Site icon BnBoi.Com

জানি তুমি আসবে – কাসেম বিন আবুবাকার

জানি তুমি আসবে - কাসেম বিন আবুবাকার

 

০১. শফি বন্ধু রবিউলের সঙ্গে

জানি তুমি আসবে
কাসেম বিন আবুবাকার

উৎস্বর্গ
প্রাণ প্রিয় নাতি মুঃ মুস্তাকিম আহম্মদ খান (আহনাফ)
আল্লাহ ওকে তার প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন।

১. “স্থলভাগে ও জলভাগে মানুষের স্বহস্তকৃত কর্মসমূহের দরুন নানা প্রকার বালা-মুসীবত ছড়াইয়া পড়িতেছে, যেন আল্লাহ তাহাদিগকে তাহাদের মন্দ কাজের কিয়দংশের স্বাদ উপভোগ করান, যাহাতে তাহারা (উহা হইতে) ফিরিয়া আসে।”– আল-কুরআন; সূরা-রূম আয়াত-৪১, পারা-২১

২. “আল্লাহ যাহার মঙ্গল কামনা করেন, তিনি তাহাকে ধর্মজ্ঞান দান করেন,–বুখারী ও মুসলীম

৩. “উত্তম স্বাস্থ্য ও উত্তম স্ত্রী পুরুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ।”–জন-রে

.

০১.

শফি বন্ধু রবিউলের সঙ্গে পাকা সড়ক দিয়ে যেতে যেতে দেখতে পেল, লাঠি হাতে এক বৃদ্ধ অন্ধ ভিক্ষুক বলছে, কে আছ বাবা আমাকে রাস্তাটা পার করে দাও।

শফির দৃষ্টি অনুসরণ করে রবিউল বলল, দাঁড়া হাসান, চাচাকে রাস্তাটা পার করে দিয়ে আসি।

শফি বলল ওনাকে চিনিস না কি?

রবিউল বলল, হ্যাঁ, চিনি। আমাদের গ্রামের পশ্চিম পাড়ায় ঘর।

ওনার কোনো ছেলেমেয়ে নেই?

ছেলে নেই, দুটো মেয়েছিল। তাদের বিয়ে দিতে গিয়ে যেটুকু জমি ছিল বিক্রি করে দিয়েছেন। তারপর যতদিন শক্তি সামর্থ ছিল, গতর খাঁটিয়ে স্বামী স্ত্রীর পেট চালিয়েছেন। অন্ধ হয়ে ভিক্ষে করতে বাধ্য হয়েছেন।

তুই দাঁড়া আমি যাচ্ছি বলে শফি বৃদ্ধের কাছে এসে তার একটা হাত ধরে বলল, চলুন, আমি পার করে দিচ্ছি।

বৃদ্ধ হাসান যেতে যেতে বলল, কে বাবা তুমি? আল্লাহ তোমার দোজাহানে মঙ্গল করুক।

রাস্তার মাঝা-মাঝি এসেছে এমন সময় একটা হুণ্ডা তাদের পাশে এসে থেমে গেল।

শফি যদি বৃদ্ধকে টেনে না নিত, তা হলে হুণ্ডার হ্যাঁন্ডেলে ধাক্কা লাগত।

শফি সেদিকে চেয়ে দেখল, হুণ্ডার চালকের সীটে চব্বিশ-পঁচিশ বছরের একটা মেয়ে। আর পিছনে বসে আছে প্রায় ত্রিশ বছরের একটা ছেলে। কিছু বলতে গিয়ে মেয়েটির মুখের দিকে চেয়ে শফি মুগ্ধ হল। মেয়েটির গায়ের রং শ্যামলা হলেও এত সুন্দর মুখ সে আর কখনও দেখেনি। পরক্ষণে তার পরণে টাইটফিট প্যান্ট শার্ট দেখে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলল, আরও ভালো করে গাড়ি চালান শিখুন তারপর রাস্তায় গাড়ি চালাবেন। নচেৎ যে কোনো সময় একসিডেন্ট করে পথচারির ও নিজের জীবন বিপন্ন করে ফেলবেন। আমি যদি এই অন্ধ বৃদ্ধকে দ্রুত টেনে না নিতাম, তা হলে কী হত ভেবে দেখুন?

মেয়েটির বদলে ছেলেটি গাড়ি থেকে নেমে বলল, বৃদ্ধ অন্ধ হতে পারে; কিন্তু তুমি তো অন্ধ না, দেখেশুনে রাস্তা পার হতে পার না?

শফি বলল, আর আমি যদি বলি চোখ কান খোলা রেখে গাড়ি চালাতে হয়।

শফির কথা শুনে ছেলেটা রাগে লাল হয়ে বলল, আমাকে জ্ঞান দান করছিস? চড়িয়ে তোর দাঁতগুলো ফেলে দিতে পারি জানিস?

আপনাকে তো চিনি না, আপনার কত ক্ষমতা জানব কী করে?

এখনই জানতে পারবি বলে ছেলেটা এগিয়ে এসে তার গালে খুব। জোরে চড় মারতে গেল।

শফি হাতটা ধরে ফেলে বলল, ছি-ছি, এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ি করা কোনো ভদ্র ঘরের ছেলের উচিত নয়। তারপর মেয়েটির দিকে চেয়ে বলল, আপনিই বলুন তো, কী এমন অপরাধ করেছি যে, উনি চড়িয়ে আমার দাঁত ফেলে দিতে চাচ্ছেন?

ছেলেটা আরও রেগে গিয়ে হাতটা ছাড়াবার চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝতে পারল। প্রতিপক্ষের গায়ে অসুরের মতো শক্তি। হাত ছাড়ান তো দূরের কথা এতটুকু নাড়াতেও পারল না। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, হাতটা ছেড়ে দে বলছি, নচেৎ পরিণাম ভালো হবে না।

শফি বলল, আপনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে দ্র ঘরের শিক্ষিত ছেলে; কিন্তু কথা-বার্তা ও আচার-আচরণ ছোটলোকের মতো কেন? আপনি নিজের হাত ছাড়াতে পারছেন না, আমার কী আর ভালো মন্দ করবেন? তারপর হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলল, যান, এবার ভদ্র ছেলের মতো চলে যান। দেখছেন না, কত লোকজন দাঁড়িয়ে ঘটনাটা দেখছে? তাদের কাছে নিজেকে। আর হাস্যাস্পদ করবেন না।

হাত ছাড়া পেয়ে ছেলেটা ঝট করে রিভলবার বের করে বলল, দাঁড়া আমার ক্ষমতা দেখতে চাস বলে শফির দিকে তাক করল।

শফি এরকমই আশা করেছিল, তাই প্রস্তুত ছিল। দ্রুত তার রিভলবারধরা হাতটা ধরে উপরের দিকে ফায়ার করে সেল খালি করে বলল, মনে হয় লেখাপড়া করলেও মানুষের মতো মানুষ হতে পারেননি। হয়তো বড়লোকের একমাত্র ছেলে। তাই ধরাকে সরা জ্ঞান করেন। তারপর চালকের আসনে বসা মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনাদের সম্পর্ক জানি না, তবু বলছি, এভাবে একসঙ্গে হুণ্ডায় চড়া উচিত নয়। আর সাবালিকা মেয়েদের এই রকম পোশাক পরা ইসলামে কঠোরভাবে নিষেধ। হাদিসে আছে, রসুল (সঃ) বলেছেন, যে সকল পুরুষ নারীর বেশ ধারণ করে এবং যে সকল নারী পুরুষের বেশ ধারণ করে, আল্লাহ তাহাদিগকে অভিশাপ দেন। [বর্ণনায় : হযরত আব্বাস (রা.)- বোখারী শরীফ] আর একটা কথা না বলে পারছি না, ইনাকে হয় পাবনা মানষিক হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন। নচেৎ কোনো মনোবিজ্ঞানের ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা করাবার ব্যবস্থা করবেন। কথা শেষ করে শফি রবিউলের কাছে এসে বলল, চল, কোথায় নিয়ে যাচ্ছিলি।

ততক্ষণে ছেলেটা রাগে ফুলতে ফুলতে হুণ্ডায় উঠে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, এর প্রতিশোধ না নিয়েছি তো আমি বাপের বেটাই না। তারপর মেয়েটিকে হুণ্ডা ছেড়ে দিতে বলল।

রবিউল তাদের দিকে চেয়েছিল। শফির কথা শুনে যেতে যেতে বলল, আর দু’এক সেকেণ্ড দেরি হলেই তুই গুলি খেতিস।

তা খেতাম। তাই তো গুলি করার আগেই ওর হাতটা ধরে ফেললাম।

তুই কি জানতিস ওর কাছে রিভলবার আছে?

জানতাম বলেই তো সতর্ক ছিলাম।

কী করে জানলি বলতো। সে কথা বলা যাবে না।

আচ্ছা, অনেক সময় তুই আগে থেকে জানতে পারিস, কী করে পারিস বলবি?

তাও বলা যাবে না। তবে এতটুকু বলতে পারি, কোনো কিছু ঘটার আগে আমার মন আমাকে বলে দেয়। ওসব কথা বাদ দেতো।

রবিউল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ওদেরকে আমি চিনি। ছেলেটার নাম মহসিন। পাশের গ্রামের বড়লোকের ছেলে। ওর বাবা এই এলাকার চেয়ারম্যান। নাম সালাউদ্দিন, মেয়েটা মহসিনের ফুপাতো বোন। ঢাকায় বাড়ি। কয়েকদিন হল মামার বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। মহসিন ঢাকায় ফুফুর বাসায় থেকে ভার্সিটিতে পড়ে। মনে হয় তোকে ছেড়ে কথা বলবে না। সময় সুযোগমতো আজকের অপমানের বদলা নেবে।

শফি বলল, ও বড়লোক চেয়ারম্যানের ছেলে, তাতে আমার কী? তাকে আমি অপমান করিনি। নিজের অহংকারের জন্য নিজেই অপমানিত হয়েছে। যদি বদলা নিতে আসে, তা হলে আরও বেশি অপমানিত হবে।

রবিউল জানে ছোটবেলায় যখন একসঙ্গে খেলাধুলা করত তখন শফি যা বলত তাই করত। সেই কথা মনে পড়তে ভাবল, এখনও কি ওর ঐ স্বভাব আছে? যদি থেকে থাকে, তা হলে মহসিন বদলা নিতে এলে তাকে আরও অপমান করে ছাড়বে। জিজ্ঞেস করল, একটা সত্যি কথা বলবি?

বল, তুই তো জানিস আমি কখনও মিথ্যা বলি না।

তোর আসল পরিচয় বলবি?

শফি হেসে উঠে বলল, পরিচয় আবার আসল নকল আছে না কি?

আমি এই গ্রামেরই ছেলে। ছোটবেলায় তোর সঙ্গে কত খেলাধূলা করেছি। তারপর না হয় হারিয়ে গিয়েছিলাম। এ কথা তো গ্রামের সবাই জানে, তুইও জানিস। তবু জিজ্ঞেস করছিস কেন?

হ্যাঁ, জানি। আমি জানতে চাচ্ছি হারানো জীবনটা কোথায়, কীভাবে কেটেছে এবং কীভাবে ফিরে এলি?

শফি আবার হেসে উঠে বলল, সেসব কথা জেনে কী লাভ হবে? তা ছাড়া সেসব বলাও যাবে না।

আচ্ছা, ছোটবেলার বন্ধুত্বের কথা নিশ্চয় মনে আছে?

হ্যাঁ, মনে আছে। তুই স্কুলে টিফিন নিয়ে আসতিস। টিফিন বাক্সে কী আছে খোলার আগে বলে দিতাম, সেকথা তোর মনে আছে?

হ্যাঁ, মনে আছে। আচ্ছা, এখনও সেরকম বলতে পারিস? পরীক্ষা করেই দেখ।

রবিউল জামার সাইড পকেট থেকে এক টাকার দুটো কয়েন হাতের মুঠোয় নিয়ে বের করে বলল, বলতো আমার হাতে কী আছে?

শফি সৃদু হেসে বলল, একটা লালচে ও একটা সাদা রং-এর দুটো কাঁচা টাকা আছে।

রবিউল খুব অবাক হয়ে বলল, কী করে বললি আমাকে শেখাবি?

শফি বলল, এটা শেখানোর বিষয় নয়। একটু আগে বললাম না, আমার মন আমাকে সবকিছু বলে দেয়।

আচ্ছা, তুই যখন এসে শুনলি বাবা মারা যাওয়ার পর তোর মা তার চাচাতো দেবরকে আবার বিয়ে করেছে তখন তোর মনের অবস্থা কী হয়েছিল? এবং ব্যাপারটা কীভাবে গ্রহণ করলি? মায়ের প্রতি তোর কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল?

কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে শফি বলল, ভার্সিটি থেকে উচ্চ ডিগ্রী নিলেও তুই ধর্মীয় বই-পুস্তক মনে হয় তেমন পড়াশোনা করিস নি। যদি করতিস, তা হলে এরকম প্রশ্ন করতে পারতিস না। শোন, একজন গ্রাম্য অল্পশিক্ষিত মেয়ে হয়ে মা যা করেছে, তা কল্পনাও করি নাই। আমার মনে হয়, মা অল্পশিক্ষিত হলেও ধর্মের জ্ঞান অনেক আছে। তাই চাচাতো দেবরকে আবার বিয়ে করে ইসলাম নারীদের যে অধিকার দিয়েছে, সমাজে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। তাই কথাটা শুনে খুশি হয়ে দু’রাকায়াত শোকরানার নামায পড়েছি।

তোর ঐ চাচা তোকে ছেলের মতো গ্রহণ করেছেন বলে হয়তো এই কথা বলছিস; কিন্তু উনি যদি তোকে গ্রহণ না করতেন, তা হলেও কি এই কথা বলতিস?

অফকোর্স! আমি এখন সাবালক, আমাকে চাচা গ্রহণ না করলেও ওনার প্রতি বা মায়ের প্রতি এতটুকু অসন্তুষ্ট হতাম না। এমন কী ওনাদের উপর এতটুকু মনকষ্টও হত না। এজন্য ওনারা আল্লাহর কাছে দায়ীও হতেন না। চাচা আমাকে গ্রহণ করে উদার মনের পরিচয় দিয়েছেন।

আর আমি যদি বলি, “তোর বাবার সম্পত্তি গ্রাস করার জন্য উনি তোর মাকে বিয়ে করেছেন?

তা বলতে পারিস, তবে আমার সেরকম মনে হয়নি। তা ছাড়া চাচা যদি সেরকম ভেবে কাজটা করে থাকেন, তবুও ওনাকে দোষ দিতে পারব না। কারণ ঐ সময়ে মায়ের একজন গার্জেনের খুব দরকার ছিল।

এমন সময় চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন ও মেম্বার সামাদ মিয়াকে আসতে দেখে রবিউল বলল, ডান দিকের লম্বা চওড়া লোকটা চেয়ারম্যান, আর সঙ্গের হ্যাংলা পাতলা লোকটা সামাদ চেম্বার। ওনাদের সঙ্গে তোর পরিচয় হয়েছে?

শফি বলল, চেয়ারম্যানের সঙ্গে হয়নি, তবে সামাদ মেম্বারের সঙ্গে গতকাল হয়েছে।

ওনারা কাছাকাছি আসতে শফি ও রবিউল একসঙ্গে সালাম দিল।

চেয়ারম্যান রবিউলকে চেনেন। সালামের উত্তর দিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাবা কেমন আছেন।

জি, ভালো আছেন।

তা তোমার সঙ্গের ছেলেটাকে তো চিনতে পারছি না। তোমাদের কোনো আত্মীয় না কি?

রবিউল কিছু বলার আগে সামাদ মেম্বার বললেন, ছেলেটা ওদের আত্মীয় হতে যাবে কেন? ওর নাম শফি। ওতো আমাদের গ্রামের মরহুম আমিনুল ইসলামের ছেলে। ন’দশ বছরের সময় হারিয়ে গিয়েছিল, কয়েকদিন হল ফিরে এসেছে।

চেয়ারম্যান কিছুক্ষণ শফির আপাদমস্তক দেখে বললেন, তাই না কি? দেখে মনে হচ্ছে এখন ওর বয়স প্রায় ত্রিশের মতো। তা এই বিশ বছর কোথায় ছিল? এত বছর পর ফিরেই বা এল কী করে? তা ছাড়া ওযে আমিনুল ইসলামের হারিয়ে যাওয়া ছেলে তার কোনো প্রমাণ পাওয়া গেছে? আজকাল তো মাঝে মধ্যে শোনা যায়, মতলববাজ লোকেরা খোঁজ খবর নিয়ে সম্পত্তি গ্রাস করার জন্য নিজেদের একজনকে হারান ছেলে সাজিয়ে পাঠিয়ে দেয়। এটা সেরকম কোনো ব্যাপার নয়তো? শুনেছি আমিনুল ইসলাম অনেক সম্পত্তি রেখে মারা গেছেন।

সামাদ মেম্বার বললেন, আমার যতদূর বিশ্বাস সেরকম কিছু নয়। আমিনুল ইসলামের মা বেঁচে আছেন। তিনি খুব ধার্মীক ও বিচক্ষণ মহিলা। প্রমাণ না পেলে তিনি কী ওকে গ্রহণ করতেন। তা ছাড়া গতকাল আমার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। কথাবার্তায় তেমন কোনো সন্দেহ হয়নি। ওর বাবার। সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিল। তেমন কিছু হলে আত্মীয়-স্বজনেরাই বা মেনে নিল কেন?

চেয়ারম্যান শফির দিকে তাকিয়ে নাম জিজ্ঞেস করলেন।

ওনার কথা শুনে শফি বুঝতে পারল, চেয়ারম্যান খুব ঘাগু লোক। নাম জিজ্ঞেস করতে নাম বলে মুখ নিচু করে নিল।

কেন কী জানি শফিকে খুব ভালো ছেলে বলে মনে হল চেয়ারম্যানের। তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, একদিন আমাদের বাড়িতে এস, আলাপ করব। তারপর সামাদ মেম্বারকে বললেন, চলুন যাই।

যেতে যেতে সামাদ মেম্বার বললেন, কয়েকদিন মাত্র ফিরে এসেছে, এরই মধ্যে ছেলেটার অনেক গুণ প্রকাশ পেয়েছে।

চেয়ারম্যান বললেন, যেমন?

ছেলেটা খুব নামাযি পরহেজগার, সারারাত নাকী মসজিদে এবাদত করে, গরিবদের প্রতি খুব দয়ালু, তাদেরকে আর্থিক সাহায্য করে, ওর পানি পড়াতে অনেকের অসুখ ভালো হয়ে গেছে।

চেয়ারম্যান হেসে উঠে বললেন, তা হলে তো ওর জন্য এখানকার ডাক্তারদের রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে।

সামাদ মেম্বার বললেন, আপনি যাই বলেন, আমার পাঁচ বছরের নাতি পেট ব্যথায় খুব ছটফট করছিল। আমার ছেলে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছিল। রাস্তায় ওর সঙ্গে দেখা হতে নাতির কান্নার কারণ জেনে পাশের চায়ের দোকান থেকে এক কাপ পানি নিয়ে কিসব পড়ে ফুঁ দিয়ে খাইয়ে দিল। খাওয়ার দু’এক মিনিটের মধ্যে নাতির পেটের ব্যথা ভালো হয়ে গেল।

চেয়ারম্যান কিছু না বলে চুপ চাপ হাঁটতে হাঁটতে চিন্তা করতে লাগলেন, সামাদ মেম্বারের কথা যদি সত্যি হয়, তা হলে ছেলেটার গুণ আছে বলতে হয়।

০২. মাদারীপুর জেলার চর দৌলতখান গ্রাম

মাদারীপুর জেলার চর দৌলতখান গ্রামের মল্লিকদের আর্থিক অবস্থা বেশ স্বচ্ছল। মুহাম্মদ শফি ওরফে শফি এ বংশের আমিনুল ইসলাম মল্লিকের একমাত্র সন্তান। শফি দেখতে খুব সুশ্রী। স্মরণশক্তি প্রখর। দশ বছর বয়সে কুরআনের হাফেজ হয়। সেই সাথে ফাঁইভের বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে বৃত্তি পায়।

একই গ্রামের দূর সম্পর্কের ভাই রবিউলের সঙ্গে শফির খুব ভাব। একদিন বিকেলে রবিউল ও পাড়ার অন্যান্য ছেলেদের সঙ্গে খেলাধুলা করার সময় শফি হারিয়ে যায়। বাবা আমিনুল ইসলাম ও আত্মীয়রা অনেক খোঁজাখুজি করেও পাইনি। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে মা সাজেদা খাতুন। খুব কান্নাকাটি করতে থাকেন। বাবা আমিনুল ইসলাম কান্নাকাটি না করলেও বেশ ভেঙ্গে পড়েন এবং বছর খানেকের মধ্যে হঠাৎ একদিন মারা যান।

শফির দাদা কুরআনের হাফেজ ছিলেন। ওনার ছেলে আমিনুল ইসলামকেও হাফেজ করার জন্য হাফিজিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করেন। কিন্তু বছর দুয়েকের মধ্যে খুব কঠিন অসুখ হয়ে আমিনুল ইসলামের মেধা শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। কোনো রকমে দাখিল পর্যন্ত পড়ে আর পড়াশোনা করেনি। বাবার সঙ্গে জমি-জায়গা দেখাশোনা করতেন। ছেলের বিয়ে দেয়ার দু’বছর পর আমিনুল ইসলামের বাবা মারা যান। আমিনুল ইসলাম খুব সুপুরুষ ছিলেন। পরিশ্রমীও ছিলেন। বাবা অনেক সম্পত্তি রেখে গেলেও বিভিন্ন কাজ কর্ম করে ও নিজের জমি-জায়গা আবাদ করে আরও অনেক সম্পত্তি বাড়ান।

তিনি মারা যাওয়ার পর ওনার স্ত্রী সাজেদা খাতুন প্রায় তিন বছর শাশুড়ী জমিলা খাতুনের কাছে থাকেন। এর মধ্যে আমিনুল ইসলামের চাচাত ভাই জাকির হোসেনের স্ত্রী-দুই ও চার বছরের দু’টো ছেলে মেয়ে রেখে মারা যান। স্ত্রী মারা যাওয়ায় ছেলেমেয়ে দুটোর কষ্ট দেখে আবার। বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে সাজেদাকে বিয়ে করার জন্য চাচি জামিলা খাতুনের কাছে প্রস্তাব দেন।

সাজেদা খাতুন সুন্দরী ও স্বাস্থ্যবতী। শফি তার একমাত্র সন্তান। শফি হারিয়ে যাওয়ার পর কেঁদে কেঁদে ও ঠিকমতো না খেয়ে না ঘুমিয়ে স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছিল। ইদানিং আবার আগের মতো স্বাস্থ্য ফিরে এসেছে।

সাজেদার বাবার অবস্থাও স্বচ্ছল। জামাই মারা যাওয়ার কিছুদিন পর একদিন এসে মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার কথা জমিলা খাতুনকে বললেন।

জমিলা খাতুন বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমার বিশ্বাস আল্লাহ চাহে তো শফি একদিন ফিরে আসবে। তবু বলব আপনারা মেয়েকে বলে দেখুন, সে যদি যেতে চায়, আমার আপত্তি নেই।

বাবাকে শাশুড়ীর সঙ্গে কথা বলতে দেখে সাজেদা খাতুন আড়ালে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শাশুড়ীর কথা শুনে সামনে এসে বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমি তোমার সঙ্গে যাব না। তারপর ডুকরে কেঁদে উঠে বললেন, শাশুড়ীর মতো আমারও বিশ্বাস, শফি একদিন না একদিন আমার কোলে ফিরে আসবে।

সাজেদা খাতুনের বাবা অনেক বুঝিয়েও মেয়েকে রাজি করাতে পারলেন না। এরপর তিন বছর পার হয়ে গেছে। স্বাস্থ্যবতী ও রূপবতী বৌকে কোননা পুরুষহীন ঘরে আগলে রাখা যে খুব কঠিন। তা জামিলা খাতুন এতদিনে বুঝতে পেরেছেন। তাই চাচাত দেবরের ছেলে জাকিরের স্ত্রী মারা যাওয়ার পর যখন সাজেদাকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তাব দিল তখন অমত করলেন না। বললেন, সাজেদার মতামত নিয়ে তোমাকে জানাব।

জমিলা খাতুন সাজেদার মা বাবাকে ডেকে পাঠালেন। ওনারা আসার পর সুবিধে অসুবিধের কথা জানিয়ে দেবরের ছেলে জাকিরের প্রস্তাব দেয়ার কথা জানালেন।

সাজেদার মা বাবা বললেন, এটা খুব ভালো কথা। আমাদের কোনো আপত্তি নেই। এ কাজ হলে বরং খুশি হব।

জমিলা খাতুন সাজেদাকে ডেকে ওনাদের সামনে সবকিছু বলে মতামত জানতে চাইলেন।

সাজেদা প্রথমে অনেক কান্নাকাটি করে অমত প্রকাশ করলেও মা বাবা ও শাশুড়ীর বোঝনর ফলে রাজি হলেন।

এর দশ পনের দিনের মধ্যে জাকির হোসেন সাজেদাকে বিয়ে করেন। তারপর থেকে জাকির হোসেন চাচির সংসার ও চাষাবাদ দেখা শোনা। করেন।

প্রায় বিশ বছর পর শফি ঘরে ফিরে এলে দাদি জমিলা খাতুন কেঁদে কেঁদে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন।

সাজেদা খাতুনও ছেলের ফিরে আসার কথা শুনে কেঁদে কেঁদে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে স্বামীকে বললেন, আমি শফির সঙ্গে দেখা করতে যাব।

জাকির হোসেন বললেন, নিশ্চয় দেখা করবে। যাও, এক্ষুনি যাও।

শফি বাবা মারা গেছেন জেনে দুঃখ পেলেও মা আবার বিয়ে করেছে শুনে দুঃখ পাইনি। বরং খুশি হয়েছে।

সাজেদা খাতুন যখন এলেন তখন শফি দাদির সঙ্গে কথা বলছিল।

শফি অল্পক্ষণ ওনার দিকে চেয়ে থেকে চিনতে পেরে সালাম দিয়ে কদমবুসি করল। তারপর মা বলে জড়িয়ে ধরল।

সালামের উত্তর দিয়ে সাজেদা খাতুন ছেলের মাথায় চুমোখেয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, আমার দৃঢ়বিশ্বাস ছিল আল্লাহ তোকে একদিন না একদিন আমার কোলে ফিরিয়ে দেবেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, এতদিন কোথায় ছিলি বাবা? একটা চিঠি দিয়েও এই হতভাগী মাকে খবর দিতে পারতিস? আজ তোর বাবা বেঁচে থাকলে কত খুশি হত।

শফিও চোখের পানি ধরে রাখতে পারল না। চোখ মুছে ভিজে গলায় বলল, বিশেষ কারণে চিঠি দিতে পারিনি। তবু অন্যায় করেছি মাফ করে দাও মা বলে দু’পা জড়িয়ে ধরল।

মা ও ছেলেকে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করতে দেখে জমিলা খাতুন বৌকে উদ্দেশ্য করে বললেন, বৌমা, এবার কান্নাকাটি থামাও। আল্লাহ তোমার মনের আশা পূরণ করেছেন, সেজন্য তার শুকরিয়া আদায় করে সবর কর।

সাজেদা খাতুন কান্না থামিয়ে শাড়ির আঁচলে নিজের চোখ মুখ মুছে ছেলের মুখ মুছে দেয়ার সময় বললেন, এতদিন কোথায় ছিলি বললি না যে?

শফি বলল, ওসব কথা এখন থাক, পরে এক সময় বলব।

সাজেদা খাতুন বললেন, আবার চলে যাবি না তো?

শফি বলল, না মা যাব না।

সাজেদা খাতুন বললেন, এখন যাই, পরে আসব বলে চলে গেলেন।

এরপর থেকে সাজেদা খাতুন বর্তমান স্বামীর সংসার করলেও প্রতিদিন এবাড়িতে শফির সঙ্গে দেখা করতে এসে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে যান। একদিন তিনি সুযোগ মতো শফিকে জিজ্ঞেস করলেন, কোনো কারণে তুই কি আমার উপর অসন্তুষ্ট হয়েছিস?

শফি বলল, আমার ব্যবহারে সেরকম কিছু কি তুমি দেখতে পেয়েছ?

সাজেদা খাতুন বললেন, না, তা পাইনি। তবু জিজ্ঞেস করলাম।

শফি বলল, আল্লাহ যদি মেহেরবানী করে ধর্মের জ্ঞান না দিতেন, তা :হলে হয়তো তোমার দ্বিতীয় বিয়ে মেনে নিতে পারতাম না। ধর্মীয় জ্ঞান থাকার ফলে তোমার প্রতি এতটুকু অসন্তুষ্ট না হয়ে বরং সন্তুষ্ট হয়েছি। তুমি অন্যের স্ত্রী হলেও আমার মা। ছেলের কাছে মা কী জিনিস সে জ্ঞানও আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। তুমি দোয়া করো মা, “আল্লাহ যেন সেই জ্ঞান মোতাবেক তোমার সেবা যত্ন করার তওফিক আমাকে দেন”।

ছেলের কথা শুনে সাজেদা খাতুনের কলিজা জুড়িয়ে গেল। ভিজে গলায় বললেন, আল্লাহ তোকে আরও ধর্মীয় জ্ঞান দিক, তাঁর প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুক। দু’চার দিন পরে তোর নানাদের বাড়িতে গিয়ে সবাইকে দেখা দিয়ে আয়। তোকে দেখে সবাই খুশি হবে। এখন যাই, পরে আবার আসব, হাতের কাজ ফেলে এসেছি বলে চলে গেলেন।

০৩. চেয়ারম্যান সালাউদ্দিনের বাড়ি

চেয়ারম্যান সালাউদ্দিনের বাড়ি চরদৌলতখান থেকে তিন চার কিলোমিটার উত্তরে শিকারমন্ডল গ্রামে। এই গ্রামের রাস্তা দিয়ে শফির নানাবাড়ি নলছটি যেতে হয়। সপ্তাহ খানেক পরে শফি নানাবাড়ি গেল। তাকে দেখে নানা-নানি, মামা মামি এবং তাদের ছেলেমেয়েরা যেমন অবাক হলেন, তেমনি খুশিও হলেন। আদর আপ্যায়নের পর সবাই তার কাছ থেকে হারিয়ে যাওয়ার পর এতদিন কোথায় ছিল এবং কিভাবে ফিরে এল জানতে চাইল।

শফি জানত নানা বাড়িতে এরকম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। তাই কী বলবে আগেই ভেবে রেখেছিল। এখন তাদের কথার উত্তরে বলল, কেমন করে হারিয়ে গিয়ে ছিলাম মনে নেই। যেখানে মানুষ হয়েছি সেখানে থাকার সময় এখানকার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। আর কেমন করে ফিরে এলাম তাও জানি না। ফিরে আসার পর ওখানকার সবকিছু ভুলে গেছি। মনে হচ্ছে এত বছর স্বপ্নের মতো কেটেছে। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে মানুষ যেমন অনেক কিছু দেখে তারপর ঘুম ভেঙ্গে গেলে সেসব মনে থাকে না, আমারও ঠিক তেমনি মনে হচ্ছে। সবাই তার কথা বিশ্বাস করলেও তার নানা জহির উদ্দিন বিশ্বাস করেন নি। তাই একসময় গোপনে তাকে বললেন, তুমি ভাই যা কিছু বলেছ, তা সব বানানো। আসল ঘটনা বলতে শুনি।

শফি বলল, আপনি ঠিক বলেছেন। যা বলেছি সব বানানো। যিনি আমাকে নিয়ে গিয়ে মানুষ করেছেন ফিরে আসার সময় তিনিই আমাকে ওয়াদা করিয়েছেন। আসল ঘটনা কাউকে যেন না বলি। বললে আমার ভীষণ ক্ষতি হবে। তা ছাড়া ওয়াদা ভঙ্গ করাও কঠিন গোনাহ। আর ওয়াদা ভঙ্গকারীকে আল্লাহ পছন্দ করেন না।

চার পাঁচ দিন নানা বাড়িতে থেকে ফেরার সময় শিকারমন্ডল গ্রামের রাস্তায় এসে দেখল, কয়েকটা যুবক ছেলের সঙ্গে চেয়ারম্যানের ছেলে মহসিন কথা বলছে। তখন তার সাথে কয়েকদিন আগে চরদৌলতখান গ্রামের রাস্তায় গোলমাল হওয়ার ঘটনা মনে পড়ল।

সেদিন মহসিন ফুপাত বোন ডালিয়ার সামনে শফির কাছে হেরে গিয়ে খুব অপমানিত হয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল, যেমন করে তোক এর বদলা নেবে। হঠাৎ কয়েকদিন আগে তাকে এই পথ দিয়ে যেতে দেখে কোথায় কাদের বাড়ি যাচ্ছে জানার জন্য রাসেল নামে একটা ছেলেকে তার পিছনে চর লাগিয়েছিল।

রাসেলের নানার বাড়িও নলছটি গ্রামে। সে শফির পিছু নিয়ে তার সঙ্গে আলাপ করতে করতে তার নানার বাড়িতে এল। আলাপ করার সময় শফি কবে ফিরবে জেনে নিল। আজ সকালে ফিরে এসে মহসিনকে সেকথা জানিয়েছিল।

মহসিন চার পাঁচজন বন্ধুকে সেদিনের ঘটনাটা সত্য মিথ্যা জানিয়ে শফিকে শায়েস্তা করার জন্য তাদেরকে নিয়ে অপেক্ষা করছিল। মহসিনের কথামতো তারা পাঁচটা লাঠি রাস্তার ধারে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছে।

কাছে এসে শফি চলন্ত অবস্থায় সবার উদ্দেশ্য সালাম দিল। কেউ সালামের উত্তর দিল না দেখে থমকে দাঁড়িয়ে বলল, কী ভাই, আপনারা কেউ সালামের উত্তর দিলেন না যে? জানেন না, সালামের উত্তর দেয়া মুসলমানের জন্য ওয়াজিব? না দিলে ওয়াজিব তরকের গুণাহ হবে?

এই কথা বলার পরও যখন কেউ কিছু বলল না তখন মহসিনের দিকে চেয়ে বলল, আপনারা সবাই মুসলমান কিনা জানি না; কিন্তু সেদিন রবিউলের কাছে আপনার পরিচয় পেয়েছি। আপনি মুসলমান হয়েও সালামের উত্তর দিলেন না, এটা কি ঠিক করলেন?

মহসিন তার কথা গ্রাহ্য না করে বন্ধুদের ঈশারা করতেই তারা পাঁচজন পাঁচটা লাঠি নিয়ে শফিকে ঘিরে ফেলল।

শফি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমি তো আপনাদের কোনো ক্ষতি করি নি। তবু কেন আমাকে লাঠিপেটা করতে চাচ্ছেন? যদি বলেন সেদিন মহসিন ভাইয়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিলাম, তা হলে বলব আপনাদের উচিত হবে পুরো ঘটনা বাদি বিবাদীর কাছ থেকে জেনে তারপর কিছু করার সিদ্ধান্ত নেয়া।

মহসিন এতক্ষণ ধৈর্য ধরতে পারলেও আর পারল না। বলল, ঐ শালার কথা কী শুনছিস? মেরে তক্তা বানিয়ে রাস্তায় ফেলে রাখ।

তার কথা শুনে শফি তাদেরকে দু’হাত তুলে থামতে বলে বলল, আগে মহসিন ভাই ওয়াদা করুক সেদিনের মতো রিভলবার বের করবেন না।

কেউ কিছু বলার আগে মহসিন বলল, ঠিক আছে, তাই হবে।

সবার আগে আমজাদ নামে একটা ছেলে শফির মাথায় লাঠির বাড়ি মারতে গেল।

শফি তার লাঠিটা ধরে কেড়ে নিয়ে তার একটা পায়ে বাড়ি লাগাল।

লাঠির বাড়ি খেয়ে আমজাদের মনে হল, পাটা ভেঙ্গে গেছে। লেংচে লেংচে সরে যেতে যেতে বলল, শালা আমার পা ভেঙ্গে দিয়েছে রে।

আমজাদের অবস্থা দেখে ও তার কথা শুনে বাকি চারজন একসঙ্গে শফিকে আক্রমণ করল।

শফি আমজাদের কেড়ে নেয়া লাঠি দিয়ে প্রথমে তাদের আক্রমণ। ঠেকাল। তারপর একে একে চারজনেরই একটা করে পা লাঠির বাড়ি মেরে ভেঙ্গে দিল।

পাঁচজনের একই অবস্থা দেখে মহসিন রাগের চোটে ওয়াদার কথা ভুলে গেল। তাড়াতাড়ি রিভলবার বের করে শফিকে গুলি করতে গেল।

শফি পাঁচজনের সঙ্গে লড়াই করলেও মহসিনের দিকে লক্ষ্য রেখেছিল। তাই তাকে রিভলবার বের করতে দেখে দ্রুত তার কাছে এসে রিভলবার ধরা হাতে খুব জোরে লাঠির বাড়ি মারল।

ততক্ষণে মহসিন ট্রিগার টিপলেও গুলি শফির গয়ে লাগল না।

তার রিভলবারটা ছিটকে দূরে পড়ে গেল। সে বুঝতে পারল, তার হাত ভেঙ্গে গেছে। প্রচণ্ড যন্ত্রণা অনুভব করে হাত ধরে চিৎকার করে বলল, কে কোথায় আছ, তাড়াতাড়ি এসে এই শালা গুন্ডাকে ধরে বেঁধে ফেল। তারপর থানায় ফোন করে দারোগাকে পুলিশ নিয়ে আসতে বল।

গুলির শব্দ পেয়ে আশ পাশের ঘর থেকে অনেক লোকজন ও ছেলেমেয়ে বেরিয়ে আসতে লাগল। মহসিনদের ঘর একটু দূরে হলেও তার বাবাও বেরিয়ে এলেন। ওনার পিছন পিছন ডালিয়াও এল।

সবার দিকে একবার চেয়ে নিয়ে শফি রিভলবারটা কুড়িয়ে মহসিনের দিকে তাক করে বলল, লোকজন কেউ আমার কাছে আসতে সাহস পাবে না। আর দারোদা পুলিশ নিয়ে আসার আগে আমি যদি আপনাকে এবং আপনার বন্ধুদের একটা করে গুলি করি, তা হলে কেমন হয়? তারপর দারোগা সাহেব এসে যখন সারজমিন করে পুরো ঘটনা জানবেন তখন আমাকে নয়, আপনাকে এবং আপনার এই বন্ধুদের এরেস্ট করে থানায় নিয়ে যাবেন। ভাববেন না, দারোগা সাহেবকে অনেক টাকা ঘুষ দিয়ে ঘটনা। উল্টো দিকে নিয়ে যাবেন, তা হলে কেস আরও জটিল হবে। এই সব লোকজন কিন্তু আমার পক্ষে সাক্ষি দেবেন।

শফির কথা শুনে ও তার দিকে রিভলবার তাক করা রয়েছে দেখে মহসিনের মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেল। কোনো কথা বলতে না পেরে ফ্যাল ফ্যাল করে তার মুখের দিকে চেয়ে রইল।

তার অবস্থা দেখে শফি মৃদু হেসে বলল, ভয় নেই, গুলি করব না। জন্ম মৃত্যু আল্লাহর হাতে, তাই ছেড়ে দিলাম। তারপর আকাশের দিকে ফায়ার করে চেম্বার খালি করে রিভলবারটা লোকজনের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে মহসিনকে উদ্দেশ্য করে বলল, শুনেছি চেয়ারম্যান সাহেব আপনাকে মানুষের মতো মানুষ করার জন্য উচ্চ ডিগ্রী নেয়ার জন্য ঢাকা ভার্সিটিতে পড়াচ্ছেন। আমার মনে হয় সেখানে আজে বাজে ছেলেদের সঙ্গে মিশে মানুষ না হয়ে অমানুষ হয়েছেন। তারপর তার বন্ধুদেরকে উদ্দেশ্য করে বলল, মনে হয় আপনারা লেখাপড়া করলেও ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করেন নি। তাই আসল ঘটনা না জেনে ও ভালোমন্দ বিচার না করে মহসিন ভাইয়ের কথায় আমাকে শায়েস্তা করতে চেয়েছিলেন। মনে রাখবেন মানুষ যতই উচ্চ ডিগ্রী নিক না কেন, সেই সঙ্গে যদি ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন না করে, তা হলে মানুষের মতো মানুষ হতে পারবে না। যাই হোক, আপনাদেরকে আহত করার জন্য দুঃখিত। তবে একেবারে ভেঙ্গে ফেলার জন্য খুব জোরে আঘাত করিনি। ডাক্তারের কাছে প্লাস্টার করিয়ে নিলে কিছুদিনের মধ্যে ভালো হয়ে যাবেন। এবার আসি, আল্লাহ হাফেজ বলে শফি হাঁটতে শুরু করল।

সাড়ে ছ’ফুট লম্বা সুন্দর সৌম্য চেহারা ও সু-স্বাস্ত্যের অধিকারী শফির দিকে চেয়ে এতক্ষণ সবাই অবাক হয়ে তার কথা শুনছিল। চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন শফিকে চিনতে পেরেছেন। ছেলে মহসিন ও তার পাঁচজন বন্ধুর সঙ্গে তার লড়াই দেখে খুব অবাক হয়েছেন। লড়াই শেষে তার কথা শুনে মনে মনে তারিফ না করে পারলেন না। তাকে চলে যেতে দেখে বললেন, এই ছেলে দাঁড়াও।

শফি কথা বলার সময় চেয়ারম্যানকে দেখে চিনতে পেরেও না চেনার ভান করেছিল। এখন ওনার গলা শুনে থমকে ঘুরে দাঁড়াল।

চেয়ারম্যান বললেন, আমার কাছে এস।

শফি কাছে এসে সালাম বিনিময় করে বলল, বলুন, কী বলবেন।

কয়েকদিন আগে পথে রবিউলের সঙ্গে তোমাকে দেখেছিলাম। তোমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর তোমাকে আমাদের বাড়িতে আসতে বলেছিলাম মনে আছে?

জি, আছে।

মনে হয় এখানে কারও বাড়িতে এসেছিলে, অথচ আমার সঙ্গে দেখা না করে চলে যাচ্ছিলে কেন?

এখানে কারও বাড়িতে আসিনি। নলছটিতে নানার বাড়ি চার-পাঁচ দিন আগে গিয়েছিলাম। আজ ফিরছিলাম। এখানে আপনার বাড়ি জানলে নিশ্চয় দেখা করতম।

এখন চল না, কিছু নাস্তা পানি করে যাবে।

শুকরিয়া। ধৃষ্টতা মাফ করবেন, আজ নয়, অন্য একদিন এসে নাস্তাপানি করব। এবার যাবার অনুমতি দিন।

ঠিক আছে, যাও। একদিন এস কেমন?

জি আসব বলে শফি সালাম বিনিময় করে হাঁটতে শুরু করল।

শফির চলে যাওয়ার দিকে সবাই চেয়ে রইল। রাস্তার বাঁকে আড়াল হয়ে যাবার পর চেয়ারম্যান একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ছেলে ও তার বন্ধুদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ঐ ছেলেটার কথাই ঠিক, তোমরা লেখাপড়া করে মানুষ না হয়ে গুডা হয়েছ। তাও ভালো গুণ্ডা হতে পার নি। তা না হলে একটা নিরস্ত্র ছেলে স্বসস্ত্র ছয়জনকে মেরে হাত পা ভেঙ্গে দিয়ে বিজয়ীর বেশে চলে গেল কী করে? শুধু তাই নয়, সে যে কথাগুলো বলে গেল, সেগুলো খুব মূল্যবান। আশা করি, তার মূল্যবান কথাগুলো মগজে ঢুকিয়ে মানুষ হওয়ার চেষ্টা করবে। যদি কোনো দিন শুনি, তোমরা ওর পিছনে লেগেছ, তা হলে মনে রেখো, আমিই তোমাদেরকে জেলে পাঠাবার ব্যবস্থা করব। কথা শেষ করে ভাগ্নি ডালিয়াকে নিয়ে বাড়ি যেতে যেতে বললেন, ঘটনা দেখে মনে হচ্ছে, ঐ ছেলেটার সঙ্গে মহসিনের আগে কোনো ঘটনা ঘটেছিল। তুই কি এ ব্যাপারে কিছু জানিস?

লড়াই করার সময় শফির মোবাইল পড়ে গিয়েছিল। ডালিয়া সবার অলক্ষ্যে সেটা কুড়িয়ে নিয়ে পেটকাপড়ে রেখেছিল। মামার কথা শুনে সেটাতে হাত বুলিয়ে দেখে নিয়ে সেদিনের ঘটনা জানিয়ে বলল, আমার ধারণা ছেলেটা যেদিন এখান দিয়ে তার নানার বাড়ি যায়, সেদিন মহসিন ভাই দেখে থাকবে এবং কবে ফিরবে সেখবরও রেখেছিল। তাই আগের ঘটনার অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য বন্ধুদের নিয়ে ওতপেতেছিল।

হ্যাঁ মা, তোর কথা শুনে আমারও তাই মনে হচ্ছে। একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিস, ছেলেটার কী দূরন্ত সাহস? ভীন গায়ে এসে পাঁচ ছয়জন স্বসস্ত্র ছেলের সাথে খালি হাতে কীভাবে লড়াই করে তাদেরকে আহত করল?

মহসিনের সঙ্গে ডালিয়ার বিয়ের কথা পাকা হয়ে আছে। তবু শফি লাঠি মেরে তার হাত ভেঙ্গে দিলেও তার মনে কোনো প্রক্রিয়া হয়নি বরং শফির সাহসিকতা ও লড়াই এর নৈপুণ্য তাকে মুগ্ধ করেছে। মামাকে শফির গুণগান করতে শুনে বলল, হ্যাঁ মামা আপনি ঠিক বলেছেন। প্রথম দিনের ঘটনা দেখে আমারও তাই মনে হয়েছিল। তারপর জিজ্ঞেস করল, ছেলেটাকে আপনি চেনেন?

হ্যাঁ চিনি। চরদৌলতখান গ্রামের ছেলে। দশ বছর বয়সের সময় হারিয়ে গিয়েছিল। ছেলের শোকে ওর বাবা একবছরের মধ্যে মারা যায়। তিন চার বছর পর ছেলেটার দাদি তার চাচাতো দেবরের ছেলের সঙ্গে ওর মায়ের বিয়ে দেন। কিছুদিন আগে ছেলেটা ফিরে এসেছে।

ডালিয়া অবাক হয়ে বলল, ওমা, তাই না কী? তারপর জিজ্ঞেস করল, ছেলেটা ফিরে এসে মায়ের বিয়ের কথা জেনে কী করল?

তা আমি জানব কী করে? তবে ঐ গ্রামের একজন মেম্বারের কাছে শুনলাম, ছেলেটা ভালো, ধর্ম কর্ম মেনে চলে। তাই হয়তো মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে মেনে নিয়েছে।

ওদের আর্থিক অবস্থা কেমন?

পূর্বপুরুষদের অনেক জমি জায়গা ছিল, প্রতিপত্তিও ছিল। এখন ওয়ারীশ বেশি হয়ে যাওয়ায় আগের মতো অবস্থা নেই। তবে ওর বাবা মা-বাবার একমাত্র সন্তান হওয়ায় অন্যদের চেয়ে ভালো। ওর চাচাত চাচা জাকির হোসেনের সঙ্গে ওর মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে হওয়ার পর সেইই জমি-জায়গা দেখাশোনা করছে। এবার হয়তো ছেলেটাই সেসব দেখাশোনা করবে।

ডালিয়া বলল, যদি উনি না দেন?

চেয়ারম্যান হেসে উঠে বললেন, বাবার সম্পত্তি ছেলেকে ফিরিয়ে দেবে না কেন? সেই তো এখন সব সম্পত্তির মালিক। এবার একটা কথা বলতো, ঐ ছেলেটার ব্যাপারে তুই এত কিছু জানতে চাচ্ছিস কেন?

প্রথম দিনের ঘটনার সময় শফিকে দেখেও তার কার্যকলাপ ও কথা বার্তায় ডালিয়া মুগ্ধ হয়েছিল। সকালে যখন মহসিনভাই তাকে বলল, ছেলেটা চার পাঁচদিন আগে আমাদের গ্রামের রাস্তা দিয়ে নানার বাড়ি গিয়েছিল আজ ফিরবে। তখন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তুমি কী সেদিনের বদলা নিতে চাও?

মহসিন বলেছিল হ্যাঁ, আজ ব্যাটাকে বুজিয়ে দেব কত ধানে কত চাল। এমন শিক্ষাদেব, আর কখনও আমার দিকে যেন চোখ তুলে চাইতে না পারে।

ডালিয়া আতংকিত হলেও সংযত কণ্ঠে বলেছিল, কাজটা কী ভালো হবে? মামা জানলে তোমাকেই রাগারাগি করবেন।

তা করুক, তুই কিন্তু বাবাকে আগে থেকে কিছু বলবি না। তারপর বলল, একেবারে কী জানে মারব, শুধু পাটায় করে তুলে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করব। তুই-ই বলনা, সেদিন আমাকে কত বড় অপমান করেছিল।

ডালিয়া বলল, সেদিন আমি দোষ করেছিলাম। তাই উনি আমাকে কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন। তাতে ওনার দোষ কোথায়? বরং তুমি উল্টো ওনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিলে। আসলে তুমি নিজের দোষে নিজে অপমানিত হয়েছ। উনি তোমাকে অপমান করেন নি।

মহসিন বিদ্রূপ কণ্ঠে বলল, কি ব্যাপার বলতো? তুই যে দেখছি ঐ শালা ছোটলোকের ফরে কথা বলছিস?

ডালিয়া বিদ্রূপটা গায়ে মাখল না। বলল কারও ফরে কথা বলতে যাব কেন? যা সত্য তাই বললাম। এই যে ওনাকে শালা ছোটলোক বললে, এতে ওনাকে অপমান করার চেয়ে নিজেই অপমানিত হলে বেশী।

মহসিন রেগে উঠে বলল, থাক, তোকে আর উপদেশ দিতে হবে না। শালা কতবড় বীর আজ দেখে ছাড়ব। আবার বলছি, তুই কিন্তু বাবাকে কিছু বলবি না।

ডালিয়া আর কিছু না বলে তার কাছ থেকে চলে এসেছিল। তারপর থেকে মহসিনের দিকে লক্ষ্য রেখেছিল। তাই মারামারির ঘটনাটা পুরো দেখে শফির প্রতি আকর্ষন আরও বেড়ে গেছে।

এখন মামা যখন জিজ্ঞেস করলেন, তুই ঐ ছেলেটার ব্যাপারে এতকিছু জানতে চাচ্ছিস কেন তখন লজ্জায় তার মুখটা রাঙা হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, এমনি মনে হল, তাই জিজ্ঞেস করলাম। তারপর ঘরে এসে গোসল করার কথা বলে ওনার কাছ থেকে চলে গেল।

চেয়ারম্যান প্রশ্নটা করে ভাগ্নির মুখের দিকে তাকিয়ে লজ্জারাঙা মুখ দেখেছেন। তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবলেন, ছেলেটা কী ওর মনে দাগ কেটেছে? হঠাৎ স্ত্রীর কথা মনে পড়ল, আমি ডালিয়াকে মহসিনের বৌ করে ঘরে আনব। অবশ্য তিনিও তাই চান। তাই তাদেরকে স্টাডি করে দেখেছেন, তারা একে অপরকে পছন্দ করে কিনা। আর ডালিয়ার মা বাবা তো এ ব্যাপারে এক পায়ে খাড়া।

০৪. টাইট ফিট প্যান্ট শার্ট পরা ডালিয়া

সেদিন টাইট ফিট প্যান্ট শার্ট পরা ডালিয়াকে হুন্ডা চালাতে দেখে শফি তার প্রতি খুব অসন্তুষ্ট হলেও মুখের দিকে চেয়ে মুগ্ধ হয়েছিল। আজ চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলার সময় ওনার পাশে তাকে শালওয়ার কামিজপরা অবস্থায় দেখে আরও মুগ্ধ হয়েছে। কথা বলতে বলতে যতবার তার দিকে চেয়েছে ততবারই চোখে চোখ পড়েছে। তখন তার মনে হয়েছে, মেয়েটিও তাকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে। ঘরে ফেরার পথে সে কথা মনে। পড়তে দেহ ও মনে এক অজানা শীহরণ অনুভব করল। এইসব চিন্তা করতে করতে ঘরে পৌঁছে গেল।

জমিলা খাতুন রান্নার জোগাড় করছিলেন। নাতিকে ফিরতে দেখে বললেন, এদিকে আয়।

শফি ওনার কাছে এসে সালাম বিনিময় করে বলল, দাদি কেমন আছেন?

জমিলা খাতুন বললেন, আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। তোর নানাদের খবর সব ভালো?

শফি বলল, হ্যাঁ সব খবর ভালো।

জমিলা খাতুন তার বিধ্বস্থ চেহেরা দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কীরে, তোর জামাকাপড়ের অবস্থা এরকম কেন? মনে হচ্ছে যেন মারামারী করে এসেছিস?

শফি মৃদু হেসে বলল, আপনি ঠিক বলেছেন। ফেরার সময় সালাউদ্দিন চেয়ারম্যানের গ্রামের কয়েকটা ছেলের সঙ্গে মারামারী করতে হয়েছে।

এই কয়েকদিনে জমিলা খাতুন জেনে গেছেন, শফি ধার্মিক হলেও খুব শক্তিশালী ও মারামারীতে পটু। এখন নাতির কথা শুনে বললেন, তুই ধার্মিক ছেলে হয়েও মারামারী করিস কেন?

কী করব বলুন, কেউ যদি আন্যায়ভাবে আমাকে মারতে আসে, তা হলে কী ধার্মিক বলে চুপ করে মার খাব?

তুই কিছু না করলে ছেলেগুলো শুধু শুধু তোকে মারতে আসবে কেন? গতকাল রবিউল তোর খোঁজে এসেছিল। তুই নানার বাড়ি গেছিস শুনে বলল, কয়েকদিন আগে নাকি তুই চেয়ারম্যানের ছেলেকে মেরেছিস। সেই ছেলে সুযোগ পেলে লোকজন নিয়ে তোকে পিটিয়ে বদলা নেবে।

হ্যাঁ দাদি, রবিউল ঠিক কথা বলেছে। আর আপনি যা অনুমান করেছেন তাও ঠিক। একটা কথা জেনে রাখুন, আমি যেমন কখনও কোনো অন্যায় করি না তেমনি কেউ অন্যায় করলে বরদাস্ত করতে পারি না। তারপর কয়েকদিন আগে চেয়ারম্যানের ছেলের সঙ্গে কেন গোলমাল হয়েছিল বলে বলল, আমাদের নবী করিম (দ.) বলেছেন, ।কাউকে কোনো অন্যায় কাজ করতে দেখলে অথবা কোথাও কোনো অন্যায় কাজ হতে দেখলে ক্ষমতা থাকলে বাধা দেবে। ক্ষমতা না থাকলে বুঝিয়ে নিষেধ করবে। বোঝাতে গেলে যদি তোমার ক্ষতি করতে পারে বলে মনে হয়, তা হলে মনে মনে। তার বা তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট বা ঘৃণাবোধ করে সেখান থেকে চলে আসবে। আর এটাই সর্ব নিম্নস্তরের ঈমানের প্রমাণ।

জমিলা খাতুন অল্পক্ষণ নাতির মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললেন, এই হাদিস জানতাম না। তবু বলব আজকাল বেশির ভাগ মুসলমান ধর্মের অনেক কিছু জেনেও মেনে চলে না। তুই একা কতজনের প্রতিবাদ করবি।

চোখে যতটুকু হতে দেখব তার প্রতিকার করার চেষ্টা করব। আর এটা করা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য।

শুনেছি চেয়ারম্যান ভালো লোক নন। দু-দুবার তার ছেলেকে পিটিয়েছিস। তোকে সহজে ছেড়ে দেবে বলে মনে হয় না।

চেয়ারম্যানের সঙ্গে দুবার আলাপ হয়েছে। কথাবার্তা ও আচার ব্যবহার তো ভালই মনে হল।

ওটা হল ওনার ভিলেজ পলিটিক্স। মাত্র কিছুদিন হল গ্রামে এসেছিস। ভিলেজ পলিটিক্স বুঝতে তোর সময় লাগবে। যা বলছি শোন, গ্রামের কোনো ব্যাপারেই মাথা গলাবি না। তারপর বললেন, এবার যা, কাপড় পাল্টে হাত মুখ ধুয়ে আয়, আমি নাস্তা রেডি করছি।

জামাকাপড় পাল্টাবার সময় শফি মোবাইল না পেয়ে ভাবল, মনে হয় মারামারী করার সময় পড়ে গেছে। চেয়ারম্যানদের বাড়ির কেউ পেয়ে থাকলে পাওয়া যেতে পারে। নাস্তা খাওয়ার পর রবিউলের কাছে গেল। সালাম ও কুশল বিনিময় করে বলল, তোর মোবাইলটা দেতো।

রবিউল বলল, কেন, তোরটা কী হল?

চেয়ারম্যানের ছেলের ঘটনা বলে শফি বলল, মনে হয় মারামারী করার সময় পড়ে গেছে। ফোন করে জানব কে পেয়েছে।

রবিউল বলল, পেলেও কী দেবে?

দিক না দিক ফোন করেই দেখি। তুই মোবাইল দে।

মোবাইল বের করে দেয়ার সময় রবিউল বলল, আমার তো মনে হয় ফোন করে কোনো কাজ হবে না।

শফি তার কথার উত্তর না দিয়ে ফোন করল।

.

সালাউদ্দিন চেয়ারম্যান খুব ঘাগু লোক। ওনার বাইরের দিক খুব ভালো; কিন্তু মনের ভিতর জিলিপির প্যাঁচ। চোখের সামনে ছেলে ও তার বন্ধুদেরকে ভিন গ্রামের একটা ছেলে হাত পা ভেঙ্গে দিয়ে চলে যেতে দেখে তার সাহস ও শক্তির প্রশংসা করলেও মনে মনে চিন্তা করেছেন, সময় সুযোগ মতো ছেলেটার হাত পা লুলা করে দেবেন। ওনার এক ছেলেও এক মেয়ে। ছেলে মহসিন, মেয়ে রাহেলা। রাহেলা গ্রামের কলেজে বি.এ পড়ছে। আজ সকালে সে কলেজে গিয়েছিল। ফিরে এসে ফুপাত বোন ডালিয়ার কাছে ঘটনা শুনে খুব রেগে গেল। সে তার বাবার চরিত্র জানে। তার চরিত্র ও বাবার মতো। ঘটনা শুনে বলল, বাবা ছেলেটাকে কিছু না বলে যেতে দিল ভেবে খুব অবাক হচ্ছি। বাবা ঘরে আছে কিনা জানিস?

ডালিয়া বলল, কিছুক্ষণ আগে বেরিয়ে যেতে দেখেছি।

ভাইয়া কোথায়?

হাত প্লাস্টার করার জন্য ডাক্তারের কাছে গেছে।

রাহেলা ডালিয়ার চেয়ে দু’বছরের ছোট হলেও তার সঙ্গে তুই তোকারি করে। একদিকে মামাত ফুপাত বোন, তার উপর কিছুদিনের মধ্যে ননদ ভাজ সম্পর্ক হবে। তাই দু’জনের মধ্যে গভীর সম্পর্ক।

এমন সময় মোবাইল রিং হতেই ডালিয়া অন করে কানের কাছে ধরে। চুপ করে রইল।

তাকে চুপ করে থাকতে দেখে রাহেলা বলল, কে ফোন করেছে রে? চুপ করে আছিস কেন?

ডালিয়া নিজের ঠোঁটে একটা আঙ্গুল ঠেকিয়ে তাকেও চুপ করে থাকতে ঈশারা করল।

রাহেলা মোবাইল সেটের দিকে চেয়ে ফিস ফিস করে বলল, এটা কার মোবাইল? ডালিয়া কিছু বলছে না দেখে ঝট করে তার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বলল, কে বলছেন?

এতক্ষণ অপরপ্রান্ত থেকে সাড়া না পেয়ে শফি চিন্তা করছিল, ফোন। রিসিভ করেও কথা বলছে না কেন?

রাহেলা যখন মোবাইল কেড়ে নিয়ে বলল কে বলছেন তখন শফি বলল, দেখুন মোবাইলটা আমার। পথে হারিয়ে গেছে। আপনার পরিচয়টা বলুন, আমি গিয়ে নিয়ে আসব।

রাহেলা বলল, আগে আপনার পরিচয় বলুন।

আমি চরদৌলতখান গ্রমের মরহুম আমিনুল ইসলামের ছেলে শফি।

ডালিয়া ঝট করে তার হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে লাইন অফ করে বলল, আজ সকালের দিকে যে ছেলেটা মহসিন ভাই ও তার বন্ধুদের। হাত পা ভেঙ্গে দিয়েছে এটা তার মোবাইল। মারামারি করার সময় রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল। সবার অলক্ষ্যে আমি কুড়িয়ে নিয়েছি।

রাহেলা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, সুযোগ যখন পেয়েছি তখন প্রতিশোধ না নিয়ে ছাড়ছি না।

ডালিয়া অবাক হয়ে বলল, মহসিন ভাই ও তার পাঁচজন বন্ধু নিয়ে আগের ঘটনার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে কি হাল হল এক্ষুনি বললাম। আর তুই মেয়েছেলে হয়ে কীভাবে প্রতিশোধ নিবি ভেবে পাচ্ছি না। ঐ মতলব বাদ দে।

আগের ঘটনা? সেটা আবার কী? কবেই বা ঘটেছিল বলতো।

ডালিয়া সেদিনকার সেই ঘটনা বলে বলল, আমি তো ছেলেটার তেমন অন্যায় কিছু দেখিনি; কিন্তু মহসিন ভাই রিভলবার বের করে তাকে গুলি করতে গিয়েছিল।

ঘটনা শুনে রাহেলা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রাগের সঙ্গে বলল, ছেলেটা মনে হয় খুব শক্তিশালী ও খুব লড়াকু। সেই অহংকারেই কাউকে গ্রাহ্য করে না। আমি ওর অহংকার চুরমার না করেছি তো আমার নাম পাল্টে রাখব।

কিন্তু কীভাবে করবি আমি তো ভাবতেই পারছি না।

তোকে কিছু ভাবতে হবে না। শোন, আমি নিজে কিছু করব না। যা করার বাবাকে দিয়ে করাব। এমন সময় আবার মোবাইল বেজে উঠতে রাহেলা তার হাত থেকে নিয়ে ধরে বলল, কে বলছেন?

শফি বলল, লাইন কেটে দিলেন কেন? আমি তো আমার পরিচয় বললাম। আপনারটা না বলেই লাইন কেটে দিলেন।

আমি সালাউদ্দিন চেয়ারম্যানের মেয়ে রাহেলা।

শফি সালাম দিয়ে বলল, মোবাইলটা নেয়ার জন্য এখন কী আসব?

রাহেলা সালামের উত্তর দিয়ে বলল, এখন না, বিকেল পাঁচটা সাড়ে পাঁচটার দিকে আসুন। এখন আমি বাড়ির বাইরে আছি।

তাই আসব বলে শফি লাইন কেটে দিল।

ডালিয়া রাহেলাকে বলল, আজই সুযোগটা নিবি বলে ছেলেটাকে মিথ্যে কথা বললি বুঝি?

হ্যাঁ, দেখি বাবা কী করে বলে রাহেলা নিজের মোবাইলে বাবাকে ফোন করল।

চেয়ারম্যান ফোন ধরে বুঝতে পারলেন, মেয়ে ফোন করেছে। বললেন, কীরে মা, কী খবর?

তুমি খুব তাড়াতাড়ি ঘরে এস, জরুরী কথা আছে।

কী এমন জরুরী কথা, বল না শুনি।

সেকথা ফোনে বলা যাবে না। তুমি তাড়াতাড়ি এস।

ঠিক আছে ঘন্টাখানেকের মধ্যে আসছি।

লাইন কেটে দিয়ে রাহেলা বলল, বাবার আসতে একঘন্টা দেরি হবে। চল, ততক্ষণ আমরা সাঁতার কেটে গোসল করে আসি।

দু’জনেই দক্ষ সাঁতারু। ডালিয়া ঢাকায় সুইমিং পুলে সাঁতার শিখে সেখানেই প্রতিদিন একঘন্টা সাঁতার কাটে। আর রাহেলা ছোটবেলা থেকে তাদের দীঘিসম বড় পুকুরে প্রতিদিন সাঁতার কেটে গোসল করে। যখনই ডালিয়া মামা বাড়িতে আসে তখনই দুই মামাত ফুপাত বোন বাজি ধরে সাঁতার কাটে। কখন ডালিয়া জিতে আবার কখন রাহেলা জিতে।

সালাউদ্দিন চেয়ারম্যানের দাদা এই পুকুরটা কাটিয়েছিলেন গরমের সময় গ্রামের লোকজনের খাওয়ার পানির কষ্ট লাঘবের জন্য। এখন প্রতিটি পাড়ায় টিউবওয়েল হয়ে গেছে। তাই এখন আর কেউ খাওয়ার পানি নিতে আসে না। তবে গরমের সময় যখন পুকুর ডোবা শুকিয়ে যায় তখন সবাই গোসল করতে আসে। পুকুরটা খুব বড় বলে লোকজন দীঘি বলে। এখন চেয়ারম্যান এই পুকুরে মাছের চাষ করেন।

গোসল করতে এসে পুকুরে নামার সময় রাহেলা বলল, আজ বেশিক্ষণ সাঁতার কাটব না, তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। বাবার সঙ্গে পরামর্শ করা লাগবে।

চেয়ারম্যান মেয়েকে একঘন্টার মধ্যে ফিরবেন বললেও ফিরলেন প্রায় দু’আড়াই ঘন্টা পর। খাওয়া দাওয়া করতে করতে তিনটে বেজে গেল। তারপর কাজের বুয়াকে দিয়ে মেয়েকে ডেকে পাঠালেন।

রাহেলা ও ডালিয়া খেয়ে উঠে গল্প করছিল। বুয়ার মুখে বাবা ডাকছে শুনে রাহেলা ডালিয়াকে বলল, তুই ঘুমো আমি আসছি। তারপর বাবার রুমে এসে বলল, এই বুঝি তোমার এক ঘন্টা?

চেয়ারম্যান বললেন, একটা কাজে গিয়েছিলাম। কাজটা শেষ না করে ফিরি কী করে? কী জন্যে জরুরী তলব করেছিলি বল।

রাহেলা বলল, চরদৌলতখান গ্রামের শফি নামে যে ছেলেটা সকালে মারামারির ঘটনা ঘটিয়ে তোমার মান সম্মান ধূলোয় মিশিয়ে দিল, তাকে নির্বিঘ্নে চলে যেতে দিলে কেন? শুনে তো আমি বিশ্বাস করতেই পারি নি। তারপর একটা মোবাইল সেট দেখিয়ে বলল, মারামারি করার সময় তার পকেট থেকে এটা পড়ে গিয়েছিল। ডালিয়া কুড়িয়ে এনেছে। দুপুরের দিকে ছেলেটা ফোন করেছিল, বলেছি, বিকেল পাঁচটা সাড়ে পাঁচটার দিকে এসে নিয়ে যেতে। আসবে বলেছে। আমি চাই, এই সময়ের মধ্যে মোবারক চাচাকে খবর দিয়ে আনিয়ে ওর হাত পা ভেঙ্গে লুলো করে দিতে।

সালাউদ্দিন চেয়ারম্যান মেয়ের মুখের দিকে অল্পক্ষণ চেয়ে থেকে মৃদু হেসে বললেন, তুই আমারই মেয়ে, এরকম কথা তোর কাছে আশা করেছিলাম। কিন্তু মা, সবকিছু ভেবেচিন্তে করতে হয়। তাড়াহুড়ো করে করলে ফল ভালো হয় না। তা ছাড়া চেয়ারম্যান হয়ে তৎক্ষণাৎ যদি কিছু করতাম, তা হলে লোকজনের কাছে কী জবাব দিতাম। আমি তোর মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। অপমানের জ্বালা তোর চেয়ে আমার অনেক বেশি। সেই জ্বালা মেটাবার জন্য তোর মোবারক চাচাকে ডাকিয়ে বলেছি, মাস খানেক পরে সুযোগ সুবিধে মতো ভিন গায়ে কাজটা করতে। যাতে করে কেউ যেন আমাদেরকে সন্দেহ করতে না পারে। আজ এলে আপ্যায়ন করিয়ে বিদায় দিবি। তা হলে এক মাস পরে কিছু ঘটলে আমরা করেছি কেউ ভাবতে পারবে না। তুই তাকে আপ্যায়ন করলে আমাদেরকে সন্দেহ না করার আরও একটা পয়েন্ট বাড়বে। সঙ্গে ডালিয়াকেও নিতে পারিস। ছেলেটা চলে যাওয়ার পর সে তার সম্পর্কে অনেক কথা আমাকে জিজ্ঞেস করেছে।

তাই নাকী বলে রাহেলা জিজ্ঞেস করল, ছেলেটা দেখতে কেমন?

এলেই দেখবি।

তাতো দেখবই।, আগে থেকে জানা থাকলে দোষ কী?

ছ’ফুটের উপর লম্বা, মানানসই স্বাস্থ্য, রং ফরসা, সহজ সরল সুন্দর ছেলে। দেখলে বোঝাই যায় না, সে একজন শক্তিমান ও মারামারীতে ওস্তাদ।

পাশের গ্রামেই তো বাড়ি, তুমি ওদের বাপ-দাদাদের চেনো নিশ্চয়?

তা চিনব না কেন? ওদের বংশের সবাইকেই চিনি। তবে ঐ ছেলেটাকে চিনতাম না। দশ বার বছর বয়সে হারিয়ে গিয়েছিল। আঠার বিশ বছর পর কিছুদিন আগে ফিরে এসেছে।

ওমা, তাই নাকী? তা ওকে চিনলে কীভাবে?

কীভাবে শফিকে চিনলেন, সে কথা চেয়ারম্যান বললেন।

রাহেলা জিজ্ঞেস করল, আপ্যায়ন করার সময় তুমি থাকবে তো?

না, থাকতে পারব না। পাশের গ্রামে মিটিং আছে যেতে হবে। তা ছাড়া আমার না থাকাটাই ভলো মনে করি। এবার যা, একটু গড়িয়ে নিয়ে বেরোব।

রাহেলার মুখে প্রতিশোধ নেয়ার কথা শোনার পর থেকে ডালিয়া বেশ আতংকিত হয়ে রয়েছে। এত সুন্দর ছেলেটার হাত পা ভেঙ্গে লুলা করে দেবে ভেবে শফির প্রতি ভীষণ মায়া অনুভব করছে। তাই রাহেলা তাকে। ঘুমাতে বলে যখন তার বাবার কাছে চলে গেল তখন মামা কী করবেন না করবেন চিন্তা করে ঘুমাতে পারল না। বিছানায় শুয়ে থাকা অসহ্য মনে হতে একটু পরে মামার রুমের দরজার আড়ালে এসে বাপ বেটির কথা শুনে কিছুটা স্বস্তি পেল। ভাবল, আজ তা হলে শফির কোনো বিপদ হবে না। আরও ভাবল, মোবারক চাচা কে? তার ঠিকানাই বা কোথায়? কত শক্তিমান লোক সে? যে নাকী মেরে শফির হাত পা ভেঙ্গে লুলা করে দেবে। মামা রাহেলাকে চলে যেতে বলায় দ্রুত ফিরে এসে বিছানায় শুয়ে ঘুমের ভান করে রইল।

রাহেলা ফিরে এসে বলল, কী রে ডালিয়া, ঘুমিয়ে পড়েছিস নাকী?

ডালিয়া বলল, না ঘুমাইনি, এমনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি।

তারপর সবকিছু জেনেও না জানার ভান করে জিজ্ঞেস করল, মামা কী বললেন?

শফিকে শায়েস্তা করার ব্যাপারে বাবা যা কিছু বলেছেন, সেসব বলে বলল, আজ ছেলেটা এলে তোকে ও আমাকে আপ্যায়ন করিয়ে বিদায় দিতে বলেছে। তুই কী বলিস?

ডালিয়া বলল, আমি আবার কী বলব? এটা তোদের ব্যাপার তোরা বুঝবি।

রাহেলা বলল, তা ঠিক। তবে আপ্যায়ন করানোর সময় বাবা তোকেও আমার সঙ্গে থাকতে বলেছে। থাকবি তো?

কথাটা মামার মুখে শোনার পর থেকে ডালিয়ার তনুমনুতে আনন্দের। শীহরন খেলছে। এখন আবার রাহেলার কথা শুনে সেই শীহরণ আরও বেড়ে গেল। কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল, ঠিক আছে থাকব।

০৫. রবিউল ও শফির মধ্যে বন্ধুত্ব

ছোটবেলায় রবিউল ও শফির মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল। শফি হারিয়ে যেতে রবিউলের মন অনেক দিন খারাপ ছিল। তারপর আস্তে আস্তে তাকে ভুলে। গেলেও মাঝে মধ্যে মনে পড়ত। রবিউলের বাবা জহির উদ্দিন চৌধুরী বেশ অবস্থাপন্ন লোক। ওনার শুধু চার ছেলে। কোনো মেয়ে নেই। রবিউল সবার ছোট। বড় তিন ভাই লেখাপড়া শেষ করে ঢাকায় চাকরি করে। তারা ঢাকাতেই ফ্যামিলি নিয়ে থাকে। রবিউল বড় ভাইয়ের কাছে থেকে ঢাকা কলেজ থেকে মাস্টার্স করে গ্রামে এসে বাবার ঘাড়ে বসে একবছর খেয়েছে। এই মাস ছয়েক হল গ্রামের কলেজে অধ্যাপনা করছে। বড় ভাইয়েরা ও ভাবিরা ঢাকাতে চাকরি করার কথা বললেও সে রাজি হয়নি। তাদেরকে বলেছে তোমরা মা বাবাকে ছেড়ে শহরে এসে বাস করছ। আমি তা করব না আর ওনাদের ছেড়ে থাকতেও পারব না।

রবিউল গ্রামের স্কুলে ক্লাস টেনে পড়ার সময় থেকে রাহেলাকে ভালবাসত, কিন্তু সেকথা রাহেলাকে বলার সাহস হয়নি। রাহেলা তখন ক্লাস সেভেনের ছাত্রী। তখন অবশ্য রাহেলার বাবা চেয়ারম্যান ছিলেন না। স্কুলটা ছিল চরদৌলতখান ও শিকরমণ্ডল গ্রামের মধ্যস্থলে। গ্রামের কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে রবিউল ঢাকায় পড়াশোনা করতে গেলেও রাহেলাকে ভুলতে পারে নি। মাস্টার্স কমপ্লীট করে গ্রামে ফিরে যখন ভার্সিটি অধ্যাপনা শুরু করল তখন রাহেলা ঐ কলেজে ডিগ্রী সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। ক্লাস নেয়ার সময় চোরা চোখে রবিউল তাকে দেখে। ছয় সাত বছর আগের কিশোরী রাহেলা এখন যুবতী। ছোটবেলা থেকে রাহেলা রূপসী। যৌবনে এসে আরও অনেক বেশি রূপসী হয়েছে। রবিউল সিদ্ধান্ত নেয় যেমন করে হোক ওকে বিয়ে করবেই।

কলেজে অধ্যাপনা শুরু করার পাঁচ ছয় মাসের মধ্যে দীর্ঘ বিশ বছর পর শফি ফিরে এলে দু’জনের মধ্যে আবার বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। এখন পর্যন্ত রাহেলাকে ভালবাসার কথা তাকে জানাইনি।

শফি মোবাইলের লাইন কেটে দিতে রবিউল জিজ্ঞেস করল, কী রে মোবাইল ওদের কেউ পেয়েছে?

হ্যাঁ, পেয়েছে। বিকেল পাঁচটা সাড়ে পাঁচটার দিকে নেয়ার জন্য ডেকেছে।

যাবি না কি?

হ্যাঁ, যাব। তুইও আমার সঙ্গে যাবি।

গেলে রাহেলার সঙ্গে দেখা হবে ভেবে খুশি হলেও রবিউল বলল, আজকেই যাওয়াটা কী ঠিক হবে?

ঠিক হবে না কেন?

না, বলছিলাম কী, আজ যে ঘটনা ঘটিয়ে এসেছিস তারপর যাওয়াটা ঠিক হবে না।

তুই অত ভীতু কেন? আমি কিন্তু আল্লাহকে ছাড়া কাউকেই ভয় করি না

তা জানি। তবু বলব আজ না গিয়ে কাল যা।

তুই বার বার যেতে নিষেধ করছিস কেন বলতো?

রবিউল জানে মহসিন খুব রাগি ও গুণ্ডা টাইপের। দু’দুবার যার কাছে অপমান হয়েছে, তাকে পেলে নির্ঘাৎ গুলি করবে। সেকথা বলে বলল, কাল আজকের মতো মহসিনের অতটা রাগ থাকবে না। তাই কাল যেতে বলছি।

শফি বলল, ওর হাতে আমার মৃত্যু থাকলে হবে, না থাকলে গুলি করলেও হবে না। তা ছাড়া ওনাকে আজই যাব বলেছি।

তাতে কী হয়েছে? এখন আবার ফোন করে জানিয়ে দে কাল যাবি।

না আজই যাব। তুই যদি যেতে না চাস, আমি একাই যাব। তবু কথার বরখেলাপ করতে পারব না।

রবিউল জানে শফি ছোটবেলা থেকে খুব একরোখা, যা করবে বলবে তা করেই ছাড়ে। এখনও সেই স্বভাবের পরিবর্তন হয়নি দেখে বলল, তুই সেই আগের মতই রয়ে গেছিস। ঠিক আছে, আজই যখন যাবি বলছিস তখন আর কী করা। আমিও তোর সঙ্গে যাব।

শফি বলল, কী জানিস, মোবাইলে যার সঙ্গে কথা বললাম, সে চেয়ারম্যানের মেয়ে রাহেলা। মারামারি হওয়ার সময় তাকে দেখিনি, দেখেছি ডালিয়াকে। মোবাইল কুড়ালে কুড়াবে ডালিয়া; কিন্তু রাহেলা বলল, তার কাছে মোবাইল আছে। আর সেই-ই যেতে বলল।

রবিউল বলল, হয়তো ঘটনার সময় রাহেলা ছিল না; ডালিয়াই কুড়িয়েছে। পরে ঘটনা জানার পর ডালিয়ার কাছ থেকে মোবাইলটা নিয়েছে।

শফি বলল, মনে হয় তোর কথাই ঠিক।

দু’বন্ধুতে যখন শিকরমন্ডলে পৌঁছাল তখন মসজিদে আসরের আজান হচ্ছে। মসজিদে গিয়ে নামায পড়ল। তারপর মানুষজনকে জিজ্ঞেস করে সাড়ে পাঁচটার সময় চেয়ারম্যানের ঘরের সামনে এসে পৌঁছাল।

মহসিন ও তার বন্ধুরা সদর হাসপাতালে গেছে হাত পা প্লাস্টার করার জন্য। তখনও ফেরেনি। চেয়ারম্যানও পাশের গ্রামের মিটিং-এ চলে গেছেন।

রাহেলা ঘরের চাকর শাহাদতকে পাঁচটা থেকে বৈঠকখানায় বসে থাকতে বলে বলেছে, চরদৌলতখান গ্রাম থেকে একটা লোক আসবে। আসার পর তাকে বসতে বলে আমাকে খবর দিবি।

শাহাদতের বয়স চৌদ্দ পনেরর মতো। সে সকালের মারামারি দেখেছে। তাই শফি ও রবিউল যখন বেঠকখানার কাছে এল তখন শফিকে চিনতে পারল। ভাবল, ইনি সকালের দিকে মহসিন ভাই ও তার বন্ধুদের হাত পা ভেঙ্গে দিয়ে গেল, এখন আবার কেন এসেছে? মহসিন ভাই ও চাচা জানতে পারলে তো মেরে ফেলবে।

তাকে ওদের দিকে চেয়ে থাকতে দেখে শফি সালাম দিয়ে বলল, চেয়ারম্যান সাহেব বা ওনার ছেলে বাড়িতে আছেন?

শাহাদতকে কেউ কখনও সালাম দেয়নি। শফিকে সালাম দিতে দেখে অবাক হয়ে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, না, কেউ নেই।

তা হলে চেয়ারম্যান সাহেবের মেয়েকে ডেকে দাও। ওবেলা আমার মোবাইল হারিয়ে গিয়েছিল, ওনার কাছে আছে। উনি এই সময়ে আসতে বলেছিলেন মোবাইলটা নেয়ার জন্য।

আপনারা বৈঠকখানায় বসুন, আমি আপাকে ডেকে দিচ্ছি। তারপর যেতে যেতে চিন্তা করল, আপা বললেন একজন আসবে; কিন্তু এসেছে দু’জন।

বাড়ির ভিতরে গিয়ে আপাকে দু’জন আসার কথা জানাল।

রাহেলা ডালিয়ার দিকে চেয়ে বলল, কী ব্যাপার বল দেখি? আসার কথা। শুধু শফির, দু’জন এসেছে কেন? মনে হয় ভয় পেয়েছে। তাই একজনকে সাথে করে এনেছে।

তারা আগে থেকে সেজেগুঁজে ছিল। ডালিয়া তার কথা শুনে ভাবল, শফি তো ভয় পাওয়ার মতো ছেলে না, হয়তো অন্য কোনো কারণে একজনকে সাথে নিয়ে এসেছে। মুখে বলল, সে যাই হোক দু’জন আসুক আর তিনজন আসুক তাতে আমাদের কী? চল যাই।

শফি ও রবিউল দু’টো চেয়ারে বসেছিল। তাদেরকে দেখে দাঁড়িয়ে সালাম দিল।

রাহেলা ও ডালিয়া শালওয়ার কামিজ পরে ওড়না ঘাড়ের দু’পাশ থেকে বুকের উপর ঝুলিয়ে দিয়েছে। দু’জনেই সালামের উত্তর দিয়ে বসতে বলল। রাহেলা রবিউলকে চিনতে পেরে অবাক কণ্ঠে বলল, স্যার আপনি?

রবিউল বলল হ্যাঁ। মোবাইলটা ওর বলে শফিকে দেখাল। তারপর শফিকে বলল, রাহেলা আমার কলেজের ছাত্রী।

কথাটা শুনে শফি রবিউলের উপর অসন্তুষ্ট হল। ভাবল, এ কথা আগে জানাল না কেন।

প্রথম ঘটনার দিন ডালিয়া শফির সঙ্গে রবিউলকে দেখেছে। তার পরিচয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, উনি কি আপনার কাজিন বলে শফিকে দেখাল।

রবিউল কিছু বলার আগে রাহেলা বলল ও ডালিয়া, আমার ফুপাত বোন, ওদের বাড়ি ঢাকায়।

তা জানি বলতে গিয়েও রবিউল বলল না। চুপ করে রইল।

ডালিয়া তার দিকে চেয়ে বলল, আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না যে?

রবিউল বলল, কাজিন না হলেও আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বের গভীর সম্পর্ক। বাড়ি একই গ্রামে।

রবিউল থেমে যেতে শফি বলল, আমার মোবাইলটা দিন। এবার আমাদেরকে ফিরতে হবে।

ডালিয়া যে চোরাচোখে বারবার শফিকে দেখছে রাহেলা তা বুঝতে পেরে বলল, এত তাড়া কিসের? স্যার যখন সঙ্গে আছেন তখন ভয়ের কোনো কারণ নেই। তা ছাড়া বাবা ও ভাইয়া কেউ বাড়িতে নেই। ভাইয়া বন্ধুদের নিয়ে সদর হাসপাতালে গেছে প্লাস্টার করাবার জন্য। আর বাবা পাশের গ্রামে মিটিং এ গেছেন।

শফি মৃদু হেসে বলল, আল্লাহকে ছাড়া আমি কাউকে ভয় করি না। আর ভয়ই যদি করতাম, তা হলে সকালের ঘটনার পর বিকেলে আসতাম না।

রাহেলা বলল, তা অবশ্য ঠিক কথা বলেছেন। অন্য যে কোনো ছেলের এত সাহস হত না। তারপর শাহাদত নাস্তার প্লেট নিয়ে এলে বলল, এখন কথা বাদ দিয়ে মুখে হাতে পানি দিয়ে নিন, নাস্তা খাবেন।

শফি বলল, এসব কষ্ট করে করতে গেলেন কেন?

রাহেলা বলল, কষ্ট হবে কেন? অতিথিকে আপ্যায়ন করান উচিত নয় কি? কথা শেষ করে নাস্তা পরিবেশন করল।

তাদেরকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে রাহেলা আবার বলল, কী হল, খাচ্ছেন না কেন? তবু যখন তারা চুপ করে বসে রইল তখন জিজ্ঞেস করল, আপনারা কি আমাদেরকে অবিশ্বাস করছেন?

শফি বলল, কী ব্যাপারে অবিশ্বাস করব?

রাহেলা বলার আগে ডালিয়া বলল, এই যেমন আমরা হয়তো খাবারে বিষ মাখিয়ে এনেছি আপনাদেরকে মেরে ফেলার জন্য অথবা অজ্ঞান করে। মারধর করে সকালের ঘটনার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য।

শফি মৃদু হেসে বলল, “ঠাকুর ঘরে কেরে? আমি কলা খায়নি” কথাটার মতো হয়ে গেল না?

ডালিয়া বলল, আপনার কথাটা ঠিক হলেও এক্ষেত্রে নয়। সব থেকে বড় কথা রাহেলার কলেজের স্যার রয়েছেন। উনি সম্মানিত ব্যক্তি। ওনার উপস্থিতিতে এরকম কাজ আমরা করতে পারি না। তারপর দু’জনে প্লেট থেকে অল্প একটু নাস্তা খেয়ে বলল, এবার নিশ্চয় খেতে অসুবিধে নেই?

শফি বলল, আপনারা আমাদেরকে বুঝতে ভুল করেছেন। ওসব চিন্তাই আমরা করিনি। আসল কথা আমি বাইরের কারও বাড়িতে খাই না। তারপর রবিউলকে বলল, তুই খাচ্ছিস না কেন?

রবিউল বলল, তুই না খেলে আমি একা খাই কী করে?

ঠিক আছে, আমি এক গ্লাস পানি খাচ্ছি বলে শফি পানি খেয়ে রবিউলকে বলল, এবার তুই খা।

ডালিয়া শফিকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনি যে কথা বললেন, তার পিছনে নিশ্চয় কারণ আছে?

আছে।

কারণটা বলবেন?

মাফ করবেন বলতে পারব না।

.

নাস্তা খাওয়ার পর মোবাইল সেট নিয়ে ফেরার পথে রবিউল বলল, ডালিয়া সর্বক্ষণ তোর দিকে চেয়েছিল।

আর তুই সর্বক্ষণ রাহেলাকে চোরাচোখে দেখছিলি কেন সেটা আগে বল।

আমার দেখার পিছনে কারণ আছে; কিন্তু ডালিয়ার কী আছে?

তোর মতো তারও কারণ থাকতে পারে।

তা থাকতেই পারে না। কেন পারে না?

কারণ, মহসিনের ফাঁইন্যাল পরীক্ষার পর তার সঙ্গে ডালিয়ার বিয়ে হওয়ার কথা পাকা হয়ে আছে।

পাকা কথা হয়ে থাকলে কী হবে তকৃদিরে থাকতে হবে। তকদিরে না থাকলে হবে না।

তুই কি বলতে চাচ্ছিস ওদের বিয়ে হবে না?

না।

রবিউল খুব অবাক হয়ে বলল, এ তুই কী বলছিস?

বলছি বাংলা, তবু যদি বুঝতে না পারিস, তা হলে এ প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে তোর কারণটা বল।

রবিউল কিছু না বলে চুপচাপ হাঁটতে লাগল।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে শফি বলল, কীরে, কারণটা বলছিস না কেন? মনে হচ্ছে ডালমে কুছ কালা হ্যাঁয়। এ কথা বলার পরও তাকে চুপ করে থাকতে দেখে শফি আবার বলল। না বললে কিন্তু মাইন্ড করব।

রবিউল বলল, বললেও মাইন্ড করবি।

ঠিক আছে ওয়াদা করছি মাইন্ড করব না।

যখন ক্লাস টেনে পড়ি তখন থেকে রাহেলাকে ভালবাসি।

শফি হেসে উঠে বলল, মনে হচ্ছে কথাটা রাহেলা তখনও জানত না এবং এখনও জানে না। কি, ঠিক বলি নি।

কথাটা সত্য; কিন্তু তুই জানলি কী করে?

যেমন করে জানলাম ডালিয়া আমাকে ভালবেসে ফেলেছে।

তাই যদি জানিস, তা হলে বল, রাহেলার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে কিনা।

হবে, আমাদের মতো তোদেরও অনেক কাঠ খড় পুড়বে।

হেঁয়ালী করে না বলে খোলাখুলি বল।

যা বলেছি এর বেশি একটা কথাও বলতে পারবনা। তবে এতটুকু বলতে পারি, আল্লাহ যার সঙ্গে যার জোড়া করে পয়দা করেছেন, তার সঙ্গে তার বিয়ে হবেই। তুই কিন্তু একটা মারাত্মক আর একটা অমারাত্মক ভুল করেছিস। প্রথমটা হল ক্লাস টেনে পড়ার সময়েই রাহেলাকে কথাটা জানান উচিত ছিল। আর দ্বিতীয়টা হল, আমি ফিরে আসার পর পর আমাকেও কথাটা জানান উচিত ছিল।

রবিউল বলল, প্রথম ভুলটার কারণ হল, অনেকবার জানাতে চেষ্টা করেও সাহসের অভাবে জানাতে পারিনি। আর দ্বিতীয় ভুলটার কারণ, বলব বলব করেও বলা হয়নি। যাই হোক, দ্বিতীয় ভুলটা তুই মাফ করে দে।

শফি হেসে উঠে বলল, আর প্রথম ভুলটা কে মাফ করবে? তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলল, রাহেলাই তোকে মাফ করবে।

রবিউল বলল, তুই মাঝে মাঝে এমন কথা বলিস, যার মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারি না।

না বুঝলে না বুঝবি, কে তোকে বুঝতে বলেছে?

কথাটা কী ঠিক বললি? শুনে মনে হচ্ছে আমাকে দূরে সরিয়ে দিতে চাচ্ছিস।

তোর ধারণা ভুল। দাদি আর তুই ছাড়া এ দুনিয়ায় আমার আপন কেউ নেই।

কেন, তোর মা?

মা তো মাই-ই। তার তুলনা কারও সঙ্গে দেয়া যায় না। তবু বলব মা। এখন অন্য লোকের স্ত্রী। যাই হোক, এ প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি চল। নচেৎ মাগরিবের নামায ধরতে পারব না।

.

ডালিয়া বারবার শফির দিকে চেয়ে দেখলেও যতবার রবিউলের দিকে চেয়েছে, ততবারই তাকে রাহেলার দিকে অপলক নয়নে চেয়ে থাকতে দেখেছে। তাই তারা চলে যাওয়ার পর রাহেলার মন বোঝার জন্য বলল, প্রফেসার সাহেবকে দেখলাম বারবার তোর মুখের দিকে চেয়ে থাকতে। ব্যাপারটা কি তুই লক্ষ্য করেছিস?

রাহেলা হেসে উঠে বলল, তা আবার করিনি। শোন, ক্লাসেও অনেকবার লক্ষ্য করেছি, উনি চোরাচোখে বারবার আমার দিকে চেয়ে থাকেন।

ডালিয়াও হেসে উঠে বলল, সত্যি বলছিস?

হ্যাঁরে, সত্যি বলছি।

এতে তোর মনে কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি?

খুব রাগ হয়।

রাগ হবে কেন? বরং অন্য কিছুতো হওয়ার কথা।

অন্য কিছু মানে?

মানে, উনি হয়তো তোকে ভালবাসেন। তাই বারবার তোর মুখের দিকে চেয়ে দেখেন।

আমি ওসব ভালবাসা-টালবাসা একদম পছন্দ করি না।

উনি কিন্তু খুব হ্যাঁন্ডসাম, মেয়েরা ঐরকম ছেলেই পছন্দ করে।

রাহেলা বিরক্ত কণ্ঠে বলল, হ্যাঁন্ডসাম হোক আর অন্য মেয়েরা ওনাকে পছন্দ করুক, তাতে আমার কী? শোন, যেসব ছেলেরা চোরাচোখে মেয়েদেরকে দেখে, তাদেরকে আমি মোটেই দেখতে পারি না। এসব বাজে প্যাচাল বাদ দিয়ে বলতো, ভাইয়ার সঙ্গে তোর বিয়ে ঠিক হয়ে থাকা সত্ত্বেও বারবার কেন শফির দিকে চেয়ে দেখছিলি?

ডালিয়া শফির চোখে এমন কিছু দেখেছে, যা বারবার তাকে দেখতে বাধ্য করেছে। সেকথা বলা উচিত হবে না ভেবে চালাকি করে বলল, শুধু শফির দিকে নয়, রবিউল স্যারের দিকেও চেয়ে দেখছিলাম, কে বেশি সুন্দর। রবিউল স্যারের দিকে চেয়ে মনে হল গ্রীষ্মকালের চাতক পাখি, যেমন একফোঁটা বৃষ্টির আশায় আকাশের দিকে হা করে চেয়ে থাকে, ঠিক সেইভাবে উনি তোর মুখের দিকে চেয়েছিলেন। তুই যে বললি উনি চোরা চোখে দেখে, কিন্তু আজ তো করেন নি। আমি হ্যাঁন্ড্রেড পার্সেন্ট সিওর উনি তোকে ভীষণ ভালবাসেন।

রাহেলা বলল, কী জানি, তোর কথা হয় তো ঠিক; কিন্তু একটু আগে বললাম না, ভালবাসা টালবাসা একদম পছন্দ করি না। সমাজে ভালবাসার কাহিনী শুনে ও তার পরিণতি দেখে প্রতিজ্ঞা করেছি, জীবনে কোনো দিন ও পথে পা বাড়াব না।

ডালিয়া বলল, ওরকম কথা অনেকে বলে; কিন্তু শেষমেষ তারাই ভালবাসা করে হাবুডুবু খায়। আমার তো মনে হচ্ছে তুইও একদিন ভালবাসা করে হাবুডুবু খাবি।

তোর মুন্ডু খাব বলে রাহেলা তার কাছ থেকে চলে গেল।

০৬. সদর হাসপাতাল থেকে হাত প্লাস্টার

সদর হাসপাতাল থেকে হাত প্লাস্টার করে ঘরে ফিরে রাহেলার মুখে শফি ও রবিউল এসে মোবাইল সেট ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা শুনে মহসিন ভীষণ রেগে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, শালা হারামীর বাচ্চার এত বড় সাহস থাকলে মোবাইল গাঁড়ে ঢুকিয়ে দিতাম।

রাহেলা বলল, হুট করে তুমি রেগে যাও কেন? এই যে তাকে গালাগালি করলে, এটা কী ঠিক হল?

মহসিন রাগের সঙ্গেই বলল, আমার কথার উপর কথা বলছিস কেন? দেব এক থাপ্পড়।

রাহেলা বলল, থাক, অত আর বাহাদূরী দেখিও না। ডালিয়ার মুখে শুনেছি তোমাদের ছ’জনকে কীভাবে শফি একাই মেরে হাত পা ভেঙ্গে দিয়ে বুক ফুলিয়ে চলে গেছে। কই, কিছুইতো তার করতে পারলে না।

ছোট বোনের কথা শুনে মহসিন লজ্জা পেয়ে রাগ সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, মোবাইল নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা বাবা জানে?

হ্যাঁ, জানে, বাবাই তো আপ্যায়ন করিয়ে মোবাইল সেট ফেরৎ দিতে বলে পাশের গ্রামে মিটিং-এ চলে গেল। আমি অবশ্য বাবাকে বলেছিলাম, ছেলেটা মোবাইল সেট নিতে এলে মোবারক চাচাকে দিয়ে তার হাত পা ভেঙ্গে লুলা করে দিতে।

উৎফুল্ল হয়ে উঠে মহসিন বলল, বাহ! তুই তো খুব ভালো সাজেসান দিয়েছিলি, বাবা শুনল না কেন?

তুমি সবকিছুতে তাড়াহুড়ো করো। বাবা কী বলল শোনার আগেই কথা বলছ। তারপর বাবা যা বলেছে বলল।

মহসিন বলল, বাবার প্ল্যানটাও অবশ্য খুব ভালো। এবার বাছাধন বুঝবে কত ধানে কত চাল। সেই সময় যদি আমি মোবারক চাচার সঙ্গে থাকতে পারতাম, তা হলে মনের ঝাল মেটাতে পারতাম।

রাহেলা বলল, তোমার আশা পূরণ হবার নয়। কারণ তা হলে সবাই জেনে যাবে কাজটা বাবাই করিয়েছে।

মহসিন বলল, সেকথা ভেবেই তো আফশোস হচ্ছে।

রাহেলা বলল, আফশোস হলেও কিছু করার নেই। তবে যখন শুনবে মোবারক চাচা মেরে শফির হাত পা ভেঙ্গে লুলা করে দিয়েছে তখন বন্ধুদের নিয়ে ফুর্তি করো।

মহসিন বলল, তাতো করবই। তারপর বলল, হ্যাঁরে, রবিউল ওর সঙ্গে কেন এসেছিল? সে তো তোদের কলেজের প্রফেসর তাই না? প্রথম ঘটনার দিন ডালিয়া রবিউলকে দেখলেও মহসিন রাগের চোটে আশপাশের কাউকেই লক্ষ্য করেনি।

ভাইয়ার কথা শুনে রাহেলা বলল, রবিউল স্যার শফির বন্ধু। আর উনি কলেজের একজন প্রফেসর জানার পর ওনার সম্পর্কে সম্মান দিয়ে কথা বলা তোমার উচিত।

মহসিন রেগে উঠে বলল, তোকে আর মাস্টারী ফলাতে হবে না। যা এখান থেকে।

.

চেয়ারম্যান সালাউদ্দিনের গ্রাম থেকে প্রায় তিন চার মাইল দূরে লাঠিয়াল সর্দার মোবারকের বাড়ি। চেয়ারম্যান অনেকবার তাকে দিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিল করেছেন। ছেলে ও তার বন্ধুদের পরিণতি ও শফির বাহাদূরী দেখে খুব অপমানিত হয়েছেন। উনি খুব বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ লোক। তাই তখন অপমানিত হয়েও শফির সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছেন।

সেই সাথে মনে মনে প্রতিশোধ নেয়ার পরিকল্পনা করেছেন। বাজারে ওনার চালের আড়ৎ আছে। শফি চলে যাওয়ার পর আড়তে এসে একজন লোকের দ্বারা মোবারক লাঠিয়ালকে ডেকে পাঠালেন।

প্রায় দু’ঘন্টা পরে মোবারক লেঠেল এসে সালাম বিনিময় করে বলল, কেন ডেকেছেন বলুন সাহেব।

চেয়ারম্যান শফির নাম ঠিকানা একটা কাগজে লিখে রেখেছিলেন। সেটা তার হাতে দিয়ে কী করতে হবে না হবে বললেন। তারপর তাকে দু’হাজার টাকা দিয়ে বললেন, কাজ শেষ করে এসে তিন হাজার নিয়ে যেও। আর শোনো, ছেলেটা সব দিকে তুখোড়। দরকার মনে করলে সঙ্গে দুতিন জনকে নিও। একেবারে জানে মারবে না। হাত পা এমনভাবে ভেঙ্গে দেবে। যেন চলা ফেরা করতে না পারে। যদি লাঠির দ্বারা কাবু করতে না পার তোমার তো লাইসেন্স করা পিস্তল আছে, সেটা দিয়ে এমন সব জায়গায়। গুলি করবে, যেন হাত পা কেটে বাদ দিতে হয়। তবে খুব সাবধান, কেউ যেন জানতে না পারে আমি তোমাকে দিয়ে এই কাজ করিয়েছি।

চেয়ারম্যান থেমে যেতে মোবারক বলল, ঠিক আছে সাহেব আপনি তো জানেন, মোবারক কোনো ফ্লু রেখে কাজ করে না। ছেলেটা যতই তুখোড় হোক এই মোবারকের কাছে নস্যি। তারপর বিদায় নিয়ে চলে গেল।

মোবারকের বয়স এখন পঞ্চাশের মতো হলেও শক্তি সামর্থে পাঁচ-দশ জন লেঠেলকে কাবু করতে মাত্র কয়েক মিনিট সময় লাগে। ফেরার পথে চিন্তা করল, আগে ছেলেটাকে চিনতে হবে। তারপর কাজে নামতে হবে।

চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, সঙ্গে দু’তিনজন লোক নিতে সত্যি কী ছেলেটা খুব তুখোড়? দেখলে বোঝা যাবে কত তুষোড়।

.

একদিন জাকির হোসেন চাচি জমিলা খাতুনের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, শফি কী আপনাকে জমি-জায়গার ব্যাপারে কিছু বলেছে?

জমিলা খাতুন বললেন, না কিছু বলেনি। ওকি ওর বাবার জমি-জমা চাষাবাদ করবে কিনা জিজ্ঞেস করেছেন?

না, করিনি।

ওকে জিজ্ঞেস করবেন। যদি নিজে সবকিছু চাষাবাদ করে, তা হলে তো ওকে সব জমি-জায়গা দেখিয়ে দিতে হবে।

এমন সময় শফি এসে সালাম দিয়ে বলল, চাচা, কেমন আছেন? জাকির হোসেন সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, ভালো আছি।

জমিলা খাতুন নাতিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোর চাচা জানতে এসেছে, তুই তোর বাপের জমি-জমা চাষ করবি কিনা।

শফি চাচার দিকে চেয়ে বলল, না আমি জমি-জমা চাষ করব না। আপনি যেমন করছেন করবেন, তবে ভাগচাষি হিসাবে যা ফসল হবে খরচ। বাদ দিয়ে অর্ধেক ফসল দেবেন। আর মা তার স্বামীর ১/৮ অংশ পাবে। সেটা মাকে দলিল করে দেব। সেই জমির ফসলের ভাগ দিতে হবে না। মা সব ফসল পাবে। বাবার সব জায়গা-জমি আমাকে দেখিয়ে শুনিয়ে বুঝিয়ে দেবেন। ফসলী জমি ছাড়া বাকি সবকিছু আমি দেখাশোনা করব।

শফি ফিরে আসায় জাকির হোসেন খুশি হননি। ওনার ইচ্ছা ছিল জমিলা খাতুন মারা যাবার পর শফির বাবার সবকিছু এমন কি বাস্তভিটা পর্যন্ত গ্রাস করার। সেই ইচ্ছা পূরণ হবে না ভেবে হতাশ হয়েছেন। তবু মনে করেছিলেন, জমা-জমি ও অন্যান্য সবকিছু দেখাশোনা করে যতটা পুশিয়ে নেয়া যায় সেই ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু এখন শফির কথা শুনে সে আশাও তার পূরণ হবে না ভেবে তার প্রতি খুব অসন্তুষ্ট হলেও তা বাহিরে প্রকাশ না করে বললেন, বেশ তাই হবে।

দেবর পুতের মনের খবর জমিলা খাতুন শফি ফিরে আসার আগে কিছুটা অনুমান করেছিলেন। এখন তার মুখের অবস্থা দেখে সেই অনুমান আরও দৃঢ় হল। নাতির কথা শুনে তাকে বললেন, তুই সবকিছু নিজে চাষবাস করবি না কেন?

শফিও চাচার মনের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছে। তাই চালাকি করে বলল, ফিরে আসার সময় ঢাকায় একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য দরখাস্ত করে এসেছি। সেটা যদি হয়ে যায়, তা হলে ঢাকা চলে যাব। তবে প্রতিমাসে মাসে আসব। আর যদি চাকরি না হয়, তা হলে হয়তো নিজের হাতে চাষবাস করব।

জমিলা খাতুন বললেন, তোর চাকরির দরকার কী? তোর বাপের যা। জমি জায়গা আছে, তা দেখাশোনা করলে রাজার হালে থাকবি।

শফি হেসে উঠে বলল, দাদি, আপনি কি জানেন, একটা রাজার কত বিষয় সম্পত্তি থাকে?

তা না জানলেও তোর বাপের যা আছে, সাতপিড়ী বসে খেলেও শেষ হবে না। এই শেষ বয়সে তোকে আমি চাকরি করতে ঢাকায় যেতে দেব না। তুই ঢাকায় গেলে আমাকে দেখাশোনা করবে কে?

আমি কী একেবারে যাব নাকী? বললাম না, প্রতি মাসে আসব। প্রয়োজনে সপ্তাহে সপ্তাহে আসব।

শফি গ্রামে না থেকে ঢাকায় চাকরি করবে শুনে জাকির হোসেন খুশি হয়েছেন। তাই তার কথা শুনে চাচিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ও বোধ হয় এত বছর শহরে ছিল, গ্রামে ওর ভালো লাগছে না। তাই ঢাকায় চাকরি করতে চাচ্ছে। আমার মতে চাকরি করলে বিষয় সম্পত্তি আরও বাড়াতে পারবে। এতদিন আমি আপনার দেখাশোনা করেছি, প্রয়োজনে সারাজীবন করব। তা ছাড়া চাকরি পাওয়ার পর আমরা ওর বিয়ে দেব। ও ঢাকায় চাকরি করলেও বৌ এখানে থেকে আপনার সেবা যত্ন করবে।

চাচার কথা বার্তায় শফিও বুঝতে পেরেছে, তার বাবার সম্পত্তি গ্রাস করতে চেয়েছিলেন। না বোঝার ভান করে বলল, আপনি ঠিক কথা বলেছেন। দাদিকে একটু বোঝান তো।

জমিলা খাতুন কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তার আগে শফি আবার বলল, আগে চাকরিটা পাই, তারপর এ ব্যাপারে আলাপ করা যাবে। মাও তখন। থাকবে।

জাকির হোসেন বললেন বেশ, তাই হবে। তারপর এবার আসি বলে চলে গেলেন।

.

চরদৌলতখান গ্রামের মাতব্বর সূরুজ মিয়া স্বনামধন্য লোক। ধর্ম কর্ম নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে চলেন। আচার বিচারের সময় কারও পক্ষপাতিত্ব না করে খাঁটি বিচার করেন। বয়স প্রায় পয়ষট্টীর মতো। গরিবদের প্রতি খুব সদয়। প্রয়োজনে তাদেরকে টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করেন। সেজন্য ছোট বড়, ধনী-গরিব সবাই মান্য করে।

দাদির মুখে সেকথা জেনে শফি একদিন ওনার সঙ্গে দেখা করতে গেল। সালাম বিনিময় করে নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, দাদু কেমন আছেন?

মাতব্বর আগেই শুনেছেন, মরহুম আমিনুল ইসলামের ছেলে প্রায় বিশ বছর পর ফিরে এসেছে। তাকে দেখেও তার কথা শুনে খুশি হলেন। বললেন, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। তারপর তাকে বসতে বলে একজন কাজের বুয়াকে ডেকে নাস্তা নিয়ে আসতে বললেন।

শফি বলল, আমি নাস্তা খেয়ে এসেছি, আর খেতে পারব না। দাদির মুখে আপনার কথা শুনে দেখা করতে এলাম।

মাতব্বর বললেন, আরে ভাই, এই বয়সে খাওয়া পেটেও খাওয়া যায়। তা তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? কী করছিলে? কী করে ফিরে এলে বলতো ভাই। তোমার বাপতো তোমাকে খুঁজে খুঁজে পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল। শেষে হঠাৎ একদিন হার্টফেল করে মারা গেল।

বাবার কথা শুনে শফির চোখে পানি এসে গিয়েছিল। চোখ মুছে বলল, আল্লাহ বাবাকে জান্নাত নবীস করুণ, তাঁর গোরআযাব মাফ করে দিন। তারপর কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, দাদি ও অনেকেই আমাকে একথা জিজ্ঞেস করেছেন; কাউকেই বলিনি। শুধু বলেছি সেকথা পরে বলব। আপনি মুরুব্বী ও আল্লাহওয়ালা মানুষ, আপনাকে বলতে বাধা নেই। তবে ওয়াদা করতে হবে, যা বলব কাউকেই বলবেন না। বললে আমার ভীষণ ক্ষতি হবে।

মাতব্বর মৃদু হেসে বললেন, কোনো মুসলমান কি আর এক মুসলমানের ক্ষতি করতে পারে? যদি কেউ করে, তা হলে সে প্রকৃত মুসলমান থাকবে না। ঠিক আছে, ওয়াদা করছি, এবার বল। এমন সময় কাজের মেয়ে নাস্তা নিয়ে এলে আবার বললেন, আগে নাস্তা খেয়ে নাও তারপর তোমার কথা শুনব।

নাস্তা খাওয়ার পর শফি বলতে আরম্ভ করল। আপনারা জানেন, আমি নয় দশ বছরের সময় খেলতে খেলতে হারিয়ে গিয়েছিলাম। তখনকার কথা তেমন মনে না থাকলেও যতটুকু মনে আছে বলছি-পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে খেলতে খেলতে হঠাৎ একজন খুব লম্বা চওড়া দাড়ি টুপিওয়ালা লোক এসে আমার নাকে ও মুখে রুমাল চাপা দিয়ে আমাকে কোলে তুলে নিল। আমি চিৎকার করতে চাইলাম; কিন্তু মুখ থেকে শব্দ বের হল না। তারপর আর কিছুই মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরল তখন দেখলাম পাকা বিল্ডিং এর একটা রুমের খাটে শুয়ে আছি। উঠে বসেছি এমন সময় সেই লম্বা চওড়া লোকটাকে রুমে ঢুকতে দেখে বললাম, আমাকে এখানে এনেছ কেন? আমি ঘরে যাব। লোকটা ইয়া বড় বড় লাল টকটকে চোখ বের করে বলল, এখানে থেকে তুমি লেখাপড়া করবে। লেখাপড়া শেষ হওয়ার পর ঘরে যেতে পারবে। আমি ঘরে আসার জন্য খুব কান্নাকাটি করতে লোকটা খুব রাগের সঙ্গে বলল, একদম কান্নাকাটি করবে না, যা যা বলব শুনবে। নচেৎ গলাটিপে মেরে ফেলব বলে আমার গলায় হাত দিল। আমি ভয় পেয়ে কান্না থামিয়ে বললাম, না-না আমাকে মেরে ফেলবেন না। আপনার সব কথা শুনব। আমার কথা শুনে লোকটা অনেক সুস্বাদু ফল খাবার খেতে দিল, সেই বিল্ডিংটা ছিল একটা মাদরাসার হোস্টেল। আমি আগেই হাফেজ হয়েছি। তাই আমাকে আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেন। টাইটেল পাশ করার পর ভার্সিটি থেকে আরবি ও ইংরেজীতে মাস্টার্স করি। লাঠিখেলা ও নানারকম অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা দেন। শুধু তাই নয় কুংফু ও ক্যারাটেতে পারদর্শী করান। এমন কি জিন হাসিলের আমলও শিক্ষা দেন বলতে গিয়েও বলল না। চুপ করে গেল।

মাতব্বর জিজ্ঞেস করলেন, এমন কি বলে থেমে গেলে কেন? নিশ্চয় আরও কিছু শিক্ষা দিয়েছে?

শফি বলল, মাফ করবেন দাদু বলতে পারব না।

ঠিক আছে, এবার বল ঐ লোকের পরিচয় জানতে পেরেছ কিনা।

অনেকবার জানতে চেয়েছি, বলেননি। শুধু এতটুকু বলেছেন আমি তোমার হিতাকাঙ্খী। ফিরে আসার কিছুদিন আগে জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন। বললেন, সে সময় আমার একটা ছেলে মারা যায়। তুমি দেখতে সেই ছেলের মতো। তাই তোমাকে নিয়ে এসে মানুষ করলাম। এখন তুমি তোমার মা বাবার কাছে ফিরে যাবে। কয়েক দিন পর এক সকালে নাস্তা খাওয়ার পর কেন কি জানি খুব ঘুম পেতে ঘুমিয়ে পড়লাম। এর আগে কোনো দিন এই সময়ে ঘুম পাইনি। জোহরের আজান শুনে ঘুম ভেঙ্গে যেতে দেখলাম যে জায়গায় খেলতে খেলতে নয় দশ বছরে হারিয়ে গিয়েছিলাম সেখানে শুয়ে আছি। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে কাপড়ের ধুলো ঝেড়ে চারপাশে তাকিয়ে সবকিছু চিনতে পারলাম। তখন সেই লম্বা চওড়া দাড়ি টুপি ওয়ালা লোকটার কথা ও বিগত বিশ বছরের কথা মনে পড়ল। শুয়ে থাকা জায়গার দিকে হঠাৎ দৃষ্টি পড়তে দেখলাম বেশ বড় একটা মুখবন্ধ খাম। খামটা নিয়ে খুলে একটা কাগজে লেখা দেখে পড়লাম, তোমাকে একদিন যেখান থেকে নিয়ে গিয়েছিলাম সেখানে দিয়ে গেলাম। আল্লাহ তোমাকে দোজাহানে সুখী করুক।

ইতি

তোমার হিতাকাঙ্খী।

খামের ভিতর যে অগুন্তিক টাকা ছিল শফি তা না বলে চুপ করে গেল।

মাতব্বর বললেন, তুমি ইচ্ছা করলে অনেক আগেই পালিয়ে আসতে পারতে, এলে না কেন?

ওখানে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যে এখানকার সবকিছু ভুলে গিয়েছিলাম। আর এখানে ফিরে আসার পর আপনাকে যতটুকু বলেছি, সেগুলো ছাড়া ওখানকার সবকিছু ভুলে গেছি।

মাতব্বর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, এরই মধ্যে তোমার সম্পর্কে ভালোমন্দ অনেক কথা আমার কানে এসেছে। তুমি একটু সাবধানে থেক। গ্রামের কোনো ব্যাপারে জড়াবে না।

শফি বলল, আপনার কথা যথাসাধ্য মেনে চলার চেষ্টা করব। তবে অন্যায় কিছু হতে দেখলে প্রতিবাদ করবই। কারণ এটা করা প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের কর্তব্য। এটা হাদিসের কথা তাই না দাদু?

মাতব্বর তার সবকিছু শুনে বুঝতে পেরেছেন, কোনো মুসলমান ভালো, জিন ওকে তুলে নিয়ে গিয়ে মানুষ করেছে। বললেন, হ্যাঁ, এটা হাসিদের কথা। তারপর বললেন, এবার ঘরে যাও, মাঝে মাঝে এসে দেখা করে যেও।

ইনশাআল্লাহ নিশ্চয় আসব বলে শফি সালাম বিনিময় করে চলে এল।

০৭. ডালিয়া মামা বাড়িতে ছিল

যতদিন ডালিয়া মামা বাড়িতে ছিল ততদিন শফিকে এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারে নি। মামাবাড়ি থেকে ঢাকায় ফিরে এসেও শফিকে মন থেকে সরাতে পারছে না। মামার মুখে শফি খুব ধার্মিক শোনার পর থেকে ভেবেছে সেও ধার্মীক হবে। তাই ঢাকায় এসে ধার্মীক হবার সাধনা করছে। সেই সাথে শফির চিন্তা তাকে পাগল করে তুলেছে। ভালো করে পড়াশোনা করতে পারছে না, ঘুমাতে পারছে না, খেতেও পারছে না। ঘুমাবার সময়। চোখ বন্ধ করলেই মনের পাতায় শফির ছবি ভেসে উঠে। তার চোখের দৃষ্টি প্রেম সাগরে সাঁতার কাটার জন্য ডাক দেয়। তখন তার তনুমনুতে আনন্দের শিহরণ বইতে থাকে। মহসিন ভাইরের ফাঁইন্যাল পরীক্ষার পর তার সঙ্গে বিয়ে হবার কথা পাকা হয়ে আছে জেনেও শফিকে মন থেকে তাড়াতে পারছে না। এক এক সময় ভাবে, কী ঝকমারি করে এবারে মহসিন ভাইয়ের সঙ্গে তাদের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। যদি না যেত, তা হলে শফি নামে ছেলেটার সঙ্গে দেখাও হত না, আর তার দেহদৌষ্ঠব ও চোখের দৃষ্টি আমাকে পাগলও করত না। হঠাৎ তার মনে হল, আচ্ছা আমি যে শফিকে নিয়ে এত চিন্তা করছি, সেও কী আমাকে নিয়ে চিন্তা করছে? তখন তার মন বলে উঠল, নিশ্চয় করছে। তা না হলে মোবাইল সেট নিতে এসে কেন বারবার আমার মুখের দিকে চেয়ে দেখেছে? আমার বিশ্বাস সেও আমাকে নিয়ে চিন্তা করছে। শুধু তাই নয়, আমাকে পাওয়ার জন্য কোনো না কোনো প্ল্যান প্রোগ্রামও করেছে। কথাটা ঠিক কিনা তা তার মোবাইল নাম্বারে রিং করে দেখলেই হয়। কথাটা মনে হতে ভাবল, এতদিন কথাটা মনে হয়নি কেন? মনকে বলল, ফোন করলে যদি হিতে বিপরীত হয়? মন বলল, ওটা তোর দুর্বলতা, ফোন করেই দেখ। যা ভাবছিস তা কিছুই নয়।

ডালিয়া রাতে ঘুমাবার সময় এইসব চিন্তা করছিল। দেয়াল ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল, রাত পৌনে বারটা। ভাবল, পাড়াগাঁয়ে দশটা এগারটা বাজলেই গভীর রাত মনে হয়। পৌনে বারটা পর্যন্ত কী শফি জেগে আছে। আর যদি জেগেও থাকে, ধার্মিক ছেলে হিসাবে আমার ফোন পেলে কী কথা বলবে অথবা অন্য কিছু কী ভাববে? মন বলল, যাই ভাবুক না কেন, তুই ফোন কর। দোনো মনো করে ডালিয়া ফোন করল।

.

শফি প্রতিদিন রাত দশটায় খাওয়া দাওয়া করে ঘন্টা দেড় দুই পৃথিবীর সমস্ত ইসলামিক রাষ্ট্রপতিরা কেন একতায় আসতে পারছে না তার কারণের উপর একটা থিসিস লিখে। আজও লিখছিল। মোবাইল বেজে উঠতে ঘড়ির দিকে চেয়ে ভাবল, এতরাতে কে আবার ফোন করল? অচেনা নাম্বার দেখে মনে করল, হয়তো কেউ রং নাম্বারে ফোন করেছে। কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোন রিসিভ করে সালাম দিয়ে বলল, কে আপনি? এতরাতে ফোন করেছেন কেন?

শফির গলাচিনতে পেরেও ডালিয়া সালামের উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করল, এটা কি শফি সাহেবের নাম্বার?

ডালিয়ার সঙ্গে মোবাইল সেট হারিয়ে যাওয়া ও সেটটা নিতে গিয়ে অল্পক্ষণ আলাপ হলেও শফি তার গলা চিনতে পারল। ভাবল, এতদিন পর এতরাতে ফোন করল কেন? তা হলে কী আমার অনুমানই ঠিক? কথাটা মনে হতে সারা শরীরে আনন্দের স্রোত বইতে শুরু করল। কিছু না বলে চুপ করে রইল।

কী হল, কিছু বলছেন না কেন?

আপনি নিশ্চয় ডালিয়া?

শফির মুখে তার নাম শুনে ডালিয়ার হার্টবিট শতগুন বেড়ে গেল। ভাবল, শফি হার্ট বিটের শব্দ শুনতে পাচ্ছে না তো? কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সামলে নিয়ে কাঁপা গলায় বলল, কী করে বুঝলেন?

আল্লাহর মেহেরবানীতে আমি অনেক কিছু বুঝতে পারি। কেমন আছেন?

বললে বিশ্বাস করবেন?

অফকোর্স। কারণ আল্লাহর মুমিন বান্দা-বান্দি কখনও মিথ্যা বলে না।

আমি এখনও আল্লাহর মুমিন বান্দি হতে পারিনি।

হওয়ার যখন চেষ্টা করছেন তখন আল্লাহ আপনাকে খুব শিগ্রী মুমিন বান্দি হওয়ার তওফিক দেবেন।

ডালিয়া অবাক কণ্ঠে বলল, আমি চেস্টা করছি আপনি জানলেন কেমন করে?

এক্ষুনি বললাম না, আল্লাহর রহমতে আমি অনেক কিছু বুঝতে পারি? এবার বলুন, এতরাতে এই হতভাগাকে কেন ফোন করেছেন?

আপনি ও আপনার চোখের দৃষ্টি আমার সবকিছু কেড়ে নিয়ে আমাকে নিঃস্ব করে দিয়েছেন একথা বলতে না পেরে ডালিয়া অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।

শফি বলল, আপনি সারারাত চুপ করে থাকলে, আমিও কিন্তু আপনার কথা শোনার জন্য ফোন ধরে সারারাত অপেক্ষায় থাকব।

আরও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ডালিয়া কান্নাজড়িত স্বরে বলল, আপনি আমার মনে প্রেমের যে তুফান বইয়ে দিয়েছেন। তা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে শফি বলল, আপনার মুখ থেকে এই কথা শোনার জন্য এতদিন প্রহর গুনেছি। আল্লাহ আজ আমার আশা পূরণ। করলেন। সেজন্য তাঁর পাক দরবারে আবার হাজারবার শুকরিয়া জানাচ্ছি।

শফিও তাকে ভীষণ ভালবাসে বুঝতে পেরে ডালিয়ার হার্টবিট আবার বেড়ে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সামলে নিয়ে বলল, আপনার কথা শুনে তুফানের গতি আরও অনেক বেড়ে গেছে। সহ্য করার উপায় বলে দিন।

শফি বলল, ইংরেজিতে একটা প্রবাদ বাক্য আছে, লাভ অলওয়েজ টিয়ার্স,” কথাটা নিশ্চয় জানেন। এবার বিখ্যাত উর্দু কবি আল্লামা ইকবালের একটা বয়েৎ বলছি,

জফা জো ইস্ক মে হোতা হ্যায়,
উহ জাফা হি নেহী,
সিতম না হোতো মুহব্বত মে
কুছ মজা হী নেহী।

এই বয়েতের অর্থ জানেন?

জি, না। আপনি বলে দিন।

এর অর্থ হল—

প্রেমে পড়লে যে জুলুম হয়,
সেটা জুলুমই নয়।
প্রেমে পড়ে অত্যাচারিত না হলে
কোনো মজাই পাওয়া যায় না

এবার নিশ্চয় তুফানের বেগ সহ্য করতে পারবেন?

জুলুম ও সীতম সহ্য করার ক্ষমতা কি সবার থাকে?

থাকে, তবে কম আর বেশি।

আমার খুব কম আছে। তা দিয়ে তুফানের বেগ সহ্য করা সম্ভব নয়।

প্রেমের ব্যাপারে অসম্ভবকে সম্ভব করতেই হয়। কারণ প্রেমের সমুদ্র পাড়ি দিতে হলে অনেক রকম জুলুম ও সীতম সহ্য করতে হয়। যারা সত্যিকার প্রেমিক প্রেমিকা তারা কোনোরকম জুলুম ও সীতমকে ভয় পায় না। বরং সানন্দে সহ্য করে যায় প্রেমাস্পদকে পাওয়ার জন্য। সেটা জাগতিক প্রেম হোক অথবা আধ্যাত্বিক প্রেম হোক। এবার একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।

করুণ।

করলে মাইন্ড করবেন না বলুন।

না, করব না।

মহসিনের ফাঁইন্যাল পরীক্ষার পর তার সঙ্গে আপনার বিয়ে হবে। এতে আপনাদের ও ওনাদের কারও এতটুকু মতবিরোধ নেই, তবু কেন এই বিপদ সংকুল পথে পা বাড়ালেন?

ডালিয়া খুব অবাক কণ্ঠে বলল, এসব কথা জানলেন কেমন করে?

যেমন করে জানি না কেন, কথাটা তো সত্য?

হ্যাঁ, সত্য।

তা হলে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।

আমি পা বাড়াইনি, আপনি বাড়াতে বাধ্য করেছেন।

জেনেও না জানার ভান করে শফি অবাক কণ্ঠে বলল, উদোরপিন্ডী বুদোর ঘাড়ে চাপাচ্ছেন কেন?

কথাটা ঠিক বলেন নি।

তা হলে ঠিক কথাটা বলুন।

“লাভ এট ফার্স্ট সাইট।”

কিন্তু যারা ফাস্ট সাইটে লাভে পড়ে, তাদের সেই লাভ খুব তাড়াতাড়ি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই বলছিলাম, এই পথ থেকে সরে দাঁড়ান আপনার উচিত।

এ কথাটাও ঠিক বলেন নি।

তা হলে এবার ও ঠিক কথাটা বলুন।

আলাপের শুরুতে বলেছি না আপনিও আপনার দৃষ্টি আমার সবকিছু কেড়ে নিয়ে আমাকে নিঃস্ব করে দিয়েছেন?

তা অবশ্য বলেছেন।

এখন আরও বলছি শুনুন। আপনি আমাকে ঘায়েল করে প্রেমের সমুদ্রে নিক্ষেপ করেছেন। সেই সমুদ্রে কতদিন সাঁতার কাটতে পারব জানি না। আপনি যদি উদ্ধার না করেন, তা হলে হয়তো ক্লান্ত হয়ে একদিন তলিয়ে যাব।

ছি ডালিয়া, এমন কথা মুখে উচ্চারণ করাও পাপ।

মূমুর্ষজনের পাপ পুন্যের জ্ঞান থাকে না। একটা প্রশ্নের উত্তর দেবেন!

জানা থাকলে নিশ্চয় দেব।

মহসিন ভাই ও আমার ব্যাপারটা জেনেও কেন এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করেছিলেন?

এটা আমার তক্বদির।

আমিও যদি ঐ একই কথা বলি?

শফি কিছু না বলে অনেক্ষণ চুপ করে রইল।

চুপ করে আছেন কেন? আমার কথার উত্তর দিন।

আপনি ঠিক কথা বলেছেন, তারপর শফি আবার বলল, এবার আমাদের লাইন কেটে দেয়া উচিত।

কেন? আমার সঙ্গে কথা বলতে আপনার ভালো লাগছে না বুঝি?

সারারাত, সারাদিন, সপ্তাহ, মাস ও বছরের পর বছর যদি আপনার সঙ্গে কথা বলি তবুও পিয়াস মিটবে না।

তবে লাইন কেটে দেয়ার কথা বললেন কেন?

ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখুন কটা বাজে।

দেড়টা বেজে গেছে দেখে ডালিয়া বলল, সরি, এক্সট্রিমলি সরি, সত্যিই আর সময় নেয়া উচিত নয়। তবু আর একটা মাত্র কথা বলে লাইন কেটে দেব।

বলুন,

লেঠেল সর্দার মোবারককে চেনেন?

না, চিনি না। হঠাৎ তার কথা বলছেন কেন?

আমার মামা সালাউদ্দিন চেয়ারম্যান তাকে অনেক টাকা দিয়ে বলেছেন, আপনার হাত পা ভেঙ্গে লুলা করে দিতে। আপনি খুব সাবধানে থাকবেন।

শফি হেসে উঠে বলল, তাই নাকি?

ডালিয়া বলল, হ্যাঁ, তাই। আমি খুব বিশ্বস্তসূত্রে কথাটা জানতে পেরেছি। তারপর জিজ্ঞেস করল, হাসলেন কেন?

হাসবার কারণ আছে তাই হাসলাম।

কারণটা বলবেন তো?

এখন বলা যাবে না। তবে কিছুদিনের মধ্যে এমনই জানতে পারবেন। তারপর বলল, সাবধান করার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আর সময় দিতে পারছি না। রাখি আসোলামু আলাইকুম।

ডালিয়া ওয়া আলাইকুম সালাম বলে বলল, মাঝে মাঝে ফোন করার অনুমতি চাই।

দিলুম বলে শফি লাইন কেটে দিল

.

চাচা জাকির হোসেনের সঙ্গে শফি কয়েকদিন ঘুরে ঘুরে বাবার জমি জায়গা, আগান-বাগান, পুকুর-ডোবা দেখে বলল, এত দেখছি প্রচুর বিষয় সম্পত্তি। প্রতি বছর এসব থেকে আয়ও হয় সেরকম। মনে হয় দাদির কাছে বহু টাকা পয়সা জমেছে, তাই না চাচা?

জাকির হোসেন ভাইপোর কথা শুনে প্রমাদ গুণলেন। ভাবলেন, ও যদি সব কিছু একবছর দেখাশোনা করে, তা হলে ফসল বিক্রি করে কত টাকা মেরেছি ধরা পড়ে যাবে।

ওনাকে চুপ করে থাকতে দেখে শফি বলল, আমার কথার জবাব দেবেন না?

জাকির হোসেন তাড়াতাড়ি বললেন, তা তো জমেছেই। কত জমেছে জানি না, তুমি তোমার দাদিকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিও।

চাচাকে চুপ করে ভাবতে দেখে শফি যা বোঝার বুঝে গেল। বলল, ঠিক আছে, তাই জেনে নেব।

.

একদিন মাতব্বর সাহেব বেঠকখানায় কয়েকজন লোকের সঙ্গে শফির ব্যাপারে আলাপ করছিলেন। তাকে আসতে দেখে একজন বলল, ঐ তো শফি আসছে।

মাতব্বর সাহেব সেদিকে তাকিয়ে তাদেরকে চলে যেতে বললেন। তারপর শফি কাছে এলে হাসি মুখে বললেন, দাদুর কথা তা হলে মনে আছে?

শফি সালাম বিনিময় করে বলল, নাতি কী দাদুর কথা ভুলতে পারে? কেমন আছেন বলুন।

আল্লাহ যে অবস্থায় রেখেছেন তাতেই শোকর আদায় করছি। তারপর তাকে বসতে বলে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কেমন আছ?

আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর রহমতে ভালো আছি।

তা বাবার জমি জায়গা চাষবাস করবে নাকি?

শুধু ফসলী জমিগুলো চাচাকে ভাগে করতে বলেছি। খরচ বাদে অর্ধেক ফসল দেবেন। আর অন্যান্য সবকিছু আমি দেখাশোনা করব।

মাতব্বর সাহেব বললেন, ভালো- খুব ভালো।

আচ্ছা দাদু, লেঠেল সর্দার মোবারককে চেনেন?

মাতব্বর হেসে উঠে বললেন, তাকে আশপাশের দশ গ্রামের মানুষ চেনে। তা হঠাৎ তার কথা জিজ্ঞেস করলে কেন?

শফি বলল, আমিও শুনেছি। তাই জিজ্ঞেস করলাম। উনি খুব বিখ্যাত লেঠেল?

হ্যাঁ, ওর বাবাও খুব বিখ্যাত লেঠেল ছিল। মোবারকের মতো লেঠেল পাঁচ দশ গ্রামে নেই। শুধু তাই নয়, আগ্নেয় অস্ত্র চালাতেও ওস্তাদ। আজ পর্যন্ত লাঠিখেলায় ও আগ্নেয় অস্ত্র চালনায় কেউ হারাতে পারেনি।

আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে মাঝে মধ্যে লাঠিখেলা ও আগ্নেয়অস্ত্রের প্রতিযোগীতা হয়?

হ্যাঁ, হয়। প্রতি বছর সালাউদ্দিন চেয়ারম্যান তাদের গ্রামে প্রতিযোগীতার আয়োজন করেন। প্রতিযোগীতায় যে জীতে তাকে দশ হাজার টাকা পুরস্কার দেয়া হয়। অবশ্য এই পর্যন্ত মোবারকই প্রতি বছর পুরস্কার পেয়ে আসছে। কারণ কেউ-ই তাকে হারাতে পারেনি।

এ বছর আমাদের গ্রামে আপনি প্রতিযোগীতার ব্যবস্থা করবেন।

কথাটা শুনে মাতব্বর সাহেব খুব অবাক হয়ে শফির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে শফি বলল, মনে হচ্ছে আমার কথা শুনে আপনি খুব অবাক হয়েছেন?

হ্যাঁ, হয়েছি। কী ব্যাপার বলতো ভাই, হঠাৎ এরকম কথা বললে কেন?

বলব, তবে তার আগে আপনি বলুন, যা বললাম করবেন?

করতে পারব না কেন? কিন্তু এসব করতে গেলে অনেক টাকার দরকার। চেয়ারম্যান করেন তার স্বার্থ সিদ্ধির জন্য। আমি কেন শুধু শুধু এতটাকা খরচ করতে যাব? তা ছাড়া এটা অপব্যয়। আল্লাহ কুরআন পাকে বলেছেন, “নিশ্চয় অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই।” [সূরা-বনি ইসরাইল, আয়াত-২৭, পারা-১৫]

তা আমিও জানি এবং মানিও। কিন্তু এই আয়োজন করার পিছনে বিশেষ কারণ আছে। আর এজন্য যত টাকা লাগবে আমি দেব।

তা হলে এবার নিশ্চয় কারনটা বলবে।

জি বলব,তারপর চেয়ারম্যান কীভাবে তার হাত পা ভেঙ্গে লুলা করার জন্য মোবারক লেঠেলকে ভাড়া করেছে শফি সবকিছু বলল।

মাতব্বর সাহেব কথাটা শুনে মোটেই অবাক হলেন না। বরং মৃদু হেসে বললেন, আমি তার চরিত্র জানি। ছেলের হয়ে বাপ প্রতিশোধ নিতে চান। এরকমই কিছু একটা আশা করেছিলাম; কিন্তু তুমি একথা জানলে কী করে?

শফি বলল, আমি খুব বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছি?

কিন্তু চেয়ারম্যান অত কাঁচা লোক নন যে, ওনার প্ল্যান প্রোগ্রাম অন্য কেউ জানতে পারবে। তা ছাড়া শোনা কথা যাচাই না করে বিশ্বাস করতে নেই। এটা হাদিসের কথা।

তা আমিও জানি। যার কাছ থেকে জেনেছি, সে জীবন গেলেও মিথ্যা বলতে পারবে না।

তার পরিচয় বল।

ডালিয়ার কথা বলা ঠিক হবে কিনা শফি চিন্তা করতে লাগল।

চুপ করে আছ কেন? তার পরিচয় বলবে তো?

বিশেষ কারণে তার পরিচয় বলতে পারছি না। সেজন্য মাফ চাইছি। তবে আমি হ্যাঁন্ড্রেড পার্সেন্ট সিওর কথাটা সত্য।

ঠিক আছে তার পরিচয় বলার অসুবিধা থাকলে বলো না; কিন্তু তুমি কি মোবারক লেঠেলের সঙ্গে পারবে? না পারলে সে তো এই সুযোগে তোমাকে মেরে হাত পা লুলা করে দেবে? তার শরীর স্বাস্থ্য তোমার দ্বিগুণ, তোমার কিছু হলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। তা ছাড়া তোমার মা, দাদি, চাচা এবং তোমার নানাবাড়ির কারও কাছে মুখ দেখাতে পারব না।

শফি বলল, আপনি ওসব নিয়ে কোনো চিন্তা করবেন না। আমি নিশ্চিত, ইনশাআল্লাহ আমি কামিয়াব হব। আর মোবারক লাঠিয়াল ভবিষ্যতে যেন কখনও কোনো প্রতিযোগীতায় নামতে না পারে এবং লেঠেলগিরী করে কারও ক্ষতি করতে না পারে সে ব্যবস্থাও করতে পারব ইনশাআল্লাহ। আপনি শুধু দোয়া করবেন।

তাতো করবই কিন্তু তবু ভাই আমার বিবেক সাড়া দিচ্ছে না। আল্লাহ করুক যদি তুমি কামিয়াব হতে না পার, তা হলে তার পরিণতি কী হবে ভেবে পাচ্ছি না।

শফি মাতব্বরের দু’পা জড়িয়ে ধরে বলল, তদিরের উপর কারও হাত নেই। তবু আবার বলছি, ইনশাআল্লাহ আমি কামিয়াব হব। আপনি কি চান, মোবারক লেঠেল গোপনে আচানক হামলা করে আমার হাত পা লুলা করে দিক?

না, তা চাই না বলে মাতব্বর সাহেব তার হাত ধরে তুলে বসতে বলে বললেন, ঠিক আছে, তোমার কথামতো সবকিছু কবর, তবে তুমি ওর সঙ্গে লড়বে সবার শেষে, তুমি যে লড়বে, সে কথা প্রথমে প্রচার করা হবে না।

শফি বলল, বেশ, তাই হবে। এবার হিসাব করে বলুন, কত টাকা লাগবে। দু’একদিনের মধ্যে দিয়ে যাব। আর একটা কথা, আপনি কি রবিউলকে চেনেন?

কোন রবিউল? আমাদের গ্রামে তো তিন পাড়ায় তিনটে রবিউল আছে।

আমি চৌধুরী পাড়ার জহীরুদ্দিন চাচার ছেলে রবিউলের কথা বলছি। ও কলেজে প্রফেসারী করছে নিশ্চয় শুনেছেন?

হ্যাঁ, শুনেছি। ওদের বাপ চাচা সবাইকে চিনি।

ঐ রবিউল আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু। ও যেন এই লড়াই-এর কথা জানতে না পারে। আমি মোবারক লাঠিয়ালের সঙ্গে প্রতিযোগীতা করব শুনলে কিছুতেই আমাকে তা করতে দেবে না।

কিন্তু ঘোষক যখন ঘোষণা দেবে তখন তো জানতে পারবে এবং বাধাও দেবে।

তা জানুক, প্রতিযোগীতায় নামার সময় জানলে ও বাধা দেয়ার চান্স পাবে না।

মাতব্বর সাহেব বললেন, বেশ তাই হবে। আর তুমি যে টাকা পয়সার হিসাবের কথা বললে, সেসব পরে করা যাবে। আগে প্রতিযোগীতা হোক তারপর না টাকার হিসাব।

০৮. লাঠিখেলার প্রতিযোগিতা

লাঠিখেলার প্রতিযোগিতার কথা মাতব্বর সাহেব কয়েকজন লোক দিয়ে কাছের ও দূরের গ্রামগুলোতে ঢেড়া পিটিয়ে দিলেন।

সালাউদ্দিন চেয়ারম্যান জেনে ভাবলেন, ভালই হল এ বছর তাকে টাকা খরচ করে প্রতিযোগীতার ব্যবস্থা করতে হল না। একদিন মোবারক লেঠেলকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, এ বছর চরদৌলতখান গ্রামের মাতব্বর লাঠিখেলার প্রতিযোগীতা করার ব্যবস্থা করেছেন, সেকথা শুনেছ নিশ্চয়?

মোবারক বলল, জি সাহেব শুনেছি এবং সে ব্যাপারে তৈরি হয়ে আছি। চেয়ারম্যান বললেন, আমরা প্রতিযোগীতা দেখতে যাব যদি শফি প্রতিযোগীতায় নামে, তা হলে খেলারছলে কাজ হাসিল করে ফেলবে। আর যদি না নামে, তা হলে লোক দিয়ে শফিকে চিনিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করব।

মোবারক বলল, প্রতিযোগীতায় নামলে এমন ধোলাই দেব, পাটাই করে তাকে ঘরে নিয়ে যেতে হবে।

আজ প্রতিযোগীতার দিন। প্রতিযোগীতা শুরু হবে বেলা তিনটে থেকে। মাতব্বর সাহেবের বাগান বাড়ির সামনের জমিতে প্রতিযোগীতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। শামিয়ানা খাঁটিয়ে লোকজনের বসার জায়গা করা হয়েছে। পর্দা খাঁটিয়ে মেয়েদেরও আলাদা বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সকাল থেকে বিভিন্ন গ্রামের লোকজন ও প্রতিযোগীরা আসতে শুরু করল। চেয়ারম্যান ও অন্যান্য গন্যমান্য লোকেরা আসার পর ঠিক তিনটেয় প্রতিযোগীতা শুরু হল। পাঁচজন লেঠেল কেউ পাঁচ মিনিটের বেশি মোবারকের কাছে টিকতে পারল না। সবাইকে হারিয়ে দিয়ে মোবারক বুক চিতিয়ে লাঠি ঠুকে বলল, আর কোনো বাপের পুত থাকলে আমার সামনে এসে দাঁড়াক।

তিন মিনিট অপেক্ষা করার পর যখন বিচারকরা তাকে বিজয়ী বলে ঘোষণা দিতে যাবেন ঠিক তখন শফি লড়াই-এর ময়দানে ঢুকল।

ঘোষক শফির পরিচয় জানাল।

শফির আপনজনেরা ও পাড়া পড়শীরা হায় হায় করে উঠল। তারা বলাবলি করতে লাগল, একী সর্বনাশের কথা, লেঠেল সর্দার মোবারকের সঙ্গে এই ছেলে কী লড়বে? ও তো মার খেতে খেতে শেষ হয়ে যাবে। আর যারা শফিকে চেনে না, তারাও বলাবলি করতে লাগল, ছেলেটার সাহস তো কম না? যেখানে বড় বড় নাম করা লেঠেলরা মোবারকের কাছে গোহারা হেরে গেলো, সেখানে এই পুচকে ছোঁড়ার অবস্থা কী হবে আল্লাহ জানে।

রবিউল গত কয়েক বছর ধরে মোবারকের লাঠিখেলার প্রতিযোগীতা দেখে আসছে। তবুও শফিকে তার সঙ্গে লড়াই করার জন্য ময়দানে ঢুকতে দেখে একটুও ভয় পেল না বা ঘাবড়ালও না। কারণ তাকে যতটুকু জেনেছে তাতে সিওর শফি জিতবে। কিন্তু সে দুঃখ পেল এই ভেবে শফি তাকে এ ব্যাপারে কিছুই জানাইনি বলে।

মোবারক যখন পাঁচজন লেঠেলের সঙ্গে লড়ছিল তখন শফি পুংখানুপুংখভাবে তার খেলার কায়দা-কানুন দেখেছে। তাই তার সঙ্গে কীভাবে লড়বে ভেবে রেখেছে।

মোবারক শফিকে দেখে ও তার পরিচয় জেনে ভাবল, এই পিচ্ছি। ছোঁড়াটাকে ঘায়েল করতে মাত্র কয়েক মিনিট লাগবে। চেয়ারম্যান সাহেব একেই তুখোড় ছেলে বলেছেন। তিন চার মিনিটের মধ্যে ওর হাতপা ভেঙ্গে না দিয়েছি তো আমি আমার বাপের জন্মই না।

হাজার হাজার লোক এই অসম লড়াই দেখার জন্য উৎসুক হয়ে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাদের দিকে চেয়ে রইল।

রেফারী হুইসেল বাজাতে খেলা শুরু হল। প্রথম চান্সেই শফিকে ঘায়েল করার জন্য মোবারক তার উপর আক্রমনাত্মক খেলা চালাল।

শফি আক্রমণ ঠেকাতে লাগল; কিন্তু প্রতি আক্রমণ করল না। সে চাচ্ছে মোবারক হাঁপিয়ে যাক, তারপর আক্রমণ করবে। তাই প্রায় দশ পনের মিনিট খেলা চলার পর শফি আক্রমণ শুরু করল। তবে ততো জোরাল নয়। কারণ মোবারক বুঝুক সে তত শক্তিশালী নয় এবং আক্রমণ করার কলাকৌশলও জানে না। ফলে এর মধ্যে মোবারকের বেশ কয়েকটা আঘাত তাকে হজম করতে হয়েছে। আরও পাঁচ মিনিট পর যখন শফি বুঝতে পারল মোবারক হাঁপিয়ে পড়েছে তখন শক্তভাবে আক্রমণ না করে লাঠিটা শুধু বনবন করে ঘুরাতে ঘুরাতে মোবারকের দিকে এগোল।

দর্শকরা অবাক হয়ে দেখল, শফির লাঠি দেখা যাচ্ছে না। শুধু বনবন আওয়াজ হচ্ছে। আর মোবারকও তাই দেখে অবাক হয়ে নিজের লাঠি দিয়ে আক্রমণ বাধা দিতে গেল। শফির লাঠির আঘাতে তার লাঠিটা হাত ছাড়া হয়ে উড়ে গিয়ে দর্শকদের মাথার উপর পড়ল।

মোবারকের মনে হল শফি মানুষ না। কোনো মানুষের গায়ে এত শক্তি থাকতে পারে না। হাতছাড়া হয়ে লাঠিটা দূরের দর্শকদের উপর পড়তে দেখে এত অবাক হল যে, শফির দিকে চেয়ে পাথরের মতো জমে গেল।

এই সুযোগে শফি তার বামহাতের কুনুই-এর নিচে প্রচন্ড জোরে আঘাত করল।

মোবারকের মনে হল হাতটা বুঝি জয়েন্ট থেকে খুলে পড়ে গেল। শফি তার পায়ে আঘাত করতে যাচ্ছে দেখে দু’হাত তুলে সারেন্ডার করতে চাইল; কিন্তু বাম হাত তুলতে না পেরে শুধু ডান হাত তুলল।

শফি লাঠিটা সামলে নিয়ে বলল, আমি কিন্তু আপনার চার হাত পা–ই। ভেঙ্গে লুলা করে দিতে চেয়েছিলাম; স্যারেন্ডার করলেন বলে তা আর করব না। কারণ ন্যায় অন্যায় চিন্তা না করে লেঠেলগিরী করে যেমন অনেক টাকা রোজগার করেছেন, তেমনি সেই সাথে অনেক গুণাহও অর্জন করেছেন। এবার তওবা করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে সম্ভাবে জীবন যাপন করার সুযোগ দিলাম। আমি তো আপনার কোনো ক্ষতি করিনি, তবু কেন কয়েকটা টাকার জন্য কারও কথায় আমার হাত পা ভেঙ্গে আমাকে লুলা। করে দিতে চেয়েছিলেন? মওত, কবর ও হাশরের কথা মনে করে এখন থেকে আল্লাহ ও তাঁর রসুল (দ.) এর হুকুম মেনে চলার চেষ্টা করুন। যদি টাকা পয়সার দরকার হয় আসবেন, যথাসাধ্য দেয়ার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। দোয়া করি “আল্লাহ আপনাকে হেদায়েত দিয়ে সভাবে জীবনযাপন করার তওফিক দিক।”

শফি থেমে যেতে মোবারক চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, তোমাকে মানুষ বলে মনে হয় না। তোমার কথা শুনে আল্লাহ আমার জ্ঞানের চোখ খুলে দিয়েছে। ওয়াদা করছি, জীবনে আর কখনও লেঠেলগিরী করে টাকা রোজগার করব না।

মোবারকের সঙ্গে লাঠি খেলার প্রতিযোগীতায় শফির ক্ষীপ্রতা ও লড়াইয়ের কলাকৌশল সর্বোপরী তার লাঠি ঘোরানো দেখে গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ জনসাধারণ অবাক। তাদেরও মনে হয়েছে, শফি মানুষ নয় অন্য কিছু। শেষে মোবারকের পরিণতি এবং শফি ও মোবারকের কথা শুনে হাততালি দিয়ে শফিকে বাহবা দিতে লাগল। বিচারকরা শফিকে বিজয়ী ঘোষণা করলেন।

শফি এগিয়ে এসে মাতব্বর সুরুজমিয়াকে কদমবুসি করে জড়িয়ে ধরে বলল, দাদু, আল্লাহর মেহেরবানীতে ও আপনার নেক দোয়ার বরকতে আমি সফল হয়েছি।

মাতব্বর নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে দোয়া করলেন, “আল্লাহ তোমাকে দোজাহানে সফলতা দান করুক।” তারপর দশহাজার টাকার বান্ডিলটা তার হাতে তুলে দিলেন।

শফি সেটা নিয়ে মোবারকের হাতে দিয়ে বলল, লেঠেলগিরী ছাড়াবার জন্য আপনার একটা হাত ভেঙ্গে দিয়েছি। আমার অন্যায় হয়েছে, আমাকে মাফ করে দিন। আর এই টাকা দিয়ে হাতের চিকিৎসা করাবেন।

প্রথম থেকে শফি চেয়ারম্যান ও মহসিনকে দেখলেও এতক্ষণ না দেখার ভান করে ছিল। এবার কাছে গিয়ে সালাম বিনিময় করে চেয়ারম্যান ও অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উদ্দেশ্য করে বলল, আপনাদের দোয়ায় আল্লাহ আমাকে সফলতা দিয়েছেন। সেজন্যে তাঁর পাক দরবারে শুকরিয়া জানাচ্ছি। এবার আপনাদের কাছে একটা অনুরোধ করছি, লেঠেল বা অন্য কোন কাজে গরিব লোকদেরকে নিজের স্বার্থ হাসিল করার জন্য কোনো অন্যায় কাজে ব্যবহার করবেন না। বরং কারও সঙ্গে কারও বিরোধ ঘটলে, উভয়পক্ষ এক সঙ্গে বৈঠক করে মিমাংসা করে নেবেন। এটাই হল ইসলামের হুকুম।

শফির কথা শুনে সবাই হাত তালি দিতে লাগল।

মাতব্বর সাহেব সবাইকে চুপ করতে বলে চলে যেতে বললেন।

.

সালাউদ্দিন চেয়ারম্যান ফেরার পথে ছেলেকে বললেন, আমি যে মোবারককে টাকা দিয়ে শফির হাত পা ভেঙ্গে লুলা করে দিতে বলেছি, তা বোধ হয় শফি জানতে পেরেছে।

মহসিন বলল, তা কী করে সম্ভব?

চেয়ারম্যান বললেন, তা তো আমিও জানি; কিন্তু ওর কথা শুনে তাই তো মনে হচ্ছে। তোরও তো বোঝা উচিত ছিল। যাই বলিস, জীবনে অনেক লেঠেলের লাঠি খেলা দেখলাম; কিন্তু শফির মতো কাউকে দেখিনি।

মহসিনও শফির লাঠিখেলার কলাকৌশল দেখে মুগ্ধ হলেও তার প্রতি রেগে রয়েছে। তাই বলল, ওসব কথা বাদ দিয়ে চিন্তা কর শফিকে কীভাবে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া যায়।

চেয়ারম্যান বুঝতে পেরেছেন, শফির বিরুদ্ধে লাগা ঠিক হবে না। তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়াও সহজ হবে না। তাই বললেন, তুই অত মাথা গরম করছিস কেন? এখন আমাদেরকে ধৈর্য্য ধরে চিন্তা ভাবনা করে কাজ করতে হবে। জানিস না, ধৈর্যই সফলতার চাবি? এসব নিয়ে তুই কিছু ভাববি না, যা করার আমি করব। তুই কাল ঢাকায় চলে যাবি, মাথা ঠান্ডা রেখে গোছগাছ করে নিবি।

শফির অন্যান্য আত্মীয়দের সঙ্গে চাচা জাকির হোসেনও এসেছেন। সকলে চলে যাওয়ার পর জাকির হোসেন রয়েছে দেখে মাতব্বর তাকেও চলে যেতে বললেন, তারপর শফিকে নিয়ে বৈঠকখানায় বসলেন।

পর্দা করা জায়গায় শফির মা সাজেদা খাতুনও পাড়ার অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে লাঠিখেলা দেখতে এসেছিলেন। সবার মতো তিনিও জানতেন না, শফি মোবারক লেঠেলের সঙ্গে লড়বে। সবার শেষে যখন ঘোষক তার নাম ঘোষণা করলেন তখন শুনে ভয়ে চমকে উঠলেন। তারপর থেকে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে দোয়া করতে থাকেন, “আল্লাহ যেন শফিকে সফলতা দেন।” শফি জিতে যাওয়ার পরও চোখের পানি বন্ধ হয়নি। সেই অবস্থায় আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছেন। স্বামী চলে যাওয়ার পর ঘোমটা দিয়ে বৈঠকখানার একপাশে দাঁড়িয়ে শফি বলে ডেকে বললেন, আমার কাছে আয়।

শফি দ্রুত মায়ের কাছে এসে কদসবুসি করে বলল, তোমার দোয়ার বরকতে আল্লাহ আমাকে জয়ী করেছেন।

ছেলের কীর্তিকলাপ দেখে সাজেদা খুব অবাক হলেও বুক গর্বে ফুলে উঠেছে। কদমবুসি করতে তাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমো খেয়ে বললেন, তুইও তো অনেক লাঠির বাড়ি খেয়েছিস। ঘরে চল, সেসব জায়গায় মলম লাগিয়ে দেব।

ওনার কথা মাতব্বর শুনতে পেয়েছেন। তাই শফি কিছু বলার আগে বললেন, শফির মা তুমি ঘরে যাও। ওর জন্য কোনো চিন্তা করো না। আমি একজনকে ডাক্তার নিয়ে আসতে পাঠিয়েছি। তা ছাড়া ওর সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। তারপর তখনও যারা সেখানে ছিল তাদেরকে চলে যেতে বলে শফিকে বলল, তুমি আমার কাছে এসে বস।

কিছুক্ষণের মধ্যে ডাক্তার এসে শফির আঘাত পাওয়ার জায়গাগুলো পরীক্ষা করে বললেন, তেমন গুরুতর কিছু নয়। তারপর প্রেসক্রীপসান করে দিয়ে বললেন, মলমটা ফুলে উঠা জায়গাগুলোতে লাগাবেন আর ওষুধগুলো ঠিকমতো খাবেন। তারপর বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।

ডাক্তার চলে যাওয়ার পর মাতব্বর শফিকে বললেন, ঘরে গিয়ে ফ্রেস হয়ে আসরের নামায পড়ে এস, একটা ব্যাপারে আলাপ করব। আমি ওষুধ কিনতে লোক পাঠিয়েছি। তখন ওগুলো নিয়ে যাবে।

ঘরে আসার পথে হঠাৎ রবিউলের কথা শফির মনে পড়ল। প্রতিযোগীতায় নামার আগে শফি তার চোখের আড়ালে ছিল। প্রতিযোগীতা শেষ হবার পর যখন সবাই তাকে হাততালি দিয়ে বাহবা দিচ্ছিল তখন রবিউলকে দেখতে না পেয়ে ভাবল, ওকে এ ব্যাপারে কিছু জানাইনি বলে নিশ্চয় আমার উপর খুব রেগে আছে। কথাটা ভেবে ঘরে না গিয়ে ওর কাছে যেতে লাগল। রবিউলের ঘরের কাছে এসে তাদের কাজের ছেলেটাকে দেখে জিজ্ঞেস করল, রবিউল ঘরে আছে?

কাজের ছেলেটা শফিকে চেনে। বলল, জ্বি আছে। লাঠিখেলা দেখে কিছুক্ষণ আগে ফিরেছে। আপনি সদরে বসুন ডেকে দিচ্ছি।

শফি বলল, বসার সময় নেই, তুমি ওকে তাড়াতাড়ি ডেকে দাও।

একটু পরে রবিউল এলে শফি সালাম দিয়ে বলল, ইচ্ছাকৃত ভুলের জন্য ক্ষমা চাইতে এলাম।

রবিউল সালামের উত্তর দিয়ে চুপ করে রইল।

কী রে, ক্ষমা চাইলাম, তবু ক্ষমা করবি না? জানিস না বুঝি ক্ষমাকারীকে আল্লাহ খুব পছন্দ করেন?

তা জানব না কেন? কিন্তু তুই তো নিজেই বললি ইচ্ছাকৃত ভুল করেছিস। কেউ না জেনে ভুল করলে তাকে ক্ষমা করা যায়; কিন্তু…….

তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে শফি বলল, মোবারক লেঠেলের সঙ্গে লড়াই করব একথা তোকে কেন বলিনি জানিস? বললে তুই লড়তে দিতিস না।

তোর ধারণা ভুল। আমি এতটুকু বাধা দিতাম না। কারণ আমি হ্যাঁন্ড্রেড পার্সেন্ট সিওর, যে কাজে তুই নামবি, তাতেই তুই সাকসেসফুল হবি। তবু তর্কের খাতিরে না হয় তোর কথা মেনেই নিলাম; কিন্তু মাতব্বরের সঙ্গে প্রতিযোগীতার প্ল্যান প্রোগ্রাম করেছিস, সেকথা জানালি না কেন? সেটাতেও বাধা দিতাম?

দিতিস না বলে শফি তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, এ ভুল আমি অজান্তে করেছি। দু’টো ভুল একসঙ্গে ক্ষমা করে দে। যদি না করিস, তা হলে তোর মনে যতটা কষ্ট হয়েছে তার চেয়ে বেশি আমার মনে কষ্ট হবে।

রবিউল নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে বলল, আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুক। তারপর বলল, ঘরে চল, নাস্তা খেয়ে যাবি।

শফি বলল, গোসল না করে এ অবস্থায় খেতে পারব না। তা ছাড়া প্রতিযোগীতার পর মায়ের সঙ্গে দেখা হলেও দাদির সঙ্গে হয়নি। জানিসতো উনি খুব পর্দা মেনে চলেন। উনি আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। এখন যাই, কাল সকালে আসব। তারপর বিদায় নিয়ে চলে গেল।

জমিলা খাতুন খুব পর্দানশীন মহিলা। তাই তিনি প্রতিযোগীতা দেখতে যাননি। কিছুক্ষণ আগে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মুখে শফি লেঠেলসর্দার মোবারকের সঙ্গে প্রতিযোগীতায় নেমে তার একটা হাত ভেঙ্গে দিয়েছে শুনে খুব খুশি হয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছেন। এখন শফিকে ঘরে ঢুকতে দেখে তবু জিজ্ঞেস করলেন, তুই নাকি মোবারক লেঠেলের সঙ্গে লড়াই-এ নেমে তার একটা হাত ভেঙ্গে দিয়েছিস?

শফি বলল, হ্যাঁ দাদি। ওনার হাত ভাঙ্গার ইচ্ছা ছিল না, তবু ভেঙ্গেছি ভবিষ্যতে উনি যেন আর কখনও লেঠেলী করতে না পারেন। তারপর বলল, এ ব্যাপারে পরে আলাপ করব। এখন আপনি নাস্তা রেডি করুন। আমি গোসল করে আসি বলে লুংগী গামছা নিয়ে পুকুরের দিকে চলে গেল। শফি ফিরে আসার পর তার কাজ-কর্ম ও আচার-ব্যবহারে গ্রামের ছোট বড় সবাই শ্ৰেণীমতো তাকে ভক্তিশ্রদ্ধা করে। আজ লাঠিখেলা প্রতিযোগীতার, ঘটনায় তার প্রতি সবাইয়ের ভক্তি শ্রদ্ধা আরও অনেক বেড়ে গেছে। শফি মসজিদে নামায পড়তে যাবার পথে সবার মুখে তার গুণাগুণ শুনে মনে মনে আল্লাহকে জানাল, কখন কোনো ব্যাপারেই যেন তার মনে অহংকার না আসে। অহংকার থেকে তাকে হেফাজত করো।

.

মাতব্বর সাহেব বৈঠকখানায় বসেছিলেন। শফিকে দেখে বললেন, এস ভাই বস, তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।

শফি সালাম বিনিময় করে বসে বলল, কী যেন আলাপ করার জন্য ডেকেছিলেন?

মাতব্বর বললেন, তোমার চাচা জাকির হোসেনকে তুমি কী করবে না করবে জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলল, তুমি না কী ঢাকায় চাকরি করবে। কথাটা কি সত্য?

শফি বলল সত্য মিথ্যা দু’টোই।

ব্যাপারটা বুঝলাম না।

বললেই বুঝবেন। শুনুন, কথাটা বলেছি সত্য; কিন্তু ওনার মন বোঝার জন্য মিথ্যে করে বলেছি।

মাতব্বর হেসে উঠে বললেন, তুমি খুব জিনিয়াস জেনেছি; কিন্তু এতটা জিনিয়াস বুঝতে পারিনি। তারপরই বললেন, কেন ডেকেছি শোন-তোমার নানাবাড়ি তো নলছটি, আমার নানার বাড়িও নলছটি। তুমি বোধ হয় জান না ওখানে একটা কামিল মাদ্রাসা আছে। যাই হোক, আমার নানার কোনো ছেলে সন্তান ছিল না, শুধু দু’টো মেয়ে ছিল। বড় মেয়ে মারা যায়। আমার মা ছোট। নানার অনেক বিষয় সম্পত্তি ছিল। তিনি মারা যাওয়ার পর মা সব সম্পত্তির মালিক হয়। মায়ের কথা মতো বাবা কারিগরী শিক্ষাসহ একটা কামিল মাদ্রাসা করে সব সম্পত্তি ওয়াকফ করে দেন। তখন বাবা ছিলেন মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির প্রেসিডেন্ট। বাবা মারা যাওয়ার পর আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও কমিটি আমাকে প্রেসিডেন্ট করেছে। আগে ওয়াকফ করা সম্পত্তির আয়ে মাদ্রাসার যাবতীয় খরচ চলত। এখন সরকারের অণুদান। পায়। মাদ্রাসায় যিনি প্রিন্সিপাল ছিলেন তিনি কিছুদিন আগে মারা গেছেন। বর্তমানে ভাইস প্রিন্সিপাল প্রিন্সিপালের কাজ করছেন। আমি চাই তোমাকে প্রিন্সিপাল করতে।

শফি বলল, শুধু আপনি চাইলে তো হবে না কমিটির অন্যান্য সদস্যদেরও তো চাইতে হবে।

মাতব্বর বললেন, তা তো বটেই। তবে আমার বিশ্বাস আমি যাকে পছন্দ করব, তাকে কমিটি না রেখে পারবে না। কয়েকদিন আগে-ঐ পদের জন্য দু’তিনটি কাগজে বিজ্ঞপ্তী দেয়া হয়েছে। আমি চাই তুমিও একটা দরখাস্ত নিজে গিয়ে ভাইস প্রিন্সিপালের কাছে দিয়ে এস। আমি একটা চিঠি লিখে দেব, সেটাও ওনাকে দিবে।

শফি বলল, ঠিক আছে দাদু, চিন্তা করে আপনাকে জানাব।

মাতব্বর বললেন, চিন্তা করতে চাও কর, তবে আমি বলব, কোথাও অন্য কিছু করার চেয়ে এখানে থেকে এটা করা অনেক ভালো। কারণ গ্রামের গরিব ও অশিক্ষিত লোকজন তোমার কাছ থেকে অনেক উপকার পাবে। তুমি যে শুধু সব বিষয়ে উচ্চশিক্ষিত তাই নও, ধার্মিক ও আদর্শবান ছেলে। গ্রামের লোকজন ধর্ম সম্পর্কে একরকম কিছুই জানে না। যারা জানে তারা সার্থের জন্য ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করছে। আর একশ্রেণীর লোক মডার্ন শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে প্রগতির নাম দিয়ে ধর্মকে এড়িয়ে চলছে। তা ছাড়া ধর্মের নামে অনেক কুসংস্কার ও রীতিনীতি প্রচলিত রয়েছে। তুমি সেসব সমাজ থেকে দূর করতে পারবে। এতকিছু জানার পরও আর কিছু চিন্তা করার আছে?

শফি বলল, আপনি ঠিক কথা বলেছেন। আমি দু’একদিনের মধ্যে এ ব্যাপারে আপনার কাছে আসব। এবার আসি বলে সালাম বিনিময় করে চলে গেল।

০৯. কালকিনির বসির মোল্লা

কালকিনির বসির মোল্লা এ বছর ইলেকসনে জিতে এম.পি. হয়েছেন। ওনার একমাত্র ছেলে জুলহাস গত বছর বি.এ. পাশ করে মাস্তানী করে বেড়াচ্ছিল। এ বছর বাবা এম.পি. হবার পর মাস্তানী আরও বেড়ে গেছে। দু’জন বন্ধুকে হুডায় নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। বাজারে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেয়। স্কুল কলেজের সেয়ানা মেয়েদের দেখলে টিজ করে। হাইজ্যাক করে নিয়ে গিয়ে ফুর্তি করার প্রস্তাব দেয়। তবে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো দুর্ঘটনা ঘটাইনি।

একদিন সালাউদ্দিন চেয়ারম্যানের মেয়ে রাহেলা যখন কলেজ থেকে ফিরছিল তখন জুলহাস তাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে পথ আগলে তার নাম ও পরিচয় জিজ্ঞেস করল।

অনেকের গায়ের রং কালো হলেও মুখের চেহারা ভালো হয়; কিন্তু জুলহাসের গায়ের রং যেমন কালো, মুখের চেহারাও তেমনি কুতসিৎ। তাই তাকে দেখে রাহেলা চমকে উঠল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সামলে নিয়ে রাগের সঙ্গে বলল, আপনি কে যে, নাম পরিচয় বলতে হবে?

জুলহাস ঘেঁতো হাসি হেসে নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, এবার আপনারটা নিশ্চয় বলবেন?

তাদের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য রাহেলা নাম পরিচয় বলে হাঁটতে শুরু করল।

জুলহাস তার চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে নিতম্বের উত্থান পতন দেখতে দেখতে বন্ধুদের বলল, এই মেয়েকে বিয়ে করতেই হবে। তারপর ঘরে এসে মাকে রাহেলার পরিচয় দিয়ে বলল, আমি ওকে বিয়ে করতে চাই। তুমি বাবাকে ব্যবস্থা করতে বল।

বশির মোল্লার আর্থিক অবস্থা খুব ভালো। তিনি সালাউদ্দিন চেয়ারম্যানকে চেনেন। ইলেকশানের সময় লোকটা তার হয়ে অনেক কাজ করেছেন। ছেলে তার মেয়েকে বিয়ে করতে চায় স্ত্রীর কাছে শুনে একজন ঘটককে ডেকে পাঠালেন। ঘটক আসার পর সালাউদ্দিন চেয়ারম্যানের ও তার মেয়ের খোঁজ খবর নিতে বললেন।

ঘটক বলল, ওনাকে খুব ভালো করে চিনি। আর্থিক অবস্থা ভালো। ওনার এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে ঢাকায় ফুপুর বাসায় থেকে ভার্সিটিতে পড়ছে। মেয়ে ঘরে থেকে গ্রামের কলেজে পড়ছে। অপূর্ব সুন্দরী, সচরাচর এত সুন্দরী মেয়ে দেখা যায় না। যেমন গায়ের রং তেমনি চেহারা। চেয়ারম্যান যে ভালো লোক, তা আপনিও জানেন। ওনার মেয়ে আপনার পূত্রবধু হওয়ারই যোগ্য।

বশির মোল্লা বললেন, তাই যদি হয়, তা হলে আপনি আজই গিয়ে প্রস্তাব দিন। তারপর তাকে এক হাজার টাকা দিয়ে বললেন, বিয়ের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর তোমাকে খুশি করে দেব।

ঘটক সালাম বিনিময় করে বিদায় নিয়ে ঐ দিন বিকেলে সালাউদ্দিন চেয়ারম্যানের বাড়িতে গেল।

চেয়ারম্যান ঘটককে চেনেন। তাকে দেখে বললেন, কী ঘটক মিয়া, কী খবর?

ঘটক সালাম ও কুশল বিনিময় করে বলল, আমাদের এম.পি. সাহেব পাঠিয়েছেন।

তাই না কী? কেন পাঠিয়েছেন বলুন।

উনি আপনার মেয়েকে একমাত্র পুত্রের বৌ করার জন্য প্রস্তাব দিয়ে পাঠিয়েছেন।

চেয়ারম্যান ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, আমার বিয়ের উপযুক্ত মেয়ে আছে উনি জানলেন কেমন করে? আপনি নিশ্চয় বলেছেন?

ঘটক বলল, আমি কিছুই বলিনি। ওনার ছেলে একদিন আপনার মেয়েকে কলেজ থেকে ঘরে ফেরার পথে দেখে পছন্দ করেছে। সেকথা জেনে এম.পি. সাহেব আমাকে প্রস্তাব নিয়ে পাঠালেন। আপনারা রাজি থাকলে কথাবার্তা বলার জন্য উনি আসবেন।

ইলেকসানের ব্যাপারে বসির মোল্লা ছেলে জুলহাসসহ বেশ কয়েকবার চেয়ারম্যানের কাছে এসেছেন। জুলহাস স্বাস্থ্যবান ও শিক্ষিত হলেও গায়ের রং কালো, মুখের শ্রীও ভালো নয়। অচেনা কেউ হঠাৎ দেখলে ভয় পাবে।

সেই ছেলের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে শুনে চেয়ারম্যান ঘটকের উপর খুব রেগে গেলেও তা বাইরে প্রকাশ করলেন না। মুখের উপর না করে ঘটককে ফিরিয়ে দিলে এম.পি সাহেব অসন্তুষ্ট হবেন। তাই নাস্তা করিয়ে বিদায় দেয়ার সময় বললেন, বিয়ে সাদির ব্যাপারে ভেবে চিন্তে কাজ করতে হয়। তা ছাড়া মেয়ে কলেজে পড়ছে, তারও মতামত নিতে হবে। যাই হোক, সপ্তাহখানেক পরে আসবেন তখন মতামত জানাব।

ঘটক ফিরে এসে এম.পি. সাহেবকে চেয়ারম্যানের কথা জানাল।

এম.পি. সাহেব বললেন, চেয়ারম্যান ভালো কথা বলেছেন। আপনি সপ্তাহখানেক পরে গিয়ে খবর নিয়ে আসবেন।

এক সপ্তাহ পরে ঘটক এলে চেয়ারম্যান বললেন, এম.পি. সাহেবকে বলবেন, ওনার প্রস্তাব পেয়ে আমরা খুশি হয়েছিলাম; কিন্তু মেয়ে এখন পড়ছে বিয়েতে একদম রাজি নয়। শিক্ষিত বয়স্কা মেয়েকে তো আর জোর করে বিয়ে দেয়া যায় না। তারপর ঘটককে বিদায় করে দিলেন।

ঘটক ফিরে এসে চেয়ারম্যান এম.পি. সাহেবকে যা কিছু বলতে বলেছেন বললেন।

নিজের ছেলে দেখতে খারাপ বলে এম.পি. সাহেব প্রায় তার বিয়ের ব্যাপারে চিন্তা করেন। কোনো উচ্চ বংশের মেয়ের বাবা তার ছেলেকে দেখলে জামাই করতে চাইবেন না। তাই যেদিন স্ত্রীর মুখে চেয়ারম্যানের মেয়েকে ছেলে পছন্দ করেছে শুনেছেন তখনই ভেবেছেন, চেয়ারম্যান রাজি হবেন না। কারণ তিনি জুলহাসকে দেখেছেন। তবু ছেলের মন রাখার জন্য ঘটককে ডেকে পাঠান। ঘটকের মুখে মেয়ে অপূর্ব সুন্দরী জেনেও ঐ একই কারণে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। এখন ঘটকের কথা শুনে বললেন, হু, যা বোঝার বুঝে গেছি। আপনি অন্য মেয়ের খোঁজ করুন। শুনুন, মেয়ের বাবাকে বলবেন, আমাদের কোনো দাবি দাওয়া নেই। পাত্রী শিক্ষিত ও সুন্দরী হলে আমরা নিজেদের খরচে সবকিছু দিয়ে বৌ করে নিয়ে আসব।

ঠিক আছে সাহেব, তাই হবে বলে ঘটক বিদায় নিয়ে চলে এল। বড় রাস্তায় এসে দেখল, এম.পি. সাহেবের ছেলে ও তার দু’জন বন্ধু হুন্ডার পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছে।

কাছে এলে জুলহাস সালাম বিনিময় করে বলল, এই যে ঘটক চাচা, কি খবর বলুন।

ঘটক বলল, চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, মেয়ে এখন বিয়ে করবে না পড়াশোনা করবে।

জুলহাসও জানে কোনো মেয়ের বাবা তাকে দেখলে যেমন জামাই করতে চাইবে না, তেমনি মেয়েও তাকে দেখলে বিয়ে করতে চাইবে না। তবে তার টাকার অহংকার আছে। ভাবে টাকা থাকলে যদি বাঘের চোখ পাওয়া যায়। তা হলে সুন্দরী মেয়ে পাওয়া যাবে না কেন? এখন ঘটকের কথা শুনে রাহেলার উপর প্রচণ্ড রেগে গেল। তাকে বিদায় করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, তোর রূপসূধা পান করে মুখে এ্যাসিড দিয়ে যদি পুড়িয়ে না দিই তো আমি বাপের বেটা নই।

এরপর থেকে রাহেলাকে ধরার জন্য দু’বন্ধুকে হুন্ডায় নিয়ে কলেজে। যাতায়াতের রাস্তায় আড্ডা দিতে লাগল।

কলেজ পনের দিন বন্ধ থাকায় রাহেলা কলেজে যাইনি। আজ কলেজ খুলতে ক্লাস করতে এসেছিল। প্রথম দিন বলে দুপুর একটায় ছুটি হয়ে যায়।

কলেজে যাতায়াতের পথে রাস্তার পাশে একটা বেশ বড় বিল আছে। বিলের পাড়ে কাশবন। বিলটা লোকালয় থেকে বেশ দূরে মাঠের মাঝখানে। তখন গ্রীষ্মকাল হওয়ায় দুপুরের পর লোকজনের যাতায়াত কম। কলেজ ছুটির পর রাহেলা ফেরার পথে বিলের কাছে এসে দেখল, সেদিনের সেই তিনটে ছেলে রাস্তার ধারে হুন্ডার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। রাহেলা না দেখার ভান করে পাশ কেটে চলে আসছিল, ওড়নায় টান পড়তে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, কাল কুচকুচে ছেলেটা, সেদিন যে এম.পি. সাহেবের ছেলে বলে পরিচয় দিয়েছিল, তার হাতে ওড়নাটা।

রাহেলা খুব স্মার্ট মেয়ে স্বাস্থ্যও ভালো, ভয় ডর কাউকে করে না। তার উপর বাবা চেয়ারম্যান। তাই একটু বেপরোয়া স্বাভাবের। ওড়নাটা ঝাঁপটা মেরে টান দিয়ে বলল ছাড়ন। এম.পি. সাহেবের ছেলের কাছ থেকে এরকম আশা করিনি। তারপর অন্য দু’জনকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনাদের ঘরে কী মা বোন নেই?

বন্ধুরা কিছু বলার আগে জুলহাস বলল, মা-বোন সবার ঘরেই থাকে। রাস্তার মেয়েরা তো মা বোন নয়। তারপর ধরা ওড়নাটা জোরে টান দিতে রাহেলা ছিটকে এসে জুলহাসের গায়ের উপর পড়ল। আর বই খাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাস্তায় পড়ে গেল।

জুলহাস তাকে জড়িয়ে ধরে বন্ধুদেরকে বলল, চল কাশবনে নিয়ে গিয়ে প্রথমে ফুর্তি করব। তারপর এসিড ঢেলে মুখ পুড়িয়ে দেব। শালিকে বিয়ে করব বলে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম। শালীর বাপ প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে। তারপর তিনজনে মিলে রাহেলাকে কাশবনে নিয়ে যাবার জন্য চেষ্টা করতে লাগল।

.

শফি পরের দিন সকালে বন্ধু রবিউলের কাছে গিয়ে মাতব্বর দাদুর চাকরির প্রস্তাবের কথা জানিয়ে বলল, তুই কী বলিস?

।রবিউল খুশি হয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, কোনো দ্বিমত

করে রাজি হয়ে যা। তারপর জিজ্ঞেস করল, তোর দাদিকে বলেছিস?

বলেছি।

উনি কী বললেন?

উনিও শুনে খুশি হয়ে বললেন, মাতব্বর খুব ভালো কথা বলেছেন। তুই ঢাকায় চাকরি করতে না গিয়ে এই চাকরি কর।

ঢাকায় চাকরি করার ইরাদা করেছিলি না কি?

না, করিনি। চাচা একদিন কি করব না করব জিজ্ঞেস করেছিলেন। ওনার মন বোঝার জন্য দাদির সামনে কথাটা বলেছিলাম। দাদি সেই কথাটা সত্য মনে করেছেন।

রবিউল বলল, দেরি না করে আজকেই মাতব্বরকে তোর মতামত জানিয়ে দে।

ঠিক আছে তাই দেব বলে শফি তার কাছে বিদায় নিয়ে মাতব্বরের কাছে গিয়ে সালাম ও কুশল বিনিময় করে মাদ্রাসায় চাকরি করার মত প্রকাশ করল।

মাতব্বর খুশি হয়ে শুকুর আলহামদুলিল্লাহ বলে বলেন, তোমার কাছ থেকে এটাই আশা করেছিলাম। আর দেরি করে কাজ নেই, কালকেই দরখাস্ত লিখে দিয়ে এস। আমি ভাইসপ্রিন্সিপালকে দেয়ার জন্য একটা চিঠি লিখে রাখব। যাওয়ার আগে আমার কাছ থেকে চিঠিটা নিয়ে যেও।

শফি জিজ্ঞেস করল, উনি কি খুব বয়স্ক লোক?

মাতব্বর বললেন, হ্যাঁ, উনি প্রায় বিশ বাইশ বছর ঐ পদে আছেন।

শফি বলল, আমি ছেলে মানুষ। তা ছাড়া প্রিন্সীপাল হওয়ার জন্য যে অভিজ্ঞতা দরকার, তা আমার নেই। তাই বলছিলাম ভাইস প্রিন্সিপালকে প্রিন্সিপাল পদে নিয়োগ করুন আর আমাকে ভাইস প্রিন্সিপাল পদে। উনি যখন রিটায়ার্ড করবেন তখন না হয় আমাকে প্রিন্সিপাল পদে নিয়োগ করবেন।

মাতব্বর সাহেব বললেন, কমিটির তরফ থেকে ওনাকে আমি কথাটা জানিয়েছিলাম। বললেন, আমার বয়স হয়েছে ঐ দায়িত্ব পালন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আমি তোমাকেই প্রিন্সিপাল পদে নিয়োগ দিতে চাই। তবে উনি যেন তোমাকে প্রিন্সিপালের কাজ-কর্ম বুঝিয়ে দেন, সেই ভাবেই আমি চিঠি লিখে ওনাকে ব্যবস্থা করতে বলব।

আজ শফি বেলা এগারটার সময় মাদ্রাসায় গিয়ে ভাইস প্রিন্সিপালের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে বলল, চরদৌলতখানের মাতব্বর সূরুজমিয়া আমাকে পাঠিয়েছেন।

ভাইস প্রিন্সিপালের বয়স পঁয়ষীর মতো। চুল দাড়ি সব পেকে সাদা। হয়ে গেছে। ইসলামের বিধি নিষেধ নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে চলেন। শফির আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে বসতে বলে বললেন, আপনি আসবেন মাতব্বর সাহেব কিছুক্ষণ আগে ফোন করে জানিয়েছেন। তারপর বললেন, কই, দরখাস্ত দিন।

শফি মাতব্বর দাদুর চিঠিসহ দরখাস্তটা ওনার হাতে দিল।

মাতব্বর ফোন করে ভাইস প্রিন্সিপালকে শুধু জানিয়েছে “একটা জিনিয়াস ছেলেকে আপনার কাছে পাঠাচ্ছি। কথাটা ঠিক বলেছি কিনা একটু পরীক্ষা করে দেখবেন।” তাই প্রথমে দরখাস্থের উপর একবার চোখ বুলিয়ে মাতব্বরের চিঠি পড়ে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে শফির দিকে তাকিয়ে থেকে চিন্তা করলেন, যে ছেলের এতগুলো ডিগ্রী, তাকে আবার কী পরীক্ষা করবেন? বললেন, আপনি এখানে কাজ করতে চান জেনে খুব খুশি হয়েছি। সামনের শুক্রবার কমিটির মিটিং বসবে। আরও অনেক দরখাস্থ পেয়েছি। ঐদিন তাদেরকে আসার জন্য খবর দেয়া হয়েছে। আপনিও আসবেন। তারপর আপ্যায়ন করিয়ে বিদায় দিলেন।

ফেরার পথে শফি যখন বিলের কাছে এল তখন কাশবনের দিক থেকে মেয়েলী কণ্ঠ শুনতে পেল, “কে কোথায় আছ আমাকে এই পশুদের হাত থেকে বাঁচাও।” ব্যাপারটা বুঝতে পেরে খুব দ্রুত সেদিকে এগোল। একটু পরেই দেখতে পেল, চেয়ারম্যানের মেয়ে রাহেলাকে তিনটে ছেলে উলঙ্গ করার চেষ্টা করছে। রাহেলা প্রাণপণে ইজ্জৎ বাঁচাবার জন্য তাদের সাথে ধস্তাধস্তী করছে আর ঐ কথা বলে চিৎকার করছে।

শফি ছুটে এসে একজনের গর্দানে প্রচন্ড জোরে ক্যারাটের চাপ মারল।

ছেলেটা বাবারে বলে রাহেলাকে ছেড়ে দিয়ে ঘাড় ধরে লুঠিয়ে পড়ে জ্ঞান হারাল।

ততক্ষণে শফি আর একজনের তলপেটের নিচে অণ্ডকোষে প্রচন্ড জোরে লাথি মেরে তৃতীয়জনকে ধরে মাটিতে কয়েকটা আছাড় মেরে ছেড়ে দিল। যার অণ্ডকোষে লাথি মেরেছিল সে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে রইল। শফি জুলহাসকে কয়েকটা আছাড় মারার ফলে তার নাখ মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে নিথর হয়ে পড়ে রইল।

রাহেলার গায়ের কামিজের অধিকাংশ ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। শফি ওদেরকে আক্রমণ করতে সুযোগ পেয়ে ওড়না গায়ে জড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল আর তার চোখ থেকে পানি পড়তে লাগল। সেই অবস্থায়। শফিকে চিনতে পেরে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তার কার্যকলাপ দেখছিল।

তিনজনকে অজ্ঞান করে শফি যখন রাহেলার কাছে এল তখন রাহেলা কৃতজ্ঞতা জানাবার চেষ্টা করেও কিছু বলতে পারল না। শুধু ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠে থেমে গেল। তবে একইভাবে তার দিকে চেয়ে থেকে চোখের। পানি ফেলতে লাগল। তার মনে হল স্বপ্ন দেখছে। কয়েকদিন আগে বাবার মুখে কীভাবে লেঠেল সর্দার মোবারকের একটা হাত ভেঙ্গে দিয়ে এবং যেসব কথা বলে পুরস্কারের দশ হাজার টাকা তাকে দিয়েছে, সেসব শুনে খুব অবাক হয়ে ভেবেছে, শফি মানুষ না ফেরেশতা। আজ আবার তিনজনকে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে মেরে অজ্ঞান করতে দেখে দৃঢ় বিশ্বাস হল, সত্যিই শফি মানুষ না ফেরেশতা। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রাহেলা এসব ভাবছিল।

রাহেলার কাপড়ের অবস্থা দেখে শফি নিজের পাঞ্জাবী খুলে তার কাঁধে রেখে বলল, এটা পরে ওড়না গায়ে জড়ান। কথা শেষ করে উল্টোদিকে ঘুরে দাঁড়াল। তারপর অল্পক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, আর ভয় নেই। আসুন আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিই বলে হাঁটতে শুরু করল।

তার কথা শুনে রাহেলা তাড়াতাড়ি পাঞ্জাবীটা গায়ে দিয়ে সারা শরীরে ওড়না জড়িয়ে তার পিছু নিল। একটু দ্রুত হেঁটে এসে পাশাপাশি যেতে যেতে কান্নাজড়িত স্বরে বলল, আপনি এসে না পড়লে আমার আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকত না। এই কথা বলে যুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

শফি জানে কাঁদলে মানুষের মন কিছু হালকা হয়। তাই কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে বলল, মানুষ ভাগ্যের হাতে বন্দি। ভাগ্যে যা থাকবে তা কেউ রোধ করতে পারবে না। তবে মানুষ যদি সাবধান হয়ে ও চিন্তা ভাবনা করে কাজ করে, তা হলে অনেক বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পেতে পারে। আল্লাহ ও তাঁর রসূল (দ.) মেয়েদেরকে ঘরের বাইরে বেরোবার সময় পর্দা করে বেরোতে বলেছেন। আজকাল মুসলমান ঘরের মেয়েরা জেনে ও না জেনে বিধর্মীদের মতো বেপর্দা হয়ে পথে ঘাটে চলাফেরা করছে। তাইতো এরকম ঘটনা অহরহ ঘটছে।

ততক্ষণে তারা বড় রাস্তায় হুন্ডার কাছে চলে এল। বই খাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে দেখে শফি সেগুলো কুড়িয়ে রাহেলার হাতে দেয়ার সময় জিজ্ঞেস করল, ওদের আপনি চেনেন?

রাহেলা বলল, কালো কুচকুচে ছেলেটা এম.পি. বশির মোল্লার ছেলে। বাকি দু’জনকে চিনি না।

শফি আর কিছু না বলে চুপচাপ হাঁটতে লাগল।

ঘরের কাছে এসে রাহেলা বলল, আপনি বৈঠকখানায় একটু বসুন, আমি আসছি। তারপর ঘরে ঢুকে মায়ের সামনে পড়ে গেল।

মেয়ের অবস্থা দেখে আখতার বানু আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোর কী হয়েছে?

রাহেলা মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।

আখতার বানু মেয়েকে কখনও কোনো ব্যাপারেই কাঁদতে দেখেন নি। বড় শক্ত মেয়ে তার। সেই মেয়েকে কাঁদতে দেখে আরও বেশি আতঙ্কিত হয়ে বললেন, কাঁদছিস কেন কি হয়েছে বলবি তো?

রাহেলা কান্না থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, বাবা ঘরে নেই?

আখতার বানু বললেন, না, একটু আগে বেরিয়ে গেল। কী হয়েছে বলছিস না কেন?

সংক্ষেপে ঘটনাটা বলে রাহেলা বলল, চরদৌলতখানের যে ছেলেটাকে বাবা মোবারক লেঠেলের দ্বারা মেরে হাত পা ভেঙ্গে লুলা করে দিতে চেয়েছিল। সেই ছেলেটাই আমাকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করে নিয়ে এসেছে। তারপর ওড়না সরিয়ে পাঞ্জাবীটা দেখিয়ে বলল, এটা ঐ ছেলেটার। তারপর কান্না জড়িতস্বরে বলল, ঠিক সময় মতো যদি ছেলেটা এসে না পড়ত, তা হলে বদমাসগুলো আমার ইজ্জৎ লুটে নিয়ে এসিড দিয়ে আমার মুখ পুড়িয়ে দিত।

আখতার বানু খুব অবাক হয়ে ভয়ার্তস্বরে বললেন, কী সর্বনাশের কথা, ছেলেগুলোকে চিনিস?

মাকে ছেড়ে দিয়ে রাহেলা বলল, একজনকে চিনি। সে কালকিনির এম.পির ছেলে জুলহাস। তার বাবা নাকি আমাকে ছেলের বৌ করার জন্য ঘটককে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন?

আখতার বানু বললেন, হ্যাঁ, কয়েকদিন আগে তোর বাবার মুখে শুনেছি। সে তো না করে দিয়েছে।

রাহেলা বলল, কই, আমাকে তো তোমরা কিছু জানাওনি।

আখতার বানু বললেন, তোর বাবা হয়তো তোকে জানাবার দরকার মনে করেনি। অথবা না করে দিয়েছে বলেও হয়তো জানাইনি। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, সেই ছেলেটা চলে গেছে।

রাহেলা বলল, যাহ্, ওনার কথা ভুলেই গেছি। বৈঠকখানায় বসতে বলেছিলাম। তুমি ওনার নাস্তার ব্যবস্থা কর বলে নিজের রুমে গিয়ে জামা কাপড় পাল্টাল। তারপর শফির পাঞ্জাবী একটা খবরের কাগজে মুড়ে নিয়ে মায়ের কাছে এসে বলল, কাজের বুয়াকে দিয়ে নাস্তা পাঠিয়ে দাও। আমি। বৈঠখানায় যাচ্ছি।

রাহেলা বৈঠকখানায় এসে শফিকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে বলল, সরি, অনেক দেরি করে ফেললাম, সেজন্যে ক্ষমা চাইছি। তারপর কাগজে মোড়া পাঞ্জাবীটা ফেরত দিয়ে বলল, আর একটু বসুন নাস্তা খেয়ে যাবেন।

শফি দাঁড়িয়ে উঠে বলল, কিছু মনে করবেন না, আজ আর দেরি করতে পারব না। আবার যেদিন আসব সেদিন খাব। একটা অনুরোধ করছি, বোরখা পরে কলেজে যাবেন আর একা যাবেন না, সঙ্গে একজনকে নেবেন। তারপর আল্লাহ হাফেজ বলে সেখান থেকে চলে এল।

রাহেলা তার দিকে চেয়ে চিন্তা করল, ঐ একহারা ছেলেটার গায়ে এত শক্তি প্রত্যক্ষ না করলে বিশ্বাস করতাম না। শফি আড়াল হয়ে যাওয়ার পরও কতক্ষণ সেদিকে চেয়েছিল খেয়াল নেই। কাজের বুয়া নাস্তা নিয়ে এসে যখন বলল, আপা, মেহমান কই? তখন সম্বিত ফিরে পেয়ে বলল, মেহমান চলে গেছেন, এগুলো নিয়ে যাও।

চেয়ারম্যান রাতে ঘরে ফিরে স্ত্রীর কাছে মেয়ের দুর্ঘটনার কথা শুনে তাকে ডেকে পাঠালেন।

রাহেলা এসে মায়ের কাছে বসল।

চেয়ারম্যান জিজ্ঞেস করলেন, তোর মায়ের কাছে যা শুনলাম তা কি সত্য?

রাহেলা ফুঁপিয়ে উঠে দু’হাতে মুখ ঢেকে বলল, হ্যাঁ বাবা, সত্য। তুমি এম.পি সাহেবকে ঘটনা জানিয়ে বিচার চাইবে।

চেয়ারম্যান বললেন, আমি তো ভাবতেই পারছি না ঘটককে ফিরিয়ে দিয়েছি বলে এম.পি সাহেবের ছেলে এরকম জঘন্য কাজ করবে?

রাহেলা রাগের সঙ্গে বলল, এম.পি. সাহেব ঘটককে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে পাঠিয়েছিলেন, সেকথা আমাকে জানাওনি কেন?

জানাবার প্রয়োজন মনে করিনি। কারণ ওনার ছেলেকে কয়েকবার দেখেছি। কালো কুৎসিত এবং মুখের শ্রীও ভালো না। তাই তোকে না। জানিয়ে ঘটকের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছি।

তবু আমাকে জানানো উচিত ছিল। তুমি কিন্তু এম.পি. সাহেবকে ঘটনা জানিয়ে বিচার চাইতে ভুলবে না।

পুরো ঘটনাটা বলতে শুনি।

রাহেলা পুরো ঘটনা জানিয়ে ছলছল চোখে বলল, শফি যদি ঐ সময়ে এসে না পড়তেন, তা হলে তোমরা আমার লাশ সেখান থেকে নিয়ে আসতে। তারপর চোখ মুছে আবার বলল, আমার একটা কথা রাখতেই হবে। বল রাখবে?

রাখব, বল কী কথা।

ভবিষ্যতে আর কখনও শফির এতটুকু ক্ষতি করার চেষ্টা করবে না। মনে রাখবে, তিনি তোমাদের মেয়ের শুধু ইজ্জৎ রক্ষা করেন নি, পুনর্জন্মও দিয়েছেন। ভাইয়াকেও ফোন করে ঘটনা জানিয়ে বলে দিও, সেও যেন। শফির এতটুকু ক্ষতি করার চেষ্টা না করে। তারপর চোখ মুছতে মুছতে সেখান থেকে চলে গেল।

চেয়ারম্যান স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, মেয়ের কথা শুনে কিছু বুঝতে পারলে?

আখতার বানু বললেন, না বোঝার কী আছে? শফি মহসিনকে দু’বার অপমান করেছিল? তাই তোমরা তাকে মারধর করে পঙ্গু করে দিতে চেয়েছিলে। তবু শফি আজ আমাদের মেয়েকে সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রক্ষা করে ঘরে পৌঁছে দিয়ে গেছে। তাই রাহেলা তার ক্ষতি করতে নিষেধ করল।

চেয়ারম্যান মৃদু হেসে বললেন, একেই বলে মেয়ে মানুষের বুদ্ধি।

আখতার বানু মুখ ভার করে বললেন বুদ্ধি আবার বুঝতে কী দোষ করল?

চেয়ারম্যান বললেন, যা শুনলে তা মেয়ের মুখের কথা, অন্তরের কথা হল, রাহেলা শফিকে ভালবেসে ফেলেছে।

তোমার যেমন কথা বলে আখতার বানু রাগে গরগর করতে করতে সেখান থেকে চলে গেলেন।

রাত্রে ঘুমাবার সময় রাহেলা চোখের পাতা এক করতে পারল না। চোখ বন্ধ করলেই দূর্ঘটনার কথা মনে পড়তে লাগল। সেই সাথে উদ্ধারকর্তা শফি কীভাবে বদমাস তিনজনকে অজ্ঞান করে তাকে বাঁচাল। তার অনিন্দ্য সুন্দর মুখটা মনের পাতায় ভেসে উঠতে লাগল। হঠাৎ ডালিয়ার কথা মনে পড়তে ফোন করল।

.

ডালিয়া কয়েকদিন শফির কথা চিন্তা করে করে ঘুমাতে পারছে না। সেদিনের পর প্রায় প্রতি রাতে তাকে ফোন করে। রিং হয়ে হয়ে লাইন কেটে যায়, তবু শফি ফোন ধরে না। আজও রাত এগারটার পর থেকে কিছুক্ষণ পর পর ফোন করছিল; কিন্তু শফি ফোন না ধরায় মনে কষ্ট পেলেও তার উপর রাগ করতে পারছে না। কারণ তার প্রতিটা শ্বাস-প্রশ্বাসে শফির কথা মনে পড়ে। তাকে এক দন্ডের জন্যও ভুলতে পারছে না। রাত বারটার সময় হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠতে তার বুকটা আনন্দে ছলকে উঠল। ভাবল নিশ্চয় শফি ফোন করেছে। তাড়াতাড়ি ফোন রিসিভ করার সময় আনন্দের চুটে নাম্বার না দেখেই উফুল্ল কণ্ঠে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?

রাহেলা খুব অবাক হলেও সালামের উত্তর দিয়ে বলল, কীরে, মনে হচ্ছে খুব আপনজনের ফোনের অপেক্ষায় ছিলি?

রাহেলার গলা চিনতে পেরে ডালিয়া সামলে নিয়ে বলল, আমার কথা বাদ দে। এত রাতে ফোন করেছিস কেন বল?

তাতো বলবই, তার আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দে।

তুই ঠিকই ধরেছিস, একজনের ফোনের অপেক্ষায় ছিলাম। এবার তোরটা বল।

সেই একজনটা কে বলবি তো?

কী বলবে ভেবে ঠিক করতে না পেরে ডালিয়া বলল, সে কথা পরে শুনিস। এতরাতে ফোন করার কারণটা বলে ফেল। আমার তো মনে হচ্ছে। এ সময়ে ফোন করার বিশেষ কোনো কারণ ঘটেছে?

রাহেলা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, তুইও ঠিক ধরেছিস।

ডালিয়া ব্যাগ্র কণ্ঠে বলল, তা হলে তাড়াতাড়ি কারণটা বলে ফেল।

বাবা লেঠেল সর্দার মোবারক চাচাকে দিয়ে শফির হাত পা ভেঙ্গে লুলা করে দিতে চেয়েছিল; কিন্তু….

কথাটা শুনে ডালিয়ার বুকটা ধড়াস করে উঠল। তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে বলল, মোবারক লেঠেল কি তাই করেছে?

আরে না, বরং উল্টো শফি মোবারক চাচার একটা হাত ভেঙ্গে একটা পাও ভেঙ্গে দিতে যাচ্ছিল। মোবারক চাচা স্যারেন্ডার করাতে তাকে ছেড়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, পুরস্কারের দশ হাজার টাকা দিয়ে হাতের চিকিৎসা। করাতে ও লেঠেলগীরি ছেড়ে দিয়ে সম্ভাবে জীবন যাপন করতে বলেছে।

এতক্ষণে ডালিয়ার ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে এল। বলল, পুরস্কারের ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম না।

রাহেলা চরদৌলতখানের মাতব্বরের লাঠিখেলার প্রতিযোগীতা করার কথা বলে বলল, আমি প্রতিযোগীতা দেখতে যাইনি। বাবা ও ভাইয়া গিয়েছিল। বাবা ফিরে এসে বলল, শফি মানুষ না জ্বিন অথবা ফেরেশতা।

পুরো ঘটনা শুনে ডালিয়ারও শফিকে তাই মনে হল। এখন বুঝতে পারল যখন ফোনে মোবারক লেঠেলের কথা বলে শফিকে সাবধানে থাকতে বলেছিলাম তখন কেন সে হেসে উঠেছিল। জিজ্ঞেস করল, এটা কতদিন আগের ঘটনা?

প্রায় পঁচিশ দিন আগের হবে।

এতদিন না জানিয়ে আজ জানালি কেন?

মনে করেছিলাম ভাইয়া তোকে বলেছে।

মহসিন ভাই তো আমাদের এখানে আর থাকে না।

রাহেলা অবাক হয়ে বলল, কই, সেকথা তো জানি না।

তারপর জিজ্ঞেস করল, কোথায় থাকে তা হলে?

তার এক বন্ধুর বাসায় পেয়িং গেষ্ট হিসাবে থাকে।

কবে থেকে বলতো?

এবারে ঢাকায় ফিরে এসে মাত্র দু’তিন দিন আমাদের বাসায় ছিল। তারপর চলে গেছে।

ফুপা ফুপু বাধা দেন নি?

তা আবার দেয়নি। তাদের কথা শুনেনি।

চলে যাওয়ার পিছনে নিশ্চয় কোনো কারণ আছে?

তা আছে।

কারণটা বলতে শুনি।

কারণটা আমি। তোর কারণে ভাইয়া অন্য জায়গায় চলে গেল, ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না, খুলে বল।

ডালিয়া বলল, একজনকে অসিলা করে আল্লাহ আমাকে হেদায়েত দিয়েছেন। আগের মতো এখন আর হুন্ডায় চড়ে কোথাও যাই না। বোরখাপরে সব জায়গায় যাতায়ত করি। ভার্সিটিতেও বোরখা পরে যাই। মহসিন ভাই বাড়ি থেকে এসে সব কথা শুনে খুব রেগে গিয়ে আমাকে এসব পাগলামী ছাড়তে বলল। তার কাছে ইসলামের বিধি বিধান মেনে চলা নাকী পাগলামী। যাই হোক, আমি ঐ সব ছাড়তে রাজি না হতে খুব তর্ক বিতর্ক করে শেষে আমার উপর রাগ করে দু’তিন দিন পর বন্ধুর বাসায় চলে গেছে।

তুই যেতে দিলি কেন? আফটার অল কয়েকমাস পরে তোদের যখন বিয়ে হচ্ছে।

কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা আমি পছন্দ করি না। তা ছাড়া সে তো ছোট না, যে তাকে জোর করে ধরে রাখব।

ফুপাফুপি ভাইয়ার চলে যাওয়ার কারণ জানেন?

জানে।

ওনারা তোকে কিছু বলেন নি?

তা আবার বলেন নি। বাবা অল্প রাগারাগি করলেও মা ভীষণ রাগারাগি করেছে।

তা তোর ঘাড়ে এরকম ভূত চাপলো কেন?

ভূত চাপেনি। বললাম না, একজনকে অসিলা করে আল্লাহ আমাকে হেদায়েত দিয়েছেন?

তোর পাগলামী দেখে ফুপাফুপি কিছু বলেননি?

বাবা কিছু বলেনি। রাগারাগী করে বলল, এসব বুড়ো বয়সের ব্যাপার এখন কার কথায় এরকম পাগলামী করছিস? তা ছাড়া মহসিন যখন এসব পছন্দ করে না তখন এসব করা ঠিক নয়। হাজার হোক কিছুদিনের মধ্যে তার সঙ্গে তোর বিয়ে হবে। তার কথা তোর মেনে চলাই উচিত। বললাম…

তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে রাহেলা বলে উঠল, ফুফু তো ঠিক কথা বলেছেন।

ডালিয়া বলল, যারা কুরআন হাসিদের ব্যাখ্যা পড়েনি তাদের কাছে ঠিক। কারণ শুধু স্বামী কেন, মা বাবাও যদি ইসলামের পরিপন্থি কোনো কাজ করতে বলে, তবু মানা চলবে না। আল্লাহ ও তাঁর রসুল (দ.) তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করতে বলেছেন। তুই তো কুরআন হাদিস পড়িসনি, এসব কথা জানবি কী করে? জেনে রাখ, জান গেলেও এপথ থেকে কেউ আমাকে ফেরাতে পারবে না।

রাহেলা বলল, এ পথ থেকে না ফিরলে ভাইয়া যদি তোকে বিয়ে করতে চায় না, তবু ফিরবি না?

ডালিয়া দৃঢ়স্বরে বলল, না, ফিরব না। এবার আমার কথা শোন, তোর ভাইয়া যদি আমি যে পথে চলেছি সেই পথে না চলে, তা হলে আমিও তাকে বিয়ে করব না। কারণ ধার্মিক ছেলে মেয়ের সঙ্গে ধর্ম বিমুখ ছেলে মেয়ের বিয়ে হওয়া যেমন একদম উচিত নয়, তেমনি তাদের দাম্পত্য জীবনও মোটেই সুখের হয় না। বরং দোযখের মতো অশান্তির আগুনে তারা সারাজীবন পুড়তে থাকে।

রাহেলা বলল, তুই যে বললি, একজনকে অসিলা করে আল্লাহ তোকে হেদায়েত দিয়েছেন, তা সেই একজনটা কে?

এখন বলতে পারব না।

কখন বলতে পারবি?

আল্লাহ যখন বলাবেন তখন বলব। তারপর ডালিয়া বলল, আমার কথা রেখে এবার তোর কথা বল। এতরাতে শুধু মোবারক লেঠেলের হাত ভাঙ্গার ঘটনা বলার জন্য নিশ্চয় ফোন করিসনি?

ভাইয়া ডালিয়াদের বাসা থেকে চলে গেছে শুনে রাহেলার খারাপ লাগছিল।

এখন তার কথা শুনে মন ভালো হয়ে গেল। বলল, তুই ঠিক বলেছিস। আজ একটা দুর্ঘটনার মাধ্যমে আমার মনে যে বিপ্লবের সৃষ্টি হয়েছে তা তুই কল্পনাও করতে পারবি না।

তাই না কী? তা হলে তো দুর্ঘটনা ও বিপ্লবের কাহিনী শুনতেই হয়।

বলছি শোন, বলে রাহেলা এম.পি. সাহেবের ছেলে জুলহাসের সঙ্গে প্রথম দিনের সাক্ষাৎ থেকে আজ কলেজ থেকে ফেরার পথে যা কিছু ঘটেছে সব বলে ভিজে গলায় বলল, ঐ সময়ে শফি এসে যদি উদ্ধার না করতেন, তা হলে আত্মহত্যা করা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় থাকত না। কথা শেষ করে রাহেলা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

মোবারক লেঠেলের পরিণতির কথা শুনে শফির প্রতি ডালিয়ার শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গিয়েছিল। এখন আবার শফি তিনজন সন্ত্রাসীর সঙ্গে লড়াই করে রাহেলার ইজ্জৎ বাঁচিয়েছে শুনে সেই শ্রদ্ধা হাজারগুণ বেড়ে গেল। সেই সাথে তার প্রতি ভালবাসাও লক্ষগুণ বেড়ে গেল। বলল, তুই কাঁদছিস কেন? আল্লাহ শফির দ্বারা তোকে সাহায্য করেছেন। সেজন্যে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানা।

রাহেলা কান্না থামিয়ে বলল, তাতো জানিয়েছি। তারপর আবার বলল, শুনে তুই কী মনে করবি জানি না; ঐ ঘটনার পর থেকে শফি নাম আমার হৃদয়ের স্পন্দনের সঙ্গে স্পন্দিত হচ্ছে। সন্ত্রাসীরা আমাকে সম্পূর্ণ না হলেও প্রায় বিবস্ত্র করে ফেলেছিল। শফি তাদেরকে অজ্ঞান করে নিজের গায়ের পাঞ্জাবী খুলে আমায় পরতে দিয়েছিল। সে সময় সে আমার শরীরের উপরের অনেক গোপন অংশ দেখেছে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাকেই বিয়ে করব। তাকে পাওয়ার জন্য আমিও তোর মতো জীবনের গতি পাল্টে ফেলব ভেবেছি। শুনেছি শফি খুব ধার্মিক। তাই আমিও ধার্মিক হবার চেষ্টা করব।

তার কথা শুনে ডালিয়ার হার্টবিট বন্ধ হবার উপক্রম হল। কিছু না বলে অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে নিজেকে সামলানর চেষ্টা করতে লাগল।

রাহেলা বলল, কীরে, চুপ করে আছিস কেন? আমার সিদ্ধান্ত ঠিক না বেঠিক বলবি তো?

ডালিয়া ততক্ষণে সামলে নিয়েছে। বলল, জেনেছি আল্লাহ যার সঙ্গে যার জোড়া করে পয়দা করেছেন তার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। শোন, ঘড়ির। দিকে চেয়ে দেখ কটা বেজেছে। আমার মাথা ধরেছে। এখন রাখছি বলে লাইন কেটে দিল।

তারপর ডালিয়া আর ঘুমাতে পারল না। চিন্তা করতে লাগল,রাহেলা প্রেম নিবেদন করলে শফি কী করবে? আবার রাহেলা যখন জানবে তার আগেই আমরা প্রেমে পড়েছি তখন সে কী করবে? এইসব চিন্তা করতে করতে ফজরের আজান হয়ে গেল। বাথরুমের কাজ সেরে অজু করে এসে নামায পড়ে কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে গুনাহখাতা মাফ চেয়ে শফিকে স্বামী হিসাবে পাওয়ার জন্য দোয়া করল। তারপর কিছুক্ষণ কুরআনের ব্যাখ্যা ও কিছুক্ষণ হাদিস পড়তে পড়তে ঘুম পেতে ঘুমাতে গেল। কিন্তু চোখে ঘুম এল না। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে পড়ে থেকে চিন্তা করতে লাগল, শফি এতদিন ফোন করেনি কেন? তাকে ফোন করলেও ধরেনি কেন? এখন ফোন করে দেখা যাক কী হয় ভেবে ফোন করল।

শফি মসজিদ থেকে ফজরের নামায পড়ে এসে প্রতিদিনের মতো আজও কুরআন তেলাওয়াত করছিল। মোবাইল বেজে উঠতে কুরআন বন্ধ করল। তারপর নাম্বার দেখে বুঝতে পারল, ডালিয়া ফোন করেছে। এর আগে যতবার করেছে ততবার শফি ইচ্ছা করে ধরেনি। কারণ শহরের বড় লোকের শিক্ষিত ছেলে মেয়েদের ব্যাপারে অনেক কিছু শুনেছে। তারা অনেকের সঙ্গে প্রেম করে। এখন মোবাইল চালু হওয়ার পরে তাদের প্রেমিক প্রেমিকার সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। অবশ্য ডালিয়া সেরকম মেয়ে নয় বুঝতে পারলেও মহসিনের সঙ্গে তার বিয়ের কথা এক রকম পাকা হয়েই আছে সেকথা সে জানে। তাই তার প্রেমের গভীরতা ও সত্য মিখ্যা যাচাই করার জন্য ফোন রিসিভ করেনি। আজ রিসিভ করে সালাম দিল।

শফিকে ফোন রিসিভ করে সালাম দিতে শুনে আনন্দে ডালিয়ার হার্টবিট বেড়ে গেল। এতদিন ফোন রিসিভ না করার ফলে তার প্রতি ডালিয়ার যত রাগ অভিমান ছিল, সেসব গলে পানি হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সামলে নিয়ে সালামের উত্তর দিয়ে তবু ফুঁপিয়ে উঠল।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে শফি বলল, কান্না মানুষের মনের ময়লা দূর করে দেয়।

ডালিয়া কান্নাভেজা কন্ঠে বলল, আমাকে কষ্ট দিয়ে খুব আনন্দ পান তাই না?

তাই বুঝি আপনার মনে হয়?

এতদিন অসংখ্যবার ফোন করেছি, রিং হয়ে হয়ে কেটে গেছে, এটাই কী তার প্রমাণ নয়?

যা বলব বিশ্বাস করবেন?

এ জগতে কাউকে যদি বিশ্বাস করি, তিনি হলেন আপনি।

আপনি ফোন করলে মোবাইলে যতক্ষণ রিং হতে থাকে ততক্ষণ আমার হৃদয় আনন্দে তড়পাতে থাকে। তখন নিজের সত্ত্বা হারিয়ে ফেলি। তাই ফোন রিসিভ করার কথা মনেই থাকে না।

শফির কথা শুনে ডালিয়ার হৃদয়ে আনন্দের তুফান দেড়শ দুশ মাইল বেগে বইতে শুরু করল। কোনো রকমে সুবহান আল্লাহ বলে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।

চুপ করে আছেন কেন? কথাটা বিশ্বাস হচ্ছে না?

ডালিয়া অনেক কষ্টে তুফানের বেগ সামলে নিয়ে বলল, এক্ষুনি কী বললাম মনে নেই বুঝি? আবার বলছি “এ জগতে কাউকে যদি বিশ্বাস করি, তিনি হলেন আপনি।” তারপর আবার বলল, আপনার কথা শুনে হৃদয়ে আনন্দের যে তুফান উঠেছিল, তা সামলাবার জন্য কথা বলতে পারিনি।

তোমার ভালো নাম কী? শাকেরা সাবিহা।

বাহ- খুব সুন্দর নাম। নামের অর্থ জান?

আগে জানতাম না, কয়েকদিন আগে একটা নামের বই কিনে এনে জেনেছি।

শফি বলল, আমি কিন্তু তোমাকে তুমি করে বলছি। কারণ এখন আর আপনি করে বলা ঠিক নয়। তুমিও তাই বলবে।

না বাবা না, আমি পারব না।

কেন পারবে না।

আপনি সব বিষয়ে আমার থেকে অনেক বড়। তা ছাড়া আপনি কত মহৎ। মহৎ ব্যক্তিকে ছোটর তুমি করে বলা কি উচিত?

না, উচিত নয়, তোমার আমার সম্পর্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে সেখানে আপনি করে বলা মানে প্রেমকে অপমান করা। এবার তুমি করে বলবে নিশ্চয়? তবু যখন ডালিয়া চুপ করে রইল তখন বলল, তুমি করে না বললে লাইন কেটে দেব। পরে রিং করলেও রিসিভ করব না।

তোমার দীল খুব শক্ত তাইতো শুধু আমাকে কাঁদাও।

তুমি করে বলছ যখন তখন আর কাদাব না।

প্ৰমিশ?

প্রমিশ। এবার খুশিতে কৃতজ্ঞতা স্বীকার কারিনী বালিকা?

আমি বুঝি এখনও বালিকা?

তাতো বলিনি, তোমার নামের অর্থ বলেছি।

তোমার নামের অর্থ কি?

শফি অর্থ অনুস্বরণকারি।

নামের আগে পরে কিছু নেই?

পুরো নাম মুহাম্মদ শফি। মুহাম্মদের অর্থ হল প্রশংসিত।

তোমার নামটা আমার নামের থেকে ভালো। একটা কথা বলতে খুব ইচ্ছা করছে।

ইচ্ছা যখন করছে তখন দেরি না করে বলেই ফেল।

তুমি মাইন্ড করবে না বল?

না, করব না।

তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছা করছে।

এই ইচ্ছাও পূরণ হবে।

কী করে?

সেটা তোমার ব্যাপার। কী করে করবে সে উপায় তুমি বের কর।

যদি তোমাকে আসতে বলি?

বলেই দেখ না।

সত্যি বলছ?

কিছুক্ষণ আগে তুমিই তো বললে, নিজের থেকে বেশি আমাকে বিশ্বাস কর। এখন আবার সত্য মিথ্যার প্রশ্ন আসছে কেন?

হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। মাফ করে দাও।

আমারও মুখ দিয়ে হঠাৎ যদি কখন কিছু বেরিয়ে যায়, তা হলে মাফ করে দেবে তো?

অফকোর্স।

তা হলে আমিও এখন তোমাকে মাফ করে দিলাম।

কবে আসছ?

তুমি বললে এক্ষুনি রওয়ানা দেব।

ডালিয়া মুখ থেকে আবার সত্য বলছ তো কথাটা বেরিয়ে যাচ্ছিল। সামলে নিয়ে বলল, এক্ষুনি রওয়ানা দিলে নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে করব।

আমার বুঝি তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করে না?

সেকথা আমার চেয়ে তুমি ভালো জান।

জমিলা খাতুনও ফজরের নামাজ পড়ে কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন। তেলাওয়াত শেষ করে ইসরাকের নামায পড়ে বেরিয়ে এসে শফিকে ফোনে কথা বলতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কার সঙ্গে কথা বলছিস?

দাদিকে রুম থেকে বেরোতে দেখেই শফি ডালিয়াকে বলল, আল্লাহ রাজি থাকলে এক্ষুনি রওয়ানা দেব। তাই লাইন কেটে দিচ্ছি বলে মোবাইল অফ করে দিল। তারপর দাদিকে বলল, ঢাকা থেকে ফোন এসেছিল, আমাকে এক্ষুনি রওয়ানা দিতে হবে। আপনি নাস্তা রেডি করুন, আমি গোসল করে আসি। জমিলা খাতুন জানেন, শফি নিজের থেকে কিছু না বললে কোনো কথার উত্তর দেয় না। তাই কে এবং কেন ফোন করেছিল জিজ্ঞেস না করে নাস্তার জোগাড়ে গেলেন।

১০. চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন একদিন

চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন একদিন মেয়ের উপর হামলাকারী তিনজনের খোঁজ নিতে শামসের নামে একজন চামচাকে কালকিনি পাঠালেন।

শামসের ফিরে এসে জানাল, এমপি সাহেবের ছেলে জুলহাসের কোমর ভেঙ্গে গেছে। সে কুঁজো হয়ে চলাফেরা করে।

যে তলপেটে আঘাত পেয়েছিল, তার একটা কিডনী নষ্ট হয়ে গেছে। আর যে ঘাড়ে আঘাত পেয়েছিল, তার ঘাড় বসে গেছে। জীবনে কোনোদিন আর ঘাড় ঘোরাতে পারবে না।

চেয়ারম্যান তিনজনের পরিণতির কথা মেয়েকে জানিয়ে বললেন, বিচার আল্লাহই করে দিয়েছেন। আর কিছু করার দরকার নেই। করতে গেলে এমপি সাহেব শফির কথা জানতে পারবেন। তখন আবার শফিকে নিয়ে টানাটানি পড়বে। ক্ষমতার জোরে আইনের প্যাঁচে ফেলে তাকে জেলে পাঠাতে পারেন অথবা তার অন্য কোনো ক্ষতি করতে পারেন। তুই তো আবার শফির কোনো ক্ষতি হোক চাস না।

রাহেলা বলল, আল্লাহ যখন বিচার করে দিয়েছেন তখন আর কিছু করার দরকার নেই। আচ্ছা বাবা, এমপি সাহেব যদি তোমাকে ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করেন, কে আপনার মেয়েকে তিনজন সন্ত্রাসীর হাত থেকে উদ্ধার করেছে? তখন কী বলবে?

ওসব নিয়ে তুই চিন্তা করিস না। বলব, আমি তাকে দেখিনি।

কিন্তু যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ছেলেটাকে চিনি কিনা?

বলবি, ছেলেটাকে ঔদিনের আগে কখনও দেখিনি, আর পরেও দেখিনি।

কী জানো বাবা, আমার যেন কেমন ভয় ভয় করছে। তুমি বোরখা কিনে দেবে। বোরখা পরে কলেজে যাব। আর একা যাব না। সঙ্গে একজন লোক দেবে।

চেয়ারম্যান বললেন, ঠিক আছে, তাই হবে। আর শোন, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যাদেরকে ভয় পাওয়ার কথা তারা তো একরকম পঙ্গু হয়ে গেছে। তা ছাড়া আমার সাহায্যে বসির মোল্লা ভোটে জিতে এমপি হয়েছেন। ইলেকসানের সময় নানাভাবে সাহায্য করেছি। যখন জানবেন, তার ছেলে বন্ধুদের নিয়ে আমার মেয়ের ইজ্জৎ নষ্ট করতে চেয়েছিল তখন এটা নিয়ে ঘাটাঘাটি করবেন বলে মনে হয় না। শুনেছি, ওদের প্রত্যেকের। বুক পকেটে একটা করে চিরকুট পাওয়া গেছে। সেগুলোতে লেখা ছিল, কি জন্যে তাদেরকে এরকম শাস্তি দেয়া হল।

বাবার কথা শুনে রাহেলা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, একেই বলে আল্লাহর বিচার। তুমি কিন্তু বোরখা কিনে না আনা পর্যন্ত আমি কলেজে যাব না।

এতদিন শফির ভালোমন্দ চিন্তা করে রাহেলা তার ফোন নাম্বার জানা সত্ত্বেও ফোন করেনি। আজ বাবার কথা শুনে নিশ্চিন্ত হয়ে রাত সাড়ে ন’টার সময় ফোন করল।

শফি সবেমাত্র খেয়ে নিজের রুমে এসেছে। মোবাইল বেজে উঠতে অচেনা নাম্বার দেখে ভাবল, কেউ দুষ্টুমী করে মিস কল দিয়েছে, নচেৎ রং নাম্বারে ফোন করেছে। তাই লাইন কেটে দিল। একটু পরে আবার মোবাইল বেজে উঠতে একই নাম্বার দেখে নিশ্চিত হল কেউ দুষ্টুমী করছে। তাই এবারও লাইন কেটে দিয়ে সুইচ অফ করে দিল। বলাবাহুল্য সে রাহেলার মোবাইল নাম্বার জানে না।

রাহেলা আবার ফোন করে বুঝতে পারল, শফি মোবাইলের সুইচ অফ করে দিয়েছে। তবু কিছুক্ষণ পরপর ফোন দিতে লাগল।

আজ শফিকে ফোন করার পালা ডালিয়ার। তাই সাড়ে দশটা বেজেছে দেখে শফি মোবাইলের সুইচ অন করে বালিশে মাথা রাখল। ডালিয়াও সে সময়ে প্রতিদিন শুয়ে শুয়ে ফোনে আলাপ করে। আজ বালিশে মাথা রাখার সাথে সাথে মোবাইল বেজে উঠতে নাম্বার দেখে বুঝতে পারল, সাড়ে নটার সময় যে ফোন করেছিল তারই নাম্বার। ফোন রিসিভ করে সালাম দিয়ে বলল, আপনি প্রায় একঘণ্টা আগে থেকে ফোন করছেন কেন? কে আপনি?

রাহেলা সালামের উত্তর দিয়ে বলল, কেমন আছেন? চিনতে পারছেন?

শফির স্মরণশক্তি খুব প্রখর। একবার কাউকে দেখলে অথবা কারও সঙ্গে আলাপ করলে বহুদিন পর্যন্ত মনে থাকে। তাই চিনতে পেরে বলল, হ্যাঁ চিনতে পেরেছি। আপনি চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন সাহেবের মেয়ে রাহেলা। কিছু মনে নেবেন না, আপনার মোবাইল নাম্বার জানা ছিল না। তাই দুষ্টুমি করে কেউ মিসকল দিচ্ছে ভেবে প্রথমে রিসিভ করিনি। পরে বার বার রিং হতে সুইচ অফ করে দিয়েছি।

রাহেলা বলল, না, কিছু মনে করিনি।

তা ফোন করেছেন কেন? এনি প্রবলেম? সে

কথা পরে, আগে বলুন কেমন আছেন?

আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?

আমিও ভালো আছি। তবে- বলে চিন্তা করতে লাগল, কিভাবে মনের কথা বলবে।

ডালিয়া নিশ্চয় বারবার ফোন করছে, এঞ্জেজ জেনে কী মনে করছে ভেবে শফি অস্থিরতা অনুভব করল। তাই রাহেলাকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল, কেন ফোন করেছেন বলবেন তো?

রাহেলা কিছু বলতে না পেরে ফুঁপিয়ে উঠল।

শফি বলল, কাঁদছেন কেন? ওরা কি আবার পিছনে লেগেছে?

রাহেলা সামলে নিয়ে বলল, ওরা আমার পিছনে আবার লাগবে কী, আপনার হাতে ধোলাই খেয়ে সবাই পঙ্গু হয়ে গেছে।

তা হলে কাঁদছিলেন কেন?

বললে বিশ্বাস করবেন?

শফির মন তাকে সাবধান করে দিল। রাহেলার কথার টোনে বুঝতে পারল, সে তাকে ভালোবেসে ফেলেছে। বলল, বিশ্বাস করার মতো হলে সবাই বিশ্বাস করবে।

আমি তো সবার কথা বলিনি, বলেছি আপনার কথা।

দেখুন, এমন কথা বলবেন না যা আমার পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন হবে।

কঠিন না সহজ জানি না, যা সত্য তাই বলছি, আমি আপনাকে হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে ভালোবেসে ফেলেছি। বলুন আমাকে ফেরাবেন না?

কথাটা শুনে শফির ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। বলল, কৌতুকেরও একটা সীমা আছে।

রাহেলা ভিজে গলায় বলল, মোটেই কৌতুক করছি না। বিশ্বাস করুণ আর নাই করুণ সত্যি কথাই বলছি।

এ রকম পাগলামী মথায় এল কেন? আপনার বাবা ও ভাইয়া আমাকে কি নজরে দেখেন তা জানেন; কিন্তু ওনারা যে আমাকে দুনিয়া থেকে গায়েব করে দিতে চান তা জানেন না। আর আপনিও তাদের দলে ছিলেন। কিছুদিন আগে নরপশুদের হাত থেকে আপনার ইজ্জত বাঁচিয়েছি বলে হয়তো আপনার মনের পরিবর্তন হয়েছে। তাই বলে এখন যা বললেন, তা যে কোনোভাবেই সম্ভব নয়, তা আপনি একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন।

আমার মনের পরিবর্তনের কথা যা বললেন তা ঠিক। আর এটাও ঠিক, তারা আমাকে টুকরো টুকরো করে কেটে মাটিতে পুঁতে ফেলবে তবু আমার ভালোবাসাকে মেনে নেবে না।

তাই যদি জানেন, তা হলে মাথায় ঢোকা ভালোবাসার ভূতকে হত্যা করে ফেলুন।

আপনি বোধ হয় জানেন না, যার মাথায় একবার ভালোবাসার ভূত। ঢুকে, তাকে হত্যা করাতো দূরের কথা, মাথা থেকে তাড়াতেও পারে না।

শফি বলল, মানুষের জীবনে হবে না, পারবে না বলে এমন কিছু নেই। চেষ্টা করলে মানুষ কি না করতে পারে। চেষ্টার দ্বারা মানুষ পানিতে, আকাশে ভ্রমণ করছে। এমনকি বিভিন্ন গ্রহ উপগ্রহে যাচ্ছে। আর এতো সামান্য…

তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে রাহেলা বলে উঠল, নীতিকথা শোনার জন্য আপনাকে ফোন করিনি, করেছি ভালোবাসার অর্ঘ আপনার পায়ে দিতে, গ্রহণ করবেন কি না বলুন।

শফি বলল, নীতিবাক্য নাই শুনলেন, এবার যা বলছি মন দিয়ে শুনুন-আমার হৃদয় শূন্য আছে, না কেউ সেই আসনে ঢুকে পড়েছে, তা না জেনে ভালোবাসার অর্থ দেয়া আপনার উচিত হয়নি। আপনাকে অপমান করার জন্য কথাটা বলছি না অথবা মিথ্যে করেও বলছি না। আমি একটা মেয়েকে ভীষণ ভালোবাসি। আর সেও আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। আমাদের বিয়ের কথাও একরকম পাকা হয়ে গেছে। এখন আপনিই বলুন, আমার কী করা উচিত। আমাকে ভালোবেসেছেন জেনে নিজেকে ধন্য মনে হচ্ছে; কিন্তু সেই ভালোবাসা গ্রহণ করতে পারছি না বলে খুব দুঃখ লাগছে। আমার মনে হয় ভালোবাসা যখন অন্তরের ব্যাপার এবং সেই ভালোবাসার সফলতার পথও বন্ধ তখন তা প্রকাশ না করে অন্তরেই চেপে রেখে বাস্তবকে মেনে নেয়াই উচিত। আমাকে যদি আপনি সত্যিই ভালোবেসে থাকেন, তা হলে যা বলব, মেনে নেবেন বলুন।

রাহেলা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, বলুন।

আমাদের মিলনের পথ যখন বন্ধ তখন আমরা ভাইবোন সম্পর্ক করে আজীবন ভালোবাসাকে ধরে রাখতে পারি। এটা ছাড়া অন্য কোনো পথ দেখতে পাচ্ছি না।

তার কথা শুনে এবারে আরও বেশিক্ষণ চুপ করে থেকে রাহেলা একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল অন্য কোনো পথ যখন ভোলা নেই তখন আপনার কথা মেনে নিলাম।

শফি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বুলল, আপনার কাছ থেকে এটাই আশা করেছিলাম। একটা কথা বলব বলব করেও বলা হয় না। আজ অনেক রাত হয়েছে। পরে এক সময় বলব। কথা শেষ করে সালাম দিয়ে লাইন কেটে দিল। রাহেলা সালামের উত্তর দিয়ে মোবাইল অফ করে চিন্তা করল, কে সেই ভাগ্যবতী, যে নাকী শফির মন জয় করেছে। পরে শফিকে ফোন করে জানতে হবে।

১১. শিকরমন্ডল গ্রামের নূর-উদ্দিন খন্দকার

শিকরমন্ডল গ্রামের নূর-উদ্দিন খন্দকার খুব নামিদামি লোক ছিলেন। ওনার এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে বড়। নাম সালাউদ্দিন। আর মেয়ে ছোট নাম শামিমা বেগম। দুই ভাই-বোনের বয়স যখন পনের ও বিশ বছর তখন নূর-উদ্দিন মারা যান। বিশ বছরের সালাউদ্দিনের উপর সংসারের দায়িত্ব পড়ল। ঢাকা ভার্সিটি থেকে উচ্চ ডিগ্রি নেয়ার ইচ্ছা থাকলেও বাবা মারা যাওয়ায় আইএ পাস করে আর পড়াশোনা করেননি। বাবা অনেক জমি-জায়গা রেখে মারা গেছেন। সেইসব দেখাশোনা করতে লাগলেন। আর একমাত্র বোন শামীমাকে গ্রামের কলেজ থেকে আইএ পাস করিয়ে ঢাকায় হোস্টেলে রেখে ভার্সিটিতে লেখাপড়া করান। মাস্টার্স করার সময় শামীমা বেগম তানভীর নামে ঢাকার মধ্যবিত্ত ঘরের একটা ছেলেকে ভালোবেসে গোপনে বিয়ে করেন। ফাঁইন্যাল পরীক্ষার পর ফোন করে প্রথমে ভাবিকে কথাটা জানান। ভাবি আখতার বানু স্বামী ও শাশুড়িকে কথাটা জানান।

কথাটা শুনে সালাউদ্দিনের মা ফজিলা বেগম খুব রেগে গিয়ে ছেলেকে বললেন, আমি কত করে বললাম, শামীমাকে আর বেশি পড়াবার দরকার নেই। এবার ওর বিয়ে দে। তা না করে বোনকে ঢাকার হোস্টেলে রেখে পড়াতে লাগলি। বোন মান ইজ্জত খুইয়ে কাকে বলতে কাকে বিয়ে করে ফেলল। তখন যদি আমার কথা শুনতিস, তা হলে এমন অঘটন ঘটত না।

শামীমাকে সালাউদ্দিন ভীষণ ভালোবাসতেন। তাই সে আইএ পাস করার পর যখন বলল, ঢাকা ভার্সিটিতে পড়বে তখন না করতে পারেননি। সেই বোন গোপনে বিয়ে করেছে শুনে যেমন খুব রেগে গেলেন, তেমনি বোনের উপর মনে কষ্টও পেলেন। রাগারাগি করাতে বললেন, তোমার কথা না শুনে ভুল করেছি। তুমি আমাকে মাফ করে দাও মা।

ফজিলা বেগম বললেন, ছেলেমেয়েরা অন্যায় করলে মায়েরা মাফ করবেই। এখন গিয়ে বোনের খোঁজ খবর নিয়ে দেখ, কোনো অজাত বেজাত ঘরের ছেলেকে বিয়ে করেছে কি না?

সালাউদ্দিন ঢাকায় এসে খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারলেন, ছেলেটা অজাত বেজাত ঘরের নয়। তবে ছেলের মা বাবা নেই। এক মামা তাকে মানুষ করেছেন এবং তিনি তাকে লেখাপড়া করিয়েছেন।

সালাউদ্দিন বোনের সাথে রাগারাগি করলেন না। তাদের বিয়ে মেনে নিলেন। তারপর অনেক টাকা পয়সা দিয়ে ছোটবোনের স্বামী তানভীরকে ব্যবসা করে দেন।

তানভীর মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে হলেও খুব ভদ্র, বুদ্ধিমান ও সৎ চরিত্রের অধিকারী। তাই কয়েক বছরের মধ্যে ব্যবসায় উন্নতি করে বাড়ি গাড়ি করেছেন। ওনাদের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে বড়, নাম তওফিক। সে লেখাপড়া শেষ করে বাবার সঙ্গে ব্যবসা করছে। তওফিকের পাঁচ বছরের ছোট ডালিয়া। সে ভার্সিটিতে বাংলায় অনার্স পড়ছে। এটা তার সেকেণ্ড ইয়ার। সবার ছোট আতিক। তানভীর সাহেব স্ত্রীর অমতে আতিককে প্রথমে হাফেজিয়া মাদরাসা থেকে হাফেজ করান। তারপর চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসায় পড়াচ্ছেন। সেখানে সে মাদরাসার হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করছে।

তানভীর সাহেব মোটামুটি ধর্মের নিয়ম-কানুন মেনে চললেও ওনার স্ত্রী শামীমা বেগম মোটেই মেনে চলেন না। তিনি পর্দা প্রথাকে ঘৃণা করেন। তাই একমাত্র মেয়ে ডালিয়াকে নিজের মতো করে মানুষ করার চেষ্টা করেছেন। তানভীর সাহেব শ্বশুরবাড়ির টাকায় ব্যবসা করে ধনী হয়েছেন। তাই ধর্মের নিয়ম-কানুন মেনে চলার কথা স্ত্রীকে বললেও তেমন জোরালোভাবে বলতে পারেন না। তা ছাড়া তিনি শান্তিপ্রিয় লোক। তাই কোনো ব্যাপারেই স্ত্রীর সঙ্গে রাগারাগি করেন না। তবে মেয়ে ডালিয়াকে স্ত্রীর অগোচরে কুরআন হাদিসের কথা বলেন।

আতিক ছেলেবেলা থেকে নিয়মিত নামায রোযা করত। তাই তানভীর সাহেব তাকে মাদরাসায় পড়াচ্ছেন। এ ব্যাপারে শামীমা বেগম স্বামীর সঙ্গে বেশ রাগারাগি করেছেন। বলেছেন, নিজে মোল্লাহ, তাই আতিককেও মোল্লা করতে চাও।

বড় ছেলে তওফিক বাবার মতো হয়েছে। সে যাতে ধর্মের দিকে বেশি ঝুঁকে না পড়ে সেজন্য শামীমা বেগম নিজে পছন্দ করে বড়লোকের ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ে নাজিয়াকে বড় বৌ করে এনেছেন।

নাজিয়া খুব চালাক-চতুর মেয়ে। স্বামীর বাড়ি এসে সেযে যেমন তার সঙ্গে তেমন ব্যবহার করে। ধর্মের বিধি-নিষেধ নিয়ে মাথা ঘামায় না। বলে ধর্ম নিজস্ব ব্যাপার। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা কারও উচিত নয়।

তওফিকও বাবার মতো শান্তিপ্রিয়। তাই ধর্মের ব্যাপারে স্ত্রীকে তেমন কিছু না বললেও তার এই কথার প্রতিবাদ করে বলে, তুমি ঠিক বলনি। প্রত্যেক মুসলমানকে ইসলামের বিধি বিধান মেনে চলতেই হবে। নচেৎ সে মুসলমান থাকবে কিনা সন্দেহ। তাদের ফাবিহা নামে দু’ বছরের একটা মেয়ে আছে।

ডালিয়া ছোটবেলা থেকে খুব জেদী ও খামখেয়ালি। একটা খেলনা এনে দিলে বড়জোর এক সপ্তাহ সেটা নিয়ে খেলবে। তারপর সেটা ভেঙ্গে ফেলে বলবে, এটা পুরোনো হয়ে গেছে বলে ভেঙ্গে ফেলেছি। অন্য আর একটা এনে দাও। ড্রেসের ব্যাপারেও তাই। এমন কি খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারেও সপ্তাহ অন্তর অন্তর খাবারের মেনু পাল্টাতে হত। অবশ্য কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ওরকম না করলেও মাঝে মাঝে বন্ধু-বান্ধবী চেঞ্জ করে।

তাই এবারে মামা বাড়িতে বেশ কিছুদিন থেকে ফিরে এসে মেয়েকে ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়তে দেখে শামীমা বেগম অসন্তুষ্ট হলেও ভাবলেন, এটাও তার খামখেয়ালি। কয়েকদিন পর ঐসব ছেড়ে দেবে। একদিন তিনি স্বামীকে কথাটা জানালেন।

শুনে তানভীর সাহেব খুশি হলেও স্ত্রীর মন রাখার জন্য মৃদু হেসে বললেন, ওর স্বভাব তো জান, কিছুদিন অপেক্ষা করে দেখ এরকম কতদিন থাকে। তবে একটা কথা না বলে পারছি না, ডালিয়ার যদি এটা খামখেয়ালি না হয়ে আল্লাহ তাকে হেদায়েত দিয়ে থাকেন, তা হলে আল্লাহর দরবারে আমাদের শুকরিয়া জানান উচিত। কারণ ও দিন দিন যেভাবে উচ্ছল জীবন যাপন করছিল, সেকথা ভেবে আমি খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম।

শামীমা বেগম রেগে উঠে ঝংকার দিয়ে বললেন, তুমি তো এরকম কথা বলবেই। নিজে মোল্লা, তাই ছেলেমেয়েকেও মোল্লাহ বানাতে চাও। সেজন্যেই আতিককে আমার কাছ থেকে সরিয়ে মাদরাসায় পড়াচ্ছ।

স্ত্রী রেগে গেলে তানভীর সাহেব সব সময় চুপ করে থাকেন। এখনও চুপ করে রইলেন।

শামীমা বেগম ডালিয়াকে ছোটবেলা থেকে নিজের মতো করে মানুষ করেছেন। তাই সে যত বড় হয়েছে তত আপটুডেট হয়েছে। টাইটফিট প্যান্ট শার্ট পরে ভার্সিটি যায়। তাদের গাড়ি থাকলেও ব্যবহার করে না। শামীমা বেগম স্বামীকে দিয়ে মেয়ের জন্য হুন্ডা কিনিয়েছেন। ডালিয়া হুন্ডা নিয়ে সবখানে যাতায়াত করে। ভাবি নাজিয়ার সঙ্গে তার খুব ভাব। হুন্ডায় চড়িয়ে তাকে নিয়ে বেড়াতে যায়, মার্কেটিং করতে মার্কেটে যায়।

এবারে মামাবাড়ি থেকে ফিরে এসে ডালিয়া ভাবির সঙ্গে আগের মতো মেলামেশা করে না। একা মার্কেটে গিয়ে কুরআন হাদিসের ব্যাখ্যা ও অন্যান্য অনেক ইসলামিক বই কিনে এনেছে। অবসর সময়ে সেগুলো পড়ে প্রথমে নামায পড়তে শুরু করল। তারপর প্যান্টশার্ট পরা ছেড়ে দিয়ে সালোয়ার কামিজ ও ওড়না ব্যবহার করতে লাগল। বোরখা পরে ভার্সিটি যেতে লাগল। হুন্ডা চালানও ছেড়ে দিল।

তাই দেখে একদিন নাজিয়া তার রুমে এসে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার, তুমি যে দিন দিন পীর সাহেব বা মৌলভী সাহেবদের বাড়ির মেয়ের মতো অসূর্যস্পর্শা হয়ে যাচ্ছ? তা ছাড়া মহসিন ভাইয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ের ঠিক ঠাক হয়ে থাকা সত্ত্বেও তাকে কী এমন বলেছ যে, সে এখান থেকে চলে গেল? এসবের পিছনে নিশ্চয় কোনো কারণ আছে? তা না হলে আমার সঙ্গেও মেলামেশা করছ না কেন?

ডালিয়া তাকে বসতে বলে বলল, দুনিয়াতে কারণ ছাড়া যখন কোনো কিছু ঘটে না তখন কিছু একটা তো আছেই।

নাজিয়া বলল, আমি সেই কিছু একটা শুনতে চাই।

তুমি ভাবি হলেও আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু। তোমাকে বলব না তো কাকে বলব? তবে তার আগে একটা কথা বলতে চাই।

বেশ তো বল।

ইসলামের নির্দেশ হল, কারও সঙ্গে দেখা করতে গেলে প্রথমে দরজার বাইরে থেকে সালাম দিতে হবে। সালামের উত্তর না পাওয়া গেলে আরও দু’বার সালাম দিতে হবে। তারপরও যদি সালামের উত্তর না পাওয়া যায়, তা হলে ফিরে আসতে হবে। কারণ অনুমতি ছাড়া অন্যের ঘরে প্রবেশ করা ইসলামে নিষেধ। একটা হাদিস বলছি, “একদা এক ব্যক্তি আসিয়া রসূল (দঃ)-কে প্রশ্ন করল, আমার মাতার নিকট গমন করিতে হলেও কি অনুমতি চাহিব? তিনি বলিলেন, হ্যাঁ। লোকটি বলিল, আমি তাহার সঙ্গে একই গৃহে বসবাস করি। রসূল (দঃ) বলিলেন, তবুও তাহার নিকট যাইতে অনুমতি চাও। লোকটি বলিল, আমি তাহার সেবা করি। রসূল (দঃ) বলিলেন, তবুও তাহার নিকট যাইতে অনুমতি চাও। তাহাকে কি তুমি উলঙ্গ দেখিতে আশা কর? লোকটি বলিল, না। তবে অনুমতি চাও।“[বর্ণনায় : আতায়া বিন ইয়াসার (রা.)-মালেক] তাই বলছিলাম, দরজার বাইরে থেকে সালাম দিয়ে ভিতরে আসার অনুমতি নেয়া উচিত।

নাজিয়া বলল, আমি তো তোমার মতো কুরআন হাদিস পড়িনি, জানব কী করে?

তুমি বোধ হয় জান না ভাবি। হাদিসে আছে, আমাদের নবী করিম (দঃ) বলেছেন, “প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করা ফরয।” তারপর বলল, আমিও এসব জানতাম না। জানার জন্য এই সমস্ত কিতাব কিনে এনে পড়ছি বলে বুকসেলফ দেখাল। তুমিও পড়বে, তা হলে আল্লাহ ও তাঁর রসুল (দঃ) এর বিধি-বিধান মেনে চলার প্রেরণা পাবে।

নাজিয়া বলল, ঠিক আছে পড়ব। এবার তোমার পরিবর্তনের কারণটা বল।

কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে ডালিয়া বলল, বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, একটা ছেলেকে দেখে ও তার কার্যকলাপ দেখে আমার জ্ঞানের চোখ খুলে গেছে। আর যার জ্ঞানের চোখ একবার খুলে যাবে, সে ধার্মিক হতে বাধ্য।

নাজিয়া বলল, নিশ্চয় ছেলেটা মৌলভী অথবা পীর সাহেবের ছেলে?

ডালিয়া বলল, আচ্ছা ভাবি, আজকাল শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা মৌলভী ও পীর সাহেবদের কথা শুনলে নাক সিটকায়, তাদেরকে বিদ্রূপ করে। কেন করে বলতে পার?

নাজিয়া বলল, তুমিও তো এতদিন তাদের দলে ছিলে, উত্তরটা তো তোমারও জানা থাকা উচিত।

ডালিয়া বলল, হ্যাঁ, তুমি ঠিক কথা বলেছ। এই কয়েকদিন ধর্মীয় বই পুস্তক পড়ে বুঝতে পারলাম, যারা ইসলামকে জানার মতো জানে না, কুরআন হাদিসের ব্যাখ্যা পড়ে না এবং ইসলামিক বই পুস্তকও পড়ে না, তারাই বিদ্রূপ করে ইসলাম পন্থীদের।

নাজিয়া বলল, আসল ঘটনা কিন্তু এড়িয়ে যাচ্ছ।

ঠিক এড়াইনি, কথা প্রসঙ্গে অন্যদিকে চলে গেছি। যাই হোক, এবার মামাবাড়িতে গিয়ে এমন একটা ছেলেকে দেখেছি, যার তুলনা সে নিজেই। কারও সঙ্গে তার তুলনা করা চলে না। আমার পরিবর্তনের কারণ সেই ছেলেটা।

কিছুই বুঝতে পারছি না। শুধু চোখের দেখা দেখে কি কেউ জীবনের গতি পরিবর্তন করতে পারে? নিশ্চয় কোনো ঘটনাকে উপলক্ষ্য করে ছেলেটাকে দেখেছ। ঘটনাটা বললে বুঝতে পারতাম।

ঘটনা তেমন কিছু নয়, তারপর প্রথম দিন রাস্তার ঘটনা ও তার কিছুদিন পর মহসিন ভাই বন্ধুদের নিয়ে যে ঘটনা ঘটিয়েছে এবং ছেলেটার মোবাইল সেট হারিয়ে যাওয়া ও ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে যতটুকু আলাপ হয়েছে, সেসব বলে ডালিয়া চুপ করে রইল।

নাজিয়া অল্পক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, কিন্তু এসব ঘটনায় তোমার আমূল পরিবর্তনের কারণ তো খুঁজে পাচ্ছি না?

ডালিয়া বলল, মামাতো কোন রাহেলাও এই ঘটনায় তোমার মতো আমার পরিবর্তনের কারণ খুঁজে পায়নি। তবে গতকাল এক দুর্ঘটনার মাধ্যমে পেয়েছে। শুধু তাই নয়, যে নাকি ছেলেটার হাত-পা ভেঙ্গে লুলা করে দিতে চেয়েছিল, সে এখন তাকে পাওয়ার জন্য পাগল।

নাজিয়া অবাক হয়ে বলল, কী বলছ মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না।

রাহেলা তার বাবার সঙ্গে পরামর্শ করে ভাইয়ার অপমানের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে কি ঘটনা ঘটাল ও রাহেলার দুর্ঘটনার কথা এবং কীভাবে শফি তার জান ও ইজ্জত বাঁচাল, সবকিছু জানিয়ে ডালিয়া বলল, গতকাল রাত বারটার পর রাহেলা ফোন করে তার দুর্ঘটনার কথা জানিয়েছে।

নাজিয়া বলল, তা হলে ঐ ছেলেটাই তোমারও মুন্ডু ঘুরিয়েছে? যার ফলে মহসিন ভাইকে আর পছন্দ করছ না।

ডালিয়া বলল, কোনো ধার্মিক ছেলেমেয়ে অধার্মিক ছেলেমেয়েকে পছন্দ করতে পারে না। মহসিন ভাইকে তো বলেছি, তুমি ধর্মকে ঠিকমতো জান ও মান তা হলে বুঝতে পারবে কেন আমি তোমাকে এড়িয়ে চলছি এবং আগের জীবনের পথ ত্যাগ করে ইসলামী পথে চলার চেষ্টা করছি।

নাজিয়া বলল, ছেলেটা সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রাহেলার জান ও ইজ্জত বাঁচিয়েছে বলে হয়তো তাকে পাওয়ার জন্য সে পাগল হয়ে উঠেছে; কিন্তু তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে ছেলেটার সঙ্গে তেমন দেখা সাক্ষাৎ ও আলাপ হয়নি, তবু তার কারণে তোমার এত পরিবর্তন হল কেন বুঝতে পারছি না।

ডালিয়া বলল, ছেলেটা যে শুধু দেখতে খুব হ্যাঁন্ডসাম তাই নয়, তার কথাবার্তা, আচার-ব্যবহার ও চরিত্রের দৃঢ়তা যারা জানবে, শ্ৰেণীমতো সবাই তাকে ভক্তি-শ্রদ্ধা ও সম্মান করতে বাধ্য হবে। আর ম্যাচিওর মেয়েরা তাকে পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠবে।

নাজিয়া বলল, এতক্ষণে বুঝতে পারলাম তুমিও তাকে পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছ। আর সেই জন্যেই ধার্মিক হওয়ার চেষ্টা করছ এবং মহসিন ভাইকে তারই কারণে এখন আর পছন্দ করছ না, কি ঠিক বলি নি?

ডালিয়া বলল, হ্যাঁ, ঠিক বলেছ; তবে বুঝতে অনেক লেট করেছ।

নাজিয়া বলল, কিন্তু ছেলেটাও যে তোমাকে চায় তাকি জেনেছ?

হ্যাঁ, জেনেছি।

তোমাদের তেমন মেলামেশা বা কথাবার্তা হয়নি বললে, তা হলে জানলে কীভাবে?

ফোনে আলাপ করে।

তোমরা কি প্রায় ফোনে আলাপ করো?

না, কয়েকদিন আগে মাত্র একবার আলাপ হয়েছে।

ছেলেটা করেছিল, না তুমি করেছিলে?

আমি করেছিলাম।

তুমি কি তাকে খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছ?

হ্যাঁ।

ছেলেটাও কি তোমাকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছে?

হ্যাঁ।

কী করে বুঝলে? মাত্র একবার ফোনে আলাপ করে তা বোঝা অসম্ভব।

তোমার কথা হয়তো ঠিক; কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

কেন প্রযোজ্য নয়?

ওটা মনের ব্যাপার মুখে বলা যাবে না।

তুমি কি ডিটারমাইন্ড ঐ ছেলেকেই জীবনসঙ্গী করবে?

হ্যাঁ।

নাজিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, বাবা তোমাকে খুব ভালোবাসেন। ওনার কথা না হয় বাদ দিলাম; কিন্তু মাকে ম্যানেজ করবে কী করে? তিনি মহসিন ভাইয়ের সঙ্গে যে তোমার বিয়ের কথা পাকা করে রেখেছেন, তা তুমিও জানো?

ডালিয়া বলল, হ্যাঁ জানি; কিন্তু আমি এখন বড় হয়েছি, ভার্সিটিতে পড়ছি, আমার ব্যক্তিগত মতামত আছে। জোর করে মা তো এই কাজ করাতে পারবে না। তবে মা যে এ ব্যাপারে আমার উপর খুব চাপ সৃষ্টি করবে তা জানি। একটা কথা বলে রাখি ভাবি, আল্লাহপাক ছাড়া দুনিয়ার কোনো শক্তিই আমার সিদ্ধান্তকে বদলাতে পারবে না।

কি জানি ভাই, তোমাকে নিয়ে আমার বেশ চিন্তা হচ্ছে।

তুমি আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না, তকৃদিরে যা লেখা আছে তা হবেই।

তুমি বললে তোমার ভাইয়ার সঙ্গে আলাপ করতে পারি।

না ভাবি, এখন ভাইয়াকে কিছু বলার দরকার নেই। সময় হলে আমিই বলব ভাইয়ার সঙ্গে আলাপ করতে।

ঠিক আছে, এখন যাই বলে নাজিয়া তার কাছ থেকে চলে গেল।

প্রায় দশ বার দিন পর আজ সকালে শফির সঙ্গে ফোনে আলাপ করে যখন জানতে পারল, তাকে দেখার জন্য আজই সে আসছে তখন তার মনে আনন্দের তুফান বইতে শুরু করেছে। তার কি করা উচিত ভেবে ঠিক করতে না পেরে ভাবিকে কথাটা জানাল।

নাজিয়া বলল, মা জানতে পারলে হুলুস্থুল কান্ড করে বসবেন। তুমি বরং বাবাকে সবকিছু জানাও। উনি নিশ্চয় কিছু একটা ব্যবস্থা করতে পারবেন।

ডালিয়া বলল, ঠিক বলেছ ভাবি। তারপর রুমে এসে বুয়াকে ডেকে বলল, বাবাকে বলবি আমি ডেকেছি। খবরদার, মা যেন জানতে না পারে।

তানভীর সাহেব ড্রইংরুমে বসে পেপার পড়ছিলেন। বুয়ার মুখে মেয়ে ডাকছে শুনে তার রুমে এসে বললেন, কীরে মা, কেন ডেকেছিস?

ডালিয়া জিজ্ঞেস করল, মা কি ঘুম থেকে উঠেছে?

তানভীর সাহেব ঘড়ি দেখে বললেন, কেন? তুই তো জানিস, সে আটটার আগে উঠে না। এখন সাতটা বাজে। তার কথা বাদ দিয়ে কেন ডেকেছিস বল।

তুমি বস বলছি।

তানভীর সাহেব বসে বললেন, কী বলবি তাড়াতাড়ি বল, অফিস যাওয়ার টাইম হয়ে আসছে।

ডালিয়া কিছুক্ষণ নিচের দিকে মুখ করে চিন্তা করতে লাগল কীভাবে কথাটা শুরু করবে।

তানভীর সাহেব অধের্য্য গলায় বললেন, চুপ করে আছিস কেন? কীজন্যে ডেকেছিস বলবি তো?

ডালিয়া ভয়ে ভয়ে বলল, এবারে মামাবাড়ি গিয়ে সেখানকার একটা ছেলেকে ভালবেসে ফেলেছি। সে ধার্মিক। তার আদর্শ চরিত্র দেখে আমি মুগ্ধ। তাকে উপলক্ষ করে আল্লাহ আমাকে হেদায়েত দিয়েছেন। কথা শেষ করে বাবার দিকে চেয়ে দেখল, বড় বড় চোখ করে তার দিকে রাগের সঙ্গে তাকিয়ে রয়েছে। বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতে না পেরে মুখ নিচু করে নিল।

তানভীর সাহেব কথাটা বিশ্বাস করতে পারলেন না। গম্ভীর স্বরে বললেন, এ তুই কী বলছিস? আমি কি আমার মেয়ের কথা শুনছি?

ডালিয়া মুখ নিচের দিকে করেই বলল, হ্যাঁ বাবা, এটা তোমার মেয়েরই কথা।

এর পরিণতির কথা ভেবেছিস? মহসিনের সঙ্গে তোর বিয়ের কথা পাকা হয়ে রয়েছে। এ কথা তোর মা শুনলে কী করবে তাও কি ভেবেছিস? তা ছাড়া ছেলেটা তোর মামাদের গ্রামের বললি, তোর মামা জানতে পারলে কী ঘটনা ঘটবে তাও ভেবে দেখবি না? না, না, এ হতেই পারে না। মহসিন শুনলে সে কী করবে তাও কী ভেবে দেখবি না? পাড়াগাঁয়ের ছেলেরা শহরের সমাজ সম্পর্কে একরকম কিছুই জানে না। তারা আনকালচার্ড। আমাদের সঙ্গে মেলামেশা করতে পারবে না। তা ছাড়া পাড়াগাঁয়ের ছেলেরা খুব লোভী হয়। ঐশ্বর্যের লোভে বড় লোকের মেয়েদেরকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ে করে। তারপর শ্বশুরের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আসার জন্য স্ত্রীর উপর অত্যাচার করে। এরকম ঘটনা যে পেপারে প্রায় লেখালেখি হচ্ছে তা তুইও জানিস। আর তোর মা যে নিজের মতের বাইরে কিছুতেই কোনো কাজ করে না, তাও তুই জানিস। তাই যা বলছি শোন, ভালোকে সবাই ভালোবাসে। তাই বলে তাকে পেতে হবে এটা তো ঠিক না। ওসব পাগলামী মাথা থেকে দূর করে দিয়ে ছেলেটাকে ভুলে যা মা। নচেৎ আমাদের সংসারে আগুন জ্বলবে।

ডালিয়া বাবার দু’পা জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, তোমার সমস্ত কথা ঠিক হলেও আমার সব কথা শুনতে হবে। বর্তমানে ছেলেমেয়েদের মধ্যে ভালোবাসার কথা যা শোনা যায়, আমাদের মধ্যে সেরকম কিছু হয়নি। ছেলেটার ধার্মিকতা, আদর্শ চরিত্র, সর্বোপরি তার সৎ গুণাবলী আমাকে এমনভাবে আকৃষ্ট করেছে, যা তাকে ভালোবাসতে বাধ্য। করেছে। তার সঙ্গে দু তিনবার দেখা ও খুব সামান্য আলাপ হলেও মনে হয়েছে তাকে যেন অনেক দিন থেকে চিনি। সে আমাকে ভালোবাসে কিনা জানতাম না। তারপর তার মোবাইল নাম্বার কী করে পেল, সে ঘটনা বলে বলল, থাকতে না পেরে আমিই তাকে ফোন করি। তার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি সেও আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। আর পাড়াগাঁয়ের ছেলেদের ব্যাপারে তুমি যা বললে তার শতভাগের একভাগও তার মধ্যে নেই। সকালে ফোন করে জানিয়েছে, আজ বিকেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে। আমার কথা সত্য না মিথ্যা তার সঙ্গে আলাপ করলেই বুঝতে পারবে। তুমি যদি আমাদের দেখা সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে না দাও, তা হলে। কাল সকালে আমার মরা মুখ দেখবে। তারপর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

তানভীর সাহেব তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে ডালিয়াকে সব থেকে বেশি ভালোবাসেন। তাই তাকে কাঁদতে দেখে ও তার কথা শুনে রাগ পড়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মেয়ের হাত ধরে পাশে বসিয়ে বললেন। কোনো বাবাই মেয়ের এরকম অন্যায় আব্দার মেনে নেবে না। মরা মুখ দেখার কথা না বললে আমিও মেনে নিতাম না। বুঝতে পারছি তোকে সব থেকে বেশি। ভালোবাসি বলে আমাকে ব্ল্যাকমেল করতে চাচ্ছিস। ঠিক আছে, তোদের দেখা সাক্ষাতের ব্যবস্থা করব, তবে আমিও থাকব।

বাবা বলে ডালিয়া ওনার দুটো হাত ধরে বলল, তোমার মতো বাবা। কারও আছে কিনা জানিনা। তারপর আবার বলল, নিশ্চয় তুমি আমাদের সঙ্গে থাকবে।

পরিচয় জানা থাকলে আলাপ করতে সুবিধে হবে ওর পরিচয় বল।

ওর নাম মুহাম্মদ শফি। ডাক নাম শফি। আরবি ও ইংরেজিতে উচ্চ শিক্ষিত। নয় দশ বছরের সময় ওর বাবা মারা যান। মা ও দাদি বেঁচে আছেন। বিষয় সম্পত্তি অনেক। গ্রামের নাম চরদৌলত খান। মামাদের গ্রামের পাশের গ্রাম।

ঠিক আছে, রেডি থাকিস। আমি ব্যবস্থা করে ফোন করে তোকে জানাব। তোর মায়ের ঘুম থেকে উঠার সময় হয়ে গেছে। আমি এবার যাই বলে তানভীর সাহেব যাওয়ার সময় বললেন, খুব সাবধান, তোর মা যেন ক্ষুণাক্ষরেও এসব জানতে না পারে।

ডালিয়া গোসল করে দু’রাকায়াত শোকরানা নামায পরে দোয়া করল, “ইয়া আল্লাহ, ইয়া রাব্বল আলামিন, শফিকে যেন বাবার পছন্দ হয়। তাকে যেন স্বামী হিসাবে পাই।”

Exit mobile version