রঘু ভয়ে পাথর হয়ে গেল।
ছেলেটা বললে, কেন মিছে ছোট বাচ্চাটাকে ভয় দেখাচ্ছ চাচা?
–মিছে ভয় দেখাচ্ছি?–লোকটার অট্টহাসিতে রঘুর মাথা ঘুরে গেল, ওটা বাচ্চা ছেলে নয়, কেউটের বাচ্চা। খুদে গোয়েন্দা! নইলে এই বলরামপুরের শালবনে এসে ঢোকে? আজই সন্ধেয় ওকে কালীর পায়ে বলি দেব; তবে আমার নাম বৃন্দা সিং—হাঁ।
রঘুর হাত থেকে ঠকাৎ করে গ্লাসটা খসে পড়ল, দুধের ঢেউ বয়ে চলল মেঝেতে।
.
পাঁচ
রঘু হাউমাউ করে কান্না জুড়েছিল, ঘরঘরে গলায় বৃন্দা সিং জোরালো ধমক দিলে একটা।
–এই রোও মৎ!
রঘুর কান্নাটা গলায় এসে কোঁৎ করে থেমে গেল।
–খাড়া হো যাও।
রঘু দাঁড়াল। কেমন করে দাঁড়াল জানে না, শুধু চোখের সামনে সেই মাকড়সার জালটা যেন বোঁ বোঁ করে ঘুরতে লাগল।
–নাম কী? ঘর কাঁহা?
রঘু জড়িয়ে জড়িয়ে কী যেন বললে, কেউ তা বুঝতে পারল না। বৃন্দা সিং চোখ পাকিয়ে আবার বিকট গলায় ধমক দিলে : সাফ সাফ বলল, নেহি তো–বিরাশি সিক্কা নয়, একশো চৌষট্টি সিক্কার একটি চড় আকাশে উঠল। সেটা গালে পড়লে রঘু সেই চম্পতিয়ার ছাতুর গোলার মতো তাল পাকিয়ে যেত সঙ্গেসঙ্গে।
রঘুর গলা দিয়ে কেবল ক্যাঁ করে একটা আওয়াজ বেরুল। আর তক্ষুনি আড়াল করে দাঁড়াল সেই কালো ছেলেটা–যার নাম মুরলী।
মুরলী বললে, কেন ঝুটমুট ওকে ভেবড়ে দিচ্ছ চাচা? আমি সব বলছি। ছানার জিলিপি চুরি করে খাওয়া, তারপর বাপের ঠ্যাঙার ভয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালানো–ট্রেনে উঠে ভোরবেলা লাফিয়ে নেমে পড়ারাঘবের অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনী সব বলে গেল মুরলী। আর তাই শুনে হা-হা করে হাসতে-হাসতে পেটে হাত চেপে বসে পড়ল বৃন্দা সিং। সঙ্গের বাকি তিনটে জোয়ানও সে-হাসিতে যোগ দিলে, আর, মনে হলো, বলরামপুরের জঙ্গলে যেন হাজার খানেক করাত একসঙ্গে কাঠ চিরছে।
হাসি থামলে বৃন্দা সিং বললে, আঁ এইসা বাত? ওরে বুদ্ধ রঘুয়া, খাওয়ার জন্য বাঁচতে নেই বাঁচার জন্যেই খেতে হয়। যাই হোক, আমার পাল্লায় যখন এসে পড়েছিস, তখন তোকে শিখিয়ে দেব সত্যিকারের বাঁচা কাকে বলে। কুস্তি লড়বি, লাঠি খেলবি, বন্দুক ছুঁড়বি। ঘি আর মেঠাই খেয়ে পেটে যে থলথলে চর্বি জমেছে–এক মাসের মধ্যে লোপাট হয়ে যাবে ওসব। ছাতি চওড়া হবে-সত্যিকারের জোয়ান করে তুলব। এই মুরলী তোর দেখাশোনা করবে–আর কিষণলাল তোকে মানুষ করার ভার নেবে। কিন্তু খবদ্দার। পালাবার চেষ্টা করেছিস তো মরেছিস! কালী মাইজীর কাছে নিয়ে তোকে বলি দেব–মনে থাকে যেন।
কথাগুলো রঘু যে সব শুনতে পেল তা নয়। কিন্তু যা শুনল তা-ই যথেষ্ট। আর-একবার কেঁদে উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু বৃন্দা সিং ওর চোখের দিকে তাকাতেই সেকান্নাটা কোঁৎ করে গলা বেয়ে পেটের ভিতরে নেমে গেল তার।
বৃন্দা সিং বললে, আমি এখন যাচ্ছি, বিকেলে ফিরে আসব। কিষণলাল, তুমি এক্ষুনি একে তালিম লাগাও, আমি এসে খবর নেব, কতদূর এগোল।
এই বলে বাকি দুজন সঙ্গীকে নিয়ে নাগরা জুতো মচমচিয়ে বেরিয়ে গেল বৃন্দা সিং। সামনে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে কোথায় যে মিলিয়ে গেল কে জানে?
রঘু একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে যাচ্ছি, কিন্তু আশা মরীচিকা। সঙ্গে সঙ্গে আর-একটা লম্বা জোয়ান এগিয়ে এল তার দিকে। গায়ের রংটা ফসার দিকে। মাথায় ছোট-ছোট লালচে চুল–রোদ পড়ে তামার কুচির মতো জ্বলছে, বাঁ দিকের ভুরুর নীচ থেকে একটা পুরনো কাটা দাগ ধনুকের মতো বেঁকে নেমে এসেছে ঠোঁট পর্যন্ত। চোখ দুটো ট্যারা। মালকোঁচা করে পরা কাপড়, গায়ে ফতুয়া, দু-হাতে দুটো লোহার বালা। সব মিলে ভয়ঙ্কর লোকটাকে আরও বিকট দেখাচ্ছে। এ-ই কিষণলাল।
কিষণলাল ট্যারা চোখে খানিকক্ষণ দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে রইল–অর্থাৎ বেশ করে লক্ষ করল রঘুকে। তারপর বললে, আও।
রঘু মুরলীর পেছনে কাঠ হয়ে রইল, এক পা নড়ল না। কিষণলাল আবার মোটা গলায় বললে, এই রঘুয়া, চলা আও।
মুরলী কানে কানে বললে, চলা যাও–ডরো মৎ।
বলির পাঁঠার মতো মুরলীর আড়াল থেকে বেরুল রাঘবলাল। কিষণলাল খপ করে তার হাতটা চেপে ধরল। আঙুল তো নয়–যেন লোহার আংটা! রঘুর হাতের হাড় মড়মড় করে উঠল।
কিষণলাল তাকে টানতে টানতে ঘর থেকে বার করে নিয়ে গেল। কিষণলালের সঙ্গে যেতে যেতে রঘু দেখল, একটা মস্ত পুরনো বাড়ির অর্ধেকটা ভেঙে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে–তৈরি হয়েছে কতগুলো মাটির পাঁজা তার ওপর ঘাস আর বনতুলসীর জঙ্গল গজিয়েছে। মাত্র খান তিন-চার ঘর কোনওমতে দাঁড়িয়ে আছে, একটু-আধটু সারিয়ে-সুরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। সেইটেই এদের আস্তানা। পুরনো চুন-সুরকি আর গাছপালার গন্ধে ভরে আছে বাতাস। বাড়িটার সামনে আর দুধারে একটু ফাঁকা জায়গা–কেটে সাফ করা হয়েছে মনে হয়। তা ছাড়া চারদিকে জঙ্গল আর জঙ্গল। শালগাছ তো আছেই, কয়েকটা শিমুল গাছ ফুলে ফুলে লাল হয়ে আছে। আরও কী কী গাছ রয়েছে রঘু চিনতে পারল না। বনের ভেতর দিয়ে কয়েকটা ছোট-ছোট পায়ে-চলা কোথায় যে চলে গেছে কে জানে?
সেই ফাঁকা জায়গার খানিকটা অংশ বেশ করে কোপানো রঘু বুঝল এখানে কুস্তি হয়। তারই কাছাকাছি একটা গাছতলায় কিষণলাল রঘুকে এনে দাঁড় করাল। বললে, খাড়া রহে।
রঘু দাঁড়িয়ে রইল।
–ইধার উধার ভাগো মৎ।
রঘু মাথা নেড়ে জানালো,–সে ভাগবে না।