পিস্তল! ভদ্র ডাকাত। নিতাইয়ের সমস্ত মুখটা ছাইয়ের মতো বিবর্ণ হয়ে গেল। এই ঘটনাটা যেন বিচ্ছিন্ন একটা আকস্মিক ব্যাপার নয়। আচমকা তার মনে হল, যেন এর সঙ্গে কোন একটা অলক্ষ্য সূত্রে তার ভাগ্যটাও জড়িয়ে আছে।
দারোগা বললেন, আরে সেই তো বলছি। এর ভেতরে মস্ত একটা রহস্য আছে, বিস্তর ঘোরপ্যাঁচ আছে। এ-নিয়ে ধস্তাধস্তি করা আমাদের মতো পুঁটিমাছ দারোগার কম্ম নয় বাবা! সিধেল চোর দু-চারটে ধরতে পারি, দাগিকে এনে ঠ্যাভানি লাগাতে পারি; অর্থাৎ সেরেফ খাই-দাই আর কাঁসি বাজাই। জয়ঢাক বাজাতে হলে কেমন করে ঠ্যালা সামলাই!
হঠাৎ নিতাই চুপ করে রইল।
একটা বিড়ি ধরিয়ে দারোগা বললেন, যাচ্ছি তো এনকোয়ারিতে। ওখান থেকে সোজা সদরে চিঠি লিখব; দু-চারটে ডিটেকটিভ-ফিভ পাঠিয়ে দাও। এসব ভদ্র ডাকাতের ব্যাপারে ইয়াসিন মিঞা নেই। শেষকালে রাত-বেরেতে দু-চারটে পিস্তলের গুলি মেরে দিলে কোন্ আফাজুদ্দিন চাচা আমাকে বাঁচাতে আসবে।
ঘোড়া ছুড়িয়ে দারোগা চলে গেলেন। যাবার আগে বলে গেলেন, তুমিও সাবধান হয়ে থেকো সরকার সক্ষণ আমার ভাল ঠেকছে না।
–অ্যাঁ–অ্যা–আমি। আমি কেন? দারোগা ঘোড়া থামালেন। ভয়ানক একটা গুরুগম্ভীর চেহারা করে তাকালেন নিতাইয়ের দিকে।
–বিশ্বাস কী! তুমি তো অনেক টাকা করেছ বাজারে জোর গুজব। ভদ্র ডাকাতেরা একবার তোমার ঘরে যদি হানা দেবার চেষ্টা করে তাতে অন্যায়টা কোথায় আছে!
নিতাইয়ের পিলে-যকৃতে ভূমিকম্প জাগিয়ে হিতৈষী ইয়াসিন দারোগা প্রস্থান করলেন। নিতাই সরকার উঠে দাঁড়াল। কী করবে কিছু বুঝতে পারছে না। হাতে আর একদিন মাত্র সময়। অশরীরী শ্ৰীমন্ত রায়ের আগুন-ভরা চোখ থেকে কোনওখানে সে নিস্তার পাবে না। বুকের গেঞ্জিতে রক্তরাঙা হাতের ছাপ তার ভয়ঙ্কর পরোয়ানা জানিয়ে গেছে।
রাধেকৃষ্ণ নিতাই চমকে উঠল। সামনে একজন বুড়ো বৈরাগী এসে দাঁড়িয়েছে। একটা গোপীযন্ত্র বাজাচ্ছে টুং টুং করে। বলছে : হরেকৃষ্ণ–দুটি ভিক্ষে পাই?
নিতাইয়ের সমস্ত রাগ নিরীহ বৈরাগীটার ওপরে গিয়েই ফেটে পড়ল। জানোয়ারের মতো দাঁত খিঁচিয়ে বললে, হ্যাঁরা কৃষ্ণ! ভিক্ষে করতে এসেছে! যাও, ভাগো এখান থেকে! বোষ্টম
–আরও কিছু, যত শালা জোচ্চোর!
–তোমার এত টাকা, গরিব বোষ্টমকে তাড়িয়ে দিচ্ছ বাবা?
–আমার এত টাকা! কে তোমাকে খবরটা দিলে তা? ইয়ার্কি পেয়েছ, মামাবাড়ির আবদার, না? যাও, নিকালো হিয়াসে! রাগের চোটে নিতাইয়ের মুখ দিয়ে হিন্দী বেরুতে লাগল : নেহি যায়গা তো এক ঘুষি দেকে মুণ্ডু উড়ায়ে দেগা!
পাকা দাড়ির আড়ালে বুড়ো বৈরাগীর চোখ একবার ধক করে জ্বলে উঠেই নিবে গেল। বৈরাগী বললে, আচ্ছা বাবা চলে যাচ্ছি, বুড়ো মানুষকে ঘুষি মেরে তোমার আর বীরত্ব দেখাতে হবে না। ভগবান তোমার মঙ্গল করুন। হরেকৃষ্ণ।
টুং টুং করে গোপীযন্ত্র বাজিয়ে বৈরাগী দ্রুতপদে অগ্রসর হয়ে গেল।
আর বৈরাগী চলে যাওয়ার পরেই একটা আশ্চর্য ব্যাপার চোখে পড়ল নিতাইয়ের। সামনে। ঘাসের ওপরে একখানা নীল রঙের খাম পড়ে আছে।
ক্ষিপ্র হাতে খামটা তুলে নিতেই তার ভেতর থেকে একটুকরো চিঠি বেরিয়ে পড়ল। রুদ্ধশ্বাসে চিঠিটা পড়ে গেল নিতাই :
তোমার বিপদের কথা আমরা জানি। কোনও ভয় নাই। শ্ৰীমন্ত রায়ের প্রেতাত্মার হাত হইতে যদি রক্ষা পাইতে চাহ, তাহা হইলে এই চিঠির আদেশ পালন করিও। আজ সন্ধ্যার পরে নীলকুঠির জঙ্গলে আসিও–একা। কোনও ভয় করিও না–তোমার সমস্ত বিপদের যাহাতে অবসান হয় সেই পথ তোমাকে বাতলাইয়া দিব। যদি অবহেলা করিয়া না আসো, তাহা হইলে জানিও যে ভয়ঙ্কর দুভাগ্য তোমার জন্য অপেক্ষা করিতেছে, তাহা হইতে কেহ তোমাকে রক্ষা করিতে পারিবে না। ইতি–
তোমার বন্ধু।
.
সাত
ব্যাপার দেখে ইয়াসিন দারোগা খানিকক্ষণ হাঁ করে রইলেন। খুনি আর দাগি নিয়ে কারবার করেছেন বিস্তর, কিন্তু এমন অভিজ্ঞতা জীবনে বিশেষ ঘটেনি। একে অজ পাড়া-গাঁ, এই ছোট স্টেশন–বিহারের একটা নিরিবিলি অঞ্চল। এখানেও যে এমন সব ঘটনা ঘটতে পারে, এ কি কল্পনাও করা যায় কখনও? জার্মানযুদ্ধের চাইতেও এ ভয়ানক–জাপানী বোমার চাইতেও এ যে মারাত্মক।
অফিস ঘরের মেঝেতে তেমনি পড়ে আছে গিরিধারীর লাশটা। গলা আর বুকের ভেতর দিয়ে দু-দুটো পিস্তলের গুলি পরিষ্কারভাবে বেরিয়ে গিয়েছে। খুব কাছে থেকেই গুলি করা হয়েছিল। নীল উর্দি রক্তে একেবারে ভিজে গেছে। মেঝের ওপর দিয়ে অনেকটা গড়িয়ে গেছে রক্ত–শুকিয়ে গিয়ে সে রক্ত আঠার মতো কালো হয়ে আছে। দেওয়ালের গায়েও সে-রক্তের ছিটে। গিরিধারীর পদা-পড়া নিষ্পলক হলদে চোখ দুটো তখনও ভয়ে আর বিস্ময়ে অস্বাভাবিকভাবে বিস্ফারিত হয়ে আছে, যেন ব্যাপারটা কী ঘটেছে ভাল করে বোঝবার আগেই মৃত্যু তার প্রেত-ছায়া ছড়িয়ে দিয়েছে তার চেতনার ওপরে।
একপাশে টেলিফোনের রিসিভারটা ঝুলে পড়েছে টেবিল থেকে নীচেতে। একটা গুলি তার মাউথপিসে লেগেছিল-খানিকটা উড়ে গেছে তার থেকে। শক্ত দেয়ালের গা থেকে খানিকটা চুন-সুরকি ঝরিয়ে দিয়ে একটা কালো বুলেট প্রায় এক-ইঞ্চি ভেতরে ঠুকে শক্ত হয়ে আটকে বসেছে–যেন একটা বড় পেরেককে জোরে ঢুকে ওখানে বসিয়ে দিয়েছে কেউ। ঘরটার দিকে একবার তাকালেই বুঝতে পারা যায়, কাল রাত্রে কী ভয়ঙ্কর প্রলয় কাণ্ড ঘটে গিয়েছে ওখানে বয়ে গেছে কী ভয়ঙ্কর একটা দুর্যোগ।