Site icon BnBoi.Com

গোবিন্দরাম – পাঁচকড়ি দে

গোবিন্দরাম - পাঁচকড়ি দে

 ১ম খণ্ড – ডাক্তারের কথা

গোবিন্দরাম (ডিটেকটিভ উপন্যাস)

বিজ্ঞাপন
একই গ্রন্থকারের ইংরাজী ভাষায় দুইখানি সর্বশ্রেষ্ঠ ডিটেকটিভ উপন্যাসের ছায়াবলম্বনে গোবিন্দরাম সঙ্কলিত। ইহা সঙ্কলন করিতে আমাকে সর্বত্র বড়ই স্বাধীনতা প্রকাশ করিতে হইয়াছে। মূলগ্রন্থ হইতে বাহুল্য বোধে অনেকস্থান পরিবর্জিত হইয়াছে; কোন কোন স্থান একেবারে স্বকোপলকল্পিত। ইহাতে যদি কোন দোষ হইয়া থাকে, তাহা আমারই। আর যদি আমার প্রিয় পাঠক পাঠিকাগণ এই উপন্যাসখানি প্রীতনেত্রে দেখেন, তাহা হইলে আমার সকল শ্রম সার্থক হইবে।
গ্রন্থকার।
গোবিন্দরাম।

প্রথম খণ্ড। (ডাক্তারের কথা।)

প্রথম পরিচ্ছেদ। ডাক্তারী পাস করিয়া দিন-কতক উপার্জনের চেষ্টায় রহিলাম, কিন্তু কোন দিকে কোন সুবিধা না হওয়ায়,-এবং গৃহেও অর্থ প্রচুর পরিমাণে থাকায়, অবশেষে সরকারী চাকরী লইয়া পশ্চিমে রওনা হইলাম।

কয়েক মাস নানাস্থানের হাসপাতালে চাকরী করিয়া আমি বদলী হইয়া রাওলপিণ্ডি আসিলাম। তথায় ১৭নং শিখ-পদাতিদলের হাসপাতালের ভার পাইলাম। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য বশতঃ শীঘ্রই কাবুল যুদ্ধ বাধিল। ১৭ নং শিখ-পদাতি যুদ্ধের জন্য কাবুলের দিকে রওনা হইল; আমিও বাধ্য হইয়া ঐ পল্টনের সহিত চলিলাম।

প্রায় বৎসরাবধি আফগানিস্থানে থাকিয়া নানা ক্লেশে ও অত্যধিক পরিশ্রমে আমার শরীর একেবারে ভগ্ন হইয়া গেল। অনেক কষ্টে ছুটি পাইয়া দেশে ফিরিবার ইচ্ছা করিলাম; কিন্তু সকলেই বলিল, দেশে ফিরিলে বাঁচিবে না। দিনকতক পাঞ্জাবে থাকিয়া শরীরটা সারিয়া তবে দেশে যাইয়ো। আমিও মনে মনে ইহাই স্থির করিলাম। আগে দিন-কতক লাহোরে থাকিয়া শরীরকে সুস্থ করিয়া পরে দেশে যাইব, স্থির করিয়া লাহোরে আসিলাম।

অপরিচিত স্থানে কোথায় যাই, কি করি, কোথায় বাসা স্থির করি, এই সকল ভাবিতে ভাবিতে আমি চকে আসিলাম; অন্যমনস্ক ভাবে চারিদিকে চাহিতেছি, এমন সময়ে সহসা পাদ্দিক হইতে কে আমার ঋন্ধে হস্ত স্থাপন করিয়া বলিল, ডাক্তার বসু যে!

আমি চমকিত হইয়া ফিরিলাম। দেখিলাম, আমার রাওলপিণ্ডির বন্ধু রামেশ্বর প্রসাদ। ইনি রাওলপিণ্ডিতে ওকালতী করিতেন; আমার সহিত বিশেষ বন্ধুত্ব হইয়াছিল। বলা বাহুল্য, অপরিচিত স্থানে একটি পূর্ব বন্ধুর সাক্ষাৎ পাইয়া আমার হৃদয়ে বিশেষ আনন্দের সঞ্চার হইল।

বন্ধু বলিলেন, কাবুল হতে কবে ফিরিলে হে? মনে করিয়া এ অধমকে কি একখানা চিঠি লিখিতেও নাই?

আমি বলিলাম, পল্টনের সঙ্গে গেলে যে কি অবস্থায় থাকতে হয়, তাহা যাহারা না গিয়াছে তাহারা বুঝিবে না। দেখিতেছ ত আমার অবস্থা।

তিনি বলিলেন, তাই ত, একেবারে যে অস্থিচর্মসার হয়েছ? দিনকতক এ দেশে থেকে শরীর ভাল না করে দেশে যেয়ো না।

আমি বলিলাম, তাই কিছুদিন লাহোরে থাক্‌ব বলে এসেছি। ছ মাসের ছুটিও পেয়েছি।

তিনি। কোথায় থাকবে?

আমি। একটা বাসা খুঁজছি। অচেনা জায়গা, তাতে শরীর বড় খারাপ। একটা মনের মত জায়গা না হলে বড় কষ্ট পেতে হবে। লাহোরে তোমার ত সবই চেনা-শোনা আছে। আমাকে একটা ভাল বাসা ঠিক করে দাও দেখি।

তিনি। কি আশ্চর্য! আজ আর একজনও আমাকে বাসা খুঁজে দিতে বলছিলেন।

আমি। তিনি কে?

তিনি। তিনিও বাঙ্গালী। সম্প্রতি লাহোরে বেড়াতে এসেছেন। দিন-কতক-এখানে থাকবেন। বোধ হয়, কিছু কাজ-কর্ম আছে। কিন্তু লোকটার সঙ্গে তোমার পোযাবে কি না, সেটা ঠিক বলতে পারি না।

আমি। কেন?

তিনি। লোকটার অনেক রকম খেয়াল আছে বলে, বোব

আমি। তা থাক, একলা থাকার চেয়ে দুজনে থাকলে অনেকটা ভালই কাটবে।

তিনি। তবে চল, তার সঙ্গে তোমার আলাপ করে দিই। আমার সন্ধানে একটা বেশ ভাল ছোট বাড়ী আছে। তোমাদের দুজনের থাবার পক্ষে সেটি বেশ হবে।

আমি। তিনি এখন কোথায় আছেন?

তিনি। মসাফেরখানায় আছেন।

আমি আশ্চর্যান্বিত হইয়া বলিলাম, মসাফেরখানায়! তিনি বলিলেন, হাঁ, আলাপ হলেই বুঝবে। তবে পোয় পোষায় সে তুমি বুঝে নিয়ে।

আমরা উভয়ে তখন মসাফেরখানার দিকে চলিলাম। তথায় আসিয়া দেখিলাম, একটি বাঙ্গালী ভদ্রলোক কতকগুলি বোতল, শিশি আরক লইয়াই বড় ব্যতিব্যস্ত। আমাদের পদশব্দে তিনি চকিতে একবার মস্তক তুলিলেন। মহেশ্বর প্রসাদকে দেখিয়া বলিলেন, আসুন, আসুন, কি সৌভাগ্য!

মহেশ্বর প্রসাদ বলিলেন, আগে আপনাদের দুজনের পরিচয় করিয়া দিই। ইনি আপনাদেরই দেশের লোক, ডাক্তার বসু। তৎপরে তিনি আমার দিকে ফিরিয়া বলিলেন, গোবিন্দ বাবু আমার বিশেষ বন্ধু।

তখন গোবিন্দ বাবু তাড়াতাড়ি উঠিয়া আমার হস্ত সবেগে বিলোড়ন করিয়া বলিলেন, কাবুল থেকে কবে ফিরিলেন?

আমি আশ্চর্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনি কিরূপে জানিলেন যে, আমি কাবুলে গিয়াছিলাম?

তিনি মৃদু হাসিয়া বলিলেন,সে কথা থাক্‌,আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে বড়ই সুখী হলেম। দেশের লোক–বিদেশে দেখা হলে স্বভাবতঃই বড় আনন্দ হয়।

মহেশ্বর বাবু বলিলেন, আপনি বাসা খুঁজছিলেন,ইনিও খুঁজছেন। আমি একটা ছোট বাড়ী ঠিক করেছি, সেখানে আপনারা দুজনে খুব ভালই থাকবেন।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, আরও ভাল, তবে একসঙ্গে থাবার আগে দুএকটা কথা হওয়া ভাল। আমি তামাকটা বড় ঘন ঘন খাই—চুরুট ত সৰ্ব্বদা মুখেই থাকে—আপত্তি আছে কি?

আমি বলিলাম, কিছু না,আমিও খাই।

গোবিন্দ। ভাল। সব আগে বলা ভাল। আমার মাঝে মাঝে একটা রোগ আছে। মৌনী হয়ে যাই। তখন কারও সঙ্গে কথা কই না। ক্রমে দুই চার দিনে আবার ঠিক হয়ে আসি।

আমি। আমারও যে এ রোগ নাই, তা নয়; তবে রোগটা এক সময়ে দুজনের হলেই বড় ভাল হয়।

গোবিন্দ। বেশ, খুব ভাল। আরও একটা কথা, আমার কাছে রং-বেরংয়ের লোক আসে, তাতে আপনার কোন আপত্তি আছে?

আমি। আপনার কাছে আসিবে, তাতে আমার আপত্তির কারণ কি?

গোবিন্দ। আমি মাঝে মাঝে সেতার বাজাই। বাদ্যি-বাজনা পছন্দ করেন?

আমি। সুমিষ্ট বাজনা, বিশেষতঃ সেতার, কে না পছন্দ করে?

গোবিন্দ। ভাল খন আপনার বিষয় বলিতে পারেন।

আমি লোকটি কথাবার্তায় বিশেষ আশ্চর্যান্বিত হইয়াছিলাম। বলিলাম, দেখিতেছেন ত আমার শরীর। শরীর শোধরাইবার জন্যই দিন-কতক লাহোরে থাকা, একটু নিশ্চিন্ত থাকিতে পারিলেই হইল।

তিনি বলিলেন, পোষাবে। তৎপরে মহেশ্বর প্রসাদের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, চলুন, এখন বাড়ীটা একবার দেখা যাক।

আমরা তিন জনে একখানি এক্কা ভাড়া করিয়া সহরের এক প্রান্তে, আসিলাম। তথায় মহেশ্বর প্রসাদ একটী ছোট বাড়ীতে আমাদের লইয়া গেলেন। বাড়ীটি বেশ, চারিদিক খোলা, সামনে একটু বাগানও ছিল। আমাদের উভয়েরই বাড়ীটি বেশ পছন্দ হইল। আমরা সেইদিনেই তথায় আসিব, স্থির করিলাম।

সন্ধ্যার পূর্বেই আমাদের জিনিষপত্র লইয়া আমরা সেই বাড়ীতে গিয়া উঠিলাম। মহেশ্বর বাবু, পাচক ও ভৃত্য স্থির করিয়া দিলেন।

মহেশ্বর বাবু বিদায় হইবার সময় আমি তাঁহার সঙ্গে রাস্তা পর্য্যন্ত আসিলাম; তিনি হাসিতে হাসিতে বলিলেন, গোবিন্দ বাবুকে বুঝিলে?

আমি বলিলাম, না, ক্ৰমে বুঝিব।

তিনি আবার হাসিয়া বলিলেন, তুমি বুঝিতে পার আর না পার, উনি তোমাকে এক ঘণ্টাতেই বুঝিয়া লইবেন। লোকটা বড়ই ক্ষমতাপন্ন।

আমি বলিলাম, তাত কতক বুঝিতেছি। ইনি কি কাজ-কর্ম করেন, জান?

ক্রমে জাতে পাবে। বলিয়া তিনি হাসিতে হাসিতে চলিয়া গেলেন।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

প্রথমে গোবিন্দ বাবুর সঙ্গে বসবাস করা পোষাইবে কি না, এ সম্বন্ধে আমার একটু ভাবনা হইয়াছিল, কিন্তু কয়েক দিন একত্রে থাকায় দেখিলাম যে, তাঁহার সহিত বাসে কোনরূপ অসুবিধা হইবার সম্ভাবনা নাই। যখন তিনি বাসায় থাকিতেন, তখন তাঁহার শিশি বোতল, কাগজ-পত্র, বই লইয়াই ব্যস্ত থাকিতেন। আহারাদির পর প্রায়ই বাহির হইয়া যাইতেন। রাত্রে কোন কোন দিন আমার সহিত কথোপকথন করিতেন, কোন দিন বা তিনি আমাকে তাঁহার প্রিয় সেতার শুনাইতেন। দেখিলাম, তিনি সুন্দর সেতার বাজাইতে পারেন।

প্রথমে আমি ভাবিয়াছিলাম, আমারও যেমন এখানে কোন বন্ধুবান্ধব নাই, বোধ হয় ইহারও তাহাই; কিন্তু ক্রমে দেখিলাম, তাহা নহে। এক দিন একজন পুলিসের ইনস্পেক্টর তাঁহার সহিত দেখা করিতে আসিলেন; আর এক দিন সূরযমল বলিয়া একটি ভদ্রলোক আসিলেন। পূর্বে যে তিনি আমাকে বলিয়াছিলেন যে তাহার নিকট রং-বেরংয়ের লোক আসে, এখন দেখিলাম তাহা সত্যই। প্রায় প্রত্যহই তাহার নিকট রকমের নানা লোক আসিতে লাগিল। তিনি তাহাদের সহিত গোপনে কথা-বার্তা কহিতেন। কি কথা হইত, তাহা আমি জানিতে পারিতাম না। জানিবার ইচ্ছা করা অন্যায় বিবেচনা করিয়া আমি কখনও সে বিষয়ে উৎসুকও হই নাই। তিনি কি কাজ কর্ম করেন, তাহাও তাহাকে কখনও জিজ্ঞাসা করি নাই। ভাবিলাম, তিনি নিজেই একদিন কথায় কথায় বলিয়া ফেলিবেন, আমার জিজ্ঞাসা করা ভাল দেখায় না।

একদিন দেখিলাম, একখানা পাওনিয়র কাগজ তাহার পার্শ্বে পড়িয়া আছে। একটা প্রবন্ধের পার্শ্বে লালকালীর দাগ দেওয়া রহিয়াছে; দেখিয়া পড়িতে আরম্ভ করিলাম। দেখিলাম, প্রবন্ধটির নাম জীবন-পৰ্যবেক্ষণ। নূতন নাম দেখিয়া একটু বিশেষ আগ্রহে সহিত পড়িতে লাগিলাম। পড়িয়া কিন্তু সন্তুষ্ট হইতে পারিলাম না। একজন লোক আশে পাশের সকল বিষয় বিশেষরূপে দেখিলে যে কত দূর শিক্ষা লাভ করিতে পারেন, তাহাই প্রমাণ করিবার চেষ্টা হইয়াছে। লেখক বলেন, চেষ্টা করিলে যে-কেহ অপরের চক্ষু দেখিয়া, মুখের ভাব দেখিয়া, তাহার হাবভাব বুঝিয়া, অনায়াসে সেই লোকের হৃদয়ের অন্তস্তম প্রদেশের কথাও জানিতে পারেন। এরূপ লোকে নিকট কিছু গোঁন করা বা মনের ভাব লুকাইয়া রাখা বা কোন রূপ প্রতারণা করা অসম্ভব। লেখক বলেন–

যেমন চিন্তাশীল নৈয়ায়িক এক ফোঁটা জল দেখিয়া অদৃষ্টপূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের অস্তিত্ব অনায়াসে স্থির করিতে পারেন, সেইরূপ যে ব্যক্তি সকল বিষয় বিশিষ্টরূপে দেখেন, তিনি মনুষ্য জীবনের সকল কথাই অনায়াসে অবগত হইতে পারেন। তবে এ বিদ্যা শিক্ষা বিশেষ পরিশ্রন সাধ্য। ইহা শিক্ষার জন্য আশে-পাশের লোকদিগকে বিশেষরূপে দেখা আবশ্যক। সকল বিষয়ে বিশেষ নজর রাখা প্রয়োজন। এইরূপে চেষ্টা করিলে সকলেই একজন লোককে দেখিয়া অনায়াসেই তিনি কি কাজ করেন, তাহার মনের কথা কি, তাহা বলিয়া দিতে পারেন–ইত্যাদি।

আমি কাগজখানা ফেলিয়া দিয়া বলিলাম, বলা সহজ, করা শক্ত। এ যদি হত, তাহা হলে জগতের অনেক দুঃখ ঘুচিত।

গোবিন্দ বাবুর কর্ণে সে কথা প্রবেশ করিবামাত্র তিনি আমার দিকে ফিরিয়া চাহিয়া বলিলেন, ব্যাপার কি?

আমি বলিলাম, এই প্রবন্ধটা দেখিতেছি আপনিও পড়িয়াছেন; কেবল পড়া নয়,দাগ দিয়াও রাখিয়াছেন। ঘরে চেয়ারে বসিয়া এ রকম লেখা সহজ, কিন্তু কাজে করাই শক্ত। আমার এ বিশ্বাসই হয় না। এই লেখককে যদি ভীড়ের সময়ে একখানা থার্ডক্লাস রেল গাড়ীর ভিতর বসাইয়া বলি, বাপুহে, বল দেখি, যে এই সকল লোকের কার কি ব্যবসা? কার কি মনের ভাব? যদি কেউ তা ঠিক বলতে পারে, তা হলে আমি তার কাছে সেই মুহূর্তে হাজার টাকা হাতে প্রস্তুত আছি।

গোবিন্দ বাবু একটু হাসিয়া বলিলেন, আপনাকে তাহা হইলে টাকা হারিতে হয়। এ প্রবন্ধ আমিই লিখেছি।

আমি একটু অপ্রস্তুত হইলাম। আশ্চর্যান্বিত হইয়া বলিলাম, আপনি লিখেছেন?

গোবিন্দরাম। গোবিন্দ। হাঁ, আমিই লিখেছি। ছেলে বেলা থেকে দেখে শুনে চেষ্টা-চরিত্র করে কিছু শিখেছি। এ বিষয়ে আমার একটু ঝোঁক আছে। আপনি যা বছেন, একেবারেই হয় না,অসম্ভব,-আমি বলি, অসম্ভব নয়, খুব সম্ভব। চেষ্টা করিলে সকলেই পারে। শুধু বলা নয়, প্রকৃত পক্ষে এই বিদ্যার উপর আমার গ্রাসাচ্ছাদন নির্ভর করছে।

আমি। কি রকম?

গোবিন্দ। আমার নিজের একটা ব্যবসা আছে। আপনি ডাক্তার, কন্সালটিং ডাক্তার কাকে বলে, তাতে নিশ্চয়ই জানেন।

আমি। হাঁ, বড় ডাক্তার। কঠিন পীড়া হলে ছোট ডাক্তারেরা যার পরামর্শ নিয়ে থাকে।

গোবিন্দ। সেই রকম আমি একজন কন্সালটিং ডিটেকটিভ। যখন সরকারী বেসরকারী ডিটেটিভেরা কোন বিষয় স্থির করতে পারেন না, বা কোন খুন জাল জুয়াচুরির কিনারা করতে পারেন না, তখন তারা আমার পরামর্শ আবশ্যক মনে করেন। আমি তাদের ঠিক পথ বলে দি, তাঁরা সেই পথ ধরে ঠিক রহস্যভেদ করতে পারেন। আমিও আমার ফি পাই।

আমি। আপনি কি বলতে চান যে আপনি ঘরে বসে কিছু না দেখে, কেবল শুনে ঠিক পথ বলে দিতে পারেন? ভাল ভাল ডিটেটিভেরা যা পারে না, আপনি ঘরে বসে তাহাই পারেন?

গোবিন্দ। হাঁ, এ বিদ্যা আমি অনেক পরিশ্রমে শিক্ষা করেছি। ইহাই আমরা ব্যবসা। তবে সব সময়েই যে ঘরে বসে পরামর্শ দিই, তা নয়। যদিও আমি পুলিশে কাজ করি না, তবুও লোকে আমাকে গোবিন্দ দারোগা বলে। ভারতবর্ষের সকল স্থানের বড় বড় ডিটেকটিভ আমার পরামর্শ নিতে আসেন। নানাস্থান আমাকে দেখতে হয়। এই দেখুন না, এখন লাহোরে; আবার এক সময় হয়ত দেখবেন বিহারে বিরাজমান।

আমি সে কথার কোন উত্তর করিলাম না, দেখিয়া তিনি বলিলেন, আমার কথা আপনার বিশ্বাস হয় না। আপনার সঙ্গে আমার যে দিন প্রথম দেখা হয়, সেদিন আমি আপনাকে দেখবামাত্র বলেছিলাম,

কাবুল হতে কবে এলেন, স্মরণ আছে?

আমি। আছে।

গোবিন্দ। কেমন করে বলে?

আমি। নিশ্চয়ই কেউ আপনাকে আগে বলেছিল।

গোবিন্দ। না, তা নয়। শুনলেম আপনি ডাক্তার। দেখলাম, আপনার পরা খাকি,পায়ে আমোনিসন বুট,শরীরের জীর্ণাবস্থা, কাজেই তখনি বুঝ লেম যে, আপনি নিশ্চয়ই কাবুলের যুদ্ধে গিয়েছিলেন। ছুটী নিয়ে ফিরেছেন।

আমি। বুঝিয়ে দিলে খুব সহজ, সন্দেহ নাই। আপনার কথায় বিখ্যাত ফরাসী গোয়েন্দা লিকোর কথা, আমার মনে পড়ল।

গোবিন্দ বাবু একটু হাসিয়া বলিলেন, লিকো খুব উদ্যমশীল গোয়েন্দা বটে, তবে বৈজ্ঞানিক নয়, লিকো যা ছ মাসে কতো আমি তা একদিনে করি।

আমি গোবিন্দ বাবুর কথায় মনে মনে বড় বিরক্ত হইলাম। ভাবিলাম, লোকটা ভারি অহঙ্কারী। আর কিছু না বলিয়া আমি জানালা দিয়া। মুখ বাহির করিয়া রাস্তার দিকে চাহিলাম। দেখিলাম, একটা লোক যেন কোন বাড়ী খুঁজিয়া বেড়াইতেছে। বলিলাম, রাস্তায় একটা লোক কার বাড়ী খুঁজে বেড়াচ্ছে।

গোবিন্দবাবু সেইদিকে চাহিয়া বলিলেন, কে, ঐ লোকটা? পল্টনের পেন্‌সনী সুবেদার দেখছি, এখন পুলিসের জমাদারী কছে।

আমি মনে মনে বলিলাম, আমাকে বাহাদুরী দেখান হচ্ছে। নিশ্চয়ই একে চেনেন। আর না চিলেও জানেন যে, উনি যা বলবেন, আমি তাই বিশ্বাস করব।

এই সময়ে সেই লোক আমাদের বাসায় প্রবেশ করিল। আমরা উভয়ে অগ্রবর্তী হইলাম। সে বলিল, আমি গোবিন্দ দারোগা সাহেবকে খুঁজছি। এই কি তার বাসা?

গোবিন্দ। আমিই গোবিন্দ দারোগা। কি চাও বাপু?

সে সেলাম দিয়া বলিল, ডিটেকটিভ-ইনেস্পেক্টর সূরযমল সাহেব এই পত্র দিয়েছেন।

গোবিন্দ বাবু পত্ৰ লইয়া খুলিলেন। আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তুমি কি কাজ কর?

সে বলিল, আগে পল্টনে সুবাদারী করতেন, এখন পেন্‌সন নিয়ে পুলিসে জমাদারী কচ্ছি।

পত্রের কোন উত্তর নাই, শুনিয়া সে সেলাম দিয়া চলিয়া গেল।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

গোবিন্দ বাবু পত্র পাঠ করিয়া আমার দিকে ফিরিয়া বলিলেন, আমি বুঝতে পেরেছি, আপনি মনে করেন এই লোকটাকে আমি আগে চিনতেম, তা নয়। আমি কোন জন্মে ওকে আগে দেখি নাই।

আমি বলিলাম, তবে কি করে জানলেন যে, ও আগে পল্টনে ছিল, এখন পুলিসে আছে?

গোবিন্দ বাবু হাসিয়া বলিলেন, অতি সহজে জানা যায়। আপনি যদি এ বিদ্যা শিক্ষার চেষ্টা করতেন, তা হলে আপনিও সহজে বলতে পাতেন। আমি দেখলেম, লোকটার বুকে একখানা মেডেল ঝুলছে, চলন সাধারণ সিপাইয়ের মত নয়, আফিসারের ধাঁজা; সুতরাং বুঝলেম, লোকটা পল্টনে সুবাদার ছিল। তার পর দেখলেম, বয়স হয়েছে; যদিও পুলিশের পোষাক পরা নেই, তবে মাথায় জমাদারের পাগণ্ডী রয়েছে, কাজেই তখনই বুঝলেম যে, লোকটা পেন নিয়ে এখন পুলিশের জমাদারী করছে। দেখলেন, সব বিষয়ে দৃষ্টি থাকলে কত শীঘ্র কত বিষয় জানা যায়।

আমি বলিলাম, যথার্থই আশ্চর্যজনক,সন্দেহ নাই। তিনি সেই পত্রখানি আমার হাতে দিয়া বলিলেন, পড়ুন।

আমি পড়িলাম; প্রিয় গোবিন্দ বাবু!

কাল রাত্রে সেটী-মহল্লায় একটা ভয়ানক কাণ্ড হইয়া গিয়াছে। গোলযোগ বলিয়া বোধ হইতেছে। রাত্রি প্রায় দুইটার সময় বিটের কনেষ্টবল একটা খালি বাড়ীর ভিতর একটা আলো অলিতেছে,দেখিতে পায়। সে গিয়া দেখে সদর দরজা খোলা; ভিতরে গিয়ে দেখে যে, সম্মুখের ঘরের মেয়ে একটি ভদ্রলোকের মৃতদেহ পড়িয়া আছে। খবর পাইয়াই আমরা গিয়ে উপস্থিত হই। পোষাক-পরিচ্ছদে দেখি লাম, লোকটা মারাঠী, ঘর রক্তময়, অথচ মৃতদেহের কোনখানে আঘাতের চিহ্নমাত্র নাই। পকেটে পঁয়তাল্লিশটা টাকা আর দুখানা চিঠী ছিল। ঠিকানায় লেখা শঙ্কর রাম পাণ্ডুরাং, কেয়ার অব পোষ্ট মাষ্টার লাহোর, আর একখানিতে বালকিষণ লক্ষ্মণ রাও, কেয়ার অব পোষ্ট মাষ্টার লাহোর। চিঠী একখানা খোলা, একখানা বন্ধ। আমরা যেখানকার যা সেই রকমই রেখেছি; আপনি যদি একবার অনুগ্রহ করিয়া আসেন, তবে বড়ই উপকৃত হই। আপনার জন্য অপেক্ষা করিতেছি। ইতি।
বশংবদ
শ্ৰীসূরযমল।

আমার পত্র পাঠ শেষ হইলে গোবিন্দ বাবু বলিলেন, সূরযমল লাহোর-পুলিশের একজন প্রধান ডিটেকটিভ। আর যে ইনস্পেক্টরটি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, গোয়েন্দাগিরীতে তারও খুব সুখ্যাতি আছে। তার নাম রাম সিং; কিন্তু দুজনে আদা-কাচকলার বন্ধুত্ব। দুজনেই খুব চালাক বটে, কিন্তু পূর্ব ভাবটা ঠিক বজায় রেখেছে। এই জন্যই এরা প্রায়ই খুন জাল জুয়াচুরীর কোন কিনারা করতে পারে না। তাড়াতাড়ি করে মরে। এই দুজনকে যদি এই ব্যাপারের একটু কিছু সূত্র ধরিয়ে দেওয়া যায়, তবে বড়ই মজা হয়।

তিনি যে রূপে স্থির ভাবে এই কথা বলিলেন, তাহাতে আমি আশ্চর্যান্বিত হইলাম। বলিলাম, বোধ হয়, আপনার আর দেরি করা উচিত নয়। আপনার জন্য কি একখানা গাড়ী ডেকে এনে দিব।

তিনি হাসিয়া বলিলেন, আমি যাব কি না ঠিক নাই?

আমি। কেন? আপনি ত এই চান।

গোবিন্দ। সত্য বটে, কিন্তু আমার লাভ কি? প্রশংসা হলে সে প্রশংসা সূরযমল রাম সিং এণ্ড কোম্পানীরই হবে।

আমি। এমন সময় একদিন আসবে, যখন আপনার নাম জগদ্বিখ্যাত হবে।

তিনি হাসিয়া বলিলেন, আপনার মুখে ফুল চন্দন পড়ুক। তৎপরে একটু ভাবিয়া বলিলেন, আচ্ছা গিয়েই একবার দেখা যাক্। আসুন।

আমি বলিলাম, আমিও যাব কি?

গোবিন্দ। ক্ষতি কি? যদি কোন কাজ না থাকে, আসুন না; একটা নূতন বিষয় দেখা হবে।

আমরা উভয়ে রওনা হইলাম। বাহিরে আসিয়া একখানা গাড়ী ভাড়া করিয়া কোচম্যান্‌কে সেটী-মহল্লায় লইয়া যাইতে বলিলাম। গোবিন্দ বাবু ঝিঁঝিট-খাম্বাজের গৎ ভাঁজিতে ভাঁজিতে চলিলেন।

আমি তাহার ভাব দেখিয়া বলিলাম, আপনি দেখছি, যে কাজে। যাচ্ছেন, সে বিষয়ে একটুও ভাবছেন না।

তিনি বলিলেন, সব না দেখে-শুনে মনে মনে কিছু আন্দাজ করে আগে থাকতেই ধারণাটা খারাপ করা বড়ই ভুল। এতে আর পরে বাধীন চিন্তার ক্ষমতাটা থাকে না।

কিয়ৎক্ষণ পরে গাড়োয়ান গাড়ী থামাইয়া বলিল, এই সেটী-মহল্লা।

গোবিন্দ বাবু গাড়ী হইতে নামিলেন; সঙ্গে সঙ্গে আমিও নামিলাম। তিনি কোচম্যানকে গাড়ী লইয়া সঙ্গে সঙ্গে আসিতে বলিয়া হাঁটিয়া চলিলেন। নিকটস্থ একজন কনেষ্টবলকে জিজ্ঞাসা করিলেন, কাল রাত্রে কোন্ বাড়ীতে খুন হয়েছে?

সে দেখাইয়া দিল। আমরা বাড়ীর সম্মুখে আগিয়া দেখিলাম, বাটার চারিদিকে প্রাচীর আছে, সম্মুখে একটি গেট, ঐ গেট হইতে একটি পথ বাড়ীর সদর দরজার সিঁড়ী পর্যন্ত গিয়াছে। বাড়ীর সম্মুখে এই বাড়ী ভাড়া দেওয়া যাইবে হিন্দীতে লেখা আছে। কাল রাত্রে বৃষ্টি হইয়াছিল, সুতরাং রাস্তায় গভীর চাকার দগ অনেক মানুষের পায়ের দাগ স্পষ্টই দেখা যাইতেছে।

আমি ভাবিয়াছিলাম, গোবিন্দ বাবু প্রথমেই বাড়িতে প্রবেশ করিয়া লাস দেখিবেন; কিন্তু তিনি তাহা না করিয়া সদর রাস্তা ও বাড়ীর রাস্তা বিশেষ রূপে লক্ষ্য করিতে লাগিলেন। চারিদিক দেখিয়া ধীরে ধীরে পথের ধারে ঘাসের উপর দিয়া চলিতে আরম্ভ করিলেন। আমাকেও সেইরূপ করিতে বলিলেন।

* *****

বাড়ীর দরজায় একজন কনেষ্টবল দাঁড়াইয়া জনতা দূর করিবার চেষ্টা পাইতেছে; চেষ্টা বৃথা, কেহ সেখান হইতে নড়িতেছে না। বাড়ীর ভিতর কি হইয়াছে ও হইতেছে দেখিবার জন্য উৎসুক হওঁ। সেই দিকে মাথা তুলিয়া চাহিতেছে। আমরা উপস্থিত হইলে সেই দ্বার রক্ষক কনেষ্টবল একটা সেলাম করিয়া সরিয়া দাঁড়াইল।

এই সময়ে সূরযমল নিকটে আসিয়া বলিলেন, আপনার আসায় বড়ই বাধিত হলেম। যা যেখানে ছিল, আপনার জন্য তা সব ঠিক সেই রকমই রেখেছি।

গোবিন্দরাম। গোবিন্দ বাবু পথের দিকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, কেবল ঐটী। এক দল মহিষের আমদানী হলেও ত বোধ হয়, রাস্তা এমন বখৎ হত না। নিশ্চয়ই, সূরযমল সাহেব, রাস্তাটা এ রকম হতে দেবার আগে আপনি এটা বিশেষ লক্ষ্য করেছিলেন।

সূরযমল একটু অপ্রস্তুত হইলেন। বলিলেন, আমি ভিতরের ব্যাপার নিয়েই বড় ব্যস্ত ছিলাম। রাম সিং সাহেব এখানে ছির ন, তিনি নিশ্চয়ই সব লক্ষ্য করেছেন।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, আপনাদের মত দুজন সুদক্ষ লোক যখন রয়েছেন, তখন সকলবিষই লক্ষ্য করেছেন সন্দেহ নাই।

সূরযমল উৎসাহের সহিত বলিলেন,না—না, কিছু ফাঁক পড়ে নাই। গেল। আপনি এখানে গাড়ী করে এসেছেন কি?

সুরয। না।

গোবিন্দ। রাম সিং সাহেব?

সূরয। না।

গোবিন্দ। তবে চলুন ভিতরটা একবার দেখা যাক।

আমরা সকলে একটি প্রকোষ্ঠে প্রবিষ্ট হইলাম। বহুদিন লোকের বসবাস না হওয়ায় গৃহতলে প্রায় চার আঙ্গুল ধূলা জমিয়াছে। মধ্যস্থলে একটি মৃতদেহ পড়িয়া আছে। লোকটি ছাদের দিকে বিকটভাবে চাহিয়া রহিয়াছে। আমি যুদ্ধে অনেক অনেক ভয়াবহ মৃতদেহ দেখিয়াছি, কিন্তু এই লাসের মুখের মত বিভীষিকাময় বিকৃত মুখ আর কখনও দেখি নাই। দেখিলে বোধ হয়,যেন লোকটা গুরুতর পাপী, মৃত্যু সময়ে কি ভয়ানক যন্ত্রণা ভোগ করিয়াছিল। এই মৃতদেহ দেখিয়া আমার শিরায় শিরায় প্রবল বেগে রক্ত ছুটিল। আমি গোবিন্দ বাবুর দিকে চাহিলাম। দেখিলাম, তিনি অতি স্থির চিত্তে এই মৃতদেহ বিশেষ রূপে লক্ষ্য করিতেছেন।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

আমরা দেখিলাম, রাম সিং আশে-পাশের ঘর সকল দেখিতেছেন। তিনি আমাদের দেখিয়া নিকটে আসিয়া বলিলেন, খুব গোলমেলে মালা, সন্দেহ নাই। আমি অনেক খুন দেখেছি, কিন্তু এই খুনের মর্ম কিছুই বুঝতে পারছি না।

সূরযমল ও বলিলেন, হাঁ, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

গোবিন্দ বাবু হাঁটু পাতিয়া বসিয়া মৃতদেহ বিশেষ রূপে পরীক্ষা করিতে লাগিলেন; জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনারা নিশ্চয় দেখেছেন যে কোনখানে কোন অস্ত্রের দাগ নাই। ঘরময় তো রক্ত।

উভয়েই বলিলেন, আমরা বিশেষ করে দেখেছি। লাসের কোন খানে অস্ত্রাঘাতের কোন চিহ্ন নাই।

গোবিন্দ। তা হলে এই রক্ত নিশ্চয়ই আর এক জনের। সম্ভবত সেই লোকই এই খুন করেছে।

রাম। সেটা কিরূপে সম্ভব?

গোবিন্দ। সম্ভব সব। আপনি কি বোম্বের পেষ্টনজী তোরাবজীর খুনের কথা পড়েন নাই?

রাম। না।

গোবিন্দ। পড়া উচিত। সংসারে প্রায়ই নূতন কিছু হয় না। যা হয়েছে তাই হয়।

বলিয়া গোবিন্দ বাবু মৃতদেহের সর্বাঙ্গ বিশেষ রূপে পরীক্ষা করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন, তবে কোন অস্ত্রে এর মৃত্যু হয় নাই— রক্ত অন্যের। পকেটে টাকা ছিল, সুতরাং টাকার জন্যেও কেহ একে খুন করে নাই। যাক্, যা দেখবার দেখা হয়েছে। এখন লাশ চালান দিতে পারেন।

লাস চালান দিবার বন্দোবস্ত পূৰ্বেই স্থির ছিল। শববাহিগণ লাস তুলিবার উদ্যেগ করিলে লাসের বস্ত্র মধ্য হইতে একটি সুন্দর ইয়ারিং ইক করিয়া মাটিতে পড়িয়া গেল। রাম সিং গিয়া এস্তে সেটা তুলিয়া লইয়া বলিলেন, দেখছি, এটি কোন স্ত্রীলোকের ইয়ারিং, তবে এখানে একজন স্ত্রীলোকও উপস্থিত ছিল।

আমরা সকলে সেই ইয়ারিংটি বিশেষ করিয়া দেখিতে লাগিলাম।

সূরবমল বলিলেন, এতে আরও রহস্য ক্রমে বেড়ে উঠছে।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, কেন? এতে কি আপনি মনে করেন যে, এ খুনের কিনারা করা সহজ হবে? পুলিশ কৰ্ম্মচারিদ্বয়ের কেহই কোন উত্তর করিলেন না।

তখন গোবিন্দ বাবু বলিলেন, ডাকঘরে খবর নেওয়া হয়েছে কি?

সূরয। হা, পত্ৰ এরা ডাকঘর থেকেই নিয়ে যেতেন; তবে, একজন পিয়ন একবার এদের বাসা দেখেছিল, সে চিঠী বিলি কছিল, এই সময় এদের একজন একটা বাড়ী হতে বার হচ্ছিলেন। সে সেলাম করলে একজন বলেন, এই বাড়ীতে আমরা থাকি। সকালে সে পিয়ন ডাকঘরে ছিল না। তার সন্ধানে আবার লোক পাঠিয়েছি।

গোবিন্দ। ভাল, এর পকেটে যে চিঠী আছে তা নাসিক থেকে এসেছে দেখছি। নাসিকে টেলিগ্রাফ করেছেন?

সূরয। হাঁ, এখনও উত্তর পাই নাই।

গোবিন্দ। কি টেলিগ্রাফ, করেছেন, শুতে পাই?

সূরয। ঘটনা সব জানিয়ে জিজ্ঞাসা করেছি, তারা কিছু খবর দিতে পারেন কি না।

গোবিন্দ। কেবল এই? সূরয। আর বিশেষ কি টেলিগ্রাফ করব?

এই সময়ে রাম সিং পশ্চিম দিক্কার গৃহ-প্রাচীর দেখাইয়া দ্বিয়া বলিলেন,দেখুন, দেখুন। আমরা সকলে সেইদিকে চাহিয়া দেখিলাম যে, তথায় বড় বড় অক্ষরে কি লেখা আছে। নিকটে গিয়া দেখিলাম, সুস্পষ্ট রক্তে লেখা–

সাজা

রাম সিং সোৎসাহে বলিলেন, দেখুন এটা রক্তে স্পষ্ট লেখা। লিখিবার সময় ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরে পড়েছিল, তাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। যা হোক্, এতে লোকটা যে আত্মহত্যা করে নাই, তা জানা যাচ্ছে। যে একে খুন করেছে, সেই কাল রাত্রে এটা লিখে গেছে।

সূরয। তা তো বুঝতে পারা গেল, কিন্তু তুমি এ দেখে কি ভাবছ বল দেখি?

রাম। আমার স্পষ্টই বোধ হচ্ছে, এই ব্যাপারে কোন-না-কোন স্ত্রীলোক জড়িত আছে; পরে জানা যাবে। বোধ হয়, সেই স্ত্রীলোকের, নাম সাজাদী। লোকটা লিখতে গিয়ে তাড়াতাড়িতে চলে গেছে।

গোবিন্দ বাবু এতক্ষণ নীরবে দাড়াইয়া ছিলেন ; এক্ষণে বলিলেন, ঘরটা এতক্ষণ আমি বিশেষ পরীক্ষা করি নাই। আপনাদের যদি কোন আপত্তি না থাকে ত এখন দেখতে পারি।

উভয় পুলিশ-কর্ম্মচারীই বলিয়া উঠিলেন, নিশ্চয়ই দেখিতে পারেন।

তখন গোবিন্দ বাবু পকেট হইতে একটা মাপের টেপ, বাহির করিয়া ঘর ও প্রাচীরের নানা স্থান মাপিতে লাগিলেন। ঘরের মেজে বিশেষ রূপে পৰ্যবেক্ষণ করিতে লাগিলেন। এক স্থান হইতে কতক গুলি সাদা ধূলা বা ছাই যন্ত্রে সংগ্রহ করিয়া একটা কগজে মুড়িয়া পকেটে রাখিলেন। তৎপরে চারিদিক বিশেষ রূপে লক্ষ্য করিয়া পকেট হইতে ধীরে ধীরে একখানি ম্যাগ্নিফাইং গ্লাস বাহির করিলেন। ঐ গ্লাস দ্বারা নানা স্থান দেখিলেন। রক্তে লেখা কথাটি উহার দ্বারা খুব ভাল করিয়া দেখিতে লাগিলেন। আমরা সকলে নীরবে; দাঁড়াইয়া তাহার কাৰ্য-কলাপ দেখিতে লাগিলাম।

কিয়ৎক্ষণ পরে ধীরে ধীরে গ্লাসখানি পকেটে রাখিয়া গোবিন্দ বাবু বলিলেন, হয়েছে। এখন যেতে পারা যায়।

সূরযমল বলিলেন, আপনি কি মনে করেন?

গোবিন্দ। আপনারা যেরূপ এ বিষয়ে চেষ্টা করছেন, তাতে আমার এখন কিছু বলা ধৃষ্টতা মাত্র। তবে আপনারা কতদূর কি করেন, যদি তা আমায় জানান, তবে পরে আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে যতদূর সম্ভব হয়, তা আমি বলতে পারি। কাল রাত্রে এ বিটে যে কনেষ্টবল ছিল, তার সঙ্গে আমি একবার দেখা করতে চাই।

রাম। সে এখন থানায় আছে। সেখানে গেলেই দেখা হতে পারে।

গোবিন্দ। আমি এখনই তার সঙ্গে দেখা কব মনে করেছি।

আমরা সকলে বাড়ীর বাহিরে আসিলাম। বিদায় হইবার সময়  গোবিন্দ বাবু গম্ভীর ভাবে বলিলেন, রাম সিং সাহেব, আপনি কোন স্ত্রীলোকের সন্ধানে বৃথা সময় নষ্ট করবেন না। কোন স্ত্রীলোক এখানে কাল রাত্রে ছিল না—দুজন মাত্র লোক ছিল। লোকটা খুন হয়েছে, আত্মহত্যা করে নি। যে খুন করেছে-সে পুরুষ, স্ত্রীলোক নয়। সে ছয় ফুটের চেয়ে লম্বা, বয়সে যুবক, পা দেহের পরিমাণে ছোট। অতি মোটা, নাগরা জুতা পায়ে ছিল। বর্ম্মা চুরুট খাচ্ছিল। সে এই লোকটাকে একখানা এক্কায় এখানে এনেছিল। এক্কার ঘোড়ার তিনটা লাল পুরাণ ও একটা নূতন ছিল। লোকটার সম্ভবমত যক্ষ্মা বা রক্ত পিত্তের ব্যারাম আছে। এখন এই পর্যন্ত বলতে পারি।

গোবিন্দ বাবুর কথা শুনিয়া আমরা তিন জনই বিশেষ আশ্চৰ্য্যাম্বিত হইলাম। কেহই কোন কথা কহিলাম না। অবশেষে সূরযমল বলিলেন, যদি খুনই হয়ে থাকে, তবে কি করে খুন হল?

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, বিষে। তৎপরে রাম সিংহের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, লোকটা সাজা লিখতে গিয়ে তাড়াতাড়ি চলে গিয়েছিল। সাজা উর্দ্দু, কথা, মানে প্রতিহিংসা; সুতরাং আপনি সাজাদী নামের মেয়ে মানুষ খুঁজতে অনর্থক সময় নষ্ট করবেন না। এই বলিয়া তিনি আমার হাত ধরিয়া দ্রুতপদে বাহিরে আসিয়া গাড়ীতে উঠিলেন।

গাড়ী থানার দিকে ছুটিল।

সরমল আমাদের সঙ্গে একজন কনেষ্টবল দিলেন।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

তথা হইতে বহির্গত হইয়া গোবিন্দ বাবু গাড়োয়ানকে তার অফিসে যাইতে আজ্ঞা করিলেন। তথায় একটি টেলিগ্রাফ করিয়া তিনি আবার আসিয়া গাড়ীতে উঠিলেন; তৎপরে বলিলেন, যদিও এ সম্বন্ধে আমি একটা স্থির ধারণ করিয়াছি, তবুও আরও কিছু জানা ভাল।

আমি বলিলাম, আমি আপনার কথায় আশ্চর্যান্বিত হইয়াছি। সত্য সত্যই কি আপনি উহাদের দুইজনকে যাহা বলিলেন, তাহা বিশ্বাস করেন?

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, ইহাতে ভুল হইবার কোন সম্ভাবনা নাই। আমি প্রথমেই পথে লক্ষ্য করিলাম যে একখানা এক্কার চাকার দাগ কাদায় স্পষ্ট দেখা যাইতেছে। কাল রাত্রি বারটা-একটার সময় বৃষ্টি হইয়াছিল, সুতরাং এই এক্কা নিশ্চয়ই এখানে একটার পরে আসিয়াছে। বোধ হয়, আপনাকে বলিতে হবে না যে, একার চাকার দাগ আর অন্যান্য গাড়ীর চাকার দাগ সকলই স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র। তার পর একটা ঘোড়ার পায়ের দাগ পড়িয়াছে; পায়ের তিন পায়ের অপেক্ষা এক পায়ের দাগ বেশী বসিয়াছে, সুতরাং বুঝিতে বেশী কষ্ট হয় না যে ঐ নালটা অপর তিনটা হতে নূতন ছিল।

আমি। যথার্থই আপনার কথায় আমি অবাক হচ্ছি।

গোবিন্দ। না না,অবাক হবার কিছুই নাই। চেষ্টা করিলে সকলেই এরূপ পারেন। তার পর এই গাড়ীখানা ভিন্ন যে আর কোন গাড়ী এখানে আসে নি, তা আর কোন গাড়ীর চাকার দাগ না দেখতে পেয়েই স্পষ্ট বুঝতে পারা যায়। আর দুজনের বেশী লোক যে এক্কায় আসে নাই তাও আমি বুঝলেম, ঘোড়র পায়ের দাগ দেখে। ঘোড়াটা স্থির হয়ে দাড়িয়ে ছিল না। পায়ের দাগ দেখে বোঝা যায়,এদিক ওদিক করছিল। যদি কেউ এর রাস ধরে বা মুখ ধরে থাকত, তবে ঘোড়া কখনও এমন করতে পারে না। লোকটা অপর লোককে নিয়ে বাড়ীর ভিতর গিয়েছিল, গাড়ী এমনই রাস্তায় দাড়িয়ে ছিল। গাড়ীর কাছে কোন লোক ছিল না। আর সাক্ষী সঙ্গে করে কেউ খুন করতে আসে না। আর কেবল দুজন লোক যে বাড়ীর ভিতর গিয়েছিল, তা তাদের পায়ের দাগেই বেশ জানা যায়। আমি কেবল দুজন লোকের পায়ের দাগই লক্ষ্য করেছিলাম, আর অধিক লোকের পায়ের দাগ দেখা যায় না। আরও লক্ষ্য করেছি, একজনের পায়ে নাগরা জুতা,একজনের পায়ে বিলাতী জুতা; যাঁর বিলাতী জুতা, তিনি এই মরে পড়ে আছেন; কাজেই নাগরা জুতাধারী মহাশয় এই হত্যা ক্রিয়া সম্পন্ন করে স্বস্থানে প্রস্থান করেছেন।

আমি। আপনি যথার্থই অদ্ভুত লোক, কিন্তু লোকটা যে ছয় ফুট লম্বা, তা কিরূপে জালেন?

গোবিন্দ। লেকের পা ফেলার দাগ দেখে শতকরা নিরনই জনের দৈর্ঘ্য বলা যায়। যে যেমন লম্বা বা বেঁটে সে তেমনই দূরে বা কাছে পা ফেলে। এ সব অনেক কথা; আর একদিন বলব।

আমি। তার পর বয়স?

গোবিন্দ। এও পা ফেলার দাগ দেখে, বলা যায়। একজন বালক যত দূরে দূরে পা ফেলে বা যেমন করে পা ফেলে, একজন যুবক বা বৃদ্ধ তেমন পারে কি? এসব বিশেষ লক্ষ্য করতে হয়, রীতিমত মনোযোগ দিয়ে শিখতে হয়। শিখতে পারূলে পা ফেলার দাগ দেখে লোকের বয়স বলা খুব সহজ।

আমি। এও যেন মানিলাম; তারপর রক্ত-পিত্তের ব্যারাম।

গোবিন্দ। এটা কতকটা আন্দাজ, তবে খুব সম্ভব। লাসের কোন থানে আঘাতের দাগ নেই, তবে ঘরে এত রক্ত এল কোথা থেকে? তা হলে এ রক্ত যে খুন করেছে তারই। কিন্তু যদি সে এই লোক টার দ্বারা আঘাতিত হয়ে থাকে, তবে, সে চুপ করে দাড়িয়ে হয় নাই। তা হলে একটা ছোটাছুটি ঠেলাঠেলি ধস্তাধস্তি হতো। তা হলে ঘরেও তার চিহ্ন থাকত। সুতরাং সে আহত হয় নি। নিজে নিজে আহত হবারও কোন কারণ নাই। যদি আত্মহত্যা করতে যেত, তা হলে সে এইখানেই পড়ে থাকৃত; এক্কায় উঠে চলে যেতে পারে না। তাই ভাবছি লোকটার রক্ত-পিত্তের বোগ ছিল। এ রোগে খুব বেশি রাগ হলে বা কোন রকমে উত্তেজিত হলে, অনর্গল রক্ত মুখ দিয়ে বার হতে থাকে। এ রক্তারক্তি ব্যাপার দেখে আমার ত তাই মনে হয়।

আমি। আর বর্মা চুরুট।

গেবিন্দ বাবু এবার একটু হাসিয়া বলিলেন, চুরুটের ছাই আমি যতটা চিনতে পারি, বোধ হয় আর কেউ ততটা পারে না। আপনি দেখলেন না, মেজে থেকে কতকটা ছাই তুলে আমি কাগজে মুড়ে পকেটে রেখেছি। এ ছাই বৰ্ম্মা চুরুটের।

আমি। যে খুন করেছে, সেই যে খাচ্ছিল তার মানে কি?

গোবিন্দ। বিলাতী জুতার এলোমেলো পা ফেলা দেখেই বুঝেছি লোকটাখুব মাতাল হয়েছিল; তারপর এর মুখ শুকেও দেখলেম, মুখে কেবল মদের গন্ধ। আর এ লোকটা যে মনে অজ্ঞান ছিল, তা সহজেই বুঝতে পারা যায়। নতুবা এ ইচ্ছে করে খুন হতে এই বাড়ীতে আসে নাই। লাসের মুখের বিকট ভাব দেখে বুঝলেন না যে, মবার সময় লোকটা তার হত্যাকারীকে চিন্‌তে পেরেছিল। বিস্ময় ভয়, রাগ, সব মিশিয়ে মুখের কি একটা ভয়ানক ভাব হয়েছে।

আমি শিহরিত হইলাম—কিয়ৎক্ষণ কোন কথাই কহিতে পারিলাম না। তৎপরে বলিলাম, ঘটনা খুব রহস্যময় সন্দেহ নাই। এই দুই জন কেন এত রাত্রে এ বাড়ীতে এল, কেনই বা একজন আর একজনকে খুন করলে? কেনই বা সে দেয়ালে সাজ লিখে গেল। বলতে কি, আমি এখনও এর কিছুই স্থির করে উঠতে পারছি না।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, ক্রমে সবই পাবেন। সে সাজ লেখে নাই, সাজা–অর্থাৎ প্রতিহিংসা বা দণ্ড লিখতে যাচ্ছিল,তাড়াতাড়িতে সবটা লিখতে পারে নি। সাজার শেষ ‘আ’রের টান মাত্র ধরেছিল। কাজেই বোঝা যায়, লোকটা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবার জন্য, খুন করেছে। বিশেষতঃ বুকে একটা বড় রকমের আঘাত না পেলে কেউ কারও প্রাণ নিয়ে টানাটানি করে না। ইয়ারিং দেখে অনুমান হয়, এর স্ত্রী বা প্রণয়পাত্রী সম্বন্ধে কোন হানি করায় এই সাজা। আর অস্ত্র ঘাতের কোন চিহ্ন না থাকায় সহজেই বোঝা যায়, লোকটা বিষে খুন হয়েছে। পরে সব জাতে পারবেন। এখন আসুন,এই পুলিশ-বারিক।

গাড়ী হইতে নামিয়া আমরা উভয়ে কনেষ্টবলের সঙ্গে পুলিশ বারিকে প্রবিষ্ট হইলাম। গত রাত্রে যে কনেষ্টবল যে বাড়ীতে খুন হইয়াছে সেইখানকার বিটে পাহারায় ছিল, সে শীঘ্রই আসিয়া গোবিন্দ বাবুকে সেলাম দিল। গোবিন্দ বাবু আমাকে ইঙ্গিত করিয়া এক খান খাটিয়ায় নিজ দেহভার অর্পণ করিলেন। আমিও বসিলাম।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

গোবিন্দ বাবু তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমিই কি কাল সেই বিটে রাত্রে পাহারায় ছিল।

সে উত্তর করিল, হাঁ হুজুর, রাত দুটা থেকে চারটা পর্যন্ত আমার পাহারা ছিল।

গোবিন্দ। আচ্ছা, তুমি সেখানে কি কি দেখেছিলে, আগাগোড়া আমাদের বল দেখি।

কনেষ্টবল। হাঁ হুজুর, আগাগোড়া যা যা হয়েছিল, সব বলে যাচ্ছি।

গোবিন্দ। হাঁ, কিছু বাদ দিও না।

কনেষ্ট। দুটোর সময় আমার বিটে গিয়ে আমার জুড়ীদারের সঙ্গে মোড়ে দাড়িয়ে কথাবার্তা করে শেষ সেটী-মহল্লার দিকে গেলাম, জুড়ীদার অন্যদিকে গেল। বড় ভারি অন্ধকার, রাস্তার আলো মিট মিট করছে, কিছুই ভাল দেখা যায় না। কোন দিকে কেউ নেই। একটু আগে বৃষ্টি হওয়ায় কাদাও খুব হয়েছে। আমি আস্তে আস্তে যাচ্ছি, এমন সময় আমার নজর হঠাৎ একটা বাড়ীর আলোর দিকে পড়ল। আমি জানতেম, সে বাড়ীটা খালি ছিল। ওলাউঠায় বাড়ীটায় তিন-চার জন মরে যাওয়ায় সেই পৰ্যন্ত বছরখানেক খালি পড়ে আছে, কেউ ভাড়া নেয় না। কেউ কেউ বলে বাড়ীটায় ভূত আছে।

গোবিন্দ। আচ্ছা ভূতের কথা পরে শুনব—এখন থাক্‌, তার পর কি হল তাই বল।

কনেষ্ট। খালি বাড়ীতে আলো দেখে ব্যাপার কি জানার জন্য আমি দরজা পর্যন্ত গেলাম, কিন্তু

গোবিন্দ। কিন্তু ভিতরে যেতে ভয় পেয়ে ফিরে এলে?

কনেষ্টবল আশ্চর্যান্বিত হইয়া গোবিন্দ বাবুর দিকে চাহিল। গোবিন্দ বাবু হাসিয়া বলিলেন, ভয় নেই, আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম না।

কনেষ্টবল কহিল, হুজুর, সে কথা ঠিক। যদিও আমি মানুষকে ভয় করিনে—কিন্তু ভূতের সঙ্গে লড়া শক্ত। তাই মনে করুলেম, জুড়ী দারকে সঙ্গে লওয়া ভাল। সেইজন্য সেখান থেকে ফিরে, রাস্তার জুড়ীদারের সন্ধানে এলেম।

গোবিন্দ। এ অবস্থায় কাকেও দেখতে পেলে?

কনেষ্ট। না, কোথাও কাকেও দেখতে পাই নি।

গোবিন্দ। তার পর তুমি আবার দরজার দিকে এলে?

কনেষ্ট। হাঁ হুজুর-সরকারী চাকরী, এতে ভয় কর চলে না। জবাবদিহি করতে হবে ভেবে আমি দরজার কাছে এসে দরজাটাতে হাত দিতেই যেন সেটা আপনা হতেই খুলে গেল। দেখি, জানালার কাছে একটা বাতি জ্বলছে। তার পর আমি সেই ঘরে ঢুকে দেখি

গোবিন্দ। (বাধা দিয়া) যা দেখলে তা আমরা জানি। তুমি চার-পাঁচ বার ঘরের চারদিকে ঘুরে, লাসের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে। ভাল করে সেটাকে দেখতে লাগলে?

কনেষ্টবল এবার বিশেষ আশ্চর্যান্বিত হইয়া বিস্ফারিত নয়নে গোবিন্দ বাবুর দিকে চাহিয়া বলিল, হুজুর সে সময়ে সেখানে আপনি কোথায় ছিলেন?

গোবিন্দ বাবু হাসিয়া বলিলেন,আমি সেখানে ছিলাম না। তার পর কি হল?

কনেষ্ট। তার পর জুড়ীদারকে চেঁচিয়ে ডালেম। সেও ছুটে সেখানে এল।

গোবিন্দ। সে সময়ে কোন লোককে রাস্তায় দেখতে পেলে?

কনেষ্ট। হাঁ, কিন্তু সে লোকের মত লোকই নয়।

গোবিন্দ। সে কি?

কনেষ্ট। দেখলেম, রাস্তায় একটা লোক মাতাল হয়ে টছে। সে দেয়ালে ঠেস্ দিয়ে গান ধরেছে। দাঁড়াতে পারছে না, গান গলা দিয়ে বেরুচ্ছে না। হুজুর, অনেক অনেক মাতাল দেখেছি, কিন্তু এমন মাতাল কখন দেখিনি।

গোবিন্দ। তাকে ধলে না কেন?

কনেষ্ট। আমাদের তখন খুনই প্রধান কাজ, মাতাল ধরার সময় নয়।

গোবিন্দ বাবু ভ্রূকুটি করিলেন। বিরক্ত ভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, লোকটার চেহারা কেমন?

কনেষ্ট। তাও তখন ভাল করে দেখিনি। আমরা দুজনে তাড়াতাড়ি লাস দেখতে ছুটলেম।

গোবিন্দ। তবে তার কিছুই ভাল করে দেখ নাই?

কনেষ্ট। না।

গোবিন্দ। তার পর সে লোকটার কি হল?

কনেষ্ট। তার পর সে কোন গতিকে নিশ্চয়ই নিজের বাড়ীর দিকে চলে গিয়েছিল।

গোবিন্দ। তার হাতে কি একটা চাবুক ছিল ?

কনেষ্ট। মনে নাই, বোধ হয়—ছিল না।

গোবিন্দ। কোন গাড়ী বা একা কাছে দেখেছিলে বা গাড়ীর শব্দ শুনতে পেয়েছিলে?

কনেষ্ট। না।

আচ্ছা, আর কিছু জাবার নাই। বলিয়া গোবিন্দ বাবু উঠিয়া দাঁড়াইলেন। আমিও সঙ্গে সঙ্গে উঠিলাম। বাহিরে আসিয়া তিনি বলিলেন, এই গাধা অনায়াসে কাল রাত্রে নিজের প্রমোসন পেতে পাত, যে খুনীর সন্ধানে সূরযমল আর রাম সিং আজ আকাশ পাতাল ভেবে মছে, কাল রাত্রে এ তাকে অনায়াসে ধতে পারত।

আমি বলিলাম, কি রকমে?

তিনি বলিলেন, যে খুন করেছিল, সেই মাতালের ভাণ করে এই গাধার চোখে ধূলা দিয়েছে।

আমি। সে কেন আবার সেই বাড়ীর কাছে আসবে?

গোবিন্দ। ইয়ারিং-ইয়ারিং। এটা আর বুঝতে পারছেন না, ইয়ারিংয়ের তল্লাসে এসেছিল। ডাক্তার, আমি এই খুনীকে ধরেছি, কেবল হাতে হাতকড়ী দিতে বাকী।

আমি। আপনি কি বলতে চান, যে লোক খুন করেছে, সে কে, আপনি জানতে পেরেছেন?

গোবিন্দ। নিশ্চয়। এখন এই পর্যন্ত, পরে সব বলব।

কাজেই আমি আর তাহাকে বেশি কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারিলাম না, নিজেও ক্লান্ত হইয়াছিলাম। বাসায় আসিয়াই শুইয়া পড়িলাম।

পর দিবস প্রাতে গোবিন্দ বাবু আমাকে একখানি সংবাদপত্র, দেখিতে দিলেন। বলিলেন, এই বিজ্ঞাপনটা একবার দেখুন।

আমি দেখিলাম;–

কুড়ান পাওয়া গিয়াছে,–গত রাত্রে সেটী-মহল্লার রাস্তায় একটি ইয়ারিং কুড়াইয়া পাওয়া গিয়াছে। যাঁহার হারাইয়াছে, তিনি সিং দরজার ৪নং বাড়ীতে ডাক্তার বসুর নিকট আবেদন করিলে পাইবেন।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, বিনানুমতিতে আপনার নাম ব্যবহার করিয়াছি, ক্ষমা করিবেন।

আমি বলিলাম,তাতে কিছুই ক্ষতি হয় নাই; তবে যদি কেহ আসে, তবে আমার কাছে ত ইয়ারিং নাই।

গোবিন্দ। ভয় নাই, আমি বাজার থেকে একটা ইয়ারিং কিনে এনেছি। এইটাতেই আমাদের কাজ চলবে।

আমি। আপনি কি মনে করেন, কেউ আসবে? গোব। নিশ্চয়ই। খুব সম্ভব সেই লোকই আবে। সে কোন রকমে ইয়ারিংটা ফেলে এসেছিল, পথে এসে ইয়ারিং সঙ্গে নেই দেখে ইয়ারিং খুঁজতে ফিরে এসেছিল; কিন্তু কনেষ্টবল দেখে মাতালের ভাণ করে চলে যায়। কাজেই সে মনে করতে পারে যে, ইয়ারিংটা হয় ত রাস্তায় পড়ে গিয়ে থাকবে।

আমি। সে কি এখানে আসা নিতান্ত বিপজ্জনক মনে করবে না?

গোবিন্দ। কেন? সে ভাববে যে ইয়ারিংটা নিশ্চয়ই রাস্তায় কোন গতিকে পড়ে গিয়েছিল, সুতরাং খুনের সঙ্গে যে ইয়ারিংটা পার কোন সম্ভাবনা আছে, তা তার মনে হবে না। পাছে সে কোন সন্দেহ করে, সেইজন্যই ত আপনার নামে বিজ্ঞাপন দিয়াছি। একজন ডাক্তার ব্যক্তি যে তাকে ধরার জন্য ফাঁদ পেতেছে, তা তার মনেই হবে না। কাজেই সে নিশ্চয়ই আসবে।

আমি। যদি আসে তবে কি করবেন?

গোবিন্দ। দেখা যাবে তখন; তবে আপনার রিভলবারটি ঠিক করে রাখুন। লোকটাকে বিশ্বাস নেই। সে এলে তার সঙ্গে বেশ গম্ভীর ভাবে কথা কবেন। যেন প্রথমেই সে কোন রকমে কোন সন্দেহ করতে না পারে।

এই সময়ে সদর দরজায় কে কড়া নাড়িল। গোবিন্দ বাবু বলিলেন, সাবধান,আমরা যে মহাত্মাকে চাই,তিনি উপস্থিত। নিতান্ত পক্ষে যদি স্বয়ং না হন, তাঁরই লোক সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।

সপ্তম পরিচ্ছেদ।

আমরা উভয়ে উৎকণ্ঠিত ভাবে আগন্তুকের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলাম। আমি ভাবিয়াছিলাম, গোবিন্দ বাবুর খুনী-যুবকই সত্য সত্যই আসিতেছে, কিন্তু যে আসিল, সে যুবক নহে—একেবারে পুরুষ মানুষই নয়। একটি অতি বৃদ্ধা স্ত্রীলোক—অতি কষ্টে ধীরে ধীরে গৃহে প্রবিষ্ট হইল। আমি আশ্চর্যান্বিত হইয়া গোবিন্দ বাবুর মুখের দিকে চাহিলাম। দেখিলাম তিনি বৃদ্ধাকে স্থির দৃষ্টিতে লক্ষ্য করিতেছেন।

বৃদ্ধা গৃহ মধ্যে আসিয়া কহিল, ডাক্তার সাহেব কি এখানে থাকেন?

আমি সত্বর বলিলাম, আমিই ডাক্তার।

বৃদ্ধা বহুক্ষণ অনুসন্ধান করিয়া পরিধেয় জীর্ণ বস্তু মধ্য হইতে একখানি সংবাদপত্র বাহির করিল; তাহার পর বলিল, এ খবরটা কি আপনি লিখেছেন?

আমি। হাঁ।

বৃদ্ধা। আমার মেয়ে মুনিয়া কাল রাত্রে তার একটা ইয়ারিং হারিয়ে ফেলেছে। সে কাল তার মামার বাড়ী গিয়েছিল, সেই তার মামা রাম সদনিয়া, সোণার—সেই চকের সোণার, তার বড় ব্যেম, তাই দেখতে যায়, আমার মুনিয়া। আমরা বড় গরিব। সে সন্ধ্যার পর সেটী-মহল্লা দিয়ে আছিল; সেইখানেই তার সোণার ইয়ারিং কোথায় পড়ে যায়। আমরা বড় গরীব, পঁচিশ টাকা দিয়ে তাকে কিনে দিই।

আমি ইয়ারিংটি বাহির করিয়া বলিলাম, এই কি সেই ইয়ারিং?

বৃদ্ধা। হাঁ, হাঁ, এই সেই, এই সেই। আহ, আমার মুনিয়া কত খুসী হবে! সে সেই পৰ্য্যন্ত কঁদছে, বাছা আমার বড় ছেলে মানুষ, তার আর কেউ নেই।

আমি। তুমি কোথায় থাক?

বৃদ্ধা। এই—এই—এই ও মহল্লায়। এই চকের পূবদিকে হামির পল্লীতে।

গোবিন্দ বাবু সঙ্কেত করায় আমি বৃদ্ধার হস্তে ইয়ারিং টা দিলাম; দিয়া বলিলাম, এখন আমি বেশ বুঝতে পারছি যে, এই ইয়ারিংটা আপনার মেয়ে মুনিয়ারই বটে।

বৃদ্ধা ইয়ারিংটা পাইয়া আমাকে বারংবার ধন্যবাদ দিয়া ধীরে ধীরে গৃহের বাহির হইয়া গেল। গোবিন্দ বাবু সত্বর উঠিয়া দাঁড়াইলেন; বোধ হইল যেন তিনিও বৃদ্ধার অনুসরণ করিতে প্রস্তুত হইলেন। কিন্তু তিনি তাহা না করিয়া জানালার নিকট গিয়া মুখ বাড়াইয়া দাঁড়াইলেন। আমি তাড়াতাড়ি উঠিয়া গিয়া তাহার পাশে উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, বৃদ্ধা অতি কষ্টে অতি ধীরে ধীরে রাস্তা দিয়া যাইতেছে। গোবিন্দ বাবু তাহাকে বিশেষ করিয়া লক্ষ্য করিতেছেন। বৃদ্ধা বহির্ভূত হইলে গোবিন্দ বাবু শিশ দিতে দিতে আবার আসিয়া চেয়ারে বসিলেন। তিনি কোন কথা কহেন না দেখিয়া আমি অবশেষে বলিলাম, কি বুঝলেন?

গোবিন্দ বাবু আমার দিকে চাহিলেন। বলিলেন, এ হয় সেই লোক, না হয় তার সঙ্গী।

আমি। যদি সেই লোক, তবে ধরিলেন না কেন?

গোবিন্দ। একটু সন্দেহের জন্য। যদি এ সেই লোক হয়, তবে যে রকম বুড়ী সেজেছে, তাতে খুব বাহাদুরী আছে। একটু সন্দেহ হওয়ায় ধরুলেম না, কারণ যথার্থই এ যদি বুড়ী হয়, তবে আমাকে বড়ই অপ্রস্তুত হতে হত। আরও একটি কথা, এ যদি সেই লোক হত, তবে অন্য ইয়ারিং নিজের বলে নিত না। তাও যদি নিয়ে থাকে লোকটা চতুর চূড়ামণি।

আমি। তা যাই হোক, সে নিজে না হলে—তার সঙ্গী ত নিশ্চয়। এর অনুসরণ করা আমাদের উচিত ছিল।

গোবিন্দ। বৃথা। এর অনুসরণ করলে,এখন এ বুড়ীটা–খুবই সম্ভব বুড়ী নয়—কিছুতেই সে সঙ্গীর নিকট যেত না। সচরাচর ডিটেক্‌টিভেরা তাই করে থাকে বটে, কিন্তু আমার প্রথা সেরূপ নয়। অনুসরণ করে অনেক সময়ই ঠিক ফল পাওয়া যায় না।

এই সময়ে সহসা ঘরের মধ্যে আট দশটা ধূলা মাখা নেংটী পরা ছোঁড়া প্রবেশ করিল। আমি আশ্চর্যান্বিত হইয়া, চমকিত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইলাম।

গোবিন্দ বাবু আমার ভাব দেখিয়া হাসিতে হাসিতে বলিলেন, এরা আমারই তাল-বেতালের দল।

তাহার পর তাঁহার তাল-বেতাল দলস্থ একজনের দিকে চাহিয়া তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, কি ননীয়া, কোন খবর আছে? তাকে খুঁজে পেয়েছ?

ননীয়া। না হুজুর, এখনও পাই নি।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, আচ্ছা, খবর পেলে ননীয়া, তুমি একলা এসে আমায় খবর দিও, আর সকলে যেন রাস্তায় থাকে। এই লও, তোমাদের জল-খাবারের পয়সা। বলিয়া পকেট হইতে কতক গুলা পয়সা বাহির করিয়া ননীয়ার হাতে দিলেন। দাতা ও গৃহীত কেহই পয়সাগুলি গণনা করিলেন না। ননীয়া পয়সাগুলি তাহার নেটীংর এটা খুটে বাঁধিলে গোবিন্দ বাবু বলিলেন, সন্ধান পাইলেই আমাকে খবর দিবে।

ননীয়া বলিল, হাঁ হুজুর।

গোবিন্দ। এখন যাও।

তাহারা উৰ্দ্ধশ্বাসে পলাইল; আমি অত্যন্ত বিস্মিতভাবে গোবিন্দ বাবুর মুখের দিকে চাহিলাম। তিনি বলিলেন, ভাল ভাল ডিটেকটিভ যা পারে না, এদের দ্বারা আমার সে কাজ হয়।

আমি। আপনি এদের সেটী-মহল্লার ব্যাপারে লাগিয়েছেন না কি?

গোবিন্দ। হাঁ।

আমি। কেন?

গোবিন্দ। পরে দেখতে পাবেন। আমি যাকে চাই, এরাই তার সন্ধান দিতে পাবে।

আর কিছু জিজ্ঞাসা করা ভাল দেখায় না ভাবিয়া আমি কিছু বলিলাম না। জানালা দিয়া রাস্তার দিকে চাহিলাম। দেখিলাম, দি সুরমল সাহেব ছড়ি ঘুরাইতে ঘুরাইতে উৎফুল্লমুখে আমাদের বাসার দিকেই আসিতেছেন। আমি সে কথা গোবিন্দ বাবুকে বলিলাম; গোবিন্দ বাবু উঠিয়া আসিয়া তাহাকে দেখিয়া বলিলেন, হাঁ। এবার কতকটা মজার কথা শুনতে পাওয়া যাবে।

আমি। কি রকম?

গোবিন্দ। দেখতেই পাবেন এখনই।

ক্ষণপরে সূরমল সাহেব আসিয়া উপস্থিত হইলেন। হাসিতে হাসিতে বলিলেন, গোবিন্দ বাবু, আমাকে প্রশংসা করুন, এক মুখে নয় শতমুখে।

গোবিন্দ বাবু হাসিয়া বলিলেন, শত মুখ আমার ত নাই ব্যাপার কি?।

সূরযমল সাহেব মশুকান্দোলন করিয়া খুব উৎসাহের সহিত বলিলেন,ব্যাপার! সেটী-মহল্লার মামলার আমিই একটা কিনারা করে ফেলেছি।

গোবিন্দ। ইতিমধ্যেই, বাঃ বেশ, আপনি তবে ঠিক সূত্র ধরতে পেরেছেন?

সূরয। কেবল সুত্র ধরা নয়। সূত্র ধরতে–

গোবিন্দ বাবু বাধা দিয়া সপরিহাসে বলিলেন, তবে কি একেবারে রজ্জু ধরা নাকি–

সূরয। রজ্জুই বটে—আসামী একেবারে হাজতে।

গোবিন্দ। বলেন কি! তার নাম কি?

সূরয। তার নাম লালা গোকুল প্রসাদ, লোকটা রেলে কাজ করে।

গোবিন্দ। বটে, সব আমাদের খুলে বলুন। আমরা দুজনেই শুনে বিস্মিত হবার জন্য উৎসুক হয়ে রয়েছি।

সূরয। বলছি, শুনুন, শোনবার কথাই বটে।

অষ্টম পরিচ্ছেদ।

সূরযমল সাহেব বলিতে লাগিলেন। আমরা উভয়ে নীরবে তাহার কথা শুনিতে লাগিলাম।

সূরযমল বলিলেন, আসল মজা হচ্ছে যে গাধা রাম সিং ভায়া উল্টা ধাঁধায় ঘুরছেন। তিনি শঙ্কর রাম পাণ্ডুরাংয়ের সন্ধানে গেছেন। হা! হা! হা! আমি সন্ধান করে সেই ডাক পিয়নটার সঙ্গে আগেই দেখা করলেম। সে এই দুজন লোক যে বাসায় থাকত, তা দেখিয়ে দিল। বলা বাহুল্য, আমি তখনই সেই বাড়ীতে গিয়ে সেখানে কে থাকে সন্ধান নিলেম। সে বাড়ীতে লালা গোকুলপ্রসাদ বলে একটা লোক বাস করে। তার সংসারে এক বুড়ী মা ও এক যুবতী বিধরা ভগ্নী ভিন্ন আর কেহ নাই। এই গোকুল প্রসাদ রেলে কেবল পনের টাকা মাহিনা পায়, তাতে তাদের চলে না দেখে বাড়ীর বার দিকটা ভাড়া দেয়। এই বার বাড়ীতে মাসখানেক দুজন মারাঠী এসে বাসা নিয়েছিল। আমি বাড়ীতে গোকুলপ্রসাদের সন্ধান নিয়ে জানলেম যে, সে রেলে কাজে গেছে। বুড়ী মা বাড়ীতে আছে। আমি তার সঙ্গে দেখা করলেম। তার মেয়েও তার পাশে বসে রয়েছে। দেখলেম, দুজনেই বড় বিষন্না; বিশেষত মেয়েটা যে খুব কেঁদেছে, তা তার চোখ দেখলেই বোঝ। যায়। আমি বুড়ীকে জিজ্ঞাসা কলাম, তোমাদের ভাড়াটিয়ার মধ্যে একজন খুন হয়েছে তা শুনেছ? বুড়ী ঘাড় নাড়িল, কিন্তু কোন কথা কহিল না, মেয়েটি কেঁদে উঠল। তখনই আমি বুঝলেম যে এরা এ খুনের ভিতরকার অনেক কথা জানে। তখন জিজ্ঞাসা করলেম, কাল কখন এরা দুজন তোমার বাড়ী থেকে বার হয়ে যান? সত্য কথা বল, আমি পুলিশের লোক। বুড়ীর মুখ আরও পাংশুবর্ণ হয়ে গেল,তার মুখ দিয়ে আর কথা সরে না। সেই সময় মেয়েটি বলে উঠল, মা, মিথ্যা কথা বলা মিছে। যা যা হয়েছে সব একে বল। দাদা তাতে সন্তুষ্ট ভিন্ন অসন্তুষ্ট হবেন না। মেয়ের কথা শুনে বুড়ী ভয়ানক রেগে উঠল। পাগলী হতভাগী, তুই ত তোর দাদাকে মালি। বলে বুড়ী কঁদতে আরম্ভ করে দিল। আমি বললেম,আমাকে সত্য কথা বল,সব ঠিক ঠিক বলে বরং তোমাদের উপকার হবে। তখন বুড়ী চোখের জল মুছে বলতে লাগল,-মনে করবেন না, যে আমার ছেলে এই খুন করেছে, সে এর কিছুই জানে না। তবে পাছে আপনারা তাকে খুনী বলে সন্দেহ করেন, এইজন্যই আমার ভয়। বলেই বুড়ী থেমে গেল। আমি তখন বললেম,সব খুলে বলে উপকার আছে। বুড়ী বলে,দুজন মারাঠী ভদ্র লোক আমাদের বাড়ীতে এক মাস বাসা করে আছেন। আমরা বড় গরীব, খরচ চলে না বলে বার দিটা ভাড়া দিই। এমন হবে জালে কে এমন কাজ করে। সে যা হক, কাল একজন মারাঠী খুন হয়েছে শুনে, আমি তাকে দেখতে যাই; গিয়ে দেখি যার নাম বালকিষণ লক্ষ্মণ রাও, তিনিই খুন হয়েছন। ইনি খুব বড় লোক বলে বোধ হয়, দু হাতে টাকা খরচ করতেন। আর একজন যার নাম শঙ্কর রাম পাণ্ডুরাং, সে বোধ হয় এর মোসাহেব ছিল। কিন্তু বড় লোক হলে কি হয়,-লোক বড় ভাল নয়। ভয়ানক মাতাল, রোজই বোতল বোতল মদ খেত, আর বলতে বলতে বুড়ী মধ্যপথে আবার থেমে গেল। আমি বললেম, কিছু গোপন কর না, সব সত্য বল। বুড়ী বলে,আয় এরা দুজনেই একদিন রাত্রে আমার মেয়ের উপর অত্যাচার করতে চান, আহা। বাছা আমার কত কেঁদেছে। সেই কথা শুনে গোকুলপ্রসাদ আমার, এদের উঠিয়ে দেবার চেষ্টা করতে লাগল। এমন সময়ে–এই পরশু এরা একটা তারের খবর পেয়ে নিজেই জিনিষ-পত্র গুছিয়ে দেশে যাবার জন্য আন্দাজ রাত আটটার সময় ষ্টেশনে রওনা হয়। তারা চলে যেতে আমি খুব খুসী হলেম। কিন্তু রাত্রি এগারটা কি বারটার সময় আবার দেখি হঠাৎ বালকিষণ আমাদের ঘরে এসে উপস্থিত হল। বাছা গোকুলপ্রসাদের রাত্রে রেলে কাজ ছিল, সে তখনও ফিরে নাই বলে দরজা খোলা ছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলেম, হাঁ, বালকিষণ এসে কি করলে? বুড়ী বলে, দেখি ভয়ানক মাতাল হয়ে এসেছে। আমার মেয়েকে ছুটে ছুটে টলে টলে ধরতে যায়, আমার সমুখে তাকে টেনে নিয়ে বেরিয়ে যেতে চায়। আমি একলা কি করব, এই মাতালের হাত থেকে কেমন করে রক্ষা পাব, চেঁচিয়ে লোক ডাক্ব মনে কছি, ঠিক সেই সময়ে আমার ছেলে গোকুলপ্রসাদ এসে পড়ল। সে এসে সেই মাতালটার গলা ধরে তাকে রাস্তায় দিয়ে এল। তাতেও সে যায় না। দরজার সমুখে ভারি মাতলামী করতে লাগল, তখন আবার গোকুলপ্রসাদ একটা লাঠী নিয়ে তাকে তাড়িয়ে দিতে গেল। আমি জিজ্ঞাসা করলেন, তার পর তোমার ছেলে কখন ফিরে এল?বুড়ী বলে,প্রায় ঘণ্টা দুই পরে।আমি জিজ্ঞাসা করলেম, এতক্ষণ কোথায় ছিল, কিছু বললে? বুড়ী বলে, হ, আমরা তার জন্য বসেছিলাম। এসে বলে যে তাকে রেল থেকে ডাক্ত এসেছিল, তাই রেল-আফিসে গিয়েছিল। আমি দেখলেম, সন্দেহের আর কিছুই নাই, ঠিক পথেই এসে পড়েছি; তথাপি বুড়ীকে জিজ্ঞাসা করলেম, আর সেই লোকটার কোন কথা তুমি তোমার ছেলেকে জিজ্ঞাসা কর নাই? বুড়ী বলে,  জিজ্ঞাসা করেছিলাম বই কি। তা সে বললে যে, তার হাতে লাঠী দেখে সে ভয়ে পালিয়ে গেছে। গোকুলপ্রসাদ পেছনে তাড়া করায়, সেইখান দিয়ে একখানা একা যাচ্ছিল, তাতে চড়ে সে পালিয়ে গেল। তখন আমি, হ, এতেই হবে, বলে বিদায় হলেম। সেখান থেকে বেরিয়ে একেবারে রেল-আফিসে গিয়ে গোকুল প্রসাদকে গ্রেপ্তার করলেম। আর প্রমাণ কি চাই? নিশ্চয়ই এ মারাঠীকে তাড়া করে নিয়ে যায়। পেটে সজোরে লাঠীর গুতো মারায় হঠাৎ লোকটা মারা পড়ে। তখন গোকুল প্রসাদ লাসটা সেই থালি বাড়ীতে টেনে নিয়ে ফেলে রেখে বাড়ী ফিরে আসে।

গোবিন্দ। রক্ত?

সূরয। পুলিশের চোখে ধূলা দেবার জন্য মুর্গী-টুগী একটা যা হয় কিছু কেটে ঘর ময় রক্ত ছড়িয়ে গেছে।

গোবিন্দ। গোকুলপ্রসাদকে গ্রেপ্তার করাতে সে কি বলে?

সূরয। সে প্রথমেই বলে উঠল, বোধ হয়, আপনারা সেই মারাঠীর খুনের জন্য আমায় গ্রেপ্তার করছেন। আমরা, হ, বলায় সে বলে,আমি খুন করি নাই, আমি এর কিছুই জানি না। আমি তাকে তাড়া করায় সে একখানা একায় চড়ে পালিয়ে যায়? হা-হা-হা, খুব সাদা কথা। কোন আদালত এ কথা বিশ্বাস করবে না।

এই সময়ে রাম সিংহের তথায় অভ্যুদয় হইল। আমরা সকলেই তাহার দিকে চাহিলাম। সূরযমল হাসিতে হাসিতে বলিলেন, ভায় আসামী যে গারদে।

রাম সিং বলিলেন, আসামীর সাজা হবে, তবে ত খুনের কিনারা হবে। শুধু গ্রেপ্তারে কি হয়?

সূরয। কেন?

রাম। কেন? এই তোমার গোকুলপ্রসাদ কি শঙ্কর রাম পাণ্ডুরাংকেও খুন করেছে ?

আমরা সকলেই অত্যন্ত বিস্ময়ের সহিত বলিয়া উঠিলাম,সে কি?

রাম নিং বলিলেন, হাঁ, শঙ্কররাম পাণ্ডুরাংও খুন হয়েছে। তার লাস মোসাফের-খানায় পড়ে আছে। তারও ঘরের দেয়ালে রক্তে লেখা সাজা।

আমরা সকলই স্তম্ভিত হইলাম। সূরযমল এরূপ ভাবে বিস্ফারিত নয়নে রাম সিংহের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন যে, তাহাকে দেখিলে প্রকৃতই বড় কষ্ট হয়; যেন তিনি সাত হাত উপর থেকে একেবারে স্নাত হাত মাটীর নীচে বসিয়া গিয়াছেন; কিন্তু এই করুণরসাভিনয়ে কিছু মাত্র মনোযোগ না দিয়া গোবিন্দ বাবু হো হো শব্দে উচ্চৈস্বরে হাসিয়া উঠিলেন।

নবম পরিচ্ছেদ।

ইহাতে পুলিশ-কর্মচারীদ্বয় উভয়েই যে বিশেষ বিরক্ত হইলেন, বলা বাহুল্য। গোবিন্দ বাবুও যে তাহা বুঝিলেন না, এমনও নহে। বলিলেন রাগ করিবেন না, আমার বাচালতা ক্ষমা করিবেন। এখন রাম সিং সাহেব যে আশ্চৰ্যজনক সংবাদ দিলেন, তাহার বিষয় সব শোনা যাক।

সূরমল বলিলেন, রাম সিং সাহেব, আপনি কি এ সংবাদ ঠিক পেয়েছেন?

রাম। ঠিক পাওয়া-পায়ি কি দাদা-আমি নিজে মসাফের-থানায় গিয়ে স্বচক্ষে তার লাস দেখে এসেছি।

গোবিন্দ। আচ্ছা, সব ব্যাপারটা শোনা যাক।

রাম। মান গেল মনে বিশ্বাস হয়ছিল যে এখন এই মারাঠীর বন্ধুই করেছে,এ আমি স্বীকার করি। আমি তাই তখন হতেই লোকটার সন্ধানে থাকি। পিয়নের কাছে ঠিকানা পেয়ে আমি গোকুল প্রসাদের বাড়ী যাই, কিন্তু ঐ বাড়ীর পাশের দোকানীর কাছে খবর পাই যে মারাঠী দুজন তাদের জিনিষ পত্র নিয়ে ষ্টেশনে চলে গেছে। তখন আমি ষ্টেশনে গিয়ে সন্ধান করি। কুলীর বলে যে, হাঁ, দুজন মারাঠী রাত্রি আটটার পর ষ্টেশনে এসেছিল, তারা তাদের জিনিষ-পত্ৰ মামিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে একজন ভারি মাতাল, সে অপরের সঙ্গে বকাবকি করে ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে আসে। অপর মারাঠী তার জন্য ষ্টেশনে অপেক্ষা করতে থাকে, গাড়ীর সময়েও কিন্তু সে ফেরে না। তখন সেই মারাঠী মুটেদের জিনিষপত্র নিয়ে তার সঙ্গে ষ্টেশনের সম্মুখের মোসাফের-খানায় যেতে বলে। তারা জিনিষ-পত্র নিয়ে সেইখানে রেখে আসে। মারাঠীও সে রাত্রের জন্য মোসাফের-খানায় বাসা নেয়।

সূরয। তার পর?

রাম। তার পর আমি এই খবর পেয়ে তখনই মোসাফের থানায় যাই। সন্ধানে জানি যে সত্যই একজন মারাঠী ভদ্রলোক কাল অনেক রাত্রে মোসাফের-খানায় বাসা নিয়েছিল; কিন্তু এখন তিনি কোথায়, কেউ সে কথা বলতে পারে না দেখে, আমি মোসাফের থানায় দারোয়ানকে সঙ্গে নিয়ে উপরে গিয়া দেখি, একটা ঘরের দরজা বন্ধ। অনেক ঠেলাঠেলিতে কেহ দরজা না খোলায় আমি দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকি। ভিতরে গিয়ে দেখি, মারাঠীর মৃতদেহ পড়ে আছে। তার বুকে কে ছোরা মেরেছে। যে ছোরা মেরেছিল, সে বিছানার চাদরে ছোরার রক্ত মুছেছে, পাশের লোটার জলে হাত ধুয়েছে, আর দেয়ালে রক্তে লিখে গেছে সেই, সাজা।

আমি বলিয়া উঠিলাম, কি ভয়ানক!

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, আর কিছু দেখিলেন?

রাম। লাসের পকেটে ছাপান্নটা টাকা ছিল,আর একখানা টেলিগ্রাফ।

গোবিন্দ। টেলিগ্রাফে কি লেখা ছিল?

রাম। নাসিকের বামন রাও লাহোরে পাণ্ডুরাংকে টেলিগ্রাফ করছে। ত্ৰিম্বক লাহোরে গিয়াছে। সাবধান।

গোবিন্দ। আর কিছু?

রাম। হাঁ, একটা কৌটা, আর তাতে দুটা বড়ী।

গোবিন্দ বাবু বিদ্যুদ্বেগে লাফাইয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন—কোন নিরন্ন ভিক্ষুকও সহসা লক্ষ টাকার সমাগমে এতখানি আনন্দ প্রকাশ করে না। গোবিন্দ বাবু খুব ৎসাহের সহিত বলিয়া উঠিলেন, হে হহ হে, আমার কেস এতক্ষণে সম্পূর্ণ হল। আমি যা খুঁজছিলাম, এতক্ষণে তাই পেয়েছি।

তাঁহার তাবগতিক দেখিয়া আমরা সকলেই আশ্চর্যান্বিত হইয়া তাঁহার দিকে চাহিলাম। সূরযমল বলিলেন, আপনি ক্ষমতাপন্ন লোক সন্দেহ নাই, সেইজনা আপনাকে সম্মান ও ভক্তি করি, কিন্তু আপনার কোন কথায়ই আমরা বুঝতে পারছি না।

গোবিন্দ। শীঘ্রই সব বুঝিয়ে দিব। এখন রাগ করবেন না। রামসিং সাহেব, সে কৌটাটা হস্তগত করেছেন ত?

রাম। হাঁ, এই যে সঙ্গেই এনেছি।

গোবিন্দ। দিন, একটা পরীক্ষা করে দেখা যাক।

গোবিন্দ বাবু কৌটা হইতে একটা বড়ীর আধখানা কাটিয়া তাহা জলে লিলেন। তৎপরে তাহাতে একটু দুধ মিশাইয়া রাস্তার একটা জীর্ণ মীd না তা পান করিতে দিলেন। ক্ষুধার্ত কুকুর তাহা তৎক্ষণাৎ খাইয়া ফেলিল। গোবিন্দ বাবু উৎসুক হৃদয়ে সেই কুকুরটাকে লক্ষ্য করিতে লাগিলেন। কিন্তু সেই কুকুরের কিছুই হইল না, সে আরও দুগ্ধ পাইবার জন্য মুখ তুলিয়া ঘন ঘন লাল আন্দোলন করিতে লাগিল। তখন গোবিন্দ বাবু বলিলেন, আশ্চৰ্য্য বটে। আমার কি ভুল হবে? কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিয়া সহসা তিনি বলিয়া উঠিলেন, আমি কি গাধ—একেবারে নিরেট! এমন সহজ কথাটাও একবার আগে মনে পড়ে নাই।

তিনি অপর বড়ীটার অর্ধেক কাটিয়া পূর্বের ন্যায় জল ও দুগ্ধের সঙ্গে মিশাইলেন; পূর্বের ন্যায় কুকুরকে পান করিতে দিলেন। সে পান করিবামাত্র বিকট চীৎকার করিয়া উঠিল, তখনই মাটিতে পড়িয়া ছট ফটু করিতে লাগিল। ক্ষণপরে আমরা সকলে তাড়াতাড়ি উঠিয়া গিয়া দেখিলাম, কুকুর মরিয়া আড়ষ্ট হইয়াছে।

তখন গোবিন্দ বাবু বলিলেন, এই বড়ীতেই মারাঠীর প্রাণ গিয়াছে।

আমি বলিলাম, একটা বিষাক্ত আর একটা অব্যিক্ত বড়ী রাখবার মানে কি?

গোবিন্দ। এখন ঠিক বলতে পারি না। তবে বোধ হয়,যে লোক এই বড়ী এনেছিল, সে নিজে জোর করে বিষ-বাড়ী খাওয়ায় নাই। লোকটা দুটা বড়ার একটা নিজে বেছে নিয়ে তাকে খেতে বলেছিল। যে কোন কারণে হো, লোকটা অনিচ্ছাসত্ত্বে একটা বড়ী খেতে, বাধ্য হয়েছিল। সৌভাগ্য বশতঃ ভগবান্ পাপীর দণ্ডের জন্য তাকে দিয়া এই বিষ বড়ই তাকে খাইয়েছিলেন।

সূরযমল বলিলেন, আপনি কি প্রকৃতই এই খুনের সমস্ত ব্যাপার জানতে পেরেছেন।

গোবিন্দ। নিশ্চয়—কেবল জানা কেন, আমি তার নাম পর্যন্ত বলতে পারি।

রাম। তবে তাকে গ্রেপ্তার করতে তিলার্ধ দেরী করা উচিত নয়।

গোবিন্দ। নাম জানা যত সহজ, তাকে গ্রেপ্তার করা ঠিক ততটা সহজ নয়। আমি এখন আপনাদিগকে সব কথা বলতে পারি না—হয় ত তাতে তাকে গ্রেপ্তার করা সহজ না হতেও পারে। এমন কি তাড়াহুড়ো দিলে সে এ সহর ছেড়ে পালাতেও পারে।

আমি। কিন্তু সে আরও ত খুন করতে পারে।

সূরয। ডাক্তার বাবু ঠিক বলেছেন।

গোবিন্দ। সে বিষয়ে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, সে আর কাকেও খুন করবে না। আমি তাকে গ্রেপ্তার করবার জন্য যে বন্দোবস্ত করেছি, তাতে বোধ হয় শীঘ্রই কাজ সফল হবে। তখন আপনাদের সব খুলে বলব। এখন আমাকে আপনারা মাপ করুন। একদিন চব্বিশঘণ্টা মাত্র চুপ করে থাকুন।

সূরয। আমরা দুজনই যখন এর কিছুই এ পর্যন্ত কিনারা করতে পারি নাই, তখন আমরা চুপ করে না থেকে আর কি করব?

গোবিন্দ। রাগ করবেন না। শীঘ্রই আসামী গ্রেপ্তার হবে।

তবে এখন আমরা বিদায় হই, আবার দেখা করব, বলিয়া পুলিশ-কর্মচারীদ্বয় উঠিলেন।

দশম পরিচ্ছেদ।

এই সময়ে সহসা তথায় সেই ননীয়া বালক উপস্থিত হইল। তাহাকে দেখিয়া গোবিন্দ বাবু পুলিশ-কৰ্ম্মচারীদ্বয়কে বলিলেন, একটু অপেক্ষা করুন। তাহারা উঠিয়াছিলেন, বসিলেন। তখন গোবিন্দ বাবু ননীয়াকে বলিলেন, তবে ননীয়া, খবর কি?

ননীয়া! হুজুর, একা দরজায়।

গোবিন্দ! বেশ ননীয়া,—তাকে একবার এইখানে ডাক,—সে আমার জিনিষ গাড়ীতে তুলুক।

গোবিন্দ বাবু কোন্‌খানে যে যাইবেন, তাহা তিনি আমাকে বলেন নাই, সুতরাং তাহার কথা শুনিয়া আমি আশ্চর্যান্বিত হইলাম; কিন্তু কোন কথা কহিলাম না। গোবিন্দ বাবু একটা নুতন ধরণের হাতকড়ী বাহির করিয়া বলিলেন, রাম সিং সাহেব, আপনারা এই নুতন ধরণের হাতকড়ী চলতি করেন না কেন? দেখুন দেখি, এ কেমন স্প্রিং দেওয়া,—এক সেকেণ্ডে পরিয়ে দেওয়া যায়।

রাম সিং বলিলেন, পুরাণতেই কাজ চলতে পারে—যদি পাইবার লোক পাওয়া যায়।

এই সময়ে ননীয়া, এক্কাওয়ালাকে লইয়া তথায় উপস্থিত হইল। তখন গোবিন্দ বাবু নিজ পোর্টম্যান্ট আঁটিবার চেষ্টা করিতেছিলেন। তিনি এক্কাওয়ালাকে বলিলেন, এস দেখি বাপু, এইটা একটু চেপে ধর, এটাকে এঁটে নি।

সে আসিয়া পোর্টম্যান্টটি চাপিয়া ধরিল। পরমুহূর্তেই ক্রিং করিয়া একটা শব্দ হইল। গোবিন্দ বাবু লম্ফ দিয়া দণ্ডায়মান হইয়া বলিয়া উঠিলেন, এই নিন্ আপনাদের খুনী, ত্রিম্বক রাও খণ্ডেকার। আমরা তিনজনই লম্ফ দিয়া দাঁড়াইয়া উঠিলাম। এক্কাওয়ালাও লম্ফ দিয়া দাঁড়াইয়া উঠিল। দেখিলাম, তাহার হাতে হাতকড়ী। সে একবার সবলে হন্তস্থ হাতকড়ী ভাঙ্গিবার চেষ্টা পাইল, পরে দ্বারের দিকে চাহিল; বোধ হইল যেন পলায়নের উদ্যম করিল। কিন্তু রাম। সিং ও রমল লম্ফ দিয়া তাহার গলার কাপড় ধরিয়া তাহাকে টানিয়া গৃহের এক কোণে ফেলিলেন। অমনি সেই ব্যক্তির মুখ ও নাক দিয়া অনর্গল রক্ত পড়িতে লাগিল। সে কাপড়ে রক্ত মুছিয়া ম্লান হাসি হাসিয়া বলিল, ভয় নাই, পালাব না। পালাবার ইচ্ছা রেখে খুন করি নাই।

গোবিন্দ বাবু আমার দিকে চাহিয়া একটু হাসিয়া বলিলেন, তবে আমার অনুমান মিথ্যা নহে; লোকটার রক্ত পিত্তের ব্যারাম ও ঠিক।

খুনী ত্ৰিম্বক রাও বলিল, আপনার বাহাদুরী আছে। আপনি আমাকে ধরায় আমি অসন্তুষ্ট নই।

রাম সিং বলিলেন, আর দেরী করা নয়। চলুন আসামীকে নিয়ে থানায় যাই।

সূরয। ঠিক কথা,-পরে গোবিন্দ বাবুর কাছে সব শুনব।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, বেশ কথা, তাই চলুন। তৎপরে আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, ডাক্তার মহাশয় ও আসুন; আপনি এই মাল্লার গোড়া থেকেই আছেন।

সূরবমল ও রাম সিং আসামীর গলার কাপড় তখনও ছাড়েন নাই। ত্ৰিম্বক রাও হাসিয়া বলিল, ভয় নাই, পালাব না। ছেড়ে দিন।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, ছেড়ে দিলে পালাবে না।

তখন ত্ৰিম্বক রাওয়ের এক্কায় রাম সিং তাহাকে লইয়া উঠিলেন। সূরযমল হাঁকাইয়া চলিলেন। আমি ও গোবিন্দ বাবু আর একখানা এক ডাকিয়া তাহাতে চড়িয়া বসিলাম।

থানায় আসিয়া আমরা সকলে আসামীকে সইয়া সুপারিন্টেন্টে সাহেবের সম্মুখে উপস্থিত হইলাম। তিনি আসামী গ্রেপ্তারের সকল বিবরণ রাম সিং সাহেবের নিকট শুনিয়া এক রাওয়ের দিকে চাহিলেন। তৎপরে বলিলেন, তোমার কিছু বলবার আছে? তুমি কি এই দুই খুন করেছ? ত্রিম্বক কি বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু সাহেব তাহাকে প্রতিবন্ধক দিয়া বলিলেন, তোমাকে আমার সাবধান করে দেওয়া উচিত। জেন, এখন তুমি যা বলবে, আমি সমস্তই লিখে রাখব। বিচার সময়ে তোমার কথা তোমারই বিরুদ্ধে প্রাণরূপে ব্যবহৃত হবে। যা বল্‌বে, বুঝে বল্‌বে।

ত্রিম্বক রাও বলিল, আমি কোন বিষয়ের জন্যই আর ভীত নই। আমি স্বীকার করছি, পা ও রং ও সর্দার বুলকিষণকে খুন,আমিই করেছি—নিজহস্তে।

সাহেব। ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে স্বীকার করবে?

ত্রিম্বক। কেন করব না। এই দুই দুরাত্মাকে খুন করে মরু বলেই ত খুন করেছি।

সাহেব। কেন খুন করলে? ত্রিম্বক। সে অনেক কথা। জগতের লোক না মনে করে যে আমি অন্যান্য খুনীর মত নরাধম। তাই সকল কথা লিখে রেখে যাব মনে করেছি। আপনারা কি অনুগ্রহ করে আমাকে কালি কল কাগজ হাজতে দিবেন? আমি আমার সমস্ত বিবরণ লিখে রাখুন। এই দুই পাপাত্মা আমার সর্বনাশ করেছিল, তাই এদের উপযুক্ত সাজা দিয়াছি।

সাহেব। এ সব কথা বিচারের সময় বলতে পার।

ত্রিম্বক। বিচার পর্যন্ত বাঁচব না।

সাহেব আসামীর মুখের দিকে চাহিলেন। ত্রিম্বক বলিল, ভয় নাই সাহেব, আত্মহত্যা করে পাপ করব। আমার যে ব্যারাম হয়েছে, তাতে আর আমি বেশি দিন বাঁচব না। কেবল বেঁচে ছিলাম, প্রতিহিংসা সাধনের জন্য। তা হয়েছে।

সাহেব আমাদের সকলের দিকে চাহিলেন।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, আমার বন্ধু একজন ডাক্তার। একবার আসামীকে পরীক্ষা করিতে ক্ষতি কি?

সাহেব বলিলেন, আপনি ভালই বলেছেন।

তখন সাহেবের অনুরোধে আমি ত্রিম্বক রাওকে বিশেষরূপে পরীক্ষা করিয়া বলিলাম, আসামী ঠিকই বলছে। এর রক্তপিত্তের উপর যক্ষ্মা রোগ হয়েছে, সুতরাং কোন কারণে মন উত্তেজিত হলে,এর সহসা মৃত্যু হওয়া সম্ভব।

সাহেব ত্রিম্বক রাওয়ের দিকে চাহিয়া বলিলেন, তোমাকে হাজতে কালি কলম কাগজ দেওয়া যাইবে। সমস্ত বৃত্তান্ত আমাদের জানা আবশ্যক। তৎপরে রাম সিংএর দিকে ফিরিয়া বলিলেন, এখনই আসামীকে ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে নিয়ে যাও। তার সম্মুখে স্বীকার পত্রে এর সহি করা আবশ্যক। তার পরে আসামীকে হাজতে রেখে কালি কলম কাগজ দিয়ো। আমাদিগকে বলিলেন, আপনারা কাল এগারটার সময় আদালতে হাজির থাকবেন।

আসামীকে লইয়া আমরা সকলে বাহিরে আসিলাম। গোবিন্দ বাবু তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, একটা কথা তোমাকে আমার জিজ্ঞাসা করবার আছে।

ত্রিম্বক। বলুন—কি।

গোবিন্দ। ইয়ারিং নিতে এসেছিল কে?

ত্রিম্বক। আমিই। ছেলে বেলা থেকে বহুরূপী সাজা আমার অভ্যাস ছিল। এই দুই দুরাত্মাকে সাজা দেবার জন্য আমাকে অনেক সাজেই সাজতে হয়েছে। দেখুন, আপনার মত লোকের চোখেও ধূলা দিয়েছিলাম।

গোবিন্দ। স্বীকার করি, তোমার বাহাদুরী আছে।

ত্রিম্বক। আপনারও বাহাদুরী খুব।

রাম সিং আসামীকে লইয়া হাজতের দিকে গেলেন। আমরাও বাসায় ফিরিলাম।

একাদশ পরিচ্ছেদ।

সেইদিন অনেক রাত্রি পর্যন্ত গোবিন্দ বাবুর সহিত অনেক কথা বার্তা হইল। আমি বলিলাম, প্রকৃতই আপনি অদ্ভুত ক্ষমতাপন্ন লোক। আপনি পূর্বে যা যা বলেছিলেন, এখন দেখছি সকলই ঠিক।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, এ ব্যাপারে কিছুই কঠিন ছিল না।

আমি আশ্চর্যান্বিত হইয়া বলিলাম, কঠিন কিছুই ছিল না, বলেন কি!

গোবিন্দ। হাঁ, সামান্য বিবেচনা শক্তি ব্যবহারে আমি তিন দিনের মধ্যে জানতে পেরেছিলাম, আসামী কে?

আমি। সে কথা সত্য। আপনি পূৰ্বে এ কথা বলেছিলেন।

গোবিন্দ। এ রকম ব্যাপারের রহস্যভেদ করতে হলে উল্টা দিকে বা পিছন দিকে বিচার করে যাওয়াই উচিত। লোকে সাধারণত তা করে না-সমুখ দিকেই দেখে। মেঘ হয়েছে, বাতাস বন্ধ হয়েছে, খুব গুমট বোধ হয়েছে, এই সকল বিবেচনা করে লোকে বলে শীঘ্র বৃষ্টি হবে। কিন্তু বৃষ্টি হয়ে গেলে কে ভাবে যে, কি কি ঘটনার সংযোগে বৃষ্টি হল। ফল দেখে সেই ফল কিসে ফল তা কয় জন ভাবে?

আমি। আমি আপনার কথার ঠিক ভাবার্থ বুঝতে পারুলেম না।

গোবিন্দ। এই খুনের ব্যাপারটিই ধরুন। আমি দেখলেম,

গোবিন্দরাম। একটা ঘটনার ফল, এই এক বা দুই খুন। কেন খুন হল, আর কে খুন করিল, এই আমাকে জানতে হবে। আমি উল্টা দিকে বিচার করতে আরম্ভ করলেম। আগেই বলেছি, গাড়ীর চাকার আর পায়ের দাগ, ঘরের অবস্থা দেখে আমি কতক স্থির করি। যা যা স্থির করে ছিলাম, তা আপনাকে ও রামসিংকে সেদিন বলেছিলাম।

আমি। হাঁ, বলেছিলেন বটে।

গোবিন্দ। জেনেছিলাম দুটা লোক একখানা এক্কায় এসে এই বাড়ীটায় যায়; একজন আর একজনকে বিষ খাইয়ে মারে। এখন এ লোকটা কে? জানেন, নাসিকে আমি টেলিগ্রাফ করি।

আমি। হাঁ, আমি ত সঙ্গেই ছিলাম।

গোবিন্দ। উত্তরে জানলাম, বালকিষণ রাও একজন বড় সর্দার। তার নামে ত্রিম্বক রাও নামে একটা লোক স্ত্রী ছিনিয়া লওয়ার জন্ম পুলিশে নালিশ করে। পুলিশ বড় লোকের দাসানুদাস, ত্ৰিম্বককে হাঁকাইয়া তাড়াইয়া দেয়। তার পর এই বালকিষণ রাই আবার পুলিশে খবর দেয় যে, ত্রিম্বক তাকে খুন করবার চেষ্টায় আছে। তখন কি বোঝ শক্ত যে ত্ৰিম্বকই এই খুন করেছে।

আমি। নিশ্চয়ই নয়।

গোবিন্দ। এ কথা আরও সপ্রমাণ হল পাণ্ডুরাংয়ের পকেটের টেলিগ্রাফ দেখে। তাতে লেখা—সাবধান, ত্রিম্বক লাহোরে। এই দুইটা লোক টেলিগ্রাফ পেয়েই ভয়ে লাহোর থেকে পালাইয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু ভগবান দুষ্টের দমনের জন্য তা হতে দিলেন না।

আমি। আপনি ঠিক বলেছেন।

গোবিন্দ। আমি আগে দেখেছিলাম,এক্কায় দুজনের অধিক শো ছি–তা এowথা চিল না। নাগরা তা দেখে বললেন

গোবিন্দরাম।

এক্কাওয়ালা হয়েছে। ইহাই খুব সম্ভব, কারণ একা হলে যত সহজে একজনের পেছনে পেছনে থাকা যায়, পায়ে হেঁটে তা হয় না।

আমি। তা নিশ্চয়ই।

গোবিন্দ। আর এক্কাওয়ালা হলে সহজে কেউ চিতেও পাবে। এইজন্যই আমি ছোঁড়াদের এক্কাওয়ালা খুঁজতে লাগিয়া দিয়েছিলেন।

আমি। আপনার কথায় আমি আশ্চর্যান্বিত হয়েছি।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, একটু বুঝে দেখলে আশ্চর্যান্বিত হবার কিছুই নাই। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, এ নাম বদলেছে; বদলে থাকলেও আমি এর চেহারা যেরূপ অনুমান করেছিলাম,তাতে সহজেই ধরা পড়ত। দ্বিতীয়তঃ আমি ভেবেছিলাম, এ নাম বলায় নাই। কেন বদলাবে? এত দূরে এক্কাওয়ালার মধ্যে নিজের নাম রাখলে ক্ষতি কি? আমার অনুমানই ঠিক, এ নিজের নামেই ছিল। আমার ননীয়া একে সহজেই ভাড়ার নাম করে ডেকে আনতে পেরেছিল।

আমি। কিন্তু এ ভাড়ায় এল কেন?

গোবিন্দ। না এলে পাছে কেউ সন্দেহ করে।

আমি। এত অনায়াসে খুন করে লাহোর থেকে চলে যেতে পাত।

গোবিন্দ। ত্রিম্বক গাধা নয়। সে স্পষ্টই জান্ত, পুলিশ এখন ষ্টেশনে বিশেষ দৃষ্টি রেখেছে। হঠাৎ একজন এক্কাওয়ালা অন্তর্ধান হলে পুলিশের তার উপর সন্দেহ হবে। তখন পুলিশের হাত এড়িয়ে পালান বড় শক্ত। একটু গোল চুকলেই সরে পড়বার ইচ্ছা ছিল।

আমি। আপনার ক্ষমতা অদ্ভুত। আপনি অদ্বিতীয় লোক।

গোবিন্দ। তা ঠিক নয়, তবে আমার গোয়েন্দাগিরি সম্পূর্ণ নুতন, পুরাণ ধাঁজায় নয়।

আমি। তা ত চোখের উপর দেখলেম। আপনি যা বলেছিলেন, তাই করলেন। ঘরে বসে দু-দুটো এমন জটিল খুনের আসামী গ্রেপ্তার করলেন।

গোবিন্দ। আমার রীতি অবলম্বন করলে সকলেই তা পারবে।

আমি। একটা কথা জান্বার আছে।

গোবিন্দ। বলুন।

আমি। ইংয়ারিংএর বিষয়টা কি?

গোবিন্দ। ত্রিম্বকের ইতিহাসেই সব জানা যাবে। কালই সব জানতে পারবেন।

অনেক রাত্রি পর্যন্ত এইরূপ কথোপকথনে কাটিল। প্রাতেই রাম সিংএর একখানা পত্ৰ আসিল। তিনি আমাদিগকে তথনই থানায় যাইতে অনুরোধ করিয়াছেন। আমরা আর ক্ষণমাত্র বিলম্ব করিলাম না, একখানা গাড়ী করিয়া থানায় উপস্থিত হইলাম। রাম সিং সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি তখনই আমাদিগকে হাজতে লইয়া গেলেন।

******

আমরা দেখিলাম, ত্রিম্বক রাও শয়ন করিয়া আছে। তাহার চতুষ্পর্শে কালি কলম কাগজ বিক্ষিপ্ত; অনেকগুলি কাগজ লেখা কিন্তু ত্রিম্বক রাও আর নাই; নিম্নের বিচারকের হাত এড়াইয়া এখন সে সেই সর্বজ্ঞ সৰ্বশক্তিমান্ বিচারপতির আসন সম্মুখে নীত হইয়াছে। তাহার মুখ দিয়া যথেষ্ট রক্ত নির্গত হইয়াছে। রক্তপিত্ত রোগেই ত্রিম্বক রাওয়ের মৃত্যু হইয়াছে। তাহার মৃত্যুতে রাম সিং মহাশয়কে বিশেষ দুঃখিত দেখিলাম, কারণ আসামীর ফাঁসী হইলে তাহার প্রমোসনের একটা আশা ছিল। আমি কিন্তু ত্রিম্বকের মৃত্যুতে হৃদয়ে বড়ই ব্যথা পাইলাম।

গোবিন্দ বাবু ত্রিম্বকের লেখা কাগজ গুলি গুছাইয়া লইয়া পড়িতে লাগিলেন। আমিও কতকটা পড়িলাম। দ্বিতীয়াংশে ত্রিম্বকের আত্ম কাহিনী লিপিবদ্ধ হইল।

২য় খণ্ড – আসামীর লিখিত

দ্বিতীয় খণ্ড।
(আসামীর লিখিত।)

প্রথম পরিচ্ছেদ।

কেন খুন করিলাম? লোকে আমাকে খুনী মনে করে, এ আমি ইচ্ছা করি না। তাই এ হাজতে আমার জীবনের কয়েকটি কথা লিখিয়া রাখিয়া যাওয়া নিতান্ত আবশ্যক মনে করিয়াছি, এবং সেই জন্য লিখিতেছি।

ছেলেবেলা হইতেই আমার মা বাপ নাই। তাহাদের কথা এখন একেবারেই আমার মনে পড়ে না। শুনিয়াছি, আমি যখন মাতৃগর্ভে তখন আমার পিতার মৃত্যু হয়। সেই শশাকে আমার মা পীড়িত হন। আমার বয়স এক বৎসর হইতে না হইতে তিনিও আমাকে ছাড়িয়া পিতার সহিত মিলিতে স্বর্গে যান।

গুণবন্ত রাও নামে পিতার একজন বন্ধু ছিলেন। তিনিই অনুগ্রহ করিয়া আমায় লালন-পালন করিতে থাকেন। আমার মৃত্যু হইল, তাঁহার ও তাহার গুণবতী জননীর যত্নে আমি দিন-দিন বড় হইতে লাগিলাম।

নাসিকের নিকট সাতগাঁও নামে গ্রামে গুণবন্ত রাও বাস করি তেন। তিনি মধ্যবিত্ত গৃহস্থ ছিলেন, কিছু জমীজারাত ছিল, তাহাই চাষবাস করিয়া তাহার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে সংসার চলিত। তিনি দুরাত্মা সর্দার বালকিষণ রাওএর প্রজা ছিলেন। যখনকার কথা বলিতেছি, তখন বালকিষণ জমীদার হয় নাই, তাহার পিতা জমীদার ছিলেন।

যখন আমার বয়স পাঁচ বৎসর, তখন গুণবন্ত রাও বিবাহ করেন। দুই-তিন বৎসর পরে তাহার এক কন্যা হয়, তিনি এই কন্যার নাম রাখিয়াছিলেন, চন্দন বাঈ। চন্দন বাঈ ও আমি ভ্রাতা-ভগিনীর ন্যায় এক সঙ্গে লালিতপালিত হইয়াছিলাম। বলা অধিক, যে আমি প্রাণ অপেক্ষাও চন্দনকে ভালবাসিতাম।

যখন তাহার বয়স বার বৎসর, তখন মহা সমারোহে গুণবন্ত রাও আমার সহিত চন্দনের বিবাহ দিলেন। আমার সুখের মাত্রা পূর্ণ হইল। আমি জানিতাম, আমার ন্যায় সুখী আর ত্রিজগতে কেহ ছিল না। কিন্তু আমার অদৃষ্টে যে এ দুর্দশা ঘটিবে, কে জানিত! আমার চন্দনের যে পরিণামে কি ঘটিবে, তাহা আমি তখন স্বপ্নেও ভাবি নাই। চার পাঁচ বৎসর আমরা বড়ই সুখে কাটাইলাম।

এই সময়ে আমাদের জমীদারের মৃত্যু হইল। পাপাত্মা বালকিষণ আমাদের সর্দার হইল। আমাদের পূর্বের সর্দার মহাত্মা লোক ছিলেন, তাঁহার দয়া-দাক্ষিণ্যের প্রশংসা সকলেই করিত; কিন্তু এই দুরাত্মার নিন্দা চারিদিকেই শীঘ্র বিকীর্ণ হইল। সকলেই বলিতে লাগিল, বালকিষণ মহা দুর্দান্ত,-অর্তি পাশব চরিত্র লম্পট,-দয়ামায়া তাহার হৃদয়ে একেবারেই নাই। সে নানা প্রকারে তাহার প্রজা দিগের উপর অত্যাচার করিতে লাগিল। তাহার অত্যাচারে অনেকেই ঘরবাড়ী ছাড়িয়া অন্যত্রে পলাইতে লাগিল।

কিন্তু এ পর্যন্ত সে আমাদিগের উপর কোন অত্যাচার করে নাই; আমাদের গ্রামবাসীর উপরও কোন অত্যাচার হয় নাই, কিন্তু আমাদের সুখের দিন শীঘ্রই শেষ হইয়া আসিল। আমরা দেখিলাম, অসংখ্য লোক জন আসিয়া আমাদের গ্রামের প্রান্তভাগে অনেক তাম্বু ফলিল। শুনিলাম, সদ্দার বালকিষণ রাও কাল আমাদের গ্রামে আসিবেন। তিনি নিকটস্থ বনে শিকার করিতে আসিতেছেন।

পর দিবস বালকিষণ বহু লোকজন সমভিব্যাহারে আসিল। দুই তিন দিন শিকার করিল, তাহার লোকজন গ্রামের লোকের উপর নানা রকমে অত্যাচার করিতে লাগিল। খাদ্যদ্রব্যাদি কাড়িয়া লইতে লাগিল, এমন কি ভদ্রলোককে ধরিয়া কুলীর কাজও করাইতে লাগিল। শুনিলাম, স্ত্রীলোকদিগের উপর অত্যাচার করিতে ত্রুটি করিল না। গ্রামবাসিগণ স্থানে স্থানে গোপনে সমবেত হইয়া নানা কথা কহিতে লাগিল, কিন্তু দুর্দান্ত সর্দারের বিরুদ্ধে কোন কথা কহিতে বা সরকার বাহাদুরের নিকট নালিশ করিতে কাহারও সাহস হইল না।

একদিন সর্দারের একজন লোক আসিয়া গুণবন্ত রাওকে সর্দারের নিকট ডাকিয়া লইয়া গেল। গুণবন্ত রাও অতি বিষঃচিত্তে ফিরিয়া আসিলেন। আমি তাহার বিষণ্ণতার কারণ জিজ্ঞাসা করিলে তিনি কেবলমাত্র বলিলেন, না, কিছু নয়।

পরদিন সর্দারের নিকট হইতে তাহাকে ডাকিতে পুনঃ পুনঃ লোক আসিলে ও তিনি গেলেন না নানা অজুহত দেখাইয়া তাহাদিগকে বিদায় করিলেন। আমি তাহাকে আবার জিজ্ঞাসা করিলাম, আপ নাকে সর্দার এমন করিয়া ডাকিয়া পাঠাইতেছেন কেন?

তিনি প্রথমে নানা কথা বলিয়া আমার কথা উড়াইবার চেষ্টা করিলেন; কিন্তু শেষে আমি নিতান্ত পীড়াপীড়ি করায় তিনি বলিলেন, আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করিও না।

আমি প্রাণে বড় কষ্ট পাইলাম। গুণবন্ত রাও আমাকে পুত্র। নিৰ্বিশেষ ভালবাসিতেন, আমাকে কোন কথা কখনও গোপন করি তেন না,কিন্তু আজ অতি বিষণ্ণভাবে বলিলেন, তোমার সে কথা শুনিবার আবশ্যক নাই। আমি তাহার ভাব দেখিয়া আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে সাহস করিলাম না।

এদিকে গুণবন্ত রাও নানা ওজরে সর্দারের সহিত সাক্ষাৎ না করিলেও সর্দার তাহাকে ছাড়িল না। বৈকালে তাহার প্রধান অনুচর পাণ্ডুরাং আমাদের বাড়ী আসিল; গোপনে কথাবার্তার জন্য ও বন্ত রাওকে অন্য একটা ঘরে লইয়া গেল। আমি আর কৌতূহলবৃত্তি দমন করিতে পারিলাম না, সেই গৃহের দরজার পাশ্বে লুকাইত থাকিয়া তাহাদের কথা শুনিতে লাগিলাম।

পাণ্ডুরাং বলিতেছেন, সর্দারকে তুমি এখনও চিনিতে পার নাই। তিনি রাগ করিলে তোমার সর্বনাশ হবে। তার যা সখ হয়, তা কে খাতে পারে।

গুণবন্ত রাও কাতরভাবে বলিলেন, তিনি আমাদের জমীদার, তিনি আমাদের মা বাপ। তিনি অত্যাচার করিলে কার কাছে আমরা দাঁড়াব।

পাণ্ড রাং। ও সব বাজে কথা এখন ছেড়ে দাও। যত টাকা চাও দিতেছি। তোমার মেয়ে রাজ-রাণী হয়ে থাকবে।

গুণবন্ত। ও কথা মুখে আবেন না। মনে করুন দেখি, যদি আপনার মেয়ে হত ত কি করতেন? সে বিবাহিত, তার স্বামী আছে।

পাণ্ডরাং। ভাল কথায় না শোন, তোমারই সর্বনাশ। সহজে সম্মত হওমেয়ে রাজরাণী হবে—নতুবা তোমার মেয়েকে চাকরাণীর অধম হয়ে থাকতে হবে।

গুণবন্ত। সংসারে কি ভগবান নাই। গরিবের বন্ধু ভগবান। ইংরেজ রাজও আছে।

পাওরাং হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। বলিল, ভাল কথা শুলে না, আজ রাত্রেই তোমার মেয়েকে জোর করে নিয়ে যাব, কোন্ বাবা রাখে দেখা যাবে?

আমি আর সহ্য করিতে পারিলাম না। একেবারে সেই ঘরে প্রবেশ করিয়া সিংহ-বলে মহাপাপীকে আক্রমণ করিলাম। সে আশ্চর্যান্বিত ও স্তম্ভিত হইয়া গেল। আমি তাহাকে বারংবার পদাঘাতে একেবারে বাড়ীর বাহিরে আনিয়া ফেলিলাম। সে দুই একেবার বল প্রকাশের চেষ্টা করিল, কিন্তু আমি তখন একেবারে মরিয়া। আমি তাহাকে পদাঘাতের উপর পদাঘাতে আমাদের বাটির সম্মুখস্থ নর্দমায় ফেলিলাম। কতক্ষণ পরে সে একটু প্রকৃতস্থ হইয়া নর্দমা হইতে উঠিল। ধূলা ও কদ্দমে আপ্লুত হইয়া অতি কষ্টে খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে সর্দারের তাম্বুর দিকে চলিল; একবার আমার দিকে বিকটভাবে চাহিল, আমি তাহা গ্রাহ্য করিলাম না।

সে দৃষ্টির বহির্ভূত হইলে আমি বাড়ীর ভিতর প্রবিষ্ট হইলাম। দেখিলাম, গুণবন্ত রাও, তাহার স্ত্রী ও কন্যাকে লইয়া ম্লানমুখে বসিয়া আছেন। সকলেই ব্যাকুল ও বিষ। আমাকে দেখিয়া কাতর ভাবে বলিলেন, ত্ৰিষক, ভাল কাজ করিলে না?

আমি বলিলাম, হাঁ, ব্যাটাকে একবারে প্রাণে না মানায় কাজটা ভালই হয় নাই বটে।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

বহুক্ষণ আমরা কেহ কোন কথা কহিলাম না। শেষে আমার শঠাকুরাণী বলিলেন,এখন চুপ করে বসে থাকলে আমাদের চন্দনকে আমরা কেমন করে রক্ষা করব?

আমি বলিলাম, আমি কি মরিছি? আমার শরীরে কি এক বিন্দুও মারাঠী রক্ত নাই। প্রাণ থাকিতে আমার স্ত্রীর গায় হাত দেয় এমন সাহস কার?

গুণবন্ত রাও বলিলেন, বাবা, তুমি যে পরম সাহসী তা কে না স্বীকার করে? কিন্তু আমরা দুজন, দুজনে সর্দারের লোকের সঙ্গে কত ক্ষণ লড়তে পারি?

আমি। যতক্ষণ প্রাণ থাবে লড় ব।

গুণবন্ত। ও সব পাগলের কথা। আর আমাদের এ গ্রামে তিলাৰ্ক থাকা উচিত নয়। তারা এখনও যে কিছু করে নাই, সে কেবল ইংরেজ রাজের ভয়ে। অনেক রাত্রে যখন গ্রামের সকলে ঘুমাবে, তখনই আসবে।

আমি। আপনি কি করতে চান?

গুণবন্ত। এখনই পালিয়ে ইংরেজ রাজের নাসিক সহরে যাওয়া। এখন থেকে রেল ষ্টেশন দশ ক্রোশ, কোন রকমে ষ্টেশনে পৌঁছিতে পারলে আর কোন ভয় নাই।

আমার শাশুড়ী বলিলেন, তবে আর দেরী কর না।

কি করি, অগত্যা আমি ও পলাইতে স্বীকার করিলাম। তখনই আমরা সকলে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিলাম। গুণবন্ত রাও তাহার মূল্যবান্ দ্রব্যাদি বাধিয়া একটা পোটলা করিলেন। টাকা কড়ি আমরা সব কোমরে বাঁধিলাম, কিছু বিছানা-পত্রও সঙ্গে লইলাম।

পাছে কেহ জানিতে পারে বলিয়া আমরা গাড়ী বা মুটে কিছুই সংগ্রহ করিলাম না। চারিজনে আমরা নিজেদের দ্রব্যাদি কাধে করিয়া লইয়া যাওয়া স্থির করিলাম।

রওনা হইবার সমস্ত বন্দোবস্ত স্থির হইলে আমার স্ত্রী আমাকে এক পাশে ডাকিয়া লইয়া বলিল, বোধ হয়, আমাদের এই শেষ দেখা। আমার মনে নিচ্ছে যে, তোমায় আমায় স্বর্গে না গেলে আর দেখা হবে না।

আমি বলিলাম, চন্দন, তুমি বৃথা ভয় করছ। সদ্দার আমাদের কিছুই করতে পারবে না। নিশ্চয় জেন, আমার প্রাণ থাকতে তোমার গায়ে কেহ হাত দিতে পাবে না।

চলন। আমাদের সহায় ভগবান্।

আমি। একবার ষ্টেশনে পৌছিতে পারলে আমাদের কে কি করে?

চন্দন । যাই হউক, ভগবান্ করুন আমাদের আর কোন বিপদ আপদ না হয়; কিন্তু যদি কিছু ঘটে, তবে আমার একটা কথা তোমায় বল্বার আছে।

আমি। বল।

চন্দন। আমার মাথায় হাত দিয়ে বল যে, তার কথা রাখবে।

আমি। নিশ্চয় রাখব। কবে না তোমার কথা রেখেছি?

চন্দন নিজ বাম কর্ণ হইতে তাহার সোণার সুন্দর ইয়ারিং আনার হাতে দিয়া বলিল, এই ইয়ারিংটা যত্নে রেখ। আমার কথা পাছে তুমি ভুলে–

আমি বাধা দিয়া বলিলাম, এ কথা কখনও মুখে এনো না।

চন্দন। তা নয়, তবে এটা তোমার কাছে থাকলে আমার কথা তোমার মনে থাকবে।

আমি। আমি দিনরাত এই ইয়ারিং বুকে বুকে রাখব। চন্দন। আমাকে যদি এরা কোন গতিকে জোর করে তোমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে যায়, তা হলে আমি আর বাঁচব না। আত্ম হত্যা কব। এই দেখ।

এই বলিয়া চন্দন নিজ বস্ত্র মধ্য হইতে একখানি শাণিত ছুরিক বাহির করিল। আমি কোন কথা কহিলাম না। চন্দন বলিল,প্রথমে পাপাত্মা দের উচিত দণ্ড দেবার চেষ্টা করব। তা যদি না পারি, নিজে মরব।

আমি বলিলাম, তুমি মারাঠী রমণী, তোমার যা করা কর্তব্য তাই করো।

চন্দন। হাঁ, করব। আমি তোমার অনুপযুক্ত নই। তাই বলছি এই একটা ইয়ারিং আমার কাণে থাল। যদি আমি ফিরে আসি ভালই; না হলে জাবে আমি আর এ জগতে নাই। যদি এই ইয়ারিং তোমার হাতে আসে, তবে বুঝবে আমি পাপীর উপযুক্ত দণ্ড দিয়ে মরেছি। আর যদি এ ইয়ারিং ফিরে না আসে, তবে বুঝবে পাপীর দণ্ড হয় নাই। প্রতিজ্ঞা কর—

আমি। কি প্রতিজ্ঞা, বল। চন্দন। ভগবানের নামে প্রতিজ্ঞা কর—

আমি। বল।

চন্দন। যেমন করে হয়,এই পাপাত্মাদের দণ্ড দেবে,—কেবল দণ্ড নয়—প্রাণদণ্ড।

আর চন্দন কথা কহিতে পারিল না। সে অন্যদিকে মুখ ফিরাইল। আমার সর্ব শরীরে শিরায় শিরায় অগ্নি ছুটিল। আমি বলিলাম, চন্দন, তুমি বৃথা ভয় পাচ্ছ। যদি যথার্থই কেহ তোমার উপর অত্যাচার করে, তবে জেন, এই তোমায় ছুয়ে ভগবানের কাছে শপথ করে বছি, তার রক্ত না দেখে—তার মৃতদেহ না দেখে আমি নিশ্চিন্ত হব না।

চন্দন। তা হলে চল, আর দেরী করে কাজ নাই। বাবা মা ব্যস্ত হয়েছেন।

আমরা বাহিরে আসিলাম। তখন রাত্রি প্রায় নয়টা। গ্রাম অতি নিস্তব্ধ, রাস্তায় লোকের চলা-ফেরা প্রায় বন্ধ হইয়াছে, কোনদিকে কোন শব্দ নাই, আমরা সুযোগ বুঝিয়া ধীরে ধীরে চারি জনে বাহির হইলাম। আমাদের তীক্ষ্ণধার দুইখানি তরবারি সুদৃঢ়ভাবে কোমরে বাঁধিয়া লইলাম।

কোনদিকে কেহ নাই দেখিয়া আমরা নিঃশব্দে আমাদের দ্রব্যাদি লইয়া অন্ধকারে বাহির হইয়া পড়িলাম। দ্রুতপদে ষ্টেশনের পথে রওনা হইলাম। আমার বোধ হইল, যেন কে একজন আমাদের বাড়ীর সম্মুখস্থ গাছের পাশে লুকাইয়া ছিল; আমাদিগকে দেখিয়া ধীরে ধীরে সরিয়া গেল। আমি এ কথা গুণবন্ত রাওকে তখনই বলিলাম।

তিনি বলিলেন,পাণ্ডুরাং যে রকম লোক তাতে সে অপমান জীবনে ভুল বার লোক নয়। বোধ হয়, আমরা কি করি না করি, দেখবার জন্য পাহারায় লোক রেখেছিল?

গুণবন্ত। বলতে পারি না, চল শীঘ্র যাওয়া যাক।

আমি। যদি আমাদের উপর অত্যাচার করতে আসে, তা হলে দু-দশটাকে আর ঘরে ফিরে যেতে হবে না।

গুণবন্ত রাও কোন কথা কহিলেন না। আমিও আর কোন কথা না কহিয়া সত্বরপদে চলিলাম। দুইটী স্ত্রীলোক আমাদের সঙ্গে সঙ্গে উৰ্দ্ধশ্বাসে ছুটিল।

এইরূপে রাত্রি প্রায় বারটা পর্যন্ত আমরা চলিলাম। পথে কোনই বিপদ-আপদ ঘটিল না। তখন আমরা সকলে মনে ভাবিলাম যে, এখন আমরা সর্দারের হাত হইতে উদ্ধার হইয়াছি, আর কোন ভয় নাই। এতক্ষণ আমরা একরপ ছুটিতে ছুটিতে আসিতেছিলাম, এখন একটু ধীরে ধীরে চলিলাম। এতক্ষণ অন্ধকার ছিল, এখন জ্যোৎস্নায় চারিদিক বেশ পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে।

গুণবন্ত রাও বলিলেন, বোধ হয় আর ভয় নাই?

আমি বলিলাম, বেটারা কি এতদূর এসেও ধরবে?

আমার শাশুড়ী ঠাকুরাণী বলিলেন, আমাদের সহায় ভগবান আছেন।

আমি আমার স্ত্রীর মুখের দিকে চাহিলাম। সে ঘাড় নাড়িল। আমি তাহার মুখের ভাব দেখিয়া বুঝিলাম, সে বলিতেছে, ভয় যায় নাই। বিপদ এখনও আছে।

আমি কি বলিব, কিরূপে তাহাকে প্রবুদ্ধ করিব? আমি কোন কথায়ই কহিতে পারিলাম না। সকলে নীরবে পথতিবাহিত করিতে লাগিলাম।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

আমরা আরও প্রায় এক ক্রোশ পথ চলিলাম, তখন প্রায় একটা বাজিল। এই সময়ে সহসা পথিপাশ্বত একটা ঝােপের মধ্যে একটা বিকট শব্দ হইল। আমরা চারিজনই স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইলাম। অমনই প্রায় বিশ-পঁচিশজন লোক আসিয়া আমাদের ঘেরিয়া ফেলিল। আমি মুহূৰ্ত্ত মধ্যে তরবারি খুলিলাম; কিন্তু গুণবস্তু ও তরোয়াল খুলিবার সময়ই পাইলেন না; এক দুরাত্মা তাহার মস্তক লক্ষ্য করিয়া তরবারি তুলিল। আমি লম্ফ দিয়া তাহাকে রক্ষা করিতে অগ্রসর হইলাম, কিন্তু তাহার নিকট পৌছিবার পূর্বেই তাঁহার মস্তকে তরবারি পড়িল। আমি দেখিলাম যে আমার শাশুড়ী ঠাকুরাণী আসিয়া স্বামীর উপর পড়িলেন, তৎপরে উভয়েই ভূমিশায়ী হইলেন।

আমি আর কিছুই দেখিতে পাইলাম না। অমনই দশ-বারজনে আমাকে ঘেরিল। আমি তাহাদিগের পাঁচ-ছয়জনকে আহত করিলাম। তখন একবার দেখিলাম, পাষণ্ড পাণ্ডুরাং চন্দনের হাতমুখ বাঁধিয়া তাহাকে একটা ঘোড়ার উপর তুলিতেছে। আমি উন্মত্তের ন্যায় সেই দিকে ছুটিলাম। আমি এইরূপে একটু অসাবধান হইবামাত্র দুই তিন জনে আমাকে আঘাত করিল; আমি চারিদিকে যেন হাজার হাজার সূর্যের আলো দেখিলাম; তৎপরে বোধ হইল, যেন কে আমাকে ঘোর অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত করিল। তাহার পর আমি—তাহার পর কি হইল আর জানি না।

যখন আমার জ্ঞান হইল, তখন আমি দেখিলাম, আমি রাস্তার পাশে একটা নর্দমায় পড়িয়া আছি। উঠিতে চেষ্টা করিলাম, পারিলাম না। তখন দেখিলাম, আমি গুরুতররূপে আহত হইয়াছি, অনেক রক্ত পড়ায় নিতান্ত দুর্বল হইয়া পড়িয়াছি। দেখিলাম, তখন বেশ বেলা। হইয়াছে, চারিদিকে খুব রৌদ্র।

এখানে থাকিলে বাঁচিব না, ভাবিয়া আমি কষ্টে রাস্তায় উঠিবার চেষ্টা পাইলাম, কিন্তু পারিলাম না, চীৎকার করিয়া আবার পড়িয়া গেলাম। এই সময়ে সেই রাস্তা দিয়া কতকগুলি চাষা যাইতেছিল, তাহারা আমার চীৎকার শুনিয়া তাড়াতাড়ি নর্দামার নিকট আসিল। আমি বাঁচিয়া আছি দেখিয়া তাহারা তিনচার জন নর্দামার মধ্যে। নামিল, এবং অনেক কষ্টে ধরাধরি করিয়া আমাকে উপরে তুলিল।

আমি দেখিলাম, গুণবন্ত রাও রক্তাক্ত কলেবরে রাস্তার উপর পড়িয়া আছেন। আরও দেখিলাম, আমার শাশুড়ী ঠাকুরাণী স্বামীকে রক্ষা করিতে গিয়া নিজেই হত হইয়াছেন। চন্দনের কোন চিহ্ন নাই। এই লোমহর্ষণ ব্যাপার দেখিয়া আমার মাথা ঘুরিয়া গেল, দারুণ মানসিক উত্তেজনায় আমার ক্ষতবিক্ষত দেহে আবার রক্ত ছুটিল, আবার আমি অবসন্ন হইয়া পড়িলাম, আবার আমার সংজ্ঞা বিলুপ্ত হইল। তাহার পর কি হইল, আমার স্মরণ নাই।

যখন আমার সংজ্ঞা হইল, তখন আমি যে কোথায় আছি, তাহা কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। ক্রমে বুঝিলাম, আমি হাসপাতালে। পরে জানিলাম, আমি নাসিকের হাসপাতালে আসিয়াছি,। কৃষকেরা পুলিশে সংবাদ দেওয়ায় তাহারা আমাকে জীবিত দেখিয়া হাসপাতালে পাঠাইয়াছিল।

আমি দিন-দিন আরােগ্য লাভ করিতে লাগিলাম। শুনিলাম। আমাদিগকে ডাকাতে আক্রমণ করিয়াছিল, ডাকাতগণ গুণবন্ত রাও ও তাহার স্ত্রীকে খুন করিয়া আমাকে অর্ধমৃত অবস্থায় রাখিয়া সমস্ত কাড়িয়া লইয়া পলাইয়াছে,এই বলিয়া পুলিশ রিপোর্ট করিয়াছে। চন্দন বাঈকে ডাকাতের লইয়া গিয়াছে,পুলিশ অনেক চেষ্টা করিতেছে, কিন্তু এখনও ডাকাতদের কোন সন্ধানই করিতে পারে নাই।

কেবল আমিই জানিতাম যে, আমরা ডাকাত কর্তৃক আক্রান্ত হই নাই। সর্দার বালকিষণ ও পাণ্ডুরাংই চন্দন বাঈকে লইয়া গিয়াছে। কিন্তু এ কথা হাসপাতালের কাহাকেও বলা আমি যুক্তিসঙ্গত বিবেচনা করিলাম না।

প্রায় এক মাস হাসপাতালে পড়িয়া থাকিয়া আমি আরোগ্য লাভ করিলাম। পরে শরীরে বল পাইলে একদিন হাসপাতাল হইতে বাহির হইলাম। সর্দার ও পাণ্ডুরাংএর সন্ধান করা এবং তাহাদের সমুচিত দণ্ড দেওয়াই আমার তখন জীবনে একমাত্র কর্তব্য। চন্দন বাঙ্গ কি এখনও বাঁচিয়া আছে? শেষ দিন সে আমাকে যাহা যাহা বলিয়া গিয়াছিল,তাহা আমার হৃদয়-কন্দরে জ্বলন্ত অক্ষরে লিখিত ছিল। আমি বস্ত্রাভ্যন্তরে হাত দিয়া দেখিলাম তাহার সেই ইয়ারিং তখনও তথায় আছে। সেই ইয়ারিং স্পর্শ করায় আমার শিরায় শিরায় অগ্নি ছুটিল, আমি উন্মত্তের প্রায় হইলাম। আমি উন্মাদের ন্যায় সমস্ত দিন নাসিক সহরের রাজপথে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইলাম।

এইরূপে দুইদিন কাটিয়া গেল। এই দুইদিন আহার নিদ্রা আমার কিছুই ছিল না। তিন দিনের দিন শরীর একেবারে অবসন্ন হইয়া পড়িল; আমি গোদাবরীর তীরে একটা বাঁধা-ঘাটে ইয়া পড়িলাম। দেখিতে দেখিতে ঘুমাইয়া পড়িলাম। কতক্ষণ যে আমি নিদ্রিত ছিলাম—তাহা জানি না।

কে আমার মাথা ধরিয়া নাড়া দেওয়ায় আমার ঘুম ভাঙিয়া গেল আমি চমকিত হইয়া উঠিয়া বসিলাম। দেখিলাম, আমাদের গ্রামের বৃদ্ধ গঙ্গাধর রাও,-গুণবন্ত রাওয়ের সঙ্গে ইহার বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল। ইনি আমাকে পুত্র নির্বিশেষে ভালবাসিতেন। তিনি বলিলেন, এখানে কেন, কবে হাসপাতাল থেকে বেরুলে?

আমি। এই তিন দিন হল?

গঙ্গা। কোথায় আছ?

আমি। কোথাও নয়। যাবার স্থান কোথায়?

গঙ্গা। এস, আগে তোমার কিছু খাওয়া আবশ্যক।

আমি দ্বিরুক্তি না করিয়া উঠিলাম। তিনি আমাকে একটা দোকানে লইয়া গিয়া আহার করাইলেন। আহার করিয়া আমি শরীরে বল পাইলাম, মনেও পূৰ্ব্ব-তেজ দেখা দিল। বলিলাম, আপনি সর্দার বালকিষণের কোন সংবাদ রাখেন?

তিনি বলিলেন, সব বলিতেছি,—সঙ্গে এস।

আমি তাহার সঙ্গে সঙ্গে চলিলাম। আমরা উভয়ে সহরের বাহিরে একটা নির্জন ভাঙ্গা মন্দিরের নিকট আসিলাম। তিনি বলিলেন, এখানে কেহ নাই,-বস। সব বলিতেছি।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

গঙ্গাধর রাও কিয়ৎক্ষণ নীরবে থাকিয়া আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, চন্দন আর নাই।

তিনি ভাবিয়াছিলেন, এ সংবাদে আমি নিতান্তই বিচলিত হইব, কিন্তু আমি তাহা না হওয়ায় তিনি বরং একটু বিচলিত হইলেন। আমি বলিলাম, আমি তা জানি।

তিনি বলিলেন, কেমন করিয়া জানিলে?

আমি। চলন আমাকে বলে গিয়েছিল।

গঙ্গা। বলে গিয়েছিল?

আমি। হাঁ,—সে আত্মহত্যা কবে বলে গিয়েছিল।

গঙ্গা। হাঁ, সত্য-সত্যই সে আত্মহত্যা করেছে।

আমি। আপনি যা কিছু জানেন, সব বলুন। আমি কিছুমাত্র কাতর হব না।

গঙ্গা। চন্দন বাঈকে নিয়ে তারা সেইদিন সর্দারের বাড়ী চলে যায়, কিন্তু সর্দার বা পাণ্ডুরাং যায় না। পাছে হঠাৎ চলে গেলে, লোকে সন্দেহ করে, সেজন্য দুজনে আরও তিন চারি দিন গ্রামে ছিল।

আমি। লোকে বা তারা এ বিষয়ে কি বলেছিল, বলতে পারেন?

গঙ্গা। হাঁ, ডাকাতে যে তোমাদের মেরে চন্দনকে কেড়ে নিয়ে গেছে, এই সকলের বিশ্বাস। পুলিশও তদন্ত করে তাই রিপোর্ট করেছে। এখনও তারা ডাকাত খুঁজে বেড়াচ্ছে।

আমি। আমি তাদের বলে দেব, এ ডাকাত কে।

গঙ্গা। কিছুই হবে না, বাপু। কে করেছে তা তারা বেশ জানে। সর্দার তাদের বেশ খাইয়েছে।

আমি। আচ্ছা, এর সাজা আর কেউ না দেয়, আমি নিজের হাতেই দেব।

গঙ্গা। গ্রামের লোকে আমাকে ভক্তি-সম্মান করে, বলে আমাকে হাত করবার জন্য তার পর দিন সর্দার আমাকে ডেকে পাঠিয়ে চারী দিতে চায়। চারী নিলে কোন-না-কোন সুযোগে আমি চন্দনকে উদ্ধার করতে পারব বলে আমি তার চারী নিতে স্বীকার করলেম।

আমি। ভালই করেছিলেন।

গঙ্গা। আমি সর্দারের সঙ্গে তার বাড়ী এলেম। পরদিন সর্দা রের রাগ রাগ ভাব দেখে ভাবলেম যে, একটা কিছু কাণ্ড হয়েছে। আমি গোপনে গোপনে সন্ধান করতে লাগলেম।

আমি। কি জানতে পারলেন?

গঙ্গা। জালেম—অনেক কষ্টে যদিও জানতে পেরেছিলাম, জালেম, যে সর্দার সেই রাত্রেই চন্দনের সঙ্গে দেখা করে, কিন্তু শীঘ্রই তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। চন্দন তার সম্মুখেই নিজের বুকে নিজে চুরি বসিয়েছিল।

আমি। তা আমি জানি।

গঙ্গা। তার পর সেই রাত্রেই বালকিষণ ও পাণ্ডুরাং ধরাধরি করে চন্দনের মৃতদেহ বাড়ীর কাছে একটা জঙ্গলের মধ্যে কোথায় পুতে রেখে চলে আসে। বাড়ীর দুই-চারিজন দাস-দাসী ভিন্ন আর কেউ এ কথা জানে না।

আমি। ইয়ারিং।

গঙ্গা। ইয়ারিং কি?

আমি। ওঃ! আপনি তা জানেন না, আর শুনে কাজ নাই।

গঙ্গা। এখন কি করবে?

আমি। কৰ্তব্য—পাপীর দণ্ড।

গঙ্গা। পাপীর দণ্ড ভগবান দেবেন। এখন দেশে ফিরে যাও, ঘর-দরজা বিষয়-সম্পত্তি দেখবার কেউ নাই।

আমি। কার জন্য দেশে যাব? দেশে যাব না। পাপীর দণ্ড দিব। আপনি আমার একটা কাজ করবেন। আপনি আমাকে ছেলের মত ভালবাসেন, তাই বলি।

গঙ্গা। বল।

আমি। আমি ত্ৰিশখানা কাগজ আপনাকে দিব, আপনি কোন গতিকে এক-একখানা কাগজ এই পাপাত্মা সর্দারের বিছানায় রাত্রে রেখে দিতে পাবেন?

গঙ্গা। বোধ হয় পাব—চেষ্টা কব-কাগজ দেবার অর্থ কি?

আমি। কাগজে কিছু লিখে দিব। আমি এই পাপিষ্ঠকে কাপুরুষের মত সহসা খুন করে আমার হাত কলঙ্কিত করব না, সে ইচ্ছা আমার নাই। একমাস ওকে সময় দেব; দুজনে লড়ব, যে হয় একজন মরবে।

গঙ্গা। যদি না লড়তে চায়?

আমি। আমি বিষের বড়ী তয়েরী করতে জানি। একটা বিষ বড়ী আর একটা ঠিক সেই রকম দেখতে অবিষাক্ত বড় একটা কৌটায় রেখে তাকে যেটা ইচ্ছে বেছে নিয়ে খেতে বলব। অন্যটা আমিও খাব। হয় সে মরবে—না হয় আমি মরব।

গঙ্গা। যদি না খায়।

আমি। খাবে না! জোর করে খাওয়াব।

এই বলিয়া আমি লম্ফ দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলাম। অমনি ঝর ঝর করিয়া আমার নাক মুখ দিয়া রক্ত পড়িতে লাগিল; দেখিয়া গঙ্গাধর রাও ভীত ও স্তম্ভিত হইলেন। ছুটিয়া গিয়া নদী হইতে কাপড় ভিজাইয়া জল আনিয়া আমার নাকে মুখে মাথায় দিতে লাগিলেন। রক্ত বন্ধ হইল, আমিও প্রকৃতিস্থ হইয়া বসিলাম।

গঙ্গাধর রাও বলিলেন, তোমার শরীর এখনও ভাল হয় নাই। আমার কথা শোেন, দিন কত দেশে গিয়ে শরীর সুস্থ কর, তার পর যা হয় কয়রা।

আপনার সব কথা শুনব, কেবল ঐটা নয়।

তবে কি কবে?

সর্দার আর পাণ্ডুরাংএর সন্ধানে যাব।

তারা সব নাসিকে রয়েছে।

তা হলে ভালই হয়েছে, আর খুঁজতে যেতে হবে না।

কোথায় থাকবে মনে করেছ। আমার কাছে থাকলে ওরা আমাকে সন্দেহ করবে।

আমি একটা বাসা খুঁজে নেব।

টাকা কড়ি-কিছু সঙ্গে আছে?

কিছু না।

গঙ্গাধর রাও নিজ বন্ত্রের ভিতর হইতে কিছু টাকা বাহির করিয়া আমার হাতে দিলেন। বলিলেন, লও, এখন খরচ চালাও, পরে শোধ দিলেই চলবে।

আমার কাছে একটি পয়সাও ছিল না, সুতরাং আমি লইলাম। বলিলাম, আপনি দেশে চিঠী লিখে দিন, যেন তারাই আমার বিষয়-সম্পত্তি দেখ।

আচ্ছা তাই হবে। বোজ রাত্রি নটার সময় এখানে এলে আমার সঙ্গে দেখা হবে। যা হয় তা খবর দিব।

আমিও কাল আপনাকে কাগজ গুলো দিব। কোন গতিকে কেউ না টের পায়, বালকিষণের বিছানায় রেখে দিবেন।

তাই হবে।

তিনি বিদায় হইলেন। আমিও একটা বাসা ঠিক করিবার চেষ্টায় চলিলাম।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

নাসিকে বাসা পাওয়া শক্ত নয়। বাসা ঠিক করিয়া আমি কাগজ কলম দোয়াত কিনিলাম। পর দিন রাত্রে গঙ্গাধর রাওকে ত্রিশখানি কাগজ দিলাম। তাহাতে লিখিয়াছিলাম;–

বালকিষণ ও পাণ্ডুরাং!

তোমাদের পাপের দণ্ড দিব। আজ হতে এক মাস সময় দিলাম। যদি সাহস থাকে, এক মাসের মধ্যে আমার সঙ্গে দেখা কবে, হয় তোমরা মরবে, না হয় আমি মরব। আর যদি দেখা না কর, তবে কুকুর-শেয়ালের মত খুন করে মারব। আজ থেকে ত্রিশ দিন সময়।

পরের খানায় লিখিলাম,আজ থেকে ২৯ দিন সময়। তার পর ২৮ দিন সময়। ২৭ দিন সময়। এই রকম শিখানা। গঙ্গাধর কাগজগুলি লইয়া গেলেন। আমি বালকিষণ ও পাণ্ডুরাংএর সন্ধানে রহিলাম ।

দিনের পর দিন বালকিষণ আমার কাগজ পাইতে লাগিল। কোথা হইতে কে তাহার বিছানায় এই কাগজ রাখিয়া যায় জানিতে না পারিয়া, সে বড়ই ভীত হইয়া পড়িল, তাহার আহার নিদ্রা গেল। আমি এই সংবাদ পাইয়া প্রাণে বড়ই আনন্দ উপলব্ধি করিলাম।

সে টাকা দিয়া পুলিশকে হাত করিল। আমার বিরুদ্ধে নালিশ করিল। পুলিশ একদিন আমাকে ধরিল, আমিও পুলিশকে বলিলাম, সর্দার বালকিষণ আমার স্ত্রী ছিনাইয়া লইয়া গিয়াছে। পুলিশ আমার কথা হাসিয়া উড়াইয়া দিল, আমাকে বলিল, শীঘ্র এ সহর থেকে পালাও,না হলে জেলে দিব। আমি অগত্যা দিন কয়েক গা ঢাকা দিয়া রহিলাম। এই সময় হইতে ছদ্মবেশ ধরিতে আরম্ভ করিলাম। এ বিদ্যায় কতদূর পাকা হইয়াছি তা—গোবিন্দ বাবু তাহা প্রত্যক্ষ করিয়াছেন।

আমার ভয়ে বালকিষণ ও পাণ্ডুরাং ক্রমে অস্থির হ উঠিল। ক্রমে যতই কাগজের দিন কম হইয়া আসিতে লাগিল, তত তাহার। উন্মত্তের ন্যায় হইল, শেষে দুজনে নাসিক ছাড়িয়া পন। কিন্তু পালাইবে কোথায়—পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত আন তাহাদের অনুসরণ করিতে প্রস্তুত।

আমি এ সংবাদ পাইয়া তাহাদের সঙ্গ লইলাম। তাহারা আমার। হাত এড়াইবার জন্য কলিকাতায় গেল, আমিও কলিকাতায় আসিলাম, নানারূপ ছদ্মবেশ ধরিয়া তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে রহিলাম, কিন্তু কিছুতেই তাহাদিগকে হাতে পাইলাম না।

তাহারা কলিকাতা হইতে কাশী, কাশী হইতে এলাহাবাদ, আগ্রা, দিল্লী হইয়া লাহোরে আসিল, আমিও সঙ্গে সঙ্গে আসিলাম। এক দিনের জন্য ও তাহাদের চক্ষের অন্তরাল হইতে দিলাম না।

লাহোরে আসিয়া তাহারা বাসা হইল । আমিও সঙ্গে সঙ্গে থাকিয়া তাহাদের বাসা দেখিলাম; কিন্তু লাহোরেও এই দুরাত্মার দণ্ড দিবার সুবিধা কিছুতেই পাইলাম না। এখানে আসিয়া তাহারা নিশ্চয় মনে করিয়াছিল যে,এ পর্যন্ত আর আমি তাহাদের সঙ্গ লই নাই। তাহারা আমার হাত এড়াইয়াছে। তাহারা এখানে আসিয়া ভারি সুখী হইল। বালকিষণ দিন রাত্রি প্রায় মাতাল হইয়া থাকিত।

তাহার যখনই বাহির হইত, তখনই গাড়ী করিয়া বাহির হইত, সুতরাং তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকা আমার পক্ষে বড়ই ক্লেশকর হইয়া উঠিল। গাড়ীর সঙ্গে সঙ্গে হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয়, পাছে তাহারা আমার চোখের আড়াল হয়, এই ভাবিয়া আমি বড়ই চিন্তিত হইলাম। ভাবিয়া ভাবিয়া শেষে আমি একটা উপায় স্থির করিলাম।

একজন বড় এক্কাওয়ালার সঙ্গে দেখা করিলাম। তাহার অনেক একা ছিল। বন্দোবস্ত হইল, দিন হিসাবে এক টাকা লইয়া সে তাহার একা ও ঘোড় আমাকে ভাড়া দিবে। লোকে এক্কা লইয়া সমস্ত দিন ভাড়া খাটিয়া এক টাকার উপর যাহা পাইত লইত, এক টাকা তাহাকে দিত। আমিও এই বন্দোবস্তে তাহার নিকট হইতে একখানি একা লইলাম। তথন বালকিষণ ও পাণ্ডুরাংয়ের সঙ্গে সঙ্গে থাকা আমার পক্ষে বড় সুবিধাজনক হইল।

আমি প্রায় এক্কা লইয়া তাহাদের বাসার নিকট ঘুরিতাম। এক দিন সন্ধ্যার সময় দেখি একখানা গাড়ী তাহাদের বাসার সম্মুখে দাঁড়াইল। তাহাদের জিনিষ-পত্র গাড়ীর ছাদে উঠিল। পরে বালকিষণ ও পাণ্ডুরাং গাড়ীতে আসিয়া বসিল। গাড়ী ষ্টেশনের দিকে চলিল, আমিও আমার একা ঐ গাড়ীর পিছনে পিছনে চালাইলাম।

তাহারা ষ্টেশনে আসিল, মুটেরা তাহাদের জিনিষ-পত্র নামাইয়া, কল। সামি মন একন এওয়ালাকে আমার এক্কা দেখিতে বলিয়া সত্বর তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে ষ্টেশনের ভিতর চলিলাম। পাণ্ডুরাং খবর লইয়া জানিল যে, তখনও গাড়ীর অনেক বিলম্ব আছে।

এই কথা শুনিয়া বালকিষণ তাহাকে বলিল, তবে তুমি এখানে অপেক্ষা কর, আমার একটা বিশেষ কাজ আছে, সেরে আসছি।

পাণ্ডুরাং ইহাতে আপত্তি করিল, কিন্তু বালকিষণ তখন বেশ মাতাল,-তাহাকে কুৎসিত গালি দিয়া উঠিল। পাণ্ডুরাং তাহার হাত ধরিতে গেলে সে তাহাকে ঠেলিয়া ফেলিয়া দিয়া ষ্টেশনের বাহিরে আসিল। আমি আমার এক্কায় উঠিবার আগেই সে সত্বর একখানা এক্কায় উঠিয়া হাঁকাইতে আজ্ঞা করিল। যো হুকুম বলিয়া এক্কাওয়ালা তাহার ঘোড়াকে সবলে চাবুক মারিল; ঘোড়া তীর বেগে ছুটিল। আমিও আমার এক্কা তাহার পশ্চাতে ছুটাইলাম।

বালকিষণের এক্কা পথে একটা মদের দোকানে থামিল। বালকিষণ নামিয়া গেল। প্রায় আধ ঘণ্টা পরে সে টলিতে টলিতে আবার আসিয়া এক্কায় উঠিল—এক্কা চলিল। আমি দেখিলাম, এক্কা তাহাদের বাসার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। ভাড়া লইয়া এক্কাওয়ালা চলিয়া গেল। বালকিষণ বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল। আমি আমার একা লইয়া সেইখানে ঘুরিতে লাগিলাম।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

প্রায় আধঘণ্টা পরে সেই বাড়ীর ভিতর একটা গোলযোগের শব্দ পাই লাম। বুঝিলাম, দুই ব্যক্তিতে খুব মারামারি হইতেছে। পরে দেখি লাম, একব্যক্তি বালকিষকে গলা ধাক্কা দিতে দিতে সদর দরজার কাছে আনিল,-তৎপরে তাহার পিঠে সবলে এক পদাঘাত করিল, বালকিষণ রাস্তায় নিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িল গেল, কিন্তু তখনই উঠিল। তখন সেই ব্যক্তি এক প্রকাণ্ড লাঠী লইয়া তাহাকে তাড়া করিল। বালকিষণ টলিতে টলিতে ছুটিল, নিকটে আমার একা দেখিয়া তাহাতে উঠিয়া বসিয়া বলিল, জদি হাঁকাও। আমিও বায়ুবেগে আমার এক্কা হাঁকাইলাম।

কিয়ৎক্ষণ পরে দেখিলাম, সে প্রায় নিদ্রিত হইয়াছে। এত দিন পরে পাপাত্মাকে হাতে পাইয়াছি ভাবিয়া, আমার প্রাণে যে কি আনন্দ হইল, তা বলা যায় না। আমি এই দুরাত্মাকে কোথায় গিয়া ইহার সমুচিত দণ্ড দিব, তাহাই ভাবিতে লাগিলাম।

সহসা সেটী-মহল্লার খালি বাড়ীটা আমার সম্মুখে পড়িল। আমি এক্কা থামাইলাম। বাড়ীর দরজায় এক্কা দাড় করাইয়া এক্কা হইতে নামিলাম। বালকিষণকে ধাক্কা দিয়া তুলিলাম। সে বলিল, এটা ষ্টেশন?

আমি বলিলাম, হাঁ।

আমি তাহাকে ধরিয়া লইয়া সেই খালি বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। সে বলিয়া উঠিল, কি বাবা, আজ আলো নাই কেন?

আমি বলিলাম, ভয় নাই,আলো জ্বলছি।

আমার পকেটে বাতি ও দেশলাই ছিল, আমি আলো জ্বালিলাম, তৎপরে তাহার মুখের উপর আলো ধরিয়া বলিলাম, বালকিষণ রাও, আমাকে চিনতে পার?

সে আমার স্বরে স্তম্ভিত হইল, বলিল,কে তুমি?

আমার তখন শিরায় শিরায় আগুন ছুটিয়াছে। আমি বলিলাম, আমি ত্রিম্বক রাও–চন্দন বাঈয়ের স্বামী। মনে পড়ে?

এই কথা শুনিয়া সে আমার দিকে বিস্ফারিত নয়নে চাহিল,–বোধ হইল, যেন এক নিমেষে তাহার সমস্ত নেশা ছুটিয়া গেল, তাহার সর্বাঙ্গ কপিতে লাগিল, সে অত্যন্ত ব্যাকুলভাবে আমার দিকে চাহিয়া কম্পিতকণ্ঠে বলিল, মা তুমি—তবে কি আমাকে খুন কবে?

আমি বলিলাম, নিশ্চয়। তবে কুকুর শিয়ালের ন্যায় তোক মারব। যে কথা আগে তোকে বলেছিলাম, এখনও তাই বছি। এই কৌটায় দুটা বড়ী আছে, একটা বিষের বড়ী, খেলেই তৎক্ষণাৎ মৃত্যু আর একটায় বিষ নাই,খেলে কিছুই হবে না। তুমি একটা খাও,আমিও একটা খাব। দেখি ভগবানের রাজত্বে ন্যায় বিচার আছে কি না।

ভীতিবিহ্বল বালকিষণ যুক্ত করে বলিল,দয়া কর,ক্ষমা কর—এবার আমায় রক্ষা কর—প্রাণ ভিক্ষা দাও।

আমার সর্বাঙ্গে বিদ্যুৎ ছুটিতেছে, আমি বলিলাম, দয়-ক্ষমা তোকে দয়া-ক্ষম—কিছুতেই নয়,—অসম্ভব। গুণবন্ত রাওকে যখন খুন করেছিলি, তখন তোর দয়া কোথায় ছিল নরাধম! তার স্ত্রীকে যখন খুন করেছিলি, তখন তোর দয়া কোথায় ছিল পাষণ্ড?

বালকিষণ। আমি খুন করি নাই।

আমি। তোর হুকুমে যে কাজ হয়েছে, সে তোরই কাজ। আমার চন্দন বাঈকে যখন কেড়ে নিয়ে গিয়েছিলি, তখন তোর দয়া কোথায় ছিল? দয়া! খা, এই বড়ী এখনি।

এই বলিয়া আমি আমার বস্ত্রের ভিতর হইতে এক শাণিত ছুরি বাহির করিয়া তাহার মাথার উপরে তুলিয়া ধরিয়া বলিলাম, বৃথা সময় নষ্ট আমি করি না,—খা বড়ী—যেটা ইচ্ছা হয় খা,-না হলে এই ছুরিতে কুকুর শিয়ালের মত তোকে মারব।

সে বংশপত্রের মত কাঁপিতে লাগিল। অবশেষে কম্পিত হস্তে কৌটা হইতে একটা বড়ী তুলিয়া লইয়া মুখে দিল,আমিও অন্যটা গিলিয়া ফেলিলাম। এক মিনিট খাইতে-না-খাইতে সে ভূমিসাৎ হইল, তাহার মুখ হইতে একটা কথাও বাহির হইল না। আমি তাহাকে নাড়িয়া-চাড়িয়া দেখিলাম, তার মৃত্যু হইয়াছে। এই উত্তে জনায় একদিন নাসিকে যেরূপ আমার নাক মুখ দিয়া রক্ত পড়িয়াছিল, আজও তেমনই হইল। রক্ত দেখিয়া আমার মনে একটা খেয়াল হইল। আমি তখনই আমার আঙ্গুল আমারই রক্তে ডুবাইয়া দেয়ালে লিখিলাম,–সাজা। কিন্তু এখন শুনিতেছি, সাজার আকার স্পষ্ট লিখিতে পারি নাই। তাড়াতাড়িতে কি লিখিলাম, ভাল করিয়া দেখি নাই।

তখন আমি সত্বর বাহিরে আসিয়া এক্কায় উঠিলাম। কিছু দূর আসিয়া কাপড়ের ভিতর হাত দিয়া দেখি, ইয়ারিংটি নাই। আমার চন্দনের ইয়ারিং, আজীবন যে ইহা আমি বুকে বুকে রাখিব তাহার নিকট প্রতিশ্রুত আছি! আমি একা ছাড়িয়া আবার সেই বাড়ীর দিকে চলিলাম। দেখি, বাড়ীতে তখন কনেষ্টবল আসিয়াছে, তাহারা আমাকে দেখিতে পাইয়াছে,তখন মাতালের ভাণ করিয়া মাতলামী করা তাহারা আমার দিকে আর দৃষ্টিপাত করিল না। আমি হতাশ হইয়া এক্কায় আসিয়া উঠিলাম।

সপ্তম পরিচ্ছেদ।

তখন আমার সর্ব শরীরে বিদ্যুৎ ছুটিতেছিল। একজনের দণ্ড দেওয়া হইয়াছে, কিন্তু এখনও পাপিষ্ঠ পাণ্ডুরাং বাকী। আমি সত্বর ষ্টেশনের দিকে চলিলাম। তথায় অনুসন্ধান করিয়া জানিলাম যে, অনেকক্ষণ সে বালকিযণের জন্য অপেক্ষা করিয়া, সে আসিল না দেখিয়া মসাফের-থানায় গিয়া বাসা লইয়াছে। আমি তখনই মাফের-খানার দিকে চলিলাম।

তখন সেখানে সকলেই ঘুমাইয়াছিল। কেবল দেখিলাম, একটা ঘর হইতে আলো দেখা যাইতেছে। আমি সেই ঘরের জানালা দিয়া উঁকি মারিয়া দেখিলাম, পাণ্ডুয়াংই সেই ঘরে আছে। সে তখনও ঘুমায় নাই, একখানা বই লইয়া পড়িতেছে; আমার পায়ের শব্দে সে দরজার দিকে চাহিল। বোধ হয়, বালকিষণের প্রতীক্ষা করিতেছিল। তাহারই। ভাবনায় ঘুমাইতে পারে নাই।

আমি আস্তে আস্তে দরজায় হাত দিয়া দেখি, দরজা খোলা। আমি তিলার্ধ দেরী না করিয়া সত্বর তাহার ঘরে প্রবেশ করিয়া একেবারে দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিলাম। পাণ্ডুরাং লক্ষ দিয়া উঠিয়া বসিল। আমি বলিলাম, চেঁচাইও না, তা হলে কুকুর শিয়ালের ন্যায় মারিব। এই মাত্র বালকিষণকে খুন করে এসেছি।

পাওরাং চীৎকার করিতে যাইতে ছিল আমার কথায় সে ভয় পাইয়া নীরব রহিল। তাহার মুখ হইতে কোন শব্দ নির্গত হইল না, কেবল বলিল, মিথ্যা কথা।

আমি বলিলাম, মিথ্যা কথা আমি বলি না—সে অভ্যাসও আমার নাই। তোরও সময় উপস্থিত। কুকুর শিয়ালের মত মাব না, এই বড়ী বাছাই করে খা।

আমি বালকিষণকে যাহা বলিয়াছিলাম, ইহাকেও তাহা বলিলাম। তাহার দিকে বড়ীর কৌটাটা ছুড়িয়া ফেলিয়া দিলাম; কিন্তু পর মুহূর্তেই পাণ্ডুরাং ক্ষিপ্ত কুকুরের ন্যায় আমার উপরে পড়িল। আমি পড়িয়া গেলাম, সে আমার উপরে পড়িল। সে এমনই বলে আমার গলা টিপিয়া ধরিল যে, আমার নিশ্বাস বন্ধ হইয়া আসিল। আমি তখন অতি কষ্টে আমার কাপড়ের ভিতর হইতে আমার ছুরিখানা বাহির করিয়া তাহার হৃদয়ে আমূল বিদ্ধ করিলাম। যখন আমি ছুরি টানিয়া লইলাম, তখন সেই সঙ্গে পাণ্ডুরাংএরও প্রাণ বাহির হইয়া গেল। আমি তাহারই রক্তে দেয়ালে লিখিলাম, সাজা।

তাহার পর তাহারই লোটার জলে হাত ধুইয়া, তারই বিছানায় ছুরি পুছিয়া নিঃশব্দে সত্বর মোসাফের-খানা হইতে বাহির হইলাম। —তখন প্রায় ভোর হইয়াছে। লোকজন তখনও উঠে নাই। আমি আমার এক্কা লইয়া বাসায় আসিলাম।

পরদিন খুনের কথা সহময় রাষ্ট্র হইল, আমিও শুনিলাম। তখনই লাহোর ছাড়িয়া যাইবার ইচ্ছা হইল,—কিন্তু ভাবিলাম, পুলিশ চারিদিকে লোক রাখিয়াছে। এখন হঠাৎ আমি যদি লাহোর হইতে চলে যেতে চাই, তা হলে আমার উপরই তাদের সন্দেহ হবে। তাহার উপর ইয়ারিং ফেলে লাহোর ছাড়িয়া যাইতে আমার মন চাহিল না।

আবার ভাবিলাম, আমার বেঁচে থেকে লাভ কি? কিসের জন্য জীবনের মায়া! কাহার জন্য আর বাঁচিয়া থাকিব! কেন নিজেই পুলিশে গিয়ে সব কথা স্বীকার করি না? কিন্তু ফাঁসী—ফসীকাঠে ঝুলিয়া মরা, তাহা কখনই হইবে না।

এই সকল ভাবনায় আবার আমার নাক মুখ দিয়া অনর্গল রক্ত পড়িল। আমি নিজে স্পষ্ট বুঝিলাম যে, আমার জীবনের আর অধিক বিলম্ব নাই, সুতরাং ইচ্ছা করিয়া কেন পুলিশের হাতে যাই।

পরদিন কাগজে ডাক্তার বাবুর বিজ্ঞাপন দেখিয়া, বুড়ী সাজিয়া তাহার সঙ্গে দেখা করিলাম। বাহিরে আসিয়া দেখিলাম যে, আমার সে ইয়ারিং নয়। তখন আমি বুঝিতে পারিলাম যে, আমাকে ধরিবার চেষ্টা হইতেছে। কতকটা সন্দেহ হইল মাত্র; কিন্তু ভাবিলাম, বোধ হয় আর কেহ ইয়ারিং রাস্তায় ফেলে গিয়ে থাকবে। কারণ ডাক্তার বাবুর সঙ্গে পুলিশের সম্বন্ধ কি?

তাহার পর একটা ছোঁড়া আসিয়া আমাকে ভাড়ার জন্য ডাকিল। ভাড়ায় না গেলে পাছে কেহ সন্দেহ করে বলিয়া আমি এক্কা লইয়া তাহার সঙ্গে সঙ্গে চলিলাম। তাহার পর যাহা যাহা হইয়াছে, আপনারা সকলই জানেন।

গোবিন্দ বাবু না হইলে পুলিশের সাধ্য ছিল না যে, আমাকে ধরে। আর দুচার দিন হইলে আমি দেশে ফিরিতে পারিতাম।

আবার সেই রক্ত,-হাত পা কঁপিতেছে, আমার সময় শেষ হইয়া আসিয়াছে,—রক্ত আর থামে না। আমি খুনী নই। ভগবান পাপীর দণ্ড দিয়াছেন,—আমার প্রতিহিংসা চরিতার্থ হইয়াছে। পাপীর সাজা হইয়াছে,-আমি এখন বড়ই সুখী। চলিলাম, স্বর্গে আমার চন্দনের সহিত মিলিতে চলিলাম। চন্দন–

 ৩য় খণ্ড – ডাক্তার বসুর কথা

তৃতীয় খণ্ড।
(ডাক্তার বসুর কথা।)

প্রথম পরিচ্ছেদ।

সেটী-মহল্লার ব্যাপার চুকিয়া গেলে গোবিন্দ বাবু কয়েক দিন মৌন ভাবাপন্ন হইলেন। নানা কারণে আমার শরীরও খারাপ হইয়া পড়ি; এইরূপে কয়েক দিন কাটিল।

একদিন দেখিলাম, তিনি তাহার শিশি-বোতল লইয়া বড়ই কাত রহিয়াছেন। তিনি কি করিতেছেন, তাহাই আমি আরাম কেদার অৰ্ধশায়িত অবস্থায় এক দৃষ্টে লক্ষ্য করিতেছিলাম। সহসা তিনি লক্ষ দিয়া উঠিয়া বঁড়াইলেন, আমিও উঠিয়া বসিলাম।, তিনি বলিলেন, ডাক্তার বাবু, এত দিনে আমার পরিশ্রম সার্থক

হল। আমি এক নূতন জিনিষ আবিষ্কার করেছি।

আমি বলিলাম, কি?

তিনি কিয়ৎক্ষণ নীরব থাকিয়া বলিলেন, এতদিন রক্ত পরীক্ষা করিবার ঠিক উপায় ছিল না। রক্তের দাগ পুরাতন হলে সেটা মানুষের রক্তের দাগ বা অন্য জানোয়রের রক্তের দাগ কি কোন ফলের রসের দাগ, তা ঠিক কবার উপায় ছিল না। অণুবীক্ষণ দিয়ে পরীক্ষা করলে কতক কতক বুঝা যেত বটে, কিন্তু ঠিক হত না।

আমি। তা ঠিক, আমাকে পুলিশ-চালানী অনেক রক্তের দাগ পরীক্ষা করতে হয়েছে, কিন্তু অনেক চেষ্টায়ও ঠিক বলতে পারি নাই। আপনি কি আবিষ্কার করেছেন?

গোবিন্দ। আপনি ত জানেন যে, রক্তে দুটা জিনিষ আছে, একটা জলীয় ভাগ আর একটা রক্তের ভাগ। রৌদ্রে শীঘ্রই জলীয় ভাগটা উড়ে যায়, কেবল রক্তের ভাগটাতেই দাগ থাকে।

আমি। তা ত নিশ্চয়।

গোবিন্দ। কিন্তু মানুষের রক্তের জলীয় ভাগ আর জানোয়ারের রক্তের বা অন্য কিছুর জলীয় ভাগ এক নয়।

আমি। এ ত সকলেই স্বীকার করবে।

গোবিন্দ। তবে কোন উপায়ে যদি মানুষের রক্তের জলীয় ভাগ শিশিতে ধরিয়া রাখা যায়, তবে কোন রক্তের দাগের মত চিহ্ন দেখিলে ঐ জল একটু ঐ দাগের উপর ঢালিয়া দিলেই সেটা মানুষের রক্তের দাগ কিনা তখনই জানতে পারা যাবে। নয় কি?

আমি। যদি মানুষের রক্তের জলীয় ভাগ ধরে রাখতে পারা যায়, তা হলে মানুষের রক্তের দাগ যত দিনেরই হউক না, তা অবশ্যই ঐ জলীয় ভাগ ঐ দাগে দিলে নিশ্চয়ই জানতে পারা যেতে পারে।

দেখুন, বলিয়া গোবিন্দ বাবু একখানা রুমাল তুলিয়া ধরিলেন। দেখিলাম, তাহাতে রক্তের দাগের মত খানিকটা দাগ লাগিয়া আছে।

পরে তিনি  এই দেখুন, বলিয়া একখানি ছুরি নিজের একটা অঙ্গুলীতে অম্লানবদনে বসাইয়া দিলেন। ঝর ঝক্ করিয়া রক্ত পড়িতে লাগিল। তিনি সেই রক্ত একটা কাচের পাত্রে ধরিলেন। উহা হইতে একটা কাচের নল আর একটা কাচ-পাত্রে গিয়াছে। তিনি তখন যে পাত্রে রক্ত ছিল, উহার নীচে একটা বাতি জ্বালিয়া ধরিলেন। রক্ত হইতে ধূম নির্গত হইয়া নল দিয়া অপর কাচ-পাত্রে যাইতে লাগিল। তিনি ঐ কাচ-পাত্রের গায়ে শীতল জল দিতে লাগিলেন। তখন ঐ ধূমে ঠাণ্ডা লাগায় কাচ-পাত্রে জলে পরিণত হইতে লাগিল।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, এই যে জল হল, এ জল কি মানুষের রক্তের জলীয় ভাগ নয়?

আমি। নিশ্চয়। এ জল অন্য কিছুর জলীয় ভাগ হতেই পারে না।

গোবিন্দ। আচ্ছা, এখন এই জল রুমালের রক্তের দাগে লাগাইয়া দেখা যাক্।

তিনি সেই জল ধীরে ধীরে রুমালের রক্তের দাগের উপর লাগাইতে লাগিলেন। আমি স্তম্ভিত ও বিস্মিত হইয়া দেখিলাম, ঐ বহুকালের অস্পষ্ট দাগগুলি টাটকা রক্তের দাগ হইয়া পড়িল। বোধ হইল, যেন এইমাত্র কে ইহাতে রক্ত লাগাইয়া দিয়াছে।

গোবিন্দ বাবু হাসিয়া বলিলেন, এখন কেউ কি বল্‌তে পারে যে, রুমালে মানুষের রক্তের দাগ ছিল না?

আমি। কারও সাধ্য নাই। আপনার নাম জগদ্বিখ্যাত হবে।

গোবিন্দ। তা হক আর নাই হক। এটা আগে আবিষ্কার হলে, যে সকল দুবৃত্ত খুনী এখনও নিশ্চিন্ত মনে পরের সর্বনাশ করে বেড়াচ্ছে, তারা ফাঁসী-কাঠে তাদের উপযুক্ত দণ্ড ইত।

আমি। নিশ্চয়ই। আমি অনেক কেস জানি, যে রক্তের দাগ

গোবিন্দ। আমি এখন ভাবছি, এ আবিষ্কার দেখে রাম সিং, সূরযমল এণ্ড কোং কি বলবে?

আমি। যা আপনার নূতন হাতকড়ী দেখে বলেছিল।

গোবিন্দ বাবু হাসিয়া খুব উৎসাহের সহিত তাহার প্রিয় সেতার তুলিয়া লইলেন। বহুক্ষণ মনের আনন্দে সেতার বাজাইতে লাগিলেন। আমি নীরবে তাহার মধুর সেতারে গৌরারং শুনিতে লাগিলাম।

প্রায় অর্ধঘণ্টা পরে তিনি সহসা থামিলেন। বলিলেন, আপনি সেদিন না আমাকে কি জিজ্ঞাসা করবেন, বলেছিলেন?

আমি বলিলাম, , আমার একটা জিজ্ঞাস্য আছে। আপনি বলেন যে এমন কি, কোন মানুষের ব্যবহারের জিনিষ দেখে আপনি সেই লোকের অনেক বিষয় বলে দিতে পারেন।

গোবিন্দ। কতকটা নিশ্চয় পারি বই কি।

আমি। এই ঘড়ীটা দেখে বলুন দেখি।

আমি তখনই আমার পকেট হইতে একটা পুরাতন রূপার ঘড়ী তাহার হাতে দিলাম। তিনি সেটি লইয়া বহুক্ষণ একমনে নাড়া-চাড়া করিতে লাগিলেন। আমি নীরবে বসিয়া রহিলাম।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

তিনি কিয়ৎক্ষণ পরে আমার মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, আপনি এই ঘড়ীর ভূতপূৰ্ব্ব মালিকের বিষয় কিছু জাতে চান? কিন্তু এই ঘড়ী আপনার হাতে আসায় আপনি একে অয়েল করিয়েছেন, সাফ করিয়েছেন, সুতরাং ভূতপূৰ্ব্ব মালিকের অনেক চিহ্ন লোপ পেয়েছে।

আমি বলিলাম, আপনি ঠিক বলেছেন। আমি ঘড়ীটী পেয়ে যথার্থই অয়েল করিয়েছিলাম।

তিনি বলিলেন, তবুও আমি কিছু কিছু বলার চেষ্টা করব। এই ঘড়ীটা আপনার দাদার ছিল। তিনি এটা আপনার পিতার মৃত্যুর পর পান।

আমি হাসিয়া বলিলাম, ঘড়ীর পিছনে বি, সি, বি খোদা আছে দেখে এটা আপনি আন্দাজ করেছেন।

গোবিন্দ। আপনি ঠিক বলেছেন। বি তে বসু, কাজেই আপ নারই কেহ। ঘড়ীর উপরের তারিখে জানা যায়, এটা প্রায় পঞ্চাশ ষাট বৎসরের আগেকার তৈয়ারী। খোদাই অক্ষর তিনটিও সেই রকম পুরাণ। সুতরাং বুঝিলাম, ঘড়ীটা আপনার পিতার ছিল। ঠিক নয় কি?

আমি। হাঁ, তাই ঠিক।

গোবিন্দ। তার পর আপনি বলেন আপনি ঘড়ীটা পেয়েই অয়েল করেছেন। অয়েল বেশী দিনের নয়, কাজেই বোঝা যায়, আপনি ঘড়ীটা বেশী দিন পান নাই।

আমি। তাও ঠিক।

গোবিন্দ। সাধারণতঃ বাপের ঘড়ী-টড়ী বড় ছেলেই পেয়ে থাকে। আপনার কাছে শুনেছি, আপনার পিতা অনেক দিন স্বর্গারোহণ করে ছেন; সুতরাং তার মৃত্যুর পর ঘড়ীটা আপনার বড় ভাই পাতার পর আপনি পেয়েছেন। এই কি ঠিক নয়?

আমি। হাঁ।

গোবিন্দ। ভাল। তার পর আপনার বড় ভাই বড়ই অসাবধানী ছিলেন। তাহার পৃথিবীতে যশঃ মান ধন হবার কথা ছিল। কিন্তু স্বভাবের দোষে কখন তাহার অবস্থা ভাল ছিল, কখনও তিনি বড়ই কষ্টে পড়িয়াছিলেন। শেষে মদ খেয়ে তাহার মৃত্যু হয়। এই পর্যন্ত এই ঘড়ী দেখে জাতে পাছি।

আমি লম্ফ দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলাম। বলিলাম, গোবিন্দ বাবু, আপনি কোন রকমে আমার অভাগা ভাইএর জীবনের সন্ধান জেনে এখন সেই কথা বলে আমাকে কষ্ট দিতে চান। এটা কি ভাল? আপনি কি বলতে চান যে, আপনি এই পুরণ ঘড়ী দেখেই এই সব জানতে পেরেছেন?

গোবিন্দ বাবু, আমার হাত ধরিয়া সাদরে আমাকে বসাইলেন। বলিলেন, ডাক্তার বাবু, আপনার প্রাণে যদি কোন কষ্ট দিয়া থাকি, তবে আমাকে ক্ষমা করুন। আমি আপনাকে নিশ্চয় বলছি, অন্য কথা কি,আপনি আমার হাতে এই ঘড়ী দিবার পূর্বে আমি যথার্থই জানতেম না যে, আপনার কোন ভাই ছিলেন।

আমি বলিলাম, তবে আপনি কেমন করে এ সব কথা জানলেন? এ সমস্তই ঠিক কথা।

গোবিন্দ। স্থির হয়ে শুনুন। শুলেই বুঝতে পাবেন।

আমি। আমায় বুঝিয়ে দিন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

গোবিন্দ। আমি প্রথমে বলি, আপনার ভাই বড় অসাবধানী ছিলেন। ঘড়ীটা কত জায়গায় টোল খেয়েছে, ইহাতে কত জিনিষের দাগ রয়েছে,–যে লোক ভাল দামী রূপার ঘড়ী এমন অসাবধানে রাখতে পারে, সে লোক যে নিতান্ত অসাবধানী—তা বলা কি বড় কঠিন?

আমি কেবল ঘাড় নাড়িলাম। তিনি বলিলেন, তার পর ভিতর দিকার ডালায় চাটে দাগ আছে। মাড়োয়ারীদের কাছে কোন জিনিষ বাঁধা রাখলে, তারা এই রকম দাগ দেয়। এতে জালেম, আপনার ভাই চারবার এই ঘড়ী বাধা দিয়েছিলেন। এতে কি বোৰা যায় না যে, সময়ে সময়ে তার টাকার বড়ই অভাব হয়েছিল। আরও বছি যে, সময়ে সময়ে তার অবস্থা ভাল হয়েছিল, তা না হলে ঘড়ী খালাস করবেন কেমন করে?

আমি কি বলিব; নীরব হইয়া রহিলাম।

তখন তিনি বলিলেন,ঘড়ীর দম দিবার জায়গায় ভাল করে দেখুন। চাবী দিবার স্থানের চারিদিকে কত চাবীর আঁচড়ের দাগ পড়েছে। মাতাল না হলে ঘড়ীতে দম দিবার সময় তাহার এত হাত কাঁপে বা তিনি দম দেবার স্থান খুঁজিয়া পান না! যে লোক এত মদ খেত,তার তাতেই মৃত্যু হয়েছে বলা শক্ত নয়। এখন কি, এরূপ বলা শক্ত বলে মনে করেন? তাহার পর আরও দেখুন, ঘড়ীর উপর নীচে পিঠেও চাবীর গোচ্ছ, যা-তা আরও কত কি পূরেছেন-এ সকল লক্ষণ মাতালেই।

আমি বলিলাম, গোবিন্দ বাবু, আমাকে মাপ করুন,আমি আপনাকে চিনতে পারি নাই। বোধ হয় কেহই পারে নাই। আপনি যথার্থই অদ্ভুত লোক।

গোবিন্দ বাবু হাসিয়া সেতার তুলিয়া লইয়া বলিলেন, এখন একটা বেহাগ শুনুন।

কিন্তু এই সময়ে ডাকওয়ালা আসিয়া তাহার হাতে একখানি পত্র দিল। তিনি পত্রের খামখানি ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখিয়া অবশেষে

অতি সাবধানে পত্রখানি খুলিলেন।

বিশেষ মনোযোগের সহিত পত্রখানি পাঠ করিয়া কিয়ৎক্ষণ নীরবে বসিয়া রহিলেন; তৎপরে পত্রখানি আমার হাতে দিয়া বলিলেন, পড়ুন।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

আমি পত্রখানি পড়িলাম,

শ্রদ্ধাস্পদেযু–

কোন আত্মীয়ের নিকটে শুনিলাম, আপনি আমার পিতার সহপাঠী ও এক সময়ের বিশেষ বন্ধু। আমি শ্ৰীযুক্ত মনোহর কর মহাশয়ের একমাত্র কন্যা। আমার পিতা বহুকাল আগ্রায় বাস করেন। তিনি ডাক্তার ছিলেন; পরে আগ্রা হইতে বলী হইয়া আন্দামানে যান। তিনি ব্রাহ্ম, আমাকে ব্রাহ্ম-বালি-বিদ্যালয়ে রাখিয়া যান। পূর্বে আমার মাতার মৃত্যু হইয়াছিল। আমার পিতা ব্রাক্ষ বলিয়া, আত্মীয়-স্বজনের সহিত তাহার সম্ভাব ছিল না।

তিনি যখন আন্দামানে যান, তখন আমার বয়স বার-তের বৎসর। দুই বৎসর তাহার রীতিমত পত্র পাইয়াছিলাম; মাসে মাসে টাকাও পাঠাইতেন। তাহার পর একদিন তাহার পত্রে জানিলাম, তিনি দেশে আসিতেছেন। কিন্তু দুই বৎসর গেল, তাহার আর কোন সংবাদ নাই। তাঁহার যে কি হইল, অদ্যাপি তাহার কিছুই জানিতে পারিলাম না।

আমাদের আচাৰ্য মহাশয়ের নিকট আপনার প্রশংসা শুনিলাম। আপনি যে আমার পিতার বাল্যবন্ধু তাহাও শুনিলাম। আজ অনন্যোপায় হইয়া আপনাকে পত্র লিখিতেছি। আপনি এই অনাথ পিতৃমাতৃহীনা বালিকার প্রতি এ দুঃসময়ে দয়া না করিলে, কে করিবে? আমি জানি, আপনি চেষ্টা করিলে নিশ্চয়ই আমার পিতার অনুসন্ধান হইবে।

যদি দয়া করিয়া একবার এখানে আসেন, তবে অন্যান্য সকল কথা জানাইতে পারি। আশা করি, অনুগ্ৰহ করিয়া আসিবেন। ইতি–

আপনার কন্যা
শ্ৰীমতী প্রতিভা দাসী।

আমি পত্র পাঠ করিয়া বলিলাম, কি করবেন?

গোবিন্দ। তাই ভাবছি।

আমি। এ রকম উপকার করা কর্ত্তব্য। এ নিরুদ্দেশ ভদ্র লোকের যদি কেউ সন্ধান করতে পারেন, তবে আপনিই পাবেন।

গোবিন্দ। আপনি এ কথা বিশ্বাস করেন?

আমি। যদি কেউ পারে, আপনিই পাবেন।

গোবিন্দ। এখন ত কিছুই জানি না।

আমি। এইজন্য এই বালিকার সঙ্গে আপনার দেখা করা কর্তব্য।

গোবিন্দ। আপনি যাবেন?

আমি গোবিন্দ বাবুর প্রশ্নে একটু বিস্মিত হইলাম। বলিলাম, আমি! আমি গিয়া কি করিব?

গোবিন্দ বাবু হাসিয়া বলিলেন, আমার আর একটা ওস্তাদী দেখিতে পাইবেন।

আমি একটু ভাবিয়া বলিলাম, আমার এখানে থাকাও যা, আগ্রায় থাকাও তাই। আর একটা চেঞ্জও হবে, তাতে আরও উপকার হতে পারে।

গোবিন্দ বাবু হাসিয়া বলিলেন, আরও একটা উপকার হতে পারে; আপনি এখনও বিবাহ করেন নাই, এই প্রতিভাকে বিবাহ করুন না কেন?

আমি। আপনি ক্ষেপিলেন দেখছি। কোথায় এই বালিকা তার নিরুদ্দেশ পিতার জন্য দিন রাত কেঁদে মছে, আপনার শরণাপন্ন হয়েছে, আপনি কোথায় তার পিতার সন্ধান কবেন, না তার বিবাহ নিয়ে উপহাস করছেন।

গোবিন্দ। উপহাস নয়। ভবিতব্যের কথা কে বলতে পারে?

আমি সে কথা চাপা দিয়া বলিলাম, তবে কবে যাওয়া স্থির কলেন?

গোবিন্দ। আপনি কবে যেতে চান?

আমি। আমাকে যখন বলবেন, তখনই প্রস্তুত আছি।

গোবিন্দ। তবে শুভস্য শীঘ্রং। আজই—এখনই।

আমি। বেশ।

আমরা তখনই আগ্রা যাইবার জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিলাম। রাত্রের গাড়ীতে রওনা হওয়াই স্থির হইল।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

আমরা আগ্রায় আসিয়া ব্রাহ্ম-বালিকাবিদ্যালয়ের সন্ধানে চলিলাম। সেটা প্রকৃত বিদ্যালয় নহে। এখানে যিনি ব্রাহ্মসমাজের আচার্যের কাৰ্য্য করিতেন, তিনি তাহার পরিবার মধ্যে একটি ছোট বিদ্যালয় স্থাপন করিয়াছিলেন। চার পাঁচটির অধিক ছাত্রী ছিল না। তাহার অবস্থা স্বচ্ছল না থাকায়, তিনি কয়েকটি বালিকাকে গৃহে থাকিতে দেওয়ায় তাহার অর্থের কিছু সহায়তা হইত। তাহার স্ত্রী বিদুষী ছিলেন; তিনিই শিক্ষয়িত্রীর কাজ করিতেন।

প্রতিভার পিতা নিরুদ্দেশ হইলে তাহার টাকা বন্ধ হইয়াছিল। এখন আচার্য্য মহাশয় তাহাকে নিতান্ত অনাথা দেখিয়া দয়া করিয়া গৃহে রাখিয়াছিলেন। তাহার পিতার সন্ধানের জন্য নিতান্ত যত্ন পাইতেছিলেন।

আমরা প্রথমে আচাৰ্য মহাশয়ের সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তিনি আমাদের উভয়কে বিশেষ সমাদর করিলেন। গোবিন্দ বাবুকে বলিলেন, আপনার প্রশংসা শুনে প্রতিভাকে আপনার আশ্রয় নিতে বলেছিলাম। আপনি তার পিতার বাল্য-বন্ধু। আপনি এই দুর্ভাগিনী বালিকার উপকার কলে, আমরা সকলেই আপনার চির ৰাধিত থাকব।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, যথাসাধ্য চেষ্টা করব।

তিনি বলিলেন, একটু অপেক্ষা করুন, আমি প্রতিভাকে এখানে আছি। তাহার মুখে শুলে আপনি সবই বুঝতে পারবেন।

তিনি উঠিয়া গেলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে এক পরম রূপবতী যোড়শী যুবতী সেই গৃহে প্রবিষ্ট হইলেন। তাহার অপরূপ রূপে গৃহ যেন প্রদ্যোতিত হইয়া উঠিল।

আচাৰ্য মহাশয় বলিলেন, এই আপনার বাল্যবন্ধুর কন্যা প্রতিভা। তৎপরে তাহার দিকে ফিরিয়া বলিলেন,ইনিই স্বনামখ্যাত গোবিন্দ বাবু—আর ইনি ইহার বিশেষ বন্ধু, ডাক্তার বসু।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, তোমার পত্র পেয়ে কতক জানতে পেরেছি। কিন্তু তোমাকে আমার আরও কিছু জিজ্ঞাসা কবার আছে।

প্রতিভা বলিল, আপনি দয়া করে এসেছেন, এতে যে কত অনুগৃহীত হয়েছি তা

গোবিন্দ। (বাধা দিয়া) সে সব কথা এখন থাক,অনুগ্রহ-নিগ্রহের কথা পরে হবে। এখন যা জিজ্ঞাসা করি, তাই বল।

প্রতিভা। বলুন।

গোবিন্দ বাবু প্রতিভার সহিত এরূপ রূঢ়ভাবে কথা কহিতেছেন দেখিয়া, আমি বিশেষ দুঃখিত হইলাম।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

প্রতিভা ধীরে ধীরে এক পার্শ্বে আসিয়া বসিল। গোবিন্দ বাবু তাহাকে বলিলেন, কোন তারিখে তোমার বাবা নিরুদ্দেশ হন, সে সম্বন্ধে তুমি কি জান?

প্রতিভা বলিল, দু বৎসর হল, কার্তিক মাসের পনেরই তারিখে বা তাঁর এখানে পৌছিবার কথা। সেই পৰ্যন্ত নিরুদ্দেশ।

তিনি পথে কোন্‌খানে নামবেন, বলেছিলেন?

হাঁ । লিখেছিলেন, যদি পারেন কাশী হয়ে আসবেন?

কেন? সেখানে কি তার কোন বন্ধু আছেন?

একজন ছিলেন। তিনি তাঁর বিশেষ বন্ধু শুনেছিলাম।

তার নাম?

হরিহর সরকার।

ইনি কি কাজ করতেন?

তিনি কমিশরিয়েটের গোমস্তা ছিলেন। শুনেছি, অনেক টাকা রোজগার করেছেন।

তার কাছে কোন সন্ধান নেওয়া হয়েছে?

প্রতিভা আচার্য্য মহাশয়ের দিকে চাহিল। তিনি বলিলেন, হাঁ, আমি নিজে কাশী গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেছিলাম।

গোবিন্দ। তিনি কি বলেন?

আচাৰ্য। তিনি বলেন, কই মনোহর বাবু ত কাশী আসেন নাই। আসিলে নিশ্চয়ই তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতেন।

গোবিন্দ। তার পর আর কিছু সন্ধান করেছিলেন?

আচাৰ্য। হাঁ, কোন সন্ধান পাই নাই।

গোবিন্দ। তিনি এখন কোথায়? আচাৰ্য। এক বৎসর হল মারা গেছেন। গোবিন্দ বাবু প্রতিভার দিকে চাহিয়া বলিলেন,তার পর।

প্রতিভা। এক বৎসর হল খবরের কাগজে আমার ঠিকানার জন্য কে একজন বিজ্ঞাপন দেন।

গোবিন্দ। যিনি বিজ্ঞাপন দেন, তার কোন ঠিকানা ছিল?

প্রতিভা। না, কেবল লেখা ছিল, ডাক্তার মনোহর কর, যিনি আন্দামানে চাকরী করিতেন, তাহার কন্যা এই সংবাদপত্রে তিনি এখন কোথায় জানাইলে, তাহার বিশেষ উপকার হইতে পারে।

গোবিন্দ। এই বিজ্ঞাপনের পর তোমার ঠিকানা কি কোন কাগজে ছাপান হয়?

আচাৰ্য মহাশয় বলিলেন, হাঁ, আমি ঠিকানা কাগজে ছাপাই।

গোবিন্দ। এই হরিহর বাবুর মৃত্যুর কতদিন পরে বিজ্ঞাপন বাহির হয়, তা কি জানেন?

আচাৰ্য। বোধ হয়, মাস দেড়েক পরে।

আবার গোবিন্দ বাবু প্রতিভাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তার পর কি কিছু ঘটেছিল?

প্রতিভা। হাঁ, তার পর প্রতি দু মাস অন্তর পার্শেল ডাকে এক একটা মুক্তা আমার নামে এসেছে। এই দেখুন।

এই বলিয়া প্রতিভা একটি বাক্স খুলিল। আমরা দেখিলাম, পাচটা বহু মূল্যবান্ মুক্তা তাহার ভিতর রহিয়াছে।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, পার্শেলের উপরের মোড়কগুলা আছে?

প্রতিভা। হাঁ, আছে। এই দেখুন।

গোবিন্দ বাবু বিশেষ করিয়া পার্শেলের মোক গুলি দেখিলেন, তৎপরে বলিলেন, তার পর আর কিছু হয়েছে?

প্রতিভা। এই চিঠী পেয়েছি।

প্রতিভা একখানি পত্র গোবিন্দ বাবুর হাতে দিল। আমরা পড়িলাম;

১৭ই তারিখে রাত ৯টার সময় তাজমহলের পশ্চিমদিকে থাকিয়ে। তোমার উপর যে অন্যায় ব্যবহার হইয়াছে,তাহার প্রতিকার করিব। যদি অবিশ্বাস হয়,কি ভয় হয়, তোমার দুইজন আত্মীয় বা শুভানু ধ্যায়ীকে সঙ্গে আনিয়ে। পুলিশের লোক আনিয়ো না, তাহা হইলে কাহারও দেখা পাইবে না। তোমারও কোন উপকার হইবে না।

গোবিন্দ বাবু পত্র ও খাম উভয়ই বিশেষ রূপে লক্ষ্য করিলেন। তৎপরে আচাৰ্য মহাশয়কে বলিলেন, আপনি নিশ্চয় এর সঙ্গে যাচ্ছেন?

আচাৰ্য। আমি বুড়ো মানুষ,-আমাকে কেন? এখন যা করতে হয়, আপনি অনুগ্রহ পূৰ্ব্বক করুন।

গোবিন্দ। এর যাওয়া নিতান্ত দরকার। দুইজন বন্ধু সঙ্গে নিতে বলেছে। আমি যাইব, আর আমার বন্ধুও আশা করি যাইবেন।

প্রতিভা আমার দিকে চাহিল।

আমি বলিলাম, আপনারা যদি বলেন, অবশ্যই যাইব।

গোবিন্দ বাবু প্রতিভাকে বলিলেন, আশা করি, আমাদের সঙ্গে যেতে তোমার কোন ভয় হইবে না।

প্রতিভা সলজ্জভাবে বলিল, আপনাদের সঙ্গে আমার যেতে ভয় কি? আপনি আমার পিতার বন্ধু।

গোবিন্দ বাবু একটু হাসিয়া বলিলেন, তুমি যথার্থই আমার বন্ধুর উপযুক্তা কন্যা। আজ থেকে আমি তোমার পিতৃস্থানীয়।

এই বলিয়া গোবিন্দ বাবু পার্শেলের মোড়কের হাতের লেখা এবং পত্রের লেখা বিশেষ রূপে মিলাইয়া দেখিতে লাগিলেন,তৎপরে বলিলেন, যদিও পত্রের লেখা একটু বাঁকিয়ে লেখা হয়েছে, তবুও এই দুই লেখা যে একই ব্যক্তির, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। যা হক, কাল সন্ধ্যার পরই আমরা আস্ব। ঠিক হয়ে থেক।

প্রতিভা ঘাড় নাড়িল। আমরা আচাৰ্য মহাশয়ের নিকটে বিদায় লইয়া বাহির হইলাম।

পথে গোবিন্দ বাবু একটি কথাও কহিলেন না। বাসায় আসিয়া বলিলেন, এই মেয়ের বাপকে তারই পরম বন্ধু গোমস্তা মশায় খুন করেছেন।

শুনিয়া আমি স্তম্ভিত হইলাম। বললাম, বলেন কি?

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, পরে দেখিবেন।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

পর দিবস সন্ধ্যার পরেই আমরা প্রতিভার সহিত দেখা করিতে চলিলাম। দেখিলাম, প্রতিভা প্রস্তুত হইয়া আছে।

আমরা উপস্থিত হইলে প্রতিভা বলিল, কাল আপনাদের একটা বিষয় দেখাতে আমি ভুলে গেছলেম।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, কি?

প্রতিভা একখানা রেজিষ্টারী পত্ৰ গোবিন্দ বাবুর হাতে দিল। রেজিষ্টারী পত্ৰখানি ভোলা ছিল। গোবিন্দ বাবু পত্রখানি বাহির করিয়া দেখিতে লাগিলেন।

প্রতিভা বলিল, বাবার যে দিন পৌঁছিবার কথা ছিল, ঠিক সেই দিন এই রেজিষ্টারী পত্ৰ তার নামে আসে। আমি সই করিয়া নিই। তার পর তিনি ফিরে না আসায় আমিই খুলেছিলাম।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন,এটা দেখছি, একটা বড় বাড়ীর রাফ, প্ল্যান, দেশী কাগজে আঁকা। অনেক ঘর, বারান্দা, উঠান আছে। এক জায় গায় একটা লাল কালির চিহ্ন আছে, তার ঠিক উপরে লেখা চার দিক হতে ৩৭ ফুট। নীচে উতে লেখা চারি সাক্ষর। তার পর ভিন্ন ভিন্ন হস্তাক্ষরে চারিটা নাম—আবদুল, দোস্ত মহম্মদ, হাজারিমল, কুমার সিং। এটা একটা দরকারী কাগজ সন্দেহ নাই, বলিয়া তিনি পত্রখানি যত্নে নিজ পকেটে রখিলেন। তৎপরে বলিলেন, আমাদের একটু আগে যাওয়া উচিত।

একখানা গাড়ী আনা হইল। আমরা তিনজনে গাড়ীতে উঠিলাম। আমরা শীঘ্রই তাজমহলে উপস্থিত হইলাম। কিন্তু সেখানে কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না।

ঠিক নয়টার সময় একজন আমাদের নিকটে আসিয়া বলিল, আপনার নাম কি প্রতিভা দেবী? প্রতিভা হ, বলিলে সেই ব্যক্তি বলিল, এরা দুজন?

প্রতিভা। আমার আত্মীয়।

লোক। পুলিশ নয়?

প্রতিভা। না—দুজন লোক সঙ্গে যাবার কথা আছে।

লোক। জানি,—আসুন।

আমরা রাস্তায় আসিয়া দেখিলাম, একখানি গাড়ী দাঁড়াইয়া আছে। আমরা তিন জনে গাড়ীতে উঠিলে, সেই ব্যক্তি গাড়ীর কোচবাক্সে উঠিয়া গাড়ী হাঁকাইয়া চলিল। গাড়ী যে যে রাস্তা দিয়া চলিল, গোবিন্দ বাবু তাহা বিশেষ লক্ষ্য করিতে লাগিলেন।

নানা রাস্তা দিয়া গাড়ী চলিল। এই রূপে অৰ্দ্ধ ঘণ্টা চলিয়া একটি বাড়ীর সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, বালুগঞ্জ-জহর মলের বাড়ী।

গোবিন্দ বাবুর অবিদিত স্থান জগতে ছিল কি না সন্দেহ।

******

কোচম্যান নামিয়া গাড়ীর দরজা খুলিয়া দিল। আমরা তিন। অনে নামিলাম। দেখিলাম, বাড়ীটি বেশ সুসজ্জিত। প্রকোষ্ঠ পর প্রকোষ্ঠ অতিক্রম করিতে করিতে আমরা একটি প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিলাম।

একটি বাঙ্গালী যুবক অগ্রবর্তী হইয়া বলিলেন, প্রতিভা দেবী?

প্রতিভা ঘাড় নাড়িলেন।

তখন তিনি বলিলেন, আমার নাম বরেন্দ্র নাথ দাস সরকার। হরিহর সরকার মহাশয়ের পুত্র-যমজ পুত্র। আমার এক যমজ ভাই আছে, তার নাম নরেন্দ্র নাথ সরকার। আমার স্বর্গীয় পিতা ঠাকুর আপনার স্বর্গীয় পিতা ঠাকুরের এক সময়ে বিশেষ বন্ধু ছিলেন। এ দুটি ভদ্রলোক কে?

প্রতিভা সলজ্জভাবে কহিলেন, আমার আত্মীয়।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, আমার নাম গোবিন্দরাম আদিত্য-ইনি ডাক্তার বসু।

বরেন্দ্র। বেশ-বেশ, খুব ভাল। তাই বলছিলাম, এঁর পিতা ঠাকুর নিরুদ্দেশ হয়েছেন।

গোবিন্দ। তা আমরা জানি।

বরেন্দ্র। সব জানেন না মহাশয়—সব জানেন না।

গোবিন্দ। কতক কতক জানি-জানি তিনি আপনাদের বাড়ীতে খুন বা গুম হয়েছেন।

প্রতিভা বিস্মিত হইয়া মুখ তুলিল।

বরেন্দ্রে বাবু বলিলেন, দেখছি আপনি কতক কতক জানেন।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন,কতক কতক কেন, সব জানি।

বরেন্দ্র। বলুন–বলুন।

গোবিন্দ। জানি, আপনার পিতা তাকে খুন করেছেন।

এই অভূতপূর্ব কথা শুনিয়া প্রতিভা চমকিত হইয়া উঠিল। আমার বোধ হইল,যেন সে মূর্চ্ছিত হইয়া পড়ে, কিন্তু মুহূর্ত মধ্যে প্রতিস্থা হইল। তাহার চক্ষু দুটী অশ্রুজলে ভরিয়া উঠিল।

গোবিন্দ বাবু এরূপ ভাবে এ কথা প্রতিভার সম্মুখে বলায় তার উপর আমার বড়ই রাগ হইল; অতি কষ্টে আত্মসংযম করিলাম। কিন্তু অনাথা প্রতিভার কষ্টে আমার বড় কষ্ট হইতে লাগিল।

বরেন্দ্র বাবু হাসিয়া বলিলেন, মহাশয়, তামাক খান,—আপনি কিছুই জানেন না। ওরে তামাক দে।

তাঁহার কথায় প্রতিভার ভগ্ন হৃদয় একটু আশ্বস্ত হইল। ব্যাকুল নেত্রে তাহার দিকে সে চাহিল।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, তবে আপনিই বলুন। আমি শুনিতে থাকি।

বরেন্দ্র। তাই ত বলতেই যাচ্ছিলাম—আপনি বাধা দেন কেন? গো

বিন্দ। বলুন।

বরেন্দ্র। বাবাও কমিসরিয়েটের গোমস্তাগিরী কাজে আন্দামানে যান। বছর দুই আগে তিনি হঠাৎ ফিরে আসেন; এসেই কাজ ছেড়ে দেন। উদরাময় রোগে তিনি অনেক দিন হতে ভুগছিলেন। তিনি অনেক টাকা রোজগার করেছিলেন; তার কোন অভাব ছিল না। অনেক টাকাও রেখে গেছেন।

গোবিন্দ। তা ত দেখতে পাচ্ছি।

বরেন্দ্র। আমার ভায়ের বাড়ী দেখলে আরও বুঝবেন। যা সে কথা, কিন্তু তিনি সুখী হতে পারেন নাই। সকল সময়েই যেন কিসের ভয়ে চম্‌কে চমকে উঠতেন। বিশেষতঃ কাঠের পা-ওয়ালা লোকের ওপর তার বড় ভয় ছিল। সকল সময়েই চাকরদের বলতেন,সাবধান, এ রকম লোক যেন বাড়ীতে না ঢুকতে পায়।

এমন সময়ে ভৃত্য তামাক আনিয়া গোবিন্দ বাবুকে দিল। বরেন্দ্র বাবু বলিলেন, তামাক খান, মহাশয়।

গোবিন্দ বলিলেন, হুঁ খাচ্ছি–তার পরে?

বরেন্দ্র বাবু বলিতে লাগিলেন, বছর দুই আগে সহসা আন্দামা থেকে এক চিঠী পেয়ে তার ব্যাম বড় বেড়ে পড়ল। তিনি একদিন আমাদের দুজনকে ডেকে গোপনে বলেন, দেখ আমার আর বড় দেরী নাই, কিন্তু আমি মহাপাপী, আমার বন্ধুর ধনও আমি চুরি করেছি,আহা তার অনাথা কন্যার উপর বড় অবিচার করেছি। যে ধন তার পাওয়া উচিত ছিল, তার এক পয়সাও তাকে দিই নাই। বলে একছড়া বহুমূল্য মুক্তার মালা বার করে আমাদের দেখিয়ে বলেন, এই দেখ এই মুক্তার হার—তাকে পাঠিয়ে দেব বলে বার করেছিলাম, কিন্তু এমন লোভী আমি,এমনই পাপী আমি যে, প্রাণ ধরে দিতে পারি নাই? যে রকমে হক আমরা দুজনে প্রায় ক্রোড় টাকার জহরত পাই। আন্দামান হতে ফিরেই মনোহর আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে, কিন্তু—এই বলে বাবা মূর্চ্ছিতপ্রায় হলেন, তার বাবোধ হল, আমরা তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডাকৃতে ছুটলেম।

সপ্তম পরিচ্ছেদ।

ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া বরেন্দ্রনাথ বাবু পুনরায় বলিতে লাগিলেন, ঘণ্টাখানেকের পর তিনি আবার কতকটা সুস্থ হয়ে উঠলেন। তখন সকলকে বিদায় করে দিয়ে আমাদের দুজনের হাত ধরে বললেন, দেখ আমি এখন মৃত্যুশয্যায়। আমায় ছুয়ে ভগবানের কাছে শপথ কর যে, সেই ধনের অর্ধেক মনোহরের মেয়েকে দিবে। আমরা উভয়ে শপথ করলাম। তখন তিনি অতি কষ্টে বলতে লাগলেন, আমি ভগবানের নামে মৃত্যু সময়ে শপথ করে বছি যে, আমি মনোহরকে খুন করি নাই। সে এলে এই ধনের ভাগ নিয়ে আমাদের দুজনে বচসা হয়, সহসা মনোহর মূৰ্জিত হয়ে পড়ে যায়। আমি তাড়া তাড়ি তাকে তুলতে গিয়ে দেখি, তার মৃত্যু হয়েছে। আমি জানতেম, তারহৃদরোগ ছিল। হঠাৎ রাগ হওয়ায় মৃত্যু ঘটেছে।

পিতার মৃত্যু সংবাদ পাইয়া প্রতিভা আকুল হইয়া কঁদিয়া উঠিল। আমি নানারূপে তাহাকে সান্ত্বনা করিবার চেষ্টা পাইতে লাগিলাম। এই পিতৃশোক-কাতরা পরারুদ্যমানাকে কিরূপে আমি সান্ত্বনা করিব, কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। তাহার হাত দুখানি আমার হাতে লইলাম। সেই সকরুণ দৃশ্যে আমারও চক্ষুদ্বয় অপূর্ণ হইয়া উঠিল। কিন্তু কি কঠিন-হৃদয় গোবিন্দ বাবু! তাহার চক্ষু সম্পূর্ণ নিরশ্রু। অষ্টম বর্ষীয় বালক যেমন আগ্রহপূর্ণ নত্রে বিচিত্রগল্পকারী মুখের দিকে চাহিয়া থাকে, গোবিন্দ বাবু ঠিক তেমনই ভাবে বরেন্দ্র বাবুর মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, তারপর?

বরেন্দ্র বাবু বলিতে লাগিলেন, ভয়ে আমার সর্ব শরীর কাপতে লাগল। আমি ভাবলাম নিশ্চয়ই আমাকে খুনী পুলিশে ধবে। তখন আমার বিশ্বাসী চাকরকে ডেকে সেই গভীর রাত্রে আমরা দুজনে মনোহরের সেই মৃতদেহ মাটির নীচে পুতে ফেলেম। ও কে—কি ভয়ানক! কে আছ—রক্ষা কর—রক্ষা কর–বলে সহসা বাবা জানালার দিকে চেয়ে ভয়ানক চীৎকার করে উঠলেন। আমরা দেখলেম, একটা দাড়ীওয়ালা বিকট মুখ জানালা দিয়া উঁকি মারূছে। আমরা ছুটে বাহিরে গেলাম, কিন্তু কোথাও তাকে দেখতে পেলাম না। ফিরে এসে দেখি, বাবার মৃত্যু হয়েছে।

বরেন্দ্র বাবু পকেট হইতে রুমাল বাহির করিয়া চোখের জল মুছিলেন। তাহার পর নীরবে তামাক টানিতে লাগিলেন।

গোবিন্দ বাবু কি ভাবিলেন জানি না। আমি কিন্তু, বরেন্দ্র বাবু নীরব হওয়ায় বিশেষ সন্তুষ্ট হইলাম। আমি নানারূপে সান্ত্বনা করিয়া প্রতিভাকে কতকটা প্রকৃতিস্থ করিলাম। কিন্তু গোবিন্দ বাবু পাষাণ হতেও পাষাণ, তিনি গম্ভীরভাবে জিজ্ঞাসা করুলেন, তার পর? যেন এখনই সবটা না শুনিলে তাহার সর্বনাশ হইবে।

বরেন্দ্র বাবু, শটকার নল পরিত্যাগ করিয়া বলিলেন, মনোহর বাবুর মৃত্যুর পর বাবা কাশীর বাড়ী ছেড়ে আগ্রায় বেলেন-বাজারে এসে বাস করেন। আমরা দু-ভাইও তার সঙ্গে ছিলাম। এইখানেই ঝবার মৃত্যু হয়। তাহার সৎকার করে এসে দেখি, বাবার যে ঘরে মৃত্যু হয়েছে, সেই ঘরের সব জিনিষ কে ওলট-পালট করেছে, কিন্তু কিছু চুরি করে নাই। তবে দেখলেন, তার বিছানার ওপর কে এক থানা কাগজ রেখে গেছে; তাতে উর্দ্দুতে লেখা;

চারি সাক্ষর।

গোবিন্দ বাবু বলিয়া উঠিলেন, আমিও ভেবেছিলাম তাই।

আমরা সকলেই বিস্মিত-হইয়া তাহার দিকে চাহিলাম, তিনি সে বিষয়ে লক্ষ্য না করিয়া বলিলেন, হাঁ, তার পর?

বরেন্দ্র বাবু বলিলেন, বাবার মুখে এই গুপ্ত ধনের কথা আমরা শুনেছিলাম, আমরা কাশীর বাড়ী আর এখানকার আগ্রার বাড়ী তন্ন তন্ন করে খুঁজলেম, কিন্তু কোন সন্ধানই পেলেন না। তখন যদিও আমার ভাই কিছুতেই রাজী হল না,তবুও আমি সেই মুক্তার হার একে দিতে প্রতিজ্ঞা করলেম। একে সহজ ভাবে দিলেকে কি বলে অথবা ইনি নেন কি না নেন, এই ভেবে আমি কাগজে এর ঠিকানার জন্য বিজ্ঞাপন দিলেম।

গোবিন্দ। তা আমরা জানি।

বরেন্দ্র। এঁর ঠিকানা পাবার পর একেবারে হারটা পাঠিয়ে দিলে পাছে কে কি সন্দেহ করে, এই ভেবে দুমাস অন্তর এক-একটা মুক্ত পাঠিয়ে দিতে লাগলেম!

গোবিন্দ। দেখছি আপনি বড় সহৃদয়। প্রতিভা নিশ্চয়ই আপনার নিকট চির-বাধিত থাকবে। তার পর সে গুপ্ত ধনের সন্ধান আপনারা কি কিছু পেয়েছেন?

বরেন্দ্র। সেই কথাই ত হচ্ছে।

গোবিন্দ। বলুন, আমরা শোনবার জন্য উৎসুক আছি।

বরেন্দ্র। আমি ধনের কথা একেবারে ছেড়েই দিয়েছিলেন, কিন্তু আমার ভাইটি সে ছেলে নয়। সে তন্ন তন্ন করে বাড়ী খুঁজে শেষ ছাদের উপর একটা ছোট চোর-কুরীতে বার করে। নীচের দিকে ছাদ খুড়লে সে জহরতের সিন্দুক দেখতে পায়। তার পর নীচে নাবিয়ে নিয়ে আসে।

গোবিন্দ। তার পর?

বরেন্দ্র। তার পর আমি বলি, দেখ এর অর্ধেক আমাদের নয়। আমরা বাবার মৃত্যুশয্যায় শপথ করেছি, মনোহর বাবুর মেয়েকে অর্ধেক দিব। এতে আর দেরী করা আমাদের ভাল নয়। সে বলে, এ ধন আমি খুঁজে বার করেছি, এর এক পয়সাও কাকেও দিব না। এই নিয়ে আমাদের দুজনের ভারি ঝগড়া হয়। তার পর আমি বিরক্ত হয়ে বাড়ী ছেড়ে এসে এখানে এই বাড়ী ভাড়া করে আছি।

গোবিন্দ। আপনি মহৎ লোক।

বরেন্দ্র। না—এতে মহত্ত্বের বিশেষ কিছু নাই। বাবার মরবার সময় শপথ করেছিলাম। যেমন করে হয়, একে তার অর্ধেক দিব।

গোবিন্দ। এ জহরতের দাম কত হতে পারে?

বরেন্দ্র। ভায়া আন্দাজ করেন ক্রোড় টাকার উপর। বাবাও তাই বলেছিলেন।

গোবিন্দ। তিনি এ জহরত কোথায় পেয়েছিলেন, তা কিছু আপনি জানেন?

বরেন্দ্র। কিছুই না।

গোবিন্দ। এখন কি করতে চান?

বরেন্দ্র। এখন আপনারা এসেছেন। এখনই তার সঙ্গে দেখা কব। এখন ভয়ে দেবে।

সেই রাত্রেই তার সঙ্গে দেখা করা স্থির হইল। প্রায় রাত্রি এগারটার সময় আমরা চারি জনে তাহার বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম।

অষ্টম পরিচ্ছেদ।

অনেক ঠেলাঠেলির পর একজন চাকর আসিয়া দরজা খুলিয়া। দিল। বরেন্দ্র বাবু বলিলেন, ব্যাটারা সব মরে আছে? ছছাট বাবু কোথায় রে?

চাকর। হুজুর, ছোট বাবু তার ঘরে আছেন।

বরেন্দ্র। চল্ ব্যাটা, আলো দেখিয়ে চল্।

আমরা সকলে উপরে চলিলান। বরেন্দ্র বাবু অগ্রে অগ্রে যাইতে ছিলেন,—তিনি একটা ঘরের দ্বারে আসিয়া ধাক্কা মারিলেন। দ্বার রুদ্ধ। তিনি আমাদের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, আর ত কোন কাজ নাই, এখন ভায়া আমার প্রত্যহ রাত্রে দরজা দিয়ে জহরতের ফন্দ করেন আর দাম কসেন। বেশী করে ধাক্কা মাতে হল দেখছি।

কিন্তু দ্বারে পুনঃ পুনঃ ধাক্কা দিতেও কেহ দ্বার খুলিল না—কোন উত্তর দিল না। তখন বরেন্দ্র বাবু দরজার একটা ছিদ্র দিয়া গৃহের ভিতর কি হইতেছে, দেখিতে চেষ্টা পাইলেন, কিন্তু তিনি সহসা এমনই চীৎকার করিয়া পশ্চাৎ পদ হইলেন যে, আমরা সকলেই চমকিত হইয়া উঠিলাম। গোবিন্দ বাবু অগ্রসর হইয়াছিলেন,—ছিদ্রে চক্ষু দিলেন, তৎপরে বলিলেন, দরজা ভাঙতে হবে।

তাহার শরীরে অসীম বল। কবটের উপরে পৃষ্ঠ স্থাপন করিয়া তিনি এমনই বল প্রয়োগ করিলেন যে, মহা শব্দে দরজা ভাঙিয়া গেল।পরক্ষণে যে দৃশ্য সম্মুখে দেখিলাম, তাহাতে আমার শিরায় শিরায় শোণিত ছুটিল। প্রতিভা মূর্চ্ছিত হইয়া ভূপতিত হইতেছিল, আমি তাহাকে ধরিয়া ফেলিলাম।

দেখিলাম, এক ব্যক্তি চেয়ারে বসিয়া আছে। তাহার দেহ অসাড় নিস্পন্দ, নিশ্চয়ই বহুক্ষণ তাহার মৃত্যু হইয়াছে। তাহার চেহারা ও বরেন্দ্র বাবুর চেহারা এমনই এক যে, আমি প্রথমে ভীত ও স্তম্ভিত হইয়া তাহার দিকে চাহিলাম। তিনিও শুন্তিতভাবে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া কাঁপিতে লাগিলেন।

সহসা বরেন্দ্র বাবু বলিয়া উঠিলেন, কে এমন সৰ্ব্বনাশ করে গেল! নরেনের মন ভাল ছিল না বটে, একটু লোভী, কিন্তু সে এদিকে লোক বড় ভাল ছিল! কে এমন সৰ্ব্বনাশ করিল। তৎপরে তিনি গোবিন্দ বাবুর দিকে চাহিয়া বলিয়া উঠিলেন, মশায় দেখুন, অরতের সিন্দুকটাও চুরি করে নিয়ে গেছে।

বরেন্দ্র বাবু বংশপত্রের ন্যায় কঁপিতে ছিলেন। কঁপিতে ঝাপিতে অস্পষ্ট স্বরে বলিলেন, আপনারা জানেন, আমি এর কিছুই। জানি না। কিন্তু এখন পুলিশে কি তা শুনবে? তারা ভাববে আমিই ধনেয়, লোভ নিজের ভাইকে খুন করেছি?

গোবিন্দ বাবু তাহার সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া আমাকে বলিলেন, ডাক্তার বাবু, প্রতিভাকে এখানে রাখা আর উচিত নয়; আপনি একে এর বাড়ী পৌছাইয়া আসুন। সেই গাড়ীতেই আপনি যেন এখন এখানে ফেরেন।

আমি বলিলাম, এখনই আসিতেছি।

গোবিন্দ বাবু তখন বরেন্দ্র বাবুর দিকে ফিরিয়া বলিলেন, যদি বাঁচতে চান, তবে আপনিও এদের গাড়ীতে কোতোয়ালীতে এখনই যান, সেখানে গিয়ে খুনের খবর দিন। তাদের তদন্তে এখন আপনি সাহায্য না করলে তারা আপনাকে আরও সন্দেহ করবে।

বরেন্দ্র বাবু কম্পিত কলেবরে বলিলেন, আপনি যা বলবেন, তাই কব। আপনি আমাকে এ বিপদে রক্ষা করুন।

গোবিন্দ। যান, এখনই যান।

আমি অর্ধ-মূর্চ্ছিতা প্রতিভাকে ক্রোড়ে করিয়া লইয়া গাড়ীতে উঠিলাম। সঙ্গে সঙ্গে বরেন্দ্র বাবুও আসিয়া গাড়ীতে উঠিলেন। তাহাকে কোতোয়ালীতে নামাইয়া দিয়া আমরা প্রতিভার বাড়ীর দিকে চলিলাম।

আমি নানারূপে প্রতিভাকে প্রকৃতিস্থ করিতে চেষ্টা পাইতে লাগিলাম। ভয়ে, বিস্ময়ে, উত্তেজনায় প্রতিভা প্রায় আমার বুকের ভিতর লুকাইয়াছিল। আমি বলিলাম, প্রতিভা, তোমার কি ভয় করছে?

প্রতিভা বলিল, না, আপনার কাছে থাকলে আমার ভয় করে না।

তাহার পর আমরা দুজনে কত কথা কহিলাম। কি কহিলাম, তাহা এখন আমার মনে নাই। তবে এইটুকু আমার বেশ মনে আছে যে, আমি বড়ই সুখে ও বিমল আনন্দে সে সময়টা কাটাইয়াছিলাম। আমি প্রতিভাকে নামাইয়া সেই গাড়ীতেই আবার সত্বর আসিয়া গোবিন্দ বাবুর সহিত মিলিলাম। দেখিলাম, তিনি গৃহটি বিশেষ রূপে লক্ষ্য করিয়া দেখিতেছেন। তখনও পুলিশের কেহ আসে নাই।

তিনি আমায় দেখিয়া বলিলেন,আসুন ডাক্তার বাবু, আমরা দুজনে একবার এই ঘরটা ভাল করে দেখি। পুলিশ বাহাদুরেরা যে ভোরের আগে এখানে পদার্পণ করেন—এ বিশ্বাস আমার নাই; তাঁদের কুষ্টিতে তা লেখেও না।

প্রথমেই গোবিন্দ বাবু আমাকে মৃতদেহের দিকে দৃষ্টিপাত করিতে বলিলেন। আমি দেখিলাম, মৃতদেহের জামার বুকে একখানি কাগজ অটা, তাহাতে লেখা সেই ভয়াবহ কথা;–

চারি সাক্ষর।

আমি বলিলাম, এ সব কি?

গোবিন্দ। খুন। এইদিকে দেখুন।

দেখিলাম মৃতদেহের ঠিক স্কন্ধের উপর একটি ক্ষুদ্র তীর বিদ্ধ রহিয়াছে। আমি সেটায় হাত দিতে উদ্যত হইলে গোবিন্দ বাবু সচকিতে বলিয়া উঠিলেন, হাত দেবেন না—হাতে দেবেন না, নিশ্চয়ই এটা বিষাক্ত তীর। দেখছেন না, লাসের ভাব?

আমি। হাঁ, নিশ্চয়ই বিষে ইহার মৃত্যু হয়েছে।

গোবিন্দ। এখন দেখা যাক্, কে খুন করেছে।

তিনি গৃহের চারিদিক আমাকে দেখাইয়া বলিতে লাগিলেন, দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল, জানালাও তাই। জানালা দিয়ে কোন রকমে কারই ঘরের ভিতর আসবার সম্ভাবনা নাই, কিন্তু তবুও কোন লোক জানালা দিয়ে উঠেছে; ওই দেখুন তার পায়ের দাগ; আবার এই দেখুন, গোল গোল ছোট ঘোট কাদার দাগ, এক জায়গায় নয়—সমস্ত ঘরময় আছে।

আমি। এ কিসের দাগ?—বোধ হয়, মোটা রকম লাঠীর।

গোবিন্দ। তা নয়, তবে এই দেখুন পায়ের দাগের পাশেই গোল গোল দাগ, কাজেই লোকটার।

আমি বলিয়া উঠিলাম, তবে নিশ্চয়ই একটা কাঠের পা ছিল।

গোবিন্দ। সেই কাঠের পায়ের এক-পেয়ে লোক।

আমি স্তম্ভিত হইলাম।

নবম পরিচ্ছেদ।

গোবিন্দ বাবু কিয়ৎক্ষণ নীরবে থাকিয়া বলিলেন, বিনা সাহায্যে জানালা খুলে এ ঘরে প্রবেশ করা যায় না, সুতরাং দুজন লোক ছিল।

আমি বলিলাম, তা নিশ্চয়ই।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, এই এখানে একটা বড় দড়ী পড়ে আছে। কেউ এ ঘর থেকে জানালা দিয়ে দড়ীটা ঝুলিয়ে দিয়েছিল। আমাদের এক-পেয়ে বন্ধু মহাশয় দড়ীটা ধরে এই ঘরে এসে, এই লোকটাকে খুন করে। তার পর জহরতের সিন্দুকটা দড়ীতে বেঁধে নীচে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। তার পর নিজেও দড়ী ধরে নেমে গেছে। এত তাড়াতাড়ি নেমেছে যে, হাতের চামড়া ছিঁড়ে গিয়েছিল। এই দেখুন, দড়ীতে রক্তের দাগও রয়েছে।

আমি বলিলাম, কিন্তু কে দড়ী ঝুলিয়ে দিয়েছিল, এখন সেই কথা। সে কেমন করে এই ঘরে প্রবেশ করলে?

ছাদের যে ছিদ্র দিয়ে জহরতের সিন্দুক এই ভদ্রলোক নামিয়ে ছিলেন,—সেই পথেই এক-পেয়ের বন্ধুর আবির্ভাব হয়েছিল।

খুব সম্ভব। আবার আর কোন পথ নাই।

এখন দেখা যাক, ইনি কে, বলিয়া গোবিন্দ বাবু বিশেষ করিয়া গৃহতল পরীক্ষা করিতে লাগিলেন; তৎপরে টেবিলের উপর দাড়াইয়া হাতের জোরে ছাতের ছিদ্র দিয়া উপরের চোর-কুটরীতেআসিলেন। আমাকে ইঙ্গিত করায় আমিও সেই রূপে উপরে আসিলাম। দেখিলাম, সেই চোর-কুটাতে একটি ছোট ঘুলঘুলি আছে। উহার ভিতর দিয়া কোন ছোট বালক বা বালিকা ঘরে সহজে প্রবেশ করিতে পারে।

গোবিন্দ বাবু সেই ঘরের ধূলায় পায়ের দাগ আমাকে দেখাইলেন। আমি বলিয়া উঠিলাম, এ যে খুব ছোট ছেলের পায়ের দাগ। কি ভয়ানক।

গোবিন্দ বাবু মন্তকান্দোলন করিয়া বলিয়া উঠিলেন, ভয়ানক কিছুই নয় ডাক্তার বাবু,ভয়ানক কিছুই নয়; সংসারে সবুই সম্ভব। পরে দেখতে পাবেন। এই বালক বা বামন কোন রকমে ছাদে ছাদে এসে চোর-কুটরী হয়ে এ ছিদ্রের মধ্য দিয়ে এই ঘরে এসেছি। তার পর সে দড়ী ঝুলিয়ে দেয়, সেই দড়ী ধরে আমাদের এক-পেয়ে বন্ধু মহাশয় এই ঘরে উঠে এসে কাজ হাসিল করে যান।

এখন তাই স্পষ্ট বোধ হচ্ছে।

এক পেয়ে লোকই ঢারি সাক্ষর লিখে গিয়েছে, সুতরাং এই এক-পেয়েকে দেখে এই ভদ্র লোকের গুণবা পিতা মরবার সময় ভয় পেয়েছিলেন।

এখন আমার স্মরণ হচ্ছে।

প্রতিভার পিতাও এই চারি সাক্ষরের মধ্যে ছিলেন, না হলে তিনি কেন এই চারি সাক্ষর যুক্ত প্ল্যান নিজের ঠিকানায় আন্দামান হতে পাঠাবেন?

হাঁ, তা নিশ্চয়।

এখন এই পর্যন্ত। এই যে আমাদের পুলিশ দেখা দিয়েছেন, বলিয়া গোবিন্দ বাবু ফিরিয়া দাঁড়াইলেন।

এই সময়ে কোতোয়ালীর দাবোগা মহম্মদ তোগী সাহেব, জন কয়েক কনেষ্টবল সহ বরেন্দ্র বাবুর সহিত তথায় উপস্থিত হইলেন। আমরা দুইজনে সরিয়া দাঁড়াইলাম।

কিন্তু গোবিন্দ বাবুকে ভারতবর্ষের প্রায় সমস্ত পুলিশ কর্মচারীই চিনিতেন। তিনি গোবিন্দ বাবুকে দেখিয়াই চিনিলেন। বললেন, আপনি। আপনি যে এখানে?

গোবিন্দ। বরেন্দ্র বাবু আমার বন্ধু, কাজেই এসে পড়েছি।

মহম্মদ। ইনিই কি আপনাকে এখানে ডেকে এনেছেন?

গোবিন্দ। হাঁ।

মহম্মদ। কি বুঝছেন? বরেন্দ্র বাবু একটু ঐদিকে যান।

তিনি ইঙ্গিত করায় কনেষ্টবলের বরেন্দ্র বাবুর সঙ্গে সঙ্গে গেল। গোবিন্দ বাবু বলিলেন,কিছুই এখন বুঝি নাই।

মহম্মদ। কেন? এত স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে।

গোবিন্দ। কি বুঝলেন?

মহম্মদ। কি আশ্চর্য! আপনার মত লোকও কোন বন্ধু বিপাকে পড়লে সে বিষয়ে আর কিছুই বুঝতে পারেন না।

গোবিন্দ। কি করি—আমি ত কিছুই বুঝতে পাছি না।

মহম্মদ। কেন? এত স্পষ্টই বুঝতে পারা যাচ্ছে। বরেন্দ্র বাবুটি ভাইকে মেরে জহরতের সিন্দুকটা সরিয়ে এখন নেকা সেজে পুলিশে খবর দিয়েছেন।

গোবিন্দ। আর লাস দাদার উপর দয়া করে, উঠে দরজা বন্ধ করে দিয়ে আবার চেয়ারে এসে বসে আছেন। ভ্রাতৃ স্নেহের এমন নিদর্শন এ জগতে বড়ই দুর্ল্লভ—তোগী সাহেব বড়ই, দুর্ল্লভ।

গোবিন্দ। কেন,ভাই ভাইকে খুন করলে, তার পর ভাই তার পরম ভ্রাতৃস্নেহ ভুলতে না পেরে উঠে দরজা বন্ধ করে দিলে। এতে আর সমস্যার কি আছে!

মহম্মদ। ওঃ—এখন বুঝেছি। এই যে ছাদে গৰ্ত্ত করা। হয়েছে। এই ছেদা দিয়ে উঠে ছাদ দিয়ে নেবে এসে শেষে পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে। গোবিন্দ বাবু, এখনও কি আপনার কোন সন্দেহ আছে?

গোবিন্দ। তার পর লাসের বুকে কাগজ মারা, তাতে উর্দ্দুতে লেখা চারি সাক্ষর।

মহম্মদ। কি মুস্কিল!–এ যে পুলিশের চোখে ধূলা দেবার চেষ্টা, অও আপনি বুঝতে পারূছেন না? বন্ধুর জন্য মানুষে এমন করেও আত্মহারা হয়! জমাদার, বরেন্দ্র বাবুকে এখনই এখানে নিয়ে এস।

জমাদার বরেন্দ্র বাবুকে তথায় আনিল। মহম্মদ তোগী সাহেব বরেন্দ্র বাবুকে বলিলেন, মশায়, আপনাকে এই খুনের জন্য আমি গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হলেম।

বরেন্দ্র বাবু কাতর ভাবে গোবিন্দ বাবুর মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, মহাশয়, আগেই আপনাকে বলেছিলাম।

গোবিন্দ। ভয় নাই,–আমি আপনাকে নির্দোষী সপ্রমাণ কর ভার নিলেম।

মহম্মদ। জমাদার, আসামীকে বাহিরে নিয়ে যাও। দেখ, সাবধান।

বরেন্দ্র। (গোবিন্দ বাবুর প্রতি) মশায়, এ বিপদে আপনি আমাকে দেখবেন।

গোবিন্দ। ভয় নাই।

জমাদার বরেন্দ্র বাবুকে লইয়া গেলে মহম্মদ সাহেব বলিলেন, আপনার কি এখনও সন্দেহ আছে?

গোবিন্দ। ঘোরতর। দাবোগা সাহেব, আপনার অনুসন্ধানের সাহায্য হবে বলে একটা কথা আমি আপনাকে এখন থেকেই বলে রাখি, যে খুন করে জহরতের সিন্দুক নিয়ে পালিয়েছে, সে আপনারই স্বজাতি—মুসলমান,-তার একটা পা কোন রকমে কাটা যায়। তার সে পাটা কাঠের।

মহম্মদ। বলে যান। তার নাম শুদ্ধ বলুন।

গোবিন্দ। তাও বলতে পারি। কিন্তু এখন বলব না। তার সঙ্গে আর একজন সঙ্গী ছিল।

মহম্মদ। বটে?

গোবিন্দ। হাঁ, সে আন্দামান দেশের লোক; এ দেশের মত অম্বা-চওড়া নয়,–ছোট। এ দেশের একটি ছোট ল্যাড়কার মত।

মহম্মদ। (সহাস্যে) বেশ, আর কিছু বলার থাকে—বলে যান।

গোবিন্দ। এখন ঠাট্টা করতে পারেন,–পরে বুঝবেন। আসুন ডাক্তার বাবু, আমরা যাই।

আমরা উভয়ে তথা হইতে প্রস্থান করিলাম। দারোগা সাহেব বরেন্দ্র বাবুকে লইয়া কোতয়ালীর দিকে রওনা হইলেন। তখন প্রায় ভোর হইয়াছে।

দশম পরিচ্ছেদ।

আমি ভাবিয়াছিলাম, গোবিন্দ বাবু এখন বাসায় যাইবেন; কিন্তু তাহা তিনি করিলেন না। তিনি বাড়ীর সম্মুখস্থ বাগানের একখানি বেঞ্চের উপর ধপাস করিয়া বসিয়া পড়িলেন। বসিয়া বলিলেন, বসুন। ডাক্তার বাবু।

আমি বলিলাম, আপনি কি এখন বাসায় যাবেন না?

তিনি বলিলেন, এত ব্যস্ত কেন? ঘুম পাচ্ছে নাকি?

আমি। ঘুমের আর অপরাধ কি? সমস্ত রাত্রি জাগরণ।

তিনি। রোদ উঠুক, আর একটু দেখবার দরকার আছে। প্রতিভার কাছে তার কাজের ভার নিয়েছি। আপনি তাকে ভুলে গেলেন নাকি?

হা অদৃষ্ট! আমি তাহাকে ভুলিব! আমি বলিলাম, না, আপনি যতক্ষণ বলবেন, তুতক্ষণ আপনার সঙ্গে থাকতে প্রস্তুত আছি।

তিনি। এ ভাল কথা।

আমি। আপনি দারোগাকে যা যা বললেন তাকি ঠিক?

তিনি। নয় কেন? সহজেই বুঝতে পারা যায়। আপনি আমার দিক্ থেকে দেখলে, ঠিক এমনই বুঝতেন।

আমি। আমার মাথায় কিছুই প্রবেশ করে নাই।

গোবিন্দ। (গম্ভীর ভাবে) হাঁ–এ সহজবোধ্য প্রেমকাহিনী নয়—তদপেক্ষ। এসব অনেক জটিল।

আমি বিরক্ত হইলাম, কোন কথা কহিলাম না।

তিনি বলিলেন, বিরক্ত হবেন না। বুঝিয়ে দিই, দেখুন।

জাবার জন্য আমিও উৎসুক হয়েছি।

একজন এক-পেয়ে লোক, আর একজন খুব ছোট-খাট লোকের সাহায্যে যে এই কাজ করেছে, তা ঘরটা ভাল করে দেখলে স্পষ্টই বোঝা যায়।

তা ত দেখেছি।

এখন চারি সাক্ষরএর কথা ভাবুন। এই চারি সাক্ষর বরে বাবুর পিতার মৃত্যুর পর তার বিছানায় দেখতে পাওয়া যায়। এখানেও আজ দেখা গেল; আবার প্রতিভার বাপের নিকট সেই চারি সাক্ষর যুক্ত একটা প্ল্যানও ছিল। ইহাতে কি বুঝেন?।

বুঝি এই যে, যে লোক খুন করেছে, তার সঙ্গে প্রতিভার পিতার ও বরেন্দ্র বাবুর পিতার কোন সম্বন্ধ ছিল।

হাঁ, এই সম্বন্ধ কিসের জন্য ছিল, তাও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। সেটা কি এই জহরতের সিন্দুক নয়?

এখন ত তাই বলে বোধ হচ্ছে।

তা হলে জানা যাচ্ছে যে, এই দুজন ভলোক এই এক-পেয়ে লোকের কাছ থেকে এই জহরত কোথায় আছে, তা আন্দামানে জানতে পারেন। বরেন্দ্রের পিতা প্রথম ফিরে আসেন। তিনিই জহরত হস্তগত করে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকেন। প্রতিভার পিতা আন্দামান থেকে ফিরে এসে প্রথমেই তার সঙ্গে দেখা করেন। দুজনে এই জহরত নিয়ে ঝগড়া হয়। প্রতিভার পিতার সেই সময়ে সেখানে মৃত্যু হয়।

এ সব জানতে পারা গেছে।

ভাল। তার পর আমরা এও জেনেছি, যে এক-পেয়ে বা কাঠের পা-ওয়ালা লোকের উপর বরেন্দ্রের পিতার বড়ই ভয় ছিল; সুতরাং বোঝা গেল যে, এই এক-পেয়ে লোকই প্রথমে জহরতের কথা জান্ত। বরেন্দ্রের পিতা তাকে ফাঁকি দিয়েছিলেন, নতুবা এত ভয় কেন?

এখন বেশ বুঝতে পাছি।

তার পর আন্দামান দ্বীপ থেকে চিঠী পেয়ে তার ব্যায়াম বেড়ে যায়; এতে বোঝা যায় যে, তিনি খবর পান যে, এক-পেয়ে কোন গতিকে আন্দামান থেকে দেশে ফিরেছে। সে তার মরুবার দিন তার জানালায় উঁকি মেরেছিল।

হাঁ, বরেন্দ্র বাবু বলেছিলেন।

বেশ। কাজেই সেদিন সে চারি সাক্ষর লিখে রেখে গিয়েছিল। সুতরাং বোঝা যায় যে, তাকে জহরত থেকে ফাঁকি দেওয়ায় সে প্রতিহিংসা নেবার চেষ্টায় ছিল।

এখন তা বেশ বুঝতে পারছি।

প্রতিভার নিকট একটা প্ল্যান পেয়েছি, এতে স্পষ্টই এখন বোঝা যাচ্ছে যে,যেখানে জহরত আছে, খুব সম্ভব পোঁতা ছিল, প্ল্যানে তাহাই দেখান হয়েছে।

এখন তাও বেশ বুঝতে পাছি।

প্ল্যানে চার জন লোকের সই আছে, সুতরাং কেবল তারাই চার জন এই জহরতের কথা জান্ত। তারা কোন কারণে,সম্ভবমত খুন করে দ্বীপান্তর যায়। সেখানে ডাক্তার বাবু আর কমিসরিয়েট বাবু তাদের কাছ থেকে কোন গতিকে জহরতের কথা জানতে পারেন, প্ল্যান ও হস্তগত করেন। শেষে সমুদয় জহরত বরেন্দ্র বাবুর গুণবান্ পিতাই আত্মসাৎ করেন।

ত সবই এখন বেশ বুঝতে পাছি। কিন্তু এক-পেয়ের সেই সঙ্গীটি কে?

তা ত বলেই দিলাম। আপনি কি জানেন না যে, আন্দামান বাসীর আকার ভারি ছোট। তাদের মধ্যে যে খুব বড় সে আমাদের দেশের বার-তের বৎসরের ছেলের মতও নয়।

এক-পেয়ে তা হলে একজন আন্দামানের লোককে সঙ্গে করে এনেছিল?

সেকথা আর দুবার করে বতে। তার পর এক-পেয়ের নাম আপনি কেমন করে জানলেন?

অতি সহজে। দু-তিন বৎসরের সব খবরের কাগজ দেখতে আরম্ভ করেছিলাম। খুঁজতে খুঁজতে দেখলেম যে, দেড় বৎসর আগে আন্দামান দ্বীপ থেকে আবদুল বলে একজন দায়মালি কয়েদী পালিয়েছে, তার খোঁজ হচ্ছে। তার বর্ণনাও দেওয়া হয়েছে। তার একটা পা কাঠের ছিল—এই যে এদিকেও ভোর হয়ে এসেছে-এখন কাজে লাগা যাক।

একাদশ পরিচ্ছেদ।

একটু পরিষ্কার হইলে লোক চলাচলের আগে গোবিন্দ বাবু উঠিয়া রাস্তা বিশেষ রূপে পরীক্ষা করিতে লাগিলেন। সহসা বলিয়া উঠিলেন, দেখছেন?

আমি স্পষ্টই সেই বালকের পায়ের দাগ দেখিতে পাইলাম। গোবিন্দ। এও দেখুন।

আমি। তাই ত!

আমি পথে সেই কাঠের পায়ের দাগ স্পষ্টই দেখিতে পাইলাম।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, এখন দেখা যা আমাদের এক-পেয়ে বন্ধু জহরতের সিন্দুকটি নিয়ে কোন্ দিকে গিয়েছিলেন। দেখছেন না, পায়ের দাগে স্পষ্টই জাতে পারা যায় যে, একটা ভারি জিনিষ নিয়ে গেছে।

গোবিন্দ বাবু পায়ের দাগগুলির উপরে লক্ষ্য রাখিয়া চলিলেন, আমিও পশ্চাতে পশ্চাতে চলিলাম। তখনও রাস্তায় লোকের চলাচল আরম্ভ হয় নাই।

আমরা সেই পায়ের দাগ অনুসরণ করিয়া কত রাস্তা ঘুরিয়া ক্রমে যমুনার নিকট আসিলাম। সেখানে একখানা খোলর ঘরের সম্মুখেও সেইরূপ পায়ের দাগ দেখিলাম; আবার সেখান হইতে সেই দাগ যমুনাতীর পর্যন্ত গিয়াছে। তাহার পর আর কোন চিহ্ন নাই।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, কি বুঝলেন?

আমি। এক-পেয়ে খোলার ঘরে কার সঙ্গে দেখা করে তার পর নদীর ধারে এসেছিল।

গোবিন্দ। কেবল তাই নয়। দেখছেন না, আরও দুজনের পায়ের দাগ স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে।

আমি। হাঁ, তা দেখতে পাচ্ছি।

গোবিন্দ। এ দুজন লোককে ডেকে নিয়ে এক-পেয়ে বন্ধু তাদের নৌকা করে সরে পড়েছে। এখন সন্ধান নেওয়া যাক, নৌকা কার আর কোথায় গেল;-বসুন এখানে একটু। ঘুরে ঘুরে যথেষ্ট ক্ষুধার উদ্রেকও হয়েছে, আর ত কিছু নাই, এখন এখানে বসে বসে যমুনা হাওয়া খাওয়া যাক।

গোবিন্দ বাবু যমুনার ধারে বসিলেন। আমিও বসিলাম। ক্রমে ধীরে ধীরে পূর্ব-গগনে সূর্যোদয় হইল।

সেই ঘাটে কতকগুলি নৌকা বাঁধা ছিল। ক্রমে বেলা হইলে দাঁড়ী মাঝিরা একে একে আসিয়া নিজ নিজ নৌকায় বসিতে আরম্ভ করিল। যাহারা নৌকায় নিদ্রিত ছিল, তাহারাও উঠিয়া বসিল।

গোবিন্দ বাবু একজন মাঝিকে ডাকিলেন। বলিলেন, বাপু, আমরা নৌকা করে মথুরা যেতে চাই,—কত নেবে?

মাঝি বলিল, নৌকা করে যাবেন, বড় দেরী হবে।

গোবিন্দ। আমরা বেড়াতে যাচ্ছি, যমুনার হাওয়া খেতে যাচ্ছি, না হলে ত রেলেই যেতে পারি।

মাঝি। পাঁচ টাকা দেবেন।

গোবিন্দ। পাঁচ টাকা, বল কি! কাল রাত্রে আমার এক বহু দু টাকায় গেছে যে।

মাঝি। দু টাকায়? কে গেছে।

এই বলিয়া সে আরও দুই-চারিজনকে ডাকিয়া বলিল, বাবুর বলছেন, কাল রাত্রে কে দু টাকায় মথুরায় গেছে। কে গেছে? দু টাকায় কে গেছে রে?

তাহারা সকলে নৌকাগুলি দেখিতে লাগিল। তৎপরে একজন বলিল, দেখছি মঙ্গলুর নৌকা নাই? হয় ত সেই গেছে।

পূর্বোক্ত মাঝি ক্রোধে কহিল, তাকে পঞ্চাতে দিব।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, বাপু, যখন একজন গেছে, তখন আমরা তোমাদের বেশী দেব কেন?

মাঝি। দু টাকায় কেউ যায় না। চলুন দেখি, দেখি সে কেমন দুটাকায় গেছে।

সে ক্রোঃ ভরে চলিল। আমরাও তার সঙ্গে সঙ্গে চলিলাম। সে সেই খোলর ঘরের দ্বারে আসিয়া মঙ্গলুর স্ত্রীকে ডাকিল। সে বাহির হইয়া আসিলে মাঝি বলিল, মঙ্গলু কোথায় গেছে?

সে বলিল, সে কাল রাত্রে তার নৌকা নিয়ে গেছে।

মাঝি। কার সঙ্গে গেছে?

মঙ্গলুর স্ত্রী। জনিয়ে সঙ্গে গেছে।

মাঝি। ভাড়ায় গেছে কি?

মঙ্গলুর স্ত্রী। হাঁ,-একটা কাঠের পা-ওয়ালা লোক সেই নৌকা তাড়া করে নিয়ে গেছে। সে লোকটাকে আমি দু চক্ষে দেখতে পারিনে। মাঝে মাঝে এখানে আসত।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, তাকে আমরা জানি। তার সঙ্গে একটা খুব ছোট-খাট বেঁটে লোক ছিল,–না?

মঙ্গলুর স্ত্রী। হাঁ, সেটাকে দেখলে ভয় করে। ওমা, যেন কেউটে সাপ।

গোবিন্দ। মথুরায় দু টাকার ভাড়া করে গেছে না?

মঙ্গলুর স্ত্রী। তা আমি জানি না।

গোবিন্দ। কবে ফিরবে, তা কিছু বলে গেছে?

মঙ্গলুর স্ত্রী। না।

গোবিন্দ বাবু মাঝির দিকে ফিরিয়া বলিলেন, দেখলে বাপু, তুমি যখন পাঁচ টাকা চাচ্ছ, তখন আমরা রেলেই যাব।

এই বলিয়া তিনি সত্বর চলিলেন। মাঝি চীৎকার করিয়া আমাদের পশ্চাৎ হইতে বলিল, কত দেবেন বলুন না।

গোবিন্দ বাবু সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া সত্বর পদে সহরের দিকে চলিলেন। কিয়দ্দর আসিয়া বলিলেন, রেলে গেলে পাছে কেউ সন্দেহ করে বলে এক-পেয়ে মহাশয় বুদ্ধি খাটিয়ে নৌকায় গেছেন?

আমি। বোধ হয়, দূরে গিয়ে কোন ষ্টেশনে রেলে উঠবে, না?

গোবিন্দ। শীঘ্র না। দিন কত কোথায়ও লুকিয়ে থাকবে। জানে খুন আর চুরির জন্য একটা মস্ত হৈ-চৈ পড়ে গেছে। পুলিশ চারিদিকে টেলিগ্রাফ করেছে।

আমি। এখন আপনি কি করবেন?

গোবিন্দ। চলুন বাসায় যাই। একটু ঘুমাতে হবে। সমস্ত রাত্রিটা নিদ্ৰা নাই।

গোবিন্দ বাবু বাসায় আসিবার পথে তার আফিসে গিয়া দুইটা টেলিগ্রাফ করিলেন। একথানা এলাহাবাদে, আর একখানা মথুরায়। আমি এতই ক্লান্ত হইয়াছিলাম যে, বাসায় আসিয়াই ঘুমাইয়া পড়িলাম।

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ।

নিদ্রার পর আমি অনেকটা প্রকৃতিস্থ হইলাম। উঠিয়া দেখি, গোবিন্দ বাবু চুরুট টানিতে টানিতে এক মনে কাগজ-পত্র দেখিতেছেন। তখন অনেক বেলা হইয়াছিল, আমরা উভয়ে স্নানাহার করিলাম। গোবিন্দ বাবু এত অন্যমনস্ক ছিলেন যে, তাহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে আমার সাহস হইল না।

সহসা তিনি বলিলেন, আমাদের একটা বড় অন্যায় কাজ হয়েছে।

আমি বলিলাম, কি?

গোবিন্দ। কি? প্রতিভা ভাবিত রয়েছে। তাকে একটা খবর দেওয়া উচিত ছিল। আপনি এখনই যান।

আমি। আমি!

গোবিন্দ। হাঁ গো মশায়, আমার অন্য কাজ আছে।

আমি। তাকে কি বল?

গোবিন্দ। আশ্চর্য! যা-যা ঘটেছে, সব তাকে খুলে বলবেন?

আমি। এখনই যাব? গোবিন্দ।

আমি তৎক্ষণাৎ প্রতিভার সহিত দেখা করিতে চলিলাম। সে নিতা উদগ্রীব হইয়াছিল। আমাকে দূর হইতে দেখিয়া প্রতি সত্বর বাহিরে আসিল। আমাকে সাদরে একটা ঘরে লইয়া গিয়া বসাইল। সলজ্জভাবে সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল; কোন কথা বলিল না।

আমি বলিলাম, কাল যা-যা ঘটেছে, তাই আপনাকে বলবার জন্য গোবিন্দ বাবু আমাকে পাঠিয়েছেন?

তৎপরে আমি সমস্ত তাহাকে বলিলাম। প্রতিভা বরেন্দ্রের গ্রেপ্তারের কথা শুনিয়া বড়ই দুঃখিত হইল। বলিল, আপনারা তাকে খালাস কার জন্য বিশেষ চেষ্টা করবেন। তিনি ত সে সময়ে বাড়ী ছিলেন না।

অবশ্যই গোবিন্দ বাবু এ বিষয়ে বিশেষ চেষ্টা করবেন?

এ লোকটা কবে ধরা পড়বে?

তা ঠিক কেমন করে বল্ব? তবে গোবিন্দ বাবু যেরূপ ক্ষমতাপন্ন লোক, তাতে বোধ হয় শীঘ্রই ধরা পড়বে।

সে ধরা পড়ক-না-পড়,ক, যা হয় হক, কিন্তু বরেন্দ্র বাবুকে আজই খালাস কবেন। নিশ্চয়ই তার ভারি কষ্ট হচ্ছে।

গোবিন্দ বাবু সে বিষয়ে খুব চেষ্টিত আছেন।

আপনি এখন যান, তাঁকে বিশেষ করে বলুন।

আমি আপনার নাম করে তাকে বলব।

আমি উঠিলাম। প্রতিভা বলিল,আপনি আবার কখন আসবেন?

আমি বড় ব্যস্ত হয়ে থাকব।

কত দুর কি হয়, রাত্রে এসে খবর দিব।

আমার জন্য আপনাদের ভারি কষ্ট হচ্ছে।

কিছুই নয়। আপনার জন্য আমাদের কোন কষ্ট হবার সম্ভাবনা কোথায়?

প্রতিভা কোন উত্তর করিল না দেখিয়া, আমি গমনোদ্যত ভাবে ফিরিয়া দাঁড়াইলাম। আমাকে গমনোদ্যত দেখিয়া প্রতিভা বলিল, কখন আসবেন?

আমি বলিলাম, যত শীঘ্র পারি আসব।

আমি বাহিরে আসিল্প ভাবিলাম, একবার কোতোয়ালীতে খবরটা নিয়ে যাওয়া ভাল। এইরূপ মনে করিয়া আমি থানায় আসিয়া

ইনস্পেক্টর মহম্মদ তোগীর সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তিনি আমাকে দেখিয়া সাদরে বসাইয়া বলিলেন, নিশ্চয়ই গোবিন্দ বাবু আপনাকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন?

আমি। না, এদিকে এসেছিলাম, তাই একবার খবর নিয়ে যাব মনে করলেম।

মহম্মদ। গোবিন্দ বাবুই হয় ত ঠিক।

আমি। কি রকম।

মহম্মদ। আমরা বরেন্দ্র বাবুকে ছেড়ে দিয়েছি।

শুনিয়া আমার প্রাণে বড় যথার্থই আনন্দ হইল। আমি সাগ্রহে বলিলাম, কেন?

মহম্মদ। তার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ নাই। খুনের রাত্রে তিনি সে বাড়ীতে ছিলেন না। এমন কি,অনেক দিন হতেই তিনি সেই বাড়ীতে আন নাই। সে রাত্রে তিনি প্রথম আপনাদের সঙ্গে ঐ বাড়ী যান, গিয়ে ভাইকে মৃতাবস্থায় দেখতে পান। এ সব বেশ ভাল রকম সপ্রমাণ হয়েছে,-সুতরাং সুপারিন্টেডেন্ট সাহেব এই সব সাক্ষী-সাবুদ নিয়ে তাঁকে ছেড়ে দিয়েছেন।

আমি। তিনি যে খুন করেন নাই, তা নিশ্চয়।

মহম্মদ। আমরা নিশ্চিন্ত নই। যিনি খুন হয়েছেন, তার বাড়ীর গত চাকর-বাকরকে ধরে এনেছি। দেখা যাক, তারা কি বলে। তার পর সমস্ত রেল-ষ্টেশনে, আর থানায় থানায়, জেলায় জেলায়, টেলিগ্রাফ করেছি; সুতরাং যিনিই খুন করুন, তাঁকে শীঘ্রই ধরা পড়তে হবে।

আমি। আপনারা যখন আছেন, তখন সে নিশ্চয়ই ধরা পড়বে। মহম্মদ। গোবিন্দ বাবুকে বলবেন; আজই সন্ধ্যার সময় তাঁর সঙ্গে আমি দেখা করব; যেন তিনি বাসায় থাকেন। সাহেব তার সঙ্গে পরামর্শ করতে হুকুম করেছেন।

আমি উঠিলাম। পথে আসিয়া ভাবিলাম, প্রতিভাকে বরে বাবুর কথা বলে যাওয়া উচিত। আমি আবার প্রতিভার বাড়ীর দিকে চলিলাম। প্রতিভা আমাকে এত শীঘ্র ফিরিতে দেখিয়া ব্যক্তভাবে বাহিরে আসিল। আমি বলিলাম ব্যস্ত হয়ো না। বরেন্দ্র বাবুকে নির্দোষী জেনে পুলিশে তাকে ছেড়ে দিয়েছে, তাই জেনে আবার এখানে বন্দুতে এলেম।

প্রতিভা বলিল, আমরা ত জানতেম যে, তিনি নির্দোষী।

আমি। এখন চললেম, সন্ধ্যার পর এসে কি হয় বলে যাব।

প্রতিভা। আমি খুব খুশী হয়েছি, বরেন্দ্র বাবুকে বলবেন।

আমি। নিশ্চয়ই বলব।

প্রতিভা। সন্ধ্যার পর নিশ্চয় আসবেন।

আমি। নিশ্চয়ই আসব।

বাসায় আসিয়া দেখিলাম, গোবিন্দ বাবু ও বরেন্দ্র বাবু উভয়ে বসিয়া কথোপকথন করিতেছেন।

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ।

বলা বাহুল্য, আমি বরেন্দ্র বাবুর মুক্তিতে বিশেষ আনন্দ প্রকাশ করিলাম। প্রতিভা যাহা বলিয়াছিল, তাহাও আমি বরেন্দ্র বাবুকে বলিলাম। তিনি বলিলেন, আমি সন্ধ্যার সময় তার সঙ্গে দেখা করব। যেমন করে হয়, চোরাই জহরত আমাকে বার করতেই হবে। এতে আমার সর্বস্ব যায়, তাও পণ; বাবা যথেষ্ট রেখে গেছেন।

গোবিন্দ বাবু আমার সম্মুখে দুইখানা টেলিগ্রাম ফেলিয়া দিয়া বলিলেন, দেখছেন, আমি তখন মথুরা আর এলাহাবাদ পুলিশকে কেন খবর দিয়েছিলেম। মঙ্গলুর নৌকা মথুরা বা এলাহাবাদ পার হতে পাবে না। পুলিশ খুব নজর রাখবে।

আমি। তার পর এখন কি কবেন?

গোবিন্দ। নৌকা মধুরার দিকে গেলে উজান ঠেলে যেতে হবে খুব দেরী হবে। তারা সম্ভবমত কাল রাত্রি এগারটার সময় নৌকায় উঠেছে। সকালের মধ্যে কখনই মথুরায় যেতে পারে না। যদি এলাহাবাদের দিকে গিয়ে থাকে, তা হলে ভাটার টান পাবে, খুব শীঘ্র যাবে। তা হলেও এলাহাবাদ পৌঁছিতে পারবে না। দুখানা নৌকা দুদিকে পাঠিয়েছি, তারা মধুর আর এলাহাবাদ গিয়ে টেলিগ্রাফ করবে। তা হলেই সব জানা যাবে।

আমি। আপনাকে দারোগা সন্ধ্যার সময় বাসায় থাকতে বলেছেন। তিনি দেখা করতে আসবেন।

গোবিন্দ। দেখলেন, ডাক্তার বাবু।

আমি। তাদের সাহেব তাকে আপনার সঙ্গে পরামর্শ করতে হুকুম দিয়েছেন।

গোবিন্দ। দিতেই হবে। এই সব পুলিশ-কর্তারা ব্যস্ত হয়ে আগে হতে একটা ধারণা করে সকল কাজ একবারে মাটা করে ফেলে। এখন একটু সেতার বাজান যাক্।

তাঁহার সুমিষ্ট সেতারে মন তন্ময় হয়। আমরা উভয়েই নীরবে বসিয়া শুনিতে লাগিল। সন্ধ্যার একটু পূৰ্বে গোবিন্দ বাবু সেতার বন্ধ করিলেন। বন্ধ করিয়া তামাক টানিতে আরম্ভ করিলেন। বরের বাবুও দুই-একটান তামাক টানিয়া উঠিয়া গেলেন।

কিয়ৎক্ষণ পরেই দারোগা সাহেব আসিয়া উপস্থিত হইলেন। গোবিন্দ বাবু তাহাকে বিশেষ সমাদরে বসাইলেন। তিনি হাসিতে হাসিতে বলিলেন, গোবিন্দ বাবু, এখন দেখছি, আপনার কথাই ঠিক।

গোবিন্দ। কাল ত হেসেই একেবারে উড়িয়ে দিলেন।

মহম্মদ। সেইজন্যই সময়ে সময়ে আমরা বোকা বনে যাই। সাহেব আপনার কথা শুনে আপনার সঙ্গে পরামর্শ করতে হুকুম দিলেন। তিনিও দেখা করতে আসবেন।

গোবিন্দ। কিছুই করতে হবে না। আসামী আমিই ধরে দেব।

মহম্মদ। বলেন কি? আপনি কি জানেন, সে কোথায় আছে?

গোবিন্দ। ঠিক জানি না, তবে শীঘ্রই জাতে পাব। আমি কাল, আপনাকে বলেছিলাম যে, আমি তার নাম পৰ্যন্ত জানি।

মহম্মদ। আপনি আশ্চৰ্য্য লোক। আমরা সকলেই আপনার কাছে মাথা নীচু করতে বাধ্য। তার নামটা কি?

গোবিন্দ। এক-পেয়ে আবদুল।

মহম্মদ। বলেন কি? আপনি অদ্ভুত লোক।

গোবিন্দ। আমি আপনাদের আসামী ধরে দিব; কিন্তু আপনাদের দু-একটা কাজ করা চাই।

মহম্মদ। বলুন, এখনই করব।

গোবিন্দ। বেশী কিছু নয়, আমি একখানা খুব ভাল নৌকা চাই, সঁড়ী-মাঝী আপনাদের বিশ্বাসী কনেষ্টবল হওয়া চাই। আর সেই নৌকা কোন রকমে কেউ যেন পুলিশের নৌকা বলে জানতে না পারে।

মহম্মদ। সে আর শক্ত কথা কি-কবে চাই?

গোবিন্দ। বোধ হয়, কালই চাই।

মহম্মদ। এখনই গিয়ে তার বন্দোবস্ত কছি।

গোবিন্দ। দুজন সুদক্ষ ইনস্পেক্টরকেও সঙ্গে চাই, সঙ্গে যেন রিভলভার থাকে। লোকটা সহজ নয়।

মহম্মদ। আমি নিজেই যাব, আর করিমবক্সকে সঙ্গে নেব।

গোবিন্দ। চারটে হাতকড়ী সঙ্গে নেবেন।

মহম্মদ। চার জন আসামী নাকি?

গোবিন্দ। এই রকম এখন বোধ করছি।

মহম্মদ। আপনি অদ্ভুত লোক,—নিশ্চয়ই অদ্ভুত লোক।

গোবিন্দ। এখন এই পর্যন্ত। আর কিছু দরকার হয় খবর দিব।

মহম্মদ। যখনই যা হুকুম করবেন, তাই তামিল হবে। আসামী ধরাই চাই।

গোবিন্দ। এখন কাকেও কিছু বলবেন না। আসামী ধরা পড়লে প্রশংসা আপনারই।

মহম্মদ। তা ত নিশ্চয়।

গোবিন্দ। প্রোমসনও হতে পারে।

মহম্মদ। সে আপনার মেহেরবানী।

মহম্মদ সাহেব অন্যান্য কথাবার্তার পর আমাদের সেলাম দানে একেবারে দাতাকর্ণ হইয়া বিদায় হইলেন। আমরাও প্রতিভার সহিত দেখা করিতে চলিলাম।

যদিও প্রতিভাকে ছাড়িয়া তখনই যাইতে আমার প্রাণ চাহিল না, কিন্তু গোবিন্দ বাবু আমাকে বিলম্ব করিতেও দিলেন না। বরেন্দ্র বাবু আমাদিগকে তাহার বাসা-বাড়ীতে রাত্রে আহারের নিমন্ত্রণ করিয়াছিলেন; আমরা তাঁহার বাসা-বাড়ীর দিকে চলিলাম।

বলা বাহুল্য,বরেন্দ্র বাবু আহারের বিশেষ বন্দোবস্ত করিয়াছিলেন। তাঁহার বাড়ী হইতে ফিরিতে আমাদের অনেক রাত্রি হইল। বাসায় আসিয়া গোবিন্দ বাবু ভৃত্যকে জিজ্ঞাসা করিলেন, কোন তার এসেছে?

সে উত্তর করিল, না।

গোবিন্দ বাবু কোন কথা কহিলেন না। আমি শয়ন করিতে গেলাম।

চতুর্দশ পরিচ্ছেদ

পরদিবস প্রাতে আমি ও গোবিন্দ বাবু মঙ্গলুর সন্ধানে বাহির হইলাম। কিন্তু জানিলাম, সে এখনও বাড়ী ফিরিয়া আসে নাই। আমার ইচ্ছা ছিল, প্রতিভার সহিত দেখা করিয়া আসি, কিন্তু গোবিন্দ বাবু দ্রুতপদে বাসার দিকে চলিলেন। আমিও সঙ্গে সঙ্গে চলিলাম। মুখ ফুটিয়া কোন কথা বলিতে পারিলাম না।

বাসার পারে পদার্পণ করিয়াই তিনি ভৃত্যকে জিজ্ঞাসা করিলেন, কোন তার এসেছে?

সে উত্তর করিল, হাঁ হুজুর।

গোবিন্দ বাবু সত্বর ভিতরে প্রবিষ্ট হইয়া টেলিগ্রাম তুলিয়া লইলেন। একটি নয়, দুইটি টেলিগ্রাম। কিন্তু টেলিগ্রাম দুইটি খুলিয়া দেখিয়া তিনি চিন্তিত হইলেন; কোন কথা কহিলেন না। চিন্তিত মনে পথ চারণ করিতে লাগিলেন।

তিনি একেবারেই কোন কথা কহেন না দেখিয়া, আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, কিছু হয়েছে নাকি?

তিনি টেলিগ্রাম দুইটি আমার দিকে ফেলিয়া দিলেন। আমি তুলিয়া লইয়া পড়িলাম।

তিনি যে দুইখানি নৌকা দুইদিকে পাঠাইয়াছিলেন, সেই দুই নৌকার লোকে টেলিগ্রাফ করিতেছে যে, তারা যমুনার কোন স্থানে মজলুর নৌকার সন্ধান পায় নাই—কোন স্থানেই সে নৌকা নাই।

সহসা গোবিন্দ বাবুর মুখ ফুটিল,ওঃ,আমি কি গাধা! মঙ্গলু ভায়ার নৌকা কোন গতিকেই মথুরা বা এলাহাবাদ পার হয়ে যেতে পারে নাই, অথচ এলাহাবাদ থেকে মথুরার মধ্যে যমুনার কোনখানে মঙ্গলুর নৌকা নাই. আমার লোকের ভুল হতে পারে না, কারণ নৌকার মাঝিরা মঙ্গলুকে চেনে। তবে কি নৌকা ডুবিয়ে দিয়ে এরা স্থলপথে পালিয়েছে। তা হতে পারে না, কারণ মঙ্গলু গরীর লোক, স্ত্রী পরিবার নিয়ে ঘর করে, সে এক-পেয়ের ভিতরের কথা কিছুই জানে না। সে তার জীবনের অবলম্বন নৌকা সহজে ডুবিয়ে দিতে রাজী হবে না। এক-পেয়েও মঙ্গলু মাঝির মত পণ্ডিতকে কখনই ভিতরের কথা বলবে না। তা হলে পুলিশের হাত এড়াবার জন্য দিন-কতক নৌকসুদ্ধ গা-ঢাকা দেবার পক্ষে আমাদের এক-পেয়ে বন্ধু মশায় কি উপায় করতে পারেন? সহজ উপায় আছে। মঙ্গলু হলে আর দাড়ী দাড়ে, ভিতরে গোপনে বন্ধু নৌকাটা বাচাল করে দেবেন। হু হু করে নৌকায় জল উঠতে থাকবে। মঙ্গলু তাড়াতাড়ি নৌকা কিনারায় লাগাবে। মেরামত না কলে নৌকা আর চলে না। নৌকা ভীরে ভোলা হবে, মেরামত আরম্ভ হবে। অবশ্য এক-পেয়ে বন্ধু মঙ্গলুকে যথেষ্ট টাকা দেবেন। এই রকমে এক-পেয়ে কোন গ্রামে নৌকা সুদ্ধ দিন কত বাস করবেন। পুলিশ নদী রেল খুঁজে মরুক, কোথায়ও তাদের সন্ধান পাবে না। গোলমালটা কিছু থামলে, তখন এক-পেয়ে ভায়া নৌকা করে এলাহাবাদ বা আর কোনখানে মেলে উঠে অন্তর্হিত হবেন। কেমন, এই কি ঠিক নয়, ডাক্তার?।

এতক্ষণ গোবিন্দ বাবু যে কথা বলিতেছিলেন, তাহাতে, কে হইতেছিল যে, যেন তিনি নিজের মনেই চিন্তা করিতেছিলেন ; এক্ষণে সহসা তিনি আমাকে প্রশ্ন করায় আমি কি উত্তর দিব, কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। একটু পরে বলিলাম, আপনি যে ভাবে বাদানুবাদ করে মীমাংসায় আছেন, তার উপর আমার কোন কথা নাই।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, তা হলে এটা সাব্যস্ত যে এক-পেয়ে ভায়া নৌকাসুদ্ধ তীরে কোন গ্রামে আছেন। নিশ্চয়ই নিশ্চিন্ত মনে আছেন; কারণ তিনি ভাবেন যে, সেখানে যে তিনি আছেন, তা কেহই সন্দেহ করবে না। তার সন্ধানে আমাকে স্বয়ংই যেতে হল, দেখছি। ডাক্তার, আপনাকে এখানে একা থাকতে হল; কারণ একজনের বাসায় থাকা দরকার। আমার নামে যদি কোন চিঠী কি টেলিগ্রাম আসে বা কেউ কোন কথা বলতে আসে, তবে যা ভাল বিবেচনা হয়করবেন। আমি এখনই রওনা হলেম।

আমার উত্তরের প্রতীক্ষা না করিয়া তিনি তখনই প্রস্থানের উদ্যোগ করিতে লাগিলেন। সামান্য কয়েকটি দ্রব্যাদি লইয়া তিনি পনের মিনিট যাইতে-না-যাইতে অন্তর্হিত হইলেন।

পরদিন তিনি ফিরিলেন না। তার পর আর একটা দিনও কাটিয়া গেল। আমাকে কোন পত্রাদিও লিখিলেন না। আমি তার কোন সন্ধানই পাইলাম না। . এই দুইদিন আমি প্রতিভার বাড়ী সকালে বৈকালে গিয়াছিলাম। সত্য কথা বলিতে কি, তাহার নিকট সৰ্ব্বদা থাকিতেই আমার প্রাণ চায়।

তৃতীয় দিবসের দুই প্রহরের সময় আমি বাসায় বসিয়া নানা বিষয় নিজ মনে ভাবিতেছিলাম, এই সময়ে একজন কাবুলীওয়ালা কতক গুলা শীতবস্ত্র মাথায় করিয়া ঘরের ভিতর আসিয়া বলিল, বাবু সাহেব, কিছু কাপড়-চোপড় নিন।

আমি। না।

কাবুলী। খুব সস্তায় দিব। নগদ টাকা দিবেন না। মাসে মাসে কিছু দেবেন।

আমি। না বাপু, আমার দরকার নাই।

কাবুলী। একখানা নিন,–না হয় একবার দেখুন।

এই বলিয়া সে মাথার কাপড়গুলা ধপ, করিয়া সেখানে ফেলিল।

আমি বিরক্ত হইয়া বলিলাম, আমি লইব না,–তুমি কি আমাকে জোর করে দেবে। এখনই বেরিয়ে যাও, না হলে পুলিশ ডাকব।

সে হো হো করিয়া খুব হাসিয়া উঠিল। তাহার সেই বেয়াদবীতে আমার রাগ আরও বাড়িয়া উঠিল; দুই-এক ঘা দিবার উদ্যোগ করিতেছি,এমন সময়ে সে বলিল,ডাক্তার বাবু! আপনি যখন আমাকে চিতে পারেন নাই, তখন আর অপরের সাধ্য কি যে চেনে?

আমি বিস্ময়বিহ্বল হইলাম। একি, এ যে গোবিন্দ বাবু।

আমি বলিলাম, আপনি অদ্বিতীয় লোক। কার সাধ্য আপনার ছদ্মবেশ চেনে?

তিনি হাসিতে হাসিতে বলিলেন, আজ কাল গ্রামে গ্রামে বেড়াবার পক্ষে কাবুলী হওয়াই সুবিধা,–নয় কি?

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ।

গোবিন্দ বাবু নিজ ছদ্মবেশ পরিত্যাগ করিয়া স্থির হইয়া বসিলেন। এবং একটা সুদীর্ঘ চুরুটে অগ্নিসংযোগ করিয়া বলিলেন,যা বলেছিলাম তাই। আমাদের এক-পেয়ে বন্ধুটি মঙ্গলুর নৌকা বানচাল করেছেন, কাজেই নৌকা মেরামত করবার দরকার হয়। এলাহাবাদের দিকে এখান থেকে আট ক্রোশ দূরে, মীরপুর বলে একটা গ্রাম আছে। সেই খানেই নৌকা উঠিয়ে মেরামত আরম্ভ হয়েছে। নিশ্চয়ই মঙ্গলুকে অনেক টাকা দিয়ে রাজী করে রেখেছে। এ দিকে একটু গোলমাল থেমে গেলে আবার নৌকা জলে ভাসিয়ে ভায়া কোন ষ্টেশনে রেলে উঠে সরে পড়তে চান। তা বোধ হয় আর হচ্ছে না। এখন আপনি যতশীঘ্ৰ পারেন, প্রস্তুত হন।

কোথায় যাবেন?

ভায়াকে গ্রেপ্তার করতে।

আমিও যাব

নিশ্চয়। রিভলবারটা সঙ্গে নিন। বেটারা সহজ লোক নয়।

নৌকা করে যাবেন?

হাঁ, নৌকাতেই তাদের গ্রেপ্তার করতে হবে। না হলে জহরতের পিক পাওয়া দায় হবে। এখন কোথায় পুতে রেখেছে নিশ্চয়।

গোবিন্দ বাবু আর কাল বিলম্ব করিলেন না। আমরা প্রস্তুত হইয়া-শীঘ্রই কোতোয়ালীতে আসিলাম। মহম্মদ সাহেব আরও দুইজন ইনস্পেক্টরকে সঙ্গে লইলেন। কেহই রিভার লইতে ভুলিলেন না। চার জোড়া হাতকড়ীও লওয়া হইল। ছয়জন কনেষ্টবল দাড়ী ও একজন জমাদার মাঝি সাজিয়া চলিল।

মহম্মদ সাহেব নৌকা আগে হইতে ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলেন। আমরা সকলে সত্বর নৌকায় উঠিয়া নৌকা ছাড়িয়া দিলাম। তীরবেগে নৌকা ছুটিল।

মিরপুরের নিকট আসিয়া গোবিন্দ বাবু নৌকা হইতে নামিলেন। আমাদের সকলকে তথায় অপেক্ষা করিতে বলিয়া তিনি সেখান হইতে একাকী গেলেন।

কিন্তু তিনি শীঘ্রই ফিরিয়া আসিলেন। বলিলেন, যা ভেবেছিলাম। তাই। বেটারা কেমন করে খবর পেয়ে বা সন্দেহ করে আধঘণ্টা আগেই নৌকা ছেড়ে এলাহাবাদের দিকে চলে গেছে। নৌকা এখনই খুলে দাও, খুব জোরে দাঁড় টান।

নৌকা তখনই খুলিয়া দেওয়া হইল। নৌকা আবার তীরবেগে দুটিল। ছয় দাড় আমাদের নৌকায় ছিল, সুতরাং তাহাদের নৌকা আমরা যে শীঘ্রই ধরিতে পারিব, সে বিষয়ে আমাদের সকলেরই বিশেষ ভরসা হইল।

তখন প্রায় সন্ধ্যা হইয়াছিল। আমরা রাত্রি আটটা পর্যন্ত চলিলাম, তবুও তাহাদের নৌকার কোন চিহ্ন দেখিলাম না। আমাদের কাহারও মুখে কোন কথা নাই। কথা কহিবার কিছু ছিল না। সকলেই বোধ হয়, আমার মত উৎসুকচিত্তে মঙ্গলুর নৌকার প্রতীক্ষা করিতে ছিলেন। গোবিন্দ বাবু নদীর চারিদিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখিতে লাগিলেন।

মহম্মদ সাহেব বলিলেন, আপনার ত ভুল হয় নাই, গোবিন্দ বাবু?

গোবিন্দ বাবু গম্ভীর ভাবে কেবল মাত্র বলিলেন, না। মহম্মদ। আমরা ত তাদের নৌকা ছেড়ে আসি নাই?

গোবিন্দ। না, সেদিকে চোখ রেখেছি।

মহম্মদ। তাদের দুই দাঁড়ের নৌকা, আর আমাদের ছয় দাড়ের নৌকা। আধ ঘন্টা আগে যদি তারা নৌকা ছেড়ে থাকে, তবে তাদের নৌকা এতক্ষণে আমাদের ধরা উচিত।

গোবিন্দ। তারা কি আর দুই চারটা দাড় বাড়াতে পারে না? সম্ভবমত তাই করেছে। বেশী পয়সা দিয়ে মিরপুর থেকে দুই তিনটা দাড়ী সংগ্রহ করেছে।

এই সময়ে আমরা সম্মুখে একখানা নৌকা দেখিতে পাইলাম। গোবিন্দ বাবু মহোল্লাসে বলিয়া উঠিলেন, খুব জোরে টান, ওই সেই নৌকা।

আমাদের নৌকা মহা বেগে ছুটিল।

******

আরও অর্ধঘণ্টা কাটিল। যদিও এখন সেই নৌকা আমাদের নৌকা হইতে বেশী দূরে ছিল না, তবু আমরা স্পষ্ট বুঝিলাম, সেই নৌকাও খুব জোরে চলিতেছে।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, দেখছেন দারোগা সাহেব, নৌকায় চার দাড়।

মহম্মদ। সে নৌকা না হতেও পারে।

গোবিন্দ। এখনই দেখা যাবে। সাধারণ চড়নদারের নৌকায়

ক্রমে আমাদের নৌকা অগ্রবর্তী নৌকার আরও নিকটস্থ হইতে লাগিল। তখন আমরা স্পষ্ট বুঝিলাম, সেই অগ্রবর্তী নৌকার মাঝি ভিতরের একজনকে কি বলিল। তখন সেই ব্যক্তি ছইয়ের বাহিরে আসিয়া আমাদের নৌকা দেখিতে লাগিল। আমরা তাহার আকৃতি বা চেহারা অন্ধকারে স্পষ্ট দেখিতে পাইলাম না।

গোবিন্দ বাবুর তীক্ষ্ণদৃষ্টি তাহাকে দেখিল। তিনি বলিয়া উঠিলেন, এই যে আমাদের এক-পেয়ে বন্ধু।

বোধ হইল যেন, তাহার কথা সেই ব্যক্তির কানে গেল। আমরা স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম সে দাড়ীদের কি বলিল। আমরা দেখিলাম, তখন তাহারা প্রাণপণে দাড় টানিতে লাগিল।

তখন দুই নৌকায় প্রকৃতই বা আরম্ভ হইল। আমরা সকলে উঠিয়া দাঁড়াইয়া ক্রমাগত বলিতে লাগিলাম,জোরেজোরেজোরে। ছয় জন পাহারাওয়ালা, তাহাদের শরীরে যত বল ছিল, সমস্ত প্রয়োগ করিয়া প্রাণপণে দাঁড় টানিতে লাগিল। মনে হইতে লাগিল, আর একটু বেশী জোর দিলে, দাড় ভাঙিয়া তাহারা উল্টাইয়া জলে গিয়া পড়িবে।

ষোড়শ পরিচ্ছেদ।

আমাদের নৌকা ক্রমে সেই নৌকার আরও নিকটবর্তী হইল। বোধ হয়, আর এক শত হাত দূরেও নাই।

এই সময়ে গোবিন্দ বাবু চীৎকার করিয়া বলিলেন, রিভলবার, রিভলবার,-গুলি-গুলি কর।

আমরা কিছু না বুঝিয়াও সত্বর নিজ নিজ পকেট হইতে বিভ বার বাহির করিলাম। এই সময়ে ঝপ করিয়া কি একটা আমাদের নৌকার সম্মুখে জলে পড়িল।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, দেখছেন না, সেই আন্দামানী, মাঝির পিছনে দাড়িয়ে আমাদের দিকে তীর ছুড়ছে-ও সব বিষাক্ত তীর। ওতেই নরেন্দ্র বাবুর মৃত্যু হয়েছে। কাছে যাবার আগে আন্দামানীর হাত বন্ধ করতে না পারুলে, প্রাণ যাবে।

সৌভাগ্যের বিষয় নৌকা তখনও তত নিকটস্থ হয় নাই, নতুবা নিক্ষিপ্ত তীর নিশ্চয়ই আমাদের গায়ে লাগিত। এখনও দুই নৌকা পরস্পর হইতে যত দূর ছিল,তাহাতে আমাদের পিস্তলের গুলিও তাহার গায় লাগিবার সম্ভাবনা ছিল না।

আন্দামানীও তাহা বুঝিয়াছিল। সে তাহার তীর ধনুকে লাগাইয়া অপেক্ষা করিতেছিল। আমাদের কাহারও মুখে কোন কথা নাই, আমাদের হৃদয় সবলে স্পন্দিত হইতেছিল।

ক্রমে নৌকা আরও নিকটস্থ হইল। সাঁ করিয়া একটা তীর আমাদের পাশ দিয়া চলিয়া গেল; আমরা একেবারে রিভলবার ছুড়িলাম। আমাদের রিভারের আওয়াজের সঙ্গে এক পৈশাচিক বিকট চীৎকারে যমুনার বক্ষ প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিল।

আমরা দেখিলাম, আন্দামানী আহত হইয়াছে। সে দুই হতে নৌকার ছই ধরিবার চেষ্টা পাইল,—কিন্তু পারিল না; ঘুরিয়া যমুনার জলে পড়িয়া গেল।

পর মুহূর্তেই আমরা তথায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম; কিন্তু আন্দা মানীর কোন চিহ্ন দেখিতে পাইলাম না। তাহার দেহ গভীর জলে নিমগ্ন হইয়াছে।

এই সময়ে গোবিন্দ বাবু চীৎকার করিয়া বলিলেন, জোরে–জোরে—আরও জোরে। বেটা জহরতের সিন্দুক জলে ফেলে দিচ্ছে।

আমরা দেখিলাম, একটা লোক যথার্থই একটা সিন্দুক নৌকার ধারে টানিয়া আনিবার চেষ্টা করিতেছে। আমরা অগ্রসর হইবার পূৰ্বেই মহা শব্দে সেই সিন্দুক যমুনা গর্ভে পড়িল।..

গোবিন্দ বাবু বলিলেন একটু দাড় ছাড়। জায়গাটা ঠিক করে রাখি। পর মুহূর্তেই তিনি বলিলেন,না-না-হয়েছে। খুব জোরে বেয়ে যাও।

নৌকা আবার সবেগে ছুটিল। কিন্তু অপর নৌকার দাড়ী-মাঝি৷ ভয় পাইয়া নৌকা তীরের দিকে চালাইল। আমাদের নৌকাও তীর বেগে পশ্চাতে ছুটিল। তীরের নিকট আসিয়া দাড়ী-মাঝিরা লম্ফ দিয়া জলে পড়িল। আমরা নৌকা ধরিয়া ফেলিলাম।

সেই লোকটাও লাফাইয়া জলে পড়িল। তখন আমরা দেখিলাম, সত্য সত্যই তাহার এক পা কাঠের।

লম্ফ দিয়া তীরে পড়ায় তাহার সেই কাঠের পা কাদায় একেবারে বসিয়া গেল। সে প্রাণপণে কাদা হইতে পা টানিয়া বাহির করিবার চেষ্টা পাইতে লাগিল। তাহাতে তাহার পা আরও কাদায় বসিয়া গেল।

মহম্মদ সাহেব ও তাহার দুই ইনস্পেক্টর সত্বর গিয়া তাহার হাতে হাতকড়ী লাগাইয়া দিলেন। অন্যান্য কনেষ্টবল নৌকা বাঁধিয়া শীঘ্রই মঙ্গলু ও তাহার সহযাত্রীদের ধরিয়া হাতকড়ী লাগাইল।

আমরা সকলে পড়িয়া টানিতে টানিতে কাদা হইতে মুক্ত করিয়া এক-পেয়ে আবদুলকে তীরে তুলিলাম। সে বিকট হাস্য করিতে লাগিল। তাহার হাসিতে অন্যের কথা বলিতে পারি না, আমার হৃদয় কঁপিয়া উঠিল।

আমরা সকলেই বড় ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম। বসিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিলাম। গোবিন্দ বাবু পকেট হইতে কতকগুলা চুরুট বাহির করিয়া সকলকে এক-একটি দিলেন; তৎপরে আবদুলকেও একটা দিয়া বলিলেন,আবদুল, খাও। এত কষ্ট না দিলেই ভাল ছিল। সিন্দুকটা জলে ফেলে না দিলে তোমার পক্ষেও ভাল ছিল।

গোবিন্দ বাবুর মুখে তাহার নাম শুনিয়া আবদুল অত্যন্ত আশ্চৰ্য্যান্বিত হইল, বলিল, আপনি আমার নাম জানলেন কেমন করে?।

গোবিন্দ। তা না জানলে কি তোমার মত লোককে ধরা যায়। তোমার কথা সব জানি,কেবল জহরত কোথা হতে এসেছিল, তাই আনি না। সব কথা যদি সত্য বল,তবে তোমাকে ফাঁসী কাঠ থেকে বাঁচাব।

আবদুল। আমি সে বাবুকে খুন করি নাই। ঐ আন্দামানী টাঙ্গা তার তাঁর দিয়ে তাকে আগে মেরেছিল,–সেই আগে ঘরে গিয়ে দড়ী ধরে উপরে উঠে গিয়ে দেখি, বাবু মরে গেছে।

মহম্মদ। সেটাকে জেন্ত ধরতে পারলেই ঠিক হত।

গোবিন্দ। এখন নৌকা খুলে দাও ফিরে যেতে যেতে আবদুল তোমার ইতিহাস শুতে চাই। সত্য বলে, তোমার উপকার হবে, জানবে।

আবদুল। আর মিথ্যা বলে লাভ কি? সব খুলে বল্ব। আগে একটু চুরুট খাই।

গোবিন্দ। আহা, খাও-খাও, ঠাণ্ডা হও। অনেক কষ্ট দিয়েছ। আরও কিছু কষ্ট পেতে হবে জহরতের সিন্দুকটার জন্য।

আবদুল আবার হ হহ শব্দে হাসিয়া উঠিল। আমার সর্বাঙ্গ জ্বলিয়া গেল। আমি মনে মনে ভাবিলাম, এমন দুরাত্মা কি জগতে আর দ্বিতীয় আছে।

কিয়ৎক্ষণ পরে আবদুল বলিল, এ বেচারারা কিছু জানে না। পয়সা পেয়ে নৌকা ভাড়া দিয়েছিল। বাবু দেখবেন, এরা যেন আমার জন্য মারা না যায়।

আমি ভাবিলাম, এরূপ দুরাত্মার মনেও নীতি-জ্ঞান আছে।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন,  আমরা জানি। ওদের কিছু হবে না।

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ।

মঙ্গলুর নৌকা আমাদের নৌকার সঙ্গে বাঁধিয়া আমরা আগ্রার দিকে ফিরিলাম। চারিজন কনেষ্টবল দাঁড় টানিতে লাগিল। দুই জন মঙ্গলুদের পাহারায় রহিল। আবদুলকে আমরা চারিদিকে বেরিয়া বসিলাম। আবদুল বলিতে লাগিল;–

আমাদের চার জনের ফতেপুর শিখরিতে বাড়ী। ছেলে বেলা থেকেই আমরা দোস্ত। যাইহোক নসীবের দোষেই হক, আর গুনেই হক, আমরা ঠগীর দলে মিশে পড়ি। সে অনেক কথা,–সেসব বলার দরকার নাই, জহরতের কথাই বলি।

গোবিন্দ। হাঁ,–সে সব বোঝা গেছে। এখন এই জহরতের গল্পই বল।

আবদুল। কোন গতিকে আমরা শুনতে পাই যে, রামগড়ের নবাব তার উজীরকে অনেক টাকার জহরত দিয়ে মথুরার শেঠের কাছে পাঠিয়েছেন। এই সব জহরত বাধা রেখে তাঁর টাকা চাই।

মহম্মদ। শুনেছিলাম বটে, কিন্তু রামগড়ের নবাব জহরতের কথা অস্বীকার করেন।

আবদুল। তিনি খুব লুকিয়ে টাকা ধার করতে ইচ্ছা করেছিলেন। তাই তার বিশ্বাসী উজীর সামান্য সওদাগর সেজে কেবল একজন লোক নিয়ে আগ্রায় পৌঁছান। কেউ এ কথা জানতে পারে না। কোন গতিকে আমরা এ খবর পাই। জহরত খোয়া গেলে, তিনি কোম্পানীর ভয়ে সব কথা অস্বীকার করেন।

গোবিন্দ। তার পর।

আবদুল। তার পর এই খবর পেয়ে আমরা তাঁর সঙ্গ নিই; কিন্তু পথে কোনখানে কাজ হাসিল করতে পারি নাই। শেষে যখন তিনি আগ্রায় মসাফের-খানায় বাসা নিলেন, তখন সেখান থেকে যেতে দিলে কাজ হাসিল হবার আর সম্ভাবনা নাই ভেবে, আমরা চারজনে সাহসে ভর করে মাফের-খানায় গিয়ে সেই রাত্রেই তার গলা টিপে কাজ শেষ করে দিই। সঙ্গের লোকটাকে দেখতে পাই নাই। তাকে শেষ করতে পালে আমাদের আর কোন ভয় ছিল না।

মহম্মদ। তার পর।

আবদুল। সে লোকটা কোন গতিকে এই ব্যাপার দেখতে পায়। আমরা জহরতের সিন্দুক নিয়ে একেবারে সেইরাত্রেই ফতেপুর সিকরিতে এসে একটা ভাঙ্গা বড় বাড়ীর মধ্যে পুতে ফেলি। ফতেপুর সিকরিতে ত জানেন,কত বাড়ী ঘর দোর আছে। জায়গাটা পাছে মনে না থাকে বলে, সেই যায়গার চারখানা নক্সা করে আমরা চারজনের কাছে রাখি। চারজনের সাক্ষর সেই চারখানা কাগবেই ছিল। আমরা জানতে পারি নাই যে, সেই লোকটা আমারে দেখেছিল। আমাদের সঙ্গ নিয়েছিল। সে অন্ধকারে আমাদের সঙ্গে সনে এসে আমাদের বাড়ী দেখে যায়। পাছে, আমরা তাকে দেখতে পাই বলে, ভয়ে যেখানে আমরা জহরতের সিন্দুক পুতে রাখি তা দেখতে পায় নাই।

মহম্মদ। তার পর?

আবদুল। সেই বেটা তার পরদিন পুলিশে সব কথা বলে দেয়। দু দিন যেতে না-যেতে পুলিশ এসে আমাদের গ্রেপ্তার করে। আমরা হাজতে যাই। বিচারের সময়ে আমরা সমস্তই অস্বীকার করি। মোকদ্দমায় জহরতের কথাও উঠে,—কিন্তু সেই লোকের সঙ্গে যে অহত ছিল, তা কেউ বল্‌তে পারে না। এমন কি তার সঙ্গের লোকলও কিছু জাত না।

মহম্মদ। হাঁ, জানি বিচারে তোমাদের চার জনের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয়েছিল।

আবদুল। হাঁ,–আমরা চারজনে দ্বীপান্তরে যাই। কোন গতিকে মুখের মধ্যে করে নক্সা চারখানা আমরা চারজনে সঙ্গে নিই। অভ্যাস কলে গলার ভেতরেও অনেক জিনিষ রাখা যায়, তা ত জানেন।

মদ। খুব জানি।

আবদুল। আন্দামানে তিন-চার বৎসর থাবার পর আগ্রার ডাক্তার বাবু সেখানে যান। তিনি আমাদের জহরতের কথা সত্য কি না জিজ্ঞাসা করেন, আমাদের আর দেশে যাবার আশা নাই দেখে, আমরা সব কথা তাকে বলি। যদি তিনি টাকা খরচ করে বা যেমন করে হয় আমাদের খালাস করতে পারেন, তা হলে যেখানে জহরত আছে, তা বলে দিব, আর তাকে একটা ভাগও দিব স্বীকার করি। তিনি সেদিন আর কিছু বলেন না। কিন্তু তার পর তার বিশেষ বন্ধু কমিসরিয়েট বাবুকে নিয়ে এলেন। আমরা ছয়জনে অনেক পরামর্শ করলেম। তারা ভগবানের কাছে শপথ কলেন যে, জহরত বেচে টাকা নিয়ে যেমন করে হয় তারা আমাদের চারজনকে খালাস কবেন। তার পর যে টাকা থাকবে, তা আমরা ছয় জনে ভাগ করে কে। তারা দুজনই ছুটির দরখাস্ত কলেন। কিন্তু ডাক্তার বাবু সে সময়ে ছুটি পেলেন না। কমিসরিয়েট বাবু ছুটি পেলেন। আমরা একখানা নক্সা তাকে দিলাম। তিনি দেশে রওনা হলেন।

গোবিন্দ। তার পর। আবদুল। তার পর তার আর কোন খবর পেলাম না। তিনি ক্তার বাবুকেও কোন চিঠী লিখলেন না। ডাক্তার বাবু খবর পেলেন যে, তিনি দেশে ফিরেই বড় ব্যারামে পড়েছেন। আবার ছুটি নিয়েছেন। তখন ডাক্তার বাবু বলেন, বোধ হয়, তিনি ব্যারামে পড়ে জহরতের সন্ধান করুতে পারেন নাই। আমি এখন ছুটি পেয়েছি, আমি গিয়ে জহরতের তল্লাস করব। তিনি আমাদের খালাস করবার জন্য শপথ করায়, আমরা আর একখানা নক্সা তাকে দিলাম। তিনি দেশে গেলেন। কিন্তু মাসের পর মাস কেটে গেল, তবু তারও কোন সংবাদ পেলাম না। শুলাম, তিনি নাকি মরে গেছেন; কিন্তু আমাদের মনে বিশ্বাস হল যে, তারা আমাদের ফাকী দিয়েছেন। আমাদের খালাসের চেষ্টা না করে দুজনে জহরত বা করে নিয়েছেন। আমরা চারজনে শপথ করলেম, যদি কখনও দেশে যেতে পারি, এর প্রতিফল দিবই দিব।

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ।

আবদুল বলিল, এই রকমে আরও অনেক দিন কেটে গেল। এমন সময়ে এই আন্দামানী টাঙ্গাকে আমি বাঁচাই। আমি একটা ঔষধ জানতেম, টাঙ্গা জঙ্গলে পড়ে মৰূছে দেখে, আমি তাকে ঔষধ দিয়ে বাচাই। তখন তার সঙ্গে আন্দামান থেকে কোন গতিকে পালাবার পরামর্শ করতে থাকি। সে আমার জন্য প্রাণ দিতেও স্বীকার করে। তার একটা ভোঙায় চড়ে কিছু খাবার আর জল নিয়ে আমরা দুজনে আন্দামান হতে পালাই। অনেক কষ্ট শেষে দেশে পৌঁছাই, সে সব বলতে গেলে অনেক কথা।

গোবিন্দ। সে সকল কথা আমাদের এখন শশাবার দরকার নাই। এখন দেশে এসে কি করলে তাই বল।

আবদুল। দেশে এসে প্রথমেই ফতেপুর শিরিতে গেলাম,–কিন্তু দেখলাম জহরত নাই। কে আগেই নিয়ে গেছে। কার নিয়ে গেছে তা বুঝতে দেরী হল না। যেমন করে হয়, যে দুজনে আমাদের ফাকী দিয়েছে, তাদের রক্ত দেখতে হবে। সন্ধান নিয়ে জানলেম, ডাক্তার নিরুদ্দেশ হয়েছে,–তার কোন খবর নাই।

গোবিন্দ। তার পর?

আবদুল। তার পর কাশী গিয়ে কমিসরেট বাবুর সন্ধান নিলেম। গুনলেম, তিনি আগ্রায়। যেদিন তাঁর সন্ধানে আমি তার জানলায় উঁকি মারি, সেইদিনই তার মৃত্যু হয়। মুরদ পোড়াতে নিয়ে গেলে, আমি জহরতের সন্ধানে তার ঘরের ভিতর যাই। কোন সন্ধান না পেয়ে চারি সাক্ষর লিখে চলে আসি।

মহম্মদ। তার পর?

আবদুল। হাঁ,–তার পর তাঁর ছেলেদের ওপর নজর রাখি। জাতে, পাই তারাও তাদের বাপ কোথায় জহরত লুকিয়ে রেখে গেছে জানে না। নানা জায়গায় খুঁজছে। একদিন জানতে পারলেম, তারা জহরতের সিন্দুক খুঁজে পেয়েছে। দুই ভাইয়ে তাই নিয়ে ঝগড়া করে। এক ভাই আর এক জায়গায় চলে গেছে। যে ঘরে সিন্দুক আছে, তাও সন্ধান নিয়ে জানতে পারি। তখন সেই জহরতের সিন্দুক যে আমাদের যথার্থ হকের ধন তাই ঘটাবার চেষ্টায় থাকি।

গোবিন্দ। তার পর?

আবদুল। সব খবর নিয়ে টাঙ্গাকে ছাদ দিয়ে পাঠিয়ে দিই। সে জলী,বাঁদরের মত সবধানে উঠতে পারে, যেতে পারে। তাতে ছোট-বেঁটে বীর। আহা, সে আমাকে বড় ভালবাসত। আপ নারা তাকে গুলি করে অন্যায় করেছেন।

গোবিন্দ। না কলে সে তার সর্বনেশে তীর দিয়ে আমাদের প্রতিও বড় অন্যায় কত।

আবদুল। তা নিশ্চয়, সে তীর গায়ে লাগলে এক মিনিটও দেরী হয় না। এমন ভয়ানক বিষ মাখান তীর। টাঙ্গাই সে বিষের তীর তৈয়ারী করতে জাত।

মহম্মদ। হাঁ, তার পর? আবদুল।

আবদুল। আমি ভেবেছিলাম, অত রাত্রে সে ঘরে কেউ নাই। কিন্তু টাঙ্গা ছাদের উপরের ছোট ফাঁক দিয়ে ঘরে লোক দেখে অমনই তীর ছুঁড়ে। সে লাফিয়ে ঘরে পড়বার আগেই কমিসরিয়েট বাবুর ছেলে সরে যায়। আমি গিয়ে দেখি, একদম আড়ষ্ট হয়ে গেছে। আমি টাঙ্গাকে অনেক গালাগালি দিয়েছিলাম। ছেলের উপর আমার রাগ ছিল না,সে বেচারা কি জানে। বাপকে পেলে বোঝা যেত।

মহম্মদ। তার পর?

আবদুল। তার পর আমি দড়ী দিয়ে সিন্দুকটা নামিয়ে দিই, পরে দুজনে নীচে নেমে এসে বরাবর যমুনার ধারে আসি। মঙ্গলুর নৌক ভাড়া করে সরে পড়ি।

গোবিন্দ। হাঁ, তার পর পাছে পুলিশ নৌকার সন্ধানে যায় বলে মজলুর অসাক্ষাতে নৌকা বাচাল করে দিয়ে মেরামতের জন্য ডেঙায় তুললে?

আবদুল। আপনি এ সব কেমন করে জানলেন?

গোবিন্দ বাবু হাসিলেন।

আবদুল বলিল, এখন সব কথাই–আপনাদের বলেম। আর আন্দামানে যাবার ইচ্ছা নাই,—ফাঁসী হলে বড় বেখুশী হব। আর একটা চুরুট দিন। এটা শেষ হয়ে এসেছে।

গোবিন্দ বাবু তাহাকে আর একটা চুরুট দিলেন।

এদিকেও রাত্রিশেষ। এইরূপ সময়ে আমাদের নৌকা আসিয়া, আগ্রায় ঘাটে লাগিল। দারোগা সাহেব তাঁহার আসামী লইয়া কোতোয়ালীতে গেলেন। যাইবার সময় বলিলেন, জহরতের সিন্দুকটা, কাল থেকে তুলতেই হবে।–জায়গাটা ত মনে আছে, গোবিন্দ বাবু?

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, কতক কতক।

পুলিশ কর্মচারিগণ আসামী লইয়া প্রস্থান করিলে গোবিন্দ বাবু আমাকে বলিলেন, প্রতিভা ব্যস্ত হয়ে আছে,–আপনি গিয়ে তাকে, সব কথা বলে তবে বাসায় আসবেন। আমি সন্ধ্যার সময় তার সঙ্গে দেখা করব।

আমি প্রতিভাদের বাড়ীর দিকে চলিলাম। সে আমাদের প্রতীক্ষায় সর্বদাই উদগ্রীব থাকিত,–আমাকে দেখিয়া, ছুটিয়া বাহিরের ঘরে আসিল। আমি তাহাকে সকল কথা বললাম। সে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় সব শুনিল। পরে আমি বিদায় হইবার জন্য উঠিয়া বলিলাম, তোমার সঙ্গে বোধ হয়, এই শেষ দেখা,-আর দেখা হবে কি না কে বলতে পারে?

প্রতিভা চকিতে আমার দিকে চাহিয়া বলিল কেন?

আমি। দেশে যাব মনে করেছি। আমি চলে গেলে আমার কথা কি তোমার মনে থাকবে,– তুমি কি একটু দুঃখিত হবে?

প্রতিভা মস্তক অবনত করিয়া বলিল, হব?

আমি কি বলিলাম জানি না,–বোধ হয়, বলিয়া ফেলিয়াছিলাম, তবে সঙ্গে চল না কেন? প্রতিভা কি বলিল, স্মরণ নাই, বোধ হয়, কিছুই বলে নাই। কিন্তু দেখিয়াছিলাম,-সহসা তাহার কপোলযুগ রক্তাভ হইয়া উঠিয়া এক অদৃষ্টপূৰ্ব কোন সৌন্দর্য্যে তাহার মুখখানি ভরিয়া উঠিয়াছিল। আর তখন আমি কম্পিত হস্তে তাহার মৃণালভূল্য হাত দুখানি ধরিয়া তাহার সেই আরজ মুখখানি চুম্বন করিয়াছিলাম। সে লজ্জায় আমার হাত ছাড়াইয়া এক নিমেষে ছুটিয়া, পালাইয়াছিল। সহসা আমার স্বপ্ন ভাঙিয়া গেল—সে ঘর হইতে বাহির হইয়া আমি আচাৰ্য মহাশয়ের সহিত দেখা করিলাম।

উপসংহার।

পরদিবস সন্ধ্যার সময় গোবিন্দ বাবু আমাকে বলিলেন, ডাক্তার বাবু, কথাটা ফল্‌ল ত?

আমি বুঝিয়া ও-না বুঝিয়া বলিলাম, কি ফলবে?

গোবিন্দ বাবু হাসিয়া বলিলেন, ভবিতব্যি,-ভবিতব্যি।

আমি বলিলাম, আমি কিছুই বুঝতে পাছি না।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, তা পাবেন কেন? তবে মনে মনে যে না পারছেন–তা নয়। বৃথা চেষ্টা ডাক্তার-আমার কাছে কিছু গোপন করতে পারবেন না। আপনি গোপন করার চেষ্টা করছেন, কিন্তু আপনারই মুখ চোখের ভাব আপনার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করছে। তিনি একটু নীরবে থাকিয়া বলিলেন, যা হক–আমি আচাৰ্য মশায়ের কাছে সব শুনেছি। প্রতিভা যখন রত্ন, আমি আপনাকে কনগ্রাচুলেট করি। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, আপনারা দুজনে চিরসুখে সুখী হন। আর আমি আমার সেতার আর তামাক চুরুট নিয়ে মহা আনন্দে বাকী দিনগুলো কাটিয়ে দিই।

আমি। আপনি সব শুনেছেন। আমি আপনাকে বলব মনে করছিলাম।

গোবিন্দ। এতে আর লজ্জা কি? আপনি ত আর ছোট নন।

Exit mobile version