Site icon BnBoi.Com

পিঞ্জরে বসিয়া শুক – কমলকুমার মজুমদার

পিঞ্জরে বসিয়া শুক - কমলকুমার মজুমদার

১. সুঘরাই হারাইয়া যায়

জয় মাধব, তারা ব্রহ্মময়ী, মাগো–জয় রামকৃষ্ণ

তখনই যে সময়ে সুঘরাই হারাইয়া যায় এই দিব্যমাল্য সাজান, ভাস্বর, হীরক-শোভাতে বিনিদ্র শহরে–ইহা শিবপুরী, ভক্ত ও মুক্তি প্রদায়িনী যাহা, সৌন্দৰ্য্য যাহা, যে শহর, তখনই সে আপনকার সীমা বুঝিয়া তীব্র আতান্তরে পড়িয়াছিল; যে তাহার শেষ অঙ্গুলিশীৰ্ষতেই ও অন্য প্রত্যঙ্গাদিতে যে ইহার পর হইতেই এবং বনস্থলী চমকপ্রদ হইয়া রহে, যে ইহার পর হইতেই দীপের জ্যোতির্ময়ী ঘটনার প্রবাহ! যে ইহার পর হইতেই আমি, হায়! আমি নারসিসস্‌-রে পথিক করিয়াছি।

ঐ সীমা ভাবিয়া, ও আমার মনিব! ও আমার মনিব! বলিয়া সে বড়ই উভরায় কান্দিয়া থাকে ইহা সত্য, অথচ আদতে তাহাতে প্রচ্ছন্ন ছিল কূট বিদ্বেষজনিত ক্রোধ, সে যেমন সেই সাধক–যে যিনি নির্ভীক তোয়াক্কাহীন দামাল, আকৰ্ণবিস্তৃত নেত্র যাঁহার হিঙ্গুল, চেহারা যাঁহার বৈরাগ্যসুন্দর দশাসই, গাত্র যাঁহার মসৃণ ও উজর তাম্রবর্ণের, যাঁহার পরনে কৌপীন, হস্তে যাঁহার সুমহৎ চিমটা; এখন যিনি এই লোকপ্রসিদ্ধ মন্দিরের দরজার চৌকাঠেতে অদম্য দুঃসাহসে ভীষণ রাগে ঐ চিমটা দ্বারা বারম্বার আঘাত করিতে উন্মাদ; ইহাতে ক্রমান্বয়ে তদীয় স্কন্ধ বলীবৰ্দের প্রায় স্ফীত হইতেছিল, ঘৰ্ম্মে তাঁহার কপালের হোমতিলক ঘুণাক্ষরে পরিণত হইল, হঁহার রুদ্রাক্ষমালা আন্দোলিত, আর যে তিনি মুহুর্মুহুঃ বীরবিক্রমে ত্রিভুবনের ত্রাসসঞ্চারী হুঙ্কার পাড়িতেছিলেন।

ঐ বিপুল হুঙ্কারমধ্যে ঐ অভিনব সাধক জলদগাম্ভীর্যে মা ভৈঃ উচ্চারণ করিয়াছিলেন, আবার কখনও বা ভগবান শিবকে বিকট আঁশটে বচনে গালি ও টিট্টিকার দিতে থাকিয়া ইহাও বলিতেছিলেন, শালা…অদ্য আমারে দর্শন দিতে হইবে, আমি কণ্ঠে ফিরিয়া আসিতে চাহি না, দে শালা অখণ্ডতা!

যে এবং ঐ সাধক এরূপ অহঙ্কারও প্রকাশ করেন, যে, আমি তোমার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করিয়াছি…আর তুমি আমাকে ফাঁকি দিবে!

.

ঈদৃশ নানান অর্থপূর্ণ শব্দের সহিত চিমটা-প্রহারের সঘন আওয়াজ হইতে থাকিল, আশ্চৰ্য্য যে ইহাতে কুকুর ও পাখীরা রব তুলে নাই, নিকটে থাকিয়া সুঘরাই কিছু আড়ষ্ট, কিছু কৌতূহলী!

সে দেখিল, অনেক পূজার্থী ও ধার্মিকরা ঐ বীরের সমীপস্থ হইয়া বিস্ফারিত লোচনে, তাঁহার ঐ ভয়ঙ্কর উদ্ধত ক্রিয়াকলাপ দেখিতে থাকিয়া ভক্তিবিহ্বল হৃদয়ে, কেহ বা অশ্রু ভারাক্রান্ত ইতিমধ্যেই, অহরহ, অহরহ ‘জয় বৈদ্যনাথ শিবশম্ভ’ ধ্বনি দিতেছিলেন; তাই ইদানীংকার সমস্ত ভাবে আমাদিগের জীবন এক সুউচ্চ মহিমার অবস্থায়ে স্থায়ী হইয়াছিল।

সাধক ঘোর দম্ভে পুনরায় ঘোষণা করিলেন,…আমি মন্দিরে যাইব না…তুমি স্বরূপে আসিয়া দেখা দাও…। এবং যে ইহার পরক্ষণেই তদীয় বিপুল দেহ ভাঙ্গিয়া পড়িল, তিনি চেতনশূন্য হইলেন; তখনই, সমবেত প্রত্যেকে তাহার অবলোকনে মহা গৌরবান্বিত বোধ করিলেন; ইহারা সশ্রদ্ধচিত্তে, মন্থরে, শিব ধ্বনি তুলিতে থাকিয়া ও তৎসঙ্গে ঐ সাড়হীন দেহের উদ্দেশে পুষ্পমাল্য আদি বর্ষণ করিতে গৌরবান্বিত বোধ করিলেন; ইহারা সশ্রদ্ধচিত্তে, মন্থরে, শিব ধ্বনি তুলিতে থাকিয়া ও তৎসঙ্গে ঐ সাড়হীন দেহের উদ্দেশে পুষ্পমাল্য আদি বর্ষণ করিতে সময়ে, ইহা বলিলেন,…হে নীলকণ্ঠ, হে ভগবান উমাপতি, তুমি অন্তর্যামী, আমাদের পুরুষানুক্রমে এবং পূৰ্ব্বজন্ম ও ইহকালের জন্য আমাদের যে অমরতা বরাদ্দ আছে…তাহা অচিরেই ঐ সাধকেরে দেওয়া হউক, কেন না তুমি তাহার (ঐ সাধকের) অবিনাশী প্রেম।

সাধকের অন্তর্দশা প্রাপ্ত দেহটির শুশ্রূষাকরণে অতীব শুদ্ধাচারী ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেহ সাহস পর্যন্ত করেন না, এই জন্য যে ঐ পাঞ্চভৌতিক দেহ অধুনা কৃষ্ণাচতুর্দশীর পরমাশ্চৰ্য্য চন্দ্রকলা! এখন কেহ সাধকের কর্ণে অমৃত শিব নাম, কেহ ব্যজন, কেহ উহার মেরুদণ্ডে ঘৃত কর্পূর মালিশ করিতেছিলেন, অনেকক্ষণ পর সাধক খানিক সহজ অবস্থায় আসিলেন ও তাবিজড়িত স্বরে কহিলেন, জল…জল খাইব!

এইভাবে ইহজগতের সহিত সম্পর্ক গঠিত হইল।

সুঘরাই এহেন প্রহেলিকার কিছু, সরলতার এতটুকুন, বীরত্বের লেশমাত্র না বুঝিয়া শুধু সাধকের দুর্ধর্ষতা গ্রহণ করিয়াছিল। আর যে তেমন তেমন রোষে সেও জ্বলিতেছিল–সম্ভবত, কেন না তাহারই ছায়া বাঁচাইতে ব্রাহ্মণ্য শ্রীসম্পন্ন পাণ্ডাঠাকুর মহাশয় ঈষৎ দিভ্রান্ত হওয়ত স্বীয় উড়নীতে সামাল দিয়াছিলেন; বিশেষই নিশ্চিত, কেন না সে বেচারী মন্দিরের দুয়ারের এই পার্শ্ববর্ত্তী স্থান ত্যাগে বাধ্য হয়। তখনই, যখন ঐ সাধক অন্তর্হিত হইয়াছেন, যখন এরূপ সুদুর্লভ পবিত্রতার অর্থাৎ মন্দিরের নৈকট্যে আসাতে যে এক অনির্বচনীয় আহ্লাদে তাহাতে গোঁয়ার হইয়া উঠিয়াছে!

এবং তাই তৎক্ষণাৎ সুঘরাই, তদীয় স্নেহশীলা মনিব পত্নী আদিষ্ট, সেই মনোলোভা সার্থক কামনা জানাইতে পারে না। যে পরম ভক্তিমতী রমণী যে সূত্রে বলিয়াছিলেন,…এখন বাবা বোদ্দিনাথের ইচ্ছে যদি হয়, এমন যদি করেন, তুই তাঁর সামনে একেবারে…উঃ তাহালে! হ্যাঁরে তেমনতারা ভাগ্য কি আর ছোঁড়া তুই করেছিস!…সে নয় নাই হ’ল…তবু তুই দাঁতে দাঁত দিয়ে…জা যায় সেও ভি আচ্ছা, তুই তাঁকে ডাকবি, দেখবি তোর পাপ তিনি মুছে দেবেন!

এই পর্য্যন্ততে সুঘরাইএর রৌদ্রনিবাস আয়ত চক্ষুর্ধয় সর্ব সময়ে বড় হয়, যাহা প্রত্যক্ষে মনিবপত্নী আবার কহিলেন, হ্যাঁরে,…তিনি বড় দুখীর ঠাকুর…মা ঠাকরুণ (সারদাদেবী) বলেছেন, যে ছোট ছেলের ডাক তিনি ফেলতে পারেন না, তুই নির্ভয়ে ডাকবি, বলবি ঠাকুর আমি বড় অধম বড় দীন, তুমি ছাড়া আমার গতি কৈ…তখুনি, দেখবি বাবা বোদ্দিনাথ তোর পুবো জন্মের সব পাপ ধুয়ে মুছে দেবেন…আবাঃ ছোঁড়া গালে হাত দেয়…কতবার বলেছি না এ সব কথা কহনও গালে হাত দিয়ে শুনতে নেই…এসব ঠাকুরদের কথা!

ইহাতে সুঘরাই আপনকার গাল হইতে হাত নামাইতেই যারপরনাই অসহায় নির্জীব হইল; এমনই যে, ইদানীং সকল নির্ভরতা তাহার ঝটিতেই খোয়া গিয়াছে, যে সে সব গরু খেদাইতেও অপারগ; এবং তাই উপস্থিত এ দেহ কোথাও হেলান চাহিতেছিল–যাহা নির্ঘাত কৃতাঞ্জলিপুটে শুনিবার, পত্ৰউদগম ও কুম্ভকারের চাকের নিগুণ গূঢ় পদ্যতে; যাহা গ্রামাঞ্চলে অনাবৃষ্টির ছড়া বোধে ব্যবহৃত হয়, নবমবর্ষীয়া বালিকারা নগ্ন দেহে, শূন্য ঘট মস্তকে ধারণে ঈষৎ নৃত্যভঙ্গিমায় উহা গাহিতে থাকিয়া প্রথমে ক্ষেত প্রদক্ষিণ করে।

এখন সুঘরাই যখন এহেন হেলান দিতে ইচ্ছুক, ঠিক সেই সময়তেই শুনিতে পাইল যে নিজ অভ্যন্তরে পাঠান দাপটে কিলকিলা রব ঘনাইয়াছে; তদীয় পেশীসকল তাহার স্বকীয় পূর্বজন্মটিকে বিনানুনে এক গ্রাসে খাইতে হাঁ হাঁ করিতেছিল, যাহাতে সে বিপদ গণিল; ইহাতে শঙ্কায় সে কিয়ৎ পিছু হটিল, সুতরাং সে নিরীহ, যে নির্বিবাদে সুতীক্ষ শীত সহিয়াছে নিজ বক্ষঃদেশে হস্ত রাখিয়া, যে নিজ হাতে কপালের ঘাম ও চোখের জল মুছিয়াছে, যে কোন লাটুঠার দড়ি (কুয়া দড়ি) স্পর্শ করে না, সে অন্য নহে। ফলে অতএব মোটেই আভাসিত তাহার মধ্যে হইল না, যে কোন একদিন কয়েকটি পালক উড়িয়া-হায়! কখনও বা মুক্তার বৈভব আতিশয্যকে প্রনষ্ট করিয়াছিল, এইহেতু যে সে আপনার ভালবাসা লইয়া ক্কচিৎ খেলা করে–তাহারে বিকট করিয়াছিল! এবং সে ন্যাংটো হইয়াও ছাড় পায় নাই।

যে স্থলে পালক উড়িয়াছে, পালক পড়িয়াছে, ধ্রুব যে ভগবান রামচন্দ্র যাবৎ না সেখানেতে পদার্পণ করেন, ততদিন সেখানে কিছুতেই দীপ জ্বালিবে না, যে ঐখানে পদক্ষেপমাত্রই সকলেই পথ ভুলিবে; এ কারণে যে, ঐ স্থলে সুঘরাইএর তর্জ্জনী কাটিয়া বেশ খানিক রক্তপাত ঘটে, এবং যে সে দেখিল ঐ রক্ত তাহার পাখীটিকে মহা সোহাগভরে পান করিতে; এখন আজব যে, ঐ দৃশ্যে সে দারুণ খুসী হওয়ার মুহূর্তেই দুর্দান্ত ক্রোধে ভৌতিক, তৎপ্রবর্ত্তীত সে তৎক্ষণাৎই পদাঘাত করিল মূদুল পক্ষীটিকে; কিছু পালক খসিল, ইহা উড়িতে থাকিয়া তাহার সম্মুখের–রিখিয়ার পশ্চিমে অবস্থিত সুরম্য ডিগরিয়া পাহাড়কে ঢাকিয়াছিল। ২৬০

দেবস্থান যাত্রার মধ্যে এবং মন্দিরে আসিবার রাস্তাকে পূজার্থী ও ব্রাহ্মণ স্পর্শ বাঁচাইবার ইতঃমধ্যে মনিবপত্নী বর্ণিত প্রার্থনা, ইহা শ্রুতি বা দেশাচারে নহে, তিলেক সে বিস্মৃত হয় নাই, বরং উহাই তাহার সম্বল ছিল; তবে ইহা ঠিক, যে, ঐ সময়েতেই, নিষ্ঠাবান মনিব মহাশয় তাহার বিষয়ে যে অভিমত ঘোষণা করিয়াছিলেন, তাহাতেই সে, তাহার এক ছত্রে সে, কেবল দোমনা হইতেছিল; তিনি প্রকাশিয়াছিলেন,…যে সে নিষ্পাপ (মনিবপত্নীর উক্তিতে) সাতজন্মের পাপ!

এবং তবু ঐকথা যাহা উচ্চারণের সঙ্গেই বাস্তবতা কাদামাখা পদে মার্বেল অভিমুখে ছুটিতে আছিল, এইজন্য যে ঐ উক্তিতে মনিবপত্নী, যিনি এ যাবৎ মৌনী, এ যাবৎ নিছাড় মালাজপকারিণী, তথাপি তিনি সমধিক বাৎসল্যভরে সুঘরাইএর প্রতি চাহিয়া স্মিতহাস্য করেন।

কিন্তু যখন সে বেদময়ী অজস্র ধ্বনির মধ্যে, যখন আহ্লাদ তাহাতে থিতাইয়াছে, তখনই সুঘরাইএর আপনকার এতাবৎ মনস্থ কামনার পদবন্ধ মনিব-ব্যক্ত পদগুলিতে ঠেক্ খাইতেছিল; এখন সে যেহেতু প্রার্থনা জানে না ফলে ক্রমাগতই সে অন্ধকার দিয়া ডাকিতেছিল।

অবশেষে পুনরায় মনিবের বিনীত কণ্ঠস্বর শুনিল, একটি শব্দ দেখিতে পাইল, ইহাতে সত্যই সে যেমন চানোয়ার বালিতে খোঁড়া গর্তের নিথর জলের চাকচিক্য সাক্ষাৎ করিয়াছিল, আশ্চর্য্য যে ঐ নিঃসঙ্গতায় থাকিবার সময়েই সুঘরাই বুঝিল তদীয় নিষ্পলক চাহনির সামনে–এই হাট দিনমানে মন্দিরের রাস্তায় এক অযুত দ্যুতিময়ী শোভাযাত্রা আসিতেছে।

সে প্রত্যক্ষ করিল এ শোভাযাত্রাতে সমস্ত পথ চারুবর্ণ ধারণ করিয়াছে, সে প্রত্যক্ষ করিল এক বহুমূল্যবান উৎকৃষ্ট কিংখাবের ছাঁদনা, যাহার চারিটি রৌপদণ্ড চারিজন বালক ব্রহ্মচারী কর্তৃক ধৃত, ইহাদের মস্তক মুণ্ডন করা, পরণে ইহাদের গৈরিক–আর ঐ ছাঁদনার নীচেতে কোন সৰ্বালঙ্কারভূষিতা, হস্তে যাঁহার ধান্যমঞ্জরী, ইনি গৌরী, ইনি সেই যিনি নৌকার অভিমানকে মান্য করিয়াছেন, ইনি সেই যিনি মরকতের গোপনতা!

ঐ শোভাযাত্রা দর্শনে পথিপার্শ্বের সকলেই ‘অহহ ভগবতীতনু! জয় জয় অপূৰ্ব্ব মিথুন! অহো। মহেশ্বরী’ বলিয়া গম্ভীর হইয়া উঠিয়াছিল; ঐ সুমহৎ আওয়াজে দিকে দিকে পবিত্র অগ্নি স্থাপিত হইতেছিল। এই জোয়ারের ইতিমধ্যেই অদৃষ্টপূৰ্ব্ব মনোরমত্ব দেখার প্রাণভরিয়া দেখার সৌভাগ্য হইতে বেচারী মন্দ কপাল সুঘাই বঞ্চিত হয়।

সে সর্বৈব বিচ্ছিন্ন হইল।

সে অনেক অনেক কান্দিল। সে অনেক অনেকবার ও আমার মনিব আমার মনিব, বলিয়া উথলিয়াছে। কিন্তু কান্দিলেও অন্তরে সে ঐ সাধকপ্রায় আস্ফালনে তৈয়ার; আপনার অঙ্গুলিশীর্ষ বারম্বার নজরে এক বিষমত্ব জানিয়া সে খ্যাপাটে, এতদিন তাহার যে সীমা গ্রাম্য ছিল, সম্প্রতি তাহা ভৌতিক হইয়াছে; এই শহর তাহাকে, নিজেকেই, তাহার স্বীয় গায়ের উপর ঢালিয়া দিয়াছে; এই শহরের উপর সে খঙ্গহস্ত, সে ব্রাহ্মণশ্রেণীর ন্যায় মোহিলিকে অভিশাপ দিয়াছে কারণ মোহিলি বলিয়াছে, ইহা মহিমান্বিত শহর, বহু জ্ঞানী এখানে, এখানে শিব বাস করেন, পঞ্চায়েত বিল্বপত্র হস্তে বিচার করে, এখানে বিস্কুটের কারখানা নাই।

ইহা মহিমান্বিত শহর! সুঘরাই বলিয়াছে, পাখীরাই তাহা জানুক; সে বলিয়াছে, মোহিলি ও যাহাদের ধারণা এ শহরে কুকুর হওয়াও পুণ্যের, তাহাদেরকে সে পদাঘাত করে এবং নিমেষেই এরূপ মনোভাবে সে ভীত; উচ্চবংশের বালকদের ন্যায় বলিতে এখনও পারে নাই যে, না বাবা বলিব না ভগবান শুনিতে পাইবেন।

সুঘরাই এই শহরকে খলযন্ত্ৰী সমঝে আপনার চোয়াল ঘর্ষণ করিতেছিল, এখানের কোথাও সে নিজেরে সম্প্রসারিত করিতে পারে না। অবিরত ঢাক বাদকের নৃত্যপদক্ষেপ তাহার পদচিহ্ন মর্পিত দেখিয়া, শান্ত তীর্থযাত্রীদের তাহার পদচিহ্নের উপর দিয়া যাইতে প্রত্যক্ষে সে মারাত্মক হইয়াছে! ইহা বড় বিষম দায়, কোন বিচারেরই সুযোগ নাই!

কখনও বালকস্বভাব বশত সুঘরাই রাস্তার এক পাশ বাছিয়াছে, এই নির্বাচনে একদা সে অহো বলিয়া ফুকারিয়াছে, সে খুসী, সে ইহাতে উচ্চবর্ণের স্পর্শ বাঁচাইয়াছে; ক্রমে তদীয় পদদ্বয় ধূলাতে বিশেষই গৈরিক যে তাহাও ঠিক কিন্তু সুরাহা হয় নাই! তাহার মনিবরা রাস্তার মধ্য দিয়ে যায় বা কখনও পথ ছাড়িতে পাশে, তবে! সে নিয়ত মনিবদের অন্বেষণও করিয়াছে, ইহারই ভিতরে যে সে অনেকবিধ কাঠামো, সুদারুণ পারিপার্শ্বিকতার সহিত আপনাকে সংযোজিত করিয়াছিল–সুতরাং এনতার অনভ্যস্ত সংস্থানের মধ্যে সে, সঙ্গে সে, এক হয়–এইরূপ বিশ্বাসে যে মনিবরা তাঁহাদের সত্ত্বগুণ বশত আকর্ষিত হইতে পারেন ঐ ঐ সংগঠনে।

এবং সুঘরাই ঐ ঐ পরিবেশ সকলের মধ্যে আপনাকে উপস্থাপিত করিয়া আবার অন্বেষণে থাকিয়া, খুবই তাজ্জব যে কখনও কখনও সে নিজেকে মনিবের চোখে নির্ধারণ করিতে মজবুত ছিল; ইহাতে, পর্য্যবেক্ষণ তাহার কি আশ্চৰ্য্য অমানুষী, বোধ কি অভাবনীয়! যে যেন বা সে কখনও জংলী নয়; ইদানীং এহেন ভিন্নতায় সে, মানে মনিবকে, দেখিল।

সে কল্পনায় দেখিল বিশৃঙ্খলতা, মসৃণতা, অনেক আবছায়া অনেক রক্তচন্দন ও তীর্থযাত্রীর দল ভেদ করত তিনি সুস্পষ্ট হইলেন; এবার তিনি মুখের পার্শ্বে হস্ত স্থাপনে ভীড়ের এখানে হঠাৎ, অন্যত্রে বারেক, সুঘরাই বলিয়া ডাকিলেন, যে ইহাতে মাতৃস্তন অরুণাভ, যে ইহাতে জনতা এই নিবিড় এই তরল হইল; এখন এবং সুঘাইএর প্রমাণের-কোনবালককে পশ্চাত হইতে দর্শনে–বালকের বস্ত্র ও গেঞ্জী ফর্সা যেহেতু ঐ সুঘরাই বিশ্বাসে অত্রাহি দৌড়াইলেন এবং চীৎকার করিলেন–এই হারামজাদা সুঘরাই!

হায় সে এক স্কুলগামী বালক!

নিরাশ হওয়ত বিষণ্ণ হৃদয়ে তিনি পূতসলিলা শিবগঙ্গার সুদৃশ চাতালে আসিলেন; এখানে কেহ কেহ যাহারা ঘুমায় তাহাদিগকে স্বীয় দেহ বাঁকাইয়া এমত নিবিষ্টতায় তিনি সমীক্ষণ করিলেন যে, যেমত বা ঘুমন্ত সকলের স্বপ্নের সুষুপ্তির অন্তরীক্ষে সুঘরাইএর খেই লুক্কায়িত আছে; যে মধুস্বরে তিনি সুঘরাই বলিয়া ডাকিলেন; ইহা নির্ঘাত অপ্রকৃতিস্থতার হইলেও আর যে, এই দেবস্থানের ধ্বনিত গভীর জয় জয় শিবশম্ভ বচনে ও স্নানের নির্মল শব্দে ঐ প্রিয় নাম ধূলিসাৎ, তীর্থকামীদের অগ্রবর্ত্তী মঙ্গল ঢাক বাদ্যে তাহা নয় ছয়!

সেখানে খুঁজিতে থাকিয়া মেঘমন্দ্রে অগণন কণ্ঠের মন্ত্রের প্রতি কখনও, সুললিত স্তবস্তোত্র আবৃত্তিসহ শিবগঙ্গাতে শুভ অবগাহনরতদের প্রতি কখনও তিনি সনাতন প্রবীণ ভঙ্গীতে চাহিয়া রহেন, কারণ যে বিবিধ ওষ্ঠের ফুটমান শব্দরাজিতে ও অবগাহনের মনোজ্ঞ রণনে ধ্রুবই যে তন্মাত্রা সমস্ত নিৰ্ব্বিকার, কোথাও অন্ধকার নাই; মাত্র যে শিখা ঊর্ধ্বগামিনী এই তত্ত্বে সবই জরিয়া আছে–তাহারাও কি সুঘরাইকে ডাকে!

আবার তিনি শ্বাস লইলেন, তিনি সহজ হইলেন, তিনি ঠিক করিলেন, এই ভাবিয়া যে সুঘরাই নিশ্চয়ই ক্লান্ত বোধ করিলেও মুষড়ায় নাই এবং আরও নিশ্চয়ই আমার খোঁজার সুবিধার্থে এখানেও সে ছিল; তাই যাহারা শিবগঙ্গায় অর্ধজলমগ্ন, করজোড়ে যাহাদের পৃথিবীর পার্থক্য, তাহাদেরই কাহারও পাঠ থামিলে এই সংবাদ লইবেন যে, যে বালক এতক্ষণ শুদ্ধাতিশুদ্ধ অবগাহন দেখিতেছিল এবং তাহাতে সে অপরোক্ষেই, যেন সে, ঐবালক, একাই সুদীর্ঘ সময়, যাহা বীজ বপন করিতে ব্যয়িত হইয়াছে এবং ঐভাবে অনেক দুরতিক্রম্য পথ বহি এখানেতে আসিয়া চমকৃত!

এবং আপনাদের স্নানের আওয়াজে সেই বালক একদা রিখিয়ার সন্ধ্যায় নীত হইল; ছোট ছোট পরিবার বেড়াইতেছে–ইহারা চেঞ্জার; ইহাদের সকলের মুখমণ্ডল, দৃষ্টি, আকাশ ও মাটির ইতিমধ্যে রক্ষিত–ইহাদের পিছনে পাহাড়, শাল ও মহুয়ার পুনরাবৃত্তিতে ন্যাংটো দিকসকল; ইহারা সমস্ত কিছুকেই গ্রাণ্ড বলিয়া প্রশংসা করে, তাহারা পেট্ররোমাক্স হাতে সুঘরাইকে দেখিয়া বলিয়াছে–ছেলেটি গ্র্যাণ্ড গ্র্যাণ্ড! বেশ কালচার আছে!

এবং আপনাদের স্তবস্তোত্রের অনুরণনেও শিবগঙ্গার শীতলতায় উহার, সেই বালকের, দেহ মন পরিবর্তিত আর যে তাহাতে এই শুভ বুদ্ধি মনে হয় জন্মে যে শিবই প্রাকৃতজনের অদ্বিতীয় জ্ঞান এবং ইহাতে সে স্মিতহাস্য করিতে চেষ্টিত হইয়াছিল…আপনারা শাশ্বত ধর্মের, মন জানে, সূক্ষ্মগতি অভিজ্ঞ আপনারা, বলুন, তাহার ঐ ভাব যেন সত্য হয় এবং এখন ধর্ম্মপ্রাণ আপনারা এই লৌকিক খবর কি বলিবেন যে সে কোথায় গেল?

কিন্তু তিনি জিজ্ঞাসিতদের উত্তর আন্দাজে, অনুৎসাহে যে সকল কুসুম শিবগঙ্গার পাপহারিণী জলস্তরে হতাদরে ভাসে অধুনা সেই সেইতে নেত্রপাত করিলেন, এখন তদীয় ক্ষুণ্ণ মানসে ফুলগুলি, ফুলগুলি, ফুলগুলি!

অনেক সন্ন্যাসীর মধ্যে এক তেজঃপুঞ্জ কলেবর ভস্মাবৃত সন্ন্যাসীর নিকট তিনি যাইয়া প্রণতি পুরঃসর কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদিলেন,–ভগবন, যে বালক অশ্রুভারাক্রান্ত নয়নে, স্বীয় মস্তকোপরি হস্ত রাখিয়া আপনাকে অবলোমাত্রেই থ হয়, সুতরাং আপনাদের মতন সন্ন্যাসীর সম্পর্কে মোহিলির উল্লেখ তাহার খেয়াল নাই; আবার ক্ষণেক পরেই সেই বালক এক আতঙ্ক দেখিল, সে দেখিল সমক্ষে থাকিয়াও নাই–এর মধ্যে আপনি আপনার ধুনির অমোঘ তর্জ্জনী আছে, সে দেখিল আপনার ধুনিতে সূর্যের যাত্রাপথ পুড়িয়া খা হইয়াছে।

সে নাসিকা কুঞ্চিত করে–আমরা জানি যে ঐ ধুনিতে পানপাত্রের কিনারের আঙুরলতা কেয়ারী করার সভ্যতা দাহ্যমান, মানুষ নিজেকে ভালবাসার নামে নিজেকে সজ্ঞানে যে তামাসা ব্যঙ্গ করিয়াছে– কত না ব্যঙ্গ উক্তি রচনা করিয়াছে–তাহারই পোড়া গন্ধ আপনার অনিৰ্ব্বাণ ধুনি হইতে নির্গত, ধূম্রজাল অনেক ঊর্ধ্বে উঠে, ইহাতে উজ্জ্বল হংসযুথ বহুদূর হইতে নিশানা পাইতেছে অথচ চন্দ্রসূর্য নক্ষত্রাদি বহুকাল হয় আপনার দিমণ্ডলে নাই–এই জটিল ঘটনা আবৰ্ত্ত কথা যেন সেই বালকও জানিয়াছে, কেন না সে নিশ্চিন্ত ছিল। অথবা এইজন্য সে স্থবির যে আপনার দর্শনে অবশ্যই সুদুর্লভ স্পন্দনরহিত যাতনা তাহাতে যেমন প্রভাবিত হইয়াছে!

অভ্রান্ত ইহা যে আপনার দিব্যদেহই পূৰ্ব্বদৃষ্ট সেই শোভাযাত্রার গূঢ়তম মন্ত্রগুপ্তি এবং যে আপনি অলৌকিক নগ্ন, আপনি অজর দুঃখবোধ, অলৌকিকী দুখের দুখী আপনি…হে মহাত্মন, হে ভেদজ্ঞানহীন, এখন যদিস্যাৎ অভেদজ্ঞান বিচারে সেই বালকটিরে নজর করিয়া থাকেন, আপনি লোকহিতকামী সৰ্ব্বজ্ঞ বলুন সেই অল্পবয়সী, যে বালকত্বে অপরিসীম, সে কোথায়?

.

ঐ মহাপুরুষের ধুনি গন্ধে সুঘরাই নাসিকা আবার কুঞ্চিত করিতেই সে শুনিতে পাইল তালপাতা পথের কাঁকরে ঘর্ষণে ভারী বিশ্রী আওয়াজ উঠে…পরক্ষণেই প্রতীয়মান যে ঐ তালপাতার উপরে একটি মৃত কুকুর বাঁধিয়া রাখা; এক অদ্ভুতদর্শন লোক, অনেকাংশে তাহার ভগ্নীপতির মতন দেখিতে, এক দীর্ঘ তালপাতার ডাঁটা ধরিয়া টানিতে থাকিয়া মন্থরে আসিতেছে, লোকটি চমৎকার কণ্ঠে গান গাহে এবং কোঁচড় হইতে মাঝে মাঝে যেন কি খাইতেছিল। পথচারিগণ মৃতের পচা দুর্গন্ধে নাকে কাপড় দিয়াছে, থুথু ফেলিতে ফেলিতে চলে।

ঐ বিষমত্বে অন্যপক্ষে সুঘরাই যেন জমিয়া উঠিল, ইহা তাহার নিকট অন্ন, ইহা জল! সে মুষ্টিবদ্ধ করিল, তাহার ক্রন্দনের কোনই কারণ নাই, সে নিবিষ্টচিত্তে ইহা লক্ষ্য করিল যে অনতিদূরে এক গাড়ঢ়ায়ে সেই মৃত কুকুরটিকে ফেলা হইল। তখনই সে যেমন বা নিজের সূত্র পাইল, তখনই দ্রুত পদসঞ্চালনে সে সেখানে–যেখানে আর কিছুকাল পরেই শকুন আসিবে; ধৰ্ম্মত সে আপনার অহঙ্কার ফিরিয়া পাইল, তাহার অজ্ঞানতা! পুনরায় লাভ করিল, পচাগলা পূতিগন্ধময় যাহা কিছু তাহার সহিত তাহার কি অবিচ্ছেদ্য যোগ! সে সুখী, সে হারাইবার নহে।

যেখানে, চাতালেই, কোন অতীব নিষ্ঠাবান আচারী ব্রাহ্মণ, সূৰ্য্যকে যিনি একাগ্র মনেতে জল-অর্ঘ্য দেন, ইহারই নিকট, ঐ কৰ্ম্মানুষ্ঠানশেষে ঐ সুঘরাই কল্পিত রীতিতে মনিব মহাশয় অবতারণা করিলেন–এক ছেলেমানুষ চপলমতি আপনকার অধরের প্রহেলিকাময়ী কম্পন হেরিয়া ও যুগপৎ সূৰ্য্য তথা নভোস্থল প্রতি নেত্রপাতে কিছু এক সমাধান উদ্দেশ্যে এতই অচেতন থাকে, যে তাই অসাবধানবশতই, আপনারে ধাক্কা দিয়ে ফেলে; তৎকালে আপনি, হে মহানুভব, তাহার দিকে ঈষৎ তাকাইয়া ঝটিতিই আবার কৰ্ম্মানুষ্ঠানে ব্যর্থ হন; অন্যপক্ষে সেই বালক কৃশ হওয়ত, রুগ্নবদনে, কিছু এক বোধ তাহার এই বিচ্ছিন্নতায় নিতান্ত দরকার কেন না আপন অন্তঃস্থিত অন্ধকারকে সে ভয় পাইতেছিল এবং তাই অন্য বোধ অভাবে কিছু সময় নিজ দুষমনী বোধে নিশ্চল ছিল–কেন না যে সে হয় জাতিতে ডোম।

তবু সে এইটুকুন তাহার সপক্ষে বলিতে নিশ্চয়ই একশা, যে তাহার দিকের খবর নাই, এমনও যে, এখন দিনমান কিম্বা নহে ইহা, অথবা কোনটি তাহার বাম হাত তাহা, সারা কিছুই উহার জ্ঞানকাণ্ডবহির্ভূত অধুনা; যেহেতু সে আমাদিগকে আকুল হইয়া খুঁজিতে আছে; বেচারী দৈবদুর্বিপাকবশত আমাদের কাছ-ছাড়া, আমাদের সান্নিধ্য হইতে বিচ্ছিন্ন। সুঘরাই তাহার নাম, বেচারী হারাইয়াছে–হ্যাঁয় যে ষড়ৈশ্চৰ্য্যশালিনী নগরীতে মানুষ আপনারে ফিরিয়া পায় সেইক্ষেত্রে সে হারাইয়াছে, এখন যদি…।

এই অবধি ভাবিতেই সুঘরাইএর চোখে মোহিলির বহু পুরাতন শতচ্ছিন্ন জুতার ন্যায় মুখোনি প্রতিভাত হয়; এখন মোহিলি হয় একজন গো শকট চালক। যেটিতে সে এবং মনিবদ্বয় আরোহী ছিল, মুখ্যত ইদানীন্তন বিপর্য্যয় ও দুর্গতি মোহিলির নিমিত্তই।

যে যাহা এই যে, গরুর গাড়ী রিখিয়া হইতে বেশ আসিয়া উত্তরিল বিলাসীর চৌরাহাতে–যে স্থলে পুবে দুমকার রাস্তা, পশ্চিমে জসিডি বরাবর; যেখানে তাহারা সকলেই–যখন, হর হর মহাদেব, জয় বাবা বৈদ্যনাথ ধ্বনি দিতে যাইবে, তৎসহ গললগ্নীকৃতবাস মনিবপত্নী সন্নিহিত বেলবৃক্ষের পত্রোদগম শোভা দর্শনে ‘আহা বলিবেন, যথার্থ লকারী ধ্বনি সেইখানেতেই; অতর্কিতে কূৰ্ম্মপৃষ্ঠ জমির শীর্ষভাগে, দেখা গেল কে একজনা ভূমি ছাড়িয়া অনেকটা লাফ বারম্বার দিয়া উঠে; লম্ফকারী সেইজন আপন বক্ষঃদেশে ঘন ঘন চাপড় মারিতে একটি হস্ত দ্বারা আঘাতিছে, এবং সে বেদনায় চীৎকার পাড়ে, কান্না যেমন, কিন্তু চোখে জল নাই; আর ‘ওহহ সুঁই’ কম্পিত কণ্ঠে বলিয়া উঠে।

এতাদৃশ সংঘটনে ভোরের মনোলোভা সমীরণ স্তোভ ছিল; এতাদৃশ নাটকীয়তায় শহরগামিনী সারিবদ্ধ সাঁওতাল রমণীকুলের গতি ব্যাহত হইল, ঐ লোকটির কিম্ভুত ব্যবহারে দারুণ আকৃষ্ট যে উহারা, উহাদিগের সুমহান মুখমণ্ডলে অবিশ্বাস্য ত্ৰাসজনিত কাতরতা আছে, উহারা আতঙ্কে তাই, যে তদানীন্তন কালেও তাহাদের কবরীস্থ ফুলসকলে আপন আপন অঙ্গুলির মঞ্জুল সোহাগ দিতে থাকে।

যন্ত্রণায়ে উৎক্ষিপ্ত লোকটির ছায়া আরবী হরফকার কাটিতেছিল, তজ্জন্য প্রায়শ ভগ্নস্বরে তদীয় সুতীব্র নিনাদউও হো পুঁই!

কথাটি আরও বিভীষিকা হয়। পুঁই শব্দ শ্রবণেই মোহিলি অব্যর্থই যে উৎপাটিত, গরুর দড়ি ছাড়িয়া কর্ণে অঙ্গুলি প্রদানিল; সৰ্ব্বনাশী আতঙ্কে উহার শিয়রে-বাঁধা গামছা খসিয়াছে, তথৈবচ অভিব্যক্তিতেই সে কহিল,–গে মাইরে হা মো কপহাড়! এবম্প্রকারে মহা আর্তনাদ করিল; এখন উহার খুদে চক্ষুদ্বয় হাঁইয়া হ্যাঁদা হইয়াছে, বুঝাইল, সে আর আগাইবে না।

সুঁই সুঁই রব চারিদিকে; ইহাতে সকালের আকাশে খরা, পথগুলি হইতে পরিপ্রেক্ষিত মুছিয়া গিয়া কোথাও নীলিমার ভাবান্তরে করবী ক্কচিৎ; সুঁই-এর ভয় মড়ক-অধিক, এ কারণ যে, তাহারা যে যারপরনাই কাঙাল; পুঁই এক ভয়ঙ্কর রক্তচোষা, যে যাহার ব্যথায় দিন কয়েক নির্ঘাত অপটু তাহারা হইবেক। ইহারা শহরের কৰ্ম্ম অন্বেষী; বেচারীরা প্রত্যেকেই ‘হা হতোস্মি!’ বিলাপে, ঐ শহরের প্রতি বড় গুঢ়তম বুক ভাঙা নয়নে চাহিয়া প্রত্যাবর্তন করিবে এখনই।

জনৈক ঐ উজ্জ্বল শহরের প্রতি তাকাইয়া, যে যেমন লোকপ্রসিদ্ধ বিরাট সনাতন দেউল তাহাতে সম্যক বিম্বিত-সুতরাং, সে আপন হৃদয়াবেগ জ্ঞাপন করিল, পাপ! আমাদিগেরই পাপ, বাবা বৈদ্যনাথ দেবাদিদেব, কিন্তু কে সেই জন যে এরূপ বিশ্বাসঘাতকতা করিল যাহাতে বহু কোল নিঙড়াইবে, বহু ছন্নছাড়া হইবে; হায় কে এরূপ বিশ্বাসঘাতকতা করিল–সে কত বড় পামর! যে, সে যদি শহরবাসী হয়। তাহাকে ধিক্‌, সে যদি বাহিরের মফঃস্বলের তাহাকে শত ধিক; তুমি বাবা বৈদ্যনাথ থাকিতে এত পাপ! জানি শত কুঠার আঘাতেও সুমহৎ বৃক্ষ যেমন ছেদনকারীকে ছায়া দিতে নিস্তেজ নহে, তদ্রূপ তুমি…কিন্তু আর ক্ষমা নহে তুমি জাগ্রত, তুমি ইহাদের তোমার ত্রিশূল দ্বারা খণ্ডিত কর, সেই বিশ্বাসঘাতকের সমুচিত শাস্তি বিধান কর। আমরা শালা জাতে অধম ছোটলোক, আমরা আলেখ কীড়া, অনেক জন্মাই অনেক মরি, আমরা রোগের ঘর…কিন্তু অদ্য, সূৰ্য্য সাক্ষী, আমরা কোন রোগ বহন করি আনি নাই। আমরা দীন, আমরা অভুক্ত, শহরের যাহা অসৎ তাহা দূরে লই, আমরাই অসৎ…এ সময় ধান পাকিবে, বহু অচেনা পাখী আসিতেছে, কুয়ার জল যেক্ষণে স্বচ্ছ, এ সময় পুঁই! ভীতি আমাদের সম্বল, আমরা ভীত, আমরা কাঁদিয়া থাকি।

সুঘরাই উক্তিসকল যেমত দেখিল; আর মোহিলি এখন, মনিবদের পীড়াপীড়িতে, উপরন্তু ইত্যাকার আশ্বাসে যে–ইহা সুনিশ্চিত শ্মশানের অপর পার্শ্বে দুধ-কাড়া ভণ্ড সাধুর ডেরা, যে প্রতি গোয়ালার নিকট হইতে আদায় করে, আস্তানার কাছেই সুঁই-এর ডেরা পড়িয়াছে, ফলে এক রশি মতন রাস্তা মোহিলি অগ্রসর হয়; পথ নিঝুম, গাড়ী রুখিয়া মোহিলি নামিল; শনৈঃ অত্যধিক সন্তর্পণে, পদক্ষেপে, শ্মশানাভিমুখে সে চলিতে থাকে; এবার সে অনেক নিসিন্দাও আতা গাছের আবডালে, তদৃষ্টে সুঘরাই মেরুদণ্ড টান করিল।

অনন্তর কিছু সময় বাদে নিদারুণ বিকারগ্রস্ত মর্মন্তুদ নখিলা রোল শ্রুত হইল, যে যাহা ক্রমে পশ্চিমের নাবাল ক্ষেতে সরিয়া অল্প রেশ সম্প্রতি, কেহ সেখানেতে ছুটিয়া আছে, সে আপাতত থামিল, দেখা গেল সে হয় মোহিলি, যে এবং গরুর গাড়ীর দিকে মুখ করত জানাইল সে-শহরে যাইবে না, সুঁইওয়ালারা শ্মশানের এই দিকে, তাই ডরে আমি রাস্তা ত্যজিয়া ক্ষেতে, যে আমি মাটির যাতনা বটে, বড় কাঙাল বটে, আমি পলাইব, পলাইব হে!

.

মোহিলি না-বাগমানিতে মাথা দুলাইল, পরে মনিবদের যথোচিত ভদ্র সুসঙ্গত অভয়বাক্যে মোহিলি সতর্ক চলনে ক্ষেত হইতে এখানে সন্নিহিত হইল, তাজ্জব যে, আপন চুটা ধরাইতে মনিব মহাশয়ের কাছে দেশলাই মাগিল; পরক্ষণেই ভূতচালিতের রকমে সে বাঁচাল, আরম্ভিল–হে রে শাললোঁ হরিজনরা, যে বেটা দুষমনরা চিনি যে কি তাহা জানে না, যে শয়তানরা হাঁটুর নিম্নে কাপড় পরিতে ভয় পায়, যে হাজতীরা (হাজতে থাকে) বাপকে শালা, আপন পুত্রকে খচ্চড়, দিবানিশি সম্বোধন করে, যাহারা মহিষের মাংস খায়, যারা ভাগাড়চারী শকুনের সহিত দাঙ্গা করে, মরা পশু খায়, হা মরি তাহারা লইবে মন্দিরের দখল! ঐ শালো হরিজনদের জন্যই এই সুঁই।

হে বাবা বৈদ্যনাথ তুমি যদি সত্য, তাহা হইলে সুঁই-এর পরও তাহাদের কলেরা হউক, যে চিঠি তাহারা করিয়াছে তাহারও কলেরা হউক, সবংশে তাহারা নিধন হউক; এখন শালা চরকাবাজরা সুইবাচক। যাহাদের পাপে মেঘ অবধি বাঁজা হয়–ডোম চামার মেথর হাড়ি পাশি, যত শালা মাতাল ডুমনীখোর বদমায়েস, আংলিস খচ্চড়, গরুচোর ধানচোর, ও হো হো আমি জাত ভাঁড়াইলেও আমার সুরত দেখিয়া চিনিবে যে, ওহো সুঁই গে মাই, আমার আগে আমার ছায়া পর্যন্ত যাইতে–যাহার নামেই ডরে, দেখুন হে আমার ছায়া বটে কীদৃশী ভয় পাইয়াছে, দেখুন উহা আমার পিছে মুখ লুকায়। অহো বাবা বৈদ্যনাথ দেখ, আমার তরাস এখন আছে, তুমি ধন্য।

তথাপি যে মনিবরা অজস্র সাধ্যসাধনা করিলেন, হায় কোনই ফলোদয় ঘটিল না; সুঘরাইএর দেহে সিঞ্চি উপস্থিত, বধির কেরেট সাপ যেমন তাহার আশেপাশে, স্বীয় গ্রামের লোকের এরূপ ভীতি দর্শনে সে নিজেই দুর্বোধ্য হইয়াছিল; ইদানীং সে চামার মোহিলির মুখমণ্ডল পাঠে সম্যক উহারে বুঝিয়া লইতে ব্যগ্র থাকে; এই সেই চামার মোহিলি যাহার বাড়ীতে বিলাতী আমড়া গাছ আছে, যে হয় খুবই ঢ্যাঙ্গা, যে খুবই রোগা, যে হয় হাড়সার, সব তেমন তেমন আছে বটেই, তবে যে কি যেন উহাতে ছিল না।

যে তাহা ইহা, যথা যে–সেই যে চামার মোহিলি, যাহার বশে কত প্রেতাত্মা, যাহাকে কতবারই না দুর্বোধ্য ছড়া কাটিতে সঙ্গেই কুশ-পেয়ের ন্যায় পা করিয়া ইব্রাহিম মিঞার ভুটে ঘোড়ার মূত্র ঝিনুকে সংগ্রহ করিতে দেখিয়াছে; যাহাকে দেখিয়াছে ঐ মূত্রপূর্ণ ঝিনুক হাতে তদ্রূপ ছড়া উচ্চারণে, যে সদ্যজাতক-কে ইলড়া ভূতে পাইয়াছে অথবা যাহাতে না পায়, তাই উহা খাওয়াইতে গিয়াছে–ইহা তাহাদেরই মারণ ঐ জাতীয় ভূতের! যাহারা নবজাতককে বিকলাঙ্গ করে, দুমড়াইতে থাকে।

ঐ ঝিনুকসহ তাদৃশ কায়দায় মোহিলির মন্থর গমন, কি পর্য্যন্ত ভাব গম্ভীর, যে সে এতটুকু ভ্রুক্ষেপ কিছুতেই করে না, উহার পিছনে তখন গাছে পায়ে ভীষণ ভূতুড়ে দৌরাত্ম্যর শব্দ ও কাণ্ড ঘটিতেছে; কি আশ্চর্য্য রহস্য সে! আর এই সুঁই ব্যাপারে নিজেই শঙ্কিত, বেপথু শরীর উহার! ইহাই কি সেই মোহিলি যে যাহার ঘুনসীতে সকলের শুভাশুভ বাঁধা নিশ্চিন্দি, যে যাহার চৰ্ম্মে জনাজাতের ঘুম লাগিয়া থাকে। রাত্র যাহার দাসানুদাস।

মোহিলির বহমানতা লুপ্ত হইতেই, এতক্ষণকার, সেই রিখিয়া হইতে যাত্রা প্রীতিময়, যাহা উদ্দীপনায় নিশ্চিহ্ন বিশেষত এই কারণে যে একদা মোহিলি জানাইয়াছিল, যে এক একজন সন্ন্যাসী মহাপুরুষ আছেন যাঁহারা তত্ত্বদর্শী, যে রহস্য তুমি শুনিয়াছ তাহার সবিশেষ তাৎপৰ্য্য জিজ্ঞাসুকে তাঁহারা বলিতে পারেন, বৈদ্যনাথে যখন যাইব তখন আমরা, তুমি আর আমি, তেমন তেমন মহাপুরুষ দেখিলে তাঁহার নিকট নিবেদন করিব, ইহাতে আমরা জন্মান্তরে উঁচু ঘরে জন্মাইব। আমরা নিশ্চয়ই জন্মাইব…।

ইহাতে কি যেন ভাবিয়া সুঘরাই কহিল,–যদি উহা শুনিয়া অচৈতন্য হয়!

মোহিলি উত্তর করিল–জানি তাঁহারা অজ্ঞান হইবার নহে।

যদিও মোহিলি এই কথার মধ্যে মধ্যে কাশিতেছিল তবুও সে আবছায়া সুঘরাইএর চোখে এবং ঐরূপ প্রস্তাবে তাহার, সুঘরাইএর দেহ নিয়মরহিত: এবং সুঘরাই অন্যত্রে, তখন সে প্রত্যক্ষ করিল, অদূরস্থিত সৌখীন টেবিল ল্যাম্পের আলো আশ্চৰ্য্য অহেতুক হঠাৎ বর্ধিত হইল। ইহাতে তাহার কণ্ঠস্বর ব্যাহত নয় যাহা একটানা ভিখারীবৎ ছিল; দ্বারদেশে থাকিয়া সে ঐ রহস্য কথা বলিতেছিল আর যে তাহার পশ্চাতে দরজায় উৎকৃষ্ট চিৎসের ফুলকারী পর্দা উড়িতে থাকে এবং বাহিরের সাঁওতাল পরগণার বিচিত্র অন্ধকার অনুভব হয়।

চিপ এণ্ড ডেল রীতিবিশিষ্ট ছোট লেখার টেবিলের সামনে মনিবপত্নী, যিনি এখন পুত্র ও কন্যাকে চিঠি লেখেন, হালকা ফলসা রঙের চিঠির কাগজের পাশেই তাঁহার বাঁ হাতখানি আড় করিয়া রাখা যেন কোন প্রসিদ্ধ আর্টিস্টের কাজের খানিক, কিন্তু অঙ্গুরীয়র চুনীর উজ্জ্বলতায় ঐ ভাবনা আর থাকে না, মনে হয় ইতিহাস একদা ভয় পাইয়াছিল; ডান হাতের কলমটির প্রান্ত তাঁহার সুমহৎ অধরে ছোঁয়ান; সামনে চমৎকার গিল্টকরা ফ্রেমে, নাবিক পোষাক পরিহিত কিশোর বালকের ছবি ও ইহারই পাশেই, একই ফ্রেমে, বালিকা কন্যা মেষপালিকার বেশে–এই কল্পনাকে তাহার জীবনপণ নৈতিকতায় বাঁচাইবে–আর তাহারা ঝরণা দেখিতে ছুটিয়াছে!

যেহেতু ইহাদের ঐ পুত্র কন্যাকে সুঘরাইএর পক্ষীবৃত্তান্ত জানাইবার জন্য মনিবপত্নী উন্মুখ ছিলেন। সুঘরাই বর্ণিত আছে, স্বরে তাহার জড়তা নাই, কিন্তু ছোট দেহখানি তাহার অস্বচ্ছন্দ, সে কহিল– মোহিলি অদ্ভুত গলায় বলিল, এখন তোমার পাখীতে যে রহস্য গোড়া বাঁধিতেছে সাবধান!–এবং তাহার জবানীর মধ্যেই টেবিলস্থ আলো কেমন করিয়া উঠিল।

মনিবপত্নী এই কথা শোনামাত্র চেয়ার ছাড়িয়া দণ্ডায়মানা, তাঁহার দেহ কোন প্রহেলিকা প্রভাবিত মৃদু টলিতেছিল, ফুলদানীর গোলাপগুলি, যেগুলি অনেক অনেকদিনই ভাবানুষঙ্গর সূত্র, তাহাদেরকে তিনি তদীয় সুষমামণ্ডিত বাম হস্তে আঁকড়াইতে চাহিলেন এবং শুধুমাত্র বলিয়া উঠিলেন, শুনছ শুনছ শিগগীর!

ইহাতে তখনই পাশের কক্ষে একটি কাঁচের গেলাসের আঘাতের আওয়াজ হইল; পরক্ষণেই মনিব। মহাশয় আসিলেন, আজ্ঞা করিলেন সুঘরাইকে, তুই যা। ইহা বলিয়া তদীয় সহধর্মিণীকে ধরিতেই যিনি অচৈতন্য হইলেন, সাবধানে চেয়ারে তাঁহারে বসাইয়াই তিনি স্মেলিং সল্টের শিশিটি আয়না দেরাজ হইতে তুলিয়াছিলেন; এবং অতঃপর ও-ডি-কোলনের এটমাইজারটি লইয়া কহিলেন, না না উঠিও না, মাথায় কাপড় দিবার কোন দরকার নাই…আবার সযত্নে তাহাকে বসাইয়া দিয়াছিলেন; পর্দায় ছায়া পড়িয়াছিল।

এবার এটমাইজারের শব্দ সহিত মাধব নাম উচ্চারণ করিতেছিলেন, কিছু বাদে মনিব মহাশয়ের ধীর আক্ষেপ শ্রুত হইল,…আমি ঐ ঘর হইতে সবই শুনিতেছিলাম, বুঝিয়া পাই না মধু ও রিলিকে এ খবর দিবার কি…অবশ্য সামান্য পাখীর পিছনে এ কথা থাকিবে তা তুমি বা কি করিয়া জানিবে…..মাধব তারা ব্রহ্মময়ী!

তন্দ্রাচ্ছন্ন মনিবপত্নী কহিলেন–আমি ভেবেছিলুম ছোঁড়া জঙ্গলের গল্পই বলে থামবে’খন! অতঃপর বলিয়াছিলেন, আ মোহিনী মায়া!

ক্রমে যে, পাখীর ব্যাপার সুঘরাইএর শুধুমাত্র অন্যমনা হওয়ার কারণ হইয়াছিল, সে এক কালো-র দিকে চাহিত, এক অচৈতন্যতার দিকে চাহিত; বৈদ্যনাথধামে আসিবার সুযোগে মন্দির দেখা ও বিবিধ অনুষ্ঠান প্রতি আগ্রহ ছাড়াও ইহা–এই মনোভার হাতে প্রচ্ছন্ন ছিল।

তাহা এই যে বহু পুরাতন সাধনলব্ধ আধ্যাত্মিকতাকে জড় তত্ত্বের উপর–যদিও যাহা এখনও বিস্ময়ের এবং আপাতত তাহা ভীতির–তাহার উপরই আবোরাপ করিতে পারিবে; যেমন শিল্প ধৰ্ম সরলতা প্রকৃতিতে আরোপিত হয়।

ভক্তিপ্লুত ভগবদারাধনায়ে তীর্থযাত্রার মধ্যে অনতিদূরস্থ ঐ বৈরাগ্যজননী অমৃতবর্ষী শহরবিষয়ক যে ধারণা তাহাতে, সুঘরাইতে, উথলিত ছিল, উহাই অধুনা অসহ্য ফোটকে পরিণত হইল; এখন যে মনিবরা নাই, আসমুদ্রহিমাচলখ্যাত মন্দিরের শীর্ষ দেখার মানসিকতা অবলম্বনহীন অব্যক্ত গোঙানি হইয়াছে; যে এবং সম্মুখের গোটা শহরই রিখিয়ার যে-সিজিনের বাড়ীর তুল্য ফাঁকা, যেখানে তাহার কণ্ঠস্বরের হরেক প্রতিধ্বনি হয়, এখানেও তেমনই হইতেও পারে।

অন্যদিকে মোহিলি ধাবনৌৎসুক্যে দড়বড়ি গরুগুলি ঘুরাইতেছিল এখন, তৎকালে সুঘরাই উহারে, মহাজন এরূপ, তাহার নাড়ী অর্থ, নির্ঞ্ঝাট আশ্রয় যথা, আত্মিক পারিবারিক কেহ ঈদৃশী সমঝে আছে; অথচ যুগপৎ সে নিজে এমত কোন প্রদেশে, যেখানে মৃত্তিকার জঠর নাই, বুদ্বুদের অন্তঃস্থল দিয়া কোন আহ্বান ভেদ করিতে অকেজো, সে বড়ই একা, ল্যাংট, তাহার ভয়ও তাহাকে ত্যাগ করিয়াছে।

এবং মনিব বলিতেছিলেন–আজব বুনো, জংলী!

মোহিলি যাইতেছে; সুতরাং উপায়রহিত সুঘরাই এই বিচ্ছেদকালীন মুহূর্তে, চামার মোহিলির অবয়ব যেন খানিক রহস্য কুহক চরিত্র তীক্ষ্ণ গভীর দৃষ্টি-দ্বারা সাহস টানিয়া লইতে বদ্ধপরিকর হইল, কিন্তু হা হন্ত মোহিলির যাবতীয় গোপনতা যে ধর্ষিত হইয়াছিল। অথচ মোহিলিকে এখন কি খাসা দেখিতে, ভয় তাহাকে সুন্দর করিয়াছে–আর সে তাহা প্রত্যক্ষে অবাক!

মনিব মহাশয় কহিলেন-তীর্থে আসিয়াছি তাই কিছু বলিতে চাহি না, নিশ্চয়ই বৈদ্যনাথের ইহা অভিপ্রেত! ও আপন পত্নীকে বলিলেন, তখনই বলিয়াছিলাম সহিসের জ্বর ছাড়ুক তখন না হয় বৈদ্যনাথে আসিব।

ইদানীং সুঘরাই, কাষ্ঠচ্যুত কূৰ্ম্মবৎ অবস্থায়ে যে সে, ইহা অনুমান তাহার হয়; তবু সে ভাবে ইতঃমধ্যে অবশ্য, যে মোহিলি, আপনার চমকপ্রদ ভীতি যাহার কণামাত্র খোয়া যায়, তাহা লইয়া ক্রমাগত আপনার রহস্যের অভিমুখে সেই গানখানি গাহিতে থাকিয়া হাল্লাঝুরি পার, মাঝে মধ্যে গরু জোড়া হাঁকানোর শব্দও হয়:

পিয়া যব যাওরে রিখিয়াকে হাটিয়া
কুছ কিন্‌ইহ নুন তামাকুল
কুছ কিন্‌ইহ ধন্‌ইয়া—বল্‌
হা পিয়া হা পিয়া হামরা খাতির মুখ মুছানির গামছা কিনি লিয়া
পিয়া পিয়া যব যাওবে…।

আঃ কি খাসা গীত, কাঁড়ার (মহিষের) গললগ্ন ঘণ্টির ধ্বনি, এ-গেননুয়ারে ডাক, শেষরাতের মোরগের ভাঙা স্বর, ছায়ার পরিবর্তন, শীতের কুয়ার জলের উষ্ণতা, সর্পের গতি সবই ঐ পদবন্ধের ভাবেতে আছে; এমনও কি ঐ গীত-জাত উদ্দীপনার মধ্যে-নোসটালজিতে; সান্ধ্যভ্রমণের চেঞ্জাররা, কমেডির ভুল উদঘাটনে–জানার হেতুতে যাহারা নিশ্চিন্ত বিশ্বাসে এবং যাহাদের কর্তব্য আপনি স্থিরীকৃত, সুখে ভ্রমণ করে; স্থানীয় খুন খারাবী হওয়াতে তাহারা বীর।

ইহারাই, চেঞ্জার তাহারা, যাহারা আধো চন্দ্রালোকে নিঃসঙ্কোচে এক ইউক্যালিপটস গাছের নিম্নে সমবেত হইয়া দাঁড়াইয়া পাতার আওয়াজ শুনিয়াছে, সকলেই চুপ ছিল, একাগ্র থাকে; কেহ নিষ্ঠ হইতে কারণে চশমা মুছিয়াছিল; অল্পবয়সী ও শিশুতে চপলতা নাই; পাতার আওয়াজ হয়!—ধিক্‌ তাহাদেরকে যাহারা ইউক্যালিপটসের উপকারিতা বিনাইয়া থাকে! তাহারা অধৰ্ম্ম করে–এইরূপে চেঞ্জারদের অনেক সময় গিয়াছে।

একদা কেহ ঘড়ির রেডিয়ামের স্পষ্টতা লক্ষ্য করত কহিলেন,কবি বলিয়াছিলেন, প্রকৃতিতে ফিরিয়া যাও। ইহা হাস্য উদ্রেক করে নাই কারণ ইহা ব্যক্ত করিতে কুহক স্বরভঙ্গ ঘটিয়াছিল–যাহা মিনতি ও কাতরতা মিশ্রিত, ইহাতে সকলেই বহু ঊর্ধ্বে ইউক্যালিপটসের হাল্কা পাতাগুলির দিকে– এইগুলি গাছটির স্বদেশ, ঐদিকে চাহিয়া অনুভব করিলেন যে তাঁহারা সকলেই ক্লান্ত; ইহা কলিকাতার ক্লান্তি; অথচ ইহা ঠিক যে তাঁহারা এখন বৈদিক আত্মসমালোচনার বাহিরে, অতএব এই তত্ত্ব নিশ্চয়ই বিচারিত হয় না, যে অনাসক্তের বীজ লইয়া তাহারা কেবল দৌড়াইয়াছে। (দৌড়াইয়াছে শব্দটি কত কত মাটির, অথচ এ ক্ষেত্রে? আঃ মানুষের নশ্বরতা!)

ইহারাই কি-সেই যাহারা শূন্য-কে ছিল বলিয়াছে!…

পুনরায় শ্রুত হইল প্রকৃতিতে ফিরিয়া যাও! ইহাতে, এই বাক্যগঠনে চোরা রাজসিকতা আছে, দর্প রহিয়াছে, যে প্রকৃতির বাড়ী যেন আদিবক্তার নখদর্পণে! এবং এখন তাহারাও ঐ সকলেরা, আত্মম্ভরিতায় পৌঁছাইয়াছে, তাহাদের প্রশ্বাসে পত্ররাজি শুষ্ক হয়।

তাহারা চরিত্রকে ছাড়াইতে পারে নাই, মানুষ কি আলেখ নেশা! ঐ গীতে এই সকল কিছু–যেই কেন উহা ঐ গীত হউক, যে চাঁদ অস্থির হইবেক; ঐ গীতের দিকেই সে বেচারী সুঘরাই আছে, তাহার পোষ মানা ভয় আছে, তাহার ঘর যে এবং, এখন এই ভাবনা প্রভাবিত হইয়া সে সুঘরাই অধিক হতাশায়ে সজল নেত্রে উত্তরের আকাশের ঠিক লইল, যে কেমনে সে যে বাড়ী ফিরিবে; এখানকার এই শহরের সমস্ত বস্তুই, ও যাহা যাহা কল্পনাসাপেক্ষ, শ্বাসরুদ্ধকারী বিরাট অহরহ, ভিখারী কুষ্ঠরোগীর ক্ষতে ক্ষিপ্ত কুকুরের মাড়ি দেখা যায়, প্রতি কিছুই করাল উত্তঙ্গ প্রাচীর; রিখিয়া চার ঘুমের পথ, হাটবারে ছাড়া চিঠি বিলি-না-হওয়ার দূরত্ব বৰ্ত্তাইয়াছে; সুঘরাই মাটির উপর চলিতে চাহিতেছিল, যে মাটিতে জেংগীল পাখী বসে, ডাকে; পায়ের তলায়ে সে চাহিয়াছিল মাটি, শহরে যাহা মাথার উপর; এ। শহরে মাথা ঠুকিয়া কান্দিবার সুযোগ নাই; হাস্য অনুমোদিত অথচ।

হঠাৎ এই বৈলক্ষণ্যের সময়েতে তাহার কানে গেল, কোন শুদ্ধাচারী বলিতেছে, যত শালার ঘোট জাতের মরণ, ছুঁইও না ছুঁইও না! তৎক্ষণাৎই সরিয়া দাঁড়াইবার মতন জন্মগত সৎ স্বাভাবিকতা তাহাতে কাজ করে নাই; যে যাহা, যদি সে বৃক্ষশীর্ষে থাকাকালীন অমন তাড়না শুনে, তবে ঝটিতিই সে মান্য করিতে উদ্যত হইতই; কিন্তু এখানে তাজ্জব এই, অচিরাৎ বেশ তিলেক পরেই, উক্ত তাড়না নিমিত্ত, দেখা গেল যে সে কান নাক মলিতেছে আর ছুটে। সে জানিতে চাহে না ঐ তাড়না কাহার উদ্দেশে, অবশেষে এবং যে সে বেসামাল, এবং সে পতিত। তদবস্থ সে পশ্চাতের পানে ত্রাসযুক্তলোচনে ও তৎক্ষণাৎ খুসীতে বারবারই নজর লইয়া থাকে।

আসলে, অপ্রাকৃতিক ভয় যে কি কারণে, খুসী যে কি জন্য, তদ্বিষয়ে ভ্রু কুঞ্চন এমনও যে ঘটে নাই, যেহেতু অদ্ভুত ঘোরে, রন্ধ্রগত সে ছিল, তাই যে সে খালি প্রতি পদক্ষেপেই বলিতেছিল—শাঁলো হারামজাদা চামার মোহিলি মানুষের জুতা হইতেও জাতিতে নীচু, তোমার জন্যই অদ্য আমার এই দুর্দৈব! ক্রমে এইরূপে সে নিজেরেও হতভাগ্য নরকের কীট কহে, নিজেকে অভিসম্পাতে নিপীড়নে। অবিরাম হেয় করিয়াছে। সে এইভাবে কোথাও দাঁড়াইতে চাহিতেছিল কেন না অনবরত সুঘরাই এর মনে হয় সে যেন বা মিলাইয়া যাইতেছে।

নিশ্চয়ই মোহিলির খবর বিভীষিকা হইয়া তাহারে আঁচড়াইতেছিল। যাহা যে শেষরাতে যখন বৃক্ষাদিও ঘুমায় তখন শিব নন্দীভৃঙ্গীসহ শিবগঙ্গায় স্নানে আসেন, যদিস্যাৎ কেহ তাহা দেখে সে। কামারের চুল্লীর স্ফুলিঙ্গের মত নস্যাৎ হয়। ইহা মোহিলি দারুণ অঙ্গভঙ্গীকরত ব্যাখ্যা করে, ফলে সুঘরাই দেখে সমস্ত প্রকৃতি পর্যন্ত ঘুমাইয়া পড়িয়াছে, শুধু সে জাগিয়া আছে।

উপস্থিত-মোহিলিসুত্রে তাহার সমক্ষে অনেক কিছু আভাসিত হইল, যাহা যথা–মোহিলি গাড়ীর মুখ ফিরাইতে তখন হন্তদন্ত, আর যে সুঘরাই দণ্ডায়মান মনিবের জুতা জোড়া বুকে ধারণ করিয়া আছে–কেন না দেবদর্শন যাত্রায়, তীর্থে, উহা নিষিদ্ধ–এখন অপ্রত্যাশিত রোমাঞ্চিত বিধায় অসাবধানে একটি জুতা মাটিতে, অবশ্য সে তখনই তাহা কুড়াইয়াছে, কিন্তু এই কৰ্ত্তব্যবোধের মধ্যেও সে বিচাল্যমান ঈষৎ হইয়াছে; যে মোহিলির প্রত্যাখ্যানের নির্দিষ্ট মুহূৰ্ত্ত হইতে আপনারে মারাত্মক নিঃসঙ্গ বলি তাহার বোধ হয়; যদ্যপি সে হয় ডোেম, তৎসত্ত্বেও মোহিলি অনন্য থৈ আছিল।

এমত ঠিক যে সে নিঃসঙ্কোচে অনায়াসে মোহিলির হাত ধরিতে পারিত কোন কিছু ঔৎসুক্যে, কোন কৌতুকাবহতে, বিশেষত কিছুর নাম মাত্র আতঙ্কে, যাহা সে আর পারিবে না; সুঘরাই ইহা লইয়া পৰ্য্যালোচনা হয়ত নির্ঘাত করিয়া থাকে, যে এই শহরে কাহারই বা সে হাত ধরিবেক, মনিব মহাশয়ের শত আতঙ্কেও না, যদিও মনিব মহাশয় ও তদীয় পত্নী অপ্রার্থিত হৃদয়বান সমস্তরূপে, সৰ্ব্বদা যত্নও করেন, তাহারে গেঞ্জী কাপড় সবই দিয়াছেন, তাহার নিমিত্ত সুঁইওয়ালাদের নগদ চার আনা পয়সা পান। খাইতে দিয়াছেন।

আশ্চৰ্য কতটুকু সময়ের মধ্যে যে সে নিখোঁজ হয়, এ কারণ যে সে জাতি ঘৃণ্য; যে অপিচ মনিব মহাশয় তাহারে যারপরনাই আড়াল করিতে প্রয়াসী হইয়াছিলেন, কিন্তু পাণ্ডা ঠাকুর মহাশয় জিজ্ঞাসিলেন–সে নেয়া কি জাত ছিকোরে তোরা।

ইত্যাকার সুমিষ্ট ভাষণ, অতীব শীল যাহা, তাহাতে সুঘরাই তুষ্ট; পাণ্ডাঠাকুর মহাশয়ের যথারীতি সম্বোধনে ইহা পরিষ্কার যে, তাহাকে বুনো, তাহাকে ডোম জাতীয় মনে হয় না, যেহেতু তাহার মাথায় অনেক তৈল, যে জন্মাবধি সে চিনি খায়, সে ডালিম কি জানে, বেশ সোহাগের চেহারা বটে তাহার।

তবে, এই ধরনের প্রথমকার আবেগ কাটিতেই সুঘরাই বানচাল, যেহেতু যে এবং বহুবারই সে অগ্নি পোহাইয়াছে, সুমহৎ শিখা তাই এখন তাহার সমক্ষে, তাই তদীয় স্বল্পায়তনের দেহ শতছিদ্র, স্বেদোদগমে গেঞ্জী পরিপ্লত,–এই স্বীকারে সে বাধ্য–যে সে হয় ডোম এই অপরাধ স্বীকারেই; কিন্তু, সম্ভবত ঐ সঙ্গে যেমন ইহাও যে, যাহার জন্য সে বেচারী দায়িক না, এবং যে সে বা তাহারা ও মহুয়া গাছ একই; কিন্তু তদ্ব্যতিরেকেও, তথাপি উহার সুঠাম অনার্য মুখশ্রী আরক্তিম কষায়িত ইত্যাকার মনোভাব তাহার পক্ষে অবিশ্বাসের।

এমনও যে কোন এক সত্য–অসাধনেই তাহার মস্তকে ঘোর করে, যে নানারূপ অদ্ভুতদর্শন যন্ত্রের, টিনকাটা চ্যরনার, বিটার ইত্যাদির পাশেই অনেক নানান আকারের চমকপ্রদ লেবেল আঁটা টিন, কোনটিতে কোনটিতে মাছের ছবি, হৃষ্টপুষ্ট শাদা শুয়ারের, কোথাও গরুর! কতবার না এইসব টিন সে মহা উৎসাহে সাজাইয়াছে, মনিবপত্নীর আজ্ঞায় কাটিয়াছে। এই ব্যাপারে এইজন্যই যে হয়ত বৈষম্য তাহাকে এতদূর ভয়ঙ্কর করে।

পাণ্ডাঠাকুর ব্রাহ্মণ স্বভাবসিদ্ধ অনুদ্বিগ্ন শান্ত, যেমত যে, আৰ্ত্ত সহিত আলাপনের স্বরক্রমে কহিলেন–তাহা হইল, তবে, কিন্তু।

ইহাতেই যে মনিব মহাশয় কিয়ৎ আত্মস্থ থাকেন, কেন না দিবালোককে মিথ্যা প্রতিপন্ন করিতে তিনি চাহেন নাই; তিনি ধর্ম্মশীল, একদা আপন জায়ার প্রতি, যিনি অযুত শ্ৰীসম্পন্না ভক্তিমতী অধুনা মালাজপকারিণী যিনি পূজারিণী, তৎপ্রতি অবলোকনিয়াই উত্তম শুভবুদ্ধিচালিত উত্তর দিলেন–হে ঠাকুর মহাশয়, মকৃত ধৃষ্টতা মার্জনা করিবেন, ইহা সত্য বটে, যে এই হতভাগ্যের ছায়া পর্যন্ত স্পর্শনে অশাস্ত্রীয়, যে উহার জল চলে না, তথাপি, যদিও মাদৃশ জনের আমূল পরিচয় আপনাদের নখদর্পণে, আমি বলি, আমি গৌড়ীয় সর্বোৎকৃষ্ট শ্রেণীর ব্রাহ্মণ, বাঙলার সর্বশ্রেষ্ঠ সম্ভ্রান্ত প্রাচীন বংশ আমাদের, সেবাব্রত থাকা সত্ত্বে বহুজনকে অন্নদান করিয়া থাকি, (আমি প্রভূত বিত্তশালী ঠাকুরের কৃপায় হইয়াও) ত্রিসন্ধ্যা গায়ত্রী জপ করি, মানুন, আমি ত বটেই, ও মদীয় ভাৰ্য্যা ইনি উচ্চ অভিজাত বংশসস্তৃতা, ইনি সত্ত্বগুণবিশিষ্টা বহু বহু জন্মের তপস্যা দেবারাধনাজনিত সুকৃতি নিবন্ধন ইহজন্মে মা জননীর রাঙাচরণ আশ্রয় লাভ করেন, ইনি মা জননীর শ্রীশ্রীমায়ের (শ্রীশ্রীসারদা দেবী) মন্ত্রশিষ্যা, ইনিও ঐ অধম দীনতম বেচারীকে অভাবনীয় স্নেহ করেন খুব স্বাভাবিকভাবেই তাহা ছাড়া ভগবান রামকৃষ্ণ আমাদিগের সন্দেহ অজ্ঞানতা বিদূরিত করিয়াছেন যে, যথা–সব্রাহ্মণ, যার কোন কামনা নেই, সে হাড়ীর বাড়ীর সিধে নিতে পারে। আবার বলিয়াছেন যে, কৃষ্ণকিশোর অত বড় আচারী ব্রাহ্মণ কোন হীন জাতিকে তিনবার। শিব শিব বলাইয়া হৃষ্টচিত্তে উহার হাতে জলপান করেন। তাই আমাদিগের সবই জল-চল, অবশ্য। বিদেশ বলিয়া নহে, যাহা হউক সুঘরাই আমাদের সহিত চলুক, বালক কখনও শহরে আসে নাই, গাড়ীও নাই, শেষে কোথায় কি ঘটিবে, অনেক জন্মের পুণ্য অর্জনে অদ্য সে এখানে দেবস্থানে, আর যে মদীয় পত্নীর কল্যাণে ধৰ্ম্ম ধারণা উহাতে আছে জানি, উহাকে এখন বিফলমনোরথ হইতে দিবেন না; ঠাকুর মহাশয় দেখুন দেখুন উহারে দেখিতে নবীন কদলী কাণ্ডের ন্যায়, তেমনই মনোলাভা তেমনই নিষ্পাপ, সে কাহাকেও তিলমাত্র স্পর্শ করিবে না, এখন আজ্ঞা করুন।

এবং যে তদ্বিধ প্রসঙ্গ পাণ্ডাঠাকুর মহাশয় শুনিতে তদীয় ললাটস্থ হোমজাত রম্য শৈবতিলক দেদীপ্যমান হইল, হর হর মহাদেব বলিয়া আদেশ দিলেন–ভগবান শঙ্কর গৌরবমণ্ডিত হউন, বাবা বৈদ্যনাথের নামে ইহা হউক, বেশ, বাবার দুয়ার অবধি যাইতে পারে! ইহাতে মনিব মহাশয় উৎফুল্ল হওয়ত বাবা বৈদ্যনাথের জয়ধ্বনি করিলেন।

এতাদৃশ অনুমোদনে এবং জয়ধ্বনিতে সুঘরাই, আহ্লাদে তাহার মনে পড়িল, যে সে পদ্ম দেখিয়াছে, অথচ বন্য, সে গাত্রের গেঞ্জী খুলিয়া তখনই পরিতে চাহিল, পঞ্চতীর্থবারিতে সে শুদ্ধ, তাহার তৈলসিক্ত মস্তকে পূত নিৰ্মাল্য আছে; ক্রমে তাহারা সকলেই এক অভূতপূৰ্ব্ব মৰ্ম্মস্থলের নিকট, আর্ট যেখানে প্রকৃতিকে প্রভাবিত করিয়াছে। যে সে এখন প্রাকৃতজনের চরম মনীষাদায়িকা শিবমন্দিরের দুয়ার সমীপস্থ আছে, যে সে ঐ পুনর্জন্মক্ষয়কারী শিবপুরীর প্রাচীরে, এই প্রথম বিবেক তাহাতে, আর যে সে বিবেকনিয়ন্ত্রিত, অনেক অনেকবার মাথা ঠুকিতেছিল; নানা মানুষের শ্লোকরাজি নানান প্রার্থনা, যথা ভগবান ইহার সুমতি দাও, ভগবান শঙ্কর অন্তিমে তোমার দর্শন পাই, তোমার শরণার্থী হে বৈদ্যনাথ।

তদীয় কানে আসে অথচ সে অন্ধকার দিয়া ডাকিতে চাহিল এবং যখন আপনকার বক্ষঃদেশে এ মন্দির ছবি মুদ্রিত হউক এরূপ কামনায়ে যে সে আপন গেঞ্জী খুলিতে যাইবে, হরি হরি যে তৎক্ষণাৎই তাহার কাল হইল, দুর্ভাগ্য উপস্থিত!

ঐ সময়েতে, অশ্রুতপূৰ্ব্ব গোল ধিকিয়া দাবদাহ, ক্রমে, বিকট জিগীর গর্জিল; যে সে, সুঘরাই, গেঞ্জী তুলিয়া অস্পন্দ, তাহার মনে উপজায় যে কাছেই নিশ্চয় কোথাও লক্কড় আক্রমণ করিয়াছে; নিমেষেই এহেন অপ্রশস্ত সঙ্কীর্ণ গলিতে এক দারুণ সঙ্কটজনক অবস্থা ঘটিয়া উঠিল, অগণন নিরীহ তসর গরদ মটকা কেটে রেশম পট্টবস্ত্রশোভিতা রমণীগণ চকিত হইলেন, বাঁশুলী নয়ন কালীঘাট হইল, ইহারা সকলে সঙক্ষুব্ধ, নথ দুলিল, কর্ণভূষণ ব্যতিব্যস্ত, কঙ্কন বাজিল, গললগ্নীকৃতবাস শিথিলীকৃত, চোখে চোখে বিভ্রান্ত বিদ্যুৎ, পূজাউপচারসকল হস্তচ্যুৎ হওনে অবোদেশে মাটিতে, পাত্ৰভ্রষ্ট কর্পূর ভূমিতে জ্বলিতেছে, ধূপ যেখানে সেখানে, ফল গড়াইতেছে, দুগ্ধ পড়িয়াছে, ফুল ও মালা সমুদায় নয়ছয়, কচি বিশ্বদল ছত্রাকার, কতক কুৎসিতদর্শন পা ঐ সকল সৌন্দৰ্য্য মর্দন করিতে থাকিয়া আইসে; ইহারা হরিজন! ইহাদের প্রত্যক্ষে শুদ্ধাচারী পুরুষগণ যাঁহারা কেহ মহামহিঃস্তব, অন্য কেহ নিৰ্বাণঘটক, কেহ কৌপীনপঞ্চক, কেহ শিবস্তোত্র আবৃত্তি রুদ্ধ করিয়াছেন, কেন না অহিতকারীরা ভীমনাদে চীৎকার পাড়িতে লাগিল।

সুঘরাই যেমত হতচেতন, সে বিস্ফারিত নয়নে হেরিল, কীদৃশী ভয়ঙ্কর মদমত্ততা! এক সঙ্গে এতেক নোংরা আকৃতি সুঘরাই কদাচ দেখে নাই, প্রতিজনের মুখমণ্ডল বিশেষত কণ্ঠলগ্না মাল্যে অধিক জঘন্যদর্শন হইয়াছে, ইহারা যাহারা শাস্তির ভয় পায় অথচ কভু জিহ্বা দংশন করে না, ইহারা তাহারা ভক্তি যাহাদের বক্ষ হইতে তের নদী পার; ইহাদের বেচারীদের পরনে ঠেটি, কণ্ঠে জবা কুসুমাদি মাল্য, ইহারা বহু যুগ অভুক্ত, ইহাদের কাহারও কাগজ নাই, উহাদিগের গাত্রগন্ধ উৎকট যেন মহুয়ার খৈল পোড়া গন্ধ, উহারা অস্নাত, উহারা যাহারা সন্ধ্যায় স্থির হয় না, তাহারা মন্দিরে প্রবেশ করিতে উদ্যত, বহু শতকের ভীতিতে এখন তাহারা বিষধরজ্ঞানরহিত।

ইহারা বেচারীরা স্বার্থোদ্ধত পন্থ চালিত ধৰ্ম্মার্থে শহীদ হইবেক, ইহারা সকলেই মদ্যপ এবং যে নানাবিধ নেশা বিজড়িত, এখন ইহাদের নেশা আড়ান কণ্ঠে ইহারা যাহাদের ছন্দানুবর্ত্তী সেই দুষ্টমতি নেতৃবর্গের নাম ঝটিকা দিতেছিল, যেমন যাহা কুৎসিত অশ্লীল পদ, নামগুলির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ যে কি তাহা পাণিনি জানেন! এই ধুরন্ধরেরা নেতৃবর্গ আদতে নীচযোনি ফিরিঙ্গীপ্রসাদ, ইংরাজ শালাদের দাস, এই সকলের নামে আকাশে বাতাসে তড়কা লাগিতেছিল ঐ বেচারীদের প্রমত্ত রোলে, ইহারা নিম্নজাতিরা ঐ ধূৰ্ত্তদের প্ররোচনায় ভয়াল, তথাপি সত্য বটে ইহাদের কাহারও কাহারও চোখে অশ্রুধারা ছিল।

যে এবং ক্রমেই ইহাদিগের অপ্রতিরোধ্য চাপে বিপ্রকর্ষণে সকল কিছুই বিধ্বস্ত এমত, সকাল কুক্সটিকা হইল; বহু আৰ্ত্ত বহু বৃদ্ধ হা হা রব করিল, যে শিবের সহিত বিবাহসূত্রে আবদ্ধ করিতে যে সুলক্ষণা উমারূপিণী ষড়ৈশৰ্যময়ী সৰ্বালঙ্কারভূষিতা কন্যারে শঙ্খ মঙ্গলাচারে লাজবর্ষণে ঘন ঘন উলুধ্বনি ও গীত ও নৃত্যবাদ্য সহকারে আনয়ন করা হইতেছিল তাহাও রাবণিক পাশবিক কদৰ্য্যতায়ে লণ্ডভণ্ড, হায় অলৌকিক বিবাহ! হা লজ্জা! উহারা অলৌকিক কন্যার মস্তকোপরি কিংখাবের চন্দ্রাতপ অপহরণ করিল, আপনাদের মধ্যে কাড়াকাড়িতে যাহা শতচ্ছিন্ন হইল, কন্যা কিছুক্ষণ ন যযৌ ন তস্থে, ঝটিতি উন্মত্তের ন্যায় দ্রুত দৌড়াইয়া অর্গলবদ্ধ মন্দিরস্থ সদর দ্বারে আঘাত করেন।

যে সকল শিশুদেরকে ত্রিনয়নের চরণ বিধৌত বারি সিঞ্চনের বিধায়ে আনা হইতেছিল তাহাদের অবস্থা সঙ্গীন, কুকুর তারস্বরে ডাকিয়া উঠে, ইদানীং এক ভীমকৰ্ম্মা নৈরাজ্যের মথন হইল; যে, সব মহামূল্যবান মণিময় খচিত স্বর্ণভুজঙ্গ কোথাও বা স্বর্ণ রৌপ্য থালি পতিত, কখনও বা খোদাই করা অত্যুৎকষ্ট মৰ্মথালি চুর্ণীকৃত হইয়া রাস্তায়ে, বিভিন্ন দেশের স্মৃতি তুচ্ছ হইয়াছে; এবং হীরক সমন্বিত ও বিবিধ রত্ন মণ্ডিত ত্রিশূল, আরও যে অপরূপ-দর্শন নীলা পান্না অলঙ্কৃত বৃষ, এতদ্ব্যতীত যাহা যথা আশ্চৰ্য রাজসিক স্বর্ণসূত্রে গ্রথিত রুদ্রাক্ষ ও স্ফটিক জপমালা যে এবং সর্বোপরি অলোকসামান্য মহাদ্যুতিময় চন্দ্রকলা যাহা মনন মাত্রই বহুপুণ্যে সৰ্বগুণযুক্ত জাতি শ্রেষ্ঠ হিন্দু জন্ম সার্থক হয়–যে। কোন-র নির্বিকল্প সমাধি হইতে পারে, এখন যতেক সম্ভার অর্ঘ্য ভূলুণ্ঠিত।

এখন সেই সেই লোকেরা কেহ কেহ ক্রন্দিত কেহ সভয়ে অগ্রসর হয়, আর কেহ কেহ ঐ অমূল্য নিদর্শনগুলি আত্মসাৎকরণে কিলকিলা রব করিল, এহেন বিবৃত্তপাকে অসংখ্য পায়ের ফাঁকে কশ্চিৎ কিম্ভুতদর্শন মুখোসধারীও লুণ্ঠনে ব্যগ্র, নেতৃবর্গের বিদেশী ঘড়ি শোভিত হাতও কর্মতৎপর, আর যাহাদের বাহুতে সুইবিদ্ধ ব্যথা তাহারা জিগীর আস্ফালন জেংগীল পাখীর ন্যায় আর্তনাদ করে।

এখন ঐ তাণ্ডব সঙঘটনে বেচারী সুঘরাই মহা বৈচিত্তে, যে সে কোনদিকে যাইবেক ভাবনায়ে বিশৃঙ্খলতা; নির্ঘাত ইহা, ঐ দেবস্থানের পবিত্র সৌরভ ত্যাগ করি যাইতে সে অভিলাষী না, কিন্তু বেচারী মন্দভাগ্য। কাছের এই পৈশাচিকতায়ে সে অসুখী, সে বিভীষিত অথচ অবলীলাক্রমে সুঘরাই বুঝিল যে সে উহাদের একজন, সেও নিশ্চয়ই উহাদের একজন! অতএব আপনারে বাঁচাইতে সুঘরাই নিয়তই। সরিতে পদক্ষেপ করে, অথচ তমুহূর্তেই সে যেন ভূতগ্রস্ত উহাদের মতই জিগীরও দেয়, এই সে কিলকিলা রব করিল, এই সে আর্তনাদে বিকট; নিজেই নিজের বাদ সাধিল, ঘোষিতে চাহিল যে আমি উহাদের একজন। খানিক বাদে দেখা গেল ক্রমাগত পাণ্ডাঠাকুর মহাশয়রা নিজ নিজ ভৃত্যগণসহ দ্রুত। পদসঞ্চালনে এখানেতে আইসেন; সম্প্রতি যমের অরুচি বৈপ্লবিক নেতৃবর্গরা পিট্টান দিল, কেন না। অভিনব ধর্মার্থীদের উপর বেধড়ক দুরমুশ আরম্ভ হইয়াছে।

যে অবশ্য সে এই বৈগুণ্য, ঐরূপে নিজেকে কবুল করার বৃত্তি, একদা যে কাটাইয়া উঠিয়াছে ইহা সম্যক তাহার উপলব্ধি তখনই হইল, যখন সে বেশ ব্যবধানে; এবার পলায়নের কথা; এবং অজস্র জটিল গলি সে ঘুরিয়াছে, এক একটিকে সে উপর্যুপরি বেড় দিয়া থাকে, এ কি বিড়ম্বন। তাহার স্বভাবগত সরলতায় সে পতঙ্গের প্রায়; এই সঙ্কীর্ণ পথে কেহ কোথাও নাই; শুধু দেওয়াল পরম্পরা। পূর্বাহ্বের হিরণ্যকশিপুর দুঃস্বপ্ন তাহার হাসি কান্না শোষণ যেমন করিয়াছে; কেবল দুজ্ঞেয় অশ্লীল ভীতি তাহাতে অথচ, উপস্থিত এই ধন্ধ হইতে নিষ্কৃতি লাভ মানসে সে ছুটিয়াছিল।

হঠাৎ এক সময় সাহসভরে সুউচ্চ বাড়ীগুলির শীর্ষে নেত্রপাত করিল, সে সূৰ্য্যালোক দেখিলেক, নিম্নে গলিময় যে ধূসর কুয়াশাচ্ছন্ন যেমন তাহারও প্রত্যক্ষ হইল, বুঝে ইহা পাণ্ডা পাড়াই; আর খানিক অতিক্রমে যে সে স্তব পাঠের আওয়াজ পাইল, ইহাতে এবং সে যেন বহু দূরের শাল গাছের পিছনে; যে সে পায়রার কলরব বুঝিল, যাহাতে যেন কাহারও নাম; যে সে সদ্যঃস্নাতা স্তোত্রে কোন বিস্ফুরিতাধারা রমণীকে কলস কাঁকে আসিতে দেখিল, যুগপৎ অন্তরে বিঘোষিত হইল, আঃ জল! জল! এই বশম্বদ আপনাকে চিনিল যে এবং তদীয় সটান-বুনটে-থাকা প্রত্যঙ্গসকল শ্লথ হয়; আর তাহাতে সুপ্রতিষ্ঠিত ইহা ধ্রুবই যে সে আর অধম নয়–যেহেতু সে বাঁচিয়াছে।

কিন্তু তা সে অতিষ্ঠ এ কারণ যে, কুহকময় বাড়ীর ঘোর, গলির তির্যক গতি, হাই উঁচুতে গবাক্ষে লাখবন কাঞ্চন-জিনি যুবতীর আনন ক্কচিৎ দৃশ্যমান এবং বিশেষত পথিপার্শ্বের বীভৎস নর্দ্দমা ও পাইখানার নাড়ী-মোচড় গন্ধ–যেখানে ইতঃমধ্যেই তাহার বিগত সংজ্ঞা-বিঘাতক-অভিজ্ঞতা পচিয়া বিকট–ইহা সমুদয় মিশ্রিত হইয়া তাহার কায়িক অশান্তি ঘটায়; ও ইহাতে তাহার দৃষ্টি ঝাঁপসা, যদিও সে নবীভূত এক ঘটনা নিজেই, অধিকন্তু যে সে পথের ঠিকও পাইয়াছে যদিও। সহসা এক সময়ে যে সে আপনকার করতল নিরীক্ষণ করিল যাহা শূন্যই, যেমন কিছু ছিল, যেন কিছু খোয়া গিয়াছে এই বিবেচনায়, অনুভবে, পশ্চাতে অসহায়ভাবে তাকাইয়াছে; আর সে স্থানীয় ভৌতিক গন্ধকে অব্যাহতি লাভে মরিয়া যে কিন্তু সফলকাম নহে।

কোন রকমে সুঘরাই শিবগঙ্গার কাছে আসিল; প্রথমেই ইহা সহজ হয় যে সে এতাবৎ শ্বাস যাতনায় অত্রাহি ছিল, যে যেমন তাহার অন্তর বাহির কুশ্রী গন্ধের ঘর, তাহার সমগ্র দেহ সীসক পরিপূর্ণ; উপরন্তু সে হঠাৎ মৃগী রোগাক্রান্ত রাত্র, যাহা বিস্মৃত সম্প্রতি, ভেদ করত এখানে সে সহজ; সে পূতঃসলিল ঐ মহিমান্বিত জলাশয়ের পানে অনিমেষনয়নে চাহিয়া বলিয়া উঠিলেক–আঃ কত কত পাহাড় পাহাড় জল, আঃ কত কত আমি। যে এবং ইদানীন্তন ‘আমি’ শব্দকে সে ডরিল না যাহা চমৎকার অনুরণন তাই।

এখানে ওতঃপ্রোত হইল কোন একজন ব্যক্তি এই পবিত্র জলে, অধোভাগ নিমজ্জিত যাহার, কৃতাঞ্জলিপুটে ঊর্ধ্বলোকের দিকে নিস্পলকদৃষ্টিতে ছিল, ইহা স্পষ্টই সে উদকক্রিয়ায় ব্যাপৃতা ঘাটেতে যাহার স্বজনরা, প্রায়ই স্ত্রীলোক শশাঙ্গীত গাহে।

এই ব্যাপারের নিকটে একজন সন্ন্যাসী সশিষ্য অবগাহন করিতে নামিয়াই ঐ অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষে এবম্প্রকার উদ্বেলিত যে হা রাম হা রাম নিনাদে অর্ধবাহ্যদশা প্রাপ্ত হইলেন, শিষ্যরা তাঁহাকে ধারণ করিয়াছে, এই সন্ন্যাসী তদ্ভাবাপন্ন আবৃত্তি করিতে থাকিলেন, হা রাম!…

বিশেষতঃ চতুর্দিকেই বিকশিত কানন, তাহাতে মন্দাকিনী মনোহারিণী মূর্তি ধারণ করিয়াছেন। সীতা সমভিব্যহারী পরম যশঃশালী রাজকুমারগণ সকলেই অতি কষ্টে তথায় গমন করিলেন অনন্তর তাঁহারা কর্দমশূন্য সুপ্রশস্ত ঘট্টে অবতরণ করিয়া ‘এতদভবতু’ বলিয়া পিতৃদেবের উদ্দেশে জলদানে প্রবৃত্ত হইলেন, রাম তৎকালে জলপূরিত অঞ্জলি গ্রহণ পূৰ্ব্বক, দক্ষিণাভিমুখে দণ্ডায়মান হইয়া রোদন করিতে করিতে কহিলেন–হে রাজশার্দুল পিতা! আপনি পিতৃলোকে গমন করিয়াছেন; অতএব এক্ষণে আপনার উদ্দেশে মদ্দত্ত সুনিৰ্ম্মল জল অক্ষয় হইয়া পিতৃলোকে উপস্থিত হউক!…

এখনই শিষ্যরা ‘ওঁ রাম’ ধ্বনি দিল।

অবশ্যই ইহারা রামায়েৎ। সুঘরাই এই রামকথার অনেকখানি ভাষাগত বাধা সত্ত্বেও অনুধাবন করে; সে এহেন প্রহেলিকার সূক্ষ্মতায় এতই বিক্ষিপ্ত যে ঊর্ধ্বে দেখিতে উহার ভরসা নাই, সামনের জলরাশি আর সে নহে; অদ্ভুত শেষ রাত্রি ঘনাইয়াছে, আবার ভয় উপজিল, সে অথবা বাষ্প হইয়া যাইতেছিল।

সে ঐ স্থান ত্যাগ করিয়া এই বাগে আসিল, যেখান হইতে এখন পুনৰ্বার অতিক্রান্ত মহল্লা নজরেই তদীয় মন পাঙাশ হয়; যে মন্দির আগত অনৈসর্গিক সুবাস তাহারে, অভ্রান্ত যে রমণীয় ভাবপ্রসারতা দিয়াছে, যে গভীর কুয়া হইতে উত্তোলিত জলে-রৌদ্র-দেখার-অবাক তাহাতে আছে, তৎপ্রভাবে, এখানকার আলো সে অনুভব করিয়াছিল আর যে সে অশ্বথের বীজের তুল্য অসংখ্য হাটবার পার হইয়া কোথাও উদগত হইয়াছে।

যদ্যপি যে তদীয় শুদ্ধাস্পদ মাননীয় মনিবরা সেখানেই মন্দিরেই অপিচ গলির জটের মধ্যে, প্রবেশ করিতে জী চাহে নাই, তবু মনে হয় তাহার ইতস্তত হাল্লাঝুরির কালীবাড়ীর গেটে যেন সে আছে, সেখান হইতে সোজা এই শিবমন্দিরের এক চোরা পথ আছে, ইহাতে তাহার আশ্চর্য্য কম্পন দেখা দিল যে তাহার মধ্যে মনিবদের কম্পনও সঞ্চারিত, বুঝিল যাঁহারা একদা হাল্লাঝুরির কালী মন্দিরের গেটে থমকাইয়াছিলেন, কেন না বাগানের অপ্রশস্ত তিনটি পথের মুখে ফলকে লেখা ইড়া, পিঙ্গলা সুষুম্না এবং অবশেষে শ্রীশ্রীতারা ব্রহ্মময়ী বিগ্রহ-তদৃষ্টে যদিও তখন ভোরবেলা তবু দম্পতিদ্বয় মর্মরিত অবশ্য সুঘরাইএর আন্দাজ তাঁহারা একে অন্যের হস্ত ধারণ করেন।

উপস্থিত গলি সকল তাহারে অসম্ভব বিশুষ্ক করে, যে তাহাতে ঈদৃশ উদ্বেগ যে ঐখানকার অশরীরী হিমবাহ গন্ধতে নিঃশব্দে ঘটির মত ডুবাইতে পারে; অথচ না-যাইতে-পারার ক্ষোভে সে অধৈৰ্য্য; এবং সে ক্রন্দন নিমিত্ত স্বরবিকারের আয়াস পাইল–অবশ্য ধৰ্ম্মত ইহার কারণ এই হয় যে তাহাকে যাইতেই হইবে, এখনও সে পদচালনারহিত তবুও, এখানকার জনসঙেঘর ব্যস্ততার কেন্দ্রে সরল নিঃশ্বাস লওয়ার অস্বাচ্ছন্দ্য নাই যাহা তাহার ভাল লাগে, মানে পরোক্ষে মন্দিরের নিকটের হট্টকারিতা, যাহা স্মরণে আপাতত নাই, অথচ তাহাতে ক্রিয়াশীল অজ্ঞাতেই।

তৎসত্ত্বেও কোনরকমে সুঘরাই খানিক পথ অগ্রসর হইতেই কেমন এক উদ্দীপন তাহার অন্তরে পুনরায় সংগঠিত হইল; সে যেমন কোন শোভাযাত্রা দেখনের নিবন্ধন প্রমত্ত, নিম-হরিৎ ধান্যমঞ্জরী থরথরিত রতনচূড় শোভিত হস্তে নববধূ যেন স্মিত হাস্যে আসে; জনতা উথলিত-হর্ষোৎফুল্ল আঃ মিথুন আঃ মহেশ্বরী আঃ গিরিনন্দিনী! ত্বমেব সা ত্বং সাবিত্রী ত্বং দেবী জননী পরা, বচনে বিস্ফুরিত, কেহ বলিল, রে চক্ষু ইহার পর তোর জ্যোতিঃ ক্ষয়প্রাপ্ত হউক। এখন সুঘরাই ধাইয়াছে ঐ কাঁঠাল পত্রে তেল ও মেটে সিন্দুর অভিজ্ঞার লোভে; একদাও ভাবে নাই সেই গলির গন্ধের বিষয়ে; যেন শোভাযাত্রা এখনও, এই সংস্কার হয়, যে আছে, সে আবার দেখিতে পাইবে আর সে নির্ভীক চলিতেছে।

অচিরাৎ পাণ্ডাঠাকুর মহাশয়ের সহিত ভাগ্যশ সাক্ষাৎকার ঘটিল, যে এবং তিনি স্নেহপ্রযুক্ত কণ্ঠে আজ্ঞা করিলেন, দৌড়াও দৌড়াও তোমার বাবু ও মাতাঠাকরুন তোমার সন্ধানে গিয়াছেন, কেন তুমি ভয়ে স্থান ত্যাগ করিলে, শিব থাকিতে ভয়, নির্বোধ বড় তুমি হে ছিঃ ছিঃ।

তদনুবর্ত্তী সুঘরাই অসহ্য উৎকণ্ঠায় দৌড়াইল, যেন তাহার স্বকৃত জিগীর তাহার পশ্চাদ্ধাবন। করিয়াছে। নিরন্তর বিশ্রী গন্ধে সে ক্রমান্বয় কালো। সে, সুঘরাই গলিভেদে যেক্ষণে খোলামেলায় তখনই। তাহার মানসিক যন্ত্রণা সমুদ্ভূত হয়; কোন দিকে সে যে চাহিবে তাহার তাহাতে মতি ছিল না। মঙ্গল বাদ্যকারী ঢাকীদের নৃত্য, বিভিন্ন দেশীয় তীর্থযাত্রী প্রবাহ, যে পাছে-হারাইয়া যায় তাই একের সহিত অন্যের রমণীগণের আঁচল বাঁধা, এ সকলি তাহার চোখে; একদা সে অত্যন্ত অসহায় বোধে নিষ্পেষিত, দেখিল সামনের শিবগঙ্গার জলের কোন কিনারা নাই, শুধু জল আর জল, সূৰ্য্যকে ইস্তক খাইয়া সারিয়াছে!

তাই তৎকালেই বেচারী অসাধনেই কান্দিয়া উঠে; তীর্থযাত্রীরা তাহার পানে এলেবেলে দৃষ্টিপাতে শিব জয়ধ্বনি করত জলদে পা ফেলিয়াছে, সুঘরাই কৰ্ত্তব্য নির্ণয়ে অপারগ, সে মনিবদের কোথায়। খুঁজিবে, অনেক বাঙালী তীর্থকামী বা পথচারীকে সে এহেন ঘোরে, উদ্বস্ত করিল; ক্রমে তাহার অত্যুগ্র আশা যাতনা, যাতনা প্রস্তর হইল; এ সময়ে ইতিমধ্যে পাঁচটি জন্তু যেন তাহার গাত্র হইতে উদ্ভূত হইয়া দিকে দিকে দৌড়াইল; এখন সাইকেলের ঘণ্টি শুনিতে থাকিয়া যে সে ঘুমাইতে এলাইয়াছে; বুঝে যে তাঁহাদের তন্নতন্ন সন্ধানের ফলে নিজেই অবশেষে সে হারাইয়াছে; ক্রমাগতই সে হারাইয়া যাইতেছে।

তৎপ্রযুক্ত তাহার নিকট ঝটিতিই চমকেই সমস্ত কিছুই যেন ভিঞ্জাতীয় আলুনি, যে এই বিষমত্বে একবার, এবং সে সুমহান ত্রিকূটপৰ্বত দেখিলেক, ডিগরিয়ার দিকে তাকাইল; এখন উভয়ের বর্ণান্তর পরিলক্ষিত হইয়াছে, সে প্রত্যক্ষও করিল: চেঞ্জাররা সার বাঁধিয়া ডিগরিয়া-র মুখোমুখি দাঁড়াইয়া প্রশস্তি জানাইল, কহিল, গ্র্যাণ্ড! কি সুন্দর! এই ঘোষণার নিমিত্ত কত অন্ধকার তাহারা পরিত্যাগ করিয়াছে– এমনও যে অতীতকে নবকলেবর দিয়াছে–নিশ্চয়ই এতাবৎ কলিকাতার ঘিঞ্জি হইতে ছাড়া পাইয়াছে, তাহারা আপন কুটস্থ প্রতিবিম্ব দেখিল।

তাহাদের–এই উক্তিকে এই পদবন্ধ যেন হারমোনাইজ করে–যে অলিগলিতে বড়রাস্তায় আমরা প্রেমকে অস্বীকার করিয়াছি! পৰ্বত দুইটিই যেন সম্পূর্ণ অচেনা, এবং সে যুগ কুঞ্চিত করিল, বুক তাহার মোচড়ায়-হায় মোহিলির গ্লানিতেই ইহা ঘটিয়াছে–হায় অধম মোহিলিই ঐ বেচারীদের ঐ পাহাড় দুইটির সৰ্ব্বনাশ সংসাধন করিয়াছে।

যে উপলক্ষে ঐ পাহাড় দুটির বিদ্যমানতা সেই যন্ত্রটিই মূর্খ স্বার্থান্ধ চামার পুত্রদ্বারা ধূলিসাৎ হইয়াছে, হা দুঃখ! চরাচর তিমিরাচ্ছন্ন যেন এখন গোশাবক ও গাভী সকলের কোন দিক নাই, চারণ ভুমি হইতে কেমনে ফিরিবে, কোন এক গাভীর ললাটে সিন্দুর তিলকও দেখা যায় না, খুরখাত অদৃশ্য, দিক। তিমিরাচ্ছন্ন। সুঘরাইএর অন্তরে উপস্থিত এই ছবি প্রতিভাসিত। এখনও ঐ প্রাকৃতিক শোভাদ্বয় নিছক অপরিজ্ঞাত, তথাপি সে উহাদের স্মরণ মননে আছিল যেন যে নিজেরে হারাইয়া না ফেলে।

ইহা খুবই সাধারণ এবং নির্ঘাত যে তদীয় মনিব মহাশয় তাহারে খুঁজিতে, তিনি তাহারই আশপাশ দিয়া কতবারই না চলিয়া গিয়াছেন; ইহা সে ভাবিল যে স্নেহ-প্রাণা পরম পূজনীয়া মনিবপত্নী ঠাকরুন সাংঘাতিক উতলা, অধীর, বিবর্ণ; পতিরে অনুনয় করত কৃতাঞ্জলি হইয়া নিবেদিলেন,বাবা বিশ্বনাথ, এ কি অঘটন! কি জ্বালা, কি পোড়ার, এমনতারা হবে জানলে ছোঁড়াকে…ওরে পুব জমে কি হেন পাপ করেছিলিস্ যে নিঘিন্নে জাতের পেটে এলি, ওরে অন্য হ’তে পালিনি, মাহাতো কিম্বা কাহার কত শত জাত ত ছিল; হায়রে কোথা রাম রাজা হবে, না, হায়রে! ছোঁড়া এখনও হয়ত উপসী, দাঁতে কিছুটি। কাটেনি গা, চন্নামেত্তর খাবে, বাবার পেসাদ পাবে বলে, আমারই মরণ দশা, তোমার কথা তখন হেলা না হলে করি, গোখুরি হয়েছে, এমন জানলে! আমার মাথা খাও, পায় পড়ি, জানি একে ছোঁড়া মূর্তিমান পাপ, তলাস করিতে তোমারও ভোগান্তির সীমা নেই, তবু দেখ, ইদিকে বেলা যায়।

তদ্বিধ খেদোক্তি মিনতি সুঘরাই সুস্পষ্ট অভিধানে শুনিতে যেমন পাইল। আর যে সেবকবৎসল মনিব মহাশয় সর্বক্লেশনাশিনী উদ্বিগ্ন পত্নীর ঈদৃশ উৎকণ্ঠা সমঝে ও রমণীর হিসটেরিয়া রোগনিমিত্তও বটে এখন দ্বিরুক্তি করেন না! অথচ স্বভাবতঃ তদীয় সত্তা আর একে পরিণত, সমস্ত অস্তিত্ব এখন আর্কিটেকটনিক ব্যঞ্জনা যাহা মন্দিরের ফুলচন্দন কর্পূরগন্ধ গম্ভীর অন্ধকার মিশ্রিত এবং কণ্ঠ এখন কাব্যবীজে স্ফীত হইয়াছিল এবং এহেন অবস্থা লইয়া নীচজন্মাকে তথা সেই পাপের পুনরপি অনুসন্ধান শুরু হইল।

সুঘারইএর মানসে সেই ঘোর শ্যাম গোচারণভূমি থাকে, এখন সেই ত্রস্ত গাভী একভাবে হম্বারবে আকাশকে অভয় দিতে আছে, যে তাহারা বিভ্রান্ত উত্তেজনায় পরমাদে একে অন্যরে সংঘর্ষে, বেচারীদের গললগ্ন ঘন্টি ক্ষিপ্তক্রমে বাজিতে অনবরত থাকিয়া উত্তপ্ত; ধ্বনিভেদ তাই, বহুদূর স্থিত সাঁওতাল পল্লীতেও শ্রুত, এরূপ অবাক ধ্বনিব্যঞ্জনায় উত্তেজিত হইয়া সাঁওতালরা মাদল বাজাইতেছে, হায় বেচারীদের গরু নাই! দাবদাহর সঙ্কেতেই খবরেই একে অন্যের হাত ধরে! ইদানীং অথৈ রিখিয়ার পথে পথে নিরবচ্ছিন্ন অন্ধকার, চৌকিদার পথ লাঠি ঠুকিয়া হাতড়ার অন্ধ যেমন বা।

নিশ্চয়ই মনিব মহাশয় ঐ ছ্যাকড়া গাড়ীর সামনে যাইলেন, সেইটি স্থিতবান আছে, সেইটি কৌতূহলোদ্দীপক, যাহার আশেপাশে সার্কাসের খেলার তাকলাগান ছবি প্রলম্বিত, যে গাড়ীর ভিতর হইতে হ্যাঁণ্ডবিল বিলি হইতেছে, যাহার ছাদে কেলড্রাম, ক্লেরিওনেট, করনিট বাজিতেছে; গাড়ী মধ্যে দেখা যায়, তিনি যিনি বাঘের খেলা দেখান, যাঁহার বুকে বাঘনখ আঁটা রূপার ঘড়ির চেইন, ইঁহার মরদ গোঁফে দারুণ কেয়ারি; উনি ঘুমন্ত; মনিব মহাশয় উঁহার পানে চাহিলেন।

বাদ্য ঢক্কানিনাদ তীর্থযাত্রীরা মুহুর্মুহু জয় শম্ভু যোগেশ্বর, এইরূপ আপন ইষ্টর নাম তুলিতেছে, ইতিমধ্যে দ্বাদশ লিঙ্গের নাম গমক দিয়া উঠে, তন্মধ্যেও আপন অহঙ্কার ফেলিয়া তিনি, বাঘেরা খেলোয়াড়, ঘুমে কাদা; অথচ বক্ষের মৃত খবরে–কি জানি বাঘনখ বা কি, কি জানি ঘড়িই বা কি অদ্ভুত কামুক ভুবন্ধাই; নিশ্চয়ই সুঘরাই অনেক বালকের তর্জ্জনী নির্দ্দেশ নিয়ন্ত্রিত ইহারে অবলোকন করিতেছিল, অবশ্য সে চোখের জল মুছে নাই, সত্যই ইনি ভীতিপ্রদ ইনি আনন্দও!

ইত্যাকার পর্যালোচনাপূৰ্ব্বক মনিব মহাশয় হ্যাঁণ্ডবিল বিলিকারী, যিনি তারের খেলা দেখান– তাঁহারে সম্ভ্রান্তস্বরে জিজ্ঞাসিলেন, মহাশয়, আপনি সুবিখ্যাত ব্যক্তি, আপনার মধ্যে সরল রেখার বৈচিত্র্য, বহু বালকের হাতে আপনি হ্যাঁণ্ডবিল দিতেছিলেন, যে বালক আপনাদের কসরতের ছবি দেখিয়া থমকাইয়াছিল, পরক্ষণেই বড় পশ্চাতে চাহে আবার বাঘেরা খেলোয়াড়কে দেখে, রোমাঞ্চিত হওয়ত শিহরায় যে যেন এখনই খেলোয়াড় জাগিয়া হালুম করিয়া উঠিতে পারে, হঠাৎ সে স্থান ত্যাগ করিল, আপনার আহ্বান সত্ত্বেও সে কাছে আসে নাই।

অবশ্য পুনরায় ফিরিয়া আইসে, যখন কৌচম্যানের পার্শ্বে বসিয়া ক্লাউন নানান রঙ্গতামাসা দেখায়, বাহবা রুমালের খরগোস ও বাখানি ইন্দুর লইয়া খেলা এখানকার দুএকটি সবস্ত্র বালক, সুঘরাই না, ও কতিপয় পথচারী বুঝিত না; অবশ্য ক্লাউন যখন কপট শ্লেষ্ম ঝাড়িয়া এই অল্পবয়সী ভিড়ে নিক্ষেপ করে, যখন কপট তাড়নায় পাদানিতে পা দ্বারা আঘাতিয়াছে, চাবুক আস্ফালনে মজা করিয়া থাকে, সর্বোপরি কপট মূত্রত্যাগজনিত অঙ্গভঙ্গীতে ও তৎশব্দের অনুকরণ, যখন অন্যান্য বালকরা হাসে, যখন পালায়, সেই বালক সরিয়াছে পালাইয়াছে কিন্তু হাসে নাই।

যে এবং চিত্রিত কসরৎ সকল দূর হইতেই, ক্ষণেক আপন অঙ্গুলি যেন ঐগুলির উপর, সে বুলাইয়া বুঝিয়া লইতে চাহিয়াছে–সে চাতুৰ্য চাহিয়াছে, বিচক্ষণতা চাহিয়াছে; কিন্তু কসরৎ বুঝিতে তদীয় গেঞ্জী আট বোধ হয়; ও যে, হঠাৎ বাঘেরা খেলোয়াড়কে অদ্ভুত বুনো আলস্য ত্যাগ করিতে প্রত্যক্ষে যাহার গাত্রে পুলকমিশ্র তরাসে সিঞ্চিড়া উদগম হইল, তখনই সে যেন ধর্ম্মভীরু, একারণ যে তাহার মনে দংশিল যে আমি ডোমপুত্র সুঘরাই আমি ত ইহাকে, ইহা সব–সার্কাসের লোকদের খুঁজিতেছি না, আমি যে মনিব মহাশয়দের…এবং তাহাকে কি আপনি যেহেতু সে আপনার হস্তচ্যুত দেশলাই তুলিয়া দেয়, আপনি এখন…।

সুঘরাইএর দেহ হইতে যাহারা যে জন্তুরা একযোগে বাহির হইয়া নিমেষেই অদৃশ্য হয়, ইদানীং সেই পাঁচটিকে দেখিল, সে সাক্ষাৎ চিনিল; ইহাদের জিহ্বা লোল, ইহারা হাঁফায়, বেচারী কুকুরগুলি; যখন তাহার গাত্র হইতে সবে মাত্র জাত তখন মনোহর শ্বেতকায়া ছিল, এখন অত্যধিক হয়রানিতে উপস্থিত যারপরনাই মলিন ধূসর; ইহারা কুণ্ঠায় জড়সড়, তাহারই দূরে দূরে অবনত মস্তকে ঘুরে, ইতিমধ্যে অসহায়ভাবে তাকায় এবং কোন কৈফিয়তে ল্যাজ তাহাদের আন্দোলিত ছিল; সুঘরাই উহাদের প্রতি খিন্ন অলস চোখে তাকাইল; সে নিজে আজ্ঞাবাহক, অথচ আশ্চর্য এই ক্ষেত্রে তাহার চাহনি মাত্রই তখনই, উহারা কুকুর সকল উহারা মাটি আঘ্রাণ করত ছুটিল, ধূলা উড়িতেছে। এখন আবার পূর্বকথিত অন্ধকার; তীর্থযাত্রিদের ম্রিয়মাণ শ্রান্তস্বর শোনা গেল–তাহাদের টুকরো কথা আসিলভবভীতি, পাপ, কর্মক্ষয় হইতেছে! এখনও পূৰ্ব্বকথিত অন্ধকার, দিকসকল অন্তঃসত্ত্বা বিড়ালের ন্যায় মন্থর।

মনিব মহাশয়ের চিত্তে প্রসন্নতা নাই, বহুকালের পুঞ্জিত শুদ্ধতা বিশেষত শিব অর্চনার সুকৃতি লইয়া এক জংলীকে খুঁজিতে কাহিল। অনন্তর তিনি কয়েকজন মিস্ত্রীর সকাশে যাইলেন। ইহারা রাস্তার ধারেই এক মোটর গাড়ী সারাইতে ছিল, যে এবং ক্ষণে ক্ষণে তাহারা সারান ব্যাপার লইয়া যুক্তিতর্ক করে, যাহা অনর্গল ইতর মুখ খারাপ মিশ্রিত; সুতরাং কিছু তীর্থযাত্রী তাহাদের কাছের একটি গাছ তলায় বসিতে যাইতে থামিয়া বেশ দূরে চলিয়া গেল। মিস্ত্রীগণ কুলি কামারীরা যে নিদারুণ খলমতি ছোটনোক প্রকৃতির স্বভাবতই ইহা তিনি জ্ঞাত। ইহাও সম্যক বিদিত যে, ইহারা মৰ্য্যাদার কিছু বা কোন কাহাকেও, দেখিলে চোয়াল ঘর্ষণ করে, তাই তিনি ইতিমধ্যে একবার দ্বিধায় পড়িলেন, এ কারণ যে উহারা এক তীর্থ আগতদের মধ্যে কশ্চিৎ উড়িষ্যাবাসী প্রিয়দর্শনা ডাগর যুবতী রমণীকে লক্ষ্য কেমন যেন করিতেছিল–এই সূত্রে, বিদ্যুতে, হিজড়ারা আভাসিত হয়, এখন পুনৰ্বার হাতুড়ি ও অন্যবিধ শব্দ হইল।

মনিব মহাশয় প্রস্তুত, বিনীত, ইহা নিবেদিলেন,–ভায়া, এক দেশওয়ালী ছেলে, তাহার চোখে জল ছিল, অবশ্য আদতে সে অনুমান করে যে আমরা হয়ত গাড়ীভাড়া উদ্দেশ্যে তোমাদের কাছে আসিতেও পারি খোঁজ খবর করিবারে, তাই, এখানে আইসে; এঞ্জিনের কিয়দংশ নিরীক্ষণে মহাভয়ে সে বিচলিত, তত্রাচ উহার এঞ্জিনের কটু চেহারা তাহারে যথাক্রমে আকর্ষণও করে, ও যে তোমাদের কর্মকুশলতায় সে বিস্ময়াবিষ্ট, ও তদীয় জিহ্বা অনেক কিছু প্রশ্ন জন্য সরস হইতে আছিল বটে, যে বিরাট টায়ার উত্তোলনে সাহায্য করিতে চাহে এবং যাহারে তোমরা অশ্লীল বচনে খেদাইলে–ঠিক যখনই সে কলকজার বৈজ্ঞানিক সূক্ষ্মতায় বিমোহিত, যখন উহা তাহার চমৎকার স্মৃতি হইতেছিল! এখন বলিতে পার সে কোথায় গেল।

এবং যে স্থলে অনেক মনোহারী পসরা-মেলান দোকান; সুঘরাই একদা চামেলীর মাতোয়ারা সৌরভে সচকিত, যে সে তির্যক নয়নে রকমওয়ারি শিশি সকল নজর করিল, ঐগুলি চাকচিক্য সমন্বিত, এতেক মধুর মনোজ্ঞ গড়নের যে যেন উহারা হেঁয়ালী গীত জানে! এহেন আতরের দোকান সাক্ষাতে সুঘরাই যেন রিখিয়াতেই, কোন ক্ষোভ নাই। অতএব মনিব মহাশয় বিচার করিলেন এমন যে, এখানে কিছু সময় হয়ত বা অতিবাহিত সুঘরাই দ্বারা হইয়াছে।

যে সে কতবারই না, মদীয় পত্নীর উৎকৃষ্ট আবলুস কাঠ নির্ম্মিত আয়না দেরাজের উপরে, জেডের সুলক্ষণা অতুলনীয় রূপের এক চৈনিক দেবীমূর্তি ও ইহারই আশেপাশে, মাইরি কি অভিরাম বোগদাদের গোলাপ পাশ, ব্যহেমীয় শিশি বাহার ও ইদানীংকার ফরাসী এসেন্সের আধার, একই কেয়ারিতে–আনারকলি-বাগিচা ছাঁদে সাজান, সুঘরাই যাহা দেখিতে মোহাচ্ছন্ন আজ্ঞাবহ দাস হইলেও সাড়হীন; যদিও হায় সে পদ্ম পাতায় খায়, সে প্রায়-জংলী, তারাময়ী অন্ধকার এখনও তাহার নিকট সুন্দর হয় নাই, পরীর গল্প সে শুনে নাই! শুধু স্মরিয়াছে ঐখানে সৌখীনতার মধ্যে কোথাও যেন ভোর হয়, আবার পাখীরা ফিরিয়া আইসে দারুণ পড়িমরি দৌড়ান যায়–তখনও সে লুপ্ত হইয়া যায় না!

তৎপ্রবর্ত্তীত, রাস্তার উপর এই বেলোয়ারী সম্ভারে গতিরহিত সুঘরাই সুনিশ্চিত হাতের কব্জিদ্বারা বিগলিত অশ্রুধারা মুছিয়াছে এখানে, জয় শিব শম্ভ ধ্বনি কানে আসে না। এখন এতদ্ভাবাপন্ন তিনি মনিব মহাশয় চুনটকৃত দোপাল্লী টুপী-পরা বিলাসী আতরওয়ালাকে প্রশ্ন করিতে যাইয়া অচিরাৎ মহা দ্বিধায়, কিসের তত্ত্ব করিবেন তাহা জ্ঞাত নহেন মুখ্যত; যেন তিনি আতরের খবর লইতে আসিয়াছেন, কেয়া গুলাব শামামা এবম্বিধ নাম তাহার স্মরণে আছে এবং যেমন ইহাদের মধ্যে একটি নাই তথা খোয়া। গিয়াছে; এখন তাহা সত্যই আতর না অন্য; না, অন্য কিছু নয় তাহা আতরই, তাহাই সুঘরাই অর্থাৎ।

অনেক শিশি দেখিতে তাহার স্থিরতা আসিল, কহিলেন,–যে বালক রক্তিম নয়নে মহাশয়ের পসরা বিদগ্ধভাবে পর্য্যবেক্ষণ করে, ফলে তাহার এই অপ্রত্যাশিত ভৌতিক সংগ্রাম হইতে নর্দ্দমা হইতে খানিক অব্যাহতি লাভ হইয়াছে ক্ৰমে বমি উদ্রেককারী গন্ধ তাহা হইতে সরিয়াছে যে এবং, সে যে অকথিত সান্ত্বনা পায়, যে, সে হারাইয়া যাইবার নহে; এবং সে এই বিশ্বাসেই, যে যদি ভগবান শিবের জয়ধ্বনির-নিকটে থাকিতে পারে তাহা হইলে কোনরূপেই সে হারাইতে পারে না–তাই সে ছুটিল, কিন্তু কোন ঢাকীর পশ্চাতে তাহা কি জানেন, সে কি ঐ সিন্ধু প্রদেশ আগত যাত্রীদের…পশ্চাতে!

অতঃপর মনিব মহাশয় আপনার পদক্ষেপ সংযত করিলেন, কেন না আশ্চর্য্য কথায় তিনি কেমন যেন, যে যাহা এই, তীর্থযাত্রিদের একজন বলিতেছিল,–যে তিনি আর ট্রেন হইতে নামেন নাই, বাবা বৈদ্যনাথকে গাড়ীতে বসিয়া প্রণাম করিয়া বলিলেন,-বাবা তুমি জান আমার মৃত্যু আসন্ন কল্য সন্ধ্যায় আমার ‘—’ ঘটিকায় কাল হইবে, আমি কাশীধামে যাই, আমি গঙ্গাতীরে শেষ নাম জপ করিব, আমি মুক্তি চাই, তুমি দেবাদিদেব তুমি লইয়া চল…তারক ব্রহ্ম নাম তুমি দিও!

সুঘরাই অদ্ভুত চোখ করি এহেন কথা শুনিতে জিহাদ্বারা অধর সিক্ত করে; সে আন্দাজে কিছু অনুধাবনে, ইহা ভাবে, যে উহা ঐ বক্তব্য এক দারুণ ষড়যন্ত্রের খবর, অন্যপক্ষে এরূপ স্বস্তিও তাহাতে জন্মায় যে ইহা ভাল, যে বৈদ্যনাথে নামিলে অব্যর্থই হারাইয়া যাইত; ঢাকীরা তাহাকে, সেই বৃদ্ধকে, পয়সার জন্য ত্যক্ত করিত, বুঝিতেই চাহিত না যে তীর্থে কাঞ্চন স্পর্শ করিবে না বলিয়া সেই বৃদ্ধের যথাসর্বস্ব তাহার সঙ্গীদের নিকট; ভাল যে কাশী গিয়াছে আর হারাইবার সম্ভাবনা নাই।

যুগপৎ ব্রত বিগ্রহ গরুটি, যাহার ললাটে চমৎকার সিন্দুর, বিশেষত সেইটির জন্য সুঘরাই ক্ষুগ্নমনা এখন দেখিল, সকল উদ্বিগ্ন কণ্টকিত গাভীর চক্ষুদ্ৰায় জাজ্বল্যমান, ইহারা ব্যথিত স্বরে হরব করে, যাহা সস্নেহ লেহনের শব্দের ব্যঞ্জনা অনুসারী, যে স্বর পদ্ম হইতে, দেবীর চরণ ন্যায় শুদ্ধ; ইহা চতুর্বিধ আকাশ, পরিক্রমণ, ভেদ করত, মহাব্যোমে পৌঁছায়, সেখানে সুস্পষ্ট অভিধানে ঐ ব্রত বিগ্রহ গাভী এই অভয় দেয়, যে, হে জ্যোতির্ময় তুমি বিকিরণ কর, অন্ধকার বিনষ্ট কর, শুন, মানুষে আর কোন অজ্ঞান নাই, বৈচিত্ত নাই, যে তাহারা ফুলে,কুঁড়ি উদগত হইতে দেখিয়াছে, প্রস্ফুটনে তাহারা উথলিত, বেশ কাল অন্তে উহার ঝরা প্রত্যক্ষে তাহার বাস্তব হইয়াছে এবং সুদীর্ঘতা ও বিপুল এই দুইকে আপেক্ষিক জানে! অগ্নিকে শপথাৰ্হ মান্য করিয়াছে, মদীয় হরবকে প্রস্তরে পর্যন্ত আরোপিত করিয়াছে। সুঘরাই গাভীসকলের কারণে চিন্তিত বিমর্ষ কেন না চৌকিদাররা ক্রমাগত রিখিয়ার পথের অন্ধকারে হাঁক পাড়িতেছে, সকল গ্রামবাসিরাও দিভ্রান্ত যে সে অনুমান করিল।

অতঃপর সে ভাবিয়াছে মনিব মহাশয় নির্ঘাত এখন সেই বদ্ধ উন্মাদের সম্মুখীন, যাহারে তিনি সমাহিতচিত্তে সংস্কারবশত পরিগণন করিলেন, যথা ইহা নির্দিষ্ট যে আত্মদর্শীরা উন্মাদবৎ রহেন, তাঁহারা জড়বৎ পিশাচবৎ বালকবৎ হয়েন, এবং যেহেতু কয়েকজন বৈষ্ণব সন্ন্যাসী মালা জপিতে থাকিয়া সেই ব্যক্তিতে আকৃষ্ট রহে–এ কারণে তিনিও বিবেচনা করিলেন, ইঁহাকে দেখি বদ্ধ উন্মাদ, নিশ্চিত মহাপুরুষ, অবশ্যই পরহিতব্রতীও হয়ত; আর যদি ইনি তাহা না হইয়া থাকেন, যদি ইনি সাধারণ পাগল হন, সেই ক্ষেত্রে ইহা বিদিত যে, পাগলরা সত্যের সন্ধান, ব্যবহারিক সত্যের সন্ধান দিয়া থাকে; এখন যে কোন পক্ষে, আমি ইহাকে শুধাইতে ব্যাকুল, বিশেষত এই নিমিত্ত যে,বেশ ভালরূপেই জানি সুঘরাইএর পাগল খ্যাপাদের প্রতি প্রগাঢ় দরদ উৎসুক্য আছে, কতদিন সে তাহাদের ভাত দিবার জন্য পদ্মপাতা আনিয়াছে, নিজ অন্নদানে উৎসাহিত হইয়াছে, আবার ইহাও ধ্রুব যে, অন্যধারে যাহাদের মতিচ্ছন্নতা তাহারে প্রমোদিত করিয়া থাকে এবং যাহাদের জ্বালাতন করণে কি অবধি হৃষ্টতা তাহার, যে পরক্ষণেই উন্মাদদের প্রতি আক্রমণে পলায়ন তুল্য আহ্লাদন তাহার আর কৈ!

এতদপ্রবর্ত্তীত, সমীপবর্ত্তী মলিন চ্যাগড়া গাত্রে উন্মাদকে করজোড়ে এবং জানাইলেন, আপনি অনন্যসাধারণ, হে নরোত্তম আপনি ধন্য, আপনার নিঃসঙ্গতা ভাগবত কথিত, আপনি গোপনতা বহন করেন–গোপনতার গোপনতা! আপনকার বিচ্ছিন্নতা নজরে যে বালক নিজ অবস্থা সত্ত্বেও থ; যে, নির্ঘাত বুঝে সেও ক্রমশ গোপন হইয়া যাইতেছে, ক্ষণেক পাংশু হইয়াছে; কোনমতে সে সোজা ছিল, যদিও যে আপনার মুখে হাস্য ছিল তথাপি সে আপনাকে বেচারী বলিয়াছে, যে যেমন আপনিও হারাইয়া গিয়াছেন, হায় আপনি থানা পোস্ট অফিস ভুলিয়াছেন, মাঠে ঘাটে ষড়ঋতু খেলা আপনি ভুলিয়াছেন; বালক ইহা অবিদিত যে, মহা ব্যোম আপনকার বৈভব; এবং যে রোরুদ্যমান সেই রিখিয়ার ছেলেটি, আপনার দৃশ্যত-আধিভৌতিক দুঃখে বড়ই বিকল, যে আপনার কেহ নাই, এখন আপনার দিক বিচারও নাই; এরূপে সে নির্ভয়েই আপনাকে দেখিতে থাকে, হঠাৎ সে আতঙ্কিত হইল, সে ত্রিকূট পাহাড়ের দিকে চাহিল এবং স্থান ত্যাগ করে…তাহার বিষয়ে কিছু বলিবেন। আর যে সেই বদ্ধ উন্মাদের তর্জ্জনী সঙ্কেত আশায়ে ক্ষণকাল বিলম্ব করিলেন। সম্মুখের পাগলামী অন্তর্হিত হইল।

বেশ খানিক দূরের পথিপার্শ্বস্থিত উত্তম তিলক-সেবা মণ্ডিত গোখুর শিখাযুক্ত জনৈক গণৎকার দর্শনে মনিব মহাশয়ের ঔৎসুক্য উপজিল, তিনি নিকটে যাইলেন এ কারণ যে এই গণৎকার কিয়ৎ অভিনব পন্থীর, ইহার সমক্ষে বিচিত্র সাজ সরঞ্জাম, অক্ষ, চিত্র ইত্যাদি, নভোমণ্ডলে গ্রহনক্ষত্র পরিস্ফুট চিত্র, শনির পরমদ্ভুত সন্ত্রাসপ্রদ কুটিল শুধুমাত্র মুণ্ড অঙ্কিত, ও যন্ত্র সকলের ছক। যখন সুঘরাই এখানে সে ঐ গণৎকার ইনি এক বর্ষীয়সীর করকোষ্ঠি স্বাধ্যায়ে নিমগ্ন, চমকে তিনি খড়ি পাতিলেন, স্মিতহাস্যে ঊর্ধ্বে হস্তসঙ্কেতে মৌনভঙ্গ যেক্ষণে করিবেন, তৎকালেই–ইতিপূৰ্ব্ব হইতে যে অস্পষ্ট গোলমালের শব্দ হেথা হইতে শোনা যাইতে আছিল, তাহার বেশ দূরে এক জনসমাবেশ দেখা গেল, সামনের কয়েকজন ঈষৎ ধীরগতি, পশ্চাতে বিক্ষুব্ধ অনেকেই।

কাহাদের পুলিশ ধরিয়া আনিতে আছে; বাম পার্শ্বে এক রোগা লোক, তদীয় হস্তষ্কৃত সাঁড়াশী কজায়ে একটি মুচি (সোনাগলানর আধার), ইহার গর্ভ হইতে একটি স্বর্ণ সর্পের মস্তক উত্তোলিত ত্রিশূলের শীর্ষ, এগুলি মুচিতে খানিক গলিত পিণ্ডে আটকান; দক্ষিণে একজনা সুবেশী পিছনে একজন গামলা-উনুন, কেহ হাফর ইত্যাদি বহিতেছে, কিছু অন্তরে মত্তমাতঙ্গপ্রায় জনতা যাহাদের দন্ত বিকট প্রকটিত, বলিতেছিল,–শালাদের আমাদের হস্তে অর্পণ কর।

কেহ কেহ প্রস্তরহস্তে রোষামর্ষ চক্ষু ঘুরাইয়া কহিতেছিল,–আমরা ঐ শনৈশ্চর নরাধমদিগের রক্তে কপালে ফোঁটা কাটিয়া পুণ্য অর্জন করি, কি ভয়ঙ্কর ইহারা!

কেহ বলিতেছিল,–ইহারা কাহারা ইহারা গাছকে গাছ জলকে জল বলে কি, ইহাদের ঘুম কি পাতাল প্রবেশ করিয়াছে!

কেহ বলিল,–আমাদের হাত কাজে অতীব শক্ত কড়া পড়িয়াছে, হৃদয় বুক আমাদের বাবার কৃপায়ে এখনও ছাগল ছানা!

কেহ, এবম্বিধ হট্টগোলে আকৃষ্ট হওয়ত, এরূপ ব্যাপার সাক্ষাতে বিভীষিত,পাপ! পাপ! বলিতে থাকিয়া কান নাক মলিয়া একটি করজোড় মস্তকে ঠেকাইয়া, সত্ত্বর শিবগঙ্গায় স্নান উদ্দেশ্যে, পাপমোচন উদ্দেশ্যে গেল।

অসমাপ্ত স্নানার্থীরাও পুনরায় স্নানে যায়, সেই দৃশ্যে রমণীমণ্ডল চক্ষু আনত করে দ্বিচারিণী হইবার ত্রাসে! এই বিবিধ উদ্বেগের মধ্যে হঠাৎ এক প্রস্তরখণ্ড আসিয়া লাগিল সুবেশী লোকটির ললাটে; রক্ত কিঞ্চিৎ পুলিশের জামায় ও স্বর্ণকারের মুচিস্থ রূপগুলিতে! রমণীরা চোখ ফিরাইল; এ সময় শহরের এক ডাক্তারবাবুর পাল্কী-গাড়ী এই ঘটনার সন্নিকট হয়, তিনি গাড়ী হইতে নামিয়া–উৎক্ষিপ্ত জনতা যাহারা বাবা বৈদ্যনাথের জয়ধ্বনি দেয়, আর মার মার বলে–তাহাদের ভেদ করত যাইলেন, আশ্চৰ্য্য মুচিস্থ অবস্থা দর্শনে তিনি সত্বর সেই দিকে হস্তের গ্ল্যাডস্টোন ব্যাগ খুলিতে ক্কচিৎ থমকাইয়া এবার সুবেশধারী লোকটির সাহায্যের নিমিত্ত প্রস্তুত।

সুঘরাই এ সকল কিছু দেখিতে থাকিয়া উৎচকিত, তাহার কণ্ঠের শিরাউপশিরা কোন এক চীৎকার নিমিত্ত স্ফীত, এখানে সেখানে দৃষ্টি সঞ্চালন করিল, মনিব মহাশয় হয়ত কাছেই কোথাও–এই অসম্ভাবিত ব্যাপারে মর্মাহত তিনি অবশ্যই–এই জনপ্রবাহ বেশ দূরে যায় যখন সুঘরাই ইহা বিবেচনা করে।

২. সুখ দুঃখ চক্রবৎ

গণৎকার তখন কহিতেছিলেন,–সুখ দুঃখ চক্রবৎ…দুঃখ যাইবেই, আবার দুঃখ তোমার গৰ্ব্ব হইবে, তুমি অপেক্ষা কর, তোমার স্বামীর এত দুশ্চিন্তার কোন কারণ দেখি না, পুত্রের পুনরায় বিবাহ অহেতুক, তোমাদের সলিতা আসিতেছে, তোমাদের কখনই অন্ধকারে ভ্রমণ করিতে হইবে না, পুত্রবধূ বীজ ধরিয়াছে…তোমাদের ধর্ম্মকর্ম যথেষ্ট দানধ্যান আছে…!

সুঘরাই নভোস্থলের প্রতি মন রাখিতে বাধ্য হয় কেননা গণৎকার ছোট একটি ছড়ি দ্বারা উর্ধের ঐ লোক দর্শাইয়া গ্রহর গতিবিধি উল্লেখ করিতেছিলেন, অতএব সে ইহাতে সেই ছবির নীল রঙকে স্পন্দিত অনুভব করিয়া রোমাঞ্চিত।

সুঘরাই, কল্পনা করিল–এখন মনিব মহাশয় এই গণকারকে শুধাইলেন,–মহাশয়, আপনি যখন এক মহিলার সংশয় দূর করা নিবন্ধন, ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান বলিতেছিলেন, ঠিক যখন পুলিশ কর্তৃক ধৃত সেই স্বর্ণকার ও সেই ধৰ্ম্ম-বৈপ্লবিক নেতাকে লইয়া যাওয়া হইতেছিল, তখনই আমি দূর হইতে দেখিলাম একটি বালক এখানে আপনার ক্রিয়াকলাপ দেখিতে উদগ্রীব, ক্ষণেকেই মহা হট্টগোল শ্রুত হয়, পথের সকলেই সেইদিকে মুখ ফিরায়, আমিও চাহিলাম, আমার আর ডাকা হইল না, পরক্ষণেই আমি আপনার সান্নিধ্যে ভীড় কাটাইয়া আসি, দেখি বালক নাই, একবার মনে হইল আমি কি ভুল দেখিলাম, না, তাহা নহে; তখনই ঐ ভীড়ের মধ্যে অনুসন্ধানক্রমে যাইলাম উচ্চৈঃস্বরে ডাকিলাম! সেই দুইজন ব্যক্তির কদর্য্য কাণ্ডে আমি সম্বিৎশূন্য, অনতিবিলম্বে ঐ সুন্দরগুলির পাষণ্ড পরিণতিতে আমি হতস্নায়ু, মুচিস্থ ভক্তি-নিদর্শনগুলি আমারে আঁচড়াইতেছিল, কেন না সেখানে প্রাণিপাত যোগভ্রষ্ট হইয়াছে, চেতনা রেখা-ছাড়া হওয়ত পিণ্ড, সঙ্গে সঙ্গে মদীয় খোঁজার প্রেরণা যুক্তি, আরোহীপ্রথা দারুভূত, কেন না ঐ দৃশ্য সর্বৈব সংজ্ঞা-বিঘাতক!

আমি যেমন যে অন্যকিছু, আমার সুকৃতি সকল বিনষ্ট, অতঃপর স্খলিত পদে চলিতেছিলাম, অবলীলাক্রমে আপনকার নভঃমণ্ডলের চিত্র আমার চোখে পড়িল, আমার দিক-নিশ্চয় হইল; আমি সন্ধানে প্রবৃত্ত হই। ইতিমধ্যে বালক আসিল, আপনার বিবাহ শব্দ তাহাকে কিস্তৃত করে, তখনই আবার যেন সে সেই চীৎকার করিতে চাহে, কিন্তু আপনার সলিতা কথা তাহাকে বড় আতান্তরে ফেলে, সে নিজে সলিতা গড়ন জানে, অথচ ইহার মানে কি, অথচ বর্ষীয়সী মহিলা ইহাতে যারপরনাই খুসী; সে সুঘরাই আবার নীল ছবিখানির দিকে তাকায়…তাহার গতিবিধি কি আপনি…!

.

শিবগঙ্গার পশ্চিমে যেখানে আছার নাপিতগণের চোখ কভু ছোট কভু বড়, কেহ বা চুল ছাঁটে, কেহ খেউরী হয়, কেহ চক্ষু বুজাইয়া উৰ্দ্ধবাহু বগল কামায়, কেহ মস্তক মুণ্ডন করায়; মনিব মহাশয় স্বাভাবিক ধারণায় এই সুদীর্ঘপথব্যাপী কর্মতৎপরতা ঈষৎ কৌতূহলে নজর করিলেন, এখন নিকটস্থ এক ক্রন্দনের শব্দ বহুত কাঁচির আওয়াজ ভেদ করত আসে, দেখিলেন একটি বালক যাহার দন্তে কুটা যাহা পাছে পতিত হয় তাই তাহা এখন দন্তে চাপিয়া কাঁদে, নাপিত সান্ত্বনাবাক্য বলিতেছিল,–ছিঃছি কান্দিও না, তিনি শিবের কাছে গিয়াছেন, তাহা ব্যতীত এরূপভাবে কান্দিলে অঘটন হইবে!

সুঘরাই অবাক চোখে পিতৃহারা বালককে দেখিল। বালকও সুঘরাইকে দেখে!

এই নাপিতের কাজের শেষে মনিব মহাশয় প্রশ্ন করিলেন, হে নাপিত একটি বালক যে অনেকক্ষণ যাবৎ গুরুদশা প্রাপ্ত (পিতৃবিয়োগ) এখনই যে ছেলেটি চুল ফেলিতেছিল তাহার ক্রন্দনে স্বীয় নয়নের অশ্রু মোচন করত অভিনিবিষ্টচিত্তে তাহাকে দেখিতেছিল।

ও যে সেই সময়তে, ক্ষৌরকর্মের মারাত্মক করাল শব্দ শুনিতে থাকিয়া চালনা কৌশলও অনুধাবন করিতেছিল, যে এবং এই সকল সূত্রে আশ্চৰ্য্য এতাদৃশও ভাবে যে, হায় আমি কি পৰ্য্যন্ত বঞ্চিত! আমার কোনই খেই নাই, এমন কোন আমার উর্দ্ধতন কেহ নাই, যাহার নিমিত্ত আমার মস্তক মুণ্ডনের সুযোগ আসিবে! হায় আমি ঝড়ের মুখে এঁটো-পাতারও অধম! হে নাপিত, ইহা লোকপ্রসিদ্ধ যে, তোমরা দারুণ চতুর, এখন তোমার হাতের ক্ষুর চালনা রাখিয়া, একটু ভাবিয়া দেখ ত, কেন না বালককে তুমি খদ্দের ভাবিয়া থাক, এখন মনে কি হয় সে কি রিখিয়ার রাস্তার দিকে গিয়াছে।

হায় যদি মনিব মহাশয়, সুঘরাই যখন এখানে, তখন এক বিলাইতী বাজনা একটি ব্যাগ-পাইপসহ ঢাকের শব্দ শুনিতেন, নিশ্চয়ই তিনি মুগ্ধ হইয়া দ্রুত সেই দিকে লক্ষ্য করিতেন, কিন্তু আদতে বাজনার হেতু দর্শনে-সুঘরাই অবিকল এখন যেন দেখিল–তিনি মুহ্যমান, একধারে আশা ও দুঃখ তাহারে কালো করিল, এ কারণ যে উহা এক শবযাত্রা, চারপাইটি অদ্ভুত সাজান বাঁখারি নির্ম্মিত ছোট ছোট খিলান করা, উপরে চেলি-ঢাকা (পাটের কাপড়) যাহার আবির রঙ সকলকেই মোহিত করে।

মনিব মহাশয় বুঝিলেন সম্ভবত ইহা ডোম জাতির মৃতদেহ, ইহাদের সহিত কি সুঘরাইএর সাক্ষাৎ হইয়াছে; হয়ত ইহাদের মধ্যে সুঘরাইএর কোন জ্ঞাতি সম্পর্কের লোক থাকিতে পারে, তথাপি তাহাদের তিনি প্রশ্ন করেন না, নিশ্চয়ই তিনি সুঘরাইএর বিকার বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে যদি ইহা বাঁশ বাঁধা শব হইত তাহা হইলে সুঘরাই নিশ্চয় অনুসরণ করিত, ভাগাড়ে যাইত, সেখানে সে দাঁড়াইয়া থাকিত, স্বজাতি তাহাকে দেখিয়া ঘোট এক হাড় ছুঁড়িয়া মারিত–হিঃ রে! সেও আহ্লাদে অধীর হওয়ত একটি হাড় ছুঁড়িয়া জানাইত যে, সেও খুসী। দুজনেই আনন্দিত খুসী আত্মীয় দর্শনে। তখনই শিশির দেখা যাইবে। বাজনা শ্মশান অভিমুখে চলিল, মনিব মহাশয়ের মস্তক উন্নীত হইল, তিনি অদূর শ্মশান হইতে উখিত কুণ্ডলীকৃত ধূমরাশির গাম্ভীর্য্যের পানে তাকাইলেন, নিশ্চয় কোন জিজ্ঞাসা তাঁহার ছিল না।

মনিব মহাশয় সত্যই নিরাশ হইয়াছেন, সামান্য এক ভৃত্যের জন্য এত তল্লাস কেহ করে না, কিন্তু যেহেতু ইনি পরম ধার্মিক তাই এতেক ব্যগ্রতা; যখন তিনি অবনত মস্তক চলিতেছিলেন, তখন সহসা শিব-জয়ধ্বনি উঁচাইয়া অস্বাভাবিক স্বরে গীতের বিস্তার হইল, এই গান নিশ্চয় সর্দার পাণ্ডাঠাকুর লিখিত যাহা–

‘আজু জাগরণে রাতিয়া বিতল সখী যে ভৈল ভোর গে, হায় রাম’–

এই মাঙ্গলিক সুললিত পদবন্ধ শ্রবণে তাকাইলেন–যে এবং কিয়ৎ রশি দূরে দৃশ্যমান হইল, ঘোর লাল পাটের সাড়ী পরিহিত, কালো তেলাল চুলে পাতাকাটা ও পাতায় চুমকী, নাকে ফাঁদি নথ ও নানাবিধ পিতলের অলঙ্কারে ভূষিত পাঁচটি হিজড়া একজন স্ত্রীলোককে, যাহার মাথায় বটপল্লবসহ ঘট, তাহাকে, মণ্ডলাকারে খেমটা নৃত্যে পরিক্রমণ করত, ঐ গীত সহকারে ক্রম অগ্রসর হয়; এই দলের পিছনে এক সুরম্য ডুলি ও যাহার অনুগমনে কুসুম-রঙ-ছোপান বস্ত্র শৌভিত আর রৌপ্য অলঙ্কার সজ্জিত দাসীরা যাহাদের হস্তে পূজা উপচার রহিয়াছে। সুঘরাইও ঐ সকল কিছু এইভাবেই দেখে! তার পর শোভাযাত্রা এক কারণে থামিয়াছে বসিয়াছে, হিজড়ার দল চুটা ধরায়। ঐ এখন আবার চলিতে সুরু করিল।

মনিব মহাশয় সবিস্ময়ে এহেন চমৎকার দলকে পর্য্যবেক্ষণ করিলেন যে তাঁহার ইদানীন্তন বৃত্তি বশবর্ত্তী তাহাদের কাছে খবর করিতে ইচ্ছা হইল; তিনি নির্ঘাত যে সুযোগ অপেক্ষায় তাহাদের অনুসরণে খানিক পথ যাইলেন, শিবগঙ্গার নিকট যখন পুনরায় সেই দল রুখিল, তৎকালে তিনি তাহাদের, ঐ হিজড়াদের কাছে–যেহেতু শোভাযাত্রার অন্য সকলেই মৌনী–সুঘরাইএর সংবাদ জানিতে গিয়া অস্বস্তিতে ইতস্তত অন্যত্র মনস্ক হইলেন। অনেকটা দূরে খোলার চালের বাড়ী, খোলার পলা-রঙা চালা ও তদুপরি পরমদ্ভূত দর্শন পোড়ামাটির হাতী ও পায়রা তদীয় দৃষ্টি ব্যাহত করে, সহসা এইগুলিতে তাহার বুকে আশ্চর্য পথে ভরসা আনিল। যে তাঁহার সঙ্কোচ আর নাই, তিনি মধুর বচনে হিজড়াদের কাছে ইহা উল্লেখে বলিলেন,–তোমরা কি আমার কথার উত্তর দিবে, যে বালক আপন গাত্র হইতে গেঞ্জীটি উন্মোচিয়া সেই গেঞ্জী দ্বারা আপন চক্ষু মুছিতে কালে তোমাদের প্রত্যক্ষ করে, এবং ভাবিয়াছিল, অনেক সময় যাবৎ তোমাদের দেখিলে মঙ্গল হয়, এবং সে আমাদের সাক্ষাৎ পাইবে এরূপ বিশ্বাসেই সে স্বাভাবিক! মনিব আরও বলিলেন, যে তোমাদের কুহকময় অঙ্গুলি আছে যেটি তোমরা আপন সুপুরু ওষ্ঠদ্বয়ে স্থাপনে আমাদের নিমিত্ত কর, মানুষের নিছক ধারাবাহিকতা পরোক্ষে স্মরণ করাও, যে তোমরা চম্পক অঙ্গুরীয় বৈপরীত্য; অঙ্গুরীয় আলো, তোমরা চমকপ্রদ স্তব্ধতা!…এখন সেই বালক, তোমাদের বিশ্রামের কারণ বুঝিয়া আপন পাপস্খলনের জন্যও মানুষের গলাতে ও স্বরে কি নোনা আছে–বলিল, যে সে মন্দির সমীপস্থ অঘটন দেখিয়াছে, যে সে চন্দ্রকলা ভূমিতে-বাঁকাচাঁদ এককলা জ্ঞানের প্রতীক যেমন শিবের মাথায় থাকে–পতিত হইতে দেখিয়া বৃক্ষে উঠিতে চাহিয়াছে, ঐ কীৰ্ত্তির চন্দ্রকলার মনোরমত্ব তাহাকে মুগ্ধ করে, সত্যই যাহা মননে যে কোন হিন্দুজনম সার্থক তখনই!

যে এবং, যে সে অবলোকন করে, এক অপূৰ্ব্ব কন্যাকে পদব্রজে আসে, যাহারা ধর্ম্মতাত্ত্বিক সাধক সন্ন্যাসী যাহারা নিজ নিজ স্তব ‘মহামহিম্ন’ ও ‘নির্ব্বান ষটক’ পাঠ করিতেছিল তাহারা কন্যাদর্শনে উহা থামাইয়া—’অহো ভগবতী তনু ভগবতী তনু’ উচ্চারণে আকাশ বিদীর্ণ করিল, যাহারা এখানে সেখানে পদ্মাসনে বসিয়া নিমীলিত নয়নে ধ্যানস্থ ছিলেন তাহাদের গাত্রে ঐ শুদ্ধ শব্দে মুহুর্মুহুঃ রোমাঞ্চিত হইতে থাকে, এমত সময় নেতৃবর্গসহ হরিজনরা আসিল, প্রলয় কাল আসিল, কন্যা ন যযৌ ন তস্থৌ হইলেন কিয়ৎক্ষণ, অতঃপর শুভমিলনের কারণে ধাবিত হইলেন, এ সব ব্যাপার অনেকক্ষণকার, এখন নিশ্চয় শাস্ত্রমতে বিবাহ কাৰ্য্য চলিতেছে! আর সেই দুবৃত্তরা অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হইয়াছে, তাহারা দন্তঘর্ষণ করিতেছে, তোমরা আর কালবিলম্ব করিও না, অদ্য অনেক দুগ্ধ ঘৃত পূজা উপচারাদি নষ্ট হইয়াছে, হোমকাষ্ঠের অভাব, সত্বর যাও, ভোগের আর বেশী দেরী নাই, জয় বাবা বৈদ্যনাথ!–সেই বালকটির কথা, যে আপন হঠকারিতায়ে অধোবদন, অনুতপ্ত যে সে-ও হরিজনদের সহিত চীৎকার করে, সেই বালকের কথা তোমরা বলিতে পার…!

হায় আমার চক্ষুর মধ্য দিয়া নিয়ত বাদুড় প্রবেশ করিতেছে, হায় আমার নাম সুঘরাই, যাহা ক্রমাগত শিব জয়ধ্বনির মধ্যে ডুবিতেছে, হায় এ পৃথিবীতে পচাগলিত দুর্গন্ধ কিছু নাই, ঐ ধ্বনি সকল কিছু গ্রাস করিতেছে, যে আওয়াজ ভেদ করত আমিও বহুসময় শালা বলিয়াছি, যেহেতু আমি ডোম, কিন্তু তাহারা আরও পাপ করে যাহারা উচ্চৈঃস্বরে বৈষয়িক কথা ঐ ধ্বনি সময় কহে, আমি শুনিয়াছি; আমিও ত আমার নাম ধরিয়া অনেক অনেক বার ডাকিয়াছি! হায়! মনিব মহাশয় যদি ঐ ব্যাঙটি দেখেন তাহা হইলে কি ভাবিবেন, নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমা করিবেন, যে আমি মহা আক্ষেপে আপশোষে ক্রোধে উহারে আহত করিয়াছি!

এখন তিনি অসংখ্য ভিখারীদের সামনে, যে সুন্দর রৌদ্র উহাদের এড়াইতে পারে নাই, যে শুধুমাত্র একের ছায়ায় অন্য ভারী কালো, একদম উদ্ভীজ, বিবিধ ভাষায় আশীৰ্বাদ কল্যাণ বচনে ইহারা বিকট, অবিলম্বেই আবার ম্লান, তিনি এই নিকৃষ্ট অবহেলিতদের নম্র বচনে প্রশ্ন করিলেন,–বাবা বৈদ্যনাথ তোমাদের মঙ্গল করুণ, বিশেষ যে, তোমাদের জিজ্ঞাসা করি যে চীৎকাঠ নিবাসী বজ্রাহত ভিখারী যাহার নাম জাঙকী সেই অষ্টবক্র বিকলাঙ্গকে চেন কি না…তাহারে কি স্মরণ আছে? বোবা ভিখারীটি যে বালসরাইএর, তাহার কথা নিষ্প্রয়োজন! অবশ্যই অগণিত তীর্থযাত্রী তোমাদের আশ্চর্য্য নেত্রে নিরীক্ষণে করজোড় করে, বুঝে তোমরা জাঙকীর মতই পূৰ্ব্বজন্মকৃত পাপ বহিতেছে; যে এবং সুঘরাই সিদ্ধান্ত করে, যেহেতু পাপ সে করে নাই তাই তাহার দেহ নিখুঁত, যদি ভবিষ্যতে কখনও সে কোন পাপ সঙঘটন করে, তন্নিবন্ধন সঙ্কল্প করে, সে আপনার হাত পদদ্বয়কে সংযত করিবে, কেননা হাতে নোনা আছে–উহারাই নচ্ছার! এমন যদি, কভু অজ্ঞানে সে পাপ করে তাই আগামী পৌষ সংক্রান্তিতে ভাগলপুরের গঙ্গায় স্নান করিয়া তাহা স্খলন করিবে।

যদিও তাহারা ডোম, নানান বিচার আচার তাহাদের নাই, তথাপি যে এবং আরও, এই মানসিক করে যে যখন সে আধ সের চাউল প্রত্যহ খাইবে তখন তোমাদের নিমিত্ত প্রতি হাটবারে এক পালি চাউল (!) আনিবে, গামছাও দান করিবে, তাহারা ডোম, যদিও তাহাদের ভিক্ষা গৃহীত হয় না, তবু। মুহূর্তের জন্য সে উচ্চবর্ণের হইবে, সেই দেশওয়ালী বালক সহসা অদ্ভুত সঙ্কুচিত হয়, এ কারণ যে। অচিরাৎ কাহারও সম্ভ্রান্ত করে ভর্ৎসনা তাহার কানে আসে; শনৈঃ ঐ তিরস্কারবাক্য সে অনুধাবনেই ত্বরিতেই নিদারুণ চমকৃত, যে ক্ষণেক ইহা সংস্কার জন্মে যে, যে সে যেমন বা হারাইয়া যায় নাই।

সে দেখিয়াছিল যে, অনতিদূরে জনৈকা উচ্চবংশসস্তৃতা গৃহিণী বোধ হয় তদীয় নাতনী, যে ফ্ৰকপরা, তাহারেই তিক্ত সমালোচনায় বলিতেছিলেন,–ছি ছি লজ্জা রাখিবার জায়গা পাই না, ইহারা (ভিখারী) সাক্ষাৎ নারায়ণ! ইহাদের ঘৃণা ছি ছি তোমার ঐ বাপটিস মিসনে এই বুঝি শিক্ষা, ছি ছি, নরকেও স্থান হবে না, ভিখারী বলিয়া…ছুঁড়িয়া ঘুড়িয়া অবজ্ঞা করিয়া দেওয়ার মত পাপ আর নাই; শতজন্ম তপস্যার ফলে মানুষ ভিক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাইয়া থাকে, উহারা কানা খোঁড়া কুষ্ঠব্যাধিগ্রস্ত কি ইচ্ছা। করিয়া হইয়াছে! বলে কুকুর বিড়ালরে অবধি হুঁড়িয়া কিছু দিতে নাই। ছি ছি! উহাদের নমস্কার কর…!

ইত্যাকার কথার সহিত গৃহিণীর উৎকৃষ্ট স্বর্ণালঙ্কারগুলির মৃদু অনুরণনও মিশ্রিত হইতে থাকে, যে। উপস্থিত সুঘরাই সদ্যস্নাত সুন্দর দেখিতে কন্যার জন্য তটস্থ হয়–এবম্বিধ উক্তিতে তাহার ডোম জন্মে আশ্চৰ্য্য এক অপরাধ জানিয়েছিল; আর তোমরা হে ভিখারীগণ, গৃহিণীর রূঢ়তায়ে বালিকার জড়তা বুঝিয়া, তোমরা গৃহিণীপ্রতি বালিকার নিমিত্ত সমবেদনায়, ক্ষমাপরবশ, অতীব করুণায়ে আশ্বাস দিয়াছিলে, থাক থাক্ উহাতে দোষ বিচ্যুতি ঘটে নাই, সে বালিকা, আমরা তিন সত্য করিতেছি উহার অপরাধ আমরা লই নাই, যে বালিকারে আমরা আশীর্বাদ করি, সে শিবলোকে যাইবে, শিবকে পতিরূপে পাইবে, উহার জীবন আমরণ দেবসেবায় ধন্য হইবে, অজস্র দান ধ্যান করিবে, উহার সন্তানরা ত্রিলোক-বিখ্যাত ধার্মিক হইবে, অমর হইবে মাগো!

তোমাদের এতাদৃশ মেহবচনে সেই বালক সুঘরাই যেন এই মাত্র স্নান করিতে চাহিল, কেননা সে চীৎকারে শিবকে পতিরূপে পাইবে, বাক্যকে তছনছ ইতিপূৰ্বেই করিয়াছে, সে কম্পিত, সে তোমাদের নমস্কার করে, তাহারে কোন দিকে যাইতে দেখিয়াছ।

অনবরত পুণ্যকামী আর ঢাকের শব্দে মনিব মহাশয় স্বতঃই বিভ্রান্ত, নূতন করিয়া যে এখন তাঁহার কোথাও গিয়া শুধাইতে ভয়ঙ্কর রাগ হইল; বিশেষত মোহিলির ব্যবহারে বৃথা ভয়ের জন্য–যে সেই কলেরা ইনজেকশন ক্যাম্প রোহিণীর ঐ দিকে না অন্যত্রে উঠিয়া গিয়াছে–গরুর গাড়ীটি থাকিলে কোন গোলই ঘটিত না, সুঘরাই অনায়াসে তাহাতে ঘুমাইতে পারিত; ওষ্ঠদংশন করত তিনি চারিদিকে চাহিলেন, নাঃ একবার শেষ চেষ্টা করি, যদি সে রিখিয়ায় ফিরিয়া গিয়া থাকে; কিন্তু ইহাতে তাঁহার অবশ্যই মনে পড়িবেই যে সুঘরাই কোন উপায়েই একা একা রিখিয়ায় ফিরিতে পারিবে না, অবশ্য যদি কোন সহায় সম্বল পাইয়া থাকে, ভিখারীদের কথা উঠে না, যদি অন্য কাহাকেও পাইয়া থাকে তাহা হইলে সে আর এক কথা।

এমনও যে বিসরিয়ার বাপ, যে প্রত্যহ শহরে পায়ে ঘুঙুর এবং বিরাট ঢাক ঘাড়ে আসিয়া থাকে, ঢাক বাজানই তাহার ব্যবসা, ক্রমাগত তীর্থযাত্রীদের সমক্ষে স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া ঢাক বাজাইয়া শুভ অভিনন্দন জানায়, এবং এইভাবে শিবগঙ্গা পর্যন্ত যায়; তীর্থযাত্রীদের কি আদরের স্মৃতি সে, ভারতের দিকে দিকে চন্দন গন্ধের পাশেই সে; তাহার মত অনেকে। সে ফাষ্ট ট্রেন ধরিবার জন্য রাত থাকিতে আসে, অদ্য তাহারও সাক্ষাৎ নাই।

তবু তিনি অবশেষে এই রিখিয়া তত্ত্ব করিবার স্থির করিলেন; তিনি দুমকার চৌরাহা গিয়া পর্য্যবেক্ষণে জানিলেন, সকাল বেলাতেই বহু কাঠের ভারী, বহু দুধওয়ালা বিষণ্ণ চিত্তে ফিরিয়া গিয়াছে। ও যে দু-চারজন সুদূর ভাগলপুর হইতে বা গঙ্গার নিকটবর্ত্তী এলাকা হইতে গঙ্গাজল, বাবা বৈদ্যনাথকে তদ্বারা পূজা করিবার মানসে আনয়ন করে, তাহারাও শহরে প্রবেশ করে নাই, ক্ষুণ্ণ মনে বালসরাইএর দোকানে প্রত্যাবর্তন করিয়াছে; যে আজ ঐ পথে একেবারে লোক চলাচল নাই, সর্বৈব নিশুতি; এখন এরূপ পথ সুঘরাইএর পক্ষে অতিক্রমিয়া যাওয়া আষাঢ়ে, কিছুতেই ঘটিবার নহে, সেরূপ সাহসও সে পাইবে না–কেন না লকড়!

.

কোন এক সাংঘাতিক সুচতুর লকড়ের উপদ্রবে রিখিয়ার আশপাশ অনেক মৌজা সৰ্ব্বদা আতঙ্কিত হইয়া আছে, যে সেখানে ঘুম নাই, ক্রমাগত নিদারুণ ফেউএর ডাকে সকলেই শঙ্কিত, কুকুররা গ্রাম হইতে বাহির হয় না, কোথাও পাতালতা তূপীকৃত করিয়া আগুন দেওয়া হয়; সকলেই একযোগে ভয় পাইয়াছে–একে অন্যকে কাছে টানিয়াছে–ঢাকীরা ঢাক ও অন্যান্যেরা, ছোট-রা, ক্যানেস্তরা টিনের কৌটা ইত্যাদি ঘুম চোখে বাজাইয়াছে, এই সঙ্গে সকলেই থরহরি! রাত্রিগামী গরুর গাড়ীর চাকার শিকে একটি কাঠের সহিত লাগিয়া যাহাতে শব্দ হয়, তজ্জন্য তাহাতে আড়ভাবে চালকরা কাঠ বাঁধিয়াছে, ইহাতে চলাকালে উৎকট আওয়াজ হয়, ফলে কোন জন্তুই গাড়ীর সমীপে আসে না। ঐ লকড় হেতু এমন কি চেঞ্জার বাবুরা কেহ কেহ বন্দুক হস্তে সান্ধ্য ভ্রমণ করেন।

কয়েকদিন হইল এই লকড় এতেক দুর্ধর্ষ হইয়া উঠিয়াছে যে দিনমানেও তাহাকে দেখা যায়, মাঠে গরু পর্য্যন্ত চরান ভাবনার হইয়াছে, তাই অড়হর ক্ষেত যদি পশ্চিমে হাওয়ায় নড়িল, যুগপৎ সকলেই লাফাইয়া উঠিয়াছে, ও হো হো হৈ লকড় হে-হাঁক পড়িয়াছে!

বিদ্রাবিত অসহায় গ্রামবাসীরা গাছের গায়ে নূতন করিয়া সিন্দুর দিয়াছে; বিশেষত এ কারণে যে বালসরাইএর রাস্তার কাছেই কয়েক ঘর ডুমনীর বাস, যে ঠিক সেইখানেতে দিন তিনেক পূৰ্ব্বে এই লকড় দ্বারা এক নৃশংস ব্যাপার সঙ্ঘটিত হয়।

ঐ সকল ডুমনীদের ঘরের সামনে রোজই রাত্রে একটি বোবা ভিখারী ঘোরাফেরা করিত, যে ডুমনী মাগীদের সঙ্গে তাহার ভাব ছিল; ডুমনীরা তাহাকে মহুয়া বা গাঁজার কল্কী দিত; বোবা সারারাত এখানেই তাহাদের ঘরের কাছে ঘোরাফেরা করে।

কোন ডুমনীর ঘরে খদ্দের (বাবু!) আগমনে যখন ঝাঁপ বন্ধ হইত, সেই ক্ষেত্রে ঐ বোবা ঝাঁপের ফাঁসা ফুটো দিয়া আভ্যন্তরীণ ক্রিয়াকলাপ দেখিতে ভালবাসিত; বোবা সে বটে কিন্তু লালা ত ছিল! যেদিন তাহার কাল হয়, সেদিন কোন কোন ডুমনী তাহারে রাত বারোটার ট্রেন যখন যায় তখন দেখিয়াছে, একজন ডুমনী তাহাকে একটু মহুয়াও দেয়, যেহেতু সে কাছেই ছিল মানে ঐ ডুমনীর ঘরের ঝাঁপে আড়ি পাতিয়াছিল; যে ইহার পর যখন সে হয়ত পুনরপি ঐ ভাবে ঝাঁপের ফাঁক দিয়া দেখিতে একমনা তখনই নির্ঘাত লকড় কর্তৃক আক্রান্ত হয়!

বেচারী বোবা!

লকড়টি, ইহা জীবিতরা ধারণা করে যে, গরুর গাড়ী বা অন্য কিছুর নিমিত্ত বোবার খানিক-খাওয়া। দেহ রাখিয়া চম্পট দিয়াছে, এবং উহার মর্মন্তুদ চীৎকার পশু পাখীর সহিত এক! যে সেই কুৎসিত বিভীষিকা সারাদিন রাস্তায় রহে–দূর দূর গ্রামে এই হিম দুঃসংবাদ পৌঁছিয়াছে; যাহারা অনেক পথ ভাঙ্গিয়া আসে এহেন বীভৎস দুর্দৈব প্রত্যক্ষ জন্য, তাহাদের অন্তর আত্মা পাঁশুটে হইয়াছিল; সুঘরাই উহাদের সঙ্গে খানিক পথ যায়–এই ঔৎসুক্যের হেতু মনিব পত্নীর নিকট বকুনিও খাইয়াছে!

উহাদের দর্শকদের মধ্যেই কেহই সেই মর্মন্তুদ দেহ অবলোকনে ‘বেচারী’ পৰ্য্যন্ত বলিতে পারে নাই; যে অন্যপক্ষে কোন নীতিজ্ঞান আব্রাহ্মণ কেহই তাদৃশ দুর্দশা হইতে মন্থনে শক্ত হয় নাই। সকলে কাতর নয়নে শকুনির পরিক্রমণ দেখিতেছিল।

শুধু মাত্র ভীতি! ভীতি তাহাদের–গ্রামবাসীদের অমোঘ অহংতা; আর যে বিশেষত তাহারা যাহারা পূৰ্ব্বজন্মজনিত পাপ বিধায় অতীব নিম্নশ্রেণীর এই জন্মে, ইহা ধ্রুব যে ভীতি তাহাদের পুণ্যও; সুঘরাই ঐ ঘটনাস্থলের খানিক পথ হইতে ফিরিয়া সৰ্ব্বপ্রথম খড় কুড়াইয়াছে, যে একটি সুদীর্ঘ দড়ি তাহার চাই, খড় দ্বারা একটি কদাকার, রশি বানায় ও যে পাখীর খাঁচাটিকে মটকায়–খিলানের লোহাতে তুলিতে চাহিয়াছিল।

.

যে, লকড় হইতে ভীতি, ভীতি চড়াই উত্রাই-এর নিঃসঙ্গতা পার হইয়াই পাখী! যে চকিতে ইহাতে সুঘাইএর নেত্র অভাবনীয় বিস্ফারিত যে যাহাতে একাধারে উদ্বেগ ও অপ্রত্যাশিত পাখী না থাকার দরুণ আপশোষ বিদ্যমান; যে সে এতাবৎকার অনভ্যস্ত মানসিকতা হইতে অধুনা সে মুক্ত, অত্রাহি ভাবান্তর এখন ধূলিসাৎ হইয়াছে, তাহার ডোমত্ব ঘুচিয়াছে।

ইহা যথার্থ যে সে নাড়ীর যোগসূত্র পাখী শব্দে প্রাপ্ত হইয়াছে; যে সে আতা গাছকে আতা গাছ। বলিয়া চিনিয়াছে, যে সে রিখিয়ার কোন সিন্দুর-লাঞ্ছিত মহুয়া গাছকে এখান হইতে নমস্কার করিল; আশ্চৰ্য্য যে এক কুকুর তাহারে দেখিয়া অজস্র চীৎকার পাড়িয়াছে কেন না সে সুঘরাই নাচিয়া উঠে যাহাতে ইহা সিদ্ধ হয় যে সে অব্যর্থ, সে আছে!

এবং এখন, সে মনিবের প্রিয় দাস, সে স্পষ্টত শুনিল, এই হারামজাদা!–আঃ হা পাপ কাহাকে বলে! এবং যে তাবৎ বিশ্বাস যে সে আছে, এই বিশ্বাস তখনই সম্যক, যখন তাহার পাখী আছে, তখনই স্থাবর জঙ্গম সবই সংখ্যায়ে, যে যাহা মননে তদীয় অব্যবস্থিত প্রকৃতি ইদানীং সাধারণ।

আর যে ঐ লকড় কারণে ভয় হইতে শহরের এতক্ষণকার যে একাকিত্বের ভয়ে সে দিকভ্রান্ত থাকে, তাহাতে আর সেই বৈলক্ষণ্যের তেমন চেহারা নাই; এখনই সুঘরাই আপনার দেহ হইতে হাতের পানে চাহিল, ইহা নিমেষেই ওতপ্রোত যেমন যে সেই হস্তে একটি খাঁচা আছে এবং আদতে নিজের গেঞ্জীটি তাই ডান হাতে লয়, যাহা যেন খাঁচা আর যে তবুদ্ধিতে নাচাইলে, যে সে এমন কি খাঁচার ভার অনুভবিয়াছিল; আশ্চর্য্য সে কি পাগল! এত সময়, হায় সে এক রকম নিজ নাম হইতে, এবং যে মাথায় সে এমন অর্থাৎ উচ্চতায় এতখানি যে এরূপ তাহারে দেখিতে হইতে, শুধুমাত্র স্থানবাচক হইয়া সর্বত্রে ব্যাকুলভাবে দৃষ্টি সঞ্চালন করিয়াছে! আঃ তাহাতে বৃত্তি আসিল, সৎসাহস আসিল যে সে চিবাইতে জানে।

এই প্রকার আক্ষেপে সুঘরাই স্বীয় বক্ষে চাপড় মারিলেক, যে হায় যদি পাখীটি থাকিত! ইহাতে তাহার ডোমত্ব নিশ্চিহ্ন হইল; আর একদিকে সে দশাসই ডোম যদি অপি, তবুও সে এখন অনায়াসে ফুল চয়ন করিয়া কানে পরিতে পারে, কোন বাধা নাই এবং সে সেই-যে ছেলেটির সহিত একটি পাখী আছে, যাহাতে সে বাস্তব, যাহাতে সে এই জড় পূর্ব পশ্চিমাদি দিকের অপেক্ষা নহে।

এ পর্যন্ত যত কিছুকে–মানে যাহাতে তাহাকে সহজে খুঁজিয়া পাওয়া যায়–সে আপন শরীরের অঙ্গীভূত করিতে আপ্রাণ ছিল, তৎসমুদয়ের ঠিক লইল এবং তাহাতে বুঝে, দেহ তদীয় সীমা আর নহে–দেহে সে আটকাইয়া নাই, ইদানীং সমস্ত কিছু মিশিয়া মিলিয়া এক অত্যদ্ভুত রূপ ধারণ করিয়াছে, যাহা দেখার তথা অনুভবের সঙ্গেই সে বলিয়া উঠিল যে, ছেলেটির সহিত একটি পাখী আছে।

এই দৈব সমাধান অহহা কীদৃশী বিস্ময়াবহ! যে সুঘাই নিজেকে নিজেই জবর ডাগর রূপে প্রস্তুত করিতে থাকে এই বাক্যাবলী: যে ছেলেটির একটি পাখী আছে, তুমুলভাবে উচ্চারণ উদ্দেশ্যে সুমহান স্বর তাহার কণ্ঠে গঠিত হইল, ঝটিতি ধ্বনিত উহা হইল, যাহাতে ধৰ্ম্মত ইহাই, ন্যায়ত ইহাই, ভাবে প্রতিষ্ঠিত যে, ঐ পাখীটি কোন একদিনের, সত্যযুগের, যেক্ষণে দেবতা মানুষ অভেদ! ও সুঘরাই যাহার সূত্র ইহাতে, ঝটিতি সুঘরাই-এ চাকচিক্য ছটা ধরিল, যে সে সুদারুণ নির্ভয়ে সে পুনরায় কহিল, যে, ছেলেটির একটি পাখী আছে। আর যে ইহাতে সে এই বসুন্ধরাকে অভয় দান করিল! যে তুমি ভীত কেন–আমি আছি!

.

ইহা এখানকার অবিশ্রান্ত স্তব স্তোত্র মন্ত্র পাঠে, গম্ভীর জয় বাবা বৈদ্যনাথজী জয়ধ্বনি মহিমাতে, অধুনা, যাহা সুদূর কুম্ভকাণম আগত তীর্থযাত্রী কর্তৃকও শব্দিত, এহেন পরম শুদ্ধ উদাত্ত স্বরবিভঙ্গে, এবমুক্তবচন যাহা সে বলে, যে ছেলেটির একটি পাখী আছে, চিরতরে আটকাইয়া গেল, সংমিশ্ৰিত নহে, কদাচ ডুবে নাই!

এবং সে কান পাতিয়া শুনিতে যাহা উদগ্রীব, ঐ সকল তপোলভ্য উচ্চারণে তাহার আপনকার নির্ম্মিত সঙ্গীতময় পদবন্ধ বিঘোষিত শুনিল, যাহার অনুরণন দেহে হওয়া মাত্রই, তাজ্জব যে, ইহা যেমন সংস্কার, যে সে মোটেই উৎচকিত ছিল না, এ যাবৎ কিঞ্চিত্র সে হা হা রবে কাঁদে নাই।

এখন গেঞ্জী যাহা খাঁচাতে পরিণত–যাহা সে বহুক্ষণ পূৰ্ব্বে গাত্র হইতে খুলিয়াছে, এমন ভাবনায় যে উহা পরিয়া থাকিতে তাহার নিশ্চয়ই চেহারার পরিবর্তন ঘটিয়াছে, কেন না ইহা খুব ফর্সা, আর তজ্জন্য মনিব মহাশয় তাহাকে, কিছুই অবিশ্বাস্য নহে, চিনিয়া লইতে পারিতে অসমর্থ নির্ঘাত, আর সে তদীয় দুর্লভ ঘৃণা হইতে বঞ্চিত!

সেই গেঞ্জী উপস্থিত বড় খুসী মনে পরিয়াছে! সে পূর্ণ! গেঞ্জীর আর্দ্র স্থান নিজ ত্ব সংস্পর্শ হইতেই সে হাসিল; অধিকন্তু খাদ্যসামগ্রীর যাবতীয়, ও দোকানের বোতলগুলি দূরে থাকিয়া দর্শনেও সে সাবধান, প্যাঁড়ার গন্ধে সে অধীর, চমৎকৃত।

আবার মনিব মহাশয়ের স্বর শুনিল–এই হারামজাদা…

মনিব পত্নী বলিলেন–কি পাপ!

এ শহরে ধূলা উড়ে, পলাশ পত্র যত্রতত্র হইতে আছে; এ শহর মুহুর্মুহুঃ উৎকৃষ্ট ঘণ্টাধ্বনি নিনাদিত, পুষ্পমাল্য দীপ দেদীপ্য, ধূপ কর্পূর চুয়া চন্দন গন্ধ এই স্থানে আছার, তীর্থযাত্রীদের কণ্ঠস্বর সুললিত; তাঁহার সেই একের সৰ্ব্বব্যাপিত্ব এই তীর্থ দ্বারা অস্বীকৃত হয় নাই! এ শহরে ব্রাহ্মণগণের গাত্রবর্ণে জৌলুস চিকন দিব্য।

এই শহরে, নিকটে কোথাও যেমন বা নিঃশঙ্কচিত্ত মৃগশিশু সকল পরিভ্রমণ করে, যে শিবগঙ্গায় অনেক চক্রবাক সকল, আর উন্মুখী পদ্ম কম্পন, আর যে সেই শহরে সে এতকাল পিতৃহন্তা পাপীর তুল্য অশরীরী ছিল! সম্প্রতি বালক এই শহর তীর্থকামীর চোখে দেখিল, যে সে সজীবতা, যে ঈদৃশী পুণ্যভাক নগরে তাহার হারাইয়া যাওয়ার কারণ যাহা আদত তাহা নির্ণীত হইল, যাহা আমি ও আমার সম্বন্ধ, তাহা বোধগম্য হইল– মানুষ এই নোংরা লইয়া দেশ-দেশান্তর করে!

যদিস্যাৎ তাঁহারা, মনিবরা উক্ত ধরণের সংজ্ঞা, যে তাহার একটি পাখী আছে, নির্ধারণ করিতে পারিতেন, অর্থাৎ কিনা তাহার ব্যাপারে সংজ্ঞা রচনার সুযোগ ঘটিত, তাহা হইলে কাহারও প্রশ্ন এতশত করিবার কথাই আসিত না, তাঁহারা মন্দির হইতে বাহিরে আসিয়া, সুঘাইকে না দেখিয়া, এদিক সেদিক চাহিয়া, পাণ্ডাঠাকুরের পরামর্শ শুনিয়া, নিশ্চয় ডাহিনে অতঃপর বামে এঁদো দুগন্ধযুক্ত সঙ্কীর্ণ গলি, ও যে কতিপয় জীর্ণ ফাটা দেওয়াল অতিক্রম করত যে রকে ছাগল ঝিমায়, তাহার পাশ দিয়া বড় রাস্তায় চর্বিত চর্বণকারী ষাঁড়কে–ইহারা নমস্কার করিয়াই দেখিতেন অসংখ্য কবুতর উড্ডীয়ান হইল এবং আলোছায়ার পর পুনরায় আলো ঘটিল, আর তথায় সুঘরাই, ওষ্ঠে তাহার স্মিত হাস্যরেখা ও সে তাহার পাখী লইয়া স্থিতবান, এই সেই সুঘরাই যে কখনই মন্দিরে হাঙ্গামাকারী হরিজনদের সহিত জিগীর দেয় নাই, ইহা এক ছত্র ডাগর দৃশ্য, আর পিছনে শিবগঙ্গা!

.

সুঘরাই এখানে বৈদ্যনাথে, পাখী আনিতে বায়না ধরিয়াছিল, মনিব মহাশয়কে এই কথা–সুঘরাইএর ইচ্ছা–তদীয় পত্নী নিবেদনও করিয়া থাকেন, কিন্তু তদুত্তরে তিনি, মনিব মহাশয় বলেন,–দুর,–তুমি কি উন্মাদ হইলে, একে উহা দেবস্থান মানে আমরা দেব দর্শনে যাইতেছি সেখানে কোন হুজ্জত লইয়া যাওয়া যায়…!

তাতে কি হয়েছে, ছোট ছেলে বলছে, আহা বেচারী পাখীটাকে এক মুহূর্তও ছেড়ে থাকতে পারে না…আর জমে নিশ্চই কেউ ছিল ও ছোঁড়ার…এক মুহূর্ত কাছছাড়া করতে পারে না…ছোঁড়া দেখ না বাহ্যে যাবে তাও পাখী…ওগো অমত কর না, ওর ভারী সাধ পাখীটাকে বোদ্দিনাথ দশ্‌শন করিয়ে আনে…।

না না তুমি বড়ই উহারে আহ্লাদ দাও–কোথাকার এক ডোম ছোঁড়া, তাহার জন্য…উহাকে রাখিয়া দেখিতেছি মহা বিপদে পড়িয়াছি…।

.

মনিব মহাশয় ও মনিব পত্নী এখানে আসিয়া এক গ্রাম্য বালকদের ভোজন দেন, ইহাতে কেয়ারি করা বাগানের কিছু নষ্ট হইয়াছিল–কিন্তু ব্রাহ্মণ হইতে সকলেই আসিয়াছিল, মনিব মহাশয়ের খাদ্যাখাদ্য বিচার নাই জানিয়াও খুব হৈ হট্টগোল হয়, তবু আসিয়াছিল! উচ্চবর্ণের বালকরা একটি বালকের সংস্পর্শ এড়াইয়াছে–যেহেতু সে ডোম, উহারা হাড়িয়াল ডোম।

এই বালকের চেহারায় নিদারুণ দুঃস্থতার ছাপ ছিল, অভাবিত নির্জনতা তদীয় অঙ্গে আছে, এখানকার জংলী বৈচিত্র্যও ছিল এবং তাহার হাতে একটি পাখী ছিল–ফলে সেই বালককে উপস্থিত উচ্চবর্ণের ঘৃণা অন্যদিকে তাহার ইহাদের প্রতি মায়া এক অপূর্ব দুঃখ বোধ দিয়াছে, আঃ তাহার দাঁড়াইবার ভঙ্গীও চমকপ্রদ, যাহাতে পশ্চাতের অজস্র মৌসুমী ফুলের চরিত্রকে সে আটকাইয়াছিল। অন্ন নহে, বহুদিনের ঘুমের পুষ্টি তাহার চোখে ছিল। সে একান্তে নিজেই বসিয়াছিল–মনিব পত্নী জিজ্ঞাসিলেন, তুমি এখানে কেন।

সে দাঁড়াইয়া উত্তর দেয়,আমি ডোম।

মনিব পত্নী তৎক্ষণাৎ আঃ মাধব আঃ ঠাকুর বলিয়া উঠিলেন।

মনিব মহাশয় কহিলেন–এই ব্যাপারের পঙক্তি ভোজনের তুমি আমি কিছুই করিতে পারিব না! তাহাকে একান্তে খাইতে দেওয়া হয়–মনিবপত্নী পরিবেশন করেন, সে যখন খাইতেছিল তখন তাহার পাখীটিও তাহার পাতেই খাইতে আছে, এই ছবি গ্রাম্য বালকদের কলরোল, রন্ধনের গন্ধ, পাখী কুকুরের চেঁচামেচি ছাড়াইয়া উঠে–ইহাতে শাস্ত্রের উদাহরণ দেখিয়া মনিব পত্নী তদীয় পতিকে উহা প্রত্যক্ষ করিতে ডাকিলেন! ঠাকুর আঃ তুমি দেখাইলে! তাহাদের সাধন নির্দেশে প্রত্যেকের পাতা ফেলিয়া দিলেন–মনিব পত্নী ঐ ডোম বালকের উচ্ছিষ্ট গ্রহণ করেন।

.

মনিব মহাশয় কহেন–না, না, ইহা হইবার নহে, পাখী লইয়া কোথায় যাইবে। ঐ ভীড়ে তুমি ক্ষেপিয়াছ দেখি…।

না, কেন ভীড় তাতে কি, পাখীটা নিক্‌ না বাপু, ওর দিদি ত মরে ভূত হয়ে গেছে, সেখানে যে ওটা কার কাছে রেখে যাবে দেখভালের জন্যে, ফিত্‌তে কত বেলাই না হবে কে জানে–আর ঐ পাষণ্ড ভগনীপতি লোকটাও ভাল নয়, শুধু বাড়ীতে থাকতেই যা ঐ লোকটা ছোঁড়াকে দেয়, সেও পাখীটাকে দেখতে পারে না…আর তা’ যে মাগী এখন যারে ওর ভগনীপতি রেখেছে, সে’ও পাখীটাকে দেখলে পরে কাঁইমাই করে, তা’ সঙ্গে সঙ্গে মিনষে মুখ পোড়াও ধুয়ো ধরবে খনে… সিদিন নাকি বলেছে বাবুরা চলে যাক্‌, তুই ফিরে ত আসবি, পাখীটা আর একটু বড় হোক…তখন একদিন খুব মহুয়া তাড়ি মিশিয়ে খাব, খুব বমি করব, বৌকে, মানে মাগীকে, খুব মারব আর পাখীটাকে কেটে, কাঁচা কাঠে ঝসে খাব…অথচ ও ছোঁড়া রোজ দুপুরে ভাত নিজে কম খেয়ে ওদের জন্যে নিয়ে যায়…হ্যাঁগা পোষা তিতির আবার খায় নাকি…এখন বেচারা…বেচারী ভয়ে কাঁটা…।

সত্যই দুঃখের কথা বটে, তবে ইহা ত অনায়াসেই হইতে পারে…যে সে এখানেতে পাখীটা রাখিয়া যাইতে পারে। এখানেই ত থাকে ও হারামজাদা! ওর পাখী থাকিবে!

ও বাবা এখানে! ঐ মালী বেটা তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, শনিচারোয়া (চাকর), বামুন ঠাকুর সব্বাই ওকে হিংসে করে, বলেছে তুই চলে গেলে পাখীটাকে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসব’খন…সহিস পৰ্য্যন্ত, আর আর সবাই বলেছে…!

ইহা কি একটা কথা হইল, ঐ সব কথা মস্করা মাত্র, তাহারা আমাদের ভৃত্য, কখনও সাহস করিবে না…বৃথা চিন্তা করিও না…।

কি যে বল, সে কথা কি আমি বুঝি না, তবে যদি বল কেন, তাহলে বলি…তা’ উত্তুর এই, যে, দেবস্থানে গিয়ে ও ছোঁড়া শান্তি পাবে না, হরি কথা শুনতে এসে পুঁই আড়ায় (মাচায়) মন; তাতে পাপ হয়, ও’র ত হবেই আমাদেরও…রিলি মধুর ও…।

দেখ, তুমি দেখি বড়ই মায়াপ্রবণ, তুমি যাহাতে দুঃখ না পাও তাই সুঘরাই ডোম জানা সত্ত্বেও অর্থাৎ ইহা জানিয়াও যে, যদি ঐ হারামজাদা পাপকে কেহ যদি আঘাত দেয়, ছোট করে, তাহা হইলে নিশ্চয় আমরা দুজনেই মরমে মরিব…ইহা বুঝিয়াও রাজী হই, কোন আপত্তি করি নাই, কিন্তু পাখী কোথায় বহিবে…আচ্ছা পাখীটি গাড়ীতে যদি…।

খেপেছ, গাড়ীতে সে ছোঁড়া রাজি হইবে না…সে শিবগঙ্গার জল ছিটুবে, মন্দির দেখাবে…কত সাধ ওর!

সত্যই তুমি দেখিতেছি, স্নেহে অন্ধ হইলে, আমারে ভুল বুঝিও না, উহাকে মন্দির কি কথা, সে রাস্তায় প্রবেশ করিতে দেয় কি না দেখ, এতদ্ব্যতীত ঐ ঢাউস পৰ্ব্বতপ্রমাণ পিঞ্জর লইয়া, সেই জনারণ্যে, ভীড়ের চাপে কি খেলার কথা, কোথায় ঘুরিবে… ।

অবশ্য যে সে পাখীটিকে লওয়ার জন্য আর পীড়াপীড়ি করে নাই। এখন বুঝিল যে সে ভালই করিয়াছে এবং ইহা ভাবিতেই অচিরাৎ অলৌকিক বিবাহ, মিলন, যাত্রা দেখিল, মুহুর্মুহুঃ আমলকী আদি পুষ্পবৃষ্টিও হয়, জয় ভগবতী তনু জয় জয়, এবং তখনই আচম্বিতে পাহাড় ধ্বসিয়া পড়িল, যে বন্যফল হরিতকী আমলকাদি ছিন্ন হইয়া উৎক্ষিপ্ত হইল, খাঁচাটি হস্তচ্যুত হইল, বিদ্যুতেই পায়ের চাপে ভাঙ্গিয়া নয়ছয় নিশ্চিত, পাখীটি থরহরি, বিশেষত মুখোসটির ভৌতিক গতিবিধি দেখিয়া, এখন মুখোস পরিহিত ভিক্ষুক ও হরিজন ও নেতৃবর্গের পায়ের চাপে সে পাখীটি মরিতই, পালাইবার পথ পাইত না, আর যে অন্যপক্ষে সুঘরাইও সরিয়া আসিতে বাধ্য হইত, এবং সে ক্ষেত্রে মনিব মহাশয় কি বলিয়া খুঁজিতেন; সুঘরাই কোন কথাই গঠনে সফলকাম হয় না।

ক্রমে ইহাও বিচারিত হয়, যে যদি সে অনন্য উপায়ে মোহিলির গাড়ীতে রাখিত যখন সে মোহিলি রিখিয়া প্রত্যাবর্তনে প্রস্তুত তখন পাখীটিকে রাখিয়া আসিত, তাহা হইলে নির্ঘাত বৈকালে রিখিয়ায় পৌঁছিয়া শুনিত, মোহিলি লম্বা লম্বা ঠ্যাং ফেলিয়া চলাফেরা করত, এক অঘটন বর্ণনা করিয়া, পরে শান্ত কণ্ঠে উপসংহারে বলিত, সিটা ভুলাই গে রে। ইহাতে বনস্পতি অসুখী হইতেন, এবং বরং বারবার ইহাই তদ্বারা অনুমিত হইল যে পাখীটি হাতে থাকিলে মহারাষ্ট্রীয় তীর্থযাত্রিণীদের অঞ্চলে অঞ্চল যেরূপ বাঁধা, সেইরূপ এই বন্ধনের ছবিত্বটি, তত্ত্বটি যাহা তাহাদের, তাহার ও মনিবদের মধ্যে অলক্ষ্যে জাগিয়া থাকিত, এমন যে আঁধি উঠিলেও সূৰ্য্য ডুবিলেও তাহা কভু ভ্রান্ত হইবার নহে!

.

এই সময় কোন পাণ্ডাঠাকুরকে, বগলে যাহার খেরোর খাতা, যে যাহাকে এক যাত্রীর পশ্চাদ্ভাবনে মহা উত্ত্যক্ত করিতে দেখিল, এবং অন্যত্রে ইহা, যে আর একজন পাণ্ডাঠাকুর স্বীয় বাম উরুদেশ উপরে ঐরূপ এক খেরোর খাতা খুলিয়া ছড়া-পড়া সুরে এক যাত্রীবর্গের বহুপূর্ধ্বতন পুরুষের নাম সাকিম। শাখাপ্রশাখার নাম ইত্যাদি পাঠ করিতেছে, শ্রোতৃবর্গ সকলে একে অন্যের মুখ অবলোকনে অদ্ভুত গৌরবান্বিত, তাহারা সকলেই প্রীত, যে তাহারা বহুদিন এই পৃথিবীতে বসবাস করিতেছে, তাহাদের বংশধারায় সময়ের অবাক ঐশ্বৰ্য্য, সৌরমণ্ডলের প্রতিটি নক্ষত্র তাহাদের চিনিতে পারে, তাহারা কুসুমের জন্ম দেখিয়াছে, নদী যখন প্রথম ধাবমানা হইল সে কথাও মনে পড়ে, তাহাদের পরিচয় অতীব মহান, অত্যন্ত সুন্দর।

শ্রোতা সমুদয়ের মুখ নিরীক্ষণে সুঘরাই সনিষ্ঠ হইতেই এক চমৎকার ক্ষুরের আওয়াজ শুনিতে পাইল এবং যে, হায় তাহাদের পাণ্ডা হয় না এমত খেদ তাহাতে আসিয়াছে, এবং তৎক্ষণাৎই ইহাও যে দুঃখের কিছু নাই এরূপ তাহাতে দৃঢ়তা দেখা দিল; এ কারণ যে তাহার পাখী আছে যাহাই তাহার নিজস্ব, তাহাই বংশধারা, সেও শ্রোতাদের মতই, যাহারা মধ্যে মধ্যে মহা শূন্যতায় আপনাদের ধারা দেখে, তেমনই সেও যেন পাখীটিরে লক্ষ্য করিল যে এবং তখনই দেখিল পথপার্শ্বে কোন মাতা সন্তানকে স্তন্যদান করিতেছে।

সুঘরাই এখন বুঝিল সে ক্লান্ত; একদিকে রিখিয়ার রাস্তা অন্যদিকে এই ধৰ্ম্ম উদ্দাম শহর তাহারে যেমন চাপিয়া ধরিয়াছে, দক্ষিণ দিক ধরিয়া মীনাবাজারের দিকে বা ইস্টিশানের দিকে যাওনের ভরসা। কখনই পায় নাই, যেহেতু তবু এদিকে গাছপালা, তবু এদিকে ঝিঁঝির শব্দ, ইহারা তাহার বড় জানাশুনা, বেশী করিয়া হারাইবার সম্ভাবনা এখানে নাই, আর কারণ যে এই পথেই মনিবদের রিখিয়ায় ফিরিতে হইবে; যে অনবরত মাথা ঘুরাইয়া দৃষ্টি ফিরাইতে তদীয় ঘাড়ে ব্যথা, এতক্ষণ এই পথে ডাক্তারবাবুর গাড়ী ব্যতীত অন্য ভাড়াটে গাড়ীও যায় নাই; এদিকে ক্রমে বেলা পড়িয়া আসিতেছে, ইদানীন্তন পাখী ব্যাপারে সমাধান সত্য, তবু অন্তঃস্থল ঝি, হাতে ঘাম হইয়াছিল।

সে ধীরে চলিতে থাকিল, যে সে তির্যকভাবে একদল দুবৃত্ত পদবাচ্য যুবকদের দেখিল, ইহারা মলিন বস্ত্র পরিহিত, ইহাদের রাশিকৃত চুলে তেল নাই, এখন ইহাদের হাতে হাতে তাস, যে ইহারা জুয়া খেলিতেছে। নিশ্চয়ই মনিব মহাশয় এখানে আসেন, ইহাদের প্রতি তিনি যারপরনাই ঘৃণাভরে তাকাইলেন, যে ছিঃ এহেন শ্ৰীসম্পন্ন শহরে যেখানে শিব নিজে বর্তমান, যেখানে সেদিন গতবছর (১৯৩৪) ভূমিকম্পে যাহার ক্ষতিসাধন করিতে পারে নাই, এই স্থানের সব কিছু শিব, তোমরা কেন সেই পুণ্যকে পরিহাস কর! এই মনোভাব এই জন্য যে ইহারা কেহ তাস ফেলিতে সময়ে শিব জয়ধ্বনি দিয়াছিল।

তত্ৰাচ তিনি কিন্তু যেহেতু আপন দায়ে বাধ্য; তাই উহাদের অতিশয় নম্রভাবে, ইস কি লজ্জা! জিজ্ঞাসিলেন,–ভাই যে ছেলেটি তোমাদের তাস খেলা দেখিতে আগ্রহশীল হয়, এ কারণ যে সে মনস্থ করে যে, তাহার ভাগ্য যাহা ইতঃপূৰ্ব্বে গণৎকারকে সে প্রশ্ন করিতে পারে নাই, এখন তাহার অভীষ্ট কল্পিত দান দর্শনে, যাহা নিশ্চয়ই তোমাদের কেহ ফেলিবে, তাহাতে স্থিরীকৃত হইবে।

সে জানে না এইভাবে সময়ক্ষেপ হয়, সম্ভাব্যের খেলার মধ্যে নিয়ত ঋতুপরিবর্তনের আঙ্গিক চরিত্র রূপ আরোপ করা বৃথা, যখন সে বুঝিবে তখন সে তাই ক্রোধপরায়ণ হইবেই, যেমন স্বীয় যুক্তি খণ্ডিত হইলে, যেমন আশা ভগ্ন হইলে, যেমন মানুষে বিকারপ্রাপ্ত হয়! তোমরা তাহাকে বলিলে, তোমাকে কি দারোগাবাবু পাঠাইয়াছে।

সে, সুঘরাই, উত্তর দিয়াছে, তাহা নহে, ঐ যে তোমাদের পিছনে যে ঢাকী ঢাক আঁকড়াইয়া ঘুমাইতেছে, তাহার ঘুম ভাঙ্গিলে, মনে হয় কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাঙ্গিবে, কেন না উহার পায়ের ঘুঙুর ইতস্তত নড়িতে আছে, ঘুম ভাঙ্গিলে জিজ্ঞাসিব যে, বিসরিয়ার বাপ যে ডোম এবং ঢাকী, নিবাস রিখিয়ায়, যে নিত্য এখানে আসে তাহারে দেখিয়াছে কি না। ইতিপূৰ্ব্বে কর্মব্যস্ত ঢাকীরা কেহ বলিয়াছে জানি না।

তোমরা কহিলে, উহার, সেই ঢাকীর এখন জাগিবার সম্ভাবনা নাই, আমরা জানি, সে অহিফেন সহযোগে মদ্যপান করিয়াছে। ইহার পর তোমাদের একজন ঘুমন্তর নাসিকার নিকট উৎকট চরসের ধোঁয়া ছাড়িলে তাহার পর বালকের উদ্দেশে কূট মুখ খারাপ করিলে–বালক যেন তোমাদের স্বরে। আপন চীৎকারের আওয়াজ পাইল, সে তাই মাথা ঘুরাইয়া আত্মরক্ষা করে যেমন, বলিতে পার সে কোনদিকে গেল।

আঃ বেচারী মনিব মহাশয়!

তেমনই ম্যাজিকওয়ালাকেও একটি বালককে দর্শাইয়া নিবেদন তিনি করিয়াছেন,–এইরূপ একটি বালক ক্রমাগত বলদ চোখে অনেকক্ষণ ধরিয়া তোমার নৈপুণ্যে একদম নিঃসাড় জড়; এমনও যে, যে সে হারাইয়াছে তাহা সে ভুলিয়াছে; অবশ্য যখন মাঝে মধ্যে সম্বিৎ আসে, সে তোমায় সিদ্ধ মহাপুরুষ জ্ঞান করিতেছিল, অগোচরে সেও অলৌকিকতাকামী; যে এবং তুমি তাহারে তোমার কোন বিশেষ ছল–হাতসাফাই, প্রদর্শন জন্য দর্শক সাধারণের মধ্যে তাহারে মনোনীত করত আহ্বান করিতেই, বালক ডুকরাইয়া কাঁদিয়া উঠে। তুমি অভয়দানে কহিলে,–আরে ডরো মৎ, ডর কেয়া। ডর এই যে, প্রথমত তাহা গ্রাম্যভীরুতা, এবং যে চিরতরে নূতন করিয়া সে হারাইতে চাহে নাই, সে কান্দিতেছে কেন না এখানকার সমবেতকণ্ঠে, তদীয় কান্নায়, হাস্যরোলের মধ্যে শুনে যে,যাও এখনই ভেড়া হইয়া যাইবে। বালকরা পুনৰ্ব্বার যোগ দিয়াছে,যাও না উহাতে ঐ মাথায়, স্থাপিত কঙ্কালটিতে মিলাইয়া যাইবে। এই বলিয়া সকলেই ভূমি উপরে রক্ষিত চমকপ্রদ করোটি কঙ্কালের দিকে অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিয়াছে। আর যে সে বোন্ধান চোখে, সেই করোটি কঙ্কালের পানে লক্ষ্য করে, প্রত্যক্ষ করে যে তাহার ঘরপথ সকল, সে নহে, বোকার মত উহাতে ক্রমান্বয়ে ঢুকিয়া যাইতে আছে। যে এবং ব্যাকুলভাবে কান্দিতে ব্যক্ত করিল যে,–সে বড় হতভাগ্য, সে দুঃখী, সে মনিব হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়াছে।

কিন্তু ইহার পূর্বাহে মানে এই খেলা দেখার আগে–যে সে বনপ্রদেশে একদা হঠাৎ আতা ফল দর্শনে যেমন চিনিয়া লইতে অপারগ হয় এখন তেমনই তাহার ভাবান্তর, যে সে হারাইয়াছে কি না ইহাও বিস্মৃত; কিন্তু এখন সে হারাইয়াছে; তাহার কথা শুনিয়া সমবেত ভীড় হাসিয়া উঠে; যে সে খুসী, সে খুসী।

হে ম্যাজিকওয়ালা,–তুমি তাহারে অব্যাহতি দিলেও সে কোনক্রমে তোমারই পাশ বরাবর আসিয়া দণ্ডায়মান থাকে, এখানে সে ঐ পূৰ্ব্বদৃষ্ট সন্ন্যাসীর মতই নিশ্চিন্ত, ইহার আসল কারণ এই যে, আমি তাহার মনিব, তাহার খোঁজে আছি, এখানে যদি আসি, স্বভাবত আমি ঐ নরকপাল হেরিয়া কি খেলা চলে তাই ধারণার নিমিত্তই, তোমা পানে তাকাইব ইহাই মানুষের প্রকৃতি মানুষের চরিত্র, হৃত বস্তু সম্পর্কে নূতন করিয়া অবহিত হইব আর যে তাহাকে দেখিতে পাইব। সে অনেক সময় যাবৎ ঐ ভাবে ছিল, যেহেতুও সেখানে সম্ভবত হাড়ের খানিক ছিল। কখন সে চিন্তার রহস্য ছাড়াইয়া–বদ্ধজীব ডোম।

ইহা এক গূঢ় কারণেই যে সে এই পরিবেশ ত্যাগ করিতে চাহে নাই। তোমার বাঁশীতে তাহার মন ছিল না, সে শুধু এই স্থলকে কজা করিয়া দাঁড়াইয়াছিল, কেননা কিছুক্ষণ আগে তাহাতে কোন প্রকারের, ইহার সর্বথা উকট, কীদৃশী কুটিল, অভিনব অমানুষিক বিভীষিকার সঞ্চার হইয়াছিল।

এবং ইহা তৎকালেই ঘটিল, যে মুহূর্তে সে আমাদের প্রমত্ত হইয়া অন্বেষণের মধ্যে অবলীলাক্রমে, ঐ সুসাজান পানের দোকানের সৌখীন উৎকৃষ্ট আয়নাতে এক মায়াবী প্রতিফলন সাক্ষাতে নিশ্চল, যে সে ব্যামোহাবিষ্ট, যে সে পূর্ণ সম্মোহিত হইয়া থাকে; অবশ্য খানিক বাদেই এবার তাহার হৃৎপিণ্ড কাঁপিল, এবার তাহার তালু শুষ্ক হইল এবং যে সে পদমেক পশ্চাতে হটিল।

যে, আয়নাতে যে সে-ই, নিজেই, যে যাহাকে সুঘরাই নামে ডাকিলে সাড়া দেয়, যে জাতিতে হয় ডোম, গোত্র যাহাদের নাই, অতীব স্বাভাবিকভাবে প্রাকৃতিকভাবে সে হয় ডোম, যাহার দৈবাৎস্পর্শে পূজার্থিণী গরদ পরিহিতা করুণাময়ী সৰ্ব্বদা স্নেহশীলা মনিব পত্নীশিহরিত, জয়দেব পাঠ স্তব্ধ, হস্ত হইতে পুষ্প সাজিচ্যুৎ হয়, পুনরপি তিনি স্নান করেন–এই তিলেক পরিচয়ে অবধি লিখিত নাই সে বিজাতীয় ঘৃণা হইতেও বঞ্চিত হইয়াছে–আর উচ্চবর্ণের ঘৃণা যাহা তাহার জীবনই যে, যাহার পিতা নাই, মাতা নাই, ভ্রাতা ভগ্নী নাই, পত্নী নাই–যে যাহার মহান-হৃদয় মনিবরা আছেন; যে যাহাদের সমভিব্যাহারে এখানে আসিয়াছে; যে সে অধুনা হারাইয়া গিয়াছে; কিন্তু কিছুই বিশদ হইল না।

যে সে-আয়নাতে নেহারিল মাত্র যে এক ভূমিকৰ্ষণকৃত জমি, পূৰ্ব্ব ফসলের গোড়া পর্যন্ত যেখানে নাই, এইবার খর অকর্ষিত জমি মতন রঙের কাহাকে কোন অবয়বকে দেখিল, আশ্চর্য্য যে সে জল চাহিতেছে, ইহাতে সুঘরাই ঢোক গিলিল,-জল!

জল ত দান করা হইয়াছে–জল পিতৃলোকে গিয়াছে! কিন্তু সে এতই তৃষ্ণার্ল্ড–তৃষ্ণার্ত না ভীত– আয়নায় প্রতিভাত মূর্তি দেখা গেল ঢোক গিলিল, ইহাই তাহার পূর্বপুরুষ; যে উহা কাহার প্রতিবিম্ব, ঈদৃশ প্রশ্নে সে বিস্ফারিতনেত্রে প্রৌঢ়শীলা সদৃশ; এমনও সুতরাং ফলে মানে, অর্থাৎ, যে উহা আমিই ত, এহেন বাক্য নিশ্চয়ত্মক করিতে, বাস্তবিক করিতে, যে, স্বভাবত লোকে নিজ বক্ষে হস্ত স্থাপনে, অথবা এক্ষেত্রে অঙ্গুলি দ্বারা যেমন নির্দিষ্ট নিজেকে করে তেমনই এখন তাহার, সুঘরাই এর, সেই বৃত্তির অভাব। থাকে; আরও যে, ‘উহা’ এই শব্দ ব্যবহার করিতে আপনকার অজ্ঞাতেই সে মূঢ়মতি–আর যে ইহা অবিশ্বাস্য নহে। সম্মুখে তাহার শনৈঃ সংজ্ঞাবিধ্বংসী নিঃশব্দ!

চেঞ্জাররা যে কোন তুচ্ছ কিছু নিরখিয়া কহিল–ভাবা যায় না কি গ্র্যাণ্ড! ইহারা তাহারা যাহারা স্বপ্নের ভার বহে! যাহারা স্থাবরকে সংবেদনশীলতা দিয়াছে।

ইতঃমধ্যে সুঘরাই আপনার পিছনে তাকাইল, সেখানে কেহ নাই, সেখানে ধূলা উড়ে, সেখানে পাতা বিদ্যমান; তখনই সে সভয়ে নেত্রপাত করিল, অদূরে বিভিন্ন তিলকধারী লোকেরা একের পর এক সাধক যায় ও আসে, ইহাদের দর্শনেই বুঝা যায় যে কে কোন সম্প্রদায়ভুক্ত, সে অবাক নয়নে তিলমণ্ডিত ললাট লক্ষ্য করিল, এমনভাবে করে যাহাতে বুঝায়–যে তাহার আক্ষেপ হইল, যে সে তিলক পাঠে অপরিজ্ঞাত, ইহা ঠিক যে বিবিধকণ্ঠের জয়ধ্বনি তাহাকে এখন চালিত করিল এবং আবার সে আয়নায়, ইদানীং সে নিজ হাতের উল্কীকৃত নীলাভ ডাং-উদ্ধত কিদিম কাঠকোম-টি ভারী অঝাঁপসা দেখিল; এখনও উল্কী বিধায়ে তদীয় হাত কিঞ্চিৎ ফুলো, কেননা ঐ বিছা উল্কী দুই হাটবার আগে, হাটেতেই করান হয়; ইহা তাহা স্মরণেই আঁকান যে, ঠিক সেদিনই সকালবেলা তাহার তিতির, তাহার ভগ্নীপতির গায়ের প্রায় এক আঙুল নিকটে উপস্থিত এক কাঁকড়া-বিছাকে পড়িমরি করিয়া দৌড়াইয়া আসিয়া ঠোঁটে ধরিয়া লইয়া ঠুকিয়া তৎক্ষণাৎ খাইল।

আর যে ইহা দর্শনে গর্বিত সুঘরাই উল্কীকরণের সঙ্কল্প করে: যে একটি তিতির ও তাহার ঠোঁটে একটি বিছা! কিন্তু দুইটির খরচা ছ’ পয়সা, আপাতত অগত্যা শুধু বিছাতেই সন্তুষ্ট থাকে; তিতির সে আঁকাইবেই, আঃ! তাহার চঞ্চপুট দ্বারা বিছা আক্রমণ, আঃ তাহার পক্ষদ্বয় কি মনোহর প্রসারিত হয়, আঃ! যেমন তাহা অনাদিকাল যাবৎ অমনই অফুরন্ত পক্ষ মেলিয়া আছে।

এখন আয়নাতে সে ওতপ্রোত, এবং বিছা উল্কী সত্ত্বেও এখনও কিম্ভুত সন্দেহ তাহাতে বর্তমান; যে সে কিছুতেই কোন উপায় ঠাওরেও সে চিনিতে পারে না ঐ প্রতিবিম্বকে; কেবলই আরবার আপনকার নিরীহতা, ইনোস্যান্সএ ভ্র সটান করে। আবার অন্যপক্ষে নিজেকে নিশ্চয়ই “উহাই’ শব্দে অভিহিত করিতে, সনাক্ত করিতে, সে নিজে ভীতিপ্রদ প্রহেলিকা।

কি হেঁয়ালীপূর্ণ আবছায়া! অঙ্গভঙ্গী মুখবিকৃতির প্রয়াস সবই বিদ্রুপাত্মক অন্ধকারে পরিণত; ক্রমে ইহা তাহার মনে পড়ে মানে অস্বস্তি হয়, যাহা এই যে, তাহার কেহই, এমনও যে তাহাদের জাতের মোড়ল, এমনও যে অনেক–তাহাদের অপেক্ষা উচ্চবর্ণের, যাহা এই জল-চল জাতের লোক যেমন আপন বয়ঃক্রম জানে না, ঠিক তেমনই, তেমন সেও যেমন নিজ বয়স জানে না, তেমনই নিশ্চয়ই সেও আপনার চেহারাবিষয় কিছুই জ্ঞাত নহে, যে চেহারা কুয়োর কাঁচ-জলে প্রতিবিম্ব, আর অন্যসূত্র হইতে তাহার শোনা-দেখা নহে!

সুঘরাই এর মনে হইল, সে যেমত ভাসিয়া আছে, তাহার দেহ নাই, মৃত্তিকা নাই, এবং হঠাৎ সে আপনার বিছা-আঁকা হাত আঘ্রাণিল; যুগপৎ দেখিল ঐখানে, আয়নাতে যে উহা, যে সে সে-ই, যে হারাইয়াছে, ইতিমধ্যে একদা যে মনে হয় আমার চেহারা নাই, তবে আমি হারাইব কেমন–এবম্বিধ ধারণা সর্বৈব বলদ!

আমি উহা, আমিই উহা এবং ইত্যাকার বলিতে ও ভূমিতে পাবাজাইয়া কবুল করিতে, সবিশেষ আত্মপ্রত্যয়-নিবন্ধন সে মরিয়া হইল; আমি ও উহা যে অলৌকিক বিবাহযাত্ৰা আমি দেখিয়াছি, সেই চৈতন্য সত্তা তাহার জড়তা ভাঙ্গিল; ইতিমধ্যের ঘোর ব্যবধানকে সে পান করিল, সে ইহাতে বেসামাল হইল; সহসা শ্রুত হইল যে সে, সাদরে ‘আতিতি-তি’ শব্দে উহাকে তথা আপনাকে ডাকে; আবার আচম্বিতে ঘোষিয়া উঠিল,–আমি সেই যাহার এক পাখী আছে। ইহার সঙ্গেই জয় বাবা বৈদ্যনাথ ধ্বনি তুলিতে চাহিলেও বেচারা পারে না। যে এবং ধীরে কহিল,–উহা সেই আমি যাহার এক পাখী আছে। অথচ স্বরে কেন যেন মনে হয় পাখীটি বেহাত হইল।

তৎকালে পানের দোকান হইতে, হে ম্যাজিকওয়ালা তোমার ডম্বরু ও বাঁশী শ্রবণে সেই উচ্চবর্ণের ভাবনার দ্বন্দ্বের ছেদ পড়িল। ম্যাজিকওয়ালাই তাহার উত্তর। সঠিকভাবে বলিতে গেলে বলা যায় যে সে যেন বাঁচিল; ভাগ্যশঃ সে বালক, তাই তোমার ম্যাজিক দর্শন জন্য ঔৎসুক্য-পরতন্ত্র দৌড়াইয়া আসিতে এক নিমেষ ত্রিকূট পাহাড় তাহার চোখে পড়িল; তোমার এখানে সে অব্যাহতি লাভের পর একদিকে বড় স্বস্তি বড় স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে, তেমনই তোমার নৈপুণ্য দেখিতে তাহার মনে হয়, হায় মনিব মহাশয় ও তদীয় পত্নীর কত জিনিষ খোয়া যাইতে সে নিজে তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়া বাহির করে, আর অদ্য সে নিজেই হারাইয়া গেল!

এবং লকড়কে সে যথেচ্ছা গালাগাল দিল; তাই সে ক্রমে পুনরায় বিমর্ষ এবং তজ্জন্যই তুমি যখন খেলা দেখানোর পর মহাচাতুরিতে নরকপালটি স্বীয় মুখের সন্নিকটে উন্নীত করত, তোমার বিড়ির ধোঁয়া, যাহা নীল, ঐ নর কপালের ছিদ্র দিয়া বালখিল্যতাবশত পাচার করাও, ফলে, কপালের করাল। দন্ত বহিয়া ধূম অনর্গল বহির্গত হয়, ইহা প্রত্যক্ষেও সে অন্যান্য সবস্ত্র ও উলঙ্গ বালক বালিকাদের মত হাসে নাই, সে কোন দিকে গেল জান! সে ম্যাজিকের কৌশল হইতে, জট হইতে, ক্রমশঃ খুলিয়া সহজ হইয়াছিল।

ইহা ধ্রুব বটে যে, আপনারে সনাক্তকরণে অকৃতকার্য হওয়াতে এবং যে আমার একটি পাখী আছে–এখন, উপস্থিত যাহা নাই ইহা ভাবিতে সে অধিকন্তু মুষড়াইয়া পড়িল, যেমত সে দ্বিগুণ হারাইয়া গিয়াছে; তাহাতে বিজাতীয় আক্রোশের ধমক উদগত হইতে চাহিল, সে দুবৃত্ত যেমন, কাহার উপর যে রুষ্ট সে ইহা বুঝিতে চাহে নাই; এমনও যে এখানে সেখানের মোটা নিম ডাল দিয়া পাথরে সিদ্ধি পেশাই করা দর্শনে প্রলুব্ধ হওয়ত, প্রসাদের নিমিত্ত কিয়ৎ দূরে দাঁড়াইতে সম্প্রতি কোন সুমধুর পাঠের আওয়াজে সে আকৃষ্ট হইল; এবার পাঠ বন্ধ হইয়া গীত হয়, যথা–

তুলসী উহাঁ যাইয়ে যাঁহা আদর ন করে কোই।
মান ঘটে মন মরে রাম কো শরণ হোই ।৷

আসমুদ্রহিমাচলে যে যেখানে রোমাঞ্চিত হইল, তাহার এই শুদ্ধ গীতের শব্দতরঙ্গই কারণ; এখানে অনেকের পুলকাতে নয়নযুগ সজল, অনবরত রামনামে স্থান সুন্দর হইয়া উঠে; ইহাতে সুঘরাই বুঝে যে সম্মুখে রামায়ণ গান হইতেছে, কিন্তু তদীয় মানসিকতা অত্রাহি সত্ত্বে সে স্থান পরিত্যাগ করে নাই, প্রথমত সে মর্মে মর্মে জানে, যে তাহার সন্ধানের মধ্যে দেবালয়, সন্ন্যাসী, অবধূত, গীতা বা রামায়ণ পাঠ আমাকে চুম্বকের মতনই টানিবে, যেহেতু আমি ও মদীয় পত্নী অতীব ধর্ম্মপরায়ণ, যদিও জানি সে নীচকুলোদ্ভব এবং এই ব্ৰণবিরহিত পবিত্র রামকথা যাহা মোক্ষ ও প্রীতিদায়িকা, তন্মিমিত্ত অবশ্য তাহার কোনই মতি নাই,–উহার বয়ঃক্রম ইহার কোন হেতুই নহে,–তবু তাই সে কিছুকাল বাধ্য হইয়া যাপন করিবে; এখন উক্ত গীতে সে আলোড়িত বিশেষত কথকের বিন্যাসই তাহার অনুপ্রেরণা হইয়াছে।

কথক ঠাকুর বলিয়াছিলেন, রে পাগল মন, ওরে তুলসী তুই ছায়া ত্যাগ করে রৌদ্রে যা; তুমি ভুজালিঙ্গন ছাড়িও, এমন স্থানে যাইও যেখানে অহঙ্কার অহরহ দলিত হয়, যেখানে তোমায় উচ্ছিষ্ট দেয়, লোকে দূরদূর করে, আগুনটুকু চাহিলে হাঁ হাঁ শব্দে তাড়না করে, কাহারও প্রজ্জ্বলিত দীপ হইতে দীপ জ্বালিতে যাইলে সে ভাবে আমি সর্বস্বান্ত হইলাম–সেখানে মন যাও, যেখানে মরমে তুমি ম’র, তোমার কেহ নাই, পরিজন নাই, তুমি একা সম্পূর্ণ তুমি যখন আপন বোঝা তখনই যখন ঠিক ঠিক দুঃখ পাইবে; তখনই রাম স্মরণ হইবে, অবশ্য দুঃখ অনুভবের মধ্যেও আমি আছে; তবে, এই আমি’র দোষ নাই, সেই আমি’তে রাম নাম স্মরণ হইবে। তেমন দুঃখের মধ্যে তেমন দুর্ভাগ্যের মধ্যে স্বতঃপ্রবৃত্ত হওয়ত হে মানুষ তুমি যাইও। রামের কথা স্মরণ হইবে। হায় রাম বলিতে পারিবে।

যথা ভূমি সব বীজময় নখত নিবাস আকাশ।
তথা রাম নাম সব ধরমময় জানত হি তুলসী দাস ॥

সুঘরাই এই গীতে ডোমসুলভ চোখে, বালক-উচিত ভঙ্গীতে গায়কদের মুখপানে চাহিয়া থাকে, ইহা অলোকসামান্য কাব্য, কাব্যত্ব ইহা তাহার নির্বুদ্ধিতা বশত সরলতায়ে নহে, তবু সে অন্যমনে দেখে। সরলতা যাহা ভক্তির বীজ, অবশ্য কোন শিশুরই সরলতা নাই, তাহার অপরিণত স্বভাব আছে, সরলতা সন্ন্যাসধৰ্ম্মের, সরলতা সন্ন্যাসীর, অবতারাদির ভাবই সরলতা–ঐ সুর উঠা পড়া দার্ভঙ্কুর রোমন্থনকারী মৃগশিশুর ন্যায় ক্রমে এখন দেখিতে লাগিল।

অবশ্য সে ডোমপুত্র, গীত শুনিতে ডিগরিয়ার পাহাড়, যেখানে সূর্য ডুবে তদবধি শঙ্খচিল যেখানে বিন্দুবৎ, পদ্মের কোরক যে পর্যন্ত গিয়া কুৎসিত, তদবধি ‘ভূমিতে পরিবর্তিত হইতে পারিল না, হায়! আমি ভূমি, বলিতে বিবেক তাহার হয় নাই; অন্যপক্ষে অবশ্য, আকাশ কথাতে, তদীয় শরীরমধ্যে বিপরীত পাকে, কি এক কিছু যেমন বা ঘুরিতে থাকে, কিন্তু ঐ প্রক্রিয়া অভাবনীয় ধীরে; সে অবশ্যই মশাল তৈয়ারী করে যদ্বারা আকাশকে দেখিবে, যে সে তখনই নিজেরে ঐরূপ কর্মে ব্যাপৃত অবস্থা বুঝিয়া ধড়েতে আর ছিল না, তাহার ওষ্ঠ শুষ্ক হইয়াছে, কেননা মধ্যে কোথাও, এই ব্যোমের, মেঘাশ্রয় নাই,–ক্রমান্বয় সন্ন্যাসীর দৃষ্টিতে নিশ্চিহ্ন হইয়াছে যাহা।

হায় সে ঐ পদবন্ধের যথা’র নিয়ন্ত্রিত, আনীত বাস্তবতায় আতান্তরে তাহাকে নিক্ষেপ করিল, সে গণৎকারের গলা যেন পাইল, যে এবং ইহাতে আরও মূঢ় সে হয়; তবু কোনওক্রমে কথকঠাকুরের দিকে দৃষ্টিপাত করিল।

ইনি বলিতেছিলেন, রাম নামে আঁখি ঝুরে…! এই সূত্রে, যদিও ঐ উপদেশ-ইঙ্গিত চমৎকার।

তবু বলি একদা, আমার পরমারাধ্য মাধব আমায় বলিয়াছেন, ‘ভগবানের নামে, আমার নামে শিশু গাত্রগন্ধ যে না পায়, সে আমারে পায় না’ আঃ শিশু গাত্রগন্ধই রাম!

কথকঠাকুর এমনভাবে, রাম উচ্চারণ করেন যেন চিরঞ্জীব হনুমানের চোখে জল আসিল।

ঐরূপ রাম উচ্চারণে যে সুঘারইএর অদ্ভুত রোমহর্ষাদি লক্ষণসমূহ উপস্থিত হইলেও, ওষ্ঠ এখন আর্দ্র হইলেও, কোথাও যেমত বা আড়ষ্টতা জড়তা সঙ্কোচ জাড্য কুণ্ঠা অপ্রতিভ, মেদাটে বৈলক্ষণ্য আছিল, এবার হঠাৎ সে ক্ষোভে অনুতাপে ক্ষিপ্ত, কেননা নেতৃবর্গশিক্ষিত কীদৃশী কদর্য্য, কি পর্য্যন্ত প্রমত্ত হিংসাপ্রযুক্ত, জগতের-নীচতম বৃত্তি সেই রাজনৈতিক রোলে তাহারই সুঘরাই স্বজাতিবৃন্দ বেচারী হরিজনরা, এহেন সুন্দর রাম নাম মধ্যে মধ্যে করে, তাহাদের সেই চীৎকারের সহিত তাহাদের উৎকট গাত্রগন্ধ স্থানকে অপবিত্র করে।

এবং সে হঠাৎ ‘আমি ডোম’ ‘আমি ডোম’ ইত্যাকার অনাৰ্য্য চীৎকারে–এখান হইতে নিষ্ক্রান্ত হয়, এইকথা মনে পড়িতে ‘আমি ডোম’ ‘আমি ডোম’ বলিতে ইহাই ধৰ্ম্মত অর্থাৎ ব্যক্ত হয় যে মনুগণের পূৰ্ব্বে বহুকাল হইতে আমি হারাইয়াছি!–তাহার পশ্চাতে সঙ্গে সঙ্গে রাম নাম নিশ্চিত গিয়াছিল। এবং মনিব মহাশয় যে ব্যক্তির নিকট সংবাদ লইতে এতেক বর্ণনা করেন, তাহাকে সুঘরাই বিষয়ে আরও প্রশ্ন করিলেন–এবং তৎসহ তাহার অন্তরে প্রার্থনা শ্রুত হইল, যে, হায় ঠাকুর তুমি অন্তৰ্য্যামী তুমি তাহার । শুভাশুভ সবই জান, তবু…।

.

অনন্তর তিনি, মনিব মহাশয়, যারপরনাই অবসন্নচিত্তে, পরিশ্রান্ত হওয়ত শিবগঙ্গার ধারে আসিলেন, এখানে তাঁহার গায়ে আদ্র মসৃণ বাতাস কিয়দংশে তাঁহার ক্লান্তির অপনোদন করিল, দেখিলেন উদ্বেলিত জলস্তর, অদূরে জনৈকা লোলচৰ্ম্মাঙ্গিণী অশীতিপর বৃদ্ধা, দেহ যাহার নজ, এখন জলে রহিয়া মুখ প্রক্ষালনে নিয়োজিতা, যে এবং তজ্জন্য তদীয় বিশুষ্ক কদাকার প্রলম্বিত নিৰ্বাপিত স্তনদ্বয় জল-ছোঁয়া, সুতরাং জলস্তরে ভাসমান ফুল ও পাপড়ি যাবতীয় উহাতে আসিয়া লাগিয়া ঠেকিয়া সরিয়া আঘাতিয়া । বিলি কাটে, অতএব এতাদৃশ সমাপতন, যদি অপি এলেবেলে, বড়ই কৌতুকপ্রদ, স্রেফ ফাজিল।

ইহা প্রত্যক্ষেও যে তিনি কোনই মজা আহরণ করেন না, এ কারণ যে সদাই তাঁহার মনে ইহা আঁচড়াইতে আছিল, ‘পুষ্পদন্তের’ শ্লোক আমার কণ্ঠস্থ করা বৃথা, কোথায় শিবই মদীয় অদ্বিতীয় স্মরণ মননের বিষয়ভূত হইবেন, না, কোথায় আমি ডোমপুত্র সুঘরাইএর সন্ধান করিয়া ফিরিতেছি। এই কি আমার নিয়তি।

মনিব মহাশয় ইদানীন্তন বৈচিত্তপরতন্ত্র সর্বত্র শ্যেনদৃষ্টিতে বিশ্লেষিত করিতে এক মহা আনন্দময় অগ্নিতুল্য দেদীপ্যমান যোগীকে দেখিলেন, দর্শনমাত্রই বিশ্বাস ইনি মহাপুরুষ, ইনি যে পরমহংস তাহাও নিশ্চয়, কেননা ঠাকুর রামকৃষ্ণ ইহাদের লক্ষণের কথা বলিয়াছেন; সেই মহাপুরুষের নিকট বেশ কিছু সবস্ত্র ও প্রায়ই উলঙ্গ বালক বালিকা; যাহাদের তিনি নিশ্চয়ই তদীয় সুদীর্ঘ ধীরনেত্ৰ মেলিয়া একদৃষ্টে দর্শনে আপনাতে বালকস্বভাবে আরোপ করিতেছিলেন, এবং মধ্যে মধ্যে মেওয়া মিছরি বিলাইতেছিলেন; তিনি নবাগত দেখিলেই,–ওঁ তৎ সৎ, এস এস আমার সমক্ষে দাঁড়াও, তোমারে আমি নয়ন ভরিয়া দেখি, খেলা কর, কথা বল, আমি শুনি, ওঁ তৎ সৎ।

মনিব মহাশয় সাষ্টাঙ্গে প্রণামের পর নিবেদন করিলেন,–ভগবান, আপনি করুণাময় ক্ষমাশীল, আমার অপরাধ মার্জনা করিবেন, যেহেতু আপনি বালকবালিকারে সাধন আদর্শ বলিয়া মান্য করেন, জ্ঞান করেন ও তদ্বারা অদ্ভুত সরলতা নির্মাণ ও তদ্বারা, ঐ সরলতার দ্বারা, অদ্ভুত রঞ্জু নির্মাণ করেন, তাই নির্ভয়ে আপনারে জিজ্ঞাসা করি, এক বালক–এই পৰ্য্যন্ত বলিতেই সেই মহাপুরুষ, মৃদু হাস্যে, ইহাতে সৃষ্টিতত্ত্ব যেন নড়িয়া উঠিল, কাব্যবৃত্তি বিকচ হইল এবং কহিলেন যে,–সে কাছে আসে নাই, প্রত্যেক বালকবালিকা তাহারে অভয় দেয় তবু,–আহা আমি তাহা দেখিয়াছি এক বালক যখন আর এক’কে অভয় দেয়–সে এক বলিহারি ছবি!…

তিনি সহাস্য বদনে আরও বলিলেন সম্ভবত এত ছোটদের মধ্যে যাহারা মাথায় ঘোট সেই সকলের উলঙ্গদের মধ্যে কি যাইব, ভাবিয়া সে চলিয়া গিয়াছে, আমার নিকট সে’ও ইহাদের মতই, তবু সে আমার আহ্বান বুঝে নাই…এখন এই মিছরি লও, মেওয়া লও, বেচারীর মুখ শুকনা। লও, তাহার মঙ্গল ইচ্ছাময় করিবেন।

মনিব মহাশয় সশ্রদ্ধায় করজোড়ে মেওয়া মিছরি গ্রহণ করত মহাপুরুষের পদাৰ্চ্চনার পর ধীরে কহিলেন,–প্রভো, আপনি সেই যিনি পত্র উদগম রহস্য দেখিয়াছেন, আপনার হাস্যে অচিন্ত্যনীয় শ্লোকপ্রবাহ, আপনার চাহনিতে শত বাত্যাতেও দীপশিক্ষা অস্পন্দ হয়, আপনি জ্ঞাত যে সেই অভাগা কেন আপনার সন্নিহিত হয় নাই; সে ঐ সময় এক দাঁড়কাকের রব শুনে যখন আপনি তাহারে আহ্বান করিলেন, সে দেখিল যে এখানেই আপনার নিকটেই বাঘেরা খেলোয়াড়ের ঘুম ভাঙ্গিল, অর্থাৎ আপনার নিকটেই উহার ঘুম থাকে, যে সে দেখিল এক উন্মাদ তুলা পিজিতেছে, এবং পরক্ষণেই আবার মহানন্দে অচেনা আকাশ লইয়া খেলা করিতেছে, আমার বুদ্ধি বলে, ইহা আপনি তাহারে দর্শাইলেন। সে অথচ ভীত হইল। সে কাষ্ঠচ্যুত কূৰ্ম্মবৎ এক অভিনব জীব, তাহারে রক্ষা করুন, হায় সে অবশ্যম্ভাবিতার দিকে ছুটিল!

তিনি, মনিব মহাশয়, অতঃপর চলিতে থাকিয়া আপন প্রসারিত করপুটে ঐ মিছরি ও মেওয়া দর্শনে অশ্রু সম্বরণ করিতে পারিলেন না, ইহাতে অত্যাশ্চর্য্য ভালবাসা ছিল। এ কারণ যে পশ্চিমের পত্রভেদী সূর্যরশ্মিতে স্ফটিকতুল্য মিছরিখণ্ডে অজস্র রামধনুর আশ্রয় হইয়াছে, কিসমিসগুলিতে রঙ ধরিয়াছে, ইহারা বহু পুরাতন হইয়াছে।

এবং যে ইহা হইতে চক্ষু তুলিতেই তিনি থ, হস্ত হইতে তখনই প্রসাদী সকল মাটিতে পতিত হইল, যে সেইদিকে তাকাইবার সময় পর্যন্ত পাইলেন না, অথচ যে তিনি প্রসাদ পতিত হওয়ার অপরাধে আপন জিহ্বা দংশন করত আপন কর্ণদ্বয় মলিতে থাকিলেন, কেন না এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখিলেন: এক। মৃত ব্যাঙ, যাহারে লইয়া দু একটি কাক ছিন্ন করিতেছে, তিনি ইহা যে তীর্থক্ষেত্র তাহা ভুলিলেন, কোন। শিব জয়ধ্বনি আর শুনিতে পাইলেন না।

যে এহেন দৃশ্য তদীয় গৃহদ্বারকে পৰ্য্যন্ত আঘাত করিল, সাঁওতাল গৃহদ্বারে কত লতাপাতা, বাঙ্গলার গৃহদ্বারে এস মা আনন্দময়ী–এহেন দৃশ্য তদীয় মমত্ববোধকে পরিহাস করিল। এবং যে তিনি নির্ঘাত, তিনি নির্ঘাৎ হঠাৎ, যেন মনে মনে কলের গানের কাছে যাইলেন, আপন আসবাবপত্র জামাজুতা দেখিলেন, স্ত্রীর ফটোগ্রাফের নিকট দাঁড়াইয়া খানিক, তৎপর যেন পাইপ ধরাইয়া একটি টান দিয়া সিদ্ধান্ত করিলেন, যে ঈদৃশী নির্দয় দুষ্কৰ্ম্ম অভ্রান্ত যে সুঘরাই কর্তৃক সংসাধিত হইয়াছে।

তখনই তিনি স্রিয়মাণ ইহাতে; অবিলম্বেই বুঝিলেন যে সে যেন দারুণ শিক্ষিতের মত রূপান্তরিত, যে তাহার নিজের মস্তকের করোটি সম্পূর্ণরূপে বদল হইয়া গিয়াছে; যে সে নিজের উপর ভয়ানক ক্রুদ্ধ হইয়াছে, একের পর এক সংস্থান সে ক্রমাগত আশাতে, কখনও কৌতূহল প্রবর্ত্তীত হইয়া ভাঙিয়াছে ও যে ইত্যাকারেই ক্রমবর্ধমান রাগে, বিশেষত নিজেরে অপাঙক্তেয় ক্কচিৎ জানিয়া, কভু নিরুপায় বুঝিয়া, সে মারাত্মক আধুনিক হইয়াছিল; অধুনা সে যে ডোম ইহাও বিস্মৃত; যে এবং সে মানসিক বৈগুণ্যে পথের কুকুরকে ঢেলা দ্বারা আক্রমণ করিয়াছে, যে অনেক নিরীহ কাঠবেড়ালীকে ক্রুর সর্পের হিস শব্দে খেদাইয়াছে।

যেমনভাবে সে তদ্রূপ বিষাক্ত আওয়াজে তাহার আপনকার প্রাণপ্রিয় জীবিত স্বরূপ তিতিরটিকে একদা ভয় প্রদর্শন ক্রমে খুসী হয়, মনিব মহাশয় বুঝিলেন, সেই প্রবৃত্তির নাশ হয় নাই, অথচ কিন্তু ঐ ব্যাপারের জন্য সে, সুঘরাই, তখন অপ্রতিভ হয়, তখন অধোবদন হয়; যাহা এইরূপ ঘটে: শনিচারোয়া সেদিন না আসাতে সুঘরাই ভিতরের বারান্দা ঝাঁট দিতেছিল, তদীয় পাখীটি নিকটেই এবং উহার গাত্রে সকালের রোদ খেলিতেছে, যাহা সহসা সুঘরাই অবলোকনে আবিষ্কার করিল; যাহাতে সে অতিশয় তন্ময়; এতদ্ভাবাপন্ন রহিতে ক্রমে, তাহার সারা দেহ এক যাদু আবেগে তছনছ হইল, রোমকূপে ঘোর শব্দ উঁচাইয়া হৈ দিয়া উঠিল।

যে আর, সে এরূপ বাক্যে আপনাকে, সে উচ্ছাসকে, প্রকাশিল,–ওরে আমার সোনার পক্ষী দেখ, দেখ, এখন আমার সর্বশরীর তোমার প্রীতিবর্ধন নিমিত্ত, তৃপ্তিসাধন হেতু, সম্পূর্ণ পতঙ্গরূপ ধারণ করিয়াছে, হে রে পক্ষী তুমি আমারে সত্বর খাও, হে রে তুমি আমারে বিনা লবণেই খাও, আমি সার্থক হই! ইহা বলিবার পর মহা আদরে গদগদভাবে সোহাগাত্মক ভাব জানাইল ও তৎসহ সে নিজ হস্ত প্রসারিত করিল, যাহাতে তাহার প্রিয়তম পাখীটি চঞ্চদ্বারা উহার হাতে মৃদু টোকা দেয়।

সে ভারী খুসী, যে এবং ইহাতে অঢেল উফুল্ল হওয়ত আপন দেহ, উপস্থিত তদীয় দেহ যাহা চতুষ্পদ ভঙ্গীতে ছিল, তাহাতে যেন গোপন কোন দুর্লভ কিছু ভোজ্য বস্তু পাকিয়া আছে, তাহাই দেহ। হইতে, অদ্ভুত ভাবে আন্দোলনে সুঘরাই উৎক্ষিপ্ত করিয়া তিতিরটিকে দিতে চাহিয়াছে, কি-যে-নিবেদন করে তাহা ব্যক্ত করিতে অনেকই বাস্তবতা, অনেক প্রাচপ্রত্যক্ষ প্রতীয়মানতা সে স্মরিয়াছে।

ও যে অবিচারিত চিত্তে অসাধনেই ডোমবুদ্ধিতে বলিয়াছিল,–ওরে পক্ষী, এখন আমি নিজেই ঐ যে দুইটি পাহাড় স্পর্ধাভরে একে অন্যের প্রতি চাহিয়া আছে সেই দুইটিই আমি, এখন আমি ত্রিকূট, এখন আমি ডিগরিয়া পাহাড়, এবার ইতোমধ্যে যে দিক সকল, যে রহস্য ব্যাপ্ত, তাহা কজা করিয়াছি, তুমি সত্বর তাহা গ্রহণ কর গ্রহণ কর, খাও আমি সুখী সার্থক ও ধন্য হই।

পরক্ষণেই বলিল, আয় আমরা কামড়াকামড়ি করি, কুকুররা যেরূপ করে! আমার ভগনীপতি ও তাহার স্ত্রীলোক যেরূপ করে।

এবম্প্রকার বচন সুঘরাইএর নিজেরই, হৃদয়ঙ্গম হইতেই সে হরষে কণ্টকিত, সে অতিকায় সুবিশাল, এখানেই এই দেহে সূৰ্য্য উঠে ডুবে ইহা প্রমাণিত হইতেই সে অধীর আছে; ভাগ্যে পক্ষী দূরে যায়, ভাগ্যে ঝাঁটা নিকটেই আছে, আর যেটি ধরিতেই সে প্রকৃতিস্থ হইল! তাই সাব্যস্ত হইল যে, সে ভীত ও যে এহেন ভীতি সম্পর্ক সুঘরাই একদমই অপরিজ্ঞাত ছিল; নিশ্চয়ই ইহা সর্প বিছা ব্যাঘ্র অন্ধকার ঝক্কা বজ্রপাত প্রেত পেয়াদা ব্রাহ্মণ বা উচ্চবর্ণ হইতে,বা ঠকিবার ভীতি হইতে ইহা, মোটর গাড়ী হইতে ইহা হয় অধিক কূট, বাঁকা!

এখন, সম্মুখে কোন কিছু কম্পনে অনুভবের পূৰ্বেই যে ঝাঁটার জলদি শব্দ কিন্তু তাহারে আকৃষ্ট করে, এখন দেশীয় ঘৃত মিশ্রিত মুরগীর মাংস পাকের গন্ধ তাহাকে প্রলুব্ধ করে নাই; যে অন্যবিধ গন্ধ হইতে ঘৃতগন্ধ যে স্বাদু তা বুঝে ইদানীং! ঝাঁটার আওয়াজে সে আর এক হইল; ফলে ত্বরিতে উহা অনুসরণ প্রাবল্যে অচিরাৎ কালান্তক গোখুরা সর্পের হিস্ সুঘরাইএর জিহ্বায় ঘটিল, আর সে তখনই পরমাশ্চৰ্য্য ভালবাসাতে ঐ বিভীষিতকারী করাল হিস্ শব্দে তিতির পাখীটিকে, আতঙ্কগ্রস্ত করিতে বাহাদুর! মহা আহ্লাদ তাহাতে, সে আপন কৌশল দেখাইবার নিমিত্ত চারিদিকে দেখিল, পরক্ষণেই হিস্ শব্দ খেলিয়া উঠিল, ইহাতে সকালের হাওয়া বজ্রাহত, মানুষের রক্ত নিস্তেজ প্রাপ্ত হইল।

অদূরে খাবার ঘরে মনিব পত্নী ষ্টোভেতে খানিক বাসি মুরগীর-মাংসর তলা-পুড়াইয়া পাক করা সকাল-বেলাকার জলখাবারের জন্য প্রস্তুত তদারক করিতেছিলেন, এবং নিজে ময়দা মাখিতে ছিলেন। ঐ শব্দে তাঁহার কান খাড়া হইল; সেই মারাত্মক ধ্বনি স্টোভ অথবা জাতীয় অন্য কোন আওয়াজের সহিত মিশিয়া যাইবার না, উহাতে নিয়তির পায়ের খস খস ধ্বনি আছে! শ্মশানভূমি যেন ফুঁসিতেছে!

অন্য ঘরে যে শব্দে, মনিব মহাশয় রাত্র-আঙরাখা পরণে পাইপ মুখে কলের গানে কমলা ঝরিয়ার গান শুনিবার মধ্যে পরিষ্কার অভিধানে বুঝিয়া থাকেন; ফলে দুজনেই, মনিব পত্নী ময়দার তাল সমেত হাতে ত্রস্ত হওয়ত দরজার গোড়ায়, ও যে মনিব মহাশয় শঙ্কিত পদে বারান্দায় আসিলেন–এখন ইনি হিস শব্দের কারণ নির্ধারণে অতি স্বাভাবিকভাবে পাইপ-ধৃত দাঁতেই কোনমতে হেই দিয়া উঠিলেন।

যাহাতে মনিব পত্নী অধিক উম্মামতি হন, তাহারে সুঘরাইকে, সাতিশয় তাড়নাপূৰ্ব্বক এই কথা বলেন, বলি পোড়ার মুখো নচ্ছার শয়তান বলি হচ্ছেটা কি, আবার দাঁত বার করে হাঁসছিস, লাজলজ্জার বালাই নেই, এই সাতসকালে বেচারা পাখীটার ‘পোঁদে’ লাগা, কি কাণ্ড! আমি ত ভয়ে কাঁটা, আর কাজ পেলি না, ঐ এক রত্তি পাখী, ছেলেমানুষ অবলা জীব, তাকে ভয় দেখাতে তোঃ বাধল না, তোঃ মতন শয়তান ত কখন দেখিনি, সাপ হয়ে হিস্‌ হিস্‌ হচ্ছে ছ্যা ছ্যা…দেখবি’খনে আঃ-জন্মে সাপ হয়ে জম্‌মাতে হবে…তোঃ ভালবাসার মুখে ঝাড়ু, তোদেঃ ছোট জাতের কি মায়া মমতা বলতে কিছুঃটি নেই র‍্যা, সাত সকালে ইকি কাণ্ড! ও ঘরে না ঁমা রয়েছেন, বুঝলি অনেক পুণ্যে মানুষ জন্ম, অনেক পাপে ছোটজেতের ঘরে জন্ম হয়, ডোম চাঁড়াল হয়, ওঁর আদরেই তুই এত বাড় বেড়েছিস্‌!

এবং ইহার সহিত আপন স্বামীর উদ্দেশে কহিলেন, তুমি ওরে কিছুটি বলনা বলেই ত এত আস্‌পদ্দা, ইস ভাবলে গা হিম হয়, কতবড় পাজি, তুই শয়তান না মানুষ, নিশ্চয়ই ডাকাত হবে…আবার ওকে তুমি বন্দুক সাফ করতে দেবে বলেছিলে (!) তুমি কিছু বল না বলেই ত…কি নরক যন্ত্রণা!

মনিব মহাশয় গান শুনিতে থাকিয়া উত্তর করিলেন,বলিলাম ত, এই সব রুক্ষু ঝামেলায় আমাদের কোন প্রয়োজন নাই, আমরা বেড়াইতে আসিয়াছি, আমরা খামখা পাদরীগিরির জন্য বরাত লইয়া আসি নাই, অতশত হুজুতে কোন কাজ নাই, আজ হিস করিতেছে, সেদিন পাখীটিরে পদাঘাত করিল, উহাকে এই মুহূর্তে এক কাপড়ে পাখীশুদ্ধ বিদায় কর, পাপ! তাড়াইয়া দাও হারামজাদাকে।

স্নেহশীলা মনিব মহাশয়া ইহাতে বিব্রতচিত্ত মর্মাহত হইয়া কর্ণে অঙ্গুলি প্রদানে প্রায় উদ্যত হইতে চাহিলেন, একদা তাহার খাঁচার প্রতি নজর গেল, যাহা তিনি সাজাইতে সাহায্য করিয়াছেন, ইনি শিহরিত আছেন!

‘নারায়ণ নারায়ণ’ এবং ‘তারা ব্ৰহ্মময়ী মাগো’ বলিয়া ‘আনন্দময়ী মাগো’ বলিয়া, আনন্দময়ী ঁশ্রীশ্রীমায়ের চরণ স্মরণে স্বামীর জন্য ক্ষমা চাহিয়া অত্রাহি হইয়া কহিলেন,–ছি ছি তোমার কি জ্ঞানগম্য হবে না কোনদিন, মাঠাকরুন কি ভাববেন! বকতে বললুম বলে ঐ সব অলুখুনে কথা, তোমায় বলতে যাওয়াই আমারই ঝমারি হয়েছে…সাত সকাল। এতবড় কথাটা কি করে তুমি মুখে তুললে; ছোঁড়া নয় ভুলই করেছে…।

যে এবং ঠিক এমত সময়ে তাঁহার কথার মধ্যে তিতিরটি মনিব পত্নীর পায়ের নিকট আসিয়া নখে ঠোকা মারিল, ইনি যন্ত্রচালিতের ন্যায় হস্তধৃত ময়দাপিণ্ড হইতে, কিঞ্চিত মাখা ময়দা লইয়া তাহারে দিয়া সুঘরাই উদ্দেশে ইহা বলিয়াছিলেন,–আঃ মরণ দশা! তুই অমনতারা হাঁ করে মূর্তিমান পাপের মত দাঁইড়ে রইলি যে, নে নে ঝটপট ঝাঁট দিয়ে, এরে, পাখীরে খাবার দিগে, দ্যাকদিকি কি খিদেটাই পেয়েছে…।

এবং পাখীটিকে আপন শিশুর ন্যায় সম্বোধনে কহিলেন ‘আহা খিদে পেয়েছে তোমাল বেচারী!’–এই সোহাগ বাক্যে পাখীটি আশ্চর্য যে, অদ্ভুতভাবে যে, মুখোনি তুলিয়াছিল।

বটেই উহাতে, ঐ হিস্ ধ্বনিতে, ভক্তিমতী মমতাময়ী সেই রমণী যারপরনাই ভীতা হইয়া থাকেন; যে কিন্তু অন্যপক্ষে, সুঘরাই এই তীব্র বকুনিতে ভারী জবুস্থবু!

কিন্তু যে এ পর্যন্তও তাহার সুঘরাইএর মুখে নীচজাতিসুলভ বাঁদুরে হাসি বিদ্যমান রহে, তত্রাচ এক সুদারুণ আত্মশ্লাঘা তদীয় সুন্দর নিটোল ললাটে প্রতিভাত, যাহা যেমন যে, এই পক্ষী হয় আমার, উহার যে পালক সকল অদ্যাবধি হাওয়াতে উড়িয়া গিয়াছে তাহাও, তাহাও; উহার হাঁটা চলা ঠোকরান ডাক্, উহার দুর্গতি, উহার কম্পন, উহার চাঁদ সর্বৈব কিছুই আমার, উহাতে অভ্রান্তই মদীয় প্রভুতা থাকে!

ও তৎপ্রভাবিত সুঘরাই আপনার প্রাণ অপেক্ষা বুকের পাখীকে মহা আহ্লাদে হেদাইয়া তির্যকে লক্ষ্য করিল; করিতেই, তন্মুহুর্তেই ঐ ভ্রম অদৃশ্য হইল; তৎপরিবর্তে পৃথগ্নিধ এক গম্ভীর চমক তাহার যুগে বৰ্ত্তাইয়াছে, তাহাতে ক্ষণেকজন্যই সে কুহকাম্বিত হইলেক, ও ঝটিতি পুনরপি সর্প হিস দিতে সে অধীর হইয়া থাকে; এই কারণেই যে, তৎকৃত ভুজঙ্গশব্দের ফলে অদৃষ্টপূৰ্ব্ব এক দুর্ধর্ষ ঘটনা ঐ পক্ষীতে, নিরীহতা মধ্যে, উদঘাটিত তদ্বারা আবিষ্কৃত হইয়াছিল; আর যাহা সাক্ষাতেই তাহাতে ভাব লাগিয়াছিল, যে সে, সুঘরাই, অবিনাশী গোপনতা সেইক্ষণে নেহারিয়াছে, ইহাতে সে নির্ঘাত আর ডোমপুত্র নহে!

যে ঐ শব্দে যুগপৎ পাখীটিতে কীদৃশী মনোরমত্ব উজাগর! কি এত অব্যর্থ অভয়, কি গৌরব, কি এক পেশী, ঝামরাইয়া তখনই উঠিল, ইহা যাহা অপরিসীম দিব্য, ইহা যাহা খাসা, কি ঘটা! সেই মুহূর্তে ঐ কাল সদৃশ ঘোর হিস আওয়াজে তিতিরটি চমকে উৎকর্ণ সচকিত হইল, কি যেমন তাহাতে! মাল্য মৃত্তিকা কুসুমাদি পতঙ্গ জুড়িয়া এক তুমুল কিছু প্রকট হইল, করতাল ঝাঁজিয়া উঠিল; সুঘরাই যেমন বনমধ্যে। আঃ পক্ষীর গ্রীবা কৌস্তুভ মণিময়, অখণ্ড তেজে দীপ্তদৃপ্ত সটান!

অয়ি শীর্ষস্থতা!

এরূপ দেখা, এই দেখার জন্য আত্মপ্রত্যয়, সুঘরাইকে ঐ দিবস বহুক্ষণ যাবৎ শ্ৰীযুক্ত, প্রজ্জ্বলিত রাখিয়াছিল; অনেকবারই সে সগর্বে পাখীটিরে কিয়ৎদুর হইতে অবলোকন করিয়াছে আর তখনই সেই শীষটান, ঐ লতেব গ্রীবার,–কোন প্রহেলিকার কম্পনে, তির্যক গতি ঝটিতি নিরেট সোজা উহাতে– যাহা তাহাকে নির্ভীক করে, সেও অজ্ঞাতে উহা রপ্ত করিতে অধ্যবসায়ী হইল।

যে এবং এই প্রথম, ডোম জীবনে যে এতাবৎ ভীত, সে জিজ্ঞাসু হয়, তন্নিষ্ঠ যখন সে –কুঞ্চিত করে, তৎক্ষণেই যে সে এক অনৈসর্গিক বিকট, ইহা প্রেততাড়িত-র অধিক, ভয়ে সে চেতনা বিনা; ইহার মধ্যে কি যেন মাথা চাড়া দিয়া উঠিয়াছিল; আবার গর্বে সে ডোম! অবশ্য সেই দিন পুনৰ্ব্বার ঐ কাণ্ডের জন্যই বড়ই অবায়ুখ তাহারে হইতে হইয়াছিল, যখন সে হিরণার টিলায়।

৩. সকালে বিকালে সাঁওতাল পরগণা

আমরা জানি সকালে বিকালে সাঁওতাল পরগণা, তথা জঙ্গল মহলের প্রায় স্থান, বিশেষত রিখিয়া, অভাবনীয় রূপ ধারণ করে–ইহার যে কোনও স্থানে দাঁড়াইলেই, এই বিশ্বাস হইবেই, যে মানুষের বড় কাছে দূরত্ব সকল; তাই সকালে এখানে রেখাব খেলিয়া উঠে, কেননা অমরতার দেখা দিবে, সন্ধ্যায় শুদ্ধ ষড়জ জাগর হয় কেননা অমরতা এখনই আসিবে; শুকতারা আশ্চৰ্য্য হরিণ যেমন বা।

ইহার আকাশে চির ব্রাহ্মণ্য, মৃত্তিকা বিস্তার হয় উৎসবময়ী ফোয়ারা! এমনই বৈচিত্র্যের মধ্যে সকালে চেঞ্জাররাই ভ্রমণে বাহির হয়, বস্তু সমুদয় কিছু অবাক মুহূৰ্ত্ত হইয়া উঠিতে থাকে, ভ্রমণকারীরা তাহার সেই মুহূর্তের সহিত করমর্দন করে।

সুঘরাইও মনিব মহাশয়েদের সহিত রিখিয়ার হাট পার হওয়ত উত্তরে হিরণার টিলায়, এখানে হাওয়া বড় বেশী, এখানে মনিবরা আঃ বলিয়া উঠিলেন।

মনিব মহাশয় তাঁহার পাইপে মিকচার ভরিতে থাকিয়া কহিলেন,–দেখ, ফাঁকা কথাটি এই স্থান সম্পর্কে যথার্থ নহে, ইহা আরও কিছু, কোন স্রোত এখানে নাই ফুল নাই–এখানে আমরা আবার নূতন–স্লেট আমাদের পরিষ্কার। এ স্থান এমনি যে, যে এই হিরণার টিলা এমনি যে ইহার জন্য সহজেই আমি তোমার শয্যা ত্যাগ করিতে পারি।

মনিব পত্নী ঐ বাক্যের প্রতি কোনমতে চাহিলেন,–উহা কঠিন উহা আমোদের!–এই জন্য কোনমতে যে, ইদানীং তিনি কশ্চিৎ নীল পালকের হাওয়াতে ভর করত নামিয়া আসা দেখিতে আছিলেন, তাই চক্ষুযুগতে, যাহা পান ও গুবাককে সংজ্ঞাতে পরিণত করিয়াছে, মৎস্যকুমারীর গল্পর সংযম যাহাতে থাকে এবং উনি উৎসাহিত ছিলেন, যে, আঃ কে জানিত ঐ পালকে মদীয় নির্ভরতা থাকিবে।

আর যে সেই আশ্বাসে হৃদ্বয় সটান, এখন কহিলেন,–আহা বেচারী পালকটা! দেখ দেখ পালকটা, কি সুদোর! ইহা প্রকাশিতে তাঁহার দেহলতা এরূপ কম্পিত তিনি যেমন বলিয়াছেন–এমন একটি নীল আসন হয়…যাহাতে বসিয়া শ্রীশ্রীমা জননীকে ডাকি (স্বর্ণমৃগ দর্শনে সীতা স্বভাবত এইরূপ বলিয়াছিলেন); অথবা এখন সন্ধ্যা হইবে, শঙ্খ বাজিবে তাই।

স্বামীর কথা তাঁহার কানে ছিল, উত্তর করিলেন,-ব্রাকেটে উচ্চৈঃস্বরে (!) হাস্যধ্বনি! এবং বুঝলুম মশাইয়ের আমার উবরি মমতা অঢেল! এখন এই নীল পালকটার জন্যেই আমার মনে হচ্ছে…এ জায়গাটা বড় আত্মীয় সমান!

.

এমত সময় একদল সাঁওতাল সারিবদ্ধভাবে ঐ টিলা অতিক্রম করিতে ক্রমে উঠিল, তাহারা নির্জন প্রবাহ, তাহারা অদ্ভুত, পায়ে চলিতেছে, তাহারা তাঁহাদের ইতিমধ্যে দিয়া যায়, ইহাতে তাহাদের মধ্যে এক আজব আড়াল সৃজিত হইল, সম্ভবত এই ক্ষণিক বিচ্ছেদ হওয়ার জন্য ভবিষ্যতে কখনও তাঁহারা উৎকণ্ঠিত হইবেন।

এখন সাঁওতাল দল তাঁহাদের দুজনকে দুজনের কাছে স্পষ্ট করিতেই, দুজনেই চমৎকারভাবে হাসিয়াছিলেন, চেনা-মানুষকে দেখার হাসি যাহা! এবং ইহার অবিলম্বেই, খানিক ইহাতে সলজ্জ মনিব পত্নী স্বভাবতই সুঘরাইএর কারণে এখানে সেখানে দৃষ্টিপাত করিলেন; দেখিলেন সাঁওতাল দলের লাইন এবার বাঁকিয়াছিল; এবং শনৈঃ সানোয়ার পথে নামিতেই খাঁচা-হাতে সুঘরাই প্রতিবিম্বিত হইল, ইহা এক দৃশ্য বটে!

মনিব পত্নী তাহারে দেখিয়া বিস্ময়ে কহিলেন, ও মা তুই ওখানে, আমরা ভেবে মরি!…দেখ দেখ। ছোঁড়া যেন সদ্য জঙ্গল! সুঘরাই তখনও সেইভাবে আছে, তাহাতে মনিব পত্নীর সাধ হইয়াছিল, চেঞ্জারদের মত বলিয়া উঠিবেন, কি গ্র্যাণ্ড দেখাচ্ছে না! কিন্তু ইহাতে, ত্বরিতে আগাইয়া-র (গ্রাম)…বাবুর বাড়ী আগত মোক্ষদা ঘোষালের গিন্নীর কণ্ঠস্বর জিহ্বায় থমকাইল, যাহা মনিব পত্নী শুনিয়াছিলেন।

নিজ বাড়ীর উঠান হইতে মোদাবাবু, ইনি সদাশিব তুল্য, ইহার বক্ষঃদেশে নস্যর দাগ, হাতে একটি নস্য-মলিন ন্যাকড়া, ডাকিলেন,–চাঁপার মা শুনিতেছ! বলি ও গো শীঘ্রই আইস একবার।

চাঁপার মা অর্থাৎ ঘোষাল গিন্নী মনিব পত্নীর সহিত গল্প থামাইয়া,–যাই ভাই একটু ঝাঁকি দর্শন দিয়া আসি, বলিলেন।

এসময় পুনরায় মোদাবাবুর কণ্ঠ পুনরপি ধ্বনিত হইল,উহারেও লইয়া আইস…।

ইহারা দুইজনে উঠানে যাইতেই, মোদাবাবু ধ্যানঘন আবেশে অঙ্গুলি নির্দেশে ব্যক্ত করিলেন, দেখ দেখ কি গ্র্যাণ্ড! এবং তাঁহারা দেখিলেন মাকড়সার জালে জল-বিন্দু!

ইহা দেখিতে ঘোষাল গিন্নীর আশ্চৰ্য্য যে ঘোমটা স্খলিতই ছিল, তাঁহার কণ্ঠলগ্ন দশ ভরির পাটি-হার কিছু অস্থায়ী, এই পাটি-হার এখনও পাটি-হার আছে! ঘোষাল গিন্নি বলিয়াছিলেন, লোকে আমায় কত বলিয়া থাকে, ভাঙ্গিয়া অন্য কিছু গড়াও না কেন, কত নূতন প্যাটার্ন হইয়াছে,–আমি বলি প্যাটার্নের মুখে, সখের মুখে, ছাই! এক প্যাটার্ন করিলেই তখন প্যাটার্ন প্যাটার্ন বাই হইবে…স্যাকরা পোড়ারমুখোদিগের গর্ভ ভরাইতে ত জন্মাই নাই…এখনও দুইটি মেয়ে পার করিতে বাকি!

এখন ঘোষাল গিন্নীর স্বর সবিশেষ আপ্লুত, যেমন বা ফোলা, তদীয় মাড়ির আড়া দেখা যায়, জালস্থিত জল-বিন্দু প্রত্যক্ষে কহিলেন,-মাইরী কি গ্র্যাণ্ড না ভাই!

উপস্থিত এই টিলায় মনিব পত্নী সমক্ষে সুঘরাই বিষয়ে, ঐ রূপ ‘গ্র্যাণ্ড’ উক্তিটি বাধা দিল, নিশ্চয়ই ভাবিয়াছিলেন, সুঘরাইএর বিষয়ে মহা বিশ্রী শুনাইবে। ইত্যাকারে তিনি আপন স্বরগ্রামই তুলিয়াছিলেন।

কেননা স্বামী বলিয়াছিলেন, গ্র্যাণ্ড গ্র্যাণ্ড ড্যানচিবাবুরা (ড্যানচিবাবু: আগে চেঞ্জাররা ঐ সব দেশের খাদ্য সামগ্রীর দাম শুনিয়া হাটে মাঠে বলিতেন damn cheap) এমতভাবেই বলে, বেচারীরা বলে যাহাতে মনে হয়, সৌন্দৰ্য কুৎসিতের প্যারডি মাত্র, অদ্ভুত না?

অথচ তিনি এখনও সেই পালক-নির্ভরতা বৃত্তিতে থাকিয়া ছেলে মানুষটিতে মনঃসংযোগ করিয়াছিলেন; এখন সুঘরাই বিশদ, যে বহুদূরস্থিত অভিমানী ত্রিকূট নিঃসঙ্কোচে উহার কাছেতে আসিয়াছে, যে বহুদূর হইতে বন সমারোহ–তাহাও, যে ধান ক্ষেতের ঝরণার শুধু মৃদু-শব্দ-গান ইহাও, যে এবং খাঁচা হস্তে বালকের পশ্চাতে অনেক অনেক লাল পথ সকল ছুটাছুটি করিতে আছে!

আরও যে, দেখা যায়, যে এই সময়েতে সুঘরাই আপন জিহ্বা দ্বারা ছোট করিয়া আপন ঠোঁট লেহন করে। স্রোত উহার বাল্যকাল, ষড়ঋতু উহার ভবিতব্য হয়! যে এবং ঈদৃশ জ্ঞানে এমনও যে মনিব পত্নী নীল পালকটি ভুলিয়াছিলেন কেননা বিশ্বাস এখন হইয়াছিল যে সে বালক নিঃশঙ্কচিত্তে প্রদীপ জ্বালাইতে ও নিভাইতে পারে।

নিরহঙ্কার মনিব মহাশয় পাইপে মৃদু টান দিতে থাকিয়া, সহধর্মিণীর উচ্ছাসহেতু সপ্রশংস প্রবণতায়ে আপনকার প্রিয় ভৃত্যের প্রতি নজরেতেই, এইটুকু তাঁহাতে ঝটিতি খেলিয়াছিল, অভিনবতম ব্রতকথার উদ্দীপনা দেখিয়াছিলেন, যাহার উপচার ঐ পৰ্বতশীর্ষের বৃক্ষপত্র, কেননা সেখানেই প্রথম বৃষ্টি হয়, কেননা সেখানেই প্রথম দিন দেখা দেয়। এই ভাঙা পদটুকু বড় আপনার, যে ইহা বড় বৈদিক! আর সম্মুখে সুঘরাই, যে আর তাঁহার চক্ষুদ্বয় ছোট হইল এবং যে তিনি খুসী সহকারে দমকা উচ্ছল হইলেন,…হা! লাল লা! সন আফ এ বিচ, হারামজাদাকে সত্যি চমৎকার স্পেইলনডি দেখাইতেছে…মিসিং লিঙ্ক! মিসিং…।

মিমি-সিং লিংক!…ও হ্যাঁ হ্যাঁ কৈ?–বলিয়া মনিব পত্নী ঐ সূত্রে সুঘরাইকে নূতন করিয়া বুঝিতে উদ্যোগী, তাঁহাতে অপ্রার্থিত বহু অভিজ্ঞতা সঞ্চারিত হইল: উহার পশ্চাতে কোথাও গেরি, কোথাও হরিৎ, কোথাও বা কমলা রঙ, কোথাও বা চলমান-রঙ অর্থাৎ যাহারা চেঞ্জার তাহারা ভ্রমণ করে; যাহা তাহাদেরই বস্ত্র ছটা!

এবং ঐ সকল রঙ প্রভাবে বিচরণের কালো মহিষগুলিও রঙীন; যে আর যাহাদের ইতঃমধ্যে তীক্ষ্ণ তছনছে হাওয়া–ইহাতে এহেন ছবিতে, তাঁহার বাম আঁখি স্পন্দিত হইল, ক্রমে ইতঃপূৰ্ব্বকার উপলব্ধি হইতে তিনি কোথায় যেন বাঃ বনরাজি যেন সুঘরাইএর গা শুকিতেছে।

তিনি মনিব পত্নী কিয়ৎ অপ্রতিভ যে স্বামীর সংজ্ঞা বোধগম্য হয় নাই, ও বিনীতভাবে প্রকাশিলেন,–সে কি গো আমি ত ছোঁড়াতে শুধু অন্ধকার দেখছি! এই অন্ধকার কথাতে তিনি নিজেই যেন সত্যযুগে, ক্লাসিক পৰ্য্যায়ে চলিয়া গিয়াছেন।

আ! যথার্থ ধরিয়াছ, উহাই ত মিসিং লিংক!

ইহাতে এখন সত্যই মনিব পত্নী বহুদূর নিঃশব্দতায়ে অন্তর্হিত হইয়া থাকেন, যে তথাপি স্বামীর উচ্চারণের রকমে, যে স্পষ্টতই স্বভাবতই অনুধাবন করিলেন, যে তাহাতে-মনিব মহাশয়ের চোখে, মিসিং লিংক প্রাপ্তির কোনও আত্মম্ভরি উদ্বেলতা আহ্লাদ আদৌ ছিল না, বরং তাঁহার চক্ষুর্ঘয় যেমন বা কোন দিব্য বিগ্রহে আকৃষ্ট হইয়া আছে।

ও এ কারণেই তাঁহার পানে মনিব পত্নী এমত নিরীক্ষণরত, যে যাহাতে, যেন ইনি উহারে বুঝিয়া লইতে চাহিয়া কিছু দিন ইহাই যেন বলিয়া চলিয়াছেন যে যথা: সেদিন এই হিরণার টিলায়–এখানে উড়িতে থাকা কতক কাগজ-টুকরা প্রত্যক্ষে তুমি থমকাইলে, চমকিলে, তুমি স্তোভযুক্ত হও, তুমি আতঙ্কিত। ক্রমে তোমার নিরীহ ওষ্ঠ সংপুট স্ফীত হইল, এতই যে তুমি যেমন দারুণ হুঙ্কারে প্রতিবাদে দিচরাচরে দৃষ্টিসঞ্চালন করিয়াছিলে, দূর হইতে জেঙ্গীল পক্ষী তোমার রোষযুক্ত ভাব অনুমানে আমাদের মাথার উপরকার আকাশ অতিক্রম করে নাই, একমাত্র টিলার যে দেবতা–টিলার অন্তর আত্মা যিনি, তোমার ঐ বৈগুণ্যে নির্ঘাত হৰ্ষযুক্ত হইয়াছিলেন।

ততঃ অচিরাৎ তুমি বিপুলতর দাপটে নির্ঘোষিলে,…এখানেও কাগজ! তোমার বাচনভঙ্গিতে চমক আয়রনি, শ্লেষ ছিল; অথচ তুমি শান্ত, অথচ তুমি নাটকীয় ভাবে দাঁড়াইলে, শিশিরবাবু যেমন ফুটলাইটের সমক্ষে, ফলে তোমাকেই তুমি, তোমার ঐ বাচনভাবকে তুমি নির্বাক করিলে, তোমার সবকিছুতে কেমন এক দুৰ্ব্বার খামখেয়ালী-ফের; কিয়দংশে মজার মনে হইলেও, আমি উদ্বিগ্ন, আমি ধন্ধে আছিলাম, যে তোমার মনুষ্যজাত দর্পিত জিহ্বায় ঈদৃশ হাহন্ত বলিয়া উঠিল, যে, এই মহাস্থানের কুমারীত্ব বিনষ্ট হইয়াছে ঐ সকল কাগজের টুকরায় যে ইহার, এই টিলার পুণ্য যা কিছু ইহার গৌরীত্ব অহঙ্কার ধ্বংসপ্রাপ্ত হইয়াছে।

যে আমারে উদ্দেশ করত ইহাই ইঙ্গিত করিলে এবং, যে, হায় তুমি না একদা কামনা করিয়াছিলে– যে এরূপ মহিমার কূৰ্ম্মপৃষ্ঠ জমি কি শান্তরসাস্পদ! কি স্তব্ধতা!–এখানে এক সুবিশাল নয়নসুখ নবরত্ন মন্দির উৎসর্গ করিব-অবশ্য যদি এমন সুকৃতি থাকে, অবশ্য যদি আদিষ্ট হই কখনও কখনও, এখানে শ্রীশ্রীমায়ের মন্দির স্থাপন করিব! কিন্তু এখন এই টিলা ইহা এখন অশাস্ত্রীয় হইয়াছে, এই টিলারে কেহ আর নালিশ জানাইবে না, সাক্ষী মানিবে না…অত্যাশ্চর্য্য যে কেবলমাত্র কাগজটুকরো দর্শনেই তুমি এবম্ভূত মতিচ্ছন্নই!

তোমার সেই অপ্রাকৃতিক বিলাপ বচনে আমি অথৈ-তে, আমাতে যারপরনাই এক পরমাশ্চৰ্য্য ভীতি সঞ্চারিত হয়! যে আর তোমার ঐ দুঃখদশা আমারে বিষণ্ণ মুহ্যমান করিলেক। জানি তুমি ধার্মিক, তুমি অতীব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম, তুমি অভিমানী, কত কত তুচ্ছ কিছু তোমারে হিম করে,…সেই যে সেই মনে পড়ে…সুন্দর মহিমাময় গম্ভীর গভীর খদির বৃক্ষ পূর্ণ আইবুড়া কুজ্ঞটিকাময়ী জঙ্গলে, যেখানে পেচকের আওয়াজে শিকড়গুলি ভয়ঙ্কর, যেখানেতে লতাগুল্মে প্রায়ই হরিণের শিং আটকাইয়া যায়, এহেন সংস্থানে তথায়ে অনেক লজ্জাবতী ও বিবিধ ভূমি গুল্মের কাছেতে, সমক্ষে, এক টুকরা দৈনিক টাইমস কাগজ, সিভার্সের মারমালেড-জার ও সাদা-পিগ মুদ্রিত টিন ও IXL এপরিকট জ্যামের টিন দর্শনে তুমি কি পরিমাণ গ্ৰাম্য, তুমি নিশ্চিহ্ন, তুমি মর্মপীড়িত ম্রিয়মাণ হইয়াছিলে, তুমি তদানীন্তন কালে এক মৌমাছি দেখিলে যাহা ঐ বিকট (!) সংস্থানে পরিক্রমণরত, তাহারে তুমি নির্বোধ বলিলে, তুমি বীভৎস দুষমনী উহাতে দেখিয়াছিলে–তুমি ধার্মিক যেহেতু–অথচ মজার কথা এই হয় যে, তোমার তাঁবুতে ঐরূপ আধারের দোকান সাজান! হায় সেই দিন তুমি ও তোমার প্রিয় বন্ধুদ্বয় (জোসেফ কিরণ। চৌধুরী ও ভবানী সি. বাসু) হরিণের পশ্চাদ্ধাবন হইতে পর্যন্ত বিরত হইলে–সূক্ষ্ম তত্ত্বে তখন তুমি বাণবিদ্ধ, যে তুমি ভক্তিযুক্তমনে চরণামৃত পান কর সেই তুমি…তোমাকে যখন যখন মনে পড়ে আমি কীদৃশী অচিন বালিকা!

ঐ সকল কাগজের টুকরা সকল তখনও এই টিলায় উড়িতে আছে!

আঃ ক্ষণজীবী পতঙ্গ সকল! তুমি সুঘরাইকে এক টুকরা কুড়াইতে নির্দ্দেশ দিলে, টুকরা আনীত হইল,–তাজ্জব, তুমি আজন্ম সংস্কার ভুলিলে, তুমি কি নেটিভ!–আনীত টুকরা পাঠে তুমি অতিমাত্রায়ে বিক্ষুব্ধ, কি এক বেদনা তোমাতে ফুটমান হইতে চাহিল, তোমাতে বাক্য বৈখরী হইল, অথচ কিন্তু ঝাঁপটা হাওয়াতে উহা গোঙানির ন্যায় বুঝায়।

তোমার আদেশে তোমার প্রিয় ভৃত্য টুকরা সংগ্রহে প্রবৃত্ত হইল, এই স্থান বৃহৎ হইল, যে অন্যপক্ষে আমি স্ত্রীলোক মাত্র–সতত পৃথিবীরে দোষারোপ করিতে ইতস্তত থাকি, অবশ্য আমি মদীয় গণ্ডদেশে তর্জ্জনী স্পর্শ করিয়াও করি না, যে এবং তোমার পাইপ সত্ত্বেও আমি বিব্রত নহি, তোমারে আর আমি নেটিভ বলি নাই, আমি শুধু তোমার পাইপের হস্তীদন্তশ্বেত বিন্দু (কোন এক দামী পাইপে এইরূপ থাকে) নিষ্পলকে দেখি; যে সেই ডোম বালক ইতঃমধ্যে মহাউৎসাহে ছুটিয়া ছুটিয়া কাগজ সকল কুড়াইতে আছে, এ দৃশ্য ভয়ঙ্কর, ঐ দৃশ্য বিশ্রী! যে তাহার আদরের তিতির পাখীটি এখন খাঁচা ছাড়া উহাও মহা আমোদে তাহারে অনুসরণ করে ক্কচিৎ কখনও বা উড়িয়া কখনও পদব্রজে।

এ দৃশ্য দারুণ খেলা।

যে তুমি দুচারখানি টুকরা পাঠে ইহাই পড়িলে, ল্যভ লেটাঃ! আশ্চৰ্য্য ঐ কথার কোন প্রতিধ্বনি ছিল না। মেঘ সকল নিঃশঙ্কচিত্ত ছিল।

এবার তুমি যখন অস্পষ্টভাবে উচ্চারিলে ল্যভ লেটাঃ কিছু প্রতিধ্বনি শ্রুত হয়, যেই না তুমি নিরীহ শিশুকণ্ঠে ঘোষিলে ল্যভ লেটাঃ! এইবার দিকে দিকে সেই শব্দ প্রতিধ্বনিত হইল। শিশুস্বর নিবন্ধন উহাতে শ্লেষ ছিল নাই। আশ্চর্য মেঘ অপসারিত হইল, আমরা দুইজনে দূরে দূরে অজানিতেই অসহায়ভাবে নয়ন ফিরাইলাম, আমরা (?) বহুদূরাগত গন্ধসমূহ পাইলাম, যে এবং দুর্জয় অপরিমেয় অতুলনীয় ঘ্রাণশক্তি ক্রমে বহু যুগের অতীতের স্বর শুনিলাম! এক প্রমত্ত জোয়ান কাব্যবীজ! দুস্তর গোপনতা ভাঙ্গিয়া যাহা আসিতে আছে।

অতঃপর তুমি টিলার দিকে পুনৰ্ব্বার অবলোকন কর, তুমি সম্বলহীন! তবু আদৃত ভাবে এখানে সেখানের পারিপার্শ্বিকতার কত গাছ, কত লতা, ধূলা উড়া হৃদয়ঙ্গম করিলে…যে ও তুমি কেমন যেমন ব্যর্থতায়, ইহাতে যে আমি মা জননীকে স্মরণ করিতেছিলাম। তুমি মথ-এর (পতঙ্গ) তুল্য নিৰ্ব্বিকার, দারুভূত আছিলে!

তৎকালে আর সেই বালক কখনও কখনও তাৎপর্যপূর্ণ জিগীর দিতে থমকায়, কখনও আপনারে ধিক্কার দিতে আছে, কখনও বা হঠাৎ উৎফুল্ল, এই যে আর এক খণ্ড! আর এক খণ্ড! পুনরপি আর এক।

খোঁজে তোমার ঘ্রাণশক্তি, যাহা মানুষে কথঞ্চিৎ, তাহাই ক্রমবর্ধমান হইতেছে।

আবার পরিলক্ষিত হয়, বালকের ঘোট হাতখানি–সে নিজ ঢালু নিম্নে থাকার কারণে মানে তাহার শরীর দেখা যায় না!–এখন ওতপ্রোত এই বিরাট নশ্বরতার মধ্যে ফাঁকার মধ্যে উচ্চাইয়া উজাইয়া উঠে। তিলেক বাদেই সে ছুটিয়া আসে, যেমন তদীয় পক্ষী যেমন পোকা ঠোঁটে দৌড়ায়–খুব সাদা সাঁওতাল গীতের লাইনের ব্যঞ্জনা যেমত বা।

আর যে তুমি ঐ সকল সংগৃহীত টুকরা সুদক্ষ প্রতিভাধর মণিকারের ন্যায়, পরীর গল্প রচয়িতার প্রায়, বিচক্ষণতায়ে কাজল-টানার যতনে, সাজাইতে বসিলে প্রত্যেক খণ্ডে নুড়ি চাপা দিলে, এবার তুমি অধিকতর চাতুর্যে নির্মাণ করিতে লাগিলে ইত্যাকারে যে,–চিঠি সুবাসিত!

সম্ভবত খোঁপায় ছিল…উঁহু তৈল চিহ্ন নাই! ব্লাউজের অন্তরে, বুকের ঘামে অক্ষর তাই নির্ঘাত আর্দ্র-হওয়ত ছাত্র…মানে কিছুক্ষণ আগেই অর্থাৎ সদ্য ঘেঁড়া…এই চিঠি প্রথম না, কিছু উত্তরের পর…পুরুষের হস্তাক্ষর। পুরুষেরই…!

ও! প্লেটোনিক…..

ফ্যা…ব্রাউন ও নিশ্চয় ফ্যানী হইতেই হইবে…কলেজের কোন ছোকরা…বেশ কথা ভালবাসিতে চাহিতেছে আর মেয়েটি বোধ হয় লিখিয়াছিল…বিবাহিতা? হয়ত না! শেলীয়ান হাইটের তোড়…চমৎকার পেগানাইজ!

আঃ শেলীয়ান হাইটেও ইহা নূতন peganisation.

যে এবং এই পর্যন্ত বলিয়া তুমি আমার প্রতি নেত্রপাত করিলে।

আমি অসহিষ্ণু হইলেও তোমার ব্যবকলনে (deduction) খুসী, অবশ্য হোমস-স্মরণে (শার্লকহোমস) সমগ্র ব্যাপার শুদ্ধ করিয়া নহে বরঞ্চ তোমার এতাদৃশ বৈচিত্র্য আমার এমনিতেই বেশ লাগিতেছিল–নিশ্চয়ই আমিও কোন ঘঘারে ছিলাম!

এখন তুমি স্নায়ু-বিধ্বস্ত কেন না চিঠির মধ্যে ফাঁকা–খানিক স্থান টুকরাবিহীন–সেখানে টিলার জমি গর্জন করিতেছিল, পোকা, ঘাস, ফুল উদ্ধৃত, এই ফাঁক নিরখিয়া তুমি জড়, থ, তুমি আধ্যাত্মিক!

যে ঝটিতি ব্যক্ত করিলে, আঃ নিষ্ঠুরতা! পত্রলেখক এক বীভৎস নিষ্ঠুরতা প্রত্যাশী-হন্যে! নিষ্ঠুরতা তাহার স্বর্গ! ইহার পর তুমি প্রচণ্ড প্রসারিত, রিখিয়ার সভ্যতার দিকে ব্যর্থতায় তাকাইলে ‘আঃ রিখিয়া’ বলিয়া এবং যে তুমি মহাশক্তিতে শ্বাস গ্রহণ করিলে যাহাতে বহু দূরস্থিত বৃক্ষলগ্ন পরগাছা চমকিত হইল।

শনৈঃ যে আরও যোগ দিয়াছিলে…মনে কর পেগানাইজেশনের তোড়ে দুজনেই দুই জনকে, একে অন্যরে, কীদৃশী ভয় পাইতে চাহে! সমস্ত অস্তিত্ব কণ্টকিত!

আর আমারে জিজ্ঞাসিলে, না না আমার সায় প্রত্যাশায়ে কহিলে…কেন মানুষ এতেক নিষ্ঠুরতা চাহে…নিষ্ঠুরতাই কি প্রেমের মৃত্তিকা…একের নিষ্ঠুরতা ক্ষয় করিবার চায়…অনৈসর্গিক মরালিটি…ফুলের ঘায়ে যে মূর্হিত এখন সে দলিত হইতে প্রস্তুত!

এবং ঐ সময় সুঘরাইএর পক্ষীটি তোমার চিঠি সাজানর নিকটে পাছে উহা ভাঙে তাই তুমি তাহারে হেই বলিয়া তাড়া দিয়া আরবার মন্তব্য করিলে যে,…অবশ্য ইহাতে আমি মনস্তত্ত্বর যুক্তি বলি নাই।

তোমার উক্ত বাক্যালাপ আমার নিকট ঝাঁপসা অবশ্যই তাই বলিয়া আমি হেঁয়ালী নামে উহা সকল দূরে ঠেলি নাই–যেহেতু তখন আমি সন্ধ্যাকালীন শঙ্খের আওয়াজে অন্যমনস্কা, অবশ্য তোমার ঐ শেয়োক্তিটিতে আমার বারম্বার মনে হইতেছিল যে তুমি, শঙ্কা হইতেছিল যে তুমি, এখনই ললাটাঘাত বিষণ্ণতায় বলিবে, আঃ মনুষ্যজাতি! অবশ্যই নিরাশার যে উহা, ঐ কথা, অবশ্য বাবার (মনিব পত্নীর শ্বশুর) গলার স্বর ঐ ব্যঞ্জনায় নাই, তবু বাবার মতই বলিয়া উঠিবে আঃ মনুষ্য জাতি!

আঃ বাবার হাতে কি অমোঘ পরমায়ু! তাঁহার হাত ট্যালকের গুঁড়ায় কি অদ্ভুত অশরীরী–কি সাদা! হাতে ম্যাগনিফাইং গ্লাস, হাতে খোলামকুচি! হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়ে বাবা একবার বলিয়াছিলেন, অসট্রাকন! এক টুকরো খোলামকুচিতে কি বিদ্বেষ, কি অট্টহাস্য, সঞ্চিত ক্ষোভ।…আবার একটুকরাতে কি হদিশ, এমন একরেখা মোটিফ, এমন এক নিরবচ্ছিন্নতা…মিসিং লিঙ্ক! আর মনুষ্য জাতি!–

ইহা বলিতে থাকিয়া বাবার চক্ষুর্ঘয় আশায় বিস্ফারিত, আর তুমি আর এক, সেদিন তদ্রূপ উপলব্ধিতে আমি যথার্থই অশান্তিতে ছিলাম, আবার ইহাও যে, সন্দেহ হইতেছিল যে তুমি রহস্যপ্রিয়, যে কোন মুহূর্তই চমক দিয়া হা-হা হাসিতে আমাকে অপ্রতিভ, আমার রমণী স্বভাবকে অপদস্থ করিতে পার!

এখন, আজ উপস্থিত আপনার স্বামীকে সম্যক বুঝিবার চেষ্টা হইতে বিরত হওয়ত ইনি কপট বিরক্তি প্রকাশে তর্ক করিলেন,…আহা বললেই হ’ল কোথায় ঐ চোর চোর দেখতে ডোম ছোঁড়ার মধ্যে তোমায় সেই যে বলছিল–এবং ইহার সহিত প্রধান শিক্ষয়িত্রীর ধারায় বলিলেন,–একশোর মধ্যে জিরো…যাও!

কিন্তু পরক্ষণেই মনিব পত্নী আত্মস্থ হইলেন কেন না তাহাতে আভাসিত ইহা যে, সেই দিনকার সেই চিঠির টুকরার পাশে বসিয়া তাহার প্রেমাস্পদ স্বামী নিজ ভাবুকতার সূচনা করিয়াছিলেন, যথা…ধর…অবশ্য বলা যায় কোন এক অলিখিত অপেরার মহতী দৃশ্য…হয়ত তোমার মনে হইবে বড় খুকু কল্পনা…তবু…একদল স্টেজের অন্তে আসিল, অঙ্গুলিনির্দেশে খণ্ডিত পত্র সকল দেখাইল, তাহারা ক্রন্দিত নয়নে কুড়াইতে লাগিল, এই রূপ কুড়াইতে, হাত বহুবার চকিয়াছে এক এক খণ্ড চমকপ্রদ মনোভাব প্রকাশিয়াছে, কখন বা মসৃণ হাতকে ভ্রমবশত, যে উহা পত্র-খণ্ড, কতবারই না একে অন্যের হাত কেহ ধরিয়া থাকে।

খণ্ডিত পত্র সকল উড়িতেছে, দ্রুত পদক্ষেপে তাহারা আছে এখন তাহাদের বসন চেহারায় যেমন পাথর নির্ম্মিত, এইভাবে ক্রমে তাহাদের বসন পাংশু মলিন বর্ণ ধারণ করিল, তাহারা প্রেক্ষাগৃহের একুসটিকে নূতন বর্ণাঢ্য সংজ্ঞা তথাপি দিল। তাহারা সংগৃহীত খণ্ডিত পত্রগুলির চারি দিকে চক্রবৎ ঘুরিল, এবার তাহারা সজল নয়নে একদা সুমহৎ বৃক্ষের সন্নিধানে গেল, ক্ষমা ভিক্ষা করিয়া লতা ছিন্ন করিল এবং লতা দিয়া পরম রমণীয় এক সাজি নির্ম্মাণ করিল–কি আজব! কি কুহক! বিজোড় না হইলে চুপড়ি আধার অসম্ভব! চুপড়ি টুকরী ধামা–সবই বিজোড় বন্ধন!

তাহারা বেদনায় ঝঙ্কারিল, আমরা কোথাও বিজোড়, আমরা কোথাও বিজোড়! সাজিতে খণ্ডিত পত্রসকল রাখা হইল, এখন তাহারা শোভাযাত্রা করিয়া চলিল; অন্ধকার হইল, তাহাদের হাতে মশাল, তাহারা চলিতেছে দিকাভিমানী দেবতা সকল মুগ্ধ প্রীত হইলেন; তুমুল বরষণ হইল, তাহাদের মশাল নিভিল না, তাহারা ধীরে প্লাটিক (মনুষ্য) অঙ্গের সীমা অতিক্রম করিল, সম্মুখে বনরাজি, ক্রন্দনই তাহাদের নির্ভীকতা, সম্মুখে বনরাজি।

সেই বনস্থলী অলৌকিক, শিশুর হাততালিই এখানে পুষ্প, অপেক্ষমানারনয়নই ফল। এবং তাহারা সেই বনে আনীত খণ্ডিত পত্ৰসকল ছড়াইয়া দিল, বারম্বার কহিল, এই পত্র যদি সত্যযুগের হয় তাহা হইলে শূন্যস্থান ইহার পূর্ণ হউক! বনস্পতি নিশ্চয় শুনিলেন! নিথর বনভূমি! শুধু শ্রুত হইতেছিল সেই বনের পূর্বাঞ্চলে কোন গৃহাভিমুখী কাঠুরিয়ার দল কোন গীতের এক ছত্রই–এখনও অন্তরার বিবর্তন হয় নাই বার বার গাহিতেছে! সকলেই খণ্ডিত পত্র বাহকরা ভক্তিযুক্ত মনে দণ্ডায়মানা, আরক্তিম চোখে প্রতীক্ষায়।

এমত কালে সম্মুখের ঝোঁপ জ্বলিয়া উঠিল।

…অনেকটা তেমনিভাবে…মনে পড়ে যেমন দাবদাহর সূত্রপাত আমরা সেই হাজারীবাগ অঞ্চলে জায়নোফর বনে যেমন দেখি, উঃ কি দারুণ নয় সেই গাইডটা, নির্জন বনের মধ্যে অদ্ভুতভাবে মুখে হাত দিয়া দারুণ প্রলুব্ধকারী ডাক দিতে থাকিয়া হঠাৎ তর্জ্জনী সঙ্কেতে এক ঝোঁপ দর্শাইয়া ফিসফিস্ স্বরে জানাইল, খসখস ফট! শব্দ! শিকার!

আমিও শিকার ভাবিয়া বন্দুক তুলিলাম, পরক্ষণেই সেখানে ধিক ধিক অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হইল, আশ্চৰ্য। ধূমহীন একেবারে…ক্রমাগতই শিখা, গাইড সেইভাবে তখনও তাহার চক্ষুৰ্বয়ে ধন্ধ! আমি জলের বোতলের প্রতি নির্বোধের ন্যায় তাকাইলাম, ইস!…তারপর সেইদিন তোপচাঁচির বাঙলায় আমরা মনমরা, আমরা অবসন্ন…ভাগ্যে সেখানে আশ্চর্য্য যে খাদ্যের পাত্র সার্ভিস সবই রূপার নির্ম্মিত। তুমি সন্দেহে হল-মার্ক দেখিলে, কহিলে নিশ্চয় মেপিন এণ্ড ওইয়েব…বেশ পুরাতন ও লেইট ভিক্টোরিয়ান রৌপ্য।

–আঃ আমরা সেই ওবজে দ’আর (object d’art) পাত্রে ভোজন করিলাম, এসপারাগ্যাস সুপ ভুলিবার নহে, আমরা অনেক অনেক বাড়ী বাসনপত্রের গল্প করিতেছিলাম, তাহার পর, তাহার পর…হ্যাঁ ওইসটার না কি একটা খাইবার সময়…আমি মস্ত হাঁ করি, না না বিশ্রীভাবে চিবাইতে দাঁত দেখা যাইতেছিল, তুমি অবাক হইয়া আমারে সাবধান কর, কাঁটা ছুরির অজস্র শব্দ করিয়া থাকি, তুমি অবাক হইয়া আমায় সাবধান কর। কেননা, উহা ত ঘটিবার নহে।…ওবজে দ’আর-এ আমরা কি সেই দাবদাহ। সূত্রপাত ভুলিয়াছিলাম?…কিন্তু দেখ ভুলি নাই…।

ঠিক তেমনই ঐ বনের ঝোঁপ জ্বলিয়া উঠিল। যাহারা খণ্ডিত পত্র লইয়া আসিয়াছে তাহারা তৎপ্রবর্ত্তীত নতজানু হইল।

প্রজ্জ্বলিত ঝোঁপ হইতে এক কিশোর সুন্দর বনদেবতা দেখিতে সুঘরাইএর মত এক অভিনব চমৎকার ফড়িং দৰ্শাইয়া কহিলেন,–ইহা কি সেই?

তাহারা সভয়ে উত্তর দিল, প্রভু উহা তাম্রবর্ণের যে! তুমি ভাল জান!

তখন বনদেবতা অদৃশ্য হইলেন, কিয়ৎ পরেই তিনি হীরকপ্রভ এক শম্বুক দেখাইলেন, কহিলেন, ইহাই কি সেই?

তাহারা সভয়ে উত্তর দিল,–প্রভু উহা রৌপ্যবর্ণের যে! তুমি ভাল জান!

তখন বনদেবতা অদৃশ্য হইলেন, কিয়ৎ পরেই তিনি এক নবারুণ সদৃশ ক্কচিৎ পান্নার ঘটা গঠিত এক বিচিত্র ক্রৌঞ্চ দেখাইলেন, কহিলেন,–ইহাই কি সেই?

নতজানু সকলে আর্দ্র চোখে উত্তর দিল,–প্রভু তুমি ভাল জান।

বনদেবতাকে দেখিতে ঐ ছোঁড়ার মত!

সেইদিন তখন ঐ মনস্তাপ জাতীয় পরমাশ্চৰ্য্য উপাখ্যান শ্রবণে মনিব পত্নী হাসিয়াছিলেন, অথচ তামাশায়, কেননা যে এতাদৃশ লিরিসিজমকে শোভনীয়তা, ঔচিত্য, মানে বাস্তবতা দানে বহুকাল আগের ততাপচাঁচির ঘটনা উল্লিখিত হইয়াছে, প্রাচীন এক ক্ষোভ বিস্মৃতির কথা যাহা!

তিনি ইহাও সঠিক বুঝিলেন যে ঐ চিঠির ফাঁক স্বামীকে উৎচকিত করিয়াছে, তাই যুগপৎ তিনি, পত্নী, সমালোচনায় বলিয়াছিলেন যে,–ধর তোমার চিঠি মিলানো ঐ কাঁক অনেকটা এমনই মানে। অক্ষমতার ছাড় বা শিল্পীর ছাড় যেখানে তাহারা ভাবিতে পারে না।

মনিব মহাশয় তদ্বিষয়ে উত্তর দিলেন,–আঃ সে শুভ্রতা! সে শুভ্রতা!

আজ এখন সেইদিনকার সেই বালকবৎ ভীরু স্বামীকে স্মরণে অধুনা তীব্র কটাক্ষপাতে প্রতিবাদ করিলেন, মিসিং লিঙ্ক না ছাই পাঁশ…কোথায় ছোঁড়া তেমনটি চেয়ে দেখত…?

সাক্ষাৎ চোর-চোর বুঝিয়া তুমি সদ্য-জঙ্গল দেখিলে কি রূপে তাহা হইলে…।

তখন কেন জানি না জঙ্গুলে বলে মনে হ’ল…। মনিব পত্নী ইহার পর ছেলেমানুষের মত আব্দার করিলেন,–ওগো এইভাবে পোড়ারমুখো ছোঁড়ার তুমি একটা ফটো তুল…ওরে বাবা পালকটা কুড়ো কুড়ো…কিন্তু তোমার কি করে মনে হল?

তোমার মনে পড়ে, সেইবার ঘুটঘুটিয়ার জঙ্গলে পিকনিকে যখন যাই তখন তুমি হুপপী (কাঠ ঠোকরার মত দেখিতে এক রূপ সাদা কাল মিশ্রিত পাখী), দেখিতে চাও আমরা সুঘরাইকে কাজের। সাহায্যে রাখিয়া বহুদুর চানোয়ার তীর ধরিয়া পূর্বদিকে যাই! বেশ সময় বাদে, আমরা যখন ফিরিয়া আসি, তখন তুমি ভৃত্যকে না দেখিয়া উতলা হইয়া যাহারা রান্না তদারক করিতেছিলেন (অনেক চেঞ্জার এই পিকনিকে মিলিত হইয়াছিলেন) তাহাদের তুমি প্রশ্ন কর!

তাঁহারা কেহই, তাহার সংবাদ দিতে পারিলেন না, তুমি বড়ই শঙ্কিত যুগপৎ অপ্রসন্ন যে তোমার অনুপস্থিতিতে কেহ যদি বেচারীকে ডোম বলিয়া ছোট করিয়া থাকে, খেদাইয়া থাকে, রান্নার কাছ হইতে তুমি আমাদের অন্য ভৃত্যদের ও অন্য চেঞ্জার বাড়ীর বালকদের তাহার খোঁজ করিতে বলিলে।

তখন, তাহার নামে বন চমকাইতে লাগিল! অজস্র প্রজাপতি পার হইয়া অনেক গভীরে সেই ডাক প্রচারিত, এমত সময় মূর্তিমানের উদয় হইল, হাতে খাঁচা দেখিয়া তুমি তাহারে চিনিলে! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া জিজ্ঞাসিলে, মুখপোড়া জানোয়ার কোথায় ছিলি…এই ভয়ঙ্কর বন, তোর কি কোন ভয় ডর নেই র‍্যা…

আজও আমার মনে আছে, জানোয়ার মৃদুহাস্যে উত্তর করিল, মা গো, কোন ভয় করিবেন না, আমার জন্য এখানে–এই দীপ্তিময়ী বনে আপনকার কোনই শঙ্কার কারণ নাই…এবং অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করত কহিল, মাগো জানিবেন, মহতী বনস্থলী আমার গা শুকিয়াছে…।

যে এবং ইহা প্রকাশিয়া সুঘরাই সমস্ত লতা গুল্ম পত্রবিকাশের, পক্ষী রবে ছন্দিত যাহা, ঐশ্বৰ্য্যময়ী যাহা, তাহারই পানে সগর্বে নির্ভীকতায়ে মস্তক সঞ্চালনে দেখে–কি এক অহংতা এখন তাহাতে যে এবং সে কেমন এক শব্দ করিল আর যে সমস্ত বন ব্যাপিয়া নিথর প্রতিধ্বনি ঘটিল।

যে ইহা শ্রবণে তুমি নিশ্চল, এমনও যে ঐ বাক্যে স্বভাববশত স্বীয় কপালে ভক্তিভাবে হাত স্পর্শ করিতে ভুলিয়াছিলে! তখন আমরা দুজনেই হারামজাদার প্রভায় আচ্ছন্ন! অবশ্য অন্যান্যরা সারিবদ্ধভাবে যাহারা তাহাকে আধা ঘিরিয়া ছিল, তাহারা হাস্য করে, কিন্তু হঠাৎ তখনই বৃক্ষ পত্র খসিতে তাহারাও ঈষৎ থ!

শুধু জগুর পিসিমা, তিনি খানিক দোক্তা মুখে ফেলিতে, তাঁহার বাহুতে আড়াই প্যাঁচ সাপ মুখো, সাপটির চোখ চুনীদার, তাগা পরিলক্ষিত হইল, ইনি সাহসে মনিব পত্নীকে সম্বোধনে কহিলেন, ওগো বৌমা, বলি শোন, আমার পঞ্চা যখন পেটে তখন একবার ননদ বাড়ী যাই–তখন তাহাদের ঘাটে একজন একজনকে বলিতেছে শুনিয়াছি, যে সেই বলে না–

গরুর কুটুম চাট্‌লে চুট্‌লে
কুকুরের কুটুম শুঁকলে শাঁক্‌লে
মানুষের কুটুম্ এলে গেলে।

…তা তোমার সুঘরাইএর গাত্র শুকিবে না?…

ইনি সেই জগুর পিসিমা যিনি, ‘…’ নিবাসে-তে আগত চেঞ্জার ঘোষবাবুর পুত্রের, যে ছেলেটি বিশেষত ধরাগলায় নবযৌবনা যাহারা তাহাদের সমক্ষে, সৌন্দর্য্যের স্তুতি করার বহর স্মরণে, বিরক্তিতে বলে যাচ্ছিলেন,–ওমা সেদিন ভোর থাকিতে আমরা, আমি, মিনি, রাধা, নিভা, ইতি, চায়নারে লইয়া সিরিয়ার পাহাড়ে বেড়াইতে গিয়াছি, দেখি, ঘোষেদের সুপুত্র ছোঁড়াকে, আমারে দেখিয়াও, ঘোর কলি কি বলবি মাইরি, কোন হৃক্ষেপ নাই, খালি ব্যাখান…ইহা উহা সব কিছু সুন্দর, আবার বলিল, সঞ্জীববাবু না কে লিখিয়াছেন…ঝাড় মারি! সোমত্ত মেয়ে সব সঙ্গে লাজলজ্জা নেই, আমি বলি ছোঁড়া তোমাকে ছাড়া পৃথিবীটা…মরণ! লোকে আমায় আনকাচ্চার বলে বলুক, এত সুন্দরের কি দরকার!…ও ছোঁড়ার মনে পাপ আছে!

একদা আবার এই পিসিমাই তাঁহার ভাই-বৌ রাধা’র মাকে সঙ্গে লইয়া ‘…’ বাবুর বাড়ী পান্থপাদপ গাছ দেখিতে গিয়াছিলেন। সেখানে বেচারী রাধার মাও সুমহৎ বৃক্ষ সমক্ষে কম্পিত, রোমাঞ্চিত, তাহাতে ভাবান্তর, তাহাতে ঐ রমণীতে রাত্র সমাগত! তদীয় মুখমণ্ডলে আরক্তিম নাসাপুট অতীব জবা হইল, ননদিনীকে কোনক্রমে কহিলেন,…দিদি এই পান্থপাদপ অবলোকনে আমার দেহমনে এক। আলোড়ন সঞ্চারিত হইতেছে, এক অভিনব পুলক ঝাঁপটা দিয়া উঠিতেছে, এমন একটি সুকৃতির সন্তান। আমাতে আসে, সত্যই জন্ম সার্থক হয়! ইহাতে ঐ সরল বাক্যের সহিত রাধা’র মা-র ঘন শ্বাসের শব্দ প্রাচীরে প্রাচীরে লাগিয়াছে।

ইহাতে জগুর পিসিমা ভূতচালিতপ্রায় হাঁ হাঁ করিয়া উঠিয়া ভর্ৎসনায়ে বলিলেন,-ছ্যা ছ্যা মরণ দশা, গাছ দেখিয়া তোমার ভাব লাগিল যে, এই সেদিন না বিয়াইলি, আবার? তাহার শেষেরটির নাম রাখিলে চায়না…আগেরটি ইতি, তারপরও চায় না, আবার?–আর যে ইনি গল্পচ্ছলে পান্থপাদপ সম্বন্ধে এই মত নিম্ন স্বরে ব্যক্ত করেন যে, সত্যই বাপু…গাছটা যেন মরদপানা! এবং ইহা প্রকাশে তিনি বস্ত্র সংযত করার পরে ঘোমটায় ঠিক দিয়াছিলেন।

 ৪. জগুর পিসিমার ছড়া কাটাতে

…জগুর পিসিমার ছড়া কাটাতে, যুক্তিতে, আমরা দুইজনে সুঘরাই হইতে সেই বিরাট বনস্থলীর প্রতি দৃষ্টি সঞ্চার করিলাম, এ বন দৃঢ়–পশু যেখানে পদে পদে পথে বাধা সৃষ্টি করে। ক্রমান্বয় আরোহী কল্পনা! দেখিলাম কুহক, আমরা বুঝিতে প্রয়াসী হইলাম, দেখিলাম হস্তী-দন্ত নির্ম্মিত রমণী, যিনি কহিলেন,–শত পুত্র গর্ভে ধরিলেও আমি কুমারী। এমনও যে কুড়লের আওয়াজ আমাদের চীনে বুলবুলির ডাক বলিয়া ভ্রম হইল, এ বনভুবঃ কুমারী যে! দূর হইতে ভাঙ্গিয়া ভাঙ্গিয়া বন্দুকের আওয়াজ আসিল, আমাদের দ্বারা বিবেচিত হইল, কোন পশুর (মিলন ইচ্ছা স্বর) মেইটিং কল!

আঃ! বন্দুকের আওয়াজও মেটিং কল!

এ কারণ যে এ বনভূমি রোসনাই! আমরা দুজনেই বড় মন কেমন অনুভবে, আবার কীদৃশী ঈর্ষায় আমি, কি ভয়ঙ্কর রোষে আমি, আবার ঠিক তখন পিকনিক পার্টিতে পোরটেল গ্রামোফনে একটি কমিক রেকর্ডের ফাটাতে পিন ঠেকিয়া ক্রমাগত একই শব্দের অদ্ভুতভাবে পুনরাবৃত্তি ঘটিতে আছে, যাহা আমারে অধিকতর উন্মত্ত করে! কোন ক্রমে আমি সুঘরাইএর প্রতি লক্ষ্য করিলাম, সেই দ্বিপ্রহরে এখন যেন সন্ধ্যাপ্রসবী শিঙ্গা বাজিতেছে! আমার আবার অক্ষর পরিচিতি ঘটিল! বুঝিলাম আমারও মনিব মাধব! আছেন, তাই আমি আর এক বুনো!

এই পৰ্য্যন্ত বিস্তারিয়া মনিব মহাশয় সদম্ভে প্রতিষ্ঠা করিলেন, ঐ বালক সেই মিসিং লিঙ্ক!

ল্যভ লেটারএর…!

ইনি এবং উচ্চারণের পরক্ষণেই মনিব পত্নী বিদ্যুতে জিহ্বা দংশনের পরই কহিলেন, ও মা, ঐ কারা আসছে দেখ…।

.

এই ডাগর মনোহর হিরণার টিলার উত্তরে আরও দেশদেশান্তর সকল আছে, এখন উত্তরে প্রতীয়মান ঐ ভাগে যোজনব্যাপী আলুলায়িত প্রলম্বিত রম্য উত্তম শ্রীমণ্ডিত উত্রাই, কোথাও একলা আতা গাছ, কখনও বা পাথরপৃষ্ঠ, মহুয়া স্থির সস্ত্রীক, তারপর সমতল; তারপরও চিঠি যাইয়া থাকে; ঐদিকে মানুষের নিঃশ্বাসে আকাশ খুব নীলিমা; চোখে জল; ঐ রাস্তা যারপরনাই লক্ষ্মী, যায় ও আসে, ঈদৃশ পথটি বেচারী ঘুমকে কভু সমালোচনা করে না।

মনিব মহাশয় ঐ পথে শরৎকালকে আসিতে দর্শনে বলিয়াছিলেন, শরৎ আসিয়াছে এস কাঁদি তাঁহার চক্ষু সজল হইয়াছিল।

বঙ্কিমবাবুর লাইন আষাঢ় আসিয়াছে এস নামি!

.

এখন পত্নীর ইঙ্গিতে, মনিব মহাশয় তাঁহার মানসিক শান্তি হইতে–তিনি যেহেতু বিচারই শান্তি বিশ্বাসী যেহেতু, তিনি কিছু সিদ্ধান্তে আসিয়াছেন, তিনি আপন বালভৃত্যকে আর এক সৌখীনতায় আপন সৌখীনতাতে (!) অন্তরিত করিতে পারিয়াছেন-উৎরাই পর্য্যবেক্ষণ করিলেন;

পরিদৃশ্যমান হইল এই যে, চৈত্রের ঘূর্ণায়মান বাত্যায়-জব্দ কিছু পাতার ন্যায় একটি দল, ইহা প্রভাময়ী; যে উহারা জনে জনে তুমুলগোঁয়ার বাতাসে গাত্রবস্ত্রাদি কেহ ফ্রক কেহ শাড়ী সামলাইতে যে, ইহা জলবৎই যে সকলেই অপূৰ্ব উৎসুক যে ঐ আলোড়িত দল গীত গাহিতে আছে, যাহারই এক আধ মাত্র ঘুরন্ত বাতাসে এত দূরেও ছিটকাই আসে।

এহেন দৃশ্য মারচ! অভিরাম রঙ্গিলা! উহারা যেন প্রকৃতিকে ডাকিতে গিয়াছিল, না না, তাহা কেন, উহারা প্রকৃতিকে বাড়ী পৌঁছাইয়া দিতে গিয়াছিল, যে ইহা নজরে মনিব মহাশয় পূর্ণ, ধীরে ধীরে বলিলেন,…বেশ দেখিতে লাগিতেছে না বল! আজব হেরোইক! উহারা যেন ব্রাহ্মণী হংসের রুট ধরিয়া। আসিতেছে না? সপ্লেইনডিড!…প্লেনডর!…

কে ওরা বুঝতে পাচ্ছ? মাগো আমার কথা ওরা বোধ হয় শুনতে পেয়েছে গো…লাজে মরি!

যে ইহা শুনিয়া মনিব মহাশয় তদীয় বৈষ্ণবীয় মনস্কতা হইতে, স্বীয় সহধর্মিণীরে আশ্বাস। স্বগতভাবেই দিয়াছিলেন, তুমি কি পাগল! ওরা কে…

বুঝতে পাচ্ছ না, ‘ছোট-বাইরেরা’ গো, যদি ওরা কিছু শুনে থাকে, ওরা বড় বাবা যেমন বলেন বড় জবরদস্ত মৌলবী!

হইবে না-ই বা কেন! হেডমিসট্রেস বলিয়া কথা…!

সম্প্রতি তাহারা, ঐ দল, দূরে থমকাইল, এখন কেমন একরূপ তাহারা দোমনা করিতেছিল অগ্রসর বিষয়ে, স্পষ্টতই যে এখন তাহারা রাস্তা ছাড়িয়া পার্শ্ববর্ত্তী জমিতে ইতস্তত রহিয়াছে! যাহা নেহারিয়া মনিব পত্নী ভ্রদ্বয় কুঞ্চিত করেন, ব্ৰীড়ায় অবনত মুখে জানাইলেন,না গো, ছ্যা ছ্যা ওরা নিশ্চই আমার ‘লাভ লেটার’ বলাটা শুনতে পেয়েছে! বড় তরাসে ওরা যদি এতটুকুন আঁশ গন্ধ রইল ত অমনি হাঁ হাঁ করবে’খুনি…।

তুমি খেপিয়াছ…আমার ধারণা বলে উহারা আমাদের এড়াইতে চাহিতেছেন, সেদিনকার ব্যাপারের, মানে সাঁওতাল নৃত্যের দিন মনে নাই!

.

রকমারি লণ্ঠন ও পেট্ররোমাক্সের বিকিরণ গাছলতাপাতা নানা ছাঁদে, বহুস্তরে, ভেদিয়াছে–কভু বা আজব রামধনু! ছটাস কতক নাবি জিনিয়াতে ও জলদি ডেলিয়াতে, কখনও আন্দোলিত চামেলীতে (আঃ আমাদের রিখিয়ার বাড়ীর জানালার নীচে কি অফুরন্ত চামেলী! কি তারিখহীন!), আবার অন্যদিকে সাঁওতাল রমণী যাহারা ইতস্তত আছে, তাহাদিগের দেহে ঐ আলো, যে এবং এই সকলের সেই ছায়াই যাহা ক্ষণিক নিমিত্তই চকিতেই জাগাইতে পরিশ্রম করিয়া করিয়া যায় মুরারীবাবুকে–ইনি তিনি যিনি রৌদ্র-প্রত্যক্ষ-বোধ লইয়া নিম-নিদ্রিত।

ইনি টুলেতে বসিয়া, যে টুল একটি ইজিচেয়ারের পিছনে আছে, ইহার শিয়রে পশ্চাৎ হইতে তিনি মাথা রাখিয়াছেন; তাই এইভাবে তাঁহার ঘাড়ের রেখাঁটি সম্মোহ হইয়াছে। নিশ্চয়ই তিনি এখানকার পাহাড়ী হাওয়ার মধ্যকার পারিপার্শ্বিকতাকে উক্ত আকার অতুলনীয় অভিব্যক্তিতে স্বপ্নে আনিতেছিলেন; যে তদীয় মুখমণ্ডল এরূপ যে স্বতঃই মনে হইবে যে মুহূর্তেই তিনি চোখ মেলিয়া ঘোষণা করিবেন, কি গ্রাণ্ড!

এবার ঐ মুরারীবাবুর আঁখিপক্ষ্ম কম্পিত ছিল, তিনি সজাগ; কেননা তিনি সজাগ, কেন না তিনি অলৌকিকতা শুনিতেছিলেন। কেহ, পরিতোষবাবুই, তাহা বর্ণিতেছিলেন যে: আমার স্ত্রী, শুধু আমার স্ত্রী বলি কেন, উহাদের গোষ্ঠী মানে ফ্যামিলির সবাই খালাস করিতে খুবই অর্থাৎ পারদর্শী, কি এক পুণ্য আছে! যদি ক্কচিৎ বাই চান্স একটি নষ্ট হয় ত কান্দিয়া আকুল হন, দু-তিন দিন অন্ন গ্রহণ পৰ্য্যন্ত করেন না, খালি কান্না! হা ভগবান, আমি জন্ম রহস্য দেখিতে বিহ্বল কেন হইলাম!

সে ক্রন্দন শুনিতে পাষাণ দ্রবীভূত হয়! কেদার দাস বলিয়াছিলেন এরূপ পাকা হাত ক্কচিৎ…একবার এক ছোকরা ডাক্তার এক পোয়াতি দর্শনে সেই গৃহস্থদের বলে,–যে মশাই কত বলিব–তোমরা গাছ চাহ না ফল চাহ…। আমার স্ত্রী বলেন তাহা শুনিয়া তাহার হাত অবশ। সেই বাড়ীর লোকেরা বলিল গাছ!

ঠিক এই সময়েতে নৃত্য উৎসবে বাড়ীর সিঁড়ির কাছে একটি ছোট ভীড় দ্বারা মধু মধুর হাস্য খেলিয়া উঠিল। যে বালিকা সেদিন চাননায়ার রোগা তীরে বালির বসত নির্ম্মাণ করিয়াছিল, আর যে, যে বালকের ভাগ্য, অপরূপ কান্তির নুড়ি সকল প্রাপ্ত ব্যাপারে, অতি অতি অতি শুভ সুপ্রসন্ন, আর এই বালকই বড় তীক্ষ্ণ তীব্র ভাবে চানোয়ার স্রোত দেখে, এবং এই দেখাঁটি ভবিষ্যতে যে কোন বহমানতা এমন কি নর্দ্দমার দ্রুত গতিপ্রবাহে আরোপিত হইবে, সে হাততালি দিয়া উঠিবেক, আঃ ঐ চানোয়া! ক্রমে ঐ ছবি তাহারই মধ্যে মরিয়া শুধু কম্পন হইবে কী?

আঃ কত বাস্তবতাই আমার রক্তে!

এখন ঐ বালিকা আর ঐ বালকের ছায়া সেই হাস্য-খর ভীড়কে শ্যামীকৃত করিয়াছিল; এবং মুরারীবাবু তদীয় (আমাদের মনগড়াই নহে) সব কিছু ঘোষণা করার মনোবৃত্তি হইতে অর্ধনিমীলিত চোখে হাস্যের প্রতি লক্ষ্যে আয়াস করিলেন।

এখন তাহার ঠাওর হইল, যে সিঁড়িতে, স্যর পি-র পরমা সুন্দরী নাতনি চতুর্দশী অলোকা! পিছনে জড়োয়া ক্যাপিটাল দেওয়া ফ্লটেড থাম–আর উপরে খিলানের রেখা; সামনে অলোকা; পাশেই তদীয় চমৎকার ‘সরাইল’ কুকুর (এরূপ নোবল কুকুর জাত খুব কমই) ও টর্চ হস্তে অলোকার পরিচারিকাবৃন্দ।

সে বেচারী অলোকা সদাই বিভীষিত, সর্প তাহার ভয়, উজর হাসনুহানা যাহার আতঙ্ক, স্ফূৰ্ত্তমান কামিনী গাছ দেখিলে যে নীল হইয়া যায়! ঐশ্বৰ্য্যময়ী অনলাকার মধ্যে তখনই চোরা-স্বেদ দেখা দেয়! তাহার অনামিকা যে নয় ক্যারেট হীরক খণ্ড ক্রমাগত ঐ সকল কিছুকে মহাস্পর্ধা শাসন করিতেছে, যে অলোকা চরাচরের দিকে চাহিয়া বলিতেছে, তোমরা আমাকে হে সৌরভিত বৃক্ষসকল, আর শঙ্কিত ভীত করিও না–তথাপি যে সেই অলোকাই ঐখানে থাকিয়া ঐ হাস্যে যোগ দিয়াছিল!

ঐ উদ্দীপনা এক শিশুকেন্দ্রিক।

অদূরে বিলি, যে এতাবৎ এক পেয়ারা গাছের একটি নমনীয় ডাল টানিতে থাকিয়া-ফলে তাহার দেহে আলোর হিলমিল আছে। নিজ জীবনযৌবনের উপাখ্যান কহিতে আছিল,–যে বহুতেই নিলর্জ হইয়াছে তাহার নিমিত্ত, এবং সে স্কুলে…যখন তখন টপসী (টমকাকার কুটির) ওরফে প্রমদা, যাহারে কাফ্রীর মত দেখিতে, যে তাহাদের ক্লাসে সর্বপ্রথম সাড়ী পরিতে বাধ্য হয়, যে তাহারে সে অনিমেষনয়নে দেখিত, প্রমদা রূপসী।

কিন্তু কি ভয়ঙ্কর তাহার ঠোঁট, গা কণ্টকিত হয়। এই বিবরণে শ্রোতারা ব্রীড়ায়ে চারিদিকের ঠিক লইয়াছে যে কেহ শুনিল কি! আরও আরও বিলি জ্ঞাপন করে, যে সে ইটুম্যান্ট বসের ডিভাইডারের কাঁটা দিয়া (তখনকার দিনে এমন লেখা খুব চলন ছিল) আপন হস্তে প্রমদার নামের আদ্যক্ষর ‘পি’ লিখিয়াছে, রক্ত পড়িয়াছে–ইহাতে যত কিছু ডাক বাবা-মা-ভাই ইত্যাদির স্বরভঙ্গ হইয়াছে–তবু সে মরিয়া!

ইতিমধ্যে ফ্রক পরা ও পুরুষ পোষাকে (যেহেতু তাহার মা ছেলে চাহে–হয় নাই বলিয়া তাহাকে পুরুষবেশী করে) একটি মেয়ের সান্নিধ্যে আসিতেই সে বলিয়াছে, অভাগীর স্বর্গ চমৎকার! কখনও ভগিনী নিবেদিতা, কভু পণ্ডিতানী রমাবাঈ, অতএব সে, বিলি, বহু প্রাচীন রীতির চতুর, বলিয়াছে, অজস্র শত চিঠি আমার নিকট জমিয়াছে…তাহা দিয়া আমি এলবামের মত(!) করিয়াছি…।

যে বিলি আবার আরম্ভিল যে একদা প্রমদার কুহকময়ী অগ্নি উদগার দেহ স্মরণে ‘এ কি এ কি!’ শব্দ উচ্চারিয়াছিল এবং যে তাহাতে ঘুম ছিল না! যে ইহা ভাবনা হইত তাহার নিজের দেহ যদি লীলা-র মত হয়, সত্যি যাহার বক্ষ সমতল ছিল! আমি রাতদিন ভগবানকে ডাকিতাম।

এ হেন যে বিলি সেও ঐ হাস্য খুসী উচ্ছাসে আকৃষ্ট হওয়ত-যে তখন বেচারী জানে নাই যে উহার কারণ কি, (আপন অনুগত) শিষ্যসমানদের লইয়া গ্রাভল পথে কর্কশ আওয়াজ তুলিয়া জলদিই এখানে, যেখানে মাধুৰ্য্য! এবং এই সময় এমন ঘটে–মনুশেফের স্ত্রী স্বীয় কন্যা অনুপমা–যে তাহার মায়ের অজস্র সঙ্কেত ইসারা দেখিয়াও দেখে নাই, যে বিলির সংস্পর্শ ত্যাগ করে না–পথ রোধ করিলেন।

অনুপমাকে কবলিত করিয়া তদীয় মাতা গোপনতা সৃষ্টি করত, উষ্মবর্ণ-প্রায় বাক্য উচ্চারণে তিরস্কার করিলেন,–রহ তোমার বাবাকে আমি বলিতেছি তুমি ওই ঢলানীর দুর্বিনীতার সহিত মাখামাখি। করিতেছ, উহার পদদ্বয়ের গড়ন বানরতুল্য! সে বিপথগামিনী, অনবরত মিথ্যাবাদিনী, বলে ডাইসেসন হইতে পাশ করিয়াছি, উহা মিথ্যা…কি এতেক তোমাদের কথা?

প্রথমে, এবম্প্রকার কটুবাক্যেও অনুপমার চোখ জোর হারায় নাই, যে সে বলিতে ইচ্ছুক যে বিলি খুব কালচারড, ফরওয়ার্ড! সে একা কলেজে যায়, সে আলোকপ্রাপ্তা!

অথচ এ সময় এবং তাহার কর্ণে বিলির শ্লেষ্ম-জড়িত স্বর ছিল, যথা প্রমদা বলিয়াছিল, বিবাহ না-হওয়া পর্যন্ত এ দেহ স্পর্শ করিতে দিবে না, বিবাহের পর যাহা খুসী যেখানে খুসী; এবং ইহা যে একদিন শিলা বৃষ্টিতে বিলির সারা অঙ্গে কিভাবে শিলা বাজিতেছিল!

এখন অনুপমার মৌনভঙ্গ হইল; তদীয় মাতাকে সে জানাইয়াছিল গত সরস্বতী পূজায় বিলির নিজেকে কি পর্য্যন্ত রমণীয় সুলক্ষণীয়া দেখিতে হইয়াছিল তাহারই কথা!

কিন্তু যে আদতে ঐ সূত্রে বিলি ঘোষণা করিয়াছিল, যে আমাকে অপূৰ্ব দেখিতে হইয়াছিল, মাথা ঘষিয়াছিলাম, সাগর-খেলা চুল মাথায়, পরনে বাসন্তী রঙের সাড়ী, কলেজের মেয়েরা সমস্বরে ‘আঃ!’ আনন্দিত ফুকারিয়া উঠিল, উঃ সত্যই আমাকে যা চমৎকার দেখিতে হইয়াছিল না, রাস্তার আবালবৃদ্ধ, সবাই হাঁ হইয়াছে, এক অতি নীচু ক্লাসের একজন লোক আমারে দেখিয়া উল্লাসে আতিশয্যে হাঁটু পর্যন্ত লুঙ্গি সংবৃত করত, লোকটি আপনার সমগ্র দেহ যেন ছুঁড়িয়া দিল, শ্রুত হইল…মাইরি দুইটি (ভাত) ছড়িয়ে দিও–পায়ে পড়িয়া থাকিব!

এবং বিলি কহিল আমি মন্তব্য করিয়াছিলাম কি অসভ্য! কি আস্পর্ধা! ছোটলোক মেয়েদের করিতে জান না!

আর যে অনুপমা যাহা স্মরণেও জন্মমূর্খের মত আপনকার মুখে ভাব আনিয়া স্থির থাকিয়া মাতাকে কহিল অন্য আর একটি মেয়েকে আপন সপক্ষে মানিল, কোকোও জানে জিজ্ঞাসা কর না কি গল্প হইতেছিল!

য-বাবুর ভগিনী, ইনি নিকটেই ছিলেন; ইনি বর্ষীয়সী, ইনি বিধবা, ইনি ‘উদভ্রান্ত প্রেম’ মুখস্থ বলিতে পারেন, হঁহার পায়ে কেডস এবং ইহার কারণে ইনি ঈষৎ কিন্তু-তে আছেন, ইনি কোকো নাম শুনিয়া বিস্মিত হইলেন, কোকো আবার কে? অবিলম্বেই তাঁহার দৃষ্টি ঐরূপ নামধারিণী অল্পবয়সী মেয়েটির প্রতি, এত বয়সেও তাহাকেও কুঞ্চিত করিতে হইল, যেহেতু ঐ মেয়েটি তাঁহারই বোনঝিরে বলিয়াছে যে তাহার নাম লাভলি।

অথচ উহার নাম দুর্গা, আশ্চর্য্য উহার, মেয়েটির মাতা প্রথম ঐ লাভলি নাম অস্বীকার করে, পরে বলিয়াছিলেন, উহার মামা রাখিয়াছিলেন।

যবাবুর ভগিনী অবাক হইয়াছিলেন, এখন তিনি থ, নিশ্চিত ভাবিলেন রিখিয়াতে আসিয়া এক একজন এক এক রূপ ধারণ করে…অনেকের কথা মনে আসিল–যে যাহা ভাবিলে গাত্রে সিঞ্চিড়া উপস্থিত হয়; মেয়েটি বিলির সহিত অহরহ কানে কানে কথা কয়!

অথচ দুর্গার মা বলিয়াছে, যে আমার কন্যা দুর্গা সেরূপ নহে, সে এখনও জানে, চুম্বনে পুত্র গর্ভে আসে, দুর্গা ‘মেস’-বাসী অসভ্যদের জুতা ঝাঁটা দেখাইয়া থাকে। য-বাবুর ভগিনীর একটি প্রবচন এই সূত্রে মনে স্বভাবতই আসিল।

পুড়বে মেয়ে উড়বে ছাই।
তবে মেয়ের গুণ গাই ॥

এবং চকিতে ইনি, খানিক বিলির প্রতি চাইলেন, তাঁহার দেহ মোচড় দিল, এই বিলিই দূর সম্পর্কে তাঁহার ভাইঝি, হাতে টাটু (তোমার পাত্র) লইয়া যখন ফুল তুলিতেছিল এবং তখনও পাঁজি লিখিত তিল সম্পর্কে ব্যাখ্যা করিতেছিল; যে এবং ইহাও তিনি সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন যে বিলির মাতাই ইহার জন্য। দায়ী, বেহায়া মেয়েরে কখন শাসন করে না এবং ইহাও যে, নিজে, বিলির মাতা, এত সোমত্ত মেয়ে থাকিতে রঙীন কাপড় পরেন, তাহার আর কাণ্ডজ্ঞান কি হইবে!

এই মাতা, ইহা প্রচলিত যে, বিলির পিতা বিলির কিছু বেচাল দর্শনে কিছু বলিলে তর্ক করিয়া থাকেন। যে: এই যুগ নূতন! তুমি বৃদ্ধ!…বিলাতে কি হয়! লোকে বলে, লোকের মুখে ছাই, তাহারা কি খাইতে অথবা পরিতে দিবে। আমরা জীবনে কোন সাধ আহ্লাদ করিতে পারি নাই, মেয়ের সম্পর্কে তোমারে ভাবিতে হইবে না! (আশ্চৰ্য্য বিলির পিতা উচ্চপদস্থ কর্মচারী)।

যে এবং এই সকল কথা বিচারিয়া যবাবুর ভগিনী উপলব্ধি করিলেন, দুই দিনের জন্য আসিয়াছি, আমার কি প্রয়োজন। তাহার সাক্ষাতে নব-যৌবনারা কেমন যেমন নগ্ন, তাহাদের গাত্রবর্ণ মেঘতুল্য ধূসর, যে এবং ইনি সংযতভাবে মুনশেফের স্ত্রীর সহিত ইহা যোগ দিলেন, না মিশিলেই পার, আমি অন্য কিছু বলি না, তবে যে ঐ ব্লাউজ পরা বগলকাটা কেন, ঘটি হাতাই ত ভদ্র…আবার হাতাবিহীন…বিলি শুনিতে পাই কাঁচা রসুন খাইয়া থাকে…গোবিন্দই জানেন!

অনুপমা এহেন তিক্ততার মধ্যে থাকিয়াও বিদ্যুতে বিলির নজর লইল, কেমন যেন ভীরু, কেমন যেন জেল্লারহিত, কিছুক্ষণ পূর্বে কি কুহকিনী যে সে! উহার হস্তীদন্তের (আসলে সাধারণ হাড়ের) ঝুমকো, উহার মীন অথচ টানা নয়ন, গৌর গাত্রবর্ণ, উহার কাজল, সিন্দুর টিপ–এ সকলেতে যেন পৃথিবী নড়িতেছিল, সর্বৈব ফোয়ারা।

এখন বিলি উপস্থিত ঐ শিশুকেন্দ্রিক আবহাওয়ায় নিজে যেন অনেকটা বিলি-র স্বীয় উক্তির ন্যায় নির্ঘাত ক্যাড, চিবি, চিশী; যাহা এই যে ঐ সরস্বতী পূজার দিন তাহার কোন বন্ধুর ভাই তাহার এক ফটো তুলিয়াছিল, ফটো আসিল, কিন্তু কোথায় সে বাসন্তী রঙ, কোথায় সেই অপূৰ্ব্ব কেশরাশি! যথার্থ বিপরীত তাহারে দেখিতে যেন রাক্ষসী…চিবি চিশ্রী ক্যাড।

এবং এই বিবরণের পরই বিলি অপোবদনে থাকে, খানিক বাদেই হঠাৎ বলিয়া ফেলিল, আমার ফটো কেন যেন ভাল উঠে না, বোধ হয় তুক আছে।…এবং এই স্বীকারে সে উৎসব-মাতৃক বিলি ফ্যাকাশে, হায় বিলির স্তব্ধতা আছে। কোন এক গ্রহের দ্বারা অজানিতেই তাহার পরমার্থ অপহৃত হইয়াছে।

কিন্তু ঝটিতি তিলেক মধ্যেই বিলি নিজের কথাকে উড়াইয়া দিল…ধেৎ মা বলিয়াছে উহাদের হাত খারাপ, ক্যামেরা বাজে। তথাপি তাহার এই যুক্তির পরও তাহার সেই বিষণ্ণতা গুণগ্রাহী সকলে দেখিয়াছে; দেখিয়াছিল, বিলি যখন একাকিনী!

এখন শিশুর সান্নিধ্যে বিলিরে অনুপমার যথার্থই তেমন তেমন উপলব্ধি হইল; যে সুতরাং সে বেচারী এতেক স্তম্ভিত, যে যাহাতে সে আপনার অতি ধ্যানে কৃত কেশবৈচিত্র্যে হাত দিয়াছে অসাবধানতায়, বিলি যেমন ময়লা যে বিলি ধূপের ধূম্র রেখার তুল্য ম্লান, সেই স্পর্কিত দ্বীপ তাহার কোথায়, চন্দ্রালোক যে দারুচিনি অরণ্য মর্মরিত করিয়া বিচ্ছুরিত হইত তদীয় ভ্রমণের হেতুতে; যে তরঙ্গ সকল তাহার লাগিয়া অলঙ্কার নিমিত্ত, বিবিধ প্রকারের ঝিনুক আনিত, তাহা শুধুই যেমত বা কবিপ্রসিদ্ধ!

এখন অনুপমার দ্বারা ইহা পরিলক্ষিত হইল, যে বিলি ঐ চম্পক স্থান হইতে অপসৃয়মাণা হয়। যে সে শিশু আদৌ ভালবাসে না, ইহা অনুপমা জানিয়াছে এবং ঈদৃশ হলপে আশঙ্কিত হইলেও চোরা-মনে রাখিয়াছে। কিন্তু, অন্যপক্ষে শিশু যে নির্দোষ মাধুৰ্য, যে ইনোসেন্স যে বিলিকে এইভাবে যে আঘাত করে–তাহা নির্বোধ অনুপমা কভু বুঝিবে না; আঃ ইন্‌নোসেন্স কি মারাত্মক!

এখন বিলি সদলে চলিয়া গিয়াছিল, গ্রাভেলের কর্কশ আওয়াজ পুনরায় বিস্তারিয়াছিল, যে ক্রমে বিলি বেষ্টিত সহচরীদের মধ্যে আপন মুখোনি বিষাদ হইতে উন্নীতকরণে-সক্ষম হয়; এবার সে তীক্ষ্ণ, প্রকাশিল, যে ঐ হাস্যসূত্র গ্রাম্য দোষযুক্ত, যে উহাদের ভাষা অশালীন আনকালচারড, প্রায় ক্যাড।

আধা বৃত্তাকারে সহচরীবৃন্দ নির্বিচারে তাহার ডাগর মানসিকতা দেখিয়াছে। তাহারা উহার ঢলঢলে বেলোয়ারি মুখ–যাহার কারণে এইবিশনের স্নো-এসেন্সের দোকানদাররা অকাতরে সাম্পেল উপহার দেয়–সেই আকর্ষণ হইতে চোখ ফিরায় নাই, বিলি সাবাস! তাহার ক্যাড শব্দ উচ্চারণ সৰ্ব্বত্রে, খেলিয়া ফিরিতে আছে।

কখনও সভয়ে ইহাও সহচরীদের মনে পড়িবে, অমলাকেই বিলি ক্যাড বলিয়াছে, তাহারা যাহারা। বাঙালী জীবনে ল্যাভম্যারেজ অবধি শুনিয়াছে, তাহারা বিলি-কে কখনও শুনে নাই!

অমলা ক্যাড। এ অমলা সেই, যে খুব সরল, যে লক্ষ্মী, যে খুব ভাল, যাহার দ্বিতীয় পক্ষে বিবাহ হইয়াছে, যে সগৰ্ব্বে রুলী পরে, তাহার বিবাহতে এক কাণ্ড হইয়াছিল, যাবতীয় মিষ্টি গুড়ের তৈয়ারী হয়, কারণ তখন বয়কটের যুগ, সবই নষ্ট হইল কেননা কেহ মুখে দেয় নাই। সে সুন্দর গান জানিত, বহু সভায় উদ্বোধন সঙ্গীত বন্দেমাতরম্ সেই গাহিত, সে কাজী সাহেবের গান আরও ভাল করিত।

এই সেই অমলা, যাহার গানের খাতাটি অতীব মনোমুগ্ধকর ছিল। এই অমলাই সেই যে গত পূজায় ঁবিজয়ার দিন সিদ্ধি খাইয়া একটু এলোমেলো হয়, গীত গাহিতে প্রথমে পাতকী বলিয়া কিগো’ পরক্ষণেই ‘লালদীঘিতে আগুন’ অবিলম্বেই ‘আয় মন বেড়াতে যাবি’ সঙ্গে সঙ্গেই ‘শত কোটি কল কল নিনাদে’ ইত্যাকারে গীতপ্রবাহের কালে বহুবারই উহার বস্ত্রাঞ্চল স্থলিত হয়, আর বহুবারই সে জিহ্বা দংশন করে! তাহাতে কোন মতিচ্ছন্নতা নাই–সে বড় ঘর-বোলা। গত ভূতচতুর্দশীর দিন সে কোথা না কোথা হইতে এই রিখিয়াতে চৌদ্দশাক তুলিয়া আনিয়া সকলকে বিলাইয়াছে। সে বহু পাখী চেনে, উহাদের ডাক নকল করিতে পারে।

এই অমলাই এখন একটি চেয়ারে বসিয়া আপন পুত্রকে স্তন্যদান করিতেছিল। আঃ সমগ্র ধরণীর মঙ্গল হউক; আঃ দিক সকল সৌর সম্বন্ধীয় না হইয়া আপনি স্থিতিশীল হউক! আঃ পতঙ্গ সকল স্রোতস্বিনীতে নির্ভয়ে স্নান করুক!

অমলার স্তন্যদান-এই নিপটতার ছায়া, চলমান লণ্ঠনে, গাছে, পাতায় দেওয়ালে জানালায়, বিলি কঠিন দৃষ্টিতে ঐ প্রতীয়মানতা লক্ষ্য বিতৃষ্ণায় করিল, তদীয় হাল্কা দুল জোড়া ক্ষিপ্র আন্দোলিত হইল, ব্লাউজের গলার নিকট রাখা রুমাল লইয়া স্বেদ অপনোদন করিল। (হাতব্যাগের তখনও চলন নাই) যে সে নিম্নগ্রামে উচ্চারিল, ক্যাড! সহচরীরা ভাবতঃ ঈষৎ অপরাধী।

বিলির খাসা শ্রীযুক্ত মুখোনি, যাহা দক্ষিণ ভারতীয়দের মত সদাই নড়ে, তাহা খানিক স্থির, জানাইয়াছিল, অধুনা স্তন্যদান কুশিক্ষা প্রণোদিত, উহাতে রমণীর রম্য সুষমা খৰ্ব্ব হইয়া থাকে, যে অমলা বৃথাই স্বদেশী (!) করিয়াছে। আর যে এহেন বাক্যে সকলেই ত্রস্ত, ক্রমে অবশ্যই দৈবক্রমে। দেখিল, স্তন্যদানের বিপরীতে যে রমণী–সে রমণী আর এক রহস্য!

আঃ বিলি তুমি আহেলী ডিকাডেন্স বহন করিতেছ! আঃ বিলির শুধুমাত্র বাম হাতের অনৈসর্গিক কালো চূড়ীর পৌনঃপুনিকতাই কি সবুজতা!

এখন ঐ শিশুকেন্দ্রিক দলের আশেপাশে গিরি ঝরণা নদী সৃজিত হইতেছিল, শিশুটি তখনও সমানভাবে খুসী, আর আর সকলে তাই বড় উৎফুল্ল। কাণ্ড এই যে, মনিব মহাশয় মহা-অথৈ আদরে বিজলী নাম্নী একটি মেয়ের সাত মাসের কন্যারে কোলে লইয়াছিলেন, আর সে সেই শিশু হঠাৎ প্রস্রাব করে! মনিব মহাশয় তাঁহার মহামূল্য চীনাংশুক পাঞ্জাবীর নিমিত্ত কোন খেদ না করিয়া বরঞ্চ উদাত্তে, গ্র্যাণ্ড…এ্যাণ্ড! বলিয়া এই সংবাদ সমবেতদের দিয়াছিলেন, তাই ঐ হাস্য-ঝটিকা!

এখন প্রধান শিক্ষয়িত্রী, যিনি রাশভারী, ইনি তড়িৎ দাশ সি.আই.ইর স্ত্রী, এবং এই সময়েতে ইনি। পুরুষদিগের সহিত বাক্যালাপ করিতে থাকিয়া–পুরুষগণের সহিতই আলাপ তাঁহার শোভা পায়– ক্কচিৎ অন্যত্র মনস্কা ছিলেন, রকমারি আসন ইজিচেয়ার, টুল, তক্তাপোষ হইতে বহু আকৃতির পশ্চাতে এখন সাঁওতাল রমণীগণ ইতস্তত আছে।

প্রধান শিক্ষয়িত্রী সহবতে ঐ সূচনাতে মনঃসংযোগ করিলেন; তিনি আপনকার চশমার তলা-কার কাঁচ দিয়া দেখিতে ব্যর্থ হইলেন; তৎক্ষণাৎই কোন সুলক্ষণা রমণী আলোকবিহীনতা হইতে শিশুকে কপট শাসন করিলেন,–ওরে আবার হাসা হচ্ছে, শয়তান মুতিয়াছ আবার…এবং মহিলার রম্য দম্ভপাতি ভাস্বর হইয়াছিল।

যাহা শ্রবণেই প্রধান শিক্ষয়িত্রীর স্নায়ু দুষ্ট হইল, অভিজাত মনিব পত্নী এবং অলোকার প্রতি অসহায়ভাবে একাধারে নেত্রপাত করিলেন, অবশেষে স্বীয় স্কন্ধের কাছে বস্ত্রাঞ্চল প্রান্ত ধৃত ব্ৰচ আছে, যাহা মনোহর কাজনিদর্শন–সোনার বসানে প্রত্যাগত এক পক্ষী, লার্ক সম্ভবত, তাহাতে যত্ন দিলেন।

এবং পার্থক্য ইহাদের সহিত তাঁহার নিজের ঐ সময়েই হৃদয়ঙ্গম হইল, পুরুষদিগের প্রতি চোখ ফিরাইতে পারেন না, ঐ সময় ভাগ্যশঃ অনেক আলো থাকিলেও ছায়া ঢাকিবার মত জোনাকী ব্যতিরেকেও, গোপনতা থাকে, সেই স্থলে উপস্থিত তিনি ক্ষিপ্রতায় ‘মুত’ শব্দটিকে নিজের কারণে সুখকর অনুবাদ (!) করিলেন ‘ছোট বাইরে’।

এবং অতঃপর তিনি অবোধ শিশু বালিকার ব্যবহারে ভদ্রতাবশে মৃদু হাস্যে কহিলেন: ও, ছোট বাইরে করেছ বুঝি! প্রধান শিক্ষয়িত্রীর চমকপ্রদ মনোলোভা স্বরে, সকলেই বুদ্ধির অঙ্ক হইয়া গেল, তখন সকলেই খানিক সচেতন ছিল, অবশ্য পরে বড় অসংযম উজরাইয়াছে নিজেদের মধ্যে ঐ পদসূত্রে।

দূরে সেই ভাবমুগ্ধকারী দল, আঁকিয়া বাঁকিয়া আসিতেছে, তাহারা আপনাদের স্বাভাবিক রাখিতে গীত গাহিতেছিল, নূপুর বেজে যায়, ক্রমে ঐ দল কোথায় যে তাহাদের স্বপ্নত্ব বাহার ত্যাগ করিল গোপন করিল তাহা বিস্ময়ের, পট তেমনই উজর আছে, পথ তেমনই মায়াযুক্ত আছে, সম্প্রতি যেমন বা ইহারা ঘোর জড়বাদের অন্তর্গত হইল। এখন তাহারা টিলায়। মনিব মহাশয় ও তদীয় পত্নী সহজ হইলেন, উদ্যোগী হইলেন, সুঘরাই অল্প তফাৎ রহিল।

ইহারা বিভিন্ন ধরনে সাড়ী পরিহিতা, তাই কিছু সলজ্জ, তাহারা একে অন্যের পশ্চাতে আশ্রয় লইতে সমুৎসুক, প্রধান শিক্ষয়িত্রী রুমাল দিয়া কপালে থুপি দিলেন, উপস্থিত দুই পক্ষই মৃদু মৃদু আনন্দ প্রকাশ করিতেছিলেন। কিয়দংশে এই ব্যবহার নিমকমিকাল বৈকি! তথাপি এই বিরাট ফাঁকা মানুষের যাবতীয় উপহাসাত্মকতাকে নিশ্চিহ্ন করিল। পার্শী মারাঠি মদ্র ধরনের এবং স্কুল ও সামনে-আঁচল রীতির কাপড় পরন দর্শনে মনিব পত্নী অনেক প্রশংসা করিলেন।

তৎকালে প্রধান শিক্ষয়িত্রী একবার বাবুটির, একবার পশ্চাতের চানোয়ার হোথায় নিরীক্ষণে কহিলেন–প্লেইজেনট! অপূৰ্ব্ব! বলিয়া তিনি মনিব মহাশয়ের দিকে ফিরিলেন।

তাঁহার মধুর স্বরসঙঘাত ব্যাপ্ত হইল; অবশ্য ঐ উক্তির রেশে যেন ‘কিন্তু আছিল, সঙ্কোচ নাই, অন্যপক্ষে যেন নিজ উপস্থিতি সম্পর্কে উহাদের সচেতন করার মতিত্বও যেন তাহাতে; এবং আরও তিনি মনে মনে যুক্তি রচনা করিতেছিলেন; এবং যে কেন তাঁহারা লোকালয় ছাড়িয়া উত্তরে যাইয়া থাকেন!

মনিব পত্নী তাঁহার অভিমান ত্বরিতেই বিচার করিতে পারিয়া সত্যই মজা পাইতে গিয়া সাবধান হইয়াছেন, তথাপি অসতর্কতায়ে তাঁহাকে তাঁহাদের গিরিডি চলিয়া যাওয়া বিষয়ে প্রশ্ন সূত্রে–গিরিডি প্রসঙ্গে: যে চমৎকার উস্রি, কি অদ্ভুত মেঘ করে! ধন্য পরেশনাথ! কি শান্তরসাস্পদ বারগড্ডা ইত্যাকার বাক্য স্থির করিতে অধুনা ন্যায়ত থমকাইয়া আছেন যে তাহাতে, ঐ সকল উল্লেখে, বেজার দেখা দিতে পারে ইহা মনে করেন।

যেহেতু প্রধান শিক্ষয়িত্রীর অভিজ্ঞতা হয় যে রিখিয়া অত্যন্ত গ্রাম্য! কুসংস্কারাচ্ছন্ন! আর যে তিনি সিন্দুর পরাতে বিশ্বাসী নন, সত্যনারায়ণ শুনিতে যাইতে রাজি নন!

তিনি বলিয়াছেন এখানে প্রায়ই স্ত্রীলোকেরা অশিক্ষিত; তাঁহার লারডারের (খাদ্যসামগ্রী রন্ধনের ছোট আলমারী) উপরে কাঁচে, কালোর উপরে সোনার জলে ‘ঈশ্বর মঙ্গলময়’ লেখা আছে এবং সেই লেখার মধ্যে ‘ঙ্গ’ অক্ষর ক্ষয়প্রাপ্ত হইয়া মিটিয়া গিয়াছে, এবং ইহা লইয়া অর্থাৎ এখন যে কথা দাঁড়াইয়াছে এবং তাঁহার ভাষা লইয়া গ্রাম্য-রিখিয়ার সকলে তামাশা করিয়াছে! এবং তাঁহারা তাই গিরিডি যাইবেন, সেখানে নিজেদের ব্রাহ্মগোষ্ঠি আছে, একটি সমাজমন্দির আছে! প্রাণীজগৎ ও উদ্ভিদ ছাড়া প্রাচীনতা সাবেকত্ব উপরন্তু নাই।

অতএব এখানে মনিব পত্নী অল্প অস্বাচ্ছন্দ্য বোধের ক্ষণেই আপন সরলতায় আসিলেন, একারণ যে, সমক্ষেই ফুলমৃদু বালিকারা–যে তাহাদের অনেক অলৌকিকতা ছিল। তিনি খুব বন্ধুতায় কহিলেন, একদিন আসুন না…আমাদের বাড়ীতে।

প্রধান শিক্ষয়িত্রী এই আহ্বানে, সম্ভবত খুসী হইয়া তৎক্ষণাৎই, নিশ্চয় আমরা খুব খুসী হইব, বলিয়াই অল্প অন্যমনা–মিথ্যা তাঁহারা প্রয়োজনে বলিয়া থাকেন কহিলেন, সময় যদি পাই।

অন্তরে তিনি–মনিব পত্নীকে, যিনি ধর্ম্মপ্রাণা, এখন এড়াইতে চাহেন যেহেতু ইহার ভাষা কুশ্রী– অথচ চালচলনে ভীষণ ইংরাজ–যেহেতু ইনি ভূতপূজক হিন্দু; জন্মান্তরবিশ্বাসী ও গঙ্গা-সমর্পিত মন, যাহাদের প্রধান শিক্ষয়িত্রী হিসাবে ঘৃণা করিতেন, অপছন্দ করিতেন! সুতরাং এই ক্ষেত্রে তিনি যে কি করিবেন তাহা মনস্থ হইবার পূৰ্বেই ফ্রক-পরা অল্পবয়সী মেয়েটিও যে মারাঠি ধরনের সাড়ী পরিহিতা, সে বিস্ময়াবিষ্ট হইল, সুঘরাইএর পাখী দেখিয়া কহিল,–পিসিমা দেখুন দেখুন, কি বিউটিফুল পক্ষী, দেখুন পক্ষীটি বালকের হাত টুকরাইতেছে! ইহা আশ্চর্য্যের! উহা কি পক্ষী!

প্রধান শিক্ষয়িত্রী ঐ অপ্রার্থিত সুযোগ লাভে স্বস্তিতে যোগ দিয়াছিলেন, সত্যই চমকপ্রদ! মহাশয় উহা কোন জাতীয় পক্ষী? এবং যুগপৎ স্বীকার করিলেন, যে এইসব বিষয়ে আমরা এত অল্পই জানি…এবং যেক্ষণে তিনি হাসিয়া উল্লেখ করিবেন যে, ঈসল্স বা হিতোপদেশে ইহার কথা নাই, তখনই শুনিলেন যে, উহা তিতির!

এবং ঐ তিতির শব্দ তিনি সুষ্ঠুভাবে উচ্চারণের পরে পার্শ্ববৰ্ত্তিনী মারাঠি সাড়ী পরিহিতা কিশোরীকে প্রশ্ন করিলেন, তিতিরের ইংরাজী কি বল ত দেখি… সিনি? আঃ অত দুলিতেছ কেন! ওকি! ভদ্র হও…ছিঃ! এই মেয়েটি এবং ঐ মেয়েটি আমার মধ্যম ভ্রাতার কন্যা…গত পরশু আসিয়াছে…আবার দুলিতেছ…যেখানে উহারা থাকে সেখানে ভাল স্কুল নাই…দুঃখের…অমন করিও না…ইহারা কি ভাবিতেছেন ছিঃ…!

ঐ তিরস্কৃত মেয়েটি তখন মনিব মহাশয়দের চোখে অলৌকিক শোভা ধারণ করিয়াছিল, এ কারণ যে,–সম্ভবপর ইহা যে সাড়ী পরার অনভ্যাস বা অস্বাচ্ছন্দ্যের জন্যই–তাহার পদদ্বয়ের যাহা সৰ্ব্বলোক বন্দনার জন্য, প্রণামের জন্য গঠিত তাহা যেমন সাঁচিতে আছে ঠিক তেমন তেমনভাবেই পশ্চাতে ঈষৎ উত্তোলিত ছিল।

মনিব মহাশয় আপন সহধর্মিণীরে নিজ মনোভাব জ্ঞাপন করিলেন, কি মিষ্টি না,…যেমনটি সাঁচিতে…নয়? আহা কি!

মনিব পত্নী জানাইলেন, আহা কি ভাব! কি চমৎকার, এবং এই পৰ্য্যন্ত বলিয়া তিনি ইতস্ততর মধ্যে, প্রায় তাঁহার ওষ্ঠে আসিয়াছিল, যে, ঐ মেয়েরে পূজা করা যায়, কিন্তু প্রধান শিক্ষয়িত্রীর রুচি তাঁহার

অবিদিত ছিল না, এখন এইরূপে শেষ করিলেন, ওদের দেখ, প্রত্যেককেই বড় খাসা দেখতে নয়!

প্রধান শিক্ষয়িত্রী পুনরায়, তিতিরের ইংরাজী জিজ্ঞাসাতে, মেয়েটি উত্তর দিল,–পারর…টরিজ।

ছিঃ কি উচ্চারণ করিতে আছ, আর-এ র’য়ে মানে প্রথমটিতে…তারপর বলিলাম ত ঐ স্থানে ভাল স্কুল নাই…।

পার্শী সাড়ী পরিহিতা যুবতী ইচ্ছাকৃত অবশ্য কিছুটা উদ্বেলতায় ঐকথায় বাধা দিল,–শুনিয়াছি ইহাতে খুব ভাল রোষ্ট হয়…খাইতে খুব ভালও…!

নিশ্চয় খুব ভাল খাইতে…তুমি তখন খুব অল্পবয়সী, যখন আমি পেশোয়ারে…স্কুলে…উনি কলেজে…এই তিতিরের মাংসে অপূৰ্ব্ব রান্না হয়, তবে সেই রন্ধনে কাশ্মীরজাত লঙ্কার প্রয়োজন হয়…আমরা একটু হলুদ দিয়া থাকি বটে, এবং শা-মরিচ…বুঝিলেন, বেশ ভালভাবে কাটিয়া…প্রথমে ভিনিগার বা নেবু রসে ভিজাইয়া অথবা মাখাইয়া…হ্যাঁ কাটার পরই…।

মনিব মহাশয় ইহাতে অবশ্যই অবাক, সুঘরাইএর প্রতি অপরাধীর ন্যায় চাহিলেন, যে এবং খুব সোজাই মৃদুস্বরে বলিয়াছিলেন,–ও বেচারীর পাখী অন্ত প্রাণ!

স্বামীর এহেন নির্ব্বুদ্ধিতায়ে মনিব পত্নী ঝটিতি অপ্রতিভ হওয়ত, যাহাতে অভ্যাগতরা না ক্ষুণ্ণ হন। তন্নিবন্ধন অতীব তিক্ত শ্লেষে বলিলেন, ছাড়ুন ত ওঁর কথা, পাখী অন্ত প্রাণ না হাতী, অষ্টপ্রহর ওর পিছনে লেগে আছে, আবার কথা, ওই মুখপোড়া ছোঁড়ার ভগনীপতিই যে বলে…বলে পাখীটাকে কাটবে বলে শাসায়, ও ভয় পায় এখন…সত্যি যদি কাটে, রাঁধে তখন ছোঁড়াও হয়ত দেখব একটা ঠ্যাং খাচ্ছে…আজই পাখীটিকে এমন হিস্ শব্দ করে জাত সাপের শব্দ করে ভয় দেখাচ্ছিল, যে আমার এবং ওঁর পিলে চমকে গেসল!…বল…আমরা আঁৎকে উঠি…খুব বকলুম ব’লে অবলা জীব তারে পোষাই বা কেন…কি বলবেন বলুন…জাতে ওরা ডোম, ছোট জাতদের আবার মায়া মমতা…মন বলতে কিছুটি ওদের নেই…উনিও বললেন পূব্বজন্মের পাপ হলে হাড়ি ডোম হয়, যে এবং তাঁহার স্বর ক্রমবিলীয়মান হইল।

মনিব মহাশয় বলিলেন, সত্যই বলুন! হাড়ি ঢোম উহাদের মন থাকিবে, মমতা থাকিবে ইহা আশা করাই বাতুলতা…।

প্রধান শিক্ষয়িত্রী ও তদীয় পার্শ্ববৰ্ত্তিনীরা সরমে কুণ্ঠিত, অধোবদন; মারাঠি সাড়ী পরিহিতা ও তাহার দিদি পৰ্য্যন্ত, যদিও তাহারা বঙ্গের বাহিরে প্রায় বাঙালীবর্জিত স্থানে থাকে, তবু, যে সকলেই মলিন, যে সকলেই নিজেদের আড়ষ্টতা কাটাইবার মানসে সুঘরাইএর প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়াছিল।

প্রধান শিক্ষয়িত্রী এহেন নোংরা ধারায়, মনিব পত্নীর, বলার ভঙ্গী জীবনে শুনেন নাই, একমাত্র এখানে স’স টানের রাহিত্য থাকে; অতএব তাঁহার ভিতরে এখন বিতৃষ্ণা উদ্ভূত হইয়াছে, তাজ্জব যে। এমনও একদা সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন যে অন্তত সব সত্ত্বেও মনিব পত্নীর শুধু আরশোলা ভীতি আছে। জানিয়া তাঁহাকে মার্জিত বলিয়া বিবেচনা তাঁহার হইয়াছিল।

আরশোলাকে ঘৃণাতে প্রধান শিক্ষয়িত্ৰী বড় সুখী হইয়াছিলেন, নিজের সহিত মিল দেখেন, যে মনিব পত্নীরও একই ঘৃণা আছে। এখন নিশ্চয় মনে হইল তাহা মিথ্যা বালখিল্যতা, সম্প্রতি কোনমতে যেন স্বগতেই তাঁহার ওষ্ঠে বাক্য ফুট হইল! কি অসভ্য! তৎসহ ভঁহার গোষ্ঠির সকলেই সুঘরাই প্রতি নেত্রপাতে সমস্বরে মন্তব্য করিল, ওমা কি অসভ্য ভাই!

অবশ্যই এবম্প্রকার উক্তি মেয়েরা যেন তাহাদের স্বীয় ইজ্জতের কারণেই বিশেষত করিয়াছিল। এবং, ঐ পদ প্রকাশের বৃত্তিতেও প্রধান শিক্ষয়িত্রীর কিন্তু যে পূৰ্ব্বলব্ধ ভ্রষ্টতা যেমন তিরোহিত হয় না, এক ঘৃণা হইতে অগণন ছুঁৎমার্গে বিশালা ব্যক্তিত্বশালিনী প্রধান শিক্ষয়িত্রী উৎক্ষিপ্ত হইলেন।

অন্যপক্ষে যে এরূপ সঙ্গীন তিনি যে তদীয় অভিভাবকত্ব অধীনাদের প্রতি তাকাইতে তিনি অসমর্থ; ক্কচিৎ আপনার সূত্রের কথা মনে হইল যেন, ধীরে তিনি শিক্ষয়িত্রী-বিহিত রীতিতে মস্তক আন্দোলিত করত সকলকে একাগ্র করত অনেক কষ্টে আরম্ভিলেন, সিলি দ্যাটাস ব্যাড! অর্থাৎ মেয়েদের ঐরূপ মন্তব্য।

যে এইটুকুতে তাঁহার হৃতমান ফিরিল, যে এই টুকুতেই ক্লান্তি বিদূরিত হইল, যে এই টুকুতেই প্রত্যয়ের সঞ্চার হইল। ঐ ছোট ইংরাজী পদ ব্যবহারে ভব্যতা সম্পর্কে তিনিই প্রথম সচেতনতা আনিলেন, যে অবশ্যই তিনি সদসৎ তত্ত্ব পৰ্য্যায়ে মনিব দম্পতিরে লইতে পারিবেন।

সুতরাং সুঘরাইকে কেন্দ্র করা তাঁহার কোন অভিপ্রায় নাই–শুধু মাত্র তাহারে উপলক্ষ করিয়া সাজাইতেছিলেন যে ডোম বলিয়া ইত্যাদি। কিন্তু অসাধনেই যেন বলিলেন, আপনি না শুনিলাম, খাদ্যাখাদ্য বিচার করেন না…অক্‌সো (oxo) খাইয়া থাকেন, এবং যাহাতে এই উক্তি আঘাতরূপে না। বুঝায় তজ্জন্য তাঁহার মুখে স্নেহপ্রযুক্ত হাস্য ছিল।

অউক্‌সো! কে বলিল…!

আমিই সিদিন বছিলুম, যে মুরগীগুনো সব মারা গেল হঠাৎ, রাতে কিছু নাই…সব্বাইকে খুঁজতে পাঠালুম; অবশেষে অউক্‌সো…ছিল…!

এ সময়ে প্রধান শিক্ষয়িত্রী তাঁহার সঙ্গের বালিকাদের ঐ বিশেষ্যটি সম্পর্কে কৌতূহল দর্শনে তাহা নিবৃত্তির মানসে নিম্নস্বরে কহিলেন, অসসা…না বভরিল কোনটি, বিফ ইন বৃফ্‌ (beef in brief)। আমার ত ভুলিয়া যাওয়া উচিত নহে, কোথায় দেখিয়াছি–আঃ আমার বয়স হইয়াছে, রহ মনে করি, ইনসিওর ইট উইথ গিলেনডারস–সম্ভবত অক্সসাই?…কিন্তু ইহার পরক্ষণেই উত্রাই-নামার বেসামাল তাঁহাতে, কেননা ঐ অক্‌সো সূত্রে মনিব পত্নীর ভদ্রতা-ব্যভিচারিণী কথা তাঁহাকে জ্বরগ্রস্ত করিল। যুগপৎ স্বদেশীনেতার মন্তব্য কানে আসিল, গরু খাওয়া ঠিক নয়!

এই বিষয়ে বিলাসিতা-বিরোধী স্বদেশী নেতার জবাব প্রথমে প্রধান শিক্ষয়িত্রীর আরামপ্রদ বলিয়া বোধ হয় (আদতে যেহেতু প্রথমত ঐ ব্যক্তি মনিব দম্পতিদের বুজরুক বলিয়া থাকে ও তাঁহারা অত্যন্ত ধনী বিধায় ইংরাজের খয়ের খাঁ বলে) তাই এই নেতাকে তিনি পছন্দ করেন–আবার অপছন্দ করেন খুবই, কেন না তাঁহার স্বামী বলিয়াছেন যে তাঁহাকে এ্যানারকিষ্ট দীননাথ জানাইয়াছে ঐ লোকটি নিজের ফটোর একটি ব্লক করিয়াছে, দুঃস্থ নির্বোধ পত্রিকাওয়ালারা যাঁহারা ব্লক ছাপান উচ্চমানভাবে, তাঁহাদের দিয়া থাকে, ছবি ছাপায়।

এইভাবে সেই লোকটি জনপ্রিয়। লোকটি রাজনীতিবিদরা যেমন হইয়া থাকে, চরকা কাটে, অনেক,গ্রামে প্রহৃত হইয়াছে, অনেক বন্যার টাকা আত্মসাৎ করিয়াছে…এ-ক্লাস প্রিঞ্জনার ত দূরের কথা কখনও বি-ক্লাসও নয়! এখন কোন এক মিউনিসিপালিটির ধাঙ্গড় নেতা, সে তাহাদের শোষণ করিতেছে, বলে পৃথিবীতে রাজা বলিয়া কিছু নাই! যুবতী দেখিলেই কামে গোঁয়ার হইয়া উঠে! এই বিলাসিতা-বিরোধী স্বদেশী নেতা মনিব পত্নীর মুখে অক্‌,সো গো-মাংস শুনিয়া মহা ধিক্কারে কহিলেন, গরু খাওয়া ঠিক নয়…একে গরম দেশ, গরু মানুষের উপকারী…আমাদের দেশ…।

ইহাতে মনিব পত্নী নিদারুণ অবজ্ঞায় মুখ ঘুরাইয়া লইয়াছিলেন, এমন যে তাহার সহিত তাঁহার বাক্যালাপে মানহানি ঘটিতে আছে, বিলাসিতা-বিরোধী স্বদেশী নেতা প্রস্থান করিল। তিনি, মনিব পত্নী এখন নিলজ্জভাবে বলিয়াছিলেন,–গরম দেশ…উনি যেমন বলেন মেয়েছেলে সহ্য হচ্ছে না? আর গরুর মাংস ত কি কথা…! সমবেত সকলে এই সরলতায় বিশেষ আমোদিত হয়। একমাত্র প্রধান শিক্ষয়িত্ৰী ব্যতিরেকে, যিনি এখনও যুবতীর ন্যায় কণ্টকিত লাল হইয়া থাকেন। তিনি বড়ই অপদস্ত হইয়াছিলেন।

এখন প্রধান শিক্ষয়িত্রী কোনক্রমে ঐ বিষয় এড়াইতে তৎপর হইয়া কহিলেন, কিছু মনে লইবেন, আপনাদিগের তুল্য এত উচ্চশ্রেণীর অর্থাৎ মানে…যা বলিতে চাহি তাহা ইহা যে…ইত্যাকারে তাঁহার কণ্ঠস্বর শ্লেষাত্মক হইতেছিল, জাতিতত্ত্ব লইয়া ঝটিতি বলিলেন–আমাদের কাহাকেও ছোট ভাবিয়া অর্থাৎ ছোট করিয়া বড় ভাবা…মানে ঈশ্বর যাহাকে যেমন করিয়াছিলেন…কি উচিত…শোভা পায় না…।

মনিব মহাশয় অত্যন্ত বাধিত হইয়া উত্তর করিলেন,–আমার বাক্য আপনি মার্জনা করিবেন –আমাদের এই চমৎকার ঘৃণা অবজ্ঞাটা থাকিতে দিন…।

যে প্রধান শিক্ষয়িত্রী একদা নিঃসংশয়চিত্ত হইলেন যে মনিব মহাশয় নিজে আত্মসমালোচনা করিলেন, আবার একদা কুঞ্চিত তাঁহার হইল, অতএব কোন তত্ত্ব অনুমানে–মনিব মহাশয়ের উক্তি কি শ্লেষ-নির্ঘাত তাহা অবধারণে তিনি মুস্কিলে ছিলেন; সম্ভবপর হইলে এই স্থান তিনি ত্যাগ করিতেন, তবু স্বভাববশত উত্তর করা উচিত বিধায়ে ব্যক্ত করিলেন, মানুষ কোন কদভ্যাস বা…আপনার ন্যায় ব্যক্তি এরূপ…মনোভাব।

সম্ভ্রান্ত শিক্ষিতা ভদ্রমহিলার মন্দ দশা বুঝিয়া মনিব মহাশয় বিচলিত হইয়াও বলিতে উদ্যত হইলেন যে আপনি কি মদীয় জীবনী পাঠ করিয়াছেন, কিন্তু তিনি স্তব্ধ।

এখন খানিক শাসনের ভঙ্গীতে বিড়ম্বিত প্রধান শিক্ষয়িত্রী ব্যাখ্যা করিলেন,–উহাদের ডোম বলিয়া ছাড়িয়া দিলে চলিবে না…আমাদের কর্তব্য উহাদের শিক্ষা দেওয়া…ক্রীশ্চান ধৰ্ম্ম বলে…আমরা ত বলি মানুষকে সৎপথে চালিত করা…বালককে…সে চপলমতি, তাহারে শিক্ষা দিতে হইবে যে পক্ষী হইলেও উহাদের সুখদুঃখ বোধ তথা প্রাণ আছে…এখন হইতে যদি শিক্ষা দিতে অবহেলা করি তাহা হইলে, একটু একটু করিয়া যে পাপ আত্মায় প্রবেশ করিতেছে…!

মনিব মহাশয় তদুত্তরে, তিনি আবাল্য জানিতেন আত্মা সম্পর্কে ভগবান কি বলিয়াছেন, তিনি আলস্য ত্যজিয়া মৌখিক বিনয়ে নিবেদন করিলেন,–সুঘরাইএর ভাবান্তর কোন আলোচনার বস্তু নহে…ইহা অবশ্যই একশবার যে আপনি যাহা বলিলেন তাহা অভ্রান্ত-তবে যদি অনুমতি করেন তাহা হইলে বলি যে সুঘরাইএর উক্ত ব্যবহারে কোন আত্মসুখ নাই–সে নিষ্পাপ! উহা নিষ্পাপ! যেমত যেমন পিঠোপিঠি ভ্রাতা ভগিনীতে ঘটিয়া থাকে…আমি দেখিয়াছি ও নিজে পাখীটিরে আঘাত করিয়া বলিতেছে, আমারে তুই মার না কেন?–সহজ সম্পর্ক তাহা ব্যতীত অন্য কিছু না,…জানিবেন ইহা খুনসুড়ীই, কেহ বলিতে পারেন যে মাত্রালঙ্ঘিত খুনসুড়ী ইহা, তবু ইহা খুনসুড়ী!

এবং ইহার সহিত-যে তিনি শিক্ষিত, যে তিনি চিন্তা করিতে পারেন, ইহা যাহাতে সুস্পষ্ট হয়, তৎপ্রবর্ত্তীত উত্থাপন করিলেন যে, ইহার মধ্যে সেই ঐতিহাসিকতার আঁশ নাই, যাহা কোন ফরাসী পাদরী (দু’বোয়া!) মনে পড়ে যাহারে ‘প্লেইজির ইল্লিসিট’ বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন ইহা তাহা নয়!…ইহা অতীব প্রাচীন মনুষ্য বা বালকস্বভাব মাত্র…দেখুন মানুষে অনেক বিশ্রী বস্তুর সুন্দর নামকরণ করে, তেমনি উচিত ছিল এই সহজ সাধারণ স্বভাবের একটি বিশেষ নাম দেওয়া…তাহা হইলে…আমরা ইহার চরিত্র বা প্রকৃতি নিরূপণে নিশ্চিত হইতাম…আমার ধারণা ইহা সম্পূর্ণ পূৰ্ব্ব কথিত সম্পর্ক ইহা।

চশমাটির ফ্রেমে ঠিক দিয়া প্রধান শিক্ষয়িত্রী অল্প হাসিলেন অর্থ এই যে কাহারও বিদ্যার অভিমানকে চোট দেওয়া তাঁহার অভিপ্রেত নহে কহিলেন বটে আপনার যুক্তি অন্যায় মানিবে না, বলা যায় পক্ষপাত অর্থাৎ শূন্য নহে…(!) আপনি একটি অনৈমিত্তিক বৃত্তিরে রাসিওনলাইজ করিতে। চাহিতেছেন…আমরা দৈনন্দিন জীবনেতে…জীবনের মধ্য হইতে অনেক তত্ত্বাভিজ্ঞতা লাভ করিতে পারি, তখন সিদ্ধান্ত হইবে যে, কথিত ঐ প্রকার খুনসুড়ী বা তদর্থবাচক শব্দ যে কোন…যে কি পৰ্য্যন্ত বিঘাতক…উদাহরণস্বরূপ ভাই-ভাইএর তাদৃশ পরস্পরের প্রতি আচরণ, কালে কলহ এবং যে কলহের। পরিণামে পরিবারের সকলেরই মর্মপীড়ার কারণ হয়,…এইরূপে প্রতিবেশীতে ও সমাজে বিশৃঙ্খলতা…আমরা দেখিব যে লঘুতা খেয়ালখুসী, বড়ই দুঃখজনক, বড় ব্যথার কারণ হয়…ঈশ্বর বড়ই…।

ক্ষমা করিবেন, যতদূর মনে হয় ভগবান উহার, সুঘরাইএর জন্য লজ্জা পাইবেন না…আর যে, আপনি যাহা বলিলেন তাহাতে বুঝায় উহারে আইন অনুগ করা–এবং যুগপৎ তিনি কহিলেন,–দেখুন দেখুন এবং তৎসহ দেখ দেখ সম্বোধনে আপন সহধর্মিণীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিলেন সুঘরাইএর প্রতি, তদীয় গাত্রে জামা সত্ত্বেও ইহা ওতপ্রোত যে সে প্রজ্জ্বলিত কিছু শিখা সকল, তিব্বতীয় টঙ্ক যাদৃশ–তেমনই, এখন ডিগরিয়ার একদিকে সূৰ্য, তাহারই কিরণমালা, সুঘরাইএ প্রতিফলিত! মনিব মহাশয় জ্ঞাপন। করিলেন,–তাজ্জব সে মনে হয় প্রজ্জ্বলিত ও দুঃখিত, দেখুন উহার বা উহাদের ভগবান নাই।

প্রধান শিক্ষয়িত্রী এবম্প্রকার উক্তিতে অত্রাহি হইলেও, তাঁহার অধীনারা বিমূঢ় হইলেও, সকলেই এককালে সুঘরাইকে লক্ষ্যে অভিভূত ক্রমে তাহারা সকলে চীৎকাঠের বাঁধ, ও অগণন তালবৃক্ষ ও সিজেল জাতীয় বৃক্ষ (!) মহিমা আর অনেক সম-বিসম ইদানীং ফলসা-টে উঁচু নীচু জমির পিছনে ডিগরিয়ার দক্ষিণে মারচস্ সূৰ্য্য দেখিল! তাহারা বিমোহিত। ইহাদের মধ্যে পার্শী সাড়ী পরিহিতা সম্ভ্রান্ত সৌভাগ্যবতী যুবতী কহিল,–যে ঈশ্বর আছেন তাহা উহারে…জ্ঞাত করা বিধেয়…আঃ ঈশ্বর বলিয়া সে আপনকার উত্তমাঙ্গ বড় নিশ্চিন্তে অলৌকিক নির্ভাবনায় রিখিয়ার বৈভবের চারিদিকে ঘুরাইল। সে। নিকটে ছিল, সুতরাং বৈকালিক প্রসাধনে ব্যবহৃত জলসেকের আর্দ্রতার, এখনও, এত ভ্রমণেও, চাকচিক্য প্রতীয়মান, পার্শী কায়দায় সে বড় দূরে ছিল, তাই সে অদৃশ্য।

তাহার ঐ বাক্য মনিব দম্পতি, যাঁহারা ধর্ম্মবিশ্বাসে অন্ধ, ভগবান বলিতে যাঁহাদের নয়ন সজল হয়, তাঁহারা সমস্ত সৃষ্টি হইতে হস্তদ্বয় তুলিলেন, মনিব পত্নী গললগ্নিকৃতবাস হইলেন, আপন আপন জুতা ত্যাগ করিলেন ও বক্ষস্থলে করজোড় স্থাপন করিলেন। তাঁহারা অপূৰ্ব্ব শোভা ধারণ করিয়াছিলেন। অতঃপর এবং ঐভাবেই মনিব মহাশয় বলিলেন, আমার ধ্রুবজ্ঞান যে বালক আপনার ধর্ম্মবিশ্বাস আপনি বহন করিতেছে।

মনিব পত্নী তদীয় সমৃদ্ধ পুষ্ট দেহ দুলাইয়া এদিক সেদিন নজরের পর শান্ত স্বরে সুঘরাইকে আজ্ঞা করিলেন,–আ মোল যা ছোঁড়া সন্ধ্যেবেলা বলেছি না স্থির হয়ে থাকতে হয়, এত ঘুঘুর করছিস কেন মরণ…! কাছে কাছে থাক না–ইহাতে এই শেষোক্ত পদে ইনি কিছু ব্যক্ত করিলেন,এখানে আয়…ও লজ্জা কচ্ছে বুঝি, বুঝেছি খবার পাখীটারে কষ্ট দিস নি…শুনলি ত ওতে পাপ হয়!

এবম্ভূত অভিযোগে, সুঘরাই বটেই যে নিগৃহীতই ছিল, যদ্যপি যে সে সহজ হইতে উন্মুখ, কিন্তু সে আপনাকে প্রকৃতই শান্ত রাখিতে লায়েক না, সে অসংলগ্ন হইয়া আছে; সে মনিব পত্নীর উপর যারপরনাই ত্যক্ত বিরক্ত হইতে সাহসী হইয়াছে; নিশ্চয়ই সে ভাবিয়াছে যে এত লোকসমক্ষে তাহাকে হেয় করা (!) সঙ্গত হয় নাই ও তপ্রভাবে সে দূরে থাকে, এবং সপক্ষে এই কথাই তাহাতে উত্থাপিত হয় যে সে বিবেচনা করে যে, যে কেন এই শালা!–এবং এই শালা উচ্চারণেই সে সচেতন যে, তাহার কোথাও এতক্ষণ গৰ্ব্ব হইতেছিল–অর্থাৎ আপন পাখীর কারণে ঐ গঞ্জনা তাহার গৌরব–যে সে আত্মপ্রসাদে, যাহা এইরূপে ব্যাখ্যা করা যায় যে, তবু ত অর্থাৎ তবু ভাল ইহা যে সে তদীয় পক্ষীর হেতুতে কথা শুনিতে আছে! পুনরায় সুঘরাই আপন পক্ষীর দিকে নজর রাখিয়া ইহা যেন কহিতে লাগিল যে:

এই শালা, এখন, যে, এই বিরাট জবা রঙ টিলায় ঘুরিতে ফিরিতে আছে শালা, তোমার জান না বড় খচ্চড়, কিছু দিন পূর্বে আমি যখন খাঁচার কাঠি বদলাইতে সারাইতে কাঠি চৌরস করি, একনিষ্ঠভাবে মোহিলির দেওয়া মন্তর উচ্চারণ করিতেছিলাম, যদি না করি তাহা হইলে, ভূত খাঁচার কাছে আসিবে; ভূত খাঁচায় ঢুকিবে, উহাকে বধ করিবে…আমি যে কত উহারে ভালবাসি…আমার তিতির তখন আমার কোলেই বসিয়াছিল, মন্তরের মাঝে মাঝে আমি তাহার সহিত গল্প করিতেছিলাম, আশ্চৰ্য্য যে সে আমার কোল সে নোংরা করে নাই, আমার হাতে ধারালো ছুরি, বাঁশ ফাড়িয়া দুই একটি কাঠি সবে মাত্র তৈয়ারী করিয়াছি হঠাৎ এমত সময় পাখী নড়িতেই আমার এই আঙুলটি কাটিয়া যায়, যে অনেক রক্তপাত হইল, আমার পরনের বস্ত্রে কিছু পড়িল,…অনেক অনেক মেজেতে; আমি লাফাইয়া উঠিয়া পড়িলাম, আমার এত আদরের পাখী শালা কিছুই বুঝে না; পাখী দূরে দূরে অবশ্য আমার দিকে চাহিয়াছিল, শুনিয়াছি…পাণ্ডাঠাকুরের ময়না পাখী। পাণ্ডাঠাকুর মরিতে অনেক কাঁদিয়াছিল, দু-তিনদিন কিছু গ্রহণ করে নাই, শুনিয়াছি বদরীবাবুর কুকুর, তিনি মরিতে, পাগল হয়।…দেওঘর হইতে দারগা আসিয়া তাহাকে গুলি করে! বেচারী।–অনেক রক্ত দর্শনে আমাতে ঘোর উপস্থিত, আমি আঙুল চাপিয়া বসিয়া পড়ি, প্রথমে পাখীটি আমার সেই পতিত রক্তের উপর দিয়া নিৰ্ব্বিবাদে চলিয়া যায়, মেঝেতে অনেক পায়ের রক্তাক্ত ছাপ অবলোকনে আমি ভীত হই–আঃ নাট্যকাররা কি সুদক্ষ কি চতুর, এহেন ভীতিকে চমৎকার স্বগত উক্তিতে রাখিয়া থাকে!

সুঘরাই লজ্জাতে কাঁদিবে এমন, মরমে সে মরিয়াছে!

তাদৃশ সদ্য রক্তাক্ত ছাপ সকল বিস্ফারিতনেত্রে সুঘরাই দেখিতে থাকে, সে যেমন যে ইহা যে গণনা শিখিবে, ঐ এলোমেলো মুদ্রণে তাহার জিজ্ঞাস্য ছিল অঢেল, কিন্তু সে আর স্থির থাকিতে পারে না, সবেগে বাগানে গিয়াছিল দ্রুতই, কিছু গাঁদাপাতা আহরণ করত ক্ষত স্থানে চাপিয়া, ঐ কথিত স্থানে ফিরিয়া সে বজ্রাহত, তাহার মাথা আপনা হইতে আনত হইল, যে সে যেমন উচ্চবর্ণসভৃত, সে ডোম নহে, কেন না ছোটজাতদের মস্তক কখনও আনত হয় না, তাহার বেচারী নেত্রপক্ষ ভারাক্রান্ত হইল, তখনও সে হতবুদ্ধি সে তটস্থ, যে তাহাবই রক্ত তাহারই প্রাণাধিক প্রিয় পক্ষী খানিক মস্তক কাৎ করত অপূৰ্ব্ব শোভাতে চঞ্চু দ্বারা রক্ত পান করিতে একমনা আছে।

ক্রমে তদ্দর্শনে সুঘরাই শনৈশ্চর হইল, চক্ষুর্ঘয়ে জরাবর্ণ দেখা দিল, যে সে উঠানে মৃত্তিকায় দানবীয় ক্রোধে পদাঘাতে আপনারে জাগ্রত করিল, যে সে ঢেলা তুলে নাই, শুধু দৌড়াইয়া গিয়া দশ মরদ জোরে লাথি মারিল; এই রক্ষা যে লাথির সবটা অর্থাৎ পায়ের পুরা চোট, পাখীর গায় লাগে নাই, তাহা হইলে, বেচারী পাখী তৎক্ষণাৎ প্রবল বেগে উৎপাটিত উৎক্ষিপ্ত হওয়ত দেওয়ালের সংঘাতে নিশ্চয়ই মরিয়া যাইত! এখন লাথির স্বল্প ঘা’য়ে পাখীর দু-চারটি পালক খসিল আর যে পাখী ত্রাহি চীৎকারে এক কোণে যাইল, কম্পিত ছিল; ঐ আতঙ্কিত পক্ষীর ভয়ার্ত আর্তনাদ অনুরূপ তাহারও কণ্ঠে ধ্বনিত আপনা হইতেই অগোচরেই হইতেছিল, আপাততভাবে মনে হয় সে যেমন বা ভ্যাংচাইতেছে; এবং সুঘরাই নিজ বেগে বেসামাল হওয়ত, সশব্দে পতিত হয়।

ঐ শব্দে মনিব পত্নী দ্বিপ্রহরিক নিদ্রা উখিত হইয়া ঐ স্থলে যাইয়া এবং তখন সুঘরাইকে ছুটিতে দেখিয়া ও তৎসহ রক্তাক্ত মেজে প্রত্যক্ষে হা হা রব করিয়া উঠিলেন, তাঁহার মাথা কেমন করিয়াছিল, তথাপি জিজ্ঞাসিলেন,–ওরে এত রক্ত কোত্থেকে এল সব্বনাশ, তোর পাখী কৈ রে…কিরে অমন হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস…পাখী কৈ…শব্দ হল কিসের–তোর কাপড়ে রক্ত কি সব্বনাশ!

সুঘরাই আনুপূর্বিক সকল কিছুর বিবৃতি দান করিল না।

সত্বর ফার্স্ট এইড বাত্সটি লইয়া আসিয়া তাহার ক্ষতস্থানে ব্যাণ্ডেজ করিলেন, সুঘরাই আইওডিনে লাফাইতে লাগিল, মনিব পত্নী তখনও বিস্মিত হইয়া আছেন, বলিলেন, বেচারী তোর দুঃখেই বুঝি অমনধারা ক্যাঁক্যাঁ করে উঠল! আমি বলি বেড়াল টেড়াল…!

সুঘরাই এখনও দারুণ রোষদগ্ধ, তাদৃশ বীভৎস কদর্য্য দৃশ্যে সে মতিচ্ছন্ন, তাহার ওষ্ঠ কাঁপিতে আছে, প্রকাশিল যে,–বেড়ালে ধরিলে খুব ভালই হইত, ঐ পক্ষী রাক্ষসী উহাকে আর সে পুষিবে না…উহা রাক্ষসী ভূত পেত্নী…আপনি শুনিলে বিকল হইবেন যে, উহা আমার রক্ত নির্ঘ মনে মাড়াইল, ঐ দেখুন সারা মেজেতে উহার রক্ত লাগা পায়ের দাগ, তখনও কিছু বলি নাই, দেখিলাম সে আমার রক্ত খাইতেছে, আমি রাগিয়া যাই আমি লাথি মারি আমি পড়িয়া যাই! উহা পেত্নী মনে হয়, উহাতে পেত্নী ঢুকিয়াছে নিশ্চয়…এই বার তাহার চোখে জল আসিল। এ বিষয়ে সে মোহিলিকে খবর দিবে।

স্নেহময়ী মনিব পত্নী তাহারে ভর্ৎসনা করিয়াছিলেন এইরূপে যে, তুই ছোঁড়া মহা পাগল,…দেখছি সাক্ষাৎ পাপ তুই–যা আগে কাপড় ছাড়…ফের যদি করিস তোর কান ধরে উনি বার করে দেবেন– পরে সান্ত্বনা দিয়াছিলেন,–দেখ দেখি কি কাঁপছে বেচারী, তুই না ওকে দারুণ ভালবাসিস…ওর কি জ্ঞান আছে…ও সব করবে, তুই তাতে মারবি কেন…তুই না বলিস আমাকে যে, মা আমাকে তি তি করে ডাকবে আমি আসব…তুই না সিরিয়া পাহাড়ে ওর নাম লিখবি!…ছোঁড়া উনি শুনলে তোকে আস্ত রাখবেন…তোর পাখী হারাতে উনি না খুঁজতে যান, কত টোটা নষ্ট হল (সেদিন অবশেষে মল্লিক লজের পশ্চাতে ভাঙা বাড়ীর কাছে যখন গুলি ছোঁড়া হইল তখন-তিতির কোথা হইতে বাহির হইয়া উড়িল–এবং একজন যুবক ও যুবতী, ইহাদের মুখ পাংশু ছিল। যুবতী শুনি, দুল হারাইয়াছিল, তাই যুবকের সহিত খুঁজিতেছিল)…ওর গায়ে পা দিলি!নমস্কার কর ছোঁড়া, ওতে না ঠাকুর আছেন? ও অমন হবে কেন…জানিস ওদের চোখেও জল আছে, নে ছোঁড়া নমস্কার কর শিগগীর।

সুঘরাই আপনার পক্ষীরে নমস্কার করিল। তিতিরটি গ্রীবা তুলিয়া সুঘরাইকে দেখিতে আছে। সুঘরাইএর দেহ সুমহৎ বেপথু খেলিয়া উঠিল, একদা শ্রাবণের ঘোর শ্যামবর্ণ মেঘের নিকট সে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল যে, সে পাখীটিকে বুকে রাখিবে, সে পিঙ্গল রক্ত স্রোত স্পর্শ করিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল যে সে পাখীকে বুকে রাখিবে, যে সে গম্ভীর অশ্বত্থ বৃক্ষের নবোদগত পত্র স্পর্শে প্রতিজ্ঞা করে যে সে উহাকে বুকে রাখিবে!

৫. প্রধান শিক্ষয়িত্রীর কন্যা

প্রধান শিক্ষয়িত্রীর কন্যা তেমনই শান্তকণ্ঠে তাহার মাতাকে অনুজ্ঞায় জানাইল, মা গো, এই সুন্দর স্থানে তুমি এনড্র মারভিলের সেই ‘অন এ ড্রপ অফ ডিউ’, আবৃত্তি কর না, কি মায়াময় স্থান ইহা হয়। যে–একবার বলিলেও মনে হইল সে যেমন বা এক বক্তব্য তিনবার বলিতেছে।

প্রধান শিক্ষয়িত্রী ঐ প্রশংসায়ে ছেলেমানুষ হইয়া থাকেন, সগর্বে ঝটিতি কহিলেন, তোমার আবৃত্তি আমি শুনিব–এবং তখন সুঘরাইকে নিকটে আসিতে দেখিয়া কিয়ৎ তাঁহার সারমর্ম নীতিসূত্র করার বৃত্তি হইতে, খানিক পূৰ্ব্ব-তর্কসূত্রে নিজের যুক্তি প্রতিষ্ঠাকল্পে, অবশ্য ইনি ঈষৎ খুসী ছিলেন যে, মনিব মহাশয় তর্ক নিয়ম অনুযায়ী করিতে পারেন নাই, মাত্র নিজের জাত্যাভিমান, যদি তাহা ব্যক্তিত্ব। হয়, তবে তাহাই ব্যবহার করিয়াছেন, আরও যে তিনি প্রমাণিতে চাহেন,–মনিব পত্নীর নাকছাবিতে হাত দেওয়াতে, ইহা সেকেলে যে তাঁহার নাকছাবি নলক দাগ নাই, আরও, আর যে তাদৃশী বিতর্ক তাহার ভাল লাগিতেছিল; তৎপ্রভাবিত সংজ্ঞাভূত করিলেন,–নিশ্চয় মানিবেন–কোন প্রাণী বিশেষত…এই সব জিনিষ পোষা ভাল নয়…সেদিন যেমন উনি স্বামী বলিতে ছিলেন…মনে পড়িবে।

.

সেই সাঁওতাল নাচের দিবস! আর প্রধান শিক্ষয়িত্রী যিনি বসন্তের হাওয়াকে নির্ঘন্ট্রচিত্তে শাসন করিতে পারেন বেশ তফাৎ আছিলেন।

এই বাড়ীর যেখানে কুঞ্জ গোছের, ছিটকান আলোয় দেখা যায় সাঁওতালরা পুরুষ-রমণী মিলিত সমাবেশ, চুটার ধোঁয়া উখিত, মহুয়া মদ তাহারা যেন চর্বণ করিয়া খাইতেছে! ঘুমন্ত মুরারীবাবু, ঐ শিশুকেন্দ্রিক গুলজার–যেখানে সেখানকার আধ-গ-আপ্লুত স্বর শুনিতে আছেন; কিন্তু উহা ছাপাইয়া–তাহাতে পরিতোষবাবু যিনি তাঁহার স্ত্রীর দক্ষতা বলিতে ক্রমশঃ এশা অর্থাৎ যে পুরুষ, রমণীর রহস্যময় বৈপরীত্যপরতন্ত্র বুঝিয়া মুগ্ধ বিহ্বল; ত্রাস-মিশ্র-শ্রদ্ধায় যে সদাসর্বদা আছে, সেই সেই ব্যক্তির গুমরান ধরনে, তিনি বিশদে বলিতেছিলেন, আমার স্ত্রী, নিজে ভুবনবাবুর মেজমেয়ে, যে ছেলে হওয়ার আগে খুব পাত খোলা চিবাইত, খুব চট সেলাই করিতে পারিত–তাঁহার পরম সুন্দর পুত্র। হইল, এই পুত্রের আঁতুড় দরজার পাশে আমার স্ত্রী নিজ হাতে চমৎকার দোয়াত কলম তালপত্র রাখেন–এই দোয়াত কলম তালপাতা আজও মদীয় গৃহে আছে…হ্যাঁ…রাত্র যখন নিশুতি…এক চমৎকার ফুলের গন্ধে তাঁহার তন্দ্রা কাটিয়া যায়, দেখিলেন এক তেজের মধ্যে বিধাতা পুরুষ! মদীয় স্ত্রী বুদ্ধিমতী, প্রণাম অন্তে জিজ্ঞাসা করিলেন,–প্রভু, মানুষে এত কষ্ট পাইয়া থাকে কেন! বিধাতা পুরুষ কহিলেন–যে সে জন্মায় এই কারণে।

আশ্চর্য্য যে পরিতোষবাবু কদাচ বলিলে বিশ্বাস করিবেন না বা পৃথিবীতে কত কি ঘটে আমরা কি জানি ইত্যাকার বচনে কৈফিয়ৎ কভু দেন না। মদ্যপ মনিব মহাশয় আপ্লুত স্বরের মধ্য হইতে বলিয়া উঠিলেন,–দেখ নৃত্যে জমি কি দারুণ চৌরস হইতেছে, এক অভিনব স্থাপত্যের গড়ন ও ভাঙ্গন পুনর্নির্মাণ হইবে…ডাগর নৃত্য হইবে! সুঘরাই তুমি খুবই ভুল করিয়াছ, যাও পক্ষী লইয়া আইস, সেই এ-ই জাঁকাল নৃত্য দেখিবে। ভয় পাইও না…কুকুর তোমার পক্ষীরে কিছু বলিবে না…।

সরসীবাবু যিনি মামলায়, প্রিভি কাউনসিলে তিনি বা তাঁহারা জিতিলেও, তিনি বা তদীয় পিতা সৰ্ব্বস্বান্ত হইয়াছেন, তাহাদের অট্টালিকার মৰ্ম্মর বিক্রীত হইয়া সুদূর সিংহলে গিয়াছে, বাড়ী ভাড়ার বিনামূল্যে রাবিশ দেওয়া হয় পড়িয়াছেন, এখন বাগান করেন, ইহার নিকট ছিলেন। পরিতোষবাবুই বা। কেহই এক্স-রূপে (X) পরিণত হয় না, সব সময় ইহার নাম উল্লেখ্য; ইনি সেই বিধাতা পুরুষের দুর্বল উত্তরে হাসিলেন, তখনই শিশুকেন্দ্রকে ভাঙ্গিয়া অনেক মহিলাকে দ্রুত পদে যাইতে প্রত্যক্ষ করিলেন। ইনি উদ্ভট অপ্রাকৃতিক, যে অথচ ইনি সুপুরুষ যে এবং একাহারী সংযমী! সকলকেই চিঠি লেখেন।

লোহার গেটের ছায়া গ্রাভেলে, অরকেরিয়ার গাছ হইতে মাগনোলিয়া-গ্র্যাণ্ডিফ্লোরাতে-আঃ মাগনোলিয়া কি অদ্ভুত কৌশলে তাহার পাপড়ী মেলিয়া থাকে–এ কারণ যে এই বাড়ীর গেট আগে-পাছে করিতেছিল! এ কারণ যে একটি সুকুমারমতি বালক, নবম বর্ষীয় যে মাত্র, গেটের পাল্লার সর্বনিম্ন বাতায় পা রাখিয়া, পায়ের দ্বারা ঠেলিয়া দুলিতে আছে, গেটে হাঁসকলের করুণ শব্দ উখিত হইতে থাকে, তৎসহ মাঝে মাঝে অন্য মৃদু সুখবর্ষী শব্দও আছে, যাহা একটি চাবির সংঘাত, যাহা বালকের গাত্রের দোছুটিতে (কাছা গলায়) লগ্ন আছে, যেহেতু কয়েক দিবস হয়, বালকের পিতৃবিয়োগ ঘটিয়াছে। এখন সে এখানে।

উৎসবের মধ্যে যাইতে তাহার বালকের মন সরে নাই, সকলে যখন সমীপে, যখন সকলে আপন আপন উচ্ছ্বাস-উদ্যমের নিমিত্ত সবিশেষ অপ্রতিভ, যখন সকলেই কথঞ্চিৎ বিমূঢ়, তখনও বালক পাল্লাতেই! গরাদের অন্যপার্শ্বে তদীয় দুঃখ-চাবকান মুখোনি বড় সুন্দর, বড় ক্লেশ অন্যদের দিতে ছিল; সকল সম অভিব্যক্তিতে উর্ধে তাকাইয়াছেন, ঐ ইউক্যালিপটসের চামর পাতার আরও ঊর্ধে, পুনরায় দৃষ্টি আনত ইহাদের, সমস্বরে বলিলেন, বেচারী, হায় ভগবান!

একান্তে প্রধান শিক্ষয়িত্রী আতঙ্কিত মনে তর্ক তুলিলেন,–ইহা খারাপ, এই হয় প্রকৃতই নিষ্ঠুর! ছোট ছেলে, দেখিলে প্রাণ ফাটিয়া যায়, এই নির্দোষ শিশুকে এহেন বস্ত্রে…উহাকে দোষী করা…এরূপ করার ঔচিত্য দেখি না…কবে আমাদের দেশ হইতে এই সকল যাইবে। আশ্চৰ্য কোনও ভদ্রলোক নামটা করিব না (মনিব মহাশয়) বলিয়াছেন, আমাকে ব্রাহ্মণ ভোজনে উহারা বলিতে চাহে, আমি নিশ্চয়ই যাইব…কি হৃদয়হীন!

কয়েকজনের, নারী ও পুরুষ সত্যই ঐ লৌকিকতা যে নির্দয়, এমত বুদ্ধি হয়, তাহারা সত্রাসে প্রধান শিক্ষয়িত্রীর প্রতি গভীরভাবে চোখ মেলিয়াছিলেন। তৎকালে গৃহকর্ত্রী যেখানে নাচের আয়োজন, আপনার ঘোর ছাড়িয়া, মধুর স্নেহযুক্ত কণ্ঠে জানিতে চাহিলেন, ও মা তুমি হঠাৎ।

হ্যাঁ আমাদের চাকরটি বোকা কিনা, তাই মা বলিলেন তুই উহার সহিত, ঐ জঙ্গলী ‘স্পিরিট’ কিছুতেই উচ্চারণ করিতে পারে নাই–এই বল ত স্পিরিট! (নিকটে চাকরটি ছিল) দেখুন কি মজা হয়…এই বল না…।

এই সরলতায় সকলেই অত্যধিক শোকে নিমজ্জিত, যে সকলের বক্ষঃদেশ আলোড়িত হইল, আঁখি নিষ্প্রভ ও যে সজল হইল, প্রধান শিক্ষয়িত্রী যিনি আপন উক্তি কারণে এতাবৎ কিন্তুতে, যে তাঁহার কথার সারবত্তা, বালকের চাপল্যে (!) অর্থ-সামঞ্জস্য লাভ করিল, ফলে কপালে বিকার নাই, অবশ্য তিনিও সন্তপ্ত হইলেও তাঁহার কণ্ঠে, ইহা হয় খারাপ, ইহা হয় অমানুষিকতা, আওয়াজে স্ফীত! অথচ ইহা অচিন্ত্যনীয় যে চোরা খুসী, যে ঈদৃশ এক বর্তমান এই শোকচিহ্ন এখানকার ফাজলামি হইতে রক্ষা করিবে, ইহাতে প্রশ্ন যে কঠিন কি তিনি, তাঁহার কন্যাদ্বয় ঈষৎ বিমূঢ় হইয়া তবুও ছিল।

বালকের এক হাত উত্তোলিত ছিল, উহা গরাদ ধরিয়াছিল, সে কহিল, নাচ হবে বুঝি…আমি নাচ বড় ভালবাসি, আমার বাবাও খুব নাচ ভালবাসিত, মাও ভালবাসে আমি ভালবাসি নাচ…নাচ…কতক্ষণ হইবে…রাত্র বারোটা অনেক রাত পর্যন্ত আমি জাগিয়া থাকিতে পারি…।

সকলেই নিম্নস্বরে, ‘বেচারী’ উচ্চারণ করিল।

আবার সকলেই ভারী পদক্ষেপে গেট হইতে ফিরিয়া আসিতেছে; যাহারা বিলিকে ঘিরিয়া তাহারা এহেন পদধ্বনিতে সচেতন, তাহারা ঘাড় বাঁকাইয়া পশ্চাতে নেত্রপাত করে! ইহাদের মধ্যেই জনৈক ভদ্রলোকের হাতের অন্যমনস্কতায় ছড়ির এলেবেলে আওয়াজ গ্রাভেলে সংঘাতে হইতেছে, যুগপৎ আরও অন্যান্য হস্তের ছড়ি লাঠির উৎসাহহীন শব্দ ঘটিল। সহচরীবৃন্দ এই সূত্রে অবলোক নিয়াছে যে নাচের জন্য মাঠ চৌরস করা চলিতেছে, এই ব্যক্তি কাজ করে কপাল হইতে ঘাম অপনয়ন করিল, উহার পশ্চাতে জলপানরত রমণী।

নাচ হইবে। মাদলের আওয়াজ আসিতেছে, মদ চলিতেছে! অভ্যাগতরা সকলেই এখন অনবরত একটি পদ মুখস্থ করিতেছিল, ‘পেট ত ভর’ল মহন ভরল না হে’–ইহা সাঁওতাল সর্দার মাঝি মহুয়া খাইতে খাইতে বলিয়াছে; চিড়া গুড় তাহারা পেট ভরিয়া খাইয়াছে, কিন্তু মদের অভাব! তাই মন ভরিয়া। উঠে নাই।

সাঁওতাল সর্দারের কথা, ঐ সংজ্ঞা ওষ্ঠ হইতে ওষ্ঠান্তরে! বাবুরা উহা প্রতিধ্বনিত করিলেন, বাতাস ভারী হইতেছিল, যে সাঁওতাল রমণী বক্ষবস্ত্র সামালিয়া বাঁকিয়া জল, স্বচ্ছ জল পান করিতেছিল সে। তিৰ্য্যকে চাহিল। সরসীবাবু সম্ভবত মনিব মহাশয়কে উপদেশ দিলেন,–আজ্ঞে এংগসট্রা বিটরস মিশাইয়া মহুয়া আপনি ট্রাই করিয়া দেখিতে পারেন…ভাবা যায় না! এই সেই সরসীবাবু, তখনি অতীব উদ্ভট।

আমার স্ত্রী, মহাশয় বলিয়াছি ত, একপ্রকার উন্মাদ, সেইবার শিমূলতলায় এক কাণ্ড ঘটে, আমাদের। বাড়ীর পাশেই নাম বলিব না এক সত্ৰাহ্মণবংশীয় ভদ্রলোক বাস করিয়াছিলেন, তাঁহার এক কন্যা মাত্র পঞ্চদশবর্ষীয়া, সে পরমাসুন্দরী রাজার ঘরে পড়িবার মতই, বিবাহের চার মাসের মধ্যে সে শাঁখা ভাঙে, এবং যে এই কন্যার দুঃখে দুঃখিত হইয়া তাহার মাতাও পান ও মৎস্য যাবতীয় বিলাসাদি ত্যাগ করেন। বেচারী সত্যই হতভাগিনী! পুত্রসম্ভবা ছিল। পুত্র জন্মিল, আশ্চৰ্য্য এগারো মাস সাত দিনের দিন, আমার তখনই বিশ্বাস ধ্রুব হইল, এ কোন মহাপুরুষ! আমার স্ত্রী খালাস করিবার পরে কাঁদিতে কাঁদিতে বাড়ী আসিলেন, তাঁহার মুখে, কি দেখিলাম কি দেখিলাম, শুধু এই কথা ছিল। তখন রাত্র অনেক, আমি কুয়ো হইতে জল তুলি, তিনি স্নান করেন, এই জল ধারার মধ্য হইতে জ্ঞাপন করিলেন–মহাপুরুষ! নবজাতক এক মহাপুরুষ আমি দেখিয়াছি কপালজোড়া হীরা জ্বলজ্বল করিতেছে, আহা আমি মধু দিয়াছিলাম, হায় তিনজন যমদূত আসিল, আমারে ধাক্কায় দূরে সরাইল! সময় পার-হওয়া (দশমাস দশ দিনের পর জন্ম) সন্তান যতই শ্রীমণ্ডিত হউক, ব্রাহ্মণ ভদ্রলোক ঘরে রাখিতে ভরসা পান নাই। আমি, মহাশয় জানি, তিরিশ এগারং তিনশো তিরিশ প্লাস সাত, তিনশো সাঁইতিরিশ, এইবার আসুন তিন তিন সাত হইল, এইবার যোগ দিন। কত? তেরো! তেরো দারুণ শাস্ত্রসম্মত পয়া শুভ সংখ্যা! মহাপ্রভু নিজেই…আচ্ছা…আমার স্ত্রী ঐ যমদূতের পশ্চাতে ছুটিলেন, ঐ যমদূতরা বনেতে যখন হাঁড়ী রাখিল, যমদূতগুলি বিস্ময়াবিষ্ট হওয়ত দেখিল, হাঁড়ীর সরা আপনি খুলিয়া গেল, দেখিল যে; মণিময় এক শিশু উঠিয়া দাঁড়াইল; দেখিল যে, ঐ তাহাদের মানে যমদূতদের প্রতি মৃদু হাসিয়া অনেকানেক রকমের আলো বিকিরণ করত গভীর বনের মধ্যে।

সহচরীবৃন্দ তখন নৃত্য অঙ্গন প্রস্তুতি দেখিয়া পুনৰ্ব্বার বিলির দিকে; যে এবং শ্রদ্ধায় গম্ভীর হওয়ত এতাদৃশ অভিব্যক্তিতে একে অন্যে নয়ন মেলিয়াছে, যাহাতে বলিয়াছে, আমরা লাভ ম্যারেইজ শুনিয়াছি, আমরা বিলিকে শুনি নাই।

আঃ বিলি আশ্চর্য্য, বিলি আশ্চৰ্য্য, বিলি আশ্চর্য্য। উহার জন্য যে যে যুবক আত্মহত্যা করিয়াছে, আঃ বিলি! আত্মহত্যার খবরে বিলি হুঙ্কার দিয়াছে, প্রেমকাতর মাজ্জারের ন্যায় তাহাতে স্বরভেদ পরিলক্ষিত হইয়াছে, পুলিশ ইন্সপেক্টার বলিয়াছে, ডেপুটি কমিশনার এইচ. কিউ. তোমাকে দেখিতে চাহেন, তুমি নিদারুণ! ইংরাজ ডেপুটি কমিশনারের সিগারের ধোঁয়ায় বিলি অস্বস্তি বোধ করে নাই, কেননা সে হয় কালচারড তাহারে দেখিয়া ঐ ধোঁয়া নিপট হয়, তিনি বলিয়াছেন…পর পর আত্মহত্যা! বিলি তুমি ব্যবিলন…অন্তত অশোকের সময় ফিরিয়া যাও! এ শতাব্দীতে তুমি অত্যধিক, বিলি বিলি বিজ্ঞান আমাদের বিস্ময় অপহরণ করিয়াছে! জীবনধারায় এমন কোন কূট-আতঙ্কও নাই। আমরা গোবেচারা। তোমার মযাদা আমরা দিতে অপারগ!

আঃ লাভ ম্যারেজ আমরা শুনিয়াছি, আমরা কখনও বিলিকে শুনি নাই! একাবলী ছন্দে ঈদৃশী বাক্য বলিতে, সাবেক পরিবারের কুমারীগণ, তাহারা এক উপত্যকায় গিয়াছে এবং হর্ষ পুলকিত।

ওগো পুণ্য নগরী কলিকাতা। গঙ্গা বিধৌত শ্ৰীশ্ৰীকালীমাতা আশ্রিত, ভগবান রামকৃষ্ণ পদ-ছোঁওয়া তুমি, ধন্য নগরী কলিকাতা! উচ্চবর্ণের অভিজাতবর্গের কলিকাতা। বিলিকে দয়া করিও, আর যে প্রকৃতিরে অনুনয় করিও, সে যেন বিলির প্রতি দয়া রাখে।

এই সেই সরসীবাবু, যাঁহার মুখমণ্ডল ভাসা-ভাসা ভাগবৎ পাঠকারীকে বিদ্রাবিত করিবে, অবশ্য যদি নিম্ন স্থানাৎ আলো আসে। ইনি মুরারীবাবুকে দেখিলেন। তখন মুরারীবাবু তেমনভাবেই ঘুমাইতে আছেন, যদি ঘুম ইহা, যে, কোন মুহূর্তেই অথচ উঠিয়া ইনি হাসিয়া কহিবেন, আমি জাপানের সূৰ্য্যবংশীয় রাজপ্রাসাদ অন্তর্গত খিড়কির বাগানে জাফরান পদ্ম ফুটিতে দেখিয়াছি, আহা হরিদ্রা! তোমার মননে আমার চক্ষু জলভরা হউক। অয়ি আমার মহত্ত্ব। যে এবং আশপাশে দৃষ্টি সঞ্চারে ইহা তাহার অনুমান হইবে যে নাচ এখনও আরম্ভ হয় নাই।

আর যে পর্য্যবেক্ষণ করিবেন অলোেকা তেমনই ভাবে দণ্ডায়মানা। এবং যে অন্য ধারে, শালা রাজনৈতিক-কবন্ধ, শালা, যে ক্রমবর্ধমান জাতীয় চরিত্র, যে রুমাল বিন্যস্ত করিতেছিল, ইহারই এই ব্যক্তির কারণে, এই ছোট ধরিত্রীতে, অনেক রমণী অনাদৃতা হইয়াছেন! ইহার লালা-মিশ্রিত বলদ হাসি হাসি কীদৃশ নীচযান! সেই দুৰ্বত্তের শব্দাবলীতে কথাতে নারী, জাতি, শোষণ শব্দ আছে, সে ভাবে অভিজাতরাই গোঁড়া অপ্রাকৃতিক এবং সে নিজে ভূত বিশ্বাস করিলেও, ভগবান নাই, ইহা জানে!

এখনও নাচ আরম্ভ হয় নাই; রাজনৈতিক কবন্ধ ক্রমশঃ বিকলাঙ্গ হইতেছে! সাঁওতালগণের চিড়া খাওয়া দর্শনে তাহার জিহ্বায় জল আসিল, অথচ এই ব্যক্তি প্রতি প্লেট হইতে কিছু না কিছু খাইয়াছে, বলিয়াছে অপচয় অন্যায়। এবং আড়দৃষ্টিতে দেখিল, সে সাঁওতাল রমণীদের সান্নিধ্য চাহিতে ছিল।

.

ঐ সেই সরসীবাবু, যিনি স্যার পি’র বহু গল্প জানেন: দেওঘর স্টেশনে স্যর পি’র খাস বেয়ারা আবদুল হাতের ঘড়ি দেখিয়া কহিল, মেরী বাবা (অলোকা) টায়েম হইয়াছে, আমি কি হুজুরকে ঔষধ দিব। কেননা স্যর পি…স্নায়ু পীড়া-গ্রস্ত; ইনি বুনো ফুল ফুটুস গাছের সমীপে বহুসময় যাপন করেন, কেহ তাঁহাকে বলিয়াছে উহার গন্ধ স্নায়ুকে সমতা দেয়। যে ঐ দিবস দেওঘর স্টেশনের ফার্স্ট ক্লাশ বিশ্রামাগারটি আর এক রূপ ধারণ করিয়াছিল, খসখসের টাটু পর্যন্ত টানান হয়; এখন অসময়; রেলওয়ের কর্মচারীবৃন্দ হন্তদন্ত। ইতিমধ্যে মাস্টার মহাশয়, অপরাধী যেমন, আসিয়া কাহিল স্বরে জানাইলেন,–স্যর গাড়ী এখনও মধুপুরে পৌঁছায় নাই! বুঝিতে পারিতেছি না…এবং ইনি টেলিগ্রাম যন্ত্রের শব্দের জন্য এই স্থান হইতে উৎকর্ণ থাকেন। অলোকা তাহার পিকিংগীজ লইয়া না-জ্বালা টেবিল আলোর গোলাকার কাঁচে আপন প্রতিচ্ছবি লক্ষ্য করিতে আছে, এখন তাহার আতঙ্ক নাই, সর্পভীতি নাই, এখানেও তাহার আকৃতির কোন বিচ্যুতি নাই! ইহার দরুণ প্রতিচ্ছবি মজা-উদ্দীপক হইল না, সে মাস্টার মহাশয়ের কথা শুনিয়া তাঁহারই দিকে অসহায়ভাবে চাহিল, পিতামহকে দেখিতে তাহার জোর ছিল না, কেন না তিনি বেচারী যারপরনাই অধৈৰ্য্য; গোলাপের কলম তাঁহার বিদেশ হইতে আসিয়া কলিকাতা বন্দরে আসিয়াছে, কয়েক রাত্র তাঁহার ঘুম ছিল না; গোলাপের কলম হাওড়া ছাড়িয়াছে তাঁহার ঘুম হয় নাই; এখন এই স্টেশনে পৌঁছিবে, তিনি গোলাপের কলম লইতে আসিয়াছেন।

সরসীবাবু সেই অভিজাতকে অপেক্ষমাণ দেখিয়াছেন। ঐ স্যর পি…মহানুভব, ঐ স্যার পি…শান্ত। প্রকৃতির! ইহাও সরসীবাবু বলিতে পারেন।

.

একদা মনে পড়ে আমাদের লেখকের বাড়ীতে আমার বাবা, অনন্যোপায় বেড়া নিমিত্ত অনেক লেডি হ্যাঁমিলটন ও মার্শল নীলের কাটিং রোপণ করেন, কালে সেগুলি ঝামরাইয়া উঠে। সেবার রিখিয়ায় আসিয়া এই সংবাদে স্যর পি…ম্রিয়মাণ; তিনি বেড়ার অন্যধারে থাকিয়া জানাইলেন, ইহা অন্যায়।

আমার বাবা উত্তর করিলেন,–মহাশয়, মুঘোল বাগিচায় এরূপ ব্যবহার আছে!

তিনি সলজ্জভাবে বলিলেন, তাহারা যাযাবর জাতি ছিল, খুনী ছিল! আমার বাবা তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিলেন, শুনিলেন স্যর পি’র কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হইল, ইহার কাঁটা আছে ইহাই জানিয়াছেন, আমি ভাবি আপনি শুধু, হায়! জানিলেন গোলাপের কাঁটা আছে…ইহা লিখিত থাকিবে! স্যর পি…অতীব দীপ্তিশীল, আবার নিষ্প্রভ কেননা মানুষের দুঃখ হইতে দুঃখতর দুঃখ তাঁহাতে আছে!

.

এখন নাচ হইবে।

মনিব পত্নী উতলা হওয়ত স্বামীকে বলিলেন,-হতভাগা এখনও এল না (সুঘরাই) তুমি ত তাকে…তোমার মাথায় যে কি চাপে…পাখী আনতে বললে! এই অন্ধকার রাস্তা!

মনিব মহাশয় আপন পত্নীর বাক্যে কিছু আশ্চর্য্যে থাকিয়া কহিলেন, তোমার মনে পড়ে, আনা পাভলুভা কে…ওঃ তাহার প্রবেশ মনে পড়ে? সব থেকে আমাদের বিরক্ত করিতেছিল, সেই আলোর ছটা যাহা সারা প্রেক্ষাগৃহ পার হইয়া আসিতেছিল,…(ওল্ড) এম্পায়ার ত…প্রজেকশ্যন রুম হইতে আলো আসিতেছিল তাই। কিন্তু ষ্টারে ব্যবস্থা আর এক, কর্ণাৰ্জ্জুন নাটকেনরেশবাবুর হাতে, মানে শকুনির হাতে, সেই অব্যর্থ পাশায়…কাহার হাড় যেন। কি আলো! আজও মনে আছে। হ্যাঁ তুমি কি। পাগল হইলে; অন্ধকারেই উহারা ভাল দেখিতে পায়…সে কি চেঞ্জার! নিশ্চয় হারামজাদা খাঁচাটি। সাজাইতেছে…নাচ আরম্ভ হইবার আগেই সে আসিবে।…আমি আনা পাভলুভার নাচ কলিকাতাতে দেখি…সমস্ত প্রেক্ষাগৃহ ঐভাবে, সেই হাঁসের ন্যায়, মরিতে চাহে…।

.

সদ্যোজাত শিশু না কাঁদিলে সকলেরই, ধাত্রী হইতে গৃহস্থের মহা দুশ্চিন্তা উদ্বেগ হয় ত, সেবার আমার স্ত্রী নবজাতক কাঁদে না দেখিয়া, কান্দিল না দেখিয়া, সন্নিহিত ধাত্রীকে কহিলেন, এই জাতক না কাঁদিলে বাঁচিবে কেমনে; না কান্দিলে…রহ, আমি চপেটাঘাত করি। সে কান্দিল! সে বাঁচিবে।

শ্রোতারা সকলেই সেই প্রহেলিকাময়ী ধাত্রীবিদ্যা পারদর্শিনীকে, যিনি এই নৃত্যজমায়েতে তাঁহাকে, এখন অদূরে আছেন, দেখিল।

মনিব পত্নী মহা উৎসাহে প্রকাশ করিলেন, দেখ ঠিক এমনিতারা আমরা কলকাতায় এ্যাট হোম দেব (!) কি বল? এমনি চেয়ার তক্তাপোষ টুল ইজিচেয়ার মোড়া বেঞ্চ এই রকমই পাথর থেকে চায়না, কাঁসা, জার্মান সিলভার, রূপার ডিস, মাটিরও কিছু গেলাসও…এ্যাট হোম দেব.পেলমেল…কি বল? খুব মজা হবে না!

এবং পরক্ষণেই মনিব পত্নীই কহিলেন, উদয়শঙ্কর দারুণ না! নিরাশা নামে এক নাচ, মনে পড়ে, কি লিরিসিজম, সবসময়ে আমার মনে হইয়াছে মিউজিক হ্যাঁণ্ড একটু বেশী হইলে বড় ভাল হইত…!

মনিব মহাশয় তদুত্তরে বিস্ময় প্রকাশে সমর্থন করিলেন,–যথার্থ, সত্যিই উদয়শঙ্কর একটি আনন্দ, পারকাশ্যনকে লীলায়িত, মানে অন্য যন্ত্রে…নৃত্যের রেখা আর বাদ্যধ্বনি রেখা কোথাও এক মানে…আরে আসুন…অবশ্য আমি যদিও গৃহস্বামী নহি…।

মনিব মহাশয় যাঁহারে অভ্যর্থনা করিলেন তিনি দাশ মহাশয়, প্রধান শিক্ষয়িত্রীর স্বামী, ইহার হস্তে ছড়ি, মাথায় ছাতা, গলদেশে কম্পাটার, অথচ কেহ খুব কিছু মজা পায় নাই, এমনও যে অল্পবয়সীরাও নহে, যে মেয়েটি পুরুষের পোষাকে–তাহার বয়ঃক্রম দ্বাদশ হইবে, তাহার পায়ে ডারবি জুতা, তাহার পরনে ধুতি–ইহা মালকোঁচা দেওয়া, তাহার সিল্ক-টুইলের সার্টের উপর ওপব্রেষ্ট কোট, তাহার কানে মাকড়ী, তাহার নাসার পুটে পাতলা-রিঙ, যে এবং তাহার দুই দিকের বেণীশেষে চমৎকার গোলাপী ফিতা…! ইহার ভাই নাই তাই ঐ বেশ, এই প্রকার পুরুষবেশী কিশোরী শুধু অবাক হইয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া অতীব গ্রাম্য চাহনিতে দাশ মহাশয়রে নিরীক্ষণে ছিল। যে অথচ এই পুরুষবেশী কিশোরী নাক। কুঞ্চিত খ্যাঁদা করিয়া হাসিতে পারে, কপোলে টোলের উদ্ভব হয়; এক ঘটা! সে হাসে নাই, যে ইহাতে দাশ মহাশয়ের কোন হেলদোল আসে না, তিনি খোলা ছাতার কারণে অনুমতি লইলেন না, কেন না তাঁহার ইত্যাকার অভ্যাস সকলের চোখ-সওয়া!

মনিব মহাশয় পুনরায় খেই ধরিলেন,–আঃ নাচ কিভাবে যে মায়া করে!…ভাবিতে থাকিলে আমরা। বিন্দুবৎ…ষ্টেজ কি সৃষ্টি, ষ্টেজ কি দারুণ সৃষ্টি!…আপনি নাচ ভাল নিশ্চয়ই বাসেন…! ঐ যে উহারা…ঐ দল দারুণ নাচে…নানাবিধ পশুপক্ষীর ডাক শুধু সঙ্গে করিয়া আনে নাই…মানে পারে নাই, যাহা মাদল, তিন ফুটো বাঁশীর টান যোগাইয়া থাকে…তবে আনা পাভলুভা উদয়শঙ্কর ছাড়াই আমাদের ইহা ভাল লাগিবে।

দাশ মহাশয় অত্যধিক গাম্ভীৰ্য্য ধারণে সম্মতি জানাইয়া, এখন নৃত্যের জমি চৌরস দেখিলেন, কেহ জল ছিটাইতেছে, কেহ মাটি পেটাইতেছে দুরমুস দ্বারা, ছাদ-পেটাই দিয়া। আর যে ইহারই পশ্চাতে অনেক সাঁওতালী মেয়ে, তাহাদের হাস্যে যেমন বা আলো যেমন কম, আরও পশ্চাতে তখন হাড়িয়ার ভাত লাল গামছাতে ছাঁকিতেছে পুরুষেরা, মেঠো-ইন্দুর চকিতে চলিয়া যায়!

ইন্দুরগুলি উহাদের ডরায় না। এই অপ্রত্যাশিত সংস্থানের সহিত কখনও তাঁহার, দাশ মহাশয়ের পরিচয় নাই, বিদেশীর ন্যায় তিনি চাহিয়াছিলেন, একবার বিদ্যুতে খেলিয়া গেল, ইহারা নাচিবে! ততঃ দূরাগত শিয়ালের ডাক তিনি শুনিয়াছেন, এবং ছাতার নির্জনতায় তিনি স্বতন্ত্রই এযাবৎ; এখনও তাই; এইবার স্বেচ্ছায় আপনাকে মনেতে সঙ্কেত-আজ্ঞা দিলেন,নাচ হইবে! তন্মুহুর্তেই বোঙ্গা উপাসক (সাঁওতাল দেবতা) হইতে তাঁহার নিজের অদ্ভুত পার্থক্য যে তাহাই পরিষ্কার হইতেছিল।

পরক্ষণেই অল্প বাদেতেই দাশ মহাশয় সরসীবাবুকে আবিষ্কার করিয়াছিলেন। এই সেই সরসীবাবু, যে যিনি উদ্ভট, যে যিনি ত্ৰাসদায়ী। চেঞ্জারদের সহিত, স্বভাবতই আলাপ হঁহার হইয়া থাকে, আর যে যখন চেঞ্জাররা চলিয়া যায়, তাহাদের বিষয়ে তাঁহার দিব্য দর্শন সকল অন্যকে ইনি পোস্টকার্ডে জানাইয়া থাকেন; কোথাও লিখিয়াছেন, আপনাদের উনুনটি ভালভাবে ভাঙা উচিত ছিল, বলিয়াছিলাম বাড়ীটি। ভাল নয়, এই সেই দিন দেখিলাম আপনার স্ত্রী আঁচল কে যেন কাটিতেছে; কোথাও, হঠাৎ সন্ধ্যা স্পষ্ট দেখিলাম আপনি কাহাকে যেন দরজা খুলিয়া দিলেন, সেই লোকটির, আশ্চর্য্য দেখিতে সৰ্ব্বাঙ্গ ব্যাণ্ডেজ; কোথাও, অনুরূপ দর্শন ১৯২৮ হয়, আবার দেখিলাম, যে তুমি আমায় বলিলে, আমায় সি-অফ করিতে যাইবেন নিশ্চয়ই!

সুতরাং ঐ সরসীবাবুকে অবলোকনেই স্বতঃই ইহা তাঁহার মনে হয় যে, উহাকে কোন পর্যায়ে ফেলিবেন, এ কারণ যে তাঁহাদের জীবনধারা এক সূক্ষ্ম সমালোচনা হইতে উদ্ভূত, সমালোচনা তাঁহার অবলম্বন, যে কুসংস্কার তাঁহার নাই; সুতরাং পত্রের বিষয় তাঁহার আলোচ্য নহে, শুধু স্বল্পপরিচিতকে পত্র দেওয়া তাঁহাদের শিষ্টাচার বহির্ভূত; যে উহা সহবত-রহিত; আবার তৎক্ষণাৎ তিনি নিজেকে সংশোধন করিলেন, যে বিশেষ প্রয়োজন না হইলে উচিত নহে এমত পত্র দান করা। অথচ তিনি যে সরসীবাবুকে এই প্রথম দেখিতেছেন এমন নহে, যে তিনি তির্যক দৃষ্টিতে লক্ষ্য করিলেন সরসীবাবু অতীব স্বাচ্ছন্দ্যে এক প্রলম্বিত হাই তুলিলেন। এই স্মরণের পর যে এবং দাশ মহাশয় স্বগত বলিলেন,-উহারাই নাচিবে।

.

সদ্যপ্রসূত শিশু, ইহা বালক, কাঁদে নাই, অত্যাশ্চর্য্য হুঙ্কার দিয়াছিল সে ঘোর গোলাপী বর্ণ হইতে, পুরীতে, সমুদ্রে, প্রথম উদিত দিবাকরের প্রায় লাল হইল, সহসা লণ্ঠন নিৰ্বাপিত আপনি! শিশুর দেহ হইতে ধূম বাহির হইল, সে নীল হইল, সেই শিশু শুধুমাত্র একটি মাত্র চক্ষুতে রূপান্তরিত পরক্ষণেই এক ত্রিকোণ বস্তু! আবার সে একটি হাত, কখনও বা একটি পা মাত্র, কখনও এক কলম; ধাত্রী চীৎকার করিল,–আরও লণ্ঠন, কি বিভীষিকা দেখ, প্রসূতির স্তন কি বিরাট হইতেছে, কি বিকট হইতেছে দুগ্ধস্রোত বহিতেছে, শঙ্খ বাজাইতে নিষেধ কর। শিশু আপন বক্ষদেশ ফাড়িয়া দেখাইল, হৃদয় নাই; কহিল,–যাহা দেখিলে তাহা সত্য, মানুষ ইহাই, তাই আমি মাতৃগর্ভ হইতে তাকাই। গৃহস্থেরা আসিল,–দেখিল সেই রূপান্তরের পুনরাবৃত্তি ঘটিল, এবং কহিল,–ইহা সৰ্ব্বনাশা, দাও ইহারে, ইহারে আমরা মাটি চাপা দিব: সেই দিবস ঝাপান ছিল, মাঠে অনেক সন্ন্যাসী–ইহা কুড়মুনের কাছে এক মাঠে ঘটে, জিলা বর্ধমান…তাহারা অন্ধকারে মৃত শিশু খুঁজিতেছিল, ঐ শিশু দর্শনে নানাবিধ রব তাহারা করিয়া উঠে, শিশুটিরে ছিনাইয়া শূল শীর্ষে বিদ্ধ করিয়া নাচিল, প্রমত্ত হওয়ত নাচিল–যে তাহারা সিদ্ধ হইবে…মেমারী আগত পুত্রহীনা বেশ্যা সনাতনী ঐ শিশুটি চাহিয়াছিল, কারণ সে তাহার অভাব পূরণ করিবে। ইহাতে দুই দল হয়, তাহারা মারপিট করে–আর সকলে অন্যেরা নাচিতেছিল।

.

মনিব মহাশয় ধীর কণ্ঠে উত্তর দিয়াছিলেন,–এত উতলা হইবার কারণ নাই, সে হারামজাদা হয়ত পাখীটিরে সাজাইতেছে…বেচারী বড় দুঃখিত হইত…এই নৃত্য একমাত্র সে আর সেই পক্ষীরই দেখার উপযুক্ত, তাহাদের ভুল হইবে না–আমরা অনেক কিছু ভাবিব তবে দেখিব…এই নৃত্য যে কোনও ধ্বংসাবশেষকে দুর্লভতা দিবে…সে যদি একা দেখে বড় ক্লেশ পাইবে!…এ নাচ দারুণ, এ নৃত্য দারুণ হইবে।

মনিব পত্নী কহিলেন, মেরীকে তুমি ডেকো…কি যে এরা ছাই স্বাধীনতা স্বাধীনতা করে চেঁচায়, মরণ!

কাছেই একদল নানা বয়সী পুরুষ ঘোর তর্ক করিতেছিল, নিয়ত বাঙালী, বাঙলা দেশ, রিট্রেঞ্চমেন্ট, চরকা–একটা হোক্স, শব্দ উৎসারিত হইতেছিল যে সকলেই তর্ক জয় ইচ্ছুক, ইহাদের উৎসাহে জাতীয়তাবাদী দৈনিক পত্র-এর প্রচারসংখ্যা ক্রমবর্ধমান, যে ইহারা দেশ-প্রেমে ক্লান্ত হওয়ত এখন হাওয়া বদলাইতে আসিয়াছে। এই দেশাত্মবোধের মধ্যে রাজনৈতিক-কবন্ধ ছিল না! কেন না এনারকিষ্ট দীননাথ এখানে, সে বড় বালাই। এহেন ঘোরতর বাগযুদ্ধে মুরারীবাবু চোখ খুলেন নাই, তিনি স্বাধীনতায়, যে এবং তাঁহার হৃদ্বয় কুঞ্চিত নয়, নিশ্চয় বিরাট কোন সিদ্ধির জন্য আরও গভীরে তিনি আছেন। এক সময় তিনি ঘোষণা করিবেন, আমার আমিত্ব কি দুস্তর, কি বিচিত্র! আমি স্বাতি নক্ষত্রে যে জল তাহাতে গৌরবান্বিত হইলাম, তোমরা আমারে আরও খানিক মগ্ন থাকিতে দাও, আমি তোমাদিগকে অনেকবিধ আশ্চৰ্য কথা বলিব!

.

ডেপুটি কমিশনার এইচ. কিউ তাঁহার মোম চর্চ্চিত গোঁফ, তিনি দারুণ জবর পিগ ষ্টিকার একজন, তাহার নেত্র বীরতুল্য, তাঁহার বুটের আওয়াজ অধস্তনদের স্মরণে! তিনি সিগার-এর ধূম ত্যাগ করিতে, ধূমবৃত্ত উদ্ভূত হইল, কহিলেন, বিলি তুমি বিস্ময়কর, তোমার উচিত ছিল…কি ক্রেজি আমি…যেহেতু বালুকার বৈভব দিয়া তুমি নিৰ্ম্মিত, তোমাতে অন্ধকারের অ নাই। সূৰ্য্য উপাসনা হইতে পৌত্তলিকতা এবং বিমূর্ত মানসিকতার যখন সবেমাত্র সঞ্চার, বাস্তবতা যখন প্রহেলিকা, তাহার ইতঃমধ্যে লহমার কোনখানে ডাগর দাম্ভিকতায় তুমি খেলা করিতে পার!

হায় এ শতাব্দীতে মারাত্মক যুদ্ধ ঘটিয়াছে, এ শতাব্দীতে, বলিতে কি, রমণীর কোন প্রয়োজনই নাই! তুমি নিরর্থক, তোমার বাম বক্ষস্থিত কৃষ্ণপক্ষ রাত্রির, স্বেদবিন্দুতে অপুত্রকের পুত্র হয়, তোমার দক্ষিণেরটিতে শুক্লপক্ষীয় স্বেদবিন্দুকে, নদীসমূহে বন্যা দেখা দেয়, দেশান্তর হইতে আজব পক্ষীতে তোমার উন্মাদনা আছে, হায় আমাদের কাহারও নিকট সেই মুক্তামালা নাই যে তোমারে প্রীতিভক্তিতে প্রণামী দিব, যে এ পর্যন্ত যাহারা তোমার শুভ নামে আত্মহত্যা করিয়াছে, সেই তাহারাই তোমারে সৰ্ব্বদা অদৃশ্য থাকিয়া রক্ষা করিতেছে, তাহারা তোমার নামে আত্মত্যাগ করিতে, বহু তরুণকে প্ররোচিত করিতেছে–তাহাদের শেষ–পত্রসল তোমাকে, যদ্যপি আইনবিরুদ্ধ, আমি তবু দিব!…যে হয়ত উহা সকল তোমার উন্মাদনাকে খুসী করিবে…কি ক্রেজি আমি…বিলি তোমাকে আমরা দেখিলাম যে বিলি তুমি অপরিসীম টেররিফিক (বিলির উচ্চারণে) তুমি…তোমার কারণে পুলিশ রিপোর্ট বলে, তোমার কারণে ম্যাডাল্স স্কোয়ারে সেদিন সন্ধ্যায় রক্তাক্ত জঙ্গ হয়, তোমার জানলা হইতে তুমি দেখিয়াছ, দুইপক্ষ সকলে উদ্বুদ্ধ হইয়া খরতর লড়াই করে, কত হকিস্টিক ভাঙ্গিল, কত ইলেকট্রিক তারের চাবুক চালনার শব্দ সাঁইসাঁই হইল, পাঞ্চ ব্যবহৃতও হয়, কে একজন পার্কের ফরাশের (যে গ্যাস জ্বালে) মই লইয়া রণস্থলে আসিল!…ইহা কিছু নয়, একটি জাতিকে উচ্ছন্ন দিবার সম্ভাবনা তোমাতে…ইহা, এতাদৃশ বাক্যে খাঁটি ইংরাজ ডি. সি-র আধা নীল চক্ষুদ্বয় সুনীল হইল।

…দেখ দেখ ঐ সাঁওতাল কি পৰ্য্যন্ত আনন্দের! কি বাঘেরা!

শ্রোতৃবর্গের কণ্ঠ শুষ্ক হয়, তাহারা পুরাতন প্যাটার্নের অলঙ্কার, যথা, মটরমালা, মপচেন ইত্যাদির নিমিত্ত খানিক মৌন, তাহারাও সাঁওতাল দেখিল। এ সাঁওতালগণ বহু জনপদবধূর রাত্র আত্মসাতে কালো!

একটি শিশু কি অফুরন্ত তাহার চেহারা, যে কাজলকে, নিজ চক্ষুস্থিত, নৈনেত্তর করিয়াছে, তবু কি মধুর। শিশু হস্তীর প্রায় ছুটিয়া আসিয়া দাশ মহাশয়কে জানাইল,–মেতমতাই নমচ্‌কাল…মেতমতাই নমচ্‌কাল (নমস্কার)।

সহচরীবৃন্দ কহিল,–আমরা লাভ ম্যারেজ শুনিয়াছি কিন্তু বিলিকে কখনও শুনি নাই। অদ্য প্রাতে ভ্রমণরত বিলিকে আমরা দেখিয়াছি, তাহার পথের সম্মুখে কয়েক তরুণদের আগমন, বিলি শুধু মাত্র ফুৎকারে তাহাদের বিশৃঙ্খল করত কহিয়াছিল,যাও এক ফুৎকারে তোমাদের উড়াইয়া দিলাম। সত্যই তাহারা ছিন্নভিন্ন মেঘের ন্যায় হইল। যে এখন সহচরীদের বিস্ময়োক্তি ও ঐ যে শিশুকথিত পদবন্ধ অবাক মিশ্রিত–দুই পক্ষের এক এক শব্দ কখনও পাশাপাশি–সুতরাং এক অদ্ভুত ভাষার কথার সৃষ্টি হয়।

এক কাশি শব্দ শ্রুত হইল, আর আর প্রসব-বৃত্তান্ত সূচিত হইয়াছিল, আর স্বরে, পুনরায় ধ্বনিত হইল,–আমার স্ত্রী জন্ম সম্পর্ক নেশার দরুণ এক এক কুহক ঘটনা জানেন, আমি জানি, তিনি আমায় অনেক গুহ্যাতিগুহ্য অভিজ্ঞতা, তত্ত্ব, বলিয়াছেন, যে তাঁহার হস্ত নাড়ী কৰ্ত্তনের মুহূর্তে ঝনাৎ শব্দ করিয়া উঠে, তাঁহাতে দিব্য দৃষ্টি উপজাত হয়, যাহার বলে তিনি প্রত্যক্ষ করেন, ঝরণা, মৃত্তিকা, উদ্ভিদের ঈশ্বরী জাগ্রত, সৌরজগত বিচ্ছিন্ন হওয়ার অনৈসর্গিক শব্দ উহা–ঐ ঝনাৎ, তাহার শরীর এক অভূতপূর্ব দশা প্রাপ্ত হয়, মনে হয় তৎক্ষণাৎই তাহার বিবাহ ও স্বামী পরিচিত হইল, ধ্রুব যে তদীয় দেহে অন্য মনোরমত্ব উপচাইল!

তিনি বলেন,–কোন আসক্তি নাই আমাতে, পরে খেদ হয়, হায় মায়া! কোথায় আমি…(হঠাৎ গলা ফিরাইয়া) ভাল আছেন স্যার, এই এমনই গল্প হইতেছে…হঁহারা কত বড় ঘর! ভঁহাকে স্যার বলিলে আমি ছোট হই না, কোন অন্যায় হয় না…হ্যাঁ বলিতে ভুলিয়াছি, ঐ শালা…এমন চেঁচাইতেছে…দেশ যে উদ্ধার হইল…তাহাতে আর ভুলিব না!

হ্যাঁ একবার আমার বড় সাধ হয় যে আমিও ঐ রূপ মদীয় স্ত্রীর মতন অনুভব লাভ করি, তাহাকে আমার মনোবাসনা বলি, একদিন তিনি ছুটিয়া আসিলেন, তাঁহার কেশভার রুক্ষ অঞ্চল মৃত্তিকায়ে, বসনে রক্তচিহ্ন, হস্তদ্বয় আঠা আঠা, তিনি যেন সন্ন্যাসিনী, চক্ষুদ্বয় প্রজ্জ্বলিত দিব্য,…আমি ঘড়িতে দম দিতেছিলাম–তদ্দর্শনে ঘড়ি রাখিলাম, আঃ সেই হাত আমায় স্পর্শ করিল, সেই স্পর্শ ও গন্ধে এক মহাদুৰ্ব্বিপাক, এক দণ্ডকারণ্য, এক মানস-সরোবর, তাতাথৈ দিয়া উঠিল, এক হংস হত্যা হইল, এক হংস জীবিত হইল, আমি স্রোতাঘাতচকিত নুড়িবৎ, আমি পিপীলিকাবৎ, আমি মেঘবৎ, আমি ব্যাঘ্রবৎ, আমি বিদ্যুৎ, এই প্রথম আমি পুরুষ হইলাম! তাঁহার হস্তগন্ধে আমার চেনা-চেতন সমাসীন হওয়ত অট্টহাস্য করিল! বহির্জগৎ নিৰ্বাপিত হইল। ক্রমে শুনিলাম মদীয় স্ত্রী সন্ন্যাসিনীরূপে খেদোক্তি করিতেছেন, হায় আমি রমণী নই!

এই উক্তি ক্রমশ সকলের, যে যাহারা এখানে, যে যাহারা, ইতস্তত, সকলের অগোচরেই আপন আপন ত্বকে, অন্তরে, কন্দরে সর্বত্রেই অনুরণিত হইল, তৎপ্রভাবে, যুগপৎ সকলেই অনলাকার প্রতি, যে দিব্য প্রভাময়ী, যে অভিজাত, সৌন্দর্যে ময়ূর, যে বিশুদ্ধ, যাহাকে একমাত্র শিশু কিশোররা কামনা করিতে দ্বিধা করে না, শিশুরা আধোস্বরে বিবাহের ইচ্ছা প্রকাশে; আর যে কিশোরদের সেই কামনা ঈদৃশ, যেন ভাই হই! অলোকা আপনারে বিকিরণ করিতে আছে, তাহার অত্যুৎকৃষ্ট লিওঁ সিল্কের কৃষ্ণ আলডিহাইড সবুজের ঘোর পার্পল ফুলকারি গ্রীবাছাড়া খানিক আবক্ষ জুনিয়ার মিস ধরনের ফ্রকে উল্লেখিত আছে।

সেই অলোকা এক আশ্চর্য্য!

এখন সে আপনার কণ্ঠের মুক্তামালায় হাত দিল–তাহার বাহু কি অপরূপ ব্ৰণবিরহিত–টিকার দাগ নাই! সে স্থাপত্যকে অভিনব করিয়াছে! অলোকার অধরদ্বয় এমন, যেমত সে ইহা কহিতে আছে যে আঃ অবশ্যম্ভাবিতা, আমার তোমাতে মতি নাই, অপার করুণানিধি ভগবান আমায় যে ভীতি দিয়াছেন, আমি অলৌকিক সৌভাগ্যবতী, হে নির্ঘাত অবশ্যম্ভাবিতা, তোমাতে আমার লোলুপতা নাই, হে হাসনুহানা, তোমাতে অনবদ্যতা সুচির, তুমি কলমের আঁচড়ে প্রস্ফুটিত হইলেও আমি কণ্টকিত, হে কামিনী তোমাতে মোহিনী মায়া অমোঘ, যুবতীর কবরীতে থাকিলেও আমি ভীত! ভীতিতেই আমি বৈদিক!

এবং তদীয় এবম্ভূত খেদে সেই জন্মরহস্য আমার চক্ষুৰ্বয় সার্সিতে দেখিয়া আরক্তিম বুঝিলাম, কে যেমন আমার অভ্যন্তরে, আমার অভ্যন্তর গঙ্গাতীরে বসিয়া রামপ্রসাদ গাহিতেছে, আনন্দময়ী নিরানন্দ কর না, যে এবং গীত থামাইয়া ঐ গায়ক কহিলেন,–মন্ত্র লও মন্ত্র লও, তোমার স্ত্রী যখন এক রমণীগর্ভস্যুত মৃত সন্তানে চমৎকৃত হয়, ইহাতে যে, আশ্চর্য্য হয় যে, রমণীগর্ভে মৃত্যু প্রবেশ করে, রমণী কি বিস্ময়রহস্য অহহা সত্য! তৎপ্রভাবে যখন তোমার সহধর্মিণী ব্যামোহাবিষ্ট, তখন ইহা কহি। নাই; অহো সত্য! এখন সময় আগত, শীঘ্রই মন্ত্র লও, অতএব…আমরা গুরুর সন্ধান করিতেছি!

.

পুলিশ রিপোর্ট বলে যে, তুমি জানলায় থাকিয়া, তোমার অজস্র কেশরাশিতে তোমার চিরুণী যায় আসে–যেমন তুমি সেই গাড়ী দুইটির মারাত্মক দুর্ঘটনা দেখ, যে দুইটি তোমার জানলার তলা দিয়া প্রায় ৮০ হইতে ১০০ স্পিডে যাইত। যেমন মোটর বাইকের দুর্ঘটনাও দেখিয়াছ, তেমনি তুমি সেই সেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম দেখিতেছিলে, অথচ তুমি ইতিহাস ভারাক্রান্ত কর নাই। বিলি তুমি সেখানে যাও যেখানে তোমার সম্মুখে পশ্চাতে অগণন খোঁজা, তাহারা কি অভাবনীয় গৰ্ব্বিত, কেন না তোমার দেহরক্ষী তাহারা!…এখন যে তরুণ সম্প্রতি তোমার কারণে আত্মহত্যা করিতে চেষ্টা করিয়াছে তাহাকে কি দেখিবে?

বিলি জানাইল,–আমি তণ্ডুবণে কহিলাম,-মন্দ কি! তরুণ আনীত হইল। যাহারে আমি কখনও, কোন বিবাহ বাড়ীতে, কোন জন্মতিথি, কোনও নিমন্ত্রণে কোনও একজিবিশানে (!) বায়োস্কোপে পথে ঘাটে বাসে ট্রামে কোথাও দেখি নাই–তবে পূৰ্ব্ব তরুণদ্বয় যাহারা আমার কারণে আত্মহত্যা করিতে চেষ্টা করিয়াছে অতএব, তাই সে পরিচিত–যেন আমি মৃদু হাসিলাম, সেই তরুণ কিছু পরিশ্রান্ত! সে আমার প্রতি গভীরভাবে নিষ্পলক দৃষ্টিতে চাহিয়াছিল, সে সন্ত্রাসে কম্পিত, আশ্চৰ্য্য সেই তরুণ আমাকে কখনও দেখে নাই! আমি কহিলাম,এখন সে যাইতে পারে।

ইহাতে সহচরীবৃন্দ সকলেই আপন আপন অলঙ্কার হইতে অতীব পুরাতন হইয়াছিল, কহিল, আমরা লাভ ম্যারেজ শুনিয়াছি–দৈব দুর্বিপাক শুনিয়াছি, কিন্তু বিলিকে শুনি নাই: যে আর ঐ সহচরীবৃন্দের মধ্যে যাহারা অম্লতা, ঋতুমতী, তাহারা ঐ বিলিকে সম্যক আঘ্রাণ করিল, যাহাতে অনুতাপ নাই, এই সেই রমণী যাহার অস্তিত্ব অনুষঙ্গ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় না। এই রমণী আমাদের আরাধ্যা! ভাগ্যশ আমরা রিখিয়ায় তাই এই রমণীরে সহজে বুঝিলাম!–ইহার পরক্ষণেই ইহারা সকলেই নৃত্যের জন্য উন্মুখ হইয়াছিল।

.

দেশের অবস্থা হইতে তার্কিকরা অনেক দূরে, কখনও আদিস আবাবা কখনও স্পেনে। বিগত মহাযুদ্ধ যাহারা দেখে নাই তাহারা অচিরেই লড়াই প্রার্থনা করিতেছিল, লড়াইতে আমাদের মুক্তি! এক স্বর শ্রুত হইল; এখন বলিতেছ বটে! আমি পড়িয়াছি, লড়াই সাংঘাতিক, ঘরবার দুই যায়, গীতাতেও আছে বর্ণসঙ্কর জন্মায়, বিশৃঙ্খলা!

অন্য কণ্ঠ,ঘরবার ত কিছুই নাই…যায় যাউক!

ভিন্ন কণ্ঠে,–পৃথিবী ত আপনার নয়…মানুষ কিভাবে ভুলিয়া যায় যে অন্যজনও মানুষ! সরসে আর একজন জানাইল–মহাশয় মানুষ নিজেরেই ভুলিয়া যায়। নিজেকে না মারিতে পারিলে অন্যরে মারা যায় না… এই বচসার অদূরে দেশবৎসল জাতীয় চরিত্র অন্যর প্লেটের দিকে নালমাখা চোখে চাহিয়াছিল এবং সে অনেকের প্লেট হইতে ভাগ পায়–সে পাঁঠার ন্যায় হাসে!

অন্যত্রে নৃত্য আরম্ভ হইয়াছে, এ নৃত্যে চড়াই উৎরাই, অসমতল-সমতল ভূমিতে চলনের ভঙ্গিমার বাস্তবতা আছে, ধিতাং ধিতাং নাদে মাদল বাজিতেছে, একজন নাসারন্ধ্র দিয়া যুগ্মবাঁশী মাঝে মাঝে বাজাইতেছে, যাহার আওয়াজ নাই বলিলেই হয়, সাঁওতাল, নৃত্যরত রমণীদের বাহুমূলের রেখা, পেলব থরথর স্তর সমন্বিত উন্নত বক্ষগত অংশ যাহা–পাঁজড়ায়ে সম্মোহ বিস্তার করিতেছে!

দাশ মহাশয় তেমনই ছাতা খোলা! প্রধান শিক্ষয়িত্রী ঐ নৃত্যের দুয়েক সঞ্চারী দর্শনে অস্বাচ্ছন্দ্য। অনুভব করিলেন, স্বামীর ঐ স্বাতন্ত্র অন্যের চোখে হাস্যকররূপে প্রতীয়মান হইল! তিনি কন্যাদের প্রতি তিৰ্য্যকে নেত্রপাত করিলেন, তিনি অলোকাকে নেহারিলেন, অলোকাতে জড়বাদী রমণীত্ব নাই!

যে নাসারন্ধ্র দ্বারা এবম্প্রকার প্রায় নিঃশব্দ প্রায় বংশী বাদনে প্রধান শিক্ষয়িত্রী অশেষ বিকারগ্রস্ত, যে তিনি নয়ছয়, যে তিনি কোণ-ঠেসা, যেমন যে লম্পট কিছুর সমীপে তিনি, যে এবং তিনি ধূপ ভালবাসেন, ধোপদুরস্ত বস্ত্র যে তাঁহার তৃপ্তি বর্ধন করে, এখন ঐ দৃশ্যে ইহা সকল সর্বৈব ভিত্তিহীন; অনন্তর তিনি নিজেকে ধিক্কার দিয়াছেন। যে, উক্ত কায়দায়ে ঐ বাঁশীগুলি বাজান হইয়া থাকে, এই জ্ঞান আগেভাগে থাকিলে, যে বংশীগুলিতে–খাসা নকাসীকৃত কাজ শ্রবণে তাহা দর্শন মানসে উদগ্রীব হইতেনই না, অবশ্য মূলত মনিব পত্নীর অসংযত মন্তব্য এড়াইতেই তদীয় শিল্প প্রবণতা ঘটিয়াছিল, অন্যথা বাঁশীর শিল্পকর্মের প্রতি তাঁহার আন্তরিক টান ছিল না, হায় কি বিড়ম্বনা!

ভাগ্যশ তিনি সাঁওতালটির হাত হইতে ঐ নিদর্শন লইয়া পর্য্যবেক্ষণ করেন নাই! যদি ঘটিত তাহা হইলে অনেক ইউক্যালিপটস ওয়েল, কারবলিক সাবানেও তিনি বহুদিন অশুচি রহিতেন! যে এখন নিকট হইতে তাহা দেখিয়াছেন স্মরণেই দেহমন কাহিল, কর্দমাক্ত; তিনি পান করিবার ছলে, জল চাহিয়াছিলেন, যে জল আনিল তাহার সাহায্যে হাতমুখ প্রক্ষালন খানিক আড়ালে যাইয়া করিলেন। এবং তিনি নির্মল এবং আরাম হইলেন, এঃ নাক দিয়া বাঁশী বাজান!

কিন্তু তিলেক পরেই পুনরপি বাঁশীর চেহারা, উহা বাদন কতটুকু বা তথাপি সৰ্ব্বদাই তাহার সমক্ষে, যে, এমনও যে উহাদের উৎকীর্ণ মৎস্যলতা কুসুম কেয়ারি অবধি, যাহাতে তিনি অত্রাহি, যাহাতে উৎখাত। সুস্বন লহরী, খোদাই বৃথা হইয়াছে। তৎপ্রভাবে এতেক বিপর্যস্ত বটে–যে সুললিত, রিখিয়ার হাওয়ার শব্দ সহিত অপসৃয়মাণ খৰ্ব্ব-প্রায় ক্ষুদ্র-তরঙ্গ ব্যঞ্জনা সমান ঐ নৃত্য, মাদল বাদকের চুলের ঝাঁপটা–যেহেতু সে নাচে, সমস্তই কদৰ্য্য এরূপ সংস্কার জন্মাইল। তিনি আরবার চশমা মুছিলেন।

পার্শ্ববর্তিনী যাহারা, যাহারা গ্র্যাণ্ড বলিতে ব্যস্ত, যাহারা নৰ্তকীদের গীতের অর্থ একে অন্যকে জ্ঞাত করিতেছে, যথা ‘শালফুল, আমার দেহতে পড়িতেছে আমার চালাতে পড়িতেছে, আমার ভাতে পড়িতেছে, আমি তাই গীত গাহিতে আছি।’ যে দর্শকরা গীতের অর্থ কি পর্য্যন্ত মধুর মধুর বলিতেছিল, তাহাদের সকলের দিকে, উপরন্তু কন্যাদ্বয়কে, নেত্রপাতে তিনি, প্রধান শিক্ষয়িত্রী স্বাভাবিক হইতে পারেন না, তিনি ক্রমান্বয় যেন পাপপঙ্কে যেন নরকে (!), এ নৃত্য সদ্য অঙ্কুরিত আবীজ নহে যে স্বহস্তে। উপড়াইয়া ফেলিয়া দিবেন।

 ৬. তিনি তাঁহার অফিস কামরা হইতে

যাহা এইরূপ–তিনি তাঁহার অফিস কামরা হইতে প্রায়শঃই লক্ষ্য করিতেন, কিণ্ডারগার্ডেনের শিশু যাহাদের তিনি দেশের ভবিষ্যৎ বলিয়া অভিহিত করিতেন, শিশু বলিয়া নহে। ইহাদের–পুরাতন মরিচা-ধরা টিনের নিকট পরিবৃত হওয়ত এক জটলা, টিফিন খাইতে থাকিয়া ইহাদের অদ্ভুত কথা কাটাকাটি চলিত!–প্রধান শিক্ষয়িত্রী রুটিন ও নানান খাতা হইতে যাহা প্রত্যক্ষ করেন, এমনও যে ক্লাস চলিবার কালে অনেক শিশুই বাহিরে আসিয়া সেই পথে গমনাগমনের সময় ঐখানে কিছু সেকেণ্ড নিশ্চল, শুধু মাথার ফিতা স্পন্দিত, কখনও স্কার্ট নড়ে, কিন্তু কোনদিনই, ব্যাপার যে কি তাহা জানিতে অবসর ঘটিয়া উঠে না।

অথচ বাল্যখিল্যরা মালীকে হটাইয়াছে, ইহা তাঁহার চোখে পড়ে, মালীকে তাহারা মারিবে ইহা শুনিলেন, হয়ত অনেক ছোট ছোট হাত উদ্যত তাহা কল্পনা করিলেন। ইহারা বৃষ্টি মানে না, উহাদের চোখ বড় হইয়াছে, কেহ মস্তকে হস্ত স্থাপন করিয়াছে, কেহ টিফিনের কিছু সেখানে দিয়াছে। এক দিবস, সেই দিন খালি রোদ, ঐ টিনের সন্নিকটে ভারী সোরগোল, তুমুল উদ্দীপনা, আমি আগে,…আমি দেখিয়াছি…না মনু ফাষ্ট তারপর আমি…!

তর্জ্জনী নির্দ্দেশ এক্ষেত্রে মারাত্মক, কেহ যদি ভুলক্রমে তর্জ্জনী দেখাইল, তৎক্ষণাৎ নির্দ্দেশকৰ্ত্তার তর্জ্জনী কেহ দংশন করিয়া দিয়াছে। একে অন্যরে মুষ্টিবদ্ধ করত ঐ টিনের দিকে দৰ্শাইয়াছে। আঃ স্বর তাহাদের অবাক মনোহর! তাহাদের হাঁ অনেকটা, ফোকলা যাহারা তাহাদের হাঁ তাৎপর্যপূর্ণ।

সেই দিবসই তিনি সেই আকৃষ্ট স্থানে যাহা নেহারিলেন, তাহাতে তিনি হাসিতে গিয়া কালো, যে এবং বজ্রাহত, একটি আবীজ আপনারে উন্মোষিত করিতে আছে–সূৰ্য্য ফাড়িয়া বর্ণসকল ফাড়িয়া কি এক দাম্ভিকতা। একি মাভৈঃ! কি এক মমত্ব!

উহার আঁশ সকল রোমশ, পসলা বারিপাত হেতু এক-আধ জলবসা নিটোল তাহাতে এ পর্যন্ত, কীদৃশী জঘন্য! কি লাম্পট্য! কোথাও কার এক গোপন রাত্র, শিকল-তোলার শব্দ যেখানে অহেতুক, প্রধান শিক্ষয়িত্ৰী যুগপৎ অসম্মানিত বিভীষিত হইলেন, বয়সী বালিকারা ইহা কি দেখিয়াছে? দেশের ভবিষ্যৎ অপ্রার্থিত কহিল, উহাতে বাঁশী হইবে!

ফোল্লা যে সে কহিল আমরা বাজাইব…আমি ফাষ্ট! ৩২২

অতীব বুদ্ধিমতী প্রধান শিক্ষয়িত্রী ঝটিতি চশমা খুলিলেন, বাস্তবতা ঝাঁপসা হইল। চোরা-অপম্মার তাহাতে উদঘাটিত হইল। মহা রোষে তিনি আজ্ঞা করিলেন,–যাও ক্লাসে।

তাহারা সকলে স্তম্ভিত, ধীরে পিছু হটে! কোন অবোধ কহিল,–টিফিন ত!

তিনি কর্কশ স্বরে কহিলেন,–গো! তাহারা পিছু খানিক হটিল যেন নাচে, হঠাৎ ঘুরিল, ছুটিল, তাহারা হাসিতে ছত্রাকার! ঘণ্টা বাজিল।

ইস অঙ্কুরিত ফাটা আবীজ কি অসভ্য!

আম্রবীজে তাঁহার প্রধান শিক্ষয়িত্রীর রন্ধন আউলাইল, উহা স্পর্শ করিবার কথায় তাঁহার জ্বর দেখা দেয়, তিনি বালি চাপা দিবেন? অবশেষে ঐ টিন সমেত উহা কোথাও, প্রাচীরের অন্যধারে, নিক্ষেপ করাই মনস্থ করিলেন। কয়েক দিবস পরে তিনি টর্চ হাতে, স্কুল যাইলেন। নিঃসঙ্গ স্কুল! দরওয়ান গেটে! মালীকে তিনি চিঠি ছাড়িতে পাঠাইলেন, হায়! তাঁহারে মিথ্যার শরণাপন্ন হইতে হইল। এখন টর্চের রশ্মিতে রামধনু বিচ্ছুরণে সেই বেলেল্লা, নোংরা, ব্যভিচার, শৃঙ্গার লালসা (!) উহাতে আবীজ যেন বেপথু!

প্রধান শিক্ষয়িত্রীর ভাব যেমন বা ঈর্ষান্বিত তাহা নিরীক্ষণে কিন্তু ইহা নহে।

ঐ আদিরসাত্মক বৈভব হইতে এক নিরীহ কমনীয় হরিৎ কাণ্ড উদ্ভূত যাহার শীর্ষ যুগ্ম পিঙ্গল-বেগুনী পত্ৰমণ্ডিত, ইহা কুলটার ভান এমত!

মৃদু শ্রাবণ বাতাসে দুলিতে আছে…মনুষ্য জাতি হিসাবে তিনি উহা অবলোকন করিলেন, মনুষ্য হিসাবে তাহার স্মৃতি নাই! তিনি ইংরাজি বলিতে বাঙলা, বাঙলা বলিতে হিন্দি, পুনৰ্ব্বার ইংরাজিতে আপনাকে, দাস আপনাকে, প্ররোচিত আপনাকে হুকুম করিলেন; কিন্তু টিন চাগাইয়া তুলা অসম্ভব হইল; যে তদনন্তর তদীয় মুখমণ্ডল অশ্বখুর দষ্ট হইল। তিনি ঝাঁপাইয়া পড়িলেন, এক পৈশাচিক ধ্বংসউন্মাদনায় তিনি কম্পিত, ঐ মৌনতাকে বিনষ্ট করিলেন। তাঁহার বিদ্যার ডিগ্রী অম্লান রহিল– তাঁহার সৌখীন এক লহমার অনুতাপ, স্বীকারোক্তির, নিমিত্ত এই নৃশংস দুষমনী সংঘটিত হইল!

.

ভারতের জাতীয় চরিত্রটি তাঁহার প্রধান শিক্ষয়িত্রীর কন্যাদ্বয়ের প্রতি চাহিয়াছে, ইহা তাঁহার নজরে এতক্ষণ পরে আসিল, সেই ব্যক্তি যে দাবার খুঁটির ন্যায় সকলের অজানিতে সান্নিধ্যে আসিবার কারণে বহু আসন বদলাইয়াছে, ইহা তিনি বুঝিলেন, বুঝিলেন কন্যাদ্বয় স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে না। তিনি উঠিয়া সেখানে যেখানে সুঘরাই তাহার খাঁচাটি কিছু তুলিয়া ধরিয়াছে! আর দাশ মহাশয় নৃত্য হইতে চোখ ফিরাইয়া উহাতে মনোনিবেশ করিলেন।

এবং মনিব মহাশয় উল্লাসে আপন সহধর্মিণীরে জ্ঞাত করিতেছিলেন,–তোমারে পূৰ্বেই। বলিয়াছি…দেখ…আমার কথা সত্য ত…বলি নাই হারামজাদা খাঁচা সাজাইতেছে?…দারুণ সাজাইয়াছে। যেন রেড ইণ্ডিয়ান হেড! পাখীটি কি গর্বিত দেখ…!

স্নেহশীলা মনিব পত্নী তদুত্তরে বলিলেন,-মরণ, ছোঁড়া তোকে কত বারই বারুণ না করেছি…রেতে গাছে হাতে দিতে নেই…তখন দেবতারা আসেন…সত্যিই ডেলিয়াগুলো আঃ ঐ সান ফ্লাওয়ারটা…মনে হচ্ছে এখানেই ফুটেছে…পাখীটা সাক্ষাৎ…সাক্ষাৎ…চমৎকার না!

দাশ মহাশয় এতক্ষণ নাচ উপভোগ করিতেছিলেন, ঘুঙুরের আওয়াজ–অবশ্য মাত্র পুরুষ নৰ্ত্তকদের পায়ে–গানের সঞ্চার এবং উল্লম্ফন ও দৈহিক দোলাতে তদীয় কাশির শব্দ অবধি বদলাইতে আছিল, যে তিনি তাহা সম্যক বুঝিতে পারিয়াছিলেন, এই দেহ স্থাপত্য-ধ্বনি সঞ্জাত, এখন কিন্তু আর সেই সত্যের রেশ নাই, এখন ইন্দ্রিয় সজাগ প্রায়!

একদা ছাতা বন্ধ করিতে চাহিলেন, যে তিনি নৃত্যর পশ্চাতে বৃক্ষসকল, ক্রমে দূরে রিখিয়ার নিগূঢ় আকাশ পর্য্যবেক্ষণ করিলেন! যেন সদ্য বিধবার ক্রন্দনধ্বনি শুনিলেন, (যেমন তদীয় স্ত্রীর অশৌচ বস্ত্র পরিহিত বালককে দর্শনে স্বস্তি হয়) তদনন্তর পুনৰ্ব্বার নর্তকীদের প্রতি একাগ্র কিন্তু ইউক্যালিপটসের পত্ৰমৰ্ম্মরে স্বামী-হারা বিলাপ নিশ্চিহ্ন হইল। তাঁহাকে অধৈৰ্য্য করিল–তিনি নাচ দেখিবেন! ভূমিতে পদাঘাতে উড়ন্ত ধূলায়, নৃত্যতে সাধারণ পদক্ষেপে হইতে, সকলকে উদ্বুদ্ধ করিতেছে। এমত কালে মনিব মহাশয়ের সংযম তাঁহারে আকৃষ্ট করিল, তিনি এক খাঁচা দেখিলেন।

অথচ ইতিমধ্যে সেই পুরুষবেশী বালিকাকে বেণী দুলাইয়া বলিতে শুনিলেন,–আমি যদি নিজেরে হত্যা করি মানে বিষ খাই তাহা হইলে জেল হইবে।

তদুত্তরে বালিকা কহিল,–কি করিয়া!

পুরুষবেশী বালিকা বলিল, তাই ত শুনিলাম…!

উত্তর হইল,–আমি যদি আমাকে মারি তাহাতে কাহার কি?

এই কলহ পার হইয়া দাশ মহাশয় খাঁচাটি বিশেষ তীক্ষ্ণ সূক্ষ্মতায় নিরীক্ষণ করিতেছিলেন, কেহ টর্চ ফেলিয়াছে, পাখীটি সুস্পষ্ট যাহাতে, এখানে ফুল ছিল, সুতরাং নির্মল আনন্দ প্রকাশের দিক ছিল। অতএব ছাতার কারণে আর তাঁহার খুঁং থাকে না, তিনি আনুনাসিক স্বরে স্বভাব-ভীত ভাবে প্রশংসা করিলেন,–সত্যই এবম্প্রকার দৃশ্য অমৃতবর্ষী…দেখুন কুসুম সকল, তখনই মনে হয় কোথাও এক স্বচ্ছতোয়া নদী আছে…কুসুমের বর্তমানতা…আঃ!

এমত সময় অহঙ্কার মদমত্ত সুঘরাই, যাহার মুখের নিকটে খাঁচা থাকার দরুণ, যে দেখিতে পাইল পক্ষী ঐ তুমুল আলোতে দুই একটি পোকা খাইতে চঞ্চু পৃথক করে, গোলাপী অভ্যন্তরে ক্ষণেক, খুট শব্দ হয়, গলদেশ উঠে-নামে, যে তন্নিবন্ধন বালক সুঘরাই যথার্থ অপদস্থ, কেন না পক্ষীর তাদৃশ তৎপরতায়ে তাহার কল্পনা ম্লান হইতেছে, সে আশা করে যে তাহার পক্ষী লক্ষ্মী হইয়া থাকিবে, ভদ্র থাকিবে; যে রুক্ষদৃষ্টিতে তাহাকে শাসন করে, তোমাকে এত খেলা শিখাইলাম, কসরৎ শিখাইলাম, কত কি শিখাইলাম, সবই পণ্ডশ্রম হইল, যে এবং তাহাতে, সুঘরাইতে, কোপনতা আসিতেছিল।

সে অস্ফুট স্বরে পক্ষীটিরে সাবধান করিয়াই জনসমাবেশের দিকে বড় করুণভাবে তাকাইল। তৎকালেই ঐ খাঁচাটি বিশেষ সশব্দে নড়িয়া উঠিয়াছে, যে যাহাতে সে দৃষ্টি ফিরাইতেই নিরীক্ষণ করিল, সান ফ্লাওয়ার খসিতেছে, ইহাতে সে ঝটিতি রুষ্ট এবং অন্য কাহারও বিবেচনার সময় না দিয়া খাঁচার উপর এক চাপড় মারিল, পক্ষী ত্রাহি স্বরে ডাকিল।

মনিব পত্নী তৎক্ষণাৎ বলিলেন,–এই তুই…কি করছিস…পাগল নাকি…!

মনিব মহাশয় বলিলেন,-হারামজাদা তাই বলিয়া অত জোরে চাপড় দিতে কখনও আছে…খাঁচা ভাঙ্গিয়া যাইত, পক্ষী ভয়ে পালাইত…আর বলিবেন না, সেদিন বৃথা আমার প্রায় একডজন গুলি নষ্ট হইল…ঠিক এইভাবে,…দেখ বেচারী এখনও ভয়ে অস্থির…আ হাহা, তিতি বল, বল,…নিগার কোথাকার!

দাশ মহাশয়ের কাশি স্বাভাবিক হইয়াছে এমত সংঘটনে, যাহাতে তিনি মনোজ্ঞ অনুনাসিক স্বরে, অর্গান বাদ্যযন্ত্রের কিয়ৎ রেশ আছে যাহাতে, বিস্তার ব্যাখ্যা করিলেন,–যথার্থ এতদ্দর্শনে বারম্বারই এই সত্য মনে আসে, পরম কল্যাণময় ঈশ্বর…যিনি সবার প্রভু,…মঙ্গলময় তিনি…চাহেন কেহ কাহারেও দুঃখ দিও না,.এখন এই পক্ষীর সূত্রে বলা যায়…ইহাদের আমি সৃষ্টি করিয়াছি, ইহারা আমার, ইহারাই প্রকৃতির প্রকৃতিই, আমি ইহারাই প্রকৃত!

এই পৰ্য্যন্ততে, যেন অতীব গূঢ় কিছু মীমাংসা ব্যক্ত করিতে, দাশ মহাশয় সমর্থ হইলেন; রহস্যসই করাই তাঁহাদের সাধনরীতি, যে এবং অধুনা তাঁহার গাম্ভীর্য অনুধাবনে ইহাই অনুমিত হইবে যে জীবন হইতে জীবনীর প্রতি তাঁহার শ্রদ্ধা আছে; কিন্তু তিনি নিজে যেমন জীবনীর চাপে কবে যেন মৃত…এখন কালো ছাতার পশ্চাদপট ক্রমে ইহাই বুঝায়–যেন কোন এক ছোট স্টেশনে তাঁহার লাশ পড়িয়া আছে।

এখন দাশ মহাশয় শুধু অনুনাসিক স্বর মাত্র। যে পার্শ্ববর্ত্তী নীরবতা, যাহা যেমন ধমক খাওয়া, যদিও সবাই তির্যক দৃষ্টিতে নাচ দেখে; ইহা তাঁহাকে অনুপ্রাণিত করিল, যে আবার সেই সঙ্গে তাৎপর্য্যপূর্ণ কাশির শব্দ ও অবিলম্বেই চোস্ত বাচনভঙ্গি শ্রুত হইল,–মঙ্গলময় সদাসর্বদা বলিতেছেন, নদী গিরিমালা লতাগুল্মবৃক্ষ কীটপতঙ্গের ভাষায়–তাহাদের সকলের ভাষায়…তোমরা আত্মসুখপরতন্ত্র ইহাদের খাঁচায় আবদ্ধ করিওনা…প্রকৃতিকে ফিরাইয়া দাও…ইহাদের সুখদুঃখ আমি জানি…তোমরা আত্মসুখে নিমজ্জিত…ইহাদের সুখদুঃখ বেদনা তোমরা কিছুই বুঝ না…ইহাদের পুষিও না…উহাতে পাপ হয়–!

সমবেত জনমণ্ডলী, নাচ দেখার ফাঁক মধ্যেই খুব একাগ্র, দাশ মহাশয়ের তত্ত্বাদেশ শুনিলেন, যারপরনাই পরিতুষ্ট হইলেন; সকলেই একবাক্যে এবং যে সাধুবাদ জ্ঞাপনকরত বলিলেন,-মহাশয় আপনি সঠিক চিন্তা করিয়াছেন। ইহার পর তাহারা সুঘরাই, যে অপ্রতিভ যে থতমত আছে, তাহারেই অবলোকনে ঈষৎ ভ্রূকুঞ্চিত করিলেন–সুঘরাইএর এতক্ষণ পরিবৃত উচ্চবর্ণের মধ্যেও এতটুকু আঁট বোধ হয় না, কিন্তু ইদানীং সকলের এহেন মনোভাব অনুভবে, সে খুব অস্বস্তিতে আপন প্রভুর প্রতি অসহায়ভাবে তাকাইয়াছিল।

মনিব মহাশয় যিনি এবম্ভূত দাশ মহাশয়ের বচন পরম্পরায় মৃদু হাসিতেছিলেন। তাঁহার কোন কথাই মানে লাগিবার নয়, কেন না দাশ মহাশয় শুধু বলিবার জন্যই বলিলেন, উনি কিছু আদিষ্ট পুরুষ নহেন; তাই তিনি শুধু নিবেদন করিলেন,–মহাশয় আপনি যা বলিলেন তাহা সত্য…তবে আমরা জড়…জড়বাদীর মানে…অবশ্য এক হয়, তিনি আছেন, তিনি যদি আসিয়া বলেন…তাহা হইলে অন্য কথা। আদতে ইনি, মনিব মহাশয় বলিতে চাহিয়াছিলেন, জড়বাদীর উপলব্ধ ভগবৎ প্রসঙ্গ বৃথা! কিন্তু আপনাকে, উচ্চবংশীয় সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ ইনি যেহেতু, সংযত রাখেন। এবং বরং আপন প্রিয় ভৃত্যরে। ধীরতার সহিত আজ্ঞা করিলেন,–আর পাপে প্রয়োজন নাই, ইনি যাহা কহিলেন তাহা অর্থপূর্ণ সত্যই, সুঘরাই তুই ঐ পক্ষীটিরে কল্যই জঙ্গলে ছাড়িয়া আসিবি…!

মমতাময়ী ধৰ্ম্মশীলা মনিব পত্নী তদুত্তরে স্বামীরে একান্তে লইয়া বাধা দিয়াছিলেন,–কি যে অলুক্ষুণে কথা বল…এই সন্ধ্যে মানে সবে সন্ধ্যে উতরোল, কেন মৎতে ও পাখী ছাড়বে ছি ছি…তুমি কি যে বল…মনে নাই ব্রজবাসী কি বলেছিল…পাখী পোষা কি যাতা…সে কথা তুমি ওনাকে বলছ না কেন?…অথচ মনে হল তুমি ওনাকে ঠাট্টা করলে যেন…!

মনিব মহাশয় বিনীত স্বরে প্রকাশিলেন,–তুমি বৃথাই আমারে দোষারোপ কর, আমি তামাসা করি নাই, যদি করিতাম উনিও তাহা বুঝিতেন, দেখ ভঁহার মুখমণ্ডল…আর জঙ্গলে ছাড়িবার কথা উহাতে সত্যই নাই…যাহারা ভগবানকে ঐরূপ জানে তাহাদের কোন কথা বলা নিরর্থক…!

মনিব পত্নীর আজও সেই ব্রজবাসীর (এই বৈষ্ণব যিনি বৃন্দাবনে থাকেন–ইহা নাম নহে) কথা মনে হয়, তাদৃশ সদানন্দময় মানুষ কমই চোখে পড়ে, ইনি মাঝে মাঝে কলিকাতায় তাহাদের বাড়ীতে আসিতেন, পূজার দালানে থামের নিম্নে বসিয়া যাঁহাকে তিলক সেবা করিতে তিনি দেখিয়াছেন, মুখে অহরহ কৃষ্ণ নাম; ইনি বলিয়াছিলেন,–ওহো তাহা নয়, খাঁচার পাখীতে মন আরোপ কর, মন আরোপের জন্যই পাখী পোষা–এই মরদেহ খাঁচা ঐ পাখী আত্মা…এ জানাই ঠিক জানা…! এই ভাব লও!

যে উপস্থিত হিরণার টিলায় প্রধান শিক্ষয়িত্রী সাঁওতাল নৃত্যের দিনকার তত্ত্বালোচনার উল্লেখে, মনিব মহাশয় শান্ত কণ্ঠে জানাইলেন,–দাশ মহাশয়ের কথায় তত্ত্বাভিজ্ঞতা আহে, উহা সূক্ষ্ম, সামান্য মানুষে উহা কেমনে ধারণা করিবে…সাধকরা উদ্দীপনার জন্য অনেক সময় পাখী পুষিয়া থাকেন…সে কথা ধরি না, তবে আপনি জানেন, বেদনা দুঃখ বুঝে না সাধারণে…মানুষের ক্ষমতা কতটুকু, সে ডাক্তারী করিতে পারে…কোন কিছুর বেদনা স্বয়ং অন্তর্যামী নারায়ণ বুঝিতে পারেন বা তাহার অবতার যেমন। ঠাকুর পারেন…মানুষ ছার!…তবে তিনি আমাদের ভালবাসা কথাটা জানাইয়াছেন…আমাকে একজনের। বা শতজনের মৃত্যু সংঘটনের ক্ষমতা যখন দিয়াছেন তখন নিশ্চয় তিনি ভালবাসার ঐশ্বৰ্যও দিয়াছেন। তবে নিশ্চয় তাঁহাকে জানাতেই সেই ভালবাসা আসে–তবু সুঘরাইকে যখন দেখি–উনি তিতি করিয়া ডাকিলে সাড়া দেয়, অবিকল তিতিরের মতোই আসে, তেমনই অদ্ভুত পদবিক্ষেপে ঘুরে…ইহা সেদিন আমার নজরে পড়িল, ভাবিয়াছিলাম যে উহা সাঁওতাল নাচ দর্শনে শিখিয়াছে, কেন না একই ভঙ্গিমা, একই ফের, অভিন্ন–কিন্তু উনি আমার সন্দেহ ঘুচাইলেন।

মনিব পত্নী সপক্ষে কহিলেন,–হ্যাঁ ছোঁড়া বরাবরই তিতিরের মত ভাবভঙ্গী করে, জানেন…আবার ছোঁড়া তিতিরটাকে নানা কিছু শেখায়, কত খেলা…ওগো সেইটে বল না, ও ছোঁড়া খাঁচার কাঠি ভগ্ন জায়গায় নিজের আঙুল বেঁধে জোড়া দিয়েছিল–আমি ত দেখে হেসে বাঁচি না…অন্য হাতে খাঁচাটা চাগিয়ে আমায় এনে দেখালে! আমার মনে হয় ও ছোঁড়া আজন্মে পাখীটার কেউ ছিল…আমি ভাবছি ওর মুরগী কাটা ছাড়িয়ে দেব…ওতেই মনে হয় বুঝলে…এখন আমার মনে হচ্ছে…তাছাড়া যখন পুষছে তখন ভাল নিশ্চয় বাসেই…।

মনিব মহাশয়, সুঘরাই আমার ধ্রুব বিশ্বাস উহারে খুব ভালবাসে, ভয়ঙ্কর ভালবাসে….. সুঘরাই ও তাহার খাঁচা এখন আবছায়ার কিছু, সুতরাং শুধুই ভালবাসা শব্দ আপনার বিশেষত্ব লইয়া প্রকট হওয়ত মায়া ধরিতেছিল। রিখিয়ার এই বিরাট চৌদিকের সর্বত্রে–প্রধান শিক্ষয়িত্রীর আর নেত্রপাত যযা ছিল না, ভালবাসা শব্দে তদীয় অধীনরাও নিজেও যেন কু কুঁ শব্দ করত ভীত! এই স্থল বুনো, লাট্টা খাম্বার শব্দ এতটুকু স্বাভাবিক করে না, কেহই সুতরাং নিজেকে জানে না। গা কেমন যেন ছম ছম করিতে আছিল। একমাত্র সুঘরাই ভাবিতে ছিল নূতন কোন অভিনব ধারায় খাঁচাটি সাজাইবে।

.

সুঘরাই অবসাদে নৈরাশ্যে যারপরনাই ক্লীব আছে, তাহার কান্দিবার মত আর ক্ষমতা ছিল না, ইহা যে শহরের অংশ তাহাও জ্ঞান ত নাই, এখন তাহার ভাবনাতে একমাত্র যে বাস্তবতা ছিল তাহা হয় ঘুম, নিজের ঘুমকে, যাহার চেহারা যেমন বা সে স্পষ্টই প্রত্যক্ষ করে, সে বড় ভয় পাইতেছিল, ইতিমধ্যে দুয়েকবার তন্দ্রাচ্ছন্ন হওয়াতে আতঙ্কিত বটে হইয়াছে।

পশ্চিমের আকাশ তাহাকে পীষিতেছিল, কেন না সন্ধ্যা সমাগত–নিজেকে এখন তাহার প্রহার করিতে ইচ্ছা করে, সে টলিতে টলিতে যেদিকে আরও কোলাহলপূর্ণ, যেদিকে সে ঘুম ভুলিতে পারে, সেই অভিমুখে শ্লথ পদক্ষেপে চলিতে আছিল। কুয়ায় হইতে জল তুলিবার শব্দে, কুয়া বাঁধান পাথর, যে স্থলে অপেক্ষাকৃত বেশী আরামদায়ক ঠাণ্ডা, সেখানেই সে থ, সে যেমন জাগিতেছে বলিয়া তাহার মনে হইল।

এবং যে দ্রুত কয়েক পদ অগ্রসরেই সুঘরাই এক কুয়ার সম্মুখে; যে লোকটি জল তুলে, সে জল দান করিতেছিল–কেহ জল পান করে, জলকণা সকল সুঘরাইএর দেহের এখানে সেখানে ছুটিয়া আসিতেই আপনা হইতেই তাহার চেতনা হইল, যে সে অনেকক্ষণ এখানে, ও ঝটিতি কি এক শব্দরোলে তাহার দেহ পূর্ণ হইল, যাহা সঠিক বুঝিতে না পারিলেও, যাহার উদ্দেশে ঐ ধ্বনি উঠে–সেই ছবি তাহাতে ক্রমে আবছায়া খেলিয়াছে। ক্রমে ভাস্বর হইল!

.

অলৌকিক বিবাহ-যাত্রা!

আশ্চৰ্য্য যে এহেন সঙ্কটেও সে ঐ শব্দ অনুকরণে–উহার যথার্থ স্বরূপ নির্ণয়ে উথলিতও হইয়াছে; এবং ইহাতে আপন কণ্ঠস্বরের পশ্চাতে মনিব মহাশয়কে সে অনুভব করিল। আশ্চৰ্য্য জল সম্বন্ধে সে যে তৃষ্ণার্ত, নিশ্চিত ক্ষুধার্ত, সে যে ঘুম ভয়ে ভীত তথা পরোক্ষভাবে সে যে হারাইয়াছে, তাহা ক্ষণেকের জন্য খেলিয়া উঠে নাই, জলধারায় শেষ সূৰ্যছটায় সেই মহিমা উদ্ভাসিত হইতে আছিল।

যে এখন যে ব্যক্তি জলপানরত সে ঈষৎ মুখ তুলিতেই সুঘরাই যেমন বা স্তম্ভিত, তথাপি কোনমতে সে ছায়া হইতে মানুষটিকে হদিশ করণে, কুঁড়িতে প্রয়াস পাইল; যখনই সেই ব্যক্তি আপন দেহ বাঁকাইয়া এক বিরাট ঢাক কাঁধে তুলিয়া অতীব স্নেহে এক গণ্ডুষ জল লইয়া ঢাকের ছাউনিতে ছিটাইল, যেমন উহা তাহারই ন্যায় তৃষ্ণার্ত! সন্নিহিত সুঘরাই এক চিরপরিচিত নাম ধরিয়া ডাকিবার অপ্রত্যাশিত স্বর আনিতে। মরিয়া হইল, অনতিকাল পরেই সে অদ্ভুতভাবে চীৎকার করি উঠিল, ইহাতে সেই ‘অহহা মহেশ্বরী! পদের রেশ থাকে!

অহো মহেশ্বরী।

শব্দের অক্ষহীন ধ্বনিতে, ঐ চীৎকারে তদীয় তিতিরের অবাধ উল্লাসে সবটুকুই পূর্ণ ছিল; সুঘরাই যেমন এতটুকু কাহিল না, ঘুম তাহার জলে ভিজিয়া গিয়াছে, যে এবং কয়েক মুহূর্ত পরেই সে নিখোঁচ গলায় ডাকিতে পারিল,–আ গে বিসরিয়ার বাপ!

এবম্বিধ ক্ষমতায় এতাবকার সমস্ত নিষ্ফলতার ক্ষোভ খেদ চমকপ্রদ কাহিনীতে সুবিন্যস্ত হইল। সুঘরাই যারপরনাই উচ্ছ্বসিত, যে সে পুলক ফেলিতে চাহিল না; বিসরিয়ার বাপের অনেক দিনকার

কামানো দাড়িতে চিড়ার কুচি, আর মুখময় জল, যে সে, বালক, তাহার স্বজাতিকে দেখিয়াছে, সে উহাকে ছুঁইতে চাহিল, আহা কতকাল যে সে মানুষ স্পর্শ করে নাই, নিশ্চয়ই বহুকাল, বহুকালই সে দল ছাড়া বিচ্ছিন্ন হওয়ত হারাইয়াছে।

সুঘরাইএর ডাকে বিসরিয়ার বাপের পদস্থিত ঘুঙুরের আওয়াজ হইল ঢাকেও মৃদু শব্দ ঘটিয়াছিল, যে এবং সে আড়নয়নে সুঘরাইকে লক্ষ্যের সঙ্গে শুধু মাত্র ‘আরে আরে’ জ্ঞাপনের পরই আর এক গণ্ডুষ জল গ্রহণ করিল, এবার মুখোনি তুলিয়াছে, নিবিষ্টচিত্তে সেই জল আপন বক্ষে বিশেষত সিঞ্চনে ক্রমে এখন লেপিতেছিল। এত নিকট হইতে সুঘরাই কখনও ইতিপূর্বে এই বৃদ্ধকে নিরীক্ষণ করে নাই!

বৃদ্ধ বিসরিয়ার বাপ কেমন যেমন অন্যমনস্ক আছে। ইহাতে সুঘরাই সত্যই আতান্তরে পড়িল, সে ত্বরিতে আশ-পাশ জলধারা সমস্ত কিছু দেখিল, সে কি সুঘরাই নয়! তৎক্ষণাৎ আপনার গেঞ্জী খুলিতে চাহিল, অধুনা জলে আর্দ্র বদনে করজোড়ে বৃদ্ধ বড় বিষাদে এই প্রার্থনা জানাইতেছিল,বাবা বৈদ্যনাথ তুমি দুঃখের দুঃখী, হয় কত দুঃখ আছে আমার, কবে ঘুম দিবে, আর কত দুঃখ আছে গো!

এই সরলতায় সুঘরাই নিশ্চিহ্ন মনে হইল, এখনও কি আমার হদিশ হয় নাই…মনিবরা? এখনও আমি কি হারাইয়া আছি…এই বিসরিয়ার বাপ কি সত্য!

ইদানীং তাহারা বিলাসীর টিলায়, বিসরিয়ার বাপ আর একবার মন্দিরের দিকে ফিরিয়া ভগবান বৈদ্যনাথকে নমস্কার করিল, এরূপ মনোহর উহার কৃতাঞ্জলি যেমন চৈত্রের শালবন প্রতিবিম্বিত হইতে পারে, অতএব মুহূর্তেই সুঘরাইএর আর উদ্বেগ নাই–এবং যেহেতু বিসরিয়ার বাপ এ সময়ে তাহার ঢাকে তিনবার কাঠি দেয়, এ কারণ যে ঢাকের আওয়াজ বড় সাহস!

উত্তর দিকে উৎরাই পথে অজস্র জোনাকি ভয়াল চক্ষুতে পরিণত হইবার নহে। এইবার তাহাদের রিখিয়া যাত্রা শুরু হইবে। বৈদ্যনাথের ধূলি মস্তকে লওয়া হইয়াছে।

বিসরিয়ার বাপ হাঁকিল,–হেরে মরোয়া রে!

মকরোয়া নামে ব্যক্তিটি নিশ্চয় কাছে কোথাও আছে!

.

সুঘরাইএর বিসরিয়া বাপের হাঁকে, চক্ষু তখন সজল হইল এবং সে এতক্ষণে ক্ষুধা অনুভব করিল, কুয়া হইতে এতটা পথ বৃদ্ধ অনবরত তাহার রোজগার গণনা করিয়াছে, এক এক হিসাব স্মরণে ঢাকে কাঠি দিয়াছে, খেয়াল রাখিতে, যথা ভোরের গাড়ী, মোটা চেহারার যাত্রীরা তাহাকে লয় নাই, কিন্তু বিধবা বুড়ী হ্যাঁ হ্যাঁ যে মন্দিরের দিকে…কাঁদিতেছিল, সে ঢোল বাজাইয়াছে, সেই বুড়ী দুপয়সা, হ্যাঁ। হ্যাঁ…তারপর এক পয়সা…তাহার পর এক পয়সা…এই ভাবে কতবার সে হিসাব ভুলিল, এইভাবে সে নিজেরে গালি পাড়িল, কিন্তু যে তদীয় পায়ের ঘুঙুর নিয়তই বাজিয়াছে, এক সময় আচমকা আপনার গালে বুকে চাপড় মারিয়া তারস্বরে দিক বিদীর্ণ করিল,হাহা আমি দেড় পয়সার চিড়া খাইতে গেলাম কেন…রাতে ভাত খাইব কেমনে…ও হো ও হো!…আমি শালা…!

তখন তাহারা বিলাসীর অভিমুখে, এখন শিবগঙ্গা প্রায় অতিক্রম করিবে, সারা পথ সুঘরাই বারম্বার পিছনে দৃষ্টিপাত করিয়াছে, যদি ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়, উপস্থিত বিসরিয়ার বাপের খেদোক্তিতে মহা ভীরুভাবে কহিল,–বিসরিয়ার বাপ, তুমি যদি আমার মনিবদের একবার পাণ্ডাপাড়ায়…আমার মনিব তোমাকে নিশ্চয় টাকা…

বিসরিয়ার বাপ সবেগে উত্তর দিল,–তুমি কি পাগল, তাহাদের ঠিক সময় ক্ষুধা পায়…তাহারা বড়লোক।

ইহাতে সুঘরাই, যদিও ডোম তবু, মুখ ঘুরাইল, অনেক যুক্তির উল্লেখে ইচ্ছা থাকিলেও সে অবতারণা করিল না, এবং যে সে নিজেরেই অদ্যকার দুর্দৈবের জন্য দোষী করিয়াছিল। যে তখনই এবং এক মহিমান্বিত ধ্বনিতে সে চমকিত! কেননা এই পুণ্য নগরের বিবিধ সোরগোল, জয়ধ্বনি, ইদানীং এখানে এক বিচিত্র শব্দ রণনে রূপান্তরিত হইয়াছে। এবং যে আশ্চৰ্য্য যে বালকের মনপ্রাণ তাহা উচ্চারণে দেদীপ্যমান!

ইতিমধ্যে বৃদ্ধের ‘এ গে মকরোয়া’ ডাক ও মুহুর্মুহু ঢাকের শব্দে, এক পাল্টা সাড় আসিল, আর যে ক্রমে দেখা গেল এক বৃদ্ধ কেমন একভাবে পশ্চিমের আকাশে চোখ রাখিয়া আসিতে আছে, সে যেমন খাড়া পশ্চিমে যাইবে, তদীয় পদশব্দ কাঁকরে ঘর্ষণেতে, তাজ্জব, যে যখন ব্যক্তি বেশ কাছে তখন বিসরিয়ার বাপ জানাইল,–হেরে মকররায়া অদ্য এই বুতরু তোমার হাত ধরিবে…আমি সারা রাস্তা নিজেকে শালা মারিব…আমি অতটা চিড়া খাইলাম…আমি কি…! …এই সেই মকোরোয়া…শিব ইহারে রাতকানা করিয়াছে…শালা পাপী তুই ইহার হাত ধরিবি!

ডোমপুত্র সুঘরাই অবলোকন করে মকররায়া বিষাদের হাসিতে তদীয় হাত প্রলম্বিত করিল। আর সে, শান্ত নেত্রপাতে ঐ রাতকানা বেচারীকে পর্য্যবেক্ষণ করিল, এতাবৎ তাহার মনে এহেন সঙ্কল্প থাকে, যে সে বিসরিয়ার বাপের কাছ ঘেঁষিয়া থাকিবে, এই বৃদ্ধের সেই প্রথমকার মর্মান্তিক প্রার্থনা তাহাতে কোন এক দুর্লভ স্মৃতি দিয়াছিল, যে প্রার্থনার পরে, ঐ বৃদ্ধ শতচ্ছিন্ন বস্ত্রপ্রান্ত দ্বারা একাধারে জল মুছিয়া ক্লান্তি অপনোদন করিয়া তাহার দিকে সরলভাবে হাসিল, তাহাতে সুঘরাইকে এক ঘোর দিয়াছিল যে, যেমন যে এই দুঃখময় বার্ধক্যে হাসি থাকে কেন! এখন সুঘরাই ঐ প্রলম্বিত হাতখানিতে প্রলুব্ধ–যে এবং যেইমাত্র সে ঐ হস্ত ধরিতে স্পর্শ করে যুগপৎ মকরোয়া অন্যপক্ষে সুঘরাইএর হাত ধরিল, ইহাতে ক্ষণেকেই দিক সকল প্রকৃতিস্থ হইল, এই পৃথিবীতে কখনও ঝড় হয় নাই, কিন্তু তিলেকের মধ্যেই দীর্ঘশ্বাস অবশ্য সে, বালক ফেলিয়াছে!

হায় ডোমেদের দীর্ঘশ্বাস আছে!

কিন্তু দীর্ঘশ্বাসের কারণ জানিতে সে প্রস্তুত নহে! (বিস্ময়ের যে সে নিজেকে চালিত করে) তৎপরিবর্তে, সে বেদম উল্লাসে নাচিয়া উঠিল, অবাক দায়িত্ববোধে সে উষ্ণ, তদীয় গেঞ্জী যেমত শুভ্রতর হইল; লক্কড় ভূত প্রেতকে সে বিদ্রাবিত করিতে পারে–সে হুঙ্কার দিয়া নির্ভীকতায় সামনের পথ নজর করিয়াছিল।

অপার্থিব গর্বে তদীয় গ্রীবা উন্নত দৃঢ়, ইহা আপনা হইতেই ঘটিল, ক্কচিৎ এই ভঙ্গীতে ইহাতে বুঝায় যে তিতিরস্বভাব তাহাতে অনেকদূর প্রবেশ করিয়াছে, যে তাহাতে অধুনা এই অভিব্যক্তি সম্বন্ধে ধীরে বোধ আসিল এবং সে আপনকার গ্রীবায় মহা ভাবুকতায় হাত বুলাইয়াছে।

.

সেদিনও ঠিক আর এক যশোগরিমার আশায়ে এমনই ঘটে, স্নেহবৎসলা মনিব পত্নী যখন, কাগজের ফুল সকল নির্ম্মাণ করিয়া তাহাকে দিয়াছিলেন–সেই ফুলরাজি মনোলোভা, ইহাতে পোকা নাই, ইহা শুকাইবে না, বর্ণ নিষ্প্রভ হইবার নহে এবং উহাতে পক্ষীটি তাহার বিরাগভাজন হইবে না। সে আহ্লাদিত যে কাহারও খাঁচা–যাহা রিখিয়ার হাটে আনীত হয়, যাহা মোহনপুরে আসে–এমত ফুলে শোভা বর্ধন ঘটে নাই।

সুঘরাই সচকিত পদক্ষেপে চলিতে আছে, মকরোয়ার ধৃত হাতে বার্ধক্যের কম্পন; মধ্যে মধ্যে তাহাকে অন্যত্রে লইতেছিল–এতাদৃশই আরএক কম্পন! তাহা কিছু আজব প্রকারের উমের পিছন হইতে আগত শীতের কুয়ার জলে যে উম নাই! সুঘরাইএর কোমরের ঘুনসী ঢ্যাঁটার চাবিটির পাশেই যে বাঁধা রহিয়াছে, ফলে যাহা কখনই খোয়া যাইবার নহে, এবং যাহা মাঝে মাঝে মনে পড়ে। এ কম্পন অভিনব, প্রথম যখন বনে গিয়াছিল ইহা তখনকার।

সে সুঘরাই বনসম্পদের একটি হইয়াই ব্যাঙের ছাতি সংগ্রহে ঘুরিতেছিল, তাহার স্কন্ধ যখন বৃষের তুল্য, যখন সে ভয়ঙ্কর! তখন এই এহেন কম্পন স্পর্শ করে–সবে চোখ ফোঁটা এক পক্ষী শাবকেতে।

শুধু তখন হয়ত তাহার মনে হইল বহুদিন তিতিরের সেই কম্পন ছোঁয়া হয় নাই, কিম্বা মনে হইবার আগেই তাহার গাত্রে ঝুমুরের কয়েক মাত্রা দুলিয়া উঠিল–কেননা বিসরিয়ার বাপ ঢাকে কাঠি দিয়া তখন এক ঝুমুর গাহিতেছে।

মুখে হাসি, সব্বলাশী, বাঙালি কা বিটিয়া।
কলকতা তে বেচতরে তামাকুল টিকিয়া ॥

এই ঝুমুর আন্দোলনে সে অচিরাৎ শিশুহস্তী, কিন্তু তখনই সে আপন দায়িত্ব ভুলিতেই বেচারী মকরোয়া ত্রাসে মৃদু হাহা করিয়া উঠিয়া ব্যক্ত করিল কিছু।

কিন্তু পরক্ষণেই বিসরিয়ার বাপ পথিপার্শ্বস্থিত আধা ঘুমন্ত গ্রামবাসীদের সম্বোধন করিয়া বলিয়া উঠে,–শুন শুন আমার কপাড় হে, আমার এককুড়ি দুইটি ছেলে…অনেকেই মৃত, আমায় খাইতে দিবার ভয়ে অনেক শালারা মৃত, যাহারা আছে তাহারা আমায় ফেন পর্য্যন্ত দেয় না গো…।

আবার কয়েক পদ অগ্রসর হইয়া তেঁড়া দিয়া চীৎকার করিল, তোমরা শুন, ঘরে ফিরিবার আনন্দ আমার নাই, তোমরা শুন রেলের জনম আমার জনম এক (সময়)…আমার জনম বড় দুঃখের হে, দুঃখই আমার বয়স…শুন…। এবং ঢাকে কাঠি দিয়াছিল।

তাহার কথার উত্তরে পারিপার্শ্বিক নিথর নিঝুম হইতে উৎসারিত হয়, শালা তুমি মর, তুমি মর তুমি মর লক্‌কড়ে তোমারে খাক!

বিসরিয়ার বাপ ইহাতে গাহিয়া উঠিল–

পাগলা মনা পাগলা মনা।
পাগলা মনা রে।
আনন্দে হরি গুণ গাও!

সম্প্রতি সুঘরাইএর দেহে অনেক কথাই আঁচড়াইতেছে, সারাদিনের নানান ফেরে সে আর একে যেন পরিবর্তিত, অনুকম্পা, করুণা আদি বহুবিধ সত্ত্বগুণ তাহাতে আছে এখন, সে পারিপার্শ্বিক আঁধারে চোখ রাখিয়া উচ্চৈঃস্বরে স্বীয় মনোভাব জ্ঞাপন করিতে প্রস্তুত বিসরিয়ার বাপ ঢাক বাজাইয়া খানিক কাহিল যেহেতু, এই উদাত্ত স্বরে বলিতে পারার জন্য সে খুসী,–বিসরিয়ার বাপ তুমি খেদ কর কেন, তুমি ইচ্ছা করিলে একটা কাঁটাহার, (কাঁঠাল) একটা পাঁঠা, এক পালি চাল খাইতে পার, তোমার ত দুঃখের কথা নহে!

বিসরিয়ার বাপ এহেন প্রশংসায় উজ্জ্বল হইয়াছে, রাতকানা মকরোয়া বেশ বুঝা গেল ঈর্ষায় হাসিয়া কহিল, কে দিবে হে…?

যে সুঘরাই একশত বিচার করিয়া বলে নাই, অথবা কি যে সে ব্যক্ত করিতে মনস্থ করে তাহা তাহার খেয়াল নাই; সে অপ্রতিভ; সে ত্বরিত নিজেই সংযত হইল অথবা সমক্ষের কোন অন্ধকার দেখাতে আকৃষ্ট; আদতে ঐ বৃদ্ধের খেদ কমাইতে সে বলিয়াছিল। এবং আরও নিশ্চয় যেহেতু এই বিসরিয়ার বাপই যে তাহাকে কুয়াতলায় সবিস্ময়ে বলে,–হ্যাঁরে বুতরু তোমার তিতির কোথায়? তিতির বিনা তুমি! আশ্চর্য্য! তোমাকে আমি চিনিয়া লইতে পারি না,…আমি ভাবি একটা গেঞ্জীওয়ালা কেহ…। সেই কারণেও হইতে পারে!

যে এখন মকরোয়ার কম্পনেই ঐ বাক্য স্মরণেই উপস্থিত যে তাহা হদিশ পাইল–যে বৃদ্ধের কুয়াতলার ঐ কথারই জন্য সৌজন্য কৃতজ্ঞতা জানাইতে এযাবৎ সে যেন সুযোগ সন্ধান করিতেছিল, কিন্তু সে অযথা সূত্র ধরিয়াছে!

এমত সময় বিসরিয়ার বাপ যে গর্বে উত্থালিত আছে, বলিল,-হা রে মকরোয়া রাতকানা, যে বুতর তোমারে অদ্য পথ দেখাইয়া লইয়া যাইতেছে, সে খুব ভাগ্যবান…আরে বাবা!…বেজায় ধনী লোকের বাড়ী কাজ করে,…বেজায় ধনী হে…তাহারা ইহারে খুব যত্ন করে, রোজ এ পোয়া চালের ভাত দেয়, কি না বল?…

এই সুঘরাই খুব চতুর হে, এ ডালিম বেদনা দেখিয়াছে…যাহা গ্রামের আর কেহ দেখে নাই…আমি, আমার কথা ছাড়…সে ডালিম বেদানা খাইতে দেখিয়াছে, আসছে জন্মে…সে বড় ঘরে জন্মাইবে…হা রে দুঃখ!…হা হা এই বুতরুর চমৎকার এক তিতির আছে…আহা ঘরকে ফিরবার টান বটে…সুখ দুঃখের সাথী সেটা…।

সুঘরাই, তাহাকে একদিন লইয়া আসিও, দুটা ভাত দিব, ঝুমুর শুনাইব…’ত্রিকূট পৰ্ব্বতই চড়ি ডুমা ছাঁটে বাঁশরে কুরু বনে সুজনোয়া’…দারুণ তিতির, অনেক টাকায় বিকাইবে গো…বড় বড় ঘাটওয়াল জোড়া (কাপড়) দিবে হে, টাকাও দিবে…হা হা যখন তাহার (তিতিরের) বিয়ের ফুল ফুটিবে, তখন আমাকে বরাৎ দিও হে, হাটে হাটে ঢেঁড়া দিব…।

এবং তৎক্ষণাৎ বিসরিয়ার বাপ নৃত্যসহ ঢেঁড়া বাজানর ছন্দে, ঢাকে কাঠি দিল, সেই মত সে বাজাইতে থাকে তিতির বিষয়ক–একের পর অন্য পদবিন্যাসের বিরতিতে, যথা…চোখ উহার কাঁটি কাঁটি, রাগিয়া গেলে লাল, মেঘ ডাকিলে বেগুন বেগুন, আবার তারার মত বটে, নদীর মত হে, আকাশ বাতাসের ছায়া, তাঁহার মাথায় বাবুদের মতন টেরী কাটা, তাহার পাখার ঝাঁপটে পোকা পালায়, তাহার ডাক যেমন বা গাডের (রেল-গার্ডএর) হুইসিল,…রেল ছাড়ল হে…।

এবার তাহার ঘুঙুর বাজিল, পুনরায় ব্যাখ্যা করিল,…তাহার চাহনিতে মকরোয়ার রাত কানা ঘুচিবে, তাহার ডাকে মাদি তিতির পাছা তুলিয়া বসে,…সে বড় জোয়ান–গাছের পাতা তাহার সামনে উড়িলে সে রুখিয়া উঠে…জাত রাজ রাজপুত…বিড়াল হুলাড় ঐ তিতিরকে ডরায়, সুঘরাই তুমি যখন দেখিবে। পাখীটা ঘেঁড়া ন্যাকড়া, ঘেঁড়া দড়িকে ঠোঁট দিয়া কজা করিয়া চেঁকি করে,…তখনই আমায় খবর দিবে…তাহার বিয়ের ফুল ফুটিয়াছে বুঝিবে…যে জোড় খাইবে।…সে যখন লড়িবে শয়ে শয়ে পয়সা পড়িবে…কত লোক হারিয়া ধূলা চাপড়াইবে।

ইহাতে সুঘরাই আপন তিতিরের গুণকীর্ত্তনে নয়ছয় আছে, যে সে মকরোয়ার কম্পনে অত্যধিক প্ররোচিত, উদ্বুদ্ধ, যে সে ইতঃমধ্যে কখন যে মকরোয়ার হাত নিজে ধরিবার মনস্থ করে–ইহা তাহার অজ্ঞাতেই; এবং সে বুঝিল যে সে ঝটিতি আপন হস্ত মুক্ত করিয়া তখনই উহার হাত ধরিল।

মকরোয়ার হাত শিরাবহুল, ও অতীব রোমযুক্ত এবং যাহা অনুভবেই সুঘরাই চমকিত হইয়াছে, যে সে হোঁচট প্রায় খাইয়াছেকীদৃশী অলৌকিক ঘটনা উহা স্পর্শে, কি এক বিহান! সে ধানক্ষেত ঝরণায় স্রোতে পা ডুবাইবে, শব্দ হইবে–নিশ্চয় ও যে তখনই সে সঠিক আরবার মহেশ্বরী ধ্বনি শব্দত দিয়া উঠিল। ইহাতে সে বিস্ময়ে ছেলেমানুষ। অথচ সে নিজে তাহা বিশ্বাস করিতে পারিল না যে উহা তাহার কণ্ঠস্বর, উহা যেমত অন্য আর কেহ!

অন্যপক্ষে রাতকানা মকরোয়া, উঃ বলিয়া সবিনয়ে জানাইল,–হে বুতরু, আমি তোমার উপর নির্ভর করি…বেসামাল হইলে আমিও হইব…আমাকে বুঝিয়া চল…আমাকে বুঝিয়া চল হে…।

অবাক যে এহেন কাতরোক্তিতে সে বিচলিত নহে, যে সে তখন আপন কর্ণে সেই মহাধ্বনির অনুরণনই কেবল শুনিতেছিল, সেই ধ্বনিকে পূর্ণভাবে নিখুঁত শব্দে জানিবার কারণে সে কেমন যেমন নিষ্ঠুর, যে এবং ক্ষণিকেই বুদ্ধি করিল যে সে ভীত ভাণে পুনৰ্ব্বার সেই আস্বাদ লইবে! সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলিয়া আছে।

তাহারা সকলেই পথ চলিতেছিল। বালসরাইয়ের অন্যধারে চড়াইয়ের পূর্ব দিকে রাঙাপড়ির শালবন সেখান হইতে মাদলের আওয়াজ আসিতেছিল, ইতিমধ্যে আঁকাবাঁকা রাস্তার বালি সাদা দেখা যায়–সুঘরাইএর চোখ ছোট হইয়াছিল, আড়ষ্ট গলায় অনুরোধ করিল,–হে বিসরিয়ার বাপ একটু ঢাকে কাঠি দাও…কেন না লক্কড়টা যদি…এবং অথচ এখন ধীর পদক্ষেপে বাজনার অপেক্ষায় না থাকিয়া সে অগ্রসর হয়, এই উত্রাইএর কোথাও বিশেষত কালভার্টের কাছে সে নিশ্চয়ই আপন কম্পিত সুযোগ পাইবে, সুতরাং! ঐ কথা।

তথাপি সে অতীব শান্ত কণ্ঠে প্রকাশিল,দেখ হে মকরোয়া আমি ইচ্ছাসুখে তোমার হাত চাপি নাই, ইহা আমি জানি তুমি বৃদ্ধ, তুমি রাতকানা…আমার কথা তুমি জান না, আমি খাওয়া দেখিয়াছি কিন্তু খাই– নাই সারাদিন…আমি উপবাসী…তাহাতে আমার দুঃখ নাই…আমার মনিবদের হইতে আমি বিচ্ছিন্ন হই– আমি এখন যেহেতু ছেলেমানুষ, লক্কড় ভীতি…।

রাতকানা মকবোয়া এই সুদীর্ঘ আধ ভাঙ্গা বাক্যবিন্যাসে যেমন বা হৃদ্বয় কুঞ্চিত করিল, অন্তত সুঘরাই ইহা অনুমান করিয়াছিল, তন্নিবন্ধন সে যথার্থই সঙ্কুচিত, যে সে আপনার কথার আওয়াজে পীড়িত, সে আপনকার বাম হস্ত এই অন্ধকারে দেখিতে উৎসুক হইল।

ভাগ্যশ বিসরিয়ার বাপ এখন ঢাকে কাঠি দিয়া ত্রিভুবনকে জ্ঞাত করিল,হি সে শালা লক্কড় পেটে যে শালা বোবা, সেই শালার পেটে মদ ছিল, লক্কড় শালা মদের আস্বাদ পাইয়াছে…মাতাল ছাড়া আর কিছু সে খাইবে না…হাঃ আমি কি দুঃস্থ, বহুদিন আমি মদ খাই নাই…আমি তালের কেঁড়ে চুষি!–ইহার অন্তে সে গাহিয়া উঠিল…।

‘ফুলল গুলাব রে ভোমরা চুষাল…’।

যদিও এহেন স্থানে ঐ প্রকারের মস্করা বিসদৃশ, তথাপি সুঘরাই যেমত স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করিয়াছে এবং সে মকরোয়াকে বলিল,-তোমাকে আমার তিতির দেখাইব…তুমি দেখিলে তাহাতে তোমার শীত গ্রীষ্ম বোধ থাকিবে না…। কিন্তু ইহা জ্ঞাত করিতে সে যেমন তটস্থ হইতেছিল, কেন না সম্মুখে বাঁশঝোঁপ, ঝটিতি সে মকরোয়ার হাত সজোরে চাপ দিল, এখন নিশ্চয়ই কম্পন উপলব্ধির আশে নহে।

মকবোয়া ইহার নিমিত্ত প্রস্তুত ছিল, ফলে সে দাঁড়াইয়া পড়িল। অন্যপক্ষে সুঘরাই সভয়ে সেই বাঁশঝোঁপ অবলোকন করিতেছিল, সে শুনিয়াছে এই বাঁশঝাঁপ বড় দুষমন, ভূত আছে; যে ভূত দুইটি বাঁশ পাশাপাশি ভূমিতে আনত করাইয়া মানুষকে মারার কল পাতে, সুঘরাই এই সংস্কারে–অবশ্যই চোরা এই সত্য যে তাহার হাতে নোনা আছে–ত্বরিতে মোহিলি হইতে প্রাপ্ত এক অমোঘ মন্ত্র মনে মনে উচ্চারিয়া আপনারেই প্রদক্ষিণ করিয়াছিল।

তিতির পাখীটি তখন কয়েকদিনের বাচ্চা মাত্র, সুঘরাই আপনার হাতের উপরে বসাইয়া সেই পাখীটি লইয়া যায় মোহিলির কাছে, যে তখন কোদাল দিয়া জমি কোপাইতেছিল, সে তদ্দর্শনে তদীয় বক সমান লম্বা ঠ্যাং ভাঙ্গিয়া লাফাইয়া কহিল,–ছি ছি তোমার কোন কাণ্ডজ্ঞান নাই…তিতিরটি খড়ের উপর বা কোন কাটোরাতে (পাত্রে) আনিতে হয় জান না, তোমারে বলি নাই…সবে ইহার চোখ ফুটিয়াছে…খুব অন্যায় করিয়াছ!…জান না তোমার হাতে নোনা আছে…মানুষের নিজের হাত তাহার মনের কথা শুনে না–হাত ভারী খচ্চড়, কেরেট সাপ হইতেও পাজি…হাত সদ্যোজাত শিশুর দক্ষিণ প্রত্যঙ্গে যে ভূত পায় তাহা হইতেও নচ্ছার!

সুঘরাই ইহাতে মাটির দিকে চাহিয়াছিল, যে সে হয় পাঁশুটে, অথচ মোহিলির বাড়ী পর্যন্ত সারাটা পথ এই হাত দ্বারা এতক্ষণ এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতায় সে মথিত ছিল, ঐ ছোট শাবকের কম্পন তাহার হৃদপিণ্ডকে যেমন ছন্দিত করিতে আছিল এবং এক হাত হইতে অন্য হাতে শাবক রাখিয়া, শূন্য হাত গভীর কৌতূহলে আঘ্রাণ করিয়াছে…কম্পনের কি মধুর গন্ধ! কি মধুর!

সম্প্রতি মোহিলির ভর্ৎসনাতে সে বিচাল্যমান নির্জীব আছে।

মোহিলি কোদাল ফেলিয়া আসিয়া একটি স্থানে দাঁড়াইয়া মন্ত্র বিড় বিড় করিতে থাকিয়া বাম পদ দ্বারা যতদূর সম্ভব–উহা দূরে প্রসারিত করিয়া, ভূমিতে এক গণ্ডিচক্ৰ নির্ম্মাণ করিল, অদ্ভুতভাবে লাফ দিয়া গণ্ডির বাহিরে আসিল ও নানান ক্রিয়ার পর পক্ষীশাবককে গণ্ডির কেন্দ্রে বসাইয়া দিল। অতঃপর চারিভিতে অদ্ভুতভাবে হাঁক মোহিলি পাড়িল, এবার আকাশের দিকে তাকাইয়া স্বীয় বক্ষে চাপড় মারিয়া কি যেন গলাধঃকরণ করিতেই তন্মুহুর্তে মাটিতে সে নিজেই আছাড় খাইয়া পড়িয়া গোঙাইতে আছিল, এবং কাটা-ছাগলের ন্যায় সে কাঁপিতেছে; আশ্চর্য্য যে এবম্বিধ ঘটনায় পাখীটি স্থান ত্যাগ করে না; অন্যপক্ষে বালক থতমত হইয়া পলায়নে উদ্যত হইয়া তেমনই রহে, সে চিত্রার্পিত।

ক্রমে মোহিলির কর্ণদ্বয় নড়িল, এবং যে সে মাটিতে মুখ রাখিয়া অস্পষ্ট বিজড়িত কণ্ঠে কি যেন বলিতে আরম্ভিল,–এখন শোনা গেল, আমি সেই ভূত, আমি সর্বনাশ করিব, যে আমি…জল পান করি, ঐ বুতর কেন তিতিরকে শুধু হাতে বহন করিয়া আনিল, দুয়ার খুলিয়া দিল, পথ করিল; তুমি কেন দেখ নাই, এখন ফল ভোগ কর, তোমরা দুয়ার খুলিয়াছ, পথ করিয়াছ, সর্বনাশ করিব!

তদুত্তরে মোহিলি ঈষৎ তাহার নিজ স্বাভাবিক স্বরে, কি যেন কহিল, সম্ভব মার্জনা ভিক্ষায়। …আমি মরদ মিয়ার একটি ছাগল এখন বিনষ্ট করিয়াছি; আমি এখনই তোমার ও ডোমপুত্রের সৰ্ব্বনাশ করিব, ও তুমি লোহা ছুঁইলে বেশ…তোমরা রক্ষা পাইলে; কিন্তু তিতিরের রক্ত পান করিবই…কেন না যে রহস্য সূৰ্য্যকে ত্রিকূটের পশ্চাতে উঠায় আবার ডিগরিয়ার বামে এবং ডাইনে সরাইয়া ডুবায়, সেই রহস্য যেক্ষণে সবে পক্ষীতে গোড়া লাগে তাই পক্ষীশাবক কম্পিত, সেইতে বালকের হাত লাগিয়াছে যে সে চোর ছ্যাঁচড়া হইবে, উহার হাতে তাই নোনা, (নোনা মানুষের হাত, উহার হাতও নোনা) সেই নোনা লাগিয়াছে, আমি পক্ষীশাবকের রক্ত পান করিব।

মোহিলি স্বাভাবিক স্বরে মিনতি করিল।

…আচ্ছা! যেদিন পিঙ্গল বর্ণের কিদিম কাঠকোম (কাঁকড়াবিছা) খাইবে সেইদিন গোড়ালাগা উহাতে পুরা হইয়াছে জানিও…।

মোহিলি কোদাল পদদ্বারা ছুঁইল এবং অতঃপর উঠিয়া সুঘরাইকে পক্ষীশাবক সম্পর্কে অনেক নিয়ম-মানার উপদেশ দিল, আপাতত মৃৎপাত্রে ছোট কেঁড়েতে পাখীটিকে রাখার কথা কহিল, তিন হাট তিন দিন পর খাঁচা! কঞ্চি কাটার মন্ত্র তাহাকে বলিল। এবং ইহার পর তাজ্জব যে বালকের ভগনীপতি, পাখী যে অপছন্দ করিত, সেও কিছু বলে নাই!

সে, সুঘরাই, সারাদিন এক বিশ্রীদর্শন খাঁচা লইয়া ঘুরিত! আর সূর্যের দিকে সভয়ে চাহিত। কেন না সে এতাবৎ শুনিয়াছে যে সূৰ্য্য নিজে উঠে! নিজেই নিজের জমিদার! এখন জানিল অন্য কথা, যাহা কাহারও সহিত আলোচনা করাতে দিব্বি আছে। শুধু খাঁচার বাঁশ-চৌরস সময়ে নিজ গাত্রের কম্পনে ভীত হওয়ত মোহিলিকে বলিয়াছিল।

মোহিলি উত্তর দিল,–উহা হাওয়ার জন্য বা ঠাণ্ডায় ও কিছু নয়!

সুঘরাই যখন ঐ বাঁশঝোপে যে ইহা রাস্তার পাশে আছে, তির্যক নিরীক্ষণ করিতে থাকিয়া, অদ্ভুতভাবে মকরোয়ার হাত সন্ধান করিতে আছে, তৎকালেই মকরোয়া অনুচ্চ কণ্ঠে বলিল,–হে বিসরিয়ার বাপ, এই বুতরু খারাপ, খচ্চড়…আমার হাতে বড় জোর আবার চাপ দিয়াছে…আমি হোঁচট খাইতাম হে।

বিসরিয়ার বাপ ঐ বক্তব্যের প্রতিধ্বনিতে মন রাখিয়া উত্তর দিল,আহা সে বুরুমাত্র…এখন রাত্রকাল, তাই সে ভীত…নিশ্চয় স্বেচ্ছায় নহে, আরেঃ বাবা! মনিব কত ধনী, সে কিরূপে খচ্চড় হইবে।

রাতকানা মকরোয়া কোন যুক্তিতে কর্ণপাত না করত প্রকাশিল,হাঃ, শালা খচ্চড়!

যে সুঘরাই কায়িকভাবে যেমন এই ছোট তাহারার মধ্যে, তেমনই সে অন্তরেও নিমেষেই উহাদের সহিত এক; কটুক্তি এখনও বিশালতায় প্রতিধ্বনিত হইতেছে, কিন্তু যেহেতু, ক্রমে খচ্চ শব্দটিও বড় হইতে ছোট হওয়ত সৰ্বশেষে দক্ষিণের ক্ষেতের আল হইতে আসিল! তাই সে ক্ষণেক বিভেদে আছিল; এবং যে তাহাতে ইহা আভাসিত হয় যে যেন মকরোয়াতে কোন রহস্যেরই গোড়া লাগে নাই; কিন্তু তৎপ্রবর্ত্তীত অনুতাপ নহে, ছোট ছিছিও নহে, একটু অপ্রতিভ হইবার পূর্বেই পুনরপি, সেই মহাধ্বনি তুলিতে যেন মরীয়া হইল।

যে ধ্বনিতে এক অলৌকিক বিবাহ-যাত্রার ছবি!

৭. স্নেহশীলা মনিব-পত্নী

আর আর পরিচারকবর্গের কথায় স্নেহশীলা মনিব-পত্নী ইদানীং যারপরনাই চিন্তিত; সত্যই সুঘরাই ক্রমশ এক অদ্ভুত অন্ধকার হইয়া উঠিতেছিল, যেমন সে এক চরিত্র! যে সে, বৈদ্যনাথ যাওয়ার দিনের যত ব্যবধান বর্ধিত হইতে আছে, ততই যেন হন্যে, খাঁচার কাগজের ফুলের গন্ধ আর অনুপ্রাণিত নহে, বাগানের ফুল তাহাতে সঠিক স্বর শব্দ জাগায় নাই, খাঁচা সাজাইবার অভিনব উদ্ভাবনশক্তির জন্য সে উন্মত্ত আছে।

অতএব তিনি যখন শুনিয়াছিলেন যে সুঘরাই রাত্রে ঘুমের মধ্যে কি এক, কোন এক ডাক, আজকাল তুলিয়া থাকে, তখন তিনি সুঘরাইকে শুধু বলিয়াছিলেন,–মুখপোড়া রাতে হাত পা বেশ ভাল করে ধুয়ে তবে শুবি! অবশেষে মোহিলিকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। মোহিলি তাঁহারে আশ্বাস দিল, যে সে বিহিত করিবে।

সুঘরাইএর সম্বন্ধে বিবিধ খবরের পর যখন বিশেষত কয়েক দিন বাদে শুনিলেন, যে, ঘুমের মধ্যেই সে দাঁড়াইয়াছে, হাতে তাহার লণ্ঠন, এবং সে ধ্বনি তুলিতেছে! এবং যে তাহার মুখে মৃদু হাসি ছিল, যে সে পুনঃপুনঃ নাসিকা কুঞ্চিত করিয়াছে! এবং সে মাদুরে বসিয়া পার্শ্বস্থিত খাঁচাটিতে কি যেন করে! সে যেন কি বলিতে থাকে পাখীটিরে!

আদতে যাহা সুঘরাই তখন বলিয়াছে, তাহা এই যে, মা ঠাকরুণের নিকট যে কাগজের গুচ্ছ আছে তন্মধ্যে হরিৎ কাগজের পরেই যে কাগজ (যেহেতু সে ঐ রঙের নাম জানে না) সেই কাগজের ফুল করিতে মা ঠাকরুণকে বলিব, এবং সেই ফুল দিয়া সাজাইব, কেন না এখনই সেই ধ্বনি তুলিতেই আমি দেখিলাম বিবাহ-যাত্রার সেই সাজানতে সেই রঙ।

কল্যই আমি ঠাকুর ঘরের নর্দ্দমা পুনরায় শুকিব, তাহা হইলে নিশ্চয়ই আমার সমগ্র ঐশ্বৰ্য্য মনে পড়িবে, আজই নিশ্চয় হইত, হঠাৎ শনিচারোয়া আপন যদি না আসিয়া উপস্থিত হইত!

.

যে সুঘরাই, এখন দ্বিপ্রহর, প্রায় নিঝুম ঠাকুর ঘরের বাহিরের দিকের, নর্দ্দমায় আঘ্রাণ করিতে ছিল; সেখানে নানাবিধ গন্ধদ্রব্যের জল নিষ্কাশিত হয়, ধূম নির্গত হয়, সেখানে ফুলের পাপড়ী ছিন্ন, কখনও কখনও মৃদু পাখীরা জল পান করে। এখানেও যে চমৎকারিত্ব আছে, যে সুঘরাই তাহা জানিত!

শুদ্ধচারিণী মনিব-পত্নী যখনই উহা পরিষ্কার করিয়াছেন তখন সুঘরাই বাহিরে থাকিয়া পয়ঃনালীর মুখ হইতে দূরে রহিয়া কাজ সঠিক হইয়াছে কিনা তদারক করিয়াছে এবং এই সময়ে পবিত্রতার কাছে থাকিতে সে যেমন শঙ্কিত হইয়াছে–এখন ঐ নর্দ্দমায় কিছু ভীতি ছিল যে সে ডোম,তবু এখন যখন সে আঘ্রাণে ক্রমে ভরপুর এবং মুখমণ্ডল আরক্তিম, কোন একভাবে তীর্থস্থানের অপূৰ্ব্ব ধ্বনি ফুকারিতে চেষ্টান্বিত, ঠিক তেমন সময় শনিচারোয়া উপস্থিত, কহিল,–হে রে ঐখানে কি করিতেছ!

সুঘরাই থতমত, চকিতে আপন খাঁচাটি যাহা এখানে ছিল তাহা অন্যপাশে স্থাপিত করিল ও ফুল আর কিছু সুতা এবং ছুরিটি এবার হাতে লইয়া কহিল,নর্দ্দমায় ময়লা আছে কি না দেখিতেছি…!

কি দেখিতেছ? দেখিলাম, তুমি ফের সেইরূপ চীৎকার করিতেছিলে।…আমি দেখিলাম! আমি দেখিলাম!…বল এবার যে লড়াইএর মন্ত্র শিখাইতেছ নর্দ্দমাকে, লড়াইএর মন্ত্র শিখাইতেছ…!

যে সুঘরাই মাথা উন্নত করিতে চাহিলেও পারে নাই, কেননা নিকটের পিচ গাছ, কেন না পশ্চাতের ফলসা গাছ, ইহারা সাক্ষ্য দিতেছিল; তাহা সত্যই ঐ শনিচারোয়া উল্লেখিত যাহা, এখন তাহার যুক্তি নিরর্থক, যাহা অবলীলাক্রমে তদীয় জিহ্বায় আসিয়াছিল। সে তেমন স্বর লাগাইবে সিরিয়ার পিছনের মাঠে যেমত ঘটিল,–সেখানে সে খাঁচা সাজানর সরঞ্জাম রাখিয়া খাঁচাটি একহাতে লইয়া দাঁড়াইয়া, কেননা উপবিষ্ট ভঙ্গিতে সে জোর নাই ভাবিয়া, আপন সমগ্র আবেগ সৎসাহস সঞ্চয় করত সেই ধ্বনি তুলিতে থাকে।

সে ছোট্ট পাহাড়টির পাশে আছে। আজ তাহার পূর্ণ বিশ্বাস ছিল যে, সে সেই শ্রুত শব্দটি পূর্ণ উচ্চারণ করিতে পারিবে! সে নিজেকে শাসাইয়াছে পৰ্য্যন্ত, যে, আজ যদি না ঠিক পার ত পাঁচ চড়! যে। এবং সে তারস্বরে, হাওয়ার বিপরীতে, সেই ধ্বনি অনুকরণে দিক সকল বিদীর্ণ করিয়াছে। তাহার নির্ধারিত অনেকগুলি তিনবার পার হইয়াও–তিনবার উচ্চারণ করিয়াও সে সফলকাম নহে।

কাগজের ফলসমূহে হাওয়া ক্ষেপিয়া উঠিয়াছে, ঝটিতি মনে হইয়াছে সন্ন্যাসী সাধকদের কণ্ঠস্বর সেখানে ফুলেতে দিব্য হইতেছে, হইয়া আছে; আর যে সে তিলমাত্র কালক্ষয় না করিয়া সেই সেই ফুলগুলি তুলিয়া কানের পাশেই ধরিয়াছে, এমত আশায় যে যদি ঐ সম্যক স্বর শুনিয়া নিজ কণ্ঠে তুলিতে পারে, তবেই তাহার সমক্ষে সেই বিবাহ-যাত্রা শোভা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে উদ্ভাসিত হইবে।

আর যে সে তেমনভাবে পক্ষীর খাঁচাটি সাজাইবে!

কিন্তু যতবার সে মনঃসংযোগ করে, ততবারই বেচারী প্রতারিত, সে বিড়ম্বিত! যে এখন কাগজের পাপড়ীতে বাঁচার-জন্য হাস্যকর আওয়াজ সেখানে, টিকটিকি ধৃত পতঙ্গ যেমন বা। যে সেই ফুলগুলির উপর আক্রোশ তাহার হয় নাই–যদিও সে বালকমাত্র–ইহারা তাহার তিতির নহে, এখন সে তাহা হৃক্ষেপ না করিয়া আবার একাগ্র হইয়াছে, যে ক্রমাগত মুখোনি প্রতিনিয়ত এক বিশেষ উচ্চারণে খেলাইতে চাহিয়াছিল।

ইতিমধ্যে এক অদ্ভুত অপ্রত্যাশিত সঙ্কল্প তাহাতে থাকিয়া থাকিয়া উৎচকিত হইয়াছে, যে সে ব্রাহ্মণ (পাণ্ডা) বাড়ীতে চুরি করিবে, বামাল বেচিবে ও পরক্ষণেই অদ্ভুত কাল্পনিক দৃশ্য উদঘাটিত হইয়াছে যে সে বামাল বেচিয়া মহুয়া কিনিল, ও তাহার ভগনীপতি মহুয়া খাইয়া শুয়োর ছানা কোলে লইয়া খুব নাচিতেছে!

কিন্তু ঐ সঙ্কল্প, ঐ দৃশ্য তাহাকে অবাক কিম্বা থ পৰ্য্যন্ত করে না এবং ইহাও সম্ভবত যে-একারণ যে, এখন সে সম্মুখে দেখিয়াছিল কয়েকটি উলঙ্গ বালক প্রায়-উলঙ্গ বালিকা নিকটে আসিল, যাহারা রাখাল ইহারা তাহার প্রতি চাহিয়া আছে, যে বালক কাঁড়ার (মহিষ) পিঠে আরূঢ়, যে কাঁড়ারের গললগ্নি ঘন্টি বাজে, কহিল,–তোমার কি হইয়াছে, তুমি এরূপ চীৎকার কর কেন?

যে এবং এই সঙ্গে আর আর নগ্নতা সকল হইতেও ঐ একই প্রশ্ন হইল।

সুঘরাই একদা আপনকার হস্তধৃত খাঁচার দিকে চাহিল, দেখিল, ফুল আর টুঙী; এবং দেখিল, আপন প্রিয় পক্ষী ঘাবড়াইয়া আছে; আর যে নিখোঁচ কণ্ঠে উত্তর দিল,আমি ইহাকে সাহসী করিতেছি, ইহাকে নির্ভীক…ইহাকে দুর্দান্ত করিতেছি…লড়াই তাহার কাছে শুনা ডাল ভাঙার মত যাহাতে সহজ হয়!…যাহা শুনিয়াছ তাহা এক দারুণ মন্ত্র, ইহাতে তিতির দামাল হয়।

যে নগ্ন অল্পবয়সীরা ইহা শ্রবণে নিজেদের মধ্যে তর্ক করিল, নিজেদের দেহের বিবিধ স্থানে হাত দিল, কেহ চুলকাইল; সিদ্ধান্ত করিল, আরেঃ বাববা! এক হাট ভৰ্ত্তি জমিদারের বাবার বাবার বাবা, উহার মনিব, কত কত ধনী…এরূপ মন্ত্র নিশ্চয় আছে…আমরা ডিগরিয়া জানি, ত্রিকূট জানি…কত কি জানি না!…আঃ খাঁচাটি কি সুন্দর!…ঐ গোল মত ফল কেমন যেন দেখিতে, আ আমরা কিছুই জানি না; উহাকে কি বলে? কি অপরূপ সে যাহার এরূপ খাঁচা আছে…সে খুব খুব!

এবং ঐ ধ্বনির কারণ রূপে সুঘরাই সকলকেই ঐ যুক্তি দিয়াছিল। এখন সে নিঃসম্বল দৃষ্টিতে নর্দ্দমাটি দেখিতে থাকে।

শনিচারোয়া যোগ দিল,–এখন…মালীর বৌ সবই দেখিয়াছে.যে তুমি নিত্য মাঠে যাও সেই তুমি বাহির-এ পাইখানায় গিয়াছিলে…তোমার ছাড়া কাপড় সিঁড়ির পাশে আতা গাছে ছিল (এই বাড়ীর আচার অনুযায়ী) তোমার খাঁচা সিঁড়ির তলায় ছিল…তুমি উলঙ্গ অবস্থায় আসিয়া সাজান-তে ঠিক দাও…পাখীটিরে খোঁচাও…সেখানে চীৎকার ঠিক কর নাই, চাপা স্বরে কর…তুমি বিড়ি খাও না অথচ তাহাকে বলিয়াছ উহা চন্দনী বিড়ি…সে যখন জিজ্ঞাসা করে এত ধূপের মত গন্ধ কেন…ইহার অর্থ কি?

সুঘরাই এবম্প্রকার প্রশ্নে আশ্চৰ্য্য যে একটুকু বিচাল্যমান নহে, সত্যই যে সে একটি ধূপ জ্বালাইয়া বারম্বার সেই ধ্বনি তুলিতে আপ্রাণ করিয়াছে, মাঠে ঘাটে ঈদৃশী চেষ্টা হাওয়ার নিমিত্ত বৃথা হইয়াছে। তজ্জন্যই, মল্লিক লজের পশ্চাতে একমাত্র ছাদহীন বাড়ীতে সে যায় নাই।

কারণ সেখানে স্ত্রী-লোকরা বহুসময় যায়! তাই ঐ স্থান, যেখানে সম্মুখের নোনা ধরা দেওয়ালে বিরাট মাকড়সা, ও পাশের দেওয়ালের গায়ে বিশ্রীদর্শন টিকটিকি…আর যে ইতিমধ্যে সে–প্রজ্জ্বলিত ধূপ হস্তে সে পবিত্র ধূমায়িত, সে খানিক চোখ বুজাইতে শঙ্কিত, তথাপি সে নিজেকে সোজা দৃঢ় করিয়াছে এবং সে সেই বিবাহ-যাত্রার সন্ন্যাসী সাধককৃত অভিনন্দন ধ্বনি তুলিয়াছে, ফলে তাহার শরীর কেমন যেমন বেসামাল হইল, তন্ময় হইল, যেন তাহার অন্তরীক্ষে কোথাও মনিব মহাশয়ের বিছানার মত বিছানা–সে শঙ্কিত হইয়া উঠিয়াছিল–কি ব্রণ-বিরহিত শুভ্রতা! এখন এবং সে দৃপ্তস্বরে মালীকে কহিল,–সে বিড়ি খাইতেছিল।

আবার মিথ্যা!…পাপ হইবে…অবশ্য তোমরা ডোম, পাপের কি জান বটে।

আবার আমাকে ডোম বলিতেছ…দাঁড়াও মাকে বলিব…।

…কোথায় ডোম বলিলাম? ও…ও…উহা আমার মুখ হইতে…আপনি…। এবং শনিচারোয়া অসহায়ভাবে থামিয়াই আরম্ভিল,কতবার বলিলাম মোহিলিকে আবার ডাকিতে…এখনই সুরাহা হইত!…আমরা ভাবি তোমার কি হইল…!

সুঘরাই শনিচারোয়ার এই ডোম সম্বোধনে চোরা-হৃষ্ট ছিল। কিন্তু মোহিলির উল্লেখে অল্প বিমর্ষ, অবশ্য মমতাময়ী মনিব পত্নী এখনও, পরিচারিকাবর্গের অনুরোধে কর্ণপাত করেন নাই, এমনও যে স্বল্পভাষী মরদ মিয়া সে-ও এবং অনেকে তাহাকে সুঘরাইকে মাঠে মহাধ্বনি তুলিতে দেখিয়া বলিয়াছিল, ইহা এরূপ কাণ্ড ভাবিবার কথা মা!

কিন্তু তিনি মৃদু হাসিয়া ব্যক্ত করিয়াছেন উহা সুঘরাইএর উল্লাস মাত্র খাঁচাটি যেহেতু মনোরম দেখিতে হইয়াছে! কিন্তু ইদানীং সুঘরাই বেশ অনুভব করে যেন তাঁহার সেই-পরিচিত ভাব–যাহা প্রশান্ত প্রসন্নময়ক্রমে অন্তর্হিত হইতেছে; বিশেষত গতকাল সে লক্ষ্য করিল, যে তিনি পাখীটির ঘা বৃদ্ধি দেখিয়া ঔষধ দিতে থাকিয়া কহিয়াছেন,–ফের যদি দেখি খুঁচিয়েছ তাহা হইলে কিন্তু ভাল হবে না…আমি কিন্তু…।

সুঘরাই এক নূতন স্বরে কহিল,–উহা ঐ পাখী নিজের ঠোঁটেই…বিশ্বাস করুন…খুঁচাইয়া মানে…ঔষধ পৰ্য্যন্ত খাইয়া ফেলে…তাই…।

ও সব কথা থাক…খবরদার প্রাণী হত্যা হয় যদি তাহলে তোরই একদিন কি আমারই একদিন…আমি বুঝি না…ও অজ্ঞান…নড়বে চড়বে কোথায়…অত যদি তাহলে পায় দড়ি বেঁধে রাখ…সাজানর চোটে বেচারীর জল খাবার বাটিটা পর্যন্ত সরিয়েছিস, ডোম না হলে এমন নির্মম বুদ্ধি হয়।…চোখ নেই, বেচারী প্রায় ঐখানটিতে বসে থাকে…।

যে এবং তিনি পাখীটারে সোহাগ জানাইতে কালেই পুনরায় বলিলেন,–তো চন্নামেত্তর খাওয়া কেন? আমারই ভীমরতি!…তুই যে মুখপোড়া বলিস ওকে একবার মারলে আমি নিজে দশবার খাই…কৈ দেখি কোথায় তোর এমন ঘা…বজ্জাত…ঠাকুর, মাগো, এত লোককে তুমি সুমতি দাও, এই ডোম হারামজাদাকে একটু দিতে পার না…পাপ হয় জানিস না…ফের যদি খোঁচাবি!…

আমি তাহারে ভালবাসি যে!

কিয়ৎ দূরেই সুঘরাই এই সতর্ক-আজ্ঞা মানিতে অবশ্যই প্রস্তুত হইলেও ইহাও সে জ্ঞাত করিতে উদগ্রীব, কেননা হস্তে-অঙ্কিত বিছা সে দেখে, যে শুধু তাহার দ্বারা বা কোন কিছুর দ্বারাই উহার ক্ষতিসাধন সম্ভব নহে, এ কারণ যে উহাতে এক রহস্যের গোড়া লাগিয়াছে! সুতরাং তাহার মুখে এক নির্ভাবনা অস্পষ্ট হইয়া রহে, কিন্তু ইহা কতক্ষণ, অবিলম্বেই সে বুঝিয়াছিল যে তিনি, মনিবপত্নীও তাহার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকাইয়াছিলেন। যাহাতে তাহার অন্তঃস্থল পর্য্যন্ত উদঘাটিত, আর যেমন সে ত্রস্ত ছিল।

.

যে ইহা সত্যই, তাহাকে তিনি অনেকবারই ঐ ধ্বনি সম্পর্কে মধুর কণ্ঠে প্রশ্ন করিয়াছেন; কিন্তু সুঘরাই কোন সময়ই মূল কারণ প্রকাশিতে সৎসাহস পায় নাই। মধ্যে মধ্যে অদ্ভুত কথা মনে আসিয়াছে, যে একদিন তুমুল বৃষ্টি হয় তখন বলিব, একদিন সাগরি পাখী বাজের দ্বারা তাড়িত হইয়া কুয়োর ভিতরকার বট গাছে বসে তবে–তখন বলিব, একদিন আমার খুব জ্বর হইবে–তখন বলিব।

মোহিলি বলিয়াছে,-যতদূর মনে হয় দেওঘরে যাওয়াটাই অঘটন হইয়াছে…ডোমের ছেলে…নিশ্চয়ই কোন ফুল বা প্রসাদী কিছু মাড়াইয়াছে…কিম্বা কিছু ছুঁইয়াছে, কোন দেবস্থান চুঁইয়াছে। বা…ভূত হইলে অনেকবিধ জ্বালাতন করিত, তবে সে হয়ত এইরূপে ধীরে ধীরে পাগল হইবে…তবে এখনই সব বুঝা যাইবে… সুঘরাই কোথায়!

সত্ত্বগুণশালিনী মনিব পত্নীর ডাকে সুঘরাই আসিল, ভৃত্যবৎসলা রমণী সুঘরাইকে আপন কক্ষে লইয়া বলিলেন,বলবি ত বল, না হলে পাখী খোঁচানর আদত কথা মোহিলি তোকে এইসা মতোর দেবে যে…।

এই পর্যন্ত শুনিয়াই যে সে মোহিলিকে একবার দেখিতেই তাহার আপনার দৃষ্টি যেন কোথাও বা নিবদ্ধ হইয়াছিল–সমক্ষে আয়না ছিল, সে ওষ্ঠদ্বয় জিহ্বার দ্বারা ঈষৎ বুলাইয়া কহিল,–আমি সেই চীৎকার যে কেন করি তাহা বলিতেছি…আমি পাগল নই…আমাতে কোনও প্রেতাত্মা ভর করে না…আমি বহুজন্মের পুণ্য (!)…তাই এই বাড়ীর দাস…এখানে আমি গেঞ্জী পরিয়াছি…বালিশ পাইয়াছি…এমন কি বৰ্ত্তনে খাই…বহু জন্মের পুণ্যবল আমার…তাই মাঠাকরুণ আপনি আমারে বৈদ্যনাথ লইয়া যান…আমি এক উৎকৃষ্ট রত্নসামগ্রী মণ্ডিত, শোভাযাত্রা দেখি! যাহা ভগবান বৈদ্যনাথের কাছে যাইতেছিল!

আঃ অলৌকিকত্ব! ধৰ্ম্মশীলা মনিব পত্নী নিশ্চয় ইহা বলিয়া করজোড় করিয়াছিলেন।

চৌকোণা ছত্র-এর তলে অলোকসামান্য বালিকা, হস্তে ধান্যমঞ্জরী!

আঃ ষড়ৈশ্বৰ্য্যময়ী কাব্যবীজ! সম্পূর্ণ চিত্র মনিব পত্নীর সমক্ষে ভাস্বর হইল!

সেই নববধূ চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিয়া আবার নাসাথে চাহিলেন, তাহাতে সকলেই করজোড়ে কহিল, আমরা সুখী, সুখী! মুক্তি মুক্তি! আঃ সৌন্দৰ্য্য!

এবং সাধক সন্ন্যাসীবর্গ নববধূর ত্রিনয়ন দর্শনে নানারূপ ধ্বনি তুলিয়াছিল, এই বলিয়া সে বিচিত্র ধ্বনি সৃষ্টি করিতে থাকে।

আঃ আধ্যাত্মিকতা! বলিতে সময় শুদ্ধা ভক্তিমতী মনিব পত্নীর দেহ পূত রোমাঞ্চে ভরিয়া উঠিল। তাঁহার আয়ত বিশাল নয়নে অশ্রু সঞ্চারিত হইল। ক্রমে যে তিনি নিস্পলক শিখাবৎ তিনি তাঁহাদের প্রিয় নীচকুলোদ্ভব ভৃত্যের প্রতি অতীব শ্রদ্ধায় চাহিয়া আছেন। আশ্চৰ্য- সে পূজা হওয়া ফুল সকল খাইয়াছে।

যে তখন সুঘরাই কহিতেছিল, আমার খাঁচাটিরে তদ্রূপ আমি সাজাইতে অভিলাষী, আমার কেন কি জানি সমগ্র সজ্জা আমার এক কালে মনে পড়ে না…তাই আমি সেই সন্ন্যাসীবর্গের মত উদাত্ত স্বরে ধ্বনি তুলিয়া থাকি, কথাগুলি আমার যদিও মনে নাই, ধ্বনি তুলিলেই আমার কিছু কিছু প্রত্যক্ষ ঘটে, আমি খাঁচাটিরে সাজাইতে চাই…সেই ছত্র, সেই বিবিধ রত্ন সমুজ্জ্বলতা সেই সামগ্ৰী সমন্বিত!

মোহিলি দেখিল ঐ ত মৃত্যু! এবং সে মন্ত্রর ধ্বনি হাঁকিল, বালকও দমে নাই–দুজনে নানা ধ্বনি তুলিতে লাগিল।

পরম বিবেকী মনিব পত্নী আশ্চর্যান্বিত হওয়ত তখনও আত্মস্থ, একদা মনে হইল, এই বালক অপরিমিত! পরক্ষণেই খাঁচার দিকে নেত্রপাত করিলেন, বুঝিলেন যে কেন সুঘরাই খাঁচার অভ্যন্তর ইদানীং সাজাইয়া থাকে, হায় সে যদি পক্ষীটিকে সাজাইতে পারিত–সঠিক থামের মত প্রলম্বিত ফুল রেখা…পূর্বে যেখানে সাজান, খাঁচার বহির্দেশই, প্রতিসম ছিল, উত্তর প্রতি-উত্তর ছিল এখন সেখানে ভেদ উপস্থিত, এক কেন্দ্র ধরিয়া নির্মাণ সঙ্ঘটিত, এক বিস্ময়! এবং তৎকালেই তিনি পক্ষীটিরে নিরীক্ষণ করিলেন, যাহা শ্রান্ত যাহা অপ্রাকৃতিক যাহা বেচারী! যে এবং তিনি অমোঘ স্বরে বলিলেন, ইহা পুরুষ! হায় তাঁহারও ভগবতীতনুর কথা মনে আসিল না!

সুঘরাই মনিব পত্নী উত্থাপিত এবম্ভূত সত্যের সমক্ষে তথাপি সমগ্র আবেগ দিয়া মহা ধ্বনি তুলিয়া সলজ্জ কণ্ঠে শুধু জানাইল, হয়ত নিশ্চয় সেই কথা এইরূপ! অবশ্য এই ধ্বনি এখন শেষের অক্ষর অর্থাৎ–’রী’ সুস্পষ্ট অভিধানে শুত হইল!

ধর্ম্মপ্রাণা মনিব পত্নী কহিলেন,–এতদিন কেন বলিসনি…আমি তেমন তেমন সাজিয়ে দেব, যা হোক এখন ডাক্তারকে আমি আসতে বলেছি, পাখীটা কেমন ধুকছে!…বুঝতে পারছি না হঠাৎ কেন এমন হল! খুব খুঁচিয়েছিস বুঝি? একে ত তাজা করতে হবে…না হলে সব বৃথা…।

সুঘরাই কহিল,–আপনি ভাবিবেন না কাল শনিবার…আমি ড়াডুপোকা উহাকে খাওয়াইব, আমাদের ঘরের পাশে ফণীমনসা হইতে পাতা চয়ন করিব…কেননা তদ্বারা ডাডু ধরা বিধেয়…ডাভু পোকা খাইলে উহার আরোগ্য হইবে…আপনি নিশ্চিন্ত হউন।

.

ডাক্তারবাবু পাখীর খাঁচাটি দেখিয়া অভিভূত, যে তিনি খুব সন্তর্পণেই তাহা অবলোকন করিতে থাকিয়া প্রশংসায় কহিলেন,–অভিনব! এরূপ কখনও দেখি নাই…সার্থক!

সুঘরাই আপনার নিন্দাকে কজা করিয়া টেবিলের একান্তে দণ্ডায়মান যে সে এমন কি খাঁচাটির দিকে। নজর করিতে সক্ষম নহে! সে আপন পাখীটির গায়ে এখন হাত বুলাইতে আছে।

ডাক্তারবাবু পুনরায় প্রকাশিলেন,–নিশ্চয়…ইহাতে আপনার লক্ষ্মী-শ্রীযুক্ত হাত, নিশ্চয়ই হলপ না। করিয়া বলা যায় যে, আছে…আহা ইহা এই খাঁচা যেন অলকাপুরীকে হার মানাইয়াছে!

এতাদৃশ গুণকীর্ত্তনে ধীর সৎস্বভাবা মনিব পত্নী কুণ্ঠায়ে বলিলেন,–আমি না, ছোঁড়াই অষ্টপ্রহর ঐ। নিয়ে আছে…উনি বলেন ছোঁড়ার টেষ্ট আছে…খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হল তার এঁড়ে কিনে…ফুলগুনো বটে আমি করে দিয়েছি…ছোঁড়ার কত সখ তাজা ফুলের মত গন্ধ হোক, তাই একটু পারফিউম দিয়েছি, তাজা ফুলে পোকা থাকে, পাখী ঠোকরায় দেখে, মানে ওনার সাজান নষ্ট হয় দেখে, উনি খোঁচান ত…তাই বললুম…ও কি মানুষ!…সেই খুঁচিয়েই ত ঘা…এখন আবার আর এক জ্বালা পাখীটা মদ্দিখানে না থাকলে… খোঁচাবে দেখুন দিকি…। এই পর্যন্ত ব্যক্ত করিয়া মনিব পত্নী সুঘরাইএর প্রেরণা, বাস্তবতা, অভিজ্ঞতার কথা সবিস্তারে কহিয়া অনুরোধ জানাইলেন,–এখন দেখুন ত ঘা-টা–নিম-ঘি এটা-সেটা সবই ত দিলুম…এ সবই জানেন ওঁর জন্যেই ওঁর আহ্লাদেই হয়েছে…উনি কিছুই বলেন না…!

.

যে মনিব পত্নী বহুবারই তাঁহার স্বামীকে সুঘরাইএর এই স্বভাব জ্ঞাত করিয়াছিলেন; তদুত্তরে মনিব মহাশয় তখন বলিয়াছেন,–দেখ…তুমি উহাকে কোন জ্ঞান দিবার আদেশ লইয়া আস নাই…উহারে কুড়াইয়া খাওয়া পাপ অস্বাস্থ্যকর বলিয়া যেমন অনেকে ক্ষান্ত হয়…আমরা তাহা নই। আর যে উহারা এত দুঃস্থ এত নিঃসহায়…পাপ কোথায়…বেচারীর নিয়তি পৰ্য্যন্ত নাই। সে দেহ সচেতন মাত্র নহে…দেখ না হাঁ করিয়া মুখ দিয়া মাছি ধরে…! আমাদের ভক্তির জোর থাকিলে উহার পাপও থাকিবে না…। উহার পাপ আমরা লইব…! কেননা উহা তাহার নহে…! ঠাকুর ভিন্ন গতি নাই…। আমরা কেহ কিছু নই!

.

এখন ডাক্তারবাবুর সমক্ষে, স্নেহময়ী মনিব পত্নী এবং সুঘরাইকে আজ্ঞা করিলেন, মুখপোড়া ওকে…পাখীটাকে, উল্টে ধর না…আলতো করে ধর! আমি টর্চ ফেলছি…।

ডাক্তারবাবু পাখীর দিকে তাকাইয়া কুঞ্চিত করত মন্তব্য করিলেন,–এখন থাক, এ কি পাখী এমন ঝিমাইয়া পড়ে কেন…যেন নিস্তেজ…উল্টাও ত…বুকটা চিতাইয়া ধর…একটা এসেন্সের গন্ধ যেন!

ঘা থেকে বিশ্রী গন্ধ বেরুচ্ছিল, তাই আমি একটু পারফিউম দিলুম, অন্যায় হয়েছে…।

তাহা নহে…তবে গন্ধক মানে…।

গন্ধক…গন্ধক!…এ বাড়ীতে? অবশ্য প্রথম আসার আগে গন্ধক ধোঁয়া দেওয়া হয়…ছোঁড়া গন্ধক কোথায় পেলি…ও বুঝেছি, বন্দুকের টোটা তৈরীর কলে বারুদে…তাই বা…।

মানে মলম…হ্যাঁ নিশ্চয় কোন মলম এই দেখুন…নিশ্চয় এই মলম পাখী খাইয়াছে…!

কোথায় পেলি আমি ত দিই নি…তুই কি সেই ফেলে-দেওয়া টিউবটা থেকে…তাতে ত কিছু ছিল না…সেটা বিষ লেখা থাকলেও এত কি…নিশ্চয় তুই সেটা দিয়েছিলি…?

না…তাতে এমন কিছু হইয়াছে বলিয়া মনে হয় না…তবে সাময়িক একটু কাজ করিয়াছে…তুমি ত বাপু বড় নিষ্ঠুর,…তুমি ত বড় তামসিক হে…দেখ কি করিয়াছ–শোৎ! পুঁজ, ছি ছি খাঁচাটিরে এরূপ সাজাইতে যখন তোমার মন আছে…তখন…ইহার জন্যই ত বাপু সাজান ছিছি…যতবারই আমার খাঁচার প্রতি দৃষ্টি যাইতেছে ততবারই জানেন আমার মন হইতেছে যে এতেক মনোরমত্ব বুদ্ধি উহাতে যে আছে তাহা আমার কল্পনাতীত…যাহাদের ছটাক জমি পর্য্যন্ত নাই–যাহাদের তাল ও কাঁঠাল আর ব্যাঙের ছাতা খাইয়া জীবনধারণ…গরুর জন্য রক্ষিত ফেন বৈ অন্য কিছু যাহারা চুরি করিতে সাহসী নহে…পাণ্ডা বাড়ীর গাছের শুকনা উড়ন্ত পাতা স্পর্শ করিতে যাহারা ত্রস্ত হয়, তাহাদেরই একজন এই বালক…তাহাতে এত সূক্ষ্মতা!…এই নিষ্ঠুরতা তোমায় পরিত্যাগ করিতে হইবে…পরিত্যাগ কর…তোমার কি মন চাহে না যে পাখীটিরে সকলে দেখিয়া সুখী হয়…! দেখ ত কি বিশ্রী গন্ধ বাহির হইতেছে…।

যে সুঘরাই, ইহা বলার কথা নহে, ঐ উৎকট ঘেমো গন্ধ কখনও কখনও শুকিতে থাকিয়া, লোকচরাচরের চারিদিকে অপটু দৃষ্টিতে চোখ ফিরাইয়াছে বটে, কিন্তু তাহাতে ঘেন্না নাই ও সে ভীত নহে; যে ঐ গন্ধ কুৎসিত ইহা তাহার দ্বারা বিচারিত হয় না, এবং ইহাও নির্ঘাত যে তাহাতে ক্কচিৎ আভাসিতও হয় নাই যে চন্দনাদি গন্ধ দ্রব্যের নিমিত্ত উন্মত্ততা তাহার অন্তরে আছে।

ঠাকুর করুন তোমাতে মায়ামমতা দেখা দিক! ডাক্তারবাবু যেন প্রার্থনা করিলেন।

ড়াডুপোকা ফণীমনসার পাতা দিয়া ধরিয়া তিতিরকে খাওয়াইবার বিধিমতে সে লুড়িয়া গ্রামের ঝাঁকাল ফণীমনসা হইতে পত্ৰসংগ্রহ করিতে যায় এবং সেখান হইতে খাঁচাটি হাতে সুঘরাই যখন তাহার ভগনীপতির ঘরের সামনে, তখন হাওয়াতে বৃক্ষের ডালসকল নুইয়া অদ্ভুত রূপ ধারণ করিল, অদূরে কাতার দিয়া লুড়িয়া গ্রামের অনেক উলঙ্গ শিশু–ইহারা পড়িমরি করিয়া সুঘরাইকে অনুসরণে এখানে আসিল, ইহারা খাঁচাটি অবলোকনে সম্মোহিত।

সুঘরাই হৃষ্টমনে চারিদিকে নেত্রপাত করিল; সে সেই চির-অভ্যস্ত ঘেমো গন্ধ পাইল, কিন্তু খাঁচাটি টলে নাই, যে নিশ্চয় ঐ গন্ধে সে নাসিকা কুঞ্চিত করিবার মুহূর্ত পায় না, যে অথবা অবশ্যই এখনও কোথাও তাহার স্বভাবে সেই গন্ধ সহজ স্বাভাবিক রহিয়া থাকে। কোথাও সে কিস্তৃত হাড়ী, ঘরের কোথাও ছেঁড়া ছেঁড়া চটের থলি এতদিন তরাসে যাহা লক্ষ্য হয় না, অদ্য স্পষ্ট এ সকল তাহার দ্বারা লক্ষিত হইল; ভগনীপতি তাহাকে দেখিয়া, তাহার খাঁচা অবলোকনে এক কোদাল-হা হইয়াছে, সে খুসীতে কখনও কহিল, খুব…খুব…খুব বহুদিবস পরে আত্মীয় দেখিলে…এক পাতা চিড়া দধি দেখিলে, যে আমোদ সেই আমোদ হইল, তোমাকে ও তোমার খাঁচাটি ও পাখীটি দর্শনে বটে আমোদ হইল।

ঐ লোক আপন রক্ষিতা ও পোষ্য শুয়োরটিকে বারম্বার আজ্ঞা করিল,…দেখ দেখ। এইরূপে এতই সন্তোষ প্রকাশ করে যে তাহা অবর্ণনীয়, যে সে আপন ঊরুদেশে, আপন বাহুতে, কখনও বা বৃক্ষের কাণ্ডে চাপড় মারিল, তাহার শুয়োরটি ঘোঁৎ ঘোঁৎ করিয়া পলাইয়াছিল, ক্রমে সে এতেক গর্বিত যেমন যে, তাহার বসিয়া খাইবার পুঁজি আছে। সুঘরাই ইহাতে স্ফীত অসম্ভব, এতদিন পর ভগনীপতিকে আর মন্দ প্রকৃতির বলিয়া বোধ হয় নাই।

ভগনীপতি আরও প্রকাশিল যে, লোকমুখে শুনিয়াছি তোমার পাখী ও খাঁচার প্রশংসার…কতবার উহা দেখিতে সাধ হইয়াছে…তুমি ভয়ে আন নাই…আমি কথা দিতেছি কখনও ইহা আমি কাটিয়া খাইবার কথা মুখে আনিব না…আহা খাঁচাটি যেন বিবিধ অলঙ্কার-ভূষিতা রমণীসদৃশ,…না না উহাকে তাড়া দিও না…ঐ বিশ্রীদর্শন কুকুর দেখিয়া, এখানে নূতন লোক দেখিয়া ভড়কাইয়াছে…বাহির করিও না উড়িয়া যাইবে…উহাকে লড়াই শিখাইতেছ ত? হ্যাঁ উহা মস্ত জঙ্গী হইবে…লড়াই লড়াই…এবং সকলেই তোমার পাখী দর্শনে চক্ষু সার্থক করুক, সকলেই গ্রামগ্রামান্তরে এই সংবাদ লইয়া যাক যে রিখিয়ার অন্তঃপাতি লুড়িয়া গ্রামের…হাড়িয়াল ডোমের শালার এক রূপবান পাখী আছে…একি তুমি ভ্রকুঞ্চিত করিয়া আছ কেন…আহা উহারে শাসাইও না…ছি ছি! আঃ খাঁচাটি যে…।

ইতিমধ্যে পাখীর ব্যবহারে সুঘরাই আরও অপদস্থ, এবং যে তাহাতে এবম্প্রকার বৈচিত্র্য আসিতেছিল যে তন্মহূর্তেই পাখীটিরে আক্রমণ করে, যে সে তীব্র কুপিত, মনে মনে সে বড় আপন এই প্রিয়স্পদের উদ্দেশে মুখ খারাপ করে এবং অনেক গঞ্জনা অনেক আপশোষ তাহাতে বিস্ফারিত, যে যেমন…শালা তোমারে এত শিখাইয়া পড়িয়া আনিলাম…ডাক্তারবাবুর ঔষধই তোমার কাল হইল…বেশ ত ছিলে…সারা দ্বিপ্রহর ধরিয়া আমার সাজানকে বানচাল করিলে…আমার মাথায় তেল দেওয়া বৃথা। গেঞ্জী পরা বৃথা হইল…আমি বাড়ি গিয়াই (মনিব বাড়ী) খাঁচা হইতে তোমাকে বহিষ্কৃত করিব…হুলাড়ে রাত্রযোগে তোমার টুটি ধরিবে…!

.

এখনও মায়ামমতাহীন রোষে সে যখন গৰ্জাইতে আছে, তৎকালে ঝটিতি যে মনিব মহাশয়ের স্বর তাহার কণ্ঠে ধ্বনিত হইল, যে এবং মনিব পত্নীকে সাক্ষাৎ দেখিল, ফলে সমস্ত মানসিকতা পরিবর্তিত, এখন সে কাপুরুষ! আপন সপক্ষে এইটুকু যুক্তি পাখীটিরে দিয়াছে, যে…আমি কি সাধ করিয়া রাগিতেছি…তোমার জন্যই ত সাজানরে, মূঢ়! তুমি যদি, তাহাতে বিশৃঙ্খলতা আনয়ন কর, তাহা হইলে কোন মানুষ না বিরক্ত হয়, আমি তো ডোম…তুমি জংলী, সাজান আমার প্রাণ…আমার সঙ্গ করিয়াও তুমি এখনও ভূত…আমারে দেখিয়া শিখিতে পার না…জান না, সাজানর মধ্যে আমি কি দেখি, আমিও চাই সকলেই তাহা দেখুক!.আর নড়া চড়া করিও না, যাহা ঘটিবার ঘটিয়াছে!

সত্যই খাঁচাটি সাজানতে তদীয় বিস্ময় নিভাঁজ নিখুঁত পূর্ণ মাত্রায় ঝমরিয়া উঠিয়াছে; ইহাতে তাহার ডোমজ সৰ্ব্বাঙ্গ বিশাল হইল। এমনও যে মহুয়া গাছটিতে টানান হাটতলার যে লাল পোস্টবক্স না-ছুঁইতে-পারার আঁট-হাটতলার ঐ পোস্টবক্স প্রত্যক্ষে সে ঝটিতি তাহারা হয় যে তাহারা সাক্ষাৎ পাপ!ব্যতীত পৃথিবীর পরেও যে আর এক সত্য আছে যে যাহা সুঘরাইতে উদ্ভিন্ন!

সে খাঁচাটি লইয়া মন্থরগতিতে চলিতে আছে, এখন তাহাতে ইতস্ততর মাত্রা আর নাই! খানিক পথ। অতিক্রম করিতেই এখন এমন হইল যে,–তাহাদের গ্রাম ও রিখিয়ার রাস্তার মধ্যে নলিনীবাবুর বাড়ীর পিছনে (অর্থাৎ আমাদের বাড়ীর) যে বিরাট প্রাচীন অশ্বত্থ গাছ আছে, সেখানে অনেক জনসমাবেশ, অনেক খাঁটিয়া, অনেক হুঁকা, অনেক ধোঁয়া, অনেক কাশির শব্দ, অনেক কথাবার্তা; এক বৃহৎ চক্র দিয়া বহু লোক উপবিষ্ট!

ইহা ছোট না-জলচল জাতির সম্মেলন, মনুষ্যচক্রের কেন্দ্রে, মধ্যখানে, এক অগ্নি প্রজ্জ্বলিত; তন্নিকটে এক যুবতী আসীনা–সে কেঁদে, তৎসহ এবং হুঁকা খাইতে আছে–এই সেই যুবতী, একদা মধ্যরাত্রে তদীয় স্বামীকে হত্যা করে শ্বশুরালয়েই, এবং যে, সেই রাত্রেই সেইখান হইতে একটি মস্ত কাঁঠাল লইয়া প্রায় চার ক্রোশ পথ ভাঙ্গিয়া রিখিয়ায় পিত্রালয়ে পালাইয়া আইসে। এই যুবতাঁকে লইয়া মারাত্মক তর্ক, অন্যান্য জাতির লোকও এখানে উপস্থিত তাহারা দুরে দাঁড়াইয়া আছে।

মুসলমান সম্প্রদায়ের অনেকেই এখানে আছে–যাহারা অনাহূত তবু তাহারাও মাঝে মধ্যে যুক্তি সরবরাহ করিতেছিল!

এবং যেইমাত্র ঐ ঐ লোকেদের, সমবেতদের, সুঘরাইকে দৃষ্টিগোচর হয় সেই ক্ষণেই এই বিজ্ঞ সম্মেলন প্রায় ছত্রাকার, যে, ঈদৃশ রোল উঠিল যে, ঐ সে বালক যাহার সুন্দর তিতির আছে, ঐ সেই বালক যাহার খাঁচাটি দেখিতে মহারাণী সমান, ঐ সেই বালক যে এখন খাঁচা লইয়া যায়! যে এবং অজস্র হাতছানি ওতপ্রোত হইল।

ইহাতে সুঘরাই গৰ্ব্বমিশ্র অস্বস্তিতে আপনার স্কন্ধস্থিত গামছায় ক্কচিৎ যত্ন দিল, তাহার এক পার্শ্বে রৌদ্র, পাখীর খাঁচা সমেত ছায়া তাহারই পদপ্রান্তে, ও যে তাহার পিছনে অনেক গ্রামের শিশু সকল! এবং সমগ্র সভার অনুরোধেতে সে সকলের প্রীতি সম্পাদন পরতন্ত্র খাঁচা হাতে ধীর হস্তীগমনে অগ্রসর হইল।

প্রাচীন যাহারা তাহাদের অভিপ্রায় অনুযায়ী, যাহারা ঘেরিয়া বসিয়াছে তাহাদের সকলকে–ইহারা প্রায়ই দূরাগত ভিন্নগ্রামের লোক সুঘরাই পক্ষী দেখাইতে পরিক্রমণ করে, যাহা দেখিতে কালে বিবিধ বিস্ময়সূচক আ আ শব্দের মধ্যেই সুঘরাই শুনিতেছিল, তুমি তোমার রুগ্ন পুরুষের উপর যথেষ্ট অত্যাচার করিয়াছ এবং অবশেষে তাহারে, প্রমাণ না থাকিলেও, সকলেই বুঝে, হত্যা করিয়াছ, এখন ঐ অগ্নির দিকে চাহিয়া বল, সেই সকালে…, এই দোষারোপ এক প্রাচীন কর্তৃক সেই যুবতী উদ্দেশে ব্যক্ত, ইহাতে সুঘরাই সেই যুবতাঁকে তির্যক দৃষ্টিতে পর্য্যবেক্ষণ করে, যে তাহার মন ঘৃণায় বিষাইয়া উঠিল।

ক্রমে সে খাঁটিয়া আসীন প্রাচীনদিগের সমক্ষে আসিল, যাহাদের চক্ষু যেমন, কেমন কঠোর, তাহারা এখনও তন্ময় হইতে পারে, ভাবে আবিষ্ট হওয়ত এই অদৃষ্টপূৰ্ব্ব খাঁচা দেখিতে নিয়ত মস্তক ঘুরাইতে থাকিয়াও, খাঁচার অন্তর্বর্তী পাখীর লক্ষণ সকল ইহারা উচিতরূপে ঠাওরে অসমর্থ, সুতরাং কেহ খাঁচাটিতে অঙ্গুলি দ্বারা টোকা দিতে যত্নবান, যাহাতে পাখী সজাগ হয়, যে এবং কেহ ফোড়ন কাটিল, পাখীটি নির্ঘাত মাদি…যদি তাহা নহে তবে এতেক ভীতু কেন? কেহ বলিল,–কেমন যেন করিতেছে?

বালক সুঘরাই ইহাতে অত্যধিক অপমানিত,–ঐ পরিহাস অসহ্য, যে এবং তৎকালেই সে দেখিল, পাখী তাহার সকল সংস্থান বিধ্বস্ত করত চঞ্চল, যে পক্ষীর এহেন স্বেচ্ছাচারিতার কোন ক্ষমা সুঘরাইএর কোমলতার বাহিরে,–সে মানিতে প্রস্তুত না, যে তাহার রোগগ্রস্ত কাহিল তিতির আতঙ্কিত হইয়াই। স্থলিত পদেই কিয়ৎ স্পন্দিত মাত্র, আর যে সুঘরাই স্থানকাল ভুলিয়া পাখীটিরে আক্রমণে উদ্যত, তৎক্ষণাৎ প্রাচীনমণ্ডলী হইতে তীব্র প্রতিবাদসূচক, সাবধান করা সূচক, গঞ্জনাসূচক নিন্দাবাচক রকমারি শব্দ ছুটিয়া আসিল।

অতএব সুঘরাই নিবৃত্ত বটেই, তবু যে সে মর্মাহত থাকিয়া ক্রোধে ফুলিতে আছিল, প্রধানত এই কারণে যে, সে কখনও ভাবে নাই, অর্থাৎ এ যাবৎ তাহার অজ্ঞতাই ছিল যাহা, যে,–তদীয় তিতিরকে কেহ তাচ্ছিল্য করিবে; এখনই এই সূত্র হঠাৎ আভাসিত যে, গত হাটের দিন, কোন পথচারীরা–তাহারা কাঁধের বাঁক লইয়া থামে–একে অন্যকে, তাহারই তিতির বিষয়ে, অনেক সাধুবাদের পর মধুর স্বরে কহিল, ইহা দারুণ মরদ, হাঁ হাঁ অদ্যও ইহারই স্মৃতি জাগরণ নিমিত্ত মেঘ হয় বৃষ্টি আইসে; ইহা দারুণ মরদ, যদি এখন বনাঞ্চলে যায় ইহারই চলনভঙ্গিতে বনস্থলীর মাদি কুকুট সকল অত্যাশ্চর্য্য সংকেত ভাষায় কণ্ঠ উন্নত করিয়া আমন্ত্রণ জানাইত পশ্চাদ্দেশ স্ফীত করত উঁচাইয়া মাটিতে বসিবে, ইহা দারুণ মরদ, ইহার প্রখর সকাম চাহনিতে মনুষ্যসমাজের যুবতীজনের জঙ্ঘা ভারাক্রান্ত হয়!

এখন এই বিজাতীয় সভাতে বিমূঢ় বালক খানিক স্তব্ধভাবে অপ্রতিভ হইয়া যাপনের পরেই, যে আপনকার এক স্কন্ধ হইতে অন্যতে গামছা স্থাপনের পরেই, সদম্ভে ঘোষণা করিল, ইহা দারুণ মরদানা, ইহার কাঁটি সাক্ষাৎ যম, ইহা রমণী-তিতিরগণের আশ্রয়স্থল, ইহা নর-তিতির সকলের কালসদৃশ, ইহার সংহারমূৰ্ত্তি ভয়ঙ্কর…পক্ষাঘাত রোগ পর্যন্ত পলায়ন করে।–যে এবং ইহা ব্যাখ্যানে সে এতই আবেগে এতই উত্তেজনাতে ছিল যে আরও যোগ দিল,…ইহা বহুরূপ শিক্ষাপ্রাপ্ত হইয়াছে, ভুখারির বানর হইতেও যথেষ্ট ইহা দক্ষ…গ্রামের অনেক বালক ইহার কসরৎ দেখিয়াছে, ইহার ক্রীড়ানৈপুণ্যে মদীয়। প্রভুরা চমৎকৃত হইয়া থাকেন…ইহা এক হাত হইতে অন্যটিতেও মস্তকেও ইঙ্গিতমাত্র যায়, বিশুষ্ক পেয়ারা কাঠে ইহার কাঁটি বসে…লড়াইএ ইহা মজবুত! ইহা দারুণ মরদ!–এই আস্ফালনের পরক্ষণেই সুঘরাইএর গাত্রে ঘাম দেখা দিল। পরেই সে স্থবির!

তখনই সভার চারিদিক হইতে, যাহাদের তিতির আছে–তাহাদের নিকট হইতে চ্যালেঞ্জ আসিল, তাহারা পরস্পর আপন আপন গ্রামের নাম কহিল, যথা সালোয়া, ধরমসী, রতনপুর, বড়কোয়া, শিমবারি ইত্যাদি…এবং তাহারা উঠিয়া দাঁড়াইয়া আপনকার উরুদেশ উন্মোচন করিল–চর্মরোগ বিক্ষুব্ধ ক্লিষ্ট যাহা, সদর্পে তথায় চাপড় মারিল একের পর এক! আর যে ঐ একের পর এক-কে অবিলম্বেই নির্ভীক সুঘরাই আপন ছোট ঊরু মেলিয়া রাবণিক ঔদ্ধত্যে চাপড়ে জবাব করিল! কিন্তু অন্যেরা যাহাদের তিতির নাই তাহারা কসরৎ দেখিতে আগ্রহী; নির্বোধ উপায়রহিত সুঘরাই তিতিরটিকে বাহির করিয়া আপন হস্তে বসাইতেই সে মাটিতে পড়িয়া দু’একবার পক্ষ আন্দোলনের পর বসিয়া চুপ!

যুগপৎ তুমুল হাস্যধ্বনি ও আলোড়ন উৎক্ষিপ্ত হইল; ইহা কি লড়িবে, ইহাকে ঘৃতমিশ্রিত মাংসের ছাঁট খাওয়াও, ইহা মাদি নিশ্চিত–ইত্যাকার রব উঠিল। অন্যপক্ষে সুঘরাই যদিও তিতিরটিকে পদাঘাত করিতে পাশবিক, কিন্তু যে তাহাতে সাড় ছিল না। একদা নির্যাতিত আহতদৃষ্টিতে তিতিরের প্রতি অবলোকন করত কহিল, বেশ বেশ, কল্যই কাহার গ্রামে যাইব বল–যাহা নিকটে তাহা বল!–তাহার কানে দু’একটি নাম বিদ্রুপাত্মক হাস্যভেদ ভাসিয়া আসিল, অতঃপর সে কোনক্রমে মস্তক সটান রাখিয়া ঐ স্থান ত্যাগ করিয়াছে!

সুঘরাইএর গাত্র অসম্ভব উষ্ণ, সে মতিচ্ছন্ন প্রায় যে সমগ্র খাঁচার সাজ হওয়াতে এবং চলার জন্য নিজ বস্ত্রের শব্দ, বড় হাস্যকর, সভার উপহাস তাহারে দগ্ধ করিতে আছে, ও আপশোষ পরস্পরাতে তাহার ওষ্ঠদ্বয় কম্পিত। সে এক আধবার শুধুমাত্র গামছাখানিক এক কাঁধ হইতে অন্যত্রে লইয়াছে, কিন্তু বুঝায় যে সে তখনও এলাইয়া পড়ে নাই, যে সে হাটের পথে, টিলার দিকে, ডাঙু পোকা সংগ্রহে, যেহেতু যায়।

এমত সময় একদল চেঞ্জার তাহার পথ রোধ করিয়াছিল; খাঁচা দর্শনে তাহারা মহা উচ্ছ্বাসে, এ্যাণ্ড গ্র্যাণ্ড বলিয়া সুঘরাইএর প্রশংসাতে (এখানকার ধারা বশম্বদ কাহাকেও কালচারড রূপে সনাক্ত করে না) প্রকাশিল, সত্যিই ছেলেটি আনকালচারড নহে!…মোটেই আনকালচারড নহে!…মোটেই আনকালচারড নহে!…একেবারে আমাদের মতন মডার্ন, না?

ইহাতে সুঘরাই যথাযথ ভদ্র-অভিব্যক্তিতে কিছু বিনয়ী হইতে কঠিন হইয়া রহে, যে সে অন্যত্রে দৃষ্টি সঞ্চার করিল, দেখিল, লাল পোস্টবক্সটি যাহা গাছের কাণ্ডে সংলগ্ন, তদ্দণ্ডে সে যেন জ্বলিয়া উঠিয়াছে! চেঞ্জাররা তাহারে অতিক্রম করিয়া এখন চলিয়া গিয়াছিল। সুঘরাই আপনকার বস্ত্রের শব্দ শুনিতে থাকে, যে সে এতই উৎক্ষিপ্ত যে মনে হইল পোস্টবক্স বিনষ্ট করে!

যদি বিচার তাহার দ্বারা সম্ভব হইত, সে মীমাংসা করিতে পারিত না এ ক্রোধ কেন, যেহেতু এতাবৎ তাহাদের জাত পোস্টবক্স ছুঁইত না, তবে দুই এক হাট পূৰ্ব্বে এই সংস্কারের বিরুদ্ধে তেঁড়া দেওয়া হইয়াছে!–এখন সেই পুরাতন প্রথা কেন নির্মূল করা হইল, ইহাই তাহার রোষ–যেন একটি অধিকার বিনষ্ট হইয়াছে, যেন একটি বিদ্বেষ তাহার খোয়া গিয়াছে–এই স্বাধীনতায়ে পুঞ্জীভূত অভিমান তাহাতে চক্র দিয়া উঠিল–অথচ সাধারণত সুঘরাইএর অর্থাৎ তাহাদের জীবনে কোথাও ব্যর্থতা নাই!

.

এখন সে হিরণার টিলায় উপস্থিত, খাঁচাটি রাখিতে গিয়া আশ্চর্য্য যে সে যেমত ছুঁড়িয়া ফেলিতে উদ্যত, যে সে অবাক, এমন ক্ষেত্রে সহসা আপনার হাতের উল্কীর প্রতি নজর গিয়াছিল, যে সে যেমন। বা কিস্তৃত ঘোরে, আপনার অঙ্গুলির তথা হাতের স্বাদ গ্রহণ করিতে চাহিল–যে কিন্তু তখনই তাহা এড়াইতে, এই বিশাল সুপ্রসারিত এলোমেলো স্থানসমূহের দিকে সে অবলোকন করিল। এখন দেখিল তাহার ঘর্মসিক্ত গেঞ্জী যেন রোদ, সে যেন ঠাণ্ডা হাওয়া খুঁজিতে আছে। যে সুঘরাই একটি অতীব জটিল শ্বাস ত্যাগ করিল!

এ শ্বাস তাহার বৰ্তনে খাওয়া হইতে গঠিত।

সে আপনকার ট্যাঁক হইতে ফণীমনসার পাতাগুলি বাহির করিতেছে সময়েই শুনিল, কে যেমন বা ‘আ তিতি’ উচ্চারণ করিতেছে–যাহা তাহাদের দুজনকার, তাহার আর তিতিরের একমাত্র ভাষা, আরও যে যুগপৎ সে প্রত্যক্ষ করিল যে তাহার আপনকার অঙ্গুলি দিয়া সে জমিতে ঘর্ষণ করিতে আছে। ইহাতে সে বিস্মিত হইয়াছিল। এবার সে পক্ষীর দিকে তাকাইল, দেখিল তাহা কোনমতে দণ্ডায়মান থাকিতে চেষ্টা করিয়াই বসিয়া পড়িল, দেখিল টুঙীগুলি দুলিতেছে কাগজের ফুল সকল শব্দিত! তৎক্ষণাৎ সুঘরাইএর চক্ষু আরক্তিম হইল।

ইহাতে সে খাঁচার দরজা সন্তর্পণে খুলিয়া পাখীটিরে অনুপ্রবিষ্ট করাইবার প্রয়াস পাইল, এবং যে সে কপট আদরে তিতি শব্দ করিতেই নিজেই উৎকর্ণ হয়, এ যেন মনিব পত্নীর অভিজাত স্বর, এ কারণে তাহার আপনার গ্রীবা কিছু উন্নত যে সে নিজেই তিতির; কিন্তু সম্মুখে রাজসিক সজ্জার অন্তঃস্থিত পাখীটিতে সে তখনই সচেতন, বুঝিল তাহার প্রিয় পক্ষীটি খানিক গ্রীবা তুলিয়া নামাইয়া লইল।

সুঘরাই আপনাকে সংযত করিয়া কয়েকটি ডাডু পোকা ফণীমনসার পাতায় রাখিয়া উহার সামনে ধরিয়াছে, এবং পুনরায় তাহাকে আহ্বান করিয়াছে, পাখীটি কোনমতে একটি পোকা খাইয়াই যেন ঢলিয়া। পড়িতে চাহিল। সুঘরাই উহার রকমে ক্রমশ ক্রুদ্ধ, অমানুষিকতাতে তাহার হাতে ভারী হইয়া উঠিল, তথাপি সে আপনাকে রুখিয়াছে!

এই টিলার উপরে তিতিরটি যেন তাহার অপরিচিত, যেন তাহার কেহ নহে, কেমন ন্যাংটা, সে সত্বর পক্ষীটিকে তুলিয়া খাঁচার মধ্যে স্থাপিত করিয়া আপনার অভিপ্রেত সংস্থানে ভিড়াইয়া তাহারে চিনিতে ভালবাসিতে ব্যগ্র, আশ্চর্য্য যে এখন বেচারী তিতিরটি খাড়া দাঁড়াইল, আশপাশে সবুজ নীল টুঙী চারিদিকে ফুলশোভা, মধ্যে মধ্যে আকাশ উল্লেখিল!

ইহা দর্শনে সুঘরাই যেন লাফাইয়া উঠিল, কিছুদূর হইতে এই বৈচিত্র্য উপভোগ উদ্দেশ্যে সে ঝটিতি দূরে টিলার উাইতে খানিক নামিয়া চক্ষু ফিরাইতেই স্পষ্টই দেখিল তাহার তিতিরটি বিকটভাবে চঞ্চু পৃথক করত কেমন এক ভাব করিতেছে–ধীরে উহার দেহভার এক পায়ের উপর ন্যস্ত হইল এখন তাহার দক্ষিণের ডানা ক্রমে ক্রমে প্রসারিত হইতেই সুঘরাইএর সাজান নষ্টপ্রায়।

কুরমতি সুঘরাই সবেগে ছুটিয়া আসিল। পাখী যেন তৃষ্ণায় অথবা অন্য কিছুর জন্য তেমনই চঞ্চু ব্যাদানে আছে, ইহা তাহার চোখে পড়িলেও সে গ্রাহ্য করে নাই–সে মহা উম্মায় পাখীটি বাহির করিতেই যে রহস্য গোড়া বাঁধিয়াছিল তাহাই তাহার হাতে সাপের মত উঠিতে ক্রিয়াশীল! সে অবশ্যই বিভীষিত; পূৰ্ব্ব হইতে বিদ্বেষে তাহার চক্ষুতে অগ্নি ক্ষরিতেছিল–এখন সে তপ্রবর্ত্তীত আপনার প্রিয় পাখীটিকে যারপরনাই জোরে আছাড় মারিল।

পাখীটি গড়াইয়া উৎরাই বহিয়া খানিক তফাতে, ক্ষণেক নিশ্চলতার পরই মনসা পাতাতে ড়াড়ু পোকা লইয়া সে ধাবমান–তিতিরের নিকট পৌঁছে, তাহা ঐ পক্ষী, এক কুৎসিত, তাহা এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য হইয়া আছে!

সে উহা পক্ষীটিকে তুলিতেই উহার লম্বমান সুশ্রী গ্রীবা শিথিল নেতাইয়া ঝুলিতেছে, সুঘরাই দমিল, পক্ষী গাত্র হইতে আগত ম্লান বিদেশী পারফিউমের গন্ধে তাহারে কোন মানসিকতা দিল না, বরং তাহার চক্ষুর্ধয় কেমন যেমন বিকারগ্রস্ত, হঠাৎ তাহার হাতে পক্ষীর ক্ষতের রস যাহা আঠাল তাহা লাগিতেই সে এক পা সরিয়াছে মাত্র–যেখানে সরিয়াছে তাহা তাহার পলায়নের জগত; নিশ্চয়ই এবং যুগপৎ সে সেই আঠা প্রথমে সচকিতে ও পরক্ষণেই গভীরভাবে শুকিয়াছে!

ঐ গন্ধ বড় পরিচিত তাহাদের, এবং হঠাৎ ইহাতে তিনবার বলিয়াছে যে আমরা ডোম–যে সে জানে নাই যে, ইহা সে বলে এবং যে তদীয় হস্ত অস্থির ও সে ভূতচালিতের প্রায় পাখীর বক্ষদেশ হইতে অজস্র পালক পৌরাণিক দুৰ্ম্মতিতে উৎপাটিত করিতে কালে অচিরাৎ তাহার দেহের অভ্যন্তরে এক প্রলয়ঙ্কর হুঙ্কার ঘনিয়া উঠিল, অন্যপক্ষে পালক উৎপাটনে বেচারী পক্ষীটির অনেকটা ক্ষতই ওতপ্রোত হইল–এবং সুঘরাইএর ইহা ‘আমরা’ বলাতে বিঘ্ন সৃষ্টি করিল।

সত্রাসে সুঘরাই ঐ পক্ষী দূরে নিক্ষেপ করত–ঝটিতি যে সে উন্মত্তের ন্যায় চীৎকার করিতে থাকিল, যাহা আতঙ্ক, যাহা বেদনা, যাহা আনন্দ, যাহা আহ্বান, যাহা মিলনকামী প্রত্যাশার ডাক, এমনও যে ইহা তাহা নহে। মনোরম খাঁচাটি সে অতীব ক্ষিপ্রতায় হাতে লইতেই চীৎকার যেন আরও দুৰ্ম্মদ আরও খ্যাপাটে, যাহা তীর্থযাত্রায় তধ্বনির বিকৃতি! উড়ন্ত পালকে সে আরও কুটিল হইল।

ইহা চমৎকার যে সে সুঘরাই এইরূপে মিথ্যারে স্মরণ করিতে চাহিয়াছিল–আ-আধুনিকতা! যে এবং শনৈঃ সে দৃঢ়তায়ে হিরণার টিলায় যেখানে সাড়ু পোকার নিবাস, দাঁড়াইয়া খাঁচাটির প্রতি লুব্ধ নয়নে চাহিয়া আপনার চীৎকারকে আপনা হইতেই ছন্দিত করিল, যেমন সে ছন্দবিধি জানিয়াছে।

যে এবং এখন কে যেমন বা গীত গাহিতে আছে।

Exit mobile version