Site icon BnBoi.Com

ব্যাচেলার – নিমাই ভট্টাচার্য

ব্যাচেলার - নিমাই ভট্টাচার্য

০১. অক্সফোর্ড স্ট্রিটে কিছু কেনাকাটা

অক্সফোর্ড স্ট্রিটে কিছু কেনাকাটা করে রাস্তা পার হয়ে বন্ড স্ট্রিট টিউব স্টেশনে ঢুকতে গিয়েই মুখোমুখি দেখা। দুজনেই প্রায় একসঙ্গে বললাম, আপনি?

দেবব্রত হাসতে হাসতে বললো, আমি তো বহুদিনই এখানে। আপনি কবে এলেন?

প্রায় দুসপ্তাহ হতে চললো। এবার তো ফেরার পালা।

সে কি? এত তাড়াতাড়ি কোথায় যাবেন?

ফেরার পথে কয়েক জায়গায় স্টপওভার করব বলে পরশুই রওনা হচ্ছি।

অজস্র যাত্রী আসা-যাওয়া করছেন। দেবব্রত আমার হাত ধরে একটু পাশে সরে গিয়ে বললো, পরশু যাওয়া হচ্ছে না।

একটু আগেই রিজার্ভেশন করে এলাম।

দ্যাটস নাথিং। ক্যানসেল করে দিলেই হবে। তারপর হাসতে হাসতে বললো, এতকাল পরে দেখা হলো আর আমার হাতের রান্না না খাইয়েই ছাড়ব?

আমি বললাম, খেলে রঞ্জনার হাতের রান্নাই খাব।

রঞ্জনা তো এখানে আসেনি। ও দিল্লিতেই…

তাই নাকি?

হ্যাঁ।

আমার হাতে টুকিটাকি কয়েকটা প্যাকেট। তাছাড়া বন্ড স্ট্রিট-টিউব স্টেশনে দাঁড়িয়ে কথা বলাও অসম্ভব। দেবব্রত জিজ্ঞাসা করল, কোথায় যাচ্ছেন?

হোটেলে।

কোনো হোটেলে? সেই স্ট্রান্ড…

হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলাম, হোটেলে আসবেন?

আপনি থাকবেন?

থাকব। আজ আর কোথাও বেরুচ্ছি না।

দেবব্রত হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল, সেকি? লন্ডনে এসে সন্ধেবেলা হোটেলে শুয়ে কাটাবেন?

কি করব? কদিন এত পরিশ্রম করতে হয়েছে যে আজ আর একটু রেস্টনা নিয়ে পারছি না।

কোনো পুরনো বন্ধুর বাড়ি নেমন্তন্ন নেই?

ছিল কিন্তু তাকে বললাম কাল যাব।

কিন্তু আমি এলে তো আপনার বিশ্রাম হবে না।

হাসতে হাসতে বললাম, পরিশ্রমও হবে না।

দেন আই অ্যাম কামিং। এই ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই আসছি।

আসুন। গল্প করা যাবে।

আমি তর তর করে নিচে নেমে গেলাম। দেবব্রত অক্সফোর্ড স্ট্রিটের ভিড়ে মিশে গেল।

.

ঠিক পনের বছর আগেকার কথা। নেহরুর সঙ্গে কমনওয়েলথ প্রাইম মিনিস্টার্স কনফারেন্স কভার করতে এসেছি লন্ডনে। তাছাড়া প্রথমবার লন্ডন দেখছি। বেশ চঞ্চল। প্রায় উত্তেজিত। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মার্লবোরা হাউসেই কাটাই। মাঝে মাঝে সময় পেলেই রাস্তার ওপাশে গিয়ে সেন্ট জেমস প্যালেসের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাই আর মনে মনে ইংল্যান্ডের ইতিহাসের কয়েকটা পাতা উল্টে যাই। ইংল্যান্ডের ইতিহাসের কত অবিস্মরণীয় চরিত্র এখানে বাস করেছেন। সপ্তম হেনরি, ষষ্ঠ এডওয়ার্ড, এলিজাবেথ, মেরী। প্রথম চার্লস ফঁসির মঞ্চে চড়ার আগে এই সেন্ট জেমস প্যালেসের চার্চেই মহামতি যীশুর নাম স্মরণ করে ঈশ্বরের কাছে তার শেষ প্রার্থনা জানিয়েছিলেন। আমাদের কোহিনূর মাথায় নিয়ে এখানেই শপথ নিয়েছে সপ্তম এডওয়ার্ড, পঞ্চম জর্জ, ষষ্ঠ ও আজকের রানী এলিজাবেথ দ্য সেকেন্ড। এই সেন্ট জেমস প্যালেসের এক ব্যালকনি থেকেই রাজার মৃত্যু সংবাদ প্রথম ঘোষণা করা হয়, দ্য কিং ইজ ডেড! লং লিভ দ্য কিং! এখনও অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রদূতদের পরিচয় পত্রে লেখা থাকে অ্যাম্বাসেডর টু দ্য কোর্ট অব সেন্ট জেমস! অথবা অন্য কোনো জার্নালিস্টের সঙ্গে গল্প করি। একটু বেশি সময় পেলে ল্যাংকাস্টার হাউস পেরিয়ে বাকিংহাম প্যালেসের আশেপাশে অহেতুক ঘোরাফেরা করি। বাকিংহাম প্যালেসের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকি কিন্তু যতটা ভালো লাগবে আশা করেছিলাম, তা লাগে না। সেন্ট জেমস প্যালেস, মার্লবোরা হাউস বা অন্যান্য রাজপ্রাসাদের মতো বাকিংহাম প্যালেস দেখে ইতিহাস মনে পড়ে না; তবে সামনের ভিক্টোরিয়ার পাথরের মূর্তিটা দেখতে ভালো লাগে। ইতিহাসের অনেক স্মৃতি হঠাৎ জীবন্ত হয়ে ওঠে। প্রথমবার বিলেত দেখতে এসে সব কিছুর সঙ্গে ইতিহাস আর মনের ছবি মিলিয়ে নিতে গিয়ে কোথাও ভালো লাগে, কোথাও দুঃখ পাই। বিকেলে নিউজ পাঠাবার পরই হোটেলে আসি। স্নান করি। কালো স্যুট-টাই পরে আবার বেরিয়ে পড়ি। রিসেপসন, কটেল, ডিনার। রোজই কিছু না কিছু থাকে। শুরু হয়েছে ব্রিটিশ প্রাইম মিনিস্টারের প্রেস রিসেপসন দিয়ে। কমনওয়েলথ প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পরই সাংবাদিকদের সম্মানে ব্রিটিশ প্রাইম মিনিস্টারের পার্টি। মার্লবোরা হাউসের পিছনের গার্ডেনের প্রবেশ পথে স্বয়ং প্রাইম মিনিস্টার নিজ হাতে তুলে দেন ড্রিঙ্ক। হুইস্কি, জিন, ব্রান্ডি, বিয়ার। তারপর কোনোদিন অস্ট্রেলিয়া হাউসে আর ঘানা হাইকমিশনে, কোনোদিন স্যাভয় বা ক্লারিজ হোটেলে। অথবা কেনসিংটন গার্ডেনে ইন্ডিয়ান হাইকমিশনারের বাড়িতে স্কচের গেলাস হাতে নিয়ে কাশ্মীরী কার্পেট বা ইন্দ্রাণী রহমানের ওডিসি নাচের আলোচনা থেকে আয়ুব সিকিউরিটি কাউন্সিল ডিঙিয়ে একেবারে ভারতীয় সমাজতন্ত্রে পৌঁছে দিয়েছেন আমাদের ডিপ্লোম্যাটরা। এসব শেষ হলেও ছুটি পাই না। কোনো না কোনো আড়ডায় আটকে পড়ি। তারপর হোটেলের রিসেপসনে এসে ঘরের চাবির জন্য হাত বাড়িয়ে সামনের বড় ঘড়িটার দিকে নজর পড়ে। দু চার পেগ হুইস্কি পেটে থাকলেও চমকে উঠি। দুটো! আড়াইটে!

ছটা দিন এভাবেই কেটে গেল। পরের দিন সকালে ইন্ডিয়ান হাই কমিশনারের বাড়িতে মস্কো বন প্যারিসের ইন্ডিয়ান অ্যাম্বাসেডরদের সঙ্গে নেহরু ঘন্টা দুই আলাপ-আলোচনা করলেন। তারপর প্রবাসী কয়েকজন ভারতীয়দের সঙ্গে তাদের নানা সমস্যা নিয়ে কিছুক্ষণ কথাবার্তা হলো। প্রাইম মিনিস্টারের সম্মানে ইন্ডিয়ান হাইকমিশনারের লাঞ্চের সময় নেহরু নিজেই কয়েকজন সাংবাদিকের কাছে এসে বললেন, ডু ইউ নো আই উইল বী মিটিং আওয়ার স্টুডেন্টস অ্যাট ফোর-পাঁচটায় নয়।

প্রাইম মিনিস্টারের প্রোগ্রাম চেঞ্জ হওয়ায় আমরা সবাই উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, হোয়াই দিস চেঞ্জ, স্যার?

নেহরু হাসতে হাসতে বললেন, ভয় নেই, নট সাইনিং এনি এগ্রিমেন্ট উইথ পাকিস্তান অ্যাবাউট কাশ্মীর।

আমরাও হাসলাম।

নেহরু এবার বললেন, কিছু বন্ধুবান্ধব দেখা করতে আসবেন বলেই পাঁচটার বদলে চারটার সময় স্টুডেন্টদের সঙ্গে মীট করব।

পনের বছর আগেকার কথা হলেও আমার সব কিছু স্পষ্ট মনে আছে। ভারি মজা হয়েছিল ঐ মিটিং-এ।

প্রথমে নেহরু একটা ছোট্ট বক্তৃতা দিলেন। কিছু উপদেশ। শেষে একটি অনুরোধ, তোমাদের অনেকেরই জ্ঞান, বুদ্ধি দেশের কাজে নিয়োজিত হলে ভারতবর্ষের অসংখ্য মানুষের কল্যাণ হবে। নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের একটু ক্ষতি স্বীকার করেও দেশে ফিরে যেতে অনুরোধ করব।

এরপর শুরু হলো ছাত্রদের প্রশ্ন, নেহরুর উত্তর। নানা বিষয়ে নানা প্রশ্ন। দু চারজন ছাত্রছাত্রী অভিযোগ করলেন, অনেকেই দেশে গিয়ে চাকরি না পেয়ে ফিরে এসেছেন।

নেহরু বললেন, সবাইকে চাকরি দেবার ক্ষমতা আমাদের নেই। তবে ইন্ডিয়া ইজ ভেরি ফাস্ট ডেভলপিং ইন্টু এ মডার্ন নেশন এবং সেজন্য সায়েন্স অ্যান্ড টেকনলজির ছাত্রদের আমাদের বেশি দরকার।

সঙ্গে সঙ্গে একটি ছাত্র উঠে দাঁড়িয়ে বললো, মিঃ প্রাইম মিনিস্টার, একটি প্রশ্ন করতে পারি?

নেহরু হাসতে হাসতে জবাব দিলেন, ইয়েস, মিঃ ইয়াংম্যান।

স্যার, আমি ইলেকট্রনিসের পোস্ট গ্রাজুয়েট কোর্স পড়ছি কিন্তু আমাদের দেশে ইলেকট্রনিক্‌সের বিশেষ উন্নতি হয়নি বলে আমরা অনেকেই বেশ চিন্তিত।

নেহরু সঙ্গে সঙ্গে বললেন, তোমরা চাকরি পাবেই কিন্তু বাইচান্স যদি না পাও তাহলে আই উইল অ্যাপয়েন্ট ইউ অ্যাজ মাই ইলেকট্রনিক্স অ্যাডভাইসার।

সবাই হো হো করে হেসে উঠলেন। হাসি থামার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রটি আবার উঠে দাঁড়িয়ে বললো, আই অ্যাম সিওর ইউ উইল নট প্রমোট মী টু বী মিনিস্টার অব ইলেকট্রনিক্স।

আবার হাসি।

হাসতে হাসতেই নেহরু জবাব দিলেন, ভুল করে তোমাকে মন্ত্রী করলেও আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি প্রথম সুযোগেই তোমাকে ড্রপ করব।

হাসিতে ফেটে পড়লেন সবাই।

আরো কত জনের কত রকমের প্রশ্ন! লন্ডনের আবহাওয়াই এমন যে কেউই কিছু মনে করেন না।

স্যার, দেশে ফিরে যাবার সময় যদি বিদেশিনী স্ত্রীকে নিয়ে যাই?

চেয়ারে নয়, টেবিলের উপর বসে হাসতে হাসতে প্রাইম মিনিস্টার বললেন, যদি কেন, নিশ্চয়ই নিয়ে যাবে কিন্তু সঙ্গে কিছু ফরেন এক্সচেঞ্জ আর স্কচের বোতল নিয়ে যেতে ভুল না। ইন্ডিয়াতে ও দুটোরই বড় অভাব।

হাসি।

স্যার! দশ বছর এখানে থাকার পর দেশে ফিরে গেলে সব শহরই নোংরা মনে হবে। আমাদের শহরগুলোর কি উন্নতি করা যায় না?

আমি সব কিছু করে গেলে তুমি প্রাইম মিনিস্টার হয়ে কি করবে?

হাসি।

স্যার। চিৎকার করল একটা ছেলে, ডু ইউ থিংক উই উইল গেট ব্যাক অকুপায়েড ক্যাশমীর?

ফিরে না পেলে ফিরিয়ে নেব।

সভার শেষে ছাত্রছাত্রীরা অটোগ্রাফের খাতা নিয়ে প্রাইম মিনিস্টারকে ঘিরে ধরলেন। অটোগ্রাফ দিতে দিতে নেহরু টুকটাক ঠাট্টা করতে করতে হঠাৎ ইন্ডিয়ান হাই-কমিশনারের দিকে ফিরে বললেন, ক্যান ইউ ফাইন্ড আউট মাই ইলেকট্রনিক্স মিনিস্টার?

পনের বছর আগেকার কথা হলেও আমার সব কিছু মনে আছে। কিছু ভুলিনি। হাই কমিশনার নিজে খোঁজখবর করে ছেলেটিকে ভিড়ের মধ্যে থেকে নিয়ে এলেন প্রাইম মিনিস্টারের সামনে। প্রাইম মিনিস্টার ওর সঙ্গে দুটো-একটা কথা বলতে বলতে এগুতে গিয়ে সামনে কয়েকজন ফটোগ্রাফারকে দেখে বললেন, তোমাদের ক্যামেরায় কি ফিল্ম নেই যে, আমার ইলেকট্রনিক্স মিনিস্টারের সঙ্গেও আমার একটা ছবি তুলছ না?

পরের দিন লন্ডনের বহু মর্নিং পেপারেই এই ছবিটা ছাপা হয়েছিল। দিল্লিতে ফিরে আসার পর দেখেছিলাম, জেনেছিলাম ভারতবর্ষের নানা কাগজেও এই ছবি ছাপা হয়েছে।

.

দেবব্রত চৌধুরীকে সেই প্রথম দেখি কিন্তু সেদিন আলাপ হয়নি। সুযোগ হয়নি। তাছাড়া হাতে সময় ছিল না।

পরের দিন নেহরু দিল্লির পথে কায়রো রওনা হলেন। আমি গেলাম না, থেকে গেলাম। তিন চার দিন পরে এক সাংবাদিক বন্ধুর বাড়ি থেকে ফেরার পথে হোবর্ন টিউব স্টেশনে দেবব্রত চৌধুরীর সঙ্গে আমার দেখা। প্রথম সাক্ষাৎ পরিচয়। নেহরুর ঐ মিটিং-এ দূর থেকে ভালো লেগেছিল, সাক্ষাৎ পরিচয়ে আরো অনেক বেশি ভালো লাগল।

উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, লন্ডনে কতদিন থাকবেন?

বললাম, ইচ্ছে আছে আরো দিন পনের থাকার, তবে আগেও ফিরে যেতে পারি।

না না, আগে ফিরে যাবেন কেন? এত দূর দেশে এসে তাড়াতাড়ি ফিরে যাবার কোনো মানে হয় না।

তা ঠিক কিন্তু চাকরি আছে যে।

দেবব্রত চৌধুরী হাসতে হাসতে বললেন, জার্নালিজমের মতো সুখের চাকরি আছে নাকি?

আমি হাসলাম। টিউব স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে বেশি তর্ক করা যায় না। আমি স্ট্রান্ড কন্টিনেন্টালে আছি। কাল বিকেলের দিকে আসুন গল্পগুজব করার পরে নিচের তলার ইন্ডিয়া ক্লাবের রেস্টুরেন্টে একসঙ্গে মাছ-ভাত খাওয়া যাবে।

প্রত্যাখ্যান করতে পারলেন না আমার আমন্ত্রণ। আচ্ছা আসব।

আমি বললাম, গুড নাইট।

গুড নাইট।

.

নোট বই-পেন্সিল আর টাইপ রাইটার নিয়ে ঘুরছে কত শহর-নগর গ্রাম-গঞ্জ। ঘুরছি স্বদেশে বিদেশে। দেখছি কত মানুষ, মিশছি বহুজনের সঙ্গে। কাউকে ভালো লাগে, কাউকে লাগে না। টাইপ রাইটার খটখট করে নিউজ টাইপ করার সঙ্গে সঙ্গেই ভুলে যাই অধিকাংশ মানুষকে। সামান্য মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের স্মৃতি একটু বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয় কিন্তু তারপর ভুলে যাই। মুছে যায় সব স্মৃতি। হঠাৎ কদাচিৎকখনও দু-একজনের দেখা পাই যারা আকর্ষণ করে, মুগ্ধ করে। নেহরুর মিটিং-এ ওই কয়েক মিনিটের মধ্যেই দেবব্রত চৌধুরী আমাকে মুগ্ধ করেছিল। অনেক ছেলে-মেয়ের বুদ্ধি থাকে, চালাক হয়, স্মার্ট হয় কিন্তু সব কিছু মিলিয়ে একটা মাধুর্য? আপন বৈশিষ্ট্য? বড় কম। সর্বত্রই। বিশেষ করে লন্ডন প্রবাসী ভারতীয় ছেলেমেয়েদের মধ্যে আরো কম।

.

টেলিফোনের বেল বাজতেই রিসিভার তুলোম। রিসেপসন থেকে মেয়েটি বললল, স্যার, মিঃ চাউডারী ইজ হিয়ার।

ডু প্লীজ সেন্ড হিম টু মাই রুম।

একটু পরেই দরজায় নক করার আওয়াজ হলো। দরজা খুলেই বললাম, আসুন, আসুন।

দেবব্রত ঘরে না ঢুকেই বললো, আমাকে তুমি বলাটাই বোধহয় বেশি সমীচীন হবে, তাই না?

আগে ভিতরে আসুন। তারপর…

ঘরে যখন ডাকছেন তখন ঘরের মতো করে নেওয়াই কি ঠিক নয়?

ইলেকট্রনিক্স ছাড়াও আপনি কি টেম্পলস ইন-এ ব্যারিস্টারি পড়ছেন?

দেবব্রত আস্তে আস্তে ঘরের মধ্যে ঢুকতে ঢুকতে বললো, ইন ফ্যাকট, দাদা আমাকে ব্যারিস্টার করতেই চেয়েছিলেন।

ইলেকট্রনিক্স পড়ছে কি বাবার অনুরোধে নাকি নিজের ইচ্ছায়?

আমার বাবা নেই। আমার খুব ছেলেবেলায় উনি মারা যান।

কথাটা শুনেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আর কোনো প্রশ্ন করার ইচ্ছা ছিল না কিন্তু হঠাৎ মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, মা আছে তো?

না, তিনিও নেই।

দেবব্রত অত্যন্ত সহজভাবে বললেও আমার মুখ থেকে হাসির শেষ রেশটুকুও উবে গেল। মিনিটখানেক বোধহয় মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়েছিলাম। তারপর আলতো করে ওর একটা হাত ধরে খুব নিচু গলায় বললাম, বসুন।

দু-চার মিনিট দুজনেই চুপ করে বসে রইলাম। তারপর দেবব্রতই প্রথম কথা বললো, বাবা মা না থাকা নিঃসন্দেহে দুঃখের কিন্তু দাদা আমার সব অভাব দুঃখ ভুলিয়ে দেন।

দাদা বুঝি আপনাকে খুব ভালোবাসেন?

দেবব্রত হাসল। ভালোবাসেন বললেই দাদার ভালোবাসা বোঝান যায় না। আমার দাদার মতো দাদা বোধহয় আর কেউ পায়নি, পাবে না। উনি আবার মুখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বললেন, হি ইজ সিম্পলি ইউনিক।

দাদার কথা বলতে বলতে ওর সারা মখখানা আনন্দে, গর্বে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বাবা-মা নেই বলে সামান্যতম দুঃখের চিহ্ন সে মুখে দেখলাম না। একটু বিস্মিত হলাম। চন্দ্র-সূর্যের মতো বাবা মার অভাব নাকি অপূরণীয়। এতকাল এই কথাই শুনে এসেছি, জেনে এসেছি কিন্তু আজ দেবব্রতকে দেখে বুঝলাম, না তা নয়। হিমালয়ের বুক চিরে গঙ্গা বেরিয়ে এসেছে। তার দুধারে অসংখ্য দেবদেবীর মন্দির, তীর্থক্ষেত্র। সে চির পবিত্র। সুখে-দুখে আনন্দ-উৎসবে জীবনে-মরণে গঙ্গার অনন্য ভূমিকা অনস্বীকার্য কিন্তু গোদাবরী কাবেরী, নর্মদা-সিন্ধুও কম পবিত্র নয়। ওদের, দুধারেও অসংখ্য বিগ্রহের মন্দির আছে, আছে তীর্থক্ষেত্র।

গঙ্গা তীরে বাস করতে করতে আমরা অনেকেই ভুলে যাই গোদাবরী কাবেরী নর্মদা-সিন্ধুও সমানভাবে পবিত্র কিন্তু একথা জানতে হলে…

আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে দেবব্রত বললে, গোদাবরী কাবেরীর দেখা পাওয়া চাই।

হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন কিন্তু সবাই তো দেখা পায় না।

ঠিক, কিন্তু আমি পেয়েছি। গোদাবরী কাবেরী নয়, মানস সরোবর পেয়েছি।

হঠাৎ অবিশ্বাস্য মনে হলো, বলেন কি?

বিলিভ মী, আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না।

শুনেছি, পড়েছি ভগবতী দেবীকে পেয়েছিলেন বলে বিদ্যাসাগর মশাইকে কোনো বিগ্রহের পূজা করতে হয়নি। দেবব্রত কি বিদ্যাসাগরের মতোই ভাগ্যবান?

সিগারেটের প্যাকেটটা এগিয়ে বললাম, নিন।

থ্যাঙ্কস। আমি সিগারেট খাই না।

তাহলে হোয়াট ক্যান আই অফার ইউ?

কিছু দরকার নেই।

খেতে যাবার তো এখনও অনেক দেরি।

বেশ তো গল্প করছি। আমার কিছু লাগবে না।

ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড আই ক্যান অফার ইউ এ ড্রিঙ্ক।

আপনি ব্যস্ত হচ্ছেন কেন?

দিল্লি বা কলকাতা হলে চাকফি খেতে খেতে গল্প করা যেতো কিন্তু এখানে এক কাপ চায়ের চাইতে এক পেগ হুইস্কি অফার করা অনেক সহজ।

দেবব্রত হাসল, তা ঠিক।

আপনি ড্রিঙ্ক করেন কি?

করি না বললে মিথ্যা বলা হবে, তবে খুব কম। কদাচিৎ, কখনও আর কি।

শেষ পর্যন্ত দু গেলাস হুইস্কি নিয়েই দুজনে শুরু করলাম গল্প করতে।

কোথায় লেখাপড়া করেছেন?

দিল্লিতে।

সে কি! আপনি দিল্লির ছেলে?

হ্যাঁ, তাই বলতে পারেন। দাদা তো দিল্লিতেই থাকেন।

বরাবরই দিল্লিতে? আপনার বাবাও দিল্লিতে থাকতেন?

শুধু বাবা কেন, আমার গ্রান্ড ফাদারও দিল্লিতে জীবন কাটিয়েছে।

বাংলাদেশের সঙ্গে বোধহয় বিশেষ যোগাযোগ নেই?

না, একেবারেই নেই। তবে দাদার সঙ্গে দুএকবার হুগলিতে গেছি।

হুগলিতে বুঝি আপনাদের আদি বাড়ি ছিল?

হ্যাঁ।

গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়ার হেড কোয়ার্টার্স কলকাতা থেকে দিল্লি আনার সঙ্গে সঙ্গেই বহু বাঙালী পরিবার বাংলাদেশ থেকে দিল্লিতে চলে আসেন।

আমাদের ফ্যামিলি কিন্তু গভর্নমেন্ট মুভ করার জন্য দিল্লি আসে না।

তবে?

সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। অ্যান্ড ইন্টারেস্টিং টু।

০২. নরহরি চৌধুরী কোম্পানির দপ্তরে

নরহরি চৌধুরী কোম্পানির দপ্তরে নানা ধরনের নথিপত্রের দেখাশুনা করতেন। মাইনে পেতেন অতি সামান্য। বোধহয় সাত বা আট টাকা। দুঃখে কষ্টে কোনোমতে সংসার চলে। হঠাৎ বুড়ো সাহেব বদলী হয়ে বিলেত চলে গেলেন, এলেন এক ছোঁকরা সাহেব। দু চার মাস যেতে না যেতেই সাহেব কাজকর্ম দেখা প্রায় ছেড়ে দিলেন। নরহরির উপর সব দায়িত্ব চাপিয়ে সাহেব জানবাজারের এক বড়লোক বাঙালিবাবুর সঙ্গে রোজ বাইজিদের নাচ দেখতে শুরু করলেন। খুব জরুরী কাজকর্ম থাকলেও নরহরি নথিপত্র নিয়ে বাইজি বাড়ি হাজির হয়ে সাহেবের শরণাপন্ন হতো। খুব বেশি। মদ না খেলে সাহেব নথিপত্র সই করে নরহরিকে বিদায় করতেন কিন্তু মদ্যপান একটু বেশি হলে। বা বাঈজির নাচ বেশি জমে উঠলেই মুশকিল হতো। সাহেবনথিপত্রে সই তো দিতেনই না, উপরন্তু নরহরিকেও আটকে রাখতেন।

নরহরি মদ্যপান করতেন কিনা বা বাইজিদের সঙ্গে তার কোনো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল কিনা, তা কেউ জানে না। তবে একথা সবাই জানে জাল নথিপত্রে সাহেবের দস্তখত করিয়ে নেবার ফলেই দীনদুঃখী নরহরি আহিরীটোলার বিরাট সম্পত্তির মালিক হয়। আস্তে আস্তে আরো অনেক কিছু হলো। আহিরীটোলার সম্পত্তি ছাড়াও নিমতলা আর কালীঘাটের অনেক বাড়ি ও জমিজমা হলো। হুগলির গ্রামের বাড়ি পাকা করার সময় হলো না নরহরির, কিন্তু সে অপূর্ণ কাজ পূর্ণ করলেন তার ছেলে শ্রীহরি চৌধুরী।

দেবব্রত হাসতে হাসতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আগে আমাদের দেশের কোনো বড়লোকই বোধহয় জোচ্চুরি না করে বড়লোক হননি।

এখনও কি জোচ্চুরি না করে আমাদের দেশে বড়লোক হওয়া যায়? এক চুমুক হুইস্কি খেয়ে বললাম, আগে শুধু জমির মালিকানা এদিক-ওদিক করে বড়লোক হতো, এখন ব্যবসা বাণিজ্য সম্পত্তি সব কিছু নিয়েই জোচ্চুরি করে বড়লোক হচ্ছে।

তবে মাই ফোর ফাদার নরহরি ওয়াজ এ গ্রেট স্কাউনড্রেল!

চৌধুরীবাড়ির দীর্ঘ ইতিহাস দেবব্রত জানে না। তবে শুনেছে অনাচার ব্যভিচারের জন্য আস্তে আস্তে চৌধুরীবাড়ির গৌরব ম্লান হতে শুরু করল। বৃন্দাবন চৌধুরী নিজে বিশেষ লেখাপড়া না জানলেও শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপারে অত্যন্ত উৎসাহী ছিলেন। শোনা যায় স্ত্রী-শিক্ষা প্রসারের জন্য উনি নিমতলার একটা বাড়ি আর নগদ পাঁচ শ টাকা বিদ্যাসাগর মশাইকে দিয়েছিলেন। বহু আত্মীয়স্বজনের পরামর্শ উপেক্ষা করে উনি তার বড় ছেলে জনার্দনকে ডাক্তারি পড়ার জন্য বিলেতে পাঠালেন। সাত-আট বছর পর আহিরীটোলার বাড়িতে যেদিন বিলেত থেকে খবর এলো জনার্দন পাস করেছে, সেদিন বৃন্দাবন চৌধুরী বেঁচে নেই। স্ত্রী বহু আগেই গত হয়েছিলেন। আহিরীটোলার বাড়িতে তখন জনার্দনের ছোট ভাই গদাধর কিছু দূর সম্পর্কের আত্মীয়দের নিয়ে থাকেন আর কলেজে এফ-এ পড়ছেন।

ডাক্তারি পাস করার পরও জনার্দন বিলেতে থেকে গেলেন। লেখাপড়া করার জন্য উনি ছোট ভাইকেও বিলেত যেতে বললেন কিন্তু আত্মীয়দের অনুরোধে ও কিছু বন্ধু বান্ধবের চাপে গদাধর কলকাতাতেই থেকে গেলেন। বিশেষ করে হেমন্ত মামা কিছুতেই যেতে দিলেন না। হেমন্ত সরকার আপন মামা না হলেও বৃন্দাবন চৌধুরীর অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন। বৃন্দাবনবাবুর মৃত্যুর পর ইনিই সম্পত্তির দেখাশুনা করতেন। সুতরাং তার পরামর্শ উপেক্ষা করা গদাধরের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাছাড়া আরো একটা বিশেষ কারণ ছিল। বাবা-মা নেই, দাদা বিলেতে। কিছু নেই নেই করেও আহিরীটোলা-নিমতলার সাতখানা বাড়ি ছাড়াও সামান্য কিছু শেয়ার আর বেশ কিছু সোনাদানার মালিক। কিছু রসিক বন্ধুবান্ধব গদাধরের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতে শুরু করেছিল। এমন সময় হেমন্ত মামা তার এক দূর সম্পর্কের শালীর সঙ্গে গদাধরের বিয়ের প্রস্তাব আনলেন। ক্ষিদের মুখে হাতের কাছে পাকা আমটি পেয়ে গদাধর মামার প্রস্তাব প্রত্যাখান করতে পারলেন না।

এই গদাধর চৌধুরীই আমার দাদু।

তাই নাকি?

হ্যাঁ।

তারপর?

বছর দুই পরে বড় দাদু দেশে ফিরলেন। ঠিক করেছিলেন কলকাতায় প্র্যাকটিশ করবেন, কিন্তু জাহাজে আসার সময় সব প্ল্যান উল্টে গেল।

কেন?

দেবব্রত হাসল। ঐ জাহাজেই কাপুরতলার মহারাজাও দলবল নিয়ে বিলেত থেকে দেশে ফিরছিলেন। মহারাজার এক প্রাইভেট সেক্রেটারির সঙ্গে বড়দাদুর আলাপ হয়। মহারাজার কাছ থেকে ছুটি পেলেই উনি বড় দাদুর সঙ্গে গল্প করতেন। কখনও কেবিনে, কখনও আপার ডেকে। কখনও আবার বার-এ। রাজাদের রাজপ্রাসাদের গল্প শুনতে বড় দাদুর ভারি মজা লাগত।…

.

মহারাজার পার্সোন্যাল পার্টির জন্য ছটা ফার্স্ট ক্লাস কেবিন ছিল। মহারাজা নিজে একটা স্পেশ্যাল ডিলক্স কেবিনে ছিলেন। এছাড়া কয়েকজন সাধারণ কর্মচারী সেকেন্ড ক্লাস কেবিনে ছিলেন। ডাঃ জনার্দন চৌধুরী দেখেশুনে অবাক। মহারাজা কি ফ্যামিলি নিয়ে ট্রাভেল করছে?

প্রাইভেট সেক্রেটারি হাসলেন, ফ্যামিলি নিয়ে মহারাজা বিলেত যাবেন? ফ্যামিলি নিয়ে গেলে কি আনন্দ হয়?

দেন হু আর ট্রাভেলিং উইথ হিম? এতগুলো কেবিনে কারা যাচ্ছেন?

ডিল্যুক্স কেবিনে হিজ হাইনেস। চারটি ফার্স্টক্লাস কেবিনে মহারাজার চারজন গার্ল ফ্রেন্ড, ফিফথ কেবিনে আমি আর অন্যটিতে হিজ হাইনেসের একজন এ-ডি-সি।

চারজন গার্ল ফ্রেন্ড?

প্রাইভেট সেক্রেটারি সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, হিজ হাইনেস হ্যাঁজ গট ফোর হানড্রেড গার্ল ফ্রেন্ড।

মাই গড!

মহারাজাস আর লাইক দ্যাট।

সত্যি? সত্যি।

ডাঃ চৌধুরী স্তম্ভিত হয়ে চুপ করে ভাবেন। একটু পরে জিজ্ঞাসা করলেন, সেকেন্ড ক্লাস কেবিনে কারা আছেন?

গার্ল ফ্রেন্ডদের দুজন লেডি অ্যাটেনডান্ট, হিজ হাইনেসের চারজন পার্সোন্যাল অ্যাটেনডান্ট, আমার একজন অ্যাটেনডান্ট আর একজন ট্রেজারী অফিসার।

এই জাহাজেও চারজন পার্সোন্যাল অ্যাটেনডান্ট চাই মুহারাজার?

দিস ইজ দি লিস্ট রিকয়ারমেন্ট। হিজ হাইনেস যখন প্যালেসে থাকেন তখন প্রত্যেক সিফট এ পঞ্চাশ জন পার্সোন্যাল অ্যাটেনডান্ট ডিউটি দেয়।

মন্থর গতিতে জাহাজ চলে। এক পরিবেশ, এক দৃশ্য দেখে দেখে যাত্রীর দল ক্লান্ত হলেও ডাঃ জনার্দন চৌধুরীর দিনগুলো বেশ কেটে যায়। এই চারজন পার্সোন্যাল অ্যাটেনডান্টের কি কাজ?

একজন হিজ হাইনেসকে ড্রিঙ্ক অ্যান্ড ফুড সার্ভ করছে, একজন টয়লেট অ্যান্ড বাথ-এ হেলপ করে, একজন হিজ হাইনেসকে জামাকাপড় পরিয়ে দেয় আর একজন নাইট ডিউটি দেয়।

টয়লেট আর বাথ-এ কি হেলপ করতে হয়?

হিজ হাইনেস কি নিজে নিজে স্নান করবেন?

মহারাজাকে স্নান করিয়ে দিতে হয়?

অব কোর্স।

জাহাজ ফ্রেঞ্চ কোস্ট ছাড়ার পরই মহারাজার এক গার্ল ফ্রেন্ডের খুব সিরিয়াস সী সিকনেস হলো। এ-ডি-সির কাছে খবর পেয়েই হিজ হাইনেস অত্যন্ত চঞ্চল হয়ে ওর পার্সোন্যাল ফিজিসিয়ানকে খবর দিতে বললেন। এ-ডি-সি মুহূর্তের জন্য চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে জানালেন, ইওর হাইনেস, আপনার পার্সোন্যাল ডাক্তার তো আমাদের পার্টিতে নেই।

ব্যস! হিজ হাইনেস রেগে লাল। তলব করলেন প্রাইভেট সেক্রেটারিকে। প্রাইভেট সেক্রেটারি কেবিনে ঢুকতেই রাগে ফেটে পড়লেন, ডু ইউ থিংক আই অ্যাম এ বেগার? আমি আমার একজন ডাক্তারকে নিয়ে বিলেত যেতে পারি না? জানেন, আমি পুরো একটা জাহাজ ভাড়া করে সারা পৃথিবী চক্কর দিতে পারি? আজ যদি আমার অসুখ হতো, তাহলে? তাহলে কি হতো? কে দেখত? আমি মরে গেলে কে রাজত্ব সামলাবে? এক নিঃশ্বাসে হাজারটা প্রশ্ন করার শেষে বললেন, আপনার মতো প্রাইভেট সেক্রেটারির আমার দরকার নেই। হ্যাঁ, জাহাজের ডাক্তার দিয়ে যেন আমার গার্ল ফ্রেন্ডদের চিকিৎসা না করা হয়।

প্রাইভেট সেক্রেটারি অত্যন্ত সম্ভ্রমের সঙ্গে নিবেদন করলেন, ইওর হাইনেস! আমি আপনার অনুমতি না নিয়েই বিলেত থেকে একজন অত্যন্ত ভালো ডাক্তারকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছি।

মহারাজা লাফিয়ে উঠে বললেন, রিয়েলি?

ইয়েস ইওর হাইনেস!

কোথায় সেই ডাক্তার?

এক্ষুনি ডেকে আনছি ইওর হাইনেস।

একটু পরেই প্রাইভেট সেক্রেটারি ডাঃ জনার্দন চৌধুরীকে এনে মহারাজার সামনে হাজির করলেন, ইওর হাইনেস, ইনিই আপনার নতুন পার্সোন্যাল ফিজিসিয়ান।

.

চৌধুরীবাড়ির গল্প শুনতে শুনতে হাসি পায়। প্রায় অবিশ্বাস্য মনে হলেও জানি এমন হতো। সাংবাদিকতা করতে গিয়ে উত্তর-পশ্চিম ভারতের বহু রাজপ্রাসাদে গেছি, থেকেছি। নানাজনের সঙ্গে মিশেছি, শুনেছি অসংখ্য কাহিনি। এর চাইতেও অনেক অনেক অবিশ্বাস্য কাহিনি।

গল্প করতে করতে হুইস্কির গেলাস খালি হয়। আমি আবার ভরে নিই, দিই। দুজনেই চুমুক দিই। ও একটু ভাবে। আনমনে একবার জানলা দিয়ে লন্ডনের ঘোলাটে আকাশের দিকে তাকায়।

বড় দাদুর আর কলকাতায় ফেরা হলো না। বোষে থেকে সোজা চলে গেলেন কাপুরতলা। তারপর সিমলা।

সিমলায় কেন?

মহারাজা বছরের চার-পাঁচ মাস সিমলায় কাটাতেন বলে বড় দাদু ওখানেই থাকতেন। সিমলার কাপুরতলা হাউসে গেলে এখনও বড় দাদুর সঙ্গে অনেক বড় বড় লোকের ছবি দেখতে পাবেন।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। আমি দাদার সঙ্গে অনেকবার সিমলা গেছি আর প্রত্যেকবার কাপুরতলা হাউসে গিয়ে বড় দাদুর ছবিগুলো দেখেছি।

.

শুধু কতকগুলো ফটো নয়, আরো কিছু আছে। এখনও অনেক বৃদ্ধের মুখে ডাঃ জনার্দন চৌধুরীর কথা শোনা যাবে, জানা যাবে অনেক মজার ঘটনা। নতুন বিলেত ফেরত ডাক্তার বলে মহারাজা ওঁকে বেশি পছন্দ করতেন। বিশ্বাসও করতেন অনেক বেশি। সেজন্য মহারানী বা মহারাজার প্রমোদ সঙ্গিনীদের কোনো কিছু হলেই ডাঃ চৌধুরীর তলব হতো। রাজপ্রাসাদের অন্য দুজন পুরনো ডাক্তার। এজন্য অত্যন্ত অসন্তুষ্ট ছিলেন এবং ডাঃ চৌধুরীর কুৎসা প্রচার করতে শুরু করলেন। মহারাজার প্রাইভেট সেক্রেটারিই ছিলেন ডাঃ চৌধুরীর প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও একমাত্র ব্যক্তিগত বন্ধু। মহারাজাও ওঁকে ভালোবাসেন। সুতরাং হিজ হাইনেসের কানে সেই কুৎসার কাহিনি পৌঁছে দেওয়া সহজ ছিল না, কিন্তু তবু একদিন সত্যি সত্যি পৌঁছল। কোর্ট মিনিস্টার দেওয়ান গুরুবচন সিং মহারাজাকে বললেন, ইওর হাইনেস, ডাঃ চৌধুরী সম্পর্কে অনেক কথা শুনছি। অবশ্য ঠিক বিশ্বাসযোগ্য না হলেও অনেকের কাছে শুনছি বলেই আপনাকে জানান কর্তব্য মনে করলাম।

ডাক্তার ড্রিঙ্ক করা শুরু করেছে নাকি?

না ইওর হাইনেস, উনি ড্রিঙ্ক করেন না ঠিকই কিন্তু শুনছি…

কি শুনছেন?

শুনছি চিকিৎসা করার সুযোগ নিয়ে ডাঃ চৌধুরী আপনার কয়েকজন বান্ধবীদের সঙ্গে…

কি? ইজ হি এনজয়িং দেয়ার কোম্পানি?

তাইতো শুনছি ইওর হাইনেস।

মহারাজা গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আর কিছু শুনেছেন?

শুনছি তো আরো অনেক কিছু কিন্তু ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না।

আরো কি শুনছেন?

ইওর হাইনেস, সেসব কথা আপনার না শোনাই ভালো।

মহারাজার অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারলেন না কোর্ট মিনিস্টার। শেষ পর্যন্ত বললেন, শুনছি দু-একজন মহারানীদের সঙ্গেও ডাঃ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠতা নাকি অনেক দূর গড়িয়েছে।

মহারাজা হাসতে হাসতে শুধু বললেন, ভেরি ইন্টারেস্টিং।

ঠিক পরের দিনই মহারাজা অর্ডার দিলেন, মহারানী ও বান্ধবীদের চিকিৎসার সম্পূর্ণ দায়িত্ব ডাঃ চৌধুরীর। শুধু তাই নয়। কারুর একটু সামান্য মাথা ব্যথা করলেই মহারাজ ডাঃ চৌধুরীকে ডেকে বলতেন, ডক্টর, রাতে পেসেন্টের কাছে থাকবেন।

ডাঃ চৌধুরী হাসতে হাসতে বলতেন, ইওর হাইনেস, সেরকম কিছু হলে আমি নিশ্চয়ই থাকব কিন্তু দিস ইজ নাথিং।

তা হোক। আপনি থাকলে আমি নিশ্চিন্ত থাকব; নয়তো চিন্তায় সারা রাত ঘুমুতে পারব না।

কোনো মহারানী বা মহারাজার প্রিয় বান্ধবীর কিছু হলেই তার পাশের ঘরে ডাঃ চৌধুরীর থাকার ব্যবস্থা হতো। দুটো ঘরের মাঝখানে দরজা। যখন ইচ্ছা পেসেন্টকে দেখাশুনা করা যাবে। ডাঃ চৌধুরীর ঘরে ওষুধপত্র ইনজেকশন থাকত। হসপিটালের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে টেলিফোন। ডাঃ চৌধুরী মনে মনে হাসেন, অস্বস্তি বোধ করেন, কিন্তু অসহায়। প্রাইভেট সেক্রেটারি সাহেবকে সব কথা জানালেন।উনি সুযোগ মতোমহারাজার কাছেও কথাটা তুললেন কিন্তু মহারাজা বললেন, নো নো নো।

তিন মাস কেটে গেল।

সেদিন রাত্রে মহারাজার ডিনার। কয়েকজন নিমন্ত্রিত। কোর্ট মিনিস্টার, প্রাইভেট সেক্রেটারি, তিনজন ডাক্তার, দুজন এ-ডি-সি, চীফ প্যালেস গার্ড কর্নেল হরকিষণ সিং আর সমস্ত মহারানী ও বান্ধবীরা। ডিনারের আগে ড্রিঙ্কস এলো কিন্তু মহারাজা কাউকে বেশি ড্রিঙ্ক করতে দিলেন না। বললেন, ডিনারের পরে গল্প করবেন। ডিনার শেষ হলো। তারপর মহারাজা একটা বিরাট ডায়মন্ডের আংটি আর একটা সোনার ঘড়ি ডাঃ চৌধুরীকে উপহার দিতেই সবাই চমকে উঠলেন। হিজ হাইনেস অনেককেই অনেক কিছু উপহার দেন কিন্তু এমন সুন্দর ও দামি উপহার বিশেষ কেউ পান না। মহারাজা হাসতে হাসতে সবাইকে একবার দেখে নিয়ে বললেন, শুনেছিলাম ডাঃ চৌধুরীর চরিত্র নাকি ভালো নয়, সেজন্য মহারানী ও বান্ধবীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার জন্য ডাঃ চৌধুরীকে অনেক সুযোগ দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে কর্নেল হরকিষণকে অর্ডার দিলাম মহারানী ও বান্ধবীদের ঘরের স্কাই লাইটের পাশে ক্যামেরা নিয়ে একজন প্যালেস গার্ড বসে থাকবে।

মহারাজের কথা শুনে সবাই হতবাক। মহারাজা থামলেন না, কর্নেলকে বলেছিলাম ডাঃ চৌধুরীর দুর্বল মুহূর্তের একটা ছবি নিতে পারলে পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার দেব। কিন্তু পুরস্কারের টাকা আমি কাউকে দিতে পারলাম না বলে আমি আনন্দিত ও গর্বিত।

এরপর শুরু হলো ড্রিঙ্কস, আনন্দ হুল্লোড়। মহারাজা একটা স্কচের গেলাস নিয়ে ডাঃ চৌধুরীকে বললেন, আজ একটু টেস্ট করবে নাকি?

.

দেবব্রত আমার হাতটা চেপে ধরে বললো, জানেন, বড়দাদু কি বলেছিলেন?

কি?

বলেছিলেন ইওর হাইনেস, আপনার হুকুম অমান্য করতে পারি, কিন্তু অনুরোধ উপেক্ষা করার ক্ষমতা আমার নেই।

আমি কৌতূহল চাপতে পারলাম না। জিজ্ঞাসা করলাম, মহারাজা কি বললেন?

না, মহারাজ অনুরোধ করেননি। কোনোদিন করেননি।

কর্নেল হরকিষণ সিং এখনও জীবিত। সোলনে থাকেন। অনেক বয়স হয়েছে। চুল দাড়ি সাদা ধবধবে। তার কাছে গেলে এখনও ডাঃ চৌধুরীর অনেক গল্প শোনা যায়। কাপুরতলা বা সিমলার আরো অনেকের কাছে শোনা যায়, জানা যায়।

বড় দাদুর খুব ইচ্ছা ছিল কলকাতায় থাকার, কিন্তু পারেননি। কাপুরতলার মহারাজকে ছেড়ে আসতে পারেননি। তাছাড়া এত লোকের সঙ্গে ওঁর বন্ধুত্ব, হৃদ্যতা হয়েছিল যে তাদের সবাইকে ছেড়ে আসাও অসম্ভব ছিল।

আমি বললাম, তা তো বটেই।

দেবব্রত বললো, বড় দাদুর জন্য আমার দাদুও প্রায় কাপুরতলা বা সিমলা আসতেন। তারপর আস্তে আস্তে উনিও একদিন সিমলার বাসিন্দা হয়ে গেলেন।

০৩. পনের বছর আগেকার ঘটনা

পনের বছর আগেকার ঘটনা। ছোটখাট অনেক ঘটনাই মনে নেই, ভুলে গেছি। তবে মনে আছে দেবব্রত চৌধুরী তিন-চারদিন আমার হোটেলে এসেছে, গল্প করেছে, খেয়েছে। একদিন কথায় কথায় বললো, আপনার সঙ্গে আগে আলাপ হলে আমি নিশ্চয়ই জার্নালিস্ট হতাম।

আমি হাসলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, কেন?

কেন নয় বলুন? চাকরি করলেও দাসত্বের শৃঙ্খল নেই, তাছাড়া কি দারুণ একসাইটিং অ্যান্ড ইন্টারেস্টিং কাজ বলুন তো?

আমি কোনো জবাব দিলাম না। একটু চাপা হাসি হাসতে হাসতে হুইস্কির গেলাসে চুমুক দিলাম। ও কিছু শুনতে চাইছিল। আমার নীরবতা বোধহয় ভালো লাগছিল না। কি হলো? কিছু বলছেন না শুধু হাসছে?

এবারে আমি জবাব দিলাম, আমি যদি ডক্টর দেবতোষ চৌধুরীর ভাই হতাম তাহলে আমি নিশ্চয়ই ইলেকট্রনিক্স নিয়ে পড়তাম,আবার একটু হুইস্কি গলায় ঢেলে বললাম, আদার্স লন ইজ

অলওয়েজ গ্রীনার, তাই না?

দেবব্রত বললো, যাই বলুন জার্নালিস্টদের রেসপেক্টই আলাদা। তাছাড়া দারুণ গ্লামারস প্রফেশন।

এককালে সত্যি সাংবাদিকদের সম্মান ছিল কিন্তু এখন নেই।

কেন?

থাক। এসব আলোচনা না করাই ভালো।

দেবব্রত আর তর্ক করেনি। ইলেকট্রনিক্স নিয়ে পড়তে অবশ্য আমার ভালোই লাগছে। ভারি ইন্টারেস্টিং সাবজেক্ট।

.

আমি সাংবাদিক। সংবাদপত্রের পরিভাষায় স্পেশাল করসপনডেন্ট। বিশেষ সংবাদদাতা। প্রাইম মিনিস্টার মিনিস্টার এম পি-দের নিয়েই আমার কারবার। পার্লামেন্টের সেন্ট্রাল হলে আড্ডা দিই। চা কফি সিগারেট। পরনিন্দা-পরচর্চা। নোট বই-পেন্সিল-টাইপ রাইটার। টেলিফোন, ট্রাংকল। টেলিপ্রিন্টার-টেলেক্স। দিনটা এইভাবেই কাটে। সন্ধ্যার পর কালো স্যুট টাই। হায়দ্রাবাদ হাউস অথবা অশোকা হোটেল। অথবা ডিপ্লোম্যাটিক পার্টি। রিসেপসন। স্কচ। ওয়াইন। অথবা ভডকা। তবুকান সতর্ক থাকে। নতুন গোপন কোনো খবর পেলেই পাঠিয়ে দেব অফিসে। ছাপা হবে পরের দিন সকালের কাগজে।

এই ত আমার, আমাদের দিল্লির জীবন। কখনও কখনও বাইরে যেতে হয়। দূরে, কাছে। বাসে ট্রেনে মোটরে প্লেনে। কখনও পাড়ি দিতে হয় বিদেশ। ছায়ার মতো অনুসরণ করতে হয় ভি আই পিদের। কত কি দেখি, শুনি, জানতে পারি কিন্তু রাজনৈতিক দুনিয়ার বাইরের কোনো কিছু জানি না বললেই চলে। বিভিন্ন রাজ্যের ডজন ডজন মন্ত্রী বা নেতাদের নাম আমাদের মুখস্থ কিন্তু কলকাতা দিলি বোম্বে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন ভাইস-চ্যান্সেলারের নাম জানেন, এমন সাংবাদিক ভারতবর্ষে নেই বললেই চলে। তবু কিছু কিছু সাহিত্যিক বৈজ্ঞানিকের খবর আমাদের রাখতে হয়। নানা কারণে, নানা উপলক্ষ্যে এদের জানতে হয়, চিনতে হয়। তিন মূর্তি ভবনে বা সাউথ ব্লকের অফিসে প্রাইম মিনিস্টার মাঝে মাঝেই দুচারজন বৈজ্ঞানিক বা অর্থনীতিবিদ বা ওই ধরনের কিছু জ্ঞানী-গুণীকে আমন্ত্রণ জানান। আলোচনা করেন, পরামর্শ করেন। প্রাইম মিনিস্টারের ঘর থেকে বেরুবার সঙ্গে সঙ্গে আমরা এদের ঘিরে ধরি, প্রশ্ন করি। এক্সকিউজ মী স্যার, কাশ্মীর ক্রাইসিসের জন্য কি ফাইভ ইয়ার প্ল্যানের কিছু মেজর চেঞ্জ হচ্ছে?

লাইব্রেরিয়ান ফ্রেমের মোটা চশমাটা ঠিক করতে করতে প্রফেসর প্রসাদ বললেন, ডোন্ট থিংক সো তবে বর্ডার এরিয়া কিছু স্পেশ্যাল ট্রিটমেন্ট পাবে বলে মনে হয়।

আমাদের দেশের যা অর্থনৈতিক অবস্থা তাতে এগ্রিকালচার, হেভী ইন্ডাস্ট্রি ও ডিফেন্স–এই তিনটি ক্ষেত্রেই কি সমানভাবে গুরুত্ব দেওয়া সম্ভব?

ডাঃ দত্ত বললেন, কোনোটাকে নেগলেক্ট করতে চান? কোনোটাকেই নেগলেক্ট করা যাবে না এবং হবে না।

পরের দিন সকালে সব খবরের কাগজে সে সংবাদ ফলাও করে ছাপা হয়। এই রকম একটা মিটিং-এর পরই ডক্টর দেবতোষ চৌধুরীকে আমি প্রথম দেখি।

আমার বেশ মনে আছে সেদিনের কথা। আমন্ত্রিত সব বৈজ্ঞানিকই স্যুট পরে এসেছিলেন। ডক্টর চৌধুরী এসেছিলেন ধুতি-পাঞ্জাবি পরে। দেখে ভারি ভালো লেগেছিল। তাছাড়া চেহারাটি মনে রাখার মতো। হঠাৎ দেখলে মনে হয় সাহিত্য বা দর্শনের অধ্যাপক। মনেই হয় না ইনি ল্যাবরেটরিতে বসে সূর্যরশ্মি নিয়ে গবেষণা করে যশস্বী হয়েছেন।

.

দেবব্রত জিজ্ঞাসা করল, দাদার সঙ্গে আপনার আলাপ আছে?

না, আলাপ নেই। তবে দেখেছি, দু-একবার সামান্য দুচারটে কথাও বলেছি।

এবার দিল্লি ফিরে দাদার সঙ্গে দেখা করবেন।

নিশ্চয়ই দেখা করব।

দাদা খুব খুশী হবেন। দেবব্রত একবার আমার দিকে তাকিয়ে বললো, অমন মানুষের সঙ্গে আলাপ করে আপনারও ভালো লাগবে।

আমি হাসতে হাসতে বললাম, কিন্তু ওর সঙ্গে তো আমি বেশিক্ষণ কথা বলতে পারব না।

কেন?

অত বড় পণ্ডিত মানুষের সঙ্গে কি বেশিক্ষণ কথা বলা যায়?

দেবব্রত হাসল, এখন কিছু বলব না, আলাপ করে আমাকে চিঠি দেবেন।

তিন সপ্তাহ পরে দিল্লি ফিরেই টেলিফোন করলাম। পেলাম না, পুণা গিয়েছিলেন। কয়েকদিন পরে আবার টেলিফোন করতেই ডক্টর চৌধুরী নিজে টেলিফোন ধরলেন। পরিচয় দিতেই বললেন, দেবুর চিঠিতে আপনার কথা জানলাম। সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন, ওর শরীর ভালো আছে তো?

ভালোই আছে।

আপনি কদিন ওকে খুব খাইয়েছেন।

আমি না হেসে পারলাম না, সে কথাও লিখেছে?

ডক্টর চৌধুরীও হাসলেন, ও একটু পেটুক আছে। তাছাড়া আমাকে ও সব কথাই জানায়।

আমি যেদিন ডক্টর চৌধুরীর বাড়ি প্রথম গেলাম সেদিন রবিবার। দরজার সামনে দাঁড়াতেই গান শুনতে পেলাম। শিল্পীর কণ্ঠস্বর চিনতে না পারলেও সুর শুনে বুঝলাম রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড। মিনিট খানেক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর বেল বাজালাম। প্রথমে চাকর, তারপর স্বয়ং ডক্টর চৌধুরী। আসুন আসুন।

ছোট্ট লবী পার হয়ে লিভিংরুমে ঢুকতে ঢুকতে উনি জিজ্ঞাসা করলেন, অনেকবার বেল বাজিয়েছেন?

না, না, একবারই বাজিয়েছি।

দেন ইউ আর রিয়েলি লাকি।

কেন বলুন তো?

হঠাৎ একটু প্রাণ খুলে হাসলেন ডক্টর চৌধুরী। যখন তখন এমন গান শুনতে মেতে যাই যে কেউ বেল বাজালেও শুনতে পাই না। অবশ্য চাকরটাকে বার বার বলে রেখেছিলাম।

লিভিংরুমে ঢুকতেই অবাক হলাম, বাঃ! চমৎকার! পর পর অতগুলো কাংড়া ভ্যালী পেন্টিং দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না।

ডু ইউ লাইক পেন্টিং?

কিছু বুঝি না কিন্তু দেখতে ভালো লাগে।

কাম টু মাই স্টাডি।

ডক্টর চৌধুরীকে অনুসরণ করে ওঁর পড়ার ঘরে ঢুকতেই সারা দেওয়াল ভর্তি স্কেচ দেখতে পেলাম।

আমার পোর্ট্রেটটা দেখেছেন?

বাঃ! ভারি সুন্দর!

ডু ইউ নো হু ইজ দ্য আর্টিস্ট?

আপনি নিশ্চয়ই!

না, না, আমার এত গুণ নেই…

কোনো ছাত্রের বুঝি?

না, দেবু।

মাই গড! পোর্ট্রেটটা ওর করা?

অব কোর্স। এ ঘরের সব স্কেচ আর পোর্ট্রেটই ওর করা। মুহূর্তের জন্য নিজের পোর্ট্রেটটা দেখে ডক্টর চৌধুরী একটু চাপা গলায় গর্বের সঙ্গে বললেন, দেবু রিয়েলি একটা জুয়েল।

পনের বছর আগের কথা। সব কথা মনে না থাকাই স্বাভাবিক কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে, ডক্টর চৌধুরীর প্রতিটি কথায় ছোট ভাই সম্পর্কে তার গভীর ভালোবাসা ও দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছিল। ওঁর একটা কথা আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না–দেবু ইজ এ পীস অব ড্রিম, দেবু আমার একটা স্বপ্ন, সাধনা। আমি অবাক হয়ে ওঁর মুখের দিকে চাইতেই উনি বললেন, রিসার্চ করতে গিয়ে ব্যর্থ হলেও আমার দুঃখ নেই। আজ না হয় কাল, কাল না পরশু কেউ না কেউ নিশ্চয়ই সাকসেসফুল হবেনই কিন্তু দেবুর ব্যাপারে ব্যর্থ হলে আমার সব স্বপ্ন, সাধনা…..

আমি ওঁকে কথাটা শেষ করতে দিলাম না, না না সে ভয় আপনার নেই।

.

এই পৃথিবীর অজস্র কোটি কোটি মানুষ আপন আপন কাজে নিমগ্ন। কবি কাব্য রচনা করেন, শিল্পী রূপ দেন তার মনের স্বপ্নকে, বৈজ্ঞানিক সাধনা করেন আপন গবেষণাগারে, সাহিত্যিক মানুষের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙক্ষা, সাফল্য-ব্যর্থতার কাহিনি লিপিবদ্ধ করেন। মাঠে-ঘাটে, অফিসে-আদালতে, কলকারখানায় অসংখ্য মানুষ সংগ্রাম করছেন দিন রাত্রি কিন্তু কেন? শুধুই কি অর্থ যশ প্রতিপত্তির জন্য? দুমুঠো অন্নের জন্য? না,কখনই নয়। আপন মুক্তির জন্য ঠাকুর রামকৃষ্ণ সাধনা করেননি, খ্যাতির জন্য বিদ্যাসাগর বিধবা-বিবাহ দেননি, কিছু ফিরিঙ্গি সাহেবের প্রশংসার জন্যও রাজা রামমোহন সতীদাহ প্রথা রদ করতে উদ্যোগী হননি। মার্কস বা এডিসন বা অন্য কোনো মহাপুরুষই শুধু আপন স্বার্থসিদ্ধির জন্য মানব সভ্যতার ইতিহাসে নতুন যুগের সূচনা করেননি। কোনো মানুষই করে না। সব কর্মকাণ্ডের পিছনেই, সাধনার অন্তরালে কিছু মানুষের কল্যাণ, ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে। ডক্টর চৌধুরীর কথা শুনে, দেবব্রতর প্রতি ওঁর ভালোবাসা দেখে এই কথাগুলো আবার নতুন করে আমার মনে পড়ল।

বেশিক্ষণ ছিলাম না। ঘণ্টা খানেক বা ঘণ্টা দেড়েক। একজন মানুষকে চেনার পক্ষে সময়টা কিছুই নয়। তবু বড় ভালো লেগেছিল দেবব্রতর দাদাকে। এত বড় বৈজ্ঞানিক হয়েও বড় সহজ, সরল অমায়িক ব্যবহার। বিয়ে করেননি। নিশ্চয়ই করবেন না। বিয়ে করার কোনো বয়স নেই ঠিকই কিন্তু মন তো চাই। আনন্দের জন্য, উপভোগের জন্য, সম্ভোগের জন্য ডক্টর চৌধুরীর বিয়ে করার দরকার। নেই। ল্যাবরেটরি, মিটিং, সেমিনার করে যেটুকু সময় হাতে থাকে সেটুকু সময় পরিপূর্ণভাবে উনি উপভোগ করেন। সকালবেলা বেরুবার সময় রেডিওগ্রামে কয়েকটা রেকর্ড চাপিয়ে চলে যান। সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরেই সুইচ টিপে দেন। ঘর ভর্তি বাংলা বই। গল্প, উপন্যাস, কবিতার বই। দিল্লিতে কারুর বাড়িতে এত বাংলা বই দেখেছি বলে মনে পড়ে না। একটু অবাক হয়ে একবার বললাম, আপনার তো বাংলা বইয়ের দারুণ কালেকশন।

ডক্টর চৌধুরী হাসতে হাসতে বললেন, বাড়িতে বাংলা বই আর গানের রেকর্ড না থাকলে দেবুর স্ত্রী সারাদিন কাটাবে কি ভাবে?

আমি হাসলাম।

উনিও হাসলেন। এক মুহূর্তের জন্য চুপ করে বললেন, সুভাষ মুখার্জির একটা কবিতায় পড়েছিলাম–বিংশ শতাব্দীতে।

মানুষের শোকের আয়ু
বড় জোর এক বছর।

উনি চুপ করে রইলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, হঠাৎ ঐ কবিতাটা মনে হলো কেন?

কথাটা নির্মম হলেও বড় সত্যি। এ যুগের কোনো শোকের আয়ুই এক বছরের বেশি নয়। আমি মরে গেলেও হয়তো দেবু বা বৌমা এক বছর পর আমাকেও ভুলে যাবে কিন্তু এই বইগুলো, এই সব পেন্টিং বা গানের রেকর্ড শুনতে শুনতে নিশ্চয়ই আমার কথা ওদের মনে পড়বে।

মুগ্ধ হয়ে, বিস্মিত হয়ে আমি ওর কথা শুনছিলাম।

বিদায় নেবার আগে ডক্টর চৌধুরী বললেন, এরপর যেদিন আসবেন সেদিন আপনাকে আমার তোলা ফিল্মের প্রজেকশন দেখাব।

আপনি বুঝি ছবিও তোলেন?

তুলবো না? জ্যেঠু বড় না হলে তো বই পড়বে না বা গান শুনবে না। তাই তো ওর জন্য ছবি তুলে রাখছি।

.

এ সব পনের বছর আগেকার কথা। কত কি ঘটে গেছে এই দীর্ঘ পরিসরে। দ্বিতীয় বার বিলেত গেলাম তখন দেবব্রতর ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেছে। রিজেন্ট পার্ক লেকের ধারে বসে দুজনে গল্প করেছি, ডুরি লেন থিয়েটারে মাই ফেয়ার লেডির অভিনয় দেখেছি। আরো কত কি। দুদিনের জন্য এসেক্সের সমুদ্র সৈকত ঘুরে এলাম। ঐ দুদিন অনেক রাত্রি পর্যন্ত সমুদ্র পাড়ে বসে দুজনে গল্প করেছিলাম।

আমি দিল্লি ফিরে আসার কয়েক দিন পরেই দেবব্রত চিঠিতে জানলাম ভালোভাবে পাস করেছে। দুতিন সপ্তাহ পরে দিল্লি ফিরেই আমাকে টেলিফোন করেছিল কিন্তু পায়নি। আমি ছুটিতে কলকাতা গিয়েছিলাম। ছুটির শেষে দিল্লি ফিরে এলাম। মাস খানেক কেটে গেল। হঠাৎ একদিন পুরনো চিঠিপত্তর ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে দেবব্রতর একটা চিঠি হাতে পড়তেই ডক্টর চৌধুরীকে একবার টেলিফোন করলাম, দেবু ফিরছে কবে?

ও তো অনেক দিন হলো ফিরেছে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ।

ও কি এখানেই আছে?

ও তো চাকরি নিয়ে বাঙ্গালোরে চলে গেছে।

আমি একটু অবাক হলাম, দুঃখিত হলাম। আমার সঙ্গে একবার দেখা না করেই চলে গেল।

ডক্টর চৌধুরীও অবাক হলেন, সেকি? ও তো আপনার ওখানে কয়েক দিন গিয়েছে, দেখা হয়নি?

না। তাহলে বোধহয় আমি তখন কলকাতায় ছিলাম।

তাই হবে।

দেবব্রত হারিয়ে গেল। চিঠি লেখার অভ্যাস আমার নেই। বোধহয় ওরও তাই। তাছাড়া এমন। বিশ্রী অর্থহীন উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে দিনগুলো কেটে যায় যে বহু পরিচিত, ঘনিষ্ঠ মানুষের কথাও মনে পড়ে না। হঠাৎ মাঝে মাঝে খবরের পাতায় পড়ে বা রেডিওতে ডক্টর চৌধুরীর নাম শুনলেই লন্ডনের সেই ছাত্রসভার ছেলেটির কথাও মনে পড়ে। ভাবি চিঠি লিখব কিন্তু লিখি না। পরের দিনের উত্তেজনায় সে ইচ্ছা হারিয়ে যায়। তলিয়ে যায়।

ডক্টর চৌধুরীর সঙ্গেও আর যোগাযোগ নেই। কারণ আছে। উনি আর এখন ন্যাশনাল ফিজিক্যাল ল্যাবরেটরির অন্ধকার গবেষণাগারের মধ্যে বন্দী নন। উনি এখন ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশনের সদস্য ছাড়াও প্ল্যানিং কমিশনের উপদেষ্টা। প্রায় ভি আই পি। খবরের কাগজের পাতায় প্রায় নিত্যই নাম ছাপা হচ্ছে। আজ শিলং, কাল সিমলা। দুদিন পরেই হায়দ্রাবাদ। পরের দিনই মাদ্রাজ হয়ে সিঙ্গাপুর। কলম্বো প্ল্যানের কনসালটেটিভ কমিটি মিটিং। কদাচিৎ কখনও বিজ্ঞান ভবনের কমিটি রুমে বা লবীতে দেখা হয়। আমাকে উনি চিনতে পারেন। জিজ্ঞাসা করেন, ভালো আছেন? আমি ছোট্ট জবাব দিই, হ্যাঁ। ওঁর কুশল জিজ্ঞাসা করার অবকাশ আমার হয় না, তার আগেই উনি কোনো মন্ত্রী বা আই-সিএস সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগিয়ে যান। ডক্টর চৌধুরীর এই উন্নতির জন্য দেবব্রতর অহঙ্কার হয়েছে কিনা জানতে পারি না। কিন্তু মনে মনে আশঙ্কা হয়, ভয় হয়। মাঝে মাঝে ওকে চিঠি লেখার ইচ্ছা হলেও ঠিক উৎসাহবোধ করিনা। পিছিয়ে যাই। কাগজ কলম নিয়ে বসেও লিখতে পারি না।

দুটি বছরে আরো কত কি ঘটে গেল। আরো কত মানুষকে জানলাম, চিনলাম, ভালোবাসলাম, কত মানুষকে ভুলে গেলাম দূরে সরিয়ে রাখলাম।

.

বেশ মনে আছে তার আগের দিন পার্লামেন্টের বাজেট অধিবেশন শেষ হয়েছে। রাষ্ট্রপতি দীর্ঘ ভাষণ নিয়ে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে মে মাসের বিশে পর্যন্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সমস্যা নিয়ে সাড়ে সাত শ এম পির মতামত শুনে ক্লান্ত হয়ে গেছি। সকালে ওঠার তাড়া নেই। রাধাকিষণকে বলেছি, চা নিয়ে ডাকাডাকি করিস না। অনেক বেলা অবধি ঘুমুব বলে টেলিফোনের প্লাগ খুলে রেখেছি। তাছাড়া রবিবার। নটা বেজে গেলেও আমি ঘুমুচ্ছিলাম। মোটা পর্দার ব্যুহ ভেদ করে সূর্যরশ্মি পর্যন্ত আমার শোবার ঘরে ঢুকতে পারেনি কিন্তু সুভাষ রায় এসে হাজির। ঘরে ঢুকেই চিৎকার, গেট আপ জার্নালিস্ট! গেট আপ

চাদর সরিয়ে মুখ বের করতেই সুভাষদা বললেন, ভয় নেই, কোনো পাওনাদার না, আমি তোমার সুভাষদা।

সুভাষদা!

আমি ভূত দেখার মতো চমকে লাফিয়ে উঠলাম। সুভাষদা, আপনি?

এখনও কি তোমার সন্দেহ হচ্ছে?

না কিন্তু আপনি কবে এলেন? বৌদি কোথায়? রমার কি খবর? এক নিশ্বাসে কথাগুলো বললাম।

সুভাষদা হাসতে হাসতে বললেন, সবাই এসেছে। তুমি চোখে মুখে জল দিয়ে এসো, তারপর সব বলছি।

আমি বিছানায় উঠে বসে জিজ্ঞাসা করলাম, কই ওরা কোথায়? বৌদি আর রমা কি গাড়িতে…।

ওরা এখন আমার সঙ্গে আসেনি; তবে দিল্লিতেই আছে।

ওদের নিয়ে এলেন না কেন?

বলছি তো চোখে-মুখে জল দিয়ে এসো, তারপর সব জানতে পারবে।

আমি বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে রাধাকিষণকে ডেকে বললাম, পর্দা হঠাও আর চা বানাও।

তাড়াতাড়ি চোখে মুখে জল দিয়ে ফিরে আসতেই সুভাষদা বললেন, কত কাণ্ড করে যে তোমার এখানে এসেছি তা ভাবতে পারবে না।

কেন, আপনি আমার বাড়ির ঠিকানা জানতেন না?

সুভাষদা হাসতে হাসতে বললেন, তোমার মতো নটোরিয়াস ব্যাচেলার কখনও বাড়ির ঠিকানা জানায়?

লজ্জিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, খুব ঘুরতে হয়েছে বুঝি?

টেলিফোন এনকোয়ারি থেকে ভুল ঠিকানা জানাল। তাছাড়া দিল্লি এত বদলে গেছে যে নতুন এসে তালগোল পাকিয়ে যায়।

আমি হাসতে হাসতে বললাম, দেখে-শুনে মনে হয় এরা বোধহয় দিল্লিকে প্যারিস বানাতে চায়।

গৌরী সেনের টাকায় নিত্যনতুন স্কীম হচ্ছে আর মাসে-মাসে শহরের চেহারা বদলে যাচ্ছে।

কিন্তু তার ঠেলায় তো আমাদের মতো নিউকামারদের জান বেরিয়ে যায়।

আই অ্যাম সরি। যাই হোক আর চিন্তা নেই। এবার বলুন কবে এলেন, কোথায় উঠেছেন?

রাধাকিষণ চা-বিস্কুট দিয়ে গেল। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সুভাষদা বললেন, রাগ করো না, ঠিক একমাস হলো এসেছি…।

আমি অবাক হই, একমাস?

একমাস এসেছি ঠিকই কিন্তু নতুন করে সংসার পাতার যা ঝামেলা, সে আর বলার না। তাছাড়া অফিসেও অত্যন্ত ব্যস্ত থাকি অথচ তোমার বৌদি তোমাকে খুঁজে বের করার জন্য পাগল করে ছাড়ছেন…

হাসলাম। তারপর?

রোজই ভাবি আমাদের কোনো পি আর ওকে তোমার ঠিকানা জিজ্ঞাসা করব কিন্তু রোজই ভুলে যাই। আজ সকালে তোমার বৌদি এমন বকবক করতে শুরু করলেন যে না বেরিয়ে পারলাম না।

আমি শুকনো হাসি হেসে বললাম, আপনি যাই কৈফিয়ত দিন আমি স্যাটিসফায়েড হচ্ছি না।

সত্যি বিশ্বাস কর ভাই, এবার দিল্লিতে এসে যা হয়রানি সহ্য করেছি, তা তুমি ভাবতে পারবে না।

সে তো বুঝলাম, কিন্তু এসেই কেন আমার খোঁজ করলেন না?

চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে সুভাষদা বললেন, আই জাস্ট গট লস্ট ইন প্রবলেমস।

সুভাষদার স্ত্রী, মিসেস জয়তী রায়, আমার বৌদি সত্যি আমাকে ভালোবাসেন। ডক্টর রাধাকৃষ্ণণের সঙ্গে আমেরিকা গিয়ে ওঁদের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ। আমাদের অ্যাম্বাসীর ডিপ্লোম্যাট অন্যান্য স্টাফ ও তাদের ফ্যামিলী মেম্বারদের ইনফরম্যাল গেট-টুগেদার এ বৌদিকে দেখেই ডক্টর রাধাকৃষ্ণণ জিজ্ঞাসা করলেন, হাউ আর ইউ জয়ন্তী?

বৌদি তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে ডক্টর রাধাকৃষ্ণণকে প্রণাম করে বললেন, ভালো আছি স্যার।

শুধু ফ্যাশান শো অর্গানাইজ করছ না কি কিছু লেখাপড়াও করছ?

সামান্য কিছু লেখাপড়াও করছি স্যার।

গুড। ভেরি গুড। এবার আমার দিকে ফিরে ডক্টর রাধাকৃষ্ণন বললেন, ডু ইউ নো, জয়ন্তী আমার কিছু কিছু লেখা বাংলায় অনুবাদ করেছে অ্যান্ড আই অ্যাম টোন্ড দে আর ভেরি গুড।

আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, তাই নাকি?

.

আমি একটু মুগ্ধ দৃষ্টিতে বৌদির দিকে তাকালাম, বৌদিও আমাকে দেখলেন। পরে মাঝে মাঝেই বৌদি মজা করে হাসতে হাসতে সুভাষদাকে বলতেন, তোমার জার্নালিস্ট সেদিন যে কি রোমান্টিক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েছিল তা তুমি ভাবতে পারবে না।

সুভাষদা আমার দিকে তাকিয়ে একটু ইশারা করেই বৌদিকে বললেন, তোমারও নিশ্চয়ই ভালো লেগেছিল।

তুমি তো জীবনেও কোনোদিন অমন করে তাকাওনি, সুতরাং ভালো না লাগার তো কারণ নেই।

এবার সুভাষদা স্ত্রীকে খুশী করার জন্য বললেন, তাছাড়া জার্নালিস্টের রোমান্টিক হবার কারণ ছিল। তোমাকে দেখে তো বোঝা যায় না তোমার কত বয়স! নো ডাউট ইউ আর স্টিল ভেরী চার্মিং।

সুভাষদা স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করার জন্য ঠাট্টা করলেও কথাটা ঠিক। জয়ন্তী বৌদি সত্যি সুন্দরী! পরিপূর্ণ নারীত্বের সৌন্দর্য ছাড়াও চোখে-মুখে বুদ্ধিদীপ্তির ছাপ বৌদিকে আরো সুন্দরী করেছিল। রমার মধ্যে এটা আরো বেশি স্পষ্টভাবে চোখে পড়ত।

বহু মেয়ের দৈহিক সৌন্দর্য থাকে। বিদ্যাবুদ্ধিরও একটা নিজস্ব লাবণ্য আছে। রমার মধ্যে এই সৌন্দর্য আর লাবণ্যের মিলনে একটা অদ্ভুত শ্রী সবার দৃষ্টি টেনে নিত।

বৌদির অনুরোধ রক্ষা করতে কলকাতা যাবার পথে বেনারস গেছি রমার সঙ্গে দেখা করতে। আমি আগে থেকে ওকে চিঠি দিয়েছিলাম আমার আসার সব কিছু খবর জানিয়ে। ওদের হোস্টেলের কাছাকাছি এসে দোতলার বারান্দায কয়েকটি মেয়েকে দেখলাম। সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিটা নামিয়ে নিলাম। ঠিকই কিন্তু ঐ সামান্য কয়েকটা মুহূর্তের মধ্যেই একটা শ্ৰীমণ্ডিত মুখের চেহারা আমার মনের ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল। মিনিট খানেকের মধ্যেই ঐ মেয়েটিই আমার সামনে এসে হাজির হয়ে জিজ্ঞাসা করল, হোস্টেল খুঁজতে বেশি কষ্ট হয়নি তো?

আমি ওর প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে গেলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কি করে জানলে আমিই…

আপনার কতগুলো ছবি আমার কাছে তা জানেন?

আমার ছবি?

হ্যাঁ, আপনার ছবি। মা পাঠিয়েছেন।

তাই নাকি?

তা না হলে আমি কি করে আপনাকে দেখেই উপরের বারান্দা থেকে নেমে এলাম?

সেদিন বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে কিছু সময় কাটিয়েই হোটেলে ফিরে এলাম। ফিরে আসার আগে রমা জিজ্ঞাসা করল, কদিন এখানে থাকবেন?

কদিন মানে? কালই রাত্রে চলে যাব।

সেকি? দুচার দিন থাকবেন না?

দুচার দিন কেন থাকব?

আপনি থাকলে আমিও একটু ঘুরে ফিরে বেড়াতে পারব, নয়তো ওই হোস্টেলের মধ্যেই…

কেন? তোমরা বেড়াতে যাও না?

বেরুতে দেয় নাকি? বাবা চিঠি দিয়েছিলেন বলেই তো আপনার সঙ্গে একটু বেরুতে পারব।

পরের দিন রাত্রেই আমি কলকাতা রওনা হলেও সারাদিন দুজনে খুব ঘুরেছিলাম। টাঙ্গায় চড়ে সারনাথ যাবার পথে আমি আর না বলে পারলাম না, তুমি বাবার বুদ্ধি আর মার সৌন্দর্য পেয়েছ, তাই না?

রমা হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল, হঠাৎ একথা বলছেন?

ভাবছিলাম বলব না কিন্তু শেষ পর্যন্ত না বলে থাকতে পারলাম না।

.

এবার রাষ্ট্রপতি আমাকে দেখিয়ে বললেন, একে একদিন রাইস অ্যান্ড ফিসকারী খাইয়ে দিও। মাছের ঝোল-ভাত না খেলে তো কোনো বাঙালিরই শান্তি নেই।

তিনদিন ওয়াশিংটনে কাটিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম ঘুরতে। ওয়াশিংটন থেকে রওনা হবার আগে বৌদি আমাকে বললেন, নিউইয়র্ক থেকেই পালিয়ে যাবেন না, ওঁর সঙ্গে ফিরে আসবেন। সুভাষদাকেও সতর্ক করে দিলেন, না পারলে বলল আমি স্যারকে বলছি।

সুভাষদা হাসতে হাসতে বললেন, তুমি প্রেসিডেন্টের ছাত্রী বলে সামান্য একজন ফাস্ট সেক্রেটারিকে ভয় দেখাচ্ছ কেন?

ওয়াশিংটন ছাড়ার সময় বৌদির আতিথ্য উপভোগ করে ফিরে আসার সঠিক কোনো পরিকল্পনা না থাকলেও ফিরে এসেছিলাম। ওয়াশিংটন থেকে অ্যাম্বাসেডর, মিনিস্টার কাউন্সেলার আর ফাস্ট সেক্রেটারি সুভাষদা-ও প্রেসিডেন্টস পার্টিতে যোগ দিলেন। ঘুরলাম চিকাগো, বস্টন স্যানফ্রান্সিসকো, নিউইয়র্ক।এ সাত দিন সুভাষদার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে মিশলাম। রোজ রাত্রে আমরা দুজনে অনেক গল্প করতাম। সুভাষদা ডিপ্লোম্যাট। কুটনীতিবিদ। উঁচু গলায় কোনো কিছুপ্রচার করা তার ধর্ম নয়। স্বভাবও নয়। উন্মত্ত পদ্মা পাড়ের মানুষ হয়েও ওঁর স্বভাবটি ভাগীরথীর মতো শান্ত ও মিষ্টি। উচ্ছ্বাস নেই কিন্তু মাধুর্য আছে। সুভাষদার সঙ্গে নিউইয়র্ক থেকে আবার ওয়াশিংটন ফিরে গেলাম। সাতদিন ওদের অ্যাডান্স মিল রোডের অ্যাপার্টমেন্টে ছিলাম। অবিস্মরণীয় সাতটি দিন। রমা তখন ছিল না। বৌদির পদাঙ্ক অনুসরণ করে বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। কথা দিয়েছিলাম দেশে ফিরে এসে রমার সঙ্গে দেখা করব।

.

এর কবছর পর ভারতীয় সাংবাদিক প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে কায়রো গিয়ে দেখি সুভাষদা আমাদের অ্যাম্বাসীর মিনিস্টার কাউন্সেলার। তখন রমাও ওখানে। বেশিদিন নয়, মাত্র দুটি দিন ওদের কাছে ছিলাম। আসার দিন এয়ারপোর্টে পৌঁছে বৌদিকে বললাম, বৌদি, ঋণের বোঝা বড্ড বেশি বাড়ছে।

কার? তোমার না আমার?

আমি না হেসে পারলাম না। বললাম, আপনার।

বৌদি জবাব দিলেন, ন্যাকামি না করে মেয়েটার একটা পাত্র দেখে দাও তো।

বৌদির অনুরোধটা শুনতে আমার ভালো লাগেনি। কেন, তা জানি না। তবে বড় বেসুরো মনে হয়েছিল। একটু আহত, একটু বেদনাবোধ করেছিলাম মনে মনে। রমাকে আমি ভালোবাসিনি কিন্তু তবুও ও বিয়ে হয়ে বহু দূরে চলে যাক, তাও চাইনি। চাইতে পারিনি। বললাম, বিয়ের জন্য এত ব্যস্ত কি?

ব্যস্ত না হলেও চুপ করে বসে থাকার মতো বয়সও আর ওর নেই।

না, না, এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেবেন না। আগে এম. এ. পাস করুক, তারপর ভেবে দেখা যাবে। এবার রমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কি রমা, এম. এ. পড়বে তো?

ও সোজাসুজি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে একটু বাঁকা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ছেলেদের মতো মেয়েরা বিয়ে পাগল হয় না।

ওসব কথা আমাকে বলল না। আমি বরযাত্রী পর্যন্ত যাই না। একটু থেমে ওদের দুজনকে দেখে নিয়ে বললাম, বরযাত্রী না গেলেও তোমার বিয়েতে নিশ্চয়ই মাতব্বরি করব।

কেউ আপনাকে মাতব্বরি করতে বলছে না।

.

সুভাষদার কায়রো বাসের পালা শেষ হলো, দিল্লি ফিরে এলেন। রমার পাত্রের হদিশ এখনও দিতে পারিনি কিন্তু তবুও যে বৌদি দিল্লি এসেই আমার কথা মনে করেছেন, সুভাষদার মতো কুঁড়ে ঘরকুনো লোককে যে ছুটির দিন সকালে বের করতে পেরেছেন, তার জন্য কৃতজ্ঞ না হয়ে পারলাম। না। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে সুভাষদার সঙ্গেই বেরিয়ে পড়লাম। বৌদি সাদরে অভ্যর্থনা করলেন, একটু ঝগড়া একটু বকাবকি করলেন। ঠিক সেই আগের মতোই; একটুও পরিবর্তন হয়নি কিন্তু রমা যেন কেমন পাল্টে গেছে। সোজাসুজি আমার দিকে তাকাতে পারল না, দৃষ্টিতে সলজ্জ আবরণ। কথাবার্তা আলাপ-আচরণে একটু সংযত ভাব। সামান্য জড়তা, দ্বিধা। বুঝলাম শরৎ হেমন্ত শেষে। বসন্ত সমাগত। অস্বাভাবিক নয়। থার্ড ইয়ারের ছাত্রী।

খাওয়া-দাওয়ার আগে আমি আর সুভাষদা ড্রইংরুমে বসে গল্প করছিলাম। রাজনৈতিক, কুটনৈতিক বিষয়ের গল্প। আচ্ছা সুভাষদা, ইন্ডিয়া সম্পর্কে ইজিপ্টের অ্যাটিচিউড কি একটু বদলেছে?

না তা ঠিক নয়, তবে নাসেরের মতো অন্যান্য লীডাররা ঠিক অতটা প্রগ্রেসিভ নয় বলেই মাঝে মাঝে আমরা অনেক ডিফিকাল্টি ফেস করছি।

একজন নেতাকে কেন্দ্র করে কি একটা দেশের প্রতি আমাদের পলিসি ঠিক করা উচিত?

সমস্ত মিডল-ইস্ট আর ব্ল্যাক আফ্রিকাতে দেশের চাইতে ব্যক্তিই বড়।

হঠাৎ রমা ঘরে ঢুকে আমাকে জিজ্ঞাসা করল, আমাকে একটু বইয়ের দোকানে নিয়ে যাবেন?

কি বই কিনবে?

আমার কয়েকটা রেফারেন্স বই।

এমনি বইয়ের দোকান তো অনেক চিনি কিন্তু তোমাদের রেফারেন্স বই ঐসব দোকানে পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ।

না পাওয়া গেলেও ওরা বলে দেবে নিশ্চয়ই।

হ্যাঁ, তা তো বলবেই।

খাওয়া-দাওয়ার পরে নিয়ে যাবেন।

খাওয়া-দাওয়ার পর তো দুরের কথা, আজ রাত্রেও আমি বাড়ি ফিরছি কিনা সন্দেহ।

সুভাষদা বললেন, সেই ভালো। তুমি আর আজ বাড়ি যেও না।

রমা একটু বিরক্ত হয়েই বললো, বাড়ি ফিরবেন না বলে কি দু এক ঘণ্টার জন্য বইয়ের দোকানেও যাওয়া যায় না?

হঠাৎ খেয়াল হলো আজ রবিবার। আজ রবিবার তো সব দোকান আজ বন্ধ।

কাল আবার ভুলে যাবেন না।

আমি হাসি। বলি, তোমার হুকুম আমি ভুলব?

আমি হুকুম করব আপনাকে? অত সাহস আমার নেই।

রমা চলে যাচ্ছিল। সুভাষদা ডাক দিলেন, একটু দাঁড়া। এবার আমার দিকে তাকিয়ে সুভাষদা জিজ্ঞাসা করলেন, ভালো জিন আছে, একটু খাবে?

আমি রমার দিকে একবার তাকিয়ে বললাম, আপনার স্ত্রী আর মেয়ে অসন্তুষ্ট না হলে একটু খেতে পারি।

রমা আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে ড্রইংরুম থেকে বেরিয়ে গেল। একটু পরেই দু গেলাস জিন দিয়ে বললো, অসন্তুষ্ট না হয়েই দিলাম।

এ বাড়িতে আমার জন্য কেউ কোনোদিন অসন্তুষ্ট হবে না, তা আমি জানি।

সত্যিই তাই; দুপুরবেলায় খেতে বসে ছোলার ডালে নারকেল দেখেই বৌদিকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার এ দুর্বলতার কথা জানলেন কি করে?

সব দুর্বলতার কথা কি আমাকে বলেছ?

তেমন কিছু দুর্বলতা তো আমার নেই বৌদি।

খেতে খেতে অবাক লাগে কবে কোনদিন কোথায় বৌদিকে বলেছিলাম ছোলার ডালে নারকেল বা মিষ্টি চাটনী খেতে ভালোবাসি, তাও ওঁর মনে আছে। ভোলেননি মাছে বেশি কাঁটা থাকলে খেতে পারি না। আমি খাওয়া-দাওয়ার শেষে খুব গম্ভীর হয়ে বললাম, আমি আজই আমার চাকরটাকে বিদায় করে দেব।

বৌদি জিজ্ঞাসা করলেন, কেন?

এই রান্না খাবার পর আর ওর রান্না মুখে তুলতে পারব?

ওঁরা তিনজনেই হাসলেন।

বৌদি বললেন, কায়রোতে তোমার দাদার আন্ডারেই শ্রীনিবাসন সেকেন্ড সেক্রেটারি ছিল। হোম লিভ থেকে ফিরে যাবার সময় কয়েকটা নারকেল নিয়ে গিয়েছিল। আমাকে দুটো নারকেল দিয়েছিল। আমরা দুজনেই বলাবলি করতাম ঐ সময় তুমি যদি একবার হঠাৎ এসে হাজির হও…

তাহলে খুব নারকেল খাওয়াতেন! এই তো?

খুব না হলেও খাওয়াতাম।

সে দুঃখ এবার ঘুচিয়ে নেবেন।

ওসব কথা বাদ দাও। তবে এবার সময় পেলেই চলে আসবে।

সময় না পেলেও আসব।

ওঁরা আবার হাসেন। সুভাষদা উঠে গেলেন, আমি উঠছি।

বৌদি বললেন, যাও! তোমার মতো বেরসিক লোক না বসে থাকাই ভালো।

রমা প্রতিবাদ করে, তুমি বাবাকে অমন করে বলবে না তো!

কি এমন খারাপ কথা বললাম?

আমি হাসতে হাসতে রমাকে বললাম, আমার ব্যক্তিত্বের কাছে তোমার বাবা একটু ম্লান হয়ে যাচ্ছেন বলেই বোধহয়…।

তা তো বটেই! আপনার মতো ব্রিলিয়ান্ট লোক তো আমরা কোনোদিন দেখিনি!

এ বাড়িতে তুমিই বোধহয় আমাকে ঠিক সহ্য করতে পার না, তাই না রমা?

রমা কিছু বলার আগেই বৌদি বললেন, তোমাকে দেখেই তো ও মাঝে মাঝে জার্নালিস্ট হতে চায়।

পরের দিন বইয়ের দোকানে নিয়ে যাবার সময় জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি জার্নালিস্ট হতে চাও নাকি?

হতে চাইলেই কি হতে পারব?

কেন হতে পারবে না?

সে অনেক অসুবিধে আছে।

অনেক অসুবিধা আবার কি?

সে আপনি বুঝবেন না।

আমি বোধহয় তোমার কোন ব্যাপারই বুঝব না, তাই না রমা?

রমা কোন জবাব দিল না। চুপ করে রইল। একটু পরে জিজ্ঞাসা করল, আপনার বাড়িটা কতদূর?

দিল্লিতে কোনো কিছুই কাছাকাছি নয়; এমনকি মানুষগুলোও না।

রমা হাসল। অনেক দূর?

খানিকটা দূর ঠিকই, তবে ইচ্ছা করলে সে দূরত্ব অতিক্রম করা যায়।

মোতিবাগ থেকে শান্তি পথ দিয়ে তিন মূর্তি ভবন-সাউথ অ্যাভিনিউ পার হয়ে আস্তে আস্তে কনট প্লেসের কাছে এলাম। যন্তর মন্তরের কাছে গাড়ি পার্ক করে গাড়ি থেকে বেরুতেই রমা বললো, কি দারুণ গরম!

এই মে-জুন মাস দুটো সত্যি বড় খারাপ।

আর এই দুটো মাসই আমাকে এখানে কাটাতে হবে।

হাঁটতে হাঁটতে বললাম, গরমের হাত থেকে বাঁচার জন্য আমি তো মাঝে মাঝে সিনেমা হলে ঢুকে পড়ি।

আপনি বুঝি খুব সিনেমা দেখেন?

বিশেষ সময় তো পাই না, তবে মাঝে মাঝে দেখি।

আপনি কখন অফিস যান?

পার্লামেন্ট থাকলে এগারোটার মধ্যে বেরুতে হয়; নয়তো একটা-দেড়টার পর অফিস যাই।

কখন ফেরেন?

তার কোনো ঠিক নেই।

ঠিক নেই মানে রাত্রে আটটানটা হয়ে যায়?

কাজ না থাকলে আটটানটা, থাকলে আরো বেশি রাত হয়।

সে কি?

সপ্তাহে দুএকদিন সাড়ে এগারোটা বাবোটা হয়ই।

রমা চমকে ওঠে, বলেন কি?

আমরা যদি রাত্রে কাজ না করি তাহলে ভোরবেলায় কাগজে সব খবর পাবে কি করে?

দুটো-তিনটে দোকানে ঘোরাঘুরি করে ওর বইগুলো পাওয়া গেল। আবার হাঁটতে হাঁটতে গাড়ির কাছে ফিরে এলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, কোল্ড ড্রিঙ্ক খাবে?

না।

জল পিপাসা লাগেনি?

আপনার বাড়ি গিয়ে চা খাব।

যাবে?

যাব না কেন?

পাঁচ মিনিটে আমার কাকানগরের আস্তানায় এসে হাজির হলাম। রাধাকিষণ দরজা খুলতেই বললাম, সকালবেলায় যে বাবুজি এসে আমাকে নিয়ে গেলেন, তার মেয়ে। রমা।

রাধাকিষণ হাত জোড় করে নমস্কার করল, নমস্তে দিদি!

নমস্তে। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে রমা বললো, তোমার কাছে চা খেতে এলাম।

জরুর। আপনারা বাবুজিকে এত ভালোবাসেন আর আমি আপনাকে চা খাওয়াব না?

রমা তখনও দাঁড়িয়ে। হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল, আমরা তোমার বাবুজিকে ভালোবাসি সেকথা তোমাকে কে বললো?

বিলাইত-আমেরিকা গেলে আপনারা বাবুজিকে কত যত্ন করেন, সে-সব আমি জানি।

রমা আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি বুঝি ওকে সবকিছু বলেন?

আর কাকে বলব বল?

রাধাকিষণ ভিতরে গেল। আমি বললাম, বসো।

আপনার বাড়িটা দেখব না?

সেজন্যে তো অনুমতি নেবার প্রয়োজন নেই।

আমি ড্রইংরুমে বসলাম। রমা আমার আস্তানা দেখার জন্য ভিতরে চলে গেল। খানিকক্ষণ পরে ফিরে এসে বললো, আপনার টেবিলের উপর আমার একটা জিনিস ছিল। আমি নিয়ে নিলাম।

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার টেবিলে তোমার জিনিস?

হ্যাঁ।

কি ছিল?

আপনি জানেন না?

কই না তো।

আমার একটা চিঠি ছিল। আমি নিয়ে নিলাম।

হেসে উঠলাম।তোমার বাবা মার চিঠি পেলেই তোমাকে একটা চিঠি লিখতাম কিন্তু অধিকাংশ চিঠিই শেষ করতে পারতাম না বলে পোস্ট করা হতো না।

রমা বসতে বসতে বললো, সে তো চিঠি দেখেই বুঝতে পারছি। সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করল, শেষ করতে পারতেন না কেন?

কি লিখব কিছুতেই ভেবে পেতাম না।

চমৎকার লোক আপনি।

চমৎকার না হলেও একটু অদ্ভুত নিশ্চয়ই।

রাধাকিষণ চা আর এক প্লেট স্যান্ডউইচ সেন্টার টেবিলে রেখে জিজ্ঞাসা করল, আর কিছু আনব?

রমা বললো, না, না, আমি শুধু চা খাব।

আমি বললাম, প্রথম দিন আমার বাড়িতে এসে শুধু চা খেয়ে যেও না।

আপনি তো আমাকে আসতে বলেননি; আমি নিজেই তো এলাম।

ঠিক, সামাজিক কাণ্ডজ্ঞান যে আমার বিশেষ নেই, তা বোধহয় এতদিনে তোমরা বুঝেছ?

শুধু সামাজিক কেন, অনেক কাণ্ডজ্ঞানই আপনার নেই।

ছেলেদের চাইতে মেয়েদের কাণ্ডজ্ঞান অনেক বিষয়েই বেশি হয়। রমা আমার চাইতে বেশ কয়েক বছরের ছোট হলেও হয়তো আমার চাইতে ওর কাণ্ডজ্ঞান বেশি। আমি চুপ করে গেলাম।

কি হলো? কথা বলছেন না যে? রমা আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল।

কই কিছু না তো।

আপনি নিশ্চয়ই আমার কথায় রাগ করেছেন।

না, না, রাগ করবো কেন?

তবুও রমা একটু কৈফিয়ত না দিয়ে পারল না, আপনার সঙ্গে আমরা বড় বেশি জড়িয়ে পড়েছি। তাই কোনো ভাবনা চিন্তা না করেই অনেক সময় অনেক কথা বলি কিন্তু মনে কোনো…

মাঝ পথেই আমি ওকে বাধা দিলাম, তা আমি জানি। খুব ভালো করেই জানি।

আমার উপর রাগ করেননি তো?

না।

ঠিক বলছেন?

তোমার উপর বোধহয় আমি কোনদিনই রাগ করব না।

.

গরমের ছুটিটা দেখতে দেখতে ফুরিয়ে গেল। তারপর একদিন রমা বেনারস ফিরে গেল। সুভাষদার কাছে পৌঁছানোর সংবাদ এলো টেলিগ্রামে, রিচড় সেফলি। কদিন পরে আমার কাছেও একটা চিঠি এলো, ছুটির পর হোস্টেলে ফিরে এসে প্রত্যেকবারই খারাপ লাগে। এবার আরো বেশি। খারাপ লাগছে। বিদেশের চাইতে দিল্লিতে বাবা-মাকে আরো আরো অনেক বেশি কাছে পেয়েছি। তাছাড়া আপনার জন্য মে-জুন মাসের দিল্লির রুক্ষতা কখনও অনুভবই করলাম না। কলকাতা যাতায়াতের পথে নিশ্চয়ই বেনারস ঘুরে যাবেন।

শেষে ছোট একটা টিপ্পনী–অসমাপ্ত চিঠিই ডাক বাক্সে ফেলবেন।

ঐ ছোট্ট টিপ্পনীর জন্যই একটা চিঠি লিখে ফেললাম। চিঠি লেখার অভ্যাস আমার নেই, তা তুমি জান। তবুও যা দুটো-একটা চিঠি লিখব, তা কখনই অসমাপ্ত হবে না। টাইপ রাইটার খট খট করে রিপোর্ট লিখতে লিখতে এমন অভ্যাস হয়ে গেছে যে কলম ধরতে পারি না। বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন এজন্য অনেকেই আমার উপর অসন্তুষ্ট কিন্তু তোমাদের মতো যাদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা মানসিক, তারা কখনই আমাকে ভুল বুঝবে না। কলকাতায় যাতায়াতের পথে সব সময় বেনারস যাওয়া সম্ভব না হলেও মাঝে মাঝে নিশ্চয়ই দেখা হবে।

.

সুভাষদা আর জয়ন্তী-বৌদির জন্য আমার জীবনধারাটাও বদলে গেল। শনিবার একটু রাত করে গেছি। দরজা খুলেই বৌদি বললেন, নিশ্চয়ই কোনো ডিপ্লোম্যাটিক পার্টিতে হুইস্কি খেতে গিয়েছিলে?

বৌদির কথায় আমি হাসি। বলি, ডিপ্লোম্যাটিক পার্টিতে হুইস্কির জন্য যাই না, যাই কিছু নিউজ পাবার লোভে।

ওই ছুতোর নাম করে জার্নালিস্টগুলো শুধু মদ খেতেই যায়।

বৌদির মুখের সামনে আলতো করে একটা হাত দিয়ে বললাম, এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আর বকাবকি করবেন না। আশপাশের ফ্ল্যাটের লোকজন শুনলে কি ভাববে বলুন তো?

বৌদি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, তোমার একটু বদনাম হওয়াই দরকার।

ঘরে ঢুকতেই সুভাষদা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই যদি বৌদির রূপ হয় তাহলে কি হতো ভাবতে পার?

বৌদি গম্ভীর হয়ে বললেন, আমরা না থাকলে তোমাদের যে কি দশা হতো তা একবার দেখতে ইচ্ছে করে।

আমি সুভাষদার পাশে বসে বললাম, আমাকে দেখেও তা বুঝতে পারছেন না?

তুমি তো হাফ ব্যাচেলার!

তার মানে?

তোমার সঙ্গে কত বৌ-বৌদির কত রকমের ঘনিষ্ঠতা যে…

আমি মাথা নাড়তে নাড়তে বললাম, শুধু একবার প্রেম করে ব্যর্থ হওয়া ছাড়া আমার জীবনে আর কোনো মেয়ের আবির্ভাব হয়নি।

বৌদি হাসতে হাসতে ড্রইংরুম থেকে ভিতরে চলে গেলেন।

সুভাষদা বললেন, ও তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়া করে সিনেমায় যাবে ভেবেছিল। তুমি দেরি করে আসার জন্য…

সে কথা তো আমাকে আগে বলতে হয়।

খেতে বসে খুব গম্ভীর হয়ে বললাম, জানেন বৌদি, আজ ভীষণ সিনেমা দেখতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু…

সন্দেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বৌদি বললেন, নিশ্চয়ই তোমার দাদা কিছু বলেছেন।

সুভাষদা বললেন, আমি তো কিছু বলিনি।

আমিও বললাম, দাদা কি বলবেন? সঙ্গে সঙ্গে বললাম, কালকে নিশ্চয়ই যাব।

দয়া করে একটু আগে থেকে জানিও।

.

দীর্ঘদিন বিদেশে থাকার জন্য হিন্দী বাংলা সিনেমা দেখার জন্য বৌদির খুব আগ্রহ। সময় পেলেই আমরা দুজনে সিনেমায় যাই। সুভাষদা যান না। সিনেমায় ওঁর ভীষণ অরুচি। উনি বাড়িতে বসে বসে বই পড়েন অথবা কোনো পার্টিতে যান। কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে আড্ডা দিয়ে, সিনেমা দেখে, এখানে-ওখানে বেড়িয়ে দিনগুলো হারিয়ে যায়। ফুরিয়ে যায়। ওঁরা ছুটিতে কলকাতা যাবার পথে বেনারস থেকে রমাকে নিয়ে নেন। আমি দিল্লিতেই থাকি। কাজ করি। অফিসের কাজে বাইরে যাই। যাই কলকাতাতেও। দুটো একটা দিন খুব হৈ-চৈ করে আবার ফিরে আসি রাধাকিষণের কাছে।

রমা বি. এ. পাস করে। এম. এ. পড়তে শুরু করে। দিল্লি আসে।

বাবুজি! বাবুজি! চা

দর মুড়ি দিয়ে শুয়ে শুয়েই উত্তর দিই, কি হলো?

দিদি আয়া হ্যায়।

কোনো দিদি এলো রে?

রমা দিদি।

মুখ থেকে চাদর সরিয়ে আবার জিজ্ঞাসা করি, কে এসেছে?

রমা দিদি।

সঙ্গে সঙ্গে রমা ঘরে ঢুকল। কটা বাজে জানেন!

কটা?

পৌনে দশটা!

পৌনে দশটা?

বিশ্বাস না হয় নিজের ঘড়িটা দেখুন!

রাধাকিষণ চলে গেল। আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে ঘড়ি খুঁজছি। রমা বললো, আপনার হাতেই তো ঘড়ি আছে।

ঘড়িটা দেখেই লজ্জিত হয়ে ওর দিকে তাকালাম।

কোনো স্বপ্ন দেখছিলেন নাকি? হাসতে হাসতে রমা প্রশ্ন করল।

কেন বলল তো?

হাতে ঘড়ি রয়েছে আর খুঁজে বেড়াচ্ছেন…

স্বপ্ন দেখার বয়স কি আর আছে?

আর লেকচার দিতে হবে না। এবার উঠুন।

কিন্তু তুমি কবে এলে, তাই আগে বল।

কাল রাত্রে এসেছি।

কই তোমার মা বাবা তো কিছু জানাননি আমাকে।

ওঁরাও ঠিক জানতেন না। রিজার্ভেশন পাবার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা চারটি মেয়ে একসঙ্গে চলে এলাম।

ভালোই করেছ। বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে বললাম, একটু বসো। এক্ষুনি আসছি।

বাথরুম থেকে বেরুতেই রাধাকিষণ চা দিল। রমাকে শুধু চা দেবার জন্য খারাপ লাগল। ওকে শুধু চা দিলে কেন?

রমা বললো, আমি খেয়ে এসেছি।

তাহলেও সামান্য কিছু তো…

এখন কিছু খাব না।

ঠিক তো?

তবে কি আমি মিথ্যে বলছি?

রাধাকিষণ চলে যেতেই রমা জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা আমি একটু মোটা হয়েছি, তাই না?

একবার ভালো করে ওকে দেখলাম।মোটা হয়েছ কিনা জানি না, তবে তোমাকে দেখতে আরো ভালো লাগছে।

ঐসব আজেবাজে কথা বললে এক্ষুনি চলে যাব।

আজেবাজে কথা বলছি নাকি?

তবে কি?

সত্যি বলছি, ইউ লুক ভেরী প্রেটি!

থাক। আর আমার রূপের তারিফ করতে হবে না।

খালি চায়ের কাপ সরিয়ে রেখে জিজ্ঞাসা করলাম, বল কেমন আছো?

ভালোই আছি।

পড়াশুনা কেমন চলছে?

মোটামুটি।

মোটামুটি কেন?

খুব বেশি পড়াশুনা করতে আর ভালো লাগে না।

তাহলে কি এবার বিয়ে করতে চাও?

হ্যাঁ। বিয়ে করার জন্য তো আমি পাগল হয়ে উঠেছি।

খুব অস্বাভাবিক নয়।

থাক! ওসব কথা আপনাকে ভাবতে হবে না।

সেই ভালো। এইভাবে যতদিন থাকো, ততই ভালো।

মাত্র দেড় মাসের ছুটি। তাহোক খুব আনন্দে কাটল দিনগুলো। রমা এলে ওদের বাড়িতে আমার যাতায়াত বেড়ে যায়। বৌদি প্রায়ই কিছু স্পেশাল রান্না করেন আর আমিও তার অংশীদার হই। দুচারদিন পর পর রমাও আমার আস্তানায় আসে।

জান রমা, তুমি এলে দিনগুলো বেশ কেটে যায়।

তাই তো দিল্লি থেকে গেলেই ভুলে যান।

চিঠি লিখি না মানেই কি ভুলে যাই?

কলকাতায় যাতায়াতের পথেও তো একবার নামতে পারেন।

সব সময় ঠিক সম্ভব হয় না।

এই এক বছরের মধ্যে একবারও সম্ভব হলো না?

এবার ঠিক যাবো।

কথা দিচ্ছেন?

হঠাৎ ওর হাতটা চেপে ধরে বললাম, তোমাকে ছুঁয়ে বলছি।

আমি তাড়াতাডি হাতটা সরিয়ে নিতেই ও হাসতে হাসতে বললো, আসবেন। খুব খুশী হব।

.

সুভাষদার দিল্লি বাসের মেয়াদ তিন বছর। কোথা দিয়ে কেমন করে যে তিনটি বছর পালিয়ে গেল, তা বুঝতেই পারলাম না। দুঃখ দুর্দিনের রাত্রি শেষ হতে চায় না, অন্ধকার চিরস্থায়ী মনে হয় কিন্তু আনন্দের দিনগুলো, বাসর রাত্রি যেন নিমেষেই ফুরিয়ে যায়। সুভাষদা মস্কো বদলী হলেন। রমা বেনারস থেকে আসতে পারেনি। কয়েক মাস পরেই এমএ পরীক্ষা। পরীক্ষা দিয়েই মস্কো যাবে। যাবার দিন শুধু বৌদি নয়, সুভাষদাও রমার জন্য একটা ছেলে দেখতে বললেন।

নিশ্চয়ই চেষ্টা করব।

বৌদি বললেন, বিয়ে দিতে পারছিলাম না বলেই এম-এ পড়ালাম কিন্তু এবার তো বিয়ে না দিলেই নয়। তাছাড়া ওর রিটায়ার করার টাইমও এসে গেল।

আমি চুপ করে সব কিছু শুনলাম কিন্তু মনে মনে জানতাম, রমার বিয়ের পাত্র আমি কখনই খুঁজে বের করব না।

সুভাষদা মস্কো রওনা হয়ে যাবার পরই রমাকে একটা চিঠি লিখলাম, তোমার বাবা-মাকে মস্কোর প্লেনে চড়িয়ে দেবার পরই খেয়াল হলো তোমার বেনারস বাসের মেয়াদও দীর্ঘ নয়। কয়েক মাস পরেই তোমার ফাইনাল পরীক্ষা। তারপর তুমি মস্কো যাবে। তারপর? অনেক কিছু ঘটতে পারে তারপরে। হয়ত তুমি হারিয়েই যাবে। আর তোমার সঙ্গে আমার দেখাই হবে না। হওয়া সম্ভব হবে না। ভবিষ্যতে আরো কত কি হতে পারে, তাই না? যাই হোক দু একদিনের জন্য বেনারস যাব ভাবছি। তোমার পড়াশুনার বিশেষ ক্ষতি না হলেই যাব। নয়তো তোমার মস্কো যাবার সময় নিশ্চয়ই দেখা হবে।

এক সপ্তাহের মধ্যেই রমার চিঠি পেলাম, আপনার চিঠি পেয়ে খুব ভালো লাগল। রবিবার ছুটি। সোমবার আমাদের কোনো ক্লাস থাকে না। সুতরাং যে কোনো রবিবার সকালে আসতে পারেন। আমি কী গেস্ট হাউসে আপনার থাকার ব্যবস্থা করব? নাকি হোটলেই থাকবেন? জানাবেন। আসার আগে হোস্টেল সুপারিন্টেডেন্টকে নিশ্চয়ই একটা টেলিগ্রাম করবেন।

শেষে লিখেছে, আমি হারিয়ে যাব কেন? আপনার সঙ্গে আমাদের কি সেই সম্পর্ক?

.

আমি বেনারস গেলাম। না গিয়ে পারলাম না কিন্তু কেন গেলাম তা জানি না। আসার দিন স্টেশনে রমাকেই জিজ্ঞাসা করলাম, কেন এলাম বলো তো রমা?

ভালো লাগল না বুঝি?

ভালো লাগল বৈকি কিন্তু তবুও মনে হচ্ছে যে জন্য এসেছিলাম তা বোধহয় হলো না।

আমাকে কিছু বলবেন?

না। কি আর বলব? সঙ্গে সঙ্গেই আবার প্রশ্ন করলাম, তুমি কিছু বলবে?

ট্রেন ছেড়ে দিল। আমার প্রশ্নের জবাব দেবার অবকাশ পেল না রমা।

অদৃষ্টের এমনই যোগাযোগ ও মস্কো যাবার সময় আমি দিল্লিতেই থাকতে পারলাম না। কমনওয়েলথ প্রেস ইউনিয়নের স্কলারশিপ নিয়ে এক বছরের জন্য লন্ডন চলে গেলাম।

.

এই রমার সঙ্গেই দেবব্রতর বিয়ে হলো। কার্ড দেখে প্রথমে বুঝতে পারিনি। ওর ভালো নাম যে রঞ্জনা, তা আমি জানতাম না। তাছাড়া দেবব্রতর এক দিদি খুব ছেলেবেলায় মারা যান। তার নামও রমা ছিল বলে ওরা রঞ্জনা বলেই ডাকেন।

ঢাকুরিয়ায় সুভাষদাদের বাড়ি আছে। তাছাড়া ওঁর বাবা জীবিত বলে কলকাতাতেই বিয়ে হয়। এর কদিন পরেই আমি ফিরে এলাম। বিয়ের পর ডক্টর চৌধুরী দিল্লিতে রিসেপসন দিলেন। ঐ রিসেপসনে গিয়ে বিয়ের গল্প শুনে আমি তাজ্জব।

এম-এ পরীক্ষা দিয়ে রমা মস্কো যাচ্ছিল। অত্যন্ত জরুরী কারণে ডক্টর চৌধুরীও মস্কো যাচ্ছিলেন ঐ একই ফ্লাইটে। পালামের ডিপারচার লাউঞ্জে কেউই কাউকে খেয়াল করেননি। এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট। অনেক ভারতীয় যাত্রী। সুতরাং খেয়াল হবার কোনো অবকাশও ছিল না। দিল্লি থেকে সোজা মস্কো, তারপরই লন্ডন। ঠিক সময়ই প্লেন টেক অফ করল। কাবুল ওভার-ফ্লাই করে হিন্দুকুশ পর্বতের উপর দিয়ে উড়ে যাবার সময়ই এঞ্জিনে গণ্ডগোল দেখা দিল। মস্কো নয়, তাসখন্দেই প্লেন ল্যান্ড করল। তাসখন্দ এয়ার পোর্টের ট্রানজিটে লাউঞ্জেই রমার সঙ্গে ডক্টর চৌধুরীর প্রথম আলাপ। অনেকক্ষণ চুপচাপ পাশাপাশি বসেছিলেন দুজনে। তারপর ডক্টর চৌধুরীই প্রথম আলাপ শুরু করলেন, লন্ডন যাচ্ছেন?

না, মস্কো।

কেন, স্কলারশিপ পেয়ে পড়তে যাচ্ছেন?

আমি বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, মানে এম-এ পরীক্ষা দিয়ে বাবা-মার কাছে যাচ্ছি।

আপনার বাবা-মা মস্কো থাকেন?

থাকেন মানে এখন ওখানেই পোস্টেড।

দুজনেই ইংরেজিতে কথা বলছেন। কেউই জানেন না কে কোথাকার লোক। ডক্টর চৌধুরী। জানতে চাইলেন, আপনার বাবা কি আমাদের এম্বাসীতে আছেন?

হ্যাঁ।

আপনার বাবার নামটা জানতে পারি?

রমা হাসতে হাসতে বললো, নিশ্চয়ই। আমার বাবার নাম সুভাষ রায়।

এবার ডক্টর চৌধুরী খুশীতে চমকে উঠলেন, আপনি বাঙালি?

আমাকে আপনি বলার দরকার নেই। আমি আপনার চাইতে অনেক ছোট।

দেবতোষ চৌধুরী খুশী হয়ে বললেন, আজকাল আপনি বলাটাই নিরাপদ–কারণ অধিকাংশ। ছেলেমেয়েরাই তুমি বলা পছন্দ করে না।

বড়দের কাছে ছোট হতে আমার ভালোই লাগে।

আধুনিক বিমান যত দ্রুত গতিতে দেশ দেশান্তর পার হয়, বিকল হলে তত বেশি সময় নষ্ট করে। অধিকাংশ যাত্রী অধৈর্য হলেও ডক্টর চৌধুরী আর রমা মনের আনন্দে গল্প করেন।

কি আশ্চর্য! এতক্ষণ তোমার সঙ্গে গল্প করছি কিন্তু তোমার নামটাও জানলাম না।

আমার নাম রঞ্জনা রায়।

বাঃ! বেশ সুন্দর নাম! আমার নাম দেবতোষ চৌধুরী। লোকে বলে ডক্টর চৌধুরী।

মস্কো এয়ারপোর্টেই সুভাষদা আর বৌদির সঙ্গে ডক্টর চৌধুরীর আলাপ হলো। আলাপ না থাকলেও ডক্টর চৌধুরী সুভাষদার অপরিচিত ছিলেন না। ফার্স্ট সেক্রেটারি পদ্মনাভন ও সোভিয়েট একাডেমী অফ সায়েন্সের একজন প্রতিনিধি তাকে রিসিভ করতেই এয়ারপোর্টে এসেছে, তাও জানেন। আলাপ হয়ে খুব খুশী হলেন। এয়ারপোর্ট থেকে বিদায় নেবার আগে ডক্টর চৌধুরী সুভাষদাকে বললেন, মিঃ রায়, রঞ্জনা একদিন আমাকে খাওয়াবে বলছে। আপনার আপত্তি নেই তো?

সে তো সৌভাগ্যের কথা।

মাত্র একদিন নয়, চার-পাঁচ দিন উনি সুভাষদার অ্যাপার্টমেন্টে এলেন, খেলেন, গল্প করলেন। একদিন রমাকে নিয়ে ক্রেমলিন প্যালেস দেখতে গেলেন। গ্রান্ড ক্রেমলিন প্যালেস, লেনিনের। পড়াশুনার ঘর, রেড স্কোয়ার ঘুরতেই ডক্টর চৌধুরী নিজেদের পরিবারের, নিজের, দেবব্রতর অনেক কথা বলেন। একটা কথা বলব রঞ্জনা?

সেজন্য অনুমতি চাইছেন কেন?

কথাটা একটু জরুরী। তাছাড়া তোমার ভবিষ্যতের প্রশ্ন জড়িত বলেই অনুমতি চাইছিলাম।

রমা চুপ করে রইল।

তুমি অনুমতি দিলে দেবুর সঙ্গে তোমার বিয়ের প্রস্তাব করতাম তোমার বাবা-মার কাছে।

রমা নিরুত্তর থেকেছে।

রমা রঞ্জনা হয়ে গেল।

০৪. রমার বিয়ে হয়ে ভালোই হলো

রমার বিয়ে হয়ে একদিক থেকে ভালোই হলো। ওর বাবাকে আমি দাদা বলি, মাকে বৌদি। কিন্তু ওঁদের চাইতে আমি অনেক ছোট, হাজার হোক আমি জার্নালিস্ট। কাজকর্মে কখনও কখনও বিদেশ যাই। আলাপ হয় বহু ইন্ডিয়ান ডিপ্লোম্যাটের সঙ্গে। ঘনিষ্ঠতাও হয় কয়েকজনের সঙ্গে। সুভাষদাদের সঙ্গেও হয়েছে। কিন্তু তাই বলে তো ওঁকে আমি কাকাবাবু বা মামাবাবু বলতে পারি না। দাদা বলি। মিসেস জয়ন্তী রায়কে বৌদি বলি। এই রকম অজস্র দাদা-বৌদি আমার আছে। পার্লামেন্টের বহু প্রবীণ সদস্যকেও দাদা বলি। সেন্ট্রাল হলে বসে রসের গল্প করি। অথচ ওঁদের অনেকেরই নাতনীদের সঙ্গে নিঃসন্দেহে আমি প্রেম করতে পারি।

সুভাষদাদের সঙ্গে আমার বয়সের পার্থক্য অতটা না হলেও যথেষ্ট। রমা আমার চাইতে কয়েক বছরের ছোট কিন্তু এমন ছোট নয় যে ও আমাকে কাকু বলতে পারে। আমি এমন বড় নই যে ওর বন্ধু হতে পারি না বা আমাদের দুজনের মনের মধ্যে একই সঙ্গে একটা ছোট্ট মিষ্টি স্বপ্ন দানা বাঁধতে পারে না। বিচ্ছিরি না হলেও বেশ অস্বস্তিকর পরিস্থিতি ছিল। ওর বিয়ে হয়ে অন্তত এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে বেঁচেছি। রমাও নিশ্চয়ই স্বস্তি পেয়েছে।

রমার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় বেনারসে। আমেরিকা থেকে ফিরে আসার পরই বৌদি ওকে চিঠি দিয়েছিলেন। মনে হয় আমার সম্পর্কে অনেক ভালো ভালো কথাই লিখেছিলেন। বৌদি আমাকেও জানান যে ওকে চিঠি দিয়েছেন। রমার সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ থাকলেও দ্বিধা ছিল মনে মনে। তার অনেক কারণ ছিল। তবু গিয়েছিলাম। একবার কলকাতা যাবার পথে বেনারস ঘুরে গেলাম। বেশ লেগেছিল। একটি মিষ্টি স্মৃতির প্রলেপ লেগেছিল আমার মনে।

এরপর মাঝে মাঝেই ওর কথা মনে পড়ত। দুএকবার ওকে চিঠি লিখেছি। অতি সাধারণ মামুলি চিঠি। বোধহয় খামে ঠিকানাও টাইপ করেছি কিন্তু ডাক বাসে ফেলিনি। ভেবেছি কি দরকার। যে স্মৃতিটুকু বুকে নিয়ে বেঁচে আছি, সেইটুকুই থাক। অম্লান থাক। ঐ পুঁজিটুকু নিয়েই আমার দিন কেটে যাবে। আমি না লিখলেও নববর্ষে রমার একটা ছোট চিঠি এসেছিল। নিছক শুভ কামনা। খামের মধ্যে ঐ নীল প্যাডের পাতায় তিন চার লাইনের চিঠিতে শুভ কামনার চাইতে কি যেন একটু বেশি ছিল। আমি জবাব দিলাম পোস্টকার্ডে তোমার শুভ কামনার জন্য ধন্যবাদ।

বেনারসের পর রমার সঙ্গে ভালোভাবে আবার আলাপ হলো কায়রোতে। ওদের বাড়িতে মাত্র দুদিন ছিলাম। আমাকে ভালোভাবে খাওয়াবার জন্য বৌদি এমন মেতে উঠলেন যে কিচেন থেকে লিভিংরুম-এ এসে গল্প করার সময় পর্যন্ত ছিল না। আমি কিচেনের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৌদির সঙ্গে গল্প করি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কয়েকটা ট্রাভেলার্স চেক ভাঙিয়ে সামান্য কিছু কেনাকাটার ছিল বলে প্রথমবার বেরুবার সময় বৌদিই বললেন, রমা তুই বরং ওর সঙ্গে যা। রমার সঙ্গেই বেরুলাম। প্রথমেই কাসর এল নীল স্ট্রিটে আমেরিকান একপ্রেসে গিয়ে ট্রাভেলার্স চেকগুলো ভাঙালাম। ব্যাঙ্ক থেকে বেরুবার সময়, রমা জিজ্ঞাসা করল, আপনি কায়রোয় এই প্রথম এলেন?

না, এর আগেও দুবার এসেছি।

তাহলে তো আপনিই আমার গাইড হতে পারেন।

একটু হাসলাম, না, অতটা চিনি না। বড় হোটেলে থেকে ট্যাকসিতে ঘুরলে কোনো কালেই কোনো শহর চেনা যায় না।

তা ঠিক।

তুমি পিরামিড-টিরামিড সব কিছু দেখেছ?

হ্যাঁ। দেখেছি।

কায়রো কেমন লাগছে?

ভালোই। বিশেষ করে নাইলের সাইডটা সত্যি ওয়ান্ডারফুল।

পরের দিন আমি, বৌদি আর রমা সিনেমা দেখলাম। বোধহয় কায়রো প্যালেসে। আমার দিন আসার ফ্লাইট ছিল অনেক রাত্রে। বৌদির অনুরোধে দুপুরবেলায় খাওয়া-দাওয়া করেই খানিকক্ষণ ঘুমুতে হলো। সেই সেদিন বিকেলবেলায় রমার সঙ্গে আবার একটু ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। ঘুরতে ঘুরতে শেষ পর্যন্ত কায়রো-টাওয়ারে গেলাম। কায়রো-টাওয়ারে বসলে মনে হয় মহাশূন্যে ঘুরছি। ভারি ভালো লাগে। মজা লাগে। একটু রোমাঞ্চ উত্তেজনাও। সমস্ত কায়রো শহরটা, নাইল নদী, পিরামিড, আরো কত কি দেখা যায়।

বাবা-মা তো আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

তাই নাকি?

হ্যাঁ।

আমি হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলাম, আর তুমি বুঝি আমার নিন্দা করো?

কার কাছে আপনার প্রশংসা বা নিন্দা করব বলুন?

হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, কেন? মনে মনে?

রমা যেন একটু লজ্জা পেল।

ট্যাকসিতে বাড়ি ফেরার পথে ও জিজ্ঞাসা করল, কবে বেনারস আসছেন?

ঠিক নেই।

কলকাতায় তো মাঝে মাঝেই যান?

তা যাই।

তবে?

তবে কি বেনারসে নামব? একটু হাসলাম, তোমার হোস্টেলে গিয়ে দেখা করতে ভীষণ অস্বস্তি লাগে।

কেন?

একটু ভাবলাম, জানি না কে কি ভাবব।

রমাও হাসল। বললো, মনে পাপ না থাকলে অস্বস্তি করার তো কথা নয়।

মুহূর্তের জন্য ভেবে বললাম, মনে মনে কে পাপী নয়? তুমি না?

রমা আর কথা বলেনি অনেকক্ষণ। বাড়ির কাছাকাছি এলে বললো, যাই হোক কলকাতায় যাতায়াতের পথে বেনারস নামবেন।

নামব?

হ্যাঁ, নামবেন।

হোস্টেলে গিয়ে দেখা করতে পারব না।

বেশ। আগের থেকে খবর দেবেন। আমি গিয়ে দেখা করব।

পরে বেনারসে রমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আমি গিয়েছিলাম। যেতে হয়েছিল। ও তখন এম এ পড়ে। সুভাষদারা মস্কোয়। বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে গণ্ডগোলের খবর পেয়েই সুভাষদা আমাকে টেলিগ্রাম পাঠালেন রমাকে দেখে খবর দেবার জন্য। আমি পৌঁছবার আগেই গণ্ডগোল বন্ধ হলেও তখনও পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। ক্যাম্পাসে ঢুকতে, বেরুতে পাস লাগে। রমা আমাকে। দেখে অবাক, আপনি হঠাৎ?

আগে বল তুমি কেমন আছ?

ও হাসতে হাসতে বললো, কেন? দেখে কি মনে হচ্ছে খারাপ আছি?

দেখে তত ভালোই মনে হচ্ছে কিন্তু খবরের কাগজ পড়ে ভেবেছিলাম হয় হাসপাতালে নয়তো পুলিশ লক-আপে তোমাকে দেখতে পাব।

তাহলে তো আপনার আশা ভঙ্গ করলাম।

নিঃসন্দেহে আশাভঙ্গ হলো কিন্তু সেজন্য তোমার বাবা-মা অত্যন্ত সুখী হবেন। একটু থেমে একবার ওর মুখের দিকে তাকিয়ে পকেট থেকে সুভাষদার টেলিগ্রামটা ওকে দিলাম।

টেলিগ্রামটা পড়েই ও চমকে উঠল, সে কি। বাবা আপনাকে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন?

পাঠাবেন না? তোমার যখন ছেলেমেয়ে হবে তখন বুঝবে…

রমা হাসল। আমাকে একবার ভালো করে দেখল। আপনি জার্নালিস্ট বলে বড় পাকা পাকা কথা বলেন।

হাজার হোক আমি তোমার বাবা-মার বন্ধু। এসব কথা বলার অধিকার আমার আছে বৈকি।

হঠাৎ রমা বললো, বাবা-মার বন্ধু হয়েই তো আপনি আমাকে মুশকিলে ফেলেছেন।

তার মানে?

রমা কিছুতেই মনের কথা খুলে বললো না। অনেক অনুরোধ করলাম।না, তবুও না। আজ পর্যন্ত রমা আমাকে সে কথা বলেনি। মনে হয় আর কোনোদিনই বলবে না। কেননা বাছ-বিচার না করেই মানুষের রোগ হয়। ধনী-দরিদ্র, ছেলেবুড়ো, শহুরে বাবু, গ্রামের চাষি। সবার স্বপ্ন দেখার মধ্যেও কোনো বাছবিচার নেই। সবাই দেখতে পারে। কোনো বাধা নেই। রমা কোনো বেহিসেবী স্বপ্ন দেখেনি তো? জানি না। কোনো গুণ না থাকলেও প্রাণ চঞ্চল কাঠবেড়ালীকে সবার ভালো লাগে। রমার ভালো লাগেনি তো? রমা রঞ্জনা হলো। আমি খুব খুশী। নিশ্চিন্ত। নানা কারণে মনে যে স্মৃতির। পলিমাটি পড়ে আছে, তার ওপর অনেক বেদনা-বিধুর স্বপ্ন জন্ম নিয়েছে। কোনো মানুষই তো শুধু দায়িত্ব-কর্তব্য, খাওয়া-পরা নিয়েই বেঁচে থাকে না। আমিও না। মনের মধ্যে কিছু স্বপ্ন সবারই জমা থাকে। আমারও আছে। বাইরে আমার যত দৈন্যই থাক, মনে মনে আমি সম্রাট। কোনো কিছুর বিনিময়েই সে সাম্রাজ্য বিলিয়ে দেওয়া যায় না।

যুক্তি, তর্ক, সামাজিকবোধ দিয়ে নিজেকে অনেক সংযত করলেও একটা বিষণ্ণ করুণ সুর মাঝে মাঝেই নিজের মধ্যে শুনতে পাচ্ছিলাম। সুভাষদাদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হবার আগের মতো। দিনগুলো কাটাচ্ছিলাম। সারাদিন সংবাদ সংগ্রহের তাগিদে ঘুরে বেড়াই, টাইপরাইটার খটখট করি, টেলিপ্রিন্টার-টেলেক্স অপারেটরকে গছিয়ে দিয়েই চলে যাই চাণক্যপুরীর কোনো না কোনো ডিপ্লোম্যাটিক পার্টিতে। রাত নটা-দশটা বা এগারোটা বারোটায় বাড়ি ফিরি। রাধাকিষণের সেবা উপভোগ করে শুয়ে পড়ি। কোনোদিন কোনো কারণে কোনো পার্টিতে না গেলে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরি। চাকফি খেয়ে লরেন্স ডুরেলের ডিপ্লোম্যাটিক জীবনের পটভূমিকায় লেখা স্পিরিট দ্য কোর বা স্টিফ আপার লিপ নিয়ে মজার মজার ঘটনাগুলো আবার পড়ি। কখনও বা শরৎচন্দ্রকেই পড়তে শুরু করি নতুন করে। বেশি ক্লান্ত থাকলে পড়ি না, পড়তে ইচ্ছা করে না। রাধাকিষণের সঙ্গেই গল্প করি।

হ্যাঁরে, একবার তোর বৌ-ছেলেদের দিল্লি দেখাবি না?

দিল তো করে মাগার…

মাগার কি হলো?

অনেক খরচা সাব।

তুই তো শুধু ট্রেন ভাড়া দিয়ে আনবি। থাকা-খাওয়ার তো খরচ লাগবে না।

রাধাকিষণ একটু কাচুমাচু করে বললো, তাছাড়া দিল্লির মতো ইতনা বড় শহরে আসতে বিবির খুব ডর।

আমি হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলাম, ভয় কিসের?

ওরা তো এত ভালো কোঠি, মোটর গাড়ি, টেলিফোন, ফ্রিজ, রেডিও–কিছুই দেখেনি…

তাহলে একবার আমিই তোর দেশে যাব।

গেলে তো সবাই খুব খুশী হবে মাগার আপনি আমাদের বাড়িতে থাকতে পারবেন না।

আমি কি কোটিপতি মহারাজা যে গ্রামে গিয়ে থাকতে পারব না?

রাধাকিষণের কাজ থাকে। বেশিক্ষণ গল্প করতে পারে না। চলে যায়। আমি একা বসে থাকি। নানা কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ রমার কথা মনে হয়। অনেক কথা। বহু ছোটখাট ঘটনা।

প্রথমবার বেনারস গেছি ওর সঙ্গে দেখা করতে। হাজার হোক প্রথম দেখা, প্রথম আলাপ। প্রথমে একটু জড়তা, দ্বিধা থাকবেই। আমারও ছিল, ওরও ছিল। সেই দ্বিধা আর জড়তা যখন চলে গেল, তখন রমা হাসতে হাসতে বললো, আপনি আসার আগে আপনার সম্পর্কে দারুণ দুশ্চিন্তা ছিল।

দুশ্চিন্তা?

হ্যাঁ।

কেন?

মার চিঠি পড়ে আর আপনার ওয়াশিংটনের ছবিগুলো দেখে মনে মনে আপনার সম্পর্কে একটা ধারণা করেছিলাম কিন্তু ভয় ছিল যদি আমার ধারণা ঠিক না হয়? যদি আপনি খুব গম্ভীর প্রকৃতির, খুব সিরিয়াস মানুষ হন?…।

আরো কিছু ভেবেছিলে নাকি? আমি হাসতে হাসতে জানতে চাই।

আমি এখানে একলা একলা থাকি বলে বাবা-মার খুব চিন্তা হয়। অনেক সময়ই, অনেককে আমার খোঁজ-খবর নিতে পাঠান কিন্তু অধিকাংশ লোককেই আমার ভালো লাগে না।

ভাবলাম জিজ্ঞাসা করি, আমাকে ভালো লেগেছে? কিন্তু পারলাম না। জানতে চাইলাম, আমার সঙ্গে আলাপ করে এখন কি মনে হচ্ছে?

আই অ্যাম নট ডিসঅ্যাপয়েন্টেড।

আমার সম্পর্কে ওর কাছ থেকে আরো কিছু শোনার আগ্রহে জিজ্ঞাসা করলাম, তার মানে?

তার মানে আপনি আমাকে হতাশ করেননি।

পরের দিন রমাকে নিয়ে টাঙ্গায় চড়ে সারনাথ গেলাম। ঝাঁকুনি সামলাতে গিয়ে দু একবার ও আমার হাতটা চেপে ধরেছে। শুধু প্রয়োজনে নাকি তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার ইচ্ছাও ছিল, তা বুঝতে পারিনি। তবে ভালো লেগেছে। ভালো লেগেছে সাবলীলভাবে মেশার জন্য। সারনাথে ধর্মরাজিকা স্কুপের পাশে দুজনে পাশাপাশি বসে অনেকক্ষণ অনেক গল্প করলাম। শেষের দিকে হঠাৎ বললো, আপনি আসার জন্য দুটো দিন বেশ কেটে গেল। রোজ কলেজ আর হোস্টেল লাইফ বড় একঘেয়ে লাগে।

কোথাও বেড়াতে যাও না?

কোথায় যাব? দু

চার দিনের ছুটিতে আশে-পাশে কোথাও তোমরা বেড়াতে যাও না?

একে হিন্দু ইউনিভার্সিটি, তার উপর আমরা মেয়ে। অত ঘুরাঘুরির সুযোগ এখানে নেই। একটু থেমে আবার বললো, কাছাকাছি যাদের বাড়ি বা আত্মীয়স্বজন আছে তারা অবশ্য দুচার দিনের ছুটিতেও অনেক সময় ঘুরে আসে কিন্তু কলকাতায় দাদু-দিদা ছাড়া আমার তো কেউ কাছাকাছি থাকে না।

কিন্তু তোমার তো এ সমস্যার সমাধান হওয়া মুশকিল।

আপনি মাঝে মাঝে আসবেন।

মাঝে মাঝেই কি আসা সম্ভব?

আপনি তো বিয়ে করে সংসারে জড়িয়ে পড়েন নি যে দু এক দিনের জন্যও বেরুতে পারবেন!

বিয়ে না করলেই বুঝি ইচ্ছামতো আসা যায়?

নিশ্চয়ই যায়।

আমি মজা করে বললাম, তাহলে তো তুমিও মাঝে মাঝে দিল্লি আসতে পার।

আমি তো মেয়ে। তাছাড়া হোস্টেল থেকে আমাকে ছাড়বে নাকি? এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আমি যখন ছুটিতে বাবা-মার কাছে যাব তখন এসে দেখবেন কত ঘুরতে পারি।

ওর প্রস্তাব শুনে হাসি পায়। বলি, তুমি ছুটিতে কায়রো-লন্ডন-মস্কো-ওয়াশিংটন যেতে পার বলে কি আমিও পারব?

আমি বলছিলাম যদি আসেন…

ঐ ইফস্ অ্যান্ড বাটগুলোই তো লাইফের সব চাইতে বড় সমস্যা।

তারপর রমা বলেছিল, বাবা দিল্লিতে এলে দেখবেন আপনাকে কি বিরক্তি করি।

হঠাৎ একজন মানুষের সঙ্গে আলাপ হতে পারে, ঘনিষ্ঠতা হতে পারে, ভালোবাসা হতে পারে কিন্তু কোনো কারণেই মুহূর্তের মধ্যে সেই পরিচিত, ভালোবাসার পাত্রপাত্রীকে মন থেকে মুছে ফেলা যায় না। আমি অনেকবার অনেক রকমভাবে চেষ্টা করেও রমার ঐ বুদ্ধিদীপ্ত মখখানা ভুলতে পারছিলাম না। পর পর কদিন নাইট শোতে সিনেমা গেলাম। সিনেমা হলে ঢুকলেই নিউজ রীল দেখতে হয়। দেখতে হলো। আরো অনেক কিছুর সঙ্গে বুদ্ধগয়া আর সারনাথে বুদ্ধ জয়ন্তী উৎসবও দেখাল। ভুলতে গিয়ে আবার সবকিছু নতুন করে মনে পড়ল।

আপনি তো জার্নালিস্ট। একদিন না একদিন কোনো না কোনো কারণে আপনাকে সারনাথে আসতেই হবে কিন্তু তখন কি মনে পড়বে আমার সঙ্গে একটা দিন কাটিয়েছিলেন?

ঐ নিউজ রীলের জন্য অর্ধেক সিনেমাটাই মন দিয়ে দেখতে পারলাম না।

বেনারসের মতো দিল্লিতেও যদি গঙ্গা থাকত তাহলে বেশ নৌকা চড়ে বেড়াতে পারতাম, তাই না?

কেন, গাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়াতে তোমার ভালো লাগে না?

লাগে কিন্তু নৌকা যখন মাঝ গঙ্গায় টলমল করে, তখন ভয়ও লাগে, মজাও লাগে।

নৌকা যখন বেশি দুলতে শুরু করত তখনই রমা দুহাত দিয়ে আমার একটা হাত চেপে ধরত। জিজ্ঞাসা করতাম, নৌকা ঘুরিয়ে নিতে বলব?

না, না, ঘুরিয়ে নেবে কেন?

তুমি ভয় পাচ্ছ যে!

একটু একটু ভয় পাচ্ছি ঠিকই কিন্তু আপনি তো আছে।

রাধাকিষণ খেতে ডাক দেয়। চটিটায় পা দিতে গেলেই আবার মনে পড়ে কায়রোতে রমাই পছন্দ করেছিল, এইটাই নিন। খুব সুন্দর মানাবে আপনাকে।

সুন্দর চটি পরলেই কি আমি সুন্দর হবো?

আপনাকে সুন্দর দেখতে বলে এত অহঙ্কার কেন?

তোমার কাছে আমি রূপের অহংকার করব?

মেয়েদের সৌন্দর্যের সঙ্গে পুরুষের সৌন্দর্যের তুলনা করার কোন মানে হয় না।

রমার কথা কেন এত মনে হয় তা জানি না। বুঝতে পারি না। কিন্তু হয়। হবেই। মাঝে মাঝেই হয়। বোধহয় মনের মধ্যে একটা শূন্যতা অনুভব করি। বোধহয় কেন? নিশ্চয়ই একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। মনে মনে বেদনাবোধ করি কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এই ভেবে সান্ত্বনা পাই যে দূরের অপরিচিত ছেলের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়নি।

তার চাইতে বড় কথা দেবব্রত চৌধুরীর সঙ্গে ওর বিয়ে হলো। কোনো না কোনো ভালো ছেলের সঙ্গেই রঞ্জনার বিয়ে হতো কিন্তু ভালোরও তো জাত আছে। দেবব্রত শুধু একটা ভালো ছেলে নয়, একটা স্বপ্ন, একটা সাধনা, একটা বিরাট সম্ভাবনা। ডক্টর চৌধুরীর রিসেপসনে সুভাষদাকে সেই কথাই বললাম।

একটু দাঁড়াও। আমি এক্ষুনি আসছি। সুভাষদা ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলেও একটু পরেই বৌদিকে নিয়ে ফিরে এলেন। বৌদিকে বললেন, শোন শোন ও কি বলছে।

বৌদি আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কি বলছ?

এবার আমি বললাম, সুভাষদাকে বলছিলাম দেবব্রতর মতো ছেলে হয় না।

সঙ্গে সঙ্গে সুভাষদা বললেন, না না, তুমি যে কথাগুলো আমাকে বললে, ঠিক সেই কথাগুলোই ওকে বলল।

বলছিলাম, দেবব্রত ইজ এ পিস অফ ড্রিম, একটা সাধনা, একটা বিরাট সম্ভাবনা।

বৌদি চট করে একবার সুভাষদার দিকে তাকিয়ে আমাকে বললেন, দেবুকে দেখে তো খুবই ভালো মনে হয়।

আমি হাসতে হাসতে বললাম, গিল্টি সোনার গহনা দেখতেও তো ভালো লাগে কিন্তু দেবু পাকা সোনা।

আনন্দে খুশীতে ওঁরা নীরব হয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন।

সত্যি বলছি বৌদি, এমন ভালো ছেলে আমি খুব কম দেখেছি।

হাজার হোক একটি মাত্র সন্তান। রমাকে ওরা অত্যন্ত বেশি ভালোবাসেন। সারা জীবন ফরেন সার্ভিসে কাটিয়েও সুভাষদা ওকে নিছক সুন্দর একটা বাঙালি মেয়ে তৈরি করেছেন। একমাত্র সন্তানকে ছেড়ে থাকতে অত্যন্ত কষ্ট হলেও বেনারসে রেখে পড়িয়েছে। মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে ওঁরা অত্যন্ত চিন্তিত ছিলেন। আমার কথা শুনে ওঁরা দুজনেই শুধু খুশী নন, নিশ্চিন্ত হলেন।

দেবব্রত পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। আমাদের তিনজনকে দেখে একটু থমকে দাঁড়াল। আমি ওকে বললাম, আপনাকে দেখে আমার ঈর্ষা হচ্ছে।

দেবব্রত জিজ্ঞাসা করল, কেন?

ভালো স্ত্রী অনেকেই পায়, কিন্তু ভালো শ্বশুর-শাশুড়ি পাওয়া সত্যি ভাগ্যের দরকার।

দেবব্রত জবাব দেবার আগেই বৌদি বললেন, না না। তোমার মতো জামাই পেয়েছি বলে আমরাই ভাগ্যবান।

দেবব্রত বললো, না মা, ওকথা বলবেন না।

আমি ঠাট্টা করে বললাম, দু মিনিট আগেই বৌদি বলছিলেন জামাইটা ঠিক মনের মতো হলো না।

সত্যি সত্যি ডান হাতটা তুলে বৌদি বললেন, একটা চড় খাবে।

দেবব্রত হাসল, মা আপনাকেও মারবেন না, আমারও নিন্দা করবেন না।

দেবব্রত আর দাঁড়াল না, চলে গেল।

আচ্ছা বৌদি, আজকালকার কোনো ছেলে এমন সুন্দর করে মা ডাকবে?

সত্যি বলছি ওর মা ডাকটা শুনতে আমার ভীষণ ভালো লাগছে।

সুভাষদা বললেন, ওর মা ডাক শুনেই বোঝা যায় হাউ ইনোসেন্ট হি ইজ।

হাজার হোক ডক্টর দেবতোষ চৌধুরীর ভাইয়ের বিয়ে। প্রেসিডেন্ট বা প্রাইম মিনিস্টার না এলেও অনেক ভি-আই-পি এসেছিলেন। এসেছিলেন অনেক গণ্যমান্য বরেণ্য অতিথি। আস্তে আস্তে সবাই চলে গেলেন। প্যান্ডেল ফাঁকা হলো। মোটর গাড়ির হর্নের আওয়াজ বন্ধ হলো। ভাটা পড়ল ক্যাটারারদের কর্মচাঞ্চল্যে। ডক্টর চৌধুরী, দেবব্রত, সুভাষদা, বৌদির কাছ থেকে ছুটি নিয়ে ভিতরের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, রঞ্জনা, আমি যাচ্ছি।

রমা হাসল, আপনিও রঞ্জনা বলছেন?

রমাই তো রঞ্জিত হয়ে রঞ্জনা হলো।

ও হাসল।

আমি যাচ্ছি।

এক্ষুনি?

হ্যাঁ।

এত তাড়াতাড়ি?

তাড়াতাড়ি কোথায়? নটা বাজে।

তাতে কি হলো?

সাড়ে পাঁচটায় এসেছি। এখনও যাব না?

রিসেপসনের সময় ছিল ছটা থেকে সাড়ে সাতটা। আটটা পর্যন্ত অনেকেই ছিলেন। রঞ্জনা তাই কিছু বলতে পারল না, চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। এমন সময় দেবব্রত এলো। বললাম, টেলিফোন করবেন।

নিশ্চয়ই।

আমি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম। বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্যান্ডেল পার হয়ে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাবার সময়ই দেবব্রত এসে হাজির। আপনি কিছু খেলেন না?

আমি ওঁর কাঁধে একটা হাত রেখে বললাম, খেয়েছি।

আপনাকে তো কিছু খেতে আমি দেখিনি।

আমার যা খাবার আমি ঠিকই খেয়েছি।

না, আপনি আমাদের সঙ্গে খেয়ে যান।

সত্যি বলছি আমি খেয়েছি, এখন আর কিছু খাব না। আমি চলি।

রঞ্জনা বলছিল…

ওকে কথাটা বলতে না দিয়েই আমি বললাম, ওকে আপনি একটু বুঝিয়ে বললেই হবে। গুড নাইট।

গুড নাইট।

আমি গাড়ির দিকে এগুতেই দেবব্রত বাড়ির মধ্যে চলে গেল।

গাড়িতে স্টার্ট দিলাম কিন্তু ক্যাটারারের একটা টেম্পো সামনে থাকায় এগুতে পারছিলাম না। হঠাৎ দেবব্রত এসে হাজির, আপনাকে রঞ্জনা একটু ডাকছে।

আমাকে?

হ্যাঁ।

স্টার্ট বন্ধ করে গাড়ি থেকে নামলাম। প্যান্ডেল পার হয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকলাম। লিভিংরুমে বসে ডক্টর চৌধুরী সুভাষদাদের সঙ্গে গল্প করছিলেন। আমাকে ওঁরা দেখতে পেলেন না। আমি আরো এগিয়ে গেলাম।

কি ব্যাপার? তুমি আমাকে ডেকেছ?

হ্যাঁ।

কেন?

আপনি আমাদের সঙ্গে খাবেন।

কফি-টফি অনেক কিছু খেয়েছি। এখন আর কিছু খাব না।

দেবব্রত আমার পাশেই দাঁড়িয়েছিল কিন্তু প্যান্ডেলের ওদিক থেকে কে যেন ডাকতেই চলে গেল।

খেয়ে যান। আমি খুব খুশী হব।

মনে মনে বললাম, তোমাকে খুশী করার দিন শেষ। কি হবে তোমাকে খুশী করে। আমি তোমার এই ছোট অনুরোধনা রাখলেও খুশীর বন্যায় তুমি ভেসে যাবে। ভীত সন্ত্রস্ত হরিণীর মতো যত সংশয়ই তোমার মধ্যে এখন থাক, সব দূর হয়ে যাবে। আসন্ন কালবৈশাখীতে তৃণখণ্ডের মতো আমাকে খুশী করার প্রবৃত্তি, মন উড়িয়ে নেবে।

কি হলো? কথা বলছেন না যে?

আমি একবার ওর দিকে চাইলাম, কাল ভোর সাড়ে ছটায় আমার ফ্লাইট, তা জান তো?

জানি।

চারটের সময় উঠতে হবে।

হোক। আপনি না খেয়ে যেতে পারবেন না।

পারব না?

না।

আমি হাসলাম।

হাসছেন কেন? বিয়ে হয়ে গেল বলে কি পর হয়ে গেলাম ভাবছেন?

আমি কিছুই ভাবছি না।

বিয়ে হোক আর যাই হোক, আমার কথা আপনাকে শুনতেই হবে।

.

এই পৃথিবীতে মানুষ কত কথা বলে। শৈশব থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত। প্রয়োজনের কথা, ইচ্ছার কথা। কখনও কখনও মনের কথাও মানুষ বলে। কিন্তু কম। খুব কম। মানুষ প্রকাশ্যে অন্যের অবগতির জন্য যত কথা বলে তার চাইতে অনেক অনেক বেশি কথা বলে মনে মনে। আপন মনে। যে বক্তা, সেই শ্রোতা। কেন জানি না, সেদিন রাত্রে আমার মনে হলো, রমা, রঞ্জনা মনে মনে অনেক কথাই বললো আমাকে। আমি শুনতে পেলাম না কিন্তু কেমন করে যেন অনুভব করলাম। মনে মনে, হৃদয় দিয়ে। ওর মুখের ভাষা, চোখের ইঙ্গিত দেখে।

সপ্তাহখানেক পরে সুভাষদা আর বৌদি মস্কো ফিরে গেলেন। ডক্টর চৌধুরী, দেবব্রত, রঞ্জনা ও সুভাষদার কয়েকজন বন্ধুবান্ধব এয়ারপোর্টে এসেছিলেন। আমিও ছিলাম। অনেক কথা, অনেক চোখের জল পড়ল। আমি রঞ্জনাকে বললাম, কাঁদছ কেন? হিন্দু ইউনিভার্সিটি থেকে এমএ পাস করে এবার দিল্লিতে ডক্টরেট পড়তে এসেছ আর রিসার্চ প্রজেক্ট হচ্ছে বাঙ্গালোরে…

কেউ কেউ হাসলেন। রঞ্জনা আমাকে বললো, আপনি চুপ করুন তো।

কিছুক্ষণ পরে সুভাষদার প্লেন ছাড়ল। আমরা সবাই আকাশের দিকে চেয়ে রইলাম কয়েক মিনিট। তারপর আস্তে আস্তে রওনা হলাম বাড়ির দিকে। ডক্টর চৌধুরী আর দেবব্রত দুজনেই ওদের ওখানে যেতে অনুরোধ করলেন। বললাম, সময় পেলেই আসব।

সময় পেয়েছি অনেক দিন অনেক সময়। আমি যাইনি। দেবব্রত লম্বা ছুটি নিয়ে এসেছে। হয়তো ঘুরবে ফিরবে বেড়াবে। দিল্লিতে, দিল্লির বাইরে। হয়তো সিমলা পাহাড়ে বা আরো দুরে ডাল লেকে।

অথবা গুলমার্গের নিশ্চিন্ত প্রশান্ত পরিবেশে। কত নামকরা লোক ডক্টর চৌধুরীর বন্ধু ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত। দেবব্রত আর রঞ্জনাকে নিয়ে তাদের কাছে যাবেন। তারাও আসবেন। এইসব নানা কিছু চিন্তা করে আমি যাইনি। আরো একটা কারণ ছিল। রঞ্জনা এখন শুধু সুভাষদার মেয়ে নয়, ডক্টর চৌধুরীর ভ্রাতৃবধু, দেবব্রতর স্ত্রী। আমি সাংবাদিক। বহু লোকের সঙ্গে আমার আলাপ, ঘনিষ্ঠতা। অনেকে খাতিরও করেন। কেউ কেউ ভালোবাসেন। কিন্তু ওদের মতো সামাজিক মর্যাদা আমার নেই। হবেনা। চাঁদের আলোর মতন সাংবাদিকদেরও নিজস্ব কোনো আলো নেই, পরের, ভি-আই পিদের সূর্য-কিরণেই উদ্ভাসিত। ছোটখাট সুক্ষ্ম আত্মসম্মানবোধ, সামাজিক কারণে আমি যাইনি। মস্কো থেকে বৌদির চিঠি এসেছে। রঞ্জনার খবর নিয়ে জানাতে বলেছেন। আমি রঞ্জনার খবর নিইনি, বৌদির চিঠিরও জবাব দিইনি। ভেবেছি কি দরকার বেশি উৎসাহী হবার। যতটুকু ঘনিষ্ঠতা আছে, সেই যথেষ্ট। আরো ঘনিষ্ঠ হবার প্রয়োজন নেই।

তাছাড়া মানুষের মতো ঘনিষ্ঠতম, হৃদ্যতা ভালোবাসা বা তিক্ততারও একটা নির্দিষ্ট আয়ু আছে। মেয়াদ আছে। এই সংসারে, এই মাটির পৃথিবীতে কোন কিছুই তো চিরস্থায়ী নয়, চিরদিনের নয়। নদীর মতো মানুষের জীবনেও জোয়ার আসে, ভরিয়ে দেয় মন-প্রাণ, দুর করে অনেক দৈন্য কিন্তু তার স্থায়িত্ব কতটুকু? ভাটার টানে আবার সবকিছু চলে যায়। ফিরিয়ে দিতে হয়। তা না হলে হিসাবের খাতায় মিল হবে কি করে? শুধু আসবে, আমদানি হবে, কিছুই ফিরে যাবে না, রফতানি হবে না? তাই কি কখনও হয়?

প্রেসিডেন্টের ট্যুর কভার করতে গিয়ে সুভাষদা, জয়ন্তী বৌদির সঙ্গে একটু বেশি হৃদ্যতা হয়ে গেছে। রমার সঙ্গে একটু অদ্ভুত ধরনের বন্ধুত্ব, ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। সামাজিক অনুশাসন বা নিজেদের কোনো দৈন্য বা অন্য যে কোনো কারণেই হোক বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখেও অনেক কাছে এসেছি দুজনে।

.

ডাইনিং টেবিলে আমার সামনের দিকে বসে রমা জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, আপনি তো অনেকবার বাইরে গিয়েছেন, তাই না? ।

হ্যাঁ গিয়েছি।

আমাদের অনেক ডিপ্লোম্যাটের সঙ্গে নিশ্চয়ই আপনার আলাপ হয়েছে বা আছে?

সে তো খুব স্বাভাবিক।

অনেকের সঙ্গেই কি আপনার ঘনিষ্ঠতা?

অনেকের সঙ্গে কি ঘনিষ্ঠতা হয়?

তাহলে বাবার সঙ্গে এত ভাব হলো কেন?

বোধহয় উই লাইকড ইচ আদার।

আর মার সঙ্গে?

ঐ একই কারণে।

আমার সঙ্গে?

তোমার সঙ্গে আবার ঘনিষ্ঠতা হলো কোথায়?

পারহ্যাপস ইউ আর রাইট। মেলামেশা করলেও ঠিক ঘনিষ্ঠ হতে আপনি চান না, তাই না?

আমি কি চাই, তা তো তুমি বলবে।

রমা হাসতে হাসতে বললো, আপনি শুধু আবির দিয়ে হোলি খেলতে চান, রঙ মাখতে চান না।

শুধু আবির দিয়ে হোলি খেলেছি নাকি রঙও মেখেছি। তা ঠিক বুঝতে পারি না। মাঝে মাঝে মনে হয় রঙও মেখেছি। আবার কখনও কখনও মনে হয় হোলিই খেলিনি। রমা কি হোলি খেলেছিল? রঙ মেখেছিল সর্বাঙ্গে? নাকি শুধু মুখেই একটু আবির মেখেছিল?

এসব প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারব না, নিতেও পারব না। অনুত্তরই থেকে যাবে। তবু মনের মধ্যে এসব প্রশ্ন উঁকি দেয়। বেশিদিন চেপে রাখতে পারি না। একটা অস্বস্তি, জ্বালা বোধ করি মনের মধ্যে। মনে হয় রমাকে একবার কাছে পেলেও বোধহয় একটু ভালো লাগত। শান্তি পেতাম। অনেকবার ভেবেছি যাই, ওদের খোঁজ করি, দেখি ওরা আছে কিনা। থাকলে একটু কথা বলব, গল্প। করব। একটু হাসব। দেখব ওর হাসি, সুন্দর বুদ্ধিদীপ্ত মখখানা…কিন্তু শেষ পর্যন্ত যাইনি, যেতে পারিনি।

.

দিন পনের পর সন্ধ্যার পর অফিস থেকে ফিরে দেখি দেবব্রত আর রঞ্জনা বাড়ির সামনে গাড়িতে বসে আছে। আমাকে দেখেই ওরা গাড়ি থেকে নামল। দুজনকেই একবার দেখে নিয়ে দেবব্রতকে জিজ্ঞাসা করলাম, অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছেন বুঝি?

বেশিক্ষণ নয়, বড় জোর মিনিট দশেক।

বুঝলাম, অনুমান করলাম তারও বেশি সময় অপেক্ষা করছে কিন্তু খেয়াল নেই। নতুন বিয়ের পর সময় যেন হাওয়ায় উড়ে যায়। ঘড়ির কাটা আর মনের কাটা একই গতিতে ঘোরে না।

আই অ্যাম রিয়েলি ভেরী সরি!

দেবব্রত বললো, এর জন্য দুঃখ করার কি আছে?

রঞ্জনা জিজ্ঞাসা করল, আপনার চাকরটা কোথায়?

ছুটিতে।

তিনজনে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। রঞ্জনা জিজ্ঞাসা করল, আপনার খাওয়া-দাওয়ার কি হচ্ছে?

তালা খুলতে খুলতে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, দেখে কি মনে হচ্ছে অনশন করছি?

এই বুঝি আমার প্রশ্নের জবাব হলো?

দরজা খুলে আলোপাখার সুইচ অন করলাম। জানালাগুলো খুলে দিলাম। এক মিনিট।

আমি কিচেনে গিয়ে চায়ের জল চাপিয়ে ফ্রিজ আর কাপবোর্ড খুলে দেখছিলাম ওদের খেতে দেবার কিছু আছে নাকি। একটাও ডিম পেলাম না। পেলাম শুধু কিছু নাটস আর একটা কেকের অর্ধেক। একটা প্লেটে নাটসগুলো ঢালছি এমন সময় পিছন থেকে রঞ্জনার কথা শুনে চমকে উঠলাম, আপনি এসব কি করছেন?

বাপরে বাপ! এমন করে কেউ চমকে দেয়?

আমাদের বসিয়ে আপনি এসব কি করছেন?

বিশেষ কিছুই না, শুধু চা।

কোনো দরকার ছিল না।

তোমাদের দরকার না থাকলেও আমার মর্যাদা আর মানসিক শান্তির জন্য দরকার আছে।

রঞ্জনা এবার বললো, চা চিনি দুধ কই?

আমি কোনো কথা না বলে সব কিছু এগিয়ে দিতেই ও বললো, আপনি যান, আমি নিয়ে আসছি।

আমি দেবব্রতর কাছে এসে বসলাম। কোথাও বেড়াতে গিয়েছিলেন?

হ্যাঁ, নৈনিতাল গিয়েছিলাম প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটু কৈফিয়ত দিল, যেতে চাইনি কিন্তু দাদা জোর করে পাঠালেন।

ভালোই করেছে। নিজেদের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং হবার জন্য এই সময় একটু বাইরে যাওয়া ভালো।

রঞ্জনা চা, নাটস কেক নিয়ে এলো। আমাদের দিল। ও নিজেও নিল।

একটু লজ্জিত হয়েই বললাম, প্রথম দিন আপনারা এলেন অথচ কিছুই অফার করতে পারলাম না বলে…

দেবব্রত বললো, এখন আবার কি অফার করবেন?

রঞ্জনা জিজ্ঞাসা করল, আপনি হঠাৎ এত ফর্মাল হয়ে গিয়েছেন কেন বলুন তো?

বিয়ের সঙ্গে সঙ্গে তোমার ও দেবব্রতবাবুর একটা নতুন মর্যাদা হয়েছে আমি তার অমর্যাদা। করতে পারি না।

আমার কথায় ওরা দুজনেই হাসল।

চা খেতে খেতে নানা কথা হলো।

রঞ্জনাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার বাবা-মার চিঠি পেয়েছ?

পৌঁছোনোর সংবাদের টেলিগ্রাম ছাড়া মার দুটো বাবার একটা চিঠি এসেছে।

তুমি চিঠি দিয়েছ?

দিয়েছি। আপনি ওঁদের কোনো চিঠি পাননি?

তোমার মার একটা চিঠি পেয়েছি।

জবাব দিয়েছেন?

না, এখনও দিইনি। দু একদিনের মধ্যেই দেব।

এবার দেবব্রতর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, রঞ্জনাকে আপনার দাদার ভালো লাগছে তো?

দাদা তো ওর প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত।

তাই নাকি?

ওরও দাদাকে খুব ভালো লেগেছে।

ভালো। খুব ভালো। অমন দাদাকে ভালো না লাগার তো কোনো কারণ নেই।

এবার রঞ্জনা বললো, সত্যি দাদার মতো মানুষ হয় না। বি-এইচ-ইউতে অনেক পণ্ডিত মানুষ দেখেছি কিন্তু দাদার মধ্যে পাণ্ডিত্য আর হিউম্যান কোয়ালিটিজ সমান।

আমি সমর্থন জানালাম, ঠিক বলেছ। এবার একটা সিগারেট ধরিয়ে দেবব্রতকে জিজ্ঞাসা করলাম, রঞ্জনাকে আপনার ভালো লেগেছে তো?

এক মুহূর্তের জন্য দেবব্রত একটু ভাবল। আমার মনে হয় আমার চাইতে আরো ভালো আরো কোয়ালিফায়েড ছেলের সঙ্গে ওর বিয়ে হওয়া উচিত ছিল।

এবার রঞ্জনার দিকে ফিরে বললাম, কি রঞ্জনা, তোমারও কি ধারণা আরো ভালো মেয়ের সঙ্গে ওঁর বিয়ে হওয়া উচিত ছিল?

রঞ্জনা একবার দেবব্রতর চোখে চোখ রেখেই ঘুরিয়ে নিল। হলে নিশ্চয়ই আরো খুশী হতে আরো সুখী হতো।

আরো কিছুক্ষণ গল্পগুজব করার পর হঠাৎ ও জিজ্ঞাসা করল, রাত্রে আপনার খাওয়া-দাওয়ার কি হবে?

রাত্রে বিশেষ কিছু খাব না।

কেন? চাকর নেই বলে?

ঠিক তা নয়। দুপুরে খুব বেশি খেয়েছি।

রঞ্জনা একটু হাসল। ঘরে চাল-ডাল তরি-তরকারি নেই?

ব্যাচেলার বলে কি সংসার করি না? সব কিছু আছে। বেশ গর্বের সঙ্গেই জানালাম।

কোথায় আছে দেখিয়ে দিন তো। বলেই ও উঠে দাঁড়াল। দেবব্রতর দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি দাদার ওষুধটা কিনে আনো। এর মধ্যে আমার এদিকের কাজ হয়ে যাবে।

দেবব্রতও সঙ্গে সঙ্গে উঠল।

আমি হাসতে হাসতে বললাম, রঞ্জনা, তুমি কি বিয়ের পর সন্ন্যাসিনী হয়েছ?

ওরা দুজনেই হাসল।রঞ্জনা বললো, আপনার জন্য দুটো ডালভাত রান্না করলেই যদি সন্ন্যাসিনী হওয়া যায় তাহলে আমি রাজি।

আমার উপকার না করে বাড়ি যাও। ডক্টর চৌধুরী নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য চিন্তা করছেন।

দেবব্রত বললল, দাদা এখানে নেই। কাল সকালে ফিরবেন।

আমি আরো কয়েকবার বললাম কিন্তু ফল হলো না। দেবব্রত আমার কথা শুনল না। স্ত্রীর কথা শুনে ওষুধ আনতে গেল। দেবব্রত বেরিয়ে যেতেই বললাম, ঠিক করলে না রঞ্জনা।

কেন?

হাজার হোক আমি ব্যাচেলার। তার উপর বয়সটা খুব বেশি নয়, আমার জন্য তোমার এতটা ব্যগ্রতা না দেখানই ভালো হতো।

রঞ্জনা একটু জোরেই হাসল। হঠাৎ হাসি থামিয়ে বললো, কে আপনাকে ব্যাচেলার থাকতে বলেছে?

আমার কথা ছাড়ো। তবে ভবিষ্যতে এমন উৎসাহ দেখিও না।

কেন?

হয়তো তোমার ক্ষতি হতে পারে।

রঞ্জনা হাসল, আচ্ছা সে দেখা যাবে। এখন কিচেনে চলুন তো।

কি করব? বাধ্য হয়ে ওকে সব কিছু দেখিয়ে দিলাম। সামান্য সাহায্য করলাম। দুটি ওভেনে একসঙ্গে রান্না শুরু হলো।

ফ্রিজ রয়েছে অথচ মাছ, মাংস, ডিম কিছুই রাখেন না কেন?

তুমি আসবে জানলে নিশ্চয়ই রাখতাম।

এবার থেকে রাখবেন।

তুমি এসে রান্না করে দেবে?

রোজ না হলেও মাঝে মাঝে এসে করব বৈকি।

তা না হলে নাটক জমবে কেন?

রঞ্জনা হাসল।

একটু পরে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, দেবব্রতর ছুটি কতদিন আছে?

আর এক সপ্তাহ।

তুমি ওঁর সঙ্গেই ব্যাঙ্গালোর যাচ্ছ?

হ্যাঁ যাচ্ছি তবে মাঝে মাঝেই আমি দিল্লি আসব।

কেন?

দাদার জন্য। তরকারি নামিয়ে একবার আড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসির রেখা ঠোঁটের পাশে লুকিয়ে বললো, তাছাড়া আপনিও তো এখানেই আছেন।

হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, আমি এখানে আছি বলেই তো এতদিন নৈনিতালে কাটিয়ে এলে।

রমার মুখের চেহারাটাই পাল্টে গেল। আমার দিকে তাকাতেই ভয়ে আমি দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। তারপর বললো, আমি বলেই নৈনিতালের লেকের জলে সবকিছু ডুবিয়ে দিতে পারিনি।

তা আমি জানি।

তাহলে এসব কথা আর কোনদিন বলবেন না।

তুমি মাঝে মাঝে আসবে তো?

বোধহয় আপনি না চাইলেও আমাকে আসতে হবে।

রান্না প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। আমি ওর কথার কোনো জবাব না দিয়ে ড্রইংরুমে এসে বসলাম। একটু পরেই দেবব্রত এলো।

ওষুধ পেয়েছেন?

হ্যাঁ পেয়েছি।

কবে ব্যাঙ্গালোর যাচ্ছেন?

এইত শুক্রবারে।

আবার কবে দিল্পি আসছেন?

আমি আর এর মধ্যে আসছি না। ও আসবে।

রঞ্জনা এলো।

আমি দেবব্রতকে বললাম, আপনার স্ত্রীর পরোপকার করার বাতিকটা একটু কন্ট্রোল করবেন।

দেবব্রত বললো, আপনার জন্য সামান্য একটু রান্না করল বলে…

ওর কথার মাঝখানেই রঞ্জনা বললো, খুব অন্যায় করেছি। এর পরদিন মাছ মাংস রান্না করে আজকের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে যাব।

আমি মাছ মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। ওরা দুজনেই হো হো করে হেসে উঠল।

০৫. ভগবানে বিশ্বাস বা ভক্তি

ভগবানে বিশ্বাস বা ভক্তি থাকুক বা নাই থাকুক পূজার প্যান্ডেলে দেবী মূর্তি দেখতে বেশ লাগে। একটু আনন্দের ছোঁয়া, একটু পূর্ণতার স্পর্শ নতুনত্বের স্বাদ সবাই পায়। বসন্ত দূরে থাক, কাছে থাক, মনে মনে রঙ লাগে। তারপর হঠাৎ যখন প্যান্ডেলটা খালি হয়, দেবীর বেদী শূন্য তখন বিষণ্ণতার করুণ সুর মনের মধ্যে বেজে ওঠে।

দেবব্রত আর রঞ্জনা ব্যাঙ্গালোরে চলে যাবার সপ্তাহখানেক পরে ডক্টর চৌধুরী আমাকে ঠিক এই কথাগুলোই বলছিলেন।

সকালবেলাতেই ওঁর টেলিফোন এলো, আমি দেবতোষ চৌধুরী কথা বলছি।

বলুন, কেমন আছেন?

আছি ভালোই তবে মনটা বিশেষ সুবিধের নয়।

কেন, কি হলো?

দেবু আর রঞ্জনা চলে যাবার পর কোনো কাজেই ঠিক মন দিতে পারছি না।

আমি বললাম, বাড়ির নতুন বউ চলে গেলে বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগে।

আজ সন্ধ্যার দিকে আপনি আসবেন?

আজ?

হ্যাঁ আজই। একটু গল্পগুজব করে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করা যাবে।

ডক্টর চৌধুরীর ব্যর্থতার জন্য গিয়েছিলাম, না যেয়ে পারিনি। অনেক গল্প হলো। ঘণ্টার পর ঘন্টা।

তাসখন্দ এয়ারপোর্টে ওকে দেখেই আমার ভালো লেগেছিল। কথাবার্তা বলার পর আবো ভালো লাগল।

আমি ডক্টর চৌধুরীকে সমর্থন জানাই, রঞ্জনা ভালো লাগার মতোই মেয়ে।

আজকালকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে শিক্ষা আর আধুনিকতার যত বেশি প্রসার হচ্ছে, মাধুর্য তত বেশি হারাচ্ছে, কিন্তু রঞ্জনা রিয়েলি একটা একসেপসন।

তা ঠিক।

এই কদিনের মধ্যেই ও যে কি ভাবে আমাদের আপন করে নিয়েছে তা কি বলব।

সন্ধ্যার পর পরই অফিস থেকে সোজা গিয়েছিলাম। আশা করেছিলাম গিয়েই এক কাপ চা পাব কিন্তু ডক্টর চৌধুরী আমাদের রমা, ওদের রঞ্জনার প্রশংসায় এমনই ভেসে গেলেন যে চাকরটাকে চা দেবার কথা বলতেও পারলেন না।

হাজার হোক সুভাষবাবু একজন সিনিয়র ডিপ্লোম্যাট। তার একমাত্র সন্তান নিশ্চয়ই খুব আদরে মানুষ হয়েছে কিন্তু তবুও এই মেয়েটি কিভাবে এত কাজের হলো, ভাবতে অবাক লাগে।

অনেক দিন হোস্টেলে কাটিয়েছে তো?

হোস্টেলে থেকে তো ছেলেমেয়েরা আরো বেশি আরামপ্রিয় হয়। এক কাপ চা পর্যন্ত তৈরি করে খেতে হয় না।

তা ঠিক।

সুভাষবাবু যদি এখানেই বরাবর থাকতেন তাহলে ছুটিতে বাড়ি এসেও রঞ্জনাকে সংসারের কিছু কাজকর্ম করতে হতো বা ছোট ভাইবোন থাকলে নিশ্চয়ই কিছু দায়দায়িত্ব নিতে হতো কিন্তু এর তো সে সব কিছুই করতে হয়নি…

আমি আবার সমর্থন জানাই ডক্টর চৌধুরীকে, না, সেসব ঝামেলা ওকে কোনোদিনই সহ্য করতে হয়নি।

ইনস্পাইট অব দ্যাট ও সংসারের সব রকম কাজ করতে পারে আর ছোটখাট খুঁটিনাটি কোনো কিছুই ওর দৃষ্টি এড়িয়ে যাবে না।

নো ডাউট সী ইজ এ নাইস গার্ল।

আমার মন্তব্য ওর কানেই পৌঁছল না। উড ইউ বিলিভ ইট ইফ আই সে যে ও রোজ আমার দুটো ফাউন্টেন পেনে কালি ভরে দিতে পর্যন্ত ভুলে যায় না।

খাওয়ার সময়ও অনেক কথা হলো। শেষে বললেন, আপনার সঙ্গে তো রঞ্জনা বা ওর বাবা মার খুব ঘনিষ্ঠতা। সুতরাং ইউ আর অলসোপার্ট অব আওয়ার বিগার ফ্যামিলী।

আমি হাসলাম।

না, না, হাসি নয়। আপনি নিয়মিত আসবেন। না এলে দুঃখ পাব।

আসব।

রেগুলার আসবেন আর এখানে এলেই খাওয়া-দাওয়া করে যাবেন।

আসব ঠিকই তবে সব সময় খাওয়া-দাওয়া করা বোধহয় সম্ভব হবে না।

ডক্টর চৌধুরী সঙ্গে সঙ্গে আপত্তি জানালেন, সম্ভব হবে না কেন? আপনি তো এখানে একাই থাকেন?

একাই থাকি তবে চাকর আছে।

উনি যেন আমার কথাটা শুনতেই পেলেন না, এইতো সেদিন রঞ্জনা বলছিল ও রান্না না করলে আপনার খাওয়াই হতো না।

ডক্টর চৌধুরী বললেও নানারকম কাজকর্মের ঝামেলায় ওঁর ওখানে যেতে পারলাম না অনেকদিন। এর মধ্যে দু তিনদিন ওঁকে টেলিফোন করেছি। পাইনি। প্ল্যানিং কমিশনের অ্যাডভাইসার বলে ওঁকে সারা দেশ ঘুরে বেড়াতে হয়। মাস তিনেক পরে হঠাৎ রঞ্জনার একটা চিঠি পেলাম, তিন তারিখে আমরা দুজনেই মাদ্রাজ যাচ্ছি। একদিন ওখানে থাকব। তারপর পাঁচই ডিলক্স। এক্সপ্রেসে আমি দিল্লি রওনা হচ্ছি। মাসখানেক দাদার কাছে থাকব। আপনি নিশ্চয়ই যোগাযোগ করবেন।

সাত তারিখ সকালে দু তিনবার নয়া দিল্লি স্টেশনে ফোন করে মাদ্রাজ ডিলক্সের খবর নিলাম। ভাবলাম স্টেশনে যাই কিন্তু গেলাম না। মনে হলো রঞ্জনা সম্পর্কে আমার অতটা উৎসাহ বা আগ্রহ। থাকা ঠিক নয়। অন্যায়। তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়া করে বেরুবার সময় রাধাকিষণকে বললাম, কেউ আমার খোঁজ করলে বলল আমি এখানে ছিলাম না। আজ দুপুরেই এসেছি।

জী সাব।

যদি খুব দরকারি টেলিফোন আসে তাহলে অফিসে টেলিফোন করতে বলল।

কোন কারণ নেই, যুক্তি নেই, দাবি নেই কিন্তু তবুও একটা প্রত্যাশায় সারাটা দিন কাটালাম। সন্ধ্যা, রাত্রিও। এলো না। কয়েকবার টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল ঘুরাতে গিয়েও পিছিয়ে এসেছি। করিনি। পরের দিন সকালে মার্শাল টিটো দিল্লি এলেন। সারাটা দিন আমি অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্যে কাটালাম। যুগোশ্লাভ অ্যাম্বাসেডরের রিসেপসন অ্যাটেন্ড করে, নিউজ ডেসপ্যাঁচ করে বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হলো। তার পরের দিনও ব্যস্ত রইলাম। তবে রাষ্ট্রপতি ভবনে ডক্টর চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হলো কিন্তু কোনো কথা হলো না। প্ল্যানিং মিনিস্টার, প্ল্যানিং কমিশনের মেম্বার ও অ্যাডভাইসাররা প্রেসিডেন্ট টিটোর সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়েছিলেন। তখন ডক্টর চৌধুরীর কথা বলার অবকাশ ছিল না। আমাকে দেখে শুধু একটু হাসলেন। সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে চা খাচ্ছি এমন সময় টেলিফোন এলো। আমি হ্যালো বলতেই ওদিক থেকে রঞ্জনার গলা শুনতে পেলাম আপনার কি ব্যাপার বলুন তো?

কেন কি হলো?

আমার চিঠি পাননি?

পেয়েছি।

তবে কি?

একটা টেলিফোনও করলেন না?

কি দারুণ ব্যস্ততার মধ্যে দিন কাটছে তা তুমি ভাবতে পারবে না।

তাই বলে একবার টেলিফোনও করা যায় না?

ওসব কথা ছাড়ো। তুমি কেমন আছ?

ভালোই; তবে একলা একলা হাঁপিয়ে উঠছি।

কেন? দাদা বাড়ি নেই?

না। টিটো এসেছেন বলে কদিনই খুব ব্যস্ত।

আজই ওঁর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ভবনে দেখা হলো।

তাই নাকি?

হ্যাঁ।

কিছু বললেন?

না। কথা বলার সময় ছিল না। দেবব্রতর কি খবর?

ভালোই।

ব্যাঙ্গালোরে কেমন লাগছে?

ওখানেও তো সারাদিন একলা কাটাতে হয়।

আমি হাসলাম, তুমি কি আশা করেছিলে বিয়ের পর স্বামী তোমার কাছে সারাদিন কাটাবে?

আমি বুঝি তাই বললাম?

আমি তো সেই রকমই বুঝলাম।

আপনি সারা জীবনই আমাকে ভুল বুঝবেন। ওর গলার স্বরটা একটু অন্য রকম মনে হলো।

বোধহয় কথাটা শুনতে ভালোই লাগল, কি বললে রঞ্জনা?

কিছু না।

বল না কি বললে?

বললাম আপনি সব সময়ই আমাকে ভুল বোঝেন।

তার মানে? কবে আবার তোমাকে ভুল বুঝলাম?

যাক গে ওসব কথা। আপনি কেমন আছেন?

যেমন ছিলাম তেমনি আছি।

খাওয়া হয়েছে?

না। এক্ষুনি বাড়ি এলাম।

স্নান করেছেন?

তোমার টেলিফোন আসার এক মিনিট আগেই এসেছি।

তাহলে আর আপনাকে বিরক্ত করব না।

না, না, বিরক্ত হবার কি আছে! বরং এতদিন পরে তোমার সঙ্গে কথা বলতে আমার ভালোই লাগছে।

বাজে বকবেন না। কথা বলতে ভালো লাগলে আপনিই আগে টেলিফোন করতেন।

ভালো না লাগলে কেউ এতক্ষণ ধরে কথা বলে?

সত্যি আপনাকে অনেকক্ষণ আটকে রেখেছি। স্নান করতে যান।

ব্যস্ত হবার কিছু নেই!

না থাক। আপনি এবার স্নান করে কিছু খাওয়া-দাওয়া করুন। কাল আবার কথা হবে।

রঞ্জনা টেলিফোন ছেড়ে দিল। আমিও আস্তে আস্তে রিসিভার নামিয়ে রাখলাম কিন্তু স্নান করতে গেলাম না। বসে রইলাম। ভাবছিলাম রঞ্জনার কথা। আমার সম্পর্কে ওর মনের মধ্যে একটু অভিমান জমা আছে বুঝতে পারি, কিন্তু কেন? আমি কি অন্যায় করেছি? ভুল করেছি? ওর মনে কি কোনো দুঃখ, আঘাত দিয়েছি? কোনো প্রত্যাশা পূর্ণ করিনি? অনেকক্ষণ ধরে ভাবলাম কিন্তু কিছুতেই কোনো কূল-কিনারা পেলাম না।

রঞ্জনা যখন রমা ছিল তখনকার সমস্ত স্মৃতির খাতা খুলে হিসাব করতে বসলাম। সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের নয় কিন্তু লেনদেন যথেষ্ট হয়েছে। যখন তখন সব জমা-খরচের কথা মনে পড়ে না। মনে পড়তে পারে না। তবু চুপ করে বসে বসে মনে করার চেষ্টা করলাম। প্রথম থেকেই খুব সহজভাবে আমরা মিশেছি। পোড়া গরু সিঁদুর মেঘ দেখলে ভয় পায়। আমিও পেতাম বলে কোনো মেয়ের সঙ্গেই প্রাণ খুলে মিশতে পারিনি, পারব না কিন্তু ওর সঙ্গে মিশেছি। প্রাণ খুলে মিশেছি। ভালো লেগেছে। মনের অনেক ছোটখাট ক্ষত ঠিক হয়ে গেছে ওর সান্নিধ্যে, সংস্পর্শে। আরো কিছুদিন ওকে কাছে পেলে সব ক্ষত সেরে যেতো কিনা বলতে পারব না। তবে সম্ভাবনা ছিল না, একথা জোর করে বলার ক্ষমতা আমার নেই। হাজার হোক আমি রক্ত-মাংসের মানুষ, আমার হৃৎপিণ্ড ওঠানামা করে, সৌন্দর্য দেখতে ভালো লাগে, প্রিয়জনের সান্নিধ্যে আনন্দ পাই। পাথরের মতো আমি জড় পদার্থ হলে এসব অনুভূতি আমার থাকত না। রমার মতো শত সহস্ৰজনের সারা জীবনের সাধনাতেও আমার কোনো পরিবর্তন হতো না।

আমি জানি না রমার জন্য আমার কি পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু একথা ঠিক ওর অভাব অনুভব করি। ওর সঙ্গে আলাপ হবার পর থেকেই ওর উপর কিছু দাবি করার স্বাধীনতা আমার হয়। এ অধিকার আমি অর্জন করেছিলাম নাকি ও স্বেচ্ছায় আমাকে দিয়েছিল তা মনে নেই। বলতে পারব না।

.

হ্যালো!

কি ব্যাপার? এই সাত সকালে টেলিফোন করছ? টেলিফোনে আমার গলা শুনেই জয়ন্তী বৌদি জিজ্ঞাসা করলেন।

আজ রমাকে আমার সংসার সামলাতে হবে।

তোমার আবার সংসার?

হঠাৎ আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব এলে সংসার না করে কি উপায় আছে?

কেউ এসেছেন নাকি?

আমার দিদির কলেজ জীবনের দুই বান্ধবী আজ বিকেলের দিকে আগ্রা থেকে আসছেন কিন্তু এদিকে রাধা গিন্নী জ্বরে বেহুঁশ।…

একটু ধর। রমাকে ডেকে দিচ্ছি।

রমা টেলিফোন তুলেই বললো, কি ব্যাপার? এত সকালে আমাকে মনে পড়ল?

সব সময়ই তোমাকে মনে পড়ে কিন্তু জানাই না।

বাজে বকবেন না। বলুন কি ব্যাপার।

আজ বিকেলের দিকে আমার দিদির দুই বান্ধবী আগ্রা থেকে আসছে। কাল ভোরের বাসেই সিমলা চলে যাবেন। কিন্তু কাল থেকে রাধাকিষণের ভীষণ জ্বর।…

আমি আসব?

সেইজন্যেই তোমাকে টেলিফোন করছি।

আপনি এসে নিয়ে যাবেন নাকি বাবাকে বলব?

তুমি কতক্ষণে রেডি হবে বল; আমিই তোমাকে নিয়ে আসব।

আটটা নাগাদ আসুন।

ঠিক আছে।

আমি গাড়ি থেকে নামতেই সুভাষদা জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার দিদির দুই বন্ধু আসছে?

আমি গাড়ি লক করতে করতে বললাম, হ্যাঁ।

ওরা তো আমার এখানেও থাকতে পারেন।

আমার ওখানে থাকার তো কোনো অসুবিধে নেই, শুধু রাধাকিষণের জ্বর হয়েই মুশকিল বাধিয়েছে।

রমা যখন যাচ্ছে তখন ও সব ব্যবস্থা করে দেবে। তোমায় কিছু ভাবতে হবে না।

তা জানি।

রমা তৈরিই ছিল। আমি এক কাপ চা খেয়েই ওকে নিয়ে রওনা হলাম। রওনা হবার আগে সুভাষদা আর বৌদিকে বললাম, রমার ফিরতে রাত হলে চিন্তা করবেন না ওদের খাওয়া-দাওয়া হবার পরই আমি ওকে ফিরিয়ে দিয়ে যাব।

বৌদি বললেন, তোমার অসুবিধে হলে টেলিফোন করো, ওকে পাঠিয়ে দেব।

না, না, দাদাকে আর কষ্ট করতে হবে না।

গাড়ি স্টার্ট করে শান্তি পথ ধরতেই বললাম, এই পথেই বাজার করে নিয়ে যাই, কি বল।

হ্যাঁ, সেই ভালো।

মাছ না মাংস কিনব বল তো।

ওঁরা কি পছন্দ করবেন তা আমি কি করে বলি বলুন।

দুরকম মাছ কেনার চাইতে মাছ-মাংস দুইই কেনা ভালো, তাই না?

তা তো বটেই।

একটু পরে রমা জিজ্ঞাসা করল, যারা আসছেন তারা আপনার দিদির সঙ্গে পড়তেন বুঝি?

হ্যাঁ। তাছাড়া আমাদের বাড়িতে খুব আসা-যাওয়া ছিল।

খুব ঘনিষ্ঠতা না থাকলে নিশ্চয়ই আপনার এখানে উঠতেন না।

এক কালে খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল তবে ইদানীং বেশ কয়েক বছর দেখাশুনা নেই।

দুই বন্ধুই শুধু আসছেন?

ওঁরা কেউই বিয়ে করেননি…

তাই নাকি?

হ্যাঁ। তাছাড়া দুজনেই একই কলেজে লেকচারার।

তাই দুই বন্ধু বেড়াতে বেরিয়েছেন।

ওঁরা খুব ঘুরে বেড়ান।

খুব স্বাভাবিক। সংসারধর্ম না করলে কিছু নিয়ে তো থাকতে হবে।

আমিও তো বিয়ে করিনি; আমি কি নিয়ে আছি? প্রশ্ন করেই রমার দিকে তাকালাম।

আপনার বিয়ে করার সময় তো চলে যায়নি।

চলে যায়নি?

না।

দেড়টা-দুটোর মধ্যে সমস্ত রান্না শেষ করার পর আমি আর রমা একসঙ্গে খেতে বসলাম। খেতে খেতে ও জিজ্ঞাসা করল, আমি যদি এখন দিল্লিতে না থাকতাম তাহলে কাকে দিয়ে রান্না বান্না করাতেন?

আমি হাসলাম। বললাম, ভয় নেই। অন্য কোনো সুন্দরী যুবতী এখানে আসে না, আনিও না।

রমা আর কোনো কথা বলল না। চুপ করে রইল।

আমি বললাম, তোমাকে ছাড়া আর কাউকেই এভাবে বিরক্ত করার অধিকার আমি পাইনি।

মুখ নিচু করেই বললো, আমিও আর কারুর হুকুম তামিল করি না।

তা আমি জানি।

কিন্তু এ অধিকার আমি কেমন করে পেলাম?রমা দিল কেন?রমাইবা কোনো অধিকারে আমাকে টেলিফোন করে বলতো, ওয়েস্টনগর থেকে আমার দুই বন্ধু দুপুরে আমাদের এখানে আসবে, খাবে। তারপর আমরা তিনজনে প্লাজায় সিনেমা দেখব। আপনাকে ওদের পৌঁছে দিতে হবে।

আমার সঙ্গে দুটি সুন্দরী মেয়েকে ছেড়ে দেওয়া কি ঠিক হবে?

ছেড়ে দিলেও আপনার দ্বারা কিছু হবে না, তা আমি জানি।

জান?

নিশ্চয়ই জানি। তবে আজ তো আমিও সঙ্গে থাকব। সিনেমা দেখে আমি কি একলা বাড়ি ফিরব?

আমি শুধু ড্রাইভারী করব নাকি আমারও একটা টিকিট কাটবে?

ওদের সঙ্গে আপনার সিনেমায় যেতে হবে না। পরে আমি আর আপনি একদিন দেখব।

সিনেমায় অনেকবারই আমরা গেছি। অনেক সময় জয়ন্তী বৌদি আমাদের সঙ্গে গিয়েছেন। সিনেমা দেখে বেরুবার সময় গাড়ির ল খুলতে গেলেই ও বলতো, এখনই বাড়ি যাবেন? একটু কফি-টফি খাওয়াবেন না?

জয়ন্তী বৌদি আমাদের সঙ্গে থাকলে সঙ্গে সঙ্গে বলতেন, ও সিনেমা দেখাল, আবার কফি খাওয়াবে কেন? বরং আমিই…

তুমি ক্ষেপেছ মা? উনি থাকতে তোমার পয়সায় কফি খাব?

আমি হাসি। জিজ্ঞাসা করি, এই রকম হ্যাংলামি করে কফি খেতে তোমার লজ্জা করে না?

ঠোঁট উল্টে, মাথা নাড়তে নাড়তে রমা বলতো, আপনার কাছে চাইতে আবার লজ্জা কিসের?

.

প্রত্যেক মাসেই সুভাষদা বাড়িতে দুটো-একটা পার্টি দিতেন।

প্রায় সব পার্টিতে আমি যেতাম। রমা দিল্লিতে থাকলে আমাকে সকালের দিকে টেলিফোন করে বলতো, আজ আপনি সেই সিল্কের পাঞ্জাবি আর ধুতি পরে আসবেন তো?

ধুতি-পাঞ্জাবি পরে আসব কেন? বরযাত্রী যাব নাকি?

ইয়ার্কি না, সত্যি ধুতি-পাঞ্জাবি পরে আসবেন।

কেন?

বাবাদের ফরেন সার্ভিসের দুই বাঙালি সাহেব আসবেন…

তাতে কি হলো?

ওদের সাহেবীয়ানা দেখলে আমার গা জ্বলে যায়। তাইতো ওরা এলেই বাবাকে ধুতি-পাঞ্জাবি আর মাকে লাল পেড়ে গরদের শাড়ি পরাই।

আর তুমি?

আর আমিও খুব সাধারণ তাঁতের শাড়ি পরি।

সত্যি ধুতি-পাঞ্জাবি পরে আসব?

অব কোর্স!

.

বসে বসে আরো কত কি মনে পড়ল। এতকাল অনেকগুলো টুকরো টুকরো ঘটনা একসঙ্গে দেখতে গিয়ে, বিচার করে মনের মধ্যে সন্দেহ দেখা দিচ্ছে। সন্দেহ হচ্ছে ও হয়তো সত্যই আমাকে ভালোবাসত, আমাকে চাইত, আমাকে নিয়ে আগামী দিনের মিষ্টি-মধুর স্বপ্ন দেখে। কিন্তু এতো আমার শুধু সন্দেহ। অনুমান। আবছা ধারণা। ও কি প্রত্যাশা করেছিল আমি নিজেই এগিয়ে যাব? অনুরোধ করব বা দাবি করব, রমা, তুমি আমার। আর কাউকে বিলিয়ে দিও না, দেবে না।

রাধাকিষণের তাগিদে আর বসে বসে ভাবতে পারলাম না। উঠে পড়লাম।

পরের দিন সকালেই প্রেসিডেন্ট টিটো চলে গেলেন। কাজকর্ম শেষ করে দুপুরের দিকেই আমি বাড়ি এলাম। খেলাম। মুলকরাজ আনন্দের কুলিপড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়লাম।কদিন খুব পরিশ্রম গেছে বলে রাধাকিষণ আমাকে ডাকেনি, চাও দেয়নি। ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যা ঘুরে যাবার পর। তখন প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে। চা খেতে খেতে রাধাকিষণকে জিজ্ঞাসা করলাম, এ বেলায় কি রান্না করছ?

এ বেলায় রান্না করিনি।

বেশ বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন?

তিন মূর্তি লেনের মেমসাব টেলিফোন করে বললেন, আপনি ওখানে খানা খাবেন…

তোমাকে বললেই আমি খেতে যাব?

উনি দুবার টেলিফোন করেছেন…

আমাকে ডাকলে না কেন?

আমি ডাকতে চেয়েছিলাম কিন্তু ঘুম ভাঙাতে মানা করলেন।

আমি বিছানার উপরেই চুপ করে বসে রইলাম। রাধাকিষণও পাশে দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণ পরে ও জিজ্ঞাসা করল, সাব খানা বানাব?

ওর কথার সোজাসুজি জবাব না দিয়ে বললাম, ও ঘর থেকে টেলিফোনটা নিয়ে এসো।

রাধাকিষণ টেলিফোন আনতেই ডায়াল ঘুরালাম। ডক্টর চৌধুরী বা রঞ্জনা নয় ওদের চাকরই টেলিফোনটা ধরল। জিজ্ঞাসা করলাম, সাব হ্যায়?

হায় মাগার বাথরুম গ্যয়া।

নায়া মেমসাহেব কাহা?

আপ হোল্ড কিজিয়ে।

দুএক মিনিট পরে রঞ্জনা টেলিফোন ধরতেই জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি টেলিফোন করেছিলে?

একবার নয় দুবার?

কি ব্যাপার?

আজ রাত্রে আপনি আমাদের এখানে খাবেন।

হঠাৎ কি ব্যাপার?

কি আবার ব্যাপার?আমি এসেছি, তাই দাদা বললেন আপনাকে যেন আজ রাত্রে খেতে বলি।

কিন্তু।

ওসব কিন্তু ছাড়ুন। এক্ষুনি ঘুম থেকে উঠলেন?

হ্যাঁ।

তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে চলে আসুন।

শুধু সেদিন রাত্রে নয় পাঁচ-সাত দিন পর পরই ওদের ওখানে নেমন্তন্ন খেতে যেতাম। যেতেই হতো। রঞ্জনা তত বলতই, তাছাড়া ডক্টর চৌধুরী নিজেও অনুরোধ করতেন, আজ কিন্তু তাড়াতাড়ি আসবেন।

আমি একটু সঙ্কোচ বোধ করতাম, এইতো সেদিন গিয়ে খেয়ে এলাম। আজ আবার…

আপনি মশাই বড় লাজুক। খাওয়া-দাওয়া ব্যাপারে ব্যাচেলারের লজ্জা করলে চলে?

আমি একটু হাসলাম, লজ্জার কিছু নয় তবে।

ওসব তবে টবে ছাড়ুন। সাতটার মধ্যে নিশ্চয়ই আসছেন।

আচ্ছা।

আমাকে যেতেই হতো, না গিয়ে পারতাম না। আর ওখানে যাওয়া মানেই রঞ্জনার প্রশংসা শোনা।

ডক্টর চৌধুরী হাসতে হাসতে বললেন, রঞ্জনা কি ডেঞ্জারাস মেয়ে তা আপনি জানেন?

আমি হাসি।

আমার মতো ঘুম কাতুরে লোককে পর্যন্ত ও ভোর পাঁচটায় উঠিয়ে দেয়।

কেন?

মর্নিং ওয়াক করতে পাঠায়।

আমি বলি, মর্নিং ওয়াক করা সত্যি ভালো।

ভালো তো বুঝি কিন্তু আপনি করেন?

দুকাপ কফি নিয়ে রঞ্জনা ড্রইংরুমে ঢুকেই বললো, কি দাদা! আমার প্রশংসা করতে শুরু করেছে?

ডক্টর চৌধুরী ডান হাত বাড়িয়ে কফির পেয়ালা নিতে নিতে বললেন, প্রশংসা নয়, নিন্দা করছি। সারা জীবনে যে সাড়ে সাতটা-আটটার আগে ঘুম থেকে ওঠেনি, আর তাকে তুমি পাঁচটার সময় মর্নিং ওয়াকএ পাঠাচ্ছ আর আমি তোমার নিন্দা করব না?

রঞ্জনা গম্ভীর গলায় বললো, দাদা ডোন্ট ফরগেট ইউ আর অ্যাবোভ ফিফটি।

রঞ্জনা চলে যেতেই ডক্টর চৌধুরী আবার প্রশংসা করতে শুরু করেন, মেয়েটা এসে আমার লাইফের প্যাটার্নই পাল্টে দিয়েছে।

…রঞ্জনার ঘরেই টাইম পিস থাকে। অ্যালার্ম বাজলেই ও উঠে ডক্টর চৌধুরীর ঘরে যায়। দু একবার পাশে দাঁড়িয়ে ডাক দেয়, দাদা! দাদা।

একটু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

আবার ডাকে, দাদা। উঠুন। পাঁচটা বাজে।

তবুও ঘুম ভাঙে না ডক্টর চৌধুরীর। রঞ্জনা আরো একটু এগিয়ে যায়, একটু ঝুঁকে পড়ে ওঁর মাথায় হাত দিতে দিতে ডাকে, দাদা, উঠবেন না? অনেকক্ষণ অ্যালার্ম বেজে গেছে।

ডক্টর চৌধুরী একবার এক মুহূর্তের জন্য চোখ মেলেই চমকে ওঠেন, অ্যালার্ম বেজে গেছে?

হ্যাঁ দাদা।

ডক্টর চৌধুরী একটু পাশ ফিরে শুতে শুতেই জিজ্ঞাসা করেন, তুমি অনেকক্ষণ ডাকছ?

না, বেশিক্ষণ না।

উনি ওপাশ ফিরে আবার একটু ঘুমুতে চেষ্টা করেন কিন্তু রঞ্জনা ওঁর মাথায় কপালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আবার ডাকে, দাদা, আর দেরি করবেন না।

একে রঞ্জনার ডাকাডাকি তার উপর চোখের উপর এমন আলো পড়ে যে ওঁকে উঠতেই হয়। উনি বাথরুমে ঢুকলেই রঞ্জনা আবার নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। ঘুমোয়। ডক্টর চৌধুরী বেরুবার সময় চাকরকে ডেকে দেন। ও দরজা বন্ধ করে দিয়েই দিনের কাজ শুরু করে। সাড়ে ছটা-পৌনে সাতটায় উনি মর্নিং ওয়াক করে ফিরে এসেই আবার বাথরুমে যান। স্নান সেরে বেরুতে না বেরুতেই চা হয়। রঞ্জনাও উঠে পড়ে।

চা খেতে খেতে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে দুজনের গল্প হয়।

চৌধুরী বাড়ির গল্প, দেবব্রতর ছেলেবেলার গল্প, দিল্লির গল্প। কখনও কখনও বেনারসের গল্প, ওয়াশিংটনের গল্প, কায়রো মস্কোর গল্প।

আচ্ছা দাদা, আপনার এখানে বড় দাদুর ছবি দেখি, কিন্তু আপনার নিজের দাদুর কোনো ছবি তো দেখি না।

আমার দাদু বিশেষ সুবিধার লোক ছিলেন না। আমার দাদুর চাইতে বড় দাদুই আমাকে বেশি ভালোবাসতেন, আমিও ওঁকেই বেশি ভালোবাসতাম…

তাই নাকি?

হ্যাঁ। তাছাড়া ওঁর জন্যই আমি একটু লেখাপড়া শিখতে পেরেছি। আমার নিজের দাদুর কাছে থাকলে আমার কিছুই হতো না।

লেখাপড়ার প্রতি বুঝি ওঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল না?

বিন্দুমাত্র না।

আপনারা আর আহিরীটোলায় যান না?

আমি দু তিনবার গিয়েছি। একবার কি দুবার দেবুকেও নিয়ে গেছি।

ওসব সম্পত্তি তো আপনাদেরই?

ঠিক জানি না। আমার মনে হয় দাদু সব কিছু বেচে দেন।

এখন ওখানে কারা থাকে?

খুব দূরসম্পর্কের কিছু আত্মীয় আর কিছু ভাড়াটে।

ডক্টর চৌধুরী যখন দেবব্রতর ছেলেবেলার গল্প করেন তখনই ভারি মজা হয়।

তখনও আমরা সিমলায়। দেবু খুব ছোট। বড় জোর পাঁচ-ছ বছরের হবে। পাশের বাড়ির একটা পাহাড়ি মেয়ের সঙ্গে ওর খুব ভাব ছিল। কিছুকাল পরে ওরা সিমলা থেকে চলে গেলে দেবুর কি কান্না।…

কেন?

ডক্টর চৌধুরী হাসেন, কেন আবার? ও ঐ মেয়েটিকে বিয়ে করবে বলে পাগল।

রঞ্জনাও হাসে। বলে, ঐ রকম একটা পাহাড়ি মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হলেই ভালো হতো।

ডক্টর চৌধুরী হাসতে হাসতে একটু আনমনা হয়ে কি যেন ভাবেন। আমাদের আহিরীটোলার বাড়িতে এক বুড়ি থাকতেন। আমি তাকে বুড়ি পিসিমা বলে ডাকতাম। প্রথম যখন দেবুকে নিয়ে আহিরীটোলার বাড়িতে যাই উনি ওকে দেখে বলেছিলেন ওর সুন্দরী শিক্ষিতা ও বিদেশিনীর সঙ্গে বিয়ে হবে।

রঞ্জনা বললো, কই বিদেশিনীর সঙ্গে তো বিয়ে হলো না?

জ্যোতিষ আমি বিশ্বাস না করলেও মাঝে মাঝে বুড়ি পিসিমার কথাটা মনে হতো। বিশেষ করে ওকে লন্ডনে পাঠাবার পর একটু বেশি মনে হতো…।

রঞ্জনা হাসতে হাসতে প্রশ্ন করে, আপনার ভাই ওখানে কাউকে বিয়ে করে রেখে আসেনি তো?

ডক্টর চৌধুরী বেশ গর্বের সঙ্গেই জবাব দেন, ভুলে যেও না ও দেবব্রত চৌধুরী।

একটু নীরবতা।

জান রঞ্জনা, বুড়ি পিসিমা ঠিকই বলেছিলেন। একদিক দিয়ে তুমিও তো বিদেশিনী।

আমি বিদেশিনী হবে কেন?

যখন তোমার বিয়ে হলো তখন তো তুমি মস্কোর বাসিন্দা।

রঞ্জনা চুপ করে থাকে।

শুনেছি আমাকে নিয়েও আলোচনা হতো। কোনো না কোনো প্রসঙ্গে হয়তো আমার কথা উঠত। আচ্ছা রঞ্জনা, রিপোর্টার সাহেবের সঙ্গে তোমাদের আলাপ কি অনেক দিনের?

উনি যখন ডক্টর রাধাকৃষ্ণণের সঙ্গে আমেরিকায় যান তখনই বাবা-মার সঙ্গে ওঁর প্রথম আলাপ।

তাহলে তো খুব বেশি দিনের আলাপ নয়।

না, খুব বেশি দিনের না হলেও খুব ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেছে বাবা-মার সঙ্গে।

তোমার বাবা-মা ওঁকে খুব ভালোবাসেন।

উনিও বাবা-মাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করেন।

কোনো কোনো দিন আলোচনা আরো এগিয়ে যায়।

রিপোর্টার সাহেব আর দেবুর মধ্যেও দারুণ ভাব তা জান?

রঞ্জনা একটু হাসে, জানি।

লন্ডনে দেবুর সঙ্গে প্রথম আলাপ হবার পর আমার কাছে ওর খুব প্রশংসা করেছিলেন। তুমি। তো জান যে কেউ দেবুর প্রশংসা করুক তাকে আমার ভালো লাগে।

এটা ঠিক বললেন না দাদা।

কেন?

আপনার ভাইয়ের প্রশংসা করলেই ভালো আর প্রশংসা না করলেই ভালো নয়?

আমি ঠিক তা বলিনি।

আপনার কথা শুনে মনে হলো উনি আপনার ভাইয়ের প্রশংসা করেছিলেন বলেই ওকে আপনার ভালো লেগেছে।

ডক্টর চৌধুরী একটু জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে রঞ্জনার দিকে তাকিয়ে বললেন, ভদ্রলোককে এমনি আমার ভালো লেগেছে। দেখতে-শুনতে আলাপেব্যবহারে বেশ সুন্দর তবে…

তবে ভাইয়ের প্রশংসা করায় আরো ভালো লেগেছে তাই তো।

ডক্টর হাসতে হাসতে বললেন, তা ঠিক।

এরপর আপনার ভাইয়ের সঙ্গে যদি আমার কোনদিন একটু মতবিরোধ বা তর্ক হয় তাহলেই তো আপনি বলবেন, রঞ্জনা মেয়েটা ভালো না।

না, তা বলব কেন? তবে তোমাদের মধ্যে তর্ক ঝগড়া হবেই না।

সংসারের অভিজ্ঞতা প্রায় না থাকলেও রঞ্জনা ওঁর কথায় হাসল। দাদা, আপনি চিরকাল ল্যাবরেটারিতে কাটিয়ে মানুষকে বড় সহজ সরল মনে করেন।

পরে টেলিফোনে ও আমাকে সব কথা জানাত। আমি শুনে হাসতাম।

ডক্টর চৌধুরী আগে সকালে কিছুই খেতেন না। এখনও বিশেষ কিছু খান না। রঞ্জনার অনুরোধে সামান্য একটু ফল খান। সাড়ে নটাতেই ভাত খেয়ে প্ল্যানিং কমিশনে চলে যান। বিকেলের দিকে এক কাপ চা। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলে রঞ্জনার চাপে কিছু খেতেই হয় কিন্তু অধিকাংশ দিনই দেরি করে ফেরেন। সাতটা-সাড়ে সাতটা-আটটা বেজে যায়। মিটিং কনফারেন্স ডেলিগেশনের ঝামেলা থাকলে আরো রাত হয়। অফিস থেকে মাঝে মাঝে বাড়িতে টেলিফোন করে রঞ্জনার খবর নেন। কাজের চাপ বেশি থাকলে তাও ভুলে যান। রঞ্জনা অবশ্য রোজই দু তিনবার ফোন করে বলে, দাদা, বাবার চিঠি এসেছে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। আপনারও চিঠি আছে।

ওরা কেমন আছেন?

ভালোই, তবে আপনাকে একবার যেতে লিখেছেন।

ডক্টর চৌধুরী হাসেন মস্কো যদি বিহার মধ্যপ্রদেশের মধ্যে হতো তাহলে হয়তো একবার চেষ্টা করতাম, কিন্তু…

কেন আপনি কি মস্কো যেতে পারেন না?

সরকার পাঠালেই যেতে পারি।

বাবার তো রিটায়ার করার টাইম হয়ে এলো।

সে এখনও অনেক দেরি।

তিন মূর্তি লেন থেকে বাজার অনেক দূরে। সময় কাটাবার জন্য রঞ্জনা আরো দূরের মার্কেটে যায়। কোনদিন আই-এন-এ মার্কেট, কোনোদিন গোল মার্কেট। বেশ খানিকটা সময় লাগে, কিন্তু তবু সারাটা দিন কাটতে চায় না। পারে না। অসহ্য মনে হয়। বরাবর হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করে একলা থাকার অভ্যাস নেই।

হ্যালো, আমি রঞ্জনা।

বলো কেমন আছো?

একবার টেলিফোনও করেন না কেন বলুন তো?

হঠাৎ টেলিফোন করেই টপ্পা-ঠুংরী গাইতে শুরু করলে কেন?

সব সময়ই আপনার ঠাট্টা। সত্যি বলুন তো আপনি টেলিফোন করেন না কেন?

কে টেলিফোন করল তাতে কি আসে যায়? কথা তো হচ্ছে রেগুলারই।

টেলিফোন করলে কথা না বলে কি করবেন? বাধ্য হয়েই বলতে হয়।

তোমার মেজাজটা খারাপ কেন বলো তো?

মেজাজটা খারাপ হবে কেন। তবে সারাটা দিন একলা থাকতে বিশ্রী লাগে।

আমি কি করতে পারি বল?

কি আবার করবেন?

তবে আর এসব কথা বলে লাভ কি?

ঠিক আছে বলব না। ঝপাং করে টেলিফোনের রিসিভার নামিয়ে রাখল রঞ্জনা।

মনে হলো একবার টেলিফোন করি, কিন্তু করলাম না। কিছুক্ষণ পরে মাথায় একটু দুষ্ট বুদ্ধি এলো। ডক্টর চৌধুরীকে প্ল্যানিং কমিশনে টেলিফোন করলাম, কেমন আছেন?

ভালোই। আপনার খবর ভালো তো?

আমার শরীরটা বিশেষ ভালো নেই।

স্নেহপ্রবণ ডক্টর চৌধুরী একটু উৎকণ্ঠার সঙ্গে বললেন, কেন, কি হলো? জ্বর নাকি?

জ্বর হয়নি। গাড়ির দরজা বন্ধ করতে গিয়ে ডান পায়ে দারুণ লেগেছে…

তাই নাকি?

হ্যাঁ। একেবারে শয্যাশায়ী।

তাহলে তো খুবই মুশকিল।

চাকরটা না থাকায় আরো বিপদে পড়েছি।

সেকি? খাওয়া-দাওয়ার কি হচ্ছে?

সুন্দর নগর মার্কেটের একটা দোকানে টেলিফোন করলে ওরা কিছু পাঠিয়ে দেয়।

মাই গড! ইউ আর রিয়েলি ইন ট্রাবল!

রঞ্জনা ভালো আছে?

হ্যাঁ, ভালোই আছে, কিন্তু আপনিই তো ভাবিয়ে তুললেন।

আপনি চিন্তা করবেন না। দুএকদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।

.

রাধাকিষণ দুদিনের ছুটি নিয়ে গড়মুক্তেশ্বরের মেলা দেখতে গেছে। আজই ভোরে গেছে। পরশু সন্ধ্যার পর ফিরবে। সকালে ডিম রুটি খেয়ে অফিসে গিয়েছিলাম, আবার বিকেলে খাবো। ফরেন অফিসের ব্রিফিং আছে। দুপুরবেলায় খাওয়া-দাওয়া করে একটা ঘুম দেব ভাবছিলাম, কিন্তু বাড়ি ফিরে রাধাকিষণকে না দেখতে পেয়েই মেজাজ বিগড়ে গেল। তারপর রঞ্জনার টেলিফোন। প্রথমে ভেবেছিলাম রাত্রে খেতে বলবে। নেমন্তন্ন তো করলই না উপরন্তু রাগ করে কথাবার্তা বললো। হঠাৎ বাতিক চাপল ওর হাতের রান্না খেতেই হবে। সেই জন্যই ডক্টর চৌধুরীকে টেলিফোন করে ঐসব মিথ্যে কথা বললাম। আশা করেছিলাম উনি সঙ্গে সঙ্গে রঞ্জনাকে টেলিফোন করবেন। আর তারপরই আমার টেলিফোন বেজে উঠবে।

পাঁচ, দশ, পনের মিনিট। আধঘণ্টা। একঘণ্টাও পার হয়ে গেল। কিন্তু আমার টেলিফোন বেজে উঠল না। আরো আধঘণ্টা হয়ে গেল তবু টেলিফোন এলো না। হঠাৎ কলিং বেল বাজতেই চমকে উঠলাম। ভাবলাম নিশ্চয়ই পিয়ন এসেছে কোনো রেজিস্টার্ড বুক-পোস্ট ডেলিভেরী দিতে। দরজা খুলে দেখি রঞ্জনা। মিটমিট করে হাসছে। হাতে টিফিন কেরিয়ার।

এসো। আমারও হাসি পাচ্ছিল, কিন্তু অনেক কষ্টে হাসি চেপে স্বাভাবিকভাবে ওকে ডাকলাম।

ও ধীর পদক্ষেপে ড্রইংরুমে ঢুকে সেন্টার টেবিলের ওপর টিফিন কেরিয়ার রেখে একটা সোফায় বসল। মিটমিট করে হাসতে হাসতেই আমার দিকে তাকিয়ে রইল। মুখে কোন কথা নেই।

অমন করে কি দেখছ?

ঠিক একই রকম ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আস্তে আস্তে বললো, দেখে মনেই হয় না ভিতরে ভিতরে এত দুষ্ট বুদ্ধি।

ন্যাকামি করে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন? আমি কি করেছি?

ও মাথা দোলাতে দোলাতে বললো, কিচ্ছু না।

কথার মোড় ঘোরাবার জন্য জিজ্ঞাসা করলাম, টিফিন কেরিয়ার খালি না ভর্তি?

রাধাকিষণ কোথায়?

ছুটিতে।

আবার ছুটিতে?

দুদিনের জন্য গড়মুক্তেশ্বরের মেলা দেখতে গেছে।

কবে গেছে?

আজই ভোরে।

তাহলে খাওয়া হয়নি?

খাওয়া হয়নি বলেই গাড়ির দরজায় পাটা এমন বিচ্ছিরিভাবে জখম হলো।

ও টিফিন কেরিয়ারটা হাতে ভিতরের দিকে যেতে যেতে আপন মনে বললো, এই না হলে জার্নালিস্ট।

আমি চুপ করে বসে রইলাম।

একটু পরে ডাইনিং টেবিলে খাবার-দাবার সাজিয়ে রঞ্জনা ডাকল, আসুন!

ডাইনিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি খেয়ে এসেছ?

হ্যাঁ।

সত্যি বলছ?

আপনার মতো সাজিয়ে-গুছিয়ে মিথ্যে বলার মতো ক্ষমতা আমার নেই।

তুমি রাগ করেছ?

ভাত ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।

বসলাম। ভাতে হাত দিতেই অবাক হলাম, ভাত তো দারুণ গরম, তুমি কি এক্ষুনি রান্না করে নিয়ে এলে?

আমি রান্না করিনি। রান্না করিয়ে নিয়ে এলাম।

এত গরম ভাত আনার কি দরকার ছিল?

আমি জানি আপনি ঠাণ্ডা ভাত খেতে পারেন না।

কিন্তু…

খেয়ে নিন তো! আর বকবক করতে হবে না।

আমি আর একটি কথা না বলে মুখ বুজে খেয়ে নিলাম। ডাইনিং টেবিলে বসেই মুখ নিচু করে বললাম, তোমাকে কষ্ট দিলাম ঠিকই, কিন্তু খুব ভালো লাগল।

এভাবে কতদিন চলবে?

তুমি যতদিন চালাবে।

আরো কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে রঞ্জনা উঠল, যাচ্ছি। রাত্রে ড্রাইভারকে দিয়ে খাবার পাঠিয়ে দেব।

আমি হাসলাম, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?

রঞ্জনা হাসতে হাসতে বললো, পায়ের ব্যথা না সারা পর্যন্ত তো দেখাশুনা করতে হবে।

অনেক হয়েছে। আর না।

দাদার হুকুম।

০৬. ভালোবাসার অনেক জ্বালা

ভালোবাসার অনেক জ্বালা, অনেক ঝঞ্জাট। যাদের ভালোবাসা যায়, তাহা হাসলে হাসতে ইচ্ছা করে, দুঃখ পেলে নিজের মনটাও পীড়িত হয়। হবেই। সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়বেই। এর থেকে নিস্তার নেই, মুক্তি নেই। একদিন আমি সব কিছু পেয়েছিলাম, পরিপূর্ণ পরিতৃপ্ত হয়েছিল আমার মন। তারপর সব হারিয়েছি। নতুন করে পরিপূর্ণ হবার সাধ নেই। সাধ্যও নেই। তাছাড়া প্রয়োজনও নেই।

বেশ আছি আমি। দিনগুলো বেশ কেটে যায়। রাজনীতি দলাদলি মারামারি কাটাকাটি। কিছু শুনি, কিছু দেখি, লোকে কিছু বলে যায়। টাইপ রাইটার খটখট করি। টেলেক্স টেলিপ্রিন্টারে চলে যায় অফিসে। পরের দিন কাগজে ছাপা হয় ফ্রম আওয়ার পলিটিক্যাল করসপন্ডেন্ট। আমন্ত্রণ নিমন্ত্রণ ককটেল–ডিনারে সন্ধ্যা, রাত্রিও কেটে যায় বেশ। এছাড়াও আছে বন্ধুবান্ধব, পরিচিতের দল। আর আছে রাধাকিষণ। সব মিলিয়ে বেশ আছি। সুখেই আছি। সুভাষদা বৌদি দেবুরঞ্জনার মতো কিছু লোকের জন্যই আমার ঝামেলা। আমি একা হয়েও একলা থাকি না। এদের কথা ভাবি। ভাবতে ইচ্ছা করে, ভালো লাগে। এদের দেখতে ইচ্ছা করে, এদের সঙ্গে কথা বলতে মন চায়। আরো কত কি! মনের ইচ্ছা, প্রাণের ব্যাকুলতাকে সংযত করা বড় কঠিন। কষ্টকর। অনেক সময় দুঃসাধ্যও বটে।

রঞ্জনা দিল্লি আসে, ব্যাঙ্গালোরে ফিরে যায়। দুতিন মাস অন্তরই আসা-যাওয়া। এর মধ্যে দেবুও এক মাসের ছুটি নিয়ে এসেছিল। ঠিক বেড়াতে নয়, কাজে। পঞ্চশীল কলোনীতে ডক্টর চৌধুরী নিজের বাড়ি তৈরি করছেন। ঐ বাড়ি তৈরির কাজ শুরু করার জন্যই দেবু ছুটি নিয়ে দিল্লি এসেছিল। দেবু আর রঞ্জনা আসার পরদিনই ভিত পূজা হলো। দেবু বার বার করে আমাকে যেতে বলেছিল। গিয়েছিলাম। পুজো শেষ হবার পর আর্কিটেকটের কাছ থেকে প্ল্যানের নীল কাগজখানা নিয়ে ডক্টর চৌধুরী আমাকে বাড়ির প্ল্যান বুঝাতে শুরু করলেন, এই হচ্ছে সামনের বারান্দা। বাঁ দিকের দরজা দিয়ে ঢুকলেই ছোট্ট একটা সিটিং রুম। ড্রইংরুম হবে এল শেপের। আঙুল দিয়ে দেখালেন এই এল শেপের সাইডে হবে ডাইনিং স্পেস। তবে এখানে আমি ডিনার ওয়াগন ফিট করব না।…

আমি বললাম, খুব ভালো। বাইরের লোককে কিছু ক্ৰকারিজ দেখাবার কোনো মানে হয় না।

দ্যাটস রাইট। সিটিংরুম আর ড্রইংরুমের মাঝখানে যে দরজা দেখছেন…

হ্যাঁ।

ঐ দরজার সামনেই একটা বড় ল্যান্ডিং থাকবে আর ল্যান্ডিং-এর এক পাশ দিয়ে দোতলার সিঁড়ি।

আই সী।

ল্যান্ডিং পার হলেই ডান দিকে কিচেন-প্যান্ট্রি-স্টোর। আর বাঁ দিকে পর পর দুটো বেড রুম। দুটোর সাইজ আঠারো বাই কুড়ি। দুটোর সঙ্গেই অ্যাটাচ বাথ অ্যান্ড টয়লেট।…

আমি হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলাম, এই দুটো বেডরুমই বুঝি আপনাদের দু ভাইয়ের?

ডক্টর চৌধুরী হাসতে হাসতে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, আপনার মাথা খারাপ হয়েছে? রঞ্জনা আর ওর ছেলেমেয়েরা আমাকে এত কাছে থাকতে দেবে? আমি থাকব উপরের একটা ঘরে।

আমি হাসলাম।

এর একটা ঘরে রঞ্জনারা, অন্যটায় আমার ফিউচার গার্ডিয়ানরা থাকবে।…

আমি না হেসে পারলাম না।

এটা হচ্ছে ওপেন প্লেস। এর পর এটা স্টাডি। জ্যেঠু এখানে পড়াশুনা করবে আর একেবারে কোণায় হচ্ছে একটা গেস্ট রুম। প্ল্যানটা কেমন লাগল বলুন?

খুব ভালো, কিন্তু আপনার কি ব্যবস্থা হবে?

ঐ তো সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলেই দুটো ঘর। একটায় পড়াশুনা করব আর অন্যটায় শোব।

প্ল্যানের কাগজটার ওপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে নিতে গিয়েই জিজ্ঞাসা করলাম এখানে কি হবে?

ও। গ্যারাজ আর সারভেন্টস কোয়ার্টার।

দেবু আমার পাশেই ছিল। আমার কানে কানে জিজ্ঞাসা করল, রঞ্জনাকে জিজ্ঞেস করুন তোত আমি কি গ্যারাজের ওপরেই থাকব?

আমি হাসলাম, এ দুশ্চিন্তার কারণ?

ও আবার আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো, দাদার বাড়ি হলে তো ভয় ছিল না। বাড়ির মালিক তো রঞ্জনা হচ্ছে।

আমাদের দুজনকে এমন ফিসফিস করে কথা বলতে দেখে রঞ্জনা আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি একবার ওর দিকে তাকিয়ে হাসলাম।

হঠাৎ ডক্টর চৌধুরী একটু গলা চড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, জানেন তো রিপোর্টার সাহেব, এ বাড়ির নাম কি হবে?

কই না তো।

বাড়ির নাম হবে রঞ্জনা।

হাজার হোক খবরের কাগজের রিপোর্টার। কিছু কিছু মিনিস্টার আর এম-পির সঙ্গে এত আজে বাজে আড্ডা দিই আর ইয়ার্কি করি যে মাঝে মাঝে যেখানে-সেখানে বেফাঁস কথা বলে ফেলি। বাড়ির নাম রঞ্জনা হবে শুনেই হঠাৎ বলে ফেললাম, আপনার মতো ভাশুর পেলে বোধ হয় অনেক হিন্দু বিধবাও আবার বিয়ে করতে রাজি হবে।

কথাটা জিব ফসকে বেরিয়ে যেতেই খারাপ লাগল, কিন্তু ওঁরা তিনজনেই হাসলেন দেখে নিশ্চিন্ত হলাম।

বাড়ি তৈরির জন্য দেবু সারাদিনই ব্যস্ত থাকত। সন্ধ্যার পর হয় দাদার সঙ্গে সারাদিনের কাজকর্ম নিয়ে কথাবার্তা বলতো, নয়তো ক্লান্তিতে শুয়েই পড়ত। কলকাতা থেকে আমার এক বন্ধুর দাদা-বৌদি দিল্লি বেড়াতে এসে আমার কাছেই ছিলেন। ওঁদের কুতুব মিনার দেখিয়ে ফেরার পথে। পঞ্চশীল কলোনীতে গিয়েছিলাম। রঞ্জনা আর দেবু দুজনেই ছিল। ঐ একমাসের মধ্যে দেবুরা একদিন আমার এখানে এসেছিল। আমিও বোধহয় দুদিন খেতে গিয়েছি।

এর মাস দুয়েক পরে রঞ্জনা যখন আবার এলো তখন আমি এখানে নেই। আসাম গেছি। ফেরার পথে কলকাতা। ভেবেছিলাম দু-তিন দিন থাকব, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কলকাতা ছাড়লাম নদিন পর। ফিরে এসেই রাধাকিষণের কাছে শুনলাম তিন মূর্তি লেনের মেমসাব অনেক দিন দিল্লিতে। জিজ্ঞাসা করলাম, মেমসাহেব কি টেলিফোন করেছিলেন?

টেলিফোন তো হরদমই করেন। দুদিন এসেও ছিলেন।

তাই নাকি?

জী হাঁ। বড় চৌধুরী সাহেবও দুদিন টেলিফোন করেছিলেন।

ঘড়িতে দেখলাম সাড়ে এগারটা বাজে। তাহলে খুব বেশি বেলা হয়নি। রাধাকিষণ, আমি বাথরুমে যাচ্ছি। তুমি তিন মূর্তি লেনের মেমসাহেবকে বলে দাও আমি ওখানে খেতে যাচ্ছি।

আমি তাহলে খানা বানাব না?

না।

বেরুতে বেরুতে সাড়ে বারোটা হয়ে গেল। তারপর গ্যারেজে গিয়ে গাড়ি স্টার্ট করতে গিয়ে দেখলাম ব্যাটারি ডাউন হয়ে গেছে। তখন আর কি করব! ট্যাকসি নিয়েই চলে গেলাম।

রঞ্জনা আমাকে দেখেই মন্তব্য করল, তাহলে ফিরেছেন দেখছি।

ফিরব না তো কোথায় যাবো?

কোথায় যান, কোথায় থাকেন, তা আপনিই জানেন।

তার মানে?

কথা বলতে বলতেই ড্রইংরুমে ঢুকলাম। রঞ্জনা বললো, সত্যি বেশ আছেন আপনি। কোনো চিন্তা-ভাবনা দায়-দায়িত্ব নেই! যা ইচ্ছে তাই করছেন।

কোথায় যা ইচ্ছে তাই করছি? কাজে আসাম গিয়েছিলাম আর ফেরার পথে কদিন কলকাতায় ছিলাম।

রঞ্জনা কিছু বলার আগেই আমি আবার বললাম, আমি খেতে এসেছি।

আমি জানি। রঞ্জনা একবার আমাকে দেখে বললো, আপনার মতো জার্নালিস্টদের সংসার ধর্ম না করাই ভালো।

সেই জন্যই তো করিনি।

না করে খুব ভালো করেছেন, কিন্তু আমি আপনার মতো কোনো জার্নালিস্টের হাতে পড়লে তো মরেই যেতাম।

ওর কথা শুনে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। কি আজেবাজে কথা বলছ?

রঞ্জনা উঠে দাঁড়িয়ে বললো, যাই খাওয়ার ব্যবস্থা করি।

খাওয়া-দাওয়ার পর কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে উঠলাম। রঞ্জনাও বাইরে বেরিয়ে এলো। চারপাশ তাকিয়ে আমার গাড়ি দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞাসা করল, গাড়ি কোথায় রেখেছেন?

গাড়ি আনিনি।

কেন?

স্টার্ট নিতে গিয়ে দেখি ব্যাটারি ডাউন হয়ে গিয়েছে।

খবরটা শুনে ও যেন খুশীই হলো, মাসের পর মাস গাড়ি পড়ে থাকলে ব্যাটারীর কি দোষ?

আমি কি বলব? শুধু হাসলাম।

তাহলে কিসে এলেন?

কেন ট্যাক্সিতে।

এখন কি ট্যাক্সি করেই ফেরত যাবেন?

তবে আর কিসে যাব?

দাঁড়ান, দাঁড়ান, আমি দাদাকে ফোন করে গাড়ি আনিয়ে নিচ্ছি।

কোনো দরকার নেই…

ও আমার কথা না শুনেই বাড়ির মধ্যে চলে গেল। আমি ঐখানেই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। দু-তিন মিনিট পরেই রঞ্জনা বেরিয়ে এলো। একটু বসুন। এক্ষুনি গাড়ি আসছে।

আমি ওর পিছন পিছন ড্রইংরুমে ঢুকতে ঢুকতে বললাম, কোনো দরকার ছিল না রঞ্জনা।

আপনি চুপ করুন। চু

প করছি কিন্তু ডক্টর চৌধুরী কি ভাববেন বলতো?

দাদার কাছে কিছু চাইলে উনি বরং খুশী হন, তা জানেন?

গাড়ির হর্ন শুনতেই রঞ্জনা উঠে দাঁড়াল। চলুন, আপনাকে ছেড়ে আসি।

তুমিও যাবে?

কেন? কোন আপত্তি আছে?

আমি একা বলে কি মানুষের সাহচর্য পছন্দ করি না?

তার মানে?

চলুন, চলুন। বলতে বলতেই বেরিয়ে গেল। চাকরটাকে বললো, আমি একটু বেরুচ্ছি।

গাড়িতে উঠেই রঞ্জনা জানতে চাইল, অফিস না বাড়ি যাবেন?

কাল থেকে অফিস যাবো।

রঞ্জনা ড্রাইভারকে বললো, সাব কা কোঠী চলো।

গাড়িতে যেতে যেতেই আমি বললাম, রঞ্জনা, আমি তোমার কথাবার্তা ঠিক বুঝি না।

ও একটু হাসল, সহজ সরল কথাবার্তা আপনি বুঝতে পারেন না, তা আমি জানি।

বাইরের দিকে তাকিয়ে আমি চুপ করে বসে রইলাম। বেশ কয়েক মিনিট পরে দৃষ্টিটা হঠাৎ গুটিয়ে ভিতরে আনতেই দেখি ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার চোখে ওর চোখ পড়তেই জিজ্ঞাসা করল, কি ভাবছিলেন?

আমি উত্তর দেবার আগেই আমার বাড়ির সামনে গাড়ি থামল। দুজনেই নামলাম। বেল বাজাতেই রাধাকিষণ দরজা খুলে দিল। ভিতরে ঢুকে বললাম, সো।

রঞ্জনা বসেই জিজ্ঞাসা করল, আমার কথার জবাব দিলেন না?

কোনো কথার?

গাড়িতে আসতে আসতে কি ভাবছিলেন?

সত্যি বলব?

নিশ্চয়ই।

কিছু মনে করবে না তো?

না।

তোমার কথাই ভাবছিলাম।

রঞ্জনা একটু হেসে উঠল, এই প্রথম বোধহয় আমার কথা ভাবলেন?

এর আগেও ভেবেছি।

সত্যি ভেবেছেন?

ভাবব না কেন বল? তোমাদের সবার সঙ্গে যখন আমার এত হৃদ্যতা, তখন তোমার কথা ভাবব না কেন?

আগে জানতে পারলে আমার একটু উপকার হতো।

উপকার হতো মানে?

যখন জানাননি তখন ওসব কথা ছাড়ুন।

আমি আর কোনো কথা না বলে একটা সিগারেট ধরালাম।

রঞ্জনা হাসতে হাসতে বললো, সিগারেটের গন্ধ আমার খুব ভালো লাগে।

আমি হাসলাম, তাই নাকি?

সত্যি। দারুণ ভালো লাগে।

দেবু সিগারেট খায়?

ও আবার সিগারেট খাবে?

তার মানে?

অত গুড বয় কখনো সিগারেট খায়?

তোমার ভালো লাগে জানলে নিশ্চয়ই খাবে।

আপনি তাহলে ওকে চেনেননি।

আমি আবার চুপ করে সিগারেট টানতে লাগলাম। রঞ্জনাও একটু চুপ করে রইল। তারপর হাসতে হাসতে বললো, হোস্টেলে থাকার সময় আমরা কয়েকজন মেয়ে মাঝে মাঝেই সিগারেট খেতাম।

আমি হাসলাম, সত্যি?

সত্যি নয়তো মিথ্যে বলছি? একটা সিগারেট দিন, খেয়ে দেখিয়ে দিচ্ছি। ও যেন মজা করে বললো।

আমি হাসতে হাসতেই ওকে একটা সিগারেট অফার করলাম। ও সিগারেটটা হাতে নিয়ে বললো, এ ঘরে না, ভিতরের ঘরে চলুন।

কেন?

হঠাৎ যদি রাধাকিষণ এসে পড়ে তাহলে…

চলো।

দুটি বেডরুমের একটিতে আমি পড়াশুনা কাজকর্ম করি, অন্যটায় শুই। স্টাডিতেই ঢুকলাম। একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বললাম, বসো।

রঞ্জনা বসল।

আমি লাইটার জ্বেলে ওর মুখের সামনে ধরতেই ও একটানে সিগারেটটা ধরিয়ে নিল। পর পর কয়েকটা টান দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, অনেক কাল পরে সিগারেট খেতে বেশ লাগছে।

আমি চুপ করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম।

হোস্টেল ওয়ার্ডেন মাঝে মাঝে হঠাৎ আমাদের রুমে এলে কি কাণ্ডটাই হতো!…

কি হতো?

চারজন মেয়ের কেউ না কেউ সিগারেট খেতই। তাছাড়া সবার টেবিলেই সিগারেট-দেশলাই পড়ে থাকত।

তাই নাকি?

হোস্টেলে থাকার যে কি আনন্দ সে আপনি কি বুঝবেন?

আমি হাসলাম।

আপনাকে নিয়েই কি হোস্টেলে কম মজা হতো?

চমকে উঠলাম, আমাকে নিয়ে?

হ্যাঁ, আপনাকে নিয়ে। আপনার জন্য আমাকে সবাই জার্নালিস্ট বলত…

সে কি?

এম. এ. পরীক্ষা দেবার পরই আমার বিয়ে হয়ে গেল, নয়তো আমি ঠিক জার্নালিজম করতাম।

রিয়েলি?

সত্যি বলছি জার্নালিজম আমার খুব ইন্টারেস্টিং লাগে।

ফরেন সার্ভিসের চাইতেও?

অব কোর্স। ফরেন সার্ভিসের সবাই বড় চালিয়াত হয়।

জার্নালিস্টরা হয় না?

সিগারেটটা শেষ হয়ে যেতেই অ্যাশট্রেতে ফেলে দিল রঞ্জনা। বললো, ওসব বাদ দিন। ভাবতে গেলেও মন-মেজাজ খারাপ হয়।

মন-মেজাজ খারাপ হবে কেন?

যাই হোক আপনি সত্যি একটা বিচিত্র মানুষ। আর যাই থাক মন বলে কোনো পদার্থ আপনার নেই।

আমি আর পারলাম না। চেয়ারটা টেনে ওর খুব কাছে গিয়ে বললাম, আমার দিকে তাকাও।

ও আমার চোখের পর দৃষ্টিটা আনতেই আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার মনের কথাটা খুলে বলবে?

রঞ্জনা বেশ জোরেই হেসে উঠল, এই পৃথিবীতে কোনো মানুষটা মনের কথা খুলে বলে বলুন তো? তাছাড়া আপনাকে বলে আমার লাভ?

লাভ-লোকসানের কথা আমি জানি না। তবে তোমার কথা শুনে বেশ বুঝতে পারি তোমার যেন কি একটা গোলমাল হয়ে গেছে।

তাতে তো আপনার কোনো ক্ষতি হয়নি।

তোমার হয়েছে?

হলে কি আপনি ক্ষতিপূরণ দেবেন?ও আমার প্যাকেট থেকে আরেকটা সিগারেট বের করতে করতে বললো, আপনার সে ক্ষমতা নেই।

কি এমন ক্ষতি তোমার হলো যে আমি ক্ষতিপূরণ করতে পারব না?

আপন মনে সিগারেট ধরাল, আমি সিগারেট খাচ্ছি বলে রাগ করছেন?

না।

রাগ না করলেও মনে মনে নিশ্চয়ই খারাপ ভাবছেন?

শখ করে সিগারেট খাচ্ছ, খারাপ ভাবব কেন?

খুব জোরে সিগারেটে টান দিয়ে রঞ্জনা একটু মুচকি হাসল, আমি জানি আপনি আমাকে ভালোবাসেন।

নিশ্চয়ই ভালোবাসি। তুমি সুভাষদার মেয়ে। তোমাকে ভালোবাসব না?

আঃ! এর মধ্যে আবার বাবা-মাকে টানছেন কেন?

আমি চুপ করে রইলাম।

রঞ্জনা নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে আমার পিছনে দাঁড়িয়ে বললো, কোনদিন মুখ ফুটে আমার একথা বলতে হবে ভাবিনি, কিন্তু আজ আর না বলে পারছি না…

রঞ্জনা হঠাৎ থামল।

আমি চুপ করে রইলাম। দু এক মিনিট পরে মুখ ঘুরিয়ে দেখি ওর চোখে জল। কাঁদছ কেন রঞ্জনা? কি হয়েছে তোমার?

রঞ্জনা বিদ্যুৎ বেগে সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে ফেলেই ঘর থেকে বেরুতে বেরুতে বললো, চলি।

রঞ্জনা। শোন!

আমি ওর পিছন পিছন যেতে যেতে আবার ডাকলাম, একটা কথা শুনে যাও রঞ্জনা। এক মিনিট…

ও দাঁড়াল না। গাড়িতে উঠেই ড্রাইভারকে বললো, সাহাব কা দপ্তর চলো।

রঞ্জনা আমার দিকে একবারও তাকাল না। ড্রাইভার হাত তুলে আমাকে একটা সেলাম দিয়েই গাড়ি স্টার্ট করল। রঞ্জনা চলে গেল। আমি ঐখানেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। অনেকক্ষণ পর্যন্ত নড়তে পারলাম না। হঠাৎ আমার সব কিছু অসহ্য মনে হলো। এক মিনিটের জন্য আর দিল্লি থাকতে মন চাইল না।

.

তাড়াতাড়ি বাড়ির মধ্যে এসেই নিউজ এডিটরকে একটা ফনোগ্রাম পাঠালাম, গোয়িং আউট অফ ডেলহি ফর অ্যান ইন্টারেস্টিং নিউজ।

এবার রাধাকিষণকে ডেকে বললাম, আমি খুব জরুরী কাজে বাইরে যাচ্ছি।

ফিন বাইরে যাবেন?

হ্যাঁ।

কব?

আজ।

রাধাকিষণ অনেক কাল ধরে আমার কাছে কাজ করছে। আমাকে ও ভালোভাবেই চেনে, জানে। বুঝল কিছু একটা অঘটন ঘটেছে, কিন্তু হাজার হোক আমি মনিব, ও আমার ভৃত্য। একটি প্রশ্নও করল না।

সন্ধ্যার পর আমি একটা অ্যাটাচিতে কয়েকটা জামাকাপড় ভরে নিয়েই দিল্লি জংশন স্টেশনে রওনা হলাম। রিজার্ভেশন পেলাম না। তবু মুসৌরী এক্সপ্রেসে চড়ে ডেরাডুন গেলাম। পরের দিনই মুসৌরী।

দিল্লি থেকে পালিয়ে এলাম ঠিকই, কিন্তু মন? তার কাছ থেকে কোথায় পালাব। হকম্যানস গ্রান্ড-এ থেকেও ভালো লাগছিল না। দুটো দিন ঘর থেকেই বেরুলাম না। তার পরদিন আর পারলাম না। বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে টিকিটের খোঁজ করলাম। সেদিনকার টিকিট ছিল না। পরের দিনের একটা টিকিট কিনে হোটেলে ফিরে এলাম।

চারদিন পর দিল্লি ফিরলাম। বাড়িতে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই রাধাকিষণ আমার হাতে একটা খাম দিল, তিন মূর্তি লেনের মেমসাব দুদিন এসে আপনাকে না পেয়ে এই চিঠি দিয়ে গেছেন।

বিচিত্র চিঠি। কোনো কিছু বলে সম্বোধন নেই। …আপনাকে এই প্রথম চিঠি লিখছি অথচ কিছু বলে সম্বোধন করতে পারছি না বলে ক্ষমা করবেন। তা ছাড়া কি বলে সম্বোধন করব? যা বলে সম্বোধন করতে মন চায় তা তো সম্ভব নয়।

প্রথমবার আপনি যখন বেনারসে এসে আমার সঙ্গে দেখা করলেন, তখনই আপনাকে ভালো লেগেছিল। আপনার মুখের হাসি, উদার দুটো চোখ, প্রাণ-প্রাচুর্য আমাকে মুগ্ধ করেছিল। আপনি চলে যাবার পরমুহূর্ত থেকেই আবার আপনার আসার প্রতীক্ষায় থেকেছি। বার বার লুকিয়ে লুকিয়ে আপনার ওয়াশিংটনের ফটোগুলো দেখেছি আর ছোট-ছোট টুকরো-টুকরো কাগজে আপনাকে চিঠি লিখেছি। সেসব চিঠি কোনদিন আপনাকে পাঠাইনি। পাঠাতে পারিনি। সাহস হয়নি।

আস্তে আস্তে আপনাকে যত দেখেছি তত বেশি ভালো লেগেছে আর নিত্য নতুন স্বপ্ন দেখেছি মনে মনে। দেখব না কেন? আপনি যেভাবে আমার সঙ্গে মিশেছেন, যেভাবে দিনে দিনে, ধাপে ধাপে আমার কাছে এগিয়ে এসেছেন, আমাকে আপন জ্ঞানে কাছে নিয়েছেন, ভালোবাসার আভাস ইঙ্গিত-প্রমাণ দিয়েছেন, তাতে স্বপ্ন দেখা অন্যায় মনে হয়নি। বরং স্বাভাবিক মনে হয়েছে। মনে হয়েছে আপনাকে ভালোবাসার, আপনাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার অধিকার আপনি আমাকে দিয়েছেন।

তারপর একদিন হোস্টেলের মেয়েদের কাছে ধরা পড়লাম। হাজার হোক এক ঘরে থাকি, একসঙ্গে লেখাপড়া করি, সিনেমা দেখি। বেড়াতে যাই। কতদিন আর ওদের কাছ থেকে লুকিয়ে। রাখা সম্ভব? ওরা কি দারুণ ঠাট্টা-ইয়ার্কি করত তা আপনি ভাবতে পারবেন না। হোস্টেলে তো। কোনোদিন থাকেননি, তাই ভাবতে পারবেন না মেয়েদের ভালোবাসার কথা, প্রেমের কাহিনি ফাস হয়ে গেলে কি কাণ্ড হয়। আমি যখন ফিফথ ইয়ারে উঠি তখন আপনার বয়সীই একজন বাঙালি লেকচারার আমার প্রতি একটু আকৃষ্ট হয়েছেন বলে হোস্টেলের গোয়েন্দা বিভাগে খবর পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গেই ওর কাছে বেনামী চিঠি চলে গেল, আপনার চাইতে অনেক সুন্দর, ব্রিলিয়ান্ট এক জার্নালিস্টের সঙ্গে ওর বিয়ে হবে বলে ঠিক হয়ে গেছে। সুতরাং মন দিয়ে অধ্যাপনা করুন আর রবিবারের আনন্দবাজার-যুগান্তরে পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপন পড়ুন।

চিঠিতে কি সব কথা জানান যায়? তাছাড়া দুই ভাইকে ফাঁকি দিয়ে এই চিঠি কি ভাবে লিখছি তা আপনি ভাবতে পারবেন না। অনেক কষ্ট করে এই চিঠি লিখছি। না লিখে পারছি না। আপনি যে কি তা আমি ভেবে পাই না। রাজনীতির এত গোপন খবর জোগাড় করেন অথচ প্রকাশ্য দিবালোকের মতো স্পষ্ট, উন্মুক্ত আমার ভালোবাসা আপনি বুঝতে পারলেন না? ভালো না বাসলে কোন মেয়ে এভাবে একজন ব্যাচেলারের সঙ্গে মিশতে পারে? সকালে, দুপুরে, সন্ধ্যায়, রাত্রিতে একা একা তাকে সাহচর্য দিতে পারে? শুধু দেহটাই আপনাকে দিইনি, কিন্তু তাছাড়া আর কি দিই নি? সেবা, যত্ন, ভালোবাসা, সম্মান, মর্যাদা–সব কিছুই তো দিয়েছি। আনন্দে, হাসি মুখে দিয়েছি। আর যদি দাবি করতে পারতেন তাহলে হয়তো এই দেহটাকেও না দিয়ে পারতাম না। আপনার মধ্যে অনেক দ্বিধা, জড়তা, সঙ্কোচ থাকলেও আমার মধ্যে ছিল না। একবার নয়, ৰবার তো সুযোগ পেয়েছে। কতদিন শুধু আমি আর আপনি আপনার পড়ার ঘরে, শোবার ঘরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছি বলুন তো। রাধাকিষণ তো সেই পিছনের দিকে নিজের কোয়ার্টারে ঘুমুতো। একবার দাবি করেই দেখতে পারতেন ভালোবাসার অগ্নিপরীক্ষায় আমি উত্তীর্ণা হই কিনা। যে মেয়ে প্রাণ মন উৎসর্গ করতে পারে, ভালোবাসার জন্য লোকলজ্জা, সামাজিক অনুশাসন উপেক্ষা করতে পারে, তার পক্ষে প্রাণের মানুষের কাছে দেহটাকে বিলিয়ে দেওয়া কিছু দুঃসাধ্য ব্যাপার নয়। ভালোবাসার খেসারত দিতে গিয়ে শুধু মেয়েরাই সমাজের কাছে কলঙ্কিনী হয়, ছেলেরা নয়। কখনই নয়। ভালোবাসার বিনিময়ে দুর্নাম সহ্য করার সাহস বা ক্ষমতা আপনাদের হয় না। হবে না।

আমি ভেরে পাই না আপনি কি? পশু? নাকি দেবতা? হয় আপনার মধ্যে শৌর্য, বীর্য, ভালোবাসার ক্ষমতা, মন কিছুই আপনার নেই; নয়তো আপনি এমন কোন মেয়ের দেখা পেয়েছেন, ভালোবাসা পেয়েছেন, নিবিড় সান্নিধ্য পেয়েছেন, যার কাছে আমি অতি সাধারণ। অতি নগণ্য। হয়তো তুচ্ছ বা ঘৃণ্য। কোনোটা ঠিক বলুন তো? বলতে পারেন কেন আপনি আমাকে এভাবে উপেক্ষা করেছেন? এভাবে শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে? কোনো অধিকারে সারা জীবনের জন্য আমার মনে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছেন?

থাক গে। ভেবেছিলাম আর আপনার এখানে আসবনা, কিন্তু না এসে পারলাম না। দুদিন এলাম দেখা হলো না। শুনলাম আপনি হঠাৎ জরুরি কাজে বাইরে গেছে। কাজটা যে কত জরুরি তা আর কেউ না বুঝুক আমি বুঝেছি। আমার জন্যই আপনার এই দুর্ভোগ। আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি ব্যাঙ্গালোরে ফিরে যাচ্ছি। দাদার জন্য দিল্লিতে আমার আসতেই হবে। তবে কথা দিচ্ছি আপনাকে আর বিরক্ত করব না।

চিঠিটা পড়ে তো অবাক হলামই, তবে আরো বেশি অবাক হলাম নিচের লেখাটুকু দেখে– মিসেস দেবব্রত চৌধুরী।

.

তারপর কত কি হলো! ডক্টর চৌধুরীর বাড়ির গৃহপ্রবেশের নিমন্ত্রণ এলো। দেবু নিজেই এসেছিল। দাদা বার বার বলে দিয়েছে আপনাকে আসার জন্য।

আমি খুব গম্ভীর হয়ে উত্তর দিয়েছি, আসব তো নিশ্চয়ই; তবে খবরের কাগজের কাজ করি তো! কখন যে কোনো কাজে আটকে যাই কিছু ঠিক নেই।

দেবু হাসতে হাসতে বলেছে, তাছাড়া বাড়িটা তো আপনাদেরই রঞ্জনার। সুতরাংনা এলে চলবে না।

অত করে বলার দরকার নেই। যদি খুব জরুরী কোনো কাজে আটকে না যাই তাহলে আসবই।

আমি যাইনি। যেতে পারিনি। রমার সামনে মুখোমুখি দাঁড়াবার সাহস আমার হয়নি। দেবু যখন নেমন্তন্ন করতে এসেছিল তখনই জানতাম যাব না। কিছুতেই যাব না কিন্তু বলতে পারিনি। কি বলব? বলব, দেবুবাবু, আপনার স্ত্রী রমা আমাকে ভালোবাসত। এখনও ভালোবাসে। একদিন সে আমাকে সব কিছু বিলিয়ে দিতে পারত। ভালোবাসার অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণা হবার জন্য সে উন্মুখ হয়ে আমার কাছে এসেছে, কিন্তু আমি কিছুই দিতে পারিনি। ওকে শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিয়েছি। একেবারেই কিছু দিইনি। ভালোবেসে প্রত্যাখ্যাত হবার মতো অপমান আর নেই। এর চাইতে বড় ব্যর্থতা, পরাজয়, মেয়েদের জীবনে আসতে পারে না। আমার কাছে রমা এই অপমানে অপমানিত হয়েছে। ওর কাছে মুখ দেখাব কি করে? কোনো সাহসে? প্রেমে প্রত্যাখ্যাত মেয়ে আহত কেউটে বা রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের চাইতেও ভয়ঙ্কর। মারাত্মক। আমি আপনাদের এই আনন্দের দিনে যেতে পারব না দেবুবাবু। আমাকে ক্ষমা করবেন।

আমি শিক্ষিত। ভদ্রলোক। ভদ্রসমাজে বিচরণ করি। তাই মনের কথা বলি না। বলার মতো চারিত্রিক দৃঢ়তা, সাহস আমার নেই। অভ্যাস নেই। বরং মনের কথা চেপে রেখে বানিয়ে বানিয়ে মিষ্টি মিষ্টি মিথ্যা কথা বলতে ওস্তাদ। তাই দেবুবাবুকে এসব কিছুই বলিনি। আমি ওর আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছি। উনি ভেবেছেন আমি নিশ্চয়ই যাব। এমন আনন্দের দিনে আমি ওঁদের পাশে দাঁড়াব না? তাই কি কখনও হয়?

সুভাষদা মস্কো থেকে ফিরে এলেন। আগেই চিঠি পেয়েছিলাম কিন্তু তবুও এয়ারপোর্টে যাইনি।

যে কারণে দেবুদের গৃহপ্রবেশের দিন যায়নি, ঐ একই কারণে পালাম যাইনি। কিন্তু পালামে গিয়ে ওঁদের অভ্যর্থনা করার জন্য মনটা সত্যি বড় ব্যাকুল হয়েছিল। সুভাষদার সংসারে যে মর্যাদা, ভালোবাসা পেয়েছি তার তুলনা হয় না। কত মানুষের সঙ্গেই তো আলাপ হয় কিন্তু কজন এভাবে। আমাকে আপন করে নিয়েছেন? একজন অপরিচিত সাংবাদিকের কাছে এভাবে নিজেদের বিলিয়ে দিতে পারেন? খুব কম। প্রায় দুর্লভ। আমার জীবনের অনেক দৈন্য, অভাব, অপূর্ণতা এরা ভরিয়ে দিয়েছে। এদের কাছে আমার ঋণ অশেষ। সীমাহীন। কল্পনাতীত। মাতৃ ঋণ যদি শোধ করা না যায় তাহলে এদের ভালোবাসার ঋণই বা শোধ করা যাবে কি ভাবে? স্নেহ-ভালোবাসার ঋণ কখনই শোধ করা যায় না। আমি ওঁদের ঋণ থেকে মুক্ত হতে পারব না। চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হব। তাই শুধু কৃতজ্ঞতার বোঝা বহন করা ছাড়া আমার দ্বারা আর কিছু হবে না। আমার সঙ্গে আলাপ হবার পর ওঁরা যতবার দিল্লি দিয়ে আসা-যাওয়া করেছেন, প্রত্যেকবার আমি উপস্থিত থেকেছি। শত কাজের মধ্যেও না যাবার কোনো কারণ হয়নি। হবে কেন? আমি যখন আমেরিকা থেকে ফিরি তখন সুভাষদা আর বৌদি ওঁদের গাড়িতে আমাকে নিউইয়র্ক পৌঁছে দিয়েছিলেন। আমার মতো একজন সাধারণ সাংবাদিকদের জন্য অন্য কোনো ভারতীয় ডিপ্লোম্যাট আর তার স্ত্রী এত কষ্ট করবেন? কেউ না। শত শত ভারতীয় ডিপ্লোম্যাটের সঙ্গে আমার আলাপ, বন্ধুত্ব, ঘনিষ্ঠতা। বিদেশে কত অলস সন্ধ্যা এঁদের সঙ্গে কাটাই। আড্ডা দিই, সিনেমা-থিয়েটারে যাই, লাঞ্চ-ডিনার খাই, হুইস্কির বোতল শেষ করি, কিন্তু সুভাষদা-জয়ন্তী বৌদির মতো কেউ স্বেচ্ছায় হাসি মুখে আমাকে। বিদায় জানাতে আসেন না এয়ারপোর্ট। আমি আশা করি না। আশা করা অন্যায়। সেই সুভাষদা আর জয়ন্তী বৌদি আসছেন কিন্তু গেলাম না। ভাবলেও অবাক লাগে। সুভাষদা রিটায়ার করে ফিরছেন। আর কোনোদিন পালাম এয়ারপোর্ট দিয়ে আসা-যাওয়া করবেন না। তিন-চার বছর পর। পর স্বদেশ-বিদেশের মধ্যে আর খেয়া পারাপার করবেন না। অন্যবার কোনো কারণে এয়ারপোর্টে না গেলেও হয়তো কিছু মনে করতেন না। ভাবতেন, বুঝতেন আমি কোনো কাজে আটকে পড়েছি, কিন্তু এবার মনে মনে একটু আহত নিশ্চয়ই হবেন। হয়তো ভাববেন রিটায়ার করেছে বলে আমি আর ওঁদের গুরুত্ব বা মর্যাদা দিচ্ছি না। হয়তো মনে করবেন আমি ওঁদের উপেক্ষা করলাম। আমি পাল্টে গেছি। আমি আর ওঁদের চাই না। আমার জীবনে ওঁদের ভূমিকা শেষ। জানি না আরো কত কি ভাববেন। এসব ভাবনা হওয়া স্বাভাবিক। অন্যায় নয়। আমি কিছু বলতে পারব না।কিন্তু বিবেক? বিবেকের কাছে তো আমাকে জবাবদিহি করতেই হবে। কি বলব বিবেককে? বলব, আমি ভীরু কাপুরুষ, আমি অকৃতজ্ঞ? বলব, আমি রমার সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার মতো মনের জোর, চরিত্রের দৃঢ়তা হারিয়েছি? তাই কি কখনও হয়? ওঁরা এয়ারপোর্টে নেমে নিশ্চয়ই আমার কথা জিজ্ঞাসা করবেন, কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারবেন না। যে বলতে পারে সে তত আমার নামও উচ্চারণ করবে না।

টেলিফোনেই সুভাষদাকে বললাম, এয়ারপোর্টে যেতে পারলাম না বলে নিশ্চয়ই রাগ করেছেন?

রাগ করব কেন? তবে আশা করেছিলাম তুমি থাকবেই।

নিশ্চয়ই আশা করবেন। আপনারা আমাকে এতো ভালোবাসেন আর এইটুকু আশা করবেন না?

একবার ভাবলাম হয়তো চিঠি পাওনি, কিন্তু যাদের চিঠি দিয়েছিলাম তাদের মধ্যে শুধু তোমাকেই দেখতে না পেয়ে মনে হলো চিঠি ঠিকই পেয়েছ।

ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে চিঠি পাঠিয়েছেন। না পাবার তো কোনো কারণ নেই।

তোমার বৌদি অবশ্য বলছিলেন নিশ্চয়ই কোনো জরুরি কাজে আটকে গিয়েছে।

বৌদির ফিফথ সেন্স রিয়েলি খুব স্ট্রং।

তা ঠিক। আমি অনেকবার তার প্রমাণ পেয়েছি।

আমি হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলাম, বৌদি পাশে আছেন?

না।

আপনার কথাগুলো বৌদি শুনলে খুব খুশী হতেন।

কথাগুলো শুনলে বলতো, আমি ওকে শোনাবার জন্যই প্রশংসা করছি।

বৌদি কি কোনো কাজ করছেন?

কাজ আবার কি করবে? নিশ্চয়ই ভিতরের ঘরে বসে রমার সঙ্গে গল্প করছে।

দেবু এখানে আছে নাকি?

না, ও তো এখানে নেই। গৃহপ্রবেশের পর পরই ব্যাঙ্গালোরে চলে গেছে।

তাই নাকি? ও চলে গেছে, তুমি জানতে না?

না।

সুভাষদা একটু বিস্ময়ের সঙ্গেই জিজ্ঞাসা করলেন, দেবু যাবার আগে তোমার সঙ্গে দেখা করেনি?

না। বোধহয় সময় পায়নি।

সময় পায়নি একটা কোনো কথাই নয়। এখান থেকে তোমার ওখানে ঘুরে আসতে কতক্ষণ আর সময় লাগে?

নিশ্চয়ই এমন কোনো কাজে জড়িয়ে পড়েছিল যে…।

এই কথার পুনরাবৃত্তি করছিলাম বলে সুভাষদা প্রশ্ন করলেন, তুমি এর মধ্যে ওদের এখানে এসেছিলে নাকি?

না দাদা, আমিও আর যেয়ে উঠতে পারিনি।

সুভাষদা ডিপ্লোম্যাট। কূটনীতিবিদ। বেশি কথা না বললেও অনেক কথা বুঝতে পারেন। অনুমান করতে পারেন। তাই বোধহয় ঐ বিষয়ে আর কিছু জানতে চাইলেন না। জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার। বৌদির সঙ্গে কথা বলবে?

নিশ্চয়ই।

একটু ধরো, ডেকে দিচ্ছি।

একটু পরেই বৌদি টেলিফোন তুলে নিলেন। অনেক কাল পরে টেলিফোনে বৌদির গলা শুনেই চমকে উঠলাম। ঠিক রমার মতো শোনাল। বললেন, তোমার দাদার কাছে শুনলাম কাজে আটকে পড়েছিলে বলে এয়ারপোর্টে আসতে পারনি।

এমন কাজের চাপ পড়েছে যে কি বলব?

শুনলাম এই নতুন বাড়িও তুমি দেখতে আসনি।

আমার এক কলিগ চাকরি ছেড়ে দেওয়ায় একা আমার উপর সব কাজের চাপ পড়েছে…

আমি তোমার দাদাকেও ঠিক এই কথাই বলছিলাম…

যাই হোক টেলিফোনেই একটা অনুরোধ করব। রাখবেন তো?

তোমার অনুরোধ রাখব না? বল কি ব্যাপার।

কাল আপনারা দুজনে আমার এখানে খাবেন।

কখন?

দিনে অথবা রাত্রে। যখন আপনাদের সুবিধে।

আমাদের আবার অসুবিধে কি? দুপুর বেলাতেই আসব।

খুব ভালো।

.

ওঁরা যখনই দিল্লি এসেছেন তখনই দুএক বেলা আমার বাসায় থেকেছে, খেয়েছে। তবে শুধু ওঁরা দুজনে কখনই আসেননি। এসেছে দেবুকে নিয়ে, রমাকে নিয়ে। দেবু দিল্লিতে না থাকলে রমাকে নিয়েই এসেছেন। কি দারুণ আনন্দে যে সময়টা কেটে যেতে তা ভাবলে অবাক লাগে। একবার সুভাষদা আগের দিন রাত্রেই আমার এখানে চলে এলেন। এসেই বললেন, রাত্রেই তোমার এখানে চলে এলাম।

খুব খুশী হয়েই বললাম, খুব ভালো করেছেন, কিন্তু বৌদি কোথায়?

তোমার বৌদি বা রমা আসেনি। আমি একলাই চলে এলাম।

ওঁদের নিয়ে এলেন না কেন?

ওরা এলে কি আমরা ঘুমুতে পারতাম? ঘুমুবার জন্যই তো তোমার এখানে চলে এলাম।

ওরা সকালেই আসবে তো?

কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই।

তার মানে? অন্য কোন প্রোগ্রাম আছে নাকি?

প্রোগ্রাম আবার কি থাকবে?…

তাহলে আসার ঠিক নেই মানে?

একবার শুনছিলাম ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠেই চলে আসবে। তারপর একবার শুনলাম লাইক রিয়েল গেস্টস ঠিক একটায় আসবে…

আমি হাসতে হাসতে বললাম, একটার সময় এলে আমি বাড়িতে ঢুকতে দেব নাকি?

ওদের ঢুকতে দেবে কি না দেবে, সে তুমিই জান, আমাকে তো বিরক্ত করবে না?

সুভাষদা আমার ঘরে ঘুমুচ্ছেন। আমি আমার স্টাডিতে ডিভানের উপর চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমুচ্ছি। হঠাৎ কানের কাছে খুব মিহি মিষ্টি ডাক শুনলাম, উঠবেন না? চা নিয়ে এসেছি।

দুতিনবার। ঘুম ভেঙে গেলেও ঘোর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন। ভাবলাম বোধহয় স্বপ্ন দেখছি।

উঠুন। চা ঠাণ্ডা হয়ে গেল যে।

চাদর সরিয়ে দেখি রমা। তুমি?

হ্যাঁ আমি।

কখন এলে?

অনেকক্ষণ।

বৌদি কোথায়?

বাথরুমে।

তুমি চা নিয়ে এলে যে?

ঘুম থেকে উঠে আমার মুখ দেখতে নেই বুঝি?

না। অভ্যাস খারাপ হয়ে যাবে।

তার মানে?

তার মানে এর পর আর অন্যের মুখ দেখলে সহ্য করতে পারব না।

আপনার অভ্যাস খারাপ করার ক্ষমতা আমার নেই।

কথার মোড় ঘোরালাম, তোমার বাবাকে চা দিয়েছ?

এত ভোরে বাবাকে চা দেব?

কেন? কটা বাজে?

সাড়ে ছটা।

সাড়ে ছটা। আমি আঁতকে উঠি। তাহলে তোমরা কখন এসেছ?

আধ ঘন্টা আগে।

রাত্রে কি ঘুমোওনি?

আপনার জন্য কি ঘুমুবার উপায় আছে?

আমার জন্য ঘুমুতে পার না?

না।

তার মানে?

সব কথার মানে বলতে পারব না। নিন উঠুন। চা খেয়ে নিন।

বৌদি বাথরুম থেকে বেরুবার পর বললাম, স্বামীর জন্য যদি এভাবে ভোরবেলায় ছুটে আসেন তাহলে মেয়ে-জামাই কি শিখবে বলুন তো?

বৌদি হাসতে হাসতে বললেন, ওদের যা কিছু শেখাবার তা তুমি যথেষ্ট শেখাতে পারবে। আমাকে কিছু শেখাতে হবে না।

রাধাকিষণকে নিয়ে বৌদি বাজারে গেলেন। কিছুতেই আমাকে যেতে দিলেন না। মা বললো, মা যখন এসেছেন তখন সংসারের ব্যাপারে আপনাকে মাথা ঘামাতে হবে না।

আমি বললাম, উনি কদিনের জন্য বেড়াতে এসেও সংসারের ঝামেলা সহ্য করবেন? আমাকে যদি দায়িত্ব দিতে না চাও তাহলে তুমি তো নিতে পারতে।

ও স্পষ্ট বললো, আমি টেম্পোরারী দায়িত্ব নিই না।

আমি আর সুভাষদা বসে বসে শুধু পলিটিক্স আলোচনা করেছি, চা-কফি খেয়েছি, সিগারেই টেনেছি। মাঝে মাঝে কিচেনের কাছে গিয়ে বলেছি, ইফ দেয়ার ইজ এনি ডিফিকাল্টি লেট মী মো।

টিপ্পনী কাটার সুযোগ রমা ছাড়ে না, আমার উপর মাতব্বরী করেন বলে কি মার উপরেও মাতব্বরী করবেন?

তোমার উপর আমি মাতব্বরী করব? এত সাহস আমার নেই!

জয়ন্তী বৌদি হাসেন।

সুভাষদা একা ঘরে বসে থাকতে পারেন না। হেলতে দুলতে কিচেনের সামনে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, বাজার-টাজার যেতে হবে নাকি?

জয়ন্তী বৌদি হাসতে হাসতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন কি দায়িত্বশীল লোক দেখেছ! পৌনে বারোটার সময় বাজার যাবেন কিনা জিজ্ঞাসা করছেন।

আমি বললাম, বৌদি, একে বলে সেকেন্ড লাইন অব ডিফেন্স। বাই চান্স যদি আপনি কিছু ভুলে যান…

তুমি, চুপ করো তো। তোমাকে আর ওর মোসাহেবী করতে হবে না!

সারপ্রাইজিং! সবাই বলে আমি আপনার আর রমার মোসাহেবী করি।

রমা রেগে যায়, এইসব বাজে কথা বললে কিন্তু ভালো হবে না।

যে কথাই বলি না কেন, তুমি আমার ভালো করবে না। সুতরাং ও ভয়ে কম্পিত নয় জার্নালিস্টের হৃদয়!

সুভাষদা হাসতে হাসতে ড্রইংরুমে চলে গেলেন। বৌদিও রান্নায় মন দিলেন। রমা বললো, জার্নালিস্টদের হৃদয় থাকে নাকি?

একবার সুভাষদা ফরেন সেক্রেটারির সঙ্গে জরুরি পরামর্শের জন্য কায়রো থেকে কয়েক দিনের জন্য দিল্লি এলেন। রমা তখন বেনারসে, কিন্তু কিছুতেই সুভাষদার পক্ষে বেনারস যাওয়া সম্ভব ছিল না। অথচ কায়রো থেকে দিল্লি এসেও মেয়ের সঙ্গে দেখা হবে না, তাও হয় না। আমার কাছে সুভাষদার টেলিগ্রাম এলো, রিচিং মনডে আর্লি মর্নিং ফর আর্জেন্ট কনশালটেশন। রমা রিচিং সানডে অর মনডে বাই এয়ার। সুভাষদার টেলিগ্রাম এলো শুক্রবার সকালে। শনিবার দুপুরে অফিস বেরুবার সময় রমার টেলিগ্রাম এলো, রিচিং মনডে ভায়া লখনৌ অ্যাটেন্ড পালাম।

সুভাষদা আর রমা পাঁচদিন আমার কাছেই ছিলেন। তিনজনে একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট খাবার পর সাড়ে নটায় সুভাষদা সাউথ ব্লক যেতেন। একটা দেড়টা-দুটোয় লাঞ্চে এসে আবার তিনটের মধ্যে ফিরে যেতেন। তারপর ফিরতে ফিরতে সাড়ে ছটা-সাতটা হয়ে যেতো। রোজ রাত্রে আমরা তিনজনে বাইরে খেতাম। একদিন নাইট শোতে সিনেমাও দেখেছিলাম। তারপর একই দিনে ওঁরা দুজনে পালাম থেকে চলে গেলেন।

ওই একবারই রমা আমার বাড়িতে থেকেছে। রাধাকিষণ সংসার চালাতো। আমি অফিসে গিয়ে বুড়ি ছুঁয়েই চলে এসেছি। থাকলেও এক ঘণ্টার বেশি কোনদিন থাকিনি। বাকি সময় বাড়িতে বসে বসে রমার সঙ্গে গল্প করেছি, আড্ডা দিয়েছি।

আমরা এসে আপনার কাজের খুব ক্ষতি করছি, তাই না? খবরের কাগজ পড়তে পড়তে নামিয়ে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল।

জীবনে কিছু ক্ষতি স্বীকার না করলে তো লাভও করা যায় না।

এ ক্ষতির বিনিময়ে কি আর লাভ করছেন?

আমি সিগারেট ধরিয়েই বললাম, এভাবে তোমার সঙ্গে আড্ডা দিতে পারছি, এটাই কি কম লাভ?

আমাকে খুশী করার জন্য এসব কথা বলে কি লাভ?

তোমাকে খুশী করার জন্য তো বলছি না। বলছি আমার মনের কথা।

রমা আবার একটু হাসল, বললো, যাই বলুন, আপনার কথা ভাবলে আমার অবাক লাগে।

কেন?

হঠাৎ কিভাবে আলাপ হলো, ঘনিষ্ঠতা হলো ভাবলে অবাক লাগে।

আমিও মাঝে মাঝে এই একই কথা ভাবি। কত ডিপ্লোম্যাটের সঙ্গেই তো আলাপ, কিন্তু কেউ কি তাদের এমন সুন্দরী মেয়েকে আমার হেপাজতে রাখবে?

কেউ বুঝি আপনাকে বিশ্বাস করেন না?

তুমিও দেখছি ডিপ্লোম্যাটদের মতো কথা ঘোরাতে ওস্তাদ হয়েছ।

.

সেই আমি রমাকে আসতে বললাম না। বলতে পারলাম না। শুধু সুভাষদা আর বৌদিই এলেন। রাধাকিষণ অনেক কিছু রান্না করেছিল। অনেক গল্পগুজব করলাম ওঁদের দুজনের সঙ্গে, কিন্তু কিছুতেই সেই আগের মতো আনন্দ পেলাম না। হলো না। অনেক সহজ সরল করে মেলামেশা করলেও মনে মনে সব সময় একটু অস্বক্তিবোধ না করে পারলাম না। বিকেলের দিকে যাবার সময় সুভাষদা শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা না করে আর পারলেন না, ডক্টর চৌধুরী বা দেবু বা রমা কি তোমার সঙ্গে কোনো খারাপ ব্যবহার করেছেন?

আমি সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করলাম, না না, ওঁরা আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবেন কেন?

তাহলে তুমি কি কোনো ব্যাপারে দুঃখ পেয়েছ?

সে রকম কিছু তো ঘটেনি।

যাই বল ভাই কিছু একটা ঘটেছে।

কিছুই ঘটেনি। তবে আপনাদের সঙ্গে যে ঘনিষ্ঠতা আছে তা তো ওঁদের সঙ্গে হতে পারে না, হবে না।

দ্যাটস্ ট্রু বাট…

ডক্টর চৌধুরী ইজ রেয়েলি সামবডি অব ডেলহি। আমার মতো জার্নালিস্টের পক্ষে ওখানে খুব বেশি যাতায়াত করা ঠিক নয়। তাছাড়া আমার এক কলিগ চাকরি ছেড়ে দেওয়ায় আমার উপর ভীষণ কাজের চাপ পড়েছে। সত্য কথাটা চাপার জন্য গড় গড় করে অনেক কথা বললাম।

বৌদি চুপ করে আমাদের কথা শুনলেন, একটি কথাও বললেন না। ট্যাক্সিতে চড়বার আগে শুধু বললেন, রমা যদি কোনো অন্যায় করে থাকে তাহলে ক্ষমা করে দিও।

না, না, বৌদি, রমা কিছু অন্যায় করেনি।

করা উচিত নয়, কিন্তু করতেও তো পারে। ভুল করেও মানুষ অন্যায় করে।

না, না, ও কিছুই করেনি।

.

সুভাষদা আর বৌদি দশদিন দিল্লি ছিলেন। একদিন ডক্টর চৌধুরী আমাকে নেমন্তন্নও করেছিলেন। পাছে ওঁরা আমাকে সন্দেহ করেন, একদিনের জন্য আগ্রা চলে গিয়েছি। আমি রঞ্জনাকে বিরক্ত করিনি।

 ০৭. সেন্ট্রাল লাইনের টিউবে চড়তে

সেন্ট্রাল লাইনের টিউবে চড়তে না চড়তেই অক্সফোর্ড সার্কাসে নেমে পড়লাম। দু মিনিটের মধ্যেই বেকারলু লাইনের গাড়ি এলো। ভীষণ ভিড় তবু উঠে পড়লাম। কিছু দেখতে না পেলেও গাড়ি থামতেই বুঝলাম পিকাডিলি সার্কাস। তারপর ট্রাফালগার স্কোয়ার। চারিং ক্ৰশ। নেমে পড়লাম। স্ট্রান্ড দিয়ে হাঁটছি। কত দেশ-বিদেশের হাজার হাজার মানুষ আমার এপাশ-ওপাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। কত সুন্দরী। কত হট প্যান্ট। কিছু দেখতে পেলাম না। চোখের সামনে শুধু রঞ্জনার ছবিটাই ভেসে উঠলো।

সারাদিন খুব ঘুরেছি। হোটেলে এসেই হাত-পা ছড়িয়ে বিছানায় লুটিয়ে পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম। ঘুম ভাঙল টেলিফোনের ঘণ্টায়। রিসেপসনের টোলিফোন, স্যার মিঃ চাউডারী ইজ হিয়ার।

আমার ঘরে পাঠিয়ে দিতে বলেই উঠলাম। দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু পরেই দেবু এলো। আসুন আসুন।

দেবু আমার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো, আপনাকে বোধহয় ডিসটার্ব করলাম, তাই না?

ডিসটার্ব করবেন কেন? আমিই তো আপনাকে আসতে বলেছি।

দেবু বলল। আপনার দরজায় কয়েকবার নক করে কোনো রেসপন্স না পেয়ে রিসেপসন থেকে টেলিফোন করলাম।

সারাদিন ঘুরাঘুরি করে এত টায়ার্ড হয়েছিলাম যে ঘরে ঢুকেই শুয়ে পড়েছিলাম।

দেবু সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল, তাহলে বরং আপনি রেস্ট নিন, আমি কাল আসব।

আমি দেবুর কাঁধে হাত দিয়ে বসিয়ে দিলাম, বসুন বসুন। হাতের ঘড়িটা দেখে বললাম, প্রায় দু ঘণ্টা ঘুমিয়েছি। আর রেস্ট নেবার দরকার নেই।

জুতার ফিরে খুলতে খুলতে বললাম, ঠিক পনেরো বছর আগে আপনার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ। মনে আছে?

নিশ্চয়ই।

সেকেন্ড টাইম যখন লন্ডনে এলাম তখন আপনার ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেছে…।

আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ও বললো, আমরা দুজনে ডুরি লেন থিয়েটারে মাই ফেয়ার লেডী দেখেছিলাম…

লীডস যাওয়ার কথা মনে আছে?

সেই ডক্টর ঘোষের নতুন অস্টিনে চড়ে গিয়েছিলাম। মনে থাকবে না?

আর ওয়াই-এম-সি-এতে একদল আলজেরিয়ান ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে…

হাসতে হাসতে দেবব্রত বললো, সত্যি অমন পাগলের মতো সারারাত ডান্স কোনদিন করিনি।

তবে ছেলেগুলো সত্যি খুব ভদ্র ছিল।

নো ডাউট অ্যাবাউট দ্যাট। তবে মোস্ট ইন্টারেস্টিং ছিল সেই রোমান্টিক ফ্রেঞ্চ ফটোগ্রাফার ছেলেটি।

দ্যাটস্ রাইট! তাহলে দেখছি আপনার সব কিছু মনে আছে।

সব কিছুই যে মনে থাকে সেইটাই তো বিপদ।

বিপদ কেন?

দেবু একটু শুকনো হাসি হাসল, সব কিছু ভুলে গেলেই ভালো হতো।

আমি হাসতে হাসতে বললাম, কি ব্যাপার? মানের মধ্যে কিছু অভিমান জমা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে?

আপনি জামা কাপড় চেঞ্জ করে নিন। তারপর কথা হবে।

জামাকাপড় পাল্টে একটু বাথরুম থেকে ঘুরে এসেই দেবুর সামনের সোফায় বসলাম। প্রস্তাব করলাম, সুড উই হ্যাভ সাম হুইস্কি?

দেবু সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে একটা হোয়াইট হর্সের বোতল আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, উইথ কাইন্ডেস্ট রিগার্ডস!

আমি একটু বিস্মিত হয়ে বললাম, একি। আপনি আনলেন কেন?

ক্ষতি কি? এখন তো আমি ছাত্র নেই, চাকুরি করছি!

তাহলেও আপনার আনা ঠিক হয়নি।

কেন?

আমি আপনাকে আসতে বলেছি, খেতে বলেছি, সো ইট ইজ মাই ডিউটি টু এন্টারটেন ইউ।

আমার সঙ্গে ফর্মালিটি করার দরকার নেই। এর আগে যতবার আপনার এখানে এসেছি প্রত্যেকবারই আপনি আমাকে যথেষ্ট এন্টারটেন করেছেন। এবার না করলেও অন্যায় হবে না।

হবে না?

অফ কোর্স নট!

শেষ পর্যন্ত বোতল খুলে দুটো গেলাসে ঢেলে শুরু হলো, চিয়ার্স।

চিয়ার্স।

শুরু হলো কথাবার্তাও। হুইস্কির গেলাসটা নামিয়ে সিগারেট ধরাতে ধরাতে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি এখানে চাকরি নিলেন কবে।

দু বছর হয়ে গেল।

হঠাৎ ব্যাঙ্গাললারের চাকরি ছাড়লেন? ওখানে তো ভালোই ছিলেন।

শুধু ব্যাঙ্গালোরের চাকরি নয়, সব কিছুই ছেড়ে দিলাম।

তার মানে? গেলাসে চুমুক দিতে গিয়েও নামিয়ে নিলাম।

তার মানে সত্যিই সব কিছু ছেড়ে এসেছি। আই মীন স্ত্রী-পুত্র, ঘর বাড়ি দেশ–সব কিছু।

কি আজেবাজে কথা বলছেন? একটু শাসন করার সুরেই বললাম।

এখন তো হাফ পেগ হুইস্কিও পেটে যায়নি। আজেবাজে কথা বলার সুযোগ পেলাম কোথায়? তাছাড়া এখন এই পুরো বোতল হুইস্কি খেলেও আমি মাতাল হবে না।

আপনি কি আজকাল খুব ড্রিঙ্ক করেন?

খুব করি কিনা জানি না, তবে তিনশ পঁয়ষট্টি দিন ড্রিঙ্ক করি।

এত ড্রিঙ্ক করে টাকা পয়সা নষ্ট করছেন কেন? রোজ ড্রিঙ্ক করবেন না।

মানি ইজ নো প্রবলেম…

কেন?

একটু লেখাপড়া শিখেছি বলে বেশ ভালোই রোজগার করি। এর সিকি ভাগ আয় করে লোকে সংসার চালিয়েও বাড়ি-গাড়ি করছে।

আপনি গাড়ি কেনেননি?

আমার গেলাসের অর্ধেকও শেষ হয়নি, কিন্তু এরই মধ্যে ওর ড্রিঙ্ক শেষ। নিজেই আবার গেলাস ভরে নিলো। তারপর এক চুমুক দিয়ে বললো, ওসব ঝামেলায় আমি আর নেই। একবার স্ত্রী-পুত্রকে যখন চিরকালের মতো ছাড়তে পেরেছি তখন…

কথাগুলো শুনতে ভারি খারাপ লাগল। বললাম, আবার আজেবাজে কথা বলছেন।

সত্যিই বাজে কথা বলছি না। অন্তত আপনাকে নিশ্চয়ই বাজে কথা বলব না।

আমি তো তাই আশা করি।

দাদা মারা গিয়েছেন জানেন তো?

উনি তো ব্যাঙ্গালোরেই মারা যান?

হ্যাঁ।

সব কাগজেই তো সে খবর ছাপা হয়েছিল।

আমার শাশুড়িও মারা গিয়েছেন…

তাই নাকি?

হ্যাঁ। ইন ফ্যাকট দাদা মারা যাবার ঠিক মাস খানেক আগেই উনি মারা যান!

কি হয়েছিল জয়ন্তী বৌদির?

ক্যান্সার। ধরা পড়ল একেবারে লাস্ট স্টেজে।

বৌদির মৃত্যুর খবরটা শুনেই মন খারাপ হয়ে গেল। মনে পড়ল ওয়াশিংটনের কথা, কায়োর কথা। আরো কত কি! বড় ভালোবাসতেন আমাকে।

পৃথিবীর সব মানুষ ভালোবাসা চায়, কিন্তু খুব কম, মুষ্টিমেয় মানুষই ভালোবাসতে পারে। মানুষের সব চাইতে বড় সম্পদ প্রেম ভালোবাসা। সেই প্রেম, সেই ভালোবাসা, মনের সব চাইতে বড় ঐশ্বর্য অপরিচিত মানুষকে তো দূরের কথা নিজের প্রিয়জনদেরও সবাই বিলিয়ে দিতে পারি না আমরা। বৌদি পারতেন। অনায়াসে পারতেন। মানুষকে ভালোবাসতে জয়ন্তী বৌদির কার্পণ্য ছিল না। আমেরিকা থেকে চলে আসার দিন নিউইয়র্ক এয়ারপোর্টে ওঁকে বললাম, লোকে এখানে। এসে কত কি জিনিস সওদা করে, কিন্তু আমার মতো বিনা পয়সায় এমন সওদা করে নিয়ে যেতে পারে কজন?

কি আবার সওদা করলে? কিছুই তো কিনলে না।

আপনাদের ভালোবাসার যে সওদা করে নিয়ে যাচ্ছি তার চাইতে…

ভালোবাসতে জানলে ভালোবাসা পাওয়া যায় ভাই। তুমি ভালো না বাসলে কি আমরা ভালোবাসতাম?

আমি তর্ক করলাম না। সময় ছিল না, কিন্তু আসলে উনি ঠিক উল্টো কথাটাই বললেন। ভাদ্দরের অন্ধকার আকাশে সামান্য একটু বিদ্যুৎ চমকের মতো তর্জন গর্জন, কিন্তু কতটুকু তার আলো? কতক্ষণই বা তার মেয়াদ। আর সূর্য? অমাবস্যার সূচীভেদ্য অন্ধকার ভেদ করে সে মহাতপস্বী সাধকের মতো মাথা তুলে দাঁড়ায়, পৃথিবীর দশ দিকে নিজের সবটুকু আলো ছড়িয়ে দেয়, কিন্তু তার কোনো তর্জন-গর্জন নেই। সুভাষদা আর জয়ন্তী বৌদি ভালোবাসার মাধুর্য আপন চারিত্রিক মহিমায় আমাকে বিলিয়ে দিয়েছেন।

কায়রো থেকে আসার আগে বৌদির কাছে একটা ফটো চাইলাম।

আমার ছবি নিয়ে কি করবে ভাই?

কি আর করব? আমার কাছে থাকবে। মাঝে মাঝে দেখব, কথা বলব।

আমার আলাদা ছবি রাখতে হবে না। ছবি দেখে জোর করে আমাকে মনে করতে হবে না। যদি এমনি আমাকে মনে রাখতে না পার, তাহলে মনে রেখো না।

অনেকবার অনুরোধ করলাম, কিন্তু কিছুতেই উনি ওঁর একটা ছবি দিলেন না। সেদিন ঠিক খুশী হইনি। পরে বুঝেছিলাম সত্যি ওঁর ফটো রাখার দরকার নেই, ওঁর সান্নিধ্য যারা পেয়েছে তাদের কাছে ওঁর স্মৃতি অম্লান রইবেই।

বড় অপরাধী মনে হলো নিজেকে। ওঁরা কলকাতা চলে যাবার পর কতবার কলকাতা গেছি, কিন্তু একবারও দেখা করিনি। সাহস হয়নি। ভয় করেছে যদি কথায় কথায় বেরিয়ে যায় রমা আমাকে…

পারিনি। কিছুতেই পারিনি। প্রত্যেকবার ফেরার পথে মনে হয়েছে অন্তত একবার কয়েক মিনিটের জন্য অবশ্যই যাওয়া উচিত ছিল। ভীষণ অন্যায় হয়েছে। এর পরের বার কলকাতায় গিয়ে নিশ্চয়ই দেখা করব। পরের বার গিয়েও পারিনি। হেরে গেছি।

বৌদি মারা গেলেন আর সুভাষদা আমাকে একটা খবর দিলেন না? নিজেই যেন নিজেকে প্রশ্ন করলাম।

দেবব্রত বললো, উনি এত বেশি আঘাত পেয়েছেন যে, চিঠিপত্র লেখা তো দুরের কথা, কারুর সঙ্গে বিশেষ কথাবার্তাও বলেন না।

আমি চুপ করে বসে রইলাম। একটা কথা বলতেও মন চাইল না। সুভাষদা আর বৌদির চিন্তায় তলিয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ ওর কথায় চমক ভাঙল, রঞ্জনার ছেলে হয়েছে, জানেন তো?

কই না তো!

এই তো একটু আগেই বললাম স্ত্রী-পুত্র ঘর বাড়ি ছেড়ে এসেছি, শোনেননি?

স্ত্রীকে ছেড়ে এসেছে শুনেই মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল। ইন এনি কেস, কনগ্রাচুলেশনস।

আমাকে নয়, রঞ্জনাকে কনগ্রাচুলেট করবেন।

ওর সঙ্গে দেখা হলে ওকে কনগ্রাচুলেট করব। এখন তো আপনাকেই করি। ইউ আর দ্য প্রাউড ফাদার…

দেবব্রতর সুন্দর মখখানা যেন হঠাৎ শুকিয়ে পাংশু বর্ণ হয়ে গেল মাথা নাড়তে নাড়তে বললো, আই অ্যাম নট…

আমার পিঠের উপর যেন একটা চাবুকের বাড়ি পড়ল। হুইস্কির গেলাসটা খুব জোরে সেন্টার টেবিলে রেখে প্রায় চিৎকার করে উঠলাম, হোয়াট?

ধীর, স্থির, শান্ত দেবব্রত আবার মাথা নাড়তে নাড়তে বললে, আমি ঐ ছেলের বাবা না।

টেবিল চাপড়ে আমি পাগলের মতো চিৎকার করে বললাম, স্টপ টকিং ননসেন্স।

আমার চিৎকারে দেবব্রত একটু থতমত খেয়ে মুহূর্তের জন্য চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ আমি ওর মুখের দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারলাম না। বেশিক্ষণ অন্যদিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। দৃষ্টিটা আবার ঘুরিয়ে আনতেই দেখি দেবব্রতর দুটো চোখ জলে ভরে গেছে। বিশ্বাস করুন দাদা, আপনাকে আমি মিথ্যে কথা বলছি না, ভগবানের নামে মা কালীর নামে শপথ করে বলছি ও ছেলে আমার নয়।

কিন্তু দেবুবাবু, রঞ্জনা তো এমন কাজ করতে পারে না। আমি তা ওকে খুব ভালোভাবে চিনি।

আমি জানি রঞ্জনা ভালো। রঞ্জনা আমাকে ভালোবাসে। তবে একথাও জানি ও ছেলের জন্মদাতা আমি না।

আমি স্বীকার করতে পারলাম না, এ হতে পারে না, এ অসম্ভব।

এই পৃথিবীতে কিছুই অসম্ভব নয়।

তা ঠিক! তবুও…

আমার দাদা ডক্টর দেবতোষ চৌধুরীই ঐ ছেলের…

আঃ। দেবুবাবু। আপনি কি উন্মাদ হয়েছেন?

দেবু উন্মাদ না হলেও প্রায় পাগলের মতো হেসে উঠল, হইনি। হলে ভালোই হতো।

বেশ রেগে আমি ওকে বললাম, গেট রিড অব অল দিজ ডার্টি আইডিয়াস।

আই উইস, আই কুড, কিন্তু যা বলছি তা বর্ণে বর্ণে সত্যি। রঞ্জনা নিজেও স্বীকার করেছে।

বলেন কি?

হ্যাঁ। ও স্বীকার করেছে।

দুজনেই গেলাসের পর গেলাস হুইস্কি খেয়ে গেলাম। কিন্তু একটি কথা বললাম না কেউই। অনেকক্ষণ। বোধহয় ঘণ্টাখানেক। বা তারও বেশি।

আমার বড় দাদু ডাঃ জনার্দন চৌধুরীর কথা আপনার মনে আছে?

যিনি কাপুরতলার মহারাজার…

দ্যাটস রাইট। হি ওয়াজ এ গ্রেট ম্যান। কিন্তু আমার নিজের দাদু গদাধর চৌধুরী এক নম্বরের স্কাউলে ছিলেন। নিজের বিবাহিতা স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে সিমলার এক পাহাড়ি মেয়েকে নিয়ে ঘর করতেন।

আমি চুপ করে শুনছি। তখনকার দিনে অনেক বাঙালিবাবুই এ কাজ করতেন। শুনে অবাক হলাম না।

আমরা ওঁর ঐ রক্ষিতারই বংশধর।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। আমার বাবাকে বড় দাদুই মানুষ করেন এবং তিনি নিছক একজন ভদ্রলোক ছিলেন। বড় দাদুই আমার বাবার বিয়ে দেন এবং আমরা হই।

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললাম, আর কি শুনব আপনার কাছে?

দাদুর এসব কথা কাউকে বলি না। ভেবেছিলাম বলার দরকার হবে না। কিন্তু দাদার কাণ্ড দেখে। মনে হচ্ছে রক্তের ধারা পাল্টান বড় কঠিন। বোধহয় অসম্ভব।

জানি না।

আমার এক কাকা–আই মীন ওই পাহাড়ি মেয়েটির ছোট ছেলে–দিল্লিতে আন্ডার সেক্রেটারি।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। আমাদের অনেক পরিচিত লোক এমনি পাহাড়ি মেয়েকে নিয়ে ঘর করতে করতে…

থাক, আর দরকার নেই। রঞ্জনা কি দিল্লিতেই আছে?

হ্যাঁ। দোতলায় থাকে। একতলা ভাড়া দিয়ে এগার শ টাকা পাচ্ছে।

টাকার হিসেব শুনতে চাইনি।

এমনি বলছিলাম। ওর সম্পর্কে আপনার চিন্তা হওয়া স্বাভাবিক।

চিঠিপত্রের লেনদেন নেই নিশ্চয়ই?

। তবে পর পর কয়েকবার টাকা পাঠিয়েছি, কিন্তু ও নেয়নি।

না নেওয়াই তো উচিত।

আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর দেবব্রত জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি পরশুই যাচ্ছেন?

কেন? আরো কিছু শোনাতে চান?

দেবব্রত উঠে দাঁড়াল। আমিও।ও একবার আমার দিকে তাকিয়েই দুহাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল। কাঁদতে কাঁদতে বললো, আমার উপর রাগ করবেন না। আমি বড় দুঃখী। আমি বড় একা।

আমিও ওকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম, রাগ করিনি ঠিকই তবে আপনার সঙ্গে আমার দেখা হলেই ভালো হতো।

আমার কাঁধের উপর ফোঁটা ফোঁটা ওর চোখের জল পড়ছিল। হয়তো আপনার ভালো হতো, কিন্তু আপনাকে সব কিছু বলে একটু হালকা হতে পারলাম।

অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। বললাম, বাড়ি যান। অনেক রাত হয়েছে।

যাচ্ছি।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে জিজ্ঞাসা করলাম, এখানেই থাকবেন না কি দেশে ফিরবেন?

দেশে ফেরার ইচ্ছা নেই। এখানেই বেশ আছি।

বেশ আর কোথায় আছেন?

যারা দেশে সুখে থাকতে পারে তারা কেউ লন্ডনে আসে না। আসবে কেন? পৃথিবীর যত দুঃখী লোকের ভিড় তত এই লন্ডনে। আমিও ওদের মধ্যে দিনগুলো ঠিক কাটিয়ে দেব।

.

অনেক দিন বিদেশে কাটিয়ে দিল্লি ফিরলাম। রাধাকিষণকে আগেই খবর দিয়েছিলাম। ও এয়ারপোর্টেও এসেছিল। পালাম থেকে বাড়ি ফেরার পথে জিজ্ঞাসা করলাম, কিছু জরুরী খবর। আছে নাকি?

।রাধাকিষণ বললো, অনেক চিঠিপত্র এসেছে আর চৌধুরী মেমসাব এসেছিলেন।

কবে এসেছিলেন?

তিন-চার দিন।

কিছু বলে গেছেন?

জিজ্ঞাসা করলেন আপনি কবে আসবেন, আর একটা চিঠি দিয়ে গেছেন।

উনি জানেন আমি আজ আসছি?

হ্যাঁ সাব। আমি বলেছি।

চিঠি কবে দিয়ে গেলেন?

আজই।

বাড়িতে এসেই রঞ্জনার চিঠি পড়লাম।…যত রাত্রিই হোক একবার আমার এখানে আসবেন।

হাতের ঘড়িতে দেখলাম দশটা বেজে গেছে। মিনিট খানেক ভাবলাম। তারপরই একটা ট্যাকসি নিয়ে চলে গেলাম।

আমি ট্যাকসি থেকে নামতেই দেখি রঞ্জনা দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। ট্যাকসি ছেড়ে দিলাম না, ড্রাইভারকে দাঁড়াতে বললাম।

এক পা এগুতেই রঞ্জনা বললো, আসুন।

আমি একটি কথা না বলে ওর পিছন পিছন উপরে উঠলাম। সামনের ঘরে ঢুকতেই বললো, বসুন।

বসলাম।

পাশের ঘর থেকে ছেলেকে কোলে করে এনে আমার সামনেই বসে পড়ে বললো, আজ এর জন্মদিন। আপনি যদি একটু আশীর্বাদ করতেন…

রঞ্জনা আর কথা বলতে পারল না।

আমি ওর কোল থেকে ছেলেটাকে দু হাতে তুলে নিয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলাম।

আমার পায়ের উপর রঞ্জনার কয়েক ফোঁটা গরম চোখের জল পড়তেই ওকেও আমি বুকের মধ্যে টেনে নিলাম।

Exit mobile version