Site icon BnBoi.Com

আলোর ময়ুর – প্রফুল্ল রায়

আলোর ময়ুর - প্রফুল্ল রায়

১. সারা গায়ে ভোরের শিশির

আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

০১.

সারা গায়ে ভোরের শিশির মেখে ট্রেনটা সাহেবগঞ্জ এসে গেল।

রোদ উঠতে এখনও ঘণ্টাখানেক দেরি। হিমে আর কুয়াশায় চারদিক ঝাপসা হয়ে আছে। সাঁওতাল পরগণার লম্বা পাহাড়ি রেঞ্জটা দূর দিগন্তে অস্পষ্ট আঁচড়ের মতন মনে হচ্ছে। আকাশের এ-কোণে ও-কোণে এখনও দু-চারটে জ্বলজ্বলে তারা চোখে পড়ে।

রেলের টাইম-টেবলে এই ট্রেনটার একটা জমকালো পোশাকি নাম আছে– আপার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস। আজ খুব ভিড়-টিড় ছিল না। ইঞ্জিনের কাছাকাছি একটা সেকেন্ড ক্লাস কম্পার্টমেন্টে তপতী আর সোমা গা ছড়িয়ে বেশ আরামেই আসতে পেরেছে। কামরাটা এত ফাঁকা, ইচ্ছে করলেই ওরা এক সিটে, মাথা, এক সিটে হাত, এক সিটে পা রেখে আসতে পারত।

তপতীর বয়স চব্বিশ-পঁচিশের মতন। গোলগাল আদুরে মুখ, ভরাট গলা, কণ্ঠার হাড় কোমল মাংসের তলায় ঢাকা। মসৃণ ত্বকে যেন কচি পাতার লাবণ্য। বড় বড় চোখে কাঁচের গুলির মতন উজ্জ্বল মণি। অজস্র চুল একবেণি করে বাঁধা। সারা রাত ট্রেন-জার্নির ফলে বেণিটা ভেঙে রুক্ষ্ম চুল উড়ছে; কপালের সবুজ টিপটা লেপটানো; পরনের শাড়িটা দলা মোচড়া হয়ে আছে।

সোমা তপতীর চাইতে দু-এক বছরের বড়ই হবে। মুখের গড়ন পানপাতার মতন। চোখ-নাক সব যেন কাটা-কাটা, নিখুঁত। গায়ের রঙ টকটকে; প্রতিমার মতন বিশাল চোখ। চুলগুলো খোঁপায় আটকানো। তপতীর মতন তার চোখে-মুখে চেহারায় উজ্জ্বলতা নেই। ঝকঝকে আয়নার ওপর ধুলো বালি জমলে যেমন দেখায় সোমাকে ঘিরে তেমনি এক বিষাদ মাখানো রয়েছে। চোখের তলায়, কপালে, ঘাড়ে কাঁচে শ্যাওলার মতন ছোপ। সেটা ট্রেনে রাত কাটাবার জন্য নয়। সোমার দিকে তাকালেই মনে হবে, তার ভেতরে অনবরত এক যুদ্ধ চলছে।

প্ল্যাটফর্ম থেকে টি-ভেন্ডারদের ঘুমন্ত ভারী গলা ভেসে আসছে, চা গ্রাম (গরম) চা গ্রাম কুলিরা সামনে চেঁচাচ্ছিল, সাহাবগঞ্জ-সাহাবগঞ্জ-চেঁচাতে চেঁচাতে হুড়মুড় করে কামরায় কামরায় ঢুকে পড়ছিল।

তপতী হাই তুলে আর আঙুল ফুটিয়ে ফুটিয়ে আলস্য কাটিয়ে নিল। এলোমেলো শাড়িটা ঠিক ঠাক করে মুখের ওপর থেকে উড়ন্ত চুলগুলো দুহাতে সরাতে সরাতে সোমাকে বলল, এবার আমাদের নামতে হবে। জিনিসপত্র গোছগাছ করে নে সোমা। দু-এক বছরের বড় হওয়াটাকে আমলই দেয় না তপতী; সোমাকে সে নাম ধরেই ডাকে।

সোমা উঠে পড়ল। জিনিসপত্র আর কী। দুটো হাওয়া ভর্তি বালিশ, একটা চাদর আর একটা কম্বল হোল্ডল থেকে বার করে ওরা পেতে নিয়েছিল। সময় কাটাবার জন্য দুটো সস্তা থিলারও সুটকেশ থেকে বার করা হয়েছিল।

দ্রুত চাদর-টাদর ভাঁজ করতে লাগল সোমা। তপতী বলল, অত তাড়াহুড়ো করতে হবে না; আস্তে আস্তে গোছা। এখানে দশ মিনিটের স্টপেজ। ইঞ্জিন জল-টল নেবে, তারপর ছাড়বে।

সোমা উত্তর দিল না। ভাজ-করা চাদর-কম্বল হোল্ডলে পুরে ফেলল। এদিকে হাওয়া-বালিশের হাওয়া বার করে বেতের বাস্কেটে ঢুকিয়ে ফেলেছে তপতী; বই দুটো চালান করেছে, সুটকেশের ভেতর। দুজনের আলাদা আলাদা সুটকেশ। কিন্তু হোল্ডল একটাই, বাস্কেটও তাই। ও দুটো ভাগের। সব গোছানো-টোছানো হলে তপতী বলল, আপার ইন্ডিয়া আজ দারুণ এসেছে। দশ বছর এদিকে যাতায়াত করছি। যতবার এসেছি ততবারই দুতিন ঘন্টা লেট। এই প্রথম গাড়িটা রাইট টাইমে এল।

সোমা বলল, তাই নাকি।

তপতী উৎসাহের গলায় বলতে লাগল, আর এসেছিও গ্র্যান্ড। অন্য অন্য বার ভিড়ে দম আটকে আসে; এবার হাত-পা ছড়িয়ে বসতে পেরেছি।

শুধু বসেই এসেছিস! সোম হাসল, ঘুমটা বুঝি বাদ গেল! যা নাক ডাকছিল! কতবার ঠেলেছি, ডেকেছি, তোর সাড়াই নেই।

তপতীও হেসে ফেলল, যা বলেছিল ভাই। ট্রেনে উঠলে আমার ভীষণ ঘুম পায়। তবে নাক ডাকে না।

নিজের নাক ডাকা কেউ শুনতে পায়?

তপতী বলল, আমি একাই ঘুমিয়েছি, তুই ঘুমোসনি? তুই বুঝি আমার নাক ডাকা শোনাবার জন্য জেগে বসে ছিলি?

সোমা চুপ করে রইল। তার মনে পড়ল কাল নটা দশে শিয়ালদা থেকে আপার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস ছেড়েছিল। দক্ষিণেশ্বর পেরুবার আগেই তপতী ঢুলতে শুরু করেছিল, তারপর আরো দু-এক কিলোমিটার যেতে না যেতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। সেই ঘুম ভেঙেছিল সাহেবগঞ্জ আসার খানিকটা আগে। সোমা কিন্তু ঘুমোত পারেনি। একেকটা স্টেশন এসেছে–বর্ধমান, বোলপুর, সাঁইথিয়া, তিনপাহাড়, রাজমহল, পাকুড়-সোমা শুধু জানালার বাইরে অন্ধকার আকাশের দিকে চোখ মেলে রেখেছে। মাঝে মাঝে মুখ ফিরিয়ে ঘুমন্ত তপতীকে দেখতে দেখতে এক ধরনের বিচিত্র ঈর্ষা অনুভব করেছে। তপতী কত সুখী, কত দুশ্চিন্তাহীন! আর সোমা নিজে? কমাস ধরে সে ইনসমনিয়ার রুগী। জীবনের আশ্চর্য এক জটিলতা তার ঘুম বিশ্রাম সুখ ছিনিয়ে নিয়েছে। দিনের বেলাটা তবু মানুষের ভিড়ে, নানারকম হইচই-তে কেটে যায়। কিন্তু রাত্রিবেলা কলকাতা নামে এক মহানগরের সব শব্দ সব হট্টগোল সব ব্যস্ততা যখন থিতিয়ে থিতিয়ে অতলে নামতে থাকে, পৃথিবী যখন ঘুমের আরকে ডুবে যায় সেই সময় ঘরময় হেঁটে বেড়ায় সোমা। সত্তর লক্ষ মানুষের নিদ্রিত শহরে সেই বোধ হয় একা, যার চোখে ঘুম নেই।

সোমার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করল না তপতী। বলল, এত মোট-ঘাট আমরা নামতে পারব না, দাঁড়া কুলি ডাকি। কম্পার্টমেন্টের দরজা খুলে একটা কুলী ডেকে আনল সে, বলল, সামান উঠাও–

কুলিটা জিগ্যেস করল, কিধার যায়েগী মাঈজি?

ঘাটগাড়ি।

কুলিটা সুটকেশ-টুটকেশ চটপট মাথায় তুলে এগিয়ে চলল। তার সঙ্গে যেতে যেতে পিছন ফিরে একবার কামরাটা দেখে নিল তপতী–কিছু পড়ে-টড়ে আছে কিনা। না, কিছু নেই। দু-তিনটে বেহারি ভদ্রলোক জানালার ধারে বসে দাঁতন করছেন। এক বিপুলদেহ মারোয়াড়ি আর তার স্ত্রী-কাল ট্রেনে উঠে এদের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, এখনও পাল্লা দিয়ে ঘুমোচ্ছে, জামা কাপড় আলুথালু। বিশ নম্বর কড়াইর মতন তাদের বিরাট পেট নিশ্বাসের তালে তালে ওঠা নামা করছে।

প্ল্যাটফর্মে নামতেই ঠান্ডা কনকনে হাওয়া ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে গায়ে কাঁটা দিল। তাড়াতাড়ি শাড়ি দিয়ে গলা হাত-টাত ঢেকে সোমা বলল, এখানে তো বেশ শীত রে–

তপতী মাথা নাড়াল, হ্যাঁ

আজ মার্চের আট তারিখ। এর মধ্যেই কলকাতার গরম পড়তে শুরু করেছে; ফ্যান ছাড়া রাত্তিরে ঘুমনো যায় না। অথচ কলকাতা থেকে শ দুই মাইল দূরে এই জায়গাটা প্রাণ ধরে এখনও শীতটাকে বিদায় দিতে পারেনি।

তপতী বলল, চারদিকে পাহাড়-টাহাড় আছে কিনা; তাই ঠান্ডাটাও আছে।

প্ল্যাটফর্মে টিউব লাইটগুলো জ্বলছিল; কালো কোট-পরা রেল-বাবুরা চারদিকে ছোটাছুটি করছিল। এধারে ওধারে যাত্রীদের ভিড়, কুলিদের জটলা।

গেটে টিকিট জমা দিয়ে ওরা স্টেশনের পিছন দিকে চলে এল। সেখানে লাইনের ওপর আবছা অন্ধকারে লম্বা সরীসৃপের মতন একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে ছিল। কুলিটা একটা ফাঁকা কামরায় মালপত্র তুলে দিয়ে ভাড়া নিয়ে চলে গেল।

হোল্ডল থেকে চাদর বার করে বেঞ্চের ওপর পাততে পাততে তপতী বলল, আর মোটে ঘণ্টা আটেক; তারপরেই বাড়ি পৌঁছে যাব, বুঝলি।

তপতীকে খুব হাসিখুশি আর উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। অনেকদিন পর বাড়ি ফিরতে পারলে কার না আনন্দ হয়। সোমা কিছু বলল না।

তপতী আবার বলল, এখান থেকে সগরিগলি ঘাট যাব; সেখান থেকে স্টিমারে মণিহারি ঘাট। মণিহারি ঘাট থেকে ট্রেনে কাটিহার। কাটিহার থেকে ট্যাক্সিতে পূর্ণিয়া। কবজি উল্টে ঘড়ি দেখে বলল, এখন ছটা; ঠিক দুটোয় দেখবি বাড়িতে হাজির হয়েছি।

সোমা উৎসাহ দেখাল না। নিরুৎসুক গলায় বলল, ও, তাই নাকি

তপতী নিজের খেয়ালে বলে যেতে লাগল, স্টিমারে নদী পার হওয়াটায় গ্র্যান্ড লাগবে। ট্যাক্সিতে কাটিহার থেকে পূর্ণিয়া ট্রিপটাও খুব এনজয় করবি।

আগের সুরেই সোমা বলল, বেশ তো।

সারা রাত ঘুম হয়নি। চোখ জ্বালা জ্বালা করছিল সোমার। মাথার ভেতরটা ঝিম ঝিম করছে। ঘাড়ের কাছটায় কেউ যেন হাজারটা পিন ফোঁটাচ্ছে। ক্লান্ত গলায় সোমা বলল, এখানে জল-টল পাওয়া যাবে রে? বাসি মুখটা না ধুতে পারলে বিশ্রী লাগছে।

নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। দাঁড়া আনছি। বড় বড় দুটো ওয়াটার বটল নিয়ে স্টেশনে চলে গেল তপতী; একটু পরেই ভর্তি করে ফিরে এল।

সোমা মুখ-টুখ ধুয়ে ঘাড়ে-গলায় জল দিল। সাঁওতাল পরগণার হিমেল বাতাস ছিলই। আস্তে আস্তে অসুস্থ স্নায়ু জুড়িয়ে আসতে লাগল তার।

তপতীও মুখ ধুয়ে নিয়েছিল। ধুয়েই সে আবার স্টেশনে ছুটল। এবার ডেকে আনল একটা টি-ভেন্ডারকে। ভেণ্ডারটা দুজনকে চা দিয়ে চলে গেল।

তপতী বলল, এখানকার চা যাচ্ছেতাই; গরম জলই বলতে পারিস। কী আর করবি, এ-ই খা, কাটিহার গিয়ে ভালো চা-খাওয়াব।

নিঃশব্দে ভড়ে চুমুক দিল সোমা। চা-টা যেমনই হোক; খাবার পর মাথার ঝিমঝিম ভাবটা কমে আসতে লাগল।

দেখতে দেখতে চারদিক ফর্সা হয়ে গেল। একটু আগে আবছা মতন যে অন্ধকারটা আকাশ এবং পাহাড়-টাহাড়ের গায়ে জড়াজড়ি করে ছিল, কেউ যেন লাটাইতে সুতো গুটোনোর মতন একটানে সেটা তুলে নিয়ে গেল। অন্ধকার নেই, তবে সিল্কের মতন সাদা কুয়াশা সাঁওতাল পরগনার দীর্ঘ রেঞ্জটার মাথায় আটকে আছে। সূর্যটা উঁকি ঝুঁকি দিতে দিতে ঝাঁপ করে দিগন্তের তলা থেকে উঠে এল। মার্চের এই সকালে ঝক ঝক পাখি বেরিয়ে পড়েছে। সারা গায়ে ভোরের আলো মেখে তারা পাক খেয়ে খেয়ে উড়ছিল।

পাহাড়ের রেঞ্জটার দিকে আঙুল বাড়িয়ে তপতী বলল, দ্যাখ দ্যাখ সোমা, কী ফাইন, না?

সাঁওতাল পরগনার ওই পাহাড় আকাশের কোল ঘেঁষে চলেছে তো চলেইছে। মাইলের পর মাইল পেরিয়ে হয়তো, দেশ থেকে দেশান্তরে। এদিকে আর কখনও আসেনি সোমা। সাঁওতাল পরগনার এই সকালবেলাটা নিজের অজান্তে কখন যেন তাকে মুগ্ধ করে ফেলেছে। পাহাড় দেখতে দেখতে সে আধফোঁটা গলায় বলল, সত্যি ফাইন রে–

সেই ছেলেবেলা থেকে এই পাহাড়ের রেঞ্জটা দেখছি। কতবার দেখেছি। তবু এখনও ভালো লাগে।

ওখানে লোকজন থাকে?

সাঁওতাল-টাওতালরা থাকে। ওদের জন্যেই তো সাঁওতাল পরগনা নাম হয়েছে। সোমা মনে মনে ভাবল, ঠিক তো। জায়গাটার নাম শুনেই সাঁওতালদের কথা তার মনে পড়া উচিত ছিল। বলল, তুই কখনও ওদিকে গেছিস?

না ভাই, তপতী বলতে লাগল, এই সাহেবগঞ্জ থেকে যতটুকু দেখা যায়, ব্যস, ওই পর্যন্ত

সোমা আর কিছু জিগ্যেস করল না।

তপতী এদিক সেদিক দেখতে দেখতে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, ওই দ্যাখ দ্যাখ, কী লাভলি সূর্যটা

সোমা সেদিকে তাকাল। সব ব্যাপারেই তপতীর উচ্ছ্বাস একটু বেশি। তবু সুযোদয়টাকে ভালোই লাগল, সোনার থালার মতন সেটা দাঁড়িয়ে আছে।

আরো কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, ঘাটগাড়িটা বোঝাই হয়ে গেছে। এত লোক কোথায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, কে জানে। কোত্থেকে একটা ইঞ্জিন এসে গাড়িটার গায়ে লেগে গেল। তারপর গার্ডের হুইসল বাজল, ফ্ল্যাগ নড়ল, ভাঙা গলায় একবার চেঁচিয়ে উঠে ঘাটগাড়ি হেলে দুলে চলতে শুরু করল।

মিনিট পনেরো যাবার পর সোমার চোখে পড়ল, দূরে সাদা কাগজের মতন একটা নদী পড়ে আছে। তপতী প্রায় লাফিয়ে উঠল, নদীটা দেখেছিস সোমা?

অনুচ্চ মৃদু স্বরে সোমা বলল, হ্যাঁ

কী নাইস!

সোমা উত্তর দিল না, পলকহীন নদীটাকে দেখতে লাগল।

তপতী আবার বলল, ওই নদীটা আমাদের পেরুতে হবে।

আধ ঘণ্টার মধ্যে ওরা সগরিগলি ঘাটে এসে গেল। ঘাটগাড়িটা সাহেবগঞ্জ থেকে যাদের তুলে এনেছিল, হুড়মুড় করে দরজা খুলে তারা বেরিয়ে পড়ল।

স্টেশনটা ভারি মজার। তার একধারে বিশাল মাঠ; আরেক ধারে দুপা বালির ডাঙা ভাঙলেই স্টিমার ঘাট। জেটিতে একটা স্টিমার দাঁড়িয়ে আছে। তার মাস্তুলে একটা শঙ্খচিল ডানা মুড়ে বসে আছে।

একটা কুলি ডেকে মালপত্র তার মাথায় চাপিয়ে ধীরে সুস্থে সোমারা নামল। স্ট্রিমারটার দিকে যেতে যেতে তপতী বলল, ঘাট অনেকটা এগিয়ে এসেছে। নইলে আরো সময় লাগত।

সোমা বলল, ঘাট এগিয়ে এসেছে; সে আবার কী? পিছিয়েও যায় নাকি?

হ্যাঁ। এই তো পুজোর পর যখন এলাম তখন ঘাটটা ছিল দুমাইল দূরে।

এ রকম কেন হয়?

নদী পাড় ভাঙছে, তাই ঘাটটা কখনও এগোয় কখনো পিছোয়।

গল্প করতে করতে ওরা স্টিমারে এসে উঠল। ডেকের একধারে চাদর বিছিয়ে বসতে বলতে সোমা জিগ্যেস করল, নদীটা পেরুতে কতক্ষণ লাগবে?

তপতী বলল, ঘণ্টাখানেক তত নিশ্চয়ই।

সূর্যটা আরো অনেকখানি উঠে এসেছে। নদীর শান্ত স্থির জলে এখন রোদের ছড়াছড়ি। বাতাসে হিমের ভাবটা কেটে এসেছে। তবু বেশ শীত শীত করছে। ঝাঁকে ঝাকে বক নদীর জলে ছোঁ দিয়ে পড়ছিল, এবং সঙ্গে সঙ্গে লম্বা ঠোঁটে একেকটা শিকার গেঁথে উঠে আসছিল।

এক সময় স্টিমার ছেড়ে দিল। ধীরে ধীরে নদীর এপারটা দূরে সরে যেতে লাগল। দূরে সাঁওতাল পরগনার পাহাড়ি রেঞ্জটা আবছা হয়ে যাচ্ছে।

এদিকে আগে আর কখনও আসেনি সোমা। সাঁওতাল পরগনা তো অনেক দূরের রাস্তা, কলকাতার পুব দিকেই এই তার প্রথম আসা। কালই প্রথম সে শিয়ালদা স্টেশনে ঢুকেছে। শিয়ালদার পর থেকে যা কিছু, এতদিন সবই ছিল তার অচেনা, বইয়ে-পড়া কোনও রহস্যময় মহাদেশের মতন।

শিয়ালদা আসার দরকারই হয় না সোমার। ঠাকুরদার আমল থেকেই ওরা ইউপি-তে ডোমিসাইল্ড। ঠাকুরদা তার যৌবনে চাকরি নিয়ে লক্ষৌ গিয়েছিলেন, সেই থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে ওদের যোগাযোগ একরকম ছিন্ন।

ঠাকুরদা অবশ্য সারাজীবন ভাড়া বাড়িতেই কাটিয়ে গেছেন, বাবা কিন্তু উত্তর প্রদেশকেই স্বদেশ বলে জানেন। চাকরিতে থাকতে থাকতেই, এই তো সেদিন জায়গাটায়গা কিনে লক্ষ্ণৌতে বাড়ি করলেন। মা অবশ্য মৃদু আপত্তি করেছিলেন, তার মতে বাড়ি-টাড়ি দেশে গিয়েই করা উচিত। দেশ বলতে বাংলাদেশ। বাবা বলেছিলেন, এতদিন পর দেশে ফেরার মানে হয় না। বাংলাদেশটা তার মাতৃভূমি; এই পর্যন্ত। কিন্তু তার কতটুকুই বা তিনি চেনেন। সেখানকার গাছপালা, পশুপাখি, মানুষজন–সবই তার অজানা। এ বয়সে বাংলাদেশে ফিরলে অচেনা বিদেশির মতন থাকতে হবে।

বছর তিনেক হল বাবা রিটায়ার করেছেন, এখন লক্ষ্ণৌতে তার শান্ত অবসরের জীবন। দুই দাদা ওখানেই স্টেট গভর্নমেন্টে বিরাট চাকরি করে, মোটা মাইনে। একমাত্র দিদির বিয়ে হয়েছে কানপুরে; জামাইবাবু অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরির অফিসার। তাদের সংসারে মোটামুটি সুখের।

ভাইবোনদের মধ্যে সোমাই ছোট। ছোট বলেই কিনা কে জানে, কিছুটা জেদি, এবং একগুঁয়ে। লক্ষ্ণৌ থেকে বিএ পাশ করার পর হঠাৎ সে ঠিক করে ফেলল কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে এমএ পড়বে। দাদারা বাধা দিয়েছিল। কলকাতায় আগে আর কখনও আসেনি সোমা। এই অচেনা শহরে কোথায় গিয়ে থাকবে সোমা, কোনও বিপদ-টিপদ হবে কিনা, এই সব ভেবেই দাদাদের আপত্তি। বড়দা বলেছিল, বিএ পর্যন্ত যখন এখানে পড়েছিস, এম.এ-টাও পড়ে ফেল। ছোটদা তার চাইতে মোটে দুবছরের বড়, দুজনের সম্পর্কটা নিয়ত যুদ্ধের। একজন আরেকজনের পেছনে দিনরাত লেগেই আছে। অবশ্য এই লাগালাগিটা পরস্পরের প্রতি টানেরই ছদ্মবেশ। ছোটদা বলেছিল, পড়িয়ে-টড়িয়ে আর দরকার নেই। বিয়ে দিয়ে ওটাকে পার করে দেওয়াই ভালো। তক্ষুনি দুজনের যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। বাবা তাদের থামিয়ে বলেছিলেন, ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির সে গ্ল্যামার আর নেই, তুই বাপু এখানেই পড়। কিন্তু সোমা ঘাড় বাঁকিয়েই রেখেছিল, কলকাতায় সে পড়বেই।

শেষ পর্যন্ত সোমার জেদেরই জয় হয়েছিল। বাবা নিজে এসে তাকে কলকাতায় ভর্তি করে হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে গিয়েছিলেন। আর ফিফথ ইয়ারে পড়তে পড়তেই বিকাশের সঙ্গে তার আলাপ। সেই আলাপের দিনটা থেকেই জীবনের এক আশ্চর্য জটিলতার ভেতর পা দিয়েছিল সোমা।

হঠাৎ কানের পাশ থেকে তপতী ডাকল, সোমা–ওই চরটা দেখছিস

সোমা চমকে উঠল। স্টিমার তখন মাঝনদীতে; প্রকাণ্ড এক চরের পাশ দিয়ে ওরা যাচ্ছিল। সোমা সেদিকে তাকাল।

তপতী বলল, চরটা ফার্স্ট ক্লাস না?

সেই সাহেবগঞ্জে নামবার পর থেকে কত কী দেখাচ্ছে তপতী। বায়োস্কোপের বাক্সে চোখ লাগাবার পর বায়োস্কোপওলা যেমন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে থাকে, আগ্ৰাকা তাজমহল দেখো, কুতুব মিনার দেখো, হাওড়া ব্রিজ দেখো, বম্বাইকা সড়ক দেখো,তেমনি তপতী ক্রমাগত বলে যাচ্ছে সাঁওতাল পরগনার পাহাড় দ্যাখ, নদী দ্যাখ, আকাশ দ্যাখ, নদীর চর দ্যাখ-ইত্যাদি ইত্যাদি–

সোমা বলল, হ্যাঁ, চরটা সত্যি সুন্দর রে–

দিন দিন এটা বড় হচ্ছে। দশ বছর আগে কতটুকু ছিল; আমার মনে হয় চরটা বড় হয়ে হয়ে একদিন নদীটাকেই বুজিয়ে ফেলবে।

সোমা চুপ। তপতী আবার বলল, আমার অনেকদিনের একটা ইচ্ছা আছে। কী?

ওই চরটায় একটা ঘর তুলে কিছুদিন থাকব। চমৎকার লাগবে না কী বলিস? নির্জন চরে, হু-হুঁ বাতাসে, চাঁদের আলোয় যা একখানা ব্যাপার হবে না? তুই থাকবি আমার সঙ্গে?

সোমা হেসে ফেলল, আমাকে কেন তোকে সঙ্গে নেবার লোক তো গোকুলে বাড়ছে। বিয়ের পর হনিমুনটা এই চরেই করিস।

তপতীর বিয়ে একরকম ঠিক হয়েই আছে। ছেলেটি আমেরিকার এক ইউনিভার্সিটিতে রিসার্চ স্কলার; মাস ছয়েকের ভেতর মেটালর্জিতে থিসিস সাবমিট করার কথা তার। ডক্টরেটটা পেয়ে গেলেই দেশে ফিরে বিয়েটা সেরে ফেলবে। ভালো চাকরি-বাকরি পেলে ইন্ডিয়ায় থেকে যাবে, নইলে বউ নিয়ে আবার আমেরিকায় পাড়ি।

হনিমুনের কথায় মুখ লাল হয়ে উঠল তপতীর। একটুক্ষণ চুপ করে থাকল সে। তারপর ঠোঁট টিপে হাসতে হাসতে চোখের কোণে তাকিয়ে বলল, হনিমুনের সময় তোকেও নিয়ে আসব।

অনেক অনেকদিন পর প্রগলভতার ঈশ্বর যেন সোমার কাঁধে ভর করল। সকালবেলার আকাশ নদী, টলটলে রোদ, সাঁওতাল পরগণার জাদুকর পাহাড়, সব একাকার হয়ে পাষাণভারের মতন তার বিষাদ ভুলিয়ে দিতে লাগল। তপতীর গলায় তর্জনীর আলতো ঠেলা দিয়ে রগড়ের গলায় সে বলল, দুজনেই মজা; তার মধ্যে আরেকজন ঢুকলেই গোলমাল। জানিস, আমাদের লক্ষ্ণৌতে একটা প্রবাদ আছে।

কী?

কাবাবমে হাড্ডি। শুধু শুধু আমাকে জুটিয়ে কেন কাবাবে হাড় ঢোকাতে চাইছিস ভাই?

দারুণ বলেছিস সোমা-শব্দ করে হেসে উঠল তপতী।

স্টিমারটা প্রকাণ্ড চাকায় জল কেটে কেটে এগিয়ে যাচ্ছিল। নদীর ওপারটা দ্রুত কাছে এগিয়ে আসছে। ডেকের ওপর যাত্রীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে ছিল, কেউ কেউ রেলিঙে ভর দিয়ে জলের উপর ঝুঁকে আছে। বেশির ভাগই স্থানীয় দেহাতি মানুষ, কিছু কিছু আদিবাসী সাঁওতালও চোখে পড়ছে। চোখে গগলস, পরনে চাপা প্যান্ট, কাঁধে ক্যামেরা, হাতে ট্রানজিস্টর-দুচারটে ছোকরাও ডেকের এ-মাথায় সে-মাথায় ঘোরাঘুরি করছে।

ঘোলা জলের দিকে তাকিয়ে সোমা বলল, আজ কতারিখ রে?

আট, কেন?

ফোরটিন্থ কিন্তু পূর্ণিয়া থেকে ফিরে আসব।

আরে বাবা এখনও পূণিয়ায় পৌঁছুলিই না। আগে চল, দুচারদিন থাক, তারপর তো ফেরার কথা।

না ভাই, ফোরটিন্থ ফিরতেই হবে। সেই কথা বলেই তুই এনেছিস। পরে ঝাট করবি না কিন্তু

আচ্ছা আচ্ছা, সে দেখা যাবে। তপতী ব্যাপারটাকে আমলই দিল না।

সোমা বলল, দেখা যাবে বললে চলবে না। যদি আটকাতে চাস, এখনই বলে ফ্যাল। আমি এখান থেকেই ফিরে যাই।

কলকাতায় এখন তোর কোন রাজকার্য যে ফোরটিন্থ না ফিরলেই নয়? কমাসের ছুটি তো পড়ে পড়ে পচছে। আমাদের বাড়ি কদিন বেশি থাকলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?

সে তুই বুঝবি না।

রাগ এবং অভিমানের গলায় তপতী বলল, বেশ বাবা, চোদ্দো তারিখেই আসিস। হল তত? ভেবেছিলাম তোকে নিয়ে কত জায়গায় যাব, কত কী দেখাব

সোমা উত্তর দিল না।

একটু পর স্টিমারটা মনিহারিঘাট পৌঁছে গেল।

.

০২.

খুব ভিড়-টিড় ছিল না; তাই হুড়োহুড়ি ছোটাছুটিও নেই। ধীরে ধীরে যাত্রীরা নেমে যাচ্ছে। রিস্টওয়াচ দেখে তপতী বলল, সাড়ে নটা বাজে। আরেকটু কষ্ট করতে হবে, তারপরেই বাড়ি।

সোমা হাসল, আরেকটু কেন, অনেকখানি কষ্ট করতে হলেও রাজি। একবার যখন কলকাতা থেকে বেরিয়েছি, তোদের বাড়ি না গিয়ে ছাড়ছি না।

কুলি ডেকে মালপত্তর তার জিম্মায় দিয়ে ওরা উঠে পড়ল। কাঠের গ্যাংওয়ে পেরিয়ে পাড়ে উঠেই থমকে গেল তপতী। স্টিমারঘাট থেকে ওপরে উঠলেই রেললাইন, লাইনের কাছে মৃন্ময় দাঁড়িয়ে আছে। কিছুটা উদ্বিগ্ন, কিছুটা চিন্তিত। তার চোখ স্টিমারের দিকে। কাউকে খুঁজছে হয়তো।

ঝকঝকে স্মার্ট চেহারা মৃন্ময়ের। বয়স পঁয়ত্রিশের মতন। গায়ের রঙ কালোও না, আর ফর্সাও না। দুয়ের মাঝামাঝি। নাক-মুখ-টুখ, আলাদা আলাদাভাবে দেখলে হয়তো হাজার গন্ডা খুত বেরিয়ে পড়বে। কিন্তু সব মিলিয়ে ভারি আকর্ষণীয়। পরনে ঢোলা পাজামা আর খদ্দরের ধবধবে পাঞ্জাবি, পাঞ্জাবির হাতা কনুই পর্যন্ত গুটনো, হাতে দামি ঘড়ি; চোখে গগলস।

মৃন্ময়কে এই মনিহারি ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাবে, কে ভাবতে পেরেছিল। কিছুক্ষণ অবাক থেকে আচমকা চেঁচিয়ে উঠল তপতী, মৃন্ময়দা

মৃন্ময় চমকে উঠল। তারপর চোখ থেকে গগল্সটা খুলে হাসিমুখে এগিয়ে এল, আরে, তপী

মৃন্ময়ের কথা শেষ হবার আগেই তপতী বলল, তুমি এখানে কী করছ?

তোর জন্যে দাঁড়িয়ে আছি।

আমার জন্যে?

ইয়েস ম্যাডাম। ভেবেছিলাম তোক একটা সারপ্রাইজ দেব।

কিন্তু এখন তুমি এখানে এলে কী করে? কাল বিকেলে কাটিহার থেকে লাস্ট ট্রেন এখানে এসেছে। তারপর তো আর কোনও ট্রেন ছিল না।

কাল বিকেলের ট্রেনটাই ধরেছিলাম। মাঝখানে মনিহারিতে নেমে রাতটা এক বিহারি বন্ধুর বাড়ি কাটিয়েছি। আজ সকালে সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে ঘাটে চলে এলাম। মৃন্ময় হাসতে লাগল।

তপতী বলল, তোমার মাথায় ছিট-টিট আছে।

যা বলেছিস; বলেই মৃন্ময় ব্যস্ত হয়ে পড়ল, হ্যাঁ রে পী, মাসিমার কাছে শুনেছি, তোর কে এক বন্ধু আসবে। তাকে দেখছি না তো–

মৃন্ময়ের সঙ্গে তপতীকে কথা বলতে দেখে সোমা কুলিটাকে নিয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তপতী তার হাত ধরে টেনে নিয়ে এল, এই যে আমার বন্ধু–সোমা চট্টোপাধ্যায়। তারপর সোমাকে বলল, আর ইনি আমার পূজ্যপাদ মাসতুতো ভাই শ্রীমান মৃন্ময় মিত্র, দিল্লির একটা ফার্মে কমার্শিয়াল আর্টিস্ট। আমার চাইতে পাক্কা তিন বছরের ছোট। তবে দাদা শুনবার খুব শখ কিনা, তাই মৃন্ময়দা বলি।

ইয়ার্কি হচ্ছে! মৃন্ময় চড় তুলল, তপতী চট করে মাথাটা সরিয়ে খুব হাসতে লাগল। মৃন্ময়ও হেসে ফেলল, তারপর সোমার দিকে ফিরে বলল, আপনার এই বন্ধুটি মহা ধনুর্ধর।

মুখ নীচু করে সোমা হাসল।

মৃন্ময় আবার বলল, তপতীর মতন আপনিও কলেজে পড়ান নাকি?

হাঁ–আস্তে করে মাথা নাড়ল সোমা।

আপনার কী সাবজেক্ট?

হিস্ট্রি

বেশ পণ্ডিত লোক দেখছি

মৃদু স্বরে সোমা বলল, কলেজে পড়ালেই পণ্ডিত হয়ে যায় নাকি?

মৃন্ময় বলল, অত শত জানি না। তবে প্রফেসার-ট্রফেসার দেখলে আমার ভীষণ ভক্তি হয়। ইচ্ছে করে পায়ের ধুলো নিই। মাঝে মাঝে তপীর পায়ের ধুলোও নিয়ে থাকি।

ওধার থেকে তপতী ভেংচে উঠল, এ-হে-হে-হে

বিব্রতভাবে সোমা বলল, কী যে বলেন।

সোমার কথা যেন শুনতেই পেল না মৃন্ময়। দ্রুত চারদিকটা ভালো করে দেখে নিয়ে খুব নীচু গলায় বলল, ব্যাপারটা কী জানেন?

কী?

নিজের বুকে একটা আঙুল রেখে মৃন্ময় বলল, এই যে মহাপুরুষটিকে দেখছেন ম্যাট্রিকের বেড়া ডিঙোতে এঁর সাতটি বছর লেগেছিল। তারপর আর কলেজে যেতে সাহস হয়নি। তাই কেউ এম.এ পাশ করে প্রফেসারি করছে শুনলে মনে হয় তার গোলাম হয়ে থাকি।

ভদ্রলোক ঠাট্টা করছে কিনা সোমা বুঝতে পারল না। সে চুপ করে রইল।

এদিকে লটবহর মাথায় কুলিটা দাঁড়িয়ে থেকে থেকে অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে, আউর কিতনা টিম (টাইম) খড়া রহেগা

তপতী তাড়া লাগাল, চল চল, সব কথা এখনই ফুরিয়ে ফেললে পরে বলবে কী? বলে চোখ টিপল।

মৃন্ময় লজ্জা পেয়ে গেল। বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ চল

ওপারের মতন মনিহারি ঘাটেও মাঠের মাঝখানে রেলস্টেশন। স্টেশন আর কী, অস্থায়ী কটা চালাঘর। তারপর দরমা আর টিনের ছাউনিতে কিছু দোকানপাট চায়ের দোকান, পানবিড়ির দোকান, সস্তা, খাবার-দাবারের দোকান এবং কটা ছোটখাটো হোটেল। সেখানে একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে ছিল।

মৃন্ময় একটা কামরায় গিয়ে উঠল। তারপর সুটকেশ-টুটকেশ গুছিয়ে অঢেল জায়গা নিয়ে সবাই বসল। পকেট থেকে সিগারেট বার করে ধরাল মৃন্ময়। লম্বা একটা টান নিয়ে ফুক ফুক করে ধোঁয়ার আংটি ছাড়তে লাগল।

হঠাৎ কী মনে পড়তে তপতী মৃন্ময়কে বলল, ওই দ্যাখ, সেই কথাটা জিগ্যেস করতে এক্কেবারে ভুলে গিয়েছি। তুমি দিল্লি থেকে কবে পূর্ণিয়ায় এসেছ?

পরশু। তোর মা জরুরি তলব পাঠিয়েছে যে

কী ব্যাপার?

দুই হাত চিত করে কঁধ ঝাঁকাল মৃন্ময়, কী জানি, এখনও ফুলমাসি (তপতীর মা) কিছু বলেনি! ঝুলি থেকে বেড়াল-টেড়াল একটা কিছু বেরুবেই। তার জন্য অপেক্ষা করছি।

একটু ভেবে তপতী বলল, এবার কিন্তু অনেকদিন পর পুর্ণিয়ায় এসেছ।

হ্যাঁ-মনে মনে হিসেব করে মৃন্ময় বলল, দেড় বছর পর এলাম।

কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর মৃন্ময়ের কী যেন মনে পড়ে গেল, হ্যাঁ রে তপী, সাহেবগঞ্জে তোরা কখন পৌঁছেছিস?

ভোরবেলা

কিছু খেয়েছিস?

এক ভাঁড় করে চা শুধু

সে কী রে–মৃন্ময় উঠে পড়ল, বাড়ি যেতে যেতে দুটো আড়াইটে হয়ে যাবে। ততক্ষণ না খেয়ে কি থাকা যায়; সঙ্গে একজন গেস্ট আছেন।

বিব্রত মুখে সোমা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আমার জন্যে ব্যস্ত হবেন না–

তাই কখনো হয়। মৃন্ময় বলল, এখানে হোটেল রয়েছে। চল, চট করে তিনজনে খেয়ে আসি। ট্রেন ছাড়তে এখনও ঘণ্টাখানেক দেরি আছে।

শক খাবার মতন চেঁচিয়ে উঠল তপতী, ওরে বাবা, রক্ষা করো।

কী হল রে? মৃন্ময় অবাক।

এ সব হোটেলে খেতে-টেতে পারব না। মাটিতে বসে খাওয়া, তার ওপর ভাত-তরকারিতে কিচকিচে বালি, রাঁধুনে ঠাকুর-টাকুরগুলো সাত জন্মে কাপড়-চোপড় কাঁচে না বড় বড় নখ আর ফাটা ফাটা হাতের ভেতর ময়লা–ন্যাস্টি! তপতীর নাক-মুখ কুঁচকে যেতে লাগল।

তোর তো আবার পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোঁরায় খাবার অভ্যাস। কিন্তু মনিহারি ঘাটের এই বেলেমাটির চড়ায় কলকাতার পার্ক স্ট্রিট কোথায় পাই। তুই ট্রেনেই বসে থাক, আমি সোমাদেবীকে খাইয়ে আনি।

আমার চাইতে সোমা অনেক বেশি খুঁতখুঁতে। মেরে ফেললেও ওকে তুমি ওই হোটেলে ঢোকাতে পারবে না।

তাহলে আর কী করব! মৃন্ময়কে হতাশ দেখাল। পরক্ষণেই কী ভেবে খুব উৎসাহিত হয়ে উঠল সে, এক কাজ করি বরং

তপতী বলল, কী?

ট্রেনের টাইমে এখানে সিঙাড়া নিমকি ভাজে। গরম গরম কটা নিয়ে আসি।

তুমি ক্ষেপেছ মৃন্ময়–পচা তেল-ফেল দিয়ে ভাজে ওই সব। খেলে আর দেখতে হবে না; হাতে হাতে একখানা গ্যাসট্রিক আলসার

ভুরু কুঁচকে ধমকে উঠল মৃন্ময়, অত খুঁতখুঁতনি কীসের রে? এই বয়সে যা পাবি তা-ই খাবি, চব্বিশ বছর না পেরুতেই বুড়ো-বুড়িদের মতন কতাবার্তা।

মৃন্ময় গাড়ি থেকে নেমে গুচ্ছের নিমকি-টিমকি নিয়ে এল।

কিছুক্ষণ নাকের ভেতর খুঁতখুঁত আওয়াজ করে নিতান্ত অনিচ্ছায় একটা সিঙাড়া তুলে নিল তপতী; সোমা নিল একটা নিমকি।

মৃন্ময় সোমাকে বলল, আর দু-একটা নিন-

সোমা বলল, না, না, আর লাগবে না।

তপীর হাওয়া আপনারও গায়ে লেগেছে দেখছি। আর সাধাসাধি না করে বাকি নিমকি-টিমকিগুলো চোখের পলকে শেষ করে ফেলল মৃন্ময়।

.

সাড়ে দশটায় ট্রেন ছাড়ল। ওরা তিনজনেই জানালার ধারে বসে ছিল। বাইরে আদিগন্ত সবুজ মাঠ। ঝোপঝাড়, গাছপালা, মাঝে মাঝে টুকরো টুকরো রবিফসলের খেত। রুপোলি ঝলকের মতন হঠাৎ একেকটা নদী কিংবা খাল দেখা দিয়েই অদৃশ্য হচ্ছে। কোথাও মোষের পাল চলেছে, তাদের পিঠে ছোট্ট দেহাতি ছেলে অবাক বিস্ময়ে ট্রেন দেখছে। অনেক উঁচুতে পালিশ করা আয়নার মতন ঝকঝকে নীলাকাশ। ট্রেন বাঁক নেওয়াতে সাঁওতাল পরগণার রেঞ্জটাকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না।

তপতী বলল, কী বিউটিফুল মাঠ দেখেছিস সোমা।

সোমার ভালো লাগছিল; আকাশ-মাঠ দেখতে দেখতে মাথা নাড়ল সে।

ওধার থেকে মৃন্ময় বলে উঠল, মনেই হয় না আমরা বিহারে আছি; একজ্যাক্ট বাংলাদেশ যেন। একটু থেমে আবার বলল, তপীটা গান জানে না, আপনি জানেন, সোমাদেবী?

সোমা বলল, না।

সত্যিই কিছু জানেন না। বাথরুম সং-টংও কোনওদিন করেননি?

না।

আপনি একটা বোগাস।

সোমার মুখ-টুখ লাল হয়ে উঠল; মাথার ভেতরটা ঝা-ঝ করতে লাগল। মৃন্ময়ের সঙ্গে ভালো করে আলাপই হয়নি। সে যে দুম করে এ রকম একটা কথা বলতে পারে, সে ভাবতে পেরেছিল। রাগ, অপমান–সব মিলিয়ে যেন কেমন হয়ে গেল সোমা। ভারি ইতর তো লোকটা!

সোমার দিকে তাকালও না মৃন্ময়। হঠাৎ উচ্ছ্বাসে মোটা বেসুরো গলায় গেয়ে উঠল।

আমার সোনার বাংলা,
আমি তোমায় ভালোবাসি
চিরদিন, তোমার আকাশ, তোমার বাতাস,
আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।
ও মা ফাগুনে তোর—

তপতী দুকানে হাত চাপা দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, থামো থামো; বেচারি রবীন্দ্রনাথকে অন্তত রেহাই দাও

মৃন্ময় গান থামিয়ে কাচুমাচু মুখে বলল, কেন রে, গানটা ভালো লাগছে না?

গানটা খারাপ কে বলেছে? বাংলা ভাষায় এরকম গান আর কটা লেখা হয়েছে! তবে

বুঝেছি, আমার গলাটা রাবিশ, এই তো? বলেই সোমার দিকে তাকাল, জানেন মিস চ্যাটার্জি, গলায় আমার একদম কনট্রোল নেই। হাঁ করলে একসঙ্গে আঠারো রকমের আওয়াজ বেরিয়ে আসে। সবই জানি, তবু আবেগ উথলে উঠলে নিজেকে আর সামলাতে পারি না। বলতে বলতে হেসে ফেলল মৃন্ময়। সোমা তাকিয়েই ছিল। এমন সরল নিষ্পাপ ছেলেমানুষির হাসি সে খুব বেশি দেখেনি। আশ্চর্য, একটু আগে মৃন্ময়কে মনে হয়েছিল ইতর।

তপতী হঠাৎ বলল, ও গানটা তোমার গাওয়া উচিত না মৃন্ময়টা

মৃন্ময় অবাক, কেন রে?

তুমি বিহারে বর্ন অ্যান্ড ব্রট-আপ। বাংলাদেশ নিয়ে মাতামাতি করার রাইট নেই তোমার। তোমার গাওয়া উচিত, আমার সোনার বিহার, আমি তোমায় ভালোবাসি।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল মৃন্ময়। তারপর গাঢ় গলায় বলল, যেখানেই জন্মাই আর যেখানেই থাকি, এই বুকের ভেতরটায় যা আছে তার নাম বাংলাদেশ।

চোখ বড় বড় করে কৌতুকের গলায় তপতী বলল, এ যে দেখছি রামভক্ত হনুমানের মতন; বুক চিরে বাংলাদেশ দেখাবে নাকি?

ইচ্ছে করলে তা পারি রে–

মাঠের মাঝখানে একেকটা স্টেশন আসে। কিছু দেহাতি লোক মালপত্র আঁকা-টাকা নিয়ে হুড়মুড় করে ওঠে, কিছু নামে। তারপরই ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে উঠে। ট্রেনটা ছুটতে থাকে।

একটা স্টেশন থেকে এক গাইয়ে ছোকরা উঠল। তেরো-চোদ্দর মতন বয়স। আঁকড়া চুল ধুলো-বালিতে জট পাকিয়ে আছে। পরনের ইজেরটা তেলে-ময়লায় চিটচিটে, খালি গা। দুহাতে দুটকরো কাঠ। সে দুটো বাজিয়ে মিষ্টি গলায় সে গেয়ে উঠল, পাতলী কোমরি হায়, তিরছি নজরী হায়—

মৃন্ময় কষে ধমক লাগল, থাম ব্যাটা—

ছেলেটা ভয় পেয়ে গেল, জি

পন্দর সাল আগের মাল এখনও চালিয়ে যাচ্ছিস ব্যাটা। নয়া গানা লাগা।

নয়া গানামে জ্যাদা পাইসা লাগেগা বাবুজি

চোখ গোল করে মৃন্ময় বলল, ও বাবা, এ যে দেখছি কড়া জিনিস। ঠিক হায়, জ্যাদা পাইসাই পাবি।

বহুত খুব—বলেই গলা চড়িয়ে গান ধরল, রূপ তেরা মস্তানা, পেয়ার মেরে দিওয়ানা সেই সঙ্গে কাঠের টুকরোর বাজনা-টক-টক্টররেট

বহুত আচ্ছা বহুত আচ্ছা—মাথা নেড়ে নেড়ে তাল দিতে লাগল মৃন্ময়।

গান চলছিলই। হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে মৃন্ময় বলল, এ ছোঁকরে, গানাকা সথ নাচা ভি তো লাগাও–

গান থামিয়ে ছেলেটা বলল, জি–

আরে বাবা, নাচা-গানা একসাথ। ছেলেটাকে উৎসাহ দেবার জন্য তুড়ি দিয়ে দিয়ে মৃন্ময় কাধ নাচাতে লাগল।

ছেলেটা এবার বুঝতে পারল। বলল, কোন্ সা নাচা সাহাব?

টুইস্ট জানিস,

জি-রাজেশ খান্নাকা তরা?

রাজেশ খান্নাকেও জানিস নাকি!

জরুর; উও তো বঢ়িয়া বাহাদুর

লাগা তাহলে রাজেশ খান্নার মতন

ছেলেটা পা কাঁপয়ে কাঁপয়ে গানের সঙ্গে নাচাও জুড়ে দিল। ঘাড় কাত করে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখল মৃন্ময়; তারপর চেঁচিয়ে উঠল, ধুর-টুইস্ট-ফুইস্ট তুই কিছু জানিস না। আমার কাছে শিখে নে। কোমর এবং হাঁটু কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে এক পাক নেচে দেখিয়ে দিল মৃন্ময়।

সোমা অবাক চোখে মৃন্ময়কে দেখছিল। কিছুক্ষণ আগে এই মানুষটাকে সরল নিষ্পাপ বালকের মতন মনে হয়েছিল। আর এখন? মনে হচ্ছে তপতীর এই মাসতুতো ভাইটা ক্লাউন ছাড়া আর কিছু না। কোনও ভদ্র রুচির মানুষ যে এভাবে নাচতে পারে, সোমা কল্পনাই করতে পারে না। বিরক্তি রাগ আর অস্বস্তিতে তার চোখমুখ কুঁচকে যেতে লাগল।

গাইয়ে ছোকরাটা আবার নতুন করে শুরু করল। কিন্তু কিছুতেই আর মৃন্ময়ের পছন্দমতো হচ্ছে না; বারবার ভুল শুধরে দিতে লাগল মৃন্ময়।

তপতী মৃন্ময়ের কাণ্ড দেখে খুব হাসছিল। হাসতে হাসতেই সোমার কাঁধে আঙুলের খোঁচা দিয়ে বলল, দ্যাখ, মৃন্ময়দাটা এক্কেবারে যাচ্ছেতাই

ওই রকম একটা বাজে লোকের কুরুচিকর কোমর-নাচানি দেখে এত হাসবার কী আছে সোমা ভেবে পেল না। সে উত্তর দিল না।

আবার কী বলতে গিয়ে হঠাৎ সোমার দিকে তাকাল তপতী, সঙ্গে সঙ্গে তার হাসি থেমে গেল। সোমার মুখ লাল, চোয়াল শক্ত। কিছু একটা আন্দাজ করে সে মৃন্ময়ের দিকে তাকাল। ধমকের গলায় বলল, কী হচ্ছে মৃন্ময়দা!

মৃন্ময় হকচকিয়ে গেল, আরে ছোঁড়াটার টুইস্ট ঠিক হচ্ছে না, তাই একটু দেখিয়ে দিচ্ছি।

কড়া গলায় তপতী বলল, চুপ করে বোসো তো

এক পলক তপতীকে দেখল মৃন্ময়, তারপর দেখল সোমাকে। দেখতে দেখতে বিমূঢ়ের মতন ঝুপ করে বসে পড়ল।

চাপা গলায় তপতী বলল, এক গাড়ি লোকের সামনে নাচতে তোমার লজ্জা করল না! ছি! বন্ধুর কাছে আমার আর মান-ইজ্জৎ রইল না।

মৃন্ময় বলতে চেষ্টা করল, না মানে তপতী চেঁচিয়ে উঠল, চুপ করো–তারপর সোমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করল, কিছু মনে করিস না ভাই। মৃন্ময়দার মাথায় ছিট-ফিট আছে।

সোমা এবারও চুপ করে থাকল।

গাইয়ে ছোকরাটা হয়তো বিপজ্জনক কিছুর আভাস পেয়েছিল। গান-টান থামিয়ে ভয়ে ভয়ে মৃন্ময়কে বলল, সাহাব, মেরা পাইসা।

নিঃশব্দে পকেট থেকে একটা টাকা বার করে দিতেই ছোকরাটা চোখের পলকে হাওয়া হয়ে গেল। তারপর সবাই চুপচাপ। সোমা, তপতী, মৃন্ময়–তিনজন অপরিচিতের মতন পাশাপাশি বসে থাকল।

আরো ঘণ্টাখানেক পর ঘাটগাড়ি কাটিহার জংশনে পৌঁছে গেল।

স্টেশনে নেমে মৃন্ময় তপতীকে বলল, এখান থেকে কীসে পূর্ণিয়া যাবি? ট্রেনে, না ট্যাক্সিতে?

তপতী বলল, ট্যাক্সিতে।

ট্রেনে গেলে কিন্তু জানিটা লাভলি লাগত,মৃন্ময় চোরা চোখে একবার সোমাকে দেখে নিল। সোমার মুখ এখনও থমথমে গম্ভীর। মৃন্ময়ের কথা সে শুনেছে বলে মনেই হল না।

তপতী বলল, না-না, এখন শোভা দেখতে দেখতে খাবার সময় নেই। সাড়ে বারোটা বাজে; দারুণ খিদে পেয়ে গেছে। তুমি চট করে একটা ট্যাক্সি নিয়ে এসো মৃন্ময়দা

মার্চের সূর্য এখন সোজা মাথার ওপর। সকালের দিকে রীতিমতো শীত শীত করছিল, হিমে গায়ে কাটা দিচ্ছিল। আর এই দুপুরবেলা বাতাস তেতে উঠেছে, বেশ গরম লাগছে।

মৃন্ময় ট্যাক্সি নিয়ে এল। ওরা উঠতেই গাড়িটা এক সেকেন্ড আর দাঁড়াল না; সঙ্গে সঙ্গে স্টার্ট দিল।

তারপর দুমিনিটের মধ্যে কাটিহার জংশন পিছনে ফেলে ট্যাক্সিটা হুস করে যেখানে এসে পড়ল তার দুধারে সবুজ কার্পেটের মতন মাঠ, টুকরো টুকরো বিহারি গ্রাম, একটানা পানিফলের বিল আর মাঝে মাঝে অনেকখানি জায়গা জুড়ে আম বাগান। ছোট ছোট সবুজ গুটিতে আমগাছগুলো বোঝাই হয়ে আছে। আর দেখা যাচ্ছিল বেঁটে বেঁটে অষ্টবক্ৰ মুনির মতো এক ধরনের অদ্ভুত গাছ। এমন গাছ আগে আর কখনও দেখেনি সোমা।

এক জানালায় বসেছিল সোমা, আরেক জানালায় মৃন্ময়। মাঝখানে তপতী। হঠাৎ ওধার থেকে মৃন্ময় চেঁচিয়ে উঠল, মিস চ্যাটার্জী, ওই ট্যারা ব্যাকা গাছগুলো মার্ক করুন–

সোমা যেমন বাইরে তাকিয়ে ছিল তেমনই তাকিয়ে থাকল।

খুব উৎসাহের গলায় মৃন্ময় বলল, ওই গাছগুলোর নাম সীসম। এমন গাছ আপনি বাংলাদেশে দেখতে পাবেন না।

সোমা কোনওরকম কৌতূহল বা আগ্রহ দেখাল না।

ঝুঁকে বসে আবার কী বোঝাতে যাচ্ছিল মৃন্ময়, তপতী বিরক্ত সুরে বলল, তুমি কি একটুও মুখ বুজে থাকতে পারো না মৃন্ময়দা

ঝপ করে আলো নিভে গেলে যেমন হয়, মৃন্ময়ের মুখটা তেমনি মলিন হয়ে গেল। বিব্রতভাবে বলল সে, আচ্ছা বাপু থামছি, আর একটি কথাও বলব না।

কাটিহার থেকে পুরো এক ঘণ্টাও লাগল না, তার অনেক আগেই ওরা পুর্ণিয়ায় পৌঁছে গেল।

.

০৩.

পুর্ণিয়ার যে পাড়ায় তপতীদের বাড়ি তার নাম ভাট্টা। একেবারে দরজার ওপর ওদের নামিয়ে দিয়ে ট্যাক্সিটা চলে গেল।

অনেকখানি জায়গা নিয়ে তপতীদের প্রকাণ্ড দোতলা বাড়ি। সামনের দিকে বিরাট ফুলের বাগান। ফুল বলতে শুধু গোলাপ। লাল, সাদা, ফিকে হলুদ– নানারঙের গোলাপে বাগান ছেয়ে আছে

আজকাল কোনও কিছুতেই মুগ্ধ হয় না সোমা; ফুটন্ত দুধের মতন টগবগে আবেগ তার খোয়া গেছে। তবু কয়েক পলক বাগানটার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারল না সে। বলল, তোদের বাগানটা তত চমৎকার রে তপতী। এত গোলাপ, এত রকমের গোলাপ, আমি আর কখনও দেখিনি।

তপতী হাসল, পুর্ণিয়ার লোকেরা আমাদের বাড়িটাকে কী বলে জানিস?

কী?

গোলাপবাড়ি।

সার্থক নাম।

দুহাতে দুই সুটকেশ, বেতের বাক্সেট আর বগলে হোল্ডল নিয়ে সোমাদের ঠিক পিছনেই আসছিল মৃন্ময়। বাগানের মাঝখান থেকেই সে গলা চড়িয়ে ডাকতে লাগল, ফুলমাসি আমরা এসে গেছি। দোলন-ঝুলন–পিন্টু, তোরা কোথায় রে? শিগগির বেরিয়ে আয়

তপতীদের পুরোনো আমলের দোতলায়। মোটা মোটা থাম, চওড়া চওড়া সিঁড়ি, গরাদহীন খড়খড়ি-ওলা বড় বড় জানলা, ঘুলঘুলিতে পায়রা–সব মিলিয়ে তার গায়ে উনিশ শতকের একটা গন্ধ যেন মাখানো।

তপতীরা সিঁড়ির কাছে আসবার আগেই দুটি কিশোরী আর একটি যুবক বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে। মেয়ে দুটির বয়স চোদ্দ থেকে ষোলর মধ্যে। এখনও শাড়ি-টাড়ি ধরেনি। যুবকটির বয়স কুড়ি একুশের মতন। তিনজনেরই চোখে মুখে তপতীর আদল বসানো। এক পলক দেখেই টের পাওয়া যায়, ওরা তপতীর ভাইবোন।

তপতী ভাইবোনদের সঙ্গে সোমার আলাপ করিয়ে দিল। কিশোরী দুটির মধ্যে যে বড় তার নাম দোলন, ছোটটির নাম ঝুলন। ছেলেটি তপতীর একমাত্র ভাই; ডাকনাম পিন্টু। ওরা সোমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। সোমা বিব্রত মুখে বলল, থাক থাক, আজকাল আবার কেউ পায়ে হাত দেয় নাকি

পিন্টু চমৎকার ছেলে। বলল, বা রে, আপনি আমাদের দিদি না?

সোমার খুব ভালো লাগল ছেলেটাকে। স্নিগ্ধ হেসে বলল, তুমি কী করো, পড়ছ?

হ্যাঁ। মেডিক্যাল স্টুডেন্ট, এটা আমার এম.বি.বি.এস. ফাইনাল ইয়ার।

তপতী বলল, বা রে তোরা সোমাকে প্রণাম করলি। আমাকে করবি না?

পিন্টু বলল, তোর প্রণামটা জমা থাক ছোটদি। ইয়ার এন্ডিং-এ সব একসঙ্গে চুকিয়ে দেব। দোলন-ঝুলন বলল, আমরাও—-

ভাইয়ের মাথায় স্নেহভরে আলতো করে একটা চটি কষিয়ে দিল তপতী, মহা ওস্তাদ হয়ে উঠেছিস।

সোমা অবাক, ব্যাপার কী রে, এক সঙ্গে প্রণাম চুকিয়ে দেবে মানে?

তপতী হেসে ফেলল, ওরা আমাকে এমনিতে প্রণাম করে না। সারা বছরের প্রণাম জমিয়ে রাখে, তারপর বছরের শেষে পাওনা চুকিয়ে দেয়।

সোমা রগড়ের গলায় বলল, সারা বছরে তোর কটা প্রণাম পাওনা হয় রে?

একটু ভেবে নিয়ে তপতী বলতে লাগল, নববর্ষে একটা, বিজয়ায় একটা, আমার জন্মদিনে–একটা হ্যাঁ, আট-দশটা তো হয়ই।

আট-দশটা প্রণাম ওরা একসঙ্গে করে?

তপতী মাথা হেলিয়ে দিল, হুঁ—-

সোমা হেসে ফেলল, বাবা, অফিসের ছুটির মতন প্রণামও যে জমানো যায়, আমার ধারণা ছিল না।

পিছন থেকে আচমকা মৃন্ময় চেঁচিয়ে উঠল, রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আর কতক্ষণ গল্প করবি তপী? আমার হাত কিন্তু ছিঁড়ে যাচ্ছে।

পিন্টু ছুটে গিয়ে মৃন্ময়ের হাত থেকে একটা সুটকেশ আর হোল্ডলটা নিয়ে তাকে খানিকটা হালকা করল।

তপতী বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। চল, ভেতরে যাই। সে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল।

সোমাও তপতীর দুই বোনের কাঁধে হাত রেখে সিঁড়ি ভাঙতে লাগল। দুজনের মধ্যে দোলন বড়, ঝুলন ছোট। সোমা দোলনকে বলল, তুমি কী পড়ো?

ক্লাস টেনে।

হিউম্যানিটিজ গ্রুপ?

না, সায়েন্স।

অঙ্কে তা হলে তোমার দারুণ মাথা

দোলন লজ্জা পেয়ে মুখ নামাল।

সোমা এবার ঝুলনকে বলল, তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?

ঝুলন বলল, নাইনে

তুমিও সায়েন্স গ্রুপের?

না, হিউম্যানিটিজ। ছোটদির মতন অঙ্ক-টঙ্ক আমার মাথায় ঢোকে না।

গল্প করতে করতে ওরা থামওলা বিরাট বারান্দায় উঠে এল। আর তখনই বাড়ির ভেতর থেকে যিনি বেরিয়ে এলেন তার দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরাতে পারল না সোমা। মনে হল, তিনি আসাতে দুপুরের সূর্যালোক যেন আরো অনেকখানি উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

বয়স কত হবে? পঁয়তাল্লিশের বেশি কখনওই না; দেখায় কিন্তু তিরিশ পঁয়তিরিশের মতন। গায়ের রঙ যেন শরতের রৌদ্রঝলক। নাক-মুখ-চোখ সব মিলিয়ে তিনি রূপের প্রতিমা। হাতভর্তি গোছা গোছা সোনার চুড়ি তার গায়ের রঙের সঙ্গে মিশে আছে। গলায় পুরনো আমলের তেঁতুলপাতা হার; নিটোল আঙুলে লাল পাথর বসানো আংটি। পরনে নকশা করা চওড়াপাড় ধবধবে শাড়ি আর গরদের ব্লাউজ। কপালে মস্ত সিঁদুরের টিপ।

তপতী বলল, আমার মা–

সোমা প্রণাম করবার জন্য ঝুঁকল কিন্তু পা ছোঁবার আগেই তপতীর মা তাকে বুকে তুলে নিলেন। সস্নেহ কোমল গলায় বললেন, তুমিই সোমা! এসো মা এসো–সবাইকে নিয়ে ভেতরে যেতে যেতে তিনি আবার বললেন, তোমাকে কিন্তু আরো আগেই আশা করেছিলাম মা। গেল বছর নভেম্বর মাসে তপী লিখেছিল, তোমাকে নিয়ে আসবে, আমরা পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর প্রতি মাসেই ও লিখে যাচ্ছে, তুমি আসছ! তারও এতদিন পর এলে।

তপতী বলল, কত সাধ্যসাধনা করে ওকে আনতে হয়েছে তা তো জানো না মা। কলকাতা থেকে নড়তেই চায় না। কলেজের ক্লাস আর হোস্টেলে নিজের ঘর, এর মধ্যেই দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কাটিয়ে দিচ্ছে।

আধফোটা জড়ানো গলায় সোমা কিছু একটা বলল, বোঝা গেল না।

তপতীর মা বললেন, তপী লিখেছিল, তোমরা লক্ষ্ণৌয়ে থাকো?

আজ্ঞে হ্যাঁ

সেখানে যাও না?

যাই মাঝে মধ্যে।

তপতী বলে উঠল, মাঝে মধ্যে না হাতি। জানো মা, আড়াই বছরে সোমা মোটে একবার লক্ষ্ণৌতে গেছে।

সোমা বলল, একবার গেছি। তোকে বলেছে। তাকে অত্যন্ত বিব্রত এবং চঞ্চল দেখাল। তপতীর মা এ সম্বন্ধে আর কোনও প্রশ্ন করলেন না।

কথায় কথায় ওরা বাড়ির ভেতর চলে এসেছিল। মাঝখানে প্রকাণ্ড বাঁধানো উঠোনের চারধারে বড় বড় খোলামেলা ঘর। তপতীর মা ওদের নিয়ে দক্ষিণ দিকের একটা ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।

জানালার ধার ঘেঁষে পুরোনো আমলের নকশা-করা ভারী খাট পাতা। তার ওপর ধবধবে বিছানা। আরেক ধারে ফুল লতাপাতা-আঁকা আলমারি, ড্রেসিং টেবল, খান দুই সোফা, মাথার ওপর দুই ফলা-ওলা ফ্যান।

তপতীর মা বললেন, এটা তোমাদের ঘর। যে কদিন আছ, তোমরা দুই বন্ধু এ ঘরে থাকবে।

এক পলক চারদিক দেখে নিল সোমা। ঘরটা বেশ নিরিবিলি; তার খুব পছন্দ হয়ে গেল।

তপতীর মা আবার বললেন, একটু বিশ্রাম-টিশ্রাম করে স্নান করে নাও। তারপর খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুমোও। নিশ্চয়ই কাল ট্রেনে ঘুম হয়নি।

তপতী বলল, আমি ঘুমিয়েছি। তবে সোমাটা ঘুমোয়নি; ওর ভীষণ ইনসমনিয়ার ধাত। ঘুমের বড়ি খেলে ঘুম আসে না।

তপতীর মা কিছুক্ষণ অবাক তাকিয়ে থাকলেন। ক্রমশ তার কপাল কুঁচকে যেতে লাগল। এক সময় বললেন, এ তো ভালো কথা না মা; কী এমন বয়স তোমার। এর মধ্যেই যদি ঘুমের বড়ি খেতে হয়-না না, তুমি ভালো ডাক্তার দেখাবে, বুঝলে?

সোমা হাঁ-নার মাঝামাঝি মাথা নাড়ল, মুখে কিছু বলল না। হঠাৎ তার চোখে পড়ল, পলকহীন তার দিকে তাকিয়ে আছে মৃন্ময়, তাদের সঙ্গে সঙ্গে সুটকেশ-টুটকেশ নিয়ে এ ঘরে ঢুকে পড়েছিল সে। চোখাচোখি হতেই অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল সোমা।

তপতীর মা বললেন, আচ্ছা আমি এখন যাই, তোমরা বেশি দেরি কোরো না

তিনি চলে গেলেন। দোলন-ঝুলন-পিন্টু তার সঙ্গে গেল।

একদৃষ্টে সোমাকে লক্ষ্য করছিল মৃন্ময়; নিঃশব্দে মালপত্র নামিয়ে রেখে সোমাকে দেখতে দেখতে সেও চলে গেল।

.

০৪.

স্নান-টান সেরে তপতী সোমাকে খাবার ঘরে নিয়ে এল। এ ঘরটাও বেশ বড়সড়। মাঝখানে প্রকাণ্ড টেবল। টেবলটাকে ঘিরে সিংহাসনের মতন অনেকগুলো চেয়ার। মাথার ওপর নাইনটিন ফরটি মডেলের ফ্যান ঘুরছে।

সোমারা আসবার আগেই দোলন ঝুলন পিন্টু এবং মৃন্ময় ডাইনিং রুমে এসে বসে ছিল। তপতীর মা-ও ছিলেন ও ঘরে।

তপতীদের দেখেই মৃন্ময় চেঁচিয়ে উঠল, তোদের জন্যে ঝাড়া একটি ঘন্টা বসে আছি। তাড়াতাড়ি বসে পড় বাপু। খিদেয় পেট চুঁই ছুঁই করছে।

বসতে বসতে তপতী বলল, আমাদের জন্যে বসে থাকতে কে বলেছিল? তুমি খেয়ে নিলেই পারতে

খেয়ে নেব! বেশ বলেছিস! বাড়িতে গেস্ট আছে না–

ও বাবা-তপতী চোখ গোল করল। ঠোঁট ছুঁচলো করে বলল, তুমি এত ফর্মালিটি-টর্মালিটি কবে থেকে মানতে শুরু করেছ?

মৃন্ময় দুই হাত চিত করে কাঁধ ঝাঁকাল, ফর্মালিটির ধার ধারতে আমার বয়েই গেছে। আমি তো খেতেই চেয়েছিলাম–ফুলমাসি দিল না যে। বলল, তোর বন্ধু কী ভাববে–

সোমার মুখ লাল হয়ে উঠল।

তপতীর মা হাসতে হাসতে উঠে পড়লেন, ভাববেই তো। আচ্ছা তোরা একটু বোস, আমি ভাতটাত নিয়ে আসি।

একটু পর খাবার-টাবার এসে গেল। টেবল চেয়ারে সাহেবি ব্যাপার কিন্তু খাওয়াটা একেবারে দিশি মতে। বড় বড় কঁসার থালা এবং বাটিতে ভাত-মাছ ডাল-তরকারি সাজিয়ে দিলেন তপতীর মা। একটা বেহারি ঠাকুর হাতের কাছে সব যুগিয়ে তাকে সাহায্য করতে লাগল।

সবাইকে খেতে দিয়ে একটা চেয়ারে বসলেন তপতীর মা। কার পাত খালি হয়ে যাচ্ছে, কার কী দরকার, লক্ষ্য রাখতে লাগলেন।

সোমা খাচ্ছিল আর মাঝে মাঝে তপতীর মাকে দেখছিল। ইচ্ছা করে যে দেখছিল তা নয়, তপতীর মা দুরন্ত আকর্ষণে যেন তার চোখ দুটিকে নিজের দিকে টেনে রাখছিলেন।

তপতীর মা হয়তো লক্ষ্য করেছিলেন। বললেন, আমায় কিছু বলবে সোমা?

না মাসিমা–সোমা মাথা নাড়ল, আমি আপনাকে দেখছি।

আমাকে দেখছ! তপতীর মা অবাক।

হ্যাঁ, আপনার মতন সুন্দর মানুষ আমি আর কখনও দেখিনি মাসিমা।

তপতীর মা লজ্জা পেয়ে গেলেন, তার কান আরক্ত হল, কী যে বলো!

তপতী ওধার থেকে বলে উঠল, জানিস সোমা, আমরা কেউ মার সঙ্গে কখনো রাস্তায় বেরুই না।

সোমা বিমুড়ের মতন জিগ্যেস করল, কেন?

লোকে বিশ্বাসই করতে চায় না আমরা এই মায়ের ছেলেমেয়ে। সবাই ভাবে সুন্দর বউটা কোত্থেকে কাকের ছানা বকের ছানা জোটাল।

দোলন চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছিল। ফস করে বলল, সেবার নতুন এসপি. সাহেবের স্ত্রী আমাদের বাড়ি বেড়াতে এসেছিলেন। দিদি কলকাতায় ছিল, দাদা পাটনায়। আমাকে আর ঝুলনকে দেখিয়ে ভদ্রমহিলা বললেন, এরা কারা? মা বলল আমার মেয়ে। ভদ্রমহিলা অবাক হয়ে বললেন, তোমার নিজের ছেলেমেয়ে, না সতীনের?

তপতীর মা বিব্রত মুখে বললেন, মেয়েদের কথা শোনো!

দোলন বলল, মেয়েরা ঠিক কথাই তো বলছে

তপতীর মা বললেন, কী ভালো লাগছে রে?

এই যে সবাই মিলে তোমার রূপের এত প্রশন্তি গাইছে। দেমাকে নিশ্চয়ই খুব ফুলে যাচ্ছ।

ধমক দিতে গিয়ে হেসে ফেললেন তপতীর মা, চুপ কর হনুমান

সোমার মনে হল, ভদ্রমহিলা রাগ করতে জানেন না।

একটু নীরবতা। তারপর তপতীর মা সোমাকে বললেন, বাঁদরগুলো সমানে জ্বালাচ্ছে। তোমার সঙ্গে কথাই বলতে পারছি না মা। তপীর চিঠিতে জেনেছি তোমরা লক্ষ্ণৌতে থাকো। কদ্দিন আছ ওখানে?

সোমা বলল, অনেকদিন। প্রায় দু-পুরুষের মতন। আমার ঠাকুরদা তার পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়সে ওখানে চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। সেই থেকেই আছি।

ওখানে বাড়ি-টাড়ি করেছ?

হ্যাঁ।

বাবা-মা?

আছেন।

খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সোমাদের বাড়ির অনেক খবর নিলেন তপতীর মা। তারপর বললেন, তোমারা কভাইবোন?

দুই ভাই, দুই বোন। আমি সবার ছোট।

অন্য ভাইবোনের বিয়ে হয়ে গেছে?

হ্যাঁ।

ওধার থেকে তপতী বলল, সোমার বিয়ের জন্যেও তো লক্ষ্ণৌ থেকে ওর বাবা-মা তাড়া দিচ্ছেন। ও কিছুতেই বিয়ে করতে চায় না।

তপতীর মা বললেন, তা তো দেবেনই। মেয়ে যত লেখাপড়াই শিখুক আর যা-ই করুক, বিয়ে দিতে না পারলে কোনও বাপ মা-ই নিশ্চিন্ত হতে পারে না। তারপর সোমাকে বললেন, তোমার বাবা-মা তো বললে বেশ অসুস্থ

হ্যাঁ-আবছা গলায় সোমা উত্তর দিল।

বিয়েটা করে ফেলো মা। যে বয়সের যা, জীবনে ওটা প্রয়োজন।

সোমা চুপ করে রইল। শুধু দুর থেকে মৃন্ময় লক্ষ্য করল, মুখটা একেবারে রক্তশূন্য হয়ে গেছে সোমার। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে। সে অনুমানও করতে পারল না, এই মুহূর্তে সোমার রক্ত মাংসে কী দারুণ যুদ্ধ চলছে।

হঠাৎ মৃন্ময় বলল, তুমি কী ফুলমাসি!

কেন, কী! মৃন্ময়ের বলার ধরনে তপতীর মা চমকে উঠলেন।

নিজেরা তো বিয়ে-টিয়ে করে ল্যাজ কেটে বসে আছ। আবার অন্যের ল্যাজও কাটাতে চাইছ। কেন বাপু, আজাদি চিড়িয়া আকাশে উড়ছে, তাকে উড়তেই দাও না

তপতীর মা চোখ পাকালেন, তোর ল্যাজও এবার কাটাব। আজাদি চিড়িয়া হয়ে সারা জীবন উড়ে বেড়াবি, সেটি হবে না।

দোলনের পাশ থেকে ঝুলন দুম করে বলে বসল, মৃন্ময়দার ল্যাজ তত একবার কাটা গিয়েছিল।

পলকে সমস্ত ঘরটার হাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। মুহূর্তের জন্য সবাই যেন বোবা।

ওদিকে হাজার হাতে এলোপাথাড়ি কালি ছুঁড়ে কেউ যেন মৃন্ময়ের মুখটা একেবারে বিকৃত কদর্য করে দিল। তার চোখের ওপর ধূসর সরের মতন কী পড়েছে। হাত-পা-ঠোঁট অসহ্য কঁপছিল। এক মিনিটও না। তারপরেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কাঁপিয়ে হেসে উঠল মৃন্ময়, ঠিক বলেছিস ঝুলন। ল্যাজ কাটার কথাটি আমার একদম মনে থাকে না। সবসময় হইচই করে কাটাই তো বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে গেল মৃন্ময়, কিন্তু যেই একলা হই, টের পাই সেই কাটার ঘাটা—

তপতীর মা ধমকে উঠলেন, চুপ কর, যত সব আজে বাজে কথা

মৃন্ময় হাসতে লাগল; ঠিক আছে ফুলমাসি, এই মুখে চাবি দিলাম। তুমি তো আবার ওই ব্যাপারটা পছন্দ করো না। বলেই ঘাড় গুঁজে বড় বড় গ্রাস মুখে পুরতে লাগল মৃন্ময়।

খেতে খেতে থমকে গিয়েছিল সোমা। সে মৃন্ময়ের দিকে তাকাল, তাকিয়েই থাকল। মনিহারি ঘাটে আলাপ-টালাপ হবার পর এই প্রথম মৃন্ময়কে স্থির পলকহীন চোখে দেখল সোমা। একবার তার ইচ্ছা হল, তপতীকে জিগ্যেস করে মৃন্ময়ের ব্যাপারটা জেনে নেয়। পরক্ষণেই মনে পড়ল, সে একজন অধ্যাপিকা, গেঁয়ো মেয়েদের মতন কৌতূহল তার অন্তত শোভা পায় না।

হঠাৎ কি মনে পড়তে দ্রুত মুখ তুলল মৃন্ময়, ফুলমাসি, মেসোকে তো দেখছি না।

তপতীও প্রায় একই সুরে বলল, বাবা কোথায় মা?

তপতীর মা বললেন, আর কোথায়, সকালবেলা টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে সাইকেলে করে যেখানে যান।

বা রে-আদুরে কিশোরীর মতন মুখ ভার করল তপতী, আমারা যে আসব বাবা জানে না?

তপতীর মা বললেন, জানে বইকি-

তবে বাড়িতে থাকল না যে?

নেশা। সকাল হলেই বেরিয়ে পড়া চাই।

তুমি থাকতে বললে না কেন?

বলেছিলাম তো। তোর বাবা বললে তপীরা এসেই তো আর চলে যাচ্ছে না।

সন্ধেবেলা দেখা হবেখন।

সোমা কী ভাবল বলো তো?

সোমা ওপাশ থেকে বলে উঠল, রোজ সকালেই বেরিয়ে যান মেসোমশাই?

রোজ–তপতীর মা হাসলেন।

কোথায় যান?

বদ-বাদাড়ে–

কিছুক্ষণ বিমূঢ়ের মতন তাকিয়ে থাকল সোমা, তপতীর বাবার সম্বন্ধে আর কোনও প্রশ্ন করল না।

কথায় কথায় খেয়াল ছিল না। হঠাৎ সোমার পাতের দিকে তাকিয়ে তপতীর মা বলে উঠলেন, এ কী মা-তুমি কিছুই তো খাওনি! সব পড়ে আছে।

না না, অনেক খেয়েছি।

তোমাকে আর দুখানা ঝালের মাছ দিই—

দুহাত দিয়ে পাত ঢেকে সোমা ভয়ের গলায় বলল, আমার পাতে প্রথমেই যা দিয়েছেন তা আমার তিনবেলার খাবার। তার ওপর আবার যদি দ্যান মরেই যাব মাসিমা।

তুমি লজ্জা করছ না তো মা?

টেবিলের শেষ মাথা থেকে ধাঁ করে মৃন্ময় বলে বসল, পেট ভরে না খেলে নিজেই কষ্ট পাবে; আমাদের কী–

সোমার চোখ ঈষৎ কুঁচকে গেল। মৃন্ময়ের দিকে না তাকিয়ে তপতীর মাকে বলল, লজ্জা করব কেন? আমি কতটা খাই তপতীকেই জিগ্যেস করুন না—

নাঃ, কিছুই খেতে পারো না দেখছি–তপতীর মা হাল ছেড়ে দিলেন।

মৃন্ময় আচমকা আবার মন্তব্য করল, একেবারে পক্ষীর আহার। খাবেন এইটুকু, রাত্তিরে ইনসমনিয়া–আছেন ভালো।

একটু আগে ওদের কথাবার্তা শুনে সোমার মনে হয়েছিল মৃন্ময়ের জীবনে কোথাও দুঃখ আছে। নিজের অজান্তেই খানিকটা সহনুভূতি বোধ করেছিল। এই মূহুর্তে তার মুখ আবার শক্ত হয়ে উঠল। লোকটার রুচিহীনতা অসহ্য।

 ২. খাওয়া-দাওয়ার পর

০৫.

খাওয়া-দাওয়ার পর সোমা আর তপতী তাদের নির্দিষ্ট ঘরটায় চলে এল। বোতাম টিপে মাথার ওপরকার ফ্যানটা চালিয়ে দিয়ে তপতী বলল, একটা কথা জিগ্যেস করব?

সোমা শুধাল, কী রে?

মৃন্ময়দার ওপর খুব চটে গেছিস, না?

সোমা উত্তর দিল না, তার মুখ কঠিন হয়ে উঠল।

বিছানায় এসে টান-টান শুয়ে পড়ল তপতী। বলল, রাগ করিস না ভাই; মৃন্ময়দাটা কোনরকম ফর্মালিটি জানে না, মুখে যা আসে দুমদাম বলে ফেলে। একেক সময় খুব খারাপ লাগে। কিন্তু মানুষটা ভারি সরল রে। দু-চারদিন মিশলে বুঝতে পারবি, কোনও রকম ঘোরপ্যাঁচ নেই।

সোমা আবছা জড়ানো গলায় কিছু বলল; বোঝা গেল না।

পাশ ফিরতে ফিরতে তপতী বলল, মৃন্ময়দাটা অদ্ভুত লোক। দারুণ দুঃখী, জীবনে ভীষণ ডিপ্রাইভড় হয়েছে, অথচ বাইরে থেকে বুঝবার উপায় নেই। সব সময় হই-হুঁল্লোড় করছে, তার গলা দ্রুত ঘুমে বুজে আসতে লাগল।

কোনও ব্যাপারেই সোমার বিশেষ আগ্রহ নেই। সে উদাসীন কৌতূহল শূন্য।

তবু নিজের অজান্তেই ফস করে বলে বলল, ডিপ্রাইভড হয়েছে মানে?

সে সপ্তকাণ্ড রামায়ণ, পরে শুনিস

কী ভেবে সোমা বলল, ঊনি তো দিল্লি থাকেন; তখন তাই বললি না?

হ্যাঁ, ঘুমন্ত গলায় উত্তর দিল তপতী।

একলাই থাকেন?

কী অস্পষ্টভাবে বলল তপতী, তারপরেই তার গলা ডুবে যেতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে তার নাক ডাকতে লাগল। ভারি বিশ্রী অভ্যাস তপতীর।

সোমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল কোথায় যেন সে দেখেছে স্রেফ নাক ডাকার জন্য একটা ডিভোর্স হয়ে গেছে। পরক্ষণেই সে জানালার বাইরে গোলাপ বাগানের দিকে তাকাল। ওখানে ঝক ঝক প্রজাপতি উড়ছিল, আর ফড়িং। ফাল্গুনের উল্টোপাল্টা এলোমেলো হওয়ার ঝড় বয়ে যাচ্ছিল।

তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় চোখ জুড়ে আসতে লাগল সোমার। তপতীর পাশে শোয়ামাত্র সে ঘুমিয়ে পড়ল।

.

০৬.

ঘুম যখন ভাঙল বিকেলের আলো মলিন হয়ে এসেছে। রোদের রঙ এখন বাসি হলুদের মতন। রাস্তার লম্বা লম্বা গাছগুলোর ছায়া দীর্ঘ হয়ে তপতীদের বাগানে এসে পড়েছে। বাইরে অনেক পাখি ডাকছিল, অজস্র গোলাপের গন্ধে ফাল্গুনের চটুল বাতাস ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছে।

বিছানায় শুয়েই বড় বড় জানালার মধ্য দিয়ে আকাশ দেখা যায়। শীতের পর আকাশ এখন ঝকঝকে নীলপালিশ-করা আয়নার মতন।

পাশ ফিরে তপতীকে ডাকতে গিয়ে সোমা দেখল, সে জায়গাটা ফাঁকা। ঘুম ভাঙবার পর কখন সে উঠে গেছে, কে জানে। সোমা শুয়েই থাকল। আকাশ দেখতে লাগল, গাছের ছায়া দেখতে লাগল, পাখিদের চেঁচামেচি শুনতে লাগল। মোটামুটি এসব ভালোই লাগছিল তার, তবু কী রকম এক অন্যমনস্কতা আর বিষাদ যেন তাকে ঘিরে থাকল। একলা হলেই এই বিষাদটা সোমাকে পেয়ে বসে। আর তখনই বিতৃষ্ণার অতল থেকে উঠে এসে সামনে দাঁড়ায় বিকাশ।

হঠাৎ হুড়মুড় করে ঘরে এসে ঢুকল তপতী। এক মুখ হেসে বলল, ঘুম ভেঙেছে তা হলে? আমি তো ভেবেছিলাম আজ আর উঠবি না।

সোমাও হাসল, কিছু বলল না।

তপতী আবার বলল, আর শুয়ে থাকতে হবে না, চটপট উঠে পড়—

মুখ-টুখ ধুয়ে চা খেয়ে রেডি হয়ে নিবি

কী ব্যাপার? হাতের ভর দিয়ে আস্তে আস্তে উঠে বসল সোমা।

কী আবার ব্যাপার, এই বিকেলবেলা ঘরে বসে থাকবি নাকি? আমাদের শহরটা কেমন, একটু ঘুরে ফিরে দেখবি না? মৃন্ময়দা টাঙ্গা ডাকতে গেছে। এসেই কী রকম তাড়া লাগায় দেখিস–

মৃন্ময়ের কথায় সোমার মুখে ছায়া পড়ল। বলল, আজই বেরুবি?

তপতী বলল, আজ বেরুলে ক্ষতিটা কী?

না, ক্ষতি কিছু না। সারা রাত ট্রেন জার্নি করে এসেছি, খুব টায়ার্ড লাগছে। এখন আর বেরুতে ইচ্ছে করছে না। মুখটা করুণ করে সোমা তাকাল। প্লিজ, মনে কিছু করিস না ভাই

আচমকা দরজার কাছ থেকে দুম করে কেউ বলল, আপনি একটা ল্যাক্টাভ্যাগাস–

চমকে সেদিকে তাকাল সোমা; দরজার ঠিক ওপরেই মৃন্ময় দাঁড়িয়ে আছে। সে কখন এসেছে, কে জানে। কতক্ষণ তাদের কথা শুনছে, তাই বা কে বলবে। রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে উঠল সোমার।

তপতী বলল, ল্যাক্টাভ্যাগাস–তার মানে কী?

মৃন্ময় বলল, কে জানে কী মানে। বলতে বেশ লাগল তাই বলে ফেললাম।

তপতী বালিকার মতন সারা গা দুলিয়ে হেসে উঠল, তুমি একটা রাবিশ।

মৃন্ময় বলল, ঠিক আছে রাবিশই। এখন তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে তোরা। টাঙ্গা দাঁড়িয়ে আছে।

জাস্ট টেন মিনিট সময় নিচ্ছি।

নো, ফাইভ মিনিট। কাপড়-চোপড় বদলাতে এর চাইতে বেশি সময় লাগে নাকি?

বা রে, চা খাব না?

চা বাইরে কোথাও খেয়ে নেব। মৃন্ময় আর দাঁড়াল না, বড় বড় পা ফেলে চলে গেল।

এই অসভ্য লোকটার সঙ্গ অসহ্য। সোমা বলল, আমি কিন্তু যাব না।

সোমা যে ভেতরে ভেতরে খুবই রেগে গেছে, তপতী লক্ষ্য করেনি। অসহিষ্ণু গলায় সে বলল, দিন দিন বুড়িয়ে যাচ্ছিস, কী যে স্বভাব হচ্ছে তোর। কলকাতায় হোস্টেলের ঘর থেকে বেরুস না; এখানে এসেও যদি ঘরেই বসে থাকবি তবে আসার মানে কী? হাত ধরে এক টানে সোমাকে বিছানা থেকে নামিয়ে আনল তপতী; তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করল, চল, আজ তোকে একটা দারুণ জিনিস দেখাব। যেভাবে সরলা কিশোরীকে চতুর পুরুষ ফুসলায় তপতীর গলায় স্বর অনেকটা সেই রকম।

সোমা বলল, কী দেখাবি?

সেটা এখন বলব না : ক্রমশ প্রকাশ্য।

সোমা শেষ চেষ্টা করল, কাল দেখলে হত না?

উঁহু আজই–প্রায় টানতে টানতে সোমাকে ঘরের বাইরে নিয়ে এল তপতী।

এক কলেজে বছর তিনেক কাজ করছে ওরা। প্রথম দিন থেকেই সোমা দেখছে, মেয়েটা যেন সব সময় টগবগ করে ফুটছে। একটুতেই সে উচ্ছ্বসিত একটুতেই তার মধ্যে ঢেউ ওঠে। আর যখন যেটা মাথায় চাপে সেটা না করে ছাড়ে না। কাজেই তার ইচ্ছায় নিজেকে না সঁপে দিয়ে রেহাই পাওয়া গেল না।

.

শাড়ি বদলাতে বেশিক্ষণ লাগল না। তারপর তপতীরা বেরিয়ে পড়ল। তপতীর মা চা খাবার কথা বলেছিলেন, মৃন্ময় সে সময় দিল না। দোলন ঝুলন যেতে চেয়েছিল; তাদের কী একটা পরীক্ষা সামনে, তাই নেওয়া হল না।

বাড়ি থেকে বেরুলেই দুর্গাবাড়ি। তার গায়েই একটা টাঙ্গা দাঁড়িয়ে ছিল। সোমা আর তপতী পিছনের সিটে বসল। মৃন্ময় বসল সামনের সিটে, কোচোয়ানের পাশে। সঙ্গে সঙ্গে টাঙ্গা চলতে শুরু করল।

একটু পর খোয়ার রাস্তা পেরিয়ে জমজমাট বাজারের কাছে এসে পড়ল টাঙ্গাটা। কলকাতার অনুকরণে এখানে কিছু দোকানপাট-ঘড়ির দোকান, রেডিওর দোকান, রেডিমেড পোশাকের দোকান। কাঁচের শো-উইন্ডোতে জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখা রয়েছে। দু-একটা ছোটখাটো রেস্তোরাঁও চোখে পড়ল।

মৃন্ময় সোমাকে বলল, বুঝলেন ম্যাডাম, এটা আমাদের পূর্ণিয়ার চৌরঙ্গী।

সোমা অন্যদিকে ফিরিয়ে থাকল।

মৃন্ময়ের হয়তো দুকান কাটা, সে বলতে লাগল, কলকাতার তুলনায় অবশ্য কিছুই না; তবু নিজেগুণে ক্ষমা করে নেবেন।

সোমা চুপ। মৃন্ময় এবার তপতীকে বলল, কি রে তপী, কোনদিকে যাবি?

তপতী বলল, যেদিকে খুশি

মৃন্ময় চট করে কী ভেবে নিল। আড়ে আড়ে একবার তাকিয়ে চোখ কুঁচকে ঠোঁট ছুঁচলো করে বলল, যদি খাদাঞ্চির দিকে যাই?

ঠোঁট কামড়ে আঁচলে আঙুল জড়াতে জড়াতে তপতী বলল, আহা, খাদাঞ্চি ছাড়া যেন পূর্ণিয়ায় আর কোনও জায়গা নেই–

নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু কেন বাপু পেটে খিদে মুখে লাজ

লাজুক হাসল তপতী। আরক্ত মুখে বলল, তোমাকে আমি বলেছি!

মৃন্ময় বলল, মুখ ফুটে না বললে কী আর বোঝা যায় না? ওখানে যাবার জন্যে তো মুখিয়েই আছিস।

আমি কিন্তু কিছুতেই খাদাঞ্চি যাব না।

যাবি যাবি, হাজারবার যাবি। নাকের ডগায় বঁড়শি আটকানো আছে, না গিয়ে কি পারবি? এখন না গেলেও লুকিয়ে চুরিয়ে তো যাবিই–

মৃন্ময় কোচোয়ানকে বলল, খাদাঞ্চি চালাও

সোমা তপতীকে লক্ষ্য করছিল। তিন বছর ধরে সে দেখছে, তপতীটা দারুণ হুল্লোড়বাজ। লজ্জা-টা বলে কিছু নেই। কিন্তু খাদাঞ্চি যাবার কথায় তার মুখে রক্তোচ্ছাস খেলে যাচ্ছে। অবাক সোমা খুব নীচু গলায় বলল, খাদাঞ্চি যাবার কথায় একেবারে লজ্জাবতী লতাটি হয়ে গেলি, কী ব্যাপার রে?

চকিতে মৃন্ময়কে দেখে নিয়ে গলার স্বর অতলে নামাল তপতী, একটা দারুণ জিনিস দেখাব বলেছিলাম না? সে জিনিসটা ওই খাদাঞ্চিতেই আছে।

জিনিসটা কী রে?

গেলেই দেখতে পাবি। একখানা বা সারপ্রাইজ দেব না।

একটু ভেবে সোমা বলল, টাঙ্গা খাদাঞ্চিতে আসবে তা হলে তুই জানতিস?

নিশ্চয়ই জানতাম। মৃন্ময়দার সঙ্গে যখন বেরিয়েছি তখন সে কি আর ওখানে না গিয়ে ছাড়বে। যা ফাজিল।

এদিকে রাস্তায় যারা যাচ্ছিল তারা প্রায় সবাই মৃন্ময়র্কে ডেকে ডেকে কথা বলছিল। কেমন আছেন মৃন্ময়বাবু? কবে এলেন? ইত্যাদি ইত্যাদি। মৃন্ময়ও কারোকে কারোকে ডাকছিল, এ বিষুণ, ক্যায়সা হায় রে?

আচ্ছা, বিষুণ নামধারী লোকটা বলে, আপ ক্যায়সা?

বহুত খু— বালবাচ্চা আচ্ছা তো?

জী—

কিংবা এ রামলগন সিং

রামগলন নামধারী লোকটা বলে, আরে বাপ, মিরিনমায়বাবু। (মৃন্ময়বাবু) আপ কব পূর্ণিয়া আয়া?

মৃন্ময় বলে, পরশু রোজ

আরে বাপ পরশু রোজ আয়া, হাম নহী জানে—

জানবি কী করে? দেখা তো হয়নি। এখনও তাড়ি খাস, বউকে পেটাস?

এক হাত জিভ কেটে রামলগন প্রায় আঁতকেই ওঠে, আরে বাপ, দারু-ঊরু কব ছোড় দিয়া

ব্যাটা ধম্মপুত্তুর হয়ে উঠেছে। ইত্যাদি ইত্যাদি।

তপতী সোমাকে বলল, মৃন্ময়দা এখানে দারুণ পপুলার। পূর্ণিয়ার এমন কেউ নেই যে তাকে চেনে না। সবার সঙ্গে ওর খাতির।

সোমা কোনওরকম উৎসাহ দেখাল না।

এক সময় বাজার এলাকাটা পিছনে ফেলে টাঙ্গাটা খানিক এগিয়ে বাঁ-ধারে ঘুরল; শিরদাঁড়ার মতো সোজা একটা রাস্তা এখান থেকে পুবে গেছে। দুধারে বাড়িঘর বেশির ভাগই টিনের চালের, মাঝে-মধ্যে পুরোনো আমলের কিছু একতলা। আচমকা বিশাল কম্পাউন্ডওলা একটা তিনতলাও চোখে পড়ল।

রাস্তায় ভিড়-টিড় বিশেষ নেই, দু-চারটে সাইকেল-রিকশা হুস হুস বেরিয়ে যাচ্ছে, কদাচিৎ এক-আধটা টাঙ্গা। কলকাতার হইচই, ট্রাফিক আর জনস্রোতের কথা মনে পড়ল সোমার। সর্বক্ষণ ফুটন্ত টগবগে সেই শহরটির তুলনায় এ শহর কত নির্জন, কত স্তিমিত আর নিরুত্তেজ। সোমার স্নায়ু জুড়িয়ে আসতে লাগল।

রাস্তার লোকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে মুখ ফিরিয়ে মৃন্ময় সোমাকে বলল, এই রাস্তাটা সোজা খাদাঞ্চি আর লাইন বাজার হয়ে হাইওয়েতে মিশেছে।

লোকটাকে কে যে গাইডের ভূমিকা নিতে বলেছে, সে-ই জানে। সোমা উত্তর না দিয়ে উদাসীন গম্ভীর মুখে বসে থাকল।

যাই হোক রাস্তাটা চেনা-চেনা লাগছিল। সোমা তপতীকে আস্তে করে বলল, এই পথটা দিয়ে আজ দুপুরে আমরা তোদের বাড়ি গেছি না?

তপতী উত্তর দেবার আগেই টাঙ্গাওলার পাশ থেকে মৃন্ময় চেঁচিয়ে উঠল, ঠিক ধরেছেন। আপনার মেমারি তো দারুণ শার্প দেখছি; একবার গিয়েই রাস্তাটাকে ঠিক ঠিক মনে করে রেখেছেন। আমার আবার বুঝলেন নিজের মাথাটা দেখিয়ে মৃন্ময় বলল, এটার ভেতর গোবর পোরা। একবারে তো পারবই না সাতবার দেখলেও মনে থাকবে কিনা সন্দেহ।

দাঁতে দাঁত চেপে রইল সোমা। এই গায়ে-পড়া বাজে টাইপের বাঁচাল লোকটাকে অনেক আগেই ঠান্ডা করে দিতে পারত; নেহাত তপতীর দাদা তাই চুপ করে আছে। আরেকটু বাড়াবাড়ি দেখলে নির্ঘাৎ চড় কষিয়ে দেবে।

কিছুক্ষণ যাবার পর ধবধবে সাদা বিরাট একখানা মসজিদ পড়ল, তার কারুকাজ করা গম্বুজে শেষ বেলার আলো এসে পড়েছে। মৃন্ময় বলল, এই মসজিদটার বয়স অনেক। কেউ কেউ বলে সেই নবাবি আমলে তৈরি হয়েছিল।

সোমা উত্তর দিল না।

মসজিদ পেরিয়ে আরো কিছুটা গিয়ে একটা তেরাস্তার মুখে এলে মৃন্ময় হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, এ বগেড়িলাল রুখো–রুখো{ টাঙ্গাওলার নাম বগেছিলাল। টাঙ্গা থেমে গেল।

মৃন্ময় তপতীর দিকে ফিরে ঠোঁট টিপে কৌতুকের গলায় বলল, যা, সোমেশের বাবা-মার সঙ্গে একটু দেখা করে আয়।

মুখ নামিয়ে নখ খুটতে খুটতে তপতী বলল, আজ থাক, পরে একদিন যাব।

না-না, আজই যাব। বুড়োবুড়ি একলা পড়ে থাকে; তুই গেলে খুব খুশি হবে।

তপতী নখ খুঁটতেই থাকল।

এবার আর কৌতুক-টৌতুক না, সস্নেহ কোমল স্বরে মৃন্ময় বলল, যা–যা-তোর বন্ধুকেও নিয়ে যা।

তুমি যাবে না?

না, আমার ওপর বুড়োবুড়ি কেমন চটা জানিস তো; দেখলেই খেপে উঠবে।

তপতী হাসল, খেপবার কাজ করলে খেপবে না?

মৃন্ময় বলল, আচ্ছা তোরা তাড়াতাড়ি ঘুরে-টুরে আয়, আবার জমে যাস না। আমি ততক্ষণ বগেড়িলালের সঙ্গে গল্প করছি।

সোমাকে নিয়ে তপতী নেমে পড়ল। তারপর সে রাস্তাটা সোজা ডানদিকে চলে গেছে সেটা ধরে হাঁটতে লাগল।

একটু আগে মৃন্ময় আর তপতী যা বলছিল তার কিছুই বুঝতে পারছিল না সোমা। মৃন্ময়ের সামনে কিছু জিগ্যেস করতেও তার ইচ্ছা হয়নি, কোন কথায় কী ইতর রসিকতা করে বসবে, লোকটাকে বিশ্বাস নেই।

বন্ধুকে একলা পেয়ে সোমা যখন কিছু বলতে যাবে সেই সময় ওরা একটা বড় দোতলা বাড়ির সামনে এসে গেছে। কাঠের গেট খুলতে খুলতে তপতী বলল, আর মাস ছয়েক পর পুর্ণিয়া এলে তুই গোলাপ বাড়িতে উঠতিস না, তোকে এখানে এনেই তুলতাম।

তার মানে?

আলতো করে সোমার কাঁধে একটা টোকা দিয়ে তপতী বলল, এক নম্বরের হাঁদারাম তুই, মাথায় তোর কিছু নেই।

বিদ্যুৎ চমকের মতো কী একটা আভাস পেয়ে গেল সোমা। বলল, তা হলে কি এটা তোর

ভাবী শ্বশুর বাড়ি।

এই দারুণ জিনিসটা দেখবার কথাই তখন বলেছিলি?

ইয়েস ফ্রেন্ড।

সোমেশ তাহলে—

নিজের বুকে একটা আঙুল রেখে তপতী বলল, আমার হৃদয়েশ্বর।

তিন বছর একসঙ্গে আছি; এই সুখবরটা তো আগে দিসনি—

ভেবেছিলাম, পূর্ণিয়ায় এনে তোকে একটা সারপ্রাইজ দেব।

সোমা খুব আগ্রহের গলায় বলল, দারুণ সারপ্রাইজ দিয়েছিস। এখন তাড়াতাড়ি গিয়ে তোর প্রাণেশ্বরের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দে–

দুহাতের সবগুলো আঙুল এবং মাথা একসঙ্গে নেড়ে তপতী বলল, ওটি পারব না।

কেন?

প্রভু এখন ইন্ডিয়ার বাইরে; আমেরিকায় রিসার্চ করছেন।

তোদের কদ্দিনের আলাপ?

সেই ছেলেবেলা থেকে। এক শহরেরই ছেলে মেয়ে আমরা।

সোমা হাসল, বেশ দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার।

তপতীও হাসল, যা বলেছিস।

হঠাৎ কী মনে পড়তে সোমা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, বুড়োবুড়ি মানে তোর শ্বশুর শাশুড়ী মৃন্ময়বাবুকে দেখলে খেপে যাবে কেন?

আর বলিস না, মৃন্ময়দাটা মহা ফাজিল। বুড়োবুড়ির বিদঘুঁটে কাটুন এঁকে একবার উপহার দিয়েছিল, তাতেই চটে আছে।

সোমা কিছু বলল না। মৃন্ময় সম্বন্ধে তার বিরক্তি আরেকটু বাড়ল শুধু। দুটি বৃদ্ধ মানুষকে নিয়ে যে এমন অসভ্যতা করতে পারে সে যে কতখানি ইতর, বলে না দিলেও চলে।

গেটের পর অনেকখানি খোলামেলা জায়গা। একধারে ছোটখাটো বাগান; আরেকধারে কুয়োতলা, ঘাসের জমি। মাঝখান দিয়ে শুরকির রাস্তা।

কথা বলতে বলতে ওরা গাড়িবারান্দার নীচে এসে পড়ল। একটা মধ্যবয়সি হিন্দুস্থানি চাকর খুব পুরোনো মডেলের একটা ফোর্ড গাড়ি ঝাড়ামোছা করছিল। তপতীকে দেখে বালকের মতন আনন্দে সে প্রায় লাফিয়ে উঠল, আরে দিদিমণি, আপ কব আগয়ী?

আজই। তপতী হাসল।

আইয়ে আইয়ে, বলেই সে ভেতর দিকে খবর দিতে ছুটল।

তপতী দাঁড়াল না, সোমাকে সঙ্গে নিয়ে ভেতরে ঢুকে দোতলায় উঠে এল। আর উঠতেই দেখা গেল সিঁড়ির মুখে একটি বৃদ্ধ আর বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে আছেন। দুজনেই প্রচণ্ড মোটা; দেখেই টের পাওয়া যায় তাদের রাতের শরীর। এখন বেশ গরম পড়ে গেছে। তবু দুজনের পায়ে পুরু মোজা, গলায় কম্ফোটার। হয়তো ওঁরা শীতকাতুরে, কিংবা একটুতেই ঠান্ডা লেগে যায়। তাই চারদিকে দুর্গ সাজিয়ে রেখেছেন। সোমা অনুমান করল, এঁরাই তপতীর ভাবী শ্বশুর-শাশুড়ি। দারুণ মোটা বলেই হয়তো এঁদের নিয়ে কার্টুন এঁকেছে মৃন্ময়।

বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধার পিছনে গন্ডাদুয়েক ঠাকুর-চাকর দাঁড়িয়ে ছিল। তপতীকে দেখে তারা ভারি খুশি, তাদের চোখে হাসি ছলকে ছলকে যাচ্ছে।

তপতী বৃদ্ধ বৃদ্ধাকে প্রণাম করল; দেখাদেখি সোমাও। স্নেহময় উজ্জ্বল চোখে বৃদ্ধা বললেন, এই মেয়েটি কে রে তপতী? আগে তো দেখিনি।

সোমার পরিচয় দিল তপতী। এবার বৃদ্ধ বললেন, সোমা মা, তপতীর সঙ্গে তুমি আমাদের বাড়ি এসেছ, খুব খুশি হয়েছি। চল ভেতরে গিয়ে বসি।

বৃদ্ধা এবং বৃদ্ধা ওদের নিয়ে সামনের একটা ঘরে এলেন। তপতীদের সোফায় বসিয়ে পুরু গদিওলা দুটো ইজিচেয়ারে তারা প্রায় শুয়েই পড়লেন। সিঁড়ির মুখ থেকে ঘর পর্যন্ত আসতে দুজনেই ক্লান্ত হয়ে গেছেন; বড় বড় শ্বাস পড়ছে। কিছুক্ষণ হাঁপিয়ে বৃদ্ধ তপতীর খবর নিলেন। কবে এসেছে, কদিনের ছুটি, কেমন আছে, এতদিন আসেনি কেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।

তারপর বৃদ্ধা বললেন, সোমেশ তোকে এর মধ্যে চিঠিপত্র দিয়েছে?

সোমা অনুমান করল, ছেলেবেলা থেকে দেখছেন বলেই ওঁরা তপতীকে তুই করে বলে।

তপতী রক্তাক্ত মুখ নীচু করে বসে থাকল।

বৃদ্ধা বললেন, তুমি না আজকালকার মেয়ে; অত লজ্জা কীসের?

মৃদু গলায় তপতী বলল, মাসখানেক আগে একটা পেয়েছিলাম।

কাল সোমেশের চিঠি এসেছে। তুইও নিশ্চয়ই পাবি। খুব সুখবর আছে।

দ্রুত মুখ তুলেই নামিয়ে নিল তপতী; তার চোখ আগ্রহে ঝকমক করছে।

বৃদ্ধ বললেন, সোমেশ ডক্টরেট পেয়ে গেছে; মাস তিনেকের মধ্যেই ফিরছে।

তপতী এবারও কিছু বলল না। পাশ থেকে সোমা লক্ষ্য করল তপতীর চোখ মুখ সারা গায়ে আনন্দের আভা ছড়িয়ে পড়ছে।

সোমেশের মা বললেন, সোমেশ এলে আমি কিন্তু আর কোনও কথা শুনব না। প্রথম যে তারিখটা পাব সেদিনই দুই হাত এক করে দেব। এখন তো তেমন জোর নেই কিন্তু বিয়েটা হয়ে যাক, কলকাতায় পড়ে থাকা চলবে না।

সোমেশের বাবা বললেন, কলেজের চাকরিটা ছেড়ে দিতে হবে। আমার একটা ছেলের বউ, সে চোখের আড়ালে দূরে দূরে থাকবে, সেটি হবে না। ছেলেকেও জানিয়ে দিয়েছি, ডক্টরেট হও আর যা-ই হও, চাকরির জন্যে দিল্লি-কলকাতা-বোম্বাই যেতে পারবে না, পুর্ণিয়াতেই যা পাও জুটিয়ে নিতে হবে। বেশি টাকা আমাদের দরকার নেই।

সোমেশের মা বললেন, এই বুড়ো বয়সে ছেলে ছেলের বউকে ছেড়ে থাকতে পারব না বাপু। বলতে বলতে হাতের ভর দিয়ে উঠে বাইরে চলে গেলেন।

একটু পর যখন ফিরে এলেন সঙ্গে দুটো চাকর। তাদের হাতে নানারকমকের প্লেটে রাজ্যের খাবার।

সোমেশের মা নিজের হাতে দুটো ছোট টেবিল টেনে এনে তপতীদের সামনে রাখতে রাখতে চাকরদের বললেন, এখানে প্লেটগুলো দে

খাবার দেখেই আদুরে কিশোরীর মতো নাকে কাঁদতে শুরু করল তপতী, এত কখনো খাওয়া যায়?

সোমেশের মা বললেন, নিশ্চয়ই খাওয়া যায়, তোদর বয়সটাই তো খাবার বয়স। যা হাতে করে দেব লক্ষ্মীমেয়ের মতো খেয়ে নিবি। কখনও ধমকে কখনও পিঠে হাত বুলিয়ে তিনি তপতীকে খাওয়াতে লাগলেন। বলতে লাগলেন, কলকাতার হস্টেলে কী যে খাস, তুই-ই জানিস। ছমাস আগে দেখেছিলাম, তখনও কী সুন্দর চেহারা। আর এখন কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে পড়েছে, গায়ের রঙ কালি। দাঁড়াও তোমাকে একবার হাতে পাই–

আরো কিছুক্ষণ গল্প-টল্প করে তপতীরা উঠে পড়ল। সোমেশের বাবা-মা বারবার বলে দিলেন বিয়ের সময় সোমা যেন নিশ্চয়ই আসে; আগে থেকেই তারা নিমন্ত্রণ করে রাখলেন। তারপর ওঁরা দুজনেই ভারী শরীর নিয়ে গেট পর্যন্ত তপতীদের এগিয়ে দিয়ে গেলেন।

রাস্তায় বেরিয়ে তপতী বলল, আমার শশুর বাড়ি কেমন দেখলি বল—

সোমা বলল, খুব ভালো।

আর শ্বশুর-শ্বাশুড়ি?

চমৎকার। তোকে দারুণ ভালোবাসে।

সবই ভালো। তবে–মুখ কাচুমাচু করে কপট ভয়ের গলায় তপতী বলল, এই শাশুড়ির পাল্লায় পড়লে খেয়ে খেয়েই আমি মরে যাব।

তপতীকে কত উজ্জ্বল, সুখী এবং পরিতৃপ্ত দেখাচ্ছে। হঠাৎ ভীষণ ঈর্ষা হতে লাগল সোমার। এমন একটা সুখের ঘরে সে-ও তো আসতে পারত। কিন্তু সেই লোকটা? স্মৃতির অতল থেকে উগ্র দুর্গন্ধের মতো উঠে এল বিকাশ। সেই পুরোনো বিষাদটা আবার যেন চারদিক থেকে জাল ছোট করে এনে তাকে ঘিরে ফেলতে লাগল।

অন্যমনস্কর মতো তপতীর সঙ্গে টাঙ্গায় ফিরে এল সোমা। টাঙ্গাওলার পাশ থেকে মৃন্ময় চেঁচিয়ে উঠল, গেলি পাঁচ মিনিটের জন্যে এলি তিন ঘণ্টা কাটিয়ে। বুড়োবুড়ির সঙ্গে কী এত গল্প করছিলি?

সত্যি অনেক দেরি হয়ে গেছে। যখন সোমেশদের বাড়ি যায় তখনও চারদিকে রোদের ছড়াছড়ি। কিন্তু এখন দিনের আলো বলতে কোথাও কিছু নেই, অন্ধকারে আলোটা ঝাপসা। একটা দুটো করে তারা ফুটছে। রাস্তায় মিউনিসিপ্যালিটির বাতিগুলো চোখ মেলতে শুরু করেছে।

তপতী বলল, এই কত রকম–

মৃন্ময় বলল, বুড়োবুড়ির সঙ্গে এতক্ষণ কাটালি; সোমেশ থাকলে দেখছি গল্পে গল্পে রাত কাবারই করে ফেলতিস।

সে যে একটা কলেজের অধ্যাপিকা, তপতীর মনে রইল না। চপলা বালিকার মতো সে জিভ ভ্যাংচাল, এ-হে-হে, তোমায় বলেছে–

টাঙ্গা চলতে শুরু করেছিল। মৃন্ময় বলল, এখনই বাড়ি ফিরে কী হবে। চল কাপ্তান পুল পর্যন্ত ঘুরে আসি। একটু পর পূর্ণিমার চাঁদ উঠবে। যা লাভলি লাগবে না

তপতী উৎসাহের গলায় বলল, তাই চলো।

টাঙ্গা লাইন বাজার ধরে কাপ্তান পুলের দিকে চলল। মৃন্ময় এবার সোমাকে বলল, তপীর শ্বশুর-শাশুড়িকে কী রকম দেখলেন ম্যাডাম? জোড়া বিন্ধ্য পর্বত, না? কার্টুনের এমন সাবজেক্ট আর হয় না–

সোমা উত্তর দিল না।

আর যেন কী একটা বলল মৃন্ময়, সোমা এবার আর শুনতে পেল না। কাপ্তান পুলের দিকে যেতে যেতে রুপোর আলোর মতো চাঁদটা কখন দিগন্তের তলা থেকে উঠে এল, কখন লাইন বাজার পার হয়ে দুধারে ধু-ধু মাঠ আর বিল আর ঝোপছাপ গাছপালা কুয়াশার আবছা হয়ে যেতে লাগল, কখন দক্ষিণ দিক থেকে ঝিরঝিরে স্নিগ্ধ বাতাস ছাড়ল সোমা জানে না। সেই লোকটা যার নাম বিকাশ, বিকাশ মিত্র এখন তার অস্তিত্ব জুড়ে একটা দুর্গন্ধময় কদর্য মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে।

.

বিকাশকে প্রথম দেখেছিল কবে? স্পষ্ট মনে আছে, বছর পাঁচেক আগে— এক পিকনিকে।

লক্ষ্ণৌ থেকে সে বছরই প্রথম কলকাতায় এসেছে সোমা। সেন্ট্রাল ক্যালকাটার এক হস্টেলে থাকত আর ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস করত। ইউনিভার্সিটি আর হস্টেল ছাড়া জটিল অরণ্যের মতো এই বিশাল শহরের প্রায় সবটুকুই তার অচেনা। অবশ্য ছুটিছাটায় কিংবা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে দু-একটা সিনেমা-টিনেমা দেখত। উত্তরে শ্যামবাজার, দক্ষিণে চৌরঙ্গি–তার কলকাতা এইটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

ফিফথ ইয়ারের শেষাশেষি ক্লাসের এক বন্ধু, রুবি-রুবি দত্ত, দারুণ আপস্টার্ট, ঠোঁটে নখে টকটকে রঙ, গায়ে আট ইঞ্চি ঝুলের স্লিভলেশ ব্লাউজ–আঁকা চোখে চাকার মতো প্রকাণ্ড গগস, উন্মক্ত ঘাড় পেট এবং বুকের অনেকটা–একদিন বলল, এই সোমা, আসছে রোববার আমাদের সঙ্গে বেড়াতে যাবি।

কলকাতার মেয়ে বলেই হয়তো, কিংবা নিজের স্বভাবের মধ্যেই স্নিগ্ধ অনুদ্ধত একটি চিরকালের বাঙালি মেয়ে আছে বলেই কিনা, রুবিকে খুব একটা পছন্দ করত না সোমা। অথচ এই মেয়েটা সম্বন্ধে তার দুরন্ত আকর্ষণও ছিল। কেন ছিল, সে বুঝিয়ে বলতে পারবে না। ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অনুভূতির। সোমা বলেছিল, কোথায়?

পিকনিকে।

পিকনিকটা কলকাতাতেই হবে?

আরে না, কলকাতায় পিকনিক করে মজা আছে নাকি? তার চাইতে ভালো একটা রেস্তোরাঁয় গিয়ে খেয়ে এলেই হয়। ঠিক করেছি ব্যারাকপুরে গঙ্গার ধারে একটা বড় বাগানবাড়ি নেব

সে এখান থেকে কতদুর?

কাছেই। এতদিন কলকাতায় এসেছিস, শহরটা ভালো করে দেখলিই না; কারো সঙ্গে মেলামেশাও করিস না। একেবারে পল্লীবালার মতো ঘরের কোণে আটকে আছিস। তোকে মানুষ করতে হবে দেখছি।

ভয়ে ভয়ে সোমা জিগ্যেস করেছিল, কখন যেতে হবে?

সকালে।

ফিরবি কখন?

আগে তো যাই; তারপর ফেরার কথা।

আর কে কে যাচ্ছে?

এই আমাদের কজন বন্ধু-টন্ধু ক্লাসের কটি মেয়ের নাম করছিল রুবি। তারপর বলেছিল, তাছাড়া বাইরেরও আছে।

তপতী জিগ্যেস করেছিল, বাইরের কারা?

সে আছে, তুই চিনবি না।

পিকনিকটা পুরোপুরি মেয়েদেরই তো?

রুবি থমকে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ অবাক তাকিয়ে থেকে আচমকা শব্দ করে হেসে উঠেছিল, হাসতে হাসতে তার পেটে খিচ ধরে যাচ্ছিল যেন। এমন অদ্ভুত মজার কথা আগে আর কখনও শোনেনি সে।

বিমূঢ়ের মতো সোমা বলেছিল, হাসছিস যে?

হাসব না তো কী! তুই কোন যুগের মেয়ে রে?

সোমা থতিয়ে গিয়েছিল, না, মানে—

মানে-টানে থাক; এখন লক্ষ্মী মেয়ের মতো কুড়িটা টাকা চাঁদা বার কর তো৷

সেই রবিবারই ব্যারাকপুর গিয়েছিল সোমা। সেখানে গিয়ে দ্যাখে অনেক যুবক-যুবতী আগেই এসে গেছে। মেয়েদের চাইতে ছেলেদের ভিড়ই বেশি।

ক্লাসের কটি বন্ধু ছাড়া অন্য ছেলে মেয়েরা তার অচেনা। মেয়েগুলোর সাজসজ্জা রুবির মতোই। ফাঁপানো চুল রাঙানো নখ, আধখোলা শরীর। ছেলেদের টাইট লো-কাট ট্রাউজার আর জ্যাকেট কিংবা শার্কস্কিনের কলারওলা পাঞ্জাবি। কঁধ পর্যন্ত নেমে আসা হিপি-মার্কা চুল, মোটা লম্বা জুলপি। কারো কাঁধে ক্যামেরা, কারো ট্রানজিস্টার। দেখতে দেখতে সোমার মনে হতে লাগল, এই যুবক-যুবতীরা নতুন অ্যাফ্লুয়েন্ট সোসাইটি থেকেই বুঝিবা উঠে এসেছে।

কবি সবার সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিল, হিয়ার ইজ আওয়ার নিউ ফ্রেন্ড সোমা, ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর যাদের সঙ্গে পরিচয় করানো হল তাদের এক গাদা নাম বলে গেছে রুবি, এ হল পল্লব, এ সোনিয়া, এ জয়া, এ বিপ্লব, এ সোমনাথ, এ ইন্দ্রাণী, এ হল বরুণ

সবার শেষে রুবি যার নাম করেছিল সে বিকাশ, বিকাশ মিত্র। এতগুলো ছেলেমেয়ের মধ্যে সে-ই সব চাইতে স্মার্ট, সব চাইতে ঝকঝকে, সব চাইতে ফর্সা। তার দিকে তাকিয়ে সোমার চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল।

রুবি বলেছিল, এ হল বিকাশ, আওয়ার ওল্ড প্যাল। এ বছর মেকানিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিংয়ে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছে। আর হয়েই দারুণ একখানা চাকরি বাগিয়ে ফেলেছে। স্টার্টিংয়ের দেড় হাজার টাকা। দু-এক বছরের ভেতর ওদের কোম্পানি ওকে আমেরিকা-টামেরিকা পাঠিয়ে দেবে।

রুবি সমানে বকে যাচ্ছিল; সোমা কিন্তু বিশেষ শুনছিল-টুনছিল না। বিকাশের দিকে পলকহীন তাকিয়ে ছিল সে।

এদিকে পরিচয়-টরিচয় হয়ে যাবার পর সোমা দুহাত জোড়া করতে যাচ্ছিল, তার আগেই নিজের হাত বাড়িয়ে সোমার একটা হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বলেছিল বিকাশ, সো গ্ল্যাড টু মিট ইউ। নাই উই আর অল ফ্রেন্ডস, আমি কিন্তু তোমাকে আপনি-টাপনি করে বলতে পারব না। অ্যান্ড আই উইল এক্সপেক্ট, তুমিও আমাদের তুমি করেই বলবে।

রুবি সঙ্গে সঙ্গে সায় দিয়েছিল, ও সিওর, সিওর। সোমা উত্তর দেয়নি।

রুবি আবার বলেছিল, বুঝলে বিকাশ, আমার এই বন্ধুটা দারুণ শাই। ভেবেছিলাম আমিই ওকে মানুষ-টানুষ করব। কিন্তু এ ব্যাপারে তোমার এফিসিয়েন্সি আমার চেয়ে অনেক বেশি। তুমিই ওর দায়িত্ব নাও।

বিকাশ দুই হাত দুদিকে ছড়িয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিল, মোস্ট গ্ল্যাডলি।

তোমরা কথাবার্তা বলো; আমি পল্লবের কাছে যাই। দূরে আঁকড়া-মাথা প্রকাণ্ড জামরুল গাছের তলায় যে যুবকটি ট্রানজিস্টর শুনছিল, প্রায় উড়তে উড়তে তার কাছে চলে গিয়েছিল রুবি।

একটু চুপ করে থেকে বিকাশ বলেছিল, চলো, কোথাও বসি; তোমার সঙ্গে জমিয়ে খানিকটা আড্ডা দেওয়া যাক।

সোমার আপত্তি ছিল না, এমন অসঙ্কোচ স্মার্ট ছেলে আগে আর কখনও দ্যাখেনি সে। বেশ ভালোই লাগছিল, আর পায়ের তলার স্রোতের টান অনুভব করছিল সোমা।

একটা পছন্দমতো জায়গার খোঁজে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছিল বিকাশ। চারধারে গাছপালা, মাধবীলতার, ঝোপ, ঝোপগুলোর ভেতর সিমেন্টের বেঞ্চ, সেগুলোর মাথায় লাল-নীল ছাতা; সেই দিনটার জন্য ওই ছাতাগুলো লাগানো হয়েছিল। মাঝখানে প্রকাণ্ড লম্বাটে দীঘি, এক দিকে সানবাঁধানো লাল ঘাট, আরেক দিকে ডাইভিং বোর্ড। বোর্ডটার ওপাশে পোশাক বদলাবার জন্য দুটো বড় ঘর। একটু পুরুষদের জন্য, অন্যটা মেয়েদের।

দেখতে দেখতে দীঘির দক্ষিণ প্রান্তে একটা ছায়াচ্ছন্ন নির্জন ঝোপ চোখে পড়েছিল বিকাশের। সে চেঁচিয়ে উঠেছিল, গ্র্যান্ড, চলো, ওখানে গিয়ে বসি।

ঝোপটার দিকে যেতে যেতে সোমা লক্ষ্য করছিল, মাধবীলতার ঝাড়গুলোর কিংবা বড় বড় গাছের তলায় জোড়া জোড়া যুবক-যুবতী বসে আছে। অনেকে আবার দলবদ্ধভাবে পুকুরপাড়ের সরু নুড়ি বিছানো রাস্তায় ঘুরছিল, অনেক আড্ডা দিতে দিতে হুল্লোড় করছিল।

ওরা যখন পাশাপাশি হাঁটছিল, তখন আশপাশ থেকে নানারকম মন্তব্য ভেসে আসছিল, চিয়ার ইউ লাকি ডগ–কিংবা উইশ ইউ বেস্ট অফ লাক

হেসে হেসে সবার উদ্দেশ্যেই বিকাশ বলছিল, থ্যাঙ্কস্থ্যাঙ্কস্থ্যাঙ্কস্

কেউ কেউ আবার চোখ টিপে ইঙ্গিত করছিল। মন্তব্যগুলোয় কিংবা চোখের ইশারায় না বুঝবার কিছু ছিল না। সোমার কান গরম হয়ে উঠছিল, চোখ মুখ আঁ আঁ করছিল। তার ভেতরেই দীঘিপারের ঝোপে গিয়ে বসে ছিল।

সোমার দিকে পলকহীন তাকিয়ে বিকাশ বলেছিল, আমার কিউরিসিটির প্রায় ফেমিনিন বলতে পারো। এখন তোমার কথা বলো–ডিটেলস চাই, কিছু বাদ দেবে না।

আমার কোন কথা?

এই তোমার ফ্যামিলির, তোমার অ্যাম্বিসনের, তোমার ভবিষ্যতের।

সোমা তাদের ফ্যামিলির কথা বলেছিল। অ্যাম্বিসান সম্বন্ধে ভাষা-ভাষা উত্তর দিয়েছিল। আর ভবিষ্যৎ? এ ব্যাপারে তখন তেমন কিছু ভাবেনি সে।

বিকাশও তার সব কথাই বলেছিল। তার বাবা রেয়ার প্রিশিসান মেশিনারির ইমপোর্ট লাইসেন্স পেয়ে কিছু টাকা পয়সা করেছেন, নিউ আলিপুরে তাদের নতুন বাড়ি হয়েছে, বিকাশের ভাই বোন কেউ নেই, সে একা। জীবনে তার বিরাট উচ্চাশা; কিছুদিন এখানে চাকরি-বাকরি করে কোম্পানির পয়সায় সে আমেরিকায় যাবে; ওখানে রিসার্চ করবার খুব ইচ্ছা; ফিরে এসে একটা কারখানা খুলবে। ইত্যাদি ইত্যাদি।

গল্পে গল্পে দুপুর হয়ে গিয়েছিল। পুকুরের ওপারে একটা ঘর থেকে খাবারের সুঘ্রাণ ভেসে আসছিল। বাবুর্চি-টাবুর্চি নিয়ে আসা হয়েছে, তারাই ওখানে রান্না-বান্না করছিল।

এই সময় একটি যুবক চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছিল খাবার রেডি, এবার সবাই স্নান করে নাও তারপরেই দেখা গেল, ঝোপঝাড় থেকে গাছতলা থেকে যুবক-যুবতীরা হুড়মুড় করে বেরিয়ে এসে ডাইভিং বোর্ডের ওপাশের ঘরে ছুটল। একটু পর সুইমিং কস্টিউম পরে যখন ওরা বেরিয়ে এসে জলে ঝাঁপ দিল, সে দৃশ্য তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে পারছিল না সোমা।

বিকাশ বলল, চলো, স্নান করি

সোমা মাথা নাড়ল, আমি স্নান করে এসেছি। তাছাড়া সাঁতার জানি না। পুকুরে কখনও নামিনি।

উৎসাহের গলায় বিকাশ বলল, তা হলে তো নামতেই হয়; একস্ট্রা কস্টিউম নিশ্চয়ই দু-একটা পাওয়া যাবে। চলো, তোমাকে সাঁতার শেখাই।

জোরে জোরে প্রবলবেগে মাথা নেড়ে সোমা বলল, না না, আমাকে ক্ষমা করুন। আপনি স্নান করে আসুন।

হঠাৎ চোখ গোল করে বিকাশ বলল, এটা কী রকম হল? উই আর ফ্রেন্ডস; একটু আগে জেন্টলম্যানস এগ্রিমেন্ট হল, আমরা তুমি করে বলব। অথচ তুমি এখনও আপনি করে চালাচ্ছ!

একদিনে কি আর তুমি বলতে পারব! ওর জন্যে সময় লাগবে।

তোমার বন্ধু রুবি কিন্তু প্রথম দিনই বলেছিল।

আমি যে রুবি নই।

একপলক সোমাকে দেখে নিয়ে বিকাশ বলেছিল, তা ঠিক; তুমি ডিফারেন্ট। বলেই সে টয়লেটের দিকে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এসে জলে ঝাঁপ দিল। তারপর বদ্ধ জলাশয়ে মাছের মতো যুবক-যুবতীরা যেভাবে খেলতে লাগল, তেমন খেলার দৃশ্য আগে আর কখনও দ্যাখেনি সোমা।

স্নানের পর হইচই করে খাওয়া-দাওয়া। তারপর সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গাছতলায় অনেকক্ষণ গড়িয়ে নিল। রোদের রঙ যখন হলুদ হয়ে এল, সেইসময় রুবি বলল, এবার একটু গান-টান হোক–

গ্র্যান্ড আইডিয়া! লোকসভায় প্রস্তাব পাস করার মতো সবাই চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে সায় দিল।

বিকাশ হঠাৎ বলে উঠল, আমার একটা বক্তব্য আছে। আমাদের নিউ ফ্রেন্ড, মানে সোমা আজ গান-টান গেয়ে কিংবা বাজিয়ে কিংবা নেচে আমাদের আনন্দ বর্ধন করবে।

লাভলি প্রোপোজাল। আমরা হোল-হার্টেডুলি সমর্থন করছি।

বিব্রতভাবে চারদিকে তাকিয়ে সোমা বলল, দেখুন, আমি নাচ-গান-টান কিছু জানি না। ম্যাক্সিমাম একটা আবৃত্তি করতে পারি।

একটা ছেলে ঠোঁট ছুঁচলো করে বলল, আবৃত্তি! মানে রেসিটেসন। কী রিসাইট করতে চান?

রবীন্দ্রনাথের কোনও কবিতা।

রবীন্দ্রনাথ? দেখুন ওই মানুষটার ওপর আমাদের সবার দারুণ শ্রদ্ধা, কিন্তু আমাদের গেট-টুগেদারে রবীন্দ্রনাথকে টানাটানি না করাই ভালো। বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা লাইট; হুল্লোড়বাজি আর কী। তার ভেতর গুরুগম্ভীর জিনিস ঢোকালে আনন্দটাই নষ্ট। আপনি বরং আজ আমাদের পারফর্মেন্স দেখুন। পরে আরেক দিন পার্টিসিপেট করবেন।

মনে মনে ছেলেটাকে হাজারটা ধন্যবাদ দিল সোমা। মুখে বলল, সেই ভালো।

একটি মেয়ে তার নাম ইন্দ্রাণী, বলল, তা হলে বিকাশ, তোমার পপ গান দিয়েই আজ শুভারম্ভ হোক–

ইজিলি, বিকাশ উঠে দাঁড়াল। তারপর দুহাত সামনে ছড়িয়ে দিয়ে শুরু করল, মাই ডার্লিং–মাই ডালিং, কেম ডাউন ফ্রম দা সিলভারি মুন–রাম্বা–রাম্বা–

আরেকটি ছেলে স্প্যানিশ গিটার বাজিয়ে বিকাশকে সাহায্য করতে লাগল।

পর পর আটটা গান গাইল বিকাশ। তার গলা বেশ ভালোই, সুরেলা। বিকাশের গানের পর রুবিরা কটি মেয়ে এবং কটা ছেলে টুইস্ট আর চা-চা-চা নাচল।

তারপর শুরু হল ফোটো ভোলা। চারধারে শুধু ক্লিক-ক্লিক-ক্লিক। সব চাইতে বেশি ফোটো তুলেছিল বিকাশ, তার সাবজেক্ট একটাই–সে হল সোমা। সোমার ফোটো তুলে তুলেই সে ফিল্ম শেষ করে ফেলেছে। ছবি তোলার পর সবাই ড্রিঙ্ক করল।

সন্ধের পর ওরা কলকাতায় ফিরে এসেছিল। এমন কী মেয়েরাও। রুবি তো ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই গেল। সোমাকে সবাই অনুরোধ করেছিল। হাতজোড় করে সে কোনওরকমে আত্মরক্ষা করেছে। এক গাড়িতে রুবি, বিকাশ, ইন্দ্রাণী, পল্লব আর সোমা। গাড়িটা বিকাশের; সে-ই চালাচ্ছিল। তার পাশে সোমা, তারপর রুবি। সোমা অন্যমনস্কর মতো সারা দিনটার কথাই ভাবছিল। ফ্রি মিক্সিং বলে একটা শব্দ আছে, এই কি তার নমুনা?

হঠাৎ পাশ থেকে রুবি বলে উঠেছিল, আজকের দিনটা কী রকম লাগল, সোমা?

সোমা বলেছিল, ইন্টারেস্টিং; দারুণ একটা অভিজ্ঞতা হল।

তুই তো আসতেই চাইছিলি না।

সোমা উত্তর দ্যায়নি।

বিকাশ ওধার থেকে বলেছিল, মাঝে মাঝেই আমরা এই রকম মিলে মিশে একটু আধটু আনন্দ করি। এবার থেকে সব গেট-টুগেদারে তোমাকে চাই কিন্তু।

আধফোটা গলায় সোমা বলেছিল, পরীক্ষা আসছে; এখন আর সময় কোথায়?

বিকাশ বলেছিল, রোজ রোজ তো আর পিকনিক-ফিকনিক হচ্ছে না। তাছাড়া পরীক্ষার এখনও এক বছর দেরি। শুধু বই নিয়ে থাকলেই কি হয়, প্যাস্টাইমও দরকার।

এক সময় ওরা কলকাতায় পৌঁছে গেল। রুবির কথা মতো সোমাকে তার হোস্টেলের কাছে নামিয়ে দিয়ে বিকাশ বলল, তুমি এখানেই থাক নাকি? জানালার বাইরে মুখ বাড়িয়ে হোস্টেল বাড়িটা ভালো করে দেখে নিয়েছিল সে।

সোমা মাথা নেড়েছিল।

বিকাশ আবার বলেছিল, হোপ টু মিট ইউ এগেন–ফির মিলেঙ্গে।

উচ্ছ্বাস এবং অনুচ্ছ্বাসের মাঝামাঝি একটা জায়গা থেকে সোমা শুধু বলেছিল, আচ্ছা।

তারপর একটা সপ্তাহে কাটেনি। এক ছুটির দিনের দুপুরে হোস্টেলবাড়ির দোতলায় নিজের ঘরের বিছানায় শুয়ে শুয়ে সিনেমা ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছিল সোমা, হঠাৎ বিকাশের স্লিপ এল। মেয়েদের হোস্টেল, তাই ওয়েটিং রুম থেকে স্লিপ পাঠাতে হয়েছে। নইলে ও যা ছেলে, দুম করে হয়তো ওপরেই চলে আসত। যাই হোক স্লিপটা হাতে নিয়েও প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিল না সোমা। বিকাশ অবশ্য আবার দেখা করবার কথা বলেছিল। কিন্তু লোকে কত কথাই তো বলে; সব কথা কি রাখবার?

হ্যাঁ আমিই। খুব অবাক হয়ে গেছ, না? বিকাশ হেসেছিল, সেদিনই কিন্তু বলেছিলাম, আবার দেখা হবে। মনে নেই?

সোমা ঘাড় কাত করেছিল, অর্থাৎ আছে।

বিকাশ এবার ব্যস্তভাবে উঠে দাঁড়িয়েছিল, কী করছিলে?

তেমন কিছু না। ভাবছিলাম একটু ঘুমোব।

দুপুরবেলা ঘুমোয় না; চটপট রেডি হয়ে এসো–

কী ব্যাপার?

আর বোলো না, এক কাণ্ড করে ফেলেছি।

কী?

এলিটে দারুণ একটা ছবি এসেছে। তোমার আর আমার জন্যে দুখানা টিকিট কেটে ফেলেছি।

একদিনের আলাপে কেউ যে এভাবে সিনেমার টিকিট নিয়ে হাজির হতে পারে, সোমা ভাবতে পারেনি। বিমূঢ়ের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে বলেছিল, টিকিটটা কেটেই ফেললেন! আমি যদি এখন হোস্টেলে না থাকতাম?

একটুও না ভেবে বিকাশ বলেছিল, না থাকলে আর কী হত? টিকিট দুটো ছিঁড়ে ফেলে দিতাম। আর দেরি কোরো না; শো কিন্তু দুটোয়।

সোমা একবার ভেবেছিল, যাবে না। কিন্তু সেই মুহূর্তে বিকাশকে না বলবার মতো শক্তি তার ছিল না। সে শুধু অনুভব করছিল দুর্দান্ত ঝড়ের মতো একটা কিছু তাকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে শুরু করেছে।

সেই শুরু। তারপর থেকে প্রায়ই হোস্টেলে আসতে লাগল বিকাশ। কখনও সে সোমাকে থিয়েটারে নিয়ে যেত, কখনও জি. টি. রোড ধরে অনেকদুর উধাও হত, কোনওদিন যেত ফিল্ম সোসাইটির দারুণ দারুণ এক্সপেরিমেন্টাল ছবি দেখাতে, যেগুলোর গায়ে শুধু সেক্সের ছড়াছড়ি। তবে সব চাইতে বেশি নিয়ে যেত পার্ক স্ট্রিটের বার-কাম-রেস্তোরাঁগুলোতে। তার ওপর পিকনিক-টিকনিক হুল্লোড়বাজি তো ছিলই।

সোমা টের পাচ্ছিল, বিকাশ তাকে দ্রুত বদলে দিচ্ছে। আপস্টার্ট যুবক-যুবতীদের যে ছাঁচ, নরম মোমের মতো তার ভেতর তাকে ঢেলে অন্যরকম একটা আকার দিতে শুরু করেছিল বিকাশ। সোমার ব্লাউজের ঝুল ছোট হতে হতে আট ইঞ্চিতে ঠেকেছিল, হাতা অদৃশ্য হয়ে স্লিভলেস হয়ে গিয়েছিল। তখন তার ঠোঁট রঞ্জিত, নখ ম্যানিকিওর কথা। চুলে শ্যাম্পু, চোখে চাকার মতো গোল চশমা এবং নাভি পর্যন্ত পেট উন্মুক্ত হয়ে গেছে। রেস্তোরাঁয় বসে এক-আধদিন বিকাশ এবং অন্য বন্ধুদের সঙ্গে বিয়ার কি শেরি খেয়ে দেখেছে সে। তবে রুবিদের মতো পাঁড় মাতাল হয়ে উঠতে পারেনি। সোমা টের পাচ্ছিল কিন্তু কিছু করার ছিল না; পাহাড়ের ঢালে এক টুকরো পাথরের মত সে দ্রুত অতলে নেমে যাচ্ছিল।

এর মধ্যে বছর দেড়েকের মতো কেটে গেছে। এম.এ পাশ করে গিয়েছিল সোমা। তারপরও কলকাতাতেই থেকে গেছে। বিকাশদের সঙ্গে আলাপ-টালাপ হবার পর লক্ষ্ণৌতে বিশেষ যেত না সে। দশবার যাবার তাড়া দিলে একবার হয়তো যেত। কলকাতা নামে এই শহর জাদুকরের মতো তখন তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।

এম.এ. পাশ করায় সোমার হাতে প্রচুর সময়। তখন বিকাশের সঙ্গে দারুণ ঘুরছে সে। কোনও কোনও দিন ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যেত, এক আধদিন ফিরতই না। এই নিয়ে হোস্টেল সুপারিন্টেন্ডেন্টের সঙ্গে রোজ কথা-কাটাকাটি, রোজ ঝগড়া। বাড়ি থেকেও ফিরে যাবার জন্য চিঠি আসছিল। বাবা ছেলে দেখছেন, সোমার বিয়ে দিয়ে কন্যাদায় থেকে মুক্ত হতে চান। সোমার তখন কোনওদিকেই চোখ ছিল না।

মনে আছে এই সময় বিকাশ অফিস থেকে কদিনের ছুটি পেয়েছিল। ছুটিটা কাটাবার জন্য সে গিয়েছিল দার্জিলিং, সঙ্গে সোমা। দার্জিলিং থেকে ফেরার তিন মাস পরেই সেই ভয়ঙ্কর ব্যাপারটা সোমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল, সে প্রেগনেন্ট। উঠতে-বসতে-চলতে ফিরতে নিজের দেহের মধ্যে আরেকটি প্রাণের অস্তিত্ব সে টের পেতে লাগল। ভীত বিমূঢ় সোমা বিকাশকে বলেছিল, আমার কী হবে?

সব শুনে শার্ট থেকে টোকা দিয়ে ধুলো ঝাড়ার মতো বিকাশ বলেছিল, ম্যাটার অফ ফাইভ মিনিটস। তোমাকে কালই একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। সে তোমাকে ফ্রি করে দেবে।

কিন্তু

কী?

চোখ-কান বুজে সমুদ্রে ঝাঁপ দেবার মতন সোমা বলেছিল, তুমি আমাকে বিয়ে করো।

বিয়ে! এমন একটা অদ্ভুত ভীতিকর শব্দ আগে আর যেন শোনেনি বিকাশ। সে বলেছিল, এই সামান্য ব্যাপারের জন্যে বিয়ে! জানোনা, রুবি দুবার অ্যাবরসান করিয়েছে, ইন্দ্রাণী একবার। করবী-হেমারা কতবার ডাক্তারের কাছে গেছে হিসেব নেই। ইটস এ শর্ট অফ এনজয়মেন্ট। বিয়ে করে এর মধ্যেই ফেঁসে যেতে চাই না। ডাক্তার-ফাত্তার ওষুধ-টোষুধের ব্যবস্থা থাকতে কে ওসব ঝামেলায় যায়। কালই তোমাকে আবার পবিত্র কুমারী করে দিচ্ছি।

সোমা বুঝেছিল, বিকাশ বিয়ে করবে না। অথচ তার কথা না শুনে উপায়ও ছিল না। পরের দিন ডাক্তারের প্রাইভেট নার্সিং হোমে ঘণ্টা দুয়েক কাটিয়ে সোমা যখন ফিরে এসেছিল তখন তার দুশ্চিন্তা নেই; বিকাশের ভাষায় আগের মতোই সে কুমারী। কিন্তু এই কয়েক ঘণ্টায় তার মধ্যে নিদারুণ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মতো কিছু একটা ঘটে গেছে। নিজেকে সে ততক্ষণে আবিষ্কার করে ফেলেছে। যতই ঠোঁট নখ ম্যানিকিওর করুক, যতই হেয়ার-টনিকে চুল ফাপাক, বিয়ারের গেলাসে চুমুক দিক নাভির তলায় শাড়ি পরুক, তার ভেতর চিরদিনের সংস্কার-ভীরু একটি মেয়ে আছে। সেদিন থেকে সে আর হোস্টেল থেকে বেরুত না। জীবন মানে এক নিষ্ঠুর খেলোয়াড় খোলামকুচির মতো তাকে অসীম শূন্যতায় ছুঁড়ে দিয়েছিল। সমস্ত পৃথিবী থেকে নিজেকে গুটিয়ে এনেছিল সোমা; তাকে ঘিরে অন্তহীন বিষাদ জমতে শুরু করেছিল।

তারপরও বিকাশ অনেকবার এসেছে, রুবিরা এসেছে। সোমা দেখা করেনি। ওয়েটিং রুম থেকেই ওরা ফিরে গেছে। লক্ষৌতে এক-আধবার গেছে কিন্তু দু-চার দিনের বেশি থাকতে পারেনি। তার মনে হয়েছে, বেশিদিন থাকলে বাবা-মার চোখে সে ধরা পড়ে যাবে। নিদারুণ পাপবোধ তখন তাকে নিয়ত দগ্ধ করছে।

যাই হোক এই সময় একটা কলেজে লেকচারারশিপ পেয়ে গিয়েছিল সোমা। পড়াতে গিয়ে ওখানেই তপতীর সঙ্গে আলাপ। আলাপের দিন থেকেই এই উজ্জ্বল প্রাণবন্ত মেয়েটা তার বন্ধু। যতদিন গেছে তপতীর প্রীতি, তপতীর ভালোবাসা তাকে মুগ্ধ করেছে। পৃথিবীতে আলো-হাওয়া-জলের মতো তপতীর বন্ধুত্বের তুলনা নেই।

বিষণ্ণ বিবর্ণ মুর্তির মতো তাকে সারাদিন চুপচাপ থাকতে দেখে তপতী কতদিন ধরে বলে আসছে, পূর্ণিয়ায় নিয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত এত কাল পর পূর্ণিয়া আসার সময় হল তার।

.

কতক্ষণ অন্যমনস্ক ছিল, সোমা জানে না। হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হাসিতে চমকে উঠল সে। দারুণ হাসছে তপতী; টাঙ্গাওলার পাশে বসে মৃন্ময়ও হাসছে।

মৃদু গলায় সোমা বলল, কী হল, হাসছিস যে?

তপতী বলল, তোর কাণ্ড দেখে। কী ভাবছিলি অত?

সোমা থতিয়ে গেল, কই, কিছু না তো।

সামনের সিট থেকে মৃন্ময় বলে উঠল, কিছু না বললেই হবে! আমরা দুজনে কম করে আটাত্তর বার ডেকেছি; আপনার সাড়া নেই। যার ধ্যান করছিলেন, সত্যিই সে ভাগ্যবান।

সোমার একবার ইচ্ছে হল, উঠে গিয়ে লোকটার গালে চড় কষায়। কিন্তু কিছুই করল না।

আরো ঘন্টাখানেক রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে তারা গোলাপবাড়িতে ফিরে এল।

.

০৭.

বাড়ি ফিরে দেখা গেল তপতীর বাবা এসে গেছেন। তপতীর মার মতো তপতীর বাবার দিকে তাকিয়েও চোখ ফেরানো যায় না। তাকে দেখলে মনে হয়, গ্রিক পুরাণের পৃষ্ঠা থেকে দেবদূত নেমে এসেছে।

তপতীর বাবার সঙ্গে আলাপ হল। মানুষটি ভারী সরল, অমায়িক। চোখ দুটি স্নেহে ভাসো-ভাসো। বললেন, তুমি কিছু মনে করোনি তত মা?

বুঝতে না পেরে সোমা বলল, কী ব্যাপারে?

তোমরা যখন এলে তখন আমি বাড়ি ছিলাম না। তোমার জন্যে অন্তত থাকা উচিত ছিল।

না না, কিছু মনে করিনি। মাসিমাই তো ছিলেন। দোলন-ঝুলন পিন্টু ছিল। আপনি না থাকতে একটুও অসুবিধা হয়নি।

দুম করে মৃন্ময় বলে উঠল, যাঃ বাবা, আমি যে একদিন আগে গিয়ে মনিহারি ঘাট থেকে নিয়ে এলাম, আমার কথাটাই বাদ চলে গেল! একেই বলে বরাত। সোমা উত্তর দিল না।

কথায় কথায় অনেক রকম প্রসঙ্গ এল। সোমাদের বাড়ির কথা, দেশের কথা, রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা, কলকাতার কথা। দেখা গেল, তপতীর বাবা কোনও ব্যাপারেই বিশেষ খবর-টবর রাখেন না, রাখার উৎসাহও নেই। নাইনটিন ফরটি ওয়ানে তিনি শেষবার কলকাতায় গিয়েছিলেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলন সম্বন্ধে তার ধারণা ভাসা-ভাসা। আলাপ-টালাপ করে মনে হতে লাগল, ভদ্রলোক এ যুগের নন।

ওঁদের গল্পের মধ্যেই তপতীর মা এসে তাড়া দিতে লাগলেন, রাত হয়েছে এবার খেতে চল সব।

.

খাবার টেবলে বসে আবার গল্প শুরু হল।

হঠাৎ কী মনে পড়তে তপতী তাড়াতাড়ি তার মাকে বলল, মা, তুমি নাকি মৃন্ময়দাকে চিঠি দিয়ে আনিয়েছ?

তপতীর মা বললেন, হ্যাঁ।

কেন?

ওর একটা বিয়ে দেব। আমি মেয়ে দেখেছি।

টেবলের দূর প্রান্ত থেকে সোমা নিজের অজান্তেই মৃন্ময়ের দিকে তাকাল। কী আশ্চর্য, মৃন্ময়ও তার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই মুখ নামিয়ে নিল সোমা। আর মৃন্ময় হেসে হেসে তপতীর মাকে বলল, ইঁদুর কলে পা দিতে আমি আর রাজি না।

তপতীর মা বললেন, বিয়েটাকে ইঁদুর কল বলছিস কেন মৃন্ময়?

মৃন্ময় বলল, আমার যা অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে ওই কথাটা ছাড়া আর কিছুই মনে আসে না।

বারবার এক রকম হবে তার কি কিছু মানে আছে?

ঘরপোড়া গরু তো বুঝতেই পারছ?

আগেরবার নিজেই পছন্দ করে বিয়ে করেছিলি, এবারটা আমার ওপর ছেড়ে দিয়ে দ্যাখ, ভালো হয় কিনা।

মৃন্ময় চুপ করে রইল।

কিছুক্ষণ নীরবতার পর তপতীর বাবা একসময় ডাকলেন, মৃন্ময়

মৃন্ময় তাকাল। তপতীর বাবা বললেন, সোমা এসেছে, তোরা ওকে পূর্ণিয়ার চারদিকটা ভালো করে দেখিয়ে দে।

মৃন্ময় উৎসাহিত হয়ে উঠল, নিশ্চয়ই। শুধু পূর্ণিয়া কেন, একদিন যোগবাণীতে গিয়ে নেপাল বর্ডার দেখিয়ে আনব, একদিন যাব মহানন্দ ব্রিজে–একের পর এক তালিকা দিয়ে যেতে লাগল মৃন্ময়।

.

০৮.

দিন দুয়েকের মধ্যে তপতীদের বাড়ির জীবনযাত্রা মোটামুটি জেনে ফেলল সোমা। তপতীর বাবা সকাল হলেই স্নান-টান সেরে চা খেয়ে টিফিন কেরিয়ারে খাবার-টাবার বোঝাই করে পুরোনো আমলের একটা সাইকেলে বেরিয়ে পড়েন। মানুষটি অদ্ভুত, সারাদিন নাকি নির্জন মাঠের মাঝখানে বসে থাকেন। পাখি দ্যাখেন, ফুল দ্যাখেন, আকাশ দ্যাখেন, গাছপালা পাখি-টাখি দ্যাখেন। মানুষের সঙ্গ বিশেষ পছন্দ করেন না। ফিরতে ফিরতে সন্ধে, কোনওদিন হয়তো খবর এল, দশ মাইল দূরের বনে সাদা শজারু বেরিয়েছে, শুনেই শজারু দেখতে ছুটলেন। কেউ হয়তো বলল অমুক জায়গায় বিচিত্র পাখি দেখা দিয়েছে, কানে আসা মাত্র রওনা হলেন। বিভূতি ভূষণের লেখায় প্রকৃতির মনোহর ছবি দেখেছে সোমা; কিন্তু এমন প্রকৃতি প্রেমিক আগে আর দ্যাখেনি সে।

সংসারের সমস্ত দায়িত্ব তপতীর মায়ের ওপর। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা থেকে কার অসুখ-বিসুখ করল, চাকর-বাকররা কাজে ফাঁকি দিচ্ছে কিনা–সব দিকে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।

তপতীর ভাইবোনেরা ভারি শান্ত, ভদ্র বিনয়ী। বাড়িতে তারা আছে কিনা, টের পাওয়া যায় না। তবে তপতীটা দারুণ চঞ্চল। দুমদাম হাঁটছে, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলছে, জোরে জোরে শব্দ করে হেসে উঠছে। আর একজনের অস্তিত্বও দারুণভাবে টের পাওয়া যায়–সে মৃন্ময়। নিস্তব্ধ বাড়িতে হঠাৎ হঠাৎ সে গেয়ে ওঠে, তুমি কোন ভাঙনের পথে এলে সুপ্ত রাতে। আমার ভাঙল যা তাই ধন্য হল চরণপাতে। কিংবা মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে সেদিন ভরা সাঁঝে কিংবা কইও কথা বন্ধুর কাছে, জল ছাড়া মীন কয়দিন বাঁচে কিংবা এ দেখো তো য়ঁহা, কোই নহী হ্যায়, কোই ভী নহী, পাশ আ যাও না– ইত্যাদি ইত্যাদি

মৃন্ময় সম্বন্ধে আরো কিছু কিছু জেনেছে সোমা। নিজে যেচে জানতে যায়নি, তপতীদের কথাবার্তা থেকে টুকরো টুকরো কানে এসেছে। মৃন্ময়ের মা-বাবা নেই। ছেলেবেলা থেকেই ফুলমাসি অর্থাৎ তপতীর মার কাছে সে মানুষ। তার স্বভাবটা অদ্ভুত; কোনও কিছুর প্রতিই বিশেস আকর্ষণ নেই। বড় বড় পাবলিসিটি ফার্মে ভালো ভালো চাকরি নিয়ে কতবার কলকাতা-বোম্বাই গেছে। কিন্তু দু-চার মাস, ভালো না লাগলেই দুম করে ছেড়ে-ছুঁড়ে চলে এসেছে। আপাতত আছে নয়া দিল্লিতে, কবে ছেড়ে দেবে ঠিক নেই। মৃন্ময়ের জীবনে একটা দুঃখ আছে, তা বিবাহ-ঘটিত। দুঃখটা ঠিক কী ধরনের এখনও জানা হয়নি।

.

যাই হোক মৃন্ময় আর তপতীর সঙ্গে একদিন নেপাল বর্ডার দেখে এল সোমা, একদিন মহানন্দা ব্রিজ পেরিয়ে গেল ওয়েস্ট দিনাজপুর। আরেকদিন গেল ফরবেসগঞ্জ। মাঝে মাঝে ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে সাইকেল রিকশায় দূর দেহাতেও চলে যেতে লাগল।

এর মধ্যেই একদিন খবর এল সোমেশ আমেরিকা থেকে ফিরে এসেছে। দেশে আসার কথা ছিল আরো পরে। কিন্তু হঠাৎ সুযোগ পেয়ে যাওয়ার আগেই এসে গেছে।

সোমেশের সঙ্গে সোমার আলাপ করিয়ে দিল তপতী। ভদ্র, নম্র, বুদ্ধিদীপ্ত সোমেশকে দেখে যত না খুশি হল সোমা তার চাইতে অনেক বেশি হল বিষণ্ণ। এমন বিষাদ আগে আর কখনও অনুভব করেনি সে। তার মনে হতে লাগল, চারপাশের সবাই যেন তাকে বঞ্চিত করেছে।

সোমেশ আসার দুদিন পর ছিল হোলি। সোমার রঙ খেলার ইচ্ছা ছিল না। তপতী সোমেশ আর মৃন্ময় জোর করে তাকে ঘরের বাইরে বার করল। অনিচ্ছুক সোমা কারো গায়ে রঙ-টঙ দিল না; তপতীরা অবশ্য আবির-টাবীর দিয়ে ওকে ভূত সাজিয়ে ছাড়ল।

রঙটা শুধু গায়েই লাগল। মনের ভেতরটা একেবারে বর্ণহীন বলা যায়, শীতের আকাশের মতো ধূসর।

হোলির পর থেকে নিজেকে আবার গুটিয়ে আনতে লাগল সোমা। সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা জায়গা, তার গাছপালা, মানুষ এবং সুন্দর দৃশ্যপট তাকে খুব বেশিদিন অন্যমনস্ক রাখতে পারল না। সেই পুরোনো বিষাদ আবার সোমার চারপাশে ঘন হতে লাগল। ঘর থেকে বেরুতে আর ইচ্ছা হয় না।

সোমেশ ফিরে আসার পর বাড়িতে আর কতটুকু সময় থাকে তপতী। সারাদিনই সে সোমেশের সঙ্গে ঘুরছে। অবশ্য সোমাকেও তাদের সঙ্গে যেতে বলে, সোমেশও দু-একবার এসে অনুরোধ করেছে, সোমা যায়নি। তার কিছুই ভালো লাগে না।

.

০৯.

তাদের জন্য নির্দিষ্ট সেই ঘরটায় সারাদিনই চুপচাপ বসে থাকে সোমা, মাঝে মধ্যে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। সামনের বড় জানালাটার বাইরেই গোলাপ-বাগান, বাগানের পর রাস্তার ওধারে গাছপালা, অনেক উঁচুতে আকাশ।

সে-সব দিকেও চোখ যায় সোমার, কিন্তু কিছু যেন দেখতে পায় না সে।

দোলন-ঝুলন কদাচিৎ এ ঘরে আসে। এসেও–কী করছেন? চা খাবেন কি? জাতীয় দু-একটা কথা বলেই চলে যায়। তপতীর মা অবশ্য অনেকবার এসেই তার খোঁজ নিয়ে যান।

তবে সব চাইতে যে বেশি আসে সে মৃন্ময়। দরজার বাইরে থেকেই চিৎকার করে বলে, মে আই কাম ইন বলেই ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে। অনুমতির জন্য অপেক্ষা পর্যন্ত করে না।

সোমা বিরক্ত চোখে তাকায়; কিছু বলে না।

চেয়ারে জাঁকিয়ে বসতে বসতে মৃন্ময় বলে, আপনি একটা ফ্যাস্টাফ্যাটাস, সারাদিন ঘরের ভেতর কী করে যে বসে থাকেন!

নীরস গলায় সোমা বলে, আমার শরীরটা ভালো না।

কী হয়েছে?

সোমা উত্তর দেয় না।

মৃন্ময় উদ্বেগের গলায় বলে, ডাক্তারকে খবর দেব?

সোমা বলে, না। আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না।

একটু চুপ। তারপর সোমার দিকে খানিকটা ঝুঁকে মৃন্মম নীচু গলায় বলে, আমার কী মনে হয় জানেন?

কী? কপাল কুঁচকে যেতে থাকে সোমার।

শরীর আপনার ভালোই আছে, গোলমালটা অন্য জায়গায়।

তার মানে?

নিজেই ভেবে দেখুন

লোকটা কি অন্তর্যামী? সোমা চমকে ওঠে। তারপরেই তীক্ষ্ণ স্বরে বলে, অনুগ্রহ করে আপনি এখন যান। আমাকে একটু একা থাকতে দিন।

কখনও এসে মৃন্ময় বলে, আপনাকে আজ একটা জিনিস দেখাব।

সোমা বিরক্ত অথচ জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়। মৃ

ন্ময় বলতে থাকে, নওটঙ্কী কাকে বলে জানেন?

না।

প্রচুর নাচ গান দিয়ে একটা পালার মতো। বাংলাদেশে যেমন যাত্রা, অনেকটা সেই রকম।

নিস্পৃহ সুরে সোমা বলে, ও–

আজ ভাট্টাবাজারের কাছে নওটঙ্কীর গান আছে। শুনতে যাবেন? উৎসাহের গলায় মৃন্ময় বলতে থাকে, খুব ভালো লাগবে; দারুণ এনজয় করবেন। জিনিসটা যাকে বলে একেবারে সয়েল থেকে উঠে এসেছে, এখানকার মাটির গন্ধ মাখানো।

না।

কী না?

এসব আমার ভালো লাগে না।

জিনিসটা আগে দেখুন, শুনুন। তারপর তো ভালো-লাগা খারাপ-লাগার প্রশ্ন।

আমাকে ক্ষমা করুন; এ ব্যাপারে আমার কিছুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই।

একদিন মৃন্ময় এক কাণ্ডই করে বসল। সোমার ঘরে এসে বলল, আজ আপনাকে আমি একটা উপহার দিতে চাই।

উপহার! বিমূঢ়ের মতো উচ্চারণ করল সোমা।

ইয়েস ম্যাডাম।

কিন্তু

কী?

আপনার উপহার আমি হাত পেতে নেব কেন?

খুব সামান্য জিনিস।

সামান্যই হোক আর অসামান্যই হোক, আমি নিতে পারব না। মনে মনে ভীষণ রাগ হচ্ছিল সোমার। লোকটার স্পর্ধা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

মৃন্ময় বলল, দেখুন, জিনিসটা আমি পয়সা দিয়ে কিনিনি। কেনা হলে দিতাম না। আমি একজন আর্টিস্ট, জানেন তো?

শুনেছি।

আমি একটা ছবি এঁকেছি, সেটাই দিতে চাই।

সোমা উত্তর দিল না।

মৃন্ময় পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বার করে সোমার সামনের টেবলটায় রাখল। যে ছবিটা আঁকা হয়েছে সেটা একপলক দেখেই সমস্ত রক্ত মাথায় গিয়ে চড়ল সোমার। ছবিটা তারই; তলায় লেখা আছে–বিষাদের প্রতিমা–দুঃখিনী। কখন কোন ফাঁকে চোরের মতো তার ছবি এঁকে নিয়েছে মৃন্ময়, কে জানে।

ঘাড়ের কাছে একটা শির কট করে ছিঁড়ে গেল যেন। হিতাহিত জ্ঞানশূন্যের মতো চিৎকার করে উঠল সোমা, অসভ্য, জানোয়ার! বেরিয়ে যান এখান থেকে বেরিয়ে যান

ফস করে আলো নিভে যাবার মতো মুখটা কালো হয়ে গেল মৃন্ময়ের। নিজেকে টেনে তুলতে তুলতে সোমাকে একবার দেখল সে, তারপর আস্তে আস্তে ঘরের বাইরে চলে গেল।

তার পর থেকে সোমার ঘরে আর আসেনি মৃন্ময়। কিন্তু যখনই সোমা চোখ তুলে জানালার বাইরে তাকিয়েছে তখনই দেখেছে, একজোড়া চোখ তারই দিকে তাকিয়ে আছে। সে চোখ কোমল, সহানুভূতিময়, আর্দ্র। অভদ্র ইতর মৃন্ময় যে এভাবে তাকাতে পারে, কে ভাবতে পেরেছিল। সোমা খুবই অস্বস্তিবোধ করতে লাগল।

.

১০.

আরো কদিন পর হঠাৎ সোমা বলল, আমি আজ কলকাতা চলে যাব।

বাড়ির সবাই চেঁচামেচি জুড়ে দিল, কিছুতেই না কিছুতেই না। আজ যাওয়া হতেই পারে না।

দোলন-ঝুলন-পিন্টু, অনেক করে থাকতে বলল, তপতীর বাবা বোঝালেন, তপতীও চিৎকার-টিৎকার করল, তপতীর মা বললেন, তিন বছর পর যা-ও এলে, দুদিন থাকতে না থাকতেই চলে যাবে? আর কটা দিন থেকে যাও মা! কিন্তু কারো কথা শুনল না সোমা।

তপতী বলল, কলকাতায় তো তোর কোনও কাজ নেই।

অবুঝের মতো সোমা বলল, না থাক, তবু যাব। এখানে আমার আর ভালো লাগছে না।

শেষ পর্যন্ত যাওয়াই ঠিক হল। কিন্তু তাকে কাটিহারে গিয়ে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসবে কে? তপতীর বাবা যাবেন না, পিন্টুর দুদিন ধরে জ্বর, আর তপতী আগে থেকেই সোমেশের সঙ্গে এক জায়গায় যাবার প্রোগ্রাম ঠিক করে রেখেছে।

সোমা বলল, কারোকেই যেতে হবে না; শেয়ারের ট্যাক্সিতে তুলে দিলে আমি একাই চলে যেতে পারব।

তপতীর মা বললেন, তাই কখনও হয়? ভালো কথা, মৃন্ময়ই তো আছে। সে-ই কাটিহারে তুলে দিয়ে আসবে।

সোমা একবার ভাবল, আপত্তি করে। কিন্তু কিছু বলল না।

.

কাটিহার থেকে দুপুর দুটোয় মনিহারি ঘাটের ট্রেন। শেয়ারের ট্যাক্সি না, কোত্থেকে একটা প্রাইভেট গাড়ি যোগাড় করে আনল মৃন্ময়। এখান থেকে কাটিহার আর কতক্ষণের রাস্তা; মোটরে গেলে বড় জোর পঁয়তাল্লিশ মিনিট। বারোটা বাজবার আগেই খানিকটা সময় হাতে নিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়ল।

ড্রাইভার নেই; গাড়িটা মৃন্ময় নিজেই চালাচ্ছিল। পিছনের সিটে চুপচাপ বসে আছে সোমা। কেউ কথা বলছিল না।

সেদিনের সেই ব্যবহারের জন্য মনে মনে লজ্জিত ছিল সোমা; রাগের মাথায় ওভাবে বলা তার উচিত হয়নি। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে দ্বিধার গলায় সে ডাকল, মৃন্ময়বাবু

সামনের দিকে চোখ রেখেই মৃন্ময় সাড়া দিল, বলুন

সেদিনের ব্যাপারটার জন্যে আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি।

ক্ষমা আবার কী।

দেখুন, ওইসব কথা বলা আমার অন্যায় হয়েছে। জীবনে হয়তো আর কখনও আপনার সঙ্গে দেখা হবে না; আপনি যদি ওই ব্যাপারটা মনে করে রাখেন আমি খুব কষ্ট পাব।

মনে করে রাখব না। তাছাড়া

কী?

কেউ কিছু বললে আমার বেঁধে না; আমার গায়ের চামড়া গন্ডারের মতো পুরু।

সোমা আর কিছু বলল না। মৃন্ময়ও চুপ করে থাকল।

আজ মৃন্ময় বড় বেশি সংযত। সোমা কথা না বললে আগে থেকে সে কিছু বলছে না, কোনওরকম মন্তব্যও করছে না। এমন কী পিছন ফিরে একবার সোমাকে দেখছেও না।

এক ঝলক মৃন্ময়কে দেখে নিয়ে জানালার বাইরে তাকাল সোমা।

গাড়িটা চলেছে তো চলেছেই। দুধারে আদিগন্ত মাঠ, পানিফলে বোঝাই মাইলের পর মাইল বিল, টুকরো টুকরো রবিশস্যের খেত, সিসম গাছের জটলা, ঝোপ-ঝাড়।

কতক্ষণ গাড়িটা চলেছিল, খেয়াল নেই। হঠাৎ হাতঘড়িতে চোখ পড়তেই চমকে উঠল সোমা, চারটে বাজে। সে প্রায় চেঁচিয়েই উঠল, এ কী, চার ঘণ্টা গাড়ি চলছে, এখনও কাটিহার গিয়ে পৌঁছালাম না?

মৃন্ময় খুব সহজ গলায় বলল, আমরা কাটিহারের দিকে গেলে তো পৌঁছুবেন—

তার মানে?

তার মানে আমরা অন্য রাস্তায় চলে এসেছি।

উদ্বিগ্ন মুখে সোমা বলল, তা হলে কলকাতায় যাব কী করে?

মৃন্ময় বলল, কলকাতায় আজ আর যাওয়া হচ্ছে কই? দুটোর ট্রেন দুঘন্টা আগে কাটিহার ছেড়ে চলে গেছে। আজ আর মণিহারি ঘাটের ট্রেন নেই। যেতে হলে কাল। নিশ্চয় আপনাকে কাটিহারে ট্রেন ধরিয়ে দিয়ে আসব।

আপনি ভেবেছেন কী?

কী ব্যাপার?

আমার কলকাতা যাওয়া কি আপনার ইচ্ছার ওপর নির্ভর?

আপাতত।

লোকটার মতলব কী কে জানে। ভাত ভাবে জানালার বাইরে তাকাতে লাগল সোমা। এখন গাড়িটা যেখানে সেটা একটা মেঠো পথ। দুধারে ঝুপসি আম বাগান। মৃন্ময় কী বুঝেছিল, সে-ই জানে। বলল, এই জায়গাটাকে আমাদের বিহারের পলাশী বলতে পারেন। আরেকটা খবর আপনাকে দিচ্ছি, এখান থেকে তিন-চার মাইলের মধ্যে কোনও দেহাত নেই, লোকজন নেই। চেঁচিয়ে মরে গেলেও কেউ আসবে না।

ভয়ার্ত রুদ্ধ গলায় সোমা বলল, আপনি কী চান?

গাড়ি থেকে নামুন, বলছি।

নিজের ইচ্ছায় নয়, অদৃশ্য কোন শক্তি সোমাকে যেন ধাক্কা মেরে মেরে গাড়ির বাইরে নামিয়ে নিয়ে গেল। তাকে একটা আমগাছের মোটা শিকড়ের সঙ্গে বসিয়ে খানিকটা দূরে মুখোমুখি বসল মৃন্ময়; তারপর পকেট থেকে সিগারেট বার করে ধরিয়ে নিল।

কাঁপা গলায় সোমা বলল, কী বলবেন বলুন

অত তাড়াতাড়ি কি আছে, আজ তো আর ট্রেন ধরতে হবে না।

না হোক; আমি তপতীদের বাড়ি ফিরে যেতে চাই।

নিশ্চয়ই। আমিও তোত সেখানেই ফিরব। আর তপীদের বাড়ি যেতে হলে আমার সঙ্গেই আপনাকে যেতে হবে।

সোমা চুপ করে রইল।

সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে অনেকগুলো ধোঁয়ার আংটি ছাড়ল মৃন্ময়। তারপর বলল, আপনার কথা আমার জানতে ইচ্ছে করে।

জেনে লাভ?

লাভ হয়তো নেই।

তবে?

কৌতূহল।

আমি যদি আপনার কৌতূহল না মেটাই?

মেটাতেই হবে।

আপনার হুকুমে?

না। আপনার নিজের জন্য।

তার মানে?

হাতের ভর দিয়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল মৃন্ময়, অন্যমনস্কর মতো ক পা হাঁটল। তারপর হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে খুব গাঢ় গলায় বলল, আপনি খুব দুঃখী, না?

আচমকা বুকের ভেতর অনেকগুলো এলোমেলো ঢেউ খেলে গেল সোমার। স্মমিত স্বরে সে বলল, কে বলেছে আপনাকে?

নিজের বুকে একটা আঙুল রেখে মৃন্ময় বলল, এখানে একটা দুঃখী মানুষ আছে, সে-ই বলে দিয়েছে।

মৃন্ময়ের জীবনে যে বেদনা আছে, সোমা তার কিছু আভাস পেয়েছে। সে বলল, আপনার ধারণাটা ভুলও তো হতে পারে।

বুকের ওপর আঙুলটা ছিলই। মৃন্ময় বলল, এখান থেকে যে বলে সে ভুল বলে না। তা ছাড়া

কী?

আপনি নিজেও বুঝিয়ে দিয়েছেন আপনি কত দুঃখী।

আমি?

হ্যাঁ। আপনার চলা-ফেরা, আপনার চুপচাপ বসে থাকা, আপনার চাউনি—এ সবের মধ্যে কী আছে, যে বুঝবার সে ঠিকই বুঝতে পারবে।

সোমা চুপ।

মৃন্ময় আবার বলল, আমার আরো কী মনে হয় জানেন?

সোমা তাকাল।

মৃন্ময় বলতে লাগল, আপনার দুঃখের কথা কোনদিন কারোকে আপনি বলেননি, বা বলতে পারেননি। চেপে রেখে শুধু কষ্টই পাচ্ছেন। আর নিজেকে ধ্বংস করছেন।

লোকটা কি অন্তর্যামী? যাকে সে ভেবেছিল অত্যন্ত হাল্কা ধরনের বাজে লোক তার মধ্যে যে এমন গভীর হৃদয়বান মানুষ আছে, কে ভাবতে পেরেছিল। সোমা চকিত হয়ে উঠল।

মৃন্ময় বলেই যাচ্ছে, আপনি আমাকে বন্ধু বলে মনে করতে পারেন, বলুনএকজনের কাছে বলেও মনের ভার অন্তত খানিকটা কমান।

হঠাৎ সমস্ত অস্তিত্বের ভেতর কী যে হয়ে গেল, কী নিদারুণ প্রতিক্রিয়া, সোমা বলতে পারবে না। এ ভাবে কেউ কোনদিন তার কথা শুনতে চায়নি।

বিচিত্র এক সম্মোহের ঘোরে বিকাশের সঙ্গে জড়ানো তার জীবনের সেই দুর্ঘটনাটার কথা বলে গেল সোমা। বলেই দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে কাঁদতে লাগল।

কতক্ষণ কেঁদেছে জানে না, এক সময় সোমা অনুভব করল, তার পিঠে একটি সহানুভূতিময় হাতের কোমল স্পর্শ এসে পড়েছে। চমকে মুখ তুলতেই দেখতে পেল দুচোখে অপার স্নেহ তাকিয়ে আছে মৃন্ময়! চোখাচোখি হতেই সে বলল, পুওর গার্ল।

সোমা উত্তর দিল না।

মৃন্ময় আবার বলল, কিন্তু এত ভেঙে পড়লে তো চলবে না। দুর্ঘটনা দুর্ঘটনাই। জানেনা, আমার জীবনেও কিছু দুঃখ আছে। একটি মেয়েকে একদিন ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম, সে আমাকে ঠকিয়ে আমার যথাসর্বস্ব নিয়ে আমারই এক বন্ধুর সঙ্গে একদিনে চলে গেল। তারপরেও দ্যাখ আমি কেমন হাসি, গান গাই, হই-হল্লা করি। ওই ঘটনাটা একেবারে ভুলেই গেছি।

হঠাৎ যেন চোখের ওপর ধারালো আলো এসে পড়ল। মৃন্ময়ের এই গান-টান, হল্লা-হুঁল্লোড়–সব যেন কান্নারই ছদ্মবেশ। রবীন্দ্রনাথের কী একটা কবিতা যেন আছে, এই মুহূর্তে মনে করতে পারল না সোমা।

অনেকক্ষণ পর সোমা বলল, আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেল।

মৃন্ময় বলল, ধুস, এর জন্যে কোন কিছুই শেষ হয় না।

মৃন্ময়ের চোখে পরিপূর্ণ দৃষ্টি রেখে সোমা বলল, সত্যিই হয় না?

না, তোমার মাথায় ওটা ফিক্সেশানের মতো আটকে আছে। কিন্তু জীবনে শেষ বলে কোন কথা নেই। রোজ সেখানে নতুন করে শুরু করা যায়। সন্ধে দুজনে উঠে পড়ল।

Exit mobile version