Site icon BnBoi.Com

ভ্রমর কইও গিয়া – তসলিমা নাসরিন

ভ্রমর কইও গিয়া - তসলিমা নাসরিন

০১. বাবা খুব ঘটা করে

বাবা খুব ঘটা করে আমার বিয়ে দিয়েছিলেন। ছেলে দেখতে ভাল, চরিত্রবান, মদ বা মেয়েমানুষের নেশা নেই। ভাল চাকরি করে। পাড়ায় তার সুনাম আছে। এমন ছেলে পছন্দ না হয়ে উপায় আছে! আমি তখন সবে হায়ার সেকেণ্ডারি দিয়েছি। দেখতে সুন্দরী। লোকে বলে, তাছাড়া আয়নায় দেখি। গায়ের রঙ ফর্সা, খাড়া নাক, চোখ বড় বড়, চিকন ঠোঁট। লম্বায় আমি পাঁচফুট পাঁচ। আর কী চাই! ছোটবেলায় খালারা বলতেন—’হীরার আর চিন্তা কী! ভাল জামাই পাবে।’ আমার ঘন কালো চুল পিঠের নিচে পড়ে। মা রিঠা দিয়ে চুল ধুয়ে দিতেন আর বলতেন–এমন মেয়ে লাখে নেই। আমি যে ভাল বিকোব, তা আমার বারো বছর বয়স থেকেই আমাকে জানানো হয়েছে। আমার এক ফুপু আমার দু’বছরের বড়, তিনি প্রায়ই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন-তোমার তো লেখাপড়া না করলেও চলবে।

আমি বলতাম–কেন?

ফুপু বলতেন–তোমার তো ভাল বিয়ে হবেই। ভাইজান বলেছেন এখন থেকেই নাকি বড় বড় বিয়ের ঘর আসছে তোমার।

ফুপু চাইতেন তাঁরও বিয়ে হয়ে যাক, পড়ালেখার ঝামেলা চুকুক। কিন্তু চাইলেই কী। হয়। ফুপু ছিলেন খাটো, কালো, তায় দাঁত উঁচু। ফুপুর পার হতে যে সময় লাগবে তা ফুপুও বুঝতেন।

আমি খুব বেশি সুন্দরী বলে স্কুল কলেজে কখনও আমাকে একা যেতে দেওয়া হয়নি। সঙ্গে একটি লোক দেওয়া হত। কবে আমার বিয়ে হবে আর এইসব পাহারা থেকে মুক্ত হব আমি সেকথাই ভাবতাম। আলতাফকে সবাই যখন পছন্দ করল আমার আপত্তি করবার কিছু ছিল না। আপত্তি করবই বা কেন, কার জন্য? এমন কেউ তো ছিল না যার জন্য বাড়ির পছন্দে ভেটো দেব। বাদলের সঙ্গে যেটুকু কথা হত, চোখে চোখেই হত। ও আমার এক ক্লাস উপরে পড়ত। আমাকে যেচে নোট দিত, সালেহার হাতে পাঠাত। সালেহা ছিল আমার ক্লাসমেট, ওদিকে বাদলের বোন। ওর নোটের ভেতর ছোট ছোট চিঠি থাকত। আমাকে ভালবেসে তার মরে যেতে ইচ্ছে করে এইসব লেখা থাকত চিঠিতে। আমি কখনও কোনও উত্তর দিইনি, বাদলকে যে আমার ভাল লাগত না তা নয়। আসলে আমার ভয় করত খুব, বাবাকে ভয়, রাস্তার ছেলেপেলেদের দিকে তাকাতে বারণ ছিল বাবার। বলতেন—’কলেজে সোজা যাবে, সোজা আসবে। কোনও দিকে তাকাবে না। লোকে যেন ভাল বলে এই ভাবে চলবে। কোনও বদনাম যেন কেউ করতে না পারে।’ আলতাফের সঙ্গে বিয়ে হলে সারাজীবন আমি রাজরাণী হয়ে থাকব এমন কথা আমার আত্মীয় স্বজন বলেছে, পাড়া পড়শিও বলেছে। রাজরাণী হবার খুব যে ইচ্ছে আমার ছিল তা নয়। কিন্তু বাবা মা আর বড় দুই ভাইএর স্বপ্নকে ভেঙ্গে দেব এমন ইচ্ছে আমার হয়নি কখনও, তাই ওঁরা আমাকে লক্ষ্মী মেয়ের মত যেদিন বিয়ের পিড়িতে বসতে বললেন, আমি বসেছি।

.

আলতাফ পি ডব্লু ডির ইঞ্জিনিয়ার। গুলশানে বাড়ি আছে নিজেদের। ইস্কাটন থেকে ফুল সাজানো গাড়ি করে আমি গুলশানে চলে এসেছি সে অনেকদিন। আলতাফ সুদর্শন যুবক একথা মানতে আমার কোনও আপত্তি নেই। বিয়ের আগে ওর সঙ্গে আমার কোনও কথা হয়নি। বাবা দেখেছেন, বাড়ির সবাই দেখেছে, আমার দেখবার দরকার কী! ছবি দেখেছি শুধু। ফুপু বলেছেন–কী যে সুন্দর তোমার বর, দুজনে চমৎকার মানাবে। আমাদের যে. মানাবে ভাল, তা আমিও মনে মনে বুঝতাম। সুন্দরের প্রতি আমার পক্ষপাত তো ছিলই সবসময়। কিন্তু বিয়ের একমাসের মধ্যে আমি যখন সুটকেস নিয়ে বাবার বাড়ি ফেরত এলাম, সবাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল–আলতাফ কোথায়?

–আসেনি। আমি একা এসেছি। আমার নির্লিপ্ত উত্তর।

–একা? একা কেন?

এর উত্তর আমার জানা ছিল না। বিত্তবান চরিত্রবান স্বামী রেখে বাবার বাড়ি একা একা চলে আসা যে উচিত হয়নি আমার, তা আমাকে বাড়ির সবাই তাদের কথা এবং ব্যবহারে বুঝিয়ে দিল। বাবার বাড়িতে বেশিদিন থাকা হয় না আমার। শাশুড়ি নিজে গিয়ে নিয়ে আসেন। বলেন–’বিয়ের পর ঘন ঘন বাবার বাড়ি এলে লোকে খারাপ বলে। আমার মা বাবাও বলেন—’ওঁরা যখন আসতে বলবেন, তখন এস। নিজের ইচ্ছেয় এস না আর। বিয়ে হয়েছে, এখন ওঁরা যা বলেন, যেভাবে চলতে বলেন, সেভাবে চলবে। নাহলে লোকে ভাল বলবে কেন?’

আমার মা চিরকালই লোকের ভাল কথা শুনতে চান। লোকে যদি মন্দ বলে তাই আমার কোনও ইচ্ছে টিচ্ছের দাম দেওয়া যাবে না। স্বামী শাশুড়ির যত্ন করলে লোকে নাকি ভাল বলে, তাই মন দিয়ে ওঁদের যত্ন করতে হবে। ওঁরা যেন আমার ওপর কিছুতেই অসন্তুষ্ট না হন।

শ্বশুর শাশুড়ি আমার ওপর সন্তুষ্ট কি না আমি ঠিক বুঝতে পারি না। আমাদের জন্য যে ঘরটি বরাদ্দ, আমাদের বলতে আমার এবং আলতাফের শোবার জন্য, সেই ঘরটিতেই বেশির ভাগ সময় আমার কাটে। বিয়ের পর পর আলতাফ আমাকে বলেছে–প্রথম প্রথম একটু আরাম করে নাও, এরপর তো সব দায়িত্ব তোমাকেই নিতে হবে। প্রথম প্রথম আরাম করব এরপর আর আরাম করা হবে না এইসব কথা আমাকে খুব ভাবাত। আমি ফিরে জিজ্ঞেস করতাম–আচ্ছা গো সব দায়িত্ব আমাকেই নিতে হবে কেন, তুমি নেবে না?’ আলতাফ হেসে বলত—’বোকা মেয়ে, আমার বাইরে বাইরে থাকতে হয় না? তুমি ঘরে থাকো, তুমিই সংসারের সব দায়িত্ব নেবে।’—’কী রকম দায়িত্ব শুনি?’—’যেমন ধর বাজার করানো, রান্নাঘরের কাজ করানো, বাড়িঘর দেখাশুনো, তারপর আমার যত্নআত্তি। মা কি এখনও আমার সেবা করবেন, বল? ঘরে এখন বউ এসেছে। আমার আর চিন্তা কী।’ এসব বলতে বলতে আলতাফ আমার কোমর জড়িয়ে ধরত।

আমি হঠাৎ হঠাৎ নিজেকে প্রশ্ন করতাম আলতাফের বাড়িতে আমি থাকি কেন? প্রশ্নের উত্তর অবশ্য নিজেই পেতাম, যেমন আলতাফকে আমার সুখ দিতে হবে, শারীরিক এবং মানসিক সুখ; আলতাফের ঘরবাড়ির শোভা আমাকে বৃদ্ধি করা। নিজেকেই আবার প্রশ্ন করতাম আমার শোভা কে বৃদ্ধি করবে? আমার শোভা তো আমার ত্বকের রঙ ও মসৃণতা, আমার চুলের দৈর্ঘ্য, আমার কোমর নিতম্ব আর বুকের গঠন–সে আমাকেই তলে তলে রক্ষা করতে হবে। মা যেমন বিয়ের আগে চুল এবং ত্বকের যত্ন করতে শেখাতেন, বিয়ের পর সেই প্রক্রিয়াকেই টেনে নিতে হবে। স্বামী আমাকে শোভা বর্ধক দেবে, অর্থাৎ শাড়ি দেবে, গয়না দেবে, কসমেটিকস দেবে। বিনিময়ে তাকে আমার জীবনের সবটুকু দিতে হবে। আমার মান মর্যাদা, ব্যক্তিত্ব সব। আমার কোনও পৃথক ইচ্ছে টিচ্ছে, আমার কোনও স্বপ্ন সাধ তখন আর স্বীকৃত নয়। আর কবেই বা ইচ্ছের মর্যাদা পেয়েছি? এই যে বিয়ে বসেছি, এই যে আমার লেখাপড়া হঠাৎ থামিয়ে আমি স্থবির জীবনে প্রবেশ করতে এতটুকু কুণ্ঠিত হইনি–সে তো দশটা লোকের শেখানো বলে। আমি আমার দাদি নানি মা খালা ফুপুর কাছে শিখেছি যে ছেলেরা মনে যা চাইবে তা করবে আর মেয়েরা, ছেলেরা যা করাবে, তা করবে। দাদি নানি মা এঁরা কখনও তাঁদের স্বামীদের আদেশ ছাড়া এক পাও বাইরে বেরোতো না। আমাকেও তারা সেরকম শেখাতে চাইছেন যে আমিও যেন তাদের মত হই, সমাজের আর দশটা মেয়ে মানুষের মত হই। আমি অবশ্য সেরকমই গড়ে উঠছিলাম, সেরকম করেই আমার বোধ বুদ্ধির সীমানা তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু অল্প অল্প করে সীমানা অতিক্রম করবার ইচ্ছে হল আমার। কেন হল, কী করে হল আমি বুঝতে পারি না। তবে এটুকু বুঝি, হল বলেই আমি স্বামীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে পেরেছি। একা বাবার বাড়ি উঠে আমি বলতে পেরেছি–’হ্যা একলা এলাম।‘

কেন এলাম এই প্রশ্ন উঠেছে। মধ্যরাত পর্যন্ত পারিবারিক বৈঠকে এই প্রশ্ন নিয়ে সবাই মাথা ঘামিয়েছেন। আমি কিছুই বলিনি। নিরুত্তর থেকেছি। আমার নিরুত্তর থাকা নিয়ে ওঁদের কৌতূহলের শেষ নেই। ওঁদের বিস্ময়ের সীমা নেই। তারপর যখন স্বামী শাশুড়িরা আমাকে নিয়ে আসতে গেলেন আমার ইচ্ছে ছিল না আসবার। আসতে হল কারণ কার কাছে থাকব আমি? বাবা মা ভাইদের কাছে? ওঁরাই তো আমাকে রাখতে রাজি নন। ওঁরাই তো আমাকে ঠেলে পাঠান স্বামীর বাড়িতে।

০২. আলতাফ মদ খায় না

আলতাফ মদ খায় না। মেয়েমানুষ দেখলে ছোঁক ছোঁক করে না। সবই আমি স্বীকার করি। সে কি আমাকে গালমন্দ করে? না তাও করে না। বরং বুকের মধ্যে জড়িয়ে। বলে ‘ও আমার হীরে। ও আমার সোনা বউ।‘ অফিস থেকে ফিরেই ‘হীরা হীরা হীরা। হীরা কাছে বস। হীরা হাসো। হীরা মুখ তোল। হীরা কী আর মুখ তোলে! হীরার তো মুখ তুলতে ইচ্ছে করে না। হীরা তুমি কি খেতে ভালবাস? চল আজ সোনার গায়ে খাই। চল লং ড্রাইভে কোথাও যাই। হীরার কি আর যেতে ইচ্ছে করে। ভাল না লাগায় পেয়েছে তাকে। সে কেন যাবে?

মা আসেন। আশংকা তিরতির করে কাঁপে তাঁর চোখের তারায়। আমাকে আড়ালে ডেকে মা জিজ্ঞেস করেন–আলতাফ কি তোর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে? আমি জানালায় উদাস তাকিয়ে উত্তর দিই–না।

–তোর শ্বশুর শাশুড়ি, ওঁরা কী তোকে ভালবাসেন না? মা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করেন।

–বাসেন। আমি দু’আঙুলে জানালার শাদা গ্রিলগুলোর ময়লা তুলতে তুলতে বলি।

–আর আলতাফ?

–আলতাফও। আমার স্বরে যথেষ্ট সংযম।

–সময় মত ফেরে অফিস থেকে?

–ফেরে।

–তোকে কি রান্নাবান্ন করতে বলে?

–না। ও তো কাজের লোকেহ করে।

— বেড়াতে টেড়াতে নয়?

–হ্যাঁ নেয়। সেদিন চিটাগাং গেলাম।

–তবে? তুই থাকতে চাস না কেন? হয়েছে কী তোর?

এর কোনও উত্তর আমি দিতে পারি না। আমি বোঝাতে পারি না কেন আমার ভাল লাগে না। কেন আলতাফের মত চমৎকার এক যুবককে আমি ভালবাসতে পারছি না। কেন এক হৃদয়বান চরিত্রবান স্বামীর ঘর ছেড়ে আমি বারবারই চলে যেতে চাই। বাবাও একদিন গুলশানে আমার স্বামীর বাড়ি এলেন। থমথমে মুখ। তাঁকে বললাম–বস চা টা দিই। না তিনি বসবেন না। আমার সঙ্গে জরুরি কথা বলবেন।

–কী কথা?

–তোর প্রব্লেম কী বল?

–প্রব্লেম মানে?-

-তুই বাড়ি যাবার জন্য কান্নকাটি করছিস?

–হ্যাঁ করছি।

–কেন? তোর কি খাওয়া পরার অভাব?

–না।

–যা দরকার আলতাফ কি সব দেয় না?

–মানে?

–মানে এই কসমেটিকস্, শাড়ি কাপড়, যখন যা লাগে টাকা পয়সা?

–হ্যাঁ দেয়।

–তবে?

এর কোনও উত্তর আমি দিতে পারি না। বাবা আমাকে যাবার সময় বলেন ‘আসলে প্রব্লেম তুই নিজেই। এত ভাল একটা ছেলে পেয়েছিস, মনে ধরছে না। আলতাফ হীরের টুকরো ছেলে, ওকে পাওয়া ভাগ্যের কথা। ঢাকা শহর খুঁজে বার কর তো এরকম দ্বিতীয় একটি ছেলে! তোর এত অহংকার কিসের? বেশি সুখে আছিস তো, টের পাচ্ছিস না। এখনও সময় আছে নিজেকে সংশোধন কর।‘

নিজেকে সংশোধনের কিছু খুঁজে পাই না আমি। আমার কোনও কিছু নিয়ে আলতাফ এখন পর্যন্ত আপত্তি করেনি। আমি যে বিয়ের একমাসের মাথায় বাবার বাড়ি চলে গিয়েছিলাম এ নিয়েও আলতাফ কিছু বলেনি, একবারও জিজ্ঞেস করেনি কেন গিয়েছিলে, বরং চলে যে এলাম তাতেই বোধহয় ও একটু অবাক হয়েছে। অবাক হবার তো কথাই। আসলে যত আপত্তি আমার বাবা মায়ের, শ্বশুর শাশুড়ির। আমি নাকি মনমরা বসে থাকি সারাদিন, খেতে চাই না, কথা টথা বলি না বেশি, সাজি না, ভাল একটা শাড়ি পরি না, বিয়ের পর বউরা একটু সেজেগুঁজে না থাকলে চলে! শাশুড়ি প্রায়ই আলতাফকে বলেন-’কীরে তোর বউএর হয়েছে কী বল তো। শরীর খারাপ?’

আলতাফ বলে–না। না। শরীর খারাপ হবে কেন?

–সারাদিন একা ঘরে শুয়ে থাকে। বলি ভিসিআর দেখ। গান টান ভাল লাগলে শোন। কিছুই করে না।

-–ও কিছু না। বাড়ির কথা মনে পড়ে তো, তাই।

–তাই বা হবে কেন? ইস্কাটন গিয়েও নাকি ওই অবস্থা করে।

–ঠিক হয়ে যাবে। এত ভেব না তো এইসব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে।

শাশুড়ির বয়স হয়েছে। সারাদিন ঘরে বসে তাসকেরাতুল আউলিয়া, বেহেসতি জেওর আর মোকসেদুল মোমেনিন পড়েন। পঁচবেলা নামাজ পড়েন আর আখেরাতের জন্য জীবন গুছিয়ে রাখেন। অবশ্য জগৎ সংসারের দিকে তার যে মনোযোগ একেবারেই নেই তা ঠিক নয়। তিনি প্রায়ই আমেরিকা যান। বড় ছেলের কাছে মাস ছয় থেকে আবার ফেরত আসেন। এখনও শক্ত সমর্থ বেশ। সকালে পার্কে হাঁটেন। বিকেলে নিয়ম করে ফলের রস খান। স্বাস্থ্য ভাল, চোখেও ভাল দেখেন। হাতে তসবিহ নিয়ে হাঁটেন আর বিড়বিড় করেন–’ঠিকের তো কিছু দেখছি না। পাশের বাড়ির মেয়েরা এসেছিল সেদিন। ভাবী ভাবী বলে কত ডাকল। বউ তো কোনও বা শব্দ করল না। ঘরের দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়ল। আমি ওদের বললাম বউমার শরীর খারাপ, আরেকদিন এস।’

আলতাফ শোনে, কিছু বলে না। আমি বুঝতে পারি না আমার কী করা উচিত। আমি কি এখন আগের মত হাসব? আগের মত, বিয়ের আগে যেমন রিনিঝিনি হাসতাম, কথা বলতাম! কিন্তু জোর করে কি হয় এসব! আলতাফ আমার মন ভাল রাখবার জন্য তার বন্ধু বান্ধবের বাড়ি নিয়ে যায়। সোহেল, রকিব, লতিফ, মনজুরের বাড়ি। সবার এক কথা–’ভাবী আমাদের সঙ্গে এত কম কথা বললে চলবে না। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে আপনার। কী, আলতাফ বুঝি ঘুমোতে দেয় না আপনাকে? হা হা হা।‘ ওরা হাসে সবাই, আমার দিকে চোখ ছোট করে তাকায়।

মনে মনে বলি ও কেন ঘুমোতে দেবে না! ও তো আমাকে ঘুমোতেই দেয়, আমারই ঘুম আসে না। আলতাফ বন্ধুদের সঙ্গে রহস্যের হাসি হাসে। যেন ও সত্যিই আমাকে ঘুমোতে দেয় না। ও আমাকে সারারাত জাগিয়ে রাখে। সারারাত আমাকে আদর করে ও যেন ওর আদর পেয়ে আমি ভরে আছি শরীরে, মনে। আমি যেন তৃপ্ত, তুষ্ট এক নারী। আমার কোনও কষ্ট নেই। কোনও অভিযোগ নেই কারও প্রতি।

আলতাফের বন্ধুরা, বন্ধুর স্ত্রীরা আমাকে নিয়ে পড়ে; নতুন বিয়ে হয়েছে বলেই বোধ হয় অথবা আলতাফকে তাদের বিশেষ পছন্দ আর আমার চেহারাছবিও তাদের মনপুত হয়েছে। আমি কী খেতে পছন্দ করি, কী গান ভাল লাগে আমার, কী পোশাক পরতে ভাল লাগে সব তাদের জানা চাই। আমার চোখের নিচের কালির অন্য অর্থ হয়। আমি বা আলতাফ কেউ সংশোধন করে দিই না যে সারারাত আদরে মেতে উঠবার জন্য নয় চোখের নিচে আমার জেগে থাকবার দাগ। এ অন্য দাগ। এ আমার কষ্ট পোহানো দাগ। এ আমার দুঃখ রাতের গান। সারারাত আমি আলতাফের ঘুমন্ত, তৃপ্ত শরীরটিকে ছুঁয়ে নিঘুম রাত পার করি। আমি তাকে আমার আরও গভীর গহনে চাই। কেবল চাই ই। পেতে পারি না। কত কত রাত আলতাফকে ডেকে তুলে বলেছি–তুমি একা একা কী করে ঘুমোও! আমার যে ঘুম হচ্ছে না!

আলতাফ বলেছে–’আমি কী করতে পারি বল। তুমি ঘুমোবার চেষ্টা কর। ঘুম এসে যাবে। আমার তো সকালে অফিস যেতে হবে। তোমার মত না ঘুমোলে তো আমার চলবে না।‘

আলতাফ ঘুমিয়ে পড়ে। আমার ঘুমোবার কোনও আয়োজন না করেই সে ঘুমিয়ে পড়ে। আমার বলতে লজ্জা হয় কেন আমার ঘুম আসে না। আলতাফ নিশ্চয়ই বুঝতে পারে কিন্তু সে এমন ভান করে সে কিছুই বোঝে না আমার ইনসোমনিয়ার ব্যাপারটি। সে কিছুই বোঝে না এ আমার বিশ্বাস হয় না–সবই বোঝে সে। সবই বোঝে উত্থানরহিত সুদর্শন পুরুষটি। আমার সামনে তার যত অবুঝ অবোধ ভঙ্গি।

আলতাফ তার বন্ধুদের কাছ থেকেও ক্রেডিট নেয়। সে খুব ভাল প্লেয়ার এই জাতীয় ক্রেডিট। আমি ম্লান হাসি। ফাঁস করি না কিছু। স্বামীর দুর্বলতা ফঁস করব এমন অকৃতজ্ঞ স্ত্রী নই আমি। সতীসাধ্বী স্ত্রীলোককে মানায় না এব। পতিব্রতা হলে সমাজে মান থাকে। আলতাফ এবং তার বন্ধুরাও ভাল বলে। আমি যদি চিরকাল এমন মুখ বুজে পড়ে থাকি, লোকে বলবে এমন ভাল মেয়েই হয় না। এমন লক্ষ্মী বউ খুব কমই দেখেছি। এসব কথার দাম আছে মেয়েদের জীবনে। এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি মেয়েদের কী আছে! মা প্রায়ই বলেন—’এই ফ্যামিলিতে মেয়ে নিয়ে কোনও স্ক্যাণ্ডাল হয়নি। দেখিস স্বামীর সঙ্গে কখনও যেন কোনও গণ্ডগোল না হয়।‘ মাও বোঝাতে চান, স্বামীর সঙ্গে কিছু হলে স্ক্যাণ্ডাল আমার হবে, স্বামীর নয়।

০৩. সারারাত কী করে আলতাফ

সারারাত কী করে আলতাফ আমার সঙ্গে? কিছু কি করে? কিছু তো করে না, করবার চেষ্টা করে শুধু। বিয়ের পর পর আমি অনেকদিন তার চেষ্টায় সাহায্য করেছি। সে বলেছে–এরকমই হয়। সব ছেলেদেরই হয়।

–কিন্তু আমার এমন লাগে কেন? আমার প্রশ্নে এক তাল সরলতা থক্‌থক্ করে।

-–কি লাগে? আলতাফ জিজ্ঞেস করে।

–এমন অস্থির অস্থির?

–ও তোমার প্রব্লেম।

–আমার প্রব্লেম?

–হ্যাঁ।

আলতাফ যখন বলে এটা আমার প্রব্লেম, আমি বুঝে পাই না প্রব্লেম কী করে আমার হয়। বড় লজ্জা হয়। অপরাধবোধও কাজ করে আমার মধ্যে। কিছুতে মন বসে না কোনও কাজে। রাতে ও যখন বাতি নিভিয়ে শুতে আসে; আমার, আমি লক্ষ্য করি দ্রুত বাস পড়ছে। অপরাধবোধ থেকে একধরনের সিটিয়ে থাকা ব্যাপার ঘটে আমার মধ্যে। আলতাফ শুয়েই আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে–’বউ আমার বউ সোনা, আমার হীরে, হীরের টুকরো বউ।‘ বলে বলে আমার ঠোঁটে ও গাঢ় করে চুমু খায়। যখন চুমু খায়, আমি বুঝে পাই না আমার এমন লাগে কেন। কোথায় যেন, কেমন যেন ভাল লাগে। যখন বলে–’হীরে আমার, গায়ে এটা কী পড়েছ, খুলে ফেল তো। আমার খুলতে হয় না, ও নিজেই খুলে দেয়। খুলেই বহুদিনের না খাওয়া ভিখিরি সামনে গরম ভাত পেলে যেমন গোগ্রাসে খায়, তেমন আমাকে, আমার সর্বাঙ্গ ও খায়। আমার সারা শরীর শিরশির করে। লজ্জা ভয় অপরাধবোধ টোধ কিছুই থাকে না। কোথায় যেন, কেমন যেন বড় ভাল লাগে আমার। আমি ওকে দু হাতে জড়িয়ে ধরি। ও যখন আমার স্তনজোড়ায় মুখ ঘসে, আমি নিজেই অবাক হই অবচেতনে আমার কণ্ঠের ‘আহ আহ শব্দ শুনে। আমার এত কেন ভাল লাগে! আলতাফও গোঙায় খুব, গোঙাতে গোঙাতে আমার সারা শরীরে ও হাত বুলোয়, চুমু খায়। আমি বুঝি, আমার কোথায় যেন জলের স্রোত নামছে, আমি ঘেমে উঠছি, ভরে উঠছি। আমি ওকে আরও নিবিড় করে জড়িয়ে ধরি। ও আমার শরীরের সঙ্গে মিশে যেতে চায় কিন্তু কী একটা হয় ওর, ও হঠাৎ, আমি কিছু বুঝে উঠবার আগে, আমার গায়ের ওপর নেতিয়ে পড়ে। আমার তখনও দ্রুত বাস পড়ছে। তখনও আমার শরীরের ভেতর ভীষণ এক সমুদ্র গর্জে উঠছে। আলতাফ পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে। আর আমি ছটফট করি। এপাশ ওপাশ করি। আমার অস্থির লাগে। আলতাফ নাক ডাকে। আমার প্রব্লেম কোথায়, খুঁজে বেড়াই। খুঁজে পাই না। হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় এই যে অস্থির লাগে এটিই বোধহয় প্রব্লেম। আমার তো শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে যাওয়ার কথা। আমার যে ঘুম আসে না!

প্রব্লেম কি তবে এই ঘুম না আসাই! আলতাফের ঘুমের শব্দ শুনি আর আমার অস্থিরতা বাড়ে। ইচ্ছে হয় ওর মত আরাম করে ঘুমোতে, ওর মত তৃপ্তি নিয়ে। ওর মত কোনওদিকে না ফিরে। কে ঘুমোল কে ঘুমোল না এ নিয়ে যেমন ওর ভাববার সময় নেই, আমারও যদি সময় না হত। আমি যদি নিশ্চিন্ত হতে পারতাম।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমার কপালে চুমু খায় আলতাফ। আমার তখন এত ভাল লাগে যে রাতে খামোকা ঘুম না হওয়ার জন্য নিজের ওপরই রাগ হয়। উঠে ওর জন্য পরাটা মাংস করা, জামা জুতো এগিয়ে দেওয়া, দরজায় দাঁড়িয়ে ওর অফিসে চলে যাওয়া দেখতে বড় ভাল লাগে আমার। গোপনে সুদর্শন যুবকটির জন্য অদ্ভুত এক ভালবাসা জন্মায়।

আলতাফ আমাকে প্রায় বুঝিয়ে ফেলে যে–এরকমই হয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এরকম ঘটনাই ঘটে। তবে আমার যে অস্থিরতা, এগুলো হচ্ছে আমার দোষ। দোষ কাটাতে চাই, অস্থিরতা কমাতেও। অস্থিরতা তো আর কমে না, লুকিয়ে ঘুমের ওষুধ খাই। অফিসে খাটাখাটনি বেশি হলে আলতাফ যেদিন সকাল সকাল শুয়ে পড়ে, সেদিন আমি লক্ষ্য করেছি আমার কোনও যন্ত্রণা হয় না। আমি দিব্যি ঘুমিয়ে পড়ি। আসলে ও চুমু টুমু না খেলে, কাপড় জামা খুলে সারা শরীরে উষ্ণ হাত না বুলোলে আমার ভেতরে যে খুব গোপনে একটি সমুদ্র জাগে, সেটি জাগে না। আর না জাগলে আমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে না।

এরকম চলে দীর্ঘ দিন, দীর্ঘ রাত। এরকম অস্পষ্ট, অপুষ্ট একটি সম্পর্ক আমাকে সরিয়ে দেয় অন্ধকারে বাড়ানো আলতাফের হাত, ঠোঁট। আমি সেদিন বলেছি–আমার ভাল লাগছে না। শরীরে হাত দিও না শুধু শুধু।

–মানে? আলতাফ চমকে ওঠে আমার আচরণে।

–আমি ঘুমাব। পাশ ফিরে শান্ত কণ্ঠে বলি।

–আরেকটু পরে ঘুমোও। একসঙ্গে ঘুমোব দুজন। আলতাফ তার দিকে আমাকে টেনে নিয়ে বলে।

–না তুমি জানোও না তুমি যে একা ঘুমোও আমার ঘুম হয় না। বিরক্ত লাগে।

–বল কী? … তোমার সমস্যাটা ঘুচল না তা হলে!

–সমস্যা আমার না কি তোমার আগে ভেবে দেখ।

আমি লক্ষ্য করে অবাক হই আমার কণ্ঠে আগের সেই বিনয় নেই। একটু যেন রূঢ় শোনায় কথাগুলো।

আলতাফ বলে–তোমার শরীরে হাত দিতে না করছ আমাকে?

যেন অসম্ভব একটি কথা আমি বলেছি এমন তার গলার স্বর।

-হ্যাঁ করছি। আমি পাশ ফিরে চোখ বুজে উত্তর দিই। এসব কথাবার্তার চেয়ে আমার যে ঘুমিয়ে পড়া জরুরি তা বোঝাতে চাই। আলতাফ মানে না। জিজ্ঞেস করে-কেন?

–জানি না।

–তোমাকে জানতে হবে। আঁঝাল কণ্ঠস্বর আলতাফের।

আমি চুপ করে থাকি। আর আলতাফ হেঁচকা টানে খুলতে থাকে আমার শাড়ি। আমি এক ঝটকায় তার হাত সরিয়ে দিয়ে বলি–এসব আমার ভাল লাগে না।

–আমি তোমার স্বামী, মাইণ্ড ইট। এসব ভাল লাগতেই হবে। আলতাফের কণ্ঠস্বর কঠিন শোনায়।

আমি অস্বীকার করছি না সে আমার স্বামী। তাকে আমার ভাল লাগে একথাও সত্যি, যখন সে অফিসের জন্য কাপড় চোপড় পরে, নাস্তার টেবিলে বসে, যখন হাত নেড়ে হেসে চলে যায় দেখতে ভাল লাগে। ব্যস। যখন ফিরে আসে, গল্প করে, হাসে–ভাল লাগে কিন্তু ভাল লাগে না আমার শরীরখানায় আঙুল ছোঁয়ালেই, শরীরে হাত দিলে শরীর আমার অস্থির হয়, অস্থিরতা কেন ভাল লাগবে আমার? নিজের শরীরকে প্রবোধ দেব এত ক্ষমতা আমার নেই। এত ক্ষমতা আমি অর্জন করিনি। যদি ঘুমিয়ে থাকি, আমি তো আর বলছি না ঘুমের মধ্যে আমি এই চাই সেই চাই; কিন্তু যদি জাগাও আমাকে, জাগলে আমার নানা কিছু চাই, আমি স্নান করব খাব বেড়াব খেলব। যদি নানা কিছুর ব্যবস্থা না করতে পারো, তবে দয়া করে আমাকে জাগিও না।

০৪. তুমি ছুঁয়ো না আমাকে

প্রতি রাতে যতই আমি আলতাফকে বলি যে তুমি ছুঁয়ো না আমাকে, সে ছোঁবেই। সে ছুঁতে চাইবেই, না ছুঁলে তার স্বস্তি নেই। ছুঁলে আমার অস্থিরতা, না ছুঁলে তার অস্থিরতা। ভীষণ এক অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। যখন ও শোবার জন্য বিছানায় যায়, আমি ড্রইং রুমের সোফায় আধশোয়া হয়ে বই বা ম্যাগাজিন পড়ি। শুতে না যাবার ছুতো করি। আলতাফ অনেকক্ষণ বিছানায় অপেক্ষা করে ড্রইং রুমে আসে।

–’কী তুমি শুতে যাবে না?’ ওর পরনে একটি কেবল লুঙ্গি থাকে। ওর খালি গা দেখলে আমার কেমন ঘেন্না ধরে। বলেছি কত ঘুমোবার সময় ট্রাউজার পড়, আর টি শার্ট না হোক স্যাণ্ডা গেঞ্জি হলেও পড়। তা না, আলতাফের লুঙ্গি না হলে চলবে না। আর থাকতে হবে খালি গায়ে। বুকে হাত বুলাবে আর আমাকে আড়চোখে দেখবে। দূর থেকে একগাদা মাংস দেখে কুকুর যেমন জিভ চাটে, আলতাফও মনে মনে বোধহয় নিজের লালা নিজে গিলে খায়। সেও বোধহয় তার লোভের লাল জিভখানা বারবারই চাটে।

আমি বিরক্ত হই আলতাফের ডাকাডাকিতে। বলি–আমি এখনই শোব না। ঘুম পাচ্ছে না।

–বিছানায় এস, ঘুম পাবে।

আলতাফ দাঁত বের করে হাসে। যেন বিছানায় আজ খুব মজার জিনিস আছে, ঘুম না পেয়ে যায়ই না।

–তুমি শোও। আমি পরে আসব। আমি বই থেকে মুখ না তুলেই বলি।

আলতাফ চলে যায় বেডরুমে। আমি তার ঘুমিয়ে যাবার অপেক্ষা করি। ঘুমিয়ে গেলে বিড়ালের মত নিঃশব্দে হেঁটে শুতে যাব। যেন সে না জাগতে পারে, জেগে যেন সে আমাকে সারারাত জাগিয়ে না রাখতে পারে। রাত প্রায় দুটো বাজলে আমি শুতে যাই। আলতাফ না ঘুমিয়ে শুয়ে ছিল। আমাকে দেখেই বলে–এখন আর শুতে এলে কেন? রাত তো শেষ করেই এলে।

ওর রাগের কারণ আমি বুঝি। কিন্তু আমার ইচ্ছে না করলে কী করব আমি। আমার ভেতরে সে আগুন কেবল জ্বালিয়ে দেবে, নেভাবে না–এ কী করে মেনে নেব? নেভাবার নিয়ম তো আমার জানা নেই, জানা থাকলে হয়ত নিজেই কিছু চেষ্টা করতাম। আমি উল্টো দিকে মুখ করে শুয়ে পড়ি। আলতাফের কথার কোনও উত্তর দিই না।

–কী ব্যাপার কথা বলছ না যে!

–বলতে ইচ্ছে করছে না।

ওর গলা যত উঁচু, আমার গলা তত খাদে। আমি বিছানার এক কিনারে আলতাফের শরীরে যেন আমার শরীর না লাগে এমন আলগোছে শুয়ে থাকি।

–তোমার হয়েছে কী বল তো? আলতাফ ভারি গলায় জিজ্ঞেস করে।

–কিছুনা।

–কিছু না বললেই হবে? তোমার কিছু একটা হয়েছে। তুমি আমাকে লুকোচ্ছ। আমাকে কিন্তু অবহেলা করছ তুমি।

–বোধ হয় করছিই।

–আমি সারাদিন কার জন্য পরিশ্রম করি বল, এই সংসারের জন্য, তোমার জন্য। তোমার জন্য, আর বাড়ি ফিরে যদি তোমার বিশ্ন মুখ দেখতে হয়, ভাল লাগে? কি এত দুঃখ তোমার?

এর কোনও উত্তর আমি দিতে পারি না। লজ্জা হয়, সংকোচ হয়। কেন মন বিষণ্ণ থাকে, বুঝি, দুঃখ কেন, বুঝি; কিন্তু বোঝাতে পারি না। আলতাফ অভিমান করে, রাগ করে। এপাশ-ওপাশ করে। আমার স্থির শান্ত শরীরের দিকে তৃষ্ণার্ত চোখে তাকায়। আমি নিজেকে সংবরণ করি। জলের লোভে লোভে সমুদ্রের কাছে যাব আর সে আমাকে সমুদ্রের উতল নোনা জোয়ারে একলা রেখে চলে যাবে, আমি সাঁতার জানি না, ভাসব ডুবব, আমার কষ্ট হবে, ভীষণ কষ্ট হবে আমার–এই ভেবেই আমি। সংবরণ করি। তৃষ্ণা গুলো সংযত করি।

আমি ধীরে খুব শান্ত কণ্ঠে বলি–কাল থেকে আমি অন্য ঘরে ঘুমোব।

–কেন?

–আমার ইচ্ছে।

এক বিছানায় ঘুমোলে আমি টের পাই আলতাফের নিশ্বাসের হলকা আমার গায়ে লাগছে, আমার গা গরম হচ্ছে। গা কেন গরম হয়? না হলেও তো পারে। না হলে চমৎকার যুবকটিকে আমি আরও বেশি ভালবাসতে পারতাম। আরও বেশি তার কাছে আসতে পারতাম, শরীরের না হোক, মনের কাছে।

মনের কাছে আসতে গেলে কোনও বাধা তো থাকা উচিত নয়। মনই তো সব থেকে বড়। মনের কাছে শরীর বড় তুচ্ছ। তবু আমি জানি না কেন আমি বলি–আমার ইচ্ছে হয় না তোমার সঙ্গে ঘুমোতে। আমার প্রব্লেম হয়।

আলতাফ চুপ হয়ে থাকে।

ওর জন্য মায়াও হয় আমার। মায়া হয় বলে যদি আমি ওর কপালে হাত বুলিয়ে দিতে যাই, আমাকে সে জড়িয়ে ধরে চুমু খাবে। অন্ধকারে একটি ভালবাসার স্পর্শ ধীরে ধীরে শিথিল করবে আমার শরীর। আলতাফকে আমি ভালবাসতে চাই, কিন্তু এসবের জন্যই পারি না। এই জড়িয়ে ধরা এই চুমু খাওয়া এসব আজকাল বড় বিব্রত করে আমাকে। বড় অবিন্যস্ত করে।

অনেকক্ষণ চুপ থেকে আলতাফ আমার গা ধাক্কা দিয়ে বলে–তুমি খুব বাড়াবাড়ি করছ, হীরা।

–কিরকম বাড়বাড়ি? ওর ধাক্কায় মোটেও না চমকে বলি।

–খুব সেক্স ক্রেজি হয়ে উঠছ।

–তাই নাকি? যদি তা-ই হই অসুবিধে কী?

–অল্পে তোমার মন ভরছে না। তোমার অনেক বেশি চাই।

–সে তো তোমার চাই। আমি তো চাইছি না কিছুই। আমি দিব্যি পাশ ফিরে ঘুমিয়ে থাকতে চাই। তুমি আমাকে ডিসটার্ব না করলেই পারো।

–আমি তোমাকে ছুঁলে তুমি ডিসটার্ব ফিল কর?

–হ্যাঁ করি।

–বলছ কী তুমি? আলতাফ তড়াক করে উঠে বসে। বলে–তুমি আমাকে অপমান করছ হীরা।

–হ্যাঁ করছি।

আলতাফের বাস পড়ে জোরে। সে আমার শরীর ধরে আবার ঝাঁকুনি দেয়। বলে–তুমি কি ভুলে যাচ্ছ আমি তোমার স্বামী?

–না মোটেও না। ভুলব কেন? বরং খুব বেশি করেই মনে থাকে।

–তাহলে আমাকে তোমার সহ্য হবে না কেন? আমি কি তোমার পর?

–স্বামী হলেই বুঝি আপন হওয়া যায়?

আলতাফ বিছানায় বসা ছিল, দাঁড়িয়ে যায়। উঠে পায়চারি করে ঘরময়। ফোঁস ফোঁস শব্দ হয় ওর রাগের। বলে-তবে কে তোমার আপন শুনি? কোন আপন মানুষ তুমি ফেলে এসেছ? আমাকে তুমি পর ভাবছ, আমি তোমার স্বামী আর আমিই তোমার পর?

আমি পাশ ফিরে মাথার বালিশটি বুকে জাপটে ধরি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি–আমাকে ঘুমোতে দাও। এত রাতে তোমার এসব বোকা বোকা কথা আমার ভাল লাগছে না। আলতাফ বাথরুমে যায়। মুখে পানির ঝাঁপটা দেয়। টেনশন হলে সে এরকমই করে আমি ঘুমোতে চাই। আলতাফ পারলে সারারাত জেগে থাকুক। আমার কী যায় আসে! আমি যখন জেগে থাকি ও কি আমার খবর নেয়?

আলতাফ সারাঘর হাঁটে আর বলে–তুমি কি চাও বল তো? কী দিলে তোমার তৃপ্তি হবে। তোমার জন্য আমি সব করব। বল, মুখ ফুটে বল কি চাও।

–তুমি ভাল করেই জানো আমি কী চাই।

–কাল মার্কেটে চল। যা ইচ্ছে হয় কেননা। তবু তুমি আমার সঙ্গে এসব করো না।

–মার্কেট থেকে কী আনতে চাও আমার জন্য? সুখ পাওয়া যায়? পাওয়া যায় সুখ তোমাদের নিউমার্কেটে? গাউছিয়ায়? গুলশানে? মৌচাকে? পাওয়া যায়?

আমার ভেতরে লাভার উদগীরণ দেখি। আলতাফ চুপ হয়ে যায়। চুপ না থেকে ও করবে কী। ওর কী আর করবার আছে? ওকে আমি দোষ দিই না কিন্তু ও আমাকে অস্থির করে মারবে কেন? আমার কি পাওয়ার কিছু নেই? আমার কি শূন্যতাকেই একমাত্র গন্তব্য বলে ধরে নিতে হবে? রাত বাড়তে থাকে। আলতাফ একবার বিছানায় শোয়, একবার ওঠে, সে গজরাতে থাকে রাগে। আমি ঘুমিয়ে পড়ি।

সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি আলতাফ ঘরের ইজিচেয়ারে বসা। চোখ জানালার দিকে। জানালাটির ওপারে একসারি দেবদারু। দেবদারুরও রূপ আছে। কী চমৎকার সুঠাম বৃক্ষ। আমি বিছানা থেকে না উঠেই রাতের শিশির ধোয়া বৃক্ষের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকি। আলতাফ কি সারারাত ঘুমোয়নি? আমি উঠে দাঁড়াই ওর চেয়ারের পেছনে। হাত রাখি চুলে। চুলগুলো কী সুন্দর! ঘন। ছেলেদেরও এত ঘুন চুল হয়! আমি আঙুল বুলিয়ে দিই ওর চুলে। আলতাফ আমার স্পর্শ বোঝে। রিয়েক্ট করে না। যেমন ছিল তেমন বসে থাকে। আমি ওর চুলে হাত বুলোই আর বলি–তুমি আমার ওপর রাগ করো না। রাত হলে আমি অন্য রকম হয়ে যাই। রাত হলে কী যে হয় আমার! আমার।

আলতাফকে শিশুর মত স্নিগ্ধ লাগে দেখতে। ওর নিঘুম রাতের কষ্টের কথা ভেবে আমারও কষ্ট হয়। কতক্ষণ পাশে দাঁড়িয়ে থাকি। ও একটি বাক্যও আমার জন্য খরচ করে না। সকালে ওর জন্য নিজের হাতে নাস্তা করি। চা দিই। চুপচাপ সে খেয়ে ওঠে। কথা বলে না। বলি–এত রাগ?

আলতাফ তবুও কথা বলে না। জুতোর গটগট শব্দ তুলে অফিসে চলে যায়। এই যে আমি তোকে জুতোর ফিতে পর্যন্ত বেঁধে দিলাম। যাবার সময় বললাম–একটু হাসো। তারপরও হাসল না সে। গেটে দাঁড়িয়ে হাত নাড়লাম, একবার ফিরে তাকাল না।

দুপুরে ফোনে সে তার মায়ের সঙ্গে কথা বলল, আমার সঙ্গে বলল না। বিকেলেও ফিরল না। ফিরল রাতে। শাশুড়ির সঙ্গে ড্রইং রুমে বসে কথা বলছিলাম, রুমে ঢুকেই আলতাফ বলল–এত রাত পর্যন্ত আপনি জেগে আছেন? আলতাফের মা হেসে বললেন–তুই এত দেরি করলি বাবা?

–আর বলবেন না। এক বন্ধুর বিয়ে ছিল।

–ও।

আমি পাশে বসে মা ছেলের কথপোকথন শুনে গেলাম। এক বন্ধুর বিয়ে অথচ আমাকে সামান্য জানানোও হয় না। বিয়ে বাড়িতে যাওয়া না হয় বাদই দিলাম। তাছাড়া আমি যে একটি মানুষ বসে রইলাম। আমি যে তাদের কেউ হই, বোঝা গেল না। কোন বন্ধু, কী নাম, কার সঙ্গে বিয়ে হল, মেয়ে খুব ভাল, লেখাপড়া জানা মেয়ে, বড় ফ্যামিলি, বাবা ইঞ্জিনিয়ার, মেয়ের ভাই বোনেরা কানাডা থাকে, ইত্যাদি নিয়ে আলতাফ তার মায়ের সঙ্গে গল্প করল। তারা দুজনেই ভুলে গেল আমার উপস্থিতি। আমি নিঃশব্দে চলে এলাম ঘরে, শোবার ঘরে, এই ঘরটিই তো মূলত আমার ঘর, কারণ এখানে আমি স্বামী নিয়ে শোব। আমার তো শোওয়াই একমাত্র কাজ। আমি ঘরে বাতি নিবিয়ে শুয়ে থাকি। আলতাফ ঘরে ঢুকেই ষ্টিকবা জ্বালায়। আমার চোখে হঠাৎ বাতি এসে পড়লে রাগ ধরে বড়। বলি–লাইট বন্ধ কর।

–আমি অন্ধকারে কাপড় ছাড়ব?

–জানি না। তুমি লাইট বন্ধ কর।

আলতাফ বাতি জ্বালিয়েই সার্ট খোলে, লুঙ্গি পরে লুঙ্গিখানা সঁতে কামড়ে প্যান্ট আর আণ্ডার ওয়ার খোলে। আমি দেখি আর আমার রাগ ধরে। বাতি জ্বালিয়ে রেখেই সে বাথরুমে যায়। বাথরুমে আবার একটি গান ধরে আলতাফ। ‘এক পেয়ার ক্যা নাগমা হ্যায়…..।‘ গানের সূরটি আমার ভাল লাগে। সূরটি ভাজতে ভাজতে সে ঘরে আসে। আমি তখন চোখ বুজে শোয়া। সূরটি সে ছাড়ে না। বাতিও নেয় না। আলতাফের সূর আমার সব রাগ জল করে দেয়। আমি আলোকিত ঘরটিতে ঘুমোবার প্রস্তুতি নিই। আমি লক্ষ্য করি আলতাফ আমার সঙ্গে কথা বলছে না। আমাকে সে স্পর্শও করছে। সকাল হয়। সে অফিসে চলে যায়। আমি তার সঙ্গে ছায়ার মত ঘুরি। আমাকে সে দেখেও দেখে না। তার বাবা মার সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা দেয়। বাড়িতে আমি যে। একটি প্রাণী সে ভুলে যায়। অথবা দেখায় সে ভুলে আছে। আসলে ভোলে না। সে যে ভোলে না সে কি আমি বুঝি না? বুঝি কিন্তু কিছু বলি না। কিন্তু কতদিন এরকম চলবে? কতদিন? রাতে পাশে শুয়ে ছটফট করে আলতাফ। ও যে দিন দিন অন্যরকম হয়ে উঠছে বুঝি। আমার কষ্ট হয়, আলতাফের জন্য মায়া হয়। একবার ইচ্ছে হয় তাকে দোষ দিই, আবার এমনও মনে হয় দোষ বোধ হয় আমারই। দোষ যারই থাক আমরা কেন উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখব? সম্পর্কটি স্বাভাবিক করবার জন্য তাগিদ আমারই থাকে বেশি। শাশুড়ি একদিন ডাকলেন তার ঘরে, বললেন–আলতাফ এমন চুপচাপ থাকে কেন বৌমা?

–জানি না।

–জানি না মানে? শাশুড়ি পাল্টা জিজ্ঞেস করেন। আমার কোনও উত্তর না পেয়ে তিনি আবার বলেন–তোমাকেই তো জানতে হবে। তুমি ছাড়া আর জানবে কে!

–সে কেন চুপচাপ থাকে সে প্রশ্ন তো তাকেই করতে পারেন। আমি কি তার সব জানি? শাশুড়ি বেজায় রাগ করেন। রাগলে তিনি জোরে জোরে শ্বাস ফেলেন। ফর্সা মুখোনা লাল হয়ে ওঠে। তিনি সম্ভবত বুঝে পান না তার সুপুত্রের প্রতি আমি এই অন্যায় আচরণ কেন করছি। মোটাসোটা মহিলা, বাতের ব্যথায় প্রায়ই কাতরান, বাহুতে ঘড়ির চেইনের মত কী একটা লাগিয়েছেন কৰ্জিতেও একটি পিতলের চুড়ি। এক রাতে ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন, আমি গিয়ে হাত পা টিপে না দিয়ে বললাম–এসব কী লাগিয়েছেন, এগুলো খুলে ফেলুন। এগুলো লাগালে ব্যথা আরো বাড়ে মনে হয়।

–কি বললে? শাশুড়ি কটমট করে আমার দিকে তাকিয়েছিলেন।

আমি এরকমই। যা বলতে ইচ্ছে করে বলে ফেলি। বলবার আগে সাত পাঁচ ভাবব এমন নই। শাশুড়ির মূল প্রশ্ন আলতাফের হয়েছে কী, এত প্রাণবান ছেলের এমন উদাস ভাব কেন, কেন চুপচাপ থাকে বাড়িতে। আমি মনে মনে বুঝি কেন সে কথা কম বলে, সে যে আমি তাকে আমাকে ছুঁতে বারণ করেছি বলে অভিমান করে চুপ থাকে তা কিন্তু নয়। সে অনেকটা বাঁচেও বৈকি। আমাকে অস্থিরতা দান করা থেকে এ তো একরকম বাঁচাই।

আলতাফ কিন্তু বেশিদিন গাম্ভীর্য ধারণ করতে পারে না। আমাকে সে ছোয়, ছুঁতে তাকে হয়ই। আমি তার নিশপিশ আঙুল দেখে বুঝি সে একটি সোমখ নারী শরীরের জন্য কি ভীষণ কাতরাচ্ছে। বসেছিলাম, শোবার ইচ্ছে করছিল না সেদিন। গুণগুণ গান করছিলাম আমার ইচ্ছা করে তোদের মত মনের কথা কই, ওলো সই। আলতাফ বোধহয় মন দিয়ে শুনছিল, সে বসেইছিল এই আশায় যে আমি তাকে খেতে ডাকব, যেমন ডেকে নিই শ্বশুর শাশুড়িকে, আমার সেদিন কাউকে ডাকতে ইচ্ছে করছিল না। কেবল গান গাইতে ইচ্ছে করছিল। খেতে কোনও ইচ্ছে নেই। খোলা জানালা পথে এক আকাশ পূর্ণিমা হুড়মুড় করে ঢুকছে ঘরে, আমার মুখে এসে পড়ছে তার আলো, তার অবাধ আলো। খেতে আমার না ইচ্ছে করতেই পারে। আমারই যে সবাইকে ভাল লাগাবার দায়িত্ব থাকতে হবে, তা কেন! আলতাফ একাই খেয়ে আসে। আমাকে ডাকে না। ডাকে না বলে আমার যে খুব কষ্ট হয়, তা নয় কিন্তু। আমি যেমন বসেছিলাম তেমনই থাকি। পূর্ণিমায় একা একাই স্নান করি। খেয়ে এসে আলতাফ শোয় বিছানায়। শুয়ে বেডসুইচ অন করে। এক ঘর জ্যোৎস্নার মধ্যে দজ্জালের মত আচমকা উপস্থিত হয় এক থোকা বিদ্যৎ। আমি অলস বসে থাকি ইজিচেয়ারে। আলতাফই হঠাৎ প্রশ্ন করে–খাওয়া টাওয়াও বাদ দিয়েছ নাকি? এত রাগ?

–রাগ? রাগ আমি করব কেন? সে তো তুমি করেছ। আমার সঙ্গে কথা বলাই ছেড়ে দিয়েছ।

–এসবের কারণ তো তুমিই।

–তাই নাকি?

আমার কণ্ঠে শ্লেষ টের পাই। শ্লেষ আলতাফের কণ্ঠেও, বলে–গান গাইছ মনের কথা কইতে নাকি ইচ্ছে করছে। কার সঙ্গে তোমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে শুনি? সখী না সখা? একেবারে না খেয়ে লেগেছ মনে হচ্ছে?

আলতাফের কথার উত্তর আমার দিতে ইচ্ছে করে না। চোখ বুজে শুনি শুধু। আলতাফ হাসি খুশি থাকলে আমার সমাদর হয় এই বাড়িতে, সে বিষণ্ণ হলেই আমি তুচ্ছতাচ্ছিল্যের বস্তু হয়ে যাই। এ কেমন নিয়ম?–খাচ্ছো না কেন? আলতাফ হঠাৎ প্রশ্ন করে।

–খিদে নেই বলে।

–খিদে হবে কেন? সারাদিন বসে থাকলে খিদে হয়?

–কী করব বল? লেখাপড়া করতে ইচ্ছে করে। তাতে তো সময় কাটত।

–সময় কাটাবার কিছু পাচ্ছো না তুমি, আশ্চর্য! বাড়িতে কাজ করতে চাইলে কাজ কী কম আছে? ছোট ছোট কাজগুলো তো করতে পারো। আমি তো বলছি না তুমি কাপড় চোপড় ধোও, ঘরদোর মোছ।

–তার মানে তুমি দয়া করে হালকা কাজগুলো করতে বলছ, যেখানে বড় কাজগুলোই আমার করা উচিত ছিল।

–যা বোঝ তাই।

আমি উত্তরে আর কথা বলি না। কী আর বলবার আছে। তার সঙ্গে তো আমার বিয়েতে এরকম শর্ত হয়নি যে আমি তার বাড়ির কোনও কাজে হাত দেব না। বরং স্বামীকে সেবা করবার একটি কথা আকারে ইঙ্গিতে বাড়ির সকলে আমাকে বলেছে।

রাত বাড়তে থাকে। আমার ভাল না লাগা গুলোওে বাড়তে থাকে। বিছানায় শুতে যে যাব সে ইচ্ছে করে না। আলতাফ ঘুমোয় না, তার না ঘুমোবার কারণ বুঝি, চাইছে আমি শুতে যাই, সে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ুক আমার ওপর। ভাবতেই গা রি রি করে ওঠে। নিজেকে মাঝে মধ্যে এরকমও বোঝাই যে যতই হোক, স্বামী যখন, স্বামী যা চায় তা

পূরণ করাবার দায়িত্ব তো আমারই। আমাকে তো তার ইচ্ছের কাছে মেলে দিতেই হবে আমার শরীর, এমন কি মনও। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ইজিচেয়ারটিতে, জানালার বাইরে থেকে আবার হাসনুহেনার ঘ্রাণ আসে। ঘ্রাণটি আমাকে বড় উতলা করে। একটি স্পর্শ আমার তন্দ্রা বা নিদ্রা যা হোক না কেন, ভাঙায়। চেনা স্পর্শ। বড় চেনা তার আলিঙ্গন, তার আদর আহ্লাদ। আমি সেই পর্শের ঘ্রাণ নিই, যেমন নিই হাসনুহেনার তীব্র সুগন্ধ। এই পৰ্শটি বড় আদরে আমাকে বিছানায় নিয়ে যায়। শুইয়ে দেয়। ধীরে ধীরে আলতো হাতে নিদ্রালু কাপড়গুলো সরিয়ে দেয়। তারপর, আমি যদি নদী হই, কে যেন আমার শরীরে সঁতরাতে চায়। প্রাণপণ সঁতরাতে চায়। নিঃশ্বাস ঘন এবং দ্রুত হয় তার। সে কখনও সাঁতার জানত বলে মনে হয় না আমার। সে যে এত চেষ্টা করে সঁতরাতে! আমি বলি তুমি এভাবে সঁতরাও এভাবে পা নেড়ে, ওরকম হাত নেড়ে, সে সবই করতে চায়, পারে না। দ্রুত যখন বাস পড়ে তার, একবার মায়া হয় যে বেচারা চাইছে অথচ পারছে না আর একবার রাগও ধরে যে সে পারবে না আর আমার জল ঘোলা করবে, আমি তা মানব কেন? কতরাত পর্যন্ত যে সাঁতরাবার চেষ্টা করে আলতাফ জানি না। বিরক্ত হতে চাই না কিন্তু শরীরই বিরক্ত হয়। আমার শরীরই তার সাঁতার না জানা শরীরকে ঠেলে সরিয়ে দেয়। সরিয়ে যে দিই তাতে কিছু বলবার থাকে না আলতাফের। সে করুণ চোখে তাকায় আমার দিকে। জ্যোৎস্নায় তার চোখের তারা দূরের নক্ষত্রের মত জ্বলে। সকালে উঠে আলতাফ আমার দিকে তাকায় না। যেন খুব ব্যস্ত সে, এত ব্যস্ত যে তাকাবার সময় পর্যন্ত নেই। আমি হেসে বলি–আজ যে এত দৌড়োচ্ছ, টিফিনও মনে হচ্ছে নেবে না।

–পূর্বাণীতে লাঞ্চ করে নেব।

–এত টাকা তোমার, সরকারি চাকরিই বা কর কেন?

–ও তুমি বুঝবে না।

–ও।

আলতাফ কথাগুলো বলে কিন্তু চোখের দিকে না তাকিয়ে। তাকাতে লজ্জা হয় নিশ্চয়। তড়িঘড়ি চলে যায় অফিসে। ওর অফিস যাওয়া দেখে আমারও ইচ্ছে করে অফিস যেতে। আমি একদিন বলেছিলাম আলতাফকে সকাল বেলা উঠে আমিও যদি অফিস যেতে পারতাম!

আলতাফ হো হো করে হেসেছিল। হাসবারই তো কথা। বাড়ির বউ, যাকে কি না ঘর সংসারে ভাল, দেখতে ভাল বলে আনা হয়েছে, সে যদি ঘর সংসার ছেড়ে চাকরি করতে চায় তবে তো হাসতেই হবে। শাশুড়ি সেদিন ভিসিআরে ছবি দেখবার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। রমজানকে দিয়ে ছবি আনালেন তিনি। রূপ কি রাণী চোর কে রাজা। আমি নাম দেখে ঠোঁট উল্টে বললাম–দুর এসব বাজে। শাশুড়ি হেসে বলেন–আরে না না, দেখই না।

ছবি যখন চলছিল, শাশুড়ির হাতে ছিল তসবিহ, তিনি এনজয় করছিলেন। আমি অবাক হয়ে শাশুড়ির হাসি হাসি চোখমুখ দেখছিলাম। শাশুড়ি সারাদুপুর ছবি দেখলেন। আমি শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম তার বিছানায়। রাতে ঘুম হয় না, তাই ঘুমও পায়, আর এই ধরনের ছবি আমাকে জাগিয়ে রাখবার কোনও ক্ষমতা রাখে না।

বিকেলে ফেরে আলতাফ, সকালের চেয়ে স্বাভাবিক। বলে–চল যাই আজ সাভারে যাই, নিজে গাড়ি চালাব কেমন? সাভারে ঘুরে জয় নামে রেস্তোরাঁয় খেয়ে চলে আসব কেমন?

আমি বলি–চল।

আলতাফ আমাকে খুশি করবার জন্য এই প্রস্তাব করেছে আমি বুঝি। দিন দিন আমি যেভাবে ক্ষেপে উঠছি, আমাকে খুশি না করালে তার চলবে কেন।

আমরা একসঙ্গে বাইরে যাচ্ছি দেখে শাশুড়ির মুখেও হাসি ফোটে।

গাড়ি যখন দ্রুত ছুটে চলে আমি দুদিকের নদী খাল বৃক্ষ ও মানুষ দেখি। আলতাফ কলকল করে কথা বলে। ওর বেশির ভাগ কথাই এরকম, লোকে আমাদের বলে চমৎকার জুটি। বলে প্রেম ট্রেম ছিল নাকি আগে থেকে। আলতাফ ভাল চালায় গাড়ি, তবু বলে কী ভয় পাচ্ছো না তো? ধর দুজনে যদি মরে যাই এমন একসিডেন্ট হয়?

–মরব। আমি শান্ত কণ্ঠে বলি।

আমি মরব এই খবরটি শুনে আলতাফ পুলকিত হয়। আমি আলতাফের সঙ্গে মরবার জন্য মরব, ব্যাপারটি যে মোটেও সেরকম নয় তা আমি বোঝাতে পারি না তাকে। সে ভেবেই নেয় তাকে আমি ভালবাসি। সাভারের সবুজ বৃক্ষ রাজি আমার ভেতরে অদ্ভুত এক ভাল লাগা জন্ম দেয়। আমি এই প্রকৃতির সন্তান। এই সবুজ অরণ্যে বাস করা বোধহয় অনেক সুখের। গুলশানের বাড়ি ফেলে যদি এই অরণ্য বাসে যাই এরকম যখন ভাবছি আলতাফ বলে–সাভারে আমার জমি আছে জানো তো? এখানে একটা বাগান বাড়ি করব। আমরা বুড়ো বয়সে এখানে থাকব, কেমন? আমার নিভৃত বনবাসের ভাবনায় আলতাফের এই সংসার চিন্তা আমাকে গোপনে আহত করে। অরণ্যে কি ইটের দালান তুলে থাকতে হয়?

সারাপথ আলতাফই কথা বলে, আমি কেবল সবুজ দেখি। দু’চোখ ভরে সবুজ দেখি।

রাতে ‘জয়ে’ খাই। খেতে খেতে আলতাফ বলে–তুমি কি কখনও আমাকে ছেড়ে যাবে হীরা?

–হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?

–মাঝে মাঝে ভয় হয়।

আমি হেসে বলি-ভয় হবার কারণটা বল তো?

–তুমি যেন ঠিক আগের মত ব্যবহার কর না।

–আগে মানে?

–বিয়ের পর পর। বিয়ের দিন তো তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোলে। এখন কি ঘুমোও বল?

–দিন কি সবসময় একরকম থাকে?

–কেন, থাকে না কেন?

–মানুষ বড় হয়। বুদ্ধি বাড়ে। দিন বদলেছে, আমিও বদলেছি।

আমি বদলে গেছি এই খবরটি শুনে আলতাফ আর কোনও প্রশ্ন করে না।

এছাড়া আমার আর কী বলবার আছে। আমার যদি তাকে জড়িয়ে ঘুমোতে ইচ্ছে না করে আমি করব কী! নিজের ইচ্ছের সঙ্গে কতদিন প্রতারণা করা যায়।

সাভার থেকে ফিরে দুজনে যখন শুই বিছানায় গা হাত পা ছড়িয়ে দিয়ে বলি–আমি যদি ব্লু ফিল্ম দেখতে চাই?

–ব্লু ফিল্ম দেখবে?

–হ্যাঁ। আমার কণ্ঠ কাঁপে সামান্যও, ভয়ে কিংবা দ্বিধায়।

–ব্লু ফিল্ম দেখতে চাও? এসব শেখালো কে তোমাকে? ছি ছি তুমি যে এত নিচে নেমে গেছ আমার জানা ছিল না। আলতাফের ঠোঁট বেঁকে ওঠে ঘৃণায়।

–স্বামী স্ত্রী ব্ল দেখবে, অসুবিধে কী? আমি হেসে বলি।

-বাজে কথা বলো না। আলতাফ রীতিমত ধমক লাগায় আমাকে। প্যান্ট খুলে সে লুঙ্গি পরে। লুঙ্গির ওপর দিয়ে উরুসন্ধি চুলকোয়। ঘরে ওর মুজো খুলবার দুর্গন্ধ ছড়ানো! শাশুড়ির ঘর থেকে হিন্দি ছবির শব্দ ভেসে আসে। আলতাফ চেঁচিয়ে ওঠে বু ফিল্মের কথা তুমি শুনলে কোথায়?

–আশ্চর্য, ব্লু না দেখি নামটা পর্যন্ত শুনব না এ তুমি ভাবলে কী করে? তুমি কি ভাব আমি আকাশ থেকে পড়েছি? কিছুই বুঝি না, জানি না কিছুই!

সে চোখ নাক কুঁচকে জিজ্ঞেস করে–ব্লু দেখতে চাও, আমার মনে হয় বু তুমি আগেও দেখেছ।

বলি–দেখিনি, কিন্তু দেখার খুব ইচ্ছে।

–আর নাম নেবে না এসবের, আমি তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি। আলতাফ উত্তেজিত হয়ে ওঠে।

সে হঠাৎ এক টানে তার শরীরের কাছে আমাকে নিয়ে যায়। আমি ছাড়িয়ে নিতে চাই। নিজেকে। বলি–তুমি কিছু করো না কিন্তু।

–কী করব না?

–চুমু দেবে না। কাপড় খুলবে না।

–তুমি কি কোনও প্রেম ট্রেম করেছ বিয়ের আগে? আলতাফের চোখের তারায় পেণ্ডুলামের মত সন্দেহ দোলে।

–না।

–মিথ্যে বলছ। আলতাফের লোমহীন বুকে শিশির কণার মত জমে ওঠে ঘাম।

–আমি মিথ্যে বলি না।

আলতাফ সঁড়াশির মত আমার দুবাহু চেপে ধরে। বলে–নিশ্চয়ই তোমার তার কথা মনে পড়ছে।

–কার কথা?

–কার আবার?তোমার প্রেমিকের।

লোকে ঠা ঠা করে যেভাবে হাসে সেরকম হেসেই আমি বলি–মোটেও না।

–যদি তোমার বাবা মার কাছে বলে দিই এসব?

–মিথ্যে বলবে কেন?

–আমি বুঝি সব।

–বুঝলে এসব বলতে না।

–আমাকে তুমি সহ্য করতে পারো না। কেন পারো না? আমি স্মার্ট নই? গুছিয়ে কথা বলতে পারি না? ম্যানার জানিনা? তোমাকে শাড়ি কাপড় গয়না গাটি কিনে দিই না? তোমাকে অবহেলা করি, বল?

–মোটেও না।

–তবে?

তবের উত্তর আলতাফকে আমি দিইনা। দিতে ইচ্ছেও করে না। প্রথম প্রথম মনে হত সব বোধহয় একদিন ঠিক হয়ে যাবে, আর আমার অস্থির লাগবে না। আমরা দু’জন এক সঙ্গে ঘুমোতে পারব। একজন জাগবে, একজন ঘুমোবে–এমন হবে না। কিন্তু দিন যায়, বছর পার হয়, যা ছিল তাই থেকে যায়। ঠিক এরকমই। এক বিছানায় প্রতি রাতে আলতাফের শরীর ঘেসে আমাকে শুতে হয়। না শুলে চিৎকার করে বাড়ি ‘মাথায় তোলে। শরীর তাকে সঁপে না দিলে চলবে না। আমি কিছু পাই ৰা না পাই তার তো পেতেই হবে। তার ক্ষুধার্ত থাকলে চলবে কেন? আলতাফ কোনও ত্যাগে বিশ্বাসী নয়! তার সবটুকু খাওয়া চাই, আর কারও খাওয়া হোক না হোক। তার সবটুকু পাওয়া চাই, আর কারও পাওয়া হোক বা না হোক। আমি আলতাফকে ঠিক বুঝতে পারি না। তাকে যত বারই এ বিষয়ে বলা হয়, সে বলে তোমারই দোষ।

আমি যতবারই চমকে উঠি আমার আবার দোষ কোথায়। আলতাফ বলে–তুমি কোঅপারেট কর না বলেই এমন হয়।

–আমি কোঅপারেট করি না?

–না।

–কি বলছ তুমি? আর কী করে কোঅপারেট করা যায়? তুমি যা বল তাই তো আমি শুনি। সেদিন উপুড় হতে বললে, তাই হয়েছি।

–হয়েছ। কিন্তু মন থাকে অন্যদিকে। অন্য কিছু ভাব তুমি।

আমি হঠাৎ চুপ হয়ে যাই। আসলে কী আমি অন্য কিছু ভাবি। আমি তো এরকম ভাবি আমার খুব পেতে ইচ্ছে করছে আলতাফকে, আমি তাকে সবটুকু পেতে চাই। পেতে চাইলেই কী হয়? আমার কেবল আশায় বসতি।

সে শুতে আসে। আমার নীরবতাকে বেশ উপভোগ করে আলতাফ, আমি বুঝি। আমাকে দোষ দিয়ে সে মনে মনে একধরণের তৃপ্তি লাভ করে। সে যে ভুল বলছে, মিথ্যে বলছে–তা সে মনে মনে বুঝলেও আমার কাছে স্বীকার করে না। ব্লু ফিল্ম খারাপ মেয়েরা দেখে, যারা দেখে তারা বিকৃত মানসিকতার মেয়ে, তাদের মত আমি যেন কখনও না হই কারণ আমি ভদ্র ঘরের মেয়ে, আমার পারভারশানে যাওয়া উচিত নয় ইত্যাদি বলতে থাকে। আমি ঘুমিয়ে পড়ি। আলতাফের কথাগুলো আমার ঘুমের নেপথ্য সঙ্গীতের কাজ করে।

০৫. এক দুপুরে আলতাফের বন্ধু

এক দুপুরে আলতাফের বন্ধু মনজুরের স্ত্রী রুবিনা আসে আমার কাছে। গল্প করতে। কাছেই বাড়ি। কাজ নেই। স্বামী দুবাই গেছে। অবসর কাটে না। আমার সঙ্গে অবসর কাটাতে এসেছে।

রুবিনা ঠোঁটে হাসি চেপে বলে–ভাবী, বাচ্চা টাচ্চা নিচ্ছেন না, আরও এনজয় করে পরে নেবেন বুঝি?

–এনজয় মানে?

রুবিনা অপ্রস্তুত হয়। স্বামী স্ত্রীর ‘এনজয়’ কী তা যদি বিবাহিত মেয়ে হয়ে বুঝতে পারি তবে তো করবার কিছু নেই তার।

সে কাটিয়ে নিয়ে বলে–হুম, লুকোনো হচ্ছে! রুবিনার সঙ্গে আমি সোয়াসদি, ভিডিও কানেকশন, স্কাই রুমের খাবার এসব নিয়ে কথা বলি। তুচ্ছ কথা বার্তা। ও এসব কথায় থাকে না। নাটাই থেকে সুতো ছাড়ে আমাকে ওড়ায়। চোখ ছোট করে হাসে। বলে–আলতাফ ভাই কি রাতে খুব জ্বালায় আপনাকে?

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উত্তর দিই–হ্যাঁ।

রুবিনা বিছানায় আরাম করে বসে। বলে–কটা পর্যন্ত?

–মানে?

–মানে কটায় ঘুমোতে দেয়?

হেসে বলি–ঘড়ি দেখি না।

–তার মানে অনেকক্ষণ চলে! মনজুর তো একঘন্টার আগে শেষ করে না। রুবিনার ঠোঁটের কোণে হাসি ঝিলিক দেয়।–আলতাফ ভাইএর সময় কি রকম?

ও রসালো কিছু আমার মুখ থেকে শুনতে চাইছে। কিন্তু এসব কথা কি করে বলতে হয়, এসব কী ভাষায় বর্ণনা করা যায়, আমি জানি না। আলতাফ আমাকে শেখায়নি কিছু। আমি চুপ হয়ে থাকি। রুবিনা আমার হাত টেনে কাছে বসায়। বলে–এত লজ্জা কিসের? আমাদের সঙ্গে মিশলে লজ্জা কোথায় পালায়, বুঝবেন। আমার জিভ তো অনেক ভাল, লিপি ভাবীর সঙ্গে কথা বললে যে কী অবস্থা হবে। ও এত স্ল্যাং জানে। রুবিনা জোরে হেসে ওঠে। আমি অবাক হয়ে দেখি কী প্রশান্তি ওর সারা মুখে। আমি হঠাৎ জিজ্ঞেস করি, আমি নিজেই প্রস্তুত ছিলাম না এই প্রশ্নটি করবার জন্য–আচ্ছা একঘন্টার কথা কী যেন বললেন!

রুবিনা চায়ে চুমুক দিয়ে আবার হাসে, বলে–মিনিমাম আধঘন্টা, ম্যাক্সিমাম একঘন্টা তো হয়ই।

–কী হয় একঘন্টা?

–কী আবার? যা করে পুরুষলোকে। আমারও পিক আসতে আধঘন্টা এক ঘন্টা লাগে। কখনও কখনও অবশ্য দশ পনেরো মিনিটেও হয়।

–পিক মানে?

–অরগাজম।

–অরগাজম মানে?

–অরগাজম জানেন না?

–না তো!

আমার চোখে অপার কৌতূহল। রুবিনার আরও পাশে সরে আসি। তার ভ্রু কুঞ্চিত হয়। বলে-ইজ ইট?

মাথা নেড়ে বলি-হ্যাঁ।

–ওহ সো কিড ইউ আর! আলতাফ ভাই বলে না কিছু?

–না।

–অরগাজম মানে কী আপনি বুঝতে পারছেন না? ওই যে সারাশরীরে একধরনের ফিলিংস হয়। তীব্র এক ভাল লাগা যাকে বলে। এরপর ঘুম নেমে আসে।

–আমার তো শরীরে একটা কষ্ট হয়। ঘুম হয় না। সারারাত ছটফট করি। রুবিনা চমকে ওঠে। বলে–বলছেন কী ভাবী! আপনি ছটফট করেন, আর আলতাফ ভাই কী করেন?

–ওর ঘুম ভাল হয়।

রুবিনার বিস্ময় কাটে না। যেন ভূতুড়ে একটি গল্প শুনছে সে। অনেকক্ষণ চুপ থেকে ‘আহারে’ বলে আমাকে জড়িয়ে জিহ্বায় চুকচুক শব্দ করে। নিজেকে বড় অসহায় লাগে। বড় একা। বড় বঞ্চিত।

আবার সে জিজ্ঞেস করে–ওরকম হয় না? খুব একটা ভাল লাগা সমস্ত শরীরে? কখনও হয়নি?

আমি অসহায় মাথা নাড়ি। ভাল লাগার তীব্র কোনও বোধের সঙ্গে আমি কখনও পরিচিত নই। আমাকে আলতাফ এরকমই ভাবতে শেখায় ব্যাপারটি এক তরফা ওর আনন্দের জন্য। এ থেকে যে আর কিছু জোটে তা আলতাফ আমাকে বলে না। আলতাফ কি জেনেও বলে না নাকি সে জানেই না, বুঝি না।

রুবিনা যাবার সময় বলে–আপনারা ডাক্তার দেখান ভাবী। আলতাফ ভাইকে বলবেন ডাক্তার দেখানো জরুরি।

আমার মাথায় এই একটি ব্যাপার ঘোরে। ঘুরতেই থাকে। আমাকে মুক্তি দেয় না কিছুতে। জগতের আর কিছুতে আমার মন বসে না।

আলতাফ এলেই আমি নরম কণ্ঠে বলি–আমার একটা কথা তুমি রাখবে?

–কী কথা?

–আগে রাখবে কি না বল।

–আগে তো শুনি।

–চল ডাক্তারের কাছে যাই।

–কেন ডাক্তার কেন?

–আমাদের দুজনেরই ডাক্তার দেখানো উচিত।

–তোমার ইচ্ছে হলে তুমি দেখাও, আমার দরকার নেই।

–আমার মনে হয় তোমারই প্রব্লেম। ডাক্তার দেখালে যদি ঠিক হয় তবে যাব না কেন আমরা, বল?

–হীরা, প্রব্লেম আসলে তোমার। তুমি পেয়েছ কী বল তো? সংসারে মন নেই তোমার। সারাদিন এক চিন্তা। অফিস থেকে ফিরে তোমার হাসি মুখ কদিন দেখি বল। আমি তো তোমাকে এ ধরনের মেয়ে ভাবিনি। এত খারাপ তুমি এ তো আমি বিয়ের আগে জানতাম না। তোমার আসলে মেন্টাল প্রব্লেম। তোমারই সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো দরকার। পড়ালেখা কম করেছ, বিদ্যা নেই বুদ্ধি নেই। সারাদিন সেক্স সেক্স সেক্স। যত্তসব।

আলতাফের মুখ চোখ লাল হয়ে ওঠে রাগে। আমি মনে মনে বলি–তার চেয়ে তুমি ছুঁয়ো না আমাকে। তুমি আমার ভেতরে ঘরবাড়িতে আগুন জ্বেলে দাও, নেভাও না। আমি কেবল পুড়ে মরি।

আলতাফ চেঁচাতে থাকে–তুমি কী ভাব আমি বুঝি না কেন তুমি এমন কর। কেন তুমি এসব বিষয় এত জানো, এত কেন অভিজ্ঞতা তোমার!

–বল, কেন করি? আমি ঠাণ্ডা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করি।

–এতদিন সবাই অভিযোগ করেছে। মেয়ে উদাসিন থাকে, মেয়ে সারাদিন কী যেন ভাবে। আমি গা করিনি। এখন বুঝি তোমার এসব অভিজ্ঞতা আগে থেকেই আছে। তোমার এক্সপোজার ছিল। এখনও তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি, বাজে মেয়েদের মত বাজে জিনিস নিয়ে ভাববে না। অন্তত আমার বাড়িতে তোমার এইসব নষ্টামি চলবে না। মনে মনে বলি–আমি তো ভাবতে চাই না। তুমি আমাকে রাতে রাতে ভাবাও। তুমি না ভাবালেই আবার আমি আগের মত হাসব। তোমার জন্য বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করব কখন আসবে। কখন এসে বলবে হীরে আমার, মানিক আমার। আমি তোমার জন্য ঘর ভরে রজনীগন্ধা সাজিয়ে রাখব। তুমি খুব খুশি হবে, বলবে আমার লক্ষী সোনা বউ তুমি আমার প্রাণ, তোমাকে ছাড়া আমি বোধহয় মরেই যাব গো। তুমি যে আমাকে ভালবাস তা দূর থেকে বলবে, কাছে আসবে না, ছোঁবে না আমাকে। আমি তোমার স্পর্শ ছাড়া আর সব চাই। তাহলেই আমার আর কোনও প্রব্লেম হবে না।

.

রাতে শুতে চাই অন্য বিছানায়। আলতাফ মানে না। সে দাঁড়ায় এসে অন্য বিছানার সামনে। বলে-ওঠ। কণ্ঠে আদেশ তার। উঠতেই হবে। রক্তচক্ষু স্বামী দাঁড়িয়ে আছে পাশে, পঁড়িয়ে থাকুক। আমি বলি–আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।

–ঘুম পাক তবু ওঠ। বিয়ে করেছি আলাদা বিছানায় থাকবার জন্য নয়।

আলতাফ আমার হাত ধরে টেনে তোলে। নিয়ে যায় পাশের ঘরে। বিছানায়। পাতলা নাইটি পরা আমার। একটানে খুলে ফেলে। একসময়, বিয়ের পর কদিন, এই স্পর্শই কী ভীষণ আনন্দ দিত, সবটুকু হোক, কিছুটা হলেও তা দিত। অথচ আলতাফের সেই হাত, সেই হাতের স্পর্শই এক বিবমিষা জাগায় ভেতরে। আলতাফের গোঙানোকে লাগে যেন কাদা পেয়ে শুয়োর ঘোৎ ঘোৎ করছে। চুমু দিতে চায়। মুখ সরিয়ে নিই। আমি যে এই সব চাচ্ছি না, এসব যে আমার ভাল লাগে না–তা আমার শরীরের নির্লিপ্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিই তাকে।

সে তার শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে আমাকে পিষে ফেলতে চায়। মুখ থেকে ভুরভুর করে দুর্গন্ধ বের হয়। বিড়বিড় করে বলে–তোমার অডাসিটি দেখে আমি অবাক হই। কি না করেছি তোমার জন্য, বন্ধু বান্ধবের বাড়িতে আড্ডা, ঘোরাঘুরি, চায়নিজ খাওয়া, ভেবেছিলাম তোমাকে ব্যংকক সিঙ্গাপুরও নিয়ে যাব এমাসে। এত করি, আর

সে বলে আমার নাকি দোষ!

আমি দাঁতে দাঁত চেপে বলি–তোমারই দোষ। আমি রুবিনা ভাবীর কাছে সব শুনেছি।

–মনজুরের বউ এসেছিল?

–হ্যাঁ, বলল মনজুর নাকি অনেকক্ষণ থাকে।

–মানে?

–মেয়েদেরও নাকি অরগাজম হয়।

–এসব কি ওই মহিলা শিখিয়ে দিয়ে গেছে?

আমি কথা বলি না। আলতাফের কথায় মনে হয় দোষ যেন তার নয়, দোষ রুবিনার। রুবিনার দোষেই আমাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হচ্ছে। আলতাফ ঝট করে উঠে যায় বিছানা থেকে। আড়চোখে লক্ষ্য করি প্রচণ্ড অস্থিরতা তার মধ্যে। বাথরুমে ঢুকে সে শাওয়ার ছেড়ে দেয়। মাথা ধোয়, মাথায় পানি ঢাললে মন নাকি শান্ত হয়, তাই। আলতাফ মন শান্ত করছে। মেয়েদের যে অরগাজম হয় তা যেন আলতাফ প্রথম জানল। আলতাফের কি হয় ওইসব রুবিনা যা বলেছিল? কী জানি বুঝিও না। ও বলেও না কিছু। আমার বড় জানতে ইচ্ছে করে ব্যাপারগুলো। অষ্পষ্ট ঠেকে সব। যেন কী একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে স্বামী-স্ত্রীতে। বড় রহস্যময় সব। এ যদি কোনও দেওয়াল হয় আমি ভেদ করতে পারিনি। আমার কাছে সবই দুর্বোধ্য লাগে। নাগাল পেতে চাই, দূরের লাগে সব। আলতাফের কাছে বুঝতে চাই। এমনও হয়েছে আমি তাকে বলেছি তোমাকে আমি দেখতে চাই পুরোটা।

–মানে? কি দেখবে?

–তোমার শরীর। আমি সামান্য লজ্জিত না হয়েই বলি।

–আমার শরীরে দেখার কী আছে?

–আছে।

আলতাফ রাগ হয় আমার কথায়। বলে রুবিনারই কাজ এসব বুঝি। ও তোমাকে উল্টোপাল্টা কী সব বুঝিয়েছে। বাজে মেয়েলোক।

–স্বামীর শরীর আমি দেখব না? বউরা কি দেখে না?

–তুমি কী ইঙ্গিত করছু আমি কি বুঝি না?

–হ্যাঁ বোঝ। আজকাল একটু বেশিই বোঝ তুমি।

আলতাফ লুঙ্গিখানা কষে পড়ে। সিগারেট ধরায়। ঘন ঘন ফোঁকে। ঘর ধোয়ায় ভরে যায়। এয়ার কুলার চলে ঘরে, এর মধ্যেই ঘাম ঝরে আলতাফের। ভনভন করে একটি মাছি ঘোরে। রাতে মাছি আসে কোত্থেকে! কানের কাছে মাছিটি ভন ভন করতেই থাকে। আমি কোথায় তাড়াব তাকে। এই ঘরের ভেতরই সে ঘুরবে। ভনভন করে ঘুরবে।

আলতাফকে দেখতে চাইলাম। চাইতেই পারি। ওর এত ক্ষেপে উঠবার কারণ কী। নাকি লজ্জা পেয়েছে। নাকি ভয়! একটির পর একটি সিগারেট সে পুড়তে থাকে। আমার পক্ষ থেকে কী করলে আলতাফ খুশি হবে জানি না। আর ওকে খুশি করবার সব দায়িত্ব আমারই বা কেন? আমি তো এমনও ভাবতে পারি আমি যা চাই তার কতটুকু পালন করছে আলতাফ! একটি প্রশ্নও মনে উঁকি দেয়। আলতাফ কেন এমন রিয়েক্ট করল। তার সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দেখবার অধিকার কি আমার নেই? আমার গুলো সবই সে দেখছে, দলছে, পিষছে; তবে?

আলতাফকে ঠিক আমি বুঝতে পারি না। সেদিন সারারাত সে আর ঘুমোল না। তাকে দেখাতে বলেছিলাম, দেখাল না। যোজন দূরত্ব নিয়ে শুয়ে থাকল। বুঝি না, দেখালে কী ক্ষতি হত ওর। ও তো পঙ্গু নয়, স্ত্রীর আবেগের সামান্য মূল্য ও দিল না। আমার কেমন সন্দেহ হয়। আলতাফের কোনও শারীরিক ত্রুটি আছে কি? আমার দুশ্চিন্তা ঘোচে না। কিন্তু একটি ব্যাপার বুঝি, আলতাফ আমাকে যেন কিছু লুকোয়। একদিন হঠাৎ বাথরুমে ঢুকেই দেখি আলতাফ কিছু একটা লুকোচ্ছে, শিশি টিশি জাতীয়। বললাম কী হাতে তোমার? বলল ও কিছু না এমনি। কিছু না হবে কেন? স্পষ্ট দেখলাম কিছু। আমাকে লুকিয়ে আলতাফ ওই শিশি গুলো নিয়ে কিছু করে এরকম মনে হয়েছিল আমার। তারপর লক্ষ্য করতাম শোবার আগে বাথরুমে ও অনেকক্ষণ সময় ব্যয় করে। জিজ্ঞেসও করেছি কত, কী কর অতক্ষণ ওখানে? আলতাফ মুখ গম্ভীর করে বলে কী করি তা দেখাতে এখন তোমাকে নিয়ে বাথরুমে ঢুকতে হবে। তাই না?

আলতাফকে আমার সন্দেহ হয়। সে কেন ডাক্তারের কাছে যেতে চায় না। সে কেন আমাকেও দেখাতে চায় না শরীর? তার কি কোনও প্রব্লেম শরীরে? আমার দুশ্চিন্তা ঘোচে না। ওর যা কিছু, আমি কেন জানব না সব? আমি তো একটু একটু করে আমার আনন্দ বেদনা সবই জানিয়েছি তাকে। আমি যদি অবাধে উমুক্ত হতে পারি, তার বেলায় বাধা কেন?

০৬. ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত

ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত। আলতাফ অফিসে চলে যাবার পর সিদ্ধান্ত নিই আলতাফ যখন যাবে না, নিজেই যাব। রুবিনার বাড়িতে ফোন করে ডাক্তারের ঠিকানা পাওয়া যায়। নয়াপল্টনে বসেন, সকালে দেখানো যায়। নয়াপল্টনে সেই ডাক্তারের চেম্বার খুঁজে বের করি। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। ডাক্তারের দেখা মেলে। ভয় ভয় লাগে। ডাক্তার জিজ্ঞেস করেন রোগী কে। রোগী যে ঠিক কে আমি বোঝাতে পারি না। বুড়ো মত ডাক্তার ভদ্রলোক ছাড়াও রুমে আরও লোক ছিল। বেশ লজ্জা করছিল বলতে কার অসুখ কী অসুখ। সাহস করে একা একা ডাক্তার পর্যন্ত চলে এসেছি বটে কিন্তু কী কথায় বা কী ভাষায় যে এসব বলা যায় আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। ওঁরাই আমাকে প্রশ্ন করলেন আমি ম্যারেড কি না। ম্যারেড জানবার পর প্রশ্ন স্বামী কোথায় স্বামী আসেনি কেন আসেনি এধরনের আরও প্রশ্নের জবাব দেবার পর আমার সমস্যা কি জানতে চাইলেন ডাক্তারের এসিসটেন্ট। কয়েকজোড়া কান সজাগ আমার সমস্যা শুনবার জন্য। অপ্রস্তুত বোধ করলাম। এত ব্যক্তিগত সমস্যা কি একঘর মানুষের সামনে হড়হড় করে বলে ফেলা যায়। ঢোক গিলে গিলে টেবিলের কোণা নখে খুঁটে খুঁটে চোখ নিচের দিকে নামিয়ে যা বললাম তা হল রাতে স্বামীর সঙ্গে যা হয় তা আমার ভাল লাগে না। কেন ভাল লাগে না? ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন। বলতে সংকোচ হয় আবার রুবিনা ভাবীর কথাও মনে হয়, তিনি বলে দিয়েছেন ডাক্তারের কাছে কিন্তু লজ্জা শরম ভেঙে সব বলবেন; তাই খানিক থেমে, খানিক কেশে আমি বলি–আমি কোনও সুখ টুখ পাই না?

–স্বামীর কি ইরেকশান হয়?

ডাক্তারের কথায় কোনও উত্তর দিতে পারি না। উত্তর দেব কী, ইরেকশান মানেই আমি বুঝতে পারি না। নিরুত্তর আমাকে ডাক্তার বুঝিয়ে বললেন ইরেকশান মানে কী। আমি বললাম আমি জানি না ওর এসব হয় কি না।

ডাক্তার প্রেসকিপশান লিখবার জন্য কলম খুলেছিলেন, বন্ধ করে বললেন স্বামীকে আসতে হবে।

–ও যে আসতে চায় না!

–রোগী না এলে ট্রিটমেন্ট হবে কী করে! আমাদের তো দু’জনকে পরীক্ষা করে বুঝতে হবে।

আমি মাথা নেড়ে চলে এলাম। বাড়ি ফিরতেই শাশুড়ি বললেন–একা একা কোথায় গিয়েছিলে?

–ডাক্তারের কাছে।

–কেন?

–একটু অসুবিধে ছিল।

–অসুখ বিসুখ হলে আলতাফ তোমাকে নেবে। তুমি বাড়ির বউ একা যাবে কেন? আর আমাকেই বা বলে গেলে না কেন?

–আপনি ঘুমিয়ে ছিলেন।

–ঘুমিয়ে থাকলে একা চলে যাবে এ কেমন কথা? আমার কি চিন্তা হয় না? কোথায় গেলে, কী হল না হল।

–আমি তো বলেই গিয়েছি রমজানের কাছে, যে, জরুরী কাজে বাইরে গেলাম।

–তুমি বলে গেলেই তো হবে না। আমাদের বুঝতে হবে আদৌ তোমার বাইরে যাওয়া দরকার কি না। ডাক্তারের কাছেই বা কেন যাবে।

আমি কোনও কথা না বলে শোবার ঘরে চলে যাই। কোলের কাছে বালিশ আঁকড়ে নিয়ে শুয়ে থাকি। আলতাফ বিকেলে ফিরলেই খবরটি তাকে পরিবেশন করা হয়, আমি একা বাইরে গিয়েছিলাম। শাশুড়ি এও বললেন-বউমার নাকি শরীর খারাপ। শরীর খারাপ হলে ডাক্তারের কাছে তুই কি নিয়ে যেতে পারিস না? বাড়ির বউ সে, তার কি একা যেতে হবে ডাক্তারের কাছে? লোকে বলবে কী। আলতাফ একটি কথা না বলে ঘরে আসে। এসেই তার জিজ্ঞাসা, কোথায় গিয়েছিলে?

–নয়াপল্টন।

–কেন?

–ডাক্তারের কাছে।

আলতাফের মুখচোখ লাল হয়ে ওঠে। বলে–ডাক্তারের কাছে মানে? অসুখ হয়েছে নাকি তোমার?

আমি কোনও উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে থাকি আলতাফের চেপে রাখা চোয়ালের দিকে। আলতাফ একসময় চোখ নামিয়ে নেয় তার। সে রাতে সেও পাশ ফিরে ঘুমোয়। আমিই তাকে আলতো পর্শে জাগাই। বলি–তুমি কি রাগ করেছ?

কথা বলে না আলতাফ। রাগ তো করেছেই সে। ভাবি, তাকে আদর করে বোঝাই। এ যদি কোনও রোগ হয়, রোগের তো চিকিৎসা প্রয়োজন। কণ্ঠে মমতা এনে বলি–আমি তো আমাদের ভালর জন্যই ডাক্তারের কাছে গিয়েছি।

আলতাফ হঠাৎ চিৎকার করে বলে–তুমি তোমার রোগ সারাতে গিয়েছিলে। আমার রোগের কথা বল কেন? আমাদের শব্দটা দয়া করে উচ্চারণ করো না।

কথাগুলো সে এমন চিবিয়ে চিবিয়ে বলে যে তার গা থেকে আমার হাত সরে যায়। আমার উৎসাহ উবে যায়।

 ০৭. বাইরে বের হওয়া নিয়ে

আমার বাইরে বের হওয়া নিয়ে আলতাফ কখনও আপত্তি করেনি। কিন্তু আজ যখন বলি–আমি গুলশান মার্কেটে যাব। আলতাফ বলে–আমি বিকেলে এসে নিয়ে যাব।

–কেন, আমি কি একা যেতে পারি না?

–তা পারবে না কেন? তুমি অনেক কিছুই পার।

–তবে একা যেতে না করছ কেন?

–আমার ইচ্ছে।

–তোমার ইচ্ছে হলেই হবে? আমার কি একটুও ইচ্ছে থাকতে নেই?

–তোমার ইচ্ছের কমতি হচ্ছে কোথায় শুনি! শাড়ি গয়না সব দিয়ে ভ তোমাকে?

–শাড়ি গয়না দাও কেন? আমি তো বলছি না আমার জন্য এইসব নিয়ে এস। এগুলো না হলে আমি মরে যাব।

–মুখে না বললেও মনে মনে ইচ্ছে আছে জানি।

–ভুল জানো। ও তোমার ভুল একটা ধারণা। ভাবো মেয়ে মাত্রই শাড়ি গয়নার পাগল। দাও বলেই মেতে থাকি এসব নিয়ে। তি;

–মেতে থাকার জন্য আর কী আছে মেয়েদের? বাড়ি ঘর সামলাবে। বাচ্চা বাচ্চা মানুষ করবে আর সাজগোজ তো করতেই হবে।

–কেন করতে হবে? না সাজলে আমি যে হীরা সেই হীরা কি আর থাকব না?

–তা হয়ত থাকবে। তবে রূপেরও তো দাম আছে। রূপের জন্যই তো…..

–রূপ মানে?

–রূপ ঠিক রাখতে হবে না। মেয়ে হয়েছ, বোঝ না?

–রূপ ঠিক না রাখলে কী হবে?

–বিয়ে হবে না। লোকে পছন্দ করবে না।

–লোকের পছন্দের জন্যই বুঝি মেয়েরা?

–আমি পছন্দ না করলে কী গতি হত তোমার?

–কিছু একটা হত নিশ্চয়ই।

–হত। ওরকমই হত। এত আরাম আয়েশ হত না। সারাদিন চুলোর পাড়ে থাকতে হত। স্বামী শাশুড়ির মার খেতে হত।

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি–হ্যাঁ, এখন তো স্বামী শাশুড়ির আদর পেয়ে একেবারে মরে যাচ্ছি। তোমরা খুব সুখ দিচ্ছো আমাকে। এত সুখী আমি, তারপরও আমার দুঃখ করা মানায় না। আমি খুব বাজে মেয়ে। খুব লোভী মেয়ে। তাই না?

এ কথায় আলতাফ চুপ হয়ে যায়।

আমি আবার কথা পাড়ি–তুমি কি চাও না আমি একা কোথাও যাই!

–না।

–ঠিক আছে আমাকে বাবার বাড়ি রেখে এস।

–কেন, ও বাড়িতে যাবে কেন শুনি!

–ওখানে আমি থাকব কদিন।

–সারাজীবন তো থাকলেই ওখানে। আবার ওখানে থাকার কী আছে!

–সেটা আমি জানি কী আছে। তুমি তো আর নিজের বাড়ির বাইরে থাকছ না, তুমি কী বুঝবে।

–কদিন থাকতে চাও?

–আমার যতদিন ইচ্ছে। আমি একটু রাগ দেখিয়েই বলি।

–তোমার যা ইচ্ছে, তাই করতে চাও?

–যা ইচ্ছে তাই করা কি খুব খারাপ জিনিস? আমার ইচ্ছে গুলো তো এত খারাপ নয়।

–ভাল আর দেখি কোথায়?

আলতাফ বলে আর এদিক ওদিক ঘটে। শাশুড়ির ঘরে যায়। ওখানে তাদের গোপন শলাপরামর্শ হয়। একসময় কখন অফিসে চলে যায়। আমাকে বলেও যায় না। বিকেলে ফিরলে বলি–আজ রুবিনা ভাবীর বাসায় যাব।

-কেন?

–ইচ্ছে হচ্ছে।

–বাজে ইচ্ছে যেন আর না হয়। ওই ম হলা তোমাকে খারাপ বানাচ্ছে।

–ওর কোনও দোষ নেই।

–দুই শয়তান মিলে নোংরা কথার আড্ডা বসিয়েছিলে। আবার বলছ দোষ নেই।

আমার আর কথা বলতে ইচ্ছে করে না। কী কথা বলব? আলতাফকে দূরের, খুব দূরের কেউ মনে হয়। সে যে আমার কাছের মানুষ, আপন মানুষ, মনেই হয় না। আলতাফের আচার আচরণ ভাষা সব বদলে গেছে। ও যে রেগে গেলে কী কুৎসিৎ হতে পারে, কী অশ্লীল ভাষায় কথা বলতে পারে তা ওকে না রাগালে আমার জানা হত না। একা একটি বাড়িতে আমার দম বন্ধ লাগে। শ্বশুর শাশুড়িও আমাকে তেমন কাছে ডাকেন না। তারা ধরেই নিয়েছেন বউ সংসারি না, দেমাগি, উদাসিন, নাচ উঁচু। শাশুড়ির ঘরে গেলে আমাকে বলেন–নামাজ টামাজ তো মনে হয় পড়ই না। জানো পড়তে নাকি মা বাপ কিছু শেখায়নি। আমি বলি–শিখিয়েছে, কিন্তু পড়ি না। ইচ্ছে হয় না। তিনি মেজাজ খারাপ করে বলেন–এত উচ্ছংখল হলে কী করে চলবে! আমি চুপচাপ চলে আসি। নামাজ রোজা না করা মানে যে উচ্ছংখল হওয়া তা আমি মানতে পারি না। শাশুড়ির ভাবনা চিন্তার সঙ্গে আমার ভাবনা মেলে না, মেলাতে পারি না। দুরত্ব অনুভব করি অনেক।

বাড়িতে ফোনই একমাত্র সঙ্গী আমার। বাবা মা, ভাই ভাবী, পুরানো বান্ধবীদের সঙ্গে কথা বলি। বাবা মা বলেন–মানিয়ে নিতে চেষ্টা কর। ঠিক হয়ে যাবে। ভাই বলে–প্রথম প্রথম এডজাস্ট হতে চায় না, পরে দেখবি সব ঠিক। সম্পর্কটা আসলে অভ্যেসের ব্যাপার। বান্ধবীরা বলে–তুই তো খুব সুখে আছিস শুনেছি, চমৎকার স্বামী পেয়েছিস। কী হ্যাঁণ্ডসাম ছেলেরে বাবা। রুমা নামে এক বান্ধবী বলে খুব আদর করে তোকে, তাই না? সুন্দরী বউ করবে না! আমাদের মত অসুন্দর মেয়েদের যে কী অবস্থা হবে!

বিবাহিত বান্ধবীরা কিন্তু ঘুরে ফিরে সেই প্রশ্নেই যায়–সারাদিনে ক’বার হয় রে তোদের?

প্রশ্ন শুনে আমার আবার জেগে ওঠে সেই বোধ, শরীর থেকে কষ্ট দলা পাকিয়ে পাকিয়ে কণ্ঠে ওঠে। বলি–ক’বার আর! জানি না।

বীদের মধ্যে শারমিনের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব, গাঢ়। সে বলে, হেসেই বলে–লুকোচ্ছিস?

–লুকোনোর কী আছে। এসব আলোচনা আমার ভাল লাগে না।

–বলিস কী এখনও বাচ্চা টাচ্চা নেই, এসব কথা ভাল না লাগার কী আছে! বিয়ের পর অন্তত পাঁচ ছ বছর তো এই সুখেই যাবে।

— কিসের সুখ? আমি সুখ বুঝি না।

–মানে?

–মানে বুঝি না। শুধু কষ্ট হয়।

–কষ্ট হয়? তাহলে ডাক্তার দেখা। কষ্ট হওয়ার তো কথা নয়।

–ডাক্তার দেখাবে না আলতাফ। জেদ ধরেছে। আমি দেখিয়েছিলাম। তাতেই ক্ষেপেছে।

–বলিস কী! আমরা ভাই সুখে আছি। এধরণের কোনও প্রব্লেম নেই। যদিও অন্য প্রব্লেম আছে।

–কী প্রব্লেম?

–পড়াশুনা করতে চাচ্ছি, হাসবেণ্ড দিচ্ছে না। চাকরি করতে চাচ্ছি, তাও না করছে। সারাদিন বাড়িতে বসে থাকতে ভাল লাগে না।

–আমারও ভাল লাগে না। চল দুজন মিলে কিছু একটা করি। পড়ালেখা নয়ত অন্য কোনও কাজ টাজ।

–চমৎকার। তোর হাসবেণ্ডকে বল, আমিও বলি। ঘরে বসে মনে হয় জং ধরে যাচ্ছে।

সারাদিন ওই কথাই মনে ঘোরে ফেরে। কিছু একটা কাজ যদি করা যেত। অথবা পড়াশুনাই। আলতাফ অফিস থেকে ফিরলে কথা পাড়ি। বলি–শোন, সারাদিন ঘরে বসে থাকতে ভাল লাগে না। কিছু একটা করা উচিত আমার।

বিছানায় গা এলিয়ে আলতাফ বেনসন এণ্ড হেজেস ধরায়। ঠোঁটে শলা চেপে বলে–কি করা উচিত?

–বি এ তে ভর্তি হয়ে যাই।

–এটা আবার কার বুদ্ধিতে হল? রুবিনা এসেছিল নাকি?

–না। আমার বান্ধবীরা, যাদের অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে গেছে, ওরা আবার পড়ালেখা করছে। কলেজে ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছে।

–বাহ শখ কত। পিঁপড়ের পাখা গজিয়েছে।

আমি চুল আঁচড়াচ্ছিলাম। চিরুনি ধরা হাত কেঁপে ওঠে সামান্য। বুকের মধ্যে যেন উপুড় হয়ে পড়ে এক বাটি ঠাণ্ডা জল। ম্লান কণ্ঠে বলি–তুমি খুব বদলে যাচ্ছ।

–বদলাব না। যেমন কুকুর তেমন মুগুর। শব্দগুলো চিবিয়ে চিবিয়ে বলে আলতাফ। আলতাফ ইচ্ছে করে হুল ফোঁটানো কথা বলে। আমার মনে হয় ও চায় আমি ওর কথায় কষ্ট পাই। ওর খাই পরি তাই ইচ্ছে না হলেও শরীর পেতে দিতে হয় বিছানায়, ও তার মন মত যেন খেলা করতে পারে। দিন দিন একটা জড় বস্তুতে পরিণত হই আমি। আমার বোধ আমার আবেগ উচ্ছাস সব লোপ পায়। আলতাফের প্রতি ভালবাসা বলতে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। থাকে একধরণের অভ্যেসের বসবাস। বসবাস তো যে কারও সঙ্গেই হতে পারে। যে কোনও উদ্ভিদ অথবা মানুষের সঙ্গেই। আলতাফকে পৃথক কিছু মনে হয় না আমার। যে কোনও ক্লীব বা যে কোনও প্রাণীই হতে পারে সে। আমার জন্য সে কোনও অপরিহার্য কিছু নয়। আমার মনে হয় ও না হলেও আমার চলবে। আমার বেঁচে থাকায় অথবা যেমন আছি তেমন থাকায় সামান্য ছেদ পড়বে না।

» ০৮. বাড়িতে আমার এক মামাতো ভাই

বাড়িতে আমার এক মামাতো ভাই বেড়াতে আসে। রতন। আমার সমবয়সী। বন্ধুর মত।

–কীরে খুব সংসার করছিস! তুই সেদিনের মেয়ে, এত সংসারি হলি কি করে? ঘরবাড়ি ঘুরে ফিরে দেখতে দেখতে রতন বলে।

–মেয়েরা সংসারি না হলে আর হবে কী! আমার বিষণ্ণ উত্তর। রতনের সঙ্গে ছোটবেলার গল্প করি। একবার পেয়ারা গাছে আমার জন্য পেয়ারা পাড়তে উঠেছিল। পড়ে পা ভেঙে গিয়েছিল ওর।–আহা তোর জন্য সে কী কেঁদেছিলাম আমি। আচ্ছা, তোর মনে আছে টুটুলের কথা? কী ধরাটা খেয়েছিল! মামা কী এখনও রাতে রাতে ভূত দেখে চমকে ওঠে? আমার চোখের তারায় থিরথির করে নষ্টালজিয়া কাঁপে।

রতন চটপটে ছেলে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। দুটো তিনটে মেয়ের সঙ্গে তার আলাপ পরিচয় হয়েছে, ওদের কী করে প্রেমে পড়ানো যায়, সেই ফন্দি করে। এ নিয়ে আমরা তুমুল হাসি। রতন ঠোঁট উল্টে বলে–আসলে জানিস হীরা, একটু খরচ করতে পারলে মেয়েদের পটানো যায়।

–কী রকম খরচ?

–ধর, কেন্টিনে চা সিঙারা খাওয়ালাম। চায়নিজে নিয়ে গেলাম। কিছু গিফট করলাম।

–আরে না, মেয়েরা এইসব পেলে খুশি হবে কেন? ওরা এত লোভী নাকি!

–তুই মেয়েদের চিনিসই না, ওরা খুব পাজি হয়।

–পাজিই যদি হয়, তবে আর প্রেম করতে চাও কেন?

–চাই। প্রেম তো করতেই হবে।

–পাজিদের সঙ্গে প্রেম করতে হবে?

–এছাড়া উপায় কী!

–ওদের ছাড়া তাহলে তোমার উপায়ও নেই।

রতন চলে যেতে চায়। আমি আটকে রাখি, বলি–খেয়ে যাও।

দুপুরে এক সঙ্গে খাই। রতন বলে–তুই খুব সুখে আছিস।

–সুখ করে নাম? বাড়ি গাড়ি, ভাল খাওয়া দাওয়া, টেলিভিশন, ভি. সি. আর, ডিশ এন্টেনা……এসবেই বুঝি খুব সুখ থাকে?

–তা তো থাকেই, যা চাচ্ছিস, পাচ্ছিস।

–অনেক জিনিসপত্র এ বাড়িতে হয়ত আছে। কিন্তু যা চাচ্ছি তা পাচ্ছি, এটা ঠিক নয়।

–বলে না সুখে থাকলে ভূতে কিলায়, তার হয়েছে সেই রোগ। রতন রাগ করে বলে। সে চায় তার বোনটি সুখে আছে, সুখে থাক। এই সুখের মধ্যে কখনও কোনও অসুখ যেন বাসা না বাঁধে। রতন দুপুরের খাবার খেয়ে চা টা খায়। বলে–দুলাভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু বিকেলে জরুরি একটা কাজ আছে রে। চলে যেতে হবে। তুই দুলাভাইকে নিয়ে বেড়াতে আসিস। বাড়িতে তোদের কথা খুব হয়, তোদের মানিয়েছে খুব এই সব। সময় নিয়ে যাস, কেমন? আলতাফ ঘরে ফিরলে রতনের কথা বলি। ও এসেছিল, দুপুরে খেয়ে গেছে এইসব। আলতাফ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে–কোন রতন?

–ওই যে এনায়েত মামার ছেলে। চেনো না? তোমাকে না সেদিন শার্ট প্রেজেন্ট করল।

–ও। ও কী বলল?

–গল্প টপ করল।

–কী গল্প করলে?

–এই ছোটবেলার কথা টথা। তারপর ওর ইউনিভার্সিটির গল্প।

–আর?

–আর কী এইসবই।

–বাড়ি বয়ে ছোটবেলার গল্প করতে এসেছে?

–মামাতো ভাইএর সঙ্গে ছোটবেলার গল্পই তো হবে। এক সঙ্গেই যখন বড় হয়েছি। আমি তো দশ বছর অব্দি নানাবাড়িতেই ছিলাম।

–বড়বেলার কোনও গল্প করনি?

–বড়বেলার মানে?

–এই ধর তোমার স্বামীটি কেমন, তাকে তোমার ভাল লাগে কি না। সহ্য হয় কি না। তাকে ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে কি না।

–তোমাকে নিয়ে কোনও কথাই হয়নি।

–ও, তাহলে নিজেদের নিয়েই মত্ত ছিলে! আমাকে ভুলেই ছিলে!

–তোমাকে ভুলব কেন!

–আমি কী করে বিশ্বাস করি?

–এসব বলে আমার লাভ কী বল?

–লাভ নিশ্চয়ই আছে। লাভ না থাকলে আর বলছি কেন?

–তুমি যে কী সব বলছ, বুঝতে পারছি না।

–বুঝতে পারবে কেন। তোমার তো মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেছে।

মাথা সত্যিই ঝিমঝিম করে ওঠে আমার। আলতাফ খেতে বসে বারবারই বলে–মামাতো ভাইটাই এর দৃষ্টি সুবিধের হয় না। ও কি আবার আসবে নাকি? জরুরি না হলে…..কী দরকার আসার?

.

সারারাত আমার ঘুম আসে না। কেমন দম বন্ধ লাগে। অল্প অল্প করে কোথায় ঠেলে দিচ্ছে সে আমাকে। রতন আর না আসুক, আলতাফ চায়। আমার এ কথা মানতে হবেই। কারণ এই বাড়িটি আলতাফের। যতই আমি বলি এটি আমার সংসার, আমার বাড়ি, আসলে যে এটি আলতাফের বাড়ি, তা সে সময় মত বুঝিয়ে দেয়। আমার একজন আত্মীয়কেও যে ইচ্ছে করলে আমি বাড়িতে ডাকতে পারি না, তাও কায়দা করে বোঝায়। আমার কিছুতে অধিকার নেই। না সম্পদে, না স্বাধীনতায়। মামাতো ভাইদের দৃষ্টি ভাল হয় না বলবার কারণ কী, রতন কি আমার দিকে খারাপ চোখে তাকায়। আলতাফের অযথা সন্দেহ হয়, স্পষ্ট বুঝি। এই অমূলক সন্দেহের কারণ কী তবে এই যে সে ভাবছে আমি কারও প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছি? রতনের প্রতি? এক রাতে আলতাফের তিন বন্ধু আসে বাড়িতে। এদের সবার সঙ্গে আমার আলাপ আছে। আলতাফ এদের বাড়ি আমাকে নিয়েও গেছে। ড্রইংরুমে বসে তারা যখন ধুম আড্ডা দিচ্ছে, আমি ভাবছি ও ঘরে গিয়ে বসব, চা টা খাব এক সঙ্গে। এলো চুলগুলো আঁচড়ে নিয়ে যেই যাব, আলতাফ আচমকা ঘরে ঢুকে বলে।

–আমি বলেছি তুমি অসুস্থ। শুয়ে আছ।

–আমি তো অসুস্থ নই! বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করি।

–ওদের বলেছি তুমি অসুস্থ। তোমার ওঘরে যাবার দরকার নেই। ওরা লোক তেমন ভাল নয়।

–তুমি না নিজেই বলেছ মনজুর, হায়দার, লতিফ এরা খুব ভাল বন্ধু তোমার!

–দূর, যতসব বাজে। আলতাফ কপাল কুঁচকে বলে।

–কেন কী করেছে ওরা?

–এরা হেন খারাপ কাজ নেই যে না করে।

–আমার সঙ্গে তো করেনি।

–তার মানে আমার কথা তুমি শুনবে না? তুমি ওখানে শরীর দেখাতে যাবে!

–শরীর দেখাতে যাব, তোমারই তাই মনে হয়?

–হ্যাঁ, তাই।

–তুমি এত মিন। ছি ছি।

–যত ছিছি কর ঘরে বসে কর। ওঘরে যেতে হবে না।

ওঘর থেকে হাসির শব্দ শোনা যায়। ওরা মদ খাচ্ছে। প্রায় রাতেই স্কচ হুইস্কির • বোতল খুলে ওরা বসে। আমি শুয়ে থাকি একা ঘরে। নিজেকে বড় একা মনে হয়। জগৎ সংসারে কেউ নেই যেন আমার। আলতাফকে আপন ভাবতে শিখিয়েছিল আমাকে সবাই, পরিবারের লোকেরা, পাড়া পড়শি, চেনা অচেনা সবাই। আপন তাকে তো ভেবেছিলাম, কিন্তু এ আবার কেমন আপন লোক, সে একা ফুর্তি করে, আমাকে ছাড়া! আমাকে একা ঘরে ফেলে! হঠাৎ লক্ষ্য করি আমার চোখ ভিজে যাচ্ছে জলে। রোধ করতে পারি না। বালিশ ভিজে যায়।

রাতে বন্ধুবান্ধব বিদেয় করে শুতে আসে আলতাফ। মুখ থেকে মদের গন্ধ বেরোয়। আমার নাক জ্বলে যায়। কথা জড়িয়ে আসে আলতাফের। বলে–লেট মি লাভ। লেট মি লাভ হীরা।

আমি সরিয়ে নিই শরীর। আলতাফ শক্ত হাতে টানে আমাকে। হাত ধরে রাখে শক্ত মুঠোয়, ছাড়াতে চাই, শক্তিতে পারি না। মুচড়ে দেয় হাত। ককিয়ে উঠি কষ্টে, বলি-খবরদার আমাকে ছোঁবে না।

হঠাৎ আমার গালে কষে চড় দেয় আলতাফ। চমকে উঠি। আলতাফ, আমার স্বামী, সে আমাকে মারছে। বিশ্বাস করতে পারি না। কথা কাটাকাটি হয়, সেটা মানা যায়; কিন্তু শেষ পর্যন্ত গায়েও হাত তুলল। আমাকে আবারও চমকে দিয়ে পর পর আরও চড় কষাতে থাকে দুই গালে। আমি আমার শরীরের সবটুকু শক্তি খরচ করেও নিজেকে ছাড়াতে পারি না।

 ০৯. আলতাফ বাড়িতে ঘোষণা করে দিয়েছে

আলতাফ বাড়িতে ঘোষণা করে দিয়েছে আমার ফোন ধরা নিষেধ। বাড়ির বাইরে। যাওয়া নিষেধ। আমার কোনও আত্মীয় স্বজন যেন বাড়িতে আসতে না পারে। আলতাফের কোনও বন্ধু বান্ধবের সামনে যাওয়া নিষেধ। ছাদে ওঠাও নিষেধ। আমি বলেছি–তোমার এই নিষেধ আমি মানব না।

–না মানলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।

–তুমি আমাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলছ!

–হ্যাঁ বলছি।

আলতাফ দিন দিন দড়ি ঘেঁড়া হিংস্র সঁড়ের মত হয়ে উঠছে। সে আমাকে ছিঁড়ে ফেলতে চায়। দাঁতে কামরাতে চায়। আমি দিতে চাই না। কিন্তু শক্তিতে পেরে উঠি না। বাবা মা দু’জন আসেন একদিন। তাঁদের খবর দিয়ে আনানো হয়। আমি বাবা মাকে কোনও রাখঢাক না করে বলি–আমি কিন্তু এখানে থাকব না।

মা চমকে ওঠেন। বলেন-পাগল হয়েছিস? ছোট আছিস নাকি এখনও? বড় হয়েছিস, বুদ্ধি হয়েছে। পাগলামি করিস না মা।

–আমি থাকব না। থাকব না।

–কেন থাকবি না?

–আলতাফ আমার গায়ে হাত তোলে।

–গায়ে হাত তোলে? বাবা মা দুজনই খানিক অপ্রস্তুত হন।

–হ্যাঁ। আমি স্পষ্ট কণ্ঠে বলি।

–বলিস কী! বাবা মা দুজনেই গম্ভীর হন।

আলতাফ আসে। বাবা মার পা ছুঁয়ে সালাম করে। বলে–শরীর ভাল তো আব্বা? আম্মা আপনার ডায়বেটিস ধরা পড়েছে শুনেছিলাম।

–হ্যাঁ বাবা। শরীরটা ভাল যাচ্ছে না।

–আমার এক বন্ধু ডায়বেটিক হাসপাতালের ডাক্তার। আমি কাল সকালে গাড়ি পাঠিয়ে দেব। আপনি কাইলি চলে আসবেন। আমি নিজে আপনাকে নিয়ে হাসপাতালে যাব।

-–আচ্ছা বাবা। মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।

কথা শুরু করে আলতাফই। বলে–হীরার কি হয়েছে ওকে জিজ্ঞাসা করুন। ওতো যাচ্ছেতাই সব কাজ করছে। এখন আপনারাই শুনুন সব, যা ভাল বুঝুন, করুন।

–তুমি বল। তোমার স্ত্রী সে। মা মিনমিন করে বলেন।

–আমার স্ত্রী হলে কী হবে? স্ত্রীর কোনও দায়িত্ব কী সে পালন করে? তাকে জিজ্ঞাসা করুন।

মা বলেন–কী হীরা, আলতাফ কী বলছে, শুনছিস?

–শুনব না কেন? কানে খাটো না যখন……

–দায়িত্ব পালন করিস না। কেন করিস না বল। মা বলেন।

–আমার বুড়ো মা বাবা থাকেন এই বাড়িতে। জিজ্ঞাসা করুন আপনার মেয়েকে, সে কোনও খবর রাখে কিনা তাঁদের! তাঁরা কী খায়, কখন খায়, কোন খোঁজ রাখে সে?

–আমার খোঁজও তো কেউ রাখে না। আমি দাঁতে নখ কাটতে কাটতে বলি।

–তার মানে? তুমি কি চাও আমার মা তোমার খোঁজ নেবে? আর তুমি রাজরাণীর মত পালঙ্কে পা তুলে বসে থাকবে?

–খোঁজাখুঁজির কী আছে, যার খাওয়া সে খাবে, আমি তো প্রতিদিন খবর রাখছিই তোমার মা বাবার জন্য স্পেশাল খাবার তৈরি হচ্ছে। রমজান এর দায়িত্বে আছে। কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। তাছাড়া তাঁরা, যখন ডাকছেন আমি তো যাচ্ছিই।

–বাড়িতে আমার বউ থাকতে রমজানকে কেন এই দায়িত্ব পালন করতে হবে? আলতাফ আমার বাবা মার দিকে তাকিয়ে এই প্রশ্ন করে।

–কারণ আমার চেয়ে সে এইসব ভাল জানে। আর আরও একটা কারণ আছে। আমি আলতাফের চোখের দিকে তাকিয়েই বলি।

-কী সেই কারণ?

–কারণ আমি তোমার বাবা মার চাকর হবার জন্য তোমাকে বিয়ে করিনি।

–বিয়ে আবার তুমি আমাকে কবে করলে? বিয়ে তো করলাম আমি! আমি যা বলি, তোমাকে শুনতে হবে।

–আমি শুনব না। কী করবে তুমি?

–দেখুন আপনাদের মেয়ের অডাসিটি দেখুন।

বাবা বলেন–হীরা তুই বাড়াবাড়ি করছিস কিন্তু। আলতাফ তো একটি কথাও খারাপ বলেনি।

মাও বলেন–শ্বশুর শাশুড়ির সেবা না করলে স্বামীর মন পাওয়া যায় নাকি! আমাকে তো দেখেছিস সেই কাক ডাকা ভোরে শ্বশুরের অযুর পানি দেবার জন্য ঘুম থেকে উঠে গেছি। শাশুড়ি তিনবছর বিছানায় পড়েছিলেন। একা হাতে সব সামলেছি। তুই আমার মেয়ে হয়ে…..

–তুমি করেছ বলে আমাকে করতে হবে?

–এটাই নিয়ম। নিয়ম বদলাবি নাকি? যা হয়ে আসছে তাই তো করতে হয়।

–আমার যা করতে ভাল লাগে না তা আমি করি না।

–শোন হীরা তোমার ইচ্ছে মত এই সংসার চলবে না। আলতাফ কঠিন কণ্ঠে বলে।

–কেন চলবে না? এটা নাকি আমার সংসার। প্রায়ই বল নিজের সংসারের কাজ তুমি নিজে কর। নিজেরই যদি সংসার হয় তবে আমার ইচ্ছে মত কেন চলবে না। কাজের বেলায় আমি আর ইচ্ছের বেলায়, অর্ডারের বেলায় তুমি?

–মুখ সামলে কথা বল বেয়াদব মেয়ে। আলতাফের আসল চেহারা বেরিয়ে আসতে থাকে।

আমি কিছু বলবার আগেই বাবা মা দুজনই বললেন–তুই চুপ কর।

আমাকে চুপ করতে হবে। আমি বাঁচাল হয়ে গেছি। বাইরের ছেলে পেলেদের সঙ্গে আড্ডা মারতে চাই। আমি ঘরোয়া নই, লক্ষ্মী মেয়ে নই, সংসারি নই। গোপনে আমি এক মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছি। আলতাফ যে আমার স্বামী তা বুঝবার উপায় নেই, কারণ স্বামীর আদেশ আমি পালন তো করিই না উল্টো তর্ক করি। বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজনের সামনে সে মুখ দেখাতে পারে না। বাবা মা যাবার আগে আমাকে আলাদা ঘরে ডেকে নিয়ে যান। আমি বলি–কী বলবে, এত গোপন জায়গায় ডেকে আনছ কেন?

বাবা বলেন–জামাই যেভাবে বলে সেভাবে থাক। মুখে মুখে তর্ক করবি না। তোর দোষ কিন্তু কম না। তোর আশেপাশে দেখ বাঙালি বউঝিরা কী করে, তোর মা কী করেছে, তোর দাদী নানী কী করেছে। কারও স্বামীর সঙ্গে তো কারোর কোনও বিরোধ লাগেনি। তোর লাগে কেন, তোর যখন লাগে বুঝতে হবে তোর মধ্যে কোনও গোলমাল আছে।

–গোলমাল যা, তা ওর মধ্যে। আমার মধ্যে নেই।

–বাজে বকিস না। আলতাফ খুবই ভাল ছেলে। সবাই বলে।

–সবাই বললে তো হবে না। আমি যত জানি ওর সম্বন্ধে, তা তো আর কেউ জানে না।

–তোর তো মাথার ঠিক নেই এখন। পরে বুঝবি। আর রতন কেন আসে এই বাড়িতে?

–কেন আসে মানে? রতন আসলে অসুবিধা কী?

–আলতাফ যার আসা পছন্দ করে না তার আসার দরকার কী?

–কিন্তু কেন পছন্দ করবে না তা তো জানতে হবে। ধর তোমাদের আসাও যদি সে পছন্দ না করে তবে তোমরাও কি আর আসবে না? আর আমিও তা মেনে নেব?

–তুই বেশি কথা বলছিস হীরা। আমরা তোর চেয়ে বেশি বুঝি। দুনিয়াটা আমরা বেশি দেখেছি। যা বলছি তাই শোন। এখনও ভাল হয়ে চলার চেষ্টা কর।

–এর চেয়ে ভাল হতে আমি পারব না।

–নিজের কপাল নিজে নষ্ট করিস না। হীরা, আমার মেয়ে হয়ে তোর এই অধঃপতন, জামাই ডেকে এনে মেয়ে সম্পর্কে কমপ্লেইন করলে এর চেয়ে লজ্জার আর কী আছে! ছি ছি।

বাবা মা বিষণ্ণ মুখে চলে যান। আমি তাদের কোনও সান্ত্বনা বাক্য উপহার দিতে পারি না। আমি তাদের কথা দিতে পারি না এখন থেকে আমি ভাল হয়ে চলব। স্বামী শাশুড়ির কথা শুনব। আলতাফ বাবা মাকে কদমবুসি করে। বাবা মা আলতাফের মাথায় হাত বুলিয়ে বলনে–ভাল থেক বাবা। ওঁরা চলে যাবার পর আলতাফ বেশ গর্বিত গ্রীবা নিয়ে আমার গা ঘেঁষে চলাফেরা করে। সে তার প্রতি পদক্ষেপে বুঝিয়ে দেয় হি ইজ রাইট।

 ১০. বাড়ির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়

বাড়ির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় টেলিফোনে আমি হাত দিতে পারব না। ফোন তো আমি করতে পারবই না, রিং বাজলেও শাশুড়ি ধরবে। বাড়ির মেইন গেটে তালা দেওয়া হয়েছে। আমার চেনা কোনও লোক যেন আসতে না পারে। চাবি শাশুড়ির কাছে থাকবে। আলতাফের নতুন নিয়ম এটি। কিন্তু এই ব্যবস্থা তো আমার সহ্য হবার নয়। আমি কিছু করতে পারি না। অক্ষম আক্রোশে ছটফট করি।’

কারও কাছে যে আমার ফোন করা জরুরি তা নয়, কিন্তু আমি ইচ্ছে করলে ফোন করতে পারব না কেন? আমাকে কেন বাধা দেওয়া হবে। এর নাম বাধা নয়, অপমান, স্রেফ অপমান। আমি কী এমন তুচ্ছ মানুষ যে আমি একজন মানুষ, আর সে আমারই মত মানুষ, দিব্যি আমাকে অপমান করবে আর তা সহ্য করতে হবে আমাকে। আলতাফ কথায় কথায় বলেছিল আমি তার খাই পরি, তাই তার কথা আমাকে শুনতে হবে। কারও খেলে পরলে যদি তার অন্যায় গুলো বরণ করে নিতে হয় শরীরে মনে–তবে না হয় আমি না-ই খেলাম পরলাম তার। নিজের খাওয়া পরা জোটাতে খুব কি অসুবিধে হবে! না হয় একটু অসুবিধে হোক। যা ভোগ করছি, তা তো আর সব সুবিধে নয়। আমাকে যে সে খাওয়াচ্ছে পরাচ্ছে তার মূল্য কি আমাকে আমার সব ইচ্ছের মৃত্যু ঘটিয়ে দিতে হবে!

আমার এও মনে হয় আমি আসলে নিজেকেই অপমন করছি। আমাকে যদি আমি কারও দ্বারা অপমানিত হতে দিই, এর অর্থ নিজেকেই অপমান করা আমার। আলতাফের কোনও পরিবর্তন নেই জীবনে। সে যেমন ছিল তেমনই আছে। মাঝখান থেকে লাভ হয়েছে রাতে সে খেলা করবার জন্য আস্ত একটা শরীর পায়। আমি কী পাই! বাবার সংসারে খাওয়া পরা পেতাম, এ সংসারেও পাই। বাবার সংসারে শরীরে যন্ত্রণা হত না, এ সংসারে হয়। তাই বলে বাবার সংসারটি যে আমার জন্য খুব চমৎকার একটি জায়গা ছিল তা আমার মনে হয় না। কারণ ওই বাড়িতে আমাকে তৈরি করা হয়েছে এই বাড়ির জন্য। আর কিছুই করা হয়নি। আমি যেন ভাল বঁধতে পারি, ভাল সাজতে পারি, ভাল ঘর গুছোতে পারি এসবেরই ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। আমি যেন আমার স্বামীকে তুষ্ট করতে পারি, তৃপ্ত করতে পারি–আমি যেন নত হতে পারি, মুক্ত হতে পারি–তারই শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। আমিও না বুঝে শিখেছি। ভেবেছি এসবেই বোধহয় সত্যিকারের সুখ। কিন্তু কই সুখ তো আমি পাচ্ছি না। আমার কেবলই মনে হচ্ছে এ আসলে সুখের কোনও পথ নয়। সুখের জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করা ঠিক নয়। স্বামী যদি সুখ দেয়, সুখ হবে, না দিলে হবে না–এই ব্যাপারটি আমাকে কিছুতেই স্বস্তি দেয় না। নিজেকে আমার জড় পদার্থ জাতীয় কিছু মনে হয়। আলতাফ আছে সুখে। স্বস্তিতে। যখন যা ইচ্ছে হচ্ছে করছে। খাচ্ছে দাচ্ছে চাকরি করছে ঘুমোচ্ছে আড্ডা দিচ্ছে। তাকে বাধা দেবার কেউ নেই। আমি তাকে বাধা দেবার ক্ষমতা রাখি না। কারণ আমার সে খায় না, আমার সে পরে না–সোজা হিসেব। এক খাওয়া পরার জন্য কত কিছু নির্ভর করছে, ভাবাই যায় না।

আচ্ছা এরকম কী হতে পারে না আমি নিজের খাওয়া পরবার ভার নিজেই নিলাম। হতে তো পারেই, হবে না কেন। মানুষ কী না পারে, সবই সম্ভব মানুষের জীবনে। ঘরের বন্দি জীবন ধীরে ধীরে আমার মাথাটা খারাপ করে দিচ্ছে। আমি একবার ভাবি, চুপিচুপি বেরিয়ে যাব, কেউ জানবে না কোথায় যাব, দূরে কোথাও গিয়ে কিছু একটা করব, জগতে কি কাজের অভাব! আবার ভাবি, এই যে মেয়েরা ‘হাউজ ওয়াইফ’ হয়ে বসে আছে, এরা তো বেশ সুখেই আছে মনে হয়। কারও কোনও অভিযোগ নেই। এরা কি আসলেই সুখে থাকে না কি ভান করে সুখী মানুষের!

এক বিকেলে, তখনও ফেরেনি আলতাফ, লতিফ আসে বাড়িতে। শাশুড়ি রমজানকে দিয়ে গেটের তালা খোলান। আলতাফের বন্ধু লতিফ। লতিফ বাড়িতে ঢুকেই ভাবী ভাবী বলে ডাকে। আমি ডাক শুনে গিয়ে বলি–আপনি বসুন, আমি, ভেতরে কাজ আছে কিছু করি।

–কী ব্যাপার এভয়েড করছেন মনে হচ্ছে। লতিফ হেসে বলে।

আমি বিব্রত হই। আসলে আলতাফের নিষেধাজ্ঞার কথা ভাবছিলাম। সে আবার লতিফের সামনে কেন এলাম এ নিয়ে কোনও ঝামেলা বাধায় কি না। খামোকা লতিফের অপমান।

–কী হয়েছে আপনার বলুন তো আজকাল আমাদের বাড়িতে যান না। আমরা এ বাড়িতে এলে কাছে আসেন না। শুনেছি অসুখ হয়েছিল। আর ইউ ক্যারিং?

আমি কোনও কথার জবাব দিই না। জবাব দেবার কিছু তো নেই।

লতিফ আবার বলে–আমরা আপনাকে খুব মিস করি ভাবী।

কারণ আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি।

–কী ব্যাপার কথা বলছেন না কেন?

আমি আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলি।

ছোটবেলায় বাবা মা বকলে যখন খুব মন খারাপ হত, কোথাও একলা বসে থাকতাম, গলার কাছে কষ্ট গুলো জমে থাকত, কেউ এসে পিঠে হাত রাখলেই কেঁদে উঠতাম। লতিফের কথায় আমার কান্না পায়। আটকে রাখি।

–ভাবী, আমরা তো আপনার পর নই। বলুন কি হয়েছে। এত চমৎকার একটি মেয়ে, আপনি আপনার মুখ এমন মলিন থাকবে, এত বিপ্ন থাকবে, এ কী মানা যায়! কি হয়েছে আপনার?

–না। কী আর হবে, বাড়িতে তো অভাব কিছুর নেই।

–অভাব বুঝি কেবল জিনিসপত্রেরই হয়, আর কিছুর হয় না!

আমি চুপ হয়ে থাকি। অভাব যে কতকিছুর আছে সে আমি বুঝি। আমার হাড় মাংস মজ্জা জানে অভাব আমার শরীরকে কত তৃষ্ণার্ত করে রেখেছে।

লতিফ হেসে বলে–আলতাফের এই গুণটা খুব ভাল।

–কী গুণ? জিজ্ঞেস করতে হয় বলেই করা, এমনিতে ওর গুণ সম্বন্ধে জানবার আগ্রহ হয় না আমার। দোষ যার এত, তার গুণ আর কী হতে পারে!

–ও কিন্তু কোনও মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকায় না। বিয়ের আগে আমরা বলতাম, তোর বিয়ে করার ইচ্ছেও বোধহয় কোনও দিন হবে না।

–ও কি বলত? আমি জিজ্ঞেস করি কারণ ওর অদ্ভুত গুণটি আমাকে আকৃষ্টই করে।

–ও হাসত। হাসির কোনও অর্থ থাকত না।

–তো বিয়েই বা করল কেন?

–হঠাৎ। শুনলাম ওর বাবা বিয়ের জন্য ধরেছেন। বিয়ে একটা করতেই হবে ছেলের। মেয়ে দেখলে দশ হাত দূর দিয়ে হাঁটত। আমরা ভেবেছিলাম বিয়ে করলে ঠিক হয়ে যাবে। তাই বিয়ের জন্য আমরাও চেষ্টা করেছি।

আমি মগ্ন হয়ে শুনি। বেশ চমকপ্রদ সংবাদই বটে।

লতিফ হেসে বলে–যা ভেবেছিলাম, বিয়ে করলেই সব ঠিক। তাই হল।

–তাই হল নাকি? আমিও হেসে জিজ্ঞেস করি।

–হল কিনা আপনি সবচেয়ে ভাল জানেন। দেখছেন না কেমন বউ পাগল ছেলে হয়েছে। আমি নিরুত্তর থাকি। লতিফকে বলতে পারি না আলতাফের প্রবলেমগলো। শাড়ির আঁচল পেতে থাকি আঙুলে। বাজে দুটো অভ্যেস আমার যায় না। নখ খোটা আর শাড়ির আঁচল আঙুলে পেচানো। আমার কষ্টগুলো এমনই, পৃথিবীর কাউকে বলা যায় না। বাবা মা জানতে চায়, আমি বলতে পারি না। লতিফকেও বোঝাতে পারি না কিছু, সংকোচে ভারি হয়ে থাকে আমার জিভ।

লতিফের সঙ্গে কথা বলছি, আলতাফ বাড়িতে ঢুকেই দেখে।

–আরে কী ব্যাপার তুই কখন এলি? উৎফুল্ল কণ্ঠস্বর আলতাফের।

–অনেকক্ষণ। ভাবীর সঙ্গে গল্প করছিলাম।

–কী হীরা চা টা দাওনি লতিফকে?

–না। ঠিক আছে বস তোমরা, আমি দিচ্ছি।

নিজেই চা করে নিয়ে আসি। আলতাফ দেখে বলে–বাহ লতিফের অনারে আমার বউএর বানানো চা খেতে পারছি। লতিফ তুই প্রায়ই আসিস তো।

আলতাফ চায়ে চুমুক দেয় আর আমার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকায়। আলতাফের মধ্যে সেই ভয়ংকর রূপের লক্ষণই নেই। বিশ্বাস হতে চায় না এই লোকটিই কারও সঙ্গে আমার কথা বলা নিষেধ করে দিয়েছে। দেখে মনে হয় আমি যে লতিফকে এতক্ষণ সঙ্গ দিয়েছি, সে খুব কৃতজ্ঞ এতে।

–ভাবীকে নিয়ে আয় একদিন আমার বাড়িতে। ভাবী মনে হয় খুব বোর ফিল করেন। একা বসে থাকেন।

–ওর জন্য খুব কষ্ট হয়। কিন্তু কী করব বল, আমি তো সময় দিতেই পারি না। বেচারাকে কোথাও নিয়ে যেতে পারি না।

আলতাফের কথায় আমার বিস্ময় বাড়ে। হয়েছে কী তার! যে লোক আজ সকালেই বলে গেছে আমার বাড়িতে বসে তুমি তোমার যা ইচ্ছে তা করতে পারো না। তোমার পছন্দ মত থাকতে চাইলে তুমি এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে থাকো। তার হঠাৎ এই পরিবর্তন কেন? আলতাফ কী তবে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। হতেও পারে, মানুষ তো আর সব সময় পশু থাকে না। পশুর স্বভাব মানুষের কাটেই একসময়। নাহলে সে আর মানুষ কেন!

লতিফ বলে-–মেয়ে দেখলে যে দৌড়ে পালাতি, ভাবীকে বললাম সে কথা।

আলতাফ হেসে বলে–পালাব না কেন? বিয়ে করে বউকেই ভালবাসব বলে তো সবাইকে এড়িয়ে চলেছি। হা হা হা।

আলতাফ এমন ভঙ্গি করে, যেন আমাকে সে ভালবাসে খুব।

–কী ভাবী, দড়ি একটু ঢিলে করুন। ও তো একেবারে ঘরকুনো ব্যাঙ হয়ে গেছে। আলতাফ হেসে বলে–বিয়ে করিস না। নিজের ভাল চাইলে বিয়ে করিস না। পুরুষ ছিলি, হয়ে যাবি আস্ত একটা গরু।

–ওরে ব্বাস। ওপথ তবে মাড়াচ্ছি না। হারে আলতাফ, বউ কি ক্রীতদাস বানিয়ে ছাড়ে?

–নির্ঘাত। আলতাফ হেসে বলে।

–ভাবী, ঠিক হচ্ছে না কিন্তু। পরে আমার বউও দেখে দেখে শিখবে। তখন উপায় কী হবে বলুন।

আলতাফ সিগারেট ধরায়। ধোয়া ছেড়ে বলে–বউ-এর কাছে হেরে যাওয়ায় আলাদা এক মজা আছে কিন্তু। আলতাফ মুচকি মুচকি হাসে। ও যদি আমার স্বামী না হত ধারণা করতাম ও স্ত্রীকে ভালবেসে বোধহয় মরেই যেতে পারে।

–তার মানে পুরোপুরি সারেণ্ডার করতে হবে? লতিফ চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে।

–তা না করলে খিটিমিটি। ঝাঁটার মার।

দুই বন্ধু হেসে ওঠে। আমি নির্বাক বসে থাকি। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারি না। এসব কী শুনছি আমি! আলতাফ যে আপাদমস্তক স্ত্রৈণর মত কথা বলছে। লতিফ চলে যায়। দুজন দরজায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ি। দরজা লক করে দিয়েই আলতাফ বলে–কখন এসেছিল লতিফ?

–চারটেয়।

–আমি বাড়িতে আসি পঁচটায়, ও চারটার সময় এসেছিল কেন?

–সে আমি কী জানি।

–তুমি নিশ্চয়ই জানো। তোমার সঙ্গেই যেহেতু গল্প করছিল।

–বাড়িতে যখন এসেছে রমজান গেট খুলে দিল। মা-ই বললেন। আমি তাকে চিনি। তাই বসিয়েছি। কথা বলেছি। খুব অন্যায় কিছু করেছি বলে তো মনে হয় না।

–কী কী বলেছ শুনি।

–কী আর! তোমার কথাই হল।

–আমার কথা? আমার দুর্নাম করলে বুঝি?

–দুর্নাম করব কেন?

–তবে কি সুনাম? তোমরা দুজন ঘনিষ্ঠ বসে আমার গুণগান গাইছিলে?

–ঘনিষ্ঠ বসতে কোথায় দেখলে?

–আমার চোখকে ফাঁকি দিতে চাও?

–ফঁকি দেওয়ার কী আছে, বুঝতে পারছি না। লতিফ তোমার বন্ধু। তোমার খোঁজে এসেছে। যেহেতু সে আমাকে ডেকেছে, আমি কথা বলেছি। এই ভদ্রতাটুকু তো করতে হবে।

–রাখ তোমার ভদ্রতা। লতিফ কেন এসেছিল ঠিক করে বল। আগে থেকে প্রোগ্রাম ছিল?

–মানে?

–মানে বোঝ না? কচি খুকি তুমি?

–কচি খুকি না হই কিন্তু তোমার কথা আমার ঠিক মাথায় ঢুকছে না।

–মাথায় ঠিকই ঢুকবে। সময় আসলে ঠিকই ঢুকবে।

–কী বলছ তুমি?

–এই লোফারটার সঙ্গে তোমার এত ভাব কেন হল আমি বুঝি না ভাবতে চাও?

–ওর সঙ্গে ভাব হতে যাবে কেন? তুমি কিন্তু যা তা বলছ।

–আমি ঠিকই বলছি। তোমার এসব বেলেল্লাপনা আমার সহ্য হচ্ছে না।

আলতাফ অফিসের কাপড় খুলে ফতুয়া আব ট্রাউজার পরে বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে। ওর দিকে তাকাতে আমার লজ্জা হয়। আমার এমন মনে হয়, সত্যিই বোধহয় লতিফের সঙ্গে আমার প্রোগ্রাম ছিল। আমার এমনও মনে হয় লতিফের সঙ্গে বেলেল্লাপনা বোধহয় করেছিই।

বারান্দায় একা বসে থাকে সে। আর আমি ভর সন্ধেয় ঘরের জানালার কাছে একা দাঁড়িয়ে থাকি। সন্ধে পার করে আলতাফ ঘরে ঢোকে। বলে–কী ব্যাপার ঘরের আলোও জ্বালোনি। খুব মনে পড়ছে বুঝি কারও কথা?

আমি কোনও উত্তর না দিয়ে জানালা থেকে সরে আসি।

–রমজানকে ডেকে চা খেতে হল! লতিফকে তো ঠিকই চা করে খাওয়ালে!

–তুমি তো বলনি চা করতে!

–বলতে হবে কেন, বুঝতে পাবো না আমার এখন চা দরকার?

আলতাফের কখন চা দরকার তা আমার বুঝতে হবে। কেন বুঝতে হবে? আমার দরকার কে বুঝবে। আমারও তো চায়ের তৃষ্ণা হয়। আমার তো আরও কিছু তৃষ্ণা হয়। আলতাফ কি কখনও জানতে চেয়েছে আমার কেন এত ভাল না লাগা? কখনও কি একবার পিঠে হাত রেখে বলেছে হীরা তোমার কষ্টের কথা বল?

–আর কী কী করলে তোমরা? আলতাফ বিছানায় আধশোয়া হয়ে জিজ্ঞেস করে।

–তুমি কি বলতে চাও? আমি প্রশ্ন করি।

আলতাফ আমার কথায় ঠোঁট বাকা করে হাসে। বলে-শুধু কি গল্পই করেছ? আর কিছু করনি?

–মানে?

–মানে তো বোঝই। তোমার তো আবার পুরুষ মানুষের শখ। তাই জিজ্ঞেস করছি। আমাকে দিয়ে তোমার তো হয় না।

–কী হয় না?

–শরীর শান্তি হয় না।

–হ্যাঁ, তা তো হয় ই না। আমি কড়া কণ্ঠে বলি।

–তাই পুরুষ মানুষ নিয়ে আমার বাড়িতে তুমি ফুর্তি করছ। তোমার সাহস কত, এক লোক এসেছে আমার কাছে, আমি বাড়ি নেই সে চলে যাবে। আর তুমি কিনা আমারই বন্ধু, তাকে ঘরে বসিয়ে মজা কর।

এই সব কথা শুনতে আমার ভাল লাগছে না। আমি নিজের কান চেপে ধরি। কী শুরু করেছে আলতাফ। ও আমাকে ভুল বুঝছে। আমাকে অবিশ্বাস করছে। আমি কী করে ভাঙাব তার ভুল! আমি কী করে মুক্তি পাব অজগরের ছোবল থেকে! নিজেকে বড় একা লাগে আমার। এই জগতে আমার মত নিঃস্ব একা অসহায় আর কেউ আছে বলে আমার মনে হয় না।

 ১১. লতিফ আবারও আসে একদিন

লতিফ আবারও আসে একদিন। হঠাৎ বিকেলে। বলে–ভাবী, আপনার সঙ্গে গল্প করতে এলাম।

–আমার সঙ্গে? আমি অবাক হয়ে বলি–আমার সঙ্গে কী গল্প?

–খুব খালি খালি লাগছিল তো, তাই।

–খালি খালি কেন। বন্ধু বান্ধব নেই?

–সবসময় বন্ধু বান্ধব ভাল লাগে না। লতিফ সোফায় আরাম করে বসে বলে।

আমি কি কথা বলব খুঁজে পাই না। শাশুড়ি একবার উঁকি দিয়ে দেখে গেছেন কে এসেছে; কার সঙ্গে কথা বলছি। আমি পড়েছি মুশকিলে। লতিফ হৈ হৈ করে ঢোকে। ভাবী ভাবী বলে ডাকে, আমাকে সামনে আসতেই হয় অগত্যা। কিছু একটা বলতে হয় বলেই বলা–বিয়ে করছেন না কেন? বিয়ে করে নিলেই তো পারেন! বউ নিয়ে বেড়াবেন। ঘুরবেন। একা একা লাগবে না।

–বিয়ে? পাত্রী কোথায় বিয়ে করার? আমার কী আর আলতাফের ভাগ্য? চাইলাম, আর সুন্দরী বউ পেয়ে গেলাম!

লতিফের কথাগুলো আমার ভাল লাগে না। আলতাফ যে বলেছিল একদিন লতিফ একটা লোফার। লতিফ একটা লোলুপ লুম্পেন। লতিফ হয়ত তাই। তা নয়ত সে আমাকে কেন বলছে তার খালি খালি লাগে! সে কি তার শূন্যতা ভরাট করতে এসেছে আমার কাছে? লতিফ আলতাফের মত লম্বা নয়, অমন সুন্দর স্বাস্থ্য আর চেহারা নেই তার। তবু দেখতে মন্দ লাগে না। হাসিতে উজ্জ্বলতা আছে তার। কামানো গালের সবুজ আভা তাকে অন্যরকম দীপ্তি দেয়। আলতাফ যে এত সুদর্শন পুরুষ, আলতাফের মধ্যে এই পৌরুষ যেন অনুপস্থিত। লতিফের দিকে আমি অপলক তাকিয়ে থাকি। লতিফও আমার চোখের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকায়। আমি ভুলেই যাই আলতাফ আমাকে নিষেধ করেছে লতিফের সঙ্গে কথা বলতে, লতিফের সামনে আসতে। কেন আমি তার সামনে আসব না? আমি কি অন্যায় করেছি? আলতাফ আমাকে কিনে নিয়েছে? আমি তার দাসী বাদি কিছু?

–কী ভাবী, মন খারাপ নাকি? লতিফ মিষ্টি হেসে প্রশ্ন করে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি–না মন খারাপ হবে কেন!

–আপনি কি এরকমই কম কথা বলেন?

–বোধহয়।

–হেঁয়ালি করছেন কিন্তু।

–লতিফ ভাই, আসলে শরীরটা আমার ভাল লাগছে না। জ্বর জ্বর লাগছে। আমি বরং শুয়ে থাকি গিয়ে। আসলে যত না শরীর খারাপ লাগা, মন খারাপ লাগা তার চেয়ে বেশি।

হঠাৎ লতিফ উঠে এসে আমার কপালে হাত রাখে–কই জ্বর? জ্বর তো নেই।

আমি কপাল সরিয়ে নিই না। লতিফ বলে–ও আপনার মনের জ্বর।

গে থাকে। ওর উষ্ণ করতলের নিবিড় স্পর্শ। আলতাফ তো কত ঘেঁয় আমাকে, গা এমন কেঁপে ওঠে না তো কখনও! আমি উঠে দাঁড়াই। বলি–আপনি বসুন, আলতাফ এসে যাবে এক্ষুণি। আমি বরং উঠি, একটু বিশ্রাম নেব।

আলতাফ দেখলে গালাগাল করবে এরকম কোনও ভয় আমার মনে কাজ করেনি। লতিফের আচরণই আমাকে অস্বস্তিতে ফেলেছিল। আমি উঠব উঠব ভাবছি তখনই আলতাফ আসে। ওকে রেখে আমি চলে যাই বেড রুমে। আলতাফ লতিফের সঙ্গে গল্পগুজব সেরে যখন ঘরে আসে, আমি শুয়েছিলাম। বিকেলটা ঘরে কাটাতে আমার ভাল লাগে না। ভাল না লাগলেও ঘরেই কাটাতে হয়। স্বামী ছাড়া বের হওয়া নিষেধ আর স্বামীও একেবারে ছেড়ে দিয়েছে আমাকে নিয়ে কোথাও বের হওয়া। ঘরে ঢুকেই সে বলে–কী আজ যে বড় পালিয়ে এলে? ধরা পড়ে গেছ লজ্জায়?

প্রথম বুঝতে পারি নি কী বলছে সে। পরে বুঝলাম লতিফের সামনে থেকে উঠে আসা নিয়ে বিদ্রূপ করছে।

–ধর তাই। আমার কণ্ঠে আশ্চর্য নির্লিপ্তি।

–আজ তো শুয়েছিলে তোমরা, তাই না?

–শোয়া মানে?

–লতিফের সঙ্গে শোওনি তুমি বলতে চাও?

–বাজে কথা বলো না।

আলতাফের চোখ থেকে আগুন ঠিকরে বের হয়। সে বলে–সেদিন তো লতিফ বলেছিল আমার জন্য সে এসেছে। আজ কার জন্য এসেছে? আজও কি বলতে চাও আমার জন্য? তুমি নিশ্চয়ই তাকে ডেকে এনেছ।

–আমি ডাকিনি।

–মিথ্যে কথা বলো না। তোমার জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলব আমি। পেয়েছটা কী। আমাকে সে মানুষ পেয়েছ? কেন শুয়েছিলে ওর সঙ্গে বল।

আলতাফ আমার চুল ধরে হেঁচকা টান দেয়। বলে–হারামজাদি, তুই আমার জীবন নষ্ট করেছিস। আমার সুন্দর সংসার ছাড়খাড় করে দিয়েছিস তুই। তোকে আমি আস্ত রাখব না।

আমি চুল ছাড়াতে চাই, পারি না।

আলতাফ দাঁতে দাঁত ঘষে জিজ্ঞেস করে-শুয়েছিলি তুই? লতিফের সঙ্গে শুয়েছিলি কি না বল। এই বিছানায় শুয়েছিলি? সে বিছানার চাঁদর বালিশ তীক্ষ্ণ চোখে পরীক্ষা করে আছে কিনা কোনও শোবার আর সঙ্গমের দাগ। আমার এত কষ্ট হয়, এত কষ্ট যে আমি বুঝতে পারি না আমরা কী বলা উচিত, কী করা উচিত। কান্না কণ্ঠে বলি–আমি শুইনি ওর সঙ্গে, বিশ্বাস কর।

আমার চোখ ফেটে জল নামে। তবু আলতাফ আমার চুল ধরে হিড়হিড় করে টেনে নামায় বিছানা থেকে, সারাঘরে ঘোরায় আর চিৎকার করে বলে-শুয়েছিলি কেন বল। তুই আমার বউ, তুই আরেক লোকের সঙ্গে শুবি কেন? বেশ্যা কোথাকার! একটা বেশ্যাকে আমার পুষতে হচ্ছে! খুব মজা পেয়েছিস ওর সঙ্গে শুয়ে, খুব মজা? তোর মজা আমি ঘোচাব। আমার সঙ্গে মজা পাও না। মজার জন্য গোপনে লোক ডেকে আনন। তোকে আমি বুঝি না ভাবিস। আমার সঙ্গে শুতে গেলেই তোর এত নাক সিটকানো কেন? আমার বাড়িতে পর পুরুষ ডেকে বেশ্যাগিরি করছিস! আলতাফ বলতে বলতে কেঁদে ফেলে। হাউমাউ করে কান্না। এ কী অদ্ভুত রূপ তার! আলতাফ কাঁদছে। যখন কাঁদছে, আমার চুল থেকে সরিয়ে নিয়েছে হাত। চুলের গোড়ায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছিল। আমার ভেতরে তবু ক্রোধ কেন জন্মায় না? এমন ক্রোধ যেন আমি আলতাফকে সবটুকু শক্তি দিয়ে মেঝেয় ফেলে কটা লাথি কষাতে পারি। গলা টিপে ধরতে পারি যেন ওর শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। আলতাফের জন্য আমার মায়া হতে পারত, মায়া হয় না। কান্নায় ওর ফুলে ফুলে ওঠা শরীর খামচে ধরে বলি-হ্যাঁ, শুয়েছি। শুয়েছি আমি, কী করবে তুমি? ওই লোকের সঙ্গে শুয়েছি। একশবার শোব। হাজারবার শোব আমি। তুমি এখন কাদো, আরও কঁদো, কেঁদে কেঁদে মরে যাও।

আলতাফ চেস্ট আব ড্রয়ারে উবু হয়ে ছিল। আমার কথায় মুখ তুলে বলে–এতক্ষণে সত্যি কথা বেরোল তাহলে। কতদিন থেকে শুচ্ছিস, বল। আলতাফের কোথায় গেল কান্না, কোথায় কী, সে দাঁত নখ বের করে আমাকে কামড় দিতে ছুটে আসে।

–অনেকদিন। যেদিন থেকে দেখলাম তুমি অক্ষম, সেদিন থেকে শুচ্ছি। কী করবে তুমি, আরও মারবে? মারো। আলতাফকে চেনা যায় না। হিংস্র জন্তুর মত তার দাঁত, নখ চোখ।

–কবার শুয়েছিস, বল। আমার দুটো বাহু শক্ত হাতে চেপে সে বলে।

–অনেকবার। হিসেব নেই। আমারও রাগ ধরে গেছে। শোয়ায় কী হয় আমিও দেখে ছাড়ব। নিজের সঙ্গমের শক্তি নেই, সে এসেছে অন্য পুরুষের সঙ্গে সঙ্গম অবরোধ অভিযানে। যতসব স্বার্থপর হিংসুক কুটিল জটিল ক্লীব।

–শুধু কি লতিফের সঙ্গে, নাকি আরও কারও সঙ্গে? আলতাফের চোখে মুখে হিংসেগুলো দাপায়।

আমারও জেদ চেপে যায়। বলি–আরও অনেকের সঙ্গে।

–তুই এত বাজে মেয়ে। বাজারের বেশ্যা তুই। আর তোকে কিনা আমার বউ পরিচয় দিতে হয় সমাজে। এক্ষুণি বের হ বাড়ি থেকে। এক্ষুণি। আমার চোখের সামনে তোর মত পাপী স্বৈরিণীর মুখ যেন না দেখি। বদমাশ মাগি। বের হ। বের হ আমার বাড়ি থেকে।

-–ঠিক আছে যাচ্ছি।

আমি কাপড় চোপড় নেবার জন্য আলমারিতে হাত রাখি। হঠাৎ পেছন থেকে এক লাথি এসে পড়ে পিঠে। সামলাতে না পেরে আলমারির শক্ত কাঠে কপাল গিয়ে পড়ে। মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে। রিমরিম করে ওঠে সমস্ত শরীর।

আলতাফ দ্রুত বাস ফেলে। রাগে সে কঁপে। আমি একটি মাঝারি ব্যাগে কিছু কাপড় নিয়ে বলি–যাচ্ছি।

আমার একবারও মনে হয় না স্বামীর ঘর থেকে বের হওয়া উচিত নয়। আলতাফের জন্য, আলতাফের বাবা মার জন্য, এই বাড়ির জন্য আমার কোনও মায়া হয় না। বরং মনে হয় এই নরক থেকে পালাতে পারলে আমি বাঁচি। সদর দরজা খুলে বেরিয়ে যাই। কেউ আমাকে বাধা দেয় না। বাইরে পা দিয়ে, আমার বেশ ফুরফুরে লাগে। যেন এতদিনে আমার একটা গতি হল। আমি বুক ভরে শ্বাস নিই। বাইরের আলো হাওয়া জানালার ফাঁক ফোকর গলে যা ভেতরে যেত, সেইটুকুই পেয়েছি। এত বড় একটা আকাশ কতদিন দেখি না। এত বড় জগত, এখানে আমাকে এখন বাধা দেবার কেউ নেই। আমার যেমন ইচ্ছে আমি চলব। পেছনে ফিরতে আমার ইচ্ছে করছে না। পেছনে আমি ফিরব না। আমি সামনে হাঁটতে থাকি। কতদিন হাঁটি না আমি। কত দীর্ঘদিন আমি একটি বন্ধ ঘরে দম আটকে কাটিয়েছি। ভাবলে মায়া হয়, নিজের ওপরই মায়া। হাঁটতে থাকি। সামনে যানবাহন কিছু একটা পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই। আবারও বাস নিই বুক ভরে। নিজেকে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ বলে মনে হয়। হাতের ব্যাগটিকেও ভার ভার লাগে। এটি নিয়ে আসাই উচিত হয়নি। কোথাও ফেলে দেওয়া যায় না? রাস্তায়? নির্ভার রাখতে চাই নিজেকে। দূর, কী আর আছে এর ভেতর গুটিকয় কাপড় ছাড়া? ছুঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করে। দিই না ফেলে? কী হবে! কী হবে এই সব তুচ্ছ বৈষয়িক জিনিসে?

ঠিক ঠিকই আমি ফেলে দিলাম কাপড়ের ব্যাগ। হাতে আর কোনও বোঝা নেই। মনেও নেই। মুক্ত আমি, মুক্ত আমি শরীরে মনে। এরকমই তো চেয়েছিলাম। এরকম মুক্ত নির্ভার জীবন। এরকম স্বাধীন সুস্থ জীবন। আহ, কী ভীষণ ভাল লাগা। আমার এক মামা বাম রাজনীতি করত, জেল খেটেছিল একবার, এক বছর মত জেলে কাটাবার পর যেদিন বেরিয়ে এল, চারদিক তাকাচ্ছিল শুধু। কী দেখছ মামা জিজ্ঞেস করলে বলেছিল–পৃথিবীটা কী সুন্দর তাই না?

আমার সেরকমই লাগছে। পাশে কেউ নেই, থাকলেও আমিও বলতাম–বাইরে এত বড় জগৎ রেখে বোকা ছাড়া কেউ বসে থাকে ঘুপচি ঘরে! এত আলো রেখে কেউ পড়ে থাকে অন্ধকারে? এত মানুষ রেখে বাইরে, কেউ পড়ে থাকে এমন একা, আমি যেমন ছিলাম! এই আকাশ এখন আমার। আমারই তো। এই যে পথ, এই পথে আমার যেমন ইচ্ছে হাঁটব। আমি যেদিকে খুশি যাব। অন্ধকার নেমে আসছে, আমার কোথাও ফিরবার তাড়া নেই।

 ১২. ও কেন তোকে মারবে

বাবা বলছেন–আলতাফ ভাল ছেলে। ও কেন তোকে মারবে?

মা বলছেন–মেরেছে যখন কোনও কারণ আছে নিশ্চয়।

আমি অবাক হই ওঁদের নির্বুদ্ধিতায়। প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে হয় না। তবু মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়–দোষ ওরই।

বাবা, মা, এমন কী দাদাও আমাকে বলছেন–কোন কারণ ছাড়া আলতাফ মারবে কেন? দোষ না করলে কেউ মারধোর করে? আলতাফ তো আর অশিক্ষিত ছেলে নয়।

রাতেই টেলিফোন করে আলতাফ, বাবাকে বলে–কেমন আছেন আব্বা। আপনার মত আদর্শবান মানুষের মেয়ে যে কেন এমন হল আমি ভাবতে পারছি না। আমার ফ্রেণ্ড সারকেল সব জেনে গেছে ব্যাপারটা। সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করছে। তো আমি বলে যাচ্ছি এসব ঠিক নয় আর আমার স্ত্রীর ব্যাপার আমি বুঝব। আর কতদিন এভাবে সামাল দেব জানি না। মানুষ তো আমি, কী বলেন? লতিফের সঙ্গে সে শুয়েছে। কী করে পারল সে আমি বুঝি না।

বাবা মা মুখ চুন করে বসে থাকেন। অনেক রাত পর্যন্ত বাড়িতে মিটিং চলে। মামারা আসেন, কাকারা আসেন, তারা সবাই একটি সিদ্ধান্তে আসেন, সে হল আমার মাপ চাইতে হবে আলতাফের কাছে। সিদ্ধান্তটি আমাকে জানানো হলে আমি বলে দিই, মাপ আমি চাইব না।

কেন আমি মাপ চাইব না? এত সাহস আমি কোথায় পেলাম? এইসব জানতে চাওয়া হয় আমার কাছে। আমি বলি–জানি না কোথায় পেলাম সাহস। তবে সাহর্স পেয়েছি। সাহস থাকা তো ভাল।

বাড়ির সবাই অবাক হয়, ভালই তো ছিল মেয়েটি, কোনও ‘ব্যাড রেকর্ড’ ছিল না, তার এমন চরিত্র খারাপ হল কবে? চরিত্র যে আমার খারাপ হয়েছে এ ব্যাপারে ওরা নিশ্চিত। কপালে আমার সুখ সইল না–এ নিয়ে ওরা দুঃখ টুখও করে।

আমি কাউকে বোঝাতে পারি না আলতাফের প্রবলেমের কথা। মাকে হয়ত বলা যেতে পারত, কিন্তু আমার বলতে ইচ্ছে হয় না। তিনি ভেবেই নিয়েছেন দোষ আমার। যে মানুষ আমাকে এতটা অবিশ্বাস করতে পারেন, তাঁকে আমার গভীর গোপন সমস্যার কথা বলতে রুচি হয় না, হয়ত সব শুনে বলেও বসতে পারেন, দোষ আমারই। তাকে তো আর একজন অক্ষম পুরুষের সঙ্গে জীবন কাটাতে হয়নি, রাতের পর রাত নিঘুম কাটাতে হয়নি। তিনি কী করে বুঝবেন শরীরের যন্ত্রণা এক সোমখ নারীকে কতটা উন্মাদ করে। শরীর ভরে কী ভীষণ তৃষ্ণা থাকে অতৃপ্ত নারীর, তা পরিতৃপ্ত নারীরা বুঝবে কেন। আমি সারাদিন এ বাড়িতেও একটি নিঝুম ঘরে বসে থাকি। এখানেও আমার বড় একা লাগে।

ফুপুও আগের মতন তেমন কেয়ার করে কথা বলেন না। কণ্ঠস্বরে তাচ্ছিল্য টের পাই। একদিন বলেন–তোমার ভবিষ্যত ভেবে দুঃখই লাগে।

আমি বলি–দুঃখ লাগার কী আছে।

ফুপু বলেন–ভাবছি, এই স্বামী যদি তোমাকে না নেয় তবে কী গতি হবে তোমার!

–স্বামী নিতে চাইলে আমি যাব, কে বলেছে তোমাকে?

–স্বামীর ঘরে যাবে না তো কোথায় যাবে?

–যেখানেই যাই, ওই বাড়িতে আর না।

বাড়িতে ফিসফিস আলোচনা চলে স্বামীর বন্ধুর প্রেমে পড়ে স্বামীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি। সেই ছেলেকে এখন বিয়ে করতে চাচ্ছি। সারাদিন আমি সেই ছেলের ভাবনায় মগ্ন থাকি। আমি আগের সেই উজ্জ্বলতা হারিয়ে ফেলেছি। বাড়ির কাউকে আমার ভাল লাগে না। ফোনেও বোধহয় সেই ছেলের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়। ইত্যাদি।

বাবা একদিন জিজ্ঞেস করলেন–ছেলেটা কে?

আমি বললাম–কোন ছেলে?

–যেই ছেলে নিয়ে গণ্ডগোল, সেই ছেলে।

–কোন ছেলে নিয়ে গণ্ডগোল?

–লতিফ। লতিফ না কী একটা নাম!

–জানই ত কী নাম। সবই যখন জানো তখন আর জিজ্ঞেস করা কেন।

–আমরা এখন সমাজে মুখ দেখাব কী করে? তোরই বা কী হবে। বাবা চশমার কাঁচ মুছে গম্ভীর কণ্ঠে বলেন।

–আমি পড়াশুনা করব। কলেজে ভর্তি হব।

–কলেজে যে পড়বি আলতাফ জানে??

–তার জানার কী দরকার!

–সে না চাইলে পড়বি কী করে?

–আমি আমার জন্য পড়ব। সে না বললে আমি পড়ব না এ কেমন কথা!

–এটাই কথা। বিয়ের পর স্বামীর অনুমতি ছাড়া কিছু করতে হয় না।

–আমি তো ওই বাড়িতে যাব না কখনও। এখানে থাকব। যথেষ্ট জোর নিয়ে কথা কটি বলি।

–এখানে তোকে রাখবে কে শুনি?

–কেন, তাড়িয়ে দেবে নাকি?

–বাড়াবাড়ি অনেক সহ্য করেছি। আর করব না। কাল আলতাফ আসবে নিতে। একটি কথা না বলে চুপচাপ গাড়িতে উঠবি। আর কোনও ঝামেলা করবি তো আমি তোর গলা কেটে ফেলে আসব। এমন মেয়ে থাকার চেয়ে না থাকাই অনেক ভাল। বাবার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে রাগে।

–আমি যদি কাল না যাই কী হবে?

–তুই যাবি। তোর ঘাড়ে যাবে। বাবা এমন সুরে কথা বলেন তাকে আমার চিনতে কষ্ট হয়। এই মানুষটি কি সত্যিই আমার বাবা? তিনি আমাকে জোর করে এক বাড়িতে পাঠাবেন, আমি সেখানে ভাল থাকি না জেনেও? কেবল বিয়ে হয়েছে এই একটি কারণেই? বিয়েটা কি এতই সাংঘাতিক কিছু যে আমাকে সব ছেড়ে, আমার শৈশব কৈশোর আমার স্বপ্ন সাধ বিসর্জন দিয়ে বিয়ের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে? একা ঘরে সারাদিন এই দুঃসহ সম্পর্কের কথা ভেবে আমার এ কথাই মনে হয় কোনও সম্পর্কেই আসলে শর্ত থাকা উচিত নয়। শর্ত থাকা মানেই অবিশ্বাস, শর্তভঙ্গের ইচ্ছে। সম্পর্ক হবে উদার আকাশের মত। আকাশের সঙ্গে মেঘের কি কোনও চুক্তি থাকে যে তাকে এই গতিতে উড়তে হবে? সে হাওয়ায় হাওয়ায় ঘুরে বেড়ায়। সে অবাধ সুখে মাতে।

.

আলতাফ আসবে বলে বাড়িতে তুমুল উৎসব শুরু হয়। তার জন্য মুরগীর রোস্ট, পোলাও, কোরমা, কাবাব, কোপ্তা নানা রকম খাবার তৈরি করা হয়। রান্না ঘরে ব্যস্ত সারাদিন মা, ফুপু। বাবা বলছেন–জামাই আসবে। বাড়িতে আরও ক’জনকে আসতে বলি। আলতাফ আসবে বলে মামা কাকারাও আসেন। তাঁরাও একসঙ্গে খাবেন। এত আদর কেন আমি বুঝি, আমাকে যেন আলতাফ নিয়ে যায়, আমি যেন আবার স্বামীর সংসারে ভাল মানুষের মত থাকতে পারি, আমার যেন মাথার ওপর একটা ছাতা থাকে, নিরাপত্তা থাকে। লোকে যেন মন্দ কথা না বলতে পারে। লোকে যেন বলতে না পারে মেয়েটি স্বামীর ঘর করতে পারে নি। স্বামীর ঘর করতে পারাটিই মেয়েদের প্রধান যোগ্যতা ভাবা হয় কিনা।

সন্ধের দিকে আসে আলতাফ। বেশ সেজেগুঁজেই আসে। সুট টাই লাগিয়ে। ছেলে হিসেবে দেখতেও যে সে চমৎকার তা আরেকবার মনে করিয়ে দেওয়াই বোধহয় তার ইচ্ছে। বাবা মা কাকা মামাদের পা ছুঁয়ে সালাম করে। ওঁদের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে না। সোফায় দুঃখী মুখ করে বসে থাকে। মা বাবা ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। বলেন–বাবা, আমাদের তুমি মাপ করে দাও। মেয়েকে তালা বন্ধ করে ঘরে রেখে দাও। সে এখন তোমাদেরই। বিয়ের পর কী আর আমাদের কোনও অধিকার থাকে। ওর ওপর তোমারই সব অধিকার। তুমি ওকে শাসন কর। মেয়ে আগে ছিল আমাদের, এখন তোমার কাছেই সমর্পণ করেই দিয়েছি। অন্যায় করলে তুমি ওকে শাসন কর, মানুষ কর। বয়স অল্প, বোঝেনি যা করেছে। ওকে বোঝালৈই বুঝবে। ছোট মানুষ……

আলতাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে–ওর জন্য আমি কত কিছু করি। সেদিনও বায়তুল মোকাররমে গিয়ে এক জড়োয়া সেটের অর্ডার দিয়েছি। এই দেখুন বলে আলতাফ পকেট থেকে একটি জুয়েলারি দোকানের স্লিপ বের করে দেখায়।

আমার বেশ হাসিই পায়। সে আমাকে সোনার নেকলেস গড়িয়ে দেবে বলে তার বশংবদ দাসি হতে হবে আমাকে? আলতাফের আচরণ লক্ষ্য করে আমি বিস্মিত হই। সে সবার সঙ্গে এত বেশি নম্র কণ্ঠে কথা বলে, এত ধোয়া তুলসি পাতা সে সাজে, আমারই ভুল করে মনে হয় আমিই বোধহয় দোষ করেছি। আমার অন্যায়ের কারণেই বোধহয় আলতাফ আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে।

আলতাফ খায় দায়, সবার সঙ্গে সমাজ, রাজনীতি, পরিবার ইত্যাদি বিষয়ে গভীর আলোচনা করে এবং শুনে অবাক হই আলোচনায় আলতাফের কথাই সবচেয়ে যুক্তিপূর্ণ জোরালো এবং বুদ্ধিদীপ্ত শোনায়। সকলের কাছে বিদায় নিয়ে আলতাফ আমার কাছে আসে। বলে–হীরা চল।

কণ্ঠে সোহাগ তার। মনে মনে আলতাফকে বাহবা দিই। এই সোহাগ ছিল কোথায়। এদ্দিন!

–চল মানে? আমি জিজ্ঞেস করি।

–চল, এখন থেকে ভাল ভাবে থাকবে এই শর্তে নিয়ে যাচ্ছি। আব্বা আম্মা তো তাই বললেন যে তুমি এখন আমার কথা শুনবে। নিজের ভুল বুঝতে পেরেছ।

বাবা মা দরজার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ঢুকে বললেন–চুল টুল আঁচড়ে নে। ভাল ভাবে থাকতে হবে। এরপর যদি গণ্ডগোলের কথা শুনি তবে আর রক্ষে নেই।

আলতাফের সামনে বাবা মার অপরাধি মুখ। যেন আমাকে সে নিয়ে যাবে বলে তারা কৃতার্থ। যেন আলতাফ লতিফের সঙ্গে আমি প্রেম করবার পরও এ বাড়িতে এসে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছে।

আমি শুয়েছিলাম। শোয়া থেকে না উঠেই বলি–আমি যাব না।

–যেতে হবে।

–যাব না তো বললাম। কণ্ঠে আমার আশ্চর্য দৃঢ়তা কাজ করে।

যাব না তো যাবই না। আমাকে টানা হেঁচড়া করেও কোনও লাভ হয়নি। আমি যাইনি। আমি যাচ্ছি না দেখে আলতাফের গা কাপছিল রাগে। নিজের বাড়ি হলে ও আমাকে ছিঁড়ে ফেলত। এ বাড়িতে মাথা নিচু করে বাবা মাকে বলেছে–আপনারা পরে নিয়ে আসুন না হয়। যদি এখন থেকে ভাল হয়ে চলে তবে আমি কেন আপত্তি করব বলুন। আমি কষ্ট করে চলব। আমার আর কী। আমার জীবনের আর মূল্য কী বলুন। আমি তো ওর জন্যই। ওর কী করে সুখ হবে তাই ভাবি। ওর যেন কোনও কষ্ট না হয় সেই চেষ্টাই দিনরাত করে যাচ্ছি। বলতে বলতে আলতাফের চোখে জল চলে আসে।

.

আলতাফ চলে যাবার পর শুরু হয় আমার ওপর নতুন রকম অত্যাচার। মা কাঁদো কণ্ঠে বলেন–এই মেয়ে জন্ম দিয়ে আমি পাপ করেছি। ভেবেছিলাম মেয়ে সুখি হবে। সবাইকে গর্ব করে বলতে পারব মেয়ে আমার ইঞ্জিনিয়ারের বউ। মা মিহি সূরে কাঁদতে থাকেন। বাবা আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেন। মামা কাকারা বলেন–বিয়ের পর স্বামীর ঘরই আসল ঘর। মান অভিমান একটু আধটু হয়েই থাকে। পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। এদিকে আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি এ বাড়িতেও আমি থাকব না। কোথাও চলে যাব। এ বাড়িটিকে, আমার জন্ম থেকে চেনা বাড়িটিকেও আমার অচেনা মনে হয়, পর মনে হয়। বাসযোগ্য মনে হয় না। আমি যে আলতাফের সঙ্গে না গিয়ে অত্যন্ত অন্যায় একটি কাজ করেছি তা আমাকে হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দেয় এই বাড়ির সদস্যরা। আমি অসহায় বোধ করি। ছটফট করি ভেতরে ভেতরে।

 ১৩. একটি চাকরি খুঁজতে থাকি

আমি একটি চাকরি খুঁজতে থাকি। চেনা পরিচিত ক’জনকে ফোনে বলি কোথাও কোনও কাজ টাজ পাওয়া যায় কি না দেখতে। সবাই অবাক হয়। বলে–তুমি চাকরি করবে কেন? তোমার না বিয়ে হয়েছে!

আমি বলি–বিয়ে হলে বুঝি চাকরি করতে নেই?

–স্বামী শুনেছি ইঞ্জিনিয়ার।

–স্বামী ইঞ্জিনিয়ার সে তো স্বামীর ব্যাপার। আমার নয়।

–তোমারও কিছু হতে হবে নাকি? তার টাকাই কি তোমার টাকা নয়?

–তার টাকা আমার টাকা হতে যাবে কেন? কোনও অর্থেই তার টাকা আমার টাকা নয়।

–কেন, সে কি টাকা পয়সা দেয় না? এটা ওটা কিনে দেয় না?

–তা দেবে না কেন? দেয়। কিন্তু সে তো তার দান হল। আমার নিজের তো কিছু হল না।

–নিজের আবার আলাদা করে লাগে না কি?

–নিশ্চয় লাগে। আমি যেহেতু একজন আলাদা মানুষ। কারও দ্বারা কোনও সাহায্য হয় না। বরং নানা রকম উদ্ভট প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় আমাকে। আর আমিও আশ্চর্য হই আমার এই বোধ জন্মালো কী করে যে আমাকে একজন আলাদা মানুষ হতে হবে। আমার বাড়ির পরিবেশ আমাকে এই বোধ জন্মাতে দেবার কথা নয়। তবে কি এসব নিজের ভেতরেই জন্মেছে! আপনা আপনি! নাকি আলতাফের স্বামী আমাকে সচেতন করিয়েছে যে স্বামীত্বের আরেক নাম প্রভুত্ব। আর তার প্রভুত্ব মানবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না বলে আমার ভেতর অবচেতনেই জন্ম নিয়েছে একটি সত্ত্বা অর্জনের তাগিদ।

বাড়ি থেকে বেরোই। অনেকদিন এখানে গুমোট অন্ধকারে বসে ছিলাম। এখানেও কেমন দম বন্ধ লাগে। ধানমণ্ডিতে পাপড়ির বাড়ি, রিক্সা করে ও বাড়িতে যাই। বন্ধুদের মধ্যে ওকেই আমার সাহসী মনে হয় সবচেয়ে বেশি। এই বয়সে ইণ্ডিয়া ঘুরে এসেছে একা একা। ওর বাবা বলেন বাইরে একা ঘোরা অভ্যেস করা দরকার। মেয়েগুলো ঘরে বসে থাকতে থাকতে ইঁদুর হয়ে গেছে। জগৎ সম্পর্কে কিছুই জানে না তারা।

আমার কী যে ভাল লাগে শুনে। পাপড়ির বাবার মত কেন আমার বাবা নন-মনে মনে এই নিয়ে আমার দুঃখও হয়েছে খুব।

আলতাফের কাছ থেকে চলে এসেছি শুনে পাপড়ি বলল–চেষ্টা করে দেখ থাকা যায় কি না।

আমি বললাম–না রে কোনও উপায় নেই। একজন ইমপোটেন্ট লোকের ঘরে বসবাস করার চেয়ে গরু ছাগলের সঙ্গে থাকা ভাল।

–বলিস কী! ইমপোটেন্ট লোককে বিয়ে করতে গেলি কেন?

–আমি কী জানতাম সে ইমপোটেন্ট?

–তাই তো কথা। তোর তো জানার কথা নয়। তোর বাবা মাকে বলেছিস?

–ওঁরা আগে থেকে এত উল্টো পাল্টা কথা বলছেন যে কিছু বলতে ইচ্ছে করে না। ওঁরা ধরেই নিয়েছেন যে আমি এক ছেলের প্রেমে পড়ে স্বামীর ঘর ছেড়েছি।

বাড়িতে আমাকে উদ্দেশ্য করে কী অশালীন এবং অসভ্য কথাবার্তা হয়, ভেবে, এই প্রথম, বাড়ি থেকে বেরিয়ে পাপড়ির বাড়ি এসে, আমি কেঁদে উঠি।

পাপড়ি আমাকে জড়িয়ে ধরে। বলে–ডোন্ট ওরি, বী হ্যাপি। তুই যদি চলেও আসতি কারও সঙ্গে কার কী বলার ছিল। চিয়ার আপ। ও আমার চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। বলে–জীবন তোর শুরু হল মাত্র, এখনই পেছনের ঝুটঝামেলা নিয়ে ভাবছিস কেন। আলতাফের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসবার পর কারও সামান্য স্নেহের স্পর্শ পাইনি। পাপড়ির এই ‘বী হ্যাপি উচ্চারণ আমাকে অনাবিল আনন্দ দেয়। অনেকদিন ভুলেই ছিলাম আনন্দ কি জিনিস।

পাপড়ি ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। ইংরেজিতে অনার্স! জিজ্ঞেস করি–যদি আমিও পড়তে চাই।

–পড়তে চাইলে পড়বি।

–পড়াবে কে শুনি? বাবা তো পড়াতে চাইছেন না। বলছেন আবার ওই স্কাউড্রেলটার ঘরে যেতে।

পাপড়ি বলে–তুই টিউশনি করে পড়ার খরচ চালা। মালা কী করছে, দেখিস না? বাবা মারা গেছে। ভাই খরচপাতি দেয় না। সে দুটো টিউশনি করছে, পড়ছে।

পাপড়ির বাড়ির লনে বসে গল্প করি। খানিক পর পর চা আসে। আমি কে, কী নিয়ে কথা বলছি ইত্যাদি জানবার জন্য কেউ উঁকি ঝুঁকি দেয় না। সারাদিন কাটিয়ে সন্ধের আগে আগে ঘরে ফিরি। ফিরে দেখি বাবা মা পায়চারি করছেন। আমি কোথায় গেলাম, বাড়ি থেকে কারও হাত ধরে পালোম কি না ভাবছেন।

–কী কোথায় গিয়েছিলি? বাবার দাঁত খিচানো প্রশ্ন।

–পাপড়ির বাড়িতে।

–মিথ্যে কথা বলছিস কেন, তুই লতিফের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলি।

–যদি তাই ভাবো তো, তাই। আমি খুব নির্বিকার উত্তর করি।

–এত সাহস তুই পেলি কোথায়?

–জানি না। আমার শান্ত কণ্ঠস্বর।

–জানি না বললে তো চলবে না। জানতে হবে। লতিফকে তুই বিয়ে করবি ঠিক করেছিস?

–তাও জানি না।

আমি কাপড় না পাল্টে শুয়ে পড়ি।

বাবা মা ধারণা করেন আমি প্রেমে অন্ধ হয়ে জগৎ সংসার ভুলে গেছি। আমার মাথার ঠিক নেই। তারা অনেক রাত অবধি জেগে থেকে আমার ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তা করেন। আর আমি রাত জেগে কেবলই ভাবি কী করে পড়ালেখাটা করা যায়, কী করে টিউশনি যোগাড় করা যায়। কী করে মুক্ত হওয়া যায় নোংরা সংসারতন্ত্র থেকে। বুঝে পাই না। রোকেয়া হলে মালার সঙ্গে দেখা করলে সম্ভবত কিছু বুদ্ধি পাওয়া যাবে। এই ভেবে আপাতত নিশ্চিন্ত হই।

পরদিন সকালে যখন বাইরে যাবার জন্য তৈরি হই, মা চমকে ওঠেন আশংকায়, বুঝি মেয়ে তার এবার পালাচ্ছেই লতিফের সঙ্গে। জিজ্ঞেস করেন–কেথায় যাচ্ছিস?

–রোকেয়া হলে।

–কেন?

–কাজ আছে।

–কী কাজ?

–আছে।

–আছে বললেই তো হবে না। আমাদের বলতে হবে কী কাজের জন্য, বাইরে যাচ্ছিস তুই। যেতে হলে কাউকে নিয়ে যা। কেউ তোর সঙ্গে যাক।

–সঙ্গে যেতে হবে কেন? আমি কি পথ চিনি না?

–পথ চিনলেও তোকে একা যেতে দেওয়া হবে না।

–আমি যাবই, পারলে আটকাও তোমরা।

মাকে হতবাক করে আমি সোজা বেরিয়ে আসি বাড়ি থেকে। এ বাড়িটিও শ্বশুর বাড়ির আকার নিচ্ছে। নরক কে বলে পৃথিবীর বাইরে কোথাও থাকে? নিজের বাবা মাই আমাকে অপমান করছেন, এর চেয়ে মন্দ আর কী হতে পারে। চোখে জল জমে যায়। হাতের পিঠে মুছে নিয়ে হাঁটতে থাকি। রোকেয়া হলে মালাকে পাওয়া যায় না। ডিপার্টমেন্টে গিয়ে খুঁজে বের করি। কোনও রাখ ঢাক না করে বলি–টিউশনি খুঁজে দাও। কলেজে ভর্তি হব। পড়ালেখাটা আমার করতেই হবে। ইন্টারমিডিয়েটে চাকরি জুটছে না। আর চাকরি কেন করব, স্বামী থাকতে এসব জিজ্ঞেস করবে তো! এসবের উত্তর হচ্ছে স্বামীটি দেখতে ভাল, কিন্তু ওর প্রবলেম আছে মানসিক শারীরিক দুই-ই।

সে কমপ্রোমাইজ চাচ্ছে আমি কোনও কমপ্রোমাইজে যেতে চাচ্ছি না।

মালা সেদিনই কিছু জানাতে পারল না। বলল–আর কদিন পরে এস, দেখি কিছু করতে পারি কি না। সময়ের অভাবে দুটো টিউশনি ছেড়ে দিতে হয়েছে। ওখানে বলে দেখব তোমার কথা।

মনে মনে হুররে বলে উঠি। কখনও ভাবতে পারি নি নিজের জন্য নিজেই কিছু করা যায়। সচ্ছল বাবার সংসার থেকে সচ্ছল স্বামীর সংসারে বাকি জীবন কাটাতে গিয়েছিলাম। ওরা খেতে পরতে দেবে, বিনিময়ে যা নয় তা শুনতে হবে আমার, এক খাওয়া পরার জন্য নিজেকে অসম্মান করতে দেব কেন?

মালার সঙ্গে কথা বলতে বলতে লাইব্রেরী গেটের কাছে দাঁড়াই। কোন দিকে না। ভেবেই একটি রিক্সা নিই। রিক্সা দোয়েল চত্বরের দিকে যেতে থাকে। বাড়িতে যাব ভাবতেই মন খারাপ হয়ে যায়। অন্য কোথাও যদি যাওয়া যেত। দূরে কোথাও। এই চেনা শোনা পরিবেশ থেকে দূরের শহরে। রিক্সা যখন প্রেসক্লাব পার হয়ে যেতে থাকে, তখনও আমি জানি না মনজু কাকার অফিসে যাব। হঠাৎই মনে পড়ে মনজু কাকার কথা। আমার এক দূর সম্পর্কের কাকা, ইণ্ডাষ্ট্রি আছে মতিঝিলে। কাকা আমেরিকা ছিলেন, দেশে এসে ইণ্ডাষ্ট্রি দিয়ে বসেছেন। এখন দেশেই থাকবার চিন্তা ভাবনা করছেন। পাঁচ ছ বছর কোনও যোগাযোগ নেই। তাঁর কথা আমার মনে পড়বার কথা নয় বা তার কাছে আমার যাবার কথা নয়।

হঠাৎ মনে পড়ায় যাই সময় কাটাতে। বাড়ি ফিরলে আবার তো সেই হুল ফোঁটানো কথা। আমার ভাল লাগে না নিরন্তর সংসার সংসার স্বামী স্বামী বলে একটানা চিৎকার। চিৎকারই মনে হয় এসব। স্বামী দিয়ে যদি আমার সুখ না হয়, তবু স্বামীর কাছে পড়ে থাকতে হবে আমার, বাবা মার মুখ রক্ষা করতে। আমার জীবনের চেয়ে তাদের মুখের মূল্য যেন বেশি।

মতিঝিলে মনজু কাকাকে পেয়ে যাই। কাকা দেখে অবাক—তুমি এখানে?

–হ্যাঁ এলাম। করার কিছু খুঁজে পাচ্ছিলাম না তো, তাই।

–বস বস। বাড়ির সবাই ভাল আছে? তোমার হাসবেন্ডের খবর কি। শুনলাম বিয়ে টিয়ে হয়েছে। আমরা তো দাওয়াত পেলাম না।

মনজু কাকার পঞ্চাশ হবে বয়স। এখনও তারুণ্যে ভরা হৃদয়। ছেলে মেয়ে সব বিদেশে। ওরা কোথায় কী পড়ছে বললেন। আমি পড়াশুনা কতদুর করেছি জিজ্ঞেস করলেন। লজ্জাই পেলাম বলতে যে মাত্র ইন্টারমিডিয়েট অবধি পড়েছি। বললাম-বিএ ভর্তি হব। সঙ্গে টিউশনি করব।

–কেন? টিউশনি করতে হবে কেন? এনি প্রবলেম?

মাথা নাড়লাম। হ্যাঁ প্রবলেম। প্রবলেমই তো। বাবার বাড়ি থেকে কোনও সাহায্য করা হবে না যেহেতু আমি স্বামীর ঘর থেকে চলে এসেছি। তাই টিউশনি করতে হবে। তখন মনজু কাকা হেসে হেসেই বললেন টিউশনি করে আর কত পয়সা পাবে? আমার কোম্পানিতে চাকরি কর।

–আপনার এখানে চাকরি? কি বলছেন? আমি পারব নাকি?

–শিখিয়ে নেব। অসুবিধে কী?

অতল জলে ডুবে যাচ্ছে এমন মানুষের হাতের কাছে মাটির পাড় পেলে বোধ হয় এমন আনন্দই হয়। আমার এমনই আনন্দ হয় যে আমি অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি।

কাকাকে বলি–আপনি কিন্তু বাড়িতে বলবেন না।

–কেন মতিন ভাই জানেন না তুমি চাকরি করবে?

–না। আমাকে ঘরে বন্দি করার প্ল্যান করছে। আপনি যদি চাকরি দেন আমি প্রাইভেটে বিএ পরীক্ষাটা দিয়ে দেব। আমার বন্ধুরা আছে। নোট ফোট নিয়ে নেব। কোনও অসুবিধে হবে না।

–দেখ যা ভাল বোঝ।

আমার আনন্দিত চোখ দেখে মনজু কাকা সম্ভবত বুঝতে পারেন আমি একটি বড় সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি। এই মুহূর্তে একটি চাকরি আমার খুবই প্রয়োজন। তার আরও একটি ব্যাপার আমার খুবই ভাল লাগে তা হল একবারও আমাকে তিনি বলেননি স্বামীর সংসারে ফিরে যাও, মানিয়ে নিতে চেষ্টা কর এই সব বোগাস কথা বার্তা অথবা তোমার বাবা না চাইলে কী করে চাকরি করবে এইসব।

মনজু কাকা ব্যস্ত হয়ে পড়েন কাজে। আমি তার রুমের সোফায় বসে থাকি। তিনি ফাঁকে ফাঁকে আমার সঙ্গে কথা বলেন–প্রথম অল্প বেতন পাবে। ধীরে ধীরে বাড়বে। আপত্তি নেই তো!

আমি হেসে বলি–কোনও আপত্তি নেই। এখানে যে এত বড় প্রাপ্তি যোগ তা কল্পনাই করিনি। আপনার কাছে আমি খুবই কৃতজ্ঞ।

ঠিক হয় আগামি শনিবার থেকে আমি চাকরি করতে যাব। হঠাৎ করে হয়েও গেল সব। বাড়ি ফিরতে ফিরতে মনে হয় এত শিগরি কারও কপাল কী খোলে! আমি তো কপাল পোড়া মেয়ে, আমার ভাগ্যে কি এত কম যোগ্যতায় আস্ত একটি চাকরি পাওয়া সম্ভব। আমার কেন যেন বিশ্বাস হয় না সত্যি সত্যি চাকরিটি আমি পেয়েছি। আমি কি করতে পারব কঠিন কঠিন সব কাজ। মনজু কাকা অবশ্য বলেছেন কাজ তেমন কঠিন নয়। চেষ্টা থাকলেই সব হয়।

 ১৪. দরজায় তালাবন্ধ করে রাখা

দরজায় তালাবন্ধ করে রাখা হয় আমাকে। বাবা বলেন–আমার মেয়ে হয়ে যা তা করে বেড়াবে, এ আমি সহ্য করব না।

দরজার তালা খুলে মা আমাকে তিনবেলা খাবার দিয়ে যান। এ যে কী অসহনীয় অবস্থা তা আমি ছাড়া আর বুঝবে কে। আমার কান্নাও পায় না আজকাল। বরং জেদ হয়। ভীষণ এক জেদ হয় আমার। এইসব আচরণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে। দরজা ভেঙে বেরোব, এ আমার শক্তিতে কুলোবে না, শরীরের শক্তিতে না পারি, মনের শক্তিতে কখন দরজা খুলে বেরিয়ে যাই, বেরিয়ে চাকরি বাকরি করি, পড়াশুনা করি, যেমন খুশি থাকি, যেমন ইচ্ছে বাঁচি।

শনিবার পার হয়ে যায়। আমার বেরোনো হয় না। আলতাফের পরামর্শে আমাকে আটকে রাখা হচ্ছে এরকম ধারণা করি। আমার বাবা মা আমার ব্যাপারে নির্মম জানি কিন্তু এত নির্মম তা আমার বিশ্বাস হয় না। এভাবে আটকে থাকব আমি কতদিন, আমাকে তো বেরোতেই হবে। বাড়িতে ফিসফিস বলাবলি হয় আমি যেহেতু লতিফ নামের এক ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যেতে চাচ্ছি, তাই আমাকে আটকে রাখা হচ্ছে। এসবের কোনও প্রতিবাদ করতেও আমার ঘৃণা হয়। তাদের ভুল একদিন ভাঙবেই, যদি মন বলে কিছু থাকে তাদের, অনুতপ্ত হবে নিশ্চয়। ঘরের দু’একটা বই নাড়া চাড়া করি। পড়ায় মন বসে না। লেখায়ও না, লিখতে গেলেই দীর্ঘশ্বাস বেরোয় বুক চিরে, কাকে লিখব, কে আছে আমার আপন। খুব দুঃখের রাতে কার কথা ভেবে চোখের জল ফেলব, এমনিই নিঃস্ব আমি, এমনই একা; আমাকে এই সভ্য দেশে, একটি সভ্য শিক্ষিত পরিবারে তালাবন্ধ করে রাখা হয়, কথা বলবার, চলবার, ফিরবার সব অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়।

একদিন দুপুরে মা ভাত নিয়ে ঘরে ঢুকতেই, তখন সাতদিন কেটেছে আমার ঘরবন্দি জীবন, আমি মাকে এক ঝটকায় সরিয়ে চলে যাই ঘরের বাইরে। বাঘের অরণ্য থেকে হরিণ যেভাবে পালায়, আমিও উধশ্বাসে ছুটি, কোথায় যাব কোনদিকে যাব না ভেবেই ছুটতে থাকি। পরনে আমার মলিন জামা কাপড়। রাস্তার লোকের চোখে কৌতূহল উপচে পড়ে, একটি মেয়ে এমন দৌড়োয় কেন। পেছনে ফিরি না। পেছনে আমার ধরবার জন্য ছুটে আসছে কিনা বুনো মোষের দল–ফিরে দেখি না। একটি স্কুটার নিয়ে সোজা চলে আসি পাপড়িদের বাড়িতে। পাপড়ি অবাক হয় না। সব জানবার পর বলে–নো প্রবলেম, তুই থাক কদিন আমাদের বাড়িতে। দুর্গতি যেমন আমার জীবনে বারবারই আসে, হঠাৎ হঠাৎ সাফল্যও কোত্থেকে জানি না হাতের মুঠোয় চলে আসে। চারদিক বিরূপ যখন, তখনই দেখি কারও প্রসন্ন মুখ। সকলেই যখন ফিরিয়ে নেয় চোখ, ধু ধু শূন্যতার ভেতর কেউ হয়ত বাড়ায় তখন ভালবাসার হাত। পাপড়ির বাবা শিক্ষিত, সংস্কৃতিবান মানুষ। আমাকে বললেন সাহস যখন করছ, মাঝপথে থেমে যেও না। গন্তব্যে পৌঁছুবার চেষ্টা করো। ইচ্ছে থাকলে কী না হয়। বাধা তো থাকবেই পদে পদে। এগোয় তো অনেকেই, বাধা পেয়ে বেশির ভাগই থেমে যায়।

পরদিন সকালে মতিঝিল যাই, চাকরিটি আমার প্রয়োজন। মনজু কাকা আমাকে বসিয়ে রেখেই এপয়েন্টমেন্ট লেটার তৈরি করে দিতে বলেন এডমিনিস্ট্রেশান অফিসার জালাল সাহেবকে। ছোট কাজ, আত্মীয় বলে খাতির নেই। টেলিফোন অপারেটর কাম অফিস এসিসটেন্ট। বেতনও খুব বেশি নয়। তিন হাজার টাকা।

মনজু কাকা বলেন–এত কম টাকায় তোমার হবে তো?

আমি খুশিতে ফেটে পড়ি। বলি–কোনও দিন কি এত টাকা আমি উপার্জন করেছি? এরচেয়ে বেশি টাকা হাতে পেয়েছি। কিন্তু সে ছিল অন্যের টাকা।

মনজু কাকা আপাদমস্তক ভদ্রলোক। তিনি আমাকে উইশ করেন। অফিসের এক লোক ডেকে কাজ বুঝিয়ে দিতে বলেন। আমার জীবনে বড় একটি পরিবর্তন ঘটল বটে। একভোকেট মতিন চৌধুরির মেয়ে, ইঞ্জিনিয়ার আলতাফ হোসেনের স্ত্রী একটি। ফার্মে টেলিফোন অপারেটর কাম অফিস এসিসটেন্টের কাজ নিয়েছে–লোকে অবাকই হবে, হোক। লোকেরা কেবল অবাক হতেই জানে। আমি যখন যন্ত্রণায় মরে যেতে থাকি অক্ষম পুরুষের আলিঙ্গনে, তখন কেউ অবাক হয় না। আমি যখন স্বামীর চড় লাথি খেতে থাকি, অবাক হবার লোক পাই না। আমাকে যখন পরকিয়া প্রেমের দায়ে ঘরে বন্দি করা হয়, কে অবাক হয়?

চাকরিটি শুরু করে দিই। আমার আশংকা হয়, বাবা কখনও খবর পেয়ে অফিসে চলে আসতে পারেন এবং মনজু কাকাকে সব কিছুর জন্য দোষী করতে পারেন। মনজু কাকা কিন্তু কোনও আশংকা করেন না। এসব ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা কমই হয় আমার। আমি যখন বললাম বাড়িতে সবাই বিট্রে করছে। তিনি বললেন–তুমি যেটা ভাল বোঝ কর। বাড়ির মানুষদের ক্ষেপিয়ে শেষ পর্যন্ত কাজ করতে পারবে কিনা ভেবে দেখ। হুট করে ভাবলে কাজ করবে আর কদিন পর জানালে করবে না, ব্যাপারটি ঠিক নয়। আমি তাঁকে বলেছি আমি যা ভাবছি তা করবই। আমার সিদ্ধান্ত পাল্টাবার কোনও কারণ নেই।

চাকরি তো জুটেছে কিন্তু একটি সমস্যা প্রকট হয়ে ওঠে, বাসস্থান সমস্যা। পাপড়ির বাড়িতে অনেকদিন হয়ে গেল। এবার পাততাড়ি গুটানো প্রয়োজন। কর্মজীবী মহিলা। হোস্টেলের কথাই ভাবি। চাইলাম আর হয়ে গেল–এত সহজ নয় ব্যাপারটি। আপাতত মালার রুমে কদিন থাকাই স্থির করি।

যা চাই তা হয়ত হয় না। কিন্তু অনেক কিছুই হয়ে যায়। মালা আমাকে ফিরিয়ে দেয় না। অফিস থেকে এডভান্স কিছু টাকা নিই। তা দিয়ে কিছু জামা কাপড় আর প্রয়োজনীয় জিনিস কিনি। হয়ে যায়, হবে না কেন, বরং অমল এক আনন্দ হয়। ব্যাপারটি কেবলই এডভেঞ্চার অনেকই মনে করতে পারে, আমার কাছে কিন্তু তা নয়। আমার কাছে জীবনের মানে খোজা। জীবন কোথায় কতদুরে পড়ে আছে তা খুঁজে আনা, খুঁটে খুঁটে দেখা। জীবনে অপার রহস্য আছে বৈকি। ক’দিন আগেই যা। আমি কল্পনাও করতে পারি নি, তাই দেখি হাতের মুঠোয় এসে যাচ্ছে। আমাকে কোথাও থামাতে পারছে না কেউ।

হোস্টেলের সিটের জন্য পাপড়িকে নিয়ে চেষ্টা চালাই, নীলক্ষেতের হোস্টেল। পাপড়িরও চেনা দু’জন সিনিয়র মেয়ে ছিল ওখনে। ওরাই ফর্ম টর্ম নিয়ে দেয়। আমার ইন্টারভিউ হয়, কেন থাকতে চাচ্ছি, ম্যারেড কী আন ম্যারেড, ম্যারেড যদি স্বামী কোথায়, কী করে ইত্যাদি। আমি স্পষ্ট জানাই স্বামী একজন আছে, তবে ছেড়ে দিচ্ছি তাকে, তার সঙ্গে ঘর সংসার করবার কোনও ইচ্ছে আমার নেই। কেন নেই এই প্রশ্ন যখন করা হয়, বলি লোকটি একটি প্রতারক। প্রতারক কী ধরণের, সে কী আরও কোনও বিয়ে করেছে, টাকাপয়সা নিয়ে পালিয়েছে? এসবের একটিরও উত্তর হ্যাঁ হয় না। ওরা বুঝে পায় না প্রতারণা আর কী ধরনের হতে পারে। আমারও ইচ্ছে করে না নিজের দুঃখ কষ্টের কথা খুলে ভেঙে বলি ওদের, আর যে না ভুগেছে এই যন্ত্রণায়, সে কিছুতে যে বুঝবে না যন্ত্রণাটি কী ভীষণ, তা আমি বেশ ভাল করেই বুঝি। শেষ অবধি সিট মেলে। সব পেয়ে যাই, যা চাই। চাকরি পাওয়া হল। থাকা, খাওয়া, পরার চিন্তা দূর হল। অফিসের কাজ শিখতে আমি প্রবল আগ্রহ বোধ করি। পেছনে কী হচ্ছে দুটো বাড়িতে, ভাবতে চাই না। যা হয় হোক, আমার কী। পেছনের কারও জন্য আমার কোনও মায়া হয় না।

পাপড়ি একদিন বলে–তোর বাবা ফোন করেছিলেন।

–কী বললি?

–বললাম হীরা চলে গেল কেন? ও তো বাড়ি থেকে পালানোর মেয়ে ছিল না। তো উনি বললেন তোর নাকি মাথা টাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

আমি হো হো করে হেসে উঠি। ওঁরা যে আমাকে হন্যে হয়ে খুঁজছেন, তাতে আমার . এতটুকু করুণা হয় না। খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের বাড়িতে এই জন্য যাইনি, খুঁজে পেয়ে টানা হেঁচড়া করবেন, খামোকা ঝামেলা। আর আমার বন্ধুদের বাড়ি খোজা তো ওঁদের মানায় না। ওঁরা খুঁজবেন লতিফের বাড়ি। লতিফ কোথায় গেল, আমাকে নিয়ে কোথায় ঘর বাঁধল এসব খবর নিশ্চয় ওঁরা নিয়েছেন। বেচারা।

মনজু কাকার ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম। ট্রান্সফরমার তৈরি হয়। দেশ বিদেশ দৌড়াদৌড়ি তার। হয়ত ব্যস্ততার জন্য বা আমার অনুরোধ রক্ষা করেই তিনি আমাদের বাড়িতে খবরটি জানাননি। একবার খবর পেলেই খামচে ধরে নিয়ে খাঁচায় পুরবে। খাঁচার কষ্ট আমি জানি। ও পথে আমি জীবন থাকতে যাব না। হোস্টেলে খাবার কষ্ট হয়, মাপা খাবার, তবু মনে হয়, এই কী অনেক নয়? এই আমার প্রথম উপার্জন। সারাজীবন, পরের পয়সায় মাছ মাংস খাওয়ার চেয়ে নিজের পয়সায় ডাল ভাত খাওয়া অনেক আনন্দের। কেউ আমাকে খাওয়ার খোটা দেবে না, কারও সামনে আমার নত হতে হবে না, কেউ আমাকে ইচ্ছে হলে পেটাবে না, কেউ আমাকে ইচ্ছে হলে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে না। ইচ্ছে হলে বিছানায় শরীর নিয়ে খেলা করবে না, যে খেলার পরে আমার কেবল একতরফা হার। আমি হারব, আমি মার খাব, আমি তবুও থেকে যাব তাদের ইচ্ছের হাতে বন্দি, যেন তারা ভাল বলে, যেন তারা গাল টিপে লক্ষী মেয়ে বলে, যেন তারা একটি পুতুলকে যেমন সাজিয়ে গুজিয়ে বলে–সুন্দর, তেমন সুন্দর বলে।

অফিসে কাজ তেমন নেই। টেলিফোন রিসিভ করা, ফাঁইল পত্র গুছিয়ে রাখা, এমডির রুম থেকে সাইন করে নিয়ে আসা ইত্যাদি। এসব কোনও পরিশ্রমের কাজ নয়। ফাঁকে ফাঁকে বিএ পরীক্ষা দেবার কথা ভাবি। হোস্টেলে এত মেয়ে, অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়, এ অন্য এক জগৎ, আমার একা লাগে না। হোস্টেলের অনেক মেয়েই চাকরির ফাঁকে ফাঁকে পড়ালেখা করে। আমি কিছু বই পত্র সংগ্রহ করি। এত ব্যস্ততা আমার জীবনে আর আসেনি। সকাল নটায় অফিস, পাঁচটায় ফেরা, ফিরে কখনও হোস্টেল, কখনও রোকেয়া হল, পাপড়ির বাড়িতে আড্ডা দিতে যাওয়া–সময় যে কী করে চলে যায়, বুঝি না।

সব কিছুর পর আমি যখন রাতে ঘুমোতে যাই, আমার শরীর জেগে ওঠে শুভ্র বিছানায়। আমার ইচ্ছে করে কোনও এক সক্ষম পুরুষের স্পর্শ পেতে। হোস্টেলে সুফিয়া নামে এক মেয়ে আছে, ডিভোর্সি মেয়ে। সে ফাঁক পেলেই তার অতীতের কথা পাড়ে। স্বামীটি খুব শরীর চাইত তার, এত বেশি ছিল তার কামনার আগুন, সুফিয়ার পক্ষে সম্ভব হত না তার তৃষ্ণা মেটানো। স্বামী গণিকাগমন করত, এ নিয়ে ঝগড়া, ঝগড়া বাড়তে বাড়তে ছাড়াছাড়ি। সুফিয়ার ঠিক উল্টো আমি, কামনার আগুন আমাকেই জ্বালিয়েছে। সে আগুনে পুড়ে আজ ছাই হয়েছি আমি অথবা খাঁটি সোনা।

১৫. ছেলেটির সঙ্গে

ছেলেটির সঙ্গে আগে আমার পরিচয় ছিল। মিতুল নামে আমার এক বন্ধুর চাচাতো ভাই টাই হবে। তাকে হঠাৎই একদিন দেখি হোস্টেলের গেটে দাঁড়িয়ে আছে। আমি প্রথম নাম মনে করতে পারিনি তার। দেখেই জিজ্ঞেস করলাম–কী ব্যাপার আপনি এখানে?

–হ্যাঁ। তুমি এখানে কেন? বলল ছেলেটি।

–আমি থাকি এখানে।

–ও তাই বল। মিতুলকে সেদিনও জিজ্ঞেস করেছি হীরা এখন থাকে কোথায়। বলল জানে না। আর আমিও অনেকদিন ভেবেছি তোমার কথা।

কথা বলতে বলতে নাম মনে হল। কায়সার। সাদামাটা চেহারা। খোঁচা খোঁচা দাড়ি। কিন্তু চোখদুটো তাকিয়ে থাকবার মত সুন্দর। সেই চোখ থেকে আমি চোখ ফেরাতে পারি না। কায়সারের সঙ্গে মিতুলের বাড়িতে দেখা হত। দুএকবার কথা হয়েছে। মনে রাখবার মত এমন কিছু নয়।

–আপনি এখানে কেন? জিজ্ঞেস করি।

–আমার বোন থাকে এই হোস্টেলে।

–আপনি কি মহসিন হলেই আছেন?

বাহ মনে রেখেছ কোন হলে থাকি? মনে মনে বলি মনে আর রেখেছিল। সবই তো ভুলে বসে আছি। নামটাও মনে পড়েনি। অল্প চেনা ছেলেকেই বড় আপন মনে হয় আমার। ছেলেটি আমাকে যে পছন্দ করত তা মিতুলও কথায় কথায় আমাকে বলেছিল। আমার সঙ্গে পরিচিত হবার আশায় সে মিতুলের জন্মদিনে গিয়েছিল। কায়সার পলটিক্যাল সায়েন্সে ফাঁইনাল ইয়ারে পড়ে। আমি গেটে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম, বলল–চল হেঁটে হেঁটে কথা বলি।

কী আর কথা। মিতুলের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, সেদিনের কথা মনে পড়ে মিতুলের বাড়িতে যেদিন লজ্জায় কথাই বলিনি তার সঙ্গে, তার বড় বোন ব্যাংকে চাকরি করে এইসব। আমি ছোট চাকরি করি বলাতে কায়সার অবাক হয়ে বলে–এই বয়সে চাকরি করছ? পারো চাকরি করতে? তুমি তো সেদিনের বাচ্চা মেয়ে। কায়সার হেসে ওঠে।

আমিও হেসে উঠি-আমি বোকা মেয়ে?

কায়সারের বোন গেটে এসে দাঁড়ায়। আমরা আবার দেখা হবে জাতীয় কিছু বলবার : আগেই বিচ্ছিন্ন হই। কায়সারকে এরপর প্রায়ই দেখি গেটে দাঁড়ানো। একদিন বলল–আজ তোমার জন্য এলাম।

–আমার জন্য? আমি বিস্মিত হই।

–তোমার জন্য বুঝি আসতে নেই? তোমার সঙ্গে কথা আছে। কথাটি হচ্ছে–তোমার চাকরি করা এখন উচিত নয়। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির দরখাস্ত চাওয়া হয়েছে। এপ্লাই কর।

–আমার চাকরি না করলে চলবে কেন?

–টিউশনি কর। তবু ভর্তি হও।

–আপনি এত করছেন কেন আমার জন্য? আমি তো বলিনি।

কায়সার চুপ হয়ে যায়। বলে–সরি।

সেদিন আর কথা হয় না। রুমে এসে চুপচাপ শুয়ে থাকি। সেই কবে বাড়ি থেকে মাকে ডিঙিয়ে বেরিয়ে এসেছি। জীবনে কত কিছু ঘটে যাচ্ছে। ওঁরা খবরও রাখেন না। নাকি আলতাফ গভীর কোনও ষড়যন্ত্র করছে। হঠাৎ একদিন তুলে নিয়ে যাবে? ভয় লাগে। একা ঘরে শিউরে উঠি আমি। মনজু কাকা বলেছেন কাজ ভাল হলে দুমাস পর বেতন বাড়াবে। মন্দ নয় চাকরিটা। আবার হলে থেকে ভার্সিটিতে পড়াশুনাও হবে-কায়সারের এই প্রস্তাবটিও মন্দ নয়।

ক্লান্ত এক বিকেলে কায়সার ডেকে পাঠায় হোস্টলের গেটে। আমার জন্য কোনও ভিজিটর অপেক্ষা করছে নিচে, ভাবতে ভাল লাগে। কায়সার ভর্তি ফরম নিয়ে এসেছে। চোখে চোখ পড়তেই হেসে বলে–তিনটে টিউশনি কর, হয়ে যাবে।

–চাকরি ছেড়ে দেব?

–চাকরি কি আর পাবে না পরে? চাকরি করলে তুমি তো ক্লাস করার সময় পাচ্ছো না।

কায়সারের কণ্ঠে ভালবাসা টের পাই। আমি ভর্তি হই না হই তার কী, অথচ যেন তার বড় একটি কর্তব্য এই ব্যাপারে আমাকে বোঝানো। কায়সার হাঁটতে হাঁটতে বলে–পল সায়েন্সে ভর্তি হলে তোমার কোনও অসুবিধে নেই। আমি তো আছিই। কায়সারের ‘আমি তো আছিই বাক্যটি আমাকে কেমন কাঁপায় ভেতরে ভেতরে। আমি হাঁটতে হাঁটতে বলি-ভালই একটি নিয়ম হয়েছে, আপনার সঙ্গে বিকেলে হেঁটে বেড়ানো।

–তোমার ভাল লাগে বেড়াতে?

বলি–খুব।

কায়সারের মুখ হাসিতে ঝলমল করে ওঠে, বলে–চল যাই, একদিন চল রিক্সা করে ঘুরে বেড়াই, ভাল লাগবে হাওয়া খেতে।

আমি মাথা নাড়ি। আমার যদি ভাল লাগে, যাব না কেন? যাব। কায়সারের ঢিলে সার্ট, না আঁচড়ানো চুল, গভীর চোখ, উদাস হাঁটাচলা সব আমার ভাল লাগে। মনে হয় বিকেলটা যদি কায়সারের সঙ্গে এমন গল্প করে কাটে, তবে মন্দ কী। আমাদের মুখে বলা হয় না, তবু বোঝা হয়ে যায়, কায়সার বিকেল হলেই আসবে, আমি তার সঙ্গে গল্প করতে রাস্তায় বেরোব। কখনও ক্রিসেন্ট লেকে গিয়ে বসব, কখনও কোনও রেস্তোরাঁয়, একদিন হাঁটতে হাঁটতে আমরা শাহবাগের একটি রেস্তোরাঁয় বসি। চা সিঙারা খাই। বিল দেয় কায়সার। আমি বলি–একদিন আমি খাওয়াব আপনাকে। আমার নিজের পয়সা, বাধা দেবার কে আছে। পরদিন বিকেলে শাহবাগ ছাড়িয়ে চলে যাই মতিঝিলের কাফে ঝিলে। পরাটা আর ঝাল ফ্রাই খাই দু’জন। আমি বিল মেটাবার পর কায়সার বলে–নেক্সট আমি খাওয়াব। কী বল?

রিক্সায় বসে কায়সার হাত রাখে আমার পিঠের পেছনে। কী রকম যেন লাগে। কী রকম এক আনন্দ। কায়সারের চোখের দিকে তাকালে কী রকম টুকরো টুকরো ভেঙে যাই ভেতরে। আমার ভেতর হঠাৎ এই ব্যাপারটি ঘটেনি। আমি অল্প অল্প করে নিজেকে জিজ্ঞেস করেছি আমি কী চাই, কায়সার ডাকলেই যে চলে আসি, সে কেন ডাকে, আর আমিই বা আসি কেন–এ কী দুদিনের মোহ, একসময় কেটে যাবে? উত্তর জোটে, কায়সার প্রতারণা না করলে মোহ কাটবে কেন? সে যদি সুস্থ সমর্থ পুরুষ হয়, ভালবাসা ম্লান হবে কেন? কায়সার এক বিকেলে টি এস সির মাঠে দাঁড়িয়ে বলে মনে হয় তোমাকে আমি অনেকদিন থেকে চিনি।

–অনেকদিন মানে কতদিন?

–জন্ম থেকে।

আমি আবার কেঁপে উঠি। টিএসসির ব্যস্ত মাঠ ছেড়ে ইচ্ছে করে দূরে কোথাও চলে যাই, সামনে কোনও নদী রেখে চুপচাপ বসে থাকি। নক্ষত্র ভরা আকাশ দেখব আর : গান গাইব—’পিপাসা হায় নাহি মিটিল।’

পিপাসা আমার তো মেটেইনি। আমার শরীর ভরে, হৃদয় ভরে প্রবল পিপাসা। কায়সার কি আমার পিপাসা মেটাতে পারবে, যদি না মেটাতে পারে, যদি সে আলতাফের মত ওরকম ছিঁড়ে খাওয়া লোক হয়! কেবল কষ্ট দেবে, সুখ দেবে না! কী করে বুঝি, পরখ করবার উপায় কী। পরখ করে দেখতে ইচ্ছে করে। কায়সারের জন্য কী রকম যেন লাগে আমার। ওকে বড় ছুঁতে ইচ্ছে করে। কতদিন কাউকে ছুঁই না। আমার আঙুলগুলো তৃজ্ঞার্ত হয়ে থাকে। কতদিন জল পায় না, কতদিন কারও পৌরুষ ছোঁয়া হয় না আমার। কতদিন কেন, আমি কবেই বা ছুঁয়েছিলাম কাকে?

আলতাফকে ছুঁতে আমার ভাল লাগত, কিন্তু ওর প্রবলেম যখন একটু একটু করে প্রকাশিত হল তখন আর ছুঁয়ে ভাল লাগেনি ওকে। মনে হত কোনও জড় কিছুকে পর্শ করছি। টেবিল চেয়ার জাতীয় কিছু। আলতাফের জন্য মাঝে মাঝে আমার মায়াই হয়। বেচারা। আবার এও ভেবে রাগ হয় ও বিয়েই বা করতে গেল. কেন, ও তো জানতোই শরীর ওর সাড়া দেয় না, ও কেন কষ্ট দেবার জন্য আমাকে এমন লোক জানিয়ে ঢোল বাজিয়ে বিয়ে করল? আমি আলতাফকে ক্ষমা করতে পারি না। সেইসব দিনের কথা ভাবলে আমার শরীর থেকে আগুন ছিটকে বেরোয়। আমি ওই নিষ্ঠুর স্বার্থপর মানুষটিকে ক্ষমা করতে পারি না।

রাতে শুয়ে থাকি একা বিছানায়। কায়সার কী আমাকে ভালবাসে? বাসেই তো মনে হয়। ও ডাকলেই আমি ছুটে যাই, আমার ভেতরেও যে ওর জন্য কিছু একটা কাজ। করে, কিছু একটা তীব্রতা তা নিশ্চয় বোঝে কায়সার। আমি কেন সামলে চলব, আমি কি কারও কাছে জীবন বন্ধক দিয়েছি যে নিজেকে সংযত করব, নিজেকে আটকে রাখব একটি অদৃশ্য খাঁচায়! কে আছে আমার যে আমি তার জন্য ভাবব, আমার মনে হবে আমি অন্যায় করছি! বরং মনে হয় আরও আগে আলতাফের ঘর আমার বেরিয়ে আসা উচিত ছিল, আরও আগেই প্রতারকটির সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে আসতে পারলে অনেকটা সময় আমি নিজের জন্য পেতাম।

কায়সার যে আমাকে ভালবাসে তা আর গোপন করতে পারেনি। ও জানে আমি বিবাহিতা এক মেয়ে, এখনও সম্পর্কটি টিকে আছে আলতাফের সঙ্গে, তারপরও কায়সার কাছে আসে, তার প্রাপ্তি কতটুকু না জেনেই আসে। এই ভালবাসা শেষ অবধি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে জানি না। মাঝে মধ্যে মনে হয় ওকে ফিরিয়ে দিই। কিন্তু ফিরিয়েই বা দেব কেন। আমি কি আলতাফের কাছে কখনও ফিরে যাব যে কায়সারকে প্রত্যাখান করতে হবে আমার! সে আসুক, ভালবাসুক, আমি তার ভালবসায় গা ভিজিয়ে স্নান করব! আমাকে কে বাধা দেবে, আলতাফের কী ক্ষমতা আছে আমাকে বাধা দেবার! সে বড়জোর আইন দেখাবে। তালাকনামা পাঠিয়ে দিলে কোথায় যাবে আইন! এসব ঠুনকো কাগুঁজে সম্পর্কের কোনও জোর আছে বলে আমার মনে হয় না। কাগজ দিয়ে মানুষকে আটকে রাখা যায়, যদি মন না চায়! আমি হঠাৎ হঠাৎ ভুলেই যাই আলতাফ নামের এক লোকের স্ত্রী আমি। আমি তার ঘরে দীর্ঘদিন থেকেছি। ভাবলে আমি অবাক হই একটি লোক নানারকম দোষের তলে আমাকে ফেলেছে। আর আমিও নির্বিচারে মেনে নিয়েছি তার সব মিথ্যাচার। যেটুকু প্রতিবাদ করেছি তা করা না করা সমানই ছিল। কষে যেখানে দু ঘা লাগানো দরকার সেখানে গাল ফুলিয়ে রাখলে চলে! আমি অপোস করেছিলাম বলেই আমার এই দুরবস্থা। সবাই ভেবে নিয়েছে একে দিয়ে যা ইচ্ছে তাই করানো যায়। এ তো মেনে নেবেই সব নির্যাতন।

১৬. মনজু কাকা বলেছেন

মনজু কাকা বলেছেন বাবা ফোন করেছেন তার অফিসে। আসবেন। আমার প্রসঙ্গে কোনও কথা হয়নি। আমি কিন্তু অনুমান করি বাবা সব জেনেই আসছেন। আমি এর মধ্যে আরও একটি জিনিস ভেবে নিই, তা হল, কাজি অফিসে গিয়ে আলতাফের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলব। ঝুলে থাকা ব্যাপারটি আমাকে হঠাৎ হঠাৎ জ্বালায়। একদিন ছুটি নেব অফিস থেকে। সারাদিনে তালাকনামার কাগজপত্র পুরণ করব আর সেলেব্রেট করব দিনটি। তালাক নামা পেয়ে আলতাফের কী রকম রাগ ধরবে ভেবে আমার বেশ আনন্দ হয়। নিশ্চয় সে রাগে ফুলে উঠবে। ফুঁসে উঠবে। হাত কামড়াবে। সারা বাড়ি দাপাবে। ওর মা বলবে মেয়ের সাহস কত, আগেই বলেছিলাম মেয়ে খারাপ, আলতাফের মা বিশ্বাস করবেন ছেলে তার সৎ সাহসী সমর্থ পুরুষ আর চরিত্রহীন হলাম আমি; তাতে অবশ্য আমার কিছু যায় আসে না। কারণ আলতাফই একমাত্র জানে তার দোষ দুর্বলতা। সে-ই জানে তাকে ছেড়ে যাবার কী কারণ আমার। যেদিন তালাকের কাজ করব, আমি সিদ্ধান্ত নিই, দিনটি আমি উদযাপন করব। অনেকদিন পর শাড়ি পরব, সাজব। সঙ্গে সেদিন কায়সার থাকলে ওকে নিয়ে পুরো শহর ঘুরে বেড়াব। দুপুরে কোথাও খাব।

এরকম যেদিন ভাবলাম, তার পরদিন অফিস থেকে ফিরেই দেখি কায়সার আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। সে টিউশনি ঠিক করে এসেছে আমার জন্য। তিনটে টিউশনিতে টাকা পাব আড়াই হাজার! চাকরিটি ছেড়ে দেওয়া যে ভাল আমাকে বোঝাতে এসেছে সে। চাকরিটি সময় বেশি খায় বলেই ওর আপত্তি। কায়সারের সঙ্গে সেদিন হাঁটতে হাঁটতে কাটাবনের মোড় অবধি যাই, সে আমাক দু’হাত ভরে রজনীগন্ধা কিনে দেয়, এত ফুল, ফুলের এত সুবাস আমি রাখব কোথায়! মনে পড়ে কতবার আলতাফকে বলেছিলাম অফিস থেকে ফেরার পথে রজনীগন্ধা এনো। আলতাফ বলেছিল দুর ওসবে পোকা হয়। পোকা হোক, তবু তো সুগন্ধ দিচ্ছে, মৃত্যু আছে বলে আমরা কি জীবনকে গ্রহণ করি না! গ্রহণের আনন্দ আলতাফ একেবারেই বোঝে না। আলতাফ আমাকে জয় করতে চেয়েছিল ওর অগাধ বিত্ত দিয়ে, ওর সৌন্দর্য দিয়ে; পারেনি। আর কায়সার তার আহামরি রূপ ছাড়াই, বিত্ত ছাড়াই আমাকে জয় করে ফেলেছে। আমি অভিভূত হচ্ছি দিন দিন। একদিকে কায়সার, আরেক দিকে পুরো জগৎ। আমার সামনে আর সব ধুসর হয়ে যায়। আমি অনেকদিন ভাল করে চুল আঁচড়াই না, ভাল কাপড় পরি না, মনে হত কী প্রয়োজন এইসবে! জীবন তো শেষ হয়ে গেল, গ্লানিময় জীবন। অথচ আশ্চর্য–চুল এখন শ্যাম্পু করে উড়িয়ে দিই, আড়ং থেকে জামা কিনে আনি, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে যখন দেখি, কায়সারের চোখ দিয়ে দেখি। কায়সার একদিন বলে–তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। শুনে আমার লজ্জাও লাগে আবার ভালও লাগে। আমার ভাল লাগার কোনও সীমা থাকে না। দিন রাত আমি ডুবে থাকি অতল ভালবাসায়। আমি বুঝি আমি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছি। আমি ভুলে যাচ্ছি আমি একটি রক্ষণশীল ঘরের মেয়ে। আমার একটি স্বামী আছে। এখনও আমি আইনত তার কাছে বাধা, এখনও সে ইচ্ছে করলে এক পাড়া মানুষের সামনে আমার ঘাড় ধরে টেনে নিয়ে যেতে পারে। আমার শক্তি নেই বাধা দেবার। লোকে বলবে স্বামী যখন, তার তো অধিকারই আছে অবাধ্য স্ত্রীকে যেমন করেই হোক বাগে আনবার।

এর মধ্যে বাবা আসেন অফিসে। এসে আমাকে দেখে যত তাঁর অবাক হবার কথা তত হন না। আমি অনুমান করি তিনি জানেন আমি এই অফিসে কাজ করি। আমার চোখে চোখ পড়ে তার। চোখ নামিয়ে সোজা ঢুকে যান মনজু কাকার রুমে। রুম থেকে বেরিয়ে আসেন ঘণ্টাখানেক পর। এম ডির পাশের রুমেই আমি বসি, আমাকে ডিঙিয়েই তাঁকে যেতে হবে। আমি ভেবেছিলাম তিনি আমার সামনে দাঁড়াবেন এবং অড কোনও সিচুয়েশনে আমাকে পড়তে হবে। আমি প্রস্তুত ছিলাম যে কোনও প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য। তিনি যদি আমাকে উঠে যেতে বলেন, আমি যাব না। তিনি যদি আলতাফের প্রসঙ্গ টানেন, বলব আমি তাকে ডিভোর্স দিচ্ছি। তিনি যদি বলেন চাকরি করা চলবে না, আমি বলব আমি চাকরি করবই। আমি প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ে আমি কী করব কী করব না সেটা আমি বুঝব। যদি বলেন বাড়িতে চলে আয়, হোস্টেলে থাকা চলবে না, সে ক্ষেত্রেও বলব যেদিন আমার ইচ্ছে করে সেদিন যাব। আমাকে জোর করলে আমি যাব না। আমাকে জোর করলে আমিও জোর করব। গায়ের শক্তি যতটা খাটানো যায়, খাটাব। যদি ভয় দেখান, কী ভয় দেখাবেন আর! এই অফিসের লোক, অফিসের বাইরের লোকেরা বাবার যুক্তি মেনে নেবেন জানি। বলবেন বাবা তো আমার ভালর জন্যই করছে। আমি মানব না। অভিভাবকরা একটি নির্দিষ্ট ছকে মেয়েদের ভাল চান। সেই ছকে নিজের জীবনকে ফেলে নিজেকে আমি অনেক অপমান করেছি। বাবার বা কোনও অভিভাবকের সাধ্য নেই বোঝেন যে এই অপমানের প্রকৃতি ঠিক কী রকম। আমি যদি বলি স্বামী আমাকে সুখ দিতে পারছে, যে সুখ আমি তাকে দিতে পারছি–তবে এমন উত্তর আসতে পারে কী দরকার পার্থিব সুখ টুখের, মেয়ে হয়ে এত সুখের আশা করা ঠিক মানায় না, অসভ্যের মত শোনায় অর্থাৎ নির্লজ্জ মেয়েরা স্বামীর সুখ ছাড়াও নিজের সুখের কথা ভাবে। আমি ভাবব না কেন? আমি নিজের সুখের জন্য উদগ্রীব হলে খারাপ দেখায় আর আলতাফ যখন উন্মাদ হয়ে ওঠে আমাকে পিষে একটু সুখ পাবে বলে কই কেউ তো তাকে খারাপ বলে না বরং আমি বাধা দিলে বলে তোমার বাধা দেওয়া উচিত নয়। কেবল স্ত্রীরই কি দায়িত্ব স্বামীকে সুখী করবার! এই নিয়ম যত বড় বিজ্ঞ ব্যক্তিরাই তৈরি করুন আমি মানতে রাজি নই। দু’জনের মধ্যে যদি ভালবাসা না থাকে তবে লোকে কী বলবে ভয়ে আমি সেই ভালবাসাহীন নরকে বাস করব–এ আমার দ্বারা কখনও সম্ভব নয়। ‘লোক’ একটা ভেগ টার্ম। লোকের ভয় দেখিয়ে মেয়েরা যা করতে চায় তা করতে দেওয়া হয় না, এতে কিছু নপুংসক, অর্থলোভী, স্বার্থপর, হিংসুক, ঈর্ষাকাতর, অবিবেচক পুরুষ আনন্দ লাভ করে। আর কিছু নয়। আমি অবাক হই বাবা আমার টেবিলের সামনে না দাঁড়িয়ে চলে যান। পরে মনজু কাকা যখন রুম থেকে বের হন, তিনিও আমাকে কিছু বলেন না কিন্তু আমি অনুমান করি আমাকে চকরি থেকে বাদ দেওয়ার আদেশ বা অনুরোধ আমার বাবা করেছেন। ইতিমধ্যে আমি কাজ শিখে গেছি। মনজু কাকা কি ডিসিশান নেবেন আমার ব্যাপারে জানি না। যে ডিসিশানই নেন, আমি যেন সবকিছুর সামনে নিজের জোর নিয়ে দাঁড়াতে পারি নিজের জন্য আমি এরকমও একটি সিদ্ধান্ত নিই।

সেদিন সারাদিন বৃষ্টি। বিকেলে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আসে কায়সার। আমি হোস্টেলের রুমে বসে চাকরিটির কথা ভাবছিলাম। মনজু কাকা এখনও জানাননি কিছু। যা কিছুই জানান আমি ভড়কে যাব না। আমার সিদ্ধান্তে আমি অটল থাকব। এরকম ভাবতে ভাবতেই কায়সারের সঙ্গে গেটে দেখা করতে যাই। তাকে বলি–আজ চলে যাও, আজ কোথাও বসে কথা বলবার জায়গা নেই।

কায়সার বলে–উঁহু, এই চমৎকার দিনে তোমাকে ছাড়া ভালই লাগবে না, চল ভিজি।

ভেজার কথা উঠতেই আমার মন নেচে ওঠে। বলি–চল।

দু’জনে রাস্তার তাবৎ লোকের বিস্মিত দৃষ্টির সামনে হাঁটতে থাকি। হাঁটতে হাঁটতে মহসিন হলের কাছে এলে কায়সার বলে–রুমে গিয়ে চল সর্ষের তেল দিয়ে মুড়ি মেখে খাই।

অমি বলি–সঙ্গে চা, কেমন?

কায়সার হেসে বলে–নিশ্চয়ই। পারলে ভুনা খিচুড়ি বেঁধে খাব।

আমার ভাল লাগে খুব। কায়সারের সঙ্গে আমার ইচ্ছেগুলো অনেকটা মিলে যায়। ও আবার ভাল গান গাইতে জানে। চা খেতে খেতে ওর গান শোনা গেলে মন্দ হয় না। একটি সিঙ্গল খাট, টেবিল বোঝাই এলোমেলো বইপত্র। মশারিটি ঝুলে আছে। আমি দাঁড়িয়ে দেখছিলাম কায়সারের রুমটি। সে একটি তোয়ালে হাতে দিয়ে বলে–মাথাটা মুছে নাও। ঠাণ্ডা লাগবে।

তোয়ালে হাতে নিয়ে বলি–চা খাওয়াও আর গান শোনাও।

কায়সার হিটারে কেটলি চাপায় আর ভরাট গলায় গায় ‘এসো এসো আমার ঘরে এসো, আমার ঘরে, বাহির হয়ে এসো’ ….

টেবিলের কোণা ঘেসে দাঁড়িয়ে দু একটি বই এর পাতা উল্টাই। আর কায়সারের চা বানাবার আয়োজন দেখি। তার ঘরে আসবার আহবান সে এত গভীর করে করে যে তার গানের লয় তাল হয়ত শুদ্ধ হয় না, কিন্তু গানে আমি প্রাণ খুঁজে পাই। দু’কাপ চা হাতে নিয়ে এসে সে বলে–কী এখনও মাথাটা মুছলে না, জ্বর হলে বুঝবে।

আমি বলি–হোক, আমার খুব জ্বর হোক। তুমি আমাকে দেখতে যাবে। আমার কপাল ছুঁয়ে জ্বর দেখবে। কাছে বসবে, বলবে ভাল হয়ে যাও। শুনে আমার খুব ভাল লাগবে। হোক না, খুব জ্বর হোক আমার।

আমার কণ্ঠে কী ছিল জানি না কায়সার মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। পলক না ফেলা চোখ। আমারও জ্বরের ঘোর কাটে যখন আমার হাতদুটো ধরে সে বিছানায় বসায়। ওর শরীর ভেজা। বুকের সঙ্গে লেগে সপসপ করছে ভেজা শার্ট। ও আমার হাত থেকে তোয়ালে নিয়ে আমার মাথা মুছিয়ে দেয়। মাথা থেকে মুখ, মুখ থেকে বুক, আমার সমস্ত শরীর ও তোয়ালে দিয়ে মোছে। আমার ভেজা শরীরে ওর উষ্ণ হাতের স্পর্শ এসে লাগে। আমি চোখ বুজে ওর উষ্ণতাটুকু উপভোগ করি। বারবার কেঁপে উঠি। ও আমার ঠোঁটে গাঢ় চুমু খায়। আমি আর নিজেকে নিজের ভেতর গুটিয়ে রাখতে পারি না। ছড়িয়ে দিই। গোলাপ যেমন ফুটতে গিয়ে পাপড়িগুলো ছড়ায়, তেমন। ঘরে আর নেই কেউ। দুজন মাত্র মানুষ আমরা। শরীর জেগে ওঠে ঘামের গন্ধমাখা কায়সারের আলুথালু বিছানায়। আমি ওকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে ওর ভেজা বুকে মুখ রেখে বুক ভরে শ্বাস নিই। নেব না কেন? আমাকে কে বাধা দেবে? ভালবাসার কাছে, নিজের গভীর গাঢ় ইচ্ছের কাছে নিজেকে সমর্পণ করবার যোগ্য আমি তো হয়েছিই। ধুম বৃষ্টির জলে ভালবাসা মিশে এমন এক সুগন্ধ আনে যে আমি সেই সুগন্ধ থেকে আর মুখ তুমি না। কায়সারের লোমশ বুক থেকে আমার মুখ তুলতে ইচ্ছে করে না। ও আমাকে আরও নিবিড় করে জড়িয়ে রাখে। তারপর কী হয় আমি ঠিক বুঝতে পারি না, দু’জন মানুষ ভালবাসতে বাসতে কোথায় হারিয়ে যাই। হারিয়ে যেতে যেতে বুঝি আমার পিপাসা মিটছে। পিপাসা মিটছে আমার।

আমার শরীর কতকাল কিছু যেন চেয়েছিল, খরার জীবনে জল চেয়েছিল সামান্য, আর হঠাৎ না চাইতেই অবাধ বৰ্ষণ জোটে সুখের। পিপাসা মিটছে আমার। এক শরীর পিপাসা। ঊষর জমি জুড়ে জলপতনের শব্দ, ফসলের সবুজ দোলা, আমি হারাই অন্য এক অচেনা জগতে। কী ঘটে আমার শরীরে বুঝি না, পিপাসা কেন মিটছে তাও বুঝি না, পিপাসা যখন মিটছে আমি কায়সারের পিঠ আঁকড়ে ধরি প্রচন্ড সুখে, শির্ষসুখে; ওর পিঠে আমার দশ নখের দাগ বসে যায়।

Exit mobile version