Site icon BnBoi.Com

কম্বল নিরুদ্দেশ – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

কম্বল নিরুদ্দেশ - নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

০১. অনেক ভেবে-চিন্তে চারজন

অনেক ভেবে-চিন্তে চারজন শেষ পর্যন্ত বদ্রীবাবুর দি গ্রেট ইন্ডিয়ান প্রিন্টিং হাউস-এ ঢুকে পড়লুম। নাম যতই জাঁদরেল হোক, প্রেসের ভেতরটায় কেমন আবছা অন্ধকার। এই দিনের বেলাতেও রামছাগলের ঘোলাটে চোখের মতন কয়েকটা হলদে হলদে ইলেকট্রিকের বাল্ব জ্বলছিল এদিকে-ওদিকে; পুরনো কতকগুলো টাইপ-কেসের সামনে ঝুঁকে পড়ে ঘষা কাচের মতো চশমা পরা একজন বুড়ো কম্পোজিটার চিমটে দিয়ে অক্ষর খুঁটে খুঁটে গ্যালি সাজাচ্ছিল; ওধারে একজন ঘটাং ঘটাং করে প্রেসে কী ছেপে যাচ্ছিল, উড়ে পড়ছিল নতুন ছাপা হওয়া কাগজ—আর একজন তা গুছিয়ে রাখছিল। পুরনো নোনাধরা দেওয়াল, কুলুঙ্গিতে সিদ্ধিদাতা গণেশ রয়েছেন, তাঁর পায়ের কাছে বসে একজোড়া আরশোলা বোধহয় ছাপার কাজই তদারক করছিল, হাত কয়েক দূরে পেটমোটা একটা টিকটিকি জ্বলন্ত চোখে লক্ষ করছিল তাদের। ঘরময় কালির গন্ধ, কাগজের গন্ধ, নোনার গন্ধ, আর তারই ভেতরে টেবিল-চেয়ার পেতে, খাতা কাগজপত্র, কালি কলম, টেলিফোন এই সব নিয়ে বদ্রীবাবু একমনে মস্ত একটা অ্যাঁলুমিনিয়ামের বাটি থেকে তেলমাখা মুড়ি আর কাঁচালঙ্কা খাচ্ছিলেন।

টেনিদা আর হাবুলের পাল্লায় পড়ে বদ্রীবাবুর প্রেসে ঢুকে পড়েছি, নইলে আমার এখানে আসবার এতটুকুও ইচ্ছে ছিল না। ক্যাবলারও না। আমরা দুজনেই প্রতিবাদ করে বলেছিলুম, কী দরকার? যাদের বাড়ির ছেলে, তাদের যখন কোনও গরজ নেই, আমরা কেন খামকা নাক গলাতে যাই?

কিন্তু টেনিদার নাকটা একটু বেয়াড়া রকমের লম্বা আর লম্বা নাকের মুস্কিল এই যে, পরের ব্যাপারে না ঢোকালে সেটা সুড়সুড় করতে থাকে। টেনিদা খেকিয়ে উঠে বললে, বা-রে, তাই বলে পাড়ার একটা জলজ্যান্ত ছেলে দুম করে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে?

হয়ে যাক না ক্যাবলা খুশি হয়ে বললে, অমন ছেলে কিছুদিন নিরুদ্দেশ থাকলেই পাড়ার লোকের হাড় জুড়োয়। কুকুরের ল্যাজে ফুলঝুরি বেঁধে দেবে, গোরুর পিঠে আছড়ে পটকা ফাটাবে, বেড়ালছানাকে চৌবাচ্চার জলে চুবোবে, গরিব ফিরিওলার জিনিস হাতসাফাই করবে, ছোট-ছোট বাচ্চাগুলোকে অকারণে মারধোর করবে, ঢিল ছুঁড়ে লোকের জানলার কাচ ভাঙবে—ও আপদ একেবারেই বিদায় হয়ে যাক না। হনলুলু কিংবা হন্ডুরাস যেখানে খুশি যাক, মোদ্দা পাড়ায় আর না ফিরলেই হল।

শুনে, নাকটাকে ঠিক বাদামবরফির মতো করে, টেনিদা কিছুক্ষণ চেয়ে রইল ক্যাবলার দিকে। তারপর বললে, ইস্‌স, কী পাষাণ প্রাণ নিয়ে জন্মেছিস ক্যাবলা! তুই শুধু পরীক্ষাতেই স্কলারশিপ পাস, কিন্তু মায়া-দয়া কিছু আছে বলে তো মনে হয় না। না হয় কম্বল এক-আধটু দুষ্টুমি করেই, তাই বলে একটা নিরীহ শিশুকে–

নিরীহ শিশু। ক্যাবলা বললে, দুবার ক্লাস সেভেনে ডিগবাজি খেল, তলা থেকে ও শক্ত হয়ে আসছে—এখনও শিশু! তা হলে দেড় হাত দাড়ি গজানো পর্যন্তও কম্বল শিশুই থাকবে, ওর বয়েস আর বাড়বে না। আর নিরীহ! অমন বিচ্ছু, অমন বিটলে, অমন মারাত্মক–

আমি সায় দিয়ে বললুম, মারাত্মক বলে মারাত্মক। কম্বলকে সাধুভাষায় সর্বার্থসাধক, কিঞ্জল্ক, ডিণ্ডিম, এমন কি সুপসুপা সমাস বললে–ও অন্যায় হয় না। এই তো সেদিন পয়লা বোশেখে আমায় বললে, প্যালাদা, তোমার একটা নববর্ষের পেন্নাম করব। আমি অবাক হয়ে ভাবছি, ব্যাপারটা কী, কম্বলের অত ভক্তি কেন—আর ভাবতে-ভাবতেই পেন্নামের নাম করে আমার দুপায়ে বিচ্ছুটির পাতা ঘষে দিয়ে দৌড়ে পালিয়েছে। তারপর একঘণ্টা ধরে আমি দাপিয়ে মরি। ও রকম বহুব্রীহি-মাকা ছেলের চিরকালের মতো নিরুদ্দেশ হওয়াই ভালো—আমি ক্যাবলার কথায় ডিটো দিচ্ছি।

টেনিদা রেগে বললে, শাটাপ! ফের কুরুবকের মতো বকবক করবি, তা হলে এক-এক চড়ে কানগুলো কানপুরে পাঠিয়ে দেব।

হাবুল অনেকক্ষণ ধরে একমনে কী যেন খাচ্ছিল, মুখটা বন্ধ ছিল তার। এতক্ষণে সেটাকে সাবাড় করে ঘাড় নেড়ে বললে, কানগুলান কর্ণাটেও পাঠাইতে পারো।

তাও পারি। নাক নাসিকে পাঠাতে পারি, দাঁত দাঁতনে পাঠাতে পারি, আরও অনেক কিছুই পারি। আপাতত কেবল ওয়ার্নিং দিয়ে রাখলাম। ক্যাবলা—প্যালা—নো তর্ক, ফলো ইয়োর লিডার—মার্চ।

ক্যাবলা গোঁজ হয়ে রইল, আমি গোঁ গোঁ করতে লাগলুম। হাবুল আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে। বললে, আরে, না হয় দিছেই তর পায়ে বিছুটা ঘইষ্যা—তাতে অত রাগ করস ক্যান? ক্ষমা কইরা দে। ক্ষমাই পরম ধর্মজানস না? শুনে আমি হাবুলের কানে কুটুস করে একটা চিমটি দিলুম-হাবুল চ্যাঁ করে উঠল।

আমি বললুম, রাগ করিসনি হাবলা, ক্ষমাই পরম ধর্ম—জানিস না?

টেনিদা বললে, কোয়ায়েট। নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-ফাঁটির কোনও মানে হয় না। এখন অতি কঠিন কর্তব্য আমাদের সামনে। আমরা বদ্রীবাবুর ওখানে যাব। গিয়ে তাঁকে জানাব যে কম্বলকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে আমরা তাঁকে সাহায্য করতে প্রস্তুত।

ক্যাবলা কান চুলকে বললে, কিন্তু তিনি তো আমাদের সাহায্য চাননি।

আমরা উপযাচক হয়ে পরোপকার করব।

আমি বললুম, কিন্তু বদ্রীবাবু যদি আমাদের তাড়া করেন?

ভুরু কুঁচকে টেনিদা বললে, তাড়া করবেন কেন?

বদ্রীবাবু সকলকে তাড়া করেন। দরজায় ভিখিরি গেলে তেড়ে আসেন, রিকশাওলাকে কম পয়সা দিয়ে ঝগড়া বাধান—তারপর তাকে তাড়া করেন, ঝি-চাকরকে দু বেলা তাড়া করেন, বাড়ির কার্নিসে কাক বসলে তাকে–

টেনিদা এবার টুকুস করে আমার চাঁদিতে একটা গাঁট্টা বসিয়ে দিলে।

ওফ্‌—এই কুকুরটার মুখ তো কিছুতেই বন্ধ হয় না। আমরা ভিখিরি, না রিকশাওলা, না দাঁড়কাক, না ওঁর ঝি-চাকর? যাচ্ছি উবগার করতে, ভদ্রলোক আমাদের তেড়ে আসবেন? কী যে বলিস তার ঠিক নেই। পাগল, না পেট খারাপ?

প্যাটই খারাপ—হাবুল মাথা নেড়ে বললে, চিরকালটাই দেখতাছি প্যাট নিয়েই প্যালার যত ন্যাটা।

টেনিদা বললে, চুলায় যাক ওর পেট। এখানে বসে আর গুলতানি করে দরকার নেই–নাউ টু অ্যাঁকশন। চলো এবার বদ্রীবাবুর কাছেই যাওয়া যাক।

আমরা কেন এসেছি, বদ্রীবাবু সেকথা শুনলেন। প্যাঁচার মতো গম্ভীর মুখে মুড়ির বাটিটা একটু-একটু করে সাবাড় করলেন, শেষে আধখানা কাঁচা লঙ্কা কচমচ করে চিবিয়ে খেলেন। তারপর কোঁচায় মুখ মুছে বললেন, হুঁ।

টেনিদা বললে, কম্বলকে খোঁজবার জন্যে আপনি কী করছেন?

বদ্রীবাবু খ্যারখেরে মোটা গলায় বললেন, আমি আবার কী করব? কীইবা করার আছে আমার?

হাবুল বললে, হাজার হোক, পোলা তো আপনার ভাইপো—

নিশ্চয়।–বদ্রীবাবু মাথা নাড়লেন : আমার মা-বাপ মরা একমাত্র ভাইপো, আমারও কোনও ছেলেপুলে নেই। আমার প্রেস, পয়সাকড়ি–সবই সে পাবে।

তবু আপনি তাকে খুঁজবেন না?—টেনিদা জানতে চাইল।

কী করে খুঁজব?–বদ্রীবাবু হাই তুললেন।

কেন, কাগজে বিজ্ঞাপন তো দিতে পারেন।

কী লিখব? বাবা কম্বল, ফিরিয়া আইস? তোমার খুড়িমা তোমার জন্য মৃত্যুশয্যায়? ঠিকানা দাও—টাকা পাঠাইব? সে অত্যন্ত ঘোড়েল ছেলে। ঠিকানা দেবে, আমি টাকা পাঠাব—টাকাও সে নেবে, কিন্তু বাড়ি ফিরবে না।

কেন ফিরবে না?—আমি জিজ্ঞেস করলুম।

তার কারণ–বদ্রীবাবু একটা দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে দাঁতের গোড়া খুঁটতে খুঁটতে বললেন, দু-দুবার ক্লাস সেভেনে ফেল করায় আমি তার জন্যে যে-মাস্টার এনেছি, সে নামকরা কুস্তিগির। তার হাতের একটা রদ্দা খেলে হাতি পর্যন্ত অজ্ঞান হয়ে যায়। কম্বল স্বেচ্ছায় আসবে না। মাস্টার নিরুদ্দেশ না হলে তার উদ্দেশ মিলবে বলে আমার মনে হয় না।

আপনে থানায় খবর দিলেন না ক্যান?–হাবুল বললে, তারা ঠিক–

থানা?–বদ্রীবাবু একটা বুক-ভাঙা নিঃশ্বাস ফেললেন : মাস দুই আগে আমার প্রেসের কিছু টাইপ চুরি হয়ে গিয়েছিল, আমি থানায় গিয়েছিলুম। সঙ্গে ছিল কম্বল। দারোগা এজাহার নিচ্ছিলেন, টেবিলের তলায় তাঁর পেয়ারের কুকুরটা ঘুমুচ্ছিল। কম্বল নিচু হয়ে কী করছিল কে জানে, কিন্তু হঠাৎ একটা বিটকেল কাণ্ড ঘটে গেল। বিকট সুরে ঘ্যাও-ঘ্যাও আওয়াজ ছেড়ে কুকুরটা একলাফে টেবিলে উঠে পড়ল, আর এক লাফে চড়ল একটা আলমারির মাথায়, সেখান থেকে একরাশ ধুলোভরা ফাইল নিয়ে নীচে আছড়ে পড়ে গেল। একজন পুলিশ তাকে ধরতে যাচ্ছিল–ঘোয়ঙ বলে তাকে কামড়ে দিয়ে ঘাঁকে ঘ্যাঁকা বলে চেঁচাতে-চেঁচাতে দরজা দিয়ে তীরবেগে বেরিয়ে গেল কুকুরটা। সে এক বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার। এজাহার চুলোয় গেল, থানায় হুলুস্থুল কাণ্ড—পাকড়ো পাকড়ো বলে দারোগা কুকুরের পেছনে ছুটলেন। কী হয়েছিল জানো?

বদ্রীবাবু একটু থেমে আমাদের মুখের দিকে তাকালেন। ক্যাবলা বললে, কী হয়েছিল?

কম্বল পকেটে হোমিওপ্যাথিক শিশিতে ভর্তি করে লাল পিঁপড়ে নিয়ে গিয়েছিল আর সেগুলো ঢেলে দিয়েছিল কুকুরটাকে কানে। দারোগা কম্বলকে ঠাস ঠাস করে কয়েকটা চড় দিয়ে বলেছিলেন, ভবিষ্যতে তাকে কিংবা আমাকে থানার কাছাকাছি দেখলেও পুরোপুরি সাতদিন হাজতে পুরে রেখে দেবেন।

টেনিদা বললে, আপনার কী দোষ? আপনি তো আর কুকুরের কানে পিঁপড়ে দেননি। কিন্তু দারোগার ধারণা, মন্ত্রটা আমিই দিয়েছি কম্বলের কানে। অভিভাবকের কাছ থেকেই। তো ছেলেমেয়ে শিক্ষা পায়।

না, তা হলে আপনার থানার যাবার পথ বন্ধ—টেনিদা মাথা নাড়ল, আচ্ছা, আমরা যদি আপনার হয়ে—

বাধা দিয়ে বদ্রীবাবু বললেন, কিছু করতে হবে না। আমি জানি, কম্বলকে আর পাওয়া যাবে না। সে যেখানে গেছে, সেখান থেকে আর ফিরে আসবে না।

কী সর্বনাশ!–আমি আঁতকে বললুম, মারা গেছে নাকি?

মারা যাওয়ার পাত্র সে নয়।বদ্রীবাবু কান থেকে একটা বিড়ি নামিয়ে ফস করে সেটা ধরালেন : সে গেছে দূরে বহু দূরে।

হাবুল বললে, কই গেছে? দিল্লি?

দিল্লি!–বদ্রীবাবু বললেন, ফুঃ।

তবে কোথায়?—টেনিদা বললে, বিলেতে? আফ্রিকায়?

এক মুখ বিড়ির ধোঁয়া ছড়িয়ে বদ্রীবাবু বললেন, না, আরও দূরে। ছেলেবেলা থেকেই তার সেখানে যাওয়ার ন্যাক ছিল। সে গেছে চাঁদে।

কী বললেন?—চারজনেই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলুম আমরা।

বললুম–কম্বল চাঁদে গেছে—এই বলে বদ্রীবাবু আমাদের ভ্যাবাচ্যাকা মুখের ওপর একরাশ বিড়ির ধোঁয়া ছড়িয়ে দিলেন।

০২. বদ্রীবাবুর কথা শুনে

আমরা চারজন বদ্রীবাবুর কথা শুনে পরোটার মত মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলুম, আর টেনিদার উঁচু নাকটা ঠিক একটা ডিম-ভাজার মতো হয়ে গেল। বদ্রীবাবু আমাদের ঠাট্টা করছেন কি না বুঝতে পারলুম না। কিন্তু অমন হাঁড়ির মতো যাঁর মুখ আর বিতিকিচ্ছিরি তিরিক্ষি যাঁর মেজাজ—এই ঝুপসি প্রেসটার ভেতরে একটা হুতোম প্যাঁচার মতো বসে বসে আর কচর মচর করে করে মুড়ি চিবুতে চিবুতে তিনি আমাদের ঠাট্টা করবেন, এটা কিছুতেই বিশ্বাস হল না।

ঠিক সেই সময় প্রেসের দিকে, বদ্রীবাবুর রান্নাঘর থেকে কড়া রসুন আর লঙ্কার ঝাঁঝের সঙ্গে উৎকট গন্ধ ভেসে এল একটা, খুব সম্ভব শুঁটকী মাছ। সেগন্ধ এমনি জাঁদরেল যে আমরা চার জন্যেই এক সঙ্গে লাফিয়ে উঠলুম—আমাদের ঘোর কেটে গেল।

টেনিদা একবার মাথা চুলকে বললেন, আপনি ঠিক বলছেন স্যার, কম্বল চাঁদেই—

বদ্রীবাবু বললেন, আই অ্যাম শিয়োর।

ক্যাবলা তার চশমার ভেতর দিয়ে প্যাট প্যাট করে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। গত বছর চশমা নেবার পর থেকেই ওকে খুব ভারিক্কি গোছের দেখায়। মুরুবিয়ানার ভঙ্গিতে বললে, আপনি এত শিয়োর হলেন কী করে, জানতে পারি কি? যেচাঁদে রাশিয়ানরা এখনও যেতে পারল না, আমেরিকানরাও আজ পর্যন্ত–

ওরা না পারলেও কম্বল পারে-সংক্ষেপে জবাব দিলেন বদ্রীবাবু।

রান্নাঘর থেকে শুঁটকী মাছের সেই বিকট গন্ধটা আসছিল, তাতে নাক টাক কুঁচকে বেজায় রকম একটা হাঁচতে যাচ্ছিল হাকুল। কী কায়দায় যে ও হচিটাকে সামলে নিলে আমি জানি না। বিচ্ছিরি মুখ করে কেমন একটা ভুতুড়ে গলায় জিজ্ঞেস করলে : ডানা আছে বুঝি কম্বলের? উইড়া যাইতে পারে?

আমি ঠিক বলতে পারব না। বদ্রীবাবু ভাবুকের মতো ঘাড় নাড়তে লাগলেন : তবে ও যা ছেলে, ওর এত দিনে যে ডানা গজায়নি এ কথাও আমি বিশ্বাস করি না। খুব সম্ভব জামার তলায় ওর ডানা লুকনো থাকত—আমি দেখতে পাইনি।

তা হলে আপনি বলছেন, টেনিদা খাবি খেয়ে বললে, সেই ডানা মেলে কম্বল পরীদের মতো উড়ে গেছে?

এগজ্যাকটলি।

ক্যাবলা বিড়বিড়িয়ে বললে, গাঁজা। ক্লিন গাঁজা।

তুমি ওখানে হুড়মুড় করে কী বলছ হে ছোকরা? বদ্রীবাবুর চোখ চোখা হয়ে উঠল, বেশ কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন : কী বকছ—অ্যাাঁ?

কিছু না স্যার কিছু না। হাবুল সেন চটপট সামলে নিলে : কইতাছিল—আহা, কী মজা।

মজা বই কি, দারুণ মজা, বদ্রীবাবু প্যাঁচার মতো প্যাঁচালো মুখে এবার এক টুকরো হাসি দেখা দিল : জানো, ছেলেবেলা থেকেই ওর চাঁদের দিকে ঝোঁক। পাঁচ বছর বয়সে আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ দেখে চাঁদ খাব, চাঁদ খাব বলে পেল্লায় চিক্কার জুড়ল রাত দুটো পর্যন্ত পাড়ার লোকে ঘুমুতে পারে না। শেষে পুরো একখানা পাটালি খাইয়ে ওকে থামাতে হয়। বারো বছরের সময় চাঁদ ধরবার জন্যে একটা নিমগাছে উঠে বাদুড়ের ঠোকর খেয়ে পানা পুকুরের ভেতরে পড়ে গিয়েছিল—ভাগ্যিস বেশি জল ছিল না, তাই রক্ষে। তারপর বড় হয়ে চাঁদা আদায় করতে ওর কী উৎসাহ! সরস্বতী পুজো হোক, ঘেঁটু পুজো হোক আর ঘণ্টাকর্ণ পুজোই। হোক—চাঁদার নাম শুনলেই স্রেফ নাওয়া-খাওয়া ভুলে যায়। সেই জন্যেই বলছিলুম, চাঁদ সম্পর্কে ওর বরাবরই একটা ন্যাক আছে।

চাঁদার ব্যাপারে ন্যাক অনেকেরই থাকে, সেটা কিছু নতুন কথা নয়—টেনিদা একবার গলাখাঁকারি দিলে : কিন্তু আমরা যদি কম্বলকে খুঁজে বের করতে পারি, আপনার কোনও আপত্তি আছে বদ্রীবাবু?

খুঁজে বের করতে পারলে আপত্তি নেই, না পারলেও আপত্তি নেই। বদ্রীবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, কিন্তু পয়সাকড়ি কিছু দিতে পারব না। তোমরা যে গোয়েন্দাগিরির ফী চেয়ে বসবে সেটি হচ্ছে না। সেইটে বুঝে তাকে চাঁদ থেকেই ধরে আনন, কিংবা চাঁদোয়ার ওপর থেকেই টেনে নামাও।

আজ্ঞে কিছুই দিতে হবে না, টেনিদা আরও গম্ভীর হয়ে বললে, একটি পয়সাও খরচ করতে হবে না আপনাকে। শুধু একটু সাহায্য করতে হবে অন্য ভাবে।

পয়সা খরচ না হলে আমি সব রকম সাহায্যেই রাজি আছি তোমাদের। এবার বেশ উৎসাহিত দেখা গেল বদ্রীবাবুকে : বলল, কী করতে হবে?

টেনিদা একবার ক্যাবলার দিকে তাকাল। বললে, ক্যাবলা।

ইয়েস লিডার।

আমরা বদ্রীবাবুর কাছ থেকে কী সাহায্য পেতে পারি?

ক্যাবলা বললে, উনি আমাদের কিছু দরকারি ইনফর্মেশন দিতে পারেন।

জেনে নাও। টেনিদা এর মধ্যেই বদ্রীবাবুর সামনে একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়েছিল। এবারে গম্ভীর হয়ে পা নাচাতে লাগল।

ক্যাবলা তার চশমাপরা ভারিক্কি মুখে এমন ভাবে চারদিকে তাকাল যে ঠিক মনে হল, যেন ইনসপেক্টর স্কুল দেখতে এসেছেন। তারপর মোটা গলায় বললে, আচ্ছা বদ্রীবাবু!

হুঁ।

নিরুদ্দেশ হওয়ার আগে আপনি কোনও রকম ভাবান্তর লক্ষ করেছিলেন কম্বলের?

ক্যাবলার সেই দারুণ সিরিয়াস ভঙ্গি আর মোটা গলা দেখে আমার তাজ্জব লেগে গেল। হাঁ, পুলিশে ঠিক এমনি ভাবেই জেরা-টো করে বটে। এমন কি, বদ্রীবাবুও যেন ঘাবড়ে গেলেন খানিকটা।

ইয়ে-ভাবান্তর—মানে হ্যাঁ, একটু ভাবান্তর হয়েছিল বই কি। অমন একখানা জাঁদরেল মাস্টার দেখলে কেই বা খুশি হয় বলো। তার একটা ঘুষিতেই কম্বল তেঁতুলের অম্বল হয়ে যেত।

আমি জিজ্ঞেস করলুম, তা হলে ঘুষি কম্বল খায়নি?

খেপেছ তুমি। বদ্রীবাবু মুখ বাঁকালেন : খেলে কি আর চাঁদে যেত? স্বর্গে পৌঁছুত তার আগে। আসলে মাস্টার প্রথম দিন এসে খুব শাসিয়ে গিয়েছিল। বলেছি, কাল এসে যদি দেখি যে পড়া হয়নি, তা হলে পিটিয়ে তোকে ছাতু করে দেব।

হাবুল বললে, অবুঝেছি। পলাইয়া আত্মরক্ষা কোরছে।

তা, ওভাবেও বলতে পারো কথাটা। পালিয়েছে মাস্টারের ভয়েই, তাতে সন্দেহ নেই।

বদ্রীবাবু হাবুলের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হলেন : এবং পালিয়ে সে চাঁদে গেছে।

টেনিদা দারুণ বিরক্ত হয়ে বললে, দেখুন বদ্রীবাবু, সব জিনিসের একটা লিমিট আছে। চাঁদে গেলেই হল—ইয়ার্কি নাকি? আর এত লোক থাকতে কম্বল? সব জিনিস পাটালি খাওয়া নয়, তা মনে রাখবেন।

বদ্রীবাবু বললেন, আমি প্রমাণ ছাড়া কথা বলি না।

বটে—আমার ভারি উৎসাহ হল : কী প্রমাণ পেয়েছেন? টেলিস্কোপ দিয়ে চাঁদের ভেতরে কম্বলকে লাফাতে দেখেছেন নাকি?

টেলিস্কোপ আমার নেই। বদ্রীবাবু হাই তুলে বললেন, কিন্তু যা আছে তা এই প্রমাণই যথেষ্ট বলে বদ্রীবাবু একটুকরো কাগজ বাড়িয়ে দিলেন আমাদের সামনে।

একসারসাইজ বুকের পাতা ছিঁড়ে নিয়ে তার ওপর শ্রীমান কম্বল তাঁর দেবাক্ষর সাজিয়েছেন। প্রথমে মনে হল, কতগুলো ছাতারে পাখি এঁকেছে বোধহয়। তারপরে ক্রমে ক্রমে পাঠোদ্ধার করে যা দাঁড়াল, এই রকম :

আমি নিরুদ্দেশ। দূরে বহু দূরে চলিলাম। লোটা কম্বলও লইলাম না! আর ফিরিব। ইতিকম্বলচন্দ্র।

এই চিঠির নীচে আবার কতকগুলো সাংকেতিক লেখা :

চাঁদ—চাঁদনি–চক্রধর। চন্দ্রকান্ত নাকেশ্বর। নিরাকার মোষের দল। ছল ছল খালের জল। ত্রিভুবন থর-থর। চাঁদে চড়—চাঁদে চড়।

সেগুলো পড়ে আমরা তো থ।

বদ্রীবাবু মুচকি হেসে বললেন, কেমন, বিশ্বাস হল তো? চাঁদে চড়—চাঁদে চড়, নির্ঘাত চড়ে বসেছে। এমন কি, ইতি লিখে চন্দ্রবিন্দু দিয়েছে নামের আগে, দেখতে পাচ্ছ না? তার মানে কী? মানে-স্বর্গীয় হয়নি, চন্দ্রলোকে—

ক্যাবলা বললে, হুঁ, নিশ্চয় চন্দ্রলোকে। তা আমরা এই লেখাটার একটা কপি পেতে পারি?

নিশ্চয়-নিশ্চয়। তাতে আর আপত্তি কী!

ক্যাবলার হাতের লেখা ভালো, সেই ওটা টুকে নিলে। তারপর উঠে দাঁড়াল টেনিদা।

তা হলে আসি আমরা। কিছু ভাববেন না বদ্রীবাবু। শিগগিরই কম্বলকে আপনার হাতে এনে দেব।

এনে দিতেও পারো, না দিলেও ক্ষতি নেইবদ্রীবাবু হাই তুললেন : সত্যি বলতে কী, ওটা এমনি অখাদ্য ছেলে যে আমার ওর ওপরে অরুচি ধরে গেছে। কিন্তু একটা কথা জিজ্ঞেস করব! তোমরা কম্বলকে খুঁজে বের করতে চাও কেন? সে কি তোমাদের কারও কিছু নিয়ে সটকান দিয়েছে?

টেনিদা বললে, আজ্ঞে না, কিছুই নেয়নি। আর নেবার ইচ্ছে থাকলেও নিতে পারত না—আমরা অত কাঁচা ছেলে নই। কম্বলকে আমরা খুঁজতে বেরিয়েছি নিতান্তই নিঃস্বার্থ পরোপকারের জন্যে।

পরোপকারের জন্যে! এ-যুগেও ওসব কেউ করে নাকি? বদ্রীবাবু খানিকক্ষণ হাঁ করা কাকের মতো চেয়ে রইলেন আমাদের দিকে : তোমরা তো দেখছি সাংঘাতিক ছেলে। তা ভবিষ্যতে গুড ক্যারাক্টারের সার্টিফিকেট দরকার থাকলে এসো আমার কাছে, আমি খুব ভালো করে লিখে দেব।

আজ্ঞে, আসব বই কি–ক্যাবলা খুব বিনীতভাবে একথা বলবার পর আমরা বদ্রীবাবুর প্রেস থেকে বেরিয়ে এলুম। রাস্তায় নেমে কেলব কয়েক পা হেঁটেছি, এমন-সময়—

বোঁ-ও-ও

টেনিদার ঠিক কান ঘেঁষে কামানের গোলার মতো একটা পচা আম ছুটে বেরিয়ে গেল—ফাটল গিয়ে সামনে ঘোষেদের দেওয়ালে। খানিকটা দুর্গন্ধ কালচে রস পড়তে লাগল দেওয়াল বেয়ে। ওইটে টেনিদার মাথায় ফাটলে আর দেখতে হত না—নির্ঘাত নাইয়ে ছাড়ত।

তক্ষুনি আমরা বুঝতে পারলুম, কম্বলের নিরুদ্দেশ হওয়ার পেছন আছে কোনও গভীর চক্রান্তজাল, আর এরই মধ্যে আমাদের ওপর শত্রুপক্ষের আক্রমণ শুরু হয়েছে।

 ০৩. আমরা দাঁড়িয়ে পড়লুম

আমরা দাঁড়িয়ে পড়লুম। তারপর টেনিদা মোটা গলায় বললে, হুঁ, উড়ম্বর।

উড়ম্বর?—আমি অবাক হয়ে বললুম, তার মানে কী?

মানে উড়ন্ত আক্রমণ—অম্বর হইতে। টেনিদা আরও গম্ভীর হয়ে বললে।

ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস হতেই পারে না। আর অম্বর হইতে উড়ন্ত আক্রমণ—এ কিছুতেই উড়ম্বরের ব্যাসবাক্য নয়। তাছাড়া উড়ম্বর মানে—

শাটাপ-তক্কো করবি না আমার সঙ্গে। টেনিদা দুমদাম করে পা ঠুকল : আমি যা বলব তাই কারেকট, তাই গ্রামার। আমি যদি ক্যাবলা মিত্তির সমাস করে বলি, মিত্তির হইয়াছে যে ক্যাবলাসুপসুপা সমাস, তা হলে কে প্রতিবাদ করে তাকে একবার আমি দেখতে চাই।

বেগতিক বুঝে ক্যাবলা চশমাসুদ্ধ নাকটাকে আকাশের দিকে তুলে চিল-ফিল কী সব দেখতে লাগল, কোনও জবাব দিলে না। হাবুল সেন বললে, না, তারে দ্যাখতে পাইবা না। গাঁট্টা খাওনের লাইগা কারই বা চাঁদি সুড় সুড় কোরতেছে? কী কস প্যালা, সৈত্য কই নাই?

আমি হাবুলের মতোই ঢাকাই ভাষায় জবাব দিলুম, হঃ, সৈত্যই কইছস।

টেনিদা বললে, না, এখন বাজে কথা নয়। গোড়াতেই দেখছি ব্যাপার বেশ পুঁদিচ্চেরিমানে, দস্তুরমতো ঘোরালো। অথাৎ কম্বল মাস্টারের থাপ্পড়ের ভয়েই পালাক আর চাঁদে চড়বার চেষ্টাই করুক, সে নিশ্চয় কোনও গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে। তা না হলে একটা পচা আম অমন ভাবে আমার কান তাক করে ছুটে আসত না। বুঝেছিস, ওটা হল ওয়ার্নিং। যেন বলতে চাইছে, টেক কেয়ার, কম্বলের ব্যাপারে তোমরা নাক গলাতে চেয়ো না।

আমি বললুম, তা হলে আমটা ছুঁড়ল কে?

টেনিদা একটা উচ্চাঙ্গের হাসি হাসল, যাকে বাংলায় বলে হাই ক্লাস। তারপরে নাকটাকে কী রকম একটা ফুলকপির সিঙাড়ার মতো চোখা করে বললে, তা যদি এখুনি জানতে পারতি রে প্যালা, তা হলে তো রহস্যকাহিনীর প্রথম পাতাতেই সব রহস্য ভেদ হয়ে যেত। যেদিন কম্বলকে পাকড়াতে পারব, সেদিন আম কে ছুঁড়েছে তা-ও বুঝতে বাকি থাকবে না।

বললুম, আচ্ছা, ছাতে ওই যে কাকটা বসে রয়েছে, ওর মুখ থেকেও তো হঠাৎ আমটা—

ক্যাবলা বললে, বাজে বকিসনি। কাকে এক-আধটা আমের আঁটি ঠোঁটে করে হয়তো নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু অত বড় একটা আম তুলতে পারে কখন? আর মনে কর, যদি ওই কাকটাকে ওয়েট লিফটিং চ্যাম্পিয়ন—মানে ওদের মধ্যেই ধরা যায়, তা হলেও কি আমটা ও বুলেটের মতো ছুঁড়ে দিতে পারে?

হাবুল ঘাড় নেড়ে বললে– যে কাগটা আম ফেইক্যা মারছে, সে হইল গিয়া ডিসকাস-থোয়িং-এর চ্যাম্পিয়ান।

টেনিদা হঠাৎ হাত বাড়িয়ে আমার আর হাবুলের মাথা কটাং করে একসঙ্গে ঠুকে দিলে। খুব খারাপ মুখ করে বললে, আরে গেল যা। এদিকে দিবা-দ্বিপ্রহরে কলকাতা শহরে আমার ওপর শত্রুর আক্রমণ আর এ দুটোতে সমানে কুরুবকের মতো বক বক করছে। শোন—একটাও আর বাজে কথা নয়। আমটা যে আমার দিকেই তাক করে ছোড়া হয়েছে। তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কোন্ বাড়ি থেকে ছুঁড়েছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু খামকা আমার সঙ্গে লাগতে সাহস করবে, এমন বুকের পাটাও এ-পাড়ায় কারও নেই। টেনি শমাকে সকলেই চেনে। অতএব প্রতিপক্ষ অতিশয় প্রবল। সেইজন্যে মনে হচ্ছে, এখন। পচা আম পড়েছে, একটু পরে ধপাৎ করে একটা পেঁপেও পড়তে পারে। আর বড় সাইজের তেমন-তেমন একখানা পেঁপে যদি হয়, তা হলে সে চিজ যারই মাথায় পড়ক, আমরা কেউই অনাহত থাকব না।

হাবুল সেন বললে, আর দশ কিলো ওজনের একখানা পচা কাঁঠাল পড়লে সকলেরেই ধরাশায়ী কইর‍্যা দিব। যদি আত্মরক্ষা কোরতে চাও, অবিলম্বে এইখান থিক্যা পৃষ্ঠ প্রদর্শন কর।

যুক্তিটা অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী, আমরা আর দাড়ালুম না। চটপট পা চালিয়ে একেবারে চাটুজ্যেদের রকে।

টেনিদা কি বলতে যাচ্ছিল, ক্যাবলা বললে, না—এখানে নয়। রাস্তার ধারে বসে কোনও সিরিয়াস আলোচনা করা যায় না। চলো আমাদের বৈঠকখানায়। বাবা টুরে বেরিয়েছেন, কাকা গেছেন দিল্লিতে, বেশ নিরিবিলিতে বসে সব প্ল্যান ঠিক করা যাবে।

প্রস্তাবে আমরা একবাক্যে রাজি হয়ে গেলুম। সত্যিই তো, এখন আমাদের খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হবে। শত্রুর চর সব সময় আমাদের গতিবিধির ওপর লক্ষ রাখছে কি না, কিছুই তো বলা যায় না। তা ছাড়া ক্যাবলার মা নানারকম খাবার করতে ভালোবাসেন, খাওয়াতেও ভালোবাসেন তাঁকেও তো একটু খুশি করা দরকার।

তা খাওয়াটা মন্দ জমল না। ক্যাবলার মা কেক তৈরি করছিলেন, গরম গরম আমাদের কেটে এনে দিলেন। হট কেকের সঙ্গে চাটা খেয়ে আমাদের মেজাজ খুলে গেল।

টেনিদা আমাদের লিডার বটে, কিন্তু সে অ্যাঁকশনের সময়। মাথা ঠাণ্ডা করে বুদ্ধি জোগাবার বেলায় ওই খুদে চেহারার ক্যাবলা মিত্তির। তা না হলে কি আর টপাটপ পরীক্ষায় স্কলারশিপ পায়!

ক্যাবলা প্রথমেই পকেট থেকে কম্বলের লেখার সেই নকলটা বের করল।

—টেনিদা, এই লেখাটার মধ্যে একটা সূত্র আছে মনে হয়।

টেনিদা বললে, আহা, সূত্র তো বটেই। পরিষ্কার লিখছে, নিরুদ্দেশ হচ্ছি। মাস্টারের ঠ্যাঙানি খাওয়ার ভয়ে যেদিকে হোক লম্বা দিয়েছে। কিন্তু কম্বলের মতো একটা অখাদ্য জীব চাঁদে গেছে, এ হতেই পারে না। আমি কখনও বিশ্বাস করব না—তা বদ্রীবাবুই বলুক আর কেদারবাবুই বলুক।

ক্যাবলা হিন্দী করে বললে, এ জী, জেরা ঠহরো না। আরে চাঁদ-উদ ছোড় দো, উতো বিলকুল দিল্লাগী মালুম হচ্ছে আমার, নীচের লেখাগুলোই একটু ভালো করে দেখা দরকার। ওদের কোনও মানে আছে।

আমি বললুম, ওই চাঁদ-চাঁদনিচক্রধর? তোর মাথা খারাপ হয়েছে ক্যাবলা। ওগুলো স্রেফ পাগলামি, ওদের কোনও মানেই হয় না।

বেশি ওস্তাদি করিসনি প্যালা, আমি কী বলছি তাই শোন। কম্বলকে আমরা সকলেই জানি। তার বিদ্যেবুদ্ধির দৌড়ও আমাদের অজানা নয়। সেদিনও সে আমায় জিজ্ঞেস করছিল, ইটালীর মুসোলিনী কি বেলাঘাটার মৃণালিনী মাসিমার বড় বোন? তার হাতের লেখা দেখলে উর্দু কিংবা কানাড়ী বলে মনে হতে থাকে। বন্ধুগণ একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে, যাকে স্রেফ পাগলামি বলে মনে হচ্ছে, তা হল লাইনের একটি কবিতা। তাতে ছন্দ আছে, মিলও আছে। কম্বলের সাধ্যও নেই ওভাবে ছন্দ মিলিয়ে, মিল রেখে, ছটা লাইন দাঁড় করায়।

হাবুল মাথা নাড়ল : হ, বুঝছি। আর কেউ লেইখ্যা দিছে।

ঠিক, আর কেউ দিয়েছে। কিন্তু খামকা লিখতে গেল কেন? নিশ্চয়ই ওর একটা মানে আছে।ক্যাবলা কাগজটা খুলে ধরে পড়তে লাগল : চাঁদ-চাঁদনিচক্রধর। চন্দ্রকান্ত নাকেশ্বর। নিরাকার মোষের দল—আচ্ছা টেনিদা?

টেনিদা বললে, ইয়েস।

আমার মাথায় প্ল্যান এসেছে একটা। একবার চাঁদনির বাজারে যাবে।

চাঁদনির বাজার!—আমরা তিনজনে একসঙ্গে চমকে উঠলুম। টেনিদা নাক কুঁচকে, মুখটাকে শোনপাপড়ির মতো করে বললে, কী জ্বালা, চাঁদনির বাজারে যেতে যাব কেন?

ক্যাবলা আরও বেশি গম্ভীর হল।

ধরো, সেখানে যদি চক্রধরকে পেয়ে যাই? কিংবা কে জানে চন্দ্ৰকান্তের সঙ্গেই দেখা হয়ে যেতে পারে হয়তো।

নাকেশ্বর বইস্যা থাকতে পারে—কেডা কইব?—হাবুল জুড়ে দিলে।

সবই হতে পারে-ক্যাবলা বললে, চলো না টেনিদা, ঘুরেই আসি একটু। যদি কোনও খোঁজ না-ই পাওয়া যায়, তাতেই বা ক্ষতি কী। ছুটির দিন, একটু বেড়িয়েই নয় আসা যাবে।

কিন্তু বেড়াবি কোথায়?—টেনিদা বিরক্ত হল : চাঁদনি তো আর একটুখানি জায়গা নয়। সেখানে চক্রধর বলে কেউ যদি থাকেই, তাকে কী করে খুঁজে পাওয়া যাবে?

এক পাল খড়ের ভেতর থেকে গোয়েন্দারা ছুঁচ খুঁজে বের করতে পারে, আর চাঁদনি থেকে একটা লোককে আমরা খুঁজে পাব না? এই কি আমাদের লিডারের মতো কথা হল? ছি-ছি, বহুৎ শরম কি বাত!

আর বলতে হল না তড়াক করে টেনিদা লাফিয়ে উঠল : চল তা হলে, দেখাই যাক একবার।

আমরা বেরিয়ে পড়লুম। চীনেবাদাম খেতে খেতে যখন চাঁদনির বাজারে যাওয়ার জন্যে ট্রাম চাপলুম, তখনও আমরা কেউ ভাবিনি যে সত্যি-সত্যিই আমরা এবার একটা রহস্যের খাসমহলের সামনে গিয়ে দাঁড়াব। আমাদের সামনে এমন দুরন্ত অভিযান ঘনিয়ে আসবে।

চাঁদনির বাজারে ঢুকে টেনিদা কেবল এক ভদ্রলোককে বোকার মতো জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, মশাই, এখানে চক্রধর বলে কেউ-হঠাৎ হাবুল থাবা মেরে তাকে থামিয়ে দিলে। বললে– টেনিদা—টেনিদা—ওই যে! লুক দেয়ার!

একটি ছোট সাইনবোর্ড। ওপরে বড়বড় অক্ষরে : শ্রীচক্রধর সামন্ত। মৎস ধরিবার সর্বপ্রকার সরঞ্জাম বিক্রেতা। পরিক্ষা প্রার্থনীয়।

অবশ্য মৎস্যে য-ফল্য নেই, তাছাড়া লেখা রয়েছে পরিক্ষা প্রার্থনীয়। কিন্তু তখন বানান ভুল ধরার মতো মনের অবস্থা ক্যাবলার মতো পণ্ডিতেরও নেই। আমরা চারজনেই হাঁ করে সাইনবোর্ডটার দিকে চেয়ে রইলুম কেবল।

 ০৪. সাইনবোর্ডে যতই বানান ভুল থাক

সাইনবোর্ডে যতই বানান ভুল থাক, মানে মৎসই লিখুক আর পরিক্ষাই চালিয়ে দিক, আসল ব্যাপার হল : এটা চাঁদনির বাজার আর চক্রধর সামন্তের দোকান একেবারে সামনেই রয়েছে। অর্থাৎ কবিতাটার প্রথম দু লাইনের মানে এখানেই পাওয়া যাচ্ছে যে।

হাবুল বললে, টেনিদা, অখন কী করন যাইব?

ক্যাবলা বললে, করবার কাজ তো একটাই রয়েছে। অর্থাৎ এখন সোজা ওখানে গিয়ে চক্রধর সামন্তের সঙ্গে দেখা করতে হবে।

আমি জিজ্ঞেস করলুম, দেখা করে কী বলবি?

টেনিদা পেছন থেকে আমার মাথায় টুক করে একটা গাঁট্টা বসিয়ে দিলে : চক্রধর সামন্তকে বাড়িতে নেমন্তন্ন করে লুচি-পোলাও খাইয়ে দিবি। দেখা করে কী আবার বলব? পরিষ্কার জানতে চাইব, এই কবিতাটার মানে কী, আর শ্রীমান কম্বল কোথায় আছেন।

ক্যাবলা ছুটে গিয়ে বললে, হুঁ, তাহলেই সব কাজ চমৎকার ভাবে পণ্ড হতে পারবে। কম্বলকে যদি এরাই কোথাও লুকিয়ে রেখে থাকে, সঙ্গে সঙ্গেই হুঁশিয়ার হয়ে যাবে। হয়তো কম্বলকে আমরা আর কোনওদিন খুঁজেই বের করতে পারব না।

হাবুল বললে, না পাইলেই বা কী হইব। সেই পোলাখান না? সে হইল গিয়া এক। নম্বরের বিচ্ছু। তারে ধইর‍্যা যদি কেউ চান্দে চালান কইর‍্যা দেয়, দুই দিনে চান্দের গলা দিয়াও কান্দন বাইরাইব।

টেনিদা ধমকে বললে, তুই থাম। কম্বল যত অখাদ্য ছেলেই হোক, তার কাকার কাছে আমরা তাকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য, মানে ডিউটি বাউন্ড। তারপর বদ্রীবাবু পিটিয়ে কম্বলের ধুলো ওড়ান কি কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়েই পড়ন—সে তিনিই বুঝবেন। কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে আর কতক্ষণ বকবক করব আমরা? কিছু একটা করতে তো হবে।

ক্যাবলা বলল, আলবাত করতে হবে। চলো, আমরা মাছধরার ছিপ-সুতো এই সব খোঁজ করিগে।

আমি চ্যাঁ-চ্যাঁ শব্দে প্রতিবাদ করে বললুম, আমি কিন্তু ছিপ সুতো নিয়ে বাড়ি যাব না। মেজদা তা হলে আমার কান কেটে নেবে।

তোর কান কেটে নেওয়াই উচিত-চশমার ভেতর দিয়ে আমার দিকে কটকটিয়ে তাকাল ক্যাবলা : আরে বোকারাম, ছিপসুতো কিনছে কে? আমরা এটা-ওটা বলে হালচাল বুঝে নেব।

টেনিদা খুব মুরব্বীর মতো বললে, প্যালা আর হাবলাকে নিয়েই মুস্কিল। এ-দুটোর তো মাথা নয়—যেন এক জোড়া খাজা কাঁটাল। কী বলতে কী বলবে আর সব মাটি হয়ে যাবে। শোন, তোরা দুজন একেবারে চুপ করে থাকবি, বুঝেছিস? যা বলবার আমরাই বলব—মানে আমি আর ক্যাবলা। মনে থাকবে?

আমরা গোঁজ হয়ে ঘাড় নাড়লুম। মনে থাকবে বই কি। এদিকে কিন্তু ভীষণ রাগ হচ্ছিল টেনিদার ওপর। বলতে ইচ্ছা করছিল, আমাদের মাথা নয় খাজা কাঁটাল, আর তোমার? পণ্ডিত মশাই বলতেন না, বৎস টেনিরাম, ওরফে ভজহরি, জগদীশ্বর কি তোমার স্কন্ধের উপর মস্তকের বদলে একটি গোময়ের হাঁড়ি বসাইয়া দিয়াছেন? রাগ হলেই তাঁর মুখ দিয়ে সাধুভাষা বেরিয়ে আসত।

সে যাই হোক, আমরা তো চক্রধর সামন্তের দোকানে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেখানে আঠারো-উনিশ বছরের একটা ছেলে খাকী হাফপ্যান্ট আর হাতকাটা গেঞ্জি পরে একটা শালপাতার ঠোঙা থেকে তেলেভাজা খাচ্ছিল।

আমাদের দেখেই বেগুনি চিবুতে চিবুতে জিজ্ঞেস করলে, কী চাই?

ক্যাবলা বললে, আমরা ছিপ কিনব।

ওই তো রয়েছে, পছন্দ করুন না বলে সে আবার একটা আলুর চপে কামড় বসাল। বেশ বোঝা যাচ্ছিল, ছিপ বিক্রি করার চাইতে তেলেভাজাতেই মনোযোগ তার বেশি।

আপনিই বুঝি চক্রধরবাবু?—টেনিদা ভারি নরমনরম গলায় ভাব করবার মতো করে জানতে চাইল।

আমি চক্রধরবাবু হতে যাব কেন?—আলুর চপের ভেতরে একটা লঙ্কা চিবিয়ে ফেলে বিচ্ছিরি মুখ করল ছেলেটা :

তিনি তো আমার মামা।

ক্যাবলা বললে, ঠিক-ঠিক। তাই চক্রধরবাবুর মুখের সঙ্গে আপনার মুখের মিল আছে! ভাগনে বলেই।

ভাগনে এবার চটে উঠল, শুনে আলুর চপের মতো ঘোরালো হয়ে উঠল তার মুখ। খ্যাঁকখ্যাঁক করে বললে, কীকার মুখের সঙ্গে মিল আছে বললেন? চক্ৰধরের? সে সাত পুরুষে আমার মামা হতে যাবে কেন? গাঁয়ের লোকে তাকে মামা বলে—আমিও বলি। আমার মুখ তার মতো ভীমরুলের চাকের মতো? আমার কপালে তার মতো আব আছে? আমার রং তার মতো কটকটে কালো? আমার নাকের তলায় একটা ঝোল্লা গোঁফ দেখতে পাচ্ছেন?

ক্যাবলার মতো চটপটে ছেলেও কী রকম ঘাবড়ে গেল এবার। বার দুই বিষম খেলে।

মানে—এই ইয়ে—

ইয়ে-টিয়ে নেই। ছিপ কিনতে এসেছেন কিনুন, নইলে ঝাঁ করে সরে পড়ুন এখান থেকে। খামকা যা তা বলে মেজাজ খারাপ করে দেবেন না স্যার।

সে তো বটেই, সে বটেই।—টেনিদা মাথা নাড়ল : ওর কথা ছেড়ে দিন মশাই, ওটা কী বলে ইয়ে মানে নেহাত নাবালক। আপনার মুখখানা—মানে—ঠিক চাঁদের মতো—অর্থাৎ কিনা চন্দ্রকান্ত বাবুও বলা যায় আপনাকে।

আমার নাম হলধর জানা।–বলেই সে হঠাৎ কী রকম চমকে উঠল : কী নাম বললেন? চন্দ্রকান্ত?

টেনিদা ফস করে বলে বসল : নিশ্চয় চন্দ্রকান্ত। এমন কি আপনার টিকোলো নাক দেখে নাকেশ্বর বলতেও ইচ্ছে করছে।

কী বললেন? নাকেশ্বর? চন্দ্রকান্ত-নাকেশ্বর?—হলধর জানা তেলেভাজার ঠোঙাটা মুড়ে ফেলে দিয়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল : আপনারা যান। ছিপ বিক্রি হবে না। দোকান বন্ধ।

ক্যাবলা বললে, দোকান বন্ধ।

হ্যাঁ, বন্ধ। হলধর কী রকম বিড়বিড় করতে লাগল : আজকে বিষুব্বর না? বিষুদবারে আমাদের দোকান বন্ধ থাকে।

মোটেই না, আজকে মঙ্গলবার—আমি প্রতিবাদ করলুম।

হোক মঙ্গলবার—হলধর কাঁচা উচ্ছে চিবুনোর মতো মুখ করে বললে, আমরা মঙ্গলবারেও দোকান বন্ধ করে রাখি। বলেই সে ঘটাং ঘটাং করে আমাদের নাকের সামনেই ঝাঁপ বন্ধ করে দিলে। তারপর একটা ফুটোর ভেতর দিয়ে নাক বের করে বললে, অন্য দোকানে গিয়ে ছিপ কিনুন, এখানে সুবিধে হবে না।

ব্যাস, হলধরের সঙ্গে আলাপ এখানেই খতম। হলধর জানাকে আর জানা হল না—তার আগেই ঝাঁপের আড়ালে সে ভ্যানিসড।

সে তো ভ্যানিসড কিন্তু আমাদের মাথার ভেতরে একেবারে চক্কর লাগিয়ে দিলে যাকে বলে। পচা চীনেবাদাম চিবুলে যেরকম লাগে, ঠিক সেই রকম বোকাবোকা হয়ে আমরা এ ওর মুখের দিকে চেয়ে রইলুম।

টেনিদা মাথা চুলকে বললে, ক্যাবলা—এবার?

ক্যাবলা বললে,। এখন চলো, কোথাও গিয়ে একটু চা খাই। সেখানে বসে প্ল্যান ঠিক করা যাবে।

কাছেই চায়ের দোকান ছিল একটা, নিরিবিলি কেবিনও পাওয়া গেল। ক্যাবলাই চা আর কেক আনতে বলে দিলে। এসব ব্যাপারে চিরকাল পয়সা-টয়সা ও-ই দেয়, আমাদের ভাববার কিছু ছিল না।

টেনিদা নাক চুলকে বললে, ব্যাপারটা খুব মেফিস্টোফিলিস বলে মনে হচ্ছে। মানে সাংঘাতিক। এত সাংঘাতিক যে পুঁদিচ্চেরিও বলা যেতে পারে।

হাবুল এতক্ষণ পরে মুখ খুলল :হ, সৈত্য কইছ।

চন্দ্রকান্ত আর নাকের শুনেই হলধর কী রকম লাফিয়ে উঠল দেখেছ?—আমি বললুম, তা হলে ছড়াটার দ্বিতীয় লাইনেরও একটা মানে আছে।

সব কিছুরই মানে আছে—বেশ গভীর মানে।–ক্যাবলা চায়ে চুমুক দিয়ে বললে, এখন তো দেখছি ছড়াটার মানে বুঝতে পারলেই কম্বলেরও হদিস পাওয়া যাবে।

টেনিদা এক কামড়েই নিজের কেকটাকে প্রায় শেষ করে ফলল। আমিও চট করে আমারটা আধখানা মুখে পুরে দিলুম, পাছে ওপাশ থেকে আমার প্লেটেও হাত বাড়ায়। টেনিদা আড় চোখে সেটা দেখল, তারপর ব্যাজার হয়ে বললে, কিন্তু পটলডাঙার কম্বল কী করে যে চাঁদনির বাজারে এল আর চক্রধরের সঙ্গে জুটলই বা কী ভাবে, সেইটেই বোঝা যাচ্ছে না।

সেটা বুঝলে তো সবই বোঝা যেত।—ক্যাবলা ফোঁস করে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল :

ভেবেছিলুম, কম্বলের পালানোটা কিছুই নয়—এখন দেখছি বদ্রীবাবুই ঠিক বলেছিলেন। কম্বল চাঁদে হয়তো যায়নি, কিন্তু যে রহস্যময় চাঁদোয়ার তলায় সে ঘাপটি মেরে বসে আছে সে-ও খুব সোজা জায়গা নয়। ওয়েল, টেনিদা।

ইয়েস ক্যাবলা।

চলো, আমরা চারজনে চারিদিক থেকে চক্রধরের দোকানের ওপর নজর রাখি। আমাদের তাড়াবার জন্যেই হলধর দোকান বন্ধ করছিল, আবার নিশ্চয় ঝাঁপ খুলবে। দেখতে হবে ঝোল্লা গোঁফ আর কপালে আব নিয়ে কটকটে কালো চক্রধর আসে কি না কিংবা লম্বা নাক নিয়ে চন্দ্রকান্ত দেখা দেয় কি না। কিন্তু টেক কেয়ার—সব্বাইকেই একটু গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে—হলধর যাতে কাউকে দেখতে না পায়।

আমরা সবাই রাজি হয়ে গেলুম।

ক্যাবলা পরীক্ষায় স্কলারশিপ পাওয়াতে ওর বাবা ওকে একটা হাতঘড়ি কিনে দিয়েছিলেন। সেটার দিকে তাকিয়ে ক্যাবলা বললে, এখন সাড়ে চারটে। পড়াশুনোর সময় নষ্ট না করেও আমরা আরও দেড় ঘণ্টা থাকতে পারি এখানে। কে জানে, হয়তো আজকেই কোনও একটা কু পেয়ে যেতে পারি কম্বলের। ফ্রেন্ডসনাউ টু অ্যাঁকশান—এবার কাজে লাগা যেতে পারে।

চাঁদনির বাজারে এদিক-ওদিক লুকিয়ে থাকা কিছু শক্ত কাজ নয়। আমরাও পাকা গোয়েন্দার মতো চারিদিকে চারটে জায়গা বেছে নিয়ে চক্রধরের দোকানের দিকে ঠায় চেয়ে রইলুম। টেনিদা আর ক্যাবলাকে দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু ঠিক আমার মুখোমুখি একটা লোহার দোকানের আড়াল থেকে মাঝে মাঝে কচ্ছপের মতো গলা বের করছিল হাবুল।

দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি, চক্রধরের দোকানের ঝাঁপ আর খোলে না। চোখ টনটন করতে লাগল, পা ব্যথা হয়ে গেল। এমন সময়, হঠাৎ পেছন থেকে আমার কাঁধে কে যেন টুক টুক করে দুটো টোকা মারল।

চমকে তাকিয়েই দেখি, ছিটের শার্ট গায়ে, ঢ্যাঙা তালগাছের মতো চেহারা, নাকের নীচে মাছিমাকা গোঁফ, বেশ ওস্তাদ চেহারার লোক একজন। মিটমিট করে হেসে বললে, ছল ছল খালের জল—তাই না?

আমি এত অবাক হয়ে গেলুম যে মুখ দিয়ে কথাই বেরুল না।

লোকটা বলল, তা হলে হলধরকে নিয়ে আর সময় নষ্ট করা কেন? কাল বেলা তিনটের সময় তেরো নম্বর শেয়ালপুকুর রোডে গেলেই তো হয়।

বলে আমার পিঠে টকটক করে আবার গোটা দুই টোকা দিয়ে, টুক করে কোনদিকে সরে পড়ল যে।

০৫. কলকাতায় কাঁটাপুকুর আছে

কলকাতায় কাঁটাপুকুর আছে, ফড়েপুকুর আছে, বেনেপুকুর, মনোহরপুকুর, পদ্মপুকুর সব আছে, কিন্তু শেয়ালপুকুর আবার কোন্ চুলোয়! হিসেবমতো শেয়ালদার কাছাকাছিই তার থাকা উচিত, কিন্তু সেখানে তাকে পাওয়া গেল না পঞ্জিকার পৃষ্ঠায় কলকাতার রাস্তার যে-লিস্টি থাকে, তাই থেকেই শেষ পর্যন্ত জানা গেল, শেয়ালপুকুর সত্যিই আছে দক্ষিণের শহরতলিতে। জায়গাটা ঠিক কোনখানে, তা আর তোমাদের নাই বললুম।

শেয়ালপুকুরের সন্ধান তো পাওয়া গেল, তেরো নম্বরও নিশ্চয়ই খুঁজে পাওয়া যাবে, কিন্তু প্রশ্ন হল, জায়গাটাতে আদৌ যাওয়া উচিত হবে কি না? কাঁটাপুকুরে কোনও কাঁটা নেই—সে আমি দেখেছি; মনোহরপুকুরে আমার মাসতুতো ভাই লোটনদা থাকে সেখানে কোনও মনোহরপুকুর আমি দেখিনি, ফড়েপুকুরেও নিশ্চয়ই ফড়েরা সাঁতরে বেড়ায় না। শেয়ালপুকুরের চারপাশেও খুব সম্ভব এখন আর শেয়ালের আস্তানা নেই—বেলা তিনটের সময় সেখানে গেলে নিশ্চয়ই আমাদের খ্যাঁক-খ্যাঁক করে কামড়ে দেবে না। কিন্তু–

কিন্তু চাঁদনির সেই সন্দেহজনক আবহাওয়া? সেই ঝোল্লা গোঁফ আর কপালে আবওলা চক্রধর সামন্ত কিংবা সেই নাকেশ্বর চন্দ্রকান্ত—যাদের এখনও আমরা দেখিনি? সেই তেলেভাজা-খাওয়া হলধর আর তালঢ্যাঙা সেই খলিফা-চেহারার লোকটা? এসবের মানে কী? ছড়াটা দেখছি ওরা সবাই ই জানে আর এই ছড়ার ভেতরে লুকিয়ে আছে কোনও সাংকেতিক রহস্য। পটলডাঙার বিচ্ছুমাকা কম্বল ও-ছড়াটা পেলেই বা কোথায়, আর কারাই বা তাকে নিরুদ্দেশ করল?

চাটুজ্যেদের রোয়াকে বসে ঝালমুড়ি খেতে-খেতে এই সব ঘোরতর চিন্তার ভেতরে আমরা চারজন হাবুড়ুবু খাচ্ছিলুম। বাঙাল হাবুল সেন বেশ তরিবত করে একটা লাল লঙ্কা চিবুচ্ছিল, আর তাই দেখে গা শিরশির করছিল আমার। টেনিদার খাড়া নাকটাকে দু-আনা দামের একটা তেলেভাজা সিঙাড়ার মতো দেখাচ্ছিল, আর ক্যাবলার নতুন চশমাটা ইস্কুলের ভূগোল স্যারের মতো একেবারে ঝুলে এসেছিল ওর ঠোঁটের ওপর।

টেনিদা মুড়ি চিবুতে চিবুতে বললে, পুঁদিচ্চেরি! মানে, ব্যাপার খুব ঘোরালো।

আমরা তিনজনেই বললুম, হুঁ।

টেনিদা বললে, যতই ভাবছি, আমার মনটা ততই মেফিস্টোফিলিস হয়ে যাচ্ছে।

ক্যাবলা গম্ভীর হয়ে বললে, মেফিস্টোফিলিস মানে শয়তান।

শাটাপ!—টেনিদা বিরক্ত হয়ে বললে, বিদ্যে ফলাসনি। লোকগুলোকে কী রকম দেখলি?

আমি বললুম, সন্দেহজনক।

হাবুল লঙ্কা চিবিয়ে জিভে লাল টেনে উস-উস করছিল। তারই ভেতরে ফোড়ন কাটল : হ, খুবই সন্দেহজনক। ক্যামন শিয়াল-শিয়াল মনে হইল।

আমি বললুম, তাই শেয়ালপুকুরে থাকে।

ক্যাবলা বললে, খামোশ! চুপ কর দেখি। আমি বলি কি টেনিদা, আজ দুপুরবেলা যাওয়াই যাক ওখানে।

টেনিদা শিঙাড়ার মতো নাকটাকে খুচুর-খুচুর করে একটুখানি চুলকে নিলে। তারপর বললে, যেতে আপত্তি নেই। কিন্তু যদি ফেঁসে যাই? মানে—লোকগুলো–

চার-চারজন আছি, দিন-দুপুরে আমাদের কে কী করবে?

তা ঠিক। তরে কিনা–টেনিদা গাঁইগুঁই করতে লাগল।

হ, সক্কল দিক ভাইবা-চিন্তাই কাম করন উচিত।—ভাবুকের মতো মাথা নাড়তে লাগল হাবুল সেন :

আর—তোমার হইল গিয়া কম্বলটা একটা অখাদ্য মানকচু। অরে শুয়ারেও খাইব না। খামকা সেইটারে খুঁজতে গিয়া বিপদে পড়ম ক্যান?

হবে না! ছিঃ ছিঃ!—এমনভাবে ধিক্কার দিয়ে কথাটা বললে– ক্যাবলা যে, হাবুল একেবারে নেতিয়ে গেল, স্রেফ মানকচু সেদ্ধর মতো। চশমাটাকে আরও ঝুলিয়ে দিয়ে এবারে সে অঙ্কস্যারের মতো কটকটে চোখে চাইল হাবুলের দিকে।

তুই এত স্বার্থপর। একটা ছেলে বেঘোরে মারা যাচ্ছে, তার জন্যে কিছু না করে স্বার্থপরের মতো নিজের গা বাঁচাতে চেষ্টা করছিস! শেম—শেম।

হাবুল জব্দ হচ্ছে দেখে আমিও বললুম, শেম-শেম! কিন্তু বলেই আমার মনে হল, হাবুলও কিছু অন্যায় বলেনি। কম্বলের মতো একটা বিকট বাঁদর ছেলে-যে কুকুরের কানে লাল পিঁপড়ে ঢেলে দেয়, লোকের গায়ে পটকা ফাটায় আর প্রণামের ছল করে খ্যাঁচখেঁচিয়ে পায়ে খিমচে দেয়, সে যদি আর নাই ফিরে আসে, তাতে দুনিয়ার বিশেষ ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। কিন্তু তক্ষুনি আমি ভাবলুম, কম্বলের মার কী হবে? ছেলে-হারানোর দুঃখ তিনি কেমন করে সহ্য করবেন? আর, কোনও ছেলে যদি খারাপ হয়েই যায়, তা হলেই কি তাকে বাতিল করা উচিত? খারাপ ছেলের ভালো হতে কদিনই বা লাগে? না হলে, ক্লাইভ কী করে ভারতবর্ষ জিতে নিলেন?

আমি ভাবছিলুম, ওরা কী বলছিল শুনতেই পাইনি। এবার কানে এল, টেনিদা বলছে, কিন্তু শেয়ালপুকুরে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে গিয়ে ওরা যদি আমাদের আক্রমণ করে?

করুক না আক্রমণ। আমাদের লিডার টেনিদা থাকতে কী ভয় আমাদের?–ক্যাবলা টেনিদাকে তাতিয়ে দিয়ে বললে, তোমার এক-একটা ঘুষি লাগবে আর এক-একজন দাঁত চরকুটে পড়বে।

হে–হে, মন্দ বলিসনি।–সঙ্গে-সঙ্গে টেনিদার দারুণ উৎসাহ হল আর সে ক্যাবলার পিঠ চাপড়ে দেবার জন্য হাত বাড়াল। কিন্তু ক্যাবলা চালাক, চট করে সরে গেল সে, তার পিঠ সঙ্গে সঙ্গেই পৃষ্ঠপ্রদর্শন করল, আর চাটিটা এসে চড়াৎ করে আমার পিঠেই চড়াও হল–

আমি চ্যাঁ চ্যাঁ করে উঠলুম, আর হাবলা দারুণ খুশি হয়ে বললে, সারছে সারছে দিছে প্যালার পিঠখান অ্যাঁক্কেবারে চ্যালা কইরা! ইচ্‌-চ্‌—পোলাপান!

টেনিদা বললে, সাইলেন্স—নো চ্যাঁচামেচি! বেশি গণ্ডগোল করবি তো সবগুলোকে আমি একেবারে জলপান করে ফেলব। যা বাড়ি পালা এখন। খেয়েদেয়ে সব দেড়টার সময় হাজিরা দিবি এখানে। এখন টুপ ডিসপার্স কুইক।

 

বাস থেকে নেমে একটু হাঁটতেই আমরা দেখলুম দুটো রাস্তা বেরিয়েছে দু দিকে। একটা ধোপাপাড়া রোড, আর একটা শেয়ালপুকুর রোড। হাবুল আমাকে বললে, এই রাস্তার ধোপারা গিয়া না ওই রাস্তার শিয়ালপুকুরে কাপড় কাচে। বোঝছস না প্যালা?

আমি বললুম, তুই থাম, তোকে আর বোঝাতে হবে না।

তরে একটু ভালো কইর‍্যা বুঝান দরকার। তর মগজ বইল্যা তো কিছুই নাই, তাই উপকার করবার চেষ্টা কোরতে আছি। বুঝিস নাই?

এমন বিচ্ছিরি করে বলছিল যে ইচ্ছে হল হাবুলের সঙ্গে আমি মারামারি করি। কিন্তু তার আর দরকার হল না, বোধহয় ভগবান কান খাড়া করে সব শুনছিলেন, একটা আমের খোসায় পা দিয়ে দুম করে আছাড় খেল হাবুল।

টেনিদা আর ক্যাবলা-আগে-আগে যাচ্ছিল। টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে বললে, আঃ, এই প্যালা। আর হাবলাকে নিয়ে কোনও কাজে যাওয়ার কোনও মানে নেই, দুটোই পয়লানম্বরের ভণ্ডুলরাম। এই হাবলা–কী হচ্ছে?

আমি বললুম, কিছু হয়নি। হাবলার মগজে জ্ঞান একটু বেশি হয়েছে কিনা, তাই বইতে পারছে না–ধপাধপ আছাড় খাচ্ছে।

হয়েছে, তোমায় আর ওস্তাদি করতে হবে না। শিগগির আয় পা চালিয়ে।

রাস্তার দুধারে কয়েকটা সেকেলে বাড়ি, কাঁচা ড্রেন থেকে দুর্গন্ধ উঠছে। গাছের ছায়া ঝুঁকে পড়েছে এখানে-ওখানে। ভর দুপুরে লোকজন কোথাও প্রায় নেই বললেই চলে। কোথায় যেন মিষ্টি গলায় দোয়েল ডাকছিল। এখানে যে কোনওরকম ভয়ের ব্যাপার আছে তা মনেই হল না।

আরে, এই তো তেরো নম্বর! উঁচু পাঁচিল-দেওয়া বাগানওলা একটা পুরনো বাড়ি। গেটের গায়ে শ্বেতপাথরের ফলকে বাংলা হরফে নম্বর লেখা। গেট খোলাই আছে, কিন্তু ঢোকবার জো নেই। গেট জুড়ে খাটিয়া পেতে শুয়ে আছে পেল্লায় এক হিন্দুস্থানী দারোয়ান, তার হাতির মতো পেট দেখে মনে হল, সে বাঘা কুস্তিগির আর দারুণ জোয়ান—আমাদের চারজনকে সে এক কিলে চিড়ে-চ্যাপটা করে দিতে পারে।

আমরা চারজন এ-ওর মুখের দিকে তাকালুম। এই জগদ্দল লাশকে ঘাঁটানো কি ঠিক হবে?

টেনিদা একবার নাক-টাকগুলো চুলকে নিলে। চাপা গলায় বললে, পুঁদিচ্চেরি! তারপর আস্তে আস্তে ডাকল :

এ দারোয়ানজী!

কোনও সাড়া নেই।

ও দারোয়ান স্যার।

এবারেও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।

পাঁড়ে মশাই!

দারোয়ান জাগল। ঘুমের ঘোরে কী যেন বিড়বিড় করতে লাগল। আর তাই শুনেই আমরা চমকে উঠলুম।

দারোয়ান সমানে বলছিল : চাঁদ—চাঁদনি চক্রধর—চাঁদ—চাঁদনি–চক্রধর—

টেনিদা ফস করে বলে বসল : চন্দ্রকান্ত নাকেশ্বর।

কথাটা মুখ থেকে পড়তেই পেল না। তক্ষুনি—যেন ম্যাজিকের মতো উঠে বসল দারোয়ান। হড় হড় করে খাটিয়া সরিয়ে নিয়ে, আমাদের লম্বা সেলাম ঠুকে বললে, যাইয়ে—অন্দর যাইয়ে—

আমরা বোধহয় বোকার মতো মুখ চাওয়া-চাউয়ি করছিলুম। ভেতরে নিয়ে গিয়ে ঠ্যাঙানি দেবে নাকি? যা রাক্ষসের মতো চেহারা, ওকে বিশ্বাস নেই।

দারোয়ান আবার মুচকি হেসে বললে, যাইয়ে—যাইয়ে–

এরপরে আর দাঁড়িয়ে থাকার কোনও মানে হয় না। আমরা দুরুদুরু বুকে দারোয়ানের পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকলুম। আর ঢুকতেই তক্ষুনি খাটিয়াটা টেনে গেট জুড়ে শুয়ে পড়ল দারোয়ান—যেন অঘোর ঘুমে ড়ুবে গেল।

কিন্তু আমরা কোথায় যাই?

সামনে একটা গাড়িবান্দাওলা লাল রঙের মস্ত দোতলা বাড়ি। জানলার সবুজ খড়খড়িগুলো সাদাটে হয়ে কবজা থেকে ঝুলে পড়ছে, তার গায়ের চুনবালির বার্নিশ খসে যাচ্ছে, তার মাথায় বট-অশ্বথের চারা গজিয়েছে। একটা ভালো ফুলের বাগান ছিল, এখন সেখানে আগাছার জঙ্গল। একটা মরকুটে লিচু গাছের ডগায় কে যেন আবার খামকা একটা কালো কাকতাড়ুয়ার হাঁড়ি বেঁধে রেখেছে।

আমরা এখানে কী করব বোঝবার আগেই বাড়ির ভেতরে থেকে তালট্যাঙা লোকটা—সেই যাকে আমরা চাঁদনির বাজারে দেখেছিলুম—মাছিমাকা গোঁফের নীচে মুচকি হাসি নিয়ে বেরিয়ে এল।

এই যে, এসে গেছেন! তিনটে বেজে দু সেকেন্ডবাঃ, ইউ অর ভেরি পাংচুয়েল।

আমরা চারজনে গা ঘেঁষে দাঁড়ালুম। যদি বিপদ কিছু ঘটেই, এক সঙ্গেই তার মোকাবেলা করতে হবে!

টেনিদা আমাদের হয়ে জবাব দিলে, আমরা সর্বদাই পাংচুয়াল।

গুড!-ভেরি গুড!—লোকটা এগিয়ে চলল, তা হলে আগে চলুন মা নেংটীশ্বরীর মন্দিরে। তিনি তো এ-যুগের সব চাইতে জাগ্রত দেবতা।

নেংটীশ্বরী!

লোকটা অবাক হয়ে ফিরে তাকালো : নাম শোনেননি? মা নেংটীশ্বরীর নাম শোনেননি? অথচ চন্দ্রকান্ত নাকেশ্বরের খবর পেয়েছেন? এটা কী রকম হল?

আমরা বুঝতে পারছিলুম, একটা-কিছু গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে। ক্যাবলা সঙ্গে সঙ্গে সামলে নিলে। না-না, নাম শুনব না কেন? না হলে আর এখানে এলুম কী করে?

তাই বলুন।—লোকটা যেন স্বস্তির শ্বাস ফেলল; আমায় একেবারে ধোঁকা ধরিয়ে দিয়েছিলেন। জয় মা নেংটীশ্বরী।

আমরাও সমস্বরে নেংটীশ্বরীর জয়ধ্বনি করলুম।

০৬. জয় মা নেংটীশ্বরীর জয়

আমরা যেই বলেছি, জয় মা নেংটীশ্বরীর জয়, সঙ্গে সঙ্গেই যেন চিচিংচন্দ্র ফাঁক হয়ে গেলেন। মানে, তক্ষুনি সেই সরু গুফো তালঢ্যাঙা চেহারার রোগা লোকটা হুড়মুড় করে একটা নকশাকাটা কালো দরজা টেনে খুলে ফেললে। আর সেই দরজা দিয়ে তাকিয়েই আমরা চারজনে একেবারে থ।

মা কালী, মা দুর্গা, রাধাকৃষ্ণ, লক্ষ্মী-সরস্বতী-বিশ্বকর্মা শীতলা-শিব, মায় ঘণ্টাকর্ণ ঠাকুর পর্যন্ত অনেক দেবতাই তো আমরা দেখেছি—মানে দেবতা আর কী করে দেখব, তাঁদের মূর্তিটুর্তি তো সব সময়েই দেখে থাকি। পাটনার সেই কংগ্রেস ময়দানে দেখেছি, বাঁশ, কাগজ আর সেই সঙ্গে আরও কী সব দিয়ে তৈরি রাবণ কুম্ভকর্ণ-ইন্দ্রজিতের আকাশ-ছোঁয়া মূর্তি-দশহরার দিন যাদের আগুনের তীর মেরে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু দরজা খুলতে আজ যা দেখতে পেলুম—এমন ঠাকুর এর আগে কোথাও কেউ দেখেছে বলে মনে হল না।

টেনিদা বিড়বিড় করে বললে, ডি লা গ্র্যান্ডি!

আমি বললুম, মেফিস্টোফিলিস!

হাবুল সেন বললে, খাইছে!

আর ক্যাবলা কিছুই বললে– না, হাঁ করে চেয়ে রইল, কেবল তার চশমাটা নাকের ওপর দিয়ে ঝুলে পড়ল নীচের দিকে।

কী দেখলুম, সে আর কী বলব তোমাদের। ছোট্ট ঘরটা এই দিন-দুপুরেই অন্ধকার, তার ভেতরে মালার মতো করে লাল-নীল অনেকগুলো ইলেকট্রিকের বা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাগুলো মিটমিটে হলেও কটা এক সঙ্গে জ্বলছে বলে একটা অদ্ভুত রঙিন আলো থমথম করছে ঘরময়। সেই আলোয় চিকচিক করছে মস্ত একটা সিংহাসন রুপো-টুপো তাতে লাগানো আছে বোধহয়। সিংহাসনের মাথায় একটা সাদা ছাতা, আর সেই ছাতার তলায় ভেলভেটের গদিতে বসে—

স্বয়ং মা নেংটীশ্বরী। অথাৎ কিনা—ইয়া জাঁদরেল একটা নেংটি ইঁদুর।

নেংটি ইংদুরটার মূর্তি একটা ধুমসো হুলো বেড়ালের চাইতেও তিনগুণ বড়। সামনের পা দুটো জড়ো করে, কান খাড়া করে, ল্যাজটাকে পিঠের ওপর দিয়ে বাঁকিয়ে এমন কায়দায় বসে আছে যে আচমকা দেখলে জ্যান্ত বলে মনে হয়। চোখ দুটো বোধ করি কালো কাচ কিংবা পুঁতি দিয়ে তৈরি লাল-নীল আলোতে সে দুটো যেন শয়তানিতে চিকচিক করছে। তার সামনে একটা মস্ত বারকোশে ছোলা কলাবাতাসা-চাল-ডাল এই সব সাজানো রয়েছে, দেবী নেংটীশ্বরীর ভোগ নিশ্চয়।

তাকিয়ে তাকিয়ে প্রাণ চমকে উঠল। রাত-বিরেতে ওরকম একখানা পেল্লায় ইঁদুর যদি কারও ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে, তা হলে আর দেখতে হবে না। কামড়ে-ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দেবে একেবারে।

লোকটা ধমক দিয়ে বললে, কী হে–হাঁ করে সবাই দাঁড়িয়ে রয়েছ যে বড়? বোম্বাচাক লেগে গেল নাকি তোমাদের? মাকে পেন্নাম করলে না?

বলার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা চারজনে একেবারে সাষ্টাঙ্গে লুটিয়ে পড়লুম।

লোকটা বলে চলল, হেঁ–হেঁ, ভারি দুর্লভ মূর্তি! দুনিয়ার কোথাও দেখতে পাবে না। এঁর প্রিতিষ্ঠে করেছেন কে জানো? বাবা বিটকেলানন্দ। তাঁর নাম শুনেছ তো?

আমরা এ ওর মুখের দিকে চাইলুম। বিটকেলানন্দ! স্বামী ঘটুঘুটানন্দের সঙ্গে একবার রায়গড়ের জঙ্গলে আমাদের দারুণ রকমের একটা মোলাকাত হয়েছিল—তাকে মুলা কাত-ও বলা যায়, কারণ তিনি আমাদের চারজনকে প্রায় কাত করে ফেলেছিলেন। বিটকেলানন্দ তাঁরই মাসতুতো ভাই কি না, কে জানে!

ক্যাবলা ঘাড়-টাড় চুলকে বললে, আজ্ঞে, তা—তা শুনেছি বইকি। বাবা বিটকেলানন্দের নাম কেই বা না জানে!

লোকটা ফোঁস করে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল : সে কথা আর বোলো না। তোমরা বুদ্ধিমান বলে তাঁর খবর রাখো, তাই চাঁদনিতে গিয়ে খালের জলের কবিতা আউড়ে এখানে আসতে পেরেছ। কিন্তু অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করে দ্যাখো, ঠোঁট উলটে অমনি বলে বসবে—অ্যাঁ, বিটকেলানন্দ? সে আবার কে!—লোকটার মুখ মনের দুঃখে যেন লম্বা হয়ে গেল : ছাঃ, এই জন্যই দেশটার কিছু হয় না।

সঙ্গে সঙ্গে টেনিদাও কেমন বাজখাঁই গলায় বলে বসল, আজ্ঞে যা বলেছেন—এই জন্যেই দেশের কিছু হয় না। কী রকম বাঘাটে গলায় টেনিদা বলে ফেলল কথাটা, ঘর গম্ করে উঠল, লোকটাও যেন চমকে গেল। তারপর বললে, অথচ দ্যাখো বাবা বিটকেলানন্দ স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। চালাকি নয়?

খাইছে!–হাবুল আর থাকতে পারল না। –খাইছে?—লোকটা আবার চমকে গেল : তার মানে? কী খেয়েছে? কোথায় খেয়েছে?কেনই বা খেল? ক্যালা বললে, যেতে দিন—যেতে দিন, ও মধ্যে মধ্যে ওই রকম বলে—কেউ কিছু খায়নি। এখন আপনি যা বলছিলেন বলুন।

—আমি বলছিলুম, স্বপ্নাদেশ।—লোকটা একবার গলাখাঁকারি দিলে : বাবা বিটকেলানন্দ ছেলেবেলা থেকেই ভাবুক। ইস্কুলে মাস্টার পড়া জিজ্ঞেস করলে মৌনী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন, পাষণ্ড মাস্টারগুলো ভাবত বাবার মাথায় কিছু নেই, তাই তাঁকে গোরুর মতো ঠ্যাঙাত। তারা তো জানত নাবাবা তখন ধ্যান করছেন। কিছু না বুঝেই মহাপাপী মাস্টারেরা পিটিয়ে তাঁর ধুন্ধুড়ি উড়িয়ে দিত ক্লাসে প্রোমোশন দিত না।

আমি বললুম, আহা! ক্যাবলা বললে, আহা-হা! হাবুলও যেন কী একটা বলতে যাচ্ছিল, ঘাড়ে একটা থাবড়া বসিয়ে টেনিদা তাকে থামিয়ে দিলে। লোকটার গলার স্বর ভাবে কাঁদো-কাঁদো হয়ে উঠল, সে বললে, আহো-হো! যাক, তারপরে শোনো। ঠ্যাঙানি খেতে খেতে বাবা বিটকেলানন্দের মতো মহাপুরুষেরও ধৈর্যচ্যুতি হল। তিনি ভেবে দেখলেন, মাস্টারের গাঁট্টাতেই যদি তাঁকে মহাপ্রস্থানে যেতে হয়, তা হলে তিনি ধ্যান-জপ করবেন কী করে—আবার জীবেরই বা গতি হবে কী! তারপর একদিন তিনি বাড়ি ছেড়ে সটকালেন।

ক্যাবলা বললে, বুদ্ধের গৃহগ আর কি।

লোকটা মাথা নাড়ল : যা বলেছ, ব্যাপার প্রায় সেই রকম। কিন্তু জানো, বুদ্ধের কাল তো এটা না, মহাপুরুষকে এখন আর চেনে কে! তাই বাবা আর বোধিবৃক্ষের তলায় বসলেন না, তার বদলে গিয়ে চাকরি নিলেন বড়বাজারের পেটমোটা এক শেঠজীর গদিতে। সেখানে দেখলেন, অনেক শিখলেন, চালে কাঁকর মেশানো, আটায় ভুষি মেশানো, ওষুধে ভেজাল দেওয়া—সব জানলেন। জেনে-শুনে বাবার মগজ সাফ হয়ে গেল—তখন তিনি স্বপ্ন দেখলেন।

-কী স্বপ্ন?—টেনিদা জিজ্ঞেস করলে।

-দেখলেন, স্বর্গে পালে-পালে নেংটি ইঁদুর হানা দিয়েছে সেখানকার চাল-ডাল-মধু-সুজি-ফল-পাকড় সব খেয়ে ফেলেছে, দেবতাদের ঝাঁকে ঝাঁকে তাড়া করেছে, ইন্দ্র-চন্দ্র কার্তিক-টার্তিক সবাই বাপ রে মা-রে বলে ছুটে পালাচ্ছে। আর ইন্দ্রের ফাঁকা সিংহাসনে বসে গোঁফ ফুলিয়ে দেবী নেংটীশ্বরী বলছেন—দেখছিস কি এখন থেকে স্বর্গে-মতে-পাতালে আমারই রাজত্ব শুরু হল। আমার হুকুমমতোই সব চলবে। আজ থেকে তোদের কাজ হল নেংটি ইঁদুরের মতো চুরি করা—গর্ত কেটে, যেখানে যা পাওয়া যায়—সব লোপাট করা। বাঁচতে হলে এখন থেকে এই রাস্তাই তোদের ধরতে হবে। দেবী এই পর্যন্ত বলতে বলতেই দুটো বেড়ালের ঝগড়ার আওয়াজে বিটকেলানন্দের ঘুম ভেঙে গেল, হুলোর ভয়েই দেবী উধাও হলেন কি না কে জানে! আর বাবা বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন, বললেন, পেয়েছি—পেয়েছি। তারপরেই দেবী নেংটীশ্বরীর এই মন্দিরপ্রতিষ্ঠা।

ক্যাবলা বললে, উঃ, কী রোমাঞ্চকর।

টেনিদা ঘাড় নেড়ে বললে, হুঁ, পয়লা নম্বরের মেফিস্টোফিলিস।

–মেফিস্টোফিলিস? লোকটা চোখ পিটপিট করে বললে, তার মানে?

আমি বললাম, তার মানে–ইয়াক ইয়াক!

—ইয়াক ইয়াক? সে আবার কী?—লোকটা খাবি খেল : তোমরা কোন্ দেশের লোক হে? তোমাদের যে বোঝা যায় না।

ক্যাবলা তাড়াতাড়ি বললে, ছেড়ে দিন ওদের ছেলেমানুষি ছেড়ে দিন। মানে, খুশি হলে ওরা অনেক সময় ও-সব বলে, ওগুলোর কোনওকালে নেই। এখন আপনি যা বলেছিলেন বলুন।

লোকটা বিরক্ত হয়ে বললে, বলতেই তো চাচ্ছি, কিন্তু তোমরা কী সব বিচ্ছিরি ভাষা আউড়ে সব গোলমাল করে দিচ্ছ?

আমি বললুম, বাবা বিটকেলানন্দ এখানে আছেন?

লোকটা আরও ব্যাজার হল : থাকতেই তো চেয়েছিলেন। কিন্তু ম্যাও ম্যাও।

–ম্যাও ম্যাও।

—আবার কী?—ওরা কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে গেল, বলে কিনা, বাবা চোর, বাবা কালোবাজারী! সইবে না সইবে না!ভীষণ চটে গিয়ে প্রায় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগল : বাবা যোগবলে জেলের গরাদ ভেঙে বেরিয়ে আসবেন। আর যে হাকিম তাঁকে জেলে দিয়েছে–

টেনিদা বললে, তাঁর কী হবে?

-কী হবে?—দাঁত কিড়মিড় করে লোকটা বলতে লাগল : রাত্তিরে যখন সে ঘুমুবে, তখন মা নেংটীশ্বরী দল বেঁধে গিয়ে তার ভুঁড়ি ফুটো করে দেবে। নির্ঘাত দেখে নিয়ো।

বলতে বলতেই–

হঠাৎ কোত্থেকে বিকট গলায় বিশটা হুলো বিড়াল এক সঙ্গে ডেকে উঠল : ম্যাও—ম্যাও—ম্যাও–

আর দারুণ চমকে উঠল লোকটা।

-লুকোও—লুকোও–লুকোও। বাঁচতে চাও তো এখুনি লুকোও। না হলে—

ঘরঘর শব্দে মা নেংটীশ্বরীর মন্দিরের দরজা বন্ধ হল, সেই তালঢ্যাঙা লোকটা জালে-পড়া গলদা চিংড়ির মতো ছটফটিয়ে উঠল, নেংটীশ্বরীর চোখ দুটো ঘরের সেই নানা রঙের আলোতে ঝকঝক করে জ্বলতে লাগল, কেমন যেন মনে হতে লাগল—মা আলোর দিকে কটমটিয়ে চেয়ে রয়েছেন, এখুনি ইকিখি বলে তেড়ে কামড়াতে আসবেন। তার উপরে আবার দরজাটা বন্ধ হয়ে যাওয়া বিচ্ছিরি গুমট গরমে আমরা সিদ্ধ হচ্ছিলুম-কেমন একটা বদখত গন্ধ আসছিল। একবার মনে হল ওটা নেংটি ইঁদুরের, তার পরেই মনে হল, না চামচিকের গন্ধ।

একেবারে বেকুব বনে গিয়ে আমরা চার মূর্তি—আলু সেদ্ধর মতো চারটে মুখ করে—এ ওর দিকে চেয়ে রইলুম। আর টেনিদা খাঁড়ার মতো নাকটাকে একবার চুলকে নিয়ে বললে, হুঁ, পুঁদিচ্চেরি।

লোকটা কী রকম চমকে গেল। বললে, পুঁদিচ্চেরি! সে আবার কী?

হাবুল বললে, ওটা হৈল গিয়া ফরাসী ভাষা। তার মানে হৈল, ব্যাপার খুবই সাংঘাতিক হইয়া উঠছে।

তালঢ্যাঙা লোকটা তাই শুনে এমন ব্যাজার হয়ে গেল যে মনে হল, এক্ষুনি কেউ তাকে জোর করে একমুঠো নিমপাতা খাইয়ে দিয়েছে। সে বললে, ব্যাপার খুবই সাংঘাতিক, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু ফরাসী ভাষা বলো আর যাই বলো—ফিসফিসিয়ে বলবে। শুনলে না—ম্যাও ম্যাও এসেছে? যদিও এ-ঘরে ঢুকতে পারবে না—আর ঘরটা কী বলে এমন কায়দায় তৈরি যে বাইরে থেকে বোঝাই যায় না এখানে ঘর আছে, তবু সাবধানের বিনাশ নেই–বুঝতে পারছ না?

আমি বললুম, আজ্ঞে সবই বুঝতে পারছি। কিন্তু ম্যাও ম্যাওটা—

ক্যাবলা আমাকে একটা চিমটি কাটল, কিন্তু যখন বলেই ফেলেছি, তখন কথাটা আর সামলে নেওয়া যায় না। লোকটা আশ্চর্য হয়ে বললে, কেন, ম্যাও ম্যাও বুঝতে পারছ না। আচ্ছা নেংটি ইঁদুরের শত্রু কে?

হাবুল বুদ্ধি করে বললে, মানুষ।

—উঁহু হল না।—লোকটা হ-য-ব-র-ল-র কাক্কেশ্বর কুচকুচের মতো মাথা নেড়ে বললে, হয়নি, ফেল। তোমার মগজে দেখছি কিছু নেই।

ক্যাবলা বললে, আজ্ঞে না, সেই জন্যেই তো ওর নাম হাবলা। নেংটি ইঁদুরের শত্রু হচ্ছে বেড়াল।

—ইয়া, রাইট। তা হলে মা নেংটীশ্বরীর শত্রু কে হতে পারে?

ক্যাবলা বললে, পুলিশ।

-ঠিক, একদম করেকট। এইবার বুঝতে পারছ তো? আজ্ঞায় পুলিশ হানা দিয়েছে। ধরতে যদি পারে আমাদের সকলকে একেবারে সোজা শ্রীঘর।

—শ্রীঘর?—টেনিদা খাবি খেয়ে বললে, মানে জেল?

লোকটা ঠোঁটে আঙুল দিলে।

—স্‌-স্‌-স্‌। তোমার তো দেখছি একেবারে হাঁড়িচাঁচার মতো গলা হে। একটু আস্তে কথা বলতে পারো না? তা ভেবেছ কী? পুলিশে একবার ধরতে পারলে তোমায় কি নেমন্তন্ন করে পোলাও-কালিয়া খাওয়াবে? একেবারে তিনটি বছর ঘানিগাছে ঘুরিয়ে দেবে—খেয়াল থাকে যেন।

টেনিদা ধুপ করে সেই চামচিকের গন্ধভরা মেঝেটার উপরে বসে পড়ল, আমার পেটের ভেতরে পিলে-টিলেগুলো যেন কী রকম তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল, হাবুল মুখটাকে ফাঁক করে এমন ভাবে চেয়ে রইল যে, মনে হল, সে এখুনি হাঁউ-মাউ করে ড়ুকরে কেঁদে উঠবে। এ আবার কী ঝঞ্ঝাটে পড়া গেল রে বাপু। সেই উনপাঁজুরে বিশ্ববখাটে কম্বলকে খুঁজতে এসে শেষে জেল খাটতে হবে কে জানে কোন্ চুরি বাটপাড়ির দায়েই জেল খাটতে হবে! আগে একটুখানি বুঝতে পারলেও কে এমন ফ্যাচাঙের মধ্যে পা বাড়িয়ে দিত। কিংবা আমাদের গোড়াতেই বোঝা উচিত ছিল—টেনিদার নাক বরাবর পচা আমটা যখন শত্রুর অদৃশ্য আক্রমণ থেকে ছুটে এসেছিল—সেই তখন।

আসলে, সব দোষ ক্যাবলার। ও-ই তো কী রকম বক্তৃতা দিয়ে আমাদের উত্তেজিত করে দিলে। মনে হল, নিরুদ্দেশ কম্বলকে খুঁজে বের করার মতন মহৎ কাজ দুনিয়ায় আর বুঝি দ্বিতীয়টি নেই। আমার একটা ভীষণ জিঘাংসা জাগল, ইচ্ছে করল, ক্যাবলার গায়ে কয়েকটা লাল পিঁপড়ে ছেড়ে দিই, কয়েকটা বিছুটির পাতা ঘষে দিই ওর পায়ে। কিন্তু এখানে লাল পিঁপড়েও নেই, বিছুটিও নেই। এখন কেবল পুলিশের হাতে পড়া, তারপর জেল খাটতে যাওয়া।

জেল খাটতেও নয় রাজি আছি, কিন্তু জেল থেকে বেরুবার পর? বড়দা কি পিঠের একফালি চামড়া বাকি রাখবে? কিংবা জেলে যাওয়ার আগেই এসে এমন ধড়াধধম্ পিটুনি লাগিয়ে যাবে তাতেই ছমাস কাটাতে হবে হাসপাতালে।

আমার চোখের সামনে সর্ষের ফুল-টুল কী সব দুলতে লাগল। যেন দেখতে পেলুম, মা নেংটীশ্বরী মুখটা একটুখানি ফাঁক করে আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত খিচুচ্ছেন, তাঁর বাঁকা লেজটা যেন অল্প অল্প নড়ছে মনে হল, আমি যেন এখুনি অজ্ঞান হয়ে পড়ব, আমার দাঁত কপাটি লেগে যাচ্ছে।

এরই মধ্যে শুনতে পেলুম, টেনিদা তোতলা হয়ে বলতে লাগল : পুল পুল পুলিশ—

তাই শুনে লোকটা উচ্চিংড়ের মতো ভেংচি কেটে বললে, ডোন্ট বি ফুলিশ। বললুম, তো সাড়া কিছু করো না—তা হলেই আর টের পাবে না। আজই তো আর প্রথম নয়, এর আগে আরও তিন-চারবার তো ম্যাও ম্যাও এসে গেছে, কিন্তু ধরতে পেরেছে কাউকে? নেংটি ইঁদুর একবার গর্তে ঢুকলে বেড়াল কিছু করতে পারে তার? এটা হল মা নেংটীশ্বরীর গর্ত, যতক্ষণ এখানে আছ—ততক্ষণ ওই যে ইংরেজিতে কী বলে—একেবারে সাউন্ড অ্যান্ড ফিউরি।

এর ভেতরে ক্যাবলা পণ্ডিতি করবার লোভ সামলাতে পারল না। টিকটিক করে বলতে লাগল : আজ্ঞে ভুল করছেন। ওটা সাউন্ড এন্ড ফিউরি নয়—সেফ অ্যান্ড সাউন্ড।

তাই শুনে লোকটার মুখ ঠিক একটা ছারপোকার মতো হিংস্র হয়ে গেল। বললে, তুমি থামো হে ছোকরা, বেশি পণ্ডিতি করো না। চল্লিশ বছর এই সাউন্ড অ্যান্ড ফিউরি দিয়ে চালিয়ে দিলুম, তুমি এসেছ ওস্তাদি করতে। বেশি বকিয়ো না এখন, বাইরে শত্রু ঝাঁ করে হয়তোবা কান ধরেই পেঁচিয়ে দেব তোমার।

ক্যাবলা রেগে ঠিক একটা টোমাটোর মতো রাঙা হয়ে গেল, তারপর কী একটা গোঁ-গোঁ। করে উঠেই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। ক্যাবলার পণ্ডিতি আমরা অবশ্য কেউই পছন্দ করি না, কিন্তু তাই বলে বাইরের একটা উটকো লোক এসে তার কান ধরতে চাইবে—সে স্কলারশিপ-পাওয়া কলেজের ছাত্র, এ-ও তো আমাদের পটলডাঙার একটা জ্বালাময়ী অপমান।

যা ভেবেছি তাই আমাদের লিডার টেনিদা সঙ্গে সঙ্গে গাঁ গাঁ করে উঠল।

-কী বলছেন মশাই, কান ধরে পেঁচিয়ে দেবেন। আমরা পটলডাঙার ছেলে-খেয়াল রাখবেন সেটা। হয় আপনার কথা উইথড্র করুন, নইলে এগিয়ে আসুন—হয়ে যাক এক হাত।

লোকটা বোধহয় এতটা আশা করেনি, কীরকম ভেবড়ে গেল কথাটা শুনে। একটু আগেই আমি অজ্ঞান হব হব ভাবছিলুম, এখন মনে হল মারামারিটা না দেখে অজ্ঞান হবার কোনও মানেই হয় না। চোখকান খুলে খুব খুশি হয়ে দেখতে পেলুম, টেনিদা আস্তিন গোটাচ্ছে।

–শিগগির উইথড্র করুন বলছি, নইলে–

লোকটা তালগাছের মত ঢ্যাঙা হলে কী হয়, বেজায় কাপুরুষ। আড়চোখে টেনিদার চওড়া চিতনো বুকের দিকে তাকিয়ে দেখল একবার। তারপর বললে, আহা—যেতে দাও, মানে বাইরে পুলিশ, এখন আত্মকলহ করে দরকার নেই। গোলমাল শুনলেই টের পেয়ে যাবে। তার চেয়ে এসোসরি বলে ফেলা যাক। ওই যে ইংরেজীতে কী বলে–ফরফিট অ্যান্ড ফরগেট–

ক্যাবলা বললে, উঁহু, আবার ভুল। ফরগিভ অ্যান্ড ফরগেট।

লোকটার মুখ আবার একটা ছারপোকার মুখের মতো হিংস্র হতে যাচ্ছিল, কিন্তু টেনিদার আস্তিনের দিকে তাকিয়ে কী রকম বিবর্ণ হয়ে গেল, তার মুখটাকে ফড়িংয়ের মুখের মতো মনে হল এখন। সে কেমন যেন পিঁপড়ে-পিঁপড়ে গলায় চু চু করে বললে, আচ্ছা-আচ্ছা, তাই হল, ফরগিভ অ্যান্ড ফরফিট।

-আবার ভুল করলেন। ফরফিট, নয় ফরগেট।

-তাই হবে, ফরগেট। আমি উইথড্র করলুম। ওহে ছোকরা, তুমি আর আস্তিনফাস্তিন গুটিয়ো না। ওদিকে বাইরে পুলিশ, এদিকে আবার হার্ট খারাপ, এর মধ্যে তুমি আবার যদি দুড়দুম করে আমাকে ঘুষি লাগিয়ে দাও—তা হলে আর আমি বাঁচব না।

টেনিদা খুশি হয়ে বললে, বেশ আসুন, হ্যান্ডশেক করি। ভাব হয়ে যাক।

-হ্যান্ডশেক? লোকটা সন্দেহে মিটমিটে চোখে চেয়ে রইল : শেষকালে পাঞ্জা ধরে আঙুল-টাঙুল ভেঙে দেবে না তো? আমার শরীর ভালো নয়, সে আগেই বলে রাখছি।

টেনিদা বললে, নানা, কোনও ভয় নেই আপনার। মা কালী, মা নেংটীশ্বরীর দিব্যি, আপনার আঙুলে চাপ দেব না নিন—আসুন হা ড়ু ড়ু—

লোকটা বললে, হা-ড়ু ড়ু? আমি তো কপাটি খেলিনি। আমি—

কিন্তু কথাটা শেষ হওয়ার আগেই বাইরে থেকে পরপর কয়েকটা জোরাল চিচির আওয়াজ উঠল। লোকটা সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে বলল, জয়গুরু লাইন ক্লিয়ার। ম্যাও ম্যাও চলে গেছে!

ঘড়ঘড়িয়ে দরজাটা খুলে গেল। যেন নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলুম আমরা। সব ভুলে-টুলে গিয়ে টেনিদা গলা খুলে চেঁচিয়ে উঠল : ডি লা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস—

সঙ্গে সঙ্গে আমরা বললাম, ইয়াক-ইয়াক।

লোকটা খানিকক্ষণ হাঁ করে চেয়ে রইল—এবার ঠিক আরশোলার মতো হয়ে গেল ওর মুখটা।কী বলে তোমরা চেঁচালে?

—ডি লা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস—ইয়াক-ইয়াক আমি জবাব দিলুম।

—মানে কী ওর?

হাবুল সেন বললে, এটা হৈল ফরাসী ভাষা। মানেটা হৈল গিয়া বড়ই কঠিন।

লোকটা পিপির করে বললে, তাই দেখছি। কিন্তু যাই বলো বাপু তোমাদের হালচাল আমি বুঝতে পারছি না। তোমরা কোন্ ব্রাঞ্চ থেকে আসছ? চট না চিটেগুড়? সঞ্চি না ধুচনি?

আমরা আর কেউ কিছু বলববার আগেই ফস করে ক্যাবলা বললে, কম্বল।

-কম্বল? লোকটা ভুরু কোষ্ঠকাল : বুঝেছি, কোনও নতুন ব্রাঞ্চ হবে। কিন্তু এখনও ওসম্বন্ধে আমরা কোনও খবর পাইনি। যাই হোক, ছড়া যখন জানো আর চাঁদনি পর্যন্তও গেছ তখন চন্দ্রকান্ত নাকেশ্বরের কাছেই এবার চলল। তার পারমিট পেলে তখনই ছল ছল খালের জল পেরুতে পারবে। আর ঘর থেকে বেরুবার আগে আরও একবার মা নেংটীশ্বরীকে প্রণাম করো, তিনি সব সিদ্ধি দেবেন।

আমরা আবার সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বললুম, জয় মা নেংটীশ্বরীর জয়।

 ০৭. সেই তালঢ্যাঙা লোকটার সঙ্গে

সেই তালঢ্যাঙা লোকটার সঙ্গে আমরা গুটি গুটি পায়ে বেরোলুম নেংটীশ্বরীর মন্দির থেকে। লোকটা বলল, এবার হাওয়া মহল। এই ডানদিকের সিঁড়ি।

একটা চওড়া সিঁড়ি ওপর দিকে উঠে গেছে, আমরা দেখতে পেলুম। এক সময়ে সিঁড়িটা খুব ভালো ছিল, পাথর-টাথর দিয়ে বাঁধানো ছিল বলে মনে হয়। এখন এখানে-ওখানে পাথর উঠে গিয়ে গর্ত হয়ে গেছে, এই দুপুর-বেলাতেও কেমন যেন একটা গুমোট অন্ধকার। মাঝে মাঝে রেলিং ভেঙে গেছে। লোকটা বললে, একটু সাবধানে এসো হে ইয়ে, কী বলে, সিঁড়িটা তেমন সুবিধের নয়। আমরাই কখনও কখনও আছাড়টাছাড় খাই। দুঃখের কথা আর কী বলব হে, আমাদের গুরুদেব বিটকেলানন্দ তো সিদ্ধপুরুষ, তা তিনিই একবার এমন কুমড়ো-গড়ান গড়ালেন যে–

হাবুল বললে, সিদ্ধপুরুষ অ্যাঁকেবারে ভাজাপুরুষ হইয়া গেলেন।

লোকটা থেমে দাঁড়িয়ে কটকট করে হাবুলের দিকে তাকালো। বললে, তুমি তো দেখছি ভারি ফক্কড় হে ছোকরা! গুরুদেবকে নিয়ে মস্করা।

ক্যাবলা বললে, ছেড়ে দিন, ওর কথা ছেড়ে দিন। ওটা একটা ঢাকাই পরোটা।

ঢাকাই পরোটা! তার মানে?

মানেটা বোঝার আগেই একটা চিৎকার ছাড়লুম আর গুরুজী বিটকেলানন্দের মতোই একটা কুমড়ো-গড়ান অনেক কষ্টে সামলে গেলুম। আমার দুকানে দুটো ঝাপটা মেরে ই-কি-কি বলতে বলতে একজোড়া চামচিকে কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেল।

লোকটা খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠল :ভয় নেই হে, ওরা আমাদের পোষা। কিছু বলে না কাউকে।

টেনিদা ব্যাজার হয়ে বললে, কী যা-তা বলছেন। চামচিকে কারও পোষা হয়?

হয়—হয়। গুরুজী বিটকেলানন্দ চামচিকে তো দূরের কথা ছারপোকাকে পর্যন্ত বশ মানাতে পারেন। হয়তো ডেকে বললেন, এই খটমলনিকাল আও বাচ্চা—জেরা ড্যানস করো, অমনি দেখবে তক্তপোশের ফাটল থেকে দলে দলে ছারপোকা বেরিয়ে ট্যাঙ্গো নাচ শুরু করেছে।

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলুম, ট্যাঙ্গো নাচ কাকে বলে?

লোকটা বললে, আমি কী করে জানব? অতই যদি জানব, তা হলে তো অ্যাঁদ্দিনে একটা কেষ্ট-বিষ্ণু হতে পারতুম। এসব ধাষ্টামো করে বেড়াতে হত না।

হাবুল মাথা চুলকোতে লাগল। ভেবে-চিন্তে বললে, তা হলে পাটকেলানন্দেরে ম্যাও ম্যাও-তে ধইর‍্যা লইয়া গ্যাল ক্যান? তিনি তো তাগোও ট্যাঙ্গো কইর‍্যা নাচাইতে পারতেন।

লোকটা আরশোলার মতো ঘাবড়ানোঘাবড়ানো মুখ করে বললে, বোকো না। এখন সবাই বেশ লক্ষ্মী ছেলের মতো চুপ করে থাকো দিকি। এইবার কাজের কথা হবে। আমরা এসে গেছি।

সত্যিই আমরা এসে গিয়েছিলুম। দোতলায়। সামনেই একটা ফাটল ধরা ময়লা মতন মস্ত বড় ন্যাড়া ছাদ। আর এক কোনায় একটা ঘর। ঘরের সামনে বড় একটা খাঁচা, তার ভেতরে একটা বাদুড় নীচে মাথা দিয়ে ঝুলে রয়েছে। আমাদের দিকে ঘুম-ঘুম চোখ মেলে চেয়ে দেখল একার।

ক্যাবলা বলে, ও কী স্যার—ওখানে একটা বাদুড় কেন?

বাদুড় বোলো না, ওর নাম অবকাশঞ্জিনী।

অবকাশরঞ্জিনী! ক্যাবলা খাবি খেলো : বাদুড়ের কখনও অমন নাম হয়?

হয়—হয়। নামের তোমরা কী জানো হে? এসব গুরুদেবের লীলা। জানোউনি একটা ছারপোকার নাম দিয়েছেন বিক্রমসিংহ। আর এই-যে বাদুড় দেখছ, ইটি সামান্যি নয়। এই-যে অবকাশঞ্জিনী—এ খুব ভালো ধামার গাইতে পারে।

টেনিদা হঠাৎ গাঁ-গাঁ করে বললে, কিছু বিশ্বাস করি না—একদম গুল।

গুল?—লোকটা কী রকম যেন কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল : বেশ, তা হলে এসব কথা থাক। এখন কাজের কথা হোক।

কার সঙ্গে কাজের কথা?—আমি ভীষণ আশ্চর্য হয়ে গেলুম : ওই অবকাশরঞ্জিনীর সঙ্গে নাকি?

চুপ!–ঠোঁটে আঙুল দিয়ে লোকটা বললে, দাঁড়াও।

সামনের ঘরটার দরজা ভেজানো ছিল। ঢ্যাঙা লোকটা আলগোছে একটা ধাক্কা দিতেই দরজাটা খুলে গেল। আর তক্ষুনি ভেতর থেকে যেন ক্যাঁকা করে বললে, দোহাই হুজুর, আমার জ্বর হয়েছে, ডিপথিরিয়া হয়েছে, পেটের মধ্যে রিং-ওয়ার্ম হয়েছে, কে জানে জলাতঙ্কও হয়েছে কিনা। আমি এখন যাকে-তাকে কামড়ে দিতে পারি। আমি কোনও কথাই জানিনে–হুজুর আমাকে ছেড়ে দিন।

আমরা দেখতে পেলুম, ঘরের ভেতরে মাদুর পাতা। তার ওপর একটা লোক একরাশ কাঁথা কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। আর খালি বিচ্ছিরি গলায় বলছে, আমার জলাতঙ্ক হয়েছে স্যার-মাইরি বলছি—এখন লোক পেলেই কামড়ে দেব।

তিন লাফ দিয়ে আমরা চারজন পিছিয়ে এলুম। ঢ্যাঙা লোকটা বললে, আঃ, কী হচ্ছে হে চক্রধর! খামকা ভদ্দরলোকের ছেলেদের ঘাবড়ে দিচ্ছ কেন? কম্বল ফেলেই চেয়ে দ্যাখোনা একবার। ম্যাও ম্যাও নেই, তারা অনেকক্ষণ চলে গেছে, আমি বিন্দেবন কথা কইছি।

শুনেই, কাঁথা-কম্বলের ভেতর যেন তুফান উঠল একটা। সেগুলোকে চারিদিকে ছিটকে ফেলে সোজা উঠে বসল একটা লোক যার বর্ণনা এর আগেই আমরা শুনেছি। আমরা চারজন দেখলুম, লোকটার কটকটে কালো রঙ, মুখে একটা ঝোল্লা গোঁফ, কপালের বাঁ-দিকে মস্ত আব। এই দারুণ গরমে কাঁথা-কম্বল চাপা দিয়ে সে ঘামে নেয়ে গেছে, কেমন ম্যাড়মেড়ে মুখ করে সে গঙ্গারামের মতো আমাদের দিকে চেয়ে রইল।

তারপর সে বিবেন,অথাৎ ঢ্যাঙা লোকটাকে বললে, তা তুমি এয়েচ, সেটা আগে কইতি কী হয়েচেল?

কইব কখন?—বিন্দেবন বিরক্ত হয়ে বললে, আমাদের সাড়া পেয়েই তুমি কাঁথার ভেতরে সেন্ধিয়ে ক্যাঁচর-ম্যাচর করতে লাগলে। বিদ্বেন দিব্যি তখন দেশী ভাষায় কথা বলতে লাগল।

সাবধানের বিনেশ নেই বুয়েচো না?—চক্রধর ফ্যাঁচ করে হেঁচে ফেলল : অ্যাঁই দ্যাকো—গরম কম্বল চাপিয়ে ঘেমে নেয়ে গেইচি, এখন বুঝি সর্দি লেগে গেল আবার। সে যাক—এঁয়ারা?

এঁয়ারা খদ্দের।

খদ্দের! আমরা এ ওর মুখের দিকে তাকালাম। টেনিদা কী একটা বলতেও যাচ্ছিল, ক্যাবলা তার পাঁজরায় ছোট্ট একটা চিমটি কাটল, আমি স্পষ্ট দেখতে পেলুম। আর চক্রধরও চোখ কুঁচকে আমাদের দিকে চেয়ে রইল—যেন ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না।

বললে, খদ্দের? এত ছেলেমানুষ?

টেনিদা বললে, আমরা কলেজে পড়ি। ছেলেমানুষ নই।

তা বটে—তা হলে তো আর ছেলেমানুষ কওয়া যায় না।

বিন্দেবন মাথা নাড়ল : তা ছাড়া ওঁরা ছড়া বলেচেন; চাঁদনিতে তোমার দোকানেও গেছলেন।—বিন্দেবন আমাদের দিকে তাকাল : বুঝছেন তো, ইনিই হচ্ছেন গুরুদেবের প্রধান শিষ্য-পাটকেলানন্দ। একেই বাইরের লোক চক্রধর সামন্ত বলে জানে। বসুন-বসুন আপনারা!

আমরা মাদুরে বসে পড়লুম।

পাটকেলানন্দ ওরফে চক্রধর এবার গম্ভীর হয়ে ঝোল্লা গোঁফে তা দিলে। তারপর খানিকক্ষণ ভাবুক-ভাবুক মুখ করে চোখ বুজে বসে রইল। সে যে আর চক্রধর নয়, একেবারে মূর্তিমান পাটকেলানন্দ, সেইটেই যেন বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করতে লাগল আমাদের। এতক্ষণ যে কম্বলের তলায় পড়ে ক্যাঁক্যাঁ করছিল, এখন আর তা বোঝবারও জো নেই।

বাইরে বাদুড়টা হঠাৎ খ্যাঁচম্যাচে আওয়াজ করে উঠল।

সেই আওয়াজে চক্রধর চোখ খুলল।

ঠিক আছে। অবকাশরঞ্জিনী সাড়া দিয়েছে। ঠিক আছে।

টেনিদা বোকার মতো বললে, মানে?

মানে অবকাশরঞ্জিনীর ভেতরে গুরুদেব যোগশক্তি সঞ্চার করেছেন। ও ক্যাঁচমেচিয়ে উঠলেই আমরা বুঝতে পারি, কোথাও কোনও গোলামাল নেই।

যদি ক্যাঁচম্যাচ না করে?—আমি জানতে চাইলুম।

তা হলে খোঁচা দিতে হয়।

যদি তাও চুপ কইরা থাকে?–হাবুল কৌতুহলী হল।

তখন বুঝতে হবে ব্যাপার খুব সঙ্গিন। তখন তক্তপোশের ফাটল থেকে বিক্ৰমসিংহকে ডাকতে হবে। যাকগে, সে সব অনেক কথা।—চক্রধর বললে, তা হলে আপনারা চারজন?

টেনিদা বললে, হুঁ, চারজন।

কোথায় থাকেন?

—পটলডাঙা।

ছড়া বলুনসঙ্গে সঙ্গে নামতা পড়ার মতো আমরা কোরাসে আরম্ভ করলুম : চাঁদ-চাঁদনিচক্রধর, চন্দ্রকান্ত নাকেশ্বর–

চক্রধর বললে, থাক–থাক, আর দরকার নেই। চন্দ্রকান্তকে ওখানে গিয়েই। পাবেন—মানে মহিষাদলে। এই বিলেবনই আপনাদের নিয়ে যাবে। টাকার রসিদ আছে তো?

টাকার রসিদ! আমি চমকে কী বলতে যাচ্ছিলুম, ক্যাবলা আমাকে একটা খোঁচা মারল। তারপর বললে,আজ্ঞে হ্যাঁ, রসিদ-উসিদ সব আছে। বাড়িতে রেখে এসেছি।

তা হলে আর কী? কবে যাবেন?

ক্যাবলা ফস করে বললে, রবিবার?

সে তো বেশ কথা। আমার দোকানের সামনে এসে দাঁড়াবেন। ভোর ছটার মধ্যে এলে চটপট চলে যেতে পারবেন, সন্দের মধ্যে ফিরেও আসতে পারবেন। রাজি?

আমরা কিছু বলার আগেই ক্যাবলা বললে, রাজি।

তা হলে এই কথা রইল।—চক্ৰধর আবার ফ্যাঁচ করে বেঁচে উঠল : ইঃ, জব্বর সর্দিটাই লাগল। খামকা ক্যাঁথা কম্বল চাপিয়ে মরুকগে, এখন মা নেংটীশ্বরীকে প্রণাম করে বাড়ি চলে যান। আর রবিবারে ভোর ছটায় আমার দোকানের সামনে এসে দাঁড়াবেন। ঠিক?

ক্যাবলা বললে, ঠিক।

জয় মা নেংটীশ্বরী—তোমারই ইচ্ছে মা!—চক্রধর শিবনেত্র হয়ে যেন ধ্যানে বসল। তারপর বললে, হাঁ, আর একটা কথা। যাবার আগে অবকাশরঞ্জিনীর ভোগের জন্য সপাঁচ আনা পয়সা রেখে যাবেন মনে করে।

 ০৮. রবিবার না হয় মহিষাদলেই গেলুম

সে তো হল। রবিবার না হয় মহিষাদলেই গেলুম। কিন্তু তারপর?

সবটাই কী রকম গোলমালে ঠেকছে। হতচ্ছাড়া কম্বলের আগাগোড়াই বিটকেল ব্যাপার। যখন নিরুদেশ হয়নি, তখন পাড়াসুদ্ধ লোকের হাড় ভাজাভাজা করে ফেলছিল; যখন উধাও হল তখনও মাথার ভেতরে বনবনিয়ে কুমোরের চাক ঘুরিয়ে দিলে।

আচ্ছা তোমারই বলল, লোকে কি আর নিরুদ্দেশ হয় না। পরীক্ষায় ফেল-টেল করে ঠেঙানি খাওয়ার ভয়ে কিংবা হয়তো ঠাকুদার কাছ থেকে একটা গিটার আদায় করবার আশায়, কেউ হয়তো বন্ধুর বাড়িতে চম্পট দেয়—আবার কেউ বা মাসি-পিসির বাড়িতে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। তারপর যেই বিজ্ঞাপন বেরুল : প্রিয় ট্যাঁপা, শীঘ্র ফিরিয়া আইস! মা মৃত্যুশয্যায়, তোমাকে কেহ কিছু বলিবে না, কিংবা স্নেহের ন্যাদা, তোমার ঠিকানা দাও—সকলেই কাঁদিতেছে তখন গর্তের থেকে পিঁপড়ের মতো সব সুড়সুড় করে একে-একে বেরিয়ে এল। তারপর রাত বুঝে কারও অদৃষ্টে চাঁটানি, কারও বা হাওয়াইয়ান গিটার!

কিন্তু এই সব ভালো ছেলেদের মতো বুঝেসুঝে নিরুদ্দেশ হবে, কম্বলচন্দর কি সে জাতের নাকি? তার কাকা বলে বসল—সে চাঁদে গেছে, তার নাকি ছেলেবেলা থেকেই চাঁদে যাওয়ার ন্যাক আছে একটা। এসব বাজে কথা কে কবে শুনেছে? তারপরে ল্যাঠার পর ল্যাঠা! কোত্থেকে কান ঘেঁষে এক আমের আঁঠি, একটা যাচ্ছেতাই ছড়া—চাঁদনির বাজার, শেয়ালপুকুর, পাটকেলানন্দ, মা নেংটীশ্বরী, ঝোল্লা-গোঁফ চক্রধর সামন্তবাদুড়ের নাম অবকাশঞ্জিনীধুত্তোর, কোনও মানে হয় এসবের?

এতেও শেষ নয়। এখন আবার ঘাড়ে চড়াও হয়েছে এক তালঢ্যাঙা বিবেন। আবার তার সঙ্গে রবিবারে মহিষাদলে যেতে হবে। মহিষাদল নামটাই যেন কী রকম—শুনলেই মনে হয় একদল বুনো মোষ শিং বাগিয়ে তাড়া করে আসছে। কপালে কী আছে, কে জানে। চন্দ্রকান্ত নাকেশ্বর আমাদের কোন্ চাঁদে নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দেবে—তাই বা কে বলতে পারে।

তারপর আবার কী সব রসিদ-ফসিদের কথাও বলছি চক্রধর। তার মানে, অনেক গণ্ডগোল আছে ভেতরে। ক্যাবলা সমানে তো টিকটিক করছে, কিন্তু মহিষাদলের মোষদের পাল্লায় পড়ে–

আমি আর হাবুল সেন এসব নিয়ে অনেক গবেষণা করলুম।

হাবুল ভেবে-চিন্তে বললে, সত্য কইছিস প্যালা। আমরা ফ্যাচাঙে পড়ম।

আমি বললুম, পেছনে আবার পুলিশ আছে ওদের। কী করছে লোকগুলো কে জানে। শেষকালে আমাদের সুষ্ঠু ধরে নিয়ে যাবে।

হাবুল—তা লইয়া যাইব। লইয়া গিয়া রাম-পিটানি দিব।

আমি বললুম, আর বাড়িতে?

—কান ধইরা ছিড়া দিব। পুলিশের পিটুনির থিক্যাও সেটা খারাপ।

আমি বললুম, অনেক খারাপ। তোর হয়তো একটা কান ছিঁড়ে দেবে, কিন্তু মেজদার বরাবর নজর আমার কানের দিকেই। ওর ডাক্তারি কাঁচি দিয়ে কচাকচ করে কেটে নেবে।

হাবুল কিছুক্ষণ ভাবুকের মতো আমার কানের দিকে চেয়ে রইল। শেষে মাথা নেড়ে বললে, তা কাইট্যা নিলে তোরে নেহাত মন্দ দ্যাখাই না। তোর খাড়া খাড়া কান দুইখান

আমি বললুম, শাট আপ! বন্ধু-বিচ্ছেদ হয়ে যাবে হাবলা।

হাবুল ফের বললে, আইচ্ছা, মনে যদি কষ্ট পাস, তাইলে ওই সব কথা থাকুক। তোর আদরের কান দুইখ্যান লইয়া তুই ঘাস-ফাস চাবা। তা অখন কী করন যায়, তাই ক।

আমার ইচ্ছে করছিল হাবলাকে একটা চড় বসিয়ে দিই, কিন্তু ভেবে দেখলুম এখন গৃহযুদ্ধের সময় নয়। এই সব ঝামেলা মিটে যাক, তারপর হাবলার সঙ্গে একটা ফয়সালা করা যাবে।

রাগ-টাগ সামলে নিয়ে বললুম, তা হলে চল, ক্যাবলার কাছে যাই। তাকে গিয়ে বলি—যা হয়েছে বেশ হয়েছে। আর দরকার নেই, চন্দ্রকান্ত নাকেশ্বরের চাঁদবদন না দেখলেও আমাদের চলবে।

হাবুল বললে, হ। দ্যাখনের তো কত কী-ই আছে। ইচ্ছা হইলেই তো চিড়িয়াখানায় গিয়া আমরা জলহস্তীর বদনখান দেইখ্যা আসতে পারি। আর কম্বলরে দিয়াই বা আমাগো কী হইব? পোলা তো না—য্যান, একখানা চামচিকা। চক্ৰধরের অবকাশরঞ্জিনীর থিক্যাও খারাপ।

আমি সায় দিয়ে বললুম, বিক্রমসিংহের চাইতেও খারাপ। সে তো শুধু ছারপোকা, ও একটা কাঁকড়াবিছে।

এই সব ভালো ভালো আলোচনা করে আমরা ক্যাবলার কাছে গেলুম। কিন্তু তাকে বাড়িতে পাওয়া গেল না। তার মা—মানে মাসিমা ছানার মুড়কি তৈরি করছিলেন, আমাদের বসিয়ে তাই খেতে দিলেন। আমরা ক্যাবলার ওপর রাগ করে এত বেশি খেয়ে নিলুম যে ক্যাবলার জন্যে কিছু রইল বলে মনে হল না।

পেট ঠাণ্ডা হলে মন খুশি হয়, আমরা দুজনে বঙ্গ আমার জননী আমার গাইতে গাইতে যেই টেনিদার বাড়ির কাছে পৌঁছেছি, অমনি কোত্থেকে হাঁ হাঁ করে বেরিয়ে এল টেনিদা।

—বেলা দশটার সময় অমন গাঁক-গাঁক করে চ্যাঁচাচ্ছিস যে দুজনে? ব্যাপার কী? হাবুল বললে, আমারা সঙ্গীত-চর্চা করতে আছিলাম।

—সঙ্গীত-চর্চা? ওকে চচ্চড়ি বলে। তোদের গানের চোটে পাড়ায় আর কুকুর থাকবে মনে হচ্ছে। তা এত আনন্দ কেন? কী হয়েছে?

–আমরা ক্যাবলার বাড়িতে গিয়ে ছানার মুড়কি খেয়ে এসেছি। আমি জানালুম।

—অ, তাই এত ফুর্তি হয়েছে। তা আমাকে ডেকে নিলি না কেন? ক্যাবলাও এমন বিশ্বাসঘাতক?

–ক্যাবলাকে বাড়িতে পাইনি। আর তোমার কথা আমাদের মনে ছিল না।

—মনে ছিল না?-টেনিদা চটে গেল। মুখটাকে বেগুনভাজার মতো করে বলল, ভালো কাজের সময় মনে থাকবে কেন?—যা বেররা এখান থেকে, গেট আউট।

আমি বললুম, আউট আবার কোথায় হব? বেরুবার আর জায়গা কোথায়? আমরা তো রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে রয়েছি।

টেনিদার মুখটা এবারে ধোঁকার ডালনার মতো হয়ে গেল। আরও ব্যাজার হয়ে বললে, ইচ্ছে করছে, দুই চড়ে তোদের দাঁতগুলোকে দাঁতনে পাঠিয়ে দিই। তা হলে মর গে যা রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে কুকুর তাড়া গে।

হাবুল বললে, না, কুকুর তাড়ামু না। তোমার কাছে আসছি।

—আমাকে তাড়াতে চাস?

–বালাই, ষাইট। তোমারে তাড়াইব কেডা? তুমি হইলা আমাগো লিডার—যারে কয় ছত্রপতি। তোমার কাছে অ্যাঁকটা নিবেদন আছিল।

—ইস্, ছানার মুড়কি খেয়ে খুব যে ভালো-ভালো কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে। টেনিদা একটা ভেংচি কাটল : তা, নিবেদন কী?

আমরা মহিষাদলে যামু না। মইষে গুঁতাইয়া মারব।

যাসনে। বাঘাটে গলায় টেনিদা বললে, লোকের বাড়ি বাড়ি চেয়ে-চিন্তে খেয়ে বেরা। কাপুরুষ কোথাকার। কাওয়ার্ডস মেনি ডেথ ডাইজ—ইয়েটাইম—মানে বিফোর—

আমি বললুম, উঁহু, ভুল হল। কাওয়ার্ডস ডাই মেনি ডেথস—

ছানার মুড়কির রাগ টেনিদা ভুলতে পারছিল না, চিৎকার করে বললে, শাটা! তোকে আর আমার ইংরিজী শুদ্ধ করতে হবে না—নিজে তো একত্রিশের ওপরে নম্বর পাস্ না! মরুক গে, কোথাও যেতে হবে না তোদের। আমি আর ক্যাবলা যাব, একটা দারুণ চক্রান্ত থেকে উদ্ধার করব কম্বলকে, বীরচক্র পুরস্কার পাব আর তোরা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকবি। কম্বলের কাকা যখন খ্যাঁট দেবে, তখন পোলাওয়ের গন্ধে দরজায় তোরা ঘুরঘুর করবি, ঢুকতে দেবে না, পিটিয়ে তাড়িয়ে দেবে।

এই বলে টেনিদা বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ল, তারপর ধড়াস করে বন্ধ করে দিল দোরটা।

তখন আমি আর হাবুল সেন এ ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলুম। আমি বললুম, বুঝলি হাবল, ব্যাপারটা রীতিমতো সঙ্গিন।

হাবুল বললে, হ। টেনিদা যারে পুঁদিচ্চেরি কয়, তাই। কীরকম য্যান মেফিস্টোফিলিস মেফিস্টোফিলিস মনে হইতাছে।

আমি বললুম, তা হলে তো যেতেই হয়, কী বলিস?

হইবই তো। বীরচক্র আমরাই বা পামু না ক্যান? আর কম্বলের কাকা যখন অগো মাংস-পোলাউ খাওয়াইব–

আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললুম, আর বলিসনি, মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। দেখিস, আমরাও খাব, নিশ্চয় খাব।

যা থাকে কপালে—পটলডাঙা জিন্দাবাদ! আমরা চারজন—সেই কথামতো-চক্রধরের দোকানের সামনে থেকে, বিন্দেবনের সঙ্গে, মহিষাদলে বেরিয়ে পড়েছি। বাড়িতে বলে এসেছি, রবিবারে এক বন্ধুর ওখানে নেমন্তন্ন খেতে যাচ্ছি, সন্ধেবেলায় ফিরে আসব।

আসবার আগে মেজদা বলে দিয়েছে, পরের বাড়িতে গিয়ে মওকা পেয়ে যা-তা খাসনে। ওই তোর পিলে-পটকা শরীর, শেষকালে একটা কেলেঙ্কেরি বাধাবি।

কী খাওয়া যে কপালে আছে—সে শুধু আমিই বুঝতে পারছি। কিন্তু বেঁচে থাকতে কাওয়ার্ড হওয়া যায় না—না হয় মোষের তোতেই প্রাণ দেব। আমি কেবল বললুম, আচ্ছা—আচ্ছা।

-আচ্ছা-আচ্ছা কী? যদি পেটের গোলমাল হয়, তা হলে তোকে ধরে আটটা ইজেকশন দেব—সে কথা খেয়াল থাকে যেন।

বাড়ির ছোট ছেলে হওয়ার সবচাইতে অসুবিধে এই যে, কোথাও কোনও সিমপ্যাথি পাওয়া যায় না। এমনি ভালোমানুষ ছোটদি পর্যন্ত খ্যাখ্যা করে হাসছিল। আমি চটে-মটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি। এই সব অপমান সহ্য করার চাইতে মৃত্যুও ভালো।

পাঁশকুড়া লোক্যালে চেপে আমরা রওনা হয়েছি হাওড়া থেকে। বিন্দেবন বললে, আমাদের নামতে হবে মেচেদায়, সেখান থেকে বাসে করে তমলুক হয়ে মহিষাদল। শুনে যতদূর মনে হচ্ছে তা নয়—যেতে বেশি সময় লাগবে না।

কিন্তু মেচেদা নাম শুনেই আমার কী-একটা ভীষণভাবে মনে পড়ছিল। একবার মামার সঙ্গে মেদিনীপুরে যাওয়ার সময়—এই মেচেদাতে—ঠিক ঠিক!

আমি বলে ফেললুম, খুব ভালো সিঙাড়া পাওয়া যায় কিন্তু!

টেনিদার চোখ চকচক করে উঠল। কিন্তু বিন্দেবনের সামনে প্রেস্টিজ রাখবার জন্যেই বোধহয়, দাঁত খিঁচিয়ে আমাকে ধমক দিলে একটা : এটা একটা রাক্ষস। রাতদিন কেবল খাই-খাই।

বিন্দেবনকে যতটা খারাপ লোক ভেবেছিলুম, দেখলুম সে তা নয়। মিটমিট করে বললে, তা ছেলেমানুষ, খিদে তো পেতেই পারে। খাওয়াব খোকাবাবু—মেচেদার সিঙাড়া খাওয়াব, কিচ্ছুটি ভাবতে হবে না! তারপর কলেজের ছেলে হয়েও তোমরা যখন আমাদের দলে এয়েছ, তখন তো মাথার মণি করে রাখব তোমাদের।

দলে এয়েচ! এই কথাটাই আমার কেমন ভালো লাগল না। মনে পড়ল মা নেংটীশ্বরীর সেই মূর্তি—যেন দাঁত বের করে কামড়াতে আসছে। মনে পড়ল, হঠাৎ সেই ম্যাও-ম্যাও এসে হাজির—চারিদিকে কী রকম সামাল-সামাল রব। এদের পাল্লায় পড়ে কোথায় চলেছি আমরা? কী আছে আমাদের কপালে?

টেনিদার দিকে চেয়ে দেখলুম। হাঁড়ির মতো মুখ করে বসে রয়েছে। বীরচক্র পাবার জন্যে তখন খুব লাফালাফি করছিল বটে, কিন্তু এখন যেন কেমন ভেবড়ে গেছে বলে মনে হল। হাবুলকে বোধহয় গাড়ির বেঞ্চিতে ছারপোকায় কামড়াচ্ছিল—সেই বিক্রমসিংহই কি না কে জানে—সে কিছুক্ষণ পা-টা চুলকে হঠাৎ বিচ্ছিরি গলায় গান ধরল :

এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি-সকল দেশের রানী–ইয়ে একবার খুব জোরে গা চুলকে প্রায় দাপিয়ে উঠল : ইস্ কী কামড়াইতেছে রে! সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি–

তার গান আর গা চুলকোনোতে প্রায় খেপে গেল টেনিদা। চেঁচিয়ে বললে, জন্মভূমি না তোর মুণ্ডু! চুপ কর বলছি হাবলা, নইলে জানালা গলিয়ে বাইরে ফেলে দেব তোকে।

বিন্দেবন বললে, আহা দাদাবাবু তো ভালোই গাইছেন! থামিয়ে দিচ্ছেন কেন?

তা হলে হাবুলের গানও কারও ভালো লাগে! হাবুল এত আশ্চর্য হল যে, গা চুলকোতে পর্যন্ত ভুলে গেল। ক্যাবলা একটা ওয়াইড ওয়ার্লর্ড ম্যাগাজিন পড়ছিল, সেটা খসে পড়ল তার হাত থেকে। টেনিদা বললে, কী ভয়ানক!

বিন্দেবন জানলার বাহিরে মুখ বাড়িয়ে বললে, এই যে, কোলাঘাট এসে গিয়েছে। এর পরেই আমরা পৌঁছে যাব মেচেদায়।

০৯. মেচেদার সিঙাড়া-টিঙাড়া খেয়ে

মেচেদার সিঙাড়া-টিঙাড়া খেয়ে, সেখান থেকে বাসে করে তমলুক পৌঁছনো গেল। সেখান থেকে আবার বাস বদলে মহিষাদলে।

নাম শুনে যেরকম ভয়-টয় ধরে যায়, গিয়ে দেখলুম আদৌ সেরকম নয়। বরং বেশ ছিমছাম জায়গাটা—দেখে-টেখে ভালোই লাগে। খুব বড় একটা রাজার বাড়ি আছে, একটা উঁচু রথ আছে, বাজার আছে, অনেক লোকজন আছে। মানুষগুলোকেও তো বেশ সাদা-মাটা মনে হল, কোথাও যে কোনও ঘোর-প্যাঁচ আছে সেটা বোঝা গেল না। আর একটা মোটে মোষ দেখতে পেলুম, একজন তার গলায় দড়ি বেঁধে নিয়ে যাচ্ছিল, সুড়সুড় করে চলে যাচ্ছিল, আমাদের দেখে সে মোটেই তোতে চাইল না।

বিন্দেবন তিনটে রিকশা ডাকল। বললে, তা হলে চলুন, একেবারে মালখানাতেই যাওয়া যাক।

টেনিদা বললে, মালখানা? সে আবার কোথায়?

বিন্দেবন বললে, দেখা নেই তো সব। চন্দ্রকান্তদার সঙ্গে সেখানেই দেখা হবে। তিনি মালপত্তর সব দেখিয়ে দেবেন। তারপর কলকাতায় কোথায় আপনারা ডেলিভারি নেবেন, সেসবও ওখানেই ঠিক হয়ে যাবে।

মালপত্তর! আমি আর ক্যাবলা একটা রিকশায় চেপে বসেছিলুম। মালপত্তর শুনেই আমার কীরকম যেন বিচ্ছিরি লাগল, সেই শেয়ালপুকুরের কথা মনে পড়ে গেল, মনে পড়ল সেই ম্যাও ম্যাও আসবার কথা, আমি ক্যাবলাকে চিমটি কাটলুম একটা।

ক্যাবলা আমাকে পালটা এমন আর-একটি চিমটি কাটল যে আমি প্রায় চ্যাঁ করে চেঁচিয়ে উঠতে গিয়ে সামলে নিলুম। ক্যাবলা আমার কানে কানে বললে, এখন চুপ করে থাক না—গাধা কোথাকার।

চিমটি আর গাধা শব্দ এ-অবস্থাতে আমাকে হজম করে নিতে হল কী আর কথা! সব ব্যাপারটাই এখন এমন ঘোলাটে মনে হচ্ছে যে আমি গাধার মতোই চুপ করে বসে রইলুম। অবিশ্যি গাধা যে সব সময়ে চুপচাপ বসে থাকে তা নয়—মনে একটু ফুরতি টুরতি হলেই বেশ দরাজ গলায় প্যাঁহোঁ হ্যাঁ হে বলে তারস্বরে গান গাইতে থাকে। আমার গলায় টান-টান শুকিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু–

কিন্তু কুঁই কুঁই করে কেমন একটা বেয়াড়া গানের আওয়াজ আসছে না? আসছেই তো। তাকিয়ে দেখলুম, সামনের রিকশাতে বসে গান ধরেছে তালঢ্যাঙা বিন্দেবন।

এমন চাঁদের আলো, মরি যদি সেও ভালো—

এ যে দেখছি গানের একেবারে গন্ধর্ব! আমার চাইতেও সরেস, হাবলার ওপরেও এক কাঠি। এমন ভালো গানটারই বারোটা বাজিয়ে দিলে! তা ছাড়া এমন সকালের রোদ্দুরে চাঁদের আলোই বা পেলে কোত্থেকে! সেই চাঁদের আলোয় বিবেন আবার মরতেও চাইছে। তা নিতান্তই যদি মরতে চায়, তা হলে নয় মারাই যাক, আমরাও ওর জন্যে শোকসভা করতে রাজি আছি, কিন্তু সে-জন্যে অমন চামচিকের মতো গলায় গান গাইবার মানে কী? নিজে এমন গাইয়ে বলেই বোধহয় সে হাবলার গানের তারিফ করছিল।

রিকশা বেশ ঠনুতুন করে নিরিবিলি রাস্তা দিয়ে এগোচ্ছিল। দু-দিকে বাড়ি-টাড়ি আছে, গাছপালা, মাঠ এইসব আছে, ভারি সুন্দর হাওয়া দিয়েছে, আকাশটা যেন নীল চোখ মেলে চেয়ে রয়েছে, এদিকে আবার একটা খালের জল রোদে ঝিলমিল করে উঠছে। বিদ্বেনের মনে ফুর্তি হতেই পারে, কিন্তু তাই বলে

আমি আর থাকতে পারলুম না। ক্যাবলাকে জিজ্ঞেস করলুম, চামচিকের গান শুনেছিস কখনও?

ক্যাবলা বললে, না।

তা হলে ওই শোন। বিবেন গান গাইছে।

ক্যাবলা বললে, চামচিকে তো তবু ভালো। তুই গান গোিল তো মনে হয় যেন হাঁড়িচাঁচা ডাকছে। এখন আর ইয়ার্কি করিসনে প্যালা—অবস্থা খুব সঙ্গিন। আমরা দারুণ বিপদের মধ্যে পড়তে যাচ্ছি।

দারুণ বিপদ! শুনেই আমি খাবি খেলুম। বিবেনের গান শুনে, সবুজ, মাঠ, নীল আকাশ আর ঝিরঝিরে হাওয়ার ভেতরে মনটা বেশ খুশি হয়ে উঠেছিল, কিন্তু ক্যাবলা আমাকে এমন দমিয়ে দিলে যে বুকের ভিতরটা ধড়ফড় করতে লাগল।

চিঁ চিঁ করে বললুম, কী বিপদ?

একটু পরেই জানতে পারবি।

তা হলে আমরা রিকশা চেপে কেন যাচ্ছি বিন্দেবনের সঙ্গে? নেমে পড়ে সোজা চম্পট দিলেই তো পারি। ইচ্ছে করে কেন পা বাড়াচ্ছি বিপদের ভেতর?

ক্যাবলা আরও গম্ভীর ভাবে বললে, আর ফেরবার পথ নেই। এখন একটা এসপার-ওসপার হয়ে যাবে।

আমি বললুম, কিন্তু ওসপার করে কী লাভ? এসপারে থাকলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়।

—তা যায় কিন্তু কম্বলকে তা হলে পাওয়া যাবে কী করে?

ঠিক কথা। ওই লক্ষ্মীছাড়া কম্বল। যত গণ্ডগোল ওকে নিয়েই। মাস্টারের ভয়ে পালালি তো পালালি—আবার বিটকেল একটা ছড়া লিখে গেলি কী জন্যে? চাঁদে গেছে না হাতি। সেই-যে কারা সব নরমাংস খায়, তাদের ওখানে গিয়ে হাজির হয়েছে, আর তারা কম্বলকে দিয়ে অম্বল বেঁধে খেয়ে বসে আছে।

কিন্তু কম্বলকে কি কেউ খেয়ে হজম করতে পারবে? আমার সন্দেহ হল। ও ঠিক বাতাপি কিংবা ইম্বলের মতো তাদের পেট ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে। যেদিন কম্বল কোত্থেকে দুটো গুবরে পোকা এনে আমার শার্টের পকেটে ছেড়ে দিয়েছিল, সেদিন থেকেই ওকে আমি চিনে গেছি।

এই সব ভাবছি, হঠাৎ ক্যাবলা আমার কানে কানে বললে, প্যালা!

আমি দারুণ চমকে গিয়ে বললুম, আবার কী হল?

—এই যে খালের ধার দিয়ে আমরা যাচ্ছি, এ দেখে কিছু মনে হচ্ছে না তো?

—কী আবার মনে হবে?

ক্যাবলা আরও ফিসফিস করে বললে, আভিতক তুম্ নেহি সমঝা? আরে, সেই যে ছড়াটা, ছল ছল খালের জল—

ঠিক ঠিক। নিরাকার মোষের দল—মানে মোষ-টোষ বিশেষ কিছু নেই অথচ মহিষাদল আছে, আর দেখাতেই ছল ছল—আরে অক্ষরে-অক্ষরেই মিলে যাচ্ছে যে!

ক্যাবলা মিটমিট করে হেসে বললে– কী বুঝছিস?

—কিছুই না।

—তোর মাথা তো মাথা নয়, যেন একটা খাজা কাঁটাল। চশমাপরা নাকটাকে কুঁচকে, মুখখানাকে স্রেফ আমড়ার চাটনির মতো করে ক্যাবলা বললে, এটাও বুঝতে পারছিস না? এবার রহস্য প্রায় ভেদ হয়ে এল।

—কিন্তু ভেদ করবার পরে আমাদের অবস্থা কী হবে? আমাদের সুদ্ধ ভেদ করে দেবে না তো?

—দেখাই যাক। আগেই ঘাবড়াচ্ছিস কেন?

বলতে বলতে রিকশা থেমে গেল। সামনেই একটা হলদে দোতলা বাড়ি। তার নাম লেখা আছে বড় বড় হরফে : চন্দ্র নিকেতন।

রিকশা থেকে নেমে বিনে ডাকতে লাগল : আসুন দাদাবাবুরা, নেমে আসুন। এই বাড়ি।

ক্যাবলা আবার আমার কানে কানে বললে, এইবারে শেষ খেলবুঝেছিস? বাড়ির নাম চন্দ্র নিকেতন—অর্থাৎ কিনা—চাঁদে চড়-চাঁদে চড়। এইটেই তা হলে শ্রীকম্বলের সেই চাঁদ।

-কম্বলের চাঁদ! এইখানে?—আমি কিছুই বুঝতে পারলুম না।

ক্যাবলা বললে, বোকার মতো বসে আছিস কী? টেনিদা, হাবলা আর বিবেন যে ভেতরে চলে গেল। নেবে আয়—নেবে আয়–

ওদিক থেকে বিন্দেবনের হাঁক শোনা গেল : অ রিকশোওলারা—একটু পেঁইড়ে যাও, আমি এক্ষুনি তোমাদের পয়সা এনে দিচ্চি।

বিন্দেবন একটা মস্ত ঘরের ভেতর আমাদের নিয়ে বসাল।

ঘরের আধখানা জুড়ে ফরাস পাতা—তার ওপর শাদা চাদর বিছানো। বাকি আধখানায় মস্ত একটা দাঁড়িপাল্লা আর কতগুলো কিসের বস্তা যেন সাজানো রয়েছে। একটা ছোট্ট কুলুঙ্গিতে সিঁদুর-মাখানো গণেশের মূর্তি। দেওয়ালে একটা রঙিন ক্যালেন্ডার রয়েছে তাতে লেখা আছে বিখ্যাত মশলার দোকান শ্রীরামধন খাঁড়া, খড়গপুর বাজার, মেদিনীপুর। দেওয়ালে আবার দুতিন জায়গায় সিঁদুর দিয়ে লেখা রয়েছে জয় মা। মা যে কে ঠিক বুঝতে পারলুম না, বোধ হল নেংটীশ্বরীই হবেন। কিন্তু এসব জয় মা আর খাঁড়া টাঁড়া আমার একদম ভালো লাগল না, বুকের ভেতরটায় কী রকম ছাঁৎ করে উঠল, একেবারে পাঁঠাবলির কথা মনে পড়ে গেল।

আমরা চারজনে বসে আছি। ক্যাবলা গম্ভীর, টেনিদা, মিটমিট করে তাকাচ্ছে। এদিক-ওদিক, হাবুল এক মনে পা চুলকোচ্ছে—বোধহয় ট্রেনের ছারপোকাগুলো ঢুকে আছে। ওর জামাকাপড়ের তলায়। আমি ভাবছি, ওই খাঁড়া-টাড়া দিয়ে ওরা জয় মা বলে কম্বলকে বলি দিয়েছে কি না, এমন সময়–

দুজন লোক ঘরে এল। বেশ ভালো মানুষের মতোই তাদের চেহারা, তার চাইতেও ভালো তাদের হাতের প্লেট নামিয়ে দিয়ে বলা, একটু জলযোগ করুন বাবুরা, কত্তা এখনি আসছেন।

মেচেদার সিঙাড়া এর মধ্যেই যখন তলিয়ে গিয়েছিল, আমরা খুশি হয়েই কাজে লেগে গেলুম। প্লেটে তিন-চার রকমের মিষ্টি, কাজু বাদাম, কলা। মোতিচুরের লাড়ুতে কামড় দিয়েই আবার আমার মনটা ছটফটিয়ে উঠল। বলির পাঁঠাকেও তো বেশ করে কাঁটাল পাতা-টাতা খাওয়ায়। এরাও কি–

আমি বললুম, ক্যাবলা—এরা—

ক্যাবলা কেবল ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বললে, চুপ।

এর মধ্যেই দেখলুম টেনিদা হাবুলের প্লেটের থেকে কী একটা খপ করে তুলে নিলে। আর তুলেই গালে পুরল। হাবুল চ্যাঁ-চ্যাঁ করে কী যেন বলতেও চাইল, সঙ্গে সঙ্গেই তার মাথায় বাঁ-হাত দিয়ে ছোট্ট একটা গাঁট্টা মারল টেনিদা।

-যা-যা, ছেলেমানুষের বেশি খেতে নেই। অসুখ করে।

একটা শান্তিভঙ্গ ঘটতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই ঘরে ঢুকল বিবেন। আর পেছনে যিনি ঢুকলেন–.

বলবার দরকার ছিল না, তিনি কে। তাঁর নাকের দিকে তাকিয়ে আমরা বুঝতে পারলুম। আমাদের টেনিদার নাক চেয়ে দেখবার মতো আমরা সেটাকে মৈনাক বলে থাকি, কিন্তু এর নাকের সামনে কে দাঁড়ায়। প্রায় আধ-হাতটা লম্বা হবে মনে হল আমার—এনাক দিয়ে দস্তুরমতো লোককে গুঁতিয়ে দেওয়া চলে।

আধবুড়ো লোকটা চকচকে টাক আর কাঁচা পাকা গোঁফ নিয়ে এক গাল হাসল। সে-হাসিতে নাকটা পর্যন্ত জ্বলজ্বল করে উঠল তার। বললে, দাদাবাবুরা দয়া করে আমার বাড়িতে এয়েচেন, বড় আনন্দ হল আমার। অধমের নাম হচ্ছে চন্দ্রকান্ত চাঁই—এঁরা আদর করে আমায় নাকেশ্বর বলেন।

টেনিদা আবার কী-একটা হাবুলের প্লেট থেকে তুলে নিয়ে গালে চালান করল। তারপর ভরাট-মুখে বললে, আজ্ঞে হ্যাঁ, আমাদেরও ভারি আনন্দ হল।

চন্দ্রকান্ত ফরাসে বসে পড়ে বললে, অল্প বয়সেই আপনারা ব্যবসা বাণিজ্যে মন। দিয়েছেন। এ ভারি সুখের কথা। দিনকাল তো দেখতেই পাচ্ছেন। চাকরিবাকরিতে আর কিছু নেই, একেবারে সব ফক্কা! এখন এই সব করেই নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে হবে। আমাদের বিটকেলানন্দ গুরুজী সেই জন্যেই আমাদের মন্তর দিয়েছেন : ধনধাত্রী মা নেংটীশ্বরী, তোমারই ল্যাজ পাকড়ে ধরি।—আহা।

শুনেই বিবেনের চোখ বুজে এল। সেও বললে, আহা-হ্‌।

চন্দ্রকান্ত বলে চলল, মা নেংটীশ্বরীর অপার দয়া যে আপনারা এই বয়েসেই মার ল্যাজে আশ্রয় পেলেন। জয় মা।

বিন্দেবনও সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠল : জয় মা। তাই দেখে আমরা চারজনও বললুম, জয় মা!

আমরা তিনজন ভালোই খেয়ে নিয়েছিলুম এর ভেতর, কেবল হাবুল সেন হাঁড়ির মত মুখ করে বসে ছিল।

টেনিদা খেয়ে-দেয়ে খুশি হয়ে বললে, আপনাদের এখানে তো বেশ ভালোই মিঠাই পাওয়া যায় দেখছি। মানে, কলকাতায় আমরা তো বিশেষ পাই-টাই না—মানে ছানা-টানা বন্ধ–

চন্দ্রকান্ত বললে, বিলক্ষণ। আমাদের এখানকার মিষ্টি তো নামকরা। আরও কিছু আনাব?

টেনিদা ভদ্রতা করে বললে, নামানে, ইয়ে—এই হাবুল একটা চমচম খেতে চাইছিল

—নিশ্চয়-নিশ্চয়, চন্দ্রকান্ত ব্যতিব্যস্ত হয়ে ডাকল, ওরে বিধু, আরও কটা চমচম নিয়ে আয়। আরও কিছু এনো।

চন্দরদা, এত আদর করে খাওয়াচ্ছ কাকে?বাজখাঁই গলায় সাড়া দিয়ে আর একটি লোক ঘরে ঢুকল। হাতকাটা গেঞ্জির নীচে তার চুয়াল্লিশ ইঞ্চি বুকের ছাতি, ড়ুমো ড়ুমো হাতের মাল্ল, ছাঁটা ছাঁটা ছোট চুল, করমচার মতো টকটকে লাল তার চোখের দৃষ্টি।

চন্দ্রকান্ত বললে, এঁরা কলকাতা থেকে এয়েচেন—ছড়া বলেচেন—আমাদের হেড আপিসে গিয়েছেন

সেই প্রকাণ্ড জোয়ান লোকটা হঠাৎ ঘর ফাটিয়ে একটা হুঙ্কার করল। বললে, চন্দরদা, সর্বনাশ হয়েছে। এরা শত্রু।

আমরা যত চমকালুম, তার চাইতেও বেশি চমকাল চন্দ্রকান্ত আর বিবেন!–শত্রু।

আলবাত।—দাঁতে দাঁতে কিশ কিশ করতে করতে একটা রাক্ষসের মতো আমাদের। দিকে এগিয়ে আসতে লাগল জোয়ানটা : আমি খগেন মাশ্চটক—আমার সঙ্গে চালাকি। এরা সেই পটলডাঙার চারজন—চাটুজ্যেদের রোয়াকে বসে থাকে, আমার সেই বিচ্ছু ছাত্র কম্বলকে এদের পিছে পিছেই আমি ঘুরঘুর করতে দেখেছি। করমচার মতো চোখ দুটোকে বনবন করে ঘোরাতে ঘোরাতে খগেন মাশ্চটক বললে, এত বড় এদের সাহস যে আজ একেবারে বাঘের গর্তে এসে মাথা গলিয়েছে। আজ যদি আমি এদের পিটিয়ে মোগলাই পরোটা না করে দিই, তা হলে আমি মিথ্যেই স্বামী বিটকেলানন্দের চ্যালা?

১০. টেনিদার ভাষায় বলা—পুঁদিচ্চেরি

একেই বলে আসল পরিস্থিতি—টেনিদার ভাষায় বলা—পুঁদিচ্চেরি।

ঘরের ভিতরে বাজ পড়েছে—এই রকম মনে হল। চন্দ্রকান্ত আর বিন্দেবন হাউমাউ করে উঠল, আমরা চারজন একেবারে চারটে জিবেগজার মতো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে রইলুম। আর পাকা করমচার মতো খুদে-খুদে লাল চোখ দুটোকে বনবন করে ঘোরাতে ঘোরাতে খ্যাপা মোষের মতো চেঁচাতে লাগল সেই ভয়ঙ্কর জোয়ান খগেন মাশ্চটক।

আর এতক্ষণে আমার মনে হল, এই মোষের মতো খগেনটা আছে বলেই জায়গাটার বোধহয় নাম হয়েছে মহিষাদল। সেই সঙ্গে আরও মনে পড়ল, আজ সকালে বাড়ি থেকে বেরুবার সময়, কেন যেন খামকাই আমার বাঁ কানটা কটকট করছিল। তখনই বোঝা উচিত ছিল, আজ একটা যাচ্ছেতাই রকমের কিছু ঘটে যাবে।

আমরা পটলডাঙার চারজন বিপদে পড়লে কি আর ভয়-টয় পাই না? আমি যখন আগে ছোট ছিলুম, পেট-ভর্তি পিলে নিয়ে প্রায় জ্বরে পড়তুম, তখন, রাত্তিরে জানালার বাইরে একটা হুতুম প্যাঁচা হুমহাম করে ডেকে উঠলেও, ভয়ে আমার দম আটকে যেত। তারপর বড় হলুম, দু-একটা ছোটখাটো অ্যাঁডভেঞ্চার জুটে গেল বরাতে। তখন দেখতে পেলুম, বিপদে ঘাবড়ে যাবার মতো বেকুবি আর কিছু নেই। তাতে বিপদ কমে না বরং বেড়েই যায়। তার চাইতে মাথা ঠাণ্ডা রেখে ভাবতে হয়, এখন কী করা যায় কী করলে সব চাইতে ভালো হয়। তা ছাড়া আরও দেখেছি-যারা আগ বাড়িয়ে ভয় দেখাতে আসে, তারা নিজেরাই মনে মনে ভীরু। পিঠে সোজা করে, বুক টান করে, মনে জোর নিয়ে রুখে দাঁড়ালে তারাই অনেক সময় পালাতে পথ পায় না।

আমি দলের তিনজনের দিকে চেয়ে দেখলুম। আমার বুকটা একটু দুরদুর করছিল, হাবুল পা চুলকোতে-চুলকোতে আমার কানে কানে ফিসফিস করে বলল, এখন একটা মজা করব, চুপ কইরা বইস্যা থাক। ক্যাবলার হাতে একটা ঘড়ি ছিল, সে বার বার তাকাচ্ছিল তার দিকে। আর আমাদের টেনিদা—বিপদ এলেই যে সঙ্গে সঙ্গে লিডার হয়ে যাবে—আমি দেখলুম, সে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে খগেনের দিকে, আর একটু একটু করে শার্টের আস্তিন তুলছে ওপরদিকে।

তখন আমার মনে পড়ল—টেনিদা বক্সিং জানে, জুডো —মানে জাপানী কুস্তিটাও সে শিখে নিয়েছিল গত বছর; তখুনি আমর বুকের ধুকধুকুনি থেমে গেল খানিকটা। বুঝতে পারলুম, খগেন মাশ্চটক যত সহজে আমাদের পিটিয়ে পরোটা করতে চাইছে, ব্যাপারটা অত সোজা হবে না। আর যদি টেনিদা একা ওকে সামাল দিতে না পারে, আমরা তিনজন তো আছি, এক সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ব খগেনের ওপর। যদি কিছু অঘটন ঘটেই যায়—ওই মোষের মতো খগেনটার ঘুষি-টুষি খেয়ে—আমি, রোগা-পট্রা প্যালারাম যদি বেমক্কা মারাই যাই, তাতেই বা কী আসে যায়। একবার বই তো দুবার মরব না! ভয় পেয়ে, কেঁচোর অধম হয়ে মাটিতে মুখ লুকিয়ে, বেঁচে থাকার চাইতে মরে যাওয়া ঢের ভালো।

আমি বুঝতে পারছিলুম—আমরা বাঘের গর্তে পা-ই দিই আর যা-ই করি, আমাদের চাইতেও ঢের বেশি ঘাবড়েছে বিবেন-চন্দ্ৰকান্তের দলবল। খগেন লম্ফঝম্ফ করে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিল, চন্দ্রকান্ত নাকেশ্বরই হাত বাড়িয়ে তাকে আটকে দিলে। আহা-হা, আগে থেকেই অমন মার মার করচ কেন হে খগেন? এয়ারা তো দেখচি ভদ্দরলোকের ছেলে সব শত্রু হতে যাবেন কী করে? বিত্তেন্তটা একবার খোলসা করে বলে দিকি।

বৃত্তান্ত আমার মাথা আর মুণ্ডু!–খগেন গাঁ গাঁ করে উঠল।–কলকাতায় আমি একটা বিচ্ছু ছেলেকে পড়াতে গিয়েছিলুম একদিন—তার নাম কম্বল। অমন হতচ্ছাড়া উনপাঁজুরে ছেলে দুনিয়ায় আর দুটো হয় না। গিয়ে তাকে পাঁচটা শক্ত শক্ত অঙ্ক কষতে দিয়ে বললুম, এগুলো চটপট করে ফ্যালকাল সারা রাত পাড়ার জলসায় গান শুনে আমার গা ম্যাজম্যাজ করছে, আমি আধ ঘণ্টা ঝিমিয়ে নিই। ঘুম ভেঙে যদি দেখি অঙ্ক হয়নি, তা হলে একটি কিলে তোকে একটা কোলা ব্যাং বানিয়ে দেব। বলেই ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভাঙতে একটু দেরিই হয়ে গেল। জেগে দেখি, ঘরে কম্বল নেই, একটা অঙ্কও সে কষেনি। উঠে হাঁকডাক। করতে তার কাকা এসে বললে, কম্বলকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না—তোমাকে দেখেই সে নিরুদ্দেশ হয়েছে।

আমরা কান খাড়া করে শুনতে লাগলুম। বিন্দেবন বললে, তাপ্পর?

—তারপর আমার পকেটে হাত দিয়েই বুঝতে পারলুম, হতভাগা ছেলে আমার পকেট হাঁটকেছে। একটা কমলালেবু রেখেছিলুম খাব বলে—সেটা নেই, তার বদলে কাগজে মোড়া দুটো আরশোলা। আর সাংকেতিক কবিতা লেখা আমাদের কাগজটা, তাতে কালির দাগ-টাগ লাগা—নিশ্চয়ই কিছু করেছে সেটা নিয়ে। এখন বুঝতে পারছি, ছড়াটা নকল করে সে এদের হাতে দিয়েছে, আর এরা তাই থেকে খুঁজতে-খুঁজতে হাজির হয়েছে এখানে।

আমরা চারজনে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলুম।

চন্দ্রকান্ত বললে, কিন্তু এঁয়ারা যে বললে রসিদ-টসিদ—

–একদম বাজে কথা, এরা রসিদ কোথায় পাবে? এ-চারটেকে আমি পটলডাঙায় চাটুজ্যেদের রকে বসে পাকৌড়ি-ডালমুট খেতে দেখেছি। আর কম্বলটাও এদের পেছনে প্রায় ঘুরঘুর করত। চন্দরদা, আর দেরি নয়, তুমি পারমিশন দাও—আমি আগে এদের আচ্ছা করে ঠেঙিয়ে নিই। তারপরে হাতের সুখ হয়ে গেলে—পোড়ো বাড়িটার ঠাণ্ডি গারদে সাত দিন আটকে রাখা যাক, কাঁকড়াবিছে আর চামচিকের সঙ্গে কদিন কাটাক-ব্যাস, দুরস্ত হয়ে যাবে। এর মধ্যে এখানকার মালপত্তর সরিয়ে দাও—শেয়ালপুকুরের আস্তানায় খবর পাঠাও।

চন্দ্রকান্ত তার প্রকাণ্ড নাকটা চুলকে বললে– কিন্তুক খগেন–

—কিন্তু পরে হবে, আগে আমি এদের দেখছি—

যমদূতের মতো এগিয়ে এল খগেন। বিবেন বললে, ওরে তোরা সব দেখছিস কী! দরজাগুলো বন্দ করে দে–

অথাৎ খাঁচায় বন্ধ করে ইঁদুর মারবার বন্দোবস্ত!

আর তক্ষুনি দাঁড়িয়ে উঠল টেনিদা। ঘর কাঁপিয়ে সিংহনাদ ছাড়ল : বুঝেসুঝে গায়ে হাত দেবেন মশাই, নইলে–

–ওরে, এ যে বুলি ঝাড়ছে! খগেন মাশ্চটকের দাঁত কিচ কিচ করে উঠল : তা হলে এইটেকেই আগে মেরামত করি। বাকিগুলো তো ছারপোকা, এক-একটা টিপুনি দিয়েই ম্যানেজ করে ফেলব।

বলেই, খগেন টেনিদার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

সেই লম্বা ঘরটার ভেতরে—যেখানে দেওয়াল ভর্তি করে জয় মা আর খাঁড়া-টাঁড়া এই সব লেখা রয়েছে, দেখতে-দেখতে তার ভেতরে যেন ভীম আর জরাসন্ধের যুদ্ধ বেধে গেল। আমরা সরে এলুম দেওয়ালের একদিকে—বিন্দেবনের দল আর-এক দিকে। খগেন টেনিদাকে জাপটে ধরতে গিয়েও পারল নাবক্সিংয়ের সাইড স্টেপিং করে সে চট করে সরে গেল একদিকে, আর দুহাতে খানিক বাতাস জাপটে ধরে মুখ থুবড়ে পড়তে-পড়তে সামলে গেল খগেন।

টেনিদা ঠাট্টা করে বললে, আহা, মাশ্চটক মশাই-ফসকে গেল বুঝি?

রাগে খগেনের মুখটা নিটোল একটা খাজা কাঁটালের মতো হয়ে গেল। লাল করমচার মতো চোখ দুটোকে ঘোরাতে ঘোরাতে খগেন বললে, অ্যাাঁআবার এয়ার্কি হচ্ছে। আমি খগেন মাশ্চটক, আমার সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি! আমি যদি এক্ষুনি তোকে চটকে আলুসেদ্ধ বানিয়ে না দিই তো—খগেন আবার ঝাঁপ মারল।

আর তক্ষুনি বোঝা গেল টেনিদা কী, আর আমরাই বা তাকে লিডার বলে মেনে নিয়েছি কেন। এবার খগেন টেনিদাকে চেপে ধরল আর ধরার সঙ্গে সঙ্গেই সে ইলেকট্রিক কারেন্টের শক খেলো একটা। জাপানী জুডোর একটা মোক্ষম প্যাঁচে দড়াম করে তিন-হাত দূরে ছিটকে পড়ল খগেন চিতপটাং। আর তার গলা দিয়ে বেরুল বিটকেল এক আওয়াজ : গাং।

ঘরসুদ্ধ লোক একদম চুপ। চন্দ্রকান্ত, বিবেন, দুটো চাকর—চোখ কপালে তুলে পাথর হয়ে রইল। টেনিদা বললে, কী মাশ্চটক মশাই, আমাকে মেরামত করবেন না?

খগেন মাশ্চটক একবার ওঠবার চেষ্টা করেই আবার ধপাৎ করে শুয়ে পড়ল। কেবল বললে, গাং-ওফ্‌-ফ।

হঠাৎ বিলেবন লাফিয়ে উঠল : চন্দর দা—দেখচ কী? এরা খুদে ডাকাতের দল। খগেনের মতো অত বড় লাশকেও অমন করে শুইয়ে দিলে? আমি দলের আরও লোকজন ডাকি–সবাই মিলে ওদের–

টেনিদা আস্তিন গুটিয়ে বললে, কাম অন–সঙ্গে সঙ্গে আমরা তিনজনও লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলুম লিডারের পাশে। বললুম, কাম অন—কাম অন—

হাবুল আমার কানে কানে বললে, অখন আরও মজা হইব।

ঠিক তখন—

ঠিক তখন বন্ধ দরজার গায়ে ঝনঝন করে ঘা পড়ল। কে যেন মোটা গলায় ডাক দিয়ে বললে, পুলিশ—শিগগির দরজা খোলো—

 ১১. চাঁদ-চাঁদনির রহস্য

চাঁদ-চাঁদনির রহস্য তো বোঝা গেল। আসলে চোরাকারবারীর এক বিরাট দল—ওই ছড়াই হল ওদের সাংকেতিক বাক্য। ছড়া বলতে পারলে আর চক্রধর সামন্তের দোকানে একবার গিয়ে পৌঁছতে পারলেই ওরা তাকে চিনে নেয় নিজের লোক বলে। তারপরে সব একসুতোয় গাঁথা। শেয়ালপুকুরের বাড়ি, গুরু বিটকেলানন্দ, দেবী নেংটীশ্বরী সব জলের মতো সোজা। ম্যাও ম্যাও যে কেন হানা দেয়, কেন ঝোল্লা গোঁফ আর আব নিয়ে চক্রধর কম্বলের তলায় শুয়ে পড়ে সব পরিষ্কার। তারপর ছল ছল খালের জল, নিরাকার মোষের দল থেকে একেবারে মহিষাদল—একদম আদত ঘাঁটিতে।

সব রহস্যের সমাধান। জিয়োমেট্রিতে যাকে বলে কিউ-ই-ডিঅর্থাৎ কিনা—ইহাই উপপাদ্য বিষয়।

ক্যাবলা আগে থেকেই হুঁশিয়ার। তার যে মামা পুলিশে চাকরি করে, গোড়াগুড়িই তাঁকে সব খবর সে জুগিয়ে যাচ্ছিল। তিনি শুনে বলেছিলেন,  বদমায়েসদের একটা গ্যাং আছে। এবার ধরে ফেলব। তোরা চালিয়ে যা ওদের সঙ্গে। আমি পেছনে তোক রাখব। তা ছাড়া মহিষাদলেও পুলিশকে খবর দিয়ে রেখেছি।

এমন কি পাঁশকুড়ো লোকালে, ঠিক আমাদের পাশের কামরায় বসে বৈরাগী-বৈরাগী চেহারায় যে-ভদ্রলোক মধ্যে-মধ্যে ট্রেনের বাইরে গলা বাড়িয়ে গেয়ে উঠছিলেন : হরিনাম বলো রে, নিতাই-গৌর ভজো রে—তিনি নাকি আমাদের ওয়াচ করছিলেন। চন্দ্র নিকেতন পর্যন্ত দূর থেকে আমাদের ফলো করেছিলেন এবং চন্দ্রকান্ত নাকেশ্বরের ঘরে যখন টেনিদা খগেন মাশ্চটককে কীচক বধ করে ফেলেছে, তখন তিনিই থানা থেকে পুলিশ নিয়ে চলে এসেছিলেন।

পুলিশের লোকেরা ওদের তো দলটল সুদ্ধ ধরে ফেলল, তারপর চন্দ্ৰকান্তের বাড়ি থেকে অনেক রকম কী সব লুকনো জিনিস-টিনিসও পেল; আর আমাদের কী বলল? সে-সব শুনলে তোমাদের হিংসে হবে। আমরা তো লজ্জায় কান-টান লাল করে দাঁড়িয়ে রইলুম। আর পুলিশের দারোগা টেনিদার হাত-টাত ঝাঁকিয়ে বললেন, তুমি তো দেখছি ছোকরা রীতিমতো গ্রেটম্যান। অত বড় একটা তিন মনী জোয়ানকে তক্তাপাট করে দিলে—অ্যাাঁ। তোমরাই হচ্ছ দেশের গৌরব—তোমাদের মতো ছেলেই এখন দরকার।

শুনে, টেনিদার মৈনাকের মতো উঁচু নাকটা বিনয়ে কীরকম যেন ছোট একটা সিঙাড়ার মতো হয়ে গেল। আমার কানে কানে বললে, জানিস প্যালা-খগেন মাশ্চটককে জুডোর প্যাঁচ কষিয়ে কীরকম খিদে পেয়ে গেল। পেটের ভেতরে ছুঁই ছুঁই করছে।

আমি অবাক হয়ে বললুম, খিদে পেল? এখুনি খেয়ে—

দারোগা শুনতে পেলেন। আমাকে আর কথাই বলতে দিলেন না। বললেন, খিদে পেয়েছে? বিলক্ষণ! এই রামভজন, জলদি রসগোল্লা-সন্দেশ-মোতিচুর-সিঙাড়া–বাজারসে যা মিলেগা-ঝুড়ি ভর্তি করকে লে আও।

সবই তো হল। চোরাকারবারীরা তো রা পড়ল—অবকাশঞ্জিনী আর বিক্রমসিংহ ওদের সঙ্গে হাজতে গেল কি না কে জানে! কিন্তু আসল গণ্ডগোল রয়েই গেল।

 

কম্বল এখনও নিরুদ্দেশ। তার টিকিরও তো খবর পাওয়া গেল না। সে কি সত্যি সত্যিই চাঁদে চলে গেল নাকি? ওর কাকা তোতা বলেছিলেন-কম্বলের চাঁদে চলে যাওয়ার একটা ন্যাক আছে!

আমরা চোরাকারবারী ধরতে চাইনি, কম্বলকে খুঁজতে বেরিয়েছিলাম। তার পাত্তাই পাওয়া গেল না। তার মানে, আমাদের অভিযান এ-যাত্রা ব্যর্থ হয়ে গেল। এখন আমরা কী বলব বদ্রীবাবুকে? কী করে মুখ দেখাব তাঁর কাছে?

চাটুজ্যেদের রকে বসে আমি, টেনিদা আর হাবুল এই নিয়ে গবেষণা করছিলুম। তা হলে কি আবার নতুন করে খোঁজা আরম্ভ করতে হবে? একটা ক্লু-টুলু তো চাই।

টেনিদা দাঁত কিড়মিড় করে বললে, পেতেই হবে হতচ্ছাড়াকে! তারপরে যদি কম্বলকে পিটিয়ে কাটে না বানিয়েছি, তা হলে আমার নাম টেনি শর্মাই নয়।

হাবুল বললে, ছাড়ান দাও—ছাড়ান দাও। অমন পোলার নিরুদ্দেশ থাকনই ভালো। পোলা তো না—য্যান অ্যাঁকখান ভাউয়া ব্যাং।

টেনিদা হাবুলের দিকে তাকাল : ভাউয়া ব্যাং কাকে বলে?

-ভাউয়া ব্যাং কয় ভাউয়া ব্যাংরে।

–শাটাপ!–বিচ্ছিরি মুখ করে টেনিদা বললে, ইদিকে নানান ভাবনায় মরে যাচ্ছি, এর মধ্যে উনি আবার এলেন মস্করা করতে। ফের যদি কুরুবকের মতো বকবক করবি, তা হলে এক থাপ্পড়ে তোর গাল—

আমি জুড়ে দিলুম :গালুডিতে উড়িয়ে দেব।

–বাঃ—এটা তো বেশ নতুন রকম বলেছিস! বিরক্ত হতে গিয়েও টেনিদা খুশি হয়ে উঠল : এর আগে তো কখনও শুনিনি।

 হুঁ হুঁ, আমি সব সময়েই ওরিজিন্যাল—মাথা নেড়ে বললুম।

—ওরিজিন্যাল তুই তো হবিই। তোর লম্বা লম্বা কান দুইখান দ্যাখলেই সেইডা বোঝন যায় হাবুল ফোড়ন কাটল।

ওফ্‌! টেনিদা চেঁচিয়ে উঠল : আমি মরছি নিজের জ্বালায় এগুলো বাজে বকুনিতে তো পাগল করে দিলে। এখন ওই কম্বলটাকে—বলতে আমাদের পেছনে আর একটা রাম চিৎকার!

কম্বল-সম্বল যথা দরবেশ কাঁপে চুপে চুপে–

আমরা ভীষণভাবে চমকে তাকিয়ে দেখি, ক্যাবলা। করমচর করে পরমানন্দে কী চিবুচ্ছে।

টেনিদা বাঘাটে গলায় বললে, খামকা অমন করে ষাঁড়ের মতো চ্যাঁচালি যে ক্যাবলা?

ক্যাবলা বললে, এমনি।

এমনি। ভেংচি কেটে টেনিদা বললে, একেবারে পিলেসুদ্ধ চমকে গেল। খাচ্ছিস কী?

–কাজুবাদাম।

হাত বাড়িয়ে টেনিদা বললে, আমার ভাগ দে।

—নেই। খেয়ে ফেলেছি।

খেয়ে ফেলেছিস? টেনিদা গজ গজ করতে লাগল : এই জন্যই দেশের কিচ্ছু হয় না।

হাবুল সেন বলল, হইবও না। আমারেও দ্যায় নাই।

টেনিদা হাবুলকে চড় মারতে গেল : এটা এমন বক্তিয়ার হয়েছে না যে কোনও সিরিয়াস কথা এর জন্য বলার জো নেই। ওয়েল ক্যাবলা—এখন কম্বলের কী করা যায় বল তো?

ক্যাবলা বাদাম চিবুতে চিবুতে, কিছুই করা যায় না। করার দরকার নেই।

–মানে?

-–মানেটা বুঝিয়ে দিচ্ছি, এসো। চলো সবাই আমার সঙ্গে।

বেশি দূর যেতে হল না। আমাদের পাড়াতেই একটুকুরো পোড়ো জমি, কারা যেন বাড়ি টাড়ি করছে। তিন-চারটে ছেলে সেখানে ইট পেতে একটা টেনিস বল নিয়ে ক্রিকেট খেলছে। তাদের একজনের মাথায় একটা ভাঙা শোলা-হ্যাট, সে চিৎকার করে বল দিচ্ছিল—এই সোবার্স বল দিচ্ছেন, ব্যারিংটন আউট হয়ে গেলেন–

আমি, হাবুল আর টেনিদা চোখ গোল করে বললুম :ওই তো কম্বল!

ক্যাবলা বললে, নির্ঘাত।

আমি বলুম, ও এখানে কী করে এল?

–তার মানে, ও কোথাও যায়নি। এখেনেই ছিল।

—এখানেই ছিল?—টেনিদার মুখটা হালুয়ার মত হয়ে গেল। তা হলে নিরুদ্দেশ হল কী করে? ওর কাকা যে বললেন, কম্বল নিশ্চয় চাঁদে চলে গেছে?

ক্যাবলা বললে, চাঁদে ঠিক যায়নি, চাঁদের রাস্তায় খানিকটা গিয়েছিল।

—চাঁদের রাস্তায়?–হাবুল একটা হাঁ করল :রকেট পাইল কই?

–রকেটের দরকার হয়নি। ক্যাবলা মিটমিটি করে হাকল : চিলেকোঠার ঘরে লুকিয়েছিল দিন কতক।

–অ্যাঁ!—আমরা তিনজনে খাবি খেলুম।

–হুঁ, সব খবরই আমি যোগাড় করে এনেছি। এই দশাসই মাস্টার খগেন মাশ্চটকের হাত থেকে বাঁচবার জন্যে কম্বলের কাকিমাই সে ব্যবস্থা করেছিলেন। কাকা তো বসে আছেন প্রেস নিয়ে, বাড়ির ভিতরে কতটুকু যান, কীই বা খবর রাখেন। আমরা যখন কম্বলের খোঁজে চাঁদনি-ধোপাপুকুর-মহিষাদল ছুটে বেড়াচ্ছি, তখন শ্রীকম্বল কাকিমার আদরে দিব্যি চিলেকোঠার ঘরে খেয়ে-দেয়ে মোটা হচ্ছেন। সেই প্রথম দিনে আমাদের দিকে কে পচা আম ছুঁড়েছিল—এবার বুঝতে পারছ টেনিদা।

—বিলক্ষণ!—টেনিদা হুঙ্কার করল : ওই হতভাগাই চিলেকোঠা থেকে আমার নাকটাকে পচা আমের টার্গেট করেছিল।

টেনিদার হুঙ্কারেই কি না কে জানে কম্বল আমাদের দিকে ফিরে তাকাল। আর তাকিয়েই বিকট ভেংচি কাটল একটা। স্বভাব যাবে কোথায়! এবার আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলুম ভাউয়া ব্যাং কাকে বলে! ভাউয়া ব্যাং না হলে অমন ভেংচি কেউ কাটতেই পারে না!

Exit mobile version