শ্রীময়ী, এগুলো বুজরুকি ছাড়া কিছুই নয়। শুনে মনে হচ্ছে, লোকটা কথাবার্তা বলে কয়েকটা প্রব্যাবিলিটি বুঝতে পারে। হারানো জিনিস কোথায় থাকতে পারে তার সম্ভাবনা। দু একটা কেস মিলে যায়। সেগুলিই মুখে মুখে ছড়ায়। বুজরুকের ব্যবসা বাড়ে। যেসব কেস ফেল। করে সেগুলো কেউ জানতে পারে না। কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাসের ব্যাপারগুলো সব এরকমই। মুখে মুখে শুনে মানুষ পাগলের মতো ছোটে। কাগজে দেখনি, মানুষ যখন চাঁদে জমি কেনার কথা ভাবছে তখন এখানে অসুখ সারাতে একদল মানুষ কাদায় গড়াগড়ি খাচ্ছিল! কোনও বহুদূরের গণ্ডগ্রামে নয়, কলকাতার কাছেই এ ঘটনা ঘটেছে। এইসব জালিয়াতদের পেইড এজেন্টও থাকে। তারা মুখে মুখে গপ্প ছড়ায়। তোমার এই রান্নার মাসি নিশ্চয় সেরকম একজন। কেন্স পিছু কমিশন পাবে। এসব একদম বিশ্বাস কর না।
শ্রীময়ী বলল, আমি বিশ্বাস করি না, কিন্তু একবার যেতে অসুবিধেটা কোথায়? পাঁচ বছর ধরে কত জায়গায় তো ছুটোছুটি করছ। যে যেরকম বলেছে সেখানেই গেছ। এখানে কত আর খরচ হবে?
নীলাদ্রি এবার বিরক্ত হলে বলল, খরচটা বিষয় নয়, বিষয়টা অন্য। যত বড়ই বিপদ হোক, তা বলে একজন বুজরুকের কাছে ছুটব; নিজেকে সারেন্ডার করব!
সারেন্ডারের প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে! শুনে চলে এলেই হবে। নতুন একটা সম্ভাবনার কথাও তো লোকটা বলতে পারে। না বুঝেও বলতে পারে। তোমাদের খোঁজার একটা নতুন দিক খুলে যাবে। দেখ নীলাদ্রি, তোমার বাবাকে পাওয়া গেলে আমি তোমাদের থেকে কম খুশি হব না। তার কারণ তোমার বাবা নন, তুমি। কথাটা স্বার্থপরের মতো শোনালেও সত্যি, আমার ভালোবাসার মানুষটাকে রোজ মন খারাপ করতে দেখলে আমার কষ্ট হয়।
নীলাদ্রি হতাশ গলায় বলল, ঠিক আছে চল, দেখি তোমার সাধুবাবা কী বলেন। তবে একটা কথা বলে দিচ্ছি, মেজাজ ঠিক থাকবে কিনা জানি না। ঘোরতর অবিশ্বাস নিয়ে যাচ্ছি তো, রাগ না চড়ে যায়। মাকে পাঠালেই ভালো হত। কিন্তু সেটা করব না। মা ওই লোকের কথা বিশ্বাস করে ফেলতে পারে। একবার কোন পুরোহিত মশাই মায়ের হাত দেখে বলেছিল, আপনার স্বামী ফিরে আসবে, আপনি তিনদিন ধরে যজ্ঞ করুন। মা বলল, তিন দিন ধরে! সে তো বিরাট ঝামেলা। পুরুত মশাই বললেন, সে তো ঝামেলাই। তবে শাস্ত্রে বিকল্প ব্যবস্থা আছে। মা বলল, কী ব্যবস্থা? পুরুতমশাই বললেন যজ্ঞ করতে না পারলে তিন হাজার তিন টাকা ধরে দিন। মা বলল, তিন হাজার! এত টাকা? পুরুতমশাই বললেন, স্বামী তিন বছর নিখোঁজ, তাই তিন হাজার। মা টাকা দিয়ে দিল। এই কারণেই মাকে এখানে পাঠাব না।
লোকটাকে মোটেই জ্যোতিষী বা পুরোহিতের মতো দেখতে নয়। ব্যস্ত রাস্তার ওপর একফালি চেম্বার। বাইরে ছোট একটা টিনের সাইনবোর্ডে এঁকাবেঁকা করে ভুল বানানে লেখা–
মধুসূদন কুইল্যা। প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের সাহায্যে হারানো জিনিস খুঁজে পাবার পরামর্শ দেন। ভিজিট একশত টাকা মাত্র।
ঘরে ঢুকে দেখা গেল লোহার টেবিলের ওদিকে কারুকাজ করা পাঞ্জাবি পরে চিমসে চেহারার একজন বসে আছে। লোকটার চেহারার মধ্যেই একটা ধূর্ত ভাব। চোখগুলো ঢুলু ঢুলু। গলায় একটা মোটা সোনার চেইন। সোনার না-ও হতে পারে, হয়তো ইমিটেশন। পাড়া গাঁয়ের লোকদের ঘাবড়ে দেবার জন্য পরে রেখেছে। অনেকসময় গরিব মানুষ বড়লোকদের বাড়তি বিশ্বাস করে। টেবিলে ল্যাপটপ খোলা। লোকটা সেই ল্যাপটপের দিকে চেয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। পিছনের দেয়ালে অজস্র ঠাকুর দেবতার ফটো। কোনওটায় শুকনো মালা ঝুলছে। টেবিলের এপাশে দুটো লোহার চেয়ার। নীলাদ্রি, শ্রীময়ী এসে সেখানেই বসেছিল। শ্রীময়ী বেরিয়ে যাওয়ার পর নীলাদ্রি বলল, একটু তাড়াতাড়ি করবেন মধুসূদনবাবু।
লোকটা চোখ তুলে গা জ্বালানো ধরনের হাসল।
বন্ধুকে চলে যেতে বলেছি বলে রাগ হল ভাইটি?
রাগে গা রি রি করে উঠল নীলাদ্রির। উপায় নেই সহ্য করতে হবে।
কী করব বল, তোমার সঙ্গে এমন সব কথা হবে যা পরিবারের বাইরের কারও শোনা উচিত নয়। জিনিস হলে একটা কথা ছিল। তার পাপপুণ্য থাকে না। কিন্তু মানুষের বেলায় তা হবার নয় ভাইটি। তার অনেক লজ্জার ব্যাপার থাকে। সেসব অন্যরা শুনলে চলবে কেন? আমিই বা বলব কেন? যাক, ওসব বাদ দাও। মানুষ খোঁজার ভিজিট কিন্তু আমার বেশি।
কত? ঠোঁট কামড়ে বলল নীলাদ্রি।
বেশি নয়, তিনশত। হাত তুলে তিনটে আঙুল দেখাল মধুসূদন।
নীলাদ্রি দ্রুত পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে টাকা দিল। আগে টাকা দিয়ে যদি আগে মুক্তি পাওয়া যায়।
ধন্যবাদ। তুমি শিক্ষিত ছেলে বলে আগে টাকা দিলে। গাঁইয়াগুলো এটাই বুঝতে চায় না। বলে আগে জিনিস পাই তারপর ভিজিট। আরে বাপু, জিনিস কি আমি খুঁজে দেব বলেছি? তুই হারিয়েছিস তুই বুঝে নিবি। আমি শুধু পরামর্শ দেব। অ্যাডভাইস। ঠিক কিনা?
নীলাদ্রি এসব কথা পাত্তা না দিয়ে বলল, বুঝতেই পারছেন মধুসুদনবাবু আমরা পাঁচ বছর ধরে কম খোঁজাখুঁজি করিনি। আজও করছি। পুলিশ ইনভেস্টিগেশন চলছে। এখনও ফোন করে ডেকে পাঠায়। সুতরাং বাদ প্রায় কিছুই নেই। আপনি সেটা মাথায় রাখবেন, তাতে আপনার পরিশ্রম কম হবে।
মধুসূদন ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে বলল, এতে পরিশ্রম বাড়ল ভাইটি। আগে এলে কাজ সহজ হত। রোগী মর মর হলে তবে ডাক্তার বদ্যি ছেড়ে আত্মীয়রা মন্দিরে ছোটে। তখন ভগবান কিছু করতে পারেন না। কারণ ততক্ষণে কেস জটিল হয়ে গেছে, বেচারি ভগবান কী করবেন? তোমার বাবা মানুষটি কীরকম ছিলেন? রাগী না ঠান্ডা মাথার? খরুচে না কিপটে? ভীতু প্রকৃতির?