Site icon BnBoi.Com

লজ্জা – তসলিমা নাসরিন

লজ্জা - তসলিমা নাসরিন

লজ্জা (০১-ক) – সুরঞ্জন শুয়ে আছে

লজ্জা – তসলিমা নাসরিন
সুরঞ্জন শুয়ে আছে

সুরঞ্জন শুয়ে আছে। মায়া এসে বারবার তাড়া দিচ্ছে–‘দাদা ওঠ, কিছু একটা ব্যবস্থা কর। দেরি হলে কিন্তু অঘটন ঘটে যেতে পারে।’ সুরঞ্জন জানে এই ব্যবস্থার নামে কোথাও গিয়ে লুকিয়ে থাকা। ইঁদুর যেমন গর্তে ঢোকে ভয়ে, ভয় কেটে গেলে বা পরিস্থিতি শান্ত হলে চারদিক দেখেশুনে লুকোনো জায়গা থেকে ইঁদুর যেমন বেরিয়ে আসে; তেমনই তাদেরও লুকোতে হবে, পরিস্থিতি শান্ত হলে এদিক ওদিক দেখে তবেই বেরোতে হবে লুকোনো জায়গা থেকে। কেন সুরঞ্জনকে নিজের ঘর ছেড়ে পালাতে হবে–-তার নামে সুরঞ্জন দত্ত বলে? বাবার নাম সুধাময় দত্ত, মায়ের নাম কিরণময়ী দত্ত, বোনের নাম নীলাঞ্জনা দত্ত বলে বাবা, মা, বোনকে বাড়ি ছাড়তে হবে? কালাম, বেলাল বা হায়দারের বাড়িতে আশ্রয় নিতে হবে যেমন নিয়েছিল দু বছর আগে? তিরিশে অক্টোবর সকালে কামাল তার ইস্কাটনের বাড়ি থেকে কিছু একটা আশঙ্কা আঁচ করে ছুটে এসেছিল, সুরঞ্জনকে ঘুম থেকে ঠেলে তুলে বলেছিল–‘শিগরি চল, দু-চারটে কাপড়চোপড় তড়িঘড়ি গুছিয়ে নে। বাড়িতে তালা দিয়ে সবাই চল তো। দেরি করিস নে, চল চল।’ কামালের বাড়িতে তাদের যত্নআত্তির অভাব হয়নি, সকালে ডিম রুটি–দুপুরে মাছ ভাত–বিকেলে লনে বসে ধুম আড্ডা–রাতে পুরু গদির বিছানায় ঘুম, চমৎকার কেটেছিল। কিন্তু কেন তাকে কামালের বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়! কামাল তার অনেক দিনের বন্ধু। আত্মীয়স্বজন নিয়ে তার বাড়িতে ক’দিন সে থাকতে পারে কিন্তু তাতে থাকতেই হবে কেন? তাকে কেন নিজের বাড়ি ছেড়ে পালাতে হয়, কামালকে তো পালাতে হয় না? এই দেশ কামালের যতটুকু, সুরঞ্জনেরও ঠিক ততটুকু। নাগরিক অধিকার দুজনের সমান হবারই কথা। কিন্তু কামালের মত সে কেন উদ্ধত দাঁড়াতে পারে না! সে কেন দাবি করতে পারে না আমি এই মাটির সন্তান, আমার যেন কোন আমার যেন কোনও অনিষ্ট না হয়!

সুরঞ্জন শুয়েই থাকে, ওঠে না। মায়া এঘরে ওঘরে অস্থির হাঁটে। বোঝাতে চায় কিছু একটা ঘটে গেলে পরে দুঃখ করে লাভ নেই। সি এন এন-এ বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার দৃশ্য দেখাচ্ছে। টেলিভিশনের সামনে স্তব্ধ বসে আছেন সুধাময় আর কিরণময়ী। তাঁরাও ভাবছেন সুরঞ্জয় বুঝি এবারও নব্বই-এর অক্টোবরের মত কোনও মুসলমান বাড়িতে তাঁদের লুকোতে নেবে। কিন্তু আজ কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না সুরঞ্জনের। সারাদিন শুয়েই কাটাবে সে ভাবে। কামাল বা কেউ নিতে এলে বলবে–‘বাড়ি ছেড়ে যাবো না, যা হয় হোক।’

.

আজ ডিসেম্বরের সাত তারিখ। গতকাল দুপুরে অযোধ্যার সরযূ নদীরে তীরে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। করসেবকরা সাড়ে চারশ বছরের পুরোনো একটি মসজিদ ভেঙে ফেলেছে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ঘোষিত করসেবা শুরুর পঁচিশ মিনিট আগে ঘটনাটি ঘটে। করসেবকরা প্রায় পাঁচ ঘণ্টার চেষ্টায় তিনটি গুম্বুজসহ সম্পূর্ণ সৌধটিকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। পুরো ঘটনাই ঘটে বি জে পি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, আর এস এস, বজরং দলের সর্ব্বোচ্চ নেতৃত্বের উপস্থিতিতে। কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী, পি এ সি ও উত্তরপ্রদেশ পুলিশ নিষ্ক্রিয় দাঁড়িয়ে করসেবকদের নৃশংস কাণ্ড দেখে। দুপুর দুটো পঁয়তাল্লিশ মিনিটে একটি গম্বুজ ভাঙা হয়, চারটায় দ্বিতীয় গম্বুজ, চারটে পঁয়তাল্লিশে তৃতীয় গম্বুজও ভেঙে ফেলে উম্মত করসেবকরা। সৌধ ভাঙতে গিয়ে চারজন করসেবক ধ্বংসস্তুপের নিচে চাপা পড়ে নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে শতাধিক।
সুরঞ্জন শুয়ে শুয়েই পত্রিকার পাতায় চোখ বুলোয়। আজ ব্যানার হেডিং–‘বাবরি মসজিদ ধ্বংস, বিধ্বস্ত।’ সে অযোধ্যায় যায়নি। বাবরি মসজিদ দেখেনি। দেখবে কী করে, দেশের বাইরে কোথাও তার যাওয়া হয়নি। রাম কোথায় জন্মেছিল, আর তার কোন মাটি ফুঁড়ে মসজিদ গজিয়েছে এসব তার কাছে নিতান্তই তুচ্ছ বিষয়। তবে ‘ষোড়শ শতাব্দীর এই স্থাপত্য কাজে আঘাত করা মানে যে কেবল ভারতীয় মুসলমানকে আঘাত করা নয়, সমগ্র হিন্দুর ওপরও আঘাত; সমগ্র কল্যাণবোধের ওপর, সমবেত বিবেকের ওপর আঘাত’–এ কথা সে মানে। ‘বাংলাদেশেও বাবরি মসজিদ নিয়ে হয়ে যাবে প্রচণ্ড তাণ্ডব। মন্দিরগুলো ধুলিস্যাৎ হবে, হিন্দুদের ঘরবাড়ি পুড়বে, দোকানপাট লুট হবে। বি জে পি-র উস্কানিতে করসেবকেরা বাবরি মসজিদ ভেঙে এ দেশের মৌলবাদী দলকে আরো হৃষ্টপুষ্ট করছে। বি জে পি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ আর তাদের সহযোগীরা কি তাদের উন্মত্ত আচরণের জের কেবল ভারতের ভৌগলিক সীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকবে ভেবেছে? ভারতে শুরু হয়ে গেছে প্রচণ্ড সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। মরছে পাঁচশ ছশ একহাজার। ঘণ্টায় ঘণ্টায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। হিন্দুর স্বার্থরক্ষকরা কি জানে দু থেকে আড়াই কোটি হিন্দু এই বাংলাদেশে আছে? শুধু বাংলাদেশে কেন, পশ্চিম এশিয়ার প্রায় প্রতিটি দেশে হিন্দু রয়েছে, তাদের কী দুর্দশা হবে হিন্দু মৌলবাদিরা একবার ভেবেছে? রাজনৈতিক দল হিসাবে ভারতীয় জনতা পার্টির জানা উচিত ভারত কোনও বিচ্ছিন্ন জম্বুদ্বীপ নয়। ভারতে যদি বিষফোঁড়ার জন্ম হয় তার যন্ত্রণা শুধু ভারতই ভোগ করবে না, যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ছে সমগ্র বিশ্বে, অন্তত প্রতিবেশী দেশে তো সবার আগে।’
সুরঞ্জন চোখ বুজে শুয়ে থাকে। তার গা ধাক্কা দিয়ে মায়া বলে–তুমি উঠবে কি না বল। বাবা মা তোমার ভরসায় বসে আছেন।

সুরঞ্জন আড়মোড়া ভেঙে বলে–তোর ইচ্ছে হলে তুই চলে যা, আমি এই বাড়ি ছেড়ে এক পাও নড়ব না।
–আর ওঁরা?
–জানি না।
–যদি কিছু হয়?
–কী হবে!
–ধর, বাড়ি লুট করল। পুড়িয়ে ফেলল।
–ফেলবে।
–তুমি তার পরও বসে থাকবে?
–বসে না, শুয়ে থাকব।

সুরঞ্জন খালি পেটে একটা সিগারেট ধরায়। তার চায়ের তেষ্টা পায়। কিরণময়ী সকালে এক কাপ চা তাকে দেন, আজ দিচ্ছেন না। এ সময় তাকে কে দেবে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা। মায়াকে বলা বৃথা। পালাবার কথা ছাড়া আপাতত মেয়েটি কিছুই ভাবছে না। চা বানাতে বললে ওর গলা আবারও সপ্তমে চড়বে। সে নিজেই উঠে বানিয়ে নিতে অয়ারে, কিন্তু আলস্য তাকে ছাড়ছে না। ওঘরে টেলিভিশন চলছে। তার ইচ্ছে হয় না সি এন এন-এর সামনে চোখ গোল গোল করে বসে থাকতে। ওঘরে খানিক পর পর মায়া চেঁচিয়ে উঠছে–দাদা শুয়ে আছে, পেপার পড়ছে, তার কোনও হুঁশ নেই।
হুঁশ সুরঞ্জনের নেই এ কথা ঠিক নয়। সে ঠিকই বোঝে যে কোন সময় দরজা ভেঙে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়তে পারে একদঙ্গল লোক, তাদের কতক চেনা কতক অচেনা, তারা বাড়ির জিনিপত্র ভাঙবে, লুট করবে, আর যাবার সময় বাড়িটি আগুনে পুড়িয়ে দেবে। এ অবস্থায় কামাল বা হায়দারের বাড়িতে উঠলে কেউ বলবে না আমাদের জায়গা নেই। কিন্তু তার খুব লজ্জা হয় যেতে। মায়া চেঁচাচ্ছে–তোমরা না যাও আমি একাই তবে চলে যাই। পারুলের বাড়ি গিয়ে বসে থাকি। দাদা কোথাও নিয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে না। তার না হয় বেঁচে থাকার দরকার নেই, আমার আছে।

মায়া ধারণা করছে সুরঞ্জন যে কারণেই হোক আজ কারও বাড়িতে তাদের লুকোতে নেবে না। অগত্যা সে নিজেই নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবছে। ‘নিরাপত্তা’ শব্দটি সুরঞ্জনকে ভোগায় খুব।

নিরাপত্তা নব্বই-এর অক্টোবরেও ছিল না। ঢাকেশ্বরী মন্দির আগুনে পুড়িয়ে দিল একদল লোক। পুলিশ নিষ্ক্রিয় দাঁড়িয়ে ছিল পাশে, বাধা দিল না। পুড়ে গেল মূল মন্দির, ওরা ধ্বংস করে ফেলল নাটমন্দির, শিবমন্দির, অতিথিশালা, অতিথিশালার পাশে শ্রীদাম ঘোষের বাস্তুভিটে। মন্দিরের ভেতরের জিনিসপত্র লুট করল। মাধব গৌড়িয় মঠের মূল মন্দির ধ্বংস করল। ওদিকে জয়কালী মন্দির চূর্ণ করে দিল। ব্রাহ্ম সমাজের বাউন্ডারি ওয়ালের ভেতরের ঘরটি বোমা মেরে উড়িয়ে দিল। রামসীতা মন্দিরের ভেতর কারুকাজ করা ঠাকুরের সিংহাসনটি বিধ্বস্ত করে ফেলল। বিধ্বস্ত করল মূল ঘর। নয়াবাজারের মঠ ভেঙে ফেলল। বনগ্রাম মন্দির ভেঙে ফেলল শাবল চালিয়ে। শাঁখারি বাজারের মুখে সাতটি হিন্দুর দোকান ভাঙচুর ও লুটপাটের পর পুড়িয়ে দেওয়া হল। শিলা বিতান, সোমা ট্রেডার্স, সেলুন, টায়ারের দোকান, লণ্ড্রি, মিতা মার্বেল, সাহা কেবিন, রেস্টুরেন্ট কিছুই রক্ষা পেল না। শাঁখারি বাজারের মোড়ে এমন ধ্বংসযজ্ঞ ঘটল যে যতদূর চোখ যায় ধ্বংসের চিহ্ন ছাড়া কিছুই চোখে পড়ল না। ডেমরায় শনির আখড়ার মন্দির লুট হল। পঁচিশটি পরিবারের বাড়িঘর লুট করল দু’তিনশ সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী। লক্ষ্মী বাজারের বীরভদ্রের মন্দিরের দেওয়াল ভেঙে ভেতরের সব নষ্ট করে দিল। ইসলামপুর রোডের ছাতা আর সোনার দোকানগুলোয় আগুন লাগিয়ে দিল। নবাবপুর রোডের মরণচাঁদ মিষ্টির দোকান ভেঙে ফেলল। ভেঙে ফেলল পুরানা পল্টনের মরণচাঁদও। রায়ের বাজারের কালী মন্দিরের মূর্তি মাটিতে ফেলে ভাঙল। সূত্রাপুরে হিন্দুদের দোকান লুট কর, ভেঙে, মুসলমানের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিল। নবাবপুর রোডের ঘোষ এণ্ড সন্স-এর মিষ্টির দোকানটি লুটপাটের পর নবাবপুর যুব ইউনিয়ন ক্লাব-এর একটি ব্যানার দোকানের ওপর টাঙিয়ে দিল। ঠাঁটারি বাজারের বটতলি মন্দির ভেঙে তছনছ করা হল। নবাবপুরে রামধন পশারি নামের পুরনো দোকানটি লুট করা হল। বাবুবাজার পুলিশ ফাঁড়ির মাত্র কয়েক গজের মধ্যে শুকলাল মিষ্টান্ন ভাণ্ডার ভেঙে চুরমার করা হল। যতীন এণ্ড কোং-এর দোকান এবং কারখানা ভেঙে ফেলল, ঘরের জিনিসপত্র পুড়ল। ঐতিহাসিক সাপ মন্দিরের অনেকটা গুঁড়ো করে ফেলল, সদরঘাট মোড়ে রতন সরকারের মার্কেট লুটপাট করল, ভাঙচুর করল। সুরঞ্জনের চোখের সামনে একটি একটি করে ভেসে ওঠে ভাঙা পোড়া সেইসব বীভৎস দৃশ্য। এর নাম কি দাঙ্গা? নব্বই-এর ঘটনাকে কি দাঙ্গা বলা যায়? দাঙ্গা অর্থ মারামারি–এক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আরেক সম্প্রদায়ের সংঘর্ষের নাম দাঙ্গা। কিন্তু একে তো দাঙ্গা বলা যায় না, এ হচ্ছে এক সম্প্রদায়ের ওপর আরেক সম্প্রদায়ের হামলা। অত্যাচার। নির্যাতন। জানলা গলে রোদ এসে পড়ে সুরঞ্জনের কপালে। শীতের রোদ, এ রোদে গা পোড়ে না। শুয়ে থেকে সে চায়ের তৃষ্ণা অনুভব করে।

(চলবে)

লজ্জা (০১-খ)

এখনও সেইসব দৃশ্য সুধাময়ের চোখে ভাসে। কাকা পিসি মামা মাসিমা একে একে চলে যাচ্ছেন। ময়ময়সিংহ জংশন থেকে ট্রেন ছাড়ে ফুলবাড়িয়ার দিকে। কয়লার ইঞ্জিন এক আকাশ কালো ধোঁয়া ছেড়ে যখন পুঁউউ হুইসেল বাজায়, ট্রেনের কমপার্টমেট থেকে বুক ভাঙা কান্নার শব্দ ভেসে আসে। পাড়া-পড়শিও যাচ্ছে আর তাগাদা দিচ্ছে—‘সুকুমার, এ হচ্ছে মুসলমানের হোমল্যান্ড। এখানে নিজের জীবনের কোনও নিশ্চয়তা নেই।’ সুকুমার দত্ত এক কথার লোক, তিনি বললেন—‘নিজের জন্মের মাটিতে যদি নিরাপত্তা না থাকে, নিরাপত্তা তবে পৃথিবীর কোথায়? দেশ ছেড়ে পালাতে আমি পারব না। তোমরা যাচ্ছ যাও। আমার বাপ ঠাকুরদার ভিটে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না। নারকেল সুপুরির বাগান, ধানি জমি, দু বিঘার উপর বাড়ি—এসব ছেড়ে শিয়ালদা স্টেশনের উদ্বাস্তু হব এ আমার ইচ্ছে নয়।’ সুধাময়ের তখন উনিশ বছর বয়স। কলেজের বন্ধুরা চোখের সামনে চলে যাচ্ছে, বলছে—‘তোর বাবা কিন্তু পরে পস্তাবে।’ সুধাময় তখন বাবার মত বলতে শিখেছেন—‘নিজের দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও যাব কেন? মরলে এই দেশেই মরব, বাঁচলে এই দেশেই।’ কলেজ ফাঁকা হয়ে গেল সাতচল্লিশে, যারা যায়নি, তারা যাব যাব করছে। হাতে গোনা কয়েকজন মুসলমান ছাত্র আর রয়ে যাওয়া কিছু দরিদ্র হিন্দুর সঙ্গে কলেজ পার করে লিটন মেডিকেলে লেখাপড়ে করলেন সুধাময়।
বাহান্নোয় চব্বিশের টগবগে যুবক তিনি। ঢাকার রাস্তায় তখন ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগান। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা—মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে উঠেছে সাহসী ও সচেতন বাঙালি তরুনেরা। তারা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নত ন্যুব্জ মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়েছে, মিছিলে পুলিশ গুলি ছোঁড়ে, রক্তে রাজপথ ভেসে যায়, তবু কেউ দাবি ছাড়েনি, রাষ্ট্রভাষা বাংলা করবার দাবি। সুধাময়ের তখন প্রচণ্ড উত্তেজনা, মিছিলের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি ‘বাংলা চাই’ শ্লোগান দিয়েছেন। পুলিশের গুলিতে যেদিন রফিক সালাম বরকত জব্বার প্রাণ হারান, সুধাময় ছিলেন সেই মিছিলে। তাঁর বুকেও লাগতে পারত গুলি। তিনিও হতে পারতেন এ দেশের মহান শহীদদের একজন।
উনসত্ত্রের গনআন্দোলনেও সুধাময় ঘরে বসে থাকেননি। আয়ুব খানের পুলিশবাহিনী তখন মিছিল দেখলেই গুলি ছোঁড়ে, এগারো দফা নিয়ে বাঙালি তবু মিছিলে নামা ছাড়ে না। পুলিশের গুলিতে নিহত আলমগীর মনসুর মিণ্টুর লাশ কাঁধে নিয়ে তিনি ময়মনসিংহের রাস্তায় হেঁটেছেন, পেছনে শত শত শোকস্তব্ধ বাঙালি পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আরেকবার মুঠো শক্ত করেছে।
বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নোর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, চৌষট্টির সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, আটষট্টির আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বিরোধী আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এ কথা প্রমাণ করেছে যে দ্বিজাতিতত্ত্বের কারণে দেশভাগ হওয়া ছিল ভুল একটি সিদ্ধান্ত। আবুল কালাম আজাদ বলেছিলেন– It is one of the greatest frauds on the people to suggest that religious affinity can unite areas which are geographically, economically and culturally different. It is true that islam sought to establish a society which transcends racial, linguistic, economic and political forntiers. History has however proved that after the first few decades or at the most after the first century, Islam was not able to unite all the muslim countries on the besis of Islam alone.
জিন্নাহও জানতেন দ্বিজাতিতত্ত্বের অসাড়তার কথা। মাউন্টব্যাটেন যখন পাঞ্জাব আর বাংলা ভাগ করবার পরিকল্পনা করছিলেন, তখন জিন্নাহ নিজেই বলেছিলেন—A man is Punjabi or a Bengali before he is Hindu or Moslem. They share a common history, language, culture and economy. You must not divide them. You will curse endless bloodshed and trouble.

১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাঙালি Endless bloodshed and trouble দেখেছে যার চূড়ান্ত পরিণতি ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। এক লক্ষ বাঙালির রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা একথা প্রমাণ করেছে যে, ধর্ম কখনও জাতিসত্তার ভিত্তি নয়। ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাসই জাতি গঠনের ভিত্তি। পাঞ্জাবি মুসলমানের সঙ্গে বাঙালি মুসলমানের একজাতিত্ব একদিন পাকিস্তান এনেছিল সত্য কিন্তু হিন্দু-মুসলমান দ্বিজাতিতত্ত্বের ধারণা ভেঙে এদেশের বাঙালিরা দেখিয়ে দিয়েছে তারা পাকিস্তানের মুসলমানের সঙ্গে আপস করেনি।
একাত্তরে সুধাময় ছিলেন ময়মনসিংহের এস কে হাসপাতালের ডাক্তার। ঘরে বাইরে ব্যস্ততা তখন, বিকেলে স্বদেশিবাজারের এক ওষুধের দোকানে প্র্যাকটিস করেন। কিরণময়ীর কোলে ছ’মাসের বাচ্চা, বড় ছেলে সুরঞ্জনের বয়স বারো। দায়িত্ব কম নয়। হাসপাতালও প্রায় একা সামলাতে হয়। সময় পেলে শরিফদের আড্ডায় যান। তখন মার্চের আট কী নয় তারিখ হবে। রেসকোর্সের মাঠে শেখ মুজিবের সাতই মার্চের ভাষণ শুনে এসেছে ওরা, শফিক বাবলু ফয়জুল নিমাই, রাত বারোটায় ওরা কড়া লাগে সুধাময়ের ব্রাহ্মপল্লীর বাড়ির দরজায়। শেখ মুজিব বলেছেন—‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয় তবে তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। এবারে সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
ওরা উত্তেজনায় কাঁপে। টেবিল চাপড়ে বলে—‘সুধাদা, কিছু একটা করতেই হবে।’ বসে থাকলে যে চলবে না সুধাময়ও বুঝেছিলেন। তারপর পঁচিশে মার্চের কালো রাতে পাকিস্তানি সৈন্য যখন বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, আবার কড়া নড়েছিল সুধাময়ের দরজায়, ফিসফিস করে ওরে বলেছিল—‘যুদ্ধে যেতে হবে। এ ছাড়া উপায় নেই।’ তাঁর ভরা সংসার, বয়সটাও যুদ্ধে যাবার জন্য সুবিধের নয়। তবু হাসপাতালে তাঁর মন বসে না; করিডরে একা পায়চারি করেন। যুদ্ধে যাবার তীব্র একটি ইচ্ছে মাঝে মাঝেই তাঁকে গ্রাস করে। ঘরে তিনি অন্যমন, কিরণময়ীকে বলেন—‘কিরণ, তুমি কি একা সামলাতে পারবে সংসার? ধর, আমি কোথাও চলে গেলাম।’ কিরণময়ী নীল হয়ে যান আশঙ্কায়, বলেন—‘চল ইন্ডিয়া চলে যাই। আশেপাশের সবাই চলে যাচ্ছে।’
সুধাময় নিজেও লক্ষ্য করেছেন সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়, সুধাংশু হালদার, নির্মলেন্দু ভৌমিক, রঞ্জন চক্রবর্তী সব চলে যাচ্ছে, সাতচল্লিশে যেমন চলে যাবার ধুম পড়েছিল, তেমন। ওদের তিনি কাওয়ার্ড বলে গাল দিতেন। নিমাই একদিন সুধাময়কে বলল—‘সুধাদা, আর্মিরা শহরের রাস্তায় হাঁটছে, ওরা হিন্দু ধরছে, পালাই চলুন।’ সাতচল্লিশে সুকুমার দত্তের কণ্ঠে যে জোর ছিল, সেই জোর সুধাময় তাঁর কণ্ঠে ধারণ করেন। তিনি নিমাইকে বললেন—‘তুমি যাচ্ছ যাও, আমি পালাচ্ছি না। পাকিস্তানি কুকুরগুলোকে মেরে স্বাধীন করব দেশ। আর তখন পারো তো ফিরে এস।’
ঠিক হল ফয়জুলের গ্রামের বাড়ি ফুলপুরে কিরণময়ীদের রেখে শরিফ বাবলু ফয়জুলের সঙ্গে নালিতাবাড়ির দিকে তিনিও চলে যাবেন। কিন্তু ধরা পড়ে গেলেন পাকিস্তানি আর্মির হাতে। তালা কিনতে বেরিয়েছিলেন, চরপাড়া মোড়ে কোনও তালা পাওয়া যায় কি না, বাড়িতে তালা দিয়ে রাতের অন্ধকারের মোষের গাড়িতে উঠবেন। উত্তেজনায় আবেগে বুক কাঁপছে তার। শ্মশানের মত শহরটি। শুনশান। দু-একটি দোকানের ঝাঁপ অর্ধেক খোলা। হঠাৎ হল্ট বলে ওরা আটকালো তাঁকে। তিনজন ছিল ওরা। একজন তাঁর পেছন থেকে সার্টের কলার ধরে হেঁচকা টান দিয়ে জিজ্ঞেস করল—নাম কেয়া হ্যায়?
সুধাময় কী নাম বললেব বুঝে পাননি। তার মনে পড়ল কিরণময়ী বলেছিলেন তাকে নাকি পাড়ার লোকেরা বলেছে বেঁচে থাকতে চাইলে নাম পাল্টাতে, ফাতেমা আখতার জাতীয় কিছু রাখতে। সুধাময় ভাবেন তার হিন্দু নামটি নিশ্চয় এই মুহূর্তে নিরাপদ নয়। তিনি বিস্মৃত হন তার নাম, পিতা সুকুমার দত্ত, ঠাকুরদা জ্যোতির্ময় দত্তের নাম। সুধাময় নিজের কণ্ঠস্বরে নিজেই চমকে ওঠেন যখন নিজের নাম তিনি বলেন—সিরাজউদ্দিন হোসেন। নাম শুনে একজন মোটা গলায় চেঁচালো—লুঙ্গি খোল। লুঙ্গি সুধাময় খোলেননি, ওরাই টান মেরে খুলেছিল। সুধাময় তখন বুঝেছিলেন নিমাই সুধাংশু রঞ্জন কেন পালিয়েছিল। ভারত ভাগের পর দেশ ত্যাগ করেছে প্রচুর হিন্দু। সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ভারত পাকিস্তান ভাগ হবার পর হিন্দুদের জন্য সীমান্ত খোলা ছিল। উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণীরা ভারত চলে যান।
১৯৮১ সালের লোক সেনসাস মতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ১ কোটি ৫ লক্ষ ৭০ হাজার অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ১২.১ শতাংশ। বারো বছরে এ সংখ্যা বেড়ে নিশ্চয় দু কোটিতে দাঁড়িয়েছে অথবা আড়াই কোটি। সরকারি হিসেবে হিন্দু সংখ্যা কমিয়ে বলা হয়। সুধাময় অনুমান করেন মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ হিন্দু আছে দেশে। ১৯০১ সালের হিসেব বলে পূর্ববঙ্গে হিন্দু ছিল ৩৩.০ শতাংশ, ১৯১১ সনে এই সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৩১.৫ শতাংশ। ১৯২১ সনে ৩০.৬ শতাংশ। ১৯৩১ সালে ২৯.৪ শতাংশ। ১৯৪১-এ ২৮ শতাংশ। ৪১ বছরে ভারত ভাগের আগে হিন্দু কমে ২২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ৪০ বছরে যা হ্রাস পায়নি, ১০ বছরে তার চেয়ে বেশি হ্রাস পেল। পাকিস্তান আমলে হিন্দুরা চলে যেতে থাকে ভারতে। ১৯৬১ সালের হিসাবে হিন্দু সংখ্যা ১৮.৫ শতাংশে দাঁড়ায়, ১৯৭৪ সালের হিসেবে ১৩.৫ শতাংশে। কিন্তু দেশ স্বাধীনের পরে হিন্দুসংখ্যা হ্রাসের হার কমে যায় অনেকটা বিভাগপূর্ব কালের মত। ১৯৭৪ সালে হিন্দু জনসংখ্যার হার ১৩.৫ শতাংশ এবং ১৯৮১ সালে যদি ১২.১ শতাংশ হয়, তবে তো নিশ্চয় করে বলা যায় যে, সংখ্যালঘুরা ভিটে ছাড়ছে আগের চেয়ে কম। কিন্তু কত সাল অবধি এই সংখ্যা কম? তিরাশি, চুরাশি, পঁচাশি, ঊননব্বই, নব্বই? নব্বই-এর পর কি হিন্দুসংখ্যা হ্রাস পাবে না দেশে? বিরানব্বই-এর পর?
সুধাময়ের বুকের বাঁদিকে ব্যথা শুরু হয়। পুরনো ব্যথা। মাথার পেছনেও যন্ত্রণা হচ্ছে। প্রেসার বেড়েছে বোধহয়। সি এন এন-এ বাবরি মসজিদ প্রসঙ্গ এলেই অফ করে দেয়া হচ্ছে দৃশ্য। সুধাময় অনুমান করেন, এই দৃশ্য দেখে লোকে হিন্দুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে তাই সরকার দয়া করছেন। কিন্তু আঁচড় লাগলেই ঝাঁপিয়ে পড়া অভ্যেস যাদের, তারা কী আর সি এন এন-এর দৃশ্য দেখবার অপেক্ষা করবে? সুধাময় বুকের বাঁদিকটা চেপে ধরে শুয়ে পড়েন। মায়া তখনও অস্থির পায়চারি করছে ঘরে বারান্দায়। সে কোথাও চলে যেতে চাইছে। সুরঞ্জন না উঠলে কোথাও যাওয়াও তো সম্ভব হচ্ছে না। সুধাময় অসহায় দৃষ্টি ফেলে রাখেন রোদ পড়া বারান্দায়। দীর্ঘ হচ্ছে মায়ার ছায়া। কিরণময়ী স্থির বসে আছেন, তাঁরও চোখে কাতর অনুনয়—চল বাঁচি। চল চলে যাই। ঘর বাড়ি ছেড়ে যাবেন কোথায় সুধাময়! এই বয়সে তাঁর পক্ষে কী আগের মত দৌড়ঝাঁপ সম্ভব! আগে যেমন মিছিল দেখলেই দৌড়োতেন। পাকিস্তানি শাসকের বিরুদ্ধে যে কোনও আন্দোলনে সবার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেন। ঘর তাকে আটকে রাখতে পারেনি। সেরকম শক্তি কোথায় তার আর! তিনি ভেবেছিলেন স্বাধীন সেক্যুলার বাংলাদেশে হিন্দুরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করবে। কিন্তু ধীরে ধীরে এ দেশের রাষ্ট্র কাঠামো থেকে খসে পড়ে ধর্মনিরপেক্ষতা। এ দেশের রাষ্ট্রধর্ম এখন ইসলাম। যে মৌলবাদী দলটি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, আর দেশ স্বাধীনের পর গর্তের মধ্যে লুকিয়েছিল তারা আজ গর্ত থেকে মাথা বের করেছে। তারা আজ গর্ত থেকে মাথা বের করেছে। তারা আজ সদর্পে ঘুরে বেড়ায়, মিছিল মিটিং করে, তারাই নব্বই-এর অক্টোবরে হিন্দুর মন্দির, ঘরবাড়ি, দোকানপাট লুট করে ভেঙে পুড়িয়ে দিয়েছে। সুধাময় চোখ বুজে শুয়ে থাকেন। এবার কী হবে তিনি জানেন না। বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলেছে উগ্র উন্মত্ত হিন্দুরা। তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে এখন বাংলাদেশের হিন্দুদের। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সুধাময়রা মৌলবাদী মুসলমানের থাবা থেকে নব্বই-এ মুক্তি পায়নি, বিরানব্বই-এ পাবে কেন? এবারও সুধাময়দের ইঁদুরের গর্তে লুকোতে হবে। কেন, হিন্দু বলে? যেহেতে হিন্দুরা ওখানে মসজিদ ভেঙেছে? এই দায় কেন সুধাময়ের হবে! তিনি আবার বারান্দায় মায়ার ছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকেন। ছায়াটি নড়ছে, কোথাও স্থির থাকছে না। ছায়াটি নড়তে নড়তে একসময় অদৃশ্য হয়। মায়া ঘরে ঢোকে। শ্যামল মায়াবী মুখখানায় ঘামের বিন্দুর মত আশঙ্কা জমছে। মায়া বলে, চেঁচিয়েই বলে—তোমরা তা হলে এখানেই পড়ে থাকো, আমি যাচ্ছি।
কিরণময়ী ধমকে ওঠেন—কোথায় যাবি?
মায়া দ্রুত চুল আঁচরায়। বলে—পারুলদের বাসায়। তোমাদের যদি বাঁচতে ইচ্ছে না হয় আমার করার কিছু নেই। দাদাও মনে হয় কোথাও যাবে না।
–আর তোর নীলাঞ্জনা নামটি কী করবি? সুধাময় মাথা তুলে প্রশ্ন করেন। মুহূর্তে তার মনে পড়ে নিজের সিরাজউদ্দিন নামটির কথা।
মায়ার কণ্ঠ কাঁপে না। বলে—লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ বলে নাকি মুসলমান হওয়া যায়, তাই হব, নাম হবে ফিরোজা বেগম।
–মায়া! কিরণময়ী মায়াকে থামাতে চান।
মায়া ঘাড় কাত করে তাকায় কিরণময়ীর দিকে। যেন সে মন্দ কিছু বলছে না, এটিই হওয়া স্বাভাবিক। কিরণময়ীর মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে মায়ার সিদ্ধান্তের কোনও পরিবর্তন হয় না। সুধাময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকান একবার মায়ার মুখে, একবার কিরণময়ীর মুখে। মায়া ছটফট করছে। একুশ বছরের প্রাণবান তরুণী মায়া, সাতচল্লিশের দেশভাগ দেখেনি সে, পঞ্চাশ বা চৌষট্টির দাঙ্গা দেখেনি, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, বুদ্ধি হবার পর দেখেছে দেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, দেখেছে সে এবং তার পরিবার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ, তাদের অনেকরকম আপস করতে হয় সমাজের সঙ্গে। দেখেছে সে নব্বই-এর লেলিহান আগুন। জীবন জীবন বাঁচাতে মায়া এখন যে কোনও চ্যালেঞ্জে যেতে প্রস্তুত। মায়া পুড়তে চায় না অন্ধ আগুনে। সুধাময়ের দৃষ্টির শূন্যতা মায়াকে গ্রাস করে নেয়। তার সামনে মায়া বলে আর কেউ থাকে না। তার বুকের ভেতর তীব্র একটা যন্ত্রণা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে।

লজ্জা (০১-গ)

সুরঞ্জনের চায়ের তৃষ্ণাটি যায় না। সে উঠে কলঘরে যায়। মুখ না ধুয়েই এক কাপ চা খেতে পারলে ভাল হত। মায়ার সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়েটি কি চলেই গেল! সুরঞ্জন দাঁত মাজে, অনেকক্ষণ সময় নিয়ে মাজে। বাড়িতে অদ্ভুত এক থমথমে ভাব, যেন এক্ষুণি কেউ মরবে। এক্ষুণি বাজ পড়বে বাড়িতে, সবার যার যার মৃত্যের অপেক্ষা করছে। সুরঞ্জন চায়ের তৃষ্ণাটি নিয়ে সুধাময়ের ঘরে যায়। বিছানায় পা তুলে আরাম করে বসে। মায়া কোথায়? সুরঞ্জনের প্রশ্নের উত্তর কেউ দেন না। কিরণময়ী জানালার সামনে উদাস বসেছিলেন, তিনি কোনও বাক্য খরচ না করে রান্নাঘরের দিকে উঠে যান। সুধাময় কড়িকাঠের দিকে ভাবলেশহীন তাকিয়েছিলেন, তিনি চোখ বুজে পাশ ফিরে শুয়ে থাকেন। কেউ সম্ভবত প্রয়োজন বোধ করছে না খবরটি তাকে জানাতে। সে বোঝে সে ঠিক দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। তার যা করা উচিত ছিল, বাড়ির সবাইকে নিয়ে কোথাও পালানো, সেটি সে সম্ভব করতে পারছে না। অথবা তার সম্ভব করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। মায়ার সঙ্গে জাহাঙ্গীর নামের এক যুবকের প্রেম, সুরঞ্জন খবর পেয়েছে। মায়া নিশ্চয়ই এই ছেলের সঙ্গে চান্স পেলেই ডেটিং-এ যাবে। ঘর থেকে বেরিয়েছে যখন, তখন আর ভাবনা কী! দাঙ্গা বাঁধলে হিন্দুরা কেমন আছে, কী করছে এসব খবর নেওয়া মুসলমানদের এক ধরনের ফ্যাশন। এই ফ্যাশন নিশ্চয়ই জাহাঙ্গীরও করবে। আর মায়া ধন্য হবে। মায়া যদি ধন্য হতে হতে একসময় বিয়েই করে ফেলে জাহাঙ্গীরকে! মায়ার দু ক্লাস ওপরে পড়ে ছেলেটি। সুরঞ্জন আশঙ্কা করে জাহাঙ্গীর মায়াকে শেষ অবধি বিয়ে করবে না। সুরঞ্জন তার নিজের জীবন দিয়ে বোঝে, পারভিনের সঙ্গে বিয়ে হয় হয় করেও তার হয়নি। পারভিন বলেছিল, তুমি মুসলমান হও। সুরঞ্জন বলেছিল, ধর্ম পাল্টানোর প্রয়োজন কী, তার চেয়ে যার যা ধর্ম তাই থাকুক। যার যা ধর্ম তাই থাকবে প্রস্তাবটি পারভিনের পরিবারের মনঃপুত হয়নি। তাঁরা একটি মুসলমান ব্যবসায়ীর সঙ্গে পারভিনের বিয়ে দিয়ে দিলেন। সেও কেঁদে-কেঁদে বিয়ের পিঁড়িতে বসল।
সুরঞ্জন উদাস চোখে চেয়ে থাকে একচিলতে বারান্দার দিকে। ভাড়া বাড়ি, উঠোন নেই, মাটি নেই খালি পায়ে হাঁটবার দৌড়োবার। কিরণময়ী চা নিয়ে ঘরে ঢোকেন। মায়ের হাত থেকে চায়ের কাপ নিতে নিতে যেন কিছুই হয়নি সুরঞ্জন বলে—ডিসেম্বর চলে এল, অথচ শীত তেমন পড়েনি, ছোটবেলায় শীরের ভোরে খেজুরের রস খেতাম।
কিরণময়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন—ভাড়া বাড়ি, খেজুরের রস কোথায় পাবি। নিজের হাতে লাগানো সব গাছ-গাছালির বাড়ি তো জলের দরে বিক্রি করে এলাম।
সুরঞ্জন চায়ে চুমুক দেয় আর তার মনে পড়ে রসের হাঁড়ি নামিয়ে আনত গাছ কাটার লোক। মায়া আর সে নীচে দাঁড়িয়ে থিরথির কাঁপত। কথা বললে মুখ থেকে সাদা ধোঁয়া বের হত। সেই খেলে বেড়ানো মাঠা, সেই আম জাম কাঁঠাক পেয়ারা সুপুরি নারকেলের বাগান আজ কোথায়! সুধাময় বলতেন—এ হচ্ছে তোর পূর্বপুরুষের ভিটে, এই ভিটে ছেড়ে কখনও কোথাও যাবি না।
শেষ পর্যন্ত বাড়িটি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন সুধাময় দত্ত। মায়ার যখন ছ’বছর বয়স, স্কুল থেকে বাড়ি ফিরবার পথে একবার সে হারিয়ে যায়। শহরের কোথাও তাকে পাওয়া যায় না। কোনও আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যায়নি, চেনা কারও বাড়িতেও নয়। সে এক টেনশনের ব্যাপার ছিল বটে। সুরঞ্জন অনুমান করেছিল এডওয়ার্ড স্কুলের গেটে আড্ডা দেয় কিছু ছেলে, পকেটে ছোরা থাকে, ওরাই মায়াকে তুলে নিয়ে গেছে। দু দিন পর মায়া ঘরে ফিরে এসেছে। একা। কোত্থেকে এসেছে, কারা ধরে নিয়েছিল কিছু বলতে পারেনি। পুরো দু মাস সে অস্বাভাবিক আচরণ করেছে। ঘুমের মধ্যে চমকে চমকে উঠত। মানুষ দেখলে ভয় পেত। রাতে রাতে ঢিল পড়ত বাড়িতে, উড়ো চিঠি আসে মেয়েকে ধরে নিয়ে যাবে তারা, বাঁচতে চাইলে টাকা দিতে হবে তাদের। সুধাময় জি ডি এন্ট্রি করতে থানায় গিয়েছিলেন। থানার পুলিশ এন্ট্রি খাতায় নাম-ধাম টুকে রাখল, ব্যস আর কিছু নয়। ছেলেরা বাড়িতে ঢুকে গাছের ফল পেড়ে নিয়ে যায়, সবজির বাগান মাড়িয়ে যায়, বাগানের ফুল ছিঁড়ে নিয়ে যায়। কেউ কিছু বলতে পারে না। পাড়ার ক’জনের কাছে সমস্যাটি পেড়েও কোনও লাভ হয়নি। তাঁরা বলেছেন, আমরা কী করতে পারি বলুন! এরকমই চলে আসছিল, অবস্থার কোনও উন্নতি হয়নি। সুরঞ্জন তার ক’জন বন্ধু নিয়ে ওদের সামাল দেবার চেষ্টা করেছিল। সামাল দেওয়া হয়ত যেত, সুধাময় রাজি হননি। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ময়মনসিংহ থেকে বদলি হয়ে যাবেন। বাড়ি বিক্রি করবেন। বাড়ি বিক্রি করবার আরও এক কারণ ছিল, এটি নিয়ে মামলা চলছিল দীর্ঘদিন। পাশের বাড়ির শওকত আলী জাল দলিল করে বাড়ির দখল নিতে চেষ্টা করছিলেন। এসব ঠেকাতে কোর্ট-কাছারি করতে করতে সুধাময় বড় বিরক্ত ছিলেন, বড় ক্লান্ত। সুরঞ্জন বাড়ি বিক্রির পক্ষে ছিল না। সে তখন কলেজে পড়া তাজা যুবক। ছাত্র ইউনিয়ন থেকে কলেজ সংসদের নির্বাচনে দাঁড়িয়ে জিতেছে। সে ইচ্ছে করলে ওই বদমাশ ছোকরাদের পেটাতে পারত। কিন্তু সুধাময়ই অস্থির হয়ে গেলেন বাড়ি বিক্রি করতে। তিনি আর এ শহরে থাকবেন না, ঢাকায় চলে যাবেন। এ শহরে প্র্যাকটিসও নাকি ভাল জমছে না, স্বদেশি বাজারের ফার্মেসিতে বিকেলে বসে থাকেন, রোগী নেইম দু-চারটে যা রোগী আসে, হিন্দু, দরিদ্র, এত দরিদ্র যে পয়সা নিতে ইচ্ছে করে না। সুধাময়ের অস্থিরতা দেখে সুরঞ্জনও আর চাপাচাপি করেনি। এখনও মনে পড়ে দু বিঘা জমির ওপর তাদের সেই বিশাল বাড়িটির কথা। যেদিন দশ লাখ টাকার বাড়িটি রইসউদ্দিন সাহেবের কাছে মাত্র দু লাখ টাকায় বিক্রি করে দিলেন সুধাময়, কিরণময়ীকে বললেন—চল চল তৈরী হও, জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও। মাটিতে আছড়ে পড়ে কেঁদেছিলেন কিরণময়ী। সুরঞ্জনের বিশ্বাস হয়নি সত্যিই বাড়িটি ছেড়ে তারা চলে যাচ্ছে। জন্ম থেকে চেনা ঘরদুয়োর ছেড়ে, শৈশবের খেলার মাঠ ছেড়ে, ব্রহ্মপুত্র ছেড়ে, বন্ধুবান্ধব ছেড়ে তার চলে যেতে ইচ্ছে করেনি। যে মায়ার জন্য যাওয়া সেই মায়াই যেতে চায়নি, সে ঘাড় নেড়ে বলেছে—‘আমি সুফিয়াকে ছেড়ে যাব না।’ সুফিয়া তার স্কুলের বন্ধু। কাছেই বাড়ি। বিকেলে উঠোনে বসে দুজনে পুতুল খেলে, হাঁড়ি পাতিল খেলে। সেও মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছিল। সুধাময় মানলেন না। যদিও শেকড়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কই ছিল বেশি। তিনিই বললেন—জীবন আর ক’দিনের, ছেলেমেয়ে নিয়ে একটু নিশ্চিন্ত বাস করতে চাই।
নিশ্চিন্ত বাস কি কোথাও সম্ভব? সুরঞ্জন জানে সম্ভব নয়। যে ঢাকায় এসে সুধাময় হাঁফ ছেড়েছিলেন, সেই ঢাকায়, একটা স্বাধীন দেশের রাজধানী শহরে সুধাময়কে ধুতি ছেড়ে পাজামা পরতে হয়েছে। সুরঞ্জন টের পেয়েছে পিতার যন্ত্রণা, তিনি মুখ ফুটে বলেননি কিছু, তবু তো তাঁর দীর্ঘশ্বাস বাড়ির দেওয়ালগুলোতে আঘাত খেত, বুঝত সব সুরঞ্জন। সামনে তাদের দেওয়াল ছিলই একটি, এত চেয়েছে অতিক্রম করতে, কেউই পারেনি। না সুধাময়, না সুরঞ্জন।
সুরঞ্জন বারান্দায় রোদের দিকে মগ্ন চোখে তাকিয়েছিল। হঠাৎ দূর থেকে ভেসে আসা একটি মিছিলের শব্দ তাকে সজাগ করে। মিছিলটি কাছে আসতেই সুরঞ্জন শুনতে চেষ্টা করে কী বলে মিছিলে, সুধাময় আর কিরণময়ীও কান পেতে থাকেন। সুরঞ্জন লক্ষ্য করে কিরণময়ী উঠে জানালা বন্ধ করে দেন। জানালা বন্ধ করলেও মিছিলটি যখন বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে পার হয় তখন স্পষ্ট শোনা যায় মিছিলের শ্লোগান—‘একটা দুইটা হিন্দু ধর, সকাল বিকাল নাস্তা কর।’ সুরঞ্জন লক্ষ্য করে সুধাময় কেঁপে উঠলেন। কিরণময়ী স্থির দাঁড়িয়েছিলেন বন্ধ জানালার দিকে পিঠ দিয়ে। সুরঞ্জনের মনে পড়ে নব্বইয়েও এই শ্লোগান দিয়েছিল ওরা, ওরা হিন্দুদের নাস্তা করতে চায়, তার মানে খেয়ে ফেলতে চায়। সুরঞ্জনকে এই মুহূর্তে হাতের কাছে পেলে ওরা খেয়ে ফেলবে। কারা এরা, পাড়ার ছেলেপুলেরাই তো! জব্বার, রমজান, আলমগীর, কবীর, আবেদিন এরাই তো। এরা বন্ধুর মত, ছোট ভাইয়ের মত, সকাল বিকেল কথা হচ্ছে, পাড়ার সমস্যা নিয়ে আলাপ আলোচনা হচ্ছে। দল বেঁধে সমাধানও হচ্ছে। এরা আজ সাতই ডিসেম্বরের চমৎকার শীতের সকালে সুরঞ্জনকে নাস্তা করবে!

লজ্জা (০১-ঘ) সুধাময় ঢাকা এসে তাঁতিবাজারে উঠেছিলেন

০১ঘ.

সুধাময় ঢাকা এসে তাঁতিবাজারে উঠেছিলেন। তাঁর মামাতো দাদার বাড়ি ছিল তাঁতিবাজার। অসিত রঞ্জনই ছোট একটি বাড়ি দেখে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন—সুধাময়, তুমি বড়লোকের ছেলে। তুমি কি থাকতে পারবে ভাড়া বাড়িতে?

সুধাময় বলেছিলেন—কেন পারব না? আর মানুষ থাকছে না?

—তা থাকছে। কিন্তু তুমি তো জন্ম থেকে কোনও অভাব দেখনি। আর নিজের বাড়ি বিক্রি করলেই বা কেন? মায়া ছোট মানুষ। ও তো আর যুবতী মেয়ে ছিল না। নিশ্চয়ই সে ধরনের কোনও ঘটনা ঘটত না। আমাদের উৎপলাকে তো পাঠিয়েই দিলাম কলকাতায়। ও তো কলেজে যেতে পারত না। ওকে তুলে নেবে, ধরে নেবে এসব বলত পাড়ার ছেলেরাই। ভয়ে পাঠিয়ে দিলাম। এখন তিলজলায় ওর মামার বাড়িতে আছে। মেয়ে বড় হলে বড় দুশ্চিন্তা হয় দাদা।

অসিত রঞ্জনের কথাকে উড়িয়ে দিতে পারেন না। সুধাময়। হ্যাঁ দুশ্চিন্তা হয় বৈকি। তিনি ভাবতে চান মুসলমানের মেয়ে বড় হলেও তো দুশ্চিন্তা হয়। সুধাময়ের এক ছাত্রীকে রাস্তায় ফেলে শাড়ি টেনে খুলেছিল একদল যুবক, মেয়েটি তো হিন্দু ছিল না, ছিল মুসলমান। যুবকরাও মুসলমান ছিল, তবে? সুধাময় নিজেকে সান্ত্বনা দেন আসলে হিন্দু মুসলমান নয়, দুর্বল পেলে সবলেরা অত্যাচার কিছু করবেই। নারী দুর্বল বলে সবল পুরুষেরা অত্যাচার করছে। অসিত রঞ্জন তাঁর দুই মেয়েকেই কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। টাকাপয়সা ভাল রোজগার করেন, সোনার দোকান আছে ইসলামপুরে, নিজেদের দোতলা একটি বাড়ি আছে পুরনো, এটির সংস্কারও করেননি তিনি। নতুন বাড়ি করবেন, তাতে উৎসাহ নেই কোনও। সুধাময়কে একদিন বললেন—টাকাপয়সা খরচ কোর না। দাদা। জমাও। বাড়ি বিক্রির টাকা পারো তো পাঠিয়ে দাও, আমার আত্মীয়রা আছে ওখানে, জমি-টমি রেখে দেবে।

সুধাময় জিজ্ঞেস করেছেন–ওখানে মানে?

অসিত রঞ্জন গলা খাটো করে বলেছেন—কলকাতায়। আমিও কিনে রেখেছি।

সুধাময় গলা উঁচু করে বলেছেন—তুমি এখানে টাকা কামাবে। আর খরচা করবে গিয়ে ওদেশে? রীতিমত দেশদ্রোহী বলা যায় তোমাকে।

অসিত রঞ্জন অবাক হতেন। সুধাময়ের কথায়। ভাবতেন কোনও হিন্দুর মুখে এ ধরনের কথা তিনি তো শোনেননি। বরং টাকা পয়সা এখানে যথেচ্ছ খরচ না করে জমিয়ে রাখবার পক্ষপাতী সকলে। কখন কী হয় বলা তো যায় না। এখানে গেড়ে বসব, আর কখন কারা খুঁটি তুলে আছাড় মারে, বলা যায়?

সুধাময় মাঝে মধ্যে ভাবেন কেন তিনি ময়মনসিংহ ছেড়ে চলে এলেন। নিজের বাড়ির মায়া তাঁকে এতটুকু কাতর করল না কেন? মায়াকে নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল, হতেই পারে। অপহরণের ঝামেলায় হিন্দু মুসলমান দু সম্প্রদায়ই ভুগতে পারে। সুধাময় নিজের বাড়িতে কি নিরাপত্তার অভাব বোধ করতেন? নিজের কাছেই গোপনে জিজ্ঞেস করেন তিনি। তাঁতিবাজারের অপরিসর ঘর বারান্দায় শুয়ে বসে সুধাময় ভাবেন; কেন তিনি নিজের ভিটে ছেড়ে অচেনা একটি এলাকায় বাস করছেন। এ কি নিজেকে লুকোনো? কেন নিজের ভিটে মাটি নিয়েও উদ্বাস্তু মনে হত নিজেকে? নাকি শওকত সাহেবের জাল দলিলের মামলায় সুধাময়ের সন্দেহ হত তিনি হেরে যাবেন? নিজের বাড়ির মামলায় নিজের হারা। তার চেয়ে মান-সম্মান নিয়ে চলে যাওয়াই ভাল। সুধাময় তাঁর এক খুড়তুতো দাদাকে দেখেছেন নিজের বাড়ি খোয়াতে। বাড়ি ছিল টাঙাইলের আকুর টাকুর পাড়ায়। এক হাত জমির দখল নিতে চায় পাশের বাড়ির জমির মুন্সি। আদালতে মামলা উঠল, পাঁচ বছর পর্যন্ত মামলা গড়িয়ে গড়িয়ে জমির মুন্সির পক্ষ নিল। তারাপদ ঘোষাল দেশের পাট, চুকিয়ে শেষ পর্যন্ত চলে গেছে। ইন্ডিয়া। শওকত সাহেবের মামলাটিরও তারাপদের দশা হয় কি না ভেবেই তিনি কি নিজের বাপ ঠাকুরদার বাড়িটি নিমেষে বিক্রি করে দিলেন? হবে হয়ত। এও কথা ঠিক, আগের সেই দাপট ছিল না। সুধাময়ের। বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যা কমে যাচ্ছিল। ফাঁক পেলেই চলে যেত এক-একটি হিন্দু ফ্যামিলি। অনেকে মরে গেলেন। ক’দিন পর পরই চেনা পরিচিতদের বা আত্মীয় বন্ধুদের লাশ কাঁধে নিয়ে ‘হরি বোল বলো হরি’ বলতে হয়েছে। যাঁরা বেঁচে হিলেন, ছিলেন চরম হতাশা নিয়ে। যেন কোনও মূল্য নেই বেঁচে থাকায়। তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে সুধাময় লক্ষ করতেন, তিনিও ভয় পাচ্ছেন, যেন খুব শিগরি গভীর রাত্তিরে একটি দৈত্য এসে তাঁদের গুড়িয়ে দেবে। সকলের স্বপ্নের দেশ ইন্ডিয়া, গোপনে ফন্দি আঁটেন বডাির পার হবার। সুধাময় শুনে অনেকদিন বলেছেন—‘দেশে যখন যুদ্ধ শুরু হল, কাপুরুষের মত পালালে ইন্ডিয়া। দেশ স্বাধীন হল তো বীরদৰ্পে ফিরে এলে। এখন কথায় কথায় এ ওকে টোকা মারল তো চলে যাবে ইন্ডিয়া, যতসব কাওয়ার্ডের দল।’ সুধাময়ের সামনে যতীন দেবনাথ, তুষার কর, খগেশ কিরণ সকলেই ধীরে ধীরে দূরত্ব তৈরি করে নিলেন। তাঁরা মুখ ফুটে মনের কথা বলতে আর রাজি হন না। সুধাময় নিজের শহরে নিজে বড় একা হয়ে গেলেন। বন্ধু শাকুর, ফয়সল, মজিদ, গাফফারদের সঙ্গে দূরত্বও স্পষ্ট হচ্ছিল। হয়ত গেলেন ওঁদের বাড়িতে, বলে বসলেন—’তুমি একটু সামনের ঘরে বস, সুধাময়, নামাজটা সেরে আসি, অথবা ‘আজ এলে, আজ তো বাড়িতে মিলাদ। বামপন্থীদের বয়স বাড়ে আর তাঁরা ধর্মে মনোযোগী হন, সুধাময় বড় নিঃসঙ্গ বোধ করেন। নিজের শহরে যুক্তি, বুদ্ধি, বিবেকের এই দৈন্য তাঁকে আহত করে খুব, তিনি তাই পালাতে চাইলেন, দেশ থেকে নয়, স্বপ্নের শহরটি ছেড়ে, যেন তাঁকে আর হাঙরের মত গিলে না খেতে পারে স্বপ্নের নীল নিকষ মৃত্যু।

সুরঞ্জন প্রথম প্রথম চেঁচামেচি করত নিজেদের বাড়ি ছেড়ে কবুতরের খোপে বাস করতে হচ্ছে বলে। তারপর তারও সয়ে গেছে। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে, বন্ধু-বান্ধব গড়ে উঠেছে নতুন করে, ভাল লাগা এখানেও জন্মেছে। এখানেও রাজনীতিতে জড়িয়েছে সে। এখানেও মিটিং মিছিলে সুরঞ্জনের ডাক পড়ে। কিরণময়ী আপত্তি করেছিলেন, এখনও আপত্তি করেন, রাতে রাতে চোখের জল ফেলেন নিজের হাতে লাগানো সিমের ম্যাচটি কী আর আছে, আমাদের পেয়ারার মত অত বড় পেয়ারা পাড়ায় আর একটি ছিল না, আহা ডাবগাছগুলোর কী অবস্থা কে জানে, গোড়ায় কি ওরা লবণজল দেয়! কেবল কি কিরণময়ীর, সুধাময়েরও কি কষ্ট কম হয়।

ঢাকায় বদলি হয়ে সুধাময় ভেবেছিলেন প্রমোশনের ব্যাপারে খোঁজখবর কিছু করা যাবে। গিয়েও ছিলেন মিনিস্ট্রিতে, গিয়ে বসে থাকতে হয় ছোটখাটো কেরানির রুমে, বড়জোর এ পি এস-এর রুমে। ‘ভাই, ফাইলটার কি কিছু হবে? এসবের সদুত্তর কখনও মিলত না। হচ্ছে হবে জাতীয় কিছু শব্দ শুনে সুধাময়কে বিদায় নিতে হত। কেউ কেউ বলতেন, ‘ডাক্তারবাবু, মেয়ের আমাশা ওষুধ লিখে দিন, বুকের বাঁদিকটা ক’দিন থেকে ব্যথা করছে, ভাল ওষুধ দিন তো। * সুধাময় ব্রিফকেস খুলে নিজের নাম-ঠিকানা লেখা প্রেসক্রিপশান প্যাড বের করতেন, তারপর গোটা গোটা অক্ষরে ওষুধের নাম লিখে দিতেন। জিজ্ঞেস করতেন, ‘আমার কাজটি হবে তো ফরিদাসাহেব?’ ফরিদাসাহেব একগাল হেসে বলতেন, ‘এসব কি, আর আমাদের হাতে মশাই? সুধাময় খবর পেতেন তাঁর জুনিয়ারদের প্রমােশন হচ্ছে। তাঁর ফাইলের ওপর চোখের সামনে ডাঃ করিমুদ্দিন, ডাঃ ইয়াকুব মোল্লার ফাইল পড়ল, ওঁরা এসোসিয়েট প্রফেসার-এর পোস্টিং নিয়ে কাজও শুরু করে দিলেন। সুধাময়ের জুতের সুখতলি কেবল খরচা হতেই লাগল। ওঁরা বললেন, ‘আজ নয় কাল আসুন, আপনার ফাইল সেক্রেটারির কাছে যাবে। কাল নয়। পরশু আসুন, আজ মিটিং আছে। মন্ত্রী দেশের বাইরে গেছেন, এক মাস পর আসুন’—এসব শুনতে শুনতে সুধাময় একদিন বুঝলেন তাঁর আসলে হবে না। দেড়-দু বছর পদোন্নতির পেছনে ছুটে তো দেখলেন যারা ডিঙিয়ে যাবার তারা যায়, যোগ্যতা না থাকলেও যায়। রিটায়ারমেন্টের সময় চলে আসছে, তাঁর প্রাপ্য ছিল এ সময় এসোসিয়েট প্রফেসারের পদটি, তিনি কোনও লোভ করেননি, এ তাঁর প্রাপ্য, জুনিয়ররা এই পদ নিয়ে মাথার ওপর বসে আছে।

শেষ পর্যন্ত সহকারী অধ্যাপক হিসেবেই অবসর গ্রহণ করলেন সুধাময় দত্ত। একইসঙ্গে চাকরি করতেন মাধব চন্দ্ৰ পাল, সুধাময়ের ফেয়ারওয়েলের দিন গলায় গাঁদা ফুলের মালা পরিয়ে ফিসফিস করে বলেছিলেন, ‘মুসলমানের দেশে নিজের জন্য খুব বেশি সুযোগ-সুবিধে আশা করা ঠিক নয়। যা পাচ্ছি তাই আমাদের জন্য বেশি।’ বলেই তিনি ঠা-ঠা করে হেসেছিলেন। তিনিও দিব্যি সহকারীর চাকরি করে যাচ্ছেন, দু-একবার তাঁর নাম দেওয়া হয়েছিল পদোন্নতির জন্য, আর সব নাম নিয়ে আপত্তি না উঠলেও এই নামটি নিয়ে উঠেছে, তা ছাড়া মাধব চন্দ্রের আরও দোষ ছিল, তিনি নাকি সোভিয়েত ঘুরে এসেছেন। সুধাময় পরে ভেবেছিলেন মাধব চন্দ্র ভুল বলেননি, প্রশাসন, পুলিশ, কিংবা সেনাবাহিনীর উঁচু পদে হিন্দুদের নিয়োগ বা পদোন্নতির ব্যাপারে বাংলাদেশের আইনের কোনও বাধা নেই। কিন্তু দেখা যায় মন্ত্রণালয়গুলোয় কোনও সেক্রেটারি বা এডিশনাল সেক্রেটারি পদে কোনও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক নেই। জয়েন্ট সেক্রেটারি আছেন তিনজন, আর হাতে গোনা ক’জন আছেন ডেপুটি সেক্রেটারি। সুধাময়ের বিশ্বাস সেই গুটিকয় জয়েন্ট সেক্রেটারি। আর ডেপুটি সেক্রেটারি নিশ্চয় পদোন্নতির আশা করেন না। ছয়জন মাত্র হিন্দু ডি সি আছেন। সারাদেশে। হাইকোর্টে হিন্দু জজ মাত্র একজন। পুলিশের নীচু পদে হয়ত তাদের নেওয়া হয়। কিন্তু এস পি পদে হিন্দু ক’জন আছেন? সুধাময় ভাবেন তিনি আজ সুধাময় দত্ত বলেই তাঁর এসোসিয়েট প্রফেসর হওয়া হয়নি। তিনি যদি মোহাম্মদ আলি অথবা সলিমুল্লাহ চৌধুরি হতেন তবে নিশ্চয় এই বাধা থাকত না। ব্যবসা বাণিজ্য করতে গেলেও মুসলমান অংশীদার না থাকলে কেবল হিন্দু প্রতিষ্ঠানের নামে সব সময় লাইসেন্স পাওয়া যায় না। তা ছাড়া সরকার নিয়ন্ত্রিত ব্যাঙ্ক, বিশেষত শিল্পঋণ সংস্থা থেকে শিল্পকারখানা গড়বার জন্য ঋণ দেওয়াও হয় না।

সুধাময় দত্ত তাঁতিবাজারেই আবার নিজের বাসযোগ্য পরিবেশ গড়ে তুলেছিলেন। জন্মের শহর ছেড়েও তাঁর মায়া যায়নি, দেশের মায়া। বলতেন, ‘ময়মনসিংহই কি দেশ? পুরো বাংলাদেশই তো আমার দেশ।’

কিরণময়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন, ‘পুকুরে মাছের পোনা ছাড়ব, দুটো সবজির গাছ লাগাব, ছেলেমেয়েরা গাছের ফল খাবে, এগুলো এখন স্বপ্নের মত, এখন মাস মাস ভাড়ী শুনতেই দেখি সব যায়।’ রাত গভীর হয়ে এলে কিরণময়ী প্রায়ই বলতেন, ‘বাড়ি বিক্রির টাকা আর রিটায়ার করার পর মোটা অঙ্কের টাকাই তো পেলে, চল চলে যাই, কলকাতায় আত্মীয়স্বজন তো কম নেই আর!’

সুধাময় বলতেন—আত্মীয়রা একবেলা তোমাকে খাওয়াবে ভেবেছ? ভাবিছ উঠবে তাঁর বাড়িতে, গিয়ে দেখলে মুখ ফিরিয়ে রাখল, বলল কোথায় উঠলেন, চা-টা খাবেন কি না।

–নিজেদের টাকা পয়সা নিলে অন্যের কাছে হাতই বা পাততে হবে কেন?

–আমি যাব না। তোমরা যেতে চাইলে যাও। নিজের ভিটে ছেড়েছি, তাই বলে নিজের দেশ ছাড়ব? সুধাময় চেচিয়েই বলতেন।

তাঁতিবাজার ছেড়ে আরমানিটোলা, ওখানে ছ’বছর থেকেছেন, এরপর প্রায় সাত বছরের মত টিকাটুলিতে আছেন সুধাময় দত্ত। এর মধ্যে হৃদপিণ্ডে অসুখ জমেছে। গোপীবাগের এক ওষুধের দোকানে বিকেলে বসবার কথা ছিল, সেখানে নিয়মিত বসা হচ্ছে না। বাড়িতেই রোগী আসে, বাইরের ঘরে রোগী দেখবার টেবিল পাতা আছে। চৌকিও আছে একদিকে। একপাশে বেতের সােফা পাতা। বুকসেলফে বইপত্র বিস্তর। ডাক্তারি, সাহিত্য, সমাজ, রাজনীতি গাদাগাদি করে এক কাতারেই দাঁড় করানো। সুধাময় ওঘরেই বেশির ভাগ সময় কাটান, সন্ধেবেলা স্যান্ডেলের চটাস চটাস শব্দ তুলে নিশীথবাৰু আসেন, আখতারুজ্জামান, শহিদুল ইসলাম, হরিপদ প্রায়ই আসেন। দেশের রাজনীতি নিয়ে আলোচনা গড়ায়। কিরণময়ী ওঁদের চা করে দেন। চিনি ছাড়া চাই দিতে হয় বেশি। বয়স হয়ে গেছে। সবারই। সুধাময়েরও কী কম হল!

মিছিলের শব্দ শুনে চকিতে উঠে বসেন সুধাময়। সুরঞ্জনের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে, কিরণময়ীর কবুতরের মত নরম বুকখানা দ্রুত ওঠা-নমা করছে। ভয়ে, ক্ৰোধে। সুধাময়েরও কি কিছু আশঙ্কা হয় না? কিছু ক্ৰোধ কি তাঁরও হওয়া উচিত নয়?

লজ্জা (০২) সুরঞ্জনের বন্ধুদের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যাই বেশি

০২ক .

সুরঞ্জনের বন্ধুদের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যাই বেশি। অবশ্য ওদের মুসলমান বলাওঁ ঠিক নয়। ওরা ধর্মন্টর্ম তেমন মানে না। আর মানলেও সুরঞ্জনকে কাছের মানুষ ভাবতে ওরা কোনও দ্বিধা করেনি। কামাল তো গত বছর বাড়িসুদ্ধ নিয়ে গেল নিজের বাড়িতে। পুলক, কাজল, অসীম, জয়দেবও সুরঞ্জনের বন্ধু কিন্তু ঘনিষ্ঠতা বেশি কামাল, হায়দার, বেলাল বা রবিউলের সঙ্গে। সুরঞ্জনের যে কোনও বিপদে কাজল অসীমের চেয়ে কাছে এসেছে হায়দার কামাল বেলালই। সুধাময়কে একবার সোহরাওয়ার্দি হাসপাতালে ভর্তি করবার প্রয়োজন পড়েছিল, রাত দেড়টা বাজে তখন। হরিপদ ডাক্তার বললেন, ‘মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশান, এক্ষুনি হাসপাতালে নাও।‘ সুরঞ্জন কাজলকে খবরটি জানালে কাজল হাই তুলে বলল, ‘এত রাতে কি করে শিফট করবে, সকাল হোক, একটা ব্যবস্থা করা যাবে।‘  অথচ খবরটি জানবার পরই গাড়ি নিয়ে ছুটে এল বেলাল। নিজে দৌড়াদৌড়ি করে ভর্তি করাল, বারবার সুধাময়কে বলল, ‘কাকাবাবু, আপনি একটুও দুশ্চিন্তা করবেন না, আমাকে আপনি নিজের ছেলেই মনে করবেন।’ সুরঞ্জনের মন ভরে গেছে দেখে। যতদিন হাসপাতালে ছিলেন সুধাময়, বেলাল খোঁজ নিয়েছে, চেনা ডাত্মারদের বলে এসেছে কেয়ার নিতে, সময় পেলেই দেখতে গিয়েছে, হাসপাতালে যাওয়া আশর জন্য গাড়ি দিয়েছে। কে করে এত? পয়সা তো কাজলেরও আছে, সে কি এমন হৃদঙ্গবন হতে পারে সুরঞ্জনের জন্য? চিকিৎসার খরচ প্রায় পুরোটাই দিয়েছে। রবিউল। একদিন টিকাটুলির বাড়িতে হঠাৎ উপস্থিত রবিউল, বলল, ‘তোর বাবা নাকি হাসপাতালে?’ সুরঞ্জন হ্যাঁ না কিছু বলবার আগেই টেবিলের ওপর একটি খাম রেখে রবিটল বলল, ‘এত পর ভাবিস না বন্ধুদের।’ বলে যেমন দমকা এসেছিল, দমকা চলেণ্ড গেল। সুরঞ্জন খাম খুলে দেখে পাঁচ হাজার টাকা। কেবল সাহায্য করে বলে নয়, ওদের সঙ্গে মনে ও মননেও বড় মেলে তার। রবিউল কামাল হায়দারকে যত আপন করে পেয়েছে সুরঞ্জন, অসীম কাজল জয়দেবকে ততটা পায়নি। শুধু তা-ই নয় পারভিনকে সে যতন্ত্র ভালবেসেছিল, সুরঞ্জনের বিশ্বাস হয় না কোনও অর্চনা, দীপ্তি, গীতা বা সুনন্দাকে সে ততটা ভালবাসতে পারবে।

সম্প্রদায়ের ভেদ সুরঞ্জন নিজে কখনও করতে শেখেনি। ছোটবেলায় সে জানোতই না যে সে হিন্দু। ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে পড়ে, খ্রি-ফোরে হবে হয়ত, খালেদ নামের এক ছাত্রের সঙ্গে ক্লাসের পড়া নিয়ে তার খুব তর্ক হচ্ছিল। তর্ক একসময় তুঙ্গে উঠলে খালেদ তাকে গাল দেয়। কুকুরের বাচ্চা, শুয়োরের বাচ্চা, হারামজাদা এমন গাল। উল্টে সুরঞ্জনও খালেদকে গাল ফিরিয়ে দিচ্ছিল। খালেদ বলে ‘কুকুরের বাচ্চা, সুরঞ্জনও বলে ‘তুই কুকুরের বাচ্চা’। ‘ খালেদ বলে ‘হিন্দু।’ সুরঞ্জন পাল্ট বলে ‘তুই হিন্দু ৷ ‘ সে ভেবেছিল কুকুরের বাচ্চা, শুয়োরের বাচ্চার মত হিন্দুও এক ধরনের গাল। সে অনেককাল ভেবেছিল হিন্দু বোধহয় তুচ্ছাৰ্থে ব্যঙ্গার্থে ব্যবহৃত কোনও শব্দ। পরে আরও বড় হয়ে সুরঞ্জন বুঝেছে হিন্দু একটি সম্প্রদায়ের নাম এবং সে এই সম্প্রদায়ের মানুষ। আরও পরে তার যে বোধ জন্ম নিয়েছে তা হল সে আসলে মানব সম্প্রদায়ের মানুষ এবং সে জাতিতে বাঙালি। কোনও ধর্ম এই জাতিকে তৈরি করেনি। বাঙালিকে সে অসাম্প্রদায়িক এবং সমাজয়বাদী জাতি হিসেবেই মানতে চায়। বাঙালি শব্দটি একটি বিভাজন বিরোধী শব্দ এর কথা সে বিশ্বাস করে। কিন্তু স্বধৰ্মীয় বিদেশিকে আপনি এবং অন্য ধমাবলম্বীকে পরজাতি বলে বাঙালি বারবারই মনে করছে, এই বিভ্ৰান্তিকর ধারণা, বোধ, বিশ্বাস বাঙালিকে হিন্দু মুসলমানে বিভক্ত করেছে।

আজি ডিসেম্বরের আট তারিখ। সারাদেশে হরতাল। হরতাল ডেকেছে৷ ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। মাঝখান থেকে জামাতে ইসলামি জানায় তারা বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিবাদে হরতাল ডেকেছে। হরতাল হচ্ছে, সুরঞ্জন আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছাড়ে, একবার ঘুরে আসা যাক। প্রিয় শহরটির মুখ দেখে না। সে আজ দু দিন। ওঘরে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকেন। কিরণময়ী। সুধাময়ের মনে কোনও শঙ্কা আছে কি না। সুরঞ্জন ঠিক বুঝতে পাত্রে না। বাড়িতে এবার সে জানিয়ে দিয়েছে কোথাও যাবে না লুকোতে। মরলে মরে যাবে। মুসলমানেরা যদি বাড়ির সবাইকে কেটে রেখে চলে যায়, যাবে। তৰু বাড়ি থেকে এক পা-ও নড়বে না। সুরঞ্জন। মায়া নিজ দায়িত্বে গেছে, যাক। বাঁচবার প্রবল ইচ্ছে নিয়ে মুসলমানের ঘরে সে আশ্রয় নিয়েছে। দুই-একজন পারুল রিফাতের ছাতার তলে সে প্রাণ বাঁচাতে চাইছে। বেচারা মায়া।

দুদিন টানা শুয়ে থেকে সুরঞ্জন যখন বাইরে যাবার জন্য তৈরি হয়, দেখে কিরণময়ী চমকে উঠে বলেন–কোথায় যাচ্ছিস?

—দেখি শহরের অবস্থা কী। হরতাল কেমন হচ্ছে দেখে আসি।

—বাইরে যাস নে সুরো। কী হয় বলা যায় না।

—যা হয় হবে। মরতে তো একদিন হবেই। আর এত ভয় পেও না তো। তোমাদের ভয় দেখলে আমার রাগ ধরে। চুলে সিঁথি কাটতে কাটতে সুরঞ্জন বলে।

কিরণময়ী কেঁপে ওঠেন। তিনি ছুটে এসে সুরঞ্জনের হাত থেকে চিরুনি কেড়ে নেন। –কথা শোন সুরঞ্জন। একটু সাবধান হ। হরতালের মধ্যেই শুনছি দোকান ভাঙছে, মন্দির পোড়াচ্ছে। ঘরে বসে থাক। শহরের অবস্থা দেখার কোনও দরকার নেই।

সুরঞ্জন চিরকালের অবাধ্য ছেলে। সে কিরণময়ীর কথা মানবে কেন? বাধা ডিঙিয়ে চলে যায় সে। বাইরের ঘরে সুধাময় একা বসেছিলেন। তিনিও অবাক তাকিয়ে থাকেন। ছেলের চলে যাওয়ার দিকে। ঘরের বাইরে বেরোতেই বিকেলের স্নিগ্ধতা ছাপিয়ে খাঁ খাঁ নির্জনতা আর ভূতুড়ে স্তব্ধতা তার গায়ে বেঁধে। একটু কি ভয় ভয় লাগে তার!! লাগেই মনে হয়। তবু সুরঞ্জন ভেবেছে যখন আজ সে শহর ঘুরবে, ঘুরবেই। এবার তাদের নিতে বা দেখতে কেউ আসেনি। না বেলাল, কামাল, না কেউ। ওরা এলেও সুরঞ্জন যেত না, যাবে কেন? ক’দিন পর পরই হামলা হবে। আর তল্পিতল্পা সহ ছোটাছুটি, ছিঃ! নেহাত গর্দভ ছিল বলে গত বছর গিয়েছিল কামালের বাড়িতে। এবার এলে দিব্যি সে বলে বসন্ত ‘তোমরা মারবেও আবার দয়াও করবে, এ কেমন কথা। তার চেয়ে সকলে মিলে একটি কাজ কর। যত হিন্দু আছে দেশে, ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে গুলি করে মারো। মরে গেলে তোমাদের ঝামেলা চুকবে। মারতেও হবে না, আবার কায়দা করে বাঁচাতেও হবে না।’ সুরঞ্জন রাস্তায় উঠতেই একদল ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল, চেচিয়ে ওঠে ‘ধর ধর, হিন্দু ধর বলে। এই ছেলেগুলো পাড়ারই। বাড়িতে ঢুকতে বেরোতে সাত বছর এদের দেখছে সে। সুরঞ্জন চেনেও দু-একজনকে। আলম নামের ছেলেটি প্রায়ই আসে। চাঁদা চাইতে। পাড়ায় একটি ক্লাব আছে। এদের। ক্লাবের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোয় সুরঞ্জন গানও গায়। কিছু ছেলেকে ডি এল রায় আর হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান শেখাবে ভেবেছিল সে। এরা প্রায়ই দাদা এটা করে দিন ওটা শিখিয়ে দিন বলে কাজে-অকাজে বাড়িতে ভিড় করে। এদেরই পাড়ার লোক বলে সুধাময় ফ্রি চিকিৎসা করছেন দীর্ঘদিন। আর এরাই ওই যে হিন্দু যায়, হিন্দু ধর’ বলে সুরঞ্জনকে ধরে পেটাবার ইঙ্গিত করে। সুরঞ্জন উল্টো পথে দ্রুত হেঁটে যায়, ভয়ে নয়, লজ্জায়; পাড়ার এই চেনা ছেলেগুলো তাকে ধরে পেটাবে ভাবলে নিজেরই লজ্জা হয়। নিজে মারি খাচ্ছে সে কারণে নয়, লজ্জা যারা পেটাবে তাদের জন্যই। লজ্জা বুঝি অত্যাচারিতের জন্য হয়, লজ্জা তো হয় অত্যাচারীর জন্য, দুৰ্বত্তের জন্য।

সুরঞ্জন হাঁটতে হাঁটতে শাপলা চত্বরের কাছে এসে থামে। থমথমে চারদিক। কোথাও কোথাও মানুষের জটিল। রাস্তায় ইটের টুকরো, পোড়া কাঠ, ভাঙা কাচ ছড়ানো, বোঝা হ্যায় এইমাত্র ভীষণ এক তাণ্ডব ঘটে গেছে। দু-একজন যুবক এদিক-ওদিক দৌড়োচ্ছে। কিছু নেড়ি কুকুর মধ্য রাস্তা বরাবর ছুটছে। টিংটিং বেল বাজিয়ে সামান্য কটি রিক্সা চলে যাচ্ছে ডানে বাঁয়ে। সে কিছু বুঝতে পারছে না কোথায় কী ঘটেছে। কুকুরগুলোর কীের্ণ ভয় নেই। জাতের ভয় নেই। তারা যে দৌড়োচ্ছে, সুরঞ্জন অনুমান করে খালি রাষ্ট্ৰী পাওয়ার আনন্দেই দৌড়োচ্ছে। সুরঞ্জনেরও ইচ্ছে করে দৌড়োতে। মতিঝিলের ব্যস্ত রাস্তা এতদিনে খালি পেয়ে সুরঞ্জনের ইচ্ছে করে ছোটবেলার মত জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল শোিণত, অথবা খড়ির স্ট্যাম্প বানিয়ে ক্রিকেট। এরকম ভাবতে ভাবতে হঠাৎ চোখে পড়ে বাঁকে একটি ঘর পোড়া। সাইনবোর্ড দরজা জানোলা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এটি ইপিন এয়ারলাইনসেক্স অফিস। কিছু লোক পােড়া অফিসটি দেখছে দাঁড়িয়ে, হাসছে। সুরঙ্গসুন্দর দিকে কেউ কি লুকুঁচকে তাকায়, সন্দেহ হয়। দ্রুত হাঁটে সে সামনের দিকে, ফে এইসব ঘরবাড়ি পুড়ে যাক, তার কী? সামনে সে দেখতে যাচ্ছে আর কী কী পুড়েছে, আৰু কি পোড়া পেট্রোলের মত পােড়া ইট কাঠের ভ্রাণ নিতে অন্যরকম আনন্দ হচ্ছে। হবে হয়?। হাঁটতে হাঁটতে সে সি পি বি অফিসের সামনে দেখে মানুষের ভিড়। রাস্তায় ইট পাটকলের ছড়াছড়ি। ফুটপাতে বই-এর দোকান ছিল। সূরঞ্জন এই ফুটপাত থেকে প্রচুর বই কনেছে। আধাপোড়া একটি বই সুরঞ্জনের পায়ে ঠেকে, ম্যাক্সিম গোর্কির মা। মুহূর্তে মনে হয়। সে পাভেল ভলািসভ। আর সে তার মায়ের গায়ে আগুন লাগিয়ে পায়ের নীচে পিন্ধই। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে সুরঞ্জনের। থমকে দাঁড়িয়ে থাকে পোড়া বইটির সামল। চারদিকে জটলা, ফিসফিস কথা, চরম উত্তেজনা পুরো এলাকায়। কী হয়েছে, কী হবে এসব নিয়ে কথা বলছে সবাই। সি পি বি অফিসটি পোড়া। কমিউনিস্টরা তাদের স্ত্র্যাটেজি চেঞ্জ করে আল্লাহ খোদার নাম নিচ্ছে, তারপরও রেহাই পেল না। আগুন থেকে? কমরেড ফরহাদ মারা গেলে বড় জানাজা হল, মিলাদও হল, তারপরও সাম্প্রদায়িকতার আগুন কমিউনিস্ট পার্টির অফিস পোড়ায়! পোড়া অফিস্টর দিকে নির্বক তাকিয়ে থাকে সুরঞ্জন। হঠাৎ সামনে পড়ে কায়সার। উড়েইগড়া চুল। শেভ না করা গাল, রক্তাভ কনজাংটিভা, কণ্ঠে উদ্বেগ তার, বলে—তুমি বেরিয়েছ কেন?

—আমার কি বেরোতে মানা? সুরঞ্জন পাল্টা প্রশ্ন করে।

—মানা নেই। তবু জানোয়ারগুলোকে তো বিশ্বাস নেই। এরা যে এত ধর্ম ধর্ম করে, আসলে কি কোনও ধর্ম মানে, বল?? জামাত শিবির যুব কমান্ডের সন্ত্রাসীরা গতকাল দুপুরে এসব করেছে। পার্টি অফিস, ফুটপাতের বইয়ের দোকান, ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের অফিস পুড়িয়ে দিয়েছে। স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিগুলো তাকে তক্কে থাকে কোথাও একটা ইস্যু তাদের ফেভারে নিয়ে চিৎকার করতে। যেন তাদের উঁচু গলাটা সবাই শোনে।

পাশাপাশি তোপখানার দিকে হাঁটতে থাকে দুজন। সুরঞ্জন জিজ্ঞেস করে—আর কোথায় কোথায় আগুন ধারালো ওরা?

–চট্টগ্রামের তুলসীধাম, পঞ্চাননধাম, কৈবল্যধাম মন্দির ভেঙে গুড়ো করে দিয়েছে। মালিপাড়ী, শ্মশান মন্দির, কোরবানিগঞ্জ, কালীবাড়ি, চট্টেশ্বরী, বিষ্ণুমন্দির, হাজারিলেন, ফকিরগািড়া এলাকার সব মন্দির লুটপাট করে আগুন জেলে দিয়েছে। অবশ্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মিছিলও বেরিয়েছে।

সুরঞ্জন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কায়সার ডান হাতে এলেচুলগুলো পেছন দিকে সরিয়ে দিতে দিতে বলে—কাল শুধু মন্দির নয় মাঝিরঘাট জেলেপাড়ায় আগুন জ্বেলে দিয়েছে। অন্তত পঞ্চাশটি ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

—আর? সুরঞ্জন নির্লিপ্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।

—জয়দেবপুরের মাধব মন্দির আর দুর্গ মন্দিরে হামলা হয়েছে। শেরপুরের কৃষি সেন্টারে অন্নপূর্ণ মন্দির, শেরিঘাট আশ্রমের কালী মন্দির ধ্বংস করে দিয়েছে। ফরিদপুরে রামকৃষ্ণ মিশনের মন্দিরগুলো লুট হয়েছে। মহারাজা আর তার ছাত্ররা সিরিয়াসলি ইনজিউরড।

—আর? সুরঞ্জনের উদাসীন স্বর।

-নরসিংদিতে চালাকচড় আর মনোহরাদির বাড়ি আর মন্দিরগুলো ভেঙে ফেলেছে। নারায়ণগঞ্জে রূপগঞ্জ থানার মর্যাপাড়া বাজারের মন্দির ধ্বংস করেছে। কুমিল্লার পুরনো অভয় আশ্রমটি জ্বলিয়ে দিয়েছে। আর নোয়াখালিতেও জঘন্য সব কাণ্ড করেছে।

—কি রকম?

—সুধারাম থানার অধর চাঁদ আশ্রম আর সাতটা হিন্দুর বাড়ি জ্বলিয়ে দিয়েছে। গঙ্গাপুর গ্রামে যত হিন্দু বাড়ি ছিল, প্রথম লুট করেছে, পরে পুড়িয়ে দিয়েছে। সোনাপুরের শিব-কালী মন্দির আর বিনোদপুর আখড়া ধ্বংস করে দিয়েছে। চৌমুহনির কালীমন্দির, দুৰ্গাপুরের দুৰ্গর্বিাড়ি মন্দির, কুতুবপুর আর গোপালপুরের মন্দির ভেঙেছে। ডাঃ পি কে সিংহের ওষুধের ফ্যাক্টরি, আখন্দ আশ্রম, ছয়আনি এলাকার মন্দিরগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে। চৌমুহনি বাবুপুর, তেতুইয়া, মেহদিপুর, রাজগঞ্জ বাজার, টঙ্গিরপাড়, কাজিরহাট, রসুলপুর, জমিদারহাট, পোতাবাড়ির দশটি মন্দির আর আঠারোটি হিন্দু বাড়ি লুট করে পুড়িয়ে দিয়েছে। একটি দোকান, একটি গাড়ি, একটি মহিলাও পুড়েছে। ভাবর্দির সতেরোটি বাড়ির মধ্যে তেরোটি বাড়িই পুড়ে গেছে, প্রতিটি বাড়ি লুট হয়েছে, বাড়ির মেয়েরা নিৰ্য্যতিত হয়েছে। বিপ্লব ভৌমিক স্টেবডি। গতকাল বিরাহিমপুরের সবকটি বাড়ি এবং মন্দির আক্রান্ত হয়েছে। জগন্নাথ মন্দির, চরহাজারি গ্রামের তিনটি দোকান, ক্লাব লুট করেছে, ভেঙেছে। চরপার্বতী গ্রামের দুটো বাড়ি, দাসের হাটের একটি বাড়ি, চরকুকরি আর মুছাপুরের দুটো মন্দির, জয়কালী মন্দির পুড়িয়ে দিয়েছে। পিরোজপুরের প্রতিটি মানুষ মার খেয়েছে, প্রতিটি বাড়ি লুট হয়েছে, বাড়িগুলো শেষে পোড়ানোও হয়েছে।

–ও।

সুরঞ্জন আর কোনও শব্দ উচ্চারণ করতে চায় না। ছোটবেলার মত রাস্তার যে কোনও ইট বা পাথরের টুকরো পায়ে ছুড়ে ছুড়ে হাঁটতে ইচ্ছে করে তার। কায়সার আরও কী কী সব বলে, আরও মন্দির পোড়ানো, আরও বাড়িঘর লুটপাট, পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা। সুরঞ্জন সব শোনেও না। তার শুনতে ইচ্ছেও করে না। প্রেস ক্লাবের সামনে দুজনই দাঁড়ায়। সাংবাদিকদের জটলা, গুঞ্জন দু চোখ ভরে দেখে সে। শোনেও কিছু। কেউ বলছে-ভারতে এ পর্যন্ত দুশর ওপর লোক দাঙ্গায় নিহত হয়েছে। আহত কয়েক হাজার। আর এস এস, শিবসেনাসহ মৌলবাদী দলগুলো নিষিদ্ধ, লোকসভায় বিরোধী নেতার পদ থেকে আদভানি পদত্যাগ করেছে। কেউ বলছে-চট্টগ্রামে, নন্দনকানন তুলসীধামের এক সেবক দীপক ঘোষ পালিয়ে যাবার সময় জামাতিরা তাকে ধরে জ্বলিয়ে দেবার চেষ্টা করে। পাশে কয়েকজন দারোয়ান ছিল, ওরা দীপককে মুসলমান পরিচয় দিলে জামাতিরা দীপককে মারধোর করে ছেড়ে দেয়।

সুরঞ্জনকে পরিচিত যারাই দেখে চমকে ওঠে। বলে—কী ব্যাপার তুমি বাইরে বেরিয়েছ যে! বিপদ হতে পারে। বাড়ি চলে যাও।

সুরঞ্জন কোনও উত্তর করে না। বড় অপ্রতিভা লাগে নিজেকে। তার নাম সুরঞ্জন দত্ত বলে তাকে ঘরের মধ্যে বসে থাকতে হবে। আর কায়সার, লতিফ, বেলাল, শাহীন এরা বাইরে বেরোবে, কোথায় কী হচ্ছে। এ নিয়ে আলোচনা করবে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মিছিলও করবে। কিন্তু সুরঞ্জনকে বলবে বাড়ি চলে যাও, এ কেমন কথা? সুরঞ্জন কি ওদের মতই বিবেকবান, মুক্তবুদ্ধির, যুক্তিবাদী মনের মানুষ নয়? দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সে উদাসীন, সিগারেটের দোকান থেকে এক কাঠি বাংলা ফাইভ কেনে, আগুনমুখো দড়ি থেকে সিগারেট ধরায়। নিজেকে বড় বিচ্ছিন্ন বোধ করে সুরঞ্জন। এত লোক চারদিকে, অনেকেই চেনা, কেউ কেউ ঘনিষ্ঠও, তবু এক লাগে তাঁর। যেন এই যে এত মানুষ হাঁটছে, কথা বলছে, বাবরি মসজিদ ভাঙা আর সেইসূত্রে এ দেশের মন্দির ভাঙা নিয়ে উত্তপ্ত কথাবাত চলছে, এসব সুরঞ্জনের বিষয় নয়। সে মিশে যেতে চাইলেও পারছে না। কোথায় যেন একটা বাধা অনুভব করছে সে। সুরঞ্জন বুঝতে পারছে তাকে সকলেই আড়াল করছে, করুণা করছে, তাকে দলে টানছে না। সুরঞ্জন গাল ভরে ধোঁয়া নিয়ে ধোঁয়ার রিং ছুড়ে দেয়। চারদিকে উত্তেজনা আর সে তার অলস শরীরের ভার দেওয়ালে ছেড়ে দেয়। অনেকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখে সুরঞ্জনকে। বিস্মিত হয়। কারণ একটি ‘হিন্দু ও আজ ঘরের বার হয়নি। ভয় পেয়ে গর্তে লুকিয়েছে সব। আর সুরঞ্জনের সাহস বা স্পধর্ম দেখে লোকে অবাক হবেই বা না কেন!

কায়সার একটি দলে ভিড়ে যায়। মিছিলের প্রস্তুতি চলছে। সাংবাদিকরা কাঁধে ঝোলা বা ক্যামেরা নিয়ে ছুটোছুটি করছে। এদের মধ্যে লুৎফরকে দেখেও সুরঞ্জন ডাকে না। ও একসময় নিজেই এগিয়ে আসে। চোখ কপালে তুলে বলে-দাদা, আপনি এখানে কেন?

—কেন থাকতে নেই?

লুৎফরের চোখে মুখে চরম উৎকণ্ঠা। জিজ্ঞেস করে–বাড়িতে কোনও অসুবিধে হয়নি তো?

লুৎফরের কথায় এবং বলবার ভঙ্গিতে এক ধরনের অভিভাবকত্ব আছে। সুরঞ্জন টের পায়। এই ছেলেটি মুখচোরা স্বভাবের ছিল। তার চোখের দিকে তাকিয়ে কখনও কথা বলেনি এমনই বিনত, লাজুক, ভদ্র। ছেলেটিকে সুরঞ্জনই ‘একতা’ পত্রিকার সম্পাদককে বলে-কয়ে চাকরি নিয়ে দিয়েছিল। লুৎফর একটি বেনসন ধরায়। সুরঞ্জনের খুব কাছে সরে এসে বলে—সুরঞ্জনদা, অসুবিধে হয়েছে কোনও?

সুরঞ্জন হেসে জিজ্ঞেস করে–কি অসুবিধে?

লুৎফর একটু অপ্রস্তুত হয়। বলে—কী আর বলব দাদা। দেশের যা অবস্থা…

সুরঞ্জন তার সিগারেটটির ফিল্টারটুকু নীচে ফেলে পায়ে পিষতে থাকে। লুৎফর তার সঙ্গে সব সময় নীচু কণ্ঠে কথা বলত, আজি কণ্ঠটা তার উঁচুই মনে হয়। ফোঁস ফোঁস করে ধোঁয়া ছাড়ে, কপাল কুঁচকে তাকায় তার দিকে, বলে—দাদা, আজ বরং আপনি অন্য কোথাও থাকুন। বাড়িতে থাকাটা ঠিক হবে না। আচ্ছা আশেপাশের কোনও মুসলমানের বাড়িতে অন্তত দুটো রাতে থাকার ব্যবস্থা করা যায় না?

সুরঞ্জনের কণ্ঠে নির্লিপ্তি। সে দোকানের আগুনমুখে দড়িটির দিকে তাকিয়ে বলে—না।

—না? লুৎফর চিন্তিত হয়। ওর ভাববার ভঙ্গিতেও অভিভাবকত্ব টের পায় সুরঞ্জন। সে বুঝে যায়, যে কেউই এখন এ ধরনের অভিভাবকত্ব দেখাবে। না চাইতেই আগ বাড়িয়ে উপদেশ দেবে। বাড়িতে থাকা ঠিক নয়, লুকিয়ে থাকে। ক’দিন বাড়ি থেকে বেরিও না। নাম পরিচয় বলো না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পরে না হয় বেরোও, এসব। সুরঞ্জনের ইচ্ছে করে আরও একটি সিগারেট ধরাতে। কিন্তু লুৎফরের গুরুগম্ভীর উপদেশ তার ইচ্ছেটিকে নষ্ট করে দেয়। শীত নেমেছে বেশ। সে হাতদুটো ভাঁজ করে -বুকের ওপর রেখে গাছের পাতার সবুজ-গাঢ় সবুজ রং দেখে। শীতকালটা সে সব সময়ই বেশ উপভোগ করে। সকালে গরম ভাপাপিঠে, রাতে গায়ের ওপর রোদে দেওয়া লেপ, মায়ের মুখে ভূতের গল্প-ভাবতেই এক ধরনের রোমাঞ্চ হয় সুরঞ্জনের। লুৎফরের সামনে –দাঁড়িয়ে একটি ঝোলা কাঁধের দাড়িঅলা যুবক নাগাড়ে বলে যায়-ঢাকেশ্বরী মন্দির, সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির, রামকৃষ্ণ মিশন, মহাপ্রকাশ মঠ, নারিন্দা গৌড়ীয় মঠ, ভোলাগিরি আশ্রমে মিছিল করে গিয়ে লোকেরা ইট মারছে, লুট করছে। স্বামীবাগ আশ্রম লুট হয়েছে। শনির আখড়ার পচিশটি বাড়ি লুট করে পুড়িয়ে দিয়েছে। শনির মন্দির, দুর্গ মন্দির ভেঙে পুড়িয়ে দিয়েছে। নারিন্দার ঋষিপাড়া আর দয়াগঞ্জের জেলেপাড়াও রক্ষা পায়নি। ফার্মগেট, পল্টন ও নবাবপুরে মরণচাঁদের মিষ্টির দোকান, টিকাটুলির দেশবন্ধু মিষ্টির দোকান লুট করেছে, ভেঙেছে, আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। ঠাঁটারি বাজারের মন্দিরে আগুন লাগিয়েছে।

লুৎফর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে—আহা।

সুরঞ্জন লুৎফরের দীর্ঘশ্বাসটি কান পেতে শোনে। সে ভেবে পায় না সে এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে, মিছিলে যোগ দেবে, নাকি দূরে কোথাও চলে যাবে। আত্মীয়হীন বন্ধুহীন কোনও ঝাড় জঙ্গলে একা বসে থাকবে। ঝোলা কাঁধের যুবকটি সরে গিয়ে অন্য আডায় মিশে যায়। লুৎফরও চলে যাবার পাঁয়তারা করে। কারণ সুরঞ্জনের ভাবলেশহীন মুখ আতাকে স্বস্তি দিচ্ছে না মোটে।

চাপা উত্তেজনা চারদিকে। সুরঞ্জনের ইচ্ছে করে দলের সঙ্গে মিশে যেতে। তার ইচ্ছে করে কোথায় কোথায় মন্দির ভাঙল, পুড়ল, কোথায় ঘরবাড়ি দোকান লুট হল এসব খবরে সেও অংশ নিক। সেও স্বতঃস্ফূর্ত বলুক—‘এই ধর্মবাদীদের চাবকে সোজা করা দরকার। <এই মুখোশধারী ধার্মিকেরা আসলে সবচেয়ে বড় প্রতারক।’ কিন্তু পারছে কই। তার —দিকে আড়াচোখে যারাই তাকাচ্ছে সকলের চোখ থেকেই করুণা ঝরছে, যেন তার এখানে শুথিাকা নিরাপদ নয়, যেন সে ঠিক এখানে দাঁড়াবার, ওদের মত উত্তেজিত হবার, ওদের সঙ্গে -মিছিল করবার যোগ্য লোক নয়। সে এতদিন ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি নিয়ে —মঞ্চে বা আড্ডায় তুখােড় তুখোড় কথা বলেছে, অথচ আজ তাকে একটি অদৃশ্য শক্তি বোবা করে রাখছে। কেউ বলছেও না, সুরঞ্জন কিছু বল, কিছু কর, রুখে দাঁড়াও।

কায়সার জটলা ভেঙে সামনে আসে। ফিসফিস করে বলে, ‘বায়তুল মোকাররমে বাবরি মসজিদ ভাঙা নিয়ে মিটিং হবে, লোক জমছে, তুমি বাড়ি চলে যাও।‘

—তুমি যাবে না? সুরঞ্জন প্রশ্ন করে।

কায়সার বলে—আরে না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মিছিল করতে হবে না!

কায়সারের পেছন লিটন আর মাহতাব বলে দুজন ছেলে ছিল। ওরাও বলে—আসলে আপনার ভালর জন্যই বলছি। শুনেছি জলখাবারও নাকি পুড়িয়ে দিয়েছে। আশেপাশেই ঘটছে ঘটনাগুলো। আপনাকে চিনতে পারলে কী হবে বলুন তো। ওরা হাতে ছুরি, লাঠি, রামদা নিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরছে।

কায়সার একটি রিক্সা ডাকে। রিক্সায় সুরঞ্জনকে তুলে দেবে সে। লুৎফর এগিয়ে এসে তার হাত ধরে টান দেয়, বলে–আসুন তো দাদা। সোজা বাড়ি যান। এ সময় কেন যে বাইরে বেরোলেন আপনি।

সুরঞ্জনকে বাড়ি পাঠানোর জন্য অনেকে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাকে চেনে না। এমন দু-একজন ছুটে এসে জানতে চায় হয়েছে কী। ওরা বুঝিয়ে বলে ও হিন্দু, ওর এখানে থাকাটা ঠিক নয়। সকলে মাথা নেড়ে সায় দেয়, হ্যাঁ চলে যাওয়াই উচিত। কিন্তু সে তো ঘরে যাবার জন্য ঘর থেকে বের হয়ে আসেনি। ওরা তার পিঠ আলতো খুঁয়ে, হাত টেনে রিক্সায় ওঠাতে যাবে আর তখনই সুরঞ্জন হাত ছাড়িয়ে নেয়। সে তার হাতখানা একটু হেঁচকাটানেই ছাড়ায়।

 

২খ.

সুখময় সটান শুয়ে থাকতে চান, পারেন না। অস্থির লাগে। সুরঞ্জন আবার এ সময় বাইরে বেরিয়েছে। ও বেরোবার পর টুকটুক শব্দ হয় দরজায়। সুধাময় লাফ দিয়ে বিছানা ছাড়েন। সূরঞ্জনই ফিরে এল। কিনা। না সুরো নয়, এসেছেন আখতারুজ্জামান। এ পাড়ায় বাড়ি তাঁর। রিটায়ার্ড অধ্যাপক। বয়স ষাটের ওপর। ঘরে ঢুকেই ছিটিকিনি আটকে দিলেন নিজ হাতে। ‘কী কিছু হয়নি তো?’ আখতারুজ্জামান প্রশ্ন করলেন চাঁপা স্বরে। ‘কইনা তো কি হবে? সুধাময় ঘরের বিছানা টেবিল বইপত্রর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়েন। আখতারুজ্জামান নিজেই চেয়ার টেনে বসেন। সারভাইক্যাল স্পনডিলাইটিসের রোগী। ঘাড় সোজা রেখে চোখের মণি নেড়ে বলেন-বাবরি মসজিদের অবস্থা তো জানেন? কিছু নেই। আর। ছিঃ ছিঃ।

一হুঁ।

—কিছু বলছেন না যে। সাপোর্ট করছেন?

–সাপোর্ট করব কেন?

—তবে যে বলছেন না কিছু?

—খারাপ লোক খারাপ কাজ করেছে। দুঃখ করা ছাড়া আর কী বা করার আছে?

-একটি সেকুলার রাষ্ট্রে যদি এই অবস্থা হয়। ছিঃ ছিঃ। সমস্ত রাষ্ট্ৰীয় পরিস্থিতি, সমস্ত রাজনৈতিক ঘোষণা, সুপ্রিম কোর্ট-লোকসভা-পর্টি, গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য-সবই আসলে ফাঁকা আওয়াজ। যাই বলুন সুধাবাবু, ভারতে যত দাঙ্গা হয়েছে, এ দেশে তুলনায় কিন্তু কিছুই হয়নি।

–হুঁ। চৌষট্টির পর নব্বই–এই প্রথম বড় দাঙ্গা হল।

—চৌষট্টি না বলে পঞ্চাশ বলাই ভাল। পঞ্চাশের পরে চৌষট্টিতে দাঙ্গা যা হয়েছিল, সবচেয়ে বড় দিক ছিল সাম্প্রদায়িকতার স্পনটেনিয়াস প্রতিরোধ, যেদিন দাঙ্গা শুরু হয়, সেদিনই মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরি আর আবদুস সালামের উদ্যোগে প্রতিটি পত্রিকার প্রথম পাতায় ব্যানার হেডিং ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’। প্রতিবেশী এক হিন্দু পরিবারকে রক্ষা করতে যেয়ে পঞ্চান্ন বছর বয়সের আমীর হোসেন চৌধুরি প্রাণ দিলেন। আহা।

সুধাময়ের বুকের ব্যথাটি বাড়ে। তিনি চৌকিতে গা এলিয়ে দেন। এক কাপ গরম চা খেতে পারলে ভাল লাগত। কিন্তু চা-টা দেবে কে? সুরঞ্জনের জন্য কিরণময়ী দুশ্চিন্তা করছেন। একা একা বাইরে গেল, গোলই যদি হায়দারের সঙ্গে গেলেই পারত। কিরণময়ীর দুশ্চিন্তাটি সুধাময়ের মধ্যেও সংক্রামিত হয়। সুরঞ্জনের আবেগ বরাবরই ঘন, তাকে ঘরে আটকে রাখা যায় না, সুধাময় তা জানেনও, তবু দুশ্চিন্তা তো এমন নয় যে তাকে বুঝিয়ে শান্ত করা যায়। তিনি সেটিকে বুকের মধ্যে পুষে আখতারুজ্জামানের প্রসঙ্গে ফেরেন—শান্তিই নাকি সকল ধর্মের মূল গন্তব্য অথচ সেই ধর্মকে নিয়ে কত অশান্তি, কত রক্তপাত, মানুষের কত লাঞ্ছনা হতে পারে এই শতাব্দীর শেষে এসে তাও দেখতে হল। ধর্মের ধ্বজা উড়িয়ে মানুষ এবং মনুষ্যত্বকে যেভাবে গুড়িয়ে ফেলা যায় তেমন আর কোনও কিছু দিয়েই সম্ভব হয় না।

আখতারুজ্জামান বলেন–হুঁ।

কিরণময়ী দু কাপ চা নিয়ে ঘরে ঢোকেন। ‘কী, ব্যথাটা তোমার বাড়ল নাকি? ঘুমের ওষুধটা না হয় খেয়ে নাও’ বলে দুজনের সামনে কাপদুটো রেখে তিনি চৌকিতে বসেন। আখতারুজ্জামান বলেন-বৌদি তো বোধহয় শাঁখা সিঁদুর পরেন না, তাই না?

কিরণময়ী চোখ নামিয়ে বলেন–পঁচাত্তরের পর থেকে পরি না।

— বাঁচা গেল। তবুও সাবধানে থাকবেন। সাবধানের মার নেই।

কিরণময়ী স্নান হাসেন। সুধাময়ের ঠোঁটেও এই হাসিটি সংক্রামিত হয়। আখতারুজ্জামান চায়ে দ্রুত চুমুক দেন। সুধাময়ের বুকের ব্যথা কমে না। তিনি বলেন–আমিও তো ধুতি ছেড়েছি সেই কবে। ফর দা সেক অফ ডিয়ার লাইফ, মাই ফ্রেন্ড।

আখতারুজ্জামান চায়ের কাপটি নামিয়ে রেখে বলেন–চলি, ওদিকে বিনোদবাবুকে একবার দেখে যাব ভাবছি।

সুধাময় টান টান শুয়ে থাকেন। চা জুড়িয়ে পড়ে থাকে। শিয়রের কাছের টেবিলে। কিরণময়ী দরজার খিল এটে বসে থাকেন। বাতির উল্টোদিকে বসা, মুখে তাঁর ছায়া পড়েছে, একসময় চমৎকার কীর্তন গাইতেন কিরণময়ী। ব্ৰাহ্মণবাড়িয়ার নামকরা পুলিশ অফিসারের মেয়ে কিরণময়ী। ষোল বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। সুধাময় বলতেন, ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত গাঁও কিরণ। ওস্তাদ রেখে দিই।’ মিথুন দে-র কাছে ক’বছর শিখেওছিলেন। গান গাওয়ার ডাকও পড়ত। ময়মনসিংহের নানা অনুষ্ঠানে। সুধাময়ের মনে পড়ে টাউন হলে একবার গান গাইতে গিয়েছিলেন কিরণময়ী। তখন সুরঞ্জনের বয়স তিন কী চার বছর। শহরে গানের শিল্পী হাতে গোনা ক’জনই ছিলেন। সমীর চন্দ্ৰ দে গেয়ে যাবার পর কিরণময়ী এলেন। সুধাময় সামনের সারিতে বসে রীতিমত ঘামছিলেন, কী জানি কেমন গান, কিরণময়ী গাইলেন—’আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর।’ অডিয়েন্স চিৎকার করে উঠল, ওয়ান মাের ওয়ান মোর। এরপর ধরেছিলেন–‘ভুবনেশ্বর হে, মোচন কর বন্ধন সব মোচন করা হে। প্ৰভু মোচন কর ভয়, সব দৈন্য করাহ লয়, নিত্য চকিত চঞ্চল চিত কর নিঃসংশয়।’ এত দরদ দিয়ে গাইছিলেন যে শুনে সুধাময়ের মত নাস্তিক মানুষের চোখেও জল চলে এসেছিল। দেশ স্বাধীনের পর বাইরে গান গাইতে যেতে চাইতেন না কিরণময়ী। উদিীচীর অনুষ্ঠানে সুমিতা নাহা গাইবে, মিতালি মুখার্জি গাইবে, সুরঞ্জন মায়ের কাছে আবদার করত তুমিও গাইবে চল। কিরণময়ী হাসতেন ‘রেওয়াজ করি না, এখন কী আর আগের মত গলা আছে!’ সুধাময় বলতেন—যাও না অসুবিধে কী। আগে গাইতে, লোকে তো চেনেও অনেকে। হাততালিও তো পেয়েছ একসময়।‘

—হুঁ পেয়েছি। যারা তালি দিত, তারাই বলত হিন্দু মেয়েদের লজ্জা শরম নেই বলেই তাঁরা গান শেখে, পরপুরুষের সামনে গা দেখিয়ে গান গায়।

—মুসলমান মেয়েরা বুঝি গান গায় না? সুধাময় সামাল দিতেন।

—সে তো এখন গায়। আগে যখন গাইত না তখন টিপ্পনিগুলো তো আমাদের শুনতে হত। এত ভাল গাইতেন মিনতিদি, একপাল ছেলে একদিন ধরল তাঁকে, তিনি নাকি মুসলমান বাড়ির মেয়েদের গান শেখাবার তাল করছেন।

—গান শেখানো তো ভাল জিনিস। সুধাময় বলেছিলেন।

–ছেলেরা বলল মুসলমান মেয়েদের গান গাওয়া ঠিক নয়। গান গাওয়া খারাপ, গান গাইলে তারা নষ্ট হয়ে যাবে।

–ও।

কিরণময়ীও আর তেমন মন দেননি। গানে। মিথুন দে মাঝে মাঝেই বলতেন, তোর গলাটা ভাল ছিল কিরণ, ছেড়েই দিলি গানটা।

কিরণময়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন—দাদা, ভাল লাগে না কিছু। মনে হয় কী হবে গেয়ে। এইসব নাচ গান তো মানুষ পছন্দ করে না। খারাপ বলে।

ছাড়তে ছাড়তে ছাড়াই হয়ে গেল। গান। সুধাময় জোর করেননি যে তোমার গাইতে হকেই। তবে মাঝে মধ্যে অনুযোগ করতেন, ‘বাইরে না গাঁও, ঘরে তো গাইতে পারে।’ ঘরে কী আর গাওয়া হয়। রাত গভীর হয়ে এলে ঘুম আসছে না। এমন অস্থির সময়ে দুজন ইন্সে উঠতেন। ব্ৰহ্মপুত্রের জন্য, ব্ৰহ্মপুত্রের কাছে ফেলে আসা বাড়িটির জন্য দুজনেরই মন কাঁদত। দূর নক্ষত্রের দিকে দুজনেই নিবাক তাকিয়ে থাকতেন। কিরণময়ী গুন গুন করতেন ‘পুরানো সেই দিনের কথা বলব। কী রে হয়, শুনে সুধাময় যে এত শক্ত মনের *মানুষ, তাঁরও কেমন কেমন জানি লাগত। তাঁরও ফিরে পেতে ইচ্ছে করত। শৈশব কৈশোরের খেলার মাঠ, ইস্কুলের আঙিনা, ভরা নদী, নদীতীরের ঘন বনের ভেতর-পথ ধরে ব’ন পীরের দিকে যাওয়া। এত যে কঠিন হৃদয়ের মানুষ সুখময়, সুধাময়ই রাতে রাতে কিরণময়ীকে দু হাতে বুকে জাপটে ধরে কেঁদে উঠতেন। সুধাময়ের কষ্ট্রের কোনও গণ্ডি নেই। একাত্তরে জগন্ময় ঘোষাল, প্রফুল্প সরকার, নিতাই সেন প্রায় চোখের সামনে খুন হলেন। ক্যাম্পে নিয়ে গুলি করে মেরে ফেলত, পরদিন ট্রাক ভরে ফেলে আসত বধ্যভূমিতে। হিন্দু পেলেই পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে আসত, বুটের লাথি, বেয়নেটের খোঁচা, চোখ উপড়ে নেওয়া, পিঠের হাড় ভেঙে দেওয়া এসব যখন করত মনে হত বুঝি ছেড়ে দেবে, শেষ পর্যন্ত কিন্তু মেরে ফেলত। অনেক মুসলমানকে পিটিয়ে ছেড়ে দিতে দেখেছে সুধাময়, হিন্দুকে ছাড়তে দেখেনি। মেথরূপট্টির কুয়ো ভর্তি হিন্দু আর মুসলমানের লাশ গাদাগাদি করে ফেলে রাখা ছিল, মাজেদ, রহিম, ইক্লিস-এর আত্মীয়রা, দেশ স্বাধীনের পর কুয়োর ভেতর থেকে যেদিন হাজার হাজার হাড় ওঠানো হল, ওই হাড়ের ওপর পড়ে চিৎকার করে কেঁদেছিল, কোন হাড় মাজেদের, কোন হাড় অনিলের কে বুঝবে? সুধাময়ের ভাঙা পা, পাঁজরের ভাঙা তিনটে হাড় জোড়া নিয়েছিল, কাটা পেনিসের ঘা-ও শুকিয়ে এসেছিল, কিন্তু বুকের ক্ষত শুকোয়নি, চোখের জলও শুকোয়নি। বেঁচে যাওয়া খুব কি বড় কিছু? শরীরে বেঁচে গিয়ে সুধাময়ের কিন্তু মনে হয়নি ক্যাম্প থেকে ফিরে খুব বেঁচে গিয়েছিলেন। ফুলপুরের অর্জুনখিলা গ্রামে আবদুস সালাম নাম নিয়ে তিনি দীর্ঘ সাত মাস কাটিয়েছিলেন একটি বাঁশের বেড়ার ঘরে, সুরঞ্জনকে ডাকতে হত সাবের বলে, কিরণময়ীকে যখন একঘর লোক ফাতেমা বলে ডাকত, সুধাময়ের লজ্জা করত শুনতে, পাঁজরের ভাঙা হাড় বুকে যত খোঁচা দিত, তার চেয়ে ফাতেমা নামের খোঁচা বুকে বাজত বেশি। ডিসেম্বরে যখন মুক্তিযোদ্ধারা ফুলপুরে নেমে এল, সারা গ্রাম ‘জয় বাংলা’ বলে আনন্দে নেচে উঠল, পুরো সাত মাস না ডাকতে পারা প্রিয় নামটি সেদিন প্ৰাণ ভরে ডেকেছিলেন সুধাময়—কিরণ, কিরণ, কিরুণাময়ী। বুকে জমিয়ে রাখা তাঁর কােষ্ট্রর আগুনগুলো সব নিভে গেল। এই-ই সুধাময়ের জয় বাংলা। কিরণময়ীকে গলা ছেড়ে হাজার মানুষের সামনে কিরণময়ী ডাকবার স্বাধীনতাকেই তিনি ‘জয় বাংলা’ বলে জানেন।

হঠাৎ কড়া নড়বার বিশ্ৰী শব্দ শুনে দুজনে চমকে ওঠেন। এসেছেন। হরিপদ, হরিপদ ভট্টাচার্য। জিভের তলে নিফিকার্ড ট্যাবলেট দিয়ে চোখ বুজে শুয়ে থাকবার পর ব্যথাটি সামান্য কমে সুধাময়ের। হরিপদ ঘরের লোকের মতই। হরিপদকে দেখে সুধাময় উঠে বসেন। ‘কী আপনার অসুখ করল নাকি? খুব পেইল লাগছে!’

—হ্যাঁ হরিপদ। কদিন থেকে শরীরের অবস্থা ভাল যাচ্ছে না। প্রেসারটাও দেখা হয় না।

–আগে জানলে আমি বি পি মেশিনটা নিয়ে আসতে পারতাম।

কিরণময়ী বলেন–সুরঞ্জনটা এ সময় বাইরে বেরোল, বুঝুন অবস্থা। আর আপনিই বা এলেন কি করে?

–শর্টকাট মেরেছি। বড় রাস্তা দিয়ে আসিনি।

অনেকক্ষণ কেউ কোনও কথা বলে না, হরিপদ গায়ের চাদরটি গা থেকে খুলে নিয়ে বলেন-চাকায় আজ বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রতিবাদ হচ্ছে, আবার শান্তি মিছিলেও বেরিয়েছে, রাজনৈতিক দল আর বিভিন্ন সংগঠন সাম্প্রদায়িক সম্প্ৰীতি বজায় রাখবার আহ্বান জানিয়েছে, মন্ত্রিসভার বৈঠকে সংযত ও সহিষ্ণু থাকার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, শেখ হাসিনাও বলেছেন, যে কোনও মূল্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্ৰীতি বজায় রাখুন। ভারতে দাঙ্গায় দুশ তেইশজন নিহত, চল্লিশটি শহরে কার্ফ, সাম্প্রদায়িক দলগুলো নিষিদ্ধ, নরসীমা রাও বাবরি মসজিদ নতুন করে তৈরি করবে। কথা দিয়েছেন।

এটুকু বলে হরিপদ গভীর মুখে বসে থাকেন। বলেন—কিছু ঠিক করেছেন? এখানেই থাকবেন? থাকাটা উচিত হবে বলে মনে হয় না। আমি তো ভেবেছিলাম শ্বশুরবাড়ি চলে যাব। মানিকগঞ্জে বাড়ি। তো আজ সন্ধ্যায় আমার বড় শ্যালক এসে বলল মানিকগঞ্জ শহরে আর ঘিওর থানায় প্রায় একশ বাড়ি লুট করে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। পাঁচিশটি মন্দির ভেঙে আগুন জ্বালিয়েছে। বাকবুড়ি বলে একটি গ্রাম আছে, ওই গ্রামের হিন্দু বাড়িগুলোয় আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। দেবেন শোরের মেয়ে সরস্বতীকে মাঝরাতে আট-দশজন ছেলে বাড়ি থেকে সোজা উঠিয়ে নিয়ে রেপ করে।

—বালছ কী! সুধাময় আর্তনাদ করে ওঠেন।

–আপনার মেয়েটি কোথায়?

—মায়া গেছে ওর বান্ধবীর বাড়িতে।

–মুসলমানের বাড়ি তো!

–হ্যাঁ।

–তা হলে ঠিক আছে। হরিপদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।

কিরণময়ীরও স্বস্তি হয়। সুধাময় চশমার কাচ মুছতে মুছতে বলেন–আসলে এদিকটাতেই যত দাঙ্গা-হাঙ্গামা ময়মনসিংহে তেমন দাঙ্গা হতে দেখিনি কিন্তু। আচ্ছা, আমাদের ময়মনসিংহে কিছু হয়েছে বলে শুনেছ নাকি হরিপদ?

–শুনলাম গত রাতে ফুলপুর থানার বাথুয়াদি গ্রামে দুটো মন্দির, একটা পূজা মণ্ডপ, আর ত্রিশালে একটি কালীমন্দির ভেঙে ফেলেছে।

—শহরে তো কিছু হয়নি নিশ্চয়ই। দেশের উত্তর দিকটায়। এসব আসলে কমই হয়। আমাদের ওদিকে, কী বল কিরণময়ী, মন্দির পোড়াবার ঘটনা কিছু শুনেছ নাকি কখনও!

–নৰ্থ ব্ৰুক হল রোডের সার্বজনীন পূজা অফিস, জমিদার বাড়ি কালী প্রতিমা, মন্দির সবই ধ্বংস করে ফেলেছে। আজ শান্তিনগরে জলখাবার মিষ্টির দোকান, শতরূপা স্টোর লুট করে ভেঙে পুড়িয়েও দিয়েছে। কুষ্টিয়ায় ছটা মন্দির গতকাল গভীর রাতে জামাত শিবিরের লোকেরা ভেঙে ফেলেছে। তারপর ধরুন চিটাগাং, সিলেট, ভোলা, শেরপুর, কক্সবাজার, নোয়াখালির কথা যা শুনেছি, আমার তো ভয় হচ্ছে খুব।

—কিসের ভয়? সুধাময় প্রশ্ন করেন।

–এক্সোডাস।

–আরো না। এদেশে ওইভাবে দাঙ্গা বাধবে না।

–নব্বই-এর কথা ভুলে গেলেন দাদা। নাকি তা তেমন গুরুতর বলে মনে হয়নি আপনার?

–ও তো এরশাদ সরকারের সাজানো ঘটনা ছিল।

—কি যে বলছেন দাদা। বাংলাদেশ সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেবটি দেখলেই তো পারেন। এবারের এক্সোডাস ভয়ঙ্করই হবে। সাজানো ঘটনায় মানুষ দেশের মাটি ছেড়ে এভাবে চলে যায় না। দেশের মাটি তো আর ফুলের টবের মাটি নয়। জল সার দিলাম। আর কদিন পর পর পাল্টালাম। দাদা, ভয় হয় খুব। এক ছেলে কলকাতায় পড়ালেখা করে। দু মেয়ে আছে। এখানে। মেয়েরা বড় হয়েছে, রাতে ঘুমোতে পারি না। ভাবছি চলেই যাব।

সুখময় আঁতকে ওঠেন। এক ঝটিকায় চশমাটি খুলে নিয়ে বলেন–পাগল হয়েছ তুমি হরিপদ? এমন অলক্ষুণে কথা উচ্চারণও কোরো না।

–এ কথাই তো বলবেন যে এখানে আমার প্র্যাকটিস ভাল। ভাল টাকা পয়সা কামাচ্ছি। নিজের বাড়ি আছে। তাই না?

—না হরিপদ। সে কারণে নয়। সুযোগ-সুবিধে আছে বলেই যে তোমার যাবার কথা ওঠে না তা নয়। সুযোগ-সুবিধে না থাকলেই বা যাবার প্রশ্ন উঠবে কেন? এ তোমার দেশ নয়? আমি তো রিটায়ার্ড লোক। আয় রোজগার নেই। ছেলেটা কোনও চাকরি-বাকরি করে না। রোগী দেখার টাকায় সংসারটা চলে। দিন দিন রোগী কমছে। আমি কি তাই বলে চলে যাব?. দেশ ছেড়ে চলে যায় যারা, তারা কি মানুষ? যা কিছুই হোক যত দাঙ্গাই ঘটুক, বাঙালি তো আর অসভের জাত নয়। একটু-আধটু কোলাহল হচ্ছে, থেমে যাবে। পাশাপাশি দুটো দেশ, এক দেশের আগুন আরেক দেশে তো একটু-আধটু ছিটকে আসবেই। মাইন্ড ইট হরিপদ, চৌষট্টির দাঙ্গ বাঙালি মুসলমান বাঁধায়নি, বাঁধিয়েছিল বিহারীরা।

হরিপদ গায়ের চাদরে নাক মুখ ভাল করে ঢেকে নিয়ে বলেন—এই যে চাদরের তলে মুখখানা লুকিয়ে বেরোচ্ছি, সে কিন্তু বিহারীদের ভয়ে নয় দাদা, আপনার বাঙালি ভাইদের ভয়েই।

হরিপদ আলগোছে দরজা খুলে বেরিয়ে পা টিপে টিপে বাঁয়ের গলিতে অদৃশ্য হয়ে যান। কিরণময়ী দরজা দু আঙুল ফাঁক করে সুরঞ্জনের অপেক্ষায় অস্থির হয়ে ওঠেন। খানিক পর পরই মিছিল যাচ্ছে ‘নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবর’ শ্লোগান দিয়ে। তাদের ভাষ্য, ভারত সরকারকে যে করেই হোক বাবরি মসজিদ গড়ে দিতে হবে, নইলে রক্ষা নেই।

সুরঞ্জন বেশ রাত করেই বাড়ি ফেরে। টলতে টলতে ফেরে। কিরণময়ীকে জানিয়ে দেয় তার খিদে নেই, রাতে সে ভাত-টাত খাবে না।

 

২গ.

বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ে সুরঞ্জন। তার ঘুম আসে না। এপাশ ওপাশ অস্থিরতায় তার সারারাত কাটে। যেহেতু ঘুম আসেই না সে এক পা এক পা করে অতীতে ফেরে। এই রাষ্ট্রের চারটি মূল নীতি ছিল—জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র। বাহান্নার ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে দীর্ঘকালের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও তার চূড়ান্ত পৰ্য্যয়ে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে সাম্প্রদায়িক ও ধমন্ধি শক্তি পরাস্ত হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল চক্র রাষ্ট্রক্ষমতা দখল ও সংবিধানের চরিত্র পরিবর্তন করবার পর মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যাখ্যাত ও পরাজিত সেই সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তি পুনবাসিত হয়। ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবার অপকৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে অবৈধ ও অসাংবিধানিকভাবে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করবার পর সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তির তৎপরতা খুব বেশি বেড়ে যায়।

কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার সবাহন গ্রামে উনিশ শ উনআশি সনের আটই ফেব্রুয়ারি ভোরে হিন্দু ঋষি সম্প্রদায়ের ওপর আশেপাশের গ্রামের প্রায় চারশ লোক অতর্কিতে আক্রমণ চালায়, তারা চিৎকার করে ঘোষণা করে, ‘সরকার দেশে ইসলামকে রাষ্ট্ৰীয় ধর্ম ঘোষণা করেছে। তাই ইসলামি দেশে থাকতে হলে তোদের সবাইকে মুসলমান হতে হবে। মুসলমান না হলে এ দেশ থেকে তোদের পালিয়ে যেতে হবে ৷ ‘ এই লোকগুলো ঋষি সম্প্রদায়ের প্রতিটি বাড়ি লুট করে, আগুন জ্বলিয়ে দেয়, মন্দির ধূলিসাৎ করে, অনেককে ধরে নিয়ে যায়, যাদের এখনও কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। মেয়েদের অবাধে ধর্ষণ করা হয়। এই হামলায় গুরুতর আহত অবস্থায় এখনও অনেকে আছেন।

নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার আবীরদিয়া গ্রামের নৃপেন্দ্ৰ কুমার সেনগুপ্ত ও তাঁর স্ত্রী অনিমা সেনগুপ্তাকে একজন এডভোকেটের বাড়িতে আটকে রেখে সোয়া আট বিঘা জমি জোর করে রেজিস্ট্রি করে নেওয়া হয়েছে। উনিশ শ উনআশি সনের সাতাশে মার্চ তারিখে অনিমা নরসিংদী পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন যে, আসামীরা তাঁকে ভয় দেখায়, এলাকার লোকও ভয়ে কিছু বলতে পারে না। এরপর অনিমাকে চার দিন হাজতে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়।

সে বছর সাতশে মে তারিখে পিরোজপুর জেলার কাউখালি উপজেলার বউলাকান্দা গ্রামে দশ-বারো জন সশস্ত্ৰ লোক হালদার বাড়িতে হামলা করে। ওরা বাড়ির জিনিসপত্র লুট করে, মন্দির ভেঙে সোল্লাশে শ্লোগান দিয়েছে, ‘মালাউন নিধন কর, মন্দির ভেঙে মসজিদ কর।’ ওরা হিন্দুদের শিগরি দেশ ত্যাগের জন্যও বলে যায়।

চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার গশ্চি গ্রামের বৈদ্যবাড়িতে মে মাসের নয় তারিখে দিনে-দুপুরে বোমা ফাটিয়ে, বাড়ি জ্বলিয়ে, গুলি করে প্রায় এক-দেড়শ জন মুসলমান তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে।

ষোলই জুন পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার আটঘর গ্রামে দশ-বারো জন পুলিশ গৌরাঙ্গ মণ্ডল, নগেন্দ্ৰ মণ্ডল, অমূল্য মণ্ডল, সুবোধ মণ্ডল, সুধীর মণ্ডল, হীরেন্দ্ৰ নাথ মণ্ডল, জহর। দেউরি সহ পনেরো-ষোলজন হিন্দুকে আটক করে এবং গৌরাঙ্গ মণ্ডলের বাড়ির উঠোনে এনে মারধোর শুরু করে। গৌরাঙ্গ মণ্ডলের স্ত্রী বেণু বাধা দিতে গেলে পুলিশেরা তাকে একটি ঘরে ধরে নিয়ে উপর্যুপরি ধর্ষণ করে। অন্য মহিলারা বাধা দিতে গেলে তাদেরও লাঞ্ছিত করা হয়। সনাতন মণ্ডলের কন্যা রীণাকেও জোর করে ধরে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। এই ঘটনার পর রাণাকে অপহরণ করা হয়। আজও রাণার কোনও খোঁজ নেই।

আঠারোই জুন তারিখে রাত এগারেটার দিকে পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার চাঁদকাঠি গ্রামে তিনজন পুলিশ ও স্থানীয় চৌকিদার কিছু সশস্ত্ৰ লোক সহ তল্লাশি চালায়। তল্লাশি চালাবার সময় তারা হিন্দুদের দেশ ত্যাগ করতে বলে। সর্বহারী পার্টির সদস্য বলে অভিযোগ করে তারা দুলাল কৃষ্ণ মণ্ডল সহ চার-পাঁচজন হিন্দুকে আটক করে থানায় নিয়ে অকথ্য নিযাতন চালায়। পরে আট-দশ হাজার টাকার বিনিময়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এই এলাকার অনেক হিন্দু দেশ ত্যাগ করেছে। খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার গাজীর হাট ইউনিয়নের বারোটি গ্রামের সংখ্যালঘু হিন্দুর ওপর শুরু হয়েছে। অকথ্য নিযাতন। নিবাচনে হেরে গিয়ে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মোল্লা জামালউদ্দিন ভাড়াটে লোক লাগিয়ে হিন্দুদের চাষাবাদে বাধা দিচ্ছে, মাঠের ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছে, গরু ছাগল নিয়ে যাচ্ছে, দোকানপাট লুট করছে।

বরিশাল জেলার দুর্গাপুর গ্রামে অর্পিত সম্পত্তির অন্যায় ভাবে লিজ গ্রহণ ও অবৈধ দখলের বিরুদ্ধে মামলার কারণে অষ্ট আশি সনের দশই ডিসেম্বর আবদুস সোবহান ভূঁইয়া ও ইউ পি সদস্য গোলাম হোসেন অস্ত্রশস্ত্র ও দলবল নিয়ে রাজেন্দ্রনাথ দাসের বাড়িতে চড়াও হয়। তারা রাজেন্দ্রনাথের বাড়িতে খুন করবার হুমকি দেখিয়ে বাড়ির সোনাদানী লুট করে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। তারা অষ্টধাতুর রাধাকৃষ্ণ মূর্তিও নিয়ে গেছে, যারা দিতে চায়নি, তাদের ইচ্ছেমত পেটানো হয়েছে। যাওয়ার আগে ওরা রাজেন্দ্রনাথ দাসকে সপরিবারে দেশ ত্যাগের নির্দেশ দিয়ে যায়।

অষ্ট আশির ছাব্বিশে আগস্ট সকালে বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলায় তািলবুনিয়া গ্রামে কিছু মৌলবাদীর প্ররোচনায় অশীতিপর বৃদ্ধ লক্ষ্মণ চন্দ্ৰ পালের বাড়িতে ঢুকে বৃদ্ধের নাতি বিকাশ চন্দ্ৰ পালকে পুলিশের খুব পেটায়, লক্ষ্মণ চন্দ্রের বড় ছেলে পুলিন বিহারী পাল ও মেজ ছেলে রবীন্দ্রনাথ পালকেও মারধোর করে। পুলিনের বউ পুলিশের কাজে বাধা দিতে গেলে পুলিশ তাকেও বেদম পেটায়। পুলিশ এরপর পুলিন, রবীন্দ্রনাথ আর বিকাশকে বেঁধে থানায় নিয়ে যায়, সেখানে মিথ্যা মামলা সাজিয়ে হাজতে পাঠিয়ে দেয়। তাদের জামিন দেওয়া হয়নি। স্বাধীনতার কিছু আগে শোলাকুড়া গ্রামের আবদুল হাকিম মোল্লা লক্ষ্মণ চন্দ্রের ভাইয়ের মেয়েকে ধর্ষণ করেছিল এবং বাড়ির অন্য সদস্যদের পিটিয়েছিল। এই অপরাধে দীর্ঘকাল জেলবাস হয় হাকিম মােল্লার। জেল থেকে ফিরে তালবুনিয়া গ্রামের সিরাজ মল্লিক, হারুণ মল্লিক ও আবদুল জব্বার কাজিকে নিয়ে প্রতিশোধ নেয় পুলিশ দিয়ে লক্ষ্মণচন্দ্রের পরিবারের সদস্যদের এ ধরনের শাস্তি দিয়ে। এই ঘটনার পর নিরাপত্তাহীনতায় এলাকার অনেক হিন্দুই দেশত্যাগের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

গোপালগঞ্জ, কোটালিপাড়া, মকসুদপুর সহ পুরো গোপালগঞ্জ জেলায় হিন্দুদের বাড়িতে চুরি, ডাকাতি, লুট, জালিয়াতি, অবৈধভাবে বাড়ি দখল, মিথ্যা মামলা, নারী ধর্ষণ, মন্দির ভেঙে আগুন লাগিয়ে দেওয়া তো আছেই, সঙ্গে পুলিশি নিযাতনও আছে। কোটালিপাড়া উপজেলার চেয়ারম্যান মন্টু কাজির পোষা গুণ্ডাবাহিনী কুশলা ইউনিয়নের মান্দ্রা লাখিরপাড় গ্রামে প্রকাশ্য দিবালোকে হামলা চালায়, হিন্দু মেয়েদের নিযতন করে, এরা মাদারবাড়ি, আদায়, দামি জিনিসপত্র লুট করে স্ট্যাম্পে সই নিচ্ছে। এখানকার অনেক হিন্দুই ভয়ে দেশ ত্যাগ করেছে। মাষ্ট্ৰ কাজি কোটালিপাড়া সোনালি ব্যাঙ্কের মিসেস ভৌমিককে ধরে এনে পাশবিক নিযাতন চালিয়েছে। কান্দি গ্রামের মমতা, মধু সহ অনেককে চাকরি দেওয়ার লোভ দেখিয়ে উপজেলা কার্যালয়ে আটকে রেখে উপর্যুপরি ধর্ষণ করে।

বাগেরহাটের চিতলমারি উপজেলার গরীবপুর গ্রামের অনিলচন্দ্রের বাড়িতে অষ্ট আশির তেসরা জুলাই গভীর রাতে পুলিশ ঢেকে। অনিলচন্দ্র বাড়িতে ছিলেন না, পুলিশ তাঁর বউ আর বাচ্চাকে বেদম পেটায়, ওই রাতে গ্রামের স্কুলমাস্টার অমূল্যবাবুর বাড়িতেও পুলিশ লুটপাট করে। চার তারিখে সুড়িগতি গ্রামের ক্ষিতীশ মণ্ডলের বাড়িতে হামলা চালায় পুলিশ। বাড়িতে কোনও পুরুষ না পেয়ে ক্ষিতীশ মণ্ডলের স্ত্রী কন্যার ওপর পাশবিক নিযাতন চালায়। পাঁচ তারিখে একই গ্রামের শ্যামল বিশ্বাসের বাড়িতে পুলিশি হামলা চলে। শ্যামলবাবুকে না পেয়ে পুলিশ তাঁর মেয়েকে ধর্ষণ করে, এবং ঘরের মূল্যবান জিনিস লুট করে নিয়ে যায়। এসব ঘটনার কয়েকদিন পর চিতলমারি গ্রামের নীরদ বিহারী রায়ের বাড়িতে এক সমাজবিরোধী লোক জোর করে বসবাস শুরু করে দিয়েছে। প্রশাসনকে জানিয়ে কোনও কাজ হয়নি। কালাশিরা গ্রামের একজন হিন্দুকে জোর করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে ইউ পি সদস্য মনসুর মল্লিক। সেখানে জোর করে বসবাস শুরু করেছে। নিরাশ্রয় হিন্দু এখন পথে পথে ঘোরে।

গোপালগঞ্জের শিক্ষা কর্মকতা জহুরসাহেব হিন্দু মহিলাদের চাকরির লোভ দেখিয়ে ধর্ষণ করেছেন। ডেমাকৈর গ্রামের বিশ্বাস।বাড়ির দুজন মহিলা এভাবে ধর্ষিতা হয়েছে। এই লোক হিন্দু শিক্ষক-শিক্ষিকদের বদলির ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করেন।

গোপালগঞ্জের আলতি গ্রামের জগদীশ হালদারের বাড়িতে পুলিশ ও এলাকার সশস্ত্র যুবকেরা একযোগে হামলা চালায়। গোটা বাড়ি তছনছ করা হয়, পরিবারের সদস্যদের মারধোর করা হয় এবং লুটপাট চালানো হয়। ওরা যাবার সময় সবাইকে মেরে ফেলবার হুমকি দিয়ে যায়। ওই বছরের বারেই আগস্ট গ্রামের আরও কয়েকটি হিন্দু বাড়িতে পুলিশসহ সশস্ত্র যুবকেরা হামলা চালায় এবং কয়েকটি মন্দির ভেঙে ফেলে। আশুতোষ রায়, সুকুমার রায়, মনোরঞ্জন রায়, অঞ্জলি রায়, সুনীতি রায়, বেলা বিশ্বাস তাদের হাতে নিগৃহীত হন। ওরা যাওয়ার সময় হুমকি দিয়ে যায় যে এ দেশে কোনও মন্দির থাকতে পারবে না।

গোপালগঞ্জ জেলার মকসুদপুর উপজেলার উজানি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খায়ের মোল্লার মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে মৌলবাদীরা ও পুলিশ এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার চালায়। পুলিশ বাসুদেবপুর গ্রামের শিবুর স্ত্রী ও মহাটলি গ্রামের কুমারী অঞ্জলি বিশ্বাসকে ধর্ষণ করে। শিমুলপুর গ্রাম থেকে বারোজনকে সর্বহারা দলের সমর্থক অভিযোগে গ্রেফতার করে প্রচণ্ড নিযাতন চালানো হয়। এরং বড় অঙ্কের টাকা দেবার পর এদের ছাড়া হয়।

বিশে জুন তারিখে পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার বাস্তুকাঠি গ্রামে পুলিশ হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায়। বাস্তুকাঠি নদীর দুই তীরে পুলিশ হিন্দু সম্প্রদায়ের জমির ফসল। তছনছ করে দেয়। মাঠে যারা কাজ করছিল তাদের আটক করে এবং প্রচুর টাকার বিনিময়ে ছাড়ে। এই গ্রামেই এগারোই জুন উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের সেবিকা মিনতি রানী তার বৌদি ও ভাইকে নিয়ে বান্ধবী ছবি রানীর সঙ্গে দেখা করতে আদমকাঠি যাওয়ার পথে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পে তাদের আটক করা হয় এবং নিযািতনের হুমকি দেওয়া হয়। পরে এক হাজার টাকা আদায় করে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। স্বরূপকাঠির পূর্বজলা বাড়ি গ্রামে সুধাংশু কুমার হালদারের মেয়ে চৌদ্দ বছর বয়সের শিউলিকে মামার বাড়ি যাবার পথে রুস্তম আলি নামের এক লোক ধর্ষণ করে। রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে শিউলি। সুধাংশু হালদার স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কাছে এ ঘটনার বিচার চাইলে তাকে বলা হয়, ‘এসব সহ্য করতে না পারলে দেশ ত্যাগ করতে হবে। ‘

উনআশি সাতই এপ্রিল তারিখে বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার বুড়িগঞ্জ বাজারে ডাঃ শচীন্দ্ৰ কুমার সাহার বসতবাড়ির কাছে মসজিদ নিমণিকে কেন্দ্র করে মসজিদ কমিটির লোকেরা হামলা চালায়, তারা ডাঃ সাহার বাড়ির দরজা জানোলা ভেঙে ফেলে, লুটপাট করে এবং বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। তারা সংলগ্ন মন্দির ভেঙে ধূলিসাৎ করে দেয়। প্রায় দুঘণ্টা ধরে তাণ্ডবলীলা চালিয়ে এগারো লাখ টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। ঘটনার সময় ডাঃ সাহার ছেলে কোনও রকমে পালিয়ে গিয়ে থানায় খবর দিলে পুলিশ কর্মকতা পুলিশ ফোর্স নিয়ে গেলে আসামী আলতাফ হোসেন মণ্ডলের নেতৃত্বে অন্যান্য আসামীরা লাঠিসোটা, লোহার রড, ইট পাটকেল নিয়ে পুলিশের ওপর আক্রমণ চালায়, এতে ক’জন পুলিশ কর্মকতা আহতও হয়। পরে শিবগঞ্জ উপজেলার ভারপ্রাপ্ত কর্মকতা বাদী হয়ে আলতাফ হোসেন মণ্ডল সহ পয়ষট্টি জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন, তাদের আটকও করা হয়। কিন্তু উর্ধর্বতন মহলের নির্দেশে আসামীরা ছাড়া পেয়েছে। ডাঃ সাহার পরিবারের সদস্যদের প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এতে গোটা এলাকার হিন্দুরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, এলাকা ছেড়ে যাবার চিন্তা ভাবনাও করছে।

ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙা উপজেলার টিকিরাপাড়া গ্রামে উনআশি সালের মে মাসের তিন ও চার তারিখে হিন্দুদের ওপর নিযাতন চালানো হয়, এলাকার হিন্দুরা প্রাণভয়ে নিজের বসতভিটে ছেড়ে অন্য জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে।

মাগুরা জেলার মোহাম্মদপুর উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের রাহাতপুর গ্রামের অধিবাসী হরেন বিশ্বাসের স্ত্রী, নাবালিকা মেয়ে এবং তার ছেলের বউকে একই এলাকার প্রভাবশালী নজীর মৃধা ধর্ষণ করেছে। এ ব্যাপারে একটি মামলা দায়ের হলে নজীর নায়েব এবং তার সাঙ্গাপাঙ্গদের অত্যাচারে হরেন বিশ্বাস তার পরিবার পরিজনসহ দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছে।

উনিশে ও বিশে মে গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়া উপজেলার দেবগ্রামের পুলিশ বঙ্গভূমি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকবার অভিযোগে ওই গ্রামের অনিল কুমার বাগচী, সুশীল কুমার পাণ্ডে, মাখন লাল গাঙ্গুলিকে আটক করে, এবং প্রচুর টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়। ঝালকাঠি জেলার ঝালকাঠি উপজেলার মিরাকাঠি গ্রামের অপ্রকৃতিস্থ রমেশ চন্দ্ৰ ওঝাকে জোর করে ধমন্তিরিত করা হয়। রমেশ চন্দ্রের স্ত্রী মিনতি রানী ও তার বড় ভাই নীরদ ওঝাকে ধমন্তিরিত করবার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। মিনতি রানী এ ব্যাপারে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিকে জানালে তাকে বরং উল্টে পাশবিক নিযািতনের হুমকি দেওয়া হয়। মিনতি রানী এখন প্রাণের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।

গোপালগঞ্জের কচুয়া উপজেলার জোবাই গ্রামের সুধীর বৈদ্যের স্ত্রীকে সুলতান নামের একজন চাকুরিচ্যুত পুলিশ ধর্ষণ করে। লোকলজ্জায় তিনি আত্মগোপন করেছেন। সুধীর বৈদ্যকে প্ৰাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়েছে। একই গ্রামের উপেন্দ্র মালোর একটি গরু জবাই করে খেয়ে ফেলা হয়, উপেন্দ্র প্রশাসনের কাছে বিচার চেয়ে বরং লাঞ্ছিত। হয়েছেন।

গোপালগঞ্জের বীেলতলি ইউনিয়নের বৌলতলি গ্রামের কার্তিক রায় নিজের জমির ধান রক্ষা করতে গিয়ে পাড়ার মুসলমানদের হাতে প্রাণ দিয়েছেন। স্ত্রী রেণুকাকে এই নিৰ্মম হত্যাকাণ্ডকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলতে বাধ্য করা হয়েছে।

কুমিল্লা জেলার লাকসাম উপজেলার দক্ষিণ চাঁদপুরের প্রেমানন্দ শীলের নাইনে পড়া মেয়ে মঞ্জুরানী শীলকে অষ্ট আশির চার ডিসেম্বর তারিখে রাত আটটার দিকে আবদুর রহিম তার শিষ্যদের নিয়ে অপহরণ করে। পরদিন সকালে লাকসাম থানায় মামলা দায়ের করা হয়। মঞ্জু রানীর এখনও কোনও খোঁজখবর পাওয়া যায়নি। অপহরণকারীদের লোকেরা প্রেমানন্দ শীল ও তার পরিবারের সদস্যদের হুমকি দিয়ে বেড়াচ্ছে। পুলিশ নীরব ভূমিকা পালন করছে। এই এলাকার হিন্দু অভিভাবকেরা মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর সাহস পাচ্ছে না।

পাঁচিশে এপ্রিল তারিখে বরিশাল জেলার উজিরপুর উপজেলার গুটিয়া গ্রামে পুলিশ কীর্তনরত অবস্থায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ষোলজনকে গ্রেফতার করে। এরা ছিল দিনমজুর। পানের বরজে কাজ করত।

রাষ্ট্রধর্ম বিল পাশ হবার পর যশোর জেলার অভয় নগর উপজেলার সিদ্ধিরপাশা গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা বিশ হাজার টাকা বিঘার জমি সাত-আট হাজারে বিক্রি করে ভারত চলে যাচ্ছিল, কারন ওখানের কিছু লোক বলছিল হিন্দুদের সম্পত্তি আর বিক্রি করা যাবে না। গ্রামের মাধব নন্দী হিন্দুদের বোঝাতে চেষ্টা করেন এদের কথায় জমি বিক্রি করা ঠিক নয়। এর কয়েক দিন পর মাধব নদীর বাড়িতে গভীর রাতে বারো-চৌদ্দজন লোক দা বল্লম নিয়ে হামলা চালায় আর সাত মাসের গর্ভবতী মাধব নন্দীর পুত্রবধু ও যুবতী কন্যাকে ধর্ষণ করে।

কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার দেবেন বিশ্বাস পনেরো মে তারিখে কারও গুলিতে নিহত হন। মামলা দায়ের করা হলেও এ পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি।

অষ্ট আশি সালের বারোই ও ষোলই আগস্ট পুলিশ সশস্ত্র যুবকদের নিয়ে বাগেরহাট জেলার চিতলমারি উপজেলার গরীবপুর গ্রামে হামলা চালায়। তারা মন্দিরের দেবমূর্তি ভেঙে ফেলে, নারীদের ধর্ষণ করে। বিশ-একুশজনকে ধরে বেদম মারের পর টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। নারায়ণ বৈরাগী, সুশান্ত ঢালী, অনুকুল বাড়ৈ, রঞ্জন ঢালী, জগদীশ বৈরাগী অনেকদিন পর্যন্ত হাজতে ছিলেন। চরবালিয়াড়ি গ্রামেও একই রকম হামলা চালালো হয়, পনেরো-ষোলজনকে আটক করে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। হিজলা ও বড়বাড়িয়া গ্রামেও আট-নজনকে আটকে রেখে নিৰ্য্যতন করা হয়, পরে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।

সাতক্ষীরার তালা উপজেলার পারকুমির গ্রামের রবীন্দ্রনাথ ঘোষের কিশোরী মেয়ে তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী ছন্দাকে গ্রামের স্কুল শিক্ষক ধর্ষণ করেছে। উনআশির ষোলই মে তারিখে ঘটনাটি ঘটে। সেদিন রাতে ছন্দা ঘুমিয়েছিল বাড়ির বারান্দায় পরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে। গভীর রাতে তার স্কুল শিক্ষক নাছিমউদ্দিন কিছু লোক নিয়ে জোর করে ধরে নিয়ে যায় ছন্দাকে। তারপর পাশের একটি বাগানে নিয়ে ধর্ষণ করে। পরদিন সকগলৈ ছন্দোকে রক্তাক্ত অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায়, তাকে সাতক্ষীরা হাসপাতালে পাঠানো হয়। তালা থানায় মামলা দায়ের করলেও অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হয়নি।

গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার গোহালা গ্রামের উজ্জ্বলা রানীকে তার বাবার সম্পত্তি দখলকারী পাঁচজন লোক ধর্ষণ করে। উজ্জ্বলা রানীর অভিভাবকেরা মুকসুদপুর থালায় এ ব্যাপারে জানাতে গেলে থানা কর্তৃপক্ষ কোনও এফ আই আর গ্রহণ করেনি।

পজিরপুর, গৌরনদী সহ সর্বহারা পার্টির সদস্যদের গ্রেফতারের নামে সংখ্যালঘুদের নির্যাতন চালানো হয়। আর গ্রেফতারের পর উৎকোচের বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। পুলিশি অত্যাচারের ভয়ে ওই এলাকার অনেক হিন্দু পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আগৈলঝরা উপেজলার কাশীনাথ হালনার পুলিশের নির্তিনের শিকার হয়ে প্রার মরা হয়ে পড়ে পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলায় দীঘ ইউনিয়নের নাওটানা গ্রামের কেশব সাধু তাঁর একমাত্র পুত্রকে সর্বহারা পার্টির সঙ্গে জড়িত থাকবার মিথ্যে অভিযোগে পুলিশ এমন পেটায় যে দেখে তিনি হার্টফেইল করেন।

নরসিংদী জেলার রায়পুর উপজেলার চরমধুয়া ইউনিয়নের চরমধুয়া গ্রামে শাহাবুদ্দিন ও আলাউদ্দিনের নেতৃত্বে সত্তর-আশিজনের একটি দল সূত্ৰধর পাড়ার হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলা চালায়, লুটপাট করে। বিশটি পরিবারের প্রায় দেড়শ সদস্য গ্রাম ছেড়ে উদ্বাস্তুর জীবন কাটাচ্ছে।

নেত্রকোণা জেলার মদন উপজেলার জাহাঙ্গীরপুর গ্রামে ষোলই মে তারিখে মৌলবাদী একটি দল সংখ্যালঘু নেতা বিনয় বৈশ্যের বাড়িতে হামলা চালায়। বিনয়বাবুর পরিবারের সদস্যদের ছত্রিশ ঘণ্টা আটকে রেখে লোকেরা লুটপাট করে। থানায় খবর দেওয়া হলে পুলিশ এসে উল্টে বিনয়বাবুর দুই ছেলেকেই ধরে নিয়ে যায়। অবশ্য পরে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

বাকেরগঞ্জ চাঁদপুর ইউনিয়নের দুৰ্গপুর গ্রামে দশই ডিসেম্বর তারিখে স্থানীয় ইউ পি সদস্য গোলাম হোসেন পিন্টুর নেতৃত্বে প্রায় একশ মত লোক রাজেন্দ্ৰ চন্দ্র দাসের বাড়িতে হামলা চালায়, লুটপাট করে, বাড়ির লোকদের মারধোর করে, শেষে বাড়িতে লাগিয়ে দেয়। কোতয়ালি থানায় রাজেন্দ্ৰ চন্দ্রের পক্ষ থেকে মামলা করা হলে এরা আবার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং পরিবারের সদস্যর প্রাণনাশের হুমকি দেয়। উপজেলায় মামলা করা হলে পুলিশ নীরব থাকে।

নোয়াখালি জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার মিরওয়ারিশপুর গ্রামের দীনেশ চন্দ্ৰ দাস-এর সম্পত্তি কিছু লোক জোর করে ভোগ দখল করছে।

সুরঞ্জনের ঘুম আসে না। একতা পত্রিকায় দু বছর কাজ করেছিল সুরঞ্জন। অষ্ট আশি উনশির দিকে। রিপোটিং-এর কাজ করতে হত তার, সারাদেশ দৌড়োতে হত। এইসব নিপীড়নের সংবাদ তার ঝোলা বোঝাই হয়ে থাকত। কিছু ছাপা হত, কিছু হত না। সম্পাদক বলতেন, ‘বুঝলে হে সুরঞ্জন, এসব হচ্ছে দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার।, দরিদ্রের ওপর ধনীর অত্যাচার। তুমি যদি ধনী হও, তুমি হিন্দু কী মুসলমান সেটা ফ্যাক্টর নয়, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার তো এরকমই নিয়ম। দেখা গিয়ে দরিদ্র মুসলমানদের একই অবস্থা। ধনীরা, সে হিন্দু হোক মুসলমান হোক, দরিদ্রকে শোষণ করছে।‘

লজ্জা (০৩) শীতটা তেমন জমিয়ে নামছে না

৩ক.

শীতটা কি তেমন জমিয়ে নামছে না? সুরঞ্জন গা থেকে লেপ সরিয়ে দেয়। সকাল হয়েছে অনেকক্ষণ। বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করে না। কাল রাতে সে সারা শহর ঘুরেছে। কারও বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করেনি, কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করেনি। একা একা হেঁটেছে। বাড়িতে বাবা মা দুশ্চিন্তা করছেন এরকম ভাবনাও তার হয়েছে। কিন্তু ইচ্ছে করেনি ফিরতে .। ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা কিরণময়ীর মুখ দেখতে তার নিজেরই ভয় হয়। সুধাময়ও কেমন ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে থাকেন। সুরঞ্জনের ইচ্ছে করে কোথাও বসে মদ খেতে। খেতে খেতে যেন সে ভুলতে পারে মায়ার মায়াবতী চোখ, সেই চোখে থোকা থোকা নীলাভ ভয় নিয়ে সে ‘দাদা দাদা’ বলে ডেকেছিল সুরঞ্জনকে। তাঁর তরী করে বড় হয়ে গেল মেয়েটি। সেদিনের মেয়েটি, দাদার আঙুল ধরে নদী দেখতে যেত। শ্যামলা সুন্দর মেয়ে, পুজো এলে আবদার করবেই, জামা কিনে দাও। সুরঞ্জন বলত পুজো-ফুজো বাদ দে তো। মাটির মূর্তি গড়ে অসভ্যগুলো নাচবে আর তুই নতুন জামা পরবি, ছিঃ! তোকে আর মানুষ করা গেল না।

মায়া আদুরে গলায় বলত—দাদা, পুজো দেখতে যাব, নেবে? সুরঞ্জন ধমক লাগাত। বলত-মানুষ হা। মানুষ হ। হিন্দু হোস নে।

মায়া খিলখিল করে হাসত। বলত-কেন হিন্দুরা কি মানুষ নয়!

মায়াকে ফরিদা বলে ডাকা হত একাত্তরে। বাহাত্তরেও হঠাৎ হঠাৎ মুখ ফসকে ‘ফরিদা’ নাম বেরিয়ে যেত সুরঞ্জনের। মায়া গাল ফুলিয়ে রাগ করত। ওর রাগ ভাঙাতে সুরঞ্জন মোড়ের দোকান থেকে চকলেট কিনে দিত। চকলেট পেয়ে ও কী যে খুশি হত, ফোলা গলে চকলেট পুরলে মায়ার মায়াবতী চোখ দুটো খুশিতে হাসত। মুসলমান বান্ধবীদের দেখে ঈদ এলেই রঙিন বেলুনের আবদার করত ছোটবেলায়, পটকা ফাটাবে, তারাবাতি জ্বলবে, কিরণময়ীর শাড়ির আঁচল ধরে ঘুর ঘুর করত ‘আজ নাদিরাদের বাড়িতে পোলাও মাংস রান্না হবে, আমিও পোলাও খাব।‘ কিরণময়ী পোলাও রাঁধতেন।

মায়া পরশু সকালে গেছে, আজও তার কোনও খবর নেই। ওকে নিয়ে বাবা মার দুশ্চিন্তাও নেই। মুসলমানের বাড়িতে অন্তত বেঁচে তো থাকতে পারবে। এই বয়সে দুটাে টিউশনি করে সে। ইডেন কলেজে পড়ে, পড়ালেখার খরচ বাড়ি থেকে নেয় না বলতে গেলে। সুরঞ্জনেরই কেবল হাত পাততে হয়। চাকরি-বাকরি করা হল না কিছুই। ফিজিক্সে মাস্টার ডিগ্রি নিয়ে বসে আছে। প্রথম প্রথম চাকরি করবার ইচ্ছে কিছু ছিল। ইন্টারভিউও দিয়েছিল। কোথাও কোথাও। ইউনিভার্সিটির তুখোড় ছাত্র সে, অথচ যে ছাত্ররা তার কাছে পড়া বুঝতে আসত, ওরাই ফাইনালে গিয়ে তার চেয়ে নম্বর বেশি। পেল। আর চাকরির বেলায়ও ঘটনা একই। শিক্ষকের চাকরি তার চেয়ে নম্বর কম। পাওয়া ছেলেদের ভাগ্যে জুটল। এদিক ওদিক ইন্টারভিউ দিয়েছে সে, ইন্টারভিউয়াররা কাত করতে পারেনি তাকে এতটুকু। অথচ বোর্ড থেকে বেরিয়ে যে ছেলেরা চুক চুক দুঃখ করত যে তেমন ভাল হয়নি ভাইবা, সুরঞ্জন আশ্চর্য হত যে ওরাই কী করে ফেন এপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়ে যেত, সুরঞ্জন পেত না। দু-একটি বোর্ডে কথা উঠেছে, সুরঞ্জন আদিবাকায়দা জানে না, এগজামিনারদের সে সালাম দেয় না। আসলে আসসালামু আলায়কুম, আদাব বা নমস্কারই যে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের একমাত্র পদ্ধতি, এ কথাই সে মানে না। আসসালামু আলায়কুম বলে যে ছেলে গদগদ ভঙ্গিতে কথা বলে সে বোর্ড থেকে বেরিয়ে পরীক্ষকদের ‘শুয়োরের বাচ্চা” বলে গাল দেয়, সেই ছেলেকেই লোকে ভদ্র বলে জানে, সে-ই হয়ত টিকে যায় ইন্টারভিউয়ে। আর যে সুরঞ্জন আসসালামু আলায়কুম বলে না, সে কিন্তু কোনও দিন গাল দেয়নি শিক্ষকদের। অথচ লোকের কাছে সুরঞ্জন বেয়াদব ছেলে হিসেবে নাম কমিয়েছে, নাম না বলে দুনামও বলা যায়। কী জানি সে কারণেই কিনা নাকি সে হিন্দু বলেই কিনা কোনও সরকারি চাকরি তার হয়নি। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ পেয়েছিল, তিন মাস করবার পর ভাল লাগেনি। ছেড়ে দিয়েছে। সেইদিক থেকে মায়া বেশ মানিয়ে নিয়েছে, দিব্যি টিউশনি করে। চাকরিও নাকি কোন এক এন জি ও-তে করবে। ঠিক হয়েছে। সুরঞ্জনের সন্দেহ হয়। এইসব সুবিধেগুলো তাকে জাহাঙ্গীর নামের ছেলেটিই করে দিচ্ছে। মায়া কি কৃতজ্ঞতা দেখাতে গিয়ে ছেলেটিকে বিয়েই করে ফেলবে শেষ পর্যন্ত? আশঙ্কার খড়কুটাে তার বুকের মধ্যে বাবুই পাখির বাসার মত বাসা বাঁধতে চায়। এককাপ চা নিয়ে সামনে দাঁড়ােন কিরণময়ী। চোখের কোল ফোলা, সুরঞ্জন বোঝে রাতে ঘুম হয়নি তাঁর। তারও যে ঘুম হয়নি এ কথা সে বুঝতে দিতে চায় না। হাই তুলে বলে-“এত বেলা হয়ে গেল টেরও পাইনি।” যেন ভাল ঘুম হওয়ার কারণে সে টের পায়নি। টের পেলে অন্যদিনের মত খুব ভোরে উঠে সে হাঁটতে যেত। জগিং করত। কিরণময়ী চা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। টেবিলে রেখে যে চলে যাবেন, তাও করেন না। সুরঞ্জন অনুমান করে কিছু বলবেন কিরণময়ী। কিন্তু কোনও শব্দ তিনি উচ্চারণ করেন না, যেন ছেলে তার হাত বাড়িয়ে কাপটি নেবে। এরই অপেক্ষা করছেন। তিনি। দুজনের মধ্যে কত যোজন দূরত্ব নির্মাণ হলে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে ঠায়, নির্বাক, সুরঞ্জন বোঝে; সে নিজেই কথা পাড়ে–মায়া কি আজও ফেরেনি?

—না। যেন একটি প্রশ্নের অপেক্ষাই তিনি করছিলেন। যেন সুরঞ্জন উচ্চারিত যে কোনও শব্দ নিয়ে তিনি দুকথা বলতে পারুেন। এমন দ্রুত উত্তর করে তিনি বিছানায় বসলেন। ছেলের নাগালের কাছেই। সুরঞ্জন অনুমান করে এত কাছে বসবার কারণ আসলে নিরাপত্তাহীনতার অস্থিরতা। কিরণময়ীর না ঘুমোনো চোখ, না আঁচড়ানো চুল, মলিন শাড়ি থেকে চোখ সরিয়ে নেয় সে। আধখানা পিঠ তুলে কাপটি হাতে নিয়ে চুমুক দেয়। ‘ও কেন ফিরছে না? মুসলমানরা তাকে বাঁচাচ্ছে বুঝি? আমাদের ওপর বিশ্বাস নেই? একবার খবরও নিচ্ছে না। এখানে আমরা কেমন আছি। শুধু নিজে বাঁচলেই চলবে।

কিরণময়ী চুপ হয়ে থাকেন। সুরঞ্জন চায়ের সঙ্গে একটি সিগারেট ধরায়। বাবা মা’র সামনে সে কখনও সিগারেট খায়নি, আজ যখন ফস করে ম্যাচের কাঠি জ্বালাল, সিগারেট ধরিয়ে মুখ ভরে ধোঁয়াও ছাড়ল, তার মনেও পড়ে না। সে কিরণময়ীর সামনে সিগারেট ফোঁকে না। যেন অন্য দিনগুলোর মত স্বাভাবিক দিন নয় এখন। এখন মা ছেলের যে দূরত্বটি রচিত ছিল তা ঘুচে গেছে। সূক্ষ্ম যে একটি দেওয়াল ছিল, তা ভেঙে যাচ্ছে। কতদিন সে একটি স্নেহকাঙািল হাত মায়ের কোলে রাখেনি। ছেলেরা বড় হয়ে গেলে কি মায়ের স্পর্শ থেকে এরকম দূরে সরে যেতে থাকে! সুরঞ্জনের ইচ্ছে করে অবোধ শিশুর মত কিরণময়ীর কোলে মাথা রেখে ছোটবেলার ঘুড়ি ওড়ানোর গল্প করুক, সেই যে সিলেট থেকে এক মামা আসত, নবীন মামা, নিজে হাতে ঘুড়ি তৈরি করত, আর ওড়ােতও চমৎকার। আকাশের আর সব ঘুড়িকে ভোকাট্টা করে দিয়ে দিব্যি সে উড়ে বেড়াত।

সুরঞ্জন মায়ের কোলটির দিকে তৃষ্ণাৰ্তা চোখে তাকায়। সিগারেটের শেষ ধোঁয়া ছেড়ে বলে–কাল কি কামাল, বেলাল বা অন্য কেউ এসেছিল?

কিরণময়ী স্নান কণ্ঠে বলেন–না।

কামাল একবার খোঁজও নিল না, অবাক লাগে বন্ধুরা কি ভাবছে। সুরঞ্জন মরে গেছে, নাকি ওকে বাঁচাবার আর ইচ্ছে নেই। কারও?

কিরণময়ী ধীরে, গলার স্বরটি বুজে আসে, বলেন–কাল তুই গেলি কোথায়? আমরা বাড়িতে দুজন মানুষ। কী হয় না হয় একটু কি ভাবিস না? আর তুই যে বাইরে চলে গেলি কিছু যদি হত? ও বাড়ির গীেতম দুপুরের দিকে পাড়ার দোকানো গিয়েছিল ডিম কিনতে, ওকে মুসলমান ছেলেরা মেরেছে। সামনের দুটো দাঁত ভেঙে গেছে। পায়ের হাঁড়ও নাকি ভেঙেছে।

–ও।

—মনে আছে। বছর দুই আগে শনির আখড়া থেকে গীতার মা আসত, ঘরবাড়ি ছিল না। পুড়িয়ে দিয়েছিল? গীতার মা এ বাড়ির কাজ ছেড়ে চলে গেল ভিটের ওপর নতুন করে ঘর তুলবে বলে। ঘর তুলেওছিল, এর ওর বাড়িতে কাজ করে টাকা জমিয়ে। সে এসেছিল ভোরে, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। এবারও তার নতুন তোলা ঘর ছাই করে দিয়েছে। ভিটেয় কিছু নেই। আজ ভোরে এসে বলল, ‘বোঁদি, বিষ পাওয়া যায় কোন দোকানে? পাগল হয়ে গেছে মনে হয়।

—ও। সুরঞ্জন চায়ের কাপটি বালিশের পাশে রাখে।

—মায়া যে এ বাড়িতে আসবে, ওকে নিয়ে তো আরও দুশ্চিন্তা হবে রে।

—তাই বলে মুসলমানের ছাতার তলে তার সারাজীবন বাস করতে হবে নাকি?

সুরঞ্জনের কণ্ঠ কঠিন হয়ে ওঠে। সে-ও একবার বাড়ির সবাইকে নিয়ে কামালের বাড়ি গিয়েছিল, তখন মুসলমানের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে বলে এরকম গ্লানি হয়নি, মনে হয়েছে কিছু দুষ্ট লোক দুষ্টোমি করছে, কেটে যাবে, সব দেশেই তো এরকম দুষ্ট লোক থাকে। এখন ওরকম মনে হয় না। এখন কিছু দুষ্ট লোকের দুষ্টেমি মনে হয় না এসব। আরও বড় কোনও গভীর কোনও ষড়যন্ত্র বলে সন্দেহ হয়। হ্যাঁ সন্দেহই হয় বৈকি। সুরঞ্জনের এখন বিশ্বাস হতে চায় না কামাল বেলাল কায়সার লুৎফর এরা কেউ অসাম্প্রদায়িক লোক। আটাত্তরে জনগণ কি সংবিধানে বিসমিল্লাহ বসাবার আন্দোলন করেছিল যে জিয়াউর রহমানের সরকার বিসমিল্লাহ বসােল? অষ্টআশিতে জনগণ কি ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করবার জন্য কেঁদেছিল যে এরশাদ সরকার ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করল? কেন করল? সেকুলারিজমে নাকি বাঙালি মুসলমানের অগাধ বিশ্বাস, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির! কই, তারা তো রাষ্ট্র কাঠামোয় সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ বপন করা দেখেও তেমন ক্ষুব্ধ হয়নি? ক্ষুব্ধ হলে কী না হয়! এত বড় একটি যুদ্ধ ঘটিয়ে দিতে পারে যে দেশের রক্ত-গরম মানুষ, সে দেশের মানুষ আজ সাপের মত শীতল কেন? কেন তারা সাম্প্রদায়িকতার চারাগাছকে সমুলে উৎপাটন করবার তাগিদ অনুভব করছে না? কেন তারা এমন একটি অসম্ভব ভাবনা ভাববার সাহস পায় যে ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া দেশে গণতন্ত্র আসবে বা এসেছে? এ ভাবনা তো তারাই ভাবছে, স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিই? প্রগতিশীল আন্দোলনে যুক্ত মানুষেরাই?

—কাল সোয়ারিঘাট মন্দির ভেঙে ফেলেছে শুনেছিস? শ্যামপুর মন্দিরও?

কিরণময়ী করুণ কণ্ঠে বলেন। সুরঞ্জন আড়মোড়া ভাঙে। বলে—তুমি কি মন্দিরে যেতে কখনও, যে মন্দির ভাঙলে কষ্ট হচ্ছে? ভাঙুক না, ক্ষতি কি? ওঁড়ো হয়ে যাক এইসব ধর্মের দালানকোঠা।

—মসজিদ ভাঙলে ওদের রাগ হয়, মন্দির ভাঙলে যে হিন্দুদের রাগ হয় এটা কি ওরা জানে না? নাকি বোঝে না? একটা মসজিদের জন্য ওরা শ’য়ে শ’য়ে মন্দির ভাঙছে। ইসলাম না শান্তির ধর্ম?

—এ দেশের হিন্দুরা যে রাগ করে কিছুই করতে পারবে না তা মুসলমানরা ভাল জানে। তাই তারা করছে। কেউ হাত দিতে পেরেছে একটি মসজিদে? নয়াবাজারের মন্দিরটা দু বছর থেকে ভেঙে পড়ে আছে। বাচ্চারা ওর ওপর উঠে নাচে, পেচ্ছাব করে। কোনও হিন্দুর শক্তি আছে মসজিদের ঝকঝকে দেওয়ালে দুটো কিল বসায়?

কিরণময়ী নিঃশব্দে উঠে চলে যান। সুরঞ্জন বোঝে যে মানুষটি নিজের ভেতর এক জগত তৈরি করে নিয়েছিলেন, সংসারের বাইরে তিনি হাত পা বড় একটা বাড়ান না, তিনি পারভিনকে যে চোখে দেখেন, অৰ্চনাকেও সে চোখে—তিনিও খানিক টালমাটাল হলেন, তাঁরও প্রশ্ন জেগেছে মনে—রোগ অভিমান ক্ৰোধ কি কেবল মুসলমানদেরই আছে?

 

৩খ.

বাবরি মসজিদ আক্রান্ত হওয়ার পরই যে নব্বই-এর অক্টোবরে শুরু হয়েছে। এ দেশে হিন্দু নিযতন এবং মন্দির হামলা, তা নয়। সুরঞ্জনের মনে পড়ে উনআশির একুশে এপ্রিল সকালে রাজশাহী জেলা সদরে সাহেব বাজারের ঐতিহাসিক কালী মন্দিরের কালী মূর্তি আয়ুব আলি নামের এক লোক নিজ হাতে ভেঙে ফেলেছিল। মন্দির ভাঙবার পর হিন্দু মালিকদের দোকানও ভাঙে ৷

ওই বছরের ষোলই এপ্রিল ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার রামগোপাল পাড়ায় রামগোপাল মন্দিরের ঐতিহ্যবাহী রামগোপাল বিগ্রহ চুরি হয়। পরে শৈলকূপা শ্মশানের পাশে ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় মূর্তিটি পাওয়া যায়। তবে বিগ্রহের সোনা রূপার অলঙ্কার পাওয়া যায়নি।

সীতাকুণ্ডের পূর্ণ লালানগর গ্রামের জয়গোপালহাট কালী মন্দির ভস্মীভূত করা হয়েছে। উত্তর চান্দগাঁও-এর কুরাইশ চান্দগাঁও দুগাবাড়ির বিগ্রহও ভেঙে ফেলা হয়েছে।

রাষ্ট্রধর্ম বিল পাশ হবার দু মাস পর খুলনা জেলার ফুলতলা উপজেলার দক্ষিণডিহি গ্রামের পাশে পুরনো কালাচাঁদ মন্দিরের কষ্টিপাথরের মূর্তি আর তার গায়ের সোনার অলঙ্কার চুরি হয়। মন্দির কমিটির সম্পাদক ফুলতলা থানায় এজাহার করতে গেলে পুলিশ তাঁকেই গ্রেফতার করে, তাঁকেই শারীরিক নিযাতন করে। মন্দির কমিটির সকলের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। জেলার এ এস পি ওই এলাকার তদন্তে গিয়ে হিন্দুদের এই বলে হুমকি দেন যে হিন্দুরাই মন্দিরের বিগ্রহ চুরি করেছে।

টাঙাইল জেলার কালীহাতি উপজেলার দ্বিমুখা গ্রামের প্রাচীন মন্দির থেকে আটই ডিসেম্বর রাতে শ্বেতপাথরের শিব, রাধাগোবিন্দ, অন্নপূর্ণ মূর্তি ও শালগ্রাম শিলা চুরি হয়ে যায়। থানার লোক আসে, নূর মোহাম্মদ তালুকদার বিগ্রহ চুরি করেছে জানাবার পরও এটি উদ্ধারের কোনও ব্যবস্থা হয়নি।

কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ময়নামতি ইউনিয়নের হিন্দুদের উদ্দেশ্যে ‘বিশ্ব ইসলাম নামের একটি সংগঠন চিঠি দেয় যে হিন্দুরা যেন অবিলম্বে এ দেশ ছেড়ে চলে যায়। চিঠিতে হাঁশিয়ার করা হয় পুজো-আচ্চা বন্ধ না করলে দাঙ্গা হবে। চৌদ্দই এপ্রিল কালীবাড়ির মন্দিরের পাশের বটবৃক্ষে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। আলী আহমদ নামের এক লোক ময়নামতি বাজারে প্রচার করে যে এলাকার হিন্দুদের দাঙ্গার মাধ্যমে উৎখাত করতে হবে।

এগারোই মার্চ ভোলার লালমোহন উপজেলার শ্ৰী শ্ৰী মদনমোহন আখড়ায় নাম সংকীর্তন চলাকালে শতাধিক লোক মণ্ডপে হামলা চালায়। তারা মন্দিরে ঢুকে প্রতিমা ভাঙচুর করে, উপস্থিত ভক্তদের মারধোর করে। দত্তপাড়ার বিভিন্ন মন্দিরে ঢুকে প্রতিমা ভাঙচুর, লুটপাট, আর আগুন ধরানো খেলা খেলে।

মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর উপজেলার বড়টিয়া গ্রামে প্রায় একশ বছরের পুরনো শ্ৰী শ্ৰী কালীমাতার মন্দিরের পাশের জমিতে এডভোকেট জিলুর আহমদ কবরস্থান ও মসজিদ নিমাণের উদ্যোগ নেওয়ায় পুজো করার অন্তরায় হবে বলে আশঙ্কা করছে হিন্দুরা।, নোয়াখালি জেলার চাটখিল উপজেলার মোহাম্মদপুর ইউনিয়নে কালীরহাটে হিন্দুরা একটি মন্দিরে দীর্ঘদিন যাবৎ পূজাৰ্চনা করে আসছে। স্থানীয় মুসলমানেরা চক্রান্ত করে জোর করে মন্দিরটি উঠিয়ে দিয়ে সেখানে ব্যবসা শুরু করেছে।

গাজিপুর পৌরসভার ফাউকাল গ্রামের লক্ষ্মী মন্দিরের বিগ্রহ ছাবিবশে মে তারিখে গভীর রাতে ভেঙে ফেলে, বিগ্রহের মাথাটি নিয়েও যায়।

ঝিনাইদহ জেলার সদর উপজেলার কষ্টসাগর গ্রামের মঠবাড়িতে চৈত্র সংক্রান্তির রাতে চড়ক পূজো চলাকালে একদল লোক হামলা চালায়, পূজারীকে বেদম পেটায়, পূজার নৈবেদ্য তছনছ করে, ঢাক কেড়ে নেয়। মামলা দায়ের করবার পরও কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি।

গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার নিজড় পূর্বপাড়ার কালীমন্দিরে উনআশির চৌদ্দই মার্চ রাত ন’টায় মুসলমানেরা হামলা করে মন্দিরের ক্ষতি করে। উলপুরের শিবমন্দিরের তালা ভেঙে শিবলিঙ্গ সহ মূল্যবান জিনিসপত্র চুরিও করে।

কুষ্টিয়া জেলা সদরে থানাপাড়ায় অষ্টআশির সতেরো অক্টোবর তারিখে দুৰ্গ প্রতিমা  ভেঙে ফেলে।

খুলনা জেলা সদর পালের বাজারে পুজো শুরু হওয়ার আগে মুর্তিগুলো ভেঙে ফেলে ঝাজারের কজুন মুসলুমান লোক।

যশোর জেলার গোবরায় দুর্গ প্রতিমা ভেঙে ফেলা হয়।

অষ্টআশির পয়লা অক্টোবর খুলনা জেলার ঐতিহ্যবাহী শ্ৰী শ্ৰী প্রণবানন্দজী মহারাজের আশ্রমের দুর্গা প্রতিমা ভেঙে ফেলা হয়।

তিরিশে সেপ্টেম্বর তারিখে সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডের পুজোমন্দিরের দুর্গ প্রতিমা ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া হয়।

খুলনা ভুমুরিয়া উপজেলার মধুগ্রাম জামে মসজিদের ইমাম শারদীয় দুগোঁহাসকের আগে এলাকার সকল পুজো মণ্ডপে চিঠি লিখে জানিয়ে দেয় প্রতিবার আজান ও নামাজের জন্য পুজোর সব কিছু বন্ধ রাখতে হবে। চিঠিটি পেঁৗছয় সতেরো অক্টোবর তারিখে।

অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে খুলনা জেলা শহরে সাম্প্রদায়িক শক্তির এক মিছিলে শ্লোগান ওঠে-মুর্তিপূজা চলবে না, ভেঙে দাও, ওঁড়িয়ে দাও।’

কুষ্টিয়ার কুমারখালি উপজেলার মহিষকোলা গ্রামে তেইশ অক্টোবর কালী মন্দিরের কালী মূর্তি ভেঙে ফেলা হয়।

গাজিপুরে কালীগঞ্জ উপজেলার কালীগঞ্জ বাজারের কালী মন্দিরে পুজোর আগে যে মূর্তিটি তৈরি হচ্ছিল, ভেঙে ফেলা হয়। –

তিরিশে সেপ্টেম্বর তারিখে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার নকীপুর গ্রামে হরিতলা মন্দিরে পুজোর আগে তৈরি করা মুর্তি ভেঙে দেয়।

পিরোজপুর জেলার ভাণ্ডারিয়া উপজেলায় কালী মন্দিরের দেওয়াল ভেঙে ড্রেন করা হয়েছে।

বরগুনা জেলার ফুলঝুরি বাজারের দুর্গ প্রতিমা বিজয়া দশমীর দিন মৌলবাদীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। বামনা উপজেলার বুকাবুনিয়া ইউনিয়নের দুর্গ প্রতিমা পূজার কয়েকদিন আগে ভেঙে ফেলে। এসবের কোনও স্ট্রিচার হয়নি।

বাংলাদেশ নাকি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। সুরঞ্জন হঠাৎ হেসে ওঠে। এক ঘরে, ঘরে কিরণময়ী নেই, একটি বেড়াল শুয়েছিল। দরজার পাশে, বেড়ালটি চমকে তাকায় সুরঞ্জনের হাসির শব্দে। বেড়ালটি কি আজ ঢাকেশ্বরী মন্দির যায়নি? আচ্ছ এই বেড়ালের জাত কি? সে কি হিন্দু? হিন্দুর বাড়িতে যখন থাকে, হিন্দুই হবে বোধহয়। সাদা কালোয় মেশানো রঙ, নীল চোখদুটোয় মায়া, বেড়ালের চোখ থেকেও কি করুণা ঝরছে। তবে তো এটিও মুসলমান! নিশ্চয়ই মুক্তচিন্তার বিবেকবান মুসলমান, আজকাল ওরা আবার হিন্দুদের দিকে করুণ চোখে তাকায়। বেড়ালটি উঠে যায়। এ বাড়িতে চুলো জ্বলছে না খুব একটা, এরকম হতে পারে, বেড়ালটি পাশের মুসলমান বাড়ির রান্নাঘরে গিয়ে বসিল, বেড়ালটির তা হলে জাত নেই। জাত কেবল মানুষের আছে। মানুষেরই মন্দির মসজিদ আছে। সুরঞ্জন দেখে সিঁড়িতে রোদ এসে পড়েছে, বেলা অনেক হল, আজ ডিসেম্বরের না তারিখ, তার খুব বেড়াল হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। সারাজীবন সে পুজো করল না, মন্দিরে গেল না, দেশে সমাজতন্ত্র আনবে বলে পণ্য করুল, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াল, মিছিল করল, মিটিং-এ ভাল ভাল কথা বলল, কৃষকের কথা ভাবল, শ্রমিকের কথা ভাবল, দেশের সামাজিক অর্থনৈতিক উন্নতির কথা ভেবে ভেবে নিজের দিকে, সংসারের দিকে তাকাবার অবসরও পায়নি। আর এই সুরঞ্জনকে সবাই আঙুল তুলে বলছে সে হিন্দু : পাড়ার ছেলেরা তাকে ‘ধর ধর বলে ধ্বনি দেয়। আজ হয়ত ওরা ধরে মার দিচ্ছে না, কাল দেবে। গৌতম ডিম কিনতে গিয়ে মার খায়, সে মোড়ের মতির দোকানে সিগারেট কিনতে যাবে, পিঠে হঠাৎ পড়বে এসে প্রবল ঘুষি, ঠোঁট থেকে সিগারেটটি পড়ে যাবে তার, ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখবে কুদ্দুস, রহমান, বেলায়েত, সোবহান এরা সব দাঁড়িয়ে আছে। হাতে শক্ত লাঠি, ধারালো ছোরা। দৃশ্যটি ভাবতেই সুরঞ্জন চোখ বন্ধ করে ফেলে। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। তবে সুরঞ্জনও কি ভয় পায়? সে তো ভয় পাওয়ার ছেলে নয়। বিছানা ছেড়ে সে উঠোনে বেড়ালটিকে খোঁজে। কী নিস্তব্ধ বাড়ি। মনে হয় কতকাল এই বাড়িতে কেউ থাকে না। একাত্তরে গ্রাম থেকে যখন ফিরে এসেছিল, ব্ৰাহ্মাপল্লীর বাড়িতে বড় বড় ঘাস গজিয়ে গিয়েছিল, থমথমে, গোটা বাড়িটায় একটি জিনিস নেই, তার লাটিম মার্বেল ঘুড়ি নাটাই ক্যারমবোর্ড দাবা বইপত্র কিছু নেই। খাঁ খাঁ করা বাড়িটিতে ঢুকে যেমন বুক কেঁপেছিল, সুরঞ্জনের তেমন বুক কাঁপে। সুধাময় কি সারাদিন শুয়ে থাকেন? প্রেসার যদি বাড়েই, ডাক্তার ডাকবে কে? বাজার করা, ওষুধ কেনা, মিস্ত্ৰি ভাকা, পত্রিকা রাখা এ ধরনের কোনও কাজই সুরঞ্জন কখনও করেনি। সে বাড়িতে তিনাবেল নয়ত দুবেলা খায়, রাত হলে বাড়ি ফেরে, বেশি রাতে হলো নিজের ঘরের দরজা বাইরে থেকে খুলে ঢোকা যায়, ঢোকে। টাকা পয়সার দরকার হলে কিরণময়ী নয় সুধাময়ের কাছে চেয়ে নেয়। টাকা চাইতে তার লজ্জাই হয়। তেত্রিশ বছর বয়স, এখনও কোনও উপার্জন নেই। সুধাময় বলেছিলেন–রিটায়ার করছি, তুই কিছু কর সুরঞ্জন।’ ‘আমার দ্বারা চাকরি-বাকরি করা হবে না।’ বলে সে কুটক্যামেলা এড়িয়ে গেছে। বাইরের ঘরে রোগী দেখে সংসার চালাচ্ছেন সুধাময়। রাত করে ঘরে ফিরেছে, পার্টি অফিসে, মধুর কেন্টিনে, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অফিসে, প্রেস ক্লাবে, বত্ৰিশ নম্বরে সারাদিন ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত সুরঞ্জন ঘরে ফিরেছে। ভাত ঢাকা থাকত টেবিলে, কোনও দিন খেয়ে, কোনও দিন না খেয়ে শুয়ে পড়েছে। দূরত্ব এভাবেই তৈরি হচ্ছিল সংসারের সঙ্গে তার, কিন্তু আজ যখন কিরণময়ী সকালের চা দিতে গিয়ে বসলেন তার বিছানায়, সুরঞ্জন অনুভব করেছে। তার মত উড়নচন্তীি উদাসীন দায়িত্বজ্ঞানহীন ছেলের ওপর এখনও বাবা মায়ের পরম নির্ভরতা। কি দিয়েছে। সে এই সংসারকে? এক সময়ের বিত্তবান সুধাময় ডাল-ভাত খেয়ে এখন তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন। সুরঞ্জনও তোলে, তার মনে আছে ছোটবেলায় তাকে নাক চেপে ধরে দুধ গেলানো হত, মাখন না খেলে পিঠে মাির পড়ত, আর এখন যদি সে কিরুণাময়ীর কাছে আবদার করে আমার সেই খাঁটি দুধ চাই, ননী চাই, মাখন চাই; দুপুরে মাছ চাই মাংস চাই, ঘিয়ে ভাজা পরোটা চাই; সুধাময়ের ক্ষমতা হবে খাওয়াবার? অবশ্য প্রাচুর্য বা বিলাসিতার প্রতি সুরঞ্জনের কোনও আকর্ষণ জন্মায়নি। না জন্মাবার কারণ সুধাময়। সমান বয়সের বন্ধুরা যখন নতুন ডিজাইনের প্যাস্ট শার্ট বানাতো, সুধাময় তখন ছেলের জন্য কিনে আনতেন আইনস্টাইন, নিউটন, গ্যালিলিওর জীবনী, ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাহিনী, গোর্কি টলস্টয়ের গল্প। সুধাময় চাইতেন ছেলে তাঁর মানুষ হবে। আজ সকালে বেজাত বেড়ালটিকে খুঁজতে খুঁজতে তার নিজের কাছেই জানতে ইচ্ছে হল সে কি আন্দীে মানুষ হয়েছে? তার কোনও লোভ নেই, সম্পদ বা সম্পঞ্জির প্রতি মোহ নেই, নিজের স্বার্থের চেয়ে দশজুনের স্বার্থকেই বড় করে দেখে। এসবোকই কি মানুষ হওয়া বলে! সুরঞ্জন এলোমেলো হাঁটতে থাকে বারান্দায়। সুধাময় পত্রিকা পড়ছিলেন। ছেলের দিকে চোখ পড়তেই ডাকেন—সুরঞ্জন, শোন।

-কল। খাটের রেলিং ধরে দাঁড়ায় সে।

—যোশী আর আদভানি সহ আটজন গ্রেফতার হয়েছে শুনেছিস? ওদিকে চারশ’রও বেশি মারা গেছে। ইউ পি-র কল্যাণ সিং-এরও বিচার হবে। আমেরিকা এমনকি সারা বিশ্ব বাবরি মসজিদ ভাঙার নিন্দা করেছে, ভোলায় কার্ফু দিয়েছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্ৰীতি রক্ষণ করার জন্য বি এন পি আওয়ামি লিগ এমনকি অনেক দলই পথে নোমছে। বিবৃতি দিচ্ছে। সুধাময়ের চোখের তারা বেড়ালের চোখের তারার মত মায়া মায়া।

—আসলে কি জানিস, যারা দাঙ্গা বাঁধাচ্ছে, তারা কি আর ধর্ম মেনে করছে? আসল কথা লুটপাট। মিষ্টির দোকানগুলো লুট হয় কেন বুঝিাস না? মিষ্টির লোভে। সোনার দোকানও ওই সোনাদানার লোভে।। গুণ্ডা বদমাশরা এই লুটপাটগুলো করছে, এখানে সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে আসলে কোনও বিরোধ নেই। আর যে হারে শান্তি মিছিল বেরোচ্ছে, কিছু একটা হবেই। নব্বই-এ এরশাদের পতন তো এই ইসুতেই হল। আচ্ছা সুরে, এরশাদ যে বলেছিল হিন্দুদের ক্ষতিপূরণ দেবে, দেওয়া হয়েছিল?

—তুমি কি পাগল হয়ে গেছ বাবা?

–কী জানি আজকাল মনেও থাকে না? নিদারাবাদ হত্যাকাণ্ডের আসামীদের ফাঁসি হবে জানিস তো?

সুরঞ্জন বোঝে সুধাময় বোঝাতে চান হিন্দুরা এ দেশে বিচার পায়। ব্ৰাহ্মণবাড়িয়ার নিদারাবাদ গ্রামের বিরজাবালা দেবনাথ আর তার পাঁচ সন্তান নিয়তিবালা, সুভাষ দেবনাথ, মিনতিবালা, সুমন দেবনাথ ও সুজন দেকনাথকে ধোপাজুড়ি বিলে নিয়ে রামদা দিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলে, মেরে দুটো ড্রামে পুরে ড্রামের মুখ চুন ও নুন দিয়ে বন্ধ করে ধোপাজুড়ি বিলে ডুবিয়ে রাখে, পরে পানির নীচ থেকে ড্রাম ভেসে ওঠে। মেরেছিল বিরজার স্বামী শশাঙ্ক দেবনাথের তিন একর চৌত্ৰিশ শতক সম্পত্তি জীবর দখল করা এবং শশাঙ্ক হত্যামামলা থেকে বাঁচবার জন্য। হত্যামামলার আসামী তাজুল ইসলাম আর চোরা বাদশাহর ফাঁসির রায় হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে, সেও আজ চার মাস হয়ে গেল, নতুন করে সুধাময়ের এই কথা বলবার কারণ কি তবে এই যে তিনি কোনও একটি ঘটনা থেকে সাত্মনা পেতে চাইছেন। ভাবতে চাইছেন হিন্দুরা এই দেশে খুব সুবিচার পায়। এই দেশে হিন্দু মুসলমান একই মযাদা পায়! হিন্দুরা এই দেশে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক নয়।

—কাল কি সম্প্রীতির মিছিলে গিয়েছিলি? কত লোক হয়েছিল রে সুরঞ্জন?

—জানি না।

–জামাতিরা ছাড়া সব দল তো রাস্তায় নেমেছিল, তাই না?

–জানি না।

—পুলিশ প্রোটেকশান তো দিচ্ছেই সরকার

—জানি না।

–শাঁখারি বাজার এলাকার এমাথা ওমাথায় ট্রাক ভর্তি পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে, দেখেছিস?

–জানি না।

—হিন্দুরা তো দোকানপাটও খুলছে।

–জনি না।

–ভোলায় নাকি খুব খারাপ অবস্থা? খুব কি খারাপ অবস্থা সুরঞ্জন? নাকি প্রচারটা বেশি হচ্ছে?

–জানি না।

-গৌতমকে বোধহয় ব্যক্তিগত শক্রতার কারণেই মেরেছে। ছেলেটি নাকি গাঁজ-টাজা খেত?

–জানি না।

সুরঞ্জনের নিষ্পৃহ ভঙ্গি সুধাময়ের উচ্ছাস দমিয়ে ফেলে। তিনি পত্রিকার পাতা মেলে ধরেন চোখের সামনে। আহত কণ্ঠে বলেন–তুই বোধহয় পত্রিকা-টত্রিকা পড়িস না!

—পত্রিকা পড়ে কী হবে?

–চারদিকে কিরকম প্রতিরোধ হচ্ছে, প্রতিবাদ হচ্ছে, জামাতিদের কি আর এত শক্তি হবে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে মন্দিরে ঢুকতে?

—মন্দির দিয়ে কী করবে তুমি, পুজো করবার ইচ্ছে হচ্ছে বুঝি শেষ বয়সে? মন্দির ওঁড়ো করে ফেললে তোমার কোনও অসুবিধে? যত মন্দির আছে ভেঙে ফেলুক না! আমি তো খুশি হই।

সুধাময় অপ্রস্তুত হন। সুরঞ্জন ইচ্ছে করেই তার ভালমানুষ বাবাকে আহত করে। এত ভাবনার কি আছে, দেশের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে, নিজেকে প্রথম শ্রেণীর কাতারে দাঁড় করাবার ইচ্ছেটাই তো বোকামি। এতকাল পুজো-আচ্চা না করে, এতকাল মুসলমানদের ভাই বন্ধু ভেবে কী লাভ হল সুধাময়ের, কী লাভ হল সুরঞ্জনের! সেই তো সকলে তাদের হিন্দু বলেই জানে। সারাজীবন মনুষ্যত্ব আর মানবতার চাচা করে, সারাজীবন নাস্তিক্যবাদে বিশ্বাস করে কী লাভ হল। এই পরিবারের! সেই তো ঢ়িল পড়ে বাড়িতে, সেই তো তটস্থ থাকতে হয় ভয়ে। সেই তো কুঁকড়ে থাকতে হয় আশঙ্কায় কখন সাম্প্রদায়িকতার অন্ধ আগুন এসে গায়ে লাগে। সুরঞ্জনের মনে আছে সে যখন ক্লাস সেভেনে পড়ে, টিফিন পিরিয়ডে তারই ক্লাশমেট ফারুক তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলেছিল-’আমি খুব ভাল একটি খাবার এনেছি বাড়ি থেকে, কাউকে দেব না, তুই আর আমি ছাদের সিঁড়িতে বসে খাব, কেমন?’ সুরঞ্জন যে খুব ক্ষুধার্ত ছিল তা কিন্তু নয়। তার কাছে ফারুকের প্রস্তাবটি মন্দ লাগেনি। টিফিনবক্স নিয়ে ফারুক উঠে এল স্কুলের ছাদে, পেছনে সুরঞ্জন। ফারুক তার টিফিনবক্স খুলে একটি কাবাব দিল সুরঞ্জনের হাতে। দুজনে গল্প করতে করতে কাবাব খেল। সুরঞ্জন ভােবল তার মা-ও চমৎকার নারকেলের নাডু বানাতে পারেন, একদিন এনে সে ফারুককে খাওয়াবে। ফারুককে সে বললও, ‘এটি কে বানিয়েছে, তোমার মা বুঝি? আমার মায়ের রান্নাও তোমাকে একদিন খাওয়াব ৷ ‘ এদিকে খাওয়া শেষ হবার পর ফারুক সজোরে আনন্দধবনি দিলে—’হুররে ৷ ‘ সে কিছু বুঝে উঠবার আগেই ফারুক দৌড়ে নেমে গেল সিঁড়ি ভেঙে। নীচে নেমে ক্লাসের সবাইকে সে জানিয়ে দিল সুরঞ্জন গরু খেয়েছে। সকলে সুরঞ্জনকে ঘিরে হৈ হৈ করে নাচতে লাগল। কেউ চিমটি কাটে, কেউ তার মাথায় চাটি মারে, কেউ জামা ধরে টান দেয়, কেউ প্যান্টখানা

নামিয়ে ফেলতে চায়, কেউ জিভ বের করে নাড়ায়, কেউ খুশিতে মরা তেলাপোকা ঢুকিয়ে দেয় শার্টের পকেটে। সুরঞ্জন লজ্জায় মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিল, তার চোখ উপচে জল নামছিল, গরুর মাংস খেয়ে তার এতটুকু গ্লানি হচ্ছিল না, গ্লানি হচ্ছিল তাকে ঘিরে জান্তব উচ্ছ্বাস দেখে। সে খুব বিচ্ছিন্ন বোধ করছিল। তার মনে হচ্ছিল যেন সে এদের বাইরে, এই বন্ধুরা একরকম মানুষ, আর সে আরেকরকম। বাড়ি ফিরে সে কী কান্না সুরঞ্জনের। সুধাময়কে বলল–ওরা আমাকে ষড়যন্ত্র করে গরুর মাংস খাইয়েছে।

শুনে সুধাময় হেসে বলেছিলেন-এর জন্য কাঁদতে হয় নাকি? গরুর মাংস তো ভাল খাবর। কালই আমি বাজার থেকে কিনে আনিব, সবাই মিলে খাব, দেখিস।

পরদিন সত্যি সত্যি গরুর মাংস কিনে এনেছিলেন সুধাময়। কিরুণাময়ী রেঁধেছিলেন সেই মাংস ৷ সহজে কি রাঁধতে চান। অর্ধেক রাত পর্যন্ত সুধাময় বুঝিয়েছিলেন এসব কুসংস্কারের কোনও অর্থ নেই, অনেক বড় বড় মনীষী এইসব সংস্কার মানতেন না, আর যাই বল মাংসটা তো টেস্টি। ঝাল ফ্রাইও করতে পারো। সুরঞ্জনের ধীরে ধীরে কেটেছিল ছোটবেলার লজ্জা, ভয়, ক্ষোভ, সংস্কার। পরিবারের শিক্ষক ছিলেন সুধাময়। সুরঞ্জনের মনে হয় তার বাবা অতিমানব গোছের কিছু হবেন। এত সততা, এত সারল্য, এত সুস্থ চিন্তা, গভীর বোধ ও ভালবাসা, এত অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আজকাল কেউ বাঁচে না।

সুরঞ্জন পত্রিকাটি ছুঁয়েও দেখে না। আলগোছে সরে যায় সুধাময়ের ঘর থেকে। তার ইচ্ছে করে না পত্রিকার ওপর ঝুঁকে থাকতে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিপক্ষে বুদ্ধিজীবীদের গীতি পড়বে, শক্তি মিছিলের ছবি দেখবে, আর প্রাণে তার আস্থার সুবাতাস বইবে এ স্পর্কবারেই অপছন্দ সুরঞ্জনের। সে বরং বেড়ালটিকে খুঁজতে থাকে। জাতছাড়া একটি বেড়াল! বেড়ালের তো জাত নেই, সম্প্রদায় নেই। সেও যদি একটি বেড়াল হতে পারত।

 

৩গ.

ক্যাম্প থেকে কদিন পর ফিরেছিলেন সুধাময়, সাতদিন? ছ’দিন? তাঁর খুব পিপাসা পেয়েছিল। এত পিপাসা যে সে হাত পা বাঁধা, চোখও বাঁধা, তবু তিনি গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছিলেন যদি কোনও মাটির কলসের দিকে যাওয়া যায়। ক্যাম্পে কলস কোথায় পাবেন, দূরে ব্ৰহ্মপুত্রের জল ছলাৎ ছলাৎ করে, ঘড়ায় কোনও জল তোলা নেই। সুধাময়ের বুক, জিভ শুকিয়ে কাঠ হয়ে থাকত। জল জল বলে যখন কাতরাতেন সুধাময়, মিলিটারিগুলো ইতি শব্দ করে হাসত। একদিন অবশ্য জল দিয়েছিল ওরা, সুধাময়ের চোখের পট্টি খুলে দিয়ে দেখিয়ে দেখিয়ে একটি ঘটিতে পেচ্ছাব করেছিল দুটো মিলিটারি, সেই ঘটির পেচ্ছাব সুধাময়ের মুখে ঢালতে নিলে তিনি সরিয়ে ফেলেছিলেন মুখ ঘূণায়, কিন্তু মুখটিকে হাঁ করিয়ে রাখলো শক্ত দুটো হাত দিয়ে একজন, আর আরেকজন ঢালল, হো হো করে হেসে উঠেছিল ক্যাম্পের বাকি মিলিটারি। নোনা গরম জল তাঁর গলা বেয়ে নামছিল, মনে মনে তিনি তাঁর প্রকৃতির কাছে বিষ চাইছিলেন। ওরা কড়িকাঠে ঝুলিয়ে পিটিয়েছিল তাঁকে। পেটাতে পেটতে বারবারই বলছিল মুসলমান হতে। কলমা পড়ে মুসলমান হতে। অ্যালেক্স হ্যালির রুটস-এ কালো ছেলে কুণ্টা কিন্টেকে যেমন তার নাম টোবি বলবার জন্য যারা চাবুক মারছিল পিঠে, তাদের সে বারবারই বলছিল তার নাম কুন্টা কিন্টে। সুধাময় যখন কিছুতেই মুসলমান হতে চাইলেন না, মুসলমান যখন হাবই ন এই নে তোর মুসলমানি করে দিলাম বলে ওরা একদিন লুঙ্গি তুলে খচ করে কেটে ফেলল তাঁর পুরুষাঙ্গ। ওটি ধরে পেচ্ছাব খাওয়াবার দিন যেমন হেসেছিল, তেমন অদ্ভুত কণ্ঠে হেসে উঠল। সুধাময় সম্ভবত জ্ঞান হারিয়েছিলেন সে মুহুর্তে। বেঁচে ফিরবেন এরকম আশা তিনি করেননি, যে হিন্দুরা চোখের সামনে বাঁধা ছিল, তারা কলমা পড়ে মুসলমান হতে চাইল, তবুও তারা প্ৰাণে বাঁচল না, সুখময়কে আমূল মুসলমানি করুবার করুণায় হয়ত বাঁচিয়ে দিল ওরা। ওরকম বেঁচে এসে তাঁর নালিতবাড়ি যাবার প্রোগ্রাম গেল ধসে।

ডাকবাংলোর ড্রেনের কাছে পড়ে থাকা দেহটি সজাগ হয়ে দেখেছিল গা থেকে রক্ত গড়াচ্ছে, কিন্তু মরেনি। সেই পা পাঁজর ভাঙা শরীর নিয়ে কী করে ব্ৰাহ্মাপল্লী অবধি এসেছিলেন ভাবলে এখনও তিনি অবাক হন, ওই ভেতরের শক্তিই সম্ভবত তাঁকে এখনও অনড় রেখেছে। বাড়ি ফিরে কিরুণাময়ীর সামনে মুখ থুবড়ে পড়েছিলেন সেদিন। দেখে থর/থার কেঁপেছিলেন কিরণময়ী। কিরণময়ীই তাঁকে পার করে নিয়ে এসেছিলেন, রাড়িঘর ফেলে ব্ৰহ্মপুত্রের ফেরি পার হলেন তিনি, সঙ্গে অবাধ দুটো শিশু ক্ষণে ক্ষণে কেঁদে উঠছিল, কিরণময়ী কাঁদতে পারেননি, সব কান্না তাঁর জমা ছিল বুকের ভেতর। ফয়জুলের মা প্রায়ই তাঁকে বলতেন—’মৌলভি ডাকি, কলমা পড়ে মুসলমান হয়ে যান, সওয়াব হবে। মায়ার বাবাকে বোঝান।’ কিরণময়ী তখনও কাঁদেননি। আটকে রেখেছিলেন। গভীর গোপন বেদনাগুলো, বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেলে শাড়ির আঁচল কেটে সুধাময়ের ক্ষতে ব্যান্ডেজ করে দিতেন, তখনও কর্মীদেননি; কেঁদেছিলেন তখন যখন সারা গ্রাম জুড়ে উৎসব শুরু হল আনন্দের, জয় বাংলার, তখন গ্রামের লোকে কী বলবে কিছু না ভেবেই কিরণময়ী সুধাময়ের বুকে পড়ে বুকের সব জমানো কান্না কেঁদেছিলেন। শিশুর মত গলা ছেড়ে কেঁদেছিলেন।

এখন কিরণময়ীর দিকে চোখ পড়তেই সুধাময়ের মনে হয় সে ভেতরে ভেতরে একাত্তরের ন’ মাসের মত কাল্লা জমাচ্ছে। হঠাৎ একদিন সব কান্না সে কাঁদবে, হঠাৎ একদিন তাঁর দুঃসহ স্তব্ধতা কাটবে। ভেতরে কালো মেঘের মত দুঃখ জমছে। একদিন জল হযে বৃষ্টি হয়ে ঝরবে সব, কবে জয় বাংলার মত স্বাধীনতার সংবাদ তাদের কানে আসবে। কবে খবর আসবে শাঁখা সিঁদুর পরুবার, ধুতি পরুবার অবাধ স্বাধীনতার। কবে কািটৰে একাত্তরের মত দম বন্ধ করা দুৰ্য্যেগের দীর্ঘ রাত? সুধাময় লক্ষ করছেন কোনও রোগীও আর আসছে না। তাঁর কাছে; দিনে ছ সাতটি রোগী তো ঝড়-বৃটির দিনেও হত। সারাদিন ঘরে বসে থাকতে ভাল লাগে না সুধাময়ের, খানিক পর পর মিছিল যায় ‘নারীয়ে তকবির আল্লাহু আকবার, হিন্দু যদি বাঁচতে চাণ্ড, এ দেশ ছেড়ে চলে যাও।’ যে কোনও সময় বোমা পড়তে পারে বাড়িতে, যে কোনও সময় আগুন লাগিয়ে দেবে মীেলাবাদীরা, যে কোনও সময় লুট হয়ে যাবে বাড়ি, খুন হয়ে যাবে বাড়ির যে কেউ। হিন্দুরা কি চলে যাচ্ছে, নব্বই-এর পর সুধাময় জানেন অনেকে দেশ ছেড়েছে, নতুন সেনসাসে হিন্দু মুসলমান আলাদা আলাদা করে গোনা হয়নি, হলে দেশ ছেড়ে গেছে কত হিন্দু তা স্পষ্ট হত। বইয়ের তাকে ধুলো জমে গেছে। সুধাময় কুঁ দিয়ে ধুলো পরিষ্কার করেন। স্কুলো কি যায়! পাঞ্জাবির খুঁট দিয়ে ধুলো মুছতে মুছতে চোখে পড়ে। বাংলাদেশ সরকারের পরিসংখ্যান ঝুরোর পরিসংখ্যান বর্ষগ্রন্থটি। উনিশ’শ ছিয়াশির পরিসংখ্যান। চুয়াত্তর এবং একাশি সনের হিসেবে। চুয়াত্তরে পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট জনসংখ্যা ছিল পাঁচ লক্ষ আট হাজার, একাশিতে দাঁড়াল পাঁচ লক্ষ আশি হাজার। চুয়াত্তিরে সেখানে মুসলমান ছিল ছিয়ানব্বই হাজার, একাশিতে হল এক লক্ষ অষ্টআশি হাজার। চুয়াত্তিরে ছিন্দু ছিল তোপ্পান্ন হাজার, একাশিতে হল ছেষট্রি হাজার। মুসলমান বৃদ্ধির হার ৯৫.৮৩%, হিন্দু বৃদ্ধির হার ২৪.৫৩%,। কুমিল্লায় চুয়াত্তিরে মুসলমানের সংখ্যা ছিল বাহান্ন লক্ষ পঞ্চাশ হাজার, একাশিতে দাঁড়াল ছেষট্টি লক্ষ, হিন্দু ছিল পাঁচ লক্ষ চৌষট্টি হাজার, একাশিতে ছিল পাঁচ লক্ষ পয়ষট্টি হাজার। মুসলমান বৃদ্ধির হার ২০.১৩%। হিন্দু বৃদ্ধির হার ০-১৮% ৷ ফরিদপুরে জনসংখ্যা চুয়াত্তর থেকে একাশিতে বৃদ্ধি পেয়েছে ১৭.৩৪%। মুসলমান সংখ্যা ছিল একত্ৰিশ লক্ষ, একাশিতে এসে হল আটত্রিশ লক্ষ বাহান্ন হাজার। বৃদ্ধির হার ২৪.২৬%। নয় লক্ষ চুয়াল্লিশ হাজার ছিল চুয়াত্তিরের হিন্দু সংখ্যা, একাশিতে দাঁড়াল আট লক্ষ চুরানব্বই হাজার। বৃদ্ধির হার (-)৫.৩৫%,। পাবনার জনসংখ্যা চুয়াত্তর থেকে একাশিতে বেড়েছে ২১.১৩%। পঁচিশ লক্ষ ছেচল্লিশ হাজার মুসলমান ছিল চুয়াত্তরে, একাশিতে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল একত্রিশ লক্ষ সাতষট্টি হাজার। বৃদ্ধির হার ২৪-৩৯% ৷ এদিকে হিন্দু ছিল দুই লক্ষ ষাট হাজার, একাশিতে হল দুই লক্ষ একান্ন হাজার। বৃদ্ধির হার (-)৩-৪৬%,। রাজশাহী জেলায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২৩.৭৮ % ৷ মুসলমান বেড়েছে। ২৭।২০%। হিন্দু ছিল চুয়াত্তিরে পাঁচ লক্ষ আটান্ন হাজার। একাশিতে হল পাঁচ লক্ষ তিন হাজার। হিন্দু বৃদ্ধির হার (-)৯.৬৮%,। পরিসংখ্যান গ্রন্থটির ১১২ নম্বর পৃষ্ঠায় সুখময় দেখলেন একটি হিসেব লেখা : ১৯৭৪ সনে হিন্দু জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার শতকরা সাড়ে তের ভাগ ছিল। ১৯৮১ সনে হিন্দুরা মোট জনসংখ্যার ১২.১ ভাগ। বাকি হিন্দু যাচ্ছে কোথায়? সুধাময় চশমার কাচ পরিষ্কার করেন জামার হাতায়। তরে কি ওরা চলে যাচ্ছে? কেন চলে যাচ্ছে? চলে যাওয়াতেই কি আসল মুক্তি? দেশে থেকে লড়াই করা কি উচিত ছিল না? সুধাময়ের আবার ইচ্ছে করে পালিয়ে যাওয়া হিন্দুদের কাওয়ার্ড বলে গাল দিতে।

তাঁর শরীরটা ভাল লাগছে না। পরিসংখ্যানের বই হাতে নেওয়ার পর থেকে তিনি লক্ষ করছেন ডান হাতটি দুর্বল লাগছে। বইটি তাকে উঠিয়ে রাখতে গিয়েও দেখেন আগের মত জোর পাচ্ছেন না হাতে। কিরণময়ীকে ডাকেন। তিনি, ডাকতে গিয়ে লক্ষ করেন জিভখানাও ভরি লাগছে। নীল নেকড়ের মত একটি আশঙ্কা তাঁর দরজায় দাঁড়ায়। নাছোড়বান্দা নেকড়ে। হাঁটতে গিয়েও লক্ষ করেন তাঁর ডান পায়ে আগের জোর নেই। ডাকেন—কিরণ! ও কিরণ!

কিরণময়ী ডাল বসিয়েছেন চুলোয়। নিঃশব্দে দাঁড়ান এসে সামনে। সুধাময় ডান হাত বাড়তে চান কিরণাময়ীর দিকে। হাতটি ঢলে পড়ে যায়। —কিরুণ, আমাকে বিছানায় শুইয়ে দাও তো।

কিরুণাময়ীও ঠিক বুঝতে পারেন না হয়েছে কী। মানুষটি এভাবে কাঁপছেন কেন। কথাই বা জড়িয়ে যাচ্ছে কেন। তিনি শোবার ঘরের বিছানায় শুইয়ে দেন সুধাময়কে। –হয়েছে কি তোমার?

—সুরঞ্জন কোথায়?

—এই তো বেরিয়ে গেল। কথা শুনল না।

–আমার ভাল লাগছে না কিরণ। কিছু একটা কর।

—তোমার কথা জড়াচ্ছে কেন? কি হয়েছে?

—ডান হাতে জোর পাচ্ছি না। ডান পায়েও না। তবে কি কিরণময়ী প্যারালাইসিস হয়ে যাচ্ছে?

কিরণময়ী দুহাতে জাপটে ধরেন সুধাময়ের দুটো বাহু। বলেন—বালাই ষাট। দুর্বলতা থেকে হচ্ছে গো, ঘুম হচ্ছে না রাতে। তাই বোধহয়। খাওয়া-দাওয়াও করছ না।

সুধাময় ছটফট করেন। অস্থিরতা তাঁর সারা শরীরে। তিনি বলেন–দেখ তো কিরণ, আমি মরে যাচ্ছি কি না। আমার এমন লাগছে কি না।

—কাকে ডাকব? হরিপদবাবুকে ডাকব একবার?

সুধাময় বাঁ হাতে খামচে ধরেন কিরণময়ীর হাত। —যেও না, আমার কাছ থেকে নড়ো না কিরণ। মায়া কোথায়?

—ও তো সেই যে গেছে। পারুলের বাড়ি। ফেরেনি।

—আমার ছেলে কোথায় কিরণ? আমার ছেলে?

—কি পাগলের মত কথা বলছি।

—কিরণ দরজা জানালাগুলো খুলে দাও।

—দরজা জানালা কেন খুলব?

—আমার একটু আলো চাই। বাতাস চাই।

—হরিপদবাবুকে ডেকে আনি। তুমি চুপচাপ শুয়ে থাকো।

—ওই হিন্দুগুলো পালিয়েছে বাড়ি ছেড়ে, ওদের পাবে না। মায়াকে ডাকো।

—খবর পাঠাবো কাকে দিয়ে বল। কেউ তো নেই।

—তুমি একচুল নড়ো না কিরণ। সুরঞ্জনকে ডাকো।

সুধাময়। এরপর বিড়বিড় করে কী বলেন কিছু বোঝা যায় না। কিরণময়ী কেঁপে ওঠেন। তিনি কি চিৎকার করে পাড়ার লোক ডাকবেন? দীর্ঘ বছর ধরে পাশাপাশি থাকা পড়শি কাউকে? হঠাৎ দমে গেলেন তিনি পড়শি কে আছে যে আসবেন? হায়দার, গৌতম বা শফিক সাহেবদের বাড়ির কাউকে? বড় অসহায় বোধ করেন কিরণময়ী। ডাল পুড়ে পোড়া গন্ধে আর ধোঁয়ায় ঘর ভেসে যায়।

 

৩ঘ.

সুরঞ্জন আজও কোথায় যাবে কোনও ঠিক নেই। একবার ভাবে বেলালের বাড়ি যাবে। কাকরাইল পার হয়ে ডানেই দেখে জলখাবার নামের দোকানটি ভাঙা। রাস্তায় দোকানের টেবিল চেয়ার এনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, পোড়া কাঠকয়লা আর ছাই জমে আছে। সুরঞ্জন দেখে, যতক্ষণ দেখা যায়। চামেলিবাগে পুলকের বাড়িও। সুরঞ্জন হঠাৎই তার ইচ্ছে পাল্টায়। পুলকের বাড়িতে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। রিক্সাকে বাঁয়ের গলিতে যেতে বলে। পুলক একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকে। এন জি ও-তে চাকরি করে। অনেকদিন দেখা হয় না। ওর সঙ্গে। পাশেই বেলালের বাড়ি আডিডা দিতে সে প্রায়ই আসে। অথচ কলেজ জীবনের বন্ধু পুলকের খোঁজ নেওয়ার সময়ই তার হয় না।

কলিং বেল বাজে। ভেতর থেকে কোনও শব্দ আসে না। একটানা কলিং বেল বাজিয়েই চলে সুরঞ্জন। ভেতর থেকে ক্ষীণ কণ্ঠে শব্দ হয়—কে?

–আমি সুরঞ্জন।

—কোন সুরঞ্জন?

–সুরঞ্জন দত্ত। ভেতর থেকে তালা খুলবার শব্দ হয়। পুলক নিজেই দরজা খুলে দেয়। চাপা কণ্ঠে বলে-ঢুকে পড়।

—কি ব্যাপার এত প্রোটেকশনের ব্যবস্থা কেন? ডোর ভিউ লাগালেই পারো।

পুলক আবার তালাটি লাগায় দরজায়। টেনে দেখেও নেয় ঠিকমত লাগল কিনা ৷ সুরঞ্জন বেশ চমকিত হয়। পুলক চাপা স্বরে আবার জিজ্ঞেস করে—তুমি বাইরে বেরিয়েছ যে?

—ইচ্ছে করেছে।

—মানে? ভয়ডর নেই নাকি? সাহস দেখিয়ে প্রাণটা খোয়াতে চাও? নাকি এডভেঞ্চারে বেরিয়েছ?

সুরঞ্জন সোফায় শরীর ছেড়ে দিয়ে বলে—যা ভাবো তাই।

পুলকের চোখের মণিতে আশঙ্কা কাঁপে। সেও পাশের সোফায় এসে বসে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। বলে-খবর রাখছ তো সব?

—নাহ।

—ভোলায় তো খুব খারাপ অবস্থা। তাজমুদ্দিন, বোরহানউদ্দিন থানার গোলকপুর, ছোট ডাউরি, শম্ভুপুর, দাসের হাট, খাসের হাট, দরিরামপুর, পদ্মামন আর মনিরাম গ্রামের দশ হাজার পরিবারের প্রায় পঞ্চাশ হাজার হিন্দু সর্বস্বাস্ত হয়েছে। লুটেপুটে আগুন লাগিয়ে ভেঙেচুরে সব শেষ করে দিয়েছে রে। পঞ্চাশ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। মরেছে দুজন, আহত দুশ। লোকের পরনে কাপড় নেই, পেটে ভাত নেই। একটি ঘরাও আর বাকি নেই। আগুন ধরাতে। শত শত দোকান লুট হয়েছে। দাসের হাট বাজারের একটি হিন্দুর দোকানও নেই। আর। ঘরবাড়িহারা মানুষগুলো এই প্রচণ্ড শীতে খোলা আকাশের নীচে দিন কাটাচ্ছে। শহরের মদনমোহন ঠাকুরবাড়ি, মন্দির, লক্ষ্মীগোবিন্দ ঠাকুরবাড়ি, তার মন্দির, মহাপ্রভুর আখড়া লুট করে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। বোরহানউদ্দিন, দৌলতখান, চরফ্যাশন, তাজমুদ্দিন, লালমোহন থানার কোনও মন্দির, কোনও আখড়ার অক্তিত্ব নেই। সব ঘরবাড়িতে লুট হয়, আগুন ধরানো হয়। ঘুইন্যার হাট বলে এক এলাকায় প্রায় দু মাইল জুড়ে হিন্দুদের ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। দৌলতখান থানার বড় আখড়াটি সাত তারিখ রাতে জ্বলিয়ে দিয়েছে। বোরহানউদ্দিন বাজারের আখড়া ভেঙে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। কুতুবা গ্রামের পঞ্চাশটি বাড়ি ছাই করে দিয়েছে। চরফ্যাশন থানায় হিন্দুদের বাড়িঘর লুট করেছে। অরবিন্দ দে নামের একজনকে ছুরিও মেরেছে।

–নীলা কোথায়?

—ও তো ভয়ে কাঁপছে। তোমার অবস্থা কি?

সুরঞ্জন সোফায় আরাম করে বসে চোখ বন্ধ করে। সে ভাবে পাশেই বেলালের বাড়ি না গিয়ে আজ সে পুলকের বাড়ি এল কেন। সে কি ভেতরে ভেতরে কম্যুনাল হয়ে উঠছে, নাকি পরিস্থিতি তাকে কম্যুনাল করছে।

—বেঁচে আছি, এইটুকুই বলতে পারি।

মেঝোয় শুয়ে পুলকের ছ’বছরের ছেলে কাঁদছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। পুলক বলে ও কাঁদছে কেমন জানো? পাশের ফ্ল্যাটের বাচ্চারা, যাদের সঙ্গে খেলত ও, আজ থেকে অলককে খেলায় নিচ্ছে না। বলছে তোমাকে খেলায় নেব না, হুজুর বলেছেন হিন্দুদের সঙ্গে না মিশতে।

—হজুর মানে? সুরঞ্জন প্রশ্ন করে।

—হুজুর হচ্ছে সকলে মৌলভি আসে আরবি পড়াতে সেই লোক।

—পাশের ফ্ল্যাটে আনিস আহমেদ থাকে না? সে তো কমিউনিস্ট পার্টি করে, সে তার বাচ্চাদের হুজুর দিয়ে আরবি পড়ায়?

—হ্যাঁ। পুলক বলে।

সুরঞ্জন আবার চোখ বোজে। সে অলক হয়ে নিজেকে অনুভব করে। অলকের গ কেঁপে কেঁপে ওঠা কান্না তার বুকেও নিঃশব্দে বাজে। তাকেও যেন কেউ খেলায় নিচ্ছে না। এতকাল যাদের সঙ্গে সে খেলেছিল, যাদের সঙ্গে খেলবে বলে ভেবেছিল, তারা তাকে খেলায় নিচ্ছে না। হুজুরেরা বলেছে হিন্দুদের খেলায় নিতে নেই। সুরঞ্জনের মনে পড়ে মায়া একবার স্কুল থেকে কেঁদে কেঁদে বাড়ি ফিরেছিল। বলেছিল—আমাকে ক্লাস থেকে বার করে দেয় টিচার।

আসলে ক্লাসের পাঠ্য বিষয়গুলোয় ধর্ম একটি বাধ্যতামূলক বিষয় ছিল। ইসলামিয়াত ক্লাসে তাকে ক্লাস থেকে বের করে দেওয়া হত। সে একা একটি হিন্দু মেয়ে, তার বইও ছিল না, তার জন্য আলাদা হিন্দু মাস্টােরও ছিল না। স্কুলে, সে একা একটি হিন্দু মেয়ে বারান্দার রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকত, বড় এক বড় নিঃসঙ্গ, বড় বিচ্ছিন্ন মনে হত নিজেকে তার।

সুধাময় জিজ্ঞেস করেছিলেন-কেন, কেন তোমাকে ক্লাস থেকে বার করে দেয়?

—সবাই ক্লাস করে। আমাকে নেয় মা, আমি হিন্দু তো, তই।

সুধাময় বুকের মধ্যে জাপটে ধরেছিলেন মায়াকে। অপমানে, বেদনায় তিনি অনেকক্ষণ কোনও কথা বলতে পারেননি। সেদিনই তিনি স্কুলের ধর্ম টিচারের বাড়ি গিয়ে বলেন–’আমার মেয়েকে ক্লাসের বাইরে পাঠাবেন না, ওকে কখনও বুঝতে দেবেন না ও আলাদা কেউ। * মায়ার মানসিক সমস্যা ঘুচল, কিন্তু ওকে আবার আলিফ বে তে সোর মোহে পেয়ে বসল। বাড়িতে খেলা করতে করতে আনমনে সে বলতে থাকে—’আলহামদুলিল্লাহ হি, রাব্বিল আল আমিন, আঁর রাহমানির রহিম। * শুনে কিরণময়ী সুধাময়কে ধরতেন—‘এসব করছে কি ও? নিজের জাত ধর্ম বিলিয়ে এখন স্কুলে লেখাপড়া করতে হবে নাকি? সুধাময়ও চিন্তিত হলেন। মেয়ের মানসিক অবস্থা সুস্থ রাখতে গিয়ে মেয়ে যদি ইসলাম ধর্মে আসক্ত হয়ে পড়ে তবে তো অসুবিধে আরও নতুন করে বাঁধিল। ওই ঘটনার সপ্তাহ খানিকের মধ্যে স্কুলের হেড মাস্টারের কাছে একটি দরখাস্ত লিখলেন যে ধর্ম হচ্ছে ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার, এটি স্কুলের পাঠ্য হওয়া জরুরি নয়। তা ছাড়া আমি যদি আমার সন্তানকে কোনও ধর্মে শিক্ষিত করবার প্রয়োজন মনে না করি। তবে তাকে স্কুল কর্তৃপক্ষ কখনও জোর করে ধর্ম শেখাবার দায়িত্ব নিতে পারেন না। আর ধর্ম নামক বিষয়টির পরিবর্তে মনীষীদের বাণী, মহৎ ব্যক্তিদের জীবনী ইত্যাদি সম্পর্কে সকল সম্প্রদায়ের পাঠ্য একটি বিষয় রচনা করা যায়, তাতে সংখ্যালঘুদের হীনমন্য ভাবটি দূর হয়। সুধাময়ের এই আবেদনে স্কুল কর্তৃপক্ষ সাড়া দেননি। যেভাবে চলছিল; সেভাবেই চলছে।

নীলা আসে। ছিপছিপে শরীর তার, সুন্দরী। সেজেগুজে থাকে। আজ তার আলুথালু বেশ। চোখের নীচে কালি, উদ্বিগ্ন চোখ, সে এসেই জিজ্ঞেস করে-সুরঞ্জনদা, কতদিন আসেন না, খবর নেন না, বেঁচে আছি কি মরে গেছি জানতেও আসেন না। খবর পাই পাশের বাড়িতেই আসেন। বলতে বলতে নীলা হঠাৎ কেঁদে ওঠে।

সুরঞ্জন আসে না বলে কেঁদে উঠবে কেন নীলা? সে কি তার সম্প্রদায়ের অসহায়ত্বের জন্মই কেঁদে উঠল, যেহেতু কষ্ট যা ধারণ করে এখন নীলা, একই বেদনা বা নিরাপত্তাহীনতা সুরঞ্জনকেও ধারণ করতে হয়? সে তা বোঝে বলে নিজের অসহায়বোধের সঙ্গে পুলক, অলক এবং সুরঞ্জনের বোধকেও সে নিদ্বিধায় মিলিয়েছে। এই পরিবারটিকে বড় আপন মনে হচ্ছে সুরঞ্জনের। বেলালের বাড়িতে চার-পাঁচ দিন আগেও আড্ডা দিয়েছে সুরঞ্জন, এ বাড়িতে আসবার প্রয়োজনই বোধ করেনি। এই বোধ তার নতুন করে জন্ম নিচ্ছে।

—ভূমি এত ন্যাভাস হচ্ছে কেন? ঢাকায় বেশি কিছু করতে পারবে না। পুলিশ পাহারা আছে শাঁখারি বাজারে, ইসলামপুরে, তাঁতিবাজারে।

-পুলিশ তো গতবারও দাঁড়িয়ে ছিল, তারা ঢাকেশ্বরী মন্দির লুট করুল, আগুন ধরাল পুলিশের সামনে, পুলিশ কিছু করল?

一হুঁ।

—আপনি রাস্তায় বেরোলেন কেন? কোনও বিশ্বাস নেই মুসলমানদের। ভাবছেন বন্ধু, দেখবেন সেই আপনার গলা কেটে ফেলে রাখিল।

সুরঞ্জন আবার চোখ বন্ধ করে। দু চোখ বন্ধ করে রাখলে কি অন্তৰ্জােলা কিছু কমে! বাইরে কোথায় যেন হইচই হচ্ছে, বোধহয় কোনও হিন্দুর দোকান ভাঙছে, পুড়ছে। চোখ বন্ধ করলেই পোড়া পোড়া গন্ধ নাকে লাগে। চোখ বন্ধ করলেই দা কুড়োল রামদা হাতে ধেয়ে আসা মৌলবাদীর দল মনে হয় চোখের সামনে নাচছে। গত রাতে গৌতমকে দেখতে গিয়েছিল সে, শুয়ে আছে, চোখের নীচে, বুকে পিঠে কালশিরে দাগ। ওর বুকে হাত রেখে বসেছিল সুরঞ্জন। কিছু জিজ্ঞেস করেনি, যে স্পর্শ সে রেখেছিল, এসে স্পর্শের পর কথা বলবার দরকার পড়ে না। গৌতমই বলেছিল–‘দাদা, আমি কিছুই করিনি। ওরা মসজিদ থেকে দুপুরের নামাজ সেরে বাড়ি ফিরছিল, বাড়িতে বাজার নেই। কিছু, মা বললেন ডিম কিনে আনতে। পাড়ার দোকান ভয় কী, আমি তো আর দূরে কোথাও যাচ্ছি। না। ডিম হাতে নিয়ে টাকা ফেরত নিচ্ছি, হঠাৎ পিঠের পেছনে দুম করে লখি এসে পড়ে। ওরা ছসৈাতজন ছেলে, আমি একা কী করে পারি! দোকানঅলা, রাস্তার লোকেরা দূর থেকে মজা দেখল, কিছু বলল না। আমাকে কোনও কারণ ছাড়াই মারল ওরা, নীচে ফেলে মারল। বিশ্বাস কর কিছু বলিনি আমি ওদের। ওরা বলছিল—’হিন্দু শালা, মালাউনের বাচ্চা, শালাকে মেরে শেষ করে দেব। আমাদের মসজিদ ভেঙে পার পেতে চাস তোরা। তোদের দেশ থেকে তাড়াবই।’ সুরঞ্জন শোনে শুধু কিছু যে বলবে, খুঁজে পায় না। গৌতমের বুকের টিপচিপ শব্দ অনুভূত হয় তার হাতে। এই শব্দ সে কি তার বুকেও বাজতে শুনেছে? বোধহয় শুনেছে। দু-একবার।

নীলা চা আনে। চা খেতে খেতে মায়ার কথা ওঠে।

—মায়াকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা হয়। সে আবার হুট করে জাহাঙ্গীরকে বিয়েই করে বসে কি না।

—সে কী সুরঞ্জনদা? এখনও ফেরান ওকে। দুঃসময়ে মানুষ ঝটি করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে।

—দেখি যাবার পথে পারুলের বাড়ি থেকে ওকে নিয়ে যাব। মায়াটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বেঁচে থাকবার প্রচণ্ড লোভে ও বোধহয় ফরিদা বেগম জাতীয় কিছু একটা হয়ে যাবে। সেলফিস।

নীলার চোখে নীল দুশ্চিন্তা খেলা করে। অলক কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেছে, গালে তার চোখের জলের দাগ। পুলক পায়চারি করে, ওর অস্থিরতা সুরঞ্জনকেও স্পর্শ করে। চায়ের মত চা পড়ে থাকে, জুড়িয়ে জল হয়ে যায়। সুরঞ্জনের চায়ের পিপাসা ছিল, কোথায় যে উবে যায় সব পিপাসা। সে চোখ বুজে ভাবতে চায় দেশটি তার, তার বাবার, তার ঠাকুরদার, ঠাকুরদারও ঠাকুরদার দেশ। এটি। সে কেন তবু বিচ্ছিন্ন বোধ করছে! কোন মনে হয় এই দেশে তার কোনও অধিকার নেই!

তার চলবার, বলবার, যা কিছু পরবার, ভাববার অধিকার নেই। তাকে সিঁটিয়ে থাকতে হবে, লুকিয়ে থাকতে হবে, তার যখন ইচ্ছে বেরোনো চলবে না, যা কিছু করা চলবে না। গলায় ফাঁস পরালে যেমন লাগে মানুষের, সুরঞ্জনের তেমন লাগে। সে নিজেই নিজের দুহাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে কণ্ঠদেশ। শ্বাস তার কিছু রোধ হয় কী হয় না। সে হঠাৎ চেচিয়ে ওঠে—আমার কিছু ভাল লাগছে না পুলক ৷

পুলকের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। এই শীতেও ঘাম জমে কেন? সুরঞ্জনের হাত নিজের কপালেও ওঠে। সে অবাক হয় তার কপালেও ঘাম জমেছে। ভয়ে? কেউ তো তাদের ধরে পেটাচ্ছে না। মেরে ফেলছে না। তবু কোন ভয় হয়, বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দ হয়?

সুরঞ্জন ফোনের ডায়াল ঘোরায়। দিলীপ দে, এক সময়ের তুখোড় ছাত্র নেতা, ওর নম্বরটি মনে পড়ে হঠাৎ। বাড়িতেই ছিলেন দিলীপ দে।

—কেমন আছেন দাদা? কোনও অসুবিধে নেই তো? কিছু ঘটেনি তো?

—অসুবিধে নেই, কিন্তু মনে স্বস্তি পাচ্ছি না। আর আমারই ঘটতে হবে কেন? সারা দেশেই তো ঘটছে।

—তা ঠিক।

—তুমি কেমন আছ? চট্টগ্রামের অবস্থা তো শুনেছ নিশ্চয়ই?

—কি রকম?

—সন্দ্বীপ থানায় বাউরিয়ায় তিনটে, কালাপানিয়ায় দুটো, মগধরায় তিনটে, টেউরিয়ায় দুটো, হরিশপুরে একটি, রহমতপুরে একটি, পশ্চিম সারিকাইতে একটি, মাইটভাঙায় একটি মন্দির ধ্বংস করেছে। পশ্চিম সারকাইতে সুচারু দাস নামের এক লোককে মারধাের করে পনেরো হাজার টাকা নিয়ে যায়। টোকাতলিতে দুটো বাড়ি লুট করে দুজনকে ছুরি মেরেও গেছে। পটিয়া থানার কচুয়ায় একটি বাড়ি, ভাটিকাইনে একটি মন্দির…

—আপনি এমন একটি দুটির হিসেব পেলেন কোথায়?

—আরে আমি চিটাগাঙের ছেলে না? ওসব এলাকায় কি হচ্ছে খবর না নিলেও খবর চলে আসে। শোন, বাঁশখালি থানার বইলছড়িতে তিনটে, পূর্ব চাম্বলে তিনটে বাড়ি ভেঙে ফেলা হয়েছে। রাঙ্গুনিয়া থানায় সরফভাটা ইউনিয়নে পাঁচটি ঘর, পায়রা ইউনিয়নে সাতটি ঘর, শিলক ইউনিয়নে একটি মন্দির, চন্দনাইশ থানায় বাদামতলিতে একটি মন্দির, জোয়ারার একটি মন্দিরে লুটপাট করা হয়, ভাঙা হয়। আনোয়ারা থানার বোয়ালগাঁও-এ। চারটে মন্দির, একটি ঘর, তেগোটায় ষোলোটি বাড়িতে হামলা, লুট, ভাঙচুর সবই হয়। বোয়ালখালি থানার মেধস মুনির আশ্রমে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

—আমি কৈবল্যধাম, তুলসীধাম আশ্রম, অভয় মিত্র শ্মশান, শ্মশান কালীবাড়ি, পঞ্চাননধাম নিয়ে দশটি কালীবাড়ি যে পুরো জ্বলিয়ে দেওয়া হয়েছে শুনেছি। সুরঞ্জন বলে।

–সদরঘাট কালীবাড়ি, গোলপাহাড় শ্মশান মন্দিরেও হামলা হয়েছে। জামালখান রোড আর সিরাজউদ্দৌলা রোড়ে দোকান ভাঙচুর করা হয়। এনায়েত বাজার, কে সি দে রোড, ব্ৰিকফিল্ড রোডের হিন্দুদের দোকান ও বাড়ি লুট করে, আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। কৈবল্যধাম মালী পাড়ায় আটত্রিশটি বাড়ি, সদরঘাট জেলেপাড়ায় একশর ওপর বাড়ি লুট হয়েছে, আগুন ধরানো হয়েছে। ঈদগাঁও আগ্রাবাদ জেলেপাড়া আর বহদ্দারহাটে ম্যানেজার কলোনিতে লুটপাট করে, ভেঙেও ফেলে। সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে মীরেরসরাই আর সীতাকুণ্ডে। মীরেরসরাই-এর সাতবাড়িয়া গ্রামে পঁচাত্তরটি পরিবার, মসদিয়া ইউনিয়নে দশটি পরিবার, হাদিনগরে চারটি পরিবার, বেশরতে ষোলটি পরিবার, তিনটি মন্দির, ওদেয়পুরে বিশটি পরিবার, খাজুরিয়ায় বারোটি পরিবার, জাফরাবাদে সােতাশিটি পরিবারে হামলা হয়েছে। তাদের বাড়িঘর লুটপাট, ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। সীতাকুণ্ডের মুরাদপুর ইউনিয়নে একটি পরিবার, বারুইয়ার ঢালা ইউনিয়নের মহালঙ্কা গ্রামে তেইশটি পরিবার, বহরপুরে আশিটি পরিবার, বারইপাড়ায় তিনশ চল্লিশটি পরিবার, নারায়ণ মন্দির, বাঁশবাড়িয়ায় বারোটি পরিবার, বাড়বকুণ্ডে সতেরোটি পরিবার, দুটো মন্দির, ফরহাদপুরে চৌদ্দটি পরিবারে হামলা হয়েছে, লুট করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

–আর কত শুনব দিলীপদা, ভাল লাগছে না।

–তুমি কি অসুস্থ সুরঞ্জন? কণ্ঠস্বর কেমন যেন লাগছে।

–ঠিক বুঝতে পারছিনা।

ফোন ছাড়তেই পুলক বলে দেবব্রতর খবর নাও তো। সুরঞ্জন দেবব্রত, মহাদেব ভট্টাচাৰ্য, অসিত পাল, সজল ধর, মাধবী ঘোষ, কুন্তলা চৌধুরী, সরল দে, রবীন্দ্র গুপ্ত, নিখিল সানাল, নির্মল সেনগুপ্ত-কে এক এক করে ফোন করে। জানতে চায় ‘ভাল আছেন কি না।‘ অনেকদিন পর পরিচিত অনেকের সঙ্গে কথা হয়। এক ধরনের আত্মীয়তাও অনুভূত হয়।

ক্রিং ক্রিং বেজে ওঠে ফোনটি। সুরঞ্জনের কানের কাছে ক্রিংক্রিং শব্দটি দ্রিম দ্রিম হয়ে বাজে। তার অস্বস্তি হয়। পুলকের ফোন। কক্সবাজার থেকে। ফোনে কথা সেরে পুলক বলে–কক্সবাজারে জামাত শিবিরের লোকেরা জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে দিয়েছে।

সুরঞ্জন শোনে এবং নিজের নিলিপ্তি দেখে সে নিজেই অবাক হয়। এই খবর শুনে তার ক্ষোভে ফেটে পড়বার কথা। আজ মনে হচ্ছে এই পতাকা পুড়ে গেলে তার কিছু যায় আসে না। এই পতাকা তার নয়। সুরঞ্জনের এমন হচ্ছে কেন? এমন হচ্ছে বলে সে নিজেকে ধিক্কার দেয়, নিজেকে বড় ক্ষুদ্র মনে হয়, বড় নীচ, বড় স্বার্থপর, তবু তার নির্লিপ্তি কাটে না। পতাকা পুড়েছে বলে তার ভেতর যে ক্রোধ হওয়া উচিত ছিল, তার কিছুই হয় না।

পুলক সুরঞ্জনের কাছে এসে বসে। বলে—আজ আর যেও না। এখানেই থেকে যাও। বাইরে বেরোলে কখন কী বিপদ ঘটে বলা যায় না। এ সময় আমাদের কারও রাস্তায় বেরোনোটা ঠিক নয়।

গতকাল লুৎফর তাকে এ ধরনের একটি উপদেশ দিয়েছিল। সুরঞ্জন অনুভব করে পুলকের কণ্ঠের আন্তরিকতা আর লুৎফরের কণ্ঠের সূক্ষ্ম অহঙ্কার বা ঔদ্ধত্য।

নীলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে—দেশে বোধহয় আর থাকতে পারব না। আজ হয়ত কিছু হচ্ছে না, কাল হবে, পরশু হবে। কী ভীষণ অনিশ্চিত জীবন আমাদের। এর চেয়ে নিশ্চিত নিরাপদ দরিদ্র জীবন অনেক ভাল।

পুলকের প্রস্তাবে সুরঞ্জন রাজি প্রায় হয়েই যেত, কিন্তু সুধাময় এবং কিরণময়ীর কথা মনে পড়ায়, ওঁরা দুশ্চিন্তা করবেন ভেবে সুরঞ্জন উঠে যায়। বলে—যা হয় হবে। মুসলমানের হাতে না হয় শহীদ হলাম। কেওয়ারিশ লাশ পড়ে থাকবে জাতীয় ফুল শাপলার নীচে। লোকে বলবে ও কিছু না অ্যাকসিডেন্ট। কী বল? সুরঞ্জন হোসে ওঠে। পুলক আর নীলার মুখে হাসি খেলে না।

রাস্তায় নেমে একটি ক্লিক্সা পেয়ে যায় সুরঞ্জন, মাত্র আটটা বাজে, তার বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না। পুলক তার কলেজ জীবনের বন্ধু। বিয়ে করে চমৎকার সংসার সাজিয়েছে, তারই হল না কিছু বয়স তো অনেক হল, রত্না নামের এক মেয়ের সঙ্গে মাস দুই হল পরিচয় হয়েছে। সুরঞ্জনের হঠাৎ হঠাৎ ইচ্ছে হয় বিয়ে করে সংসারী হতে। পারভিনের বিয়ে হয়ে যাবার পর সে তো ভেবেইছিল সন্ন্যাসব্যাপনের কথা। তবু রত্না কেমন যেন এলোমেলো করে দিল তার ছন্নছাড়া জীবন। এখন বড় গুছিয়ে উঠতে ইচ্ছে করে, এখন স্থির হতে ইচ্ছে করে কোথাও। রত্নাকে অবশ্য এখনও বলা হয়নি ‘তোমাকে এই যে এত ভাল লাগছে আমার, তুমি বোঝা সে কথা?’

রত্নার সঙ্গে প্রথম আলাপের কয়েকদিন পর রত্না বলেছিল–এখন করছেন কি?

—কিছু না। সুরঞ্জন ঠোঁট উল্টে বলেছিল।

—চাকরি বাকরি ব্যবসা বাণিজ্য কিছু না?

–না।

–রাজনীতি করতেন, সেটা?

–ছেড়েছি।

—খুব ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন জানতাম।

–ওসব আর ভাল লাগে না।

–কি ভাল লাগে?

–ঘুরে বেড়াতে। মানুষ দেখতে।

–গাছপালা, নদী উদী দেখতে ভাল লাগে না?

—লাগে। তবে সবচেয়ে ভাল লাগে মানুষ। মানুষের ভেতর যে রহস্যময়তা আছে তার জট খুলতে আমার ভাল লাগে।

–কবিতা-টবিতা লেখেন নাকি?

—আরে না। তবে প্রচুর কবি বন্ধু আছে।

—মদ-টদ খান?

–মাঝে মধ্যে।

—সিগারেট তো বেশ ফোঁকেন।

–হ্যাঁ, তা ফুঁকি। পয়সা-টয়সা তেমন পাই না।

—সিগারেট ইজ ইনজুরিয়াস টু হেলথ, তা জানেন তো?

—জানি। করার কিছু নেই।

—বিয়ে করেননি কেন?

—কেউ পছন্দ করেনি তাই।

–কেউ না?

—একজন করেছিল। সে রিস্ক নেয়নি আলটিমেটালি।

–কেন?

—সে মুসলমান ছিল, আর আমাকে তো বলা হয় হিন্দু। হিন্দুর সঙ্গে বিয়ে, ওকে তো আর হিন্দু হতে হত না। আমাকেই আবদুস সাকের নাম-টাম রাখতে হত।

রত্না হেসেছিল শুনে। বলেছিল–বিয়ে না করাই ভাল, ক’দিনের মাত্র জীবন। বন্ধনহীন কাটিয়ে দেওয়াই তো ভাল।

—তাই বুঝি আপনিও ওপথ মাড়াচ্ছেন না।

—ঠিক তাই।

—ঐ অবশ্য একদিক থেকে ভালই।

—ঐকই সিদ্ধান্ত হলে আপনার আমার বন্ধুত্ব জামবে ভাল।

—বন্ধুত্বের খুব বড় অর্থকরি আমি। দু-একটা সিদ্ধান্ত মিললেই বন্ধু হওয়া যায় নাকি!

—আপনার বন্ধু হতে গেলে বুঝি খুব সাধনা করতে হবে?

সূরঞ্জন জোরে হেসে উঠে বলেছিল—আমার কি এত সৌভাগ্য হবে নাকি?

–আত্মবিশ্বাস খুব কম বুঝি আপনার?

–না সে কথা না। নিজেকে বিশ্বাস আছে। অন্যকে বিশ্বাস নেই।

—আমাকে বিশ্বাস করে দেখুন তো।

সূরঞ্জনের সেদিন সারাদিন মন ভাল ছিল। আজ আবার রত্নার কথা ভাবতে ইচ্ছে করছে তার, সম্ভবত মন ভাল করবার জন্য। ইদানীং সে তাই করে, কিছুতে মন খারাপ হলে রত্নাকে স্মরণ করে। রত্না আছে কেমন? একবার যাবে নাকি আজিমপুরে। গিয়ে জিজ্ঞেস করবে–কেমন আছেন রত্না মিত্ৰ?’ প্রত্না কি সামান্য অপ্রস্তুত হবে তাকে দেখে? সুরঞ্জন স্থির করতে পারে না তার কি করা উচিত। সাম্প্রদায়িক সম্রাসের কারণে এক ধরনের হিন্দু পুনর্মিলনী হচ্ছে, তা সে অনুমান করে। আর রত্না নিশ্চয় অবাক হবে না, ভাববে। এ সময় হিন্দুরা হিন্দুদের খোঁজ নিচ্ছে, দুঃসময়ে যখন পাশেই দাঁড়াচ্ছে সবাই, তখন, হঠাৎ, কোনও নিমন্ত্রণ ছাড়াই সুরঞ্জন নিশ্চয়ই দাঁড়াতে পারে রত্নার সামনে।

রিক্সাকে আজিমপুরের দিকে ঘুরতে বলে সে। রত্না তেমন লম্বা নয়, সুরঞ্জনের কাঁধের নীচে পড়ে, ফসর্ণ গোল মুখ, কিন্তু ওর চোখে কী যে অতল বিষন্নতা, সুরঞ্জন থাই পায় না। সে বুক পকেট থেকে টেলিফোন ইনডেক্সে লিখে রাখা ঠিকানাটি বের করে বাড়িটি খোঁজে। চাইলে খুঁজে পাবে না এমন কী হয়!

রত্না বাড়িতে নেই। দরজা সামান্য ফাঁক করে বুড়োমত এক লোক বললেন–আপনার নাম কি?

—সুরঞ্জন।

—ও তো ঢাকার বাইরে গেছে।

—কবে? কোথায়? সুরঞ্জন নিজেই তার কণ্ঠস্বরে আবেগ বা আকুলতা টের পেয়ে সামান্য লজা পায়।

—সিলেট।

–কবে ফিরবে জানেন কিছু?

—না।

সিলেটে কি অফিসের কাজে গেছে রত্না নাকি বেড়াতে, নাকি পালিয়েছে? নাকি আদৌ সিলেট যায়নি, বলা হচ্ছে সিলেট। কিন্তু সুরঞ্জন নাম শুনে, যেহেতু এটি ‘হিন্দু নাম’, লুকোবার তো কিছু নেই—এরকম ভাবতে ভাবতে সুরঞ্জন আজিমপুরের রাস্তায় হাঁটতে থাকে। এখানে কেউ তাকে হিন্দু বলে চিনতে পারছে না। টুপি মাথার পথচারী, গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা উত্তপ্ত যুবকেরা, রাস্তার টোকাই কিশোরেরা কেউ যে তাকে চিনতে পারছে না। এ বেশ মজার ব্যাপার বটে। যদি ওরা চিনতে পারে, যদি ওদের ইচ্ছে করে চ্যাংদোলা করে কবরস্থানে ফেলে আসবে তাকে, সুরঞ্জনের কি একার শক্তি হবে নিজেকে বাঁচায়! তার বুকের ভেতর ঢিপিটিপ শব্দটি আবার শুরু হয়। হাঁটতে হাঁটতে দেখে সে ঘািমছে। পরনে কোনও গরম জামা নেই তার, পাতলা একটি শার্ট, শার্টের ভেতর সূচের মত হাওয়া ঢুকছে, অথচ তার কপালে জমছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। হাঁটতে হাঁটতে পলাশি পৌঁছে যায় সুরঞ্জন। পলাশি যখন এসেছেই, একবার নির্মলেন্দু গুণের খবর নেওয়া যায়। ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির ফোর্থ ক্লাস এমপ্লয়িদের জন্য কলোনি আছে পলাশিতে। কলোনির মালির ঘরটি ভাড়া নিয়ে থাকেন নির্মলেন্দু গুণ। সত্যভাষী এই মানুষটির প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা সুরঞ্জনের। দরজায় টোকা পড়লেই পাল্লা হাট করে খুলে দেয় দশ-বারো বছরের একটি মেয়ে। নির্মলেন্দু গুণ বিছানায় পা তুলে বসে মন দিয়ে টেলিভিশন দেখছিলেন। সুরঞ্জনকে দেখেই সুর করে বলে উঠলেন—‘এস এস এস আমার ঘরে এস, আমার ঘরে…।‘

—টিভিতে দেখার কি আছে?

—বিজ্ঞাপন দেখি। সানলাইট ব্যাটারি, জিয়া সিল্ক শাড়ি, পেপসি জেল টুথপেস্ট-এর বিজ্ঞাপন। হামদ নাত দেখি। কোরানের বাণী দেখি।

সুরঞ্জন হেসে ওঠে। বলে—সারাদিন এই করেই কাটে আপনার? বাইরে বের-টের হননি নিশ্চয়?

—আমার বাড়িতে চার বছরের এক মুসলমান ছেলে থাকে। ওর ভরসায় তো বেঁচে আছি। কাল অসীমের বাড়ি গেলাম, ও আগে আগে গেল, আমি পেছন পেছন।

সুরঞ্জন হেসে ওঠে আবার। বলে—এই যে না দেখে দরজা খুলে দিলেন। যদি অন্য কেউ হত?

গুণ হেসে বলেন–কাল রাত দুটোর সময় ফুটপাতে দাঁড়িয়ে কিছু ছেলে মিছিল করবার প্ল্যান করছিল, হিন্দুদের গাল দিয়ে কী কী শ্লোগান দেওয়া যায়, আলোচনা চলছিল। হঠাৎ হাঁক দিলাম, ‘কে ওখানে, গেলি?’ ওরা সরে গেল। আর আমার চুল দাড়ি দেখে অনেকে তো ভাবে আমি মুসলমান, মৌলভি।

—কবিতা লেখেন না?

—না। ওসব লিখে কি হবে। ছেড়ে দিয়েছি।

–রাতে নাকি আজিমপুর বাজারে জুয়ো খেলেন?

–হ্যাঁ। সময় কাটাই। তবে ক’দিন তো যাচ্ছি না।

–কেন?

–বিছানা থেকেই নামি না, ভয়ে। মনে হয় নামলেই বুঝি ওরা ধরে ফেলবে।

—টিভিতে কিছু বলছে, মন্দির ভাঙা-টাঙা কিছু দেখাচ্ছে?

—আরে না। টিভি দেখলে মনে হবে এ দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এ দেশে দাঙ্গা-টাঙ্গা কিছু ঘটছে না। যা কিছু ঘটছে ভারতে।

—সেদিন একজন বলল, ভারতে এ পর্যন্ত চার হাজার দাঙ্গা হয়েছে। তবু তো ভারতের মুসলমান দেশ ত্যাগ করছে না। কিন্তু এখানকার হিন্দুদের এক পা থাকে বাংলাদেশে, আরেক পা ভারতে। অৰ্থাৎ ভারতের মুসলমানরা লড়াই করছে, আর বাংলাদেশের হিন্দুরা পালাচ্ছে।

গুণ গভীর হয়ে বলেন-ওখানকার মুসলমানরা লড়াই করতেই পারে। ভারত সেকুলার রাষ্ট্র। আর এখানে ফান্ডামেন্টালিস্টরা ক্ষমতায়। এখানে আবার লড়াই কিসের। এখানে হিন্দুরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের কি লড়াই করবার জোর থাকে?

—এসব নিয়ে কিছু লেখেন না কেন?

—লিখতে তো ইচ্ছে করেই। লিখলে আবার ভারতের দালাল বলে গাল দেবে। কত কিছু লিখতে ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করেই লিখি না। কী হবে লিখে!

গুণ বোধহীন চোখে তাকিয়ে থাকেন টেলিভিশন নামের খেলনা বাক্সটির দিকে। গীতা চা রেখে যায় টেবিলে। সুরঞ্জনের খেতে ইচ্ছে করে না। গুণদার ভেতরের যন্ত্রণা তাকেও স্পর্শ করে।

হঠাৎ হেসে ওঠেন গুণ, বলেন—তুমি যে অন্যের খোঁজ-খবর নিচ্ছ, তোমার নিজের নিরাপত্তা আছে তো?

—আচ্ছা গুণদা, জুয়ো খেলে কি জেতেন কখনও?

—না খেললে ওরা মা বাপ তুলে গাল দেয়, তাই খেলতে হয়।

শুনে হো হো করে হেসে ওঠে সুরঞ্জন। গুণও হাসেন। চমৎকার রসিকতা জানেন মানুষটি। আমেরিকার লাস ভেগাসের ক্যাসিনোয় বসে তিনি জুয়ো খেলতে পারেন, আবার পলাশির বস্তিতে বসে মশার কামড়ও খেতে পারেন। কিছুতে আপত্তি নেই, বিরক্তি নেই তাঁর। বারো বাই বারো ফুটের একটি ঘরে দিব্যি তিনি তুচ্ছ আমোদ আহ্রদে কাটিয়ে দিচ্ছেন। এত অমল আনন্দে তিনি ভেসে থাকেন কী করে, সুরঞ্জন ভাবে। আসলেই কি আনন্দ নাকি বুকের ভেতরে তিনিও গোপনে গোপনে দুঃখ পোষেন। কিছুই করবার নেই বলে হেসে পার করেন দুঃসহ সময়।

সুরঞ্জন উঠে পড়ে। তার নিজের ভেতরেও দুঃখবোধটা বেড়ে উঠছে। দুঃখ কি সংক্রামক কিছু? সে হেঁটে হেঁটে টিকাটুলির দিকে যেতে থাকে। রিক্সা নেবে না। পাঁচটি টাকা আছে পকেটে। পলাশির মোড় থেকে সিগারেট কেনে। বাংলা ফাইভ চাইলে দোকানিটি সুরঞ্জনের মুখের দিকে অবাক তাকায়। ওর তোকানো দেখে বুকের মধ্যে সেই টিপচিপ শব্দটি হয়। লোকটি কি টের পাচ্ছে সে হিন্দু ছেলে, লোকটি কি জানে ব্যবরি মসজিদ ভেঙেছে বলে ঐখন যে কোনও হিন্দুকেই ইচ্ছে করলে পেটানো যায়? সিগারেট কিনে দ্রুত্ব সরে যায় সুরঞ্জন। তার এমন হচ্ছে কেন? সে সিগারেটটি দোকানে না ধরিয়েই চলে এসেছে। আগুন চাইতে গেলে যদি বুঝে ফেলে সে হিন্দু? হিন্দু মুসলমান পরিচয় তো আর গায়ে লেখা থাকে না। তবু তার সন্দেহ হয় তার হাঁটায়, ভাষায়, চোখের চাহনিতেও বোধহয় ধরে ফেলবার কিছু আছে। টিকাটুলির মোড়ে আসতেই একটি কুকুর ঘেউ করে ওঠে। চমকে ওঠে। সে। হঠাৎ পেছনে শোনো একপাল ছেলের ‘ধর ধর’ আওয়াজ। শুনে সে আর পেছন ফেরে না। উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়োয়। গা ঘামতে থাকে  তার। শার্টের বোতাম খুলে যায়, তবু  দৌড় দৌড়। অনেকদূর দৌড়ে এসে সে পেছনে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই। তবে কি সে মিছিমিছি দৌড়োলো। শব্দটি তার উদ্দেশ্যে ছিল না? নাকি এ তার অডিটরি হ্যালুশিনেশন!

রাত বেশি হয়ে গেলে, সুরঞ্জন সদর দরজায় ডাকাডাকি না করে বাইরে থেকে অলা দিয়ে যাওয়া নিজের ঘরটিতে ঢুকে পড়ে। ঢুকেই পাশের ঘর থেকে ভগবান ভগবান বলে করুণ একটি ক্ৰন্দন শোনে সুরঞ্জন। বাড়িতে কোনও হিন্দু অতিথি বা আল্পীয় এসেছে কিনা একবার ভাবে সে। হতেও পারে। এরকম ভেবেই সে যখন সুধাময়ের ঘরে ঢুকতে যাবে, দেখে সে অবাক হয়, কিরণময়ী ঘরের কোণে একটি জলচৌকিতে মাটির এক মূর্তি নিয়ে বসেছেন। মূর্তিটির ব্ল্যামনে গলায় আঁচল পেঁচিয়ে উবু হয়ে ‘ভগবান ভগৱােন বলে ৰুদ্রিছেন। এরকম দৃশ্য এই বাড়িতে দেখা যায় না। অদ্ভুত অচেনা একটি দৃশ্য সুরঞ্জনকে এত স্তম্ভিত করে, সে কিছুক্ষণ বুঝে পায় না তার কী করা উচিত। সে কি মুর্তিটিকে আছাড় মেরে ভেঙে ফেলবে, নাকি কিরণময়ীকে নতমস্তক সে নিজে হাতে টেনে সরিয়ে আনবে। নতমস্তক দেখিলে তার গা ঘিনঘিন করে।

কাছে এসে কিরুণাময়ীর দু বাহু ধরে দাঁড় করায়। বলে–হয়েছে কি তোমার। মূর্তি নিয়ে বসেছ কেন? মূর্তি তোমাকে বাঁচাবে?

কিরুণাময়ী ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন। বলেন—তোর বাবার হাত পা অবশ হয়ে গেছে। কথা জড়িয়ে আসছে।

সঙ্গে সঙ্গে সুধাময়ের দিকে চোখ পড়ে তার। শুয়ে আছেন। বিড়বিড় করে কথা বলছেন। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না। কী বলছেন। বাবার গা ঘেঁষে বসে সে ডান হাতটি নগ্নড়ে, হাতে কোনও চেতন নেই, শক্তি নেই। বুকের ঝোপে কুড়োলের কোপ পড়ে সুরঞ্জনের। তার ঠাকুরুদ্রার ঠিক এরকম শরীরের একদিক অবশ হয়ে গিয়েছিল, ডাক্তার বলেছিলেন-ষ্ট্রেক! মুড়ির মত ওষুধ খেতে হত শুয়ে শুয়ে। আর ফ্রিািজওথেরাপিস্ট এসে হাত পায়ের এক্সক্লসাইজ কন্নতেন। বোঝা চোখে একবার কিরণময়ীর দিকে একবার সূরঞ্জনের দিকে তাকান সুধাময়।

আত্মীয়স্বজনও ধারে কাছে কেউ নেই। কার কাছে যাবে সে? ঘনিষ্ঠ কোনও আত্মীয়াই অবশ্য নেই তাদের। এক এক করে সবাই দেশ ছেড়েছে। খুব একা, অসচ্ছল, অসহায় বোধ করে সুরঞ্জন। ছেলে হিসেবে এখন সব দায়িত্ব তার কাঁধেই বর্তাবে। সংসারের অপদাৰ্থ ছেলে সে। আজও তার ঘুরে ঘুরে জীবন কাটে। কোনও চাকরিতে সে স্থায়ী হয়নি। ব্যবসাও করতে চেয়েছিল, সম্ভব হয়নি। সুধাময় অসুস্থ পড়ে থাকলে বাড়ির চুলো বন্ধ হবে, বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় দাঁড়াতে হরে সবাইকে।

—কামাল-টামাল কেউ আসেনি? সুরঞ্জন জিজ্ঞেস করে।

—না। কিরণময়ী মাথা নাড়েন।

কেউ একবার খোঁজ নিতে আসেনি। সুরঞ্জন কেমন আছে। অথচ শহরে ঘুরে কতজনের খবৰ নিয়ে এল সে ৷ সকলে ভাল আছে, কেবল সে ছাড়া। এত দারিদ্র্য, অনিশ্চয়তা আর কোনও সংসারে বোধহয় নেই। সুধাময়ের অচেতন হাতটি চেপে ধরে সুরঞ্জনের বড় মায় হয়। এই বিরুদ্ধ-জগতে তিনি কি ইচ্ছে করেই অচল হয়ে গেলেন কিনা কে জানে।

–মায়া ফেরেনি? হঠাৎ উঠে দাঁড়ায় সুরঞ্জন।

–না।

—কোন ফেরেনি সে? আচমকা চিৎকার করে ওঠে সুরঞ্জন। কিরণময়ীও অবাক হন নম্র স্বভাবের ছেলেটি কখনও এমন মাথা গরম করে কথা বলে না। আজ হঠাৎ চেঁসিয়ে কথা বলছে কোন! মায়া যে পাক্রিলের ব্রাড়ি গিয়েছে। এ এমন কোনও অন্যায় ঘটনা নয়, বরং এ অনেকটা নিশ্চিম্ভের। হিন্দু বাড়ি লুট করতে এলে মায়া ছাড়া আর কোনও সম্পদ নেই তো ঘরে। মেয়েদের তো মানুষ সোনাদোনর মত সম্পদই মনে করে।

সুরঞ্জন সারাঘর জুড়ে অস্থির হাঁটে আর বলে–মুসলমানদের এত বিশ্বাস কেন ওর? ক’দিন বাঁচাবে ওরা?

কিরণময়ী বুঝে পান না। সুধাময় অসুস্থ, এখন ডাক্তার ডাকতে হবে। এই মুহুর্তে মায়া কেন মুসলমানের বাড়ি গেল, এ নিয়ে রাগারগি করছে কেন ছেলে?

সুরঞ্জন বিভূবিভু করে-ডাক্তার ডাকতে হবে, চিকিৎসার খরচাটা কোথায় পাবে, শুনি? পাড়ার দুটো-পিচ্চি ছেলে ভয় দেখিয়েছিল, সেই ভয়ে দশ লাখ টাকার বাড়ি দু লাখ টাকায় বিক্রি করে এলে, এখন ভিক্ষুকের মত বাঁচতে লজ্জা করে না।

–কেবল কি ছেলে-ছোকরাদের ভয়ে, বাড়ি নিয়ে মামলার ঝামেলাও তো কম ছিল না। কিরণময়ী উত্তর দেন।

বারান্দায় একটি চেয়ার ছিল, সুরঞ্জন সেটিকে লাথি মেরে সরিয়ে দেয়।

—আর মেয়ে গেছে মুসলমানকে রিয়ে করতে। ভেবেছে মুসলমানরা তাকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবে। মেয়ে বড়লোক হতে চায়।

বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় সে। পাড়ায় দুজন ডাক্তার আছেন। হরিপদ সরকার টিকাটুলির মোড়ে, আর দু বাড়ি পরে আছেন। আমজাদ হোসেন। কাকে ডাকবে সে? সুরঞ্জিল এলোমেলো হাঁটতে থাকে। মায়া বাড়ি ফেরেনি বলে এই যে কেঁচালো সে, সেকি মায়া ফেরেনি বলে, নাকি মুসলমানদের ওপর মায়ার নির্ভরতা দেখে? সুরঞ্জন কি অল্প অল্প কমুনীল হয়ে উঠছে? নিজেকে সন্দেহ হয় তার। সে হেঁটে টিকাটুলির মোড়ের দিকে যায়।

লজ্জা (০৪) হায়দার এসেছে সুরঞ্জনের বাড়িতে

৪ক.

হায়দার এসেছে সুরঞ্জনের বাড়িতে। কেমন আছে জানতে নয়, স্রেফ আড্ডা দিতে। হায়দার আওয়ামি লিগ করে। একসময় সুরঞ্জন তার সঙ্গে ছোটখাটো বাণিজ্য করতে সেমেছিল, পরে উন্নতির সম্ভাবনা নেই বলে বাদ দিতে হয়েছে পরিকল্পনাটি। হায়দারের প্রিয় বিষয় রাজনীতি। সুরঞ্জনেরও বিষয় ছিল এটি, আজকাল অবশ্য রাজনীতি প্রসঙ্গ সে একেবারেই পছন্দ করে না। এরশাদ কি করেছিল, খালেদা কি করছে, হাসিনা কি করবে: এসব চিন্তায় মাথা নষ্ট না করে চুপচাপ শুয়ে থাকাই ঢের ভাল। হায়দার এক-একই কথা বলে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নিয়ে সে লম্বা একটি বক্তৃতা দেয়।

–আচ্ছা হায়দার, সুরঞ্জন তার বিছানায় আধশোয়া হয়ে প্রশ্ন করে–তোমাদের রাষ্ট্রের বা সংসদের কি অধিকার আছে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করবার?

হায়দার চেয়ারে বসে টেবিলে পা তুলে দিয়ে সুরঞ্জনের লাল মলাটের বইগুলোর পাতা ওল্টাচ্ছিল, শুনে ঠা ঠা করে হেসে ওঠে। বলে–তোমাদের রাষ্ট্রের মানে? রাষ্ট্র কি তোমারও নয়?

সুরঞ্জন ঠোঁট চেপে হাসে। সে ইচ্ছে করেই আজ ‘তোমাদের’ শব্দটি হায়দারকে উপহার দিয়েছে। সে হেসেই বলে–আমি কিছু প্রশ্ন করব, প্রশ্নগুলোর জবাব তোমার কাছে চাইছি।

হায়দার সোজা হয়ে বসে বলে—তোমার প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে–না। অর্থাৎ রাষ্ট্রের কোনও অধিকার নেই বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করবার।

সুরঞ্জন সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে প্রশ্ন করে–রাষ্ট্রের বা সংসদের কি অধিকার আছে কোনও ধর্মকে অন্য ধর্মের চেয়ে প্রাধান্য বা বিশেষ আনুকুল্য দেখাবার?

হায়দার সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দেয়–না।

সুরঞ্জন তৃতীয় প্রশ্ন করে—রাষ্ট্রের বা সংসদের কি অধিকার আছে পক্ষপাতিত্বের?

হায়দার মাথা নাড়ে।

—সংসদের কি অধিকার আছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধানে বর্ণিত অন্যতম মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি পরিবর্তনের?

হায়দার মন দিয়ে কথা কটি শোনে। বলে–নিশ্চয়ই না।

সুরঞ্জন আবার প্রশ্ন করে—দেশের সার্বভৌমত্ব সকল মানুষের সমান অধিকারের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। সংবিধান সংশোধনের নামে সেই-ভিত্তিমূলেই কি কুঠারাঘাত করা হচ্ছে না?

হায়দার এবার চোখ ছোট করে তাকায় সুরঞ্জনের দিকে। ও ঠাট্টা করছে না তো! এসব পুরনো প্রশ্ন ও আবার নতুন করে টানছে কেন।

সুরঞ্জন তার ষষ্ঠ প্রশ্ন করে–রাষ্ট্ৰীয় ধর্ম ইসলাম ঘোষণার মাধ্যমে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্ৰীয় আনুকুল্য বা স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করা হয় না কি?

হায়দার কপাল কুঁচকে বলে—হয়। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সব জানা সুরঞ্জনের, হায়দারেরও। সুরঞ্জনও জানে হায়দার আর সে এসবের উত্তরের ব্যাপারে একমত। তবু প্রশ্ন করবার অর্থ কি এই যে, হায়দার ভাবে, সুরঞ্জন হায়দারকে একটি বিশেষ সময়ে প্রশ্ন করে পরীক্ষা করছে হায়দার ভেতরে ভেতরে সামান্যও সাম্প্রদায়িক কি না, তাই অষ্টম সংশোধনীর প্রসঙ্গ ওঠায় সে এই প্রশ্নগুলো করে।

সুরঞ্জন তার সিগারেটের শেষ অংশটুকু এসট্রেতে চেপে বলে-আমার শেষ প্রশ্ন ব্রিটিশ ভারতে ভারতবর্ষ থেকে আলাদা হয়ে ভিন্ন রাষ্ট্র সৃষ্টির কারণে প্রবর্তিত দ্বিজাতিতত্ত্বের জটিল আবর্তে বাংলাদেশকে আবার জড়িয়ে ফেলার এ অপচেষ্টা কেন এবং কাদের স্বার্থে?

হায়দার এবার কোনও উত্তর না দিয়ে একটি সিগারেট ধরায়। ধোঁয়া ছেড়ে বলে-জিন্নাহ নিজেও কিন্তু দ্বিজাতিতত্ত্বকে রাষ্ট্ৰীয় কাঠামো হিসেবে প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন ‘আজ থেকে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান, বীেন্ধ রাষ্ট্ৰীয় জীবনে নিজের নিজের ধর্ম পরিচয়ে পরিচিত থাকবে না। তারা সকলেই শুধু জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এক জাতি পাকিস্তানের নাগরিক পাকিস্তানি এবং তারা শুধু পাকিস্তানি হিসেবেই পরিচিত হবে। ‘

সুরঞ্জন আধশোয়া থেকে সোজা হয়ে বসে বলে–পাকিস্তানই বোধহয় ভাল ছিল, কি বল?

উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে যায় হায়দার। বলে–আসলে পাকিস্তান ভাল ছিল না মোটেও, পাকিস্তানে তোমাদের আশা করবার কিছু ছিল না। বাংলাদেশ হবার পর তোমরা ভেবেছ এই দেশে তোমাদের সবরকম অধিকার থাকবে, এ হচ্ছে সেকুলার রাষ্ট্র, কিন্তু এই দেশ যখন তোমাদের স্বপ্ন পূরণে বাধা হল, তখন বুকে তোমাদের লাগল বেশি।

সুরঞ্জন জোরে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে বলে—শেষ পর্যন্ত তুমিও বেশ তোমাদের আশা তোমাদের স্বপ্ন-টল্প বলে গেলে গেলে? এই তোমরা কারা? হিন্দুরা তো? তুমি আমাকেও হিন্দুর দলে ফেললে? এতকাল নাস্তিক্যবাদে বিশ্বাস করে এই লাভ হল আমার?

সুরঞ্জন ঘর জুড়ে অস্থির পায়চারি করে। ভারতে মৃতের সংখ্যা সাড়ে ছশ ছাড়িয়ে গেছে। পুলিশ আটজন মৌলবাদী নেতাকে গ্রেফতার করেছে। এদের মধ্যে বি জে পি-র সভাপতি মুকুলী মনোহর যোশী। আর এল কে আদভানিও রয়েছেন। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিবাদে সারা ভারতে বন্‌ধ পালিত হয়। বোম্বে, রাঁচি, কণাটক, মহারাষ্ট্রে দাঙ্গা হচ্ছে, মানুষ মরছে। উগ্ৰ হিন্দু মৌলবাদীদের প্রতি ঘূণীয় সুরঞ্জন হাত মুষ্টিবদ্ধ করে। তার যদি শক্তি থাকত, জগতের সব মৌলবাদীকে সে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করত। এ দেশের সাম্প্রদায়িক দলটি মুখে বলছে ‘বাবরি মসজিদ ধ্বংসের জন্য ভারত সরকার দায়ী। ভারত সরকারের এই দোষের জন্য বাংলাদেশের হিন্দুরা দায়ী নয়। বাংলাদেশের হিন্দু ও মন্দিরের বিরুদ্ধে আমাদের কোনও ক্ষোভ নেই। ইসলামিক চেতনায় উদ্ধৃদ্ধ হয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্ৰীতি রক্ষা করতে হবে।’ সাম্প্রদায়িক দলটির কক্তব্য রেডিও টেলিভিশনে, সংবাদপত্রে প্রচার হচ্ছে। কিন্তু মুখে এ কথা বললেও সারাদেশে হরতালের দিন মসজিদ ধ্বংসের প্রতিবাদ করবার নামে যে তাণ্ডব, যে সন্ত্রাস চালিয়েছে তা না দেখলে বিশ্বাস হবার নয়। প্রতিবাদের ছুতোয় একাত্তরের ঘাতকের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অফিস এমনকি কমিউনিস্ট পাটির অফিসও ভাঙচুর করছে আগুন লাগাচ্ছে, কেন? জামাতে ইসলামির একটি প্রতিনিধি দল বি জে পি-র নেতাদের সঙ্গে দেখা করেছে। কঁী কথা হয়েছে তাদের? কী আলোচনা, কী ষড়যন্ত্র সুরঞ্জন তা অনুমান করে। পুরো উপমহাদেশে ধর্মের নামে যে দাঙ্গা শুরু হয়েছে, সংখ্যালঘুদের ওপর যে নৃশংস নির্যাতন, সুরঞ্জন নিজে সংখ্যালঘু হয়ে টের পায় এই নৃশংসতা। কত ভয়াবহ। বসনিয়া হারজেগোভেনিয়ার ঘটনার জন্য যেমন বাংলাদেশের কোনও খ্রিস্টান নাগরিক দায়ী নয় তেমনি ভারতের কোনও দুর্ঘটনার জন্য বাংলাদেশের হিন্দু নাগরিক দায়ী নয়। এ কথা সুরঞ্জন কাকে বোঝাবে!

হায়দার বলে—’চল চল, তৈরি হও। মানব-বন্ধনে যাব। মানব-বন্ধন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণে জাতীয় ঐক্য ও একাত্তরের ঘাতক যুদ্ধাপরাধীসহ সকল সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আঞ্চলিক সৌহার্দ ও বিশ্ব শান্তির লক্ষে বিশ্ব মানবতার ঐক্যের প্রতীক হিসেবে জাতীয় সমন্বয় কমিটির ডাকে সারাদেশে মানক-বন্ধন।

—তাতে আমার কী? সুরঞ্জন প্রশ্ন করে।

–তোমার কি মানে? তোমার কিছুই না? হায়দার অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।

সুরঞ্জন শান্ত, স্থির। বলে–না!

হায়দার এত বিস্মিত হয়। সে দাঁড়িয়েছিল। বসে পড়ে। আবার একটি সিগারেট ধরায় সে। বলে—এক কাপ চা খাওয়াতে পারো?

সুরঞ্জন বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে বলে—ঘরে চিনি নেই।

বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে জাতীয় সংসদ ভবন পর্যন্ত মানব-বন্ধনের রুট। সকাল এগারোটা থেকে দুপুর একটা অবধি এই ক্লটে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। হায়দার মানব-বন্ধন সম্পর্কে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, সুরঞ্জন থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে–কাল আওয়ামি লিগের মিটিং-এ হাসিনা কি বলল?

–শান্তি সমাবেশে।

—হ্যাঁ।

–সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখবার জন্য প্রত্যেক মহল্লায় ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে শান্তি ব্রিগেড গড়ে তুলতে হবে।

—এতে কি হিন্দুরা অর্থাৎ আমরা রক্ষা পাবো? মানে প্ৰাণে বাঁচব?

হায়দার উত্তর না দিয়ে তাকায় সুরঞ্জনের দিকে। শেভ না করা মুখ। চুল উড়োথুড়ো। হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টায় সে। জিজ্ঞেস করে–মায়া কোথায়?

–ও জাহান্নামে গেছে। সুরঞ্জনের মুখে জাহান্নাম শব্দটি হায়দারকে চমকিত করে। সে হোসে বলে-জাহান্নামটা কিরকম শুনি?

—সাপ কামড়ায়, বিচ্ছু ধরে, আগুন জ্বলে শরীরে, পুড়ে ছাই হয়ে যায়, তবুও মরে না।

—বাহ্‌ তুমি তো আমার চেয়ে বেশি খবর রাখো জাহান্নামের।

—রাখতেই হয়। আগুন আমাদেরই পোড়ায় কি না।

–বাড়ি এত নিস্তব্ধ কেন? মেসো মাসিমা কোথায়? অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিয়েছ?

–না।

—আচ্ছা সুরঞ্জন, একটা ব্যাপার লক্ষ করেছ গোলাম আজমের বিচারের দাবিকে জামাতিরা বাবরি মসজিদের ছুতোয় ভিন্ন খাতে নিয়ে যাচ্ছে?

–তা হয়ত নিচ্ছে। কিন্তু গোলাম আজমকে নিয়েও বিশ্বাস কর তুমি যেভাবে ফিল করছ, আমি সেভাবে করছি না। তার জেল ফাঁসি হলে আমার কী আর না হলেই বা আমার কী?

—তুমি খুব বদলে যাচ্ছ।

—হায়দার, খালেদা জিয়াও বললেন বাবরি মসজিদ পুননির্মাণ করতে হবে। আচ্ছা! তিনি কেন মন্দির পুনর্নির্মাণের কথা বলছেন না?

—তুমি কি মন্দির নির্মাণ চাও?

–খুব ভাল করেই জানো মন্দির মসজিদ কিছুই চাই না আমি। কিন্তু নির্মাণের কথা যখন উঠছেই, তখন কেবল মসজিদ নির্মাণ কেন?

হায়দার আরেকটি সিগারেট ধরায়। সে ভেবে পায় না মানক বন্ধনের দিন সুরঞ্জন এক একা ঘরে বসে থাকবে কেন। গণআদালত যেদিন হল, এ বছরের ছাবিবশে মার্চ, সুরঞ্জনই হায়দারকে ঘুম থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। গণসমাবেশের দিন ঝড়বৃষ্টি ছিল, হায়দার একটি কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়েছিল, হাই তুলে বলেছিল-’আজি বরং না। যাই, ঘরে বসে মুড়ি ভাজা খাই চল।’ সুরঞ্জন রাজি হয়নি, উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল—’যেতে তোমাকে হবেই। এক্ষুণি তৈরি হও। আমরাই যদি পিছিয়ে যাই তবে উপায় কী হবে? ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ওরা বেরিয়েছিল। সেই সুরঞ্জন কি না। আজ বলছে তার এই সব সভা-সমিতি ভাল লাগে না। মানব-বন্ধন-স্টন্ধন সব ফাঁকি মনে হয় তার।

হায়দার সকাল নটা থেকে এগারোটা অবধি বসে থেকেও সুরঞ্জনকে মানব-বন্ধনে নিতে পারে না।

 

৪খ.

পারুলের বাড়ি থেকে মায়াকে নিয়ে এসেছেন কিরণময়ী। এসেই মায়া অক্ষম, আচল, অকল, অকর বাবার বুকের ওপর পড়ে হাউমাউ করে কাঁদছে। কান্নার শব্দ শুনলে বড় রাগ ধরে সুরঞ্জনের। চোখের জল ফেলে জগতে কিছু হয়? তার চেয়ে চিকিৎসা করা জরুরি। হরিপদ ডাক্তারের লেখা ওষুধ সুরঞ্জন কিনেছে মোটে তিন দিনের ডোজ। কিরণময়ীর আলমারি খুললে। এরপর আর কত বেরোবে? আদৌ বেরোবে কি না কে জানে!

সে নিজেও কোনও চাকরি বাকরি করল না। আসলে পরের ‘গোলামি করা ধাতে সইবে না তার। হায়দারের সঙ্গে পুরনো ব্যবসায় সে আবার জড়াবে কি না ভাবতে ভাবতে সুরঞ্জনের বড় ক্ষিদে পায়। কিন্তু কাকে সে এই অসময়ে ক্ষিদের কথা বলবো? মায়া কিরশময়ী কেউ তো এ ঘরে আসছে না। সে বেকার বলে, অকৰ্মণ্য বলে তাকে কেউ গোণায় নিচ্ছে না। বাড়িতে কি রান্না হচ্ছে নাকি হচ্ছে না, এসবের খবর নিতে তার ইচ্ছে করে না। সেও আজ সুধাময়ের ঘরের দিকে যায়নি। সুরঞ্জনের ঘরের দরজা আজ বাইরে থেকে খোলা, বন্ধুবান্ধব এলে বাইরের দরজা দিয়েই সোজা তার ঘরে ঢেকে। আজ অন্দরের দরজা সে ভেজিয়ে রেখেছে, তাই কি কেউ টোকা দিচ্ছে না ঘরে, ভাবছে বন্ধুবান্ধব নিয়ে গভীর আড্ডায় মগ্ন সে! আর সুরঞ্জন এত আশাই বা করে কেন? কি করেছে সে এই সংসারের জন্য? কেবল বাইরে বাইরে ঘুরেছে বন্ধুবান্ধব নিয়ে, বাড়ির সবার সঙ্গে যে কোনও কিছু নিয়ে চিৎকার করেছে নয়। উদাসীন থেকেছে। কেবল আন্দোলনে ঝাঁপিয়েছে। পার্টির যে কোনও নির্দেশ বশংবাদ ভূত্যের মত পালন করেছে। গভীর রাতে বাড়ি ফিরে মার্কস লেনিনের বই মুখস্থ করেছে। কী লাভ হয়েছে। এতে তার? তার পরিবারের?

হায়দার চলে গেছে, যাক। সুরঞ্জন যাবে না। কেন সে মানব-বন্ধনে যাবে? মানব-বন্ধন তার বিচ্ছিন্নতা বোধ থেকে মুক্তি দেবে তাঁকে? বিশ্বাস হয় না। সুরঞ্জনের আজকাল এরকম হচ্ছে, সব কিছুতে সে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। এই হায়দার, অনেক দিনের বন্ধু তার, দিনের পর দিন যুক্তি বুদ্ধি বিবেকের চর্চা করেছে তারা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানিয়েছে দেশের মানুষকে, সভ্যতাকে রক্ষণ কক্সবার জন্য, মানবিক মূল্যবোধকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য তারা কতগুলো বছর পার করেছে। আজ সুরঞ্জনের মনে হচ্ছে কোনও প্রয়োজন ছিল লা। এসবের, তার চেয়ে পেট ভরে মদ খেত, ভি সি আর-এ ছবি দেখাত, ব্লু ফিল্ম দেখাত, ইভ টিজিং-এ মেতে থাকত, অথবা বিয়ে-থা করে প্রচণ্ড বৈষয়িক লোক হয়ে যেত, পিঁয়াজ রসূনের হিসেব কষত, মাছের শরীর টিপে টিপে ভদ্রলোকের মত মাছ কিনে আনত, তাতেই বোধহয় ভাল হত, এত কষ্ট-টষ্ট হত না। সিগারেট ধরায় সুরঞ্জন। টেবিল থেকে চুটি একটি বই টেনে চোখ বুলোয়। নব্বইয়ের সাম্প্রদায়িক সম্রাসের খবর আছে। বইটি কোনওদিন খুলেও দেখেনি সে। আগ্রহ বোধ করেনি। আঙ্গ গভীর মনোযোগ আসে সুরঞ্জনের। তিরিশে অক্টোবর রাত একটা তখন। হঠাত মিছিলের শব্দ শুনে পঞ্চাননধাম আশ্রমের মানুষ জেগে ওঠে। মিছিলকারীরা গেট আর দেওয়াল ভেঙে ঢুকে পড়ে, ঢুকেই গালাগাল করল আশ্রমবাসীদের, কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় পাশের টিনের ছাউনি ঘরে। আশ্রমের লোক ভয়ে এদিক ওদিক পালিয়ে যায়। এক এক করে সব বিগ্ৰহ মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলে। সাধুবাবার সমাধিমন্দিরের চুড়া ভেঙে ফেলে, ধর্মের বইয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। আশ্রমের মধ্যেই ছিল সংস্কৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠানের আলমারি ভেঙে সব বইপত্রে আগুন দেয় এবং টাকা পয়সা সব লুট করে নিয়ে যায়। সদরঘাট কালীবাড়িতে তিরিশে অক্টোবর রাত বারোটায় প্রায় আড়াই হাজার লোক ইট ছুঁড়তে ছুঁড়তে মন্দির প্রধান ফটক ভেঙে সশস্ত্র ভেতরে ঢুকে পড়ে। মূল মন্দিরের ভেক্তর ঢুকে তারা বিগ্রহ ভাঙে, ভারি লোহার রড, খন্তা দিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। চট্টেশ্বরী মায়ের মন্দিরে উঠবার সিঁড়ির দুপাশের দোকান এবং বাড়িঘর ভেঙে লুট করে আগুন লাগিয়ে ধ্বংস করে দেয়। গোলপাহাড় শ্মশানের সব জিনিস লুট করে নিয়ে যায় রাত সাড়ে এগারোটায়, শ্মশানে আগুন লাগিয়ে দেয়। শ্মশান কালীমূর্তি ধ্বংস হয়ে যায়। তিরিশে অক্টোবর রাতে ভয়েস অব আমেরিকার খবরের পর সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী নগ্ন হামলা চালায় কৈবল্যধাম আশ্রমে। আশ্রমের প্রতিটি দেবপ্রতিকৃতি ভেঙে, প্রতিটি ঘরের জিনিসপত্রে আগুন লাগিয়ে দেয়। আশ্রমের লোক ভয়ে পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। তাদের নাগাল পেলেই মার দেওয়া হয়। কয়েক হাজার লোক মন্দিরের ওপর কয়েকবার আক্রমণ চালায়। লোহার রদ, খন্তা দিয়ে মন্দিরের কাঠামো নষ্ট করে ফেলে। হরগৌরী মন্দিরের ভেতর মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলে, টাকা পয়সা, মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়। ধর্মগ্রন্থগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয় আগুনে। মন্দিরের আশেপাশের প্রতিটা এলাকা, মালিপাড়ার প্রতিটি পরিবার আকাশের নীচে দিনযাপন করতে বাধ্য হয়, তাদের কিছুই ছিল না সম্বল। চট্টেশ্বরী রোড়ের কৃষ্ণ গোপালজীর মন্দিরে সশস্ত্ৰ লোকেরা আক্রমণ করে রাত নটার দিকে। তারা দুশ ভরি রূপা, পঁচিশ ভরি স্বৰ্ণলঙ্কার সহ বহু মূল্যবান জিনিস লুট করে বিগ্রহ সহ মূল ঘরটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। মন্দিরে ঢুকবার পথে তোরণের ওপর গাড়ীমূর্তিটি ভেঙে ফেলে তাদের শাবলের আঘাতে মন্দিরের পাইনগাছগুলো ভুলুষ্ঠিত হয়। রাস উপলক্ষে বানানো মুর্তিগুলোও রেহাই পায়নি। বদ্দরহাট ইলিয়াস কলোনির প্রতিটি হিন্দু ঘরে লুটতরাজ, ভাঙচুর, নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবার ওপর অকথ্য শারীরিক নির্যাতন চালায়। সিলিংফ্যানের শাখাগুলো ঘটিকা করে অকেজো করে দেয়।

চট্টগ্রাম শহরের কলেজ রোডের দশভুজা সুগৰ্বিাড়ি, কোরবনিগঞ্জের বরদেশ্বরী কালীমন্দির, চকবাজারের পরমহংস মহাত্মা নরসিংহ মন্দির, উত্তর চান্দগাঁয় বর্ষা কালীবাড়ি, দুর্গা কালীবাড়ি, সদরঘাটের সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির, দেওয়ানহাটের দেওয়ানেশ্বরী কালীবাড়ি, কাটঘরের উত্তর পতেংগা শ্মশান কালীবাড়ি, পূর্ব মাদারবাড়ির মগধেশ্বরী বিগ্ৰহ, রক্ষাকালী মন্দির, মোগলটুলির মিলন পরিষদ মন্দির, টাইগার পাসের দুর্গ মন্দির,শিব বাড়ি ও হরিমন্দির, সদরঘাটের রাজ-রাজেশ্বরী ঠাকুরবাড়ি, জালালাবাদের কালীমন্দির, দুৰ্গাবাড়ি, কুল গাঁওর নাপিতপাড়া শ্মশান মন্দির, কাতালগঞ্জের করুণাময়ী কালীমন্দির, চান্দগাঁওর নাথপাড়া জয়কালী মন্দির, নাজিরপাড়ার দয়াময়ী কালীবাড়ি ও মগধেশ্বরী কালীমন্দির, পশ্চিম বাকলিয়ার কালীবাড়ি, কাতালগঞ্জের ব্ৰহ্মময়ী কালীবাড়ি, পশ্চিম বাকলিয়ার বড় বাজার শ্ৰীকৃষ্ণ মন্দির, হিমাংশু দাস, সতীন্দ্র দাশ, রামমােহন দাশ, চণ্ডীচরণ দাশের শিবমন্দির, মনোমোহন দাশের কৃষ্ণমন্দির, নন্দন কাননের তুলসীধাম মন্দির, বন্দর এলাকার দক্ষিণ হালিশহর মন্দির, পাঁচলাইশের গোলপাহাড় মহাশ্মশান ও কালীবাড়ি, আমান আলী রোডের জেলেপাড়া কালীমন্দির, মেডিকেল কলেজ রোডের আনন্দময়ী কালীমন্দিরে লুটপাট, ভাঙচুর আর আগুন ধরানো হয়।

সাতকানিয়ার নলুয়ার বুড়া কালীবাড়ি, জগরিয়ার সার্বজনীন কালীবাড়ি ও দুগামণ্ডপ, দক্ষিণ কাঞ্চনার চণ্ডীমণ্ডপ, মগধেশ্বরী মন্দির, দক্ষিণ চরতির মধ্যপাড়া কালীবাড়ি, মধ্যনলুয়ার সার্বজনীন কালীবাড়ি, চরতির মন্দির, দক্ষিণ চরতির বাণাকপাড়া রূপ কালীবাড়ি ও ধরমন্দির, পশ্চিম মাটিয়াডাঙার জ্বালাকুমারী মন্দির, বাদোনা ডেপুটি হাটের কৃষ্ণহরি মন্দির, বাঙ্গালিয়া দূরনিগড়ের দুরনিগড় মহাবোধি বিহার, বোয়ালখালি কফুল্লখিলের ঐতিহ্যবাহী মিলনমন্দির ও কৃষ্ণ মন্দির, আবুরুদণ্ডীর জগদানন্দ মিশন, পশ্চিম শাকপুরার সার্বজনীন মগধেশ্বরী মন্দির, মধ্য শাকপুরার মোহিনীবাবুর আশ্রম, ধোেরল কালাইয়া হাটের কালীমন্দির, কখুল্লখিলের সার্বজনীন জগদ্ধাত্রী মন্দির, কোক দণ্ডীয় ঋষিধাম অধিপতি, কণুৱলি শাশ্বত চৌধুরীর বিগ্ৰহ মন্দির, মগধেশ্বরী, ধনপােতা, সেবাখেলা, পটিয়ার সার্বজনীন কালীবাড়ি, সাতকানিয়ার নলুয়ার দ্বিজেন্দ্র দাশ, হরিমন্দির ও জগন্নাথ বাড়ি, সাতকানিয়া দক্ষিণ চরতির দক্ষিণপাড়া সার্বজনীন কালীবাড়ি, দক্ষিণ ব্ৰাহ্মণডাঙার সাৰ্বজনীন কালীবাড়ি ভেঙে, লুট করে আগুন জ্বলিয়ে দিয়েছে।

হাটহাজারি উপজেলার মিজাপুর জগন্নাথ আশ্রমে একত্ৰিশে অক্টোবর রাত এগারেটার দিকে একশ সাম্প্রদায়িক লোক চড়াও হয়। আশ্রমের মূর্তিগুলো ওরা আছড়ে ভেঙে ফেলে। জগন্নাথ ঠাকুরের সব অলঙ্কার লুটপাট করে নিয়ে যায়, পরদিন একশ লোক আশ্রমের টিনের ওপর সাদা পাউডার ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরদিন যখন ওরা আসে, পুলিশ দাঁড়িয়েছিল, মিছিল আসতে দেখে পুলিশ সরে যায়। পরে নিরাপত্তার জন্য পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে পুলিশ জ্বদের সীমাবদ্ধতার কথা জানায়। সে রাতেই চল্লিশ পায়তাল্লিশ জন লোক অস্ত্রশস্ত্ৰ নিয়ে মেখল গ্রামে নিরস্ত্র গ্রামবাসীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা প্রথম এসে কমান্ডো কায়দায় ককটেল ফাটিয়ে হিন্দুদের ভয় ধরিয়ে দেয়। লোকজন ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেলে ঘরের দরজা জানোলা ভেঙে লুটপাট শুরু করে, ঘরের মূর্তিগুলো ভেঙে চুরমার করে দেয়। পার্বতী উচ্চ বিদ্যালয়ের মাস্টার মদীননাথের মন্দির এবং মগধেশ্বরী বাড়ির সবগুলো মূর্তি ভেঙে ফেলে।

চন্দনাইশ উপজেলার ধাইরহাট হরিমন্দিরের মূর্তি ভেঙে ফেলে দেয়, জগন্নাথের রথ ভেঙে ফেলে। বড় কল ইউনিয়নের পাঠানদণ্ডীগ্রামে মাতৃ মন্দির এবং রাধাগোবিন্দ মন্দির আক্রমণ করে। বোয়ালখালির চারশ লোক রাত বারোটায় কথুরখিল ইউনিয়নের মিলনমন্দির, হিমাংশু চৌধুরী, পরেশ বিশ্বাস, ভূপাল চৌধুরী, ফণীন্দ্ৰ চৌধুরী, অনুকুল চৌধুরীর বাড়ির মন্দির ভাঙচুর করে। বাঁশখালি উপজেলার প্রাচীন ঋষিধাম আশ্রম ধ্বংস করে দেয়। প্রতিটি ঘর পুড়িয়ে দেয়, বইপত্রে আগুন ধরিয়ে দেয়।

সীতাকুণ্ডের জগন্নাথ আশ্রমে মুসলমান মৌলবাদীরা লাঠি দা খন্তা নিয়ে হামলা চালায় একত্ৰিশে অক্টোবর রাতে। ১২০৮ সালে স্থাপিত বটতলা শ্ৰী শ্ৰী কালীমন্দিরে ঢুকে কালী মুর্তির মাথা ভেঙে ফেলে দিয়ে রূপার মুকুট আর বিগ্রহের সোনার অলঙ্কার লুট করে নিয়ে যায়। চরশরৎ একটি হিন্দুপ্রধান গ্রাম। দুশ তিনশ লোক পয়লা নভেম্বর রাত দশটায় মিছিল করে এসে পুরো গ্ৰাম লুট করে নেয়। যা নিতে পারেনি, পুড়িয়ে দিয়ে গেছে, স্তৃপ ভূপ ছাই ভস্মের বাড়িঘর আর আধাপোড়া নিবাক বৃক্ষরাজি। ওরা যাওয়ার সময় বলে গেছে দশ তারিখের মধ্যে চলে না গেলে সবাইকে মেরে লাশ বানিয়ে দেবে। গ্রাম থেকে যে গরু ছাগল বের হচ্ছিল না সেগুলোকে কুপিয়ে মারা হয়েছে। আগুন দেওয়া হয়েছে ধানের গোলায়। প্রায় ৪০০০ হিন্দু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পঁচাত্তর ভাগ ঘরবাড়ি পুড়ে গেছে, একজন মরেছে, অসংখ্য গরু ছাগল আগুনে পুড়ে গেছে। অনেক নারী ধর্ষিতা হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা। সাতবাড়িয়া গ্রামে রাত সোয়া নটায় প্রায় দুশ লোক লাঠি দা কিরিস লোহার রড নিয়ে জয়রাম মন্দির আক্রমণ করে মন্দিরের প্রতিটি বিগ্ৰহ ভেঙে চুৰ্ণ করে দেয়। হামলার খবর পেয়ে আশেপাশের লোক প্রাণভয়ে চারদিকে ভয়ে পালিয়ে যায়, সে রাতে প্রতিটি পরিবার কাটিয়েছে জঙ্গলে, নয়। ধানক্ষেতে। তারা প্রতিটি বাড়ি লুট করে। সাতবাড়িয়া সার্বজনীন দুৰ্গর্বিাড়ির কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি। খেজুরিয়া গ্রামের মন্দির আর বাড়িঘরেও আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। চাষী পরিবারগুলো সর্বস্বাস্ত এখন। শৈলেন্দ্ৰ কুমারের স্ত্রীর গায়ে আগুন লাগিয়েছে, আগুনে ঝলসে গেছে তার শরীর। শিব মন্দিরে যখন ভক্তরা প্রার্থনারত ছিল, তখন কয়েকজন লোক এসে অশ্রাব্য গালাগাল করে, মূর্তি ও আসন ভেঙে দিয়ে তাতে প্রস্রাব করে চলে যায়।

সুরঞ্জনের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। ওদের প্রস্রাব যেন সুরঞ্জনের গায়ে এসে লাগে। সে চটি বইটি ছুড়ে ফেলে দেয়।

 

৪গ.

হরিপদ ডাক্তার শিখিয়ে দিয়েছেন হাত পায়ের শক্তি ফিরিয়ে আনতে গেলে কী করে এক্সারসাইজ করতে হবে। মায়া কিরুণাময়ী দুজনই দুবেলা সুধাময়ের হাত পায়ের এক্সারসাইজ করাচ্ছে। সময় করে ওষুধ খাওয়াচ্ছে। মায়ার সেই চঞ্চল স্বভাব হঠাৎ চুপসে গেছে। বাবাকে দেখেছে সে প্রাণবান পুরুষ। আর এখন নিথর শুয়ে আছেন মানুষটি। মায়া মায়া’ বলে যখন জড়ানো কণ্ঠে ডাকেন, বুক ভেঙে যায় মায়ার। অসহায় বোবা দুটো চোেখ কী যেন বলতে চায়। বাবা তাকে মানুষ হতে বলতেন, শুদ্ধ মানুষ। নিজে সৎ ও সাহসী মানুষ ছিলেন। কিরণময়ী মাঝে মধ্যেই বলতেন, মেয়ে বড় হয়েছে, বিয়ে দিয়ে দিই। সুধাময় রুখে উঠতেন শুনে। বলতেন-’পড়াশুনা করবে, চাকরি-বাকরি করবে, তারপর যদি বিয়ে করতে মন চায়, করবে।’ কিরণময়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন–নাকি কলকাতায় ওর মামার কাছে পাঠিয়ে দেব! অঞ্জলি, নীলিমা, স্বাভা, শিবানী, মায়ার বয়সী মেয়েগুলো কলকাতায় পড়াশুনো করতে চলে গেছে। ‘ সুখময় বলতেন—’তাতে কী। এখানে কি পড়ালেখা করবার নিয়ম নেই। স্কুল কলেজ উড়ে গেছে?’

–মেয়ে বড় হয়েছে। রাতে রাতে ঘুম হয় না আমার। বিজয়াকে কলেজ যাবার পথে সেদিন আটকাল না ছেলেরা?

–সে তো মুসলমান মেয়ে হলেও আটকায়। মুসলমান মেয়েরা রেপড হচ্ছে না? তাদের কিডনাপ করা হয় না?

—তা হয়। তবু।

কিরণময়ী বুঝতে পারতেন  সুধাময় কিছুতে সায় দেবেন না। বাপের ভিটে না থাক, দেশের মাটি তো আছে পায়ের নীচে। এই তাঁর সান্ত্বনা। মায়ার অবশ্য কলকাতা যাবার কোনও আগ্রহ ছিল ন কখনও। কলকাতা বেড়াতে গিয়েছে সে একবার, মাসির বাড়িতে। ভাল লাগেনি। মাসতুতো বোনগুলো কেমন যেন নাকউঁচু স্বভাবের। তাকে গল্প আড্ডায় কিছুতে নেয় না। সারাদিন একলা বসে সে বাড়ির কথা ভাবত। পুজোর ছুটিতে যাওয়া, অথচ ছুটি শেষ হবার আগেই সে মেসোমশাইকে ধরল—দেশে ফিরব।

মাসি বললেন—সে কি রে, দিদি তো তোকে দশ দিনের জন্য পাঠালেন।

—বাড়ির জন্য মন কাঁদছে।

মায়ার চোখে জল চলে এসেছিল বলতে গিয়ে। কলকাতার পুজোয় অত হৈ হুল্লোড় তার ভালও লাগেনি। সারা শহর ঝকমক করছিল, তবু কী যে এক লাগছিল তার। তা না হলে দশ দিনের জায়গায় সাত দিনের মাথায় সে চলে আসে! কিরণময়ীর ইচ্ছে ছিল ভূভাল লাগলে মায়া থেকে যাবে ওখানে।

সুধাময়ের শিয়রের কাছে বসে মায়া জাহাঙ্গীরের কথা ভাবে। পারুলের বাড়ি থেকে ফোনে ওর সঙ্গে কথাও হয়েছে দু’বার। জাহাঙ্গীরের কণ্ঠে আগের সেই আবেগ ছিল না। তার চাচা আমেরিকা থাকেন। ওখানে যাবার কথা লিখেছেন তিনি, সে চলে যাবার চেষ্টা করছে। শুনে মায়া প্রায় আর্তনাদ করে উঠল—তুমি চলে যাবে?

—বাহ, আমেরিকার মত জায়গা। যাব না?

—গিয়ে কি করবে?

—আপাতত অড জব করতে হবে। সিটিজেনশিপ পেয়ে যাব একসময়।

—ফিরিবে না দেশে?

–দেশে ফিরে কী করব। এই বাজে দেশে মানুষ থাকতে পারে?

—কবে যাবে ঠিক করেছ?

–সামনের মাসেই। চাচা তাড়া দিচ্ছেন ৷ ভাবছেন এখানে রাজনীতিতে জড়িয়ে আমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছি।

–ও।

জাহাজীর একবারও বলেনি সে চলে গেলে মায়ার কী হবে–মায়া কি তার সঙ্গে যাবে, নাকি দেশে বসে তার জন্য অপেক্ষা করবে! আমেরিকার স্বপ্ন তার দীর্ঘ চার বছরের প্রেম, রেস্তোরাঁয় ক্রিসেন্ট লেকের ধারে টি এস সি-তে বসে বিয়ের কথা বলা সব একেবারে ভুলিয়ে দিল? প্রাচুর্য আর জৌলুসের মোহ মানুষের এত যে জলজ্যান্ত এক মায়া, তাকে ছেড়ে চলে যাবে জাহাঙ্গীর! সুধাময়ের শিয়রের কাছে বসে মায়ার বারবারই জাহাঙ্গীরের কথা মনে পড়ে। ভুলতে চায় সে, পারে না। সুধাময়ের এই নিথর পড়ে থাকার কষ্টও মায়া একই সঙ্গে ধারণ করছে। কিরণময়ীর কষ্ট বোঝা যায় না। তিনি হঠাৎ হঠাৎ মধ্যরাতে কেঁদে ওঠেন। কেন কাঁদেন, কার জন্য কাঁদেন কিছুই বলেন না। সারাদিন নিঃশব্দে কাজ করেন; রান্না করা, স্বামীর মল মুত্র পরিষ্কার করা সবই নিঃশব্দে।

কিরণময়ী সিঁদুর পরেন না। লোহা শাঁখা কিছুই না। সুধাময় খুলে রাখতে বলেছিলেন একাত্তরে। পঁচাত্তরের পর কিরুণময়ী নিজেই খুলে রাখলেন। পঁচাত্তরের পর সুধাময় নিজেও ধুতি ছেড়েছেন। সাদা লংক্ৰন্থ কিনে তারু খলিফার দোকানে পাজামার মাপ দিয়ে এলেন যেদিন, বাড়ি ফিরে কিরণময়ীকে বলেছিলেন—দেখ তো কিরণ, গা-টা গরম হচ্ছে কি না। জ্বর-জ্বর লাগছে।

কিরণময়ী কথা বলেননি। তিনি জানতেন। সুধাময়ের মন খারাপ হলেই গায়ে জ্বর-জ্বর লাগে।

মায়ার অবাক লাগে, সুরঞ্জন। এ সময়ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকছে। সারাদিন ঘরে গুম হয়ে পড়ে থাকে, খাবে কী খাবে না কিছুই বলে না, বাবা তার আছেন কী মরে গেছেন সে খোঁজও কি নেবার প্রয়োজন নেই তার? ঘরে তার বন্ধুরা আসছে, আড্ডা দিচ্ছে, সে বাইরে থেকে ঘর তালা দিয়ে চলে যাচ্ছে, কখন যাচ্ছে, ফিরবে। কখন কিছুই বলছে না-কিছুই কি দায়িত্ব নেই তার? তার কাছে কেউ তো টাকা পয়সা চাইছে না, ছেলে হিসেবে খোঁজ-খবরটুকু করা, ডাক্তার ডাকা, ওষুধ কেনা, পাশে এসে একটু বসলেও তো মনে জোর পাওয়া যায়। অন্তত সুধাময় তো দাবি করতে পারুেন ছেলের কাছে যে তার বাম হাতখানা একবার এসে স্পর্শ করুক সুরঞ্জন। ডান হাত না হয় অচল, বাম হাতে এখনও তো অনুভবের শক্তি আছে।

হরিপদ ডাক্তারের ওষুধে সুধাময় অনেকটা সুস্থ হচ্ছেন। জড়ানো কথা কমে আসছে। তবে হাত পায়ের চেতন ফেরেনি। ডাক্তার বলেছেন-নিয়মিত ব্যায়াম করলে শিগরি ভাল হয়ে যাকেন। মায়ার তো আর কোনও কাজ নেই। টিউশনিতে যেতে হচ্ছে না। মিনতি নামের এক মেয়ে পড়ত, ওর মা বলে দিয়েছে আর পড়াতে হবে না, ওরা ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছে।

-ইন্ডিয়া কেন? মায়া জিজ্ঞেস করেছিল।

ওর মা বিষণ্ণ হেসেছিল শুধু কিছু বলেনি।

মিনতি ভিখারুন্নেসা স্কুলে পড়ত। একদিন সে মিনতিকে অঙ্ক করাতে গিয়ে লক্ষ করল মিনতি পেন্সিল নাড়ছে আর বলছে আলহামদুলিল্লাহির রাহমানির রাহিম, আর রাহমানির রাহিম।

মায়া অবাক হয়ে বলেছিল—এসব কি বলছি তুমি?

মিনতি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিয়েছিল—আমাদের এসেম্বলিতে সূরা পড়া হয়।

–তাই নাকি? এসেম্বলিতে সূরা পড়ে ভিখারুন্নেসায়?

—দুটো সূরা পড়া হয়। তারপর জাতীয় সঙ্গীত।

—সূরা যখন পড়ে, কী কর তুমি?

— আমিও পড়ি। মাথায় ওড়না দিই।

—স্কুলে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টানদের জন্য কোনও প্রেয়ার নেই?

–না।

মায়ার যেন কেমন করে উঠেছিল মন। দেশের বড় একটি স্কুলের এসেম্বলিতে মুসলমানের ধর্ম পালন হয়, আর সেই স্কুলের হিন্দু মেয়েদেরও নীরবে সেই ধর্ম পালনে অংশগ্ৰহণ করতে হয়-এ নিশ্চয়ই এক ধরনের অনাচার।

মায়ার আর একটি টিউশনি ছিল, পারুলেরই আত্মীয় হয় মেয়েটি, সুমাইয়া, ও একদিন বলল-দিদি, আপনার কাছে আর পড়ব না।

–কেন?

–আব্বা বলেছেন একজন মুসলমান টিচার রাখবেন।

–ও আচ্ছা।

টিউশনি দুটো যে আর নেই মায়া বাড়ির কাউকে জানায়নি সে কথা। সুরঞ্জন সংসার থেকে নিচ্ছে, এখন মায়াকেও যদি হাত পাততে হয়, কিরণময়ী সামলাবেন কী করে! সংসারের এত বড় একটি দুর্ঘটনার ওপর সে আর এই দুঃসংবাদটি পাড়ে না।

কিরণময়ীও চুপ হয়ে গেছেন। হঠাৎ। নিঃশব্দে দুটো ডাল ভাত রাঁধেন। সুধাময়ের জন্য ফলের রস, সুপ করতে হয়। ফলই বা কে এনে দেবে এত, সুরঞ্জন সারাদিন শুয়ে থাকে, মানুষ এত শুয়ে থাকতে পারে! মায়ার খানিকটা অভিমােনও আছে দাদাকে নিয়ে। সাত তারিখে এত সে বলেছে—দাদা, চল কোথাও যাই বাড়ি ছেড়ে, সে গা করল না। এখনও কি আর বিপদ কেটে গেছে? বাড়ির সবার নির্লিপ্তি দেখে মায়াও অনেকটা নির্লিপ্ত হয়ে গেছে। সেও ভাবতে চাচ্ছে যা হয় হোক আমার কী। সুরঞ্জনই যদি না ভাবে মায়া একা ভেবে কী করবে!! তার তো এমন কোনও বন্ধু নেই। যেখানে সবাই মিলে উঠতে পারে। পারুলের বাড়িতেই তার অস্বত্তি হচ্ছিল। এমনিতে পারুল তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন, দিন রাত ওবাড়িতে কেটেছে তার আড্ডা দিয়ে, কেউ কখনও প্রশ্ন করেনি ও কেন এসেছে। কিন্তু সেদিন, মায়া এত চেনা ওবাড়িতে, তবু ওরা অচেনা চোখে তাকাল তার দিকে, এত যায় সে ওবাড়িতে, তবু চোখে চোখে প্রশ্ন ছিল কেন এসেছে। পারুল অবশ্য বারবারই বলেছে-এ সময় ওর বাড়িতে থাকা নিরাপদ না।

নিরাপদ অনিরাপদের কথা কেবল মায়াকে নিয়ে ওঠে, কই পারুলকে নিয়ে তো ওঠে। না! পারুলকে কি কখনও বাড়ি ছেড়ে মায়ার বাড়িতে উঠতে হবে? মায়া কুষ্ঠিত হয়, কুঞ্চিত হয়, তবু বেঁচে থাকবার প্রয়োজনে সে পারুলের বাড়িতেই অবাঞ্ছিত অতিথির মত পড়ে থেকেছে। পারুল আতিথেয়তা কম করেনি তবু তার আত্মীয়রা বেড়াতে এসে অনেকেই যখন জিজ্ঞেস করেছে–কী নাম তোমার?

—মায়া।

-পুরো নাম কি?

পারুল মায়াকে পুরো নাম বলতে না দিয়ে নিজে বলেছে–ওর নাম জাকিয়া সুলতানা।

মায়া চমকেছে নাম শুনে। পরে আত্মীয়রা বিদেয় হলে পারুল বলেছে—তোর নাম মিথ্যে বলতে হল, কারণ এরা আবার অন্যরকম, মুন্সি টাইপের। বলে বেড়াবে আমরা হিন্দুদের শেল্টার দিচ্ছি।

–ও।

মায়া বুঝেছে। কিন্তু মনে খুব কষ্ট হয়েছে তার। হিন্দুকে শেল্টার দেওয়া বুঝি অন্যায় কাজ? আর আরেকটি প্রশ্নও তাকে প্রায় রাতেই ঘুমোতে দেয়নি যে হিন্দুকে কেন শেল্টার দিতে হয়? মায়া ইন্টারমিডিয়েট স্টার পাওয়া মেয়ে, আর পারুল সাধারণ দ্বিতীয় বিভাগ। তবু প্রায়ই মনে হয় পারুল বুঝি তাকে করুণা করছে।

 

–বাবা, আঙুলগুলোকে মুঠি কর তো। হাত একটু ভুলতে চেষ্টা করে তো।

মায়ার কথা লক্ষ্মী ছেলের মত শোনেন সুধাময়। মায়ার মনে হয় একটু একটু জোর ফিরছে। সুধাময়ের আঙুলে।

–দাদা কি খাবে না?

—কি জানি, ঘুমোচ্ছে দেখলাম। কিরণময়ী বিরস মুখে বলেন।

কিরণময়ী নিজে খান না। মায়ার জন্য ভাত বেড়ে রাখেন। দরজা জানোলা বন্ধ করা ঘর, আঁধার আঁধার লাগে। মায়ারও ঘুম ঘুম লাগে। হঠাৎ আধা-স্কুমেই চমকে ওঠে মিছিলের শব্দ শুনে। মিছিল যায়-হিন্দু যদি বাঁচতে চাও, এ দেশ ছেড়ে চলে যাও। ‘ সুধাময়ও শোনেন, মায়ার হাতে ধরা ছিল সুধাময়ের হাত, হাতটি তার কেঁপে ওঠে, সে টের পায়।

 

৪ঘ.

সুরঞ্জনের পেট মোচড় দিয়ে ওঠে ক্ষিদেয়। আগে তো খাক না খাক টেবিলে তার ভাত বাড়া থাকত। সে আজ কারও কাছেই বলবে না ক্ষিদের কথা। পাকা উঠোনের কলতলায় গিয়ে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে তারে ঝোলানো তোয়ালে দিয়ে মুখ মেছে। ঘরে এসে শার্ট পাল্টে বেরিয়ে যায় বাইরে। বাইরে যে বেরোয় সে ভেবে পায় না যাবে কোথায়? হায়দারের বাড়িতে? হায়দারের তো এ সময় বাড়ি থাকবার কথা নয়। তবে কি বেলাল, কামাল কারও বাড়িতে? সুরঞ্জন এদের বাড়িতে গেলে ওরা যদি ভাবে বিপদে পড়েছে বলে এসেছে আশ্রয় বা অনুকম্প চাইতে? না সুরঞ্জন যাবে না। সে সারা শহর ঘুরে বেড়াবে একা একা। শহরটি তো তার নিজেরই। একসময় সে ময়মনসিংহ ছেড়ে আসতে চায়নি, আনন্দমোহনে বন্ধুবান্ধব ছিল প্রচুর, ওদের ছেড়ে হঠাৎ করে নতুন একটি শহরে কেন আসতে চাইবে সে। কিন্তু কোনও এক গভীর রাতে রইসউদ্দিনের কাছে বাড়ি যখন বিক্রি করে এলেন সুধাময়, তার পরদিন ভোরে সুরঞ্জন জানত না তার জন্মের এই বাড়িটি, কামিনী ফুলের গন্ধ ভরা, স্বচ্ছ পুকুরে সাঁতার কাটা দত্ত বাড়িটি আর তাদের নেই। সুরঞ্জন যখন শুনল এ বাড়ি তাদের ছেড়ে দিতে হবে সাত দিনের মধ্যে, অভিমানে সে বাড়িই ফেরেনি দুদিন।

সুরঞ্জন বুঝে পায় না। এত অভিমান কেন তার। বাড়ির সবার ওপর তা ছাড়া নিজের ওপরও মাঝে মধ্যেই তার তীব্র অভিমান হয়। পারভিনের ওপরও অভিমান হত তার। মেয়েটি তাকে ভালবাসত, লুকিয়ে চলে আসত তার ঘরে, বলত–চল পালাই।

–পালিয়ে যাবে কোথায়?

—দুরে কোনও পাহাড়ের কাছে।

—পাহাড় পাবে কোথায়? পাহাড় পেতে হলে সিলেট নয় চট্টগ্রাম যেতে হয়।

–তাই যাব। পাহাড়ের ওপর ঘর বানিয়ে থাকব।

—খাবে কি? লতাপাতা?

পারভিন হেসে গড়িয়ে পড়ত সুরঞ্জনের গায়ে। বলত—তোমাকে ছাড়া আমি মরেই যাব।

–এরকম কথা মেয়েরা বলে, আসলে কিন্তু মরে না।

ঠিকই তো বলেছিল সুরঞ্জন। পারভিন মরেনি। বরং বাধ্য মেয়ের মত বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিল। বিয়ের দুদিন আগে জানিয়েছিল, বাড়িতে বলছে তোমাকে মুসলমান হতে হবে। সুরঞ্জন হেসে বলেছিল–আমি নিজে ধর্ম টর্ম মানি না। সে তো তুমি জানোই।

—না তোমাকে মুসলমান হতে হবে।

—আমি মুসলমান হতে চাই না।

–তার মানে তুমি আমাকে চাও না?

–নিশ্চয়ই চাই। কিন্তু সেজন্য আমাকে মুসলমান হতে হবে এ কেমন কথা?

পারভিনের ফর্সা মুখ মুহুর্তে লাল হয়ে উঠেছিল অপমানে। সুরঞ্জন জানত তাকে ত্যাগ করবার জন্য পরিবার থেকে পারভিনের ওপর চাপ আসছে। তার খুব জানতে ইচ্ছে করে হায়দার তখন কোন পক্ষে ছিল। হায়দার পারভিনের ভাই, এদিকে আবার সুরঞ্জনের বন্ধু। সে সব সময় নীরব থেকেছে৷ তাদের সম্পর্কের ব্যাপারে। নীরব থাকাটা সুরঞ্জনের তখন একদমই পছন্দ ছিল না। যে কোনও একটি পক্ষ তো নেওয়া উচিত। হায়দারের সঙ্গে দীর্ঘ আড্ডাগু হত তখন, পারভিন প্রসঙ্গে কোনও কথা হত না। হায়দার যেহেতু প্রসঙ্গ তুলত না, সুরঞ্জনও তুলত না।

পারভিনের একদিন বিয়ে হয়ে গেল এক মুসলমান ব্যবসায়ীর সঙ্গে। সুরঞ্জন যেহেতু মুসলমান হল না সম্ভবত পারভিনও তাই তাকে নিয়ে পাহাড়ে যাবার স্বল্প বিসর্জন দিল। স্বল্প কি এত সহজে পুজোর মূর্তির মত হাসি আনন্দ শেষ হলে ভাসিয়ে দেওয়া যায় জলে! পারভিন যেমন দিয়েছিল? সুরঞ্জনের ধর্মই প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল পারভিনের পরিবারে।

আজ সকালে হায়দার বলেছে–পারভিন বোধহয় ডিভোর্স দেবে তার হাসবেন্ডকে।

দু বছরের মধ্যেই ডিভোর্স? সুরঞ্জন বলতে চেয়েও বলেনি। সে পারভিনকে তো ভুলেই গিয়েছিল, তবু ডিভোর্সের খবরটি শুনে বুকের মধ্যে ধ্বক করে ওঠে। পারভিন নামটি কি খুব যত্ন করে বুকের সিন্দুকে রাখা নেপথলিন দিয়ে? বোধহয়। কতদিন সে পারভিনকে দেখে না। বুকের ভেতর কষ্ট মোচড় দিয়ে ওঠে। সে ইচ্ছে করেই রত্নীর মুখটি মনে করে। রত্না মিত্র। মেয়েটি চমৎকার। সুরঞ্জনের সঙ্গে মানাবেও ভাল। পারভিন ডিভোর্স দেবে তাতে সুরঞ্জনের কী। মুসলমানের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল, পরিবারের পছন্দের বিয়ে, জাত ধর্ম মিললেই বুঝি বিয়ে টেকে? তবে ফেরত আসতে হয় কেন এখন? পাহাড়ে ওঠেনি। স্বামী তাকে নিয়ে? স্বপ্ন পূরণ করেনি? সে বেকার হিন্দু ছেলে, উড়ে বেড়ায়, ঘুরে বেড়ায়, সে কি আর বিয়ের পাত্র হিসেবে ভাল? সুরঞ্জন একটি ক্লিক্সা নেয় টিকাটুলির মোড়ে উঠে। বুকের সিন্দুক থেকে আরশোলার মত বারবারই লাফিয়ে উঠছে পারভিনের মুখ। পারভিন তাকে চুমু খেত, সে পারভিনকে জড়িয়ে ধরে বলত–তুমি একটা পাখি, চড়ুইপাখি।

পারভিন হেসে গড়িয়ে পড়ত, বলত–তুমি একটা বানর।

আচ্ছা সে কি আসলেই একটা বানর? বানর না হলে পাঁচ বছরে সে যা ছিল তাই কি আর থেকে যায়। বয়স ভেসে গেছে। কচুরিপানার মত, তার পাওয়া হয়নি কিছু। কেউ এসে পারভিনের মত বলেনি-তোমাকে খুব ভাল লাগে আমার। পারভিন যেদিন এই কথা বলেছিল, পারভিনকে সেদিন সে বলেছিল—কারও সঙ্গে বাজি হয়েছে বুঝি?

–মানে?

–এই কথাটি আমাকে বলতে পারো কি না এই নিয়ে?

–মোটেও না।

—তবে কি মন থেকে বলছি?

–আমি মন থেকে ছাড়া কথা বলি না।

সেই ঘাড় শক্ত মেয়েটি বাড়িতে বিয়ের কথা উঠল আর ভেঙে পড়তে লাগল, উৰে গেল তার অদ্ভুত অদ্ভুত স্বল্প আর মন যা চাইবে তা করবার ইচ্ছে। তাকে ধরে বেঁধে যেদিন বিয়ে দিয়ে দিল, পারভিন তো একবারও বলেনি। আমি ওবাড়ির বানরকে বিয়ে করব। দু বাড়ি পার হলেই হায়দারদের বাড়ি, বিয়েতে মায়া গিয়েছিল, কিরণময়ীও, সুরঞ্জন যায়নি।

রিক্সাকে চামেলিবাগের দিকে যেতে বলে। সন্ধে নামছে। ক্ষিদেয় পেট কামড়াচ্ছে। বুক জ্বলা রোগ তার আছেই, টক ঢেকুর ওঠে। সুধাময় এন্টাসিড খেতে বলেন। ঠোঁট সাদা করে ট্যাবলেট খেতে তার বিচ্ছিরি লাগে! তা ছাড়া মনেও থাকে না পকেটে ওষুধ নিয়ে বেরোতে। পুলকের বাড়ি গিয়ে কিছু খেতে হবে। পুলককে ঘরেই পাওয়া যায়। সে পাঁচ দিন ঘর বন্দি, দরজায় তালা দিয়ে ঘরে বসে থাকে। ঘরে ঢুকেই সুরঞ্জন বলে—কিছু খাবার দাও। বাড়িতে বোধহয় রান্না-টান্না কিছু হয়নি আজ।

–কেন রান্না হয়নি?

–ডাঃ সুধাময় দত্তের ষ্ট্রেক হয়েছে। তাঁর স্ত্রী কন্যা আপাতত তাঁকে নিয়ে ব্যস্ত। এককালের ধনাঢ্য সুকুমার দত্তের পুত্র সুধাময় দত্ত এখন নিজের চিকিৎসার খরচ যোগাতে পারেন না।

–আসলে তোমার কিছু করা উচিত ছিল। চাকরি টাকরি।

–মুসলমানের দেশে চাকরি পাওয়া খুব কঠিন। আর এই মূর্খদের আন্ডারে চাকরি করব কি বল!

পুলক বিস্মিত হয়, সুরঞ্জনের আরও কাছে সরে আসে, বলে–তুমি মুসলমানদের গাল দিচ্ছ সুরঞ্জন?

–ভয় পাচ্ছ কেন? গাল তো তোমার সামনে দিচ্ছি, ওদের সামনে তো আর দিচ্ছি। না। সামনে ওদের গাল দেওয়া কি সম্ভব? ধড়ে কি তবে মুণ্ডুটি থাকবে?

সুরঞ্জন দাঁতে দাঁত চেপে সোফার হাতলটি চেপে ধরে। পুলকও কেমন হতভম্ব বসে থাকে। নীলা ভাত তরকারি গরম করে টেবিলে দেয়। কষ্ট-কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে–সুরঞ্জনদা, সারাদিন কিছুই খাননি?

সুরঞ্জন ম্লান হাসে। বলে–আমার আবার খাওয়া। আমার খাওয়ার জন্য ভাবে কে বল।

—বিয়ে-টিয়ে করে নেন।

–বিয়ে? সুরঞ্জন বিষম খায়। —আমাকে কে করবে বিয়ে?

—সেই পারভিনের কারণে বিয়ে থেকেই মন উঠে গেল? এ কিন্তু ঠিক না।

—না না। তা হবে কেন? আসলে বিয়ে যে করতে হবে এ আমি এতদিন ভুলেই বসেছিলাম।

কষ্টের মধ্যেও পুলক আর নীলা হাসে।

সূরঞ্জনের তেমন রুচি নেই খাবারে। তবু সে ক্ষিদেটাকে চাপা দেবার জন্য খায়।

—আমাকে কিছু টাকা ধার দিতে পারবে পুলক? খেতে খেতেই সে জিজ্ঞেস করে।

–কত টাকা?

—যত পারে। বাড়িতে কেউ আমাকে কিছু জানাচ্ছে না। টাকা পয়সা দরকার কি না। কিন্তু টের পাচ্ছি মা’র হাত খালি।

–তা না হয় দিচ্ছি। দেশের খবর জানো তো? ভোলার, চট্টগ্রামের, সিলেটের? কক্সবাজারের? পিরোজপুরের?

–এই তো বলবে যে সব মন্দির ভেঙে গুড়িয়ে ফেলেছে। হিন্দুদের ঘরবাড়ি লুট করেছে, পুড়িয়ে দিয়েছে। পুরুষদের মেরেছে, নারীদের ধর্ষণ করেছে। এ ছাড়া নতুন কোনও খবর থাকলে বল।

—এগুলো তোমার কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে?

—নিশ্চয় স্বাভাবিক। কী আশা কর তুমি এই দেশ থেকে? পিঠ পেতে বসে থাকবে আর তারা কিল দিলে গোসা করবে, এ তো ঠিক নয়।

খাবার টেবিলে সুরঞ্জনের মুখোমুখি চেয়ারে বসে পুলক। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে বলে—সিলেটে চৈতন্যদেবের বাড়িটি পুড়িয়ে দিয়েছে। পুরনো লাইব্রেরীটিও রাখেনি। সিলেট থেকে আমার দাদা এসেছে। কালীঘাট কালীবাড়ি, শিকবাড়ি, জগন্নাথ আখড়া, চালি বন্দর ভৈরব বাড়ি, চালি বন্দর শ্মশান, ষন্তরীপুর মহাপ্রভুর আখড়া, মীরা বাজার রামকৃষ্ণ মিশন, মীরা বাজার বলরামের আখড়া, নির্মলবালা ছাত্রাবাস, বন্দর বাজার ব্রাহ্ম মন্দির, জিন্দাবাজার জগন্নাথের আখড়া, গোবিন্দজীর আখড়া, লামা বাজার নরসিংহের আখড়া, নয়া সড়ক আখড়া, দেবপুর আখড়া, টিলাগড় দুৰ্গাবাড়ি, বিয়ানি বাজার কালীবাড়ি, ঢাকা দক্ষিণ মহাপ্রভুর বাড়ি, গোটাটিকর শিব বাড়ি, মহালক্ষ্মী বাড়ি মহাপীঠ, ফেঞ্চুগঞ্জ, সারকারখানা দুৰ্গর্বিাড়ি, বিশ্বনাথে শাজিবাড়ি, বৈরাগী বাজার আখড়া, চন্দগ্রাম শিব মন্দির, আকিলাপুর আখড়া, কোম্পানিগঞ্জ জীবনপুর কালীবাড়ি, বালাগঞ্জ যোগীপুর কালীবাড়ি, জকিগঞ্জ আমলসী কালীমন্দির, বারহাটা আখড়া, গাজীপুর আখড়া, বীরশ্ৰী আখড়া ভেঙে আগুন লাগিয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে। বেণুভূষণ দাস, সুনীল কুমার দাস, কানুভুষণ দাস আগুনে পুড়েছে।

—তাই নাকি?

—ক’ত যে কাণ্ড হচ্ছে সুরঞ্জন, আমরা এ দেশে থাকব কি করে বুঝি না। চট্টগ্রামে তো জামাত আর বি এন পি মিলে বাড়িঘর মন্দির পুড়িয়েছে। হিন্দুদের ঘটিবাটি, পুকুরের মাছ পর্যন্ত ধরে নিয়ে যাচ্ছে ওরা। সাত-আট দিন পেটে ভাত নেই হিন্দুদের। সীতাকুণ্ডের খাজুরিয়া গ্রামের কানুবিহারী নাথ আর তার ছেলে অৰ্জ্জুন বিহারী নাথের বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে জামাত শিবিরের লোকেরা বলেছে বিশ হাজার টাকা না দিতে পারলে বাড়িতে থাকতে দেওয়া হবে না। তারা বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। মীরেরসরাই কলেজের অধ্যাপকের মেয়ে উৎপলা রানী ভৌমিককে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে নিয়ে যায়, ফেরত দেয় শেষ রাতে। আচ্ছা বল তো এসবের প্রতিবাদ কি আমরা করব না?

—করলে কি হবে জানো? ডি এল রায়ের কবিতাটা জানো তো, আমি যদি পিঠে তোর ঐ লাথি একটা মারিই রাগে, তোর তো স্পর্ধা বড় পিঠে যে তোর ব্যথা লাগে?

সুরঞ্জন সোফায় হেলান দেয়। চোখ বোজে।

–ভোলায় তো কয়েক হাজার বাড়ি লুট হয়েছে, কয়েক হাজার বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আজ সকালে কার্ফ ভেঙেছিল বারো ঘন্টার জন্য। তিনশ লোক শাবল কুড়াল নিয়ে লক্ষ্মী নারায়ণ আখড়ায় থার্ড টাইম হামলা করে। পুলিশ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। বোরহানউদ্দিনে দেড় হাজারের বেশি ছাই হয়ে গেছে। দু হাজার বাড়ির ক্ষতি হয়েছে। তজমুদ্দিনে ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছে দু হাজার দুশ, অর্ধেক ধ্বংস দু হাজার। ভোলায় মন্দির ধ্বংস করেছে। দুশ ষাটটি।

সুরঞ্জন হেসে বলে—একদমে রিপোর্টারের মত কথা বলে গেলে। তোমার বুঝি খুব কষ্ট হচ্ছে এসব ঘটনায়?

পুলক অবাক চোখে তাকায় সুরঞ্জনের দিকে। বলে—তোমার কষ্ট হচ্ছে না?

সুরঞ্জন ঘর কাঁপিয়ে হেসে ওঠে। বলে—একবিন্দু না। কষ্ট হবে কেন?

পুলক সামান্য চিন্তিত হয়। বলে—আসলে ওদিকে আমার অনেক আত্মীয় আছেন তো, খুব ভাবনা হচ্ছে ওদের জন্য।

—মুসলমানের কাজ মুসলমান করেছে, আগুন দিয়েছে ঘরে, তাই বলে কি মুসলমানের ঘর পোড়ানো হিন্দুর শোভা পায়? তোমাকে আমি কোনও রকম সাল্কনা দিতে পারছি না পুলক। আই অ্যাম সরি।

পুলক দু হাজার টাকা ভেতর ঘর থেকে নিয়ে সুরঞ্জনের হাতে দেয়। টাকা কটি পকেটে পুরে সুরঞ্জন বলে–অলকের খবর কি, খেলায় নিয়েছে। ওকে?

–না। সারাদিন সে মন খারাপ করে ঘরে বসে থাকে। করার কিছু নেই। ও জানোলা দিয়ে দেখছে ওর বন্ধুরা মাঠে খেলছে। ও একা একা ঘরে ছটফট করে।

—শোন পুলক, যাদের অসাম্প্রদায়িক ভাবি, নিজেদের মানুষ ভাবি, বন্ধু ভাবি, তারা ভেতরে ভেতরে সাম্প্রদায়িক। এ দেশের মুসলমানের সঙ্গে এমন ভাবে মিশেছি যে আমরা এখন অনর্গল আসসালামু আলায়কুম বলি, খোদা হাফেজ বলি, জলকে পানি বলি, স্নানকে গোসল বলি, যাদের রমজান মাসে আমরা বাইরে চা সিগারেট খাই না, এমন কি প্রয়োজনে হোটেল রেস্তোরাঁয় খেতে পারি না দিনের বেলা, তারা আসলে আমাদের কতটুকু আপন? কাদের জন্য আমাদের এই স্যাক্রিাফাইস, বল? পুজোয় কদিন ছুটি পাই? আর দুটো ঈদে তো সরকারি হাসপাতালগুলোয় ঘাড় ধরে হিন্দুদের দিয়ে কাজ করানো হয়। অষ্টম সংশোধনী হয়ে গেল, আওয়ামি লিগ কদিন চেঁচালো ব্যাস, হাসিনা নিজেই তো এখন মাথা ঢেকেছে ঘোমটায়। হজ্ব করে আসার পর চুল দেখা যায় না। এমন ঘোমটাই দিয়েছিল। সবার চরিত্র এক পুলক, সবার। এখন আমাদের সবার হয় আত্মহত্যা করতে হবে, নয় দেশ ছাড়তে হবে।

 

পুলক দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সুরঞ্জন দরজার দিকে এগোয়। কিরণময়ী একবার বলেছিল ময়মনসিংহে রইসউদ্দিনের কাছে একবার যেতে, এত অল্প টাকায় বাড়িটি নিয়েছেন, তিনি যদি এ সময় কিছু সাহায্য করেন। সুরঞ্জন টাকা ধার চায় না কারও কাছে। মুন্দির দোকানে বাকি পড়ে, মাস শেষে দিয়ে দেয়। পুলকের কাছে সে সহজে চাইতে পেরেছে। সম্ভবত একসময় তাকে দিয়েছে সে, সে কারণে, এও হতে পারে পুলক হিন্দু ছেলে, সে যত বুঝবে সংখ্যালঘুর কষ্ট, তত আর কেউ বুঝবে না। অন্যদের কাছে চাইলে হয়ত দেবে কিন্তু মন থেকে দেবে না। সুরঞ্জন সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবার সে কেনিও মুসলমানের কাছে হাত পাতবে না। বাড়ি থেকে তাকে কোনও দায়িত্ব দিচ্ছে না কেউ। ভাবছে দেশপ্রেমিক ছেলে, দেশের মঙ্গল চিন্তায় দিনরাত খেয়ে না খেয়ে জীবন পার করছে, একে খামোক বিরক্ত করে কী লাভ। টাকা কটি সে কিরণময়ীর হাতে দেবে। কী করে যে সংসারের হাল ধরে আছে মানুষটি, কারও প্রতি তার কোনও অভিযোগ নেই। অকৰ্মণ্য ছেলেটির প্রতিও। এত যে দারিদ্র গেছে, তিনি কোনও দিন বিরক্ত হননি।

পুলকের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে হনহন হাঁটতে থাকে টিকাটুলির দিকে। তার হঠাৎ মনে হয় কী লাভ মানুষের বেঁচে থেকে। এই যে সুধাময় বেঁচে আছেন ধুঁকে ধুঁকে, তাঁকে অন্যরা পেচ্ছাব পায়খানা করাচ্ছে, খাওয়াচ্ছে দাওয়াচ্ছে, কী লাভ তার এরকম বেঁচে থেকে? সুরঞ্জনই বা কেন বেঁচে আছে। একবার ভাবে টাকা তো আছেই প্যান্টের পকেটে, কয়েক এস্পপুল পেথিডিন কিনে একবার পুশ করলে কেমন হয় শিরায়। মরে যাবার ব্যাপারটি সে বেশ উপভোগ করে। মরে গেলে, ধরা যাক বিছানায় শুয়ে মরে পড়ে আছে, বাড়ির কেউ জানবে না, ভাববে ঘুমিয়ে আছে ছেলে, তাকে বিরক্ত করা ঠিক নয়। একসময় মায়া হয়ত ডাকতে আসবে, দাদা ওঠ, বাবার জন্য আমাদের জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা কর, দাদা তখন আর সাডা দেবে না। এরকম সে ভাবছে যখন, তখনই বিজয় নগরের মোড়ে দেখে মিছিল, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মিছিল। হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই জাতীয় শ্লোগান। সুরঞ্জনের ঠোঁটের কোণে বিদ্রূপের হাসি খেলে যায়।

বাড়ি যাবার আগে সে গৌতমের বাড়ি যায়। গৌতম শুয়ে ছিল। আগের চেয়ে ভাল এখন। কিন্তু তার চোখে মুখে সেই আশঙ্কাটুকু আছেই। কোথাও শব্দ হলে চমকে ওঠে। সাদাসিধে ছেলে, মেডিকেলে পড়ে, রাজনীতি করে না, পাড়ায় শত্ৰু নেই কোনও, আর তাকেই মার খেতে হল, ভারতের বাবরি মসজিদ কোন ভাঙল সেই অপরাধে!

গৌতমের মা কাছেই বসেছিলেন। কেউ যেন না শোনে এমন সতর্ক কণ্ঠে বললেন–বাবা, আমরা তো চলে যাচ্ছি।

–চলে যাচ্ছেন? সুরঞ্জন চমকে ওঠে।

–হ্যাঁ, বাড়ি বিক্রি করার ব্যবস্থা হচ্ছে।

ওরা কোথায় চলে যাবে তা আর শুনতে ইচ্ছে করে না। সুরঞ্জনের। সে জিজ্ঞেসও করে। না। ওরা কি দেশ ছেড়ে চলে যাবে? বসে থাকলে এই ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদটি সুরঞ্জনকে শুনতে হবে বলে সে হঠাৎ চেয়ার ঠেলে উঠে পড়ে। বলে-যাই। গৌতমের মা বলেন, বস বাবা, যাবার আগে আর দেখা হয়। কিনা। দুটো কথা বলি বস। তাঁর কণ্ঠে দলা পাকানো কান্না।

–না মাসি, বাড়িতে কাজ আছে, যাই। আরেকদিন না হয় আসব।

সুরঞ্জন না মাসির দিকে তাকায়, না গীেতমের দিকে। চোখ নামিয়ে চলে যায়। সে একটি দীর্ঘশ্বাস গোপন করতে চায়, পারে না।

লজ্জা (০৫) বিরূপাক্ষ সুরঞ্জনের পার্টির ছেলে

৫ক.

বিরূপাক্ষ সুরঞ্জনের পার্টির ছেলে। নতুন ঢুকেছে। বেশ মেধাবী ছেলে। সুরঞ্জন তখনও বিছনা ছাড়েনি, বিরূপাক্ষ ঢোকে।

—দশটা বাজে এখনও ঘুমোচ্ছেন?

–ঘুমোচ্ছি। কই। শুয়ে আছি। কিছুই করার না থাকলে শুয়ে থাকতেই হয়। আমাদের তো আর মসজিদ ভাঙার সাহস নেই। তাই শুয়ে থাকতেই হবে।

–ঠিকই বলেছেন। শত শত মন্দির ভাঙছে ওরা। যদি আমরা একটা চিল ছুঁড়ি কোনও মসজিদে, কী উপায় হবে! চারশ বছরের পুরনো রমনা কালীবাড়িটি পাকিস্তানিরা ধুলোয় মিশিয়ে দিল, কোনও সরকারই তো বলেনি ওটি গড়ে দেবে!

—হাসিনা বার বার বলছেন বাবরি মসজিদ পুনর্নির্মাণের কথা। কিন্তু বাংলাদেশের হিন্দুদের ক্ষতিপূরণের কথা বললেও ভাঙা মন্দির পুনর্নির্মাণের কথা কিন্তু একবারও বলেননি। বাংলাদেশের হিন্দুরা বানের জলে ভেসে আসেনি। তারা এ দেশের নাগরিক। তাদের বেঁচে থাকবার অধিকার, নিজের জীবন, সম্পত্তি, উপাসনালয় রক্ষা করবার অধিকার কারও চেয়ে কম নয়।

–কেবল কি বাবরি মসজিদ ইস্যু নিয়ে ওরা লুটপাট ভাঙচুর করে? বিরানব্বইয়ের একুশে মার্চ ভোরবেলা বাগেরহাটের বিশারিহাটা গ্ৰাম থেকে কলিন্দ্রনাথ হালদারের মেয়ে পুতুল রানীকে ওই এলাকারই মোখলেসুর রহমান আর চাঁদ মিয়া তালুকদার কিডন্যাপ করেছে। পটুয়াখালির বগা ইউনিয়নের ইউ পি চেয়ারম্যান ইউনুস মিয়া আর ইউ পি সদস্য নবী আলি মৃধার অত্যাচারে গ্রামের মণি আর কানাই লালের পরিবার দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। রাজনগর গ্রামের বীরেনের জমি দখল করার জন্য বীরেনকে ধরে নিয়ে যায়, আজও বীরেনের কোনও খবর পাওয়া যায়নি। সুধীরের জায়গা জমি দখল করার জন্য অত্যাচার চালালে সুধীরও দেশ ত্যাগ করে। সাবুপুরা গ্রামের চন্দন শীলকে চেয়ারম্যান নিজেই ধরে নিয়ে যায়। আজও তার কোনও খোঁজ নেই। বামনকাঠি গ্রামের দীনেশের কাছ থেকে জোর করে সাদা স্ট্যাম্পে সই নিয়েছে। বগা গ্রামের চিত্তরঞ্জন চক্রবতীর ক্ষেতের ধান কেটে নিয়ে যায়। চিত্তবাবু মামলা করলে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য চাপ দেয়। এমনকি মেরে ফেলার হুমকিও দিচ্ছে।

সুরঞ্জন সিগারেট ধরায়। বিরূপক্ষের আলোচনায় সে অংশ নিতে চায় না। তবু সে লক্ষ করে অল্প অল্প জড়িয়ে যাচ্ছে ঘটনায়। সিগারেট ঠোঁটে চেপে সে বলে-পিয়লা এপ্রিল স্বপন চন্দ্ৰ ঘোষের নিউ জলখাবারে সাত-আটজন লোক পিস্তল দেখিয়ে দশ হাজার টাকা চাঁদা চায়। চাঁদা না পেয়ে দোকানের কর্মচারীদের পেটাতে শুরু করে। পিটিয়ে ক্যাশ ভেঙে বিশ হাজার টাকা নিয়ে যায়। অবশ্য এসব ঘটনা মুসলমানদের দোকানেও ঘটছে। চাঁদাবাজাদের অত্যাচার দিন দিন বাড়ছে। তারপর ধর সিদ্দিক বাজারের মানিক লাল থুপীর নিজস্ব সম্পত্তির অর্ধেক অংশ এলাকার সাহাবুদ্দিন, সিরাজ, পারভেজ, সালাউদ্দিন এরা জোর করে দখল করে নিয়েছে। এখন তারা মানিক লালের পুরো সম্পত্তি নিয়ে নেবার চেষ্টা চালাচ্ছে।

সুরঞ্জন কিছুক্ষণ থেমে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে—ধান কেটে নেওয়া, মেয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া, রেপ করা, জমি দখল, মেরে ফেলার হুমকি, পিটিয়ে বাড়ি ছাড়া করা, দেশ ছাড়া করা এসব কি আর এদিক সেদিক উদাহরণ দিয়ে হবে! এ তো সারা দেশ জুড়ে হচ্ছে। আমরা আর কটা অত্যাচারের খবর রাখি, দেশত্যাগের খবর আর কটা রাখি, বল।

—নোয়াখালির সেনাবাগে কৃষ্ণলাল দাসের বউ স্বর্ণবালা দাসকে আবুল কালাম মুলি, আবুল কাশেম সহ কয়েকজন কিডন্যাপ করে, রেপ করে, তারপর অজ্ঞান অবস্থায় বাড়ির পাশের ধানক্ষেতে ফেলে রেখে যায়। বিরূপাক্ষ বলে।

সুরঞ্জন বিছানা ছেড়ে কালতলায় যায়। মুখ ধুতে গিয়ে কিরণময়ীকে দুটো চায়ের কথা বলে। কাল রাতে কিরণময়ীর হাতে সে দু হাজার টাকা দিয়েছে। সুতরাং ছেলে যে একেবারই দায়িত্বজ্ঞানহীন এ কথা নিশ্চয়ই বলবেন না। তিনি। কিরণময়ীকে অন্য দিনের তুলনায় ফ্রেশ লাগছে। সম্ভবত অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তা ঘুচেছে বলে। বিরূপাক্ষ শুকনো মুখে চেয়ারে বসেছিল। সুরঞ্জন ঘুরে ঢুকেই বলে–চিয়ার আপ, চিয়ার আপ।

বিরূপাক্ষ ম্লান হাসে। সুরঞ্জনেরও আজ অনেকটা তাজা লাগছে হাত পা। সুধাময়ের ঘরে একবার টু দিয়ে আসবার কথা ভাবে সে। এর মধ্যেই চা চলে আসে। মায়া নিয়ে আসে দু কাপ চা ৷

–কিরে তুই এ ক’দিনে বেশ শুকিয়ে গেছিস মনে হচ্ছে। পারুলের বাড়িতে খাওয়া-টাওয়া দেয়নি বুঝি? মায়া কোনও উত্তর না দিয়ে চলে যায়। সুরঞ্জনের এই রসিকত্ৰা সে গায়ে মাখে না। সুধাময় অসুস্থ। এ সময় এমন হাস্যরস করা বোধহয় উচিত হয়নি সুরঞ্জনের। মায়ার নীরবতা তাকে খানিকটা ভাবায়।

এই ভাবনা থেকে বিরূপাক্ষ তাকে সরিয়ে আনে। সে চা পান করতে করতে বলে—সুরঞ্জনদা, আপনি তো ধর্ম মানেন না। পুজো করেন না, গরুর মাংস খান, মুসলমানদের বলুন আপনি সত্যিকার হিন্দু নন, অর্ধেক মুসলমান।

—আমি যে সত্যিকার মানুষ, ওদের আপত্তি তো ওখানেই। উগ্ৰ মৌলবাদী হিন্দু আর মুসলমানে কোনও বিরোধ নেই। এখানকার জামাত নেতার সঙ্গে ভারতের বি জে পি নেতাঙ্গের বন্ধুত্ব দেখছ না? দুই দেশে দুই মৌলবাদী দল ক্ষমতাবান হতে চাইছে। ভারতের দাঙ্গার জন্য দায়ী বি জে পি নয়, দায়ী কংগ্রেস এ কথা তো বায়তুল মোকাররমের সভায় নিজামি নিজেই বলেছে।

—ভারতের দাঙ্গায় এক হাজার লোক নিহত হয়েছে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, আর এস এস, বজরঙ্গ, জামায়াত, ইসলামি সেবক সংঘ দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এদিকে সিলেটে হরতাল হচ্ছে, পিরোজপুরে একশ চুয়াল্লিশ ধারা, ভোলায় কার্ফু, তা ছাড়া টুকরো টুকরো শান্তি মিছিল তো হচ্ছেই। মিছিলে শ্লোগান উঠছে ‘নিজামি আদভানি ভাই ভাই, এক দড়িতে ফাঁসি চাই।’ আজ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সর্বদলীয় শান্তি সভা। ব্রিটেনের মন্দিরে ও নাকি হামলা হয়েছে। তোফায়েল আহমেদ ভোলা ঘুরে এসে বলেছেন ভোলায় বি ডি আর পাঠানো দরকার। এলাকার অবস্থা খারাপ।

–কেন, পুড়ে সব ছাই হয়ে গেলে বি ডি আর গিয়ে কি করবে ওখানে? ছাই-এর গাদা জমাবো? কোথায় ছিলেন তোফায়েল ছয় তারিখ রাতে? সে রাতেই তিনি কেন প্রটেকশনের ব্যবস্থা করলেন না?

সুরঞ্জন উত্তেজিত হয়ে ওঠে। বলে–আওয়ামি লিগকে ধোয়া তুলসীপাতা ভেব না।

–এরকম কি হতে পারে, এই সরকারের ওপর দোষ পড়ার জন্য আওয়ামি লিগও দাঙ্গা থামানোর চেষ্টা করেনি?

-জানি না। হতে পারে। তবে সবার হচ্ছে ভোটের প্রয়োজন। এই দেশে চলে ভোটের রাজনীতি, এখানে আদর্শ ফাদর্শের ধার কেউ ধারে না, ছলে-বলে-কৌশলে ভোট পেলেই হল। আওয়ামি লিগ তো ভেবেছে হিন্দুর ভোট তারা পাবেই। কী যেন বলে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক না কি। কোথাও কোথাও নাকি ওরাই লুটপাট করেছে।

–কোথাও এমনও হয়েছে, যেসব এলাকা থেকে আওয়ামি লিগ ভোটে জেতে, সেসব এলাকার বি এন পি-র লোকেরা হিন্দু বাড়ি লুট করে মন্দির ভেঙে-পুড়িয়ে বলছে যাদের ভোট দাও, তারা কোথায় এখন? একইরকম বি এন পি যেখানে জেতে, আওয়ামি লিগ করেছে। ভোলায় করেছে বি এন পি-র লোকেরা, এদিকে আবার মহেশখালি, ঘিওর, মানিকগঞ্জে করেছে আওয়ামি লিগের লোক।

—রাজনীতির ব্যাপার তো আছেই। কিন্তু মৌলবাদীদের বাদ দিয়ে কিছু হয়নি। আচ্ছা, আজ নাকি অভিন্ন সম্পাদকীয় বের হয়েছে প্ৰায় সব পত্রিকায়? সাম্প্রদায়িক সম্প্ৰীতি রক্ষার আবেদন আছে নাকি ওতে?

–আপনি কি পত্রিকা পড়েন না?

—ইচ্ছে করে না। এ সময় মায়া ঢেকে ঘরে। একটি খাম রাখে টেবিলে, বলে—মা দিয়ে দিল, বলল লাগবে না!

মা কি দিল। এই প্রশ্ন করুবার আগে মায়া চলে যায়। সুরঞ্জন খাম খুলে দেখে গত রাতের দু হাজার টাকা। অপমানে লাল হয়ে ওঠে সুরঞ্জনের মুখ। এ কি কিরণময়ীর অহঙ্কার? নাকি তিনি ভেবেছেন বেকার ছেলে চুরি ডাকাতি করে টাকা এনেছে? অভিমানে লজ্জায় সুরঞ্জনের আর কথা বলতে ইচ্ছে করে না। বিরূপাক্ষর সঙ্গেও না।

 

৫খ.

কিরণময়ীর বাবা ছিলেন ব্ৰাহ্মণবাড়িয়ার নামকরা লোক। বড় উকিল। অখিল চন্দ্ৰ বসু। ষোল বছরের মেয়েকে ডাক্তার ছেলের কাছে বিয়ে দিয়ে পুরো ফ্যামিলি নিয়ে কলকাতা চলে গিয়েছিলেন। তাঁদের আশা ছিল মেয়ে জামাইও বুঝি চলে আসবে একসময়। কিরণময়ীও ভেবেছিলেন এক এক করে বাপ মা জ্যাঠা কাকা পিসি মাসি মামা প্রায় সবাই যখন চলে গেছেন, তিনিও বোধহয় যাবেন। কিন্তু এ এক অদ্ভুত ফ্যামিলিতে এসে পড়েছেন তিনি, শ্বশুর শাশুড়ির কাছে ছিলেন ছ’ বছর, ছ’বছরে তাঁরা আত্মীয়স্বজন পাড়া-পড়শিকে চোখের সামনে পাততাড়ি গুটোতে দেখেছেন, তবু ভুলেও কখনও দেশত্যাগের নাম করেননি। কিরণময়ী লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতেন। কলকাতা থেকে বাবার চিঠি আসন্ত-মা কিরণ, তোমরা কি আসিবে না ঠিক করিলে? সুন্ধাময়কে আরও ভাবিতে বল। দেশ ছাড়িয়া আসিতে তো আমাদেরও ইচ্ছা করেনি। কিন্তু আসিতে বাধ্য হইয়াছি। এইখানে আসিয়া খুব যে ভাল আছি তাহা নহে। দেশের জন্য মন কেমন করে। তবু বাস্তবকে তো মানিয়া লইতেই হয়। তোমাদের জন্য চিন্তা হয়। ইতি তোমার বাবা।’ এইসব চিঠি কিরণময়ী কত যে পড়তেন, চোখের জল মুছতেন, রাতে রাতে। সুধাময়কে বলতেন—’তোমার আত্মীয়রা অনেকেই নেই। আমার আত্মীয়রাও চলে গেছে। এখানে থেকে রোগে শোকে মুখ জল দেবার লোক পাব না।’ সুধাময় বিদ্যুপের হাসি হেসে বলতেন-‘জলের এত কাঙালি তুমি। তোমাকে পুরো ব্ৰহ্মপুত্রই দিয়ে দেব। কত জল খেতে পারো দেখব। আন্ধীয়রা কি ব্ৰহ্মপুত্রের চেয়ে বেশি জল ধারণ করে দু’ দেশ ছেড়ে যাবার কথা শ্বশুর নয়, স্বামী নয়, এমনকি পেটের ছেলে সুরঞ্জন, সেও মনোনি কোনও দিন। কিরুণাময়ীকে অগত্যা এই সংসারের স্বাভাবি চরিত্রের সঙ্গে তাল মেলাতে হয়েছে। তাল মেলাতে গিয়ে কিরণময়ী অবাক হন সংসারের সুখ দুঃখে, সম্পদে দারিদ্রে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছেন সুধাময়ের চেয়ে বেশি।

কিরণময়ী তাঁর হাতের দুটো বালা বিক্রি করেছেন। হরিপদ ডাক্তারের স্ত্রীর কাছে। বাড়ির কাউকে তিনি জানতে দেননি ঘটনাটি। এসব জানাবারুই বা কি আছে। সোনাদানা তো এমন মূল্যবান কিছু নয় যে প্রয়োজনে বিক্রি করা যাবে না। সুধাময়ের সুস্থ হয়ে ওঠাই এ মুহুর্তে সবচেয়ে জরুরি। মানুষটির প্রতি কোথেকে যে এত ভালবাসা জন্মায়, কিরণময়ী বুঝতে পারেন না। সেই একাত্তরের পর থেকে সুখময়কে তাঁর গভীর করে পণ্ডিয়া হয় না। মাঝে মধ্যে সুধাময় বলেন—কিরণময়ী, আমি বোধহয় তোমাকে ঠকালাম খুব, তাই না?

কিরণময়ী বোঝেন কিসের ঠিকার কথা বলেন সুধাময়। তিনি চুপ করে থাকেন। কিছু যে বলবেন তিনি, তিনি যে বলকেন-না, আমি আবার ঠিকাছি কোথায়? বলা হয় না। তাঁর। বলবার কোনও কথা তিনি খুঁজে পান না। সুধাময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন-তুমি কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে কিরণ? আমার বড় ভয় হয়।

কিরণময়ী কখনও সুন্ধাময়কে ছেড়ে যাবার কথা ভাবতে পারেন না। মানুষের কি ওই একটি সম্পর্কই প্রধান? আর তুচ্ছ সব? তুচ্ছ তবে পিঁয়ত্ৰিশ বছর একঘরের জীকন? এত সহজেই স্নান হয়ে যেতে পারে দীর্ঘ আনন্দ-বেদনার সংসারযাপন? না, কিরণময়ী ভাবেন-জীবন মানুষের একটাই। এই জীকন তো আর ঘুরে ফিরে বার বার আসবে না। জীবনে না হয় মেনেই নিলাম কিছুটা দুঃসহবাস। একাত্তর থেকে সুধাময় যৌন জীবন যাপনে অক্ষম একজন মানুষ। এ নিয়ে কিরণময়ীর কাছে তাঁর লজ্জার অন্ত ছিল না। তিনি প্রায়ই গভীর রাতে ফিসফিস করে তাঁকে ডেকে তুলে বলতেন—তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে কিরণ?

—কি কষ্ট? কিরণময়ী বুঝেও বোঝেননি ভাব করতেন।

সুধাময়ের অস্বক্তি হত বলতে। তিনি অক্ষমতার যন্ত্রণায় বালিশে মুখ খুঁজতেন। আর কিরণময়ী দেয়ালের দিকে ফিরে নিঝুম রাত পার করতেন। মাঝে মধ্যে সুধাময় বলতেন—’তুমি যদি ইচ্ছে কর, না হয় নতুন করে সংসার পাতো, আমি কিছু মনে করব না।‘

কিরণময়ীর শরীরে কোনও তৃষ্ণা ছিল না। এ কথা সত্য নয়। ছিল, সুধাময়ের বন্ধুরা যখন আসতেন, সামনে বসে গল্প করতেন, ওঁদের ছায়া পড়ত তাঁর কোলে, কিরণময়ী প্রায়ই তাঁর কোলের ছায়ার দিকে আড়াচোখে তাকতেন। তাঁর হঠাৎ হঠাৎ ইচ্ছেও হত কোলের ছায়াটি যদি সত্যি হত, যদি ছায়াটির মানুষ একবার মাথা রাখত কোলে। শরীরের তৃষ্ণাটি খুব বেশি বছর ভোগায়নি তাঁকে। সংযমে সংযমে পার হয়ে গেছে। বয়স কি থেমে থাকে! একুশ বছর দেখতে দেখতে কেটে গেল। কিরুণাময়ী এর মধ্যে এও ভেবেছেন সুখময়কে ছেড়ে যার কাছে যাকেন সেও যদি এমন অক্ষম পুরুষ হয়। অথবা অক্ষম না হোক, যদি এত হৃদয়বান না হয় সুধাময়ের মত!

কিরণময়ী মাঝে মধ্যেই ভাবেন সুধাময় বুঝি তাঁকে ভালবাসেন খুব। সঙ্গে ছাড়া খেতে বসেন না, মাছের বড় টুকরোটি নিজের পাত থেকে কিরণময়ীর পাতে তুলে দেন। বাড়িতে কাজের লোক না থাকলে বলেন-বাসন মাজ-টাজ কিছু থাকলে বল, আমি বেশ ভাল বাসন মাজতে পারি।

বিকেলে-টিকেলে কিরণময়ী উদাস বসে থাকলে সুধাময় বলেন-চুলে তোমার জট। পড়েছে কিরণ, এস ছাড়িয়ে দিই। আজ বিকেলে রমনা ভবনে গিয়ে ভাল দুটো শাড়ি কিনে এন। ঘরে পরিবার শাড়ি তোমার নেই-ই তেমন। টাকা থাকলে তোমার নামে বড় একটি বাড়ি বানিয়ে দিতাম কিরণ। তুমি বাড়ির উঠোনে খালি পায়ে হেঁটে বেড়াতে। বাড়ি ভরে ফল ফলাস্তির গাছ লাগাতে। মৌসুমের সবজি লাগাতে, ফুলগাছ লাগাতে। শিমগাছে শিম, লাউয়ের মাচায় লাউ, জানালার ধার ঘেষে হাসনুহেনা, আসলে তোমাকে ব্ৰাহ্মাপল্লীর বাড়িতেই মানাত বেশি। কিন্তু আমার সমস্যাটা কি জানো তো, টাকার লাইনের দিকে আমি মোটে গেলামই না। চাইলে যে টাকা করা যেত না তা নয়। বাড়ি বিত্ত দেখে তোমার বাবা বিয়ে দিয়েছিলেন, সেই বাড়িও আর নেই, বিত্তও নেই। অনেকটা হ্যান্ড টু মাউথ অবস্থা। এ নিয়ে আমার কোনও দুঃখ নেই। তোমার বোধহয় কষ্ট-টষ্ট হয় কিরণ।

কিরণময়ী বুঝতে পারতেন এই সরল সোজা, নিরীহ ভালমানুষটি তাঁকে ভালবাসেন বড়। কোনও ভালমানুষকে ভালবেসে জীবনের ছোটখাট সুখ যদি ত্যাগ করা যায়, অথবা ছোটখাট নয়, বড় কোনও স্বার্থও, তবে ক্ষতি কী। কিরুণময়ী তাঁর আঠাশ বছর বয়স থেকে এক অতৃপ্তি পুষছেন শরীরে, কিন্তু মনের ভেতর যে গোঙরায় এক সমুদ্র ভালবাসার জল, এই জল তাঁর শরীরের অসুখগুলো, ব্যথা ও বেদনাগুলো ধুয়ে দেয় বার বার।

সুরঞ্জন টাকা দিয়েছে। সম্ভবত ধার করে। উপার্জন করে না বলে এক ধরনের হীনমন্যতায় বোধহয় ভোগে ও। কিন্তু দেওয়ালে এখনও পিঠ ঠেকে যায়নি। কিরণময়ীর। এখনও চালিয়ে নেবার মত কিছু টাকা আছে হাতে, সুধাময় কখনও নিজের কাছে একটি পয়সা রাখেননি, উপার্জনের সবটুকুই কিরণের হাতে তুলে দিতেন। তা ছাড়া এখনও সোনাদানও কিছু অবশিষ্ট আছে। তিনি মায়ার হাত দিয়ে সুরঞ্জনের টাকা কটি ফেরত পাঠান। ফেরত পাঠানোয় ও যে কষ্ট পাবে ভাবেননি কিরণময়ী। আচমকা ঘরে ঢুকেই সুরঞ্জন বলে-ভেবেছ চুরি-ডাকাতি করে টাকা এনেছি? নাকি বেকারের টাকা নিতে লজ্জা হয়? কিছুই হয়ত করতে পারি না। কিন্তু করতে তো ইচ্ছে করে আমার। এ কথা কি বোঝা উচিত ছিল না কারও?

নিথর বসেছিলেন কিরণময়ী। কথাগুলো বেঁধে তাঁর বুকে।

 

৫গ.

রত্নার বাড়িতে কড়া নাড়ে সুরঞ্জন। রত্নাই দরজা খোলে। দেখে খুব চমকায় না। সে। যেন সুরঞ্জনের আসবার কথাই ছিল। সোজা তাকে শোবার ঘরে নিয়ে যায়। যেন কতকালের আত্মীয় সে। এক প্যাঁচে সুতি শাড়ি পড়েছে রত্না। কপালে লাল একটি টিপ হলে চমৎকার মানাত। আর যদি সিঁথিতে সিঁদুরের দাগ থাকত অল্প। সুরঞ্জন কুসংস্কার মানে না, কিন্তু শাঁখা সিঁদুরের, উলুধ্বনির, শাঁখ বাজানোর বাঙালিয়ানা তাকে মুগ্ধই করে। বাড়িতে তাদের পুজো-আচ্চা একেবারেই নিষেধ ছিল, কিন্তু দল বেধে পুজো দেখতে যাওয়া, আরতিতে শখের নাচা, পুজো মণ্ডপের গানে তাল দেওয়া, দু-চারটে নাডু টাডু খাওয়া এসবে সে আপত্তি করেনি।

রত্না তাকে বসিয়ে রেখে চা করতে গেছে। কেমন আছেন ছাড়া একটি বাক্যও সে বলেনি। সুরঞ্জনও বলেনি। কথা খুঁজে পায়নি সে। সে ভালবাসতে এসেছে। ইঞ্জি করা একটি শার্ট পরে, অনেকদিন পর শেভ করে, স্নান করে, গায়ে একটু সুগন্ধি লাগিয়ে এসেছে। বুড়ো বাবা মা, বড় ভাই আর রত্না, এই নিয়ে সংসার। ভাই-এর বউ ছেলে মেয়ে আছে। ছেলে মেয়েগুলো ঘুরঘুর করছে, নতুন মানুষটি কে, কি চায় এখানে ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর তারা পায় না বলে দরজা থেকে তারা খুব দূরেও যায় না। সুরঞ্জন একটি সাত বছরের মেয়েকে ডেকে জিজ্ঞেস করে নাম কি?

মেয়েটি ঝটপট উত্তর দেয়–মৃত্তিকা।

—বাহ, সুন্দর নাম তো। কী হয় রত্না তোমার?

—পিসি।

–ও।

—তুমি বুঝি পিসির অফিসে চাকরি কর?

–না। আমি কোনও চাকরি টাকরি করিনা। ঘুরে বেড়াই।

ঘুরে বেড়াই বাক্যটি মৃত্তিকার পছন্দ হয়। সে আরও কিছু কথা বলতে যাবে এমন সময় রত্না ঢেকে ঘরে, হাতে ট্র, ট্রেতে চা বিস্কুট, চানাচুর, দুরকম মিষ্টি।

—কি ব্যাপার হিন্দুদের ঘরে আজকাল তো খাবার থাকার কথা নয়। তারা ঘরের বাইরে যেতে পারছে না। আর এখানে তো দিব্যি দোকান খুলে বসা হয়েছে। তা সিলেট থেকে এলেন কবে?

—সিলেটে না। গিয়েছিলাম হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভিবাজার। আমার চোখের সামনে হবিগঞ্জের মাধবপুর বাজারে তিনটে মন্দির ভেঙে ফেলেছে।

-কার ভেঙেছে?

-টুপি দাড়িঅলা মুসল্লিরা। এরপর বাজারের কালী মন্দির ভেঙে ফেলেছে। আমার আত্মীয় হন তপন দাশগুপ্ত, ডাক্তার, তার চেম্বারও লুট করে ভেঙে দিয়েছে। সুনামগঞ্জে দুটো মন্দির ভেঙে ফেলল। আট তারিখে। নয় তারিখে চারটে মন্দির, পঞ্চাশটা দোকান, ভেঙে লুট করে আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে। মৌলভিবাজারের রাজনগর ও কুলাউড়ায় ছটা মন্দির আর আখড়া ভেঙে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। ব্ৰাহ্মণবাজারের সাতটি দোকানও লুট করেছে।

–নিশ্চয় হিন্দুর দোকান!

রত্না হেসে বলে-তো আর বলতে।

চাচানাচুর এগিয়ে দিয়ে রত্না বলে-বলুন তো, এ দেশে কি আর থাকা যাবে?

—কোন যাবে না? এ দেশ কি মুসলমানের বাপের সম্পত্তি?

রত্না হাসে। হাসিতে বিষগ্নতা খেলা করে। বলে-ভোলায় নাকি টিপসই দিয়ে জায়গা বেচে চলে যাচ্ছে মানুষ। কেউ টাকা পয়সা পাচ্ছে সামান্য, কেউ পাচ্ছে না।

–ভোলা থেকে কারা যাচ্ছে? হিন্দুরা তো?

–তা তো নিশ্চয়ই।

—তবে উল্লেখ করছেন না কেন? সুরঞ্জন চানাচুর খেতে খেতে বলে।

হিন্দু শব্দটি উল্লেখ করবার কোনও প্রয়োজন পড়ছে না। তারপরও সুরঞ্জনের ইচ্ছে যারা যাচ্ছে তারা যে হিন্দু, যাদের লুট হচ্ছে বাড়িঘর দোকানপাট, তারা যে ভোলা বা হবিগঞ্জের ‘মানুষ’ নয়, কেবল হিন্দু—এ কথাই রত্নাকে বোঝায়।

রত্না কী বোঝে কে জানে সে গভীর দুচোখ মেলে সুরঞ্জনের চোখে তাকায়। সে ভেবে এসেছিল, কোনও রকম রাখঢাক না করেই আজ সে কথা পড়বে। বলবে–আপনাকে আমার ভাল লাগে, বিয়ে-টিয়ে করতে চাইলে বলুন করে ফেলি।

রত্না জল আনতে ওঠে। ওর শাড়ির আঁচল সুরঞ্জনের বাঁ হাত ছুঁয়ে যায়। স্পর্শ লেগে থাকে বাহুতে। আচ্ছা রত্না তো ইচ্ছে করলেই পারে বউ হতে তার, উড়নচণ্ডী জীবনটিকে একটি সংসারে স্থির করা উচিত এই জন্য যে তার বিয়ে করতে ইচ্ছে হচ্ছে তা কিন্তু নয়। সারাদিন শুয়ে শুয়ে রত্নার আঙুল নিয়ে খেলা করা যাবে, খেলতে খেলতে ন্যাংটোকালের গল্প করতে করতে এমন হবে যে দুজনের মধ্যে না জানা কিছু, দেয়াল কিছু থাকবে না। সে আসলে ঠিক বউ হবে না তার, বন্ধু হবে।

রত্নার গভীর চোখদুটো কি চায়? সুরঞ্জন বিব্রত হয়। বলে ওঠে–দেখতে এসেছিলাম অক্ষত আছেন কি না?

–অক্ষত? অক্ষতার তো আবার দুরকম অর্থ, নারীর বেলায় এক, পুরুষের বেলায় আরেক। কোনটি দেখতে এসেছিলেন?

–দুটোই।

রত্না হেসে মাথা নীচু করে। সে হাসলে মুক্তে হয়ত ঝরে না, কিন্তু বেশ লাগে দেখতে। ওর মুখ থেকে চোখ সরতে চায় না সুরঞ্জনের। তার কি বয়স বেশি বেড়ে গেছে? এই বয়সের ছেলেদের কি খুব বুড়ো বুড়ো লাগে দেখতে? বিয়ের জন্য একেবারেই বেমানান? ভাবতে গিয়ে সুরঞ্জন লক্ষ্য করে রত্না তাকে দেখছে। দৃষ্টিতে মোহঘোর।

—আপনার সেই বিয়ে না করার সিদ্ধান্তটি এখনও আছে? রত্না হোসে জিজ্ঞেস করে।

কিছুক্ষণ সময় নিয়ে সুরঞ্জন বলে—জীবন হচ্ছে নদীর মত জানেন তো? নদী কোথাও থেমে থাকে? সিদ্ধান্তও সব সময় অনড় থাকে না। বদলায়।

শুনে বাইরে হিন্দুর ওপর সাম্প্রদায়িক আক্রমণ, আর এই চরম দুঃসময়ে রত্না হাসতে হাসতে বলে–বাঁচলাম।

সুরঞ্জন জিজ্ঞেস করে না ‘বাঁচলাম’ অর্থ কী। সে বুঝে নেয়। রত্না তাকে আমল এক আনন্দ দিচ্ছে। তার ইচ্ছে করে রত্নার সরু সরু আঙুলগুলো খুঁয়ে বলে-চলুন আজ শালবন বিহার যাই। সবুজ ঘাসে সারারাত শুয়ে থাকি। চাঁদ আমাদের পাহারা দেবে। চাঁদকে আমরা তার জ্যোৎস্না লুকোতে বলব না। সুরঞ্জন সিঁড়ির কাছে গিয়েও ভাবে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা রত্নাকে সে বলবে–আমাদের অনড় সিদ্ধান্তগুলো পাল্টে চলুন কিছু একটা করে ফেলি দুজন।

সুরঞ্জনের বলা হয় না। রত্না দুসিঁড়ি নেমে বলে—আবার আসবেন। আপনি এলেন বলে মনে হল পাশে দাঁড়াবার কেউ একজন আছে। একেবারে একা হয়ে যাইনি।

সুরঞ্জন স্পষ্ট বুঝতে পারছে পারভিনের জন্য যেমন হত, ওই চঞ্চল চড়ুইটি তাকে যেমন সুখে ভাসিয়ে রাখত, তেমনই সুখ হচ্ছে তার।

 লজ্জা (০৬) পত্রিকা হাতে নেয় সুরঞ্জন

৬ক.

সকালে চায়ের সঙ্গে পত্রিকা হাতে নেয় সুরঞ্জন। আজ মন ভাল তার। রাতেও ভাল ঘুম হয়েছে। পত্রিকায় চোখ বুলিয়ে মায়াকে ডাকে সে।

—ফিরে তোর হয়েছে কি! এত মন খারাপ করে বসে থাকিস কেন?

—আমার আবার কী হবে। তুমিই তো ঝিম ধরেছ। একবারও বাবার কাছে বস না।

—আমার ওসব দেখতে ভাল লাগে না। সুস্থ সকল মানুষটি মড়ার মত বিছানায় পড়ে আছে দেখলে আমার রাগ ধরে। আর তোরা পাশে বসে মিউ মিউ করে। সারাক্ষণ কাঁদিস, এসব আরও ভাল লাগে না। আচ্ছা, মা টাকা রাখেনি কেন? খুব টাকা বুঝি তাঁর?

–মা গয়না বিক্রি করেছে।

—এ কাজটা অবশ্য ভাল করেছে। গয়না-টয়না। আমি একদম পছন্দ করি না।

—পছন্দ কর না। পারভিন আপকে তো ঠিকই মুক্তোবসানো আংটি দিয়েছিলে?

—তখন কাঁচা বয়স ছিল, মনে রঙ ছিল, এত বুদ্ধি হয়নি তো, তাই।

—এখন বুঝি খুব পেকেছ? মায়া হেসে বলে।

মায়ার মুখে কতদিন পর হাসি দেখল সুরঞ্জন। হাসিটিকে আরও কিছুক্ষণ দেখবে বলে সে পত্রিকার প্রথম পাতার খবরটি দেখায়। বলে-দেখেছিস, নগরীতে শান্তি মিছিল হয়েছে, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে আমরা আছি বাংলাদেশে। সাম্প্রদায়িকতা রুখে দাঁড়াও—সর্বদলীয় শান্তি মিছিলের দৃপ্ত ঘোষণা। যে কোনও মূল্যে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী ও লুটেরাদের প্রতিরোধ করার আহ্বান। ভারতে সহিংসতা স্তিমিত। উত্তরপ্রদেশ সরকারের মসজিদের জমি দখলকে হাইকোর্টে অবৈধ ঘোষণা। নরসিমা রাও বলেছেন, বাবরি মসজিদ ভাঙার জন্য কেন্দ্র নয়, উত্তরপ্রদেশ সরকারই দায়ী। পশ্চিমবঙ্গ, গুজরাট, মহারাষ্ট্রে এখনও সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে। মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের জেহাদ ঘোষণা। আজ পল্টন মোড়ে সি পি বি-র সমাবেশ আছে। আওয়ামি লিগ বলেছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় শান্তি ব্রিগেড গঠন করতে হবে। নগর সমন্বয় কমিটি বলেছে দাঙ্গা বাঁধানোর দায়ে নিজামি কাদের মোল্লাদের গ্রেফতার করুন। নির্মূল কমিটিরও সমাবেশ আজ। টঙ্গীতে সর্বদলীয় শান্তি মিছিল। সাংস্কৃতিক জোটের শ্লোগোন-সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবাজাদের রুখবে এবার বাংলাদেশ। পনেরো জন বিশিষ্ট নাগরিকের বিবৃতি সাম্প্রদায়িক সম্প্ৰীতি সবার নাগরিক দায়িত্ব। কর্নেল আকবর বলেছেন ফ্যাসিবাদী শক্তি জামাতকে নিষিদ্ধ করতে হবে। বরিশালে সম্মিলিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা পরিষদ গঠিত। ঢাকা ভার্সিটির শিক্ষক সমিতি সাম্প্রদায়িক সমিতি বিনষ্ট হলে বিজয়ের মাসের পবিত্ৰতা নষ্ট হবে বলেছেন। ধামরাইয়ে মন্দির ভাঙার অভিযোগে আঠাশ জন গ্রেফতার। জ্যোতি বসুর অনুশোচনা ভারতের মুখ দেখাবার জায়গা নেই। –কেবল ভাল খবরগুলো পড়ে গেলে? মায়া বিছানায় পা তুলে আসন করে বসে। পত্রিকাটি টেনে নিয়ে সে বলে—আর বাকি খবরগুলো? ভোলার দশ হাজার পরিবার গৃহহারা। চট্টগ্রামে সাতশ বাড়ি ভস্মীভূত। কিশোরগঞ্জে মন্দির ভাঙচুর। পিরোজপুরে একশ চুয়াল্লিশ ধারা। সীতাকুণ্ড মিরসরাই-এ সাতশ বাড়িতে অগ্নিসংযোগ।

-আজ কোনও মন্দ খবর শুনতে চাই না। আজ আমার মন ভাল।

–কেন পারভিন আপা ডিভোর্স দিচ্ছে বলে? এসেছিল কাল, বলল স্বামী নাকি তাকে প্রতি রাতে পেটায়।

—এখন কেন? মুসলমানকে বিয়ে করলেই নাকি অপার শান্তি? নারে পারভিন না। আমার মন মজেছে অন্য কোথাও। এবার আর মুসলমান নয়, যেন বিয়ের আগে কাঁদো কাঁদো গলায় না বলতে পারে, তুমি ধর্ম পাল্টাও।

মায়া হেসে ওঠে। অনেকদিন পর মায়া হাসছে।

সুরঞ্জন হঠাৎ গভীর হয়ে বলে–বাবার অবস্থা এখন কেমন? ভাল হয়ে উঠবেন না শিগরি?

—আগের চেয়ে ভাল এখন। ভাল কথা বলতে পারছেন। ধরে ধরে বাথরুমে নিচ্ছি। নরম খাবারও খেতে পারছেন। ও শোনো, কাল সন্ধ্যায় বেলাল ভাই এসেছিলেন। তোমার খোঁজে। বাবাকে দেখে গেলেন। বললেন তুমি যেন বাইরে না বেরোও। বাইরে বের হওয়া এখন রিস্কি।

–ও।

সুরঞ্জন হঠাৎ এক লাফে দাঁড়িয়ে যায়। মায়া বলে–কি ব্যাপার কোথাও যাচ্ছ মনে হয়?

–আমি কি ঘরে বসে থাকার ছেলে?

—তুমি বাইরে গেলে মা যে কি দুশ্চিন্তা করেন। দাদা, তুমি যেও না। আমারও খুব ভয় ভয় লাগে।

—পুলককে টাকাটা ফেরত দিতে হবে। তোর কাছে কিছু টাকা হবে নাকি? তুই তো আবার রোজগোরে মেয়ে। দে না তোর ফান্ড থেকে সিগারেট কেনার টাকা?

—উহু, সিগারেট কেনার টাকা আমি দেব না। তুমি খুব শিগরি মরে যাও এ আমি চাই না।

মায়া বলে কিন্তু দাদার জন্য ঠিকই একটি একশ টাকার নোট এনে দেয়। ছোটবেলায় এই মায়া একবার কেঁদে বুক ভাসিয়েছিল। তাকে স্কুলের মেয়েরা ক্ষেপাত ‘হিন্দু হিন্দু তুলসীপাতা, হিন্দুরা খায় গরুর মাথা।’ মায়া বাড়ি ফিরে কেঁদেকেটে সুরঞ্জনকে জিজ্ঞেস করেছিল—আমি নাকি হিন্দু। আমি কি হিন্দু দাদা?

–হ্যাঁ। সুরঞ্জন বলেছিল।

–আমি আর হিন্দু হব না। হিন্দু বলে ওরা আমাকে ক্ষেপায়।

সুধাময় শুনে বলেছিলেন–তুমি হিন্দু কে বলল? তুমি হচ্ছে মানুষ। মানুষের চেয়ে বড় কিছু জগতে নেই। সুধাময়ের প্রতি শ্ৰদ্ধায় নুয়ে আসে সুরঞ্জনের প্রাণ। সে এত মানুষ দেখেছে, সুধাময়ের মত আদর্শবান, যুক্তি বুদ্ধি বিবেকসম্পন্ন মানুষ সে খুব কমই দেখেছে। ঈশ্বর যদি সে কাউকে মানে, সুধাময়কেই মানবে। এত উদারতা, সহনশীলতা, যুক্তিবাদী মানুষ সংসারে ক’জন হয়?

 

৬খ.

চৌষট্টিতে সুধাময় শ্লোগান দিয়েছিলেন ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’। সেদিনের সেই দাঙ্গা বাড়তে পারেনি। শেখ মুজিব এসে থামিয়েছিলেন। আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন যেন বাড়তে না পারে, সে কারণেই দাঙ্গা বাঁধিয়েছিল সরকার নিজে। সরকার-বিরোধী আন্দোলনের জন্য সরকার ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা দায়ের করল। সুধাময় ছিলেন মামলার একজন আসামী। সুধাময় অতীত নিয়ে ভাবতে চান না। তবু অতীত এসে মনের ওপর নগ্ন হয়ে দাঁড়ায়। দেশ দেশ করে কী হয়েছে দেশের? কতটুকু কল্যাণ? পাঁচাত্তরের পর থেকে দেশটি মৌলবাদীদের মুঠোর মধ্যে চলে যাচ্ছে। সব জেনে বুঝেও মানুষগুলো নিস্পন্দ, স্থির। এই প্রজন্ম কি চেতনাহীন? এদের রক্তে কি সেই রক্ত বইছে না, বাহাম্নোয় রাষ্ট্রভাষা করবার দাবিতে যে রক্ত ঝরেছে রাস্তায়, উনসত্তরের গণঅভু্যুত্থানের রক্ত, একাত্তরের ত্রিশ লক্ষ মানুষের রক্ত? সেই উত্তাপ কোথায়? যে উত্তাপ উত্তেজনায় সুধাময় ঝাঁপিয়ে পড়তেন আন্দোলনে? কোথায় টগবগে যুবকেরা এখন? কেন এরা আজ সাপের মত শীতল? কোন ধর্মনিরপেক্ষ একটি দেশে মৌলবাদ খুঁটি গাড়ছে? কেউ কি বুঝতে পারছে না কি ভীষণ দুযোগের দিন আসছে? সুধাময় সমস্ত শক্তি খরচ করে বিছানা থেকে উঠতে চান। পারেন না। মুখ তাঁর বেদনায়, অক্ষমতায়, আক্ৰোশে নীল হয়ে ওঠে।

আইয়ুব খানের শত্ৰু সম্পত্তি আইন আওয়ামি লিগের আইন মন্ত্রী আবার বহাল করলেন সংসদে। অবশ্য নাম পাল্টে। তিনি নাম রাখলেন ‘অৰ্পিত সম্পত্তি আইন। দেশ ছেড়ে হে হিন্দুল্লা চলে গেছে, তাদের সম্পত্তিকে বলা হত শক্রির সম্পত্তি। সুধাময়ের কাক, জাঠা, মামারা কি দেশের শত্রু ছিল? এই ঢাকা শহরে জ্যাঠা মামাদের বড় বড় বাড়িঘর ছিল, সোনারগাঁয়ে ছিল, নরসিংদি, কিশোরগঞ্জ, ফরিদপুরে ছিল, এগুলো কোনওটি কলেজ হয়েছে, কোনওটি হয়েছে পশু হাসপাতাল, পরিবার পরিকল্পনা অফিস, আয়কর রেজিস্ট্রি অফিস। অনিল কাকার বাড়িতে ছোটবেলায় আসতেন। সুধাময়। রামকৃষ্ণ রোডের মন্ত বন্ড বাড়িটিতে দশটি ঘোড়া ছিল, অনিল কাকা তাকে ঘোড়ায় চড়াতেন। সুধাময় দত্ত এখন টিকাটুলির একটি অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে বাড়িতে দিন কাটান, অথচ কাছেই নিজের ককার বাড়ি এখন সরকারের নামে। অৰ্পিত সম্পত্তি আইন বদল হয়ে সম্পত্তি উত্তরাধিকার অথবা সগোত্রে অর্পিত হলে অনেক হিন্দুর দুর্দশা ঘুচত। সুধাময় এই প্রস্তাবটি অনেক হোমরাচোমরা ব্যক্তিকে করেছিলেন, কাজ হয়নি। তিনি তাঁর অচল। অথর্ব। জীবনে আজকাল ক্লান্তি বোধ করেন। বেঁচে থাকবার কোনও অর্থ খুঁজে পান না। জানেন, এই বিছানায় এখন নিঃশব্দে মরে গেলে কারও কোনও ক্ষতি হবে না। বরং নিরস্তুর রাত্রি জাগরণ আর সেবাশুশ্ৰুষার দায়িত্ব থেকে বাঁচবে কিরণময়ী। ‘

১৯৬৫-র পাক-ভারত যুদ্ধের বিশেষ পরিবেশে ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের কারণে শক্ৰ সম্পত্তি আইন হয়েছিল, স্বাধীনতার পরও বাংলাদেশে সুকৌশলে সেই আইনের টিকে থাকা দেখে অবাক হন সুধাময়। স্বাধীন একটি দেশের জন্য, বাঙালি জাতির জন্য এ কলঙ্কের ঘটনা নয়? এই আইন দু কোটি মানুষের মৌলিক, মানবিক, গণতান্ত্রিক ও নাগরিক অধিকার হরণ করেছে, শাসনতন্ত্রের সমঅধিকার আর সামাজিক সাম্য নীতির পরিপহী এ আইন বহাল রেখে দু কোটি মানুষকে তাদের ভিটে বািড় থেকে উচ্ছেদ করে অসহায় সৰ্ব্বনাশা পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এই কারণে হিন্দুদের মধ্যে যদি চরম নিরাপত্তাহীনতা কাজ করে, এ দোষ কি হিন্দুদের? সাম্প্রদায়িকতার বীজ রোপণ হচ্ছে সমাজের গভীর মাটিতে। বাংলাদেশের সংবিধানে দেশের প্রতিটি নাগরিকের সমনিরাপত্তা ও সমঅধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করা হলেও সরকার অর্পিত (শত্রু) সম্পত্তি আইন বহাল রেখে শাসনতন্ত্রের বিধান লঙ্ঘন করে জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি চরম অশ্রদ্ধা দেখাচ্ছে। অথচ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রের মৌলিক অধিকার এই ধারার কথা বলে—

২৬ (১) এই ভাগের বিধানাবলির সহিত অসামঞ্জস্য সকল আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ এই সংবিধান প্রবর্তন হইতে সেই সকল আইনের ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।

(২) রাষ্ট্র এই ভাগের কোনও বিধানের সহিত অসামঞ্জস্য কোনও আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোনও বিধানের সহিত অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোনও আইন প্রণয়ন করিকেন না। এবং অনুরূপ কোনও আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোনও বিধানের সহিত যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।

২৭. সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।

২৮ (১) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বৰ্ণ, নারী পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনও নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিকেন না।

৩১. আইনের আশ্রয় লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইল্যানুযায়ী ব্যবহার লাভ যে কোনও স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনও ব্যবস্থা করা যাইবে না, যাহাতে কোনও ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।

১১২ নং ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ আছে ‘All authorities, executive and judicial, in the Republic shall act in aid of the Supreme Court.’

পাকিস্তানি প্রতিরক্ষণ আইন ৬৫’-র ধারাগুলো এরকম ছিল :

  1. any state, or sovereign of a state, at war with, or engaged in military operation against Pakistan, or
  2. any individual resident in enemy territory, or c. anybody of persons constituted or in corporation in enemy territory, or in or under the laws of a state at war with, or engaged in military operations againt Pakistan, or
  3. any other persons or body of persons declared by the Central Govt. to be an enemy, or

e, any body of persons (whether incorporated or not) carrying on business in any place, if and so long as the body is controlled by a person who under this rule is an enemy, or

f, as respect any business carried on in enemy territory and individual or body of persons (whether incorporate or not) carrying on that business.

১৬৯.১. Enemy subject means:
(a) any individual who possesses the nationality of a state at war with, or engaged in military operation against Pakistan, or having possessed such nationality at any time has lost without acquiring another nationality, or b) any body of persons constituted or incorporated in or under the laws of such state.’

১৬৯ (৪) ‘Enemy property means: any property för the time being belonging to or held or managed on behalf of an enemy as defined in rule 161, an enemy subject or any enemy firm, but does not include the property which is ‘Evacuee property’ under the Pakistan (administration of evacuee property) Act, 1957 (xll of 1957).’

আরও বলা হয় ‘Where an individual enemy subject dies in Pakistan any property, which, individually before his death, belonged to or was held by him, or was managed on his behalf, may not withstanding his death continue to be regarded as enemy property for the purpose of rule 182.’

সাতচল্লিশের পর পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলে লক্ষ লক্ষ হিন্দু ভারত পাড়ি দেয়। তখনকার পাকিস্তান সরকার East Bengal Evacuees (administration of property) Act VIII of 1949, the East Bengal Evacuees (Restoration of possession) Act XXIII of 1951-the East Bengal Evacuees (Administration of Emmoveable property) Act XXIV of 1951 জারি করেন। ১৯৫১ সালের East Bengal Evacuees (Admiistration of Immoveable Property) Act XXIV-iq ritPt 33, The evacuee property committees constituted under this Act shall not take charge of any evacuate property.

  1. if the sole owner or all the co-sharer owners of the property object to the management of such property by the committee on the ground that he or they has or have made other arrangements for the management and utilisation of the property and if the committee is satisfied that the a large ent so Inade proper and adequate, or
  2. if an objection is filed and allowed under this section.

এই আইনে আরো বলা হয় the property shall be vested only on the applications of the evacuees and it shall be wested with the right to dispose of property as het likes.

১৯৫৭ সালে পাকিস্তান সরকার এই আইনের আরও কিছু বদল করে জারি করলেন Pakistan (administration of evacuee property) Act XII of 1957. এই আইনে বলা হল ‘properties of the persons who is resident in any place in the territories now comprising India or in any area occupied by India and is unable to occupy supervise or manage in person his property in then Pakistan or is being occupied, supervised or managed by a person.’ এই আইনও হিন্দুদের তত অসুবিধে করেনি, যত অসুবিধে করেছে  East Pakistan Disturbed Persons and Rehabilitation Ordinance 1964.

১৯৬৫-র পাক-ভারত যুদ্ধের কারণে পাকিস্তান সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে পাকিস্তান শাসনতন্ত্র ১৯৬২-এর পরিচ্ছদ নং ১ ও ২-এর জনগণের মৌলিক অধিকার খর্ব করে ৬ই সেপ্টেম্বর ১৯৬৫ তারিখে  Defence of Pakistan Ordinance mo, XXIII মত Defence of Pakistan Rules Sasa set (stry Defence of Pakistan Rules 1965-এর ১৮২ ধারায় বলা হয় ‘with a view to preventing the payment of money to an enemy firm, and to provide for the administration and disposal by way of transfer or otherwise of enemy property and matters connected there with or incidential thereto, the Central Government may appoint a Custodian of enemy property for Pakistan and one or more Deputy Custodian and Asstt. Custodians of enemy property for such local areas as may be prescribed and may, by order-vest or provide for and regulate the vesting in the prescribed custodian such enemy property as may be prescribed-এর ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিরক্ষণ আইন ও বিধির আওতায় অন্তর্ভুক্ত সব সম্পত্তি সরকারে ন্যস্ত হল। সে সব শক্ৰ সম্পত্তির প্রকৃত মালিকদের যুদ্ধকালীন অবস্থায় আটক বা চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় এবং তাদের সম্পত্তির যথাযথ পরিচালনা নিরাপদ না মনে হওয়ায় সে সব সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য শক্ৰ সম্পত্তির মালিকদের অধিকার বা স্বার্থের পরিপূর্ণ নিশ্চয়তা দেবে বলে সে সব সম্পত্তি প্রকৃত মালিকদের ফিরিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকারে অস্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার Enemy Property (Custody and Registration) Order১৯৬৫ জারি করেন এবং পরে Enemy Property (Land and Building) Administration & Disposal order, ১৯৬৬-এর আওতায় ওই সম্পত্তিসমূহের অর্থ ও ক্ষতিপূরণ আদায়, দেওয়া নেওয়ার জন্য আলাদা আলাদা ভাবে হিসাব সংরক্ষণ সহ রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পাকিস্তান সরকারের একজন কর্মকর্তার ওপর অৰ্পিত হয়।

পাক-ভারত যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পরও আগের আইন বহাল রাখার উদ্দেশ্যে Enemy Property (Continuance of Emergency Provision) Ordinance No 1 of 1969 জারি করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত মিত্ৰ শক্তি হওয়া এবং দু দেশের মধ্যে কোনও যুদ্ধাবস্থা না থাকার পরও রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ২৯/১৯৭২ অর্থাৎ Bangladesh vesting of property and assets Order স্থায়ী বলে কথিত শত্রু সম্পত্তি যা পাকিস্তান সরকারের কাস্টেডিয়ানের ওপর ন্যস্ত ছিল, তা বাংলাদেশ সরকারের কাছে ন্যস্ত হয়। আসলে ১৯৬৯-এর পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠীর Enemy Property (Continuance of Emergency Provision) ordinance বহাল রেখে জনগণের মানবিক মর্যাদা, সামাজিক অধিকার ও সমতা প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করা হয়। পাকিস্তান আমলের মতই স্বাধীন বাংলাদেশেও শত্রু সম্পত্তির তদারকি অত্যন্ত অন্যায় ভাবে অব্যাহত রাখা হয়। জনগণের দাবি উপেক্ষা করেও শত্রু সম্পত্তি আইন (Continuance of Emergency Provision) Repeal Act XLV of 1974 জারি করে বাতিলেরনাম করে Vested & Non-Resident Property (Administration) Act XLVI of 1974-এর আবরণে পাকিস্তান আমলে সরকারের হাতে ন্যস্ত সম্পত্তি সহ বাংলাদেশের স্থায়ী অধিবাসী নয় has ceased to be permanent resident বা বৈদেশিক নাগরিকত্ব অর্জন করেছেন এমন লোকের সম্পত্তি সরকারে ন্যস্ত করবার মধ্য দিয়ে সব সম্পত্তি পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার জন্য একটি পরিচালনা কমিটি গঠন করেন। এই কমিটিকে নিজ উদ্যোগে বা অনাবাসীর আবেদনের প্রেক্ষিতে বা সরকারের নির্দেশে ঘোষিত সম্পত্তির দায়িত্ব অৰ্পণ করা হয়। এই আইনের আওতায় কেবল পাকিস্তানি আমলের শক্ৰ সম্পত্তি হিসেবে যেসব সম্পত্তি তালিকাভুক্ত হয় সেগুলোই নয়, পাকিস্তানি সরকার বা শত্ৰু সম্পত্তি তত্ত্বাবধায়কেরা যেসব সম্পত্তি তাদের তদারকিতে আনেননি, সেগুলোও আনবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু আইন কার্যকর হবার আগেই ১৯৭৬ সালের Ordinance no. XCIII জারি করা হয়। এই আইনে বলা হয়-Those properties which have had wested under the Act shall be administered, controlled, managed and disposed of by transfer or otherwise, by the Government on such officer or authority as Government may direct এরপর এক বছর যেতে না যেতেই ১৯৭৭ সালের মে মাসের ২৩ তারিখে এক সার্কুলারে বলা হয়-10 kathas of vacant non-agricultural land shall be given long term lease to a person deserving to get it, realising full market value as premium and proper rent, that non-agricultural lands situated in business centre shall be settled in open auction with the highest bidder. অর্থাৎ বাংলাদেশের দেড়-দু কোটি জনগণের যে অকৃষিজাত জমিতে অংশ বা দখল রয়েছে তা নিলামে দীর্ঘমেয়াদী ইজারা দেবার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয়েছে। নির্দেশের ৩৭ অনুচ্ছেদে আরও বলা হয়েছে, তহশীল অফিসের যে সব তহশীলদার বা কর্মচারী নিজ নিজ এলাকার গোপন ন্যস্ত সম্পত্তি খুঁজে বের করে দিতে পারকেন, বা ওই সংক্রান্ত খবরাখবর দিতে পারবেন তাদের পুরস্কার দেওয়া হবে।. ৩৮ অনুচ্ছেদে আরও বলা হয়েছে, এ কাজে নিয়োজিত অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব), সকল মহকুমা প্রশাসক, সার্কেল অফিসার (রাজস্ব), এবং ভূমি প্রশাসক ও ভূমি সংস্কার বিভাগের কর্মচারীদের সম্মানী দেওয়া হবে। পুরস্কার পাবার লোভে এরা ন্যস্ত সম্পত্তি খুঁজে বের করবার নামে হিন্দুদের ভিটে বাড়ি থেকে বা তাদের দখলকৃত অংশ থেকে জোর করে উচ্ছেদও করেছে।

১৯৬৬-র পর পূর্ব পাকিস্তান সরকার সারাদেশে জরিপ চালিয়েছিলেন, এতে দেখা যায়’৪৭-এর দেশত্যাগ, ‘৫০ ও’৫৪-র দাঙ্গার পর যারা তাদের সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা তদারকি এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তাদের পরিবারের সদস্য, সহঅংশীদার, বা অন্য আত্মীয়স্বজনদের বা অন্য নাগরিকের সঙ্গে শাসন সংরক্ষণ বা ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারত চলে গেছে কেবল তাদের বাড়িঘর, পুকুর বাগান, পারিবারিক শ্মশান, মঠ, মন্দির, কৃষিজাত অকৃষিজাত সম্পত্তি শত্ৰু সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। এ ছাড়াও যে হিন্দুরা ভারতে যায়নি, ভারতের বাইরে যারা বিদেশে থাকেন অস্থায়ীভাবে ভারতে থাকে, তাদের সম্পত্তিও শক্ৰ সম্পত্তির আওতায় আনা হয়। অথচ যে মুসলমানরা ভারত বা ভারতের বাইরে চলে গেছে তাদের সম্পত্তি কিন্তু শত্ৰু সম্পত্তির আওতায় আনা হয়নি। এ জন্য কোনও জরিপ ও চালানো হয়নি। হিন্দু যৌথ পরিবারের আইনের বিধান অনুযায়ী পরিবারের অনুপস্থিত সদস্যের সম্পত্তির মালিকানা যৌথ পরিবারের সারভাইভিং সদস্যদের ওপর ন্যস্ত হবে এবং তারা ভোগদখল করবে। অথচ এইসব সম্পত্তি সরকারের ওপর ন্যস্ত হচ্ছে।

সুধাময় ভাবেন, নিয়াজ হোসেন, ফজলুর আলম, আনোয়ার আহমেদরা ফ্যামিলিসহ তো তাঁর চোখের সামনেই লন্ডন আমেরিকায় চলে গেলেন, তাঁদের দেশের বাড়িতে দুল্পসম্পর্কের আত্মীয়রা বাস করছে, কেয়ারটেকার রেখে গেছেন, কেউ আবার ভাড়া দিয়ে গেছেন বাড়ি, কারও মাধ্যমে ভাড়া তুলে নেন। তাঁদের সম্পত্তিকে তো শত্ৰু সম্পত্তি বলা হয় না। সুধাময় উঠে দাঁড়াতে চান, তাঁর গা ঘামছে। কেউ নেই ঘরে, মায়া, কিরণময়ী সব গেল কোথায়?

 

৬গ.

সুরঞ্জন পুরনো ঢাকার রাস্তায় হাঁটে আর ভাবে এই শহরে এত হেঁটে বেড়িয়েও ময়মনসিংহকে সে ভুলতে পারেনি। ওই শহরে তার জন্ম, শুই ছোট্ট শহরে কেটেছে তার শৈশব, কৈশোর। বুড়িগঙ্গায় পা ডুবিয়ে রেখে ব্ৰহ্মপুত্রের কথাই সে ভাবে বেশি। মানুষ যদি তার জন্মকে অস্বীকার করতে চায়। তবেই বোধহয় ভুলতে পারে জন্মের মাটিকে, জন্মপাড়ের নদীকে। গৌতমরা চলে যাচ্ছে দেশ ছেড়ে। তারা ভাবছে। এই দেশ তাদের জন্য আর নিরাপদ নয়। কিন্তু যাবার আগে হু হু করে কাঁদছে কোন! পাঁচ বছর আগে তার মামা এসেছিলেন। কলকাতা থেকে, ব্ৰাহ্মণবাড়িয়ায় গিয়ে কী যে শিশুর মত কাঁদলেন। তিনি। কিরণময়ী বলেছিলেন–সুরঞ্জন, যাবি নাকি তোর মামার সঙ্গে কলকাতায়? শুনে ছিঃ ছিঃ করে উঠেছিল সুরঞ্জন।

চার-ছয় বছর আগে পার্টির কাজে তাকে যেতে হয়েছিল ময়মনসিংহ। জানালায় বসে বুজ ধানক্ষেত, দিগন্ত অবধি বৃক্ষরাজি, কুড়েঘর, খড়ের গাদা, বিলে দৌড়ঝাপ করে উলঙ্গ শিশুদের গামছা পেতে মাছ ধরা, ট্রেন দেখে ফিরে চাওয়া সরল কৃষকের মুখ, দেখতে দেখতে তার মনে হয়েছে সে বাংলার মুখ দেখছে। জীবনানন্দ এই মুখ দেখেছিলেন বলে পৃথিবীর আর কোনও রূপ দেখতে চাননি। সুরঞ্জনের মুগ্ধতা হঠাৎ হোঁচটি খেল রামলক্ষ্মণপুর নামের স্টেশনটি আহমদ বাড়ি হয়ে গেছে দেখে, এক এক করে সে দেখল বালীর বাজারের নাম ফাতেমা নগর, কৃষ্ণনগরের নাম আওলিয়া নগর। ইসলামাইজেশন চলছে। সারাদেশ জুড়ে, ময়মনসিংহের ছোট্ট স্টেশনগুলোও বাদ গেল না। ব্ৰাহ্মণবাড়িয়াকে লোকে বলে বি বাড়িয়া, বরিশালের ব্ৰজমোহন কলেজকে বলে বি এম কলেজ, মুরারি চাঁদ কলেজকে ডাকা হয় এম সি কলেজ, হিন্দু নামগুলো বেরিয়ে আসে বলেই বুঝি সংক্ষেপের আশ্রয়? সুরঞ্জন আশঙ্কা করে। অচিরে এই সংক্ষেপগুলোও বিদেয় হয়ে মোহাম্মদ আলি কলেজ, সিরাজউদ্দৌলা কলেজ হয়ে যাবে ৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন্নাহ হলের নাম গল্টে সূর্য সেন হল করায় স্বাধীনতার একুশ বছর পর স্বাধীনতা বিরোধী লোকেরা বলছে সূর্য সেন ডাকাত ছিল, ডাকাতের নামে কী করে হলের নাম হয়? এর মানে নাম পল্টানোর আবদার। সরকার যে কখনও এই আবদার রাখবেন না, তা মনে হয় না। কারণ মৌলবাদী শক্তির সহায়তায় বি এন পি ক্ষমতায় বসেছে, তারাও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মীেলাবাদীদের স্বার্থরক্ষা করছে।

পুরনো ঢাকার অলিগিলিতে হাঁটতে হাঁটতে সুরঞ্জন দেখে অক্ষত হিন্দু দোকানগুলো বন্ধ, ওরা যে কপাট খুলবে, কী ভরসায় খুলবে। তবু নব্বই-এর পর খুলেছিল, বিরানব্বইয়ের পরও হয়ত খুলবে। হিন্দুর গায়ের চামড়া বোধহয় গণ্ডারের। তা না হলে ওরা ভাঙা ঘর আবার বাঁধে। কী করে। ভাঙা দোকান আবার জোড়া লাগায় কী করে!! ঘরবাড়ি দোকানপাট না হয় চুন সুরকি দিয়ে জোড়া লাগে। ওদের ভাঙা মন কি জোড়া লাগে?

নব্বই-এ পাটুয়াটুলির ব্ৰাহ্ম সমাজ, শাঁখারি বাজারের শ্ৰীধর বিগ্ৰহ মন্দির, নয়াবাজারের প্রাচীন মঠ, কায়েতটুলির সাপ মন্দিরে লুটপাট, ভাঙচুর আগুন লাগানো হয়েছে। পটুয়াটুলির বিখ্যাত এম ভট্টাচার্য এন্ড কোং, হোটেল রাজ, ঢাকেশ্বরী জুয়েলার্স এভারগ্রীন জুয়েলার্স, নিউ ঘোষ জুয়েলার্স, আল্পনা জুয়েলার্স, কাশ্মীরি বিরিয়ানি হাউজ, রূপশ্রী জুয়েলার্স, মানসী জুয়েলার্স, মিতালি জুয়েলার্স, শাঁখারি বাজারের সোমা স্টোর, অনন্যা লন্ড্রী, কৃষ্ণা হেয়ার ড্রেসার, টায়ার টিউব রিপেয়ারিং, সাহা কেন্টিন, সদরঘাটে ভাসমান হোৱাটল উজালা, পান্থনিবাস লুট করে ভেঙে পুড়িয়ে দিয়েছে। নয়াবাজারের মিউনিসিপ্যালিটি সুইপার কলোনি লুট করে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। ঢাকা জেলা আদালতের সুইপার ব্যক্তিটা পুরো জ্বলিয়ে দেওয়া হয়। কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া পূর্বপাড়ার হরিসভা মন্দির, কালী মন্দির, মীর বাগ-এর মন্দির, গোশম বাজার আখড়া, শুভাঢ়া গোসাইর বাগের দুর্গ মন্দির, চন্দ্রাণিকারার মন্দির, পশ্চিম পাড়ার কালী মন্দির, শ্মশানঘাট, তেঘরিয়া পূকনদীর রামকানাই মন্দির, কালিন্দী বাড়ীশুর বাজারে দুর্গ মন্দির, কালী মন্দির, মনসা মন্দিরে হামলা, লুটপাট মুর্তি ভাঙা সবই ঘটেছে। শুভাঢ্যার খেজুর বাগ-এর প্যারীমােহন মিশ্রের ছেলে রবি মিশ্রেীর বাড়ি সহ পঞ্চাশটি ভাড়া বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তেঘরিয়ার ভাবতোষ ঘোষ, পরিতোষ ঘোষ, কালিন্দীর মান্দাইল হিন্দু পাড়ায়, আর বনগাঁও ঋষিপাড়ায় তিনশ বাড়ি ভেঙে লুট করে পুড়িয়ে ফেলেছে। সুরঞ্জন এসব কিছু দেখেছে, কিছু শুনেছে।

সূরঞ্জন কোথায় যাবে ঠিক বুঝে পায় না। এই ঢাকা শহরে তার আপনি কে আছে? কার কাছে গিয়ে দুদণ্ড বসবে, কথা বলবে? আজি মায়া তাকে দেবে না দেবে না বলেও একশ টাকা দিয়েছে। বুক পকেটে নোটটি রাখা, খরচ করতে ইচ্ছে করছে না। দু-একবার ভেবেছে এক প্যাকেট বাংলা ফাইভ কিনবে, কিন্তু কিনলেই তো ফুরিয়ে যাবে। টাকার মায় সে কখনই করে না। সুধাময় তাকে শর্ট-প্যান্ট বানাবার টাকা দিতেন, সেই টাকা সে বন্ধুবান্ধবের পেছনে খরচ করত, কেউ হয়ত পালিয়ে বিয়ে করবে, টাকা পয়সা পাচ্ছে না, সুরঞ্জন বিয়ে করবার খরচ দিয়ে দিল, একবার পরীক্ষার ফিস দিয়ে দিল রহমত নামের এক ছেলেকে। ছেলেটির মা ছিল হাসপাতালে, ওষুধ কিনবার টাকা ছিল না হাতে, ব্যস সুরঞ্জন ফিসের টাকাটি তাকে দিয়ে দিতে সামান্যও দেরি করেনি। একবার কি রত্নার কাছে যাবে। সে স্ট্র রত্না মিত্ৰ? এরকম হয় না বিয়ের পর সে রত্নার পদবী আর বদলালো না? মেয়েরা কেন বিয়ে হলেই পদবী বদলায়? বিয়ের আগে বাবার লেজ ধরে বেঁচে থাকে, বিয়ের পর ধরে স্বামীর লেজ। যত্তসব। সুরঞ্জনেরও ইচ্ছে করে নিজের নাম থেকে দত্ত পদবী তুলে দিতে। মানুষের এই ধর্ম বর্ণ ভেদাই মানুষকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। বাঙালি সে হিন্দু হোক, মুসলমান হোক, বাংলা নাম রাখবে। মায়ার নাম সে অনেকদিন ভেবেছে নীলাঞ্জনা মায়া হলে বেশ হত। আর তার নাম হতে পারত, কী হতে পারত, ‘নিবিড় সুরঞ্জন? সুরঞ্জন সুধা’? ‘নিখিল সুরঞ্জন? এরকম কিছু হলেই ধর্মের কালি আর গায়ে মাখতে হয় না। বাঙালি মুসলমানের মধ্যেও সে আরবি নাম রাখবার প্রবণতা লক্ষ করেছে। অতি প্রগতিবাদী ছেলেও যে কি না বাঙালি সংস্কৃতির কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলে সেও তার বাচ্চার নাম রাখতে গেলে রাখে ফয়সল রহমান, তৌহিদুল ইসলাম, ফাইয়জ চৌধুরি। কেন গো? বাঙালি মানুষের আরবি নাম থাকবে কেন? সুরঞ্জন তার মেয়ের নাম রাখবে স্রোতস্বিনী ভালবাসা, অথবা অর্থই নীলিমা; অর্থই নীলিমা বরং মায়ার নীলাঞ্জনা নামের সঙ্গে মেলে। এই নামটি মায়ার মেয়ের জন্য না হয় দিয়ে দেওয়া যাবে।

সুরঞ্জন হাঁটতে থাকে। এলোমেলো হাঁটা, অথচ বাড়ি থেকে বেরোবার সময় মনে হয়েছে কত তার কাজ। বাইরে বেরোলেই আর সে যাবার জায়গা পায় না খুঁজে। যেন সবাই ব্যস্ত, যে যার কাজে ছুটছে সবাই, কেবল তারই কাজ নেই, তারই কোনও ব্যস্ততা নেই। সে এই সন্ত্রাসের শহরে কারও সঙ্গে বসে দুটো কথা বলতে চায়। বংশালে দুলালের বাড়ি যাবে নাকি? নাকি আজিমপুরের মহাদেবদার বাড়ি? ইস্পাহানি কলোনিতে কাজল দেবনাথের বাড়িও যাওয়া যায়। যাবার কথা উঠতেই তার কেবল হিন্দু নাম মনে পড়ছে কেন? কাল বেলাল এসেছিল, সে তো বেলালের বাড়ি একবার যেতে পারে। হায়দার ফিরে গেল সেদিন, হায়দারের বাড়িতেও আডিডা দেওয়া যায়। এদের বাড়িতে গেলে সেই একই কথার ফুলকি উঠবে, বাবরি মসজিদ। ভারতে কী হচ্ছে ক’জন মরল, বি জে পি নেতারা কী বলল, সেনা নামিল কোন কোন শহরে, কারা গ্রেফতার হল, কোন দল নিষিদ্ধ হল—ভবিষ্যৎ কী হবে, এইসব। এগুলো শুনতে আর ভাল লাগে না তার। ওখানে বি জে পি যা, এখানে জামাতি তা। উদ্দেশ্য দু দলের একই। মৌলবাদকে প্রতিষ্ঠিত করা। দুটো দেশ থেকে যদি ধর্মের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা যেত! ধৰ্ম এমন জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসেছে, এ থেকে তৃতীয় বিশ্বের নিরন্ন, নিরীহ, নির্যাতিত মানুষের বোধহয় মুক্তি নেই। কার্ল মার্ক্স-এর এই কথাটি বড় প্রিয় তার, ভিড়ের মধ্যে বিড়বিড় করে বলে—’ধমীয় ক্লেশ হল একই বাস্তব ক্লেশের অভিব্যক্তি এবং বাস্তব ক্লেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও। ধর্ম হল নিপীড়িত জীবের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন জগতের হৃদয়, ঠিক যেমন সেটা হল আত্মাহীন পরিবেশের আত্মা। ধর্ম হল জনগণের জন্য আফিম। ‘

হেঁটে হেঁটে ওয়ারি, নবাবপুর, নয়াবাজার, তাঁতিবাজার, কোর্ট এরিয়া, রজনী বসাক লেন, গেণ্ডারিয়া, বেগম বাজার ঘুরে ঘুরে দুপুর পার করে সুরঞ্জন শেষ পর্যন্ত কাজলের বাড়িই যায়। তাকে বাড়িতেই পাওয়া যায়, আজকাল সব হিন্দুকে বাড়িতে পাওয়া যায়। হয়। বাড়ির বাইরে কোথাও লুকিয়ে থাকে, নয় ঘাপটি মেরে বাড়িতে বসে থাকে। আড্ডা দিয়ে বেড়ানোর জন্য বেকার সুরঞ্জনের জন্য ভালই হল, কাজলকে পেয়ে সে মনে মনে বলে। কাজলের ঘরে আরও ক’জনকে পাওয়া যায়। সুভাষ সিংহ, তাপস পাল, দিলীপ দে, নির্মল চ্যাটার্জি, অঞ্জন মজুমদার, যতীন চক্রবর্তী, সাইদুর রহমান, কবীর চৌধুরি।

—কি খবর বেশ হিন্দু সমাগম দেখছি।

সুরঞ্জনের কথায় কেউ হাসে না। সে নিজেই বরং হেসে ওঠে।

—কি খবর সবার এত মন খারাপ কেন? হিন্দুদের মারা হচ্ছে বলে? সুরঞ্জনই প্রশ্ন করে।

—মন ভাল থাকবার কোনও কারণ আছে? সুভাষ বলে।

কাজল দেবনাথ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ করে। সুরঞ্জন এই পরিষদকে কখনও সমর্থন করেনি। তার মনে হয়েছে এটিও একটি সাম্প্রদায়িক দল। এই দল সমর্থন করলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করবার দাবিটিতে তেমন জোর থাকে না। এ প্রসঙ্গে কাজল অবশ্য বলেন, চল্লিশ বছর প্রত্যাশায়, প্রতীক্ষায় থেকে নিরাশ হয়ে শেষ পর্যন্ত আত্মরক্ষার, স্বনির্ভরতার তাগিদে এই পরিষদ গঠন করেছি।

—খালেদা কি একবারও স্বীকার করেছে দেশে সাম্প্রদায়িক হামলা হচ্ছে? একবারও তো বিধবন্ত এলাকা দেখতে গেলেন না। তিনি। আসরের একজন এই কথা বলতেই কাজল বলেন-আওয়ামি লিগই বা কি করেছে। বিবৃতি দিয়েছে। এরকম বিবৃতি জামাতে ইসলামি দিয়েছে আগে। গত নিবাচনে আওয়ামি লিগ ক্ষমতায় এলে সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ রাখবে না বলে এক ধরনের অপবাদ প্রচার হয়েছে। তারা এখন ক্ষমতায় না। যেতে পেরে ভাবছে। এইটথ এমেন্ডমেন্টের বিরুদ্ধে কথা বললে জনপ্রিয়তা কমে যাবে।

আওয়ামি লিগ কি ভোটে জিততে চায় নাকি নীতিতে অটল থাকতে চায়? অটল থাকলে এই বিলের বিরুদ্ধে কোনও কথা বলছে না কেন?

—ভেবেছে ক্ষমতায় আগে তো যাই, তারপর যা রদবদল করা দরকার, করা যাবে। সাইদুর রহমান আওয়ামি লিগের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করান।

–কাউকে বিশ্বাস নেই। সবাই ক্ষমতায় গিয়ে ইসলামের গান গাইবে আর ভারতের বিরোধিতা করবে। এ দেশে ভারত বিরোধিতা এবং ইসলাম লোকে খায় ভাল। কাজল মাথা নেড়ে বলেন।

হঠাৎ সুরঞ্জন আলোচনার প্রসঙ্গে না গিয়ে তার পুরনো প্রশ্নটিই করে—কিন্তু কাজলদা, আপনাদের এই সাম্প্রদায়িক পরিষদটি না করে অসাম্প্রদায়িক মানুষের একটি দল করলে ভাল হত না? আর এই পরিষদে সাইদুর রহমান নেই কেন, জানতে পারি?

যতীন চক্রবর্তী ভারী কণ্ঠে বলেন–সাইদুর রহমানকে না নিতে পারা আমাদের ব্যর্থতা নয়। ব্যৰ্থতা রাষ্ট্রধর্ম যারা তৈরি করেছে, তাদের। এতকাল তো আমাদের এরকম পরিষদ করতে হয়নি, এখন করতে হয় কেন? বাংলাদেশটি এমনি এমনি গড়ে ওঠেনি। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলমান সকলেরই অবদান ছিল, কিন্তু একটি বিশেষ ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা মানে অন্য ধর্মের মানুষদের মনে বিচ্ছিন্নতাবোধের জন্ম দেওয়া। স্বদেশের প্রতি ‘ভালবাসা কারও চেয়ে কারও কম নয়। কিন্তু যারা দেখে ইসলাম তাদের ধর্ম না। হওয়ায় রাষ্ট্রের চোখে তাদের পৈত্রিক ধর্ম দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর ধর্ম বলে বিবেচিত হয়, এবং ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক কারণেই তারা দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হয়ে গেছে, তখন তাদের অভিমান মারাত্মক হয়। এ কারণে যদি তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের বদলে সাম্প্রদায়িকতার চেতনাই প্রবল হয়ে ওঠে, তবে তাদের দোষ দেওয়া যায় কি?

উত্তরটি যেহেতু সুরঞ্জনের দিকে ছুড়ে দেওয়া, সুরঞ্জন আই নীচু কণ্ঠে বলে-কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রে এরকম একটি সম্প্রদোয়ভিত্তিক সংগঠন থাকার যুক্তি কি?

যতীন চক্রবর্তী মুহূর্ত দেরি না করে বলেন—কিন্তু ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের এ রকম সম্প্রদায়ভিত্তিক সংগঠন করতে বাধ্য করেছে। কারা? যারা রাষ্ট্ৰীয় ধর্মের প্রবক্তা, তারা নয়? একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের রিলিজিয়নকে রাষ্ট্রধর্ম বানালে সেই রাষ্ট্রটি তো আর জাতীয় রাষ্ট্র থাকে না। যে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রধর্ম আছে, সে রাষ্ট্র ধর্মীয় রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত হতে পারে যে কোনও মুহুর্তে। এই রাষ্ট্র দ্রুত সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হচ্ছে, এখানে জাতীয় সংহতির কথা বলা হাস্যকর। এইটথ এমেন্ডমেন্ট যে আসলে বাঙালিকে কলা দেখানো তা সংখ্যালঘুরা বুঝতে পারছে কারণ তারা ভুক্তভোগী।

–আপনি কি ভাবছেন মুসলমানদের জন্য রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হওয়া, বা ধর্মীয় রাষ্ট্র হওয়া কল্যাণকর? আমি কিন্তু তা মনে করি না।

—-নিশ্চয়ই না। এটা তারা আজ না বুঝলেও একদিন বুঝবে।

—আওয়ামি লিগ কিন্তু এ সময় ভাল একটি ভূমিকা রাখতে পারত। অঞ্জন বলে।

সুরঞ্জন বলে—হ্যাঁ আওয়ামি লিগের বিলেও অষ্টম সংশোধনী বাতিলের প্রস্তাব নেই। যে কোনও আধুনিক গণতন্ত্রী মানুষ জানে গণতন্ত্রের অপরিহার্য শর্ত হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। আমি বুঝি না যে দেশের শতকরা ছিয়াশি জন মুসলমান, সে দেশে ইসলামকে রাষ্ট্ৰীয় ধর্ম করার দরকার কী। বাংলাদেশের মুসলমানেরা এমনিতেই ধর্ম পালন করে, তাদের জন্য রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার কোনও দরকার পড়ে না।

যতীনবাবু নড়েচড়ে বসে বলেন–নীতির প্রশ্নে কোনও আপিস হয় না। আওয়ামি লিগ তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার হচ্ছে বলে এক ধরনের আপিস করছে।

সুভাষ চুপচাপ কথা শুনছিল। এবার বলে—আসলে জামাতি আর বি এন পি-র সমালোচনা না করে আমরা খামোক আওয়ামি লিগকে নিয়ে পড়েছি। ওরা কি আওয়ামি লিগের চেয়ে ভাল কাজ করছে। কাজল তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন–আসলে যারা চিহ্নিত শত্ৰু, তাদের সম্পর্কে বলার কিছু থাকে না। কিন্তু যাদের ওপর আশা করি, তাদের স্খলন দেখলেই মনে লাগে বেশি।

কবীর চৌধুরি হঠাৎ মাঝখান থেকে বলেন—এত যে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলছে সবাই, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে কিন্তু সকল ধর্মের প্রতি একই রকম দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা, এখানে পক্ষপাতিত্ব বলে কিছু নেই। আর সেকুলারিজম শব্দটির মানে হচ্ছে ইহজাগতিকতা, সোজা ভাষায়, রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক থাকবে না।

কাজল দেবনাথ উত্তেজিত হয়ে ওঠেন, বলেন–দেশ বিভাগের সময় মুসলিম মৌলবাদ জিতে পাকিস্তানের জন্ম দেয়। ভারতে হিন্দু মৌলবাদ। কিন্তু হেরে যায়। হেরে যায় বলেই ভারত একটি আধুনিক, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হতে পেরেছে। ভারতীয় মুসলমানদের জন্য এ দেশের হিন্দুদের জিম্মি বলে ঘোষণা হয়েছিল। কেবল হিন্দু বিতাড়নের অজুহাত হিসেবে, মূল উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু সম্পত্তি দখল। পাকিস্তান আমলের কায়দায় আবার যখন ইসলামি ব্যবস্থার জিগির শোনা যায়। তখন হিন্দুল্লা ভয় পাবে না কেন? এ দেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র না করলে হিন্দুদের বাঁচা অসম্ভব। আমাদের আরও দাবি শত্ৰু সম্পত্তি আইন বাতিল করতে হবে। এডমিনিষ্ট্রেশনে কোনও হিন্দু নেই। পাকিস্তান আমল থেকে কোনও সেক্রেটারি পদে হিন্দুদের নেওয়া হচ্ছে না। আমিতে হিন্দু সংখ্যা খুবই কম। যারা আছে কারোরই প্রমোশন হয় না। নেভি বা এয়ারফোর্সে হিন্দু কেউ আছে বলে তো মনে হয় না।

নির্মল বলে–কাজলদা, হিন্দুদের মধ্যে কোনও ব্রিগেডিয়ার বা মেজর জেনারেল নেই। কর্নেল সত্তরজনে একজন, লেফটেনেন্ট কর্নেল চারশ পঞ্চাশজনে আটজন, মেজর এক হাজার জনে চল্লিশজন, ক্যাপ্টেন তেরশজনে আটজন, সেকেন্ড লেফটেনেন্ট নয়শীজনে তিনজন, সিপাহি আশি হাজারে মাত্র পাঁচশজন। চল্লিশ হাজার বি ডি আর-এর মধ্যে হিন্দু মাত্র তিনশজন। সেক্রেটারি কেবল হিন্দু নেই বলছেন কেন, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানও তো নেই। এডিশনাল সেক্রেটারিও তো নেই। জয়েন্ট সেক্রেটারি আছেন একশ চৌতিরিশজনে মাত্র একজন।

কাজল আবার শুরু করেন—ফরেন সার্ভিসে সংখ্যালঘু কি আছে। একজনও? আমার তো মনে হয় নেই।

সুভাষ মোড়ায় বসেছিল, হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায়। বলে—না কাজলদা নেই।

ঘরে কার্পেট পাতা। সুরঞ্জন কর্পেটে বসেই একটি কুশনে হেলান দেয়। তার বেশ ভাল লাগছে আলোচনা শুনতে।

কবীর চৌধুরি বলেন–পাকিস্তান আমল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে আওয়ামি লিগের আমলে একমাত্ৰ মনোরঞ্জন ধরকে কিছুদিনের জন্য জাপানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত করা হয়েছিল।

—হায়ার স্টাডিজের জন্য, বিদেশে ট্রেনিং এসব ব্যাপারে হিন্দুদের এভিয়েড করা হয়। কোন লাভজনক ব্যবসাই এখন হিন্দুদের হাতে নেই। ব্যবসা বাণিজ্য করতে গেলে মুসলমান অংশীদার না থাকলে কেবল হিন্দু প্রতিষ্ঠানের নামে সব সময় লাইসেন্স পাওয়া যায় না। তা ছাড়া শিল্পঋণ সংস্থা থেকে ইন্ডাস্ট্রি করার জন্য ঋণ দেওয়া হয় না।

অঞ্জন বলে–হ্যাঁ, আমিই তো গামেন্টস করার জন্য জুতোর সুকতলি খরচ করে ফেললাম। ব্যাঙ্ক-এর কোনও হেলপ পেলাম না। তারপর আফসারকে পার্টনার করে লোন নিতে হল।

সুভাষ বলে–একটা ব্যাপার লক্ষ করেছেন, রেডিও টেলিভিশনে কোরানের বাণী দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করা হয়। কোরানকে পবিত্র গ্রন্থ বলা হচ্ছে। কিন্তু গীতা বা ত্রিপিটক থেকে পাঠ করার সময় কিন্তু পবিত্র বলা হচ্ছে না।

সুল্লঞ্জন বলে—আসলে কোনও ধর্মগ্ৰন্থই তো পবিত্র নয়। যতসব বদমায়েসি এসব। সব বাদ দিলেই তো হয়। দাবি করা যেতে পারে রেডিও টিভিতে ধর্মপ্রচার বন্ধ করতে হবে।

আসর খানিকটা চুপ হয়ে যায়। সুরঞ্জনের চা খেতে ইচ্ছে করে। সম্ভবত চায়ের কোনও ব্যবস্থা এ বাড়িতে হচ্ছে না। তার শুয়ে পড়তে টুচ্ছে করে কার্পেটটিতে। শুয়ে শুয়ে সবার ভেতরকার কষ্টগুলোর যে উদগীরণ হচ্ছে, তা সে উপভোগ করবে।

কাজল দেবনাথ তার না শেষ হওয়া কথা বলতে থাকেন–সরকারি যে কোনও অনুষ্ঠানে, প্রতিটি সভা-সমিতিতে কোরানের সূরা পাঠ করা হয়। কই, গীতা থেকে তো করা হয় না? সারা বছরে সরকারি হিন্দু কর্মচারীদের জন্য মাত্র দুদিন ছুটির ব্যবস্থা রয়েছে। তাদের ঐচ্ছিক ছুটির অধিকারও তেমন নেই। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে মসজিদ নিমণি করান্ধি ঘোষণা করা হয়, কিন্তু মন্দির নিমণ করার কথা তো বলা হয় না। প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা খরচ করে নতুন মসজিদ করা হচ্ছে, অথবা পুরনো মসজিদের সংস্কার চলছে, কিজ মন্দির গিজা প্যাগোড়ার জন্য কিছু কি খরচ করা হয়?

সুরঞ্জন শোয়া থেকে মাথা উঠিয়ে বলে—রেডিও টিভিতে গীতা থেকে পাঠ হলে খুশি হন? মন্দির নিমণি হলে খুব মঙ্গল হবে? একবিংশ শতাব্দী এসে যাচ্ছে, আমরা আজও ধমের প্রবেশ চাচ্ছি সমাজে, রাষ্ট্রে। তার চেয়ে বলুন রাষ্ট্রনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষানীতি ধর্মীয় অনুপ্রবেশ থেকে মুক্ত থাকবে। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষত চাই মানে তো এই নয় যে এখন কোরান পড়লে গীতাও পড়তে হবে। আমাদের চাইতে হবে রাষ্ট্ৰীয় সমস্ত কাহকিলাপে ধমীয় অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে। স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটিতে কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠান, ধমীয় প্রার্থনা, পাঠ্য বইয়ে কোনও ধর্মীয় নেতার জীবনী দেওয়াও নিষিদ্ধ করতে হবে। ধমীয় কার্যকলাপে পলিটিক্যাল লিডারদের সহযোগিতা নিষিদ্ধ করতে হবে। যদি কোনও নেতা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নেয়, অথবা পৃষ্ঠপোষকতা করে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করতে হবে। সরকারি প্রচার মাধ্যমে ধর্মীয় প্রচার নিষিদ্ধ করতে হবে। কোনও আবেদন পত্রে আবেদনকারীর ধর্ম জানতে চাওয়া হবে না।

সূরঞ্জনের কথায় কাজল দেবনাথ হেসে ওঠেন, বলেন–তুমি বেশি এগিয়ে যাচ্ছ ভাবনায়। একটি সেকুলার দেশে তোমার প্রস্তাবগুলো চলে, এই দেশে চলে না।

সুভাষ উসখুস করছিল, ফাঁক পেয়ে বলে–আজ বাংলাদেশ ছাত্র-যুব ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে প্রেস ক্লাবের সামনে মিটিং করেছি। হোম মিনিস্টারের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছি, ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির পুনর্নির্মাণ, ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘরের ক্ষতিপূরণ দান, সহায় সম্বলহীনদের ত্রাণ ও পুনর্বাসন, দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়া এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি ছিল ওতে।

সুরঞ্জন কুশনে মাথা দিয়ে শুয়ে ছিল, উঠে বলে—তোমার একটি দাবিও এই সরকার মানবে না।

কবীর চৌধুরি বলেন—তা মানবে কেন? হোম মিনিস্টার তো আস্ত একটা রাজাকার। শুনেছি এই লোক একাত্তরে কাঁচপুর ব্রিজে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানি ক্যাম্প পাহারা দিত।

সাইদুর রহমান বলেন–রাজাকারগুলোই তো এখন ক্ষমতায়। শেখ মুজিব এদের ক্ষমা করেছে। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় বসিয়েছে। এরশাদ এদের আরও শক্তিশালী করেছে। আর খালেদা জিয়া সরাসরি রাজাকারদের সহযোগিতায় ক্ষমতায় বসেছে।

—কক্সবাজারের খবর পেলাম, সেবাখোলার মন্দিরটি ভেঙে ফেলেছে। চিন্তামন্দির ছিল একটি, সেটিও। জালালাবাদের ঈদগাঁও বাজারের কেন্দ্রীয় কালী মন্দির, হিন্দুপাড়ার আগুনে পুড়ে ছাই করে দিয়েছে। ইসলামাবাদের হিন্দুপাড়ায় সার্বজনীন দুর্গ মন্দির, বোয়ালখালির দুর্গ মন্দির, অদ্বৈত চিন্তাহরি মঠ, মঠাধ্যক্ষের বাড়ি, সঙ্গে আরও পাঁচটি পারিবারিক মন্দির সম্পূর্ণ ছাই করে দিয়েছে। বোয়ালখালির হরি মন্দির লুট করেছে। চৌফলদভীর আটটি মন্দির, ছটি বাড়ি, দুটো দোকান পুরো ছাই করে দিয়েছে। হিন্দু পাড়ায় মোট একশ পয়ষট্রিটি পরিবারের সব কিছু লুট হয়ে গেছে। বাজারের পাঁচটি হিন্দু দোকান লুট, হিন্দুদের যেখানে পাচ্ছে মারছে। হিন্দু বাড়িগুলোর ধানের গোলায় কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। উখিয়ার ভৈরববাড়ি পুরো ধ্বংস করে দিয়েছে। টেকনাফের কালীবাড়ি, পুরোহিতের বাড়িঘর জ্বলিয়ে পুড়িয়ে ছাই করেছে। সারাবাং-এর মন্দিরও ভেঙে পুড়িয়ে দিয়েছে ৭ মহেশখালির তিনটি মন্দির এগারোটি ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। চারটি গীতা স্কুলও পুড়িয়ে দিয়েছে। কালারমার বাজারে কালী মন্দির আর হরি মন্দির ভেঙে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। কুতুবদিয়ার বড়ঘোপা বাজারের কালী মন্দির নাটমন্দির, সব মিলিয়ে ছটি মন্দিরে আগুন দিয়েছে। বাজারের চারটি কর্মকারের দোকান লুট করেছে। আলী আকবর ডেইল-এ একাল্পটি জেলে পরিবারের ঘরবাড়ির যাবতীয় জিনিস সম্পূর্ণ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। কুতুবদিয়ার এইসব আগুন লাগানোয় তিনটি বাচ্চা মারা গেছে। রামুর ঈদগড়ে সার্বজনীন কালী মন্দির আর জেলে পাড়ায় হরি মন্দির ভেঙে পুড়িয়ে দিয়েছে। ফতেখাঁরকুলে অনেক বাড়িঘর জ্বলিয়ে পুড়িয়ে ছারখার…

তাপস পালকে থামিয়ে দিয়ে সুরঞ্জন বলে–ধুত্তোরি, রাখো তোমার জ্বালানো পোড়ানো খবর। তার চেয়ে বরং একটা গান গাও।

—গান? আসরের সবাই অবাক হয়। গান আবার এ সময় হয় নাকি! আজি কি আর অন্য দিনের মত দিন? দেশে হিন্দুদের ঘরবাড়ি মন্দির দোকান লুট হচ্ছে, ভাঙছে, পুড়ছে। আর সুরঞ্জনের কি না গান শোনার শখ হল।

হঠাৎ গানের প্রসঙ্গ ছেড়ে সুরঞ্জন বলে—খুব ক্ষিদে পেয়েছে কাজলদা। ভাত খাওয়াবেন?

—এই অসময়ে ভাত? দু-একজন অবাক হয়।

পেট ভরে ভাত খেতে ইচ্ছে করছে সুরঞ্জনের। একথাল ভাত, চেপা শুটকি দিয়ে মেখে মেখে খেতে ইচ্ছে করছে। ভন ভন করে মাছি ঘুরবে, বাঁ হাত দিয়ে তাড়াবে আর খাবে। সে রামরতিয়াকে দেখেছিল এরকম খেতে, ব্ৰহ্মপল্লীর বাড়ির উঠোনে বসে। রামান্নতিয়া ছিল রাজবাড়ি স্কুলের সুইপার। মায়াকে নিয়ে এসেছিল স্কুল থেকে, সেদিন মায়ার পেট খারাপ ছিল, বাচ্চা মেয়ে, দৌড়ে বাথরুমে যাবে সে বুদ্ধি হয়নি, সাদা পাজামা হলুদ বানিয়ে মাঠে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল, হেডমিস্ট্রেস রামরতিয়াকে দিয়ে মায়াকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কিরণময়ী রামারতিয়াকে ভাত দিয়েছিলেন খেতে, এত তৃপ্তি করে যে ভাতের মত জিনিস খাওয়া যায়, রামরতিয়ার খাওয়া না দেখলে সুরঞ্জন জানতই না। এখন সে একঘর লোকের সামনে ভাত খেতে চাইছে, সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে! পাগল হঁয়ত নয়, পাগল হলে কি বুক ভেঙে এমন কান্না নামে! গভীর আলোচনা হচ্ছে ঘরে, আর এর মধ্যে সে যদি হু হু করে কেঁদে ওঠে, কেমন বিচ্ছিরি লাগবে না। সারাদিন রোদে রোদে ঘুরেছে সে। পুলকের বাড়ি যাবার কথা। টাকা ফেরত দিতে হবে। মায়ার দেওয়া নোটটি এখনও খরচ হয়নি। রাতে একবার পুলিকের বাড়ি যেতে হবে। তার ক্ষিদে লাগছে, ঘুমও পাচ্ছে।

সুরঞ্জন তন্দ্রার ভেতরে শুনতে পায় কে যেন বলছে নরসিংদির লোহারকান্দা গ্রামের বাসন রানী চৌধুরিকে গ্রামের লোকেরা নিজের বাস্তুভিটে থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। বাসনার ছেলেকে ছুরি দেখিয়ে স্ট্যাম্প ও সাদা কাগজে সই নেয়। ওরা যাবার আগে বলে যায়। এই ঘটনা কাউকে জানালে বাসনা আর তার দুই ছেলেকে মেরে ফেলা হবে। বাসনা কি করুণাময়ীর মত দেখতে? কিরণময়ীর মত নরম, নিরীহ, নিরুপদ্রব মানুষ? মাদারিপুরের রমজানপুর গ্রামে সবিতা রানী আর পুষ্প রানীকে ধর্ষণ করে ইউনুস সদরের লোকেরা। খুলনার ভুমুরিয়ায় অৰ্চনা রানী বিশ্বাস, ভগবতী বিশ্বাসকে বাজার.থেকে বাড়ি ফেরার পথে মালো পাড়ায় ভ্যান গাড়ি থেকে টেনে হিঁচড়ে দু বোনকে নামিয়ে ওয়াজেদ আলীর বাড়িতে ধর্ষণ করে। কারা করে? কারা? কি যেন নাম, মধু, শওকত, আমিনুর। চট্টগ্রামের পটিয়ায় পরিমল দাসের ছেলে উত্তম দাসকে বাদশা মিয়া, নূর ইসলাম, নূর হোসেন রাত তিনটের সময় ঘরে ঢুকে হত্যা করে। মামলা করেছিল উত্তমের লোকেরা, এর ফলে এদের ভিােট ছাড়া করবার চক্রান্ত চলছে। সিলেটের বড়লেখা বিদ্যালয়ের ছাত্রী সবিস্তা রানী দে রাতে পড়ছিল, এমন সময় নিজামুদ্দিন গুণ্ডােপাণ্ড নিয়ে তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। সবিতার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। বগুড়ার নৃপেন্দ্ৰ চন্দ্র দত্তের মেয়ে শেফালি রানী দত্তকে অপহরণ করে নিয়ে জোর করে ধমন্তিরিত করা হয়। এডমিনিষ্ট্রেশন কোনও হেল্প করেনি। যশোরের শুড়ো আর বাগডোঙা গ্রামে আর্মস নিয়ে চারদিক ঘেরাও করে হিন্দুদের বাড়ি লুট করে, হিন্দুদের ইচ্ছেমত পেটায়, এগারোজন মেয়েকে সারারাত ধলে রোপ করে। তারপর, তারপর? কেউ বোধহয় জানতে চায়। যে জানতে চায় তার চোখ কি বিস্ফারিত হচ্ছে ভয়ে, ঘূণায় নাকি অন্যরকম এক পুলকে? সুরঞ্জনের চোখ বন্ধ, তার ঘুম পাচ্ছে, তার দেখবার ধৈর্য নেই কার এত কৌতুহল এসব শুনতে যে নোয়াখালির ঘোষবাগ এলাকার সাবিত্রী বালা রায় তার স্বামী মোহনবাসি রায় আর যুবতী মেয়ে নিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আলিপুরের আবদুল হালিম ননু আবদুর রব বাচু মিয়ারা একদিন সাবিত্রী দেবীর বাড়ি গিয়ে মেয়ের বিয়ে দেবার জন্য যে চাষযোগ্য জমি বিক্রি কল্লেছিলেন, সেই জমি বিক্রির আঠারো হাজার টাকা ছুরি দেখিয়ে ছিনিয়ে নেয়। তারা তাদের বাকি জমি তাদের নামে লিখে দিয়ে ভারত চলে যেতে বলে প্ৰাণনাশের হুমকি দেয়। তার যাবার সময় গোয়ালের গরুগুলোও নিয়ে যায়। যদি সাবিত্রীরা ভারত না যায় কি হবে? কী হবে। আর, মেরে ফেলা হবে। শেরপুরের সাপমারি গ্রামের তিনশ ষাটটি গোয়ালা পরিবার মৌলবাদীর অত্যাচারে দেশ ত্যাগ করেছে। কিশোরগঞ্জের কটিয়াদির চারুচন্দ্ৰ দে সরকার, সুমন্তমোহন দে সরকার, যতীন্দ্রমোহন দে সরকার, দীনেশচন্দ্ৰ দে সরকারের প্রচুর জমাজমি জাল দলিলের মাধ্যমে এলাকার টাউট মুসলমানেরা দখল করে নিয়েছে। ময়মনসিংহের দাপুনিয়ার রঞ্জন রাজভর-এর পরিবারকে জাল দলিল করে ভিটে থেকে উচ্ছেদের চেষ্টা করছে। রঞ্জনের দু বোন মালতী আর রামরতিকে জোর করে মুসলমান বানিয়ে বিয়ে করে, বিয়ের কিছুদিন পর দু বোনকেই তাড়িয়ে দেয়। জয়পুর হাটের বালিঘাটা গ্রামের নারায়ণ চন্দ্ৰ কুণ্ডের কুড়ি বিঘা জমি জোর করে দখল করে নিয়েছে মুসলমান বগর্দিাররা। তারা ওখানে ঘরবাড়িও বানিয়ে নিয়েছে। সুরঞ্জনের ঘুম পায়, আবার পায়ও না। সে শুনতে চায় না, তবু কানে ভাসে কারও কণ্ঠ-আলী মাস্টার, আবুল বাশার, আর শহীদ মোড়লরা বন্দুক স্টেনগান নিয়ে কমান্ডো কায়দায় নারায়ণগঞ্জের চরগোরকুলের ছটি হিন্দু পরিবারের ঘরবাড়ি ভেঙে দিয়েছে। তারা সুভাষ মণ্ডল, সম্ভোষ, নেতাই, ক্ষেত্রমোহনের সব কিছু কেড়ে নিয়ে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে।

কে একজন সুরঞ্জনকে ডাকে-ওঠ, ওঠ সুরঞ্জন, খেয়ে নাও! ভাত দিয়েছে।

কাজলদাই ডাকছেন মনে হয়। মায়া এরকম ডাকে, দাদা এস, ভাত দিয়েছি, খেয়ে নাও। মায়ার নোটটি রাতে সে ভাঙাবো। কটা ঘুমের ওষুধ কিনবে। কতদিন মনে হয় ঘুমানো হয় না। তার। রাত হলেই ছারপোকা কামড়ায়। বিছানা ভরা ছারপোকা, ছোটবেলায় সুরঞ্জন দেখত কিরণময়ী হাতপাখা মেঝোয় টুকে ঠুকে ছারপোকা মারতেন। মায়াকে বলে আজ রাতেই ঘরের সব ছারপোকা মেরে ফেলতে হবে। টুকটুক করে কামড়ায় সারারাত। মাথার ভেতর কামড়ায়। সুরঞ্জনের আবার বিমঝিম করে ওঠে মাথা। বমি আসতে চায়। এর মধ্যে কে একজন বলে, তার বাড়ি রাজবাড়ি, সম্ভকত তাপসের গলা। এটি, আমাদের ওখানে তিরিশটি মন্দির আর মন্দিরের আশেপাশের বাড়িঘরে আগুন জ্বলিয়ে দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে একটি কণ্ঠ সন্ধের ঝোঁকে গলগল করে বলে-নোয়াখালির খবর বলি শোন, সুন্দলপুর গ্রামে সাতটি বাড়ি আর অধরচাঁদ আশ্রম লুট করে আগুন জ্বলিয়ে দেয়। জগন্নানন্দ গ্রামে তিনটি বাড়িতে লুটপাটের পর আগুন লাগিয়ে দেয়। গঙ্গাপুর গ্রামেও তিনটি বাড়িতে আগুন লাগিয়ে ছাই করে দিয়েছে। রাগারগাঁও গ্রাম, দৌলতপুর গ্রাম, ঘোষবাগ, মাইজদি, সোনাপুরের কালী মন্দির, বিনোদপুর আখড়া, চৌমুহুনির কালী মন্দির, দুৰ্গাপুর গ্রাম, কুতুবপুর, গোপালপুর, সুলতানপুরের অখণ্ড আশ্রম, ছয়আনি বাজারের কয়েকটি মন্দির ভেঙে ফেলেছে। বাবুপুর তেতুইয়া, মহদিপুর, রাজগঞ্জ বাজার, টঙ্গির পাড়, কাজির হাট, রসূলপুর, জমিদারহাট, চৌমুহঁনি পোড়াবাড়ি, ভবভদ্রী গ্রামে দশটি মন্দির আঠারোটি বাড়িতে আগুন জ্বালানো হয়। কোম্পানিগঞ্জে বড় রাজপুর গ্রামে উনিশটি বাড়িতে লুটপাট, মেয়েদের নিয়ে যাচ্ছেতাই কাণ্ড ঘটানো হয়। রামদি গ্রামে আজ বিপ্লব ভৌমিক নামের এক লোককে দা দিয়ে কোপানো হয়েছে।

সুরঞ্জন যদি তুলো দিয়ে কানের ফুটো দুটো বন্ধ করে রাখতে পারত। চারদিকে বাবরি মসজিদ প্রসঙ্গ, চারদিকে ভাঙা পোড়ার গল্প। আহ, যদি কোনও নির্জনতা পেত সুরঞ্জন। এই সময় ময়মনসিংহে চলে যেতে পারলে ভাল হত। এইসব ভাঙাভাঙিগুলো ওখানে কম। ব্ৰহ্মপুত্রে সারাদুপুর স্বান করতে পারলে বোধহয় শরীরে যে জ্বালা ধরছে, কিছু জুড়তো। ঝাঁট করে উঠে পড়ে সে। ঘরের লোক অনেকে এর মধ্যে চলে গেছে। সুরঞ্জনও যাবার জন্য পা বাড়ায়। কাজলদা বলেন–টেবিলে ভাত আছে, খেয়ে নাও। এই অসময়ে ঘুমোলে যে! শরীর খারাপ?

সূরঞ্জন আড়মোড়া ভেঙে বলে—না কাজলদা, খাব না। ইচ্ছে করছে না। শরীরটা যেন কেমন কেমন লাগছে।

–এর কোনও মানে হয়?

—মনে হয়ত হয় না। কিন্তু করব কি বলুন। একবার ক্ষিদে লাগে, একবার ক্ষিদে চলে যায়। টক ঢেকুর উঠছে, বুক জ্বলছে। ঘুম পায়, কিন্তু ঘুমোতে গেলে ঘুমও আসে না আর।

যতীন চক্রবর্তী সুরঞ্জনের কাঁধে হাত রেখে বলেন—তুমি ভেঙে পড়ছি সুরঞ্জন। আমাদের কি এভাবে হতাশ হলে চলবে? শক্ত হও। বেঁচে তো থাকতে হবে।

সুরঞ্জন মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিল, যতীনন্দার কথাগুলো সুধাময়ের কথার মত শোনায়। বাবার অসুস্থ শিয়রে তার কতদিন বসা হয় না। আজ আর দেরি করবে না বাইরে। কাজলদার বাড়ি এলেই এই হয়, নানারকম লোক আসেন। ধুম আড্ডা হয়। রাজনীতি, সমাজনীতির কঠিন কঠিন কথাবাত চলে অর্ধেক রাত পর্যন্ত। সুরঞ্জন কতক শোনে, কতক শোনে না।

টেবিলে বাড়া ভাত রেখেই সে চলে যায়। অনেকদিন বাড়িতে খায় না, আজ খাবে। আজি মায়া, কিরণময়ী, সুধাময়কে নিয়ে সে একসঙ্গে খেতে বসবে। এতদূরত্ব তৈরি হচ্ছে বাড়ির সবার সঙ্গে, দূরত্ব তৈরির কারণ অবশ্য সে নিজে। সামনে আর দেওয়াল রাখবে না। সুরঞ্জন। সকালে যেমন খুব মন ভাল ছিল, তেমন ভাল মন নিয়ে সে সবার সঙ্গে হাসবে, কথা বলবে, ছোটবেলার সেই রোদে বসে ভাপা পিঠে খাওয়ার দিনের মতা-মনেই হবে না। কেউ কারও পিতা পুত্র, কেউ কারও ভাই বোন, যেন বন্ধু সব, খুব কাছের বন্ধু। আজ আল্প কারও বাড়িতে যাবে না। সে, পুলকের বাড়ি না, রত্নার বাড়ি না। সোজা টুিকটুলি গিয়ে ডাল ভাত যা হোক খেয়ে সবার সঙ্গে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করবে, তারপর ঘুম দেবে।

কাজলদা নীচের গেট অদি এগিয়ে দেন। খুব আন্তরিক কষ্ঠেই বলে-তোমার কিন্তু এভাবে বাইরে বের হওয়া ঠিক হচ্ছে না। আমরা এই বাউন্ডারির ভেতরেই যা চলাফেরা করছি, এর বাইরে নয়। এ বাড়িতে যারা এসেছে তারা কেউ দূর থেকে আসেনি। আর তুমি দিব্যি একা একা শহর ঘুরে বেড়ােচ্ছ। কখন কি ঘটে যায় বলা যায় না।

সুরঞ্জন কোনও কথা না বলে দ্রুত সামনে হাঁটে। পকেটে টাকা আছে, দিব্যি রিক্সা নেওয়া যায়। কিন্তু মায়ার টাকাটায় রীতিমত মায়া বসে গেছে, খরচ করতে ইচ্ছে করছে। না। সারাদিন সিগারেট ফোঁকেনি সে। টাকার মায়া ফুঁড়ে সারাদিন পর রাত ঘন হয়ে এলে তার সিগারেটের তৃষ্ণা হয়; দোকানো দাঁড়িয়ে এক প্যাকেট বাংলা ফাইভ কেনে, রাজা রাজা লাগে নিজেকে। হেঁটে হেঁটে কাকরাইলের মোড়ে এসে সে রিক্সা নেয়। শহর যেন অনেক আগেই আজকাল ঘুমিয়ে পড়ে। অসুস্থ থাকলে মানুষ যেমন সকাল সকাল ঘুমায়, শহরও তেমনি। শহরের রোগটা কি? ভাবতে ভাবতে তার মনে পড়ে তার এক বন্ধুর পাছায় বড় এক ফোঁড়া হয়েছিল, দিনরাত চিৎকার করত, কিন্তু ওষুধ দেখলে ভয় পেত, ইনজেকশন দেখে তার রীতিমত কাঁপুনি উঠত। শহরের পাছায় কি তেমন একটি ফোঁড়া হয়েছে। সুরঞ্জনের সেরকমই মনে হয়।

 

৬ঘ.

-আচ্ছা মায়া, সুরঞ্জনের হয়েছে কি বল তো? সে এ সময় বাইরে বাইরে ঘুরছে। কোথায় বল তো দেখি। সুধাময় জিজ্ঞেস করেন।

—পুলকদার বাড়ি যাবে বলেছে। ওখানে আড্ডায় বসেছে নিশ্চয়।

—তাই বলে সন্ধের আগে বাড়ি ফিরবে না?

—কী জানি, বুঝতে পারি না। ফেরা তো উচিত?

–সে কি একবারও ভাবে না বাড়িতে মানুষগুলো দুশ্চিন্তা করছে, এবার বাড়ি ফিরি।

মায়া থামিয়ে দেয় সুধাময়কে। —থাক তুমি এত কথা বলে না। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে তোমার। উচিতও নয়। চুপচাপ শুয়ে থােক। এখন অল্প একটু খাবে। এরপর কোনও বই-টই যদি পড়ে শোনাতে হয়, শোনাব। ঠিক দশটায় ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে যাবে। এর মধ্যে দাদা ফিরবেই, তুমি ভেব না।

—তুই আমাকে শিগরি ভাল করে তুলছিস মায়া। আমি না হয় আরও কটা দিন পড়ে থাকতাম বিছানায়। ভাল হওয়ার কিন্তু বিপদও আছে।

—কি রকম বিপদ? মায়া বিছানায় বসে ভাত চটকায় আর জিজ্ঞেস করে।

সুধাময় হেসে বলেন–তুই মুখে তুলে খাওয়াচ্ছিস, কিরণময়ী হাত পা মালিশ করছে। মাথা টিপে দিচ্ছে। এত আদর কি ভাল হয়ে গেলে পাব? তখন রোগী দেখ, বাজার কর, মায়ার সঙ্গে দুবেলা ঝগড়া কর। সুধুময় হেসে ওঠেন। মায়া অপলক সুধাময়ের হাসির দিকে তাকিয়ে থাকেন। অসুখের পর আজ প্রথম হাসতে দেখছে সে সুধাময়কে।

তিনি কিরণময়ীকেও বলছেন—আজ সব জানালা খুলে দাও তো। ঘর এত অন্ধকার হয়ে থাকে, ভাল লাগে না। আজ একটু হাওয়া ঢুকুক। শীতের হাওয়ার স্বাদই পেলাম না। কেবল কি বসন্তের হাওয়ায় সব ভাল লাগা? যৌবনে কনকনে শীতে দেওয়ালে পোস্টার লাগাতাম। গায়ে একটা ফিনফিনে শার্ট থাকত। মনি সিং-এর সঙ্গে সুসং দুগাপুরের পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরেছি। সে সময়ের টংক আন্দোলন, হাজং বিদ্রোহের কথা কিছু জানো কিরণময়ী?

কিরণময়ীরাও মন ভাল, বলেন—তুমি বিয়ের পর কত না গল্প করেছ। নেত্রকোণার এক অচেনা বাড়িতে মনি সিং-এর সঙ্গে রাত কাটিয়েছিলে!

—আচ্ছা কিরণ, সুরঞ্জন কি গরম কাপড় পরে গেছে।

মায়া ঠোঁট উল্টে বলে—আরে না। তোমার মতই ফিনিফিনে শার্ট পরা। তিনি তো আবার এ কালের বিপ্লবী। গায়ে তার প্রকৃতির হাওয়া লাগে না। যুগের হাওয়া সামলাতে ব্যস্ত।

কিরণময়ীর কণ্ঠে রাগ ফোটে–সারাদিন কোথায় থাকে, কী খায় না খায়। আন্দেী খায় কি না। ওর উচ্ছঙ্খলতা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে।

তখনই দরজায় খুটি খুঁট শব্দ। সুরঞ্জন এল নাকি? সুধাময়ের শিয়রের কাছে বসেছিলেন কিরণময়ী, উঠে যান দরজার দিকে। সুরঞ্জন ঠিক এভাবেই শব্দ করে। বেশি রাত হলে ও অবশ্য তার ঘরেই সোজা ঢোকে। কখনও দরজায় তালা দিয়ে যায়। তালা না দিলেও বাইরে থেকে ভেতরের ছিটিকিনি খুলবার কায়দা জানে। ও। বেশি রাতে যখন হয়নি, সুরঞ্জনই বোধহয়। মায়া সুধাময়ের জন্য জাউদ্ভাতে ডাল মাখছিল। খাবার ডলে ডলে সে নরম করছিল, সুধাময়ের খেতে যেন অসুবিধে না হয়। অনেক দিন লিকুইড খাওয়ানো হয়েছে। ডাক্তার সেমি সলিড খাবার কথা বলে গেছেন। শিংমাছের ঝোল করা হয়েছে। সামান্য ঝোল নিয়ে মাখছে। যখন মায়া, তখনই দরজায় খুঁট খুঁট শব্দ শোনে। কিরণময়ী দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করছেন কে। ওদিক থেকে কি উত্তর আসে কান পেতেছিলেন সুধাময়। কিরণময়ী দরজা খুলবোর সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড় করে ঢোকে সাতজন যুবক। চারজনের হাতে মোটা লাঠি, আর বাকি তিনজনের হাতে কি দেখবার আগেই ওরা কিরণময়ীকে ডিঙিয়ে ভেতরের ঘরে ঢোকে। বয়স ওদের একুশ বাইশ হবে। দুজনের মাথারটুপি, পাজামা পাঞ্জাবি পরা। বাকি তিনজনের শার্ট প্যান্ট। ওরা ঢুকে কারও সঙ্গে কোনও কথা নেই টেবিল চেয়ার, কাচের আলমারি, টেলিভিশন, রেডিও, থালাবাসন, গ্লাস, বাটি, বইপত্র, ড্রেসিং টেবিল, কাপড়াচোপড়, পেডেস্টাল ফ্যান যা সামনে পাচ্ছে উন্মত্তের মত ভাঙতে শুরু করে। সুধাময় উঠে বসতে চান, পারেন না। মায়া চিৎকার করে ওঠে বাবা বলে। কিরণময়ী দরজা ধরে স্তব্ধ দাঁড়িয়েছিলেন। কী বীভৎস দৃশ্য। একজন কোমর থেকে একটি রামদা বের করে, বলে—শালারা বাবরি মসজিদ ভেঙেছিস। তোদের আস্ত রাখব ভেবেছিস?

ঘরের একটি জিনিসও আস্ত থাকে না। ঝনঝনি করে সব ভেঙে পড়তে থাকে। মুহুর্তের মধ্যে তছনছ হয়ে যায় সব, কেউ কিছু বুঝে উঠবার আগেই। মায়াও ছিল স্থির, স্তব্ধ। হঠাৎ সে চিৎকার করে ওঠে যখন তার হাত ধরে টান দেয়। ওদের মধ্যে একজন। কিরণময়ীও তার ধৈর্য ভেঙে আর্তনাদ করে ওঠেন। সুধাময় গোঙান কেবল। তাঁর ভাষা ফোটে না। তিনি চোখের সামনে দেখেন মায়াকে ওরা টেনে নিচ্ছে। মায়া খাটের রেলিং ধরে নিজেকে আটকে রাখছে। কিরণময়ী দৌড়ে এসে দু হাতে আটকে রাখেন মায়াকে। দুজনের গায়ের শক্তি, দুজনের আর্তনাদকে ছুড়ে দিয়ে ওরা মায়াকে টেনে নিয়ে যায়। পেছন পেছন দৌড়েন। কিরণময়ী। চিৎকার করে বলতে থাকেনা-বাবারা ছেড়ে দাও। আমার মেয়েকে ছেড়ে দাও।

রাস্তায় দুটো বেবি ট্যাক্সি দাঁড়ানো ছিল। মায়ার হাতে তখনও সুধাময়ের জন্য ভাত মাখানোর দাগ। ওড়না খুলে পড়ে গেছে। ওর। সে ‘মা গো মা গো চিৎকার করছেই। পেছনে আকুল চোখে তাকাচ্ছে কিরণময়ীর দিকে। কিরণময়ী তাঁর শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়েও মায়াকে ধরে রাখতে পারেননি। ওদের চকচকে রামদাকে তুচ্ছ করে কিরণময়ী ঠেলে সরাতে চেয়েছিলেন দুজনকে। পারেননি। ছুটে যাওয়া বেবি ট্যাক্সির পেছন পেছন তিনি দৌড়োতে থাকেন। পথচারী যাকে পান, বলেন-আমার মেয়েকে ধরে নিয়ে গেছে। একটু দেখুন, দেখুন না। দাদা। মোড়ের দোকানে কিরণময়ী থামেন। চুল খোলা, খালি পা, কিরণময়ী মতি মিয়াকে বলেন-একটু দেখবেন দাদা, কারা এইমাত্র ধরে নিয়ে গেল মায়াকে, আমার মেয়েকে। সকলে নিরুজ্ঞাপ চোখে তাকায় কিরণময়ীর দিকে। যেন পথের পাগল আবোল-তাবোল বকছে। কিরণময়ী দৌড়োতে থাকেন।

 

সুরঞ্জন বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে অবাক হয়। দরজা হাট করে খোলা! জিনিসপত্র সব তছনছ, টেবিল উল্টে পড়ে আছে, বইপত্র মেঝোয় গড়াচ্ছে। বিছানার তোষক চাদর বিছানায় নেই। আলনা ভেঙে পড়ে আছে, কাপড়চোপড় ছড়িয়ে আছে। সারা ঘরে। তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। সে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে ঢোকে। মেঝে ভর্তি ভাঙা কাচের টুকরো, চেয়ারের ভাঙা হাতল, ছেড়া বই, ওষুধের শিশি। সুখময় উপুড় হয়ে পড়ে আছেন ঘরের মেঝোয়। কাতরাচ্ছেন। মায়া, কিরণময়ী কেউ নেই। সুরঞ্জনের জিজ্ঞেস করতে ভয় হয় বাড়িতে কী হয়েছে’। সুধাময় নীচে পড়ে আছেন কেন? ওরাই বা কোথায়? জিজ্ঞেস করতে গিয়ে সুরঞ্জন ট্রের পায় তার গলা কাঁপছে। সে হতভম্ব দাঁড়িয়ে থাকে।

সুধাময় ধীরে, বেদনায় উচ্চারণ করেন-মায়াকে ধরে নিয়ে গেছে।

সুরঞ্জন আমূল কেঁপে ওঠে–ধরে নিয়ে গেছে? কারা নিয়েছে, কোথায়? কখন?

সুধাময় পড়ে আছেন, না পারছেন নড়তে, না পারছেন কাউকে ডাকতে। সুরঞ্জন আলগোছে সুধাময়কে তুলে বিছানায় শুইয়ে দেয়। দ্রুত শ্বাস ফেলছেন তিনি, কুলকুল ঘামছেন।

—ম কোথায়? সুরঞ্জন অক্ষুট কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।

সুধাময়ের নীল হয়ে গেছে মুখ শঙ্কায়, হতাশায়। সারা শরীর কাঁপছে তাঁর। প্রেসার বাড়লে যে কোনও দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। সে এখন সুধাময়কে দেখবে, নাকি মায়াকে খুজতে যাবে। কিছুই স্থির করতে পারে না। সুরঞ্জন। তারও গা হাত পা কাঁপে। তার মাথার ভেতর পাক খায় ক্রুদ্ধ অস্থির জল। পাক খায় একপাল হিংস্ৰ কুকুরের মুখে পড়া একটি আদুরে বেড়ালী ছানার মায়াময় মুখ। সুরঞ্জন দ্রুত বেরিয়ে যায়। সুধাময়ের অচল হাতটি ছুঁয়ে বলে যায়–মায়াকে যে করেই হোক নিয়ে আসব বাবা।

হায়দারের বাড়ির দরজা জোরে ধাক্কায় সুরঞ্জন। এত জোরে যে হায়দার নিজে দরজা খোলে।

সুরঞ্জনকে দেখে চমকে ওঠে। বলে–কী খবর সুরঞ্জন? হয়েছে কি তোমার?

সুরঞ্জন প্রথম কিছু বলতে পারে না। গলার কাছে আটকে থাকে দালা-পাকানো কষ্ট। –মায়াকে ধরে নিয়ে গেছে। কলবার সময় কণ্ঠ বুজে আসে সুরঞ্জনের। তার আর বোঝাতে হয় না। মায়াকে কারা ধরে নিয়ে গেছে।

–কখন নিয়েছে?

সুরঞ্জন উত্তরে কিছু বলে না, কখন নিয়েছে এই খবরটির চেয়ে মায়াকে যে নিয়ে গেছে, এটিই কি জরুরি নয়? হায়দারের কপালে ভাঁজ পড়ে ভাবনার। দলের মিটিং ছিল, মিটিং সেরে সে মাত্রই বাড়ি ফিরেছে। এখনও কাপড় পাল্টানো হয়নি। শার্টের বোতাম খুলছে কেবল। সুরঞ্জন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে হায়দারের দিকে। বানে সৰ ভেসে গেলে যেমন দেখতে হয় মুখ, তাকে ঠিক লাগছে তেমন। সূরঞ্জন দাঁড়িয়েছিল। দরজা ধরে, যে হাতে দরজা ধরা সে হাতটি কাঁপছে তার। কপিন থামাবার জন্য সে মুঠি করে ধরে হাতটি। হায়দার তার কাঁধে হাত রেখে বলে-শান্তু হয়ে ঘরে বস, দেখি কি করা যায়।

কাঁধে হাত পড়তেই ডুকরে কেঁদে ওঠে সুরঞ্জন। হায়দারকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে বলে–মায়াকে এনে দাও হায়দার। মায়াকে দাও।

সুরঞ্জন কাঁদতে কাঁদতে নত হয়। নত হতে হতে সে হায়দারের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে। হায়দার অবাক হয়। এই লোহার মত শক্ত ছেলেটিকে কখনও সে কাঁদতে দেখেনি। তুলে তাকে দাঁড় করায় সে। হায়দার তখনও রাতের খাবার খায়নি, ক্ষিদে পেটে। তবু চল দেখি বলে বেরিয়ে যায়। হোন্ডার পেছনে সুরঞ্জনকে বসিয়ে টিকাটুলির অলিগিলিতে খোঁজে। সুরঞ্জন চেনে না। এমন সব ঘরে ঢেকে। টিমটিম করে বাতি জ্বলছে এমন কিছু পান বিড়ির দোকানঅলার সঙ্গেও ফিসফিস করে কথা বলে। টিকাটুলি পার করে ইংলিশ রোড, নবাবপুর, লক্ষ্মীবাজার, লালমোহন সাহা স্ট্রিট, বকশি বাজার, লালবোগ, সূত্রপুর, ওয়াইজ ঘাট, সদরঘাট, প্যারীমোহন দাস রোড, অভয় দাস লেন, নারিন্দা, আলু বাজার, ঠাঁটারি বাজার, প্যারীদাস রোড, বাবুবাজার, উর্দু রোড, চক বাজারে বোঁ বোঁ করে ঘুরুল হায়দারের হোন্ডা। এঁদো গলির ভেতর কাদাজলে হাঁটু ডুবিয়ে গিয়ে এক-একটি অস্বীকার বাড়ির কড়া নেড়ে হায়দার কাকে যে খোঁজে, সুরঞ্জন বুঝে পায় না কিছু। হায়দার এক-এক জায়গায় নামে আর সে ভাবে এখানেই বুঝি আছে মায়া। মায়াকে বোধহয় এখানেই হাত পা বেঁধে ওরা পেটাচ্ছে, কেবল কি পেটাচ্ছেই নাকি আরও কিছু করছে। সুরঞ্জন কান পেতে থাকে মায়ার কান্নার শব্দ কোথাও থেকে ভেসে আসে কি না।

লক্ষ্মী বাজারের কাছে একটি কান্নার শব্দ শুনে সুরঞ্জন হোল্ডা থামাতে বলে। বলে–শোন তো, মায়ার কান্না মনে হচ্ছে না?

কান্নাটির পেছন পেছন যায়। তারা দেখে টিনের একটি দোচালা বাড়িতে বাচ্চা কাঁদছে। বিলি কেটে কেটে খোঁজে হায়দার। রাত গভীর হতে থাকে। সুরঞ্জন থামে না। গলিতে গলিতে দিলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে লাল চোখের ছেলেরা, দেখে সুরঞ্জনের মনে হয়, বুঝি। এরাই নিয়েছে, এরাই বুঝি তার নিরীহ মায়া মায়া মুখের বোনটিকে আটকে রেখেছে।

—হায়দার, পাচ্ছ না কেন? এখনও পাচ্ছ না কেন মায়াকে?

–আমি তো চেষ্টা করছিই।

—যে করেই হোক মায়াকে আজ রাতের মধ্যেই পেতে হবে।

—এমন কোনও মস্তান ছেলে নেই যাকে খুঁজছি না। না পেলে কি করব বল। সুরঞ্জন একটির পর একটি সিগারেট ধরায়। মায়ার টাকায় কেনা সিগারেট।

—সুপারস্টারে চল কিছু খেয়ে নিই। ক্ষিধে পেয়েছে।

পরোটা মাংসের অডার দেয় হায়দার। দু প্লেট। সুরঞ্জন খেতে চায়, পরোটার টুকরো তার হাতেই রয়ে যায়, মুখে ওঠে না। যত সময় যায়, বুকের মধ্যটা খালি হয় তত। হায়দার গোগ্রাসে খায়। খেয়ে সিগারেট ধরায়। সুরঞ্জন তাড়া দেয়। —চল উঠি, এখনও তো পাওয়া যাচ্ছে না।

–আর কোথায় খুঁজিব, বল। বাকি তো রাখিনি কোনও জায়গা। নিজের চোখেই তো দেখলে!

–ঢাকা একটা ছোট্ট শহর। এখানে মায়াকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, কথা হল? থানায় চল।

থানায় ঘটনাটি জানালে পুলিশের লোক ভাবলেশহীন মুখে ডায়রি করুবার খাতা টেনে নাম-ধাম লিখে রাখে। ব্যস। থানা থেকে বেরিয়ে সুরঞ্জন বলে-ওরা কোনও কাজ করবে বলে মনে হচ্ছে না।

—করতেও পারে।

–ওয়ারির দিকটা চল যাই। ওখানে চেনা কেউ আছে-তোমার?

–আমি পাটির ছেলেদের লাগিয়ে দিয়েছি। ওরাও খুঁজবে। তুমি ভেব না তো।

হায়দার চেষ্টা করছে, তবু দুশ্চিন্তার বোলতা সুরঞ্জনের সারা শরীর কামড়ায়। সারারাত হায়দারের হোন্ডটি পুরনো শহরে ঘোরে। মস্তানদের মদের আড্ডা, জুয়োর আড্ডা, স্মাগলারদের ঘুপচি ঘর খুঁজতে খুঁজতে একসময় আজান পড়ে। আজানের সুরটি সুরঞ্জনের ভালই লাগত, ভৈরবী রাগে গাওয়া। এটি আজ বড় বিচ্ছিরি লাগে তার। আজান হচ্ছে, তার মানে রাত শেষ হয়ে এল, মায়াকে পাওয়া হল না!! টিকাটুলিতে এসে হোল্ডা থামায় হায়দার। বলে—সুরঞ্জন, মন খারাপ করো না। কাল দেখি কী করা যায়।

লণ্ডভণ্ড ঘরে বসে কিরণময়ী ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে ছিলেন দরজার দিকে, সুরঞ্জন মায়াকে নিয়ে ফিরবে। এই আশায় সুধাময়ও তাঁর চেতনাহীন অঙ্গ নিয়ে নিদ্রাহীন উদ্বিগ্ন সময় পার করছিলেন। ওঁরা দেখেন ছেলে খালি হাতে ফিরেছে। মায়া নেই। ক্লান্ত, ব্যর্থ নতমুখ, বিষন্ন সুরঞ্জনকে দেখে দুজনই বাকরুদ্ধ হন। তবে কি মায়াকে আর পাওয়া যাবে না? দুজনই ভয়ে সিঁটিয়ে আছেন। বাড়ির দরজা জানোলা সব বন্ধ, কোনও ঘরে ভেন্টিলেটর নেই। হাওয়া আটকে আছে। ঘরে। ভ্যাপসা গন্ধ বেরোচ্ছে। হাত পা মাথা গুটিয়ে বসে আছেন ওঁরা। কেমন ভূতের মত দেখতে লাগে ওঁদের, সুরঞ্জনের ইচ্ছে করে না। কারও সঙ্গে কথা বলতে। ওঁদের দু চোখে একগাদা প্রশ্ন। সব প্রশ্নের তো উত্তর একটিই, মায়াকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

মেঝোয় পা ছড়িয়ে বসে পড়ে সুরঞ্জন। তার বমি বমি লাগে। এতক্ষণে মায়ার ওপর সম্ভবত গণধর্ষণও সারা। আচ্ছ এরকম কি হতে পারে না, ছ। বছরের মায়া যেমন দু দিন পর ফিরে এসেছিল, সেরকম এবারও ফিরে এল! সুরঞ্জন দরজা খুলেই রেখেছে, মায়া ফিরে আসবে, ফিরে আসুক মায়া, ছোটবেলার মত উদাসীন পায়ে হেঁটে ফিরে আসুক। এই ছোট্ট, বিধ্বস্ত, সর্বস্বাস্ত সংসারে ও ফিরে আসুক। হায়দার কথা দিয়েছে মায়াকে খুঁজবে আরও। কথা যখন দিয়েছে, সুরঞ্জন কি এই স্বপ্ন দেখতে পারে যে মায়া ফিরবে! মায়াকে কেন ধরে নিয়ে গেল ওরা? মায়া হিন্দু বলে? আর কত ধর্ষণ, কত রক্ত, কত ধনসম্পদের বিনিময়ে হিন্দুদের বেঁচে থাকতে হবে এই দেশে? কচ্ছপের মত মাথা গুটিয়ে রেখে! কতদিন? সুরঞ্জন নিজের কাছে উত্তর চায়। পায় না।

কিরণময়ী বসেছিলেন ঘরের এক কোণে, দেওয়ালে পিঠ রেখে, কারও জন্য নয়, নিজেকে শুনিয়ে তিনি বলেন–ওরা বলল, মাসিমা, আপনাদের দেখতে এসেছি কেমন আছেন। আমরা পাড়ারই ছেলে। দরজাটা খুলুন। ওদের বয়স আর কত, কুড়ি একুশ, বাইশ এরকম। আমি কি ওদের সঙ্গে পারি শক্তিতে? পাড়ার বাড়িগুলোয় গিয়ে কেঁদে পড়লাম, সবাই শুনল শুধু। চুক চুক করে দুঃখ করল, কেউ কোনও সাহায্য করল না। ওদের একজনের নাম রফিক, টুপিঅলা একটা ছেলেকে ডাকতে শুনলাম। পারুলের বাড়ি লুকিয়ে ছিল। ক’দিন। ওখানে থাকলে বেঁচে যেত। মায়া কি ফেরত আসবে না? তার চেয়ে বাড়িটা পুড়িয়ে দিত। নাকি বাড়িঅলা মুসলমান বলে পোড়ায়নি। তার চেয়ে মেরে যেত, আমাকেই মেরে যেত। তবু নিরপরাধ মেয়েটিকে রেখে যেত। জীবন তো শেষই ছিল আমার, ওর তো ছিল শুরু।

প্রচণ্ড ঘুরে ওঠে মাথা সুরঞ্জনের। সে গলগল করে বমি করে কলঘর ভাসিয়ে ফেলে।

» লজ্জা (০৭) রোদ পড়েছে বারান্দায়

৭ক.

রোদ পড়েছে বারান্দায়। কালো সাদা বেড়ালটি এদিক ওদিক হাঁটছে। ও কি কাঁটা খুঁজছে, নাকি মায়াকে খুঁজছে। মায়া ওকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াত, মায়ার লেপের তলে ও গুটিসুটি ঘুমিয়ে থাকত। ও কি জানে মায়া নেই?

মায়া নিশ্চয় খুব কাঁদছে। ‘দাদা দাদা’ বলেও হয়ত ডাকছে। মায়ার কি হাত পা বেঁধে নিয়েছে ওরা? মুখে কাপড় খুঁজে? ছ’ বছর আর একুশ বছর এক নয়। দু বয়সের মেয়েকে ধরে নেবার উদ্দেশ্যও এক নয়। সুরঞ্জন অনুমান করতে পারে একুশ বছর বয়সের একটি মেয়েকে নিয়ে সাতজন পুরুষ কি করতে পারে। তার সমস্ত শরীর শক্ত হয়ে ওঠে ক্ষোভে, যন্ত্রণায়। মরে গেলে যেমন কাঠ হয়ে পড়ে থাকে শরীর, অনেকটা সেরকম। সুরঞ্জন কি বেঁচে আছে? বেঁচে তো আছেই। মায়া নেই। মায়া নেই বলে মায়ার আত্মীয়রা বেঁচে থাকবে না? জীবনের ভাগ কেউ কাউকে দেয় না। মানুষের মত স্বার্থপর প্রাণী জগতে আর নেই।

হায়দার খুঁজেছে ঠিকই। তবু সুরঞ্জনের মনে হয়, হায়দার যেন ঠিক মন দিয়ে খোঁজেনি! সুরঞ্জন মুসলমান দিয়ে মুসলমানদের খুঁজিয়েছে, কাঁটা দিয়ে যেমন কাঁটা তুলতে হয়, তেমন। শুয়ে শুয়ে উঠোনের রোদে শোয়া বেড়ালটি দেখতে দেখতে সুরঞ্জনের হঠাৎ সন্দেহ হয়, হায়দার আসলে জানে মায়াকে কারা নিয়ে গেছে। ও যখন সুপারস্টারে খাচ্ছিল, হাপুস হুপুস করে, ওর মুখে কোনও দুশ্চিস্তার ভাঁজ ছিল না। বরং খাবার পর বেশী তৃপ্তির ঢেকুর ছিল, সিগারেটের ধোঁয়াও যখন ছাড়ল, এত আয়েশ ছিল ওর ধোঁয়া ছাড়ায়, মনে হয়নি ও কাউকে খুঁজতে বেরিয়েছে, এবং খুঁজে পাওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। গুর আবার রাতভর নিশাচরের মত শহর ঘুরুবার শখ আছে। ও কি শখ মেটালো। তবে? মায়াকে ফিরে পাবার সত্যিকার কোনও উৎসাহ ছিল না? যেটুকু ছিল তা যেন তেন করে বাঞ্ছাস্ট্রের দায় শোধ। থানার লোককেও তেমন জোর দিয়ে বলেনি, পাটির যে ছেলেদের সঙ্গে সে কথা বলেছে, আগে পার্টির কথা সেরে পরে বলেছে, যেন মায়ার বিষয়টি জরুরি কুতুব এক নম্বরে নয়, দুই নম্বরে। হিন্দুৱা দেশের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, তাই বলেই কি?

সুরঞ্জনের বিশ্বাস হয় না মায়া পাশের ঘরে নেই, যেন সে এক্ষুণি ওঘরে গেলেই দেখতে পাৰে মায়া সুধাময়ের ডান হাতটির ব্যায়াম করিয়ে দিচ্ছে। যেন ওঘরে গেলেই শ্যামলা মেয়েটির মুখে দাদা কিছু একটা করা-র আকুলতা ফুটে উঠবে। মেয়েটার জন্য কিছুই করা হয়নি। থাকে না দাদার কাছে আবদার, বেড়াতে নাও, ওটা কিনে দাও, এটা দাও। আবদার তো করেই ছিল মায়া, সুরঞ্জন রাখেনি, নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে৷ দিনরাত। বন্ধু-বান্ধব, আড্ডা, পার্টি-কে মায়া, কে কিরণময়ী, কে সুধাময়, তাদের সুখ-দুঃখের কথা শুনে তার দরকার কী! সে এই দেশকে মানুষ বানাতে চেয়েছিল, সুরঞ্জনের সাধের দেশটি কি মানুষ হয়েছে আদৌ?

নটা বাজলেই হায়দারের বাড়ি ছোটে সুরঞ্জন। কাছেই বাড়ি।–তখনও ঘুমোচ্ছে হায়দার। বাইরের ঘরে অপেক্ষা করে সে। অপেক্ষা করতে করতে তার সন্দেহ হয়, ওদের সাতজনের একজনের নাম ছিল রফিক, ছেলেটিকে বোধহয় চেনে হায়দার। এমনও হতে পারে রফিক তার আত্মীয় হয়। গা শিউরে ওঠে সুরঞ্জনের। দুঘণ্টা পর ঘুম ভাঙে হায়দারের। সুরঞ্জনকে বসে থাকা দেখে সে জিজ্ঞেস করে–ফিরেছে?

—ফিরলে কি আর এসেছি তোমার কাছে?

—ও। হায়দারের কণ্ঠে নির্লিপ্তি। সে লুঙ্গি পরা, খালি গা, গা দু হাতে চুলকোয়। বলে–এবার শীত পড়েনি তেমন, তাই না? আজও সভানেত্রীর বাড়িতে মিটিং আছে। সম্ভবত মিছিল করার প্রস্তুতি চলবে। গোলাম আজমের ব্যাপারটা যখন তুঙ্গে, তখনই শাল দাঙ্গা বাঁধল। আসলে এগুলো হচ্ছে বি এন পি-র চাল, বুঝলে! ইস্যুটািকে ঘুরিয়ে দেওয়াই তাদের ইচ্ছে।

—আচ্ছা হায়দার, রফিক নামের কোনও ছেলেকে চোন? ওদের মধ্যে রফিক নামের একটি ছেলে ছিল।

—কোন পাড়ার?

—জানি না। বয়স একুশ বাইশ হবে। এ পাড়ারও হতে পারে।

—এরকম কাউকে চিনি না তো! তবু লোক লাগাচ্ছি।

—চল বেরোই। দেরি করাটা তো ঠিক হচ্ছে না। মা বাবার মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। বাবার স্ট্রোক হয়েছে, এই টেনশনে আবার না বড় কোনও দুর্ঘটনা ঘটে যায়।

—এ সময় আমার সঙ্গে ঘোরাটা তোমার ঠিক হবে না।

—কেন, ঠিক হবে না কেন?

–বুঝতে পারছি না কেন। বোঝার চেষ্টা কর।

সুরঞ্জন বুঝবে না কেন, ঠিকই বুঝতে পারছে হায়দার কেন বলছে তার না থাকবার কথা। তার সঙ্গে থাকাটা এখন ঠিক হবে না। কারণ সুরঞ্জন হিন্দু, হিন্দু হয়ে মুসলমানদের গাল দেওয়া ঠিক ভাল ঠেকে না। সেই মুসলমান চোর হোক, কী বদমাশ হোক, কী খুনি হোক। মুসলমানের কবজ থেকে হিন্দু মেয়েকে ছিনিয়ে আনাটাও বোধহও বেশি ঔদ্ধত্য দেখানো হয়ে যায়।

সুরঞ্জন ফিরে আসে। কোথায় ফিরবে। সে? বাড়িতে? ওই খাঁ খাঁ করা বাড়িতে তার ফিরতে ইচ্ছে করে না। সুরঞ্জন মায়াকে ফিরিয়ে আনবে এই আশায় চাতক পাখির মত তৃষ্ণা নিয়ে বসে আছেন ওঁরা। মায়াকে ছাড়া বাড়ি ফিরতে তার ইচ্ছে করে না। হায়দার নাকি লোক লাগিয়েছে, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে ওর লোকেরা মায়াকে একদিন উদ্ধার করবে, আবার সংশয় দানা বাঁধে, মায়া নেই তাতে ওদের কী, ওদের তো আর মায়ার জন্য কানও মায়া নেই। হিন্দুদের জন্য মুসলমানের মায়া থাকবে কেন, মায়া থাকলে আজ পাশের মুসলমান বাড়ি তো লুট হয় না, ওদের বাড়ি ভাঙা হয় না, ভাঙা হয় কেবল রঞ্জনের বাড়ি, পোড়ানো হয় গোপাল হালদারের বাড়ি, কাজলেন্দু দে’র বাড়ি। সুরঞ্জন বাড়ি ফেরে না। পথে পথে ঘোরে। সারা শহর ঘুরে মায়াকে খোঁজে। কী অপরাধ ছিল মায়ার যে ওকে ওরা জোর করে ধরে নিয়ে যাবে? হিন্দু হবার অপরাধ এত বেশি? এত বশি যে তার বাড়িঘর ভাঙা যায়, তাকে ইচ্ছেমত পেটানো যায়, তাকে ধরে নেওয়া যায়, তাকে ধর্ষণ করা যায়। সুরঞ্জন এদিক ওদিক হাঁটে, দৌড়োয়। রাস্তায় একুশ বাইশ বছরের যে কোনও ছেলেকে দেখেই মনে হয় এই ছেলেই বোধহয় মায়াকে নিয়েছে, তার ভতর সংশয় জমা হয়। হতেই থাকে।

ইসলামপুরের এক মুদি দোকানে দাঁড়িয়ে সে এক ঠোঙা মুড়ি কেনে। দোকানচঅলা তার দিকে আড়ে আড়ে তাকায়, সুরঞ্জনের মনে হয় এই লোকটিও বোধহয় জানে যে তার বোন অপহৃত। সে এলোমেলো হাঁটে, নয়াবাজারের ভাঙা মঠের ওপর বসে থাকে। কিছুক্ষে স্বস্তি পায় না। সুরঞ্জন। কারও বাড়িতে গেলে সেই বাবরি মসজিদ প্রসঙ্গ। সেদিন তো সেলিম বলেই বসল, তোরা আমাদের মসজিদ ভাঙতে পারিস, আমরা মন্দির ভাঙলে ক্ষতি কী? সেলিম অবশ্য হাসতে হাসতে বলছিল, হেসেছে বলে সেলিমের মনে যে এই প্রশ্নটি কাজ করেনি তা নয়।

মায়া যদি এর মধ্যে বাড়ি ফেরে, ফিরতেও তো পারে। ধর্ষিতা হয়েও সে ফিরে আসুন তবু ফিরে তো আসুক। মায়া ফিরেছে, ফিরেছে এই ভাবনায় সুরঞ্জন বাড়ি ফেরে, দেখে দুটো মানুষ চোখ কান নাক সজাগ রেখে বসে আছে নিম্পন্দ নিথর, মায়ার অপেক্ষায়। মায়া যে ফেরেনি। এর চেয়ে নিষ্ঠুর নির্মম ভয়ঙ্কর সংবাদ আর কী আছে! বালিশে মুখ ডুবিয়ে উপুড় হয়ে পড়ে থাকে সুরঞ্জন। ওঘর থেকে সুধাময়ের গোঙানোর শব্দ আসে। রাতের স্তব্ধতা ফুঁড়ে বিঝির ডাকের মত ভেসে আসা কিরণময়ীর মিহি কান্না সুরঞ্জনকে একফোঁটা ঘুমোতে দেয় না। তার চেয়ে যদি বিষ পাওয়া যেত, তিনজনই খেয়ে মরে যেতে পারত। কষ্টগুলো এভাবে ফালি ফালি কাটত না তাদের। কী দরকার বেঁচে থেকে? হিন্দু হয়ে এই বাংলাদেশে বেঁচে থাকবার কোনও অর্থ হয় না।

 

৭খ.

সেরেব্রাল থ্রমবসিস বা এমবলিসম জাতীয় কিছু ঘটেছে সুধাময় অনুমান করেন। যদি হেমোরেজ হত নির্ঘাত মরে যেতেন। মরে গেলে খুব কি মন্দ হত? সুধাময় মনে-মনে বড় একটি হেমোরেজ। আশা করছেন। তিনি তো অর্ধেক মৃতই ছিলেন, নিজের বিনিময়ে যদি মায়া অন্তত বাঁচতে পারত। বড় বেঁচে থাকবার শখ ছিল মেয়েটির। একা একই পােরন্সলর বাড়ি চলে গিয়েছিল, তাঁর অসুস্থতাই তার অপহরণের জন্য দায়ী। অপরাধের ঘুণ প্ৰামায়কে কুরে খায়। বারবার তাঁর ঝাপসা হয়ে যায় চোখ। তিনি কিরণময়ীকে একক্স স্পর্শ করবার জন্য হাত বাড়ান। নেই, কেউ নেই। সুরঞ্জনও কাছে নেই, মায়া * তাঁর জল খেতে ইচ্ছে করে, শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে জিভ, আলজিভ, কণ্ঠদেশ।

কিরণময়ীকেও তিনি কম কষ্ট দেননি। পুজো করবার অভ্যোস ছিল কিরুণাময়ীর। বিয়ের পরই সুধাময় জানিয়ে দেন এ বাড়িতে পুজোটুজো চলবে না। কিরণময়ী গান গাইতে জানতেন ভাল, লোকে বলত বেহায়া বেশিরম মেয়ে, হিন্দু মেয়েদের লজ্জা-শরম নেই এই সব কটাক্ষ কিরণময়ীকে অস্বস্তিতে ফেলত। নিজেকে সংযত করতে করতে কিরকময়ী গান গাওয়া প্রায় ছেড়েই দিলেন। এই যে তিনি গান ছাড়লেন, সুধাময় আর কতটুকুছ তাঁর পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। হয়ত তিনিও এরকম ভাবতেন লোকে যখন মন্দ বলৱ তখন কী আর করা। একুশ বছর তিনি কিরণময়ীকে পাশে নিয়ে শুয়েছেন। কেন্ম শুয়েছেনই। কিরণময়ীর সতীত্বকে আগলে রেখেছেন। কি দরকার ছিল তাঁর স্ত্রীর সতী উপভোগ করবার? এও তো এক ধরনের পারভারশান। শাড়ি গয়নার দিকেও কিক্সমবায়ীর তেমন আকর্ষণ ছিল না। কখনও তিনি বলেননি ওই শাড়িটি চাই, বা একজাড়া ইয়ারিং দরকার। সুধাময় প্রায়ই বলতেন-কিরণময়ী, তুমি কি মনে কোনও কষ্ট লুকিয়ে রাখা?

কিরণময়ী বলতেন–না তো। আমার এই সংসারেই আমার স্বপ্ন সুখ সব। নিজের জন্য আমি আলাদা করে কোনও আনন্দ চাই না।

সুধাময়ের মেয়ের শখ ছিল। সুরঞ্জনের জন্মের আগে কিরণময়ীর পেটে স্টেথেসকোপ লাগিয়ে বলতেন—আমার মেয়ের হার্টবিট শুনতে পাচ্ছি কিরণময়ী। তুমি শুনবে?

সুধাময় বলতেন— বাপ মা’কে শেষ বয়সে মেয়েরাই দেখে। ছেলেরা বউ নিয়ে আলাদা হয়ে যায়। মেয়েরাই স্বামী সংসার ফেলে বাপ মায়ের যত্ন করে। আমি তো হাসপাতালে থাকি, দেখি। অসুস্থ বাপ মা’র শিয়রে বসে আছে মেয়েরা। ছেলে আছে, অতিথির মত দেখতে হয়ত আসে, এর বেশি না।

স্টেথোর নল কিরণময়ীর কানে লাগিয়ে তিনি তাঁকেও শোনাতেন হৃদপিণ্ডের লাবড়াব শব্দ। জগতসুদ্ধ সবাই পুত্ৰ চায়, আর সুধাময় চাইতেন কন্যা। ছোটবেলায় সুরঞ্জনকে ফ্রক পরিয়ে সুধাময় বেড়াতে নিতেন। মায়া জন্ম নেবার পর সুধাময়ের আশা পূরণ হল। ‘মায়া’ নামটি সুধাময় নিজেই রেখেছিলেন, বলেছিলেন—এ আমার মায়ের নাম। আমার এক মা গেছেন, আরেক মা এলেন।

রাতে মায়াই সুধাময়কে ওষুধ খাইয়ে দিত। ওষুধ খাবার সময় হয়ে গেছে। কখন। তিনি ‘মায়া মায়া’ বলে তাঁর প্রিয় কন্যাকে ডাকেন। পড়শিরা ঘুমিয়ে গেছে সব। তাঁর ডাকটি জেগে থাকা কিরণময়ী শোনেন, সুরঞ্জন শোনে, সাদা কালো বেড়ালটিও শোনে।

লজ্জা (০৮) অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলবার পর

৮ক.

উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলবার পর সারা ভারত জুড়ে যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল তার মাত্রা কমে আসছে। ধীরে ধীরে। ভারতে মৃতের সংখ্যা এর মধ্যে আঠারশ ছাড়িয়ে গেছে। কানপুর ও ভূপালে এখনও সংঘর্ষ চলছে। প্রতিরোধ করতে গুজরাট, কণাটক, কেরালা, অন্ধ্রপ্রদেশ, আসাম, রাজস্থান এবং পশ্চিমবঙ্গের রাস্তায় সেনাবাহিনী নেমেছে। তারা টহল দিচ্ছে। ভারতে নিষিদ্ধ ঘোষিত দলগুলোর দরজায় তালা পড়েছে।

শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য ঢাকায় সর্বদলীয় স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল হচ্ছে, তাতে কী। এদিকে শদ্ভূ-গোলকপুরের ত্ৰিশজন হিন্দু মেয়ে ধর্ষিতা হয়েছে, চঞ্চলী, সন্ধ্যা, মণি..। মারা গেছে নিকুঞ্জ দত্ত। ভয়ে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছে এক বৃদ্ধা, ভগবতী। গোলকপুরে দিনের বেলায়ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। মুসলমানের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া মেয়েরাও ধর্ষিতা হয়েছে। দাসের হাট বাজারের নাটু হালদারের চৌদ্দশ মণ সুপারির আড়ত ছাই হয়ে গেছে। ভোলা শহরের মন্দির ভাঙচুরের সময় পুলিশ, ম্যাজিষ্ট্রেট, ডি সি নীরবে: দাঁড়িয়ে ছিল। জুয়েলারিগুলো প্রকাশ্যে লুট হয়েছে। হিন্দু ধােপাবাড়ি পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। মানিকগঞ্জ শহরের লক্ষ্মী মণ্ডপ, সার্বজনীন শিববাড়ি, দাশেরা, কালিখলা, স্বর্ণকার পট্টি, গদাধর পালের বেভারেজ ও সিগারেটের বড় মজুত দোকান ভাঙচুর করা হয়। তিন ট্রাক ভর্তি লোক ত্বরা, বানিয়াজুরি, পুকুরিয়া, উথলি, মহাদেবপুর, জোকা, শিবালয় থানায় হামলা চালায়। শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে বেতিলা গ্রামে হিন্দুদের ঘর লুট করা হয়। পোড়ানো হয়। বেতিলার শত বছরের পুরনো নাটমন্দিরে হামলালানো হয়। গড়পাড়ায় জীবন সাহার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তার তিনটে গোয়াল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, কয়েকশ মণ ধানও পুড়ে গেছে। ঘিওর থানার তেরাষ্ট্ৰীবাজারের হিন্দুদের দোকান, গাণ্ডভুবি, বানিয়াজুরি, সেনপাড়ার হিন্দু বাড়িগুলোয় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেনপাড়ায় এক হিন্দু গৃহবধূকেও ধর্ষণ করা হয়েছে। পিরোজপুরের কালীবাড়ি দেবার্চনা কমিটির কালী মন্দির, মনসা মন্দির, দুর্গা মন্দির, শীতল মন্দির শিব মন্দির, নারায়ণ মন্দির, পিরোজপুর মদনমোহন বিগ্রহের মন্দির, আখড়াবাড়ি, রায়েক্লাঠি কালীবাড়ির মন্দির, কৃষ্ণনগর রাইরাসরাজ সেবাশ্রম, ডুমুরতলা শ্ৰীশুরু সংঘের আশ্রম মন্দির, দক্ষিণ ডুমুরতলার সুরেশ সাহার বাড়ির কালী মন্দির, ডুমুরতলার নরেন সাহা বাড়ির মনসা মন্দির, রমেশ সাহার বাড়ির মনসা মন্দির ও বসতবাড়ি, ডুমুরতলা বারোর কালী মন্দির, সুচরণ মণ্ডল, গৌরাঙ্গ হালদার, হরেন্দ্রনাথ সাহা, নরেন্দ্রনাথ সাহার বাড়িল্লমন্দির, ডুমুরতলা হাই স্কুলের পাশে কালী মন্দির, রানীপুর পঞ্চদেবীর মন্দির, হুলারাহাট সার্বজনীন দুৰ্গ মন্দির ও কার্তিক দাসের কাঠের দোকান, কলাখালি সনাতন আশ্ৰৱল কালী মন্দির, জুজখোলা গৌরগোবিন্দ সেবাশ্রম, হরিসভার সনাতন ধর্মমন্দির, রনজিৎ শীলের বাড়ির কালী মন্দির, জুজখোলা বারোয়ারি পূজামণ্ডপ, গাবতলা স্কুলের পাশে সার্বজনীন দুর্গা মন্দির, কৃষ্ণনগর বিপিন হালদারের বাড়ির মন্দির, নামাজপুর সার্বজনীন কালী মন্দির, কালিকাঠি বিশ্বাস বাড়ির মন্দির ও মঠ, লাইরি কালী মন্দির, স্বরূপঠি থানার ইন্দের হাট সার্বজনীন মন্দির, ইন্দের হাট কানাই বিশ্বাসের বাড়ির দুর্গ মন্দিরবানকুল সাহার সিনেমা হল, অমল গুহর বাড়ির দুর্গ মন্দির, হেমন্ত শীলের বাড়ির মন্দির, মঠবাড়িয়া থানার যাদব দাসের বাড়ির কালী মন্দির জ্বালানো হয়। সৈয়দপুর মিস্ত্রী পাড়ায় শিব মন্দিরও ভাঙা হয়। নড়াইল জেলার রতডাঙ্গা গ্রামে সাৰ্বজনীন মন্দির, বারোর ঘোনা সার্বজনীন মন্দির, কুডুলিয়ার সার্বজনীন শ্মশানঘাট, নিখিল চন্দ্ৰ দে’র পারিবারিক মন্দির, কালীপদ হাজরার পারিবারিক মন্দির, শিবুপ্রসাদ পালের পারিবারিক মন্দির, বাদন গ্রামের দুলাল চন্দ্র চক্রবর্তীর বাড়ির মন্দির, কৃষ্ণচন্দ্র লস্করের বাড়ির মন্দির, তালতলা গ্রামের সার্বজনীন মন্দির, পঙ্কবিলা গ্রামের বৈদ্যনাথ সাহা, সুকুমার বিশ্বাস, পাগলা বিশ্বালে পারিবারিক মন্দির, পঙ্কবিলা গ্রামের সার্বজনীন মন্দির ও লোহাগড়া থানার দৌলতপুর পূর্বপাড়া নারায়ণ জিউ মন্দির ভেঙেচুরে তছনছ করা হয়। খুলনায় দশটি মন্দিল্লী ভেঙেছে। পাইকপাড়ার রাডুলি, সোবনাদাশ। আর বাকা গ্রামে চার-পাঁচটি মন্দির ভাঙচুহু কয়েকটি বাড়িতে লুটপাট করা হয়। রূপসা থানার তালিমপুর এলাকায় দুটো মন্দির-ভেঙে দেওয়া হয়। পাশের হিন্দু বাড়িগুলো লুট করা হয়। দীঘলিয়া আর সেন✉ট এলাকায় আটই ডিসেম্বর রাতে তিনটি মন্দির ভেঙে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফেনীর সহদেবপুর গ্রামে একদল মিছিলকারী তেরোটি বাড়িতে হামলা চালায়। ছাগল-ইয়ার জয়পুর গ্রামে হামলা হওয়ায় বিশজন আহত হয়েছে। লাঙ্গলবোয়া গ্রাম থেকে মোয়াজেম হোসেনের নেতৃত্বে দুশ লোক গোবিন্দপ্ৰসাদ রায়ের বাড়িতে হামলা চালাম্বী কমল বিশ্বাস নামে একজন গুরুতর আহত হয়। সম্ভবত মারা যাবে।

বিরূপাক্ষ, নয়ন, দেবব্রত, সুরঞ্জনের সামনে বসে গলগল করে ভাঙচুরের বমি করে। সুরঞ্জন চোখ বুজে শুয়ে থাকে। একটি কথাও সে এতগুলো ভাঙনের গল্প শুনবার পরও উচ্চারণ করে না। এরা কেউ জানে না কেবল ভোলা চট্টগ্রাম পিরোজপুর সিলেট কুমিল্লার হিন্দু বাড়ি লুট হয়নি, টিকাটুলির এই বাড়ি থেকে লুট হয়ে গেছে মায়া নামের একটি চমৎকার মেয়ে, মেয়েমানুষ তো অনেকটা সম্পদের মত, তাই সোনাদানা ধনসম্পদের মত মায়াকেও তুলে নিয়ে গেছে ওরা।

–কি ব্যাপার সুরঞ্জন কথা বলছি না কেন? হয়েছে কি তোমার? দেবব্রত প্রশ্ন করে।

–মদ খেতে চাই। পেট ভরে মদ খাওয়া যায় না আজ?

–মদ খাবে?

–হ্যাঁ খাব ৷

— টাকা আছে আমার পকেটে, কেউ গিয়ে এক বোতল হুইস্কি নিয়ে এস।

–বাড়িতে বসে খাবে? তোমার বাবা মা?

–গুল্লি মারো বাবা মা। আমি খেতে চাইছি, খাব। বিরূ যাও, সাকুরা পিয়সি কোনও একটাতে পাবে।

–কিন্তু সুরঞ্জনদা…

–এত হেসিটেট করো না তো, যাও।

ওঘর থেকে কিরণময়ীর কান্নার শব্দ ভেসে আসে।

–কাঁদে কে? মাসিমা? বিরূপাক্ষ জিজ্ঞেস করে।

–হিন্দু হয়েছে যখন, না কেঁদে উপায় আছে?

চুপ হয়ে যায় তিন যুবক। হিন্দু তো ওরাও, ওরাও অনুভব করে মাসিমাকে কাঁদতে হয় কেন। প্রত্যেকের বুকের মধ্য থেকে বোবা কান্না ঠেলে ওঠে। বিরূপাক্ষ টাকা নিয়ে দ্রুত চলে যায়, ফেন চলে গেলেই সে সকল বেদনা থেকে মুক্তি পাবে। যেমন সুরঞ্জন মুক্তি পেতে চাইছে মদ খেয়ে।

বিরূপাক্ষ চলে যেতেই সুরঞ্জন প্রশ্ন করে–আচ্ছা দেবব্রত, মসজিদ পোড়ানো যায় না?

–মসজিদ? তোমার কি মাথা-ট্যাথা খারাপ হয়ে গেছে?

—চল আজ রাতে ‘তারা মসজিদ’ পুড়িয়ে ফেলি। দেবব্রত বিস্মিত চোখে একবার সুরঞ্জনের দিকে, একবার নয়নের দিকে তাকায়।

—আমরা দু কোটি হিন্দু আছি, চাইলে বায়তুল মোকাররমটাকেও তো পুড়িয়ে ফেলতে পারি।

—তুমি তো কখনও নিজেকে হিন্দু বলনি। আজ বলছ কেন?

–মানুষ বলতাম তো, মানবতাবাদী বলতাম। আমাকে মুসলমানেরা মানুষ থাকতে দেয়নি। হিন্দু বানিয়েছে।

–তুমি খুব বদলে যােচ্ছ সুরঞ্জন।

–সে আমার দোষ নয়।

–মসজিদ ভেঙে আমাদের কি লাভ? আমরা কি আর মন্দির ফিরে পাব? দেবব্রত চেয়ারের ভাঙা হাতলে নখ ঘষতে ঘষতে বলে।

–না পাই, তবু আমরাও যে ভাঙতে পারি। আমাদেরও যে রাগ আছে তা একবার জানানো উচিত নয়? বাবরি মসজিদ সাঁড়ে চারশ বছরের পুরনো মসজিদ ছিল। চৈতন্যদেবের বাড়িও তো পাঁচশ বছরের পুরনো ছিল। চার-পাঁচশ বছরের পুরনো ঐতিহ্য কি এ দেশে গুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না? আমার সোবহানবাগ মসজিদটাও ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করছে। গুলশান এক নম্বরের মসজিদটা সৌদি আরবের টাকায় করা। চল ওটা দখল করে মন্দির বানিয়ে ফেলি।

–কী বলছি তুমি সুরঞ্জন? পাগলই হয়েছ বটে। তুমি না। আগে বলতে ‘মন্দির ও মসজিদের জায়গায় দিঘি কেটে নধর পতিহাঁস ছেড়ে দেব?

–কেবল কি তাই বলতাম, বলতাম,  গুঁড়ো হয়ে যাক ধর্মের দালানকোঠা, পুড়ে যাক অন্ধাগুনে মন্দির মসজিদ গুরুদয়ারা গির্জার ইট, আর সেই ধ্বংসস্তুপের ওপর সুগন্ধ ছড়িয়ে বড় হোক মনোলোভা ফুলের বাগান, বড় হোক শিশুর ইস্কুল, পাঠাগার। মানুষের কল্যাণের জন্য এখন প্রার্থনালয় হোক হাসপাতাল, এতিমখানা, বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়। এখন প্রার্থনালয় হোক শিল্পকলা একাডেমি, কলামন্দির, বিজ্ঞান গবেষণাগার, এখন প্রার্থনালয় হোক ভোরের কিরণময় সোনালি ধানের ক্ষেত, খোলা মাঠ, নদী, উতল সমুদ্র। ধর্মের অপর নাম আজ থেকে মনুষ্যত্ব হোক।

–সেদিন দেবেশ রায়ের একটি লেখা পড়লাম। লিখেছেন বড়ে গোলাম তাঁর সুরমণ্ডল নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নেচে নেচে গাইছেন, হরি ওম তৎসৎ, হরি ওম তৎসৎ। আজও বড়ে গোলাম সেই একই গান গেয়ে চলেছেন। কিন্তু যারা বাবরি মসজিদকে ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে সেখানে রামলালার মূর্তি বসিয়ে পালিয়ে আসে, সেই হিন্দু এ গান শুনতে পায় না। এ গান আদভানি, অশোক সিঙ্ঘলরা শুনতে পায় না। এ গান রাস্ট্রীয় সেবক সংঘ বা বজরং দল শুনতে পায় না। বড়ে গোলাম আলি মুসলমান ছিলো। অথচ তাঁর গলায় এই হরি ওম তৎসৎ সেইসব মুসলমানরাও শুনতে পায় না। স্বামীনে করে মসজিদ ধ্বংসের একমাত্র প্রতিবিধান হতে পারে মন্দির ধ্বংস করে।

—সুতরাং বলতে চাইছ মন্দির ধ্বংসের কারণে মন্দির ধ্বংস করা ঠিক নয়। তুমি আমার বাবার মত আদর্শবাদের কথা বলছি। আই হেট হিম। আই হেট দ্যাট ওলন্ড হেগার।

সুরঞ্জন উত্তেজিত হয়ে শোয়া থেকে একলাফে উঠে দাঁড়ায়।

–শান্ত হও সুরঞ্জন। শান্ত হও। তুমি যা বলছ এগুলো কোনও সমাধান নয়।

–আমি এভাবেই সমাধান চাই। আমার হাতেও আমি রামদা কিরিচ পিস্তল চাই। মোটামোটা লাঠি চাই। ওরা পুরনো ঢাকার এক মন্দিরে পেচ্ছাব করে এসেছিল না? আমি পেচ্ছাব করতে চাই ওদের মসজিদে।

–ওহ সুরঞ্জন। তুমি কম্যুনাল হয়ে যাচ্ছ।

— হ্যাঁ আমি কম্যুনাল হচ্ছি। কম্যুনাল হচ্ছি। কম্যুনাল হচ্ছি।

সুব্ৰত সুরঞ্জনের পার্টির ছেলে। নানা কাজে একসঙ্গে থেকেছে দুজন। সে অবাক হয় রঞ্জনের আচরণে। মদ খেতে চাইছে। নিজের মুখে বলছে কম্যুনাল হচ্ছে। বাবাকে পর্যন্ত গাল দিচ্ছে।

 

৮খ.

‘দাঙ্গা তো বন্যা নয় যে, জল থেকে তুলে আনলেই বিপদ কাটল, তারপর চিড়েমুড়ি গাড় করতে পারলেই আপাতত ঝামেলা মিটল। দাঙ্গা তো আগুন লাগা নয় যে, জল ঢলে নিভিয়ে দিলেই পরিত্রাণ জুটবে। দাঙ্গায় মানুষ তার মনুষ্যত্ব স্থগিত রাখে। দাসী মানুষের মনের বিষ বেরিয়ে আসে। দাঙ্গা কোনও প্রাকৃতিক ঘটনা নয়, কোনও দুৰ্ঘটনা নয়। দাঙ্গা মনুষ্যত্বের বিকার।’ সুধাময় দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। কিরণময়ী ঘরের কোণে তাঁর ভগবানের কাছে কপাল ঠুকে রাখেন। মাটির ঠাকুরটি নেই। ভেঙে ফেলেছে সেদিন। রাধাকৃষ্ণের একটি ছবি ছিল কোথাও। সেটি সামনে নিয়ে কপাল ঠোঁকেন কিরণময়ী। নিঃশব্দে চোখের জল ফেলেন। সুধাময় তাঁর চলৎশক্তিহীন শরীর নিয়ে শুয়ে শুয়ে ভাকেন। রাধা বা কৃষ্ণের কি কোনও ক্ষমতা আছে মায়াকে ফিরিয়ে দেবার! এই যে ছবি, এ তো কেবল ছবি। কেবল গল্প। এরা কি করে মায়াকে কঠোর কঠিন নিষ্ঠুর মৌলবাদের কবল থেকে উদ্ধার করবে? এই দেশের নাগরিক হয়েও, ভাষা আন্দোলন করেও, যুদ্ধ করে পাকিস্তানিদের খেদিয়ে দেশ স্বাধীন করেও এই দেশে তাঁর নিরাপত্তা জোটে না। আর কোথাকার কোন রাধা কৃষ্ণ তাঁকে বলা নেই কওয়া নেই নিরাপত্তা দেবে! এদের আর খেয়ে-দোয়ে কাজ নেই। জন্ম থেকে চেনা পড়শিই তোমার বাড়ি দখল করে নিচ্ছে, তোমার পাশের বাড়ির দেশি ভাইয়েরা তোমার মেয়েকে অপহরণ করে নিচ্ছে। আর সেখানে তোমার দুৰ্গতি দূর করতে ননীচোর আসবে! আয়ান ঘোষের স্ত্রী আসবে! দুৰ্গতি যদি দূর করতে হয় সবাই মিলে এক জাতি হবার জন্য যারা যুদ্ধ করেছিল, তারাই করবে।

সুধাময় করুন ক্লান্ত স্বরে কিরণময়ীকে ডাকেন–কিরণ কিরণ।

কিরণময়ী রোবটের মত কাছে দাঁড়াতেই তিনি বলেন—সুরঞ্জন মায়াকে আজ খুঁজতে যায়নি?

–জানি না।

—হায়দার নাকি লোক দিয়ে খোঁজাচ্ছে। ও কি এসেছিল?

–না।

–তবে কি মায়াকে পাওয়া যাচ্ছে না?

–জানি না।

—আমার পাশে একটু বসবে কিরণ?

কিরণময়ী জড়বস্তুর মত থপ করে বসেন ৷ বসেই থাকেন। না হাত বাড়ান। তাঁর অচেতন হাত পায়ে, না একবার তোকান অসুস্থ স্বামীর দিকে। ওঘরে হইচই চিৎকারের শব্দ। সুধাময় বলেন-সুরঞ্জন এত চেঁচাচ্ছে কেন? ও হায়দারের খোঁজে যায়নি? আমি নিজেই তো যেতে পারতাম। এই অসুখটা কেন আমার হতে গেল! আমি সুস্থ থাকলে মায়াকে কেউ ষ্টুতে পারত? পিটিয়ে লাশ বানিয়ে দিতাম না! সুস্থ থাকলে যে করেই হোক মায়াকে আমি খুঁজে আনতাম…সুধাময় একই উঠতে চান। উঠতে গিয়ে আবারই চিৎ হয়ে পড়ে যান বিছানায়। কিরণময়ী তাঁকে ধরে ওঠান না। স্থির তাকিয়ে থাকেন বন্ধ দরজার দিকে। কখন শব্দ হয়। কখন ফেরে মায়া।

—একবার ডাকো তোমার সুযোগ্য পুত্ৰধনকে। স্কাউন্ড্রেল কোথাকার। বোন নেই। আর বাড়িতে সে মদের আসর বসিয়েছে ৷ হৈ-হাল্লা করছে। ছিঃ ছিঃ।

কিরণময়ী সুরঞ্জনকে না ডাকতে যান, না। সুধাময়কে শাস্ত হতে বলেন, তিনি স্থির তাকিয়ে থাকেন দরজায়। ঘরের কোণে রাধাকৃষ্ণের ছবি বসিয়েছেন। তিনি এখন আর স্বামী বা পুত্রের নিষেধ মেনে নাস্তিকতার চাচা করতে রাজি নন। এই মুহুর্তে কোনও মানুষ সহায় নয়, যদি একবার ভগবান সহায় হন।

সুধাময় একবার দাঁড়াতে চান। একবার জেনাথন সুইফটের মত বলতে চান পরস্পরকে ঘৃণা করবার ধর্ম আমাদের অনেক আছে, কিন্তু পরস্পরকে ভালবাসার ধর্ম নেই। মানুষের ইতিহাস কলঙ্কিত হয়ে আছে ধর্মীয় কলহে, যুদ্ধে, জেহাদে। ছেচল্লিশে শ্লোগান দিতেন সুধাময়রা ‘হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই’। এরকম শ্লোগান আজও হয়। এই শ্লোগান এতকাল ধরে দিতে হয় কেন? এই উপমহাদেশে এই শ্লোগান স্পষ্ট বছর কত শতাব্দী ধরে দিতে হবে। এখনও প্রয়োজন ফুরোয়নি আহ্বানের! এই শ্লোগান শ্লোগানে বোধবুদ্ধিহীন মানুষ কি জাগে আদৌ? মানুষ যদি ভেতরে অসাম্প্রদায়িক না হয়, তবে এই শ্লোগান দিয়ে আর যাই ঘুচুক, সাম্প্রদায়িকতা ঘুচবে না।

 

৮গ.

হায়দারের বাড়ি ঘুরে এসেছে সুরঞ্জন। সে নেই। ভোলা গেছে। ভোলায় হিন্দুর দুর্দশা দেখতে গেছে। নিশ্চয়ই ফিরে এসে আহা উহু করবে। দশ জায়গায় বক্তৃতা করবে। লোকে বাহবা দেবে। বলবে—আওয়ামি লিগের কর্মীরা বড় দরদী। বড় অসাম্প্রদায়িক। সুতরাং হিন্দুর ভোটগুলো আর যায় কই! তার পাশের বাড়ির মায়ার প্রতি মায়া নেই। সে গেছে দূরের মায়াদের দেখতে।

ছিপি খুলে গলায় ঢকচক করে কিছু ঢেলে নেয় সুরঞ্জন। অন্যদের তেমন আগ্রহ নেই খেতে। তবু সঙ্গ দিতে জল মিশিয়ে মুখে দেয়। খালি পেটে মদ পড়লে কেমন গুলিয়ে ওঠে সব।

–বিকেলবেলাটা আমার খুব ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে হত। মায়ারও ঘুরে বেড়াবার খুব শখ। একদিন শালবন বিহার নিয়ে যাব।

–জানুয়ারির দু তারিখ থেকে ওলামা মাশায়েখদের লং মার্চ। বিরূপাক্ষ বলে।

–কিসের লং মার্চ?

–তারা হেঁটে হেঁটে ভারত যাবে বাবরি মসজিদ পুনর্নির্মাণের জন্য।

–হিন্দুদের নেবে লং মার্চে? নিলে আমিও যাব। তোমরা যাবে কেউ? সুরঞ্জন প্রশ্ন করে।

সকলে নীরব। এ ওর মুখ চায়।

দেবব্রত খানিকটা ধমকের সুরেই বলে—তুমি এত হিন্দু মুসলমান হিন্দু মুসলমান করছ কেন? তোমার হিন্দুত্বটা বেশি বেড়ে গেছে।

–আচ্ছা দেবু, ছেলেদের সারকামশিসন করা না থাকলে বোঝা যায় সে হিন্দু। কিন্তু মেয়েদের হিন্দুত্ব বোঝার উপায় কি বল তো! ধর মায়া। মায়াকে যদি ছেড়ে দেওয়া হয় রাস্তায়। ধর ওর মুখ বাঁধা হাত পা বাঁধা। ও যে হিন্দু বুঝবে কি করে? ওর তো মুসলমানদের মতই দেখতে নাক চোখ মুখ, হাত পা মাথা।

সুরঞ্জনের কথায় কোনও উত্তর না দিয়ে দেবব্রত বলে–জিয়াউর রহমানের সময় ফারাক্কার জলের জন্য রাজনৈতিক লং মার্চ হয়েছিল সীমান্ত পর্যন্ত। খালেদা জিয়ার আমলে তিরানব্বই সালে শুরু হবে বাবরি মসজিদ তৈরির জন্য সাম্প্রদায়িক লং মার্চের মধ্য দিয়ে। ফারাক্কার লং মার্চও যেমন জলের জন্য হয়নি, বাবরি মসজিদের লং মার্চও বাবরি মসজিদের পুননির্মাণের জন্য হবে না। আসলে বাবরি মসজিদ নিয়ে বাড়াবাড়ির উদ্দেশ্য রাজনৈতিকে সাম্প্রদায়িকতার পাওয়ার হাউজে পরিণত করা আর গোলাম আজম-বিরোধী আন্দোলন থেকে দৃষ্টি অন্য দিকে সরিয়ে দেওয়া। এ সময় সরকারের এয়ার টাইট নীরবতাটাও লক্ষ করবার মত। এত কিছু ঘটে যাচ্ছে, অথচ সরকার বলেই চলেছে, এ দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্ৰীতি আছে।

এ সময় পুলক ঢেকে ঘরে। বলে-কি ব্যাপার দরজা খোলা রেখে বসে আছ?

—দরজা খোলা, মদ খাচ্ছি, চিৎকার করছি। ভয়ের কি আছে, মরে গেলে মরে যাব। তুমি বেরোলে যে বাইরে!

—পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত। তাই বেরোতে সাহস পেলাম।

–আবার অশান্ত হলে দরজায় খিল এটে বসবে, তাই না? সুরঞ্জন শব্দ করে হেসে ওঠে।

পুলক অবাক হয় সুরঞ্জনের মদ্যপান দেখে। সে ভয়ে ভয়ে স্কুটারে গা লুকিয়ে এসেছে। দেশের পরিস্থিতি কী ভয়াবহ। আর সুরঞ্জনের মত রাজনীতি সচেতন ছেলে ঘরে বসে হাসছে, মদ খাচ্ছে। এই দৃশ্যটি সে কল্পনা করতে পারে না। সুরঞ্জন হঠাৎ এমন বদলে গেল কেন?

সুরঞ্জন গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলে–গোলাম আজম গোলাম আজম গোলাম আজম। গোলাম আজম দিয়ে আমার কি? আমার.কী লাভ গোলাম আজমের শাস্তি হলে? তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে আমি কোনও উৎসাহ পাই না। মায়ার আবার ঘৃণায় গা রি রি করে। নাম শুনলে বমি করে। মুক্তিযুদ্ধে আমার দুই জ্ঞাতি কাকা আর তিন মামাকে পাকিস্তানিরা গুলি করে মেরে ফেলেছে। আমি বুঝি না বাবাকে কেন বাঁচিয়ে দিয়েছিল ওরা। সম্ভবত স্বাধীনতার মজা ভোগ করতে। এখন ভোগ করছে না? বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে স্বাধীনতার রোদ পোহাচ্ছে না ডক্টর সুধাময় দত্ত?

মেঝোয় পা ছড়িয়ে বসেছে সুরঞ্জন। পুলকও বসে। ধুলো ভরা ঘর, ভাঙা চেয়ার। বইপত্র ছড়ানো। সারা ঘরে সিগারেটের ছাই। ঘরের কোণে একটি আলমারি, ভাঙা। সুরঞ্জনের যে মেজাজ, মদ খেয়ে খেয়ে বোধহয় ভেঙেছে সব। বাড়ি এত নিঝুম, আর কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না।

—একরাম হোসেন ভোলায় গিয়েছিল। ফিরে বলল ভোলার পুলিশ, প্রশাসন, বি এন পি-র লোক বলছে ভোলার ঘটনা নাকি বাবরি মসজিদ ভাঙার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া, মানে স্পনটেনিয়াস ব্যাপার, এগুলো নাকি লুটেরাদের কাজ, আর কিছু নয়। হিন্দু উচ্ছেদ অভিযানের ফলে গ্রামের পর গ্রাম পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। বাতাসে পোড়া গন্ধ শুধু। খড়ের গাদা, গোলাঘর কিছু বাদ যায়নি। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে সব। ঘরের কাপড়চোপড়, জুতো, কাঁথা-বালিশ থেকে শুরু তেলের শিশি, এমন কি ঘরের ঝাড়ু পর্যন্ত লুট করে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বলিয়ে দিয়েছে। আগুনে পুড়ে গেছে ধানক্ষেত, নারকেলের বাগান, ছেলেদের পরনের লুঙ্গিও জোর করে খুলে নিয়েছে। মেয়েদের যাকে পেয়েছে ধর্ষণ করেছে, শাড়ি অলঙ্কার জোর করে খুলে নিয়েছে। ধানক্ষেতে লুকিয়ে ছিল হিন্দুল্লা। শম্ভুপুর খাসেরহাট স্কুলের টিচার নিকুঞ্জ দত্তকে ধানক্ষেতে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় টাকার জন্য মারধোর করে। নিকুঞ্জ দত্ত সম্ভবত মারা যাকেন। ভোলায় শ্লোগান দিয়েছে, হিন্দু যদি বাঁচতে চাও, বাংলা ছেড়ে ভারত যাও। হিন্দুদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে কবে যাবি, ‘কোিট গরুকে দিয়ে খাওয়াব। বিত্তবান হিন্দুদের অবস্থাও একই রকম। তাদেরও কিছু নেই, পুড়ে ছাই সব। তারা এখন নারকেলের মালায় জল খাচ্ছে, কলাপাতায় ভাত খাচ্ছে তাও সাহায্যের চাল। দিনে একবার শাকপাতা, কচুঘেঁচু রান্না করে খাচ্ছে। স্বামী সামনে স্ত্রী, বাবার সামনে মেয়েকে, ভাইয়ের সামনে বোনকে ধর্ষণ করেছে। মা আর মেয়েয়েকে একই সঙ্গে ধর্ষণের ঘটনাও ঘটেছে। অনেকে খোলাখুলি বলছে–ভিক্ষে করব, তবু এখানে আর না।’ সাহায্য নিয়ে যারা যাচ্ছে, তাদের কেউ কেউ মুখ ফুটেই বলে—’সাহায্য লাগবে না। আমাদের পার করে দিন, আমরা চলে যাই।’ শম্ভুপুর গোলপুরে হামলা করেছে এম এ বাছেত আর সিরাজ পাটোয়ারি, এরা আগে শিবিরের নেতা ছিল এখন বি এন পি করে। লর্ড হার্ডিঞ্জের একটি হিন্দু বাড়িও নাকি নেই যে পোড়া হয়নি। প্রিয়ালালবাবু ছিলেন ফ্রিডম ফাইটার। তাঁর বাড়িতেও অত্যাচার হয়। তাঁদের গ্রামে হামলা করেছে আওয়ামি লিগ নেতা আবদুল কাদের চেয়ারম্যান, বেলায়েত হোসেন। বাবুল দাসের তিনটি পাওয়ার টিলার পুড়ে গেছে। একরাম তাঁর ভবিষ্যৎ কি জানতে চাইলে নাকি কান্নায় ভেঙে পড়েন, বলেন, সময় পেলে চলে যাব। পুলক হয়ত বলতেই থাকত। সুরঞ্জন তাকে ধমকে থামায়। বলে—শাট আপ। আর একটিও কথা না। আর একটি কথা বল তো চাবকাবো তোমাকে।

পুলক প্রথম ঘাবড়ে যায় সুরঞ্জনের ধমকে। সে বুঝে পায় না সুরঞ্জন এমন অস্বাভাবিক আচরন করছে কেন। মদের ঝোঁকে? হতে পারে। দেবব্রতর দিকে তাকিয়ে সে শুকনো ঠোঁটে হাসে।

অনেকক্ষণ কেউ কোনও কথা বলে না। সুরঞ্জনের গ্লাস দ্রুত শেষ হতে থাকে। সে মদে অভ্যস্ত নয়। হঠাৎ হঠাৎ কারও বাড়ির আসরে পান করে। তাও অল্প। আজ তার ইচ্ছে করছে কয়েক বোতল এক ঢেকে খেয়ে ফেলতে। পুলককে থামিয়ে দেবার পর হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায় পরিবেশ। স্তব্ধতার মধ্য থেকে সবাইকে অবাক করে দিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে সুরঞ্জন। পুলকের কাঁধে মাথা রেখে চিৎকার করে কাঁদে। পুলিকের কাঁধ থেকে ওর মাথা গড়িয়ে মেঝেয় নামে। টিমটিমে আলো জ্বলছে ঘরে, মদের গন্ধ, আর বুক-ফাটা সুরঞ্জনের কান্না শুনে ঘরের হতবাক মানুষগুলো আরও কাঠ হয়ে থাকে আশঙ্কায়। পরনে ওর গত রাতের পরা শার্ট প্যান্ট, আর পাল্টানো হয়নি। স্নান নেই, খাওয়া নেই। ধুলোভরা শরীর। ওই ধুলোর শরীরে আরও ধূলোয় গড়াতে গড়াতে সুরঞ্জন বলে—মায়াকে ওরা কাল রাতে ধরে নিয়ে গেছে।

—কি বললে? চমকে ফেরে সুরঞ্জনের দিকে পুলক। একই সঙ্গে দেবব্রত, নয়ন, বিরূপাক্ষ।

রঞ্জনের গায়ে তখনও কান্নার দমক। মদ মদের মত পড়ে থাকে। গ্লাস উল্টে থাকে। না খাওয়া গ্লাসের মদগুলো গড়িয়ে পড়ে মেঝোয়। মায়া নেই–এই শব্দদ্বয়ের কাছে আর সব তুচ্ছ হয়ে যায়। কেউ কোনও কথা খুঁজে পায় না। এর তো এরকম কোনও সান্ত্বনা নেই যে অসুখ হয়েছে, ভেবো না সেরে যাবে।

ঘর যখন স্তব্ধতার জলে নিমজ্জিত তখন বেলাল ঢোকে। ঘরে। সে ঘরের পরিবেশটি লক্ষ করে। সুরঞ্জনের মেঝোয় পড়ে থাকা শরীরটি ছুঁয়ে বলে—সুরঞ্জন, মায়াকে নাকি ধরে নিয়া গেছে?

সুরঞ্জন মুখ তোলে না।

—জি ডি এন্ট্রি করা হয়েছে?

সুরঞ্জন তবুও মুখ তোলে না। বেলাল আর সবার দিকে তাকিয়ে উত্তরের আশা করে। কেউ এ ব্যাপারে কিছু জানে না ইঙ্গিতে জানায়।

—কোনও খোঁজখবর করেছি, কারা নিয়েছে?

সুরঞ্জন এবারও মুখ তোলে না। বেলাল বিছানায় বসে। সিগারেট ধরায়। বলে—কি যে শুরু হয়েছে চারদিকে। গুণ্ডা বদমাশরা ভাল একটা সুযোগ পেয়েছে। ওদিকে ইন্ডিয়ায় তো ‘আমাদের’ সমানে মারছে।

—আপনাদের মানে? বিরূপাক্ষ জিজ্ঞেস করে।

—মুসলমানদের। বি জে পি তো কচু-কাঁটা করছে।

–ও।

–ওদিককার খবর শুনে এদেরও মাথার ঠিক নেই। দোষ কাকে দেব। ওখানে ‘আমরা’ মরছি। এখানে ‘তোমরা’। কী দরকার ছিল মসজিদটাি ভাঙার। এত বছরের পুরনো মসজিদ। মহাকাব্যের চরিত্র রামের আঁতুড় ঘর খুঁজতে মসজিদ খুঁড়ছে ইন্ডিয়ানরা। কদিন পর বলবে তাজমহলে হনুমানের জন্ম হয়েছিল, সুতরাং তাজমহল ভাঙো। ব্যস ভেঙে ফেলবে। ভারতে নাকি সেকুলারিজমের চর্চা হয়! মায়াকে আজ ধরে নিচ্ছে কেন? মূল নায়ক তো আদভানি, যোশী। মেটিয়াবুরুজের অবস্থা শুনেছি ভয়াবহ।

সুরঞ্জন বেওয়ারিশ লাশের মত পড়ে থাকে মেঝেয়। ওঘর থেকে কিরণময়ীর কান্নার শব্দ, সুধাময়ের অস্ফুট গোঙানো বেলালের দুঃখকে ম্লান করে দেয়।

—মায়া নিশ্চয় ফিরে আসবে। ওরা তো আর জলজ্যান্তু মেয়েটিকে খেয়ে ফেলবে না। ককিমাকে বল ধৈর্য ধরতে। আর তুমিই বা মেয়েমানুষের মত এমন কাঁদাছ কেন? কেঁদে সমস্যার সমাধান হবে? আর আপনারাই বা বসে আছেন কেন?’ মেয়েটা গেল কই খোঁজখবর তো করতে পারেন।

বিরূপাক্ষ বলে–আমরা তো এইমাত্রই খবরটা জানলাম। কাউকে ধরে নিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়া যায়? আর কোথায় বা খুঁজব।

—নিশ্চয় গাঁজা হেরোইন খায়, পাড়ারই হবে। চোখ পড়েছে মেয়ের দিকে। তাই চান্স পেয়েছে, ধরে নিয়ে গেছে। ভাল লোকেরা এসব করে? আজকালকার উঠতি ছেলেপেলেরা কী সব যাচ্ছেতাই কাণ্ড করছে। মূল কারণ অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, বুঝলেন?

বিরূপাক্ষ মাথা নীচু করে। এদের কারও সঙ্গে বেলালের আলাপ নেই। বেলাল উত্তেজিত, পকেট থেকে বেনসন আর লাইটার বের করে। সিগারেটটি হাতেই থাকে তার ৷ বলে—মদ কোনও সমাধান হল? আপনারাই বলুন, মদ কোনও সমাধান? এ দেশে কখনও বড় কোনও দাঙ্গা হয়েছে? এসব তো দাঙ্গা নয়। মিষ্টি খাবার লোভে ছেলেরা মিষ্টির দোকান লুট করে। ভারতে এ পর্যন্ত চার হাজার নাকি ছয় হাজার দাঙ্গা হয়েছে। হাজার হাজার মুসলমান মারা গেছে। এখানে কটা হিন্দু মারা গেছে? প্রতিটি হিন্দু এলাকায় ট্রাক ভর্তি পুলিশ দেওয়া হয়েছে।

কেউ কোনও কথা বলে না। সুরঞ্জনও না। সুরঞ্জনের কথা বলতে ইচ্ছে করে না। তার ঘুম পায় খুব। বেলাল সিগারেটটি ধরায় না। কাছেই কোথাও তার কাজ আছে বলে চলে যায়। এক এক করে অন্যরাও চলে যায়।

 লজ্জা (০৯) গোপালদের বাড়ি লুট হয়েছে

৯ক.

গোপালদের বাড়ি লুট হয়েছে। সুরঞ্জনদের পাশের বাড়িই। একটি দশ-বারো বছরের মেয়ে আসে সুরঞ্জনদের বাড়িতে। গোপালের ছোট বোন। সে এসে ভাঙা ঘরদোর দেখে। ঘরগুলোয় নিঃশব্দে হাঁটে। সুরঞ্জন শুয়ে শুয়ে মেয়েটিকে দেখে, বেড়ালের মত মেয়েটি। এই বয়সেই চোখে নীল ভয় তার, মেয়েটি সুরঞ্জনের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে গো গোল চোখে তাকায়। সুরঞ্জন মেঝেতেই পড়ে ছিল সারারাত। বারান্দার রোদ দেখে ঠাহর হয়। বেলা হয়েছে অনেক। ইশারায় মেয়েটিকে ডাকে সে। জিজ্ঞেস করে—তোমার নাম কি?

–মাদল।

—কোন স্কুলে পড়?

—শেরে বাংলা বালিকা বিদ্যালয়।

স্কুললটির নাম আগে ছিল ‘নারী শিক্ষা মন্দির। লীলা নাগের করা। লীলা নাগের নাম কিন্তু আজ উচ্চারিত হয় কোথাও? মেয়েদের যখন লেখাপড়া করবার নিয়ম ছিল না, তখন তিনি ঘরে ঘরে গিয়ে স্কুলে পড়বার জন্য মেয়েদের উৎসাহ দিতেন। ঢাকা শহরে তিনি নিজে খেটে মেয়েদের স্কুল গড়েছিলেন। সেই স্কুলটি এখনও আছে, মানে সেই দালানঘরটি আছে, কিন্তু নামটি বদলে গেছে। সম্ভবত লীলা নাগের নাম উচ্চারণ করা বারণ, নারী শিক্ষা মন্দির নামেও অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আছে কি না কে জানে। এও ঠিক বি এম কলেজ, এম সি কলেজের মত। সংক্ষেপের জট খুললে মুসলমানের দেশে হিন্দুত্ব না আবার প্রকট হয়ে ওঠে। একাত্তরেও ঢাকার রাস্তার নাম বদলের চক্রান্ত চলেছিল, পাকিস্তানিরা শহরের দুশ চল্লিশটি রাস্তার নাম পরিবর্তন করে ইসলামিকরণ করেছিল–লালমোহন পোদ্দার লেনকে আবদুল করিম গজনভী স্ট্রিট, শাঁখারি নগর লেনকে গুল বদন স্ট্রিট, নবীন চাঁদ গোস্বামী রোডকে বখতিয়ার খিলজি রোড, কালীচরণ সাহা রোডকে গাজী সালাউদ্দিন রোড, রায়ের বাজারকে সুলতানগঞ্জ, শশীভূষণ চ্যাটার্জি লেনকে সৈয়দ সলীম স্ট্রিট, ইন্দিরা রোডকে আনার কলি রোড এরকম।

মেয়েটি জিজ্ঞেস করে–আপনি মাটিতে ঘুমোচ্ছেন কেন?

—মাটি যে আমার ভাল লাগে।

—মাটি আমারও খুব ভাল লাগে। আমাদের এ বাড়িতে উঠেন ছিল, এ বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছি, নতুন বাড়িতে উঠোন নেই। মাটিও নেই।

–তা হলে তুমি খেলা করতেও পারবে না। মেয়েটি সুরঞ্জনের মাথার কাছে বসে। খাটের পায়ায় হেলান দিয়ে। তারও ভাল লগছে সুরঞ্জনের সঙ্গে গল্প করতে। সে ছোট ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর বলে—আমার খুব মায়া হচ্ছে চলে যেতে। মেয়েটি মায়া শব্দটি উচ্চারণ করতেই সুরঞ্জনের গা ঝিমঝিম করে ওঠে। মেয়েটিকে সে আরও কাছে বসতে বলে। যেন এ মায়া। ছোটকালের মায়া, দাদার কাছে বসে গল্প করত যে মেয়েটি। স্কুলের গল্প, খেলাধূলার গল্প। কতদিন মায়াকে কাছে বসিয়ে গল্প করা হয়নি। নদীপাড়ে মাটির ঘর বানাত সুরঞ্জনরা ছোটবেলায়। মায়াও বানাত। বিকেলে বানিয়ে রাখত, রাতের ফুঁসে ওঠা অন্ধকার জল ভেঙে দিত তাদের মাটির খেলাঘর। হাওয়াই মিঠাই খেয়ে জিভ গোলাপি করবার সেই দিন, সেই মহুয়া মলুয়ার দিন, বাড়ি পালিয়ে কাশবনে ঘুরে বেড়াবার দিন…মেয়েটিকে হাত বাড়িয়ে ছোঁয় সুরঞ্জন। মায়ার মত নরম নরম হাত। মায়ার হাত দুটো এখন কারা ধরে আছে, অনেকগুলো নির্মম নিষ্ঠুর কর্কশ হাত নিশ্চয়ই। মায়া কি ছুটতে চাইছে? ছুটতে চাইছে, পারছে না? আবার তার ঝিমঝিম করে ওঠে গা। সে ধরেই রাখে মাদলের হাতখানা। যেন মায়া সে। ছেড়ে দিলে কেউ ধরে নিয়ে যাবে। কেউ বেঁধে ফেলবে শক্ত দাঁড়িতে। মাদল বলে–আপনার হাত কাঁপছে কেন?

—কাঁপছে? তোমার জন্য খুব মায়া হচ্ছে বলে। তুমি যে চলে যাবে।

—আমরা তো আর ইন্ডিয়া যাচ্ছি না। যাচ্ছি মিরপুরে। সুবলরা ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছে।

—তোমাদের বাড়িতে যখন ঢোকে ওরা, কি করছিলে তখন?

—বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঁদছিলাম। ভয়ে। ওরা আমাদের টেলিভিশনটা নিয়ে গেছে, আলমারি থেকে গয়নার বাক্স নিয়ে গেছে। বাবার টাকাও নিয়েছে।

–তোমাকে কিছু বলেনি। ওরা?

–যাবার সময় আমার গালে জোরে দুটো চড় মেরেছে। বলেছে চুপ করে থাক, কাঁদবি না।

—আর কিছু করেনি? তোমাকে ধরে নিতে চায়নি?

–না। মায়াদিকে ওরা মারছে খুব, তাই না? আমার দাদাকেও মেরেছে। দাদা ঘুমিয়ে ছিল। দাদার মাথায় লাঠি দিয়ে বাড়ি দিয়েছে। রক্ত বেরিয়েছে অনেক।

সুরঞ্জন ভাবে, মায়ার বয়স যদি মাদলের মত হত, তবে বোধহয় বেঁচে যেত। অমন টেনে হিঁচড়ে ওকে কেউ নিত না। মায়াকে ওরা ক’জন মিলে ধর্ষণ করছে? পাঁচজন? সাতজন? নাকি আরও বেশি। মায়ার কি খুব রক্ত ঝরছে?

মাদল বলে—মা পাঠাল, বলল মসিমার সঙ্গে দেখা করে আয়। মাসিমা যে খুব কাঁদছেন।

—মাদল, তুমি আমার সঙ্গে বেড়াতে যাবে?

—মা চিন্তা করবে।

–তোমার মা’কে বলে যাবে।

মায়া খুব বলত ‘দাদা, একবার কক্সবাজার বেড়াতে নেবে? চল না মধুপুর জঙ্গলে যাই? আমার খুব সুন্দরবনেও যেতে ইচ্ছে করে।’ ক’দিন জীবনানন্দের কবিতা পড়ে ধরল ‘নাটোর যাব।’ সুরঞ্জন মায়ার সব আবদারই ছোঃ বলে উড়িয়ে দিত। বলত ‘রাখ তোর নাটোর-ফাটোর। তার চেয়ে তেজগাঁর বস্তিতে যা, মানুষ দেখ। মানুষের জীবন দেখ। ওসব গাছ পাথর দেখার চেয়ে জীবন দেখা অনেক ভাল।’ মায়ার উৎসাহ চুপসে যেত। আজ ভেবে সুরঞ্জনের মনে হয় কী লাভ হয়েছে তার জীবন দেখে? কী লাভ হয়েছে জন্ম থেকে মানুষের ভাল চেয়ে? শ্রমিক কৃষকের আন্দোলন, প্রলেতারিয়েতের উত্থান, সমাজতন্ত্রের বিকাশ, এসব কথা ভেবে কী লাভ হল, সেই তো পতনই হল সমাজতন্ত্রের, সেই তো নামানেই হল লেনিনকে দড়ি বেঁধে টেনে। সেই তো হলই হার, মানবতার গান গেয়ে বেড়িয়েছে যে ছেলে, তারই ঘরে আজ চূড়ান্ত অমানবিক হামলা।

মাদল ধীরে উঠে যায়। তার হাত থেকে মায়ার মত মাদলের নরম হাতটি সরে যায়। হায়দার আজও আসছে না। নাকি সে রণে ভঙ্গ দিয়েছে! সে আর ঝামেলায় জড়াতে চায় না। সুরঞ্জনও বোঝে মায়াকে খোঁজাখুঁজি করা বৃথা। মায়া যদি ফেরত আসে, সেই ছ’বছর বয়সের মত ফেরত আসবে। সুরঞ্জনের বড় খালি খালি লাগে। মায়া যখন পারুলদের বাড়ি ছিল, এ বাড়িও তখন এমনই নিস্তব্ধ ছিল, তবু কোনও খারাপ লাগা তার ছিল না। জানত সে মায়া আছে, ফিরবে। আর এখন শ্মশান শ্মশান লাগে বাড়িটি। যেন কেউ মরেছে। ঘরে মদের বোতল, পায়ের কাছে গড়ানো গ্লাস, ছড়ানো বই দেখতে দেখত সুরঞ্জনের খালি বুকটা জলে ভরে যায়। চোখের জলগুলো যেন সব বুকে গিয়ে জমেছে।

এবার কামাল, রবিউল, কেউ খোঁজ নেয়নি সুরঞ্জনের। ভাবছে হয়ত, যাদের জীবন তারাই সামলাক। বেলাল যে গত রাতে এল, তার কণ্ঠেও সে একই সুর শুনেছে ‘তোরা আমাদের বাবরি মসজিদ ভেঙেছিস কেন? সুরঞ্জন ভাবে, বাবরি মসজিদ ভারতীয়দের মসজিদ, এ মসজিদ বেলালের হতে যাবে কেন? আর সুরঞ্জনরা বাবরি মসজিদ ভাঙল কি করে? সুরঞ্জন নিজে কখনও ভারতেই যায়নি। সে কি করে মসজিদ ভাঙল, বেলাল কি ভারতের হিন্দু আর এ দেশের হিন্দুকে এক করে দেখছে? হিন্দুরা মসজিদ ভেঙেছে এর অর্থ সুরঞ্জনরা ভেঙেছে? অযোধ্যার হিন্দু মৌলবাদী এবং সুরঞ্জন এক? বেলাল কামাল হায়দারের মত নয় সে? সে কি কেবলই হিন্দু? ভারতের মসজিদ ভাঙবার দায় সুরঞ্জনের? ধর্মের কাছে দেশ আর জাতি তুচ্ছ হয়ে যায়? সে না হয় যারা অশিক্ষিত, দুর্বল যারা ধর্মের খুঁটি আঁকড়ে বাঁচে, তারা ভাবে; কিন্তু বেলাল কেন? বেলাল উচ্চশক্ষিত ছেলে, ফ্রিডম ফাইটার, ধর্মের ক্লেদে তারও পা ফসকে যাবে কেন? এ সব প্রশ্ন সে কোনও উত্তর পায় না। দুটো কলা আর বিস্কুট রাখা টেবিলে। কিরণময়ী রেখে গেছেন নিঃশব্দে। ওগুলো না ছুঁয়ে তার বরং বোতলের বাকি মদটুকু চকঢক করে পান করতে ইচ্ছে করে। কাল অচেতন ঘুমিয়ে ছিল, মায়া এসে বার বার তাকে চুৰ্ণ করেছি। চেতন ফিরলেই মেয়েটির মুখ ভাসে। চোখ বুজলেই মনে হয় তাকে ছিড়ে খাচ্ছে একপাল কুকুর।

হায়দার জানাতেও আসেনি মায়ার খবর কোথাও পাওয়া গেল কি না। সন্ত্রাসীদের হায়দার যতটা চেনে, সুরঞ্জন ততটা চেনে না বলে ওর আশ্রয় নেওয়া। নইলে সে তো বেরিয়ে পড়তে পারত গলি-ঘুপচির ভেতর। অবশ্য হিন্দুদের রেপ করতে এখন আর গলি-ঘুপচির দরকার হয় না, সে প্রকাশ্যেই করা যায়। প্রকাশ্যে যেমন লুট হয়। ভাঙা পোড়া হয়। হিন্দুদের অত্যাচার করতে আজকাল এত রাখঢাকের দরকার হয় না। কারণ সরকারের সায় তো একরকম আছেই। সরকার তো আর সেকুলার রাষ্ট্রের সরকার নয়। মৌলবাদীদের স্বাৰ্থই কায়দা করে রক্ষা করছে তারা। শেখ হাসিনা সেদিন বলেছেন ভারতীর চৌদ্দ কোটি মুসলমানের জানমাল রক্ষা করবার খাতিরে দেশে সাম্প্রদায়িকতা বজায় রাখতে হবে। শেখ হাসিনাকে কেন ভারতের মুসলমানের নিরাপত্তার কথা আগে ভাবতে হয়? এ দেশের মানুষের নাগরিকের অধিকারের কারণেই কি সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি রক্ষা জরুরি নয়? নিজ দেশের নাগরিকের জানমালের চেয়ে ভারতীয় মুসলমানের জনগণের প্রতি দরদ বেশি দেখাতে হয় কেন? তবে কি ধরে নিতে হবে জামাতি ইসলামি যে ভারত বিরোধিতা এবং ইসলাম মশলায় আজ রান্না চড়াচ্ছে জনগণকে গেলাবে বলে, সেইন মশলা আওয়ামি লিগকেও ব্যবহার করতে হচ্ছে? এও কি কমুনিস্টদের ইসলামি মুখোশ পরবার কৌশল? ভারতের মুসলমানের স্বার্থে নয়, সবচেয়ে মৌলিক এবং যৌক্তিক কারণ হল ‘সাংবিধানিক অধিকার সংরক্ষণ। নিজের ধর্ম ও বিশ্বাসসহ জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করবার অধিকার এ দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে হিন্দুদের জন্য স্বীকৃত। কোনও ধর্ম বা কোনও রাজনৈতিক দলের কৃপায় নয়, কোনও ব্যক্তিবিশেষের করুণায় নয়, হিন্দুদের বাঁচবার অধিকার রাষ্ট্ৰীয় নীতিমালায় আছে বলেই তারা আর দশটা মানুষের মত বাঁচবে। কেন সুরঞ্জনকে কামাল বেলাল বা হায়দারের আশ্রয়ে বা অনুকম্পায় বেঁচে থাকতে হবে?

চট্টগ্রামের মিরসরাই-এ ছাত্র ইউনিয়নের নেতা কমল ভৌমিকের বাড়িতে আগুন ধারালে তার কাকী সেই আগুনে পুড়ে মারা গেছে। কুতুবদিয়ার হিন্দু পল্লীতে আগুন ধরিয়ে দিলে তিনটি শিশু পুড়ে মারা গেছে। সাতকানিয়ার নাথপাড়ায় সূর্যমোহন আগুনে পুড়েছে। মিরসরাই-এর বাসুদেবকে প্রশ্ন করা হয়েছিল গ্রামে কারা আক্রমণ করেছে, বাসুদেব বলেছে।–রাতে যারা মারে, দিনে তারাই এসে সমবেদনা জানিয়ে বলে ‘তোরা গো লাই পরাণ পুড়ে। খাজুরিয়ার যাত্রামােহন নাথকে জিজ্ঞেস করলে সে বলেছে, ‘তার থেকে আমাকে গুলি করে দিন, সেটা ভাল হবে। * আর এদিকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা শুরু হওয়ার ছ’দিন পর বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল, জাতীয় সমন্বয় কমিটি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট মিলে সর্বদলীয় সাম্প্রদায়িক সম্প্ৰীতি গঠন করেছে। সাম্প্রদায়িকতার আগুন যখন নিভেছে কমিটি গঠন করা হল তখন। এই কমিটি একটি শান্তি মিছিল আর একটি গণসমাবেশ ছাড়া আর কোনও কর্মসূচী এখন পর্যন্ত নিতে ব্যর্থ হয়েছে। গণসমাবেশ থেকে জামাত শিবির ফ্রিডম পাটির রাজনীতি নিষিদ্ধ করবার দাবি জানানো হবে। এই দাবি সম্পর্কে সম্প্রীতি কমিটি কতটা গুরুত্ব দেবে, সরকার জামাত শিবির ফ্রিডম পার্টির রাজনীতি নিষিদ্ধ না করলে সম্প্রীতি কমিটি এ নিয়ে দেশব্যাপী আন্দোলনে যাবে কি না। এ নিয়ে সুরঞ্জন জানে নেতারা কোনও কিছু বলবে না। কমিটির কেউ কেউ লুটপাটকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করবার কথা বলেছেন। কিন্তু শনির আখড়ার ক্ষতিগ্রস্ত একজন বলেছেন—’শনির আখড়া ভাঙচুর করেছে যারা, আমাদের ঘরবাড়ি যারা পুড়িয়েছে, লুটপাট করেছে, তাদের আমরা চিনি; কিন্তু মামলা আমরা করব না। কারণ বিরোধী দলগুলো যখন আমাদের ওপর আক্রমণ ঠেকাতে পারল না, তখন মামলার পর আমাদের নিরাপত্তা তারা দিতে পারবে না। * মামলা করা নিয়ে সারা দেশে এই ধরনের প্রতিক্রিয়াই হবে, মামলা করবার আহ্বানকে সুরঞ্জন রাজনৈতিক স্টােস্টই মনে করছে। গণতান্ত্রিক শক্তি দ্রুত কর্মসূচী নিয়ে সাম্প্রদায়িক হিংস্ৰতা রোধে এগিয়ে যেতে পারেনি। সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো সেই তুলনায় অনেক বেশি সংগঠিত এবং কাজও করছে দ্রুত। এক সপ্তাহ পর সর্বদলীয় সম্প্ৰীতি কমিটি গঠন করে গণতান্ত্রিক (?) রাজনৈতিক দল এবং সংগঠনগুলোর আত্মসন্তুষ্টির কোনও কারণ নেই। পাকিস্তান এবং ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কম হয়েছে এরকম তৃপ্তি অনেক বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও আছে, কিন্তু সুরঞ্জন বোঝে না। ওরা কেন বুঝতে চায় না। বাংলাদেশে ঘটনা ঘটে একতরফা। এখানের হিন্দুরা ভারতের মুসলমানের মত পাল্টা আঘাত করে না। সেই কারণে পাল্টা-পাল্টি হয় না। এই উপমহাদেশের তিনটি রাষ্ট্রেই মৌলবাদী-ফ্যাসিবাদী অপশক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে সরকারি দলগুলো রাজনৈতিক ফায়দার জন্য। মৌলবাদীরা শক্তি সঞ্চয় করছে। ভারতে, তাজিকিস্তানে, আফগানিস্তানে, পাকিস্তানে, আলজেরিয়ায়, মিশরে, ইরানে, সার্বিয়ায়। তাদের লক্ষ একটিই, গণতান্ত্রিক শক্তিকে আঘাত করা। জার্মানির সরকার তিনজন তুর্কি নারীকে পুড়িয়ে মারবার অপরাধে দুটো ফ্যাসিবাদী দলকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। ভারতেও নিষিদ্ধ হয়েছে মৌলবাদী দলগুলো, অবশ্য ভারতের এই নিষেধাজ্ঞা ক’দিন টেকে বলা যায় না। আলজেরিয়ায় নিষিদ্ধ হয়েছে। মিশর সরকার কঠোর হাতে দমন করছে মৌলবাদীদের। তাজিকিস্তানে যুদ্ধ হচ্ছে মৌলবাদী এবং কমিউনিস্টদের মধ্যে। বাংলাদেশ সরকার কি মৌলবাদী ফ্যাসিবাদী দলগুলো নিষিদ্ধ করার কথা একবার ভুলেও বলেছে! আর যে দেশেই হোক, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি অন্তত এ দেশে বন্ধ হবে না; সুরঞ্জন ভাবে।

ভারতের উগ্র সাম্প্রদায়িক দলগুলোর কল্যাণে ক্ষমতাসীন বি এন পি সরকার গোলাম আজম বিচারকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের গতিমুখ ঘুরিয়ে সাম্প্রদায়িকতার দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। এ ব্যাপারে জামাত শিবির ফ্রিডম পার্টি এবং অন্যান্য সাম্প্রদায়িক দলের তৎপরতা সরকারকে সাহায্য করেছে। জামাতে ইসলামি দেশবাসীর মন অন্যদিকে ফিরিয়ে স্বস্তি পেয়েছে গোলাম আজম-বিচার আন্দোলনের চাপ থেকে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের মিছিলে শ্লোগান উঠেছে-‘সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবাজাদের রুখবে এবার বাংলাদেশ। আহা বাংলাদেশ। সুরঞ্জন সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বলেশালা শুয়োরের বাচ্চা বাংলাদেশ। গালিটি সে বারবার উচ্চারণ করে। তার বেশ আনন্দ হয়। হোসেও ওঠে। হঠাৎ, হাসিটিকে নিজের কাছেই বড় ক্রুর মনে হয়।

 

৯খ.

মদল কিরণময়ীর গা ঘেঁষে বসে থাকে। বলে—মাসিম, আমরা মিরপুর চলে যাচ্ছি। ওখানে গুণ্ডারা যেতে পারবে না।

–কোন পারবে না?

—মিরপুর তো অনেক দূর।

মাদল এরকমই বোঝে যে গুণ্ডারা কেবল টিকাটুলিতে থাকে। তারা মিরপুর দূর বলে ওখানে যায় না। কিরণময়ী ভাবেন যারা হিন্দুদের বাড়ি লুট করে, ভাঙে পোড়ায়, মায়াদের নিয়ে যায়, তারা কি কেবল গুণ্ডা? গুণ্ডারা তো হিন্দু মুসলমান মানে না, সব বাড়িই আত্রিমণ করে। যারা ধর্ম দেখে লুট করে, হরণ করে, তাদের গুণ্ড বললে গুণ্ডা নামটিকেই বরং অপমান করা হয়।

সুধাময় শুয়ে আছেন। শুয়ে থাকা ছাড়া আর কোনও কাজই তো নেই তার। আচল অথর্ব জীবন নিয়ে কী প্রয়োজন বেঁচে থেকে। খামোেকা কিরণময়ীর কষ্ট। সৰ্বংসহা মানুষ এইকিরণময়ী। এতটুকু ক্লান্তি নেই তাঁর। সারারাত চোখের জল ফেলেন, তাঁর কি আর চুলে ধরাতে ইচ্ছে করে। তবু ধরাতে হয়। পেটের যন্ত্রণা তো সব ছাপিয়ে ওঠে। সুরঞ্জন তো বাদই দিয়েছে নাওয়া-খাওয়া, কিরণময়ীও অনেকটা। সুধাময়েরও রুচি হয় না। মায়া যে আজও ফিরছে না! মায়া কি ফিরিবে না? তাঁর জীবনের বিনিময়ে যদি পারতেন মায়াকে ফিরিয়ে আনতে! যদি চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে বলা যেত–’মায়াকে ফেরত চাই। মায়াকে ফেরত চাইবার অধিকার আমার আছে।’ অধিকার? অধিকার শব্দটি এখন সুখময়ের কাছে ভূতুড়ে একটি শব্দ মনে হয়। ছেচল্লিশে, তখন কত আর বয়স সুধাময়ের, কালীবাড়ির এক দোকানে সন্দেশ খেয়ে তিনি বলেছিলেন—’এক গ্লাস পানি দাও তো ভাই।’ শহরে তখন ঘন হয়ে উঠছিল হিন্দু মুসলমানে অসন্তোষ। মিষ্টির দোকানে তাঁর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়েছিল কিছু মুসলমান। ‘জল’ বলতে পারেনন সুধাময়। ভয়ে? ভয়েই হবে, আর কী!

ইংরেজরা এ কথা বুঝেছিল যে হিন্দু মুসলমানের একতা এবং সদ্ভাব ভাঙতে না পারলে তাদের পক্ষে ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। তাদের কূটবুদ্ধি থেকেই জন্ম নিল ডিভাইড এন্ড রুল নীতি। এরকম কি হতে পারে, সুধাময় ভাবেন, যেখানে শতকরা নব্বইজন চাষী মুসলমান, সেখানে নব্বই ভাগ জমি ছিল হিন্দুর, জমি থেকেই রুশ চীনে বিপ্লব, জমি থেকেই বাংলায় হিন্দু মুসলমান সংঘর্ষ। জমিঘটিত ব্যাপার ধর্মঘটিত হয়ে দাঁড়ায়। ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই বাংলাদেশেই ১৯০৬ সালে সাম্প্রদায়িক নীতির ওপর ভিত্তি করে মুসলিম লিগের জন্ম হয়েছিল। অবিভক্ত ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনকে সাম্প্রদায়িক বিষে কলুষিত করবার জন্য এই দলটিই দায়ী { অবশ্য কংগ্রেসকেও ছেড়ে দেওয়া যায় না। সাতচল্লিশের পর থেকে চব্বিশটি বছর সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী পাকিস্তানের শাসকরা ইসলামি জিগির, ভারত বিরোধী ধ্বনি আর সাম্প্রদায়িকতার ধুয়ো তুলে এ দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেছিল। একাত্তরে সেই অধিকার ফিরে পেয়ে সুধাময় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। কিন্তু এই নিঃশ্বাসটি তাঁর মাঝে মধ্যেই বন্ধ হয়ে আসে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর রাষ্ট্ৰীয় চার মূল নীতির একটি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানে স্থান দেওয়া হয়। এটি ছিল সাম্প্রদায়িকতার পুনরুত্থানের বিরুদ্ধে এক দুৰ্জয় বর্ম। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের পর থেকেই সাম্প্রদায়িকতার নতুন আবির্ভাব ঘটল। সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে জোট বাঁধলা সহিংসতা, মৌলবাদ, ধমন্ধিতা, স্বৈরাচার। সাম্প্রদায়িক চিন্তাকে অভদ্রজন্যোচিত করবার জন্য দরকার হয় একটি আদর্শভিত্তিক তত্ত্ব। পাকিস্তান বানাবার আগে এই তত্ত্বের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব, আর বাংলাদেশে পঁচাত্তরের পর নাম হল ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। হাজার বছরের বাঙালি ঐতিহ্য ধুয়ে ‘বাংলাদেশি হতে হবে তাদের, বাংলাদেশি গরু গাধা ধান পাটের মত মানুষও এখন বাংলাদেশি! অষ্ট আশি সালে অষ্টম সংশোধনীর পর বাংলাদেশ সংবিধানে লেখা হল–The state religion of the Republic is Islam, but other religions may be practised in peace and harmony in the Republic. এখানে may be কথাটা বলা হল কেন? কেন shall be নয়? মৌলিক অধিকার-এর ক্ষেত্রে লেখা অবশ্য আছে। ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী শপুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনও নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’ কিন্তু বৈষম্যের কথা স্বীকার না করলে হবে কী, বৈষম্য যদি বিরাজ না-ই করে তবে ‘মায়াকে কোন ধরে নিয়ে যাবে ওরা। কোন গাল দেবে ‘মালাউনের বাচ্চা’ বলে? গুণ্ডারা কি মালাউনের বাচ্চা বলে গাল দেয়? তা হলে এসব গুণ্ডামি নয়, অন্য কিছু। যা দিনদিন স্বাধন হয়ে আসছে, স্কুলের বদলে মাদ্রাসা বাড়ছে দেশে, মসজিদ বাড়ছে, ইসলামি জলসা বাড়ছে, মাইকে আজান বাড়ছে, এক মহল্লায় দু-তিন বাড়ি পর পর মসজিদ, চারদিকে তার মাইক। হিন্দুদের পুজোর সময় অবশ্য মাইক নিয়ন্ত্রণ করা হয়। যদি মাইক বাজেই, তবে মুসলমানের মাইকই কেন বাজবে শুধু? জাতিসংঘ মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের ২৮ ধারায় আছে ‘প্রত্যেকের চিন্তা, বিবেক ও ধর্মের স্বাধীনতার অধিকার রয়েছে। নিজ ধর্ম অথবা-বিশ্বাস পরিবর্তনের স্বাধীনতা এবং একই অথবা অপরের সহিত যোগসাজশে ও প্রকাশে বা গোপনে নিজ ধৰ্ম বা বিশ্বাস শিক্ষাদান, প্রচার, উপাসনা ও পালনের মাধ্যমে প্রকাশ করবার স্বাধীনতা এই অধিকারের অন্তর্ভুক্ত।’ তাই যদি হয় তবে হিন্দুদের মন্দির ভাঙলে কেন, মন্দিরে যদিও বিশ্বাস নেই। সুধাময়ের, তবে ভাঙবার বেলায় কেবল মন্দির ভাঙবার পক্ষপাতী তিনি নন মোটেও। আর এই যে এত ভাঙা পোড়া হচ্ছে, কিছু কি শাস্তি কুরাদ নেই। এদের জন্য টু পেনাল কেড়ে শাস্তি লেখা এক বছরের জেল, বড়জোর দুই। খুব বেশি হলে তিন।

সুধাময়ের অসুস্থতা ছাপিয়ে আর সকল অসুস্থতা তাঁকে গ্রাস করে নেয়। একটি দেশ ক্ৰমে ক্ৰমে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ বছর সংগ্রামের পর পাকিস্তানের থাবা থেকে বাঙালি মুক্তি পেল, স্বাধীন একটি দেশের সংবিধান রচিত হল ‘we, the people of Bangadesh, having proclaimed our Independence on the 26th day of Marcu 1971 and through a historic struggle for national liberation, established the independent, sovereign People’s Republic of Bangladesh.

Pledging that the high ideals of nationalism, socialism, democracy, and secakrism, which inspired our heroic people to dedicate themselves to, and our rave martyrs to sacrifice their lives in, the national liberation strugie, shall be the fundamental principles of the constitution.

Suggle for national liberation বদলে ১৯৭৮-এ হয়ে গেল a historic war for natical independence. Oris Pat & …high ideals of absolute trust and faith in the Almighty Allah, nationalism, democracy and socialisFa mealing economic and social justice, তার ওপর liberation struggle হয়ে গেল independence.

বাত্তরের সংবিধান পাল্টে আটাত্তরে সংবিধানের শুরুতে বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম (দয়ালু, পরম দয়ালু, আল্লাহর নামে। ) বসানো হল। সংবিধানের বারো নম্বর ধারাটি পুরো ভ্যানিস করে দেওয়া হয়। ধারাটি এরকম ছিল Secularism and freedom of religion.

  1. The principle of secularism shall be realised by the elimination of
    a. communalism in all its forms.
    b. the granting by the State of political status in favour of any religion.
    c. the abuse of religion forpolitical purposes.
    d. any discrimination against, or persecution of, persons practising a particular religion.

সেকুলারিজম উড়িয়ে দিয়ে ২৫(২) নম্বর ধারায় যোগ করা হয় ‘রাষ্ট্র ইসলামি সংহতির ভিত্তিত মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন।

বাহাত্তরে সংবিধানের ছয় নম্বর ধারায় ছিল The citizenship of Bangladesh  shall be determined and regulated by law; citizens of Bangladesh shall be known as langalees.  জিয়াউর রহমান করলেন The citizens of Bangladesh shall be known as Bangladeshis.

সুধাময় চোখে অন্ধকার দেখেন। দুপুরও গড়ায়নি এখনই ঘর কেন অন্ধকার হবে। তবেকি তাঁর চোখের জ্যোতি কমে যাচ্ছে। নাকি অনেক দিন হল চশমা পাল্টানো হচ্ছে না, তাই। নাকি ছানি পড়ছে চোখে, নাকি বারবার জল এসে ঝাপসা করে দিচ্ছে তাঁর চোখ।

সুরঞ্জনটাও কেমন পাল্টে যাচ্ছে। কাছে এসে একটিবার বসেও না। মায়াকে ধরে নিয়ে যাবার পর দিন থেকে এঘরে সে ভুলেও পা দেয় না। সুধাময় এঘর থেকেই ওঘরের আড্ডায় মদ খাবার শব্দ শোনেন। ছেলেটি কি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে? ঘরে বসে মদ্যপান করতে কখনও তিনি সুরঞ্জনকে দেখেননি। সে হয়ত এখন আর কাউকে কেয়ার করছে না। মায়াকেও ভুলে গেল দুদিনে! সুধাময়ের বিশ্বাস হয় না, তার হঠাৎ স্তব্ধতা সুধাময়কে আরও ব্যাকুল করে তোলে, ছেলেটি উচ্ছন্নে যাচ্ছে না তো!

 

৯গ.

সুরঞ্জন কোথাও বেরোবে না। মায়াকে যে খুঁজে কোনও লাভ নেই তা সে বুঝে গেছে। তার চেয়ে ঘরে বসে থাকাই ভাল, রাস্তায় বেরোলেই লোকে বলবে ‘শালা মালাউনের বাচ্চারা বাবরি মসজিদ ভেঙেছে। এদের সব ঠেঙিয়ে ভারত পাঠানো উচিত। ‘ এসব শুনতে শুনতে কান পচে যাচ্ছে সুরঞ্জনের। সে এখন কোনও সমাজতান্ত্রিক পাটি, বামপন্থী নেতা-ফেতায় বিশ্বাস করে না। অনেক বামপন্থীকেও সে তাকে গাল দিতে শুনেছে ‘শালা মালু, মালাউনের বাচ্চা’ বলে। কৃষ্ণবিনোদ রায়কে সবাই বলত কবীর ভাই। বারীন দত্তকে নাম পাল্টে আবদুস সালাম হতে হয়। কমিউনিস্ট পাটিতেও যদি হিন্দু নাম পাল্টাতে হয়, তবে কোন পাটিতে আর ভরসা করা যায়! নাকি সে জামাতে নাম লেখাবে? সোজা গিয়ে নিজামিকে বলবে—’হুজুর, আসসালামু আলায়কুম!’ পরদিন খবরের কাগজে বড় বড় অক্ষরে খবর বেরোবে ‘হিন্দুর জামাতি ইসলামে যোগদান।‘  জগন্নাথ হলেও নাকি জামাতি ইসলামি ভোট পায়, এর কারণ টাকা। মাসে মাসে পাঁচ হাজার টাকা পেলে কে ভোট দেবে না জামাতিকে? সুরঞ্জন শোধ নিতে চায় বামপন্থী দলগুলোর ওপর, যে দলগুলো তাকে আশার বদলে হতাশায় ডুবিয়েছে, দলের লোক একের পর এক অন্য দলে ঢুকে গেছে। আজ এক কথা বলে কাল আরেক কথা বলেছে। কমরেড ফরহাদ মারা গেলে সি পি বি অফিসে কোরানখানি আর মিলাদ মাহফিলের আয়োজন হয়েছে। মহা সমারোহে কমরেডের জানাজা হয়েছে। কেন হয়েছে, কেন কমিউনিস্টদের ইসলামের পতাকা তলেই শেষ পর্যন্ত আশ্রয় নিতে হয়? জনগণের নাস্তিক অপবাদ থেকে বাঁচবার জন্য তো! কই তাতে বেঁচেছে কি তারা? এত কপাল ঠুকেও দেশের সবচেয়ে পুরনো পার্টিটি মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। দোষ সুরঞ্জন জনগণকে দেয় না, দেয় বামপন্থী নামের দিশেহারা নেতাদেরই।

দেশে আজ মাদ্রাসা বাড়ছে। একটি দেশকে অর্থনৈতিক ভাবে পঙ্গু করে দেবার জন্য এই পরিকল্পনাটি অত্যন্ত উত্তম বৈকি। শেখ মুজিবই বোধহয় গ্রামে গ্রামে মাদ্রাসার প্রসার করেছিলেন। কোথা দিয়ে কে যে দেশটির সর্বনাশ করে গেছে, যে জাতি ভাষা আন্দোলন করল, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ করল, সে জাতির এমন সর্বনাশ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। কোথায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের সেই বোধ, কোথায় ‘বাংলার হিন্দু বাংলার বৌদ্ধ বাংলার খ্রিস্টান বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালির সেই সুর, সেই চেতনা? সুরঞ্জন বড় এক বোধ করে। বড় একা। ফেন সে বাঙালি নয়, মানুষ নয়, হিন্দু একটি দ্বিপদী জীব নিজের মাটিতেই নিজে ‘পরবাসী’ হয়ে বসে আছে।

এ বংশের মন্ত্রণালয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয় নামে একটি মন্ত্রণালয় আছে। ধর্মীয় খাতে বিগত বছরের বাজেট ছিল বেশ উপাদেয়। সুরঞ্জন একে উপাদেয়ই বলবে। অনুন্নয়ন খাতে ছিল ধর্মীয় উদ্দেশ্যে সাহায্য মঞ্জুরি; ইসলামিক ফাউন্ডেশন ঢাকা ১,৫০,০০,০০০ টাকা। ওয়াকফ প্রশাসক মজুরি ৮,০০,০০০ টাকা। অন্যান্য ধৰ্মীয় উদ্দেশ্যে মজুরি ২,৬০,৭৫,০০০। জাকাত ফান্ড প্রশাসক মঞ্জুরি ২,২০,০০০। ইসলামিক মিশন প্রতিষ্ঠান বাবদ অয় ২,৫০,০০,০০০। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য আমানত তহবিল ২,৫০,০০০। মসজিদে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ ১,২০,০০,০০০। মসজিদে বিনামূল্যে পানি সরবরাহ ৫০,০০,০০০। ঢাকা তারা মসজিদ ৩,০০,০০০। মোট ৮,৪৫,৭০,০০০ টাকা। বায়তুলমোকারম মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ : ১৫,০০,০০০। প্রশিক্ষণ ও উৎপাদনমুখী কার্যক্রম নিবিড়করণ ও প্রসারের জন্য থোক বরাদ্ধ সহ মোট অনুন্নয়ন বরাদ্দ :, ১০,৯৩,১৮,০০০। এর মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য আমানত তহবিল হিসেবে বরাদের পরিমাণ মাত্র ২,৫০,০০০ টাকা। দেশে ধৰ্মীয় সংখ্যালঘু প্রায় আড়াই কোটি। আড়াই কাটি লোকের জন্য আড়াই লাখ টাকার বরাদ্দ বেশ মজার বৈকি।

উন্নয়ন খাতে, ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়; বাংলায় ইসলামি বিশ্বকোষ : সংকলন ও প্রকাশন ২০,০০,০০০। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্ৰ  প্রকল্প **০,০,০০০। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রকাশনা অনুবাদ ও গবেষণা কার্যক্রম ১,৬৮, ৭,০০০। ইমাম প্রশিক্ষণ প্রকল্প, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের লাইব্রেরি উন্নয়ন কাৰ্যক্রমে ১৫,০০,০০০। মসজিদ পাঠাগার প্রকল্প ২৫,০০,০০০। নতুন জেলাসমূহে ইসলামিক সংস্কৃতিক কেন্দ্র সম্প্রসারণ, ঈমান প্রশিক্ষণ/ট্রেনিং একাডেমি ১,৫০,০০,০০০। মোট উন্নয়ন বরাদ্দ ৫,৬৮,৭৫,০০০ টাকা। তারপর অন্যান্য ধর্মীয় উদ্দেশ্যে মজুরি উপখাতে ২,৬০,০০০ টাকার বিভাজন হয়েছে এরকম, ইসলাম ধর্মীয় অনুষ্ঠান/ উৎসব উদযাপন ইত্যাদি ৫,০০,০০০। ইসলাম ধৰ্মীয় সংগঠনের জন্য কর্মসূচী ভিত্তিক সাহায্য মঞ্জুরি ৮,৬০,০০০। মাননীয় সংসদ সদস্য/ সদস্যদের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন মসজিদ সংস্কার মেরামত ও পুনবার্বাসনের জন্য ২,০০,০০,০০০। বিদেশ থেকে আগত ও বিদেশ গমনকারী ধর্মীয় প্রতিনিধি দলের জন্য ব্যয় বরাদ্দ ১০,০০,০০০। আন্তর্জাতিক ধর্মীয় সংস্থা সংক্রান্ত চাঁদা ৬,৪০,০০০। নও মুসলমান, দুঃস্থ পুনর্বাসনের জন্য ১০,০০,০০০। ১৯৯২ সালে ধর্মীয় খাতের বাজেট বরাদ্দে দেখা যায় যে উন্নয়ন এবং অনুন্নয়ন খাতে মোট বরাদ্দের পরিমাণ ১৬,৬২,১৩,০০০। এই বাজেটের নও মুসলমানদের পুনর্বাসনের খাতট বেশ মজার। দশ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়েছে এই খাতে। অথচ উন্নয়ন খাতে সংখ্যালঘুদের জন্য কোনও বরাদ্দ নেই। বহু ধর্মে বহু বর্ণে অধ্যুষিত একটি দরিদ্র দেশের জন্য বিশেষ একটি ধর্ম গ্রহণে উদ্বুদ্ধকরণের এই প্রলোভন অত্যন্ত লজ্জার। দেশের মেরুদণ্ড ভাঙা মাথা পিছু বিদেশি ঋণের বোঝা কত তা কি একবার আমরা হিসেব করি! এরকম যদি অর্থনৈতিক পঙ্গুত্ব তবে জাতীয় বাজেটে ইসলাম বিষয়ে এত মোটা কম বরাদ্দ কতটা যৌক্তিক? এবং এই বাজেটের বৈষম্যমূলক বরাদ্দ জাতীয় সম্প্ৰীতি নষ্ট করছে। কেউ কি ভাবে না এসব? সুরঞ্জন এইসব বৈষম্যের কথা ভাবতে ভাবতে দেখে দরজা খুলে কাজল দেবনাথ ঢোকেন।

—কি ব্যাপার অসময়ে শুয়ে আছ যে সুরঞ্জন?

—আমার আবার সময় অসময় কি! সুরঞ্জন সরে কাজলের বসবার জায়গা করে দেয়।

–মায়া ফিরেছে?

–নাহ। সুরঞ্জন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

—কি করতে পারি বল তো? কিছু একটা করা উচিত আমাদের।

–কি করবেন?

কাজল দেকনাথের কাঁচা পাকা চুল, বয়স চল্লিশের ওপর, ঢিলেঢালা শার্ট পরেছেন, কপালে তাঁরও ভাঁজ পড়েছে ভাবনার। সিগারেট বের করেন, বলেন–খাবে নাকি?

–দিন। হাত বাড়ায় সুরঞ্জন। অনেকদিন সিগারেট কেনা হয় না। তার ৷ পয়সা, কার কাছে চাইবে সে, কিরণময়ীর কাছে? লজ্জায় তো ওঘরে যাওয়াই সে বাদ দিয়েছে। মায়া হারিয়ে যাবার লজ্জা যেন তারই, এরকমই মনে হয় সুরঞ্জনের। দেশ নিয়ে সে-ই তো বেশি লাফিয়েছে, এদেশের মানুষ অসম্প্রদায়িক একথা তো সেই চেয়েছে বেশি প্রমাণ করতে, লজ্জা তাই তারই। সে এই লজ্জিত মুখ নিয়ে দাঁড়াতে চায় না। সুধাময়ের মত একজন আদর্শবান, সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ মানুষের সামনে।

খালি পেটে সিগারেট ফোঁকে সুরঞ্জন। মায়া দেখলেই হয়ত ধরে বসত, বলত— খবরদার ভাল হবে না বলে দিচ্ছি। দাদা। খালি পেটে সিগারেট খােচ্ছ তো, নির্ঘাত ক্যান্সার হবে। মারবে।

সুরঞ্জনের যদি ক্যান্সার হত। মন্দ হত না। শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করত। কোনও প্রত্যাশা নিয়ে তাকে বাঁচতে হত না।

কাজল দেবনাথ কি করবেন, কিছু খুঁজে পান না। তিনি বলেন—আজ তোমার বোনকে নিয়ে গেছে। কাল আমার মেয়েকে নেবে। নেবেই তো। আজ গৌতমের মাথায় কোপ পড়ল। কাল তোমার বা আমার মাথায় পড়বে।

সুরঞ্জন বলে–আমরা আগে মানুষ না হিন্দু, বলুন তো?

কাজল ঘরটির চারপাশ তাকিয়ে বলেন–এঘরেও এসেছিল, তাই না?

–হ্যাঁ।

–মায়া কি করছিল তখন?

–শুনলাম। বাবার জন্য ভাত মাখছিল।

–ওদের কিছুমার দিতে পারল না?

–কি করে দেবে। ওদের হাতে মোটা মোটা লাঠি, রড। আর হিন্দুর কি ক্ষমতা আছে মুসলমানের গায়ে হাত তোলা? ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানরা পাল্টা মারে। দুদিলে মারামারি হলে তাকে বলে দাঙ্গা। ওখানে হচ্ছে দাঙ্গা। আর লোকে এদেশের ঘটনাকে দাঙ্গা বলে। এখানে যা হচ্ছে তা হল সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, এর নাম অত্যাচার বলা যায়, নির্যাতন বলা যায়। এক দল আরেক দলকে আচ্ছাসে পেটাচ্ছে, মারছে।

—মায়া কি ফিরবে মনে হয়?

—জানি না। সুরঞ্জন মায়ার প্রসঙ্গে গেলেই লক্ষ করে তার গলার কাছে কি যেন আটকে আছে। বুকের মধ্যটা খালি হয়ে যায়।

–কাজলদা, দেশে আর কি কি ঘটল?

সুরজন মায়া প্রসঙ্গ থেকে দূরে সরতে চায়।

কাজল দেকনাথ ঘরের ছাদের দিকে ধোঁয়া ছুঁড়ে দেন, বলেন— আঠাশ হাজার ঘরবাড়ি, দুহাজার সাতশ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, তিন হাজার ছয়শ মন্দির ক্ষতিগ্ৰস্ত, বিধ্বস্ত। বারো জন হত, দুশ কোটি টাকার ক্ষতি। গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস হয়ে গেছে। তেতাল্লিশটি জেলায় ধ্বংস যজ্ঞ চালানো হয়েছে। নির্যাতিত হয়েছে দু হাজার ছয়শ মহিলা। মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ মন্দিরগুলো হচ্ছে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর প্রায় পাঁচশ বছরের প্রাচীন মন্দির, এটি ছিল সিলেটের দক্ষিণে, বানিয়াচংয়ের প্রায় কয়েকশ বছরের প্রাচীন কালী বাড়ি, চট্টগ্রামের কৈবল্যধাম, তুলসীধাম, ভোলার মদনমোহন আখড়া, সুনামগঞ্জ আর ফরিদপুরের রামকৃষ্ণ মিশন।

সুরঞ্জন জিজ্ঞেস করে–সরকার কিছু সাহায্য-টাহায্য দেয়নি? –

-না। সরকার তো দেয়নি, কোনও সাহায্য সংস্থাকেও অনুমতি দেয়নি। অবশ্য বেসরকারি কিছু সংস্থা নিজ উদ্যোগে এগিয়ে এসেছে। হাজার হাজার মানুষ খোলা আকার নিচে বসে আছে। কাপড় নেই, খাবার নেই, ঘর নেই, ধর্ষিতা মেয়েরা এক একজন বোবা হয়ে গেছে, রা নেই। ব্যবসায়ীরা সব হারিয়ে হাঁ হয়ে বসে আছে। এখনও ওদের কাছ থেকে ভয় দেখিয়ে টাকা নিচ্ছে, জায়গা জমি দখল করছে। ঘরবাড়ির ক্ষতি বরিশাল বিভাগে পঁচাত্তর কোটি টাকা। চট্টগ্রাম বিভাগে বিশ কোটি টাকা। ঢাকা বিভাগে দশ কোটি। খুলনা আর রাজশাহী বিভাগে এক কোটি করে। মোট একশ সাত কোটি টাকা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সব মিলিয়ে বাইশ কোটি টাকা। মন্দির সব মিলিয়ে সাতান্ন কোটি টাকা।

–আর ভাল লাগে না কাজলদা। আর ভাল লাগে না।

—সবচেয়ে খারাপ কি হচ্ছে জানো তো? দেশ ত্যাগ। এবারের ভয়াবহ দেশত্যাগকে ঠেকাবার আর উপায় নেই। সরকারি মহল থেকে সবসময় বলা হয়েছে দেশ ত্যাগ করছে না হিন্দুরা। কলকাতার দেশ পত্রিকা একবার লিখল না বছরে প্রায় লাখ দেড়েক বাংলাদেশির অনুপ্রবেশ ঘটছে এখানে এবং এর প্রধান অংশই আর ফিরে যাচ্ছে না। গত দুই দশকে পঞ্চাশ লক্ষেরও বেশি সংখ্যালঘু দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। ছটি সেনসাস রিপোর্ট কী বলছে দেখ, ১৯৪১ সালে মুসলমান ছিল ৭০.৩%, হিন্দু ছিল ২৮.৩%। ১৯৫১ সালে মুসলমান ছিল ৭৬.৯%, হিন্দু ছিল ২২.৫০%,। ১৯৬১ সালে মুসলমান ছিল ৮০.৪%, হিন্দু ১৮.৫%,। ১৯৭৪ সালে মুসলমান ৮৫.৪%, হিন্দু ১৩.৫%। ১৯৮১ সালে মুসলমান ৮৬.৭%, হিন্দু ১২.১%,। ১৯৯১ সালে মুসলমান ৮৭.৭৪%, হিন্দু ধর ১২.৬%। এর মানেটা কি, প্রতিবারই দেখা যাচ্ছে মুসলমানের সংখ্যা বাড়ছে, হিন্দুর সংখ্যা কমছে। কমছে কেন, যাচ্ছে কোথায় তাহলে? সরকার যদি বলেনই যে মাইগ্রেশন হচ্ছে তবে সেনসাসের এমন রিপোর্ট কেন। এখন নতুন সেনসাসে কি নিয়ম হয়েছে জানো হিন্দু মুসলমান আলাদা করে গুনবে না।

–কারণ?

–কারণ হিন্দু সংখ্যা কমে যাওয়ার হিসেবটা পাওয়া যাবে বলে।

—তাহলে বলা যায় এই সরকার খুব চতুর, তাই না কাজলদা? সুরঞ্জন আড়মোড়া ভেঙে বলে।

কাজল দেবনাথ কিছু না বলে আরেকটি শলা ঠোঁটে নেন। জিজ্ঞেস করেন–এ্যাসট্রে আছে?

–পুরো ঘরটাকেই এ্যাসট্রে ধরে নিন।

—তোমার বাবা মা’র সঙ্গে যে দেখা করব, কি সান্ত্বনা ওঁদের দেব বলা! কাজল দেবনাথ মাথা নীচু করেন লজ্জায়। যেন তাঁর নিজের ভাই মায়াকে অপহরণ করেছে, এমন তাঁর লজ্জা ৷

আবার মায়া প্রসঙ্গ। আবার তার বুক থেকে অগ্নিগিরির লাভার মত বেরোয়। সুরঞ্জন প্রসঙ্গ পাল্টে বলে— আচ্ছা কাজলদা, জিন্নাহ তো বলেই ছিল এখন থেকে সবাই আমরা পাকিস্তানি, কোনও হিন্দু মুসলিম নয়। তারপর কি হিন্দুদের ভারত যাওয়া কমেনি?

—জিন্নাহ ছিল ইসমাইলিয়া খোজা। মুসলমান হলেও ওরা হিন্দুর উত্তরাধিকার আইন মানত। ওর পদবী আসলে খোজানি। নাম ছিল ‘ঝীনাভাই খোজানি’। ঝীনাটুকু রেখে বাকি নাম সে বাদ দিয়েছিল। জিন্নাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বটে, তারপরও হিন্দুরা বৈষম্যের শিকার হয়। তা নাহলে ১৯৪৮ সালের জুন মাসের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ১১ লাখ হিন্দু ভারতে চলে যাবে কেন? ভারতে তারা রিফিউজি হিসেবে পরিচিত হয়।

–পশ্চিমবঙ্গের দাঙ্গায় অনেক মুসলমান এদেশেও চলে এসেছে।

–হ্যাঁ, আসাম আর ওয়েস্ট বেঙ্গল থেকে বহু মুসলমান এদেশে, চলেও গেছে। কারণ তখন ভারত ও পাকিস্তান সরকারের মধ্যে ‘নেহেরু লিয়াকত চুক্তি’ হয়েছিল, চুক্তিতে বলা হয় ‘দুদেশেই সংখ্যালঘুরা ধর্ম নির্বিশেষে নাগরিক হিসেবে সমান অধিকার ভোগ করবে।’ তাদের জীবন, সংস্কৃতি ও সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করা হয়, মত প্রকাশ এবং ধর্মীয় আচরণের স্বাধীনতাকেও স্বীকার করা হয়। এই চুক্তির শর্ত মতে ওখান থেকে আসা লোকগুলো ফিরে যায়। কিন্তু এখন থেকে যাওয়া লোকগুলো আর ফেরেনি। না। ফিরলেও তখনকার মত যাওয়া বন্ধ হয়েছিল। কিন্তু ১৯৫১ সালে পাকিস্তানের আইনসভায় এমন দুটো আইন পাস হয়, ইস্ট বেঙ্গল ইভাকুই প্রোপার্টি এ্যাক্ট অব ১৯৫১ আর ইস্ট বেঙ্গল ইভাকুইস এ্যাক্ট অব ১৯৫১। এসব কারণে পূর্ব পাকিস্তান থেকে দেশত্যাগ করা লোকের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৫ লক্ষ। এসব তোমার বাবা ভাল জানবেন।

— বাবা এসব কিছুই বলেন না। আমাকে, দেশত্যাগের কথা উঠলে তিনি ফায়ার হয়ে যান। কিছুতে সহ্য করতে পারেন না।

–দেশত্যাগ কি আমরাই মানি? কিন্তু যারা যাচ্ছে, গোপনে চলে যাচ্ছে, তাদের তুমি ফেরাবে কি বলে? কিছু একটা আশ্বাস তো তাদের দিতেই হবে। নইলে নিজের মাটি থেকে কেউ যেতে চায়? শাস্ত্রে একটা কথা আছে না যে যে অপ্রবাসী সে-ই সবচেয়ে সুখী। মুসলমানরা হিজরত করে অভ্যস্ত। তারা এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরে বেড়িয়েছে ইতিহাসই বলে। কিন্তু হিন্দুর জন্য মাটি একটি ব্যাপার বটে।

বলতে বলতে কাজল দেবনাথ উঠে বারান্দায় যান। সম্ভবত আবেগকে প্রশমিত করবার জন্যই।

ফিরে এসে বলেন–বড় চা খেতে ইচ্ছে করছে। চল কোনও চায়ের দোকানে যাই।

সুরঞ্জন আর কাপড় পাল্টায় না। যে কাপড় ছিল, স্নান নেই, খাওয়াও কদিন পেটে পড়েছে ঠিক নেই। সে গায়ের লেপ ফেলে ঝাঁট করে দাঁড়িয়ে যায়। বলে —চলুন। শরীরে জং ধরে গেছে শুয়ে থাকতে থাকতে।

দরজা খোলা রেখেই বেরোয় সুরঞ্জন। কেন আর বন্ধ করবে। অঘটন যা ঘটবার ঘটেই তো গেছে। হাঁটতে হাঁটতে কাজল দেকনাথ জিজ্ঞেস করেন— বাড়িতে খাওয়া দাওয়া হচ্ছে তোমার?

–মা রেখে যান ঘরে, কখনও খাই কখনও খাই না। ইচ্ছে করে না। ভাল লাগে না আমার। সুরঞ্জন আঙুলে মাথার চুলগুলো আঁচড়ায়। এ ঠিক চুল নিপাট করবার উদ্দেশ্যে নয়। ভেতরের যন্ত্রণা কমাবার জন্য।

সুরঞ্জন পুরনো প্রসঙ্গে ফেরে—উনসত্তর, সত্তরে বোধহয় হিন্দুদের মাইগ্রেশন কম হয়েছে কাজলদা।

—ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন শুরু হল। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন থেকে মুক্তিযুদ্ধের আগ পর্যন্ত হিন্দুরা কম গেছে। ফিফটি ফাইভ থেকে ষাট পর্যন্ত প্রচুর গেছে। সিক্সটি থেকে পয়ষট্টি পর্যন্ত দশ লাখ মত লোক চলে গেছে। যুদ্ধ শুরু হলে প্রায় এক কোটির মত ভারতে আশ্রয় নেয়। এদের মধ্যে আশি ভাগই ছিল হিন্দু। যুদ্ধের পর ফিরে এসে হিন্দুরা দেখেছে তাদের ঘরবাড়ি বেদখল হয়ে গেছে। অনেকে তখন চলে গেয়ে কেউ থেকে গেছে আশায় আশায়। স্বাধীন দেশ তাদের নিরাপত্তা দেবে এই আশা। তারপর তো দেখছই চুয়াত্তরেও মুজিব সরকার শত্ৰু সম্পত্তির নাম ছাড়া আর কিছু চেঞ্জ করল না। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ক্ষমতায় বসাল। সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিল। এরপর এরশাদ এসে ইসলামি পুনরুজ্জীবন আন্দোলন শুরু করল। বিরাশির বাইশে ডিসেম্বর এরশাদ ঘোষণা করল ইসলাম ও কোরানের নীতিই হবে দেশের নতুন সংবিধানের ভিত্তি। চব্বিশ বছর ধর্মের নামে শোষিত হবার পর ধর্ম আবার রাজনৈতিক জীবনে ফিরে আসবে সদম্ভে, তাই বা কে ভেবেছিল।

একটি চায়ের দোকান দেখে থামে। ওরা। কাজল দেবনাথ সুরঞ্জনের আপাদমস্তক লক্ষ্য করে বলেন–তোমাকে খুব অন্যমনস্ক লাগছে। যে প্রশ্নগুলো তোমার খুব ভাল করেই জানা তাই আবার জিজ্ঞেস জিজ্ঞেস করছ। কেন? মনে হচ্ছে তোমার ভেতর প্রচণ্ড অস্থিরতা। এ সময় স্থির হও সুরঞ্জন। তোমার মত প্রতিভাবান ছেলে হতাশায় ভুগলে চলবে কেন?

একটি টেবিলে মুখোমুখি দুজন বসে। কাজল দেবনাথ জিজ্ঞেস করেন— চায়ের সঙ্গে কিছু খাবে?

সুরঞ্জন মাথা নাড়ে। খাবে। দুটো সিঙ্গাড়া খায় সে। কাজল দেবনাথও নেন। সিঙ্গারা খেয়ে দোকানের ছেলেটিকে বলেন–পানি দাও।

পানি শব্দটি সুরঞ্জন শোনে। কাজল দেকনাথ বাড়িতে জল বলেন। কিন্তু আজ তিনি পানি বললেন। এ কি অভ্যোস হয়ে গেছে পানি বলায়, তাই বললেন? নাকি ভয়ে বলান? সুরঞ্জনের জানতে ইচ্ছে করে। প্রশ্ন করতে গিয়েও সে করে না। তার মনে হয়, একসঙ্গে অনেকগুলো চোখ তাদের লক্ষ করছে। চায়ে দ্রুত চুমুক দেয় সে। ভয়ে? এ ভয় জন্মাচ্ছে কেন? গরম চায়ে হঠাৎ চুমুক পড়াতে তার জিভ পুড়ে যায়। তীক্ষ্ণ চোখে যে ছেলেটি পাশের টেবিল থেকে দেখছে, তার থুতনিতে দাড়ি, মাথায় একটি কুরাশি বোনা টুপিও। বয়স বাইশ একুশ হবে। সুরঞ্জনের মনে হয় মায়াকে যারা নিয়ে গেছে, এই ছেটি নিশ্চয়ই ছিল তাদের মধ্যে, না হলে এত কান পেতে আছে কেন? এত কেন একি মনোযোগ! সুরঞ্জন লক্ষ্য করে ছেলেটি মিটমিট হাসছে। তবে কি এই জন্য হাসছ যে কেমন বুঝছ মজা, বোনটিকে তো যাচ্ছেতাই করে খেলছি আমরা। চা শেষ হয় না রঞ্জনের। বলে— চলুন উঠি কাজলদা। ভাল লাগছে না।

—এত তড়িঘড়ি উঠতে চাইছ যে?

–ভাল লাগছে না।

লজ্জা (১০) জাতীয় সংসদে সংখ্যালঘু সদস্য

১০ক.

জাতীয় সংসদে ১৯৫৪ সালে মোট সদস্য ছিলেন ৩০৯ জন। সংখ্যালঘু ছিলেন ৭২ জন,’৭০-এ ৩০০-র মধ্যে সংখ্যালঘু ১১ জন, ১৯৭৩ সালে ৩১৫ জনে ১২ জন, ১৯৭৯ সালে ৩৩০ জনে ৮জন। ১৯৮৬ সালে ৩৩০ জনে ৭ জন, ১৯৮৮ সালে ৪ জন, ১৯৯১ সালে ৩৩০ জনে ১২ জন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কোনও সংখ্যালঘু ব্রিগেডিয়ার বা মেজর জেনারেল নেই। কর্নেল সত্তর জনে একজন, লেফটেনেন্ট কর্নেল চারশ পঞ্চাশ জনে আটজন, মেজর এক হাজার জনে চল্লিশ জন, ক্যাপ্টেন তেরশ জনে আটজন, সেকেন্ড লেফটেনেন্ট নয়শ জনে তিনজন, সিপাহি আশি হাজারে পাঁচশ জন। চল্লিশ হাজার বি ডি আর-এর মধ্যে হিন্দু মাত্র তিনশ জন। আশি হাজার পুলিশের মধ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘু মাত্র দুই হাজার। এডিশনাল আই জি কেউ নেই, আই জি তো নেই-ই। পুলিশ অফিসারের ৮৭০ জন সদস্যের মধ্যে সংখ্যালঘু মাত্ৰ ৫৩ জন। স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদে, বিদেশে বাংলাদেশ মিশনের উচ্চপদে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনও লোক নেই। সচিবালয়ের অবস্থা আরও করুণ। সচিব বা অতিরিক্ত সচিব পদে কোনও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোক নেই। জয়েস্ট সেক্রেটারি আছেন একশ চৌতিরিশ জনে মাত্র তিনজন, চারশ তেষট্টি জন ডেপুটি সেক্রেটারির মধ্যে সংখ্যালঘু আছেন। পাঁচশ জন। স্বায়ত্ব-শাসিত সংস্থাগুলোর মধ্যে প্রথম শ্রেণীর কর্মকতা ছেচল্লিশ হাজার। আটশ চুরানব্বই-এর মধ্যে আছেন সাড়ে তিনশ জন। সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্ব-শাসিত প্ৰতিষ্ঠানের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকতা পদে সংখ্যালঘু লোক শতকরা পাঁচ ভাগের বেশি নেই। আবগারি ও শুষ্ক কর্মকতা একশ বাহান্নো জনে একজন, আয়কর কর্মকতা সাড়ে চারশর মধ্যে আটজন। রাষ্ট্রািয়ত্ব শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোয় কর্মকতা শতকরা এক ভাগ, কর্মচারী তিন থেকে চার ভাগ, শ্ৰমিক এক ভাগেরও নীচে। শুধু তাই নয়। বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক সহ কোনও ব্যাঙ্কেরই ডাইরেক্টর, চেয়ারম্যান বা এম ডি পদে হিন্দু নেই। এমনকি বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলোর কোনও শাখায় ম্যানেজার পদে হিন্দু নেই। ব্যবসা বাণিজ্য করতে গেলে মুসলমান অংশীদার না থাকলে কেবল হিন্দু প্রতিষ্ঠানের নামে সব সময় লাইসেন্স পাওয়া যায় না। তাছাড়া সরকার নিয়ন্ত্রিত ব্যাঙ্ক, বিশেষত শিল্প সংস্থা থেকে শিল্প কারখানা গড়বার জন্য কোনও ঋণ দেওয়া হয় না।

সুরঞ্জনের ঘুম হয়নি। সারারাত। ভাল না লাগায় তাকে পেয়ে বসেছে। কিরণময়ী সকালে একবার এসেছিলেন ঘরে। সম্ভবত মায়ার কথাই জিজ্ঞেস করতে যে, কিছু কি হবে না, দিন কি এমন মায়াহীন যাবে? এ ক’দিনে কিরণময়ীও কেমন মরা মরা হয়ে গেছেন। চোখের কোণে কালি, শুকনো মুখে রা নেই, হাসি নেই। ঘুমিয়ে আছে এমন শিথিল পড়ে ছিল সুরঞ্জন বিছানায়। কিরণময়ীকে বুঝতে দেয়নি তার ভেতরে ভীষণ এক যন্ত্রণা হচ্ছে। কিরণময়ী তার টেবিলে দুবেলা খাবার রেখে যান, নিঃশব্দে। সুরঞ্জনের মাঝে মধ্যে রাগও ধরে, মানুষটি কি পাথর? তাঁর স্বামী পঙ্গু, কন্যা হারিয়ে গেছে, পুত্ৰ থেকেও নেই, তবু কেন অভিযোগ নেই। কারও প্রতি? মৃত মানুষের মত অভিযোগহীন, অনুভবহীন আশ্চর্য নিথর জীবন কিরণময়ীর।

সে সিদ্ধান্ত নেয় সারাদিন সে ঘুমোবে। তার ঘুম দরকার। অনেকদিন ঘুম হয় না। ভয়ঙ্কর এক থাবা সে চোখ বুজলেই টের পায় এগিয়ে আসছে তার দিকে। গলা টিপে ধরছে তার। শ্বাসরোধকারী হাত একটির পর একটি আসছেই। সে স্বস্তি পায় না, একফোঁটা শান্তি পায় না।

 

১০খ.

ননীগোপাল এসেছেন মানিকগঞ্জ থেকে, সঙ্গে বউ ছেলে মেয়ে। ননীগোপাল সুধাময়ের লতায়-পাতায় আত্মীয় হন। সুধাময়ের ঘরের ভাঙা জিনিসগুলো দেখে এতটুকু বিস্মিত হন না। ননীগোপাল, বলেন—আপনার বাড়িও তবে বাদ দেয়নি?

ললিতা, ননীগোপালের বউ, সিঁদুর মোছা সিঁথিও ঘোমটায় ঢেকেছেন। তিনি কিরণময়ীর দুটো হাত বুকে চেপে ‘বৌদিগো’ বলে কেঁদে ওঠেন। জড়সড় দাঁড়িয়ে থাকে ললিতার মেয়েটি। কি নাম যেন ওর, সুধাময় মনে করতে পারেন না। মায়ার বয়সী হবে মেয়েটা। মায়ার চেয়ে দু-এক বছর কম হতে পারে। মেয়েটির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকেন সুধাময়। তাঁর চোখ আবার ঝাপসা হয়ে ওঠে। মায়া নেই। মায়া যে নেই এ কথা সুধাময়ের বিশ্বাস হতে চায় না। যেন আছে, পাশের বাড়িতেই আছে, অথবা টিউশনিতে গেলে বিকেলে ফিরে আসবে। আসলে বাড়ির সকলের গোপনে গোপনে এই আশা থেকেই গেছে, যে, ধর্ষিতা নির্যাতিতা ক্ষতবিক্ষত মায়া একদিন ফিরে আসবে।

–দাদা, এই দেশে আর থাকব না। মেয়ে বড় হয়েছে, বড় ভয় হয় কখন কী হয়।

সুধাময় মেয়েটি থেকে চোখ ফিরিয়ে বলেন–চলে যাবার কথা আমার-সামনে বলো না। শুনলাম পাশের বাড়ির গৌতমরাও চলে যাচ্ছে। পেয়েছটা কি? কথায় কথায় চলে যাব। যেখানে যাবে সেখানে গুণ্ডা বদমাশ নেই? সেখানে ভয়-ডর নেই? মেয়েদের নিরাপত্তার অভাব সব দেশেই। বলে না নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস? তোমার হয়েছে সেই অবস্থা।

ননীগোপালের পরনে পাজামা পাঞ্জাবি। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়িও গজিয়েছে। তিনি কপালে দুটো হাত রেখে চুপচাপ বসে থাকেন। ললিতা কাঁদেন। আশঙ্কায় কাঁদেন। আর কিরণময়ী পাথর হয়ে ললিতার কান্না শোনেন। এ কথা বলতেও তাঁর স্বর ওঠে না যে না মায়াকে ধরে নিয়ে গেছে, আজও ফেরেনি মায়া।

ননীগোপালের কাঠের ব্যবসা ছিল। পুড়িয়ে দিয়েছে ওরা কাঠের গোলা। এতেও তিনি বিচলিত হননি, তাঁর ভয় অঞ্জলিকে নিয়ে। মেয়েকে না। আবার কবে ধরে নিয়ে যায়! তিনি বলেন–দাদা, ললিতার এক আত্মীয় ফেনীর চাঁদপুরে বাড়ি, সম্পত্তির লোভে তাঁকে ধরে নিয়ে গেছে, পরে তাঁকে মেরে ফেলে রেখেছে। জয়দেবপুরের পিংগাইলে অশ্বিনী কুমার চন্দ্রের চৌদ্দ বছরের মেয়ে মিকোকে ধরে নিয়ে রেপ করেছে জানেন না? পরে মেয়েটি মারা গেছে। গোপালগঞ্জের বেদগ্রামের হরেন্দ্রনাথ হীরার মেয়ে নন্দিতা রানী হীরাকে ধরে নিয়ে গেছে। বাঞ্ছারামপুরের ক্ষিতীশ চন্দ্র দেবনাথের মেয়ে করুণাবালাকে গ্রামের মুসলমান ছেলেরা ধরে নিয়ে রেপ করেছে। ভোলার কালীনাথ বাজারের শোভা রানীর মেয়ে তন্দ্ৰা রানীকেও ধরে নিয়ে রেপ করেছে। টাঙ্গাইলের আদালত পাড়া থেকে সুধীর চন্দ্ৰ দাসের মেয়ে মুক্তি রানী ঘোষকে আবদুল কাইয়ুম নামের এক আদম ব্যাপারী ধরে নিয়ে গেছে। ভালুকার পূর্ণচন্দ্ৰ বৰ্মণের মেয়েকে জোর করে ধরে নিয়ে গেছে। রংপুরের তারাগঞ্জে তিনকড়ি সাহার মেয়ে জয়ন্তী রানী সাহাকে অপহরণ করা হয়। এসব শোনেননি?

—এসব কবেকার ঘটনা? সুধাময় ক্লান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন।

ননীগোপাল বলেন–উননব্বই-এর।

—এত আগের কথা এখনও মুখস্থ করে রেখেছ?

—এসব কি ভোলার মত?

—কোন পরীবানু, আনোয়ারা, মনোয়ারা, সুফিয়া, সুলতানা। এদের খবর রাখো না? এদেরও তো ধরে নিয়ে যায়। এদেরও তো অত্যাচার করে, রেপ করে।

ননীগোপাল আবারও মাথায় দুই হাত রেখে বসে থাকেন। খানিকপর বলেন—আপনার অসুখ খবর পেয়েছি। দেখতে যে আসব, নিজের চিন্তায় বাঁচি না। যাবার সময় ভাবলাম দেখা করে যাই। আজ রাতেই বেনাপোল চলে যাব। বাড়িঘর বিক্রি করা সম্ভব হল না। ললিতার এক মামাতো ভাইকে বলেছি সে যেন একসময় বিক্রি করে দেয়।

–সুধাময় বুঝতে পারেন তিনি ফেরাতে পারবেন না। ননীগোপালকে। তিনি ভেবে পান না চলে গেলে কী লাভ ৷ এই দেশের রয়ে যাওয়া হিন্দুরা সংখ্যায় আরও যদি কমে যায়, তবে এদের ওপর অত্যাচার আরও বাড়বে। লাভ হবে–যারা যাবে তাদের, নাকি যারা থেকে যাবে তাদের? সুধাময় অনুমান করেন লাভ আসলে কারওর নয়, ক্ষতি সকলের, ক্ষতি দরিদ্রের, ক্ষতি সংখ্যালঘুদের। কী করলে, ঠিক কতজন মারা গেলে এ দেশের হিন্দুরা ভারতের উগ্ৰবাদী হিন্দুদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সকল অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারবে তা জানতে ইচ্ছে করে সুধাময়ের। জানলে তিনি নিজে অন্তত আত্মহত্যা করতেন। অনেককে আত্মহত্যার জন্য বলতেন। তাতে যদি বাকি হিন্দুদের কিছু কল্যাণ হত।

 

১০গ.

বিকেলে শফিক আহমেদের স্ত্রী আসেন বাড়িতে। আলেয়া বেগম। আগে প্রায়ই আসতেন। আজকাল অনেকেই আসেন না। হায়দারের বাবা মা-ও অনেকদিন আসেন না। কিরণময়ী বড় একা হয়ে গেছেন টের পান সুধাময়। আলেয়া বেগমকে দেখে একটু অবাকই হন কিরণময়ী, যেন কারও আসবার কথা নয় এ বাড়িতে। এ বাড়ি একটি পোড়োবাড়ির মত। আলেয়া বেগমের হাসি হাসি মুখ, ঝকমকে শাড়ি, গায়ের গয়না দেখে সুধাময় ভাবেন কিরণময়ী কি তাঁর সামনে ম্লান বোধ করছেন? কিরণময়ীর ওপর তিনি বোধহয় এতদিন অন্যায়ই করেছেন। একটি সচ্ছল, শিক্ষিত রুচিবান পরিবারের মেয়েকে একটি অসচ্ছল, স্বপ্নহীন সংসারে ঢুকিয়ে, তার ওপর একুশ বছর তাঁকে শরীরী অবদমন দিয়ে বঞ্চিত করেছেন। সুধাময় নিজের স্বার্থই বড় করে দেখেছেন, নয়ত তাঁর বলা উচিত ছিল কিরণময়ী তুমি আবার বিয়ে কর। বললে কি কিরণময়ী চলে যেতেন? আলেয়া বেগমের মত ঝলমলে জীবনের সাধ কি ছিল না তাঁর গোপনে? মানুষের মন তো, চলে যেতেও পারতেন। ঐই ভয়ে সুধাময় কিরণময়ীর কাছাকাছি থেকেছেন বেশি, বন্ধুবান্ধবকে খুব একটা ডাকতেন না বাড়িতে। কেন ডাকতেন না, সুধাময় তাঁর অসুস্থ শয্যায় নিজের দুর্বলতাকে নিজেই আঙুল তুলে দেখিয়ে দেন, বলেন—সুধাময়, তুমি যে নির্বান্ধব হয়ে যাচ্ছিলে ক্রমশ, ইচ্ছে করেই হচ্ছিলে, যেন এ বাড়িতে তোমার বন্ধুদের আড্ডা বসলে কিরণময়ীর আবার কোনও সক্ষম পুরুষকে যদি পছন্দ হয়ে যায়। কিরণময়ীর জন্য সুধাময়ের ভালবাসা এত তীব্র হয়ে উঠবার পেছনে ছিল স্বার্থপরতা, যেন এই তীব্ৰতা দেখে ক্রিয়াময়ী ভাবেন এই ভালবাসা ছেড়ে কোথাও যাওয়া তাঁরা উচিত নয়। কেবল ভালবাসায় কি মন ভরে? এতকাল পর সুধাময়ের মনে হয় কেবল ভালবাসায় মানুষের মন ভরেনা, আরও কিছুর প্রয়োজন হয়।

আলেয়া বেগম ঘরের ভাঙা জিনিসপত্র দেখেন, সুধাময়ের অচল হাত পা দেখেন, মায়ার অপহৃত হওয়ার গল্প শোনেন আর চুকচুক করে দুঃখ করেন। একসময় বলেন—বৌদি, আপনার কোনও আত্মীয়-টাত্মীয় থাকে না ইন্ডিয়ায়?

–থাকে। আমার প্রায় সব আত্মীয়ই তো ওখানে।

–তবে আর এখানে পড়ে আছেন কেন?

–নিজের দেশ তো তাই।

কিরণময়ীর উত্তরে আলেয়া বেগম একটু যেন অবাকই হন। কারণ কিরণময়ীরও যে দেশ এটি, তা যেন প্রথম তিনি অনুধাবন করছেন। আলেয়া বেগম যত জোর দিয়ে বলেন ‘এটা আমার দেশ’, কিরণময়ীকে তত জোর কি মানায়–আলেয়া বোধহয় ভাবছেন এ কথাই। আজ সুধাময় ভাবেন আলেয়া আর কিরণময়ী এক নয়। কোথায় যেন সূক্ষ্ম এক ফারাক তৈরি হচ্ছে।

লজ্জা (১১) আজ বিজয় দিবস

আজ বিজয় দিবস। এই দিনে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। স্বাধীনতা শব্দটি সুরঞ্জনকে বিষপিঁপড়ের মত কামড়ায়। সারাদেশ বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান করছে, কুচকাওয়াজ করছে। বেশ আনন্দ হচ্ছে চারদিকে। সুরঞ্জনের মনে কোনও আনন্দ হচ্ছে না৷ এই দিনটিতে সুরঞ্জন বেরিয়ে পড়ত ভোরে, এদিক ওদিক নানা অনুষ্ঠান করে ফিরত। ট্রাকে ঘুরে গান গাইত। সুরঞ্জনের মনে হয় বাজে কাজেই সে এত বছর সময় নষ্ট করেছে। কিসের স্বাধীনতা সে পেয়েছে, কী লাভ হয়েছে তার বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে? ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’, ‘পূর্ব দিগন্তে সূৰ্য উঠেছে’…’রক্ত লাল রক্ত লাল’, ‘বিশ্বকবির সোনার বাংলা নজরুলের বাংলাদেশ জীবনানন্দের রূপসী বাংলা রূপের যে তার নেইকো শেষ’, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা আমরা তোমাদের ভুলব না’, ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি, মোরা একটি মুখের হাসির জন্য যুদ্ধ করি’—এই গানগুলো বারবারই সুরঞ্জনের মুখে সুর হয়ে বাজতে চায়। সে দেয় না। সুরঞ্জনের ইচ্ছে করে না এসব শুনতে। সে প্রাণপণে মাড়িয়ে যায় বুকের বকুলগুলো।

সারাদিন শুয়ে থেকে সে একটি ইচ্ছের জন্ম দেয়। তার গোপন ইচ্ছেটিকে সে লালন করে। ইচ্ছেটিকে সে জিইয়ে রাখে, যেন না মরে, ইচ্ছেটি যেন ডালপালা মেলে বড় হতে থাকে। সারাদিন ইচ্ছের গোড়ায় সে জল ঢালে, ইচ্ছের চারায় ফুলও ফোটে, সে গন্ধও নেয়। সেই ফুলের। ইচ্ছেটিকে সন্ধে অবধি তা দিয়ে দিয়ে সে বেরোয় বাড়ি থেকে রাত আটটার দিকে। রিক্সাকে বলে যেদিকে খুশি যাও। রিক্সা তাকে তোপখানা, বিজয় নগর, কাকরাইল, মগবাজার ঘুরিয়ে রমনায় নেয়। সুরঞ্জন রাতের আলোকসজ্জা দেখে। আলোকিত রাজপথ কি জানে সে একটি হিন্দু ছেলে! জানলে বোধহয় পিচের পথও বলত, দ্বিধা হও। আজ এই ইচ্ছেটি পূরণ না করলে হৃদয়ের কোষে কোষে যে আগুন জ্বলছে, তা নিভবে না। এই কাজটি না করলে শ্বাসরুদ্ধকর জীবন থেকে সে মুক্তি পাবে না, এই কাজটি হয়ত কোনও সমস্যার সমাধান নয়। তবু কাজটি তাকে স্বস্তি দেবে, এই কাজ করে সে তার ক্ৰোধ, তার ক্ষোভ, তার যন্ত্রণা কিছুটা হলেও কমাবে।

বার কাউন্সিলের সামনে সুরঞ্জন তার রিক্সা থামায়। থামিয়ে সিগারেট ধরায়। মায়াকে ফেরত পাবার আশা সুরঞ্জন ছেড়েই দিয়েছে। সুধাময় আর কিরুণাময়ীকে সে জানিয়ে দেবে তাঁরা যেন মায়ার আশা আর না করেন। যেন ভাঝেন মায়া সড়ক দুৰ্ঘটনায় মারা গেছে। সেদিনের সচল সক্ষম সুধাময়ের এমন নিঃস্ব নির্জন অসহায় অবস্থা সুরঞ্জনের সহ্য হতে চায় না। মানুষটা গোঙায় সারাদিন–মায়াকে ফিরে না পাবার বেদনায়, যন্ত্রণায়। মায়াকে নিশ্চয় শকুন যেভাবে মরা মানুষ খায়, তেমন করে খাচ্ছে ওরা। খুবলে খাচ্ছে। ছিঁড়ে খাচ্ছে। আদিম মানুষেরা যেমন কাঁচা মাংস খেত, তেমন করে কী? কী এক অবোধ যন্ত্রণা সুরঞ্জনের বুক ছিঁড়ে নেয়। যেন তাকেই খাচ্ছে কেউ। তাকেই খাচ্ছে সাত হয়েনার দল। সিগারেটটি শেষ হয় না তার, রিক্সার সামনে একটি মেয়ে দাঁড়ায়। সোডিয়াম আলোয় মেয়েটির মুখ উজ্জ্বল লাগে। মুখে নিশ্চয় রং মাখিয়েছে। বয়স উনিশ-বিশ হবে মেয়েটির।

সুরঞ্জন সিগারেটটি খুঁড়ে ফেলে মেয়েটিকে কাছে ডাকে। বলে—এই শোন।

রিক্সা ঘেঁষে দাঁড়ায় মেয়েটি। শরীর নাড়ায়। হাসে।

সুরঞ্জন জিজ্ঞেস করে–তোমার নাম কি?

মেয়েটি হেসে বলে–পিংকি।

—পুরো নাম বল।

–শামিমা বেগম।

–বাবার নাম?

—আবদুল জলিল।

-বাড়ি?

–রংপুর।

—কি নাম যেন তোমার?

-শামিমা।

মেয়েটি অবাক হয় কেউ তো এমন বাপের নাম বাড়ির নাম জিজ্ঞেস করে না। এ কেমন খদ্দের! তীক্ষ্ণ চোখে সুরঞ্জন শামিমাকে দেখে। মেয়েটি কি মিথ্যে বলছে? মনে হয় না।

—ঠিক আছে রিক্সায় ওঠ।

শামিমা রিক্সায় ওঠে। রিক্সাকে টিকাটুলির দিকে যেতে বলে সুরঞ্জন। শামিমার সঙ্গে সারাপথ সে কোনও কথা বলে না। তার দিকে একবার তাকিয়েও দেখে না। এই যে একটি মেয়ে তার গা ঘেঁষে বসেছে, অযথা কথা বলছে, গানও গেয়ে উঠছে হঠাৎ হঠাৎ, হাসতে হাসতে ঢলে পড়তে চাইছে সুরঞ্জনের গায়ে—এসব কিছুই তাকে স্পর্শ করছে না। সে খুব মন দিয়ে সিগারেট ফোঁকে। রিক্সা অলটিকেও বেশ খুশি খুশি মনে হয়। সে এঁকেবেঁকে রিক্স চালায়। মাঝে মধ্যে হিন্দি ছবির দু-এক কলি গানও গায়। শহর সেজেছ আজ। লাল নীল আলোয় ঝলমল করছে। সে আজ যা করছে, সুস্থ মাথায় করলে কোনও নেশা করেনি সে।

বাইরে থেকে তালা দিয়ে এসেছে সে ঘরে। সদর দরজায় ডাকাডাকি না করে নিজের ঘরে নিঃশব্দে ঢুকে পড়া যায়। ঘরে ঢুকেই শামিমা বলে—দরদাম কিন্তু কিছু হইল না।

সুরঞ্জন তাকে থামিয়ে দেয়। বলে—চুপ একটি কথা না। একেবারে চুপ।

ঘরটি তেমনই অগোছালো। বিছানার চাদর অর্ধেক ঝুলে আছে নীচে। ওঘর থেকে কোনো শব্দ আসে না। সম্ভবত ঘুমিয়ে গেছে। সুরঞ্জন কান পেতে রেখে শোনে সুখময় গোঙাচ্ছেন। তিনি কি বুঝতে পেরেছেন তাঁর মেধাবী পুত্ৰধান বাড়িতে একটি বেশ্যা নিয়ে ঢুকেছে! সে অবশ্য শামিমাকে কোনও বেশ্যা ভাবছে না। ভাবছে একটি মুসলমান মেয়ে। একটি মুসলমান মেয়েকে তার খুব ইচ্ছে হচ্ছে ধর্ষণ করতে। শামিমাকে ধর্ষণ করে সে, স্রেফ ধর্ষণ।। ঘরের বাতি নিবিয়ে দেয় সে। মেয়েটিকে মেঝোয় ফেলে কাপচোপড় টেনে খুলে ফেলে। সুরঞ্জনের শ্বাস পড়ে দ্রুত, সে তার নখ বসিয়ে দেয় মেটের তলপেটে। দাঁতে কামড়ে ধরে স্তন। সুরঞ্জন বুঝতে পারে এর নাম আদর নয়, সে অযথাই মেয়েটির চুল ধরে হেঁচকা টান দিচ্ছে, গালে, গলায়, বুকে কামড় বসাচ্ছে। তলপেটে, পেটে, নিতম্বে, উরুতে ধারালো নখের আঁচড় দিচ্ছে। মেয়েটি রাস্তার বেশ্যা, সে ‘উহ আহ মাগো গেলাম গো’ করে ওঠে যন্ত্রণায়, তা শুনে সুরঞ্জনের আনন্দ হয়। একে আরও কষ্ট দিতে দিতে, আরও তছনছ করে পেষে সে, ধর্ষণ করে। মেয়েটিও অবাক হয় মন হিংস্র খদ্দের সে দেখেনি আগে যে তাকে এভাবে কামড়ে ছেঁড়ে। বাঘের থাবা থেকে হরিণী যেমন ভয়ে পালাতে চায়, মেয়েটি ‘শাড়ি কাপড় গুটিয়ে নিয়ে দরজার কাছে তো দাঁড়ায়।

রঞ্জন বড় শান্ত এখন। নির্ভার লাগছে তার। যে ইচ্ছেটা তাকে কামড়াচ্ছিল সারাদিন, তার একটা সদগতি হল। এই মেয়েটিকে লাথি মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারলে তার আরও আনন্দ হবে। তার শ্বাস আবার ঘন হয়ে ওঠে। সে মুসলমান মেয়েটিকে এখনই কষে লাথি দেবে? উলঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি, সে বুঝতে পারছে না রাতে তাকে থাকতে হবে নাকি চলে যেতে হবে। যেহেতু কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে, ভয়ে সে মুখও খুলতে পারছে না।

মায়া এখন কোথায়, তাকে কি ঘর বন্ধ করে হাত পা বেধে ওরা ধর্ষণ করেছে, ওরা সাতজনই? মায়ার খুব কষ্ট হয়েছে নিশ্চয়ই, মায়া কি চিৎকার করছিল তখন? একবার, মাযায় তখন পনেরো কি ষোল বছর বয়স, স্বপ্নের মধ্যে ‘দাদা দাদা বলে চিৎকার করে উঠছিল, সুরঞ্জন দৌড়ে গিয়ে দেখে মায়া ঘুমের মধ্যে থরথর কাঁপছে—কি মায়া, কাঁপছিস কেন?’ জেগেও মায়ার কাঁপুনি থামেনি, মগ্ন হয়ে স্বপ্নের কথা বলল,’খুব সুন্দর একটা গ্রামে আমরা দুজন বেড়াতে গেছি, সবুজ ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে তুমি আর আমি হাঁটছি। হাঁটছি। গল্প করছি। দু-একটা লোক হাঁটছে। তারা আমাদের সঙ্গে অল্প অল্প কথা বলছে। হঠাৎ দেখি ধানক্ষেত নেই। একটা নির্জন মাঠ, সঙ্গে তুমি নেই, হঠাৎ দেখি পেছন থেকে কতগুলো লোক আমাকে ধরতে আসছে, ভয়ে আমি দৌড়োচ্ছি। আর তোমাকে খুঁজছি।‘ আহা মায়া। সুরঞ্জনের শ্বাস ঘন হয়ে ওঠে, তার মনে হয় মায়া চিৎকার করছে খুব। মায়ার চিৎকার কেউ শুনতে পাচ্ছে না। কেউ শুনতে পাচ্ছে না মায়া কাঁদছে। কাঁদছে মায়া। কোনও অন্ধকার ঘরে একপাল বুনো জন্তুর সামনে বসে ও কাঁদছে। মায়া কোথায় আছে এখন, ছোট্ট একটি শহর, অথচ সে জানে না তার প্রিয় বোনটি আস্তাকুঁড়ে, পতিতালয়ে না বুড়িগঙ্গার জলে? কোথায় মায়া? এই দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে ইচ্ছে করছে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে।

মেয়েটি ভয় পেয়ে যায় সুরঞ্জনের আচরণে। সে দ্রুত তার শাড়ি কাপড় পরে নিয়ে বলে–টাকা দেন।

—খবরদার এক্ষুনি বের হ। সুরঞ্জন লাফিয়ে ওঠে ক্ৰোধে।

শামিমা দরজা খুলে এক পা দেয় বাইরে, আবার করুণ চোখে তাকায় পেছনে, গালের কামড় থেকে রক্ত গড়াচ্ছে, বলে–দশটা টাকা হইলেও দেন।

ক্ৰোধ তখন লাফিয়ে উঠতে চাইছে সুরঞ্জনের সারা শরীরে। কিন্তু মেয়েটির করুণ চোখ দেখে তার মায়া হয়। দরিদ্র একটি মেয়ে। পেটের দায়ে শরীর বেচে। সমাজের নষ্ট নিয়ম তার শ্রম মেধা কিছুই কাজে না লাগিয়ে ঠেলে দিচ্ছে অন্ধকার গলিতে। সে নিশ্চয় আজকের টাকা দিয়ে দুটো ভাত খাবে। ক’বেলা খায় না কে জানে! সুরঞ্জন প্যান্টের পকেট থেকে দশটি টাকা বের করে শামিমার হাতে দেয়, জিজ্ঞেস করে–তুই তো মুসলমান, না?

–হ্যাঁ।

–তোরা তো আবার নাম পাল্টাস, নাম পাল্টাসনি তো?

–না।

—ঠিক আছে, যা।

শামিমা চলে যায়। সুরঞ্জনের মনে বড় আরাম হয়। সে আজ আর কোনও দুঃখ করবে না। আজ বিজয়ের দিন, সকলে আনন্দ-উল্লাস করছে, বাজি ফাটাচ্ছে, একুশ বছর আগে এই দিনে স্বাধীনতা এসেছিল, এই দিনে শামিমা বেগমও এসেছে সুরঞ্জন দত্তের ঘরে। বাহু স্বাধীনতা বাহু। সুরঞ্জনের ইচ্ছে করে তুড়ি বাজাতে। সে কি এক কলি গেয়ে উঠবে নাকি ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ, জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ?’

শামিমাকে একবারও তার নামটি বলা হয়নি। তার নাম যে সুরঞ্জন দত্ত এই কথাটি বলা উচিত ছিল। তবে শামিমাও টের পেত তাকে আঁচড়ে কামড়ে রক্তাক্ত করেছে যে মানুষ, সে একটি হিন্দু যুবক। হিন্দুরাও ধর্ষণ করতে জানে, তাদেরও হাত পা মাথা আছে, তাদেরও দাঁতে ধার আছে, তাদের নখও আঁচড় কাটতে জানে। শামিমা নিতান্তই নিরীহ একটি মেয়ে, তবু তো মুসলমান। মুসলমানের গালে একটু চড় কষাতে পারলেও সুরঞ্জনের আনন্দ হয়।

সারারাত কাটে প্রচণ্ড অস্থিরতায়। সারারাত কাটে ঘোরে বেঘোরে। সারারাত কেটে যায় সুরঞ্জনের একা, ভূতুড়ে নিস্তব্ধতায়, নিরাপত্তাহীনতায়, সন্ত্রাসের কালো ডানার নীচে সে তড়পায়, তার ঘুম আসে না। সে আজ তুচ্ছ একটি প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল, পারেনি। প্রতিরোধ সে নিতে পারে না। সারারাত শামিমা মেয়েটির জন্য সুরঞ্জন অবাক হয়ে লক্ষ করে তার মায়া হচ্ছে। করুণা হচ্ছে। হিংসে হয় না। রাগ হয় না। যদি না-ই হয় তবে আর প্রতিশোধ কিসের। তবে তো এ এক ধরনের পরাজয়। সুরঞ্জন কি পরাজিত? সুরঞ্জন তবে পরাজিতই। শামিমাকে সে ঠকাতে পারেনি। এমনিতেই মেয়েটি ঠকে আছে। তার কাছে সম্ভোগ আর ধর্ষণ আলাদা কোনও আচরণ নয়। সুরঞ্জন কুঁকড়ে যেতে থাকে বিছানায়; যন্ত্রণায়, লজ্জায়। রাত তো অনেক হয়েছে, ঘুম আসে না কেন সুরঞ্জনের! সে কি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে! বাবরি মসজিদের ঘটনা তাকে নষ্ট করে দিচ্ছে, সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে তার হৃদয়ে পচন ধরেছে। এত কষ্ট হচ্ছে কেন, যে মেয়েটিকে সে দাঁতে ছিঁড়ল, কামড়াল, তার জন্যই কষ্ট হচ্ছে, মেয়েটির গালের রক্ত যদি সে যাবার আগে একবার রুমালে মুছে দিতে পারত! মেয়েটিকে কি আবার কখনও পাওয়া যাবে, বার কাউন্সিলের মোড়ে দাঁড়ালে মেয়েটিকে যদি পাওয়া যায়, সুরঞ্জন ক্ষমা চেয়ে নেবে। এই শীতের রাতেও তার গরম লাগে গায়ে। গায়ের লেপখানা সে গা থেকে ফেলে দেয়। বিছানার চাদরটি পায়ের কাছে দলা পাকিয়ে আছে। ময়লা তোষকের ওপর হাঁটুর কাছে মাথা নামিয়ে এনে শুয়ে থাকে। কুকুরের মত শরীর কুণ্ডুলি করে। সকালে খুব প্রস্রাবের বেগ হয় তার, তবু উঠতে ইচ্ছে করে না। কিরণময়ী চা রেখে যান, তার কিছুই খেতে ইচ্ছেকরে না। বমি বমি লাগে। তার গরম জলে স্নান করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু গরম জলপাবে কোথায়? ব্রাহ্মপল্লীর বাড়িতে পুকুর ছিল, শীতের সকালে পুকুরে নামলে গায়ে লোম দাঁড়িয়ে যেত। তবু পুকুরে না সাঁতরালে তার স্নানই হত না। আজ খুব সাঁতার সাঁতরে স্নান করা যেত যদি, কিন্তু পুকুর কোথায়! অগাধ সেই জল কোথায়! কলঘরের মাপা জলে তার স্নান করতে ইচ্ছে করে না। এত কেন জীবনে মাপামাপি!

 লজ্জা (১২) সুরঞ্জন বিছানা ছাড়ে

১২ক.

সুরঞ্জন বিছানা ছাড়ে। সকাল দশটায়। সে দাঁত মাজছিল বারান্দায় দাঁড়িয়ে। শুনতে পায় খাদেম আলীর ছেলে আশরাফ কিরণময়ীকে বলছে-মাসিম, আমাদের বাড়ির পুটু কাল সন্ধের দিকে মায়ার মত এক মেয়েকে গেণ্ডারিয়া লোহার পুলের নীচে ভেসে থাকতে দেখেছে।

রঞ্জনের টুথব্রাশ ধরা হাতটি হঠাৎ পাথর হয়ে যায়। সারা শরীরে ইলেকট্রিক কারেন্ট বইলে যেমন লাগে, তেমন লাগে তার শরীরে। ভেতর থেকে কোনও কান্নার শব্দ আসে না। স্তব্ধ হয়ে আছে বাড়িটি। যেন কথা বললেই গমগম করে বাতাসে প্রতিধ্বনি হবে। যেন সে ছাড়া হাজার বছর ধরে এ বাড়িতে কেউ ছিল না। বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সুরঞ্জন বোঝে, গতরাতের বিজয় উৎসবের পর শহরের ঘুম এখনও ভাল করে ভাঙেনি। টুথব্রাশ হাতে নিয়েই সে দাঁড়িয়ে ছিল, হায়দার জার্সি পরে রাস্তায় হাঁটছিল, তাকে দেখে থামে, চোখ পড়েছে বলেই ভদ্রতা করে থামে সে, ধীর পায়ে সামনে আসে, জিজ্ঞেস করে–কেমন আছ?

সুরঞ্জন হেসে বলে—ভাল।

এর পরই মায়ার প্রসঙ্গ উঠবার কথা কিন্তু হায়দার সে প্রসঙ্গ তোলে না। সে রেলিং-এ হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। কলে–গতকাল শিবিরের লোকেরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হলে যে গণকবরের স্মৃতিফলক ছিল তা ভেঙে দিয়েছে।

সুরঞ্জন থুক করে একদলা পেস্ট ফেলে মাটিতে, বলে— গণকবর মানে?

— গণকবর মানে তুমি জানো না? হায়দার বিস্মিত চোখে তাকায় সুরঞ্জনের দিকে।

মাথা নাড়ে সুরঞ্জন, সে জানে না। অপমানে হায়দারের মুখ নীল হয়ে ওঠে। সে বুঝতে পারে না। সুরঞ্জন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ কেন্দ্রের নেতা হয়েও গণকবর মানে জানে না বলছে কেন। শিবিরের লোকেরা গণকবরের স্মৃতিফলক ভেঙে দিয়েছে, ভেঙে দিক। ওদের হাতে অস্ত্ৰ এখন, অস্ত্ৰ ওরা কাজে লাগাচ্ছে, কে বাধা দেবে ওদের! ধীরে ধীরে ওরা ভেঙে ফেলবে অপরাজেয় বাংলা, স্বোপার্জিত স্বাধীনতা, ভেঙে ফেলবে সাবাস বাংলাদেশ, জয়দেবপুরের মুক্তিযোদ্ধা। এত বাধা দেবে কে? দু-একটা মিছিল মিটিং হবে। জামাত শিবির যুব কমান্ডের রাজনীতি বন্ধ হোক’ বলে কিছু প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল চিৎকার করবে-এই তো! এতে কি হবে, সুরঞ্জন মনে মনে বলে কচু হবে।

হায়দার মাথা নীচু করে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবার পর বলে–শুনেছি তো, পারভিন এখন এখানে। ওর ডিভোর্স হয়ে গেছে।

সুরঞ্জন শোনে, বিনিময়ে কিছু বলে না। পারভিনের ডিভোর্স হওয়াতে তার কোনও কষ্ট হয় না। বরং মনে হয় বেশ হয়েছে। মজা হয়েছে। হিন্দুর কাছে বিয়ে দাওনি, মুসলমানের কাছে দিয়েছিলে, এখন কেমন? পারভিনকে সে মনে মনে একবার রেপ করে। এই সকলে দাঁত মাজা অবস্থায় রেপ তেমন স্বাদের হয় না, তবু মনে মনের রেপ-এ স্বাদ থাকে।

হায়দার কিছুক্ষণ পর বলে—চলি। হায়দারের চলে যাওয়ায় সে আপত্তি করে না।

 

সুধাময় এখন উঠে বসতে পারেন। পেছনে বালিশ রেখে শব্দহীন বাড়িটির শব্দ শোনেন। সুধাময়ের মনে হয় এ বাড়িতে সবচেয়ে বেশি বেঁচে থাকবার সাধ ছিল মায়ার। তাঁর এই দুর্ঘটনাটি না ঘটলে মায়াকে পারুলের বাড়ি থেকে আসতে হয় না, এমন নিখোঁজও হতে হয় না। ওকে নাকি কে লোহার পুলের নীচে পড়ে থাকতে দেখেছে। কিন্তু লাশ দেখতে যাবে কে? সুধাময় জানেন কেউ যাবে না। কারণ সকলে বিশ্বাস করতে চায় একদিন নিশ্চয়ই ফিরে আসবে মায়া। যদি পুলের নীচে পড়ে থাকা লাশটি মায়ারই হয়, তবে তো চিরকালের মত একটি আশা অন্তত বুকে করে বাঁচতে পারবে না। ওঁরা যে মায়া ফিরবে, আজ হোক কাল হোক পরশু হোক ফিরবে, এক বছর দু বছর পাঁচ বছর পর হলেও ফিরে আসবে মায়া। কিছু কিছু আশা আছে মানুষকে বাঁচায়, এই সংসারে বেঁচে থাকবার অবলম্বন এত কম, সামান্য কিছু আশা অন্তত থাক। সুরঞ্জনকে অনেকদিন পর তিনি কাছে ডাকেন। পাশে বসতে বলেন। ভাঙা কণ্ঠে বলেন—দরজা জানালা বন্ধ করে থাকতে বড় লজ্জা হয়।

–তোমার লজ্জা হয়? আমার তো রাগ হয়।

—তোর জন্যও বড় দুশ্চিন্তা হয়! সুধাময় ছেলের পিঠে বাঁ হাতটি রাখতে চান!

কেন?

রাত করে ঘরে ফিরছিস। কাল হরিপদ এসেছিল, ভোলায় নাকি খুব খারাপ অবস্থা। হাজার হাজার লোক খোলা আকাশের নীচে বসে আছে, বাড়িঘর নেই। মেয়েদেরও নাকি রেপ করছে।

—এসব কি নতুন খবর ?

—নতুনই তো। এসব কি আগে কখনও ঘটেছে ? তাই তো তোকে নিয়ে ভয় সুরঞ্জন।

–আমাকে নিয়েই ভয় ? কেন তোমাদের জন্য ভয় নেই। তোমরা হিন্দু নও ?

–আমাদের আর কি করবে ?

—তোমাদের মুণ্ডু বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেবে। এখনও চেননি এ দেশের মানুষকে, হিন্দু পেলে ওরা নাস্তা করবে, বুড়ো ছেলে মানবে না।

সুধাময়ের কপালে বিরক্তির ভাঁজ। তিনি বলেন—এ দেশের মানুষ কি তুই নস?

–না। আমি নিজেকে আর এ দেশের মানুষ ভাবতে পারছি না। খুব চাইছি ভাবতে। কিন্তু ভাবা সম্ভব হচ্ছে না। আগে কাজলদারা বৈষম্যের কথা বলত, খুব মেজাজ খারাপ করতাম। বলতাম বাজে কথা রাখুন তো, দেশে বড় বড় অনেক কাজ আছে, কোথায় হিন্দুদের কি হচ্ছে ক’জন মরছে এসব নিয়ে সময় খরচা করার কোনও মানে আছে ? ধীরে ধীরে দেখছি ওরা ভুল বলে না। আর আমিও কেমন যেন হয়ে যাচ্ছি। এরকম হওয়ার কথা ছিল না বাবা। সুরঞ্জনের কণ্ঠস্বর বুজে আসে।

সুধাময় হাত রাখেন ছেলের পিঠে। বলেন–মানুষ তো রাস্তায় নামছে। প্রতিবাদ হচ্ছে। কাগজে বিস্তর লেখালেখিও হচ্ছে। বুদ্ধিজীবীরা প্রতিদিন লিখছেন।

—এসব করে ছাই হবে। সুরঞ্জনের গলায় রোষ।

দা কুড়োল নিয়ে নেমেছে একদল আর ওদের বিরুদ্ধে হাত উচিয়ে গলা ফাটালে লাভ হবে না কিছু। দায়ের প্রতিবাদ দা দিয়ে হয়। অস্ত্রের সামনে খালি হাতে লড়াই করতে চাওয়া বোকামি।

–আমরা কি আদর্শ বিসর্জন দেব ?

—আদর্শ আবার কি ? বোগাস জিনিস।

সুধাময়ের চুলে এ ক’দিনে আরও পাক ধরেছে। গাল ভেঙে গেছে। স্বাস্থ্য অর্ধেক নেমে এসেছে। তবু মন ভাঙে না তাঁর। বলেন—এখনও তো অন্যায় অনাচারের বিরুদ্ধে কথা বলছে মানুষ। এই শক্তিটি কি সব দেশে আছে ? প্রতিবাদ করার অধিকার ?

সুরঞ্জন কথা বলে না। সে অনুমান করে ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ নামটি উঠে গিয়ে খুব শিগরি এটি ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’-এ পরিণত হবে। দেশে বিরাজ করবে শরিয়তি আইন। মেয়েরা বোরখা পরে রাস্তায় বেরোবে, টুপি দাড়ি পাঞ্জাবিঅ’লা লোক বেড়ে যাবে দেশে, স্কুল কলেজের বদলে শনৈ শনৈ বাড়বে মসজিদ মাদ্রাসা, হিন্দুদের নীরবে ধ্বংস করে দেবে, ভেবে সে শিউরে ওঠে। কুনো ব্যাঙের মত ঘরে বসে থাকতে হয়। বাইরে আন্দোলন দেখলে, প্রতিবাদ প্রতিশোধের শব্দ শুনলে সামিল না হয়ে দরজায় খিল এঁটে বসতে হয়। কারণ তাদের বেলা রিস্ক বেশি। মুসলমানরা অসঙ্কোচে দাবি আদায়ের শ্লোগান দিতে পারে, হিন্দুরা তা পারে না। হিন্দুদের ওপর অবিচার হচ্ছে এই কথাটি যত জোরগলায় একজন মুসলমান বলতে পারে, তত জোরে হিন্দুরা পারে না। কারণ তার গলা আটকে আসে বলতে গেলে, কখন আবার কে রাতের আঁধারে এই জোরগলার জন্য গলাখানি কেটে রেখে যায়, বলা যায় না। আহমদ শরীফকে মুরতাদ ঘোষণা করেও বাঁচিয়ে রাখে ওরা, কিন্তু সুধাময় উল্টোসিধে কথা বললেই নিঃশব্দে কতল হয়ে যেতে হবে। হিন্দুকে অতি মারমুখো দেখলে মৌলভিরা তো নয়ই, কোনও প্রগতিবাদী মুসলমানও তা সহ্য করবে না। সুরঞ্জনের ভেবে হাসি পায় প্রগতিবাদীরা আবার হিন্দু বা মুসলমান নাম ধারণ করে। সুরঞ্জন নিজেকে একজন আধুনিক মানুষ ভাবত। এখন কেমন হিন্দু হিন্দু লাগে নিজেকে। সে কি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে? সে বোধহয় নষ্টই হয়ে যাচ্ছে। সুধাময় সুরঞ্জনকে তাঁর আরও কাছে সরে আসতে বলেন, ভাঙা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন–মায়াকে কি কোথাও পাওয়া যাবে না খুঁজে?

—জানি না।

—কিরণ তো সেই থেকে একটি রাতও ঘুমোয় না। আর তোকে নিয়েও ভাবে। এখন তোর কিছু হলে….

—মরে গেলে মরে যাব। কত লোকই তো মরছে।

—এখন একটু বসতে পারি, কিরণ ধরে ধরে বাথরুমে নিয়ে যায়। পুরো সুস্থ না হলে রোগী দেখাও তো সম্ভব নয়। দু মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি। তুই একটা চাকরি-বাকরি…

—পরের গোলামি আমি করব না।

—সংসারটা আসলে.আমাদের সেই জমিদারিও তো আর নেই। গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ, গোয়ালভরা গরুর স্বাদ আমরা পেয়েছি। তোদের কালে আর কী দেখেছিস; গ্রামের জমিজমা বিক্রি করে ফেলেছিলাম, সেগুলো থাকলেও তো শেষ বয়সে গ্রামে গিয়ে শনের একটি ঘর তুলে বাকি জীবন পার করা যেত।

সুরঞ্জন ধমকে ওঠে–বোকার মত কথা বলছি কেন? গ্রামে গিয়েই বা তুমি বাঁচতে পারতে নাকি? মাতব্বরের লেঠেলরা তোমার মাথায় লাঠি মেরে সব কেড়ে নিত না!

–সবাইকে এত অবিশ্বাস করছিস কেন? দেশে কি দু-একটা ভাল লোকও নেই?

–না নেই।

—তুই অযথা হতাশায় ভুগছিস।

— অযথা নয়।

—তোর বন্ধুবান্ধব? এতকাল যে কম্যুনিজমের ওপর লেখাপড়া করলি, আন্দোলন করলি, যাদের সঙ্গে চললি ফিরলি, ওরা কেউ ভালমানুষ নয়?

—না কেউ নয়। সবাই কম্যুনাল।

—আমার মনে হয় তুইও কিছু কম্যুনাল হয়ে যাচ্ছিস?

–হ্যাঁ হচ্ছি। এই দেশ আমাকে কম্যুনাল করছে। আমার দোষ নেই।

—এই দেশ তোকে কম্যুনাল করছে? সুধাময়ের কণ্ঠে অবিশ্বাস ভর করে।

–হ্যাঁ দেশ করছে। সুরঞ্জন দেশ শব্দটির ওপর জোর দেয়। সুধাময় চুপ হয়ে যান। সুরঞ্জন ঘরের ভাঙা জিনিসগুলো দেখে। ভাঙা কাচ এখনও মেঝোয় ছড়ানো। পায়ে বেঁধে না এসব? পায়ে না বিঁধলেও মনে তো বেঁধে!

 

 

 

১২খ.

সারাদিন ঘরেই শুয়ে থাকে সুরঞ্জন। তার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। কারও সঙ্গে কথা বা যে সময় কাটাবে, সে ইচ্ছেও নেই। একবার কি যাবে লোহার পুলে, একবার তাকাবে নীচের দিকে, মায়ার গলে যাওয়া ফুলে ওঠা শরীরটি দেখতে? না, সে আজ কোথাও যাবে না।

দুপুর পার হলে সুরঞ্জন বাড়ির পাকা উঠোনটিতে হাঁটে। একা এক উদাস হাঁটে। একসময় ঘরে গিয়ে ঘরের বই সব উঠোনে ফেলে। কিরণময়ী ঘরে বসে ভাবেন ও বোধ হয় বই রোদে দিচ্ছে, পোকায় কাটা বই। দাস ক্যাপিটাল, লেনিন রচনাবলি, এঙ্গেলস মার্কস-এর রচনা, মরগ্যান, গোর্কি, দস্তয়েভস্কি, টলস্টয়, জ্যাঁ পল সার্ত্র, পাভলভ, রবীন্দ্রনাথ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, নেহরু, আজাদ…সমাজতত্ত্ব, অর্থনীতি, রাজনীতি, ইতিহাসের থানইট সাইজ বইগুলোর পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে উঠোনে ছড়ায় সুরঞ্জন, জড়ো করে, তারপর ম্যাচের একটি কাঠি জ্বেলে ওতে ফেলে। হিন্দু পেলে উগ্র মুসলমান মৌলবাদী যেমন জ্বলে ওঠে, কাগজ পেলে আগুনও তেমনই দাউ দাউ জ্বলে ওঠে। কালো ধোঁয়ায় ভরে যায় উঠেন। পোড়া গন্ধ পেয়ে দৌড়ে আসেন কিরণময়ী। সুরঞ্জন হোসে বলে—আগুন তাপাবে? এস।

–কিণময়ী অস্ফুট কণ্ঠে বলেন—তুই কি পাগল হয়ে গেছিস?

–হ্যাঁ মা। অনেকদিন ভালমানুষ ছিলাম তো। এবার পাগল হচ্ছি। পাগল না হলে মনে শান্তি পাওয়া যায় না।

কিণময়ী দরজায় দাঁড়িয়ে সুরঞ্জনের যজ্ঞধূম দেখেন। তিনি যে কলতলা থেকে বালতি করে জল এনে আগুনে ফেলবেন, এই বোধও তাঁর লোপ পায়। কালো ধোঁয়ার আড়ালে সুরঞ্জনের শরীর ঢেকে যায়। কিরণময়ীর মনে হয়, সুরঞ্জন আসলে বই নয়, নিজেকে পোড়াচ্ছে।

সুধাময় ভাবেন প্রখর মেধার প্রাণবান ছেলেটি যে নিজেই বিষহরা মন্ত্রের কাজ করত, সে এখন পান করছে বিষ, বিষ পান করে করে ও নীল হয়ে যাচ্ছে, তার নিঃশব্দে শুয়ে থাকা বন্ধুদের সঙ্গে চেঁচিয়ে কথা বলা, রাতে মেয়ে নিয়ে ঘরে ঢোকা, মুসলমানদের গালাগাল করা, বই পোড়ানো…সুধাময় বোঝেন সুরঞ্জন আসলে অভিমান করেছে খুব। সংসার, সমাজ, রাষ্ট্র সকল কিছুর ওপর তীব্র অভিমান করে ও নিজেকে পোড়াচ্ছে হীনমন্যতার অন্ধ আগুনে।

সুরঞ্জনের বেশ আনন্দ হয় আগুন দেখতে। দেশ জুড়ে হিন্দুর বাড়িঘর এমন আগুনেই পুড়েছে। এমন লেলিহান আগুনে। কেবল কি বাড়িঘর আর মন্দিরই পুড়েছে, মানুষের মন পোড়েনি? সুধাময়ের আদর্শ ধুয়ে সুরঞ্জন আর জল খাবে না। সুধাময় বামপন্থী মানুষ, সুরঞ্জনও গড়ে উঠেছিল একই বিশ্বাসে। এসব এখন আর বিশ্বাস করে না সে। সে অনেক বামপন্থীকেও তাকে গাল দিতে দেখেছে ‘শালা মালউন’ বলে। ‘মালাউন’ শব্দটি সে স্কুল থেকে শুনে আসছে। ক্লাসের বন্ধুদের সঙ্গে তর্ক লাগলেই ওরা দু-এক কথার পরই বলত ‘মালাউনের বাচ্চা’। সুরঞ্জনের চোখ জ্বালা করে জল জমে উঠে সে বুঝে পায় না। এই জল কি কোনও কষ্ট থেকে এল, নাকি আদর্শ পোড়া ধোঁয়া থেকে! পোড়া শেষ হলে সুরঞ্জন স্বস্তির শ্বাস ফেলে। শুয়ে থেকে থেকে এই বইগুলোর ওপর এ ক’দিনে যখনই তার চোখ পড়েছে, বইগুলো থেকে নানারকম নীতিকথার কীট তাকে কুরে খেয়েছে। সে আর নীতি-ফীতি মানে না। কষে একটি লাথি লাগাতে পারত যদি এতকালের বিশ্বাসের ওপর। কেন সে ধারণ করবে এসব, জ্ঞানের পেয়ালা মানুষ ঠোঁট পর্যন্ত ঠেকায়, অন্তরে নেয় না। অন্তরে একা নেবে কেন সে?

যজ্ঞ শেষে লম্বা একটি ঘুম দিতে চায় সে। ঘুম আসে না। রত্নাকে মনে পড়ে। অনেকদিন দেখা হয় না। কেমন আছে মেয়েটি। রত্নার গভীর কালো চোখদুটো পড়া যায়, ওর আর কথা বলবার প্রয়োজন হয় না। ও নিশ্চয়ই ভাবছে হঠাৎ একদিন ওর বাড়ির দরজায় কড়া নাড়বে সুরঞ্জন, চায়ের সঙ্গে জীবনের গল্পগুলো পেতে বসলে রাত পার হয়ে যাবে। সুরঞ্জন ভাবে আজ রাতে সে যাবে রত্নার বাড়িতে। বলবে—কেবল কি আমিই দেখতে আসব? আর কারও কি ইচ্ছে করে না কাউকে দেখতে যাবার?

সুরঞ্জনের বিশ্বাস হয় রত্না হঠাৎ এক বিষয় বিকেলে তার বাড়িতে উঠবে এসে বলবে–কেমন জানি খালি খালি লাগে সুরঞ্জন ৷ ‘ সুরঞ্জনকে কতদিন চুমু খায় না কেউ। পারভিন খেত। পারভিন তাকে জড়ীয়ে ধরে বলত, ‘তুমি আমার, আমার, আমার ছাড়া আর কারও না, তোমাকে আজ একশ চুমু খাব।‘ ঘরে হঠাৎ কিরণময়ী ঢুকে পড়লে ওরা বিযুক্ত হত। মুসলমানের সঙ্গে বিয়ে হলে বুট-ঝামেলা নেই, সেরকম জীবনই সে বেছে নিয়েছিল। রত্নার তো আর ‘জাত’-এর প্রবলেম নেই। ওর কাছেই সমৰ্পণ করবে। এই পোড়খাওয়া জীবন। সুরঞ্জন যখন এরকম ভাবছে, আজ রাতে সে যাবে, শরীরে যত বুল কালি জমেছে। সব ধুয়ে, ধোয়া একটি শার্ট গায়ে দিয়ে সে রত্নার বাড়িতে যাবে–তখনই দরজায় টোকা পড়ে। দরজা খুলে দেখে রত্না দাঁড়িয়ে আছে। বেশ সেজেছে। ঝকমকে শাড়ি, হাত ভর্তি চুড়ি, রিন রিন করে বাজলও বোধহয়। রত্না মিষ্টি করে হাসছে, ওর হাসি সুরঞ্জনকে বিস্মিত ও অভিভূত করে। ‘আসুন ভেতরে আসুন’ বলতে বলতেই সে লক্ষ করে সুদৰ্শন এক ভদ্রলোক রত্নার পেছনে দাঁড়ানো।

রত্নাকে সে বসাবে কোথায়। যে বিচ্ছিরি অবস্থা ঘরের। তবু ‘বসুন বসুন’ বলে ভাঙা চেয়ারটি এগিয়ে দেয়। রত্না হেসে বলে—বলুন তো কাকে নিয়ে এসেছি?

রত্নার দাদাকে দেখেনি সুরঞ্জন। ভাবে সে-ই কি না। সুরঞ্জনকে বেশি ভাবতে দেয় না। রত্না, তার হাতের চুড়ির মত রিন রিন হেসে বলে—ওর নাম হুমায়ুন, আমার বর।

বুকের মধ্যে মুহুর্তে এক ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়, ঝড়ে তার যে শেষ বৃক্ষটি ছিল আকড়ে ধরবার, সেটিও শেকড়সুদ্ধ উপড়ে পড়ে। জীবনের অনেকটা বছর হেলায় হারিয়ে বড় ইচ্ছে ছিল বাকি জীবন রত্নাকে নিয়ে একটি ছোটখাট সংসার করবে। আর রত্না কিনা মুসলমান স্বামী নিয়ে এই সন্ত্রাসের দেশে বেঁচে থাকবার বিকল্প ব্যবস্থা নিয়েছে! সুরঞ্জন অপমানে ক্ৰোধে নীল হয়ে ওঠে। সে এখন তার এলোমেলো দরিদ্র ঘরটিতে রত্না আর তার সুদৰ্শন সম্ভবত বিত্তবানও, স্বামীকে বসিয়ে ভালমানুষের মত ভাল ভাল কথা বলবে, তার সঙ্গে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডসেক করবে, চা খেতে দেবে, যাবার সময় হেসে বলবে ‘আবার আসবেন’! না, সুরঞ্জন এসব কিছুই করবে না। এসব ভদ্রতা তার করতে ইচ্ছে করছে না। সে হঠাৎ ঘরের অতিথি দুজনকে অবাক করে দিয়ে বলে—’আমি খুব জরুরি কাজে বাইরে বেরোচ্ছি, আপনাদের সঙ্গে কথা বলার সময় আমার নেই।‘ ওরা এত অপমানিত হয় যে ‘দুঃখিত বলে দ্রুত বেরিয়ে যায়। সুরঞ্জন দরজার পাল্লাদুটো শব্দ করে লাগায়, লাগিয়ে পিঠ ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, তার সম্বিত ফেরে কিরণময়ী ঘরে ঢুকে যখন বলেন–যে টাকা কটা ধার করেছিলি, ফিরিয়ে দিয়েছিস তো? ‘ধার’ শব্দটি বিষমখা তীরের মত বেঁধে সুরঞ্জনের বুকে। সে কিরণময়ীর উদ্বিগ্ন মুখের দিকে তাকায় শুধু, কিছু বলে না।

রঞ্জনের বড় দমবন্ধ লাগে। ঘরটি যেন একটি লোহার বাক্স, খুলে সে বেরোতে পারছে না। বরান্দায় হাঁটে কিছুক্ষণ, তবু তার ওপর শ্রাবণের বৃষ্টির মত কেঁপে নামে এক আী শ দুঃখ। কিরণময়ী নিঃশব্দে এক কাপ চা রেখে যান টেবিলে। সুরঞ্জন দেখে, কিন্তু চাত্রে দিকে হাত বাড়ায় না। খানিকক্ষণ শোয়, আবার ওঠে, সে কি একবার লোহার পুল যাব? লোহার পুলের কথা ভাবতে গেলেই বুক কেঁপে ওঠে, মনে হয় তারও লাশ বুঝি গলে পচে পড়ে থাকবে নীচের নর্দমায়। বাড়িটি একটি স্থবির ডোবার মত নিস্তব্ধ। জহির ওপর জলপোকা যেমন নিঃশব্দে চলে, নিস্তব্ধতার মধ্যে বাড়ির তিনটি প্রাণী তেমন জলপাকার মত হাঁটে, কেউ কারও পায়ের শব্দ শুনতে পায় না।

হঠাৎ সব ভুতুড়ে নিস্তব্ধতা ভেঙে দেন কিরণময়ী। কোনও কারণ নেই, কিছু নেই, সুধাময়কে তিনি এক কাপ চা দিয়েছেন কিছুক্ষণ আগে–তিনি কেঁদে ওঠেন, তাঁর কান্নার তীব্র শব্দে সুধাময় চকিতে উঠে বসেন, সুরঞ্জন ছুটে আসে। দেখে কিরণময়ী ঘরের দেয়ালে মাথা রেখে কাঁদছেন, তার সাহস হয় না এই কান্না থামাতে, এ কান্না থামবার নয়, এই কান্না কেঁদে যাবার, দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনীর জল যখন জমতে জমতে বুকের নদী উঠি পড়তে চায়, কোনও বাঁধ থাকে না তাকে আটকে রাখে। সুধাময়ও নতমুখ, স্থির; কান্না থেকে উঠে আসা তীব্ৰ হাহাকার তাঁর বুকেও গিয়ে বেঁধে। কান্না থামে না। কেন কাঁদছেন কিরণময়ী কেউ জিজ্ঞেস করে না; কেন তাঁর এত বুকফাটা আর্তনাদ, তা সুধাময় সুরঞ্জন দুজনই যেন জানে, তাদের আর জানিবার দরকার হয় না।

সুরঞ্জন দরজায় দাঁড়িয়েছিল, নিঃশব্দে ঘরে ঢোকে যেন কিরণময়ীর কান্না তার পায়ের শব্দে থেমে না যায়। তাঁর ভেতরের ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ে, চূর্ণ হয়, পুড়ে যায়, ছাই হয়ে যায় তার সাজানো স্বপ্ন। কিরণময়ী যেমন হঠাৎ বাড়িটির নিস্তব্ধতা ভেঙে কেঁদে উঠছেন, তেমন সুরঞ্জনও হঠাৎ কান্না ভেঙে চিৎকার করে ওঠে–বাবা।

সুধাময় চমকে তাকান। সুরঞ্জন তাঁর দুটো হাত চেপে ধরে, বলে–বাবা, আমি কাল সারারাত একটা কথা ভেবেছি, তুমি আমার কথা রাখবে না জানি। তবু বলছি তুমি আমার কথা রাখো। কথাটা রাখো বাবা। চল আমরা চলে যাই।

সুধাময় জিজ্ঞেস করেন—কোথায়?

–ইন্ডিয়া।

–ইন্ডিয়া? সুধাময় এমন আঁতকে ওঠেন যেন অদ্ভুত একটি শব্দ শুনলেন তিনি, যেন ইন্ডিয়া অত্যন্ত অশ্লীল একটি শব্দ, একটি নিষিদ্ধ শব্দ, এটি উচ্চারণ করা অপরাধ।

কিরণময়ীর কান্না ধীরে ধীরে থেমে আসে। গোঙাতে থাকেন। তিনি, গোঙাতে গোঙাতে মেঝেয় উপুড় হয়ে পড়ে। সুধাময়ের কপালে বিষম বিরক্তির ভাঁজ, বলেন–ইন্ডিয়া তোর বাবার বাড়ি না ঠাকুদদার বাড়ি? তোর চৌদ্দ গোষ্ঠীর কার বাড়ি ইন্ডিয়া যে ইন্ডিয়া যাবি? নিজের দেশ ছেড়ে পালাতে চাস, লজ্জা করে না?

–দেশ ধুয়ে জল খাব বাবা? দেশ তোমাকে কি দিচ্ছে? কি দিচ্ছে আমাকে? মায়াকে কি দিয়েছে তোমার এই দেশ? মা’কে কেন কাঁদতে হয়? তোমাকে কোন রাতে রাতে গোঙাতে হয়? আমার কেন ঘুম আসে না?

–দাঙ্গা তো সব দেশেই হয়। ইন্ডিয়ায় হচ্ছে না? ওখানে মরছে না মানুষ? কত লোক মরছে খবর রাখিস?

–দাঙ্গ তো ভাল জিনিস বাবা, এখানে দাঙ্গা হচ্ছে না, এখানে মুসলমানরা হিন্দুদের মারছে।

—নিজেকে হিন্দু ভাবছিস তুই? সুধাময় উত্তেজিত হয়ে বিছানা থেকে উঠতে চান। তাঁকে দু হাতে থামিয়ে সুরঞ্জন বলে—যত নাস্তিকই হই আমরা যত মানবতাবাদীই হই লোকে আমাদের হিন্দুই বলবে। মালাউনই বলবে। এই দেশকে যত ভালবাসাব, যত আপন ভাবব, এই দেশ আমাদের তত দুরে সরাবে। মানুষকে যত ভালবাসাব, মানুষ তত একঘরে করবে আমাদের। এদের বিশ্বাস নেই বাবা। তুমি তো কত মুসলমান পরিবারকে বিনে পয়সায় চিকিৎসা কর। এই দুর্যোগের দিনে তারা ক’জন তোমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে? আমাদের সবাইকে মায়ার মত লোহার পুলের নীচে মরে পড়ে থাকতে হবে। বাবা, চল চলে যাই। সুরঞ্জন ঝুঁকে পড়ে সুধাময়ের ওপর।

–মায়া ফিরে আসবে।

—মায়া ফিরবে না বাবা। মায়া ফিরিবে না। সুরঞ্জনের কণ্ঠ থেকে এক থোকা কষ্ট উঠে আসে।

সুধাময় শুয়ে পড়েন। শিথিল হয়ে পড়ে শরীর তাঁর। বিড়বিড় করে বলেন–মায়াকেই যদি রক্ষা করা গেল না, কাকে রক্ষা করতে যাব?

— নিজেদের। যেটুকু হারিয়েছি, সেটুকুর জন্য শোক করার জন্য এখানে বসে থাকব? এই ভয়ঙ্কর নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে? তার চেয়ে চল চলে যাই।

—ওখানে কি করব?

–ওখানে যা হোক কিছু করব। এখানেই বা কি করছি? আমরা কি খুব ভাল আছি? খুব সুখে?

—শেকড়হীন জীবন।

—শেকড় দিয়ে কি করবে বাবা? শেকড় দিয়ে যদি কিছু হোতই তবে ঘরের দরজা জানোলা বন্ধ করে বসে থাকতে হয় কেন? সারা জীবন এমন কুনো ব্যাঙের জীবন কাটাতে হবে। এরা কথায় কথায় আমাদের বাড়িঘরে হামলা করার, আমাদের জবাই করার অভ্যোস রপ্ত করে ফেলেছে। এরকম ইঁদুরের মত বেঁচে থাকতে আমার লজ্জা হয় বাবা। বড় রাগ হয়। আমি কিছু করতে পারি না। রাগ হলে আমি কি ওদের দুটো বাড়ি জ্বালিয়ে দিতে পারব? আমরা কি এমন বোকার মত তাকিয়ে তাকিয়ে আমাদের সর্বনাশই দেখব? কথা বলার, কোনও মুসলমান আমার গালে এক চড় দিলে তাকে উল্টে চড় দেবার অধিকার কি আমার আছে? চল চলে যাই।

—-এখন তো শাস্ত হয়ে আসছে পরিস্থিতি। এত ভাবছিস কেন? আবেগে ভর করে জীবন চলে না।

–শান্ত হয়ে আসছে? সব ওপরে ওপরে। ভেতরে হিংস্ৰতা আছেই। ভেতরে ভয়ঙ্কর দাঁত নখ বের করে ওরা ফাঁদ পেতে আছে। তুমি ধুতি ছেড়ে আজ পাজামা পর কেন? কেন তোমার ধুতি পরবার স্বাধীনতা নেই? চল চলে যাই।

সুধাময় দাঁতে দাঁত পেষেন রাগে, বলেন–না। আমি যাব না। তোর ইচ্ছে হয় তুই চলে যা।

—যাবে না তুমি?

–না। ঘৃণায়, বিরক্তিতে মুখ ফিরিয়ে নেন সুধাময়।

—আবারও বলছি বাবা, চল ঘাই চল। সুরঞ্জন বাবার কাঁধে হাত রেখে নরম স্বরে বলে। স্বরে তার কষ্ট থাকে, কান্না থাকে।

সুখময় কষ্ঠে আগের সেই দৃঢ়তা নিয়েই বলেন—না।

এই না’ শব্দটি সুরঞ্জনের পিঠে ইস্পাতের চাবুকের মত পড়ে। ‘

সুরঞ্জন ব্যর্থ হয়। সে জানত সে ব্যর্থ হবে। সুধাময়ের মত কঠিন চরিত্রের মানুষটি লাথিঝাঁটা খেয়েও মাটি কামড়ে পড়ে থাকবেন। মাটির সাপ বিছুরা তাঁকে কামড়াবে, তবু তিনি মাটিতেই কামড় দেবেন, মাটিতেই মুখ থুবড়ে পড়বেন।

কিরণময়ীর কান্না থেমেছে। তিনি ঝুঁকে আছেন একটি রাধাকৃষ্ণের ছবির সামনে। এর আগে সুরঞ্জন একটি গণেশের মূর্তি দেখেছিল। ঘরে, সম্ভবত মুসলমানেরা ওটি ভেঙে ফেলেছে। গোপনে কোথাও হয়ত কিরুণাময়ী লুকিয়ে রেখেছিলেন রাধাকৃষ্ণের এই ছবিটি, এটিকে সামনে নিয়ে তিনি ঝুঁকে আছেন, ভগবান কৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করছেন নিরাপত্তার,  নির্ভাবনার, নিশ্চয়তার, নিরুপদ্রব জীবনের।

নিরাশার উজান-জলে সুরঞ্জন একা একা সাঁতরায়। রাত হয়। রাত গভীর হয়। বড় একা লাগে তার। কেউ নেই, কেউ সহায় নয় তার। নিজ দেশে নিজেকে পরবাসী বলে মনে হয়। নিজের যুক্তি-বুদ্ধি বিবেকসহ সে গুটিয়ে যেতে থাকে নিজের ভেতর। তার উদারতা, সহিষ্ণুতা, যুক্তিবাদী মন হরতাল কারফিউ আর সন্ত্রাসের দেশে ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে আসে, ভয়ংকর এক একাকীত্ব তাকে নিঃশেষ করে আনে, সে তার দরজা জানালা বন্ধ করা ঘরে নিঃশ্বাস নেবার অমল হওয়া পায় না। যেন ভয়াবহ কোনও মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে সবাই। এখন আর মায়ার জন্য নয়, নিজের ভবিষ্যতের আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে সবার হৃদয়। তারা একা হয়ে যাচ্ছে, চেনা লোকেরা, মুসলমান বন্ধু বা পড়শি দেখতে আসছে কিন্তু কেউ বলতে পারছে না—আমাদের যেমন নিশ্চয়তা আছে জীবনের, তোমাদেরও আছে। তোমরা কুষ্ঠিত হয়ো না। কুঁকড়ে থেকে না। তোমরা নিৰ্ভয়ে হাঁটো, নির্বিঘ্নে কাজ কর, প্রাণখুলে হাসো, নিশ্চিন্তে ঘুমাও।

সারারাত এক ভয়ঙ্কর অস্থিরতা সুরঞ্জনকে ছিড়ে খায়।

লজ্জা (১৩) শেষ রাতের দিকে ঘুম পায় সুরঞ্জনের

শেষ রাতের দিকে ঘুম পায় সুরঞ্জনের। ঘুমের মধ্যে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখে সে। এক একটি নদীর পাড়ে সে হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে দেখে নদীর একটি উন্মত্ত ঢেউ তাকে নিয়ে যাচ্ছে গভীরে, সে পাকে পড়ছে, তলিয়ে যাচ্ছে, সে বাঁচতে চাইছে, কেউ নেই তার অসহায় হাতটি ধরে তাকে ডাঙায় তোলে। সে ঘামতে থাকে, তলিয়ে যেতে থাকে যুঁসে ওঠা অচেনা জলে। এমন সময় একটি শান্ত স্নিগ্ধ হাত তাকে স্পর্শ করে, জাগায়। সুরঞ্জন চমকে ওঠে। ভয়ে বিকৰ্ণ হয়ে ওঠে তার মুখ। পাক খাওয়া জল তাকে ডুবিয়ে নিচ্ছিল, সে প্রাণপণ চিৎকার করছিল, একটি খড়কুটোও আঁকড়ে ধরবার জন্য সে হাত বাড়াচ্ছিল স্বপ্নের মধ্যে, যেন একটি হাত সে পেয়ে গেছে, তাকে উদ্ধার করবার জন্য একটি হাত এগিয়ে এসেছে, সুরঞ্জন তেমন আঁকড়ে ধরে সুধাময়ের শক্তিমান হাত।

কিরণময়ীর কাঁধে ভর রেখে তিনি হেঁটে এসেছেন। অল্প অল্প শক্তি ফিরেছে তাঁর শরীরে। তিনি সুরঞ্জনের শিয়রে বসেন। তাঁর চোখে দূর নক্ষত্রের আলো।

–বাবা?

একটি বোবা জিজ্ঞাসা সুরঞ্জনের ধুকপুক করা অন্তরে। তখন ভোর হচ্ছে। জানালার ছিদ্ৰ ফুঁড়ে আলো আসছে। সুধাময় বলেন–চল আমরা চলে যাই।

সুরঞ্জন বিস্মিত হয়। জিজ্ঞেস করে—কোথায় যাব বাবা?

সুধাময় বলেন–ইন্ডিয়া।

সুধাময়ের বলতে লজ্জা হয়, তাঁর কণ্ঠ কাঁপে, তবু তিনি চলে যাবার কথা বলেন; কারণ তাঁর ভেতরে গড়ে তোলা শক্ত পাহাড়টিও দিনে দিনে ধসে পড়েছে।

Exit mobile version