Site icon BnBoi.Com

বাঘবন্দি মিসির আলি – হুমায়ূন আহমেদ

বাঘবন্দি মিসির আলি - হুমায়ূন আহমেদ

যখন যা প্রয়োজন

যখন যা প্রয়োজন তা হাতের কাছে পাওয়া গেলে কেমন হত-এরকম চিন্তা ইদানীং মিসির আলি করা শুরু করেছেন। এবং তিনি খানিকটা দুশ্চিন্তায়ও পড়েছেন। মানুষ যখন শারীরিক এবং মানসিকভাবে দুর্বল হয় তখনই এ ধরনের চিন্তা করে। তখনই শুধু মনে হয়—সব কেন হাতের কাছে নেই। তিনি মানসিক এই অবস্থার নাম দিয়েছেনবেহেশত কমপ্লেক্স। এ ধরনের ব্যবস্থা ধর্মগ্রন্থের বেহেশতের বর্ণনায় আছে। যা ইচ্ছা! করা হবে তাই হাতের মুঠোয় চলে আসবে। আঙুর খেতে ইচ্ছে করছে, আঙুরের থোকা ঝুলতে থাকবে নাকের কাছে।

মিসির আলি খাটে শুয়ে আছেন। পায়ের কাছের জানালাটা খোলা। ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। পা শিরশির করছে। এবং তিনি ভাবছেন-কেউ যদি জানালাটা বন্ধ করে দিত। ঘরে কাজের একটা ছেলে আছে। ইয়াসিন নাম। তাকে ডাকলেই সে এসে জানালা বন্ধ করে দেবে। ডাকতে ইচ্ছা করছে না। তার পায়ের কাছে ভঁাজ করা একটা চাদর আছে। ভেড়ার লোমের পশমিনা চাদর। নেপাল থেকে কে যেন ভঁর জন্য নিয়ে এসেছিল। ইচ্ছা! করলেই তিনি চাদরটা গায়ে দিতে পারেন। সেই ইচ্ছাও করছে না। বরং ভাবছেন চাদরটা যদি আপনাআপনি গায়ের ওপর পড়ত তা হলে মন্দ হত না। নেপাল থেকে চাদরটা কে এনেছিল? নাম বা পরিচয় কিছুই মনে আসছে না। উপহারটা তিনি ব্যবহার করছেন, কিন্তু উপহারদাতার কথা তার মনে নেই। এই ব্যর্থতা মানসিক ব্যৰ্থতা।

রাত কত হয়েছে মিসির আলি জানেন না। এই ঘরে কোনো ঘড়ি নেই। বসার ঘরে আছে। সময় জানতে হলে বসার ঘরে যেতে হবে, ঘড়ি দেখতে হবে। ইয়াসিনকে সময় দেখতে বললে লাভ হবে না। সে ঘড়ি দেখতে জানে না। অনেক চেষ্টা করেও এই সামান্য ব্যাপারটা ইয়াসিনকে তিনি শেখাতে পারেন নি। কাজেই ধরে নেওয়া যেতে পারে শিক্ষক হিসেবে তিনি ব্যৰ্থ। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এই ব্যৰ্থতাটাও তিনি নিতে পারছেন না। এটাও মানসিক দুর্বলতার লক্ষণ। মানসিকভাবে দুর্বল মানুষ ব্যর্থতা নিতে পারে না। মানসিকভাবে সবল মানুষের কাছে ব্যর্থতা কোনো ব্যাপার না। সে জানে সাফল্য এবং ব্যর্থতা দুই সহোদর বোন। এরা যে কোনো মানুষের চলার পথে হাত ধরাধরি করে দাড়িয়ে থাকে। সাফল্য নামের বোনটি দেখতে খুব সুন্দর। তার পটলচেরা চোখ, সেই চোখের আছে জন্ম কাজল। তার মুখে প্রথম প্ৰভাতের রাঙা আলো ঝলমল করে। আর ব্যর্থতা নামের বোনটি কদাকার, মুখে বসন্তের দাগ, চোখে অল্প বয়সে ছানি পড়েছে। সবাই চায় রূপবতী বোনটির হাত ধরতে। কিন্তু তার হাত ধরার আগে কদাকার বোনটির হাত ধরতে হবে এই সহজ সত্যটা বেশিরভাগ মানুষের মনে থাকে না। মানুষের মন যতই দুর্বল হয় ততই সে কুঁকতে থাকে রূপবতী বোনটির দিকে। এটা অতি অবশ্যই মানসিক জড়তার লক্ষণ।

স্যার ঘুম পাড়ছেন?

মিসির আলি উঠে বসলেন। দাঁত কেলিয়ে ইয়াসিন দাঁড়িয়ে আছে। তার বয়স বার-তের। হাবাগোবা চেহারা। কিন্তু হাবাগোবা না। যথেষ্ট বুদ্ধি আছে। শুধু বুদ্ধির ছাপ চেহারায় আসে নি। ঠোঁটে গোফের ঘন রেখা জাগতে শুরু করেছে, এতে হঠাৎ করে। তাকে খানিকটা ধূৰ্তও মনে হচ্ছে। যদিও তিনি খুব ভালো করেই জানেন ইয়াসিন ধূর্ত না। ইয়াসিনকে অনেকবার বলা হয়েছে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকা অবস্থায় তাকে যেন কখনো জিজ্ঞাসা করা না হয়-তিনি ঘুম পাড়ছেন না পাড়েন নি। কোনো লাভ হয় নি। বরং উল্টোটা হয়েছে, তিনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলেই ইয়াসিন তাকে ডেকে তোলাকে তার দায়িত্বের অংশ বলে মনে করা শুরু করেছে। এবং সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালনের জন্যে তাকে বেশ আনন্দিতও মনে হচ্ছে।

মিসির আলি শান্ত গলায় বললেন, কটা বাজে দেখে আয় তো। ইয়াসিন উৎসাহের সঙ্গে রওনা হল। তার যাবার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে হয়তো আজ সে সময়ট বলতে পারবে। গতকাল রাতেও তিনি ছবিটবি এঁকে ঘড়ির সময় বোঝানোর চূড়ান্ত চেষ্টা করেছেন। ইয়াসিনের ঘন ঘন মাথা নাড়া দেখে মনে হয়েছে সে ব্যাপারটা ধরতে পেরেছে। দেখা যাক।

ইয়াসিন হাসিমুখে ফিরে এল। মিসির আলি বললেন, কটা বাজে? ইয়ালিনের মুখের হানি আরো বিস্তৃত হল। আনন্দময় গলায় কাল, বুঝি না। আউলা ঠেকে।

ছোট কাঁটা কটার ঘরে?

তিনের ঘরে।

আর বড়টা?

ছোট জন যে ঘরে। বড় জনও একই ঘরে।

মিসির আলি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। দশটার বেশি রাত হয় নি। ছোট কাঁটা তিনের ঘরে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। ছোট কাঁটা বড় কাটার ব্যাপারটাই হয়তো ইয়াসিন বোঝে নি। গোড়াতেই গিট্টু লেগে আছে।

স্যার চা খাইবেন?

না।

দরজা বন কইরা দেন। কাইল সক্কালে আমুনে।

আজ না গেলে হয় না?

হয়। না গেলেও হয়। যাই গা। কাইল সক্কালে আমু।

মিসির আলি উঠলেন। ইয়াসিন একবার যখন বলেছে যাবে তখন সে যাবেই। ইয়াসিনের বাবা-ফার্মগেট এলাকায় ভিক্ষা করে। ভিক্ষুক বাবার খোঁজখবর করার জন্য সে প্রায়ই যায়। মাঝে মধ্যে নিজেও ভিক্ষা করে। ইয়াসিনরা তিন পুরুষের ভিক্ষুক। তার দাদাও ভিক্ষা করতেন। মিসির আলি ব্যাপক চেষ্টা করছেন। পুরুষানুক্রমিক এই পেশা শুঙার। ইয়াসিনকে এনে কাজ দিয়েছেন। লেখাপড়া শেখানোর চেষ্টা করেছেন। মাঝে মাঝে বক্তৃতা-মানুষ পৃথিবীতে দুটা হাত নিয়ে এসেছে কাজ করার জন্য ভিক্ষা করার জন্য না। আল্লাহ যদি চাইতেন মানুষ ভিক্ষা করবে তা হলে তাকে একটা হাত দিয়েই পাঠাতেন। ভিক্ষার থালা ধরার জন্য একটা হাতই যথেষ্ট। মনে হচ্ছে না শেষ

পর্যন্ত উপদেশমূলক বক্তৃতায় কোনো লাভ হবে। ইয়াসিনের প্রধান ঝোঁক ভিক্ষার দিকে। মিসির আলি নিশ্চিত আজ সে ভিক্ষা করার জন্যই যাচ্ছে। বিষুদবার রাতে বাবার সঙ্গে সে আজমপুর গোরস্থানের গেটে ভিক্ষা করতে যায়।

মিসির আলি বললেন, ভিক্ষা করতে যাচ্ছিস?

ইয়াসিন জবাব দিল না। উদাস দৃষ্টিতে তাকাল।

সকালে কখন আসবি?

দেখি।

সকাল দশটার পরে এলে কিন্তু ঘরে ঢুকতে পারবি না। আমি তালা দিয়ে চলে যাব। এগারোটার সময় আমার একটা মিটিং আছে। তুই অবিশ্যি দশটার আগে চলে অ্যাসবি।

দেখি।

মিসির আলি লক্ষ করলেন, ইয়াসিন তার ট্রাঙ্ক নিয়ে বের হচ্ছে। ভালো সম্ভাবনা যে সে আর ফিরবে না। নিজের সব সম্পত্তি নিয়ে বের হচ্ছে। এই ট্রাঙ্কটা সম্পর্কে মিসির আলির সামান্য কৌতুহল আছে। ইয়াসিন ট্রাঙ্কে বড় একটা তালা বুলিয়ে রাখে। গভীর রাতে শব্দ শুনে মিসির আলি টের পান যে তালা খোলা হচ্ছে।

তুই কি সকালে সত্যি আসবি?

হ্যাঁ।

ট্রাঙ্ক নিয়ে যাচ্ছিস কেন?

প্রয়োজন আছে।

আচ্ছা যা।

ইয়াসিন পা ছুঁয়ে তাকে সালাম করল। এটা নতুন কিছু না। ইয়াসিন বাইরে যাবার আগে তার পা ছুঁয়ে সালাম করে।

মিসির আলি বিছানা থেকে নামলেন। দরজা বন্ধ করে ঘড়ি দেখতে বসার ঘরে গেলেন। ঘড়ির দুটা কাঁটা তিনের ঘরে এই কথাটা ইয়াসিন মিথ্যা বলে নি। তিনটা পনেরো মিনিটে ঘড়ি বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যাটগরি শেষ হয়েছে নিশ্চয়ই। ঘরে একটা মাত্র ঘড়ি। তার নিজের হাতঘড়িটা মাস তিনেক হল হারিয়েছেন। কাজেই রাতে আর সময় জানা যাবে না।

মিসির আলি সূক্ষ্ম অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করলেন। তাঁর মনে হল সময় জানাটা খুবই দরকার। ঘরে খাবার পানি না থাকলে সঙ্গে সঙ্গে পানির পিপাসা পেয়ে যায়। তৃষ্ণায় বুকের ছাতি শুকিয়ে আসে। ঘরে পানি থাকলে কখনো এত তৃষ্ণা পেত না।

সময় জানার জন্য মিসির আলি উসখুসি করতে লাগলেন। যদিও সময় এখন না। জানলেও কিছু না। তাঁর ঘুমিয়ে পড়ার কথা! শরীর ভালো যাচ্ছে না। বুকে প্রায় সময়ই চাপ বোধ করেন। রাতে হঠাৎ হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। তখন মনে হয় বুকের উপর কেউ যেন বসে আছে। সেও স্থির হয়ে বসে নেই, নড়াচড়া করছে। তিনি উঠে বসেন। বিছানা থেকে নামেন। বুকের উপর বসে থাকা বস্তুটা কিন্তু তখনো থাকে। টিকটিকির মতো বুকে সেঁটে থাকে। এইসব লক্ষণ ভালো না। এসব হচ্ছে ঘণ্টা বাজার লক্ষণ। প্রতিটি জীবিত প্রাণীর জন্য ঘণ্টা বাজানো হয়। জানিয়ে দেওয়া হয় তোমার জন্য অদৃশ্য ট্রেন পাঠানো হল। এ তারই ঘণ্টা। ভালো করে তাকাও দেখবে সিগন্যাল ডাউন হয়েছে। ট্রেন চলে আসার সবুজ বাতি জ্বলে উঠেছে। ট্রেন থামতেই তুমি টুক করে তোমার কমরায় উঠে পড়বে। না তোমাকে কোনো সুটকেস, বেডিং নিতে হবে না। ট্রেনটা যখন তোমাকে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিল তখন যেভাবে এসেছিলে যাবেও সেইভাবে। ট্রেন থামতে থামতে যাবে, নানান যাত্রী উঠবে।—সবার গন্তব্য এক জায়গায়। সে জায়গাটা সম্পর্কে করোরই কোনো ধারণা নেই।

মিসির আলি দরজা খুললেন। বারান্দায় এস বসলেন। বুকে চাপ ব্যথাটা আবারো অনুভব করছেন। ফাঁকা জায়গায় বসে বড় বড় নিশ্বাস ফেললে আরাম হবার কথা। সেই আরামটা হচ্ছে না। মিসির আলির দু কামরার এই বাড়িটার আবার একটা বারান্দাও আছে। গ্রিল দেওয়া বারান্দা। বারান্দাটা এত ছোট যে দুটা চেয়ারেই বারান্দা ভর্তি। মিসির আলি এই বারান্দায় কখনো বসেন না। গ্রিল দেওয়ার কারণে বারান্দাটা তার কাছে জেলখানার গরীদের মতো লাগে। বারান্দা থাকবে খেলামেলা; এবং অতি অবশ্যই বারান্দা থেকে আকাশ দেখা যাবে। জানালা মানে যেমন আকাশ, বারান্দা মানেও আকাশ। গ্রিল দেওয়া এই বারান্দা থেকে আকাশ দেখা যায় না।

বারান্দা থেকে বাড়িওয়ালা বাড়ির খানিক অংশ এবং নর্দমাসহ গলি ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। মিসির আলির খুব ইচ্ছা অন্তত জীবনের শেষ কিছুদিন তিনি এমন একটা বাড়িতে থাকবেন যে বাড়ির বড় বড় জানালা থাকবে। জানালার পাশ থেকে আকাশ দেখা যাবে। জীবনের শেষ সময় এসে পড়েছে বলেই তার ধারণা-জানালাওয়ালা বারান্দার কোনো ব্যবস্থা এখনো হয় নি। তবে তীর ধারণা তার শেষ ইচ্ছােটা পূর্ণ হবে। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তাঁর আত্মীয়স্বজনরা অবশ্যই তাকে কোনো একটা ভালো ক্লিনিকে ভর্তি করবে। সেই ক্লিনিকের ভাড়া তিনি দিতে পারবেন কি পারবেন না তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।

ক্লিনিকে তাঁর বিছানাটা থাকবে জানালার কাছে। তিনি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে পারবেন। ডাক্তার এবং নার্সরা মিলে তাঁর জীবন রক্ষার জন্যে যখন ছোটাছুটি করতে থাকবেন, তিনি তখন তাকিয়ে থাকবেন আকাশের দিকে। মৃত্যুর আগে আগে শারীরবৃত্তির সকল নিয়মকানুন এলোমেলো হয়ে যায়। কাজেই তিনি হয়তো তখন আকাশের কোনো অদ্ভূত রঙ দেখবেন। নীল আকাশ হঠাৎ দেখা গেল গাঢ় সবুজ হয়ে গেছে। কিংবা আকাশ হয়েছে বেগুনি। বেগুনি তাঁর প্রিয় রঙ।

স্যার স্নামালিকুম।

মিসির আলি চমকে তাকালেন। বাড়িওয়ালা বদরুল সাহেবের ভাগ্নে ফতে মিয়া। আপন ভাগ্নে না। দূরসম্পর্কের ভাগ্নে। ফতে মিয়া মিসির আলির ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তিনি তাকে তাঁর সামনে এসে দাঁড়াতে দেখেন নি। যখন চোখ বন্ধ করে ছিলেন তখন এসেছে। ফতে মিয়ার চলাফেরা সম্পূর্ণ নিঃশব্দ। মানুষটা মনে হয়। বাতাসের ওপর চলে। মানুষটা বাতাসের ওপর দিয়ে চলাফেরা করার মতো ছোটখাটো না। তার শরীর-স্বাস্থ্য ভালো। শুধু শরীরের তুলনায় মাথাটা ছোট। দেখে মনে হয় খুব রোগা কোনো মানুষের মাথা একজন কুস্তিগিরের শরীরে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ফতে মিয়ার গলার স্বর পরিষ্কার; ঝনঝনি করে কথা বলে।

ফতে মিয়া কেমন আছ?

স্যার আপনার দোয়া।

সঙ্গে ঘড়ি আছে? কটা বাজে বলতে পার?

দশটা চল্লিশ।

মিসির আলি লক্ষ্য করলেন সময় বলতে গিয়ে ফতে ঘড়ি দেখল না। এটা তেমন কোনো ব্যাপার না। ঘড়ি হয়তো সে একটু আগেই দেখেছে। তার পরেও মানুষের স্বভাব হল সময় বলার আগে ঘড়ি দেখে নেওয়া। ফতে মিয়া সময় বলেছে। দশটা চল্লিশ। পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে এভাবে সময় বলা সম্ভব না। মিসির আলির মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল। একবার ইচ্ছা হল জিজ্ঞেস করেন ঘড়ি না দেখে এমন নিখুঁতভাবে সময়টা সে বলছে কীভাবে। তিনি কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। ফতে মিয়া বলল, স্যার যাই?

আচ্ছা।

ঠাণ্ডা পড়েছে। ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকেন। ৱেষ্ট নেন। আশ্বিন-কার্তিক মাসের ঠাণ্ডাটা বুকে লাগে। পৌষ-মাঘ মাসের ঠাণ্ডায় কিছু হয় না।

ফতে যেমন নিঃশব্দে এসেছিল সেরকম নিঃশব্দেই চলে গেলেন। নিশাচর পশুরাই এমন নিঃশব্দে চলে। নিশাচরদের সঙ্গে ফতে মিয়ার কোথায় যেন খানিকটা মিল আছে। মিসির আলি বাড়িওয়ালা বদরুল সাহেবের হইচই চিৎকার শোনার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। বদরুল সাহেব তার ভাগ্নেকে গলাগলি না করে ঘুমাতে যাবেন তা হবার না। ছমাসের ওপর হল মিসির আলি এ বাড়িতে আছেন। ছমাসে এ নিয়মের ব্যতিক্রম দেখেন নি। বদরুল সাহেবের মেজাজ এমনিতেই চড়া। বাড়িতে যতক্ষণ থাকেন, হইচই চিৎকার গালাগালির মধ্যেই থাকেন। নিজের ভাগ্লের ক্ষেত্রে সব সীমা অতিক্রম করে। তিনি শুরুই করেন—শুয়োরের বাচ্চা পাছায় লাথি মেরে তোমাকে আমি… দিয়ে। মাঝে মাঝে চড়থাপ্পড় পর্যন্ত গড়ায়। বদরুল সাহেব ছোটখাটো রোগা পটকা মানুষ। তাঁর নানান অসুখবিসুখ আছে। চুপচাপ যখন বসে থাকেন তখন বুকের ভিতর থেকে শী শা শব্দ আসে। এরকম একজন মানুষের ফতে মিয়ার মতো বলশালী কাউকে চড় মারতে সাহস লাগে। সেই অর্থে বদরুল সাহেবকে সাহসী মানুষ বলা যায়।

আশ্ৰিত মানুষকে নানান অপমানের মধ্যে বাস করতে হয়। সেই অপমানেরও একটা মাত্রা আছে। ফতে মিয়ার ব্যাপারে কোনো মাত্রা নেই! মিসির আলি একবার তাকে দেখলেন ঠোঁট অনেকখানি কাটা। স্টিচ দিতে হয়েছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে ফতে?

সে মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, মামা রাগ করে ধাক্কার মতো দিয়েছিলেন। সিঁড়িতে পড়ে গেলাম। তেমন কিছু না। মামা প্রেসারের রোগী, রাগ সামলাতে পারেন না। তার ওপর মেয়েটা অসুস্থ। মেয়েটার জন্য মন থাকে খারাপ।

বদরুল সাহেবের একটাই মেয়ে। ছবছর বয়স-নাম লুনা। মেয়েটার মানসিক কোনো সমস্যা আছে। চুপচাপ একা বসে থাকে। তার একটাই খেলা-হাতের মুঠি বন্ধ করছে, মুঠি খুলছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে এই খেলা খেলে পার করে দিতে পারে। মেয়েটা পরীর মতো সুন্দর।

মিসির আলি প্রায়ই মেয়েটাকে সিঁড়ির গোড়ায় বসে থাকতে দেখেন। একমনে হাতের মুঠি বন্ধ করছে, খুলছে। দৃশ্যটা দেখে মিসির আলির মন খুবই খারাপ।

আজ অনেকক্ষণ বসে থেকেও ফতে মিয়ার প্রেসারের রোগী মামার কোনো হইচই শোনা গেল না! আজ হয়তো তিনি সকাল সকাল শুয়ে পড়েছেন। বাড়িওয়ালার চিৎকারটাও রুটিনের অংশ হয়ে গেছে। কোনোদিন যদি শোনা না যায় তা হলে মনে হয়। দিনটা ঠিকমতো শেষ হয় নি। কোথাও ফাক আছে।

মিসির আলি বারান্দা ছেড়ে ঘরে ঢুকলেন। রাত কত হয়েছে বোঝার উপায় নেই। ঘড়ি বন্ধ। বিছানায় যাবার আগে এক কাপ গরম চা খেলে হত। বেশিরভাগ মানুষই কফি অথচ চা খেলে ঘুমাতে পারে না! অথচ গরম চা তার জন্যে ঘুমের ওষুধের মতো কাজ করে। ইয়াসিন থাকলে চা এক কাপ খাওয়া যেত। তাঁর নিজের এখন আর চুলার কাছে যেতে ইচ্ছা করছে না।

খুব হালকাভাবে কে যেন দরজায় কড়া নাড়ছে। ইয়াসিনই ফিরে এসেছে কি না। কে জানে। বাবাকে হয়তো খুঁজে পায় নি, কিংবা ভিক্ষা করে আজ তেমন সুবিধা করতে পারে নি।

কে?

স্যার আমি ফতে।

কী ব্যাপার?

আপনার জন্যে মোমবাতি নিয়ে এসেছি। স্যার।

মিসির আলি বিস্মিত হলেন। মোমবাতির কথা কি তিনি ফতে মিয়াকে বলেছেন? না। বলেন নি। মোমবাতি নিয়ে তার উপস্থিত হবার কোনোই কারণ নেই।

ফতে মিয়া শুধু মোমবাতি আনে নি। ফ্লাঙ্কে করে চা এনেছে। আজকাল দুটা বিস্কুটের ছোট ছোট প্যাকেট পাওয়া যায়। এক প্যাকেট বিস্কুটও এনেছে। সে ঘরে ঢুকে ফ্লাস্কের মুখে চা ঢেলে মিসির আলির দিকে এগিয়ে দিল। প্যাকেট খুলে বিস্কুট বের করুল। দুটা বড় বড় মোমবাতি সামনে রাখল। মোমবাতির পাশে রাখল দেয়াশলাই! কাজগুলো করল। যন্ত্রের মতো। যেন প্রতিদিনই এরকম কাজ সে করে। যে কোনো অভ্যস্ত কাজ করায় যে যান্ত্রিকতা থাকে তার সবটাই ফতের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। মিসির আলি বললেন, তোমাকে কি মোমবাতি আনতে বলেছিলাম?

ফতে লজ্জিত গলায় বলল, জি না বলেন নাই। দশ মিনিটের মধ্যে কারেন্ট চলে যাবে। লোডশেডিং হবে। অন্ধকারে কথা বলে আরাম পাওয়া যায় না, এই জন্য মোমবাতি নিয়ে এসেছি।

দশ মিনিটের ভেতর লোডশেডিং হবে।

জি। চা খান। আমি নিজে বানিয়েছি। চিনি ঠিক হয়েছে কি না একটু দেখেন।

মিসির আলি চায়ে চুমুক দিলেন। তিনি চায়ে যতটুকু চিনি খান, ঠিক ততটুকু চিনিই আছে। তিনি কড়া একটু তিতকুট ধরনের চা পছন্দ করেন—এই চা কড়া এবং তিতকুট ধরনের।

ফতে।

জি স্যার।

তোমার চা খুব ভালো হয়েছে। আমি কোন ধরনের চা খাই তা তুমি জান?

ইয়াসিনকে জিজ্ঞেস করে জেনেছি।

এখন কটা বাজে?

এগারোটা পাঁচ।

তোমার হাতে ঘড়ি আছে?

জি না।

আমার এখানে আসার আগে কি ঘড়ি দেখে এসেছ?

জি না।

তা হলে কী করে বলছ-এগারোটা পাঁচ বাজে?

ঘড়ি না দেখেও আমি সময় বলতে পারি। ছোটবেলা থেকেই পারি। মৃত্যুঞ্জয় হাই স্কুলে যখন পড়ি তখন স্কুল পরিদর্শনে ইন্সপেক্টর সাহেব এসেছিলেন, তাকে ঘড়ির খেলা দেখিয়েছিলাম। উনি খুব খুশি হয়েছিলেন। বলেছিলেন আমাকে একটা ভালো ঘড়ি পাঠিয়ে দেবেন। পাঠান নাই। ভুলে গেছেন হয়তো।

ঘড়ির খেলাটা কী?

ঘড়ি না দেখে বলা সময় কত।

ও আচ্ছা।

স্যারের শরীর কি খারাপ?

সামান্য খারাপ।

শরীরের যত্ন নিবেন স্যার। যত্ন বিনা কোনো কিছুই ঠিক থাকে না। এই আমাকে দেখেন সকালে ফজরের নামাজ পড়ে হাঁটতে বের হই। চাইর থেকে পাচ মাইল হাঁটি। এই কারণে আমার কোনো অসুখবিসুখ হয় না। আপনে যদি অনুমতি দেন সকালে হাঁটতে যাবার সময় আপনাকে ডেকে সঙ্গে নিয়ে যাব।

কোনো দরকার নেই ফতে মিয়া। হাঁটাহঁটি ব্যাপারটা আমার পছন্দ না। দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার জন্যে মানুষ নানান কষ্টকর পদ্ধতির ভিতর দিয়ে যায়-ব্যায়াম করে, হাঁটাহঁটি করে। আমার দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার কোনো বাসনা নেই।

কথা শেষ করার আগেই কারেন্ট চলে গেল। ফতে মিয়া বলেছিল দশ মিনিটের মধ্যে কারেন্ট চলে যাবে। তাই হয়েছে। চমকানোর মতো কোনো ঘটনা না। ঢাকা শহরে রাতে পঁচ-ছবার করে ইলেকট্রসিটি চলে যাচ্ছে। এর মধ্যে কেউ যদি বলে দশ মিনিটের মধ্যে লোডশেডিং হবে তার কথা সত্যি হবার সম্ভাবনাই বেশি। মিসির আলি ভেবেছিলেন ফতে বলবে, দশ মিনিটের মধ্যে কারেন্ট চলে যাবে বলেছিলাম দেখলেন। সার কারেন্ট চলে গেছে।

ফতে তা করুল না। সে সাবধানে মোমবাতি জ্বালাল। পাশাপাশি দুটা মোমবাতি। তার মুখ হাসি হাসি। কোনো একটা বিষয় নিয়ে সে আনন্দিত। ফ্লাস্ক থেকে নিজের জন্যে চা ঢালতে ঢালতে বলল, স্যার আজ আমার মনটা খুব ভালো।

ভালো কেন?

আমি একটা দোকান নিয়েছি। সেলামির টাকা ছাড়াই দোকান পেয়েছি। আঠারো হাজার টাকা শুধু দিতে হয়েছে।

কিসের দোকান?

সরজির দোকান। আমি দরজির কাজ কিছু জানি না। ইনশাল্লাহ শিখে ফেলব। তবে একজন কর্মচারী আছে। কাজ ভালো জানে। দোকান নেওয়ার খবরটা স্যার আপনাকেই প্রথম দিলাম। আপনি নাদান ফতের জন্যে খাস দিলে একটু দোয়া করবেন।

ফতের চোখ চকচক করছে। গলার স্বর ভারী হয়ে এসেছে। মনে হচ্ছে সে কেঁদেই ফেলবে। ফতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, দোকানের টাকাটা খুবই কষ্ট করে যোগাড় করেছি। মামার সঙ্গে দুবছর ধরে আছি। এই দুবছরে মামার বাজার করতাম। রোজ কিছু কিছু টাকা সরাতাম। কোনোদিন দশ টাকা কোনোদিন পনেরো টাকা। এই অনেক টাকা হয়ে গেল-ঐ কবিতাটা পড়েছেন না। স্যার বিন্দু বিন্দু বালিকণা বিন্দু বিন্দু জল গড়ে তুলে সাগর অতল। দৈনিক পনেরো টাকা সরালে দুই বছরে হয় দশ হাজার নয়শ পঞ্চাশ টাকা। আমার হয়েছে সাড়ে নয়। হাজার টাকা। কিছু টাকা খরচ করে ফেলেছি। আমার আবার সিগারেট খাওয়ার বদভ্যাস আছে। নেশার মধ্যে সিগারেট আর জারদা দিয়ে পান। স্যার নেন আমার প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নেন। বাংলা ফাইত।

মিসির আলি সিগারেট নিলেন। ফতে আবারো কথা শুরু করুল-একবার করুলাম কি স্যার বেশ কিছু টাকা একসঙ্গে সরিয়ে ফেললাম। পঁচিশ হাজার টাকা। আমাকে ব্যাংকে পাঠিয়েছে জমা দিতে, আমি ফিরে এসে বললাম টাকা হাইজ্যাক হয়ে গেছে। মামা-মামি দুজনই আমার কথা বিশ্বাস করল। বিশ্বাস না করে উপায়ও নাই-আমার হাত-পা কাটা সারা শরীর রক্তে মাখামাখি।

নিজেই নিজের হাত-পা কেটেছ?

জি স্যার। একটা ব্লেড কিনে, ব্লেড দিয়ে কেটেছি। নিজের হাতে নিজের শরীর কাটাকুটি করা খুবই কষ্টের কিন্তু কি আর করা এতগুলি টাকা। এত রক্ত বের হচ্ছিল যে আমার মামি পর্যন্ত মামার উপরে রেগে গিয়ে বলল-কেন তুমি তাকে একা একা এতগুলি টাকা দিয়ে পাঠালে! একে তো মেরেই ফেলত। স্যার আমার কথা শুনে কি আপনার খারাপ লাগছে?

মিসির আলি কিছু বললেন না। তিনি আগ্রহ নিয়ে কথা শুনছেন। ফতের গল্প বলার ক্ষমতা ডালো। গলার স্বরের উঠানামা আছে। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ কথা বন্ধ করে। রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসে। এতে গল্পটা আরো জমে যায়।

স্যার বোধহয় আমাকে খুব খারাপ মানুষ ভাবছেন! স্যার আমি খারাপ না। মামার কাছ থেকে আমি কত টাকা নিয়েছি। সব একটা খাতায় লিখে রেখেছি। ইনশাল্লাহ সব টাকা একদিন ফিরত দেব।

দরজির দোকান দেওয়ার ব্যাপারটা তোমার মামা জানে?

জি স্যার আজ বিকালে বলেছি।

উনি জিজ্ঞেস করেন নাই এত টাকা কোথায় পেয়েছ?

উনাকে বলেছি যে আমার এক বন্ধু আমাকে টাকাটা ধার দিয়েছে।

বন্ধুর কথা উনি বিশ্বাস করেছেন?

জি করেছেন। উনি জানেন আমার এক বন্ধু কুয়েতে কাজ করে। বাবুর্চি। সে আমাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করবে। এটা মামাকে অনেক দিন থেকেই বলছিলাম। মামা এটা নিয়ে আমাকে অনেক ঠাট্টা-মশকরাও করতেন। প্রায়ই বলতেন-কই তোর বন্ধুর টাকা কবে অ্যাসবে?

আজ সন্ধ্যায় মামাকে পা ছুঁয়ে বলেছি টাকা এসেছে। মিষ্টি কিনে নিয়ে গিয়েছি। মামা খুশি হয়েছে। দরজির দোকানের কথা মামাকে বলেছি। মামা বলেছেন প্রয়োজনে তাঁর কাছ থেকে কিছু টাকা নিতে। এটা অবশ্য মামার মুখের কথা। মামা মুখে অনেক কথা বলেন।

ফতে।

জি স্যার।

তুমি আমাকে যেসব কথা বললে তার সবই তো গোপন কথা। প্রকাশ হয়ে পড়লে তোমার সমস্যা। কথাগুলি আমাকে কেন বললে?

আপনার কাছ থেকে কোনো কথাই প্ৰকাশ হবে না। আপনি গাছের মতো। গাছের কাছ থেকে কোনো কথা প্রকাশ হয় না।

আমাকে কথাগুলি বলার কারণ কী?

কাউকে বলার ইচ্ছা করছিল। আমার স্যার কথা বলার লোক নাই। বাবা-মা শৈশবে গত হয়েছেন। একটা বোন আছে মাথা খারাপ। বন্ধুবান্ধব কেউ নাই!

কাউকে বলতে হয় বলেই কি তুমি আমাকে কথাগুলি বললে?

জি স্যার।

কারেন্ট চলে এসেছে। ফতে ফু দিয়ে বাতি নিভিয়ে উঠে দাঁড়াল। বিনীত ভঙ্গিতে বলল, স্যার যাই। আমার জন্যে একটু দোয়া রাখবেন স্যার। গরিবের ছেলে যদি দোকানটা দিয়ে কিছু করতে পারি। আরেকটা ছোট্ট অনুরোধ। যদি রাগ না করেন তা হলে বলি।

বল।

দরজির দোকানের একটা নাম যদি দেন। সুন্দর কোনো নাম। আগে নাম ছিল বোম্বে টেইলারিং হাউস। আমি স্যার সুন্দর একটা নাম দিতে চাই। বাংলা নাম।

নামটাম আমার ঠিক আসে না।

আপনি যে নাম দিবেন। সেটাই আমি রাখব। আপনি যদি খারাপ নামও দেন কোনো অসুবিধা নাই। আপনি যদি নাম দেন-গু-গোবর টেইলারিং শপ আল্লাহর কসম সেই নামই রাখব।

কেন?

এটা আমা একটা শখ। মানুষের অনেক শখ থাকে। আমার শখ আমার দরজির দোকানোর নামটা আপনি দিবেন।

আচ্ছা দেখি মাথায় কোনো নাম আসে কি না।

এত চিন্তাভাবনা করার কিছু তো নাই। সার। এখন আপনার মাথায় যে নামটা আসছে সেটা বলেন।

এখন মাথায় কিছু নেই।

যা ইচ্ছা বলেন।

সাজঘর।

আলহামদুলিল্লাহ। আমার দোকানের নাম সাজঘর। স্যার উঠি?

আচ্ছা।

ফতে বিনীত গলায় বলল, দুটা মোমবাতি আর একটা দেয়াশলাইয়ের দাম পড়েছে পােচ টাকা। আপনার কথা ভেবে কিনেছিলাম। ভাংতি পাঁচ টাকা কি আছে স্যার?

মিসির আলি ড্রয়ার খুলে পাচ টাকার একটা নোট বের করলেন। ফতের সঙ্গে দীর্ঘ কথোপকথনে তিনি যতটা না অবাক হয়েছেন তারচে অনেক বেশি অবাক হয়েছেন। পাঁচ টাকার ব্যাপারটায়।

ফতে চলে গেল। যাবার আগে অতি বিনয়ের সঙ্গে মিসির আলিকে কদমবুসি করল। মিসির আলির মনে হল তিনি ছোট্ট একটা ভুল করেছেন। চলে যাবার আগে ফতেকে জিজ্ঞেস করা প্রয়োজন ছিল—কটা বাজে? ঘুমাতে যাবার আগে সময়টা জানা থাকা দরকার। আধুনিক মানুষ যন্ত্রনির্ভর হয়ে গেছে। মানুষ যেমন যন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করছে, যন্ত্রও মানুষ নিয়ন্ত্রণ করছে।

মিসির আলি দরজা বন্ধ করে ঘুমাতে গেলেন। ভালো শীত লাগছে। কোন্ড ওয়েভ হচ্ছে কি না কে জানে। কোন্ড ওয়েডের বাংলাটা ভালো হয়েছে-শৈত্যপ্রবাহ। কিছু কিছু শব্দ এমন আছে যে বাংলাটা সুন্দর-ইংরেজি তত সুন্দর না। যেমন Air condition বাংলা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ। বায়ু নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে না।–তাপ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।

জানোলা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। তিনি পায়ের ওপর চাদরটা দিয়ে দিলেনতখনই মনে পড়ল চাদরটা যে তাকে উপহার দিয়েছিল তার নাম তিনি মনে করতে পারছেন না। শুধু নাম না, মানুষটার পরিচয়ও তার মনে নেই। মস্তিষ্ক মানুষটার পরিচয় মুছে ফেলেছে। মস্তিষ্ক মাঝে মাঝে এ ধরনের কাজ করে। খুব ঠাণ্ডায় মাথার বিশেষ বিশেষ কিছু স্মৃতির দরজা বন্ধ করে দেয়। মস্তিষ্ক মনে করে এই কাজটি করা প্রয়োজন, দরজা বন্ধ না করলে মস্তিষ্কের ক্ষতি হবে। এমন কোনো পদ্ধতি কি আছে যাতে এই বন্ধ দরজা খোলা যায়?

কম্পিউটারের হার্ডডিস্কের কিছু কিছু ফাইল হঠাৎ হারিয়ে যেতে পারে। সেই সব ফাইল উদ্ধারের প্রক্রিয়া আছে। মানুষের মস্তিষ্ক তো অবিকল কম্পিউটারের মতোই। স্মৃতি তো কিছু না সাজিয়ে রাখা ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যাল! কাজেই যে পদ্ধতিতে কম্পিউটারের হারানো ফাইল খোঁজা হয়-সেই পদ্ধতিতেই বা তার কাছাকাছি পদ্ধতিতে হারানো স্মৃতি খোঁজার চেষ্টা কেন হচ্ছে না?

মিসির আলি হাত বাড়িয়ে টেবিলের উপর থেকে বই নিলেন। তিনি বুঝতে পারছেন তাঁর মন যে কোনো কারণেই হোক কিছুটা বিক্ষিপ্ত। মনকে শান্ত করতে না পারলে রাতে ভালো ঘুম হবে না। মন শান্ত করার একটি পদ্ধতিই মিসির আলি জানেন। বই পড়া। সেই বইও হালকা গল্প-উপন্যাস না, থ্রিলার না, জটিল কোনো বিষয় নিয়ে লেখা বই। তিনি যে বইটি হাতে নিলেন তার নাম-Dark days. অন্ধকার দিন। লেখক এই পৃথিবীর ভয়াবহ কয়েকজন অপরাধীর একজন, নাম-David Bertzowitz, তার লেখা আত্মজীবনী। তিনি লিখেছেন–

I have often noticed just how unobservant people are. It has been said that parents are the east to know. This may be true in my case, for wonder how I at the ages of nine, eleven, thirteen manged to do so many negative things and go unnoticed. It is puzzling indeed. And I think it is sad.

আমি প্রায়ই লক্ষ করেছি মানুষের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ভালো না। বলা হয়ে থাকেবাবা-মারা সবার শেষে জানতে পারেন। আমার জন্যে এটা সত্যি। আমি খুবই অবাক হই যখন ভাবি ন বছর, এগারো বছর এবং তেরো বছরে যেসব অন্ধকার কর্মকাণ্ড আমি করেছি তা কী করে কারোর চোখে পড়ল না। চোখে না পড়ার বিষয়টা রহস্যময় এবং অবশ্যই দুঃখের।

মিসির আলি লক্ষ করলেন তার মন শান্ত হয়েছে। মন নানান দিকে ডালপালা ছড়িয়ে দিয়েছিল। একসঙ্গে অনেকগুলি পথে হাটছিল–এখন একটি পথে হাঁটছে। বইটির বিষয়বস্তুতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। David Bertzowitz ঠিকই লিখেছে মানুষের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা নিম্নমানের। সে দেখেও দেখে না।

ফতের মামার কথাই ধরা যাক। ফতের মামা বদরুল সাহেব নিশ্চয়ই কখনো ফতেকে ভালোভাবে দেখেন নি। তিনি নিশ্চয়ই ফতের মানসিকতা, তার চিন্তাভাবনা কিছুই বলতে পারবেন না। ফজরের নামাজ শেষ করে ফতে মর্নিং ওয়াক করতে যায় এই তথ্য তিনি জানেন। কিন্তু কোথায় যায় তা কি জানেন? তিনি কি জানেন যে ফতের অনিদ্রা রোগ আছে, সে মাঝে মাঝে অনেক রাত পর্যন্ত ছাদে হাটে। এই কাজটা যখন করে সে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে; ফতের মামা কি জানেন যে ফতে বাজারের ভারী ব্যাগ নিয়ে যখন ঢোকে তখন ব্যাগটা থাকে তার বা হাতে। বী হাতি মানুষরা এই কাজ করে। ফতে বা হাতি না। তারপরেও ভারী কাজগুলি সে বাঁ হাতে করে; ডান হাত ব্যবহার করে না।

মিসির আলি চিন্তা বন্ধ করে হঠাৎ নিজের ওপর খানিকটা বিরক্তি বোধ করলেন। ছেলেমানুষ এই কাজটা তিনি কেন করছেন? কেন প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন যে তাঁর পৰ্যবেক্ষণ ক্ষমতা ভালো। এটা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। যার পড়াশোনার বিষয় মানুষের মন তাকে তো মানুষ পর্যবেক্ষণ করতেই হবে। মানুষের দিকে তাকিয়ে তুর আচার-আচরণ বিশ্লেষণ করে পৌঁছতে হবে মন নামক অথরা বস্তৃত। আচ্ছা মন কী?

মিসির আলি ভুরু কুঁচকালেন। উত্তরটা আঁর জানা নেই। গত পঁচিশ বছর এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়েছেন। উত্তর পান নি। এখন বয়স হয়ে গেছে। যে কোনো একদিন অদ্ভুত ট্রেনে উঠে পড়তে হবে। ট্রেনে উঠার আগে কি উত্তরটা জেনে যাওয়া যাবে না?

বাড়িওয়ালা বদরুল সাহেবের মেয়েটা কঁদছে। শিশুরা ব্যথা পেয়ে যখন কাঁদে তখন কান্নার আওয়াজ এক রকম, আবার যখন মনে কষ্ট পেয়ে কঁদে তখন অন্য রকম। লুনা মেয়েটার কান্না শুনে মনে হচ্ছে সে গভীর দুঃখে কাঁদছে।

মেয়েটা প্রায়ই এরকম কাঁদে। তখন কিছুতেই তার কান্না থামানো যায় না। বদরুল সাহেব কোলে নিয়ে হাঁটেন। তার স্ত্রী হাঁটেন। আদর করেন, ধমক দেন। কিছুতেই কিছু হয় না। একটা পৰ্যায়ে তারা মেয়েকে ফতের কাছে দিয়ে দেন। ফতে কিছুক্ষণের মধ্যেই শান্ত করে ফেলে।

অনেকক্ষণ ধরেই মেয়েটা কান্দছে; মিসির আলি বই বন্ধ করে বসে আছেন। বাচ্চা একটা মেয়ে গভীর দুঃখে কঁদিবে। আর তিনি তা অগ্রাহ্য করে স্বাভাবিকভাবে ঘুমাতে যাবেন-তা কীভাবে হয়?

তিনি বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় এস। দাঁড়ালেন। লুনাকে নিয়ে তার মা দোতলার বারান্দায় রেলিং ঘেঁষে হাঁটছেন। এত দূর থেকেও ভদ্রমহিলাকে ক্লান্ত এবং হতাশ মনে হচ্ছে।

মিসির আলি বারান্দা ছেড়ে ঘরে ঢুকলেন। লুনার কান্নাটা সহ্য করা যাচ্ছে না। তাঁর বিরক্তি লাগছে। কেন মেয়েটার বাবা-মা ফতেকে ডাকছেন না। ফতে নিমিষের মধ্যেই বাচ্চাটাকে ঘুম পাড়িয়ে দেবে।

বাচ্চা মেয়েটা কেঁদেই যাচ্ছে। কেঁদেই যাচ্ছে।

লুনাকে সামলে রাখার দায়িত্ব

লুনাকে সামলে রাখার দায়িত্ব পড়েছে ফতের ওপর।

প্রতি মাসে এক-দুদিন ফতেকে এই দায়িত্ব পালন করতে হয়। কারণ প্রতি মাসে এই এক-দুদিন তসলিমা খানম যাত্রাবাড়ীতে তার বোনকে দেখতে যান। বোনের ক্যানসার হয়েছে। বাঁচার কোনো আশা ডাক্তাররা দিচ্ছেন না, আবার দ্রুত মরে গিয়ে অন্যদের ঝামেলাও কমাচ্ছে না?

তসলিমার অনুপস্থিতিতে ফতে লুনার দিকে লক্ষ রাখে। তাকে বলা আছে একটা সেকেন্ডের জন্যেও যেন মেয়েকে চোখের আড়াল না করে। ফতে তা করে না। সে লুনার আশপাশেই থাকে। লুনা এমনই লক্ষ্মীমেয়ে যে কোনো কান্নাকাটি করে না। খাবার সময় হলে শান্ত হয়ে ভাত খায়। সে শুধু রাতে কাঁদে। মেয়েটির আঁধারভীতি আছে।

লুনা বারান্দায় বসে আপনমনে খেলছে। হাতের মুঠি বন্ধ করছে, খুলছে। খুব ক্লান্তিকর খেলা কিন্তু ফতের দেখতে ভালো লাগছে।

ফতে ডাকল, লুনা। এই লুনা। লুনা ফতের দিকে তাকিয়ে হাসল। আবার খেলা শুরু করল। ফতে বলল, লুনা কী করে?

লুনা তার হাতের মুঠি থেকে চোখ না তুলেই বলল, খেলি। এই খেলার নাম কী?

জানি না।

মা কোথায় গেছে। লুনা?

জানি না।

মা কোথায় গেছে আমি জানি। সে প্রতি মাসে দুই-তিন দিন কোথায় যায় সেটা আমি জানি। বোনকে দেখতে যাবার নাম করে যায়। বোনকে দেখতে ঠিকই যায়। বোনের কাছে দশ-পনেরো মিনিট, খুব বেশি হলে আধঘণ্টা থাকে। বাকি সময়টা কোথায় থাকে। আমি জানি।

লুনা ফতের দিকে তাকিয়ে আছে। সে মিষ্টি করে হাসল।

ফতে বলল, তোমার মা কোথায় যায় আমি জানি। কীভাবে জানি বলব?

লুনা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। ফতে হতাশ মুখে বলল, কীভাবে জানি বললে তুমি বুঝবে না। এই জন্যে বলব না। অবিশ্যি বুঝতে পারলেও বলতাম না।

ফতে লুনার মতো খেলা নিজেও খেলতে শুরু করল। লুনা তাতে খুব মজা পাচ্ছে! খিলখিল করে হাসছে।

আইসক্রিম খাবে?

লুনা খুশি হয়ে মাথা নাড়ল।

ফতে বলল, চল আইসক্রিম খেয়ে আসি।

লুনা সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। তার চোখ চকচক করছে। এর আগেও সে ফতের সঙ্গেই কয়েকবার চিড়িয়াখানায় গিয়েছে। লুনাকে নিয়ে বাড়ির বাইরে এক পাও যাবার অনুমতি নেই। তারপরেও ফতে লুনাকে নিয়ে পঁচি থেকে ছবার চিড়িয়াখানায় গিয়েছে। কেউ কিছু ধরতে পার নি। কাজের মেয়েটা কিছু বলে দেয় নি, আবার দারোয়ানও নালিশ করে নি। ফতে নিশ্চিত আজো কেউ কিছু ধরতে পারবে না। চিড়িয়াখানা যাওয়া, চিড়িয়াখানা থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা সব মিলিয়ে তিন ঘণ্টার মামলা।

ফতে লুনাকে শুধু যে চিড়িয়াখানা দেখাল তা-না-এয়ারপোর্ট নিয়ে গিয়ে প্লেন ওঠানামা দেখাল। এটা ফতের নিজের খুব পছন্দ। বিরাট একটা জিনিস কেমন করে শা করে আকাশে উড়ে যাচ্ছে।

লুনা কেমন লাগল?

লুনা হাসল, কিছু বলল না।

শুধু হাসলে হবে না, মুখে বল ভালো। বল, ভালো।

ভালো।

এখন বল আমি লোকটা কেমন?

লুনা আবার হাসল।

আরেকটা আইসক্রিম খাবে?

হুঁ।

ফতে দুটা আইসক্রিম কিনল। একটা তার জন্যে একটা লুনার জন্যে। লুনা নিজে আইসক্রিম খেলে যত খুশি হয় বড় কাউকে আইসক্রিম খেতে দেখলে তার চেয়েও বেশি খুশি হয়। লুনাকে খুশি রাখা ফতের প্রয়োজন। খুশি রাখা না পোষ মানিয়ে ফেলা। এই কাজটা মনে হয় খুব সহজ-আসলে খুব কঠিন। বড়দের পোষ মানানো সহজ, শিশুদের পোষ মানানো কঠিন! ভয়ঙ্কর কঠিন। কারণ শিশুরা অনেক কিছু বুঝতে পারে-বড়রা পারে না।

লুনার ব্যাপারটা ভিন্ন। সে শিশু হলেও জড়বুদ্ধির কারণে অনেকটাই পশুর মতো। খাবার দিয়ে, মিথ্যা মমতা দিয়ে পশুদের পোষ মানানো যায়। যে কসাই গরু জবেহা করবে সে যদি গরুটার গায়ে হাত বুলিয়ে দেয় গরু তাতে আনন্দ পায়। চোখ বন্ধ করে লেজ নেড়ে আদর নেয়। আদরের সত্যি মিথ্যা ধরতে পারে না।

লুনা আরেকটা আইসক্রিম খাবে?

লুনা আবারো ইঠা সূচক মাথা নাড়ল। আবার তার চোখ চকচক করে উঠল।

ফতে আকারো আইসক্রিম কিনল। এই মেয়েটা পোষ মেনেই আছে। পোষ মানানোটা আরো বাড়াতে হবে। মেয়েটাকে নিয়ে তার কিছু পরিকল্পনা আছে।

লুনা বাসায় যাবে?

না।

চল আজ বাসায় চলে যাই। খুব তাড়াতাড়ি আবার বেড়াতে আসব। তখন আর বাসায় ফিরব না। আচ্ছা?

লুনা মনের আনন্দে ঘাড় কাত করল।

ফতে যে তিন ঘণ্টা লুনাকে নিয়ে ঘুরে এসেছে ব্যাপারটা প্রকাশিত হল না। তসলিমা বেগমের হাতে মেয়েকে তুলে দিয়ে ফতে নিজের কাজে বের হল। দোকানটা ঠিক করতে হবে। সাইনবোর্ড বানাতে হবে। হঠাৎ হঠাৎ দোকানে থাকতে হতে পারে। তার জন্যে বিছানা-বালিশ লাগবে। মশারি লাগবে। তার নিজের জন্যেও বাসা ভাড়া করা দরকারী।

বুড়িগঙ্গায় বাড়ি ভাড়ার মতো নৌকা ভাড়া পাওয়া যায়। নৌকার ভেতর ঘুমানোর ব্যবস্থা। নৌকার ভেতরই রান্নাঘর, বাথরুম। দুমাস, তিন মাসের জন্যে একটা নৌকা ভাড়া করে ফেলা যায়। স্থায়ী বাড়ির চেয়ে লীকা বাড়ি অনেক ভালো। যেখানে সেখানে নৌক নিয়ে যাওয়া যায়। কয়েকটা নৌকাওয়ালার সঙ্গে ফতের আলাপ হয়েছে। পছন্দসই নৌকা পাচ্ছে না। তাড়াহুড়া করে একটা নৌকা নিয়ে নিলেই হবে না। কোনো কিছু নিয়েই তাড়াহুড়া করা ঠিক না। আল্লাহপাক কোরান শরিফেও বলেছেন–হে মানব সস্তান, তোমাদের বড়ই তাড়াহুড়া। ফতে তাড়াহুড়ায় বিশ্বাস করে না।

 

রাত এগারোটা বাজে। ফতে বসে আছে তাদের বাসার পেছনে মিউনিসিপ্যালিটির ফ্ৰকা জায়গাটিার ভেতরে কংক্রিটের এক চেয়ারে। জায়গাটিার নাম–শিশু বিনোদন পার্ক। এই নামে ক্ৰীড়া প্রতিমন্ত্রী জায়গার উদ্বোধন করেছেন। শ্বেতপাথরের একটি ফলকে এই বিশেষ ঘটনাটি বর্ণনা করা হয়েছে। উদ্বোধনের দুদিন আগে তড়িঘড়ি করে কয়েকটা লম্বা চেয়ার বসানো হয়েছে। একটা স্নাইড এবং দুটা সি-সো। একটা দোলনা আনা হয়েছে, বসানো হয় নি। যেহেতু উদ্বোধন হয়ে গেছে এখন আর বসানোর তাড়া নেই। জিনিসগুলি রোদে পুড়ছে, বৃষ্টিতে ভিজছে। দোলনাটা অবিশ্যি কিছু কাজে লাগছে। দোলনার খুঁটিতে দড়ি লাগিয়ে পলিথিন ঝুলিয়ে গ্রাম থেকে আসা একটা পরিবার সুন্দর সংসার পেতে ফেলেছে।

ফতে এই পরিবারটিকে শুরু থেকেই লক্ষ করছে। বাবা-মা, তেরো-চৌদ্দ বছরের একটা বড় বড় চোখের রোগা মেয়ে। এরা দিশাহারা ভঙ্গিতে একদিন পার্কে ঢুকল, ফতে তখন বেঞ্চিতে বসে বাদাম খাচ্ছে। লক্ষ্য রাখছে পরিবারটি কী করে। স্বামী-স্ত্রী নিচুগলায় কিছুক্ষণ কথা বলল। লোকটি এগিয়ে এল ফতের দিকে। ভিক্ষা চাইতে আসছে না এটা বোঝা যাচ্ছে। গ্রাম থেকে যারা আসে তারা এসেই ভিক্ষা করা শুরু করতে পারে না। সময় লাগে।

ভাইসাব এইটা কি সরকারি জায়গা?

লোকটা খুবই বিনীত ভঙ্গিতে প্রশ্ন করছে। তার স্ত্রী ও কন্যা আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। ফতে বলল, হ্যাঁ, এটা মিউনিসিপালটির জায়গা।

সরকারি জাগোত আমরা যদি থাকি কোনো অসুবিধা আছে?

কোনো অসুবিধা নাই–থাকেন।

আমরা এই পরথম ঢাকা শহরে আসছি। কাজের ধান্দায় আসছি।

ভালো করেছেন।

এই জায়গাটা কি নিরাপদ?

আপনার এবং আপনার স্ত্রীর জন্যে নিরাপদ। আপনাদের মেয়ের জন্যে নিরাপদ না। একদিন দেখবেন মেয়ে নাই।

লোকটা ভীত মুখে তাকিয়ে রইল। ফতে বলল, মেয়ের নাম কী?

মেয়ের নাম দিলজান।

দিলজানকে বাকির খাতায় ধরে সংসার পাতেন কোনো সমস্যা নাই। আপনার দেখাদেখি আরো অনেকে উঠে আসবে। সুন্দর একটা বস্তি তৈরি হয়ে যাবে। আপনাদের সাহায্যের জন্যে এনজিওরা আসবে। সুন্দর সুন্দর স্মার্ট মেয়েরা ভিটামিন এ ট্যাবলেট দিয়ে যাবে। বয়স্করা স্কুলে ভর্তি হবে। নানান রকম পরীক্ষা হবে।

কী বলতেছেন কিছু বুঝতেছি না জনাব।

বোঝবার কিছু নাই। সংসার পাততে চান-পাতেন। নেন সিগারেট নেন।

লোকটা একবার সিগারেটের দিকে তাকাচ্ছে একবার তার কন্যার দিকে তাকাচ্ছে। অপরিচিত মানুষের থেকে সিগারেট নেওয়া ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছে না। আবার আস্ত সিগারেটের লোভও ছাড়তে পারছে না। শেষ পর্যন্ত লোভ জয়ী হল-সে সিগারেট নিয়ে চলে গেল।

ফতে ফজলু মিয়ার পরিবারের পরবর্তী কর্মকাণ্ডে প্রায় মুগ্ধ হয়ে গেল। তারা অতিদ্রুত সংসার সাজিয়ে ফেলল। প্রথম দিনেই লোকটির স্ত্রী চুলা বানিয়ে ফেলল-চুলার আশপাশের কিছু অংশ লেপে ফেলল। সেখানে একটা মোড়া এবং কাঠের খুঁড়ি চলে এল। এক রাতে দেখা গেল চুলার উপরে কাপড় শুকানোর মতো করে লম্বা করে তার টানানো হয়েছে। সেই তারে মাছ শুকানো হচ্ছে। লোকটিও চালাক-ঠেলা চালানোর কাজ যোগাড় করে ফেলল। দিনের বেলা ঠেলা চালায়, রাতে এক চায়ের দোকানের এসিসটেন্ট। মেয়েটিকে নিয়ে এখনো তাদের কোনো সমস্যা হয় নি। তবে তারা এখন এক না, আরো চার-পাঁচটি পরিবার চলে এসেছে। এখন নিশ্চয়ই তাদের খানিকটা জোর হয়েছে।

ফজলু রান্না চড়িয়েছে। তার কাছেই দিলাজান। বাবার সঙ্গে নিচুগলায় গল্প করছে, মাঝে মাঝে চুলার খড়ি নেড়েচেড়ে দিচ্ছে। রান্না আজ অনেক দেরিতে শুরু হয়েছে। মনে হচ্ছে ফজলুর স্ত্রী অসুস্থ। ফতে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফজলুর দিকে এগিয়ে গেল, আগুনের পাশে বসে সিগারেটটা শেষ করলে ভালো লাগবে।

ফজলু কেমন আছ?

ফতে নিঃশব্দে এসে পেছনে দাঁড়িয়েছে। ফজলু বুঝতে পারে নি বলে ভয়ঙ্কর চমকে গেল। ফতেকে দেখে সে নিশ্চিন্ত হতে পারুল না। চোখে-মুখে ভয়ের ভাবটা থেকে গেল। শুকনো গলায় বলল,  জে ভালো আছি। আপনের সাইল ভালো। এই বলেই সে ফতে যাতে দেখতে না পায় এমন ভঙ্গিতে মেয়েকে চােখের ইশারা করল—যার অর্থ তুই এখানে থাকিস না। ঘরে ঢুকে যা। মেয়ে বাবার আদেশ পালন করল। ফতে পুরো প্রক্রিয়াটি দেখল। তার চেহারায় কোনো ভাবান্তর হল না। দিলজান যে মোড়ায় বসে ছিল ফতে সেই মোড়াতে বসতে বসতে বলল-কী রান্না হচ্ছে?

ফজলু বিনীত গলায় বলল, গরিবের খাওয়া খাদ্য।

গরিবের খাওয়া খাদ্যটা কী? আমার তো মনে হচ্ছে মাংস রান্না হচ্ছে। ভালো ঘ্রাণ বের হচ্ছে!

দিলজান মাংস খাইতে চায়। কয়েক দিন ধইরা বলতেছে। দুই দিন পরে বিবাহ কইরা শ্বশুরবাড়িতে যাইব। আমার কাছে যে কয়দিন আছে। শখ মিটিয়ে দেই।

বিয়ে ঠিক হয়েছে নাকি?

জে না, তবে এইটা নিয়া চিন্তা করি না। জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ আল্লাপাকের ঠিক করা। উনি যেখানে ঠিক করেছেন সেইখানেই হবে।

খারাপ না। আল্লা মেহেরবান-রোজই কাজ পাই। গতির খাটনি কাম–তয় গাছপালার কাম পাইলে ভালো হইত।

গাছপালার কামটা কী?

ফজলু উৎসাহ নিয়ে ঘুরে বসল। আগ্রহের সঙ্গে বলল–ঢাকা শহরে দেখছি রাস্তায় রাস্তায় গাছপালা বেচে। ফুলের গাছ, ফলের গাছ। গাছ বেচতে পারলে ভালো হইত। গাছপালা আমার হাতে খুব হয়।

ফতের সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। সে সিগারেটের টুকরাটা দূরে ফেলে আরেকটা ধরাতে ধরাতে বলল-নার্সারির কাজ খারাপ না, কোনো ফুটপাত দখল করে বসে পড়লেই হয়। তবে ব্যবসাটা কীভাবে হয় জানতে হবে। গাছপালা যোগাড় করতে হবে। আমি এক নার্সারির মালিককে চিনি তার সাথে আলাপ করে দেখতে পারি।

ফজলুর চোখ চকচক করছে। মনে হচ্ছে সে চোখের সামনে দেখছে অসংখ্য গাছপালা সাজিয়ে সে বসে আছে। শহরের লোকজন বড় বড় গাড়ি নিয়ে আসছে। চকচকে নোট বের করে গাছ নিয়ে চলে যাচ্ছে। ফতে বলল-সিগারেট খাবে? ফজলু আনন্দের সঙ্গে বলল, দেন একটা টান দেই।

ফতে সিগারেট দিল। ফজলু চুলা থেকে জ্বলন্ত লাকড়ি বের করে সেই আগুনে সিগারেট ধরিয়ে তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলে বলল—গাছের ব্যবসার খোঁজখবর নিয়েন। আমি কলমের কামও খুব ভালো জানি।

তাই নাকি?

জি। আমরার গেরামের যত তিতকুট বরই গাছ আছে-কলম দিয়া সব বরই মিষ্টি বানায়ে দিছি। আমরার গোরামে আমারে কী ডাকত জানেন ভাইজোন? আমারে ডাকত গাছ ডাকাতর।

তোমার গ্রামের নাম কী?

শুভপুর। বড়ই সৌন্দর্য জায়গা। কপালে নাই বইল্যা থাকতে পারলাম না।

ফতে উঠে পড়ল। রাত বারোটার আগে তাকে বাড়িতে পৌঁছতে হবে। রাত বারোটার সময় মূল গেট বন্ধ হয়ে যায়। দারোয়ান গেটে তালা লাগিয়ে গেটের পাশে বেঞ্চিতে বসে ঘুমাবার আয়োজন করে। তার ওপর নির্দেশ আছে বারোটার সময় গেট বন্ধ হয়ে যাবে। তখন গেট খুলতে হলে মালিকের অনুমতি লাগবে। গেট খোলার সময় তিনি উপস্থিত থাকবেন।

ফতের বেলায় হয়তো এটা হবে না। দারোয়ানের সঙ্গে ভালোই খাতির আছে, তারপরেও বিস্ক নেবার দরকার কী? মামা যদি জেগে থাকে গেট খোলার শব্দে অবশ্যই বারান্দায় এসে দাঁড়াবে। চিলের মতো গলায় বলবে-কে আসল? ও আচ্ছা, বাংলার ছোট লাট সাহেব।

ফতে থাকে তার মামার বাড়ির গ্যারেজে।

মামা গাড়ি কেনেন নি বলে তার গ্যারেজ খালি। তিনি কখনো গাড়ি কিনবেন। এরকম মনে হয় না। দরিদ্র লোকজন যখন টাকা পয়সা করে তখন জমি কেনে, বাড়ি বানায়। কেউ কেউ এক পর্যায়ে গাড়ি কেনার মতো সাহস সঞ্চয় করে ফেলে। আর কেউ কোনোদিনই তা পারে না। বদরুল সাহেব দ্বিতীয় দলের। গাড়ি না। কিনলেও তিনি একটা বেবিট্যাক্সি কিনেছেন। প্রাইভেট সাইনবোর্ড লাগানো বেবিট্যাক্সিতে করে তিনি ঘুরে বেড়ান, তার ব্যবসা-বাণিজ্য দেখেন।

গ্যারেজে দুটো চৌকি আছে। একটায় ফতে ঘুমায় পাশেরটায় বেবিট্যাক্সির ড্রাইভার বাদল। তবে বেশিরভাগ সময় বাদল তার বাড়িতে চলে যায়। হঠাৎ হঠাৎ বেবিট্যাক্সি চালানোর প্রয়োজন পড়লে ফতে চালায়। তার লাইসেন্স নেই। কিন্তু বেবিট্যাক্সি সে ভালোই চালাতে পারে। যদিও বদরুল সাহেব তার ভাগ্লের বেবিট্যাক্সি চালানোর কোনো ভরসা পান না। সারাক্ষিণ টেনশনে থাকেন। সারাক্ষণ উপদেশ দিতে থাকেন–এই গাধা আস্তে চালা। এই গাধা তোর ওভারটেক করার দরকার কী? তোর কি হাগা ধরেছে? হর্ন দেস না কেন? হর্ন না দিলে রিকশাওয়ালা বুঝবে কী করে তার পিছনে বেবিট্যাক্সি? রিকশাওয়ালার মাথার পিছনে কি চক্ষু আছে?

 

বাসায় পৌঁছেই ফতে দেখে উঠানে জটিল। তার মামা ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাঁটাহাঁটি করছেন। ফতেকে দেখেই তিনি ধমক দিয়ে উঠলেন-রাত বারোটা বাজে তুই ছিলি কোথায়? মদ ধরেছিস নাকি? মদের আখড়ায় ছিলি? গা দিয়ে তো মদের গন্ধ বের হচ্ছে। মাল টেনে এসেছিস?

ফতে জবাব দিল না। উত্তপ্ত মুহূর্তে যাবতীয় প্রশ্নের উত্তরে নীরব থাকতে হয়। মামা অতি উত্তপ্ত।

বেবিট্যাক্সি বের করা। তোর মামিকে হাসপাতালে নিতে হবে। হঠাৎ তার পেটে ব্যথা শুরু হয়েছে। ব্যথায় হাত-পা নীল হয়ে যাচ্ছে! বুঝলাম না। কী ব্যাপার।

ফতে বলল, কোন হাসপাতালে যাবেন মামা?

আরো গাধা গাড়ি বের কর আগে। বেহুদা কথা বলে সময় নষ্ট।

ফতে বলল, ব্যথা থাকবে না মামা। কমে যাবে।

বদরুল ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, তুই কি গণক এসেছিস? গান গুনে বলে দিলি ব্যথা কমে যাবে। কথা বলে সময় নষ্ট। গাড়ি স্টার্ট দে।

ফতে গাড়ি স্টার্ট দিল। বদরুল তার স্ত্রীকে হাত ধরে নিচে নিয়ে এলেন। তারা গাড়িতে ওঠার পরপরই ফতের মামি বলল, ব্যথা কমে গেছে।

বদরুল বললেন-কতটুকু কমেছে?

অনেক কম। বলতে গেলে ব্যথা নাই।

একটু আগে কাটা মুরগির মতো ছটফট করছিলে এখন বলছ ব্যথা নাই।

হাসপাতালে যাব না।

আবার যদি শুরু হয়?

শুরু হলে তখন যাব।

বদরুল স্ত্রীকে হাত ধরে নামালেন। ফতের দিকে তাকিয়ে বললেন-তুই ঘুমাবি না। তোর মরণ ঘুম। একবার ঘুমালে কার সাধ্য তোকে ডেকে তোলে। তুই জেগে বসে থাকিবি। তোর মামির ব্যথা আবার উঠবে বলে আমার ধারণা।

ফতে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ুল। এবং ফজরের আজান না পড়া পর্যন্ত জেগে বসে রইল। অনেকের রাত জগতে কষ্ট হয়। ফতের কখনো হয় না। বরং রাত জাগতে তার ভালো লাগে। রাতে নানান চিন্তা করতে তার ভালো লাগে। এই চিন্তা দিনে কখনো করতে ভালো লাগে না। দিনে অবিশ্যি চিন্তাগুলি মাথায় আসেও না। চিন্তাগুলি রাতের। রাত যত গভীর হয় চিন্তাগুলিও গভীর হয়।

ফতের আশপাশের সব মানুষকে শাস্তি দিতে ইচ্ছা করে। কাকে কীভাবে শাস্তি দেওয়া যায়-এই চিন্তা। যেমন মামা বদরুল আলম। তাকে নানানভাবে শাস্তি দেওয়া যায়-নরম শাস্তি, নরমের চেয়ে একটু বেশি-কঠিন শাস্তি। তবে মামার মানসিক অবস্থা এইরকম যে-যে কোনো শাস্তিই তার জন্যে কঠিন শাস্তি। ফতে একেক সময় একেক ধরনের শাস্তির কথা ভাবে। গতরাতে ভেবেছে সে তার মামিকে নিয়ে কিছু আজেবাজে কথা লিখে বেনামে মামার কাছে একটা চিঠি লিখবে। এই শাস্তিটা হবে খুবই কঠিন। কারণ তার মামার অসংখ্য দোষ থাকলেও তিনি তাঁর স্ত্রীকে পাগলের মতো ভালবাসেন। ভালবাসেন বলেই সন্দেহের চোখে দেখেন। স্ত্রীকে একা কোথাও যেতে দেবেন না। সব সময় নিজে সঙ্গে যাবেন। তার স্ত্রীকে কেউ টেলিফেন করলে তিনি তৎক্ষণাৎ একতলায় চলে যাকেন। অতি সাবধানে একতলার টেলিফোন রিসিভার কানে নিয়ে শুনবেন কে টেলিফোন করেছে। একতলাক্স টেলিফোন এবং দোতলার টেলিফোন প্যারালাল কানেকশন আছে। তার স্ত্রীর নামে যেসব চিঠি আসে তার প্রত্যেকটা তিনি আগে পড়ে তারপর স্ত্রীর হাতে দেন। এই যখন অবস্থা তখন যদি তার কাছে একটা চিঠি আসে যার বিষয়বস্তু ভয়াবহ তখন কী হবে? চিঠিটা এরকম হতে পারে–

জনাব বদরুল আলম সাহেব, সালাম, পর সমাচার, জ্যোমি আপনাকে কিছু গোপন বিষয় জানাইবার জন্য এই পুত্ৰ লিখিতেছি। বিষয়টি অত্যধিক গোপন বুলিয়া আমি আমার নিজের পরিচয়ও গোপন রাখলাম। এই ক্ৰটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখিবুল-ইহাই আমার কামনা। যাহা হউক এখন মূল বিষয়ে আসি–আপনার স্ত্রী তসলিমা খানম বিষয়ে কিছু কথা। তসলিমা খানম যখন বিদ্যাসুন্দরী স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাষ্ট্রে তখন জনৈক তরুণের সঙ্গে তাহার অতীব ঘনিষ্ঠত হয়। য়ে ঘনিষ্ঠতার কথা ভাষায় বর্ণনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নহে। উক্ত তরুণ দুষ্ট প্ৰকৃতির ছিল, সে তসলিমা খানমের সহিত তাহার ঘনিষ্ঠতার কিছু ছবি গোপনে তাহার আরেক দুষ্ট বন্ধুর সহায়তায় তোলে। ছবির সর্বমোট সংখ্যা একুশ। এই একুশটি ছবির মধ্যে পাঁচটি ছবি এতই কুরুটিপূর্ণ যে, যে কোনো মানুষ শিহরিত হইবে। জনাব আপনাকে উত্তেজিত এবং ছবির কারণে ভীত হইতে নিষেধ করিতেছে। কারণ আমি সমুদয় ছবির নেগেটিভসহ সঞ্চগ্ৰহ কারয়া নষ্ট কবিয়া দিয়াছি। কাজেই উক্ত ছবি দেখাইয়া কেহই অৰ্থ সংগ্রহের জন্যে আপনাকে চাপ দিতে পারিবে না। আপনাকে এই তথ্য জানাইয়া রাখিলাম। এখন কেহ যদি ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে ছবির কথা বলিয়া আপনার নিকট হইতে অর্থ গ্ৰহণের চেষ্টা করে আপনি ইহাকে মোটেই আমল দিবেন না।

হয়তো আপনার মনে প্রশ্ন জাগিতেছে আমি এই কাজটি কেন করলাম? আমি কাজটি করলাম। কারণ আমার কাছে মনে হইয়াছে ইহা একটি সৎকর্ম। ইহকালে আমি সৎকর্মের কোনো প্রতিদান আশা করি না। কিন্তু পর্যুকালে আমি এই সৎকর্মের প্রতিদান অবশ্যই পাইব।

এখন জনাব আপনার নিকট আমার একটি আবদার—আমি আপনার মঙ্গলের জন্যে একটি কঠিন কর্ম কবিয়ছি। আমি আশা করি তাহার প্রতিদানে আপনি আমার একটি আবদার রক্ষা করিবেন। আবদারটি হইল—এই বিষয়ে আপনি আপনার স্ত্রীর সঙ্গে কোনো আলোচনা করিবেন না। উঠতি বয়সে তিনি একটি ভুল করিয়াছিলেন-সেই ভুল ক্ষমা করবেন। আল্লাহপাক ক্ষমা পছন্দ করেন।
আরজ ইতি
আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী জনৈক মাদান।

এই এক চিঠিতেই চৌদ্দটা বেজে যাবার কথা। শাস্তির শুরু। তারপর আস্তে আস্তে শাস্তির ডোজ বাড়াতে হবে।

ফতে ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল। মিথ্যা চিঠি মানুষ বিশ্বাস করে না। মিথ্যা কখনো টেকে না। খুব বেশি হলে সাত দিন। মিথ্যার আয়ু অল্প। শাস্তি দিতে হলে সত্যি দিয়ে শাস্তি দিতে হবে। সেই ধরনের সত্য কিছু বিষয় ফতে জানে। অন্যভাবে জানে! এমনভাবে জানে যার সম্পর্কে ধারণা করা মানুষের জন্যে কঠিন। বেশ কঠিন। ফতে ক্ষমতাধর মানুষ। তার ক্ষমতা অন্য রকম ক্ষমতা।

ফতে সিগারেট ধরাল। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠাণ্ডাও বাড়ছে। গলা থেকে মাফলার খুলে সে কান ঢাকল। মিসির আলি সাহেবের ঘরে বাতি জুলছে। বুড়ো এখনো জেগে গুন্টুর গুটুর করে বই পড়ছে। একটা মানুষ দিনরাত বই পড়ে কীভাবে কে জানে? এত জ্ঞান নিয়ে কী হবে? মৃত্যুর পর সব জ্ঞান নিয়ে কবরে যেতে হবে। যে মাথায় গিজগিজ করত। জ্ঞান সেই মাথার মগজ পিঁপড়া খেয়ে ফেলবে। শরীরে ধরবে পোকা। ফতে সব মানুষকে চট করে বুঝে ফেলে এই মানুষটাকে এখনো বোঝা যাচ্ছে না। কখনো মনে হয় মানুষটা বোকা। শুধু বোকা না-বোকাদের উজির-নাজির। আবার কখনো মনে হয় লোকটী মহাচালাক। সে আসলে চালাকদের উজির-নাজির। তার কাজের একটা ছেলে আছে তার সাথে যেভাবে কথা বলে মনে হয় নিজের ছেলের সঙ্গে কথা বলে। একদিন সে বাড়িতে উঁকি দিয়ে দেখেছে দুজন পাশাপাশি বসে ভাত খাচ্ছে। আরেক দিনের কথা ফতের স্পষ্ট মনে আছে। সে গিয়েছে বাড়ি ভাড়া আনতে। মিসির আলি সাহেব তখন নিজেই চা বানাচ্ছিলেন। ফতেকে বলল, চা খাবে? ফতে বলল, না। এখন কাজের ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ইয়াসিন চা খাবি? ইয়াসিন গাড়ীর গলায় বলল, হা। চিনি বেশি দিয়েন। ফতে অবাক হয়ে দেখল মিসির আলি কাজের ছেলের জন্যে চা বানিয়ে আনছেন।

লোকটা নাকি অনেক জটিল বিষয় জানে। কী জানে কতটুকু জানে তা ফতের দেখার ইচ্ছা। জটিল বিষয় ফতে নিজেও জানে। তাকে কেউ চিনে না। কারণ সে বলতে গেলে–এক বাড়ির কাজের লোক, বেবিট্যাক্সির ড্রাইভার। তার কথা কে বিশ্বাস করবে? সে যদি বলে এই দুনিয়ার জটিল বিষয় আমি যত জানি আর কেউ এত জানে না। তা হলে কেউ কি তা বিশ্বাস করবে? কেউ বিশ্বাস করবে না। কারণ সে মিসির আলির মতো জ্ঞানী না। সে ইউনিভার্সিটিতে পড়ানো দূরে থাকুক-নিজে ইউনিভার্সিটির ধারেকাছে কোনোদিন যায় নাই। যাওয়ার ইচ্ছাও নাই। সে যা শিখেছে নিজে নিজে শিখেছে। সবার ওস্তাদ থাকে তার কোনো ওস্তাদ নেই।

ফতের ইচ্ছা করে মিসির আলিকেও শাস্তি দিতে। জ্ঞানী লোকের জন্য জ্ঞানী শাস্তি। মনে কষ্ট দেওয়া শান্তি। এই লোকটা কিসে কষ্ট পাবে তা আগে বের করতে হবে। মানুষ হল মাছধরা জালের মতো। মাছধরা জালে দুই একটা সুতা ছেড়া থাকে। মানুষের জালেও সেরকম ছেড়া সুতা আছে। সুতার ছেড়া জায়গাটা হল তার দুর্বল জায়গা। আক্রমণ করতে হয় দুর্বল জায়গায়। ফতের ধারণা মিসির আলির দুর্বল জায়গা তার জ্ঞান। ধাক্কাটা দিতে হবে জ্ঞানে। প্রমাণ করে দিতে হবে এত আগ্রহ করে যে জ্ঞান অর্জন করা হচ্ছে সেই জ্ঞান ভুল। কাজটা কঠিন, তবে খুব কঠিন না।

ফজলু মিয়াকেও শাস্তি দিতে হবে। আজ সে চোখের ইশারায় তার মেয়েকে সরে যেতে বলল। যেন ফতে কোনো দুষ্ট লোক! দুষ্ট লোকের হাত থেকে মেয়েকে রক্ষা করার চেষ্টা। ফজলু ঠিকই ভেবেছে ফতে মিয়া দুষ্ট লোক। কিন্তু কী রকম দুষ্ট লোক তা সে জানে না। জানার কথাও না। ফতে নিজেই জানে না, সে কীভাবে জানবে? ফজলু ভেবেছে ফিতে তার চোখের ইশারা দেখতে পায় নি। ফতে ঠিকই দেখেছে। কাজেই ফজলু মিয়াও শাস্তি পাবে। তার শাস্তি আবার হবে অন্য রকম। শাস্তি হল জামার মতো। সাইজ হিসাবে জামা বানাতে হয়। কাঁধের পুট ঠিক থাকতে হয়, হাতার মুহুরি ঠিক থাকতে হয়, কলার ঠিক থাকতে হয়। যে কোনো শাস্তিই হতে হয় মাপমতো।

ফতে সিগারেট ধরাল। শীত আরো বেড়েছে। কুয়াশা বাড়ছে। কুয়াশায় মাথার মাফলার ভিজে যাচ্ছে। তার জেগে বসে থাকার কথা-সে নিজের ঘরে জেগে বসে। থাকতে পারে। তা না করে সে আগের জায়গাতেই বসে রইল। সে হালকাতাবে শিন্স দিচ্ছে এবং পা নাচাচ্ছে। তাকে আনন্দিত মনে হচ্ছে।

লুনা কাঁদতে শুরু করেছে। কেঁদেই যাচ্ছে। কেঁদেই যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফতের ডাক পড়বে। ফতে অপেক্ষা করতে লাগল। এখনো ডাক আসছে না। মেয়ের মা মেয়েকে শান্ত করার চেষ্টা করছে! লাভ হচ্ছে না। আচ্ছা এমন কি হবে যে বিরক্ত হয়ে লুনাকে কোলে নিয়ে তার মা বারান্দায় এল তারপর বিরক্ত হয়ে দোতলা থেকে মেয়েকে ফেলে দিল?

হওয়া বিচিত্র কিছু না। এই দুনিয়ায় অনেক বিচিত্র ব্যাপার ঘটে।

দাওয়াতের কার্ড

বদরুল সাহেবের হাতে দাওয়াতের একটা কার্ড। দাওয়াতের কার্ডটা মিসির আলির। বদরুল সাহেবের ঠিকানায় এসেছে, তিনি নিজেই কার্ড দিতে এসেছেন। বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র। মিসির আলি বললেন, আপনার আসার প্রয়োজন ছিল না। কার্ডটা কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেই হত।

বদরুল সাহেব বললেন, আপনার সঙ্গে তো কথা হয় না, ভাবলাম এই সুযোগে দুটা কথা বলে আসি। ঢাকা শহরে ভাড়াটে আর বাড়িওয়ালার মধ্যে সুসম্পর্ক হয় না। আমি চাই সুসম্পর্ক।

মিসির আলি বললেন, আপনি বসুন।

বদরুল সাহেব বললেন, বসব না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কথা বলে চলে যাব। নানান ব্যস্ততায় থাকি। বসে গল্পগুজব করার মতো সময় কোথায়? আমার বাড়িতে আপনার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?

জি না।

অসুবিধা হলে সরাসরি আমাকে বলবেন। আগে ফতেকে বললেই হত। এখন আবার ফতে দোকান দিয়েছে। আলাদা বাসা নিবে।

আমার কোনো সমস্যা হলে আমি আপনাকেই বলব।

আপনার কাজের ছেলেটাকে এক কাপ চা দিতে বলুন। চা খেয়েই যাই। নিজের বাড়ির চায়ের চেয়ে অন্যের বাড়ির চা খেতে সব সময়ই ভালো লাগে।

মিসির আলি খানিকটা শঙ্কিত বোধ করলেন। খুব যারা কাজের মানুষ তারা মাঝে মাঝে গা এলিয়ে দেয়। এই ভদ্রলোক মনে হচ্ছে গা এলিয়ে দিতেই এসেছেন। মিসির আলির হাতে কোনো কাজকর্ম নেই–তারপরেও আজ তিনি সামান্য ব্যস্ত। ঢাকা মেডিকেল এসোসিয়েশনের একটা সেমিনারে যাবেন বলে ঠিক করেছেন। সবকিছু থেকে তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন। এই কাজটা ঠিক হচ্ছে না।

বদরুল সাহেব চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, আপনি কী করেন এটাই এখনো জানলাম না। আপনি করেন কী?

মিসির আলি বললেন, কিছু করি না।

রিটায়ারও করি নি। মাস্টারি করতাম। চাকরি চলে গিয়েছিল।

বলেন কি আপনার চলে কীভাবে?

কয়েকটা বই লিখেছিলাম–সেখান থেকে রয়েলটি পাই। এতে কষ্টটষ্ট করে চলে যায়।

বই বিক্রি বন্ধ হয়ে পেলে কী করবেন?

তখন খুব সমস্যার পড়ব।

ফতের কাছে শুনলাম, বিয়েও করেন নি।

ঠিকই শুনেছেন। এতে একদিক দিয়ে সুবিধা হয়েছে–টাকা পয়সার সাপ্লাই বন্ধ হয়ে গেলে রাস্তায় নেমে পড়ব। একা মানুষের জন্যে বিরাট শহরে বাসস্থান ছাড়া বাস করা তেমন কঠিন না।

বদরুল সাহেব বিস্মিত গলায় বললেন, রাতে ঘুমাবেন কোথায়? বাথরুম করবেন কোথায়?

মিসির আলি হাসিমুখে বললেন, একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

বদরুল সাহেব উঠে দাঁড়ালেন, ইতস্তত করে বললেন—বাড়ি ছাড়ার আগে আমাকে এক মাসের নোটিশ দিতে হবে।

মিসির আলি বললেন, নোটিশ অবশ্যই দেব। আপনি চা না খেয়ে উঠে যাচ্ছেন।

চা খাব না।

মিসির আলির মনে হল এই ভদ্রলোক তার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি এখন মিসির আলিকে ভাড়াটে হিসেবে দেখছেন না–একজন ছিন্নমূল মানুষ হিসেবে দেখছেন। ছিন্নমূল মানুষের সঙ্গে কোনো বাড়িওয়ালা কখনো গল্পগুজব করে সময় নষ্ট করবে না। মিসির আলির মনে হল—খুব শিগগিরই তিনি বাড়ি ছাড়ার নোটিশও পাবেন। যে ভাড়াটের টাকা পয়সার সাপ্লাইয়ের ঠিক নেই তাকে কোনো বাড়িওয়ালা রাখবে না।

বদরুল সাহেব চলে যাওয়ায় মিসির আলির জন্যে খানিকটা সুবিধা হল। সেমিনারে যাওয়া যাবে। শুধু সেমিনার না, তিনি ঠিক করলেন-বিয়ের যে নিমন্ত্রণটা পেয়েছেন, সেখানেও যাবেন। প্লেট ভর্তি করে পোলাও নেবেন। হাতাহাতি করে রেজালা নেবেন। একগ্লাস বোরহানি থাকা সত্ত্বেও আরো একগ্লাস নিতে গিয়ে তাড়াহুড়া করে গ্লাস ফেলে পাশের জনের জামাকাপড় ভিজিয়ে দেবেন। নগরে বাস করতে হলে নাগরিক মানুষ হতে হয়। মিসির আলি ঠিক করলেন, তিনি পুরোপুরি নাগরিক মানুষ হবার একটা চেষ্টা চালাবেন।

সেমিনারের বিষয়বস্তু বয়ঃসন্ধিকালীন মানসিক জটিলতা। গেস্ট স্পিকার অধ্যাপক স্ট্রাইনার এসেছেন আমেরিকা থেকে। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিদ্যার অধ্যাপক। তিনি সস্ত্রীক দশ দিনের জন্যে এসেছেন। বাংলাদেশে একদিন থেকে চলে যাবেন নেপালের পোখরায়। দুদিন ছুটি কাটয়ে যাবেন নয়াদিল্লি। নয়াদিল্লির আরেকটি সেমিনার শেষ করে ইজিপ্ট হয়ে দেশে ফিরবেন। প্রফেসর স্টাইনারের মূল স্পনসর দিল্লির মেডিকেল এসোসিয়েশন। বাংলাদেশ ফাঁকতালে ঢুকে পড়েছে। যেহেতু নেপাল যাবার পথে বাংলাদেশের ঢাকায় একদিনের জন্যে ট্রানজিট নিতেই হবে কাজেই তাকে ধরা হল একটা দিন বাংলাদেশকে দিতে হবে। সেমিনারের গেস্ট স্পিকার হবার বিনীত অনুরোধ। তাঁকে সামান্য সম্মানী দেওয়া হবে। ঢাকায় একরাত তাকে রাখা হবে ফাইভ স্টার হোটেলে।

বিদেশী বিশেষজ্ঞরা এই জাতীয় প্রস্তাবে সহজেই রাজি হয়ে যান। প্রফেসর স্টাইনারও সানন্দে রাজি হলেন। আরেকটা দেশ দেখা হলে মন্দ কি? প্রফেসর রাজি হওয়া মাত্রই ঢাকা মেডিকেল এসোসিয়েশনের কর্তব্যক্তিরা ছোটাছুটি শুরু করলেন। বিদেশী বিশেষজ্ঞ এলেই হবে না, প্রধানমন্ত্রীকে আনতে হবে। প্রধানমন্ত্রী মানেই পাবলিসিটি। টিভিতে বিরাট কভারেজ। প্রধানমন্ত্রীর আগমনের কারণে মেডিকেল এসোসিয়েশনের কর্তব্যক্তিদের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ঘোরাঘুরির বাড়তি সুযোগ। মোটামুটি নিরুত্তাপ ডাক্তারদের জীবনে কিছু উত্তাপ। সেমিনার উপলক্ষে খাওয়াদাওয়া। যেহেতু বিদেশী বিশেষজ্ঞ গেস্ট আসছেন তাঁর সম্মানে রাতে একটা এক্সক্লুসিভ ককটেল পার্টি। প্রধান বিষয় প্রধানমন্ত্রীর আগমন। মানের ক্রম অনুসারে ককটেল পার্টি, সেমিনারের খাওয়াদাওয়া, বিদেশী বিশেষজ্ঞকে নিয়ে শহর পর্যটন। সেমিনারটা ফাও!

প্রায় এক সপ্তাহ কর্মকর্তারা ছোটাছুটি করলেন। তাঁরা পুরোপুরি হতাশ হয়ে গেলেন যখন জানা গেল। এই সময় প্রধানমন্ত্রী থাকবেন না। তিনি বিদেশে যাচ্ছেন। এই তারিখে প্রেসিডেন্টকেও পাওয়া যায় কি না সেই চেষ্টা চলতে থাকল। চারটি কমিটি করা হল। একটা হল এন্টারটেইনমেন্ট কমিটি। এই কমিটি সন্ধ্যাবেলায় একটি স্যা অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে। আরেকটি কমিটি হল ফুড কমিটি! এই কমিটির দায়িত্ব সেমিনারের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা। তৃতীয় কমিটি দেখছে ককটেল পার্টি। খুবই সেনসেটিভ বিষয়। কাকে দাওয়াত দিতে হবে কাকে দাওয়াত দিতে হবে না। এটা চিন্তাভাবনা করে ঠিক করতে হবে। নানান ধরনের ড্রিংকের ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে বোতলের সংখ্যা এবং বৈচিত্র্য দেখে অধ্যাপক এবং অধ্যাপকপত্নীর চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। মূল সেমিনার বিষয়ে কোনো কমিটি হল না। এটা এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না। প্রফেসর স্টাইনারকে পাওয়া গেছে এটাই গুরুত্বপূর্ণ। সেমিনারে বাংলাদেশ থেকে দুটা পেপার পড়া হবে। পেপার দুটা তৈরি আছে–ব্যস। আর কি।

সেমিনার শেষ হয়েছে। দু ঘণ্টার সেমিনার শেষে অতিথিদের জন্যে লাইট রিফ্লেসমেন্ট। সাংবাদিক এবং অতিথিরা খাবারের টেবিলে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। তাদের দেখে মনে হচ্ছে দীর্ঘদিন তারা অনশনে ছিলেন। আজ অনশন ভঙ্গ করেছেন। কে কার আগে প্লেট নেবেন তা নিয়ে ধাক্কাধাব্ধি চলছে। খাবার ভালো। ফাইভ স্টার হোটেলের খাবার, পাঁচশ টাকা প্লেটের রিফ্লেসমেন্ট খারাপ হবার কারণ নেই।

এ ধরনের সেমিনারে মিসির আলি প্ৰথমে এক কাপ কফি নিয়ে নেন। শুরুতে চা এবং কফির টেবিল খালি থাকে। কোনোরকম ধাক্কাধাব্ধি ছাড়াই চা-কফি নিয়ে নেওয়া যায়। নাশতার টেবিলের ভিড় যখন কমে তখন সেখানে নাশতা থাকে না।

আজ ঘটনা অন্য রকম হল। মিসির আলি কফি নিয়ে এক কোনায় বসে কফিতে চুমুক দিচ্ছেন! তাঁর সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে কিন্তু জায়গাটা স্মোক ফ্রি কি না বুঝতে পারছেন না। অ্যাশট্রে চোখে পড়ছে না। এই সময় মিসির আলির পেছনে প্রফেসর স্ট্রাইনার এসে উপস্থিত হলেন। বিশুদ্ধ বিস্ময় নিয়ে সাউথের উচ্চারণে ইংরেজিতে বললেন–প্রফেসর মিসির আলি না? আমার কথা মনে আছে?

মিসির আলি বললেন, হ্যাঁ মনে আছে।

আপনি বাংলাদেশের তা ধারণা ছিল না। আমি জানতাম আপনি শ্ৰীলংকান।

মিসির আলি বললেন, আপনি তেমনভাবে আমার খোঁজ নেবার চেষ্টা করেন নি। ভাসা ভাসা খোঁজ নিয়েছেন কাজেই ভাসা ভাসা তথ্য পেয়েছেন।

প্রফেসর স্টাইনার খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েন তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে মিসির আলির পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যে। তিনি মিসির আলির হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন তাঁর স্ত্রীর কাছে! মুগ্ধ গলায় বললেন–কেরোলিন ইনি হচ্ছেন প্যারাসাইকোলজির গুরু। উনার কিছু প্ৰবন্ধ নিয়ে কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি একটি বই প্রকাশ করেছে। বইটির নাম দি থার্ড কামিং। আমি বইটি তোমাকেও পড়তে দিয়েছিলাম। আমি নিশ্চিত তুমি পড় নি। না পড়লেও পৃথিবী নামক এই গ্রহের কয়েকটি শুদ্ধতম ব্রেইনের অধিকারীদের একজনের সঙ্গে হ্যান্ডশেক কর। এই ঘটনার পর মিসির আলির আর নাশতার জন্যে চিন্তা করতে হল না। বিশিষ্ট মেহমানদের সঙ্গে খাবার জন্যে তাঁকে আলাদা করে নেওয়া হল। কর্মকর্তাদের একজন এক ফাঁকে গলা নিচু করে বলল, মিসির আলি সাহেব সন্ধ্যার পর ফ্রি থাকবেন। এক্সকুসিভ ককটেল পার্টি। হুইস্কির মধ্যে ব্লু লেভেল যোগাড় হয়েছে।

মিসির আলি বললেন, আমি তো হুইঙ্কি খাই না।

লাইটার ড্রিংকসও আছে–খুব ভালো ওয়াইন আছে।

আমি মদ্যপান করি না।

কোকা-পেপসিও আছে। কোকা-পেপসি খাবেন।

মিসির আলি সহজ গলায় বললেন, মদের আসরে পেপসি-কোকওয়ালাদের না থাকাই ভালো।

আপনার যে বই আছে তা জানতাম না। বইয়ের কপি কি আছে–একটা কপি আমাকে দেবেন তো।

আমার কাছে কোনো কপি নাই। নিজের কপিও নাই।

আচ্ছা ঠিক আছে–আমি বই যোগাড় করে নেব। আমার জন্যে আমেরিকা থেকে বই আনা কোনো ব্যাপার না। আমার মেয়ে জামাই থাকে আমেরিকায়। ইন্টারনেটে জানিয়ে দিলে নেক্সট উইকে বই এসে যাবে। আপনার জন্যে কি একটা কপি আনব?

না। আমার জন্যে কোনো কপি লাগবে না।

মিসির আলি ভরপেট খাবার খেলেন। আরো এক কাপ কফি খেলেন। প্রফেসর বিখ্যাত মানুষটার সঙ্গে ছবি তুলব, এবং তাঁর অটোগ্রাফ নেব। ছবি সেশন এবং অটোগ্রাফ সেশনও শেষ হল। ফটোগ্রাফারদের ফ্ল্যাশ একের পর এক জ্বলতেই থাকল। মিসির আলি তাঁর মুখ হাসি হাসি করে রাখলেন। যে পূজার যে মন্ত্র। ফটো সেশান পূজার মন্ত্র হল–মুখভর্তি হাসি। মুখ হাসি হাসি করে রাখা যে এমন এক ক্লান্তিকর ব্যাপার তিনি জানতেন না। সেমিনার হলে মিসির আলি যতটা বিরক্ত হয়েছিলেন তারচেয়ে অনেক বিরক্ত হলেন সেমিনার-পরবর্তী কর্মকাণ্ডে।

হোটেল থেকে বের হয়ে তাঁর বিরক্তি কেটে গেল। আকাশে মেঘ করেছে। কার্তিক মাসের ঘোলাটে পাতলা মেঘ না, আষাঢ়ের ঘন কালো মেঘ। মেঘ দেখেই মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে। বর্ষাকালের বৃষ্টির এক ধরনের মজা, শীতের অপ্রত্যাশিত বৃষ্টির অন্য ধরনের মজা।

বৃষ্টি দেখলে মানুষ উতলা হয় কেন? এরকম চিন্তা করতে করতে মিসির আলি হাঁটতে শুরু করলেন। বৃষ্টি দেখে মন উতলা হবার তেমন কোনো বাস্তব কারণ নেই! ব্যবস্থাটা প্রকৃতি করে রেখেছে। সমস্ত প্রাণিকুলের জিনে কিছু তথ্য দিয়েছে। এই তথ্য বলছে–আকাশ যখন মেঘে ঢেকে যায় তখন তোমরা উতলা হবে। শুধু প্রাণিকুল না। বৃক্ষকুলের জন্যেও একই তথ্য। এর কারণ কী? প্রকৃতি কি আমাদের বিশেষ কিছু বলতে চাচ্ছে যা আমরা ধরতে পারছি না। প্রকৃতি কি চায় বর্ষা বাদলায় আমরা বিশেষ কিছু ভাবি? অন্য ধরনের চিন্তা করি। বর্ষা বাদলার সঙ্গে সৃষ্টি সম্পর্কিত কিছু কি জড়িয়ে আছে? শুধু মানুষকে সরাসরি কিছু বলে না। সে কথা বলে ইঙ্গিতে। সেই ইঙ্গিত বোঝাও কঠিন।

বাসায় ফিরে মিসির আলি স্বস্তি পেলেন। ইয়াসিন চলে এসেছে। বাসায় তালা খুলে ঢুকে পড়েছে। তালা খোলার ব্যাপারে এই ছেলেটির দক্ষতা ভালো। মিসির আলি সদর দরজার জন্যে তিন শ টাকা খরচ করে একটা আমেরিকান তালা লাগিয়েছিলেন। তালার প্যাকেটে লেখা ছিল—বাৰ্গলার প্রাফ লক। সেই কঠিন তালা এগোরো-বারো বছরের একটা ছেলে মাথার ক্লিপ দিয়ে খুঁচিয়ে কীভাবে খুলে ফেলে সেটা এক রহস্য। একই সঙ্গে চিন্তারও বিষয়।

ইয়াসিন যখন কাজ করে–মন লাগিয়ে কাজ করে, এবং অত্যন্ত দ্রুত কাজ করে। ঘর ঝাঁট দেওয়া হয়েছে। পানি দিয়ে মোছা হয়েছে। বিছানার চাদর বদলে নতুন চাদর টানটান করে বিছানো হয়েছে। দেয়াল ঘড়িতে ব্যাটারি লাগানো হয়েছে এবং ঘড়ি চলছে। ঠিক টাইম দিচ্ছে। ইয়াসিন যেহেতু ঘড়ির টাইম দেখতে পারে না কাজেই ধরে নেওয়া যায়–ঘড়ি নিয়ে দোকানে গিয়ে ব্যাটারি লাগিয়ে এনেছে। মিসির আলি সাহেবের পড়ার টেবিলও গোছানো। টেবিলের ওপর চকচকে পাঁচ শ টাকার একটা নোট–কলম দিয়ে চাপা দেওয়া।

গত সপ্তাহে এই টেবিল থেকেই পাঁচ শ টাকার একটা নোট হারিয়েছে। সেই নোটও কলম দিয়ে চাপা দেওয়া ছিল। তিনি যখন ইয়াসিনকে জিজ্ঞেস করলেন, একটা পাঁচ শ টাকার নোট রেখেছিলাম নোটটা কোথায় রে?

ইয়াসিন বলল, জানি না।

তুই নিয়েছিস নাকি?

না।

ভালো করে মনে করে দেখ নোটটা নিয়ে মনের ভুলে পকেটে রেখেছিস কি না।

ইয়াসিন আবারো বলল, না। তারপর থমথমে মুখে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। মিসির আলির সামান্য মন খারাপ হল–ছেলেটা কি চুরি করা শিখছে? এবং এই চুরি শেখার জন্যে নানান জায়গায় টাকা পয়সা ছড়িয়ে রেখে তাকে সাহায্য করছে? তিনি এই বিষয়ে ইয়াসিনকে আর কিছু বলেন নি। ভেবে রেখেছিলেন, সময় সুযোগমতো নানান ব্যাখ্যা দিয়ে চুরি যে গুরুতর অপরাধের একটি তা বুঝিয়ে দেবেন। সেই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে আর যাওয়া হয় নি। তারপর ঘটনাটা ভুলেই গেছেন। আজ টেবিলে পঁচিশ টাকার নোট পড়ে থাকতে দেখে মনে পড়ল। তিনি ইয়াসিনকে ডাকলেন। শান্ত গলায় বললেন, টেবিলের ওপর পাঁচ শ টাকার নোট কে রেখেছে, তুই?

ইয়াসিন হ্যাঁ-না, কিছুই বলল না।

মিসির আলি বললেন, যে নোটটা হারিয়েছিল, এটা কিন্তু সেই নোট না। হারানো নোটটা ছিল ময়লা। আর এই নোটটা চকচক করছে।

ইয়াসিন তার পরেও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

তুই এখন করছিস কী?

রান্ধি।

কী, রাঁধিস?

হুকনা মরিচের ভর্তি, ডাইল আর ডিমের সালুন।

রান্না শেষ করার পর আমার কাছে আসবি-পাঁচ শ টাকার নোটের বিষয়ে কথা বলব। আমাকে ভয় পাবার কিছু নেই। আমি কখনো কাউকে শাস্তি দেই না। তুই কি আমাকে ভয় পাস?

না।

ইয়াসিন রান্নাঘরের দিকে চলে যাচ্ছে। আসন্ন বিচারসভা নিয়ে তাকে তেমন চিন্তিত মনে হচ্ছে না। তার পেট থেকে কোনো কথা বের করা যাবে এটাও মিসির আলির মনে হচ্ছে না। মানুষ দু শ্রেণীর–এক শ্রেণীর মানুষ কিছুতেই ভাঙবে না। তবে মাচকাবে। আরেক শ্রেণীর মানুষের চরিত্রে মাচকানোর ব্যাপারটি নেই। সে ভেঙে দুটুকরা হবে, কিন্তু কিছুতেই মাচকাবে না। ইয়াসিন দ্বিতীয় শ্রেণীর। পঁচিশ টাকার নতুন নোট প্রসঙ্গে তার মুখ থেকে একটি বাক্যও বের করা যাবে না। সে পাথরের মতো মুখ করে মেজের দিকে তাকিয়ে থাকবে। বিড়াল যেমন গড়গড় শব্দ করে, মাঝে মাঝে এই ধরনের শব্দ করবে।

বিজ্ঞান দ্রুত এগুচ্ছে—এমন যন্ত্র হয়তো খুব শিগগিরই বের হয়ে যাবে যার সামনে কাউকে বসালে তার মাথায় কী আছে সব পরদায় পরিষ্কার দেখা যাবে। মস্তিষ্কে জমা স্মৃতি ভিডিওর মতো পরদায় চলে আসবে। কোনো অপরাধী বলতে পারবে না–এই অপরাধ সে করে নি। মস্তিষ্ক থেকে স্মৃতি বের করে পরদায় নিয়ে আসা খুব কঠিন কোনো প্রযুক্তি বলে মিসির আলির মনে হয় না। আগামী বিশ-পঁচিশ বছরেই গুরুত্বপূর্ণ এই ব্যাপারটা ঘটে যাবে।

.

কিছুদিন আগে মিসির আলি কাগজে পড়েছেন—দুই ভাড়াটে খুনির ফাঁসি হয়ে গেছে। যারা তাকে ভাড়া করেছে তাদের কিছু হয় নি। তারা বেকসুর খালাস পেয়েছে। কারণ প্রমাণ নেই। নতুন পৃথিবীতে প্রমাণের জন্যে মাথা ঘামাতে হবে না। আদালতের নির্দেশে মাথা থেকে স্মৃতির টেপ সরাসরি নিয়ে নেওয়া হবে। নতুন পৃথিবীতে নির্দোষ মানুষ কখনো শাস্তি পাবে না।

মিসির আলি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালেন। মেঘ আরো ঘন হয়েছে। শীতের ধূলি ধূসরিত শুকনো শহর তৃষিতের মতো তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। এখন যদি কোনো কারণে বৃষ্টি না হয় তা হলে কষ্টের ব্যাপার হবে।

স্যার গো।

মিসির আলি চমকে তাকালেন। দরজা ধরে ইয়াসিন দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে দুশ্চিন্তার লেশমাত্র নেই। বরং মুখ হাসি হাসি।

কী ব্যাপার ইয়াসিন?

একটা মেয়েছেলে আসছে। আপনেরে চায়।

মিসির আলি বসার ঘরে চলে এলেন। খুবই আধুনিক সাজ পোশাকের একজন তরুণী! গায়ে বোরকা জাতীয় কালো পোশাক যা ঠিক বোরকাও না। মাথায় স্কার্ফ বাঁধা। স্কার্কের উজ্জ্বল রঙ। সাধারণত মরুভূমির মেয়েরা এমন উজ্জ্বল রঙ ব্যবহার করে। মেয়েটি রূপবতী। তাকে দেখেই মিসির আলির মনে যে উপমা এল তা হল জ্বলন্ত মোমবাতি। মিসির আলি মেয়েটিকে চিনতে পারলেন না। মেয়েটি মিসির আলিকে দেখেই চট করে উঠে দাঁড়াল। এবং তিনি কিছু বুঝতে পারার আগেই তাকে এসে সালাম করে ফেলল।

স্যার আমাকে চিনতে পারছেন?

না।

ভালো করে আমার দিকে তাকান। ভালো করে না তাকালে আপনি আমাকে চিনবেন কী করে। আপনি তো কখনো কোনো মেয়ের দিকে ভালো করে তাকান না।

মিসির আলি ভালো করে তাকালেন। লাভ হল না। তিনি তখনো চিনতে পারছেন না।

মেয়েটি বলল, আমার নাম প্রতিমা। হিন্দু নাম। কিন্তু আমি মুসলমান মেয়ে এখন চিনতে পেরেছেন?

না।

মাথায় স্কার্ফ আছে বলে আপনি হয়তো চিনতে পারছেন না। আপনার সঙ্গে যতবার দেখা হয়েছে কখনোই মাথায় স্কার্ফ ছিল না। মাথাভর্তি চুল ছিল। এখন স্কার্ফ থাকায় হয়তো অচেনা লাগছে।

মেয়েটি মাথার স্কার্ক খুলে মাথায় ঝাঁকুনি দিল। সঙ্গে সঙ্গে মাথার চুল চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। মিসির আলি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন। এমন রূপবতী একজনকে দেখতে পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার।

স্যার আমাকে এখন কি চিনতে পেরেছেন?

হ্যাঁ।

কেন আমার নাম প্রতিমা, এটা মনে পড়েছে?

হ্যাঁ মনে পড়েছে। তোমার মা এক দুপার বেলায় গান শুনছিলেন। প্রতিমা নামের একজন গায়িকার গান–একটা গান লিখ আমার জন্য। এই গান শুনতে শুনতে তোমার মা আবেগে দ্রবীভূত হলেন। তাঁর চোখে পানি এসে গেল। তার কিছুক্ষণ পর তোমার মার ব্যথা শুরু হল। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। আট ঘণ্টা পর তোমার জন্ম হল। এই আট ঘণ্টা তীব্র ব্যথার মধ্যে তোমার মায়ের মাথায় একটা গান লিখা আমার জন্য ঘুরতে লাগল। যখন তিনি শুনলেন, তাঁর মেয়ে হয়েছে–গায়িকার নামে মেয়ের নাম রাখলেন, প্রতিমা।

এই তো আপনার সবকিছু মনে পড়েছে। আপনার জন্যে আমি নেপাল থেকে একটা চাদর এনেছিলাম। চাদরটা আপনি ব্যবহার করছেন দেখে ভালো লাগছে। স্যার এখন বলুন আমি কবে থেকে কাজ শুরু করব?

মিসির আলি থমকে গেলেন। তিনি যে যন্ত্রণার কথা ভুলে গিয়েছিলেন, সেই যন্ত্রণা আবার শুরু হয়েছে।

প্রতিমা বলল, আপনি পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন–ভেবেছিলেন আপনার ঠিকানাটা আমি খুঁজে বের করতে পারব না। দেখলেন, কীভাবে খুঁজে বের করেছি?

দেখলাম।

প্রতিমা বসতে বসতে বলল, স্যার আপনি আমাকে ভয় পান কেন? আমাকে ভয় পাবার কিছু নেই। আমি আপনাকে নিয়ে একটা বই লিখব। আপনার জীবনের বিচিত্র সব ঘটনার নোট নেব। ব্যস ফুরিয়ে গেল।

মিসির আলি কিছু বললেন না। চুপ করে রইলেন–প্রতিমা নামের এই মেয়েটি ভয়াবহ একটা সমস্যা নিয়ে তাঁর কাছে এসেছিল। তিনি সেই সমস্যার দ্রুত সমাধান করেছিলেন। তারপরই মেয়েটির মাথায় ঢুকে গেছে মিসির আলি তাঁর জীবনে যত সমস্যার সমাধান করেছেন সেগুলি সে লিখে ফেলবে।

প্রতিমা হাসতে হাসতে বলল, স্যার আপনি এমন হতাশ চোখে তাকাচ্ছেন কেন? আমি বাঘ-ভাল্লুক কিছু না। আমি খুবই সাধারণ একটা মেয়ে। সাধারণ হলেও ভালো মেয়ে। আমি নানানভাবে আপনাকে সাহায্য করব। মনে করুন সকালবেলা আপনার কাছে এলাম। আপনি কিছুক্ষণ কথা বললেন, আমি নোট নিলাম। তারপর আপনার ঘরের কাজকর্ম গুছিয়ে দিলাম। আমি রান্না করা শিখেছি। আপনার জন্যে রান্ন করলাম।

তোমার এখনো বিয়ে হয় নি?

না। আমি তো আগেই বলেছি–আমি কখনো বিয়ে করব না।

প্রতিমা খিলখিল করে হাসছে। মিসির আলি বললেন, হাসছ কেন?

প্রতিমা বলল, আপনি হতাশ চোখে তাকাচ্ছেন। আপনাকে দেখে খুবই মায়া লাগছে। এই জন্যে হাসছি।

চা খাবে?

না। চা খাব না। আমি চলে যাব। আপনি প্রথম ধাক্কাটা সামলে নিন। তারপর আমি আসব। স্যার, ভালো কথা আপনার সঙ্গে আমার সাক্ষাতের বিবরণ আমি গুছিয়ে লিখে ফেলেছি। কপি আপনার জন্যে নিয়ে এসেছি। কপি আপনি পড়বেন-এবং বলবেন কিছু বাদ পড়েছে কি না। স্যার ঠিক আছে?

হ্যাঁ ঠিক আছে।

আজই পড়বেন। স্যার, আপনি ঘুম থেকে কখন ওঠেন?

রাত করে ঘুমাতে যাই তো, ঘুম ভাঙতে নটা-দশটা বেজে যায়।

আমি যখন চার্জ নেব, আপনাকে ঠিক রাত দশটায় ঘুমাতে যেতে হবে। ভোর ছটায় ঘুম থেকে তুলে দেব। এক ঘণ্টা আপনাকে হাঁটতে হবে। এক ঘণ্টা পর মর্নিং ওয়াক সেরে এসে দেখবেন–ব্রেকফাস্ট রেডি।

মিসির আলি চিন্তিত গলায় বললেন, তুমি এখানে থাকবে নাকি?

প্রতিমা বলল, হ্যাঁ। তবে এ বাড়িতে না। বারিধারায় আমার পাশাপাশি দুটা ফ্ল্যাট আছে–একটায় আপনি থাকবেন, অন্যটায় আমি থাকব। আমি একজন ইনটেরিয়ার ডিজাইনারকে খবর দিয়েছি–সে আপনার ফ্ল্যাটটা আপনার প্রয়োজনমতো সাজিয়ে দেবে। লাইব্রেরি থাকবে, লেখার টেবিল থাকবে।

আমাকে গিয়ে তোমার ফ্ল্যাটে উঠতে হবে?

হ্যাঁ। স্যার এ রকম শুকনা মুখ করে তাকালে হবে না। আমি আগামীকাল সকাল নটার সময় আসব। ঝড়-বৃষ্টি-সাইক্লেন-হরতাল যাই হোক না কেন সকাল নটায় আমি উপস্থিত হব।

ঠিক আছে।

এর মধ্যে আমার লেখাটা পড়ে ফেলবেন। লেখার কিছু কিছু অংশ ভালোমতো দেখে দেবেন। আমি দাগ দিয়ে রেখেছি।

তুমি কি এখন চলে যাচ্ছ?

প্রতিমা হাসতে হাসতে বলল, হ্যাঁ–তবে কাল দেখা হবে। ঠিক সকাল নটায়। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। লাভ নেই–আপনি নিশ্চয়ই একদিনের মধ্যে বাড়ি বদলাতে পারবেন না?

মিসির আলির মনে হল মেয়েটা পুরোপুরি সুস্থ না। কিছু সমস্যা তার এখনো রয়ে গেছে।

.

মিসির আলি দুপুরের খাওয়া শেষ করে ঘড়ির দিকে তাকালেন, দুটা পঁচিশ বাজে। বিছানায় এসে কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করা যায়। দুপুরের খাবার শেষ করে বই হাতে বিছানায় কত হবার মধ্যে আনন্দ আছে। শরীর ভরা আলস্য, চেখভর্তি ঘুম-হাতে চমৎকার একটা বই। আজ অবিশ্যি হাতে বই নেই–প্রতিমা নামের জ্বলন্ত মোমবাতির লেখা বাহান্ন পৃষ্ঠার খাতা। হাতের লেখা না, কম্পিউটারে কম্পোজ করা হয়েছে, স্পাইরেল বাইন্ডিং করা হয়েছে। হাতের লেখা হলে ভালো হত। মানুষ তার চরিত্রের অনেকখানি হাতের লেখায় প্রকাশ করে। কারো লেখা হয় জড়ানো। একটা অক্ষরের গায়ে আরেকটা অক্ষর মিশে থাকে। কেউ কেউ লেখে গোটা গোটা হরফে। কেউ প্রতিটি অক্ষর ভেবেচিন্তে লেখে। কেউ অতি দ্রুত লেখে। লেখা দেখেই মনে হয় তার চিন্তা করার ক্ষমতা দ্রুত। সে মাথার চিন্তাকে অনুসরণ করছে বলে লেখাও দ্রুত লিখতে হচ্ছে। তবে কেউ কেউ লেখে টিমোতালে।

কম্পিউটার মানুষকে অনেক কিছু দিচ্ছে, আবার অনেক কিছু কেড়েও নিচ্ছে। কম্পিউটারের লেখায় কোনো কাটাকুটি নেই। হাতের লেখায় কাটাকুটি থাকবেই। সেই কাটাকুটিই হবে মানুষের চরিত্রের রহস্যের প্রতিফলন। হাতের লেখার যুগ পার হয়েছে। এখন শুরু হয়েছে কম্পিউটারে লেখার যুগ। এই যুগ শেষ হয়ে নতুন যুগ আসবে। কী রকম হবে সেটা? মানুষ চিন্তা করছে আর সেই চিন্তা লেখা হয়ে বের হয়ে আসবে? সে রকম কিছু হলে মন্দ হয় না। তা হলে সেই যুগ হবে হাতের লেখার যুগের কাছাকাছি। কারণ চিন্তার মধ্যেও কাটাকুটি থাকবে।

প্রতিমার লেখার ওপর মিসির আলি চোখ বুলাতে শুরু করলেন। তাঁর কাছে মনে হচ্ছে তিনি কোনো গল্পের বই পড়ছেন। মেয়েটা সে রকম ভঙ্গিতেই লেখার চেষ্টা করছে। লেখার ভঙ্গিটা জার্নালিস্টিক হলে ভালো হত। প্রতিমা লিখছে–

আমার নাম প্রতিমা। এটা কিন্তু কাগজপত্রের নাম না। কাগজপত্রে আমার নাম আফরোজা। যেহেতু আমার মা খুব শখ করে প্রতিমা নাম রেখেছিলেন, এবং আমার বয়স এক বছর পার হবার আগেই মারা গেছেন সে কারণে মার প্রতি মমতাবশত সবাই আমাকে ডাকা শুরু করল প্রতিমা। মুখে মুখে ডাকনাম এক ব্যাপার, কাগজপত্রে নাম থাকা অন্য ব্যাপার।

আকিকা করে আমার মুসলমানি নাম রাখা হল। তবে সেই নামে কেউ ডাকত না। শুধু বাবা মাঝে মধ্যে ডাকতেন। তখন আমি জবাব দিতাম না।

আমার বাবা আমাকে অতি আদরে মানুষ করতে লাগলেন। তিনি আদর্শ পত্নীপ্রেমিকদের মতো দ্বিতীয় বিয়ে করেন নি। বাড়িতে মাতৃস্থানীয় কেউ না থাকলে তার কন্যার অযত্ন হবে ভেবে তিনি সাৰ্ব্বক্ষণিক একজন নার্স রাখলেন। ছোটবেলায় এই নার্সকেই আমি মা ডাকতাম। আমার বয়স যখন পাঁচ বছর তখন কী একটা কারণে যেন এই নার্স মহিলাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। শৈশবের এই স্মৃতিটি আমার মনে আছে। এই মহিলা হাউমাউ করে কাঁদছেন এবং বাবার পা জড়িয়ে ধরতে যাচ্ছেন। বাবা বলছেন-ডোন্ট টাচ মি। ডোন্ট টাচ মি। তোমাকে যে আমি কানে ধরে উঠবাস করাচ্ছি না এই কারণেই তোমার সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।

যে মহিলাকে আমি মা বলে জানতাম সেই মহিলার এমন হেনস্তা দেখে আমি খুবই অবাক হলে গেলাম। ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপতে লাগল। আমাকে অন্য ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। আমি এর পরে আর কোনোদিন দেখি নি। বাড়িতে এই মহিলার কোনো ছবি ছিল না বলে কিছুদিনের মধ্যেই আমি তার চেহারাও ভুলে গেলাম। শুধু মনে থাকিল-শ্যামলা একটি মেয়ে-যার মুখ গোলাকার এবং তিনি ঠোঁট গোল করে শিস দিতে খুব পছন্দ করতেন।

শৈশবের ভয়াবহ স্মৃতি এই একটাই। এই স্মৃতির ব্যাপারটা আমাকে সাইকিয়াট্রিস্টদের কাছে বারবার বলতে হয়েছে। বাবা আমাকে নিয়ে অনেক বড় বড় সাইকিয়াট্রিস্টর কাছে নিয়ে গিয়েছেন। তাদের প্রথম প্রশ্নই হল–শৈশবে কোনো দুঃখময় স্মৃতি আছে Painful memory?

মিসির আলি সাহেবও এই প্রশ্ন করলেন। তবে অন্য সাইকিয়াট্রিস্টরা যেমন এই ঘটনা শুনে ঝাঁকের পর ঝাঁক প্রশ্ন করেছিলেন মিসির আলি তা করলেন না। তিনি শুধু বললেন–ঐ মহিলার গলার স্বর কেমন ছিল?

আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম। গলার স্বর দিয়ে কী হবে? উনার গলার স্বর কেমন জানতে চাচ্ছেন কেন?

মিসির আলি বললেন, এমনি জানতে চাচ্ছি।

আমি বললাম, গলার স্বর মিষ্টি ছিল। খুব মিষ্টি। উনার বিষয়ে আমার আর কিছু মনে নেই শুধু মনে আছে উনি ঠোঁট গোল করে শিস দিতেন।

মিসির আলি বললেন, আরেকটি জিনিস নিশ্চয়ই তোমার মনে আছে। উনি যে তোমাকে বিশেষ নামে ডাকতেন সেটা তো মনে থাকার কথা।

উনি আমাকে বিশেষ নামে ডাকতেন এটা আপনাকে কে বলেছেন?

কেউ বলে নি। আমি অনুমান করছি।

এ রকম অনুমান কেন করছেন? কেন?

তোমার কথা থেকে মনে হচ্ছে এই মহিলা তোমায় খুবই আদর করত। মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে অতি আদরের কাউকে বিশেষ নামে ডাকা। যে নামে অন্য কেউ ডাকবে না। এই থেকেই অনুমান করছি তোমাকে বিশেষ কোনো নামে ডাকতেন। সেই বিশেষ নামটা কী?

উনি আমাকে ডাকতেন মাফু। মা বলার পর ফুঁ বলে লম্বা টান দিতেন—এ রকম করে মাফুউউউ।

মিসির আলি হাসলেন এবং প্রায় সেই মহিলার মতো করে ডাকলেন মাফুউউউ। আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, জি। তিনি বললেন, মাফু তুমি কেমন আছ?

আমি বললাম ভালো নেই। আপনি আমাকে সারিয়ে দিন।

তিনি আবারো হাসলেন। এবং আমার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল–ইনি আমাকে সারিয়ে দেবেন। উনার সেই ক্ষমতা আছে।

এখন আমি আমার অসুখের ঘটনাটা বলি-আমি যখন ইউনিভার্সিটিতে থার্ড ইয়ারে পড়ি তখন বাবার শরীর হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। হার্টের সমস্যা, ডায়াবেটিস, অ্যাজমার অ্যাটাক সব একসঙ্গে। তিনি প্রায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। আমাকে একদিন ডেকে নিয়ে বললেন–মা, তোর কি পছন্দের কোনো ছেলে আছে?

আমি বললাম কেন?

বাবা বললেন, তোর কোনো পছন্দের ছেলে থাকলে বল। আমি তোর বিয়ে দিতে চাই। আমার শরীর ভালো না। যে কোনো সময় যে কোনো কিছু ঘটতে পারে। তার আগেই আমি দেখে যেতে চাই তোর সংসার হয়েছে। যার ওপর ভরসা করতে পারিস এমন একজন কেউ তোর আশপাশে আছে।

আমি বললাম, আমার পছন্দের কেউ নেই।

বাবা বললেন, আমি দেখেশুনে তোর জন্যে একজন ছেলে নিয়ে আসি? বাবার হতাশ মুখ দেখে আমার খুবই মায়া লাগল। তখন তার অ্যাজমার টান উঠেছে। বুকের ভেতর থেকে শাঁ শাঁ শব্দ আসছে। মনে হচ্ছে তার ফুসফুসে ছোট কোনো বাঁশি কেউ রেখে দিয়েছে–যেই তিনি লম্বা করে নিশ্বাস নিচ্ছেন। ওমনি সেই বাঁশিতে শব্দ উঠছে। তখন আমার বিয়ে করার কোনো রকম ইচ্ছা ছিল না। বাবার অবস্থা দেখে বললাম, তুমি যা ভালো মনে কর—করতে পার!

বাবা অতি দ্রুত একটা ছেলে যোগাড় করে ফেললেন। ছেলের বাবা মফস্বলের কোনো এক কলেজের অধ্যাপক। বাবা-মার একমাত্র ছেলে। মেডিকেল কলেজে ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। সুন্দর চেহারা। ছেলের সঙ্গে বাবা আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি দেখলাম ছেলে খুব লাজুক। কথা বলার সময় সে সরাসরি আমার দিকে তাকায় না। অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। আমি তাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম। সেখানে কথা যা বলার আমিই বললাম। সে শুধু হ্যাঁ হুঁ করল। বিয়ে উপলক্ষে ছেলের বাবা-মা ঢাকায় চলে এলেন। ঢাকায় তারা দুমাসের জন্যে একটা বাড়ি ভাড়া করলেন। সব যখন ঠিকঠাক তখন বাবা বললেন–এখন বিয়ে হবে না। ছেলেটার কিছু সমস্যা আছে। কী সমস্যা বাবা তা ব্যাখ্যা করলেন না।

বিয়ে বাতিল হয়েছে শুনে ছেলের বাবা-মা দুজনই খুব আপসেট হয়ে পড়লেন। বাবার সঙ্গে নানান কথাবার্তা বলতে লাগলেন। আমার সঙ্গেও কথা বলার চেষ্টা করলেন। আমি কথা বললাম না। শুধু যে ছেলের বাবা-মা আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন তা না, ছেলেও আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইল। বারবার টেলিফোন–সে শুধু পাঁচ মিনিটের জন্যে কথা বলতে চায়।

সেই পাঁচ মিনিট তাকে দেওয়া হল না। তারপরই একটা দুৰ্ঘটনা ঘটল। ছেলেটা রিকশা করে যাচ্ছিল। পেছন থেকে একটা মাইক্রোবাস এসে ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দিল। লোকজন ধরাধরি করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। হাসপাতালে নেবার পথেই সে মারা গেল।

ছেলেটির সঙ্গে আমার কোনো মানসিক বন্ধন তৈরি হয় নি, কাজেই তার মৃত্যু আমার জন্যে ভয়ঙ্কর রকম আপসেট হবার মতো কোনো ঘটনা না। তারপরেও কয়েকদিন আমার মন খারাপ গেল। বেচারা পাঁচ মিনিট আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল। কী হত পাঁচ মিনিট কথা বললে?

আমার সমস্যাটা শুরু হল ছেলেটার মৃত্যুর ঠিক ছদিন পর। আমি আমার ঘরে ঘুমাচ্ছি। টেলিফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। আমার হাতের কাছে টেলিফোন। টেলিফোন ধরার আগে ঘড়ি দেখলাম। রাত তিনটা বাজে। রাত তিনটায় কে টেলিফোন করবে? কোনো ক্র্যাংক কল নিশ্চয় এসেছে। টেলিফোন ধরলেই জড়ানো গলায় কেউ নোংরা কোনো কথা বলবে। ধরব না ধরব না করেও টেলিফোন ধরলাম। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে লাইন কেটে দিল। আমি বিরক্ত হয়ে টেলিফোন রেখে বাথরুমে গেলাম। রাতে ঘুম ভেঙে গেলে আমার খুব সমস্যা হয়। ঘুম আসতে চায় না। হাত-মুখ ধুয়ে ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে দেখি–আমার বিছানায় পা তুলে ছেলেটা বসে আছে। যে বইটা পড়তে পড়তে রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সেই বইটা তার হাতে। খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সে বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছে। আমি ঘরে ঢুকতেই সে বই রেখে বলল, পাঁচটা মিনিট তোমার সঙ্গে কথা বলব। এর বেশি না।

আমি চিৎকার করে মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। শুরু হল আমার দুঃস্বপ্নের দিনরাত্রি।

এইটুকু পড়েই মিসির আলি খাতা নামিয়ে রাখলেন। মেয়েটির চিকিৎসা কীভাবে করা হয়েছে তাঁর মনে পড়েছে। লেখা পড়ে নুতন কিছু জানা যাবে না। মিসির আলির ঘুম পাচ্ছে। বরং কিছুক্ষণ ঘুমানো যেতে পারে। ঘুমের মধ্যে বৃষ্টি নামলে চমৎকার হয়। বৃষ্টির শব্দটা কোনো-না-কোনো ভাবে ঘুমন্ত মানুষের মাথায় ঢুকে যায়। ঝমোঝম শব্দে আনন্দময় বাজনা মাথার ভেতর বাজতে থাকে। মানুষের অবচেতন মন বৃষ্টির গান খুবই পছন্দ করে। কেন করে তার নিশ্চয়ই কারণ আছে। কারণটা একদিন ভেবে দেখতে হবে।

দিন শুরু হয়েছে রুটিন মতোই

মিসির আলির দিন শুরু হয়েছে রুটিন মতোই। সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখেছেনমশারির ভেতর দিয়ে খবরের কাগজটা ঢুকিয়ে দেওয়া। একসময় বাসিমুখে খবরের কাগজ পড়তে তিনি আনন্দ পেতেন, এখন পান না, কিন্তু অভ্যাসটা রয়ে গেছে। অভ্যাস সহজে যায় না। খবরের কাগজ পড়তে পড়তেই ইয়াসিন চা নিয়ে আসে। মশারির ভেতরে ঢুকিয়ে গলা খাকারি দেয়। সেই চা, চা-না অতিরিক্ত চিনির কারণে সিরাপ জাতীয় ঘন তরল পদার্থ। ইয়াসিনকে অনেক বলেও চিনি কমানোর ব্যবস্থা মিসির আলি করতে পারেন নি। এখন মিসির আলির গরম সিরাপ খাওয়া অভ্যাস হয়ে গেছে। প্রায়ই তাকে বলতে শোনা যায়-ইয়াসিন আরেক চামচ চিনি দে। ইংরেজি প্রবচনটা এতই সঠিক-Old habit die hard. পুরোনো অভ্যাস সহজে মরে না।

মিসির আলির হাতে খবরের কাগজ। তিনি খবরের কাগজে চোখ বুলাচ্ছেন—হঠাৎ এমন কোনো খবর চোখে পড়ে কি না যা মনে গেঁথে যায়। এমন কিছু চোখে পড়ছে না। হত্যা, ধর্ষণ ছাড়া তেমন কিছু নেই। মিসির আলির মনে হল সব পত্রিকার উচিত এই দুটি বিষয়ে আলাদা পাতা করা। খেলার পাতা, সাহিত্য পাতার মতো ধর্ষণ পাতা, হত্যা পাতা। যারা ঐ সব বিষয় পড়তে ভালবাসে তারা ঐ পাতাগুলি পড়বে। যারা পড়তে চায় না তারা পাতা আলাদা করে রাখবে। বিশেষ দিনে হত্যা এবং ধর্ষণ বিষয়ে সচিত্র ক্রোড়পত্র বের হবে।

পত্রিকায় নতুন একটি বিষয় চালু হয়েছে–জন্মদিনের শুভেচ্ছা। মামণির এক বছর বয়সপূর্তি উপলক্ষে পিতা-মাতার শুভেচ্ছা। মিসির আলি বেশ আগ্রহ নিয়েই পড়ছেন।

অনিক

পৃথিবীতে আজ যত গোলাপ ফুটেছে সবই তোমার জন্যে

তোমার বাঘা ও মা

অনিকের ছবি। দুই হাতে ভর দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত গোলাপের মালিক হাঁ করে বসে আছে। তার জিব দেখা যাচ্ছে।

শিপ্রা,
আজ আমাদের শিপ্রার শুভ জন্মদিন
পৃথিবীর সব দুঃখ করবে। সে বিলীন।

শিপ্রার
নানা নানু ছোট মামা, ছোট মামি ও রনি।

পৃথিবীর সমস্ত দুঃখ যে বিলীন করবে। সেই শিপ্রার ক্ৰন্দনরতা একটা ছবি। শিপ্রার হাতে চকবার।

মিসির আলি ছবিটির দিকে তাকিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলেন। মেয়েটি কাঁদছে কেন? চোখে মুখে কি চকবারের কাঠির খোচা লেগেছে?

জন্মদিনের শুভেচ্ছায় শুধু ছোট মামা, ছোট মামি আছেন। যেহেতু ছোট মামার উল্লেখ করা আছে। অবশ্যই ধরে নিতে হবে বড় মামাও আছেন। বড় মামা-মামি কি আলাদা বাণী দেবেন? তিনি কি পরিবারের সঙ্গে থাকেন না? নাকি বড় মামা মারা গেছেন। শুভেচ্ছা বাণীতে বড় মামা নেই কেন? আরেকটা নাম আছে। রনি! এই রনিটা কে? কাজিন? মামাতো ভাই। শিপ্রা মেয়েটির কি কোনো খালা নেই।

ইয়াসিন চায়ের কাপ মশারির ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে। যথারীতি গরম সিরাপ। মিসির আলি চুমুক দিলেন–তার কাছে মনে হল মিষ্টি সামান্য বেশি। তবে খেতে খারাপ না। চায়ে চুমুক দিতে দিতে মিসির আলি শিক্ষার্থীর পাতা উল্টালেন। শিক্ষার্থীর পাতা বলে আরেকটা জিনিস খবরের কাগজে চালু হয়েছে। আজ আছে ক্লাস সিক্সের বৃত্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি বিষয়ে আলোচনা। অগ্রণী গার্লস হাই স্কুলের ফার্স্ট গার্লের ইন্টারভু। ভিকারুননিসা নুন স্কুলের একজন শিক্ষিকার বৃত্তি পরীক্ষার ওপর কিছু-টিপস। মিসির আলি প্রথম পড়তে শুরু করলেন ফার্স্ট গার্ল নাজনিন বেগমের ইন্টারভ্যু–

তুমি দৈনিক কত ঘণ্টা পড়াশোনা কর?

আমি দৈনিক পাঁচ থেকে ছঘণ্টা পড়াশোনা করি।

তুমি অবসর সময়ে কী করা?

আমি অবসর সময়ে গল্পের বই পড়ি। টিভি দেখি।

তোমার পড়াশোনার পেছনে কার অনুপ্রেরণা সবচেয়ে বেশি কাজ করে?

আমার পিতা-মাতা এবং শিক্ষক-শিক্ষিকা।

তুমি কি কোনো কোচিং সেন্টারে যাও?

আমি একটি কোচিং সেন্টারে সপ্তাহে তিনদিন যাই।

তোমার সাফল্যের রহস্য কী?

আমি দিনের পড়া দিনে তৈরি করে রাখি।

তোমার বয়সী ছাত্রছাত্রীদের প্রতি তোমার কী উপদেশ?

তোমরা নিয়মিত পড়াশোনা কর।

ফার্স্ট গার্ল নাজনিন বেগমের ইন্টারভ্যু শেষ করে মিসির আলি ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শিক্ষিকার কঠিন উপদেশগুলি পড়তে শুরু করলেন। তার খানিকটা মন খারাপ হতে শুরু করেছে–তার কাছে মনে হচ্ছে সবাই বাচ্চাগুলির পেছনে লেগেছে। শিশুর স্বপ্ন, শিশুর আনন্দ কেড়ে নেবার খেলা শুরু করেছে। শিশুদের শিশুর মতো থাকতে দিলে কেমন হয়। বৃত্তি পরীক্ষা উঠিয়ে দিলে কেমন হয়ঃ পরীক্ষার ব্যাপারটা কি উঠিয়ে দেওয়া যায় না। পরীক্ষা নামের ব্যাপারগুলি রেখে অতি অল্পবয়সেই শিশুদের মাথায় একটা জিনিস আমরা ঢুকিয়ে দিচ্ছি–তোমাদের মধ্যে কেউ ভালো, কেউ খারাপ। তোমাদের মধ্যে একদল বৃত্তি পায়, একদল পায় না। তোমাদের মধ্যে একজন হয়। ফার্স্ট গার্ল নাজনিন। আরেকজন খুব চেষ্টা করেও দশের ভেতর থাকতে পারে না। যেদিন স্কুলে রেজাল্ট দেয় সেদিন সে কান্না কান্না মুখে বাড়ি ফেরে। এবং তার মা মেয়ের ওপর প্রচণ্ড রাগ করেন। এই মা-ই আবার মেয়েকে গান শেখান–আমরা সবাই রাজা, আমাদের এই রাজার রাজত্বে।

আমরা যে সবাই রাজা না, কেউ কেউ রাজা কেউ কেউ প্ৰজা, পরীক্ষা নামক ব্যবস্থাটা তা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়।

মিসির আলি পত্রিকা ভাঁজ করে রাখলেন। মশারির ভেতর থেকে বের হলেন না। সকালে মশারির ভেতর থেকে তিনি বেশ আয়োজন করে বের হন। যেন তিনি জেলখানা থেকে মুক্তি পাচ্ছেন, সারা দিন কাজকর্ম করবেন আবার রাত এগারোটা বারোটায় জেলখানায় ঢুকবেন।

কলিংবেল বাজছে।

নটা বাজে। প্রতিমা এসে পড়েছে। সে নটায় আসবে বলেছিল-ঠিক নটায় এসেছে। পাঁচ-ছমিনিট আগেই হয়তো এসেছে। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে নটা বাজার অপেক্ষা করেছে। এ ধরনের মানুষ খুব যন্ত্রণাদায়ক হয়। মিসির আলি ছোট্ট নিশ্বাস ফেললেন। মানুষের সঙ্গ তাঁর কাছে খুব আনন্দদায়ক কোনো ব্যাপার না। তিনি একা থেকে থেকে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। অন্যরা ব্যাপারটা বুঝতে পারে না।

মিসির আলির ধারণা যেসব মানুষ দীর্ঘদিন একা থাকে এবং বই পড়ে সময় কাটায় তারা অন্য রকম। মানুষকেও তারা বই মনে করে। যে বই তার পছন্দ সে লাইব্রেরি থেকে সেই বই টেনে নেয়। ঠিক একইভাবে যে মানুষটি তার পছন্দ সেই মানুষকে সে ডেকে নিয়ে আসে। কোনো মানুষ নিজে তাদের কাছে উপস্থিত হবে এটা তাদের পছন্দ না।

মিসির আলি অপ্ৰসন্ন মুখে মশারির ভেতর থেকে বের হলেন। বসার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখেন প্ৰতিমা আসে নি। বেতের চেয়ারে ফতে মিয়া বসে আছে।

স্যার কেমন আছেন?

মিসির আলি বললেন, ভালো আছি।

ফতে বলল, চলে যাচ্ছি। তো স্যার, এইজন্যে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। একটু দোয়া রাখবেন।

কোথায় যাচ্ছে?

গতকাল আপনাকে বললাম না। আমি একটা দরজির দোকান দিচ্ছি। এখন থেকে দোকানেই থাকব।

ও আচ্ছা।

আপনাকে একদিন আমার দোকানে নিয়ে যাব।

মিসির আলি ফতের সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, ঠিক আছে।

আমার একটা আবদার আছে স্যার। যদি রাখেন খুব খুশি হব।

কী অবদার? আমার দোকানের প্রথম দরজির কাজটা আপনাকে দিয়ে করবে। আপনার জন্যে একটা পাঞ্জাবি বা ফতুয়া দিয়ে দোকানের শুরু। আপনাকে কখনো ফতুয়া পরতে দেখি নাই। আপনি কি ফতুয়া পরেন?

পোশাক নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। পোশাক নিয়ে আমি তেমন ভাবি না।

স্যার আপনি কি নাশতা করেছেন?

আমিও নাশতা করি নাই। ইয়াসিনকে বলেছি আমাদের দুজনের নাশতা দিতে। শুধু পরোটা ভাজতে বলেছি। আমি বিরিয়ানি হাউস থেকে মুরগির লটপট নিয়ে এসেছি। মুরগির লটপট জিনিসটা কখনো খেয়েছেন?

না।

হোটেলে অনেক মুরগি রান্না হয় তো। সেই সব মুরগির গিলা, কলিজা, পাখনা, এইগুলো কী করবে? ফেলে তো দিতে পারে না–হোটেলওয়ালারা এইগুলো দিয়ে একটা ঝোলের মতো বানায়। এটাকে বলে লটপট। পরোটা দিয়ে লটপট খেতে খুবই সুস্বাদু।

ও আচ্ছা।

ফতে মিয়া হাসতে হাসতে বলল, সকালবেলা এসে আপনার সঙ্গে বকবক শুরু করেছি, আপনার খুব বিরক্ত লাগছে তাই না স্যার?

মিসির আলি বললেন, খুব বিরক্তি লাগছে না, তবে কিছুটা যে বিরক্ত হচ্ছি না–তা না। অকারণ কথাবার্তা বলতে আমার ভালো লাগে না।

ফতে বলল, আমি তো চলেই যাচ্ছি স্যার। এরপর আর রোজ রোজ এসে আপনাকে বিরক্ত করব না। যান হাত-মুখ ধুয়ে আসুন, একসঙ্গে নাশতা খাই! আমি স্যার গজফিতা নিয়ে এসেছি–আপনার ফতুয়ার মাপ নিব। আমি মাপ নেওয়া শিখেছি। আপনাকে দিয়ে বিসমিল্লাহ করব।

মিসির আলি অপ্ৰসন্ন মুখে বাথরুমের দিকে রওনা হলেন। ফতে মিয়া ঘণ্টাখানেক সময় নষ্ট করবে। এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। এর মধ্যে নিশ্চয়ই প্ৰতিমা চলে আসবে। সে তো আর সহজে যাবে না। বাজারটাজার নিয়ে আসবে। মহাউৎসাহে মাছ ভাজতে শুরু করবে। ঘর ধোয়া মোছা করবে। প্রতিমার কর্মকাণ্ড এখানেই শেষ হবে না। সে অবশ্যই চেষ্টা করবে তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে। বাড়াবাড়ি এই মেয়ে করবেই। মানুষের জিনের মধ্যে এমন কিছু কি আছে যা তাকে দিয়ে বাড়াবাড়ি করায়। ডিএনএ অণুতে প্রোটিনের এমন কোনো বিশেষ অবস্থান যা বাড়াবাড়ি করতে বিশেষ বিশেষ মানুষকে প্রেরণা দেয়। সেই মানুষ যখন ঘৃণা করে বাড়াবাড়ি ধরনের ঘৃণা করে। যখন ভালবাসে বাড়াবাড়ি ভালবার্সে। অনেক অসুখের মতো এটাও যে একটা অসুখ তা কি মানুষ জানে? এখন না জানলেও একদিন জানবে। কোনো ওষুধ কোম্পানি ওষুধ বের করে ফেলবে। যেসব মানুষের বাড়াবাড়ি করার রোগ আছে তারা ট্যাবলেট খেয়ে রোগ সারাবে। একসময় হুপিং কফ, পোলিওর মতো বাড়াবাড়ি। রোগেরও টিকা বের হবে। শিশুদের বয়স ছয় মাস হবার আগেই তাদের বাড়াবাড়ি প্রবণতা রোগের টিকা দেওয়া হবে। রাস্তায় রাস্তায় পোস্টার দেখা যাবে আপনার শিশুঁকে কি বাড়াবাড়ি প্রবণতার টিকা দিয়েছেন?

বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মিসির আলি বিরক্ত মুখে নিজের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর দূরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছা করছে। তাঁর যদি প্রচুর টাকা থাকত তিনি সমুদ্রের কোনো জনমানবশূন্য দ্বীপে একটা ঘর বানাতেন। আলেকজান্ডিয়ার লাইব্রেরির মতো-সেখানে তাঁর বিশাল লাইব্রেরি থাকত। তিনি দ্বীপে ঘুরে ঘুরে বই পড়তেন। ঘুম পেলে বালির ওপর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। রবিনসন ক্রুশোর আনন্দময় জীবন।

মিসির আলির চোখ-মুখ জ্বালা করছে। তিনি মুখে ঠাণ্ডা পানির ছিটা দিচ্ছেন তাতেও জুলুনি কমছে না! হঠাৎ তার খুব মেজাজ খারাপ লাগছে। এতটা মেজাজ খারাপ হবার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। তিনি সমাজে বাস করছেন। সমাজের আর দশটা মানুষের মতোই তাকে থাকতে হবে। সামাজিকতা করতে হবে। কেউ তার সঙ্গে গল্প করতে চাইলে গল্প করতে হবে। কেউ লটপট নামক বস্তু নিয়ে এসে তার সঙ্গে নাশতা খেতে চাইলে নাশতা খেতে হবে। কোনো উপায় নেই। তিনি সমাজে বাস করছেন-বাস করার মূল্য তাঁকে দিতেই হবে।

মিসির আলি বাথরুম থেকে বের হয়ে ইয়াসিনকে গরম পানি দিতে বললেন। গোসল করবেন। সকালে গোসল করার অভ্যাস তার নেই। এখন গোসলে যাওয়ার অর্থ কিছুটা সময় নিজের করে পাওয়া। ফতে তার গজফিতা নিয়ে থাকুক একা একা। একা থাকার অভ্যাস করাটাও জরুরি।

 

ফতে সিগারেট ধরিয়েছে। পা নাচাচ্ছে। সে আনন্দেই আছে। তার মুখ হাসি হাসি। সে ঠিক করেই এসেছে আজ মিসির আলি সাহেবকে সে চমকে দেবে। ছোটখাটো চমক না, বড় ধরনের চমক। ছোটখাটো চমকে এই লোকের কিছু হবে না। ছোটখাটো চমক সে দিয়ে দেখেছে। ঘড়ি না দেখে ঘড়ির সময় বলেছে। আজ তার চেয়ে বেশি কিছু করবে। সকালবেলা মিসির আলি সাহেব যখন তার সামনে এসে বসেছিলেন তখন ফত্ত্বে পরিষ্কার বুঝতে পারছিল উনার মাথায় ঘুরছে রনি নামের একজনের নাম। রনিটা কে তিনি বুঝতে পারছিলেন না। রুনির সঙ্গে শিপ্রার সম্পর্ক কী তা নিয়ে তিনি চিন্তিত। ফতে ইচ্ছা করলে এই কথাটা বলেও তাকে চমক দিতে পারত। কিংবা সে সকল নটায় যখন এসেছে তখন বলতে পারত,–নটার সময় অন্য একজনের আসার কথা। সে আসে। নি। আমি এসেছি। যার আসার কথা তার নাম প্রতিমা।

ফতে জানে সে ক্ষমতাধর একজন মানুষ। অন্যের মাথার ভেতর সে ঢুকে পড়তে পারে। ছোটবেলা থেকেই পারে। তার ধারণা ছিল সব মানুষই এটা পারে। ব্যাপারটা যে অন্যরা পারে না। শুধু সে একা পারে এটা ধরতে তার অনেক সময় লেগেছে। ক্লাস ফাইভে যখন পড়ে তখন তার হঠাৎ চিন্তা হল-সে কী ভাবছে অন্যরা তা বুঝতে পারছে না কেন? অন্যদের তো বুঝতে পারা উচিত।

ক্লাসের স্যার যখন তাকে প্রশ্ন করলেন, ফতে বল তিব্বতের রাজধানী কী?

ফতে খুবই অবাক হল। প্রশ্ন করার দরকার কী? স্যার কেন তার মাথার ভেতর ঢুকে পড়ছেন না! মাথার ভেতর ঢুকলেই তো স্যার জানতে পারতেন। তিব্বতের রাজধানীর নাম ফতে জানে না। তবে এই মুহুর্তে জানে—কারণ স্যারের মাথায় নামটা ঘুরছে। তিব্বতের রাজধানী-লাসা। এই প্রশ্নের পরে স্যার কী প্রশ্ন করতেন এটাও সে জানে। মার পরের এক্স-ফুটানের রাজধানীর নাম কী। উত্তর সালের মাথায় আছে— থিম্পু।

মানুষের মাথার ভেতর ঢুকতে পারার অস্বাভাবিক ক্ষমতা দিয়ে ফতের কোনো লাভ হয় নি। সে কিছুই করতে পারে নি। এই ক্ষমতার কারণে স্কুল জীবনটা তার মোটামুটি ভালো কেটেছে–স্যারদের মার খেতে হয় নি। প্রশংসা শুনেছে–। ইতিহাসের স্যার তো গৰ্ব করে বলতেন-ইতিহাসের সন তারিখ সব ফতের মুখস্থ। তার সমস্যা একটা পরীক্ষার খাতায় কিছু লিখতে পারে না।

ক্ষমতা পাওয়ায় ফতের লাভের চেয়ে ক্ষতিই হয়েছে। তাকে সারাক্ষণ চিন্তার ভিতর থাকতে হয়-অন্য কেউ কি আমার মাথার ভিতর ঢুকে পড়ছে! চুকে পড়লে ভয়ঙ্কর হবে। কারণ আমার মাথার ভেতর ভয়ঙ্কর সব জিনিস আছে। ফতে তার জীবনটাই কাটাল আতঙ্ক নিয়ে। কেউ অন্য রকমভাবে তার দিকে তাকালেই তার বুক ছ্যাঁৎ করে ওঠে। সর্বনাশ কি হয়ে গেল?

কেউ তার মাথার ভিতর ঢুকতে পেরেছে। এ রকম কোনো প্রমাণ তার হাতে নেই— তবে মাঝে মাঝেই সে লক্ষ করেছে তার দিকে তাকানোর সময় কেমন করে যেন তাকাচ্ছে। তার কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করছে। শিশুদের ব্যাপারে এই ঘটনাটা বেশি ঘটে। বেশিরভাগ শিশুই তাকে দেখলে কাঁদতে শুরু করে। সাধারণ কান্না না। চেঁচিয়ে বাড়ি মাত করে ফেলার মতো কান্না। তখন ফতের ভয়ঙ্কর রাগ লাগে। ইচ্ছা করে আছড়ে দিয়ে মাথাটা ফাটিয়ে ফেলতে।

আরো একজনের সঙ্গে ফতের দেখা হয়েছিল যাকে দেখে সে নিজে আতঙ্কে অস্থির হয়েছিল। ঘটনাটা এ রকম-ফাতের মামা ফতেকে দোকানে পাঠিয়েছিলেন-টুথপেষ্ট আনতে। ফতে টুথপেষ্ট কিনল। ষ্টেশনারি দোকানের পাশের সিগারেটের দোকান থেকে সিগারেট কেনার সময় হঠাৎ পাশ থেকে এক ভদ্রলোক বললেন, কিছু মনে করবেন না। আপনার নাম কী?

অপরিচিত কোনো মানুষ হঠাৎ এ ধরনের কথা বলে না। ফতে হকচকিয়ে গেল। তার বুকে ধাক্কার মতো লাগল। ঘটনা কী? লোকটা কি সব বুঝে ফেলেছে। ফতে বলল, আমার নাম ফতে।

আপনি কোথায় থাকেন?

ফতে ক্ষীণ স্বরে বলল, কেন?

আপনার বিষয়ে আমার কৌতূহল হচ্ছে এই জন্যেই জানতে চাচ্ছি।

ফতে খুব নার্ভাস হয়ে গেল। তার বুক ধড়ফড় করা শুরু হয়ে গেল। সে ইচ্ছা করলে লোকটার মাথার ভিতর ঢুকতে পারে। লোকটা কেন এ রকম প্রশ্ন করছে তা জানতে পারে—সমস্যা হচ্ছে ফতে যখন ভয় পেয়ে যায় তখন তার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। তখনো হল। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা একটা লোক। রোপা। খুতনিতে সামান্য দাড়ি আছে। শান্ত ভদ্র চেহারা। লোকটা তাকিয়ে আছে তীক্ষ্ণ চোখে। ফতে নিজেকে শান্ত করার জন্যে সিগারেট ধরাল। লোকটা বলল, আপনি কী করেন জানতে পাবি?

ফতে নিজেকে সামলে নিয়ে কঠিন গলায় বলল, আমি কী করি তা দিয়ে আপনার প্ৰয়োজন কী?

লোকটা বলল, প্রয়োজন নেই। শুধুই কৌতূহল।

ফতে বলল, এত কৌতূহল ভালো না।

এই বলেই সে আর দাঁড়াল না। হাঁটতে শুরু করল। কিছুদূর যাবার পর পেছন ফিরে দেখে লোকটা তার পেছনে পেছনে আসছে। ফতের বুক আবার ধড়ফড় করতে শুরু করল। সে দৌড়াতে শুরু করল। তখন ঐ লোকটা দাঁড়িয়ে পড়ল, তবে তাকিয়ে রইল। ফতের দিকে। দৃশ্যটা মনে পড়লেই ফতের বুক কাঁপে।

মিসির আলির ব্যাপারটা ফতে ঠিক ধরতে পারছে না। ফতেরা যে ক্ষমতা এই মানুষটার কি সেই ক্ষমতা আছে? মাঝে মাঝে মনে হয় আছে–আবার মাঝে মাঝে মনে হয় নেই। মিসির আলির মাথায় বেশিরভাগ সময়ই ফতে ঢুকতে পারে না। সন্দেহটা সেই কারণেই হয়। যতবার ফতে মিসির আলির মাথার ভিতর ঢুকেছে ততবারই সে ধাক্কার মতো খেয়েছে। লোকটা একসঙ্গে অনেক কিছু চিন্তা করছে। তিনটা-চারটা চিন্তা কোনো মানুষ একসঙ্গে করছে—এমন কারোর সঙ্গেই ফতের এর আগে দেখা হয় নি। ফতে মিসির আলির ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হতে চায়। পুরোপুরি জানতে চায় এই মানুষটারও কি তার মতো ক্ষমতা আছে?

ফতের মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে তার ক্ষমতার ব্যাপারটা মিসির আলিকে খোলাখুলি বলে। কিন্তু তার মন সায় দেয় না। লোকটাকে এটা বলে তার লাভ কী। এমন তো না যে এটা কোনো অসুখ সে অসুখ থেকে মুক্তি চায়। আগবাড়িয়ে বললে–একজন তার গোপন ব্যাপারটা জেনে ফেলবে। একজন জানা মানেই অনেকের জানা। কী দরকার।

মিসির আলির গোসল শেষ হয়েছে। তিনি এসে ফতের সামনের চেয়ারে বসেছেন। ফতে খুবই হতাশা বোধ করছে। মিসির আলির মাথার ভেতর সে ঢুকতে পারছে না। ইয়াসিন এসে পরোটা এবং বাটিতে করে মুরগির লটপট দিয়ে গেল। ফতে বলল, স্যার খান এর নাম মুরগির লটপটি।

মিসির আলি কোনো কথা না বলে খেতে শুরু করলেন। ফতে বলল, খেতে কেমন স্যার?

মিসির আলি বললেন, ভালো।

আপনার কি শরীর খারাপ? –

না শরীর খারাপ না। মেজাজ। সামান্য খারাপ। কোনো কারণ ছাড়াই খারাপ।

আমি বেশিক্ষণ থাকব না। স্যার। নাশতা খেয়ে আপনার ফতুয়ার মাপটা নিয়ে কাপড় কিনতে যাব। কী রঙের কাপড় আপনার পছন্দ?

মিসির আলি বললেন, কাপড়ের রঙ নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। শুধু কটকট না করলেই হল।

হালকা নীল রঙ কিনব স্যার?

কিনতে পার।

কাপড়ের দামটা স্যার আমি দিব। আপনি যদি কিছু মনে না করেন। শুধু দরজির খরচষ্টা। আপনি দিবেন। প্রথম ব্যবসা-বিনা টুটাকায় করা ঠিক না।

মিসির আলি বললেন, আমি দরজির খরচ দেব। কোনো অসুবিধা নেই।

আজ সন্ধ্যার মধ্যে ফতুয়া দোকানে গিয়ে ডেলিভারি নেবেন। কষ্টটা আপনাকে করতে হবে।

আচ্ছা করব। ঠিকানা রেখে যাও, আমি সন্ধ্যার পরপর যাব।

মিসির আলির নাশতা খাওয়া শেষ হয়েছে। তিনি চা খাচ্ছেন। ফতে কয়েকবার চেষ্টা করেও মিসির আলির মাথার ভেতর ঢুকতে পারল না। সে পরিকল্পনা বদলাল। লোকটাকে চমকে দেবার কোনো দরকার নেই। পরে হয়তো দেখা যাবে চমকে দিতে গিয়ে এমন কিছু ঘটল যে উল্টো সে নিজেই চমকাল। লোকটির বিষয়ে আগে সে পুরোপুরি জানবে। তারপর অন্য ব্যবস্থা।

ফতে মাপ নেবার জন্যে ফিতা বের করল। দরজিদের মতোই উঁচু গলায় মাপ বলতে বলতে কাগজে লিখে নিল।
লম্বা – ২৯
বুক – ৩৪
পুট – ৬
হাত – ১২
মুহরি – ১৬
গলা – ১৩.৫

ফতে বলল, একটু দোয়া রাখবেন স্যার দরজির কাজটা যেন তাড়াতাড়ি শিখতে পারি। খবরের কাগজে নকশা করে, খবরের কাগজ কেটে কেটে কয়েকদিন চেষ্টা করেছি আউল লেগে যায়।

মিসির আলি বললেন, সব কাজ সবার জন্যে না।

ফতে সামান্য চমকাল মিসির আলি এই কথাটা কেন বললেন। তিনি কি কিছু বুঝতে পারছেন? না এটা শুধুই কথার কথা। ফতে বলল, স্যার আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব। যদি কিছু মনে না নেন।

জিজ্ঞেস কর।

ফতে মিনমিনে গলায় বলল, আমার বিষয়ে আপনার কী ধারণা?

তোমার প্রশ্নটা বুঝতে পারছি না। আরো পরিষ্কার করে বল।

আমাকে দেখলে আপনার কী মনে হয়?

মনে হয় তুমি সব সময় আতঙ্কে আছে। সবাইকে ভয় পাচ্ছ।

ফতে মুখ শুকনা করে ফেলল। ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে উঠে পড়ল। তার মাথা ঝিমঝিম করছে। এই লোক কী করে বুঝল সে সবাইকে ভয় পায়। তার ভয় তো সে প্রকাশ করে না। নিজের ভিতর লুকিয়ে রাখে। লুকানো জিনিস সে জানল কীভাবে?

স্যার আমি যাই?

ফতুয়ার লেখা কাগজটা ফেলে গেছি। মাপটা নিয়ে যাও। লম্বার মাপে ভুল আছে-লম্বা বাইশ। তুমি মাপ নিয়েছ বাইশের বলেছ ঊনত্রিশ, লিখেছও ঊনত্রিশ।

 

মিসির আলি সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘরেই থাকলেন। প্রতিমা এল না। এতে তার টেনশন কমল মা-যে কোনো সময় চলে আসবে। এই টেনশন থেকেই গেল।

সন্ধ্যায়, ফতুয়া আনতে গেলেন। দরজির দোকান ফতে সুন্দর সাজিয়েছে। ঝলমলে বাতি জুলছে। টাকা দিয়ে মিসির আলি ফতুয়া নিলেন। দোকানের মালিক ফতে ছিল না। মিসির আলি কেমন যেন স্বস্তিবোধ করলেন। স্বস্তিবোধ করার কারণটা তার কাছে স্পষ্ট না। মিসির আলি মাথা নিচু করে হাঁটছেন। বাসায় ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে না। তার মনে ক্ষীণ সন্দেহ-বাসায় ফিরে দেখবেন প্রতিমা এসেছে। দেড়টনি একটা ট্রাক নিয়ে এসেছে। সে ট্রাকে মিসির আলির জিনিসপত্র তুলে অপেক্ষা করছে কখন মিসির আলি আসবেন।

এতটা এই মেয়ে নিশ্চয়ই করবে না, আবার করতেও পারে। অস্বাভাবিক মানুষ পারে না এমন কোজ নেই। কাউকে চট করে অস্বাভাবিক বলা ঠিক না। মানুষ স্বাভাবিক এবং অস্বাভাবিকের সীমারেখায় বাস করে। একজন স্বাভাবিক মানুষ মাঝে মধ্যে অস্বাভাবিক আচরণ করে, আবার খুবই অস্বাভাবিক মানুষ হঠাৎ স্বাভাবিক আচরণ করে। এখানেও কথা আছে-কোন আচরণগুলিকে আমরা স্বাভাবিক আচরণ বলব। স্বাভাবিকের মানদণ্ড কে ঠিক করে দেবো? মিসির আলি যে আচরণকে স্বাভাবিক ভাবছোন-ফতে মিয়া কি তাকে স্বাভাবিক ভাববে?

ভ্রূ কুঁচকে মিসির আলি ফতের কথা ভাবতে শুরু করলেন। ফতেকে কি খুব স্বাভাবিক মানুষ বলা যায়?

মিসির আলি মাথা নেড়ে নিজের মনে বললেন, হ্যাঁ বলা যায়।

মিসির আলি আবারো নিজেকে প্রশ্ন করলেন, ফতেকে কি অস্বাভাবিক বলতে চাইলে বলতে পারে?

প্রশ্ন এবং উত্তরের খেলা চলতে লাগল। কিছু দাবা খেলোয়াড় আছে সঙ্গী না পেলে নিজেই নিজের সঙ্গে দাবা খেলে—মিসির আলিও ইদানীং তাই করেন। নিজেই প্রশ্ন করেন। নিজেই উত্তর দেন। কাজটা বেশিরভাগ সময় করেন। পথে যখন হাটেন। এটাও বয়স বাড়ার কোনো লক্ষণ কি না। তিনি জানেন না। একটা বয়সের পর সবাই কি এ রকম করে? করার কথা।

মিসির আলির নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলার নমুনা এ রকম—

প্রশ্ন : ফতের কোন আচরণটা সবচেয়ে অস্বাভাবিক?

উত্তর : সে ভীতু প্রকৃতির মানুষ। ভয়ে সে অস্থির হয়ে থাকে। ভীতু মানুষরা কারো চোখের দিকে সরাসরি তাকায় না। আর তাকালেও খুব অল্প সময়ের জন্যে তাকায়। এ ধরনের মানুষ বেশিরভাগ সময় মেজের দিকে তাকিয়ে কথা বলবে। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ফতে সব সময় চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

প্রশ্ন : সে কেন চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে?

উত্তর : হয়তোবা চোখের ভাষা পড়তে চায়। হয়তো সে চোখের ভাষা সহজে বুঝতে পারে।

প্রশ্ন : তোমার এই হাইপোথিসিস কীভাবে প্রমাণ করা যাবে?

উত্তর : খুব সহজেই প্রমাণ করা যায়! চোখে সানগ্লাস পরে তার সামনে বসতে হবে। সানগ্লাসের কারণে তার চোখ দেখা যাবে না। কাজেই ফতে আর চোখের দিকে তাকাবে না।

প্রশ্ন : আর কোনো পদ্ধতি আছে?

উত্তর : একজন জন্মান্ধের সঙ্গে তাকে কথা বলতে দিয়ে দেখা যেতে পারে।

প্রশ্ন : তার অস্বাভাবিকতার আর কোনো উদাহরণ কি আছে?

উত্তর : হ্যাঁ আছে। বড় একটা উদাহরণ আছে।

প্রশ্ন : ফল শুনি।

উত্তর : না এখন বলব না। আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে নিই।

প্রশ্ন : কী আশ্চর্য তুমি যা বলার আমাকেই তো বলছি। আমি তো বাইরের কেউ না।

উত্তর : যে প্রশ্ন করছে এবং যে উত্তর দিচ্ছে তারা একই ব্যক্তি হলেও আলাদা সত্তা। একটি সত্তা অন্য সত্তার থেকে নিজেকে আলাদা রাখতে চাইতেই পারে।

মিসির আলি ঘড়ি দেখলেন সাড়ে সাতটা বাজে। প্রায় দেড় ঘণ্টা তিনি হেঁটেছেন-কোনো এক চিপা গলির ভেতর ঢুকে পড়েছেন। জায়গাটা চিনতে পারছেন না। একজনকে জিজ্ঞেস করলেন—ভাই এই জায়গাটার নাম কী? সে এমনভাবে তাকাল যেন খুব গৰ্হিত কোনো প্রশ্ন তিনি করে ফেলেছেন। জবাব না দিয়ে সে চলে গেল। আরেকজনকে একই প্রশ্ন করলেন, সে নিতান্তই বিরক্ত গলায় বলল, জানি না।

অদ্ভুত এক গলি, তার চোখের সামনে দিয়ে কালো রঙের প্রকাণ্ড এক শূকর কয়েকটা বাচ্চা নিয়ে চলে গেল। মেথরপট্টিতে শূকর পোষা হয় এই জায়গাটা নিশ্চয় মেথরপট্টি না। তিনি কোথায় এসে পড়েছেন?

 

রাত নটা।

ফতে মিয়াকে নিউমার্কেটের কাঁচাবাজারে ঘোরাফেরা করতে দেখা যাচ্ছে। সে এসেছে মুরগি কিনতে। সে চারটা রোষ্টের মুরগি কিনবে। ফতের মামির কিছু বান্ধবী কাল দুপুরে খাবে। মামি রাতেই রোষ্ট রোধে ফেলতে চান।

ফতে দাঁড়িয়ে আছে–বড় মাছের দোকানোর সামনে। বিশাল চকচকে বঁটি দিয়ে মাছ কাটা হয়–বঁটির গা বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ে। কী অসাধারণ দৃশ্য! ফতের দেখতে ভালো লাগে। দৃশ্যটা দেখার সময় মেরুদণ্ড দিয়ে শিরশির করে কী যেন বয়। শরীর ঝন ঝন করতে থাকে। ফতের বড় ভালো লাগে। মাছটা যদি জীবিত হয় তখন তার আরো ভালো লাগে। আজ একটা কাতল মাছ কাটা হচ্ছে। মাছটা জীবিত ছটফট করছে। আহা কী দৃশ্য!

মাছ কাটা দেখে। ফতে গেল মুরগি কিনতে। ফতে মনের ভেতর চাপা আনন্দ অনুভব করছে। জীবিত মুরগিগুলিকে জবেহ করা হবে। জবেহ করার ঠিক আগে মুরগিগুলি আতঙ্কে অস্থির হয়ে ছটফট করতে থাকে, তখনো ফতের ভালো লাগে। ফতে ঠিক করেছে মুরগি জবেহ করার সময় সে বলবে মাথাগুলি যেন পুরোপুরি শরীর থেকে আলাদা করা হয়। খুব ছোটবেলায় একবার সে এই দৃশ্য দেখেছিল। বাড়িতে মেহমান এসেছেমুরগি জবেহ হচ্ছে। ধারালো বঁটি দিয়ে টান দিতেই মুরগির মাথাটা শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেল। যে মুরগি ধরে ছিল সে হাত ছেড়ে দিল। কী আশ্চৰ্য মাথা ছাড়া মুরগিটা তিন-চার পা এগিয়ে গিয়ে ধাপ করে পড়ে গেল। এই দৃশ্য এর পরে ফতে আর দেখে নি। যতবারই মুরগি কাটা হয়—ফতে আগ্রহ নিয়ে এই দৃশ্য দেখার জন্যে বসে থাকে। সে নিশ্চিত একসময় না একসময় সে দৃশ্যটা দেখবে। কে জানে কপাল ভালো হলে হয়তো আজই দেখবে। আজ তার জন্যে শুভদিন। নিজের দোকান চালু হয়েছে।

ফতে মুরগি কাটতে দিয়ে নিচুগলায় বলল, মুরগির মাথা পুরাটা আলগা করে ফেলেন।

মুরগি কাটার লোক বলল, বুঝলাম না কী কন।

ফতে বলল, এক পোচ দিয়ে মাথা আলাদা করে ফেলেন।

লোকটা আপত্তি করল না। যা বলা হল তাই সে করল। ছোটবেলার ঘটনোটা ঘটল না। মাথাবিহীন কোনো মুরগি দৌড় দিল না। ফতে আফসোসের ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল। এ ধরনের মজাদার ঘটনা রোজ রোজ ঘাটে না। হঠাৎ হঠাৎ ঘটে।

মুরগির কাটা মাথাগুলি ফতে আলাদা করে পলিথিনের ব্যাগে নিয়ে নিল। কাটা মাথাগুলি নিয়ে একটা মজা করা যাবে। যে বেবিট্যাক্সিতে করে সে বাড়িতে ফিরকেমুরগির কাটা মাথাগুলি সেই বেবিট্যাক্সির সিটে রেখে দেবে। সিটের উপর রক্তমাখা মাথা রেখে ফাঁতে নেমে যাবে। পরে যে যাত্রী উঠবে সে বসতে গিয়ে ভয়ে ভিরমি খাবে। চিৎকার–চোঁচামেচি করবে। ফতের ভাবতেই ভালো লাগছে। এই সময় সে কাছে থাকবে না এটাই একটা আফসোস।

ফতে বেবিট্যাক্সি বাড়ি পর্যন্ত নিল না, বাড়ির কাছাকাছি এসে ছেড়ে দিল। বেবিট্যাক্সিওয়ালাকে বাড়ি চেন্নানো মোটেই ঠিক হবে না। কেন সে মুরপির মাথা সিটে রেখেছে তা নিয়ে দরবার করতে পারে। এই সব সূক্ষ্ম কাজ খুব ঠাণ্ডা মাথায় করতে হয়। সামান্য উনিশ-বিশও করা যায় না। ফতে এই কাজগুলি ঠাণ্ডা মাথায় করে বলেই এখনো টিকে আছে। কেউ তাকে ধরতে পারে নি। কোনোদিন পারকেও না।

চারটা মুরগি নিয়ে ফতে রওনা হয়েছে। তার বেশ মজা লাগছে। সে কল্পনায় দেখতে পাচ্ছে তার পরে বেবিট্যাক্সিতে যে উঠবে তার দশটা কী হবে। ধরা যাক স্বামীস্ত্রী উঠেছে। প্রথমে উঠল। স্ত্রী। সে বসতে গিয়ে বলল, কিসের ওপর বসলাম গো? স্বামী বলল, তুমি সব সময় যন্ত্রণা কর! স্ত্রী বলল, হাতে যেন রসের মতো কী লাগল। এর মধ্যে স্বামী এসে উঠেছে। দেয়াশলাই জ্বালিয়ে আঁতকে উঠেছে-হতভম্ব গলায় বলছে সর্বনাশ শত শত মুরগির মাথা। কোত্থেকে আসল?

চারটা মুরগির মাথাই তখন তাদের কাছে শত শত মুরগির মাথা বলে মনে হবে। ভয় পেলে এ রকম হয়।

ফতে ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে ভাবল মুরগির মাথা না হয়ে যদি মানুষের মাথা হত তখন কেমন হত! চারটা মাথার তখন প্রয়োজন নেই। একটা কাটা মাথাই যথেষ্ট। সিটের এক কোনায় কাটা মাথাটা পড়ে আছে। অন্ধকার বলে সবকিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। যাত্রী উঠিল। বেবিট্যাক্সি চলা শুরু করেছে। যাত্রী বলল, কে যেন ব্যাগ নাকি ফেলে গেছে। বলেই সে হাত দিয়ে জিনিসটা তুলল। এরপর যে নাটক হবে তার কোনো তুলনা নেই। এই নাটক কল্পনায় দেখলে হবে না। এই নাটক দেখতে হবে বাস্তবে। বেবিট্যাক্সি নিয়ে ফতেকেই বের হতে হবে। যাত্রী যখন কাটা মাথাটা হাত দিয়ে তুলে ধরে হতভম্ব গলায় বলবে—এটা কী? তখন ফতে খুব স্বাভাবিক গলায় বলবে, এটা একটা ছোট বাচ্চার কাটা মাথা। সাইডে রেখে দেন।

ভাবতেই গা যেন কেমন করছে। মেরুদণ্ড দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে। শরীর ঝলমল করছে।

কাজটা করতে হবে। একটা কাটা মাথা নিয়ে বের হতে পারলে অনেক মজা করা যাবে। হয়তো আত্মভোলা টাইপ কোনো যাত্রী উঠেছে। সিটের কোনায় কী পড়ে আছে সে তাকিয়েও দেখছে না। তাকে সে বলল, স্যার সিটের কোনায় ছোট বাচ্চার একটা কাটা মাথা আছে! একটু খেয়াল রাখবেন মাথাটা যেন পড়ে না যায়।

কিংবা ধরা যাক খুব সাহসী কোনো যাত্রী এসেছে। সে প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বলল, এই বেবি থামাও। গাড়ির ভেতর মানুষের মাথা কেন? কোত্থেকে এসেছে। চল থানায় চল।

সে তখন খুবই বিনীত গলায় বলবে, মাথাটা স্যার আমি এনেছি। শুক্রবাদ থেকে আরেকটা মাথা তুলে ডেলিভারি দিতে হবে। মাল দুটা ডেলিভারি দিয়ে আপনার সঙ্গে থানায় যাব। কোনো সমস্যা নেই।

ফতের চোখ চকচক করছে। কল্পনা করতেই এত আনন্দ। আসল ঘটনার সময় নাজানি কত আনন্দ হবে।

আসল ঘটনার খুব দেরিও নেই। নকল ঘটনা ঘটতে ঘটতে আসল ঘটনা ঘটে। তার জীবনে সব সময় এ রকমই হয়েছে। অতীতে যেহেতু হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। কোনো এক বর্ষার রাতে দেখা যাবে মাফলার দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে সে বেবিট্যাক্সি নিয়ে বের হয়েছে। সেই বেবিট্যাক্সির প্রাইভেট লেখা সাইনবোর্ড সে খুলে ফেলেছে। এখন তারটা সাধারণ ভাড়ার বেবিট্যাক্সি। ফার্মগেট থেকে যাত্রী তুলেছে, যাবে উত্তরায়। মোটামুটি ফাঁকা রাস্তা। স্বামী-স্ত্রী এবং ছোট একটা বাচ্চা। বাচ্চাটাই প্রথম দেখল। সহজ, গলায় মাকে বলল-মা এটা কী?

ফতের মামি তসলিমা খানম ফতেকে দেখেই রেগে উঠলেন। ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, চারটা মুরগি কিনতে এতক্ষণ লাগে? তুমি কি ডিমে তা দিয়ে মুরগি ফুটিয়ে এনেছ?

ফতে কিছু বলল না। বলার কিছু নেই। সে যদি পাঁচ মিনিটের মধ্যে চলে আসত–তা হলেও তসলিমা খানম চোঁচামেচি করতেন। অন্য কোনো প্ৰসঙ্গ নিয়ে চোঁচামেচি। তখন হয়তো বলতেন-বুড়া মোরগ কোত্থেকে এনেছি? এটা কি রোষ্টের মুরগির সাইজ। রোষ্টের মুরগির যে মিডিয়াম সাইজ হয় তুমি জান না। নাকি জীবনে কখনো রোষ্ট খাও নি। তোমাকে কি রোষ্ট কোনোদিন দেওয়া হয় না। আবার বেয়াদবের মতো চোখে চোখে তাকিয়ে আছ কেন?

মামির চোঁচামেচিকে ফতে গ্রাহ্য করে না। কিন্তু ভাব করে যেন খুব গ্রাহ্য করছে। ভয়ে বুক কাঁপছে। এই অভিনয় সে ভালোই করে শুধু একটাই সমস্যা তাকে তাকিয়ে থাকতে হয়। চোখের দিকে না তাকালে সে মাথার ভেতর ঢুকতে পারে না। সমস্যা হচ্ছে চোখের দিকে তাকালেই লোকজন মনে করে সে বেয়াদবি করছে।

তসলিমা খানমের মাথার ভেতর ঢোকা ফতের জন্যে খুব সহজ। হুট করে ঢুকে যাওয়া যায়। তবে খুব সাধারণ একটা মাথা। ঢুকে কোনো আনন্দ নেই। এই মহিলার সমস্ত চিন্তাভাবনা সংসার নিয়ে। আজ কী রান্না হবে। ঘর কোথায় নোংরা। ধোপাখানা থেকে কাপড় আনতে হবে। সবুজ রঙের বিছানার চাদরটা কি শেষ পর্যন্ত হারিয়ে গেল। কাজের বুয়া চুরি করে নি তো। এই মহিলার চিন্তাভাবনার মধ্যে শুধু একটাই মজার ব্যাপার আছে–খায়রুল কবির নামের একজন আধাবুড়ো মানুষ। এই আধাবুড়ো লোকটাকে এই মহিলা ডাকেন—বড়দা। আধাবুড়োটা তাকে ডাকে পুটুরানী। আধাবুড়ো শয়তানটা বিয়ে করে নি। সে বাসাবের একটা দোতলা বাড়িতে থাকে। ফতে কোনোদিন সে বাড়িতে যায় নি। তবে বাড়িটা কোথায়, কেমন সব জানে। কোন ঘরে কী ফার্নিচার তাও সে বলতে পারবে। কারণ ঐ বাড়িটা তসলিমা খানমের মাথায় খুব পরিষ্কারভাবে আছে। তসলিমা খানম স্কুলে পড়ার সময় থেকে ঐ বাড়িতে যেতেন। বিয়ের পরেও যান। আধাবুড়ো শয়তানটা তখন তাকে পুটুরানী, পুটুরানী করে খুবই নোংরাভাবে আদর করা শুরু করে। একসময় পুটুরানী বলে, বড়দা এ রকম করলে আমি কিন্তু আর আসব না। তুমি একা একা থাক বলে মাঝে মাঝে তোমাকে দেখতে আসি, তুমি এসব কী করা। বুড়োটা বলে-আচ্ছা যা আর আসতে হবে না। পুটুরানী তখন বলে, দরজাটা বন্ধ করা। দরজা তো খোলা। বুড়োটা বলে, তোর বন্ধ করতে ইচ্ছা হলে তুই কর। পুটুরানী বলে, কে না কে দেখবে। বুড়ো বলে, দেখুক যার ইচ্ছা।

ফতের মাঝে মাঝে ইচ্ছা করেছে বুড়োর কথা বলে হঠাৎ সে তার মামিকে চমকে দেয়। যেমন সে খুব সহজ গলায় বলল, মামি বুধবার যে আপনার বড়দার কাছে যাওয়ার কথা, আপনি যাবেন না?

এটা করা ঠিক হবে না। তখন তার আশ্ৰয় নষ্ট হয়ে যাবে। মামি তৎক্ষণাৎ তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবেন। তবে এখন যদি সে চায় তা হলে এই কাজটা করতে পারে। এখন বাড়ি থেকে বের করে দিলেও তার থাকার জায়গা আছে। সাজঘরে বিছানা পেতে শুয়ে থাকবে। এখন পুটুরানীর বিষয়টা নিয়ে মজা করা যায়। মজাটা এমনভাবে করা যেন কেউ ধরতে না পারে মজার পেছনে সে আছে।

ফতের আবার বাজারে যেতে হচ্ছে। গরম মশলা এনে বাসায় ঢ়োক মাত্র মামি বললেন, টক দই আন নি কেন? তিনটা মাত্র জিনিস আনতে পাঠালাম এর মধ্যে একটা ভুলে গেলে। তখন ফতে যদি বলে, টক দইয়ের কথা। আপনি বলেন নি তা হলে মামি খুবই রেগে যাবেন! আবার ফতে যদি নিজ থেকে টক দই নিয়ে আসে তা হলেও মামি রাগ করবেন। গলার রগ ফুলিয়ে বলবেন, আগবাড়িয়ে তোমাকে কে দই আনতে বলেছে? সব সময় মাতন্ত্বরি কর কেন? আলগা মাতব্বরি করবে না।

বাজারে যাবার সময় ফতে দেখল-সিঁড়ির গোড়ায় লুনা বসে আছে। একা একা খেলছে। হাতের আঙুল একবার খুলছে একবার বন্ধ করছে। এটা লুনার বিশেষ ধরনের খেলা এবং খুবই পছন্দের খেলাটা সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খেলতে পারে।ফতে তার কাছে এগিয়ে বলল-পুঁটুরানী পুটুরানী।

লুনা চোখ তুলে তাকাল। মিষ্টি করে হাসল। ফতে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল-পুঁটুরানী, পুটুরানী, পুটুরানী।

এইবার লুনা ফিসফিস করে বলল, পুটুরানী।

ফতে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। কাজ হয়েছে। এখন লুনা নিজের মনেই পুটুরানী পুঁটুরানী করতে থাকবে। ফতের মামি ব্যাপারটা খুব সহজভাবে নিতে পারবেন না। লুনার কপালে আজ দুঃখ আছে। চড়থাপ্নড় অবশ্যই খাবে। ভাবতেই ফতের মজা লাগছে। লুনার চড়থাপ্লড়ের চেয়ে মজার দৃশ্য হবে পুটুরানী পুটুরানী শুনে তসলিমা খানম কী করেন সেটা। এই মজার দৃশ্য ফতে দেখতে পাবে না। কী আফসোস!

স্যার কেমন আছেন

 

স্যার কেমন আছেন?

প্রশ্নের জবাব দেবার আগে মিসির আলি দেয়ালঘড়ির দিকে তাকালেন। সকাল নটা। দেয়ালঘড়িটা আধুনিক ইলেকট্রিক্যাল ঘড়ি না হয়ে পুরোনো দিনের পেন্ডুলাম ঘড়ি হলে ঢং ঢেং করে নটা ঘণ্টা বাজাতে শুরু করত। মিসির আলি শুকনো গলায় বললেন, ভালো আছি। প্রতিমা তুমি কেমন আছ?

ফাক নাম তা হলে মনে আছে। আমি ভাবলাম আবার বোধহয় প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। আমার পরিচয় দিতে হবে। কেন আমার নাম প্ৰতিমা ব্যাখ্যা করতে হবে।

মিসির আলি মনে মনে ভাবলেন-মেয়েটা আগে এত কথা বলত না। এখন বলছে কেন?

প্রতিমা বলল, স্যার এখন বলুন আমাকে দেখে কি রাগ লাগছে?

না।

বিরক্তি লাগছে।

বুঝতে পারছি না।

প্রতিমা বলল, আমাকে দেখে আসলে আপনি খুশি হয়েছেন। আপনি বুঝানোর চেষ্টা করছেন যে বিরক্ত হয়েছেন–আসলে তা-না। স্যার ঠিক বলেছি?

আনন্দে এবং উৎসাহে প্রতিমা ঝলমল করছে। আজ তাকে আরো সুন্দর লাগছে। মিসির আলি তাকিয়ে দেখলেন। বসার ঘরে দুটা বড় বড় সুটকেস। এই সুটকেস প্রতিমাই নিয়ে এসেছে। সুটকেস কেন এনেছে কে জানে। মিসির আলি বললেন, যেদিন আসার কথা ছিল সেদিন আস নি। আস নি কেন?

প্রতিমা বলল, আপনি বলুন কেন আসি নি। আপনি হচ্ছেন্ন দ্য গ্রেট মিসির আলি। আমার দিকে তাকিয়েই আপনার বলে দেওয়া উচিত কেন আসি নি। বসার ঘরে দুটা সুটকেস, কেন এনেছি বলুন তো? দেখব। আপনি আগের মিসির আলি আছেন না বয়স হবার কারণে আপনার আগের ডিটেকটিভ ক্ষমতা কমে গেছে।

মিসির আলি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি ছটফট করছ, কেন? বস।

প্রতিমা বলল, আপনিইবা আমাকে দেখে এত অস্থির হচ্ছেন কেন? আপনিও বসুন।

মিসির আলি বসলেন। প্ৰতিমা বলল-আমি বলেছিলাম নটার সময় আসব। আমি ঠিকই এসেছিলাম। নটা বাজার আগেই গেটের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। ঠিক নটার সময় ঢুকব এই হচ্ছে আমার প্ল্যান। নটা বাজতেই প্ল্যান বদলালাম। ঠিক করলামআপনার কাছে যাব না, যাতে সারা দিন আপনি মনে মনে অপেক্ষা করেন। তাই করেছিলেন না?

হ্যাঁ।

তার পরদিন এলাম না। তার পরদিনও না। এটা করলাম-যাতে অপেক্ষা করতে করতে আপনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন। বলুন আপনি ক্লান্ত হয়েছেন না?

খানিকটা হয়েছি।

এবং একসময় আপনার নিশ্চয়ই মনে হওয়া শুরু হয়েছে–আচ্ছা মেয়েটা আসছে। না কেন-ওর কী হয়েছে। বলুন। এ রকম হয়েছে না?

হ্যাঁ হয়েছে।

আমি এই অবস্থাটা আপনার ভেতর তৈরি করার চেষ্টা করেছি। সত্যি করে বলুন, পেরেছি কি না।

হ্যাঁ পেরেছি।

প্রতিমা হাসি হাসি মুখে বলল-ঐ দিন আমার ওপর আপনি খুবই বিরক্ত হচ্ছিলেন। আমি আপনাকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাব এটা ভেবে আপনি আতঙ্কে অস্থির হয়েছিলেন। আমার খুবই খারাপ লেগেছিল। তখনই ঠিক করেছিলাম আমি এমন অবস্থা তৈরি করব যাতে আপনি খুব আগ্রহ নিয়েই আমার সঙ্গে থাকতে আসেন।

তোমার কি ধারণা সে রকম অবস্থা তৈরি করতে পেরেছ?

না এখনো পারি নি। তবে এখন আর আপনি আমাকে আগের মতো অপছন্দ করছেন না।

সুটকেসে কী?

সুটকেসে কিছু না। খালি সুটকেস। আপনার বইগুলি আজ। আমি সুটকেসে ভরে সঙ্গে করে নিয়ে যাব। প্রথম দিন বই, তারপর জামাকাপড়, তারপর বাসনকোসন এইভাবে ঘর খালি করব। সব শেষের দিন। আপনি যাবেন! আমি আপনাকে নিয়ে যাব না, আপনি নিজ থেকে যাবেন।

বল কী?

প্রতিমা খিলখিল করে হাসছে। মনে হচ্ছে সে খুবই মজা পাচ্ছে। মেয়েটার হাসি শুনে মিসির আলির বুক ধড়ফড় করতে লাগল। এই মেয়ে হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে সে যা করবে বলছে তা সে করবে।

প্রতিমা গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, স্যার শুনুন–আপনার শোবার ঘরে যেখানে আপনার বিছানা করেছি। সেখানে বিশাল একটা জানালা আছে। আপনি সরক্ষণ অরকাশ দেখতে পারবেন।

আমি সারাক্ষণ আকাশ দেখতে চাই এটা তোমাকে কে বলল?

 

কেউ বলে নি। আমি জানি। আপনার একটা ইচ্ছা হল-মৃত্যুর সময় আপনি আকাশ দেখতে দেখতে মারা যাবেন।

আমি আকাশ দেখে মক্কাতে চাই তোমাকে কে বলল?

কেউ বলে নি। আমি বুঝতে পেরেছি।

মিসির আলি অবাক হয়ে বললেন, কীভাবে বুঝতে পেরেছ?

প্রতিমা হতাশ গলায় বলল, স্যার আপনার হয়েছে কী? আমি যে মনের কথা বুঝতে পারি আপনি তো সেটা জানেন। খুব ভালো করে জানেন। এই নিয়ে আপনি অনেক পরীক্ষাটরীক্ষাও করেছেন–এখন মনে করতে পারছেন না কেন?

বুঝতে পারছি না, কেন মনে করতে পারছি না।

আপনার কি আলজেমিয়ারস ডিজিজ হয়েছে? আমার ধারণা তাই হয়েছে। নেপাল থেকে আমি আপনাকে পশমি চাদর এনে দিলাম। আপনাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলাম–সব সময় এই চাদর ব্যবহার করবেন। আপনি ঠিকই এই চাদর ব্যবহার করছেন। কিন্তু আমি যে চাদরটা দিয়েছি। এটা ভুল মেরে বসে আছেন। কেন স্যার?

মিসির আলি জবাব দিলেন না। মেয়েটা সত্যি কথাই বলছে-এর বিষয়ে তার কিছুই মনে নেই। মেয়েটি সম্পর্কে যাবতীয় স্মৃতি মস্তিষ্ক মুছে ফেলেছে। ব্যাপারটা রহস্যময়। প্রতিমা সম্পর্কে জানার জন্যে তিনি তাঁর পুরোনো ফাইল ঘেঁটেছেন। প্রতিটি কেইস হিস্ট্রির ফাইল তার আলাদা করা। সেখানে প্ৰতিমার কেইস হিস্ট্রি থাকার কথা—অথচ নেই। পাঁচটি পাতা ফাইল থেকে ছেঁড়া হয়েছে। যে ছিঁড়েছে সে যে খুব সাবধানে গুছিয়ে ছিঁড়েছে তাও না—টেনে ছিঁড়েছে।

প্রতিমা বলল, স্যার এই মুহূর্তে আপনি কী ভাবছেন বলি?

বল।

এই মুহুর্তে আপনি ভাবছেন-পাতাগুলি কে ছিঁড়ল?

মিসির আলি চমকে উঠলেন। প্রতিমা হাসতে হাসতে বলল, আপনি এত চমকে গেলেন কেন? আমি যে মানের কথা ধরতে পারি। তার প্রমাণ অনেকবার আপনাকে দিয়েছি। অথচ আপনি এমনভাবে চমকেছেন যেন প্রথমবার দেখলেন।

ইয়াসিন দু কাপ চা নিয়ে ঢুকেছে। প্রতিমা তার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বলল, তুমি চা বানিয়ে নিয়ে এসেছি কেন? আমি না তোমাকে বললাম তুমি পানি গরম করে আমাকে খবর দেবে আমি চা বানিয়ে দেব। কি বলি নি?

বলছেন।

আর কখনো এই ভুল করবে না।

ইয়াসিন মুখ ভোঁতা করে দাঁড়িয়ে রইল। প্রতিমা কড়া গলায় বলল, যা হাঁদারামের মতো দাঁড়িয়ে থাকবি না।

ইয়াসিন চলে গেল। প্রতিমা এমনভাবে কথা বলছে যেন সে এ বাড়ির কান্ত্রী। বাড়ির দেখাশোনা, সংসার চালানোর সব দায়িত্ব তার একার। মিসির আলি চায়ে চুমুক দিলেন। প্রতিমা বলল, স্যার আপনি কি নিজের হাতের লেখা চিনতে পারবেন? নাকি নিজের হাতের লেখাও ভুলে গেছেন।

মিসির আলি বললেন, হাতের লেখা চিনব।

পঞ্চাশ টাকার স্ট্যাম্পে আপনাকে দিয়ে কিছু কথা লিখিয়ে নিয়েছিলাম। মনে আছে?

দলিল সঙ্গে নিয়ে এসেছি। চা শেষ করে দলিলটা দেখুন। চা খেতে খেতে দলিল দেখলে সমস্যা আছে।

কী সমস্যা?

আপনি বিষম খাবেন। চা শ্বাসনালি দিয়ে ঢুকে সমস্যা তৈরি করবে।

ভয়ঙ্কর কিছু কি লিখেছি?

আপনার কাছে ভয়ঙ্কর মনে হতে পারে। নিন দেখুন। শুধু পড়ার সময় চায়ে চুমুক দেবেন না।

মিসির আলি দলিল পড়ছেন। হাতের লেখা তার। কালির কলমে লেখা। লেখা দেখে কোন কলামটা ব্যবহার করেছেন সেটাও মনে পড়েছে। ওয়াটারম্যান কলম। ইয়াসিনের আগে যে ছেলেটা কাজ করত। সে অনেক জিনিসপত্রের সঙ্গে তার এই শখের কলামটাও চুরি করে নিয়ে যায়। দলিলে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা–

আমি মিসির অ্যালি

সজ্ঞানে, সুস্থ মস্তিষ্কে নিম্নলিখিত অঙ্গীকার করছি।

ক. আমার চিকিৎসাধীন রোগী প্রতিমার (ভালো নাম আফরোজা বানু) সঙ্গে জীবনের একটি অংশ কাটবে। সে যখন আমাকে তার সঙ্গে থাকতে ডাকবে তখনই আমি তাতে রাজি হব।

খ. প্রতিমার (আফরোজা বানু) সঙ্গে বিবাহ নামক সামাজিক প্রথার ভেতর দিয়ে যেতেও আমার কোনো আপত্তি নেই।

অস্বীকারনামার শেষে ইংরেজি ও বাংলায় মিসির আলির দস্তখত। তারিখ দেওয়া আছে। ছবছর আগের একটা তারিখ।

প্রতিমা দলিলটা মিসির আলির হাত থেকে নিয়ে তার হ্যান্ডব্যাগে রাখতে রাখতে বলল-দলিল পড়ে। আপনি কি চমকেছেন?

মিসির আলি জবাব দিলেন না।

প্ৰতিমা বলল, দলিলটা যে আপনার হাতেই লেখা, এ বিষয়ে কি আপনার কোনো সন্দেহ আছে?

মিসির আলি বললেন, সন্দেহ নেই।

প্রতিমা মিটমিটি হাসতে হাসতে বলল, তা হলে কী দাঁড়াচ্ছে-আপনি আমার সঙ্গে যাচ্ছেন? এই মুহুর্তে আমি আপনাকে বিয়ের জন্যে চাপ দেব না! একসঙ্গে এতটা টেনশন আপনার সহ্য হবে না। আপাতত আমার সঙ্গে থাকলেই হবে।

মিসির আলি চুপ করে রইলেন।

প্রতিমা বলল-কথা বলুন। মুখ পুরোপুরি সিল করে রাখলে হবে কীভাবে? বইগুলি বের করে দিন, আমি ব্যাগে গুছাতে থাকি।

মিসির আলি বললেন, আমাকে কিছু দিন সময় দাও।

প্রতিমা শান্ত গলায় বলল, কতদিন সময় চান?

সাত দিন।

সাত দিন সময় চাচ্ছেন কী জন্যে?

চিন্তা করার জন্যে।

কী চিন্তা করবেন?

আমি আমার মতো করে চিন্তা করব।

ঠিক আছে সাত দিন চিন্তা করুন। সাত দিন পর আমি এসে আপনাকে নিয়ে शांद!

তোমাকে নিয়ে যেতে হবে না। তুমি তোমার ঠিকানা রেখে যাও। সাত দিন পর আমি নিজেই উপস্থিত হব।

প্ৰতিমা শান্ত গলায় বলল, না। আমি আপনাকে নিয়ে যাব। ব্যাগ থাকল, আমি উঠলাম। ভুলে যাবেন না, আগামী সোমবার।

 

ইয়াসিন দরজা ধরে চোখ গোল করে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টি মিসির আলির দিকে। মানুষটা ছটফট করছে। কেন ছটফট করছে সে বুঝতে পারছে না, তবে তার ধারণা একটু আগে যে মেয়েটা এসেছিল তার সঙ্গে এর কোনো যোগ আছে। ব্যাপারটা ইয়াসিনের ভালো লাগছে না। সে তার ছোট জীবনে লক্ষ করেছে। নিরিবিলি সংসারে কোনো একটা মেয়ে উপস্থিত হলেই সব লণ্ডভণ্ড হতে শুরু করে। তার নিজের বাবার সংসারেও একই ঘটনা ঘটেছে। সে এবং তার বাবা সুখেই ছিল। একসঙ্গে ভিক্ষা করত। রাতে ঘুমানোর জন্যে সুন্দর একটা জায়গাও তাদের ছিল। বাবাকে জড়িয়ে ধরে সে ঘুমোত। বাবা গুটুর গুটুর করে কত মজার গল্প করত। তার বাবার ভিক্ষুক জীবন বড়ই রোমাঞ্চকর। হঠাৎ তাদের সংসারে এক কমবয়সী ভিখারিনি উপস্থিত হল। সেও তাদের সঙ্গে ভিক্ষণ করা শুরু করল। এরপর থেকে বাবা আর তার ছেলেকে দেখতে পারে না। কারণে-অকারণে ধমক। একদিন তাকে এমন এক ধাক্কা দিল যে সে একটু হলেই ট্রাকের নিচে পড়ত।

এই সংসারেও একই ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। মেয়েটা ঢুকে পড়েছে। এখনই কেমন মাতিবরি শুরু করেছে–পানি গরম করে আমাকে ডাকবি। চা বানাবি না। চা আমি এসে বানাব। শখ কত। তুমি চা বানাবে কেন? আমি কি বানাতে পারি না? এই মেয়েকে শিক্ষা দেবার ক্ষমতা ইয়াসিনের আছে। মেয়েকে শিক্ষা দেবার জিনিস তার ব্যাগেই আছে। শিক্ষা দেবার ভয়ঙ্কর জিনিসটা সে আসলে যোগাড় করেছিল তার বাবার সঙ্গে যে মেয়েটা ঘোরে তাকে শিক্ষা দেবার জন্যে। সেই সুযোগ তার খুব ভালোই আছে। বাবা মনে কষ্ট পাবে এমন কাজ ইয়াসিন কোনোদিন করবে না। আসমান থেকে ফেরেশতা নেমেও যদি বলে-ইয়াসিনরে কাজটা করা। তোর আখেরে মঙ্গল হবে। তবু সে কাজটা করবে না। তার বাবার মনে কষ্ট হয় এমন কিছু করা তার পক্ষে সম্ভব না।

মিসির আলি নামের মানুষটার মনে কষ্ট হয় এমন কিছুও সে করতে পারবে না। এই মানুষটাও পেয়ারা মানুষ। তবে প্রতিমা নামের মেয়েটার কিছু হলে মিসির আলির যাবে আসবে না। কারণ উনি মেয়েটাকে পছন্দ করেন না। উনি যে ছটফট করছেন—

মেয়েটার কারণেই ছটফট করছেন। মেয়েটা উনাকে নিয়ে চলে যেতে চাচ্ছে। উনি যেতে চাচ্ছেন না। মেয়েটার ক্ষতি হলে উনি খুশিই হবেন।

ইয়াসিনের ট্র্যাংকে একটা বোতল আছে। বোতলে ভয়ঙ্কর জিনিস আছে। ভয়ঙ্কর জিনিসটা দেখতে পানির মতো। গ্লাসে ঢাললে মনে হবে পানি ঢালা হয়েছে। সেই পানি মুখে দিলে জ্বলোপুড়ে সব ছারখার হয়ে যাবে। জিনিসটার নাম এসিড। এর আরেকটা নাম আছে-ভোম্বল। ভোম্বল নামটা ফিসফিস করে বললেই—যার বোঝার সে বুঝে নেবে।

ইয়াসিন বলল, স্যার চা খাইবেন?

মিসির আলি কিছু বললেন না। ইয়াসিন আবার বলল, স্যার চা খাইবেন?

মিসির আলি সেই প্রশ্নেরও জবাব দিলেন না। ইয়াসিনের মনটা খারাপ হয়ে গেলআহারে লোকটা কী কষ্টে পড়েছে! দুনিয়াদারিই তার মাথায় নাই। লোকটার মাথায় মেয়েটা ঘুরছে। লোকটাকে মেয়ের হাত থেকে বঁচাতে হবে। বাঁচানোর সরঞ্জাম তার হাতেই আছে-এক নম্বুরি ভোম্বল। এই ভোম্বল লোহা হজম করে ফেলে। এই ভোম্বল সহজ, ভোম্বল না।

ইয়াসিন চা বানাতে গেল। মিসির আলি না চাইলেও সে সুন্দর করে চা বানিয়ে সামনে রাখবে। মনে মনে বলবে–এত চিন্তার কিছু নাই। আমি আছি না। আমি একবার যারে ভালো পাই তারে জন্মের মতো ভালো পাই।

 

মিসির আলি বেতের চেয়ারে বসে আছেন। তাঁর হাতে সিগারেট। সামনে চায়ের কাপ। চায়ের কাপের চা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে–তিনি খালি কাপেই চুমুক দিচ্ছেন। হাতের সিগারেটের ছাইও সেইখানেই ফেলছেন। তাঁর মুখের কাঠিন্য কমে আসছে। দলিলের রহস্য পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। তিনি এগুচ্ছেন। সহজ লজিক দিয়ে। সহজ লজিক তাকে যেখানে পেঁৗছে দিচ্ছে সেই জায়গাটা উঠার পছন্দ না। তিনি এই জায়গাটায় পৌঁছতে চাচ্ছেন না।

মিসির আলি লজিকের সিঁড়িগুলি এইভাবে দাড়া করিয়েছেন—

১. দলিলের লেখাগুলি তার হাতের। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

২. কোনো নেশার কন্তু খাইয়ে ঘোরের মধ্যে এই লেখা আদায় করা হয় নি। কারণ লেখা স্পষ্ট, পরিষ্কার।

৩. মানুষকে হিপনোটাইজ করে কিছু লেখা লেখানো যায়-সেই লেখাও হবে নেশাগ্ৰস্ত মানুষের হাতের লেখার মতো। ছােট কোনো বাক্যও সম্পূর্ণ করা প্রায় অসম্ভব। নেশাগ্ৰস্ত এবং হিপনোটিক ইনফ্লুয়েন্সের লেখা হবে কঁপি কঁপা। এই সময় ভিশন ডিসটন্টেড হয় বলে কেউ সরলরেখা টানতে পারে না, এবং সরলরেখায় লিখতেও পারে না।

কাজেই তিনি দলিলের লেখাগুলি ঠাণ্ডা মাথায় এবং অবশ্যই সূক্ষ্ম মস্তিষ্কে লিখেছেন।

৪. প্রতিমা তাকে দলিল দেখাবার সময় খুব মজা পাচ্ছিল এবং হাসােহাসি করছিল। কাজেই দলিলের ব্যাপারটা মেয়েটার কাছে সিরিয়াস কোনো ব্যাপার না-মজার কোনো খেলা। এই খেলা সে প্রথম খেলছে না। আগেও খেলেছে।

তা হলে ব্যাপার এই দাঁড়াচ্ছে যে মেয়েটি মজা করার জন্যে মিসির আলিকে দিয়ে লেখাগুলি লিখিয়ে নিয়েছে। এবং মেয়েটি জানে এই লেখার বিষয় মিসির আলির মনে নেই। মনে থাকলে তো খেলাটার মজা থাকত না।

তা হলে কী দাঁড়াচ্ছে মেয়েটা মিসির আলিকে দিয়ে কাগজে লেখার মতো জটিল কাজটি করিয়ে নিয়েছে এমনভাবে যে মিসির আলি কিছু বুঝতেই পারেন নি। যার স্মৃতি পর্যন্ত মস্তিষ্কে নেই। অর্থাৎ মিসির আলির মস্তিষ্কের পুরো নিয়ন্ত্রণ ছিল মেয়েটির কাছে। মেয়েটি কোনো এক অস্বাভাবিক ক্ষমতায় মানুষের মাথার ভেতর সরাসরি ঢুকে যেতে পারছে। এই ক্ষমতা বিজ্ঞান স্বীকার করে না। তবে এ ধরনের ক্ষমতার উল্লেখ বারবারই প্রাচীন সাহিত্যে পাওয়া যায়। পৌরাণিক কাহিনীতে পাওয়া যায়। আমেরিকার ডিউক ইউনিভার্সিটি এই বিষয়ের ওপর দীর্ঘ গবেষণা চালিয়ে প্রমাণ করেছে যে, এই ক্ষমতার কোনো অস্তিত্ব নেই। এটি শুধুমাত্রই লোকজ বিশ্বাস।

মিসির আলি আরেকটা সিগারেট ধরালেন। বুক শেলফ থেকে সাইকোপ্যাথিক মাইন্ড বইটি হাতে নিলেন–কিন্তু পাতা উন্টলেন না। তাঁর স্মৃতিশক্তি আগের মতো নেই–তার পরেও এই বইটির প্রতিটি পাতা তার প্রায় মুখস্থ।

পৃথিবীর ভয়ঙ্কর সব খুনিদের মানসিক ছবি বা সাইকোলজিক্যাল প্ৰফাইল এই বইটিতে দেওয়া আছে। প্রতিটি ভয়ঙ্কর অপরাধীর ক্ষেত্রেই বলা হচ্ছে-অপরাধীর একটি অস্বাভাবিক ক্ষমতার কথা-অন্যকে বশীভূত করার ক্ষমতা।

এই ক্ষমতার উৎস কী? অপরাধী কি অন্যের মাথার ভেতর ঢুকে পড়ছে? তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছে?

এই ক্ষমতা শুধু যে ভয়ঙ্কর অপরাধীদের আছে তা না-মহান সাধুসন্তদেরও আছে বলে বলা হয়ে থাকে। তারাও মানুষের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারতেন। একজনের নিয়ন্ত্রণ আলোর দিকে-অন্যজনের নিয়ন্ত্রণ অন্ধকারের দিকে।

স্যার চা খাইবেন?

মিসির আলি চমকে তাকালেন। ইয়াসিন তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখের দৃষ্টিটা যেন কেমন। যেন অশুভ কিছু সেখানে আছে।

মিসির আলি বললেন, না চা খাব না। আমি রাস্তায় কিছুক্ষণ হাঁটব।

স্যার অ্যাপনের শইল কি খারাপ? না।

আমার শরীর ভালো।

 

ফজলু খুব লজ্জিত বোধ করছে। ফতে নামের এমন একজন ভালো মানুষের ব্যাপারে সে এত খারাপ ধারণা করেছিল। ছিঃ ছিঃ ছিঃ! প্রথম থেকেই তার মনে হয়েছিল-লোকটা খারাপ। লোকটার ভেতর মতলব আছে। লোকটার নজর দিলজনের দিকে। লোকটা যখন তাকে সিগারেট দিত–তার কাছে মনে হত সে কোনো মতলবে সিগারেটটা দিচ্ছে। তার নিতে ইচ্ছা করত না, লোভে পড়ে নিত। লোভ খুব খারাপ জিনিস।

ফজলু দিলজনকে বলে দিয়েছে যেন কখনো ফতের কাছে না যায়। ফতে যদি তাকে ডাকে সে যেন ঘরে ঢুকে পড়ে। ফজলু নিশ্চিত ছিল-ফতে দিলজানকে ডাকবে। ফতে ডাকে নি। কোনোদিনও ডাকে নি। তার পরেও ফজলুর সন্দেহ দূর হয় নি। আজ সন্দেহ পুরোপুরি দূর হয়েছে। ফতে তাকে নার্সারিতে কাজ যোগাড় করে দিয়েছে। প্ৰতিদিন তিন ঘণ্টা কাজ করবে। গাছে পানি দেবে-গোবর আর মাটি মিশিয়ে মশলা তৈরি করবে। বিনিময়ে পঞ্চাশ টাকা পাবে।

কাজটা শেখা হয়ে গেলে সে নিজেই একটা নার্সারি দিবে। কোনো একটা রাস্তার ফুটপাত দখল করে বসে পড়বে। সে টাকা জমাতে শুরু করেছে। বন্ধর্কি বসতবাড়ি ছাড়িয়ে এনে স্ত্রী-কন্যাকে গ্রামে পাঠিয়ে দেবে। মেয়ের বিয়ে দেবে।

ফজলু গাঢ় স্বরে বলল, আপনি আমার বড় একটা উপকার করলেন।

ফতে বলল, এটা কোনো উপকার হল নাকি। এটা কোনো উপকারই না। নাও একটা সিগারেট নাও।

ফজলু আনন্দে অভিভূত হয়ে সিগারেট নিল। এমন একটা ভালোমানুষের বিষয়ে সে কী খারাপ ধারণাই না করেছিল। ছিঃ ছিঃ ছিঃ।

ফতে বলল, চা খাবে নাকি? চল এক কাপ চা খাই।

ফজলু বলল, চলেন। চায়ের দাম কিন্তু আমি দিমু। এইটা আমার একটা আবদার।

 

ফতে চা খাচ্ছে। রাস্তার পাশের দোকানের টুলের উপর সে একা বসে আছে। ফতের এটা দ্বিতীয় কাপ। প্রথম কাপের দাম ফজলু দিয়ে চলে গেছে। দ্বিতীয় কাপে সে একা বসে চুমুক দিচ্ছে।

তার হাতে সময় বেশি নেই। বড় ঘটনা আজ রাতেই ঘটবে। এই ভেবে তার মনে আলাদা কোনো উত্তেজনা নেই বরং শান্তি শান্তি লাগছে। ঘটনাগুলি সে সাজিয়ে রেখেছে। সাজানোর কোনো ভুল নেই। তার পরেও প্রতিটি ঘটনায় একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া দরকার। ঠাণ্ডা মাথায় বিবেচনা করা।

ফতের মাথা ঠাণ্ডাই আছে। যে কোনো বড় ঘটনা ঘটাবার আগে তার মাথা ঠাণ্ডা থাকে। বড় ঘটনা এর আগে সে চারবার ঘটিয়েছে–তিনবার গ্রামে, একবার শহরে। কোনোবারই তার মাথা এলোমেলো ছিল না। চারটা বড় ঘটনার বিষয়ে কেউই কিছু জানে না। এবারো কেউ কিছু জানবে না। এবারেরটা আরো বেশি গোছানো।

আজ বুধবার তার মামি গিয়েছেন তার আদরের বুড়ো ভাইয়ার কাছে। সেই ভাইয়া মনের সুখে পুটুরানী পুটুরানী করে আদর করছে। আদরটাব্দর খেয়ে মামি বাসায় ফিরবে। তার আগেই বাড়ির গেটের কাছে ফতে বসে থাকবে লুনাকে নিয়ে। লুনা তার মাকে দেখে আনন্দে হাততালি দিয়ে বলবে-পুটুরানী পুটুরানী। এটা লুনা বলবে কারণ ফতে তাকে শিখিয়ে দেবে। এই ঘটনার ফলাফল কী হবে। ফতে জানে না। হয়তো মা মেয়েকে চড়ুথাপ্নড় দেবে। কিংবা হাত ধরে মেয়েকে ঘরে নিয়ে যাবে। যাই করুক না কেন ফতের কিছু যায় আসে না। সে জানে মামি তাকে অকারণে কিছুক্ষণ ধমক ধমকি করবে। তারপর পাঠাবে কোনো একটা কিছু দোকান থেকে কিনে আনতে। কাপড় ধোয়ার সাবান, সয়াবিন তেল, কিংবা কাঁচা মরিচ বা ধনেপাতা।

ফতে গায়ে চাদর জড়িয়ে বাজার আনতে যাবে। চাদরের নিচে গুটিসুটি মেরে লুকিয়ে থাকবে লুনা। গেট দিয়ে যখন ফতে বের হবে তখন কেউ বুঝতেও পারবে না, ফতের চাদরের নিচে কী আছে।

ফতে কিছুক্ষণের জন্যে লুনাকে রাখবে ফজলুর কাছে। লুনা খুব স্বাভাবিকভাবেই থাকবে-হইচই করবে না, কান্নাকাটি করবে না। নিজের মনে মুঠি বন্ধ করা এবং মুঠি খোলার খেলা খেলতে থাকবে। লুনাকে রেখে ফতে অতিদ্রুত বাজার শেষ করে বাড়ি ফিরবে। তখন ফতের মামি আতঙ্কিত গলায় ফতেকে জিজ্ঞেস করবেন-লুনা কোথায়। ওকে পাচ্ছি না। ফতে বলবে, আপনার সঙ্গেই তো ছিল। মামি তখন কাঁদো কাঁদো গলায় বলবেন, দেখছি নাতো। ফতে তৎক্ষণাৎ লুনার খোঁজে রাস্তায় বের হবে। চলে যাবে ফজলুর কাছে। সেখান থেকে লুনাকে নিয়ে যাবে বুড়িগঙ্গায়। যে নৌকাটা সে থাকার জন্যে ভাড়া করেছে সেই নৌকায়। আসল ঘটনা নৌকায় ঘটানো হবে।

তারপর সে আবার বাড়ি ফিরে আসবে। ততক্ষণে পুলিশ চলে এসেছে। বাড়িতে কান্নাকাটি হচ্ছে। ফতে আবারো লুনার খোঁজে বের হবে। এবার বের হবে বেবিট্যাক্সি নিয়ে। তার চাদরের নিচে বড় কালো পলিথিনের ব্যাগে সযত্নে রাখা মাথাটা বের করে সে যাত্রীদের সিটের এক কোনায় রেখে দেবে। আসল খেলা শুরু হবে তখন।

লুনা মেয়েটাকে নিয়ে মন খারাপ করার কিছু নেই। এই মেয়েটা বড় হয়ে বাবামার জন্যে যন্ত্রণ ছাড়া কিছু নিয়ে আসবে না। সব যন্ত্রণার সমাধান। এক অর্থে ফতে তার মামা-মামির উপকারই করছে।

পুরো ব্যাপারটা ভাবতে ফতের খুব মজা লাগছে। হাসি চাপিতে পারছে না। চায়ের দোকানি অবাক হয়ে বলল, ভাইজান একলা একলা হাসেন ক্যান?

ফতে হাসি না থামিয়েই বলল, আমার মাথা খারাপ। এই জন্যে একা এক হাসি। দেখি আরেক কাপ চা দেন। চিনি বেশি করে দেবেন। সব পাগল চিনি বেশি খায়।

ফতে শরীর দুলিয়ে শব্দ করে হাসবে। তার কাছে মনে হচ্ছে কালো পলিথিনের ব্যাগে মোড়া জিনিসটা একবার এই দোকানদারকে দেখিয়ে দিলে হয়। এই সব চায়ের দোকান অনেক রাত পৰ্যন্ত খোলা থাকে। রাত একটা দেড়টার দিকে দোকান খোলা থাকার কথা। বেবিট্যাক্সি দোকানোর সামনে রেখে সে চ খেতে আসতে পারে। তখন দোকানিকে বলতে পারে–ভাইসাব আমার বেবিট্যাক্সির সিটে একটা জিনিস আছে। দেখলে মজা পাবেন। দেখে আসেন।

জটিল হইচই

বদরুল সাহেবের বাড়ির সামনে জটিল হইচই হচ্ছে। বদরুল সাহেবের স্ত্রীর তীক্ষ্ণ গলা শোনা যাচ্ছে। মিসির আলি ইয়াসিনকে বললেন, কী হয়েছে রে?

ইয়াসিন বলল, জানি না। মনে হয় চোর ধরছে।

সন্ধ্যার দিকে ঐ বাড়িতে রোজই হইচই হয়। এতে গুরুত্ব দেবার কিছু নেই। কিন্তু মহিলার তীক্ষ্ণ গলার স্বর কানে লাগছে।

মিসির আলি ইয়াসিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার জন্যে মাথা ধরার ট্যাবলেট নিয়ে এস। খুব মাথা ধরেছে।

ইয়াসিন বলল, মাথা বানায়া দেই।

মিসির আলি বললেন, মাথা বানাতে হবে না। মাথা বানানোই আছে। তুমি মাথা ধরার ট্যাবলেট কিনে এনে খুব কড়া করে এক কাপ চা বানিয়ে দাও!

ইয়াসিন চলে গেল। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফতে ঘরে ঢুকল। মিসির আলির দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার আপনার ঘরে কি লুনা লুকিয়ে আছে?

মিসির আলি অবাক হয়ে বললেন, নাতো।

ফতে বলল, মেয়েটারে পাওয়া যাচ্ছে না! চুপিচুপি এসে খাটের নিচে হয়তো লুকিয়ে আছে। স্যার একটু খুঁজে দেখি?

হ্যাঁ দেখ।

ফতে সবগুলি ঘর খুঁজল। বাথরুমে উঁকি দিল। খাটের নিচে দেখল। ফতের সঙ্গে সঙ্গে মিসির আলিও খুঁজলেন।

ফতে বলল, নাহ। এদিকে আসে নাই।

মিসির আলি বললেন, ফতে তোমাকে একটা কথা বলি শোন। তুমি মেয়েটাকে খুঁজতে এসেছ-খাটের নিচে উঁকি দিয়েছ-কিন্তু তুমি কিন্তু মেয়েটাকে খুঁজছিলে না।

ফতে শান্ত গলায় বলল, স্যার এটা কেন বললেন?

মিসির আলি বললেন, আমার খাটের নিচে দুটা বইভর্তি ট্রাংক আছে। সত্যি সত্যি মেয়েটাকে খুঁজলে তুমি অবশ্যই ট্রাংকের ওপাশে কী আছে দেখার চেষ্টা করতে। তা ছাড়া তুমি বাথরুমে উঁকি দিয়েছ? বাথরুমের ভেতরটাও তুমি দেখ নি। বাথরুমের দরজা খুলে তুমি তাকিয়ে ছিলে আমার দিকে।

ফতে বলল, স্যার আপনি ঠিক ধরেছেন। আমি আসলে খুঁজি নাই। কারণ আমি জানি লুনা এই দিকে আসে নাই। সে নিজে নিজে কোনোদিকে যায় না। তার মার মনের শান্তির জন্যে আমি এদিক-ওদিক খোঁজাখুঁজি করতেছি। ছাদে গিয়েছি দুইবার। ছাদের পানির টাংকির মুখ খুলে ভিতরে দেখেছি।

মিসির আলি বললেন, ফতে তুমি একটু বস তো। এই চেয়ারটায় বস।

ফতে বসল।

মিসির আলি বললেন, বাচ্চা একটা মেয়ে পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়ের মা কান্নাকাটি করছে–আমি কিন্তু তোমার ভেতর কোনো উত্তেজনা লক্ষ করছি না। তোমাকে খুবই স্বাভাবিক লাগছে।

ফতে বলল, সব মানুষ তো একরকম না। স্যার। আমি যেরকম, আপনি সেরকম না। কিছু কিছু মানুষ উত্তেজিত হলেও বাইরে থেকে বোঝা যায় না। স্যার কী করে বুঝলেন যে আমি খুব স্বাভাবিক আছি? আমার কপাল ঘামে নাই, আমার কথাবার্তা জড়ায়ে যায় নাই এই জন্যে।

না, তা না। তুমি খুব স্বাভাবিক আছ এটা বুঝেছি সম্পূর্ণ অন্য একটা ব্যাপার থেকে। তুমি লেফট হ্যান্ডার। বঁহাতি মানুষ। বঁহাতি মানুষ উত্তেজিত অবস্থায় ডান হাত ব্যবহার করতে শুরু করে। তুমি তা করছ না। তুমি বঁ। হাতই ব্যবহার করছি। অথচ তোমাদের বাড়িতে আজ ভয়ন্ধের ঘটনা ঘটেছে।

ফতে মনে মনে বলল, শাবাশ বেটা। তুই মানুষের মাথার ভিতর ঢুকতে পারিস না। তার পরেও তুই অনেক কিছু বুঝতে পারিস। তোর সাথে পাল্লা দিতে পারলে খারাপ হয় না। আমি তোকে চিনে ফেলেছি, তুই কিন্তু এখনো আমাকে চিনস নাই।

মিসির আলি বললেন, ফতে শোন তুমি এতই স্বাভাবিক আছ যে আমার সন্দেহ হচ্ছে মেয়েটা কোথায় আছে তুমি জন। এবং আমার ধারণা মেয়েটাকে তুমিই সরিয়েছ।

ফতে আবারো মনে মনে বলল, শাবাশ। শাবাশ। আয় দুইজনে একটা খেলা খেলি। বাঘবন্দি খেলা। তুই একটা চাল দিবি। আমিও একটা চাল দিব।

মিসির আলি বললেন, ফতে কিছু একটা বল। চুপ করে আছ কেন? মেয়েটাকে তুমি সরাও নি?

ফতে বলল, গেটে দারোয়ান আছে! লুনাকে নিয়ে গেট থেকে বের হলে দারোয়ান দেখত না?

মিসির আলি বললেন, তোমার গায়ে ভারী চাদর। এই চাদর দিয়ে ঢেকে মেয়েটাকে সরিয়ে নিলে কারোর সন্দেহ করার কিছু নেই। চাদরের নিচ থেকে মেয়েটাও কোনো শব্দ করবে না। কারণ সে তোমাকে খুব পছন্দ করে। তাকে চাদরের নিচে ঢুকিয়ে তুমি বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছ এই দৃশ্য আমি বেশ কয়েকবার দেখেছি।

ফতে মনে মনে বলল, তুই বাঘবন্দি খেলা খেলতে চাস, আয় খেলি। তুই তিনচারটা ভালো চাল দিয়ে ফেলেছিস। আমি কোনো চাল দেই নাই। এখন দেব।

মিসির আলি বললেন, ফতে কথা বল। চুপ করে থেক না। বাচ্চা মেয়েটাকে তুমি সরিয়েছ?

জি।

মেয়েটা কোথায় আছে?

খুব ভালো জায়গায় আছে, স্যার কোনো সমস্যা নেই। আপনি এত দুশ্চিন্তা কইরেন না। স্যার। নেন একটা সিগারেট খান।

তুমি এই কাজটা কেন করলে?

ফতে হেসে ফেলে বলল, মামা করতে বলেছে। এই জন্যে করেছি।

বদরুল সাহেব বলেছেন?

জি। মামার হুকুমে লুনাকে এক বাসায় রেখে এসে এমন ভাব করতেছি যেন আমি খুব পেরেশান হয়ে খুঁজতেছি।

মিসির আলি বললেন, তোমার মামা এই কাজটা কেন করছেন?

ফতে হাই তুলতে তুলতে বলল, মামিকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যে কাজটা করেছেন। মামি এই বাচ্চাটাকে মাঝে মাঝে মারে। এটা মামার ভালো লাগে না। অসুস্থ একটা বাচ্চা। একে তার মা মারবে কেন? এই জন্যে মামা ঠিক করেছে। লুনাকে তিন-চার ঘণ্টা লুকিয়ে রাখবে-যাতে মামি বুঝতে পারে সন্তান কী জিনিস। ঘটনাটা কি এখন বুঝেছেন স্যার?

হ্যাঁ বুঝেছি। বাচ্চাটা আছে কোথায়?

বুড়িগঙ্গা নদীতে-নৌকার ভিতরে। সে খুব মজায় আছে। স্যার একটা কাজ করবেন?

মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, বল কী কাজ?

ফতে বলল, আপনি আমার সঙ্গে চলেন। নৌকা থেকে দুজনে মেয়েটাকে নিয়ে আসি।

মিসির আলি বললেন, চল যাই।

ফতে বলল, দুজন একসঙ্গে বের হলে মামি সন্দেহ করবে। স্যার আপনি আগে চলে যান। সদরঘাট লঞ্চ টাৰ্মিনালের সামনে চায়ের দোকান আছে। ঐখানে বসে চা খান–আমি মামিকে বলি লুনাকে খোজার জন্যে বের হচ্ছি। এই বলে চলে আসব। আমার পৌঁছতে দশ মিনিটের বেশি দেরি হবে না। স্যার যাবেন?

মিসির আলি বললেন, হ্যাঁ।

 

এক ঘণ্টার বেশি হয়েছে মিসির আলি অপেক্ষা করছেন। ফতের কোনো দেখা নেই। তিনি দুশ্চিন্তা করা শুরু করেছেন। ফতে লুনা সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা দিয়েছে মিসির আলির কাছে মনে হয়েছে এই ব্যাখ্যা ঠিক না। ফতে তাৎক্ষণিকভাবে একটা ব্যাখ্যা দাড় করিয়েছে। মানসিকভাবে অসুস্থ একটা মেয়েকে রাতের বেলা বুড়িগঙ্গায় নৌকার উপর রাখার কোনো যুক্তি নেই। মেয়েটিকে লুকিয়ে রাখলে তার বাবা তাকে খুব কাছাকাছি কোথাও রাখবে। বুড়িগঙ্গায় নৌকার উপর পাঠাবে না। মিসির আলির মনে হল লুনা মেয়েটি বিপদে আছে। সহজ কোনো বিপদ না। জটিল ধরনের বিপদ। বিপদ ঘটতে খুব দেরিও নেই। মিসির আলি ইয়াসিনের দিকে তাকালেন। ইয়াসিন কী মনে করে যেন তাঁর সঙ্গে এসেছে। ইয়াসিনকে কি লুনার বাবার কাছে চিঠি দিয়ে পাঠাবেন? তিনি অপেক্ষা করবেন। ফতের জন্যে-ইয়াসিন চিঠি নিয়ে চলে যাবে বদরুল সাহেবের কাছে। চিঠিতে লেখা থাকবে–আপনার মেয়ের মহাবিপদ। পুলিশে খবর দিন। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা কী তার মাথায় আসছে না। মাথায় এলে সেটাও চিঠিতে লিখে দিতেন।

মিসির আলি চমকে দেখলেন ফতে পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।

জামে আটকা পোড়ে গেছিলাম—এমন জাম শেষে বেবিট্যাক্সি রেখে হেঁটে চলে এসেছি। স্যার চলেন যাই–।

মিসির আলি কিছু বললেন না, নিঃশব্দে ফতেকে অনুসরণ করলেন। ফতে বলল, সঙ্গে সিগারেট আছে স্যার? না থাকলে নিয়ে নেই। নদীর মাঝখানে সিগারেট টান দিতে বড়ই মজা।

সিগারেট সঙ্গে আছে?

মিসির আলি ক্লান্ত গলায় বললেন, সিগারেট সঙ্গে আছে।

 

ইঞ্জিন লাগানো নৌকা। বেশ বড়সড়। অনেকটা বজরার মতো দরজা-জানালা আছে। নৌকায় কোনো মাঝি নেই। ফতে নিজেই ইঞ্জিন চালু করে নৌক ছেড়ে দিয়ে বললস্যার আপনি ভিতরে যান। লুনা ভেতরে আছে। এতক্ষণ ঘুমাচ্ছিল—এখন মনে হয় জেগেছে।

মিসির আলি বললেন, মেয়েটা একা ছিল নাকি?

ফতে বলল, একই ছিল। তার কাছে একা যে কথা দোকা তিকাও সেই কথা। যান স্যার মেয়েটার সঙ্গে কথা বলেন-এর মধ্যে আমি নৌকা ঐ পারে নিয়ে যাই।

নৌকা ঐ পারে নেবার দরকার কী?

দরকার আছে স্যার। ফতে বিনা প্রয়োজনে কোনো কাজ করে না। ঐ পারে ভিড় নাই।

মিসির আলি দরজা খুলে নৌকার ভেতরে ঢুকলেন। লুনা বসে আছে। তার সামনে লজেন্সের দুটা প্যাকেট। সে প্যাকেট থেকে সব লিজেন্সের খোসা ছাড়িয়ে এক পাশে রাখছে। কাজটায় সে খুবই আনন্দ পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। মিসির আলির দিকে তাকিয়ে লুনা হাসল। একটা লজেন্স মিসির আলির দিকে বাড়িয়ে দিল।

মিসির আলি বললেন, খুকি। তুমি কেমন আছ?

লুনা বলল, ভালো।

কী কর?

খেলি।

এই খেলার নাম কী?

জানি না।

লুনা আরেকটা লজেন্স ইয়াসিনের দিকে বাড়িয়ে দিল। ইয়াসিন লজেন্স নিল না। লুনা হাত বাড়িয়েই থাকল। মিসির আলি বুঝতে পারছেন। লজেন্স হাত থেকে না নেওয়া পর্যন্ত এই মেয়ে হাত নামাবে না। মেয়েটা খুবই অসুস্থ। তার মস্তিষ্কের কোনো একটা অংশ জট পাকিয়ে গেছে। এই জন্ট কে খুলতে পারে? এমন কোনো বুদ্ধি যদি থাকত মাথার ভেতর ঢুকে জটি খোলা যেত। মিসির আলির হঠাৎ করে প্রতিমার কথা মনে পড়ল। প্রতিমা কি এই মেয়েটার জন্যে কিছু করতে পারে।

নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেছে। ফতে দরজা খুলে নৌকায় ঢুকেই দরজা বন্ধ করে মিসির আলির দিকে তাকিয়ে হাসল। মিসির আলির বুক ধক করে উঠল। এই হাসি তো মানুষের হাসি না। এই হাসি পিশাচের। হাসি। ফতে মিসির আলির চোখে চোখ রেখে শান্ত গলায় বলল-স্যার আপনার তো খুবই বুদ্ধি। বুদ্ধি খাটায়ে বলেন তো-লুনা মেয়েটাকে নিয়ে আমি মাঝনদীতে কেন এসেছি। বলতে পারলে আমি আপনাকে একটা প্রাইজ দিব।

মিসির আলি এখন জানেন ফতে কেন লুনাকে মাঝনদীতে নিয়ে এসেছে। কিন্তু এখন তার সেই কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। তিনি ফতের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ইয়াসিনকে বললেন, ইয়াসিন তুমি মেয়েটার হাত থেকে লজেন্সটা নাও। লজেন্স না নেওয়া পর্যন্ত সে হাত উঁচু করে রাখবে। ইয়াসিন লজেন্স নিল। লুনা মিষ্টি করে হেসে আবারো লজেন্সের খোসা ছাড়ানোয় মন দিল।

ফতে সিগারেট ধরিয়ে তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, স্যার যে কাজটা করতে যাচ্ছি। এই কাজ এর আগে আমি আরো চারবার করেছি।

মিসির আলি বললেন, কেন করেছ?

করতে খুব মজা লাগে স্যার। আমার হাতের কাজ যে দেখে সে খুবই ভয় পায়। কেউ ভয় পেলে আমি খুব সহজে তার মাথার ভিতর ঢুকে পড়তে পারি। অনেক দূর যেতে পারি। তার মাথা লণ্ডভণ্ড করে ফেলতে পারি। তখন কী যে আনন্দ হয়!

ফতে তুমি যে খুব অসুস্থ একজন মানুষ তা কি তুমি জান?

জানি। তার জন্যে আমার খারাপ লাগে না। আল্লাই আমাকে অসুস্থ করে পাঠিয়েছেন। আমি কী করব।

এক অর্থে তোমার কথা ঠিক। তোমার জিনে কোনো গণ্ডগোল আছে। যে কারণে ভয়াবহ কাণ্ডগুলি হাসিমুখে করছি। তোমার সুস্থ হবার কোনো সুযোগ আছে বলেও আমার মনে হয় না।

আপনার ভয় লাগছে না?

না, ভয় লাগছে না। যে ভয়ঙ্কর ঘটনা তুমি ঘটাবে বলে ভাবছ সেই ঘটনা তুমি ঘটাতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না?

ফতে সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলল, স্যার আমার ক্ষমতা সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণা নেই। আমি যে কোনো মানুষের মাথার ভেতর ঢুকে পড়তে পারি। এখন আপনার এই কাজের ছেলের মাথার ভেতর আমি ঢুকে বসে আছি। এর পকেটে একটা কাচের বোতল আছে। বোতল ভর্তি নাইট্রিক এসিড। আমি যখনই তাকে বলব–ইয়াসিন বোতলের জিনিসটা মিসির আলি সাহেবের গায়ে ঢেলে দে-সে। গায়ে ঢেলে দেবে।

ফতে ইয়াসিনের দিকে তাকিয়ে বলল, কীরে ইয়াসিন ঢালবি না? যে মেয়েটার গায়ে ঢালার জন্যে বোতল ভর্তি এসিড নিয়ে ঘুরছিস সে যখন নেই তখন স্যারের গায়ে ঢালবি। পারবি না?

ইয়াসিন হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। ক্ষীণ স্বরে বলল, পারব।

ফতে বলল, তা হলে বোতলটা পকেট থেকে বের করে মুখটা খুলে রাখ।

ইয়াসিন তাই করল। ফতে হাসতে হাসতে বলল, একটু ভয় ভয় লাগছে না স্যার?

মিসির আলি বললেন, না।

একটুও লাগছে না?

না।

মিসির আলি নিজেও বিস্মিত হচ্ছেন। ভয়ঙ্কর একজন মানুষ তার সামনে বসে আছে অথচ তিনি বিচলিত হচ্ছেন না। প্রচণ্ড ভয়ের কোনো কারণ ঘটলে রক্তে এন্দ্রোলিন নামের এনজাইম প্রচুর পরিমাণ চলে আসে। ভয় কেটে যায়। সেরকম কিছু কি ঘটেছে? তিনি ইয়াসিনের দিকে তাকালেন। এসিডের বোতল হাতে সে শক্ত হয়ে বসে আছে। তার দৃষ্টি পুরোপুরি ফতের দিকে। ফতে তাকিয়ে আছে ইয়াসিনের দিকে। মিসির লক্ষ করলেন ফতে যখনই তার দৃষ্টি মিসির আলির দিকে দিচ্ছে–ইয়াসিন তখনই নড়ে উঠছে। তা হলে কী দাঁড়াচ্ছে ফতে যে দাবি করছে সে মানুষের মাথার ভেতর ঢুকে পড়তে পারে-মাথার ভেতর ঢুকতে তার কি চোখ নামক পথের প্রয়োজন হয়। ইয়াসিন যদি চোখ বন্ধ করে ফেলে তা হলেও কি ফতে তার মাথার ভেতর ঢুকে বসে থাকতে পারবে।

মিসির আলিকে অতিদ্রুত যে কাজটা করতে হবে তা হল ইয়াসিনের হাত থেকে এসিডের বোতলাটা নিয়ে নিতে হবে। মিসির আলি ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে ডাকলেন–ইয়াসিন!

ইয়াসিন তার দিকে তাকল না। ফতের দিকেই তাকিয়ে রইল। ফতের ঠোঁটের কোণায় ক্ষীণ হাসির রেখা। মিসির আলি দ্রুত চিন্তা করছেন। ফতেকে এক্ষুনি বিভ্রান্ত করতে হবে। চমকে দিতে হবে। মিসির আলি হালকা গলায় বললেন, ফতে শোন তুমি যে ক্ষমতার কথা বলছ এই ক্ষমতা যে আমার নেই তা কী করে বুঝলে?

ফতে চমকে তাকাল।

মিসির আলি বললেন, এস আমার মাথার ভেতর ঢুকে দেখ।

ফতে তাকিয়ে আছে। তার চোখ তীক্ষ্ণ ও তীব্র। তার মুখ হাঁ হয়ে আছে। ঠোঁট বেয়ে লালার মতো কিছু গড়িয়ে পড়ল। ফতে মিসির আলির মাথার ভেতর চোকার চেষ্টা করছে। অনেকক্ষণ থেকেই করছে। পারছে না। তার নিজেরই সামান্য ভয় ভয় লাগছে। ভয় পাওয়া ঠিক হবে না। সে ভয় পেলে মাথায় ঢুকতে পারবে না। খুব বেশি ভয় পেয়ে গেলে হয়তো উল্টো ব্যাপার ঘটবে! মিসির আলিই তার মাথায় ঢুকে পড়বেন। ফতে ঘন ঘন নিশ্বাস নিতে লাগল।

মিসির আলি বললেন, তুমি আমার সঙ্গে যে খেলা খেলতে চেয়েছ। এই খেলোটা খেলতে পারবে না। আমি খেলায় কয়েকটা দান এগিয়ে আছি।

ফতে বলল, কীভাবে?

আমি এক ঘণ্টা লঞ্চঘাটে দাঁড়িয়ে ছিলাম না। আমি পুলিশে খবর দিয়েছি।

আপনি মিথ্যা কথা বলছেন।

ফতে আমি তো বোকা না। তুমি আমাকে বোকা ভাবলে কেন? তোমার মতো ক্ষমতা আছে এমন একজন রোগীর আমি চিকিৎসা করেছিলাম, সেও আমাকে বোকা ভাবত। এখনো ভাবে। এজাতীয় ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষের প্রধান দুর্বলতা হল এরা অন্য সবাইকে বোকা ভাবে! তুমি কি এখনো আমাকে বোকা ভাবছ?

ফতে শীতল গলায় বলল, আপনি মিথ্যা কথা বলছেন, আপনি পুলিশকে খবর দেন নাই।

মিসির আলি বললেন, ফতে তুমি বোধ হয় লক্ষ কর নি। ইয়াসিনের হাতে যে বোতলটা ছিল-সে বোতলটা এখন আমার হাতে। পুলিশের বাঁশির আওয়াজ তুমি এক্ষুনি শুনবে।

মিসির আলির কথা শেষ হবার আগেই-পরপর দুবার বাঁশি বেজে উঠল। নৌকা দুলে উঠল। ফতে ভয়ঙ্করভাবে কেঁপে উঠল।

মিসির আলি বললেন, এটা পুলিশের বাঁশির শব্দ না। লঞ্চ ছাড়ছে-ভেঁপু দিচ্ছে। ফতে তুমি ভয়ঙ্কর ভয় পেয়েছ।

ফতে কঁপা কঁপা গলায় বলল, আপনি পুলিশে খবর দেন নাই।

মিসির আলি বললেন, তুমি ঠিকই বলছ। আমি পুলিশে খবর দেই নি। পুলিশের কথা বলেছি তোমার ভিতর ভয়ের বীজ ঢুকিয়ে দেবার জন্যে। ভয়ের বীজ ঢুকে গেছে। সত্যি করে বল ফতে তোমার ভয় লাগছে না?

না।

মিথ্যা কথা বলার দরকার নেই ফতে। আমি যেমন সত্যি কথা বলছি তুমিও সত্যি কথা বল। তীব্ৰ ভয়ে অস্থির হলে মানুষের যেসব শারীরিক পরিবর্তন হয় তার সবই তোমার হচ্ছে। তোমার শরীর কাঁপছে। তোমার চোখের মণি বড় বড় হয়ে গেছে। পুলিশকে তো আমি খবর দেই নি। তুমি কাকে ভয় পাচ্ছ?

আপনাকে।

আমার হাতে এসিডের বোতল এই জন্যে ভয় পাচ্ছ? শোন ফতে আমার পক্ষে কোনো অবস্থাতেই কারো গায়ে এসিড ছুড়ে ফেলা সম্ভব না। এই দেখ বোতলটা আমি পানিতে ফেলে দিচ্ছি। তাতেও কিন্তু তোমার ভয় কমবে না।

ফতে ঢোক গিলল। মিসির আলি নামের মানুষটা সত্যি সত্যি বোতলটা ফেলে দিয়েছে। মানুষটার দুর্দান্ত সাহস। এত সাহস সে পেল কোথায়। ফতে যেখানে বসেছে তার নিচেই বড় একটা ধারালো ছুরি আছে। হাত নামিয়ে সে কি ছুরিটা নেবে।

ফতে!

জি।

তুমি ভয়ঙ্কর অসুস্থ একজন মানুষ। তোমার চিকিৎসা হওয়া দরকার। প্রতিমার সাহায্য নিয়ে আমি তোমার চিকিৎসা করার চেষ্টা করতে পারি। তুমি কি চাও আমি তোমার চিকিৎসা করি?

না।

তোমাকে তো ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না। ফতে। তোমাকে ছেড়ে দিলে তুমি ভয়ঙ্কর সব অপরাধ করবে। আমি তা হতে দিতে পারি না।

লুনা আরেকটা লজেন্সের খোসা ছাড়িয়ে ফতের দিকে ধরে আছে। মিসির আলি বললেন, ফতে লজেন্সটা ওর হাত থেকে নাও। লজেন্স না নেওয়া পর্যন্ত সে হাত উঁচু করেই রাখবে।

ফতে লজেন্স নিল। মিসির আলি বললেন, চল নৌকার পাটাতনে গিয়ে দাঁড়াই। তুমি বলেছিলে মাঝনদীতে সিগারেট টানতে খুব মজা-দেখি আসলেই মজা কি না। ফতে কোনোরকম আপত্তি করল না, মিসির আলির সঙ্গে নৌকার পাটাতনে এসে দাঁড়াল।

মিসির আলি বললেন, ফতে তুমি কি পানিতে ঝাঁপ দেওয়ার কথা চিন্তা করছ?

ফতে চমকে উঠে বলল, আপনি কীভাবে বললেন?

মিসির আলি বললেন, অনুমান করে বলছি। আমার কারো মাথায় ঢোকার ক্ষমতা নেই। তবে আমি খুব ভালো অনুমান করতে পারি। সেই অনুমানটা মাথায় ঢোকার মতোই। ফতে তুমি পানিতে ঝাঁপ দিও না। পানি অতিরিক্ত ঠাণ্ডা হবার কথা। আর স্রোতও বেশি। তোমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।

মিসির আলি সিগারেট ধরলেন। ফতে ঠিকই বলেছে মাঝনদীতে সিগারেট ধরাধোর আনন্দই আলাদা। আনন্দের সঙ্গে তিনি গাঢ় বিষাদও অনুভব করছেন। বিষাদের কারণটা তিনি ধরতে পারছেন না। নৌকার ভেতরে লুনা মেয়েটা খিলখিল করে হাসছে। আশ্চর্য প্রতিমাও ঠিক এ রকম করেই হাসে।

Exit mobile version