খেয়াঘাট থেকে কালো মাটির পথটা গ্রামের মধ্যে পাকা রাস্তায় গিয়ে মিশেছে–দু-পাশে সাজানো গাছের সারি, চর শ্রীপুর আর পাটনি পাড়ার মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে গোপখালি নদী। ছোট্ট কুলটা দূর থেকে দেখা যায়–আরও, আরও একটু দূরে ঐতিহাসিক মজুমদার বাড়ি চোখে পড়ে। এঁদের দাপটে নাকি একদিন বাঘে-গোরুতে একই ঘাটে জল খেত। মজুমদার বাড়ির কোল বেয়ে এক সড়ক চলে গেছে দাদপুরের মধ্য দিয়ে সোজা। দু-পাশে খেজুর গাছ আর ধানখেত। আর ওই তো, অদূরে পাতনার বিল-যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু বিলই চোখে পড়ে। সন্ধের পর এই বিলের ওপর দিয়ে লোক চলাচল করে না। গা ছমছম করে। রাত্রে কারা যেন ঘোড়া ছুটিয়ে বেড়ায় খটাখট খটাখট। বোসপুকুর আর মুচিপোতা লোকশূন্য। আজও মায়েরা ছেলেদের ভয় দেখিয়ে বলতেন, মুচিপোতার স্কন্ধকাটাকে ডাকব। চল চল বোসপুকুরধারে তোকে দিয়ে আসি। ঝোপেঝাড়ে বনেজঙ্গলে ভরে গেছে এর সবদিক সন্ধের পর যে-কোনো অতিসাহসী ব্যক্তিরও বুকটা ধড়াস করে ওঠে।
সরকার পাড়ার পাশ কাটিয়ে লাল সড়কের পথ–এপ্রান্ত হতে ওপ্রান্ত অবধি চলে গেছে। এ পথ চলে গেছে যেন কোনো এক অজানা পথের ডাক দিয়ে। সরকারদের দাপট একদিন ছিল–চৌধুরিরাও বড়ো কম যেতেন না। মিউনিসিপ্যালিটি, ডাকঘর, উচ্চ ইংরাজি ও মধ্য ইংরাজি বিদ্যালয়, বালিকা বিদ্যালয়, মেটারনিটি হোম, বাঁধা থিয়েটার স্টেজ কিছুরই অভাব নেই। কত ত্যাগ স্বীকারের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে এই আদর্শ গ্রাম।
একটা গ্রামে এমন শিক্ষার ব্যবস্থা, লাইব্রেরি, বাঁধানো স্টেজ, চিকিৎসালয়, ক্রীড়াব্যবস্থা আর কোথায় দেখতে পাওয়া যায়? আশা ও অনুরাগের স্বচ্ছন্দ গতিপ্রবাহ নিয়ে এগিয়ে চলছিল এই জীবন। স্যর পি. সি. রায় এই গ্রামকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। মাঝে মাঝে এসে তিনি বাস করতেন এখানে। তিনি ভালোবেসেছিলেন ইছামতাঁকে, ইছার জলকল্লোল তাঁকে ডাক দিত, আর এর শ্রী তাকে দিত হাতছানি–এ গ্রামেই পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের জন্ম।
তবু চোখটা ঝাপসা হয়ে আসে কেন? দূরের রাঙাদির চরটা যেন ঝাপসা বলে মনে হয়। সাহেবখালি আর ইছামতী যমুনার সঙ্গমস্থলে দীর্ঘ মাইল চর বনজঙ্গলে ছেয়ে আছে, কেউ কেউ বলে রানিচর। গভীর রাত্রে কার যেন কান্না শোনা যায়।
অনেক পিছনে দৃষ্টি যায় ফিরে। প্রতাপের সঙ্গে যখন মোগলদের চলছিল লড়াই, জয়লাভের যখন কোনো আশাই ছিল না তখন প্রতাপের নির্দেশে নাকি সেনাপতি রডা পুরনারীদের জাহাজে করে এনে এখানে ডুবিয়ে দেয়। তারপরই এই চরের জন্ম–তাই লোকে বলে রানিচর। এ কাহিনির সত্য-মিথ্যা নিয়ে কেউ তর্ক করে না। কত, কতদিন এই চরে এসেছি, এর বনের মধ্যে পথ করে চলতে আনন্দ পেয়েছি। কত অজানা জীবজন্তুর হাড় পেয়ে অবাক হয়ে বিচিত্র পৃথিবীর কথা ভেবেছি। আরও, আরও কিছু পাওয়ার আশায় যেন অধীর আগ্রহে ছুটে চলেছি সামনের দিকে।
মেঘ জমেছে–কালবৈশাখীর প্রচন্ড দাপট বুঝি সব কিছু ভেঙে চুরমার করে দিয়ে যাবে। ভয়ে নৌকা করে পালিয়ে এসেছি তরঙ্গবিক্ষুব্ধ নদীর বুক বেয়ে। অজানা আনন্দে মনটা উঠেছে ভরে। ঝড় আসে তার অমিত শক্তিবেগ নিয়ে। নদী গর্জে গর্জে ওঠে–আছড়ে পড়ে তীরের ওপর–তীরের মাটি ধসে পড়ে নদীর বুকে–সর্বগ্রাসী ক্ষুধায় নৃত্য করে নদী। কত চালা যায় উড়ে, কত জীর্ণ প্রাচীর যায় ধসে, কত বাগানে কত গাছের ডালপালা যায় ভেঙে, দুর্ভাবনার অন্ত থাকে না সাধারণের। ঝড়ের গতিবেগ ক্রমে থেমে আসে। নামে বৃষ্টি। বছরের প্রথম বর্ষা। পড়শির ছেলেরা মনের আনন্দে খেলা করে সেই জলধারার সঙ্গে। জোরে জোরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে, ‘এই বৃষ্টি ধরে যা, লেবুর পাতা করমচা।’ জেলেরা জাল কাঁধে মাছ ধরতে বেরিয়ে পড়ে। গ্রীষ্মের দাপটে অস্থির চঞ্চল মানুষের চিত্ত শান্ত হয়। ছেলেরা আম কুড়োতে বেরোয়–আমিও তাদের দলে ভিড়ে গেছি কতদিন। গ্রীষ্মের তাপদগ্ধ পৃথিবী শীতল হয়। তৃষিত মৃত্তিকা জল পায়। গাছের একটা ভাঙা ডালে বসে চাতক তখন ডাকে –’দে ফটিক জল।’ কিষাণ লাঙল ঠিক করে। চাষের সময় হয়ে এসেছে। মেঘভরা আকাশ–সেদিকে চেয়ে তাদের চোখগুলো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সামনে বর্ষা!
মর্নিং স্কুল। খুব ভোরে স্কুলে যাওয়ার আনন্দ। বোসপুকুরকে পেছনে রেখে, ঘোষের বাড়ির পাশ দিয়ে সদর বিলের ওপর দিয়ে স্কুল যাওয়ার সে আনন্দ কোনোদিন ভুলবার নয়। পথে যেতে যেতে আমরা বকুল ফুলের মালা গাঁথি, কোনো কোনো দিন ছুটির পর মনে হয় : মাস্টারমশাই যেন কী? একটু দেরি হলেই কি মারতে আছে! মালা গাঁথতে যে দেরি হয়ে গেল। সূর্য তখন তালগাছের মাথার ওপর। পাগলা তালের রস পাড়ছে! মাথাভাঙা খেজুর গাছটায় বসে একটা দাঁড়কাক ডাকছে। কী যেন আনন্দ, কী যেন অনুভূতি, হঠাৎ ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরি। মা মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। আস্তে আস্তে বলেন, গ্রীষ্মের ছুটি ক-দিন দিল রে? একমাস বুঝি? হ্যাঁ, একমাস। কী আনন্দ। কাঁঠাল, আম, জাম, জামরুলের সময়। যাদের গাছ আছে তারা অনেক খাবে। আমাদের তো কোনো গাছ নেই। শিশুমন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। দূর-বোসেদের বাগানের আম রাখব নাকি? সব ঢিলিয়ে পেড়ে নেব। তাড়া করলে দে ছুট। একে তো আর চুরি বলে না?