লক্ষ্মীনারায়ণ বিক্ষুব্ধ; পুত্রদ্বয় এবং কৃষ্ণপ্রাণ–ইহাদের ক্ষণকালের জন্য স্পষ্ট করিয়া দেখিয়া লইলেন। অনন্তহরির পদতলগত খড়গুলি এক প্রকার শব্দ করিয়া উঠিল, তাঁহার ধৈৰ্য্যচ্যুতি ঘটিয়াছিল, ক্রোধান্ধ বিড়ালের মতই সাপাট ছাড়িয়া কহিলেন, “বলি আপনি ত জ্ঞানী সাজছেন, কেন, আপনারা বংশপরম্পরা ওষুধ এত্যাদি দেন না…”
“দেব না কেন, না দিলে ঘর দোর জ্বালাবে বলে…”
“বটে, ঘর রাখতে আপনি যেমন উপায়হীন তেমনি…লক্ষ্মীনারায়ণ আপনার ধৰ্ম্ম…আপনার সঙ্গে বাক্য নিষ্প্রয়োজন; এক্ষেত্রে ওঁদের কুলপুরোহিত, পুত্ররা বর্তমান…অমত নেই…ব্রাহ্মণের ধর্ম্ম রক্ষা করতে ব্রাহ্মণই আছে…”।
কৃষ্ণপ্রাণ কহিলেন, “অনন্তহরি, সীতারামের যখন জ্ঞান এসেছে, আৰ্ত্ত নয়, তখন তার একটা মত নেওয়া প্রয়োজন।”
ইতিমধ্যে রিক্ত-মেদ কুঞ্চিত হাতখানি ক্রমে ক্রমে অপগত হয়, তথা সীতারাম আপনার হাতখানি অপসারণ করিল, বিষাক্ত সর্পের ল্যাজ যেমন গহ্বরে অদৃশ্য; তদ্দর্শনে নিকটস্থ মানুষেরা নিশ্চিত হইয়াছিল, শুধুমাত্র লক্ষ্মীনারায়ণ ভীত।
সীতারাম প্রমাণ করিলেন, তাঁহার জ্ঞান আসিয়াছে এবং কৃষ্ণপ্রাণ দৃঢ়স্বরে বলিলেন, “জ্ঞান ফিরে এসেছে।”
‘জ্ঞান এসেছে’ উক্তিতে জলে নোঙ্গর নিক্ষেপ করার আওয়াজ ছিল, অনন্তহরি ইত্যাদির মধ্যে এক অপরিজ্ঞাত ভাবান্তর হয়–ক্রমাগতই কাহারা জপ করিতেছে, কাহারও মধ্যে শেষোক্ত চন্দ্রকলা পুনরায় দৃশ্যমান, কাহারও সম্মুখে জোনাকী খেলিতে লাগিল, কাহারও মধ্যে বর্ণচ্ছটা আলোড়িত হইল, কোথাও বিন্দু স্ফীত হইতে চাহিল!
সকলেই কিছুক্ষণ এইভাবে অতিবাহিত করিবার পর, সত্বর বৃদ্ধকে স্পর্শ করিবার জন্য আগ্রহান্বিত হইলেন। কেহ বা আপন আপন ইষ্টনাম জপ করিতে লাগিলেন, আরও মনে হয় কেহ বা নিদ্রাকে হস্ত দ্বারা স্পর্শ করিলেন।
জ্ঞান আসিল। বৃদ্ধের পুনরায় ‘আমি’ বলিবার ক্ষমতা আসিল। পৃথিবীর চক্রবৎ পরিবর্তনের শব্দ শ্রুত হইল।
বৃদ্ধের দৈহিক জ্ঞান বিষয়ে অনন্তহরি অত্যধিক আস্থাবান; লক্ষ্মীনারায়ণ অনবরত দুর্গা নামে ব্যস্ত, তৎসহ তাঁহার করজোড় কভু বক্ষস্থলে ক্কচিৎ কপালের আজ্ঞাচক্রে আবেগে উত্তেজনায় উঠানামা করিতে লাগিল। তাঁহার দেহের অনিশ্চয়ত্মক দ্বন্দ্ব তাঁহার নিঃশ্বাসে এখন যন্ত্র আঁকিয়া বীজমন্ত্র লিখিতেছিল।
জ্যোতিষীর হাতের মধ্য হইতে সীতারাম আপনার হাতটি সরাইয়া লইয়াছিলেন। তাঁহার চোখের পাতা দুই চারিবার উঠাপড়া করিয়া প্রমাণ করিল যে জ্ঞানলাভ হইতেছে। কবিরাজ তাঁহার বক্ষের কাছে মাথা রাখিয়া বুঝিলেন, পৃথিবীর জন্য আবার হৃদয় স্পন্দিত হইতেছে। এবং তিনি মাথা উঠাইতেই কুলপুরোহিত কৃষ্ণপ্রাণ সীতারামের কান হইতে তুলা খুলিয়া বলিলেন, “সীতারাম…”
সীতারাম তাঁহার দিকে চাহিলেন।
“তোমার বিয়ে…”
সীতারাম নির্বাক।
“তোমার বিয়ে, তুমি রাজী…”
দ্বিতীয় প্রশ্নে মনে হয় কৃষ্ণপ্রাণের কথা বুঝিয়া লইবার ইচ্ছা থাকিলেও এখনও, একাধারে কীৰ্ত্তন ও ব্যাখ্যার জন্য সীতারাম সঠিকভাবে শুনিতে পান নাই; কাতর মুখোনি কোনরূপে ঈষৎ নাড়িলেন; কৃষ্ণপ্রাণ তাহাতে যেন বুঝিতে পারিলেন, এবং সেই সঙ্গেই কীৰ্ত্তনকারী ও গীতাপাঠকারীকে থামিতে কহিলেন। তাহারা থামিল। পুনৰ্ব্বার তিনি সীতারামের কর্ণকুহরে বলিবার জন্য গলা পরিষ্কার করিয়া কহিলেন, “সীতারাম, ব্রাহ্মণের কন্যাদায়, তুমি তাকে আমাদের ইচ্ছা, বিয়ে করে, ব্রাহ্মণকে বাঁচাও…তুমি রাজী…”
অধুনা শায়িত সীতারামের মুখে কীৰ্ত্তন থামার দরুণ সকালের আলো পড়িয়াছিল; তিনি–টিয়াপাখী আপনার নাম শুনিলে যেমত মাথা ঘুরায়–তেমনি, মাথা ঘুরাইতে লাগিলেন, এমন মনে হয় উপস্থিত সকলকে যেন ঠিক দিয়া লইলেন, এবং ইহার পর উর্দ্ধ আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়াছিলেন। সীতারাম চাটুজ্জ্যের ইত্যাকার ভাব দেখিয়া কৃষ্ণপ্রাণ কাতরভাবে মাথা দুলাইয়া বলিলেন, “সম্ভবত রাজী নয়…”
এই কথায় লক্ষ্মীনারায়ণ কাঁদ কাঁদ হইয়া কহিলেন, “আর একবার…”
“রাজী হতেই হবে! না হলে সাবালক দুই পুত্র বর্তমান, তারাই মত দেবে…আমার গণনা মিথ্যে হতে পারে না…” অনন্তহরি মহা দর্পে বলিলেন।
“নাড়ী ফিরলেই যে সকল জ্ঞান থাকবে এমন নয়, মাঝে মাঝে লুপ্ত হবেই…” কবিরাজ মন্তব্য করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন, এবং ঘৃণায় বলিলেন, “অনেক পাপ ত করেছি, এটা নয় নাই করলাম…আমি যাচ্ছি, তবু বলি বাঁড়ুজ্জ্যে মশাই, আমার কাছে অনেক বিষ আছে…তার একটু আপনি…”
লক্ষ্মীনারায়ণ নিজের কানে আঙ্গুল দিয়া কহিলেন, “ছিঃ ছিঃ আপনি কি ব্রাহ্মণ!”
কবিরাজ আর অপেক্ষা করিলেন না।
“ঠাকুর মশাই আপনি বলুন” জ্যোতিষী অনুরোধ করিলেন।
“সীতারাম, ব্রাহ্মণের কন্যাদায়, বিয়ে করবে? রাজী…”
এই কথায় সীতারামের নাসিকাগহ্বর দিয়া জল আসিল। ধীরে ধীরে শীতকম্পিত হাতখানি মুখমণ্ডলে বুলাইয়া কোনমতে বলিলেন, “দাড়ি…” দন্তহীন, মাড়ি দেখা গেল; বাক্যের শব্দের পরিবর্তে হাওয়াই বেশী করিয়া শোনা গেল।
‘খেউরি হইব’ কথাটি বলিতে হইল না, সকলেই বুঝিয়া লইল।
লক্ষ্মীনারায়ণ বোকার মত হাঁ করিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন, তাঁহার শরীর কিছুটা বাঁকিয়া নীচু হইয়াছিল, তাঁহার মুখের ঠিক নিম্নস্থান দিয়া অনুচ্চ হাসির স্রোত চলাফেরা করিতেছিল, এবং ইহার সহিত জ্যোতিষীর সরস মন্তব্য, “কবিরাজ বলে নাকি জ্ঞান নেই? না না জ্ঞান মাঝে মাঝে লুপ্ত হবে! এই জ্ঞানটুকুই যথেষ্ট…ব্রাহ্মণ বাঁচলো…যাও দাঁড়িয়ে কেন, লক্ষ্মীনারায়ণ, যাও মেয়ে আন।”