Site icon BnBoi.Com

নীল বসনা সুন্দরী – পাঁচকড়ি দে

নীল বসনা সুন্দরী - পাঁচকড়ি দে

১.০১. প্রথম পরিচ্ছেদ – আলোকে

প্রথম খণ্ড

নিয়তি – লীলাক্ষেত্র

Cas. Vengeance, lie still, thy cravings shall be stated
Death roams at large, the furies are unchain’d,
and murder plays her mighty master-piece.
Nathaniel Lee-Alexander-The Great, Act. V. Scene II.

প্রথম পরিচ্ছেদ

আলোকে

রাত দুইটা বাজিয়া গিয়াছে । এখনও প্রসিদ্ধ ধনী রাজাব-আলীর বহির্ব্বাটীর বিস্তৃত প্রাঙ্গন সহস্র দীপালোকে উজ্জ্বল । সেই আলোকোজ্জ্বল সুসজ্জিত প্রাঙ্গনে নানালঙ্কারে সুসজ্জিতা, সুবেশা, সুস্বরা নর্ত্তকী গায়িতেছে – নাচিতেছে – ঘুরিতেছে – ফিরিতেছে – উঠিতেছে – বসিতেছে, উপস্থিত সহস্র ব্যক্তির মন মোহিতেছে । তাহার উন্নত বঙ্কিম গ্রীবার কত রকম ভঙ্গি, নয়নের কত রকম ভঙ্গি, মুখের কত রকম ভঙ্গি, হাত নাড়িবার কত রকম ভঙ্গি, পা ফেলিবারই বা কত রকম ভঙ্গি ! তন্ময় হৃদয়ে সকলে তাহার দিকে চাহিয়া আছে আর শুনিতেছে –

“সেইঞা যাও যাও যাও, নেহি বোল জবান্ ।
ইতনী বাত মোরি মান্ ।
ভোর ভেইয়া রে, যাওয়ে যাঁহু রহে;
তেরা পাঁও পড়ি, মেরি জান্ ।”

বীণানিক্কণবৎ কণ্ঠ কি মধুর ! সেই মধুর কণ্ঠে কি মধুরতর তান ধরিয়াছে – বেহাগের সুমিষ্ট আলাপ ! মীড়, গমকে, মুর্চ্ছণায়, গিট্কারীতে, উদারা মুদারা তারা তিনগ্রামে, প্রক্ষেপে ও বিক্ষেপে ষড়জ রেখাব, গান্ধার পঞ্চম, ধৈবত প্রভৃতি সপ্তস্বরে সেই মধুর কণ্ঠ কি অনাস্বাদিত্পূর্ব্ব পীযূষধারা বর্ষণ করিতেছে !

প্রাঙ্গন সুন্দররূপে সজ্জিত । ঊর্ধ্বে বহু শাখাবিশিষ্ট ঝাড় ঝুলিতেছে তাহাতে অগন্য দীপমালা । লাল, নীল, পীত, শ্বেত – বর্ণবিচিত্র পতাকাশ্রেণী । নিম্নে বহুমূল্য গালিচা বিস্তৃত, রজত-নির্ম্মিত আতরদান গোলাপপাশ, আল্বোলা, শট্কা এবং তাম্বুল-এলাচপূর্ণ রজত্পাত্রের ছড়াছড়ি । চারিপার্শে গৃহ-প্রাচীরে দেয়ালগিরি, তাহাতে অসংখ্য দীপ জ্বলিতেছে । অলিন্দে অলিন্দে – লাল, নীল, সবুজ, জরদ বিবিধ বর্ণের স্ফটিক-গোলক্মালা দুলিতেছে, তন্মধ্যস্থিত দীপশিখা বিবিধ বর্ণে আলোক বিকীর্ণ করিতেছে । স্তম্ভে স্তম্ভে দেবদারুপত্র, চিত্র, পতাকা ও পুষ্পমাল্য শোভা পাইতেছে । আলোকে-পুলোকে সকলেই উজ্জ্বলতর দেখাইতেছে । উর্দ্ধে, নিম্নে, মধ্যে, পার্শ্বে সহস্র দীপ জ্বলিতেছে । সেই উজ্জ্বল আলোকে বাইজীর সল্মার্ কাজ করা ওড়্না এক-একবার ঝক্মক্ করিয়া জ্বলিতেছে । ঈষন্মুক্ত বাতায়নগুলির পার্শ্বে সুন্দরীদিগের অসংখ্য উজ্জ্বল কৃষ্ণচক্ষুঃ তদধিক জ্বলিতেছে । কেহ কেহ বা সেই উজ্জ্বল চক্ষুঃ বারেক দৃষ্টি করিয়া অন্তরে তদধিক জ্বলিতেছে ।

আসরে নর্ত্তকী গায়িতেছে । নর্ত্তকীর নাম গুলজার-মহল । গুলজার-মহল কলিকাতার প্রসিদ্ধ বাইজী । তাহার গান শুনিতে চৌধুরী সাহেবের বাড়ীতে লোক ধরে না – শ্রোতৃবর্গে প্রাঙ্গণ ভরিয়া গিয়াছে । পুষ্প, পুষ্পস্তবক ও পুষ্পমাল্যে আসর ভরিয়া গিয়াছে । আতর গোলাপজল ও ফুলের গন্ধে আসর ভরিয়া গিয়াছে । সুবাসিত অম্বুরী তামাকের ধূমে ও গন্ধে আসর ভরিয়া গিয়াছে । সুরঙ্গম বাদ্যে আসর ভরিয়া গিয়াছে । আর নর্ত্তকীর সেই দীর্ঘায়ত কজ্জ্বলরেখাঙ্কিত নেত্রের বিদ্যুচ্চকিত কটাক্ষে, রত্নাভরাণোজ্জ্বল লাবণ্যবিকসিত দেহের ললিত কোমল ভঙ্গিতে প্রাঙ্গণবর্ত্তী শ্রোতৃমাত্রেরই হৃদয় ভরিয়া গিয়াছে । রাজাব-আলীর সেই আলোকিত, গীতবাদ্যবিক্ষুব্দ্ধ প্রমোদমদিরোচ্ছ্বসিত জমাট্ আসর ত্যাগ করিয়া কেহ উঠিতেছে না, কেহ উঠিব উঠিব মনে করিয়াও উঠিতে পারিতেছে না, কাহারও না-উঠিলে নয় – তথাপি উঠিতে পারিতেছে না ।
কেবল একজন যুবক বড় অন্যমনষ্ক; কিছুতেই তার মন স্থির হইতে চাহিতেছে না । যুবক আসর ত্যাগ করিয়া উঠিল । তাহাকে উঠিতে দেখিয়া রাজব-আলীর জ্যেষ্ঠ পুত্র সুজাত-আলি গিয়া তাহার হাত ধরিল, কহিল, “এখনই উঠিলে যে ?”
যুবকের নাম মোবারক-উদ্দীন । মোবারক-উদ্দীন কহিল, “রাত দুইটা বাজিয়া গিয়াছে ।”
সুজাত-আলি হাসিয়া বলিল, “তাহা হইলেও আরও দুই-একটা গান শুনিবার সময় আছে । অমৃতে অরুচি কেন ? গান ভাল লাগিতেছে না ?”
p;    মোবারক হাসিয়া বলিল, “না,বেশ গায়িতেছে ।”
উভয়ে বহিদ্বারে গিয়া দাঁড়াইল ।
সুজাত বলিল, “বেশ গায়িলে আর উঠিতে চাও ? গুলজার-মহল বাইজীর গান বুঝি তোমার ভাল লাগে না ?”
মোবারক কহিল, “এমন লোক দেখিনা গুলজার-মহল বাইজীর গান যাহার ভাল না লাগে । বিশেষতঃ আজ গুলজার-মহল আসর একেবারে গুল্জার করিয়া তুলিয়াছে । আসরে অনেক বড় লোক আসিয়া বসিয়াছে, নাচগানে গুলজার মহলের আজ নিজের উৎসাহও খুব দেখিতেছি ।”
সুজাত কহিল, “উৎসাহের আরও অনেক কারণ আছে । আমাদিগের সঙ্গে পাঁচ শত টাকা চুক্তি হইয়াছে । তা ছাড়া মুন্সী জোহিরুদ্দীন মল্লিকের স্ত্রী নিমন্ত্রণে আসিয়াছিলেন ; তাঁহার সঙ্গে নাজিব-উদ্দীন চৌধুরীর কন্যা জোহেরাও আসিয়াছিল । তাঁহারা দুইজনে গান শুনিয়া বাইজীকে দুইটী হীরার আংটি বখশিস্ দিয়া গিয়াছে ।”
কিছু বিস্মিত হইয়া মোবারক কহিল, “মুন্সী জোহিরুদ্দীন বুড়া বয়সে আবার বিবাহ করিয়াছেন না কি ?”
সুজাত কহিল, “টেক্কা রকমের বিবাহ করিয়াছেন ! স্ত্রীটি খুব সুন্দরী-যেমন গায়ের রং, তেমনি সুন্দর মুখ-ভাসা ভাস চোখ-যেন পরী । কিন্তু স্বভাবের কিছু দোষ আছে-গর্ব্বিতা ।”
মোবারক জিজ্ঞাসা করিল, “কাহার মেয়ে ?”
সুজাত কহিল, “তা ঠিক বলিতে পারি না । কোন গরীবের ঘরের মেয়ে হইবে । সন্ধান করিয়া করিয়া এতদিনের পর সহসা মুন্সী সাহেব কোথা হইতে এ রত্ন কুড়াইয়া আনিয়াছেন কেহ জানে না । জোহিরুদ্দীন সুন্দরী স্ত্রীর একান্ত বশীভূত হইয়া পড়িয়াছেন ; একবারও স্ত্রীকে চোখের অন্তরাল করেন না । কোন কাজে আজ তিনি কলিকাতায় গিয়াছেন ; নতুবা আজ গুলজার-মহলের আংটি লাভে সন্দেহ ছিল ।”
মোবারক বলিল, ” তাহা হইলে উভয়ের মধ্যে প্রণয়ও খুব জমিয়াছে ।”
সুজাত হাসিয়া কহিল, ” একদিকে খুব জমিয়াছে ; কিন্তু বৃদ্ধের নবীনা স্ত্রী বিবাহে সচরাচর যাহা ঘটিয়া থাকে, তাহাই ঘটিয়াছে । সৃজান বিবির স্বভাবের কিছু দোষ আছে । ইহারই মধ্যে তাহার একটা নিন্দাপবাদও বাহির হইতে আরম্ভ হইয়াছে । শুনিয়াছি, স্বভাবটা ভাল নহে – মনিরুদ্দীনের উপরেই নাকি তাহার নজরটা পড়িয়াছে ।”
মোবারক বিস্মিত হইয়া কহিল, “মনিরুদ্দীন ইহার ভিতরে আছে ? জোহেরার সহিত তাহার বিবাহ হইবার কথা ছিল না ? জোহেরা ইহা শুনে নাই ?”
সুজাত কহিল, “আমার শুনিয়াছি, আর জোহেরা শুনে নাই ? জোহেরার তাহাতে বড় কিছু আসে যায় না । জোহেরা ভাল রকম লেখাপড়া শিখিয়াছে, জ্ঞান-বুদ্ধি বেশ হইয়াছে, সে কি বড়লোকের ছেলে বলিয়া মদ্যপ দুশ্চরিত্র মনিরুদ্দীনকে বিবাহ করিবে ? জোহেরা বরং মনিরুদ্দীনকে ঘৃণার চোখেই দেখিয়া থাকে । আর জোহেরার অর্থের অভাবই বা কি ? তাহার বিস্তৃত জমিদারীর মাসিক পঁচিশ হাজার টাকা আয় । দুই বৎসর পরে সাবালিকা হইলে সে তাহার অতুল বিষয়ৈশ্বর্য্যের অধিকার পাইবে ; তখন নায়েব জোহেরুদ্দীনকে তাহার সমুদয় বিষয় বুঝাইয়া দিতে হইবে । জোহেরার ইচ্ছা, মজিদের সহিত তাহার বিবাহ হয় ; কিন্তু অভিভাবক জোহিরুদ্দীনের সেরূপ ইচ্ছা নহে ; তিনি মোনিরুদ্দীনের সহিত জোহেরার বিবাহ দিতে চাহেন । জোহিরুদ্দীনের ইচ্ছা কার্যে পরিণত হইবার কোন সম্ভাবনা দেখিনা – আর দুই বৎসর পরে জোহেরাকে জোহিরুদ্দীনের মুখ চাহিয়া থাকিতে হইবে না ; তখন সে নিজের মতে চলিতে পারিবে । জোহেরা-রত্নলাভ মজিদের কপালেই আছে । আর আমরা যতটা জানি, মজিদ নিজে লোকটা ভাল । স্বভাব-চরিত্রে কোন দোষ নাই – বিশেষতঃ খুব পরোপকারী ; ঈশ্বর অবশ্যই মজিদের কপাল সুপ্রসন্ন করিবেন ।”
তখন ভিতরে গুলজার-মহল গায়িতেছে; –
“পিয়ালা মুজে ভ’রে দে
আবনু আবত মাতোয়ারা, তু তো লেয়েলি – ”
মোবারক কহিল, ” আমি মজিদকে খুব জানি । তাহার সহিত আমার খুব আলাপ আছে । লোকটা লেখাপড়াও বেশ শিখিয়াছে ; কিন্তু কিছুতেই অদ্যাপি অবস্থার উন্নতি করিতে পারিল না ”
সুজাত কহিল, “উপার্জ্জনটা অদৃষ্টক্রমেই হইয়া থাকে । যাহা-হউক, মজিদের অদৃষ্টে যদি জোহেরা-লাভ ঘটে, তখন আর তাহার উপার্জ্জনের কিছুমাত্র আবশ্যকতা থাকিবে না । জোহেরার অগাধ বিষয়-অগাধ আয় । হয়ত আবার মোনিরুদ্দীনের বিষয়টাও তাহার হাতে আসিতে পারে । মোনিরুদ্দীনের পিতা মজিদকে বাল্যকাল হইতে প্রতিপালন করেন ; নিজের যত্নে তাহাকে লেখাপড়া শিখান্ । তিনি মজিদকে নিজের পুত্রের ন্যায় স্নেহ করিতেন । যাহার মন ভাল, ঈশ্বর তাহার ভাল করেন – তা’ মানুষ । মজিদের মন ভাল, ঈশ্বর অবশ্যই তাহার ভাল করিবেন । মনিরুদ্দীনের পিতা মৃত্যুপূর্ব্বে উইল করিয়া গিয়াছেন যে, মোনিরুদ্দীনের অবর্ত্তমানে যদি তাঁহার পুত্রাদি কেহ উত্তরাধিকারী না থাকে, তাঁহার সমস্ত বিষয় মজিদই পাইবে । এখনও মজিদ মোনিরুদ্দীনের নিকট হইতে পঞ্চাশ টাকা মাসহারা পাইয়া থাকে । যত্দিন জীবিত থাকিবে, ততদিন এই মাসহারা পাইবে, উইলে এরূপ বন্দোবস্ত আছে ।”
মোবরক কহিল, “মোনিরুদ্দীন এখন বিবাহই করে নাই – ইহার পর বিবাহ করিবে – পুত্রাদি হইবে – সে অনেক দূরের কথা । অল্প বয়সে অগাধ বিষয় হাতে পাইয়া মোনিরুদ্দীন যেরূপ মাতাল হইয়া উঠিয়াছে, তাহাতে তাহাকে বোধ হয়, ততদূর অগ্রসর হইতে হইবে না । কোন্দিন বেজায় মদ খাইয়া, হ্ঠাৎ দম আট্কাইয়া মরিয়া থাকিবে । মনিরুদ্দীনের বিষয়ও বড় অল্প নহে ; পরে মজিদেরই ভোগে আসিবে, দেখিতেছি ।”
অনন্তর অন্যান্য দুই-একটি কথার পর মোবারক, সুজাত-আলির নিকটে বিদায় লইয়া তথা হইতে বাহির হইয়া পড়িল ।
মোবারক-উদ্দীন সুজাত-আলির বাল্যবন্ধু । শৈশবে উভয়ে একসঙ্গে খেলা করিয়াছে ; পঠদ্দশায় উভয়ে একসঙ্গে এক বিদ্যালয়ে পাঠ করিয়াছে । মোবারক এখন অর্থোপার্জ্জনের জন্য বিদেশে বাস করে ; কোন কাজে এক সপ্তাহমাত্র কলিকাতায় আসিয়াছে ; সংবাদ পাইয়া সুজাত তাহাকে অদ্য নিমন্ত্রণ করিয়াছিল ।

» ১.০২. দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – অন্ধকারে

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

অন্ধকারে

      মোবারক যখন রাজাব-আলির বাটী পরিত্যাগ করিল, তখন রাত তিনটা| পথে জনপ্রাণী নাই| পথ বড় অন্ধকার – কুজ্ঝটিকাবৃত| দুই-একটা কুকুর বা শৃগাল পথের এদিক্ ওদিক্ করিয়া ছুটাছুটি করিতেছে; তাহাদিগকে দেখা যাইতেছে না – তাহাদিগের সঞ্চারণের শব্দমাত্র শুনা যাইতেছে| যখনকার কথা বলিতেছি, তখন গ্যাসের আলোক ততটা বিস্তৃতি লাভ করে নাই, কলিকাতা সহরেও সকল পথে তখন গ্যাসের আলো ছিল না| অনেক বড় রাস্তাতেও তখন খুব তফাতে তফাতে প্রোথিত কাষ্ঠস্তম্ভের মস্ত্কে এক-একটা কেরোসিন তৈলের আলো একান্ত নিস্তেজভাবে জ্বলিত| গলিপথমাত্রেরই ব্যবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় ছিল- সেখানে আলোকের কিছুমাত্র বন্দোবস্ত ছিল না| পথিপার্শ্বস্থ গৃহস্থদিগের বাতায়ননিঃসৃত আলোকই পথিকদিগের ভরসাস্থল; কিন্তু অধিক রাত্রে তাহাও দুষ্প্রাপ্য ছিল|
জানবাজারে রাজাব-আলির বাটী| মোবারক জানবাজার ছাড়িয়া কলিঙ্গাবাজারের পথে প্রবেশ করিল| পথ নির্জ্জনতায় একান্ত নিস্তব্ধ এবং অন্ধকারে অত্যন্ত ভীষণ! অনেক দূরে দূরে এক-একটা আলো- তাহাও কুজ্ঝটিকাবৃত| চারিদিকে অন্ধকার – অন্ধকারে বিপুল রাজত্ব| মোবারকের বাসা বালিগঞ্জে| মোবারক অন্যপথ দিয়াও বাসায় ফিরিতে পারিত; তথাপি সে কলিঙ্গাবাজারের সোজা পথ ধরিল| অনেক রাত হইয়াছে, বোধ করি, শীঘ্র বাসায় উপস্থিত হইবার জন্য দ্রুতপদে পথ অতিক্রম করিয়া চলিতে লাগিল| ক্রমে মেহেদী-বাগানে আসিয়া পড়িল| এবং সেখানকার একটা অন্ধকার গলিমধ্যে প্রবেশ করিল| দুই-চারি পদ গিয়াছে, এমন সময়ে সম্মুখদিক্ হইতে কে একটা লোক সবেগে তাহার গায়ের উপরে আসিয়া পড়িল| এত অন্ধকার, কেহ কাহাকে স্পষ্ট দেখিতে পাইল না, উভয়েই চমকিত হইয়া দুইপদ পশ্চাতে হটিয়া দাঁড়াইল| যে লোকটা অন্ধকারে না দেখিতে পাইয়া, মোবারকের গায়ের উপরে আসিয়া পড়িয়াছিল, সে বলিল, “মহাশয়, মাপ করিবেন-আমি অন্ধকারে আপনাকে দেখিতে পাই নাই|” বলিয়াই তাড়াতাড়ি পাশ কাটাইয়া চলিয়া যাইবার উপক্রম করিল|
স্বর মোবারকের পরিচিত| মোবারক তৎক্ষণাৎ তাহার হাত ধরিল ; বলিল, “কেও, মজিদ নাকি – আরে দাঁড়াও| অনেক দিন পরে তোমার সহিত দেখা|”
মোবারক তাহাকে চিনিতে পারায় মজিদ মনে মনে কিছু বিরক্ত ও ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠিল| স্তম্ভিত হইয়া ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল , “মোবারক নাকি! কি আশ্চর্য্য! তুমি এখানে কবে আসিলে? আমি মনে করিয়াছিলাম, তুমি এখনও নেপালে আছ| এত রাত্রে এ পথে কেন হে?”
মোবারক বলিল, “রাজাব-আলির বাটীতে নিমন্ত্রণ ছিল; সেখানে হইতেই ফিরিতেছি| আমি সপ্তাহখানেক এখানে আসিয়াছি| চল-আমার বাসায় চল; আজ তোমাকে ছাড়িব না|”
ব্যস্ত-সমস্ত্ভাবে মজিদ বলিল, ” না-না-এখন না-আজ আমি যাইতে পারিব না – এখন আমার- আমি কিছু ব্যস্ত আছি, ভাই! কি জান – কাল নিশ্চয় যাইব| বাসাটা কোথায়? ”
মোবারক বলিল , ” এই বালিগঞ্জে|”
“বটে, তবে ত নিকটেই| কাল আমি এক সময়ে যাইব – সেই ভাল,” বলিয়া মজিদ পুনরপি মোবারকের পাশ কাটাইয়া চলিয়া যাইবার উপক্রম করিল|
মোবারক একবারও তাহাকে যাইতে দিল না| “দাঁড়াও,” বলিয়া পুনরায় তাহার হাত চাপিয়া ধরিল বলিল, “তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে- এত ব্যস্ত কেন? মনিরুদ্দীন এখন কোথায়, ভাল আছে ত? কখন তাহার সহিত দেখা হইবে, বল দেখি? তাহার সহিত আমাকে একবার দেখা করিতে হইবে ; একটা বিশেষ প্রয়োজন আছে|”
মজিদ বলিল, “মনিরুদ্দীন আজ এগারটার ট্রেনে ফরিদপুরের জমিদারীতে গিয়াছে| এখন তাহার সহিত দেখা হইবে না|”
মোবারক জিজ্ঞাসা করিল, “কতদিন পরে ফিরিবে?”
মজিদ বলিল, “ঠিক বলিতে পারি না| বোধ হয়, কিছু বিলম্ব হইবে| আমাকে এখন ছেড়ে দাও – কাল আমি বাসায় গিয়া তোমার সহিত দেখা করিব, এখন আমি কিছু-বিশেষ বড় ব্যস্ত আছি|”
মজিদের এইরূপ পীড়াপীড়িতে মোবারক তাহার হাত ছাড়িয়া দিল| হাতছাড়া হইতেই মজিদ নিবিড় কুজ্ঝটিকা ও অন্ধকারের মধ্যে কোথায় অন্তর্হিত হইয়া গেল – আর তাহাকে দেখিতে পাওয়া গেল না|
মোবারক মজিদের এইরূপ উদ্বিগ্নভাব দেখিয়া বিস্মিত হইল| কারণও কিছু ঠাওর হইল না| সে মজিদের কথা ভাবিতে ভাবিতে সেই গলির ভিতরে অগ্র্সর হইয়া চলিল| কিছুদূর গিয়া দেখিল, একজন কর্ত্তব্যপরায়ণ পাহারাওয়ালা প্রজ্বলিত লণ্ঠনহস্তে পথিপার্শ্বস্থ এক প্রকাণ্ড কদম্ব্তরুতলে বিরাজ করিতেছে|
মোবারক তাহাকে বলিল, ” পাহারাওয়ালা সাহেব, জ্যরা মদৎ কর্নে সকোগে|”
পাহারাওয়ালা বলিল, “ফরমাইয়ে|”
মোবারক কহিল, “তোম্হারে পাশ রৌস্নি হৈ, অগর মুঝে ইস্ গল্লিকে বাহার কর দেওতো – ইনাম মিলেগা|”
ইনামের নাম শুনিয়া পাহারাওয়ালা সহেব, ” জনাব্কা যো হুকুম, ” বলিয়া মোবারকের পশ্চাদনুসরণ করিল|
গলির প্রায় শেষ সীমান্তে আসিয়া মোবারক পাহারাওয়ালার হাতে কয়েকটি তাম্রখণ্ড প্রদান করিয়া বলিল, ” অব্ তোম্হারে আনে কোই জরুরৎ ন্যহি,” বলিয়া দ্রুতপদে একা গলির মোড়ের দিকে যাইতে লাগিল| পাহারাওয়ালা যেখানে নিজের পারিশ্রমিক পাইয়াছিল, সেইখানেই হস্তস্থিত লণ্ঠনটা উর্দ্ধে তুলিয়া দাঁড়াইয়া রহিল| তাহার পর যেমন সে স্বস্থানে ফিরিবার জন্য কিছুদূর অগ্রসর হইয়াছে, এমন সময়ে শুনিতে পাইল, সেই ইনাম্দাতা ভদ্রলোকটি ‘পাহারওয়ালা’ ‘পাহারওয়ালা’ বলিয়া চীৎকার করিয়া তাহাকে ডাকিতেছে| শুনিবামাত্রই হস্তস্থিত লণ্ঠন দোলাইয়া পাহারাওয়ালা সেইদিকে ছুটিয়া চলিল| য্থাস্থানে উপস্থিত হইয়া দেখিল, ভদ্রলোকটি সেইখানে জানুপরি ভর দিয়া বসিয়া আছে, তাহার সম্মুখে কাপড় জড়ান কি একটা স্তূপীকৃত হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে|

১.০৩. তৃতীয় পরিচ্ছেদ – নারীহত্যা

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

নারীহত্যা

    পাহারাওয়ালাকে দেখিয়া, অতি উদ্বিগ্নভাবে উঠিয়া মোবারক অঙ্গুলি নির্দ্দেশ কহিল, “ইয়ে দেখ্যো, হিঁয়া এক জানানা পড়ি হৈ| ”
পাহারাওয়ালা বলিল, “ন্যহি ন্যহি, কোই মাতোয়ালী পড়ি হোগী|”
মোবারক কহিল “আরে ন্যহি, মাতোয়ালী ন্যহি হৈ, মেয়্নে দেখা ইস্কা বদন বহুৎ ঠাণ্ডা হৈ|”
শুনিয়া পাহারাওয়ালা ভীত হইল| মোবারক পাহারওয়ালার হাত হইতে লণ্ঠনটা কাড়িয়া লইয়া ভূতলাবলুণ্ঠিতা রমণীর সর্ব্বাঙ্গে আলোক সঞ্চালন করিতে করিতে ভাল করিয়া দেখিতে লাগিল| দেখিল, রমণী যুবতী, সুন্দরী, বয়স অষ্টাদশ বৎসরের বেশী হইবে না| মুখখানি সুন্দর| সুন্দর মুখখানির চারিদিকে রাশিকৃত কেশ বিস্তৃতভাবে ছড়াইয়া পড়িয়াছে| বিশালায়ত চোখ দুইটি উন্মীলিত ও বিস্ফারিত| মোবারক দেখিল, সেই চক্ষুঃ যেন তাহারই দিকে দৃষ্টি করিতেছে| হাত্দুইটি এখনও দৃঢ়রূপে মুষ্টিবদ্ধ হইয়া রহিয়াছে| দেহের কোন স্থানে আঘাতের চিহ্ণ নাই| রক্তপাতেরও কোন চিহ্ণ নাই| সুন্দর মুখখানি মৃত্যুবিবর্ণীকৃত, চম্পকের ন্যায় কোমল বর্ণ মৃত্যুচ্ছায়ান্ধকারম্লান| মুখবিবর ঈষদুন্মুক্ত, দন্তের উপরে বক্রভাবে জিহ্বার কিয়দংশ বাহির হইয়া পড়িয়াছে| পরিধানে নীলরঙের সিল্কের পার্শিসাড়ী, সাটীনের একটি জ্যাকেট, তাহাও নীলরঙের| খুব পাৎলা জাপানী সিল্কের একখানা ওড়না – তাহাও নীলরঙের| তাহাতে রেশমের ফুল-লতার কাজ|
“ঔর দেখ্নেকা কোই জরুরৎ ন্যহি হৈ – একদম্ ম্যর গয়ী|” বলিয়া পাহারাওয়ালা অভ্রভেদী কণ্ঠে ‘জুড়িদার ভেইয়াকে’ হাঁক পাড়িতে লাগিল| দুই-তিনদিক্ হইতে দুই-তিনজন ‘জুড়িদার ভেইয়া’ জবাব দিল| অনতিবিলম্বে দুইজন দেখাও দিল|
মোবারক বলিল, “মেরি সমঝ্মে ইয়ে হৈ কি, কিসীনে ইস্কী গলা দবায়কে খুন কিয়া হৈ, কেঁওকি ইস্কী চেহারা কালা হো গয়া হৈ| জীভ্ভি নিকল্ পড়ী হৈ, ঔর বদন্মে কোই তর্হকা ছোরা, চক্কুকা চোট্ভি ন্যহি হৈ|”
একজন পাহারাওয়ালা মৃতার গলদেশের নিকটে মুখ লইয়া ভাল করিয়া দেখিতে লাগিল| গলা টিপিয়া খুন করার কোন চিহ্ণ দেখিতে পাইল না| বলিল, “ও নেহিন্, ক্যায়া জানে কুছ্ সমঝ্মে আতা ন্যহি| অ্যবি হাঁসপাতালমে চালান্ করো, ডাঁক্ডর সাহেবকে দেখ্নেসে সব্ হাল্ মালুম পড়েগা !”
তখন পাহারাওয়ালা লাস্ হাঁসপাতালে চালান দিবার বন্দোবস্ত করিতে লাগিল; এবং মোবারকের ঠিকানা জানিয়া লইল| কাল প্রাতেই তাহাকে দরকার হইবে| মোবারকই প্রথমে লাস্ দেখিতে পাইয়াছে|
মোবারক-উদ্দীন পকেট হইতে একখানা কাগজ বাহির করিয়া নিজের নাম ঠিকানা লিখিয়া তাহাদিগের একজনের হাতে দিল| এবং তথা হইতে নিজের বাসার দিকে চলিয়া গেল|
যথা সময়ে মোবারক বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইল| বারংবার সেই নীলবসনা সুন্দরীর মৃতদেহ তাহার মনে পড়িতে লাগিল| সেই ভীষণ দৃশ্যের কথা যতই তাহার মনে পড়িতে লাগিল – মনটা ততই খারাপ হইতে লাগিল|
ঘরে ব্র্যাণ্ডী ছিল, খানিকটা পান করিয়া শুইয়া পড়িলেন ; তথাপি শীঘ্র নিদ্রা আসিল না – নিদ্রিত হইলেও অনেকবার সেই নীলবসনা সুন্দরীর যন্ত্রণাবিকৃত মুখমণ্ডল স্বপ্নে দেখিল – ভীতিপ্রদ স্বপ্নে বারংবার তাহার নিদ্রাভঙ্গ হইতে লাগিল|
কে এ নীলবসনা সুন্দরী ?

১.০৪. চতুর্থ পরিচ্ছেদ – সংবাদ-পত্রের মন্তব্য

যখনকার কথা বলিতেছি, তখন সম্পাদক এবং সংবাদপত্রের এত ছড়াছড়ি ছিল না| দুই-একখানির সাপ্তাহিক সংবাদপত্র বাহির হইত| তাহারই একখানিতে এই হত্যাকাহিনী ছাপার অক্ষরে গ্রথিত হইয়া বাহির হইল, –
“অত্যাশ্চর্য নারীহ্ত্যা!”

“মেহেদী-বাগানের হত্যাকাণ্ডের ন্যায় অদ্ভুত হ্ত্যাকাণ্ড আর কখনও ঘটে নাই| রাত তিনটার সময়ে মোবারক-উদ্দীন, বিখ্যাত ধনী রাজাব-আলির বাটী হইতে মেহেদী-বাগানের ভিতর দিয়া নিজের বাসায় ফিরিতেছিলেন| তিনি সেইখানকার একটা নির্জ্জন গলিপথে একটি স্ত্রীলোকের মৃতদেহ দেখিতে পান| এবং তখনই তিনি নিকটবর্ত্তী ঘাটির পাহারাওয়ালাদিগকে ডাকিয়া সেই মৃতদেহ হাসপাতালে পাঠাইবার বন্দোবস্ত করেন| হাঁসপাতালে সেই লাস্ পরীক্ষা করা হইয়াছে| রমণীর প্রতি যে কোনরূপ বলপ্রয়োগ করা হইয়াছে, এরূপ কোন চিহ্ণ দেখিতে পাওয়া যায় নাই| গলদেশের একপার্শ্বে সামান্য একটু ক্ষত্চিহ্ণ, তাহাতে মৃত্যু ঘটিতে পারে না| দেখিয়া বোধ হয়, হত্যাকারী রমণীর কণ্ঠভূষা জোর করিয়া ছিনাইয়া লইয়াছে ! তাহা ছাড়া কোনপ্রকার সাঙ্ঘাতিক আঘাতের চিহ্ণ নাই|
“কিন্তু ডাক্তারী পরীক্ষায় স্থির হইয়াছে, রক্ত বিষাক্ত হওয়ায় রমণীর মৃত্যু হইয়াছে| রমণীর দেহ বিবর্ণ, স্থানে স্থানে ফুলিয়া উঠিয়াছে, জিহ্বাও বক্রভাবে মুখের বাহিরে আসিয়া পড়িয়াছে – মুখমণ্ডল কালিমাঙ্কিত – এ সকলে বিষ প্রয়োগেরই লক্ষণ| রমণীর গলদেশে যে সামান্য একটু ক্ষতচিহ্ণ দেখিতে পাওয়া গিয়াছে, তাহা বিষাক্ত ছুরি বা অন্য কোন অস্ত্র-প্রয়োগেরই চিহ্ণ|
“স্থানীয় থানার ইন্স্পেক্টর রমণীর আকৃতি ও বেশভূষা বর্ণনা করিয়া এই হত্যাকাহিনীর একখানি বিজ্ঞাপন শহরের সর্ব্ব্ত্র প্রচার করিয়া দিয়াছেন| সকল রাজপথের গৃহ-প্রাচীরে সেই বিজ্ঞাপন সংলগ্ন করিয়া দেওয়া হইয়াছে; তথাপি এখনও মৃতার কোন পরিচয় পাওয়া যায় নাই|
“সুযোগ্য ডিটেক্টিভ দেবেন্দ্রবিজয়ের উপরে এই মোকদ্দমার তদন্তের ভার পড়িয়াছে; সুতরাং আশা করা যায়, প্রকৃত হত্যাকারী শীঘ্র ধরা পড়িবে; এবং সেই মৃতা স্ত্রীলোকটি যে কে, তাহাও জানিতে পারা যাইবে| দুর্ভেদ্য রহস্যের ভিতর হইতে হত্যাকারীকে চিনিয়া বাহির করিবার তাঁহার কত বড় ক্ষমতা, তাহা আমরা সবিশেষে অবগত আছি| তাঁহার তীক্ষ্ণদৃষ্টি হইতে এ পর্য্যন্ত আমরা কখনও কোন অপরাধীকে নিষ্কৃতিলাভ করিতে দেখি নাই|”

» ১.০৫. পঞ্চম পরিচ্ছেদ – দেবেন্দ্রবিজয়

যখনকার কথা লিপিবদ্ধ করিতেছি, তখন সুদক্ষ ডিটেক্টিভ দেবেন্দ্রবিজয়ের নাম-ডাক খুব | সর্ব্বাপেক্ষা তাঁহারই প্রাধান্য | যে সকল বড় বড় কেসে অপরের নিকটে কোন সুফলের আশা করা যায় না, তাহা দেবেন্দ্রবিজয়ের হাতেই আসে; সুতরাং মেহেদী-বাগানের সেই অত্যাশ্চর্য্য নারী-হ্ত্যার কেস্টা তাঁহারই হাতে পড়িল |
কেস্টা হাতে লইয়া দেবেন্দ্রবিজয় প্রথমে একটু বিব্রত হইয়া পড়িলেন | কিরূপে হত্যাকারীর সন্ধান হইবে এবং কিরূপে সেই অপরিচিতার মৃত্দেহ সনাক্ত করিবেন, এমন কোন সূত্র পাইলেন না | মৃতাকে দেখিয়া বোধ হয় না, সে বারাঙ্গনা কিম্বা কোন ইতর-বংশীয়া | রাত্রি-জাগরণ, অতিরিক্ত মদ্যপান ও অপরিমিত ইন্দ্রিয়-পরিচালনায় বেশ্যাদিগের চোখে-মুখে যে একটা কালিমা পড়ে, তাহা তাহার মুখে আদৌ নাই – মৃতার মুখ কেবল মৃত্যুবিবর্ণীকৃত | মুখ দেখিয়া সহজে বুঝিতে পারা যায়, সে কোন সম্ভ্রান্ত পরিবারের অন্তর্গতা হইবে; কিন্তু এরূপ নির্জ্জন পথিমধ্যে, গভীর রাত্রে কোন্ সম্ভ্রান্ত গৃহস্থের কন্যা কাহার দ্বারা খুন হইল ? দেবেন্দ্রবিজয় মনে মনে স্থির করিলেন, ভদ্রকন্যা হইলেও এই রমণী চরিত্রহীনা; নতুবা সদভিপ্রায়ে কোন্ ভদ্রমহিলা অরক্ষিত অবস্থায় গভীর রাত্রে গৃহের বাহির হইয়া থাকে ? এরূপ স্থলে কে ইহাকে হত্যা করিয়াছে বলিয়া সম্ভব হয় ? যাহার জন্য এই সুন্দরী গভীর রাত্রে গৃহত্যাগ করিয়া আসিয়াছিল, সেই ব্যক্তি কি ইহাকে হত্যা করিয়াছে ? এমন কোন কারণ থাকিতে পারে, যাহাতে ইহাও অসম্ভব নহে | হয়ত কোন কারণ বশতঃ সেই ব্যক্তি ইহাকে খুন করিয়া থাকিবে; অথবা এই রমণীর স্বামী, স্ত্রীর চরিত্রহীনতার কথা কোন রকমে জানিতে পারিয়া থাকিবে; তাহার পর সংগোপনে স্ত্রীর অনুসরণে আসিয়া সকলেই স্বচক্ষে দেখিয়াছিল, এবং পাপিষ্ঠার পাপের এইরূপ প্রায়শ্চিত্ত বিধান করিয়াছে; অথবা এমনও হইতে পারে, এই রমণী যাহার জন্য গোপনে রাত্রে গৃহত্যাগ করিত, তাহার আর কোন প্রণয়পাত্রী কিম্বা প্রণয়াকাঙিক্ষণীর দ্বারা খুন হইয়াছে; কিন্তু পথিমধ্যে এরূপ একটা ভয়ানক হত্যাকাণ্ড সমাধা করা অল্প সাহসের পরিচয় নহে | স্ত্রীলোক সহসা কি এতটা সাহস করিতে পারে ? দেবেন্দ্রবিজয় ভাবিয়া কিছুই ঠিক করিতে পারিলেন না | বুঝিতে পারিলেন – যতক্ষণ না মৃতকে সনাক্ত করিতে পারা যায়, ততক্ষণ এইরূপ গাঢ়তর অন্ধকারের মধ্যেই তাঁহাকে থাকিতে হইবে | প্রথমে অনুসন্ধান করিয়া ঠিক করতে হইবে , যে স্ত্রীলোকটি খুন হইয়াছে , – সে কে – কোথায় থাকিত , এবং তাহার চরিত্র কিরূপ ছিল ; এইগুলি যদি প্রথমে সন্ধান করিয়া ঠিক করিতে পারা যায় , তাহা হইলে তখন হত্যার কারণ এবং হত্যাকারীকে ঠিক করিতে বিশেষ শ্রমস্বীকারের আবশ্যকতা হইবে না |
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, এমন কোন সূত্র নাই, যাহা অবলম্বন করিয়া তিনি প্রথমতঃ সেই মৃতাকে সনাক্ত করিতে পারেন | পরিহিত বস্ত্রাদিতে যে রজকের চিহ্ণ থাকে, তাহার দ্বারাও অনেক সময় অনেক কাজ হয়, তাহা থাকিলে দেবেন্দ্রবিজয় প্রথমতঃ কাজে হস্তক্ষেপ করিবার একটা সুবিধা পাইতেন; কিন্তু মৃতার পরিহিত কপড়, জামা, ওড়না প্রভৃতি সকলেই সিল্কের | তাহাতে রজকের কোন চিহ্ণ ছিল না, সুতরাং সে সুবিধাও দেবেন্দ্রবিজয়ের অদৃষ্টে ঘটিল না |
স্থানীয় থানায় মৃতার পরিহিত বস্ত্রাদি রক্ষিত হইয়াছিল | দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন তন্মধ্যে ওড়্নাখানি তাঁহার কিছু উপকারে আসিতে পারে | সেইখানির চতুষ্প্রান্তে রেশমের ফুল-লতার সূক্ষ কারুকার্য্য ছিল | রেশমী বস্ত্রের উপরে রেশমের এইরূপ সুন্দর সূচী-কার্য্যে করিমের মা খুব নিপুণা | ইহাতে বৃদ্ধা করিমের মা সুনামের সহিত যথেষ্ট অর্থোপার্জ্জনও করিয়াছে | অনেকেই তাহাকে জানে, এবং দেবেন্দ্রবিজয়েরও সহিত তাহার পরিচয় আছে | বৃদ্ধা এখন বয়োদোষে নিজের হাতে কাজ করিতে না পারিলেও, তাহার কন্যাকে এই শিল্পকার্য্যে এমন সুশিক্ষিতা ও সুনিপুণা করিয়া তুলিয়াছে যে, সেই কন্যা হইতে তাহার সুনাম সম্পূর্ণরূপে অব্যাহত আছে | করিমের পিতা একজন নামজাদা চিকন্দার জরদ্-দর্জ্জি ছিল; কিন্তু অদৃষ্টক্রমে সে নিজের অর্থাগমের বড় কিছু সুবিধা করিতে পারে নাই | মৃত্যুপূর্ব্বে সে স্ত্রীর জন্য অর্থাদি তেমন কিছু রাখিয়া যাইতে পারে নাই; কিন্তু সে স্ত্রীকে যে বহুবিধ সূচি-শিল্প শিক্ষা দিয়াছিল, তাহাতেই স্ত্রীকে স্বামীর মৃত্যুর পরে অর্থাভাবে কিছুমাত্র কষ্ট পাইতে হয় নাই | এক্ষণে বৃদ্ধা করিনের মার দুই-তিনখানা ভাড়াটিয়া বাড়ী, হাতে নগদ টাকাও আট-দশ হাজার | করিমের মা সেই টাকায় গহনা, বাড়ী জমি ইত্যাদি বন্ধক রাখিয়া সুদে খাটাইতেছে – সকল রকমে এখন তাহার মাসিক আড়াই শত টাকা আয় ; কিন্তু বুড়ী নিজে বড় কৃপণ; এত টাকার আয় – তথাপি বুড়ী বালিগঞ্জের নিকটে পেয়ারা-বাগানে একখানা একতলা বাড়ীতে থাকে | বাড়ীতে একটি মাত্র ঘর, সেই এক ঘরেই মা ও মেয়ে থাকে | ঘরখানির সম্মুখে অনেকটা খালি জমি রাংচিতা গাছের বেড়াতে ঘেরা | সেখানে সময়ে সময়ে লাউ, কুম্ড়া, শশা, বেগুন, পটল প্রভৃতি অনেক রকমের গাছ দেখিতে পাওয়া যায় | ইহাতে করিমের মার একটা আয় আছে, বৃদ্ধা সেই সকল লাউ, কুম্ড়া, শশা, বেগুন এক আনা রকম নিজের জন্য রাখে, বাকী পনের আনা বিক্রয় করিয়া ফেলে |
দেবেন্দ্রবিজয় সেই রেশমের ফুল-লতার কাজ করা ওড়্নাখানি একখানি কাগজে জড়াইয়া লইয়া একবারে করিমের মার বাড়ীতে উপস্থিত হইলেন |
করিমের মা দেবেন্দ্রবিজয়কে দেখিয়া বলিল, ” এই যে গো, তুমি নিজেই এসে হাজির হয়েছ ! আমি এখনই তোমার কাছে যাব, মনে করছিলাম |”
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, ” কেন, ব্যাপার কি ? ”
করিমের মা বলিল, “মুন্সী জোহিরুদ্দীনের স্ত্রী সৃজান বিবিকে এক রাশ টাকা ধার দিয়ে ব’সে আছি; এখন শুন্ছি, মনিরুদ্দীনের সঙ্গে সে কোথায় স’রে গেছে – কোন সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না | আমার টাকাগুলোর যে কি কিনারা হবে, ভেবে কিছু ঠিক করতে পারছি না |”
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “শুধু হাতে টাকা ধার দিয়েছিলে না কি ?”
“শুধু হাতে টাকা !” বৃদ্ধা চক্ষুর্দ্বয় ললাটে তুলিল | তাহার পর হাসিতে হাসিতে বলিল, ” আমাকে কি তেম্নি ন্যাকাহাবা পেয়েছ ? একছড়া জড়োয়া কণ্ঠহার বাঁধা রেখে টাকা দিয়েছি | তা’ কণ্ঠহার ছড়াটা মুন্সী সাহেবরই হবে – খুব দামী | সেই কণ্ঠহার নিয়ে একবার মুন্সী সাহেবের সঙ্গে দেখা করলে হয় না ?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, ” তবে আর ভাবনা কি ? এখন একবার মুন্সী সাহেবের সঙ্গে দেখা করলেই ত সকল গোল মিটে যায় |”
করিমের মা বলিল, ” দিন-কতক সবুর ক’রে দেখি; ইহার মধ্যে সৃজার বিবির যদি কোন খবর পাই, তা’ হলে আর আমার এ সব গোলযোগে দরকার নাই | যার জিনিষ সে নিজে এসেই খালাস ক’রে নিয়ে যাবে | আমার বোধ হয়, সৃজান বিবি ফারখৎ দিয়ে মনিরুদ্দীনকে নিকে করবে; তখন সে এই কণ্ঠহার খালাসের জন্য আমার কাছে আবার আস্তে পারে | কবে আস্বে, কোথায় গেছে কতদিন পরে খবর পাব, কিছুই ভেবে ঠিক করতে পারছি না – বড়ই মুস্কিল হ’ল আমার দেখ্ছি |”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, ” যখন কণ্ঠহার তোমার লোহার সিন্দুকে আছে, তখন এ মুস্কিল একদিন-না-একদিন আসান্ হয়ে যাবে-তার জন্য এত ভাবনা কেন ? এখন সে কথা থাক, আমি একটা বিশেষ কাজের জন্য তোমার কাছে এসেছি | দেখ দেখি, এই রেশমের কাজ তোমার হাতের কি না ?” বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় কাগজের মোড়া খুলিয়া সেই ওড়্নাখানি করিমের মার হাতে দিলেন |

১.০৬. ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – মা ও মেয়ে

ওড়নাখানি খুলিয়া দেখিয়া করিমের মা বলিল, ” এ ওড়্না আমাদেরই তৈয়ারী; এ রকম ফুল-লতা-মোড়ের কাজ আর কোথাও হয় না| গোয়েন্দা বাবুর বৌ-এর জন্য এ রকম একখানি ওড়্না চাই না কি? তা’ ইহার অপেক্ষাও যাতে ভাল হয়, তা’ আমি ক’রে দিব| বৌ-এর হুকুমে বুঝি আজ তাড়াতাড়ি এখানে ছুটে এসেছ?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “না, সে রকম হুকুম আপাততঃ আমার উপরে পড়েনি; পড়্লেই তামিল করবার জন্য এখানে ছুটে আসতে হবে, সেজন্য বিশেষ চিন্তা নাই|”
করিমের মা বলিল, “তবে এ ওড়্না সঙ্গে কেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, ” কে তোমাকে এই ওড়্নাখানি তৈয়ারী করতে দিয়েছিল, বলিতে পার?”
করিমর মা হাসিয়া বলিল, ” কেন-তাকে আবার কেন? পাছে তোমার কাছে বেশি নিই, তাই কত খরচ পড়েছে, সেটা আগে তার কাছে খবর নিয়ে আস্বে -মনে করেছ? তাতে দরকার নাই, খুব কম খরচে ক’রে দিব, সে তোমার গায়েই লাগ্বে না| কি মুস্কিল ! তোমার কছে কি আমি বেশে নিতে যাব !”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “না করিমের মা, তুমি যা’ মনে করেছ, সেটা ঠিক নয়| কার জন্য এই ওড়্নাখানি তৈয়ারী করেছিলে বল দেখি; কাজ আছে-বিশেষ দরকার|”
করিমের মা ওড়্নাখানি ভাঁজ করিতে করিতে বলিল, ” তাকি আর এখনও মনে আছে ! কত লোকের কত রকম ওড়্না ক’রে দিচ্ছি-সে কি আর মনে রাখা যায় ! এ বয়সে সব কথা আর মনে থাকে কি? দেখি, আমার মেয়ের যদি মনে থাকে-সে নিজের হাতেই এই ওড়্নায় রেশমের ফুল তুলেছে|”
এই বলিয়া করিমের মা মেয়েকে ডাকিল| মেয়ে ঘরের ভিতরে জানালার ধারে বসিয়া শিল্পকার্য্যে মনোনিবেশ করিয়াছিল; তখন উঠিয়া আসিল| মেয়ে সেই ওড়্না দেখিয়া তৎক্ষণাৎ চিনিতে পারিল, এবং সে নিজের হাতে সেই ফুল তুলিয়াছে, বলিল|
মেয়ের বয়স ত্রিশ বৎসরের কম নহে| তাহারও মহিমের মা কি জালিমের মা-এই রকমেরই একটা কিছু নাম হইবে| তাহার নামে আমাদিগের বিশেষ কোন প্রয়োজন নাই| করিমের মা মেয়েকে জিজ্ঞাসা করিল, “এই ওড়্নাখানি কে তৈয়ারী করতে দিয়েছিল, মনে আছে কি?”
মেয়ে বলিল, ” সে আজকের কথা কি? প্রায় সাত-আট মাস হ’ল, একজন বাইজী এই ওড়্নাখানি তৈয়ারী করতে দিয়েছিল|”
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলের, ” কে সেই বাইজী, নাম কি?”
“লতিমন বাইজী|”
‘কোথায় থাকে?”
” বামুন-বস্তিতে| সেখানে তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলে আপনি সবই জানতে পারবেন| আমার ঠিক মনে পড়্ছে এ নিশ্চয় সেই লতিমন বাইজীর ওড়্না|”
“আর তার দেখা পাওয়া যাবে না; সে আর নাই|”
“নাই কি ! কোথায় গেল?”
“যেখানে সকলে যায়-সকলকে যেতে হবে| লতিমন মরিয়াছে|”
“সে কি ! কবে-কি হইয়াছিল?” বলিয়া করিমের মা চকিতে উঠিয়া দাঁড়াইল|
দেবেন্দ্রবিজয় সেই ওড়্খানি পুনরায় নিজের হাতে লইয়া কহিলেন, ” এই ওড়্না যদি লতিমনেরই হয়, তা’ হলে লতিমন আর এ জগতে নাই| তার মৃত্যু হয়েছে|”
“কি সর্ব্বনাশ|” বলিয়া করিমের মা আবার বসিয়া পড়িল|
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “মেহেদী-বাগানের একটা গলিপথে লতিমনকে কে খুন ক’রে গেছে|”
“কি সর্ব্বনাশ গো ! কে খুন করিল?”বলিয়া করিমের মা বিস্ময়স্থিরনেত্রে দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল|
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, ” যে খুন করেছে, সে এখনও ধরা পড়ে নাই| যাতে শীঘ্র সন্ধান ক’রে ধরতে পারি, সেইজন্য যে খুন হয়েছে, তার নাম জান্বার চেষ্টায় এখানে এসেছি; আমার সে চেষ্টাও প্রায় সফল হয়েছে, এখন আর একটু চেষ্টা করলেই খুনীকে ধরতে পারব|”
করিমের মা বলিল, “লতিমন বাই যে খুন হয়েছে-তার এখন ঠিক কি? লতিমন এই ওড়্না যদি আর কাকে দিয়ে থাকে-কি আর কারও জন্যে আমাদের এখানে তৈয়ারী করিয়ে থাকে?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “এখন আমাকে সেটা সন্ধান ক’রে ঠিক করতে হবে| যখন একটা নাম পাওয়া গেছে, তখন সহজেই সব কাজই শেষ করতে পারব| এখন চল্লেম, দরকার হয় আবার দেখা করব|” বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় তথা হইতে বাহির হইয়া পড়িলেন|

১.০৭. সপ্তম পরিচ্ছেদ – লতিমন

দেবেন্দ্রবিজয় লতিমন বাইজীর সন্ধানে বামুন-বস্তিতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন | লতিমনের প্রকাণ্ড দ্বিতল বাটী, বামুন-বস্তির আবালবৃদ্ধবনিতার পরিচিত | লতিমনও তদ্রূপ | তাহার জন্য দেবেন্দ্রবিজয়কে বিশেষ কষ্ট-স্বীকার করিতে হইল না; পাড়া প্রতিবেশীদিগের নিকট হইতে তিনি অল্পায়াসে লতিমন বাইজীর সম্বন্ধে অনেকখানি সংবাদ গ্রহণ করিয়া ফেলিলেন | লতিমন সর্ব্বদা বাটীর বাহির হয় না-কখন কখন দেশে-বিদেশে মজ্রো কর্তে যায়-সুতরাং লতিমন এখন বাড়ীতে আছে, কি বিদেশে গাওনা করিতে গিয়াছে, এই সম্বন্ধে কেহ কোন সন্তোষজনক উত্তর করিতে পারিল না | দেবেন্দ্রবিজয় আরও একটা সংবাদ পাইলেন, মনিরুদ্দীনেরও সেখানে যাতায়াত আছে | লতিমনের বাড়ীতে দিলজান নামে আর একটি ষোড়শী সুন্দরী বাস করে; মনিরুদ্দীন কোথা হইতে তাহাকে এখানে আনিয়া রাখিয়াছে | লতিমনের বাড়ী দ্বিমহল, ভিতর মহলে লতিমন নিজে থাকে; বাহির মহলের দ্বিতলে একটা প্রকাণ্ড হলঘরে দিলজান বাস করে |
দেবেন্দ্রবিজয় মনে মনে স্থির করিলেন, দিলজানের সহিত দেখা করিলে লতিমন সম্বন্ধে সমুদয় সংবাদ পাওয়া যাইবে; তা’ ছাড়া মনিরুদ্দীনের সম্বন্ধেও অনেক বিষয় জনিতে পারা যাইবে |
দেবেন্দ্রবিজয় লতিমন বাইজীর বাড়ীতে প্রবেশ করিলেন | একজন ভৃত্য তাঁহাকে উপরে একটী সুসজ্জিত প্রকোষ্ঠে লইয়া গিয়া বসাইল এবং সংবাদ লইয়া বাড়ীর ভিতরে চলিয়া গেল |
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, গৃহটী মূল্যবান্ আস্বাবে পূর্ণ | গৃহতলে গালিচা বিস্তৃত | গৃহ-প্রাচীরে উৎকৃষ্ট তৈল-চিত্র ও দেয়ালগিরি | একপার্শ্বে একখানি প্রকাণ্ড দর্পণ-সম্মুখে গিয়া কেহ দাঁড়াইলে তাহার মাথা হইতে পা পর্য্যন্ত তাহাকে প্রতিবিম্বপাত হয় | অপরপার্শ্বে গবাক্ষের নিকটে একটি হারমোনিয়ম রহিয়াছে, নিকটে একখানি মখমলমণ্ডিত চেয়ার ও একখানি কৌচ | দেবেন্দ্রবিজয় মনে করিলেন, হয়ত দিলজান বিবি ঐ চেয়ারে বসিয়া হারমোনিয়মের স্বরে কণ্ঠস্বর-সংযোগপূর্ব্বক শব্দতরঙ্গে সেই সুসজ্জিত প্রকোষ্ঠ প্লাবিত করিতে থাকে, আর মনিরুদ্দীন সেই কৌচে কান পাতিয়া পড়িয়া থাকেন |
দেবেন্দ্রবিজয় পশ্চাদ্ভাগে হাত দুইখানি গোট করিয়া সেই কক্ষমধ্যে পরিক্রমণ করিতে করিতে গৃহের সমগ্র সামগ্রী সবিশেষ মনোযোগ সহকারে দেখিতে লাগিলেন | কিয়ৎপরে সহসা তাঁহার দৃষ্টি হারমোনিয়মের উপরিস্থিত মরক্কো-মণ্ডিত দুইটি ক্ষুদ্র বাক্সের উপরে পড়িল | বাক্স দুইটি দেখিতে একপ্রকার | দৈর্ঘ্যে অর্দ্ধ-হস্ত এবং প্রস্থে পাঁচ-ছয় অঙ্গুলি পরিমিত | দেবেন্দ্রবিজয় একটি বাক্স তুলিয়া লইলেন, এবং ডালাখানি ধীরে ধীরে খুলিয়া দেখিলেন, তন্মধ্যে একখানি সুদীর্ঘ সূক্ষাগ্র, ধারাল ছুরিকা রহিয়াছে | ছুরিখানির মূলদেশ উজ্জ্বল হস্তিদন্তনির্ম্মিত | অপর বাক্সটিও লইয়া খুলিয়া দেখিলেন | দেখিলেন, তন্মধ্যে কিছুই নাই, কিন্তু তন্মধ্যে যে ঠিক সেইরূপ একখানি ছুরি ছিল, তাহা দেবেন্দ্রবিজয়ের বুঝিতে বাকী রহিল না |
বাক্স দুইটি একই ধরণের তৈয়ারী | হস্তস্থিত বাক্সটি যেখানে ছিল, সেইখানেই রাখিয়া দিলেন | তাহার পর গবাক্ষের সম্মুখে আসিয়া ছুরিখানি ঘুরাইয়া-ফিরাইয়া বিশেষ মনোনিবেশ পূর্ব্বক দেখিতে লাগিলেন | দেখিলেন, ছুরিখানির অগ্রভাগ তেমন উজ্জ্বল নহে-নীলাভ এবং খুব সূক্ষ; বিষাক্ত বলিয়া বোধ হইল | দেবেন্দ্রবিজয় মনে মনে স্থির করিলেন, এখন রাসায়নিক পরীক্ষা দ্বারা দেখিতে হইবে, এই ছুরিখানি বিষাক্ত কি না | তাহার পর কোন একটা বিড়াল বা কুকুরের গায়ে বিদ্ধ করিলেই বুঝিতে পারিব, এই বিষে কতক্ষণে কিরূপ ভাবে মৃত্যু ঘটে | মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া দেবেন্দ্রবিজয় কক্ষের চতুর্দ্দিকে দৃষ্টি সঞ্চালন করিয়া দেখিলেন, কেহ কোথায় নাই | তখন ছুরিখানি ব্যগ্রভাবে একখানি কাগজে জড়াইয়া নিজের পকেটে ফেলিলেন ; এবং একখানি চেয়ার টানিয়া বসিয়া রুমালে মুখ মুছিতে লাগিলেন |
অনতিবিলম্বে পার্শ্ববর্ত্তী দ্বারপথ দিয়া একটি স্ত্রীলোক তথায় প্রবেশ করিল | তাহাকে দেখিতে তেমন সুন্দরী নহে – শ্যামবর্ণা-বয়ঃক্রমও ত্রিশ বৎসর হইবে | মুখে বসন্তের ক্ষতচিহ্ণ | সর্ব্বাঙ্গে স্বর্ণালঙ্কারে শোভিত | পায়ে জরীর কাজ করা চটিজুতা | দেবেন্দ্রবিজয় তাহার আপাদমস্তক সাভিনিবেশ দৃষ্টিসঞ্চালন করিতে লাগিলেন | ভাবিলেন, কে এ ! দিলজান কখনই নয়-মনিরুদ্দীন কি ইহারই প্রেমে মুগ্ধ হইয়া এ যাবৎ বিবাহ করে নাই ? একান্ত অসম্ভব !
সেই স্ত্রীলোকটি অপরিচিত দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে বিস্মিত চিত্তে চাহিয়া বলিল “আপনি কি সেই দিলজানের সহিত দেখা করিতে আসিয়াছেন ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিল্লেন, “হাঁ, বিশেষ প্রয়োজন আছে, অপনার নাম কি দিল -”
বাধা দিয়া স্ত্রীলোকটি বলিল, ” না, আমার নাম দিলজান নয় | আপনার কি প্রয়োজন বলুন-আমি দিলজান্কে তাহা বলিব |”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “তাহার সহিত আমার দেখা করা দরকার |”
স্ত্রী | এখন দেখা হইবে না-দিলজান এখন এখানে নাই | আপনি কোথা হইতে আসিতেছেন ?
দে (ইতস্ততঃ করিয়া ) আমি-আমি-এই মনিরুদ্দীনের নিকট হইতে আসিতেছি |
স্ত্রী | আপনি মিথ্যা বলিতেছেন |
দে | কেন ?
স্ত্রী | মনিরিদ্দীন এখন অখানে নাই | দিলজান্কে সঙ্গে লইয়া তিনি কোন্ দেশে বেড়াইতে গিয়াছেন |
দেবেন্দ্রবিজয় বড় বিভ্রাটে পড়িলেন | দেখিলন, কথাটা ঠিক খাটিল না; পাছে অপ্রতিভ হইতে হয়, মনে করিয়া তিনি সে কথাটি একেবারে চাপা দিয়া বলিলেন, “ওঃ ! তা হবে; কিন্তু আরও একটা কথা আছে, আপনি বাহিরের খবর কিছু রাখেন ?”
স্ত্রী | কি খবর বুঝিলাম না | তা’ বাহিরের খবরের জন্য এখানে আমার কছে কেন ? বাহিরে অনেক লোক আছে |
দে | এখানে প্রয়োজন আছে |
স্ত্রী | আপনার কথা আমি ভাল বুঝিতে পারিতেছি না-আপনার অভিপ্রায় কি, স্পষ্ট বলুন | আপনার নামটি জানিতে পারি কি ?
দে | আমার নাম দেবেন্দ্রবিজয়-আমি পুলিস-কর্ম্মচারী |
শুনিয়া স্ত্রীলোকটি চমকিত হইল | বিস্মিতনেত্র দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আপনার কি প্রয়োজন, বলুন ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “লতিমন সম্বন্ধে আপনি কিছু জানেন ?”
পুনরপি স্ত্রীলোকটি চমকিত হইল; বলিল, “সে ত ঘরের সংবাদ – জানি | আপনি তাহার সম্বন্ধে কি জানিতে চাহেন বলুন |”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, ” লতিমন বাই খুন হইয়াছে-মেহেদী-বাগানে তাহার লাস পাওয়া গিয়াছে |”
স্ত্রীলোকটি বলিল, “আপনার ভ্রম হইয়াছে |”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, ” আমার ত তা’ বোধ হয় না | এই দেখুন দেখি, এটা চিনিতে পারেন কি না |” বলিয়া তিনি সাগ্রহে কাপড়ে জড়ান সেই ওড়্নাখানি বাহির করিয়া তাহার হাতে দিলেন | ওড়্নাখানি দেখিয়া সেই স্ত্রীলোকটির হৃদয় অত্যন্ত উদ্বেগপূর্ণ হইয়া উঠিল এবং মুখমণ্ডলে সে চিহ্ণ সুস্পষ্ট প্রকটিত হইল | সোদ্বেগে কম্পিতকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, “হাঁ, চিনিতে পারিয়াছি-ইহা আপনি কোথায় পাইলেন ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, ” মেহেদী-বাগানে যে স্ত্রীলোকটি খুন হইয়াছে, তাহারই গায়ে ইহা ছিল |”
শুনিয়া স্ত্রীলোকটি দুইপদে পশ্চাতে হটিয়া গেল-কি এক ভয়ানক আশঙ্কায় তাহার চোখ-মুখ একবারে বিবর্ণ হইয়া গেল | রুদ্ধশ্বাসে কহিল, ” কি সর্ব্বনাশ ! এ কি ভয়ানক ব্যাপার !”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, ” ব্যাপার গুরুতর, লতিমন খুন হইয়াছে |”
দারুণ উৎকণ্ঠার সহিত সেই স্ত্রীলোকটি বলিল, ” না-পনি ভুল করিয়াছেন, লতিমন খুন হয় নাই |”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, ” আপনি কিরূপে জানিলেন, লতিমন খুন হয় নাই ?”
স্ত্রীলোকটি ব্যাকুল্ভাবে বলিল, “আমারই নাম লতিমন |”
দেবেন্দ্রবিজয় বিস্ময়বিহলনেত্রে লতিমনের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন |

১.০৮. অষ্টম পরিচ্ছেদ – নুতন রহস্য

লতিমন মলিল, “হাঁ, ওড়্না আমারই বটে, আপনি কিরূপে ইহা জানিতে পারিলেন ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, ” আমি এই ওড়না লইয়া করিমের মার কাছে গিয়াছিলাম | তাহারই মুখে শুনিলাম, আপনি তাহার নিকট হইতে এই ওড়্না তৈয়ারী করিয়া লইয়াছেন | এই ওড়না যদি আপনার-আপনারই নাম লতিমন বাই-তবে মেহেদী-বাগানে যে স্ত্রীলোকটি খুন হইয়াছে, সে কে ?”
এবার লতিমন বাই আকুলভাবে কাঁদিয়া ফেলিল | দেবেন্দ্রবিজয় কারণ বুঝিতে না পারিয়া আরও বিস্মিত হইলেন |
লতিমন কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, “হায় ! হায় ! কি সর্ব্বনাশ হ’ল গো-আমাদেরই সর্ব্বনাশ হয়েছে ! মেহেদী-বাগানে যে মেয়েমানুষটি খুন হয়েছে-তার কাপড়-চোপড় কি রকম ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, ” সকলই নীলরঙের সিল্কের তৈয়ারী | সাঁচ্চার কাজ করা |”
লতিমন বাই হতাশভাবে বলিল, “তবেই ঠিক হয়েছে |
“ঠিক হয়েছে কি?”
“আমাদের দিলজানই খুন হয়েছে |” বলিয়া লতিমন দুই হাতে মুখ ঢাকিল |
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন রহস্য ক্রমশঃ নিবিড় হইতেছে-এই রহস্যের মর্ম্মভেদ বড় সহজে হইবে না | তিনি একখানি ফটোগ্রাফ বাহির করিয়া লতিমনকে দিয়া কহিলেন, “চিনিতে পারো কি ?”
লতিমন বাই দেখিবামাত্র কহিল, ” এ দিলজান বাইএর চেহারা; কিন্তু মুখখান যেন কেমন-এক-রকম ফুলো ফুলো দেখাইতেছে |”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, ” দিলজানের মৃত্যুর পর এই ফোটো লওয়া হইয়াছে-বিষে মুখখানা ফুলিয়া উঠিয়াছে |”
“বিষে?”
“হাঁ, গত বুধবার রাত্রে কেহ বিষাক্ত ছুরিতে তাহাকে হত্যা করিয়াছে |”
“গত বুধবার রাত্রে ! সেইদিনেই সে আমার নিকট হইতে এই ওড়্না লইয়া বাহির হইয়াছিল,” বলিয়া লতিমন বাই পুনরায় ক্রন্দনের উপক্রম করিল |
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, ” দেখুন, এখন কান্নাকাটি করিলে সকল দিক নষ্ট হইবে | দিলজান সম্বন্ধে আপনি যাহা কিছু জানেন, আমাকে বলুন | দিলজানের হত্যাকারীর অনুসন্ধানে আমি নিযুক্ত হইয়াছি-যাহাতে হত্যাকারী ধরা পড়ে, সেজন্য আপনার সর্ব্বতোভাবে চেষ্টা করা উচিৎ | বোধ হয়, আপনার সাহায্যে আমি প্রকৃত হত্যাকারীকে সহজে গ্রেপ্তার করিতে পারিব |”
লতিমন বাই চোখের জল মুছিয়া ভাল হইয়া বসিল | বলিল, “যাহাতে হত্যাকারী ধরা পড়ে সেজন্য যতদূর সাহায্য আমার দ্বারা হইতে পারে, তাহা আমি করিব | দিলজানকে আমি সহোদরা ভগ্নী অপেক্ষাও স্নেহ করিতাম | আমি যাহা কিছু জানি, সমুদয় আপনাকে এখনই বলিতেছি; কিন্তু কে তাহাকে হত্যা করিল-আমি ভাবিয়া কিছুই ঠিক করিতে পারিতেছি না | কে জানে, কে তাহার এমন ভয়ানক শত্রু ! সে কাহারও সঙ্গে মিশিত না-কাহারও সঙ্গে সঙ্গে তাহার বাদ-বিসংবাদ ছিল না-একমাত্র মনিরুদ্দীনকে সে খুব ভালবাসিত | মনিরুদ্দীন তাহাকে কোথা হইতে আনিয়া আমার এখানে রাখিয়াছিলেন | মনিরুদ্দীন তাহাকে বিবাহ করিবে বলিয়া মধ্যে মধ্যে আশা দিতেন | দিলজানও সেজন্য তাঁহাকে যখন-তখন পীড়াপীড়ি করিত | ইদানীং মনিরুদ্দীন বড় একটা এদিকে আসিতেন না-আসিলে তখনই চলিয়া যাইতেন | তিনি ইদানীং আর একজন সুন্দরীর রূপ-ফাঁদে পড়িয়াছিলেন |”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, ” আমি তাহাকে জানি-সে সুন্দরীর নাম সৃজান নয় কি ?”
লতিমন সবিস্ময়ে কহিলেন, “হাঁ, সৃজান | আপনি কিরূপে নাম জানিলেন ? এই সৃজান বিবিকে লইয়া দিলজানের সহিত মনিরুদ্দীনের প্রায় বচসা হইত | সপ্তাহ-দুই হইবে, আমি মজ্রো করিতে বিদেশে যাই | যখন ফিরিয়া আসিলাম-দেখি, দিলজানের সে ভাব আর নাই-মনিরুদ্দীনের উপরে সে একবারে মরিয়া হইয়া উঠিয়াছে | শুনিলাম, দিলজান কিরূপে জানিতে পারিয়াছে-মনিরুদ্দীন সৃজানকে কুলের বাহির করিবার মতলব ঠিক করিয়াছে | দিলজানকে আমি অনেক করিয়া বুঝাইতে লাগিলাম; আমার একটা কথাও তাহার কানে গেল না | সে বলিল, যদি তাহাই হয়-তাহা হইলে সে দুইজনকে খুন না করিয়া ছাড়িবে না | গত বুধবার রাত্রে মনিরুদ্দীন সৃজানকে লইয়া সরিয়া পড়িবার বন্দোবস্ত করিয়াছিল | সেইদিনেই দিলজান একটা মতলব ঠিক করিল-চতুরের সহিত চাতুরী করিতে হইবে | সৃজানকে কোন রকমে আটক করিয়া নিজেই মনিরুদ্দীনের সঙ্গ গ্রহণ করিবে |”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, ” তাহা হইলে মেহেদী-বাগানের খুনের রাত্রেই এখানে এই ঘটনা হয় |”
লতিমন বলিতে লাগিল, ” সেইদিন অপরাহ্ণে দিলজান যখন মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে যায়, তখন মনিরুদ্দীন বাড়ীতে ছিলেন না | যে বাঁদী মাগী ইহার ভিতরে ছিল, তাহাকে কিছু ইনাম্ দিয়া দিলজান তাহার নিকট হইতে বেবাক্ খবর বাহির করে | কখন কোন্ সময়ে ঘটনাটা ঘটিবে-কোথায় গাড়ী ঠিক থাকিবে, তামাম খবর লইয়া সে সন্ধ্যার পর আবার এখানে ফিরিয়া আসে | তাহার পর রাত দশটার সময়ে নিজে সাজিয়া-গুজিয়া বাহির হইয়া যায়; যাইবার সময়ে আমার ওড়্নাখানি চাহিয়া লইয়াছিল | তাহার পর আমি আর তাহার কোন খবর পাই নাই | মনে করিয়াছিলাম, সে তাহার মতলব ঠিক হাসিল্ করিয়াছে-সৃজানকে ফাঁকি দিয়া সে নিজেই মনিরুদ্দীনের সঙ্গে চলিয়া গিয়াছে |”
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, ” আপনি কি ইতিপূর্ব্বে মেহেদী-বাগানের খুনের কথা কিছুই শোনেন নাই ?”
লতিমন বাই কহিল, “শুনিয়াছিলাম, কিন্তু ঐ খুনের সঙ্গে আমাদের দিলজানের যে কোন সংশ্রব আছে, এ কথা আমার বুদ্ধিতে আসে নাই |”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “মেহেদী-বাগানের নিকটে মনিরুদ্দীনের বাড়ী | বুধবার রাত্রে দিলজান মেহেদী-বাগানে গিয়া যে খুন হইয়াছে, সে সম্বন্ধে আর কোন সন্দেহ নাই | এখন দেখিতে হইবে খুনী কে ? আপনি জানেন কি দিলজানের প্রতি কাহারও কখন কোন বিদ্বেষ ছিল কি না ?”
” না, কই এমন কাহাকেও দেখি না|”
দেবেন্দ্রবিজয় চেয়ার ছাড়িয়া দাঁড়াইয়া উঠিলেন | বলিলেন, আচ্ছা, আমি সময়ে আবার আপনার সহিত দেখা করিব | আর একটা কথা জিজ্ঞাস্য আছে; ইহার ভিতরে কি ছিল বলিতে পারেন ?” বলিয়া সেই ছুরির বাক্স দুইটি লতিমনের হাতে দিলেন |
লতিমন কহিল, “কি সর্ব্বনাশ ! দুইখানি ছুরি যে নাই, দেখ্ছি |”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “একখানি আমার কাছে আছে-আর একখানি কোথায় গেল ?”
লতিমন কহিল, “বুধবার রাত্রে দিলজান যাইবার সময়ে একখানা ছুরি সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছিল | যদি কৌশলে তাহার সঙ্কল্প সিদ্ধ না হয়, সেই ছুরি দ্বারা সে নিজের সঙ্কল্প সিদ্ধ করিবে স্থির করিয়াছিল | আমি ত পূর্ব্বেই আপনাকে বলিয়াছি, মনিরুদ্দীনের উপরে সে একবারে এমন মরিয়া হইয়া উঠিয়াছিল যে যদি মনিরুদ্দীন তাহাকে নিরাশ করেন, মনিরুদ্দীনকেও সে হত্যা করিতে কুণ্ঠিত নহে | সেই অভিপ্রায়েই দিলজান ছুরিখানা সঙ্গে লইয়াছিল |”
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “তাহা হইলে প্রয়োজনমত মনিরুদ্দীনকেই হত্যা করিবার উদ্দেশ্যে দিলজান ছুরিখানি সঙ্গে লইয়াছিল, নিজেকে নিজে খুন করে, এমন অভিপ্রায় তাহার ছিল না ?”
লতিমন কহিল, “না, আত্মহত্যা করিবার কথা তাহার মুখে একবারও শুনি নাই-সে অভিপ্রায় তাহার আদৌ ছিল না | দিলজানের এদিকে সব ভাল ছিল-কিন্তু রাগলেই মুস্কিল-একেবারে মরিয়া | সে কথা যাক্, আপনি এখন এ ছুরিখানা লইয়া কি করিবেন ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, ” এখানা আমার অনেক কাজে লাগিবে বলিয়া, আমি ছুরিখানি লইয়াছি | প্রথমতঃ পরীক্ষা করিয়া দেখিতে হইবে, এই ছুরি বিষাক্ত কিনা | যদি বিষাক্ত হয়-দিলজান যে ছুরিখানি লইয়া গিয়াছে-সেখানিও বিষাক্ত হওয়া ষোল আনা সম্ভব | বাক্স দেখিয়া বুঝিতে পারিতেছি, দুইখানি একই প্রকার | তাহার পর এই ছুরি কোন একটা বিড়াল বা কুকুরের গায়ে বিদ্ধ করিলেই বুঝিতে পারিব-ইহার বিষে কতক্ষণে কিরূপভাবে মৃত্যু ঘটে, মৃত্যুর পরের লক্ষণই বা কিরূপ হয় | যদি লক্ষণগুলি দিলজানের সহিত ঠিক মিলিয়া যায়-তবে বুঝিতে পারিব, এই একজোড়া ছুরির অপরখানিতেই দিলজানের মৃত্যু ঘটিয়াছে |”
লতিমন শিহরিত হইয়া কহিল, “দিলজানের ছুরি লইয়া দিলজানকেই খুন করিয়াছে, কে এমন লোক ?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “এখন তাহার সন্ধান করিয়া দেখিতে হইবে |”
লতিমন কহিল, ” হতভাগী আত্মহত্যা করে নাই ত ?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “আত্মহত্যা করিয়াছে বলিয়া বোধ হয় না ; আর স্ত্রীলোকে পথে-ঘাটে এইরূপে কখনও আত্মহত্যা করে না | খুবই সম্ভব, দিলজানের কোন শত্রু তাহাকে রাত্রে নির্জন গলিমধ্যে একা পাইয়া খুন করিয়াছে ! যাহা হউক, সময়ে সকলেই প্রকাশ পাইবে-এখন উঠিলাম |”
লতিমন জিজ্ঞাসা করিল, ” আবার কখন আপনার দেখা পাইব ?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “দুই-একদিনের মধ্যে আবার আমি আসিতেছি |” এখন একবার সন্ধান লইতে হইবে, খুনের রাত্রে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে কি ব্যাপার ঘটিয়াছিল |”
উপস্থিত অনুসন্ধান অনেকাংশে সফল হইয়াছে মনে করিয়া, দেবেন্দ্রবিজয় প্রসন্নমনে লতিমনের গৃহত্যাগ করিয়া বাহিরে আসিলেন |

১.০৯. নবম পরিচ্ছেদ – বেনামী পত্র

লতিমনের বাটী ত্যাগ করিয়া বাহির হইবামাত্র একটী মুসলমান বালক ছুটিয়া আসিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের হাতে একখানি পত্র দিল। বলিল, “বাবু, আপনার পত্র।”
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, পত্রের খামে তাঁহারই নাম লিখিত রহিয়াছে। বালককে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ পত্র তুই কোথায় পাইলি?”
বালক কহিল, “একজন বাবুলোক দিয়ে গেছে।”
দেবেন্দ্রবিজয় তখনই খাম ছিঁড়িয়া, পত্রখানি বাহির করিয়া পড়িতে লগিলেন;-
“দেবেন্দ্রবিজয়!
বৃথা চেষ্টা-তুমি আমাকে কখনও ধরিতে পারিবে না-তোমার ন্যায় নির্ব্বোধ গোয়েন্দার এ কর্ম্ম নহে। আমি তোমাকে গ্রাহ্যই করি না। তোমার মত বিশ-পঁচিশটা গোয়েন্দাকে আমি কেনা-বেচা করিতে পারি-সে ক্ষমতা আমার খুব আছে। যাহা হোউক, এখনই এমন কাজে ইস্তফা দাও নতুবা প্রাণে মরিবে। তোমার মত শতটা অকর্ম্মা গোয়েন্দা আমার কিছুই করিতে পারিবে না। তোমাকে আমি এখন হইতে সাবধান করিয়া দিতেছি, আমাকে বিরক্ত করিতে চেষ্টা করিয়ো না। এ পত্র পাইয়াও যদি তুমি বাহাদুরী দেখাইতে যাও-তাহা হইলে যদি কিছু বিষয়-সম্পত্তি থাকে, তাহা উইল করিয়া কাজে হাত দিবে। আমার ত মনে খুব বিশ্বাস, তোমার মত গোয়েন্দার হাতে আমি কখনও ধরা পড়িব না-যদি তেমন কোন সম্ভবনা দেখি-যদি ফাঁসীর দড়ীতে একান্তই ঝুলিতে হয়, তোমাকে খুন করিয়া ফাঁসী যাইব। তুমি যখন যেখানে যাইতেছ, যখন যাহা করিতেছ, আমি সকল খবরই রাখি। আমি সর্ব্বদা তোমার পিছু পিছু ফিরিতেছি। তাহাতে বুঝিতে পারিয়াছি-তুমি এখনও ঘোর অন্ধকারে আছ-অন্ধকারে অন্ধের মত ঘুরিয়া বেড়াইতেছ। তুমি একটা আস্ত বোকা, সেইজন্য তোমাকে আমি একতিল ভয় করি না।
সেই
মেহেদী-বাগানের খুনী।”
পত্রখানি পাঠ করিয়া দেবেন্দ্রবিজয় অত্যন্ত চিন্তিত হইলেন। বুঝিলেন, তিনি যাহার অনুসরণে প্রবৃত্ত হইয়াছেন, সে বড় সহজ লোক নহে। দেবেন্দ্রবিজয় পত্র হইতে দৃষ্টি নামাইয়া সম্মুখস্থ বালকের মুখের দিকে চাহিবামাত্র, সেই বালক তাঁহার খুব উপকার করিয়াছে মনে করিয়া বলিল, “বাবু বখা্‌শিশ দিনা্‌। যে বাবু আমার হাতে পত্র দিয়া গেল, সে বাবুর কছে একেবারে একটাকা বখা্‌শিশ পেয়েছি, এই দেখুন।” বলিয়া বালক বামহস্তের মুষ্টিমধ্যে হইতে চাকচিক্যময় একটি টাকা বাহির করিয়া দেবেন্দ্রবিজয়কে দেখাইল।
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “তুই সে বাবুকে চিনিস? আর কখনও দেখিয়াছিসা্‌?”
বালক কহিল, “না বাবু।”
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, ” সেই বাবুর চেহারা কি রকম?”
বালক সেই পত্রদাতার যেরূপ বর্ণনা করিল, তাহাতে পত্রগ্রহীতার কিছুমাত্র উপকার দর্শিল না।
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, ” এ পত্র যে আমাকে দিতে হইবে, তুই তা’ কি ক’রে জানা্‌লি?”
বালক বলিল, ” সেই বাবু আমার হাতে এই পত্রখানা দিয়ে ব’লে গেল এই বাড়ী থেকে এখনই যে একজন বাঙ্গালী বাবু বেরুবে, তার হাতে এই পত্রখানা দিবি।”
দে। সে কতক্ষণের কথা?
বা। এই খানিক আগে।
দে। সে বাবু কোনা্‌ দিকে গেল।
বা। এইদিক দিয়ে বরাবর সোজা চ’লে গেল।
দেবেন্দ্রবিজয় বুঝিলেন, এখন তাহার অনুসরণ করা বৃথা-এতক্ষণ সে কোথায়-কোনা্‌পথে চলিয়া গিয়াছে, ঠিক করা কঠিন।
দেবেন্দ্রবিজয়কে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া বালক পুনরপি বলিল, “হজুর, আমার বখা্‌শিশ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, ” সেই বাবুকে যদি তুই কোন রকমে চিনাইয়া দিতে পারিস, কি তার বাড়ী কোথায় আমাকে ব’লে দিতে পারিসা্‌ তোকে আমি দশ টাকা বখা্‌শিশ দিব।”
বালক বলিল, ” আমি দিন-রাত ঘুরে ঘুরে চেষ্টা ক’রে দেখব, যদি তাকে আমি দেখতে পাই, ঠিক আপনাকে খবর দেব। কোথায় আপনার দেখা পাব?”
দেবেন্দ্রবিজয় তাহাকে নিজের ঠিকানা বলিয়া দিলেন; কিন্তু মনে মনে বুঝিলেন, এই বালক দ্বারা তাহার বিশেষ কোন কাজ হইবে না; পত্রলেখক লোকটি যেরূপ চতুর দেখিতেছি, তাহাতে অবশ্যই সে ছদ্মবেশে আসিয়া থাকিবে। তিনি বালককে পুনরপি জিজ্ঞাসা করিলেন, ” সে বাবুর দাড়ী গোঁফ ছিল?”
বালক কহিল, “হাঁ, খুব মস্ত মস্ত দাড়ী গোঁফ, মস্ত মস্ত চুল-চোখে নীল রঙের চশমা।”
দেবেন্দ্রবিজয় বুঝিতে পারিলেন, তাঁহার অনুমান ঠিক-লোকটি ছদ্মবেশেই আসিয়াছিল। বালককে বলিলেন, ” তবে আর তুই সে লোককে দেখিতে পাইবি না-তোর অদৃষ্টে আর বখা্‌শিশের টাকাগুলো নাই দেখা্‌ছি।”
অনন্তর দেবেন্দ্রবিজয় বালককে বিদায় করিয়া দিলেন এবং নিজে মনিরুদ্দীনের বাটী অভিমুখে চলিলেন।

১.১০. দশম পরিচ্ছেদ – অনুসন্ধান

মেহেদী-বাগানের বাহিরে পশ্চিমাংশে মনিরুদ্দীন মল্লিকের প্রকাণ্ড ত্রিতল অট্টালিকা। সম্মুখে অনেকটা উন্মুক্ত তৃণভূমি প্রাচীর-বেষ্টিত। দেবেন্দ্রবিজয় তৃণভূমি অতিক্রম করিয়া বহির্দ্বারে করাঘাত করিলেন। অনতিবিলম্বে রুদ্ধদ্বার উন্মুক্ত করিয়া একজন স্থূলাঙ্গী বৃদ্ধা দেখা দিল। দেবেন্দ্রবিজয় তাহাকে দেখিয়া বুঝিতে পারিলেন, সে এখান্কার প্রধানা দাসী অথবা পাচিকা হইবে।
দেবেন্দ্রবিজয়ের অনুমান সত্য। সেই বৃদ্ধা মনিরুদ্দীনের প্রধানা দাসী তাহার নাম কেহ জানে না-এমন কি বোধ হয়, মনিরুদ্দীনও না। সকলে তাহাকে গনির মা বলিয়া ডাকিয়া থাকে-সে অত্যন্ত বিশ্বাসী-আজীবন এই সংসারেই আছে-মনিরুদ্দীনকে সে কোলে-পিঠে করিয়া মানুষ করিয়াছে।
বৃদ্ধা গনির মা বলিল, ” কাকে খুঁজেন, মশাই ?”
দেবেন্দ্রবজোয় বলিলেন ” মল্লিক সাহেবের কি এই বাড়ী ?”
বৃ। হাঁ।
দে। তিনি এখন কোথায় ?
বৃ। তিনি এখন এখানে নাই। তাঁকে কি দরকার ?”
দে। তাঁকে বিশেষ কোন দরকার নাই। তাঁর সম্বন্ধে আমি দুই একটা কথা জানিতে চাই।
মনিরুদ্দেনের নামে যে অপবাদ গ্রামের মধ্যে প্রচারিত হইয়াছিল, তাহা বৃদ্ধা গনির মায়েরও কাণে উঠিয়াছিল; সুতরাং দেবেন্দ্রবিজয়ের কথায় সে বড় বিব্রত হইয়া উঠিল। বিরক্তভাবে বলিল, “তা এখানে কেন-এখানে কি জান্বেন ? আপনি যান্-মশাই।” বলিয়া দ্বার রুদ্ধ করিবার উদ্যোগ করিল।
দেবেন্দ্রবিজয় বেগতিক দেখিয়া তাড়াতাড়ি দ্বারের ভিতরের দিকে একটা পা বাড়াইয়া দিয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন, “আমি মনিরুদ্দীনের ভালর জন্যই আসিয়াছি। যা’ বলি শোন, আমাকে তাড়াইলে ভাল কাজ করিবে না। বিশেষ একটা কথা আছে।”
বৃদ্ধার বিরক্তি অদম্য কৈতূহলে পরিণত হইল। বলিল, ” তবে ভিতরে এসে বসুন; মনিরুদ্দীনের কিছু খারাপী ঘটেছে না কি ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “না-না, তিনি ভাল আছেন-সেজন্য কোন ভয় নাই। তবে একটা বেজায় গাফিলী হয়েছে-বসো-স্থির হ’য়ে সব শোন।”
বৃদ্ধা দেবেন্দ্রবিজয়কে বাহিরের বৈঠকখানা ঘরে লইয়া বসাইল।
বৈঠকখানাটি অতি সুন্দররূপে সজ্জিত। গৃহতলে মূল্যবান গালিচা বিস্তৃত; তদুপরি দুই-তিনখানি মখমলমণ্ডিত কৌচ; একপার্শ্বে একটি মর্ম্মর প্রস্তরের ছোট টেবিল। টেবিলের উপরে সুদীর্ঘলাঙ্গলবিশিষ্ট রৌপ্যনির্ম্মিত আলবোলা শোভা পাইতেছে। গবাক্ষপার্শ্বে দুইটি কারুকার্য্য-বিশিষ্ট আল্মারী। তন্মধ্যে সুন্দররূপে বাঁধান, স্বর্ণাক্ষরে শোভিত অনেকগুলি ইংরাজী ও বাঙ্গালা উপন্যাস সাজান রহিয়াছে। দেবেন্দ্রবিজয় সর্ব্বাগ্রে একখানি কৌচের উপরে নিজের দেহভার অর্পণ করিয়া দিলেন। গনির মা অদূরে দ্বার-সম্মুখে গালিচার উপরে বসিল।
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “দেখ, আমি মল্লিক সাহেবের ভালর জন্যই এসেছি। যা’ যা’ জিজ্ঞাসা করি-ঠিক ঠিক উত্তর দিয়ে যাবে, মিথ্যা বল্লেই মুস্কিল। আমি কে, সে পরিচায়টাও তোমাকে এখনই দিয়ে রাখ্ছি; তা’ না হলে তোমার কাছে যে, সব কথা সহজে পাওয়া যাবে না, তা আমি বেশ বুঝ্তে পেরেছি। আমার নাম দেবেন্দ্রবিজয়-আমি পুলিশের লোক।”
শুনিয়া বৃদ্ধার চক্ষুঃস্থির; অত্যন্ত ভীতভাবে সে উঠিয়া দাঁড়াইল, সভয়ে কম্পিতস্বরে বলিল, ” কি মুস্কিল, ওমা! পুলিসের লোক এখানে কেন গো ! মনিরুদ্দীন আমাদের কি করেছে !”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “না-না, মনিরুদ্দীন এমন কিছু করে নাই। তবে কি জান, তার পিছনে অনেক শত্রু লেগেছে-সেই শত্রুদের হাত থেকে তাকে রক্ষা করবার জন্য আমি প্রাণপণে চেষ্টা করছি।”
বৃদ্ধা বলিল, ” তা আমাকে কি করতে হবে ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “বিশেষ কিছু করতে হবে না-আমি যা জিজ্ঞাসা করি, তোমাকে তার ঠিক ঠিক উত্তর দিতে হবে। দিলজানকে তুমি জান ?”
ক্রুদ্ধভাবে বৃদ্ধা বলিল, ” না দিলজান-ফিলজানকে আমি জানি না।”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “ফিলজানকে না জান, তাতে ক্ষতি নাই, দিলজানকে জানা দরকার হচ্ছে। যা জিজ্ঞাসা করি, উত্তর দাও; নতুবা তোমাকেও বড় মুস্কিলে পড়্তে হবে।”
গনির মা প্রথমটা মনে করিয়াছিল, কিছু বলিবে না, কিন্তু দেবেন্দ্রবিজয়ের রুষ্টভাব দেখিয়া সে নিজে একটু নরম হইয়া গেল।
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, ” কোন্ দিন থেকে মনিরুদ্দীন বাড়ীতে নাই ?”
বৃদ্ধা বলিল,” গত বুধবার রাত্রে কোথায় গেছেন এখনও ফিরেন নাই।”
দে। কোথায় গেছেন।
বৃ। তা’ জানি না।
দে। সঙ্গে কেহ আছে ?
বৃ। কি জানি মশাই, তা’ আমি ঠিক জানি না-পাঁচজনের মুখে ত এখন পাঁচ রকম কথা শুনতে পাচ্ছি-সত্যি-মিথ্যা কি ক’রে জানব বাবু ?
দে। গত বুধবারে দিলজান কি এখানে এসেছিল ?
বৃ। এসেছিল।
দে। কখন ?
বৃ। সন্ধ্যার আগে।
দে। কেন এসেছিল ?
বৃ। মনিরুদ্দীনের সঙ্গে দেখা করতে।
দে। দেখা হয়েছিল কি ?
বৃ। না, মনিরুদ্দীন বাড়ীতে ছিল না। দিলজান রাত্রে দেখা কর্তে আস্বে ব’লে তখনই চ’লে যায়।
দে। রাত্রে আবার এসেছিল।
বৃ। এসেছিল, কিন্তু মনিরুদ্দীনের সঙ্গে তার দেখা হয় নাই। দিলজানের আসিবার আগে মনিরুদ্দীন আবার বেরিয়ে গিয়েছিল।
দে। সেদিন রাত্রে মনিরুদ্দীন সৃজানকে নিয়ে পালাবে, তা’ দিলজান জান্তে পেরেছিল ?
বৃ। তা আমি ঠিক জানি না।
দে। মনিরুদ্দীনের দেখা না পাওয়ায় দিলজান তখন কি করিল ?
বৃ। মজিদ তখন এখানে ছিল। উপরের একটা ঘরে ব’সে তার সঙ্গে দিলজান অনেকক্ষণ ধ’রে কি পরামর্শ কর্তে লাগ্ল।
দে। মজিদ এসেছিল কেন ?
বৃ। মজিদ এমন মাঝে মাঝে এখানে আসে।
দে। তাদের পরামর্শ কিছু শুনেছ ?
বৃ। কিছু না। আমিই বা তা’ শুন্তে যাব কেন ? আমাকে কি বাপু, তেমনি ছোটলোকের মেয়ে পেয়েছ ? যা হো্ক শেষকালটা তাদের মধ্যে যেন কি খুব রাগারাগির মতন হয়। দুজনেই যেন খুব জোরে জোরে কথা বল্ছিল।
দে। তখন রাত কত হবে ?
বৃ। এগারটার কম নয়।
দে। সেই রাগারাগির পর দিলজান কি একা এখানে থেকে চ’লে যায় ?
বৃ। একা; কিন্তু তার একটু পরেই মজিদও তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে যায়।
দে। মজিদ যাবার সময়ে তোমাকে কিছু বলেছিল ?
বৃ। কিছু-না-কিছু না।
দেবেন্দ্রবিজয় বিষম সমস্যায় পড়িলেন। তাঁহার মনে হইল, মজিদও এই খুন-রহস্যের মধ্যে অবশ্য কিছু-না কিছু জড়িত আছে। দিলজানের সহিত তাহার রাগারাগির কারণ কি ? তাহার মুখে এমন কি কথা শুনিল, যাহাতে দিলজানের ক্রোধসঞ্চার হইয়াছিল ? এ প্রশ্নের সদুত্তর এখন একমাত্র মজিদের নিকটে পাওয়া যাইতে পারে। সেই সময়ে সহসা আর একটা কথা দেবেন্দ্রবিজয়ের মনে পড়িয়া গেল; মোবারক-উদ্দীন দিলজানের মৃতদেহ আবিষ্কারের অনতিকাল পূর্ব্বে মেহেদী-বাগানের মোড়ে মজিদকে সেই গলির ভিতর হইতে ফিরিতে দেখিয়াছিলেন। তাহা হইলে মজিদের কি এই কাজ ? মজিদই কি দিলজানের হত্যাকারী ? দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, তিনি ক্রমেই এক গভীর রহস্য হইতে অন্য এক গভীরতর রহস্যে উপনীত হইতেছেন; কিন্তু সেই রহস্যোদ্ভেদের কোন পন্থা না দেখিতে পাইয়া তিনি মনের মধ্যে অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন। স্থির করিলেন, এখনই তিনি একবার বালিগঞ্জে যাইয়া মোবারক-উদ্দীনের সঙ্গে দেখা করিবেন। তাহার নিকটে যাহা জানিবার, তাহা জানিয়া পরে মজিদের সহিত দেখা করিবেন। এখানে গত বুধবার রাত্রে তাঁহার সহিত দিলজানের কি কি কথা হইয়াছিল, তদুভয়ের বাগ্বিতণ্ডার কারণ কি; এবং নিজেই বা তিনি তেমন সময়ে মেহেদী-বাগানে কেন গিয়াছিলেন, এই সকল প্রশ্নের সদুত্তর না দিতে পারে-তাহা হইলে সে যে এই খুনের ভিতরে জড়িত আছে, সে সম্বন্ধে আর তখন সন্দেহের কোন কারণ থাকিবে না।
গনির মা দেবেন্দ্রবিজয়কে অনেকক্ষণ নীরব থাকিতে দেখিয়া বলিল, “মশাই, যা কিছু আমি জানি, সব আপনাকে বলেছি; এখন আপনার যা’ইচ্ছে হয় করুন। আমি ত এখনও কিছু বুঝ্তে পার্ছি না। কি হয়েছে ?
দেবেন্দ্রবিজয় সংক্ষেপে বলিলেন, ” খুন।”
বুড়ী বসিয়াছিল, খুনের কথা শুনিয়া যেন সবেগে তিন হাত লাফাইয়া উঠিল; চোখ-মুখ কপালে তুলিয়া কহিল, ” কি মুস্কিল ! কে খুন হয়েছে-আমাদের মনিরুদ্দীন না কি ?”
“না, দিলজান।”
“দিলজান !”
“হাঁ, দিলজান মজিদের সঙ্গে রাগারাগি ক’রে যাবার পরে মেহেদী-বাগানের একটা গলি-পথে খুন হয়েছে।”
বৃদ্ধা ব্যগ্রভাবে কহিল, ” তা হ’তে পারে, মজিদের কোন দোষ নাই-সে কখনই খুন করে নাই, আমি তা বেশ জানি ! সে কেন দিলজানকে খুন করতে যাবে ? সে ওদিকে বড় মেশে না; মদ, বাইজীর সখ তার নাই-জোহেরার সঙ্গে তার খুব আস্নাই হয়েছে।”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, ” তবে শুন্লেম, মনিরুদ্দীনের সঙ্গেই না কি, জোহেরার সাদি হবে, ঠিক হ’য়ে গেছে?”
বৃদ্ধা বলিল, “না, না-সে কোন কাজের কথাই নয়। জোহেরা কখনই মনিরুদ্দীনকে সাদি কর্বে না-সে মজিদকেই সাদি কর্বে-মজিদের সঙ্গে তার খুব ভাব। আপনি কি মনে করেছেন, মজিদ দিলজানকে খুন করেছে ? আপনি মজিদকেই খুনী ব’লে চালান দিবেন না কি ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “না, মজিদের বিরুদ্ধে তেমন বিশেষ কোন প্রমাণ এখনও কোন পাই নাই।”
অন্যান্য আরও দুই-একটী কথার পর দেবেন্দ্রবিজয় মনিরুদ্দীনের বাটী ত্যাগ করিলেন। বৃদ্ধা গনির মা নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিল।

১.১১. একাদশ পরিচ্ছেদ – দারুণ সন্দেহ

দেবেন্দ্রবিজয় তখনই মোবারক-উদ্দীনের সহিত দেখা করিতে বালিগঞ্জের দিকে চলিলেন। তাঁহার মন অত্যন্ত চিন্তাপূর্ণ এবং অত্যন্ত সন্দেহপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। তিনি পথে চলিতে চলিতে ভাবিতে লাগিলেন, মজিদ দিলজানকে কেন হত্যা করিবে ? আপাততঃ ইহার তেমন কোন কারণ দেখিতেছি না। সেদিন রাত্রে রুষ্টভাবে দিলজান মনিরুদ্দীনের বাটী ত্যাগ করিবার পরক্ষণেই মজিদও বাহির হইয়া যায়। ইহাতে বোধ হইতেছে, মজিদ নিশ্চয়ই কোন কারণে দিলজানের অনুসরণ করিয়াছিল। মেহেদী-বাগানের পথে সেই রাত্রে মোবারক-উদ্দীনও মজিদকে একা ফিরিতে দেখিয়াছিলেন। তাহা যেন হইল, কিন্তু দিলজান বাড়ীতে ফিরিবার অন্য সোজা পথ থাকিতে রাত এগারটার পর এই গলি পথে কোনা্‌ অভিপ্রায়ে প্রবেশ করিয়াছিল ? না, কুয়াসা ও অন্ধকারে হতভাগিনী পথ ভুল করিয়া ফেলিয়াছিল ? তাহার মত বুদ্ধিমতী যুবতী স্ত্রীলোকের কি সহসা এতটা ভুল হইতে পারে ? ইহা সম্ভবপর নহে। হয় ত পথে এমন কোন পরিচিত ব্যক্তির সহিত তাহার দেখা হইয়া থাকিবে যে , কোন কারণে তাহাকে এই গলির ভিতরে ডাকিয়া লইয়া যাইতে পারে; কিন্তু এত অধিক রাত্রে এই নির্জ্জন পথে কোন পরিচিতের সহিত দেখা সাক্ষাত্‍‌ হওয়াও অসম্ভব। অর্থলোভে কোন দুর্ব্বৃত্ত যে এ কাজ করিয়াছে, তাহাও বোধ হয় না। তাহা হইলে দিলজানের গায়ে যে দুই-একখানি স্বর্ণালঙ্কার ছিল; তাহা দেখিতে পাইতাম না। বিশেষতঃ এখনও এ দেশের তস্কর ও দস্যুদিগের মধ্যে বিষমাখা ছুরির ব্যবহার প্রচলন হয় নাই। তবে যদি কেহ, দিলজানের কাছে যে ছুরি ছিল, সেই ছুরি লইয়া-দূর হউক, এ সকল কোন কাজের কথাই নয়। যতক্ষণ না মজিদের সহিত দেখা করিয়া আমার জ্ঞাতব্য বিষয়গুলির সন্তোষজনক উত্তর পাইতেছি, ততক্ষণ এ জটিল রহস্যের উদ্ভেদ সুদূরপরাহত।
অনন্তর দেবেন্দ্রবিজয় যখন বালিগঞ্জে উপস্থিত হইলেন, তখন বেলা পড়িয়া আসিয়াছে। শ্যামল তরুশ্রেণীর অন্তরালে রক্তরাগোজ্জ্বল রবি সুবৃহত্‍‌ স্বর্ণপাত্রের ন্যায় দেখাইতেছে। তাহার হেমাভকিরণচ্ছটা পশ্চিমাকাশ হইতে সমগ্র আকাশে উজ্জ্বলভাবে ছড়াইয়া পড়িয়াছে। বায়ুচঞ্চল বৃক্ষশিরে সেই স্বর্ণকিরণ শোভা পাইতেছে। এবং তখন হইতে সন্ধ্যার বাতাস ধীরে ধীরে বহিতে আরম্ভ করিয়াছে।
যখন দেবেন্দ্রবিজয় মোবারক-ইদ্দীনের বাসায় উপনীত হইলেন, তখন মোবারক একখানি ইংরাজী সংবাদপত্র হাতে লইয়া দ্বার-সম্মুখে ধীরে ধীরে পদচারণা করিতেছিলেন। এবং তাঁহার একটা পোষমানা কুকুর দ্বারপার্শ্বে দাঁড়াইয়া ঘন ঘন লাঙ্গুলান্দোলন করিতেছিল। দেবেন্দ্রবিজয়কে দেখিয়া কুকুরটা লাফাইয়া গর্জ্জন করিয়া উঠিল। মোবারক তাহাকে একটা ধমক দিয়া দেবেন্দ্রবিজয়কে কহিলেন, “কি দেবেন্দ্রবিজয় বাবু, এদিকে কোথায় ?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “আপনার কাছে।”
মোবারক-উদ্দীন ললাট কুঞ্চিত এবং ভ্রূযুগ সঙ্কোচ করিয়া বলিলেন, ” আমার কাছে কেন ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “সেই খুনের মামা্‌লা-”
বাধা দিয়া মোবারক বলিলেন, “হাঁ, তা’ কি হইয়াছে, আমি যাহা জানি, সকলেই তা আপনাদিগকে বলিয়াছি।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হাঁ, আরও দুই-একটা কথা জিজ্ঞাসা করিবার আছে।”
মোবারক বলিলেন, “বেশ, চলুন ঘরের ভিতরে গিয়া বসি।”
মুবারক দেবেন্দ্রবিজয়কে একটি ঘরের ভিতরে লইয়া গেলেন। কুকুরটাও লাঙ্গুলান্দোলন করিতে করিতে সেখানে গিয়া উপস্থিত হইল, এবং দুই-একবার এদিকা্‌ ওদিকা্‌ করিয়া ঘরের মাঝখানে শুইয়া পড়িল। দেবেন্দ্রবিজয় দ্বারপার্শ্বে একখানি চেয়ার টানিয়া উপবেশন করিলেন। এবং মোবারক কিছু তফাতে ঘরের অপর পার্শ্বস্থ একটি ক্ষুদ্র শয্যার উপরে বসিয়া, সই ইংরাজী খবরের কাগজখানা নাড়িয়া-নাড়িয়া নিজের দেহের উপরে ব্যজন করিতে লাগিলেন। জিজ্ঞাসিলেন, “কেসা্‌টার কিছু সুবিধা করিতে পারিলেন কি ?”
ইতিমধ্যে যতটা সুবিধা করিতে হয়, তা’ করিয়াছি। অনেক সন্ধান-সুলভও হইয়াছে।”
“বটে, কে খুন করিয়াছে, তাহা কিছু ঠিক করিতে পারিলেন কি ? কে সে, কি নাম ?”
“খুনির নাম এখনও ঠিক করিতে পারি নাই; তবে যে খুন হইয়াছে, তাহার নাম পাইয়াছি।”
“বটে, কে সে, কি নাম ?”
“দিলজান।”
“কই, এ নাম ত পূর্ব্বে কখনও শুনি নাই; কে সে, কোথায় থাকিত ?”
“মনিরুদ্দীনের রক্ষিতা। বামুন-বস্তিতে, লতিমন বাইজীর বাড়ীতে থাকিত। মনিরুদ্দীন তাহাকে কোথা হইতে আনিয়া সেখানে রাখিয়া ছিল, বলিতে পারি না।”
“অন্ধকার রাত্রে মেহেদী-বাগানে সেই অন্ধকার গলির ভিতরে সে কেন গিয়াছিল ? কিরূপে আপনি এ সকল সন্ধান পাইলেন ?”
“আমি সমুদয় আপনাকে বলিতেছি; কোন কোন বিষয়ে এখন আপনার সাহায্য আমাদের অবশ্যক হইতেছে।”
“সেজন্য চিন্তা নাই-আমি সাধ্যমত আপনাদের সাহায্য করিব-তাহার কোন ত্রুটি হইবে না।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিতে লাগিলেন, “মেহেদী-বাগানে যে লাস পাওয়া যায়, তাহার সেই রেশমের কাজ করা ওড়া্‌নাখানি অবলম্বন করিয়া আমি এতদূর অগ্রসর হইতে পারিয়াছি। আমি প্রথমে সেই ওড়া্‌নাখানি লইয়া করিমের মা’র কাছে যাই; সেখানে শুনিলাম, তাহারাই সেই ওড়া্‌না বামুন-বস্তির লতিমন বাইজীকে তৈয়ারী করিয়া দিয়াছিল। তখন আমি মনে করিলাম, তবে লতিমন বাইজীর খুন হইয়াছে; কিন্তু লতিমন বাইজীর বাড়ীতে গিয়া দেখিলাম, আমার সে অনুমান ঠিক নহে; লতিমন বাইজী বেশ সবল ও সুস্থদেহে বাঁচিয়া আছে। তাহার কাছে শুনিলাম, গত বুধবার রাত্রে দিলজান তাহার নিকট হইতে সেই ওড়া্‌নাখানি চাহিয়া লইয়াছিল। সেই ওড়া্‌না গায়ে দিয়া সে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে গিয়াছিল।”
মো। মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে কেন ?
দে। সৃজান বিবিকে লইয়া সরিয়া পড়িবার উদ্যোগ করিতেছিল, তাহা দিলজান কিরূপে জানিতে পারে; কিন্তু কার্য্যতঃ সেটা যাহাতে না ঘটে, সেই চেষ্টায় দিলজান রাত্রে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে যায়; কিন্তু মনিরুদ্দীন তার আগেই বাড়ী হইতে বাহির হইয়া গিয়াছিল। সেখানে মজিদ খাঁ ছিলেন; তাঁহারই সহিত দিলজানের দেখা হইয়া যায়; তাহার পর লি কথা লইয়া দু’জনের কিছু বচসা হয়। রাত প্রায় বারটার পর দিলজান সেখানে হইতে বাহির হইয়া যায়; মজিদ খাঁ তাহার সঙ্গে সঙ্গে বাহির হইয়া পড়েন। মজিদ খাঁ দিলজানকে শেষজীবিত থাকিতে দেখিয়াছেন।”
মোবারক বলিলেন, “তা’ হইলে দিলজান রাত্রে আর বাড়ী ফিরে নাই। কিন্তু যখন সে দেখিল, মনিরুদ্দীনের সহিত তাহার সাক্ষাত্‍‌ হইল না, তখন সে সেখান হইতে বরাবর নিজের বাড়ীতে না আসিয়া, এত অধিক রাত্রে মেহেদী-বাগানের সেই ভয়ানক অন্ধকার গলিপথে কি উদ্দেশ্যে গিয়াছিল, বুঝিতে পারিলাম না। মনিরুদ্দীনের বাড়ী হইতে বামুন-বস্তিতে যাইবার ত একটা বেশ সোজা পথ রহিয়াছে।”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “তা’ আমি ঠিক বলিতে পারি না। হয় সে পথ ভুল করিয়া থাকিবে, নতুবা ইহার ভিতরে আরও কোন লোক জড়িত আছে।”
মোবারক কহিলেন, ” এ কোন কাজের কথাই নয়। ইহার ভিতরে আবার কে জড়িত আছে ?”
দে। আছে-মজিদ খাঁ।
শুনিয়া মোবারক লাফাইয়া উঠিলেন; বলিলেন, “মজিদ খাঁ-কি সর্ব্বনাশ !” তালু ও জিহ্বার সংযোগে বারদ্বয় এক প্রকার অব্যক্ত শব্দ করিয়া বলিলেন, “না-ইহা কখনই সম্ভব নয়; আমি মজিদ খাঁকে বরাবর খুব রকমেই জানি; খুব ভাল চরিত্র-তিনি কখনই খুন করেন নাই; এমন একটা ভয়ানক খুন কখনই তাঁহার দ্বারা হইতে পারে না। আপনার এ সন্দেহ একান্ত অমূলক।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, ” শুনিয়াছি, সেদিন রাত্রে আপনি যখন বাসায় ফিরিতেছিলেন, দিলজানের মৃতদেহ আবিষ্কারের পূর্ব্বে এই মেহেদী-বাগানে মজিদ খাঁর সঙ্গে আপনার দেখা হইয়াছিল। তাহা বোধ হয়, এখন আপনার স্মরণ আছে ?”
রুষ্ট ও উদ্বিগ্নভাবে মোবারক বলিলেন, “কি ভয়ানক লোক আপনি ! মজিদ আমার বন্ধু, যাহাতে তিনি বিপদে পড়েন, তাঁহার বিরুদ্ধে কোন কথা বলা আমার ঠিক হয় না। আপনি কি সেইজন্য এখানে আসিয়াছেন ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হাঁ, আপনি তখন মজিদ খাঁকে কিরূপে দেখিয়াছিলেন, আপনার সঙ্গে তাঁহার কি কথাবার্ত্তা হইয়াছিল, সেই সকল জানিবার জন্য আমি আপনার সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছি। আপনি কি তাহা আমাকে বলিবেন না ?”
মোবারক কহিলেন, “কেন বলিব না ? ইহাতে দোষের কথা কিছুই নাই। রাত্রে মেহেদী-বাগানে মজিদ খাঁকে দেখিয়াছি বলিয়াই যে, তিনি খুনী হইলেন এমন ধারণা ঠিক নহে।”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, ” কি ভাবে আপনি তাঁহাকে প্রথম দেখেন, আপনার সঙ্গে তাঁহার কি কি কথা হয় ?”
মোবারক কহিলেন, “অন্ধকারে আমি তাঁহার ভাব-ভঙ্গী দেখিবার সুবিধা পাই নাই। তিনি তাড়াতাড়ি ফিরিতেছিলেন। অন্ধকারে তিনি একবারে আমার গায়ের উপরে আসিয়া পড়েন। যে অন্ধকার ! তাহাতে এরূপ ঘটনা সচরাচর ঘটিয়া থাকে, তিনি যদি আমার গায়ের উপরে আসিয়া না পড়িতেন, হয় ত আমিই তাঁহার গায়ের উপরে গিয়া পড়িতাম। যাহা হউক, তার পর আমি তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া নিজের বাসায় আনিবার জন্য জেদাজেদি করিলাম-মনিরুদ্দীনের কথা জিজ্ঞাসা করিলাম-এই রকম দুই-একটী বাজে কথা হইয়াছিল।”
দেবেন্দ্রবিজয় চিন্তিতভাবে বলিলেন, “তাই ত ! ঠিক সেইদিন তেমন রাত্রে মেহেদী-বাগানে মজিদ খাঁর আবির্ভাব কিছু সন্দেহজনক বলিয়া বোধ হয়।”
মো। আমি ত ইহাতে সন্দেহের কিছুই দেখি না; যদি আপনি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি অবশ্যই আপনাকে ইহার কারণ দেখাইবেন। বিশেষতঃ তিনি দিলজানকে খুন করিতে যাইবেন কেন-দিলজানের সহিত তাঁহার সংশ্রব কি ?
দে। খুন করিব মনে করিয়াই যে, মজিদ খাঁ দিলজানকে খুন করিয়াছেন, আমি এমন কথা বলিতেছি না; তবে দৈবাত্‍‌ কি রকম হ’য়ে গেছে। আপনি এই ছুরিখানা দেখিলেই বুঝিতে পারিবেন।”
এই বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় লতিমন বাইজীর বাড়ীতে যে ছুরিখানি পাইয়াছিলেন, তাহা বাহির করিয়া দেখাইলেন।

১.১২. দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – ছুরি – বিষাক্ত

সভয়ে মোবারক কহিলেন, “ছুরি কোথায় পাইলেন? এই ছুরিতেই খুন –”
বাধা দিয়া দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, ” না, এই ছুরিতেই খুন হয় নাই। ইহার জোড়া ছুরিতে খুন হইয়াছে। লতিমন বাইজীর কছে শুনিলাম, দিলজানের এইরূপ দুইখানি ছুরি ছিল। দিলজান, সৃজান বিবির কথা কিরূপে জানিতে পারে, বলিতে পারি না। সে মনিরুদ্দীনের উপরে রাগিয়া এমন অধীর হইয়া উঠে যে, যদি মনিরুদ্দীনকে বুঝাইয়া সে নিজের কাজ উদ্ধার করিতে না পারে, তবে ছুরিতে কাজ উদ্ধার করিবে স্থির করিয়া গত বুধবার রাত্রে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে যায়। মনিরুদ্দীন তখন বাড়িতে ছিলেন না। সেখানে মজিদ খাঁর সঙ্গে তাহার দেখা হয়; সম্ভব -এই সকল কথা লইয়া মজিদ খাঁর সঙ্গে বচসাও হয়। সেই সময়ে রাগের মুখে দিলজান রাগভারে মজিদ খাঁকে সেই ছুরি দেখাইয়া থাকিবে। এবং যে সঙ্কল্প করিয়া সে ছুরি লইয়া ফিরিতেছে, তাহাও বলিয়া থাকিবে। হয়ত মজিদ খাঁ তখন তাহাকে প্রবোধ দিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন; কিন্তু দিলজান সেখানে হইতে বাহির হইয়া আসে। রাগের বশে দিলজান হ্ঠাত্‍‌ কি একটা অনর্থ ঘটাইবে মনে করিয়া, মজিদ খাঁ সেই ছুরিখানি তাহার হাত হইতে কাড়িয়া লইবার চেষ্টায় তাহার অনুসরণ করিয়া থাকিবেন; তাহার পর হয় ত মেহেদী-বাগানে আবার উভয়ের দেখা হইয়াছে। মজিদ খাঁ সেই সময়ে দিলজানের সহিত ছুরিখানি লইয়া কাড়াকাড়ি করিয়াছেন; এবং অসাবধানবশতঃ ছুরিখানি হঠাত্‍‌ দিলজানের গলায় বিদ্ধ হওয়ায় দিলজানের মৃত্যু হইয়াছে। পাছে খুনী বলিয়া অভিযুক্ত হইতে হয়, এই ভয়ে মজিদ খাঁও সে সম্বন্ধে আর কোন উচ্চবাচ্য না করিয়া চুপ করিয়া গিয়াছেন।”
মোবারক বলিলেন, ” অনেকটা সম্ভব বটে; কিন্তু ইহা কতদূর সত্য, আমি বলিতে পারি না। মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে দিলজানের সহিত মজিদ খাঁর কি কথাবার্ত্তা হইয়াছিল, তাঁহার সঙ্গে দেখা করিয়া আপনি এখন তাহা তদন্ত করিয়া দেখুন। ইহা ভিন্ন সত্য আবিষ্কারের আর কোন উপায় দেখি না। এই ছুরি লইয়া আপনি এখন কি করিবেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “ছুরিখানি বিষাক্ত কি না , তাহা পরীক্ষা করিয়া দেখিতে হইবে। যদি এই ছুরিখানি বিষাক্ত হয়, তাহা হইলে ইহার জোড়া ছুরিখানি বিষাক্ত নিশ্চয়। এই খুনটা কোন বিষাক্ত ছুরিতেই হইয়াছে।”
হস্ত প্রসারণ করিয়া মোবারক কহিলেন, ” একবার আমি ছুরিখানি দেখিতে পারি কি?”
“অনায়াসে,” বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় ছুরিখানি মোবারকের হাতে দিতে উঠিলেন। মোবারক একটু তফাতে বিছনার উপরে বসিয়া ছিলেন। দেবেন্দ্রবিজয় যেমন তাঁহার দিকে এক পা অগ্রসর হইয়াছেন, সম্মুখে কুকুরটা শুইয়াছিল-একেবারে তাহার ঘাড়ের উপরে পা তুলিয়া দিয়াছেন। কুকুরটা রাগিয়া চীত্‍‌কার করিয়া তত্‍‌ক্ষণাত্‍‌ দেবেন্দ্রবিজয়ের পায়ে কামড়াইয়া দিল। দেবেন্দ্রবিজয় যেমন চমকিত ভাবে সরিয়া যাইবেন, হাত হইতে ছুরিখানি কুকুরটার উপরে পড়িয়া গেল।
মোবারক উঠিয়া তাড়াতাড়ি কুকুরটাকে সরাইয়া লইলেন। একটা চপেটাঘাতের সহিত ধমকও দিলেন। তাহার পর দেবেন্দ্রবিজয়ের নিকটে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ” কি মহাশয়, আপনাকে কামড়াইয়াছে না কি? দেখি দেখি-”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “না-দাঁত ফুটাইতে পারে নাই, কাপড়খানা একটু ছিঁড়িয়া গিয়াছে মাত্র।”
কুকুরটা তখন মাটিতে পড়িয়া ছটা্‌ফট করিতেছে; অথচ চীত্‍‌কার করিতেও পারিতেছে না। কুকুরটাকে তদবস্থ দেখিয়া মোবারকের বড় ভয় হইল; দেখিলেন, কুকুরের গলার কাছে অল্প রক্তের দাগ; রক্ত মুছিয়া দেখিলেন, সামান্য ক্ষতচিহ্ণ। একান্ত রুষ্টভাবে বলিলেন, “নিশ্চয়ই আপনার ছুরি বিষাক্ত-কুকুরটা এমন করিতেছে কেন? কি সর্ব্বনাশ কুকুরটাকে মারিয়া ফেলিলেন-কি রকম ভদ্রলোক আপনি?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আপনাকে যদি কাহারও কুকুর এরূপভাবে আক্রমণ করিত, সম্ভব, আপনিও এইরূপ ভদ্রতার পরিচয় দিতেন। যাহা হউক, আপনার এরূপ ক্ষতি করিয়া আমি অত্যন্ত দুঃখিত হইলাম।”
মোবারক বিরক্তভাবে বলিলেন, “যথেষ্ট হইয়াছে, আর আপনার দুঃখিত হইয়া কাজ নাই; কুকুরটাকে একেবারে মারিয়া ফেলিলেন !”
কুকুরটা ক্রমশঃ অবসন্ন হইয়া আসিতে লাগিল। দেবেন্দ্রবিজয় বিশেষ মনোযোগের সহিত সেইদিকে চাহিয়া রহিলেন। মোবারক কুকুরটাকে ধরিয়া উঠাইবার চেষ্টা করিলেন। অবসন্নভাবে কুকুরটা আবার গৃহতলে লুটাইয়া পড়িল। মোবারক পকেট হইতে রুমাল বাহির করিয়া বারংবার ক্ষতস্থান মুছাইয়া দিতে লাগিলেন। তখন আর উপায় নাই, জীবন প্রায় শেষ হইয়া আসিতেছে। কুকুরটা দুই-একবার বিকৃত মুখব্যাদনসহকারে জৃম্ভণ ত্যাগ করিল; তাহার পর কয়েকবার অন্তিম বলে উঠিয়া দাঁড়াইবার চেষ্টা করিয়া পড়িয়া গেল। দুই-একবার এইরূপ করিয়া আর উঠিল না-ধীরে ধীরে পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইল।
একান্ত উত্তেজিতভাবে মোবারক বলিলেন, ” আপনি করলেন কি-কুকুরটাকে সত্যসত্যই মারিয়া ফেলিলেন ! আপনার মত বে-আক্কেলে লোক দুনিয়াই নাই !”
দেবেন্দ্রবিজয় ছুরিখানা কাগজে ভাল করিয়া জড়াইতে জড়াইতে বলিলেন, “অপনি আমার উপরে অন্যায় রাগ করিতেছেন; দৈবাত্‍‌ –”
বাধা দিয়া ক্রোধভরে মোবারক বলিলেন, ” আর আপনার কথায় কাজ নাই-আপনি নিজের পথ দেখুন। আপনার ছুরি ভনায়ক বিষাক্ত।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হাঁ, নতুবা একটু আঘাতেই আপনার কুকুরটা মরিবে কেন? এ ছুরিখানি বিষাক্ত হওয়ায় আমি এখন বেশ বুঝিতে পারিতেছি, দিলজান যে ছুরিতে খুন হইয়াছে, তাহাও বিষাক্ত। একজোড়া ছুরির একখানিতে দিলজানের অদৃষ্টলিপি গ্রথিত ছিল, অপরখানিতে আপনার কুকুরটা মারা পড়িল।”
মোবারক পূর্ব্ববত্‍‌ ক্রুদ্ধভাবে বলিলেন, “বেশ, এখন আপনার পথ দেখুন-আমি আপনাকে মানে মানে বিদায় দিতেছি-ইহাই আমার পক্ষে যথেষ্ট।”
দেবেন্দ্রবিজয় রাগ প্রকাশ করিলেন না। মোবারকের কথা তিনি কানে না করিয়া, আপন মনে ছুরিখানি ভাল করিয়া কাগজে জড়াইয়া, সাবধানে পকেটের মধ্যে রাখিয়া দিয়া তথা হইতে বহির্গত হইলেন। ছুরিখানি বিষাক্ত হওয়ায় তিনি মনে মনে অনেকটা পরিমাণে আনন্দানুভব করিলেন। রাস্তায় আসিয়া আপন মনে বলিলেন, “এইবার একবার মজিদ খাঁর সহিত দেখা করিতে পারিলে, এই নিবিড় খুন-রহস্যাটা অনেকটা তরল হইয়া আসিবে।”

২.০১. প্রথম পরিচ্ছেদ – পরিচয়

দ্বিতীয় খণ্ড
নিয়তি – লীলাময়ী

Countess.
This horrid fear-I can no longer bear it
For heaven’s sake, tell me, what has taken place.”
Coleridge :- The death of Walleustein, Act I-Seene IX.

প্রথম পরিচ্ছেদ
পরিচয়

এখন মজিদ খাঁর একটু পরিচয় আবশ্যক।
মজিদ খাঁর মাতাপিতা জীবিত নাই। অতি শৈশব হইতে তিনি মাতৃপিতৃহীন। মজিদের পিতার সহিত মনিরুদ্দীনের পিতার খুব হৃদ্যতা ছিল। মজিদের পিতা তেমন সঙ্গতিসম্পন্ন ছিলেন না, মৃত্যুকালে তিনি মনিরুদ্দীনের পিতার হস্তে প্রতিপালন ও রক্ষণাবেক্ষণের ভারসহ মজিদকে সমর্পণ করিয়া যানা্‌। মনিরুদ্দীনের পিতা একজন বড় জমিদার–পূর্ব্ববঙ্গে তাঁহার বিস্তৃত জমিদারী। বিশেষতঃ তিনি নিজে দয়ালু ও পরোপকারী ছিলেন। তিনি মজিদ খাঁর জন্য যথেষ্ট য্ত্ন লইয়াছিলেন, তাহা তাঁহার মৃত বন্ধুর পক্ষে আশাতীত। তাঁহার যত্নে এবং তত্ত্বাবধানে মজিদ খাঁ সুশিক্ষিত হইয়া উঠিলেন। বিশেষতঃ জমিদারী কাজ-কর্ম্মে মজিদ খাঁর অসাধারণ নৈপুণ্য প্রকাশ পাইতে লাগিল। মজিদ খাঁ শ্রমশীল, বুদ্ধিমানা্‌ এবং সচ্চরিত্র। মনিরুদ্দীনের পিতা তাঁহাকে সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করিতেন। জমিদারী সংক্রান্ত প্রায় সকল কাজই মজিদ খাঁ দেখিতেন। এমন কি মনিরুদ্দীনের পিতা তাঁহার সহিত পরামর্শ না করিয়া কোন কাজ করিতেন না; কিন্তু নিজের একমাত্র পুত্র মনিরুদ্দীন ঠিক ভিন্ন পথে চালিত হইলেন-একেবারে বিলাসীর অগ্রগণ্য হইয়া উঠিলেন; বিষয়-সম্পত্তি রক্ষার দিকে তাঁহার আদৌ দৃষ্টিপাত ছিল না। তাহার পর পিতার মৃত্যুতে যখন একেবারে অগাধ সম্পত্তি তাঁহার হাতে আসিয়া পড়িল, উদ্দাম যৌবনের আবেগে তিনি তখন ধূলিমুষ্টির ন্যায় স্বর্ণমুষ্টি উড়াইতে লগিলেন। মধুপূর্ণ মধুচক্র দেখিয়া অনেক মোসাহেবও আসিয়া জুটিল। মজিদের তাহা অসহ্য হইত; তিনি বন্ধুভাবে মনিরুদ্দীনকে অনেক বুঝাইতেন, কাজে কিছুই হইত না; কিন্তু ইহা লইয়াই ইদানীং মনিরুদ্দীনের সহিত মজিদের বনিবনাও হইল না। মজিদ স্বতন্ত্র বাটীতে উঠিয়া গেলেন। মনিরুদ্দীনেরও নিজের গন্তব্য পথের একটা অন্তরায় সরিয়া গেল মনে করিয়া, মনে মনে সন্তুষ্ট হইলেন। মজিদের সমক্ষে তাঁহার অনেক বিষয় কুণ্ঠা উপস্থিত হইতে-নির্ব্বিঘ্নভাবে যাহা-ইচ্ছা-তাহা করিতে পারিতেন না; কিন্তু এক বিষয়ে তাঁহার বড় অসুবিধা হইল। বৈষয়িক কাজ-কর্ম্মে তাঁহার কিছুমাত্র অভিজ্ঞতা ছিল না। মজিদের উপরেই তিনি নির্ভর করিতেন। যৌবনাবেগে মনিরুদ্দীনের চিত্ত একান্ত উদ্দাম ও উচ্ছৃঙ্খল হইয়া উঠিলেও তাঁহার প্রতি মজিদের যথেষ্ট আন্তরিকতা ছিল। মনিরুদ্দীনের পিতার স্নেহানুগ্রহে তিনি মনুষ হইয়াছেন, তাহা মজিদ সর্ব্বদা সর্ব্বান্তঃকরণে অনুভব করিতেন। ভিন্নস্থানে বাসা লইয়াও তিনি মধ্যে মধ্যে আসিয়া বৈষয়িক কাজ-কর্ম্ম দেখিয়া যাইতেন; সত্‍‌পথে টানিয়া আনিবার জন্য মনিরুদ্দীনকে উপদেশও দিতেন; কিন্তু মনিরুদ্দীন যতদূর নীচে নামিয়া পড়িয়াছেন, সেখান হইতে তাঁহাকে টানিয়া তুলিয়া আনা বড় শক্ত। একযাত্রায় পৃথকা্‌ ফল-উভয়ে সমবয়ষ্ক, বাল্যকালে এক বিদ্যালয়ে পাঠ করিয়াছেন, একসঙ্গে খেলা করিয়াছেন, একই ব্যক্তির স্নেহেলালিত-পালিত হইয়াছেন; এখন উভয়ের মতি উভয়বিধ পথে চালিত হওয়ায় উভয়ের মধ্যে পূর্ব্ব সদ্ভাব কিছু হ্রাস পাইয়া আসিল। পরে যাহা ঘটিবে, মনিরুদ্দীনের পিতা তাহা বুঝিতে পারিয়াই তিনি নিজের উইলে মজিদ খাঁ যাহাতে বার্ষিক ছয় শত টাকা প্রাপ্ত হন, তাহার সুবন্দোবস্ত করিয়া দিয়াছিলেন। অদ্যাপি মনিরুদ্দীন বিবাহ করেন নাই। তাঁহার পিতা কয়েকবার বিবাহ দিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, তখন মনিরুদ্দীন বাইজী ও সরাপ লইয়া একবারে উণ্মত্ত। অনেক বিবচনার পর পিতা সে সঙ্কল্প পরিত্যাগ করিয়াছিলেন।
মজিদ খাঁ এখন কলিঙ্গাবাজারের পূর্ব্বাংশে বৃদ্ধা হামিদার বাড়ীতে বাস করেন। সেখানে আরও চারি-পাঁচজন মুসলমান ভদ্রলোক বাস করিয়া থাকেন। তন্মধ্যে কেহ মোক্তার, কেহ সওদাগরী অফিসের কেরাণী, কেহ বা উমেদার-সে পরিচয় আমাদিগের নিষ্প্রয়োজন। মজিদ খাঁ কাহারও সহিত মিশেন না। তিনি হামিদার বাটীর দ্বিতলস্থ দুইটি প্রকোষ্ঠ ভাড়া লইয়া বাস করিতেছেন।
মজিদ খাঁর বয়ঃক্রম এখন আটাশ বত্‍‌সর। বয়সে যুবক হইলেও সকল বিষয়ে তাঁহার বৃদ্ধের অভিজ্ঞতা ছিল; তাঁহার ন্যায় সচ্চরিত্র যুবককে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত দেখিয়া বিস্মিত হইবার কথা; কিন্তু অনেক ভাল লোকেরও পতন হয়।
মজিদ খাঁ কিছু দীর্ঘাকৃতি-দেহের বর্ণ গৌর। মুখখানি সুন্দর-দেখিয়া তাঁহাকে বুদ্ধিমানা্‌ বলিয়া অনুমান হয়।
দেবেন্দ্রবিজয় যখন তাঁহার সহিত দেখা করিতে হামিদার বাড়ীতে উপস্থিত হইলেন, তখন তিনি টেবিলের উপরে হেঁট হইয়া একখানি ইংরাজী সংবাদপত্র মনে মনে পড়িতেছিলেন। তাঁহার মুখখানি মলিন, ললাটে চিন্তার রেখাবলী প্রকটিত, মস্তকের কেশ অবিন্যস্ত নহে, বিশৃঙ্খলভাবে কতক ললাটের উপরে আসিয়া পড়িয়াছে। চক্ষুঃপ্রান্ত কালিমাঙ্কিত; দেখিয়া বোধ হয়, মজিদ খাঁ যেন উপর্য্যুপরি তিনটা বিনিদ্র রজনী অতিবাহিত করিয়াছেন।
দেবেন্দ্রবিজয় কক্ষমধ্যে প্রবিষ্ট হইলে মজিদ খাঁ বিস্ময়পূর্ণদৃষ্টিতে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন।

২.০২. দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – আর এক রহস্য

প্রথমে দেবেন্দ্রবিজয়ই স্তব্ধতা ভঙ্গ করিলেন। বলিলেন, “আমি আপনার অপরিচিত-আমার নাম দেবেন্দ্রবিজয় মিত্র। আমি একজন ডিটেকা্‌টিভ-ইনা্‌স্পেক্টর।”
শুনিয়া মজিদের মলিনমুখ আরও মলিন হইয়া গেল। আর একবার দেবেন্দ্রবিজয়ের দিকে চকিত-দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া সংবাদ-পত্রখানা ফেলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “আসুন-আসুন, আপনার নাম দেবেন্দ্রবিজয় বাবু ! নাম শুনিয়াছি, আপনাকে দেখি নাই। তা’আজ এখানে কি মনে করিয়া ?”
দেবেন্দ্রবিজয় একখানি স্বতন্ত্র চেয়ার টানিয়া বসিয়া বলিলেন, “কোন একটা বিশেষ কারণে আমি আপনার নিকটে আসিয়াছি। বোধ করি, আপনি নিজে তাহা মনে মনে বুঝিতে পারিয়াছেন।”
মজিদ উভয় ভ্রূ সঙ্কুচিত এবং মস্তক সঞ্চালিত করিয়া বলিলেন, “কই, আমি কিছুই ত বুঝিতে পারি নাই।”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “তবে আমিই স্পষ্টবাক্যে বুঝাইয়া দিই, মেহেদী-বাগানের খুনের তদন্তে আমি এখানে আসিয়াছি।”
কথাটা শুনিয়া সহসা মজিদের যেন শ্বাসরুদ্ধ হইল। স্তম্ভিতভাবে উঠিয়া দাঁড়াইলেন; মুখের পূর্ব্বভাব একেবারে পরিবর্ত্তিত হইয়া দারুণ উদ্বেগের চিহ্ণ ফুটিয়া উঠিল। তাড়াতাড়ি তিনি দেবেন্দ্রবিজয়ের তীক্ষ্ণদৃষ্টি হইতে মুখ ফিরাইয়া লইলেন। সংবাদপত্রখানা টেবিলের নীচে পড়িয়া গিয়াছিল; সেখানা তুলিয়া ধূলা ঝাড়িয়া নতমস্তকে ভাঁজ করিতে লাগিলেন। কিছু প্রকৃতিস্থ হইয়া শুষ্কহাস্যের সহিত জিজ্ঞাসা করিলেন, “খুনের তদেন্তে আমার কাছে আসিয়াছেন কেন ? আমি ইহার কি জানি ? আমার সহিত ইহার কি সংশ্রব আছে ? ”
একটু কঠিনভাবে দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন,”কি সংশ্রব আছে, আমি তাহাই জানিতে আসিয়াছি।”
মজিদ খাঁ অত্যন্ত তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে একবার দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে চাহিলেন। তাহার পর পকেট হইতে একটা চুরুট বাহির করিয়া অগ্নি সংযোগ করিলেন। এবং চুরুটে দুই-একটী টান দিয়া নিজের চেয়ারে ভাল হইয়া বসিলেন। অবিচলিতকণ্ঠে কহিলেন, “আপনি হেঁয়ালির ছন্দ ছাড়িয়া দিনা্‌।”
দেবেন্দ্রবিজয় সহাস্যে কহিলেন, “আপনার নিকটে এই হেঁয়ালি ছন্দের অর্থ দুরূহ নহে।”
মজিদ খাঁ বলিলেন, “অত্যন্ত দুরূহ-আপনার অভিপ্রায় স্পষ্টবাক্যে প্রকাশ করুন।”
উভয়ে বাগা্‌াযুদ্ধে নিপুণ। মজিদ এই খুন সম্বন্ধে এমন কিছু অবগত আছেন, যাহা দেবেন্দ্রবিজয় তাঁহার মুখ হইতে বাহির করিয়া লইতে চাহেন; কিন্তু মজিদ তাহা প্রাণপনে চাপিয়া যাইতে চেষ্টা করিতেছেন। উভয়ের মধ্যে যিনি অধিকতর দক্ষ, তাঁহারই জয়লাভ অবশ্যম্ভাবী। প্রথমে দেবেন্দ্রবিজয় বাগা্‌াযুদ্ধে অগ্রসর হইলেন। বলিলেন, “যে স্ত্রীলোকটি মেহেদী-বাগানে খুন হইয়াছে, সে আপনাদের মনিরুদ্দীনের রক্ষিতা-নাম দিলজান।”
“বটে ! আপনি ইহা কিরূপে জানিলেন ?” বলিয়া মজিদ অত্যন্ত চকিতভাবে দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে চাহিলেন।
দে। সে কথা এখন হইতেছে না। তবে এইমাত্র আপনি জানিয়া রাখুন, মেহেদী-বাগানে যে লাস পাওয়া গিয়াছে, তাহা দিলজানেরই। আপনি তাহাকে শেষ-জীবিত দেখিয়াছেন।
ম। বটে, এমন কথা !
দে। হাঁ, গত বুধবার রাত এগারটার পর মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে আপনার সহিত দিলজানের দেখা হইয়াছিল।
ম। কে আপনাকে এমন সুচারু মিথ্যাকথা বলিয়াছে ? কে এমন সত্যবাদী ?
দে। গনির মা।
মজিদের ওষ্ঠাধর কুঞ্চিত হইল। বলিলেন, “আপনি ইতিমধ্যে সকল সংবাদই সংগ্রহ করিয়া ফেলিয়াছেন দেখিতেছি। এখন আপনি আমার কাছে কি জন্য আসিয়াছেন, প্রকাশ করুন। কিছু জিজ্ঞাসা করিবার থাকে, বলুন।”
দে। গত বুধবার রাত্রিতে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে দিলজানের সহিত আপনার দেখা হইয়াছিল ?
ম। হইয়াছিল-সন্ধ্যার সময়ে-রাত্রিতে নহে।
দে। গনির মা’র মুখে শুনিলাম, রাত্রেও আপনার সহিত দিলজানের সহিত আমার দেখা হয় নাই। আর কাহারও সহিত দেখা হইয়াছিল ?
ম। সে কথা আমি বলিব না; তাহাতে আপনার কোন প্রয়োজন নাই।
দে। রাগ করিবেন না-খুব প্রয়োজন আছে। আপনি বুঝিতে পারিতেছেন না-আপনার মাথার উপরে কি ভয়ানক বিপদা্‌ উপস্থিত। যদি আপনি সরলভাবে আমার সকল প্রশ্নের উত্তর না করেন, আমি আপনাকে এখনই বিপদা্‌গ্রস্ত করিতে পারি-তাহা জানেন ?
ম। তাহা হইলে আপনি দিলজানের হত্যাপরাধটা আমারা্‌ স্কন্ধে চাপাইতে মনস্থ করিয়াছেন দেখিতেছি।
দে। তাহা পরে বিবেচ্য। এখন বলুন দেখি, গত বুধবরে কেন আপনি মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে গিয়াছিলেন ?
মজিদ নিজের বিপদের গুরুত্ব বুঝিতে পারিলেন। মনে মনে বড় বিরক্ত হইলেন। বিরক্তভাবে বলিলেন, “খুন করিবার উদ্দেশ্যে নহে; অন্য কাজ ছিল। মনিরুদ্দীনের সঙ্গে দেখা করিতে গিয়াছিলাম।”
“দেখা হইয়াছিল ?”
“না।”
“কেন ?”
“রাত নয়টার ট্রেনে তিনি ফরিদপুর যাত্রা করিয়াছিলেন।”
“মনিরুদ্দীনের সহিত যদি আপনার দেখা হয় নাই, কিরূপে আপনি জানিতে পারিলেন, তিনি ফরিদপুর-যাত্রা করিয়াছেন ?”
“দুই-একদিন পূর্ব্বে আমি তাঁহার মুখে শুনিয়াছিলাম, তিনি ফরিদপুর যাইবেন।”
“সৃজান বিবিকে সঙ্গে লইয়া ?”
“সে সম্বন্ধে আমি কিছুই জানি না। ফরিদপুরে তাঁহার জমিদারী; জমিদারীতে কাজকর্ম্ম দেখিতে যাইবেন, এইমাত্র আমি জানি।”
“আপনি কেন বুধবার রাত্রে তাঁহার সহিত দেখা করিতে গিয়াছিলেন ?”
“আমি তাঁহার বৈষয়িক আয়ব্যয়ের হিসাব রাখি। দুই-একটা হিসাব বুঝাইয়া দিতে গিয়াছিলাম।”
“সেদিন রাত্রিতে সেখানে কাহারও সহিত আপনার দেখা হয় নাই ?”
(ইতস্ততঃ করিয়া ) হইয়াছিল।
“হাঁ, কোন স্ত্রীলোকের সহিত কি।”
“হাঁ, কোন স্ত্রীলোকের সহিত।”
“দিলজান।”
“দিলজান নহে। আপনার অনুমান ভুল।”
“তবে কে তিনি ?”
“যিনিই হউন না কেন, আপনার এই খুনের মামা্‌লার সহিত তাঁহার কোন সংশ্রব নাই।
“তা’ না থাকিলেও তাঁহার নামটা আমার জানা দরকার; অবশ্যই আপনাকে তাহা প্রকাশ করিতে হইবে।”
“কিছুতেই নহে-আমি বলিব না।”
উভয়ের পরস্পরের মুখপ্রতি স্থিরদৃষ্টিতে চাহিয়া রহিলেন। দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, মজিদ কিছুতেই সেই স্ত্রীলোকের নাম প্রকাশ করিবেন না। তখন তিনি সে সঙ্কল্প পরিত্যাগ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপত্তি থাকে-নাম না বলিলেন; তবে সেই স্ত্রীলোকের সহিত আপনার কি বচসা হইয়াছিল, বলিতে কোন আপত্তি আছে কি ?
ম। আছে, সে কথায় আপনার কোন আবশ্যকতা নাই।
দে। কতক্ষণ সেই স্ত্রীলোকটি সেখানে ছিল ?
ম। প্রায় রাত্রি বারটা পর্য্যন্ত।
দে। সে বাহির হইয়া গেলে আপনি কতক্ষণ সেখানে ছিলেন ?
ম। আমিও তখনই চলিয়া আসি।
দে। বরাবর এখানে-আপনার এই বাড়ীতে ?
ম। না, এখানে ফিরিতে রাত হইয়াছিল।
দে। সেখান হইতে বাহির হইয়া আপনি আবার কোথায় গিয়াছিলেন ?”
ম। তাহা আমি আপনাকে বলিতে পারি না।
দে। আপনি না বলিতে পারেন, আমি বলিতে পারি-মেহেদী-বাগানে।

২.০৩. তৃতীয় পরিচ্ছেদ – আত্মসংযম

মজিদ বজ্রস্তম্ভিত হইয়া গেলেন । তীক্ষ্ণকণ্ঠে জুজ্ঞাসা করিলেন, “কে আপনাকে বলিল ?”
দে । সে কথা পরে হইবে । মোবারকের সহিত সেখানে আপনার দেখা হইয়াছিল কি ?
ম । দেখা হইয়াছিল ।
দে । আপনি বরাবর এখানে না আসিয়া মেহেদী-বাগানে তখন কোন্ অভিপ্রায়ে গিয়াছিলেন ?
মজিদ একটু চিন্তিত হইলেন । ক্ষণপরে, “রাত্রি অধিক হইয়াছিল; পাছে সেই স্ত্রীলোকটি অন্ধকার রাত্রিতে পথ ভুল করে, অথবা কোন বিপদে পড়ে মনে করিয়া, আমি তাহার অনুসরণে মেহেদী-বাগানে গিয়েছিলাম । অনেকক্ষণ সন্ধান করিয়া তাহাকে আর দেখিতে পাইলাম না । সেখান হইতে ফিরিবার সময়ে মোবারক-উদ্দীনের সহিত সাক্ষাৎ হয় ।”
দে । পথে বাহির হইয়া আপনি কি আর সেই স্ত্রীলোকটিকে একবারও দেখিতে পান নাই ?
ম । (নতমুখে) না,-আর তাহাকে দেখি নাই ।
দেবেন্দ্রবিজয় মনে মনে বুঝিলেন, কথাটা একেবারে মিথ্যা । মজিদের মুখের দিকে কঠিন দৃষ্টিনিক্ষেপপূর্ব্বক বলিলেন, “আমি আপনার নিকটে আমার সকল প্রশ্নের উত্তর পাইয়াছি; কিন্তু এখনও একটি বাকী আছে ।”
মজিদ বলিলেন, “কিছুই বাকী নাই; যাহা কিছু বলিবার সকলই আমি বলিয়াছি । যাহা অপ্রকাশ্য-তাহা বলি নাই । বলিতেও পারিব না ।”
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসিলেন, “তাহা হইলে আপনি কিছুতেই সেই স্ত্রীলোকটির নাম বলিবেন না ?”
মজিদ দৃঢ়স্বরে কহিলেন, “কিছুতেই না ।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আপনি অস্বীকার করিলে চলিবে না-গনির মা দেখিয়াছে, সেই স্ত্রীলোক দিলজান ।”
মজিদ বলিলেন, “আমি ত আপনাকে পূর্ব্বেই বলিয়াছি, গনির মার ভ্রম হইয়াছে ।”
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, সোজা অঙ্গুলিতে ঘৃত বাহির হইবে না । কর্ত্তৃত্বের তীক্ষ্ণকণ্ঠে কহিলেন, “আপনি জানেন, আমি মনে করিলে আপনাকে এখনই গ্রেপ্তার করিতে পারি ?”
মজিদ বলিলেন, “পারেন না । আমি কি করিয়াছি ?”
দেবেন্দ্রবিজয় দৃঢ়কণ্ঠে বলিলেন, “আপনিই দিলজানকে শেষ-জীবিত দেখিয়াছেন ।”
মজিদ বলিলেন, “আমি অস্বীকার করিব ।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “অস্বীকার করিলে চলিবে না; গনির মা তাহা সপ্রমাণ করিবে ।”
অত্যন্ত বিরক্তির সহিত অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া মজিদ বলিলেন, “তাহাই তাহাকে করিতে বলিবেন ! ”
মজিদের এইরূপ অপূর্ব্ব আত্মসংযম ও দৃঢ়তা দেখিয়া দেবেন্দ্রবিজয় মনে মনে অত্য্ন্ত রুষ্ট হইলেন । বলিলেন, “আপনি বড় ভাল কাজ করিতেছেন না; আপনাকেই ইহার ফলভোগ করিতে হইবে ।”
মজিদ খাঁ সেইরূপ দৃঢ়স্বরে বলিলেন, “তাহাতে আমি রাজি আছি । যাহা আমি করিতেছি, ভাল কি মন্দ বিবেচনা করার ক্ষমতা আমার নিজের যথেষ্ট আছে; আপনার নিকটে সে পরামর্শ আমি চাহি না ।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তাহা হইলে আপনি গত বুধবার রাত্রিতে মনিরুদ্দীনের বাড়ী হইতে বাহির হইয়া নিজের বাসায় ফিরিবার পূর্ব্বে কোথায় গিয়াছিলেন, কি করিয়াছিলেন, সে সকল কথা কিছুতেই কি আমার কাছে প্রকাশ করিবেন না ?”
মজিদ বলিলেন, “কিছুতেই না ।”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “সময়ে আপনাকে সকলই প্রকাশ করিতে হইবে ।”
মজিদ বলিলেন, “যখন করিতে হইবে-করিব ।”
দেবেন্দ্রবিজয় উঠিলেন । মজিদের বিনত মুখের দিকে একবার তীক্ষ্ণদৃষ্টিক্ষেপ করিয়া বলিলেন, “সেই কথাই ভাল । আমি আপনাকে সহজে ছাড়িব না ।” বলিয়া তিনি সেই কক্ষ ত্যাগ করিয়া বাহিরে আসিলেন ।
পথিমধ্যে আসিয়া আপন মনে অস্ফুটস্বরে বলিলেন, “আমার অনুমান ঠিক, মজিদ বড় সহজ লোক নহে; খুনের সকল খবরই মজিদ জানে; কিন্তু সে সকল কথা সহজে তাহার কাছে পাওয়া যাইবে না-আমিও সহজে ছড়িব না; দেখা যাউক, কোথাকার জল কোথায় দাঁড়ায় । এখন মজিদকে নজরের উপরে রাখিতে হইবে, কিছুতেই চোখের বাহির করা হইবে না । ধূর্ত্ত শ্রীশ ছোঁড়াটাকে এইবার দরকার হইবে দেখিতেছি ।”

২.০৪. চতুর্থ পরিচ্ছেদ – সন্দেহ প্রবল হইল

দেবেন্দ্রবিজয় কিছুদূর গিয়াছেন, এমন সময়ে দেখিলেন, হামিদা বিবি একখানি কাগজে অঞ্চলাগ্রে বাঁধিতে বাঁধিতে বাটীর বাহির হইল| দেখিয়া দেবেন্দ্রবিজয় মনে করিলেন, খুব সম্ভব, ইহা মজিদের পত্র| দেখিতে হইবে, পত্রখানি কোন্ উদ্দেশ্যে, কাহার নামে, কোথায় যাইতেছে|
যেদিকে হামিদা বিবি যাইতেছিল, সেইদিক্কার পথে সহজে ঠাহর হয়; এমন জায়গায় অকটি টাকা ফেলিয়া দিয়া দেবেন্দ্রবিজয় কিছুদূরে গিয়া দাঁড়াইলেন| পথ চলিতে চলিতে হামিদা বিবি পথিমধ্যে সেই টাকাটিকে অভিভাবকশুন্য দেখিয়া তুলিয়া লইল| দেবেন্দ্রবিজয় দূর হইতে তাহা দেখিয়া হামিদা বিবির নিকটে ছুটিয়া আসিয়া বলিলেন, “কে রে মাগী তুই, দে আমার নোট দে-টাকা দে-আমার নোট আর টাকা হারিয়েছে|”
বৃদ্ধা হামিদা বিবি থতমত খাইয়া বাহির করিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের হাতে দিয়া বলিল, “এই বাবু, তোমার টাকা|”
দেবেন্দ্রবিজয় গলাবাজি করিয়া বলিলেন “নোট-আমার নোট কোথা? তুই মাগী নিয়েছিস্| চালাকি বটে! এখনই থানায় চালান্ দিব, জান না বটে?”
হামিদা বিবিও তদপেক্ষা গলাবাজি করিতে জানে| আঘাতপ্রাপ্ত কাংস্যপাত্রের ন্যায় তাহার কণ্ঠ ঝন্ঝন্ করিয়া উঠিল; বলিল, “আ মর্ মিন্সে! মর্বার অর জায়গা পাও না-পথের মধ্যে বেইজ্জৎ করতে এসেছ| তোমার নোট কোথা, তা’ আমি কি জানি?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আমি নিজের চোখে তোকে নোট তুলে নিতে দেখেছি, এখন, ‘কি জানি’ বল্লে চল্বে না| ঐ যে মাগী, এরই মধ্যে আঁচলে বেঁধে ফেলেছিস্| বেশী চালাকী কর্লে এখনই পাহারাওয়ালা ডেকে হাজির করব|”
হামিদা বুড়ী রাগিয়া, চোখমুখ কপালে তুলিয়া, অস্থির হইয়া উঠিল, “আসুক না পাহারাওয়ালা-পাহারাওয়ালার নিকুচি করেছে! আমি সেই ভয়ে ম’রে গেলুম আর কি! আমি নোট নিয়েছি, এখানা কি তোমার নোট? চোখের মাথা একেবারে খেয়েছ? বলিয়া তাড়াতাড়ি আঁচল হইতে সেই পত্রখানা বাহির করিয়া ফেলিল|
“কই দেখি, কেমন নোট কি না, বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় সেই পত্রখানি হামিদা বিবির হাত হইতে টানিয়া লইলেন| পত্রখানি খামে বন্ধ না থাকায় দেবেন্দ্রবিজউের সুবিধা হইল| ভাজগুলি তাড়াতাড়ি খুলিয়া ফেলিয়া দেখিলেন, দুই-তিন ছত্রমাত্র লিপিবদ্ধ| খুলিতে-না-খুলিতে পাঠ শেষ হইয়া গেল| লিখিত ছিল:-
“জোহেরা,
আমি অত্য্ন্ত বিপদ্গ্রস্ত| অদ্য সন্ধ্যার পর তোমাদের বাগানে অতি অবশ্য আমার সহিত গোপনে দেখ করিবে-কথা আছে|
মজিদ”
দেবেন্দ্রবিজয় পত্রখানি হামিদাকে ফেরৎ দিয়া বলিলেন, “না গো, কিছু মনে ক’রো না-আমারই ভুল হয়েছে-তুমি ভাল মানুষের মেয়ে-তুমি কেন নোট নিতে যাবে? টাকাটি পেয়েছিলে, তখনই আমাকে ফেরৎ দিলে-তা’কিছু মনে ক’রো না|”
হামিদা বিবি দেবেন্দ্রবিজয়ের মিষ্টবাক্যে একেবারে দ্রবীভূত হইয়া গেল| পত্রখানি আঁচলে বাঁধিতে বাঁধিতে বলিল, “না মনে আর কর্ব কি? টাকা খোয়া গেলে সকলেরই গায়ের জ্বালা হয়-গায়ের জ্বালায় দু’কথা যাকে তাকে ব’লেও ফেলে-সে কথা কি আর মনে করতে আছে, বাপু?” বলিয়া হামিদা বিবি নিজের পথ দেখিল|
দেবেন্দ্রবিজয় চিন্তিতভাবে আপন মনে বলিলেন, “জোহেরার সহিত মজিদের কি কথা আছে? জোহেরার সহিত মজিদের বিবাহ হইবে, শুনিয়াছি| আজ সন্ধ্যার পর কোন্ অভিপ্রায়ে মজিদ গোপনে তাহার সহিত দেখা করিবে, তাহাও আমাকে দেখিতে হইবে; কিন্তু নিজের দ্বারা সে কাজ হইবে না-মজিদ আমাকে চিনে| শ্রীশের দ্বারা কাজটা যাহাতে ঠিক করিয়া লইতে পারি, সেই চেষ্টা দেখিতে হইবে|”

 ২.০৫. পঞ্চম পরিছেদ – বালক শ্রীশচন্দ্র

যাঁহারা আমার “মনোরমা” উপন্যাস পাঠ করিয়াছেন, তাঁহাদিগকে এই বুদ্ধিমান ছোক্‌রা শ্রীশচন্দ্রের পরিচয় দিতে হইবে না|
অদ্যাপি শ্রীশ, সুযোগ্য ডিটেক্‌টিভ দেবেন্দ্রবিজয়ের নিকটে প্রতিপালিত হইতেছে| এখন সে আরও কাজের লোক হইয়া উঠিয়াছে| ঝুনা নারিকেলের ন্যায় দেবেন্দ্রবিজয় বাহিরে যতই কঠিন হউন, কিন্তু তাঁহার হৃদয় মায়া-মমতায় পূর্ণ ছিল| তাঁহার পরম নারী-শত্রু জুমেলিয়ার মৃত্যু-সময়েও আমরা একদিন চক্ষুর্দ্বয় সজল দেখিয়াছিলাম| তিনি শ্রীশকে অত্যন্ত স্নেহ করেন| বালক শ্রীশও তাঁহার একান্ত অনুরক্ত| দেবেন্দ্রবিজয় তাহাকে যখন যাহা আদেশ করেন, শ্রীশচন্দ্র তাহা সুচারূপে সম্পন্ন না করিয়া ছাড়ে না|
শ্রীশের বয়স এখন পনের বৎসর| অতি শৈশবে সে মাতৃ-হীন হইয়াছে| মাতাপিতার কথা এখন আর তাহার মনেই পড়ে না| নিজের সম্বন্ধে যখন তাহার কোন চিন্তা উপস্থিত হয়, মনে হয়, সে আকাশ হইতে পড়িয়াছে, নয় মাটি ভেদ করিয়া উঠিয়াছে| তাহার পিতামাতা এমন কিছুই রাখিয়া যায় নাই-কোন চিহ্ণ নাই-যাহাতে তাহাদের কথা এই দীন বালকের মনে একবার উদয় হইতে পারে|
শৈশবকাল হইতে এই সংসারের অনেক দুঃখ-কষ্টের সহিত যুদ্ধ করিয়া নিরাশ্রয় বালক শ্রীশচন্দ্রের বুদ্ধিটা অত্যন্ত প্রখরতা লাভ করিয়াছিল| দেবেন্দ্রবিজয়ের আদেশমত সে কখন কোন সন্দেহজনক গাড়ীর পশ্চাতে ছুটিত, প্রয়োজনীয় খবরাখবর লইয়া আসিত, এইরূপ আরও অনেক কাজ শ্রীশ এমন আশর্য্যরূপে, অতি সত্বরে এবং অতি সহজে সুসম্পন্ন করিত যে, অনেক সময়ে দেবেন্দ্রবিজয়কেও বিস্ময়াপন্ন করিয়া তুলিত| দেবেন্দ্রবিজয় বুঝিতে পারিয়াছিলেন, কালে শ্রীশ একজন পাকা, নামজাদা গোয়েন্দা হইয়া দাঁড়াইবে| শ্রীশ যাহাতে কিছু লেখাপড়া শিখিতে পারে, তিনি এমন বন্দোবস্ত করিয়াও দিয়াছিলেন| পাছে শ্রীশ, বাবু বনিয়া যায় মনে করিয়া, কখনও তিনি তাহাকে ভাল কাপড়. জামা কি জুতা কিছুই পরিতে দিতেন না-সেদিকে তাঁহার বিশেষ দৃষ্টি ছিল| সকল সময়েই শ্রীশকে একখানি মোটা, খাটো কাপড় পরিয়া থাকিতে দেখা যাইত; অধিকন্তু একখানি ছোট লাল গাত্রমার্জ্জনী তাহার স্কন্ধে সতত শোভা পাইত| দেবেন্দ্রবিজয় মনে করিয়াছিলেন, শ্রীশের এখনকার মনের ভাব ঠিক রাখিতে পারিলে, কালে সে নিশ্চয়ই উন্নতি করিতে পারিবে|
অতি দ্রুতপদে সন্ধ্যার পূর্ব্বেই দেবেন্দ্রবিজয় ঘর্ম্মাক্ত কলেবরে বাটী ফিরিলেন| সারাদিন পরিশ্রমের পর তিনি অত্যন্ত ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন| গৃহিণী রেবতীসুন্দরী তাড়াতাড়ি আসিয়া, পাখা লইয়া ব্যজন করিতে বসিলেন| বলিলেন, “সেই কখন বাহির হইয়াছিলে, আর এতক্ষণের পর সময় হইল?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “কাজ ছিল”|
রে| সারাদিনই কি কাজ?
দে| আবার বাহির হইতে হইবে|
রে| আজ আর নয়, বোধ হয়|
দে| এখনই|
রে| তবে না আসিলেই হইত|
দে| সারাদিন ঘুরিয়া ঘুরিয়া অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছিলাম, তাই ঐ সুন্দর মুখখানি একবার দেখিতে আসিলাম| মনে আবার নূতন বল পাইলাম-যে কাজ বাকী আছে, তাহা এখন অনায়াসে শেষ করিতে পারিব|
রে| পরিহাস কেন?
দে| পরিহাস নয়-খুব সত্যকথা|
রে| খুব মিথ্যাকথা|
দে| না বিশ্বাস করিলে নাচার|
রে| আজ আর কোনখানে গিয়ে কাজ নাই|
দে| কেন?
রে| কেন আবার কি?
দে| না গেলে নয়| কাজ আছে|
রে| তবে আসা কেন?
দে| তা ত পূর্ব্বেই প্রকাশ করিয়াছি| এখন বল দেখি, শ্রীশ ছোঁড়াটা কোথা?
রে| কেন? তাকে আবার কেন?
দে| প্রয়োজন আছে|
রে| নীচের ঘরে বোধ হয় ব’সে আছে|
দেবেন্দ্রবিজয় উচ্চকণ্ঠে ‘শ্রীশ’ বলিয়া একবার হাঁক দিতেই, একেবারে দ্বিতলে-তাঁহার সম্মুখে শ্রীশচন্দ্রের আবির্ভাব|
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “কি খবর ?”
শ্রীশ বলিল, “আপনার একখানা চিঠি এসেছে|”
দে| কখন?
শ্রীশ| এই কতক্ষণ!
দে| কোথায় সে চিঠি?
শ্রীশ| শচীদাদার কাছে|
দে| তাহাকে এখন ডাক| আসিবার সময়ে যেন চিঠীখানা সঙ্গে লইয়া ফিরিয়া আসিল| শচীন্দ্রনাথ দেবেন্দ্রবিজয়ের ভাগিনেয়|

২.০৬. ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – দ্বিতীয় পত্র

দেবেন্দ্রবিজয় শচীন্দ্রের নিকট হইতে পত্রখানি লইয়া, খুলিয়া ফেলিয়া তখনই পড়িতে আরম্ভ করিলেন|
“দেবেন্দ্রবিজয়!
এখনও তুমি তোমার সঙ্কল্প পরিত্যাগ করিলে না? ক্রমেই তুমি বাড়াবাড়ি আরম্ভ করিলে| তোমার নিতান্তই মতিচ্ছন্ন ঘটিয়াছে, দেখিতেছি|
মাথায় দুই এক ঘা লাঠী না পড়িলে, তুমি কিছুতেই সোজা হইতেছ না| কেন বাপু, আর মিছিমিছি জ্বালাও? তুমি যে আমাকে কখনও ধরিতে পারিবে, ইহা মনেও স্থান দিয়ো না| আমি তোমার মত অনেক গোয়েন্দা দেখিয়াছি, তোমার চোখের সাম্নে হত্যাকারী ঘুরিয়া বেড়াইতেছে-আর তুমি তাহাকে দেখিয়াও দেখিতে পাইতেছ না?
এতদিন গোয়েন্দাগিরি করিলে, সাধারণে সুনাম হইয়াছে; আর আমার কাছে তুমি একেবারে বোকা বনিয়া গেলে? কি লজ্জার কথা! এই তুমি পাকা ডিটেকটিভ্? এই তোমার নাম-ডাক? ছি-ছি-ধিক্-ধিক্? সত্যকথা বলিতে কি আমি তোমার মত নিরেট বোকা গোয়েন্দাকে গ্রাহ্যই করি না| আমি তোমাকে বার বার সাবধান করিয়া দিতেছি, আর বেশীদূর অগ্রসর হইয়ো না-একদিন ভারী বিপদে পড়িবে-এমন বিপদে পড়িবে, একদম্ এ জগৎ ছাড়িয়া যাইতে হইবে প্রিয়তম স্ত্রীর বৈধব্য যদি তোমার একান্ত প্রার্থনীয় হয়-তবে আমার উপদেশে কর্ণপাত করিবে না|
আমি তোমাকে একটা সৎপরামর্শ দিতে চাই-শুনিবে কি? তুমি যদি এই কেস্টা ছাড়িয়া দাও, এরূপে আমাকে আর বিরক্ত না কর-আমি তোমাকে কিছু টাকা দিতে পারি, হাজার টাকা-কি বল, মন উঠিবে? যদি রাজী হও, কাল ঠিক রাত নয়টার সময়ে গোলদীঘীর ভিতরে যেয়ো| আমি সেইখানে তোমার সঙ্গে দেখা করিব| আর যদি তুমি আমাকে ধরিবার জন্য লোক বন্দোবস্ত ক’রে রাখ-আমার দেখা পাইবে না| কেবল দেখা পাইবে না নহে, তাহা হইলে বুঝিবে, তোমার মৃত্যু সন্নিকটে| আমি আর তখন তোমাকে কিছুতেই ক্ষমা করিব না| আমি এখনও তোমাকে সাবধান করিয়া দিতেছি, আমার কাছে গোয়েন্দাগিরি ফলাইতে চেষ্টা করিয়ো না|

সেই
মেহেদী-বাগানের খুনী|”
এ কি ভয়ানক পত্র! শুনিয়া রেবতীর আপাদমস্তক শিহরিয়া উঠিল| শচীন্দ্র চিন্তিত হইল| বুঝিতে পারিল, তাহার মাতুল মহাশয় এবার একজন শক্ত লোকের পাল্লায় পড়িয়াছেন| শ্রীশচন্দ্র খুব মনোযোগের সহিত পত্রের আদ্যোপান্ত শুনিয়া অত্যন্ত বুদ্ধিমানের ন্যায় মস্তকান্দোলন করিয়া বলিল, “হাঁ, দেখা যাবে!”
শচীন্দ্র বলিল, “আমিও তবে আপনার সহিত যোগ দিব না কি?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “না, শচী, তুমি এই সেদিন অসুখ হইতে উঠিয়াছ; তোমার শরীর এখনও ভাল রকম সারে নাই| তাহা না হইলেও তোমাকে দরকার নাই; আমি নিজেই সব ঠিক করে ফেলিব|”
শচীন্দ্র বলিল, “পত্রখানা দেখিয়া বুঝিতে পারা যাইতেছে, লোকটা বড় সহজ নহে; তাই বলিতেছিলাম|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “লোকটা সহজ না হইতে পারে; কিন্তু আমিও তাহার অপেক্ষা বড় সহজ নহি| লোকটা আমাকে ঠিক জানে না; তাহা হইলে কি সে আমাকে এমন পত্র লিখিতে সাহস করে? নারী-পিশাচী জুমেলিয়ার ঘটনা তোমার মনে পড়ে?”
শচীন্দ্র সহাস্যে বলিলেন “খুব! জুমেলিয়ার কথা এ জীবনে ভুলিবার নহে|”
জুমেলিয়ার নামে রেবতীর অনেক কথা মনে পড়িয়া গেল| পিশাচী তাঁহাকে কত কষ্ট না দিয়াছে-কি ভয়ানক বিপদেই না ফেলিয়াছে-সমুদয় মনে পড়িয়া গেল! রেবতী শিহরিয়া কহিলেন, “সে কি মেয়ে? পুরুষের বাবা!”
শ্রীশ বলিল, “ডাকিনী – ডাকিনী-মাগীটা আমাকে ত আর একটু হ’লেই গঙ্গায় ডুবিয়ে মারত|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তাহার কথা ছাড়িয়া দাও, পিশাচী আমার শিক্ষাগুরু অরিন্দম বাবুকে পর্য্যন্ত নাস্তানাবুদ করিয়া তুলিয়াছিল| (শচীন্দ্রের প্রতি) অরিন্দম বাবুকে এখিতে গিয়াছিলে?”
শচীন্দ্র বলিল, “হাঁ, এই কতক্ষণ হইল, আমি সেখান হইতে ফিরিতেছি|”
দে| তিনি কেমন আছেন?
শ| বড় ভাল নহে| বোধ হয়, তিনি এ যাত্রা রক্ষা পাইবেন না| একেবারে স্বাস্থ্যভঙ্গ হইয়াছে| ডাক্তারেরাও চিন্তিত|
দে| এই কেস্টা হাতে লইয়া অবধি আমি কয়দিন একবারও দেখিতে যাইতে পারি নাই-সময় পাই নাই| আমার কথা তাঁহাকে বলিয়াছ যে, আমি একটা খুনের মাম্লা লইয়া বড়ই বিব্রত হইয়া পড়িয়াছি, সেজন্য কয়েকদিন যাইতে পারি নাই?
শ| বলিয়াছিলাম| এই খুনের সম্বন্ধে যাহা কিছু জানিতাম, তাহাও আমি তাঁহাকে সমুদয় বলিয়াছি|
দে| শুনিয়া তিনি কি বলিলেন?
শ| আপনাকে একবার যাইতে বলিয়াছেন|
দে| কিছু মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছেন?
শ| আপনার নাম করিয়া বলিলেন যে, অনুসন্ধানের ঠিক পথ এখনও অবলম্বন করিতে পারেন নাই|
দে| তা’ হইবে| আজিকার কথা শুনিলে তিনি কখনই এরূপ মন্তব্য প্রকাশ করিতে পারিতেন না| ভাল, দুই-একদিনের মধ্যে আমি একবার তাঁহার সহিত দেখা করিব|
রেবতী বলিলেন, “মা কালী করুন, দাদামশাই যেন শীঘ্র ভাল হইয়া উঠেন| তাঁহার মত সদাশয় পরোপকারী লোক থাকিলে এ জগতের অনেক উপকার আছে| আমাদের জন্য তিনি অনেক করিয়াছেন; তাঁহার কথা চিরকাল মনে থাকিবে| আমি আর একদিন তাঁহাকে দেখিতে যাইব|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “চল শ্রীশ, তোমাকে একবার আমার সঙ্গে যাইতে হইবে| আর বিলম্ব করিলে চলিবে না|”
শ্রীশ বলিল, “কোথায়? আমাকে কি করিতে হইবে?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “যাহা বলিব, তাহই করিতে হইবে| কোন একটা বাগানে তোমাকে লুকাইয়া থাকিতে হইবে| সেখানে দুইজন লোককে পরে দেখিতে পাইবে, একজন স্ত্রীলোক, একজন পুরুষ| তাহাদের কি কথাবার্ত্তা হয়, সব শুনিয়া আসিবে- খুব মন দিয়া শুনিবে, যেন একটি কথাও ভুল বা ছাড় না হয়|”
রেবতী বলিলেন, “আবার এখনই যাইতে হইবে? তবে একটু জল খেয়ে যাও|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “এখন জল খাবার সময় নয়, ঠিক সময়ে পৌঁছাইতে না পারিলে সব মাটি হইয়া যাইবে|”
রেবতী কহিলেন, “একটু মিষ্টি মুখে দিয়া এক গ্লাস জল খাইতে আর কত সময়ে যাইবে?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “এতক্ষণ দিলে কথায় কথায় খাইয়া ফেলিতে পারিতাম-এখন আর নয়| এস শ্রীশ, আর বিলম্ব নয়|” বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় সত্বর উঠিয়া ঘরের বাহির হইয়া পড়িলেন| শ্রীশচন্দ্র তাঁহার অনুসরণ করিল| শচীন্দ্রও সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাহির হইয়া গেল|
রেবতী একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া গৃহকার্য্যে মনোযোগ দিতে চেষ্টা করিলেন|

 ২.০৭. সপ্তম পরিচ্ছেদ – জোহেরা

জোহেরা সুন্দরী| অসীম রূপ-লাবণ্য তাহার সর্ব্বাঙ্গে ঝল্মল্ করিতেছিল| যৌবনের প্রথম বিকাশে শুভ্র শরৎকালের ন্যায় একটা গভীর প্রগাঢ় প্রশান্তভাবে ও সৌন্দর্য্যে জোহেরা যেন ভরিয়া উঠিয়াছিল; কিন্তু উদ্দাম যৌবনের বসন্ত-চাঞ্চল্যে তাহা এখনও কূলপ্লাবী হয় নাই| মাধুর্য্যে যাহা কিছু-সকলই যেন সেই সুকুমার অবয়বের মধ্যে ওতপ্রোতভাবে স্ফুটতররূপে অঙ্কিত হইয়া গিয়াছে-বাহিরের চারিদিকে যেন তাহারই কেবল একটা উজ্জ্বল আভা প্রতিক্ষণে ঠিক্রিয়া পড়িতেছে| যেন তাহার অন্তরাকাশের দূর দিগন্ত হইতে মৃদু মলয়ানিল বহিয়া বিশ্বপৃথিবীকে কি এক মোহন বাসন্তীশ্রীতে ডুবাইয়া দিয়াছে| তাহার সেই কুঞ্চিত-কৃষ্ণ-কুন্তলাবলীপরিবেষ্টিত সুন্দর ঢল ঢল মুখখানি নবীন সূর্য্যাগ্রে বিকাশোম্মুখ পদ্মের সৌন্দর্য্যে, সৌকুমার্য্যে, ভাবে ভঙ্গিতে অতি সুন্দর! দেখিলে যেন দর্শন-বুভুক্ষা আরও বাড়িয়া উঠে-যেন তৎপ্রতি চিত্ত আরও আকৃষ্ট হইয়া পড়ে| উন্নত পরিপুষ্ট দেহ – সেই দেহের তেমনই সুন্দর, বসন্তসমীরসঞ্চালিত, নবপুষ্পিত ব্রততীর মন্দান্দোলনতুল্য সেই দেহের তেমনই কি সুন্দর ললিত কোমল মনোমোহন ভঙ্গী| একবার দেখিলে আর ভুলিতে পারা যয় না| তিমির-তরঙ্গের ন্যায় কেশদাম, অপ্রশস্ত নির্ম্মল ললাট, তন্নিম্নে তুলিকাচিত্রিতবৎ বিচিত্র ভ্রূযুগ, তন্নিম্নে নীলেন্দীবরতুল্য চক্ষু, তন্মধ্যে মধুময় চঞ্চল দৃষ্টি,পদ্মারক্ত অধরপুটে বিমল হাসির লীলা-একবার দেখিলে তাহা হৃদয়ের মর্ম্মকোষে গাঁথিয়া যায়|
জোহেরা যখন বড় বালিকা, তখন তাহার পিতামাতার মৃত্যু হয়| তাঁহাদিগের কথা স্বপ্নের মত এখনও এক-একবার জোহেরার মনে পড়ে| জোহেরার পিতার নাম নাজিব-উদ্দীন চৌধুরী| তিনি একজন উচ্চশিক্ষিত, অতি সদাশয় জমিদার ছিলেন| তাঁহার জমিদারীর আয় বাৎসরিক প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা| ইহার উত্তরাধিকারিণী এক্ষণে একমাত্র জোহেরা| নাজিব-উদ্দীন মৃত্যুপূর্ব্বে মুন্সী জোহিরুদ্দীনকে তাঁহার সমগ্র বিষয়ৈশ্বর্য্যের অছি নিযুক্ত করিয়া যান্| এবং যাহাতে পরে তাঁহার একমাত্র কন্যা, সুশিক্ষিতা এবং সুপাত্রে পরিণীতা হয়, সেজন্য তাঁহার প্রধান নায়েব জোহিরুদ্দীনের উপরে তাঁহার একটি বিশেষ আদেশ ছিল|
মুন্সী জোহিরুদ্দীন, নাজিব-উদ্দীনের বিশ্বস্ত বন্ধু ছিলেন| নাজিবউদ্দীন সকল রকমে তাঁহাকে খুব বিশ্বাস করিতেন| এমন কি সকল বিষয়ে তাঁহাকে নিজের দক্ষিণহস্ত স্বরূপ মনে করিতেন| তিনি অনেক বিবেচনা করিয়া তাঁহার নিজের জমিদারীতে তাঁহাকে নায়েবের পদ দিয়াছিলেন| তখন তাঁহার বার্ষিক আয় চল্লিশ হাজার টাকা ছিল, কিন্তু জোহিরুদ্দীনের নৈপুণ্যে তাহা অচিরকাল মধ্যে পঞ্চাশ সহস্রে পরিণত হইল| জোহিরুদ্দীনেরও মাসিক দেড়শত টাকা বেতন আড়াইশতে পরিণত হইল| মৃত্যুপূর্ব্বে নাজিব-উদ্দীন যখন তাঁহাকে সমগ্র বিষয়ের অছি নিযুক্ত করিয়া গেলেন, তখন তিনি তাঁহার বেতন তিন শত টাকা নির্দ্ধারণ করিয়া দিয়াছিলেন|
জোহিরুদ্দীন মনে করিলে জোহেরার অনেক সম্পত্তি আত্মসাৎ করিতে পারিতেন; কিন্তু তিনি তাহা করেন নাই| একান্ত বিশ্বস্তভাবে তিনি নিজের সেই মৃত বন্ধু বা প্রভুর আদেশ পালন এবং নিজের কর্ত্তব্যসাধন করিয়া আসিতেছিলেন| তিনি প্রভু-কন্যাকে সুশিক্ষিতা করিয়া তুলিলেন; কিন্তু অদ্যাপি তাহাকে সুপাত্রে পরিণীতা করিতে পারেন নাই| পাত্রীকে বিষয়ৈশ্বর্য্যশালিনী দেখিয়া পাত্র অনেক জুটিল বটে; কিন্তু কেহই সে সৌভাগ্যলাভে কৃতকার্য্য হইল না| জোহেরা বিবাহে একান্ত নারাজ-শিক্ষার গুণে সে নিজে অনেক পরিমাণে স্বাধীন প্রকৃতির হইয়া উঠিয়াছিল| কেবল তাহাই নহে, মজিদ খাঁ ইতঃপূর্ব্বে তাহার চিত্তহরণ করিয়াছিলেন| মজিদের সহিত জোহেরার বিবাহ হয়, এ ইচ্ছা মুন্সী জোহিরুদ্দীনের আদৌ ছিল না; তিনি জোহেরার জন্য মনিরুদ্দীনকেই সুপাত্র স্থির করিয়াছিলেন; কিন্তু মনিরুদ্দীনের চরিত্রহীনতার জন্য জোহেরা তাঁহাকে আন্তরিক ঘৃণা করিত; সুতরাং বিবাহ স্থগিত রহিল| মজিদ ভিন্ন জোহেরা আর কাহাকেও বিবাহ করিবে না বলিয়া দৃঢ় পণ করিয়া বসিল; কিন্তু মৃত বন্ধুর আদেশ স্মরণ করিয়া মুন্সী জোহিরুদ্দীন কিছুতেই তাহাতে মত দিতে পারিলেন না-অভিভাবকের বিনানুমতিতে জোহেরাও বিবাহ করিতে পারিল না| এখনও সে নাবালিকা-অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া স্বেচ্ছায় কোন কাজই করিতে পারে না; সুতরাং বিবাহ আপাততঃ স্থগিত রহিল| আইনের নির্দিষ্ট বয়সে যখন সে সাবালিকা হইবে, তখন আর তাহাকে অভিভাবকের মুখপ্রেক্ষী থাকিতে হইবে না; তখন সে নিজেি মজিদকে বিবাহ করিতে পারিবে মনে করিয়া, জোহেরা দিনাতিবাহিত করিতে লাগিল| সত্যকথা বলিতে কি, ইহাতে জোহেরা মনে মনে জোহিরুদ্দীনের উপরে অত্যন্ত উষ্ণ হইয়া উঠিল| জোহিরুদ্দীনও মেয়েটাকে এইরূপ অবাধ্য দেখিয়া মনে মনে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হইলেন| জোহিরুদ্দীনের ইহাতে বিশেষ কোন দোষ দেখি না, তাঁহার বিশ্বাস, পাত্র সঙ্গতিসম্পন্ন হইলেই সুপাত্র| বিশেষতঃ মনিরুদ্দীন জমিদার-পুত্র; এক্ষণে তিনি নিজে একজন জমিদার, সমৃদ্ধির ইয়ত্তা হয় না| অতএব জোহিরুদ্দীনের মতে তিনি একটি সুপাত্র| তাঁহার সহিত জোহেরার বিবাহ হইলে তাঁহার পরলোকগত প্রভুর আত্মা নিশয়ই সুখানুভব করিবেন, ইহা জোহিরুদ্দীনের স্থির বিশ্বাস| পূর্ব্বেই বলিয়াছি, নিজের সঙ্কল্প কার্য্যে পরিণত করিতে না পারিয়া জোহিরুদ্দীন জোহেরার ব্যবহারে মনে মনে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হইয়াছিলেন; কিন্তু মজিদকে তাঁহার সঙ্কল্পসিদ্ধির অন্তরায় হইতে দেখিতে অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া উঠিলেন| মজিদকে তাঁহাদিগের বাড়ীতে আসিতে নিষেধ করিয়া দিলেন| এবং জোহেরাকেও নিষেধ করিয়া দিলেন, সে যেন মজিদের সাক্ষাতে বাহির না হয় ও তাঁহার সহিত কথাও না কহে|
কাজে তাহার কিছুই হয় না| প্রণয় বাধা মানে না-যেখানে বাধা, সেখানে প্রণয়ের চাতুর্য্য প্রকাশ পায়; এবং সেখানে প্রণয় প্রবঞ্চনা করিতে জানে| প্রায়ই জোহেরা ও মজিদ রাত্রে গোপনে গৃহসংলগ্ন উদ্যান মধ্যে মিলিত হইতেন| পরষ্পর পত্র লেখালেখিও চলিত| তাহাতে তাঁহাদের যেন আরও সুখবোধ হইত| মুন্সী জোহিরুদ্দীন আপনার কাজ লইয়া ব্যস্ত, ইহার বিন্দু-বিসর্গ জানিতে পারিতেন না| তিনি মনে করিয়াছিলেন, জোহেরার সম্মুখ হইতে মজিদকে কিছুদিনের জন্য সরাইয়া ফেলিতে পারিলে, জোহেরার মন পরিবর্ত্তিত হইতে পারে; কিন্তু সেটি তাঁহার মস্ত ভ্রম| বাধাপ্রাপ্ত প্রণয় ভাদ্রের রুদ্ধ নদীর ন্যায় একান্ত খরপ্রবাহ ও কূলপ্লাবী হইয়া উঠে|
মুন্সী জোহিরুদ্দীন লোকটা বরাবরই মিতব্যয়ী| তিনি যৌবনকাল হইতে এই পঞ্চাশোর্দ্ধ বয়ঃক্রম পর্য্যন্ত নায়েবগিরি করিয়া নিজেও অনেক সঙ্গতিসম্পন্ন হইয়া উঠিয়াছেন| কলিকাতার মধ্যে পনের ষোলখানি বড় বড় ভাড়াটীয়া বাড়ী তৈয়ারী করিয়াছেন; জায়গা-জমিও কিছু কিছু করিয়াছেন; বেতন ছাড়াও এদিকেও তাঁহার মাসে অন্যূন তিনশত টাকার আয় হইয়া থাকে| সংসারে ব্যয় কিছুই ছিল না-প্রথম যৌবনে একবার বিবাহ করিয়াছিলেন, সন্তানাদি হয় নাই; তাঁহার চল্লিশ বৎসর বয়সে স্ত্রী-বিয়োগ হয়| আট-দশ বৎসর পরে আবার একটী বিবাহ করেন| দুর্ভাগ্যবশতঃ এবারকার স্ত্রীটি একান্ত অমিতব্যয়িনী ছিলেন; কিন্তু সেজন্য জোহিরুদ্দীনের বিশেষ কিছু আর্থিক ক্ষতি হয় নাই-কিছুদিন পরে সেই স্ত্রীটি হঠাৎ তাঁহার স্কন্ধ পরিত্যাগ করিয়াছেন| তাঁহারই নাম সৃজান|

২.০৮. অষ্টম পরিছেদ – উদ্যানে

মনিরুদ্দীন সৃজান বিবিকে লইয়া নিরুদ্দেশ হইয়াছেন; কিছুদিন পরে যখন জোহিরুদ্দীন ইহা জানিতে পারিলেন; তখন তাঁহার সুর একেবারে বদ্লাইয়া গেল| এ সময়ে যদি জোহেরা তাহার অভিভাবকের নিকটে মজিদকে বিবাহ করিবার প্রস্তাব উপস্থিত করিতে পারিত, তিনি নিশ্চয়ই জোহেরাকে নিজের অপেক্ষা বুদ্ধিমতী জ্ঞান করিতেন-আর অন্যমত করিতে পারিতেন না|
এই বৃদ্ধ বয়সে অপমানে, ঘৃণায় মুন্সী জোহিরুদ্দীনের মাথটা যেন কাটা গেল; তিনি একেবারে মুমূর্ষুর মত হইয়া পড়িলেন| তিনি আর বাটীর বাহির হইতেন না| কাহারও সহিত দেখা করিতেন না| তিনি সৃজান বিবিকে অত্যন্ত ভালবাসিতেন; যাহাকে একদণ্ড চোখের অন্তরাল করিতে প্রাণ চাহিত না, সে আজ অই বিশ্বাসঘাতকতা করিল! আর মনিরুদ্দীন যে তাঁহার বুকে এমনভাবে বিষমাখা বাঁকা ছুরিকা বসাইবে, তাহাও তিনি একবার স্বপ্নেও ভাবেন নাই|
জোহেরাও ইহাতে অত্যন্ত অপমান বোধ করিল| যদিও সৃজান তাহার কোন আত্মীয়া নহে; তথাপি সে তাহার অভিভাবকের বিবাহিতা পত্নী এবং সকলের এক বাটীতে বাস| পাছে কাহারও সহিত দেখা হইলে কেহ এই সকল কথা উত্থাপন করে, এই ভয়ে জোহেরাও আর বাড়ীর বাহির হইত না; এবং কাহারও সহিত দেখা করিত না| কেবল মজিদকে কয়েকবার আসিবার জন্য গোপনে পত্র লিখিয়াছিল| পত্রত্তোরে একটা-না-একটা অজুহাত দেখাইয়া মজিদ নিশ্চিত হইলেন; আসিতে পারিলেন না| জোহেরা মজিদের এরূপ ভাব বৈলক্ষণ্যের কারণ বুঝিতে না পারিয়া, অত্যন্ত চিন্তিত ও বিমর্ষ হইল| যখন জোহেরার মনের এইরূপ অবস্থা, এমন সময়ে মজিদের প্রেরিত সেই পত্র তাহার হস্তগত হইল| এ পত্রে মজিদ তাহাকে রাত্রে গোপনে তাঁহার সহিত দেখা করিবার জন্য অনুরোধ করিতেছেন| তিনি নিজেই আজ দেখা করিতে আসিতেছেন| ইহার অর্থ কি? জোহেরা পত্র পড়িয়া আরও চিন্তিত হইল| এবং মজিদের সহিত দেখা করিবার জন্য তাহার মন নিরতিশ্রয় ব্যগ্র হইয়া উঠিল|
বাটীর পশ্চাদ্ভাগে প্রকাণ্ড উদ্যান| জোহেরা যথাসময়ে সেই উদ্যানে প্রবেশ করিল| কিছুদূর গিয়া দেখিল, পুষ্করিণীর নিকটে লতামণ্ডপ পার্শ্বে মজিদ খাঁ দাঁড়াইয়া| পরে পরষ্পর সাক্ষাৎ হইল; এবং নির্জ্জন স্থান পাইয়া নির্ভয়ে স্বাভাবিক স্বরে কথোপকথন আরম্ভ করিয়া দিলেন| তাঁহারা ঘুণাক্ষরে জানিতে পারিলেন না, বাহিরে অন্তরালে দাঁড়াইয়া দেবেন্দ্রবিজয়-প্রেরিত শ্রীশচন্দ্র নামক একটি চতুর বালক অত্যন্ত মনোযোগের সহিত তাঁহাদিগের কথোপকথন শ্রবণ করিতেছে|
যখন মজিদ এখানে আসিতেছিলেন, পথে দেবেন্দ্রবিজয় শ্রীশকে দূর হইতে তাঁহাকে দেখাইয়া দিয়াছিলেন| শ্রীশচন্দ্র অলক্ষ্যে মজিদের অনুসরণে বাগানের মধ্যে আসিয়া যথাস্থানে লুক্কায়িতভাবে অপেক্ষা করিতেছিল|
রাত্রি প্রহরাতীত| চন্দ্রোদয়ে চারিদিকে জ্যোৎস্না ফুটিয়াছে| বড় অনুজ্জ্বল জ্যোৎস্না; কিন্তু তাহা বিশ্বজগতের স্বপ্নময় আবরণের মত বড় মধুর! মলিন জ্যোৎস্নামণ্ডিত আকাশের স্থানে স্থানে তরল মেঘখণ্ড রহিয়াছে-ম্রিয়মাণ চন্দ্রের ম্লান কিরণে শুভ্রকায় মেঘ-সন্ততিগুলি স্নান করিতেছে| বিমলিনজ্যোৎস্নাব-গুণ্ঠনমণ্ডিতা নিসর্গসুন্দরী মৃদুহাস্যে উর্দ্ধনেত্রে সেইদিকে চাহিয়া রহিয়াছে| ঝিল্লিরবে সেই বিজন উদ্যানভূমি মুখরিত| অগণ্য-তরুলতা-ফলপুষ্পবিশোভিত উদ্যানভূমি ছায়ালোক-চিত্রিত হইয়া সুচিত্রকর-অঙ্কিত একখানি উৎকৃষ্ট চিত্রের ন্যায় প্রতীয়মান হইতেছে| সম্মুখে স্বচ্ছ দর্পণের ন্যায় নীলজলপূর্ণ প্রকাণ্ড দীর্ঘিকা অনেকদূর পর্য্যন্ত বিস্তৃত রহিয়াছে; এবং তাহার উর্ম্মি চঞ্চল বক্ষে চন্দ্রকর-লেখা খেলা করিতেছে| যে লতাবিতানে বসিয়া মজিদ ও জোহেরা কথোপকথন করিতেছিল, সেখানে পত্রান্তরাল ভেদ করিয়া চন্দ্রকিরণ প্রবেশ করায় ঈষদালোক সঞ্চিত হইয়াছিল| সেই ঈষদালোকে শ্রীশ বহির হইতেও লতামণ্ডপমধ্যবর্ত্তী দুইজনকে দেখিতে পাইতেছিল| কিরূপ ভাবে হাত-মুখ নাড়িয়া, কোন্ কথা কিরূপ ভঙ্গীতে তাঁহারা বলিতেছিল, শ্রীশ তাহাও নিবিষ্টচিত্তে লক্ষ্য করিতেছিল| ইতিপূর্ব্বে লতামণ্ডপের বাহিরে দাঁড়াইয়া তাঁহাদিগের কি কথাবার্ত্তা হইয়াছিল, তাহা শ্রীশ শুনিবার জন্য সুবিধা করিতে পারে নাই| লতামণ্ডপমধ্যে প্রবেশ করিয়া তদুভয়ে যাহা বলাবলি করিতে লাগিলেন, শ্রীশ তাহার প্রত্যেক শব্দটি যেন গলাধঃকরণ করিতে লাগিল|
লতামণ্ডপ মধ্যস্থ শিলাখণ্ডের উপরে বসিয়া জোহেরা জিজ্ঞাসা করিল, “তাহা হইলে তোমার উপরেই কি লোকটার সন্দেহ হইতেছে?”
বিষণ্ণভাবে মজিদ বলিলেন, “আমার ত তাহাই বোধ হয়| দেবেন্দ্রবিজয় লোকটা বড় সহজ নহে| আমি যে কিরূপে আত্মপক্ষ-সমর্থন করিব, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না| দায়ে পড়িয়া আমাকে মুখবন্ধ করিয়া থাকিতে হইবে, দেখিতেছি|”
জো| কেন?
ম| কেন? তাহার সন্দেহভঞ্জন করিতে হইলে আমাকে সে রাত্রের সমূদয় ঘটনা প্রকাশ করিতে হইবে| কিছুতেই আমি তাহা পারিব না|
জো| কেন পারিবে না?
মজিদ কোন উত্তর করিতে পারিল না-নীরবে নতমুখে রহিলেন| তাঁহার ভাব দেখিয়া জোহেরার মুখ ম্লান হইয়া গেল-জোহেরা চিন্তিত হইল| ক্ষণপরে বলিল, “ইহার ভিতর একটা কারণ আছে-কোন বিশেষ কারণ, কেমন?”
মজিদ মুখ না তুলিয়া বলিলেন, “হাঁ, জোহেরা|”
জোহেরা জিজ্ঞাসা করিল, “এই কারণটার ভিতরে কোন স্ত্রীলোকের অস্তিত্ব আছে কি?”
মজিদ মাথা নাড়িয়া জানাইলেন, ‘আছে’| মুখে কিছুই বলিলেন না|
জোহেরার মলিনমুখে যেন আর একখানা বিষাদের মেঘ ঘনাইয়া আসিল|
একটু পরে ঘৃণাভরে উঠিয়া কঠিন হাস্যের সহিত বলিল, “এ বড় মন্দ রহস্য নহে, মজিদ! এই খোস-খবর দিবার জন্য কি তুমি আজ আমার সঙ্গে দেখা করিতে চাহিয়াছিলে? আমি মনে জানি, তুমি আমাকে আন্তরিক ভালবাস-আমি তোমার মুখ চাহিয়া রহিয়াছি-আর তুমি-তুমি মজিদ, আমার কাছে অনায়াসে অন্য একজন স্ত্রীলোকের নাম লইয়া-”
বাধা দিয়া বিচলিতভাবে মজিদ বলিলেন, “নির্ব্বোধের ন্যায় কি বলিতেছ? আমি যে স্ত্রীলোকের কথা বলিতেছি, তাহার সহিত প্রণয়ের কোন সংশ্রব নাই| কোনবিশেষ কারণে আমি কোন বিষয়ে তাহার নিকট প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়াছি| প্রতিজ্ঞাভঙ্গ ভিন্ন দেবেন্দ্রবিজয়ের ও তোমার সন্দেহ-ভঞ্জনের আর কোন উপায় দেখি না; কিন্তু আমি কিছুতেই তাহা পারিব না| আমার কথায় কি তোমার বিশ্বাস হয় না? সত্য কি তুমি মনে করিতেছ, আমি তোমার সহিত প্রবঞ্চনা করিতেছি? এত সহজে আমাকে অবিশ্বাসী ভাবিয়ো না| আমি তাহা নহি|”
জোহেরা সন্দেহপূর্ণদৃষ্টিতে ক্ষণেক মজিদের মুখপ্রতি চাহিয়া বিষণ্ণভাবে অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া কহিল, “পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস করিতে নাই|”
দুই হাতে জোহেরার হাত দুইখানি ধরিয়া মজিদ হাসিয়া বলিলেন, “সকলেই কি সমান? আমাকে অবিশ্বাস করিতে হয়-এখন না| যতক্ষণ না, আমি মুখ ফুটিয়া সে সকল কথা প্রকাশ করিতেছি, ততক্ষণ তুমি আমাকে অবিশ্বাসী ভাবিয়ো না| আমি একান্ত তোমারই|”
সাগ্রহে জোহেরা জিজ্ঞাসা করিল, “তাহা হইলে তুমি সে সকল কথা প্রকাশ করিতে সম্মত আছ?”
মজিদ বলিলেন, “যখন দেখিব, বিপদ্ অত্যন্ত গুরুতর-আর গোপন করিলে চলিবে না-তখন অবশ্যই আমাকে তাহা প্রকাশ করিতে হইবে; কিন্তু সহজে আমি প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিব না-সহজে আমি বিচলিত হইব না|”

২.০৯. নবম পরিচ্ছেদ – বিশ্রম্ভালাপে

জোহেরা কোমল বাহুদুটি প্রসারণ করিয়া সবেগে মজিদের কণ্ঠ বেষ্টন করিয়া ধরিল| মজিদ সাগ্রহে জোহেরার সুন্দর মুখখানি লইয়া তদুপরি দুইটী চুম্বনরেখা অঙ্কিত করিয়া দিলেন| জোহেরা অনেকক্ষণ বাহ্যজ্ঞানপরিশূন্যা হইয়া রহিল| এইরূপে তাঁহাদিগের বিবাদ একেবারে মিটিয়া গেল| তাহার পর উভয় প্রেমিক-প্রেমিকার প্রমালাপে কত কথাই হইল-কত প্রাণের কথা-কত মানাভিমানের কথা, কত বিরহের কথা, বালক শ্রীশচন্দ্র তাহার একটি বর্ণও হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিল না; এবং যুক্তাক্ষরসঙ্কুল বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগের ন্যায় তাহা শ্রীশচন্দের নিকটে একান্ত কঠিন ও দুর্ব্বোধ্য অনুমিত হইল|
তাহার পর মজিদ খাঁ পুনরায় নিজের কাজের কথা পাড়িলেন| এখন বিপদের বজ্র তাঁহার মাথার উপর ছুটিতেছে| তিনি বুঝিয়াছিলেন, নিশ্চিন্তে প্রেমালাপের সময় ইহা নহে| বলিলেন, “জান কি জোহেরা, গত বুধবার রাত্রে সৃজান বিবি কখন কোথায় গিয়াছিল, কোথায় কি করিয়াছিল?”
জোহেরা বলিল, “কিছু কিছু খবর আমি বলিতে পারি| সেদিন রাজাব-আলির বাড়ীতে আমাদিগের নিমন্ত্রণ ছিল| সৃজান আর আমি দুইজনেই একসঙ্গে সেখানে যাই|”
ম| কখন গিয়াছিলে?
জো| রাত নয়টার পর|
ম| রাজাব-আলির বাড়ী হইতে কখন তোমরা ফিরিয়া আসিলে?
জো| সৃজান বিবির মাথা ধরায় বেশিক্ষণ সেখানে আমরা থাকিতে পারি নাই| রাত সাড়ে দশটার সময়ে আমরা সেখান হইতে চলিয়া আসিলাম|
ম| বাড়ীতে ফিরিয়া সৃজান বিবি কি করিল?
জো| তাহার সহিত দেখা করিবার জন্য একটি স্ত্রীলোক অপেক্ষা করিতেছিল| সৃজান বিবি তখনই তাহার সহিত দেখা করিতে গেল|
ম| (সবিস্ময়ে) স্ত্রীলোক! কে সে?
জো| তা’ আমি ঠিক জানি না| তাহাকে আমি দেখি নাই| তাহার পর সৃজান বিবির সহিত আমার আর দেখা হয় নাই| বোধ হয়, সেই স্ত্রীলোকটি মনিরুদ্দীনের কোন সংবাদ আনিয়া থাকিবে| রাত সাড়ে এগারটার সময়ে সে চলিয়া যায়|
ম| কিরূপে জানিলে|
জো| সাখিয়ার মুখে শুনিয়াছি|
ম| সাখিয়া কে?
জো| সৃজান বিবির বাঁদী|
ম| তাহার কাছে আর কি শুনিয়াছ? মুন্সী জোহিরুদ্দীন সাহেব তখন কোথায় ছিলেন?
জো| তখন তিনি বাড়ীতে ছিলেন না; কোন কাজে তিনি বাহিরে গিয়াছিলেন; রাত বারটার সময়ে তিনি ফিরিয়া আসেন| জানিতে পারিয়া, সৃজান বিবি অভিমানের ভাণে তখন অন্য একটা ঘরে গিয়া দ্বাররুদ্ধ করিয়া শয়ন করে| তাহার পর সে কখন উঠিয়া চলিয়া গিয়াছে, কেহ তাহা জানে না| বোধ হয় শেষ রাত্রিতে, সৃজান বিবি পলাইয়া গিয়াছে|
ম| কাহারও জন্য কোন পত্র রাখিয়া গিয়াছিল?
জো| তাহা আমি ঠিক জানি না| কেন মজিদ, এ সকল কথা তুমি আমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছ?
ম| ফাঁসীর দড়ী থেকে নিজের গলাটা বাঁচাইবার জন্য, আর কেন? আমি বিভ্রাটে পড়িয়াছি; জোহেরা! কি করিব, কিছুই ভাবিয়া ঠিক করিতে পারিতেছি না| শুনিলাম, মেহেদী-বাগানে যে স্ত্রীলোকটি খুন হইয়াছে, তাহার নাম দিলজান| সে মনিরুদ্দীনের রক্ষিতা| গত বুধবার সন্ধ্যার পূর্ব্বে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে তাহাকে আমি একবার দেখিয়াছিলাম| সেইদিনই রাত এগারটার পর সেখানে আমার সহিত আর একটি স্ত্রীলোকের দেখা হইয়াছিল| দেবেন্দ্রবিজয়ের ধারণা, রাত্রে যাহার সহিত আমার দেখা হইয়াছিল, সে স্ত্রীলোক দিলজান ভিন্ন আর কেহই নহে; কিন্তু প্রকৃত পক্ষে সে দিলজান নহে| সেইদিন রাত বারটার সময়ে আমি মনিরুদ্দীনের বাড়ী হইতে বাহির হইয়া যাই| মেহেদী-বাগানেই আমাকে যাইতে হইয়াছিল; সেইখানে মোবারক উদ্দীনের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়| যেখানে সাক্ষাৎ হয়, তাহার অল্পদূরেই দিলজানের লাস পাওয়া গিয়াছে| যদি এখন আমি এই হত্যাপরাধে ধৃত হই, ঘটনাচক্রে আমাকেই দোষী হইতে হইবে| রাত্রে আমার সহিত যে, দিলজানের আর দেখা হয় নাই, এ কথা আমি কিছুতেই সপ্রমাণ করিতে পারিব না-কেহই ইহা বিশ্বাস করিবে না| প্রতিজ্ঞালঙ্ঘন ভিন্ন তখন নিজের নির্দ্দোষতা সপ্রমাণ করিবার আর কোন উপায়ই থাকিবে না|
জো| সকলই বুঝিলাম; কিন্তু ইহাতে সৃজান বিবির কি সংশ্রব আছে, বুঝিতে পারিলাম না|
ম| না, তা’, আমি মনে করি নাই| (চিন্তিতভাবে) প্রকৃতপক্ষে তা’ আমি মনে করি নাই| তবে আমি জানিতে চাই, মনিরুদ্দীন সে রাত্রে কখন কোথায় ছিল-কি করিয়াছিল-কোথায় গিয়াছিল, এ সকল সংবাদ সংগ্রহ করা এখন আমার অত্যন্ত দরকার হইতেছে| আমি এখন ঘটনাচক্রে কিরূপ অবস্থাধীন হইয়া পড়িয়াছি, কি গুরুতর বিপদ্ চারিদিক্ হইতে আমাকে গ্রাস করিবার জন্য ব্যগ্র হইয়া উঠিয়াছে-বুঝিতে পার নাই কি? যদি আমি এখন ধরা পড়ি, অথচ মনিরুদ্দীন ফিরিয়া না আসে, তাহা হইলে আর আমার নিস্তার নাই|
জো| কেন?
ম| মনিরুদ্দীন ফিরিয়া না আসিলে, কিছুতেই আমি নিজেকে নির্দ্দোষ বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে পারিব না|
জো| তুমি কি সত্যই নির্দ্দোষ?
ম| আমাকে কি সন্দেহ হয়?
জো| না|
ম| তবে আর বেশি কিছু জিজ্ঞাসা করিয়ো না|
তাহার পর অন্যান্য দুই-একটি কথার পর মজিদ খাঁ বিদায় গ্রহণ করিলেন| জোহেরা দ্রুতপদে বাটীমধ্যে প্রবেশ করিল| এবং শ্রীশচন্দ্র অত্যন্ত উৎসাহের সহিত দেবেন্দ্রবিজয়ের সহিত দেখা করিতে ছুটিল|

২.১০. দশম পরিচ্ছেদ – ঘটনা-সূত্র

শ্রীমান্ শ্রীশচন্দ্রের স্মরণশক্তি অত্যন্ত প্রখর| শিক্ষকের নিকটে মেধাবী ছাত্র যেমন মুখস্থ পাঠ আবৃত্তি করিতে থাকে, ঠিক তেমনই ভাবে শ্রীশচন্দ্র, মজিদ ও জোহেরার কথোপকথনের যাহা কিছু শুনিয়াছিল, দেবেন্দ্রবিজয়ের সম্মুখে দাঁড়াইয়া সমুদয় ‘জলবত্তরলং’ বলিয়া গেল| অধিকন্তু তাঁহারা যেরূপভাবে হাত-মুখ নাড়িয়া কথা কহিয়াছিলেন, সুদক্ষ অভিনেতার ন্যায় শ্রীশ তাহাও দেবেন্দ্রবিজয়কে ঠিক প্রদর্শন করিতে ত্রুটি করিল না| ইহাতে অনেক স্থলে শ্রোতা দেবেন্দ্রবিজয়কে অতিকষ্টে হাস্যসংবরণ করিতে হইয়াছিল|
শ্রীশের মুখে দেবেন্দ্রবিজয় যাহা শুনিলেন, তাহাতে এ পর্য্যন্ত তিনি এই হত্যাকাণ্ডের যে সকল সূত্র বাহির করিয়াছিলেন, সেই সূত্রাবলীতে আর একটি নূতন গ্রন্থির সংযোগ হইল| অনন্তবিধ চিন্তায় তাঁহার মস্তিক পূর্ণ হইয়া গেল| কিছুতেই তিনি ভাবিয়া ঠিক করিতে পারিলেন না, মজিদ কেন এরূপ ব্যবহার করিতেছেন| খুনের রাত্রিতে দিলজানের সহিত যে তাঁহার দেখা হইয়াছিল; কেন তিনি ইহা কিছুতেই এখন স্বীকার করিতে চাহেন না? কারণ কি? তিনি এখন বলিতেছেন, যে স্ত্রীলোকের সহিত তাঁহার দেখা হইয়াছিল, সে দিলজান নহে; ইহাতে তাঁহার কি ফলোদয় হইতেছে? কে তাঁহার কথা বিশ্বাস করিবে? যাহাতে তাঁহার প্রতি কাহারও সন্দেহ না হয়, সেইজন্য তিনি এই মিথ্যাকথা বলিয়া অনর্থক নির্দ্দোষ সপ্রমাণ করিবার চেষ্টা করিতেছেন| রাত্রি এগারটার পর গনির মা দিলজানকে পুনরায় আসিতে দেখিয়াছে| আর গনির মা’র যদি ভুলই হয়-সে দিলজান না হইয়া যদি আর কেহই হয়-তাহা হইলে কে সে স্ত্রীলোক? মজিদের কথার ভাবে বুঝিতে পারা যাইতেছে, রাত্রিতে সেখানে এমন কোন স্ত্রীলোক আসিয়াছিল, যাহার নাম প্রকাশ করিলে সম্ভ্রমের হানি হইতে পারে| ভাবে বোধ হয়, মজিদ যেন কোন ভদ্রমহিলার সম্ভ্রম রক্ষার জন্যই এইরূপ ব্যগ্রতা প্রকাশ করিতেছেন| যদি তাহা সত্য হয়, সেই স্ত্রীলোক দিলজান না হইতে পারে| দিলজান ভদ্রমহিলা ছিল না, এবং হানি হইতে পারে-এমন সম্ভ্রমও তাহার কিছুই ছিল না| কে তবে সেই স্ত্রীলোক? কাহার জন্য মজিদ এমন বিব্রত হইয়া উঠিয়াছেন? মজিদ অতি অদ্ভুত প্রকৃতির লোক-এ জগতে তাঁহার দ্বিতীয় নাই দেখিতেছি| আমাকে তাঁহার অন্তরের ভিতরে ভাল করিয়া প্রবেশ করিতে হইবে; নতুবা সহজে তাঁহাকে ঠিক বুঝিতে পারিব না|
এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে ঝাঁ করিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের আর একটা কথা মনে পড়িয়া গেল| তবে কি সেদিন রাত্রে মনিরুদ্দীনের বাটীতে যে স্ত্রীলোকের সহিত মজিদের সাক্ষাৎ হইয়াছিল, সে সৃজান বিবি? হয়তো সৃজান মনিরুদ্দীনের সহিত দেখা করিতে আসিয়াছিল, ঘটনাক্রমে মজিদের সহিত তাহার দেখা হইয়া গিয়াছিল| মজিদ হয়তো ভিতরের কথা সকলই জানিতেন| যাহাতে সৃজান বিবি এই গর্হিত সঙ্কল্প পরিত্যাগ করে, সেজন্য হয় ত তাহাকে অনেক বুঝাইয়া থাকিবেন; এবং সেই কথা লইয়াই হয়তো দুজনের বচসা হইয়া থাকিবে| অসম্ভব নয়, তাহাই ঠিক-তেমন গভীর রাত্রে ভিন্ন স্থানে গিয়া নির্জ্জনে একজন পর-পুরুষের সহিত সাক্ষাৎ করা কোন ভদ্রমহিলার পক্ষে একান্ত অবৈধ ও নিন্দনীয় সে কথা সাধারণে প্রকাশ করাও ঠিক নহে| এই সকল কারণ বশতঃ অবশ্যই মজিদ এখন কথা একেবারে চাপিয়া যাইবার চেষ্টা করিতেছেন| এখন তাহা প্রকাশ করিলে সৃজান বিবির সম্ভ্রম হানি না হইতে পারে; কেন না, সে নিজের মান-সম্ভ্রম একেবারে জলাঞ্জলি দিয়া মনিরুদ্দীনের সহিত উধাও হইয়া গিয়াছে; কিন্তু মজিদের চরিত্রে সকলেই দোষারোপ করিবে|
এই অনুমান সত্য হইলেও ইহার সহিত দিলজানের খুনের কি সংশ্রব আছে? কিছুই না| দিলজানকে কে খুন করিল? সৃজান বিবি কি তবে দিলজানকে খুন করিয়াছে? না, তাহা কখনই সম্ভবপর নহে|
শ্রীশের মুখে দেবেন্দ্রবিজয় যে সকল কথা শুনিয়াছিলেন, তাহাই মনে মনে আলোচনা করিতে লাগিলেন| সহসা তাঁহার চিন্তাস্রোত ভিন্ন পথে প্রবেশ করিল| তিনি ভাবিতে লাগিলেন, সৃজান বিবি যে শেষ রাত্রিতে গৃহত্যাগ করিয়াছিল, মজিদ ও জোহেরার কথোপকথনে তাহার প্রমাণও পাওয়া যাইতেছে| তাহা হইলে সেদিন রাত্রে এগারটার পর যে রমণীর সহিত মজিদের দেখা হইয়াছিল,-সে কখনই সৃজান হইতে পারে না| এখন আমাকে সন্ধান করিয়া বাহির করিতে হইবে, মনিরুদ্দীনের বাটীতে রাত্রিতে মজিদের সহিত যাহার সাক্ষাৎ হইয়াছিল সেই রমণীই বা কে; এবং এদিকে ঠিক সেই রাত্রে যে রমণী সৃজানের সহিত দেখা করিতে গিয়াছিল, সেই রমণীই বা কে| আরও সন্ধান করিয়া দেখিতে হইবে, ঠিক কোন্ সময়ে সৃজান গৃহত্যাগ করিয়াছিল| এই সকলের প্রকৃত সন্ধান যতক্ষণ না পাইতেছি, ততক্ষণ আমাকে অন্ধকারের মধ্যেই থাকিতে হইবে| আর যদি কাল গোলাদিঘীতে গিয়া কার্য্যোদ্ধার করিতে পারি, তাহা হইলে সকল রহস্যই প্রকাশ পাইবে-আর কোন সন্ধানের আবশ্যকতা থাকিবে না| হত্যাকারী বড় সহজ নহে; তাহাকে যে সহজে ধরিতে পারিব, এমন বোধ হয় না| উপন্যাসের সর্ব্বশক্তিমান্, সর্বজ্ঞ নিরাকার গোয়েন্দাদিগের মত ক্ষমতা এবং প্রভাব মাংসাস্থিবিশিষ্ট কাহারও থাকে না-আমারও নাই| গ্রন্থকারের কল্পনায় তাহারা সকল বিষয়েই অবলীলাক্রমে কৃতকার্য্যে হইতে পারে; সকল বিষয়েই অমানুষিক প্রভাব বিস্তার করিতে পারে|
তাহাদিগের মত অনন্যসুলভ ক্ষমতা, সর্ব্বজ্ঞতা আমার মত এ শরীরী গোয়েন্দা কোথায় পাইবে? অনেকস্থলে আমার ভ্রম হইতে পারে, ভ্রমক্রমে আমি ভিন্ন পথেও চালিত হইতে পারি; এবং সকল বিষয়ে কৃতকার্য্যে না হইতেও পারি| তবে চেষ্টা করিলে এক-সময়ে-না-এক-সময়ে যে, যথাস্থানে আমি উপনীত হইতে পারিব, এ বিশ্বাস আমার নিজের মনে খুব আছে| হয় ত ইহাতে দিলজানের হত্যাকারীর কোন একটা উদ্দেশ্য আছে| যে উদ্দেশ্যই থাক্ না কেন, আমি কাল রাত্রি নয়টার পর গোলদিঘীতে গিয়া তাহার সঙ্গে দেখা করিব-ধরিবার চেষ্টা করিব| দেখা যাক্, কাজে কতদূর কি করিতে পারি|
দেবেন্দ্রবিজয় পকেট হইতে নোটবুকখানি টানিয়া বাহির করিয়া এইরূপ মন্তব্যগুলি লিখিতে লাগিলেন;-
১| হত্যাকারী কোন্ উদ্দেশ্যে এরূপ পত্র লিখিতেছে? আমাকে যদি সে ভয়ই না করে, তবে হাজার টাকার উৎকোচ দিতে চাহে কেন?
কাল রাত নয়টার পর গোলদিঘীতে গেলে, তাহা অনেকটা বুঝিতে পারিব| যদি তাহার উদ্দেশ্যটা মন্দ হয়-বলিতে পারি না-তাহাকে ধৃত করিবার জন্য লোক মোতায়েন রাখিতে হইবে|
মন্তব্য-কাল রাত নয়টার পর গোলদিঘীতে যাইতে হইবে|
২| গত বুধবার (যে রাত্রে দিলজানের লাস মেহেদী-বাগানে পাওয়া গিয়াছিল) রাত্রি এগারটার হইতে বারটার মধ্যে কোন্ স্ত্রীলোক মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে গিয়াছিল, তাহার সন্ধান গ্রহণ|
একমাত্র মজিদের নিকটে সে সন্ধান পাওয়া যাইতে পারে| গনির মা বলিতেছে, দিলজান; কিন্তু মজিদ তাহা একেবারে উড়াইয়া দিতেছেন| এখন দেখিতে হইবে, তদুভয়ের মধ্যে কে প্রকৃত মিথ্যাবাদী|
মন্তব্য-মজিদের সহিত দেখা করিয়া যে কোন কৌশলে হউক, সেই স্ত্রীলোকের নামটি বাহির করিয়া লইতে হইবে|
৩| সেই খুনের রাত্রিতে যে স্ত্রীলোক সৃজান বিবির সহিত দেখা করিতে গিয়াছিল, তাহার আকৃতি কিরূপ, বয়স কত, যদি সম্ভবপর হয়, নামটা জানিবার জন্য চেষ্টা করিতে হইবে| এই খুনের মাম্লায় কোন-না-কোন বিষয়ে সেই স্ত্রীলোক জড়িত থাকিতে পারে| মুন্সী জোহিরুদ্দীনের বাটীর কোন-না-কোন ভৃত্যের নিকটে ইহার সন্ধান হইতে পারে|
মন্তব্য-ভৃত্যদিগের মধ্যে যে এ বিষয়ের কিছু জানে, এমন একজনকে হস্তগত করিতে হইবে|
৪| সেই খুনের রাত্রে ঠিক কোন্ সময়ে দিলজান গৃহত্যাগ করিয়াছিল; গৃহত্যাগ করিবার পূর্ব্বে ও পরে কখন কোথায় গিয়াছিল-কোথায় কি করিয়াছিল, তাহার গতিবিধির অনুসন্ধান করিয়া দেখা খুব প্রয়োজন|
চেষ্টা করিলে তাহাদের কোন ভৃত্যের নিকটে ইহারও কিছু-না-কিছু জানিতে পারিব|
মন্তব্য-রহস্যটা একটু পরিষ্কার হইয়া আসিলে-ঘটনা-সূত্রে ইহা আপনা হইতেই সব প্রকাশ হইয়া পড়িবে|
৫| যে বিষাক্ত ছুরিকায় দিলজান খুন হইয়াছে, সেই ছুরিখানা কোথায় গেল, তাহা খুঁজিয়া বাহির করা চাই|
সম্ভব ইহা মজিদের নিকটে পওয়া যাইবে|
মন্তব্য-গোপনে তাহার শয়ন-গৃহ অনুসন্ধান করিতে হইবে| নিজের দ্বারা বিশেষ সুবিধা হইবে না; অপর কাহারও দ্বারা-শ্রীশ আছে|
৬| দিলজানের পূর্ব্বজীবনী সংগ্রহ করিতে হইবে|
লতিমন বাইজীর নিকটে কিছু কিছু সংগ্রহ হইতে পারে| দিলজান অনেক দিন তাহার নিকটে ছিল; অবশ্যই দিলজানের কিছু কিছু খবর লতিমন জানে|
মন্তব্য-লতিমন বাইজীর সঙ্গে আর একবার দেখা করিতে হইবে|

২.১১. একাদশ পরিচ্ছেদ – বিপদে

পরদিন রাত্রি নয়টার সময় দেবেন্দ্রবিজয় গোলদিঘীতে উপস্থিত হইলেন| ইতিপূর্ব্বে তিনি স্থানীয় থানা হইতে কয়েকজন অনুচর ঠিক করিয়া লইয়াছিলেন| তাহাদিগকে স্থানে স্থানে লুকাইয়া রাখিলেন; এবং নিজে গোলদিঘীর ভিতরে গিয়া হত্যাকারীর অপেক্ষা করিতে লাগিলেন|
ক্রমে রাত্রি দশটা বাজিয়া আসিল| দেবেন্দ্রবিজয় কোথায় কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না-হত্যাকারী আসিল না| সম্মুখবর্ত্তী পথ দিয়া পথিকগণ যে যাহার গন্তব্যস্থানে যাইতেছে; কত লোক যাইতেছে-আসিতেছে-কাহাকেও তাঁহার প্রতি লক্ষ্য করিতে দেখিলেন না-সকলেই আপন মনে ফিরিতেছে|
আকাশে চাঁদ উঠিয়াছে| অষ্টমীর অর্দ্ধচন্দ্রের কিরণ তেমন উজ্জ্বল নহে-কেবল যেন একটু অন্ধকার-মাখা হইয়া চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছে| তুলারাশিবৎ লঘু মেঘখণ্ডগুলি আকাশতলে দুষ্ট বালকের মত উদ্দামভাবে ছুটাছুটি করিতেছে| চন্দ্রদেব মৃদুহাস্যে সেই অশিষ্ট মেঘশিশুদিগের সেই ক্রীড়া দেখিতেছেলন; কখনও বা কহাকেও আপনার বুকের উপরে টানিয়া লইতেছিলেন| অন্যত্র অদূরস্থিত অশ্বত্থশাখাসীন কলকণ্ঠ পাপিয়ার ঝঙ্কৃত মধুর স্বরতরঙ্গ আকাশ ভেদ করিয়া উঠিতেছিল এবং দক্ষিণ দিক্ হইতে বৃক্ষশাখা কাঁপাইয়া, পথের ধূলিরাশি উড়াইয়া হু হু শব্দে বাতাস বহিয়া আসিতেছিল| স্থান ও কাল উভয়ই সুন্দর| দেবেন্দ্রবিজয়ের সেদিকে লক্ষ ছিল না-তিনি হত্যাকারীর অপেক্ষা করিতেছিলেন| এবং চারিদিকে তাঁহার সতর্কদৃষ্টি ঘন ঘন সঞ্চালিত হইতেছিল|
চন্দ্র অস্ত গেল| ক্রমে রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর উর্ত্তীণ হইল-তথাপি কেহই আসিল না|
দেবেন্দ্রবিজয় হতাশ হইলেন; নিজের অনুচরবর্গকে বিদায় করিয়া দিলেন| এবং নিজে শীঘ্র বাড়ী পৌঁছিবার জন্য একটা গলিপথে প্রবেশ করিলেন| পথ একান্ত নির্জ্জন| চারিদিকে গভীর অন্ধকার-গলিপথে অন্ধকার গভীরতর; গগনস্পর্শী বৃক্ষগুলির নিম্নে অন্ধকার আরও গভীর হইয়া ছড়াইয়া পড়িয়াছে| সেই গভীর অন্ধকারবেষ্টিত সমুন্নশীর্ষ বৃক্ষসমূহের চতুষ্পার্শ্বে অসংখ্য খদ্যোৎ,হীরকখণ্ডবৎ জ্বলিতেছে-নিবিতেছে-নিবিয়া আবার জ্বলিতেছে| কেহ কোথায় নাই-কেবল অদূরে কতকগুলা শৃগাল ও কুকুর দল-বাঁধিয়া চীৎকার করিয়া ছুটাছুটি করিতেছে| দেবেন্দ্রবিজয় ক্রমশঃ অগ্রসর হইয়া চলিলেন| সহসা একটা পেচক কর্কশকণ্ঠে হাঁকিয়া তাঁহার মাথার উপর দিয়া উড়িয়া গেল| দেবেন্দ্রবিজয় সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করিলেন না, পূর্ব্ববৎ দ্রুতবেগে চলিতে লাগিলেন|
এমন সময়ে কে তাঁহাকে পশ্চাদ্দিক হইতে বলিল, “আমার সঙ্গে চালাকি-এইবার মজাটা দেখ!” দেবেন্দ্রবিজয় যেমন পশ্চাতে ফিরিয়াছেন, দেখিলেন একটা পাহারাওয়ালা উদ্যত সুদীর্ঘ বংশযষ্টিহস্তে দাঁড়াইয়া| দেবেন্দ্রবিজয় আত্মরক্ষারও সময় পাইলেন না-সেই উদ্যত যষ্টি সবেগে তাঁহার মস্তকের উপরে আসিয়া পড়িল|
তিনি একান্ত নিঃসহায়ভাবে সেইখানে মুর্চ্ছিত হইয়া পড়িলেন|

২.১২. দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – সংজ্ঞালাভে

দেবেন্দ্রবিজয়ের যখন জ্ঞান হইল, তখন রাত্রি শেষ হইয়া আসিয়াছে| তিনি হস্তপদাদি-বিক্ষেপপূর্ব্বক চক্ষুরন্মীলন করিবামাত্র দুইটা শৃগাল তাঁহার মুখের নিকট হইতে সভয়ে দূরে পলাইয়া গেল| দেবেন্দ্রবিজয় ধীরে ধীরে উঠিয়া বসিলেন| দারুণ আঘাতে তাঁহার মস্তকের একস্থানে কাটিয়া গিয়াছিল;এবং রক্তে তাঁহাদের পরিধেয় বস্ত্রাদি ভিজিয়া গিয়াছিল|
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, সারারাত তিনি অজ্ঞান অবস্থায় একান্ত নিঃসহায়ভাবে একা পথিমধ্যে পড়িয়া আছেন| সুযোগ বুঝিয়া শৃগাল কুক্কুর দন্তনখরসংযোগে যে এখনও তাঁহার দেহের মাংস কাটিয়া খণ্ড-বিখণ্ড করিয়া দেয় নাই, সেজন্য তিনি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করিলেন, এবং ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলেন|
এদিকে রাত্রি শেষ হইয়া আসিয়াছে| ঊষার রক্তরাগ তখনও পূর্ব্বাকাশে অনুরঞ্জিত করে নাই| পাখীরা জাগিয়া, কুলায়ে বসিয়া কূজন আরম্ভ করিয়াছে| এবং ঊষার স্নিগ্ধবাতাস বহিয়া আসিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের ললাট স্পর্শ করিতেছে| তখনও দেবেন্দ্রবিজয়ের মাথা ঘুরিতেছে-শরীর একান্ত দুর্ব্বল| তাঁহার মনে পড়িল, তিনি মূর্চ্ছিত হইবার পূর্ব্বমুহূর্ত্তে একজন পাহারাওয়ালাকে উদ্যত বংশযষ্টি হস্তে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়াছিলেন| তাহারই উদ্যত বংশদণ্ড মস্তকে নিপতিত হওয়ায় তাঁহার যে এই দুর্দ্দশা ঘটিয়াছে, তাহা নিশ্চিত; কিন্তু একজন পাহারাওয়ালা যে কেন তাঁহার প্রতি এমন সদ্ব্যবহার(?) করিল, ইহার মর্ম্মগ্রহণ তাঁহার অত্যন্ত কঠিন বোধ হইল| একবার ভাবিলেন, অর্থলোভে সামান্য বেতনভোগী পাহারাওয়ালাদিগের মধ্যে কেহ কেহ এরূপে অর্থসঞ্চয় করিতে পারে| দেবেন্দ্রবিজয় জামার পকেটে হাত দিলেন| তাঁহার যে কয়েকটি টাকা সঙ্গে ছিল, তাহা যথাস্থানেই রহিয়াছে; অঙ্গুলির দিকে দৃষ্টি করিলেন, হীরার আংটীটাও যথাস্থানে রহিয়াছে; এ পর্য্যন্ত কেহ তাহা খুলিয়া লয় নাই| বুক-পকেটে দুইখানি দশ টাকার নোট ছিল. দেবেন্দ্রবিজয় তাহাও টানিয়া বাহির করিয়া দেখিলেন| সেই নোট দুখানির সঙ্গে আর একখানি কাগজ দেখিতে পাইলেন; রাত্রিশেষের অস্পষ্টালোকে তিনি বুঝিতে পারিলেন না, সেখানি কি কাগজ! পকেট হইতে দিয়াশলাই-কাঠি বাহির করিয়া জ্বালিয়া দেখিলেন, একখানি পত্র| পত্রখানি খুব দ্রুতহস্তে উড্পেন্সিলে লেখা|
দেবেন্দ্রবিজয় দিয়াশলাই-কাঠি জ্বালিয়া জ্বালিয়া পত্রখানি পড়িয়া শেষ করিতে লাগিলেন;-
“দেবেন্দ্রবিজয়!
আজ তোমাকে একটু শিক্ষা দিলাম| যদি ইহাতেও তোমার আক্কেল না হয়, আবার একদিন আমার হাতে এমন শিক্ষা পাইবে, যাহা তুমি সারাজীবন ভুলিতে পারিবে না|
তুমি এখন অজ্ঞান হইয়া আমার পায়ের কাছে লুটাইয়া পড়িয়াছ| মনে করিলে আমি এখনই তোমার লীলাখেলা একেবারে শেষ করিয়া দিতে পারি; তোমার দেহ খণ্ড-বিখণ্ড করিয়া কুক্কুর শৃগালের ভোজনেরও সুবন্দোবস্ত করিতে পারি| অনুগ্রহ করিয়া তাহা করিলাম না, এরূপ মনে করিও না-তোমার মত একটা নির্ব্বোধ গোয়েন্দাকে খুন করিয়া আমার মত ব্যক্তির লাভ কি?
তুমি মনে করিয়াছিলে, সহজেই আমার হাতে হাতকড়ি লাগাইবে| কি স্পর্দ্ধা তোমার ! আমাকে তেমন নিরীহ ভালমানুষটি পাও নাই| তুমি বেড়াও ডালে ডালে, আমি বেড়াই পাতায় পাতায়-আমি তোমাকে আমার যোগ্য-প্রতিদ্বন্দ্বী বোধ করি না, তোমাকে আমি ক্ষুদ্র-কীটাণুকীট মনে করি| যখনই আমি মনে করিব, তখনই তোমাকে পদদলিত করিয়া মারিতে পারিব; কিন্তু সে ইচ্ছা আমার আদৌ নাই| তাহা না হইলে তোমার নাম এতদিন কোন্কালে এ জগতের জীবিত-মনুষ্যের তালিকা হইতে একেবারে মুছিয়া যাইত| তবে তুমি একান্তই বাড়াবাড়ি করিয়া তুলিয়াছিলে বলিয়া, তোমার মত রাস্কেলকে কিছু শিক্ষা দেওয়া গেল|
আমি ত পূর্ব্বেই বলিয়াছিলাম, আমার সহিত তুমি কিছুতেই পারিয়া উঠিবে না| তুমি আমাকে ধরিবার জন্য যে ফাঁদ পাতিয়াছিলে, তাহা আমি পূর্ব্বেই জানিতে পারিয়াছিলাম| আমার সঙ্গে “পাল্লা” দেওয়া তোমার মত অর্ব্বাচীনের কর্ম্ম নহে| তোমার মত নিরেট বোকা এ দুনিয়ায় দু’টী নাই| আমি ইচ্ছা করিয়া তোমার সম্মুখে গেলাম, তোমার সহিত কথা কহিলাম, তুমি আমাকে গোয়েন্দার চিহ্ণ দেখাইয়া তোমার সাহায্য করিবার লম্বা হুকুম জারী করিলে; কই, তুমি আমাকে ধরিতে পারিলে কি? আমি জানি, তোমার মত অকর্ম্মা নির্ব্বোধকে ভয় করিবার কোন কারণই নায়| তোমার দ্বারা আমার কোন অনিষ্ট হইতে পারে, যদি এরূপ আশঙ্কা কিছু থাকিত, তাহা হইলে আজই তোমার দেহ হইতে মাথাটা বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িত| সাবধান, আর কখনও আমার কছে গোয়েন্দাগিরি ফলাইতে চেষ্টা করিয়ো না| এইবার যদি তুমি আমার কথা না শোন, তাহা হইলে নিশ্চয় জানিবে, তোমার আয়ুটা একান্ত সংক্ষিপ্ত হইয়া আসিয়াছে| সাবধান-সাবধান-সাবধান!
সেই
মেহেদী-বাগানের খুনী |”
“পুঃ-তুমি মজিদ খাঁকে অন্যায় সন্দেহ করিতেছ; তিনি একজন নিরীহ ভদ্রলোক| তোমার এ খুনী মোকদ্দমার সহিত তাঁহার কোন সংশ্রব নাই| এতকাল গোয়েন্দাগিরি করিতেছ, আর ভালমন্দ লোক দেখিয়া চিনিতে পার না?”
পত্রপাঠে দেবেন্দ্রবিজয় চিন্তিত হইলেন| ভাবিতে লাগিলেন লোকটা খুব বাহাদুর বটে, আমাকে আজ খুব ঠকাইয়া গিয়াছে; পাহারাওয়ালার ছদ্মবেশে আমার অনুচর সাজিয়া আমার সহিত কথা কহিয়া গেল, আমার সমুদয় গুপ্ত অভিসন্ধি জানিয়া গেল-কি আশ্চর্য্য! আমি তাহাকে তিলমাত্র সন্দেহ করিতে পারিলাম না| এই মহাত্মা যদি পুলিস লাইনে কাজ করিতেন, বোধ করি, খুব একজন পাকা নামজাদা উচ্চ শ্রেণীর গোয়েন্দা হইতে পারিতেন; লোকটার অতুল বুদ্ধি দেখিতেছি| এখন লোকটাকে দেখিবার জন্য আমাকে প্রাণপণ করিতে হইবে| মজিদ কি এই পত্র লিখিয়াছে? অসম্ভব নয়-শেষের কয়েকটি পংক্তি পড়িয়া যেন তাহাই মনে হয়| মজিদ যে নির্দ্দোষ, নিরীহ ভদ্রলোক, হত্যাকারী কোন্ উদ্দেশ্যে ইহা লিখিবে? যাহাতে তাহার উপর আমার আর সন্দেহ না থাকে, সেজন্য সে এরূপ লিখিতে পারে| ইহাও একটা মন্দ চতুরতা নহে! দেখা যাক্ এই হত্যাকাণ্ডের সত্য আবিষ্কার করিবার জন্য আমাকে পৃথিবীর একপ্রান্ত হইতে অপরপ্রান্তে ছুটিতে হয়-এমন কি যমালয়ের দ্বার পর্য্যন্তও অগ্রসর হইতে হয়-আহাও আমি করিব| সে আমার হাত হইতে সহজে পরিত্রাণ পাইবে না-আমার নাম দেবেন্দ্রবিজয়! যেরূপ হউক, ইহার প্রতোশোধ গ্রহণ করিবই| যে কাজ দশ দিনে শেষ হইবার, এখন তাহা আমাকে দুই দিনে শেষ করিয়া ফেলিতে হইবে| দুই দিনের মধ্যে সেই নারীঘাতক পিশাচকে সমুচিত শিক্ষা দিতে হইবে|
উৎসাহের সহিত দেবেন্দ্রবিজয় উঠিয়া দাঁড়াইলেন; দেখিলেন, প্রভাতোদয় হইয়াছে| নবীন সূর্য্যের কিরণলেখা আকাশের গায়ে অনেক দূর পর্য্যন্ত ছড়াইয়া পড়িয়াছে| উচ্চবৃক্ষশীর্ষসমূহ হিরণ্য কররঞ্জিত| বৃক্ষশাখায় বসিয়া পাখীরা মধুর কাকলী বর্ষণ করিতেছে| বিরাট বিশ্ব যেন চারিদিক্ হইতে অশান্ত জনকোলহলে একেবারে জাগিয়া উঠিয়াছে| দেবেন্দ্রবিজয় গলির ভিতর হইতে অতি কষ্টে বাহির হইয়া বাটীতে ফিরিবার জন্য একখানি গাড়ীভাড়া করিলেন এবং তন্মধ্যে উঠিয়া বসিলেন| ঠিক সময়ে দূরবর্ত্তী ডোমপাড়া হইতে বাউলের সুরে কে গায়িয়া উঠিল;-
“সামাল মাঝি এই পারাবারে|
(ভারি বান্ ডেকেছে সাগরে)
(এবার) তোমার দফা হলো রফা, প’ড়ে গেলে ফাঁপরে”|

৩.০১ – প্রথম পরিচ্ছেদ – আর এক উদ্যম

তৃতীয় খণ্ড
নিয়তি – রহস্যময়ী

Mme-de Mon [aside], A clue-another clue-that I
will follow,
Until it lead to the throne?
Lord Lytton- The Duchess de la Vulliere. Act III, Scene III.

প্রথম পরিচ্ছেদ
আর এক উদ্যম

দেবেন্দ্রবিজয় বাটীতে পৌঁছিয়া বস্ত্রাদি পরিবর্ত্তন করিলেন। তখনই ডাক্তারের কাছে খবর গেল। ডাক্তার আসিয়া তাঁহার মস্তকের ক্ষতস্থান বাঁধিয়া দিয়া গেলেন।
অপরাহ্নে দেবেন্দ্রবিজয় শ্রীশচন্দ্রকে নিকটে ডাকিলেন। তিনি লতিমন বাইজীর বাটীতে যে ছুরিখানি পাইয়াছিলেন আল্মারীর ভিতর হইতে সেই ছুরিখানি বাহির করিয়া বলিলেন, “আমার হাতে এটা দেখিতে পাইতেছ?”
শ্রীশচন্দ্র মাথাটা একপার্শ্বে খুব অবনত করিয়া মনোভাব প্রকাশ করিল-মুখে কিছু বলিল না।
দেবেন্দ্রবিজয় বলিতে লাগিলেন, ” তোমাকে এবার একটা বড় শক্ত কাজ করিতে হইবে। কল্যকার সেই মজিদের কথা তোমার খুব মনে আছে বোধ করি।
সেই ভদ্রলোকের বাড়ীতে ঠিক এই রকম আর একখানি ছুরি আছে; যে কোন প্রকারে সেই ছুরিখানি বাহির করিয়া আনিতে হইবে। পারিবে?”
শ্রীশচন্দ্রের ওষ্ঠাধর কুঞ্চিত হইল। মুখে একবার গভীর চিন্তার রেখা ফুটিয়া উঠিল। ক্ষণপরে পাকা বুদ্ধিমানের ন্যায় মস্তক সঞ্চালনপূর্ব্বক বলিল, “খুব পারিব?”
নবীন গোয়েন্দা শ্রীশচন্দ্র কিরূপ কৌশলে কার্যে্যাদ্ধার করিবে, ঠিক করিতে না পারিয়া, প্রবীন দেবেন্দ্রবিজয় সবিস্ময়ে শ্রীশের মুখের দিকে চাহিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিরূপে?”
শ্রীশ বলিল,”যেরূপে পারি। যদি ছুরিখানি মজিদ খাঁর বাড়ীতে থাকে, আমি নিশ্চয়ই সন্ধান ক’রে বাহির করিব। ত’ যদি না পারি, তবে এতদিন আপনার কাছে প’ড়ে আছি কেন? আজ সন্ধ্যার পর মুসলমান ছেলেদের মত কাপড়-চোপড় প’রে, তার দরজায় হত্যা দিয়ে পড়ব-মড়ার মত প’ড়ে থাক্ব। যেন না খেতে পেয়ে মরতে বসেছি, ঠিক এমন ভাব দেখাব। অবশ্যই ছেলে-মানুষ দেখে ,মজিদ আমাকে কিছু খেতে দিবার জন্য বাড়ীর ভতরে নিয়ে যাবে। একবার বাড়ীর ভিতরে যেতে পারলে শর্ম্মারামকে আর পায় কে-কাজ না শেষ ক’রে, শর্ম্মারাম সে বাড়ী থেকে সহজে বেরুবে না।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “যেরূপে পার, কার্য্যোদ্ধার করা চাই। খুব সবধান, ছুরিখানা যদি পাওয়া যায়, খুব সবধানে রাখিবে; বিষাক্ত ছুরি-একটুখানি কাটিয়া গেলে আর রক্ষা নাই-মনে থাকে যেন।”
শ্রীশচন্দ্র বলিল, “খুব মনে থাকিবে।”

৩.০২ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – উদ্যমের ফল

সন্ধ্যা উত্তীর্ণ গিয়াছে। আকাশে মেঘ, তন্নিম্নে অন্ধকার, মেঘও অন্ধকার যন একসঙ্গে মিশিয়াছে। মেঘে সনাথনক্ষত্রমালা ঢাকা পড়িয়াছে। এবং অন্ধকারে গগনতলস্পর্শী বড় বড় গাছগুলা প্রকাণ্ড দৈত্যের ন্যায় প্রতীয়মান হইতেছে।
এমন সময়ে শ্রীশচন্দ্র দীন মুসলমান বালকের বেশে বাটী হইতে বাহির হইল। একেবারে সরাসরি মজিদের বাড়ীর সম্মুখে গিয়া উপস্থিত হইল। গোপনে খবর লইল, মজিদ খাঁ বাড়ীতে নাই-সান্ধ্য-ভ্রমণে বাহির হইয়াছেন। শ্রীশচন্দ্র মনে মনে বুঝিল, খাঁ সাহেব তাহা হইলে এখনই ফিরিবেন। দ্বার সম্মুখস্থ সোপানের উপরে তাড়াতাড়ি শুইয়া পড়িল।
অনতিবিলম্বে মুষলধারে ভয়ানক বৃষ্টি আরম্ভ হইল। মেঘের গর্জ্জনে দিগবলয় পর্য্যন্ত কম্পিত হইতে লাগিল। এবং ঘন ঘন ক্ষণপ্রভার তীব্র দীপ্তিতে বিরাট বিশ্ব আলোকিত হইতে লাগিল। ইহাতে শ্রীশচন্দ্র সুবিধা বোধ করিল; সেইখানে শুইয়া পড়িয়া বৃষ্টিজলে ভিজিতে লাগিল এবং কাঁপিতে লাগিল।
পথে লোকের গতিবিধি নাই বলিলেই হয়; কদাচিৎ কোন পথিক ছাতা মাথায় দিয়া দ্রুতবেগে বাটী ফিরিতেছে; কদাচিৎ কোন ইতর শ্রমজীবী কর্ম্মস্থান হইতে বাটী ফিরিতেছে-ভিজিতে ভিজিতে, গায়িতে গায়িতে চলিয়াছে। শ্রীশচন্দ্রকে লক্ষ্য করিবার কাহারও অবসর নাই। পথে প্রায় এক হাঁটু জল জমিয়া গিয়াছে। কিয়ৎপরে শ্রীশচন্দ্র একটা শব্দ শুনিতে পাইল; বোধ হইল কে একটা লোক ছপ্ ছপ্ শব্দে জল ভাঙিয়া তাহারই দিকে আসিতেছে। যে হউক না কেন, মজিদ খাঁ আসিতেছেন, মনে করিয়া শ্রীশচন্দ্র গেঙাইতে লাগিল-কাঁপিতে লাগিল। পদশব্দে বুঝিতে পারিল, লোকটা তাহারই দিকে আসিতেছে। শ্রীশচন্দ্র একবার বক্রদৃষ্টিপাতে বিদ্যুতের আলোকে দেখিয়া লইল, তাহার অনুমান মিথ্যা নহে-মজিদ খাঁ বটে।
মজিদ অন্ধকারে আর একটু হইলেই শ্রীশচন্দ্রের ঘাড়ের উপরে পা তুলিয়া দিতেন। গেঙানি শব্দ শুনিয়া তিনি চমকিত চিত্তে একপার্শ্বে সরিয়া দাঁড়াইলেন। মজিদ খাঁ হউন আর যিনিই হউন, কাহারও পা তাহার ঘাড়ের উপরে পড়িয়া বেদনা প্রদান করে, এইরূপ ইচ্ছা শ্রীশচন্দ্রের আদৌ ছিল না, সুতরাং মজিদ নিকটস্থ হইলে, সে একটু জোরে জোরে গেঙাইতে আরম্ভ করিয়া দিল। মজিদ সবিস্ময়ে বলিলেন, “কেরে তুই, এখানে?”
শ্রীশচন্দ্র পড়িয়া পড়িয়া গেঙাইতে লাগিল-উত্তর করিল না; বরং এবার একটু মাত্রা চড়াইয়া দিল।
মজিদ বলিলেন, “কে তুই? এমন করছিস্ কেন, কি হয়েছে?”
শ্রীশচন্দ্র গেঙাইতে গেঙাইতে কহিল, “আ-মি-এ-সমা-ইল, আজ-দু-দিন-খাও-য়া-হয়-নি।” পেটে হাত বুলাইতে এবং গেঙাইতে লাগিল। তাহা দেখিয়া মজিদের হৃদয় দয়া নামক কোন অদৃশ্য স্নৈহিক পদার্থ আর্দ্রীভূত হইল। তিনি অবনত হইয়া ছদ্মবেশী শ্রীশের গাত্রে হস্তার্পণ করিয়া কহিলেন, “অসুখ করেছে না কি, কি অসুখ করছে?”
শ্রীশচন্দ্র নিজের ক্ষুদ্র উদরে হস্তাবমর্ষণ করিতে করিতে বলিল, “যত অসুখ-এই পেটের-ভ-ত-রে। আজ-দু-দিন-খেতে-পাই-নি। পেট-জ্ব’-লে-গে-ল।”
মজিদের মন করুণাপূর্ণ। তিনি সেই অজাতশ্মত্রু বালকের ধূর্ত্ততা বুঝিতে পারিলেন না। তাঁহার বোধ হইল, সত্যসত্যই বালকের অত্যন্ত কষ্টভোগ হইতেছে। তিনি শ্রীশচন্দ্রকে নিজের গৃহমধ্যে লইতে ব্যস্ত হইলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি উঠিতে পারিবে? এখানে পড়িয়া থাকিলে মারা পড়িবে। আমি তোমাকে খাইতে দিব। ওঠ দেখি।” বলিয়া তিনি শ্রীশের হাত ধরিয়া উঠাইবার চেষ্টা করিলেন।
বুদ্ধিমান শ্রীশ নানারূপে নিজের যন্ত্রণা ও দৌর্ব্বল্য প্রকাশ করিয়া-টলিয়া-হেলিয়া-বসিয়া-অনেক রকম ভঙ্গি করিয়া টলিতে টলিতে উঠিল। মজিদ অনেক কষ্টে তাহাকে সোপান অতিক্রম করিয়া দ্বিতলে নিজের ঘরে লইয়া গেলেন। শ্রীশচন্দ্র অবসন্নভাবে সেই গৃহতলে পুনরায় শুইয়া পড়িল-পড়িয়া ভয়ানক কাঁপিতে আরম্ভ করিয়া দিল। এবং বাইন্ মৎস্যের মত ঘন ঘন পাক্ খাইতে লাগিল। কেবল গেঙানিটা একটু কম পড়িল।
মজিদ দীপ জ্বালিয়া বলিলেন, “ভয় নাই, আমি এখনই গরম দুধ লইয়া আসিতেছি।” বলিয়া ব্যস্তভাবে নীচে নামিয়া গেলেন।
মজিদ চলিয়া যাইবামাত্র শ্রীশ একবার ঘরের চারিদিক্টা দেখিয়া লইল। দেখিল, কেহ কোথায় নাই, ঘর আলোকিত-একেবারে লাফাইয়া দাঁড়াইয়া উঠিল।
গৃহ-প্রাচীরের পার্শ্বে একটা আল্মারী ছিল, শ্রীশ তাহা টানিয়া খুলিয়া ফেলিল। দীপবর্ত্তিকা হস্তে তাড়াতাড়ি চারিদিক্ বেশ করিয়া দেখিয়া লইল। তন্মধ্যে ছুরি পাওয়া গেল না।
গবাক্ষের নিকটে একখানি টেবিল ছিল। শ্রীশ ছুটিয়া সেই টেবিলের নিকটে গেল; এবং টেবিলের উভয় পার্শ্বস্থ ড্রয়ার দুইটিই একেবারে দুই হাতে টানিয়া খুলিয়া ফেলিল; তাহার ভিতরে যে সব কাগজ-পত্র ছিল, তাহা উল্টাইয়া দেখিল-ছুরি নাই।
একপার্শ্বে একটি ক্ষুদ্র বিছানা ছিল। শ্রীশ সেই বিছানার গদি, বালিশ, লেপ সমুদয় তুলিয়া তুলিয়া দেখিল, সেখানেও ছুরি পাওয়া গেল না। এত পরিশ্রম সার্থক হইল না-শ্রীশ বড় হতাশ হইয়া পড়িল; কিন্তু হতাশ হইয়া বসিয়া থাকিবার এ সময় নহে-আর এক মুহূর্ত্ত ভাবিবার সময় নাই-এখনই মজিদ আসিয়া পড়িবেন। তিনি আসিয়া পড়িলে আর কিছুই হইবে না-সকল শ্রম পণ্ড হইবে। এত জলে ভেজা-এত গেঙানি-এত কাঁপুনি সকলই বৃথা হইবে। এমন কি প্রতিপালক দেবেন্দ্রবিজয়ের নিকটে মুখ দেখানই ভার হইবে। শ্রীশচন্দ্র ব্যাকুলভাবে গৃহের চারিদিকে দৃষ্টি সঞ্চালন করিতে লাগিল। টেবিলের উপরে একটা কাঠের বাক্স ছিল। সেই বাক্সের উপরে শ্রীশের দৃষ্টি পড়িল। শ্রীশ বাক্স খুলিতে গেল, খুলিতে পারিল না-তাহা চাবিবন্ধ। বাক্সটা কৌশলে খুলিবার সময় ইহা নহে-ভাঙিতে গেলেও বিলম্ব হইবে-ততক্ষণে মজিদ আসিয়া পড়িবেন। শ্রীশ মনে ভাবিল, যখন ছুরি ঘরের আর কোথাও পাওয়া গেল না; তখন নিশ্চয়ই তাহা এই বাক্সের ভিতরে আছে; কিন্তু বাক্সটি চাবিবন্ধ, শ্রীশের বড় আশায় ছাই পড়িল! শ্রীশ একবার মনে করিল, বাক্সটি তুলিয়া লইয়া জানালা দিয়া পার্শ্বের গলিপথে ফেলিয়া দেবে-তাহার পর সময় মত খুলিয়া দেখিতে পারিবে। যেমন সঙ্কল্প-তেমনই কাজ-শ্রীশ দুই হাতে বাক্সটি লইয়া একটা উন্মুক্ত গবাক্ষের দিকে অগ্রসর হইল। এমন সময়ে গবাক্ষ পার্শ্ববর্ত্তী একখানি ছবির দিকে সহসা তাহার নজর পড়িল। শ্রীশ দেখিল, সেই ছবির পার্শ্বে ছুরির অগ্রভাগের মত কি একটা দেখা যাইতেছে; বাক্স রাখিয়া শ্রীশ তখনই সেটা আগে টানিয়া বাহির করিল-একখানা ছুরিই বটে-ঠিক সেই রকমের ছুরি-ঠিক এই রকমের একখানা ছুরি সে পূর্ব্বে দেবেন্দ্রবিজয়ের হাতে দেখিয়া আসিয়াছে; কিন্তু ইহার বাঁট নাই-তা’ না থাক্। শ্রীশ তাড়াতাড়ি সেই বাক্সটি যথাস্থানে রাখিয়া দিল। দীপবর্ত্তিকা লইয়া পুনরায় সেই ছবির পশ্চাদ্ভাগ অনুসন্ধান করিয়া দেখিল, সত্যসত্যই সেখানে ছুরির ভাঙা বাঁটখানা পড়িয়া রহিয়াছে। শ্রীশ তখনই ছুরিখানি ঠিক করিয়া সেই বাঁটের মধ্যে বসাইয়া দিল; তখন তাহার আর কোন সন্দেহ রহিল না, এই ছুরিই বটে।কার্যে্যাদ্ধার হইয়াছে, শ্রীশের মনে আর আনন্দ ধরে না-এমন কি আনন্দে সে লাফাইবে-কি নাচিবে-কিছুই ঠিক করিতে পারিল না; কিন্তু লাফাইবার অথবা নাচিবার সে সময় নহে- সে জ্ঞান শ্রীমান্ শ্রীশচন্দ্রের খুব ছিল। ছুরিখানা বিষাক্ত; পাছে, অসাবধানে কোথায় কাটিয়া-কুটিয়া যায়, এই ভয়ে সেই শ্রীশ একখানি ইংরাজী খবরের কাগজ ছিড়িয়া আট-দশ ভাঁজে সেই ছুরিখানা মুড়িয়া তখনই তাহা কটির বসনাভ্যন্তরে অতি সন্তর্পণে লুকাইয়া ফেলিল। শ্রীশ এত সত্বর-এত দ্রুতহস্তে এই সকল কাজ শেষ করিয়া ফেলিল যে, দেখিয়া আশ্চর্য্য বোধ হয়।
এমন সময়ে বাহির সোপানে মজিদ খাঁর দ্রুত পদশব্দ শ্রুত হইল। ইতিপূর্ব্বে গৃহতলে যেখানে পড়িয়া ছট্ফট্ করিতেছিল, পুনরায় সে ঠিক সেইস্থানে নিজের ক্ষুদ্র দেহখানা বিস্তার করিয়া দিল; এবং পূর্ব্বভাব অবলম্বন করিয়া হাত-পা ছুঁড়িতে লাগিল-এ পাশ ও-পাশ করিতে লাগিল। শ্রীশ বাহাদুর ছেলে!

৩.০৩ তৃতীয় পরিচ্ছেদ – কে ধরা পড়িল?

এমন সময়ে মজিদ খাঁ দুগ্ধপূর্ণ একটা বড় কাচের পেয়ালা হস্তে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিলেন। দুগ্ধ হইতে ধুঁয়া উড়িতেছে। মজিদ দুঃখিত ভাবে কহিলেন, “বড় কষ্ট হইতেছে-না?”
শ্রীশ রোদনের সুরে কহিল, ” বড় কষ্ট-পেট জ্ব’লে গেল-বুক পর্য্যন্ত শুকিয়ে গেছে-হুজুর-আমি আর বাঁচব না!”
“ভয় কি!” বলিয়া জানুতে ভর দিয়া মজিদ শ্রীশের মাথার কাছে বসিলেন। বসিয়া বলিলেন, “এই দুধটুকু খেয়ে ফেল দেখি; গায়ে এখনই জোর পাবে।”
শ্রীশ অনেক কষ্টে (?) উঠিল। এবং দুধের পেয়ালা নিজের হাতে লইয়া পান করিতে আরম্ভ করিয়া দিল।
মজিদ নিকটস্থ একখানা চেয়ারে বসিয়া, একটা চুরুটে অগ্নিসংযোগ করিয়া টানিতে আরম্ভ করিয়া দিলেন, এবং প্রসন্ননেত্রে বালক শ্রীশের দুগ্ধ পান দেখিতে লাগিলেন।
হায়, হতভাগ্য মজিদ! তুমি এখনও বুঝিতে পার নাই-কালসর্পকে দুগ্ধ দিয়া পোষণ করিতেছ-এখনই একটা সুযোগ পাইলে সে তোমাকেই দংশন করিবে। দুগ্ধপান শেষ করিয়া শ্রীশ ভাবভঙ্গিতে জানাইল, সে অনেকটা সুস্থ হইতে পারিয়াছে। সুস্থ হইবার কথা-এক সেরের অধিক দুগ্ধ তাহাকে দেওয়া হইয়াছিল।
মজিদ জিজ্ঞাসা করিলেন, ” আর কিছু খাবে?”
শ্রীশ বলিল, ” আর কিছু না-হুজুরের দয়ায় এ যাত্রা বেঁচে গেলাম-আপনি না দয়া কর্লে এতক্ষণে জাহান্নমে যেতে হ’ত।”
মজিদ তাহাকে কিছু পয়সা দিলেন। বলিলেন, “এই পয়সা নিয়ে যাও, এখনও খাবারের দোকান খোলা আছে, কিছু খাবার কিনে খাও গিয়ে।”
শ্রীশ ছাড়িবার পাত্র নহে-অনেকগুলি পয়সা ট্যাঁকে গুঁজিয়া বাহির হইয়া পড়িল।
মজিদ খাঁ নিজের ঘরের দ্বার বন্ধ করিলেন। তখন ঝড়-বৃষ্টি থামিয়া গিয়াছিল। আকাশ পরিষ্কার-মজিদ খাঁ সমুদয় গবাক্ষগুলি খুলিয়া দিলেন। গবাক্ষপথে চাহিয়া দেখিলেন, সেই অনাহারক্লিষ্ট বালক, এক্ষণে পার্শ্বস্থ গলিপথে দিয়া উর্দ্ধশ্বাসে ছুটিয়া চলিয়াছে। আপনমনে বলিলেন, “পরোপকারে মনের তৃপ্তি হয়-ফলও আছে।”
বলিতে কি, মজিদ এই পরোপকারে যে ফলপ্রাপ্ত হইলেন, তাহা পাঠক নিম্নলিখিত কয়েকটি পংক্তি পাঠে বুঝিতে পারিবেন।
পরদিন অপরাহ্নে মজিদ নিজের ঘরে বসিয়া মনিরুদ্দীনের জমিদারী সংক্রান্ত হিসাব-নিকাশ ঠিক করিতেছিলেন।
এমন সময়ে দুই ব্যক্তি আসিয়া তাঁহার পার্শ্বে দাঁড়াইলেন তন্মধ্যে একজন দেবেন্দ্রবিজয়, একজন স্থানীয় থানার জমাদার। মজিদ খাঁ দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে চকিতে চাহিয়া বলিলেন, “মহাশয়, আবার কি মনে ক’রে?”
দেবেন্দ্রবিজয় পকেট হইতে একখানি ওয়ারেন্ট বাহির করিয়া দেখাইলেন। মজিদ আরও চমকিত হইয়া, মহা ভয় পাইয়া কহিলেন, ” কি সর্ব্বনাশ! এ ওয়ারেন্ট যে আমারই নামে! আমি কি করিয়াছি?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “আপনি দিলজানকে হত্যা করিয়াছেন। সেই হত্যাপরাধে মহারাণীর নাম লইয়া আপনাকে এখন বন্দী করিলাম।”
তখনই মজিদ খাঁর হাতে সশব্দে হাতকড়ি পড়িল। মজিদ খাঁ বন্দী হইলেন।

৩.০৪ চতুর্থ পরিচ্ছেদ – মনে মনে নানা ভাবের প্রাবল্য

দেবেন্দ্রবিজয় তাড়াতাড়ি গ্রেপ্তার করিলেন বটে, কিন্তু মজিদ দোষী কি নির্দ্দোষ, তাহা ঠিক বুঝিতে পারিলেন না। তাঁহার মনের ভিতরে সেই সন্দেহ পূর্ব্ববৎ রহিল। যে ছুরিতে খুন হইয়াছে, সেই ছুরিকানি মজিদ খাঁর গৃহে পাওয়া গিয়াছে-ইহা একটা খুনের বিশিষ্ট প্রমাণ বটে; এবং এই প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়াই তিনি মজিদ খাঁকে গ্রেপ্তার করিয়াছেন; কিন্তু মজিদ যে দিলজানকে খুন করিয়াছেন, তাহার কোন সুবিধাজনক কারণ দেখিতে পাইলেন না। তিনি বুঝিয়াছিলেন, এ খুনটা অত্যন্ত জটিল রহস্যে পূর্ণ-ইহার স্থির-সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াও কঠিন। এরূপ স্থলে এখন যাহার উপরে একটুমাত্র সন্দেহ হইবে, তাহাকে ধরিয়া নাড়াচাড়া দিতে হইবে-নতুবা সহজে রহস্যোদ্ভেদ হইবে না; সেইজন্য দেবেন্দ্রবিজয় মজিদ খাঁকে ঠিক দোষী বলিয়া বুঝিতে না পারিলেও তাঁহাকে গ্রেপ্তার করা যুক্তিসঙ্গত বোধ করিয়াছিলেন। যেমন সেই ছুরিতে একদিকে মজিদের উপরে দেবেন্দ্রবিজয়ের সন্দেহ প্রবল হইয়াছে; আর একদিকে শ্রীশ প্রমুখাৎ মজিদ ও জোহেরার কথোপকথন সম্বন্ধে যাহা তিনি শুনিয়াছিলেন, তাহাতে মজিদের উপর হইতে সন্দেহটা কিছু হাল্কা হইয়াও গিয়াছে। মজিদের কথার ভবে বুঝা যায়, তিনি নিজেই মনিরুদ্দীনকে সন্দেহ করিতেছেন। দেবেন্দ্রবিজয় আবার ভাবিলেন, ” এমনও হইতে পারে, মজিদ জোহেরাকে মিথ্যা বলিয়াছে-আত্মদোষ ক্ষালনার্থে অনেকেই পরের উপর ঝোঁক্ দিয়া থাকে। মজিদ হয় দোষী, না হয় কোন-না-কোন রকমে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত আছেন। আরও বেশ বুঝা যাইতেছে, সৃজান বিবির গৃহত্যাগের সহিত এই খুনের মাম্লার কিছু সংশ্রব আছে। খুনের রাত্রে যে স্ত্রীলোক সৃজান বিবির সঙ্গে দেখা করিতে গিয়াছিল, সে কে? দিলজান? দিলজান কেন তাহার সহিত দেখা করিতে যাইবে? দিলজানের কি সহসা এতখানি সাহস হইতে পারে? সে বারাঙ্গনা-মুন্সী জোহিরুদ্দীনের অন্তঃপুরে প্রবেশ করা তাহার পক্ষে সম্ভবপর নহে। তবে এরূপও হইতে পারে, সৃজান বিবি তাহার মনিরুদ্দীনকে কাড়িয়া লইতেছে দেখিয়া, সে সৃজান বিবিকে দুই একটা কঠিন কথা শুনাইয়া দিবার লোভ সংবরণ করিতে পারে নাই। এইরূপ গাত্রদাহ উপস্থিত হইলে রমণীমাত্রেই দিগবিদিক্ জ্ঞানশূন্য হইয়া পড়ে; এবং তখন তাহাদের ভালমন্দ বিবচনা করিবার ক্ষমতা থাকে না। আমার বিশ্বাস, নিশ্চয়ই সে দিলজান। দেখিতেছি, এ রহস্য-সমুদ্রের তলদেশ পর্য্যন্ত আমাকে নামিতে হইবে।” মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া দ্দেবেন্দ্রবিজয় বাটী হইতে সাধারণ ভদ্রলোকের মত সাদাশিধে পোষাকে বাহির হইয়া পড়িলেন; এবং লতিমন বাইজীর বাটী-অভিমুখে চলিলেন।
লতিমন বাইজী এবার দেবেন্দ্রবিজয়কে খুব খাতির করিয়া নিজের ঘরে লইয়া বসাইল। লতিমন দিলজানকে খুব ভালবাসিত। যাহাতে তাহার হত্যাকারী শীঘ্র ধরা পড়িয়া স্ব-কৃত পাপের ফলভোগ করে, তাহাতে লতিমন বাইজীরও খুব আগ্রহ দেখা গেল। এক্ষণে সে দেবেন্দ্রবিজয়কে প্রচুর সাহায্য করিতেও প্রস্তুত। প্রথম হইতেই সে অযাচিতভাবে দেবেন্দ্রবিজয়ের প্রতি বহুবিধ উপদেশ বর্ষণ করিতে আরম্ভ করিয়া দিল।
কিন্তু দেবেন্দ্রবিজয় তাহাতে কাজের কথা কিছুও পাইলেন না। তিনি নিজের একেবারে নিজের কথাই পাড়িলেন! বলিলেন, “সেদিন রাত্রে দিলজান বাটী হইতে বাহির হইয়া যাইবার সময়, কোথায় সে যাইতেছে, সে সম্বন্ধে আপনাকে কিছু বলিয়া গিয়াছিল?”
লতিমন বলিল, “তাহা ত আপনাকে পূর্ব্বেই বলিয়াছি, সে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে যাইবে বলিয়া বাহির হইয়াছিল।”
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসিলেন, কেবল মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে? আর কোথায় নহে কি?
লতি। কই, আমাকে আর কোনখানে যাইবার কথা কিছু বলে নাই।
দেবেন্দ্র। নাই বলুক-তার ভাব-গতিক দেখিয়া ত কোন কথায় আপনি কি তখন এরূপ একটা অনুমান করিতে পারেন নাই যে, দিলজান সৃজান বিবির নিকটেও যাইবে?
লতি। (সবিস্ময়ে) সৃজান বিবি! সৃজান বিবির কাছে সে কি করিতে যাইবে?
দে। কি করিতে যাইবে, তা’ আমি কি করিয়া বলিব? আমার ধারণা যাহা হউক, একটা-কিছু করিতে সে গিয়াছিল।
দেবেন্দ্রবিজয়, মজিদ ও জোহেরার সেই কথোপকথনের সারাংশ লতিমন বাইজীকে শুনাইয়া দিলেন। বাইজী এতক্ষণে রুদ্ধ নিঃশ্বাসে সব শুনিয়া একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল, “তা’ হবে-আর্শ্চয্য কি! আমি ত ইহার কিছুই জানি না।”।
দে। তা’ না জানেন-ক্ষতি নাই। মুন্সী জোহিরুদ্দীনের বাড়ীর দাসী-বাঁদীদের কাহাকেও আপনি চিনেন কি?
লতি। চিনি একজনকে আমি খুব চিনি, সে আমার এখানে দুই-তিন মাস কাজ করিয়া গিয়াছে। তার নাম সাখিয়া-সে এখন খোদ সৃজান বিবিরই বাঁদী।
দে। (সাগ্রহে) বটে! তবে সে নিশ্চয় অনেক খবরই রাখে। কোন রকমে এখন তাকে এখানে যদি একবার আনাইতে পারেন, তাহা হইলে আমার অনেকটা উপকার হয়। তাহার মুখ হইতে সকল কথাই আমি বাহির করিয়া লইতে পারি।
লতি। কেন পারিব না? আমার কথা সে কখনই ঠেলিবে না। এখন কর্ত্রী নাই, কাজকর্ম্মও তার হাতে বিশেষ কিছু নাই; খবর পাইলে এখনই সে আসিবে। আমি তার কাছে লোক পাঠাইতেছি।
দে। এখনই একজন লোক পাঠাইয়া দিন্, বিলম্ব করিবেন না। যতক্ষণ না সে আসে, ততক্ষণ আমাকে তাহার অপেক্ষায় এখানেই বসিয়া থাকিতে হইবে।
আচ্ছা, আমি এখনই ইহার বন্দোবস্ত করিতেছি,” বলিয়া লতিমন ঘর হইতে বাহির হইয়া যাইবার উপক্রম করিল। যেমন সে দ্বারের নিকট গিয়াছে দেবেন্দ্রবিজয় তাহাকে বলিলেন, ” দাঁড়ান, আর একটা কথা আছে।”
লতিমন ফিরিয়া দাঁড়াইল।
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, ” আমি দিলজানের ঘরটা একবার অনুসন্ধান করিয়া দেখিতে চাই; বিশেষতঃ বাক্স-দেরাজগুলি আমাকে একবার ভাল করিয়া দেখিতে হইবে।”
শিহরিত হইয়া সভয়ে লতিমন বলিল, “কেন, বাক্স-দেরাজ দেখিয়া কি হইবে?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “দেরাজ-বাক্সে লোকে অনেক রকম জিনিষ রাখে। গুপ্তচিঠি-পত্রও থাকিতে পারে, বিশেষতঃ কোন গুরুতর কারণ উপস্থিত না হইলে স্ত্রীলোক সহজে চিঠি-পত্র নষ্ট করে না। প্রেমপত্রাদি আরও যত্নপূর্ব্বক রক্ষা করে। যদি দিলজানের সেই রকম দুই-একখানা চিঠিপত্র পাওয়া যায়, হয়ত তাহা হইতে দিলজানের পূর্ব্ব-জীবনের অনেক কথা প্রকাশ পাইতে পারে। আর কোন উদ্দেশ্যে কে তাহাকে খুন করিয়াছে, তাহাও জানা যাইতে পারে। আমাদের দেখা আছে, গুপ্তচিঠিপত্রে অনেক সময়ে অনেক কাজ হয়।”
চিন্তিতভাবে লতিমন ক্ষণপরে কহিল, “তাহা হইলে মজিদ খাঁকে খুনী বলিয়া আপনার বোধ হয় না?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন,” সে কথা এখন কিরূপে বলিল্ব? আমি এখন কোন কারণ খুঁজিয়া পাই না, যাহাতে মজিদ দিলজানকে খুন করিয়াছে বলিয়া একটা স্থির-সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পারি। মজিদ দিলজানকে কেন খুন করিবে? অবশ্যই ইহার ভিতরে একটা অভিপ্রায় থাকা চাই-হাসি-তামাসার কথা নহে-খুন। চলুন, এখন আপনি আমাকে একবার দিলজানের ঘরে লইয়া চলুন দেখি।”
একটু ইতস্ততঃ করিয়া লতিমন কহিল, “সে কাজটা কি ঠিক হয়? আমার বিবেচনায় পরের বাক্স-দেরাজটা খোলা- ”
দেবেন্দ্রবিজয় উচ্চহাস্য করিয়া, বাধা দিয়া বলিলেন, “ক্ষতি কি আছে? আপনার দিলজান ত এ জগতে নাই। তাহার হত্যাকারীকে উপযুক্ত দণ্ড দিবার জন্যই আমরা তার বাক্স-দেরাজ খুলিতে চাই-কোন মন্দ উদ্দেশ্য ত নাই। এই উপলক্ষে হয় ত একজন নির্দ্দোষীর জীবনরক্ষাও হইতে পারে।”
লতিমন আর আপত্তি করিল না। দিলজান যে ঘরে বাস করিত, দেবেন্দ্রবিজয়কে সেখানে লইয়া গেল। দেবেন্দ্রবিজয় পূর্ব্বে আর একবার মাত্র এই ঘরে আসিয়া ছিলেন। সেইদিন এই ঘরেই তিনি সেই বিষাক্ত ছুরি পাইয়াছিলেন। পাঠক তাহা অবগত আছেন।
দেবেন্দ্রবিজয় প্রথমেই দিলজানের বাক্সের ডালা ও দেরাজের ড্রয়ারগুলি টানিয়া দেখিতে লাগিলেন,-সকলগুলিই চাবি বন্ধ। লতিমনকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনার কাছে দিলজান চাবি রাখিয়া গিয়াছিল?”
লতিমন বলিল, “না, কেবল ঘরের চাবি আমার কাছে দিয়া গিয়াছে, আর সব চাবি তাহারই সঙ্গে ছিল।”
দেবেন্দ্রবিজয় চিন্তিত হইলেন। তাহার পর বলিলেন, “চাবি না থাকে, আপনি এক কাজ করুন আমাকে খানিকটা লোহার তার আনিয়া দিন, ছাতা ভাঙ্গা লোহার শিক্ একটু যদি আনিতে পারেন, খুব সুবিধা হয়।”
“যাই-খুঁজিয়া দেখি, আর অমনি সাখিয়াকে আনিবার জন্য একজন বান্দাকেও পাঠাইয়া দিয়া আসি, “বলিয়া লতিমন ঘরের বাহির হইয়া গেল। এবং ক্ষণপরে একটী ছাতার শিক ও খানিকটা লোহার তার লইয়া ফিরিয়া আসিল।
দেবেন্দ্রবিজয় লোহার তার ও শিক হাতে লইয়া জিজ্ঞাসিলেন, “সাখিয়ার কাছে খবর গেল?”
লতিমন কহিল, “হাঁ, খবর পাঠাইয়াছি।”

৩.০৫ পঞ্চম পরিছেদ – সাখিয়া

তাহার পর দেবেন্দ্রবিজয় সেই লোহার তার ও শিকের সাহায্যে দিলজানের বাক্স ও ড্রয়ারগুলি খুলিয়া ফেলিতে লাগিলেন; এবং তন্মধ্যস্থিত জিনিষ-পত্র সমুদয় উল্টাইয়া-পাল্টাইয়া দেখিতে লাগিলেন। প্রায় একঘন্টা কঠিন পরিশ্রমের পর নিজের কাজে লাগিতে পারে, এমন দুই-একটি মাত্র জিনিষ তাঁহার হস্তগত হইল’ তাহা একতাড়া পুরাতন চিঠী এবং দুইখানি ফটোগ্রাফ ভিন্ন আর কিছু নহে। চিঠীগুলি আমীর খাঁ নামক কোন ব্যক্তি মৃজান নাম্নী কোন রমণীকে লিখিতেছে। সকলগুলিই প্রেমপত্র, তাহা ভালবাসার কথা-বিরহের কথা-অন্তরঙ্গতার কথা ও অনন্তবিধ হা-হুতাশে পূর্ণ। ফটোগ্রাফ্ দুইখানির একখানিতে একটি শুক্লকেশ বৃদ্ধ মুসলমানের প্রতিকৃতি অঙ্কিত। তাহার পরপৃষ্ঠায় লেখা-“মুন্সী মোজাম হোসেন-সাং খিদিরপুর।” অপর ফটোখানি দিলজানের নিজের। ইহাতে দিলজান সালঙ্কারা নীলবসনা নহে, শুভ্রবসনা নিরলঙ্কারা-তথাপি তাহা বড় সুন্দর দেখাইতেছে। অবেণীসম্বন্ধ কেশগুচ্ছ-গুচ্ছে গুচ্ছে সুন্দর মুখখানির উভয় পার্শ্বে বেষ্টন করিয়া অংসে পৃষ্ঠে এবং বক্ষের উপরে লুটাইয়া পড়িয়াছে। তুলিকাচিত্রিতবৎ আকর্ণবিশ্রান্ত বঙ্কিম ভ্রুযুগল, এবং ভাসা ভাসা প্রচুরায়ত ও কৃষ্ণচক্ষু দু’টী সে সুন্দর মুখমণ্ডলের অপূর্ব্ব শোভাবর্দ্ধন করিতেছে। সেই ডাগর চক্ষু দুটীতে তেমনিই আবার কি মনোমোহিনী দৃষ্টি! তাহার পর, আরও মনোহর সেই উন্নত গ্রীবার বঙ্কিম ভঙ্গি। প্রসৃত পরিপুষ্ট বক্ষের উর্দ্ধার্দ্ধভাগ উন্মুক্ত। একটি কুসুমিতা লতা মালার সেই মত অংস ও কণ্ঠ বেষ্টন করিয়া সেই কামদেবের লীলা-ক্ষেত্রতুল্য সমুন্নত বক্ষের উপরে আসিয়া পড়িয়াছে।
দেবেন্দ্রবিজয় ফটোগ্রাফ্ দুইখানি বিশেষরূপে পর্য্যবেক্ষণ করিয়া একে একে পত্রগুলি পড়িতে আরম্ভ করিলেন। দশ-দশখানি সুদীর্ঘ পত্র-দেবেন্দ্রবিজয় সকলগুলিরই আদ্যোপান্ত বিশেষ মনোযোগের সহিত মনে মনে পাঠ করিলেন। পাঠ শেষ করিয়া তিনি লতিমনের মুখের দিকে চাহিলেন। লতিমন এতক্ষণে নীরবে তাহার মুখের দিকে অবাক্ হইয়া চাহিয়াছিল। দেবেন্দ্রবিজয় তাহাকে বলিলেন, “ঘটনা যাহা ঘটিয়াছে, এতক্ষণে সব বুঝিলাম। আপনি যাহাকে দিলজান বলিয়া জানেন, তাহার প্রকৃত নাম দিলজান নহে-মৃজান। খিদিরপুরে তাহার পিতৃগৃহ। তাহার পিতার নাম মোজাম হোসেন। ঘটনাক্রমে পিতৃগৃহে মনিরুদ্দীনের সহিত তাহার প্রণয় হয়। মনিরুদ্দীন নিজের নাম গোপন করিয়া আমীর খাঁ নামে তাহার নিকটে পরিচিত হইয়া ছিলেন। মৃজান আমীর খাঁকে বিবাহ করিবার জন্য পীড়াপীড়ি করে; কিন্তু আমীর খাঁ সে সকল কথা উড়াইয়া দিয়া তাহাকে গৃহের বাহির করিবার চেষ্টা করে। পরিশেষে মনিরুদ্দীনেরই চেষ্টা সফল হইল। পরে যখন মৃজান বুঝিল, কাজটা সে নিতান্ত বুদ্ধিহীনার মত করিয়া ফেলিয়াছে, নিজে কলঙ্ক-সাগরে ডুবিয়াছে, এবং সেই কলঙ্কের কালিমা তাহার বৃদ্ধ পিতার মুখে লেপন করিয়াছে, তখন আত্ম-পরিচয় গোপন করিয়া দিলজান নাম লইয়া থাকিল।এই যে বৃদ্ধের তস্বীর দেখিতেছেন, ইনিই দিলজানের পিতা, নাম মোজাম হোসেন। আর এইখানি সেই আপনার মৃজান ওরফে দিলজানের তস্বীর।”
লতিমন মনোহর রূপকথার মত দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখে এই প্রেম কাহিনী একান্ত বিস্ময়ের সহিত শুনিল। সে বুঝিতে পারিল না, দেবেন্দ্রবিজয় কিরূপে ক্ষণকালের মধ্যে এত কথা জানিতে পারিলেন। নিজে সে এতদিন দিলজানের সহিত একসঙ্গে বাস করিতেছে, অথচ সে নিজে ইহার বিন্দু-বিসর্গ জানে না। লতিমনের বিস্ময়ের সীমা রহিল না। সে দেবেন্দ্রবিজয়ের হাত হইতে ফটোগ্রাফ্ দুইখানি লইয়া, নাড়িয়া-চাড়িয়া দেখিয়া সমুখস্থ টেবিলের উপরে রাখিয়া দিল। এবং একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিল, “হাঁ, একখানি দিলজানের তস্বীর। এখানে আমি তাহাকে কখনও এ রকম পোষাকে দেখি নাই।”
দেবেন্দ্রবিজয় কি বলিতে যাইতেছিলেন, এমন সময়ে দ্বার ঠেলিয়া আর একটি স্ত্রীলোক তথায় প্রবেশ করিল। স্ত্রীলোক দীর্ঘাঙ্গী, কৃশা শ্যামবর্ণা। তাহার বয়ঃক্রম পঁচিশ হইতে পারে-পঁয়ত্রিশও হইতে পারে-ঠিক করা কঠিন। তাহাকে দেখিয়া সাগ্রহে লতিমন বলিয়া উঠিল, “কে, সাখিয়া না কি? বেশ-বেশ-খুব শীঘ্র এসে পড়েছিস্ ত!”
দেবেন্দ্রবিজয় বুঝিলেন, এই সাখিয়া সৃজান বিবির প্রধানা দাসী। তিনি তাহার মুখের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চাহিয়া রহিলেন।
সাখিয়া, দেবেন্দ্রবিজয়কে তেমন কঠিনভাবে তাহার দিকে চাহিতে দেখিয়া ভীতা হইল। একটু যেন থতমত খাইয়া গেল। কি বলিবে, স্থির করিতে না পারিয়া চুপ করিয়া রহিল।
তখন লতিমন সাখিয়াকে দেবেন্দ্রবিজয়ের পরিচয় দিল। শুনিয়া সে আরও ভীতা হইয়া উঠিল।
লতিমন বলিল, “সাখিয়া, ইনি তোকে গোটাকতক কথা জিজ্ঞাসা কর্তে চান্। যা’ জানিস্ সত্য বলবি।”
সাখিয়া শুনিয়া মনে মনে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইল। বলিল, “কি মুস্কিল! আমি কি জানি, আমি কি বলব? থানা-পুলিসের হাঙ্গামে আমি নেই।”
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, সকলই বিগ্ড়াইয়া যায়। তিনি সাখিয়াকে বুঝাইয়া বলিতে লাগিলেন, “না-না-থানা পুলিসের হাঙ্গামা ইহাতে কিছুই নাই। যে রাত্রে সৃজান বিবি পলাইয়া যায়, সেই রাত্রের দুই-একটা খবর আমি তোমার কাছে জনিতে চাই। আমি পুলিসের লোক ঠিক নই-একজন গোয়েন্দা। মুন্সী জোহিরুদ্দীন আমাকে নিযুক্ত করিয়াছেন। তিনি আমার উপরেই সৃজান বিবিকে সন্ধান করিয়া বাহির করিবার ভার দিয়াছেন। তা’ তোমাদের মত দুই-একজন লোক যদি এ সময়ে আমায় সাহায্য না করে, তা হইলে আমি একা কতদূর কি করিতে পারি? ইহাতে শুধু আমার উপকার করা হইবে না-তোমার মনিবেরও যথেষ্ট উপকার হইবে।”
শুনিয়া সাখিয়া মনে মনে সন্তুষ্ট হইল। বলিল, “এমন মনিব আর হয় না! বিবি সাহেবাকে তিনি কত ভালবাস্তেন-একদণ্ড চোখের তফাৎ করতেন না! এমন কি-”
দেবেন্দ্রবিজয় বাধা দিয়া বলিলেন, “তোমার মনিব সাহেবের ভালবাসার কথা পরে শুনিব; এখন বিবি সাহেবার কথা কি জান, তাহাই আগে বল। একটা ভয়ানক খুনের মামলা ইহার ভিতরে রহিয়াছে।”
চোখ মুখ কপালে তুলিয়া সভয়ে বলিল, “খুন! কে খুন হয়েছে-আমাদের বিবি সাহেবা না কি?”
চোখে দুই ফোঁটা জল আনিয়া লতিমন বলিল, “না সাখিয়া, তোর বিবি সাহেবা নয়-আমাদেরই কপাল ভেঙ্গেছে-দিলজান খুন হয়েছে।”
সাখিয়া বলিল, “তাই ভাল-একটা বেশ্যা মাগী খুন হয়েছে, তার আবার কথা। আমি মনে করেছিলুম, আমাদের বিবি সাহেবা।”
লতিমন রাগিয়া বলিল, “রেখে দে তোর বিবি সাহেবা-সে আবার বেশ্যার অধম; নৈলে সে এমন কাজ করে? তার আবার মান! আমাদের দিলজানের সঙ্গে তার তুলনা? যদিও মনিরুদ্দীনের সঙ্গে দিলজানের বিবাহ হয় নাই; তা’ না হ’লেও, সে মনিরুদ্দীন ভিন্ন আর কিছু জানিত না। তোর বিবি সাহেবা কি নামটাই কিন্লে বল্ দেখি? তোর বিবি সাহেবা যদি মনিরুদ্দীনের মাথাটা একেবারে না খেয়ে দিত, তা’হ’লে আমাদের দিলজানই বা খুন হবে কেন?”
সাখিয়া ক্রোধভরে উঠিয়া কহিল, “বেশ-তোমাদের দিলজান খুব সতী-আমাদের বিবি সাহেবার সঙ্গে তুলনা হয় না! তোমরা যে কেন আমাকে ডেকেছ, তা’ আমি বেশ বুঝ্তে পেরেছি; এখন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এই খুন খারাপীটা বিবি সাহেবার ঘাড়ে ফেলিতে চাও; আমি সব বুঝিতে পারি। আমি নিতান্ত আর ছেলে মানুষটি ত নই-আমি তোমাদের এ সব কথায় নেই-আমি কিছুই জানি না, ” বলিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া যাইবার উপক্রম করিল। দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, আগেই খুনের কথা তুলিয়া নিজে আবার সব মাটি করিয়া ফেলিলেন। এখন আর বিনয় ছলে কিছু হইবে, এমন বোধ হয় না; বলপ্রয়োগ প্রয়োজন। তিনি তৎক্ষণাৎ প্রস্থানোদ্যতা সাখিয়ার বস্ত্রাঞ্চল ধরিয়া, সজোরে একটা টান্ দিয়া কঠোরকণ্ঠে বলিলেন, “আরে ব’স মাগী, যবি কোথায়? যা জনিস্, তোকে এখনই বল্তে হবে-চলাকী করতে গেলে একেবারে পুলিসে চালান্ দিব জানিস্?”
সাখিয়া মাটিতে বসিয়া পড়িয়া, হাঁউমাউ করিয়া কাঁদিয়া উঠিল। এবং এক্ষণে যে ধর্ম্মকর্ম্ম ও ভাল মানুষের দিন-কাল আর নাই, এবং ইংরাজের এত বড় রাজত্বটা সহসা মগের মুল্লুকে পরিণত হইয়াছে, অতিশয় বিস্ময়ের সহিত সে তাহাই বারংবার উল্লেখ করিতে লাগিল।

৩.০৬ ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – রহস্য ক্রমেই গভীর হইতেছে

দেবেন্দ্রবিজয় অনেক বলিয়া-কহিয়া, বুঝাইয়া সাখিয়াকে একটু ঠাণ্ডা করিলেন। বুঝাইয়া দিলেন, যাহাতে তাহার বিবি সাহেবার উপরে এই খুনের অপরাধটা না পড়ে, সেই চেষ্টাই তিনি করিতেছেন, তখন সাখিয়া যাহা জানে বলিতে সম্মত হইল। এবং তাহার এজাহার লিখিয়া লইবার জন্য দেবেন্দ্রবিজয় পকেট হইতে নোটবুকখানি বাহির করিয়া ঠিক হইয়া বসিলেন।
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, ” যেদিন রাত্রে তোমার বিবি সাহেবা পলাইয়া যায়, সেদিনকার সমুদয় কথা তোমার এখন বেশ মনে আছে?”
সাখিয়া বলিল, “তা, আর মনে নাই? এই ত সেদিনকার কথা! খুব মনে আছে।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “কি মনে আছে, বল? সেদিনকার কি জান তুমি?”
সাখিয়া। (চিন্তিতভাবে) সেদিন রাজাব-আলির বাড়ীতে আমাদের নিমন্ত্রণ ছিল।
দেবেন্দ্র। কে নিমন্ত্রণ রাখিতে গিয়াছিল?
সাখি। দুজনেই।
দে। দুইজন আবার কে?
সাখি। বিবি সাহেবা আর জোহেরা বিবি-দুজনেই নিমন্ত্রণে গেছ্লেন। দে। সেখান হ’তে তাঁরা কখন ফিরলেন?
সাখি। রাত তখন দশটা-কি সাড়ে দশটা হবে! সেদিন বিবি সাহেবার তবিয়ৎ আচ্ছা ছিল না- বড় মাথা ধরিয়াছিল।
দে। আর কিছু ধরিয়াছিল?
লতি। (সহসা মাঝখান হইতে হাসিয়া বলিয়া উঠিল) আর ভূতে ধরিয়াছিল!
দে। আপনি চুপ করুন। (সাখিয়ার প্রতি) মাথা ধরায় তোমার বিবি সাহেবা বড়ই কাবু হইয়া পড়িয়াছিলেন; তাহাতে বোধ হয়, বাড়ীতে আসিয়াই শয়ন করিতে গিয়াছিলেন?
সাখি। না-তা’ ঠিক নয়। আর একজন কে তাঁর সঙ্গে দেখা করবার জন্য এসে ব’সে ছিল, তারই সঙ্গে দেখা করতে গেলেন।
দে। কে সে?
সাখি। তা’ আমি জানি না।
দে। কোন স্ত্রীলোক না কি?
সাখি। তা’ নয় ত আর কি-রাত এগারটার সময়ে পুরুষ মানুষের সঙ্গে কি-
লতি। (বাধা দিয়া) তোমার বিবি সাহেবার পক্ষে সেটা বড় আশ্চর্য্য নয়।
দে। কে সে স্ত্রীলোক? তাহাকে তুমি দেখিয়াছ?
সাখি। দেখিয়াছি।
দে। কি রকম দেখ্তে? বয়স কত?
সাখি। তা’ আমি কি ক’রে জানব? আমি তার মুখ দেখ্তে পাইনি-ঘোম্টায় মুখখানা একেবারে ঢাকা ছিল! বয়সও কিছু ঠাহর কর্তে পারিনি।
দে। তাহার কাপড়-চোপড় কি রকম?
সাখিয়া কি উত্তর করে শুনিবার জন্য কৌতূহলপূর্ণহৃদয়ে লতিমন সোৎসুকে তাহার মুখের দিকে চাহিল।
সাখি। সবই নীলরঙের-রেশমী কাপড়জামা সব। যে ওড়নাতে মুখখানা ডাহা ছিল, তাও নীলরঙের; তাতে আবার যে রেশমের চমৎকার ফুল-লতার কাজ, তেমন আমি-
লতিমন বাইজীকে আর শুনিতে হইল না। আকুলভবে বলিয়া উঠিল, “তবেই হয়েছে-সে আমাদেরই দিলজান।”
সাখিয়া প্রতিধ্বনি করিয়া বলিয়া উঠিল, “দিলজান! তা’ কেমন ক’রে হবে-আমাদের বাড়ীতে দিলজান-ফিলজানের পা বাড়াতে সাহস হবে না। সে নিশ্চয় কোন বড়লোকের মেয়ে-দিলজান কখনই নয়।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “দিলজান বটে, সেই নীলবসনা সুন্দরী-দিলজান ছাড়া আর কেহই নহে।”
“কখনই নয়,” বলিয়া সাখিয়া লাফাইয়া উঠিল। বলিল, “কখনই সে দিলজান নয়।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তা’ না হউক, সে কথা যাক্-”
সাখিয়া বলিল, “সে কথা যাবে কেন-সে যদি দিলজানই হয়-তাতে দোষই বা হয়েছে কি?”
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, সাখিয়া বড় ঝগ্ড়াটে। তাহাকে রাগান ঠিক নহে। বলিলেন, “সে কথা যাক, সে দিলজানই হবে-তাতে আর হয়েছে কি? তাহার পর তুমি আর কি দেখিয়াছ, বল? সেই স্ত্রীলোকটি কখন গেল?
সাখি। স্ত্রীলোকটি আবার কেন? দিলজান।
দে। ভাল আপদ! সেই দিলজান কখন গেল? তোমার বিবি সাহেবার কাছে সে কি জন্যে গিয়াছিল?
সাখি। তা’ আমি কেমন ক’রে জানব্? আমার তাতে কি দরকার?
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, সাখিয়াকে রোগে ধরিয়াছে-এখন কোন প্রশ্ন করিতে গেলেই সে ফোঁস করিয়া উঠিবে। বলিলেন, “তোমার তা’ জেনে দরকার নাই। তুমি যা’ জান তুমি যা’ দেখেছ, তাই বল? আমি কোন কথা জিজ্ঞাসা কর্তে চাহি না।”
সাখিয়া বলিতে লাগিল, ” সে দিলজান কি-কে, জানি না বাবু, তার সঙ্গে বিবি সাহেবা দেখা কর্তে গেলেন। জোহেরা বিবি আপনার মহলে গিয়ে শুয়ে পড়্লেন। আমি শুতে যেতে পারলেম না-কি জানি-কি হুকুম হবে-জেগে ব’সে থাক্লেম। তা’ আর কোন হুকুম হয় নি। অনেকক্ষণ তাদের কথাবার্ত্তা হ’ল, তা আমি জানি না; প্রায় একঘন্টা পরে সে চ’লে গেল।”
দে। কে? দিলজান?
সাখি। দিলজান কি-কে জানি না, সেই নীলরঙের কাপড় পরা মেয়েটি। তারপর আমি বিবি সাহেবার শোবার ঘরের দিকে গেলাম। দেখি, তিনি কবাট বন্ধ ক’রে শুয়ে পড়েছেন। আমি নীচে নেমে এসে যে দু-একটা কাজ বাকী ছিল, শেষ ক’রে ফেল্লেম। প্রায় রাত বারটা বেজে গেল। কাজ-কর্ম্ম সেরে যখন উপরে আসি, তখনও দেখি, আমাদের বিবি সাহেবার কবাট বন্ধ। আমিও নিজের ঘরে গিয়ে কবাট বন্ধ ক’রে শুয়ে পড়্লেম। তার পর বিবি সাহেবা কখন উঠে গিয়েছেন, তা’ বিবি সাহেবাই জানেন।
দে। তাহা হইলে তোমার বিবি সাহেবা রাত বারটা পর্য্যন্ত নিশ্চয়ই বাড়ীতে ছিলেন?
সাখি। রাত বারটার মধ্যে কি ক’রে বাড়ী থেকে যাবেন? তখন সকলেই জেগে-চারিদিকে লোকজন, চাকর-বাকর-তা’ হলে ত তখনই ধরা পড়তেন। সকলে ঘুমুলে কখন চুপি চুপি উঠে গেছেন। আমার বোধ হয়, শেষরাত্রে উঠে গেছেন।
দে। রাত বারটার মধ্যে যে তিনি বাড়ী ছাড়েন নাই, তা’ তুমি বেশ জান?
সাখি। আমি কি মিথ্যাকথা বল্ছি? আমি তেমন মেয়ে নই। যা’ বল্ব-তা’ স্পষ্ট মুখের উপরেই বল্ব।
দেবেন্দ্রবিজয় আপন-মনে বলিলেন, “সাখিয়ার মুখে এখন যেরূপ শুনিতেছি, তাহাতে রাত বারটার পর সেদিন মজিদের সঙ্গে যে স্ত্রীলোকের দেখা হইয়াছিল, সে সৃজান বিবি নয়। আমারই অনুমান ঠিক, মজিদের আর অস্বীকার করিলে চলিবে না-সে নিশ্চয় দিলজান ভিন্ন আর কেহই নহে।”
সাখি। আর কি মশাই-যা’ আমি জানি সবই ব’লে দেয়েছি-আমাকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করবার আছে?
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আছে বৈ কি-তোমার বিবি সাহেবা কেমন দেখ্তে ছিলেন, বল দেখি?”
সাখিয়া বলিল, “তুমি কি রকম ভদ্রলোক, মশাই! ভদ্রঘরের মেয়ের রূপের খোঁজে তোমার কি দরকার? সে সব কথা আমি কিছুই জানি না। এ সব-”
সাখিয়া আরও কিছু বলিতে যাইতেছিল, এমন সময়ে দিলজানের ফোটোগ্রাফ্খানি তাহার চঞ্চল দৃষ্টিপথে পড়িল। সুর বদ্লাইয়া বলিল, ” এই যে, আপনি আমাদের বিবি সাহেবের একখানি তস্বীরও যোগাড় করেছেন!”
দেবেন্দ্রবিজয় তাড়াতাড়ি দিলজানের ফোটোগ্রাফ্খানি সাখিয়ার হাতে দিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখানি তোমার বিবি সাহেবার তস্বীর না কি?”
সাখিয়া তস্বীর দেখিতে দেখিতে বলিল, “হাঁ, এ আমাদের বিবি সাহেবারই তস্বীর। মুন্সী সাহেব বুঝি, বিবি সাহেবার সন্ধান কররার জন্য আপনাকে একখানা তস্বীর দিয়েছেন?”
লতিমন বলিল, “আরে পোড়ার-মুখী সাখি, তুই কি আজকাল চোখেও কম দেখিস্ নাকি? এ যে আমাদের দিলজানের তস্বীর।”
সাখিয়া বলিল, “আমি চোখে কম দেখ্তে যাব কেন? যে আমাকে ‘কম দেখে’ বলে, সে নিজে দু’চোখ কাণা। কে জানে কে তোমার দিলজান-তার মুখে আগুন, এ তস্বীর তার হ’তে যাবে কেন? এ ত আমাদের বিবি সাহেবার তস্বীর।”
লতিমন ছাড়িয়া কথা কহিবার পাত্রী নহে। বলিল, ” কে জানে, কে তোমার বিবি সাহেবা-মুখে আগুন তার! এ আমাদের দিলজানের তস্বীর।”
দেখিয়া-শুনিয়া দেবেন্দ্রবিজয় অবাক্! এবার তিনি ইহার মুখের দিকে চাহেন, একবার উহার মুখের দিকে চাহেন-কেহেই কম নহেন, উভয়েরই মুখের স্রোত সমান। গতিক বড় ভাল নয় দেখিয়া, ফটো দুইখানি ও সেই পত্রের তাড়াটি নিজের পকেটের ভিতরে পুরিয়া ফেলিলেন। অমনি সেই সঙ্গে দুইটি টাকা পকেট হইতে বাহির করিয়া সাখিয়ার হাতে দিতে-যেন জ্বলন্ত আগুনে জল পড়িল; ঝগ্ড়া ভুলিয়া সাখিয়া পরমানন্দে সেই টাকা দুটি বাজাইয়া আঁচলের খুঁটে বাঁধিতে লাগিল। তাহার সুর এবার একেবারে বদ্লাইয়া গেল-কতমতে সে দেবেন্দ্রবিজয়ের ভদ্রলোকত্ব সপ্রমাণ করিতে লাগিল।
দেবেন্দ্রবিজয় তাহাতে কর্ণপাত করিলেন না। তিনি ভাবিতে লাগিলেন, রহস্য ক্রমেই গভীর হইতেছে-সৃজান ও মৃজান উভয়েরই আকৃতি এরূপ সৌসাদৃশ্য থাকিবার কারণ কি? নিশ্চয়ই তাহারা উভয়ে একরকম দেখিতে; নতুবা একজনের ফটোগ্রাফ লইয়া লতিমন ও সাখিয়ার এরূপ গোলযোগ বাধিবে কেন? দিলজান সৃজানের সঙ্গে দেখা করিতে গিয়াছিল, এবং উভয়ের নামেও অনেকটা মিল আছে। বোধ হয়, সৃজান দিলজানের কোন নিকট-আত্মীয়া হইবে। উভয়ের মধ্যে একটা কিছু সম্পর্ক থাকা খুবই সম্ভব; নতুবা বারনারী হইয়া দিলজান সৃজানের সহিত দেখা করিতে সেজন্য আপাততঃ খিদিরপুরে গিয়া মুন্সী মোজাম হোসেনের সহিত একবার সাক্ষাৎ করা বিশেষ প্রয়োজন হইতেছে। যে ব্যক্তি এই ফটোগ্রাফ তুলিয়াছে ইতোমধ্যে একবার তাহারও সহিত দেখা করিতে হইবে।

৩.০৭ সপ্তম পরিচ্ছেদ – তিতুরাম

দেবেন্দ্রবিজয় সহজে ছাড়িবার পাত্র নহেন। তখনই খিদিরপুর অভিমুখে যাত্রা করিলেন। মোজাম হোসেনের সহিত দেখা করিবার পূর্ব্বে তিনি সেই ফটোগ্রাফ ছবি প্রস্তুতকারীর সহিত দেখা করিলেন। তাঁহার নাম কবিরুদ্দীন! ফটোগ্রাফ ছবিতেই তাঁহার নাম ও ঠিকানা লেখা ছিল, তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে দেবেন্দ্রবিজয়ের বিশেষ কোন কষ্ট স্বীকার করিতে হইল না। কবিরুদ্দীনের নিকটে গিয়া যাহা তিনি শুনিলেন, তাহাতে তাঁহাকে আরও আশ্চর্য্যান্বিত হইতে হইল। কবিরুদ্দীন বলিলেন, সেই ফটো দুইখানির একখানি মুন্সী মোজাম হোসেনের এবং অপরখানি তাহার কন্যা সৃজানের। তিনি দিলজান বা মৃজান সম্বন্ধে কিছু জানেন না। দেবেন্দ্রবিজয়ের বিস্ময় সীমাতিক্রম করিয়া উঠিল; তিনি ভাবিতে লাগিলেন, সৃজন বিবির ফটো দিলজানের দেরাজের মধ্যে কেন? অথচ লতিমন বাইজী সৃজান বিবির ফটোকে দিলজানের প্রতিকৃতি বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে চাহে। অবশ্যই লতিমনের এরূপ করিবার একটা গুপ্ত-উদ্দেশ্য আছে; কিন্তু সে উদ্দেশ্য কি? হয়তো লতিমনও এই খুনের মামলায় জড়ীভূত আছে; নতুবা তাহার ভ্রম হইয়াছে। এ যে বিষম ভ্রম! আগে একবার মুন্সী মোজাম হোসেনের সহিত দেখা করি তাহার পর দেখিতে হইবে, দিলজানের খুনের সহিত লতিমন বাইজীর কতটুকু সংশ্রব আছে। মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া দেবেন্দ্রবিজয় তথা হইতে বাহির হইলেন।
দেবেন্দ্রবিজয় একেবারে মুন্সী মোজাম হোসেনের সহিত সাক্ষাৎ করা যুক্তি-যুক্ত বোধ করিলেন না। আগে বাহির হইতে তাহার বিষয়টা যতটা জানিতে পারা যায়, সেই চেষ্টা করিতে হইবে স্থির করিয়া, দেবেন্দ্রবিজয় সেখানকার একটি পল্লীর মধ্যে প্রবেশ করিলেন। পল্লীতে মুসলমান অধিবাসীর সংখ্যাই বেশি। দক্ষিণাংশে কয়েকজন দরিদ্র হিন্দুর বসতি। দেবেন্দ্রবিজয় সেখান দিয়া যাইবার সময়ে দেখিলেন, একখানি খোলার ঘরে বাহিরের দাবায় বসিয়া একজন পক্ককেশ বৃদ্ধ ক্রোড়স্থিত একটি পঞ্চমবর্ষীয় শিশুর সহাস্যে অনেক কটূক্তি বর্ষণ করিতেছেন। তাহাকে “ভাই-দাদা’ বলিয়া সম্বোধন করিতেছেন, তখনই আবার তাহাকে শ্যালক পদাভিষিক্ত করিয়া নিজে নিজে খুব একটা আনন্দানুভাব করিতেছেন; সেই আনন্দাতিশয্যে সেই বালকের ভাবী-পত্নীর উপরে (হয় ত এখনও সে জন্মগ্রহণ করে নাই) একটা অযথা দাবী দিয়া রাখিতেছেন! মুখর বৃদ্ধের মুখের বিশ্রাম নাই-অনবরত বকিতেছেন। শিশু কখনও ‘হাঁ’-কখনও ‘না’-কখনও বা ‘আচ্ছা’ বলিয়া ঘাড় নাড়িতেছে। বালকটি তাঁহার পৌত্র।
দেবেন্দ্রবিজয় সেই মুখর বৃদ্ধের সম্মুখীন হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়, বলিতে পারেন, এখানে মুন্সী মোজাম হোসেন সাহেব কোথায় থাকেন?”
বৃদ্ধ কহিলেন “আরও আপনাকে অনেকটা যাইতে হইবে-গ্রামের বাহিরে গঙ্গার ধারে তিনি থাকেন। মহাশয়ের নাম?”
দে। দেবেন্দ্রবিজয় মিত্র। আপনার নাম?
বৃ। আমার নাম শ্রীতিতুরাম পরামাণিক।
দে। মহাশয়ের কি করা হয়?
বৃ। নিজের জাতীয় ব্যবসা-আমরা জতিতে নাপিত। তবে আমি নিজের হাতে আর পারি না, এ বুড়োবয়সে চোখে ঠাহর হয় না; আমার ছেলেই সব দেখে-শোনে।
দে। সে ত ঠিক কথা, উপযুক্ত ছেলের কাজই ত এই।
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, তিনি যথাস্থানে ও যোগ্য ব্যক্তির নিকটেই উপনীত হইয়াছেন। এই বৃদ্ধের নিকটে সকল খবরই পাওয়া হাইবে। বৃদ্ধ জাতিতে নাপিত-নাপিত গ্রামের সংবাদপত্র-বিশেষ। যেখানে যাহা কিছু ঘটে, সে সংবাদ আগে ইহাদের নিকটে পৌঁছায়। বিশেষতঃ ইনি বৃদ্ধ-তাতে বেকার-নিজেকে বড়-একটা কিছু করিতে হয় না; সুতরাং ইনি গ্রামের ভালমন্দ সর্ব্ববিধ সংবাদে কূলে কূলে পূর্ণ হইয়া আছেন। দেবেন্দ্রবিজয় “আঃ! আর পারা যায় না, অনেক ঘুরেছি,” বলিয়া সেইখানে বসিয়া পড়িলেন। বসিয়া বলিলেন, “এখন কি মুন্সী সাহেবের সঙ্গে দেখা হইবে?”
বৃ। সকল সময়ে দেখা হবে। তিনি আজ পাঁচ বৎসর শয্যাশায়ী হ’য়ে রয়েছেন। খুব আমীর লোক ছিল গো-ইদানীং অবস্থাটা একেবারে খারাপ হ’য়ে গেছে। তাঁর কাছে আপনার কি দরকার?
দে। (যাহা মনে আসিল)। তাঁহার একখানি বাড়ী বিক্রয় হইবে, শুনিয়াছি। সেই বাড়ী কিনিবার ইচ্ছা আছে।
বৃ। সে বাড়ী অনেকদিন বিক্রী হ’য়ে গেছে। সে আজ সাত-আট বছরের কথা। এখন নিজে একখানি ছোট খোলার ঘর ভাড়া নিয়ে গঙ্গার ধারে থাকেন। তাঁর আর বাড়ী কোথায়। এখন অবস্থা বড় খারাপ।
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, কথাটা ঠিক খাটিল না উল্টাইয়া দেওয়া দরকার। বলিলেন, “তাই ত, তবে কি ক’রে তাঁর চলে? তাঁর কি আর কেহ নাই-ছেলে-মেয়ে?”
তিতুরাম কহিলেন, “ছেলে নাই-দুইটি মেয়ে।”
দেবেন্দ্রবিজয় সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তাঁর দুইটি কন্যা?”
তিতুরাম বলিল, “হাঁ, দুটি মেয়ে-যমজ। বড় চমৎকার দেখতে, বামুন-কায়স্থের ঘরেও এমন রূপ হয় না-যেন ফেটে পড়্ছে। একজনের নাম মৃজান আর একজনের নাম সৃজান।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “বটে! মেয়ে দুটি কি এখন মুন্সী সাহেবের কাছেই আছে না কি?”
গম্ভীরভাবে তিতুরাম বলিলেন, “না মশাই! বড়-বড় মেয়ে। মুন্সী সাহেব আজ পাঁচ বৎসর ব্যারামে প’ড়ে। কে বা মেয়েদের দেখে, কে বা বিয়ে দেয়! একটা মেয়ে, মৃজান যার নাম, একটা কোন লোকের সঙ্গে তার ভাব হয়, তারই সঙ্গে সে কোথায় চ’লে গেছে। সেই অবধি সে একেবারে নিরুদ্দেশ।”
দে। কে সে লোক-নাম কি?
তিতু। কি আমীর খাঁ, না হামির খাঁ-মুসলমানের নাম ঠিক মনে থাকে না, বাপু।
দেবেন্দ্রবিজয় বুঝিলেন, তিনি সেই সকল পত্র পড়িয়া পূর্ব্বে যাহা অনুমান করিয়াছিলেন, তাহা অভ্রান্ত। মনিরুদ্দীন আমীর খাঁ নামে এখানে আবির্ভূত হইয়া মৃজান সহ অন্তর্হিত হইয়াছিলেন। এবং বামুন বস্তিতে লতিমনের বাড়ীতে মৃজানকে দিলজান নামে জাহির করিয়া রাখিয়াছিলেন। দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “আর সেই সৃজান নামে যে মেয়েটি?”
তিতু। তার অদৃষ্টা ভাল। খুব একজন বড়লোকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। সে এখন মুন্সী জোহিরুদ্দীনের পত্নী। যদিও জোহিরুদ্দীনের বয়স হয়েছে, তাতে আর আসে-যায় কি, খুব বড়লোক, বুড়ো হ’লে কি হয়!
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, বৃদ্ধ তিতুরাম এবার নিজের গায়ে হাত দিয়া কথা কহিতেছে। বলিলেন, “তা’ ত বটেই, এক সময়ে সকলেই বুড়ো হ’তে হবে।” মনে ভাবিলেন, যাহা হউক, এখানে আসিয়া অনেকটা কাজ হইল। দিলজান যে সৃজানের ভগিনী, ইহাতে সন্দেহ নাই। এখন একবার মুন্সী সাহেবের সঙ্গে দেখা করিতে পারিলেই সকল গোল চুকিয়া যায়।
অনন্তর দেবেন্দ্রবিজয় মুন্সী মোজাম হোসেনের বাসস্থানের ঠিকানা ঠিক করিয়া লইয়া সেখান হইতে উঠিলেন।

৩.০৮ অষ্টম পরিচ্ছেদ – পারিবারিক

দেবেন্দ্রবিজয় যখন গঙ্গার ধারে উপস্থিত হইলেন, তখন সূর্য্য অস্তোন্মুখ! অস্তোন্মুখ সূর্য্যের কনকপ্রবাহে চারিদিক্ ঝ্ল ম্ল করিতেছে। এবং সন্ধ্যার বাতাস বহিতে আরম্ভ করিয়াছে। বাত্যাবিতাড়িত তরঙ্গমালা প্রচণ্ডবেগে গঙ্গার কূলে আঘাত করিতেছে।
পশ্চিম-গগন হইতে বিকীর্ণ হইয়া কনকধারা গঙ্গার উভয় সৈকতশয্যায় স্বর্ণাস্তরণের ন্যায় বিস্তৃত রহিয়াছে। আকাশ এখনও স্বর্ণোজ্জ্বল রহিয়ছে; এবং সেখানে মেঘ বিচরণ করিতেছে। মেঘ কখনও বাঘ, কখনও হাতী, কখনও ঘোড়া, কখনও রথ, কখনও বা লাঠী কাঁধে এক বিকটাকার দৈত্যের আকৃতি ধারণ করিতেছে।
বলা বাহুল্য, সেদিকে দেবেন্দ্রবিজয়ের দৃষ্টি ছিল না; তিনি আপনার কার্য্যোদ্ধারের চিন্তায় মগ্ন ছিলেন। কনকাস্তরণবিস্তৃত সৈকত-শয্যা, তথায় তরঙ্গের প্রচণ্ড আঘাত, অথবা আকাশে মেঘের নানারূপ মূর্ত্তিধারণ, এ সকল দেখিবার তাঁহার আদৌ অবসর ছিল না।
যথা সময়ে দেবেন্দ্রবিজয় মুন্সী সাহেবের বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। মুন্সী সাহেব একটী ঘরে একখানি খাটিয়ার উপরে শুইয়া আছেন। তিনি অত্যন্ত কৃশ-যেন সে শরীরে অস্থি ও ত্বক্ ছাড়া আর কিছুই নাই। চোখে মুখে কালিমা পড়িয়াছে। গণ্ডাস্থি বাহির হইয়া পড়িয়াছে। এবং চোখের দৃষ্টি একান্ত নিষ্প্রভ হইয়া গিয়াছে। তাহা হইলেও এখনও বুঝিতে পারা যায়, এক সময়ে এই মুখ খুব সুন্দর ছিল।
দেবেন্দ্রবিজয়কে দেখিয়া মোজাম সাহেব বলিলেন, “কে আপনি, মহাশয়? কোথা হইতে আসিয়াছেন? কি আবশ্যক?”
দেবেন্দ্রবিজয় প্রথম প্রশ্ন দুটীর উত্তর দেওয়া প্রয়োজন দেখিলেন না। বলিলেন “আবশ্যক কিছু আছে। আমি একটা বিশেষ কাজে আপনার নিকটে আসিয়াছি। আপনার সহিত অনেক কথা আছে।”
মোজাম হোসেন বলিলেন, “অনেক কথা কহিবার সুবিধা আমার নাই। ডাক্তারের নিষেধ-খুব নির্জ্জনে থাকা দরকার। এমন কি কাহারও সঙ্গে দেখা করাও ঠিক নহে; আপনি বিদায় লইলে সুখী হইব।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “যথা সময়ে বিদায় লইব, সেজন্য আপনি অকারণ উদ্বিগ্ন হইবেননা। আপনার কন্যাদের সম্বন্ধে দুই-একটী কথা জিজ্ঞাস্য আছে।”
অতিরিক্ত ক্রুদ্ধ হইয়া বৃদ্ধ মোজাম হোসেন বলিলেন, “কন্যাদের! আমার একটি ভিন্ন কন্যা নাই। আপনি কি ভুল বকিতেছেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “না, আমার কিছু মাত্র ভুল হয় নাই। আপনার দুইটি কন্যা। একজনের নাম সৃজান, কলিঙ্গা-বাজারের মুন্সী জোহিরুদ্দীনের সঙ্গে তাহার বিবাহ হইয়াছে। অপর মেয়েটির নাম মৃজান।”
রুগ্ন বৃদ্ধ কঠোর-নেত্রে দেবেন্দ্রবিজয়ের দিকে চাহিলেন। তেমনি কঠোর-কণ্ঠে বলিলেন, “কে তুমি বেয়াদব্, ঐ সকল পারিবারিক কথায় তোমার কি প্রয়োজন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আমার নাম দেবেন্দ্রবিজয়-আমি ডিটেকটিভ-পুলিসের লোক।”
মুন্সী মোজাম হোসেন শুইয়াছিলেন-ব্যগ্রভাবে উঠিয়া বসিলেন। রোষক্ষুদ্ধকণ্ঠে বলিলেন, “বুঝিয়াছি, মুন্সী জোহিরুদ্দীন কোন গুপ্ত অভিসন্ধিতে আপনাকে এখানে পাঠাইয়াছেন। পাঠাইয়া ভাল করেন নাই; আমি সেখানকার সকল খবর শুনিয়াছি। মুন্সী জোহিরুদ্দীনের দোষেই আমার কন্যার এই অধঃপতন হইয়াছে। তিনি যদি আমার কন্যার প্রতি সদ্ব্যবহার করিতেন, তাহা হইলে কখনই এমন একটা দুর্ঘটনা ঘটিতে পারিত না। এমন কি তিনি, আমি শয্যাশায়ী হইয়া পড়িয়াছি জানিয়াও, আমাকে দেখিবার জন্য আমার কন্যাকে একবারও এখানে পাঠাইতেন না। দোষ আমার কন্যার নহে-দোষ তাঁহার নিজেরই।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “মুন্সী জোহিরুদ্দীন আমাকে পাঠান নাই। আমি নিজেই কোন প্রয়োজনে আসিয়াছি। আমার হাতে একটা বড় জটিল মাম্লা পড়িয়াছে।”
মোজাম হোসেন বলিলেন, “কিসের মাম্লা?”
দেবেন্দ্রবিজয় সহসা উত্তর করিলেন, “আপনার অপর কন্যার খুনের মাম্লা।”
মৃত্যুশরাহত মৃগের ন্যায় মুন্সী সাহেব চমকিত হইয়া উঠিলেন। তাঁহার বিবর্ণ মুখ আরও শুকাইয়া গেল। কম্পিতকণ্ঠে বলিলেন, “হা আল্লা! মৃজান খুন হইয়াছে!”
দেবেন্দ্রবিজয় ছাড়িবার পাত্র নহেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “মৃজান আবার কে?”
“আমার কন্যা-আমার কন্যা!” বলিয়া বৃদ্ধ উভয় হস্তে মুখ আবৃত করিলেন।
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “এই মাত্র আপনি বলিলেন, আপনার একটি ভিন্ন আর কন্যা নাই; আমিও ঠিক তাহাই মনে করিয়াছিলাম।”
বৃদ্ধ রোদনোচ্ছ্বসিতকণ্ঠে বলিতে লাগিলেন, “আমার দুইটি কন্যা-আমি আপনাকে মিথ্যা কথা বলিয়াছিলাম। আপনি যে মৃজানের কথা বলিতেছেন, সে আমীর খাঁ নামে একটা বদ্মায়েসের প্রলোভনে পড়িয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে। তাহার আর সন্ধান পাই নাই। আমার নিজের অবস্থা দেখিতেছেন, তাহাতে সন্ধান করিবার সামর্থ্যও আর নাই। সে অবধি আমি সেই শয়তানীর নাম মুখে আনি না-সে আমার মুখে কলঙ্কের কালি দিয়া গিয়াছে; কিন্তু তথাপি সে দোষ তাহার নয়-বেইমান্ আমীর খাঁই তাঁহার সর্ব্বনাশ করিয়াছে।”
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, বৃদ্ধের মনের মধ্যে এ সময়ে একটা অদম্য বেগ আসিয়াছে। এই সময়ে বৃদ্ধের হৃদয়ের দ্বার কোন রকমে একটুখানি উদ্ঘাটন করিয়া দিতে পারিলে, তাঁহার মুখ হইতে অনেককথাই বাহির হইয়া পড়িবে; কিন্তু কোন্ কথা দ্বারা ঠিক স্থানে আঘাত করা যাইতে পারে, দেবেন্দ্রবিজয় তাহা খুঁজিতে লাগিলেন। তখনই একটা ঠিক করিয়াও ফেলিলেন। বলিলেন, “দেখুন মুন্সী সাহেব, আপনি একজন মান্য-গণ্য, মহাশয় ব্যক্তি, আপনার পারিবারিক বিষয়ে কোন কথার উত্থাপন করা আমার পক্ষে একান্ত অনুচিত, সেটুকু বুঝিবার শক্তি যে আমার নাই, এমন নহে। তবে আমার উপরে একটা দায়িত্ব রহিয়াছে, সে দায়িত্ব যে-সে দায়িত্ব নহে, একজন লোকের জীবন নিয়ে টানাটানি। যদি তাহা আমার কাছে শোনেন, আপনিও আমাকে সাধ্যমত সাহায্য করিতে প্রস্তুত হইবেন। তখন আমার নিকটে আপনি অসঙ্কোচে সকল কথাই প্রকাশ করিবেন।”
জ্বলন্ত রক্তচক্ষুঃ মেলিয়া মুন্সী সাহেব একবার দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে চাহিলেন; তাহার পর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “বলুন, আমি শুনিতে প্রস্তুত আছি-আপনার বক্তব্য শেষ করুন। যদি উচিত বোধ করি, দ্বিধা করিবার কিছুই না থাকে, আমি আপনার কাছে কোন কথা গোপন করিব না।”
তখন দেবেন্দ্রবিজয় মেহেদী-বাগানের খুন ও সৃজানের গৃহত্যাগ সম্বন্ধে যাহা কিছু জানিতেন, বলিলেন। এবং এই খুনের সহিত সৃজানের গৃহত্যাগের যে কতটা সংসক্তি আছে, তাহাও বুঝাইয়া দিলেন। তাহার পর মজিদ খাঁকে যে সকল ভিত্তিহীন সন্দেহ দ্বারা কঠিনভাবে জড়াইয়া ফেলিয়া, তিনি তাহাকে একেবারে হাজতে পুরিয়া ফেলিয়াছেন, তাহাও অনুক্ত রাখিলেন না।
বিশেষ মনোযোগের সহিত সকল কথা শুনিয়া মোজাম হোসেন ক্ষণকাল নতমুখে নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন। অনন্তর দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে চাহিয়া হস্তে হস্তাবমর্ষণ করিতে করিতে অত্যন্ত করুণ-কণ্ঠে বলিতে লাগিলেন, “এক সময়ে আমার এমন দিন ছিল, যখন অনেকেই আমার মুখ চাহিয়া থাকিত। যাহাদের আসন নিম্নে ছিল, এখন আমাকে অবস্থা বিপাকে তাহাদের নিম্নে আসন পাতিতে হইয়াছে। এখন একটা কিছু সামান্য নিন্দাতে সকলেই আমার উপরে চাপিয়া পড়িবে, সেইজন্য আমাকে খুব সাবধানে চলিতে হয়; কলঙ্কের কথা যত গোপন থাকে, সেজন্য এখন আমার বিশেষ চেষ্টা করাই কর্ত্তব্য; কিন্তু আপনার মুখে যেরূপ শুনিতেছি, তাহাতে একজন নির্দ্দোষীর জীবন-সংশয়। এখন তাহাকে উদ্ধার করিবার জন্য ভদ্রব্যক্তিমাত্রেরই চেষ্টা ও সাহায্য করা উচিত। বলুন, আপনি কি জানিতে চহেন? অবক্তব্য হইলেও আমি তাহা আপনাকে বলিব।”
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “দিলজান কি আপনার কন্যা?”
প্রত্যুত্তরে মুন্সী সাহেব একখানি কেতাবের ভিতর হইতে দুইখানি ফটোগ্রাফ বাহির করিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের সম্মুখে ফেলিয়া দিলেন।

৩.০৯ নবম পরিচ্ছেদ – পূর্ব্বকথা

ফটোগ্রাফ দুইখানি কুড়াইয়া লইয়া দেখিতে দেখিতে দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “এ যে দুইখানিই আপনার কন্যা দিলজানের তস্বীর দেখিতেছি।”
মুন্সী সাহেব শুষ্কমুখে শুষ্ক হাসি হাসিয়া বলিলেন, “কেবল আপনার নহে, এরূপ ভ্রম অনেকেরই হইয়াছে। উহা একজনের নহে, আমার দুই কন্যারই তস্বীর। এইখানি মৃজানের-আপনি যাহাকে দিলজান বলিতেছেন। আর এইখানি সৃজানের।” বলিয়া নির্দেশ করিয়া দেখাইয়া দিলেন।
দেবেন্দ্রবিজয় ছবি দুইখানি বিশেষ মনোনিবেশপূর্ব্বক পর্য্যবেক্ষণ করিতে লাগিলেন। দুইখানিতে অনিন্দ্যসুন্দরী স্ত্রীমূর্ত্তি। উভয়ের মুখাকৃতির অতি সাদৃশ্য। তাহার উপর বেশভূষা একপ্রকার হওয়ায় আরও মিলিয়া গিয়াছে-চিনিবার যো নাই। এমন কি দুইজনের পৃথক্ ছবি উঠাইবার কোন আবশ্যকতা ছিল না; এবং কোন মিতব্যয়ী ইহাতে কখনই অনুমোদন করিতে পারিতেন না। যাহা হউক, সেই একমাত্র ছবি লইয়া লতিমন ও সাখিয়ার ভয়ানক গোলযোগ ঘটইবার কারণ দেবেন্দ্রবিজয়ের নিকটে এতক্ষণে সুস্পষ্ট হইয়া উঠিল। তিনি এখন আর তাহাতে বিস্ময়ের কিছুই দেখিলেন না।
মুন্সী মোজাম হোসেন বলিতে লাগিলেন, ” আমি এখানে প্রায় আজ দশ বৎসর, এই গঙ্গার ধারে বাস করিতেছি। মেয়ে দুটি আমার কাছে থাকিত। অনেক দিন পূর্ব্বেই তাহাদিগের মাতার মৃত্যু হইয়াছিল। আমিই তাহাদিগকে মাতৃপিতৃস্নেহে বুকে করিয়া লালন-পালন করিয়াছি।
হায়, তাহার পরিমাণ যে এমন হইবে, কে তাহা পূর্ব্বে ভাবিয়াছিল। প্রায় দুই বৎসর হইল, আমীর নামে একটী যুবক আমার কাছে ফার্সী শিখিতে আসিয়াছিল। আমি উত্থান শক্তি রহিত-কোথাও যাইবার ক্ষমতা ছিল না। আমীর খাঁ আমার এইখানেই অধ্যয়ন করিতে আসিত। এইখানেই সে কোথায় একটা বাসা ভাড়া করিয়াছিল। প্রথম হইতেই আমার কন্যা মৃজানকে তাহার একান্ত অনুরাগিণী দেখিয়াছিলাম। বুঝিলাম, মনের ভিতরে একটা ঘোরতর দুরভিসন্ধি লইয়া আমীর খাঁ আমার সংসারের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে। কিছুদিন পরে আমি সেই চরিত্রহীন, বেইমান্ আমীর খাঁকে এখান হইতে দূর করিয়া দিলাম। আমার কন্যা তখন সেই প্রতারকের প্রলোভনে একান্ত মুগ্ধ হইয়া পড়িয়াছিল। একদিন আমার মৃজানকে লইয়া একেবারে কোথায় অন্তর্হিত হইয়া গেল-আর তাহাদের কোন সংবাদ পাইলাম না। সেই অবধি আমি সেই কলঙ্কিনী কন্যার নাম মুখে আনি না-মৃজান নামে একটা শয়তানী যে আমার এখানে এতকাল আশ্রয় করিয়াছিল, সে কথা আমি একেবারে ভুলিয়া যাইতে চেষ্টা করিতেছিলাম। মৃজান নামে যে কোন কালে আমার একটা মেয়ে ছিল, তাহা আমি আর মনে মনে স্থান দিতে ইচ্ছা করিতাম না। এমন কি সৃজানই যে আমার একমাত্র মেয়ে, এই ধারণাই এখন আমার মনের মধ্যে এক রকম ঠিক হইয়া গিয়াছিল। ক্রমে সেই সৃজানও তাহার ভগিনীর পথানুসরণ করিল। আমার মান-সম্ভ্রম আর কিছুই রহিল না। কিন্তু এ কাজটা ঠিক জোহিরুদ্দীনের দোষেই হইয়াছে; তিনি সৃজানকে অত্যন্ত সন্দেহের চোখে দেখিতেন-একে তাঁহার বয়স হইয়াছে, তাহার উপরে আবার তিনি অমূলক সন্দেহের বশে সৃজানের সহিত এমন সব ব্যবহার করিতেন যে, তাহাতে তাহার হৃদয় অধিকার করা দূরে থাক্, বরং তাহার হৃদয়ে যতটুকু স্থান পাইয়াছিল, নিজদোষে তাহাও নষ্ট করিয়া ফেলিলেন। এ দুনিয়ার নিয়মই এই। সে যাহা হউক, আমরাও তাই বোধ হয় যে, সৃজান ও মোনিরুদ্দীনের গুপ্ত-অভিসন্ধি মৃজান কোন রকমে টের পাইয়াছিল; পাছে, মনিরুদ্দীন তাহার যেমন সর্ব্বনাশ করিয়াছে, তাহার ভগিনীরও সেইরূপ দুর্গতি করে, এই আশঙ্কায় হয় ত সে নিজেই ভগিনীকে সাবধান করিতে রাত্রিতে জোহিরুদ্দীনের বাটীতে গিয়াছিল। সম্ভব, সৃজান মৃজানের কথায় কর্ণপাত করে নাই। তাই মৃজান আর কোন উপায় না দেখিয়া মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে যায়, মনিরুদ্দীন তখন বাড়ীতে ছিল না- তাহার পর সেখান হইতে ফিরিয়া আসিবার সময়ে পথে হতভাগিনী খুন হইয়াছে। তেমন একজন সম্ভ্রান্ত, সদাশয় ব্যক্তির পুত্র হইয়া মনিরুদ্দীন যে এরূপে পিতৃনাম রক্ষা করিতেছে, ইহাই আশ্চর্য্য!”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “আপনার মুখে যাহা শুনিলাম, তাহাতে আপনার কন্যা দিলজানের খুনের কি কিনারা হইল?”
বিরক্তভবে, মুন্সী মোজাম হোসেন বলিলেন, “দিলজানের নাম আমার কছে করিবেন না। আপনার কথাই ঠিক, কে মৃজানকে খুন করিয়াছে, কেমন করিয়া বলিব? আপনি যেমন বলিতেছেন, আমরাও তাহাই বোধ হয়; মজিদ খাঁর কোন দোষ নাই- সে কেন মৃজানকে খুন করিবে? কোন কারণ দেখি না।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হাঁ, আমি তাহার বিরুদ্ধে অনেক প্রমাণ পাইয়াছি; কিন্তু এমন কোন একটা কারণ দেখিতেছি না, যাহাতে তাহাকে খুনী বলিয়া বুঝিতে পারি। এখন আপনার কন্যা মৃজানের পূর্ব্বজীবন সম্বন্ধে দুই-একটী বিষয় আমার জানা দরকার। আমীর খাঁর পূর্ব্বে মৃজান আর কাহারও অনুরাগিনী হইয়াছিল?”
অবনতমস্তকে মোজাম হোসেন বলিলেন, “না”।
“মৃজানের কেহ অনুরাগী হইয়াছিল?”
“না।”
“একজনও না?”
“না।”
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, মুন্সী মোজাম হোসেনের নিকট থাকিয়া আর বিশেষ কোনকাজ হইবে না; বিদায় লইয়া সুতরাং উঠিয়া পড়িলেন। কাজের মধ্যে-প্রকৃতরূপে এক্ষণে জানিতে পারা গেল, দিলজান সৃজানের সহোদরা ভগিনী। এবং উভয় ভগিনীই একজনের প্রেমাকাঙ্ক্ষিণী। সুতরাং দিলজানের খুনের সহিত সৃজানের গৃহত্যাগের যে একটা খুব ঘনিষ্ট সম্পর্ক আছে, সে সম্বন্ধে দেবেন্দ্রবিজয়ের আর কোন সন্দেহ রহিল না। কিন্তু কিছুতেই ভাবিয়া ঠিক করিতে পারিলেন না-সে সম্পর্কটি কি-এবং কেনই বা দিলজান খুন হইল-কে বা তাহাকে খুন করিল? একবার মনে হইল, সৃজানই কি ঈর্ষাবশে নিজের ভগিনীকে খুন করিয়া নিজের অধঃপতনের পথ পরিষ্কার করিয়া লইয়াছে? কে জানে, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না-আরও গোলযোগে পড়িলাম। মুন্সী মোজাম হোসেনের সহিত দেখা করিয়া এ রহস্য পরিষ্কার হওয়া দূরে থাক্, আরও গোলযোগ বাঁধিয়া গেল। দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, তিনি গন্তব্যস্থানে পৌঁছাইবার চেষ্টা করিয়া যখন যে সূত্র অবলম্বন করিতেছেন, সামান্য দূর যাইতে-না-যাইতে তাহাই ছিঁড়িয়া গিয়া তাঁহাকে এমন অন্ধকারময় বিপথে চালিত করিতেছে যে, তিনি তথা হইতে বাহির হইবার কোন সুগম পথ খুঁজিয়া পাইতেছেন না। বুঝিলেন, এ রহস্যজালে যেরূপ বিষম জট্ ধরিয়াছে, যাহা আরও নিবিড়ভাবে পাক-খাইয়া যাইতেছে। দেবেন্দ্রবিজয় তখন আপন মনে বলিলেন, “এখন একবার মুন্সী জোহিরুদ্দীনের সহিত দেখা করিতে হইবে। যদি তাঁহার স্ত্রী সৃজান বিবি এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকে? অনুচিত হইলেও আমাকে এই সকল কথা তাঁহার নিকটে তুলিতে হইবে। তাঁহার কলঙ্কিনী স্ত্রী সম্বন্ধে কোন কথা এখন তাঁহাকে বলিতে গেলে তিনি রাগ করিতে পারেন। তাহাতে ক্ষতি কি? একজন নির্দ্দোষী ব্যক্তিকে রক্ষা করিবার জন্য আমি সর্ব্বতোভাবে চেষ্টা করিব। আমার খুব বিশ্বাস-মজিদ খাঁ নির্দ্দোষী।”

৩.১০ দশম পরিচ্ছেদ – উকীল-হরিপ্রসন্ন

কোন কোন তৃণ করতলে দলিত করিলে তাহা হইতে সুগন্ধ বাহির হয়; তেমনই মজিদ খাঁ কারারুদ্ধ হইলেই অনেকেরই মুখে তাঁহার গুণগ্রামের কথা বাহির হইতে লাগিল। এমন একজন ধর্ম্মনিষ্ঠ, দয়ালু, বুদ্ধিমান্, সদ্বিদ্বান্ সচ্চরিত্র যুবক মজিদ খাঁ যে, এইরূপ একটা কলঙ্কজনক বারবনিতার হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত আছেন, একথা সহসা কাহারও বিশ্বাস হইল না। দুঃসহ বিস্ময়ের সহিত প্রথমে সকলেই এই অপ্রত্যাশিতপূর্ব্ব সংবাদ শুনিল, কিন্তু কেহ বুঝিতে পারিল না, কোন্ কারণে মজিদ খাঁ দিলজানকে খুন করিতে পারেন। সকলেই মজিদ খাঁকে এই বিপদ্ হইতে উদ্ধার করিবার জন্য সচেষ্ট হইল। সাধারণতঃ এরূপ দেখা যায়, কেহ বিপদে পড়িলে তাহার বন্ধুবর্গ ধীরে ধীরে গা-ঢাকা দেন; কিন্তু মজিদ খাঁর বন্ধুবর্গ তেমন নহেন, তাঁহার সকলে আজ মজিদ খাঁকে বিপন্মুক্ত করিবার জন্য বদ্ধপরিকর।
লদ্ধপ্রতিষ্ঠ বৃদ্ধ উকীল হরিপ্রসন্ন বাবু নম্র-স্বভাব মজিদ খাঁকে বড় স্নেহ করিতেন। তিনি মজিদ খাঁর এই বিপদের কথা শুনিয়া অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হইলেন; এবং যাহাতে তাঁহাকে ফাঁসীকাঠের মুখ হইতে বাঁচাইতে পারেন, তাহার আয়োজন করিতে লাগিলেন।
উকীল হরিপ্রসন্ন বাবু মনিরুদ্দীনের পিতার সহাধ্যায়ী বাল্যবন্ধু। বন্ধুর জমিদারী-সেরেস্তার সমস্ত মাম্লা-মোকদ্দমা তাঁহাকেই দেখিতে হইত; তাঁহার অবর্ত্তমানে এখনও দেখিয়া থাকেন। তিনি মজিদ খাঁ ও মনিরুদ্দীনের বাল্যকাল হইতে তদুভয়কে দেখিয়া আসিতেছেন। তদুভয়ের স্বভাব পরষ্পর ভিন্ন রকমের। মনিরুদ্দীন যেমন দাম্ভিক, নির্ব্বোধ, অশিষ্ট, চঞ্চল এবং নির্দ্দয়; মজিদ তেমনি ঠিক তাহার বিপরীত-মজিদ মার্জ্জিতবুদ্ধি, বিনয়ী, শিষ্ট শান্ত ধীর এবং পরোপকারী। সেইজন্য হরিপ্রসন্ন বাবু মজিদেরই বিশেষ পক্ষপাতী। মনিরুদ্দীনের পিতার মৃত্যুর পর হইতে তাঁহার জমিদার-সংক্রান্ত কোন মাম্লা-মোকদ্দমা উপস্থিত হইলে হরিপ্রসন্ন বাবু মজিদ খাঁর সহিতই তৎসম্বন্ধে পরামর্শ করিতেন। মনিরুদ্দীনকে সেজন্য তাঁহার বড়-একটা প্রয়োজন হইত না।
জোহেরার পিতার সহিতও সুবিজ্ঞ উকীল হরিপ্রসন্ন বাবুর বন্ধুত্ব ছিল। মনিরুদ্দীনের পিতার ন্যায় তাঁহারও জমিদারী-সেরেস্তার মাম্লা-মোকদ্দমা, হরিপ্রসন্ন বাবুর হাতে আসিয়া পড়িত। জোহেরার পিতার সহিত মনিরুদ্দীনের পিতার বিশেষ সদ্ভাব থাকায় তদুভয়ের জমিদারী সেরেস্তার মাম্লা-মোকদ্দমা একা নিজের হাতে লইতে হরিপ্রসন্ন বাবুর কোন গোলযোগের সম্ভাবনা ছিল না। এবং দুইজন বড় জমিদারকে হাতে পাইয়া তাঁহার আয়ের পথ বেশ সুগম হইয়াছিল। এক্ষণে মুন্সী জোহিরুদ্দীন জোহেরার বিষয়-সম্পত্তির অছি হওয়ায় হরিপ্রসন্ন বাবুর একটু ক্ষতি হইয়াছে। মুন্সী সাহেব কিছু স্বজাতিপ্রিয়। তিনি অধিকাংশ মোকদ্দমা একজন স্বজাতীয় ব্যবহারজীবীর হস্তে নির্ভর করিয়া থাকেন। তবে কোন সঙ্গীন মোকদ্দমা উপস্থিত হইলে হরিপ্রসন্ন বাবুকেই তাঁহাকেই তাঁহার প্রয়োজন হইত। হরিপ্রসন্ন বাবুও তাহাতে কিছুমাত্র দুঃখিত ছিলেন না; যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করিয়াছেন, এখন এই বৃদ্ধ বয়সে অতিরিক্ত পরিশ্রমে আর তাঁহার বড় একটি রুচি ছিল না। তবে তিনি জোহেরাকে অত্যন্ত স্নেহ করিতেন বলিয়া অনেক সময়ে তাঁহাকে স্বেচ্ছা-প্রণোদিত হইয়া অনেক কাজ সম্পন্ন করিতে হইত। যখন জোহেরা এতটুকুটি, তখন তিনি তাহাকে অনেকবার কোলে পিঠে করিয়াছেন। তাঁহার নিজের সন্তানাদি না থাকায় তিনি বিজাতীয় বন্ধুর কন্যা জোহেরাকে অত্যন্ত ভালবাসিয়া ফেলিয়াছেন। এবং জোহেরা অদ্যাপি তাঁহাকে পিতৃতুল্য ভক্তি করে। জোহেরা যে মজিদ খাঁর অনুরাগিণী এবং কেবল অভিভাবক মুন্সী জোহিরুদ্দীনের মত্ না থাকায় বয়স অধিক হইলেও জোহেরার বিবাহ বন্ধ আছে, তাহা হরিপ্রসন্ন বাবুর অগোচর ছিল না। মজিদ খাঁ অতি সুপাত্র। তাঁহার সহিত জোহেরার বিবাহে তিনি পক্ষপাতী ছিলেন; কিন্তু ইদানীং তিনি অত্যন্ত বিস্ময়ের সহিত একটা জনরব শুনিয়াছিলেন যে, জোহেরা মনিরুদ্দীনকে বিবাহ করিতে সম্মত হইয়াছে; কিন্তু অদ্য সহসা জোহেরা সাক্ষাৎ অভিলাষিণী হইয়া তাঁহার নিকটে একজন লোক পাঠাইতে বুঝিতে পারিলেন, তাহা জনরবমাত্র। উকীল মানুষ তিনি, জোহেরার মনোগত ভাব বুঝিতে তাঁহার কতখানি সময়ের আবশ্যক? তিনি আপন মনে কহিলেন, নিশ্চয়ই জোহেরা মজিদ খাঁ কারারুদ্ধ হওয়ায় অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিয়াছে, এখন আমার সহিত দেখা করিয়া একটা পরামর্শ করিতে চায়। মনে করিয়াছে, মজিদ খাঁর বিপদে আমি নিশ্চিন্ত আছি-কি ভ্রম! যাক্ এখন জোহেরার সহিত দেখা না করিয়া আগে মজিদ খাঁর সঙ্গে আর একবার দেখা করিতে হইবে। মজিদ, যেরূপ জটিলভাবে এই বিপদে পড়িয়াছে- যদিও সে নির্দ্দোষী, তথাপি তাহাকে উদ্ধার করা বড় শক্ত হইবে। তাহার বিরুদ্ধে তিনটি ভয়ানক প্রমাণ বলবৎ রহিয়াছে। প্রমাণগুলি লিখিয়া রাখা দরকার, ” বলিয়া পকেট হইতে নোটবুকখানি বাহির করিয়া লিখিতে লাগিলেন।
১। মজিদ খুনের রাতিতে দিলজানকে শেষজীবিত দেখিয়াছে।
২। সেই রাত্রিতেই মেহেদী-বাগানে অকুস্থানের অনতিদূরে মোবারক মজিদকে দেখিয়াছে; তখন মজিদের বড় ব্যস্ত-সমস্ত ভাব।
৩। মজিদের বাসা হইতে একখানা বিষাক্ত ছুরি পাওয়া গিয়াছে। খুব সম্ভব, সেই ছুরিতেই দিলজান খুন হইয়াছে।
অত্যন্ত কঠিন প্রমাণ। ভাবিয়া দেখিলেন, ইহাতে মজিদ যে প্রতিবাদ করিয়াছে, তাহা কোন কাজেরই নহে; তথাপি হরিপ্রসন্ন বাবু তাহাও নোটবুকের অপর পৃষ্ঠায় লিখিলেন:-
১। মজিদ এখন বলিতেছে, খুনের রাত্রিতে যে স্ত্রীলোকের সহিত তাহার দেখা হইয়াছিল, সে দিলজান নহে। সে অন্য কোন স্ত্রীলোক। তাহার নাম সে কিছুতেই প্রকাশ করিতে পারিবে না।
২। মেহেদী-বাগানে অকুস্থানের কিছুদূরে তাহার সহিত মোবারকউদ্দীনের যে সাক্ষাৎ হইয়াছিল, মজিদ বলিতেছে, তাহা দৈবক্রমেই হইয়া থাকিবে।
৩। যেদিন রাত্রিকালে দিলজান খুন হয়, সেই দিন অপরাহ্ণে দিলজানের সহিত মজিদের দেখা হইয়াছিল। মজিদ বলিতেছে, সে তাহার নিকট হইতে ঐ ছুরি জোর করিয়া কাড়িয়া লইয়াছিল।
হরিপ্রসন্ন বাবু অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া দেখিলেন, মজিদ যে প্রতিবাদ করিতেছে, কিছুতেই টিকিবে না। নির্দ্দোষ হইলেও তাহাকে তাহারই দোষে এই হত্যাপরাধে দণ্ডার্হ হইতে হইবে। মজিদ কেন এরূপ কপট ব্যবহার করিতেছে? এখন আর একবার তাহার সহিত দেখা করিয়া যাহাতে তাহার মতি ফিরাইতে পারি, যাহাতে সে অকপটভাবে আমার কছে সকল কথা প্রকাশ করে, সে চেষ্টা এখন আমাকে দেখিতে হইবে। এইরূপ স্থির করিয়া হরিপ্রসন্ন বাবু মজিদ খাঁর সহিত দেখা করিতে বাহির হইয়া পড়িলেন।

৩.১১ একাদশ পরিচ্ছেদ – মুখ বন্ধ

মজিদ খাঁ হাজতে ।
হরিপ্রসন্ন তাঁহার সহিত দেখা করিয়া অনেক রকমে বুঝাইতে লাগিলেন । তাঁহার মাথার উপরে অতি সূক্ষসূত্রে যে একখানা ভয়ানক বিপদের খড়গ ঝুলিতেছে, তাহাও নির্দ্দেশ করিয়া দেখাইয়া দিলেন ।
মজিদ খাঁ বলিলেন, “যাহা বলিবার, তাহা আমি পূর্ব্বেই আপনাকে বলিয়াছি । তবে ছুরিখানির সম্বন্ধে আমি আপনার নিকটে কোন কথা গোপন করিতে চাহি না । আমি বিগত বুধবারে অপরাহ্ণে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে গিয়াছিলাম । সেইখানে দিলজানের সহিত আমার দেখা হয় । দিলজান মনিরুদ্দীনের সহিত দেখা করিতে আসিয়াছিল । তাহার অবস্থা তখন ভাল নহে; সে ক্ষোভে, রোষে যেন উন্মত্তা হইয়া উঠিয়াছিল । আমি তাহাকে অনেক করিয়া বুঝাইতে লাগিলাম. কিছুতেই তাহাকে প্রকৃতিস্থ করিতে পারিলাম না । একবার সে রোষভরে সেই ছুরিখানা বাহির করিয়া বলিল, “আগে সে মনিরুদ্দীনকে খুন করিবে, তাহার পর সৃজানকে; নতুবা সে কিছুতেই ক্ষান্ত হইবে না । আমি তাহার নিকট হইতে জোর করিয়া ছুরিখানা কাড়িয়া লইতে গেলাম; সে তখন ছুরিখানি দ্বারের বাহিরে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিল । আমি যেমন ছুটিয়া গিয়া ছুরিখানি কুড়াইয়া লইতে যাইব-দেখিতে না পাইয়া ছুরিখানি মাড়াইয়া ফেলিলাম, তাহাতেই ছুরির বাঁট ভাঙ্গিয়া যায় । আমি ছুরিখানি তুলিয়া পকেটে রাখিয়া দিলাম । ছুরিখানি যে বিষাক্ত, তাহা আমরা কেহই তখন জানিতাম না । দিলজানের যদি জানা থাকিত, তাহা হইলে আমি যখন ছুরিখানা লইয়া কাড়াকাড়ি করি, অবশ্যই সে আমাকে সাবধান করিয়া দিত, আর সে নিজেও সাবধান হইত । যাহা হউক, তাহাকে বিদায় করিয়া দিয়া আমি নিজের বাসায় চলিয়া আসি; ইহার পর দিলজানের সহিত আর আমার দেখা হয় নাই । বাসায় আসিয়া ছুরিখানা পকেট হইতে বাহির করিয়া আমি টেবিলের উপরেই ফেলিয়া রাখিয়া দিই । আমি চাবির পাশে ছুরি রাখি নাই-আর কেহ সেখানে রাখিয়া থাকিবে ।”
হরিপ্রসন্ন বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “তবে সেইদিন মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে রাত এগারটার পর যে স্ত্রীলোকটির সহিত তোমার দেখা হইয়াছিল, সে কে?”
মজিদ খাঁ অবনতমস্তকে কহিলেন, “সে কথা আমি কিছুতেই বলিতে পারিব না-বাধা আছে । আমি যতক্ষণ না সেই স্ত্রীলোকের সহিত আর একবার দেখা করিতে পারিতেছি ততক্ষণ আমি তাহার নাম প্রকাশ করিতে পারিব না, আমি তাহার নিকটে এইরূপ প্রতিশ্রুত আছি । তাহার সম্মতি ব্যতীত এখন আর উপায় নাই ।”
হরি । তাহার সম্মতি কতদিনে পাইবে?
মজিদ । তা’ আমি এখন কিরূপে বলিব? তবে এ সময়ে মনিরুদ্দীনের সঙ্গে একবার দেখা হইলে আমি যাহা হয়, একটা স্থির করিয়া হয় ত সেই স্ত্রীলোকের নাম প্রকাশ করিতে পারিতাম ।
হরি । তোমার কথার ভাবে বুঝিতে পারা যাইতেছে, সেই স্ত্রীলোক নিশ্চয়ই সৃজান ।
মজিদ । কই, আমি ত আপনাকে কিছু বলি নাই ।
হরি । স্পষ্টতঃ না বলিলেও, তোমার কথার ভাবে বুঝাইতেছে, সেই স্ত্রীলোক আর কেহ নহে-সৃজানই সম্ভব ।সম্ভব কেন-নিশ্চয়ই । আর আমাকে গোপন করিতে চেষ্টা করিয়ো না । ঠিক করিয়া বল দেখি, সে সৃজান কি না?
মজিদ । আমার অপরাধ ক্ষমা করুন, আপনি কোন ক্রমেই এখন আমার কছে আপনার এ প্রশ্নের উত্তর পাইবেন না ।
হরিপ্রসন্ন বাবু আরও অনেক চেষ্টা করিলেন, কিছুতেই মজিদ খাঁর মত্ পরিবর্ত্তন করিতে পারিলেন না । বলিলেন, “তুমি যদি বাপু, তোমার নিজের বিপদের কতটা গুরুত্ব না বুঝিতে পার, তোমার মত নির্ব্বোধ আর কেহই নাই । যদি তুমি এখনও আমার কাছে সত্য গোপন করিতে চাও-আমি তোমাকে উদ্ধার করিবার কোন সুবিধাই করিতে পারিব না ।”
তথাপি মজিদ খাঁ নিরুত্তর রহিল ।

৩.১২ দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – মুখবন্ধের কারণ কি?

হরিপ্রসন্ন বাবু হাজত হইতে বাহির হইয়া নিজের বাড়ীর দিকে চলিলেন । বাটীসম্মুখে আসিয়া দেখিলেন বহির্দ্বারের নিকটে একখানি গাড়ী দাঁড়াইয়া রহিয়াছে । দেখিয়াই চিনিতে পারিলেন, সে গাড়ী জোহেরার । বুঝিতে পারিলেন, তাঁহার যাইতে বিলম্ব হওয়ায় জোহেরা নিজে আসিয়াছে । গাড়ীর ভিতরে জোহেরা বসিয়া ছিল । হরিপ্রসন্ন বাবু তাহাকে সস্নেহ-সম্ভাষণ করিয়া আপনার বাটীর ভিতরে লইয়া গেলেন । দ্বিতলে একটি প্রকোষ্ঠে লইয়া গিয়া তাহাকে বসিতে বলিলেন; এবং একটা স্বতন্ত্র আসনে তাহার সম্মুখবর্ত্তী হইয়া বসিলেন । বসিয়া বলিলেন, “আমি এখনই তোমার ওখানে যাইব বলিয়া মনে করিতেছিলাম । একটা বিশেষ কাজ থাকায়-খবর পাইয়াই যাইতে পারি নাই । তা’ তুমি আসিয়াছ, ভালই হইয়াছে । যে জন্য তুমি আমাকে তোমার সহিত দেখা করিতে বলিয়াছিলে, তাহা আমি অনুভবে তখনই এক প্রকার বুঝিতে পারিয়াছিলাম । আমি এই মাত্র মজিদের নিকট হইতে ফিরিতেছি । মজিদ নিশ্চয়ই নির্দ্দোষী-তাহাতে আমার কোন সন্দেহ নাই ।”
জোহেরা বলিল, “নির্দ্দোষী -তিনি যে নির্দ্দোষী, তাহা আমিও জানি । তাঁহার দ্বারা কখনই এই ভয়ানক হত্যাকাণ্ড সম্ভবপর নয়; কিন্তু কিরূপে তাঁহার নির্দ্দোষতা সপ্রমাণ হইবে, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না ।”
চিন্তিতমুখে হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “তাই ত, যেরূপ দেখিতেছি, তাহাতে এখন মজিদের নির্দ্দোষতা সপ্রমাণ করা বড় শক্ত ব্যাপার! এমন কি সে আমার কাছেও কিছুতেই কোন কথা প্রকাশ করিতে চাহে না । কেবল সকলই গোপন করিবার চেষ্টা করিতেছে ।”
জোহেরা ব্যাকুলভাবে কহিল, “কি মুস্কিল! তিনি আবার এ সময়ে – এই ভয়ানক বিপদের মাঝখানে দাঁড়াইয়া এমন করিতেছেন কেন? কি কথা তিনি আপনার কাছে প্রকাশ করেন নাই?”
উকীলবাবু বলিলেন, “সেই খুনের রাত্রে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে যে স্ত্রীলোকের সহিত তাহার সাক্ষাৎ হইয়াছিল, তাহার নাম জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম । কিছুতেই মজিদ তাহার নাম বলিল না । আমার বোধ হয়, সেই স্ত্রীলোক আর কেহই নহে-সৃজান বিবি ।”
“সৃজান বিবি!” যেন প্রতিধ্বনি করিয়া জোহেরা বলিল, “কি সর্ব্বনাশ! তিনি সেখানে-তেমন সময়ে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে কেন যাইবেন? আপনার অনুমানই ঠিক নহে ।”
উকীল বাবু বলিলেন, “আমার অনুমানই ঠিক-সৃজান বিবি মনিরুদ্দীনের সহিত গোপনে দেখা করিতে গিয়াছিল, কিন্তু মনিরুদ্দীনের সহিত তাহার দেখা না হইয়া ঘটনাক্রমে মজিদের সহিতই তাহার দেখা হইয়া যায় । সৃজান বিবি-যাহাতে মজিদ তাহার নাম প্রকাশ না করে, সেজন্য তাহাকে প্রতিশ্রুত করাইয়া থাকিবে । এইরূপ একটা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ায় মজিদ সেই স্ত্রীলোকের নাম প্রকাশ করিতে পারিতেছে না । মজিদ এখন বলিতেছে, সেই স্ত্রীলোকের নাম প্রকাশ করুতে হইলে, অন্ততঃ মনিরুদ্দীনের সহিত একবার দেখা করা দরকার; কিন্তু এ সময়ে কি মনিরুদ্দীনের সহজে দেখা পাওয়া যাইবে? সে এখন একেবারে নিরুদ্দেশ ।
জোহেরা কহিল, “নিজে এমন বিপদাপন্ন; এ সময়ে সৃজান বিবির নাম প্রকাশ করিতে হইলে কি ক্ষতি আছে? কি আশ্চর্য্য! সামান্য প্রতিজ্ঞার জন্য বিবির যে সম্ভ্রমহানি হইবে, এখন আর এমন সম্ভবনা নাই-সে ত নিজের মান-সম্ভ্রম নিজেই জলাজ্ঞলি দিয়া গৃহত্যাগ করিয়া গিয়াছে; তবে তাহার জন্য কেন আত্মোৎসর্গ?”
উকীল বাবু বলিলেন, “আরও একটা কারণ আছে । সৃজান বিবি যে মনিরুদ্দীনের সহিত গৃহত্যাগ করিয়া গিয়াছে, ইহা লোকে শুনিলেও সত্য-মিথ্যা সম্বন্ধে এখন সকলেরই সন্দেহ আছে । কিন্তু এখন যদি মজিদ প্রকাশ করে যে, সৃজান বিবিকেই সেদিন রাত্রে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে দেখিয়াছে, তাহা হইলে মনিরুদ্দীন যে, সৃজান বিবিকে লইয়া সরিয়া পড়িয়াছে, সে সম্বন্ধে ত আর কাহারও সন্দেহের কোন কারণই থাকিবে না । যাহা তাহারা শুনিয়াছে, তাহাতেই সকলে কৃতনিশ্চয় হইতে পারিবে । ইহাতে মনিরুদ্দীন দোষী হইলেও মজিদ তাহাকে আপনার ভ্রাতার ন্যায় স্নেহ করে-কিছুতেই সে তাহার বিরুদ্ধে কোন কথা প্রকাশ করিবে না । সেইজন্যই মজিদ কোন কথা প্রকাশ করিবার পূর্ব্বে একবার মনিরুদ্দীনের সহিত দেখা করিতে চাহে বোধ হয় ।”
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া জোহেরা বলিল, “কিন্তু এখন মনিরুদ্দীনকে কোথায় পাওয়া যাইবে- তাঁহার ত কোন সন্ধান নাই । তবে কি হবে?”
উকীল বাবু বলিলেন, “তাই ত, কিছুতেই বুঝিতে পারিতেছি না । মজিদের বিরুদ্ধে কয়েকটা প্রমাণ বলবৎ রহিয়াছে ।”
সোৎসুক জোহেরা জিজ্ঞাসা করিল, “তাহার অনুকূলে কি কোন প্রমাণই নাই? তিনি কি নিজের উদ্ধারের জন্য আপনার নিকটে কোন কথাই প্রকাশ করেন নাই? আত্মরক্ষায় তিনি কি এমনই উদাসীন?”
উকীল বাবু বলিলেন, “তাঁহার অনুকূলে একটা প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে-এখন তাহা সপ্রমাণ করা চাই । মজিদের মুখে শুনিলাম, যে ছুরিখানি তাহার বাসায় পাওয়া গিয়াছে, তাহা সে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে দিলজানের নিকট হইতে কাড়িয়া লইয়াছিল । তাহার পর নিজের বাসায় আনিয়া টেবিলের উপরে সেই ছুরিখানা ফেলিয়া রাখে; কিন্তু ছবির পাশে কে তাহা তুলিয়া রাখিয়াছিল, তাহা মজিদ নিজে জানে না । তাহার অনুমান, বাড়ীওয়ালীই ঘর পরিষ্কার করিতে আসিবার সময় ছুরিখানি ছবির পাশে তুলিয়া রাখিয়া থাকিবে ।”
জোহেরা বলিল, “তাহা হইলে এখন একবার তাহা আপনাকে সন্ধান করিয়া দেখিতে হইবে । আপনি হামিদার সহিত একবার দেখা করুন ।”
উকীল বাবু বলিলেন, দেখা ত করিবই; কিন্তু কাজে কতদূর হইবে, বুঝিতে পারিতেছি না ।
জোহেরা ব্যগ্রভাবে কহিল “হতাশ হইবেন না-নিশ্চয়ই আপনি কৃতকার্য্য হইবেন ।”

৩.১৩ ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – কারণ – দুর্জ্ঞেয়

হরিপ্রসন্ন বাবু আর কালবিলম্ব না করিয়া মজিদ খাঁর বাসাতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন । হামিদা তখন বাড়ীতেই ছিল । হরিপ্রসন্ন বাবু হামিদাকে ডাকিয়া বলিলেন, “আমাকে একবার মজিদ খাঁর ঘরে লইয়া চল । বিশেষ আবশ্যক আছে ।”
হামিদা বৃদ্ধ উকীল হরিপ্রসন্ন বাবুকে চিনিত । খুব খাতির করিয়া তাঁহাকে মজিদ খাঁর ঘরে লইয়া গিয়া বসাইল ।
বসিয়া হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “আমি তোমাকে দুই-একটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাই । যাহা জান, সত্য বলিবে ।”
হামিদা বলিল, “আপনার সঙ্গে মিথ্যাকথা কি, মশাই? আমি মিথ্যাকথা কখনও কহি না-আমাকে এখানকার সকলেই জানে ।”
হরিপ্রসন্ন বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “মজিদ খাঁর ঘর কে পরিষ্কার করে?”
হামিদা বলিল, “আমি-আর কে কর্বে?”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “মনে পড়ে, তুমি এ ঘরে কখনও একখানা বাঁটভাঙ্গা ছুরি টেবিলের উপরে প’ড়ে থাক্তে দেখেছ?”
হামিদা অঙ্গুলীতে অঞ্চল জড়াইতে জড়াইতে চিন্তা করিতে লাগিল । অনেকক্ষণ পরে বলিল, “হাঁ, একখানা বাঁটভাঙ্গা ছুরি দেখেছি বটে ।”
হরি । কতদিন পূর্ব্বে?
হামি । বেশি দিন না-এই সেদিন হবে । কোন্ দিন তা, ঠিক আমার মনে হচ্ছে না । একদিন সন্ধ্যার সময়ে খাঁ সাহেব বাড়ীতে এলেন । এসেই পকেট থেকে একখানা ভাঙ্গা ছুরি বের ক’রে এই টেবিলের উপরে রাখ্লেন- আমি তখন এই ঘরটা পরিষ্কার করছিলেম । তার পর তিনি গা ধুতে নীচে চ’লে গেলেন; তখনই তাড়াতাড়ি গা ধুয়ে উপরে উঠে এলেন, আবার কাপড়-চোপড় প’রে বেরিয়ে গেলেন । যাবার সময়ে আমাকে খানা তৈয়ারী রাখ্তে মানা ক’রে দিলেন । বল্লেন, “ফির্তে অনেক রাত হবে, হোটেলেই খাবেন,” আমার তা’ বেশ মনে আছে ।
হরি । ছুরিখানা কি তখনও টেবিলের উপরেই প’ড়ে ছিল?
হামি । সেই ছুরিখানা? হাঁ, টেবিলের উপরেই পড়েছিল বৈকি । তা’ আমি সেখানা একখানা ছবির পাশে তুলে রেখে দিই । কেন-কি হয়েছে?
হরি । রাত্রে মজিদ খাঁ ফিরে এসেছিল?
হামি । হাঁ, অনেকরাত্রে । রাত তখন শেষ হ’য়ে এসেছে ।
হরি । তখন মজিদের মেজাজ্ কেমন ছিল?
হামি । বড় ভাল নয়-মুখ চোখের ভাবে আমি তা’ বেশ বুঝ্তে পারলেম । বাড়ীর ভিতরে এসে সরাসর উপরে উঠে গেলেন । এমন কি আমাকে সাম্নে দেখ্তে পেয়েও আমার সঙ্গে একটী কথা কহিলেন না ।
হামিদার নিকটে আর বিশেষ কিছু সংবাদ পাওয়া গেল না । হরিপ্রসন্ন বাবু হামিদার বাটী ত্যাগ করিয়া পুনরায় জোহেরার সহিত দেখা করিতে তাহাদিগের বাড়ীর দিকে চলিলেন ।
অনন্তর জোহেরার সহিত দেখা করিয়া তিনি হামিদার প্রমুখাৎ যাহা কিছু শুনিয়াছিলেন সমুদয় তাহাকে বুঝাইয়া দিলেন । তাহার পর বলিলেন, এখন বুঝিতে পারিতেছ, মজিদ খাঁর অনুকূলে একটা খুবই প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে । মজিদ খাঁ এই ছুরি দ্বারা দিলজানকে খুন করে নাই, তাহা এখন আমি হামিদাকে দিয়া সপ্রমাণ করিতে পারিব ।”
জোহেরা বলিল, “তাহাতে এখন আমাদের এমন বিশেষ কি কাজ হইবে? ঐ ছুরিতে খুন না করিলেও, তিনি অপর ছুরি দ্বারা দিলজানকে খুন করিয়াছেন, এই কথাই এখন তাঁহার বিপক্ষেরা বলিলেন ।”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “তাহা হইলেও ত মোকদ্দমা অনেকখানি হালকা হইয়া গেল । দেবেন্দ্রবিজয়ের দৃঢ় ধারণা, ঐ ছুরি দ্বারা দিলজান খুন হইয়াছে । মজিদ যে এই খুন করিয়াছে, তিনি এ পর্য্যন্ত তাহার আর এমন কোন কারণ দেখিতে পান নাই । কেবল ওই ছুরিখানা মজিদের ঘরে পাওয়ায় তিনি সন্দেহের বশেই তাহাকে গ্রেপ্তার করিয়াছেন ।”
জো । তবে এখন উপায়?
হ । উপায় আমি করিতেছি । মুন্সী সাহেব এখন বাড়ীতে আছেন কি?
জো । আছেন । সৃজান বিবি গৃহত্যাগ করার পর তিনি আর বাহিরে যান না, কাহারও সহিত দেখাও করেন না -দিনরাত উপরের বৈঠকখানায় একা ব’সে থাকেন ।
হ । তাঁহার সহিত একবার দেখা করিতে হইবে ।
জো । কেন?
হ । সৃজান বিবির সম্বন্ধে দুই – একটি কথা তাঁহাকে জিজ্ঞাস্য আছে । সৃজান বিবি কখন গৃহত্যাগ করিয়াছিল, কখন তিনি তাহা প্রথম জানিতে পারিলেন-
জো । (বাধা দিয়া) তাহাতে কি উপকার হইবে? সে সম্বন্ধে বোধ হয়, তিনি আপনাকে বিশেষ কিছু বলিতে পারিবেন না । হয় ত রাগও করিতে পারেন । আপনি জনিতে চাহেন, সৃজান বিবি গৃহত্যাগের পর মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে গিয়াছিল কি না-যদিই সেখানে গিয়া থাকে, তাহাতে আমাদের এমন কি উপকার হইবে?
হ । তোমার বয়স কম, বুদ্ধিও সেরূপ অপরিপক্ক-কি উপকার হইবে কি না, তুমি তাহার কি বুঝিবে? ইহাতে হয়তো পরে কেস্টা এমন হইয়া যাইতে পারে যে, তখন মজিদ খাঁকে নির্দ্দোষ প্রতিপন্ন করিতে আর আমাদিগকে বিশেষ কষ্ট স্বীকার করিতে হইবে না ।

৩.১৪ – চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ – স্বপক্ষে

জোহেরা হরিপ্রসন্ন বাবুকে সঙ্গে লইয়া মুন্সী জোহিরুদ্দীনের কক্ষে প্রবেশ করিলেন । ধুমপানরত মুন্সী সাহেব মুখ হইতে শট্কার নল নামাইয়া হরিপ্রসন্ন বাবুর মুখের দিকে বিস্মিতভাবে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি মনে ক’রে, উকীল বাবু?”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “একটা বিশেষ প্রয়োজনে আপনার নিকটে আসিয়াছি । বোধ করি, আপনি শুনিয়া থাকিবেন, পুলিস দিলজানের হত্যাপরাধে মজিদ খাঁকে গ্রেপ্তার করিয়া হাজতে রাখিয়াছে ।”
মুন্সী । কই, আমি ত ইহার কিছুই শুনি নাই ।
হরি । ডিটেক্টিভ-ইন্স্পেক্টর দেবেন্দ্রবিজয় তাহার বিপক্ষে । মজিদ এখন বড় সঙ্কটাপন্ন, তাহার প্রণরক্ষা করা দরকার ।
মুন্সী । খুনীর প্রাণরক্ষা! কিরূপে তাহা হইবে?
জোহেরা । মজিদ খুনী নহেন-নির্দ্দোষী হইয়াও এখন তাঁহাকে দোষী হইতে হইয়াছে ।
মুন্সী সাহেব শট্কার ফরসীর উপর দৃষ্টি স্থির রাখিয়া, ধীরে ধীরে মাথা নাড়িতে নাড়িতে বলিলেন “মজিদ খাঁর উপরে এখনও তোমার সেই অন্ধ অনুরাগ সমভাবে আছে দেখিতেছি ।” কথাটা জোহেরাকে বলিলেন কি ফর্সীটাকে বলিলেন, তাহা ঠিক বুঝিতে পারা গেল না ।
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “মজিদ খাঁ যে দোষী নহে, আমিও তাহা জানি । অন্যায় ভাবে এই হত্যাপরাধটা তাহার স্কন্ধে চাপিলেও, সে এখন কোন একটা অনির্দ্দেশ্য কারণে মুখ ফুটিয়া কিছু প্রকাশ করিতে পারিতেছে না! এখন যদি আমরা তাহাকে এই বিপদ্ হইতে রক্ষা করিবার চেষ্টা না করি, তাহা হইলে তাহাকে বিনা দোষেই ফাঁসী যাইতে হয় ।”
মুন্সী । তা’ আমার দ্বারা আপনার কি সাহায্য হইতে পারে?
হরি । অনেক সাহায্য হইতে পারে । আমার বিশ্বাস, খুবই সম্ভব-আপনার স্ত্রী এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন ।
মুন্সী সাহেব বিরক্তভাবে বিবর্ণমুখে বলিলেন, “কি সর্ব্বনাশ! কিরূপে তাহা হইবে? আপনি একান্ত অবিবেচক-তাই এই সকল কথা আমার কাছে উত্থাপন করিতে আসিয়াছেন । আমি আপনাকে সাবধান করিয়া দিতেছি, আপনি ভদ্রলোক, ভদ্রলোকের সম্ভ্রম রাখিয়া অবশ্য আপনার কথা কহা উচিত ।”
হরি । দায়ে পড়িয়াই আমাকে আপনার পতিতা স্ত্রীর কথা আপনারই সমক্ষে উত্থাপন করিতে হইতেছে; নতুবা একজন নির্দ্দোষীর জীবন রক্ষা হয় না । আপনার স্ত্রীর দ্বারা যে, এই হত্যাকাণ্ড সমাধা হইয়াছে, এমন কথা আমি বলিতেছি না । আমার অনুমান, খুনের রাত্রে এগারটার পর মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে মজিদ খাঁর সহিত আপনার স্ত্রীর একবার দেখা হইয়াছিল ।
মুন্সী । মজিদ এখন তাহাই বলিতেছে না কি?
হরি । না, মজিদ কোন কথাই প্রকাশ করিতে চাহে না-সে একেবারে মুখ বন্ধ করিয়াছে । একজন স্ত্রীলোকের সহিত যে, সেদিন রাত্রিকালে তেমন সময়ে তাহার সাক্ষাৎ হইয়াছিল, তাহা নিশ্চয়; কিন্তু কে সে স্ত্রীলোক, এ পর্য্যন্ত তাহা আবিষ্কার করিতে পারা যায় নাই । আমার অনুমান, সেই স্ত্রীলোক আপনার পতিতা স্ত্রী ব্যতীত আর কেহই নহে । আমার এই অনুমানটা কতদূর সত্য জানিতে হইলে, আপনারই সহায়তার প্রয়োজন । আপনার স্ত্রী কখন গৃহত্যাগ করিয়াছিলেন, জানিতে পারিলে আমি এক-রকম সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হইতে পারি; একমাত্র আপনার কাছেই সে সংবাদ পাওয়া যাইতে পারে ।
মুন্সী । সে সংবাদ আমার কাছে কিরূপে পাইবেন? আমি জানিতে পারিলে কখনই এমন দুর্ঘটনা ঘটিতে না ।
হরি । না, আমি সে কথা বলিতেছি না । আপনার স্ত্রী গৃহত্যাগের কথা কখ্ন আপনি প্রথমে জানিতে পারিলেন? তখন রাত কত-রাত বারটার পূর্ব্বে কি?
মুন্সী । না, রাত তখন শেষ হইয়া আসিয়াছে ।
হরি । রাত বারটার সময়ে আপনার স্ত্রী বাড়ীতে ছিলেন কি না, তাহা জানেন?
মুন্সি । না, তাহাও আমি ঠিক বলিতে পারিলাম না । আমি কোন কাজে বাহির হইয়াছিলাম; রাত এগারটার পর আমি বাড়ীতে ফিরিয়া আসি । তখন বাড়ীর সকলেই ঘুমাইয়া পড়িয়াছে । আমি নিজের শয়ন-কক্ষে শয়ন করিতে গেলাম; দেখিলাম, ভিতর হইতে দ্বার রুদ্ধ । অনেকবার ডাকিলাম, আমার স্ত্রীর কোন উত্তর পাইলাম না । ঘুরিয়া আসিয়া অত্যন্ত ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম, আর অপেক্ষা করিতে না পারিয়া, তখনই এই বৈঠকখানায় আসিয়া শয়ন করিলাম । তাহার পর শেষ-রাত্রিতে উঠিয়া আমি এই দুর্ঘটনার কথা জানিতে পারিলাম । আমি ত পূর্ব্বেই আপনাকে বলিয়াছি, আমার নিকটে আপনি বিশেষ কোন সংবাদ পাইবেন না ।
হরিপ্রসন্ন বাবু কি বলিতে যাইতেছিলেন-এমন সময়ে একজন ভৃত্য আসিয়া মুন্সী সাহেবের হাতে একখানি কার্ড দিলেন । মুন্সী সাহেব কার্ডখানি একবার চক্ষুর নিকটে লইয়া, তৎক্ষণাৎ হরিপ্রসন্ন বাবুর হাতে দিয়া বলিলেন, “আপনার সেই দেবেন্দ্রবিজয় বাবু আসিয়া উপস্থিত ।আপনি ইচ্ছা করিলে এখন তাঁহার কাছে অনেক সংবাদ পাইতে পারেন । ঠিক সময়েই তিনি আসিয়াছেন, দেখিতেছি । তাহার পর ভৃত্যকে বলিলেন, “তাহাকে এখানে আসিতে বল ।”
ভৃত্য চলিয়া গেলে হরিপ্রসন্নবাবু বলিলেন, “দেবেন্দ্রবিজয় বাবু লোকটা বড় সহজ নহেন । অবশ্যই একটা কোন গুরুতর মত্লব মাথায় করিয়া এখানে আসিয়া উপস্থিত । যে অভিপ্রায়ে আসিয়াছেন, আমি তাহা বুঝিতে পারিয়াছি । তিনি মজিদ খাঁকে গ্রপ্তার করিয়াছেন, এখন মজিদ খাঁকে অপরাধী সাব্যস্ত করিবার প্রমাণ সংগ্রহ করিয়া বেড়াইতেছেন ।”
এমন সময়ে সেই প্রকোষ্ঠ মধ্যে ধীরে ধীরে দেবেন্দ্রবিজয় প্রবেশ করিলেন । সম্মুখদিকে একটু মাথা নাড়িয়া আগে জোহেরার, তাহার পর মুন্সী সাহেবের সম্মান রক্ষা করিলেন । তাঁহারাও সেইরূপ ভাবে সম্মান জানাইয়া দেবেন্দ্রবিজয়কে বসিতে বলিলেন ।

৩.১৫ পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ – সন্দেহ-বৈষম্য

আসন পরিগ্রহ করিয়া দেবেন্দ্রবিজয় সংযতস্বরে হরিপ্রসন্ন বাবুকে বলিলেন, “কেমন আছেন, মহাশয়? অনেকদিন আপনাকে দেখি নাই; এখানে আজ কি মনে করিয়া? বোধ করি, এক অভিপ্রায়েই আমাদের উভয়েরই এখানে আগমন হইয়াছে ।”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “ঠিক তাহা নহে-মহাশয়, বরং বিপরীত-আপনি মজিদ খাঁকে ফাঁসীর দড়ীতে লট্কাইয়া দিবার জন্য ব্যস্ত; কিন্তু আমি সেই নির্দ্দোষী বেচারার প্রাণরক্ষা করিতে চেষ্টা করিতেছি ।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হরিপ্রসন্ন বাবু, এইখানেই আপনি একটা মস্ত ভুল করিয়া ফেলিয়াছেন । আমিও সেই নির্দ্দোষী বেচারার প্রাণরক্ষার জন্য সচেষ্ট ।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হাঁ, ইহাতে বিস্ময়ের কিছুই নাই; আমারও বিশ্বাস, মজিদ খাঁ নির্দ্দোষী ।”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “তবে আপনি তহাকে গ্রেপ্তার করিলেন কেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তাঁহার বিরুদ্ধে যে বলবৎ প্রমণ পাওয়া গিয়াছে, তাহাতে তাঁহকে গ্রেপ্তার করা অন্যায় হয় নাই । সম্প্রতি দেখিতেছি, কয়েকটা বিষয়ে আমি বেশ বুঝিতেও পারিয়াছি, মজিদ খাঁ প্রকৃত পক্ষে দোষী ব্যক্তি নহেন ।”
দেবেন্দ্রবিজয় এমনভাবে কথাগুলি বলিলেন, “হরিপ্রসন্ন বাবু ও জোহেরা তাহাতে অবিশ্বাসের কিছুই দেখিতে পাইলেন না দেখিয়া অনেকটা আশ্বস্ত হইলেন ।
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “তাহা হইলে আপনিও আমাদের দলে আসিতেছেন, দেখিতেছি ।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আমিই আপনার দলে যাই-আর আপনিই আমার দলে আসুন, এখন তাহা একই কথা । মজিদ খাঁর নির্দ্দোষতা সপ্রমাণ করা এখন হইতে আমাদের উভয়ের প্রধান উদ্দেশ্য রহিল । এই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইলে, প্রকৃত হ্ত্যাকারী গ্রেপ্তার করা ঘটনাক্রমে অনেকটা পরিমাণে সহজ হইয়া আসিতে পারে ।”
মুন্সী সাহেব বলিলেন, “সকলই ত বুঝিলাম-আপনারা উভয়েই মজিদ খাঁর প্রাণরক্ষার জন্য সচেষ্ট; আপনাদের উদ্দেশ্য সফল হউক; কিন্তু দেবেন্দ্রবিজয় বাবু, আপনি আজ কি অভিপ্রায়ে আমার সহিত দেখা করিতে আসিয়াছেন, সে সম্বন্ধে ত কোন কথাই বলিলেন না?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “এইবার বলিতেছি-কাজের কথা আমি কখনও ভুলি না । যে কথাটা উঠিয়াছে, তাহা শেষ করিয়া অন্য কথা আরম্ভ করাই ঠিক । আমি আপনার স্ত্রীর সম্বন্ধে দুই-একটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাই । বোধ করি, আপনি কোন ত্রুটি লইবেন না!”
হরিপ্রসন্ন বাবু ও জোহেরা সবিস্ময়ে দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে চাহিলেন । বুঝিলেন, তিনি মিথ্যা বলেন নাই-তাঁহারা যে উদ্দেশ্যে আসিয়াছেন, তিনিও ঠিক সেই সেই উদ্দেশ্যে মুন্সী সাহেবের সহিত দেখা করিতে উপস্থিত ।
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আপনার স্ত্রী সেদিন রাত বারটার পূর্ব্বে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে গিয়াছিলেন কি?”
মুন্সী । এ কথা আপনাকে কে বলিল?
দেবেন্দ্র । কেহ বলে নাই । গিয়াছিলেন কি?
“আমি কিছুই জানি না ।” বলিয়া মুন্সী সাহেব যাহা জানিতেন, দেবেন্দ্রবিজয়কে বলিলেন । ইতিপূর্ব্বে হরিপ্রসন্ন বাবুকে যাহা বলিয়াছিলেন, তাহারই পুনরাবৃত্তিমাত্র-সুতরাং তাহার পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন ।
দেবেন্দ্রবিজয় তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে মুন্সী সাহেবের মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “তাহা হইলে আপনি সেদিন রাত এগারটার পরই বাড়ীতে ফিরিয়াছিলেন । তাহার পর আর বাড়ী হইতে বাহির হন্ নাই?”
দেবেন্দ্রবিজয়ের তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে মুন্সী সাহেব যেন একটু বিব্রত হইয়া উঠিলেন । বলিলেন, “না ।”
দেবেন্দ্র । (হরিপ্রসন্নের প্রতি) আপনার কি বোধ হয়, হরিপ্রসন্ন বাবু? সেদিন রাত্রিতে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে যে স্ত্রীলোকের সহিত মজিদ খাঁর দেখা হয়, কে সে? কখনই সে মুন্সী সাহেবের স্ত্রী নহেন । আমার অনুমানই ঠিক- সে দিলজান না হইয়া যায় না-সেদিন রাত বারটার পূর্ব্বে মুন্সী সাহেবের স্ত্রী বাড়ীতেই ছিলেন ।
মুন্সী । কিরূপে আপনি তাহা জানিতে পারিলেন?
দেবে । সাখিয়া বাঁদীর মুখে শুনিয়াছি ।
জোহে । হাঁ, আমাকেও সে ইহা বলিয়াছে । তাহা হইলে-তাহা হইলে-
সহসা মধ্যপথে থামিয়া গিয়া জোহেরা সকলের মুখের দিকে একান্ত ব্যাকুলভাবে বারংবার চাহিতে লাগিল ।
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তাহা হইলে কে সে স্ত্রীলোক, কিরূপে এখন ঠিক হইতে পারে? যখন মজিদ খাঁ নিজে কোন কথা প্রকাশ করিবেন না, তখন আমাদিগকে অন্য উপায় অবলম্বন করিতে হইবে । এখন মুন্সী সাহেবের পলাতক স্ত্রীর সন্ধান লইতে হইবে; তাঁহার সহিত একবার দেখা করিতে পারিলে, এই খুন-রহস্যটা অনেক পরিষ্কার হইয়া যাইবে ।”
মুন্সী সাহেব বলিলেন, “সে দিলজানের খুন সম্বন্ধে কি জানে?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “বেশী কিছু না জানিলেও তাঁহার ভগিনীর খুনের কারণটা হয় ত তিনি কিছু কিছু জানেন-”
সকলে । (সবিস্ময়ে) তাঁহার ভগিনী!
মুন্সী । কে তাহার ভগিনী ।
দেবেন্দ্র । দিলজান-যে মেহেদী-বাগানে খুন হইয়াছে-
মুন্সী । (বাধা দিয়া-বিরক্তভাবে) আপনি পাগল না কি! কে আমার স্ত্রী, তাহা কি আপনি জানেন?
দেবেন্দ্র । খুব জানি-খিদিরপুরের মুন্সী মোজাম হোসেনের দুহিতা । তাঁহার দুই যমজ কন্যা-একজনের নাম মৃজান-মৃজান মনিরুদ্দীনের সহিত পিতৃগৃহ পরিত্যাগ করিয়া দিলজান নাম গ্রহণ করে; অপর কন্যার নাম সৃজান-আপনার সহিতই পরে তাঁহার বিবাহ হইয়াছিল ।
মুন্সী সাহেব অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া ঘৃণাভরে বলিলেন, “ইহাও কি সম্ভব! আমার স্ত্রীর যে মৃজান নামে এক যমজ ভগিনী ছিল, তাহা আমি ইতিপূর্ব্বে শুনিয়াছিলাম, কিন্তু আমার বিবাহের পূর্ব্বেই তাহার মৃত্যু হইয়াছিল ।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “মৃজান নামে মরিয়া দিলজান নামে সে এতদিন বাঁচিয়া ছিল । এখন সে একেবারেই মরিয়াছে । যখন দেখা যাইতেছে, সৃজানের গৃহত্যাগ এবং মৃজানের হত্যা এক রাত্রিরই ঘটনা, তখন খুবই সম্ভব, সৃজান বিবি এই হত্যাকাণ্ডে কিছু জড়িত আছেন ।”
হরিপ্রসন্ন বাবু দেখিলেন, আবার এক নুতন গোলযোগ উপস্থিত । সন্দিগ্ধভাবে দেবেন্দ্রবিজয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সৃজান বিবি নিজের ভগিনী দিলজানকে খুন করিতে যাইবেন কেন, ইহাতে তাঁহার স্বার্থ কি?”
দেবেন্দ্রবিজয় মৃদুহাস্যে বলিলেন, “ওকালতী অর ডিটেক্টিভগিরি একই জিনিষ নহে, হরিপ্রসন্ন বাবু ।”
মুন্সী সাহেব বলিলেন, “তাহা হইলে আপনি কি এখন সৃজানকেই খুনী মনে করিতেছেন? ইহাতে তাঁহার কি স্বার্থ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “এখনও কি আপনারা বুঝিতে পারেন নাই-স্বার্থ কি? উভয় ভগিনী এক ব্যক্তিরই প্রেমাকাঙ্ক্ষিণী । এরূপ স্থলে একজন অপরকে খুন করিবার যে কি স্বার্থ, তাহা পরিষ্কার বুঝা যাইতেছে ।”
মুন্সী সাহেব বলিলেন, “সৃজানের স্বভাব-চরিত্র কলঙ্কিত হইলেও আমার বিশ্বাস হয় না, স্ত্রীলোক হইয়া সে সহসা এতটা সাহস করিতে পারে ।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “পুরুষের অপেক্ষা স্ত্রীলোকের সাহস অনেক বেশী; প্রেম-প্রতিযোগীতায় ঈর্ষায় যখন তাহারা মরিয়া হইয়া উঠে, তখন তাহারা সকলই করিতে পারে-একটা খুন ত অতি সামান্য কথা! ”
এমন সময়ে একজন ভৃত্য আসিয়া মুন্সী সাহেবের হাতে একখানি পত্র দিল । তিনি তখনই পত্রখানি খুলিয়া পাঠ করিলেন । পাঠান্তে বলিলেন, “ঠিক হইয়াছে-এইবার প্রকৃত ঘটনা বুঝিতে পারা যাইবে ।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “কি হইয়াছে-ব্যাপার কি?”
রুক্ষস্বরে মুন্সী সাহেব বলিলেন, “সয়তান আর সয়তানী উভয়ই মিলিয়া ফরিদপুরের বাগানে বাস করিতেছে ।”
ব্যগ্রভাবে জোহেরা জিজ্ঞাসা করিল, “কে-বিবি সাহেবা আর মনিরুদ্দীন?”
মুন্সী । হাঁ, আমি যাহাকে তাহাদের সন্ধানে নিযুক্ত করিয়াছিলাম, সেই ব্যক্তি তাহাদের সন্ধান করিয়া আমাকে এই পত্র লিখিয়াছে ।
দে । ভালই হইয়াছে-সেখানে গেলে প্রকৃত ঘটনা যাহা ঘটিয়াছে, বুঝিতে পারা যাইবে । আপনি সেখানে যাইবেন কি?
মু । এখন আমি সে কথা বলিতে পারি না; কাল যাহা হয় ঠিক করিয়া বলিব ।
দে । আমরা তিনজনেই কাল একসঙ্গে ফরিদপুরে যাইব । আপনারও সেখানে যাওয়া দরকার ।
মু । কাল সে যাহা হয়, করা যাইবে ।

৪.০১ প্রথম পরিচ্ছেদ – স্বপক্ষে না বিপক্ষে?

চতুর্থ খণ্ড
নিয়তি – ছদ্মবেশা

” Nature naver made
A heart all marble, but all in its fissures sows
The wild flower Love; from whose rich seeds spring forth
A word of mercies and sweet charities,”
Barry Cornwall.

প্রথম পরিচ্ছেদ
স্বপক্ষে না বিপক্ষে?

মজিদ খাঁ এইরূপ বিপদ্গ্রস্ত হওয়ায় তাঁহার বন্ধুবর্গের মধ্যে মোবারক উদ্দীনকেই সর্ব্বপেক্ষা অধিক দুঃখিত বোধ হয়। কেবল দুঃখিত কেন, তিনি যে মজিদ খাঁর বন্দিত্বে যথেষ্ট অনুতপ্ত, তাহা তাঁহার ভাবগতিকে এখন অনেকেই অনুমান করিতেছেন। তাঁহার একটিমাত্র কথার জন্য আজ মজিদ খাঁ কারারুদ্ধ। যেখানে কত অসংখ্য দস্যু, নরহন্তা, তস্কর তাহাদের পদচিহ্ণ রাখিয়া গিয়াছে, সেইখানে আজ তাঁহারই দোষে নিরপরাধ মজিদ খাঁ লুণ্ঠিত হইতেছেন; ইহাতে কাহার না হৃদয় ব্যথিত হয়? সেদিন খুনের রাত্রে মজিদ খাঁর সহিত যে, তেমন সময়ে মেহেদী-বাগানে তাঁহার সাক্ষাৎ হইয়াছিল, এ কথা যদি তিনি নিজের এজাহারে পূর্ব্বে প্রকাশ না করিতেন, তাহা হইলে ত মজিদ খাঁকে আজ হত্যাপরাধে অভিযুক্ত হইয়া অকারণ কারাকূপে নিক্ষিপ্ত হইতে হইত না।
অদ্য অপরাহ্ণে কলিঙ্গা-বাজারে রাজাব-আলির বহির্ব্বাটীর নিম্নতলস্থ প্রশস্ত বৈঠকখানায় বসিয়া তাঁহার পুত্র সুজাত-আলির সহিত মোবারক-উদ্দীনের নিভৃতে এইরূপ কথোপকথন হইতেছিল। সঙ্গে সঙ্গে মদ্যপানও চলিতেছিল। বাল্যে উভয়ে এক ক্লাসের ফ্রেণ্ড ছিল, যৌবনে এখন এক গ্লাসের ফ্রেণ্ডে পরিণত হইয়াছে-এইটুকু পরিবর্ত্তন।
মোবারক বলিল, “আমার দোষেই বৈ কি; কে জানে যে এমন হইবে? তাহা হইলে কি আমার মুখ দিয়া একটা কথাও প্রকাশ পায়! প্রকাশ করিবার ইচ্ছাটাও আমার ছিল না; কথায় কথায়- ডিটেক্টিভ দেবেন্দ্রবিজয় লোকটা বড় ধড়ীবাজ-আমার কাছ থেকে এমনভাবে কথাটা বাহির করিয়া লইল যে, কাজটা ভাল করিতেছি, কি মন্দ করিতেছি-আমি তখন তাহা বিবেচনা করিয়া দেখিবারও অবসর পাইলাম না। লোকটা ভয়ানক বদলোক-আমার সেই কুকুরটাকেও নিকেশ করিয়াছে।”
সুজাত বলিল, “এখন শুনিতে পাই, সে ছুরিতে যে দিলজান খুন হইয়াছে, দেবেন্দ্রবিজয় তাহা এখন ঠিক প্রমাণ করিতে পারিতেছে না। মজিদকে দোষী বলিয়া আমার একবারও মনে হয় না।”
মুখের কথা লুফিয়া লইয়া মোবারক বলিল, “কেনই বা হইবে? মজিদ খাঁকে যে জানে, সে কখনই ইহা বিশ্বাস করিবে না। আরও ভাবিয়া দেখা উচিত, কেনই বা সে দিলজানকে খুন করিতে যাইবে? কারণ কি? এমন একটা ভয়ানক খুন-অবশ্যই ইহার একটা কারণ থাকা চাই। মজিদের সঙ্গে দিলজানের কোন সম্বন্ধই নাই। দেবেন্দ্রবিজয় লোকটা পাকা ডিটেক্টিভ হইলেও কাজটা বড়ই অন্যায় করিয়াছে। কেবলমাত্র সেই ছুরির উপর নির্ভর করিয়া, একজন নির্ব্বিরোধ ভদ্রলোককে অকারণ টানাটানি করা কাজটা তাহার নিতান্ত গর্হিত হইয়াছে। মজিদ কোন্ উদ্দেশ্যে দিলজানকে খুন করিবে? তাহাকে ধরিয়া পুলিস অনর্থক পীড়াপীড়ি করিতেছে; বরং মনিরুদ্দীনকে-“বলিতে বলিতে মোবারক মধ্যপথে সহসা চুপ করিয়া গেল।
সুজাত বলিল, “মনিরুদ্দীনও বড় বাদ যাইবে না। আমার বোধ হয়, তাহাকেই শেষে বেশি জড়াইয়া পড়িতে হইবে। দেবেন্দ্রবিজয় যখন ইহাতে হাত দিয়াছে, তখন একটা-না-একটা কিছু না করিয়া ছাড়িতেছে না। এদিকে মনিরুদ্দীনেরও সন্ধান পাওয়া গিয়াছে। তাহার সঙ্গে দেখা করিতে আজ মুন্সী সাহেব, দেবেন্দ্রবিজয় ও উকীল হরিপ্রসন্ন বাবু সকলে একসঙ্গে রওনা হয়েছেন।”
সুজাত বলিল, “হাঁ, সৃজান বিবিও সেখানে আছে।”
মোবারক জিজ্ঞাসা করিল, “কোথায়-এই শহরে না কি?”
সুজাত বলিল, “সহরে না-ফরিদপুরে মনিরুদ্দীনের নিজের যে একটা বাগান-বাড়ী আছে, দুজনে মিলিয়া সেখানে সুখে-স্বচ্ছন্দে নিরিবিলি বাস করিতেছে। এইবার যত গোলযোগ আরম্ভ হইল, আর কি।”
মোবারক বলিল, “খুব গোলযোগ-মনিরুদ্দীনের একটা খুবই দুর্নাম রটিয়া গেল। এদিকে জোহেরার সঙ্গে তাহার বিবাহের কথা হইতেছিল, তা’ আর ঘটিতেছে না, দেখিতেছি। জোহেরা যদিও সম্মত হইত, এখন সে কিছুতেই মনিরুদ্দীনকে বিবাহ করিবে না। মনিরুদ্দীন নিতান্ত নির্ব্বোধ-সৃজানের লোভে এমন একটা স্বর্ণসুযোগ ছাড়িয়া দিল।”
সুজাত বলিল, “মনিরুদ্দীনের আর স্বর্ণসুযোগ কি? স্বর্ণসুযোগ মজিদ খাঁর। মনিরুদ্দীনের এ দুর্নামটা না রটিলেও জোহেরা তাহাকে বিবাহ করিত না। তাহা হইলে কি বিবাহ এতদিন বাকী থাকে! মুন্সী সাহেব অনেক চেষ্টা করিয়াছিলেন; জোহেরা কিছুতেই স্বীকার করে নাই। কেনই বা করিবে, অগাধ ঐশ্বর্য্য-নিজেই সর্ব্বেসর্ব্বা-তার উপরে আবার সে লেখাপড়া-জানা মেয়েমানুষ-পরের মতে মত দিবার মেয়েই নয়! এ রত্ন মজিদ খাঁর ভাগ্যেই আছে!”
মোবারক বলিল, “আমার ত আর তাহা মনে হয় না। যদিও মজিদ মুক্তি পায়-এ দুর্নাম কি তাহার সহজে যাইবে, মনে করিয়াছ? আমার বিশ্বাস, জোহেরা এখন আর মজিদকেও বিবাহ করিতে রাজী হইবে না। আমার কথাটা ঠিক কি না, পরে দেখিতে পাইবে।”
সুজাত জিজ্ঞাসা করিল, “কেন, কিসে তুমি জানিলে?”
মোবারক বলিল, “আমি এখন নিজেই মজিদ খাঁর পদপ্রার্থী।”
সুজাত চমকিত হইয়া বলিল, “দূর-মিথ্যাকথা!”
মোবারক বলিল, “মিথ্যা নয়; অতি সত্যকথা। আমি এতদিন জোহেরাকে দেখি নাই-সেদিন তাহাকে দেখিয়া একেবারে মুগ্ধ হইয়াছি। আমি কিছুতেই আর তাহার আশা ত্যাগ করিতে পারিব না।”
সুজাত হাসিয়া বলিল, “তুমি না আশা ত্যাগ করিলেই যে , তোমার আশা নিশ্চয় পূর্ণ হইতেই হইবে, এমন কি কথা? মজিদ মধ্যে থাকিতে তুমি কিছুতেই জোহেরাকে লাভ করিতে পারিবে না।”
মোবারক বলিল, “একবার চেষ্টা করিয়া দেখিতে ক্ষতি কি আছে?”
সুজাত বলিল, “সহস্র চেষ্টাতেও তুমি কিছুতেই কৃতকার্য হইতে পারিবে না। জোহেরা কখনই তোমার প্রস্তাবে সম্মত হইবে না। সে যদি তোমাকে বিবাহ করে, আমার নাম সুজাত-আলি নয়।”
মোবারক দৃঢ়স্বরে বলিল, “যদি আমি জোহেরাকে বিবাহ করিতে না পারি-আমার নামও মোবারক-উদ্দীন নয়।”

৪.০২ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – পট-পরিবর্ত্তন

যখন মোবারক ও সুজাত-আলির মধ্যে এইরূপ তর্কবিতর্ক চলিতেছে, তখন এদিকে পাংসা স্টেশনে একখানি ট্রেন আসিয়া লাগিল। তাহার একটি কাম্রা হইতে তিন ব্যক্তি ব্যস্তভাবে নামিয়া পড়িল-মুন্সী জোহিরুদ্দীন, ডিটেক্টিভ দেবেন্দ্রবিজয় এবং উকীল হরিপ্রসন্ন।
ফরিদপুর জেলার উত্তর-পূর্ব্বভাগে পাংসা অবস্থিত। সেখান হইতে একমাইল দূরে মনিরুদ্দীনের বাগান-বাটী। স্টেশন ত্যাগ করিয়া তখনই তিনজনে সেই বাগানের দিকে চলিলেন।
পথিমধ্যে দেবেন্দ্রবিজয় উকীল হরিপ্রসন্ন বাবুকে বলিলেন, “সেই ভাঙ্গা ছুরিখানি খুনের রাতে মজিদ খাঁর বাসাতেই ছিল-মজিদ খাঁ তাহা সঙ্গে করিয়া বাহির হ’ন্ নাই, এরূপ স্থলে এই ছুরিদ্বারা দিলজান যে খুন হয় নাই, আপনি এখন হামিদা দ্বারা প্রমাণ দিতে চেষ্টা করিবেন; কিন্তু তাহাতে আপনি কতদূর কৃতকার্য্য হইবেন, বলিতে পারি না। ঐ ছুরি দিলজান সঙ্গে লইয়া বাহির হইয়াছিল; আর মজিদ খাঁই মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে দিলজানের নিকট হইতে ঐ ছুরি কাড়িয়া লইয়াছেন, ইহা যখন স্পষ্ট জানা যাইতেছে-পরে স্পষ্টরূপে প্রমাণীকৃতও হইবে, তখন হামিদার কথা কতদূর টিকিবে তাহা আপনি সহজেই বুঝিতে পারিতেছেন। মজিদ খাঁর নিকটে যখন ছুরিখানি পাওয়া যাইতেছে, তখন ঐ ছুরিতেই দিলজান খুন হইয়াছে, ইহা খুবই সম্ভব; ইহাতে সন্দেহের কিছুই নাই।”
হরিপ্রসন্ন ববু বলিলেন, “এ সংসারে লোকও আনেক আছে-ছুরিও অনেক আছে।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তাহা সত্য; কিন্তু ঐ ছুরিখানিই যখন দিলজানের সেই বিষাক্ত ছুরি বলিয়া জানা যাইতেছে-এবং যখন বিষাক্ত ছুরিই দিলজানের মৃত্যুর কারণ, তখন কে বিশ্বাস করিবে, দিলজান অন্য একখানা ছুরিতে খুন হইয়াছে?”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “সকলই প্রমাণের উপরে নির্ভর করিতেছে। বেশই বুঝা যাইতেছে, একটা দুর্গম রহস্যের ভিতরে সকলই প্রছন্ন রহিয়াছে।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আমারও তাহাই অনুমান-আমরা একটা দুর্লঙ্ঘ্য রহস্য-ব্যুহের চারিদিক্ বেড়িয়া, অন্ধের ন্যায় ঘুরিয়া বেড়াইতেছি; ভেদ করিয়া যাইবার পথ এখনও খুঁজিয়া পাই নাই। আমার বোধ হয়, সেদিন রাত্রিতে মজিদ খাঁর সহিত সৃজান বিবির যে সকল কথোপকথন হইয়াছিল, তাহা যদি এখন কোন রকমে জানিতে পারা যায়, তাহা হইলে সহজে আপনা হইতে সত্যাবিষ্কার হইয়া পড়ে, আর কোন গোল থাকে না।”
মুন্সী সাহেব বলিলেন, “বুঝিয়াছি, আপনাদের মনে ধারণা, আমার স্ত্রীর দ্বারাই দিলজান খুন হইয়াছে।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “যতক্ষণ সৃজান বিবির সহিত দেখা না হইতেছে, ততক্ষণ আমাদিগের ধারণা কতদূর সত্য, বুঝা যাইতেছে না।”
যথাসময়ে তাঁহারা সেই বাগানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সুন্দর সাজান বাগান। তখন সন্ধ্যার তরল অন্ধকারে চারিদিক্ আছন্ন হইতে আরম্ভ হইয়াছে। সম্মুখে স্বচ্ছ জলপূর্ণ নীল দীর্ঘিকা সেই তরল অন্ধকরে গভীর নীলবর্ণ দেখাইতেছে। তাহার বক্ষে পার্শ্বস্থিত প্রেতবৎ বড় বড় গাছগুলার দীর্ঘতর প্রতিবিম্ব আসিয়া পড়িয়াছে-এবং ঝিল্লিমন্দ্রে চারিদিক্ মুখরিত। দীর্ঘিকার অপর পারে একখানি সুন্দর ছোট দ্বিতল বাটী। সেই বাটীর উপরিতলস্থ দুই-একটি কক্ষে দীপ জ্বলিতেছে। এবং উন্মুক্ত গবাক্ষ-পথ দিয়া সেই দীপলোক নিকটবর্ত্তী দেবদারুশ্রেণীর উপরে আসিয়া পড়িয়াছে। সকলে সেই বাটী-অভিমুখে চলিলেন। দ্বার-সম্মুখে আসিয়া একজন ভৃত্যকে দেখিতে পাইলেন।
দেবেন্দ্রবিজয় সেই ভৃত্যকে বলিলেন, “মনিরুদ্দীন সাহেবকে সাথ, একদফে মোলাকাৎ কর্না চাহিয়ে; তুম জলদী খবর দেও।”
ভৃত্য বলিল, “সাহাব খানা-পিনা কর্কে বারা বাজাকে ট্যরেণ্মে সহর্মে চলা গ্যয়া।”
হরিপ্রসন্ন বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “মল্লিক সাহাব কো সাথ্ যো বিবি সাহাব অ-রহা, উন্নে অযবি কাঁহা হৈ? সাহাবকে সাথ্ তো গ্যয়া নেহি?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “বিবি সাহেব আর কোথায় যাইবেন, এইখানেই আছেন। (ভৃত্যের প্রতি) আব্বি তুম্ বিবি সাহাব্কী খবর দেও।”
ভৃত্য সঙ্কুচিতভাবে কহিল, “হুজুর, আব্বি সাহাব্কী সাথ্ কেঁও কর-”
দেবেন্দ্রবিজয় বাধা দিয়া বলিলেন, “জল্দি খবর দেও, ন্যহিতো তুম্হারা বিবি সাহাব্কী বহুৎ মুস্কিল হোগা!”
অনন্যোপায় ভৃত্য তাঁহাদিজকে নিম্নতলস্থ একটি কক্ষে লইয়া গিয়া বসাইল। এবং ‘বিবি সাহেবের’ নিকটে সংবাদ লইয়া উপরিতলে উঠিয়া গেল।
ঘরটি ছোট-টেবিল, কৌচ, আল্মারী, চেয়ার ও ছবিতে সুন্দররূপে সাজান। এক কোণে একটা বড় টেবিল-হার্মোনিয়ম রহিয়াছে, তাহার পার্শ্বে বাঁয়া তবলা, মৃদঙ্গ, সারঙ্গ, সেতার, এস্রাজ-কয়েকটা বাদ্যযন্ত্র পড়িয়া রহিয়াছে।
সকলে নীরবে সেই ছোট ঘরটিতে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করিতে হইল না। কক্ষের বাহিরে কাহার মৃদু পদধ্বনি শুনা গেল। তখনই পার্শ্ববর্ত্তী একটি কক্ষের দ্বারসম্মুখস্থ পর্দ্দা উঠিয়া দীর্ঘাবয়বসম্পন্না, চারুচন্দ্রবদনা একটি সুন্দরী দ্বারপথে বিস্ময়োদ্বিগ্নমুখে দাঁড়াইল।
দেবেন্দ্রবিজয় ও হরিপ্রসন্ন বাবু বিস্মিতভাবে মুন্সী সাহেবের মুখের দিকে চাহিলেন। ইচ্ছা – পলাতক পত্নীর পুনাবির্ভাবে মুন্সী সাহেব কি ম্করেন, দেখিবেন।
মুন্সী সাহেব রুষ্ট সিংহের ন্যায় গর্জ্জিয়া উঠিলেন, “পিশাচী-সয়তানী” বলিতে বলিতে লাফাইয়া সেই রমণীর সম্মুখীন হইলেন। সহসা যেন একটা কি বাধাপ্রাপ্ত হইয়া, চকিত দুই পদ পশ্চাতে হটিয়া জড়িতকণ্ঠে বলিলেন, “তুমি-তুমি-তুমি-ত সেই সৃজান নও।”
রমণীও বিস্মিতভাবে স্মিতমুখে কহিল, “আমি! আমি কেন সৃজান হইতে যাইব? আমি নই-আপনাদের ভুল হইয়াছে।”
দেবেন্দ্রবিজয় ও হরিপ্রসন্ন বাবু উভয়ে বিদ্যুৎপৃষ্টের ন্যায় দাঁড়াইয়া উঠিলেন। সমস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে তবে তুমি?”
রমণী কহিল, “দিলজান।”

৪.০৩ তৃতীয় পরিচ্ছেদ – ভ্রম-নিরাস

 

আরও বিস্ময়-একি ব্যাপার-দিলজান জীবিতা-কি ভয়ানক ভ্রম! বিস্ময়বিহ্বলচিত্তে নিনির্মেষনেত্রে দিলজানের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। সহসা কেহ কিছু বলিতে পারিলেন না।
রমণী তাঁহাদিগকে অবাঙ্মুখে তাহার দিকে চাহিতে দেখিয়া বিস্মিত হইল। মৃদুকণ্ঠে বলিল, “আপনাদের কি প্রয়োজন, মহাশয়? বোধ করি, মল্লিক সাহেবের সহিত দেখা করিতে আসিয়াছেন; তিনি ত এখন এখানে নাই।”
দেবেন্দ্রবিজয় কতকটা প্রকৃতিস্থ হইয়া বলিলেন, “না, আমরা আপনার সঙ্গেই দেখা করিতে আসিয়াছি।”
রমণী সবিস্ময়ে বলিল, “আমার সঙ্গে! কেন? কই আপনাদিগের কাহাকেও আমি ত চিনি না!”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “না চিনিতে পারেন। ঠিক আপনার সঙ্গে দেখা করিতে আসি নাই-আপনার পরিবর্ত্তে আমরা এখানে সৃজান বিবিকেই দেখিতে পাইব, মনে করিয়াছিলাম।”
সৃজান বিবির নাম শুনিয়া দিলজান একবার ঘৃণার হাসি হাসিয়া বলিল বলিল, “এত্ক্ষনে আমি আপনাদের অভিপ্রায় বুঝিতে পারিলাম। আপনারা মনে করিয়াছিলেন, মল্লিক সাহেব সৃজানকে গৃহের বাহির করিয়া আনিয়া এখানে রাখিয়াছেন। সেই ইচ্ছাটা তাঁহার ছিল বটে, কিন্তু আমি তাহা ঘটিত দিই নাই। আমি মাঝে পড়িয়া সেদিন রাত্রিতে সব গোল বাধাইয়া দিয়াছি।”
হরিপ্রসন বাবু বলিলেন, “সেদিন রাত্রিতে তুমি সৃজানের সহিত দেখা করিতে গিয়াছিলে, তাহা আমরা জানিতে পারিয়াছি। তোমার সহিত তাঁহার কি কথা হইয়াছিল?”
দিলজান বলিল, “অনেক কথা হইয়াছিল। আপনারা কে, কেনই বা আমাকে এ কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন, তাহা জানিতে না পারিলে আমি সে কথা আপনাদিগের নিকটে প্রকাশ করিতে পারি না।”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “আমাদের নাম বোধ হয়, তুমি শুনিয়া থাকিবে। আমার নাম হরিপ্রসন্ন-আমি উকীল, ইনি দেবেন্দ্রবিজয়-ডিটেক্টিভ-পুলিসের একজন নামজাদা কর্ম্মচারী-”
“আর আমার নাম মুন্সী জোহিরুদ্দীন,” বলিয়া মুন্সী সাহেব নিকটবর্ত্তী একটা আসন গ্রহণ করিলেন।
দিল। (সবিস্ময়ে) আপনি-আপনি মুন্সী সাহেব।
দেবেন্দ্র। হাঁ-ইনি তোমার ভগিনীপতি।
দিল। সৃজান যে আমার সহোদরা, কিরূপে আপনি তাহা জানিতে পারিলেন?
দেবেন্দ্র। অনেক অনুসন্ধানের পর জানিয়াছি।
দিল। কে আপনাকে বলিল?
দেবেন্দ্র। তোমার পিতা-মুন্সী মোজাম হোসেন।
দিল। (বিবর্ণমুখে) আমার পিতা! সেখানেও আপনি গিয়াছিলেন।
দেবেন্দ্র। গিয়াছিলাম বৈ কি! কোন জায়গাই বাকী রাখি নাই; নতুবা জানিতে পারিব কিরূপে?
দিল। তাহ হইলে আমার আর আমার ভগিনী সম্বন্ধে সকলি ত আপনি জানিতে পারিয়াছেন; তবে আমাকে আবার কি জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন?
দেবেন্দ্র। তোমার ভগিনী সম্বন্ধে আমরা একটি কথা জানিতে পারি নাই।
দিল। কোন্ বিষয়ে, বলুন?
দেবেন্দ্র। তাহার হত্যা বিষয়ে।
দিলজান বজ্রাহতের ন্যায় চকিত হইয়া উঠিল; তীব্রকণ্ঠে বলিল, “কি ভয়ানক! হত্যা-হত্যা! কি সর্বনাশ! কাহার কথা আপনি বলিতেছেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “যেদিন রাত্রিতে মনিরুদ্দীনের সহিত সৃজানের গৃহত্যাগ করিবার কথা, সেইদিন রাত্রিতে মেহেদী-বাগানে একটা স্ত্রীলোকের লাস পাওয়া যায়। আমরা প্রথমে তাহা তোমারই মৃতদেহ মনে করিয়া-ছিলাম; এখন দেখিতেছি, আমাদের সে অনুমান মিথ্যা-সে মৃতদেহ সৃজান বিবির।”
“আমার স্ত্রী! কি মুস্কিল- হা ঈশ্বর, শেষে এই করিলে!” বলিয়া মুন্সী সাহেব একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া অত্যন্ত কাতরভাবে অন্যদিকে মুখ ফিরাইলেন।
দিলজান শুনিয়া, সেইখানে ব্যাকুলভাবে বসিয়া পড়িল। কাতরকণ্ঠে বলিল, “কি ভয়ানক! সৃজান নাই-খুন হইয়াছে-খুন! কে তাহাকে খুন করিল?”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “জানা যায় নাই; তাহাই এখন আমাদিগকে সন্ধান করিয়া দেখিতে হইবে।”
দিলজান চিন্তিতভাবে বলিতে লাগিল, “তার কে এমন ভয়ানক শত্রু ছিল, আমি ত কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না; আপনারা কি কিছু ঠাহর করিতে পারিয়াছেন? ভাল কথা, আপনারা সৃজানের মৃতদেহ দেখিয়া আমি খুন হইয়াছি, এরূপ মনে করিয়াছিলেন কেন?”
দে। সেদিন তুমি যে কাপড়-চোপড় পরিয়া বাহির হইয়াছিলে, সৃজানের মৃতদেহে আমরা তাহা দেখিয়াছিলাম।
দিল। হাঁ, তাহাই ত বটে-এতক্ষণে আমি সব বুঝিতে পারিয়াছি, ঠিক হইয়াছে।
দে। তুমি সেদিন রাত্রিতে তোমার ভগিনীকে কোথায় শেষ-জীবিত দেখিয়াছ?
দিল। তাহার বাড়ীতে।
দে। কখ্ন তুমি চলিয়া এস?
দিল। রাত দুইটার পর।
দে। এত রাত্রি পর্য্যন্ত তোমার ভগিনীর সহিত তুমি কি করিতেছিলে? কি এত কথা ছিল?
দিল। কথা যাহা ছিল, তাহা অনেকক্ষণ শেষ হইয়া গিয়াছিল। রাত এগারটার পর সৃজান বাহির হইয়া যায়। আমি তাহার জন্য দুইটা পর্য্যন্ত তাহাদের বাড়ীতে অপেক্ষা করিয়াছিলাম।
দেবেন্দ্রবিজয়ের দৃষ্টিপথ হইতে যেন একখানা মেঘ সরিয়া গেল। তিনি ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “ওঃ! সকলই বুঝিতে পারিয়াছি-পাছে কেহ জানিতে পারে, এই ভয়ে সৃজান তোমার বেশ ধরিয়া বাহির হইয়া গিয়াছিল।”
দিলজান বলিল, “হাঁ-সে মনিরুদ্দীনের সঙ্গে দেখা করিতে গিয়াছিল; তাহার পর তাহাকে আর আমি ফিরিতে দেখি নাই-রাত দুইটা পর্য্যন্ত আমি অপেক্ষা করিয়াছিলাম।”
হরিপ্রসন্ন বাবু খুব উৎসাহের সহিত বলিয়া উঠিলেন, “আমার অনুমানই ঠিক, রাত বারটার সময়ে যে স্ত্রীলোকের সহিত মজিদ খাঁর দেখা হইয়াছিল-সে নিশ্চয়ই সৃজান।”
দিলজান বলিল, “মজিদ খাঁ-মজিদ খাঁ-তাঁহাকে আমি চিনি, তিনি ইহার কি জানেন?”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “তিনি বিশেষ কিছু না জানিলেও-এখন তাঁহার মাথার উপরেই এই সকল বিপদ্ চাপিয়া পড়িয়াছে। দিলজানের হত্যাপরাধে অভিযুক্ত হইয়া তিনি অবস্থা-বিপাকে এখন হাজত-বন্দী।”
দিলজান বলিল, “আপনারা আমার ভগিনীর মৃতদেহ দেখিয়া মনে করিয়াছিলেন, আমি খুন হইয়াছি-কি ভয়ানক ভ্রম! কিন্তু মজিদ খাঁ-তিনি নিরীহ ভাল মানুষ; আমি তাঁহাকে জানি। তিনি কেন খুন করিতে-(সহসা বাধাপ্রাপ্ত হইয়া) কি জানি আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না-আমি যতদূর-
মধ্যপথে বাধা দিয়া মুন্সী সাহেব বলিলেন, “শোন, দিলজান, এখন কিছুই জানি না বলিলে চলিবে না। একজন নিরীহ ভদ্রলোক আজ বিপদ্গ্রস্ত-ভয়ানক বিপদ্-এমন কি তাহার প্রাণও যাইতে পারে; এ সময়ে তুমি কোন কথা গোপন করিবার চেষ্টা করিয়ো না। তোমার ভগিনীর সহিত তোমার কি কি কথা হইয়াছিল; অকপটে সমুদয় প্রকাশ কর।”

 ৪.০৪ চতুর্থ পরিচ্ছেদ – দিলজানের কথা

দিলজান একজন ভৃত্যকে ডাকিয়া এক গ্লাস জল আনিতে আদেশ করিল। ভগিনীর মৃত্যু-যে-সে মৃত্যু নহে-খুন, তাহার পর এই সকল জবাবদিহি। দিলজান যেন প্রাণের ভিতরে হাঁপাইয়া উঠিয়াছিল। ভৃত্য জল লইয়া আসিলে দিলজান পর্দ্দার অন্তরালে গিয়া এক নিঃশ্বাসে একগ্লাসে জল পান করিয়া ফেলিল-এবং অনেকটা যেন সুস্থ হইতে পারিল। পুনরায় আসিয়া সে দ্বারপ্রান্তে উপবেশন করিল। বসিয়া দিলজান বলিতে আরম্ভ করিল-প্রথমে স্বরটা কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিতে লাগিল-ক্রমে তাহা বেশ সংযত হইয়া আসিল। দিলজান বলিতে লাগিল;-“আমার বাল্য-জীবনী প্রকাশের কোন প্রয়োজন দেখিতেছি না আপনারা তাহা এখন শুনিয়াছেন। মল্লিক সাহেব আমাকে লতিমন বাইজীর বাড়ীতে আনিয়া রাখিয়াছিলেন। তিনি আমাকে বিবাহ করিবেন বলিয়া আশাও দিয়াছিলেন; সেই প্রলোভনে আমি তাঁহার সহিত গৃহত্যাগ করি; কিন্তু আমাকে নিজের করতলগত করিয়া শেষে তিনি বিবাহের কথায় বড় একটা কান দিতেন না-কখন কখন আশা দিতেন মাত্র।
এইরূপে অনেকদিন কাটিয়া গেল। একদিন তাঁহারই মুখে শুনিলাম, কলিঙ্গা বাজারের মুন্সী সাহেবের সঙ্গে আমার ভগিনী সৃজানের বিবাহ হইয়াছে। শুনিয়া প্রথমতঃ সুখী হইলাম-তাহার পর ভিতরের কথা ক্রমে ক্রমে জানিতে পারিয়া নিজের সর্ব্বনাশ বুঝিতে পারিলাম। শুনিলাম আমার ভগিনীও মল্লিক সাহেবের প্রলোভনে মুগ্ধ হইয়াছে। আর রক্ষা নাই-সত্বর ইহার প্রতিবিধান করা দরকার। আমি গোপনে সন্ধান লইতে লাগিলাম। একদিন শুনিলাম, আমার ভগিনী মনিরুদ্দীনের সহিত গৃহত্যাগ করিবার জন্য স্থিরসঙ্কল্প। যাহাতে তাহার সঙ্কল্প সিদ্ধ না হয়, সেজন্য প্রাণপণ করিতে হইবে-নতুবা আমাকে একেবারে পথে বসিতে হয়। যেদিন রাত্রিতে আমার ভগিনী গৃহত্যাগের বন্দোবস্ত ঠিক করিয়া ফেলিয়াছিল, সেইদিন অপরাহ্ণে আমি মল্লিক সাহেবের বাড়ীতে গিয়াছিলাম। মনে করিয়াছিলাম, যেমন করিয়া হউক, তাঁহাকে নিরস্ত করিতে হইবে। পায়ে ধরিয়া পারি-না পারি, তাঁহাকে খুন করিব-এ সঙ্কল্পও আমার ছিল। তাঁহাকে খুন করিয়া সেই ছুরিতে নিজের প্রাণ নিজে বাহির করিয়া ফেলিতে কতক্ষণ সময়ের দরকার? সেজন্য আমি একখানি ছুরিও নিজের সঙ্গে লইয়াছিলাম। দারুণ নৈরাশ্যে, ঈর্ষা-দ্বেষে আমি তখন এক রকম পাগলের মতই হইয়া গিয়াছিলাম-মনের কিছুই ঠিক ছিল না। মল্লিক সাহেব তখন বাড়ীতে ছিলেন না; মজিদ খাঁর সঙ্গেই আমার দেখা হয়-মনের ঠিক ছিল না-আবেগে তাঁহাকে সকল কথা বলিয়া ফেলিলাম। তিনি আমাকে বুঝাইয়া বিদায় করিয়া দিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। আমি কিছুতেই বুঝিলাম না-সে শক্তিও তখন আমার ছিল না। তিনি জোর করিয়া আমার নিকট হইতে ছুরিখানি কাড়িয়া লইতে আসিলেন। আমি কিছুতেই দিব না-তিনিও কিছুতেই ছাড়িবেন না-আমি তখন অনন্যোপায় হইয়া ছুরিখানা ঘরের বাহিরে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিলাম। যেমন তিনি তাহা উঠাইয়া লইবার জন্য ছুটিয়া যাইবেন-দেখিতে না পাইয়া জুতাসুদ্ধ পা সেই ছুরিখানির উপরে তুলিয়া দিতে, সেখানা দুই টুক্রা হইয়া গেল। তিনি সেই ভাঙা ছুরিখানি নিজের জামার পকেটের মধ্যে রাখিয়া দিলেন। আমি হতাশ হইয়া বাড়ীতে ফিরিয়া আসিলাম। বাড়ীতে ফিরিয়া মন আরও অস্থির হইয়া উঠিল-আশা ত্যাগ করা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য হইল। আমি আর একটা নূতন উপায় স্থির করিলাম। স্থির করিলাম, আমার ভগিনীর সহিত গোপনে দেখা করিয়া মর্ম্মকথা সমুদয় খুলিয়া বলিল। যাহাতে সে আমার গন্তব্য পথের অন্তরায় না হয়, সেজন্য তাহাকে বুঝাইয়া বলিব-নিশ্চয়ই সে আমার কথা ঠেলিতে পারিবে না-জানিয়া-শুনিয়া সে কখনই আমার সর্ব্বনাশ করিবে না। শুধু আমার নয়-সকল কথা খুলিয়া বলিলে সে নিজের সর্ব্বনাশও নিজে বুঝিতে পারিবে, মনে করিয়া আমি তাহার সহিত দেখা করিতে যাইলাম। যাইয়াই তাহার দেখা পাইলাম না; সে কোথায় নিমন্ত্রণ রাখিতে গিয়াছিল। আমি তাহার জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। যখন আমার ভগিনী ফিরিয়া আসিল, তখন রাত প্রায় এগারটা। আমি তাহাকে নিজের অভিপ্রায় বেশ করিয়া বুঝাইয়া বলিলাম। কিন্তু কিছুতেই সে বুঝিল না-আমার সহিত ঝগড়া আরম্ভ করিয়া দিল। কিছুতেই সে মল্লিক সাহেবকে ত্যাগ করিতে সম্মত হইল না। শেষে অনেক তর্ক-বিতর্কের পর স্থির হইল;-সে অগ্রে মল্লিক সাহেবের বাড়ীতে গিয়া, তাঁহার সহিত দেখা করিয়া জানিবে, আমার কথা কতদূর সত্য-তিনি আমাকে আন্তরিক ভালবাসেন কি না-তাহার পর যাহা হয় করিবে। যদি সে বুঝিতে পারে, মল্লিক সাহেব তাহার সর্ব্বনাশ সাধনের জন্য তাহার সহিত এইরূপ প্রণয়াভিনয় আরম্ভ করিয়াছেন, তাহা হইলে সে তাঁহার আশা ত্যাগ করিবে, নতুবা নহে-এইরূপ স্থির হইল। আমিও তাহা যুক্তিযুক্ত বলিয়া বোধ করিলাম! তখনই মনিরুদ্দীনের সহিত দেখা করা দরকার-কিন্তু কিরূপে তেমন সময়ে সে গোপনে তাঁহার সহিত দেখা করিবে, কোন উপায় স্থির করিতে পারিল না। বিশেষতঃ তেমন সময়ে বাটীর বাহির হইয়া একজন অপর পুরুষের সহিত দেখা করা তাহার পক্ষে খুবই দোষাবহ; কিন্তু দেখা করা চাই-ই । আমি একটা নূতন উপায় ঠিক করিয়া ফেলিলাম; তাহাকে আমার কাপড় জামা ওড়্না সমুদয় খুলিয়া দিলাম। সে তাহাই পরিয়া বাহির হইয়া গেল। আমি তাহার পোষাক পরিয়া তাহার প্রতীক্ষা করিতে লাগিলাম। পাছে কোন রকমে ধরা পড়ি, এই ভয়ে আমি তাহার শয়নকক্ষে গিয়া ভিতর হইতে দ্বার বন্ধ করিয়া রহিলাম। মনিরুদ্দীনের সহিত দেখা করিয়া, যা’ হয় একটা স্থির করিয়া তাহার শীঘ্র ফিরিবার কথা ছিল; কিন্তু অনেকক্ষণ আমি তাহার অপেক্ষা করিলাম। ক্রমে রাত দুটা বাজিয়া গেল। তখনও সৃজানকে ফিরিতে না দেখিয়া আমার মনে নানারকম সন্দেহ হইতে লাগিল। মনে ভাবিলাম, সে নিশ্চয়ই আমাকে বড় ফাঁকি দিয়া গিয়াছে; তথাপি নিরাশ হইলাম না-গোপনে আমিও সেখানে হইতে বাহির হইয়া পড়িলাম। আমি বরাবর মনিরুদ্দীনের বাড়ীর দিকে গেলাম। বাড়ীর পশ্চাতে একটা গলিপথে দেখি, একখানা গাড়ী তখনও সেখানে দাঁড়াইয়া আছে। দেখিয়া অনেক ভরসা হইল; বুঝিতে পারিলাম, সৃজান আমাকে ফাঁকি দিতে পারে নাই। মল্লিক সাহেব সৃজানের জন্য গাড়ী লইয়া অপেক্ষা করিতেছেন। তখন আমার মাথায় আর একটা মতলব উপস্থিত হইল; আমি সেই গাড়ীর দ্বার-সম্মুখে গিয়া দ্বারের হাতলে হাত দিয়া দাঁড়াইলাম। ভিতরে মনিরুদ্দীন সাহেব বসিয়াছিলেন। তিনি আমার হাত ধরিয়া গাড়ীর ভিতরে উঠাইয়া লইলেন। অন্ধকারে আমাকে তিনি চিনিতে পারিলেন না। গাড়ীর ভিতরে আরও অন্ধকার-আমার আরও সুবিধা হইল। আমি গাড়ীর ভিতরে উঠিয়া বসিলে, তিনি মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এত রাত হ’ল? আমি তাঁহার অপেক্ষা মৃদুস্বরে-পাছে ধরা পড়ি-খুব সংক্ষিপ্ত উত্তর করিলাম, ‘হাঁ।’ তখনই গাড়ী ছাড়িয়া দেওয়া হইল। পথে তিনি অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন, পাছে কণ্ঠস্বরে আমাকে চিনিতে পারেন, সেইজন্য আমি খুব মৃদুস্বরে তাঁহার প্রশ্নের ‘হাঁ’ ‘না’ ‘হুঁ’ বলিয়া উত্তর দিতে লগিলাম। ক্রমে গাড়ী শিয়ালদহ ষ্টেশনে আসিয়া পৌঁছিল। ষ্টেশনে অনেক লোকের ভিড়-দীপালোকে চারিদিক্ আলোকিত। অবগুণ্ঠনে মুখ ঢাকিয়া গাড়ী হইতে নামিয়া পড়িলাম; না ঢাকিলেও ক্ষতি ছিল না-সহজে তিনি আমাকে চিনিতে পারিতেন না; তথাপি সাবধান হওয়া দরকার। যাহা হউক, আমার একটা খুব সুবিধা ছিল। আমার পরিধানে সৃজানের পোষাক-সৃজানের জাফ্রাণ রঙের সিল্কের কাপড় জামা ওড়্না-তিনি আমাকে সন্দেহ করিতে পারিলেন না। এদিকে ট্রেণ ছাড়িবার বিলম্ব ছিল না; তিনি তাড়াতাড়ি প্রথম শ্রেণীর টিকিট কিনিয়া আমাকে লইয়া ট্রেণে উঠিলেন। তৎক্ষণাৎ সে ট্রেণ ছাড়িয়া দিল। তখন আমি অবগুণ্ঠন উন্মুক্ত করিয়া দিলাম। প্রথমে তিনি আমাকে চিনিতে পারিলেন না; তাহার পর যখন তিনি নিজের ভ্রম বুঝিতে পারিলেন, তখন যেন একেবারে হতবুদ্ধি হইয়া পড়িলেন। তখন আমি তাঁহাকে সমুদয় কথা খুলিয়া বলিলাম। শুনিয়া তিনি আমার উপরে একেবারে খড়গহস্ত হইয়া উঠিলেন- অনেক তিরস্কার করিতে লাগিলেন। আমি তাহাতে কর্ণপাত করিলাম না। তিনি পরের ষ্টশনে নামিয়া পুনরায় কলিকাতায় ফিরিবার অভিপ্রায় প্রকাশ করিলেন। তাহা হইলে আমি ট্রেণ হইতে লাফাইয়া পড়িয়া আত্মহত্যা করিব বলিয়া তাঁহাকে আমি ভয় দেখাইলাম। তিনি আর বাড়াবাড়ি করিলেন না। ষ্টেশনের পর ষ্টেশন পার হইয়া ট্রেণ চলিতে লাগিল। তিনি আর উচ্চবাচ্য করিলেন না; আমাকে এই বাগানে আনিয়া রাখিলেন।”

 ৪.০৫ পঞ্চম পরিছেদ – ঘটনা-বৈষম্য

দেবেন্দ্রবিজয় দিলজানকে বলিলেন, “তোমার কথায় অনেক গুপ্তরহস্য ভেদ হইল বটে; কিন্তু তোমার ভগিনীর হত্যাকাণ্ডের রহস্য ভেদে সুবিধা হইতে পারে, এমন কোন কথাই পাওয়া গেল না। তোমার কথায় বুঝিতে পারিলাম, মজিদ খাঁ সেই ছুরি সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন, মিথ্যা নহে। আর তাঁহার সহিত মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে যে স্ত্রীলোকের দেখা হইয়াছিল, যাহার নাম তিনি এমন বিপদে পড়িয়াও অদ্যাপি প্রকাশ করেন নাই-আমরা মনে করিয়াছিলাম, তুমিই সেই স্ত্রীলোক। এখন বুঝিলাম, তোমার বেশ ধরিয়া তোমার ভগিনীই সেখানে গিয়াছিল। একমুহূর্ত্তে সকলই উল্টাইয়া-পাল্টাইয়া গেল। যাহা হউক, এখন যাহাতে যোমার ভগিনীর হত্যাকারী ধরা পড়ে, তাহা করিতে হইবে; এ পর্য্যন্ত হত্যাকারীকে ধরিবার কোন সূত্রই পাওয়া যায় নাই। তুমি কি ইহার সম্বন্ধে কিছুই জান না?”
দিল। না।
দেবেন্দ্র। তোমার ভগিনী খুন হইয়াছে, তাহা কি মল্লিক সাহেব জানিতেন? সে সম্বন্ধে তিনি তোমাকে কিছু বলিয়াছেন?
দিল। না, তিনি কিরূপে জানিতে পারিবেন?
দে। কিরূপে জানিতে পারিবেন, তা’ আমি তোমাকে কি বলিল? তিনি তোমার ভগিনীর না হউক-যে কোন একটা খুন সম্বন্ধে কিছু বলিয়াছেন কি?
দিল। না।
মুন্সী সাহেব দেবেন্দ্রবিজয়কে বলিলেন, “এখনকার কাজ ত সব মিটিয়া গেল; মেহেদী-বাগানের সেই নিহত স্ত্রীলোক যে আমারই স্ত্রী, সে সম্বন্ধে আর কোন সন্দেহ নাই। এখন কি করিবেন, স্থির করিয়াছেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “এখন কলিকাতায় গিয়া একবার মনিরুদ্দীনের সহিত দেখা করিতে হইবে। তিনি সেদিন রাত বারটার পর হইতে কোথায় ছিলেন, কি করিয়াছিলেন-তাঁহার গতিবিধি সম্বন্ধে সমুদয় কথা জানা এখন আমাদের বিশেষ দরকার হইতেছে।”
ব্যাঘ্রীর মত সবেগে মাথা তুলিয়া দিলজান দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে কঠোর দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিল, “কি ভয়ানক! আপনি কি শেষে তাঁহাকেই সন্দেহ করিলেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “কই-সন্দেহের কোন কথা ত আমি বলি নাই। তিনি সেদিন রাত বারটার পর কোন্ কাজে কোথায় ছিলেন, কোথায় গিয়াছিলেন, তাঁহারই গতিবিধির সন্তোষজনক উত্তর আমাদিগকে দিবেন মাত্র। ইহাতে ক্ষতি কি?”
“ক্ষতি কিছুই না,” বলিয়া দিলজান সহসা উঠিয়া দাঁড়াইল। তাহার পর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল, “যাহা ভাল বুঝিবেন, তাহাই করিবেন। আমি যাহা কিছু জানিতাম, সমুদয় বলিয়াছি।” তৎক্ষণাৎ দিলজান পর্দ্দা তুলিয়া, সেই দ্বারপথে কক্ষের বাহির হইয়া গেল।
হরিপ্রসন্ন বাবু দেবেন্দ্রবিজয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সত্যই কি আপনি এখন অনুমান করিতেছেন, মনিরুদ্দীন সৃজানকে খুন করিয়াছে? সে সৃজানকে কেন খুন করিতে যাইবে?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তা’ সৃজানকে সে কেন খুন করিতে যাইবে? সৃজানকে খুন করিবার কোন কারণই নাই; তা’ না থকিলেও সে খুন করিতে পারে আর তাহার কারণেরও কোন অভাব নাই।”
মুন্সী সাহেব চকিত হইয়া বলিলেন, “তবে কি মনিরুদ্দীন দিলজানকে খুন করিতে গিয়া ভ্রমক্রমে আমার স্ত্রীকে খুন করিয়াছেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তাহাই ঠিক।”

৪.০৬ ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – প্রত্যাগমন

এদিকে মনিরুদ্দীন সুস্থ শরীরে বাড়ী ফিরিয়া আসিতে গনির মার আনন্দ ধরে না। সে মনিরুদ্দীনকে কোলে-পিঠে করিয়া মানুষ করিয়াছে; মনিরুদ্দীনের উপরে তাহার খুব একটা স্নেহ পড়িয়া গিয়াছিল। কাল অনেক রাত্রিতে মনিরুদ্দীন বাড়ীতে আসিয়াছিলেন, রেলপথে আসায় অনেকটা অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছিলেন। গনির মা তাহার সহিত ভাল করিয়া কথা কহিবার অবসর পায় নাই। বেলা দশটার পর নিদ্রাভঙ্গে উঠিয়া যখন মনিরুদ্দীন দ্বিতলের বৈঠকখানা গৃহে বসিয়া আল্বোলায় নল-সংযোগে ধূমপানে মনোনিবেশ করিয়াছেন, বৃদ্ধা গনির মা একটু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হইয়া, একখানি ধপ্ধপে কাপড় পরিয়া তাঁহার সম্মুখে গিয়া বসিল। গত রাত্রিতে মনিরুদ্দীন গনির মার সহিত ভাল করিয়া কথা কহে নাই বলিয়া, গনির মা মুখখানা একটু ভারি করিয়া বসিল।
মনিরুদ্দীন মৃদুহাস্যে তাহাকে পরিহাস করিয়া বলিলেন, “আর তোমার এ বিরহ-য্ন্ত্রণা দেখিতে পারি না-গনির মা, একটা নিকা করিবার চেষ্টা দেখ। চেষ্টা বা দেখিতে হইবে কেন-তুমি একবার মত্ কর, কত বাদশাহ ওম্রাও এখনি তোমার দ্বারস্থ হয়। আমি এখানে ছিলাম না- বোধ হয়, ইহার মধ্যে কোন বাদ্শাহ তোমার কাছে এক-আধখানা দরখাস্ত পেস করিয়া থাকিবে। তোমার মুখের ভাব দেখিয়া আমার ত তাহাই বিবেচনা হয়।”
গনির মা বলিল, “ওম্রাও বাদ্শাহে আর দরকার কি? আর দুইদিন বাদে একেবারে গোরের মাটির সঙ্গে নিকা হবে।”
মনিরুদ্দীন বলিল, “তাই বা মন্দ কি! কোন খবর এসেছে না কি?”
গনির মা বলিলেন, “খবর ত হ’য়েই আছে-পা বাড়ালেই হয়। এখন তামাসা থাক্, কাজের কথা শোন, তুমি এখান থেকে চ’লে গেলে একজন থানার লোক আমার কাছে তোমার সন্ধান নিতে এসেছিল।”
মনিরুদ্দীন চকিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “থানার লোক? সে কি, কি হইয়াছে? সে কে?”
গনির মা বলিল, “কি নাম বাপু তার-ঠিক মনে পড়্ছে না, কি দেবিন্দর না ফেবিন্দর-লোকটা বড় নাছোড়বান্দা।”
মনিরুদ্দীন বলিলেন, “ওঃ! ঠিক হয়েছে, দেবেন্দ্রবিজয়-ডিটেক্টিভ-ইন্স্পেক্টর। তিনিই ত এখন আমাদের মজিদ খাঁকে গ্রেপ্তার করিয়াছেন।”
গনির মা জিজ্ঞাস করিল, “এ সকল কথা তুমি কোথায় শুন্লে বাপ্?”
মনিরুদ্দীন বলিলেন, “আমি কাল বাড়ীতে ঢুকিবার আগেই সব শুনিয়াছি। মেহেদী-বাগানে কে একটা মাগী খুন হইয়াছে-পুলিসের লোক তাহাকে দিলজান মনে করিয়াছে-কি পাগল!”
গনির মা ব্যগ্রভাবে বলিল, “তবে কি দিলজান সত্যি সত্যি খুন হয় নি?”
মনিরুদ্দীন বলিলেন, “না, সৃজান বিবি খুন হইয়াছে।”
গনির মা সংশয়িতচিত্তে বলিয়া উঠিল, “সে কি! তবে শুনেছিলুম, তুমি না কি সৃজানকে কোথায় নিয়ে গিয়ে রেখেছ; পাড়ার লোকের কাছে একেবারে কান-পাতা যায় না-ছেলে বুড়ো আদি ক’রে কেবল তোমার নিন্দা। দেখ দেখি কোথায় কিছু নাই-একজনের নামে অমনি এত বঢ় একটা অপবাদ কেমন করে রটিয়া দিলে গো!”
মনিরুদ্দীন বলিলেন, “তুমি কি আমাকে এমনই মনে কর? যাহা হউক, পুলিস এখন সৃজানের হত্যাকাণ্ডে আমাকে বোধ হয়, জড়াইতে চেষ্টা করিবে। আজ সকালেও একবার দেবেন্দ্রবিজয়ের এখানে আসিবার কথা ছিল। এখনও যে তাঁর কোন দেখা নাই, তাহাই ভাবিতেছি।”
গনির মা বলিল, “কেন, এখানে আবার তোমার কাছে আস্বে কেন?”
মনিরুদ্দীন বলিলেন, ‘খুন সম্বন্ধে আমি কিছু জানি কি না, তাহাই জিজ্ঞাসা করিতে আসিবেন!”
গনির মা জিজ্ঞাসা করিল, “মজিদ খাঁ কি সত্য-সত্যই খুন করিয়াছে?”
মনিরুদ্দীন বলিল, “কি আশ্চর্য্য! মজিদ খাঁকেই খুনী বলিয়া তোমার বিশ্বাস হইল? তুমি আমাদের সংসারে থাকিয়া চুল পাকাইয়া ফেলিলে-আমাদের দুইজনকে জন্মাবধি দেখিয়া আসিতেছ-নিজের হাতে মানুষ করিয়াছ, তবু তুমি আমাদের এখনও চিনিতে পারিলে না?”
এমন সময়ে কক্ষদ্বারে কে মৃদু শব্দ করিল। মনিরুদ্দীন বলিলেন, “কে ওখানে?”
ধীরে ধীরে দ্বার ঠেলিয়া একটী বালক ভৃত্য কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিল। এবং মনিরুদ্দীনের হাতে একখানি কার্ড দিল।
মনিরুদ্দীন কার্ডের দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া গনির মাকে বলিলেন, “দেবেন্দ্রবিজয় উপস্থিত। আমি ত তোমাকে পূর্ব্বেই বলিয়াছিলাম, তিনি খুনের তদন্তে আজ আমার কাছেও আসিবেন। (ভৃত্যের প্রতি) যাও, তাঁহাকে এইখানেই লইয়া এস।”
ভৃত্য চলিয়া গেল। গনির মা-ও উঠিয়া যাইবার উপক্রম করিল। মনিরুদ্দীন তাহাকে বসিতে বলিলেন। ক্ষণপরে তথায় দেবেন্দ্রবিজয় প্রবেশ করিলেন।

৪.০৭ – সপ্তম পরিচ্ছেদ – দোষক্ষালনের জন্য কি?

মনিরুদ্দীন দেবেন্দ্রবিজয়কে বসিতে বলিয়া বলিলেন, “আপনার নাম দেবেন্দ্রবিজয় বাবু-একজন খুব খ্যাতনামা ডিটেক্টিভ, তাহা আমি শুনিয়াছি। মহাশয়ের সহিত পরিচয় হওয়ায় আমি খুব সুখী হইলাম। বোধ করি, মেহেদী-বাগানের খুনের তদন্তেই আপনি আমার কাছে আসিয়া থাকিবেন।”
দেবেন্দ্রবিজয় মনিরুদ্দীনকে একবারে কাজের কথা পাড়িতে দেখিয়া অত্যন্ত বিস্মিত হইলেন। বলিলেন, “হাঁ, আপনার অনুমান ঠিক-আমি দুই-একটী কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাই; সন্তোষজনক উত্তর পাইলে সুখী হইব।”
মনিরুদ্দীন বলিলেন, “বটে, ফরিদপুরে আমার বাগানে গিয়া যাহার সহিত দেখা করিয়াছিলেন, তাহার নিকটে আপনি ত সকলই শুনিয়াছেন।”
দেবেন্দ্রবিজয় আরও বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “আপনি তাহা কিরূপে জানিতে পারিলেন?”
মনিরুদ্দীন বলিলেন, “আমি কাল রাত্রেই সেখানকার একখানা বড় রকম টেলিগ্রাম পাইয়াছি। আমার বাগানে যাহার সঙ্গে আপনাদের দেখা হইয়াছিল, সে সৃজান নয়-দিলজান, তাহা আপনি এখন বেশ বুঝিতে পারিয়াছেন?”
দে। হাঁ, আমার ভুল হইয়াছিল।
মনি। আপনার ন্যায় খ্যাতনামা লব্ধপ্রতিষ্ঠ ডিটেক্টিভের এমন ভুল হওয়া ঠিক নহে।
দে। উপন্যাসের ডিটেক্টিভের ভুল না হইতে পারে; আমরা সে রকমের ডিটেক্টিভ নহি-সামান্য মনুষ্যমাত্র; আমাদের পদে পদে ভ্রম হওয়াই সম্ভব।
মনি। যাক্, সে কথায় আর দরকার নাই। দিলজানই যে সেদিন রাত্রিতে সৃজানের সহিত দেখা করিতে তাহাদের বাড়ীতে গিয়াছিল, আপনি ফরিদপুরে গিয়া তাহার নিজের মুখে সে কথা শুনিয়াছেন, বোধ হয়।
দে। শুনিয়াছি।
মনি। সৃজান যে এখানে আমার বাড়ীতে আসিয়াছিল, তাহাও বোধ হয়, দিলজান আপনাকে বলিয়াছে।
দে। বলিয়াছে।
মনি। তবে আপনি সকলই ত শুনিয়াছেন, এ ছাড়া আমার নিকটে আর নূতন কথা কি পাইবেন?
দে। আপনার কাছে আপনার সম্বন্ধে, দুই-একটী কথা জানিবার জন্য আসিয়াছি।
মনি। কি, বলুন?
দে। সেদিন রাত্রে আপনি রাত এগারটার পর কোথায় গিয়াছিলেন-কি করিয়াছিলেন-কোথায় কাহার সহিত আপনার দেখা হইয়াছিল, আশা করি, আপনার কাছে তাহার সন্তোষজনক উত্তর পাইব।
মনি। ওঃ! এতক্ষণে আপনার মনের অভিপ্রায় বুঝিতে পারিলাম; তাহা হইলে আপনি এখন আমাকেই সৃজানের হত্যাকারী স্থির করিয়াছেন দেখিতেছি; মন্দ নয়!
দেবেন্দ্রবিজয় কোন কথা কহিলেন না। একটু অপ্রতিভভাবে অন্যদিকে মুখ ফিরাইলেন।
মনিরুদ্দীন বলিতে লাগিলেন, “মহাশয়, এ আপনার কিরূপ পরিহাস, বুঝিতে পারিলাম না। পরিহাস-প্রসঙ্গেও এ কথা বলা আপনার যুক্তি-সঙ্গত হয় নাই। আমার স্বভাব-চরিত্র সম্বন্ধে বোধ হয়, আপনি সবিশেষ অবগত নহেন; তাহা হইলে কখনই আপনি আমার উপরে এমন একটা ভয়ানক সন্দেহ করিতে পারিতেন না। মদ্যপ, বেশ্যাসক্ত হইলেও আমি এমন পিশাচ নহি-একজন স্ত্রীলোককে খুন করিতে যাইব। আপনি যে সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন, মজিদ খাঁ ধৃত না হইলে আপনি কিছুতেই আমার কাছে তাহার একটিরও উত্তর পাইতেন না। কিন্তু এখন দেখিতেছি, মজিদ খাঁর জন্য বাধ্য হইয়া আমাকে আপনার এই সকল প্রশ্নের উত্তর করিতে হইবে। বেশ ভাল হইয়া বসুন, বলিতেছি।” গনির মাকে বলিলেন, “তুনি এখন যাইতে পর-তোমার এখানে থাকিবার অরার কোন প্রয়োজন নাই।”
গনির মা যেমন উঠিয়া যাইবে, দেবেন্দ্রবিজয় তাহাকে বলিলেন, “আমার একটু প্রয়োজন আছে। তুমি না আমায় বলিয়ছিলে, সেদিন রাত এগারটর পর মজিদ খাঁর সহিত যে স্ত্রীলোকের দেখা হইয়াছিল, সে দিলজান?”
গনির মা বলিলেন, “হাঁ, দিলজানই ত – সে নিশ্চয়ই দিলজান আর কেহ নহে?”
গনির মা বলিল,”কি মুস্কিল্! আমি যে নিজের চোখে তাকে দেখেছি। আমি কি তাকে চিনি না? সেই মুখ – সেই চোখ, তা ছাড়া সন্ধ্যার আগে, সে যেমন সেজে-গুজে এসেছিল-রাতেও ঠিক সেই কাপড়-চোপড় পরেই এসেছিল।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “মিথ্যাকথা-ঠিক চিন্তে পার নাই।”
বৃদ্ধা গনির মার ক্রোধ মস্তকে উঠিল। সে হাত মুখ নাড়িয়া বলিল, “আমি বুড়োমাগী, আমার মিথ্যাকথা-তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে-আমি মিছে কথা বল্তে গেছি! কি আমার পীর-পয়গম্বর এসেছে রে” বলিতে বলিতে ক্রোধভরে ঘরের বাহির হইয়া গেল।
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “দিলজান ও সৃজান যমজ ভগিনী-উভয়েই একই রকম দেখিতে-তাহাতে উপরে আবার একই রকমের পোষাক-তাহাতে বৃদ্ধা গনির মার যে এরূপ ভুল হইবে, তাহার আশ্চর্য্য কি?”
মনিরুদ্দীন বলিলেন, “ভুল হওয়াই খুব সম্ভব। যাহা হউক, আপনি এখন আমাকে কি জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আপনারই কথা।”
মনিরুদ্দীন বলিলেন, “দেখুন, আমি সামান্য মনুষ্য মাত্র- প্রলোভনের দাস-প্রবৃত্তির দাস-কি জানি, কি মোহবশে সৃজানকে দেখিয়া আমি মুগ্ধ হইয়াছিলাম। তাহাকে লাভ করিবার জন্য আমার হৃদয় একটা অদম্য তৃষ্ণায় পূর্ণ হইয়া গিয়াছিল। আপনি আমাকে অসচ্চরিত্র পরস্ত্রীলোলুপ বলিয়া ঘৃণা করিতে পারেন; কিন্তু আপনি স্থির জানিবেন, আমার কথা ছাড়িয়া দিই-অনেক সাধুপুরুষও এ প্রলোভনের হাত এড়াইতে পারে না। সেইদিন রাত্রিতে সত্যসত্যই আমি সৃজানকে লইয়া কলিকাতা ত্যাগ করিতে প্রস্তুত হইয়াছিলাম। রাত্রি এগারটার পর হইতে আমি বাড়ীর পশ্চাদ্ভাগে একখানা গাড়ী লইয়া সৃজানের অপেক্ষা করিতেছিলাম। নিজের গাড়ী নহে-একখানা ভাড়াটিয়া গাড়ী ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলাম। আপনি সে প্রমাণ সেই গাড়ীর কোচম্যানের নিকটে অনায়াসে পাইবেন। তাহার নাম করিম; এই জানবাজারেই সে থাকে। রাত যখন প্রায় বারটা, তখন আমি গাড়ী ছাড়িয়া একবার চলিয়া আসি; তাড়াতাড়িতে ঘড়ীটা সঙ্গে লইতে ভুল করিয়াছিলাম। পুনরায় বাড়ীর ভিতরে গিয়া ঘড়ীটা লইয়া আসিতে হইবে, মনে করিয়া আমি গাড়ী হইতে উঠিয়া আসিলাম। বাড়ীর সম্মুখভাগে আসিতেই দেখিলাম, একটী স্ত্রীলোক দ্রুতবেগে উন্মাদিনীর মত আমার বাড়ী হইতে বাহির হইয়া গেল। সেদিন ভয়ানক অন্ধকারময় রাত্রি-তাহার উপর কুয়াশায় চারিদিক্ ঢাকিয়া ফেলিয়াছিল। বাহিরে অন্ধকারের মধ্যে সে কোথায় মিশিয়া গেল, আর তাহাকে দেখিতে পাইলাম না। বহির্দ্বারের ভিতরে একটা লণ্ঠন জ্বলিতেছিল; তাহারই আলোকে আমি কেবল একবার নিমেষমাত্র তাহার মুখ দেখিতে পাইয়াছিলাম; তাহাতেই তাহাকে আমি তখন দিলজান মনে করিয়াছিলাম। সাজসজ্জাও ঠিক দিলজানের অনুরূপ। আমি দেখিয়াই আর অগ্রসর হই নাই; সেখানেই স্তম্ভিত ভাবে দাঁড়াইয়া রহিলাম। এমন সময়ে আর একজন কে আমার পাশ দিয়া ছুটিয়া চলিয়া গেল। সেই স্ত্রীলোকটি যেদিকে গিয়াছিল, সেই লোকটিকেও সেইদিকে যাইতে দেখিলাম। মনে বড় সন্দেহ হইল-কে এ লোক? কেনই বা দিলজানের অনুসরণ করিতেছে? অবশ্যই ইহার ভিতরে কিছু রহস্য আছে সেটুকু দেখা দরকার। তাহারা দুইজনে যেদিকে গিয়াছিল, আমিও দ্রুতপদে সেইদিকে তখন ছুটিয়া গেলাম। নিকটবর্ত্তী সকল স্থানেই তাহাদের অনুসরণ করিতে লাগিলাম। যে অন্ধকার, নিজেকেই নিজে দেখিতে পাওয়া যায় না। অনেক চেষ্টা করিলাম, দুইজনের কাহাকেও আর দেখিতে পাইলাম না। পরিশ্রান্ত হইয়া প্রায় একঘণ্টা পরে আবার সেই গাড়ীতে ফিরিয়া আসিলাম। সৃজানের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলাম। রাত্রি দুইটার পর দিলজান আমার গাড়ীর সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। আমি সৃজান মনে করিয়া তাহাকে ভিতরে তুলিয়া লইলাম। এদিকে গাড়ী শিয়ালদহ ষ্টেশনের দিকে চলিল। সেখানে ট্রেণে উঠিয়া আমার ভ্রম আমি বুঝিতে পারিলাম।”
দেবেন্দ্রবিজয় অত্যন্ত আগ্রহের সহিত মনিরুদ্দীনের কথা শুনিয়া যাইতেছিলেন। মনিরুদ্দীন নীরব হইলে, তিনি সন্দিগ্ধদৃষ্টিতে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “যে লোকটিকে আপনি সেই রমণীর অনুসরণ করিতে দেখিয়াছিলেন, কে সে লোক?”
ম। কিরূপে জানিব?
দে। সে কি আপনার পরিচিতের মধ্যে কেহ নহে?
ম। পরিচিত হইলেও–তেমন অন্ধকারে তাহাকে কিরূপে চিনিতে পারিব?
দে। যদিও ঠিক না চিনিতে পারেন-তাহার আকার-প্রকারে ভাবে অমুক লোক বলিয়া আপনার মনে কোন রকম একটা ধারণা হয় নাই কি? হওয়াই খুব সম্ভব।
ম। (চিন্তিতভাবে) সে ধারণা হয় নাই কি? হওয়াই খুব সম্ভব।
দে। (ব্যগ্রভাবে) কি নাম?
ম। মুন্সী সাহেব।
দে। (চকিতে) কে, জোহিরুদ্দীন?
ম। হাঁ।

৪.০৮ অষ্টম পরিচ্ছেদ – তাহার পর কি হইল?

দেবেন্দ্রবিজয় মহাবিস্ময়ে হতবুদ্ধি হইয়া গেলেন| এই হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত সমগ্র ঘ্টনা মনে মনে তোলপাড় করিতে লাগিলেন| শেষে ভাবিয়া স্থির করিলেন, মনিরুদ্দীন ‘উদোর বোঝা বুদোর ঘাড়ে’ চাপাইতে চাহেন| নিজের দোষক্ষালনের জন্য তিনি এই হত্যাপরাধটা মুন্সী সাহেবের স্কন্ধে তুলিয়া দিতে পারিলেই এখন নিশ্চিন্ত হইতে পারেন| লোকটা নিশ্চয়ই আমাকে বিপথে চালিত করিবার চেষ্টা করিতেছে| যাহা হউক, দেবেন্দ্রবিজয় সহসা কিছু বলিতে পারিলেন না|
মনিরুদ্দীন দেবেন্দ্রবিজয়কে নীরব থাকিতে দেখিয়া বলিলেন, “কি ভাবিতেছেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আপনি এখন মুন্সী সাহেবের উপরে এই হত্যাপরাধটা চাপাইতে চাহেন, দেখিতেছি, আপনার এইরূপ দোষারোপের কারণ যে আমি না বুঝিতে পারি, এমন মনে করিবেন না|”
মনিরুদ্দীন ক্রোধভরে বলিলেন, “না, আমি কাহারও উপরে দোষারোপ করিতেছি না; সে ইচ্ছাও আমার নাই| আমি মুন্সী সাহেবের মত একজনকে দেখিয়াছিলাম, এইমাত্র| ইহাতে আপনি দোষারোপের কথা কি পাইলেন? যাক্, আপনার সহিত আমার আর কোন কথা নাই| আপনি এখন নিজের পথ দেখিতে পারেন|” বলিয়া মল্লিক সাহেব রাগে অস্থির হইয়া একেবারে উঠিয়া দাঁড়াইলেন|
দেবেন্দ্রবিজয়ও তখনই চকিতে দাঁড়াইয়া উঠিলেন; এবং অন্তর্ভেদী বক্রদৃষ্টিতে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন| মনিরুদ্দীনও তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাঁহার মুখ নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন| এমন সময়ে তাঁহাদিগের পশ্চাতে কক্ষদ্বারে নিঃশব্দে ঈষন্মুক্ত হইল তখন কেহই তাহা লক্ষ্য করিলেন না|
প্রশান্তস্বরে দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আর দুই-একটি প্রশ্নের সদুত্তর পাইলেই আমি নিজের পথ দেখিব| যে একঘন্টাকাল আপনি অন্ধকারে তাহাদের অনুসন্ধানে ব্যাপৃত ছিলেন, তাহার মধ্যে আর কোন কাণ্ড ঘটে নাই? আপনি কি আর কিছুই দেখেন নাই?”
মনি| না-কিছু না|
দে| তাদের অনুসন্ধান ছাড়া আপনি আর কিছুই করেন নাই?
মনি| না|
দে| অনুসন্ধানে কোন ফল হয় নাই?
মনি| কিছুই না| আমি সে দু’জনের কাহাকেও আর দেখিতে পাই নাই|
দে| কাহাকেও না-দিলজানকেও নয়?
মনি| না|
দে| বাঃ! কেহ ইহা বিশ্বাস করিবে?
মনিরুদ্দীন আরও রুষ্ট হইলেন; ক্রোধে তাঁহার আপাদমস্তক কাঁপিয়া উঠিল; এবং হস্তদ্বয় দৃঢ়রূপে মুষ্টিবদ্ধ হইল| অত্যন্ত কঠিনকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তাহা হইলে আপনি কি এই হত্যাপরাধে আমাকেই দোষী সাবুদ্ করিতে চাহেন?”
দে| না-সে ইচ্ছা আমার আদৌ নাই| আমি আপনাকেই একবার আপনার নিজের কথা ভাবিয়া দেখিতে বলি; তাহা হইলে আপনি আমার মনের ভাব বেশ বুঝিতে পারিবেন| ভাল, আমিই আপনাকে বুঝাইয়া দিতেছি| মনে করুন, কোন ভদ্রলোক একটি স্ত্রীলোককে লইয়া একেবারে নিরুদ্দেশ হইবার চেষ্টায় আছেন| তাঁহার আর একটি প্রণয়িনী তখন বর্ত্তমান| তাহাকেও সেই ভদ্রলোকটি পূর্ব্বে গৃহের বাহির করিয়া আনিয়াছিলেন| কোন রকমে সে তাহার প্রণয়ীর এই নূতন প্রেমাভিনয়ের কথা জানিতে পারিয়া সেই রাত্রিতেই সে তাহাতে বাধা দিবার জন্য তহাদিগের বাড়ীতে আসে| সেই ভদ্রলোকটি তখন বাড়ীতে ছিলেন না; কিন্তু স্ত্রীলোকটি যখন হতাশ হইয়া বাহির হইয়া যায়, গোপনে থাকিয়া তিনি তাহাকে দেখিতে পাইয়া তখন তাঁহার অনুসরণ করেন| তাহার পর পথিমধ্যে কোন নির্জ্জন স্থানে অবশ্য তাঁহাদের সাক্ষাৎ হইয়া থাকিবে| পরস্পর সাক্ষাতে স্ত্রীলোকটি সুমিষ্ট প্রেমসম্ভাষণের পরিবর্ত্তে নিজের অন্তর্দাহের বেগে তাঁহাকে যখন অনেকগুলি কটূবাক্য শুনাইয়া দিতে আরম্ভ করিল, তখন সেই ভদ্রলোকটি-”
মনিরুদ্দীন বাধা দিয়া বলিলেন,-“তাহাকে খুন করিল, এই ত আপনি বলিতে চাহেন? আপনার ধারণা, আমিই তাহাকে খুন করিয়াছি| ইহা আমি অনেকক্ষণ বুঝিয়াছি; কিন্তু আপনার এ ধারণা সম্পূর্ণ অমূলক-আমার সঙ্গে সেই স্ত্রীলোকের আর দেখা হয় নাই| যদিই বা পরে দেখা হইয়া থাকে, তহা হইলে আমি আমার বাঞ্ছিত সৃজানকে দেখিতে পাইতাম-প্রকৃত পক্ষে সে দিলজান নহে|”
দেবেন্দ্রবিজয় মহা-অপ্রতিভ হইলেন| এ জীবনে তিনি আর কখনও অপ্রতিভ হন্ নই| মনে ভাবিলেন, এই খুনের কেসটা ভয়ানক বিশ্রী| কয়েকদিন হইতে অনবরত ভাবিয়া ভাবিয়া, ঘুরিয়া ঘুরিয়া, তাঁহার মাথা যেন একেবারে বিগ্ড়াইয়া গিয়াছে; নতুবা তিনি নিজে আজ সহসা এমন একটা ভুল করিয়া ফেলিতেন না| তিনি ইহাও সহজে বুঝিতে পারিলেন, মনিরুদ্দীন বড় ধূর্ত্ত, তাঁহারই সমকক্ষ বুদ্ধিমান্-সহজে হটিবার পাত্র নহেন| নিমেষের মধ্যে অনেক কথাই তাঁহার মনে পড়িল-সেই বেনামী পত্রাবলী-ঘুষ দেওয়ার প্রলোভন, নির্জ্জন গলিপথে অলক্ষিতে লগুড়াঘাত-সেই সকল ক্রিয়ার কর্ত্তা-এই কি সেই লোক? সন্দেহে দেবেন্দ্রবিজয়ের মস্তিষ্ক বড় চঞ্চল হইয়া উঠিল| তিনি সহসা অতি কঠিনকণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন, “হাঁ, কথাটা বলা আমার ভুল হইয়াছে-স্বীকার করি; কিন্তু আপনি নিশ্চয় জানিবেন কি ভয়ানক বিপদের বজ্র আপনার মাথার উপরে উদ্যত রহিয়াছে| সহজে আপনি নিষ্কৃতি পাইবেন না| দিলজান মনে করিয়া আপনি ভ্রমক্রমে সৃজানকেও খুন করিতে পারেন-তাহাই ঠিক| আপনি খুন না করিলে এরূপ ভাবে, এরূপ সময়ে কে তাহাকে খুন করিল?”
“দিলজান|”

৪.০৯ নবম পরিচ্ছেদ – ইহা কি সম্ভব?

পশ্চাৎ হইতে কে উত্তর করিল, কি আশ্চর্য্য! স্ত্রীলোকের কণ্ঠস্বর না? দেবেন্দ্রবিজয় ও মনিরুদ্দীন উভয়েই মহা বিস্মিত হইয়া মাথা তুলিয়া ফিরিয়া দেখিলেন, মুক্ত কক্ষদ্বারে দাঁড়াইয়া মুক্তকেশা দিলজান| তাহার কৃষ্ণচক্ষুঃ জ্বলিতেছে, -সুকৃষ্ণকেশপাশ আলুলায়িত-কতকগুলা চোখে মুখে আসিয়া পড়িয়াছে-কি এক তীব্র উত্তেজনায় তাহার আপাদমস্তক কম্পিত হইতেছে! তাহার দক্ষিণ হস্তে একখানি সুদীর্ঘ শাণিতা ছুরিকা-তাহাও ভয়ানক বেগে কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিতেছে-দৃষ্টি উন্মাদের; কিন্তু স্বর অত্যন্ত কঠিন ও দৃঢ়-দৃঢ়স্বরেই দিলজান বলিল, “আর কেহ নহে, এই দিলজান নিজে| আমার জন্য একজন নির্দ্দোষীকে দণ্ডিত করিবার চেষ্টা করিয়ো না| আমি অন্তরালে থাকিয়া সমুদয় শুনিয়াছি-কাহারও কোন দোষ নাই-আমি শয়তানীই সকল অনর্থের মূল| তোমরা যে আমার অপরাধ একজন নির্দ্দোষীর উপরে ফেলিবে, তা’ আমি তোমাদের কথার ভাবে ফরিদপুরের সেই বাগানেই বুঝিতে পারিয়াছিলাম| যত শীঘ্র পারিয়াছি, এখানে চলিয়া আসিয়াছি| আরও শীঘ্র পৌঁছতে পারিলে ভাল হইত-মল্লিক সাহেবকে সকল কথা বলিয়া সাবধান করিয়া দিতে পারিতাম| ঠিক সময়ে আসিতে পারি নাই-যাহা মনে করিয়াছিলাম, তাহা হইল না| তাহা না হইলেও এখানে অসিয়া তোমাদের হাত হইতে এখন একজন নির্দ্দোষীকে যে রক্ষা করিতে পারিলাম, ইহাই আমার পক্ষে যথেষ্ট| কে আমার ভগিনীকে খুন করিয়াছে, শুনিতে চাও? আমি নিজে-নিজের হাতে নিজের ভগিনীকে খুন করিয়াছি-রোষে, দ্বেষে, প্রাণের জ্বালায়, দারুণ ঈর্ষায় উন্মাদিনী হইয়া ভগিনী ভগিনীর বুকে ছুরি বসাইতেও কুণ্ঠিত হয় নাই| সৃজান যেমন আমাকে অপেক্ষা করিতে বলিয়া বাড়ী হইতে বাহির হইল, আমিও তখনই গোপনে তাহার অনুসরণ করিলাম| সৃজান এখানে আসিলে আমি পথে গোপনে তাহার অপেক্ষা করিোতে লাগিলাম| এখান হইতে সে বাহির হইলে আবার আমি তাহার অনুসরণ করিয়া মেহেদীবাগানে তাহাকে ধরিলাম| সে কিছুতেই মল্লিক সাহেবকে ত্যাগ করিতে চাহিল না| আমি তাহাকে বুঝাইতে চেষ্টা করিলাম| সে না বুঝিয়া মর্ম্মভেদী কটুক্তি বর্ষণ করিয়া আমার রাগ বাড়াইয়া দিল| আমি আর সহিতে না পরিয়া এই ছুরিতে তাহাকে খুন করিলাম|” হস্তস্থিত রৌপ্যমণ্ডিত সুদীর্ঘ ছুরিকা দেবেন্দ্রবিজয়ের পায়ের কাছে সজোরে নিক্ষেপ করিল| শারীরিক ও মানষিক উভয়বিধ দারুণ উত্তেজনায় তখনই দিলজানের সংজ্ঞা লুপ্ত হইয়া গেল| সে সেইখানে মৃতবৎ লুটায়া পড়িল|
দেবেন্দ্রবিজয় ছুরিখানি তাড়াতাড়ি কুড়াইয়া লইলেন| এবং মনিরুদ্দীন স্তম্ভিতভাবে দাঁড়াইলেন| পরক্ষণে মনিরুদ্দীন ছুটিয়া গিয়া দিলজানের মাথার কাছে ভূলগ্নজানু হইয়া বসিয়া ব্যাকুলভাবে বলিলেন, “একি ভয়ানক ব্যাপার!”
দে| সত্য হইলে খুব ভয়ানক বৈ কি!
ম| আপনি কি বিশ্বাস করেন না?
দে| একটি বর্ণও না|

৪.১০ দশম পরিচ্ছেদ – রোগশয্যায় অরিন্দম

 

সহসা এই একটা অপ্রত্যাশিতপূর্ব্বক ঘটনায় দেবেন্দ্রবিজয় মহাবিব্রত হইয়া উঠিলেন| দেখিলেন, তিনি এক প্রবল রহস্য-স্রোতে সটান্ ভাসিয়া চলিয়াছেন| কূলে উঠিবার জন্য তিনি যখন যে তীর-লতা সুদৃঢ়বোধে ব্যগ্রভাবে দুই বাহু প্রসারিত করিয়া টানিয়া ধরিতেছেন, তাহাই ছিঁড়িয়া যাইতেছে| বরংবার এই অকৃতকার্য্যতা তাঁহার গর্ব্বিত হৃদয়ে দারুণ আঘাত করিল| তিনি একেবারে হতাশ হইয়া পড়িলেন কি করিবেন, কিছু স্থির করিতে না পরিয়া ক্ষুন্নমনে মনিরুদ্দীনের বাটী হইতে অবিলম্বে বাহির হইয়া পড়িলেন| নিজের বাটীতে না ফিরিয়া অরিন্দম বাবুর সহিত দেখা করিতে চলিলেন| এই একটা দারুণ গোলযোগে পড়িয়া অনেকদিন তাঁহার কোন সংবাদ লওয়া হয় নাই; সংবাদটা লওয়া হইবে| তাহা ছাড়া তাহার নিকটে সমুদয় খুলিয়া বলিলে, তিনি দুই-একটা সুপরামর্শও দেতে পারিবেন; মনে মনে এইরূপ স্তির করিয়া দেবেন্দ্রবিজয় সেই স্বনামখ্যাত বৃদ্ধ ডিটেক্টিভ অরিন্দম বাবুর সহিত সাক্ষাৎ করাই যুক্তি-যুক্ত বোধ করিলেন|
অরিন্দম বাবু একজন নামজাদা পাকা ডিটেক্টিভ| বিশেষতঃ ফুল সাহেবের কেস্টায় তাঁহার নাম আরও বিখ্যাত করিয়া দিয়াছে| অরিন্দম বাবুকে দেখিলে তাঁহাকে বুদ্ধিমানের পরিবর্ত্তে নির্ব্বোধই বোধ হয়; তাঁহার সরল মুখাকৃতি দেখিয়া কিছুতেই বুঝিতে পারা যায় না, ইনি ডিটেক্টিভ পুলিসের একজন তীক্ষ্ণবুদ্ধিশালী, প্রধান কর্ম্মচারী| তিনি প্রথমে যখন কর্ম্মে প্রবিষ্ট হন, পুলিসের প্রবীণ কর্ম্মচারীগণের মধ্যে কেহই তখন মনে করেন নাই, কালে ইনি এমন একজন হইয়া উঠিবেন| এমন কি শেষে, যাঁহারা পূর্ব্বে এই কথা মনে করিয়াছিলেন, তাঁহারাই অনেকে অনেক সময়ে সেই নির্ব্বোধের মত চেহারার অরিন্দম বাবুর পরামর্শ গ্রহণে কুণ্ঠিত হইতেন না| যখন তাঁহারা কোন একটা জটিল রহস্যপূর্ণ মামলা হাতে লইয়া রহস্যভেদের পন্থা-অন্বেষণে একেবারে হতাশ হইয়া পড়িতেন, তখন অরিন্দম বাবু সেখানে উপস্থিত হইয়া সহসা এক আঘাতেই রহস্য-যব্নিকা ভেদ করিয়া নিজের অমানুষিক বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতেন|
আজ প্রায় ছয়মাসকাল অরিন্দম বাবু বাতরোগে শয্যাশায়ী| শয্যাশায়ী হইবার অনেক পূর্ব্বে তিনি কর্ম্মত্যাগ করিয়াছিলেন| বয়স বেশি হইয়াছিল বলিয়া তিনি যে আর বড় পরিশ্রম করিতে পারিতেন না; তাহা নহে; সে জন্য তিনি কর্ম্মত্যাগ করেন নাই| বৃদ্ধ বয়সেও তাঁহার দেহে যৌবনের সামর্থ্য ছিল| সারাজীবনটা চোর ডাকাত খুনীর পিছনে পিছনে ঘুরিয়া সহসা একদিন তাঁহার নিজের জীবনের উপরে স্বতঃ কেমন একটা ঘৃণা জন্মিয়া গেল| এবং সেই ঘৃণা তাঁহার হৃদয়স্থিত অদম্য উদ্যম একেবারে নষ্ট করিয়া ফেলিল| তিনি আর ইহাতে সুখবোধ করিতে পারিলেন না| আর যেন তাহা ভাল লাগিল না| শেষে তিনি এমন নিরুদ্যম হইয়া পড়িলেন যে, দুই-একটা মামলা হাতে লইয়া তাঁহাকে অকৃতকার্য্যই হইতে হইল| এমন কি যথাযোগ্য মনোযোগের অভাবে তিনি একবার একবার একজন নির্দ্দোষীকে দণ্ডিত করিয়া ফেলিলেন| সেইবার শেষবার-একজন নির্দ্দোষীকে দণ্ডিত করিয়া তাঁহার মনে এমন একটা দুর্নিবার আত্মগ্লানি উপস্থিত হইল যে, তিনি সেইদিনই কর্ম্মে ইস্তফা দিলেন| ইহাতেও তাঁহার নিস্তার ছিল না| যেমন বড় বড় ব্যাবহারজীবীগণ নিত্য আদালত-গৃহে যাতায়াত করিয়া, প্রভৃত ধন এবং তৎসহ তেমনই প্রভূত খ্যাতি, প্রতিপত্তি লাভ করিয়া শেষ দশায় যখন ব্যবসায়ে একেবারে বীতরাগ হইয়া পড়েন, তখন তাঁহাদের আর কিছু ভাল না লাগিলেও গৃহে বসিয়া, অপরকে নিজের তীক্ষ্ণধার অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত যেমন খুব আত্মপ্রসাদ অনুভব করেন, অরিন্দম বাবুরও শেষ দশায় ঠিক তাহাই ঘটিয়াছিল| কিন্তু অরিন্দম বাবুর উদ্দেশ্যটা একটু স্বতন্ত্র রকমের ছিল; যাহাতে কোন অর্ব্বাচীনের হাতে পড়িয়া কোন নির্দ্দোষী দণ্ডিত না হয়, সেজন্য তিনি পরামর্শগ্রাহীদের ভ্রমের দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখিতেন| সর্ব্বাগ্রে তাহাদিগকে তাহাদের ভ্রমগুলি দেখাইয়া দিয়া পরে হত্যাকারীকে ধরিবার সূত্র নির্দ্দেশ করিয়া দিতেন| এবং ইহাতে তাঁহার খুব উৎসাহ দেখা যাইত| তাঁহার সেই উৎসাহ দেখিয়া সহজেই সকলে বুঝিতে পারিত, তাঁহার সেই নষ্ট উদ্যম আবার নবীবভাবে তাঁহার হৃদয়ে ফিরিয়া আসিয়াছে|
অরিন্দম বাবু চিকিৎসার জন্য কালীঘাটে গঙ্গার ধারে একখানি বাটী ভাড়া লইয়া এখন বাস করিতেছেন| শুশ্রূষার জন্য বাড়ীর মেয়েছেলেরাও সঙ্গে আসিয়াছেন| এদিকে চিকিৎসাও খুব চলিতেছে; কিন্তু কিছুতেই রোগের উপশম হইতেছে না| শরীরের অবস্থাও ভাল নহে-তিনি একেবারে শয্যাগত হইয়া পড়িয়াছেন| এমন কি এখন উঠিয়া বসিবার সামর্থ্যও নাই|
দেবেন্দ্রবিজয় যখন অরিন্দম বাবুর বাটীতে উপস্থিত হইলেন, তখন বেলা অনেক বাড়িয়া গিয়াছে| অরিন্দম বাবুর গৃহে তাঁহার অবারিত দ্বার-তিনি সরাসরি ভিতর বাটীতে প্রবেশ করিয়া দ্বিতলে উঠিলেন| এবং দ্বিতলস্থ যে কক্ষে রুগ্নশয্যায় অরিন্দম বাবু পড়িয়াছিলেন, সেই কক্ষ মধ্যে তিনি প্রবেশ করিলেন| অরিন্দম বাবু বিছানায় যন্ত্রণাসূচক দীর্ঘানিঃশ্বাস ফেলিতেছেন, এক-একবার চীৎকার করিয়াও উঠিতেছিলেন| এমন সময়ে অনেক দিনের পর আজ সহসা দেবেন্দ্রবিজয়কে দেখিয় নিজের রোগের কথা তিনি একেবারে ভুলিয়া গেলেন| অত্যন্ত আগ্রহের সহিত বলিয়া উঠিলেন, “আরে কেও-দাদা? এস-অনেকদিন তোমাকে দেখি নাই|”
দেবেন্দ্রবিজয় শয্যাপার্শ্বে উপবেশন করিয়া বলিলেন, “আপনি এখন কেমন আছেন? একটা গোলযোগে পড়িয়া অনেক দিন আপনার সঙ্গে দেখা করিতে পারি নাই|”
অরিন্দম বাবু কহিলেন, “কই কিছুতেই কিছু হইতেছে না-আর যন্ত্রণাও সহ্য হয় না| সে কথা যাক্, তোমার যে এতদিন দেখা নাই, কেন বল দেখি-কি এমন গোলযোগে পড়িয়াছিলে?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন,-“একটা খুনের কেস হাতে লইয়া বড়ই বিব্রত হইয়া পড়িয়াছি; এখন আপনার পরামর্শ বিশেষ দরকার; আর কোন উপায় দেখিতেছি না|”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “বটে, এমন কি ব্যাপার?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “বড় শক্তলোকের পাল্লায় পড়িয়াছি-আমাকে একদম্ বোকা বানাইয়া দিয়াছে|”
বুকের মর্ম্মকোষ হইতে টানিয়া খুব একটা সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলিয়া অরিন্দম বাবু বলিলেন, “তাই ত-লোকটা এমনই ভয়ানক না কি?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “যতদূর হইতে হয়| এমন কি, ব্যাপার দেখিয়া আমার বোধ হইতেছে, এবার আমি আপনার সেই পরমশত্রু ফুল সাহেবেরই প্রেতাত্মার হাতে পড়িয়াছি| সে আমাকে এমন বিপদে ফেলিয়াছিল যে, মনে করিলে অনায়াসে আমার প্রাণনাশও করিতে পারিত| অনুগ্রহপূর্ব্বক তাহা করে নাই-এই আমার পরম সৌভাগ্য|”

 ৪.১১ একাদশ পরিচ্ছেদ – উপদেশ

অরিন্দম বাবু বলিলেন, “বল কি, এমন লোক সে! তাহা হইলে ত, এইবার তোমার স্বর্ণসুযোগ উপস্থিত-ইহার জন্য আবার দুঃখিত হইতে আছে? যশস্বী হইবার ত এই একমাত্র পন্থা| ইহা ত্যাগ করা কদাচ বুদ্ধিমানের কাজ নহে| গোয়েন্দাগিরি করিয়া বাহাদুরী লইবার যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী আজকাল দুর্ল্লভ| আগেকার মত কি আর সে রকম চতুর, সে রকম সুদক্ষ চোর ডাকাত, খুনী পাওয়া যায় হে? তা’ পাওয়া যায় না| এখনকার অপরাধীরা ও সব সাদা সিধে রকমের, নিতান্ত সরল প্রকৃতির; তাহাদের অপরাধগুলাও তেমনি সরল এবং নির্জ্জীব-তাহার মধ্যে দুরূহতা বা দুরাবগাহতার কিছুই পাইবে না| আজ-কালকার চোর ঘটী বাটী চুরি করিয়াই একটা মস্ত চোর; খুনী রক্তপাতের উত্তেজনা নিজের বুকের মধ্যে নিজেই সংবরণ করিতে না পারিয়া আত্মপ্রকাশ করিয়া ফেলে| তাহাদিগকে ধরিবার জন্য বিশেষ কোন কষ্ট স্বীকারের আবশ্যক দেখি না| কাহাকেও ধরিতে হইলে, সটান্ একখানা গাড়ী ভাড়া কর-সটান্ তাহার বাড়ীতে গিয়া হাতকড়ি লাগাইয়া দাও-ব্যস, আসামী গ্রেপ্তার হইয়া গেল| ইহাতে চিন্তাই বা কি এত, উদ্বেগেই বা কি এত? তুমি যে ইহার মধ্যে এমন একজন সুযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী পাইয়াছ, শুনিয়া সুখী হইলাম| তোমার অপরাধীর অপরাধটা কি রকম আমাকে বল দেখি; তাহা হইলে অনেকটা বুঝিতে পারিব, তিনি কিরূপ উচ্চদরের লোক|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তিনি খুব উচ্চদরের লোক, সন্দেহ নাই| পথিমধ্যে একজন স্ত্রীলোককে অতি অদ্ভুত উপায়ে হত্যা করিয়া একেবারে অন্তর্হিত হইয়াছেন|”
অরিন্দম বাবু বলিলেন-পর পর তিনবার তিন রকমস্বরে বলিলেন, ‘বটে! বটে! বটে!’ যেন তিনটি লোকের মুখ হইতে তিনটা ‘বটে’ বাহির হইল| ক্ষণেক চিন্তার পর বলিলেন, “খুনটা হয়েছে কোথায়?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “মেহেদী-বাগানের একটা গলি মধ্যে|”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “ওঃ! আমি এ কথা শচীন্দ্রের মুখে একবার শুনিয়াছিলাম বটে| তা’ ছাড়া একখানা খবরের কাগজেও এই খুনের বিষয় একটু লিখিয়াছিল| সে খুনটার তুমি কি এখনও কোন কিনারা করিতে পার নাই? কি আশ্চর্য্য! তোমার হাতে কেস্ পড়ায় হত্যাকারী যখন এখনও নিরুদ্দেশ-তখন অবশ্যই সে একজন যোগ্য লোক বটে! ব্যাপারটা সব খুলিয়া আমাকে বল দেখি; দেখি আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে যদি তোমার কিছু সাহায্য করিতে পারি| আচ্ছা, পরে তোমার শুনিব| (নিম্নস্বরে) তার আগে পা টিপিয়া টিপিয়া গিয়া, ধাঁ করিয়া এই দরজা টা খুলিয়া ফেল দেখি-একটা বড় মজা দেখিতে পাইবে| নিশ্চয়ই একজন কেহ দরজার পাশে দাঁড়াইয়া আমাদের পরামর্শ শুনিবার চেষ্টায় আছে| আমি এখান থেকে তাহার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট শুনিতে পাইতেছি|”
কবাট ভিতর হইতে ভেজান ছিল| দেবেন্দ্রবিজয় ধীরে ধীরে উঠিয়া গিয়া দ্রুতহস্তে কবাট খুলিয়া ফেলিলেন| চকিতে দেখিলেন, সম্মুখে দাঁড়াইয়া-রেবতী| দেখিয়া দেবেন্দ্রবিজয় খুব বিস্মিত হইলেন| অরিন্দম বাবু খুব একটা উচ্চহাস্য করিয়া উঠিলেন, এবং রেবতী খুব লজ্জিত হইয়া মাথার কাপড় টানিয়া পলাইবার পথ পাইলেন না|
অরিন্দম বাবু এখনও হাস্য সম্বরণ করিতে পারেন নাই| হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “তাই ত’ দিদি যে আবার আমাদের উপরে ডিটেক্টিভগিরি করিতে আসিবে, তা’ আমি ভাবি নাই; যাহা হউক, খুব ধরা পড়িয়া গিয়াছে|” তাহার পর হাস্য সম্বরণ করিয়া, সুর বদ্লাইয়া বলিলেন, “দেখ্লে দাদা, পুরুষের হৃদয় হইতে স্ত্রীলোকের হৃদয় কত তফাৎ! আমি রোগে শয্যাশায়ী হইয়া পড়িয়াছি; তুমি পুরুষ মানুষ-মনে করিলেই এখানে আসিতে পার, তাই আসো না; কিন্তু দিদি আমাকে ভুলিতে পারে নাই-সংসারের শত কাজ-কর্ম্ম ফেলিয়াও তাড়াতাড়ি আমাকে দেখিতে আসিয়াছে|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আপনি আপনার দিদির কত উপকার করিয়াছেন!”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “দাদারই বা কি অনুপকার করিয়াছি?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আমার যে উপকার করিয়াছেন, তাহাতেও প্রকারান্তে আপনার দিদিরই উপকার করা হইয়াছে|”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “আর দিদির যে উপকার করিয়াছি, তাহাতে বুঝি প্রকারান্তে দাদার কোন উপকার করা হয় নাই? যাক্ ভাই, আর তর্কের প্রয়োজন নাই; এখন কাজের কথাই হউক|”
দেবেন্দ্রবিজয় মেহেদী-বাগানের খুনের মোকদ্দমা হাতে লওয়া অবধি যখন যাহা ঘটিয়াছে, যাহা তিনি করিয়াছেন, আদ্যোপান্ত অরিন্দম বাবুকে বেশ গুছাইয়া বলিতে লাগিলেন|
শুনিতে শুনিতে অরিন্দম বাবুর মুখভাব বদ্লাইয়া গেল; রোগের যন্ত্রণা তিনি একেবারে বিস্মৃত হইয়া গেলেন, অখণ্ড মনোযোগের সহিত শুনিয়া যাইতে লাগিলেন| কখন বা শুনিতে শুনিতে কি-এক তীব্র উত্তেজনায় দুই হস্তে শয্যাস্তরণ মুষ্টিবদ্ধ করিয়া উঠিবার উপক্রম করেন, আবার একান্তে তন্ময়ভাবে নীরবে শুনিতে থাকেন| পরমভক্ত বৈষ্ণব যেমন সুমধুর হরিনামের মধ্যে মগ্ন হইয়া যান, আমাদের অরিন্দম বাবুও দেবেন্দ্রবিজয়ের কাহিনীর মধ্যে তেমনি মগ্ন হইয়া গেলেন| কেবল এক-একবার তাঁহার মুখ হইতে বাহির হইতে লাগিল, ‘পূর্ব্বে যদি ইহা শুনিতাম’, ‘পূর্ব্বে যদি আমি খবর পাইতাম’, ‘তখন যদি আমি সেখানে উপস্থিত থাকিতাম! ‘ ইত্যাদি|
তাহার পর দেবেন্দ্রবিজয়ের কাহিনী শেষ হইলে তিনি অধিক উত্তেজনায় উভয় হস্তে হস্তাবমর্ষণ করিতে করিতে বলিয়া উঠিলেন, “বড় মজাই হইয়াছে-বিরাট ব্যাপার! একরূপ লুকোচুরি খেলাই আরম্ভ হইয়াছে-খেলা জমিয়াছে-এখন বুড়ি ছুঁইবার পালা| আরে দাদা, তুমি ত এ কেস্টা বুদ্ধিমানের মত পরিচালিত করিতেছ|”
হতাশ দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আপনি উপহাস করিতেছেন-ইহাতে আমার নির্ব্বুদ্ধিতাই প্রকাশ পাইয়াছে|”
জিহ্বা ও তালুর সংযোগে একটা অব্যক্ত শব্দ করিয়া অরিন্দম বাবু বলিলেন, “নিশ্চয়ই না-তোমার কথা শুনিয়া এ বুড়ার বুকে আনন্দ ধরিতেছে না! এখন আমি বুঝিয়াছি, আমি মরিলেও আমার আসন অধিকার করিবার একজন যোগ্য লোক রাখিয়া যাইতে পারিব| আমার ইচ্ছা হইতেছে, একবার উঠিয়া, তোমার বুকে করিয়া নৃত্য করি|”
দেবেন্দ্রবিজয়ের মনে এখনও সন্দেহ যে, অরিন্দম বাবু তাঁহাকে উপহাস করিতেছেন| তিনি বলিলেন, “আপনি আমাকে উপহাসই করিতেছেন; আমি কিসে এতটা প্রশংসার যোগ্য-বুঝিতে পারিলাম না| হত্যাকারী এখনও ধরা পড়ে নাই; আমার এ কাজে যতটুকু যশঃ ছিল, বরং তাহা এখন যাবার দাখিলে পড়িয়াছে|”
বিশ্রী মুখভঙ্গি করিয়া অরিন্দম বাবু বলিলেন, “কিছু না-কিছু না-ব্যস্ত হইয়ো না-ইহাতে তোমার যশঃ শতগুণে বাড়িয়া যাইবে| আমার ত খুবই মনে হয়, তুমি এই কেস্টা বেশ ভাল রকমেই পরিচালিত করিয়া আসিতেছ; কিন্তু আরও ভাল রকম হওয়া দরকার ছিল| মনোযোগ থাকিলে খুবই ভাল পরিচালিত করা যাইতে পারিত| তোমার মুখে যেরূপ শুনিলাম, তাহাতে তোমার বুদ্ধি ও সাহসের যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়| কেবল একটু অভিজ্ঞতার অভাব, একটুতেই তুমি লাফাইয়া ওঠ, আবার একটুতেই একেবারে হতাশ হইয়া পড়| স্থিরসঙ্কল্প হওয়া চাই-একটা বিষয়ে স্থির লক্ষ্য চাই-এখনও তুমি অনেক ছেলেমানুষ-পাকাচুলের অবশ্যই একটা মূল্য আছে| যাহা হউক, তুমি ইহাতে কয়েকটা বিষয়ে বড় ভুল করিয়াছ; আমি তাহা তোমাকে এখন সরলভাবে বুঝাইয়া দিতেছি|”

৪.১২ দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – গুরু ও শিষ্য

বিদ্যালয়ের ছাত্র যেমন নীরবে অবনতমস্তকে শিক্ষকের নিকটে পাঠ গ্রহণ করে, দেবেন্দ্রবিজয়ও ঠিক সেইরূপ নতশিরে রহিলেন| আর উভয়ের মধ্যে গুরু-শিষ্য সম্পর্কও বটে|
অরিন্দম বাবু বলিতে লাগিলেন, “সত্যসত্যই তুমি কয়েকটা বড় ভুল করিয়া ফেলিয়াছ| রহস্য-ভেদের তিন-তিনটি সুযোগ তিনবার তোমার হাত এড়াইয়া গিয়াছে; আমি তাহা তোমাকে দেখাইয়া দিতেছি|”
“কিন্তু আপনি যদি-” দেবেন্দ্রবিজয় কি বলিতে যাইতেছিলেন, তখনই বাধা দিয়া, মুখভঙ্গি সহকারে, জিহ্বা ও তালু সংযোগে একটা অব্যক্ত শব্দ করিয়া অরিন্দম বলিলেন, “দুই-একটা কথা আমাকে বলিতে দাও-ব্যস্ত হইও না| কি সূত্র ধরিয়া গোয়েন্দাগিরি করিতে হয়, তাহা তোমার মনে আছে কি? গোয়েন্দাগিরির মূলমন্ত্র হইতেছে যে, কিছুতেই বিশ্বাস স্থাপন করিবে না-যাহা কিছু সম্ভব বা সত্য বোধ হইবে, তাহাই আগে অবিশ্বাস করিবে| এই মূলমন্ত্র কি তোমার মনে ছিল? ইহাই অবলম্বনে কাজ করিতে কি তুমি চেষ্টা করিয়াছিলে?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হাঁ, আমিও এই মূলমন্ত্র লক্ষ্য করিয়া কাজ করিতে চেষ্টা করিয়াছি| অনেক স্থলে চেষ্টা ব্যর্থ হইয়াছে| যাহা একান্ত সত্য বলিয়া মনে হয়, তাহার উপরে জোর করিয়া অবিশ্বাস করা বড় শক্ত কাজ|”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “তাহাই ত চাই, এই সূত্র ধরিয়া তুমি যে কোন অন্ধকারময় পথ অবলম্বন কর না কেন, ইহা পরিশেষে দীপালোকের কাজ করিবে, বিপথে চালিত হইবার কোন শঙ্কা থাকিবে না; অথচ যথাসময়ে ইহা তোমাকে ঠিক সত্যে উপনীত করিয়া দিবে| এমন মূলমন্ত্র কি একবারও ভুলিতে আছে! নতুবা এমন একটা অবস্থাধীন ঘটনা ঘটিল, যাহা খুবই সম্ভব বলিয়া মনে লাগিল; তুমি এই মূলমন্ত্র ভুলিয়া তাহা বিশ্বাস করিলে; তাহার পর এমন একটা ঘটনা ঘটিল, যাহাতে তাহা তুমি বুঝিলে ইহা আরও সম্ভবপর- ইহা কখনই মিথ্যা হইতে পারে না| তুমি অমনি ইহাই প্রকৃত বলিয়া লাফাইয়া উঠিলে; এরূপ করিলে ডিটেক্টিভগিরি হয়? তা’ হয় না|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আমার ত বোধ হয়, আপনি যতটা মনে করিয়াছেন, আমি একেবারে ততটা সরল-বিশ্বাসী নই|”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “ঠিকই ততটা| এখন যেরূপ ঘটনা দাঁড়াইয়াছে, তাহাতে মনিরুদ্দীনকেই দোষী বলিয়াই বোধ হয়| তুমিও তাহাই খুব সম্ভব বলিয়া মনে করিতেছ, বিশ্বাসও করিয়াছ| কেমন ঠিক কি না?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হাঁ, যেরূপ দেখিতেছি তাহাতে মনিরুদ্দীনকেই আমার দোষী বলিয়া বিশ্বাস হয়; কারণ-”
মধ্যপথে বাধা দিয়া অরিন্দম বাবু বলিয়া উঠিলেন, “কারণ তোমাকে বলিতে হইবে না- আমি নিজেই তাহা বেশ বুঝিতে পারিয়াছি; খুবই সম্ভব বলিয়া বিশ্বাস করিতেছ-সেই বিশ্বাসে কাজ করিয়া পরে কৃতকার্য্য হইবে, এরূপ মনেও করিয়াছ|”
দেবেন্দ্রবিজয় মনে মনে বড় বিরক্ত হইলেন| জিজ্ঞাসা করিলেন, “এরূপ স্থলে আপনি যদি দাঁড়াইতেন, তা’ হ’লে আপনি কি করিতেন?”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “ঠিক বিপরীত| হয় ত তাহাতে আমি ভুলও করিয়া ফেলিতাম; কিন্তু সে ভুলে বিশেষ কিছু ক্ষতি হইত না; এই অবিশ্বাসে পরে আমি একটা ন্যায়সঙ্গত মীমাংসায় উপনীত হইতে পারিতাম|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আরও দুই-একটি কারণে মনিরুদ্দীনকে দোষী বলিয়া আমার বিশ্বাস হইয়াছে| তিনি নিজের দোষ ঢাকিবার জন্য মুন্সী সাহেবের ঘাড়ে দোষ চাপাইবার চেষ্টা করিতেছেন|”
অরি| এই জন্যই কি তোমার বিশ্বাস এতটা বদ্ধমূল হইয়াছে?
দেবে| আরও একটা কারণ আছে; বোধ হয়, দিলজান ভিতরের সকল কথাই জানে| মনিরুদ্দীনকে বাঁচাইবার জন্য সে নিজে খুন স্বীকার করিতেছে|
অরি| এইখানে তুমি পদে পদে ভ্রম করিয়াছ|
দেবেন্দ্রবিজয় মনে মনে অত্যন্ত রুষ্ট হইলেন| বলিলেন, “তবে কি আপনি মনে করেন, মনিরুদ্দীন নিরপরাধ?”
সহসা অরিন্দম বাবুর মুখমণ্ডল ঘনঘটাচ্ছন্ন হইল| দেখিয়া ভয় হয়, এমন একটা মুখভঙ্গি করিয়া তিনি বলিলেন, “বোধ করা করি কি, আমি নিশ্চয়ই বলিতেছি, সে নিরপরাধ|”
শুনিয়া দেবেন্দ্রবিজয় ‘থ’ হইয়া গেলেন|

৪.১৩ ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – কাজের কথা

দেবেন্দ্রবিজয় জানিতেন, যাঁহার পরামর্শ লইতে আসিয়াছেন তিনি একজন দৈবশক্তিসম্পন্ন মহানিপুণ ব্যক্তি| তিনি যাহা বলেন, কদাচ তাহার ব্যতিক্রম হইতে দেখা যায় না| তথাপি দেবেন্দ্রবিজয় তাঁহার এই কথায় আস্থা স্থাপন করিতে পারিলেন না| ভাবিলেন, এক-এক বার সকলেরই ভুল হয়, ইনি হয়ত এবার ঠিক মীমাংসায় উপনীত হইতে পারেন নাই| দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখ অপ্রসন্নভাব ধারণ করিল|
তাহা অরিন্দম বাবুর লক্ষ্য এড়াইল না| তিনি দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখে সেই মনের কথাগুলি স্বহস্তস্থিত লিপির ন্যায় পাঠ করিলেন| বুঝিতে পারিলেন, তাঁহার কথাটা দেবেন্দ্রবিজয় বিশ্বাস করিতে পারিতেছেন না; কিছু বলিলেন না|
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আপনার এ অনুমান কি ঠিক? মনিরুদ্দীন কি এ খুন সম্বন্ধে কিছুই জানে না?”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “খুব ঠিক, মনিরুদ্দীন তোমার মত একান্ত নির্দ্দোষ-এমন কি খুন সম্বন্ধে তুমি আমি যতটা জানি, সে নিজে এতটা খবর রাখে না|”
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিসে আপনি এরূপ কৃতনিশ্চয় হইতেছেন, বুঝিতে পারিলাম না|”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “এই হত্যাকাণ্ড সম্বন্ধে যাহা কিছু তোমার মুখে আমি শুনিয়াছি, তাহা যদি অপ্রকৃত না হয়, আমার অনুমানও অপ্রকৃত হইবে না| আমার খুবই মনে হয়, মোবারক ইহার ভিতরকার অনেক কথা জানে, এমন কি সে হত্যাকারীরও খবর রাখে|”
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমার ত তাহা বোধ হয় না| কেন সে তাহা গোপন করিতে যাইবে?”
একান্ত হতাশভাবে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া অরিন্দম বাবু বলিলেন, “এতদিন গোয়েন্দাগিরি করিয়া যে, তুমি নির্ব্বোধের মত এমন একটা প্রশ্ন করিবে, তাহা আমি স্বপ্নেও ভাবি নাই| তোমাকে দেখিয়া আমি মনে করিয়াছিলাম, আমি মরিলেও একজন যোগ্য ব্যক্তি আমার আসন অধিকার করিতে পারিবে-কি মহাভ্রম আমার| তুমিই নিজেই মনে মনে একবার ভাল করিয়া ভাবিয়া দেখ দেখি, তোমার এই প্রশ্নটা কতটা নির্ব্বোধের মত হইয়াছে| ভাল, আমিই না হয়, তোমাকে দুই-একটা কথা বুঝাইয়া দিতেছি| মনে কর, তুমি একটা খুন করিয়াছ, তোমার কোন বন্ধু তোমাকে খুন করিতে দেখিয়াছে, এরূপ স্থলে সে কি তোমার বিরুদ্ধে কোন কথা প্রকাশ করিতে পারে?” কথাগুলি অরিন্দম বাবু অত্যন্ত বেগের সহিত বলিলেন|
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “না, মোবারকের তেমন কোন উদ্দেশ্য নাই| তাহা হইলে সে কখনও তাহার বন্ধু মজিদ খাঁর নাম প্রকাশ করিত না|”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “আমিও যে তাহা না বুঝি, তাহা নহে; আর সেই খুনটা যদি মজিদ খাঁ নামক কোন বন্ধুর দ্বারা না হইয়া, তাহার অন্য কোন শত্রুর দ্বারা হইয়া থাকে?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “শত্রু হইলে ত কোন কথাই নাই; তাহা হইলে ত মোবারক তাহাকে তখনই পুলিসের হাতে ধরাইয়া দিত|”
অরিন্দম বাবু জিজ্ঞাসিলেন, “আর যদি মোবারক তোমার মত নির্ব্বোধ না হয়?”
অরিন্দম বাবুর এইরূপ প্রশ্নে দেবেন্দ্রবিজয় মনে মনে অত্যন্ত রুষ্ট হইলেন, মুখে কিছু বলিলেন না| কিছু না বলিলেও অরিন্দম বাবু তাহা বেশ বুঝিতে পারিলেন| বলিলেন, “দেখ দাদা, এ বৃদ্ধের কথায় রাগ করিয়ো না-রাগ করিলে ‘গৃহের অন্ন অধিক পরিমাণে ভক্ষণ করা’ ভিন্ন আর কোন বিশেষ ফললাভ করিতে পারিবে না| মোবারক যদি তাহার কোন শত্রুকে খুন করিতে দেখিয়া থাকে, আর সে যদি নিজে তোমার মত নির্ব্বোধ না হইয়া বেশ বুদ্ধিমান্ হয়, তাহা হইলে সে সেই হত্যাকারীর নাম প্রকাশ করিতে না পারে; বরং সে সময়ে সেই শত্রুকে পুলিসের হাত হইতে রক্ষা করিবার জন্য সে তাহার সাহায্যও করিতে পারে| কোন প্রবল শত্রুকে নিজের মুঠার ভিতরে রাখিবার ইহাই ত প্রকৃষ্ট উপায়| সময়ে সেই শত্রুর নিকট হইতে অনেক কাজ আদায় হইতে পারে| শত্রু হ’ক্, আর মিত্র হ’ক্, মোবারক হত্যাকারীকে নিশ্চয় জানে, কোন একটা কারণে সে তাহা এখন চাপিয়া যাইবার চেষ্টা করিতেছে| তাহাকে কূট-প্রশ্নের অগ্নি-পরীক্ষায় না ফেলিতে পারিলে ভিতরের কোন কথাই তুমি কখনও তাহার মুখ হইতে বাহির করিতে পারিবে না|” এই বলিয়া অরিন্দম বাবু বিষম উদ্বেগের সহিত ঘন ঘন উভয় করতল নিষ্পীড়ন করিতে লাগিলেন|
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “ভাল, এইবার আমি আপনার পরামর্শ মত কাজ করিব|”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “এখন তুমি কিরূপে কাজ হাসিল্ করিবে, বল দেখি?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “এখনও কিছু ঠিক করিতে পারি নাই| ঠিক করিবার পূর্ব্বে আপনার কথাগুলি আমাকে আরও একবার ভাল করিয়া ভাবিয়া দেখিতে হইবে|”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “হাঁ, আগে ভাবিয়া-চিন্তিয়া পরে কাজে হাত দেওয়াই ঠিক; নতুবা অনেক সময়ে পরিশ্রম সার হয়| এবার বিশেষ বিবেচনার পর এমন একটা সূত্র অবলম্বন করিবে, যাহা অবলম্বনে প্রকৃত স্থানে উপনীত হইতে পার| অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়িলে কি হইবে? যাহা হউক, তুমি ইহার মধ্যে যে দুই-তিনটা মস্ত ভুল করিয়া ফেলিয়াছ, তাহা আমি দেখাইয়া দেতেছি| একটু বুঝিয়া চলিলে এতদিন সর্ব্বতোভাবে এ রহস্য ভেদ হইয়া যাইত|”
দেবেন্দ্রবিজয় কি বলেন শুনিবার জন্য অরিন্দম বাবু ক্ষনকাল নীরবে রহিলেন| দেবেন্দ্রবিজয় মৌন হইয়া রহিলেন, কোন কথা কহিলেন না| মনে করিলেন, অবশ্যই আমি কোন বিষয়ে বড় ভুল করিয়া থাকিব; নতুবা ইনি এ কথা এত জোরের সহিত বলিবেন কেন?
অরিন্দম বাবুর নিকটে ‘ভাবা’ ও ‘বলা’ একই কথা| তিনি দেবেন্দ্রবিজয়ের মনোভাব বুঝিতে পারিয়া তাঁহার উপরে বড় সন্তুষ্ট হইলেন| বলিলেন, “প্রথমেই তুমি সেই ছুরিখানা লইয়া খুব একটা অবিবেচকের মত কাজ করিয়া ফেলিয়াছ| মজিদ খাঁ যদি খু করিয়াই থাকিবে, তাহা হইলে কেন সে সেই হত্যাকাণ্ডের সাঙ্ঘাতিক প্রমাণ স্বরূপ সেই ছুরিখানা নিজের ঘরে লুকাইয়া রাখিতে যাইবে? সে অনায়াসে সেইখানে ফেলিয়া আসিতে পারে| সে ছুরি মজিদ খাঁর নিজের নহে যে, সেখানে ফেলিয়া আসিলে তাহার কোন বিপদের সম্ভাবনা ছিল| লাসের পাশে ঐ ছুরিখানি পড়িয়া থাকিলে কেহই এমন সন্দেহ করিতে পারিত না যে, মজিদ খাঁর দ্বারা এই খুনটা হইয়াছে| মজিদ খাঁর নিজের ছুরি হইলে অবশ্যই সে তাহা গোপন করিবার চেষ্টা করিত| এখন তোমার এই প্রথম ভ্রমটা বুঝিতে পারিলে কি?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তখন আমি ইহা ভাবিয়া দেখি নাই; অবস্থাগত প্রমাণের উপরে নির্ভর করিয়াই আমি অগ্রসর হইতেছিলাম|”
বর্ষণোম্মুখ মেঘের ন্যায় মুখখানা গম্ভীর করিয়া অরিন্দম বাবু বলিলেন, “ইহার নাম অগ্রসর নহে, বরং ক্রমশঃ হটিয়া আসা| আমি হইলে কখনই সেই ছুরিখানার উপরে এতটা পরিশ্রম করিতে রাজী হইতাম না| তাহার পর দ্বিতীয়তঃ হত্যাকারীর সেই বেনামী-পত্র| হাতে-পায়ে সূতা বাঁধিয়া, যেমন করিয়া লোকে পুতুল নাচায়, হত্যাকারীও এই বেনামী-পত্রে তোমাকে সেই রকম করিয়া নাচাইয়া লইয়া বেড়াইয়াছে| যে অভিপ্রায়ে সে তোমাকে পত্র লিখিয়াছিল, তুমি এমনই আস্ত হনূমান্, যে ঠিক তাহার মতলব মত কাজই করিয়াছ|”
দেবেন্দ্রবিজয় মহা অপরাধীর ন্যায় কহিলেন, “এখন আমি তাহা বেশ বুঝিতে পারিতেছি; কিন্তু এরূপ স্থলে ইহা ভিন্ন আর কি উপায় করা যাইতে পারে?”
বৃদ্ধ অরিন্দম বাবু সহসা স্পিরিটের মত যেন দপ্ করিয়া জ্বলিয়া উঠিলেন| কহিলেন, “কি সর্ব্বনাশ! এখনও তুমি বলিতেছ, আর কি উপায় করা যাইতে পারে| এই বুদ্ধি লইয়া তুমি ডিটেক্টিভগিরি করিতে চাও? গোয়েন্দাদিগকে কত প্রতিকূল ঘটনার মধ্য দিয়া কার্য্যোদ্ধারের দিকে অগ্রসর হইতে হয়, সে সম্বন্ধে তোমার কিছুমাত্র অভিজ্ঞতা হয় নাই, দেখিতেছি| যদি হত্যাকারীকে জানিবার ইচ্ছা এতটা প্রবল হইয়াছিল, তখন নিজে একটা ছদ্মবেশ ধরিয়া সেই গোলদিঘীতে গেলে কোন গোল ছিল না, সহজে কার্য্যোদ্ধারও হইত|”

৪.১৪ চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ – ভ্রম-সংশোধন

দেবেন্দ্রবিজয় অত্যন্ত রুষ্ট হইলেন, এবার অরিন্দম বাবুর প্রতি নহে-নিজের প্রতি| নিজের এতবড় একটা নির্ব্বুদ্ধিতার জন্য তাঁহার মনে অত্যন্ত ক্ষোভ উপস্থিত হইল| তিনি নিজের জনুদেশে সশব্দে এক প্রচণ্ড চপেটাঘাত করিয়া বলিলেন “কি আপদ্! আমার মত হস্তিমূর্খ কি আর আছে! এমন একটা সহজ উপায় থাকিতে আমি নিজের ক্ষেপ্ হারাইয়া বসিলাম! যতদিন বাঁচিব, সেদিনকার সেই নির্ব্বুদ্ধিতার কথা আমার মনে চির-জাগরুক থাকিবে| কখনই ভুলিতে পারিব না|ও
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “এতটা কুণ্ঠিত হইবার কোন আবশ্যকতা নাই| তুমি যাহাকে নির্ব্বুদ্ধিতা বলিতেছ, তাহা ঠিক নির্ব্বুদ্ধিতা নয়; বরং অমনোযোগিতা ও অবিমৃষ্যকারিতা বলিতে পার| সে যাহা হউক, তাহার পর তৃতীয়তঃ তুমি সেই হত্যাকারীকে ধরিবার জন্য গোলদিঘীর নিকটে কয়েকজন অনুচরকেও ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলে|”
একান্ত নিরাশভাবে দেবেন্দ্রবিজয় অস্পষ্টকণ্ঠে বলিলেন, “ইহাতেও কি আমার দোষ হইয়াছে?”
হঠাৎ একটা টক্ কুলে কামড় দিয়ে ফেলিলে মুখখানা সহসা যেরূপ বিকৃতভাব ধারণ করে, সেইরূপ বিকৃত মুখভঙ্গি করিয়া অরিন্দম বাবু বলিলেন, “কি বিপদ্! এখনও তুমি নিজে সেটা বুঝিতে পার নাই? খুবই দোষ হইয়াছে-ইহার নাম ডিটেক্টিভগিরি নয়-পেয়াদাগিরি!”
কথাটায় দেবেন্দ্রবিজয় তীব্র কশাঘাতের জ্বালা অনুভব করিলেন| গুরুমহাশয়ের নিকটে কানমলা খাইয়া নিরুপায় সুবোধ বালক যেমন অপ্রতিভভাবে মুখ নত করে, দেবেন্দ্রবিজয় তাহাই করিলেন| ক্ষণপরে নতমুখে মহাপরাধীর ন্যায় মৃদুকণ্ঠে বলিলেন, “আপনি কি বলেন, হাতে পাইয়া তাহাকে ছাড়িয়া দেওয়াই ঠিক?”
দেবেন্দ্রবিজয়ের কথায় একান্ত ক্ষুব্ধভাবে অরিন্দম বাবু সবেগে উঠিয়া বলিতে গেলেন-পারিলেন না| পায়ের যেখানটা বাতে ফুলিয়া উঠিয়াছিল, সহসা নাড়া পাইয়া সেখানটা ঝন্ ঝন্ করিয়া উঠিল| যন্ত্রণাসূচক একটা অব্যক্ত শব্দ করিয়া তিনি তখনই আবার শুইয়া পড়িলেন| মহা গরম হইয়া বলিলেন, “কি মুস্কিল! আগে তুমি তাহাকে হাতে পাও, তাহার পর তাহাকে ধরিবার বন্দোবস্ত কর| এখন কোথায় তোমার হাত – আর কোথায় তোমার হত্যাকারী! গোলদিঘীতে নিজে ছদ্মবেশে গিয়া আগে সেই ধড়ীবাজ লোকটাকে চিনিয়া লইতে হয়| তাহার পর ধীরে ধীরে যেমন রহস্য উদ্ভেদ হইতে থাকিত-তেমনই ধীরে ধীরে ক্রমশঃ তাহার নিকটস্থ হইয়া যথাসময়ে-ঠিক যথা-মুহুর্ত্তে তাহাকে গ্রেপ্তার করিতে হয়| হাত পাতিয়া বসিয়া থাকিলে কি হাতে পাখী আসিয়া বসে, না পাখীর পশ্চাৎদিকে থাকিয়া দূর হইতে ধীরে ধীরে নিঃশব্দপদসঞ্চারে অলক্ষ্যে গিয়া তাহাকে সহসা ধরিয়া ফেলিতে হয়?”
দেবেন্দ্রবিজয় বিবর্ণ হইয়া বলিলেনম “হাঁ, আপনার কথায় এখন আমি সব বুঝিতে পারিতেছি|”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “তুমি তাহা না করিয়া বাগানের চারিদিকে ঘাটী বসাইয়া, কথাটা পাঁচ-কান করিয়া ফেলিয়াছ; নিজে সাধ করিয়া এমন একটা মহাসুযোগ ছাড়িয়া দিয়াছ! যাহাতে মাছে শীঘ্র টোপ ধরে, সেজন্য টোপের চরিদিকে চার ফেলিতে হয়| তুমি তাহা না করিয়া, একটা লাঠী লইয়া জল ঠেঙাইয়া চারিদিক্ হইতে মাছ তাড়াইয়া টোপের নিকটে আনিতে চেষ্টা করিয়াছ|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তাড়াতাড়ি করিয়া আমি অনেকগুলি ভুল করিয়াছি সত্য, কিন্তু এখন আর উপায় নাই-বিশেষ বিবেচনার সহিত কোন কাজ না করিলে এইরূপ ঠকিতে হয়| তা’ যাহাই হউক, আমার ত খুবই মনে হয়, এতগুলো ভুলভ্রান্তি করিয়াও আমি অনেকটা অগ্রসর হইতে পারিয়াছি| রহস্যোদ্ভদের আর বড় বিলম্ব নাই|”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “কথাটা বুদ্ধিমানের মত হইল না, অন্ধকারে পথ হাত্ড়াইয়া অগ্রসর হওয়া অপেক্ষা একটা আলোক সংগ্রহ করাই ঠিক-আর তাহাই বুদ্ধিমানের কাজ; নতুবা অগ্রসর হইতে হইতে এমন একটা বিপথে গিয়া পড়িতে পার যে, গন্তব্য স্থান হইতে তাহা আরও অকেন দূরে| এমন কি সেখান হইতে ফিরিয়া পুনরায় পূর্ব্বস্থানে আসিতেই তোমার দম ছুটিয়া যাইবে, তা’ গন্তব্য স্থানে তখন উপস্থিত হওয়া ত বহু দূরের কথা|
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “আমার ঠিক তাহা ঘটে নাই, আমি বিপথে চালিত হইয়া দূরে গিয়া পড়ি নাই; সোজা পথ ধরিতে না পারিয়া বাঁকা পথে অগ্রসর হইতেছি, ইহাই আমার বিশ্বাস| আশা করি, এইবার আমি প্রকৃত হত্যাকারীকে ধরিতে পারিব| আমি এখন একবার মুন্সী সাহেবের সঙ্গে দেখা করিব, মনে করিতেছি|”
অরিন্দম বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “তাঁহার কাছে কেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “সন্ধান করিয়া জানিতে পারিয়াছি, মোবারক এখন জোহেরার পাণিপ্রার্থী| এখন সে মুন্সী সাহেবের সহায়তা করিতে গিয়া সত্য গোপন করিতে পারে|”
অরি| তাহা হইলে তুমি আবার মুন্সী সাহেবকে সন্দেহ করিতেছ, দেখিতেছি|
দে| কতকটা তাহাই বটে; আপনি কি বলেন? আপনার অনুমান-শক্তি যেরূপ তীক্ষ্ণ, বোধ করি, আপনি প্রকৃত হত্যাকারীকে জানিতে পারিয়াছেন|
অ| জানিতে পারিয়াছি| ডাক্তার মৃতদেহ পরীক্ষা করিয়া মৃত্যুর কিরূপ সময় স্থির করিয়াছিলেন?
দে| রাত বারটার সময়|
অ| তাহাই ঠিক-ঠিক হইয়াছে|
দে| কে হত্যাকারী?
অ| আমি এখন কিছু বলিব না| যাহা কিছু বলিবার, তাহা বলিয়াছি| তুমি নিজে তদন্ত করিয়া নিজের বুদ্ধিতে যদি কাজ হাঁসিল করিতে পার, তাহাতে তোমার মনে আনন্দ হইবে, আমিও শুনিয়া সন্তুষ্ট হইতে পারিব| এখন আমি হত্যাকারীর নাম প্রকাশ করিয়া তোমাকে নিরুদ্যম করিতে চাহি না|
এই বলিয়া অরিন্দমববু ধীরে ধীরে উঠিয়া বসিলেন| পার্শ্বস্থ টেবিলের উপরে একটা ষ্টিলের ছোট ক্যাস-বাক্স ছিল, তাহা উঠাইয়া শয্যার উপরে লইলেন, এবং চাবী লাগাইয়া খুলিয়া ফেলিলেন| তন্মধ্যে উপস্থিত খরচের জন্য দশটাকার পাঁচ-সাত কেতা নোট, কয়েকটা খুচ্রা টাকা,-পয়সা, কতকগুলা সিকি, দুয়ানি ছিল, সেগুলি বাহির করিয়া বালিসের নীচে রাখিয়া দিলেন| তাহার পর টেবিলের উপর হইতে একখানি কাগজ ও কলম কালি লইয়া অন্যদিকে ফিরিয়া কি লিখিলেন| লিখিলেন-কালি শুকাইবার বিলম্ব রহিল না-কাগজখানি ভাঁজ করিয়া বাক্সের মধ্যে ফেলিয়া দিলেন, এবং চাবি লাগাইয়া, বাক্স বন্ধ করিয়া, চাবিটা যেখানে নোট, টাকা, পয়সা রাখিয়াছিলেন, সেইখানে রাখিয়া দিলেন| তাহার পর বাক্সটি দেবেন্দ্রবিজয়ের হাতে দিয়া বলিলেন, “ইহার ভিতরে হত্যাকারীর নাম লেখা রহিল| এখন তুমি এই বাক্সটি লইয়া যাও| যখন কৃতকার্য্য হইবে, আমার কাছে লইয়া আসিয়ো; আমি তোমার মুখে গল্পমাত্র শুনিয়া কিরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি, তখন এই বাক্স খুলিয়া তোমাকে দেখাইয়া দিব; এখন নয়-এখন আর কোন কথা আমার কাছে পাইবে না| আমি ইঙ্গিতে তোমাকে পূর্ব্বে অনেক কথাই বলিয়া দিয়াছি-তোমার পক্ষে তাহাই যথেষ্ট|” দুই-একটি কঠিন কথা বলিয়াছি; দেখো দাদা, সেজন্য যেন বুড়োটার উপরে রাগ করিয়ো না, তাহা হইলে বড় অন্যায় হইবে| আমি তোমাকে কিছুতেই ক্ষমা করিতে পারিব না; তোমার উপরে এই অপদার্থ বুড়োটার অনেকখানি জোর খাটে-মনে থাকে যেন|”

৫.০১ প্রথম পরিচ্ছেদ – কারাকক্ষে

পঞ্চম খণ্ড
নিয়তি-রাক্ষসী
“This is the man should do the bloody deed;
The image of a wicked heinous fault
Lives in his eye; that close aspect of his
Does show the mood of a much-troubled breast.”
Dodd’s “Beauties of Shakespeare.”

প্রথম পরিচ্ছেদ
কারাকক্ষে
মজিদ খাঁ এখনও হাজতে| কয়েক দিবস একস্থানে আবদ্ধ থাকায় তাঁহার মনটা অত্যন্ত খারাপ হইয়া গিয়াছে| বিশেষতঃ আজ-কাল তিনি আরও বিমর্ষ| উকীল হরিপ্রসন্ন বাবু মধ্যে মধ্যে তাঁহাকে দেখিতে আসিতেন| মজিদ খাঁ তাঁহার নিকটে এই হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত সমুদয় সংবাদ শুনিতে পাইতেন| শুনিয়া বুঝিতে পারিতেন, রহস্যের ক্রমশঃ উদ্ভেদ হইয়া অসিতেছে-শীঘ্রই তিনি মুক্তি পাইবেন| সৃজান সংক্রান্ত যে কথা তিনি গোপন করিবার জন্য প্রাণপণ করিতেছিলেন, এখন আত্মরক্ষার্থ আর তাহা প্রকাশ না করিলেও বিশেষ কোন ক্ষতি হইবে না|
এই কয়েকদিন মজিদ খাঁ একেবারে অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছেন| প্রাণসমা জোহেরাকে তিনি কতদিন দেখেন নাই, কতদিন তাহার মধুর কণ্ঠে সুমধুর প্রেমসম্ভাষণ শুনিতে পান্ নাই| একমাত্র জোহেরার চিন্তা অনুক্ষণ তাঁহার হৃদয়ে জাগরূক| নির্জ্জনে চিন্তা যেরূপ গভীর হইয়া উঠে, মজিদ খাঁর ঠিক তাহাই হইয়াছিল| অনেক সময়ে তিনি মনকে অন্যদিকে ফিরাইবার চেষ্টা করিতেন-পারিতেন না| কখনও মনে হইত, এই আমি যেমন একমনে কেবল জোহেরার ভাবনা ভাবিতেছি, জোহেরার কি আমার জন্য এমন কাতর হইয়াছে? কখনও ভাবিতেছেন, অন্যের ন্যায় জোহেরাও হয়ত আমাকেই হত্যাপরাধী বলিয়া বিশ্বাস করিয়াছে| আমার অপরাধের পরিমাণ আমি নিজে জানি; কিন্তু আমি তাহাকে কি করিয়া বুঝাইব, আমি সম্পূর্ণ নির্দ্দোষ? হায়, এই সূত্রে সে যদি আমাকে ঘৃণার চোখে দেখিতে আরম্ভ করে, তাহা হইলে ত সেখানেই আমার সকল আশা-ভরসা ঘুচিয়া যায়! কি করি, কিরূপে আমি সকল দিক্ বজায় রাখিয়া এত বিপদ-বিঘ্ন ঠেলিয়া মাথা তুলিতে পারিব? তাহার ত আর কিছুমাত্র সম্ভাবনা দেখিতেছি না| মজিদ খাঁ সেই নির্জ্জন কারা-কূপে পড়িয়া, আত্মহারা হইয়া ব্যাকুল হৃদয়ে অবিরত জোহেরার কথাই ভাবিতেছেন| ক্ষুব্ধ সিন্ধুবক্ষে যেমন তরঙ্গের পর তরঙ্গ উঠে, মজিদ খাঁর হৃদয়-সমুদ্র মথিত করিয়া তেমনই তরঙ্গ ছুটিতেছে-একটির পর একটি-তাহার পর আর একটি-ক্রমান্বয়ে-এক মুহুর্ত্তের জন্য বিরাম নাই-বিশ্রাম নাই-অবসর নাই| মোহ্যমান মজিদ খাঁ করতললগ্নশীর্ষ হইয়া নতমুখে নিজের ভবিষৎ চিন্তা করিতেছেন-বর্ত্তমানের ন্যায় ভবিষৎও তাঁহার অন্ধকারময় বোধ হইতেছে, কেবল অন্ধকার- নিরবছিন্ন দুর্ভেদ্য ঘোর অন্ধকার- সেই নিবিড় অন্ধকার ততোধিক অন্ধকারময়ী নিরাশার বিকটমূর্ত্তি ভিন্ন মজিদ খাঁ আর কিছুই দেখিতেছে না-সেখানে কোথায় আশার একটু ক্ষীণালোকরেখাও পড়ে নাই|
মজিদ খাঁ যখন আপন দুশ্চিন্তায় একেবারে বাহ্যজ্ঞান-রহিত তখন সহসা কাহার পদশব্দে তাঁহার চমক হইল| চকিতে চাহিয়া দেখেন, অন্ধকার সরিয়া গিয়াছে নয়নাগ্র হইতে সেই নিরাশার বিকটমূর্ত্তি অন্তর্হিত-চারিদিক্ দিবালোকপ্রদ্যোতিত-এবং আশার মোহিনীমূর্ত্তির ন্যায় কারাগৃহতলে অনতিদূরে দাঁড়াইয়া-তাঁহারই সেই হৃদয়ানন্দবিধায়িনী, অপরূপ রূপলাবণ্যময়ী জোহেরা যেন ভাস্কর-রচিত সকরুণ পাষাণ-প্রতিমা স্থিরনেত্রে তাঁহারই দিকে নীরবে দৃষ্টিপাত করিতেছে|
প্রথমে মজিদ খাঁ নিজের চক্ষুকে বিশ্বাস করিতে পারিলেন না| মনে হইল, দিনরাত যাহাকে মনে ভাবা যায়, কখন কখন স্বপ্নঘোরে তাহার মূর্ত্তি প্রকটিত হয়-ইহাও কি স্বপ্ন? তাঁহার মুখ দিয়া সহসা কথা বাহির হইল না; তিনি দুঃসহ বিস্ময়ে অবাক মুখে জোহেরার মুখের দিকে স্থিরনেত্রে চাহিয়া রহিলেন|
ত্খন বীণাবিনিন্দিত সুমধুর কণ্ঠে সুন্দরী জোহেরা হকিল, “একি! তুমি কি আমাকে চিনিতে পারিতেছ না? এমন করিয়া অপরিচিতের ন্যায় আমার দিকে চাহিয়া আছ কেন? আমি জোহেরা-আমি তোমাকে দেখিতে আসিয়াছি|”
সেই অমৃতবর্ষী স্নেহকণ্ঠ একান্ত পরিচিত-একান্ত মধুর-একান্ত করুণাময়, একবার শুনিলে আর তাহা সহজে ভুলিতে পারা যায় না| তখন সহজে মজিদ খাঁ তাহাকে চিনিতে পারিলেন| তাড়াতাড়ি উঠিয়া, দুই হাতে জোহেরার হাত দুখানি ধরিয়া নতমুখে দাঁড়াইলেন| ক্ষণপরে কম্পিতকণ্ঠে বলিলেন, “জোহেরা, তুমি এখানে! তুমি কেন এ কলঙ্কিত স্থানে আসিলে? এখানে কত তস্কর, কত দস্যু, কত পরস্বাপহারী, নরনারীহন্তা পদচিহ্ণ রাখিয়া গিয়াছে-তুমি কেন জোহেরা, না বুঝিয়া তাহার মধ্যে তোমার পদচিহ্ণ মিশাইতে আসিয়াছ? সহস্র নরপিশাচের পাপ-নিশ্বাসে এখানকার বায়ুও দুষিত, তাহা কি তুমি জান না? এখানে দয়া, মায়া, স্নেহ, প্রেম নাই-এখানকার লোকেরা এক স্বতন্ত্র জীব-এমন অপবিত্র স্থানে তোমাকে দেখিয়া আমি আজ বড় বিস্মিত হইলাম!”
জোহেরা মৃদুকণ্ঠে কহিল, “ইহাতে বিস্ময়ের কিছুই নাই, মজিদ; তুমি যেখানে আছ, সে স্থান জাহান্নাম্ হইলেও আমার নিকটে পরম পবিত্র|”
মজিদ খাঁ জিজ্ঞাসা করিলেন, ” তুমি কিরূপে এখানে আসিবার অনুমতি পাইলে?”
জোহেরা কহিল, “উকীল বাবু আমার সঙ্গে আসিয়াছেন; তাঁহারই সাহায্যে আমি এখানে আসিতে পারিয়াছি| তিনি এখনই এখানে আসিবেন| উকীল বাবু আমাদিগের মঙ্গলের জন্য অনেক চেষ্টা করিতেছেন|”
মজিদ খাঁ কহিলেন, “হাঁ, তাঁহার ঋণ অপরিশোধ্য| সত্যই তিনি আমাদিগকে আন্তরিক স্নেহ করেন; কিন্তু আমি এ জীবনে তাঁহার নিকটে অকৃতজ্ঞই রহিয়া গেলাম| আমি দেখিতেছি, আমার ভবিষৎ বড় ভয়ানক| এই ত অবস্থা-বিপাকে কি একটা ভয়ানক দুর্নাম কিনিলাম!”
জোহেরা কহিল, “ভবিষ্যতের তমোময় গর্ভে কি নিহিত আছে, কে জানে? যে সকল বিঘ্ন-বাধা এখন দুরতিক্রম্য বলিয়া বোধ হইতেছে, দুইদিন পরে তাহা সমুদয় দূর হইয়া যাইতে পারে| মানুষের হৃদয়ে বল থাকে কেন? বিপদ্ যেমন গুরুতর ভাবে চাপিয়া পড়ুক না কেন, ততই তাহার সহিত অন্তিমবলে যুঝিতে হইবে|”
মজিদ খাঁ ব্যগ্রভাবে কহিলেন, “জোহেরা, আমি যে ভয়ানক অপরাধে এখানে বন্দী রহিয়াছি, তাহা তুমি অবশ্যই শুনিয়াছ; কিন্তু জোহেরা, তুমি কি তাহা বিশ্বাস কর?”
জোহেরা কহিল, “একটী বর্ণও না| আমি কেন-কেহই ইহা বিশ্বাস করেন নাই| ডিটেক্টিভ দেবেন্দ্রবিজয় বাবু, মুন্সী সাহেব, মোবারক সকলেরই মনে ধারণা-তুমি নিরপরাধ|”
অত্যন্ত বিস্মিতভাবে মজিদ খাঁ বলিলেন, “মিবারক! মোবারকেরও ধারণা আমি নিরপরাধ? খুনের রাত্রিতে মোবারকই ত আমাকে মেহেদী-বাগানে একটা গলির মোড়ে দেখিতে পাইয়াছিল; ইহাতে বরং খুনী বলিয়া আমার উপরেই তাহার সন্দেহই হইতে পারে|”
জোহেরা বলিল, “না তোমার উপরে তাঁহার সন্দেহ হয় নাই|”
মজিদ খাঁ বলিলেন, “মোবারক আমার একজন প্রকৃত বন্ধু বটে| আমি তাহাকে অনেক দিন হইতে ভাল রকমে জানি|”
জোহেরা কহিল, “তুমি যতখানি প্রকৃত মনে করিতেছ, মোবারক ঠিক ততখানি নহেন-তিনি আমাকে বিবাহ করিবার চেষ্টায় আছেন|”
ম|(সাশ্চর্য্যে) কি আশ্চর্য্য-অসম্ভব!
জো| অসম্ভব নয়-পরশু সকালে এইজন্য তিনি আমার সঙ্গে দেখাও করিয়াছিলেন|
ম| তোমার সঙ্গে ! তুমি তাহাকে কি বলিলে?
জোহেরার চক্ষু জ্বলিয়া উঠিল| জোহেরা বলিল, “ইহা আবার তুমি আমায় জিজ্ঞাসা করিতেছ? তোমার সহিত যে আমার বিবাহ-সম্বন্ধ এক-প্রকার ঠিক হইয়া গিয়াছে, সে কথা আমি তাঁহাকে বলিলাম| তাহাতে মোবারক বলিলেন যে, তিনি এইরূপ শুনিয়াছেন বটে; কিন্তু কথাটা যে কতদূর সত্য, তাহা তিনি বুঝিতে পারেন নাই|”
মজিদ খাঁ ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “তাহার পর তোমাকে সে আর কি বলিল?”
জোহেরা| তাহার পর তিনি তোমার এই বিপদের কথা তুলিয়া বলিলেন, আমি যদি তাঁহাকে বিবাহ করিতে সম্মত হই, তাহা হইলে তিনি তোমাকে নির্দ্দোষ সাব্যস্ত করিয়া এই বিপদ্ হইতে উদ্ধার করিতে পারেন|
মজিদ| অসম্ভব-মোবারক কিরূপে আমাকে উদ্ধার করিবে?
জোহেরা| তাহা আমি জানি না| তাঁহার কথায় আমার বড় রাগ হইল, তাঁহার সাহায্য ব্যতিরেকেও আমরা যে তোমাকে নিরপরাধ সপ্রমাণ করিতে পারিব, তোমার সেই প্রকৃত বন্ধুটিকে তখন আমি তাহা বলিলাম| বলিয়াই আমি সেখান হইতে চলিয়া গেলাম| ইহার পর তাঁহার সহিত আমার আর দেখা হয় নই|
মজিদ খাঁ বলিলেন, “মোবারক যে আমাকে এ বিপদ্ হইতে উদ্ধার করিবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছে, ইহা ত বন্ধুর কর্ত্তব্য কর্ম্ম; কিন্তু সেই সাহায্যের বিনিময়ে তোমার নিকট হইতে সে যে প্রস্তাব করিয়াছে, তাহ খুবই গর্হিত| বিশেষতঃ আমার সহিত তোমার বিবাহ-সম্বন্ধের কথা সে যে না শুনিয়াছে, এমনও নহে|”
জোহেরা বলিল, ” শুনিয়াছেন সত্য, কিন্তু কথটা কতদূর সত্য, তাহা তিনি জানিতেন না; তাহা হইলে তিনি বোধ হয়, এ কথা তুলিতে সাহস করিতেন না| সকলেরই ধারণা ছিল, মনিরুদ্দীনের সহিত আমার বিবাহ হইবে|”

৫.০২ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – রহস্য-দুর্ভেদ্য

এমন সময়ে হরিপ্রসন্ন বাবু তথায় উপস্থিত হইলেন| মজিদ খাঁকে বলিলেন, “তোমার সহিত কয়েকটা বিশেষ কথা আছে, মজিদ!”
মজিদ খাঁ বলিলেন, “বলুন|”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “বোধ হয়, তোমার স্মরণ আছে, একদিন তুমি বলিয়াছিলে যে, মনিরুদ্দীন এখানে ফিরিয়া আসিলে, সেদিন খুনের রাত্রিতে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে রাত্রি বারটার সময়ে যে স্ত্রীলোকের সহিত তোমার দেখা হইয়াছিল, তাহার সম্বন্ধে সমুদয় বিষয় প্রকাশ করিতে আপত্তি করিবে না| এখন মনিরুদ্দীন ফিরিয়া আসিয়াছে, তুমি অনায়াসে সে কথা বলিতে পার|”
মজিদ খাঁর মুখমণ্ডলে মলিনতার স্পষ্ট ছায়াপাত হইল| কম্পিতকণ্ঠে, বিবের্ণমুখে বলিলেন, “মনিরুদ্দীন ফিরিয়াছে?”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “হাঁ, মনিরুদ্দীন ফিরিয়াছে; যাহাকে লইয়া এত কাণ্ড, সেই দিলজানও ফিরিয়াছে|”
মজিদ চকিতে একটা সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস টানিয়া বলিলেন, “দিলজান!”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “হাঁ, দিলজান, এখন আমরা সকলেই জানিতে পারিয়াছি, সেদিল খুনের রাত্রিতে বারটার সময়ে যে স্ত্রীলোকের সহিত তোমার দেখা হইয়াছিল-যাহার কথা তুমি প্রাণপণে গোপন করিতে চেষ্টা করিতেছ-সে মুন্সী সাহেবের স্ত্রী সৃজান| আর মেহেদী-বাগানে যে স্ত্রীলোকের লাস পাওয়া গিয়াছিল, তাহা দিলজানের নয়, সৃজানের| সৃজানই খুন হইয়াছে|”
মজিদ খাঁ বলিলেন, “হাঁ,-তাহাই বটে! তাহাই ঠিক|”
জোহেরা ব্যগ্রভাবে বলিয়া উঠিল, “তুমি কি ইহা আগে হইতে জানিতে যে, দিলজান খুন হয় নাই-সৃজান বিবিই খুন হইয়াছে?”
মজিদ খাঁ মুখ নত করিলেন| বলিলেন, “হাঁ, খুনের রাত্রিতে বারটার পর সৃজান বিবির সঙ্গেই আমার দেখা হইয়াছিল| মনিরুদ্দীন ও সৃজান বিবির অবৈধ প্রণয়ের কথা আমি জানিতাম| মনিরুদ্দীন কোন কাজই আমাকে লুকাইয়া করিতে পারিত না-আমি তাহাকে দিন রাত চোখে চোখে রাখিতাম-এমন কি সেজন্য সে অনেক সময়ে আমার উপরে বিরক্ত হইত| আমি অনেকবার সৃজান বিবিকে গোপনে মনিরুদ্দীনের সঙ্গে দেখা করিতে আসিতে দেখিয়াছি| যাহাতে উভয়ে নিজ-নিজ চরিত্র সংশোধন করিতে পারে, সেজন্য আমি উভয়কেই অনেকসময়ে বুঝাইয়া নিরস্ত করিবার চেষ্টা করিয়াছি; কিন্তু পতনের বেগ ক্রমশঃ বর্দ্ধিত হয়|
আমি কিছুতেই কৃতকার্য্য হইতে পারি নাই| সেদিন রাত্রিতে সৃজান মনিরুদ্দীনের সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছিল| মনিরুদ্দীন তখন বাড়ীতে ছিল না| আমার সঙ্গেই তাহার সাক্ষাৎ হইয়া যায়| তাহার পর তাহার মুখে শুনিলাম, দিলজান না কি তাহার বাড়ীতে গিয়া উঠিয়াছে, এবং তাহাকে এখনও যে মনিরুদ্দীন ত্যাগ করে নাই, সমভাবে এখনও তাহাকে ভালবাসিয়া আসিতেছে, এমন কি বিবাহ করিবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধও হইয়াছে, তাহা দিলজান, সৃজান বিবির কাছে প্রকাশ করিয়া দিয়াছে| দিলজানের এই সকল কথা কতদূর সত্য, তাহা মনিরুদ্দীনের নিজের মুখে শুনিবার জন্য সৃজান বিবি তেমন সময়ে দিলজানের বেশে মনিরুদ্দীনের সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছিল| দিলজানের মুখে যাহা সে শুনিয়াছিল, তাহা যে মিথ্যা নহে, আমি সৃজান বিবিকে বুঝাইয়া বলিলাম| আমি মনে করিয়াছিলাম, এই সুযোগে যদি আমি পাপিষ্ঠা সৃজানকে নিরস্ত করিতে পারি, তাহা হইলে মনিরুদ্দীনকে একটা ভয়ানক দুর্নাম হইতে-বিশেষতঃ রাক্ষসী সৃজানের হাত হইতে রক্ষা করিবার অনেকটা সুবিধা হয়| আমার কথা শুনিয়া সৃজান বিবি অত্যন্ত রাগিয়া উঠিল| মনিরুদ্দীন যে এইরূপভাবে তাহার সহিত প্রবঞ্চনা করিয়াছে, সেজন্য মনিরুদ্দীনের প্রতি দোষারোপ করিতে করিতে সে আমাকেই দশ কথা শুনাইয়া দিল| আমি তাহাকে কিছুতেই শান্ত করিতে পারিলাম না| তখনই সে ক্রোধভরে বাড়ীর বাহির হইয়া গেল| সেই ভয়ানক রাগের মুখে সে কি ভয়ানক কাজ করিয়া ফেলিবে, এই ভয়ে আমিও তাহার অনুসরণ করিলাম; পথে আসিয়া আর তহাকে দেখিতে পাইলাম না; সেদিন যেমন ভয়ানক কুয়াশা-তেমনি আবার ভয়ানক অন্ধকার! পথে দাঁড়াইয়া চরিদিকে চাহিতে চাহিতে এক ব্যক্তিকে যেন মেহেদী-বাগানের পথ ধরিয়া যাইতে দেখিলাম| কিছুদূর গিয়া আর তাহাকে দেখিতে পাইলাম না| ক্রমে মেহেদী-বাগানে আসিয়া পড়িলাম| সেখানেও তাহার অনেক অনুসন্ধান করিলাম| এমন কি, দিলজানের বাড়ী পর্য্যন্ত গিয়াছিলাম; সেখানেও গোপনে খবর লইয়া জানিলাম, সৃজানের বাড়ী হইতে দিলজান তখনও বাড়ী ফিরিয়া আসে নাই| ফিরিবার মুখেও মেহেদী-বাগানে আমি সৃজানের অনেক অনুসন্ধান করিলাম| নিরাশ হইয়া যখন বাড়ী ফিরিতেছি, তখন একটা গলির মোড়ে মোবারকের সঙ্গে আমার দেখা হয়| তাহার পর বাড়ীতে ফিরিয়া শয়ন করিলাম| পরদিন ঘুম হইতে উঠিয়াই এই খুনের কথা শুনিলাম| তাহার পর সেই লাসের পরিধেয় বস্ত্রাদির যেরূপ বর্ণনা শুনিলাম, তাহাতে আমি সহজেই বুঝিতে পারিলাম, সৃজান বিবিই খুন হইয়াছে| এদিকে ক্রমে দিলজান খুন হইয়াছে বলিয়া চারিদিকে একটা রব উঠিয়া গেল| ভালই হইল মনে করিয়া আমিও অনেকটা আশ্বস্ত হইতে পারিলাম|”
হরিপ্রসন্ন বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন?”
মজিদ খাঁ বলিলেন, “তাহার একটা বিশেষ কারণ আছে|”
হ| এই খুন সম্বন্ধে না কি?
ম| খুন সম্বন্ধে বৈ কি|
হ| এখন কি তাহা প্রকাশ করিতে কোন আপত্তি আছে?
ম| একটু সময় দিন্, একবার ভাবিয়া দেখি, তাহার পর বলিতেছি|
হ| বেশ কথা|
জো| (মজিদের প্রতি) এ সকল কথা পূর্ব্বে কেন আমাদিগকে বল নাই?
ম| তাহারও কারণ আছে| আমি সৃজান বিবির নিকটে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়াছিলাম যে, তাহার সম্বন্ধে সেদিনকার কোন কথা কাহারও নিকটে প্রকাশ করিব না| বিশেষতঃ তখন মনিরুদ্দীনের উপরে সৃজান বিবির যেরূপ রাগ দেখিয়াছিলাম, তাহাতে আমার বোধ হইয়াছিল যে, সে নিশ্চয়ই এইবার মনিরুদ্দীনকে ত্যাগ করিবে; এরূপ স্থলে এ কলঙ্ক-কাহিনী একেবারে চাপা পড়িয়া যাওয়াই ভাল| যদি আমি প্রকাশ করিতাম যে, সেদিন রাত্রে সৃজানের সহিত আমার দেখা হইয়াছিল, তাহা হইলে আমাকে বাধ্য হইয়াই, সেই সঙ্গে তাহার সম্বন্ধে সকল কথাই প্রকাশ করিতে হইত|
হরিপ্রসন্ন বাবু, “কি আশ্চর্য্য! একজন স্ত্রীলোকের জন্য তুমি নিজের গলায় ফাঁসীর দড়ী জড়াইতে বসিয়াছ|”
মজিদ খাঁ বলিলেন, “না, এতদূর আমাকে অগ্রসর হইতে হইত না| বেগতিক দেখিলে আমাকে সকল কথাই বলিয়া ফেলিতে হইত| তবে যতক্ষণ পারি, ততক্ষণ কেন না চেষ্টা করিব?”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “আগে তুমি কি মনে করিয়াছিলে যে, কে মনিরুদ্দীনের সঙ্গে গিয়াছে?”
মজিদ খাঁ বলিলেন, “আগে আমি মনে করিয়াছিলাম, কেহই মনিরুদ্দীনের সঙ্গে যায় নাই| তাহার পর যখন আপনি দিলজানের কথা আমার কাছে তুলিলেন, তখনই আমি বুঝিতে পারিয়াছিলাম, যদি কেহ গিয়া থাকে, ত দিলজানই মনিরুদ্দীনের সঙ্গে গিয়াছে| দিলজান সৃজানের যমজ ভগিনী| উভয়েই দেখিতে এক রকম, তাহার উপরে দুই জনে পরস্পর পোষাক পরিবর্ত্তন করিয়াছিল; বিশেষতঃ দিলজান খুব চতুর; এমন একটা সুযোগ কি সহজে তাহার হাত এড়াইতে পারে?”
হরিপ্রসন্ন বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “সে কথা যাক্, সেই মৃত স্ত্রীলোকের নাম জানিয়াও এমন কোন্ বিশেষ কারণে তখন তুমি প্রকাশ করিতে সাহস কর নাই, তাহা এখন বলিবে কি?”
মজিদ খাঁর মুখ মলিন, এবং ললাটদেশ কুঞ্চিত হইল| এবং অতি কঠিনভাবে তিনি অধর দংশিত করিয়া একান্ত নিরাশভাবে একবার কক্ষের চারিদিকে চাহিলেন| তাহার পর কঠিন-কণ্ঠে বলিলেন, “জোহেরা, সে বড় ভয়ানক কথা-তুমি তাহা সহ্য করিতে পারিবে না|”
জোহেরা বলিল, “যেমনই ভয়ানকই হউক না কেন-আমি তাহা সহ্য করিব| তুমি বল|”
মজিদের মুখের ভাব দেখিয়া হরিপ্রসন্ন বাবুর বড় ভয় হইল| ভাবিলেন, মজিদ নিজেই খুনী না কি| জোহেরার সমক্ষে নিজের খুন-স্বীকার করিতে তাই এত ভীত হইতেছে? না-না-ইহা কখনই সম্ভব্পর নয়|

৫.০৩ তৃতীয় পরিচ্ছেদ – রহস্য-বৈষম্য

মজিদ খাঁ একবার নীরবে কি চিন্তা করিলেন| তাঁহার মুখমণ্ডল অন্ধকার হইয়া গেল| ক্ষণপরে তিনি মুখ তুলিয়া কি বলিবার উপক্রম করিতেছে, এমন সময়ে খুব ব্যস্তভাবে হাঁপাইতে হাঁপাইতে দেবেন্দ্রবিজয় সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন|
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “এই যে, আপনারা সকলেই এখানে আছেন-ভালই হইয়াছে-আপনাদিগের জন্য আজ আমি একটা নূতন খবর আনিয়াছি|”
হরিপ্রসন্ন বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিসের নূতন খবর ?”
দে| খুনের| আমি ইতিমধ্যে মনিরুদ্দীনের সহিত একবার দেখা করিয়াছিলাম| সেদিন খুনের রাত্রিতে তিনি কোথায় ছিলেন, কি করিয়াছিলেন, সে সকল বিষয় একপ্রকার জানা গিয়াছে|
হ| এমন কিছু শুনিলেন, যাহাতে তাহাকে এই হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত বিবেচনা করা যাইতে পারে?
দে| তাহাতে আর বিশেষ কি ফল হইত? এবার আমি প্রকৃত খুনীকে জানিতে পারিয়াছি|
“কে সে লোক?” অত্যন্ত ব্যগ্রভাবে হরিপ্রসন্ন বাবু ও জোহেরা বলিয়া উঠিলেন| মজিদ খাঁ কিছু বলিলেন না-ব্যকুলনেত্রে দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন|
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “লোক নয়-একজন স্ত্রীলোক-একজন স্ত্রীলোক দ্বারাই এই কাজ হইয়াছে| সে এখন নিজের মুখে খুন স্বীকার করিয়াছে|”
জোহেরা আরও ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞাসা করিল, “কে এমন স্ত্রীলোক? নাম কি?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “দিলজান|”
জোহেরা সবিস্ময়ে প্রতিধ্বনি করিয়া বলিল, “দিলজান!”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “আশ্চর্য্য ব্যাপার!”
মজিদ খাঁ বলিলেন, “ভয়ানক!”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আশ্চর্য্য ব্যাপারই হউক-আর ভয়ানক ব্যাপারই হউক, দিলজান এখন নিজের মুখে খুন স্বীকার করিয়াছে| সেই খুনের রাত্রিতে দিলজান দারুণ ঈর্ষা-দ্বেষে মরিয়া হইয়া মেহেদী-বাগান পর্য্যন্ত সৃজানের অনুসরণ করিয়াছিল| সেইখানে সে সৃজানকে নিজ হস্তে খুন করিয়াছে|”
সন্দিগ্ধভাবে মজিদ খাঁ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিরূপ ভাবে, কোন অস্ত্রে খুন করিয়াছে, দিলজান কি কিছু বলিয়াছে?”
“এই ছুরিতেই সে সৃজানকে খুন করিয়াছে; দিলজান খুন স্বীকার করিয়া নিজের হাতে এই ছুরি আমাকে দিয়াছে, “বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় সেই দিলজান প্রদত্ত ছুরিখানি বাহির করিয়া দেখাইলেন|
মজিদ খাঁ, বিস্মিতভাবে দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইহা কি আপনি বিশ্বাস করেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “প্রথমতঃ আমি একটি কথাও বিশ্বাস করি নাই| এখন আমার মনে সন্দেহ হইতেছে, যদি দিলজান নিজেই খুন না করিবে, তবে কেন সে নিজের মুখে খুন স্বীকার করিতেছে?”
মজিদ খাঁ বলিলেন, “ইহার কারণ আছে; আমার মুখেই আপনি তাহা শুনিতে পাইবেন| দিলজান মনিরুদ্দীনকে আন্তরিক ভালবাসে| আপনি এই খুনের অপরাধে সেই মনিরুদ্দীনকেই জড়াইয়া ফেলিতে চেষ্টা করিতেছেন, ইহা হয়ত সে শুনিয়া থাকিবে|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, ” হাঁ, সেদিন আমি যখন মনিরুদ্দীনের স্কন্ধে এই হত্যাপরাধটা চাপাইবার চেষ্টা করিতেছিলাম, তখন সে অন্তরালে থাকিয়া আমাদের অনেক কথাই শুনিয়াছিল|”
মজিদ খাঁ বলিলেন, “তাহা হইলে ত ঠিকই হইয়াছে; পাছে মনিরুদ্দীনকে আপনি খুনের অপরাধে ফাঁসীর দড়ীতে তুলিয়া দেন, এই ভয়ে সে নিজে খুন স্বীকার করিয়াছে| বিশেষতঃ দিলজান স্বভাবতঃ বড় উগ্র প্রকৃতির স্ত্রীলোক; আপনি বোধ হয়, তাহা বুঝিতে পারিয়াছেন| তাহার উপর ভগিনীর খুনের কথা শুনিয়া, সেই খুনের অপরাধে মনিরুদ্দীনকে জড়াইয়া পড়িতে দেখিয়া দারুণ উত্তেজনায় তাহার মেজাজ আরও বিগ্ড়াইয়া যাইবার কথা| এখন কি বলিতেছে, কি করিতেছে সম্ভব, সে জ্ঞান আর তাহার নাই|”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, ” কিন্তু এই ছুরিখানা?”
মজিদ খাঁ অবজ্ঞাভরে বলিলেন, “কিছু না-এই ছুরিতে সৃজান খুন হয় নাই-হইতে পারে না-ইহা কখনই বিষাক্ত নহে; আপনি বরং পরীক্ষা করিয়া দেখিতে পারেন| আমি খুব জোর করিয়া বলিতে পারি, দিলজানের দ্বারা কখনই এ খুন হয় নাই|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আপনার এ দৃঢ় বিশ্বাসের অবশ্যই একটা কারণ আছে; নতুবা আপনি এরূপ জোরের সহিত দিলজানের পক্ষ সমর্থন করিতে পারিতেন না| আপনার বোধ হইতেছে-বোধ হইতেছে কেন-নিশ্চয়ই আপনি জানেন, কে সৃজানকে খুন করিয়াছে|”
মজিদ খাঁ কহিলেন, “না, আমি ঠিক জানি না| যাহা জানি, আপনাকে বলিতেছি| আমার মনে একটা ঘোরতর সন্দেহ রহিয়াছে; মেহেদী-বাগানের সেই স্ত্রীলোকের লাস যে সৃজানের, তাহা আমি প্রথমেই জানিতে পারিয়াছিলাম| জানিয়াও নাম প্রকাশ করিতে সাহস করি নাই| সাহস না করিবার কারণই হইতেছে, আমি যাহা দেখিয়াছি-অতি ভয়ানক! দিলজান যে খুন করে নাই, আমার দৃঢ়বিশ্বাসের তাহাই একমাত্র কারণ| আমি পূর্ব্বেই বলিয়াছিলাম, সেদিন খুনের রাত্রিতে সৃজান রাগিয়া চলিয়া গেলে আমি তাহার অনুসরণ করিতে বাহির হইয়া পথে আর তাহাকে দেখিতে পাই নাই| এ কথাটা একেবারে মিথ্যা; বাধ্য হইয়া আমাকে সত্য গোপন করিতে হইয়াছিল| সৃজানের নিজের বাড়ীর দিকে গিয়াছে মনে করিয়া, আমি বাহির হইয়াই কলিঙ্গ-বাজারের পথে প্রথমে যাই| কিছুদূর গিয়া দেখি, পথিপার্শ্বস্থ লণ্ঠনের নীচে-নীচে অস্পষ্ট অন্ধকার-সেই অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়াইয়া একজন লোকের সহিত সৃজান বিবি কি বকাবকি করিতেছে| লোকটা কথায় কথায় খুব রাগিয়া উঠিল-স্বরও ক্রমে খুব ঊর্দ্ধে উঠিল| ক্রমে সেই লোকটা একহাতে সৃজানের গলা টিপিয়া ধরিয়া, অপর হাতে জোর করিয়া গলা হইতে কণ্ঠহার ছিনাইয়া লইল| সহসা সৃজান ব্যাকুলকণ্ঠে চীৎকার করিয়া উঠিল, এবং প্রাণপণে মেহেদী-বাগানের দিকে ছুটিয়া গেল| লোকটাও সেইদিকে ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটিয়া গেল| আমি তাহাদের অনুসরণ করিয়া মেহেদী-বাগানের দিকে ছুটিলাম| চারিদিকে যেমন কুয়াশা, তেমনি ভয়ানক অন্ধকার, তাহাদের কাহাকেও কোথাও দেখিতে পাইলাম না| আপনার বোধ হয় স্মরণ আছে, সৃজানের গলদেশে একটা আঁচড়ের দাগ ছিল-তাহা জোর করিয়া কণ্ঠহার ছিনাইয়া লইবার দাগ| আমার বোধ হয়, সেই লোকটা সেই সময়েই সৃজানের গায়ে কোন বিষাক্ত অস্ত্র বিদ্ধ করিয়া দিয়া থাকিবে| সেই জন্যই ভয় পাইয়া, সৃজান বিবি একবার আর্ত্তনাদ করিয়া উঠিয়াছে তাহর নিকট হইতে ঊর্দ্ধশ্বাসে পলাইয়া যায়| তাহার পর মেহেদী-বাগানে গিয়া, সেই বিষের প্রকোপে অবসন্ন হইয়া লুটাইয়া পড়ে; এবং সেইখানেই একান্ত অসহায়ভাবে হতভাগিনীর প্রাণবায়ু বাহির হইয়া যায়| আমার ত ইহই ধারণা|”
দেবেন্দ্রবিজয় অত্যন্ত মনোযোগের সহিত সমস্ত শুনিতেছিলেন| মজিদ খাঁকে চুপ করিতে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি সেই লোকটাকে চিনিতে পারিয়াছিলেন কি?”
সকলে| কে-কে-কে?
ম| মুন্সী সাহেব|
জোহেরা একান্ত স্তম্ভিতভাবে প্রাণহীন পাষাণ-প্রতিমার মত দাঁড়াইয়া রহিল| তাহার মুখ দিয়া একটা কথাও বাহির হইল না|
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “কি ভয়ানক! তাহা হইলে মনিরুদ্দীন ত আমাকে মিথ্যাকথা বলেন নাই| তিনিও মুন্সী সাহেবকে ঊর্দ্ধশ্বাসে সৃজানের অনুসরণ করিতে দেখিয়াছিলেন| ঘটমাক্রমে এই নারীহত্যাটা স্ত্রী-হত্যায় পরিণত হইল দেখিতেছি| শেষে মুন্সী সাহেবই খুনী দ্মাড়াইলেন-এখনই আমাকে উঠিতে হইল| আর বিলম্ব নয়|” বলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন|
হরিপ্রসন্ন বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায় চলিলেন?”
“মুন্সী সাহেব সৃজানের গলা হইতে যে কণ্ঠহার ছিনাইয়া লইয়াছিলেন এইবার একবার সেই কণ্ঠহার তদন্ত করিতে হইবে, “বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় তৎক্ষণাৎ দ্রুতপদে সেখান হইতে বাহির হইয়া গেলেন|

৫.০৪ চতুর্থ পরিচ্ছেদ – ঝটিকা ভিন্নদিকে বহিল

মুন্সী সাহেবের সেই হত্যারাত্রির গতিবিধি সম্বন্ধে পূর্ব্বে দেবেন্দ্রবিজয় মনিরুদ্দীনের নিকট কতক শুনিয়াছিলেন; তাহার পর এখন আবার মজিদ খাঁর মুখে সেই সম্বন্ধে যাহা শুনিলেন, তাহাতে মুন্সী সাহেবকেই হত্যাকারী স্থির করিয়া একরূপ কৃতনিশ্চয় হইতে পরিলেন| মুন্সী সাহেব ও সৃজান বিবির মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর সম্বন্ধের পরিবর্ত্তে যে, সর্প-নকুল সম্বন্ধ স্থাপিত হইয়াছিল, তাহা প্রতিবেশীরা সকলেই জানিত| দেবেন্দ্রবিজয়ও তাহাদের নিকটে কিছু কিছু শুনিয়াছিলেন| এখন তিনি বুঝিতে পারিলেন, বিশ্বাস-হন্ত্রী এই নূতন ব্যভিচারের কথা কোন রকমে জানিতে পারিয়া মুন্সী সাহেব গোপনে স্ত্রীর উপরে লক্ষ্য রাখিয়াছিলেন| তাহার পর সুযোগমত সময়ে তাহাকে খুন করিয়াছেন|
দেবেন্দ্রবিজয় আরও ভাবিয়া দেখিলেন, কেবল সন্দেহ করিলে কোন কাজ হইবে না, মুন্সী সাহেব খুনের রাত্রিতে তাঁহার স্ত্রীর গলদেশ হইতে কণ্ঠহার ছিনাইয়া লইয়া কোথায় রাখিয়াছেন, তাহা এখন অনুসন্ধান করিয়া বাহির করিতে হইবে| যে ছুরি মজিদ খাঁর বাড়ীতে পাওয়া গিয়াছে, সে ছুরিতে যে এই খুন হয় নাই-তাহা নিশ্চয়| এখন ঘটনা আর এক ভাব ধারণা করিয়াছে| পূর্ব্বে যে সকল সূত্র অবলম্বন করিয়া কাজ করিতেছিলাম, তাহা এখন একান্ত নিরর্থক বলিয়া বুঝিতে পারিতেছি| যে বিষাক্ত অস্ত্রে সৃজান খুন হইয়াছে, তাহাও এখন সন্ধান করিয়া মুন্সী সাহেবের অধিকার হইতে বাহির করিতে পারি, তাহা হইলে তাঁহার নিজের দোষস্খালনের আর তখন কোন উপায়ই থাকিবে না| বিশেষতঃ মনিরুদ্দীন ও মজিদ খাঁর নিকটে তাঁহার সেই খুনের রাত্রির গতিবিধি সম্বন্ধে যতটা প্রমাণ পাওয়া যাইবে, তাহাতে আমি তাঁহাকে অতি সহজে দোষী সাবুদ করিতে পারিব| মুন্সী সাহেব যে নিজেই স্ত্রীর হত্যাকারী, সে বিষয়ে আর কোন সন্দেহ থাকিতে পারে না| এখন তাহার নিকট হইতে সেই কণ্ঠহার আর যে বিষাক্ত অস্ত্রে তিনি সৃজানকে খুন করিয়াছেন, তাহা এখন অনুসন্ধান করিয়া বাহির করা চাই; কিন্তু তিনিই যদি প্রকৃত হত্যাকারী হইবেন, তাহা হইলে সেদিন সৃজান বিবির সন্ধানে আমাদের সঙ্গে ফরিদপুরে গিয়াছিলেন কেন? এখানে দেবেন্দ্রবিজয়ের মনে একটা খটকা লাগিল, বড় গোলমালে পড়িলেন| একবার ইচ্ছা হইল, অরিন্দম প্রদত্ত সেই বাক্সটি ভাঙিয়া দেখেন, তন্মধ্যে অরিন্দম বাবুর হস্তাক্ষরে কোন্ নিরীহ (?) ব্যক্তির নামটি লিখিত রহিয়াছে-কে সৃজান বিবির হত্যাকারী| কিন্তু তাহা তিনি করিলেন না| ক্ষণেক চিন্তার পর আপন মনে বলিলেন, “কিছু নয়-মুন্সী সাহেবই প্রকৃত হত্যাকারী-নিশ্চয় এই বাক্সের মধ্যে তাঁহারই নাম লিখিত রহিয়াছে| মুন্সী সাহেব নিজের অপরাধ ঢাকিবার জন্যই সৃজান বিবির সন্ধানে আমাদের সহিত ফরিদপুরে গিয়াছিলেন| মনে করিয়াছিলেন, এরূপ করিলে কেহ তাঁহাকে সন্দেহ করিতে পারিবে না| সেখানে গিয়া যে সৃজানকে দেখিতে পাইবেন না, তাহা তিনি নিজের মনে বেশ জানিতেন| কেবল নিজের অপরাধ গোপন করিবার জন্য তিনি এইরূপ কৌশল অবলম্বন করিয়া থাকিবেন|”
দেবেন্দ্রবিজয় মুন্সী সাহেবের সহিত দেখা করিতে বাহির হইলেন| সেই পথে মনিরুদ্দীনের বাড়ী| যাইবার সময়ে একবার মনিরুদ্দীনের সঙ্গে দেখা করিয়া যাইতে মনস্থ করিলেন| বহির্ব্বাটীতেই মনিরুদ্দীনের সহিত তাঁহার দেখা হইল| সেখানে আর কেহ ছিল না|
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, অত্যন্ত চিন্তা-গম্ভীর মুখে মনিরুদ্দীন একাকী বসিয়া আছেন| তাঁহার মুখমণ্ডল যেমন গম্ভীর, তেমনই বিবর্ণ| এবং বিশৃঙ্খলভাবে কতকগুলা চুল ললাটের উপরে আসিয়া পড়িয়াছে|
দেবেন্দ্রবিজয়কে গৃহপ্রবিষ্ট দেখিয়া মনিরুদ্দীন রুক্ষস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি মনে করিয়া আবার? এবার দিলজানকে গ্রেপ্তার করিয়া লইয়া যাইতে আসিয়াছেন না কি?”
দেবেন্দ্রবিজয় খুব সংক্ষিপ্তভাবে বলিলেন, “না|”
মনিরুদ্দীন কহিলেন, “না কেন?’
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আমি ত সেইদিনই আপনাকে বলিয়াছি, তাহার কথা আমার বিশ্বাস হয় নাই; কেবল আপনাকে এই বিপদ্ হইতে রক্ষা করিবার জন্য দিলজান এরূপভাবে খুন স্বীকার করিয়াছে| তাহার ধারণা, আপনার দ্বারাই খুন হইয়াছে|”
মনিরুদ্দীন কহিলেন, “তাহার ধারণা যাহাই হউক-আপনার ধারণা কি?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আপনি সম্পূর্ণ নির্দ্দোষ|”
মনিরুদ্দীন জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিরূপে আপনি বুঝিতে পারিলেন, আমি সম্পূর্ণ নির্দ্দোষ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “এখন আমি প্রকৃত হত্যাকারীর সন্ধান পাইয়াছি| আমি খুব সাহস করিয়া বলিতে পারি, নিশ্চয় তিনিই সৃজানকে খুন করিয়াছেন|”
ম| কে-মুন্সী সাহেব?
দে| হাঁ-মুন্সী সাহেব নিজে|
ম| আমিও তাহাই ভাবিয়াছিলাম| তিনি সৃজানকে ইদানীং ঘৃণা করিতেন|
দে| ইহার কারণ?
ম| কারণ অনেক| দেখুন-দেবেন্দ্রবিজয় বাবু, আমি জিতেন্দ্রিয় মহাপুরুষ নই-এমন কি সাধারণ লোকের অপেক্ষাও আমার অন্তঃকরণ নীচ; কিন্তু কি করিব? আমার হৃদয় যেরূপ দুর্ব্বল-তাহাতে কোন প্রবৃত্তিকে বশে রাখা আমার সাধ্যাতীত-চেষ্টা করিয়াও তাহা পারি নাই; কেবল আমি কেন-আমার বোধ হয়, অনেকেই এরূপ প্রলোভনের হাত এড়াইতে পারে না|
দে| অবশিষ্ট জীবনটাও কি এইরূপভাবে অতিবাহিত করিবেন?
ম| না-সে ইচ্ছা আর আমার নাই| এখন হইতে যাহাতে সৎপথে চলিতে পারি, সেজন্য সর্ব্বতোভাবে চেষ্টা করিব| আমি এবার বিবাহ করিব, স্থির করিয়াছি|
দে| পাত্রী কে?
ম| দিলজান| দিলজান যে আমাকে এত ভালবাসে, তাহা আমি পূর্ব্বে জানিতাম না| যদিও আমি তাহাকে দেখিয়াও দেখিতাম না; কিন্তু সে অদ্যপি অগাধ বিশ্বাসের সহিত আমার উপরে নির্ভর করিয়া আসিতেছে; কিন্তু আমি কেবল তাহাকে প্রবঞ্চিত করিতেই চেষ্টা করিয়াছি| এমন গভীর প্রেম যাহার, তাহাকে উপেক্ষা করিয়া আমি যে কি ভয়ানক অপরাধ করিয়াছি, সেজন্য আমার মনে এখন অত্যন্ত অনুতাপ হইতেছে| যতদিন না আমি তাহাকে বিবাহ করিয়া তাহার বিষন্ন মুখে হাসি আনিতে পারি, ততদিন কিছুতেই আমার চিত্ত স্থির হইবে না|
দে| তবে আর বিলম্ব করিতেছেন কেন|
ম| দিলজান বড় পীড়িত-ঈশ্বর যদি এখন রক্ষা না করেন, হয়ত সারাজীবন এই অনুতাপ আমাকে হৃদয়ের মধ্যে পোষণ করিতে হইবে|
দে| দিলজানের কি অসুখ করিয়াছে?
ম| দিলজান এখন উন্মাদিনী-তাহার মস্তিষ্ক একেবারে বিকৃত হইয়া গিয়াছে| সেই মূর্চ্ছাভঙ্গের পর হইতেই তাহার এইরূপ শোচনীয় অবস্থা|
দে| তাই ত-দিলজানের এরূপ অবস্থা, বড়ই দুঃখের বিষয়| এখন হইতে বিধিমতে চিকিৎসা আরম্ভ করুন|
ম| হাঁ-খুব চেষ্টা করিতেছি; চিকিৎসায় কোন ফল হইতেছে না| দিলজান দিনরাত কেবল প্রলাপ বকিতেছে|
এই বলিয়া মনিরুদ্দীন ললাটে হস্তার্পণ করিয়া নিতান্ত বিষন্নভাবে মুখ নত করিয়া রহিলেন| দেবেন্দ্রবিজয় আর কিছু না বলিয়া সেখান হইতে বাহির হইয়া পড়িলেন|

৫.০৫ পঞ্চম পরিচ্ছেদ – তদন্তে

মনিরুদ্দীনের বাটী হইতে মুন্সী জোহিরুদ্দীন সাহেবের বাটী বেশি দূরে নহে| এক বাড়ীর ছাদ হইতে অপর বাড়ী বেশ দেখা যায়| দেবেন্দ্রবিজয় অনতিবিলম্বে মুন্সী সাহেবের বাটীতে গিয়া উপনীত হইলেন| দ্বার-রক্ষক ভৃত্যের মুখে শুনিলেন, মুন্সী সাহেব তখন বাটীতে নাই-প্রাতেই বাহির হইয়া গিয়াছেন|
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “জোহেরা বিবি অভী কাঁহা হৈঁ? উন্কি সাথ্ মোলাকাৎ হো সক্তা হৈঁ?”
ভৃত্য বলিল, “জী হুজুর! হো সক্তা! উন্নে অভী উকীল বাবুকে সাথ্ বৈঠকখানামে বাত্চিৎ কর্তে হৈঁ|”
দেবেন্দ্রবিজয় দ্রুতপদে দ্বিতলে উঠিয়া বৈঠকখানা ঘরের দ্বার-সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলেন| গৃহমধ্যে জোহেরা ও বৃদ্ধ উকীল হরিপ্রসন্ন বাবু| দুইজনে দুইখানি চেয়ারে বসিয়া আছেন| সম্মুখস্থ টেবিলের উপরে অনেকগুলি কাগজ পত্র ছড়ান রহিয়াছে|
দেবেন্দ্রবিজয়কে দেখিয়া জোহেরা বলিয়া উঠিল, “এই যে আপনি আসিয়াছেন, ভালই হাইয়াছে| সৃজান বিবির খুনের সম্বন্ধে আমাদের কথাবার্ত্তা হইতেছিল| ঘটনা যেরূপ দেখিতেছি, তাহাতে আপনার সাহায্য বিশেষ আবশ্যক!”
দেবেন্দ্রবিজয় একখানি চেয়ার টানিয়া বসিয়া বলিলেন, “আমার দ্বারা আপনাদিগের যতদূর সাহায্য হইতে পারে, তাহা আমি সাগ্রহে করিব| আমারই ভ্রমে মজিদ খাঁ আজ বিপদ্গ্রস্ত; যাহাতে এখন তাঁহাকে উদ্ধার করিতে পারি, সেজন্য আমি সর্ব্বতোভাবে চেষ্টা করিব| তাঁহার এই বিপদে আমি যথেষ্ট অনুতপ্ত|”
হরিপ্রসন্নবাবু বলিলেন, “আপনি আপনার কর্ত্তব্য কর্ম করিয়াছেন, ইহাতে আর অনুতাপ কি? মজিদের বিরুদ্ধে যে সকল অকাট্য প্রমাণ পাওয়া গিয়াছিল, তাহাতে আপনি কেন-সকলেই তাহাকে দোষী স্থির করিয়াছিল| এখন আবার মুন্সী সাহেবের বিরুদ্ধে যে সকল প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে-”
বাধা দিয়া দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “খুবই অকাট্য| মনিরুদ্দীন ও মজিদ খাঁ উভয়েই মুন্সী সাহেবকে তাঁহার পত্নীর অনুসরণ করিতে দেখিয়াছেন| বিশেষতঃ মজিদ খাঁ তাহাকে সৃজান বিবির গলা হইতে কণ্ঠহার ছিনাইয়া লইতে দেখিয়াছেন| ঘটনা খুব সত্য-তথাপি আমাদিগকে এ সম্বন্ধে দুই-একটা প্রমাণ সংগ্রহ করিতে হইবে| এখন আমাদিগকে সন্ধান করিয়া দেখিতে হইবে, মুন্সী সাহেব তাঁহার স্ত্রীর গলদেশ হইতে যে কণ্ঠহার ছিনাইয়া লইয়াছেন, কোথায় তাহা রাখিয়াছেন; তাহার পর যে বিষাক্ত ছুরিতে সৃজান বিবিকে হত্যা করিয়াছেন, তাহাও সন্ধান করিয়া বাহির করিবার চেষ্টা করিতে হইবে| সেই উদ্দেশ্যেই আমি তাঁহার সহিত দেখা করিতে আসিয়াছি|”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “কি আশ্চর্য্য! আপনি কি মনে করেন, খুনের এমন ভয়ানক প্রমাণগুলি তিনি নিজের সর্ব্বনাশ করিবার জন্য-এখনও নিজের কাছে রাখিয়াছেন? আমার ত ইহা বিশ্বাস হয় না|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “বিশ্বাস না হইবার কোন কারণ নাই| এই হত্যাপরাধটা যে তাঁহার স্কন্ধে পড়িবে, এমন সম্ভাবনা তাঁহার মনে একবারও হয় নাই-দৈবাৎ মনিরুদ্দীন ও মজিদ খাঁ অলক্ষ্যে তাঁহাকে সেইদিন মেহেদী-বাগানে দেখিয়াছেন-এইমাত্র| নিজে তিনি তাহাও জানেন না| তা’ যাহাই হউক, যদি তিনি ছুরিখানি না রাখিতে পারেন, কিন্তু সেই কণ্ঠহার – কণ্ঠহার নিশ্চয়ই তিনি কোনখানে লুকাইয়া রাখিয়াছেন|”
জোহেরা জিজ্ঞাসা করিল, “তাহার কারণ কি?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “কণ্ঠহার লইয়া যে ভবিষ্যতে একটা গোলযোগ উপস্থিত হইবে, ইহা মুন্সী সাহেবের স্বপ্নাতীত| কে বিশেষ লক্ষ্য করিয়া দেখিতে গিয়ছে যে, সৃজান বিবি সেদিন রাত্রিতে কণ্ঠহার পরিয়া বাহির হইয়াছিল কি না?”
জোহেরা বলিল, “তিনি দিনরাত্রি সেই কণ্ঠহার পরিতেন| আমি তাঁহাকে সর্ব্বদাই সেই কণ্ঠহার গলায় রাখিতে দেখিয়াছি|”
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “কণ্ঠহার ছড়াটা কিরূপ দেখিতে?”
জোহেরা বলিল, “সাবেক ধরণের; আজ-কাল সে রকম ধরণের কণ্ঠহার বড় একটা দেখিতে পাওয়া যায় না| বড় বড় হীরা-মুক্তা দিয়া পরিপাটী সাজান – দামও অনেক হইবে; মাঝখানে একখানা হীরার খুব বড় ধুক্ধুকী|”
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “অনুমান করিয়া আপনি বলিতে পারেন, মুন্সী সাহেব এখন সেই কণ্ঠহার কোথায় রাখিয়াছেন?”
জোহেরা কহিল, “কোথায় তিনি রাখিয়াছেন, তিনিই জানেন; আমি কিরূপে বলিব? হয় ত নিজের শোবার ঘরে রাখিয়া থাকিবেন-কি এখানেও তিনি রাখিতে পারেন|”
দেবেন্দ্রবিজয় ও হরিপ্রসন্ন বাবু চমকিতভাবে বলিয়া উঠিলেন, “এখানে!”
জোহেরা বলিল, “হাঁ, এখানেও তিনি সেই কণ্ঠহার রাখিতে পারেন-এই ঘরেই তিনি সদাসর্ব্বদা বসেন| তাঁহার দলিল-দস্তাবেজ, জমিদারীর কাগজ-পত্র সকলেই এই দেরাজে রাখিয়া থাকেন; তাঁহার সেই সকল দরকারী কাগজ-পত্র কেহ হাত দিতে যাইবে না, মনে করিয়া তিনি ইহারই একটা টানার মধ্যে সেই কণ্ঠহার ছড়াটাও হয়ত রাখিয়াছেন|”
জোহেরা যে দেরাজটি তাঁহাদিগকে দেখাইয়া দিল, তেমন সুন্দর গঠনের প্রকাণ্ড দেরাজ এখন বড়-একটা দেখিতে পাওয়া যায় না-দৈর্ঘ্যে প্রায় ছাদতলস্পর্শী| উপর হইতে নীচ পর্য্যন্ত ছোট বড় অনেকগুলি ড্রয়ারে পরিশোভিত| এবং প্রত্যেক ড্রয়ারে দুইটি করিয়া উজ্জ্বল স্ফটিক-গোলক সংলগ্ন রহিয়াছে|

৫.০৬ ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – কণ্ঠহার

দেবেন্দ্রবিজয় চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া গিয়া সোৎসাহে ড্রয়ারগুলি টানিয়া দেখিতে লাগিলেন; সকলগুলিই চাবি-বন্ধ-একটাও খুলিতে পারিলেন না| তখন দেবেন্দ্রবিজয় একান্ত হতাশভাবে নিজের চেয়ারে বসিয়া বলিলেন, “না-সুবিধা হইল না দেখিতেছি, সকলগুলিই চাবি দেওয়া| তালা ভাঙ্গিয়া খানা-তল্লাসী করিবার অধিকার এখন আমার নাই|”
জোহেরা বলিল, “সে অধিকার থাকিলেও আপনি এ দেরাজ হইতে সেই কণ্ঠহার বাহির করিতে পারিবেন না| ইহাতে এমন একটি গুপ্তস্থান, তাহা কেহই জানে না, অথচ সেই গুপ্তস্থান বিনা চাবির সাহায্যে খুলিতে পারা যায়| যদি মুন্সী সাহেব কণ্ঠহার গোপন করিতে ইচ্ছা করিয়া থাকেন, খুব সম্ভব-সেই গুপ্তস্থানে রাখিয়া দিয়াছেন|”
তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দেরাজের আপনাদমস্তক নিরীক্ষণ করিতে করিতে দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “এই দেরাজে এমন একটা গুপ্তস্থান আছে না কি?”
জোহেরা কহিল, “হাঁ, আমি একদিন সৃজান বিবির কাছে এই দেরাজের সুখ্যাতি শুনিয়াছিলাম| কথায় কথায় সৃজান বিবি সেই গুপ্তস্থানের কথা বলিয়া ফেলিলেন| সে গুপ্তস্থানের কথা বাড়ীর আর কেহই জানে না; এমন কি নিজে মুন্সী সাহেবও জানেন না| এ দেরাজটি সৃজান বিবির পিতার ছিল| কন্যার বিবাহের সময়ে তিনি কন্যাকে এই দেরাজটি পাঠাইয়া দিয়াছিলেন|”
হরিপ্রসন্ন বাবু কহিলেন, “সে গুপ্তস্থান কোথায়?”
জোহেরা কহিল, “তাহা আমি জানি না| সে গুপ্তস্থান কোথায়, কিরূপভাবে খুলিতে হয়, সে সম্বন্ধে সৃজান বিবি আমাকে কিছুতেই বলেন নাই| এই দেরাজের মধ্যে এমন একটা গুপ্তস্থান আছে, কেবল এই কথাই বলিয়াছেন|”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “তুমি নিজে অন্য কোন সময়ে সৃজান বিবির অসাক্ষাতে সেই গুপ্তস্থান খুঁজিয়া বাহির করিবার চেষ্টা করিয়াছিলে?”
জোহেরা কহিল, “হাঁ, দুই-তিন দিন করিয়াছিলাম; স্ত্রীলোকের মনে কৌতূহলের প্রভাব বড় বেশি; কিন্তু চেষ্টা সফল হয় নাই|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “ভাল আমি একবার চেষ্টা করিয়া দেখি; সেই গুপ্তস্থানের কথাটা যদি মিথ্যা না হয়, আমি ঠিক সন্ধান করিয়া বাহির করিব|” বলিয়া আসন ত্যাগ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন|
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “বৃথা পরিশ্রমের ফল কি, দেবেন্দ্র বাবু? যদি আপনি সন্ধান করিয়া বাহির করিতে পারেন, তাহাতে বিশেষ কি ফল হইবে? জোহেরা মুখেই ত শুনিলেন, এই সৃজান বিবি ছাড়া মুন্সী সাহেবও সে গুপ্তস্থানের কথা জানেন না-তাহা হইলে তিনি কিরূপে সেখানে সেই কণ্ঠহার রাখিবেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “পূর্ব্বে-বোধ হয়, মুন্সী সাহেব সে গুপ্তস্থানের কথা জানিতেন না; সম্ভব, পরে তিনি কোন রকমে জানিতে পারেন| একবার চেষ্টা করিয়া দেখিতে দোষ কি আছে? হয় ত সেই গুপ্তস্থানে এই সকল ড্রয়ার খুলিবার চাবি পাওয়া যাইতে পারে|”
দেবেন্দ্রবিজয় উঠিয়া দেরাজটির চারিদিক্ বিশেষ মনোযোগের সহিত দেখিতে লাগিলেন| সেই গুপ্তস্থান আবিষ্কারের কোন সুযোগ দেখিতে পাইলেন না| দেরাজের উপরে কাঠের উদ্ভিন্ন ফুললতামোড়ের অনেক কারুকার্য্য ছিল| পরিশেষে দেবেন্দ্রবিজয় সেইগুলি পরীক্ষা করিয়া দেখিতে আরম্ভ করিলেন| একস্থানে দেখিলেন, সেই সকল কাঠের ফুললতার মধ্যে একটা ফুল কিছু মলিন, বারংবার হাত লাগিলে পালিসের ঔজ্জ্বল্যের যেরূপ হ্রাস হয়, এবং একটা দাগ পড়িয়া যায়, সেই ফুলটিতে ঠিক সেই রকমের একটা দাগ পড়িয়া গিয়াছিল| দেখিয়া দেবেন্দ্রবিজয় মনে আশার সঞ্চার হইল| তিনি সেই কাঠের ফুলটি ঘুরাইয়া, ফিরাইয়া, টিপিয়া টানিয়া অনেক রকমে পরীক্ষা করিয়া দেখিতে লাগিলেন| কিছুতেই সেটা একটু সরিল না-নড়িল না| তথাপি তিনি হতাশ হইলেন না, সেই ফুলটি লইয়া তিনি ক্রমাগত নাড়াচাড়া করিতে লাগিলেন| বারংবার এইরূপ করিতে হঠাৎ একটা ‘ক্রিং’ শব্দ হইল; এবং সেই সঙ্গে সেই ফুলের পার্শ্বসংলগ্ন একটা কাঠের পাতা উল্টাইয়া ঝুলিয়া পড়িল; সেখানে একটি রূপার ছোট হাতল রহিয়াছে| দেখিয়া বুঝিতে পারিলেন, তাঁহার চেষ্টা সফল হইয়াছে-সেই হাতল ধরিয়া ধীরে ধীরে টানিতে লাগিলেন-নিঃশব্দে একটি ক্ষুদ্র ড্রয়ার বাহির হইল| দেবেন্দ্রবিজয় বিস্ময়ব্যাকুলনেত্রে দেখিলেন, সে ড্রয়ারের মধ্যে একছড়া হীরামুক্তাখচিত কণ্ঠহার-আরও একটা তীক্ষ্ণমুখ তীরের ফলা পড়িয়া রহিয়াছে| তা’ ছাড়া আর কিছুই নাই|

 ৫.০৭ সপ্তম পরিচ্ছেদ – মেঘ-ঘনীভূত

গুপ্ত-ড্রয়ারের ভিতর হইতে সেই কণ্ঠহার বাহির হইতে দেখিয়া জোহেরার মুখে কথা নাই-হরিপ্রসন্ন বাবুর মুখেও কথা নাই-দেবেন্দ্রবিজয়ও বিস্ময়-স্তম্ভিত| সর্ব্বপ্রথমে দেবেন্দ্রবিজয় নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিলেন| জোহেরাকে বলিলেন, “দেখুন দেখি, সেই সেই কণ্ঠহার কি না; আপনি যেরূপ বর্ণনা করিয়াছিলেন, তাহাতে ইহা যে সেই সৃজান বিবির কণ্ঠহার, দেখিয়া বেশ বুঝা যাইতেছে; এই যে মাঝখানে হীরার একখানা বড় ধুক্ধুকিও রহিয়াছে|”
জোহেরা কম্পিতকণ্ঠে কহিল, “হাঁ, এই সেই কণ্ঠহার; কিন্তু-কিন্তু-এ তীরের ফলা-ইহা ত কখনও আমি দেখি নাই|” বলিয়া জোহেরা তাহা ড্রয়ারের মধ্য হইতে তুলিয়া লইল|
জোহেরার হাত হইতে সেই তীরের ফলা লইয়া উকীল হরিপ্রসন্ন বাবু উল্টাইয়া দেখিতে লাগিলেন, “তাই ত এ তীরের ফলা কোথা হইতে আসিল? খুব ধারাল দেখিতেছি|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “খুব সাবধান, হরিপ্রসন্ন বাবু! ধার পরীক্ষা করিতে চেষ্টা করিবেন না| এখনই বিপদ্ ঘটিয়া যাইবে – বড় সাংঘতিক – দেখিতেছেন না, ইহা বিষাক্ত?”
“বিষাক্ত!’ বলিয়া সভয়ে হরিপ্রসন্ন বাবু সেই তীরের ফলাটা ড্রয়ারের মধ্যে ফেলিয়া দিলেন| বলিলেন, “কিরূপে আপনি বুঝিতে পারিলেন, ইহা বিষাক্ত?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “নিশ্চয়ই বিষাক্ত! পূর্ব্বে আমাদের ভুল হইয়াছিল; সেই ছুরিতে সৃজান বিবি খুন হয় নাই| আমি এখন ঠিক বুঝিতে পারিতেছি, এই তীরের ফলা দিয়া সৃজান বিবিকে খুন করা হইয়াছে|”
জোহেরা হতাশভাবে বলিল, “মহাশয়, তবে কি আপনি এখন মুন্সী সাহেবকেই দোষী স্থির করিতেছেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হাঁ, নিজের পত্নীর অসচ্চরিত্রতার কথা তাঁহার অনবগত ছিল না| সৃজান বিবি মনিরুদ্দীনের সঙ্গে গৃহত্যাগ করিবার যে বন্দোবস্ত করিয়াছিল, তাহাও তিনি সেদিন কোন রকমে জানিতে পারিয়া থাকিবেন| সেই খুনের রাত্রিতে তিনি যে গোপনে স্ত্রীর অনুসরণ করিয়া মেহেদী-বাগানের দিকে গিয়াছিলেন. তাহা মনিরুদ্দীন দেখিয়াছিলেন| আর একজন – মজিদ খাঁ, তিনিও মুন্সী সাহেবকে পথের ধারে একটা আলোক-স্তম্ভের নীচে দাঁড়াইয়া সৃজান বিবির সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডা করিতে করিতে তাহার গলদেশ হইতে একছড়া কণ্ঠহার ছিনাইয়া লইতে দেখিয়াছেন| তখনই সৃজান বিবি মেহেদী-বাগানের দিকে ছুটিয়া পালাইয়া যায়-মুন্সী সাহেবও তাহার অনুসরণ করেন| তাহার পর যখন সেই মেহেদী-বাগানে সৃজান বিবির লাস পাওয়া যাইতেছে, তখন মুন্সী সাহেবই দোষী| বিশেষতঃ মুন্সী সাহেব ভিন্ন আর কেহই এ গুপ্ত ড্রয়ারের বিষয় জানে না, আর সৃজান বিবি যদিও জানিত, সে এখন জীবিত নাই; অথচ যখন এই ড্রয়ারের মধ্যে সৃজান বিবির খুনের প্রধান নিদর্শন স্বরূপ এই কণ্ঠহার আর তীরের ফলা পাওয়া যাইতেছে, তখন মুন্সী সাহেবই ইহা এইখানে লুকাইয়া রাখিয়াছেন| নিশ্চয়ই তিনি স্ত্রীহন্তা!”
হরিপ্রসন্ন বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখন আপনি কি করিবেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “এখন এই কণ্ঠহার আর তীরের ফলা গুপ্ত-ড্রয়ারের ভিতরেই রাখিয়া দিয়া মুন্সী সাহেবের অপেক্ষায় বসিয়া থাকিব| তিনি আসিলে প্রথমতঃ তাঁহাকে খুন সম্বন্ধে যাহা জিজ্ঞাসা করিবার, তাহা করিব| অবশ্যই তিনি অস্বীকার করিবেন; তখন এইগুলি সহসা তাঁহার চোখের সাম্নে ধরিয়া দিলে তিনি মহা গোলমালে পড়িয়া আত্মদোষক্ষালনের কোন উপায়ই পাইবেন না|”
জোহেরা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া মুখ নত করিল| জোহেরা বুঝিল, তাহার আর এক নূতন বিপদ্ উপস্থিত! এক্ষণে ঘটনা যেরূপ দাঁড়াইতেছে, তাহাতে মজিদ খাঁ মুক্তি পাইবেন বটে; কিন্তু তাহার অভিভাবক মুন্সী সাহেবের বিপদ্ বড়ই গুরুতর হইয়া উঠিতেছে| জোহেরা মনে অত্যন্ত ব্যথা লাগিল| বলিল, “যদি সৃজান বিবির স্বভাব ভাল হইত, তাহা হইলে আমাদের আজ এমন সর্ব্বনাশ হইত না!”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “সকলের স্বভাব যদি ভাল হইত, তাহা হইলে আমাদের কাজ চলে কৈ? হাত-পা গুটাইয়া বেকার বসিয়া থাকিতে হয়|”
অনন্তর দেবেন্দ্রবিজয় এই গুপ্ত-ড্রয়ারটা কিরূপে খোলা ও বন্ধ করা যায়, পরীক্ষা করিয়া দেখিয়া তন্মধ্যে হীরার কণ্ঠহার ও বিষাক্ত তীরের ফলাটা রাখিয়া বন্ধ করিয়া দিলেন|
এমন সময়ে বাহিরের সোপানে কাহার পদশব্দ হইল| পরে কণ্ঠস্বরও শুনা গেল| স্বর শুনিয়া জোহেরা বুঝিতে পারিল, মোবারক| বলিল, “মোবারক বিবাহের প্রস্তাব লইয়া মুন্সী সাহেবের সহিত দেখা করিতে আসিতেছেন; বোধ হয়, এই ঘরেই আসিবেন| আমি তাঁহার সহিত দেখা করিতে চহি না – আপনারা বসুন – আমি বাড়ীর ভিতরে যাই|” বলিয়া জোহেরা গমনোদ্যতভাবে ফিরিয়া দাঁড়াইল|
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তাই ত, এমন সময়ে আবার মোবারক আসিয়া উপস্থিত| আমি মুন্সী সাহেবের সঙ্গে একাকী দেখা করিব মনে করিয়াছিলাম| আমারও এখন একবার অন্য একটা ঘরে গিয়া বসিলে সুবিধা হয়|”
জোহেরা বলিল, “এই পাশের ঘরে আপনারা উভয়ে বসিতে পারেন| মোবারক চলিয়া গেলে আপনারা মুন্সী সাহেবের সঙ্গে দেখা করিবেন|” এই বলিয়া জোহেরা পার্শ্ববর্ত্তী কক্ষের-দ্বার সম্মুখস্থ পর্দ্দাখানা সরাইয়া দিল| সকলে পার্শ্ববর্ত্তী প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিলে জোহেরা ভিতরে গিয়া পর্দ্দা টানিয়া দিল|

৫.০৮ অষ্টম পরিচ্ছেদ – মহা বিপদ্

ক্ষণপরে হাস্যপ্রফুল্ল মুখে মোবারক-উদ্দীন সেই বৈঠকখানা ঘরে প্রবেশ করিলেন; কিন্তু তথায় কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না| তাঁহার মুখমণ্ডল সহসা অপ্রসন্নভাব ধারণ করিল| য়ে ভৃত্য তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া উপরে আনিয়াছিল, সে ঘরের বাহিরে দ্বার-সম্মুখে দাঁড়াইয়াছিল| মোবারক-উদ্দীন তাহাকে রুক্ষকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুম্নে অভী বোলা কি জোহেরা বিবি উপর্কা বৈঠকনামে বৈঠৈ হৈঁ; পর বে কাঁহা হৈঁ?”
থতমত খাইয়া বৃত্য বলিল, “খোদাবন্দ! বিবি সাহব্ নে ইস ঘর্মে থী, ঔর উন্কে সাথ্ ঔর দো রইসোঁ ভি থা-”
বাধা দিয়া মোবারক বলিলেন, “কুল দো রইসোঁ| আব্ তো বহুৎ রইসোঁকা আমদানী হোগা| জানে দেও ইস্ বাত্ কো, অব্ জোহেরা বিবি কাঁহা হৈঁ?”
ভৃত্য বলিল, “হুজুর মেরে সমঝ্মে উননে অন্দরমে গয়া হোগা| কহিয়ে তো উন্কো খবর দেঁ|”
মোবারক একখানা চেয়ার টানিয়া বসিয়া, একটা জৃম্ভণ ত্যাগ করিয়া বলিলেন, “ন্যহি, অভী কুছ্ জরুরৎ ন্যহি হৈ; বাদ্ উন্সে মোলাকাৎ করুঙ্গা| অব্ মুন্সী সাহব্কে সাথ্ একদফে মোলাকাৎ কর্না চাহিয়ে| যবতক্ মুন্সী সাহেব না আবে, তবতক্ হমে ইস্ জায়গা হাজির রহ্না হোগা!”
ভৃত্য একটা সেলাম করিয়া চলিয়া গেল| অনতিবিলম্বে ধীরে ধীরে সাহেব সেই কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিলেন| তাঁহার মুখভাব মলিন, চক্ষু কালিমালেপিত, মাথার চুলগুলাও বড় বিশৃঙ্খল|
তাঁহাকে আসিতে দেখিয়া মোবারক দ্বারপার্শ্বে সরিয়া দাঁড়াইলেন| এবং উন্মুক্ত দ্বার ভিতর হইতে চাপিয়া দিয়া বলিলেন, “এই যে আপনি খুব শীঘ্র আসিয়াছেন| আমি মনে করিতেছিলাম, আপনার জন্য কতক্ষণই না আমাকে এখানে বসিয়া অপেক্ষা হইবে|”
মুন্সী সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমাকে আপনার কি প্রয়োজন?”
মোবারক পুনরায় নিজের আসন গ্রহণ করিয়া বলিলেন, “বিশেষ প্রয়োজন আছে|”
মুন্সী সাহেব ভ্রুযুগ ললাটে তুলিয়া বলিলেন, “ব্যাপরটা কি?”
মো| ব্যাপারটা-বিবাহ|
মু| কাহার বিবাহ?
মো| আমার|
মু| তা’ আমার কাছে কেন?
মো| আপনার মত না হইলে হইবে না| আমি জোহেরা বিবিকে বিবাহ করিতে চাই|
মু| (চমকিত ভাবে) অসম্ভব! কিছুতেই তাহা হইবে না|
মো| না হইবার কারণ? আমি নীচবংশীয় নই – অর্থোপার্জ্জনে সক্ষম – বাহিরে আমার মান-সম্ভ্রম যথেষ্ট|
মু| (ঘৃণাভরে) কিন্তু চরিত্র সম্বন্ধে?
মো| (সহাস্যে) মন্দ কি? তবে এরূপ বয়সে সকলেরই যেরূপ একটু-আধটু চরিত্র-দোষ ঘটে, আমারও তাহাই জানিবেন-তাহার বেশি কিছু পাইবেন না| আপনি কি বিবাহে আপত্তি করিবেন?
মু| নিশ্চয়ই|
মো| কেন?
মু| প্রথমতঃ-জোহেরা মজিদ খাঁকে বিবাহ করিতে স্থিরসঙ্কল্প|
মো| (ঘৃণাভরে) মজ্জিদ খাঁকে-কি আশ্চর্য্য! হত্যাপরাধে যে লোক জেলে পচিতেছে-অনতিবিলম্বে ফাঁসী-কাঠে ঝুলিবে – তাহাকে বিবাহ!
মু| হত্যাপরাধ হইতে সে শীঘ্র নির্দ্দোষ প্রতিপন্ন হইবে|
মো| কিরূপে?
মু| (বিরক্তভাবে) সে কথায় এখন দরকার কি?
মোবারক কঠিন হাস্যের সহিত বলিলেন, “এই আপনার প্রথম আপত্তি| দ্বিতীয়টা কি শুনি?”
মুন্সী সাহেব কিছু না বলিয়া পকেট হইতে চাবি বাহির করিয়া সেই প্রকাণ্ড দেরাজের একটা ড্রয়ার টানিয়া খুলিয়া ফেলিলেন| এবং তন্মধ্য হইতে গোলাপী রঙের ফিতে-বাঁধা একতাড়া পত্র বাহির করিয়া সশব্দে টেবিলের উপরে ফেলিয়া দিয়া, সেই তাড়ার প্রতি অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিয়া বলিলেন, “এগুলি কি, বলিয়া দিতে হইবে কি?”
পত্রগুলি দেখিয়া মোবারকের মুখ একেবারে অন্ধকার হইয়া গেল| অর্দ্ধোত্থিত হইয়া টেবিলের উপরে ঝুঁকিয়া পড়িয়া জিজ্ঞাসা করিল, “ইহা আপনি কোথায় পাইলেন?”
মুন্সী সাহেব বলিলেন, “এই দেরাজের একটা গুপ্ত-ড্রয়ারের মধ্যে এই চিঠিগুলি পাওয়া গিয়াছে| এই গুপ্ত-ড্রয়ারের বিষয় কেহ কিছু জানে না, মনে করিয়া আমার স্ত্রী এই চিঠিগুলা এইখানেই লুকাইয়া রাখিয়াছিল; কিন্তু তাহার পিতা যখন এই দেরাজটী দেন্, তখনই তিনি এই গুপ্ত-ড্রয়ারের কথা আমাকে বলিয়া দিয়াছিলেন| তাহা আমার স্ত্রী জানিত না| একদিন কি খেয়াল হইল, ঐ গুপ্ত-ড্রয়ার খুলিয়া এই চিঠিগুলা দেখিতে পাইলাম|”
শুষ্কহাসি হাসিয়া মোবারক বলিল, “কিসের চিঠি এ সব?”
কঠিনকণ্ঠে মুন্সী সাহেব বলিলেন, “কিসের চিঠি তাহা আবার তোমাকে বুঝাইয়া বলিয়া দিতে হইবে? তুমি এই সকল চিঠি আমার স্ত্রীকে লিখিয়াছিলে-এখন একেবারে আকাশ হইতে পড়িয়া কোন ফল নাই|”
মোবারক বলিল, “এই সকল চিঠি আমার লেখা, আমি তাহা স্বীকার করিতেছি; কিন্তু আপনার স্ত্রীকে আমি লিখি নাই-সৃজানকে লিখিয়াছিলাম, তখন আপনার সহিত তাহার বিবাহই হয় নাই| ইহার জন্য আপনি আমার উপরে অন্যায় রাগ করিতেছেন| ইহাতে আমার এমন বিশেষ কি অপরাধ দেখিলেন?”
উঠিয়া ক্রোধে কম্পিতস্বরে মুন্সী সাহেব কহিলেন, “বেত্মিজ, তোমার পরম সৌভাগ্য যে এখনও আমি তোমার রক্ত-দর্শন করি নাই| আমার স্ত্রীর স্বভাব ভাল ছিল না বলিয়াই, আমি ততটা করি নাই; নতুবা তুমি এখন যেখানে বসিয়া আছ, এতক্ষণ ঐখানে তোমার মৃতদেহ লুটাইয়া পড়িত| বেয়াদব্ বেইমান্, কোন সাহসে তুমি জোহেরাকে বিবাহ করিতে চাও? তোমার মত বদ্মাইসের সহিত আমি জোহেরার বিবাহ দিব-এ কথা মনেও স্থান দিয়ো না|”
মোবারক টেবিলের উপরে সজোরে একটা চপেটাঘাত করিয়া বলিল, “নিশ্চয়ই আপনি আমার সহিত জোহেরার বিবাহ দেবেন| বিশেষ একটা কারণে আপনাকে বাধ্য হইয়া জোহেরা-রত্ন আমার হাতে সমর্পণ করিতেই হইবে|”
মুন্সী সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিশেষ কারণটা কি শুনি?”
মোবারক বিরক্তভাবে বলিল, “আমার মুখে কি শুনিবেন? আপনি নিজে কি তাহা জানেন না?”
মুন্সী সাহেব বলিলেন, “কই, আমি কিছুই জানি না-তোমার কথা আমি বুঝিতে পারিতেছি না|”
মোবারক বলিল, “এবার পুলিসের লোক তদন্তে আসিলে আমি তাহাদিগকে বলিতে পারিব, সৃজান বিবির হত্যাকারী – সৃজান বিবিরই স্বামী – স্বয়ং মুন্সী সাহেব|”
মুন্সী সাহেব মহা রাগিয়া উঠিয়া কহিলেন, “কি ভয়ানক! তুমি মনে করিয়াছ, আমি আমার স্ত্রীকে খুন করিয়াছি?”
মনে করিয়াছি কি, “টেবিলের উপরে মোবারক পুনরপি সশব্দে আর একটা চপেটাঘাত করিল| বলিল, “আমি নিশ্চয়ই জানি, আপনি আপনার স্ত্রীর হত্যাকারী – ইহা আমি শপথ করিয়াই বলিতে পারি| যদি আপনি আমার সহিত জোহেরার বিবাহ দিতে সম্মত না হন্, তাহা হইলে আমি সকলের নিকটে এ কথা প্রকাশ করিয়া দিতেও কুণ্ঠিত হইব না|”
রাগিয়া, বিবর্ণ হইয়া মুন্সী সাহেব বলিলেন, “কি ভয়ানক মিথ্যাকথা! আমি যে আমার স্ত্রীকে হত্যা করিয়াছি, তাহার প্রমাণ কোথায়?”
মোবারক বলিল, “প্রমাণ আপনার গুপ্ত-ড্রয়ার মধ্যেই আছে-আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়া কেন কষ্ট পাইতেছেন?”
উন্মেত্তের ন্যায় সবেগে মুন্সী সাহেব দেরাজের কাছে ছুটিয়া গেলেন| দ্রুতহস্তে গুপ্ত-ড্রয়ারটা খুলিয়া ফেলিলেন| খুলিয়া সেই গুপ্ত-ড্রয়ার মধ্যে তাঁহার স্ত্রীর সেই কণ্ঠহার এবং একটা তীরের ফলা দেখিতে পাইলেন| তাঁহার বিবর্ণ মুখ আরও বিবর্ণ হইয়া গেল| এবং মোবারক তাঁহার বিবর্ণ মুখের দিকে চাহিয়া চোখে-মুখে পরিহাসের মৃদু হাসি হাসিতে লাগিল|
পার্শ্ববর্ত্তী গৃহের দ্বারপার্শ্বে রুদ্ধশ্বাসে উৎকর্ণ হইয়া দাঁড়াইয়া উকীল হরিপ্রসন্ন বাবু, ডিটেক্টিভ ইন্স্পেক্টর দেবেন্দ্রবিজয় ও জোহেরা এতক্ষণে তাহাদিগের নেপথ্যবর্ত্তী এই ভয়ানক অভিনয়ের বক্তৃতাবলী শ্রবণ করিতেছিলেন| রহস্য ক্রমশঃ ভেদ হইতে দেখিয়া সমস্ত কথাগুলি শুনিবার জন্য তাঁহারা সেখানে উদ্বিগ্নহৃদয়ে নীরবে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন|
মোবারক মুন্সী সাহেবের নিকটস্থ হইয়া সেই গুপ্ত-ড্রয়ার মধ্যে অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিয়া অত্যন্ত পরুষকণ্ঠে কহিল, “এখন প্রমাণ দেখিতে পাইলেন ত? এই কণ্ঠহার আপনি খুনের রাত্রিতে সৃজান বিবির গলদেশ হইতে জোর করিয়া ছিনাইয়া লইয়াছিলেন, মনে পড়ে, এই বিষাক্ত তীরের ফলা দিয়া সৃজানকে আপনি স্বহস্তে খুন করিয়াছিলেন? এই দেখুন, সেটাও এই পড়িয়া রহিয়াছে|”
মুন্সী সাহেব একান্ত শূন্যদৃষ্টিতে সেই কণ্ঠহার ও তীরের ফলাটার দিকে চাহিয়া রহিলেন| তাঁহার আপাদমস্তক কাঁপিতেছিল-আরও কাঁপিতে লাগিল| সহসা তাঁহার মুখ দিয়া কোন কথা বাহির হইল না|

৫.০৯ নবম পরিচ্ছেদ – ধরা পড়িল

ক্ষণপরে কিছু প্রকৃতিস্থ হইয়া, মুন্সী সাহেব বিস্ময়বিক্ষুব্ধকণ্ঠে চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলেন, “এ ভয়ানক ষড়যন্ত্র! এই কণ্ঠহার-হাঁ এই কণ্ঠহার আমি রাখিয়াছি বটে-কিন্তু এ তীরের ফলা কোথা হইতে আসিল? আমি ত ইহার কিছুই জানি না|”
সপরিহাসে মোবারক কহিল, “এখন ত আপনি ইহাই বলিবেন, কিন্তু ‘জানি না’ বলিলে কি লোকে এখন আপনার কথা বিশ্বাস করিবে? বিশেষতঃ আপনার ড্রয়ার হইতেই যখন এই সকল জিনিষ পাওয়া যাইতেছে, তখন আর ‘জানি না’ বলা যে একান্ত বিড়ম্বনা!”
মহা গরম হইয়া মুন্সী সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি এ গুপ্ত ড্রয়ারের কথা কিরূপে জানিলে?”
মোবারক কহিল, “কই গুপ্ত-ড্রয়ার সম্বন্ধে আমি ত আপনাকে কোন কথাই বলি নাই|”
মুন্সী সাহেব আরও গরম হইয়া কহিলেন, “মিথ্যাবাদী-তুমি নিশ্চয়ই এই গুপ্ত-ড্রয়ারের বিষয় অবগত আছ, তুমি এই গুপ্ত-ড্রয়ারের ভিতরে কি আছে কি না, কিরূপে জানিলে? আমি এখন বেশ বুঝিতে পারিতেছি, এই তীরের ফলা তুমিই এখানে রাখিয়াছ|”
মোবারক হটিবার পাত্র নহে| কঠিন পরিহাসের সহিত কহিল, “তাই না কি! এ তীরের ফলা আমি কোথায় পাইব? মুন্সী সাহেব, এ বৃদ্ধ বয়সে একজন নির্দ্দোষীর স্কন্ধে নিজের হত্যাপরাধটা চাপাইতে চেষ্টা করিবেন না | চেষ্টা করিয়াও বিশেষ কিছু ফল হইবে না-আপনার পাপের ফল, একা আপনাকেই ভোগ করিতে হইবে|”
মুন্সী সাহেব অত্যন্ত ব্যাকুলভাবে বলিলেন, “আমি খুন করি নাই-কে খুন করিয়াছে, তাহাও জানি না| আমার স্ত্রী গৃহত্যাগের সঙ্কল্প করিয়াছিল, তাহা আমি জানিতাম, স্বীকার করি| সেই খুনের রাত্রিতে আমি গোপনে আমার স্ত্রীর অনুসরণও করিয়াছিলাম| মনিরুদ্দীনের বাড়ী হইতে আমার স্ত্রী বাহির হইয়া আসিলে আমিই তাহার নিকট হইতে এই কণ্ঠহার জোর করিয়া কাড়িয়া লইয়াছি| সে তখনই ভয় পাইয়া মেহেদী-বাগানের দিকে ছুটিয়া চলিয়া যায়| আমিও তাহার অনুসরণ করি; কিন্তু কিছুদূর গিয়া অন্ধকারে তাহাকে দেখিতে পাই নাই| ইহা ছাড়া সেদিনকার রাত্রির খবর আমি আর কিছুই জানি না| পরদিন প্রাতে শুনিলাম, মেহেদী-বাগানে একটা স্ত্রীলোক খুন হইয়া পড়িয়া আছে|”
মোবারক জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি কি তখন বুঝিতে পড়িয়াছিলেন যে, মেহেদী-বাগানে যে স্ত্রীলোকের মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, তাহা আপনার স্ত্রী?”
মুন্সী সাহেব বলিলেন, “না-তখন আমি ঠিক বুঝিতে পারি নাই| মনিরুদ্দীন সেই রাত্রিতে এখান হইতে চলিয়া যাওয়ায় মনে করিয়াছিলাম, আমার স্ত্রীও তাহার সঙ্গ গ্রহণ করিয়াছে; অন্য কোন স্ত্রীলোক খুন হইয়া থাকিবে| তাহার পর যখন ফরিদপুরে গিয়া দেখিলাম, তখন বুঝিতে পারিলাম, মেহেদী-বাগানে আমার স্ত্রীই খুন হইয়াছে, কিন্তু কে খুন করিয়াছে-তাহার সম্বন্ধে আমি বিন্দু-বিসর্গ জানি না|”
চোখে মুখে পরিহাসের হাসি হাসিয়া মোবারক কহিল, “এখন ত আপনি ইহাই বলিবেন| এরূপভাবে এখন কথাটা উড়াইয়া দিবার চেষ্টা করা বুদ্ধিমানের কাজ; কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে যে অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে, তাহাতে আপনার এ কথা কে এখন বিশ্বাস করিবে?”
ভীত হইয়া মুন্সী সাহেব কহিলেন, “তাহা হইলে তুমি এখন আমাকেই হত্যাকারী বলিয়া ধরাইয়া দিতে চাও নাকি?”
মোবারক কহিল, “যদি আপনি আমার প্রস্তাবে সম্মত না হ’ন কাজেই আমাকে তাহা করিতে হইবে|”
মু| কি প্রস্তাব?
মো| পূর্ব্বেই বলিয়াছি-জোহেরাকে আমার সহিত বিবাহ দিতে হইবে|
মু| জোহেরা যদি তোমাকে বিবাহ করিতে না চায়, আমি তো তাহার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করিয়া কোন কাজ করিতে পারি না|
মো| অবশ্য আপনি তাহা পারেন-আপনি তাহার একমাত্র অভিভাবক|
মু| আমি কিছুতেই পারিব না|
মো| না পাড়েন – বিপদে পড়িবেন|
মু| কি বিপদ্?
“সহজ বিপদ্ নহে-ফাঁসী-কাঠে ঝুলিতে হইবে,” বলিয়া মোবারক অত্যন্ত কঠিনভাবে মুন্সী সাহেবের মুখের দিকে চাহিলেন| মুন্সী সাহেবও ভীতি-বিস্ফারিতনেত্রে মোবারকের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন| কাহারও মুখে কথা নাই| পার্শ্ববর্ত্তী গৃহে যাঁহারা রহস্যোদ্ভেদের অপেক্ষায় ছিলেন, মোবারকের শেষ কথায় তাঁহাদেরও হৃদয় স্তম্ভিত হইয়া গেল|
কিয়ৎক্ষণ গভীর চিন্তার পর মুন্সী সাহেবই প্রথমে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিলেন| দৃঢ়স্বরে কহিলেন, “তুমি যাহা মনে করিয়াছ, কিছুতেই তাহা হইবে না-আমি তোমার প্রস্তাব ঘৃণার সহিত অগ্রাহ্য করিলাম|”
মোবারক মুন্সী সাহেবের মুখের সম্মুখে ঘন ঘন তর্জ্জনী অঙ্গুলিটা কম্পিত করিয়া কহিল, “স্মরণে থাকে যেন, ইহার শেষ-ফল বড় ভয়ানক হইবে|”
মুন্সী সাহেব দৃঢ়স্বরে কহিলেন, “যেমনই ভয়ানক হউক না কেন, আমি সেজন্য প্রস্তুত আছি|”
মোবারক ক্ষণেক কি ভাবিল| ভাবিয়া বলিল, “আপনার মাথার উপরে এমন একটা ভয়ানক বিপদ্; তথাপি যে আপনি এমন সময়ে কেন এমন করিতেছেন, বুঝিতে পরিলাম না| আপনার মনে কি ভয় হইতেছে না? ইহার কারণ কি?”
মুন্সী সাহেব বলিলেন, “কারণ-প্রথমতঃ আমি খুন করি নাই| দ্বিতীয়তঃ এই বিষাক্ত তীরের ফলার বিষয়ে আমি কিছুই জানি না| তুমিই আমাকে বিপদে ফেলিবার জন্য ইহা এইখানে রাখিয়াছ| নিশ্চয়ই এ সকল ষড়্যন্ত্র- তোমার|”
মোবারক কহিল, “যে কারণে হউক না কেন, আপনি নির্দ্দোষ হইলেও আপনার আর রক্ষার উপায় নাই| ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি রাখিয়া কাজ করিবেন| এখন আপনাকে সকল কথা খুলিয়া বলিতে ক্ষতি কি-আপনি ত আমার হাতে| আপনাকে এই হত্যাকাণ্ডে জড়াইয়া বিপদে ফেলিবার জন্য আমিই এই তীরের ফলাটা আপনার গুপ্ত-ড্রয়ারের মধ্যে রাখিয়াছিলাম|”
সেই তীরের ফলাটা উদ্যত করিয়া মুন্সী সাহেব ক্রোধভরে মোবারকের দিকে দুই পদ অগ্রসর হইয়া বলিলেন, “বদ্বখ্ত| তবে তুমিই আমার স্ত্রীকে খুন করিয়াছ|”
হাত হইতে তীরের ফলাটা কাড়িয়া লইয়া মোবারক কহিল, “আপনার স্ত্রীকে আমি খুন করিয়াছি, এমন কথা ত আমি আপনাকে বলি নাই| প্রকৃত ব্যাপার যাহা ঘটিয়াছে, আমার কাছে এখন শুনুন, তাহার পর আপনি যাহা বলিতে হয়, বলিবেন| আপনি যখন আপনার স্ত্রীকে অনুসরণ করিয়া মেহেদী-বাগানে গিয়াছিলেন, তখন আমিও আপনাদের অনুসরণ করিয়াছিলাম| আপনার স্ত্রী যে মনিরুদ্দীনের সঙ্গে সে রাত্রিতে গৃহত্যাগ করিবার সঙ্কল্প করিয়াছিল, তাহা আমিও শুনিয়াছিলাম| ব্যাপারে কি ঘটে দেখিবার জন্য আপনার ন্যায় আমিও মনিরুদ্দীনের বাড়ীর নিকটে গোপনে অপেক্ষা করিতেছিলাম| আপনি মেহেদী-বাগানে আপনার স্ত্রীকে খুঁজিয়া না পাইয়া, ফিরিয়া আসিয়াছিলেন; কিন্তু আমার সহিত তাহার দেখা হইয়াছিল| আমি তখন তাহার নিকট হইতে এই সকল গুপ্ত-চিঠি ফেরৎ চাই; তাহাতে সে আপনার ঐ গুপ্ত-ড্রয়ারের ভিতর ঐ চিঠিগুলা পাওয়া যাইবে বলে, আর গুপ্ত-ড্রয়ার খুলিবার কৌশলও আমাকে বলিয়া দেয়| তাহার পর সেদিন আপনার সহিত দেখা করিতে আসিলাম, তখন এখানে আর কেহই ছিল না| আমি এই চিঠিগুলির জন্য আপনার গুপ্ত-ড্রয়ার খুলিয়া ফেলিলাম, কিন্তু ইহার ভিতরে চিঠি-পত্র দেখিতে পাইলাম না|”
মুন্সী সাহেব বলিলেন, “না পাইবার কথা-এই চিঠিগুলা আমি গুপ্তড্রয়ার হইতে বাহির করিয়া অন্যস্থানে রাখিয়াছিলাম|” মোবারক কহিল, “হাঁ, এখন আমি তাহা জানিতে পারিয়াছি| যাহা হউক, চিঠির পরিবর্ত্তে আমি আপনার গুপ্ত-ড্রয়রের মধ্যে এই কণ্ঠহার ছড়াটা দেখিতে পাইলাম| আমি সেদিন খুনের রাত্রিতে আপনাকে আপনার স্ত্রীর নিকট হইতে ইহা কাড়িয়া লইতে দেখিয়াছিলাম| আমার আরও সুবিধা হইল; জোহেরাকে বিবাহ করিতে হইলে আগে আপনাকে হাতে রাখা দরকার মনে করিয়া, আমিই এই বিষাক্ত তীরের ফলাটা এই কণ্ঠহারের সঙ্গে রাখিয়া দিয়াছিলাম| এখন আমার সে অভিপ্রায় সিদ্ধ হইয়াছে-আপনাকে বাধ্য হইয়া এখন আমার প্রস্তাবে সম্মত হইতে হইবে-সকল বিষয়ে আমাকে সাহায্য করিতে হইবে|”
মহা খাপ্পা হইয়া সাহেব গর্জ্জন করিয়া বলিয়া উঠিলেন, “সয়তান! তবে তুমিই আমার স্ত্রীকে খুন করিয়াছ নিশ্চয়ই-আর কেহ নহে-এখন আর অস্বীকার করিলে চলিবে না| আমি তোমার মুখ-চোখের ভাব দেখিয়া বেশ বুঝিতে পারিতেছি, তোমার দ্বারাই এই কাজ হইয়াছে| আমি এখনই তোমাকে পুলিসের হাতে ধরাইয়া দিব-ফাঁসী-কাঠে ঝুলাইয়া তবে ছাড়িব|”
মোবারক কহিল, “বাঃ! আপনি যে পাগলের মত কথা বলিতেছেন! এখন যদি আপনি আমার বিরুদ্ধে কোন কথা কাহাকেও বলেন, কেহই আপনার কথা বিশ্বাস করিবে না| লাভের মধ্যে নিজেকে আরও জড়াইয়া ফেলিবেন| যদিও আমি দোষী, কিন্তু আমার বিরুদ্ধে এমন একটাও প্রমাণ নাই, যাহাতে আপনি আমাকে খুনী সাব্যস্ত করিতে পারেন|”
আরও রাগিয়া মুন্সী সাহেব বলিলেন, “আর কোন প্রমাণের আবশ্যকতা নাই-তুমি নিজমুখে এইমাত্র খুন স্বীকার করিলে|”
মোবারক কহিল, “ইহাকে খুন স্বীকার করা বলে না-আপনার নিকটে যাহা বলিলাম, সাধারণের নিকটে তাহা আমি একেবারে উড়াইয়া দিব-দুঃখের বিষয়, আপনার একজনও সাক্ষী নাই|”
সাক্ষী নাই কি-মিথ্যাকথা! এই পাশের ঘরে তিনজন সাক্ষী বিদ্যমান, “বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় বাহির হইয়া আসিলেন| তাঁহার পশ্চাতে-উকীল হরিপ্রসন্ন বাবু এবং জোহেরা|

৫.১০ দশম পরিচ্ছেদ – নিজের বিষে

মোবারক ভয় পাইয়া একটা অব্যক্ত চীৎকার করিয়া উঠিল| মুন্সী সাহেব স্তম্ভিত হইয়া গেলেন| রাগে, দুঃখে, বিস্ময়ে তাঁহার সর্ব্বশরীর কাঁপিতে লাগিল| মোবারক সমূহ বিপদ্ দেখিয়া পলাইবার উপক্রম করিল – ঘর হইতে বাহির হইবার জন্য দ্বারের দিকে সবেগে ছুটিয়া গেল| মুন্সী সাহেব ক্ষুধিত ব্যাঘ্রের মত তাহার উপরে লাফাইয়া পড়িলেন; এবং দুই হাতে তাহার গলদেশ বেষ্টন করিয়া ধরিলেন| মোবারক তাঁহাকে এক ধাক্কা দিয়া, সবেগে ফিরিয়া দাঁড়াইয়া তাঁহার ললাটপার্শ্বে এক প্রচণ্ড মুষ্ট্যাঘাত করিল, মুন্সী সাহেব সে দারুণ আঘাত সহ্য করিতে পারিলেন না|-তখনই মৃতবৎ ধরাশায়ী হইলেন| ব্যাপার দেখিয়া ভয়ে জোহেরাও সংজ্ঞা হারাইল, টলিতে টলিতে মাটিতে পাড়িয়া যাইবার উপক্রম করিল; পার্শ্বে বৃদ্ধা হরিপ্রসন্ন বাবু ছিলেন, তিনি জোহেরাকে ধরিয়া ফেলিলেন| দেবেন্দ্রবিজয়ও এতক্ষণ নিশ্চিন্ত ছিলেন না; মুন্সী সাহেবকে মুষ্ট্যাঘাত করিতে দেখিয়া তিনি পকেট হইতে পিস্তল বাহির করিয়া মোবারকের দিকে ছুটিয়া গেলেন| মোবারক দেবেন্দ্রবিজয়ের দিকে সেই তীরের ফলাটা দক্ষিণ হস্তে উদ্যত করিয়া নিকটস্থ একখনা চেয়ারে বসিয়া পড়িল|
দেবেন্দ্রবিজয় মোবারকের মস্তক লক্ষ্যে পিস্তলটা উদ্যত করিয়া কহিলেন, “এক পা নড়িলে এই পিস্তলের গুলিতে তোমার মাথার খুলি উড়াইয়া দিব| নারকি, সাবধান! উঠিবার চেষ্টা করিলেই মরিবে-কিছুতেই আমাদের হাত হইতে আর পলাইতে পারিবে না|”
“আর কি-আর উপায় নাই!” বলিয়া মোবারক একান্ত হতাশভাবে সেই বিষাক্ত তীরের ফলাটা ভূতলে নিক্ষেপ করিল| কহিল, “দেবেন্দ্রবিজয়! আমি নিশ্চয়ই পলাইব! তুমি কি মনে করিয়াছ, মোবারককে আর ধরিয়া রাখিতে পারিবে? কখনও তাহা পারিবে না| কিছুতেই না|”
দেবেন্দ্রবিজয় অত্যন্ত কঠিন কণ্ঠে কহিলেন, “তোমাকে শীঘ্রই ফাঁসীর দড়ীতে ঝুলিতে হইবে-সহজে পরিত্রাণ পাইবে না|”
ভ্রুভঙ্গি করিয়া, পৈঁশাচিক হাসি হাসিয়া মোবারক কহিল, “ভুল-ভুল-একান্ত ভুল| আর তোমরা কেহই মোবারককে ফাঁসীর দড়িতে ঝুলাইতে পারিবে না| মোবারক তোমাদের হাত ছাড়াইয়া এখন অনেক দূরে গিয়া পড়িয়াছে-সে আর এখন কাহাকেও কিছুমাত্র ভয় করিবার পাত্র নহে| এই দেখিতেছ না-এ কি হইয়াছে?” বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের দৃষ্টিসম্মুখে বাম হস্ত প্রসারিত করিয়া দিল| দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, মোবারকের হাত কাটিয়া গিয়া রক্ত ঝরিতেছে|
মোবারক বলিল, “যখন মুন্সী সাহেব আমাকে অক্রমণ করেন, সেই সময়ে অসাবধানে আমি ঐ বিষাক্ত তীরের ফলাতে নিজের হাত কাটিয়া ফেলিয়াছি আর পনের মিনিট – পনের মিনিট পরে আমাকে পাইবে না-সকলই ফুরাইবে| আমি মরিব| আর কেহই আমাকে রাখিতে পারিবে না-এ বিষ একেবারে অব্যর্থ|”
দেবেন্দ্রবিজয় ক্ষুব্ধভাবে বলিয়া উঠিলেন, “কি আপদ্! সব মাটি হইল|”
“একেবারে মাটি! সেজন্য আর অনর্থক ক্ষোভ প্রকাশ করিয়া ফল কি?” বলিতে বলিতে মোবারক চেয়ার ছাড়িয়া মাটিতে লুটাইয়া পড়িল| ক্ষণপরে ক্ষীণকণ্ঠে বলিল, “আমাকে ধরিয়া ফাঁসীর দড়ীতে ঝুলাইতে পারিলেই কি দেবেন্দ্রবিজয়, তুমি কৃতার্থ হইতে? আর তাহাতেই বা তোমার কি এমন বাহাদুরি প্রকাশ পাইত? তোমার বাহাদুরি আমি বেশ জানিয়াছি-এতদিন কেবল অন্ধের ন্যায় হাতড়াইয়া ঘুরিয়াছ বৈ ত নয়-বুদ্ধির কাজটা করিয়াছ কি? কিছুই ত দেখিতে পাই না| প্রথমে তুমি মজিদ খাঁকে সন্দেহ কর, তাহার পর মনিরুদ্দীনকে-দিলজানকে-শেষে মুন্সী সাহেবকে একে একে সকলকেই তুমি খুনী মনে করিয়াছ – তখন কাজেই শ – | তোমার গোয়েন্দা-গিরিটা অনেকটা সেই রকমের দেখিতে পাই| তোমার চোখে ধূলিমুষ্টি নিক্ষেপ করিয়া আমি কিরূপভাবে নিজের কার্য্যোদ্ধার করিয়া আসিতেছিলাম-একবার মনে ভাবিয়া দেখ দেখি| খুনী বলিয়া কি একবারও আমর উপরে সন্দেহ করিতে পারিয়াছিলে-দৈব এমন প্রতিকূল না হইলে সাধ্য কি তোমার-দেবেন্দ্রবিজয়, তুমি আমাকে ধরিতে পার? তোমাকে আমি পদে পদে বোকা বানাইয়া নিজের কাজ হাসিল করিয়াছি; আমি সকল সময়েই তোমার পশ্চাতে ফিরিয়াছি-চোখ থাকিতে তুমি অন্ধ-আমাকে দেখিতে পাও নাই| আমিই তোমাকে কয়েকখানা পত্র লিখিয়া সতর্ক করিয়াছিলাম| একদিন রাত্রিতে গলিপথে আমার হাতে তোমার কি দুর্দ্দশা হইয়াছিল, মনে পড়ে কি? কেবল দয়া করিয়াই সেদিন তোমার জীবনটা একেবারে শেষ করিয়া দিই নাই| এখন বুঝিতেছি তোমাকে সেরূপ দয়া করাটা ভাল হয় নাই| সেইদিনই এই পৃথিবী হইতে তোমাকে একেবারে বিদায় করিয়া দিলেই ভাল হইত| তোমার মত একজন নামজাদা ডিটেক্টিভকে এরূপভাবে এ পর্য্যন্ত বোকা বানাইয়া রাখা, যে-সে লোকের কাজ নহে-বড় সহজ কাজও নহে; কিন্তু আমি কত সহজে তাহা করিয়াছি, ভাবিয়া দেখ দেখি; ভাবিয়া দেখ দেখি, কাহার বাহাদুরি বেশি! যদিও আমি এখন দৈব-দুর্ব্বিপাকে তোমার হাতে ধরা পড়িয়াছি-কিন্তু তুমি সহস্র চেষ্টাতেও আর আমাকে ধরিয়া রাখিতে পারিবে না|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তুমি মহাপাপী-তোমার পাপের মাত্রা পূর্ণ হইয়াছে| সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ এখনও নিজের মুখে নিজের পাপ স্বীকার কর| তোমার অপরাধে মজিদ খাঁ এখনও বন্দী হইয়া রহিয়াছে| দেখি, এ সময়ে একজন ডাক্তারকে আনিলে যদি কিছু সুবিধা হয়|” এই বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় উঠিয়া দাঁড়াইলেন|
মোবারক হাত নাড়িয়া নিষেধ করিয়া মৃদুকণ্ঠে বলিল, “ডাক্তার ডাকিয়া কোন ফল নাই| আমি যাহা করিয়াছি-সমুদয় বলিতেছি, একখানা কাগজে তোমরা লিখিয়া লও-লিখিয়া শেষ করা পর্য্যন্ত যদি বাঁচি-লিখিবার শক্তি থাকে, আমি তাহাতে নিজের নাম সহি করিয়াও দিব|”
ইতিপূর্ব্বে জোহেরা অনেকটা প্রকৃতিস্থ হইতে পারিয়াছিল| হরিপ্রসন্ন বাবু তাহাকে একখানি চেয়ারে বসাইয়া টেবিলের উপর হইতে কাগজ কলম টানিয়া লইয়া বলিলেন, “আমিই লিখিয়া লইতেছি|”

৫.১১ একাদশ পরিচ্ছেদ – নিজে মরিল

মোবারক গৃহতলে পড়িয়া, অর্দ্ধমুদিতনেত্রে ক্ষীণকণ্ঠে নিজের পাপকাহিনী বলিতে লাগিল,- “ইদানীং আমি অর্থোপার্জ্জনের চেষ্টায় নেপালে থাকিতাম| কিছুদিনের জন্য কলিকাতায় আসিয়াছিলাম| নেপালের দক্ষিণপ্রান্তস্থ পর্ব্বতমালায় কাওয়াল জাতি বাস করে| কাওয়াল জাতির স্ত্রীলোকেরা অত্যন্ত সুন্দরী; কিন্তু তাহাদিগের স্বভাব অত্যন্ত কলুষিত-সকলেই স্বেচ্ছাচারিণী-সতীত্ব বলিয়া যে কিছু আছে, তাহা তাহারা জানে না| আমি একটু অবসর পাইলেই তাহাদের সঙ্গে গিয়া মিশিতাম| তাহাদের মধ্যে মানিয়া নাম্নী কোন রমণীর সহিত আমার বেশি ঘনিষ্ঠতা হয়| কিছুদিন পরেই মনিয়ার মৃত্যু হয়- সেই মানিয়ার কাছেই আমি এই তীরের ফলাটা পাইয়াছিলাম| তাহার মুখে শুনিয়াছি, কাওয়াল জতিরা এই তীরের ফলা তৈয়ারী করিয়া পক্ষাধিক কাল কোন একটা বিষাক্ত গাছে বিদ্ধ করিয়া রাখিয়া দেয়| তাহাতে সেই তীরের ফলা এমনই বিষাক্ত হয় যে, তাহার একটু আঁচড়ে দেহস্থ সমুদয় রক্ত বিষাক্ত হইয়া উঠে; অতি অল্পক্ষণে প্রাণ বহির হইয়া যায়| কাওয়াল জাতিরা হিংস্র প্রাণী শিকারে এই তীরের ফলা ব্যবহার করিয়া থাকে| নেপাল হইতে আসিবার সময়ে এই তীরের ফলা আমিই সঙ্গে আনিয়াছিলাম| নেপালে আমি অনেকদিন ছিলাম| তাহার পূর্ব্বে আমি খিদিরপুরে থাকিতাম| খিদিরপুরে সৃজান বিবির পিত্রালয়| আমি সৃজানকে প্রাণের অধিক ভালবাসিতাম| সৃজানও আমাকে ভালবাসিত-তখন মুন্সী সাহেবের সহিত তাহার বিবাহ হয় নাই| আমার মনে ধারণা ছিল, পরে আমার সহিত নিশ্চয়ই সৃজানের বিবাহ হইবে| কিছুদিন পরে সহসা সৃজানের মনের পরিবর্ত্তন ঘটিল-সৃজানের ভালবাসা ক্রমেই শিথিল হইয়া আসিতে লাগিল| বিষয়-ঐশ্বর্য্যে, ধন-দৌলতের উপরেই তাহার অনুরাগটা বেশি প্রকাশ পাইতে লাগিল| সে আমাকে বিবাহ করিতে চাহিল না-উপেক্ষাও করিল না-প্রকারান্তরে আমাকে হাতে রাখিল| ইচ্ছা, যদি একান্তই কোন ধনবান্ জমিদার, আমীর-ওম্রাও না জুটে, তখন সে আমাকে বিবাহ করিবে| এই সময়ে আমাকে অর্থোপার্জ্জনের চেষ্টায় নেপাল যাইতে হয়| কিছুকাল পরে সেখান হইতে ফিরিয়া আসিয়া শুনিলাম, মুন্সী সাহেবের সহিত সৃজানের বিবাহ হইয়া গিয়াছে| আমি একদিন সৃজানের সহিত গোপনে দেখা করিলাম| এই প্রবঞ্চনার জন্য আমি তাহাকে অনেক কটূক্তি করিলাম-সে সকলই হাসিয়া উড়াইয়া দিতে লাগিল| ক্রমেজানিতে পারিলাম, সে মনিরুদ্দীনের সহিত গৃহত্যাগের চেষ্টায় আছে| আমাকে ছাড়িয়া সৃজান মনিরুদ্দীনের অঙ্কশোভিনী হইবে, ইহা আমার একান্ত অসহ্য হইল; মনে মনে স্থির করিলাম, প্রাণ থাকিতে কখনই তাহা ঘটিতে দিব না| আমাকে এতদিন আশা দিয়া আজ যে, সে হঠাৎ এরূপভাবে নিরাশ করিবে, এতদিন ভালবাসা জানাইয়া আজ যে সে হঠাৎ এরূপভাবে আমাকে উপেক্ষা করিবে, ইহা আমার পক্ষে একান্তই অসহ্য! আমাকে ঘৃণা করিয়া, মনিরুদ্দীনকে লইয়া সে সুখী হইবে, আর আমি দীননেত্রে তাহার সুখ-সৌভাগ্যের দিকে চাহিয়া থাকিব-তাহা কখনই হইতে দিব না| মনে মনে স্থির করিলাম, গোপনে সৃজানের সহিত একবার দেখা করিয়া যাহাতে সে এ সঙ্কল্প ত্যাগ করে, সেজন্য বুঝাইয়া বলিব| যদি সে তাহাতে অন্যমত করে, তাহা হইলে তাহাকে এই বিষাক্ত তীরের ফলাটা সাহায্যে খুন করিতেও কুণ্ঠিত হইব না| তাহার পর হঠাৎ একদিন জানিতে পারিলাম যে, সেদিন রাত্রিতেই সে মনিরুদ্দীনের সহিত গৃহত্যাগ করিবে| আমিও রাত্রি দশটার পর বাসা হইতে বাহির হইয়া পড়িলাম| প্রথমে মুন্সী সাহেবের বাড়ীতে গিয়া গোপনে সন্ধান লইলাম যে, সৃজান রাজাব-আলির বাড়ীতে নিমন্ত্রণ রাখিতে গিয়াছে| সেখান হইতে ফিরিয়া আমি মনিরুদ্দীনের বাড়ীর দিকে আসিলাম| সেখান গোপনে সন্ধান লইয়া জানিতে পারিলাম, মনিরুদ্দীনও বাড়ীতে নাই| মনে বড় সন্দেহ হইল, সৃজান নিমন্ত্রণ রাখিতে যাইবার অজুহাতে বাড়ী হইতে বাহির হইয়াছে-মনিরুদ্দীনও বাড়ীতে নাই; অবশ্যই ভিতরে ভিতরে উভয়ে পলাইবার একটা কিছু বন্দোবস্ত করিয়াছে| রাগে দ্বেষে আমার সর্ব্বঙ্গ জ্বলিয়া যাইতে লাগিল|স্থির করিলাম, যদি সহজ উপায়ে কার্য্যসিদ্ধ না হয়, দুইজনকেই খুন করিব| পুনরায় বাসায় ফিরিয়া আসিলাম| বিষাক্ত তীরের ফলাটা পকেট লইয়া আবার মনিরুদ্দীনের বাড়ীর দিকে ছুটিলাম| মনিরুদ্দীনের বাড়ীর নিকটে আসিয়া দূর হইতে মুন্সী সাহেবকে সেখানে দেখিতে পাইলাম| কি আশ্চর্য্য! এমন সময়ে মুন্সী সাহেব এরূপভাবে এখানে দাঁড়াইয়া কেন? কিছুই বুঝিতে পারিলাম না| তাঁহাকে দেখিয়া বোধ হইল, তিনি যেন কাহার অপেক্ষায় সেখানে দাঁড়াইয়া আছেন| তিনি আমাকে দেখিতে পান্ নাই; আমিও তাঁহার সহিত তখন দেখা করা যুক্তিযুক্ত বোধ করিলাম না| মনে অত্যন্ত কৌতূহল উপস্থিত হইল; কি ঘটে দেখিবার জন্য আমি কিছু দূরে একটা গাছের আড়ালে লুকাইয়া রহিলাম| এমন সময় মনিরুদ্দীনের বাড়ীর ভিতর হইতে ঊর্দ্ধশ্বাসে একটি স্ত্রীলোক ছুটিয়া বাহির হইয়া আসিল| দ্বারের উপরে লণ্ঠন জ্বলিতেছিল, তাহারই আলোক চকিতে একবারমাত্র আমি তাহার মুখখানি দেখিতে পাইলাম-দেখিয়াই চিনিতে পারিলাম-সে সুন্দরী সৃজান| সৃজানকে বাহির হইতে দেখিয়াই মুন্সী সাহেব ছুটিয়া গিয়া তাহার হাত ধরিল| এবং তাহাকে টানিয়া একটু তফাতে পথিপার্শ্বস্থ একটা অলোকস্তম্ভের নিম্নে গিয়া দাঁড়াইল| মুন্সী সাহেব তাহাকে হাত মুখ নাড়িয়া কি বলিতে লাগিলেন| দুই-একটা কথা আমি শুনিতে পাইলাম, ভাল বুঝিতে পারিলাম না; কিন্তু ভাবভঙ্গিতে খুব রাগের লক্ষণ দেখা গেল| সৃজান একবার মাত্র চীৎকার করিয়া উঠিয়া মেহেদী-বাগানের দিকে ছুটিয়া চলিয়া গেল| মুন্সী সাহেবও তাহার পশ্চাতে ছুটিয়া গেলেন| পরে আরও কি ঘটে দেখিবার জন্য আমি দ্রুতপদে মেহেদী-বাগানের দিকে চলিলাম| মেহেদী-বাগানে আসিয়া প্রথমে তাহাদের দুইজনের কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না| পরে একটা গলির ভিতর হইতে সৃজানকে বাহির হইতে দেখিলাম| আমি তখনই ছুটিয়া গিয়া তাহার হাত ধরিলাম| সে অন্ধকারে প্রথমে আমাকে চিনিতে না পারিয়া, চমকিত হইয়া হাত ছাড়াইয়া লইবার চেষ্টা করিল| তাহার পর চিনিতে পারিয়াও সে আমাকে অনেক কটূক্তি করিতে লাগিল| আমি ধীরভাবে তাহা শুনিয়া গেলাম-তাহার কথায় রাগ করিলাম না| মনিরুদ্দীনকে ছাড়িয়া সে যাহাতে আবার আমার হয়, সেজন্য তাহাকে অনেক বুঝাইতে লাগিলাম| আমি তাহাকে তখনই বালিগঞ্জে আমার বাসায় লইয়া যাইবার জন্য পীড়াপীড়ি করিতে লাগিলাম| বলিলাম, ‘দেখ সৃজান, তুমি কিছুতেই আমার হাত হইতে অব্যাহতি পাইবে না| আমার সঙ্গে তোমাকে আমার বাসায় যাইতে হইবে| তাহার পর রাত্রিশেষে তোমায় আমায় একদিকে চলিয়া যাইব| এখন তোমার আর গৃহে ফিরিবার কোন উপায়ই নাই; মুন্সী সাহেব স্বচক্ষে তোমাকে মনিরুদ্দীনের বাড়ী হইতে বাহির হইতে দেখিয়াছেন-তিনি নিশ্চয়ই এখন তোমাকে হত্যা করিবেন| আমি এতদিন তোমার আশাপথ চাহিয়া আছি-আর আজ যে তুমি এমন কঠিনভাবে আমাকে একেবারে নিরাশ করিবে, কিছুতেই তাহা হইবে না|’ অনেক সাধ্য-সাধনার পর সৃজান আমার সহিত যাইতে সম্মত হইল| তখন সম্মত হইতে দেখিয়া আমি সেই প্রেম-পত্রগুলির কথা জিজ্ঞাসা করিলাম| এই পত্রগুলি আমি অনেকদিন পূর্ব্বে-যখন সৃজানের বিবাহ হয় নাই-তখন লিখিয়াছিলাম| সৃজানকে বলিলাম, এই সকল পত্র যদি পরে কখনও কাহারও হাতে পড়ে, তাহা হইলে সকলই প্রকাশ হইয়া পড়িবে! সকলেই জানিতে পারিবে, তুমি আমার সহিত গিয়াছ; কিন্তু দুই-চারিদিনের মধ্যে কোন রকমে যদি এই পত্রগুলি বাহির করিয়া আনিতে পারা যায়-তাহা হইলে আমাদের আর সে ভয় থাকে না| তাহাতে সৃজান এই পত্রগুলি যেখানে যেরূপভাবে রাখিয়াছিল, বলিল| গুপ্ত-ড্রয়ার খুলিবার কৌশল আমাকে বলিয়া দিল| আমি তাহাকে মেহেদী-বাগানের একটা গলিপথ দিয়া নিজের বাসার দিকে লইয়া চলিলাম| কিছুদূর গিয়াই সৃজানের মত আবার ফিরিয়া গেল-সে আমার সহিত আর যাইতে চাহিল ন| আমার মুখের উপরেই আমাকে সে ঘৃণার সহিত বলিল, আমি তাহার যোগ্য নই-সে সর্ব্বান্তঃকরণে মনিরুদ্দীনকেই ভালবাসে| শুনিয়া দারুণ ঈর্ষায় আমার আপাদমস্তক জ্বলিয়া গেল-মুখে রাগের ভাব কিছু প্রকাশ করিলাম না-তাহাকে খুন করিতে প্রস্তুত হইযা বলিলাম, ‘সৃজান, তুমি আমাকে ত্যাগ করিলেও আমি কিন্তু তোমাকে এ জীবনে ভুলিব না| যদি একান্তই আমি এখন তোমর অযোগ্য হইয়া থাকি, যদি একান্তই তুমি আমাকে চিরকালের জন্য ত্যাগ করিবে, এরূপ কঠিনভাবে উপেক্ষার সহিত আমাকে ত্যাগ করিয়ো না, আমার মর্ম্মভেদ করিয়ো না; তাহা আমার অসহ্য হইবে| আজ একবার হাসিমুখে শেষবার তোমার ঐ মুখখানি চুম্বন করিতে দাও- বহুদিনের তৃষিত আমি, চিরবিদায়ের আজ শেষ প্রেমালিঙ্গন, সৃজান, আর আমি তোমাকে কখনও বিরক্ত করিতে আসিব না|’ বলিয়া তাহাকে বুকে লইয়া মুখচুম্বন করিলাম; সেই ব্যাকুলতার সময়ে আমি অলক্ষ্যে তাহার গলদেশে বিষাক্ত তীরের ফলা দিয়া একটা আঁচড় লাগাইয়া দিলাম| সে তাহার কিছুই জনিতে পারিল না| ক্রমে যখন তাহার সর্ব্বাঙ্গ একেবারে অবসন্ন হইয়া আসিল, তখন আমি তাহাকে প্রকৃত যাহা ঘটিয়াছে প্রকাশ করিলাম| বলিলাম, ‘সৃজান, এখনই তুমি মরিবে-আর তোমার রক্ষার উপায় নাই, বড় ভয়ানক বিষ| কি ভ্রম! মোবারক বাঁচিয়া থাকিতে তুমি অন্যের উপভোগ্য হইবে, মনে করিয়াছিলে!’ সৃজান কোন উত্তর করিল না- তখন তাহার কণ্ঠস্বরও অতি ক্ষীণ হইয়া আসিয়াছে-কি বলিতে চেষ্টা করিল, স্পষ্ট বলিতে পারিল না-অনতিবিলম্বে তাহার মৃত্যু হইল| আমিও তখন আত্মরক্ষার একটা উপায় উদ্ভাবন করিয়া ফেলিলাম| তাহার মৃতদেহ পথের উপর হইতে তুলিয়া লইয়া যাহাতে সহজে কহারও নজর না পড়ে, এরূপভাবে একটা গাছের আড়ালে রাখিয়া দিলাম| তখনই আমি রাজাব-আলির বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম; সেখানে সেদিন আমারও নিমন্ত্রণ ছিল| পরে কোন রকমে আমার উপরে সন্দেহের কোন কারণ উপস্থিত হইলেও নিজেকে নির্দ্দোষ প্রতিপন্ন করিতে পারিব মনে করিয়া আমি সেখানে অনেক রাত্রি পর্য্যন্ত রহিলাম| রাত দুইটার পর রাজাব-আলির বাড়ী হইতে বাহির হইলাম| মাথায় আর একটা মতলব আসিয়া উপস্থিত হইল| আমি আবার মেহেদী-বাগানের দিকে গেলাম-সেখানে পথ দেখাইবার অজুহাতে একজন পাহারাওয়ালাকে সঙ্গে লইলাম; তাহাকে কিছুদূর গিয়া ছাড়িয়া দিলাম| যে গাছতলায় সৃজানের দেহ মৃতদেহ রাখিয়াছিলাম, সেখানে গিয়া দেখিলাম, যেমনভাবে সৃজানকে ফেলিয়া গিয়াছিলাম, তখনও ঠিক সেইভাবে পড়িয়া রহিয়াছে-হাত পা অত্যন্ত কঠিন হইয়া গিয়াছে| তখনও সেই মৃতদেহ কহারও নজরে পড়ে নাই| আমি তখনই মৃতদেহ সেখান হইতে তুলিয়া আনিয়া গলিপথের মাঝখানে ফেলিয়া সেই পাহারাওয়ালাকে ডাকিতে লাগিলাম| সে আবার ছুটিয়া আসিল-পরে আরও দুই-তিনজন পাহারাওয়ালা আসিয়া জুটিল-আমি তাহাদের হাতে সৃজানের মৃতদেহ তুলিয়া নিশ্চিন্ত মনে বাসায় ফিরিয়া আসিলাম| তাহার পর যাহা, ঘটিয়াছে, সকলই আপনার জানেন| পরে এই সকল চিঠি হইতে এই খুনের সম্বন্ধে আমার উপরে কোন কারণ উপস্থিত না হয়, সেজন্য একদিন আমি এই চিঠিগুলার সন্ধানে মুন্সী সাহেবের সঙ্গে সেখা করিতে আসি| মুন্সী সাহেব তখন বাড়ীতে ছিলেন না; আমি এই ঘরে একাকী বসিয়া তাঁহার অপেক্ষা করিতে লাগিলাম; সেই সুযোগে গুপ্ত-ড্রয়ারটা খুলিয়া ফেলিলাম; কিন্তু তাহার ভিতরে চিঠিগুলা দেখিতে পাইলাম না; কেবলমাত্র একছড়া কণ্ঠহার ছিল| খুনের রাতে মুন্সী সাহেব যাহা করিয়াছিলেন, আমি সমস্তই জানিতাম; ইহাতে সহজেই তাঁহার ঘাড়ে দোষ চাপাইতে পারা যাইবে মনে করিয়া, আমি সেই বিষাক্ত তীরের ফলাটা সেই কণ্ঠহারের সঙ্গে রাখিয়া গুপ্ত-ড্রয়ারটা পূর্ব্ববৎ বন্ধ করিলাম|” এই পর্য্যন্ত বলিয়া মোবারক চুপ্ করিল| তাহার কণ্ঠস্বর ক্রমশঃ ভগ্ন হইয়া আসিয়াছিল-বলিতে বলিতে কথা অনেকবার জড়াইয়া যাইতেছিল| মোবারক যাহা বলিল, হরিপ্রসন্ন বাবু একখানি কাগজে তাহা লিখিয়া লইয়াছিলেন| মোবারকের মৃত্যু সন্নিকটবর্ত্তী দেখিয়া তিনি তাড়াতড়ি উঠিয়া এক কলম কালি লইয়া, মোবারকের হাতে দিয়া সেই কাগজখানায় একটা নাম সহি করিতে বলিলেন| অতি কষ্টে মোবারক নিজের নাম সহি করিল| তাহার ইসাদীর স্থলে দেবেন্দ্রবিজয়, হরিপ্রসন্ন বাবু এবং জোহেরা নিজ নিজ নাম সহি করিলেন| এবং দেবেন্দ্রবিজয় একটা লম্বা খামের মধ্যে সেই কাগজখানা ভাঁজ করিয়া পুরিয়া ফেলিলেন| এদিকে মোবারকের দেহ ক্রমশঃ অবসন্ন ও অবশ হইয়া আসিতে লাগিল| ঘন ঘন শ্বাস বহিতে আরম্ভ হইল| স্বপ্নাবিষ্টের জড়িত ভগ্নকণ্ঠে বলিতে লাগিল, “পাপের পরিণাম কি ভয়ানক! কি মনে-করে এখানে-আসিলাম, কি হইল? কোথায়-জোহেরাকে-বিবাহ-করিব, না-নিজের-বিষে-নিজে-মরি-লা-ম| বিষ-বিষ-বড়-জ্বালা-অসহ্য-স-র্ব্বাঙ্গ-জ্ব’-লে-গে-ল-পুড়ে-গেল| এই-বিষে-এক-দিন-সৃজান-জ্বলিয়া-পুড়িয়া-মরি-য়াছে| কোথায়-যাই-তেছি-কত-দূরে, জা-হা-ন্নমে-না-না-ঐ-যে-জোহেরা,-না-জোহে-রা-নয়-সৃজান-পিশাচী-সৃ-জা-ন-আর-না-আ-মি-আ-র-উঃ- ”
মোবারকের মুখ দিয়া আর কথা বাহির হইল না| ধীরে ধীরে তাহার চক্ষুদ্বয় নিমীলিত হইয়া আসিল; যেন হতভাগ্য নিদ্রিত হইল| দেবেন্দ্রবিজয় বুঝিলেন, এ জগতে ইহা শেষ নিদ্রা-এ নিদ্রা যখন ভাঙিবে, তখন সে আর এক নূতন জগতে গিয়া উপস্থিত হইবে|

৫.১২ দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – শেষ

মোবারকের মৃত্যুর পরদিন প্রাতেই দেবেন্দ্রবিজয় সহর্ষমুখে বৃদ্ধ অরিন্দম বাবুর বাসায় উপস্থিত হইলেন| বগলে অরিন্দম-প্রদত্ত সেই বাক্স|
অরিন্দম বাবু তঁহাকে আনন্দোৎফুল্ল দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হে, কার্য্যোদ্ধার হইল?”
দে| হইয়াছে|
অ| খুনী ধরা পড়িয়াছে?
দে| ধরা পড়িয়াও সে পলাইয়া গিয়াছে-সে আর ধরা পড়িবে না|
অ| কেন-মরিয়াছে না কি?
দে| হাঁ|
অ| খুনী কে?
দে| মোবারক!
অ| (সবিস্ময়ে) মোবারক! কিরূপে জানিতে পারিলে মোবারক খুনী?
দেবেন্দ্রবিজয় তখন আনুপূর্ব্বিক সমুদয় ঘটনা অরিন্দম বাবুকে বলিলেন| শুনিয়া অরিন্দম বাবু বলিলেন, “তাই ত! কপ্লিত গল্পের অপেক্ষা এক-একটা সত্য ঘটনা অধিকতর বিস্ময়কর হইয়া দাঁড়ায়|
যাহ হউক, মোবারক শেষে হত্যাকরীতে পরিণত হইল, দেখিতেছি|”
দে| হাঁ, বড়ই আশ্চর্য্য ব্যপার! মোবারককে আমি একবারও সন্দেহ করি নাই|
অ| আশ্চর্য্য ব্যাপার আর কি, মোবারককে সন্দেহ না করাই তোমার অন্যায় হইয়াছে|
দে| কিন্তু তাহাকে সন্দেহ করিবার কোন সূত্র এ পর্য্যন্ত পাওয়া যায় নাই|
অরিন্দম একটু উষ্ণভাবে বলিলেন, “অন্ধ তুমি! অনেক সূত্র ছিল| তুমি দেখিয়াও দেখ নাই-সেজন্য চেষ্টাও কর নই| ঘটনাস্রোতে, তোমাকে যখন যেদিকে টানিয়া লইয়া গিয়াছে, তুমি তখনই সেইদিকে ভাসিয়া গিয়াছ| ইহা তোমার একটা মহৎ দোষ| এখন হইতে সর্ব্বাগ্রে ইহার সংশোধনের চেষ্টা করিবে| এই দেখ, আমি তোমাকে এমন একটা সূত্র বলিয়া দিই, যাহাতে তুমি অবশ্য প্রথম হইতেই মোবারকের উপর সন্দেহ করিতে পারিতে| তোমার মুখেই শুনিয়াছি, ডাক্তার লাস পরীক্ষা করিয়া রাত বারটার সময়ে মৃত্যুকাল নির্দ্ধারণ করেন| তাহা হইলে রাত বারটা হইতে মৃতদেহটা সেই গলির ভিতরেই পড়িয়াছিল| রাত দুইটার পর মোবারক গিয়া প্রথমে সেই মৃতদেহ দেখিতে পায়| রাত বারটা হইতে দুইটার মধ্যে আর কেহ সে পথে যায় নাই, ইহা কি সম্ভব? অবশ্যই এই সময়ের আরও দুই-চারিজন সেই গলিপথে যাতায়াত করিয়া থাকিবে| সেই মৃতদেহ আর কাহারও চোখে না পড়িয়া তেমন কুয়াশার অন্ধকারে একেবারে মোবারকের চোখে যে পড়িল-ইহার অর্থ কি? এইখানেই কেমন একটু গোলযোগ ঠেকিতেছে না? তাহার পর আরও দেখ, মোবারক মজিদ খাঁকে ঐ গলির ভিতর হইতে বাহির হইয়া আসিতে দেখিয়াছিল| তখন মোবারক মজিদ খাঁর যে ভাব দেখিয়াছিল, সে ভাবে মজিদ খাঁকে খুনী বুঝায় কি? কিছুতেই নয়| যদি মজিদ খাঁ নিজে খুনী হইত, সে মোবারকের সহিত অন্যরূপ ব্যবহার করিত| হত্যাকাণ্ড সম্বন্ধে মোবারক তখন কিছু না জানিতে পারে, সেইজন্য মজিদ খাঁ কি মোবারককে সেই গলিপথে না যাইতে দিয়া প্রকারান্তরে তাহাকে অন্যদিকে কি নিজের বাসাতে লইয়া যাইবার চেষ্টা করিত না? এরূপ স্থলে অতি নির্ব্বোধেরও মাথায় এ বুদ্ধি যোগায়; কিন্তু মজিদ খাঁ প্রকৃত খুনী নহে, সেজন্য সে এরূপ কোন চেষ্টাও করে নাই| আর মজিদ খাঁ সেই গলির মধ্যে যদি এরূপভাবে অরক্ষিত অবস্থায় স্ত্রীলোকের একটা লাস পড়িয়া থাকিতে দেখিত, তাহা হইলে সে অবশ্যই সে কথা মোবারকের নিকটে প্রকাশ করিত|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “কিন্তু মজিদ খাঁ যদি ভয়ে সে কথা প্রকাশ না করিয়া থাকে?”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “ইহাতে ভয়ের বিশেষ কারণ কি? যদি ভয়ের কোন কারণ থাকিত, তাহা হইলেও মজিদ খাঁ মোবারক যাহাতে তখন সে গলির ভিতরে না যায়, সেজন্য কোন উপায় অবলম্বন করিত; কিন্তু মজিদ সেজন্য চেষ্টামাত্রও করে নাই| ইহাতে বেশ বুঝিতে পারা যাইতেছে, মজিদ খাঁ গলির ভিতরে সেই মৃতদেহ দেখে নাই, অথচ ঠিক পথের উপরে মৃতদেহ এরূপভাবে পড়িয়াছিল যে, সেখান দিয়া কাহাকেও যাইতে হইলে, হয় মৃতদেহ বেড়িয়া, না হয় পদদলিত করিয়া যাইতে হইত| এরূপ স্থলে মৃতদেহ মজিদের লক্ষ্য না হওয়াই আশ্চর্য্য; কিন্তু পরক্ষণেই মোবারক সেই গলির ভিতর প্রবেশ করিয়া মৃতদেহ আবিষ্কার করিয়া ফেলিল, পাহারাওয়ালাকে ডাকিল-লাস হাসপাতালে পাঠাইয়া দিল-ব্যস্| আমার বোধ হয়, মোবারক পূর্ব্বে খুন করিয়া ঐ লাস কোথায় লুকাইয়া রাখিয়াছিল| তাহার পর একটা বুদ্ধি খাটাইয়া সেই লাস্টা পাহারাওয়ালাদের স্কন্ধে চাপাইয়া দিয়াছিল|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হাঁ, তাহাই ঠিক, মৃত্যুকালে মোবারক সে কথা নিজেই স্বীকার করিয়াছে; কিন্তু মোবারক যে খুনী, ইহা একবারও আমার মনে হয় নাই, কি আশ্চর্য্য! যাহা হউক, এখন কার্য্যোদ্ধার হইয়াছে, আপনার সেই বাক্স আমি লইয়া আসিয়াছি, একবার চাবিটা চাই, দেখিতে হইবে-”
দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখ হইতে কথাটা লুফিয়া লইয়া অরিন্দম বাবু বলিলেন, “-কে হত্যাকারী| এই না? এখন আর তাহা দেখিয়া লাভ?”
দেবেন্দ্রবিজয় কোন উত্তর করিল না| অরিন্দম বাবু বালিশের নীচে হইতে বাক্সের চাবিটা বাহির করিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের সম্মুখে নিক্ষেপ করিলেন|
দেবেন্দ্রবিজয় বাক্স খুলিয়া ফেলিলেন| দেখিলেন, তন্মধ্যে একখানি কাগজে লিখিত রহিয়াছে- “মোবারক|”
দেবেন্দ্রবিজয় থ হইয়া গেলেন|

৫.১৩ উপসংহার

মেহেদী-বাগানের এই অত্যাশ্চর্য্য নারীহত্যা-রহস্যের উদ্ভেদ হইলে আবার একটা খুব হৈ-চৈ পড়িয়া গেল| পরে কয়েকখানি সাপ্তাহিক সংবাদ-পত্রে সমগ্র ঘটনাটা সুশৃঙ্খলভাবে বাহির হইলে সকলে অত্যন্ত আগ্রহ ও বিস্ময়ের সহিত তাহা পাঠ করিতে লাগিল| এক-একটা সত্য ঘটনা গল্পাপেক্ষা অদ্ভুতও হয়, ইহা এখন অনেকেই বুঝিতে পারিলেন|
মজিদ খাঁ মুক্তি পাইলেন| মুন্সী সাহেব এবার মজিদ খাঁর সহিত জোহেরার বিবাহ দিতে আপত্তি করিলেন না| খুব জাঁক-জমকের সহিত মহাসমারোহে শুভবিবাহ সম্পন্ন হইয়া গেল|
মনিরুদ্দীন দিলজানকেই বিবাহ করিলেন| জীবনের এই ঘটনাপূর্ণ অধ্যায়টা বিস্মৃত হইবার আশায় তিনি সহর ত্যাগ করিয়া ফরিদপুরের সেই বাগান-বাটীতে গিয়া আপাততঃ বাস করিতে লাগিলেন| দিলজানও সেই বাগান-বাটীতে স্থানপ্রাপ্ত হইল| ইহার পর মনিরুদ্দীনের চরিত্রে আর কোন দোষ দেখা দেয় নাই-দিলজানের অদৃষ্ট ভাল|
মুন্সী সাহেব আর বিবাহ করিলেন না| সে অভিরুচিও আর ছিল না| এই ঘটনায় নারীজাতির উপর হইতে তাঁহার বিশ্বাস একেবারে অন্তর্হিত হইয়াছিল| তিনি সহরত্যাগ করিয়া স্বদেশে গিয়া বাস করিতে লাগিলেন; ইচ্ছা অবশিষ্ট জীবনটা সেইখানেই অতিবাহিত করিবেন|
দেবেন্দ্রবিজয় কয়েকদিন অত্যধিক পরিশ্রম ও চিন্তায় অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছিলেন; এক্ষণে বিশ্রামের একটু অবসর পাইলেন| অনেক সময়েই তাঁহার মন হইত, এমন জটিল রহস্যপূর্ণ মোকদ্দমা আর কখনও তাঁহার হাতে পড়ে নাই| ঘটনাচক্রে যেরূপ ভাবে ঘুরিতেছিল, তাহাতে বৃদ্ধ মুন্সী সাহেবেরই চাপা পড়িবার উপক্রম হইয়াছিল| যাহা হউক, ঈশ্বর তাঁহাকে রক্ষা করিয়াছেন| নতুবা একজন নিরপরাধ বৃদ্ধকে ফাঁসীর দড়িতে ঝুলাইয়া তাঁহাকে আজীবন অনুতাপ করিতে হইত|
পরে কখনও কোন সূত্রে দশজন বন্ধুবান্ধবের সহিত মিলিত হইলে অনুরুদ্ধ দেবেন্দ্রবিজয় সর্ব্বাগ্রে মেহেদী-বাগানের এই অত্যাশ্চর্য্য নারীহত্যার বিপুল রহস্যপূর্ণ কাহিনীতে সকলের হৃদয়ে অত্যন্ত বিস্ময়োদ্রেক করিতেন |

( সমাপ্ত)

Exit mobile version