ওর ঘুম ভাঙাতে আমার মন চাইল না। ও এত নিশ্চিন্তে, শান্তিতে ঘুমুচ্চিল যে দেখতে বেশ লাগছিল। বহুক্ষণ ধরে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম। তারপর উঠে বসে আরো ভাল করে দেখলাম। ওর সর্বাঙ্গের পর দিয়ে বার বার চোখ বুলিয়ে নিলাম। একটু হয়ত হাত বুলিয়ে দিয়েছিলাম ওর গায়।
মনে মনে কত কি ভাবলাম। ভাবলাম, এই মেমসাহেব। এই আমার জীবন-নাট্যের নায়িকা। এই সেই চপলা, চঞ্চল বালা যে আমার জীবন ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়েছে? এই সেই শিল্পী যে আমার জীবনে সুর দিয়েছে, চোখে স্বপ্ন দিয়েছে। ভাবলাম, এই সেই, মেয়ে যে আমার জীবনে না এলে আমি কোথায় সবার অলক্ষ্যে হারিয়ে যেতাম, শুকনো পাতার মত কালবৈশাখীর মাতাল হাওয়ায় অজানা ভবিষ্যতের কোলে চিরকালের জন্য লুকিয়ে পড়তাম?
ভাবতে ভাবতে ভারী ভাল লাগল। ওর কপালের পর থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে একটু আদর করলাম।
মেমসাহেব কান্ত হয়ে শুয়েছিল। ওর দীর্ঘ মোটা বিনুনিট কঁধের পাশ, বুকের পর দিয়ে এসে বিছানায় লুটিয়ে পড়েছিল। আমি মুগ্ধ হয়ে আরো অনেকক্ষণ চেয়ে রইলাম। ওর ছন্দোবন্ধ দেহের চড়াই-উতরাই দেখে যেন মনে হলো প্ৰাক্সিটলীসএর ভেনাস বা সাঁচীর যক্ষী টর্সো! নাকি খাজুরাহো’র নায়িকা, অজন্তায় মারকন্যা!
মনে পড়ল ঈতার প্রতি মিলটনের কথা-O fairest of creation last and best, of all God’s works’
ঈভার মত মেমসাহেব নিশ্চয়ই অত সুন্দরী ছিল না কিন্তু আমার চোখে আমার মনে সে তো অনন্যা। আমার শ্যামা মেমসাহেবকে মুগ্ধ হয়ে দেখলাম অনেকক্ষণ। ভাবলাম বাইবেলের মতে তো নারীই ভগবানের শেষ কীর্তি, শ্ৰেষ্ঠ কীর্তি। কিন্তু সবাই কি মেমসাহেব হয়? দেহের এই মাধুৰ্য, চোখে এমনি স্বপ্ন, চরিত্রে এই দৃঢ়তা, মনের এই প্ৰসারতা তো আর কোথাও পেলাম না।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও যেন ও আমাকে ইশারা করল। মনে হলো যেন ডাক দিল ওগো, কাছে এসো না, দূরে কেন? তুমি কি আমাকে তোমার বুকের মধ্যে তুলে নেবে না?
আমি হাসলাম। মনে মনে বললাম, পোড়ামুখী তুই তো জানিস না, তোকে বেশী আদর করতেও আমার ভয় হয়। তোকে বেশীক্ষণ বুকের মধ্যে ধরে রাখলে জ্বালা করে, ভয় ধরে।
ভয়?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ভয়। ভয় হবে না? যদি কোনদিন কোন কারণে কোন দৈবদুর্বিপাকে আমার বুকটা খালি হয়ে যায়? তখন?
ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই মেমসাহেব ওর ডান হাতটা আমার কোলের ’পর ফেলে একটু জড়িয়ে ধরবার চেষ্টা করল। যেন বলল, না গো, না, আমি তোমাকে ছেড়ে কোত্থাও যাব না।
আমি মেমসাহেবকে একটু কাছে টেনে নিলাম, একটু আদর করলাম।
ঐ সকালবেলার মিষ্টি সূর্যের আলোয় মেমসাহেবকে আদর করে বড় ভাল লাগল। কিন্তু আনন্দেয় ঐ পরম মুহুর্তেও একবার মনে হলো, সন্ধ্যায় তো সূৰ্য অস্ত যায়, পৃথিবীতে তো অন্ধকার নেমে আসে।
জান দোলাবৌদি, ঐ হতচ্ছাড়ী মেয়েটাকে যখনই বেশী করে কাছে পেয়েছি তখনই আমার মনের মধ্যে ভয় করত। কেন করত তা জানি না কিন্তু আজ মনে হয়–
থাকগে। ওসব কথা বলতে শুরু করলে আবার সব কিছু গুলিয়ে যাবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাকে আমার মেমসাহেবের কাহিনী শোনাতে হবে। সময় ঝড়ের বেগে এগিয়ে চলেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা শুভলগ্নে আমাকে তো তোমার পাত্রীস্থ করতে হবে। তাই না? তাছাড়া আমারও তো বয়স বাড়ছে। বয়স বেশী হয়ে গেলে কি আমার কপালে কিছু জুটবে?
ঐ অরণ্য-পৰ্বত-লেকের ধারের রাজপ্রাসাদে দুটি দিন, দুটি রাত্রি স্বপ্ন দেখে আমরা আবার দিল্লী ফিরে এলাম। ফিরে এলাম ঠিকই কিন্তু যে মেমসাহেব। আর আমি গিয়েছিলাম। সেই আমরা ফিরে এলাম না। ফিরে এলাম সম্পূর্ণ নতুন হয়ে।
দিল্লীতে ফিরে এসে মেমসাহেব একটি মুহুৰ্তও নষ্ট করে নি। সংসার পাতার কাজে মেতেছিল। একটা স্কুটার রিক্সা নিয়ে দুজনে মিলে দিল্লীর পাড়ায় পাড়ায় ঘুরেছিলাম ভবিষ্যতের আস্তান পছন্দ করবার আশায়। ৰুরোলবাগ, ওয়েস্টার্ন এক্সটেনশন, নিউ রাজেন্দ্রনগর, ইস্ট প্যাটেল নগর থেকে দক্ষিণে নিজামুদ্দীন, জংপুর, ডিফেন্স, সাউথ একসটেনশন, কৈলাস, হাউসখাস, গ্ৰীনপার্ক পর্যন্ত ঘুরেছিলাম। সব দেখেশুনে ও বলেছিল, গ্ৰীনাপার্কেই একটা ছোট্ট কটেজ নেব। আমরা।
এত জায়গা থাকতে গ্রানিপার্ক?
শহর থেকে বেশ একটু দূরে আর বেশ ফাঁকা ফাঁকা আছে।
বড্ড দুর।
তা, হোক। তবুও থেকে শান্তি পাওয়া যাবে।
তা ঠিক।
পরে আবার বলেছিল, দুতিন মাসের মধ্যেই বাড়ি ঠিক করবে। তারপর একটু গোছগাছ করে নিয়েই আমরা সংসার পাতব।
হাত দিয়ে আমার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে মেমসাহেব জিজ্ঞাসা করল, কেমন? তোমার আপত্তি নেই তো?
আমি মাথা নেড়ে বলেছিলাম, না।
আরো দু’চারটি কি যেন কথাবার্তা বলার পর ও আমার গলাটা জড়িয়ে ধরে বলল, দেখ না, বিয়ের পর তোমাকে কেমন জব্দ করি।
কি জব্দ করবে? আজেবাজে খাওয়া-দাওয়া ফালতু আডা দেওয়া সব বন্ধ করে দেব।
তাই বুঝি?
তবে কি?
এবার আমিও একটা হাত দিয়ে ওর গলাটা জড়িয়ে ধরে বললাম, আর কি করবে মেমসাহেব?
আধো আধো গলায় উত্তর দিল, সব কথা বলব কেন?
তাই বুঝি?
তবে কি? বাট ইউ উইল সী আই উইল মেক ইউ হ্যাপি।
তা আমি জানি। তবে মাঝে মাঝে আমার ভয় হয়।
কি ভয় হয়?
আমি ওর কানে কানে ফিসফিস করে বললাম, আমি বোধহয় স্ত্রৈণ হবো!
মেমসাহেব আমাকে একটা ধাক্কা দিয়ে বললে, বাজে বকো না।