Site icon BnBoi.Com

অন্তরে – ইমদাদুল হক মিলন

অন্তরে - ইমদাদুল হক মিলন

 ১. ব্যাপারটা শুরু হলো পা থেকে

অন্তরে – (উপন্যাস) ইমদাদুল হক মিলন
প্রথম প্রকাশ – একুশের বইমেলা ২০০১

উৎসর্গ
প্রিয়দর্শন গায়ক শুভ্রদেবকে
গভীর ভালবাসায়

ব্যাপারটা শুরু হলো পা থেকে।

রাত দুপুরে সুমির মনে হলো তার ডানপায়ে কে যেন সুরসুরি দিচ্ছে। মৃদু মোলায়েম সুরসুরি। পায়ের পাতার ওপর দিয়ে আলতো ভঙ্গিতে তেলাপোকা হেঁটে গেলে যে অনুভূতি হয় ব্যাপারটা তেমন।

সুমির ঘুম পাতলা। ফলে মুহূর্তেই ভেঙে গেল। কিন্তু ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে সুরসুরিটা উধাও। সুমি ঠিক বুঝতে পারল না আসলেই কি অনুভূতিটা হচ্ছিল নাকি ঘুমঘোরে এমন মনে হয়েছে। নাকি সে আসলে স্বপ্ন দেখছিল। অনুভূতিটা হচ্ছিল স্বপ্নে। নাকি সত্যি সত্যি তেলাপোকা হেঁটে গেছে পায়ের ওপর দিয়ে।

কিন্তু সুমির বিছানায় মশারি টাঙানো। এ বাড়িতে মশার উপদ্রব তেমন নেই। মা বাবা এবং ভাইয়া মশারি না টাঙিয়েই ঘুমোয়। শুধু সুমি, মশারি না টাঙিয়ে কিছুতেই বিছানায় যাবে না সে। মশা নয়, তেলাপোকার কারণে এই ব্যবস্থা। |||||||||| সুমির তেলাপোকা ভীতি ভয়াবহ। গায়ে তেলাপোকা উঠলে অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে সে। তেলাপোকার কারণে মশারি তো সে টাঙাবেই, টাঙিয়ে অতি যত্নে, অতি নিখুঁত ভঙ্গিতে বিছানার চারপাশে এমন করে গুজবে মশারি, তেলাপোকার বাবারও সাধ্য নেই এই দুর্ভেদ্য প্রাচীর গলে ভেতরে প্রবেশ করার। তার ওপর প্রতি পনের দিনে একবার নকরোচ এনে নিজ হাতে ছড়িয়ে রাখবে আনাচে কানাচে, যে সমস্ত জায়গায় তেলাপোকাঁদের থাকার সম্ভাবনা সে সমস্ত জায়গায়। হাতের কাছে সব সময় আছে এরোসল। ধারী তেলাপোকা তো দূরের কথা, নকরোচের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া ছানাপোনাও যদি দুএকটা চেখে পড়ে, তক্ষুণি তাদের ওপর ফুস করে স্প্রে করবে এরোসল। অর্থাৎ তেলাপোকার বংশ ধ্বংস।

সুমির এই অত্যাচারের ফলে বাড়িটা একেবারেই তেলাপোকা শূন্য। তাহলে সুমির পায়ে এই অনুভূতিটা হলো কী করে? কে সুরসুরি দিল পায়ে।

দরজা বন্ধ করে ঘুমোনোর অভ্যেস সুমির। সুতরাং কেউ যে তার রুমে ঢুকে পায়ে সুরসুরি দেবে সে উপায় নেই। তাছাড়া মধ্যরাতে তাকে না ডেকে কে ঢুকবে তার রুমে?

সুমিদের বাড়িতে তারা চারজন মানুষ। মা বাবা ভাইয়া আর সুমি। দুজন। কাজের লোক আছে। নূরজাহান বুয়া আর তার তেরো চোদ্দ বছরের ছেলে মতি। মা বাবা কিংবা ভাইয়া রাত দুপুরে সুমির ঘরে ঢুকে নিশ্চয় তার পায়ে সুরসুরি দেবে না। নূরজাহান বুয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। দিনভর কাজ করে। রাতভর মরার মতো ঘুমোয়। সম্ভব শুধু মতির পক্ষে। কারণ ছোঁকড়াটা দুষ্ট প্রকৃতির। কিন্তু সুমিকে সে যমের মতো ভয় পায়। এমন সাহস মতির কখনই হবে না, সুমি ঘুমিয়ে আছে আর তার রুমে ঢুকে তার পায়ে সুরসুরি দিচ্ছে! সবচে’ বড় কথা হলো রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। লোক ঢুকবে কী করে!

তারপরই সুমির মনে হলো ঘুমোবার আগে দরজাটা কি আজ সে বন্ধ করেছিল!

হয়তো বন্ধ করেনি। দরজা খোলা দেখে বাবা হয়তো তার রুমে ঢুকে সুমির সঙ্গে একটু দুষ্টুমি করছে। এই ধরনের দুষ্টুমির স্বভাব বাবার আছে। বিশেষ করে সুমির সঙ্গে। আচমকা এমন করতেও পারেন তিনি।

বাবার কথা ভেবে ভাল লাগল সুমির। সত্যি সত্যি বাবা যদি এসে থাকেন, সত্যি সত্যি যদি সুমির পায়ে সুরসুরি দিয়ে থাকেন তাহলে বেশ মজা হবে।

বাবার কথা ভেবে প্রথমে মাথার কাছের আলোটা জ্বালল সুমি। তারপর বিছানায় উঠে বসল।

রুমে কেউ নেই। ওই তো ভেতর থেকে ছিটকিনি বন্ধ দরজা। তাহলে পায়ে সুরসুরিটা সুমির দিল কে? সুমি একটু চিন্তিত হলো। তাহলে কি তেলাপোকা ঢুকেছে মশারির ভেতর!

সুমি তারপর পাগলের মতো তেলাপোকা খুঁজতে লাগল। কিন্তু তন্নতন্ন করে খুঁজেও তেলাপোকা পেল না। আর যেভাবে মশারি গোঁজা, তেলাপোকা ঢোকা সম্ভবই না।

মশারি গোঁজার আগেই যদি ঢুকে বসে থাকত তাহলেও যেভাবে সুমি খুঁজেছে, না পাওয়ার কোনও কারণ নেই। তোলাপোকা কেন পিঁপড়ে হলেও চোখে পড়ত।

তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াল কী? সুমির পায়ে আসলে কেউ সুরসুরি দেয়নি। তেলাপোকা, না মানুষ। সে হয়তো স্বপ্ন দেখেছে। সুরসুরির অনুভূতিটা হয়েছে স্বপ্নে।

লাইট অফ করে শুয়ে পড়ল সুমি।

সুমির ঘুম পাতলা তার ওপর একবার ভাঙলে সহজে আর আসতে চায় না। ঘুম ভাঙার পর আবার ঘুম না আসা পর্যন্ত সময়টা খুবই যন্ত্রণার। কী যে অসহায় লাগে! সবচে’ বড় কথা কত কথা যে মনে পড়ে!

এখনও পড়ল।

কিন্তু যে মানুষটার কথা মনে পড়ল তার কথা সুমি ভাবতে চায় না। একেবারেই ভাবতে চায় না। সেই মানুষটার কারণে জীবন অন্যরকম হয়ে গেছে তার। এলোমেলো হয়ে গেছে। মনের ভেতর দেখা দিয়েছে নানারকমের জটিলতা। হাজার চেষ্টায়ও জটিলতাগুলো কাটাতে পারছে না সে।

কিন্তু এই যে রাত দুপুরে ঘুম ভেঙে মানুষটার কথা সুমির মনে পড়ছে, মন থেকে এখন সে তাকে মোছে কী করে?

ভাবনাটা সে তাড়ায় কী করে?

এইসব মুহূর্তে আজকাল খুব আল্লাহকে ডাকে সুমি। আল্লাহকে বলে, ইয়া হে আল্লাহ, তোমার রহমতের দরজা আমার জন্য খুলে দাও। আমার মন থেকে ওর চিন্তা মুছে দাও। আমার মনে শান্তি দাও।

আজও এভাবেই বলল। বলতে বলতে মন এলোমেলো করে দেয়া মানুষটার কথা ভুলতে পারল এবং এক সময় তন্দ্রামতো এলো সুমির।

এই অবস্থায় আবার সেই অনুভূতিটা ফিরে এলো। সেই সুরসুরির অনুভূতি।

কিন্তু এবার আর পায়ে নয়। তলপেটের সামান্য ওপরে, নাভির কাছাকাছি। সুমির মনে হলো তলপেটের সামান্য নিচে নেমে আছে তার সালোয়ার এবং নাভির সামান্য উপরে ওঠে গেছে কামিজ। ফলে যে জায়গাটুকু উন্মুক্ত হয়েছে। সেখানে মৃদু মোলায়েম হাতে সুরসুরি দিচ্ছে কেউ।

সুরসুরি দিচ্ছে নাকি হাত বুলাচ্ছে! সঙ্গে সঙ্গে গলার কাছে, গালের কাছেও একই অনুভূতি। কিন্তু এখানে ঠিক সুরসুরি নয়, যেন কেউ মুখ ঘষছে। খুবই নরম, আদুরে ভঙ্গিতে মুখ ঘষছে। তার শ্বাস প্রশ্বাসও যেন টের পেল সুমি। সঙ্গে বেশ পুরুষালি একটা পারফিউমের গন্ধ।

এবার আপাদমস্তক কেঁপে উঠল সুমি। ধরফর করে উঠে বসতে গিয়ে পারফিউমের গন্ধটা চিনতে পারল। খুবই পরিচিত, কমন পারফিউম, ওয়ান ম্যান শো।

কিন্তু এতরাতে বন্ধঘরে এই পারফিউম মেখে কে এসে নাভিমূলে সুরসুরি দিচ্ছে সুমির?

গলার কাছে, গালের কাছেই বা মুখ ঘষছে কে?

সুমি বেডসুইচ টিপল। কিন্তু আলো জ্বলল না।

এবার বুকটা ধ্বক করে উঠল সুমির। হাত পা কাঁপতে লাগল। ঢোক গিলতে গিয়ে টের পেল গলা একেবারেই শুকিয়ে গেছে। দমটাও কী রকম বন্ধ হয়ে আসছে। অর্থাৎ প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে সে।

ব্যাপারটা কী? কী হচ্ছে এসব? প্রথমে পায়ে সুরসুরি, তারপর নাভিমূল এবং গালে মুখে। সঙ্গে পারফিউমের গন্ধ, গালে গলায় কার মুখের স্পর্শ! এখন সুইচ টিপে দেখছে আলো জ্বলছে না।

কিন্তু ভূতের ভয়ে সুমির একদমই নেই। কোনওদিনও ছিল না। স্কুলে পড়ার সময় থেকে সে একা ঘরে শোয়। ভয় টয় কোনওদিনও তেমন পায়নি। এমন কি দুঃস্বপ্নও সে তেমন দেখে না। ঘুম আগে আর একটু গভীর ছিল। গত কয়েক মাসে হালকা হয়ে গেছে। আজেবাজে স্বপ্ন দেখে প্রায়ই। অর্থাৎ আগের সুমির সঙ্গে আজকের সুমির অনেক ব্যবধান। গত কয়েক মাসে সুমি অনেক বদলে গেছে।

কিন্তু ভূতের ভয় তার তৈরি হয়নি।

তবু সুমি এখন ভয় পাচ্ছে। প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছে। কিন্তু বন্ধ ঘরে কে এসে ঢুকবে, কে এমন করবে সুমির সঙ্গে!

নাকি আসলে এসব ঘটেনি, সুমি দুঃস্বপ্ন দেখেছে অথবা অবচেতনে এই ধরনের অনুভূতি হচ্ছে।

কিন্তু আলো জ্বলছে না কেন? এটা তো ভৌতিক কাণ্ড!

ঠিক তখুনি গ্রীবার কাছে অতি মৃদু ভঙ্গিতে শ্বাস ফেলল কেউ, সঙ্গে সেই পারফিউমের গন্ধ।

সঙ্গে সঙ্গে সুমি একেবারে লাফিয়ে উঠল। কে? কে এখানে? কে? এ্যা, কে?

নিজের অজান্তে অন্ধের ভঙ্গিতে এদিক ওদিক শূন্যে হাতাতে লাগল সে। কে? কে এখানে? কে?

কিন্তু কাউকে ছুঁতে পারল না সুমি। কারও স্পর্শ কিংবা অস্তিত্ব টের পেল না। শুধু নিরেট বিছানা, নেটের মশারি, বেডসুইচ, পড়ার টেবিল চেয়ারে হাত লাগছে, বইপত্রে হাত লাগছে।

লাফিয়ে বিছানা থেকে নামলো সুমি। নিরেট অন্ধকারে হাতাতে হাতাতে দরজার কাছে এল। ছিটকিনি খুলে পাগলের মতো ছুটে এল মা বাবার বেডরুমের দরজায়। দুহাতে দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে মাকে ডাকতে লাগল, বাবাকে ডাকতে লাগল। ওমা, মা। বাবা, বাবা দরজা খোল, তাড়াতাড়ি দরজা খোল। তাড়াতাড়ি।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে আলো জ্বলল। মূসা সাহেব দরজা খুললেন। তাঁর পেছনে রুনু। রুনুই আগে কথা বললেন, কী রে, কী হয়েছে?

সুমির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। চোখে আতঙ্ক। প্রথমে কথাই বলতে পারল না সে।

মূসা সাহেব দেখতে পেলেন মেয়েটি তাঁর থরথর করে কাঁপছে। দুহাতে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। কী হয়েছে মা? কী হয়েছে? এমন করছিস কেন?

তখনও কথা বলতে পারছে না সুমি। বাবার বুকে থরথর করে কাঁপছে। কোন ফাঁকে রুনু ধরেছিলেন মেয়ের হাত। তিনিও ততোক্ষণে দিশেহারা। অস্থির গলায় বললেন, কী রে, কথা বলছিস না কেন? কী হয়েছে? ভয় পেয়েছিস? দুঃস্বপ্ন দেখেছিস?

সুমি কথা বলবার আগেই নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এল সাদি। হৈ চৈ শুনে ঘুম ভেঙে গেছে তার। মা বাবা এবং সুমিকে দেখে সে এসে দাঁড়াল তিনজন মানুষের সামনে। ঘুম ঘুম গলায় বলল, কী হয়েছে?

রুনু বললেন, কিছুই তো বুঝতে পারছি না। পাগলের মতো দরজা ধাক্কাচ্ছিল। এখন কোনও কথা বলছে না।

মূসা সাহেব এসব কথা গ্রাহ্য করলেন না। সুমিকে বুকে জড়িয়ে তার মাথায় পিঠে হাত বুলাচ্ছেন। কী হয়েছে মা? বল আমাকে। ভয় পেয়েছিস? বল। না বললে বুঝব কী করে?

সাদিও বলল কথাটা। বল কী হয়েছে? না বললে সমস্যাটা আমরা বুঝব কী করে?

তততক্ষণে নিজেকে কিছুটা সামলেছে সুমি। কোনও রকমে বলল, আমার রুমে যেন কে ঢুকেছিল।

এ কথা শুনে তিনজন মানুষ একসঙ্গে চমকাল।

মূসা সাহেব বললেন, কী?

সুমি মাথা নাড়ল। হ্যাঁ বাবা। কে যেন ঢুকেছিল আমার রুমে।

রুনু বললেন, কে? কে ঢুকেছিল?

তা বলতে পারি না!

সাদি বলল, তোর রুমের দরজা বন্ধ ছিল না?

ছিল।

সঙ্গে সঙ্গে তিনজন মানুষ মুখ চাওয়া চাওয়ি করল।

মূসা সাহেব বললেন, দরজা ভেতর থেকে বন্ধ থাকলে সেই রুমে কেউ ঢোকে কেমন করে?

রুনু বললেন, কী আশ্চর্য কথা! তাছাড়া ওর রুমে মাঝরাতে কে ঢুকতে যাবে? এই বাড়িতে আছে কে? বুয়া আর মতি থাকে নীচতলায়। তাছাড়া এরকম রাত দুপুরে…।

সাদি বলল, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

মূসা সাহেব বললেন, বাড়িতে চোর টোর ঢোকেনি তো?

রুনু আইনজ্ঞ। জজকোর্টে প্রাকটিস করেন অনেকদিন ধরে। বাড়ির নীচতলায় তাঁর চেম্বার। নারী এবং শিশু বিষয়ক কেস বেশি ডিল করেন। পেশার ক্ষেত্রে মোটামুটি নামডাক আছে তার। রোজগার ভালই।

কিন্তু আইনজ্ঞ হওয়ার ফলে যে কোনও বিষয়ে জেরা করার একটা স্বভাব নিজের অজান্তেই তৈরি হয়ে গেছে তাঁর। যুক্তিবাদি মানুষ তিনি। অযৌক্তিক কথাবার্তা একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। স্বামীর কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাঁর দিকে তাকালেন। এরকম বাড়িতে চোর ঢোকে কী করে? নীচের মেইনগেট বন্ধ করলে বাড়িটা দূর্গ। মেইনগেটের পর গাড়ি বারান্দা। তারপর ভেতরে ঢোকার আরেকটা কোলাপসিবল গেট। ইয়া বড় একটা তালা সেই গেটে লাগিয়ে দেয় মতি। দোতলায় ওঠার পরও ফ্ল্যাটে ঢোকার মুখে কাঠের দরজা। আজ সেই দরজাটা আমি নিজ হাতে লক করেছি। এরকম তিনটে দরজা টপকে চোর ঢোকে কী করে? তার ওপর সুমির নিজের রুমও ভেতর থেকে বন্ধ ছিল।

অকাট্য যুক্তি।

তবু আমতা আমতা করে মূসা সাহেব বললেন, হয়তো দিনের বেলায় কোনও ফাঁকে চোর ঢুকে ঘাপটি মেরেছিল।

রুনু বললেন, তাও সম্ভব নয়। কারণ সুমির রুমে তেমন কোনও ফার্নিচার নেই। বাথরুম ছাড়া ঘাপটি মেরে থাকার জায়গা নেই। তবে আমি সিওর বাথরুমে ওভাবে ঘাপটি মেরে কেউ ছিল না। কারণ ঘুমোবার আগে সুমি নিশ্চয় বাথরুমে ঢুকেছিল। কেউ থাকলে তখুনি দেখে ফেলত।

সাদি অস্থির গলায় বলল, বুঝলাম কিন্তু ব্যাপারটা তাহলে দাঁড়াল কী?

রুনু বললেন, সুমিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জিজ্ঞেস করা উচিত। নয়তো বোঝা যাবে না কী ঘটেছে।

তারপর সুমির দিকে তাকালেন তিনি। তুই যে বললি তোর রুমে কেউ ঢুকেছিল, বুঝলি কী করে? মানে তুই দেখেছিস কী না?

মা বাবা এবং ভাইয়ার কথা শুনতে শুনতে কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে সুমি। বাবা তখনও তাকে জড়িয়ে রেখেছে। বাবার দুহাত সরিয়ে দিয়ে নিজেকে মুক্ত করল সে। না আমি কাউকে দেখতে পাইনি।

তাহলে বুঝলি কী করে যে কেউ ঢুকেছে?

আমার পায়ে সুরসুরি দিয়েছে।

রুনু কথা বলবার আগেই মূসা সাহেব বললেন, মানে?

আমার পায়ে কে যেন সুরসুরি দিচ্ছিল।

সাদি হেসে ফেলল। পায়ে সুরসুরি দিচ্ছিল?

রুনুও হাসলেন। এমন কথা বাপের জন্মেও শুনিনি। চোর ঘরে ঢুকে চুরি না করে কারও পায়ে সুরসুরি দিচ্ছে, শুনলে লোকে খানিক বুঝতেই পারবে না তার হাসা উচিত না কাঁদা।

সুমি বলল, আমি কি তোমাকে বলেছি যে ঘরে চোর ঢুকেছিল?

মূসা সাহেব বললেন, না না আমি বলেছি। তোদের যুক্তিতর্কে বুঝলাম চোর ঢোকেনি। ব্যাপারটা অন্য কিছু।

সাদি বলল, অন্যকিছু মানে?

রুনু বললেন, তেলাপোকা টোকা পায়ে উঠেছিল।

সুমি বলল, না, তেলাপোকা না। বেশ কয়েকবার সুরসুরি দেয়ার পর আমার ঘুম ভেঙে গেছে। ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে সুরসুরিটা বন্ধ হয়ে যায়। তবু আমি উঠে লাইট জ্বেলেছি। দেখি, না কোথাও কেউ নেই। মশারির ভেতর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তেলাপোকা কিংবা ওরকম কিছু আমার চোখে পড়েনি।

মূসা সাহেব বললেন, তাহলে সুরসুরি তোর পায়ের কেউ দেয়নি। তুই হয়তো স্বপ্নে দেখেছিস তোর পায়ে কেউ সুরসুরি দিচ্ছে।

প্রথমবার আমিও তাই ভেবেছি। তারপর ঘুমিয়ে পড়েছি। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার…।

কথাটা শেষ করল না সুমি।

রুনু বললেন, আবার কী হল? আবার সেই পায়ে সুরসুরি?

না।

তাহলে?

নাভিমূলের ব্যাপারটা বাবা এবং ভাইয়ার সামনে বলতে লজ্জা করছিল সুমির। ওইটুকু চেপে বাকিটুকু বলল সে, তবে বলল একটু ঘুরিয়ে। পরের বার গলার কাছটায় সুরসুরি দিচ্ছিল। ঘুম ভাঙার পর সুরসুরিটা বন্ধ হলো ঠিকই কিন্তু একটা গন্ধ পাচ্ছিলাম।

রুনু ভ্রু কোঁচকালেন। গন্ধ মানে? কিসের গন্ধ?

পারফিউমের।

পারফিউমের? পুরুষালি পারফিউম না মেয়েলি?

পুরুষালি শব্দটাই শুধু নয় পারফিউমের নামটাও প্রায় মুখে এসে যাচ্ছিল সুমির, কিন্তু কী যেন কী কারণে বলতে লজ্জা করল তার। মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে সরাসরি মিথ্যে কথা বলল, তা খেয়াল করিনি।

মূসা সাহেব অবাক হয়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। কিছু একটা বলতে চাইলেন তিনি তার আগেই রুনু বলল, তারপর কী করলি তুই? ভয় পেয়ে গেলি? ছুটে এসে আমাদের দরজা ধাক্কাতে লাগলি?

না। বেডসুইচ টিপেছি, দেখি জ্বলছে না। তখুনি পিঠের কাছে কে যেন শ্বাস ফেলল। আবার সেই পারফিউমের গন্ধটা পেলাম। কে কে করে চিৎকার করলাম। তারপর অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে দরজা খুলে…।

মূসা সাহেব রুনুর দিকে তাকালেন। এসবের মানে কী?

রুনু বেশ চিন্তিত। কিছুই তো বুঝতে পারছি না।

সাদি বলল, বুঝতে না পারার কিছু নেই। সুরসুরি বা শ্বাস ফেলার ব্যাপারটি ঘটেছে স্বপ্নে। আর পারফিউমের গন্ধটা ওর নিজের পারফিউমেরই গন্ধ। হয়তো ঘরের কোথাও পারফিউমের শিশি আগেই ছিটকে পড়ে ভেঙে টেঙে ছিল, ওই থেকে গন্ধ আসছিল।

সুমি বলল, তাহলে প্রথমবার গন্ধটা পাইনি কেন?

হয়তো গন্ধটা তখনও ছিল। তুই খেয়াল করিসনি।

কিন্তু সুইচ টেপার পর আলোটা পরেরবার জ্বলল না কেন?

কী করে জ্বলবে? তখন তো ইলেকট্রিসিটি ছিল না।

মূসা সাহেব বললেন, তুই বুঝলি কী করে যে ইলেকট্রিসিটি ছিল না?

তোমাদের কথাবার্তা শুনে বেরিয়ে আসবার কিছুক্ষণ আগে টয়লেটে গিয়েছিলাম আমি। তখন আমার বাথরুমের আলো জ্বলেনি। ব্যাপারটা হয়েছে এই রকম, সুমি এসে তোমাদের দরজায় ধাক্কা দিয়েছে ঠিক তখুনি আলো এসেছে। এইজন্য তোমরা সুইচ টেপার সঙ্গে সঙ্গে আলো জ্বলেছে।

রুনু বললেন, ঠিকই বলেছিস। এরকমই ঘটেছে।

সুমি বলল, না। নিশ্চয় এর মধ্যে অন্যকোনও ব্যাপার আছে। সুরসুরিটা আমি পরিষ্কার টের পেয়েছি। শ্বাস ফেলাটা টের পেয়েছি। যে ধরনের পারফিউমের গন্ধ ছিল ওই ধরনের পারফিউম আমার কালেকশানে নেই।

মূসা সাহেব বললেন, তুই কি তাহলে বলতে চাচ্ছিস যে ব্যাপারটা ভুতুড়ে?

কিন্তু ভূতের ভয় আমার নেই। বিশ্বাসও নেই।

তাহলে এত ভয় পেয়েছিস কেন?

ভয় পাওয়ার কারণ, ব্যাপারটা সত্যি ঘটেছে।

এবার সাদি একটা হাই তুলল। ধুৎ কিছু না এসব। যা শুয়ে পড় গিয়ে। আমি গেলাম। সকালে অফিস আছে।

সুমি বলল, কিন্তু একটা ব্যাপার তোমাদের প্রমাণ করা উচিত।

কী?

ওই যে তুমি বললে হয়তো আমার রুমে কোনও পারফিউমের শিশি ভোলা আছে কিংবা ভেঙেছে, ওটা তো এখুনি তোমরা প্রমাণ করতে পার।

রুনু বললেন, ঠিক।

মূসা সাহেব বললেন, চল সবাই মিলে তাহলে ওর রুমে যাই। খুঁজে পেতে দেখি।

সাদির খুব একটা ইচ্ছে ছিল না। তবু সবার সঙ্গে সুমির রুমে এসে ঢুকল।

রুমে ঢুকে প্রথমেই সুইচ টিপলেন রুনু। উজ্জ্বল আলোয় ভরে গেল রুম।

সুমি কী রকম একটা হাপ ছাড়ল। ভয়টা এখন অনেকটাই কমেছে। তবু বুকের ভেতর কী রকম থম ধরে আছে।

মূসা সাহেব রুনু এবং সাদি তখন রুমের চারদিকে তাকিয়ে ভাঙা কিংবা মুখ ভোলা পারফিউমের শিশি খুঁজছে। সুমি নিজেও তার ড্রেসিংটেবিলটা তন্ন তন্ন করে খুঁজল, ও রকম কোনও পারফিউমের শিশি পাওয়া যায় কী না।

না পাওয়া গেল না।

হতাশ হয়ে সাদি বলল, সুমি, এসব আসলে তোর মনের গণ্ডগোল। এই রুমের কোথাও কিছু নেই, কিছু হয়নি। যেসব অনুভূতির কথা তুই বললি ওসব হয়েছে স্বপ্নে অথবা তোর অবচেতন মনে। হয়তো এই ধরনের কিছু তুই ভেবেছিস কিংবা কল্পনা করেছিস। ঘুমটা গম্ভীর হয়নি বলে ঘুমে জাগরণে মিলেমিশে ওসব তোর মনে হয়েছে। কিছু না, কিছু না। শুয়ে পড়। দরকার হলে একটা রিলাকজিন খা। ফ্রেস ঘুম হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

সঙ্গে সঙ্গে ভয় পেল সুমি। না না এই রুমে একা আমি আর পোব না। কিছুতেই না।

তাহলে কোথায় শুবি?

মূসা সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকালেন। মেয়েটা যখন ভয় পাচ্ছে, তুমি না হয় ওর সঙ্গে থাক।

রুনু একটু বিরক্ত হলেন। ওর বিছানায় আমার ঘুম হবে? তুমি তো জানো নিজের বিছানা ছাড়া একদম ঘুমোতে পারি না আমি। সকালে কোর্টে দৌড়াতে হবে। জরুরী একটা কেস আছে। ঘুমটা ভাল না হলে…। তারচে’ বরং একটা কাজ করি নীচতলা থেকে নূরজাহান আর মতিকে ডাকি। নূরজাহান শোবে সুমির রুমের মেঝেতে আর মতি সামনের বারান্দায়।

শুনে মূসা সাহেব একটু গম্ভীর হলেন। এতকিছুর দরকার নেই। সুমি, তুই গিয়ে তোর মার সঙ্গে আমাদের রুমে শো। আমি থাকছি তোর রুমে।

সাদি বলল, আমি তাহলে গেলাম বাবা।

যা।

কিন্তু মায়ের পাশে শুয়েও বাকি রাতটা আর ঘুমোতে পারল না সুমি। সারারাত মনের ভেতরটা আকুলি বিকুলি করল তার। বুকটা ভার হয়ে রইল। মনে মনে প্রায় সারারাত আল্লাহকে ডাকল সুমি।

২. আপনি কোথায়

আপনি কোথায়?

ফোনে হ্যালো ইত্যাদি না বলে সরাসরি এরকম প্রশ্ন, জয় একটু থতমত খেল। তারপরই বুঝে গেল ফোনটা কার। সঙ্গে সঙ্গে মুখটা হাসি হাসি হয়ে গেল তার, গলার স্বর রোমান্টিক হয়ে গেল। মিলা?

তো কে?

কোত্থেকে?

টেলিফোনের দোকান থেকে। কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর কই?

কোথায় আমি?

হ্যাঁ।

উত্তরায়।

ওখানে কী করছেন?

সুপারভাইজারি।

মানে?

সুপারভাইজারি মানে জানো না? তদারকি।

বুঝলাম। কিসের তদারকি করছেন আপনি?

বাড়ির।

মিলা বুঝে গেল উত্তরায় যে বাড়ি তৈরি করছেন জয়ের বাবা সে বাড়ির কাজ দেখতে গেছে জয়। এরকম প্রায়ই যায় সে। সারাদিন কাটিয়ে দেয় ওই। বাড়িতে। পরিচয়ের পর বার তিনেক ওই বাড়িতে বসে মিলার ফোন রিসিভ করেছে সে।

কিন্তু আজ এতদূরে আছে জয় এটা তেমন ভাল লাগল না মিলার। বিরক্ত হয়ে বলল, ইস, অতদূরে গেছেন কেন? কাছাকাছি কোথাও থাকতে পারলেন না?

জয় হাসল। কাছাকাছি থাকলে কী হতো?

দেখা হতে পারত।

তাই নাকি?

তো কী!

কী সৌভাগ্য আমার! সত্যি বলছ?

এখনও পর্যন্ত মিথ্যে কথা আপনার সঙ্গে আমি বলিনি।

কবে বলবে?

কখনই না।

কেন?

মিথ্যে বলতে আমি খুব অপছন্দ করি।

একথা সবাই বলে। তারপরও নানাভাবে প্রচুর মিথ্যে বলে।

আমি বলব না।

বলো অন্তত আমার সঙ্গে বলবে না।

আপনার সঙ্গে নয়, কারও সঙ্গেই বলবে না।

বলবে তো বটেই। এবং আজই বলবে।

কার সঙ্গে?

তোমার মা বাবার সঙ্গে কিংবা বাড়ির অন্য কারোর সঙ্গে।

কী ভাবে?

ধরো তোমার মা বাবা কিংবা গার্জিয়ান ধরনের কেউ ঠিক এই সময়টার কথা তোমাকে জিজ্ঞেস করল। এই সময়টায় তুমি কী করছিলে। তুমি কি সত্য কথা বলবে? বলবে যে বান্ধবীর প্রাক্তন প্রেমিকের সঙ্গে কথা বলছিলে। এবং কথাও মোটামুটি রোমান্টিক ধাঁচের।

বান্ধবীর প্রাক্তন প্রেমিক কথাটা শুনে বিরক্ত হলো মিলা। রুক্ষ গলায় বলল, আমার এত পয়সা নেই যে ফোনের দোকান থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইল টু মোবাইল ফালতু কথা বলব।

জয় বুঝে গেল মিলা রেগেছে। বলল, সরি। জরুরী কথাটাই বলো।

এখন আর বলার মুড নেই।

প্লিজ বলো, প্লিজ।

মিলা চুপ করে রইল।

জয় বলল, তুমি কি তোমাদের বাড়ির ওখান থেকে ফোন করেছ?

না।

তাহলে কোথায় তুমি?

ইস্কাটনে।

ওখানে কী?

আমার বান্ধবী মুন্নিদের ফ্ল্যাট। ওর কাছে এসেছিলাম একটু দরকারে। কিন্তু মুন্নি নেই।

ফোন করে আসনি?

না। ওকে না পেয়ে আপনাকে ফোন করলাম। অন্য রকমের একটা প্ল্যান ছিল, আপনার কথা শুনে মুড অফ হয়ে গেছে।

সেজন্য সরি বললাম তো বাবা।

মিলা চুপ করে রইল।

জয় বলল, প্ল্যানটা বল।

ভেবেছিলাম আপনার সঙ্গে দেখা করব।

সত্যি?

সত্যি।

আমি তাহলে আসি।

কোথায়?

ইস্কাটনের কাছাকাছ কোথাও।

এদিকে কোথায় আসবেন?

তুমি বলো।

আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

কোনও চায়নিজ রেস্টুরেন্টে?

না, রেস্টুরেন্টে বসতে আমার খুব বিশ্রি লাগে। কে কোথা দিয়ে দেখে ফেলবে?

এই সম্ভবনা সব জায়গায়ই থাকবে।

তা ঠিক।

কিন্তু দেখা করতে হলে কোথাও না কোথাও…।

কথাটা শেষ না করে স্বর বদলালো জয়। তুমি সাহস দিলে একটা কথা বলতে পারি।

বলুন।

রাগ করবে না তো?

না।

প্রমিজ?

প্রমিজ।

আমার এখানে চলে আস।

আপনার ওখানে মানে?

উত্তরার এই বাড়িতে।

মিলা চমকাল। কী?

হ্যাঁ।

কথাটা আপনি ভাবলেন কী করে?

কেন, অসুবিধা কী?

অসুবিধা যে আসলে কী মিলা ঠিক বুঝতে পারল না। একটু থতমত খেল। তারপর বলল, যে বাড়ির কনস্ট্রাকশন চলছে সেই বাড়িতে লোক যায় কী করে?

ইচ্ছে করলেই যাওয়া যায়। বাড়িটা আমরা তিনতলা করব। একতলাটা প্রায় কমপ্লিট। নিজের মোটামুটি সুন্দর একটা রুম আছে আমার। আমি তো এখন সেই রুমে বসেই তোমার সঙ্গে কথা বলছি। সঙ্গে এটাচড বাথ। একটা এসিও লাগানো হয়েছে রুমে।

এটাচড বাথ শুনে একটু ভাবল মিলা। জয় কি অন্যরকমের কোনও ইঙ্গিত দিল?

মিলার স্বভাব হচ্ছে যে কোনও কথাই সরাসরি বলা। এটাও বলল, আপনি কি অন্যকিছু মিন করলেন?

জয় একটু থতমত খেল। অন্যকিছু মানে?

এটাচড বাথ মানে কী?

এটাচড বাথের আবার মানে কী? রুম সংযুক্ত বাথ।

তা আমি বুঝেছি।

তাহলে?

মেয়েদের কাছে এটাচড বাথের অন্যরকম একটা অর্থ আছে। মানে কথাটা অন্যরকমের ইঙ্গিত বহন করে।

জয় হাসল। আমি সেই অর্থে বলিনি।

তাহলে কোন অর্থে বলেছেন?

আমি আসলে আমাদের বাড়ির অবস্থাটা তোমাকে বোঝাতে চেয়েছি। আমার রুমের অবস্থাটা বোঝাতে চেয়েছি। তুমি যদি এখানে আস তোমার কোনও রকমের অসুবিধা হবে না, এটা বোঝাতে চেয়েছি। তাছাড়া বাথরুম জিনিসটা মানুষের জন্য অত্যন্ত জরুরী।

জয়ের কথা বলার ধরনে মিলার মনে হলো অতি সরল ভঙ্গিতে কথাগুলো সে বলেছে। এই ধরনের মানুষদের চালিয়াতি কম থাকে।

তাহলে মিলা এখন কী করবে?

যাবে জয়ের ওখানে?

এখন এগারোটা বাজে। এখান থেকে স্কুটারে উত্তরায় যেতে চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগবে। অর্থাৎ সবমিলে প্রায় বারোটা। বাড়িতে সে বলে এসেছে তিনটায় ফিরবে। তার মানে উত্তরা থেকে তাকে আবার স্কুটারে চড়তে হবে দুটোর দিকে। সবমিলে ঘণ্টা দুয়েক জয়ের সঙ্গে কাটানো যাবে। মন্দ কী! তাছাড়া জয়ের পরীক্ষাটাও আজ সে নিয়ে ফেলতে পারবে।

মিলা বলল, আসতে পারি, কিন্তু আমার দুএকটা শর্ত আছে।

জয় হাসল। শর্তগুলো আমি জানি।

বলুন তো।

তুমি বলো।

বলেই বলল, না না তুমি বলো না। তুমি টেলিফোনের দোকান থেকে ফোন করেছ। নিশ্চয় দোকানে লোজন আছে। তারা শুনে ফেলবে।

সঙ্গে সঙ্গে জিভ কাটল মিলা। আড়চোখে দোকানের লোকজন দেখে নিয়ে বলল, ঠিক বলেছেন। আপনি খুব সার্ফ। তাহলে আপনিই বলে দিন না কী বলতে চাইছি আমি।

বলতে চাইছ, একা একটি রুমে পেয়ে আমি যেন তোমার সঙ্গে কোনও অশোভন আচরণ না করি, তোমার হাত টাত না ধরি, চুমু খাওয়ার চেষ্টা না করি।

অথবা তারচেও বেশি কিছু…। কথা শেষ করল না মিলা।

জয় বলল, আমি অত খারাপ লোক নই। তুমি না চাইলে জীবনেও তোমাকে স্পর্শ করব না আমি।

সুমিকেও কি এভাবেই বলেছেন?

কথা অন্যদিকে ঘোরাল জয়। তার আগে বলো, তুমি কি আসবে? যদি আস তাহলে আর সময় নষ্ট করো না। আর যদি না আস তাহলে যতক্ষণ ইচ্ছে টেলিফোনে কথা বলতে পার, আমার কোনও অসুবিধা নেই।

সামান্য সময় কী ভাবল মিলা তারপর বলল, আমি আসছি। বাড়ির ঠিকানাটা বলুন।

জয় ঠিকানা বলল। লোকেশান বুঝিয়ে দিল।

৩. কাল রাতে কী হয়েছিল

কাল রাতে কী হয়েছিল?

সত্যি কি কেউ ঢুকেছিল আমার রুমে! নাকি পুরো ব্যাপারটাই ঘটেছিল স্বপ্নে! অবচেতন মনে!

কিন্তু স্বপ্নে এই ধরনের অনুভূতি হয় কী করে?

স্বপ্নে যদি কেউ আমার হাত ধরে, বাস্তবে কি সেই হাত ধরা টের পাব আমি!

এমন কি হয়?

তাহলে ব্যাপারটা আসলে কী?

কোনও অশরীরী ঘটনা!

কিন্তু ওসবে যে আমার একদম বিশ্বাস নেই! ভূত প্রেত আমি মানিই না। কত ভূতের গল্প পড়েছি, হরর মুভি দেখেছি, দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছি। কই কোনওদিন তো এই ধরনের অনুভূতি হয়নি!

কাল রাতের ঘটনাটা মা বাবা ভাইয়া কেউ বিশ্বাস করেনি। ইলেকট্রিসিটির ব্যাপারটা পরিষ্কার না হলে হয়তো কিছুটা বিশ্বাস করতো।

কিন্তু সুমি তার নিজের কাছে একদম পরিষ্কার। ব্যাপারটা সত্যি ঘটেছিল। প্রথমে পায়ে সুরসুরি, তারপর নাভিমূলে, গালে গলায়। সবচে’ আশ্চর্যের কথা হচ্ছে পারফিউমের গন্ধ। এবং গন্ধটা পরিচিত। ওয়ান ম্যান শো।

স্বপ্নে কি কখনও পারফিউমের গন্ধ পাওয়া যায়!

নিজের রুমের জানালার সামনে বসে এসব ভাবছে সুমি। জানালার পর্দা সরানো। এই জানালা থেকে পাশের বাড়ির গাছপালার ফাঁক ফোকর দিয়ে পশ্চিমের আকাশ কিছুটা দেখা যায়। সকাল এগারটার রোদেলা আকাশ আজ অন্যরকম লাগছে।

এই আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করেই সুমির এক কাপ চা খেতে ইচ্ছে করল। নূরজাহান বুয়াকে ডাকল সে। চা দিতে বলল।

মতি বড় হয়ে গেছে তারপরও নূরজাহানকে তেমন বয়স্ক লাগে না। বাড়ির কাজের বুয়া সে ঠিকই, ছেলে নিয়ে বিধবা হয়েছে পাঁচ সাত বছর আগে তারপরও ফিগার বেশ সুন্দর নূরজাহানের, চেহারায় কমনীয়তা আছে। চাইলে এখনও বিয়েশাদি আবার করতে পারে সে। কিন্তু সেই মনোভাব নূরজাহানের একদম নেই। সে আছে এই বাড়ির কাজ নিয়ে। কাজে ফাঁকিজুকি কাকে বলে একদম বোঝে না। চলাফেরা উচ্ছল কিশোরীর মতো।

চার পাঁচ মিনিটের মধ্যে নীচতলার কিচেন থেকে সুমির জন্য চা করে নিয়ে এল নূরজাহান। কিন্তু চায়ের কাপ সুমির হাতে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বেরুল না, দাঁড়িয়ে রইল।

চায়ে চুমুক দিয়ে সুমি বলল, কী হলো, দাঁড়িয়ে আছ যে?

আপনার সঙ্গে একটু কথা বলব।

কী কথা?

কাইল রাইতে কী হইছে?

তুমি শুনলে কার কাছে?

মতি বলল।

ও শুনলো কার কাছে?

তা আমি জানি না।

কী বলল সে?

কইলো রাইতে বলে আপনে ভয় পাইছেন?

চায়ে চুমুক দিয়ে উদাস হল সুমি। হ্যাঁ।

কিসের ভয়? ভূতের?

ব্যাপারটা ভৌতিক। কিন্তু ভূতে আমি বিশ্বাস করি না।

হইছিল কি সেইটা আমারে বলেন।

তোমাকে বলে কী হবে?

সমস্যাটা মনে হয় আমি বুঝুম।

ভুরু কুঁচকে নূরজাহানের দিকে তাকাল সুমি। আমার সমস্যা তুমি বুঝবে কী করে?

নূরজাহান হাসল। আমিও তো মাইয়া মানুষ!

মেয়েমানুষের সঙ্গে ভৌতিক ব্যাপারের কী সম্পর্ক?

সম্পর্ক আছে। আপনি আমারে বলেন।

তোমার এখন কোনও কাজ নেই?

না। সব কাজ শেষ। দুপুরের রান্না হইয়া গেছে। নিজের গোসলটা খালি বাকি আছে আমার। সেইটা পরে করুম।

নূরজাহানের কথা বলার ভঙ্গিটা সব সময়ই ভাল লাগে সুমির। এখনও লাগল।

চা শেষ করে কাপটা নূরজাহানের হাতে দিয়ে বলল, বস।

সঙ্গে সঙ্গে মেঝেতে বসল নূরজাহান।

পুরো ঘটনাটা নূরজাহানকে বলল সুমি।

শুনে তীক্ষ্মচোখে সুমির মুখের দিকে তাকাল নূরজাহান। এইটা তো বড় আজব কাণ্ড। এই বাড়ির আশেপাশে তো খারাপ জিনিস কিছু নাই।

সুমি অবাক হলো। খারাপ জিনিস মানে?

যুবতী মেয়েদের সঙ্গে এই ধরনের কাণ্ড করে বদজীনে।

বদজীন কথাটা শুনে সুমি একটু নড়েচড়ে বসল। বদজীন ব্যাপারটা কী?

খারাপ জীন। জীন হইল দুই রকম। ভাল জীন আর খারাপ জীন। খারাপ জীনগুলিরে বলে বদজীন। মানুষের মধ্যে যেমুন ভাল মানুষ আর খারাপ মানুষ আছে, জীনের মধ্যেও তেমন আছে। ভাল জীনরা মানুষের উপকার করে আর বদজীনগুলি অনিষ্ট করে।

একটা একটা করে বল। ভাল জীনরা কী ধরনের উপকার করে মানুষের?

বহুত রকমের উপকার করে। তারা থাকেন পরহেজগার মানুষের লগে। কামেল দরবেশ পীর ফকিরের লগে। ভাল জীন দিয়া মানুষের অসুখ বিসুখ সারায়া দেন পীর ফকিররা। ধন সম্পত্তি টেকা পয়সাও জোগাড় কইরা দেয় ভাল জীনে। পথের ফকিররে রাজা বাদশা বানাইয়া দেয়। বহুত ঘটনা আছে এই রকম। ভাল জীন যদি কোনও মানুষের উপরে আছড় করে, তারে তারা আর দেশ গেরামে রাখে না। নিজেগ দেশে লইয়া যায়।

জীনদের দেশ কোথায়?

পরিস্থানে।

পরিস্থান তো শুনেছি পরিদের দেশ।

নূরজাহান হাসল। জ্বীন আর পরি তো একই। পুরুষরা হইল জীন, মেয়েরা হইল পরি। ভূত আর পেত্নির মতন। পুরুষ ভূতগুলি ভূত, মেয়েগুলি পেত্নি।

এসব আমি জানি।

জানোনের তো কথাই। এইসব কথা কে না জানে! ভাল জীনরা যে তাগ পছন্দের মানুষরে দেশ গেরামে রাখে না এমুন একটা ঘটনা আমগ গেরামে ঘটছিল।

সুমি অবাক হলো। তাই নাকি?

হ। বলুম ঘটনাটা?

বলো।

আমাগ গেরামে একজন দরবেশ আছিল। খালেক দরবেশ। দরবেশ সাবে যখন ছোট, একদিন দুপুরবেলা ঘরে ঘুমাইয়া রইছে, পাকের ঘরে তার মায় রানতে বইছে, হঠাৎ কইরা মার মনডা কেমুন কইরা উঠল। পোলার মুখটা দেখনের লেইগা পাগল হইয়া গেল। পোলা যেই ঘরে শুইয়া রইছে দৌড়াইয়া সেই ঘরে চইলা আসলো। আইসা দেখে ঘুমন্ত অবস্থায় পোলা তার শূন্যে ভাইসা রইছে। ভাইসা ভাইসা আস্তে আস্তে দরজার দিকে যাইতাছে। এই অবস্থা দেইখা মায় তো একেবারে পাগল হইয়া গেছে। দুইহাতে পোলারে জড়াইয়া ধরছে। বাজান, কই যাস তুই? এই অবস্থায় তুই কই যাস? তখন গায়েবি আওয়াজ হইল, দুনিয়া বড় বদ জায়গা। খালেকরে এখানে রাখুম না। এই আওয়াজ শুইনা মায় দুইহাতে বুকে জড়াইয়া ধরল শূন্যে ভাইসা থাকা পোলা। কইলো, না না,

আমার বুকের ধন আপনেরা নিতে পারবেন না। তারপর খালেক দরবেশরে তারা। রাইখা যায়। তয় যেই জীনে তারে নিতে চাইছিল সেই জীনটা সারাজীবনই দরবেশ সাবের লগে আছিল।

ঘটনাটা যে খুব আলোড়িত করল সুমিকে তেমন নয়। তবু সে বলল, তার মানে এরা হচ্ছে ভাল জীন?

হ।

এবার তাহলে একটা বদজীনের ঘটনাও বল।

তার আগে খালেক দরবেশের ঘটনাটা শেষ করি।

করো।

তারপর হঠাৎ করেই যেন বাড়ির পরিস্থিতিটা বুঝতে চাইল সুমি। তুমি যে এখানে, নীচতলায় কে?

মতি আছে।

মার চেম্বার লক করা তো?

হ। নীচের ঘরদুয়ার বেবাকই বন্ধ।

বাবা বেরিয়েছে কখন?

আম্মার লগেই গেছে। আম্মারে কোটে নামাইয়া দিয়া সিটি করপোরেশান না কই বলে যাইব।

বুঝেছি, বাড়ির ট্যাক্সের ব্যাপারে কী ঝামেলা হয়েছে। ভাইয়া কি আগে বেরিয়েছে?

না। সে বাইর হইছে পরে।

নীচে মতি আছে তো? চোর টোর ঢুকে যাবে না তো?

না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকেন।

সুমি জানালার দিকে তাকাল। পাশের বাড়ি পেয়ারা গাছে দুটো শালিক বসে আছে। এত চুপচাপ শালিক সাধারণত থাকে না। কিন্তু এই শালিক দুটো আছে।

পাখি দুটোর দিকে তাকিয়ে বেশ বড় একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল সুমির।

নূরজাহান বলল, খালেক দরবেশের ঘটনাটা শেষ করুম?

নূরজাহানের দিকে তাকাল না সুমি। বলল, হ্যাঁ।

দরবেশ সাব সারাজীবন নীল রংয়ের একখান কাপড় পরতেন। মাইয়া লোকের শাড়ির মতন কাপড়। ওই এক কাপড়ে পুরা শইল ঢাইকা রাখতেন। নীল কাপড় ছাড়া পরতেন না। খালি সিগ্রেট খাইতেন। তেমুন কথাবার্তা মানুষের লগে বলতেন না। রাস্তা দিয়া হাঁটতে হাঁটতে বিড় বিড় কইরা কথা কইতেন, হাসতেন। তাগ বাড়ি থিকা পদ্ম আছিল কাছে। জোসনা রাইতে পদ্মার তীরে গিয়া বইসা থাকতেন, একলা একলা কথা কইতেন। আসলে তো একলা কথা কইতেন না! কইতেন তো জীনগ লগে!

শীতকালেও কি ওই একই কাপড় পরে থাকতেন?

হ। শীত গরম আছিল না তার।

বিয়ে শাদি করেননি?

একথা শুনে উফুল্ল হলো নূরজাহান। এই ঘটনাটাই আপনেরে কইতে চাইতাছি।

বলো।

বয়েসকালে বিয়া ঠিক হইল দরবেশ সাবের। বিয়ার আগের দিন বউরে সাপে কাটল।

মানে? মারা গেলেন মহিলা?

হ। তারপর সারাজীবন দরবেশ সাব আর বিয়া করেন নাই। মানুষে কয় তার লগের জীনেই বলে সাপের রূপ ধইরা তার বউরে কাটছে।

কেন?

দরবেশ সাবে বিয়া করুক, সংসার ধর্ম করুক এইটা জীনেরা চায় নাই।

কারণটা কী?

আল্লায়ই জানে। মনে হয় তারা এই দুনিয়াতে দরবেশ সাবরে বেশিদিন রাখতে চায় নাই। দরবেশ সাবে যদি বিয়াশাদি কইরা সংসার ধর্ম করে, যদি তার বউ পোলাপান থাকে তয় দুনিয়ার মায়া বাইড়া যাইব, বোধহয় এইসব চিন্তা করছে জীনে।

তাহলে তিনি কি কম বয়সে মারা যান?

খুব কম বয়সে না। তয় এসব কামেল দরবেশরা তো মরেন না। তারা শরিল বদলান।

শরীর বদলানো মানে?

এক শরিল ছাইড়া আরেক শরিল নেন। সেই শরিল নিয়া পরিস্থানে চইলা যান। দরবেশ সাবের জীনরাও তারে পরিস্থানে নিয়া গেছে।

ঘটনাগুলো শুনতে ভালই লাগল সুমির। কালরাত থেকে অন্যরকম হয়ে থাকা মন কেমন যেন বদলালো। হালকা হয়ে গেল।

নূরজাহানের দিকে তাকিয়ে সুমি বলল, এবার বদজীনের কথা বল। যুবতী মেয়েদের সঙ্গে বদজীনের কী সম্পর্ক, বল।

নূরজাহান একটু নড়েচড়ে বসল। বদজীনগুলি যুবতী মাইয়াগ খুব জ্বালায়। দেশ গেরামে শোনেন না, অমুকের বউরে ভূতে ধরছে, তমুকের যুবতী মাইয়ারে ভূতে ধরছে, অল্প বয়সে বিধবা হইয়া আছে কেউ, তারে ধরছে।

ভূত আর বদজীন কী এক নাকি?

একই। কেউ বলে ভূত, কেউ বলে বদজীন। আসলে সব খারাপ জিনিসই ভূত। শোনেন না, খারাপ মানুষরে অনেকে বলে ভূত। খারাপ মেয়েরে বলে পেত্নি।

সুমি হাসল। বুঝেছি।

সুমিকে হাসতে দেখে নূরজাহানও হাসল। এইবার আপনেরে একটা বদজীনের ঘটনা কই। আমগ গেরামে শিরিন নামে একটা মাইয়া আছিল। পাড়া বেড়াইনা মাইয়া। নিজেগ বাড়িতে থাকেই না। এই বাড়িত যায়, ওই বাড়িত যায়। দিন দোফর মানে না, রাইত বিরাইত মানে না। যখন যেখানে মন চায় চইলা যায়। বয়স হইয়া গেছে কিন্তু গরিব মা বাপে বিয়া দিতে পারে না। শিরিনের শরিল স্বাস্থ্য খুব ভাল। এই ধরনের মাইয়াগ পুরুষ পোলারা খুব পছন্দ করে। কিন্তু শিরিনের স্বভাব চরিত্র খারাপ না। নষ্ট মাইয়া না সে। শিরিনের সই আছিল কাজল নামে আর একটা মাইয়া। কাজলের বিয়া হইয়া গেছে। শ্বশুরবাড়ি থাকে সে। যখন নিজেগ গেরামে আসতো, কাজলরে শিরিন নিজের দুঃখের কথা কইতো।

কী দুঃখ?

বিয়া না হওনের দুঃখ।

বলেই মুখ টিপে হাসল নূরজাহান।

তার হাসি খেয়াল করল সুমি। বলল, হাসছ কেন?

ওই যে বিয়া না হওনের দুঃখ কথাটা কইলাম, কইয়া নিজেরই হাসি পাইল। আপনে তো যুবতী মাইয়া, বিয়া না হওনের দুঃখ আপনে বোঝবেন।

কথাটা আসলে বুঝল না সুমি। অবাক চোখে নূরজাহানের মুখের দিকে তাকাল। আমি কিন্তু বুঝিনি।

না বুঝলে ঘটনাটা শোনেন, পরে বুঝবেন।

ঠিক আছে। বল।

সইর লগে বিয়া না হওনের দুঃখের কথা কয় শিরিন, শুইনা সইয়ে কয়, হ লো সই, বিয়া হওনের পর, স্বামীর লগে থাকনের পর আমি চিন্তাই করতে পারি না স্বামী ছাড়া যুবতি মাইয়ারা থাকে কেমনে! সইয়ের এই কথাটা তারপর থিকা খালি মাথায় ঘোরতো শিরিনের। রাইতে ঘুমাইতে পারতো না। এই সময় একদিন বদজীনে ধরল শিরিনরে।

কোথায় ধরল, কীভাবে?

আগে শোনেন না ঘটনা। একদিন সন্ধ্যা বইসা যাওয়ার পর বাড়িত আইসা পাগলামী শুরু করল শিরিন। উল্টাপাল্টা কথা কয়, কাপড় চোপড় খুইলা ফালায়। বাড়ির মুরব্বিরা কইলো, শিরিনরে ভূতে ধরছে। ভূত ছাড়ান লাগবো। ভূত না। ছাড়াইলে এই মাইয়া ভাল হইব না। আমগ পাশের গেরামে বদর নামে একজন ফকির আছে। তার কাম হইল ভূত ছাড়ান। পাঁচ টেকা নিয়া, দুইতিন দিন চেষ্টা কইরা সে ভূত ছাড়ায়। বদররে খবর দেওয়া হইল। পরদিন সন্ধ্যায় বদর আইলো শিরিনের ভূত ছাড়াইতে। বদর ফকিরমানুষ হইলে কী হইব, দেখতে তাগড়া জুয়ান। বদররে দেইখাই পাগলামি শুরু করল শিরিন। কাপড় চোপড় খুইলা ফালাইতে চাইল। শিরিনের চোখের দিকে চাইয়া বদর কইল, তরে আমি চিনা ফালাইছি। পুব পাড়ার বাঁশঝাড়ে থাকছ তুই। তর মতন বদজীন আমি অনেক ছাড়াইছি। খাড়া আইজই তর খবর লইতাছি। তারপর শিরিনের মারে বদর কইল, ঘর আন্ধার করেন। তারবাদে আপনেরা বেবাকতে বাইরে যান। শিরিনের। বদজীন আমি ছাড়াইতাছি। যেই কথা সেই কাজ। সবাই ঘর থিকা বাইর হইয়া গেল। ভিতর থিকা দরজার খিল লাগাইয়া দিল বদর ফকির। বাড়ির উঠানে লোকজন সব খাড়াইয়া রইছে আর বন্ধ ঘরে শিরিনের বদজীন ছাড়াইতাছে ফকিরে। মাঝে মাঝে শুনা যায় বদজীনরে গালিগালাজ করতাছে ফকিরে আর শিরিন গোঙাইতাছে। এইভাবে ঘণ্টাখানেক। তারপর দেখা গেল শিরিন বেহুশের মতো ঘুমাইতাছে। সেই রাইতে পাগলামি আর করল না। ফকির বইলা গেল এইভাবে তিন সন্ধ্যা ছাড়াইতে হইব নাইলে শিরিনরে পুরাপুরি ছাইড়া যাইব না বদজীনে। তারপর দিন সারাদিন ভাল রইল শিরিন, বিকালের দিকে একটু একটু পাগলামি শুরু করল। বদর ফকির আসলো সন্ধ্যাবেলা। আবার আন্ধার ঘরে ভূত ছাড়াইল। তিনদিন পর পুরাপুরি ভাল শিরিন।

সুমির খুবই অবাক লাগছিল। বলল, সত্যি?

নূরজাহান হাসল। আসল ঘটনাটা আগে শোনেন।

আসল ঘটনা আবার কী? সব তো বলেই ফেললে!

বলি নাই। শোনেন। দেড় দুই মাসের মাথায় শিরিন একদিন বমি করতে লাগল।

শুনে চমকাল সুমি। কী?

হ। বেদম বমি।

কেন?

বোঝেন নাই আপনে?

না।

শিরিন পোয়াতি হইয়া গেছে।

তাই নাকি? কীভাবে?

নূরজাহান আবার হাসল। আপনে অহনও অনেক কিছু বোঝেন না। এইডা তো খুব সোজা ব্যাপার। আন্ধার ঘরে তাগড়া জুয়ান বদর ফকির শিরিনের বদজীন ছাড়াইছে কেমনে? পর পর তিনদিন?

সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা বুঝে গেল সুমি। শরীরের ভেতর কেমন একটা অনুভূতি হলো তার। একেবারেই অচেনা এক অনুভূতি। ফ্যাল ফ্যাল করে নূরজাহানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সে।

নূরজাহান বলল, এইবার আপনেরে আসল কথাটা কই। দুনিয়াতে বদজীন ভূত পেত্নি পরি এইসব আছে কি নাই কেউ জানে না। তবে মাইয়া মানুষের শরিলে আর মনে যে একটা কইরা বদজীন আছে এইডা বেবাক মাইয়া মাইনষেই জানে। যুবতী হইয়া উঠনের পরই বদজীনটা বিরক্ত শুরু করে। সেই বদজীনরে কেউ কেউ দমাইয়া রাখতে পারে, কেউ কেউ পারে না। যারা না পারে তাগ নানান পদের অসুবিধা দেখা দেয়। তয় বিয়া হইয়া গেলে, স্বামীর লগে থাকতে শুরু করলে বদজীনে আর বিরক্ত করে না।

নূরজাহানের কথার অর্থ পরিষ্কার বুঝল সুমি।

কিন্তু তার সমস্যাটা কি ওরকম?

নূরজাহান বলল, আমার মনে হয় মনের বদজীনে আপনেরে বিরক্ত করতে শুরু করছে।

এখন তাহলে কী করা উচিত আমার?

বলব?

হ্যাঁ।

রাগ করবেন না তো?

না।

আপনের বিয়া হইয়া যাওন উচিত।

কিন্তু তুমি যা বলছ ওই ধরনের সমস্যা আমার নেই।

আছে। আপনে বুঝতে পারছেন না।

এবার অন্য একটা কথা মনে পড়ল সুমির। বলল, তাহলে কথা শুরুর প্রথম দিকে তুমি যে বলেছিলে এই এলাকায় নাকি বদজীন নেই, থাকলে তুমি টের পেতে না কী যেন! সেই কথাটার অর্থ কী?

নূরজাহান আবার হাসল। ওই কথার কোনও অর্থ নাই। এমনিতেই বলছিলাম। অর্থ ছাড়াও কত কথা আমরা কই।

আমার মনে হয় তুমি মিথ্যে বলছ।

কেমুন?

আসলে আমার সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করার জন্য, অথবা কালরাতে কী হয়েছে এসব জানার জন্য ওইসব বদজীন ইত্যাদির কথা বলে আমার মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছ।

নূরজাহান হাসল। ঠিকই বলছেন।

তারপর উঠল। যাই। অনেক কথা কইলাম আপনের লগে। তয় যা কইলাম বেবাকই সত্য। মাইয়া মানুষের শরিল আর মনেই থাকে বদজীন। এই বদজীন ছাড়ানের একমাত্র পথ হইল বিয়া।

কিন্তু তুমি তো বলেছ বিবাহিত মেয়েদেরকেও বদজীনে ধরে!

হ ধরে! কখন ধরে জানেন?

কখন?

যখন নতুন নতুন বিয়া হয় মেয়েগ, দুই চাইরদিন স্বামীর লগে থাকে। তারপর দেখা গেল বউ রাইখা স্বামী চইলা গেছে দূরে। দুই চাইর ছয়মাস একবছর স্বামী ফিরে না, এই পদের মেয়েগও বদজীনে ধরে।

বলে নূরজাহান আর দাঁড়াল না।

নূরজাহান চলে যাওয়ার পর শুধুই জয়ের কথা মনে পড়তে লাগল সুমির।

 ৪. জয়দের বাড়িতে পৌঁছতে

জয়দের বাড়িতে পৌঁছতে ঠিক পঞ্চাশ মিনিট লাগল।

তেমন খুঁজতেও হয়নি বাড়ি। একবারেই পাওয়া গেল।

স্কুটার থেকে নেমে জয়কে দেখতে পেল মিলা। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। ফেডেড জিনসের লুজ ধরনের জিনস পরা, আকাশি রংয়ের টিশার্ট। বাঁহাতে সুন্দর বেল্টের ঘড়ি। পায়ে সুন্দর স্যান্ডেলসু। সকালবেলা গোসল, সেভ এসব সেরে বেরুবার ফলে বেশ ফ্রেস লাগছে তাকে।

জয়কে দেখে খুব ভাল লাগল মিলার। মনে হলো এই মানুষের ওপর সর্বান্তকরণে নির্ভর করা যায়। এই মানুষ কারও কোনও ক্ষতি করতে পারে না।

মনটা আশ্চর্য এক ভাল লাগায় ভরে গেল তার।

মিলাকে দেখেই স্কুটারের সামনে এগিয়ে এসেছে জয়। সঙ্গে সঙ্গে তার গা থেকে চমৎকার একটা পারফিউমের গন্ধ এলো। এই গন্ধে মুহূর্তের জন্য কী রকম যেন দিশেহারা হলো মিলা। অপলক চোখে জয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সে।

মিলাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাসল জয়। কী হলো? নামবে না?

মিলা থতমত খেল। তারপর লাজুক হাসল। নামব না কেন?

কোলের ওপর কলেজের ব্যাগ। ব্যাগ নিয়ে নামল সে।

জয় বলল, আমি একটা কাজ করতে চাই। তুমি কি রাগ করবে?

জয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে মিলা বলল, হ্যাঁ খুবই রাগ করব।

কথাটা না শুনেই বলছ?

বুঝে গেছি কী করতে চাইছেন আপনি।

বলো তো?

স্কুটার ভাড়াটা দিয়ে দিতে চাইছেন।

জয় হাসল। হ্যাঁ।

কেন আপনি দেবেন?

বলেই ব্যাগের ভেতর থেকে ছোট্ট পার্স বের করল মিলা। একটা পঞ্চাশ টাকা আর একটা দশ টাকার নোট স্কুটারঅলাকে দিল। তারপর জয়ের দিকে। তাকাল। চলুন।

মিলাকে নিয়ে নিজের রুমে চলে এল জয়।

বাড়ির ভেতরে নানা রকমের জিনিসপত্র ছড়ানো। লেবার ওস্তাগাররা আসছে, যাচ্ছে। ঠুকুর ঠাকুর শব্দ হচ্ছে। বাইরে থেকে বেশ একটা হযবরল অবস্থা। কিন্তু জয়ের রুমে বলতে গেলে তেমন কোনও শব্দই আসছে না। বেশ ছিমছাম সুন্দর রুম। সিঙ্গেল খাট পাতা। নরম ফোমের ওপর আড়ংয়ের বেডকাভার। বিছানার একপাশে বেডসাইট টেবিল। তাতে জয়ের মোবাইল সেটটা পড়ে আছে। দুতিনটি পত্রিকা, সুন্দর একটা টেবিল ল্যাম্প। এক পাশে দেয়ালের সঙ্গে দুটো বেতের সোফা, ছোট্ট টিপয়। আরেক পাশে ওয়ার্ডরোব। তার ওপর চৌদ্দইঞ্চি সনি টেলিভিশন। একটা ক্রিস্টালের ফ্লাওয়ারভাস, ছোট্ট একটা টেপ রেকর্ডার, কয়েকটা অডিও ক্যাসেট, দুতিনটি পারফিউম, রুম স্প্রে। সবমিলে অত্যন্ত রুচিকর একটা পরিবেশ।

জয়কে গেটের সামনে দেখে যেমন ভাল লেগেছিল মিলার, এখন এই রুমে ঢুকেও তেমন ভাল লাগল। রুম ভরে আছে এয়ার ফ্রেসনারের গন্ধে।

মিলা মুগ্ধ গলায় বলল, খুব সুন্দর রুম।

জয় হাসল। আমার মতোই।

মানে?

তুমি একদিন বলেছ আমিও সুন্দর।

না তা বলিনি। বলেছি, ব্যক্তিত্ববান।

ব্যক্তিত্বই তো মানুষকে সুন্দর করে।

তা ঠিক। সেই অর্থে আপনি সুন্দর।

ব্যাগটা এক সোফায় রেখে পাশের সোফায় বসল মিলা। এবার বলুন তো স্কুটার ভাড়াটা আপনি কেন দিতে চাইছিলেন?

তেমন কোনও কারণ নেই। ভদ্রতা।

কিসের ভদ্রতা?

আমাদের ফ্যামিলির কিছু নিজস্ব নিয়ম আছে। আমাদের বাড়িতে কেউ এলে, যদি রিকশা কিংবা স্কুটারে আসে, আমরা চেষ্টা করি তাদের আসা যাওয়ার ভাড়াটা দিয়ে দিতে। যদিও বেশির ভাগ সময়ই কেউ নিতে চায় না।

চাইবে কেন? কেউ যদি কারও কাছে আসে, যার কাছে আসবে তার কাছে থেকে পথখরচা নেবে নাকি!

তা ঠিক। তবু আমরা অফার করি।

আমার ক্ষেত্রে আর কখনও করবেন না।

তা করব না। তবে কথাটা শুনে খুব খুশি হলাম।

এতে খুশি হওয়ার কী হলো?

খুশি হচ্ছি এই কারণে যে আজকের পরও তুমি আমার কাছে আসবে।

চোখ তুলে জয়ের মুখের দিকে তাকাল মিলা। তার মানে কী? আপনি কি আজ এমন কোনও ব্যবহার করবেন যার ফলে আমি আর কখনও এখানে আসব না?

জয় হাসল। ধুঁৎ। তুমি সব সময় এসব ভাব কেন? তোমার কথা শুনে আমার ভাল লেগেছে যে তুমি আমার কাছে, এখানে, আমি ডাকলেই আসবে।

আপনি না ডাকলেও আসতে পারি।

কথাটা আমি এসব ভেবেই বলেছি।

মিলা যে সোফাটায় ব্যাগ রেখেছে, সেই সোফার সামনে এসে দাঁড়াল জয়। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগটা সোফার পাশে নামিয়ে রাখল মিলা। বসুন।

জয় বসল। তোমার কোনও অসুবিধা হয়নি তো?

কিসের অসুবিধা?

এখানে আসতে?

না।

মানে স্কুটার পাওয়া, বাড়ি খুঁজে পাওয়া।

কোথাও কোনও অসুবিধা হয়নি।

গুড।

বলেই উঠে দাঁড়াল জয়।

মিলা অবাক হলো। কী হলো, উঠলেন কেন?

পাশাপাশি বসতে ভাল লাগছে না।

কেন?

তোমার মুখটা দেখতে পাচ্ছি না। প্রিয় মানুষ সামনে থাকলে তার মুখ না দেখতে পেলে আমার খুব অস্থির লাগে।

জয় বিছানায় বসল। মিলার মুখোমুখি। এবার তোমাকে খুব ভাল দেখতে পাচ্ছি।

মিলা হাসল। কেমন লাগছে আমাকে?

পেইল লাগছে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। তোমার বোধহয় রাতে ভাল ঘুম হয়নি।

ঠিকই বলেছেন। ঘুমটা খুব ভাল হয়নি।

কেন?

জানি না।

আমার কথা ভেবেছ?

ইস, আপনার কথা ভাববার কী এমন ঠেকা পড়েছে আমার?

সত্যি ভাবনি?

না।

তাহলে আজ এলে কেন?

মুন্নিকে না পেয়ে ভেবেছি।

তার মানে একজনকে না পেয়ে আরেকজনের কথা ভেবেছ?

মুন্নি কিন্তু মেয়ে।

তা আমি জানি। কারণ আজ পর্যন্ত মুন্নি নামে কোনও ছেলে আমি দেখিনি। ছেলেদের নাম হয় মুন্না।

মুন্না কিন্তু মেয়েদেরও নাম হয়।

তাই নাকি?

হ্যাঁ, মুন্না নামের একটি মেয়েকে আমি চিনি।

কোথায় থাকে?

আমেরিকায়। আগে আমাদের এলাকায় থাকত।

বিয়ে হয়ে গেছে? হাজব্যান্ডের সঙ্গে থাকে আমেরিকায়?

না পড়তে গেছে।

বাহ্, ভাল তো।

তারপর জয় বলল, তুমি কি বাথরুমে যাবে?

মিলা হাসল। কেন আমি হঠাৎ বাথরুমে যাব? আর আপনি এত বাথরুম বাথরুম করেন কেন?

জয়ও হাসল। আসলে তোমাকে খুব পেইল লাগছে। এমনিতেই রাতে ঘুমোওনি তার ওপর স্কুটার জার্নি। বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেস হও, ভাল লাগবে।

বাথরুমে যাওয়ার দরকারও ছিল মিলার। জয়ের কথা শুনে উঠল সে। ফ্রেস হয়ে এল।

জয় মুগ্ধ গলায় বলল, এবার সত্যি তোমাকে সুন্দর লাগছে।

মিলা কপট রাগ দেখাল। হয়েছে, আর পটাতে হবে না।

নতুন করে পটাবার কিছু নেই।

তারমানে পটিয়ে ফেলেছেন?

অবশ্যই। নয়তো তুমি এখানে আসতে?

মিলা কথা বলল না। আগের জায়গায় বসল। আপনি এত বাথরুম বাথরুম কেন করছিলেন আমি বুঝতে পেরেছি।

কেন বল তো?

বাথরুমটা আমাকে দেখাতে চেয়েছেন। চেয়েছেন আমি যেন আপনার বাথরুমের প্রশংসা করি। প্রশংসা আমি করছি। বাথরুমটা সত্যি সুন্দর।

ধন্যবাদ। কিন্তু এই উদ্দেশ্য নিয়ে আমি বলিনি।

সঙ্গে সঙ্গে গা এলিয়ে বসল মিলা। আমি আজ কেন এসেছি জানেন?

জানি।

কেন বলুন তো?

আমার সঙ্গে প্রেম করতে।

জ্বী না, আপনার সঙ্গে প্রেম আমি করব না।

কেন?

আগে একটি প্রেম আপনি করেছেন। এবং আমারই বান্ধবীর সঙ্গে। সেকেন্ডহ্যান্ড প্রেমিকের সঙ্গে প্রেম আমি করব না।

তাহলে তো আমার খুব লস হয়ে গেল।

কী রকম?

তোমার বান্ধবীকেও হারালাম, তোমাকেও হারালাম।

কিন্তু আমার বান্ধবীর সঙ্গে এমন আপনি করলেন কেন? সুমি তো খুব ভাল মেয়ে।

তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

ওদের ফ্যামিলিও খুব স্ট্যান্ডোর্ড।

আমি সব জানি। প্রেম ভালবাসার সঙ্গে এসবের কোনও সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক যাকে তুমি ভালবাসবে শুধু তার সঙ্গে। সে কেমন, তার চরিত্র কেমন, ব্যক্তিত্ব এবং রুচি কেমন। মানুষ হিসেবে সে কোন স্তরের, এইসব।

প্রেমিকা হিসাবে সুমি কেমন ছিল?

তা তোমাকে আমি বলতে চাই না।

কেন?

থাক।

কিন্তু আমার জানা দরকার।

কেন?

আমার মনে হচ্ছে আপনার সঙ্গে আমার প্রেম হবে।

জয় হাসল। এখনও হয়নি?

বলব না। এখন যা জানতে চাইছি শুধু তাই বলুন।

তোমাকে খুব সিরিয়াস মনে হচ্ছে।

আমি সত্যি খুব সিরিয়াস টাইপের মেয়ে।

মুখের সুন্দর একটা ভঙ্গি করে জয় বলল, আচ্ছা শুনুন সিরিয়াস মেয়ে, কোন কোন ব্যাপারে আপনি খুব সিরিয়াস?

মিলা অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, সব ব্যাপারেই।

খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে?

মিলা হাসল। এই একটা ব্যাপারে আমি একেবারেই সিরিয়াস না।

অর্থাৎ না খেয়ে থাকেন?

আরে না।

তাহলে?

খাই। খিদে পেলে হাতের কাছে যা পাই তাই খেয়ে ফেলি। আমার তেমন কোনও চয়েজ থাকে না।

এখন কি আপনার খিদে পেয়েছে?

না। কখন পাবে?

জানি না।

দুপুরে খিদে আপনার পায় তো, নাকি?

তা পায়।

তখন কী খাবেন?

ভাত।

কিন্তু এখানে যে ভাতের ব্যবস্থা নেই।

মিলা বুঝে গেল এতক্ষণ ধরে খাওয়া দাওয়া নিয়ে কেন কথা বলছে জয়। বলল, এখানে ভাতের কোনও দরকার নেই। আমি বাসায় গিয়ে খাব।

তুমি যাবে কটায়?

এখান থেকে দুটো কিংবা সোয়া দুটোয় স্টার্ট করব। অর্থাৎ তিনটার মধ্যে বাসায় পৌঁছাতে হবে। সেভাবেই বলে বেরিয়েছি।

সোয়া দুটো পর্যন্ত না খেয়ে থাকবে তুমি?

আমার কোনও অসুবিধা হবে না।

কিন্তু আমাকে তো কিছু না কিছু খেতে হবে। খিদে কিন্তু আমি একদম সহ্য করতে পারি না। খিদে পেলে মাথা খারাপ হয়ে যায় আমার।

আপনি খান। আপনাকে খেতে মানা করেছে কে?

তবে ভাত আমি খেতেই চাই না। খাদ্যের মধ্যে আমার সবচে’ অপছন্দ ভাত।

আর পছন্দ?

চুমু।

মিলা হাসল। ধুৎ। সব সময় ফাজলামো করবেন না।

এবার জয়ও হাসল। নির্মল মুখ করে হাসল। তোমার সঙ্গে খুব ফান করি আমি।

কেন করেন?

ভাল লাগে। খুব ভাল লাগে। ফান কিন্তু সবার সঙ্গে করা যায় না, জানো? কোনও কোনও মানুষের সঙ্গে করা যায়।

আমার সঙ্গে কেন করা যায় বলুন তো?

ফানটা তুমি বোঝ এবং এনজয় করো। তোমার সঙ্গে যেদিন প্রথম দেখা হলো, কথা হলো, সেদিনই বুঝে গিয়েছিলাম তুমি ঠাট্টাপ্রিয় মানুষ। যারা ঠাট্টা পছন্দ করে তারা মনের দিক দিয়ে খুব ভাল হয়। এজন্যই তো তোমাকে আমি প্রপোজ করলাম।

এখন তো মনে হচ্ছে সেটাও ঠাট্টা।

জয় সঙ্গে সঙ্গে অমিতাভ বচ্চন হয়ে গেল। কৌন বনেগা ক্রোড়পতি স্টাইলে বলল, এই প্রশ্নের জবাব, ব্রেক কা বাদ।

মিলা খিলখিল করে হেসে উঠল। তারপর বলল, কিসের ব্রেক?

আগের প্রসঙ্গ। বল কী খাবে?

বললাম তো কিছু খাব না।

তুমি এমনিতেই অত্যন্ত স্লিম, এট্রাকটিভ ফিগারের, তোমার ডায়েট করবার কোনও দরকার নেই।

আরে ধুৎ ওসব ডায়েট ফায়েট আমি করি না।

তাহলে বল, কী খাবে? ভাত ছাড়া।

আপনি কি সারাদিন এখানে থাকবেন?

তীক্ষ্ণচোখে মিলার মুখের দিকে তাকাল জয়। কেন বল তো?

এমনি।

আমার মনে হয় কারণ আছে।

কী কারণ?

তুমি কি চাইছো আমি তোমার সঙ্গে বেরুই। তারপর কোথাও কিছু খেয়ে, মানে কোথাও ফাস্টফুডের দোকান থেকে কিংবা কোনও চায়নিজ রেস্টুরেন্ট থেকে লাঞ্চ করে তোমাদের বাড়ির কাছাকাছি কোথাও তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি!

না আমি এরকম ভাবিনি।

তাহলে ঠিক আছে।

তারপর নিজেই খাবারের ডিসিশানটা নিল জয়। এখন আর ফান নয়, আমি সিরিয়াসলি বলছি।

মিলা সঙ্গে সঙ্গে বলল, বলুন। আমিও সিরিয়াসলি শুনছি।

তুমি যদি সত্যি সত্যি ভাত খেতে চাও, আমি আনাতে পারি। উত্তরায় এখন সব ব্যবস্থা আছে। সুন্দর সুন্দর ভাতের হোটেল আছে। ভাত মাছ মাংস সবজি ডাল, চাইলে সবই তোমাকে আমি আনিয়ে দিতে পারি। আমার রুমে প্লেট গ্লাস ফ্রেসপানি চামচ সবই আছে। অর্থাৎ ভাল ব্যবস্থা।

কিন্তু ভাত এখানে আমি খাব না।

শুনে খুশি হলাম।

কেন?

তুমি ভাত খেলে, তোমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য ভদ্রতা করে আমাকেও খেতে হতো। এখন তাহলে একটা কাজ করি, চিকেন বার্গার আর ভার্জিনকোলা আনাই, বেশ স্মার্ট খাবার…।

জয়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই মিলা বলল, কিন্তু আমার একদম খিদে পাচ্ছে না। আপনি শুধু আপনার জন্য আনান।

জয় গম্ভীর হলো। বাজে কথা বলো না। দুপুর হয়ে গেছে, খিদে পাবে না কেন তোমার?

মিলা বুঝল খেতে তাকে হবেই। বলল, কিন্তু আনবে কে?

লোক আছে। কোনও অসুবিধা নেই। তুমি স্রেফ দুটো মিনিট বসবে, আমি লোক পাঠিয়ে আসছি।

সত্যি সত্যি দেড় দুমিনিটে ফিরে এল জয়। মুখে সুন্দর হাসি।

মিলা বলল, ব্রেক কা বাদ কিন্তু শেষ। এবার আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।

জয় কী রকম উদাস এবং আনমনা হলো। সামান্য সময় কিছু ভাবল। তারপর বলল, তোমার সব কথার উত্তরই আজ পেয়ে যাবে। মানে যা যা জানতে চাইবে তুমি। তোমার মনে যা যা আছে।

একটা একটা করে প্রশ্ন করব?

সিওর।

প্রথমে তাহলে ওই প্রশ্নটার উত্তর দিন।

আমি তোমাকে প্রপোজ করেছিলাম ওটা ফান কী না?

হ্যাঁ।

এই প্রশ্নটার উত্তর দেব সবার শেষে।

কেন?

এমনি।

উত্তরটা কিন্তু আমি জানি।

আমিও জানি।

মিলা অবাক হলো, ওমা, আপনি তো জানবেনই।

জয় শব্দ করে হাসল। তোমার এই অবাক হওয়াটা দেখার জন্য এভাবে বললাম।

ইস আপনি সারাক্ষণ কীভাবে যে এত মজা করেন!

এবার প্রশ্নগুলো করতে থাকো।

মিলা আচমকা বলল, সুমির সঙ্গে আপনার কী হয়েছিল?

প্রেম, প্রেম হয়েছিল।

আমি তো তাই জানতাম। এনিওয়ে, কীভাবে হয়েছিল বলবেন আমাকে?

সুমি তোমাকে বলেনি?

কিছুটা বলেছে।

কিছুটা কেন বলবে? তুমি হচ্ছো সুমির এক নাম্বার বন্ধু। তোমাকে তার সবই বলার কথা। এবং আমাকে সে বলেছে, আমাদের কথা তুমি সব জানো। অর্থাৎ তোমাকে সে সব বলেছে।

কী কী বলেছে শুনবেন?

বল।

আপনাদের পরিচয় হয়েছিল টেলিফোনে।

হ্যাঁ। ওর এক মামাতো ভাইয়ের কাছ থেকে নাম্বারটা আমি পেয়েছিলাম।

কিন্তু মামাতো ভাইটাকে আপনি চেনেন না।

রাইট। সে আমার চেনা পরিচিত কেউ নয়। আসলে সুমিকে ফোন করার ব্যাপারটাও ছিল একটা ফান। আমার যা স্বভাব আর কি? ধানমন্ডিতে একটা ফোন ফ্যাক্সের দোকান করেছে আমার বন্ধু বাবু। বাবুর দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছি, একটা ছেলে এল ফোন করতে। আমাদের বয়সীই হবে। নাম্বারটা সে বলল। বাবুর সামনে একটা সাদা খাতা। খাতায় চট করে নাম্বারটা সে লিখল। লিখে ফোন ডায়াল করল। করে ছেলেটাকে ধরিয়ে দিল। ছেলেটা বলল, কে? সুমি? আমি বাদশা। কোন বাদশা মানে? তোর মামাতো ভাই।

তার মানে সুমি প্রথমে তার মামাতো ভাইকে চিনতেই পারেনি। সুমির অবশ্য এরকম একটা স্বভাব আছে। চট করে অনেক চেনা মানুষকেও চিনতে পারে না সে।

এই স্বভাবটার কথা আমি অবশ্য জানি না। যাহোক, শোন। আমি তারপর ভাবলাম, অকারণেই ভাবলাম, সুমি তো তার মামাতো ভাইকেই চিনতে পারেনি, দেখি তত অন্য কেউ মামাতো ভাই সেজে ফোন করলে সে কী করে? কিন্তু আমার বন্ধু বাবু খুবই কঠিন টাইপের জিনিস। চাইলে খাতায় লিখে রাখা সুমির নাম্বার আমাকে কিছুতেই দেবে না।

কিন্তু একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না, নাম্বারটা সে খাতায় লিখে রাখল কেন?

জয় হাসল। কোনও কারণ নেই। কেউ এই ধরনের দোকানে এসে যদি বলে ভাই আমি একটা ফোন করব, সাধারণত দোকানের লোকরা বলে, নাম্বারটা বলুন ডায়াল করে দিচ্ছি।

ও এই কারণ?

না আর একটা কারণও আছে।

কী?

এইভাবে নাম্বারটা লিখে রাখলে সারাদিনে কতগুলি ফোন করা হলো তার একটা হিসেব থাকে। বিজনেসের হিসাব মেলাতে সুবিধে হয়।

মুখের মজাদার একটা ভঙ্গি করল মিলা। বুঝেছি। কিন্তু ওই খাতা থেকে কোনও নাম্বার চাইলে আপনার বন্ধু আপনাকে দেবে না কেন?

নীতিগতভাবেই তো দেয়া উচিত না। কারণ ওটা বাবুর বিজনেস। তার ওখান থেকে নাম্বার নিয়ে কেউ যদি কাউকে ডিস্টার্ব করে!

তা ঠিক।

কিন্তু সুমির নাম্বারটা আমি পেয়ে গেলাম বেশ সহজ একটা কায়দায়। ওর মামাতো ভাই যখন ফোন করে প্রথমদিককার দুতিনটে নাম্বার আমি মনে রেখেছিলাম। হঠাৎ করে বাবুকে বললাম, দেখি তোর খাতাটা, আজ কতগুলো ফোন হলো? বিজেনেস কেমন হলো? বাবু খুবই উৎসাহ নিয়ে খাতাটা আমাকে দিল। সুমির নাম্বারটা আমি মুখস্ত করে ফেললাম। বাবু কিছু বুঝতেই পারল না। সেদিনই বিকেলবেলা সুমিকে ফোন করলাম। ভাগ্য কী রকম ভাল দেখ, সুমিই ফোন ধরল। বললাম, হ্যালো, সুমি আছে? সুমি বলল, বলছি। আপনি কে? সুমির গলার স্বর এবং কথা বলার ধরন আমার এত ভাল লাগল, আমি কিন্তু আর কোনও চালাকি করলাম না। পরিষ্কার বললাম, কীভাবে ওর নাম্বার পেয়েছি এবং ফোনটা ওর মামাতো ভাই সেজে ফান করার জন্য করেছিলাম, কিন্তু সুমির গলা এবং কথা বলার ধরন এত ভাল লাগল যে তার সঙ্গে ফান করতে ইচ্ছে করছে না। আমার কথা শুনে সুমি একেবারে আকাশ থেকে পড়ল। কী বলছেন আপনি? এইভাবে অচেনা কারও সঙ্গে কেউ ফান করে? আপনি তো অদ্ভুত মানুষ!

জয় একটু থামল। এইভাবে শুরু হয়েছিল আমাদের।

মিলা কিছু বলতে যাবে তার আগেই দরজায় কে নক করল। উঠে দরজা খুলল জয়। শপিংব্যাগে বার্গার এবং ভার্জিনকোলা দিয়ে গেল অল্প বয়েসি একটা ছেলে। সে এই বাড়ির কাজের একজন লেবার।

খাবারের প্যাকেট মিলার সামনে ছোট্ট টিপয়ের ওপর নামিয়ে রাখল জয়। বলল, চল আগে খেয়ে নিই। আমার খুব খিদে পেয়েছে।

মিলা সঙ্গে সঙ্গে একটা বার্গার এবং ভার্জিনকোলা বের করে জয়ের হাতে দিল। আপনি খান।

আমি একা খাব কেন? তুমিও খাও।

খাচ্ছি।

বলে মিলাও তার প্যাকেট খুলল।

খেতে খেতে জয় বলল, তারপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই আমাদের কথা হয়। কখনও আমি ফোন করি, কখনও সুমি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা হয়। কারণ আমাদের দুজনার কারও তেমন কোনও কাজ নেই। আমি মাস্টার্স করে বসে আছি। চাকরি বাকরি করতে চাইলাম। বাবা বললেন দরকার নেই। আগে বাড়িটা তৈরি কর তারপর বিজনেসে লাগিয়ে দেব। সুমি বিএ পাস করেছে, মাস্টার্সে ভর্তি হবে। দুজনের হাতেই অনেক সময়। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার কী জানো, কথা বলতে বলতে নিজেদের অজান্তে কখন যে আমরা পরস্পরকে তুমি করে বলতে শুরু করেছি, পরস্পরকে ভালবেসে ফেলেছি, পরস্পরের প্রতিটি খুটিনাটি বিষয় শেয়ার করতে শুরু করেছি, টেরই পাইনি।

তখনও আপনারা কেউ কাউকে দেখেননি।

হ্যাঁ।

এটাই সবচে আশ্চর্যের ঘটনা।

সত্যি। খুবই আশ্চর্যের ঘটনা।

বার্গার শেষ করে ভার্জিনকোলা খুলল জয়। চুমুক দিল। কিন্তু ততদিনে ভালবাসার কথা সবই আমাদের হয়ে গেছে। এক পর্যায়ে যখন দুজন দুজনকে দেখার জন্য অস্থির তখন সুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে এল তোমাকে নিয়ে।

ওই তো গুলশানের সেই রেস্টুরেন্টে। কিন্তু সুমিকে দেখে আপনার ভাল লাগল না।

চোখ তুলে মিলার দিকে তাকাল জয়। কে বলেছে তোমাকে?

আমি জানি। আমার মনে হয়েছিল সুমির চে’ আপনি আমাকে বেশি লাইক করেছেন। এজন্য সুমির সামনেই আমার ফোন নাম্বার চাইলেন। তারপর ফোন করে আমাকে প্রপোজ করলেন।

প্রপোজ করলাম মানে কী? তোমাকে বললাম, তোমাকে আমার খুব ভাল লেগেছে। তুমি সুমির চে’ বেশি সুন্দর এবং স্মার্ট। তুমি চাইলে সুমিকে বাদ দিয়ে আমি তোমার সঙ্গে প্রেম করব।

এটা প্রপোজ করা না?

এক অর্থে তো অবশ্যই।

কিন্তু আপনার কি মনে হয়নি কথাটা আমি সুমিকে বলে দেব?

না মনে হয়নি।

কেন?

আমার দিকে তোমার তাকানো ইত্যাদি দেখে আমার মনে হয়েছিল আমাকেও বোধহয় তোমার ভাল লেগেছে।

তা কিন্তু ঠিক। আপনাকে আমার ভাল লেগেছে।

এজন্যই মনে হয়েছে সুমিকে তুমি বলবে না।

আমি কিন্তু সুমিকে বলে দিয়েছিলাম।

আমি জানি। যেদিন তুমি বলেছ সেদিনই সুমি আমাকে সব জানিয়েছে। এবং আমার সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করেছে। আমাকে আর ফোন করে না, আমি ফোন করলে রিসিভ করে না। কখনও যদি ফোন ধরে, আমার গলা শোনার সঙ্গে সঙ্গে রেখে দেয়।

এটাই তো উচিত। সুমির জায়গায় আপনি হলেও তো তাই করতেন।

হয়তো করতাম। কিন্তু আজ তোমাকে আমি আসল কথাটা বলি, তোমাকে ফোন করে প্রপোজ ইত্যাদি করা বা তোমার সঙ্গে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলা, পুরোটাই কিন্তু ফান ছিল।

মিলা একেবারে থতমত খেয়ে গেল। ফান ছিল মানে?

আমি এক ধরনের মজা করার জন্য ওভাবে বলেছিলাম তোমাকে। দেখতে চেয়েছিলাম ব্যাপারটা কী দাঁড়ায়। তুমি সত্যি সত্যি আমার প্রতি দুর্বল হও কী না। নিজেকে দিয়ে দেখতে চাইলাম, মানুষের মত বদলায় কী না। ভালবাসার ক্ষেত্র বদলায় কি না।

কী দেখলেন?

বদলায়।

হ্যাঁ। আমিও তাই মনে করি।

বদলায় বলেই সুমি যখন আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করল আমি তোমাকে ফোন করতে শুরু করলাম। তোমার সঙ্গে আলাদা করে দেখা টেখাও হলো।

আর আমার কী হলো জানেন? সুমির ওপর খুব রাগ হলো যখন সে আমাকে ব্লেম দিল।

কী ব্লেম?

বলল নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রশ্রয় দিয়েছি। নয়তো আপনি নাকি প্রপোজ করার সাহস পেতেন না। শুনে এত মেজাজ খারাপ হলো আমার। ডিসাইড করলাম সুমির সঙ্গে আর কোনও সম্পর্ক রাখব না এবং আপনার সঙ্গে সম্পর্ক করব।

এবং তাই করতে লাগলে?

হ্যাঁ।

কোন ফাঁকে দুজনেরই খাওয়া শেষ। বাগারের খালি প্যাকেট এবং ভার্জিনকোলার শূন্য টিন ঘরের কোণে একটা বাক্সেটে ফেলে দিল জয়। দেখে মিলা বলল, আপনি খুব গুছালো ধরনের।

কিন্তু জীবনের আসল জায়গাটাই অগোছালো করে ফেলেছি।

কীভাবে?

ছেলেমানুষি করে।

আপনার কথা আমি বুঝতে পারিনি।

এই যে সুমিকে নিয়ে, তোমাকে নিয়ে যা করলাম।

হ্যাঁ এটা আসলে ছেলেমানুষিই।

তুমিও তো আমার সঙ্গে তাল দিয়ে গেলে! তোমার তো উচিত ছিল আমাদের দুজনার সমস্যাটা মিটিয়ে দেয়া।

কীভাবে?

প্রেমিক প্রেমিকার ভুল বোঝাবুঝি হলে মাঝখানে যে বন্ধু থাকে সে তা মিটিয়ে দেয় না?

কিন্তু সমস্যা তো সেই বন্ধুটাকে নিয়েই!

তা ঠিক। জয়ের চোখের দিকে তাকাল মিলা। আপনাকে একটা প্রশ্ন করব?

সিওর।

আজ কিন্তু কোনও ফান করবেন না। পরিষ্কার জবাব দেবেন।

ঠিক আছে।

আপনি কি সত্যি সুমিকে ভালবাসতেন?

জয়ও মিলার চোখের দিকে তাকাল। বাসতাম না, এখনও বাসি।

কিন্তু আপনি যে বলেছেন আমি সুমির চে’ বেশি সুন্দর, বেশি স্মার্ট?

সেটাও সত্যি। সত্যি তুমি সুমির চে’ অনেক বেশি সুন্দর এবং স্মার্ট। কিন্তু সৌন্দর্য এবং স্মার্টনেসের সঙ্গে প্রেমের কোনও সম্পর্ক নেই। পৃথিবীতে অনেক সুন্দরী এবং স্মার্ট মেয়ে আছে কিন্তু তারা আমার প্রেমিকা নয়। তাদেরকে আমি ভালবাসি না। আমি ভালবাসি সুমিকে।

মিলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কথাটা আরও আগে বললে পারতেন।

কী হতো তাহলে?

এই জটিলতাগুলো তৈরি হতো না।

সুমিকে আমি বলতে চেয়েছি। নানারকমভাবে চেষ্টা করেছি কিন্তু সে আমার সঙ্গে কথাই বলে না। আমার ফোন রিসিভই করে না।

মিলা আবার জয়ের চোখের দিকে তাকাল। বুঝলাম। আর আমার ব্যাপারটা?

জয় হাসল। তোমার আবার কোন ব্যাপার?

এই যে যখন তখন আমাকে ফোন করা, আজ নিয়ে চারবার দেখা হলো। এত রোমান্টিক কথাবার্তা বললেন। এরকম নিভৃত ঘরে বসে আছি আমরা। দুজন।

আসলে তোমাকে আমি আমার বন্ধু ভেবেছি। সুমির এত ভাল বন্ধু তুমি, ভেবেছি আমারও বন্ধু হবে তুমি।

আমিও তাই হতে চেয়েছিলাম। কিন্ত…।

কী?

কোথায় যেন অন্যরকম কী একটা হতে চলেছে।

ওসব কিছু না। মন থেকে সব ঝেড়ে ফেল। ভাব আমরা দুজন বন্ধু, স্রেফ বন্ধু। ভাল বন্ধু।

আমার মনে হয় সেটা ভাবাই ভাল।

তারপর মিলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

জয় বলল, কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছি না সুমিকে আমি কেমন করে ফিরে পাব?

মিলা উঠল। চেষ্টা করুন। নিশ্চয় পেয়ে যাবেন।

মিলাকে উঠতে দেখে জয়ও উঠল। তোমাকে কি একটা স্কুটার ডেকে দেব?

ভাল হয়।

যে ছেলেটা খাবার এনেছিল তাকেই স্কুটার ডাকতে পাঠালো জয়।

স্কুটার আসার পর, স্কুটারে চড়ার আগে মিলা বলল, আপনি সত্যি খুব ভাল।

জয় হাসল। কেন এটা বলছ?

টেলিফোনে কত রকমের কথা আপনার সঙ্গে হয়েছে। প্রেম, ভালবাসা, চুমু, কত রকমের কথা বলেছেন। অথচ আজ এতটা নিভৃতে পেয়ে আপনি আমার হাতটাও ধরেননি। কোনও না কোনওভাবে আমার ওপর কোনও চান্স নেননি। ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করেননি।

তা আমি কেন করব, বলো। আমার সব স্পর্শ আমি সুমির জন্য তুলে রেখেছি।

৫. বিকেলবেলা দোতলার বারান্দায় বসে

বিকেলবেলা দোতলার বারান্দায় বসে আছে সুমি।

এই বারান্দায় তিন চারটা বেতের চেয়ার আর নীচু ধরনের বেতের গ্লাসটপ টেবিল আছে। বিকেলবেলা কখনও কখনও এখানে বসে চা খায় সবাই।

আজ কেউ নেই। আজ সুমি একা।

আজকাল একা থাকলেই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে সুমি। কী যে ভাবে তা সে নিজেই জানে। পাশ দিয়ে কেউ হেঁটে গেলে কিংবা কেউ এসে দাঁড়ালে সহজে দেখতেই পায় না।

এখনও পেল না।

কয়েক মুহূর্ত সুমির পেছনে দাঁড়িয়ে থেকে মৃদুশব্দে গলা খাঁকাড়ি দিল মিলা।

এই শব্দে সুমি যে খুব একটা চমকালো তা নয়, তবে পেছনে মুখ ফেরাল সে। কিন্তু মিলাকে দেখে মুখের তেমন ভাবান্তর হলো না। নির্বিকার গলায় বলল, কখন এলি?

এই মাত্র।

আয়, বোস।

সুমির মুখোমুখি চেয়ারে বসল মিলা। তীক্ষ্ণচোখে সুমির মুখের দিকে তাকাল। কী হয়েছে তোর?

কই?

চেহারা কী রকম ভেঙে গেছে। চোখ ঢুকে গেছে গর্তে। চোখের কোলে গাঢ় হয়ে কালি পড়েছে। মনে হচ্ছে চোখে কাজল দিয়েছিস তুই।

রাতেরবেলা একদম ঘুম হয় না আমার।

কেন?

প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল সুমি। চা খাবি?

না। চা খেয়ে বেরিয়েছি।

অনেকদিন পর এলি। অনেকদিন পর তোর সঙ্গে দেখা হলো।

মিলা মাথা নীচু করে বলল, হ্যাঁ।

তুই ভাল আছিস তো?

আছি।

সুমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, অন্যান্য খবর কী?

এই তো চলছে।

তোদের বাড়ির সবাই ভাল?

হ্যাঁ।

তারপর দুজনেই চুপচাপ হয়ে গেল। যেন কথা ফুরিয়ে গেছে তাদের। যেন কথা খুঁজে পাচ্ছে না কেউ।

এই রকম অস্বস্তিকর পরিবেশে বেশ খানিকটা সময় কাটল। তারপর মিলা এক সময় বলল, আমি তোর সঙ্গে কিছু কথা বলতে এসেছি, সুমি।

মিলার দিকে তাকাল না সুমি। বলল, কী কথা?

তোর আর আমার ব্যাপারে।

বল।

মাঝখানে অবশ্য আরেকজন লোক আছে।

এই ব্যাপারটায় আমি কোনও কথা বলতে চাই না।

তুই বলতে না চাইলেও আমাকে যে বলতেই হবে।

কেন?

কারণ তোদের দুজনার মাঝখানে আমি কাঁটার মতো ফুটে আছি।

এবার মুখ ঘুরিয়ে মিলার দিকে তাকাল সুমি। এতদিন পর আজ একথা তোর কেন মনে হলো?

এতদিন পর মানে?

ব্যাপারটা তো আড়াই তিনমাসের পুরনো।

তা হোক। আড়াই তিনমাস এমন কিছু সময় নয়।

এতদিন এসব বলতে তুই আসিসনি কেন?

তোর ওপর আমার খুব রাগ হয়েছিল।

উল্টো বলছিস।

কেমন?

রাগ তো তোর ওপর আমার হওয়ার কথা।

তা তো তুই হয়েইছিলি এবং খুবই অপমানকর কথাবার্তা বলেছিলি আমাকে। সেজন্য আমারও রাগ হয়েছে। আসলে তুই আমাকে অযথা ভুল বুঝেছিলি। আমার তো কোনও দোষ ছিল না। আমি তোর সঙ্গে তোর লাভারের ওখানে গেছি, তারপর সে যদি আমাকে প্রপোজ করে তাতে আমার কী করার থাকে বল তো?

তখন হয়তো ছিল না। কিন্তু তারপর তুই তাকে প্রশ্রয় দিয়েছিস।

ওটা আমি তোর ওপর রাগ করে করেছি।

প্রকৃত বন্ধু বন্ধুর ওপর রাগ করে কি বন্ধুর প্রেমিক কিংবা প্রেমিকাকে ভাগিয়ে নিতে পারে?

না তা পারে না। সেটা উচিত নয়।

তাহলে?

কিন্তু একটা কথা তুই ঠাণ্ডামাথায় ভাব তো, আমার মধ্যে যদি সত্যি কোনও শয়তানি থাকতো, যদি সত্যি জয়কে আমি চাইতাম তাহলে কি সে আমাকে প্রপোজ করার পর সেকথা তোকে আমি বলতাম?

সুমি কথা বলল না।

মিলা বলল, আমি তোকে বলেছিলাম তুই আমার প্রিয়বন্ধু বলেই। বলার উদ্দেশ্যটা ছিল জয়ের ব্যাপারে তোকে সাবধান করে দেয়া। অর্থাৎ বলতে চেয়েছি এই ধরনের পুরুষকে শক্ত হাতে ধরে রাখতে হয়। কিন্তু তুই উল্টো আমার ওপর রেগে গেলি।

আর এই রাগের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তুই তার সঙ্গে ঢলাঢলি করতে শুরু করলি?

মিলা মুখ কালো করে বলল, ছিঃ সুমি! তোর মুখে এই ধরনের শব্দ মানায় না।

সুমি একটু লজ্জা পেল। কথা বলল না।

মিলা বলল, তারপরও আমি কিছু মনে করলাম না। কারণ আমি আজ এসেছি ভুল বোঝাবুঝিটা মিটিয়ে ফেলতে।

সুমি মন খারাপ করা গলায় বলল, এখন আর মিটিয়ে ফেলবার কিছু নেই। সব শেষ হয়ে গেছে।

না কিছুই শেষ হয়নি। সব ঠিক আছে। তোর জয় তোরই আছে।

চোখ তুলে মিলার দিকে তাকাল সুমি। এই কথাটি তুই আর কক্ষনো আমার সামনে উচ্চারণ করবি না।

মিলা হাসল। কিন্তু করতে আমাকে হবেই।

কেন?

তোদের দুজনার ভালোর জন্য।

ওকে নিয়ে ভালমন্দ কোনও কিছুরই দরকার নেই আমার। তুই তো একটা মেয়ে, তুই কি আসলে বুঝতে পেরেছিস কতো বড় অপমান সে আমাকে করেছে? যে বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে আমি আমার ভালবাসার মানুষের সঙ্গে দেখা করতে গেছি, মানুষটি আমাকে পাত্তা না দিয়ে, আমার কথা না ভেবে আমার। বন্ধুকে প্রস্তাব দিল! একবারও আমার কথা ভাবল না, একবারও বুঝল না ব্যাপারটা আমার জন্য কত অপমানকর! আমি যদি বিশ্বসুন্দরী সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াই, আমি যত কুৎসিতই হই, আমার প্রেমিক কি আমাকে রেখে ওই বিশ্ব সুন্দরী নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে? এটা হয় নাকি?

না এটা আসলে অন্যায়। ঘোরতর অন্যায়।

তাহলে?

কিন্তু ব্যাপারটা তো ছিল ফান।

সুমি যেন বেশ বড় রকমের একটা ধাক্কা খেল। কী?

হ্যাঁ। জয় আমাকে বলেছে, ওটা ছিল ঠাট্টা। মজা করার জন্য সে এমন করেছে। এটা তার স্বভাব।

এসব হাস্যকর কথা বলে কোনও লাভ নেই। এই ধরনের ফান কখনও কেউ করে না।

তুই বিশ্বাস কর, সত্যি এটা ফান।

মিলার চোখের দিকে তাকিয়ে সুমি বলল, বুঝলাম জয়ের দিক থেকে এটা ফান ছিল। আর তোর দিক থেকে?

মিলা চুপ করে রইল।

চুপ করে আছিস কেন? কথা বল।

আমি আজ তোর সঙ্গে মিথ্যে বলব না। তোর ওপর রাগ করে আমি জয়কে প্রায়ই ফোন করেছি, জয়ের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলেছি, চারবার। আমাদের দেখা হয়েছে, আমি বেশ দুর্বল হয়ে যাচ্ছিলাম ওর ওপর, জয়ও বোধহয় আমাকে একটু প্রশ্রয় দিচ্ছিল। সবকিছু পরিষ্কার বোঝার জন্য কয়েকদিন আগে আমি ওদের উত্তরার বাড়িতে গিয়েছিলাম…।

মিলার কথা শেষ হওয়ার আগেই সুমি বলল, ব্যাস, আমি আর শুনতে চাই না।

কিন্তু শুনতে তোকে আজ হবেই।

সুমি অন্যদিকে তাকিয়ে রইল।

মিলা বলল, ওই যাওয়াটায় যে কী উপকার হয়েছে আমার, আমি ছাড়া কেউ তা বুঝতে পারবে না। পুরো ভুল বোঝাবুঝিটা শেষ হয়েছে। জয়ের ব্যাপারে আমার মধ্যে তৈরি হওয়া দুর্বলতাটুকু কেটে গেছে এবং আমি তোর কাছে ফিরে আসার সাহস পেয়েছি।

সুমি কথা বলল না।

হাত বাড়িয়ে সুমির একটা হাত ধরল মিলা। সুমি, জয় তোকে খুব ভালবাসে। খুব। তুই হয়তো জানিসই না কী রকম ভাল সে তোকে বাসে। জীবনের সবকিছু সে তোর জন্য রেখে দিয়েছে।

কিন্তু আমি খুব চেষ্টা করছি আমার মন থেকে ওকে মুছে ফেলতে।

এই চেষ্টা করাটা তোর ভুল হবে।

কেন?

মনের দিক দিয়ে জয় খুবই অসাধারণ মানুষ। ওদের বয়সী ছেলেদের মতো মেয়েদের ব্যাপারে ওর কোনও লোভ নেই। বিন্দুমাত্র লোভ নেই।

কেন তুই আমাকে এসব বলার চেষ্টা করছিস?

আমি চাই তুই আবার আগের মতো হয়ে যা। তুই আবার জয়ের কাছে ফের। আমার কাছে ফের।

না, ব্যাপরগুলো এমন দাগ ফেলে দিয়েছে আমার মনে, চাইলেও মন থেকে আমি তা মুছতে পারব না। তারচে’ এই ভাল। আস্তেধীরে সব শেষ হয়ে যাওয়া ভাল।

তাতে দুজন মানুষেরই কষ্ট। যেমন তোর, তেমন জয়ের। আর মাঝখান থেকে সারাজীবন ব্যাপারটা নিয়ে আমি সাফার করব।

কথা বলতে বলতে শেষদিকে গলা ধরে এল মিলার।

সুমি তখন আবার আকাশের দিকে তাকিয়েছে। আবার নির্বিকার হয়ে গেছে।

এই ফাঁকে নিজেকে একটু যেন গুছালো মিলা। তারপর সুমির দিকে তাকাল। তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

মিলার দিকে তাকাল না সুমি। বলল, বল।

তুই আমাকে কতটা বুঝিস?

কথাটা শুনে সামান্য চমকাল সুমি। চট করে মিলার দিকে তাকাল। কতটা বুঝি মানে?

মানে আমি জানতে চাইছি তুই তো আমার ছোটবেলার বন্ধু। ক্লাশ ওয়ান থেকে এস এস সি পর্যন্ত ভিকারুন নিসায় পড়েছি আমরা। তারপর কলেজ ইউনিভার্সিটি বদলে গেছে আমাদের। কিন্তু দেখা সাক্ষাৎ, যোগাযোগ, বন্ধুত্ব সবই সেই ছেলেবেলার মতোই রয়ে গেছে। দিন সাতেক দেখা না হলে আমরা দুজন দুজনার জন্য পাগল হয়ে যাই।

যাই না, বল যেতাম। এখন আর সেই অবস্থাটা নেই। প্রায় তিনমাস হতে চলল।

হ্যাঁ এতবড় গ্যাপ আমাদের বন্ধুত্বের জীবনে নেই। দেখা সাক্ষাত কোনও সপ্তাহে না হলেও দু একদিন পর পর ফোনে কথা হতো আমাদের। প্রতিদিন কী

কী ঘটছে সব খুঁটিনাটি দুজন দুজনকে বলতাম আমরা।

মিলা একটু থামল। এতকিছুর পর আজ আমি জানতে চাইছি, তুই বল আমাকে তুই কতটা বুঝিস? কেমন মেয়ে আমি?

বাদ দে, এসব বলতে আমার ভাল লাগছে না।

কিন্তু আজ আমি এসব কথা বলার জন্যই এসেছি।

তাহলে তার আগে তুই আমাকে বল, আমি কেমন মেয়ে? আমাকে কতটা বুঝিস তুই?

তোকে কিন্তু আমি মোটামুটি বুঝি।

তাহলে বল।

তুই খুব আত্মমগ্ন ধরনের মেয়ে। একবার মনের মধ্যে কোনও কিছু গেঁথে গেলে, কোনও দাগ পড়ে গেলে কিছুতেই তুই তা মুছতে পারিস না। দিনরাত ওই নিয়ে ভাবিস। ভাবতে ভাবতে অসুস্থও হয়ে যেতে পারিস তুই।

হ্যাঁ। তাই, ঠিক তাই।

আর কখনও কোনও ডিসিসান নিয়ে ফেললে তুই সহজে তা বদলাতে পারিস না।

সুমি কথা বলল না।

সবার সঙ্গে মিশতেও পারিস না তুই। যাকে ভাল না লাগে সে যেই হোক তুই তার সঙ্গে কথা বলতে চাস না। ঠাট্টা মশকরা তুই তেমন পছন্দ করিস না। ঠাট্টা জিনিসটা তেমন বুঝিসও না। কেউ করলে বিরক্ত হয়ে যাস।

আর তুই হচ্ছিস এসবের উল্টো। কেউ ঠাট্টা করলে তুইও করিস। খুব সহজে মানুষের সঙ্গে মিশে যাস। তোর পেটে কোনও কথা থাকে না। গড়গড় করে সবাইকে সব বলে দিস। তোর আচরণে যে কেউ তোকে একটু সহজলভ্য মেয়ে ভাবতে পারে।

তোর সবগুলো কথা ঠিক নয়। কোনও কোনওটা ঠিক। হ্যাঁ আমি ঠাট্টাপ্রিয় মেয়ে। ঠাট্টা মশকরা, ইয়ার্কি ফাজলামো আমি একটু পছন্দ করি। সহজে মানুষের সঙ্গে মিশি, কথা বলি কিন্তু আমাকে কেউ সহজলভ্য মেয়ে ভাবতে পারে এই ধারণা আমার ছিল না।

আমারও ছিল না।

তাহলে বললি কেন?

জয় তোকে প্রপোজ করেছে দেখে আমার মনে হয়েছে।

কিন্তু ওতে আমার কী দোষ?

তোকে সহজলভ্য ভেবেছে বলেই প্রপোজ করার সাহস পেয়েছে।

মিলা চিন্তিত চোখে সুমির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কিন্তু সুমি আর কিছু বলল না।

খানিক চুপ করে থেকে মিলা বলল, আর তোর ধারণা আমার পেটে কোনও কথা থাকে না?

হ্যাঁ। তোর এই ধারণাটাও ঠিক না।

আমি মনে করি আমার ধারণাটা ঠিক। মানে তোকে আমি আমার সবকথা বলেছি বলে এটা তোর মনে হচ্ছে?

সুমি আবার মিলার চোখের দিকে তাকাল। সব কথা তো তুই আমাকে বলিসনি। মানে জয়ের সঙ্গে গত তিনমাসে তোর কী কী হয়েছে…।

তারপরই মুখে বিরক্তির চিহ্ন ফুটে উঠল সুমির। অবশ্য আমি ওসব জানতে চাইও না।

ঠিক আছে তা না চাইলি, কিন্তু এসবের আগের জীবনে, অর্থাৎ তোর ধারণা ক্লাস ওয়ান থেকে তিনমাস আগ পর্যন্ত আমার সবকথা আমি তোকে বলেছি? তুই সব জানিস?

আমার মনে হয় বলেছিস।

না বলিনি।

কী বলিসনি?

আমার মেয়ে জীবনের সবচে’ মর্মান্তিক ঘটনাটার কথাই তোকে আমি বলিনি।

সুমি চোখ তুলে মিলার দিকে তাকাল। মর্মান্তিক ঘটনা মানে?

মিলা মাথা নীচু করল। আমি রেপড হয়েছিলাম।

কথাটা যেন বুঝতে পারল না সুমি। থতমত খেল। কী?

হ্যাঁ।

কী বলছিস তুই?

আমি সত্য কথা বলছি।

শুনে হঠাৎ করে এতটা উত্তেজিত হলো সুমি, হাত পা কাঁপতে লাগল তার। বুক কাঁপতে লাগলো। দম যেন বন্ধ হয়ে এল। কোনও রকমে সে শুধু বলল, কবে? কীভাবে?

আমাকে নিয়ে তুই যখন জয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাস ঠিক তার কয়েকদিন আগে।

বলিস কী?

হ্যাঁ।

কিন্তু তখন তো তোর সঙ্গে আমার কোনও মনোমালিন্য নেই, তুই আমাকে বলিসনি কেন?

আমি এতটাই শকড ছিলাম, নিজের কাছেই ব্যাপারটা আমার অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে। কয়েকদিন পর্যন্ত আমি নিজেই বিশ্বাস করিনি সত্যি সত্যি ঘটনাটা ঘটেছে। আমার জীবনেই ঘটেছে। তোর তখন দিনের তিনচার ঘণ্টা কাটে জয়ের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে। আমার সঙ্গে কথা বলায় একটু গ্যাপ যাচ্ছিল।

সুমি ফ্যাল ফ্যাল করে মিলার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

মিলা বলল,গ্যাপ না হলেও বোধহয় তোকে আমি একথা বলতাম না। পৃথিবীর কাউকে বলতাম না।

তার মানে এটা কেউ জানে না?

যে করেছে সে জানে।

সে তো জানবেই।

এছাড়া আর কেউ জানে না।

আজ তাহলে আমাকে বললি কেন?

না বললে আমাকে তুই বুঝতে পারবি না।

আমি যে বললাম তোর পেটে কোনও কথা থাকে না, কথা যে থাকে সেটা প্রমাণ করার জন্য বললি?

কিছুটা সেজন্য কিন্তু বেশির ভাগটাই অন্য কারণে।

কী কারণ?

জয়কে কেন আমি অতটা প্রশ্রয় দিয়েছিলাম এই ব্যাপারটির সঙ্গে কিছুটা হলেও তা জড়িত। আসলে ব্যাপারটি তাৎক্ষণিকভাবে আমাকে কিছুটা, কিছুটা নয় অনেকখানি বদলে দিয়েছিল। অন্যরকম করে দিয়েছিল। নিজেকে যেন আমি আর চিনতে পারছিলাম না। আমার মনে হচ্ছিল ব্যাপারটা ভোলার জন্য আমি যা নই তাই হয়ে যাব, নীতিগতভাবে যে সমস্ত কাজ মানুষের করা উচিত নয়, আমি তাই করব। অর্থাৎ উল্টোপাল্টা সবকিছু।

এজন্যই জয়ের প্রপোজাল একসেপ্ট করেছিলি?

মনে হয়।

তাহলে সে কথা আবার আমাকে বললি কেন?

সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু বলিনি।

তাহলে?

বেশ কয়েকদিন পরে বলেছি।

কেন?

মনে হলো সবচে’ প্রিয় বন্ধুটিকে জানাই। এমন একটা জায়গায় আঘাত দিই তার, সে দিনরাত জ্বলুক।

বলিস কী? তুই তো সাইকিক পেসেন্ট হয়ে গিয়েছিলি!

সত্যি আমি তাই হয়ে গিয়েছিলাম। তবে জয় খুব ভালছেলে।

কেমন?

সে যদি তখন কোনও রকমের বাড়াবাড়ি করতো, অর্থাৎ ফিজিক্যালি আমাকে চাইতো আমি বোধহয় রাজি হয়ে যেতাম।

বলিস কী?

সত্যি। কিন্তু জয়ের সবকিছু ওই মুখে মুখে। কাছাকাছি গেলে সে অতি দ্র। হাতটাত ধরা তো দূরের কথা, আমার দিকে ভাল করে তাকিয়েও দেখেনি। শুধু মজার মজার কথা আর কথা। জয়ের কথা শুনতে শুনতেই আসলে নিজের মধ্যে ফিরে আসতে পেরেছি আমি। তোর কাছে আজ ফিরে আসতে পেরেছি।

একথা শুনে সুমি আবার উদাস হলো। জয়কে ঘিরে মনের ভেতর জমে থাকা কিছু কথা মনে পড়তে চাইল। জোর করে তা দমিয়ে রাখল সুমি। মিলার দিকে তাকিয়ে বলল, ঘটনাটা কীভাবে ঘটল আমাকে বল। কে ঘটাল?

মিলা বলল, না বলব না।

কেন?

আমি ভুলে যেতে চাই। আমি সব ভুলে যেতে চাই। ও রকম ঘটনা আমার জীবনে ঘটেছিল, আমি ভুলে যেতে চাই। আমি গত তিন সাড়ে তিনমাস

সময়কেই আমার জীবন থেকে মুছে ফেলতে চাই। তোর সঙ্গে আমার আচরণ, জয়ের সঙ্গে নীতিহীন মেলামেশা, আমি সব ভুলে যেতে চাই। আমি এখন থেকে আবার তোর সেই বন্ধু। আমি আর কেউ না।

বলে হু হু করে কাঁদতে লাগল মিলা।

মিলার কান্না দেখে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল সুমি। তারপর উঠে মিলার পাশে এসে দাঁড়াল। দুহাতে মিলার মাথাটা বুকে চেপে ধরে বলল, কাঁদিস না, কাঁদিস না। মানুষের জীবনে কত কী ঘটে! খারাপ স্মৃতি ভুলে যাওয়াই ভাল। আমিও ভুলে যাব সব। আমি এই খারাপ সময়টার কথা মনে রাখব না।

বিকেলবেলার আকাশ তখন একটু যেন বেশি উজ্জ্বল হয়েছে।

 ৬. সেই একটা রাতই রুনুর রুমে

সেই একটা রাতই রুনুর রুমে কাটিয়ে ছিল সুমি।

তার পরদিন থেকে রাতেরবেলা নূরজাহান থাকে তার রুমে। সুমি তার বিছানায়, নূরজাহান নীচে। মেঝেতে।

আগে বেশ টিভি দেখার শখ ছিল সুমির।

নিজের রুমে টেলিভিশন একটা আছে। চৌদ্দইঞ্চি সনি টেলিভিশন। গত দুআড়াই মাস ধরে সেভাবে টেলিভিশন আর দেখা হয় না তার। দেখতে ভাল লাগে না।

টেলিভিশনের কারণে আগে ঘুমাতে ঘুমাতে বারোটা সাড়ে বারোটা বেজে যেত। আজকাল দশটা সাড়ে দশটার মধ্যেই শুয়ে পড়ে।

সুমির আরেকটা অভ্যেস হচ্ছে, আলোতে সে একদমই ঘুমোতে পারে না। সেই আলো যতই মৃদু হোক, যতই মোলায়েম হোক। এজন্য ডিমলাইট থাকার পরও কখনও ডিমলাইট জ্বালানো হয় না তার। অন্ধকারে নিজের বিছানায় শুয়ে মগ্ন হয়ে যে কোনও কিছু ভাবতেই ভাল লাগে সুমির। কিন্তু ভাবতে সে আজকাল চায় না। এজন্য শুয়ে পড়ার পর যতক্ষণ ঘুম না আসে নূরজাহানের সঙ্গে টুকটাক কথা বলে।

সেদিনের পর থেকে নূরজাহানের সঙ্গে যেন আলাদা একটা ভাব হয়ে গেছে তার।

আজও শুয়ে পড়ার পর অনেকক্ষণ কথা বলেছিল।

মিলার ব্যাপারটা জানার পর থেকে অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে তার। মিলার ওপর থেকে যাবতীয় রাগ অভিমান চলে গেছে। আশ্চর্য এক মায়া হচ্ছে মিলার জন্য। ও রকম ঘটনা কোনও মেয়ের জীবনে ঘটলে সেই মেয়ের সব কিছুই উলট পালট হয়ে যাওয়ার কথা। মিলারও তাই হয়েছিল। তার ওপর পুরো ব্যাপারটাই সে চেপে গিয়েছিল। কারও সঙ্গে শেয়ার করেনি বলে মনের ওপর চাপটা তার বেশি পড়েছিল। এজন্যই সুমি এবং জয়ের সঙ্গে এলোমেলো আচরণগুলো সে করেছে।

সবচে’ আনন্দের কথা মাস তিনেকের মধ্যে নিজেকে সে সামাল দিয়ে ফেলেছে। ভেতরে ভেতরে আশ্চর্য এক শক্তি সঞ্চয় করেছে। জয়ের কাছ থেকে নিজেকে ফিরিয়েছে। প্রিয়তম বন্ধুর কাছে ফিরে এসেছে।

কিন্তু কে এই সর্বনাশটা করল মিলার?

এইসব ব্যাপার কি তাহলে গোপন প্রেমের মতোই এমন এক গোপন ক্ষত, জীবন দিয়ে হলেও মেয়েরা তা চেপে রাখে!

তারপরই একটা কথা ভেবে দম বন্ধ হয়ে এল সুমির।

গল্প উপন্যাস এবং সিনেমা নাটকে যে দেখা যায় এই ধরনের ঘটনা ঘটলেই মেয়েটি প্রগন্যান্ট হয়ে যায়। মিলার সেই ধরনের কোনও সমস্যা হয়নি তো?

সর্বনাশ!

একথা তো মিলাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি!

যদি তেমন কিছু হয়ে থাকে তাহলে তো ভয়াবহ রকমের বিপাকে পড়বে মিলা।

সুমির ইচ্ছে হলো উঠে গিয়ে এখুনি ফোন করে মিলাকে। পরিষ্কার জেনে নেয় ব্যাপারটি।

তারপরই অন্য একটা কথা ভেবে ভেতরে ভেতরে শান্ত হলো সে।

না তেমন ব্যাপার নিশ্চয় হয়নি।

তিনমাস হয়ে গেছে।

তেমন কিছু হলে এর মধ্যেই টের পেয়ে যেত মিলা। সুমিকে বলতো।

এসব ভেবে সুমি কেমন একটা হাঁপ ছাড়ল।

ঠিক তখুনি মেঝেতে শোয়া নূরজাহান বলল, কী হলো?

সুমি অবাক হলো। কী?

ঘুমান নাই?

না।

ক্যান?

ঘুম আসছে না।

নূরজাহান হাসল। তেলাপোকার ডর না বদজীনের?

কোনটারই না।

তাহলে?

এমনি।

তারপর আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ। এই ফাঁকে সুমি ভাবল একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রেপ সম্পর্ক নূরজাহানের কাছ থেকে কিছু জানা যায় কী না দেখা যাক। ব্যাপারটা ঘটে যাওয়ার পর কী কী ধরনের সমস্যা হতে পারে মেয়েদের! শারীরিক এবং মানসিক সমস্যা। হয়তো মানসিক সমস্যার কথা তেমন বলতে পারবে না নূরজাহান, শারীরিকগুলো নিশ্চয় পারবে।

সুমি তারপর মেঝের দিকে কাত হলো। বুয়া?

জী।

তোমার কি ঘুম পাচ্ছে?

না।

কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করি?

জ্বী করেন।

তুমি কি রেপ বোঝ?

জ্বী না।

শব্দটা ইংরেজি। হয়তো এজন্য বুঝতে পারছ না। বাংলায় বললে বুঝবে। শ্লীলতাহানি। সহজ বাংলায় ধর্ষণ।

জ্বী বুঝছি। বদমাইসা ব্যাটাগুলি জোর জবরদস্তি মাইয়া মানুষের ইজ্জত নষ্ট করলে সেইটারে বলে ধর্ষণ।

হ্যাঁ।

হঠাৎ এই কথাটা আপনার মনে আসল ক্যান?

তেমন কোনও কারণ নেই। পেপারে প্রায়ই এসব নিয়ে পড়ি তো, এজন্য তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম।

হ এই হগল কাম দেশ গেরামে বেশি হয়।

শহরেও হয়।

শহরে মনে হয় কম হয়।

না, আমার ধারণা শহরেই বেশি হয়। শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে বেশি হয়। কিন্তু সেসব কথা তেমন বাইরে আসে না। কেউ জানতে পারে না।

হইতে পারে। দেশ গেরামের ঘটনাগুলি মাইনষে জাইনা যায়। শহরেরগুলি মাইনষে জানে না। কেউ পোয়াতি হইয়া গেলেও অন্যে টের পায় না।

হ্যাঁ। কারণ শহরে এগুলো তেমন কোনও সমস্যা নয়।

কিন্তু দেশ গেরামের মাইয়াগুলির বড় সমস্যা হয়। এইসব কারণে আত্মহত্যাও করে কোনও কোনও মাইয়া।

এমন ঘটনা জানা আছে তোমার?

থাকব না ক্যান? আমাগ গেরামের রাবি, মানে রাবেয়াই তো আত্মহত্যা করছিল।

সে রেপড হয়েছিল?

জী?

মানে তাকে কেউ ওসব করেছিল?

হ।

বল তো ঘটনাটা।

রাবি আছিল বাড়ির কামের মাইয়া। আমাগ গেরামে সর্দার বাড়ি বহুত বড়বাড়ি। ওই বাড়িতে কাম করতো সে। রাবিগ বাড়ি আছিল পদ্মার চরে। গরিব মানুষের মাইয়া। তেরো চৌদ্দ বছর বয়সে চর থিকা কাজের আশায় আইছিল আমাগ গেরামে। সর্দার বাড়িতে ঝিয়ের কাম লইলো। চুপচাপ ধরনের ভাল মাইয়া। কাম ছাড়া কিছু বোঝে না। ওই বয়েসি মাইয়াগ লাহান শয়তানি বদমাইসি নাই।

দেখতে কেমন ছিল?

ভাল না।

কী?

হ একদমই ভাল না। পাতিলের তলার লাহান গায়ের রং। চেহারাও ভাল না। তয় শইলখান বড় সোন্দর। ওই রকম শইলের মাইয়াগ পুরুষ পোলারা বহুত পছন্দ করে। সর্দার বাড়িতে তাগড়া জুয়ান লোকজন আছিল ম্যালা। সর্দারগ ভাই বেরাদর, পোলাপান সব মিলা ম্যালা পুরুষপোলা। রাবি থাকত রান্ধন ঘরে। এক রাইতে ঘরের ঝাঁপ কেমনে কেমনে খুইলা কে একজন ঢুইকা গেল সেই ঘরে। তারপর রাবির মুখ চাইপা ধইরা, পুরুষপোলাগুলি যা করে আর কি? রাবির সর্বনাশ হইয়া গেল। কিন্তু মাইয়াডা বুঝতেই পারল না কামডা কে করল! ঘুটঘুইটা আন্ধারে রাবি চিনতেই পারল না তারে। যাওনের সময় বেড়া আবার কইয়া গেল এই কথা কেউরে কইলে জান যাইব তোর। রাবি কেউরে কয় নাই। দুই তিনমাস পর তো পেট ফুইলা উঠল রাবির। বাড়ির মহিলারা টের পাইয়া গেল। ধরল রাবিরে। ক কার লগে নষ্টামি করছস? রাবি লজ্জায় মরে। কইতে চায় না, কইতে চায় না। শেষ পর্যন্ত বলল ঘটনাটা, কিন্তু কেউ বিশ্বাস করল না। কইলো, এই ঘটনা তুই বানাইছস। সত্য না। সত্য হইলে ঘটনা ঘইটা যাওনের পর আমাগ কছ নাই ক্যান? রাবি বলল, ডরে কই নাই। কেউ বিশ্বাস করল না। রাবিরে বাড়িত থিকা বাইর কইরা দিতে চাইল। সেই রাইতেই সর্দার বাড়ির বাগানে গিয়া আমগাছের লগে গলায় দড়ি দিল রাবি।

কিন্তু এই ঘটনা তোমরা জানলে কী করে? মানে গেরামের অন্যান্য লোকে জানল কী করে?

এইসব ঘটনা কি আর চাপা থাকে নাকি? কোনও না কোনওভাবে লোকে জাইনা যায়।

কিন্তু এই কাজগুলি পুরুষ মানুষরা করে কেন?

পুরুষ মানুষরা আসলে মানুষ হিসাবে ভাল হয় না। মাইয়া মানুষের লগে জোর দেখাইতে তারা পছন্দ করে।

অথচ মেয়েরা মায়ের জাত। মেয়েদের পেট থেকেই পুরুষরা জন্মায়। এই কথা তারা মনে রাখে না।

হ্যাঁ। রাখলে এসব করা সম্ভব নয়। অথচ নারী পুরুষের সত্যিকার মিলন পৃথিবীর সবচে’ আনন্দের বিষয়। যদি সেই মিলনে প্রেম থাকে, ভালবাসা থাকে।

এইটা ঠিক বলছেন। প্রেম ভালবাসা থাকলে দুইজন দুইজনরে পাওয়ার জন্য পাগল হয়।

তার মানে ভালবাসা থাকলে ব্যাপারটা গভীর আনন্দের আর ভালবাসা না থাকলে ব্যাপারটা চরম ঘৃণার এবং বেদনার।

হ।

জোর করে ব্যাপারটা হলে সাধারণত কী কী অসুবিধা হয় মেয়েদের? তুমি জানো বুয়া?

শরীরের অসুবিধা হয়। বাচ্চা হইয়া যাইতে পারে। আর যেইটা সবচে’ বড় ক্ষতি হয়, এত আনন্দের ব্যাপারটার মধ্যে বিরাট একটা ভয় ঢুইকা যায়। অনেক মাইয়া সারাজীবনেও আর এই ব্যাপারটার স্বাদ বোঝে না।

সুমি মনে মনে বলল, ঠিক।

নূরজাহান বলল, তয় আপনেরে একটা কথা কই। বেশির ভাগ পুরুষ মানুষই কইলাম মাইয়া মানুষের লগে জোর জবরদস্তি করে। মাইয়াগ মন না বুইঝা, শরীল না বুইঝা কামডা করে। প্রেম ভালবাসা ওই টাইমে বোঝতে চায় না। বিয়া কইরা পুরুষপোলাগুলি কী করে? পয়লা রাইতেই বউডার লগে জোর করে। বউডার মনও বোঝে না, শইলও বোঝে না। আপনেরা যে ধর্ষণ ধর্ষণ বলেন, দুনিয়ার বেশির ভাগ পুরুষ মাইয়াগ আসলে ধর্ষণই করে।

সুমি কথা বলল না।

নূরজাহান বলল, তয় প্রেম ভালবাসা থাকলে, দুইজনে দুইজনরে বুইঝা যদি মিলিত হয় সেইটা দুনিয়ার সবচে’ আনন্দের।

একথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে জয়ের কথা মনে পড়ল সুমির। শরীরের খুব ভেতরে কেমন একটা কাঁপন লাগল। সুমি যেন কেমন দিশেহারা হলো। নূরজাহান ঘুমিয়ে পড়ার পরও অনেকক্ষণ জেগে রইল সে।

গভীর রাতে ঘুমের ভেতর সে রাতের পর আজ আবার সেই অনুভূতিটা হলো সুমির। প্রথমে মনে হলো পায়ের পাতায় কে যেন খুব আলতো ভঙ্গিতে সুরসুরি দিচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমটা সুমির ভাঙল। প্রথমে পা দুটো সে টেনে নিল। তারপর অপেক্ষা করতে লাগল ব্যাপারটা আবার ঘটে কি না!

কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আবার সেই অনুভূতি।

অনুভূতিটা এবার ওপর দিকে উঠছে। শরীর কাঁটা দিচ্ছে সুমির। কী রকম হিম হয়ে আসছে।

তবু দম বন্ধ করে পড়ে রইল সুমি।

কিন্তু হাঁটুর ওপর আর উঠল না অনুভূতিটা। আচমকাই থেমে গেল। তারপরও সেই অনুভূতির জন্য অপেক্ষা করতে লাগল সুমি। কারণ ঘুম ভাঙার পর পরই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যাপারটা আসলে কী হচ্ছে তাকে আজ বুঝতে হবে।

দম বন্ধ করে পড়ে রইল সুমি।

কয়েক মুহূর্ত পর টের পেল তার নাভিমূলে সে রাতের সেই অনুভূতি হচ্ছে। কে যেন আলতো করে মুখ ঘষছে। ফলে শরীরের ভেতর অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে তার। একেবারেই অচেনা এক অনুভূতি। অস্থির লাগছে তার, ভীষণ অস্থির লাগছে।

তরপর আচমকাই থেমে গেল অনুভূতিটা।

কিন্তু তারপরও অপেক্ষা করতে লাগল সুমি। শেষ অবস্থাটা বোঝার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই যা আশা করেছে সুমি তাই হলো। তার গলার কাছে, ঘাড়ের কাছে এবং গালে কে যেন খুবই আলতো এবং আদুরে ভঙ্গিতে মুখ ঘষতে লাগল। সঙ্গে সেই পারফিউমের গন্ধটাও পেল সুমি। ওয়ান ম্যান শো।

কয়েক মুহূর্ত মাত্র। তারপরই ধরফর করে বিছানায় উঠে বসল সুমি। বেডসুইচ টিপে লাইট জালল।

কই রুমে কেউ নেই। ওই তো মেঝেতে গভীর ঘুমে ডুবে আছে নূরজাহান।

আজ আর সেই রাতের মতো ভয় পেল না সুমি। নূরজাহানকে ডাকল।

চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসল নূরজাহান। কী হইছে?

ঘটনাটা বলল সুমি। শুনে ঘুম ভাঙা চোখে তার দিকে খানিক তাকিয়ে রইল নূরজাহান। তারপর বলল, আপনেরে কিছু কথা জিজ্ঞাসা করি?

করো।

আপনার সঙ্গে কী কারও মনের সম্পর্ক আছে?

কেন একথা বলছ?

কারণ আছে।

কী কারণ?

থাকলে আমারে বলেন। তাইলে ঘটনাটা বুঝতে আমার সুবিধা হইব।

হ্যাঁ।

নূরজাহান উৎফুল্ল হলো। আছে?

এখন নেই।

তাইলে?

ছিল।

এখন নাই ক্যান?

ওসব শুনে তোমার লাভ কী?

লাভ আছে।

কী লাভ?

আমিও তো মাইয়া মানুষ। আমি আপনের সমস্যাটা বুঝতে পারুম।

ওসব আমি আসলে কাউকে বলতে চাই না। যা শেষ হয়ে গেছে তা বলে আর লাভ কী?

সুমির মুখের দিকে তাকিয়ে নূরজাহান বলল, আপনে কইতাছেন শেষ হইয়া গেছে কিন্তু আমার মনে হয় শেষ হয় নাই।

কেন?

আমার মনে হয় আপনের মনের মইধ্যে, অন্তরের মইধ্যে এখনও রইয়া গেছে সে।

সুমি কথা বলল না।

নূরজাহান বলল, আপনি এখনও তার কথা ভাবেন?

না একদম ভাবি না।

নূরজাহান হাসল। ভাবেন কিন্তু আপনি বুঝতে পারেন না। আপনার মনে হয় আপনি তার কথা ভাবতাছেন না। তার কথা আপনে ভুইলা গেছেন। আসলে ভোলেন নাই।

সুমি চুপ করে রইল।

নূরজাহান বলল, যখন ভাব ছিল তখন তার লগে আপনের কী কী হইছে?

কী কী হয়েছে মানে?

টান ভালবাসা থাকলে দুইজন মানুষে যা যা হয় আমি তা বলতাছি।

ধুৎ ওসব কিছুই আমাদের হয়নি।

সে আপনের হাত ধরছে? জড়াইয়া ধরছে কোনওদিন। চুমা দিছে?

না। এসবের কিছুই হয়নি তার সঙ্গে আমার। শুধু কথা হয়েছে।

খালি কথা? দেখা সাক্ষাৎ হয় নাই?

একদিন মাত্র হয়েছিল। তারপরই…।

তারপর কী হইছে?

বাদ দাও ওসব কথা। বলতে ভাল লাগছে না।

সুমি অন্যদিকে মুখ ফেরাল।

নূরজাহান তখন চিন্তিত চোখে সুমির দিকে তাকিয়ে আছে।

খানিক তাকিয়ে থেকে বলল, যখন কথা হইত তখন কী ধরনের কথা হইত?

একথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সুমি কী রকম কেঁপে উঠল। কী যেন কী কথা মনে পড়ল তার। মুখটা উজ্জ্বল হয়ে গেল। নূরজাহানকে সে বলল, ঠিক আছে। তুমি শুয়ে পড়। আমি লাইট অফ করে দিচ্ছি। যা বোঝার আমি বুঝে গেছি।

সুমি লাইট অফ করে শুয়ে পড়ল।

কিন্তু সুমির আচরণের মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারল না নূরজাহান। সুমি শুয়ে পড়ার পরও অন্ধকার বিছানায় অনেকক্ষণ বসে রইল সে।

৭. অপলক চোখে সুমির দিকে তাকিয়ে

অপলক চোখে সুমির দিকে তাকিয়ে রইল জয়।

একি সত্যি সুমি?

নাকি সে স্বপ্ন দেখছে?

সুমিও তাকিয়ে ছিল জয়ের দিকে। জয়ের চোখে পলক পড়ছে না দেখে মিষ্টি হেসে, স্নিগ্ধ গলায় বলল, কী দেখছ?

সঙ্গে সঙ্গে চোখে পলক পড়ল জয়ের। মুগ্ধ গলায় সে বলল, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।

কী বিশ্বাস হচ্ছে না?

এই তুমি কি সত্যি সেই তুমি?

হ্যাঁ এই আমিই সেই আমি।

মনে হচ্ছে আমি স্বপ্ন দেখছি।

জয়ের দিকে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে সুমি বলল, ছুঁয়ে দেখ।

সঙ্গে সঙ্গে সুমির হাতটা ধরল জয়। বুক কাঁপিয়ে একটা শ্বাস পড়ল তার।

সুমি বলল, দীর্ঘশ্বাস ফেলছ কেন?

দীর্ঘশ্বাস না। হাঁপ ছাড়লাম।

কেন?

মনে হলো বহুদিন ধরে হাজার মন ওজনের এক পাথর আমার বুকে চেপেছিল। এই মাত্র সেই পাথর নেমে গেল। বুকটা হালকা হলো আমার। আমি। যেন বেঁচে উঠলাম।

কিন্তু আমাকে কি তুমি বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখবে?

জয়দের উত্তরার বাড়িতে জয়ের রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল ওরা। খানিক আগে এই বাড়ির গেটে এসে স্কুটার থেকে নেমেছে সুমি। স্কুটার ভাড়া মিটিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকেছে। লেবার ধরনের একজন লোক লম্বা একটা কাঠ কাঁধে। করে সিঁড়ির দিকে যাচ্ছিল, সুমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিল জয় আছে কি না। তারপর জয়ের বন্ধরুমে এসে নক করেছে।

এখন বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবার কথা বলায় জয় কেমন লজ্জা পেল। তখনও সুমির হাতটা সে ধরে রেখেছে। সেই হাত ধরেই ভেতরে নিয়ে এল তাকে।

রুমে ঢুকে সুমি বলল, খুব সুন্দর রুম।

জয় কী বলবে কিছু বুঝতে পারছ না। তখনও সুমির হাতটা ধরা।

জয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে সুমি বলল, একটা কথা কি তুমি জানো?

কী?

আজই প্রথম তুমি যে আমাকে স্পর্শ করলে?

সঙ্গে সঙ্গে সুমির হাতটা ছেড়ে দিল জয়। কেমন নার্ভাস হলো। আবার কি আমার কোনও ভুল হয়ে গেল?

সুমি হাসল। কিসের ভুল?

আমার তো শুধুই ভুল হয়। মিলাকে নিয়ে ঠাট্টা করতে গিয়ে…।

হাত তুলে জয়ের ঠোঁটে ছোঁয়াল সুমি। পুরনো কথা আমরা সব ভুলে যাব।

তারপরই বলল, না না সব ভুলব না। মধুর স্মৃতিগুলো মনে রাখব, সুন্দর কথাগুলো মনে রাখব। ভুলে যাব শুধু ভুল বোঝাবুঝি, শুধু দুঃখের স্মৃতি।

একথা শুনে কী যে খুশি হলো জয়!

দুহাতে সুমির হাতটা ধরল সে। তাই ভাল। তাই ভাল।

উচ্ছল কিশোরীর ভঙ্গিতে জয়ের বিছানায় বসল সুমি।

জয় বলল, এই বাড়ি তুমি চিনলে কী করে?

মিলার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়েছি।

কিন্তু আমাকে তো ফোন করনি?

ইচ্ছে করেই করিনি।

কেন?

তোমাকে চমকে দিতে চেয়েছি।

যদি আমি না থাকতাম?

যেখানেই থাকতে খুঁজে বের করতাম তোমাকে।

সুমি হাসল। হঠাৎ করেই আমি আবার তোমাকে ভালবাসতে শুরু করেছি।

কবে থেকে?

কাল মাঝরাত থেকে।

মাঝরাতে কী হয়েছিল?

সে কথা তোমাকে বলব না।

একটু থামল সুমি। তারপর বলল, এই, কেমন লাগছে আমাকে?

জয় মুগ্ধ গলায় বলল, অপূর্ব।

তোমার জন্য এই নীল শাড়িটা আমি আজ পরেছি।

শাড়িতে তোমাকে অসাধারণ লাগছে। সবাই কিন্তু সুন্দর করে শাড়ি পরতে পারে না।

আমি পারি।

সত্যি তুমি পার। এত সুন্দর করে শাড়ি পরতে কোনও মেয়েকে আমি কখনও দেখিনি।

কিন্তু অতোদূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার প্রশংসা করছ কেন? কাছে এসো। আমার পাশে এসে বোস।

জয় এসে সুমির পাশে বসল। সঙ্গে সঙ্গে জয়ের গা থেকে ওয়ান ম্যান শোর পাগল করা গন্ধটা এল। এই গন্ধে আপাদমস্তক কেঁপে উঠল সুমি। দিশেহারা গলায় বলল, তুমি কি ওয়ান ম্যান শো ইউজ করেছ?

হ্যাঁ। আমার খুব প্রিয় পারফিউম। কেন তোমার খারাপ লাগছে?

না না।

আমি যেদিন তোমার সঙ্গে দেখা করেছিলাম সেদিনও কি তুমি এই। পারফিউমটাই ইউজ করেছিলে?

হ্যাঁ। কেন বল তো?

সুমি মিষ্টি করে হাসল। না কিছু না।

তারপর দুহাতে জয়ের একটা হাত ধরল। অভিমানী শিশুর মতো আদুরে। গলায় বলল, তুমি আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছ।

জয় কাতর গলায় বলল, আমি আর কখনও এমন করব না।

করো না। এবার আমি বেঁচে উঠেছি, আরেকবার করলে বোধহয় বাঁচবোই না। এই জানো, কী হয়েছিল আমার?

না। কী হয়েছিল?

আমাকে একটা বদজীনে ধরেছিল।

কী?

সত্যি। এমন কিন্তু হয়। কোনও কোনও মেয়েকে কিন্তু সত্যি বদজীনে ধরে।

জীনটা কী কী করেছে বল তো?

একদিন গভীর রাতে প্রথমে অনেকক্ষণ ধরে আমার পায়ে সুরসুরি দিয়েছে। তারপর, তারপর…। ধুৎ আমার বলতে লজ্জা করছে।

জয় কী রকম যেন উত্তেজিত হলো। বল না আমাকে, না বললে বুঝব কী করে?

সুমি মিষ্টি করে হেসে বলল, আমার তলপেটের কাছে, নাভীর কাছে আলতো করে সুরসুরি দিয়েছে।

যাহ্!

সত্যি।

তারপর?

তারপর ঘাড়ে গলায় গালে আস্তে আস্তে মুখ ঘষে দিয়েছে। জীনটি বোধহয় সেদিন সেভ করেনি। দাড়ি গোঁফগুলো একটু একটু ধারাল লাগছিল।

ফ্যাল ফ্যাল করে সুমির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল জয়। কী বলছ এসব?

আমি মিথ্যে বলছি না। এবং জীনটির গা থেকে তখন ওয়ান ম্যান শোর গন্ধ আসছিল।

এবার একটু থতমত খেল জয়। যাহ্!

সত্যি।

জীনরা সেভ করে, পারফিউম ইউজ করে এমন তো কখনও শুনিনি।

সুমি গম্ভীর গলায় বলল, কালরাতেও জীনটা আমার ঘরে ঢুকেছিল। প্রথমদিন যা যা করেছে কালও তাই তাই করেছে। তারপরই তোমার জন্য পাগল হয়েছি আমি। সম্ভব হলে ওই মুহূর্তেই আমি তোমার কাছে চলে আসতাম।

জয় অসহায় গলায় বলল, তোমার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। জীন ওই ধরনের রোমান্টিক আচরণ করবে আর তোমার মনে পড়বে আমার কথা, মানে কী এসবের?

দুহাতে জয়ের গলা জড়িয়ে ধরল সুমি। আমার সেই জীনটা যে তুমি! তবুও আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

একদিনের কথা বলি তাহলেই বুঝতে পারবে। টেলিফোনে তুমি আমাকে একদিন বলেছিলে না, যেদিন প্রথম আমাকে তুমি স্পর্শ করবে, আমাকে প্রথম আদর করবে, সেদিন আদরটা শুরু করবে আমার পায়ের পাতা থেকে। আমার পায়ের পাতা থেকে চুমু খেতে শুরু করবে। তারপর আস্তে আস্তে হাঁটু অব্দি উঠবে। তারপর আমার তলপেট এবং নাভিমূলে চুমু খাবে। আমার গালে গলায় গ্রীবায় চুমু খাবে। এই কথাগুলো এমন করে আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল, চেতন। অবচেতন মনে আমি কেবল একথাই ভেবেছি। ভাবতে ভাবতে বাস্তবে এক সময় তেমন অনুভূতি হতে শুরু করেছিল আমার। আর প্রথম দিন সেই যে তোমার গা থেকে ওয়ান ম্যান শোর গন্ধ পেয়েছিলাম, সেই গন্ধটাও আমার স্মৃতিতে রয়ে গিয়েছিল।

সুমির কথা শুনে অদ্ভুত এক ভাল লাগায় মন ভরে গেল জয়ের। অপলক চোখে সুমির মুখের দিকে সে তাকিয়ে রইল।

সুমি বলল, তোমার ভালবাসায় শরীর মন, অন্তর আত্মা সব ভরে গেছে আমার। বেঁচে থাকলে তোমার হাত ধরে বেঁচে থাকব, মরে গেলেও তোমার হাত ধরে মরে যাব।

জয় স্বরাচ্ছন্ন গলায় বলল, আমিও।

তারপর জয়ের বিছানায় শুয়ে পড়ল সুমি। এই, তুমি যেমন যেমন বলছিলে তেমন করে আদর কর আমাকে। পায়ের পাতায়, নাভিমূলে, গালে গলায় গ্রীবায়। তোমার ছোঁয়ায় ভালবাসাকে ছুঁয়ে দেখব আমি।

Exit mobile version