এবং দাদাদের নীচতা আর গোপন ষড়যন্ত্র অদিতিকে প্রচণ্ড কষ্ট দিচ্ছিল। মৃণালিনী একটু আগে যা বললেন সেই কথাগুলিই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সে ভাবছে। নিজের সম্বন্ধে অদিতির ধারণা, নারী স্বাধীনতা এবং মেয়েদের অসংখ্য সমস্যার ব্যাপারে সে একজন ধর্মযোদ্ধা। এই শহরে যেখানেই বধূহত্যা, নারী নির্যাতন বা মেয়েদের ওপর আক্রমণ সেখানেই অদিতি। মেয়েদের সামাজিক মর্যাদা এবং নিরাপত্তার কারণে সে ঊধ্বশ্বাসে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে চলেছে। অথচ তাকেই যে বিক্রি করে দেবার চক্রান্ত চলছে সেই খবরটা পর্যন্ত সে রাখে না। অদিতি নিজে একজন অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত তরুণী, আর্থিক দিক থেকে যথেষ্ট স্বাবলম্বী। একটি কলেজে সে পড়ায়। সামাজিক মর্যাদা এবং প্রতিষ্ঠা বলতে যা বোঝায় সে সবই তার আছে। তার মতো একটি মেয়ের স্বাধীনতা যেখানে বিপন্ন সেখানে তার চেয়ে অনেক নীচের স্তরের অশিক্ষিত এবং আর্থিক দিক থেকে পুরুষের ওপর নির্ভরশীল মেয়েদের জন্য সে কতটুকু কী করতে পারে? হঠাৎ অদ্ভুত এক নৈরাশ্য চারিদিক থেকে তাকে যেন ঘিরে ধরতে থাকে।

মৃণালিনী আবার বলেন, নিজেকে শক্ত রাখবি বুবু। ওদের কথায় একেবারে রাজি হবি না। আমাদের পরিবারে দুটো দুর্ঘটনা ঘটছে। তৃতীয়বার আর যেন না ঘটে। আমি অন্তত ঘটতে দেব না।

মৃণালিনীর মতো মহিলা এই সামাজিক সিস্টেমে ক্বচিৎ কখনও দেখা যায়। পক্ষাঘাতে একটা দিক পড়ে গেছে, দশ বছর একটানা শয্যাশায়ী হয়ে আছেন কিন্তু এখনও মনের জোর তাঁর অপরিসীম। তাঁর মধ্যে একটি অপরাজেয় দৃঢ়তা আছে, কোনো কারণেই সেটা মাথা নোয়াতে জানে না।

দুটি পারিবারিক দুর্ঘটনার কথা যে মৃণালিনী বলেছেন তার একটি ঘটেছে মৃণালিনীর জীবনে, অন্যটি সুজাতার। সুজাতা অদিতির ছোটদি।

প্রথমে মৃণালিনীর কথাই ধরা যাক। এক সময় দারুণ ছাত্রী ছিলেন মৃণালিনী। সতেরো বছর বয়সে স্কলারশিপ নিয়ে ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন। তার পরেই ঠাকুরদা তাঁর বিয়ে দিয়েছিলেন। মৃণালিনী আরও পড়াশোনা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু প্রচুর পয়সা করলেও এ-বাড়ির আবহাওয়ায় বহুকালের প্রাচীন সংস্কার শিকড় গেড়ে ছিল। পনেরো পেরুবার আগেই এই বংশের মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়। সেদিক থেকে বয়স দুবছর বেশি হয়ে গিয়েছিল মৃণালিনীর। বিয়েটা আটকাবার জন্য প্রচুর কান্নাকাটি করেছেন তিনি, পুরো তিনটে দিন প্রতিবাদ হিসেবে কিছু খাননি। কিন্তু রমাপ্রসাদকে টলানো যায়নি। মেয়ের জন্য পারিবারিক প্রথা তিনি পুরোপুরি ভাঙতে পারেন না।

বিয়ে হয়েছিল উত্তর কলকাতার এক বনেদি অভিজাত পরিবারে। পৃথিবীতে কাম্য বস্তু বলতে তাদের যদি কিছু থাকে তা হল অর্থ। নিজেদের কোনোরকম অভাব ছিল না। গোটাচারেক বাড়ি, তিন-চারটে গাড়ি, ওয়েলার ঘোড়ায় টানা ফিটন ইত্যাদি। তাছাড়া ব্যাঙ্কের ফিক্সড ডিপোজিট অজস্র টাকা, নানা কোম্পানিতে আট-দশ লাখ টাকার শেয়ার। তবু তাদের খাই মিটত না। এইসব টাকার বেশিরভাগ এসেছে ছেলেদের বিয়ের যৌতুক হিসেবে। মৃণালিনীর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা বিয়েটাকে টাকা বানাবার একটা কৌশল হিসেবে ব্যবহার করত। বেছে বেছে এমন সব বাড়ি থেকে পুত্রবধু যোগাড় করত যাদের প্রচুর অর্থ, বিপুল প্রপার্টি।

মৃণালিনীর বিয়ের সময় তাঁর শ্বশুরেরা যৌতুক এবং নগদ টাকা যা আদায় করার তা তো আদায় করেছিলই, মাসখানেক পর থেকে আরও টাকা আনার জন্য মৃণালিনীর ওপর চাপ দেওয়া শুরু হয়েছিল। প্রথম প্রথম শাশুড়িই তাঁকে টাকার কথা বলত, মৃণালিনী শুনতেন কিন্তু উত্তর দিতেন না। পরে শ্বশুর বলতে শুরু করেছিল। অন্য পুত্রবধূরা যে কত ভালো এবং তাদের বাপেরবাড়ি থেকে কতভাবে কত টাকা নিয়ে এসেছে নাটকীয় ভঙ্গিতে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে বলত, শ্বশুরবাড়িই হচ্ছে মেয়েদের সর্বস্ব এবং সব মেয়েরই কর্তব্য সেখানকার বিষয়-সম্পত্তি আর টাকাপয়সা অনবরত বাড়িয়ে চলা। মৃণালিনীর স্বামীরও এ ব্যাপারে পুরোপুরি সায় ছিল।

মৃণালিনী আগে জানতেন না, পরে শুনেছেন তাঁর শ্বশুরবাড়িতে বধূ হত্যার দু-একটি দৃষ্টান্ত আছে। যে পুত্রবধূরা বাপেরবাড়ি থেকে টাকা আনতে রাজি হয়নি বা এ-ব্যাপারে প্রতিবাদ জানিয়েছে তাদের অকালে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। একেবারে খুনির বংশ। পয়সার জন্য এরা না-পারে এমন কোনো কাজ নেই।

দু-চারবার শোনার পর মৃণালিনী মনস্থির করে ফেলেছিলেন। একদিন শ্বশুরকে বলেছিলেন, আপনি আমাকে নিয়ে বাবার কাছে চলুন।

শ্বশুরের চোখ-মুখ লোভ চকচকিয়ে উঠেছিল। সে তক্ষুনি চুনোট-করা ধাক্কাপড় কাচি ধুতি, গিলে-করা পাঞ্জাবি পরে পায়ে গুঁড়োলা নাগরা লাগিয়ে, মাথায় পরিপাটি টেড়িটি কেটে মৃণালিনীকে নিয়ে ফিটনে উঠেছিলেন।

ওল্ড বালিগঞ্জে নিজেদের বাড়ি এসে শ্বশুরকে ড্রইংরুমে বসিয়ে বাবা, দাদা এবং মাকে ডেকে নিয়ে এসেছিলেন মৃণালিনী। শান্ত গলায় বাবাকে বলেছিলেন, বাবা, থানার

অফিসার-ইন-চার্জকে খবর দাও, এখনই যেন তিনি চলে আসেন।

সবাই হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। শিবপ্রসাদ বিমূঢ়ের মতো বলেছিলেন, থানার অফিসার এসে এখানে কী করবে?

শ্বশুরকে দেখিয়ে মৃণালিনী বলেছিলেন, এই লোকটার নামে আমি একটা ডায়েরি করব।

মা বাবা দাদা, এমনকী মৃণালিনীর শ্বশুর পর্যন্ত আঁতকে উঠেছিল। মা বলেছিলেন, কার সম্বন্ধে কী বলছিস মিনু! তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে!

মাথা আমার ঠিকই আছে মা। তোমরা ভালো করে খোঁজখবর না নিয়ে খুনিদের বাড়িতে আমার বিয়ে দিয়েছিলে।

শিবপ্রসাদ ধমকে উঠেছিলেন, মিনু!

মৃণালিনী বলেছিলেন, আমার সব কথা আগে শুনে নাও। এরা আমার বিয়ের সময় তোমার কাছ থেকে এক লাখ টাকা আদায় করেছিল। এখন আবার পঞ্চাশ হাজার চাইছে। আর সেই টাকাটা নেবার জন্যেই আমাকে নিয়ে এখানে এসেছে। তোমরা যদি না দাও আমার মৃত্যু কেউ ঠেকাতে পারবে না। ঠিক সেই কারণে তিন-চারটি বউকে এরা খুন করেছে।

ভয়ে মৃণালিনীর শ্বশুরের মুখ প্রথমটা একেবারে রক্তশূন্য হয়ে গিয়েছিল। তারপরেই অসহ্য রাগে উঠে দাঁড়িয়েছিল সে। গলায় শির ছিঁড়ে চিৎকার করে উঠেছিল, এই অপমানের কথা আমার মনে থাকবে।

মৃণালিনী বলেছিলেন, মনে থাকাটা খুব দরকার।

শ্বশুর আর দাঁড়ায়নি, দাঁতে দাঁত চেপে বেরিয়ে গিয়েছিল।

শিবপ্রসাদ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসেছিলেন। তারপর বলেছেন, এ তুই কী করলি মিনু! পঞ্চাশ হাজার টাকা নাহয় আমি দিতাম।

কিছুতেই না। এই অন্যায়কে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। আজ পঞ্চাশ হাজার দিয়ে তুমি রেহাই পাবে ভেবেছ! কালই আবার এক লাখ চেয়ে বসবে। ওদের লোভের শেষ নেই।

কিন্তু যে কাণ্ড তুই করলি তাতে শ্বশুরবাড়ির দরজা তো চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল।

আমি সেটাই চাই। ওইরকম পশুদের বাড়ি আমি কখনোই যাব না।

পাগলামি করিস না। আমি তোর শ্বশুরমশাইয়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে বরং-~

একেবারে না বাবা। তীব্র গলায় মৃণালিনী বলেছিলেন, একটা ইতর শয়তানের কাছে তুমি হাতজোড় করে গিয়ে দাঁড়াবে, এ আমি ভাবতেই পারি না।

শিবপ্রসাদ একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন, কিন্তু তোর ভবিষ্যৎ?

সেটা আমি ভেবে রেখেছি।

সেদিনই শিবপ্রসাদ এবং রমাপ্রসাদকে সঙ্গে নিয়ে থানায় গিয়ে শ্বশুরবাড়ির নামে একটা ডায়েরি করেছিলেন। পরের দিন থেকে নতুন করে তাঁর পড়াশোনা শুরু হয়েছিল।

শিবপ্রসাদ বেঁচে থাকতে থাকতেই মৃণালিনী এম.এ পাশ করে একটা স্কুলে চাকরি নিয়েছিলেন। এতে খুবই দুঃখ পেয়েছিলেন শিবপ্রসাদ। মেয়েদের সম্পর্কে এই পরিবারের ধ্যানধারণার সঙ্গে চাকরিটা একেবারেই খাপ খায় না। মেয়েরা পয়সা রোজগারের জন্য বাইরে বেরুবে, এটা ছিল একেবারে অভাবনীয়। ক্ষুব্ধ শিবপ্রসাদ বলেছিলেন, আমি কি তোকে দু-বেলা দুটো খেতে দিতে পারি না?

মৃণালিনী বলেছিলেন, নিশ্চয়ই পারো। তুমি যতদিন আছ ততদিন ঠিক আছে। তারপর?

রমাপ্রসাদ কাছেই দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, আমার ওপর তোর কি বিশ্বাস নেই মিনু? তাঁর চোখে-মুখে অভিমান এবং কষ্টের ছাপ ফুটে উঠেছে।

মৃণালিনী বলেছেন, কাউকেই আমি অবিশ্বাস করি না দাদা। এম.এ পাশ করে চুপচাপ ঘরে বসে থাকার মানে হয় না। কিছু একটা করা ভালো।

শিবপ্রসাদ কুণ্ঠিত মুখে বলেছিলেন, আমি একটা কথা ভাবছিলাম।

মৃণালিনী জিগ্যেস করেছিলেন, কী কথা?

আবার যদি তোর বিয়ে দিই?

মেয়েদের ব্যাপারে এ বাড়ির লোকেরা বিয়ে ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারত না। সেটাই যেন তাদের পক্ষে ভবিষ্যতের একমাত্র গ্যারান্টি। সেই যে মৃণালিনীর শ্বশুর উত্তেজিত ভঙ্গিতে চলে গিয়েছিল, তার কয়েক দিন বাদেই চিঠি লিখে জানিয়ে দিয়েছিল, মৃণালিনীর সঙ্গে তাদের আর কোনো সম্পর্ক নেই, তাঁর কাছে শ্বশুরবাড়ির দরজা চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। চিঠিটা পাওয়ার পরই ভঙ্গুর বিবাহিত জীবনের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে মৃণালিনীর হাতে যে শাখা ছিল তা খুলে ফেলেছেন তিনি, সিঁথি থেকে সিঁদুর ঘষে ঘষে মুছে দিয়েছেন। একমাসের দাম্পত্যজীবন এইভাবেই শেষ হয়ে গিয়েছিল তাঁর। সতেরো বছর বয়সে পুরুষদের সম্পর্কে যে মারাত্মক ধারণাটি তাঁর হয়েছিল তাতে নতুন করে বিয়ের ফাঁদে আর পা দিতে চাননি। মৃণালিনী বলেছেন, যথেষ্ট হয়েছে, আর দরকার নেই।

কিন্তু~~

আমার সম্বন্ধে অত ভেবে ভেবে এই বয়সে কেন শরীর খারাপ করছ? শুধু এ বাড়িতে আমাকে একটু থাকতে দিও। আর কিছু দরকার নেই। আমি তো বাচ্চা মেয়ে নই। কীসে আমার ভালোমন্দ সেটা বুঝি। আমার ভাবনা আমাকেই ভাবতে দাও।

তারপর দশ বছর আগে পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী না-হওয়া পর্যন্ত একটানা স্কুলে পড়িয়ে গেছেন মৃণালিনী। হেড মিস্ট্রেসও হয়েছিলেন।

এর মধ্যে শিবপ্রসাদ এবং তাঁর স্ত্রী অর্থাৎ মৃণালিনীর মা মারা গেছেন।

দ্বিতীয় ঘটনাটি অদিতির ছোটদি সুজাতাকে নিয়ে। সুজাতার স্বামী এবং শ্বশুর ব্যবসার নাম করে রমাপ্রসাদের কাছে বেশ কিছু টাকা চেয়েছিল কিন্তু তখন এ-বাড়ির অবস্থা পড়ে গেছে। টাকা দেবার ক্ষমতা এদের ছিল না। ফলে সুজাতাকে আর বাপের বাড়ি আসতে দেওয়া হয় না। অদিতিদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক একরকম শেষ-ই হয়ে গেছে বলা যায়। তবে মন্দের এটুকুই ভালো, বধূহত্যার তালিকায় তার নামটা অন্তত ওঠেনি।

মৃণালিনীর মতো সুজাতার অতটা সাহস বা দৃঢ়তা ছিল না। শ্বশুরবাড়ি থেকে মাথা উঁচু করে সে বেরিয়ে আসতে পারেনি। শ্বশুর এবং স্বামীর সিদ্ধান্ত সে নিঃশব্দে মাথা পেতে মেনে নিয়েছিল…।

মৃণালিনী এবার বললেন, এই বিয়েতে আমি মত দিলাম বুবু, যদি বুঝতাম সিতাংশু ভালো ছেলে। কিন্তু ওটা পাজির পা ঝাড়া

এতক্ষণ মৃণালিনী এবং সুজাতার অতীত জীবনের কথা ভাবছিল অদিতি। সে চমকে ওঠে।

মৃণালিনী থামেননি, দুশ্চরিত্র, লম্পট। অনেক মেয়ের সর্বনাশ করেছে।

অবাক হয়ে পিসিকে দেখতে থাকে অদিতি। এই মহিলা কি অলৌকিক কোনো ক্ষমতার অধিকারিণী? ঘরে শুয়ে থেকে এত সব খবর পান কী করে? নিজের অজান্তেই অদিতি বলে, তুমি কেমন করে জানলে?

মৃণালিনী বলেন, যখন খবর পেলাম তোর বাবা আর দাদারা সিতাংশুর সঙ্গে তোর বিয়ে দেবার মতলব করেছে তখন চিঠি লিখে টোকনকে ডাকিয়ে এনেছিলাম।

টোকন অদিতির দূর সম্পর্কের খুড়তুতো ভাই। বছর দেড়েক আগে বি.এস সি পাশ করেই নিজের চেষ্টায় একটা বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ফ্যাক্টরিতে অ্যাপ্রেন্টিসশিপ জোগাড় করে ফেলেছে। টোকন দারুণ তুখোড় আর স্মার্ট। অসম্ভব বলে তার কাছে কোনো ব্যাপারই নেই। যে কাজেই তাকে লাগিয়ে দেওয়া যাক, যেভাবেই হোক, সেটি করবেই।

অদিতি এবং মৃণালিনী দরকার হলেই তাকে খবর দেন। পিসি যখন চিঠি দিয়ে ডাকিয়ে এনেছিলেন তখন গোয়েন্দা হিসেবে নিশ্চয়ই সিতাংশুর পেছনে লাগিয়ে দিয়েছেন এবং টোকন অবশ্যই তার সম্বন্ধে যাবতীয় তথ্য সরবরাহ করে গেছে। এসব কাজে টোকনের প্রচণ্ড উৎসাহ।

মৃণালিনী আবার বললেন, বুঝতেই পারছিস কেন টোকনকে চিঠি লিখেছি। ও পরশু জানিয়ে গেছে, সিতাংশু এর আগে দু-বার বিয়ে করে দু-বার ডিভোর্স করেছে। তা ছাড়া দু-একটা রক্ষিতাও নাকি আছে। তা ছাড়া প্রায়ই নতুন নতুন মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করতে পোয়া, গোপালপুর এমনি সব জায়গায় যায়। কন্ট্রাক্টারি করে লাখ লাখ টাকা করেছে–প্রচুর নাকি ব্ল্যাক মানি। পাপের টাকা এইভাবেই খানিকটা ওড়াচ্ছে।

অদিতি বলে, বাবা বড়দা ছোটদা এসব জানে?

জানা তো উচিত।

আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল অদিতি, দুর্গা এসে দরজার সামনে দাঁড়ায়। বলে, ছোটদি, বড়বাবু তোমাকে ডাকছেন। এক্ষুনি নীচে যাও

ঠিক আছে, তুই যা। আমি আসছি। বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায় অদিতি। তার মুখ-চোখ দেখে মনে হয়, ভেতরে ভেতরে সিংশুর ব্যাপারে একটা কিছু সিদ্ধান্ত করে ফেলেছে।

দরজার কাছ থেকে চলে যায় দুর্গা। মৃণালিনী বলেন, চললি?

হ্যাঁ।

আমার কথাটা মনে থাকে যেন।

থাকবে।

নীচে নামতে নামতে অদিতি দেখতে পায়, দোতলার বারান্দায় বড় বউদি বন্দনা আর ছোট বউদি মীরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। হেমলতাকে এবার আর দেখা যায় না। অদিতির পায়ের শব্দে মুখ ফিরিয়ে তারা থামকে যায়। বোঝা যাচ্ছে, তার সম্পর্কেই দুই বউদি কিছু আলোচনা করছিল।

বড় বউদি বন্দনার বয়স বত্রিশ-তেত্রিশ। ছেলেপুলে হয়নি। খুবই গরিবের ঘরের মেয়ে বন্দনা। বরুণ প্রেম করে তাকে বিয়ে করেছিল। যেমন চতুর তেমনি স্বার্থপর। পারিবারিক ডিপ্লোম্যাসিটা এমনভাবে চালিয়ে যায় যাতে ধরার উপায় নেই। কার সঙ্গে কী ব্যবহার করলে, কার কানে কী লাগালে, কার মন যুগিয়ে চললে স্বার্থটি বজায় থাকে, সে সব সুচারুভাবে করে যায় বন্দনা। তার কাজ এতটাই নিখুঁত যে ধরার উপায় থাকে না।

মীরাও প্রেমের রাস্তাতেই, কিঞ্চিৎ ঘুরপথে এ-বাড়িতে এসে ঢুকেছিল। তবে ছোটদা মৃগাঙ্ক তাকে বিয়ে করে আনেনি। তিন মাসের বাচ্চা পেটে নিয়ে বিয়ের আগেই তার প্রবেশ। প্রথমটা মৃগাঙ্ক মীরার সন্তানের দায়িত্ব স্বীকার করতে চায়নি। এই নিয়ে প্রচুর ঝাট হয়েছে। পরে পাড়ার ছেলে এবং পলিটিক্যাল পার্টিগুলোর চাপে সুড় সুড় করে বিয়ে করেছে। তাদের একটিমাত্র ছেলে–চিকু। সে একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে।

মীরার বয়স ছাব্বিশ-সাতাশ। তার বাপের বাড়ির অবস্থা বন্দনাদের তুলনায় অনেক ভালো। বন্দনার মতো সে অতটা স্বার্থপর বা ধুরন্ধর নয়। তার মধ্যে কিছুটা উদারতা এবং সারল্য রয়েছে।

দুই বউদি একটিও কথা না বলে অদিতিকে লক্ষ করতে লাগল। অদিতি তাদের দিকে চোখ রেখে আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে।

নীচের ড্রইংরুমে আসতে রমাপ্রসাদ বললেন, এত দেরি করলি! সেই কখন থেকে সিতাংশু বসে আছে। বস।

একটা ছেঁড়া জরাজীর্ণ সোফায় বসতে বসতে অদিতি জিগ্যেস করে, আমার জন্যে?

হ্যাঁ।

সব জেনে-শুনেও অদিতি বলে, কেন?

বিব্রতভাবে রমাপ্রসাদ বলেন, এই তোর সঙ্গে একটু আলাপ করবে। তাই

অদিতি বলে, কার কাছে যেন শুনেছিলাম সিতাংশুবাবু একজন বিরাট বিল্ডার বিরাট কনস্ট্রাকশান বিজনেস আছে ওঁর। কিন্তু সে ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। আমি জানি শেক্সপিয়র, শেলি, কিটস, টেনিসন, সুইনবার্ন, এলিয়ট। এঁদের নিয়ে আলোচনা করলে আমার আপত্তি নেই।

বিপন্ন মুখে রমাপ্রসাদ বলেন, না, মানে

তীক্ষ্ণ চোখে বাবাকে দেখতে দেখতে অদ্ভুত হাসে অদিতি। বলে, বাবা বড়দা ছোটদা, তোমরা ওপরে যাও। সিতাংশুবাবুর সঙ্গে আমিই আলাপ করে নিচ্ছি।

অদিতি যা বলেছে তা প্রায় অভাবনীয়। এর জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। সবাই প্রথমটা হকচকিয়ে গেল। তাপর চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

অদিতি এবার সিতাংশুকে বলে, আপনি চা খেয়েছেন?

সিতাংশু শশব্যস্তে বলে ওঠে, হা হা, নিশ্চয়ই।

আরেকবার দিতে বলব?

আপনি যদি খান তা হলে

ঠিক আছে, খাব।

অদিতি জানে ঘরের বাইরে রমাপ্রসাদ না থাকুন, দুই দাদা নিশ্চয়ই কাছাকাছি কোথাও রয়েছে। সিতাংশুর সঙ্গে তার কথাবার্তা শোনার জন্য তাদের দম আটকে আছে। গলা তুলে অদিতি বলে, ছোটদা-বড়দা, দুর্গাকে দিয়ে দু-কাপ চা পাঠিয়ে দিও–

বরুণ বা মৃগাঙ্কর সাড়া পাওয়া যায় না। তবে কয়েক মিনিটের ভেতর চা দিয়ে যায় দুর্গা।

একটা কাপ তুলে নিয়ে অদিতি বলে, সারাদিন নানা কাজে অনেক জায়গায় ঘুরতে হয়েছে। আমি ভীষণ টায়ার্ড। আপনিও শুনলাম বেশ কিছুক্ষণ ওয়েট করছেন। বাজে ভণিতা না করে কাজের কথা শুরু করা যাক

সিতাংশু চায়ের কাপ তুলে নিয়েছিল। সে আলতো করে একটা চুমুক দিয়ে উৎসুক চোখে তাকায়।

অদিতি সোজাসুজি সিতাংশুকে লক্ষ করতে করতে বলে, দেখুন কেউ আমাকে স্ট্রেট কিছু বলেনি। তবে মাস দু-তিনেক ধরে খবর পাচ্ছি আপনি রেগুলার আমাদের বাড়ি আসছেন। আমার দাদাদের আপনি বন্ধু, বাবারও বিশেষ পরিচিত। আসাটা স্বাভাবিক। এ ব্যাপারে আমার মাথা ঘামাবার কিছু ছিল না।

কী?

কয়েকদিন হল টের পাচ্ছি, বাবা আর দাদারা চান আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে হোক আর সেই উদ্দেশ্য মাথায় রেখে ওঁরা ঠিক করেছিলেন আজ আপনার সঙ্গে আমার ফরম্যাল আলাপের সুযোগ করে দেবেন। ঠিক বলছি তো?

কোনো মেয়ে সরাসরি এ জাতীয় কথা এত অসঙ্কোচে বলতে পারে, সিতাংশুর ধারণা ছিল না। সে প্রথমটা অবাক হয়ে যায়। তারপর দ্বিধান্বিতভাবে বলে, ঠিক

যদি আমার কোথাও ভুল হয় কারেক্ট করে দেবেন।

সিতাংশু উত্তর দেয় না।

অদিতি আবার বলে, আপনি যখন কয়েকঘণ্টা ওয়েট করছেন তখন ধরে নিতে পারি এ বিয়েতে আপনারও সায় রয়েছে।

চোখ নামিয়ে আস্তে আস্তে মুখ হেলিয়ে দেয় সিতাংশু।

অদিতি বলে, যাক, বিয়ের ব্যাপারে আপনার পরিষ্কার মতামতটা যখন জানা গেল তখন আলোচনা করতে সুবিধে হবে।

সিতাংশু এবারও কিছু না-বলে অদিতির দিকে তাকায়।

অদিতি বলে, এবার নিজের সম্বন্ধে আপনাকে কিছু ইনফরমেশন দিই। তাতে আমাকে বুঝতে আপনার পক্ষে সুবিধে হবে।

সিতাংশু স্মার্ট হবার চেষ্টা করে, বেশ তো। ডিসকাশানটা খোলামেলা হওয়াই ভালো। একটু থেমে বলে, সিগারেট খেলে আপনার আপত্তি নেই তো?

নট অ্যাট অল। অদিতি বলতে থাকে, আমি ডিভোর্সি নই, আগে আমার বিয়ে হয়নি। ভার্জিন কুমারী মেয়ে বলতে যা বোঝা যায় আমি তা-ই। তবে

তবে কী?

আপনি হয়তো জানেন আমি একটা কলেজে পড়াই।

জানি।

সেখানে আমার বেশিরভাগ কলিগই পুরুষ। এ ছাড়াও নানা দরকারে বহু পুরুষের সঙ্গে মিশতে হয়। অসংখ্য বয়-ফ্রেন্ড রয়েছে আমার।

এ নিয়ে আমার কোনোরকম শুচিবাই নেই।

ফাইন।

আপনি কি জানেন নারী-জাগরণ নামে আমাদের একটা অরগানাইজেশন আছে?

না। সেটা কী?

নারী-জাগরণ-এর উদ্দেশ্য সংক্ষেপে জানিয়ে অদিতি যা বলে তা এইরকম। পুরুষশাসিত সমাজে মেয়েরা নানা কুসংস্কার এবং শৃঙ্খলে বন্দি হয়ে আছে। এই নারীদের মুক্তির জন্যই তাদের সংগঠন অবিরাম যুদ্ধ করে চলেছে। যেভাবেই হোক মেয়েদের ওপর লাঞ্ছনা এবং অত্যাচার বন্ধ করতেই হবে। যতদিন-না নারীর সম্মান মর্যাদা আর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে নারী-জাগরণ-এর লড়াই চলবেই।

রীতিমতো উৎসাহিত হয়ে ওঠে সিতাংশু। বলে, এ তো বিরাট কাজ। এতে আমার সাপোর্ট আছে।

যদি ডোনেশন নিতে আপনারা রাজি থাকেন, আমি দেব।

ধন্যবাদ। তেমন দরকার হলে নিশ্চয়ই আপনার কাছে নারী-জাগরণ হাত পাতবে।

সিতাংশু অল্প হাসে, তবে উত্তর দেয় না। আগেই একটা সিগারেট ধরিয়ে নিয়েছিল সে, আস্তে আস্তে সেটা টানতে থাকে।

অদিতি থামেনি। সে বলে, নারীমুক্তির জন্য যখন আন্দোলন করছি তখন বুঝতেই পারছেন আমি কী টাইপের মেয়ে। আমার যিনি স্বামী হবেন তাঁকে গ্যারান্টি দিতে হবে, বিয়ের পর আমার স্বাধীনতায় হাত দিতে পারবেন না। আমি কোথায় যাব, কার সঙ্গে মিশব, কখন বাড়ি ফিরব–এসব নিয়ে প্রশ্ন করা চলবে না।

সিতাংশু নড়েচড়ে বসে। অ্যাশট্রেতে সিগারেটের ছাই ঝেড়ে বলে, কিন্তু সংসারের দিকটাও তত মেয়েদের দেখা উচিত।

নিশ্চয়ই। সংসারের ব্যাপারে আমার যেটুকু কর্তব্য তা তো করতেই হবে।

সিতাংশুর মুখ দেখে মনে হয়, অদিতির কথায় খুশি হয়েছে। একটু চুপচাপ।

তারপর কিছুটা ইতস্তত করে সিতাংশু বলে, আমার সামান্য একটা অনুরোধ ছিল।

বলুন।

ব্যবসা করে আমার টাকাপয়সার অভাব নেই। আমার স্ত্রী চাকরি করবেন, এটা ভালো লাগছে না।

চাকরির ব্যাপারটা আগে ঠিক করে নেওয়া যাক। আপনার কত টাকা আছে, আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। তবে ফোর্ড বা রকফেলারের বাড়িতে বিয়ে হলেও চাকরিটা ছাড়তে পারব না। অর্থিক স্বাধীনতা আমার কাছে খুবই ইম্পর্টান্ট। অদিতি না থেমে একটানা বলে যায়, আশা করি চাকরির ব্যাপারটা আপনার কাছে ক্লিয়ার করে দিতে পেরেছি।

সিতাংশুর ধারণা ছিল, এক কথায় চাকরি ছেড়ে দেবে অদিতি।

উত্তর শুনে ভেতরে ভেতরে একটু থমকে যায় সে। আস্তে করে বলে, হ্যাঁ। চাকরি করার যখন এত ইচ্ছে তখন আর কী বলব। ঠিক আছে তা-ই কোরো তুমি। বেশ সচেতনভাবেই, নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্যই হয়তো, অদিতিকে তুমি করে বলতে শুরু করে সে।

অদিতি দ্রুত একটি আঙুল তুলে জোরে মাথা নাড়ে, উঁহু উঁহু, এখনও আমরা তুমি বলার স্টেজে আসিনি। আরও কয়েকটা বিষয় আমাদের পরিষ্কার করে নিতে হবে।

সিতাংশু হকচকিয়ে যায়, কী কী বিষয়?

আমার সম্বন্ধে জরুরি ইনফরমেশনগুলো মোটামুটি সবই দিয়েছি মিস্টার ভৌমিক।

কিন্তু বলুন

নিজের সম্বন্ধে আপনি এখনও কিছু জানাননি। বেটার আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের জন্য ওটা আমার জানা দরকার–তাই না?

কিছুটা অস্বস্তি বোধ করে সিতাংশু। সিগারেটের বাকি অংশটুকু অ্যাশট্রেতে নামিয়ে রেখে বলে, অবশ্যই। আমার সম্বন্ধে কী কী ইনফরমেশন পেলে আপনার সুবিধা হয় বলুন।

দেখুন, আমি ইংরেজিতে ফাস্ট ক্লাস পেয়ে এম. এ পাশ করেছি। একটা কলেজে কাজ করি। প্রথমেই জানতে ইচ্ছে হবে, যিনি আমার স্বামী হবেন তাঁর এডুকেশনাল কোয়ালিফিকেশনটা কী?

নিশ্চয়ই। আমি একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। শিবপুর থেকে পাশ করেছি।

ঠিক আছে। শুনেছি আপনি একজন বিজনেসম্যান। কী ধরনের ব্যবসা করেন?

কনস্ট্রাকশনের। বড় বড় অ্যাপার্টমেন্ট হাউস, হাইরাইজ অফিস বিল্ডিং, সিনেমাহল, ব্রিজ–এইসব তৈরি করে আমার ফার্ম।

এর সঙ্গে ব্ল্যাকমানির সম্পর্ক কতটা?

ভীষণ হকচকিয়ে যায় সিতাংশু। পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, অস্বীকার করব না, কিছুটা তো রয়েছেই। ইন্ডিয়াতে এমন কোনো বিজনেস আপনি দেখাতে পারবেন না যার সঙ্গে ব্ল্যাক মানি ইনভলভড় নেই। দিস ইজ আ পার্ট অফ দি গেম। নান ক্যান হেল্প। একটু থেমে জিগ্যেস করে, হঠাৎ ব্ল্যাক মানির কথা জানতে চাইলেন?

বিয়ের পর বাড়িতে সি.বি.আই, আর ইনিকামট্যাক্স রেইড় হতে পারে সেটাই বুঝতে চাইছি।

হেসে হেসে হালকা গলায় সিতাংশু বলে, আজকাল এই রেইডগুলো হল স্টেটাস সিম্বল। এ দিয়ে প্রমাণ হয় ইউ আর সামবডি। তবে–

কী?

আমাদের মতো ছোটখাটো বিজনেসম্যানদের সি.বি.আই-ওয়ালারা কাউন্টই করে না। ভয় নেই, কেউ রেইড করতে আসবে না।

সিতাংশুকে লক্ষ করতে করতে অদিতি বলে, আমি কিছু কিছু ওল্ড ভ্যালুজে বিশ্বাসী। মানুষের, বিশেষ করে প্রিয়জনদের মধ্যে মিনিমাম অনেস্টিটুকু দেখলে আমার আনন্দ হয়।

ব্যস্তভাবে সিতাংশু বলে, আমিও সেন্ট পারসেন্ট অনেস্ট থাকতে চাই। কিন্তু ওই যে একটু আগে বললাম, ব্ল্যাক মানি ছাড়া বিজনেসে একটা স্টেপও ফেলা যায় না। অনেস্টি নিয়ে চললে সাতদিনে আমার কোম্পানি বন্ধ করে দিতে হবে। আর নিট রেজাল্ট হবে এই, চারশো ওয়ার্কার সঙ্গে সঙ্গে বেকার হয়ে যাবে। এই লোকগুলোর ভবিষ্যৎ কী, তারা কী খাবে, কী হবে তাদের ছেলেমেয়ের–এসবও তো মাথায় রাখতে হয়।

কিছুক্ষণ চিন্তা করে অদিতি বলে, অনেস্ট হওয়ার সমস্যাও তা হলে আছে দেখছি।

সিতাংশু বলে, আমাদের সোশিও-ইকনমিক প্যাটার্নটাই এরকম দাঁড়িয়ে গেছে। দু-একজন অনেস্ট হয়ে কী করবে?

ডিজঅনেস্টি যদি চারশোটা ফ্যামিলিকে বাঁচাতে পারে, তা হলে সততা নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলেনা কি বলেন?

সিতাংশু উত্তর দেয় না।

অদিতি বলে, এবার অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। আপনার একজাট বয়স কত?

বিরুদ্ধ পক্ষের উকিলের মতো উলটোপালটা জেরা করে অদিতি তার কাছ থেকে কোন গোপন তথ্য বের করে নিতে চাইছে, বোঝা যাচ্ছে না। সে সতর্ক ভঙ্গিতে জিগ্যেস করে, বয়েস জানতে চাইছেন কেন?

বলুন না—

চল্লিশের কাছাকাছি।

আমাদের দেশের পক্ষে বিয়ের বয়েসটা অনেক আগেই পার হয়ে এসেছেন। পুরোনো কাল হলে বানপ্রস্থর আগে স্টেজে চলে যেতেন। বলতে বলতে সামনের দিকে ঝুঁকে গলার স্বর অনেকটা নামিয়ে দেয়, এতদিন বিয়ে করেননি কেন?

হঠাৎ ভীষণ ঘাবড়ে যায় সিতাংশু। তার মতো একজন সফল স্মার্ট বিজনেসম্যানও উপযুক্ত উত্তরটি খুঁজে পায় না। কোনোরকমে সে বলে, আমি–আমি মানে

অদিতি তার চোখের দিকে পলকহীন তাকিয়ে ছিল। আস্তে আস্তে বলে, আমি আপনার সম্বন্ধে একটা খবর পেয়েছি। সেটা কতদুর সত্যি, আদৌ সত্যি কিনা, আপনিই শুধু বলতে পারবেন। তিনটে বিয়ের কথাই মৃণালিনী তাকে জানিয়েছেন কিনা, সে মনে করতে পারল না। অবশ্য সিতাংশু তিনটে করুক কি দশটা করুক সংখ্যায় তার কিছু এসে যায় না।

কী খবর?

আপনি আগে তিনবার বিয়ে করেছেন। একবার ডিভোর্স হয়েছে। একবার

অদিতির কথা শেষ হবার আগেই সিতাংশু বলে ওঠে, প্রথম বিয়েটা হয়েছিল নামমাত্র। অ্যাডজাস্টমেন্ট হল না, বছরখানেকের ভেতর আমরা মিউঁচুয়ালি সেপারেশন করে নিই।

আদিতি বলে, আর সেকেন্ড ম্যারেজ? শুনেছি মিস্টিরিয়াস অবস্থায় আপনার দ্বিতীয় স্ত্রী আগুনে পুড়ে মারা যান। ব্যাপারটা থানা পুলিশ পর্যন্ত নাকি গড়িয়েছিল?

সিতাংশুর কপালে দানা দানা ঘাম জমতে থাকে। রুমাল দিয়ে মুছতে মুছতে সে বলে, কে আপনাকে এসব বাজে খবর দিয়েছে, জানি না। মনে হয়, বিজনেসে আমার যারা শত্রুপক্ষ তারাই এভাবে ক্যারেক্টার অ্যাসাসিনেশন করছে। ইটস আ ডার্টি সোন্ডারিং এগনেস্ট মি। আসলে ঘটনাটা খুবই আনফরচুনেট। একটা গ্যাস সিলিন্ডার বাচঁ করে রমলা, মানে আমার দ্বিতীয় স্ত্রী মারা যায়। এ নিয়ে থানা-পুলিশের ইনভলভমেন্টটা সম্পূর্ণ মিথ্যে। একটানা দম-আটকানো গলায় বলে যায় সে।

অদিতি বলে, আপনার মতো একজন বিশিষ্টি শিক্ষিত ভদ্রলোক যখন বলছেন তখন তা বিশ্বাস করা উচিত। আমিও করলাম। এবার থার্ড ম্যারেজের কী গতি হল বলুন।

অদিতির দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছিল না সিতাংশু। ঘাড় ভেঙে তার মাথা বুকের ওপর ঝুলে পড়েছে যেন। সে বলে, সেটাও আমার পক্ষে খুবই দুর্ভাগ্যজনক। রেখার সঙ্গেও শেষ পর্যন্ত অ্যাডজাস্ট করা গেল না। কোর্ট থেকে আমরা ডিভোর্স নিয়েছি বছর তিনেক আগে।

তৃতীয় বিয়েটার কথা স্রেফ আন্দাজেই বলেছে অদিতি। দেখা গেল, সেটাও লেগে গেছে। কে জানে, আরও ডজনখানেক বিয়ে সিতাংশু করে বসে আছে কিনা। অদিতি অত্যন্ত শান্ত নিস্পৃহ মুখে বলে, আপনি যে কোনো কিছু না লুকিয়ে সব কথা ফ্রাঙ্কলি জানিয়েছেন, সে জন্য অনেক ধন্যবাদ।

গল গল করে ঘামতে ঘামতে এবং সেই ঘাম মুছতে মুছতে সিতাংশু বলে, লুকোবার কী আছে? যা ঘটেছে তা একদিন-না-একদিন জানাজানি হয়ে যাবেই। আমি আর কদিন চাপা দিয়ে রাখতে পারব?

দ্যাট শুড বি দ্যা স্পিরিট। অদিতি বলতে থাকে, আরও কিছু খবর আমার কানে এসেছে। যদিও কোনোরকম রিউমার আমি গ্রাহ্য করি না, তবু ব্যাপারটা আপনার কাছ থেকে শুনলে আপনাকে বুঝতে আমার পক্ষে সুবিধে হয়।

আমার সম্বন্ধে আর কী শুনেছেন? সিতাংশুর চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ ফুটে উঠতে থাকে।

অদিতি কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলে, সংকোচ হচ্ছে, তবু বলি। শুনেছি, কয়েকটা ফ্ল্যাট কিনে আপনি চার-পাঁচজন রক্ষিতা রেখেছেন।

দ্রুত মাথা তোলে সিতাংশু। তার মুখ থেকে পরতে পরতে রক্ত নেমে গিয়ে একেবারে ফ্যাকাশে দেখায়। ঝাপসা গলায় সে বলে, কারা কারা এসব রটিয়ে বেড়াচ্ছে? দিজ আর অ্যাবসোলুটলি ফলস্।

অদিতি হাসে, আপনার চোখ-মুখ কিন্তু অন্য কথা বলছে মিস্টার ভৌমিক।

কী বলতে চাইছেন আপনি?

যা বলার তা তো বলেই ফেলেছি। তার মধ্যে কোনোরকম অস্পষ্টতা নেই। বিয়ের ব্যাপারে আপনি যেভাবে বললেন, আশা করি রক্ষিতাদের বিষয়েও ঠিক সেইরকম ফ্রাঙ্ক হবেন।

কয়েক সেকেন্ড আগে মুখটা একেবারে রক্তশূন্য হয়ে গিয়েছিল। এবার শরীরের সব রক্ত সেখানে উঠে এসে মুখটাকে ভয়ংকর করে তোলে। সে বলে, কে আপনাকে এ খবর দিয়েছে?

যে-ই দিক, তার নাম বলব না। কথাটা সত্যি কিনা সেটুকুই শুধু জানতে চাইছি।

সিতাংশু উত্তর দেয় না। তার চোয়াল পাথরের মতো শক্ত হয়ে ওঠে।

অদিতি বলে, ভিকটোরিয়ান মরালিটি বলতে যা বোঝায় আমি তা নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামাই না। মানুষের বায়োলজিক্যাল প্রয়োজনটা বাস্তব ব্যাপার। নীতি-টীতি দিয়ে সেটা ঠেকিয়ে রাখা যায় না। এনিওয়ে আপনার হয়তো বলতে সংকোচ হচ্ছে। ধরেই নিলাম, এ ব্যাপারে যা শুনেছি, সেটা রিউমার নয়।

মুখের কাঠিন্য বাড়তে থাকে সিতাংশুর। রুক্ষ গলায় সে বলে, সেটা ডেফিনিটলি রিউমার।

আপনি তা হলে ওই ব্যাপারটা অস্বীকার করছেন?

নিশ্চয়ই।

তা হলে এই টপিকটা থাক।

আচ্ছা

বলুন।

আমার সম্বন্ধে সোন্ডারিং-এর খবরই শুধু আপনার কানে এসেছে। একটাও ভালো ইনফরমেশন পাননি?

চমকে ওঠার মতো ভঙ্গি করে অদিতি বলে, পেয়েছি বইকি, অবশ্যই পেয়েছি।

সিতাংশুকে কিছুটা উৎসুক দেখায়, তবে মুখের সেই কঠোরতা কমে না। সে বলে, কী পেয়েছেন?

আপনি অত্যন্ত দয়ালু। আপনার মতো হৃদয়বান মানুষ খুব বেশি দেখা যায় না।

সিতাংশু হকচিকয়ে যায়। একটু আগে যে অদিতি রক্ষিতাদের ব্যাপারে উলটোপালটা প্রশ্ন করে যাচ্ছিল, সে এই মুহূর্তে কোমল গলায় এমন কিছু বলছে যার জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিল না সিতাংশু। মেয়েটাকে একেবারেই বোঝা যাচ্ছে না। এক প্রসঙ্গ থেকে এত দ্রুত অভাবনীয় এমন একদিকে সে সরে যাচ্ছে যে খেই রাখা সম্ভব হচ্ছে না। বিমূঢ়ের মতো সিতাংশু বলে, মানে?

শুনেছি কেউ বিপদে পড়লে আপনি টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করেন।

মুখের সেই কর্কশ কাঠিন্য এখন আর নেই সিতাংশুর। লাজুক হেসে নরম গলায় সে বলে, না না, ওটা এমন কিছু ব্যাপার না। কারও দুঃখের দিনে যদি পাশে গিয়ে না-দাঁড়াই সোসাইটিতে বাস করা কেন? সামাজিক কিছু দায়দায়িত্বও তো থাকা দরকার।

একজাক্টলি সো? অদিতি আস্তে মাথা নেড়ে বলতে থাকে, আচ্ছা মিস্টার ভৌমিক

বলুন।

এখনও পর্যন্ত কত লোককে আপনি সাহায্য করেছেন?

এই মূহুর্তে অত্যন্ত পরিতৃপ্ত এবং খুশি দেখাচ্ছে সিতাংশুকে। অদিতি যে পরোপকারের কারণে তার সম্বন্ধে শ্রদ্ধাশীল সেটা টের পাওয়া যাচ্ছে। বিপন্ন দুঃস্থ মানুষকে সাহায্য করার খবর তাকে কে দিয়েছে, কে জানে! যে-ই দিয়ে থাক, সিতাংশু তার কাছে কৃতজ্ঞ। যদিও সাহায্যের ব্যাপারটা কতখানি সত্যি, সে-ই সব চেয়ে ভালো জানে। সিতাংশু বুঝতে পারে অদিতি এমন একটি মেয়ে মোটা ব্যাঙ্ক ব্যালান্স, দামি গাড়ি-বাড়ি, বিলাসের উপকরণ বা অঢেল আরাম দিয়ে যার মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া যাবে না। যাকে সে শ্রদ্ধা করতে পারবে তেমন একটি পুরুষকেই শুধু বিয়ে করবে। সিতাংশু মনে মনে ঠিক করে ফেলে তার সম্পর্কে অদিতির যে দুর্বলতাটুকু দেখা দিয়েছে সেটাকে টোকা মেরে মেরে উসকে দেবে।

সিতাংশু বলে, এসব জিগ্যেস করলে খুব লজ্জা পাই। আমার সারপ্লাস কিছু টাকা আছে। লোকের দরকারে দিই। কাকে দিলাম, কেন দিলাম–সেসব মনে করে রাখি না।

অদিতি বলে, তাই তো উচিত। যারা কিছু দিয়েই ঢাক পিটিয়ে প্রচারে নামে তাদের আমি খুব ঘৃণা করি। যাই হোক, আপনি মনে করে না রাখলেও আমি তিনজনের নাম বলে দিতে পারি যাদের আপনি প্রচুর টাকা দিয়েছেন।

সিতাংশু একটু অবাক হয়েই বলে, তারা কারা?

অদিতি বলে, আবার বাবা আর দুই দাদা

সিতাংশু কীসের একটা সংকেত পেয়ে চমকে ওঠে। স্থির চোখে অত্যন্ত সতর্ক ভঙ্গিতে অদিতিকে লক্ষ করতে থাকে।

অদিতি বলে, বাবা আর দাদাদের কত টাকা দিয়েছেন আপনি?

তার কণ্ঠস্বরে একটু আগের কোমলতা নেই, চাপা তীব্রতা বেরিয়ে আসছে সেখান থেকে।

আক্রমণটা এমনই আকস্মিক যে কী উত্তর দেবে, প্রথমটায় বুঝে উঠতে পারে না সিতাংশু। কোনোরকমে বলে, আপনি মানে

চোখ মুখ ক্রমশ ধারালো হয়ে উঠতে থাকে অদিতির। সে বলে, আমার কথার উত্তর দিন। কত টাকা দিয়েছেন? কারেক্ট ফিগারটা আমি জানতে চাই।

অদিতির বলার ধরনে এমন একটা কর্তৃত্ব রয়েছে যা সিতাংশুকে প্রায় মাটিতে নুইয়ে রাখে। সে মিনমিনে গলায় কিছু একটা বলতে চেষ্টা করে, কিন্তু তার একটি বর্ণও বোঝা যায় না।

অদিতি একটু ভেবে বলে, আপনার তো আবার দান-টান করে কিছুই মনে থাকে না। আমি হেল্প করছি। আশা করি মনে পড়ে যাবে। বাবা আর দাদাদের এখনও পর্যন্ত সাড়ে চার। লাখ টাকার মধ্যে দিয়েছেন। তাই না? ভুল হলে কারেক্ট করে দেবেন।

সিতাংশু চুপ করে থাকে।

অদিতি থামেনি, এতগুলো টাকার কী গতি হয়েছে আপনি কি জানেন?

সিতাংশু এবারও উত্তর দেয় না।

অদিতি বলতে থাকে, ডেফিনিটলি আপনি জানেন কিন্তু আমাকে বলতে বোধহয় আটকাচ্ছে। ঠিক আছে, তবু আরেকবার বলা যাক। বাবা শেয়ার মার্কেটের ফাটকাবাজিতে আর দুই দাদা রেস গ্যাম্বলিং উইম্যানজিংয়ে উড়িয়ে দিয়েছে। আমার ধারণা, এইসব মহৎ উদ্দেশ্যে বাবা দাদারা চাইলে আরও টাকা আপনি দেবেন। কারেক্ট? একটু থেমে পরক্ষণেই আবার সে শুরু করে, মিস্টার ভৌমিক, লোকে দু-পাঁচশো, বড়জোর হাজার দু-হাজার পর্যন্ত দান-টান করে। কিন্তু বিনা স্বার্থে সাড়ে চার লাখ টাকা দিয়ে বসেছে, এমন দানবীরকে চোখে তো দেখিইনি, নামও শুনেনি। আমার ধারণা–

এতক্ষণে সিতাংশুর গলা থেকে একটি মাত্র শব্দ বেরিয়ে আসে, কী?

নিশ্চয়ই স্ট্যাম্পড কাগজে বাবা-দাদাদের দিয়ে সই করিয়ে এই টাকাগুলো আপনি দিয়েছেন। সেখানে কী কী শর্ত আছে, মোটামুটি আন্দাজ করতে পারি।

একটা ঢোক গিলে সিতাংশু বলে, বুঝতেই পারেন, এতগুলো টাকা

ডেফিনিটলি পারি। অদিতি বলতে থাকে, শর্তগুলো কি এইরকম? সাড়ে চার লাখ টাকা ইন্টারেস্ট সুষ্ঠু পার্টিকুলার একটি পিরিয়ডের ভেতর ফেরত দিতে না পারলে, আরও কিছু টাকা দিয়ে এই বাড়িটা আপনি দখল করবেন

মানে আমি তো একজন বিজনেসম্যান। তাই

সিতাংশুর কথা শেষ হবার আগেই হাত তুলে তাকে থামিয়ে দেয় অদিতি, লেট মি ফিনিশ। প্রথম দিকে হয়তো আপনার ইচ্ছে ছিল, এই বিরাট কম্পাউন্ডওলা বাড়িটার পজেশন নিয়ে পুরোনো বিল্ডিং ভেঙে এখানে হাইরাইজ বিল্ডিং বানিয়ে বেচে দেবেন। তাতে মিনিমাম পঞ্চাশ লাখ টাকা লাভ হবে। আফটার অল, ইউ আর ইন দা কনস্ট্রাকশান বিজনেস। কি, ঠিক বলছি?

সিতাংশু স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। এই মেয়েটির সঙ্গে আগে কখনও আলাপ হয়নি। রমাপ্রসাদ, বরুণ এবং মৃগাঙ্কর সঙ্গে তার যা কথাবার্তা হয়েছে সেটা এতই গোপন যে কারো পক্ষেই তার আঁচ পাওয়া আদৌ সম্ভব নয়। কিন্তু অদিতি টের পেল কী করে? যদি তার নিয়মিত যাতায়াত এবং রমাপ্রসাদের টাকা দেওয়া থেকে এ-সব ধরে নিয়ে থাকে তা হলে বুঝতে হবে অদিতির মতো অসাধারণ বুদ্ধিমতী এই পৃথিবীতে খুব বেশি নেই।

সিতাংশু কী বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই অদিতি আবার শুরু করে, এবার শুনুন, তার পরের স্টেজটা এরকম হয়েছিল কিনা। হাইরাইজ বিল্ডিয়ের ব্যাপারটা প্ল্যান করতে করতে হঠাৎ আপনার নজর এসে পড়ে আমার ওপর। লোকে আমাকে সুন্দরীই বলে থাকে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় দু-একজন ফিল্ম ডিরেক্টর তাদের ছবিতে হিরোইন করার জন্য আমাদের বাড়ি পর্যন্ত হানা দিয়েছিল। মেয়েদের সম্বন্ধে আপনার উইকনেস আর লোভের তো শেষ নেই। আমাকে দেখেই আগের প্ল্যানটা অ্যাপসেট হয়ে যায়। আপনি বাবা আর দাদাদের নতুন করে প্রোপোজাল দেন। আমার সঙ্গে বিয়ে হলে সাড়ে চার লাখ টাকা ছেড়েও দিতে পারেন।

ভীষণ অস্বস্তি হতে থাকে সিতাংশুর। জিভ দিয়ে শুকনো খসখসে ঠোঁট দুটো চেটে অস্পষ্ট গলায় সে কী বলে, বোঝা যায় না।

অদিতি বলে, কিন্তু মিস্টার ভৌমিক, আপনার একটা পরিকল্পনাও সাকসেসফুল হবে না। প্রথমত, এই বাড়ি আপনি পাচ্ছেন না। যতরকমভাবে সম্ভব আমি বাধা দেব। আর আমার সঙ্গে বিয়ে! বলতে বলতে তার গলায় স্বর কয়েক পর্দা উঁচুতে উঠে যায়! ডিবচ, স্কাউলে, আ গাটার স্রাইপ-তোমার এতবড় সাহস আমাকে বিয়ে করতে চাও! গেট আউট, গেট আউট। আর কোনোদিন যেন তোমাকে এ-বাড়িতে না দেখি—

সিতাংশুর নাক মুখ ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকে। শরীরের সমস্ত রক্ত একলাফে মাথায় চড়ে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে সে বলে, ঠিক আছে কিন্তু কাজটা আপনি ভালো করলেন না–

কতটা খারাপ করেছি আর কতটা করা উচিত ছিল, আমি জানি। নাউ গেট আউট-বলে সোজা দরজার দিকে আঙুল বাড়িয়ে দেয়। জ্বলন্ত চোখে অদিতিকে দেখতে দেখতে উন্মাদের মতো এলোমেলো পা ফেলে বেরিয়ে যায় সিতাংশু।

৩. সিতাংশু চলে যাওয়ার পর

০৫.

সিতাংশু চলে যাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ দু-হাতে মুখ ঢেকে চুপচাপ বসে থাকে অদিতি। সেই বিকেল থেকে একের পর এক বিস্ফোরক ঘটনাগুলি তার শালীনতা ভদ্রতা এবং সৌজন্যের বোধগুলিকে একেবারে চুরমার করে দিয়েছে। একটু আগে যে ভাষায় সিতাংশুকে সে আক্রমণ করেছে, যেভাবে তাকে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছে, এখন সেসব ভাবতে গিয়ে এক ধরনের গ্লানি বোধ করতে থাকে। পরক্ষণেই মনে হয়, এটা না করে তার উপায়ই বা কী ছিল? লোকজন ডেকে লোকটাকে ঘাড়ধাক্কা দিতে দিতে এবং বেদম মারতে মারতে কুকুরের মতো তাড়িয়ে দিলেই ভালো হত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি রয়েছে তার, একটা নামকরা কলেজের সে অধ্যাপিকা। অদিতির যা শিক্ষাদীক্ষা এবং রুচি তাতে একটা বিশেষ লেভেলের নীচে তার পক্ষে নামা অসম্ভব।

একসময় উত্তেজিত স্নায়ুগুলো জুড়িয়ে এলে আস্তে আস্তে ড্রইংরুম থেকে বেরিয়ে বাইরের প্যাসেজে চলে আসে অদিতি। আর তখনই দেখতে পায় দশ ফুট দূরত্বে ওপরে ওঠার সিঁড়িটার মুখে দাঁড়িয়ে আছে বরুণ এবং মৃগাঙ্ক। অবশ্য রমাপ্রসাদ আশেপাশে কোথাও নেই।

সিতাংশুর সঙ্গে কথা বলার সময়ই অদিতির মনে হয়েছিল, কাছাকাছি কোথাও রয়েছে। বরুণরা। তার ধারণা যে আগাগোড়া নির্ভুল, হাতেনাতেই তার প্রমাণ পাওয়া গেল। সে চোখ বুজে বলে দিতে পারে, সিতাংশুর সঙ্গে তার যা যা আলোচলা হয়েছে–সবটাই বরুণরা শুনেছে। কেননা এই আলোচনার ওপর তাদের ভবিষ্যৎ অনেকটাই নির্ভর করছে।

সিঁড়ির কাছে এসে বরুণ এবং মৃগাঙ্ককে ভালো করে লক্ষ করতেই চমকে ওঠে অদিতি। দুই ভাইয়ের চোখে এই মুহূর্তে ঘাতকের দৃষ্টি।

প্রথমটা ভয় পেয়ে যায় সে। পরক্ষণেই স্বয়ংক্রিয় কোনো পদ্ধতিতে নিজের মধ্যে অদম্য এক দৃঢ়তা অনুভব করে। দুই ভাইকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে থাকে। বরুণদের পার হয়ে যাবার পর, পেছনে না-ফিরেও অদিতি টের পায় ভাইদের চোখ থেকে আগুন ঝরছে।

দোতলার ল্যান্ডিং-এর কাছে আসতে দেখা গেল ওধারের বিশাল বারান্দায় মাথায় হাত দিয়ে একটা চেয়ারে ঘাড় গুঁজে বসে আছেন রমাপ্রসাদ। তাঁর পাশে হেমলতা। চিরদিনের ভীরু মাকে এই মুহূর্তে আরও শঙ্কিত এবং সন্ত্রস্ত দেখাচ্ছে। একটু দূরে শ্বাসরুদ্ধের মতো দাঁড়িয়ে আছে দুই বউদি-বন্দনা আর মীরা। ওদের দেখতে দেখতে মনে হচ্ছে, এইমাত্র এ-বাড়িতে কোনো মারাত্মক পারিবারিক বিপর্যয় ঘটে গেছে।

ভয়ে ভয়ে হেমলতা ডাকেন, বুবু এদিকে আয়

সিঁড়ি দিয়ে তেতলার দিকে উঠতে উঠতে অদিতি বলে, শাড়ি-টাড়ি পালটে আসছি মা। নারী-জাগরণ-এর অফিসে চাঁপাকে রেখে আসার পর পোশাক-টোশাক বদলাবার সময় পাওয়া যায়নি। সারাদিনের ধুলোবালি ঘাম আর গ্যাসোলিনের ধোঁয়া-মাখা শাড়ি-ব্লাউজ গায়ে জড়িয়ে আছে। ওগুলো না-ছাড়া পর্যন্ত বিশ্রী লাগছে অদিতির।

তেতলায় উঠতেই কোত্থেকে দুর্গা ছুটতে ছুটতে এসে হাজির। বলে, পিসিমা তোমাকে ডাকছে ছোটদি–

অদিতি ঠিকই করে রেখেছিল, সবার আগে মৃণালিনীর সঙ্গে দেখা করে সিতাংশুর সঙ্গে তার যা যা কথা হয়েছে, জানাবে।

সে বলে, পিসিকে বল দশ মিনিটের ভেতর আসছি।

মৃণালিনীর ডানপাশে অদিতির ঘর। সোজা সেখানে চলে আসে সে।

ঘরটার মাঝখানে সিঙ্গল-বেড খাটে ধবধবে বিছানা। একধারে জানলা ঘেঁষে লেখাপড়ার টেবিল-চেয়ার। আরেক দিকের গোটা দেয়াল জুড়ে পর পর অনেকগুলো আলমারি। সেগুলো বইয়ে-ঠাসা। আরেক দেয়ালের গায়ে নীচু নীচু র‍্যাক। সেগুলোও ভর্তি হয়ে বই উপচে পড়ছে। এমনকী মেঝেতেও প্রচুর ম্যাগাজিন, খবরের কাগজ, প্যামফ্লেট ডাঁই হয়ে আছে।

আরেক দেওয়ালে ছোট একটা ড্রেসিং টেবিল। জামাকাপড়ের আলমারি। অন্য সব ঘরের মতো এ-ঘরেও অ্যাটাচড বাথরুম।

আলমারি থেকে কাঁচানো শাড়ি জামা-টামা বের করে বাথরুমে ঢুকে পড়ে অদিতি। দ্রুত মুখ-টুখ ধুয়ে, পোশাক বদলে ঠিক দশ মিনিটের ভেতর মৃণালিনীর ঘরে চলে আসে।

মৃণালিনী প্রায় দম বন্ধ করে অপেক্ষা করছিলেন। হাত বাড়িয়ে অদিতিকে তার পাশে বসিয়ে বলেন, কী কথা হল ওই বদমাসটার সঙ্গে? তাঁর চোখে মুখে কণ্ঠস্বরে অসীম ব্যগ্রতা এবং উৎকণ্ঠা, ওদের ফাঁদে পা দিসনি তো?

অদিতি হাসে, না পিসি। তারপর বাবা এবং দাদাদের ড্রইংরুম থেকে বের করে দিয়ে সিতাংশুর সঙ্গে যেসব কথাবার্তা হয়েছে, সংক্ষেপে জানিয়ে দেয়।

ঠিক বলেছিস। মৃণালিনীর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করতে থাকে। আমার এই অবস্থা! বিছানায় পড়ে না-থাকলে আমি নিজেই পশুটাকে যা বলার বলতাম। তোকে ওর কাছে পাঠাতাম না। তা হারে–

বলো—

তোর বাপ আর দাদারা ওদের শয়তানিটা কাঁচিয়ে দেবার পর কিছু বলেনি তোকে?

এখনও বলেনি। তবে সবাই আমার জন্যে বন্দুক শানিয়ে বসে আছে। একবার গেলেই

আমি তোর বাপ-দাদাদের হাড়ে হাড়ে চিনি। ওরা হয়তো রাগারাগি কিংবা কাকুতি-মিনতি করে এ বিয়েতে তোকে রাজি করাতে চেষ্টা করবে। কিন্তু ওদের কোনো কথা শুনবি না।

মৃণালিনী যে তার কতবড় হিতাকাঙ্ক্ষী, অদিতি নতুন করে আবার অনুভব করে। রমাপ্রসাদের স্বার্থের কারণে তার জীবন, তার ভবিষ্যৎ যাতে নষ্ট হয়ে না যায় সেজন্য তাঁর দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগের শেষ নেই। অদিতি বলে, তুমি ভেবো না পিসি।

খাওয়া-দাওয়া তো হয়নি তোর?

না।

যা, খেয়ে আয়।

অদিতি উঠে পড়ে, জানো পিসি, আজ নারী-জাগরণ-এর কাজে একটা বস্তিতে গিয়ে দারুণ ব্যাপার ঘটে গেছে। ফিরে এসে তোমাকে বলছি।

নারী-জাগরণ-এর কাজকর্ম সম্পর্কে প্রবল উৎসাহ মৃণালিনীর। আবহমানকাল ধরে এ দেশের মেয়েরা লাঞ্ছিত হচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে এখানে নারীর অসম্মান। প্রতিদিন এখানে নারীহত্যা, নারীনিগ্রহ। এইসব অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে ক্রুসেড শুরু করেছে নারী-জাগরণ। মৃণালিনী মনে মনে নিজেকে এই যুদ্ধের একজন সৈনিক মনে করেন। তাঁর আক্ষেপ, পঙ্গু হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। নইলে বাকি জীবনটা নারী-জাগরণ-এর কাজেই কাটিয়ে দিতেন।

ঘর থেকে বেরুতে না পারলেও অদিতি রাত্তিরে বাড়ি ফিরলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব খবর নেন মৃণালিনী। নারী-জাগরণ-এর মেম্বাররা মেয়েদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদে প্রায় রোজই হয় মিছিল বার করছে, নইলে স্ট্রিট কর্নার মিটিংয়ের বক্তৃতা দিচ্ছে, কিংবা সমাজের নানা স্তরের লোকজন ডেকে এনে সেমিনার বসাচ্ছে। মিছিলে কী হল, কে কী বক্তৃতা দিল–সমস্ত কিছু না-জানা পর্যন্ত তাঁর ঘুম আসে না।

নারী-জাগরণ-এর খবর তো আছেই, তাছাড়া রাস্তায় চলতে ফিরতে অদিতি কী দেখল, কার সঙ্গে কী কথা হল, কলেজে গিয়ে কটা ক্লাস করল, ইত্যাদি ইত্যাদি সব জানা চাই মৃণালিনীর।

আসলে অদিতি আর দুর্গা ছাড়া তাঁর ঘরে এ-বাড়ির কেউ বিশেষ আসে না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে মাথার দিকের জানলা দিয়ে আকাশের একটা টুকরো, বাড়ির সামনে ঝোঁপঝাড়ে বোঝাই খানিকটা জমি, ভাঙা গেটের বাইরে পিচের রাস্তা, রাস্তার ওধারে দু-চারটে বাড়ি-টাড়ি ছাড়া এই শহরের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে। এর বাইরে বিশাল পৃথিবীর সঙ্গে যে সামান্য যোগাযোগটুকু এখনও বজায় আছে তা অদিতির জন্যই। প্রতিদিন রাত্তিরে নানা মানুষ এবং অসংখ্য ঘটনার খবর এনে অদিতি পঙ্গু শরীরের ভেতরে তাঁর উন্মুখ অস্থির মনকে সতেজ করে তোলে।

মৃণালিনী বলেন, আচ্ছা, যা।

.

দোতলায় নেমে এসে অদিতি দেখতে পায় দুই বউদি, মা আর বাবা অবিকল কিছুক্ষণ আগের মতো দাঁড়িয়ে এবং বসে আছে। এবার অবশ্য দাদারাও আছে। সে যখন তেতলায় ছিল তখন বরুণরা নীচের সিঁড়ি থেকে উঠে এসেছে।

অদিতি লক্ষ করে, মা ছাড়া সবার চোখে-মুখেই অদ্ভুত এক কাঠিন্য আর নিষ্ঠুরতা ফুটে রয়েছে। বোঝা যায়, এরা তাকে সহজে ছাড়বে না। অদিতি নিজের স্নায়ুগুলোকে টান টান রেখে সতর্ক ভঙ্গিতে অপেক্ষা করতে থাকে।

আচমকা বরুণ চিৎকার করে ওঠে, আমাদের এভাবে অপমান করার মানে কী?

পালটা চেঁচিয়ে উঠতে পারত অদিতি। তা না করে খুব সংযত গলায় বলে, এই প্রশ্নটা তো আমার করার কথা।

কী বলতে চাস তুই?

বলতে চাই, একটা ডিবচ বদমাস স্কাউন্ট্রেলকে তোমরা আমার কাঁধে চাপিয়ে দেবার জন্য বাড়ির ভেতর নিয়ে এসেছ। আমাকে কোন লেভেলে নামতে চাইছ, ভালো করে ভেবে দেখেছ?

রমাপ্রসাদ এই সময় চড়া গলায় বলেন, সিতাংশু একজন রেসপেক্টবল বিজনেসম্যান। তার সম্বন্ধে ভদ্রভাবে কথা বল

মৃগাঙ্ক ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে ছিল। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, একজ্যাক্টলি।

সোজা রমাপ্রসাদের চোখের দিকে তাকিয়ে অদিতি বলে, রেসপেক্টবল! যার দু-দুটো স্ত্রী ডিভোর্স করে চলে গেছে, একটা স্ত্রী মার্ডার হয়েছে।

মৃগাঙ্ক মাঝখান থেকে গলা চড়িয়ে বলে, কে বললে মার্ডার? হঠাৎ আগুন লেগে মারা গেছে। ইটস অ্যান অ্যাকসিডেন্ট

কোনটা অ্যাকসিডেন্ট আর কোনটা মার্ডার, সেটুকু বুঝবার মতো বয়েস এবং বিদ্যাবুদ্ধি আমার হয়েছে। কোনো সাফাই গাইবার দরকার নেই। অদিতি ঘুরে মৃগাঙ্কর দিকে তাকায়।

বরুণ ওধার থেকে বলে ওঠে, মার্ডার হলে কোর্টে কেস উঠত না? আইন ওকে ছেড়ে দিত?

অদিতি এবার বরুণের দিকে ফিরে দাঁড়ায়, টাকা থাকলে পাঁচটা খুন করেও যে পার পাওয়া যায়, তুমি কি জানো না? তীব্র বিদ্রুপে তার ঠোঁট বেঁকে যায়।

বরুণ পলকের জন্য থতিয়ে যায়। পরক্ষণেই গলার স্বর কয়েক পর্দা চড়িয়ে দেয়, আমি জানি সিতাংশু সম্পর্কে কে এই স্ক্যান্ডাল রটাচ্ছে। তাকে বাড়ি থেকে দূর করে দেব।

রমাপ্রসাদ তীব্র গলায় বলেন, সেই যে পয়তাল্লিশ বছর আগে শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে এসে আমাদের ঘাড়ে চেপে বসল, তারপর থেকে সারাটা জীবন জ্বালিয়ে যাচ্ছে। এবার আমি আর বরদাস্ত করব না, সহ্যের সীমা একেবারে পার হয়ে গেছে।

মৃগাঙ্ক বলে, বাবা, পিসি এ-বাড়িতে থাকলে আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে। তুমি কিছু একটা ব্যবস্থা করো। আমাদের খাবে, আর দিন রাত আমাদেরই ক্ষতির মতলব করবে, এটা কিছুতেই হতে দেব না। একটা উইচ।

নিজের অজান্তেই অদিতির মুখ শক্ত হয়ে ওঠে। ছোটদা, সব ব্যাপারের একটা লিমিট আছে, তুমি সেটা ছাড়িয়ে গেছ। যে ভাষাটি নিজের পিসি সম্পর্কে বললে তাতে সন্দেহ হয় ভদ্রবংশে জন্মেছ কিনা। তারপরই রমাপ্রসাদের দিকে ফিরে বলতে থাকে, বাবা, পিসি আমার ওয়েল উইশার, তাই আগে থেকে ওই ডিবচ বদমাসটার সম্পর্কে ওয়ার্নিং দিয়েছে। তোমাদের একটা কথা মনে করিয়ে দিচ্ছি, উইলে দাদু এ-বাড়ির একটা অংশ পিসিকে দিয়ে গেছে। তাকে তাড়াবার চেষ্টা করলে ফলাফল মারাত্মক হবে। আমি কিন্তু কাউকে ছেড়ে দেব না। বলতে বলতে মৃগাঙ্কর দিকে ফেরে সে, জীবনে নিজে কপয়সা রোজগার করেছ যে পিসিকে খাওয়াবার কথা বললে! পিসির সমস্ত খরচ আমি দিয়ে থাকি। ডোন্ট ফরগেট

শাট আপ। গলার শির ছিঁড়ে চেঁচিয়ে ওঠে মৃগাঙ্ক।

তোমার ভয়ে? অনেস্টলি যে একটা পয়সা রোজগার করতে পারেনি, গ্যাম্বলিং যার একমাত্র প্রফেশান, তার মতো ডার্টি বাজে লোকের ধমকে আমাকে চুপ করে যেতে হবে?

মৃগাঙ্ক হিতাহিত জ্ঞানশুন্যের মতো অদিতির ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে রমাপ্রসাদ বলেন, বাবলু, তুই এখান থেকে যা। যা বলার আমি বুবুকে বলছি।

তাঁর কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যাতে আর দাঁড়ায় না মৃগাঙ্ক। হিংস্র চোখে অদিতিকে দেখতে দেখতে দুমদাম পা ফেলে ওধারের একটা ঘরে গিয়ে ঢোকে।

রমাপ্রসাদ এবার তাঁর স্ট্র্যাটেজি বদলে ফেলেন। ভয় দেখিয়ে চড়া মেজাজে তাঁর এই একগুঁয়ে মেয়েটিকে কোনোভাবেই বাগ মানানো যাবে না। তাঁকে এগুতে হবে সুকৌশলে, ঠান্ডা মাথায়।

শান্ত, সস্নেহ ভঙ্গিতে রমাপ্রসাদ বলেন, রাগারাগি, হইচই করে কিছু লাভ আছে? তুই আমার কাছে এসে বস। আয়–

এটা বাবার যে একটা চতুর চাল, বুঝতে অসুবিধে হয় না অদিতির। তবু দেখাই যাক রমাপ্রসাদ তার জন্য ফাঁদটা নতুন করে কীভাবে সাজান। সে পায়ে পায়ে বাবার মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসে পড়ে। বলে, কী বলবে বলো–

দ্যাখ, মিনুর মতো আমরা যে তোকে ভালোবাসি, এটা নিশ্চয়ই মানিস।

অদিতি চুপ করে থাকে।

রমাপ্রসাদ আবার বলেন, মিনু তো ঘর থেকে বেরুতে পারে না। ওকে কে সিতাংশু সম্পর্কে উলটোপালটা খবর দিয়ে গেছে। তাই শুনে ও একটা খারাপ ধারণা করে নিয়েছে। আমি বলছি, সিতাংশু খুব ভালো ছেলে–জেম অফ এ বয়।

এবারও উত্তর দেয় না অদিতি।

রমাপ্রসাদ চোখের কোণ দিয়ে মেয়ের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করতে করতে বলেন, বিরাট কনস্ট্রাকশনের ফার্ম ওর। লাখ লাখ টাকা ইনকাম। আমি বলছি, এ বিয়ে হলে তুই সুখে থাকবি।

কিন্তু বাবা

কী?

আমি তো ওই লোকটকাকে অপমান করে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছি।

রমাপ্রাসাদ হঠাৎ আশান্বিত হয়ে ওঠেন। ভাবেন, এটা বুঝি অদিতির রাজি হওয়ার লক্ষণ। বলেন, সে জন্যে তুই ভাবিস না। আমি গিয়ে বোঝালে এ ব্যাপারটা ও আর মনে রাখবে না। তা হলে কালই ওদের বাড়ি চলে যাই?

অদিতি হাত তুলে বলে, দাঁড়াও দাঁড়াও, আরও কিছু কথা তোমার সঙ্গে বাকি আছে।

কী রে?

বড়দা ছোটদা আর তুমি, তিনজনে সিতাংশু ভৌমিকের কাছ থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা ধার নিয়েছ-এটা নিশ্চয়ই অস্বীকার করতে পারবে না।

রমাপ্রসাদ ভীষণ অস্বস্তি বোধ করতে থাকেন। বলেন, হ্যাঁ। মানে শেয়ার মার্কেটের ব্যাপারে–এই পর্যন্ত বলে হঠাৎ থেমে যান।

অদিতি বলে, তুমি শেয়ার মার্কেটে ফাটকাবাজি করে আর দাদারা জুয়া রেস, এইসব করে টাকাটা উড়িয়ে দিয়েছে। আমার সঙ্গে সিতাংশু ভৌমিকের বিয়ে হলে টাকাটা আর ফেরত দিতে হবে না, কী বলে?

বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থাকেন রমাপ্রসাদ।

অদিতি বলতে থাকে, তার মানে, সাড়ে চার লাখ টাকায় তোমরা আমাকে একটা বজ্জাতের কাছে বেচে দিতে চাইছ।

রুদ্ধ গলায় রমাপ্রসাদ বলেন, কী যা তা বলছিস বুবু! আমি তোর বাবা

তাঁকে শেষ করতে দেয় না অদিতি। তীক্ষ্ণ গলায় বলে, এখানেই তো আমার অদ্ভুত লাগছে। তোমরা শেষ পর্যন্ত আমাকে একটা প্রপার্টি ভাবছ। টাকার বদলে আমাকে একটা বদ লোকের হাতে তুলে দিতে চাইছ। কিন্তু তা হবে না। আর

হঠাৎ ভীষণ অসুস্থবোধ করেন রমাপ্রসাদ। তাঁর হাত-পায়ের জোড় যেন আলগা হয়ে যেতে থাকে। শিথিল গলায় কোনোরকমে বলেন, আর কী?

তোমরা যদি ভেবে থাকো, তোমাদের ধার শোধ করার জন্য সিতাংশু ভৌমিককে এই বাড়ি বেচে দেবে, তা আমি কিছুতেই করতে দেব না। তোমরা জুয়া ফাটকা খেলে টাকা ওড়াবে, তার জন্যে বাকি সকলে পথে বসবে, সেটা হতে দেব না। দাদুর উইল আমি দেখেছি। এ-বাড়ি বিক্রি করা যাবে একটি মাত্র কন্ডিশানে। বিক্রির সময় এই ফ্যামিলির যারা বেঁচে থাকবে তাদের সবার কনসেন্ট না-পাওয়া গেলে কেউ বাড়ি ব্রিকি করতে পারবে না। দু-একজনের খামখেয়ালিতে পারিবারিক প্রাপার্টি নষ্ট করে অন্যদের কিছুতেই পথে বসানো চলবে না।

রমাপ্রসাদ চমকে ওঠেন। তাঁর আর্থারাইটিসের কষ্টটা হঠাৎ কয়েক গুণ বেড়ে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সামলাতে সামলাতে কাতর গলায় বলেন, কিন্তু

কী?

বাড়িঘর বা আমাদের ধারদেনার কথা থাক। বাবা হিসেবে তোর ওপর আমার কিছু কর্তব্য তো আছে।

রমাপ্রাসাদ ঠিক কী বলতে চান, বুঝতে না পেরে অদিতি জিগ্যেস করে, কোন কর্তব্যের কথা বলছ?

রমাপ্রসাদ বলেন, তোর তো এবার বিয়ে দেওয়া দরকার।

কর্তব্যের ছদ্মবেশে রমাপ্রসাদ কী ধরনের তুখোড় চাল দিতে চাইছেন, ধরতে চেষ্টা করে অদিতি। হঠাৎ তার মনে হয়, রমাপ্রসাদ বুঝে ফেলেছেন সিতাংশুর সঙ্গে তার বিয়ে কোনোভাবেই ঘটাতে পারবেন না। তাই কি এ বাড়ি থেকে তাকে কৌশলে বার করে দিতে চাইছেন? সে এখানে থাকলে বাড়ি বিক্রির কনসেন্ট সবার কাছ থেকে সহজে আদায় করা যাবে না। অথচ এটা না বেচলে ঋণ শোধ করা অসম্ভব। ওদিকে টাকা ফেরত না পেলে সিতাংশু কিছুতেই ছাড়বে না। এতগুলো টাকা নিঃস্বার্থভাবে দান খয়রাত করার মতো মানুষ আর যে-ই হোক, সিতাংশু নয়।

সতর্কভাবে অদিতি বলে, বাবা, যে মেয়েদের পক্ষে বিয়েটা ভীষণ জরুরি, আমি কিন্তু তাদের মধ্যে পড়ি না। আমি মোটামুটি একটা চাকরি করি। আমি কারও ঘাড়ের ওপর বোঝ হয়ে নেই।

এতক্ষণ হেমলতা রমাপ্রসাদের পেছনে তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। একটি কথাও বলেননি। এবার শ্বাসরুদ্ধের মতো বলেন, বুবু, দেশাচার বলে একটা কথা আছে, সেটা কি না মানলে চলে?

রমাপ্রসাদ তৎক্ষণাৎ সায় দেন, ঠিকই তো। মেয়েরা যতই লেখাপড়া শিখুক, যতই রোজগার করে স্বাবলম্বী হোক, তার বিয়ে না দিলে মা-বাপকে লোকের কাছে অনেক কথা শুনতে হয়।

অদিতি স্থির চোখে রমাপ্রসাদকে দেখতে দেখতে বলে, কে কী বলল, সে-সব আমি গ্রাহ্য করি না। একটু থেমে আবার বলে, আচ্ছা বাবা, তোমরা কি বিয়ের নাম করে আমাকে এ বাড়ি থেকে তাড়াতে চাইছ?

কোমরে হাত চেপে দ্রুত খাড়া হয়ে বসেন রমাপ্রসাদ। বলেন, মানে?

আমি এখান থেকে চলে গেলে অন্যের ওপর প্রেসার দিয়ে বাড়ি বিক্রির কনসেন্ট আদায় করা অনেক সহজ হয়।

রমাপ্রসাদের মুখ-চোখ করুণ দেখায়। বিমর্ষ গলায় তিনি বলেন, তুই আমাকে কী ভাবিস বুবু? আমি এতটাই নীচে নেমে গেছি।

তার কথায় কতটা আন্তরিকতা এবং কতটা অভিনয়, অদিতি বুঝতে পারে না। সে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্তের মতো বলে, ঠিক আছে, বাড়ি বেহাত না হলেই ভালো।

হেমলতা বলেন, কিন্তু তুই কি বিয়ে করবি না বুবু?

একটু চুপ করে থাকে অদিতি। তারপর খুব আস্তে বলে, বিয়ে করব না, এমন প্রতিজ্ঞা তো করিনি মা, নিশ্চয়ই করব। আর

আর কী?

আমার বিয়ের জন্য তোমাদের চিন্তা করতে হবে না।

আমরা চিন্তা না করলে বিয়েটা হবে কী করে?

ও ব্যাপারে আমি ভেবেছি। পরে তোমাদের জানাব।

মৃগাঙ্ক স্নায়ুগুলো টান টান করে অদিতিকে লক্ষ করছিল। এবার সে বলে, তুই কি বিকাশকে বিয়ে করবি বলে ঠিক করেছিস?

মৃগাঙ্কর দিকে মুখ ফেরায় অদিতি। শান্ত গলায় বলে, একটু ধৈর্য ধরো, পরে জানতে পারবে।

মৃগাঙ্ক অত্যন্ত বিরক্ত এবং ক্রুদ্ধ গলায় বলতে থাকে, নতুন করে জানাবার আর কিছু নেই। আমি সবই জানি। নিজের চোখে কতদিন দেখেছি ওই ছোকরার সঙ্গে ট্যাং ট্যাং করে ঘুরে বেড়াচ্ছিস। শুধু আমি একাই না, আমার বন্ধুরাও দেখে যা তা বলে।

অসহ্য রাগে মাথার ভেতর শিরা ছিঁড়ে যায় যেন অদিতির। ভাবে, চিৎকার করে উঠবে। কিন্তু প্রাণপণে নিজেকে সংযত রেখে কোনোরকম বিস্ফোরণ ঘটতে দেয় না।

মৃগাঙ্ক থামেনি, ছোকরার কোনো ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। শুনেছি থাকার মধ্যে ভবানীপুরের থার্ড ক্লাস গলির ভেতর পুরোনো ভাঙাচোরা ছোট একটা বাড়ি। তা-ও একার না, ভাগের বাড়ি। এরকম একটা

অদিতি হাত তুলে মৃগাঙ্ককে থামিয়ে দেয়। গম্ভীর মুখে বলে, ছোটদা, আমি বাচ্চা মেয়ে নই। আমি কাকে বিয়ে করব, না করব, এসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আর বিকাশ অত্যন্ত শিক্ষিত, একজন ভদ্রলোক। তার সম্মান রেখে কথা বলবে। সে আরও বলতে যাচ্ছিল, বিকাশ আর যাই হোক মৃগাঙ্কর মতো রেস বা জুয়ায় সর্বস্ব উড়িয়ে দেয় না। কী ভেবে শেষ পর্যন্ত আর বলে না।

মৃগাঙ্ক ভেংচে ওঠে, ভদ্রলোক। শিক্ষিত! আমি–

তাকে শেষ করতে দেন না রমাপ্রসাদ। বলেন, বাবলু, এত রাতে এরকম চেঁচামেচি আমার ভালো লাগছে না।

ঠিক আছে মৃগাঙ্ক আর দাঁড়ায় না, উত্তেজিতভাবে পা ফেলে ফেলে উত্তর দিকের একটা ঘরে গিয়ে ঢোকে।

দশ ফুট দুরত্বে দাঁড়িয়ে ছিল মীরা। সে চাপা গলায় বলে, নিজের বিয়ের ব্যাপারে বাপ আর বড় ভাইদের সঙ্গে কোনো মেয়েকে এভাবে কথা বলতে আগে দেখিনি। নির্লজ্জ কোথাকার!

তীব্র মোচড়ে শরীরটা মীরার দিকে ঘুরে যায় অদিতির। ভেবেছিল, কোনো প্ররোচনাতেই সে উত্তেজিত হবে না বা ধৈর্য হারাবে না। কিন্তু এখন আর মাথাটা একেবারেই ঠান্ডা রাখা যাচ্ছে না। তীক্ষ্ণ গলায় সে বলে, তোমার চেয়েও আমি বেশি নির্লজ্জ! আমি তো বাবা আর দাদাদের সঙ্গে আলোচনা করছি। বিয়ের আগে তুমি এ-বাড়িতে কীভাবে এসে উঠেছিলে, মনে আছে?

অদিতির ইঙ্গিতটা মারাত্মক। বিয়ের আগে পেটে বাচ্চা নিয়ে মীরা যে এখানে চলে এসেছিল সেটাই নতুন করে জানিয়ে দিয়ে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায় তার। রাগের মাথায় তার এই লেভেলে নেমে যাওয়া ঠিক হয়নি।

মীরা আকস্মিক আঘাতে প্রথমটা চমকে ওঠে। তারপর আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে প্রায় টলতে টলতে উত্তর দিকে তার ঘরে চলে যায়।

কিছুক্ষণের জন্য গোটা বাড়িটা স্তব্ধ হয়ে থাকে।

তারপর হেমলতা বলেন, অনেক রাত হল। সবাই এবার খেয়ে নেবে চলো।

বার বার ডাকা সত্ত্বেও বরুণ মৃগাঙ্ক মীরা বা বন্দনা, কেউ খেতে আসে না। মৃগাঙ্কর ছেলে চিকু আর মৃণালিনীকে সন্ধের পরই খাইয়ে দেওয়া হয়। অগত্যা রমাপ্রসাদ হেমলতা আর অদিতি দোতলার একধারে খাবারঘরে চলে যায়।

খাওয়ার ইচ্ছেটা একেবারেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। নিঃশব্দে, পাতের ওপর ঘাড় গুঁজে রুটি তরকারি বা মাংসের নাড়াচাড়া করে এক সময় উঠে পড়ে অদিতি।

তেতলায় এসে প্রথমেই মৃণালিনীর ঘরে যায় অদিতি।

মৃণালিনী তার জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিলেন। বলেন, নীচে এত চেঁচামেচি হচ্ছিল কেন রে?

এই মুহূর্তে একেবারেই কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না অদিতির। নেহাত মৃণালিনী তার জন্য জেগে থাকবেন, তাই আসতে হয়েছে।

অদিতি বলে, কাল শুনো পিসি। আমার শরীরটা ভালো লাগছে না।

অদিতির মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বুঝতে চেষ্টা করেন মৃণালিনী। বলেন, আচ্ছা যা, শুয়ে পড় গিয়ে। আর আমার ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিয়ে যা।

অদিতি সুইচ টিপে ঘর অন্ধকার করে দেয়। তারপর বাইরে থেকে দরজাটা টেনে দিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।

.

০৬.

পরের দিন কলেজে পর পর চারটে ক্লাস ছিল অদিতির। একেকটা ক্লাসে প্রায় সত্তর-আশিজন মেয়ে। হিন্দি ফিল্মের ভিলেনের মতো গলার স্বর চড়ায় না তুললে লাস্ট বেঞ্চের ছাত্রীরা ক্লাস-লেকচার শুনতে পাবে না।

একটানা দুশো মিনিট গলায় ফেনা তুলে চেঁচিয়ে অদিতি যখন কলেজ থেকে বেরুল, চারটে বেজে গেছে। এই মুহূর্তে তার মাথা ঝিম ঝিম করছে।

অমিতাদি কাল বলে দিয়েছিলেন, আজ অবশ্যই যেন, নারী-জাগরণ-এর অফিসে একবার চলে আসে। কেন না, কাল ঢাকুরিয়ার বস্তি থেকে চাঁপাকে নিয়ে গিয়ে ওখানে রাখা হয়েছে। তার সম্বন্ধে কী করা যায়, আজ সেটা ঠিক হবে।

কলেজটা বড় রাস্তার ওপর। একটা বাস ধরে অদিতি যখন সাউথ ক্যালকাটায় নারী-জাগরণ-এর অফিসে পৌঁছোয়, সন্ধে হতে খুব দেরি নেই।

কাল বধূহত্যার প্রতিবাদে মিছিল বার করার কারণে প্রায় সব মেম্বারই হাজির ছিল। কালকের মতো অত ভিড় না থাকলেও বেশ কিছু মেম্বারকে আজও দেখা যাচ্ছে।

অমিতাদির ঘরে ঢুকতেই অদিতির চোখে পড়ে দশ-বারোজন মেম্বার এখানে রয়েছে। তাদের মধ্যে বিকাশ এবং চাঁপাকেও দেখা গেল। চাঁপা দুই হাঁটুর ফাঁকে মুখ গুঁজে মেঝেতে বসে আছে।

অদিতিকে দেখে যারা বাইরে ছিল, তারাও এঘরে চলে আসে। এতজনের বসার মতো চেয়ার-টেয়ার নেই, বেশিরভাগই দাঁড়িয়ে থাকে।

অদিতি লক্ষ করে, সবার চোখে মুখেই প্রচণ্ড উত্তেজনা। তার ধারণা, সে এখানে আসার আগে মারাত্মক কিছু ঘটে গেছে।

অমিতাদি বলেন, বসো অদিতি

অমিতদির মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসে ছিল কৃষ্ণা। সে উঠে গিয়ে অদিতির জন্য জায়গা করে দেয়। অদিতি বসতেই অমিতাদি বলেন, তোমার জন্যেই আমরা ওয়েট করছি। এত দেরি করলে?

অদিতি দেরিতে আসার কারণ জানিয়ে বলে, এখানে কিছু একটা হয়েছে মনে হচ্ছে–

অমিতাদি গম্ভীরমুখে বলেন, হ্যাঁ। চাঁপাকে নিয়ে খুব আনপ্লেজান্ট ব্যাপার ঘটে গেল একটু আগে।

ঘরের আবহাওয়া দেখে সেরকমই কিছু একটা মনে হচ্ছিল অদিতির। ভেতরে ভেতরে সে বেশ উৎকণ্ঠাই বোধ করে। বলে, কী হয়েছে?

নগেন নামে একটা লোক ড্রিংক করে এসে নানারকম কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করে খিস্তি করছিল। লোকটার মুখ অত্যন্ত ফিলদি। যেমন তার জঘন্য ল্যাংগুয়েজ তেমনি তার চিৎকার। প্রথমে তো আমরা একেবারে স্টান্ড। পরে জানতে পারলাম, নগেন চাঁপার স্বামী। সে এসেছিল ওকে নিয়ে যেতে। আমরা অবশ্য তাড়িয়ে দিয়েছি। অমিতাদি বলতে থাকেন, সহজে কি যেতে চায়? একরকম জোরই করতে হয়েছে।

নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুনে যাচ্ছিল অদিতি। ফুসফুসের আবদ্ধ বাতাস আস্তে-আস্তে বার করে দিয়ে সে বলে, তাড়িয়ে দিয়ে ভালোই করেছেন অমিতাদি। চাঁপাকে একবার হাতে পেলে লোকটা খুন করে ফেলবে। হি ইজ জেঞ্জারাস।

হ্যাঁ। দেখেশুনে মনে হল একটা অ্যান্টিসোশাল রাফায়েল। বলে একটু ভেবে আবার শুরু করেন অমিতাদি, নগেন আমাদের শাসিয়ে গেছে। কী বলেছে জানো?

দলবল জুটিয়ে এখানে হানা হবে। এরকম একটা জঘন্য টাইপের মাতাল, বজ্জাত এখানে এসে খিস্তিখেউড় করবে, হল্লা বাধাবে, ভাবতেই আমার বিশ্রী লাগছে। তা ছাড়া আশেপাশের লোকজন কী ভাববে বলো তো?

অদিতি বিষণ্ণ হাসে। বলে, অমিতাদি, মেয়েদের সামাজিক সম্মান আর মর্যাদা রক্ষার জন্যে আমরা রাস্তায় নেমেছি। কে কী বলল বা ভাবল তা নিয়ে মাথা ঘামালে চলে! কত ইনফ্লুয়েনশিয়াল মেম্বার রয়েছেন নারী-জাগরণ-এ। আমরা একটা বাজে লোককে শায়েস্তা করতে পারব না?

বিব্রতভাবে অমিতাদি বলেন, নিশ্চয়ই পারব। কিন্তু আমার একটা কথা ভেবে দেখো—

বলুন

এইসব অ্যান্টিসোশালদের পেছনে আমরা যদি সময় আর শক্তি ক্ষয় করে ফেলি, আসল কাজ কখন করব?

এটাই তো আসল কাজ অমিতাদি। এরকম জন্তুদের হাতেই তো বেশিরভাগ মেয়ে টরচারড হচ্ছে। এই মেয়েদের জন্যে যদি একটা আঙুলও তোলেন, নগেনের মতো বিস্টরা এখানে লাইন দিয়ে হানা দেবে। আর সেটা যদি হয়, বুঝব সঠিক কাজটাই শুরু করতে পেরেছি।

ডানদিকে একটা চেয়ারে বসে আছে এষা। তার বাঁ-হাতের দুই আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট। মেয়েটা চেইন-স্মোকার। এষার পরনে জিনস এবং ঢোলা শার্ট। ডান হাতের কবজিতে চওড়া স্টিল ব্যান্ডে চৌকো ঘড়ি। চুল ছেলেদের মতো করে ছাঁটা। এই পোশাক এবং সিগারেট বা চুলের ছাঁট পুরুষশাসিত সমাজের বিরুদ্ধে প্রোটেস্ট। সে এতক্ষণ চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল। এবার বলে ওঠে, নারী-জাগরণ-এর একজাট কাজটা তা হলে কি এই হবে অদিতিদি?

কী?

আমরা অনবরত সোসাইটির টরচারড় মেয়েদের নিয়ে এসে শেলটার দেব, আর তাদের মাতাল স্বামীরা যখন ঝামেলা করতে আসবে তাদের টি করব?

অদিতি কী উত্তর দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই অমিতাদি বলে ওঠেন, ও-সব পরে হবে। এখন চাঁপার প্রবলেমটা কী করে সলভ করা যায় সেটা ভাবো।

অদিতি এষার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে অমিতাদিকে লক্ষ করতে থাকে।

অমিতাদি বলে, চাঁপার ব্যাপারে একটা লিগ্যাল পয়েন্টও রয়েছে।

অদিতি জিগ্যেস করে, কী সেটা?

নগেন থানায় গিয়ে অভিযোগ করতে পারে, আমরা বে-আইনিভাবে তার স্ত্রীকে এখানে আটকে রেখেছি। তা হলে অবস্থাটা কী দাঁড়াবে, চিন্তা করে দেখো। কোর্ট উকিল উইটনেস–সব মিলিয়ে একটা ভীষণ কমপ্লিকেটেড ব্যাপার।

এ-দিকটা ভেবে দেখেনি অদিতি। সে একটু হকচকিয়ে যায়, পরক্ষণেই কী মনে পড়তে বলে ওঠে, চিন্তা নেই অমিতাদি, নগেন মরে গেলেও পুলিশের কাছে যাবে না।

মানে?

প্রথমত, সে হল, অ্যান্টিসোশাল, তার ওপর চাঁপা তার থার্ড ওয়াইফ। হিন্দু কোড বিল পাশ হবার পর ও কি গিয়ে বলবে, আমরা তিন নম্বর স্ত্রীকে নারী-জাগরণ গায়ের জোরে আটকে রেখেছে?

কিন্তু চাঁপা বলছিল, নগেনের পেছনে নাকি পলিটিক্যাল পার্টির লোকেরা রয়েছে। তারা এসে হাঙ্গামা করতে পারে।

আগে হাঙ্গামা করুক। তারপর দেখা যাবে। এত ভয় পেলে কোনো কাজই করা যাবে না অমিতাদি। যা চলে আসছে, মেয়েদের ওপর অত্যাচার, বধূহত্যা, পণপ্রথা, নারীর অসম্মান–এ সবই তা হলে চলুক। নারী-জাগরণ-এর তা হলে আর দরকার কী?

রমেন বাঁ-দিকে দাঁড়িয়েছিল। সে বলে, অদিতি ঠিকই বলেছে। গায়ে আঁচ লাগবে না, অথচ রাতারাতি সোশাল প্যাটার্ন পালটে যাবে, এটা হয় না অমিতাদি।

ডানদিকের শেষ মাথা থেকে হৈমন্তী বলে, আমরা কিন্তু আবার অন্যদিকে সরে যাচ্ছি। চাঁপার ব্যাপারটা ঠিক করে নেওয়া যাক।

হৈমন্তী নারী-জাগরণ-এর একজন অত্যন্ত সক্রিয় মেম্বার। নির্যাতিত মেয়েদের অসংখ্য সমস্যা, কলেজ আর ছাত্রছাত্রী নিয়ে তার জগৎ। এ-সবের বাইরে সে আর কিছু ভাবতে পারে না।

নারী-জাগরণ-এর পক্ষে থেকে একটা ত্রৈমাসিক বাই-লিংগুয়াল অর্থাৎ দ্বিভাষিক পত্রিকা বার করা হয়। দুই ভাষার একটি বাংলা, অন্যটি ইংরেজি। সমাজের নানা স্তরের মেয়েদের বিভিন্ন সমস্যা এখানে তুলে ধরা হয়। ছাপা হয় ধর্ষিতা লাঞ্ছিতা মেয়েদের ইন্টারভিউ। কাগজটির নাম নারী। এজন্য পশ্চিমবাংলা ছাড়াও দেশের বড় বড় শহরে নারীর অনেক মহিলা রিপ্রেজেন্টেটিভ রয়েছে। যদিও সম্পাদক হিসেবে এতে অমিতা সরকারের নামটা রয়েছে, আসল কাজটা করে হৈমন্তী-হৈমন্তী আচার্য। সে একটা কলেজে ফিজিক্স পড়ায়। খানিকটা রোগা হলেও, অত্যন্ত ধারালো চেহারা, চোখে বেশি পাওয়ারের চশমা।

অমিতাদি বললেন, অবস্থা এখন যা দাঁড়িয়েছে তাতে চাপাকে আর নগেনের কাছে পাঠানো যাবে না।

সবাই সায় দিয়ে জানায়, চাঁপাকে পাঠালে মারাত্মক ঝুঁকি নেওয়া হবে। চাঁপার যদি খারাপ কিছু হয়, আইনত না হলেও নৈতিক দিক থেকে নারী-জাগরণ-এর সভ্যরা এর জন্য ষোলআনা দায়ী থাকবে।

অমিতাদি বলেন, আমরা নাহয় চাঁপার দায়িত্ব নিলাম। একটা মানুষকে দুটো খেতে দেওয়া এমন কিছু ব্যাপার না। কিন্তু ও থাকবে কোথায়? আমাদের বেয়ারা একটামাত্র ঘরে বউ-বাচ্চা নিয়ে পেছন দিকে থাকে। চাঁপাকে সেখানে বা অফিসে রাখা সম্ভব না। একটা ইয়ং গার্ল একা অফিস বিল্ডিয়ে রাত্রিবেলা থাকবে, সেটা ঠিক না।

হৈমন্তী বলে, এতে ভীষণ রিস্কও থেকে যায়। আমরা কেউ এখানে রাত্তিরে থাকি না। চাঁপার ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে মানে কত রকমের বাজে এলিমেন্ট রয়েছে, তারা একেবারে বেপরোয়া। কে যে কী করে বসবে! হয়তো দরজা-টরজা ভেঙে ঢুকেই পড়ল। তার পরের কথা আর ভাবা যায় না। খারাপ কিছু ঘটে গেলে তার সব দায় কিন্তু এসে পড়বে আমাদের ওপর।

অমিতাদি আস্তে মাথা নাড়েন, তাহলে?

অদিতি এবার বলে, চাঁপাকে আমাদের কারও বাড়িতে আপাতত শেল্টার দিতে হবে।

অমিতাদি বলেন, আমার ফ্ল্যাটটা খুবই ছোট। আমার ভাই আর আমি থাকি। তাছাড়া রয়েছে একজন কাজের লোক। সেখানে একস্ট্রা আরেকজনকে নিয়ে গিয়ে ভীষণ অসুবিধে হবে।

কৃষ্ণা বলে, আমাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু পরশু কানাডা থেকে সেজদিরা এসেছে। বাড়ি একেবারে প্যাকড়। দশ বছর পর এল। ওরা মাস তিন-চারেক থাকবে। আমাদের অবস্থাটা কী, বুঝতেই পারছেন।

এরপর অন্য সবাই একে একে তাদের অসুবিধের কারণগুলি জানিয়ে দেয়।

একজন তো বলেই বসল, আমাদের বাড়িতে প্রচুর জায়গা। একজন কেন, দশজন বাড়তি লোকও থাকতে পারে। কিন্তু দ্যাট আন্টিসোশাল গুন্ডা, সে নিশ্চয়ই গিয়ে চড়াও হবে। বাবা এসব পছন্দ করবে না।

এটা ঠিক, অনেকের বাড়ি বা ফ্ল্যাটে জায়গা বেশ কম। যাদের বাড়ি বড় তারা নগেনের ভয়ে চাঁপাকে আশ্রয় দিতে চাইছে না। এ-জাতীয় সমাজবিরোধী ক্রিমিনাল টাইপের লোককে তারা এড়িয়ে চলতে চায়।

অদিতি অন্যমনস্কর মতো সবার কথা শুনছিল। শুনতে শুনতে তার চোখের সামনে অদৃশ্য সিনেমার স্ক্রিনে তাদের বাড়িটা ফুটে উঠছিল। সেখানে চাঁপার মতো পঞ্চাশজনের জায়গা হয়ে যাবে। কিন্তু বাবা মা এবং দাদারা কীভাবে চাঁপার ব্যাপারটা নেবে, ভেবে উঠতে পারছিল না অদিতি। দ্বিধার ভাবটা কাটিয়ে এক সময় মনঃস্থির করে ফেলে সে। বলে, ঠিক আছে, সবার যখন এত অসুবিধা তখন ওকে আমাদের বাড়িই নিয়ে যাচ্ছি। একটু থেমে বলে, আমি যখন চাঁপাকে বস্তি থেকে নিয়ে এসেছি তখন মরাল রেসপনসিবিলিটি আমার।

সবাই একসঙ্গে প্রায় গলা মিলিয়ে বলে, এভাবে ব্যাপারটা নিও না। রেসপনসিবিলিটি আমাদের সকলের। কিন্তু কিছু কিছু অসুবিধে তো প্রত্যেকের থাকে। ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড।

অদিতি উত্তর দেয় না।

অমিতাদি আবার বলেন, চাঁপাকে মেয়েদের কোনো হোমে আপাতত রেখে দিলে কী হয়?

অদিতি মনস্থির করে ফেলে। দৃঢ় গলায় বলে, না।

না মানে?

আমি দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চাই না। ওকে আজই আমাদের বাড়ি নিয়ে যাব। তারপর দেখা যাক, কী করা যায়–

অমিতাদি অস্বস্তি বোধ করেন। বলেন, চাঁপার ব্যাপারটা তোমাদের বাড়ির লোকেরা জানেন?

অদিতি বলে, এখনও জানে না। নিয়ে যাবার পর জানতে পারবে।

হঠাৎ এভাবে নিয়ে গেলে বলতে বলতে থেমে যান অমিতাদি। তিনি কী ইঙ্গিত দিয়েছেন, বুঝতে অসুবিধে হয় না অদিতির।

সে বলে, এ ব্যাপারে চিন্তা করবেন না অমিতাদি বলে চাঁপার দিকে চোখ ফেরায়, চল আমার সঙ্গে। বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায়।

চাঁপাও হাঁটুর ফাঁক থেকে মুখ তুলে উঠে পড়েছিল। অমিতাদি বলেন, এখনই যাবে?

অদিতি মাথাটা সামান্য হেলিয়ে দেয়, হ্যাঁ।

আজ তো বস্তিতে যাওয়া হল না।

হ্যাঁ। কাল থেকে যাব।

অমিতাদি বলেন, তুমি আসার আগে একটা বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করছিলাম।

অদিতি কোনো প্রশ্ন না করে অমিতাদির দিকে তাকায়।

তিনি থামেননি, তুমি বরং কিছুদিন বস্তিতে যেও না। পরশু থেকে আমরা যে সেমিনার করছি সেখানে মডারেটর হিসেবে থাকো।

অমিতাদির মনোভাব খুবই স্পষ্ট। বস্তিতে গেলে নগেন গন্ডগোল করতে পারে, সেই কারণে তিনি অদিতিকে সেখানে যেতে দিতে চান না।

পরশুদিনের সেমিনারটার কথা অদিতি জানে। দিল্লি বম্বে বাঙ্গালোর হায়দ্রাবাদ থেকে নাম-করা সোশিওলজিস্ট, ঐতিহাসিক, ইকনোমিস্ট, রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা এতে বক্তা হিসেবে যোগ দেবেন। তাছাড়া কলকাতার কয়েকজন সাংবাদিক এবং ঐতিহাসিককেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এজন্য তিনমাস আগেই একটা এয়ার-কন্ডিশনড হল ভাড়া করা হয়েছে। অবশ্য নারী-জাগরণ-এর এতে একটি পয়সাও খরচ নেই। একটা মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানি সেমিনারটা স্পনসর করছে। বড় বড় কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া থেকে শুরু করে ভালো হোটেলে বক্তাদের রাখার ব্যবস্থা, তাঁদের প্লেন ভাড়া, ইত্যাদি যাবতীয় দায়িত্ব ওই কোম্পানির।

অদিতির এ জাতীয় সেমিনার খুব একটা পছন্দ নয়। সে গ্লাস-রুটে গিয়ে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কাজটা করতে চায়।

অদিতি বলে, আপনি কী ভাবছেন বুঝতে পারছি অমিতাদি। কিন্তু একটা অ্যান্টিসোশাল হুলিগানের ভয়ে যদি বস্তিতে যাওয়া বন্ধ করে দিই তার চেয়ে লজ্জার কিছু নেই। আজ আর হল না, কাল থেকে আবার বস্তিতে যাব। আপনি অন্য কারও ওপর সেমিনারের দায়িত্ব দিন। বিকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, তোমার যদি এখানে খুব জরুরি কাজ না থাকে, আমাদের সঙ্গে আসবে?

বিকাশ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে, না, তেমন কোনো কাজ নেই। চলো–

.

রাস্তায় বেরিয়ে বিকাশ আর অদিতি পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। তাদের পিছনে চাঁপা।

অদিতি আগে কোনোদিন তাকে এভাবে ডেকে নিয়ে আসেনি। বিকাশ বেশ অবাকই হয়ে গিয়েছিল। সে বলে, আমাকে কিছু বলবে?

অন্যমনস্কর মতো মাথাটা সামান্য কাত করে অদিতি, হ্যাঁ।

বলো–বিকাশ উদগ্রীব হয়ে তাকায়।

কাল বলছিলে, তোমার ফ্ল্যাটটার পজেশান শিগগিরই পেয়ে যাবে

হ্যাঁ।

এক উইকের মধ্যে পাওয়া কি সম্ভব?

চেষ্টা করতে পারি। কেন বলোতো?

অদিতি বলে, মনে হচ্ছে, খুব তাড়াতাড়ি আমাকে একটা ডিসিশান নিতে হতে পারে।

শোনার পরও ব্যাপারটা বিকাশের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়। কিছুক্ষণ বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থাকে সে। তার পরই টের পায় বুকের ভেতর হাজারটা ঘোড়া যেন ছুটে যাচ্ছে। মনে হয়, প্রবল রক্তচাপে তার হৃৎপিণ্ড যেন ফেটে যাবে। প্রবল আগ্রহে তার চোখ মুখ ঝকমক করতে থাকে। সে বলে সত্যি!

অদিতির চোখে মুখে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। শান্ত নিস্পৃহ মুখে সে বলে, হ্যাঁ।

অদিতির এই একটি কথা শোনার জন্য কতদিন উন্মুখ হয়ে আছে বিকাশ। এমনকী কালও রাত্তিরে যখন অদিতিকে তাদের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে যায় তখনও সে মনস্থির করে উঠতে পারেনি। চব্বিশ ঘণ্টার ভেতর হঠাৎ কী এমন ঘটে গেল যাতে তাকে এরকম স্পষ্ট একটি সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে?

যাই ঘটুক তা নিয়ে বিকাশের বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই। অদিতি যে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছে তাতেই সে খুশি।

আসলে বিকাশ যে নারী-জাগরণ-এর মেম্বার হয়েছিল তার একমাত্র কারণ অদিতি। মেয়েরা যে অনবরত লাঞ্ছিত হচ্ছে বা তাদের পুড়িয়ে মারার ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই ঘটে যাচ্ছে, এসব নিয়ে আদৌ মাথা ঘামায় না সে। নারীর মর্যাদা রক্ষার নৈতিক এবং সামাজিক দায় যে প্রতিটি শিক্ষিত সচেতন মানুষের থাকা উচিত, এমন কোনো বোধ তার মধ্যে বিশেষ নেই। তার লক্ষ্য শুধুই অদিতি। এতকাল পর সে তার ধৈর্য এবং সহিষ্ণুতার দাম পেতে চলেছে।

বিকাশ বলে, তাহলে তো

কী? নিরুৎসুক সুরে জিগ্যেস করে অদিতি।

ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিসে নোটিশ দিতে হয়।

এ নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে।

ঠিক আছে। বিকাশ বলতে থাকে, হাউসিং বোর্ডে আমার কিছু জানাশোনা অফিসার আছে। কালই তাহলে ফ্ল্যাটটার ব্যাপারে তাদের ধরা যাক, না কী বলো

অদিতি উত্তর দেয় না। কেন না যা বলার আগেই বলে দিয়েছে। এক কথা বার বার বলা সে পছন্দ করে না।

হঠাৎ কিছু মনে পড়তে গলা অনেকটা নামিয়ে বিকাশ চাপা গলায় বলে, চাঁপাকে তো নিয়ে এলে। তার কী হবে?

হাঁটতে হাঁটতে দ্রুত মুখ ফিরিয়ে বিকাশের দিকে তাকায় অদিতি। আস্তে করে বলে, কিছু একটা নিশ্চয়ই হবে।

এ নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন করে না বিকাশ।

একসময় ওরা বড় রাস্তায় চলে এল এবং কালকের মতো প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেল।

আধ ঘণ্টা পর অদিতিদের বাড়ির কাছে চাঁপা এবং অদিতিকে নামিয়ে দিয়ে বিকাশ ভবানীপুর চলে যায়।

.

০৭.

সামনের ঝোঁপঝাড় পেরিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকতেই একতলার বসার ঘরে সিতাংশু ভৌমিকের চড়া গলায় শাসানি কানে আসে।

আপনাদের একমাস সময় দিচ্ছি। এর ভেতর আমার টাকাটা শোধ করে দেবেন না। হলে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।

শুনতে শুনতে অদিতির হাসিই পায়। মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে লোকটা আমূল বদলে গেছে এবং তার আসল চেহারা বেরিয়ে পড়েছে।

এবার দুই দাদা এবং বাবার ভীরু-মিনমিনে কণ্ঠস্বর শোনা যায়।

আপনি শান্ত হোন। দয়া করে একটু ধৈর্য ধরুন। আমরা বুবুকে আরেকবার বোঝাব।

অদিতির রাগ হয় না, বরং মজাই লাগে। বাবা এবং দাদারা এখনও আশা করে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাকে দিয়ে সিতাংশুর গলায় বরমাল্য পরাতে পারবে।

কিন্তু ফাঁপা রঙিন প্রতিশ্রুতিতে কাজ হয় না। সিতাংশু ঝানু ব্যবসাদার। লেনদেনের হিসেবটা তার কাছে পরিষ্কার। সে বলে, অদিতি যেভাবে কাল আমাকে অপমান করেছে, তারপর আর বোঝাবার দরকার নেই। আমার কথাটা মনে রাখবেন, এক মাসের মধ্যে টাকাটা ফেরত চাই।

প্যাসেজে অন্য দিনের মতো আজও টিমটিমে বালটা ওপর থেকে ঝুলছিল। সেটার তলা দিয়ে চাপাকে নিয়ে যেতে যেতে অদিতির চোখে পড়ে, বাঁ-পাশের ড্রইংরুমে সিতাংশু,

বাবা এবং দুই দাদা কালকের মতোই মুখোমুখি বসে আছে।

ওরা চারজনই ভেতর থেকে অদিতি আর চাঁপাকে দেখতে পেয়েছিল। কিছুক্ষণের জন্যে সবাই চুপ করে যায় এবং তার মধ্যেই অদিতিরা সিঁড়ির কাছে চলে আসে। সেখানে কালকের মতোই দুর্গা দাঁড়িয়ে আছে। সে নিশ্চয়ই বাইরের ঘরের কথা শুনছিল।

দুর্গা তার এবং মৃণালিনীর গুপ্তচর। ভালো ট্রেনিং পেলে আরেকটি মাতাহারি হয়ে উঠতে পারত। অদিতি জানে, সে যদি এখন না-ও ফিরত সিতাংশুর আসার খবর আর বাবা-দাদাদের সঙ্গে তার কথাবার্তার পুঙ্খানুপুঙ্খ ডিটেল মস্তিষ্কে নোট করে রাখত দুর্গা এবং শুতে যাবার আগে এসব জেনে যেত অদিতি।

দুর্গা বলে, সেই লোকটা আবার এসেছে ছোটদি।

সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে অদিতি বলে, দেখলাম তো। তুই কতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে আছিস?

তা আধঘণ্টা হবে।

বোঝা যায়, ঠিক আধ ঘণ্টা আগেই এ বাড়িতে ঢুকেছে সিতাংশু এবং সে এখান থেকে না যাওয়া পর্যন্ত দুর্গাকে নড়ানো যাবে না।

দুর্গা কথা বলতে বলতে বার বার চাঁপার দিকে তাকাচ্ছিল।

এবার সে জিগ্যেস করে, এ কে গো ছোটদি?

পরে শুনিস।

দোতলায় উঠতেই চোখে পড়ে, বাঁ-দিকের ঢালা বারান্দায় হেমলতা একটা জামায় বোতাম লাগাচ্ছেন। প্রায় রোজই বিকেলের পর মাকে এখানে বসে থাকতে দেখা যায়। হয় সেলাই-ফোঁড়াই কিছু করছেন, নইলে বই পড়ছেন বা চাল বাছছেন।

ছোট বউদি মীরা একধারে বসে হেমলতার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আগামী শীতের কথা মাথায় রেখে একটা কার্ডিগান বুনছে।

একটু দ্বিধান্বিতভাবে দাঁড়িয়ে পড়ে অদিতি। প্রথমে সে ভেবেছিল, চাঁপাকে নিয়ে সোজা তেতলায় নিজের ঘরে চলে যাবে এবং পরে এসে তার কথা সবাইকে জানাবে। কিন্তু এখন ঠিক করে ফেলে, আগেই চাঁপাকে সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে তার এ বাড়িতে থাকার কথা বলবে। তারপর ওপরে নিয়ে যাবে।

অদিতি চাঁপাকে বলে, এসো আমার সঙ্গে

দুজনে বারান্দায় এলে হেমলতা এবং মীরা চোখ তুলে তাকায়। মীরার মুখ মুহূর্তে থমথমে হয়ে যায়। তৎক্ষণাৎ এক হেঁচকায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে দেয় সে এবং দুমদাম পা ফেলে নিজের ঘরে গিয়ে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দেয়। কাল রাতের সেই উত্তেজক ঘটনার পর মীরা তার সঙ্গে কথা বলছে না।

হেমলতা অদিতির সঙ্গে একটি অচেনা বিবাহিত মেয়েকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। ঘুচ-সুতো আর জামা নীচে নামিয়ে রেখে আস্তে আস্তে বলেন, মেয়েটি কে রে?

অদিতি কী উত্তর দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই সিঁড়িতে অনেকগুলো পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। মুখ ফেরাতেই অদিতির চোখে পড়ে, একসঙ্গে দুটো-তিনটে করে সিঁড়ি ভেঙে রুদ্ধশ্বাসে তেতলায় চলে গেল দুর্গা। একটু পরে বরুণ, মৃগাঙ্ক এবং রমাপ্রসাদ উঠে এসে সোজা দোতলায় চলে আসেন।

রমাপ্রসাদ বেশ নরম গলায় অদিতিকে বলেন, খানিকক্ষণ আগে তোকে আসতে দেখলাম। আজ তোর মুড কেমন আছে রে বুবু?

এসব কীসের ভূমিকা, মোটামুটি আন্দাজ করতে পারে অদিতি। বাবা বা দাদারা খুব সম্ভব স্ট্র্যাটেজিটা পালটে ফেলেছে। সে ভেতরে ভেতরে সতর্ক হয়ে যায়। বলে, এখনও পর্যন্ত ভালোই আছে। এরপর যদি তোমরা খারাপ করে দাও, আলাদা কথা—

তোর সঙ্গে একটা কাজের কথা ছিল বলতে বলতে হঠাৎ চাঁপার দিকে নজর চলে যায় রমাপ্রসাদের। কপালটা সমান্য কুঁচকে যায় তার। পা থেকে মাথা পর্যন্ত চাঁপাকে দেখতে দেখতে বলেন, মেয়েটিকে তো চিনলাম না।

অদিতি বলে ওর নাম চাঁপা।

তা এখানে—

আমি ওকে নিয়ে এসেছি।

কিছুই বুঝতে পারছিলেন না রমাপ্রসাদ। রীতিমতো অবাক হয়েই জিগ্যেস করেন, হঠাৎ?

অদিতি বলে, তোমরা বসো। ওর কথা তোমাদের শোনা দরকার।

রমাপ্রসাদ বলেন, মেয়েটির কথা পরে শোনা যাবে। ও অন্য কোথাও একটু বসুক। তোর সঙ্গে আমাদের আলোচনাটা আগে সেরে নিই।

অদিতি প্রায় জেদই ধরে, না। চাঁপার ব্যাপারটা ভীষণ জরুরি। এটা ওর লাইফ অ্যান্ড ডেথের প্রশ্ন।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও রমাপ্রসাদ বলেন, ঠিক আছে, তুই যখন না-শুনিয়ে ছাড়বি না তখন বল

বারান্দার এধারে-ওধারে কয়েকটা বেতের মোড়া এবং চেয়ার-টেয়ার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। সেগুলো টেনে এনে রমাপ্রসাদরা বসে পড়েন। অদিতিও বসে। কিন্তু চাঁপাকে বসতে বললেও সে একধারে দেয়ালের গায়ে সেঁটে একেবারে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

কাল নারী-জাগরণ-এর তরফ থেকে বস্তিতে সমীক্ষা চালাতে যাবার পর থেকে এখন পর্যন্ত চাঁপাকে নিয়ে যা যা ঘটেছে, সমস্ত জানিয়ে অদিতি বলে, ওকে বাড়িতে না-নিয়ে এসে আমার উপায় ছিল না বাবা। তোমরাই ভেবে দেখো, মেয়েটাকে আমরা জানোয়ারের হাতে তুলে দিতে পারি না।

ষাট-সত্তর বছরের এই পুরোনো বাড়িটা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকে। তারপরেই বিস্ফোরণ ঘটে যায়। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে মৃগাঙ্ক বলে, এটা কি ধর্মশালা যে তাকে শেলটার দিতে হবে?

বরুণও তীব্র গলায় বলে, সব ব্যাপারের একটা সীমা আছে। বস্তি থেকে একটা মেয়েকে ধরে নিয়ে এল। এর দায়িত্ব কে নেবে?

রমাপ্রসাদ অবশ্য কিছু বলেন না। মুখচোখ দেখে টেরে পাওয়া যায়, তার আর্থারাইটিসের যন্ত্রণাটা হঠাৎ চাড়া দিয়ে উঠেছে।

চাঁপার কথা বললে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া ঘটতে পারে, অদিতির সে সম্পর্কে ধারণা ছিল। সে আদৌ উত্তেজিত হয় না। অত্যন্ত শান্ত মুখে বলে, তোমাদের কাউকেই ওর দায়িত্ব নিতে হবে না। তা ছাড়া চাঁপা থাকবে আমার ঘরে। সেখান থেকে ও বেরুবে না। বাইরে যাবার দরকার হলে আমিই ওকে নিয়ে যাব। কোনোভাবেই ও কাউকে ডিসটার্ব করবে না।

বরুণ বলে, তুমি রোজগার করো, ওকে খেতে দিতে পারবে। সবই জানি। তবু ওর এ-বাড়িতে থাকা চলবে না।

মুখটা শক্ত হয়ে ওঠে অদিতির, কেন? কিছুদিন আগে দিল্লি থেকে তোমার এক পাঞ্জাবি বন্ধু ফ্যামিলি নিয়ে এসে যখন দেড়মাস থেকে গেল তখন আমি তো আপত্তি করিনি।

কাদের সঙ্গে কার তুলনা করছিস। তারা বিশিষ্ট ভদ্রলোক।

চাঁপাকে তুমি অভদ্র ধরে নিলে কী কারণে? বস্তিতে থাকে বলে?

বরুণ বলে, একজাকটলি। এদের নানারকম ঝামেলা থাকে। তা ছাড়া ওই টাইপের হুলিগান যার হাজব্যান্ড তাকে নিয়ে অনেক প্রবলেম। পরে ঝঞ্ঝাট হলে কে সে-সব সামলাবে।

অদিতি বলে, এ নিয়ে কাউকে ভাবতে হবে না।

মৃগাঙ্ক ওধার থেকে বলে, যে-ই দায়িত্ব নিক, এ-বাড়িতে ওইরকম একটা মেয়েকে থাকতে দিতে আমার অন্তত আপত্তি আছে। আই ডোন্ট লাইক ইট।

অদিতি এবার রমাপ্রসাদের দিকে তাকিয়ে বলে, বাবা, তোমার কী মত?

রমাপ্রসাদের খুবই কষ্ট হচ্ছিল। তিনি কাতর গলায় বলেন, ওরা যখন চাইছে না তখন

বাবাকে দেখতে দেখতে স্তম্ভিত হয়ে যায় অদিতি। সে এম.এ-তে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে, একটা বড় কলেজের নামকরা অধ্যাপিকা, তার সামাজিক প্রতিষ্ঠা রয়েছে। সাংসারিক খরচের অনেকটাই সে দিয়ে থাকে। অথচ বাবার কাছে অদিতির সামাজিক দায়িত্ববোধের চেয়ে দুই জুয়াড়ি ছেলের মতামতের দাম অনেক বেশি। অদিতির মন বিষাদে ভরে যায়। সে বলে, তার মনে তোমারও আপত্তি আছে। কিন্তু তোমরা যাই ভাবো, যতদিন কিছু ব্যবস্থা নাহয় চাঁপা এখানে থাকবে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ।

তারপর অদিতি এভাবে শুরু করে, বাবা, আমার সঙ্গে তোমাদের কী জরুরি কথা যেন ছিল–

সুর কেটে গিয়েছিল। রমাপ্রসাদ ক্লান্ত গলায় বলেন, আজ থাক, কাল শুনিস—

আমি তা হলে এখন ওপরে যাই।

রমাপ্রসাদ উত্তর দেয় না।

অদিতি আর বসে না, চাঁপাকে নিয়ে তেতলায় চলে যায়

.

০৮.

পরদিন সকালে সবে রোদ উঠেছে, একটানা বোমার আওয়াজে অদিতিদের নিরিবিলি অভিজাত পাড়াটা হকচকিয়ে যায়। এই অঞ্চলটা কলকাতার ভেতরে থেকেও যেন কলকাতার বাইরে একটা প্রায় নির্জন দ্বীপ বা লেগুনের মতো। এখানকার চিরস্থায়ী শান্তি চুরমার করে এমন ঘটনা আর কখনও ঘটেনি।

খুব ভোরে ওঠা অদিতির বহুকালের অভ্যেস। সে যখন ওঠে, এ-বাড়ির কারোর ঘুম ভাঙে না। তেতলায় তার নিজের ঘরটিতে হিটার এবং চা তৈরির যাবতীয় সরঞ্জাম রয়েছে। মুখটুখ ধুয়ে এসে এক কাপ করে নেয় সে, তারপর টেবিলের সামনে গিয়ে বসে। এই সময়টা হয় পড়াশুনো বা লেখালেখি কিছু করে, নইলে ছাত্রছাত্রীদের খাতা দেখে।

আজ দুকাপ চা করে নিয়েছিল অদিতি। এক কাপ নিজের জন্য, দ্বিতীয় কাপটা চাঁপার।

চা খেতে খেতে অদিতি ক্লাস টেস্টের খাতা দেখছে, আর চাঁপা রাস্তার দিকের জানলার কাছে দাঁড়িয়ে আছে।

বাড়ির সামনে এবং পেছনে ঝুপসি গাছপালার মাথায় তুমুল হই-চই বাঁধিয়ে অগুন্তি পাখি উড়ছে। দূরের রাস্তা দিয়ে ক্কচিৎ ক্যালকাটা মিল্ক সাপ্লাইয়ের দু-একটা ভ্যান কিংবা রিকশা চলেছে। আর দেখা যাচ্ছে খবরের কাগজওলাদের। ঊর্ধ্বশ্বাসে সাইকেল ছুটিয়ে তারা এ-বাড়ি ও-বাড়ি ঢুকে পড়ছে। কাগজ ফেলে দিয়ে আবার দৌড়।

এমন এক উত্তেজনাশূন্য শান্ত সকালে এইরকম একটি পাড়ায় বোমা ফাটানোর মতো মারাত্মক ব্যাপার ঘটতে পারে, এখানকার বাসিন্দাদের কাছে তা অভাবনীয়। বোমার আওয়াজের ফাঁকে ফাঁকে উত্তেজিত চিৎকারও ভেসে আসছে।

খাতা দেখতে দেখতে চমকে উঠে অদিতি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চাঁপার ভয়ার্ত গলা শোনা যায়, দিদি

দ্রুত ঘুরে বসতেই অদিতি দেখতে পায়, চাঁপা প্রায় কাঁপছে। সে এতই সন্ত্রস্ত যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না।

অদিতি জিগ্যেস করে, কী হয়েছে?

জানলার দিকে আঙুল বাড়িয়ে শিথিল গলায় চাঁপা বলে, ওরা–ওরা এসেছে।

বোমা ফাটিয়ে হল্লা করতে করতে কারা এভাবে হানা দিতে পারে, মুহূর্তে আন্দাজ করে নেয় অদিতি। চেয়ার থেকে উঠে এক দৌড়ে রাস্তার দিকের জানলাটার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় সে। যা ভেবেছিল তা-ই। তাদের বাড়ির গেটটার ঠিক বাইরে প্রচণ্ড উত্তেজিত ভঙ্গিতে আট-দশটা চোয়াড়ে হুলিগান ধরনের লোক সমানে চেঁচাচ্ছে আর মাঝে মাঝে দু-একটা বোমা ফাটাচ্ছে। ওদের ভেতর নগেনকে দেখতে পাওয়া যায়।

একসঙ্গে চিৎকার করে তারা কী বলছে, কিছুই প্রায় বোঝা যায় না। তবে অকথ্য খিস্তিখেউড় যে দিচ্ছে, তাদের অঙ্গভঙ্গি থেকেই সেটা টের পাওয়া যায়।

নগেনরা যে এতদূরে এসে সকালবেলা চড়াও হবে, ভাবতে পারেনি অদিতি। বাড়িতে এর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, তার একটা পরিষ্কার ছবি চোখের সামনে ফুটে ওঠে অদিতির। প্রথমটা ভীষণ ভয় পেয়ে যায় অদিতি। পরক্ষণেই অসহ্য রাগে তার মাথায় বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে। একটা অ্যান্টিসোশাল ক্রিমিনালের এত বড় সাহস যে তাদের বাড়ির সামনে এসে বোমা ফাটয়ে খিস্তি করছে।

তাদের ব্যাচমেট সৈকত আই.পি.এস হয়ে এখন লালবাজারে পোস্টেড। অদিতি ঠিক করে ফেলে এখনই তাকে ফোন করে পুলিশ পাঠাতে বলবে।

আগে এ-বাড়িতে ফোন ছিল। বিল দিতে না পারায় অনেক দিন আগেই ক্যালকাটা টেলিফোনের লোকেরা লাইন কেটে দিয়ে গেছে। পাশের বাড়িতে অবশ্য ফোন আছে। তেমন জরুরি ব্যাপার হলে ওখানে চলে যায় অদিতি। ওরা খুবই ভদ্র, আপত্তি করে না।

যেভাবে নগেনরা হামলা করছে তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে এখন যাওয়া ঠিক হবে না। পেছন দিয়ে সরু একটা প্যাসেজ রয়েছে, ওই দিক দিয়েই যাবে অদিতি।

চাঁপা বলে, কী হবে দিদি?

অদিতির মুখ শক্ত হয়ে উঠেছিল। দাঁতে দাঁত চেপে সে বলে, কী আবার হবে! নগেনকে ঢিট করার ব্যবস্থা করছি। আমি একটা ফোন করে আসি। তুমি এঘর থেকে একেবারে বেরুবে না। একটু ভেবে বলে, ঠিক আছে, তোমাকে পিসির কাছে দিয়ে যাই। কাল রাত্তিরেই তেতলায় এসে মৃণালিনীর সঙ্গে চাঁপার আলাপ করিয়ে দিয়েছিল অদিতি।

চাঁপা যেন তার কথা শুনতে পাচ্ছিল না। অপরাধীর মতো মুখ করে সে বলে, আমার জন্যে আপনি কী বিপদে পড়লেন বলুন তো। একটা কথা বলব?

কী?

আমি বরঞ্চ ওর সনগে চলেই যাই। আমার কপালে যা আছে তা-ই হোক। চাঁপার মুখ দেখে মনে হয়, তার ভেতরকার সব শক্তি এবং সাহস একেবারে শেষ হয়ে যাচ্ছে।

না। প্রায় ধমকের গলায় বলে ওঠে অদিতি, এসো আমার সঙ্গে।

কিন্তু যাওয়া আর হয় না। তার আগেই চোখে পড়ে, মৃগাঙ্ক এবং বরুণ বাড়ির ভেতর থেকে ছুটতে ছুটতে গেটের দিকে যাচ্ছে। দুজনেই, বিশেষ করে করে মৃগাঙ্ক দারুণ গোঁয়ার। কলেজে ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় প্রচুর মারদাঙ্গা করেছে। পুলিশে ওর নামে রিপোর্টও হয়েছিল বারকয়েক।

দুই দাদার পর রমাপ্রসাদকেও গেটের দিকে যেতে দেখা যায়। বাবার এমনিতেই শরীর ভালো না, কোমরে বহুদিনের আর্থরাইটিস, হার্টের অবস্থাও বেশ খারাপ। বিপজ্জনক কিছু একটা ঘটে যেতে পারে যে-কোনো মুহূর্তে। তার আগেই লালবাজারে সৈকতকে ফোনটা করা দরকার।

অদিতি চাঁপার একটা হাত ধরে মৃণালিনীর ঘরে নিয়ে আসে। বলে, পিসি, ও তোমার কাছে রইল। আমি আসছি।

মৃণালিনী বোমার আওয়াজ এবং হল্লা শুনে ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। বলেন, নীচে কী হচ্ছে রে বুবু? কারা বোমা ফাটাচ্ছে?

পরে এসে বলব। এখন দাঁড়াবার সময় নেই। একসঙ্গে দু-তিনটে করে সিঁড়ি ভেঙে নামতে থাকে অদিতি।

পাশের বাড়ি গিয়ে একবার ডায়াল করতেই সৈকতকে পাওয়া যায়। সৈকত রীতিমতো অবাক, আরে তুমি! কতদিন পর তোমার গলা শুনলাম! ভালো আছ?

অদিতি বলে, ফিজিকালি অলরাইট। একটা বিপদে পড়ে তোমাকে ডিসটার্ব করছি ভাই-

তার কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যাতে চমকে ওঠে সৈকত। সেই চমকের রেশ টেলিফোনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আসে যেন, কী হয়েছে।

দলবল নিয়ে নগেন কীভাবে ঝামেলা করছে, সমস্ত জানিয়ে অদিতি বলে, কিছু একটা ব্যবস্থা করো সৈকত।

ব্যস্তভাবে সৈকত বলে, হা হা, নিশ্চয়। তুমি লাইনটা ছেড়ে দাও। আমি বালিগঞ্জ ফাঁড়িতে ফোন করে দিচ্ছি। দশ মিনিটের মধ্যে পুলিশ চলে যাবে। তোমাদের বাড়ি অ্যাড্রেসটা দাও–

ঠিকানা জানিয়ে দেয়, অদিতি।

সৈকত এবার বলে, ঘণ্টাখানেক পর আবার ফোন করে কী হল, না-হল, খবরটা দিও। ডোন্ট ওরি–

ফোন নামিয়ে পাশের বাড়ি থেকে উধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে নিজের বাড়ির গেটের দিকে যেতে যেতে থামকে দাঁড়ায় অদিতি।

ওখানে তুলকালাম ব্যাপার চলছে এই মুহূর্তে।

মৃগাঙ্ক নগেনের গলার কাছটা জামাসুদ্ধ চেপে ধরে চিৎকার করছে, বাস্টার্ড, তোমার চামড়া গুটিয়ে ছাড়ব। এটা ভদ্রলোকের বাড়ি

নগেনের মাথাতেও খুন চেপে গেছে। এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে হিংস্র গলায় সে বলে, শালা! অন্যের মেয়েছেলেকে ঘরে পুরে রেখে ভদ্দরলোক সেজেছে! ভদ্রলোকের আমি–এরপর জঘন্য একটা খিস্তি করে সে।

তোমার মুখ আমি তুবড়ে দেব শুয়োরের বাচ্চা।

যা যা মাকড়া! তোর মতো তুবড়ে দেনেবালা আমি বহুত দেখেছি! নিজের ভালো চাইলে চাঁপাকে বার করে দে! নাইলে

একটা বাজে অ্যান্টিসোশাল তাকে তুই-তোকারি করছে। মাথায় রক্ত ফুটতে থাকে মৃগাঙ্কর। ঝাঁপিয়ে পড়ে নগেনের গলা টিপে ধরে সে, নইলে কী?

আবার ঝাড়া মেরে মৃগাঙ্কর হাতটা আলগা করে করে দেয় নগেন। বলে, তোমার লাইফ কিচাইন হয়ে যাবে। আমাকে তুমি চেনো না শালা!

এদিকে বরুণ চেঁচাচ্ছিল, এই জানোয়ারেরা ভাগ এখান থেকে

রমাপ্রসাদও হিতাহিত জ্ঞানশূন্যের মতো চিৎকার করছিলেন। নগেনের সঙ্গে যারা এসেছে তারাও সমানে চিৎকার এবং খিস্তি করে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে রাস্তায় বোমা ফটাচ্ছে।

এদিকে মৃগাঙ্ক আবার নগেনের দিকে দৌড়ে যায় এবং উন্মত্তের মতো তার মুখে ঘুষি চালিয়ে দেয়।

নগেনের নাক-মুখ ভেঙেচুরে রক্তাক্ত মাংসের দলা হয়ে গেল। লাট খেয়ে পড়ে যেতে যেতে নিজের রক্ত দেখে খুন চড়ে যায় তার। চোখ দুটো ঝলকে ওঠে। কোমরের কাছ থেকে লিকলিকে একটা ছোরা বের করেই মৃগাঙ্কর গায়ে বসিয়ে দেয় নগেন।

আতঙ্কে রমাপ্রসাদ, বরুণ এবং অনেকটা দূরে অদিতি চেঁচিয়ে উঠেছিল। মৃগাঙ্ক ক্ষিপ্র একটি মোচড়ে শরীরটাকে বাঁ দিকে হেলিয়ে দেয়। যদিও তার বুক ছিল নগেনের টার্গেট, সেখানে না-বসে ছোরার ফলা মৃগাঙ্কর কাঁধে গেঁথে যায় এবং গরম তাজা রক্ত ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসতে থাকে।

মৃগাঙ্কর শরীর মুহূর্তে কুঁকড়ে যায়। ঠোঁট কামড়ে হাত দুটোয় মুঠো পাকিয়ে যন্ত্রণা সামলাতে চেষ্টা করে সে কিন্তু পারে না। এক সময় হাত-পায়ের জোর আলগা হয়ে হুড়মুড় করে মাটিতে পড়ে যায় সে।

হল্লা এবং বোমার আওয়াজে চারদিকের বাড়ি থেকে অনেকে বেরিয়ে এসেছিল কিন্তু ভয়ে কেউ এগুতে পারছে না। অন্যের জন্য অকারণে কে আর ঝুঁকি নিতে চায়?

বরুণ আর রমাপ্রসাদ মৃগাঙ্কর দিকে দৌড়ে যায়। অদিতি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। মৃগাঙ্কর এই পরিণতির যাবতীয় দায়িত্ব যে তারই, সেটা মেনে নিয়েই উদ্ভ্রান্তের মতো সে এগিয়ে যায়।

এদিকে ছুরি মারায় একটু থমকে গিয়েছিল নগেন। হঠাৎ অদিতিকে দেখে সে কিছু বলতে যাবে, পুলিশের একটা কালো ভ্যান কর্কশ আওয়াজ করে গেটের সামনে এসে ব্রেক কষে।

তৎক্ষণাৎ নগেন এবং তার গ্যাংটা উধাও হয়ে যায়।

ছজন আর্মড কনস্টেবল সঙ্গে করে একজন অল্পবয়সি অফিসার ভ্যান থেকে নেমে মৃগাঙ্ককে দেখতে দেখতে বলে, কে এঁকে স্ট্যাব করল?

ছুরি মারার খবর পেয়ে বাড়ি থেকে হেমলতা, মীরা এবং বন্দনা পাগলের মতো বেরিয়ে এসেছিল। তারা রক্তাক্ত বেহুশ মৃগাঙ্ককে পড়ে থাকতে দেখে বুক-ফাটা কান্না জুড়ে দেয়।

হাজার বিপদেও ধৈর্য হারায় না অদিতি। সে পুলিশ অফিসারকে একধারে ডেকে বলে, যাঁকে স্ট্যাব করা হয়েছে উনি আমার ছোটদা। পরে আপনাকে সব বলব, আপনি ছোটদাকে নিয়ে আগে কোনো হসপিটালে চলুন।

মৃগাঙ্ককে ধরাধরি করে ভ্যানে তোলা হয়। তার সঙ্গে বন্দনা, মীরা, রমাপ্রসাদ, বরুণ এবং অদিতিও ওঠে। আর হেমলতা, মীরাকে বোঝানো হয়েছিল, পরে তাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে, কিন্তু তাদের ভ্যান থেকে নামানো যায়নি।

হাসপাতাল পর্যন্ত সারাটা পথ হেমলতা নিঃশব্দে কেঁদে যান। কিন্তু মীরা পাগলের মতো চিৎকার করে কাঁদতে থাকে এবং মৃগাঙ্কর এই অবস্থার জন্য যে অদিতিই একমাত্র দায়ী, সেটা কান্না-জড়ানো ভাঙা ভাঙা গলায় একনাগাড়ে বলে যায়।

.

হাসপাতালে পৌঁছোবার পর ডাক্তারেরা এমার্জেন্সিতে ভর্তি করে নেন মৃগাঙ্ককে এবং পরীক্ষা করে জানান, প্রাণের আশঙ্কা নেই। যদিও ছুরির ফলা কাঁধের মাংসপেশীগুলোকে খুবই জখম করেছে। রক্তপাতও হয়েছে প্রচুর। অবশ্য ডাক্তারদের ধারণা, মৃগাঙ্ককে চার-পাঁচদিনের বেশি হাসপাতালে থাকতে হবে না, তার পরেই তাকে রিলিজ করে দেওয়া হবে। বাড়িতে সপ্তাহখানেক রেস্ট নিলে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে সে।

অদিতিরা হাসপাতালে থাকতে থাকতেই জ্ঞান ফিরে আসে মৃগাঙ্কর এবং তাকে এমার্জেন্সি থেকে পেয়িং বেড়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

এইসব করতে করতে ঘণ্টাদুয়েক কাটে। তারপর একটা ট্যাক্সি করে মীরা আর হেমলতাকে নিয়ে বরুণ বাড়ি ফিরে যায়। রমাপ্রসাদ এবং অদিতি আদ্যোপান্ত জানিয়ে নগেনের নামে ডায়েরি করিয়ে বলে, লোকটা খুবই বিপজ্জনক।

তরুণ পুলিশ অফিসারটি বলে, আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, নগেনকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অ্যারেস্ট করা হবে।

অদিতি বলে, ধন্যবাদ। আপনার এখান থেকে আমি কি একটা ফোন করতে পারি?

নিশ্চয়ই। ব্যস্তভাবে টেলিফোনটা অদিতির দিকে এগিয়ে দেয় পুলিশ অফিসার।

বালিগঞ্জ ফাঁড়ি থেকে পুলিশ অদিতিদের বাড়ি যাবার পর কী হল না হল, সব জানিয়ে দিতে বলেছিল সৈকত। সে নিশ্চয়ই উগ্রীব হয়ে আছে। ডায়াল ঘুরিয়ে লালবাজারে কানেকশান পেয়ে যায় অদিতি। লাইনের ওধার ধেকে সৈতকের গলা ভেসে আসে, হ্যালো

অদিতি বলছি।

হ্যাঁ হ্যাঁ, বলো।

পুলিশ আসার পর এখন পর্যন্ত যা যা ঘটেছে, সব বলে গেল অদিতি।

সৈকত বলে, আগে যে ফোন করেছিলে তখন একটা কথা মনে হয়নি

কী?

নগেন তোমাদের বাড়ির ঠিকানা পেল কোথায়?

একটু চিন্তা করে অদিতি বলে, জানি না। তবে মনে হচ্ছে, ও আরও একবার নারী-জাগরণ-এর অফিসে গিয়েছিল। ওখানে যে কাজের লোকটা থাকে তাকে ভয় দেখিয়ে ঠিকানাটা নিয়েছে। কিংবা অন্য কারও কাছ থেকেও জোগাড় করতে পারে।

সৈকত বলে, যাইহোক, লোকটা খুবই ডেসপারেট। অবশ্য ওকে অ্যারেস্ট করতে অসুবিধে হবে না। যদি দরকার হয়, পরে আমাকে ফোন কোরো।

আচ্ছা।

খুট করে একটা শব্দ হল। সৈকত ফোন নামিয়ে রেখেছে।

 ৪. বাড়ির আবহাওয়া থমথমে

০৯.

বিয়ের ব্যাপারে অদিতি সিতাংশুকে নাকচ করে দেবার পর থেকেই বাড়ির আবহাওয়া থমথমে হয়ে গিয়েছিল। নগেন মৃগাঙ্ককে ছুরি মারলে সেটা একেবারে বিস্ফোরণের পর্যায়ে চলে আসে। এই ঘটনার জন্য মৃণালিনীকে বাদ দিলে বাড়ির প্রতিটি মানুষ, বিশেষ করে মীরা আঙুল তুলে অদিতিকেই দায়ী করছে। শুধু তাই না, মা বাবা বড়দা এবং বউদিরা দিনরাত সমস্বরে চেঁচিয়ে যাচ্ছে, চাঁপাকে বের করে দিতে হবে। সে এখানে থাকলে বাড়ির লোকেদের যে আরও মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যাবে, এতে কারও এতটুকু সংশয় নেই। উটকো ঝামেলা ঘরে পুষে রেখে নিজেদের অকারণে বিপন্ন করতে কে-ই বা চায়?

প্রচণ্ড জেদে গোটা বাড়ির বিরুদ্ধে একাই যুদ্ধ চালিয়ে যায় অদিতি। যত চাপই আসুক, চাঁপাকে কিছুতেই তাড়িয়ে দিতে পারবে না। সে এ বাড়িতেই থাকবে।

অদিতি বোঝাতে চেষ্টা করে, কেন তোমরা এত ভয় পাচ্ছ? লালবাজারে আমি কথা বলেছি, খুব শিগগিরই নগেনকে অ্যারেস্ট করা হবে। তাছাড়া দরকার হলে আমাদের বাড়িতে আমর্ড গার্ডের ব্যবস্থা করা যাবে।

রমাপ্রসাদ বলেন, তোমার কোনো কথা শুনতে চাই না। আমাদের আত্মীয় না, স্বজন না, চেনা-জানাও না, এমন একটা মেয়ের জন্য ফ্যামিলি পিস ডিসটার্বড় হোক, এটা আমি একেবারেই চাই না। তুই ওকে যেখান থেকে এনেছিস সেখানে দিয়ে আয়।

অদিতি বলে, না, কিছুতেই না। তার কণ্ঠস্বরে দৃঢ়তা ফুটে বেরোয়।

হেমলতা বলেন, খুব বাড়াবাড়ি করছিস বুবু।

যে মায়ের গলা কোনোদিন কোনো কারণেই একটা বিশেষ সীমারেখার ওপর ওঠে না, হঠাৎ তাকে এভাবে বলতে দেখে হকচকিয়ে যায় অদিতি। সে বলে, মা, আমি একটা মেয়েকে বাঁচাতে চেষ্টা করছি। তুমি একে বাড়াবাড়ি বলছ।

হেমলতা বলেন, ওকে বাঁচাতে গিয়ে যদি আমাদের কারও সর্বনাশ হয়ে যায়, সেটা কিছুতেই মানব না। ছুরিটা বাবলুর কাঁধে না লেগে বুকে লাগলে কী হত, আগে তার জবাব দে।

অদিতি বুঝতে পারছিল, মৃগাঙ্ককে ছুরি মারার ঘটনায় হেমলতা ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়েছেন। এটা মায়ের আশঙ্কা এবং আবেগের ব্যাপার! যুক্তি-তর্ক বা সামাজিক দায়িত্ববোধের ব্যাপারগুলো তাঁর মাথায় কিছুতেই ঢোকানো যাবে না। ছেলেমেয়ে বা স্বামীর নিরাপত্তা তাঁর কাছে সবার ওপরে। সেখানে অন্য সমস্ত কিছুই তুচ্ছ।

অদিতি জানে সে বাড়ি থেকে বেরুলেই চাঁপাকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। তাই একটি মুহূর্তের জন্যও সে বাইরে যাচ্ছে না। সারাক্ষণই চাঁপাকে আগলে আগলে রাখছে।

কিন্তু সে একটা চাকরি করে। ইচ্ছেমতো কলেজে ছুটি নিলে চলে না। ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা এসে যাচ্ছে। অনার্সের কোর্স অর্ধেকটাই পড়ানো হয়নি। হাতে আর আছে মাত্র ছটি মাস। এর ভেতরে পুরো কোর্স শেষ করে দিতে হবে। রেগুলার ক্লাস ছাড়াও টিউটোরিয়াল ক্লাসগুলো রয়েছে। এখন একটা দিনও কলেজে না গেলে ছেলেমেয়েদের দারুণ ক্ষতি হয়ে যাবে।

তবু দুটো দিন চাঁপাকে নিয়েই রইল অদিতি। কিন্তু আজ সকালে প্রিন্সিপ্যাল পাশের বাড়িতে ফোন করে জানিয়েছেন, অদিতি যেন অবশ্যই কলেজে আসে। দু-দিন ক্লাস না হওয়ায় ছেলেমেয়েরা ভীষণ ক্ষুব্ধ। তারা প্রিন্সিপ্যালের ঘরে এসে খুব হইচই করেছে।

অগত্যা, চাঁপাকে ঘরে দরজা বন্ধ করে থাকতে বলে দশটা নাগাদ যখন অদিতি বেরুতে যাবে, চাঁপা ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করে, দিদি, আপনি কখন ফিরবেন?

অদিতি বলে, পাঁচটার ভেতর। ক্লাস হয়ে গেলে এক মিনিটও দেরি করব না। সাবধানে থাকবে।

আচ্ছা। কিন্তু

বলো।

আমার খুব ভয় করছে।

চাঁপা আসায় বাড়িতে যে দমবন্ধ-করা যুদ্ধকালীন অবস্থা চলছে, সেটুকু বোঝার মতো বুদ্ধিসুদ্ধি তার আছে। অদিতি ভরসা দিয়ে বলে, কীসের ভয়? আমি দুর্গাকে বলে যাচ্ছি তোমার ভাত দিয়ে যাবে।

চাঁপা বলে, এভাবে কদিন আমাকে আগলে রাখবেন?

এই প্রশ্নটার উত্তর জানা নেই অদিতির। সে বলে, এ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। কিছু একটা ঠিক হয়ে যাবে। আচ্ছা যাচ্ছি।

.

কলেজে এসে পর পর দুটো অনার্স ক্লাস নিয়ে আগের দুদিনের যেসব ক্লাস নেওয়া হয়নি তার থেকে দুটো ক্লাস নিল। সে ঠিকই করে রেখেছে, রোজ একটা-দুটো করে একস্ট্রা ক্লাস নিয়ে মেক-আপ করে ফেলবে।

একটানা চারটে ক্লাস নেবার পর স্টাফরুমে আসতেই অরুণা বলে, অদিতিদি, বিকাশবাবু তিনবার ফোন করেছেন। উনি অফিসে চারটে পর্যন্ত থাকবেন। তোমাকে রিং করতে বলেছেন। অরুণা এই কলেজে হিস্ট্রি পড়ায়, বিকাশকে চেনে।

দুদিন বিকাশের সঙ্গে দেখা হয়নি। শুধু বিকাশ কেন, বাইরের সবার সঙ্গেই অদিতির যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। এই দুটো দিন সারাক্ষণ চাঁপাকে পাহারা দিয়ে রেখেছে সে।

স্টাফরুমের এক কোণে উঁচু একটা টুলের ওপর টেলিফোনটা রয়েছে। অদিতি উঠে সেখানে চলে যায়। বার তিনেক ডায়াল করার পর বিকাশকে ধরতে পারে সে।

বিকাশ বলে, কী ব্যাপার, দুদিন তোমার দেখা নেই। কলেজে কাল-পরশু ফোন করেছিলাম। নারী-জাগরণ-এর অফিসে রোজ যাচ্ছি। কেউ কোনো খবর দিতে পারছে না। আজ অফিসে আসার পর রমেনের ফোন পেলাম। ও বলছিল তোমাদের বাড়িতে নাকি কারা রেইড করেছিল। কী হয়েছিল? তার কণ্ঠস্বরে উৎকণ্ঠার ছাপ।

মৃগাঙ্ককে ছুরি মারার ঘটনা থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত যা যা হয়েছে সংক্ষেপে সমস্ত জানিয়ে অদিতি বলে, বুঝতেই পারছ, কেন আমাকে বাড়িতে আটকে থাকতে হয়েছিল?

হ্যাঁ। কিন্তু-

কী?

এভাবে কতদিন চলবে?

যতদিন না সমস্যাটার কোনো সমাধান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।

কিন্তু ব্যাপারটা খুব কমপ্লিকেটেড হয়ে গেল যে।

অদিতি হাসে, সহজ সরল হলে সেটা আবার সমস্যা থাকে নাকি?

অনিশ্চিতভাবে বিকাশ বলে, তা অবশ্য। একটু থেমে আবার বলে, তোমার সঙ্গে দেখা হওয়া খুব দরকার। জানো, হাউসিং বোর্ড থেকে কাল আমার, মানে আমাদের ফ্ল্যাটটার পজেশান দিয়েছে।

হঠাৎ মৃদু উত্তেজনা অনুভব করে অদিতি। চাঁপার মুখটা বিদ্যুৎচমকের মতো এক পলক তার চোখের সামনে ফুটে উঠেই মিলিয়ে যায়। বলে, এত তাড়াতাড়ি দিয়ে দিল?

বিকাশ বলে, তুমি সেদিন বলার পর হাউসিং-বোর্ডে গিয়ে খুব ধরাধরি করেছি। বলেছি, ফ্ল্যাট না পেলে বিয়েটা আটকে যাচ্ছে বলতে বলতে তার গলা তরল এবং হালকা শোনায়।

বিকাশের তারল্য বা লঘুতা অদিতির ওপর কোনো দাগ কাটে না। সে অন্যমনস্কর মতো বলে, একটা ভালো খবর দিলে।

এখন ফ্ল্যাটটা তো সাজাতে হবে। কাল একজন ইন্টেরিওর ডেকরটরের সঙ্গে কথা বলেছি। ওরা মান্থলি ইনস্টলমেন্টে সবকিছু করে দিতে চাইছে। এই চান্সটা আমাদের নেওয়া উচিত। তবে–

কী?

কীভাবে ঘর সাজানো হবে, ওয়ার্ডরোব খাট ডাইনিং টেবিল–এ-সব কীরকম ডিজাইনের হবে, কোন ঘরে কী রাখা হবে, তুমি বলে না দিলে ডেকরেটর কিছু করতে পারবে না। তোমার সঙ্গে ডেকরেটরের কথা হওয়া দরকার। বেস্ট হত, তুমি যদি এরমধ্যে সময় করে একদিন ফ্ল্যাটে আসতে, ডেকরেটরকেও তখন আসতে বলতাম। কবে আসতে পারবে?

ঠিক বলতে পারছি না। যাবার আগে তোমাকে ফোন করব।

ফোনটা একটু তাড়াতাড়িই কোরো।

আচ্ছা

আরেকটা কথা, অমিতাদি তোমার জন্যে ওরিড। তাঁকে একটা রিং কোরো। আজ তোমার ফোন না পেলে কাল উনি তোমাদের বাড়ি যাবেন।

অমিতাদি বাড়িতে এলে খুব ভালো লাগবে। অবশ্য আমি এক্ষুনি ওঁকে ফোন করছি।

রাখলাম—

ঠিক আছে।

এবার ইউনিভার্সিটিতে ফোন করে একবারই অমিতাদিকে পেয়ে যায় অদিতি।

সব শোনার পর অমিতাদি বলে, খুব বিপদ হল তো।

কণ্ঠস্বরে মনে হয় অমিতাদি খুবই উদ্বিগ্ন। অদিতি বলে, তা একটু তো হবেই। যা চলছে তার বিরুদ্ধে গেলে কেউ কি তা মেনে নিতে চায়? প্রবলেম যখন এসেছে তখন ফেস করব।

একটা কথা বলব অদিতি?

বলুন না—

তুমি চাঁপাকে ওদের বস্তিতে পাঠিয়ে দাও।

অদিতির মনে হয়েছিল, ঠিক এমনই কিছু একটা বলবেন অমিতাদি। আগেও তিনি এবং নারী-জাগরণ-এর আরও অনেকেই এ-জাতীয় পরামর্শ দিয়েছে। বাড়ির লোকেরা তো চাঁপাকে বের করে দেবার জন্য প্রথমদিন থেকেই তার ওপর প্রচণ্ড চাপ দিয়ে যাচ্ছে।

অমিতাদির কথায় উত্তেজিত হয় না অদিতি। খুব শান্ত গলায় বলে, এখন আর তা সম্ভব না। আমি যখন ওকে বস্তি থেকে নিয়েই এসেছি, শেষপর্যন্ত দেখতে চাই।

ফাইট টু ফিনিশ?

রাইট।

একটা মেয়ের জন্যে নাহয় তুমি লড়াই করলে, কিন্তু আমাদের সোসাইটিতে চাঁপার মতো হাজার হাজার মেয়ে রয়েছে। তাদের সবার জন্যে তো এই মুহূর্তে কিছু করতে পারছ না।

এই কথাগুলোও নতুন না। আগেও কয়েকজনের মুখে শুনেছে অদিতি। সে বলে, একজনকে দিয়েই শুরু করা যাক না। যদি তেমন কিছু করে উঠতে পারি, অনেকেই এগিয়ে আসবে।

একটু চুপ করে থাকার পর অমিতাদি বলেন, তুমি নারী-জাগরণ-এর অফিসে আসতে পারবে?

অদিতি বলে, যত তাড়াতাড়ি পারি। বস্তির সেই সাভের কাজটা সবে আরম্ভ করেছিলাম। চাঁপার একটা ব্যবস্থা হয়ে গেলে ওটা আবার নতুন করে স্টার্ট করতে হবে।

কিন্তু এখানে নগেন থাকে-অমিতাদির গলা শুনে মনে হয় তিনি বেশ চিন্তান্বিত।

থাক না। ক্রিমিনালরা বেসিক্যালি কাওয়ার্ড হয়। ভয় পেয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিলে পৃথিবীতে কোনো কাজই করা সম্ভব না।

ঠিক আছে, তুমি এলে এ নিয়ে কথা হবে। আমাদের মেম্বাররা তোমার জন্যে ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছে।

ফোন নামিয়ে আর দেরি করে না অদিতি। ব্যাগ এবং ছেলেমেয়েদের অ্যানসার পেপারের একটা বান্ডিল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।

.

১০.

বাড়ির কাছে এসে গেটের পাশে চাঁপাকে বসে থাকতে দেখে থমকে যায়। ভয়ে এবং আশঙ্কায় সিঁটিয়ে আছে মেয়েটা।

কী হতে পারে চাঁপার? কেন সে রাস্তায় বসে আছে? তবে কি তাকে নিয়ে বাড়িতে নতুন করে কোনো ব্যাট হয়েছে? ঝাঁক বেঁধে এইসব প্রশ্ন অদিতিকে বিচলিত এবং উদ্বিগ্ন করে তোলে।

প্রায়ই দৌড়েই সে চাঁপার কাছে চলে আসে। বলে, তুমি এখানে।

চাপা উত্তর দেয় না। তার ঠোঁটদুটো শুধু কাঁপতে থাকে এবং চোখ জল ভরে যায়।

চাঁপাকে হাত ধরে টেনে তোলে অদিতি। প্রবল উৎকণ্ঠায় জিগ্যেস করে, কী হয়েছে?

চাঁপা এবারও কিছু বলে না, মুখ নীচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।

অদিতি আবার বলে, কী হল, কথা বলছ না কেন?

ভাঙা ভাঙা ঝাপসা গলায় এবার চাঁপা বলে, বড়দা, বাবা আর বউদিরা আমাকে বার করে দিয়েছে।

অদিতি চমকে ওঠে, কখন?

আপনি কলেজে যাবার পর।

তারপর থেকে এখানে বসে আছ?

হ্যাঁ।

অদিতি দ্রুত বাঁ-হাতের কবজি উলটে ঘড়িটা দেখে নেয়। তিনটে বেজে কুড়ি। সে বেরিয়েছে দশটায়। তার মানে পাঁচ ঘণ্টা কুড়ি মিনিট মেয়েটা রাস্তায় বসে তার জন্য অপেক্ষা করছে।

অদিতি জিগ্যেস করে, আমি বেরুবার পর কোনো গোলমাল হয়েছিল কি?

না।

তা হলে তোমাকে বের করে দিল যে?

জানি না। হঠাৎ ওনারা এসে দরজা খুলতে বলল। আমি ভয়ে ভয়ে খুলে দিলাম। ওনারা বলল, এই মুহূর্তে দূর হয়ে যাও। নইলে পুলিশ ডাকব। পুলিশের নামে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। তবু বললাম, ছোটদি আমাকে এখানে থাকতে বলেছে। শুনে ওনারা রেগে গিয়ে এত গালাগাল দিতে শুরু করলে যে থাকতে সাহস হল না। অবশ্যি

কী?

পাশের ঘর থেকে পিসিমা সমানে বলে যাচ্ছিল আমাকে যেন তাড়িয়ে না দেয়। কিন্তু তেনার বিছানা ছেড়ে নামার ক্ষ্যামতা নেই। এদিকে বস্তিতে যে ফিরে যাব, সে রাস্তাও বন্ধ।

শুনতে-শুনতে মুখ শক্ত ওঠে অদিতির। পঙ্গু শয্যাশয়ী পিসিমা ছাড়া বাড়ির প্রতিটি মানুষ চাঁপার বিরুদ্ধে। তার জন্য বিন্দুমাত্র সহানুভূতি কারও নেই। এদিকে সারাক্ষণ তাকে পাহারা দিয়ে বাড়িতে বসে থাকার মতো পর্যাপ্ত সময় অদিতির নেই। তার কলেজ আছে, নারী-জাগরণ আছে, বাইরে হাজার রকম কাজ আছে। তাকে বেরুতেই হবে। যদি জোর করে চাঁপাকে আবার বাড়িতে নিয়েও যায়, সে যখন বাইরে বেরুবে, বাবা দাদা এবং বউদিরা নিশ্চয়ই ফের তাড়িয়ে দেবে। তাতে তিক্ততা আর অশান্তিই শুধু বাড়বে।

রাস্তায় দাঁড়িয়েই কিছুক্ষণ ভেবে ভবিষ্যৎ কার্যসূচি ঠিক করে নেয় অদিতি। কেন না সে জানে, বিকেল চারটে পর্যন্ত আজ অফিসে থাকবে বিকাশ। তার আগেই তাকে ফোন করা অত্যন্ত জরুরি। তাছাড়া বাড়ির লোকেদের সঙ্গে তার বোঝাঁপড়া আছে। যাকে বাড়িতে এনে আশ্রয় দিয়েছে তাকে সবাই মিলে তাড়িয়ে দেবে, এটা সে কিছুতেই মেনে নেবে না। অন্তত একটা জোরালো প্রতিবাদ করতেই হবে।

অদিতি বলে, তুমি এখানেই দাঁড়াও। আমি আসছি।

চাঁপা ভীরু গলায় বলে, দিদি একটা কথা বলব?

বলো

আমার জন্যে বাড়িতে গিয়ে রাগারাগি করবেন না।

চাঁপার মনোভাব বুঝতে অসুবিধে হয় না। ইদানীং এ বাড়িতে যেসব অশান্তি এবং দুর্ঘটনা ঘটেছে তার কারণ সে। এজন্য মেয়েটা লজ্জায় সঙ্কোচে একেবারে কুকড়ে আছে।

অদিতি বলে, ঠিক আছে, এ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। বলে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ে। তারপর পেছন দিক দিয়ে পাশের বাড়ি চলে যায়। প্রথমে বিকাশকে ফোন করা দরকার।

এক ঘন্টা আগে যার সঙ্গে কথা হয়েছে, এত অল্প সময়ের মধ্যে আবার তার ফোন পেয়ে বেশ অবাকই হয়ে যায় বিকাশ। বলে, কী ব্যাপার!

অদিতি বলে, চারটের সময় তুমি তো বেরিয়ে যাবে?

হ্যাঁ। আমাদের বাড়িতে আমার যে অংশটা রয়েছে সেটা দাদাকে বিক্রি করে দিচ্ছি। ওই ব্যাপারে আমাদের ল-ইয়ার এগ্রিমেন্ট ড্রাফট করে রেখেছেন। সেটা দেখতে যাব।

মুশকিল হল। আজ ল-ইয়ারের কাছে না গিয়ে যদি কাল যাও, খুব অসুবিধে হবে?

কেন?

তোমার সঙ্গে আজ আমার দেখা হওয়াটা ভীষণ জরুরি।

হঠাৎ কী হল? কিছুক্ষণ আগে যখন কথা বললাম তখন তো এত আর্জেন্সির কথা জানাওনি।

অদিতি বলে, হঠাৎ নতুন একটা ডেভলাপমেন্ট হয়েছে।

কী ডেভলাপমেন্ট? বিকাশের কণ্ঠস্বরে একই সঙ্গে উৎকণ্ঠা এবং আগ্রহ।

ফোনে বলা যাবে না। দেখা হলে শুনো।

ঠিক আছে, ল-ইয়ারকে ফোন করে দিচ্ছি, কালই যাব। এখন বলল, আমাকে কী করতে হবে?

তুমি অফিস থেকে সোজা গলফ গ্রিনের নতুন ফ্ল্যাটে চলে যাও। আমি ঘণ্টাখানেকের ভেতর ওখানে পৌঁছে যাব।

আচ্ছা।

ফোন নামিয়ে অদিতি নিজেদের বাড়িতে আসে। বাবা মা বড়দা এবং দুই বউদি দোতলাতেই ছিল।

অদিতি তীব্র গলায় বলে, এ-বাড়িতে আমার কি সামান্য অধিকারও নেই?

বরুণের চোখ কুঁচকে যায়। সে বলে, তার মানে?

আমি একটা অসহায় মেয়েকে আমার ঘরে এনে রাখলাম, আর তোমরা তাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলে?

আমাদের ফ্যামিলির সিকিউরিটি নষ্ট হয়, এ হতে দেওয়া যায় না।

অদিতির মাথার ভেতর কোথায় যেন বারুদের স্তূপে আগুন ধরে যায়। সে বলে, আর তোমরা ফ্যামিলির জন্যে কী করতে যাচ্ছ? একটা বজ্জাত ডিবচের কাছে আমাকে বেচতে যাচ্ছিলে? আমার ধারণা টাকার জন্যে ওই লোকটা এ বাড়ির সবাইকে পথে বসাবে। আর তার জন্যে তোমরা দায়ী।

রমাপ্রসাদ গলা চড়িয়ে বলেন, এভাবে তুমি কথা বলবে না বুবু। বড়দের সম্মান দিতে শেখো–

বড়দের উচিত এমন দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যাতে ছোটরা সম্মান করতে বাধ্য হয়। সে যাক, একটা পরিষ্কার কথা জানতে চাই, তোমরা চাঁপাকে এখানে থাকতে দেবে কিনা–

না, কিছুতেই না। আমাদের নিজেদেরই যথেষ্ট প্রবলেম আছে। চাঁপা থাকা মানেই নিত্যনতুন ঝামেলা।

ঠিক আছে, তাহলে আমাকেই এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়।

হেমলতা ওধার থেকে চেঁচিয়ে ওঠেন, কী বলছিস বুবু? তোর কি মাথাটা খারাপ হয়ে গেল?

রমাপ্রসাদ বলেন, একটা উটকো মেয়ের জন্যে কেন এত জেদ ধরে আছিস?

অদিতি বলে, বাবা, শুধু চাঁপার জন্যেই না, আমার নিজের জন্যেই আমাকে এ বাড়ি ছাড়তে হবে। আমার অজান্তে যেদিন তোমরা আমাকে একটা বদমাসের হাতে তুলে দেবার ষড়যন্ত্র করেছিলে সেদিনই ভেবেছিলাম এই পরিবেশে থাকা ঠিক না। চাঁপা আসার পর তোমরা যা করলে তাতে ডিসিশানটা নিতেই হল।

হেমলতা উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে এসে অদিতির দুই হাত ধরে বলেন, কোথাকার কে একটা মেয়ে, তার জন্যে বাপ-মা, বাড়ি-ঘর ছেড়ে চলে যাবি বুবু? বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন।

মায়ের কষ্টটা খুবই আন্তরিক। নরম গলায় অদিতি বলে, চাঁপার জন্যে না, আমার নিজের জন্যে বাড়ি ছাড়ছি মা।

অদিতিকে হেমলতার মতো কে আর বেশি চেনে। যেমন জেদি তেমনি একগুঁয়ে। সিদ্ধান্ত যা সে নিয়েছে সেখান থেকে তাকে ফেরানো যাবে না।

হেমলতা ব্যাকুল হয়ে বলেন, কোথায় যাবি তুই?

এই মুহূর্তে বাড়ির আবহাওয়া যেরকম তাতে বিকাশের নাম বললে মারাত্মক কিছু ঘটে যাবে। অদিতি বলে, পরে জানাব।

এরপর রমাপ্রসাদ, বন্দনা, এমনকী মীরা আর বরুণও অদিতিকে আটকাবার চেষ্টা করে। তারা বলে, এভাবে বাড়ি ছেড়ে যাওয়া ভালো দেখায় না, লোকের কাছে মুখ দেখাবার উপায় থাকবে না, ইত্যাদি। কিন্তু অদিতি অনড় থাকে। সে বলে, কাল-পরশু এসে আমার জিনিসপত্র নিয়ে যাব।

হেমলতা বলেন, তুই কি এ-বাড়ির সঙ্গে সব সম্পর্ক শেষ করে দিলি বুবু?

কে বললে শেষ করে দিলাম? দু-চারদিন পর পর এসে তোমাদের সঙ্গে দেখা করে যাব। বলে আর দাঁড়ায় না অদিতি। সোজা তেতলায় গিয়ে একটা সুটকেসে কিছু জামা-কাপড়, ব্রাশ পেস্ট, এমনি টুকিটাকি দরকারি জিনিস পুরে মৃণালিনীর সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে পড়ে।

গলফ গ্রিনের ফ্ল্যাটে আগে আর আসেনি অদিতি। তবে বিকাশের কাছ থেকে ঠিকানাটা জেনে নিয়েছিল। চাঁপাকে সঙ্গে করে খুঁজে খুঁজে ফ্ল্যাটটা যখন সে বের করল, কলকাতা মেট্রোপলিসের ওপর সন্ধে নামতে তখন আর বেশি দেরি নেই।

এখনও কলিংবেল লাগানো হয়নি। কড়া নাড়তেই দরজা খুলে মুখোমুখি দাঁড়ায় বিকাশ। অদিতিরা পৌঁছুবার আগেই সে এখানে এসে বসে আছে। দারুণ খুশিতে তার চোখমুখ ঝকমক করছে। অদিতির জন্য অসীম ধৈর্য নিয়ে চার-পাঁচটা বছর সে অপেক্ষা করেছে। এত দিনে কাম্য নারীটি নিজের থেকেই তার কাছে ধরা দিল।

হেসে হেসে বিকাশ বলে, এসো এসো। বলতে বলতেই অদিতির পেছনে চাঁপাকে দেখতে পায়। সঙ্গে সঙ্গে এক ফুয়ে আলো নিভিয়ে দেবার মতো তার মুখ কালো হয়ে যায়। নিরুচ্ছাস গলায় এবার বলে, এ কি, চাঁপাকেও নিয়ে এসেছ!

চাঁপা সে এখানে কতটা অবাঞ্ছিত, মুহূর্তে টের পেয়ে যায় আদিতি। সে যেখানে ছিল সেখানে দাঁড়িয়েই বলে, ওর জন্যেই আজ বাড়ি ছেড়ে চলে এলাম। এখন বলো ভেতরে ঢুকব কি ঢুকব না?

বিকাশ লজ্জা পেয়ে যায়। শশব্যস্তে অদিতির হাত থেকে সুটকেসটা নিয়ে বলে, কী আশ্চর্য, এসো। প্লিজ

ভেতরে যেতেই অদিতি দেখতে পায় বসবার ঘরে খানতিনেক চেয়ার পাতা রয়েছে। এগুলোও সে আশা করেনি। চেয়ার দেখিয়ে জিগ্যেস করে, পেলে কোথায়?

তুমি আসবে বলে পাশের ফ্ল্যাট থেকে চেয়ে এনেছি। কিন্তু

বলো–

তুমি তো বললে বাড়ি থেকে একেবারে চলে এসেছ। এখানে খাট, বিছানা রান্নাবান্নার ব্যবস্থা কিছুই নেই।

ওসব কোনো প্রবলেম না।

একটু ভেবে বিকাশ বলে, হঠাৎ এভাবে চলে এলে। আমি কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না।

উত্তর না দিয়ে অদিতি চাঁপাকে অন্য একটা ঘরে রেখে ফিরে আসে। বলে, এত হেস্টি ডিসিশান নিতে অবাক হয়ে গেছ-না?

তা তো হয়েছিই।

এবার সব ঘটনা জানিয়ে অদিতি জিগ্যেস করে, এ ছাড়া আমি আর কী করতে পারতাম বলো?

খানিকটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে বিকাশ। অদিতির একখানা হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে গাঢ় গলায় বলে, তুমি তো জানো এই দিনটার জন্যে কতদিন ধরে অপেক্ষা করে আছি। কিন্তু ওই চাঁপাও আমাদের লাইফে অনেক সমস্যা নিয়ে আসবে। অকারণে অশান্তি, টেনশান, থানা-পুলিশ! ওর হাজব্যান্ড লোকটা একটা জঘন্য ক্রিমিনাল

আমার জন্যে ওকে মেনে নাও। প্লিজ বিকাশ–অদিতি বিকাশের মুখের দিকে স্থির চোখে তাকায়।

দ্বিধান্বিতভাবে বিকাশ বলে, ঠিক আছে।

বিকাশ রাজি হয়েছে বটে, তবু অদিতির মনে হয় সবটাই বোধহয় ঠিক নেই। কোথায় যেন অদৃশ্য একটা কাঁটা থেকেই যাচ্ছে। অবশ্য বিকাশের দিকটাও ভেবে দেখা দরকার! নারী সচেতনতা, নারীর মর্যাদা রক্ষা–এইসব জরুরি ব্যাপার তো আছেই। কিন্তু যে নতুন বিয়ে করবে সে কখনোই চাইবে না স্ত্রীর সঙ্গে একটি বিপজ্জনক এবং স্থায়ী সমস্যা এসে হাজির হোক।

বিকাশ এবার বলে, চলো, ফ্ল্যাটটা তোমাকে দেখাই। তারপর খাওয়া এবং ঘুমের ব্যবস্থা করা যাবে।

মোট তিনটে বেড রুম, একটা বড় হল, দুটো বাথরুম, কিচেন, ব্যালকনি, দেওয়ালে এবং সিলিংয়ে টাটকা পেইন্টের গন্ধ, মোজেক-করা ঝকঝকে ফ্লোর-সব মিলিয়ে ফ্ল্যাটটা চমৎকার।

দেখা হয়ে গেলে বিকাশ জিগ্যেস করল, কি, পছন্দ হয়েছে?

অদিতি ঘাড় হেলিয়ে দেয়, হ্যাঁ।

এবার বাজারে যাওয়া যাক। একটা কথা ভাবছি—

বলো

যতদিন না খাট-টাট কেনা হচ্ছে ডেকরেটরদের কাছ থেকে বালিশ তোষক মশারি-টশারি ভাড়া করে আনলে কেমন হয়?

আমিও ঠিক সেই কথাই ভেবেছি।

চাঁপাকে ফ্ল্যাটে রেখে অদিতি এবং বিকাশ বাজারে চলে যায়। ডেকরেটরকে বিছানা-টিছানা পাঠাতে বলে কিছু স্টেনলেস স্টিলের বাসন এবং কাপ-প্লেট কেনে। তাছাড়া কেরোসিন স্টোভ, দশ লিটার কেরোসিন, চাল, ডাল, চিনি, জেলি, মাখন, চা, দুধের টিন, কিছু আনাজ, মশলা, বাদাম তেল ইত্যাদি কিনে ফিরে আসে।

আপাতত জোড়াতালি দেওয়া অস্থায়ী সংসার পাতা যাক। পরে ধীরেসুস্থে সব গুছিয়ে নেওয়া যাবে।

ফিরেই স্টোভ ধরিয়ে চা করতে বসে যায় অদিতি। সেই কখন নাকেমুখে গুঁজে কলেজে ছুটেছিল। বাড়ি ফেরার পর ক্রমাগত এমন সব নাটকীয় ঘটনা ঘটে গেছে নিঃশ্বাস ফেলার সময় পাওয়া যায়নি।

এতক্ষণে দম বন্ধ করা নাটকের পর টান-টান স্নায়ুগুলো এখন আলগা হয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে এক কাপ চা না পেলে মাথা ছিঁড়ে পড়ছে। তা ছাড়া খিদেও পেয়েছে প্রচণ্ড।

ক্ষিপ্র হাতে তিনজনের মতো চা এবং টোস্ট করে নেয় অদিতি। তার আর বিকাশের চায়ের কাপ-টাপ নিয়ে সে চলে আসে বাইরের ঘরে। চাঁপা কিচেনে বসেই খাবে।

চায়ে একটা চুমুক দিয়ে হেসে ফেলে বিকাশ। বলে, এমন ড্রামাটিকালি কেউ সংসার শুরু করেছে কিনা, আমার অন্তত জানা নেই।

হালকা শব্দ করে অদিতিও হাসে, না।

এলোমেলো কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর বিকাশ বলে, তুমি এসেছ, মোস্ট ওয়েলকাম। কিন্তু একসঙ্গে জীবন শুরু করার আগে একটা খুব ইম্পর্টান্ট ফরমাল ব্যাপার রয়েছে। সেটা সেরে নেওয়া দরকার।

বিয়ের কথা বলছ?

হ্যাঁ। মানে সামাজিক রেকগনিশনের কথাটাও তো ভাবতে হয়।

অদিতি হাসে, লোকনিন্দার ভয় তোমার তাহলে আছে।

বিকাশ বিব্রতভাবে বলে, মানুষের মধ্যে থাকতে হলে কিছু কিছু প্রথা তো মানতেই হয়, যখন বিয়ের সাবস্টিটিউট আমরা ভেবে উঠতে পারিনি এখনও। তোমার সিঁথিতে সিঁদুর-চিঁদুর না দেখলে চারপাশের লোক আজেবাজে কমেন্ট করবে

তোমার কি ধারণা, বিয়ের পর আমি সিঁদুর পরব? ওটা বুঝি সাধু স্ত্রীর সার্টিফিকেট?

তা বলছি না। ওটা বহুকালের সিস্টেম। তাহলে ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের কাছে নোটিশ দিই?

ওসব পরে ভাবা যাবে। সিঁদুর, রেজিস্ট্রি ম্যারেজ, এ নিয়ে এখন মাথা খারাপ করার দরকার নেই। সারাদিন চাঁপা আর আমার ওপর দিয়ে যা গেছে তাতে আমাদের রেস্ট দরকার।

বিকাশ সংকোচ বোধ করে। বলে, সরি! একটু থেমে আবার শুরু করে, একটা কথা ভেবে দেখলাম।

বলো।

যতদিন না আমাদের বিয়েটা হচ্ছে, আমি ভবানীপুরের বাড়িতে থেকে যাব। তোমরা এখানে থাকবে।

তুমিও এখানে থাকলে, আমার আপত্তি নেই। অবশ্য যদি বাড়িতে থাকাটা খুব জরুরি হয় তাহলে আলাদা কথা।

খানিকটা চুপচাপ।

তারপর অদিতি ফের বলে, তুমি নিশ্চয়ই আমার বদনামের কথা ভাবছ—

বিকাশ অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বলে, হ্যাঁ, মানে

ওসব আমি গ্রাহ্য করি না। তোমার আর আমার মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা বড় ব্যাপার। বিয়েটা তো হাতেই রইল। এক সময় ওটা করে ফেললেই হবে। তার চেয়ে এখন বড় ব্যাপার হল, চাঁপার জন্যে এমন কিছু করে দেওয়া যাতে অন্যের ওপর নির্ভর না করে, নিজের সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে।

হুঁ। অনিশ্চিতভাবে মাথা নাড়ে বিকাশ।

.

১১.

দেখতে দেখতে দশটা দিন কেটে যায়।

গলফ গ্রিনে আসার পরদিন সকালেই অদিতি লালবাজারে সৈকতকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল, সে এখন থেকে এখানেই থাকবে। যদি জরুরি কোনো খবর থাকে তার কলেজে যেন ফোন করে সৈকত। নইলে গলফ গ্রিনে লোক পাঠিয়ে যোগাযোগ করতে হবে।

সৈকত সেদিন একটা দরকারি খবর দেয়। নগেনকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। তবে তাকে বেশিদিন আটকে রাখা যাবে না। কেন না লোকটার পেছনে একজন পাওয়ারফুল রাজনৈতিক দাদা রয়েছেন। নগেন তাঁর জন্যে জান দিয়ে ইলেকশানের সময় খাটে। কাজেই দাদাটি তার প্রভাব খাঁটিয়ে যেন-তেন প্রকারে নগেনকে পুলিশের কবজা থেকে বের করে আনবেনই। তবে অদিতি বা চাঁপার ভয় নেই। সে যাতে বড় রকমের গোলমাল বাধাতে না পারে, ব্যক্তিগতভাবে সেদিকে নজর রাখবে সৈকত।

তাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে অদিতি ভেবেছে, লালবাজারে তার জানাশোনা না থাকলে নগেন যে তাকে অতিষ্ঠ করে তুলত, সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই।

এই দশ দিনে নানা ঘটনা ঘটে গেছে।

এর মধ্যে একদিন বালিগঞ্জে নিজস্ব জিনিসপত্র আনতে গিয়েছিল অদিতি। হেমলতা সেদিন তার দুই হাত নিজের বুকের ভেতর টেনে নিয়ে ব্যাকুলভাবে বলেছিলেন, তুই কোথায় আছিস বুবু-আমাকে বলতেই হবে।

মায়ের কষ্ট, দুর্ভাবনা এবং ব্যাকুলতা যে কতটা আন্তরিক তা বুঝতে অসুবিধে হয়নি অদিতির। সে বলেছে, তোমাকেই তো বলব মা, কিন্তু পরে। গাঢ় গভীর আবেগে তার গলা বুজে এসেছিল।

পরে না, এখনই বল।

একটু ভেবে অদিতি মুখ নামিয়ে বলেছে, গলফ গ্রিনে, বিকাশের ফ্লাটে।

হেমতলা স্থির চোখে অদিতিকে লক্ষ করতে করতে বলেছেন, তোদের বিয়ে হয়ে গেছে?

না মা।

বিয়েটা যত তাড়াতাড়ি পারো, করে ফেলো।

যে কথাগুলো বিকাশকে অসংকোচে বলতে পেরেছিল অদিতি, মা-কে তা বলা যায়নি। সে বলেছে, এত তাড়া কী মা?

হেমলতা বলেছেন, লোকসমাজে বাস করতে হলে ওটা দরকার বুবু। মানুষকে বাদ দিয়ে তো কেউ বাঁচতে পারে না। তাদের পছন্দ-অপছন্দ আর মতামতকে উপেক্ষা করলে কি চলে? বিয়েটা কিন্তু করে ফেলবে?

চিরকালের দুর্বল শঙ্কিত মায়ের ভেতর থেকে অন্য এক মা বেরিয়ে এসেছিল যেন। তাঁর আচরণে কথাবার্তায় এতটুকু ভীরুতা নেই। যা রয়েছে তা হলে কর্তৃত্ব এবং দৃঢ়তা। অদিতি বলে, ঠিক আছে। তোমাকে একদিন গলফ গ্রিনে নিয়ে যাবে।

আগে তোদের বিয়ে হোক, তার আগে নয়।

রমাপ্রসাদ বরুণ মীরা এবং বন্দনার সঙ্গে দেখাও হয়েছিল। তারা কেউ অদিতির সঙ্গে একটি কথাও বলেনি। শুধু প্রবল আক্রোশে তীব্র দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থেকেছে।

হাসপাতাল থেকে মৃগাঙ্ককে রিলিজ করে দেওয়া হয়েছিল। অদিতি তার ঘরে গিয়ে জিগ্যেস করেছিল, এখন কেমন আছ ছোটদা?

মৃগাঙ্ক খাটে শুয়ে ছিল। উত্তর না দিয়ে দেয়ালের দিকে পাশ ফিরেছে। আর মীরা কর্কশ গলায় বলেছে, যথেষ্ট হয়েছে আর আহ্লাদের দরকার নেই।

হেমলতাকে বাদ দিলে আর যিনি সেদিন সস্নেহ এবং স্বাভাবিক ব্যবহার করেছেনে তিনি মৃণালিনী।

মৃণালিনী কাছে বসিয়ে পিঠে এবং মাথায় হাত বুলাতে বুলোতে অদিতি কোথায় আছে, সেখানে আর কে কে থাকে ইত্যাদি নানা খবর খুঁটিয়ে জেনে নিয়েছিলেন। তারপর জিগ্যেস করেছিলেন, হা-রে, বিকাশ ছেলেটা কেমন?

অদিতি বলেছে, এখন পর্যন্ত ভালোই মনে হচ্ছে।

বিয়ে হয়ে গেছে তোদের?

না।

সব দিক বুঝে বিয়ে করবি। পরে যেন আপসোস না করতে হয়।

মৃণালিনীর জীবন সম্পর্কে ধ্যানধারণা এবং দৃষ্টিভঙ্গি অন্য মেয়েদের থেকে একেবারে আলাদা। বিয়ের পর প্রচণ্ড ধাক্কায় তিনি আমূল বদলে গেছেন। যে সমাজে পুরুষের অবাধ প্রভুত্ব সেটা তিনি ঘৃণার চোখে দেখে থাকেন। পৃথিবীর কোনো পুরুষকেই তিনি শতকরা একশো ভাগ বিশ্বাস করেন না।

অদিতি হেসে বলেছে, মা তো এক্ষুনি বিয়েটা সেরে ফেলার জন্যে চাপ দিচ্ছে। নইলে নাকি ভীষণ দুর্নাম রটে যাবে।

মৃণালিনীকে এবার অসহিষ্ণু দেখিয়েছে। তিনি বলেছেন, না না, বউদির কথা মোটেও শুনবি না। আমাদের সময় মেয়েদের সুনাম আর সতীত্বের দাম ছিল। ও দুটোর জোরেই তাদের বিয়ের বাজারে বিকোতে হত। কিন্তু তুই একালের মেয়ে, সুন্দরী, সবচেয়ে বড় কথা চাকরি-বাকরি করিস। তোকে বিয়ে করার জন্যে কত ছেলে হাঁ করে আছে। কিছুদিন মেলামেশা করে দ্যাখ, বিকাশ ছেলেটা কেমন। যদি মনে হয় খাঁটি, বিয়ে করবি। নইলে কোনোমতেই না।

তুমি একজন রিবেল পিসি।

তাতে আমার কোনো সংকোচের কারণ নেই। জানবি ওটাই আমার আসল পরিচয়। যাক-গে, বাড়ির অন্যসব খবর বলো। সেই লোকটা মানে সিতাংশু ভৌমিক এখনও আসে?

রোজ। তবে আগের মতো হই-চই আর হয় না। মনে হয়, কিছু একটা মতলব ওরা করছে। ঠিক বুঝতে পারছি না। দুর্গাকে অবশ্য লাগিয়ে রেখেছি, ঠিক জেনে যাব।

একটু চিন্তা করে অদিতি এবার বলে, আমি চলে যাবার পর সবাই তোমার সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করছে?

মৃণালিনী হাসেন, আগের চেয়ে খারাপ কিছু না। তোর মাকে বাদ দিলে সকলেই আমার মৃত্যু চায় কিন্তু অত সহজে আমি মরছি না।

অদিতি বলে, আমি ঠিকানা লিখে কটা পোস্টকার্ড নিয়ে এসেছি। তেমন দরকার হলে চিঠি লিখে দুর্গাকে দিয়ে পোস্ট করিয়ে দিও।

আচ্ছা। একদিন তোদের ফ্ল্যাটে আমাকে নিয়ে যাস।

নিশ্চয়ই।

এরমধ্যে নিয়মিত কলেজে গেছে অদিতি। রোজ চারটে কি পাঁচটা করে ক্লাস নিয়েছে। কলেজ থেকে গেছে নারী-জাগরণ-এর অফিসে। সেখান থেকে বিকাশ কৃষ্ণা হৈমন্তী বা রমেনকে সঙ্গে করে ঢাকুরিয়ার বস্তিতে গেছে।

প্রথমদিকে অমিতাদিরা বাধা দিতে চেয়েছিলেন। তাঁদের ভয়, বস্তিতে অদিতি ফের গেলে গোলমাল হবে কিন্তু তাকে আটকানো যায়নি। যে কাজের দায়িত্ব সে নিয়েছে একটা ক্রিমিনালের ভয়ে তা মাঝপথে ছেড়ে দেওয়ার মানে হয় না।

এদিকে সৈকত যা বলেছিল তা-ই ঘটেছে। অ্যারেস্ট করার পর নগেনকে ধরে রাখা যায়নি। রাজনৈতিক দাদাটি তাকে পুলিশের হাত থেকে ছাড়িয়ে এনেছেন। তবে আগের মতো অতটা মারমুখী উগ্র নেই নগেন। দূর থেকে অদিতির উদ্দেশে রোজই কিছু খিস্তিখেউড় দিয়ে এবং অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে সে অদৃশ্য হয়ে যায়।

নারী-জাগরণ-এর কাজের সঙ্গে সঙ্গে চাঁপার জন্য একটা কাজের চেষ্টা চলছে। অমিতাদি থেকে শুরু করে প্রতিটি মেম্বারই এ ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছে।

এর মধ্যে চমকপ্রদ যে ব্যাপারটা ঘটেছে তা এইরকম। প্রথম যেদিন অদিতি গলফ গ্রিনে আসে, সেই রাতটা ফ্ল্যাটে থাকেনি বিকাশ। ভবানীপুরে তাদের বাড়িতে চলে গিয়েছিল। কিন্তু পরের দিন অফিস থেকে সোজা নারী-জাগরণ হয়ে গলফ গ্রিনে চলে আসে। তারপর থেকে এখানেই আছে।

অদিতি বিকাশ এবং চাঁপা আপাতত তিনজন রাতে তিনটে বেডরুমে থাকে।

এখানে আসার দিন পাঁচেক বাদে হঠাৎ একদিন দরজায় খুট খুট আওয়াজে দরজা খুলে সে অবাক। বিকাশ দাঁড়িয়ে আছে।

অদিতি বলেছে, তুমি!

বিকাশ বলেছে, আমার ঘরে চলো।

বিকাশের আচ্ছন্ন চোখ, চাপা অথচ তীব্র কণ্ঠস্বর বুঝিয়ে দিয়েছে সে কী চায়। অদিতি শান্ত মুখে বলেছে, না।

তুমি তো কোনোরকম বাজে সংস্কার মানো না। বিকাশ আরেকটু এগিয়ে এসেছিল।

তা হয়তো মানি না, কিন্তু তুমি যা চাইছ মানসিক দিক থেকে আমি তার জন্যে এখনও প্রস্তুত হতে পারিনি।

আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিল বিকাশ। তারপর ঝুঁকে দুহাতে অদিতির মুখ তুলে ধরে গভীর আবেগে চুমু খায়। অদিতি বাধা দেয় না।

.

১২.

আরও কয়েক মাস কেটে যায়।

এর মধ্যে ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিসে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিকাশকে বিয়ে করেছে অদিতি। বলা যায় করতে হয়েছে। এই বিয়েটার জন্য প্রথম থেকেই মা প্রবল চাপ দিয়ে গেছেন। যখনই অদিতি বালিগঞ্জের বাড়িতে সবার খোঁজখবর নিতে গেছে হেমতলার এক কথা, এবার বিয়েটা করে ফ্যাল বুবু, আর দেরি করিস না। লোকে আজেবাজে কথা বলছে।

বিয়ে বিয়ে করে মা প্রচুর কান্নাকাটি করেছেন, রাগারাগি করেছেন, জেদ ধরেছেন। তিনি পুরোনো ধ্যানধারণার মানুষ, সংস্কার এবং চিরাচরিত প্রথা ভাঙার কথা চিন্তাও করতে পারেন না। একটি পুরুষ এবং একটি নারী বিয়ে না-করে সমাজে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বাস করবে, তাঁর কাছে এটা অভাবনীয়। তিনি মনে করেন এ ধরনের সম্পর্ক সম্পূর্ণ অবৈধ এবং অপবিত্র। তাঁর স্থির বিশ্বাস, বিয়ে না করে, একসঙ্গে থেকে অদিতিরা পাপ করেছে।

হেমতলা যে ভয়ানক কষ্ট পাচ্ছিলেন, অদিতির বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না। বিয়েটা সে নিশ্চয়ই করত, তবে আরও কিছুদিন পরে। মায়ের তাড়াতেই তাকে সব কাজ ফেলে একদিন ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিসে ছুটতে হয়েছিল।

কিন্তু বিয়ের পর দ্রুত পালটে যেতে থাকে বিকাশ। তার ভেতর থেকে এমন একটা পুরুষ বেরিয়ে আসতে থাকে যে প্রচণ্ড রক্ষণশীল, অধিকারবোধে সচেতন, স্ত্রী যার কাছে ব্যক্তিগত প্রপার্টির মতো। যে মনে করে তার পছন্দ-অপছন্দ অনুযায়ী স্ত্রী উঠবে বসবে চলবে ফিরবে। বৈধ আইনসিদ্ধ বিয়েটা যেন স্ত্রীর ওপর অবাধ প্রশ্নাতীত মালিকানা তার হাতে তুলে দিয়েছে।

এ জাতীয় পুরুষ চারদিকে আকছার দেখা যায় এবং তাদের মেনেও নেওয়া হয়। সামাজিক প্যাটার্নটাই তো এইরকম। কিন্তু বিকাশের ভেতর পুরুষশাসিত সমাজের এমন একজন মারাত্মক প্রতিনিধি যে আত্মগোপন করেছিল, আগে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি অদিতি। সে একেবারে হকচকিয়ে যায়।

বিয়ের পর থেকেই নারী-জাগরণ-এ যাতায়াত বন্ধ করে দিয়েছে বিকাশ। সে চায় না অদিতিও ওখানকার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখুক। দেশে গভর্নমেন্ট আছে। রাজনৈতিক দল, সোশাল অর্গানাইজেশন, চ্যারিটেবল সোসাইটি–এসবের অভাব নেই। তারাই লাঞ্ছিত অপমানিত মেয়েদের কথা ভাবুক, তাদের দায়দায়িত্ব নিক। বিকাশ বা অদিতির মতো দু-একজন এ ব্যাপারে মাথা না ঘামালেও চলে যাবে।

বিকাশের জীবনদর্শন খুবই পরিষ্কার, সেখানে কোনোরকম গোঁজামিল নেই। সে চায় প্রচুর টাকা, অফিসে প্রোমোশন। গলফ গ্রিনের ফ্ল্যাটের তিন গুণ একটা ফ্ল্যাট বা সল্টলেকে বাংলো ধরনের বাড়ি, ঝকঝকে গাড়ি, বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে হই-হুল্লোড়, দু-তিন বছর পর পর বিদেশ ভ্রমণ, ইত্যাদি ইত্যাদি। নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য এবং আরামের বাইরে আর কোনো কিছু নিয়ে সে ভাবতে চায় না। তবে কটা বছর অসীম ধৈর্যে নারী-জাগরণ-এ সে যে ঘোরাঘুরি করেছে তার একমাত্র কারণ অদিতি।

যাই হোক, অদিতি তার কথা শুনেছে ঠিকই কিন্তু নিজে যা করেছিল তা-ই করে গেছে। কলেজ, নারী-জাগরণ, বস্তিতে সার্ভে বা নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে স্ট্রিট কর্নার মিটিং, এইসব কর্মসূচি থেকে তাকে এতটুকু সরানো যায়নি। এই নিয়ে বাড়িতে অশান্তি এবং টেনশান শুরু হয়েছে।

চাঁপা এখনও তাদের ফ্ল্যাটে আছে। তাকে নিয়ে পুরোনো গোলমালটা থেকেই গেছে। তার উপযুক্ত কাজ আজ পর্যন্ত জোটানো যায়নি। তবে এ নিয়ে খুব একটা হই-চই করছে না বিকাশ। কেননা রান্নাবান্না থেকে শুরু করে বাড়ির যাবতীয় কাজই করে। তারা দুজন যখন বেরিয়ে যায়, সে ফ্ল্যাটে পাহারা দেয়। অবশ্য অদিতি যতক্ষণ থাকে, চাঁপাকে সাহায্য করে।

আশ্রয় এবং চারবেলা খাওয়ার বদলে যার কাছ থেকে এত কাজ পাওয়া যায়, নিজেদের স্বার্থেই তাকে তাড়ানোর কথা তেমন করে আর বলে না বিকাশ। নগেন যদি আর হামলা-টামলা না করে হয়তো চাঁপা এখানে স্থায়ীভাবেই থেকে যাবে। তবে অদিতির একেবারেই তা ইচ্ছে নয়। চাঁপাকে ঝি খাটাবার জন্য সে বস্তি থেকে নিয়ে আসেনি। সসম্মানে স্বাধীনভাবে মাথা তুলে এই সমাজে বাস করার সুযোগ সে পাক, এটা সে চায়। সেজন্য চেষ্টার ত্রুটি নেই তার।

এর মধ্যে হঠাৎ একদিন ফোন করে সৈকত জানিয়ে দিল, ট্রান্সফার হয়ে সে নর্থ-বেঙ্গল যাচ্ছে।

সৈকত চলে যাবার দিন সাতেক পর একদিন সকালে দলবলসুদ্ধ নগেন হানা দিল। অকথ্য খিস্তি এবং চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকে তারা। উদ্দেশ্য চাঁপাকে নিয়ে যাবে। বোঝ যায়, এতদিন সৈকত তাকে কন্ট্রোলে রেখেছিল। এখন সে আবার বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

কিন্তু এখনকার প্রতিবেশীরা মানুষ ভালো। তারা নগেনদের তাড়িয়ে দেয়।

নগেনরা নতুন করে ঝামেলা করায় পুরোনো অশান্তিটা আবার চাড়া দিয়ে ওঠে। বিকাশ বিরক্ত মুখে বলে, ওকে তাড়াও

অদিতি বলে, তাড়াবার জন্যে ওকে নিয়ে আসিনি।

কিন্তু ওই অ্যান্টিসোশালটা ফের ঝঞ্জাট বাঁধালে কে সামলাবে? আমাকে দিয়ে ওসব হবে না।

তোমাকে কিছু করতে হবে না। যা করার আমি করব।

.

এইভাবেই চলছিল।

হঠাৎ একদিন রাত্তিরে খেতে খেতে বিকাশ বলে, একটা খবর শুনেছ?

অদিতি মুখ তুলে তাকায়। বিকাশকে বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছে। নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বলে, কী খবর?

তোমার দাদারা আর বাবা তোমাদের বাড়িটা বেচে দিতে যাচ্ছেন।

অদিতি চমকে ওঠে, কে বললে?

বিকাশ জানায়, একটা রিয়েল এস্টেট কোম্পানির মালিকের সঙ্গে তার জানাশোনা আছে। তার কাছেই শুনেছে, রমাপ্রসাদরা নাকি তাদের কোম্পানিকে বিশ লাখ টাকার বিনিময়ে বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে।

অদিতি নিজের অজান্তেই জিগ্যেস করে, রিয়েল এস্টেট কোম্পানির মালিক কে? সিতাংশু ভৌমিক?

না। অরুণোদয় ভট্টাচার্য। সিতাংশু ভৌমিক আবার কে?

একজন কন্ট্রাক্টর। সে-ও বাড়ি-টাড়ি কেনে।

ও।

অদিতি বুঝতে পারে কাউকে না-জানিয়ে বাড়ি বেচে সিতাংশুর ধার শোধ করতে চাইছেন রমাপ্রসাদরা। সিতাংশুর কাছে বিক্রি করতে গেলে কিছুতেই এত টাকা পাওয়া যাবে না। যে টাকাটা সে জুয়া এবং ফাটকার জন্য ঋণ দিয়েছিল তার ওপর সামান্য কিছু দিয়ে বাড়িটা নির্ঘাত লিখিয়ে নেবে।

বিকাশ আবার বলে, ও বাড়িতে তোমারও তো অংশ রয়েছে।

অদিতি লক্ষ করে, বিকাশের চোখ চকচক করছে। তার স্নায়ুগুলো মুহূর্তে টান টান হয়ে যায়। সে বলে, হয়তো আছে। কেন?

তোমার ভাগের টাকাটা পেলে সল্ট লেকে জমিটমির চেষ্টা করা যাবে। তারপর ছোটখাটো বাংলো টাইপের সুন্দর একটা বাড়ি

বিকাশের কথাবার্তা, আচরণ অনেকদিন থেকেই পছন্দ হচ্ছে না অদিতির। এই মুহূর্তে ঘৃণায় তার ভেতরটা কুঁকড়ে যায়। লোকটা এত লোভী, আগে টের পাওয়া যায়নি।

অদিতি উত্তর দেয় না। তবে বাড়ি বিক্রির ব্যাপারটা তার মাথায় কাঁটার মতো বিঁধে থাকে। দু-এক দিনের ভেতর বালিগঞ্জে গিয়ে খোঁজখবর নিতে হবে।

.

যেদিন বিকাশ বাড়ি বিক্রির খবর দিল তার পরদিন দুপুরে অদিতি যখন কলেজে বেরুচ্ছে সেই সময় মৃণালিনীর চিঠি এল। লিখেছেন, চিঠি পেয়েই যেন অদিতি বালিগঞ্জে চলে যায়, তিনি খুবই বিপন্ন।

আজ কলেজের পর ঢাকুরিয়া বস্তিতে যাবার কথা আছে। কিছুদিন হল, কাজটা খুব ঢিলেঢালা চলেছে। এভাবে চললে একটা বস্তির সার্ভে শেষ করতে পাঁচ বছর লেগে যাবে। এ ব্যাপারে স্পিড় আনতেই হবে। অদিতি ঠিক করে রেখেছিল, আজ কম করে পঁচিশ-তিরিশটি মেয়ের ইন্টারভিউ নেবে। কিন্তু এই চিঠির পর কিছুই করা সম্ভব না।

কোনোরকমে কলেজে জরুরি ক্লাসগুলো নিয়ে বিকেলের দিকে বালিগঞ্জ চলে আসে। মৃণালিনী তাকে জানান, বাড়ি বিক্রির চক্রান্ত চলছে। যদি তা না করা যায়, মোটা টাকায় মর্টগেজ দেওয়া হবে। বাড়ির একটা অংশ মৃণালিনীর নামে দিয়ে গেছেন তাঁর বাবা–অদিতির ঠাকুরদা। তাঁর ওপর রীতিমতো জুলুম করা হচ্ছে যেন তিনি বিক্রি বা মর্টগেজে রাজি হন। নিরুপায় হয়েই শেষ পর্যন্ত অদিতিকে চিঠি লিখতে হয়েছে।

সব শোনার পর অদিতি ট্যাক্সি ডেকে আনে। মৃণালিনীকে সে নিজের কাছে নিয়ে যাবে।

রমাপ্রসাদরা আটকাতে চেষ্টা করেছিল, একরকম জোর করেই মৃণালিনীকে ট্যাক্সিতে নিয়ে তোলে অদিতি।

.

রাত্তিরে অফিস থেকে ফিরে মৃণালিনীকে দেখে কপাল কুঁচকে যায় বিকাশের।

কী কারণে মৃণালিনীকে নিয়ে আসতে হয়েছে জানিয়ে অদিতি বলে, বলো তো, কী অন্যায় জোর করা হচ্ছে পিসির ওপর!

বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে বিকাশ বলে, তা হলে টাকা আসবে কী করে? বাড়ি বেচলে তবে তো টাকা!

অদিতি নিশ্চুপ। স্থিরচোখে তাকিয়ে থাকে।

হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটায় বিকাশ। চিৎকার করে বলে, ভেবেছ কি–এটা ধর্মশালা, না রিফিউজি ক্যাম্প। যাকে খুশি এনে তুলছ! এসব এখানে চলবে না।

অদিতি বিন্দুমাত্র বিচলিত বা অস্থির হয় না। গম্ভীর গলায় শুধু বলে, ঠিকই বলেছ। ভেবে দেখলাম আমারও এভাবে চলবে না। দু-চারদিনের ভেতরে চাঁপা, পিসিকে নিয়ে এখান থেকে চলে যাব।

বিকাশ বলে, তোমাকে যাবার কথা তো বলিনি।

অদিতি উত্তর দেয় না।

.

দিন সাতেক পর একটা বাড়ি ভাড়া করে চাঁপা মৃণালিনীকে নিয়ে যাদবপুরে চলে যায় অদিতি। সে বুঝতে পারছে, চারপাশে তার জন্য অসংখ্য রণক্ষেত্র সাজানো হয়েছে। যুদ্ধ ছাড়া এখন আর কোনো উপায় নেই অদিতির।

Exit mobile version