Site icon BnBoi.Com

বিমান দুর্ঘটনা – রকিব হাসান

বিমান দুর্ঘটনা

 

বিমান দুর্ঘটনা

০১.

সকালের রোদে গুঞ্জন তুলে উড়ে চলেছে সেসনা। ছোট্ট বিমানটার নিচে ছড়িয়ে রয়েছে ক্যালিফোর্নিয়ার সিয়েরা নেভাডা রেঞ্জের পাহাড়ী অঞ্চল। সবুজ পাইন বনের ভেতর থেকে মাথা তুলেছে অসংখ্য লাল পাহাড়ের চূড়া।

ককপিটের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল রবিন। চোখে বিনোকিউলার। পাশে পাইলটের সীটে বসে তার বাবা রোজার মিলফোর্ড। সিঙ্গল-ইঞ্জিন টার্বোপ্রপেলার বিমানটাকে স্বচ্ছন্দে উড়িয়ে নিয়ে চলেছেন গ্র্যানিটের পাহাড় আর পান্না-সবুজ উপত্যকার ওপর দিয়ে।

নিচে ওটা কি? রবিন বলল। ওই তৃণভূমিটার ওপারে। দেখতে পাচ্ছ?

কিশোরকে কনুইয়ের তো মেরে চৌখ টিপল মুসা। রবিন আর তার বাবার পেছনে প্যাসেঞ্জার সীটে বসে দুজনে। ওরাও তাকিয়ে নিচে। তবে খালি চোখে। সব কিছু ভাল দেখা যাচ্ছে না বলে পালা করে বিনোকিউলারটা নিয়ে দেখছে। নিচে একের পর পার হয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের চূড়া।

কি আর, মুসা বলল রবিনকে। মেয়েটেয়ে হবে। সুন্দরী। তোমার মুখটা, দেখতে পেলেই হাত নাড়বে।

এবং পরক্ষণেই ফোন নম্বর চাইবে, হেসে যোগ করল কিশোর।

জিজ্ঞেস করবে, মুসা বলল, আজকে সন্ধেয় তোমার কোন কাজ আছে কি না।

আঙ্কেল, মিস্টার মিলফোর্ডকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, ডায়মণ্ড লেকে সিনেমা হল আছে? শান্ত, নিরীহ ভঙ্গি। সন্ধ্যায় রবিনকে তো আর পাব না। মুসার আর আমার সময় কাটাতে হবে।

শব্দ করে হাসলেন মিলফোর্ড।

চোখ থেকে দূরবীন সরাল রবিন। মেয়েটেয়ে কিছু না, ওটা কুগার। ফিরে তাকাল দুই বন্ধুর দিকে। সুন্দর চেহারা, সোনালি ঘন চুল, কালচে নীল চোখ, আর। আকর্ষণীয় হাসি। যেখানেই যায়, কোথা থেকে যেন এসে উদয় হয় মেয়েরা, পিছে লাগে তার। টিটকারি তো খুব মারলে আমাকে। আমি কি একা নাকি?

আর কে? ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল মুসা।

কেন, কমিক গার্লকে ভুলে গেলে? মিরিনা জরডান? ও আমার পিছে লেগেছিল?

কিশোরের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল মুসা। কিশোর মিয়া, এইবার তোমাকে পেয়েছে…

আর আমি যা করি, মুসার কথা শেষ হওয়ার আগেই বলল রবিন, সেটা স্বাভাবিক। মেয়েদের নিয়ে বেড়াতে যাই, রেস্টুরেন্টে খেতে যাই, ছবি দেখি…অ্যাটমের স্ট্রাকচার বোঝাতে বোঝাতে বিরক্ত করে ফেলি না।

মুখ তুলল কিশোর। পিস্তলের নলের মত করে রবিনের দিকে চোখা থুতনি। নিশানা করল যেন। রেগে গেছে। জিনা জানতে চাইল, আমি কি করব? ও-ই তো বলল, ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতে…

ছেলেদের এই ঝগড়া দারুণ উপভোগ করছেন মিলফোর্ড। হো হো করে হেসে উঠলেন। লাল হয়ে গেল কিশোর। রবিন আর মুসাও হাসছে। শেষে সবার সঙ্গে তাল মেলাতেই যেন অল্প একটু হাসল সে-ও। মেয়েরা তাকে পছন্দ করে। কিন্তু ওদের সঙ্গে সহজ হতে পারে না সে। তার প্রখর বুদ্ধিমান মগজের কাছেও যেন মেয়েরা একটা বিরাট রহস্য।

উঠে দাঁড়াল সে। সেসনার ছাত নিচু, সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না। মাথা নুইয়ে রেখেই লেজের দিকে এগোল সে। ওখানে মালপত্র আর নানা রকম যন্ত্রপাতি গাদাগাদি করে ফেলে রাখা হয়েছে।

কোথায় যাচ্ছ? জিজ্ঞেস করল মুসা।

আরেকটা বিনোকিউলার দরকার, না তাকিয়েই জবাব দিল কিশোর। নিচে কে আছে দেখব। এমন কেউও থাকতে পারে, যে আগে থেকেই ই ইকোয়্যাল টু এম সি টু দি পাওয়ার টু-এর মানে জানে। আমাকে আর শেখাতে হবে না।

আরেকবার হাসল সবাই। এবার কিশোরের হাসিটা সবার চেয়ে জোরাল শোনাল। গ্রীষ্মের এই উইক এণ্ডের শুরুটা বড় চমৎকার। উজ্জ্বল রোদ। আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার, গাঢ় নীল। তিন দিন লাগতে পারে মিস্টার মিলফোর্ডের কাজ শেষ হতে হতে। চুটিয়ে আনন্দ করে ছুটি কাটাতে পারবে তাহলে তিন গোয়েন্দা। খবরের কাগজের একটা স্টোরি করার জন্যে ডায়মণ্ড লেকে চলেছেন তিনি।

কাজ অনেক পেছনে ফেলে এসেছে ওরা, রকি বীচে। কোন বাধা নেই, কোন দায়িত্ব নেই। মুক্ত, স্বাধীন, কয়েকটা দিনের জন্যে। হেসেখেলে কাটাতে পারবে ক্যালিফোর্নিয়ার সবচেয়ে দামি মাউনটেইন রিসোর্টে। ডায়মণ্ড লেকে গলফ কোর্স আছে, বিশাল সুইমিং পুল আছে, টেনিস কোর্ট আছে। ঘোড়ায় চড়া, ক্যাম্পিং এসবের ব্যবস্থা আছে। রানওয়ে আছে, যাতে প্লেন নামতে পারে, কারণ। মাঝেসাঝেই এখানে পালিয়ে এসে নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচেন ভীষণ ব্যস্ত ব্যবসায়ী কিংবা সরকারী কর্মকর্তারা। কিছু দিন নির্বিঘ্নে কাটিয়ে চাঙা হয়ে আবার ফিরে যান। তাদের নৈমিত্তিক কাজে।

এটাওটা সরিয়ে জিনিসপত্রের মাঝে বিনোকিউলার খুঁজতে লাগল কিশোর। লোকটাকে হয়ত দেখতে পাব। আনমনা হয়ে বলল সে। কয়েকটা যন্ত্রপাতি তুলে নিয়ে একপাশে ফেলে রাখল, একটা খালি ফলের রসের ক্যান, একটা দোমড়ানো নার্ফ বল, এবং আরও কিছু বাতিল জিনিস সরাল। হঠাৎ মিস্টার মিলফোর্ডের দিকে মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, আঙ্কেল, যার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন, লোকটার নাম যেন কি বললেন?

কই, বলিনি তো!

হুম, তাহলে যার কাছ থেকে সংবাদ জোগাড় করতে যাচ্ছেন, সে একজন, পুরুষ। আমি বললাম, লোকটা, আপনি বললেন বলিনি। তার মানে স্বীকার করে। নিয়েছেন, আপনার সংবাদদাতা একজন পুরুষ। যাক, একটা সূত্র মিলল।

আরেক দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসিটা লুকালেন মিলফোর্ড।

বাবা, চাপাচাপি শুরু করল রবিন, বল না। লোকটা কে? কাউকে বলব না, সত্যি।

সরি। মাথা নাড়লেন মিলফোর্ড। সুদর্শন, ভাল স্বভাবের লোক তিনি। প্রায় ছয় ফুট লম্বা। রবিন এখনও তার উচ্চতায় পৌঁছাতে পারেনি। চোখে কালো সানগ্লাস, মাথায় লস অ্যাঞ্জেলেস ডজারস বেসবল ক্যাপ, গায়ে নেভি ব্লু রঙের উইণ্ডব্রেকার, বুক পকেট থেকে বেরিয়ে আছে আধ ডজন পেন্সিল। বয়েস এত কম লাগছে, মনে হচ্ছে তিনি রবিনের বাবা নন, বড় ভাই।

কি ধরনের স্টোরি করতে যাচ্ছেন? মুসার প্রশ্ন। কোন সুপার অ্যাথলিটকে নিয়ে? ডায়মণ্ড লেকে পাহাড়ে ওঠার রেকর্ড ভাঙছে না তো কেউ? জাত অ্যাথলিট মুসার প্রথমেই মনে আসে খেলাধুলা আর ব্যায়ামের কথা। না না, বুঝেছি, ওসব না! আগামী মাসে স্টেট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইন্যাল যেটা শুরু হতে যাচ্ছে, তারই কোন ব্যাপার…

কিচ্ছু বলব না, আমি, মুসাকে থামিয়ে দিলেন মিলফোর্ড। পত্রিকায় বেরোনোর আগে খবর গোপন রাখা সাংবাদিকের দায়িত্ব।

সে আমরা জানি, রবিন বলল। গোপন সূত্রের সাহায্য ছাড়া,বহুবার শোনা কথাটা যেন উগড়ে দিল সে, পুরো স্টোরি জোগাড় করা কঠিন হয়ে যায় সাংবাদিকের জন্যে।

আর, সুর মেলাল মুসা, সাংবাদিকরা যদি সূত্রদের নাম ফাস করত, তাহলে কেউই আর ভয়ে একাজ করতে আসত না। সূত্ররা সব শুকিয়ে যেত।

হ্যাঁ, গোপন রাখাটা যে কত জরুরী, কিশোর বলল, জানি আমরা। আমাদের বিশ্বাস করতে পারেন আপনি। পেটে বোমা মারলেও মুখ খুলব না।

হাসলেন মিলফোর্ড। ঠিক। যা জানবে না তা বলতেও পারবে না।

গুঙিয়ে উঠল তিন গোয়েন্দা। কঠিন লোক মিলফোর্ড। লস অ্যাঞ্জেলেসের এতবড় একটা নামকরা পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টার খামোকা হননি। কোন স্টোরির ওপর কাজ করছেন এখন, কিছুতেই সেটা জানার উপায় নেই।

কাগজ কোম্পানির ছোট্ট একটা বিমান নিয়ে তিনি ডায়মণ্ড লেকে যাবেন, এটা নিয়ে ফোনে কার সঙ্গে যেন আলাপ করছিলেন, শুনে ফেলেছিল রবিন। গরম কোন খবর, নইলে বিমান নিয়ে এভাবে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ত না, বুঝতে পেরেছে। সে। কিন্তু কার ওপর, কেন স্টোরিটা করা হচ্ছে, বিন্দুমাত্র ধারণা করতে পারেনি।

কি করলে আমাদের সঙ্গে নিতে বাধ্য করা যাবে তোমাকে? ফোন রাখতেই বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল রবিন।

মায়া, হেসে বলেছেন মিলফোর্ড। পঞ্চাশ ফুট দূর থেকেই যে মায়াজালে সুন্দরী মেয়েগুলোকে জড়িয়ে ফেলো তুমি, সেই মায়া দিয়ে। তবে আপাতত তোমাদের নিজেদের চরকায় তেল দেয়াটাই ভাল মনে করছি আমি। এটা তিন গোয়েন্দার ব্যাপার নয়।

ওই সময় রবিনদের বাড়িতেই ছিল কিশোর আর মুসা। আরেক ঘরে। তিন গোয়েন্দা নামটা শুনেই কান খাড়া করল কিশোর। মুসাকে নিয়ে চলে এল হলঘরে। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করল রবিনকে। জানাল রবিন।

দয়া করুন আমাদের ওপর, মিনতি করে বলেছে মুসা। খাটাতে খাটাতে তো মেরে ফেলেছেন পুরো হপ্তাটা। কত কিছু করে দিলাম। বাগান সাফ করলাম, গ্যারেজ পরিষ্কার করলাম…

হ্যাঁ, অনেক কাজই করেছ, স্বীকার করলেন মিলফোর্ড।

তাহলে দয়া করুন, আবার বলল মুসা। নিয়ে চলুন আমাদের। ছুটি কাটানোর এত সুন্দর জায়গা শুনেছি আর নেই।

নেই কথাটা ভুল, শুধরে দিল কিশোর। আছে, তবে কম। হ্যাঁ, আঙ্কেল নিয়ে চলুন। বিশ্রামটাও হয়ে যাবে আমাদের, সেই সঙ্গে রিক্রিয়েশন।

ছেলেদের অনুরোধ ফেলতে পারলেন না মিলফোর্ড। রাজি হয়ে গেলেন। তবে শর্ত দিলেন একটা। তার কাজে ওরা নাক গলাতে পারবে না। এবং এটা বলেই কৌতূহলী করে তুললেন কিশোরকে। ওই সময় আর কিছু বলল না সে। রাজি হয়ে গেল শর্তে।

গরমের ছুটির সময় কাজ করে কিছু পয়সা জমিয়েছে তিন গোয়েন্দা। এতে হোটেলের শস্তা ঘর ভাড়া আর খাওয়ার খরচ হয়ে যাবে। সুইমিং পুলটা বিনে। পয়সায়ই ব্যবহার করা যাবে। অল্প পয়সা দিয়ে আরও যা যা চিত্তবিনোদন করা সম্ভব, করবে।

এই, দেখ, জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে রয়েছেন মিলফোর্ড। সামনের উপত্যকার দিকে চোখ। ওদিকে দেখ কি দেখা যায়।

বিনোকিউলার দিয়ে দেখল রবিন। তাঁরপর নীরবে সেটা তুলে দিল মুসার হাতে।

আরও কাছে থেকে দেখা দরকার, মিলফোর্ড বললেন। ডায়মণ্ড লেকের কাছাকাছি এসে গেছি আমরা।

সামনের দিকে নিচু হয়ে গেল বিমানের নাক। বদলে গেল ইঞ্জিনের গুঞ্জন।

বিনোকিউলার খোঁজা বাদ দিয়ে মিলফোর্ডের সীটের পেছনে চলে এল কিশোর। সামনের সরু সবুজ উপত্যকাটার দিকে তাকাল। উপত্যকার কিনারে গ্র্যানিটের খাড়া দেয়াল লম্বা হয়ে ছড়িয়ে গেছে উত্তর দক্ষিণে। দেয়ালটার দক্ষিণ মাথায় কয়েক মাইল লম্বা একটা পাহাড়, পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত। ওপর থেকে গড়িয়ে পড়ছে রূপালি ঝর্না।

বাহ, দারুণ! কিশোর বলল।

উপত্যকাটার নাম কি? রবিনের প্রশ্ন।

আমারও জানতে ইচ্ছে করছে, জবাব দিলেন মিলফোর্ড। খুব সুন্দর। সামনে দেখ। সুন্দর, না? ডায়মণ্ড লেক এখান থেকে উত্তরে। চল্লিশ-পঞ্চাশ মাইল হবে আর।

ডায়মণ্ড লেক দেখা গেল। ঘন নীল, উজ্জ্বল রোদে যেন নীলা পাথরের মত জ্বলছে। একধারে একগুচ্ছ বাড়ি, পিঁপড়ের সমান লাগছে এখান থেকে। লেকের পাড় আর পাহাড়ের ভেতর দিয়ে দিয়ে চলে গেছে একটা কংক্রীটের রাস্তা, সাদা সরু একটা ফিতের মত দেখাচ্ছে।

মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে শিস দিয়ে উঠল রবিন।

সময় মতই এসেছি, কিশোর বলল। লাঞ্চ ওখানে গিয়েই করতে পারব।

এইবার একটা কথার মত কথা বলেছ, মাথা দোলাল মুসা।

এই সময় ছোট্ট একটা ঝাঁকি দিল সেসনা। কিশোরের সে রকমই মনে হলো। প্রায় টেরই পাওয়া যায়নি…

তোমরা কি… কথা শেষ করতে পারল না সে।

একে অন্যের দিকে তাকাল তিন গোয়েন্দা। পরক্ষণেই একযোগে তাকাল। সামনের দিকে, যেখানে সেসনার একমাত্র ইঞ্জিনটা রয়েছে।

বদলে গেছে ইঞ্জিনের গুঞ্জন।

আঙ্কেল… চিৎকার করে উঠল কিশোর। এবারেও কথা শেষ করতে পারল না সে।

থেমে গেছে ইঞ্জিন।

কন্ট্রোলের ওপর পাগলের মত ছোটাছুটি করছে মিলফোর্ডের আঙুল। দুই বছর হল পাইলটের লাইসেন্স পেয়েছেন তিনি, বহুবার আকাশে উঠেছেন বিমান নিয়ে, কখনও কোন গোলমালে পড়েননি।

অসংখ্য সুইচ টেপাটিপি করলেন তিনি, গজগুলো চেক করলেন, তারপর যখন দেখলেন কোনটাই কাজ করছে না, শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ওগুলোর দিকে। কাটাগুলো সব নিথর হয়ে আছে, নড়ে না, ডিজিটাল নম্বরগুলো যেখানে ছিল সেখানেই আটকে গেছে। অলটিচিউড, এয়ার স্পীড, ফুয়েল…

ইলেকট্রিক্যাল সিসটেমটা গেছে! বিড়বিড় করল রবিন।

ইঞ্জিন? জবাব জানা হয়ে গেছে কিশোরের, তবু প্রশ্নটা করল।

ডেড! মিলফোর্ড বললেন।

.

০২.

কাগজের খেলনা বিমানের মত ভেসে চলেছে সেসনা। ইঞ্জিন স্তব্ধ। চারপাশে শিস দিচ্ছে যেন বাতাস, গোঙাচ্ছে। ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেল থেকে থাবা দিয়ে। মাইক্রোফোনটা তুলে নিয়ে সুইচ টিপলেন মিলফোর্ড।

মে-ডে! মে-ডে! তার কণ্ঠস্বর শান্ত, কিন্তু জরুরী। সেসনা নভেম্বর থ্রি সিক্স থ্রি এইট পাপা থেকে বলছি। আমাদের ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেছে। নিচে পড়ছি। পজিশন জিরো ফোর সেভেন রেডিয়াল অভ ব্যাকারসফিল্ড ভি ও আর অ্যাট সেভেন্টি ফাইভ ডি এম ই।

মাইক্রোফোনটা রবিনের হাতে গুঁজে দিয়ে আবার স্টিক ধরলেন তিনি।

একই কথা বলতে লাগল রবিন, সেসনা নভেম্বর…

হঠাৎ ফ্যাকাসে হয়ে গেল মিলফোর্ডের চেহারা। রবিন, লাভ নেই! রেখে দাও!

মানে?

অহেতুক কথা বলবে, বুঝে ফেলেছে কিশোর, লাভ হবে না। মেসেজ যাবে না কোথাও। বিদ্যুতই নেই। রেডিও অচল।

আরি, ভুলেই গিয়েছিলাম, রবিন বলল, ইমারজেন্সি লোকেটর বিকন আছে একটা। প্লেন ক্র্যাশ করলে আপনা-আপনি চালু হয়ে যায় ওটা।

অনেক ধন্যবাদ, আমি ক্র্যাশ করতে চাই না, দুই হাত নাড়ল কিশোর। দ্রুত হয়ে গেছে হৃৎপিণ্ডের গতি। নিরাপদে এখন কোনমতে মাটিতে নামতে পারলে…

হ্যাঁ, আমারও এই কথা, মুসা বলল।

নীরবে সিটবেল্ট বাঁধতে লাগল ওরা।

গ্র্যানিটের একটা চূড়ার দিকে নাক নিচু করে ধেয়ে চলেছে বিমান। বাড়ি লাগলে ডিমের খোসার মত গুঁড়িয়ে যাবে।

মোচড় দিয়ে উঠল কিশোরের পেট। ভয় পেলে যা হয়। ঘামতে আরম্ভ করেছে।

মুঠো খুলে-বন্ধ করে আঙুলের ব্যায়াম করতে লাগল মুসা, আনমনে, যেন পতনের পর পরই কোন কিছু আঁকড়ে ধরে বাঁচার জন্যে তৈরি হচ্ছে। উত্তেজনায় শক্ত হয়ে গেছে পেশী।

ঢোক গিলল রবিন। সহজ ভাবে শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করছে। যাচ্ছি কোথায় আমরা? স্বর শুনে মনে হলো গলায় ফাঁসি লাগিয়ে দেয়া হয়েছে।

ওই তৃণভূমিটায় নামার চেষ্টা করব, মিলফোর্ড বললেন।

তৃণভূমিটা বেশ বড়, উপত্যকার পুব ধারে।

কতক্ষণ লাগবে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

আর মিনিট তিনেক।

পাথর হয়ে গেছে যেন ছেলেরা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে। বাতাস চিরে নিচে নামছে বিমান। দ্রুত বড় হচ্ছে গাছপালা, গ্র্যানিটের চাঙড়। তৃণভূমির উত্তরের পাহাড়টা লম্বা হচ্ছে, সাদা হচ্ছে, মাথা তুলছে যেন দানবীয় টাওয়ারের মত।

মায়ের কথা ভাবল রবিন। কাগজে যখন পড়বেন, সে আর তার বাবা মারা। গেছেন বিমান দুর্ঘটনায়, দুঃখটা কেমন পাবেন? নিশ্চয় ভয়াবহ।

মাটির যত কাছাকাছি হচ্ছে ততই যেন গতি বেড়ে যাচ্ছে বিমানের।

মাথা নামাও! চিৎকার করে বললেন মিলফোর্ড। হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরো। শক্ত করে!

বাবা…

জলদি করো! কথা বলার সময় নেই!

মাথা নুইয়ে হাত দিয়ে চেপে ধরল, কিংবা বলা যায় বাহু দিয়ে পেঁচিয়ে ধরল তিনজনে।

যাই হোক, চাকাগুলো ঠিকই আছে, বিড়বিড় করে নিজেকেই সান্ত্বনা দিল রবিন। ধাক্কা কিছুটা অন্তত বাঁচাবে।

ব্রেকের কথা উল্লেখ করল না কেউ। লাভ নেই। ইলেকট্রিক সিসটেম বাতিল, কাজেই ব্রেক কাজ করবে না।

বিমানের চারপাশে বাতাসের গর্জন বাড়ছে।

হয়েছে! এইবার! ভাবতে গিয়ে গায়ে কাটা দিল রবিনের।

মাটিতে আছড়ে পড়ল বিমান।

প্রচণ্ড বেগে সামনের দিকে ছিটকে যেতে চাইল ওদের শরীর, সীট বেল্টে টান। লেগে আবার ফিরে এসে পিঠ বাড়ি লাগল সিটের হেলানে। রবিনের মনে হলো, তীক্ষ্ণ ব্যথা যেন লাল সাদা স্ফুলিঙ্গ ছিটিয়ে গেল চোখে।

পড়েই বলের মত ড্রপ খেয়ে লাফিয়ে উঠল বিমান, ভয়ঙ্কর গতিতে আবার আছাড় খেল। সীট বেল্টে আটকানো মানুষগুলোকে এলোপাতাড়ি ঝাঁকিয়ে দিল। আবার লাফিয়ে উঠল।

শক্ত হয়ে থাক! চিৎকার করে হুঁশিয়ার করলেন মিলফোর্ড।

তৃতীয় বার মাটিতে পড়ল বিমান। কাপল, ঝাঁকি খেল, দোল খেল, গোঙাল। তবে আর লাফ দিল না। সামনের দিকে দৌড়াল মাতালের মত টলতে টলতে।

সীট আঁকড়ে ধরেছে রবিন। মাথা নিচু করে রেখেছে। ভীষণ ঝাঁকুনি লাগছে। মনে হচ্ছে, শরীরের ভেতরের যন্ত্রপাতি সব ভর্তা হয়ে যাচ্ছে। বেঁচে আছে এখনও, তবে আর কতক্ষণ?

হঠাৎ শোনা গেল বিকট শব্দ, ধাতুর শরীর থেকে ধাতু ছিঁড়ে, খসে আসার আর্তনাদ। কলজে কাঁপিয়ে দেয়।

আরেকবার সামনে ঝাঁকি খেয়ে পেছনে ধাক্কা খেল ওদের দেহ, তারপর খেল। পাশে, মাথা ঠুকে গেল দেয়ালের সঙ্গে। বাতাসে উড়ছে বই, খাতা, কাগজ। কানের পাশ দিয়ে উড়ে গেল যন্ত্রপাতি আর ইলেকট্রিকের তার। কি যেন এসে লাগল রবিনের হাতে। ব্যথায় উহ করে উঠল সে। পাগল হয়ে গেছে যেন বিমান, এ পাশে দোল খাচ্ছে, ওপাশে দোল খাচ্ছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে এর মাঝে।

তারপর নামল নীরবতা। স্তব্ধ নীরবতা। দাঁড়িয়ে গেছে সেসনা।

আস্তে মাথা তুলল রবিন।

বাবা!

ইনস্ট্রমেন্ট প্যানেলে মাথা রেখে উবু হয়ে আছেন মিলফোর্ড।

তার কাধ ধরে ঠেলা দিল রবিন। বাবা! ঠিক আছ তুমি?

কিন্তু নড়লেন না তিনি।

ওখান থেকে বের করে নিয়ে আসা দরকার! সামনের দুটো সীটের মাঝের ফাঁকে এসে দাঁড়াল মুসা।

দ্রুতহাতে বাবার কানে লাগানো হেডফোন খুলে নিল রবিন। মুসা খুলল সীটবেল্ট। মিলফোর্ডের কপালে রক্ত। বাড়ি লেগে গোল হয়ে ফুলে উঠেছে একটা জায়গা, লালচে বেগুনী হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই।, মুসার পেছন পেছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়ল রবিন, বেসামাল পায়ে দৌড়ে বিমানের সামনে দিয়ে ঘুরে চলে এল আরেক পাশে। সে ভাল আছে। মুসা আর। কিশোরও ভাল আছে। নেই কেবল তার বাবা। বেহুশ হয়ে গেছেন। আঘাত কতটা মারাত্মক এখনও বোঝা যাচ্ছে না। হাতল ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে পাইলটের পাশের দরজাটা খুলল সে।

তার পাশে চলে এল মুসা। রবিনকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে পাজাকোলা করে বের করে আনল মিলফোর্ডকে। নিজের গায়েও জখম আছে, ব্যথা আছে, তবে গুরুত্ব দিল না। আগে মিলফোর্ডের সেবা দরকার।

কিশোর কই? অচেতন দেহটা কোলে নিয়েই সামনের একটা উঁচু পাথরের চাঙড়ের দিকে প্রায় দৌড়ে চলল সে। ওর পাশে রইল রবিন। বাবার দিকে কড়া দৃষ্টি।

এই যে, এখানে! দুর্বল জড়ানো কণ্ঠে জবাব দিল কিশোর। বিমানের ভেতরেই রয়েছে। ধীরে ধীরে হাত-পা নেড়েচেড়ে দেখছে ভেঙেছে কি-না। নড়ছে। স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই, তার মানে ঠিকই আছে…

বেরোও ওখান থেকে! গ্র্যানিটের চাঙড়টার দিকে ছুটতে ছুটতে চেঁচিয়ে উঠল মুসা। পাথরের কাছে পৌঁছে ঘাসের ওপর শুইয়ে দিল মিলফোর্ডকে।

হাঁটু গেড়ে বাবার পাশে বসে পড়ল রবিন। নাড়ি দেখল। ডাক দিল, বাবা, শুনতে পাচ্ছ? বাবা?

মিলফোর্ডকে নামিয়ে দিয়েই আবার বিমানের দিকে দৌড় দিল মুসা, কিশোরের কাছে।

আসছি! দরজায় দাঁড়িয়ে বোকা বোকা চোখে মুসার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কিশোর।

নাম না জলদি, গাধা কোথাকার! ধমকে উঠল মুসা। কিশোরের হাত ধরে টান মারল। ফুয়েল ট্যাঙ্ক…

বড় বড় হয়ে গেল কিশোরের চোখ। ফুয়েল ট্যাঙ্ক! ভুলেই গিয়েছিলাম…! আতঙ্ক ফুটল কণ্ঠে। আগুনের মত গরম হয়ে আছে ইঞ্জিন। ট্যাঙ্কের পেট্রল এখন তাতে গিয়ে লাগলে দপ করে জ্বলে উঠবে।

লাফ দিতে যাচ্ছিল কিশোর, এই সময় হাতে টান দিল মুসা, তাল সামলাতে না পেরে উপুড় হয়ে পড়ে গেল সে। উঠে দাঁড়াল আবার। কোথাও হাড়টাড় ভেঙেছে কিনা দেখার সময় নেই আর। দৌড়াতে শুরু করল মুসার পেছনে। যে পাথরটার আড়ালে শুইয়ে দেয়া হয়েছে মিলফোর্ডকে, রবিন রয়েছে, সেখানে চলেছে। বিমাটা বিস্ফোরিত হলেও ওখানে টুকরোটাকরা ছিটকে গিয়ে ক্ষতি করার আশঙ্কা নেই।

মিলফোর্ডের কাছে এসে ধপ করে বসে পড়ল কিশোর। পর মুহূর্তেই চিত। জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে। ঘামে চকচক করছে মুখ। তার পাশে বসে পড়ল মুসা।

বিস্ফোরণের অপেক্ষা করছে ওরা। প্রচণ্ড শব্দের পরক্ষণেই এসে গায়ে লাগবে। আগুনের আঁচ, বাতাস ভরে যাবে পোড়া তেলের গন্ধে।

গায়ের ডেনিম জ্যাকেট খুলে ফেলল রবিন। গুটিয়ে নিয়ে বালিশ বানিয়ে ঢুকিয়ে দিল বাবার মাথার নিচে। আরেকবার নাড়ি দেখে বন্ধুদের দিকে মুখ তুলে তাকাল। বলল, নাড়ি ঠিকই আছে।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। বেহুশ হয়ে গেছেন। আর কিছু না। প্রচণ্ড শক লেগেছে তো।

খুব শক্ত মানুষ! মুসা বলল।

নিজের জ্যাকেট খুলে মিলফোর্ডের গায়ে ছড়িয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। হাত টান টান করে ঝাঁকি দিল, পা ঝাঁকি দিল, পেশীগুলোকে ঢিল করে নিয়ে আবার বসল। বিমানটা এখনও ফাটছে না কেন? ঠাণ্ডা হয়ে যায়নি তো ইঞ্জিন? বার বার সীটে ধাক্কা লাগায় পিঠ ব্যথা করছে, বুক ব্যথা করছে সীট বেল্টের টান লেগে।

গুঙিয়ে উঠলেন মিলফোর্ড।

বাবা? ডাক দিল রবিন। চোখ মেল, বাবা?

আঙ্কেল, শুনছেন? উঠে বসে কিশোরও ডাকল।

চোখ মেললেন মিলফোর্ড রবিনের মুখে চোখ পড়ল।

হাসি ফুটল রবিনের মুখে। ল্যাণ্ডিংটা দারুণ হয়েছে, বাবা।

দুর্দান্ত হয়েছে, একমত হলো কিশোর।

তাহলে আবার কখন উড়ছি আমরা? রসিকতা করল মুসা।

মলিন হাসি হাসলেন মিলফোর্ড। তোমরা ঠিক আছ তো?

প্লেনটার চেয়ে যে ভাল আছি, কিশোর জবাব দিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

উঠে বসতে গেলেন। ঠেলে আবার শুইয়ে দিল রবিন।

প্লেনটার কি অবস্থা! উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন মিলফোর্ড। ডানাটানা আছে?

ডানা?

তাই তো! লক্ষ্যই করা হয়নি! তিনজনেই উঠে দাঁড়াল। পাথরটার পাশে এসে তাকাল। অসংখ্য মেঠো ফুল জন্মে রয়েছে তৃণভূমিতে। মাঠের বুক চিরে চলে গেছে। একটা লম্বা দাগ, বিমানটার হিঁচড়ে যাওয়ার চিহ্ন। সেসনার ডানায় লেগে মাথা। কেটে গেছে অনেক চারাগাছের। কাণ্ডগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে রোদের মধ্যে, ওপরের অংশটা যেন মুচড়ে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। প্রপেলারের চার ফুট লম্বা একটা ডানা খসে গেছে, কয়েক টুকরো হয়ে এখন পড়ে আছে শখানেক ফুট দূরে। বিমানের। চলার পথে পড়ে আছে দুটো চাকা। ধারাল পাথরে লেগে ছিঁড়ে গেছে একটা ডানা। ওই পাথরটাতে বাড়ি খেয়েই অবশেষে থেমেছে বিমানটা। ডানা ছাড়া উড়তে পারবে না আর সেসনা।

জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে রবিন বলল, গেছে!

নামতে যে পেরেছি, এটাই বেশি, মুসা বলল।

কিশোর বলল, হ্যাঁ, অল্পের ওপর দিয়ে গেছে। আমি তো ভেবেছিলাম, জীবনটা এখানেই খোয়াতে হবে। অথচ একটা হাডিডও ভাঙল না, আশ্চর্য!

আমার ক্যাপটা কোথায়? মিলফোর্ড বললেন। ছেলেদের বাধা দেয়ার তোয়াক্কা করলেন না আর, পাথরের একটা ধার খামচে ধরে টেনে তুললেন শরীরটাকে।

বাবা!

আঙ্কেল!

পাথরে হেলান দিলেন মিলফোর্ড। সোজা রাখলেন মাথাটা। তিক্ত হাসি ফুটল ঠোঁটে। মাথায় সামান্য ব্যথা, আর কোন অসুবিধে নেই।

বসে পড়ো! রবিন বলল।

উপায় নেই, মিলফোর্ড বললেন। প্লেনটার অবস্থা দেখতে হবে।

কিন্তু ইঞ্জিন গরম…

মুসাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন তিনি, আগুন লাগার ভয় করছ? এখনও যখন লাগেনি, আর লাগবে না। বিমানটার দিকে তাকালেন। এক পা বাড়ালেন সামনে, তারপর আরেক পা। নাহ, পারছি হাঁটতে। পারব। অতটা খারাপ না। টলে উঠলেন তিনি।

খপ করে এক হাত ধরে ফেলল রবিন। মুসা ধরল আরেক হাত।

বড় বেশি গোয়ার্তুমি করো তুমি, বাবা!

তোর মা-ও একই কথা বলে, হেসে বললেন মিলফোর্ড। আমাদের এডিটর সাহেবও। সব সময়ই বলেন। আবার পা বাড়ালেন তিনি। তবে ছেলেদের সাহায্য নিতে অমত করলেন না।

পাশে পাশে চলল কিশোর। বিমানের কাছে পৌঁছে পাইলটের সীট থেকে বাবার সানগ্লাস আর ক্যাপটা তুলে নিল রবিন।

এ নীল উইণ্ডব্রেকারের পকেটে চশমাটা রেখে দিলেন মিলফোর্ড। ক্যাপটা মাথায়। দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঠিকমত বসার চেষ্টা করলেন, যাতে কপালে না লাগে। বসিয়ে, হাসলেন। যেন বোঝাতে চাইলেন, আমাকে অত অসহায় ভাবছ কেন? আমি এখনও সবই পারি।

আশপাশটায় চোখ বোলাল ওরা। পাহাড়ের ঢালে ঢালু হয়ে নেমে গেছে তৃণভূমি। তার পরে ঘন বন। তিন পাশেই, বেশ কিছুটা দূরে মাথা তুলেছে গ্র্যানিটের পাহাড়। রোদে চকচক করছে। পেছনে প্রায় দুশো ফুট উঁচু আরেকটা পাহাড়, দুই প্রান্তই ঢালু হয়ে গিয়ে ঢুকেছে পাইন বনের ভেতরে। উত্তরের পাহাড় চূড়ার জন্যে দেখা যাচ্ছে না তার ওপাশে কি আছে।

লোকালয়ে কোন চিহ্নই চোখে পড়ল না। ডায়মণ্ড লেক এখান থেকে কম করে হলেও তিরিশ-চল্লিশ মাইল দূরে হবে। উত্তরের চূড়াটা না থাকলে হয়তো চোখে পড়ত। তবে আকাশ থেকে নিচের জিনিস যতটা ভালভাবে দেখা যায়, নিচে থেকে যায় না।

তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে রবিন নিচের তরাই অঞ্চল। অন্য কোন সময় হলে, অর্থাৎ পরিস্থিতি ভাল থাকলে জায়গাকে খুব সুন্দর বলত সে। চোখা হয়ে উঠে যাওয়া চূড়া, নিচের সবুজ উপত্যকা, ঘন বন। এখন সে সব উপভোগ করার সময়। নেই। একটা কথাই বার বার পীড়িত করছে মনকে, ওরা এখানে একা। নির্জন এক পার্বত্য এলাকায় নামতে বাধ্য হয়েছে ওরা। সাথে খাবার নেই, পানি নেই। রেডিও, ক্যাম্প করার সরঞ্জাম কিছুই নেই। বাঁচবে কি করে?

যেন তার মনের কথাটাই পড়তে পেরে ক্লান্ত স্বরে মিলফোর্ড বললেন, শোনো। তোমরা, এসব বুনো এলাকায় কি করে বেঁচে থাকতে হয় জানা আছে তো?

.

০৩.

কতটা বেশি ঠাণ্ডা পড়বে এখানে? বাবাকে জিজ্ঞেস করল রবিন।

উষ্ণ রোদে আরাম করে বসে আছ দুজনে। কিশোর আর মুসা পানি রাখার জন্যে একটা পাত্র পাওয়া জায় কি-না খুঁজে দেখতে গেছে বিমানের ভেতরে। মেডিক্যাল কিটও দরকার।

আবহাওয়া এখন ততটা খারাপ হবে না, মিলফোর্ড বললেন। আগস্ট মাস তো, ঠাণ্ডায় জমে মরার ভয় নেই। রাতে তাপমাত্রা চল্লিশের নিচে নামবে বলে মনে হয় না।

চল্লিশ! ভুরু ওপর দিকে উঠে গেল রবিনের। ঠাণ্ডাই তো!

তা একরকম ধরতে পারো, হাসলেন মিলফোর্ড। হাজার হোক ক্যালিফোর্নিয়া…

হ্যাঁ, ক্যালিফোর্নিয়া তো বটেই, মুসা বলল। বিমানের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে এগোনোর সময় মিলফোর্ডের কথা কানে গেছে তার। যত সব গণ্ডগোলের আখড়া। আবহাওয়ার কোন ঠিকঠিকানা নেই। মুসার হাতে একটা ধাতব বাক্স।

শীত সহ্য করার মত শরীর নয় আমাদের, কার বিরুদ্ধে অভিযোগ করল রবিন সে-ই জানে।

মুসার পেট গুড়গুড় করে উঠল। ক্ষুধা সহ্য করার মতও নয়। ভাবছিলাম, ডায়মণ্ড লেকে গিয়ে পেট পুরে ভেড়ার কাবাব খাব। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাত নাড়ল সে। গেল সব!

একমত হয়ে মাথা জাঁকালেন ফিলফোর্ড আর রবিন। খিদে তাঁদেরও পেয়েছে।

ডায়েট কন্ট্রোল করা ছাড়া আর কিছু করার নেই আপাতত, বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল রবিন।

দেখো, কিশোর কি বলে? করুণ হাসি ফুটল মুসার ঠোঁটে। কিছু একটা আবিষ্কার করেই ফেলবে–মনে নেই, প্রশান্ত মহাসাগরের মরুদ্বীপে…

হ্যাঁ, তা তো আছেই। পিঁপড়ের ডিম আর শুয়াপোকা খাওয়াবে আর কি শেষে… বিমান দুর্ঘটনা।

বাধা দিয়ে মিলফোর্ড বললেন, অতটা নিরাশ হচ্ছ কেন? বেরিয়ে যাওয়ার একটা না একটা ব্যবস্থা হবেই। আমাদের মে-ডে কারও কানে যেতেও পারে। ওয়ান টোয়েন্টি ওয়ান পয়েন্ট ফাইভ মেগাহার্টজে এখন ব্রডকাস্ট চলছে।

আপনি শিওর? ভরসা করতে পারছে না মুসা। সত্যিই চলছে রেডিওটা?

চলার তো কথা। ব্যাটারিতে চলে। জোরে ধাক্কা কিংবা বাড়ি খেলেই আপনাআপনি চালু হয়ে যায়। এমনও শোনা গেছে, হাত থেকে টেবিলের ওপর। পড়ে গেলেও চালু হয়ে যায়।

নীল আকাশের দিকে তাকালেন তিনি। অনেক ওপরে ধোয়ার হালকা একটা সাদা রেখা চোখে পড়ছে। একটা জেট বিমান যাওয়ার চিহ্ন। সেদিকে তাকিয়ে থেকে মিলফোর্ড বললেন, ওখান থেকে আমাদেরকে দেখতে পাবে না, ঠিক, তবে আমাদের এস ও এস শুনতে বাধা নেই।

অনেক দূরে চলে গেছে বিমানটা। ছোট হয়ে এসেছে, মিলিয়ে যাবে যে কোন মুহূর্তে। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে হাসল রবিন। অনেকটা স্বস্তি পাচ্ছে এখন। পরিস্থিতি খারাপ সন্দেহ নেই, কিন্তু তার বাবা এমন সহজ ভঙ্গিতে কথা বলছে, হতাশা অনেকটাই কেটে গেছে ওর। আশা হচ্ছে এখন, ওদেরকে উদ্ধার করতে আসবেই কেউ না কেউ। মুসার হাতের বাক্সটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি ওটা?

ইমারজেন্সি কিট। অনেক জঞ্জালের ভেতর থেকে বের করেছি। দেখো না, কি ধুলো লেগে আছে।

হু।

বাক্সটা খোলা হলো। ভেতরে রয়েছে অ্যাসপিরিন, বায়োডিগ্রেডেবল সোপ, ব্যাণ্ডেজ, মসকুইটো রিপেলেন্ট, স্কিন অ্যানটিবায়োটিক, পানি পরিশোধিত করার আয়োডিন পিল, এক বাক্স দিয়াশলাই, আর ছয়টা হালকা স্পেস ব্ল্যাঙ্কেট। চকচকে এক ধরনের জিনিস দিয়ে এত পাতলা করে বানানো, ভাঁজ করে নিলে খুব অল্প জায়গার ভেতরে ভরে রাখা যায়।

দিয়াশলাই! খুশি হয়ে উঠেছে রবিন, যাক, আগুনের ব্যবস্থা হয়ে গেল।

আয়োডিন পিল আছে যখন, মিলফোর্ড বললেন, খাবার পানিও পেয়ে যাব।

এগুলো দেখে তো মনে হচ্ছে মহাকাশচারীদের কাজে লাগে, একটা স্পেস ব্ল্যাঙ্কেট খুলল মুসা। একটা ধার ঢুকিয়ে দিল টি-শার্টের গলা দিয়ে। ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি মনে হয়? রক স্টারের মত লাগছে?

জবাব দিল না রবিন। ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বাবার কপালের জখমটায় পরিষ্কার করে ব্যাণ্ডেজ বাধল। কাটাটা খুব বেশি না, তবে বাড়িটা লেগেছে বেশ জোরেই। অনেকখানি উঁচু হয়ে ফুলে গেছে। বেগুনী রঙ।

ফোলা মাংসে আঙুল দিয়ে চাপ দিল রবিন। উহ করে উঠলেন মিলফোর্ড। বেশি ব্যথা লাগছে? জিজ্ঞেস করল রবিন। বেশি খারাপ লাগলে শুয়ে পড়ো। মাথায় বাড়ি লাগা ভাল না! বমি বমি লাগছে? মাথা ঘোরে…

একেবারে ডাক্তার হয়ে গেলি যে রে! হেসে বললেন মিলফোর্ড। রেড ক্রসের ট্রেনিং নিয়ে ভালই হয়েছে…।

আমারও তাই বিশ্বাস। এখন চুপ কর তো! খারাপ লাগলে শুয়ে পড়।

ব্ল্যাঙ্কেটটা আবার আগের মত ভাজ করে রেখে দিল মুসা। তারপর রওনা। হলো তৃণভূমির কিনারে, আগুন জ্বালানোর জন্যে লাকড়ি জোগাড় করতে। প্রথমে। যেখানটায় আশ্রয় নিয়েছিল, বিমান বিস্ফোরিত হলে আত্মরক্ষার জন্যে, সেখানটায় এসে জড় করল কাঠকুটো। আগুন যদি জ্বালতেই হয়, জ্বালবে বিমান আর ট্যাঙ্কের পেট্রোল থেকে দূরে। সাবধান থাকা ভাল।

সেসনার ভেতরে রয়েছে এখনও কিশোর। একটা পানির পাত্র খুঁজছে। আচমকা চিৎকার উঠল, অ্যাই, শুনছ তোমরা, একটা গোলমাল হয়ে গেল!

বিমানের কাছে দৌড়ে এল মুসা আর রবিন। ওদের পেছনে এলেন মিলফোর্ড।

যন্ত্রটা, গম্ভীর হয়ে বলল কিশোর, কাজ করছে না। মে-ডে পাঠানোর কথা যেটার।

কেন? জানতে চাইলেন মিলফোর্ড।

বাক্সটা খুলল কিশোর। লাল একটা আলো জ্বলে-নিভে সঙ্কেত দেয়ার কথা। ওটা দেখে বোঝা যায় যে, সঙ্কেত দিচ্ছে যন্ত্রটা। তারটার আর কানেকশনগুলো। ঠিকই আছে। গোলমালটা ব্যাটারির। মনে হয় ডেড।

ডেড? হতাশার ভঙ্গিতে প্রতিধ্বনি করল যেন রবিন।

তার মানে সাহায্য চেয়ে সিগন্যাল পাঠাচ্ছে না? মুসাও খুব হতাশ। বড় বড় হয়ে গেছে চোখ।

ব্যাটারি না থাকলে পাঠাবে কি করে? প্রশ্নটা যেন নিজেকেই করল কিশোর।

খাইছে! হাতের আঙুলগুলো মুঠোবদ্ধ হয়ে গেল মুসার। বেড়ে যাচ্ছে। হৃৎপিণ্ডের গতি, অ্যাড্রেনালিন পাম্প করতে আরম্ভ করেছে। কি সাংঘাতিক বিপদে পড়েছে বুঝতে পারছে।

প্রথমে গেল ইলেকট্রিক সিসটেম, আনমনে মাথা নাড়ছে রবিন, এখন ব্যাটারি! অসুস্থই বোধ করছে সে।

গেলাম তাহলে আমরা! মুসা বলল।

ইলেকট্রিক্যাল সিসটেম মাঝে মাঝে খারাপ হয়, মিলফোর্ড বললেন, যদিও খুব রেয়ার। কানেকশনে গোলমাল থাকলে হয়। তবে ব্যাটারি খারাপ হয় না, ফুরিয়ে যায়। বদলে নিলেই হয়। আসলে, চেক করেনি, নতুন ব্যাটারিও আর লাগায়নি। ভুলের জন্যেই এটা ঘটল।

আর এই ভুলের কারণেই মরতে বসেছি আমরা, তিক্ত কণ্ঠে বলল মুসা।

কিন্তু কিছু করার নেই। পাইনের বন থেকে শিস কেটে বেরিয়ে আসছে বাতাস, বয়ে যাচ্ছে বিশাল ঘেসো প্রান্তরের বুকে ঢেউ খেলিয়ে। ওদের পেছনে ঝকঝকে পরিষ্কার নীল আকাশে মাথা তুলে রেখেছে পর্বতের চূড়া।

বেহশত, আবার আনমনে মাথা নাড়তে লাগল রবিন সেদিকে তাকিয়ে।

দেখেই মজে যাওয়ার কোন কারণ নেই, সাবধান করলেন মিলফোর্ড। শোননি, স্বর্গেও সাপ থাকে।

আমি মজিনি, কিশোর বলল। এখানে কি কি থাকতে পারে, ভাল করেই জানি। বিষাক্ত সাপ, হিংস্র মাংসাশী জানোয়ার, ভূমিধস, দাবানল, বজ্রপাত, আর আরও হাজারটা বিপদ ওত পেতে আছে। ফল ধরে থাকতে দেখা যাবে গাছে গাছে, দেখলেই খেতে ইচ্ছে করবে, কিন্তু খেলেই মরতে হবে, এতই বিষাক্ত।

আচ্ছা, হঠাৎ যেন আশার আলো দেখতে পেল রবিন, বাবা, ডায়মণ্ড লেকে যার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছ, সে কি করবে? সময়মত তুমি না পৌঁছলে কিছু করবে না?

হয়তো করবে। ফোন করবে আমার অফিসে। ও না করলে আর কেউ করবে না। বাড়িতে বলে এসেছি আমরা সবাই, দিন তিনেক লাগতে পারে। তিন। দিন না গেলে কেউ খবর নেয়ার কথা ভাববেই না।

বাহ, চমৎকার! বিড়বিড় করল মুসা।

মুসা, অত ভেঙে পড়ছ কেন? এ রকম পরিস্থিতিতে অনেক পড়েছ তোমরা। দুর্গম জায়গায় আটকা পড়েছ, বেঁচে ফিরেও এসেছ। এসব অবস্থায় প্রথমে কি করা উচিত?

প্রথমে দেখা দরকার, কি কি জিনিস আছে আমাদের কাছে। আমার কাছে আছে গায়ের এই পোশাক।

মুসার পরনে জিনস, পায়ে টেনিস শু, গায়ে কালো টি-শার্ট, বুকে সোনালি অক্ষরে বড় বড় করে লেখাঃ পিঙ্ক ফ্লয়েড। একটা জ্যাকেট আছে, একটা ছোট ছুরি আছে, সুটকেসে আরও কিছু কাপড় আছে। রবিন আর কিশোরকে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের কাছে কি আছে?

আমার কাছেও এইই, রবিন বলল। ওর জিনসে রয়েছে ক্যালভিন ক্লেইন, আর টি-শার্টে ব্যানানা রিপাবলিক মিনিস্টার অভ কালচার-এর মনোগ্রাম। ছুরিটা বাদ।

আমার কাছেও ছুরি নেই, মিলফোর্ড বললেন। তার পরনে জিনসের প্যান্ট আর শার্ট, মাথায় ক্যাপ।

ক্যাম্পিঙের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সহ একটা ব্যাকপ্যাক থাকলে এখন খুবই ভাল হত, ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। তবে মনে হয় তিনটে দিন কাটিয়ে দিতে পারব কোনমতে। প্রতিকূল পরিবেশ, খাওয়াও তেমন জুটবে বলে মনে হয় না, তবু…

তেমন জুটবে, না মানে? কথাটা ধরল রবিন। তার মানে কিছু খাবার তোমার কাছে আছে?

মাথা নাড়ল কিশোর, না, খাবার আমার কাছে নেই, তবে…

তবে কি? তর সইছে না মুসার। জলদি বল!

যে ভাবে বলছ, কিশোর বলল, ধরেই নিয়েছ, খাবার আছে আমার কাছে।

না হলে বললে কেন?

হ্যাঁ, বাবাআ, মিলফোর্ডও অধৈর্য হয়ে উঠছেন, থাকলে বের কর না!

শ্রাগ করল কিশোর। আসছি, বলে গিয়ে ঢুকে পড়ল বিমানের ভেতরে।

এত দেরি কেন? বাইরে থেকে ডেকে বলল মুসা, মাইক্রোওয়েভে খাবার তৈরি করছ নাকি?

একটা ডাফেল ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এল কিশোর। টকটকে লালের ওপর সাদা সাদা ডোরা। চট করে চোখে পড়বার জন্যে বেশ কায়দা করে লেখা রয়েছেঃ আই কেম ফ্রম, পিজা হ্যাঁভেন, ই। কাগজে মোড়া কিছু হালকা খাবার আর ক্যাণ্ডি বের করল সে।

দাও দাও, জলদি দাও! হাত বাড়াল মুসা। আর পারি না…

খাবারগুলো ভাগাভাগি করে নিল ওরা। সাধারণ জিনিস, এখন সেগুলোই রাজকীয় মনে হলো।

এগুলো আনতে গেলে কেন? ক্যাণ্ডিতে কামড় বসিয়ে জিজ্ঞেস করল রবিন।

মনে করলাম, কিশোরের জবাব, প্লেনে যদি খিদে লাগে। নিয়ে নিলাম।

খুব ভাল করেছ, মুসা বলল। জীবনে যে কটা সত্যিকারের ভাল কাজ করেছ, তার মধ্যে এটা একটা।

তার কথার ধরনে হাসলেন মিলফোর্ড। হ্যাঁ, বি থাকলে বুদ্ধিটাও খোলে।

সেটা খোলানর জন্যেই যেন খাওয়া শেষ করার পর বিমানের গায়ে হেলান দিয়ে চোখ মুদে ভাবতে শুরু করল কিশোর।

নিজের ভাগের খাবার চেটেপুটে খেয়ে মিলফোর্ড বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ, কিশোর। খাবার যা বাকি আছে, যত্ন করে রেখে দাও। তিনদিন ধরে অল্প অল্প। করে খেতে হবে। বলা যায় না, তিনদিনের বেশিও থাকতে হতে পারে আমাদের।

ওঠা যাক এবার, মুসা বলল। বসে থাকলে হবে না। ঘুরে দেখে আসা। দরকার, আশেপাশে ঘরবাড়ি, আছে কি-না। রেঞ্জারের কেবিন থাকতে পারে। কিংবা ক্যাম্পগ্রাউণ্ড, কিংবা রাস্তা। পানিও লাগবে আমাদের। লাকড়ি কুড়ানোর সময় পানির শব্দ শুনছিলাম। কাছেই কোথাও ঝর্না আছে। হাত তুলে দক্ষিণ পশ্চিম দিকে দেখাল সে। ঝর্নার ধারেই করা হয় ক্যাম্পগ্রাউণ্ডগুলো, কাজেই…

..থাকলে ওদিকটায় থাকতে পারে, কথাটা শেষ করে দিল কিশোর। বিমানের ভেতর থেকে দুই কোয়ার্টের একটা প্লাস্টিকের বোতল বের করে এনে মুসাকে দিয়ে বলল, এটা নিয়ে যাও। পানি আনতে পারবে।

কমলার রস ছিল বোতলটায়, এখন খালি। আগ্রহের সঙ্গে সেটা হাতে নিয়ে মুসা বলল, গুড। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল ওটা, ফুটোটুটো আছে কিনা। নেই। রবিনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, নাও। সাবান দিয়ে ভাল করে ধুয়ে তারপর পানি ভরবে। আয়োডিন পিল ফেলে দেবে ভেতরে, যাতে নিশ্চিন্তে খাওয়া যায়।

বোতলটা নিল রবিন। তুমি কি করবে?

দক্ষিণে হাত তুলল আবার মুসা। ওদিকে বনের ভেতরে একটা পায়েচলা পথ। ঢুকে গেছে দেখেছি। বুনো জানোয়ার চলার পথ হতে পারে। বলা যায় না, কপাল। খুলেও যেতে পারে। হয়ত মানুষেই তৈরি করেছে ওটা।

ভাল বলেছ, মিলফোর্ড বললেন। যাও, দেখ গিয়ে। আমি ওটাতে চড়ব। তৃণভূমির উত্তর ধার দিয়ে চলে যাওয়া গ্র্যানিটের দেয়ালটা দেখলেন তিনি। একপাশে বেশ ঢালু, চূড়ায় চড়া সহজ। ওপর থেকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাবে। কি আছে না আছে দেখতে পারব।

পারবে? রবিন বলল, ভাল লাগছে কিছুটা?

পারব।

কিশোর কি করবে সেটা জানার জন্যে তার দিকে তাকাল তিনজনে।

প্রশ্ন করতে হলো না, কিশোর নিজে নিজেই বলল, আ-আমার মনে হয়…আমার এখানে থাকাই ভাল। কেউ যদি চলে আসে, তাকে বলতে হবে তো আমরা আছি এখানে, চলে যাইনি।

আরও লাকড়ি দরকার আমাদের, মুসা বলল। ভেজা লাকড়ি। বেশি করে জমিয়ে আগুন ধরিয়ে দিলে অনেক ধোয়া বেরোবে। সঙ্কেত দিতে পারব। স্মোক সিগন্যাল। এই কাজটা তুমি করতে পার, প্লেনের কাছ থেকে দূরে যাওয়া লাগবে না। আরও একটা কাজ, আমাদের সবার সুটকেস থেকেই কিছু কাপড় বের করে তিন-চারটা গাছের মগডালে পতাকার মত উড়িয়ে দিতে পার। আরেক ধরনের সিগন্যাল হয়ে যাবে।

মুসার কথা কিশোর শুনছে বলে মনে হলো না, বিমানের গায়ে হেলান দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে শূন্য দৃষ্টিতে কাজ করার ইচ্ছে নেই, না গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে, বোঝা গেল না। মুসা বলেই চলেছে, তারপর, পাথর টেনে মাঠের মাঝে সেগুলো সাজিয়ে এস ও এস লিখবে, যাতে ওপর থেকে কোন প্লেনের চোখে পড়লে বুঝতে পারে এখানে গোলমাল হয়েছে।

গুঙিয়ে উঠল কিশোর। কাঠ দিয়ে একটা কেবিন বানানোর কথাটা আর বাকি রাখলে কেন?

হেসে উঠল অন্য দুজন, রবিন আর তার বাবা।

লাকড়ি কুড়াতে রাজি আছি আমি, নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল কিশোর। আর কিছু পারব না।

তাহলে অনেক বেশি করে আনতে হবে, মুসা বলল। কম হলে চলবে না। অনেক বড় ধোয়া হওয়া চাই…

আসলে আমার বসে থাকাটা সহ্য করতে পারছ না তুমি…

কিছু বলতে যাচ্ছিল মুসা, হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে রবিন বলল, মুসা, তুমি আসল কথাটাই ভুলে যাচ্ছ। আমাদেরকে খাইয়েছে ও। কাজেই এখন ওর কাজগুলো ভাগাভাগি করে আমাদেরই করে দেয়া উচিত। না কি বলো?

তাই তো। এতক্ষণে যেন টনক নড়ল মুসার। চুপ হয়ে গেল। মাথা চুলকে আমতা আমতা করতে লাগল, ইয়ে…মানে…ইয়ে…

হেসে ফেলল এবার কিশোর। মুসাও হাসল। চলি।

হুঁশিয়ার করলেন মিলফোর্ড, চিহ্ন দিয়ে দিয়ে যেও কিন্তু। নইলে বনের ভেতর পথ হারিয়ে ফেলবে।

তৃণভূমির কিনারে এসে আলাদা হয়ে গেল রবিন আর মুসা। দক্ষিণ-পশ্চিমে ঘুরে পাইন বনে ঢুকে পড়ল রবিন। পানির মৃদু শব্দ কানে আসছে তার। সেদিকেই চলল। মুসা ঢুকল দক্ষিণ-পুবের সরু পায়ে চলা পথটা ধরে।

মা বাবার কথা মনে আছে রবিনের। চিহ্ন রেখে যাওয়া দরকার। আশপাশে কোথায় কি আছে না আছে ভাল করে দেখে দেখে চলতে হয়, বনে চলার এটাই নিয়ম, বিশেষ করে অপরিচিত এলাকায়। একটা ট্রিপল পাইন চোখে পড়ল তার। একই জায়গা থেকে তিনটে চারাগাছ গজিয়েছিল, একই গোড়া থেকে, গায়ে গায়ে লেগে সেগুলো এখন একটা হয়ে গেছে। এটা একটা ভাল চিহ্ন। ওরকম ট্রিপল পাইন খুব কম দেখা যায়। তারপর সে পেরোল একটা চ্যাপ্টা পাথর, মাঝখানটা। গামলার মত, বেশ বড়। আদিম ইণ্ডিয়ানরা সম্ভবত পাথর দিয়ে ওখানে কোন ধরনের বাদাম গুড়ো করে আটা তৈরি করত। আরও কিছু চিহ্ন মনে গেঁথে রাখল। সে। অবশেষে খুঁজে পেল পথটা। দেখেটেখে মনে হল জানোয়ারই চলাচল করে। সেই পথ ধরে এগোল সে। কানে আসছে পানির শব্দ, বাড়ছে ক্রমেই।

তারপর হঠাৎ করেই চোখে পড়ল ওটা, বিশ ফুট চওড়া অগভীর একটা নদী। পানিতে বড় বড় পাথর আর ডালপালার ছড়াছড়ি, নদীর বুকে বিছিয়ে রয়েছে নুড়ি। যেখানটায় রোদ পড়ছে চকচক করছে পানি, আর বনের ভেতর দিয়ে যেখানে গেছে, গাছপালার ছায়া পড়েছে, কালো হয়ে আছে সেখানে। টলটলে পরিষ্কার পানি, নিশ্চিন্তে খাওয়া যায় মনে হয়।

বায়োডিগ্রেডেবল সাবান দিয়ে কমলার রসের বোতলটা ভালমত ধুয়ে নিল রবিন। ঝাড়া দিয়ে ভেতরের পানির কণা যতটা সম্ভব ফেলে দিয়ে পরে রোদে শুকিয়ে নিল। পানি ভরে তাতে আয়োডিন পিল ফেলে দিল।

উঠে দাঁড়িয়ে পাহাড়ী নদীর এপাশ ওপাশ ভাল করে দেখতে লাগল সে। লোকজন কি আছে? ক্যাম্পগ্রাউণ্ড থাকলে নদীর পাড়েই কোথাও আছে। কোথায়? উজানে, না ভাটিতে?

বিমান থেকে দেখা উপত্যকাটার কথা ভাবল সে। তৃণভূমির পশ্চিমেই কোথাও রয়েছে। ওর অনুমান ঠিক হলে এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার উত্তরে থাকবে উপত্যকাটা। এত সুন্দর একটা জায়গায় ক্যাম্পগ্রাউণ্ড থাকাটা স্বাভাবিক।

উজানের দিকে রওনা হল রবিন। নদীর তীর ধরে। বড় পাথর আর গাছপালা পড়ছে মাঝে মাঝেই, ঘুরে ওগুলো পার হয়ে আসছে। কোথাও কোথাও জন্মে আছে কাটাঝোপ, কোথাও বা জলজ উদ্ভিদ পানি থেকে উঠে এসেছে পাড়ের ভেজা মাটিতে। যতই এগোচ্ছে পানির শব্দ বাড়ছে।

কয়েকটা লাল ম্যানজানিটা গাছ জটলা করে জন্মে রয়েছে এক জায়গায়, সেটার পাশ ঘুরে একটুকরো খোলা জায়গায় বেরোল সে। নদীতে এখানে তীব্র স্রোত। ওপর থেকে অনেকটা জলপ্রপাতের মত ঝরে পড়ছে পানি।

অপরূপ দৃশ্য। কোটি কোটি মৌমাছির মিলিত গুঞ্জন তুলে পড়ছে পানি, অসংখ্য ঘূর্ণিপাক তৈরি করে ছুটে চলেছে ভাটির দিকে।

বাতাসে পানির কণা। ভেজা বাতাসে শ্বাস নিতে হচ্ছে রবিনকে। জলপ্রপাত থেকে ধীরে ধীরে ওপর দিকে দৃষ্টি ভুলতে লাগল সে। নাটকীয় ভঙ্গিতে প্রপাতের দুদিক থেকে উঠে গেছে উঁচু পাহাড়ের চূড়া। কঠিন পাথরে গভীর নালা কেটে দিয়েছে পানি।

বিমান থেকে দেখা প্রপাতটা যদি এটাই হয়, তাহলে উপত্যকাটা রয়েছে। পাহাড়ের ওই পাশেই। দেখতে হলে ওই পাহাড়ে চড়তে হবে, পাথরের দেয়াল বেয়ে। প্রশ্ন হলো, কোনখান থেকে শুরু করবে?

গ্র্যানিটের দেয়ালে একটা জায়গা দেখা গেল, যেখানে পাথরে চিড় ধরে আছে, পা রাখা যাবে ওখানটায়। পানির বোতলটা রেখে, পাথরের একটা স্তূপ পেরিয়ে চিড়টার কাছে চলে এল সে। উঠতে শুরু করল দেয়াল বেয়ে। পা লাগলেই খসে যাচ্ছে আলগা পাথর, ঠোকর খেতে খেতে নেমে যাচ্ছে নিচে। পা ফসকালে রবিনকেও ওভাবেই পড়তে হবে, কাজেই সাবধান রইল। খুব ধীরে, দেয়ালের গা থেকে বেরিয়ে থাকা শেকড় ধরে, পাথরের খাঁজে পা রেখেই উঠে চলল সে।

হঠাৎ করেই ঘটল ঘটনাটা।

ওপর থেকে কয়েকটা ছোট ছোট নুড়ি এসে পড়ল তার মাথায়। গুমগুম শব্দ কানে এল।

ওপরে তাকাল সে। বিশাল এক পাথর নেমে আসছে, সঙ্গে নিয়ে আসছে ছোট বড় আরও একগাদা পাথর, মাটি, ধুলো, ওর সামান্য ডানে।

ধস নেমেছে পাহাড়ে! ধেয়ে আসছে তাকে থেঁতলে দেয়ার জন্যে।

০৪.

গতি বাড়ছে ধসের। পিছানর উপায় নেই, আতঙ্ক চেপে ধরল যেন রবিনকে। ধসের পথেই রয়েছে। জলদি সরে যেতে না পারলে নিশ্চিত মৃত্যু। ভাবনারও সময় নেই।

থাবা দিয়ে বায়ের একটা খাঁজ আকড়ে ধরল সে। সরে যেতে শুরু করল। কপালে ঘাম। চোখ জ্বালা করছে। নাকে ঢুকছে বালি।

মরিয়া হয়ে উঠেছে রবিন। যত দ্রুত সম্ভব সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে।

বাড়ছে গুমগুম শব্দ।

অনেকটা সরে এসেছে সে। এই সময় পাশ দিয়ে ভারি গর্জন করতে করতে নেমে যেতে লাগল ধস। পাথরের খুদে কণা। তীব্র গতিতে এসে সুচের মত বিধছে চামড়ায়।

ধসটা নেমে গিয়ে জমা হল নিচের পাথরের স্তূপের সঙ্গে। তার মানে মাঝে মাঝেই ধস নামে ওই জায়গাটায়, স্থপটা ওভাবেই হয়েছে। পাহাড়ের চূড়াটা ওখানে নড়বড়ে, যে কোন ধরনের চমক ধসিয়ে দিতে পারে ওটাকে–একটা, পার্বত্য সিংহ লাফিয়ে উঠলে, একটুখানি ভূকম্পন হলে, কিংবা রোদ-বাতাস বৃষ্টিতে ক্ষয়ে যাওয়া একটা পাথর, চূড়ার নিচ থেকে খসে গেলেই টলে উঠবে চূড়াটা। ওখানে চড়তে যাওয়াটা মোটেও নিরাপদ নয়।

ধড়াস ধড়াস করছে রবিনের বুক। চোখ মুদল সে। একটু আগের আতঙ্কের রেশ পুরোপুরি কাটেনি এখনও।

কিন্তু চিরকাল তো আর এখানে এভাবে থাকা যাবে না।

চোখ মেলল সে। আশপাশে তাকাল। কি করবে? ওপরে উঠবে? নিচে নামবে?

এই সময় অদ্ভুত একটা দৃশ্য চোখে পড়ল তার। হাত রাখার জায়গা, না পা রাখার জায়গা? দুটোই মনে হচ্ছে। পাথর কুঁদে তৈরি প্রাকৃতিক নয়। প্রাকৃতিক কারণে ওভাবে তাক তৈরি। হতে পারে না। ঠিক তাকও বলা যাবে না। পাথরের দেয়ালে এমন ভাবে তৈরি হয়েছে ওগুলো, যাতে হাত দিয়ে চেপে ধরে পা রেখে বেয়ে ওঠা যায়।

এখনও কাঁপুনি থামেনি রবিনের। হাত বাড়ালেই তাক ধরতে পারে সে। তা ই করল। যেখানে ছিল, সেখান থেকে সরে চলে এল তাকের সারিতে। সুন্দর ভাবে ওপরের একটা খাজ ধরে নিচের একটায় পা রাখতে পারল। দেয়ালে ওঠার এক ধরনের সিঁড়ি। আরও ভালমত দেখতে পাচ্ছে এখন। বিপজ্জনক জায়গা ধরে। বহুদূর পর্যন্ত উঠে গেছে, বাঁয়ের খাড়া চুড়ার কাছাকাছি। গ্যানিট কেটে যে ইনডিয়ানরা বাদাম গুড়ো করার গর্ত করেছে তারাই হয়ত পাহাড়ে চড়ার জন্যে তৈরি করেছিল এই সিঁড়ি।

ঘড়ি দেখল রবিন। দেরি হয়ে যাচ্ছে। অন্যেরা নিশ্চয় তার ফেরার অপেক্ষায় আছে।

দেয়ালে পেট ঠেকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল সে। পৌঁছে গেল জলপ্রপাতের সামান্য ওপরের একটা জায়গায়। বাতাসে পানির কণা এখানে অনেক বেশি, প্রপাত থেকে উঠছে। মনে হয় হালকা বাষ্প ভাসছে বাতাসে।

আরেকটু পাশে সরে একটা নালার কাছে চলে এল সে। পানির ঘষায় সৃষ্টি হয়েছে ওটা। উঠে গেছে ওপর দিকে। ওখানে আসতেই চোখে পড়ল উপত্যকাটা। বিমান থেকে যেটা দেখেছিল সেটাই। ঘন গাছের জঙ্গল। কিছু কিছু জায়গায় অনেক চওড়া, কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে এখান থেকে দেখতে পাচ্ছে না সে। মাথার ওপরে গ্র্যানিটের গায়ে রোদ চমকাচ্ছে। উপত্যকার বুক চিরে চলে গেছে পাহাড়ী নদী। কিন্তু ওটার পাড়ে ক্যাম্পগ্রাউণ্ড চোখে পড়ল না তার, যেটা আশায় এসেছিল।

উত্তর থেকে বাতাস বইছে। বয়ে আনছে গন্ধকের কটু গন্ধ, যার অর্থ, পর্বতের ভেতরে গরম পানির ঝর্না আছে কোথাও। চোখ জ্বালা করছে এখনও ওর, বোধহয় গন্ধকের জন্যেই। হাত দিয়ে ডলে মুছে নিয়ে আবার তাকাল উপত্যকার দিকে।

মনে হচ্ছে, যেন বহুকাল আগে বিমান থেকে দেখেছিল জায়গাটা। তার পর কত ঘটনা ঘটে গেছে। কপালজোরে বেঁচে রয়েছে এখনও।

আর দেখার কিছু নেই আপাতত। সিঁড়ি বেয়ে আবার নামতে শুরু করল সে। যেখানে আরেকটু হলেই ধসের আঘাতে মরতে চলেছিল সেই জায়গাটা পেরিয়ে। এল। তারপর পেরোল সরু একটা শৈলশিরা, ঘন ঝোপঝাড় জন্মে রয়েছে ওখানে।

সিঁড়িটার কথা ভাবছে সে। নিচে থেকে চোখে পড়ে না। কোন্ রহস্যময় কারণে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখার মত করে তৈরি করেছিল ইনডিয়ানরা কে জানে! প্রপাতের আশপাশের খোলা অঞ্চলে দাঁড়ালে সামনে বাধা হয়ে থাকে পাইন বন, ওই বনের জন্যেই ওখান থেকে দেখা যায় না সিঁড়িটা।

কয়েক ফুট ওপর থেকে লাফিয়ে বনতলে নামল রবিন। আবার ঘড়ি দেখল। এবার সত্যি অনেক দেরি হয়ে গেছে।

দৌড়ে এল পানির বোতলটা যেখানে রেখেছিল সেখানে। তুলে নিয়ে আবার দৌড়ে চলল বনের ভেতর দিয়ে। চিহ্ন ভুল করল না।

অবশেষে চোখে পড়ল তৃণভূমিটা, যেখানে নামতে বাধ্য করা হয়েছে সেসনা। সূর্য ডুবতে আর ঘণ্টাখানেক বাকি। ক্লান্তি লাগছে রবিনের। উত্তেজিত। কি দেখেছে, কি ভাবে ধস থেকে বেঁচে এসেছে সবাইকে বলার জন্য অস্থির।

.

রবিনের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে সরু পথটা ধরে এগোল মুসা। যা অনুমান। করেছিল, তা-ই। দক্ষিণ-পুবের ঘন বনের ভেতরে ঢুকে গেছে পথটা।

উঁচু গাছের ডালপালার ভেতর দিয়ে চুঁইয়ে নামছে সূর্যালোক, বনতলে উষ্ণ আলো আর শীতল ছায়া সৃষ্টি করেছে। বিচিত্র এক আলোআঁধারির খেলা চলছে। ওপরে গাছের মাথা, কোথাও এত গায়ে গায়ে লেগে গেছে যে আকাশই চোখে পড়ে না। মাটি আর পাইনের তাজা সুগন্ধে ভুরভুর করছে বাতাস।

পথটা ধরে প্রায় আধ ঘণ্টা চলল মুসা। বালুতে মানুষের পায়ের ছাপ খুঁজল। হরিণ, ব্ল্যাকুন আর কুগারের ছাপ দেখতে পেল। পথের ওপরে আর পথের ধারে হরিণ ও ভালুকের নাদা পড়ে আছে। হতাশ হল হাইকিং বুট কিংবা টেনিস–এর ছাপ না দেখে। ক্যাম্পফায়ারের ধোয়ার গন্ধ আশা করেছিল, পেল না। কান খাড়া রেখেছে জীপের ইঞ্জিনের শব্দ শোনার জন্যে, শুনল না। টেলিফোনের থাম দেখল না। মানুষের অস্তিত্ব ঘোষণা করে এরকম কিছুই নেই।

হঠাৎ কি যেন নড়ে উঠল। টের পেল সে। পেছন থেকে দ্রুত এগিয়ে আসছে। ওর দিকে। মানুষ, না জানোয়ার?

খসখস শব্দ কানে এল।

থমকে দাঁড়াল সে। কান পেতে রইল আরও শব্দের আশায়। সতর্ক হয়ে উঠেছে। আস্তে করে সরে চলে এল পথ থেকে, একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে তাকিয়ে রইল পথের দিকে।

এগিয়ে আসছে শব্দটা।

চলেও গেল এক সময়।

কিছুই দেখতে পেল না মুসা। ঘাড়ের রোম দাঁড়িয়ে গেল তার। কি…কি ওটা!

অ্যাই! আর থাকতে না পেরে চিৎকার করে ডাকল সে। জানোয়ার হলে ডাক: শুনে ছুটে পালাবে। মানুষ হলে থামবে, দেখতে আসবে কে ডাকছে। অ্যাই, শুনছেন?

জবাবের আশায় রইল মুসা। কেউ দৌড় দিল না। ঝোপঝাড় ভেঙে ছুটে পালাল না কোন জানোয়ার। সেই একই ভাবে খসখস শব্দ হয়েই চলেছে, মুসার ডাক যেন কানেই যায়নি।

শব্দের দিকে দৌড় দিল সে। কিছুদূর এগিয়ে গতি কমিয়ে কান পাতল শোনার জন্যে। আছে শব্দটা। থামেনি।

রাস্তা থেকে নেমে গাছপালার ভেতরে ঢুকে পড়ল সে। মুখে লাগছে পাইন নীডল। কেয়ারই করল না মুসা।

আরেকটু এগিয়েই দেখতে পেল মূর্তিটাকে। মানুষ। গাছপালার ভেতর দিয়ে ঘন ছায়ায় থেকে হাঁটছে, ফলে ভাল করে না তাকালে চোখেই পড়ে না।

অ্যাই, শুনুন! জোরে চিৎকার করে ডাকল মুসা, দৌড় বন্ধ করেনি। শুনুন, কথা আছে! সাহায্য দরকার আমাদের!

দ্বিধা করল লোকটা। গতিও কমাল ক্ষণিকের জন্যে। পর মুহূর্তেই আরও বাড়িয়ে দিয়ে প্রায় ছুটতে শুরু করল। হারিয়ে যেতে চাইছে গভীর বনের ভেতরে।

মুসাও গতি বাড়িয়ে দিল। কি ধরনের লোক? সাহায্যের কথা শুনেও থামেনি, বরং পালিয়ে যেতে চাইছে?

কয়েকটা গাছের ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গেল লোকটা।

ছুটতে ছুটতে গাছগুলোর কাছে পৌঁছে গেল মুসা। ঘুরে অন্য পাশে এসে তাকিয়েই থমকে গেল। নেই! উধাও হয়ে গেছে ভূতুড়ে মূর্তিটা। মানুষ? নাকি ভূতপ্রেত! গায়ে কাঁটা দিল তার।

চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে মুসা। কান খাড়া। চোখের দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণ। না শুনল আর কোন শব্দ, না দেখতে পেল লোকটাকে। গেল কোথায়? শুয়ে পড়ল না তো মাটিতে? ঘন ঝোপের ভেতরে ঢুকে গেল?

আবার ডাক দিল সে, এই যে ভাই, শুনছেন! বিপদে পড়েছি আমরা! আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই! শুনছেন?

সাড়া নেই।

ও ভাই! আমি কিছু করব না আপনাকে…!

নীরবতা! খুঁজে বের করতেই হবে লোকটাকে, ভাবল মুসা।

খুঁজতে আরম্ভ করল সে। গাছপালার আড়ালে, ছায়ায়, ঝোপের ভেতরে।

মনে পড়ল সময়ের কথা। ঘড়ি দেখল। আরি, অনেক দেরি হয়ে গেছে! তাড়াতাড়ি ফেরা দরকার। কিন্তু কোনদিকে ফিরবে!

হায় হায়, কি গাধা আমি! নিজেকেই বকা দিল সে। পথটা যে কোথায়, কোন দিকে আছে, তা-ও বলতে পারবে না। উত্তেজিত হয়ে ছুটে আসার সময় নিশানা রাখতেও ভুলে গিয়েছিল।

পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল ওর। ভয়ে। কি বোকামিটা করেছে বুঝতে পারছে।

পথ হারিয়েছে সে!

.

০৫.

আস্তে আস্তে শ্বাস নিচ্ছে মুসা। শান্ত হও, বোঝাল নিজেকে। মাথা ঠাণ্ডা করো। নইলে বিপদ থেকে মুক্তি পাবে না। আসতে যখন পেরেছ এখানে, যেতেও পারবে। কি করে যাবে কেবল সেইটাই ভেবে বের কর এখন।

আবার ঘড়ি দেখল সে। সরে চলে এল এমন একটা জায়গায়, যেখানে বন মোটামুটি পাতলা, গাছের মাথার ফাঁক দিয়ে আকাশ চোখে পড়ে। এদিকে সরে ওদিকে সরে, এপাশে মাথা কাত করে ওপাশে মাথা কাত করে সূর্যটা দেখল সে। তারপর হিসেব শুরু করল।

তৃণভূমি থেকে রাস্তায় উঠে এসে দক্ষিণ পুবে রওনা হয়েছিল। রোদ পড়ছিল। তখন তার ডান কাঁধে। এখন নেমে গেছে সূর্য। উত্তর-পশ্চিমে যাওয়ার সময় তার বাঁ কাঁধের নিচের দিকে, প্রায় বুকে রোদ পড়ার কথা।

ঘন গাছপালায় ছাওয়া এই তরাই থেকে বেরিয়ে তৃণভূমিটা খুঁজে বের করা খুব মুশকিল। তবু, চেষ্টা তো করতে হবে।

সাবধানে হাঁটতে শুরু করল সে। বার বার মুখ তুলে তাকাচ্ছে সূর্যের দিকে। পাখি ডাকছে, গাছের পাতায় শিরশির কাঁপন তুলে বইছে বাতাস, ঝোপের ভেতর, হুটোপুটি করছে ছোট ছোট জীব। পায়ের কাছ থেকে সড়াৎ করে সরে যাচ্ছে। কাঠবেড়ালি, ইঁদুর, লাফিয়ে উঠে ছুটে পালাচ্ছে খরগোশ।

এক ঘণ্টা ধরে হাঁটল সে। কোন কিছুই তো চিনতে পারছি না, নিরাশ হয়ে নিজেকে বলল। একটা চিহ্ন, একটা নিশানা দেখছি না যেটা দেখে বোঝা যায় ঠিক পথেই চলেছি।

আরও নেমেছে সূর্য। বড় জোর আর এক ঘণ্টা, তার পরেই ডুবে যাবে। এই সময় বনের ভেতরে আবার শব্দ শুনতে পেল সে। ডেকে উঠতে যাচ্ছিল আবার, সময় মত সামলে নিয়ে চুপ হয়ে গেল। আগের বারও ডাকাডাকি করতে গিয়ে হুঁশিয়ার করেছে লোকটাকে, পালিয়েছে সে।

পা টিপে টিপে শব্দের দিকে এগোল এবার।

উত্তরে এগোচ্ছে সে। বাড়ছে শব্দ। লোকটা প্রথমবার যে রকম শব্দ করেছিল, তার চেয়ে বেশি লাগছে এখন।

থেমে গেল শব্দটা।

পাগল হয়ে গেলে নাকি! নিজেকে ধমক লাগাল মুসা। কোথায় তৃণভূমিটা খুঁজে বের করে নিরাপদ হবে, তা না, আবার এগিয়ে চলেছে শব্দ লক্ষ্য করে আরেকবার পথ হারানর জন্যে।

দ্বিধা করল সে। তবে একটা মুহূর্ত। তারপর আবার এগোল শব্দের দিকে।

হঠাৎ করেই থেমে গেল, যেন ব্রেক কষে।

খাইছে! রবিন! চিৎকার করে উঠল সে।

ফিরে তাকাল রবিন। সে-ও চমকে গিয়েছিল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ও, মুসা!

হাসতে লাগল মুসা। হো হো করে। পরিচিত একটা মানুষকে সামনে দেখে খুশি আর ধরে রাখতে পারছে না।

কি হয়েছে, মুসা? ওরকম করছ কেন?

জবাবে আরও জোরে হাসতে লাগল মুসা।

আরে কি হলো! পাগল হয়ে গেলে নাকি! ভুরু কুঁচকে বলল রবিন।

না! মাথা নাড়তে লাগল মুসা। আরও কিছু হো-হো-হো। না, পাগল হইনি। তোমাকে দেখে কি যে ভাল লাগছে!

কেন, আমাকে কি নতুন দেখলে নাকি?

নতুন না হলেও পরিচিত তো। ভূত নও যে গায়েব হয়ে যাবে।

এখানে আবার ভুত এল কোত্থেকে? আরও অবাক হয়েছে রবিন।

চলো, যেতে যেতে বলছি। তুমিও যখন এদিকেই আছ, তার মানে পথ ভুল করিনি। ঠিকই এগোচ্ছি। চলো।

হাঁটতে হাঁটতে সব কথা বলল মুসা।

ভূত? ভুল দেখনি তো? রবিন বলল।

না। ঠিকই দেখেছি।

হু! বনের ভূতে পেল শেষ পর্যন্ত তোমাকে, চিন্তিত ভঙ্গিকে বলল রবিন।

তোমার কথা বললে না? তুমি কি করে এলে? বলল রবিন।

ধস! বলো কি? বিশ্বাস করতে পারছে না মুসা। পাহাড়ে যেখানে সেখানে। তো এভাবে ধস নামে না! ভাগ্যিস সরে যেতে পেরেছিলে! নইলে ভর্তা হয়ে যেতে!

আলোচনা করতে করতে চলল দুজনে। হঠাৎ হাত তুলে রবিন বলল, দেখো দেখো, কিশোর আমাদের চেয়ে আরামে আছে। কোন রকম বিপদে পড়তে হয়নি। তো। যা ধোয়া করছে, কাছাকাছি কেউ থেকে থাকলে চোখে পড়বেই।

মুসাও দেখতে পাচ্ছে। কালো ধোয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠে যাচ্ছে ওপরে।

আগুনের কাছ থেকে কিছু দূরে বসে রয়েছে কিশোর। সূর্য ঢলে যেতেই শীত পড়তে আরম্ভ করেছে। জ্যাকেট গায়ে দিয়েছে সে। চেন টেনে দিয়েছে একেবারে গলা পর্যন্ত। ধোয়া করেই শুধু ক্ষান্ত হয়নি। রাতে শোয়ার ব্যবস্থাও করে ফেলেছে। আগুনের কুণ্ড ঘিরে ছয় ফুট জায়গার পচা পাতা, ঘাস আর পড়ে থাকা অন্যান্য জিনিস সাফ করেছে। লতাপাতা জোগাড় করে এনে রেখেছে বিছানা পাতার জন্যে।

কি ব্যাপার? মুসা আর রবিনের দিকে তাকাতে লাগল কিশোর। হাটুরে। কিল খেয়ে এসেছ মনে হয়? মুখ ওরকম কেন?

আমাকে দেখে খুশি হয়েছে মুসা, আরেক দিকে তাকিয়ে জবাব দিল রবিন।

চোখ সরু হয়ে এল কিশোরের। মুসার দিকে দৃষ্টি স্থির। খুশির তো কোন লক্ষণ দেখছি না?

কি করলে লক্ষণটা বোঝা যাবে? রেগে গেল মুসা। দাঁত বের করে হি হি করে হাসতে হবে?

না, তা বলছিনে। তবে মনে হচ্ছে ভূতের তাড়া খেয়ে এসেছ।

তা অনেকটা ওই রকমই, রবিন বলল।

জ্যাকেট গায়ে দিয়ে এসে আগুনের পাশে বসে পড়ল মুসা আর রবিনও। হাত সেঁকতে সেঁকতে বলতে লাগল কি করে এসেছে। বেশ ভাল ঠাণ্ডা পড়ছে এখন।

চারপাশে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল রবিন, বাবা কই?

ফেরেনি তো, কিশোর জানাল।

অনেক আগেই চলে আসার কথা, উদ্বিগ্ন হলো রবিন। পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে বাবার কথা ভাবল। কপালের জখমটার কথা ভেবে উঠে দাঁড়াল সে। রওনা হয়ে গেল।

মুসাও উঠে দাঁড়াল। দাঁড়াও, আমিও আসছি।

জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। এখানে বসে একজনকে ক্যাম্পের ওপর নজর রাখতেই হবে। নইলে বিপদ হতে পারে। দেখার কেউ না থাকলে অনেক সময় ক্যাম্পে ফায়ার ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের সৃষ্টি করে। মুসা আর রবিনের। সঙ্গে এবার যাওয়ার ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে উঠেছে তার। মিস্টার মিলফোর্ডের জন্যে তারও দুশ্চিন্তা হচ্ছে। কিন্তু কিছু করার নেই। বসে থাকতেই হবে।

পশ্চিম আকাশের দিকে তাকাল মুসা। সূর্য ডোবার আর আধ ঘণ্টা বাকি। তার পরে আলো আর বেশিক্ষণ থাকবে না, ঝুপ করে নামবে অন্ধকার, এসব পাহাড়ী এলাকায় যেমন করে নামে।

পাহাড় বেয়ে উঠতে শুরু করল রবিন। তবে প্রপাতের ধারের পাহাড়ের মত দেয়ালের গায়ে এখানে খোঁচা খোঁচা পাথর বেরিয়ে নেই। পরতের পর পরত এ্যানিট এমন ভাবে পড়েছে, যেন পাহাড়ে চড়ার উপযুক্ত করেই। কোথাও কোথাও খুবই মসৃণ, প্রায় হাত পিছলে যাওয়ার মত, হাজার হাজার বছর আগে। বরফের ধস নামার সময় বরফের ঘষায় এরকম হয়েছে।

চূড়ায় উঠে এল দুজনে। জোরে জোরে দম নিচ্ছে।

উৎকন্ঠিত হয়ে চারপাশে তাকাল রবিন। কই, গেল কোথায়? দেখছি না।

বসে আছেন হয়ত কোথাও। বিশ্রাম নিচ্ছেন, মুসা বলল।

নিচে শত শত মাইল জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে চড়াই উতরাই। ঘন বনে ছাওয়া। ডুবন্ত সূর্যের লম্বা লম্বা ছায়া পড়ছে বনের ওপর, এক অপরূপ দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে। সবুজ বনের মাথায় লাল রোদ, যেখানে রোদ পড়তে পারেনি সেখানে গভীর কালো গর্তের মত লাগছে। পাহাড়ের চূড়াগুলোকে মনে হচ্ছে সোনায় তৈরি। কিন্তু এসব দেখার আগ্রহ নেই এখন দুই গোয়েন্দার। ওরা যা দেখতে এসেছে সেই ফায়ার টাওয়ার কোথাও চোখে পড়ল না।

নজর ফেরাল ওরা। যেখানে রয়েছে পাহাড়ের সেই চূড়াটা দেখতে লাগল। লম্বা, গ্র্যানিটে তৈরি একটা মালভূমি। এখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে বড় বড় পাথরের চাঙড়। পাথরের মধ্যেই যেখানে সামান্যতম মাটি পেয়েছে সেখানেই গজিয়ে উঠেছে কাঁটাঝোপ। রুক্ষ পাথরের মাঝে টিকে থাকার জন্যে প্রাণপণ লড়াই করে যাচ্ছে। মালভূমির সবটাই দেখতে প্রায় একই রকম। কোথাও কোন বৈচিত্র নেই। উত্তরে আধ মাইল দূরে ঘন হয়ে জন্মেছে পাইন। আরেকটা জঙ্গল, এই মালভূমির সঙ্গে সম্পর্ক নেই। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠে গেছে একটা শৈলশিরার কাছে, দ্বিগন্ত আড়াল করে দিয়ে লম্বা হয়ে পড়ে আছে যেন শিরাটা। ওই শিরাটারই কোন প্রান্তে রয়েছে ডায়মণ্ড লেক।

মিলফোর্ডকে খোঁজার জন্যে আলাদা হয়ে দুদিকে সরে গেল মুসা আর রবিন। চিৎকার করে ডাকতে লাগল।

বাবা!

আঙ্কেল!

বাবা!

ঠাণ্ডা একঝলক জোরাল হাওয়া বয়ে গেল মালভূমির ওপর দিয়ে। কেঁপে উঠল রবিন। ওর বাবা কোথায়? ওদেরকে কিছু না বলে দূরে কোথাও যাওয়ার কথা। নয়। যাবেন না।

চোখে পড়ল জিনিসটা। তার বাবার নীল ডজারস ক্যাপ।

বাবা! জোরে চিৎকার করে ডাকল আবার রবিন। দৌড়ে এল ক্যাপটার কাছে। পাশেই একটা ম্যানজানিটা ঝাড়। ঝড় তো নয়, যেন ঝাড়ের কঙ্কাল। বাবা! কাছাকাছি কোথাও রয়েছেন তিনি, অনুমান করল সে। কোথায় তুমি?

এই রবিন, পেলে নাকি কিছু? দৌড়ে আসছে মুসা।

কি পেয়েছে দেখাল রবিন। এই ক্যাপটার ওপর বাবার দুর্বলতা আছে। ফেলে যাওয়ার কথা নয়। নিশ্চয় কিছু হয়েছে। খারাপ কিছু। জখম-টখম হয়ে এমনিতেই শরীর কাহিল, পাহাড়ে উঠে আরও খারাপ হয়েছে। মাথা ঘুরে কোথাও পড়ে আছে হয়ত। কিংবা পথ হারিয়েছে।

দেখি তো। ক্যাপটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগল মুসা। কোন দুর্ঘটনায় মাথা থেকে পড়ে গেলে যেমন হয়, ছিঁড়ে যায়, ময়লা কিংবা রক্ত লেগে থাকে, সে রকম কিছুই নেই। ঠিকই তো আছে!

বাবা! আবার ডাকল রবিন।

অযথা ভয় পাচ্ছ। মাথা থেকে খুলে পড়ে গেছে। খেয়াল করেননি।

মাথা নাড়ল রবিন। অসম্ভব! মাথা থেকে ক্যাপ খুলে পড়ে যাবে আর খেয়াল করবে না এটা হতেই পারে না। তাছাড়া এটা তার লাকি ক্যাপ।

একটা পাথর কুড়িয়ে নিল মুসা। বলল, একটা পিরামিড বানাই। টুপিটা কোথায় পেলাম তার চিহ্ন। তুমি খোঁজা চালিয়ে যাও।

মাথা ঝাঁকিয়ে সরে গেল রবিন।

পশ্চিমে তাকাল মুসা। উজ্জ্বল কমলা রঙ হয়ে গেছে সূর্যটার। ডুবে যাচ্ছে। দ্রুত হাত চালাল সে। পাথর দিয়ে পিরামিড তৈরি করে চিহ্ন রাখা বনচারী মানুষ আর অভিযাত্রীদের একটা পুরানো কৌশল। বানাতে দেরি হল না। উঠে সে-ও খুঁজতে শুরু করল আবার। কতটা উদ্বিগ্ন হয়েছে, সেটা রবিনকে জানাতে চায় না। তাহলে মন আরও খারাপ হয়ে যাবে বেচারার।

মুখের সামনে হাত জড় করে জোরে জোরে মিলফোর্ডকে ডাকতে লাগল দুজনে। চিৎকার বেরোতে না বেরোতেই সেটাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাতাস, যেন পছন্দ না হওয়ায় ঝেটিয়ে বিদেয় করতে চাইছে ওই শব্দকে। সব জায়গায় খুঁজতে লাগল ওরা। পাথরের আড়ালে, গাছের ছায়ায়, ভূমিকম্পে ফেটে যাওয়া গ্র্যানিটের খাজের ভেতরে।

অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে মুসা বলল, ফিরে যাওয়া দরকার!

আরও পরে! উত্তরের বনের দিকে এগিয়ে চলেছে রবিন।

গিয়ে লাভ হবে না। এতক্ষণে নিশ্চয় ক্যাম্পে ফিরে গেছেন আঙ্কেল। আমাদের দেরি দেখলে রাগ করবেন।

না, যায়নি! রবিনের বিশ্বাস, কাছাকাছিই কোথাও রয়েছেন তার বাবা।

এই, শোনো, পথ হারাব আমরা। তাহলে আরও বেশি রাগ করবেন তিনি।

থেমে গেল রবিন। ঝুলে পড়ল কাধ।

সূর্য ডুবে গেছে দেখছ না, পাশে চলে এল মুসা। এখনও বাইরে ঘোরাফেরা করছেন না নিশ্চয় আঙ্কেল। চলো। গিয়ে দেখব, বসে আছেন। আমাদের জন্যেই দুশ্চিন্তা করছেন।

পশ্চিম আকাশের দিকে তাকাল রবিন। গোধূলীর বিচিত্র রঙে রঙিন হয়ে গেছে আকাশ। মুসার কথায় যুক্তি আছে, যদিও মানতে পারছে না রবিন। তার ধারণা, ফিরে যাননি তার বাবা। গিয়ে দেখবে নেই। তাহলে আবার বেরোতে হবে খুঁজতে। কিন্তু এই রাতের বেলা কি ভাবে কোথায় খুঁজবে? কাল সকালের আগে আর হবে না।

যেতে ইচ্ছে করছে না। নিরাশ হয়ে প্রায় খোঁড়াতে খোঁড়াতে হাঁটতে লাগল। সে মুসার সঙ্গে। যেখান দিয়ে চূড়ায় উঠেছিল, চুড়ার সেই ধারটায় এসে থামল। নিচে তাকাল একবার। তারপর নামতে শুরু করল। বেগুনী আকাশ থেকে দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছে দিনের আলো। বিশাল একটা চাঁদ উঠছে, পূর্ণিমার বেশি বাকি নেই। আলো যথেষ্টই ছড়াবে, তবে এতটা বেশি নয় যাতে বনের ভেতর খোঁজা যায়।

তৃণভূমিতে নেমে শীতে কাঁপা শুরু করল ওরা। ছুটে চলল ক্যাম্পের দিকে। এতে শরীর গরম হবে, শীতটা একটু কম লাগবে। অন্ধকার হয়ে গেছে। আগুনের দিকে তাকিয়ে মনে হতে লাগল ওদের, চারপাশে কিছুদূর পর্যন্ত উষ্ণ একটা চক্র তৈরি করে জ্বলছে যেন আগুন।

মিলফোর্ডকে দেখা গেল না আগুনের পাশে। কিশোর একা।

পেলে না? জিজ্ঞেস করল গোয়েন্দাপ্রধান।

শুধু ক্যাপটা, জবাব দিল মুসা।

ধপ করে একটা পাথরের ওপর বসে পড়ল রবিন। বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আগুনের দিকে।

মুসার চোখে চোখে তাকাল কিশোর। একটা ভুরু সামান্য উঁচু করল। ইঙ্গিতটা বুঝতে পারল মুসা। রবিনকে সান্ত্বনা দিতে হবে এখন, ওর মন হালকা করার চেষ্টা করতে হবে।

এই, রবিন, আচমকা কথা বলল মুসা, শুনেছি, হট পিসটন নাকি সাংঘাতিক। যে ট্যালেন্ট এজেন্সিতে কাজ করে রবিন, সেখানকারই একটা নতুন রক গ্রুপ হট পিসটন। রবিনের খুব পছন্দ।

হ্যাঁ, ভালই, দায়সারা জবাব দিল রবিন।

আমিও শুনেছি ভাল, কিশোর বলল। যদিও গানবাজনা তার বিশেষ পছন্দ নয়, রবিনের খাতিরেই বলল। ওদের নতুন মিউজিকটা কি?

আমি জানি, মুসা বলল, লো দা গ্রাউণ্ড। দারুণ! আমার খুবই ভাল লেগেছে…।

শোনো, আমি বলি কি…

বাবার কথাই বলতে যাচ্ছে রবিন, বুঝতে পেরে তাকে থামিয়ে দিয়ে আরেক কথায় চলে গেল মুসা, রবিন, বিশ্বাস করবে না, কি ভয়টাই না তখন পেয়েছি! লোকটা ভূতের মত এল, ভূতের মতই হারিয়ে গেল। বনের মধ্যে আমার মনে হয়েছিল-মনে হয়েছিল…কি জানি মনে হয়েছিল? মাথা চুলকাতে লাগল সে।

তোমার কি মনে হয়েছিল, সেটা কি আমরা জানি নাকি? হেসে ফেলল কিশোর।

দাঁড়াও, কি মনে হয়েছিল মনে করি…

হয়েছে, আর মনে করতে হবে না। আমিই বলে দিচ্ছি। প্যান্ট খারাপ হয়ে যাচ্ছিল, আর তুমি টের পাচ্ছিলে না…

খাইছে! তুমি জানলে কি করে?

এতে জানাজানির আর কি আছে? ভূত দেখলেই তো তুমি প্রথমে ওই একটি কাজ করে ফেলো…

হাসল মুসা।

রবিনের ঠোঁটেও এক চিলতে হাসি ফুটেই মিলিয়ে গেল।

সুযোগটা কাজে লাগাল কিশোর, বেসুরো গলায় গেয়ে উঠল রবীন্দ্রনাথের গান, আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশীনী…

ওই গান থেকে যে কখন ওয়েস্টার্ন বাফেলো গালসে (গার্ল) চলে গেল। খেয়ালই রইল না। যখন খেয়াল হলো, দেখল তিনজনে গলা মেলাচ্ছে। বন্য রাতের আকাশ যেন ভরে দিল তিনটে কণ্ঠ, একেকটা একেক রকম। তিনজনের মাঝে রবিনের গলাই কেবল ভাল। মুসারটা খসখসে, আর কিশোরেরটা শুনলেই লেজ গুটিয়ে পালাবে নেড়ি কুকুর। একটা বাদ্যযন্ত্র হলে ভাল হয়। আর কিছু না পেয়ে দুটো ডাল তুলে নিয়ে ভুটানিদের মত একটার সঙ্গে আরেকটা পিটিয়ে শব্দ করতে লাগল মুসা। ওকে আর রবিনকে অবাক করে দিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। কোমর দুলিয়ে নাচতে শুরু করল। গলা যেমন বেসুরো, পা-ও তেমনি বেতাল। বাজনা বাজানো আর হল না মুসার। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল। রবিনও না হেসে পারল না। মনে দুর্ভাবনা না থাকলে তারও মুসার দশাই হত। তবে কিছুক্ষণ আগের মত আর ভার হয়ে নেই মন, অনেক হালকা হয়েছে।

মুসা গাইল, আর কয়েক রকমের নাচ নাচল কিশোর। ভুটানি, বাংলাদেশী খেমটা, আফ্রিকান আদিবাসীদের উন্মাদ নৃত্য, আর রক স্টারদের দাপাদাপি, কোনটাই বাদ রাখল না। শেষে ক্লান্ত হয়ে আগুনের ধারে বসে প্রায় জিভ বের করে। হাঁপাতে লাগল।

নাচের শেষ পর্যায়ে তার সঙ্গে মুসা আর রবিনও যোগ দিয়েছে।

রাত হয়েছে। এবার শোয়া দরকার। সেই ব্যবস্থাই করতে লাগল তিনজনে।

মুসা বলল, গায়ের শার্ট খুলে নাও। ঘামে ভিজে গেছে। রাতে কষ্ট পাবে। খুলে শুকনো শার্ট যতগুলো আছে সব পরে নাও।

খুলতে ইচ্ছে করছে না কিশোরের। কিন্তু জানে, মুসা ঠিকই বলেছে। রাতে তাপমাত্রা আরও কমে যাবে, আর ওরা ঘুমিয়ে থাকতে থাকতে যদি আগুন নিভে যায় তাহলে তো সাংঘাতিক অবস্থা হবে গায়ে কাপড় বেশি না থাকলে।

দ্রুত শার্ট বদলে নিল ওরা। তার ওপরে চড়াল জ্যাকেট। চেন টেনে দিয়ে মুসা বলল, মোজাও খোলো। ভেজা মোজা শরীরের তাপ শুষে নেয়।

জুতো খুলে মোজায় টান দিতেই দুর্গন্ধ বেরেতে শুরু করল। নাক কুঁচকে ফেলল তিনজনেই। মোজা বদলে জিনসের প্যান্টের নিচটা মোজার ভেতরে গুঁজে দিল। শার্ট জল প্যান্টের ভেতরে। মোটকথা বাতাস ঢোকার কোন পথই রাখল না।

রাতের জন্যে রাখা খাবার ভাগ করে দিল কিশোর। খুব সামান্য খাবার। কিছু পপকর্ন আর ক্যাণ্ডি। ধীরে ধীরে খেল ওরা। তারপর ডালপাতা বিছিয়ে পুরু করে ম্যাট্রেস তৈরি করল।

পপকর্নের খালি প্যাকেটগুলো নিয়ে গিয়ে বিমানের ভেতরে রেখে এল মুসা। বলল, এসব ছড়িয়ে ফেলে রাখলে গন্ধে গন্ধে এসে হাজির হবে বুনো জানোয়ার। আর কিছু না পেয়ে শেষে আমাদেরকেই ধরে খাবে।

মাইলার স্পেস ব্লাঙ্কেট মুড়ি দিয়ে আগুনের পাশে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়ল। ওরা। আগুনের নিচের অংশটা নীল, ওপরের কমলা রঙের শিখা যেন লকলক করে বেড়ে উঠে লাফ দিয়ে দিয়ে কালো তারাজ্বলা আকাশ ছুঁতে চাইছে।

চোখ মুদল ওরা। বিশ্রাম দরকার, আগামী দিনের পরিশ্রমের জন্যে। মিস্টার মিলফোর্ডকে খুঁজে বের করতে হবে।

হঠাৎ করেই কথাটা মনে এল কিশোরের। ঘুমজড়িত গলায় জিজ্ঞেস করল, রবিন, তোমার কন্ট্যাক্ট লেন্সের কি খবর? কবে খুলতে হবে?

কি একটা অসুবিধে দেখা দিয়েছে রবিনের চোখে। কন্ট্যাক্ট লেন্স পরার পরামর্শ দিয়েছেন ডাক্তার।

আরও হপ্তাখানেক পরে থাকতে হবে।

ও। তাহলে সময় আছে। এখান থেকে বেরিয়ে যেতে সাতদিনের বেশি লাগবে না আমাদের। অসুবিধেয় পড়তে হবে না তোমাকে। সময় মতই গিয়ে খুলতে পারবে।

রবিন চুপ করে রইল। তিক্ত হাসি হাসল মুসা। নিঃশব্দে। আদৌ কোন দিন। এই দুর্গোম বুনো এলাকা থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে কি-না, যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তার।

ঘুমিয়ে পড়ল কিশোর আর মুসা। অস্বস্তি নিয়ে ঘুমিয়েছে, ফলে গাঢ় হচ্ছে না ঘুম। রবিন ঘুমাতেই পারল না। চোখ খোলা। তাকিয়ে রয়েছে আকাশের দিকে। তারা দেখছে। ওই যে বিগ ডিপার, ওটা উরসা মেজর, আর ওটা বাবা, কোথায় তুমি! প্রায় নিঃশব্দে ককিয়ে উঠল সে। ভেব না, বাবা, কোনমতে রাতটা কাটাও। কাল তোমাকে খুঁজে বের করবই আমরা!

চোখ মুদল অবশেষে রবিন। একটা পেঁচা কিরর কিরর করল। হউউ হউউ করল কোট। বনের ভেতরে ঘুরে বেড়াতে লাগল একটা বড় জানোয়ার। বহুদূরে পাহাড়ী পথে ট্রাকের ভারি ইঞ্জিনের শব্দ মৃদুভাবে কানে এল বলে মনে হল তার। রাতের বেলা শব্দ অনেক দূরে ভেসে যায়, আর অনেক সময় নীরবতার মাঝে থেকে নানা রকম অদ্ভুত কল্পনাও করতে থাকে মানুষ, ভুল শোনে…

ভারি হয়ে এল রবিনের নিঃশ্বাস। জেগে থেকে এখন রাবার কোন উপকারই। করতে পারবে না, বুঝতে পারছে। নিজের শরীরেই ক্ষতি করবে। তাতে পরোক্ষভাবে তার বাবার ক্ষতিই হবে, যদি কাল খুঁজতে বেরোতে না পারে সে। ধীরে ধীরে ঢিলে করে দিল শরীর। স্নায়ু ঢিল করতেই চেপে ধরল এসে সারাদিনের পরিশ্রমের ক্লান্তি। ঘুমিয়ে পড়ল। মুসা আর কিশোরের মতই তার ঘুমও গাঢ় হতে পারছে না। ঘুমের মধ্যেই অবচেতন মনে একটা প্রশ্ন ঘোরাঘুরি করছে, কোথায় রয়েছে সে?

.

০৬.

ঠাণ্ডা, শীতল সূর্য উঠল পর্বতের ঢালের ওপরে। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল তিন গোয়েন্দা। হাত ডলে, মাটিতে লাথি মেরে পা গরম করতে লাগল। আগুন নিভে গেছে। রাতে আর আগুনে কাঠ ফেলা হয়নি। তবে ঠাণ্ডা লাগেনি ওদের। স্পেস ব্ল্যাঙ্কেট আর শার্টগুলো শরীর গরম রেখেছে।

যাক, আমরা ভাল থাকাতে, রবিন বলল, বাবার উপকার হবে।

অবশিষ্ট পপকর্নগুলো দিয়ে নাস্তা সারল ওরা। ক্যাণ্ডি বাঁচিয়ে রাখল রাতের জন্যে। ঝোপের ওপর শুকানোর জন্যে ছড়িয়ে দিল ব্ল্যাঙ্কেট। বাড়তি মোজা আর শার্ট খুলে নিল থেকে।

সেসনা থেকে ছোট একটা নোটবুক হাতে বেরিয়ে এল রবিন। বন্ধুদেরকে দেখিয়ে বলল, এটা বাবার। প্রথম পাতায় কালকের তারিখ আর একটা লোকের নাম লেখা রয়েছে। হ্যারিস হেরিং। চেনো নাকি?

না, একসাথে জবাব দিল কিশোর আর মুসা।

ওর সঙ্গে দেখা করতেই বোধহয় যাচ্ছিল বাবা, অনুমান করল রবিন। তারিখটা ঠিক আছে। এই একটা নোটবুকই সঙ্গে এনেছে। বইটা পকেটে রেখে বিমান থেকে নেমে এল সে। তিনজনে মিলে রওনা হল তৃণভূমি ধরে পাহাড়ের দিকে।

গ্র্যানিটের দেয়ালে প্রথমে চড়ল রবিন। অন্য দুজনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল। কোমরে হাত, চিবুক উঁচু, তাকিয়ে তাকিয়ে চারপাশের রুক্ষ, নির্জন পাহাড় দেখছে সে। বাবার নীল ক্যাপটা মাথায়। বয়েস আরও বেশি আর স্বাস্থ্য আরেকটু ভাল হলে রোজার মিলফোর্ড বলেই চালিয়ে দেয়া যেত তাকে।

ছড়িয়ে পড়ব আমরা, বলল সে। কাল রাতে আমি আর মুসা এখানে খুঁজেছি। আরও উত্তরে চলে যাব আমি, গাছগুলোর দিকে। তোমরা একজন বায়ে যাও, আরেকজন ডানে। এক ঘন্টা পর ফিরে এসে এখানে এই পিরামিডের কাছে মিলিত হব। ঠিক আছে?

তিনজনের ঘড়ি মিলিয়ে নিয়ে রওনা হয়ে গেল ওরা। মিস্টার মিলফোর্ডকে ডাকতে ডাকতে চলল। মানুষ লুকিয়ে থাকতে পারে এরকম কোন জায়গাই দেখা বাদ দিল না।

অনেকখানি জায়গা নিয়ে খুঁজল ওরা। তারপর ফেরার জন্যে ঘুরল। তিনজনেই ভাবছে, অন্য দুজন হয়ত কিছু দেখতে পেয়েছে। ফিরে এল ওরা।

পিরামিড়টাকে আর দেখতে পেল না।

কোথায় গেল? অবাক হয়ে প্রশ্ন করল মুসা।

ধূসর গ্র্যানিটের ওপর ঘুরতে লাগল ওরা।

ছিল তো এখানেই, রবিন বলল।

না, মনে হয় ওখানে, মুসা বুলল।

দুজনেই ভুল করছ তোমরা, কিশোর বলল। এখানেই ছিল ওটা। গ্র্যানিটের গায়ে ওই যে গোল শ্যাওলার দাগ ওটা তখনও দেখে গেছি। এখান থেকেই রওনা হয়েছিলাম আমরা।

নিচু হয়ে একটা সিগারেটের গোড়া তুলে নিল সে। অন্য দুজনকে দেখিয়ে ৪ বলল, দেখ। কাগজটা কি রকম সাদা দেখেছ? তার মানে বেশি পুরানো নয়। আজ সকালে আমরা রওনা হওয়ার সময় এটা এখানে ছিল না। তাহলে চোখে পড়তই।

কি বোঝাতে চাইছ? মুসার চোখের পাতা সরু হয়ে এসেছে।

বোঝাতে চাইছে, চিন্তিত ভঙ্গিতে রবিন বলল, কেউ এসেছিল এখানে। যে সিগারেট খায়। আমাদের চিহ্ন নষ্ট করেছে। হয়ত আমাদের ওপর নজর রাখতে এসেছিল, তিনজন তিনদিকে চলে যাওয়ায় পারেনি। একসাথে আর কজনের ওপর রাখবে। তাছাড়া গাছপালা ঝোপঝাড় তেমন নেই যে আড়ালে থেকে পিছু নেবে।

কিংবা হয়ত এমনিতেই ঘুরতে এসেছিল, সিগারেটের গোড়াটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে কিশোর। লম্বা ফিল্টারের সঙ্গে যেখানে সাদা কাগজ জোড়া দেয়া হয়েছে, সেখানে সরু একটা সবুজ রঙের ব্যাণ্ড। দামি জিনিস। গোড়াটা শার্টের পকেটে রেখে দিল সে।

সময় নষ্ট করা উচিত না, রবিন বলল। বাবা এখানে নেই। মুসা কাল যেখানে গিয়েছিল সেখানে গিয়ে দেখা দরকার। একজন লোককে দেখেছিল সে। হয়ত বাবাকেই দেখেছে।

আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে, মুসা বলল।

কিন্তু হতে তো পারে। ভাল করে দেখনি তুমি। হয়তো মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে। আবার কপালে ব্যথা পেয়েছিল বাবা। ফলে মাথার ঠিকঠিকানা ছিল না, তোমার। ডাক চিনতে পারেনি।

চিনতে পারুক বা না পারুক, জবাব দিল না কেন? শুনতে পাননি, এটা বলতে পারবে না।

এ কথার জবাব দিতে পারল না রবিন। বলল, একটা কাজ অবশ্য করতে পারি। কাকে দেখেছিলে, সেটা জানার চেষ্টা করা যায়। ফরেস্ট সার্ভিসের লোক হতে পারে। তাদের পেলে তো বেঁচেই গেলাম। আমাদের চেয়ে অনেক বেশি জায়গায় খুঁজতে পারবে তারা। এখানকার বনও তাদের চেনা।

পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল কিশোর আর মুসা। ঠিকই বলেছে। রবিন। ফরেস্ট সার্ভিসের লোক পেলে অনেক সহজ হয়ে যাবে খোঁজা। বুনন এলাকায় তল্লাশি চালানোর মত যন্ত্রপাতি এবং লোকবল আছে তাদের।

তাড়াহুড়ো করে ক্যাম্পে ফিরে এল ওরা। একেবারেই নিভে গেছে ক্যাম্পফায়ারের কয়লা। তবু আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্যে তার ওপরে মাটি ছড়িয়ে দিল কিশোর। তৃণভূমির মাঝখানে পাথর সাজিয়ে বড় করে এস ও এস লিখল রবিন আর মুসা। যাতে ওপর দিয়ে গেলে বিমানের চোখে পড়ে। পপকর্ন আর ক্যাণ্ডি পকেটে ভরল তিনজনে। পানির বোতলটা নিল রবিন।

স্পেস ব্ল্যাঙ্কেটগুলোও নিতে হবে, মুসা বলল। আর ইমারজেন্সি কিটটা। বিপদে তো পড়েই আছি, আরও বাড়তে পারে। তৈরি হয়ে যাওয়াই ভাল।

মুসার সঙ্গে একমত হয়ে মাথা নাড়ল কিশোর আর রবিন। রবিনের আফসোস হতে লাগল, ইস, তার বাবা যদি সাথে করে একটা স্পেস ব্লাঙ্কেট অন্তত নিয়ে যেতেন! ভাল হত।

উঁচু গাছের মাথার ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকছে রোদের বর্শা, গোল গোল হয়ে এসে পড়ছে মাটিতে। পায়ে চলা সরু পথ ধরে একসারিতে এগিয়ে চলেছে ভিন গোয়েন্দা। আগের দিন এই পথ ধরেই গিয়েছিল মুসা। রবিনের মাথায় নীল টুপিটা পরাই আছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে চলেছে কোথাও তার বাবার চিহ্ন আছে কিনা।

এক চিলতে ভোলা জায়গা দেখা গেল। বিমানের ইঞ্জিনের শব্দ কানে এল এই সময়।

হায় হায়, চলে গেল তো! খোলা জায়গাটার দিকে দৌড় দিল কিশোর।

অন্য দুজনও এল পেছনে। তিনজনেই হাত তুলে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগল, নাচতে লাগল, বিমানটার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে। অনেক ওপর দিয়ে উড়ছে ওটা।

হয়তো আমার জানে, অন্য দুচোখে পড়ার সম্ভাবনা

চিৎকার করতে করতেই পকেট থেকে একটানে ওর স্পেস ব্ল্যাঙ্কেটটা বের করে খুলে নাড়তে লাগল মুসা। রবিন আর কিশোরও একই কাজ করল। জোরে জোরে ওপর দিকে লাফ মারতে লাগল রবিন। যে কোন ভাবেই হোক, বিমানটার চোখে পড়তে চায়। বাবাকে সাহায্য করার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে।

এই যে এখানে! আমরা এখানে! চেঁচিয়ে চলেছে।

আরে দেখো না, আমরা এখানে! বলল কিশোর।

কিন্তু বিমানটা ওদেরকে দেখতে পেয়েছে বলে মনে হলো না। একই গতিতে সোজা এগিয়ে যেতে লাগল। ছোট হয়ে যাচ্ছে। আরও ছোট।

হয়তো আমাদের এস ও এস দেখতে পেয়েছে। আশা করল রবিন।

কিন্তু সে যেমন জানে, অন্য দুজনও জানে, অত ওপর থেকে ঘাসের মধ্যে তৈরি পাথরের এস ও এস-টা বিমানের চোখে পড়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

আবার রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করল রবিন। এখানে আর সময় নষ্ট করতে চায় না। বাবাকে খুঁজে বের করতেই হবে!

অন্য দুজনেরও একই সংকল্প। বের করতেই হবে।

গুড়গুড় করে উঠল মুসার পাকস্থলী। কিশোরেরও একই অবস্থা।

হাই-ফাই স্টেরিও হয়ে গেছে পেট, রসিকতা করার চেষ্টা করল মুসা, কিন্তু নিমের তেতো ঝরল কণ্ঠ থেকে।

হাসল রবিন। বাজাতে থাক। কি আর করবে?

হঠাৎ থমকে দাঁড়াল মুসা। ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরেছে। কয়েকটা পাইন। গাছের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে, বাঁয়ে।

ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে রবিনও তাকাল। ছায়ার ভেতরে ডাল নড়ছে। ওর বাবা না তো! মৃদু খসখস শব্দ হলো। অবশেষে দেখা গেল যে ডাল নাড়িয়েছে। তাকে। ছায়ায় ছায়ায় এগোচ্ছে। সাংঘাতিক হতাশ হলো রবিন। ওর বাবা নয়।

ইশারায় রবিন আর কিশোরকে ওখানেই থাকতে বলে রওনা হয়ে গেল মুসা। যেন পিছলে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল গাছপালার আড়ালে।

কি ভেবে দাঁড়াল না কিশোর। রবিনকে নিয়ে রাস্তা ধরে দ্রুত পা চালাল। মুসার সঙ্গে সঙ্গে থাকার চেষ্টা করল। পাতায় ঘষা লাগার খসখস কানে আসছে। ওদের, মাঝে মাঝে চোখেও পড়ছে মুসাকে। কিন্তু যে লোকটার পিছু নিয়েছে, তাকে আর দেখতে পেল না।

তবে মুসা দেখতে পাচ্ছে। লোকটার সঙ্গে একই গতিতে এগিয়ে চলেছে। গাছপালার আড়ালে আড়ালে। সেই লোকটাই, আগের দিন যাকে দেখেছিল, কোন সন্দেহ নেই। নিঃশব্দে চলার চেষ্টা করছে সে।

বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর বোধহয় সন্দেহ হলো লোকটার, শব্দটব্দ কানে। গেছে হয়তো। দেখে ফেলল মুসাকে। ঝট করে ডানে ঘুরে ঘন গাছের জটলার ভেতরে ঢুকে পড়ল সে। দৌড়াতে শুরু করল। আগের দিনের মতই খসাতে চাইছে।

কিন্তু আর ছাড়ল না মুসা। চোখের পলকে পেরিয়ে এল জটলাটা। যেন হোঁচট খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। অবাক হয়েছে। সামনে দাঁড়িয়ে আছে তারই বয়েসী একটা ইনডিয়ান ছেলে। চকচকে কালো চোখ।

চামড়ার ফতুয়া গায়ে, পরনে জিনস।

গাছের ঘন ছায়ায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা। এতটাই চুপচাপ, মনে। হয় গাছ হয়ে যেতে চাইছে। গাছের সঙ্গে মিশে গিয়ে আত্মগোপনের একটা চমৎকার কৌশল এটা ইনডিয়ানদের। চট করে চোখে পড়ে না। মুখের একটা পেশী কাঁপছে না, এমনকি চোখের পলকও পড়ছে না।

ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে মুসার। বলল, এই, আমাদের সাহায্য দরকার…

জবাব দিল না ইনডিয়ান ছেলেটা। গোড়ালিতে ভর দিয়ে চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরল, তারপর নিঃশব্দে ছুটে ঢুকে পড়ল গাছের আরেকটা জটলায়।

পিছু নিল মুসা। দেখতে পাচ্ছে না আর ছেলেটাকে। গাছপালা যেন গিলে নিয়েছে তাকে। শব্দ না করে এত দ্রুত যে কেউ ছুটতে পারে না দেখলে বিশ্বাস করত না মুসা।

ইতিমধ্যে থেমে থাকেনি কিশোর আর রবিন। রাস্তা ধরে এগিয়েই চলেছে। হাঁপাচ্ছে দুজনেই। শেষ যেন হবে না এই সীমাহীন পথ। বার বার তাকাচ্ছে ওরা। মুসাকে দেখার জন্যে। দেখতে পাচ্ছে না।

তারপর হঠাৎ করেই একশো ফুট সামনে বনের ভেতর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় উঠল মুসা। জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে। ঘামে চকচক করছে কালো মুখ।

দৌড়ে কাছে এল কিশোর আর রবিন।

ওকে দেখেছ? জিজ্ঞেস করল মুসা।

কাকে?

ইনডিয়ান ছেলেটাকে?

কী? রবিন অবাক।

দেখেছি। হারিয়েও ফেলেছি। চলো।

বুনো পথ ধরে এগোল আবার তিনজনে। সামনে পাহাড়ের কারণে উঁচুনিচু হতে আরম্ভ করেছে পথ। চলতে চলতেই জানাল মুসা, কি হয়েছে।

তাহলে এদিকেই যাচ্ছিল সে! চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল রবিন।

সামনে কি আছে আল্লাহই জানে,মুসা বলল।

বেশি সামনে যাতে যেতে না হয় আর! বিড়বিড় করে বলল কিশোর। পা ব্যথা হয়ে গেছে!

মাটিতে বসে গাছের গায়ে হেলান দিয়ে পাঁচ মিনিট বিশ্রাম নিয়ে নিল ওরা। তারপর আবার উঠে চলতে লাগল।

অনেক ওপরে উঠেছে সূর্য। গরম বাড়ছে। ডানা মেলে যেন ভেসে রয়েছে। প্রজাপতি। কিচ কিচ করে তীক্ষ্ণ ডাক ছাড়ছে নীল জে পাখি। বাতাসে পাইনের গন্ধ।

অধৈর্য, অস্থির হয়ে পড়ছে মুসা। সামনে চলে যাচ্ছে সে। রবিন আর কিশোর পড়ে যাচ্ছে পেছনে। ওদের এগিয়ে আসার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে তাকে। চিৎকার করে বলছে ওদেরকে তাড়াতাড়ি করার জন্যে।

কয়েকবার এরকম হলো। আরও একবার আগে চলে গেল মুসা। পথের বাঁকে হারিয়ে গেল। ওখান থেকেই চেঁচিয়ে ডাকতে লাগল ওদের।

রবিন জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে?

নিশ্চয় কিছু দেখতে পেয়েছে, কিশোর বলল। আল্লাহ, ভাল কিছু যেন হয়! অ্যা

ই, আরেকটা রাস্তা!

যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব মুসার কাছে চলে এল অন্য দুজন। সরু আরেকটা কাঁচা রাস্তার কিনারে দাঁড়িয়ে রয়েছে মুসা। উত্তর-পুবের বন থেকে বেরিয়ে আবার দক্ষিণ-পশ্চিমের জঙ্গলে ঢুকে গেছে পথটা। জন্তু-জানোয়ারের পায়ের ছাপের মাঝে নতুন আরেকটা দাগ দেখতে পেল ওরা, গাড়ির চাকার দাগ।

কই, আকাশ থেকে তো দেখিনি পথটা? রবিনের প্রশ্ন।

এই এলাকায় আসার পর দেখার সুযোগই পেলাম কই?

কিশোর বলল। এখানকার আকাশে ঢোকার পর তো কেবল ভয়ে ভয়েই কাটিয়েছি, কখন আছড়ে পড়বে প্লেন।

রাস্তার এদিক ওদিক তাকাতে লাগল ওরা। দুই ধারে প্রচুর গাছপালা ঝোপঝাড় আছে, দুটো গাড়ি পাশাপাশি পার হতে পারবে,, একটা ঢুকলে আর অর্ধেকটার জায়গা হবে বড়জোর।

ভাটির দিকেই যাই? নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল কিশোর। নিচের দিকে গেলে হাঁটতে সুবিধে। শ্রান্ত পা চলতে চাইছে না। ওপরে ওঠা বড় কঠিন।

চলো, মুসাকে যেদিকেই যেতে বলা হোক, রাজি।

চলো, দাঁড়িয়ে থেকে কি হবে? তাগাদা দিল রবিন। সাহায্য এখন ভীষণ প্রয়োজন ওদের। নিজেদের জন্যে যতটা না হোক, তার বাবাকে খোঁজার জন্যে বেশি।

নিচে নামাটা অনেক সহজ। প্রায় দৌড়ে নামতে লাগল ওরা। একটু পরেই দেখতে পেল তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়ে পশ্চিমে চলে গেছে রাস্তাটা।

মাটি শুকনো, কঠিন। গভীর দাগ হয়ে আছে। শরৎকালে আর বুসন্তে বৃষ্টিতে ভিজে নরম হয়েছিল মাটি, তখন পড়েছে দাগগুলো, পরে রোদে শুকিয়ে ওরকম হয়ে গেছে।

পাশাপাশি হাঁটছে এখন ওরা। যেমন খিদে পেয়েছে, তেমনি ক্লান্ত। কথা প্রায় বলছেই না। এগিয়ে যাওয়ার দিকেই কেবল ঝোঁক। ডালে ডালে অসংখ্য পাখি দেখা যাচ্ছে। উড়ছে, বসছে, ডাকছে। ক্রমেই আরও, আরও ওপরে উঠছে সূর্য। গরম হচ্ছে রোদ।

খুব মৃদু প্রতিধ্বনির মত করে এসে কানে বাজল শব্দটা। থেমে গিয়ে পরস্পরের দিকে তাকাল ওরা। কিসের শব্দ? কয়েক সেকেণ্ড দাঁড়িয়ে থেকে শব্দটা ভাল করে শুনে আবার এগোল। খানিক পরেই চিনতে পারল। অনেক মানুষের কথাবার্তা, কুকুরের ডাক আর ছেলেমেয়ের চিৎকার। বিচিত্র কলরব।

শহরের কোলাহল নয়। শহর বা গ্রাম যা-ই হোক, মানুষ তো! আশায় দুলে উঠল ওদের বুক।

চলার গতি আপনাআপনি বেড়ে গেল।

হাসি ফুটল রবিনের মুখে।

আরেকটা মোড় ঘুরে চওড়া হয়ে গেল পথটা। পথের মাথায় কতগুলো কাঠের পুরানো নরবড়ে কুঁড়ে। চারপাশ ঘিরে আছে রেডউড গাছ। কুঁড়ের বাইরে উঠানে পড়ে আছে মাছ ধরার আর শিকারের সরজ্ঞাম, মুরগীর খাবার দেয়ার গামলা। চারাগাছে তৈরি লম্বা ফ্রেমে, ঝোলানো রয়েছে চামড়া, শুকানর জন্যে। শরীর তোবড়ানো, পুরানো ঝরঝরে পিকআপ ট্রাক আর জীপ মরে পড়ে আছে যেন, কিংবা মরার প্রহর গুনছে।

ইনডিয়ানদের ছোট একটা গ্রাম। খেলা করছিল দুটো ছেলে, পরনে শার্ট, গায়ে টি-শার্ট। খেলা থেকে মুখ তুলে হাঁ করে তাকিয়ে রইল তিন গোয়েন্দার দিকে। চোখ লাল, নাক থেকে পানি গড়াচ্ছে। ওদের পাশের বাদামী রঙের কুকুরটা লাফাতে লাফাতে ছুটে এল গোয়েন্দাদের জুতো শোকার জন্যে।

কি কারণে যেন খুব ব্যস্ত হয়ে উঠেছে গাঁয়ের লোক। ছড়ানো একটা উঠানে জড় হতে আরম্ভ করেছে মহিলা আর বাচ্চারা।

দ্রিম দ্রিম করে বাজতে শুরু করল ঢাক।

অ্যাই, তুমি! আঙুল তুলে চিৎকার করে বলল মুসা, শোনো! দাঁড়াও!

একটা কুঁড়ের দিকে দৌড় দিল সে। চামড়ার ফতুয়া আর জিনস পরা এক ইনডিয়ান ছেলের কাঁধ খামচে ধরল এসে। হ্যাঁচকা টান দিয়ে ছেলেটাকে ঘুরিয়ে ফেলল নিজের দিকে। আরেকটু হলেই পড়ে যাচ্ছিল ছেলেটা। জ্বলন্ত চোখে তাকাল সে মুসার দিকে। কঠিন, ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে চেহারা।

তুমিই! জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ফিরিয়ে দিয়ে বলল মুসা, হ্যাঁ, তোমাকেই দেখেছিলাম তখন! পিছু নিয়েছিলাম!

০৭.

কেমন লোক তুমি? অভিযোগের সুরে বলল মুসা। ছুটে পালালে কেন অমন করে?

কালো লম্বা চুল, চকচকে কালো চোখ, ঠোঁট সামান্য কুঁচকানো, সব মিলিয়ে ইনডিয়ান ছেলেটার চেহারা দেখলে ভয় লাগে। মুসাকে চিনতে পেরে চোখ বড় বড় হয়ে গেল তার। নরম হয়ে এল মুখের ভাব। ঝকঝকে দাঁত বের করে হাসল।

এখানে এলে কি করে? ছেলেটা জিজ্ঞেস করল। আমার পিছু নিয়ে?…না না, তা হতে পারে না।…যা-ই হোক পেয়ে তো গেছ। অবশ্য আবার ফিরে যেতাম তোমাদের কাছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। তোমাদেরকে ওভাবে ফেলে রেখে আসতে হলো। সরি।

এবার অবাক হওয়ার পালা মুসার। আসতে হলো মানে?

বলছি। গায়ের ফতুয়া টেনে সোজা করল সে। পুরানো হয়ে রঙ চটে গেছে জিনসের। কোমরের বেল্টের বাকলসটা খুব সুন্দর, সচরাচর দেখা যায় না ওরকম। রূপা দিয়ে তৈরি, ডিম্বাকৃতি, মাঝখানে বসানো একটা নীলকান্তমণি। বাকলসটায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, আমি গিয়েছিলাম ভিশন কোয়েস্টে…

এই সময় সেখানে এসে হাজির হলো রবিন আর কিশোর।

আমার নাম নরম্যান জনজুনস, ভদ্র গলায় নিজের নাম জানাল ইনডিয়ান ছেলেটা। আমি…

তোমাদের এখানে টেলিফোন আছে? বাধা দিয়ে বলল রবিন, ফরেস্ট সার্ভিসকে খবর দিতে হবে। পাহাড়ের ভেতরে ভেঙে পড়েছে আমাদের প্লেন। আমার বাবা হারিয়ে গেছে। অনেক খুঁজেছি, পাইনি।

মাথা নেড়ে জন বলল, সরি, টেলিফোন নেই। এমনকি রেডিওও নেই। কোন জিনিসের প্রয়োজন হলে গাড়ি নিয়ে চলে যাই আমরা।

সবচে কাছের রেঞ্জার স্টেশনটায় নিয়ে যেতে পারবে?

এখন কারও বেরোনো চলবে না, পেছন থেকে বলে উঠল ভারি, খসখসে একটা কণ্ঠ। জন, ছেলেগুলো কে?

ফিরে তাকাল তিন গোয়েন্দা। মাঝারি উচ্চতার একজন মানুষ। বিশাল চওড়া কাঁধ, পেশীবহুল শরীর। চোখের মণি ঘিরে রক্ত জমে লাল একটা রিং তৈরি করেছে। মনে হয় মণিতে পানি টসটস করছে, নাড়া লাগলেই গড়িয়ে পড়বে।

চাচা, এদের কথাই তোমাকে বলেছিলাম, জন বলল।

ওদের সঙ্গে কথা বলেছ?

জঙ্গলে বলিনি।

ভাল। জনের দিকে তাকিয়ে হাসলেন তার চাচা। তিন গোয়েন্দার দিকে ফিরতেই আবার গম্ভীর হয়ে গেল মুখ, হাসিটা মিলিয়ে গেছে।

নিজেদের পরিচয় দিল কিশোর, রবিন আর মুসা।

গাঁয়ের মোড়ল আর সর্দার শিকারি তার চাচা ডুম সবলের পরিচয় দিল জন।

আমার বাবা হারিয়ে গেছে। কি হয়েছে অল্প কথায় জানাল রবিন। তাড়াতাড়ি খুঁজতে বেরোনর জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে সে।

চাচা, ডুমকে জিজ্ঞেস করল জন, ওদের কি সাহায্য করতে পারি আমরা?

উদ্বিগ্ন হয়ে মোড়লের দিকে তাকিয়ে রয়েছে রবিন।

সমস্যাই! বললেন মোড়ল। বুঝতে পারছি না কি করা উচিত। কথা বলতে হবে।

যেমন নিঃশব্দে আচমকা এসেছিলেন ডুম, তেমনি করেই চলে গেলেন। আবার। হতাশায় কালো হয়ে গেল রবিনের মুখ।

জোর করে কিছুই করার উপায় নেই আমাদের। সান্ত্বনা দিয়ে জন বলল, গাঁয়ে পঞ্চায়েত আছে। শামান আছে। চুপ করে থাকো। আশা করি ভাল খবরই আসবে।

মাথা ঝাঁকাল রবিন। খুব একটা সান্ত্বনা পেয়েছে বলে মনে হলো না।

হ্যাঁ, তখন মুসার সঙ্গে কি যেন বলছিলে? আগের কথার খেই ধরল। কিশোর। ভিশন কোয়েস্টে গিয়েছিলে… জনের দিকে তাকাল সে। কি দেখতে? মোচড় দিয়ে উঠল ওর পেট। রান্না হচ্ছে কোথাও, সুগন্ধ এসে নাকে লেগেছে।

বলব, সবই বলব, জন বলল। আগে কিছু খেয়ে নাও।

নিশ্চয়ই! অধৈর্য কণ্ঠে বলে উঠল কিশোর, মুসার আগেই।

আসছি, বলে চলে গেল জন। খোলা জায়গাটার দিকে, যেখানে ঢাক বাজছে।

বাপরে বাপ! ভুরু কুঁচকে ইনডিয়ান ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে মুসা, চলে কি! হাঁটে না তো, মনে হয় পিছলে চলে যায়!

রবিন ওসব কিছু দেখছে না। তার একটাই ভাবনা। সাহায্য করবে তো ওরা?

তা করবে, যতটা জোর দিয়ে বলল কিশোর, ততটা আশা অবশ্য করতে পারল না। এদিক ওদিক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল, ঢাক বাজছে কেন।

তাড়াতাড়িই ফিরে এল জন। এসো। খাবার দেয়া হয়েছে। প্রথমে নাচব। আমরা, তারপর খাওয়া। সব শেষে অনুষ্ঠান। তোমরা আমাদের অতিথি, কাজেই তোমাদের আগেই খেয়ে ফেলতে হবে।

তোমরা পরে খাবে? রবিন বলল, সেটা উচিত না।

আমরাও অপেক্ষা করি, মুসা বলল। তোমাদের ফেলে রেখে একলা খাব, তা হয় না।

ঢোক গিলল কিশোর। এত খিদে পেয়েছে তার, অপেক্ষা করাটা কঠিন। তবু মুসার টিটকারি শুনতে চায় না বলে কোনমতে বলল, ঠিক। পরেই খাব।

জন হাসল। অত ভদ্রতার দরকার নেই। খাবার তৈরি। তোমাদেরও খুব। খিদে পেয়েছে, আমি জানি। আগে খেয়ে নিলেই বরং সম্মান দেখানো হবে। এটাই নিয়ম।

পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল তিন গোয়েন্দা।

ওদের অপমান করা উচিত হবে না আমাদের, কিশোর বলল, কি বলো?

তাই তো মনে হচ্ছে, একমত হলো মুসা।

থ্যাংকস, জন, ভদ্রতা দেখাল রবিন। সে ভাবছে বাবার কথা। কোথায় কি ভাবে পড়ে আছেন কে জানে! খাওয়া নিশ্চয় হয়নি। ইস্, তাঁকেও যদি কেউ এখন। খাবার দিত!

জনের পেছন পেছন এগোল তিন গোয়েন্দা। কৌতূহলী চোখে ওদের দিকে তাকাচ্ছে গাঁয়ের লোক, বিশেষ করে বাচ্চারা। খোলা জায়গায় জমায়েত হয়েছে নারী-পুরুষ-শিশু। পুরুষদের খালি গা, মাথায় পাখির পালকের মুকুট, গলায় পাখির পালক আর পাথরে তৈরি মালা। মেয়েদের গলায় পুঁতির মালা। পুঁতি আর ছোট পাথর খচিত জামা পরেছে। ঢাকের সঙ্গে তাল রেখে দুটো করে কাঠি বাজাচ্ছে কয়েকজন লোক।

ওগুলোকে বলে ক্ল্যাপ স্টিক, জন বলল। বাজনার এখনও কিছুই না। জোর অনেক বাড়বে। এদিকে এসো। বাসন নিয়ে যার যার খাবার নিজেরাই তুলে নাও। খেতে খেতে দেখ। যেটা না বুঝবে, আমি বলে দেব।

বড় বড় কাঠের পাত্রে খাবার রাখা। বাঁশের তৈরি ঢাকনা দিয়ে ঢাকা। সরিয়ে নিল মেয়েরা। কয়েক পদের ভাজা মাংস, আলু, সীম আর রুটি। খাবার দেখে এতটাই খুশি হল কিশোর, ভাবনাচিন্তা আর করল না, তুলে নিতে লাগল প্লেটে।

মুসা অতটা অস্থির হয়নি, খাবার দেখলে যে সব চেয়ে বেশি হয় সাধারণত। মাংসের একটা পাত্র দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, শুয়োর?

মাথা ঝাঁকাল জন। হ্যাঁ।

থমকে গেল কিশোর। একবার চিন্তাও করেনি, মাংসটা সুন্দর দেখে ওটার দিকেই হাত বাড়িয়েছিল নেয়ার জন্যে। আর কিছু নেই? হতাশ হয়েছে সে।

থাকবে না কেন? জন বলল, শুয়োর খাও না নাকি?

মাথা নাড়ল মুসা, কিশোর দুজনেই।

অসুবিধে নেই, জন আরেকটা পাত্র দেখিয়ে বলল, ওটা খরগোশ। আর ওটা কাঠবোলি। এগুলোও পছন্দ না হলে, একটা পাত্রের ঢাকনা তুলতে তুলতে বলল সে, মাছ নাও। অনেক আছে। টুয়ক থেকে ধরেছি। আমাদের ভাষায় টুয়ক বলে নদীকে।

হাসি ফুটল আবার মুসা আর কিশোরের মুখে। মাংস নিয়ে রবিনের কোন অসুবিধে নেই। সে শুয়োরও খায়।

বিশাল এক রেডউড গাছের নিচে নিচু বেঞ্চিতে বসেছে ওরা। টেবিল হল বড় বড় কাঠের বাক্স। গায়ে লেখা রয়েছেঃ ইঞ্জিন পার্টস, জোনস ট্রাকিং কোম্পানি। কাছেই দাঁড়িয়ে আছে একটা শেভ্রলে ট্রাক, বনেট তোলা। ইঞ্জিন খুলে ছড়িয়ে রাখা হয়েছে কয়েকটা বাক্সের ওপর। তার ওপাশে, বেশ কিছুটা দূরে টুয়ক, যেটাকে নদী না বলে বরং চওড়া বড় ধরনের নালা বললেই ঠিক হয়। গাঁয়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে কুলকুল করে। টলটলে পানি। গভীরও বেশ।

উত্তরের বিশাল উপত্যকা থেকেই কি এসেছে ওই নদী? জিজ্ঞেস করল রবিন।

চেনো নাকি তুমি উপত্যকাটা? জনের কণ্ঠে সন্দেহ।

চিনি, মানে, সতর্ক হয়ে গেল রবিন। একটুকরো মাংস চিবিয়ে গিলল। দূর থেকে দেখেছি আরকি।

বাইরের কেউ যেতে পারে না ওখানে। ওটা পবিত্র জায়গা। আমরা ওর নাম দিয়েছি পূর্বপুরুষের উপত্যকা। জায়গাটা সংরক্ষিত করে রেখেছি আমরা। ইনডিয়ানদের গোরস্থান। মাঝে মাঝে ওখানে গিয়ে অনুষ্ঠানও করি।

আমি যাইনি, জনকে নিশ্চিন্ত করল রবিন। আরেক টুকরো মাংস মুখে পুরল। তোমরা নিশ্চয় অনেক কাল ধরে আছ এখানে?

কি করে জানলে?

পাহাড়ে সিঁড়ি, দেখেছি আমি। বেয়ে ওঠার জন্যে পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে। ওখান দিয়ে উঠতে গিয়ে আরেকটু হলেই ধসের কবলে পড়েছিলাম। ধস না নামলে অবশ্য সিঁড়িটা দেখতে পেতাম না। অনেক কাল আগে কাটা হয়েছে।

হ্যাঁ, অনেক অনেক আগে এখানে এসেছিল আমাদের পূর্বপুরুষেরা, স্রষ্টা ওদের সৃষ্টি করার পর পরই। অজ্ঞান লোকেরা পাহাড়ে চড়তে চেষ্টা করলে ঈশ্বরই ধস নামিয়ে ওদের সরিয়ে দেন, কিংবা মেরে ফেলেন। তিনিই উইলো গাছ তৈরি করেছেন, যাতে আমরা বুড়ি বানাতে পারি, সেই ঝুড়িতে করে লাশ নিয়ে যেতে পারি উপত্যকায়। সব কিছুই সৃষ্টি করেছেন ঈশ্বর। হাসল জন। ওহহো, ভুলে গিয়েছিলাম, তুমি তোমার বাবাকে খুঁজছ। ভেব না। গাঁয়ের বুড়ো জ্ঞানী লোকেরা সেটা বুঝবেন।

কিন্তু বাইরের মানুষের সমস্যা তারা বুঝতে চান না।

চান না, তার কারণ টুরিস্টদের পছন্দ করেন না তো। বড় বিরক্ত করে।

একটা কথাও বলেনি এতক্ষণ কিশোর। চুপচাপ খেয়েছে। পেট কিছুটা শান্ত হলে বলল, কিছু একটা ঘটছে নিশ্চয় এখন তোমাদের গায়ে।

ঘটছে। অসুস্থ হয়ে পড়ছে লোকে, জন জানাল। চোখ লাল হয়ে যায়, কাশি হয়, বুক ব্যথা করে। কারও কারও পেটে যেন আগুন জ্বালানো শয়তান ঢুকেছে। ভীষণ জ্বালাপোড়া করে পেটে। তাই জ্ঞানীরা ভেবেচিন্তে ঠিক করেছে, ভয়াবহ ওই রোগ তাড়ানর জন্যে একটা উৎসব করা দরকার। গ্রাম থেকে বেরোনো নিষিদ্ধ। করে দেয়া হয়েছে। কাল দুপুরের আগে কেউ বেরোতে পারবে না।

ডাক্তারের কাছে যাও না কেন তোমরা? মুসার প্রশ্ন। রোগ হলে ডাক্তারই তো-..

মুসার পায়ে লাথি মারল কিশোর।

আউ করে উঠে থেমে গেল মুসা। ইঙ্গিতটা বুঝতে পারল।

একটা মুহূর্ত অবাক হয়ে মুসার দিকে তাকিয়ে রইল জন। মুসাকে হাসতে দেখে আরও অবাক হলো। তবে ব্যাপারটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামাল না। বলতে লাগল, তোমাদের ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, আমাদেরও তেমন ডাক্তার আছে। গান গাওয়া ডাক্তার, শামান। এখনকার যে শামান, আমার জন্মের। আগে থেকেই আছে, চিকিৎসা করছে বহু বছর ধরে। অনেক জানে, অনেক জ্ঞানী। মাঝে মাঝে অবশ্য বেকারসফিল্ডের ক্লিনিকে পাঠায় আমাদের, তবে সব সময় না। স্বাস্থ্যটাস্থ্য ভালই থাকে আমাদের, রোগ বালাই তেমন হয় না, আর হলেও অল্পতেই সেরে যায়। মানে যেত আরকি। এবারের অসুখটা আর সারতে চাইছে না। কয়েক মাস ধরে চলছে।

গা থেকে যে বোরোনো যাবে না বললে, শঙ্কিত হয়ে উঠেছে রবিন, সেটা কি আমাদের বেলায়ও? জরুরী অবস্থায়ও কি বেরোনো যাবে না?

সেটাই শামানের কাছে জানতে গেছেন চাচা।

হঠাৎ ঢাকের আওয়াজ বেড়ে গেল। সেই সঙ্গে বাড়ল ক্ল্যাপ স্টিকের খটাখট। সম্মিলিত বিকট চিৎকার উঠল, মানুষের গলা থেকে যে ওরকম শব্দ বেরোতে পারে না শুনলে বিশ্বাস করা কঠিন, ছড়িয়ে গেল গাঁয়ের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। তাকিয়ে রয়েছে তিন গোয়েন্দা।

নাচ আরম্ভ হয়েছে। অনেক বড় চক্র তৈরি করে নাচছে নর্তকেরা। কাঁচা চামড়ায় তৈরি মোকাসিন পায়ে থাকায় পায়ের শব্দ তেমন হচ্ছে না। আরেকটা ব্যাপার অবাক করল গোয়েন্দাদেরকে। চক্রের এক প্রান্তের লোকেরা যখন নাচছে, আরেক প্রান্ত চুপ থাকছে। কারণটা জিজ্ঞেস করল জনকে।

ও, জান না। বুঝিয়ে দিল জন, পৃথিবীটা হলো একটা নৌকার মত। পানিতে ভাসার সময় নৌকার এক পাশে যদি ভার বেশি হয়ে যায়, তাহলে কাত হয়ে যায়। আর সবাই একসাথে একপাশে চলে গেলে তো উল্টেই যাবে। সে জন্যে দুই দিকেই সমান ভার রাখতে হবে। নাচের বেলায়ও তাই। সবাই একধারে গিয়ে একসাথে নাচলে চলবে না।

তাহলে কাত হয়ে যাবে নাকি পৃথিবীটা? ফস করে জিজ্ঞেস করে বসল। মুসা। আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, আবার লাথি খেল পায়ে। চোখের ইশারায়। বুঝিয়ে দিল কিশোর, যা বলছে চুপচাপ শুনে যাও না, এত কথা বলার দরকার কি?

ঘুরতে ঘুরতে কয়েকজন নর্তক এসে ঢুকে পড়ল চক্রের মাঝখানে। যতটা জোরে সম্ভব লাফাতে লাগল। যেন কার চেয়ে কে কত বেশি উঁচুতে উঠতে পারবে সেই প্রতিযোগিতা চলছে।

এরও কারণ ব্যাখ্যা করে দিল জন, আগে একবার ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল পৃথিবী। তারপর আবার সৃষ্টি করলেন ঈশ্বর। কাঠঠোকরার ওপর ভার দিলেন, কোথায় কেমন চলছে, সেই খবর নিয়মিত দিয়ে আসার। কাজেই আমাদের মধ্যে যাদের অন্তর খুব ভাল, ঈশ্বরের ভক্ত, তাদের রাখা হয়েছে কাঠঠোকরার অনুকরণ করার জন্যে। দেখছ না, মাথা আগেপিছে করছে কেমন ভাবে? কাঠঠোকরা ওরকম করেই গাছ ঠোকরায়, নিশ্চয় দেখেছ। কাঠঠোকরা যেভাবে ডানা ছড়িয়ে দিয়ে গান গায়, ওরাও তেমন করেই গাইছে। এর কারণ জানো? কাঠঠোকরারা এই গান শুনতে পেয়ে ঈশ্বরকে গিয়ে খবর দেবে, এখানে কিছু মানুষের বড় দুর্ভোগ, অসুখ করেছে তাদের। ঈশ্বর শুনলে একটা ব্যবস্থা করবেনই। যাদের তৈরি করেছেন, তাদের তো আর কষ্টে রাখতে পারেন না। হয় রোগ সারিয়ে দেবেন, নয় তো শামানের ওপর ভার দিয়ে দেবেন, তাকে শক্তিশালী করে দেবেন যাতে মানুষের এই রোগ সারিয়ে দিতে পারে।

নাচ চলছে। দরদর করে ঘামছে নাচিয়েরা। মেয়েরা আর বাচ্চারা নাচে অংশ। নিচ্ছে না, তারা বসে বসে দেখছে, মাঝে মাঝে হাততালি দিচ্ছে, গানের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছে। এর বেশি আর কিছু করণীয় নেই তাদের। বেশি অসুস্থ রোগীদেরকে মাদুরে শুইয়ে রাখা হয়েছে। কম্বল পাকিয়ে তাদের মাথার নিচে দিয়ে দেয়া হয়েছে, যাতে আরাম করে শুতে পারে, আর মাথাটা কিছুটা উঁচু হয়ে থাকায় নাচ দেখতে সুবিধে হয়। বেশ জমজমাট উৎসব, আন্তরিকতার অভাব নেই।

একসময় শেষ হলো নাচ।

ঢাক বাজানো বন্ধ হলো। নর্তক এবং দর্শকেরা খাবারের দিকে এগিয়ে এল। তাড়াতাড়ি এসে খাবারের পাত্রের ওপর থেকে ঢাকনা সরিয়ে দিল মেয়েরা। কিশোর লক্ষ করল, নর্তকদের অনেকেরই চোখ লাল, কেউ কেউ কাশছে।

জনের চাচা মোড়ল আরেকজন বুড়ো মানুষকে নিয়ে হাজির হলেন। দুজনেরই পরনে উৎসবের পোশাক। লোকে যেভাবে ভক্তিতে গদগদ হয়ে সরে। জায়গা করে দিচ্ছে বুড়ো মানুষটাকে, শ্রদ্ধার চোখে তাকাচ্ছে, তাতে বুঝতে অসুবিধে হয় না এ লোকই গাঁয়ের শামান, গান গাওয়া ডাক্তার।

কথা বলতে বলতে তিন গোয়েন্দার দিকে এগিয়ে এল দুজনে।

কাছে এসে থামল।

মোড়ল ডুম সবল ঘোষণা করলেন, তোমাদেরকে সাহায্য করতে পারছি না। আমরা। একাই যেতে হবে তোমাদের। এটাই আমাদের সিদ্ধান্ত।

.

০৮.

বেরোলে ঝুঁকিটা বেশি হয়ে যাবে, গান গাওয়া ডাক্তার বলল। অনুষ্ঠানটা নির্ভেজাল রাখতে হবে। অনেক মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েছে আমাদের এখানে।

বুড়ো হতে হতে কুঁচকে গেছে শামানের মুখের চামড়া। যেতে পারছে না বলে সত্যিই দুঃখিত, এটা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না তিন গোয়েন্দার। কিন্তু তার এই দুঃখিত হওয়ায় মিস্টার মিলফোর্ডের কোন উপকার হচ্ছে না।

তোমরা এখানে থেকে গেলেই ভাল করবে, পরামর্শ দিলেন মোড়ল ডুম সবল। কাল গাড়িতে করে দিয়ে আসা যাবে তোমাদের।

আজই যেতে হবে আমাদের, রবিন বলল। আমার বাবা নিশ্চয় ভীষণ বিপদে পড়েছে।

বিশাল এলাকা এটা, মোড়ল বলল। কল্পনাও করতে পারবে না কতটা বড়। ডায়মণ্ড লেক কি করে খুঁজে বের করবে?

রাস্তা ধরে যাব, মুসা জবাব দিল।

চল্লিশ মাইল হাঁটতে হবে তাহলে।

চল্লিশ মাইল! ঢোক গিলল মুসা।

নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। স্থির দৃষ্টিতে মোড়লের দিকে তাকিয়ে রইল এক মুহূর্ত। বলল, আপনাদের একটা পিকআপ ভাড়া নিতে পারি আমরা।

গাঁয়ে আসার পর এই প্রথম উজ্জ্বল হলো রবিনের মুখ। এই না হলে কিশোর পাশা! আসল কথাটা ঠিক তার মাথায় এসে যায়। অথচ এই সহজ কথাটাই মনে। পড়েনি রবিন কিংবা মুসার।

তাড়াতাড়ি রবিন বলল, আমাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে।

টাকাও আছে, বলতে বলতে পকেট থেকে টাকা বের করে ফেলল রবিন। ডায়মণ্ড লেকে গিয়ে খরচ করার জন্যে রেখেছিল। ভাড়া দিতে পারব।

আপনি যেখানে রেখে যেতে বলবেন, আমাদের কাজ শেষ হয়ে গেলে সেখানেই রেখে যাব গাড়িটা, কিশোর বলল। খুব যত্ন করে চালাব, কিচ্ছু নষ্ট করব না। এই যে নিন, আমাদের কার্ড। লোকে আমাদের বিশ্বাস করে রকি বীচে। একটা উপকার চাইছি, করবেন না?

একটা করে তিন গোয়েন্দার কার্ড মোড়ল আর শামানের হাতে গুঁজে দিল কিশোর।

কার্ডটার দিকে তাকিয়ে রইলেন মোড়ল। শামান তাকালেনও না, তুলে দিলেন জনের হাতে। জোরে জোরে পড়ল জন।

মাথা নেড়ে মোড়ল বললেন, প্রস্তাবটা ভাল মনে হচ্ছে না।

ভ্রূকুটি করল গান গাওয়া ডাক্তার। তা ঠিক। তবে তাতে কোন ক্ষতি হবে না। প্রশংসার দৃষ্টিতে ছেলেদের দিকে তাকাল শামান। ঘোলা হয়ে আসা চোখে বুদ্ধির ঝিলিক। এই তিনজন এমনিতেই চলে যাচ্ছে, থাকছে না, যা নিতে চায়। দিয়ে দিতে পারি আমরা।

ঠোঁট গোল করলেন মোড়ল। ব্যাপারটা তার পছন্দ হচ্ছে না। কিন্তু শামানের সিদ্ধান্তের ওপর কথাও বলতে পারেন না। বললেন, বেশ, ব্যবস্থা করছি। বলে খাবার খেতে বসা লোকগুলোর দিকে চলে গেলেন তিনি।

থ্যাংক ইউ, শামানের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞ গলায় বলল রবিন।

বুড়ো মানুষটাও হাসল। একটা মুহূর্তের জন্যে নেচে উঠল তার চোখের তারা। আজকালকার ছেলেছোকরাগুলোকে নিয়ে এই এক অসুবিধে। সব সময় একটা না একটা গণ্ডগোল বাধাবেই, বিড়বিড় করে বলল সে। জনের দিকে তাকিয়ে বলল, তাই না?

আপনার কথা অমান্য করি না আমি, জন জবাব দিল।

কি করে এসেছ বলো ওদের, আদেশ দিল গান গাওয়া ডাক্তার। শোনাও।

তিন গোয়েন্দার দিকে ফিরে বলল জন, দৈব আদেশ পাওয়ার জন্যে বেরিয়েছিলাম আমি। ভিশন কোয়েস্টে। চব্বিশ ঘণ্টা বনের ভেতরে ছুটে বেড়িয়েছি। কেবল প্রার্থনার জন্যে থেমেছি। রাতে ঘুমিয়েছি ঈশ্বরের নির্দেশ পাওয়ার জন্যে।

কি স্বপ্নে দেখলে, নাতি? জিজ্ঞেস করল শামান।

নাতি? সবাই তোমার আত্মীয় নাকি এখানে, জন? মুসার প্রশ্ন।

হেসে উঠল জন আর শামান।

আমরা এভাবেই বড়দের সম্মান জানাই, জন জবাব দিল। মাথা ঝাঁকিয়ে তার কথায় সায় দিল শামান।

তার মানে মোড়ল তোমার চাচা নন, রবিন বলল।

না। আর শামানেরও আমি নাতি নই। তবে তিনি এখানে আমার বয়েসী সবার কাছেই দাদার মত।

মাথা ঝাঁকাল তিন গোয়েন্দা। বুঝেছে।

অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি আমি, দাদা, শামানের প্রশ্নের জবাবে বলল জন। শুরু হলো হ্রদ দিয়ে। দেখি, সবুজ একটা হৃদের ধারে গিয়ে পড়েছি আমি। ঝাঁপিয়ে পড়লাম তাতে। দাপাদাপি করতে লাগলাম। একটা মাছ আপনাআপনি এসে হাতে ধরা দিল। ভাগ্যবান মনে হলো নিজেকে। মাছটা দিয়ে চমৎকার খাবার হবে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলাম। আরও অনেক মাছ এসে পড়তে লাগল আমার হাতের কাছে, এত বেশি, ধরলে হাতে রাখার জায়গা পাব না। ওরা কেবলই আমার গায়ে এসে পড়তে লাগল, আমার পিঠে, আমার বুকে, আমার মুখে লাফিয়ে পড়তে লাগল। আরও এল, আরও, আরও জোরে জোরে গুতো মারতে লাগল আমাকে। ঠোকর মারতে লাগল।

কি মনে হলো তোমার? শামান জিজ্ঞেস করল, তোমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছে?

মাথা ঝাঁকাল জন। হাতের মাছগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে এলাম পানি থেকে।

ঠিক কাজটাই করেছ। কি শিখলে?

শিখলাম, বিনা কষ্টে যা হাতে আসবে তার কোন মূল্য নেই। মাঝে মাঝে ক্ষতিকর হয়ে ওঠে ওসব জিনিস।

খুশি হয়ে মাথা ঝাঁকাল গান গাওয়া ডাক্তার। ঈশ্বর তোমাকে কি নির্দেশ দিলেন?

ঠিক জায়গায়, কিন্তু আর্শীবাদ ছাড়া!

মানে বুঝেছ?

না।

কৌতূহলী হয়ে জনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে তিন গোয়েন্দা।

কিছুই তো বুঝলাম না, বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল জন। তার দেখাই পাইনি।

যা-ই হোক, ঈশ্বর তোমার প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন, শামান বলল। সেটাকে কাজে লাগাবে।

চোখ নামিয়ে ফেলল জুন। লাগাব, দাদা।

পরের অনুষ্ঠানে অবশ্যই উৎসবের পোশাক পরবে তুমি।

পরব, দাদা। তিন গোয়েন্দার দিকে ফিরে হাসল জন। ঝকঝকে উজ্জ্বল হাসি। গুড লাক। বলেই রওনা হয়ে গেল সে। দৌড়ে চলে গেল, দমকা হাওয়ার মত।

গুড বাই, তরুণ যোদ্ধারা, তিন গোয়েন্দাকে বলল শামান। পৃথিবীতে। কেবল নিজেকে বিশ্বাস করবে, আর কাউকে না।

ভিড়ের দিকে চলে গেল সে। হাসিমুখে কথা বলতে লাগল তার ভক্তদের।

ওই দেখো, মোড়ল, পঞ্চাশ গজ দূরের একটা টিনের কুঁড়ে দেখাল মুসা।

ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে হালকা-পাতলা এক ইনডিয়ানের সঙ্গে কথা বলছেন, ডুম। জিনসের সামনের দিকে হাত মুছছে লোকটা। মাথা ঝাঁকাচ্ছে। তারপর মোড়ল চলে এলেন খাবার টেবিলের দিকে, লোকটা চলে গেল ঘরের ভেতরে।

জোনস ট্রাকিং কোম্পানি লেখা বাক্সগুলোর সামনে থেকে সরেনি এখনও কিশোর। তার সামনের বাক্সটায় প্লেট রাখা। তাতে কিছু আলুভাজি রয়ে গেছে। শেষ করে ফেলার জন্যে চামচ দিয়ে তুলতে যাবে এই সময় চোখে পড়ল। সিগারেটের গোড়াটা। একটা বাক্সের কাছে পড়ে আছে। মাটিতে।

ঝুঁকে গোড়াটা তুলে নিল সে। হলদে হয়ে গেছে কাগজ, দোমড়ানো। একই রকমের সবুজ রঙের বন্ধনী লাগানো ফিল্টারের জোড়ার কাছে, সকালে যেটা পেয়েছিল সেরকম।

কিশোর, মুসা জিজ্ঞেস করল, কি ওটা?

দেখো। সকালের পাওয়া গোড়াটা পকেট থেকে বের করে ফেলেছে। কিশোর। পরে যেটা পেয়েছে সেটাও একই সাথে হাতের তালুতে রেখে বাড়িয়ে ধরল।

খাইছে!

এর মানে কি? রবিনের প্রশ্ন।

জানি না, জবাব দিল কিশোর। রেখে দিই। কাজে লেগেও যেতে পারে। কখন যে কোন জিনিসটা দরকার হয়ে পড়ে, আগে থেকে বলা যায় না।

ভিড় থেকে বেরিয়ে কিশোরদের দিকে এগিয়ে এল এক কিশোরী। আমি মালটি জনজুনস। জনের বোন। হেসে একটা চাবি বের করে ফেলে দিল রবিনের হাতে, মোড়ল বললেন পিকআপটা পাবে। চালানোর জন্যে তৈরি করা হচ্ছে। খেয়েছ তো ভালমত?

খেয়েছি, জবাব দিল রবিন। মেয়েটাকে দেখছে। চেহারাটা খুব সুন্দর। লম্বা। চুল। ঢিলাঢালা সাদা পোশাক পরেছে। গলায় নীলকান্তমণির মালা। তার চোখও লাল। আসলেই কি তুমি জনের বোন? না এটাও সম্মান দেখানোর জন্যে বলা?

একটা মুহূর্ত অবাক হয়ে রবিনের দিকে তাকিয়ে রইল মালটি। তারপর বুঝতে পেরে হাসল। না না, আমি সত্যিই তার বোন।

আর কোন অনুষ্ঠান হবে তোমাদের?

এবার শামান গান গাইবে আর নাচবে। তারপর প্রার্থনা করবে। ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলার জন্যে তৈরি হচ্ছে। ঈশ্বরকে জিজ্ঞেস করবে, কি কারণে অসুখ হয়েছে আমাদের। কি করলে সারবে। সেই মত কাজ করে আমাদের সারিয়ে তুলবে তখন।

আবার নিশ্চয় নাচ-গান?

হ্যাঁ। ওষুধের ব্যবস্থাও আছে।

কিশোর জানতে চাইল, ভিশন কোয়েস্টটা কি জিনিস?

মনোযোগী হলো মালটি। জনের কোয়েস্টের কথা শুনেছ তাহলে? কি মেসেজ দিলেন ঈশ্বর?

ভাবল কিশোর। বলল, ঠিক জাগায়, কিন্তু আশীর্বাদ ছাড়া। এ কথাগুলোর মানে বুঝতে না পেরে মাথা নাড়ল মালটি। ঈশ্বরই জানেন কি বলেছেন। জন বুঝতে পেরেছে?

না। গান গাওয়া ডাক্তার তাকে এটা নিয়ে ভাবতে বলেছে, রবিন বলল। কেন, এমন কি জরুরী, এটা?

কারণ… চুপ হয়ে গেল মালটি। চোখ মুদল। খুলল। আমাদের চাচা, আমাদের সত্যিকারের চাচা হারিয়ে গেছে। বাবা চলে যাওয়ার পর আমাকে আর জনকে বড় করেছে এই চাচাই। বাবা হারিয়ে গেছে বহু বছর আগে। এখন হারাল আমাদের চাচা। এক মাস হয়েছে। সমস্ত জঙ্গলে খোঁজাখুঁজি করেও তাকে বের করতে পারেনি জন।

অদ্ভুত কিছু একটা ঘটছে এই এলাকায়, রবিন বলল। আমার বাবাও হারিয়ে গেছে।

মাথা ঝাঁকাল মালটি। চোখে বিষণ্ণতা। জনতার দিকে চোখ পড়তে তাকিয়ে রইল সেদিকে। হালকাপাতলা সেই লোকটা, যার সঙ্গে কথা বলেছিলেন মোড়ল, হাত নেড়ে মালটিকে ইশারা করছে।

তোমাদের পিকআপ রেডি, লাল চোখ ডলতে ডলতে বলল মালটি।

পথ দেখিয়ে গায়ের আরেক প্রান্তে তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে এল সে। পথে। কয়েকটা বেঁধে রাখা কুকুর দেখতে পেল ওরা, আর উঁচু উঁচু মাটির দেয়ালে একটা জায়গা ঘেরা। ওটা হলো শোধনাগার। দেহকে ওখান থেকে পবিত্র করে আনে লোকে।

একটা কথা বলতে পারবে? পকেট থেকে সিগারেটের গোড়া দুটো, বের। করে মালটিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর, এই জিনিস এখানে কে খায়?

না, অবাক হয়েছে মেয়েটা।

হতাশ হয়ে আবার ওগুলো পকেটে রেখে দিল গোয়েন্দাপ্রধান।

পুরানো ট্রাক আর জীপের মাঝে ঝকঝকে নতুন লাল একটা পিকআপ দেখে ওটা কার জিজ্ঞেস করল মুসা।

মোড়ল চাচার, মালটি বলল। খুব ভাল মানুষ। রাইফেলে দারুণ নিশানা। নতুন কাপড়, কাজের যন্ত্রপাতি আর গাড়ির পার্টস ভেঙে গেলে এনে দেন। আমাদের।

টাকা পান কোথায়? কিশোরের প্রশ্ন।

ত্যাগ করল মালটি। জানি না। ডায়মণ্ড লেকে পার্ট-টাইম কোন কাজ করেন বোধহয়। ওসব আমার ব্যাপার নয়, মাথাও ঘামাই না। রঙচটা, মরচে পরা একটা পুরানো ফোর্ড ফ-১০০ গাড়ির ফেণ্ডারে চাপড় দিল সে। এটাই তোমাদের দেয়া হয়েছে। যত্ন করবে। কাজ শেষে ডায়মণ্ড লেকে রেঞ্জার স্টেশনে রেখে যেও, তাহলেই হবে।

জিনিসপত্র যা সঙ্গে আনতে পেরেছে সেগুলো গাড়ির পেছনে রেখে সামনের সীটে উঠে বসল তিনজনে। সীটবেল্ট নেই। স্টিয়ারিঙে বসল মুসা। তিনজনের মাঝে সব চেয়ে ভাল ড্রাইভার সে।

উত্তর দিকে যাবে, বলে দিল মালটি। কিছু দূর গেলে একটা দোরাস্তা দেখতে পাবে, কাঠ ব্যবসায়ীরা তৈরি করেছে। পশ্চিমের কাঁচা রাস্তাটা ধরবে, তাহলেই পৌঁছে যাবে হাইওয়েতে। ডানে যাবে, ডায়মণ্ড লেকে চলে যেতে পারবে।

মালটিকে ধন্যবাদ দিল ওরা। ইঞ্জিন স্টার্ট দিল মুসা। হেসে, হাত নেড়ে ওদেরকে বিদায় জানাল মেয়েটা। রওনা হয়ে গেল ওরা। ব্যাকফায়ার করছে। পুরানো ইঞ্জিন। তবে চলছে। চাকার পেছনে ধুলো উড়ছে। ঘেউ ঘেউ করছে কুকুর।

যাক, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল মুসা, একটা গাড়ি পেলাম শেষ পর্যন্ত। পায়ে না হেঁটে চাকার ওপর গড়ানো।

হ্যাঁ, রবিন বলল। ধন্যবাদটা কিশোরেরই পাওনা। ও কথাটা মনে করেছিল। বলেই পেলাম।

সীটে হেলান দিয়ে আছে কিশোর। চুপচাপ।

পথের দিকে নজর দিল মুসা। সরু রাস্তা। উঁচু-নিচু। যেখানে-সেখানে মোড়। একটু অসতর্ক হলেই বিপদে পড়তে হবে। রেডউডের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে পাইনের বনে ঢুকল গাড়ি। পাহাড়ী উপত্যকায় ঢেউ খেলে যেন এগিয়ে গেছে পথ, একবার উঠছে একবার নামছে, একবার উঠছে একবার নামছে।

মোড়ল আমাদের পছন্দ করেনি, একসময় মুসা বলল।

শামান করেছে, বলল কিশোর। ও রাজি হওয়াতেই গাড়িটা পেলাম আমরা। ওর চেহারা দেখেছ, ভাবসাব, যখন দৈব নির্দেশ পাওয়ার কথা বলল জন? মেসেজের মানে বুঝতে পেরেছে, এবং বুঝে খুশি হতে পারেনি।

মালটির চাচার কি হয়েছে, বলো তো?

এক মাস অনেক সময়। রহস্য বলা চলে। আরেকটা রহস্য হলো ওই মানুষগুলোর আজব অসুখ। ভাইরাসের আক্রমণ হতে পারে, কিন্তু ভাবছি… আচমকা নীরব হয়ে গেল কিশোর। চিমটি কাটতে লাগল নিচের ঠোঁটে। কোন কিছু ভাবিয়ে তুলেছে ওকে।

যেখান থেকে রওনা হয়েছে, তার মাইল দুয়েক আসার পর চড়াই বাড়তে লাগল। অনেক খাড়া হয়ে এখানে উঠে গেছে পথ। সুগন্ধী পাইনের বনে ঝলমল করছে বিকেলের রোদ।

পাহাড়ের ওপরে উঠে জোরে জোরে ব্যাকফায়ার করতে লাগল ইঞ্জিন। থামল না। ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল গাড়ি। চড়াইটা যেমন খাড়া ছিল উতরাইটা তেমনি ঢালু। দ্রুত গতি বাড়ছে গাড়ির।

ব্রেক চাপল মুসা। গতি কমল গাড়ির। ব্রেক ছেড়ে দিতেই আবার বাড়তে লাগল, দ্রুত, আরও দ্রুত। পাশ দিয়ে সাঁ সাঁ করে সরে যাচ্ছে গাছপালা ঝোপঝাড়।

ব্রেক চাপল আবার মুসা। গতি কমল গাড়ির। হঠাৎ মেঝেতে গিয়ে লেগে গেল ফুট পেডাল। নিচের দিকে ছুটতে লাগল আবার গাড়ি। অকেজো হয়ে গেছে। ব্রেক।

খাইছে! চিৎকার করে উঠল মুসা, ব্রেকটা গেল?

.

০৯.

ক্রমেই গতি বাড়ছে পিকআপের। মাটিতে গভীর খাঁজ, অনেকটা রেল লাইনের মত কাজ করছে। তাতে ঢুকে গেছে চাকা। ফলে খাজ যেভাবে এগিয়েছে সেভাবেই চলতে হচ্ছে গাড়িটাকে, আর কোন দিকে ঘোরানোর উপায় নেই।

শক্ত করে স্টিয়ারিং ধরে রেখেছে মুসা। প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে ঝাঁকি খাচ্ছে পাশে বসা কিশোর। তার পাশে বসা রবিন আঁকড়ে ধরে রেখেছে প্যাসেঞ্জার ডোরের আর্মরেস্ট। মাঝে মাঝেই লাফিয়ে উঠছে তিনজনের শরীর, ছাতে মাথা বুকে যাওয়ার অবস্থা।

ইমারজেন্সি ব্রেক! চেঁচিয়ে বলল কিশোর।

সাংঘাতিক জোরে চলছে, জবাব দিল মুসা। কোন কাজই করবে না এখন!

তাহলে? রবিনও চিৎকার করেই বলল।

সামনে রাস্তা হয়তো ভাল, আশা করল কিশোর। ঝকির চোটে দাঁতে দাতে বাড়ি লাগছে তার।

গিয়ার নামানোর চেষ্টা করে দেখি, মুসা বলল।

ঘাম ফুটেছে মুসার কপালে। শক্ত করে চেপে ধরল স্টিকটা। দ্বিধা করল। পরক্ষণেই একটানে তৃতীয় গিয়ার থেকে নামিয়ে নিয়ে এল দ্বিতীয় গিয়ারে।

হঠাৎ এই পরিবর্তনে চাপ পড়ল ইঞ্জিনে, বিকট আর্তনাদ করে প্রতিবাদ জানাল। জোরে একবার দুলে উঠল গাড়ি, গতি কমে গেল।

খবরদার! চিৎকার করে উঠল রবিন, বাঁক! সামনে ডানে মোড় নিয়ে। পাহাড়ের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেছে পথটা।

তীব্র গতিতে মোড় নেয়ার সময় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল তিনজনেই। বৃষ্টিতে ধুয়ে মাটি ক্ষয়ে গিয়ে গাছের শেকড় বেরিয়ে আছে পাহাড়ের গা থেকে, লম্বা আঙুল বাড়িয়ে দিয়ে যেন চাকা আটকে গতি রোধ করতে চাইছে গাড়ির।

ডানে কাটল মুসা, পাহাড়ের দিকে।

কি করো! আঁতকে উঠে বলল রবিন।

পাহাড়ের গায়ে লাগিয়ে দিই! দেখি থামে কি না! জবাব দিল মুসা।

ঝটকা দিয়ে খাজ থেকে উঠে এল চাকা।

দেখো, আস্তে আস্তে! কিশোর বলল।

পথের কিনারে স্তূপ হয়ে আছে ধসে পড়া মাটি, ছোট ছোট পাথর। ঘ্যাঁচ করে ওগুলোর মধ্যেই ঢুকে গেল গাড়ি।

স্টিয়ারিং নিয়ে পাগল হয়ে গেছে যেন মুসা। হাত থেকে ছুটে যেতে চাইছে। বার বার। লাফাচ্ছে, ঝাঁকি খাচ্ছে, থরথর করে কাঁপছে পিকআপ।

আবার পাহাড়ের দেয়ালের দিকে গাড়ির নাক ঘোরানোর চেষ্টা করল মুসা। দেরি করে ফেলল। আলগা পাথরে পিছলে গিয়ে আবার খাজের মধ্যে পড়ল চাকা।

মরলাম আবার! মুসা বলল।

খাঁজ ধরে ছুটতে ছুটতে পরের বাকটার কাছে চলে এল গাড়ি, উড়ে পেরিয়ে এল যেন।

আরি! বলে উঠল রবিন, ওড়াল দেবে নাকি!

সামনে একটা ছোট পাহাড় দেখা গেল। ঢালটা খুব ধীরে ধীরে ওপরে উঠেছে, খাড়াই কম।

এইবার আরও মরলাম! ঘামে চকচক করছে কিশোরের মুখ।

গর্জন করতে করতে তীব্র গতিতে পাহাড়ের গোড়ার দিকে ধেয়ে গেল গাড়ি। উঠতে শুরু করল ঢাল বেয়ে। যেন সাগরের উথাল পাথাল ঢেউয়ে পড়েছে, দোল খেতে লাগল। ভয়াবহ গতিবেগ অব্যাহত রেখেছে।

স্টিয়ারিং ছাড়ছে না মুসা। চেপে ধরে রেখেছে প্রাণপণে। খোলা জানালার কিনার খামচে ধরেছে রবিন, যেন সারা জীবনের জন্যে ধরেছে, ছাড়ার ইচ্ছে নেই। দুজনের মাঝে বসে দরদর করে ঘামছে কিশোর। এক হাতে ড্যাশবোর্ডে, আরেক হাত ছাতে ঠেকিয়ে চাপ দিয়ে আটকে রাখার চেষ্টা করছে নিজেকে।

অনেক পেছনে সরে গেছে আগের পাহাড়টা। সামনে পথের দুধারে ঘন হয়ে জন্মেছে ঝোপঝাড়। ওপরে উঠতে গিয়ে ধীরে ধীরে গতি কমে আসছে পিকআপের।

কিছুটা স্বস্তি বোধ করল তিন গোয়েন্দা। চূড়াটা.মালভূমির মত সমতল হয়ে। থাকলে হয়তো থেমে যাবে গাড়ি…

সর্বনাশ! গাড়ি চূড়ায় পৌঁছতেই চিৎকার করে উঠল কিশোর।

গতি অনেকটা কমেছে, কিন্তু তারপরেও যা রয়েছে, অনেক। চূড়াটা সমতল নয়। লাফ দিয়ে চূড়া পেরোল গাড়ি, আঁকুনিতে হাড়গোড় সব আলাদা হয়ে যাবে বলে মনে হলো অভিযাত্রীদের, ওপাশের ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল। গতি বেড়ে গেছে আবার। সাট সাট করে পাশ দিয়ে উড়ে চলে যাচ্ছে যেন গাছপালা।

গাড়িটাকে বাগে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে মুসা। এরই মাঝে চিৎকার করে সঙ্গীদেরকে হুঁশিয়ার করল, শক্ত হয়ে বসে থাকার জন্যে।

কিন্তু থাকাটা মোটেও সহজ নয়। সীটবেল্ট নেই। ঝটকা দিয়ে দিয়ে এদিকে কাত হয়ে পড়ছে, ওদিকে কাত হয়ে পড়ছে, লাফ দিয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে। গাড়িটার যেন ম্যালেরিয়া হয়েছে, এমনই কাঁপুনি। সেই সঙ্গে নাচানাচি তো আছেই। আবার খাজের মধ্যে পড়ে গেছে চাকা।

নাহ, আর বাঁচোয়া নেই! কিশোর বলল, খুলে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। বডি!

তাই তো মনে হচ্ছে! জানালার ধার থেকে হাত সরায়নি রবিন।

হঠাৎ রাস্তার ডানপাশটা অদৃশ্য হয়ে গেল। গাছের মাথা চোখে পড়ছে, বেরিয়ে আছে নিচে থেকে, পথের ওপরে এসে পড়েছে ডাল পাতা। খানিক পরে আর তা-ও থাকল না। একশো ফুট নিচে খাড়া নেমে গেছে ওখানে পাহাড়ের দেয়াল, ঢাল নেই যে গাছ জন্মাবে। নিচে জন্মে রয়েছে পাইন, কাঁটাঝোপ। মাঝে মাঝে বেরিয়ে আছে পাথরের চাঙড়। ওগুলোর কোনটায় গিয়ে যদি আছড়ে পড়ে গাড়ি, ছাতু হয়ে যাবে।

যে খাজকে এতক্ষণ গালাগাল করছিল মুসা, সেটাকেই এখন আশীর্বাদ বলে। মনে হচ্ছে। বের করার তো এখন প্রশ্নই ওঠে না, ভেতরে রাখার জন্যেই যেন যত চিন্তা।

এই দেখো দেখো! উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করল মুসা।

সামনেই দেখা গেল ওটা, ওদের এই দুঃস্বপ্ন-যাত্রার অবসান ঘটাতেই যেন। মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে গ্র্যানিটের উঁচু দেয়াল। পুব থেকে পশ্চিমে বিস্তৃত। ডানে মোড় নিয়ে ওটার পাশ দিয়ে চলে গেছে পথ। যে গতিতে চলছে, যদি নাক ঘোরাতে না পারে, যদি সোজাসুজি গিয়ে…আর ভাবতে চাইল না মুসা। বলল, গাড়ির পাশটায় ঘষা লাগালে কেমন হয়? থেমেও যেতে পারে।

পাগলামি! স্রেফ পাগলামি! বিড়বিড় করে বলল কিশোর। গাড়ির পাশ ছিঁড়ে খুলে রয়ে যাবে!

আর ঘষা লাগলেই আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছুটবে, বলল রবিন। একটা কণা যদি গিয়ে লাগে ট্যাঙ্কে, ব্যস, ভ্রম!

আর কোন ভাল বুদ্ধি দিতে পার? রেগে গিয়েই বলল মুসা।

চুপ হয়ে গেল রবিন আর কিশোর। গাড়িটাকে রোখার আর কোন উপায়ই বলতে পারল না। পথের বাঁয়ে যেন আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে গ্র্যানিটের দেয়াল, চোখ বড় বড় করে সেদিকে তাকিয়ে রয়েছে দুজনে।

খেপা জানোয়ারের মত গর্জন করতে করতে ছুটছে ফোর্ড। জোরাজুরি করে আরও একবার খাজ থেকে চাকা তুলে আনল মুসা।

ঘাঅ্যাস করে দেয়ালে ঘষা লাগল পিকআপের এক পাশ। ঝনঝন করে উঠল। শরীর। আগুনের ফুলকি ছিটাল একরাশ।

চেঁচিয়ে উঠল রবিন।

আর কোন দিকে নজর নেই মুসার, দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে ধূসর দেয়ালের দিকে। আবার সামান্য বাঁয়ে স্টিয়ারিং কাটল সে। এ্যানিটে ঘষা খেল পিকাপের নাক। আবার ফুলকি ছুটল। আবার লাগাল। আবার ফুলকি।

গাড়ির ভেতরে টানটান উত্তেজনা।

যা করছ করে যাও, কিশোরও বুঝতে পারছে এছাড়া আর কোন উপায় নেই।

পারবে! আশা বাড়ছে রবিনের। মনে হচ্ছে পারবে এভাবেই। চালিয়ে যাও।

সাহস পেল মুসা। আবার কাটল স্টিয়ারিং। দেয়ালে তো লাগাল পিকআপ, এ্যানিটে ঘষা লেগে ছেড়ে যাওয়ার সময় তীক্ষ্ণ আর্তনাদ তুলল গাড়ির ধাতব শরীর, নাগাড়ে ফুলকি ছিটিয়ে চলেছে।

দরদর করে ঘামছে তিন গোয়েন্দা।

গতি কমে এল পিকআপের। এগোনর চেষ্টা করেও পারছে না। প্রচণ্ড চাপে গুঙিয়ে উঠছে বডি।

অবশেষে থামতে বাধ্য হলো গাড়ি। ইঞ্জিন চলছে। বন্ধ করে দিল মুসা। বা দিকের সামনের ফেণ্ডার ঠেকে রয়েছে দেয়ালে।

সীটে হেলান দিয়ে জোরে জোরে দম নিচ্ছে তিন গোয়েন্দা। হঠাৎ যেন বড় বেশি নীরব হয়ে গেছে সব কিছু। বাতাসে ধুলোর ঘূর্ণি। কেউ নড়ছে না, কোন, কথা বলছে না।

শেষে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে কিশোর বলল, মুসা, গাড়িটা তো গেল!

দামটা দিয়ে দিতে হবে! বলল রবিন।

ভাল ড্রাইভার বলে তোমার সুনাম আর থাকবে না!

কোন কথারই জবাব দিল না মুসা। কেবল ঘুরে তাকাল দুই বন্ধুর দিকে।

তবে যত যা-ই হোক, হেসে মুসার কাঁধ চাপড়ে দিয়ে বলল কিশোর, তোমাকে ধন্যবাদ দেয়ার ভাষা আমাদের নেই।

দেখালে বটে! রবিনও হাসল। চাপড় দিল মুসার বাহুতে।

হাসতে আরম্ভ করল মুসা। বাচলাম তো, কিন্তু বাঁচার আনন্দে সারাদিন বসে থাকলে চলবে না। কতটা ক্ষতি হয়েছে দেখা দরকার।

নেমে পড়ল ওরা।

বডির বাঁ পাশে রঙ বলতে আর কিছু নেই, ঘষা খেয়ে উঠে গেছে। মরচেও নেই। চকচক করছে ইস্পাত। লম্বা কাটা রয়েছে অনেকগুলো। ধারাল পাথরে লেগে ওই অবস্থা হয়েছে। দরজার হাতলটা গায়েব। সামনের ফেণ্ডারের একটা মাথা বেঁকে গেছে।

চমৎকার! ফিরে এসে আবার গাড়িতে উঠল মুসা।

তার পেছনে এল কিশোর।

মেঝেতে প্রায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল মুসা। মাথা চলে গেছে স্টিয়ারিং হুইলের নিচে। ফুট পেড়ালের রডটা পরীক্ষা করল। একটা বোল্ট তুলে নিল মেঝে থেকে।

কি ব্যাপার? অধৈর্য কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

স্টিয়ারিঙের নিচ থেকে বেরিয়ে এসে মাথা তুলল মুসা। নীরবে বোল্টটা তুলে দিল কিশোরের হাতে।

কিশোরও ভাল করে দেখল জিনিসটা। লোহাকাটা করাতের দাগ দেখতে পেল ওতে। অনেকটাই কেটেছে। দেখে তুলে দিল রবিনের হাতে। ব্রেক কেন কাজ করছিল না, বোঝা গেল এতক্ষণে।

ঠিক, আঙুল তুলল মুসা। ব্রেক পেডাল একটা শ্যাফটের সঙ্গে লাগানো থাকে, যেটার সঙ্গে মাস্টার সিলিণ্ডারের যোগাযোগ। পেডালে চাপ দিলেই সিলিণ্ডারের পিস্টন ব্রেক লাইনের ব্রেক ফ্লুইডের ওপর চাপ বাড়ায়…

আসল কথা বলো, বাধা দিয়ে বলল রবিন, কি বলতে চাও?

বলছি, বলছি। শ্যাফটের সাথে পেডালটাকে আটকে রাখতে এই বোল্টটা দরকার।

এবং কেউ এটাকে এমন ভাবে কেটে রেখেছে, যোগ করল কিশোর, যাতে বেশি জোরে চাপ পড়লেই ভেঙে যায়।

তা-ই করেছে, মাথা দোলাল মুসা।

গুঙিয়ে উঠল রবিন। ওর বাবাকে খুঁজতে যাওয়ার পথে আবার বিরাট বাধা এসে হাজির।

একে অন্যের দিকে তাকাতে লাগল তিনজনে।

কে করল কাজটা? রবিনের প্রশ্ন।

ইনডিয়ানদেরই কেউ হবে, জবাব দিল কিশোর।

মোড়ল? নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল মুসা। আমাদের পছন্দ করেনি, এটা বোঝা গেছে তখনই। কিন্তু এতটাই অপছন্দ যে খুন করার চেষ্টা করল?

জন করেনি তো? ভুরু কোঁচকাল রবিন।

কিংবা মালটি? বলল কিশোর।

নাহ, ও করবে বলে মনে হয় না, মুসা বলল।

যে-ই করে থাকুক, রবিন বলল, সাহায্যের জন্যে আর ওখানে যাওয়া যাবে না।

প্রশ্নই ওঠে না, বলল কিশোর। খুন করতে চেয়েছিল আমাদের, আবার যাব? যেতে হবে ডায়মণ্ড লেকে, যে করেই হোক। ব্রেকটা ঠিক করতে পারবে?

নতুন একটা বোল্ট পেতে পারি। কিন্তু পাব কোথায়?

ট্রাকের ভেতরে খুঁজে এল সে আর রবিন। কিছুই পেল না। একটা জ্যাকও না, সাধারণত যে টুলসটা সব গাড়িতেই রাখা হয়।

সেসনাতে পাওয়া যাবে না তো? মুসার দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর, পেছনের জিনিসপত্রের মাঝে টুলস দেখেছি বলে মনে পড়ে। বলেই আর দাঁড়াল না। পাহাড়ের দিকে রওনা হয়ে গেল।

হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে রইল মুসা আর রবিন।

আরি, ওই পাহাড়টাই তো! অবাক হয়ে প্রায় চিৎকার করে বলল মুসা।

মনে তো হচ্ছে, ওর দিকে না তাকিয়েই বলল কিশোর। ওটা ধরে তৃণভূমিতে যেতে পারব আমরা, বোল্ট নিয়ে ফিরে এসে ব্রেক মেরামত করে চলে যৗব ডায়মণ্ড লেকে, সাহায্য নিয়ে খুঁজতে বেরোব আঙ্কেলকে। খুব সহজ ভাবেই কথাগুলো বলল বটে কিশোর, কিন্তু আবার পাহাড় ডিঙিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতেই সিটিয়ে গেল মন। আরেকবার ওই ভয়ানক পরিশ্রম করতে মন চাইছে না।

ট্রাকের পেছন থেকে পানির বোতলটা নামিয়ে আনল রবিন। যার যার জ্যাকেট কোমরে জড়িয়ে নিল, ঠাণ্ডা পরলে গায়ে দেবে। এগিয়ে গেছে কিশোর। তার পেছনে চলল দুজনে। যে পথে এসেছে ওই পথ ধরেই পাহাড় বেয়ে উঠতে হবে। পিকআপের ঘষায় গ্র্যানিটের দেয়ালের গভীর আঁচড়গুলো দেখতে পেল ওরা। এক জায়গায় পড়ে থাকতে দেখল দরজার হাতলটা। এক লাথিতে রাস্তার পাশের এক ঝোপে পাঠিয়ে দিল ওটাকে রবিন।

কিছুদূর এগোনোর পর যেখানে রাস্তাটা দক্ষিণে ইনডিয়ানদের গায়ের দিকে চলে গেছে, সেখানে এসে পশ্চিমে মোড় নিয়ে বনের ভেতরে ঢুকে পড়ল ওরা।

খানিক পরেই ঘন হয়ে এল পাইন, উঁচু মাথাগুলোর ওপরটা বাঁকা হয়ে আছে। ধনুকের মত। পাখি ডাকছে প্রচুর। হালকা বাতাস দোলা দিয়ে গেল ডালে ডালে। বাইরে বিকেলের রোদ, অথচ বনের ভেতরে এখানে বেশ ছায়া, ঠাণ্ডাও।

হঠাৎ গুলির শব্দ হলো।

মুসার কানের পাশ দিয়ে চলে গেল বুলেট। থ্যাক করে বিধল একটা গাছে। কলরব করে উড়ে গেল একঝাঁক পাখি।

গুলির পর পরই ঝাঁপ দিয়েছে তিনজনে। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছে মাটিতে।

আবার গুলি হলো। মাথার ওপর দিয়ে বাতাস কাটার শব্দ তুলে বেরিয়ে গেল বুলেট। শুয়ে শুয়েই তাকাল ওরা পরস্পরের দিকে।

কেউ গুলি করছে ওদের লক্ষ করে!

১০.

গেল কোথায়? পেছনের বন থেকে বলল একটা কর্কশ কণ্ঠ।

দাঁড়িয়ে পড়লে কেন আবার? এস…অ্যাই ডক, বলল আরেকটা কণ্ঠ, খুঁজে বের করতে হবে ওদের। ঘন গাছপালার ভেতরে কথা বললে শব্দটা ঠিক কোনখান থেকে আছে বোঝা মুশকিল।

আমাদের গুলি করল কেন? মাটিতে গাল ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলল রবিন।

জানি না, ফিসফিস করেই জবাব দিল কিশোর। সেটা জানার চেষ্টা করতে যাওয়াটাও এখন গাধামি। এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল, এখানে পড়ে থাকাটা ঠিক না। খুঁজে বের করে ফেলবে।

অন্য দুজনও একমত হয়ে মাথা ঝাঁকাল। নিঃশব্দে উঠে পড়ল তিনজনে।

জলদি করো! পাইনের ভেতর দিয়ে চলার জন্যে তাগাদা দিল মুসা।

শব্দ না করে যতটা জোরে চলা সম্ভব তার পেছনে পেছনে চলল রবিন আর কিশোর। একপাশে রয়েছে এখন পাহাড়টা। তৃণভূমিটা পড়বে সামনে। সেদিকেই চলেছে ওরা।

আবার হলো গুলির শব্দ। ঝরঝর করে ওদের মাথায় ঝরে পড়ল পাইন নীড়ল।

ঝট করে বসে পড়ল আবার গোয়েন্দারা। চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে সরে এল বিরাট এক পাথরের চাঙরের আড়ালে।

গেল কই? ঘোৎ ঘোঁৎ করে উঠল আবার ডকের কণ্ঠ। পেছনের ঘন জঙ্গলে রয়েছে।

বিচ্ছু! একেবারে বি্চছু একেকটা! বলল দ্বিতীয় কণ্ঠটা।

ভারি পায়ে হাঁটছে লোক দুজন। সাবধান হওয়ার প্রয়োজনই বোধ করছে না। পায়ের চাপে মট করে ভাঙল শুকনো ডাল।

এদিকেই আসছে দেখে আবার উঠে পড়ল মুসা। পাইনের ভেতর দিয়ে প্রায় ছুটে চলল।

ওই, ওই যে! চেঁচিয়ে উঠল ডক। মার, মার!

গুলির শব্দ হলো। ছুটে এসে গোয়েন্দাদের আশপাশের মাটিতে বিধতে লাগল। বুলেট। ছিটকে উঠল মাটি।

দৌড় দাও! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।

ছায়ায় ছায়ায় ছুটছে সে। পেছনে লেগে রয়েছে কিশোর আর রবিন। যাতে পথ না হারায় সেজন্যে পাহাড়টাকে নিশানা করে রেখেছে। সব সময়ই এক পাশে রেখেছে ওটাকে। হাঁপাতে আরম্ভ করেছে কিশোর। মনে মনে গাল দিচ্ছে নিজেকে। কয়েক দিন ব্যায়াম করেনি, অবহেলা করে, তার ফল পাচ্ছে এখন।

ঘন একটা ম্যানজানিটা ঝোপ দেখে তার আড়ালে এসে লুকাল ওরা।

ওদের দেখেছ? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

না, মাথা নাড়ল রবিন। মাথা থেকে বাবার ক্যাপটা খুলে একহাতে নিল, আরেক হাতে মুখের ঘাম মুছল। তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে, না কিশোর? টমেটোর মত লাল হয়ে গেছে মুখ।

আক্কেল হচ্ছে! ব্যায়াম বাদ দিয়েছি, আনফিট হয়ে গেছে শরীর। যাবেই।

চলো, আবার তাড়া দিল মুসা। এখানে থাকলে ধরা পড়ে যাব।

ছায়ায় ছায়ায় আবার ছুটতে লাগল তিনজনে।

খসাতে পেরেছি? আরও কিছু দূর আসার পর রবিন বলল।

হয়তো, জবাব দিল কিশোর, ঠিক বলা যাচ্ছে না!

ছেড়ে দেয়ার পাত্র নয় ওরা, মুসা বলল, কথা শুনে তো তাই মনে হলো।

পশ্চিমে এগিয়ে চলল তিন গোয়েন্দা। পাহাড়টাকে আগের মতই এক পাশে। রেখেছে। যতটা সম্ভব গাছপালার ভেতরে থাকার চেষ্টা করছে। খোলা জায়গায় একদম বেরোচ্ছে না।

আরও মাইল দুই একটানা হাঁটল ওরা। পেরিয়ে এল প্রচুর বুনো ফুল, ঘন পাইনের জটলা, পাথরের চাঙড়, আর সেই টলটলে পানির ঝর্নাটা, যেটা থেকে পানি ভরেছিল রবিন।

আর কদ্দূর? মুসা জানতে চাইল।

ঠিক পথেই এগোচ্ছি মনে হচ্ছে, কিশোর বলল। আর বেশিক্ষণ লাগবে না।

মিনিটখানেক জিরিয়ে নিয়ে আবার হাঁটতে লাগল ওরা।

ওই যে! হাত তুলে দেখাল মুসা।

বিশাল তৃণভূমিটার দক্ষিণ পাশ দিয়ে বন থেকে বেরোল ওরা।

প্লেনটা কোথায়? বলে উঠল কিশোর।

তাকিয়ে রয়েছে তিনজনেই। চমকে গেছে। সেসনাটা নেই। ভাঙা ডানাটাও গায়েব! এ কি করে হয়?

দাঁড়াও, হাত তুলে অন্য দুজনকে এগোতে বারণ করল মুসা। সাবধানে গলা লম্বা করে তাকাল সামনের দিকে। আছে। লুকিয়ে রাখা হয়েছে ওটাকে!

তাই তো! বলল রবিন, ডালপাতা দিয়ে ঢেকে ফেলেছে! দেখো, আমাদের এস ও এসটাও নেই!

ওপর থেকে যাতে কেউ না দেখতে পায়, মুসা বলল।

বুঝলে, ধীরে ধীরে বলল কিশোর, কেউ আছে এখানে, যে আমাদেরকে পছন্দ করতে পারছে না।

তা তো বুঝতেই পারছি, রবিন বলল। কিন্তু কে? কেন?

পথ হারিয়েছ নাকি তোমরা? বলে উঠল ভারি একটা কণ্ঠ।

চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরল তিনজনে।

বিশালদেহী একজন মানুষ দাঁড়িয়ে। সোনালি চুল, চোখে বড় বড় কাঁচওয়ালা একটা সানগ্লাস। দক্ষিণ-পুবের বন থেকে বেরিয়ে ওদের দিকেই আসছেন।

সাহায্য লাগবে? আন্তরিক হাসি হাসলেন তিনি। পরনে খাকি পোশাক, পিঠে বাধা ব্যাকপ্যাক, ডান কাঁধে ঝোলানো চামড়ার খাপে পোরা রাইফেল। খাপের ঢাকনাটা খোলা, হাঁটার তালে তালে গায়ের সঙ্গে বাড়ি খাচ্ছে।

কোত্থেকে এলেন আপনি? জানতে চাইল মুসা। বেশ অবাক হয়েছে।

শিকারে বেরিয়েছি, জবাব দিলেন লোকটা। কপালটা আজ খারাপ, কিছুই পাইনি। এদিকটায় আগে আর. আসিনি। সিয়েরার এই এলাকা আমার কাছে। নতুন। মোটা, মাংসল একটা হাত বাড়িয়ে দিলেন তিনি। মুসার মনে হলো ভালুকের থাবা। আমার নাম ফ্রাঙ্কলিন জোনস। আবার হাসলেন তিনি। হাত মেলালেন তিন গোয়েন্দার সঙ্গে। ওরা পরিচয় দিল নিজেদের।

পরিচয়ের পর প্রথম কথাটাই জিজ্ঞেস করল রবিন, আপনার গাড়ি আছে, মিস্টার জোনস?

আছে, মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন জোনস। উঁচু পাহাড়টা দেখালেন হাতের ইশারায়, ওদিকটায়। অনেক দূরে। কাঠ নেয়ার একটা কাঁচা রাস্তা আছে উত্তরে। ডায়মণ্ড লেকে যাওয়ার হাইওয়েতে গিয়ে পড়েছে।

হোক দূর, হেঁটে যেতে কোন আপত্তি নেই আমাদের। চলুন।

এক মিনিট, জোনস বললেন, তোমাদেরকে লিফট দিতে আমারও আপত্তি নেই। কিন্তু জানতে হবে, দেয়াটা কতখানি জরুরী।

বিমান দুর্ঘটনা আর তার বাবার নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার কথা জানাল রবিন। শেষে বলল, তাড়াতাড়ি চলুন। বাবা কি অবস্থায় আছে কে জানে!

আর কিছু ঘটেনি তো? একটু আগে বুনের ভেতর গুলির শব্দ শুনেছি।

চট করে দুই সহকারীর দিকে তাকিয়ে নিল কিশোর। ওদের পেছনেই লেগেছিল লোকগুলো, গুলি করে মারতে চেয়েছিল, জোনসকে একথা বললে হয়তো তিনি ভয় পেয়ে যাবেন, ওদের আর লিফট দিতে রাজি হবেন না। তাই মিথ্যে কথা বলুল কিশোর, হবে হয়তো কোন শিকারি-টিকারি।

তাড়াতাড়ি করা দরকার, তাগাদা দিল রবিন।

দ্বিধা করলেন জোনস। মনে হচ্ছে, আরও ব্যাপার আছে, তোমরা লুকাচ্ছ আমার কাছে। ঠিক আছে, বলতে না চাইলে নেই। সাহায্য আমি করব তোমাদের।

তৃণভূমির মাঝখান দিয়ে আগে আগে রওনা হলেন জোনস। সোজা এগিয়ে। চলেছেন পাহাড়ের দিকে। ডানে রয়েছে রবিন, বায়ে কিশোর, আর মুসা রয়েছে পেছনে।

আপনার নামটা পরিচিত লাগছে, কিশোর বলল, বিখ্যাত লোক মনে হয় আপনি?

নাহ, তেমন কিছু না, হাসলেন জোনস। বেকারসফিল্ডে গোটা দুই ছোট রেস্টুরেন্ট আছে আমার। এখানে তোমার বাবা কেন এসেছিল, রবিন?

মিস্টার মিলফোর্ড একজন সাংবাদিক, সেকথা জোনসকে জানাল রবিন। ডায়মণ্ড লেকে খবর সংগ্রহ করতে যাচ্ছিল, সেকথাও বলল।

সিগারেট বের করলেন জোনস। আঁতকে উঠল মুসা, এরকম অঞ্চলে সিগারেট ধরানো ভয়ানক বিপজ্জনক, দাবানল লেগে যেতে পারে। বলতে যাচ্ছিল সেকথা। কিন্তু ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বলল কিশোর। যে সিগারেটটা বের করেছেন। জোনস, সেটাতে লম্বা ফিল্টার লাগানো, সাদা কাগজ, আর জোড়ার কাছে সবুজ বন্ধনী। যে দুটো গোড়া কুড়িয়ে পেয়েছে কিশোর, ঠিক একই রকম সিগারেটের। জোনস নামটাও চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু মনে করতে পারছে না কোথায় শুনেছে।

যে লোকটার কাছে যাচ্ছিল বাবা, বলছে রবিন, সম্ভবত তার নাম হ্যারিস হেরিং। পকেট থেকে বাবার নোটবুক বের করে দেখে নিল নামটা। হ্যাঁ, এই নামই। শুনেছেন নাকি নামটা কখনও?

আশ্চর্য! জোনস বললেন, সত্যিই অবাক লাগছে। ওকে চিনি না। কিন্তু আজ সকালে রেডিওতে শুনলাম, গতকাল ডায়মণ্ড লেকে যাওয়ার পথে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করে মারা গেছে হ্যারিস হেরিং নামে এক লোক। ছুটি কাটাতে এসেছিল সে। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে পাশের খাদে পড়ে গিয়ে আগুন ধরে যায়। গাড়িতে। সঙ্গে সঙ্গে মারা গেছে বেচারা!

তাই নাকি! নিঃশ্বাস ভারি হয়ে গেছে রবিনের।

চুপ হয়ে গেল তিন গোয়েন্দা। ভাবছে হেরিঙের মৃত্যুর কথা। জোনসের কাঁধে ঝোলানো রাইফেলের খাপের দিকে চোখ পড়ল কিশোরের। ঢাকনাটা বাড়ি খাচ্ছে বার বার। ঢাকনা ওপরে উঠলেই দেখা যাচ্ছে ভেতরের কালো ধাতব জিনিসটার শরীর। ফায়ার আর্মস সম্পর্কে আগ্রহ আছে তার। পড়াশোনা করেছে। রাইফেলটার আকারটা আর দশটা রাইফেলের মত নয়, পেটের কাছটায় ফোলা। শক্তিশালী অস্ত্র।

বুঝতে পারছি তোমরা আর মিস্টার মিলফোর্ড ইমপরট্যান্ট লোক, জোনস বললেন। তোমরা যে এখানে আছ কে কে জানে?

রবিন আর কেউ না বলে দেয়ার আগেই তাড়াতাড়ি জবাব দিয়ে দিল কিশোর, অল্প কয়েকজন। তাদের মধ্যে খবরের কাগজের লোকও রয়েছে।

তাই নাকি, রবিন? রবিনের দিকে ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন জোনস।

তার মাথাটা যখন আরেক দিকে ঘুরে গেছে, খাপের ডালা তুলে ভেতরের জিনিসটা ভালমত দেখার চেষ্টা করল কিশোর।

খচখচ করছে তার মন। সিগারেটের ব্যাপারটা কাকতালীয়, একথা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। মনে পড়েছে, ইনডিয়ানদের গায়ে লাঞ্চ খাবার সময় যে বাক্সগুলোকে ডিনার টেবিল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল, ওগুলোতে জোনস। ট্রাকিং কোম্পানির নাম লেখা ছিল দেখেছে। একটা কুঁড়ের সামনে ফেলে রাখা সমস্ত বাক্সতে দেখেছে একই নাম ছাপ মারা। ওই কুঁড়েতে দেখা গেছে হালকাপাতলা লোকটাকে, যার সঙ্গে কথা বলেছিলেন মোড়ল, যে ইশারায় মালটিকে জানিয়েছে গাড়ি তৈরি। তার মানে মিথ্যে কথা বলেছেন জোনস, এর আগেও তিনি এসেছেন এই অঞ্চলে। ঘন ঘন এসেছেন।

আড়চোখে কিশোরের দিকে তাকাল রবিন। রাইফেল কেসের ভেতরে দেখার চেষ্টা করছে কিশোর, এটা দেখে অবাক হলো সে। দ্রুত একবার চোখ মিটমিট করেই সামলে নিল। কিশোরকে সাহায্য করা দরকার এখন। মুখে মধুর হাসি ফুটিয়ে তুলে জোনসের দিকে তাকাল সে। কিশোরের কথাই সমর্থন করে জবাব দিল তার প্রশ্নের, হ্যাঁ, জানে। আমাদের যাওয়ার কথা সিটি এডিটরকে জানিয়েছে। বাবা। ম্যানেজিং এডিটরকেও জানিয়ে রেখেছে, কারণ হোটেলের বিলগুলো ওই মহিলাকেই শোধ করতে হবে।

পাশে কাত হয়ে ঝুঁকে এসেছে, খাপের ভেতর উঁকি দেবে এই সময় আচমকা দাঁড়িয়ে গেলেন জোনস।

ঝট করে খাপ থেকে হাত সরিয়ে আনল কিশোর। ঝুঁকে জুতোর ফিতে বাঁধার ভান করল, যেন খুলে গেছে ওটা।

শেষবারের মত লম্বা একটা টান দিয়ে জ্বলন্ত সিগারেটটা মাটিতে ফেলে জুতো দিয়ে পিষে মারলেন জোনস। এরকম জায়গায় সিগারেটের গোড়া ফেলাটা যেন সইতে পারল না মুসা, অনেক সময় জুতো দিয়ে থেঁতলানো সিগারেটেও আগুন থেকে যায়, পুরোপুরি নেভে না, আর সেটা থেকে সৃষ্টি হয় আগুন, বিড়বিড় করে এসব কথা বলে নিচু হয়ে গোড়াটা তুলে নিয়ে পকেটে রেখে দিল, নিরাপদ জায়গায় নিয়ে গিয়ে ফেলবে বলে।

তোমরা কখন যাচ্ছ বলা হয়েছে? আবার হাঁটতে আরম্ভ করেছেন জোনস। উঁচু, ধূসর দেয়ালটার কাছে প্রায় পৌঁছে গেছেন তারা।

গতকালই যাওয়ার কথা ছিল, রবিন বলল। বুঝে ফেলেছে, জোনসকে বিশ্বাস করতে পারছে না কিশোর, কাজেই সেই মতই কথা বলতে লাগল গোয়েন্দা সহকারী।

রবিনের দিকে তাকিয়ে তার সঙ্গে কথা বলছেন জোনস, এই সুযোগে আরেকবার ডালা তুলে ভেতরে দেখার চেষ্টা চালাল কিশোর। হেসে ঠাট্টা করে মাঝে মাঝেই মুসা বলে ওকে, পকেটমার হলেও তুমি উন্নতি করতে পারতে। বাপরে বাপ, কি হাত সাফাই! আসলেই, কাজটা খুব ভাল পারে গোয়েন্দাপ্রধান। অনেক সময় বাজি ধরে মুসা আর রবিনের পকেট মেরে দিয়েছে, টেরই পায়নি। ওরা।

তাহলে তো তোমাদেরকে খুঁজতে কাউকে পাঠাবেই ওরা, জোনস বললেন।

খাপের ভেতরে দেখার জন্যে সাবধানে পাশে ঝুঁকে এল কিশোর।

যে-কোন মুহূর্তে সার্চ পাটি চলে আসতে পারে, রবিন বলল।

আরও তাড়াতাড়ি করা দরকার, মুসা বলল। ওরা এসে পড়ার আগেই আমরা চলে যেতে পারলে ঝামেলা বাঁচত। বলতে বলতে জোনসের একেবারে পাশে চলে এল সে, কিশোরের কাছে, সে-ও দেখার চেষ্টা করল খাপের ভেতরে কি আছে।

রাইফেলের ওপরের ক্যারিইং হ্যাঁণ্ডেল দেখতে পেল কিশোর। অস্ত্রটার অস্বাভাবিক আকৃতির মানে বুঝে ফেলল।

হঠাৎ আরেকবার দাঁড়িয়ে গেলেন জোনস।

এই কি করছ! রাগত গলায় বললেন তিনি। বলেই কিশোরের হাতটা চেপে ধরে এক ঝটকায় সরিয়ে দিলেন। পিছিয়ে গেলেন এক পা। সরু হয়ে এল চোখের পাতা। খাপ থেকে টান দিয়ে বের করে নিলেন রাইফেল।

হু, যা ভেবেছি, বিড়বিড় করল কিশোর, এম সিক্সটিন! খাপটা তৈরিই হয়েছে এভাবে, যাতে এম-১৬ রাইফেলের বিশেষ হ্যাঁণ্ডেল, পিস্তল গ্রিপ আর ফোলা ম্যাগাজিন জায়গা হয়ে যায়।

কি বলো? কিশোরের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল রবিন।

এম সিক্সটিন প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল ভিয়েতনামের যুদ্ধে, বলতে থাকল। কিশোর, দুরুদুরু করছে বুক। এখন পৃথিবীতে বেশ জনপ্রিয় অস্ত্র এটা। তবে এগুলো ব্যবহার হয় মানুষ শিকারের জন্যে, জানোয়ার নয়। কে আপনি, মিস্টার, জোনস? আমাদেরকে নিয়ে কি করার ইচ্ছে?

চেয়েছিলাম ভাল কিছুই করতে, জবাব দিলেন জোনস, তোমরা তা হতে দিলে না। বেশি ছোঁক ছোঁক করলে তার ফল ভাল হয় না কোনদিনই। আর কোন উপায় রাখলে না আমার জন্যে। যাও, পাহাড়ে চড়। আমার সঙ্গেই যেতে হচ্ছে। তোমাদের।

.

১১.

এই, এসো তোমরা, মিনমিন করে বলল কিশোর, মিস্টার জোনসের মাথা গরম করে দিয়ে লাভ নেই। পাহাড়ের দিকে এগিয়ে চলল সে।

কিশোরের দিকে তাকিয়ে তার এই আচমকা পরিবর্তনে অবাক হয়ে গেল রবিন আর মুসা। কি করতে চাইছে? ভাল অভিনেতা কিশোর পাশা। ছোট বেলায় মোটোরামের অভিনয় করে বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল। অভিনয় যে করছে বোঝাই মুশকিল, মনে হয় এক্কেবারে স্বাভাবিক। তবু, যেহেতু চেনে ওকে, দুই সহকারীর মনে হলো, এই মুহূর্তে অভিনয়ই করছে সে।

হাঁট! শীতল কঠিন গলায় আদেশ দিল সোনালিচুল লোকটা।

হাঁটতে লাগল রবিন আর মুসা। পেছনে রাইফেল তাক করে ধরে এগোল জোনস।

মিস্টার মিলফোর্ডের কাছেই নিয়ে যাচ্ছেন তো আমাদের? ফিরে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করল কিশোর।

চুপ! ধমক দিয়ে বলল জোনস, কোথায় নিয়ে যাব সেটা আমার ব্যাপার। একদম চুপ!।

আপনিই তাহলে আমার বাবাকে কিডন্যাপ করেছেন? বিশ্বাস করতে পারছে না রবিন। কেন করলেন?

তোমাদের মতই ছোঁক ছোঁক করছিল, বিশেষ করে তোমার ওই বন্ধুটির মত, কিশোরকে দেখিয়ে বলল জোনস। সেজন্যেই আটকাতে হল। লাভ হয়নি কিছুই। একটা কথাও বের করতে পারিনি মুখ থেকে।

নীরবে পশ্চিমমুখো হেঁটে চলল ওরা। পাহাড়ে চড়ার জন্যে একটা সুবিধেমত জায়গা খুঁজছে। জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে কিশোর, জিভ বের করে ফেলবে, যেন কুকুরের মত। এত জোরে হাঁটাবেন না আমাদেরকে, প্লীজ! অনুনয় করে বলল।

হাঁট! আবার ধমক লাগাল জোনস। আস্তে যাওয়া চলবে না!

হাউফ! করে মুখ দিয়ে বাতাস ছাড়ল কিশোর। শেওলায় ঢাকা একটা পাথরে পা ফেলল ইচ্ছে করেই, সড়াৎ করে পিছলে গেল পা, চিত হয়ে পড়ে গেল রবিনের গায়ে।

টলে উঠল রবিন। তাল সামলাল কোনমতে।

চোখ মিটমিট করল মুসা। পরক্ষণেই বুঝে ফেলল কি চালাকি করেছে কিশোর আর রবিন।

ভ্রূকুটি করল জোনস। দ্বিধায় পড়ে গেছে।

একটা মুহূর্তের দ্বিধা। সেটাই কাজে লাগাল মুসা। পাই করে ঘুরল। কারাতের প্রচুর প্র্যাকটিস চিতার মত ক্ষিপ্র করে তুলেছে ওকে। চোখের পলকে সোজা হয়ে গেল ভাজ করা কনুই, থাবা লাগল রাইফেলে। কারাতের হাইশু-ইউঁকি। জোর। থাবা খেয়ে একপাশে সরে গেল ভারি রাইফেলের নল।

ভাগ! ভাগ! চিৎকার করে বলল রবিন আর কিশোরকে।

পলকে যেন পায়ে হরিণের গতি চলে এল দুই গোয়েন্দার। তৃণভূমির ওপর দিয়ে ছুটল পশ্চিমের বনের দিকে।

এক লাফে সামনে চলে এল মুসা। শক্ত ঘুসি লাগাল জোনসের পুরু বুকে, কারাতের ওই-জুকি।

টলে উঠল যেন পাহাড়। পিছিয়ে গেল জোনস। ভারসাম্য হারাল। হাত থেকে রাইফেল ছাড়ল না।

বনের দিকে দৌড় দিল মুসা।

শট শট করে গাছে বিধল একঝাঁক বুলেট। বাতাসে উড়তে লাগল পাইনের নীড়ল, বাকল আর ধুলো। ভয়ে চিৎকার করে, আকাশে উড়ল পাখি। ঝাঁপ দিয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা। বুকে হিঁচড়ে চলে এল ঝোপের ভেতর।

ডক! হিলারি! চেঁচিয়ে ডাকল জোনস। কোথায় গেলে? আলসের দল! জুলদি বেরোও! ধর ব্যাটাদের! পালানর চেষ্টা করছে!

মাথা তুলল মুসা। তৃণভূমিতে রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা জোনসকে দেখতে পাচ্ছে। লোকটার হাতে বেরিয়ে এসেছে একটা ওয়াকি-টকি। সেটাতেই কথা বলে আদেশ দিচ্ছে।

ডক সেই দুজনের একজন, রবিন বলল ফিসফিসিয়ে, যারা বনের ভেতর তাড়া করেছিল আমাদের। গলা খুবই কর্কশ।

তাহলে হিলারি নিশ্চয় অন্য লোকটা, কিশার অনুমান করল। ওরা আমাদের খেদিয়ে নিয়ে গিয়ে জোনসের মুখে ফেলেছিল। তখনই বোঝা উচিত ছিল আমার, এত সহজে পিছ ছেড়ে দিল দেখেই। জোনসের সিগারেট আর প্যাকিং বাক্সের গায়ে লেখা নাম বিশ্লেষণ করে কি বের করেছে, দুই সহকারীকে জানাল সে।

অসম্ভব, মানতে পারল না রবিন। পিকআপটাকে স্যাবোটাজ সে করেনি। ছিলই না গাঁয়ে, কি করে করবে?

আমার বিশ্বাস, মুসা বলল, শয়তানীটা মোড়লের।

আপাতত ওসব চিন্তা বাদ, কিশোর বলল, পরে ভাবা যাবে। চলো, চলো।

বাবার কি হবে? রবিন জিজ্ঞেস করল।

একটা ব্যাপারে আমরা এখন শিওর, কিশোর বলল, জোনসের কথা থেকে। আঙ্কেল জীবিতই আছেন। আগে আমাদের এই বিপদ থেকে মুক্তি পেতে হবে। তারপর খুঁজে বের করব তাকে।

তুণভূমির দিকে তাকাল তিনজনেই। বনের দিকে তাকিয়ে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে জোনস।

গুলি বাঁচাচ্ছে ব্যাটা, কিশোর বলল। আমাদের না দেখে শিওর না হয়ে গুলি করবে না।

আস্তে করে উঠে দাঁড়াল তিনজনে। মাথা নিচু করে পা টিপে টিপে এগোল বনের দিকে।

ওই যে! ওই তো! ডকের কর্কশ কণ্ঠ শোনা গেল।

ছয় কদম দৌড়ে গিয়ে যেন হোঁচট খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল গোয়েন্দারা।

তাকিয়ে রয়েছে আরেকটা এম-১৬ রাইফেলের দিকে।

এবার রাইফেল তাক করেছে কালো চুল, রোদে পোড়া চামড়া, নীল চোখওয়ালা একটা লোক। নলের মুখ ঘোরাচ্ছে একজনের ওপর থেকে আরেকজনের ওপর। ধীরে ধীরে হাসি ফুটল ঠোঁটে, ঠোঁটেই রইল, মুখে ছড়াল না হাসিটা।

ধরেছি, বলল লোকটা। ওর কণ্ঠস্বরেই বুঝতে পারল গোয়েন্দারা, হিলারি।

বাঁ দিক থেকে বেরিয়ে এল আরেকজন। তার হাতেও একটা এম-১৬।

পালিয়ে বাঁচতে আর পারলে না, তিন গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে বলল ডক। ছোটখাট শরীর, খাটো করে ছাঁটা বাদামী চুল, ঘন ভুরু। মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধি তেমন নেই ছেলেগুলোর। বেপরোয়া, এই যা।

পেছন থেকে শোনা গেল জোনসের কথা, যাও, নিয়ে চল ওদের। অনেক পথ যেতে হবে।

কি বলল শুনলে তো? গোয়েন্দাদেরকে বলল ডক। হট।

শ্রাগ করল মুসা। চুপ করে রইল রবিন আর কিশোর। আদেশ পালন না করে আর উপায় নেই।

কি হলো! ধমকে উঠল ডক, দাঁড়িয়ে আছ কেন?

বলেই ভুলটা করল। মুসার পিঠে চেপে ধরল রাইফেলের নল।

গোড়ালিতে ভর দিয়ে পাক খেয়ে ঘুরে গেল মুসা। একপাশ থেকে থাবা দিয়ে ধরে ফেলল নল। ওভাবে ধরেই জোরে এক ঠেলা দিয়ে বাঁটের গুতো মারল ডকের। পেটে। হুক করে উঠল লোকটা। হা হয়ে গেছে মুখ। হাসফাস করছে বাতাসের জন্যে।

দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। পড়তে আরম্ভ করল।

রবিনও চুপ করে রইল না। ঝট করে পা সোজা করে অনেক উঁচুতে তুলে হফেলল। লাথি চালাল, কারাতের ইওকো-গেরিকিয়াজ হিলারির চোয়ালে লাগল লাথিটা। টলে উঠে পিছিয়ে গেল হিলারি। এক লাফে আগে বেড়েই আবার একই কায়দায় লাথি মারল রবিন। কাটা কলাগাছের মত ঢলে পড়ে গেল হিলারি।

এক দৌড়ে পাইনের জটলায় ঢুকে পড়ল কিশোর। বনের প্রান্তে থাকা জোনসের ওপর তার জুডোর প্র্যাকটিসটা করার ইচ্ছে। তবে শেষ মুহূর্তে পরিকল্পনা বাতিল করে দিল সে। জুডো কারাত কোনটারই দরকার পড়ল না। গাছের আড়াল থেকে শুধু একটা পা হঠাৎ বাড়িয়ে দিল সামনে। কিছুই আন্দাজ করতে পারেনি জোনস, সতর্ক ছিল না, কিশোরের পায়ে হোঁচট খেল।

ততক্ষণে মুসাও পৌঁছে গেছে সেখানে। কনুই দিয়ে অতোশি হিজি-আতি মারল জোনসের ঘাড়ে। হাত-পা ছড়িয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল মাটিতে বিশালদেহী। লোকটা।

মুহূর্ত দেরি করল না তিন গোয়েন্দা। এক ছুটে ঢুকে পড়ল জঙ্গলে।

পেছনে, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগল জোনস, ধর, ধর ওদেরকে! পালিয়ে গেল তো!

থামল না ছেলেরা। গাছের পাশ কাটিয়ে, পাথর ডিঙিয়ে ছুটে চলেছে দক্ষিণে। পেছনে শোনা যাচ্ছে ভারি জুতো পায়ে ছুটে আসার শব্দ।

ক্লান্ত হয়ে পড়ছে ওরা। হতাশা বাড়ছে, যখন দেখছে জুতোর শব্দ থামছে না, কাছেই আসছে আরও।

পশ্চিমে ঘুরে একটা কাঁচা রাস্তা ধরে ছুটল মুসা। রাস্তাটা চিনতে পারল রবিন। ঝর্না থেকে পানি ভরতে এসেছিল সেদিন এই পথেই।

একটা বুদ্ধি বের করতে হবে,হাঁপাতে হাঁপাতে বলল কিশোর। এভাবে চলে পারব না!

বাবাকেও বাঁচাতে হবে! বলল রবিন।

পেছনে উত্তেজিত চিৎকার শোনা গেল।

রাস্তাটা পেয়ে গেছে ব্যাটারা, মুসা বলল।

রাস্তা ধরে ছুটলে ঠিক এসে আমাদেরকে ধরে ফেলবে, বলল রবিন।

পিকাপের কথা ভুলে যেতে হবে আমাদের, ছুটতে ছুটতেই বলল কিশোর। মুসা, জোনস যে রাস্তাটার কথা বলেছে সেটা খুঁজে বের করতে পারবে?

কাঠ নেয়ার রাস্তা, বিড়বিড় করল মুসা, হাইওয়েতে গিয়ে যেটা পড়েছে। মালটি বলেছিল অবশ্য ওটার কথা। ইনডিয়ানদের রাস্তাটা বোধহয় ওটাতেই পড়েছে।

হ্যাঁ, মাথা দোলাল কিশোর। বনের ভেতর কিভাবে বাঁচতে হয়, জানা আছে তোমার। ইস, কেন যে তোমার মত ট্রেনিংটা নিলাম না, কাজে লাগত! বাঁচলে ফিরে গিয়ে নিশ্চয় নেব এবার…

কি করতে হবে সেকথা বলো? বাধা দিয়ে বলল মুসা।

তুমি বেশি দৌড়াতে পার। তোমার গায়ে শক্তি বেশি। বনে বেঁচে থাকার। ট্রেনিং আছে। ডায়মণ্ড লেকে গিয়ে কেউ যদি পৌঁছতে পারে, সেটা তুমি।

হয়তো পারব। কি বলতে চাও?

আমি বুঝেছি, রবিন বলল, জোনস আমাদের পিছে লেগে থাকুক, এই তো চাও?

হ্যাঁ,সায় জানাল কিশোর।

দ্রুত একবার হাত মিলিয়ে নিয়ে, গুড বাই আর সি ইউ এগেন বলে পথ থেকে সরে গেল মুসা। হারিয়ে গেল গাছপালার আড়ালে। জোনসের লোকেরা কিশোর আর রবিনকে তাড়া করে নিয়ে যাওয়ার পর আবার এসে পথে উঠবে সে, চলতে থাকবে ডায়মণ্ড লেকের উদ্দেশে।

ছুটে চলেছে কিশোর আর রবিন।

লুকিয়ে পড়ার জায়গা খোঁজা দরকার, কিশোর বলল।

উপত্যকায় চলে গেলে কেমন হয়? বিপদে পড়েছি আমরা, ইচ্ছে করে তো যাচ্ছি না। আশা করি ইনডিয়ানদের মরা দাদারা কিছু মনে করবে না।

ভাল বলেছ! ভীষণ হাঁপাচ্ছে কিশোর।

পথের একটা চওড়া জায়গায় এসে থামল রবিন। এবার আর জোনসও আসছে কিনা না দেখে যাচ্ছি না। আর গিয়ে ওর মুখে পড়তে রাজি নই।

হাসল কিশোর। তারপর হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, রবিন, আমি আর পারছি না! বসতে আমাকে হবেই!

তোমার তো সব সময়ই খালি বসা লাগে! চিৎকার করেই জবাব দিল রবিন। তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না! এরকম সময়েও…।

একটা ভুরু উঁচু হয়ে গেল কিশোরের। ভাবল, আসলেই বলছে না তো? অভিনয় বলে মনেই হলো না। বলল, পার আর না-ই পার, আমি বসছি!

চুপ হয়ে গেল দুজনে। কান পেতে রইল। তিনজনই আসছে, সন্দেহ নেই। দুপদাপ দুপদাপ শোনা যাচ্ছে ওদের পায়ের শব্দ।

সর্বনাশ হয়ে গেছে! বলে উঠল রবিন।

কী?

বোতলটা উঁচু করে ধরল রবিন।

ও, দেয়া হয়নি!

না, মাথা নাড়ল রবিন। পানির অভাবেই শেষে মরে কিনা কে জানে!

.

১২.

লুকিয়ে থেকে কিশোর আর রবিনের কথা সবই শুনতে পেল মুসা। একটু পরেই ভারি পায়ের শব্দ ছুটে চলে গেল তার পাশ দিয়ে।

মুসার কল্পনায় ভেসে উঠল, ভয়ঙ্কর এম-১৬ রাইফেলের চেহারা, যেগুলো বহন করছে জোনস আর তার সহকারীরা। দুই বন্ধুর জন্যে ভাবনা হতে লাগল। তার। জোর করে ঠেলে সরাল মন থেকে দুশ্চিন্তা। ভাবলে কাজ কিছু হবে না। এখন তাকে যা করতে হবে, তা হলো ডায়মণ্ড লেকে পৌঁছানো। নিজেদের কাঁধে। বিপদ নিয়ে তাকে মুক্ত করে দিয়েছে কিশোর আর রবিন, মস্ত ঝুঁকি নিয়েছে, এখন সে যদি কিছু করতে না পারে, সবই বিফলে যাবে।

সারাদিনে অনেক পরিশ্রম করেছে। বিশ্রাম নিতে পারলে ভাল হত। কিন্তু সময় নেই। আর এই মুহূর্তে আলস্যকে প্রশ্রয় দিলে পস্তাতে হবে। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। পায়ের শব্দ আরেকটু এগিয়ে যাওয়ার সময় দিল। তারপর চলতে শুরু করল একটা বিশেষ ভঙ্গিতে, লাফ দিয়ে দিয়ে, এভাবে চললে গতিও বাড়বে, ক্লান্তও হবে কম। দুর্গম অঞ্চলে টিকে থাকার জন্যে ট্রেনিং নেয়ার সময় এটা শেখানো হয়েছে ওকে।

ঠাণ্ডা হয়ে আসছে আবহাওয়া। বাতাস বাড়ছে। শরশর কাঁপন তুলছে গাছের পাতায়।

জন্তুজানোয়ার চলার সরু একটা পথ ধরে এগোল সে। তৃণভূমিতে বেরিয়ে ওটার ধার দিয়ে এগোল পাহাড়ের দিকে। সাবধান থাকল। দেখেছে, ডক আর হিলারি ছাড়া জোনসের সঙ্গে আর কোন সহকারী নেই, তবু বলা যায় না। খোলা জায়গায় বেরোল না কিছুতেই, গাছের আড়ালে আড়ালে থাকল।

পাহাড়ের কাছে পৌঁছেই ওপরে উঠতে শুরু করল। নিচে থাকার চেয়ে এখন ওপরে থাকা নিরাপদ। নির্জন মালভূমিটার ওপরে উঠে হাঁপ ছাড়ল। দম নিতে নিতে তাকিয়ে দেখল নিচে কোথাও কিছু দেখা যায় কিনা। এখানেই কোথাও রবিনের বাবার ক্যাপটা পড়ে ছিল। সম্ভবত এখান থেকেই ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাকে। কিন্তু কেন? জবাব খুঁজে পেল না।

বনে ছাওয়া পর্বতের ঢালের দিকে তাকাল সে। বাতাসের বেগ আরও বেড়েছে। এত ওপরে এমনিতেই বেশি থাকে। পাতলা টি-শার্ট ভেদ করে যেন। ছুরির ফলার মত বিধতে লাগল। জ্যাকেট কোমরে জড়ানো রয়েছে, স্পেস ব্ল্যাঙ্কেটটা পকেটে। দুটোই লাগবে, তবে পরে। রবিনের কাছ থেকে বোতলটা না এনে ভুল করেছে। মনে পড়েছে অনেক দেরিতে। ফিরে যাওয়ার উপায় ছিল না। তখন আর। খাবার বলতে সাথে রয়েছে কিছু ক্যাণ্ডি, তবে এটুকু আছে যে এর জন্যেই ধন্যবাদ দিল ভাগ্যকে।

উত্তরে ঘুরল সে। কাঁধে আর পিঠে পড়ছে রোদ। লক্ষ্য রাখতে হবে এটা। এখন সূর্যই তার একমাত্র কম্পাস।

ঘন হয়ে জন্মে থাকা কতগুলো গাছের কাছে উঠে গেছে পাহাড়ের একটা চূড়া। সেখানে উঠে এল সে। পথ খুঁজতে লাগল। কিছুই নেই, কোন পথই চোখে পড়ল না। শেষে গাছের ফাঁক দিয়ে এগিয়ে চলল উত্তরে।

খাড়া হয়ে আসছে ঢাল। চলার গতি আপনাআপনিই কমে গেল ওর। দিগন্তের দিকে দ্রুত নেমে চলেছে সূর্য। খাড়াই বেয়ে ওঠার পরিশ্রমে ঘামে ভিজে গেছে ওর শরীর।

একটা জায়গায় এসে সমান হয়ে এগিয়ে গেল কিছুদূর পথ, তারপর আবার। উঠে গেল। _ একটা শৈলশিরায় এসে পড়ল মুসা। দাঁড়িয়ে গেল। তাকিয়ে রয়েছে নিচের দিকে।

অবাক কাণ্ড! অলৌকিক ব্যাপার মনে হচ্ছে ওর কাছে।

পুবে-পশ্চিমে চলে গেছে একটা কাঁচা রাস্তা, ইনডিয়ানদের পথটার দ্বিগুণ চওড়া। মনে হয় এটাই সেই রাস্তা, কাঠ চালান করার জন্যে তৈরি করা হয়েছে, মালটি যেটার কথা বলেছিল।

শৈলশিরা থেকে নেমে এসে পথের ওপর দাঁড়াল মুসা। একটা কাজের কাজ হয়েছে পথটা পেয়ে গিয়ে। দারুণ খুশি লাগছে ওর। অন্ধের মত আর বনের ভেতরে পথ হাতড়ে মরতে হবে না। এখন একটা গাড়ি যদি পেত, ইস্…

হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যথা হয়ে গেছে। যেতে হবে আরও অনেক দূর। পঁচিশ তিরিশ মাইলের কম না। হাইওয়েতে পৌঁছে একটা গাড়ি পেলে বেঁচে যেত।

পশ্চিমে চলতে লাগল সে। ডুবন্ত সূর্যের শেষ আলোর উজ্জ্বল বর্শাগুলো এসে লাগছে চোখেমুখে। হাঁটতে হাঁটতেই কোমর থেকে খুলে নিল জ্যাকেটটা। দ্রুত নেমে যাচ্ছে তাপমাত্রা।

ডুবে গেল সূর্য। দেখা দিল ভরা চাঁদ। একটা পুলের কাছে পৌঁছল সে। দুটো সরু নদী পরস্পরকে ক্রসের মত কেটেছে যেখানে, ঠিক তার ওপরে তৈরি হয়েছে পুল। ঠাণ্ডা বাতাসে কুয়াশার মত এক ধরনের বাষ্প উড়ছে। পাইনের গন্ধে বাতাস, ভারি। পানি দেখে পিপাসা টের পেল, কিন্তু খাওয়াব সাহস করতে পারল না।

পুলের অন্য পাশে এসে থামল সে। চাঁদের আলোয় মনে হলো, মূল রাস্তাটা থেকে আরেকটা রাস্তা নেমে চলে গেছে। ভাল করে তাকাতে বুঝল, রাস্তাই। হবে। হয়তো ফরেস্ট সার্ভিসের ফায়ার রোড। নিচের দিকে নেমে গিয়ে এগিয়ে গেছে নদীর ধার ধরে। ঘুরতে আসা মানুষকে ঠেকানোর জন্যেই বোধহয় একটা গেট তৈরি করা হয়েছে এক জায়গায়, নতুন খিল লাগানো, চাঁদের আলোয় চকচক করছে ওটার রূপালি রঙ। সরু রাস্তা আর নদীটা পাশাপাশি এগিয়ে গিয়ে ঢুকেছে। পাহাড়ের মাঝের একটা গিরিপথের মত ফাঁকের ভেতরে।

রাস্তাটা উত্তেজিত করে তুলল মুসাকে। আশা হলো। তবে সেটা মিলিয়ে গেল অচিরেই, যখন মনে পড়ল, এসব জায়গায় ফরেস্ট সার্ভিসের লোক সব সময় থাকে না। ক্বচিত কদাচিৎ দেখতে আসে, সব কিছু ঠিকঠাক আছে কিনা। এসব রাস্তা তৈরি করে রাখা হয়েছে দাবানল লাগলে নিভাতে যাওয়ার জন্যে। জরুরী অবস্থা না দেখলে ফরেস্ট সার্ভিসের কর্মীদের এখানে আসার কোন কারণ নেই।

যা করছিল তা-ই করতে লাগল মুসা। আবার এগিয়ে চলা। চলতে চলতেই ক্যাণ্ডি খেয়ে নিল সে। ক্লান্তি বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে ঠাণ্ডা। পর্বতের দিক থেকে ভেসে আসছে কয়োটের ডাক, মন ভারি করে দেয় ওই শব্দ। ভীষণ নিঃসঙ্গতা বোধ চেপে ধরে যেন।

.

মুসা যখন বনের ভেতরে ঢুকে ঘাপটি মেরে ছিল, রবিন আর কিশোর তখন ছুটছে। পেছনে ধাওয়া করছে ভারি পায়ের শব্দ। ওরা যত জোরে ছুটছে, পেছনের লোকগুলো আরও জোরে ছুটছে। না ধরে আর ছাড়বে না।

ওই শব্দ শোনার ভাল দিকও আছে, মন্দ দিকও আছে। ভাল দিকটা হল, লোকগুলো মুসাকে দেখতে পায়নি। আর মন্দ দিকটা হলো ধরা পড়তে যাচ্ছে দুজনে, যদি ওদের চোখে ধুলো দেয়ার কোন ব্যবস্থা এখনই করতে না পারে।

নদীর কাছে পৌঁছে গেল ওরা, ইনডিয়ানদের টুয়ক। নদীর ধার ধরে উজানের দিকে ছুটল। শেষ বিকেলের জোরাল বাতাস নদীর পানি ছুঁয়ে এসে ঝাঁপটা মারছে ওদের মুখে। সালফারের গন্ধ জ্বালা ধরাচ্ছে চোখে।

আগে আগে ছুটছে রবিন। আগের দিন যে পাথুরে পথটা ধরে গিয়েছিল, যতটা সম্ভব সেটাকে এড়িয়ে থাকতে চাইছে। দম ফুরিয়ে গেছে ওদের। ক্লান্তিতে পা আর চলতে চাইছে না। সগর্জনে ঝরে পড়ছে জলপ্রপাত, অনেকগুলো নালা দিয়ে গড়িয়ে চলেছে পানি, রোদ পড়ে চিকচিক করছে।

বাআহ, চমৎকার! প্রপাতের দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর, এখানেই ধসের কবলে পড়ে মরতে বসেছিলে নাকি?

হ্যাঁ, ভাটির দিকে তাকিয়ে রয়েছে রবিন। ওই যে, আসছে!

কিশোরও তাকাল সেদিকে। প্রায় আধ মাইল দূরে বড় একটা পাথরের চাঙড়– ঘুরে আসছে তিনজন লোক। সবার আগে রয়েছে জোনস। কাঁধে ঝোলানো এম ১৬ রাইফেল। ওপরের দিকে তাকিয়েই দেখে ফেলল গোয়েন্দাদের। ডক বোধহয় বলল কিছু, এতদূর থেকে তার কর্কশ কণ্ঠ শোনা গেল না, কেবল মুঠি পাকিয়ে নাড়াচ্ছে যে সেটা দেখা গেল।

আর এখানে থাকা চলবে না! কিশোর বলল।

দ্রুত আবার জঙ্গলে ঢুকে পড়ল রবিন। পেছনে রইল কিশোর। কিছুদূর এগিয়ে থামল রবিন। পাহাড়ের খাড়া দেয়ালের দিকে মুখ। হাত বাড়িয়ে একটা খাজ চেপে ধরল। আরেকটা খাজে পা রাখল। বেয়ে উঠতে লাগল সে।

কিশোরও রবিনের মত একই ভাবে এক খাজে আঙুল বাধিয়ে আরেক খাঁজে পা রেখে উঠতে শুরু করল। ককিয়ে উঠল। সারাদিনের দৌড়াদৌড়ির পর এখনকার এই পরিশ্রমটা অসহনীয় লাগছে। কপালের ঘাম চোখের পাতায় পড়ে অস্বস্তি লাগছে, মুখেও ঘাম। হাতের তালু ঘামছে। আঙুল পিছলে না গেলেই হয় এখন।

রবিনের অতটা কষ্ট হচ্ছে না। পাহাড় বেশ ভালই বাইতে পারে সে। ছোট বেলা থেকে এই অভ্যেস। পাহাড়ে চড়তে গিয়ে গড়িয়ে পড়ে পা-ও ভেঙেছে। তার। পরেও লোভটা ছাড়তে পারে না সে। তবে এই মুহূর্তে ভাল না লেগে বরং বিরক্তিই লাগছে। কোন ব্যাপারে বাধ্য করা হলে যা হয় আর কি মানুষের।

নিশ্চিত ভঙ্গিতে উঠে চলেছে রবিন। একটি বারের জন্যে আঙুল ছুটছে না, পা ফসকাচ্ছে না।

কিশোর অতটা সহজ ভাবে পারছে না। অনেক নিচে রয়ে গেছে সে।

খাড়া দেয়াল বেয়ে প্রপাতের ওপরে উঠে গেছে রবিন। এর ওপাশেই রয়েছে। ইনডিয়ানদের প্রাচীন সমাধি উপত্যকা।

হাত-পা ভীষণ ভারি লাগছে কিশোরের। টনটন করছে। থরথর করে কাঁপছে হাত। মনে হচ্ছে অবশ হয়ে যাবে। এখন হাত অবাধ্য হয়ে গেলে…আর ভাবতে পারছে না সে। গালাগাল করছে নিজেকে, এই পাহাড়ে চড়া আরম্ভ করেছিল বলে। বাঁচতে চাইলে উঠতেই হবে এখন, হাল ছেড়ে দেয়ার আর কোন উপায় নেই।

ঠিক এই সময় ডান পা পিছলাল তার। এতই আচমকা, বুঝতেই পারেনি এরকমটা ঘটবে। মাটি থেকে পঞ্চাশ ফুট ওপরে রয়েছে, প্রপাতের পানির কণা উড়ে এসে আশপাশের পাথরকে ভিজিয়ে বরফের মত পিচ্ছিল করে রেখেছে। ডান পা-টাকে তুলে আনার চেষ্টা করতেই পিছলে যেতে শুরু করল ডান হাত।

মরিয়া হয়ে আঙুলগুলোকে আটকে রাখতে চাইল সে। বুকের খাঁচায় পাগল হয়ে গেছে যেন হৃৎপিণ্ডটা, ধড়াস ধড়াস করে লাফ মারছে, বেরিয়ে আসার ষড়যন্ত্র! অনেক চেষ্টা করছে কিশোর, কিছুতেই আটকে থাকছে না আঙুলগুলো। হাতের দিকে তাকাল একবার। ছুটে গেল আঙুল।

সময় যেন স্থির হয়ে গেছে।

জায়গামত রয়েছে কেবল এখন ওর বাঁ হাত আর বাঁ পা।

নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে শরীর। ভয়ে দেয়ালের উঁচুতে একপাশের কজা খুলে যাওয়া দরজার পাল্লার মত ঝুলছে সে। এইবার আর আমার মৃত্যু কেউ ঠেকাতে পারল না, ভাবল। নিচের পাথরে পড়ে ছেচে ভর্তা হয়ে যাব!

কিশোর! ওর অবস্থা দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে রবিন।

সাদা হয়ে গেছে কিশোরের মুখ।

জলদি মুখ চেপে ধর দেয়ালে! চিৎকার করে বলল রবিন। নিচের দিকে তাকাবে না! ভয় যেন অক্টোপাসের বাহু দিয়ে জড়িয়ে চাপ দিচ্ছে ওর বুকে। কিশোরকে বাঁচাতেই হবে। ডান কাঁধটা নাড়াও! ডান পা সরিয়ে নিয়ে যাও দেয়ালের দিকে। খুব আস্তে।

কিন্তু নড়লও না কিশোর।

কি ব্যাপার? শুনতে পায়নি নাকি? আরও জোরে চিৎকার করে ডাকল রবিন, কিশোর! সাড়া পেল না এবারেও। সাহায্য করতে হলে ওর কাছে যেতে হবে। নামতে শুরু করল সে।

রবিন যে আসছে বুঝতে পারল কিশোর। তবে দেখতে পাচ্ছে না। মৃদু খসখস কানে আসছে। নিজে তো বিপদে পড়েছেই, আরেকজনকেও বিপদে ফেলতে যাচ্ছে মনে হতেই বিদ্রোহী হয়ে উঠল মন। ধমক দিল নিজেকে, এই গর্দভ! ভয় দূর কর। এভাবে মরার কোন অর্থ হয় না!

পৌঁছে গেল রবিন। কিশোরের ফ্যাকাসে মুখে বেপরোয়া ভাব দেখতে পেল সে। তাকিয়ে রইল রবিন। বুঝতে পারল, আবার চালু হয়ে গেছে কিশোরের খুলির ভেতরে সাংঘাতিক সজাগ ক্ষুরধার মগজটা। এইবার ঠিকমত শ্বাস নিতে পারল রবিন। আশা হল, বেঁচে যাবে এযাত্রা ওর বন্ধু।

হঠাৎ ঝটকা দিয়ে আগে বাড়ল কিশোরের মুখ। কেঁপে উঠল ডান, কাঁধটা, আস্তে আস্তে এগিয়ে যেতে শুরু করল দেয়ালের দিকে। তারপর এগোতে শুরু করল ডান পা।

ডান হাতটা নড়ে উঠল। পাথরের গা হাতড়ে হাতড়ে আঁকড়ে ধরার জায়গা। খুঁজছে। পেলও। পা-টা ঢুকিয়ে দিল আরেকটা খাজে। দেয়ালে বুক ঠেকিয়ে বিশ্রাম নেয়ার চেষ্টা করল, যদিও এই অবস্থায় বিশ্রাম হয় না।

হয়ে গেছে, কিশোর, পেরেছ! আনন্দে চোখ দিয়ে পানি এসে যাওয়ার জোগাড় হলো রবিনের। আর ভয় নেই। এসো, ওঠো আমার পিছে পিছে। ওপরে চ্যাপ্টা একটা জায়গা আছে, ঝোপ আছে, লুকিয়ে থাকতে পারব। আমাদেরকে দেখতে পাবে না ওরা। এসো, কিশোর, আর বেশি ওপরে নেই।

শক্ত হয়ে গেছে যেন বাঁ হাত। নড়াতে পারবে না আর কোনদিনই, পাথরের সঙ্গে থেকে থেকে পাথরই হয়ে গেছে। দুত্তোর বলে জোর করে হাতটা সরিয়ে নিয়ে এল কিশোর। ওপরে বাড়াল। ধরল আরেকটা খাঁজ। আত্মবিশ্বাস বাড়ল। আবার উঠতে লাগল।

ওপরে ওপরে উঠছে রবিন। অবশেষে উঠে গেল সরু একটা শৈলশিরায়। শিরার কিনারে গজিয়ে আছে কাঁটাঝোপ। মাথা কাত হয়ে আছে নিচের দিকে। ওই ঝোপের ওপাশে কোনমতে চলে যেতে পারলেই হল, লুকিয়ে বসতে পারবে, নিচে থেকে দেখা যাবে না ওদেরকে।

এসে গেছে ওরা! বলল রবিন, আরেকটু তাড়াতাড়ি করো!

পারল না কিশোর। সেই একই রকম শামুকের গতি। হাত-পা যে আর ফসকাচ্ছে না, এতেই খুশি সে। তাড়াহুড়া করার ক্ষমতাই নেই। দীর্ঘ অনেকগুলো যুগ পার হয়ে যেন অবশেষে রবিনের কাছে উঠে আসতে পারল সে। ওপরে উপুড় হয়ে শুয়ে নিচের দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিল রবিন। কিশোরের একটা হাত চেপে ধরে তাকে শৈলশিরায় উঠতে সাহায্য করল।

যাক, পারলে শেষ পর্যন্ত! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রবিন।

কিছু বলল না কিশোর। গড়িয়ে গড়িয়ে কোনমতে ঢুকল ঝোপের ভেতর। চুপ করে বসে চোখ মুদল।

কতটা কাছে এল? খসখসে গলায় জিজ্ঞেস করল সে।

অনেক কাছে, রবিন জানাল। দেখো না।

প্রপাত থেকে ওঠা শীতল বাষ্প উড়ছে বাতাসে। উপত্যকার দিক থেকে আসা বাতাসের ঝাঁপটায় উড়ে চলে যাচ্ছে, সেই জায়গায় ঠাই নিচ্ছে নতুন বাষ্প। চোখ মেললেই জ্বালা করে। তবু জোর করে তাকিয়ে রয়েছে জোনস আর তার সঙ্গীদের। দিকে। প্রপাতের কাছে প্রায় পৌঁছে গেছে ওরা।

শয়তানগুলো গেল কোথায়? ফোঁস করে উঠল জোনস। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে তাকাতে লাগল পাহাড় আর বনের দিকে।

প্রপাতের গর্জনকে ছাপিয়েও তার কথা শোনা যাচ্ছে। চিৎকার করে বলল, তোমাদের দোষ! গাধা কোথাকার! আটকাতে পারলে না!

এখানেই কোথাও আছে ওরা, বসো! হিলারি বলল।

বের করে ফেলব! বলল ডক।

তাহলে করছ না কেন? খেঁকিয়ে উঠল জোনস। কিছুতেই পালাতে দেয়া চলবে না। ওই খুঁতখুঁতে সাংবাদিকটাকে আটকেই ভেবেছিলাম সব ঠিক হয়ে। যাবে। ছেলেগুলো যে এতটা বিচ্ছু কল্পনাই করতে পারিনি!

সাংবাদিক কথাটা শুনে পরস্পরের দিকে তাকাল দুই গোয়েন্দা।

মনে হচ্ছে, ফিসফিস করে বলল কিশোর, কোন কিছুর তদন্ত করে রিপোর্ট লিখতে এসেছিলেন আংকেল, সে জন্যেই তাকে আটকানো হয়েছে। ডায়মণ্ড লেকের গল্পের সঙ্গে এসবের কোন সম্পর্ক আছে।

ভাবছি, হেরিং লোকটা কে? কি জানে?

এমন ভাবে সারতে হবে, জোনস বলছে, যাতে মনে হয় অ্যাক্সিডেন্ট।

তা করা যাবে। হেরিংকে যা করেছি তা-ই করব। পাথরে মাথা ঠুকে আগে বেহুশ করে নেব। তারপর ফেলে দিলেই হবে, ডক বলল।

আবার একে অন্যের দিকে তাকাল কিশোর আর রবিন। খুব চমকে গেছে। জোনসের লোকেরা খুন করেছে হেরিংকে!

না, একই কাজ করতে গেলে সন্দেহ করবে পুলিশ, জোনস বলল। ধরে নিয়ে গিয়ে প্লেনের ভেতরে ভরতে হবে সব কটাকে। ধাড়িটাকে সহ। তারপর দেবে আগুন লাগিয়ে। যাতে মনে হয় ল্যাণ্ড করার সময় পুড়ে মরেছে। আরেকটা অ্যাক্সিডেন্ট। কেউ ধরতে পারবে না।

তা পারবে না, প্রতিধ্বনি করল যেন ডক।

আগে ধর ওদের, জোনস বলল। ডক, তুমি চলে যাও। বিচ্ছুগুলোকে ধরতে সময় লাগবে মনে হচ্ছে। আজ রাতে আরেকটা চালান আসবে। ওটা তুমি সামলাও গিয়ে।

আমি! হতাশ হয়েছে মনে হল ডক।

হ্যাঁ, তুমি। ছেলেগুলোকে ধরে আনব আমরা। তারপর ইচ্ছে হলে আগুন লাগানোর কাজটা তুমিই করো।

উজ্জ্বল হলো ডকের মুখ। ঠিক আছে। ঘুরে জোর কদমে নদীর দিকে রওনা হয়ে গেল সে।

কিসের চালান? রবিনের প্রশ্ন।

হবে কোন কিছু, কিছু ভাবছে কিশোর, রবিনের কথায় মন নেই।

চলো, হিলারি, সঙ্গীকে বলল জোনস, এই প্রপাতের ওপাশে একটা উপত্যকা আছে। ওখানে লুকানোর কথা ভাবতে পারে ছেলেগুলো।

দেয়াল বেয়ে উঠতে শুরু করল সে।

হাসল হিলারি, বেরিয়ে পড়ল বেকাতেড়া কুৎসিত দাঁত। কাঁধে ঝোলানো এম-১৬টা একবার টেনেটুনে দেখে বসের পিছু নিল সে-ও। উঠতে আসতে লাগল রবিন আর কিশোর যেখানে লুকিয়েছে।

পাথর হয়ে গেল যেন দুই গোয়েন্দা। লোকগুলো উঠে এলেই দেখে ফেলবে ওদেরকে।

১৩.

সাবধানে বেয়ে বেয়ে উঠে আসছে জোনস আর হিলারি। আগের দিন যে সিঁড়িটা দিয়ে উঠেছিল রবিন, সেটা দেখে ফেলল জোনস। ওঠা অনেক সহজ হয়ে গেল তার জন্যে।

হিলারির কাছে বোধহয় অতটা সহজ লাগছে না। ওর ভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

উঠে আসছে দুজনে। জানে না, ওদের মাথার ওপরেই লুকিয়ে রয়েছে যাদেরকে খুজছে।

কিশোর, এবার? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল রবিন।

এখনও হাত-পা কাঁপছে কিশোরের। তবে মগজটা ঠিকমতই কাজ করছে। বেরিয়ে থাকা একটা গাছের শেকড় ধরে টান দিল। কিছু হল না। আরও জোরে টানল। উঠে এল শেকড়, সাথে করে নিয়ে এল ধুলো, মাটি, পাথর।

ওপর দিকে তাকাল জোনস আর হিলারি। কয়েকটা পাথর গড়িয়ে গেল ওদের দিকে। সাথে করে নিয়ে নামতে লাগল আলগা পাথর আর মাটি। বাড়ি লেগে বড় পাথরও নড়ে উঠল। আরেকবার বাড়ি লাগতেই খসে গিয়ে ধসের সৃষ্টি করল।

তাড়াতাড়ি দুপাশে সরে গেল দুজন লোক।

ধসটা নেমে গেল ওদের মাঝখান দিয়ে।

বস… শুরু করতে যাচ্ছিল হিলারি, ওর গলা কাঁপছে। নিশ্চয় হাতও কাঁপছে।

হয়েছে, আর উঠতে হবে না, জোনস বলল। এখানে ওঠেনি ওরা। ওঠার উপায় নেই। যে হারে ধস নামে! নিশ্চয় বনের মধ্যে লুকিয়েছে। আজ রাতটা নদীর কিনারে কাটাব আমরা। কাল সকালে আবার খুঁজতে বেরোব।

চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা আস্তে আস্তে ছেড়ে বুক খালি করল রবিন। তারপর বলল, বাঁচালে, কিশোর!

নেমে যাচ্ছে জোনস আর হিলারি।

ওরা দৃষ্টির বাইরে চলে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল কিশোর আর রবিন। তারপর উঠে এগিয়ে চলল শৈলশিরা ধরে। যতই এগোচ্ছে, চওড়া হচ্ছে শিরাটা। ওপর থেকে এখন উপত্যকাটা দেখতে পাচ্ছে ওরা। গাছগাছালিতে ছেয়ে আছে, ঘন সবুজ।

সূর্য ডুবছে। লম্বা লম্বা ছায়া ছড়িয়ে দিয়েছে উপত্যকার ওপর। মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে নদীটা, বেশ চওড়া হয়ে। দুধারে গজিয়ে উঠেছে লম্বা ঘাস, ঘন ঝোপঝাড়। এখানে ওখানে বাষ্প উড়ছে, নিশ্চয় গরম পানির অনেক ঝর্না রয়েছে ওখানে। উপত্যকার আরেকটা প্রান্ত এত দূরে, চোখেই পড়ে না।

রবিনের দিকে তাকিয়ে কিশোর বলল, তোমার চোখ তো লাল। আমার কি অবস্থা?

কিশোরের চোখের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল রবিন। একেবারে গায়ের লোকের মত। কি যেন মনে পড়তে বলল, এই শোনা শোনো, জনের চোখ কিন্তু লাল ছিল না। যেদিন আমরা তাকে দেখেছি সেদিন গাঁয়ের বাইরে থেকে এসেছিল। মনে হচ্ছে গন্ধই ওদের ক্ষতিটা করে। ওরা রয়েছে ভাটিতে, নদীর কিনারে। বাতাস গন্ধকের গন্ধ উড়িয়ে নিয়ে যায় সোজা ওদের দিকে।

তা নেয়, কিশোর বলল। তবে যে হারে অসুস্থ, মনে হয় শুধু গন্ধকের গন্ধে নয়। আরও কোন কারণ আছে। তার হাত-পায়ের কাপুনি এখনও রয়েছে। পাহাড় বেয়ে নামার কথা ভাবতেই মুখ কালো হয়ে গেল। ইস, রাতটা এখানেই থেকে যেতে পারলে ভাল হত! কিন্তু উপায় নেই। আবার নামতে আরম্ভ করল। রবিনের পিছু পিছু। ওঠাটা যত কঠিন, নামা ততটা নয়, তাই কোন রকম বিপদ না ঘটিয়ে নিরাপদেই পা রাখতে পারল নিজের ঘাসে। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। স্বস্তির।

নেমেই চারপাশে চোখ বোলাল সে। কাছাকাছি যে কটা ফার্ন জাতীয় গাছ দেখল, সবগুলোর পাতা, ডাল, ফুল বাদামি হয়ে গেছে। নদীর পানির রঙ ধূসর, তীরের কাছে পানিতে পাতলা সরের মত জমে রয়েছে।

দেখো, রবিনকে বলল সে।

দেখল রবিন। কি মনে হচ্ছে?

অস্বাভাবিক লাগে, তাই না?

পানির দুষণ?

হতে পারে। আমার চোখ জ্বালা করছে। চলো এখান থেকে চলে যাই।

উঁচু পাহাড়ের ওপাশে ডুব দিয়েছে সূর্য। সোনালি রশ্মি আর ঢুকতে পারছে না, এখানে। ঠাণ্ডা, কালো কালো ছায়া ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। জ্যাকেট গায়ে দিয়ে নদীর ধার ধরে এগোল দুজনে। পানির ধারে ঘন হয়ে জন্মে থাকা ঘাস, লতাপাতা, ঝোপ সব বাদামী হয়ে গেছে, পানির একেবারে লাগোয়াগুলো মরেই গেছে প্রায়।

ঢালের ওপরেই রয়েছে ওরা, তবে এত কম ঢালু, অন্য প্রান্তের দিকে না, তাকালে বোঝাই যায় না। ওপাশটা এখান থেকে উঁচুতে। পাহাড়ের পাথুরে দেয়াল জায়গায় জায়গায় ক্ষয়ে গেছে অগণিত ধসের ঘষায়।

এখন তো মনে হচ্ছে, আমাদের প্লেন অ্যাক্সিডেন্টটাও অ্যাক্সিডেন্ট নয়, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর, ঘটানো হয়েছে। পকেট থেকে একটা ক্যাণ্ডি বের করে খেতে লাগল সে।

তা কি করে হয়? পানি খাওয়ার জন্যে বোতলের মুখ খুলল রবিন।

তা-ই হয়েছে। প্রথমে ইলেকট্রিক সিসটেম নষ্ট হয়ে গেল, ক্যাণ্ডি চিবাতে চিবাতে বলল কিশোর। নামতে বাধ্য হলাম আমরা। তোমার বাবাকে কিডন্যাপ করার জন্যে তৈরি হয়ে ছিল ফ্র্যাঙ্কলিন জোনস।

তাই তো! চোখ বড় বড় করে ফেলল রবিন। তার মানে স্যাবোটাজ করা হয়েছে প্লেনটাকে?

হ্যাঁ। জোনস কিংবা তার কোন সহকারী করেছে কাজটা।

নীরবে খেল কিছুক্ষণ দুজনে। তারপর রবিন জিজ্ঞেস করল, এখন কি করা? বাবাকে বের করতেই হবে।

আপাতত হাঁটতে হবে আমাদের। আমার বিশ্বাস, উপত্যকাটা উত্তর-দক্ষিণে ছড়ানো। তার মানে কাঠ পারাপারের রাস্তাটা রয়েছে সামনে। গেলে হয়তো মুসার সঙ্গেও দেখা হয়ে যেতে পারে আমাদের। কিংবা ফরেস্ট সার্ভিসের সঙ্গে।

তা ঠিক। এদিক দিয়ে গেলে অবশ্য আরেকটা সুবিধে, জোনস আমাদের পিছু নিতে পারবে না। দেয়াল ডিঙানোর সাহস নেই ওর।

আরেকটা কাজ হতে পারে, যোগ করল কিশোর, হয়তো জানতে পারব কি কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ছে ইনডিয়ানরা।

খাওয়া শেষ করে ক্যাণ্ডির মোড়কগুলো পকেটে রেখে দিল ওরা। বুনো এলাকার প্রতিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট করতে চায় না, যেমন আছে তেমনি থাক।

অন্ধকার হয়ে আছে উপত্যকা। ওপরে তারা ঝিলমিল করছে। ধীরে ধীরে পাহাড়ের কিনারে উঁকি দিল বিশাল চাঁদ।

পরিশ্রমে ভেঙে পড়ছে শরীর, কিন্তু বিশ্রামের উপায় নেই। চাঁদের আলোয়। পথ দেখে দেখে এগিয়ে চলল ওরা। নদীর ধার ধরে। সামনে বড় পাথর কিংবা ঝোপঝাড় পড়লে সেগুলো ঘুরে এসে আবার আগের রাস্তা ধরছে। আধ মাইল মত চলার পর একটা জলাভূমি পড়ল, সরে আসতে বাধ্য হলো ওরা, একদিকের দেয়ালের কাছে। জলাভূমি শেষ হয়ে গেছে কিছুটা এগিয়ে, আবার নদীর দিকে ঘুরতে গিয়েই বরফের মত জমে গেল যেন রবিন। যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে গেল স্থির হয়ে। ঘাড়ের রোম খাড়া হয়ে গেছে।

কি হয়েছে? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

নীরবে হাত তুলে দেখাল রবিন। ফুট বিশেক দূরে মাটিতে পড়ে জ্বলছে সাদা সাদা কি যেন।

কিশোরের হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল।

আমি যা ভাবছি তা-ই ভাবছ? তোতলাতে শুরু করল রবিন।

কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে ধীরে ধীরে এগোল ওরা। যতই কাছে এগোল আরও ভাল করে দেখতে পেল, সাদা জিনিস অনেক বেশি জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে আছে। ঘাস আর ঝোপের ভেতর থেকে ফুটে বোরোচ্ছে ফেকাসে আলো। বাতাস বয়ে গেলে ঘাসে ঢেউ জাগে, তাতে মনে হয় ভেতরের সাদা রঙটাই বোধহয় কাঁপছে।

আরেকটু এগিয়ে থামল দুজনে। থরথর করে কাঁপছে রবিন। কিশোরেরও কাঁপুনি শুরু হয়েছে, তবে সেটা ঢাকা দেয়ার চেষ্টা করছে সে।

ওদের প্রায় পায়ের কাছেই পরে রয়েছে একচিলতে সাদা রঙ, দূর থেকে এটাকেই দেখেছিল।

দে-দেখ, কত লম্বা! কোনমতে বলল রবিন।

একটা টিবিয়া, হাড়টার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। বয়স্ক লোকের। ইনডিয়ানদের সমাধিতে চলে এসেছি আমরা।

দেখার কোন ইচ্ছেই ছিল না আমার! বিকৃত হয়ে গেছে রবিনের কণ্ঠ। ধসটস নেমে বোধহয় মাটির নিচ থেকে বের করে দিয়েছে হাড়গুলোকে। কতগুলো আছে, আন্দাজ করতে পারো? পাথর আর মাটির একটা বড় স্কুপের কাছে জড় হয়ে আছে হাড়গুলো, ধসটা নেমেছিল পাশের পাহাড় থেকে।

ওই আরেকটা ঢিবিয়া, কিশোর বলল। ওই যে ওটা ফিমার, ওগুলো পাজরের হাড়, ওটা মেরুদণ্ড ভাঙা। চাঁদের আলোয় চকচক করছে হাড়গুলো। পুরো একটা কঙ্কালই বোধহয় রয়েছে এখানে।

ওই যে খুলিটা! গায়ে কাটা দিল রবিনের।

খুলির চোখের জায়গায় কালো কালো বড় দুটো গর্ত। ছোট কালো একটা তিনকোনা গর্ত, নাক ছিল যেখানটায়। হাঁ হয়ে আছে চোয়াল, দুই সারি দাঁত নীরব বিকট হাসিতে ফেটে পড়ছে যেন।

দাঁড়াও তো দেখি! এগিয়ে গিয়ে ঝকঝকে একটা জিনিস তুলে নিল কিশোর। কোমরের বেল্টের রূপার একটা বাকস, মাঝখানে ইয়া বড় এক নীলকান্তমণি বসানো।

দেখেটেখে রবিন বলল, একেবারে জনেরটার মত দেখতে।

কঙ্কালটা তার হারিয়ে যাওয়া চাচারও হতে পারে, বাকলসটা পকেটে রেখে দিল কিশোর।

কিন্তু চাচা তো নিখোঁজ হয়েছে একমাস আগে। এত তাড়াতাড়ি হাড়ের এই দশা…

জানোয়ারে খেয়ে সাফ করে দিয়ে যেতে পারে।

খুলিটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। ভয়টা চলে গেছে। তার জায়গায়। ঠাই নিয়েছে বিষণ্ণতা। অসুস্থ বোধ করছে সে। এটা দেখো। গোল একটা ছিদ্র দেখাল সে।

বুলেটের ছিদ্র?,

হ্যাঁ। খুন করা হয়েছে লোকটাকে।

.

এগিয়ে চলেছে মুসা। ক্লান্ত হয়ে আসছে ক্রমেই। শেষে আর পারল না। খোলা রাস্তা থেকে সরে চলে এল বনের ভেতরে। স্পেস ব্লাংকেটটা বের করে গায়ে। জড়িয়ে শুয়ে পড়ল একটা পাইনের গোড়ায়। একটু পরেই কানে এল ট্রাকের ইঞ্জিনের শব্দ। এগিয়ে চলেছে ভুল দিকে, যেদিক থেকে সে এসেছে, পর্বতের দিকে। ওদিকে কেন? ডায়মণ্ড লেক তো ওদিকে নয়?

উঠে বসল সে। পাশের রাস্তা দিয়ে চলে গেল ট্রাক। হেডলাইট নিভানো। আবার শুয়ে পড়ল সে, ঘুমে জড়িয়ে আসছে চোখ। সেই অবস্থায়ই ভাবল, হেডলাইট জ্বালেনি কেন? শুধু পার্কিং লাইট জ্বেলে চলেছে?

মনে হলো সবে চোখ মুদেছে, এই সময় আবার শুনতে পেয়েছে ট্রাকের শব্দ। হাতের ডিজিটাল ঘড়ি দেখল। মধ্যরাত হয়ে গেছে। ঘুমিয়েছে ভালমতই।

উঠে দাঁড়াল সে। এইবার ট্রাকগুলো ঠিক দিকেই চলেছে, হাইওয়ের দিকে। চলে যায় মিস্টার মিলফোর্ড, রবিন আর কিশোরের সাহায্য…ভাবতে ভাবতে দৌড়ে রাস্তায় বেরিয়ে এল সে। স্পেস ব্লাংকেটটা নেড়ে চিৎকার করতে লাগল, থামো! থামো!

সামনের ট্রাকটার গতি কমে গেল। ফলে পেছনেরগুলোও কমাতে বাধ্য হলো।

উত্তেজিত হয়ে ট্রাকের কাছে ছুটে এল মুসা।

আগের ট্রাকটা থেমে গেছে। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল প্যাসেঞ্জার সাইডের দরজা।

রানিং বোর্ডে লাফিয়ে উঠল সে।

ভেতরে চোখ পড়তেই স্থির হয়ে গেল। সোজা তার কপালের দিকে তাক করে রয়েছে এম-১৬ রাইফেলের নল। মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল শিহরণ নেমে গেল। তার। মনে পড়ল কিশোরের কথা জানোয়ার নয়, মানুষ শিকারের কাজে ব্যবহর হয় এম-১৬।

ঢোকো! নেকড়ের মত গরগর স্বর বেরোল ডকের গলা থেকে, শয়তানী হাসি ফুটেছে ঠোঁটে। তোমার বন্ধুরা কোথায়?

.

আর পারা যায় না, এবার বিশ্রাম নিতেই হবে, ঠিক করল রবিন আর কিশোর। কুঙ্কালটা যেখানে পেয়েছে তার কাছ থেকে দূরে উজানে এসে স্পেস ব্লাংকেট মুড়ি দিয়ে ঘাসের ওপরই শুয়ে পড়ল। আগুন জ্বালতে সাহস করল না জোনসের লোকদের ভয়ে।

ভোরের আগেই উঠে পড়ল আবার। খিদেয় মোচড় দিচ্ছে পেট, কিন্তু সাথে রয়েছে কেবল পপকর্ন, সেদ্ধ করারও ব্যবস্থা নেই। অনেক ধরনের গাছ জন্মে রয়েছে, ফুলফল সবই আছে, তবু খেতে সাহস করল না। বুনো অঞ্চলের মানুষের জন্যে সেই পুরানো প্রবাদ; যেটা তুমি চেনো না, সেটা খেয়ো না। খেয়ে মরার। চেয়ে না খেয়ে বেঁচে থাকা অনেক ভাল। কাজেই খিদেটা সহ্য করতে লাগল ওরা।

আবার এগিয়ে চলা। নদীটা বাঁয়ে রেখে হাঁটছে দুজনে। পথ নেই, ঘাস আর রুক্ষ পাথরের ছড়াছড়ি, ফলে গতি হয়ে যাচ্ছে ধীর। গন্ধকে বোঝাই গরম পানির ঝর্না পেরিয়ে আসতে লাগল একের পর এক, পার হওয়ার সময় দম বন্ধ করে রাখে, দৌড়ে পার হয়ে যায় যত দ্রুত সম্ভব। নদীর পানিতে মাঝে মাঝেই চোখে পড়ছে ধূসর রঙের সর, কোথাও কোথাও ভাসমান তেল।

একটা উঁচু জায়গায় উঠে এল ওরা।

থামল। অনেক কষ্টে অবশেষে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছে, মনে হলো। সামনে ছড়িয়ে রয়েছে উপত্যকার অন্য প্রান্ত, সবুজ ঝলমল করছে দুপুরের রোদে। উপত্যকাটা অনেক চওড়া। ধীরে ধীরে উঠে গেছে ওপর দিকে। গাছপালায় ছাওয়া। ওখান থেকেই নেমে আসছে সরু নদী।

ওই যে, রাস্তা! টুপিটা পেছনে ঠেলে দিয়ে বলল রবিন।

পাহাড়ের যেখান থেকে জলধারাটা বেরিয়েছে, সেই একই ফাঁক দিয়ে পাশাপাশি বেরিয়েছে সরু পথটা। কয়েক শো গজ এগিয়ে গিয়ে শেষ হয়েছে। সমতল একটা জায়গায়।

কাঠ বয়ে নেয়ার রাস্তা বলে তো মনে হচ্ছে না, রবিন বলল, মালটি যেটার কথা বলেছিল।

না।

সরু নদীটার কাছে চলে এল ওরা। ভয়াবহ দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। পানিতে দেখা গেল কালো আলকাতরার মত জিনিস। আটকে রয়েছে নদীর কিনারে এসে ছোট ছোট খাড়িতে। খাড়ির কিনারের উদ্ভিদ হয় মরে গেছে, কিংবা মরছে।

নোংরা পানির দিকে তাকিয়ে রইল দুজনে। ঝর্নার পানি যে রকম টলটলে থাকার কথা সে রকম নয়, বরং পুকুরের বদ্ধ পানির মত ময়লা। তেল ভাসছে। রোদ লেগে চিকচিক করছে রামধনুর সাত রঙ সৃষ্টি করে।

বেশিক্ষণ থাকতে পারল না ওরা। বাতাসের জন্যে হাঁসফাস করছে ফুসফুস। ওই বাতাসে শ্বাস নেয়া যায় না। তাড়াতাড়ি সরে চলে এল সেখান থেকে।

তেল অথবা অ্যাসফল্ট, রবিন বলল। কিংবা হয়তো দুটোই আছে।

অন্য কিছু। দুর্গন্ধটা বেশি খারাপ, কিশোর বলল। জঘন্য।

তোমার একটা পরীক্ষার কথা মনে পড়ছে, কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরিতে করেছিলে। সেটা থেকেও এরকমই গন্ধ বেরোচ্ছিল।

জটিল একটা থার্মো-রিঅ্যাকটিভ এক্সপেরিমেন্ট ছিল সেটা, কিশোর বলল। হাসি ফুটল পরক্ষণেই। মনে পড়ে, স্যার কি রকম কুঁকড়ে গিয়েছিলেন, ফেটে গিয়ে জিনিসটা যখন ছড়িয়ে গিয়েছিল?

হাসতে লাগল দুজনেই। চলে এল সরু পথের শেষ মাথায় চ্যাপ্টা গোলাকার জায়গাটাতে। চাকার অসংখ্য দাগ দেখা গেল।

ট্রাক! নিচু হয়ে মাটি থেকে একটা সিগারেটের গোড়া কুড়িয়ে নিল রবিন, কিশোর যে দুটো পেয়েছিল সেরকম।

গম্ভীর হয়ে মাথা ঝকাল কিশোর। হ্যাঁ, চালানের কথা বলেছিল না জোনস?

নদী, ঝোপ, গাছপালা আর শৈলশিরার দিকে তাকাতে লাগল ওরা। গোলাকার সমতল জায়গাটা থেকে আরেক দিকে আরেকটা পথ বেরিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে উত্তর-পশ্চিমের বার্চ আর পাইন গাছে ভরা একটা বনের ভেতর।

দেখো, হাত তুলে দেখাল কিশোর।

গোলাকার জায়গাটার দক্ষিণ-পশ্চিমে শৈলশিরার নিচে পাহাড়ের গায়ে কতগুলো গুহা। ওগুলোর কাছে এগিয়ে গেছে চাকার দাগ। সেদিকে রওনা হলো দুজনে।

বাবা! চিৎকার করে ডাকল রবিন। উত্তেজনায় গলা শুকিয়ে গেছে।

গুহার সারির কাছে এসে দাঁড়াল ওরা। ভেতর থেকে আসছে দুর্গন্ধ। চোখে জ্বালা ধরাল। ঝাজ লাগল গলায়। কাশতে শুরু করল ওরা, সেই সঙ্গে ঘন ঘন হাঁচি। শেষে আর টিকতে না পেরে ফিরে আসতে লাগল আগের জায়গায়।

পথের ধারে আরেকটা গুহামুখ দেখে ওটার সামনে দাঁড়াল।

কিশোর বলল, এটার গন্ধ এত খারাপ না।

ভেতরে উঁকি দিল রবিন। জানাল, চারকোনা গুহা।

ঢুকে পড়ল দুজনে। ভেতরে আলো খুবই কম, চোখে সয়ে আসার সময় দিল। ওরা। দেখতে পেল অবশেষে। দেখে হা হয়ে গেল। মেঝে থেকে ছাত পর্যন্ত একটার ওপর আকেরটা সাজিয়ে রাখা হয়েছে শত শত ৫৫-গ্যালনের ড্রাম।

লেবেলে পড়ল কিশোর, পিসিবি এস।

রবিন পড়ল আরেকটার, অ্যাসিড।

পড়তে থাকল কিশোর, অ্যালকালাইন, অক্সিডাইজারস, সালফার স্লাজ।

আতঙ্ক ফুটেছে দুজনের চোখে। রাসায়নিক বর্জ্য পদার্থ! মারাত্মক বিষাক্ত!

সহসা ছায়া ঘন হল গুহার ভেতরে, সূর্যের মুখ কালো মেঘে ঢাকা পড়েছে। যেন। ঝট করে ফিরে তাকাল ওরা। গুহামুখে এসে দাঁড়িয়েছে একজন মানুষ, আলো আসা ঢেকে দিয়েছে। আটকা পড়ল ওরা!

.

১৪.

তোমরা! রাগত গলায় বলল কণ্ঠটা, তোমরা এখানে কি করছ?

জন, তুমি? কিশোর বলল।

আমরা এখানে কি করে জানলে? জিজ্ঞেস করল রবিন।

আরও রেগে যাচ্ছে জন। বেরোও! বাইরের লোকের এখানে ঢোকা নিষেধ! এটা আমাদের পবিত্র জায়গা। কেউ ঢোকে না এখানে।

ভুল করছ, কিশোর বলল, এস, দেখাচ্ছি, কিসে তোমাদের অসুস্থ করে –তুলছে।

দ্বিধা করল জন। তারপর ভেতরে এসে ঢুকল।

ড্রামগুলো দেখাল কিশোর। একটা ড্রামের তলা ফুটো হয়ে গিয়ে ভেতরের আঠাল পদার্থ চুঁইয়ে পড়ছে মেঝেতে। তীব্র রাসায়নিক গন্ধ।

চুপচাপ দেখল জন। তারপর কিশোর আর রবিনের সঙ্গে চুপচাপ বেরিয়ে এল। বাইরে, খোলা হাওয়ায়, যেখানে ঠিকমত শ্বাস নেয়া যায়।

ড্রামগুলোতে কি আছে বলল কিশোর।

রাসায়নিক বর্জ্য! জন বলল, আমাদের বাতাস আর পানি দুষিত করছে!

করছে। তোমার চোখ লাল হয়ে গেছে, রবিন বলল। আমাদেরও হয়েছে। এটাও এই বর্জ্যের কারণেই।

দুজনের চোখের দিকে তাকাল জন। তাহলে তো ট্রয়কের পানি খাওয়া নিরাপদ নয় আমাদের জন্যে। ওটার মাছও নিশ্চয় বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে।

বনের জানোয়ারও। নদীতে পানি খেতে আসে ওরা।

এই গুহাটাতে তো গন্ধ কমই, কিশোর বলল। অন্যগুলোর কাছে যাওয়া যায় না, এতই বেশি। ওগুলোতে নিশ্চয় বোঝাই হয়ে আছে ফুটো হয়ে যাওয়া ড্রামে। বর্জ্যের ডাস্টবিন হিসেবে ব্যবহার করছে তোমাদের পবিত্র উপত্যকাকে।

কঠিন হয়ে গেছে জনের মুখ। ভাবছে রাসায়নিক বর্জ্যের ভয়াবহতার কথা। রাগে আগুন হয়ে ফুঁসে উঠল, আমাদের পবিত্র জায়গার এই সর্বনাশ কে করছে?

ফ্র্যাঙ্কলিন জোনস। জোনস ট্র্যাকিং কোম্পানির মালিক। চেনো?

নিশ্চয়। আমাদের মোড়ল মাঝে মাঝে গিয়ে তার কাজ করে। আমাদের অনেক সাহায্য করেন মিস্টার জোনস…

সেটা কাছাকাটি থাকার জন্যে, রবিন বলল। এই এলাকায় ঢুকতে যাতে সুবিধে হয়। জোনসই আমার বাবাকে কিডন্যাপ করেছে। কোথায় রাখবে, আন্দাজ করতে পারো?

না। এদিকটায় এর আগে আসিইনি আমি। তবে চেষ্টা করলে খুঁজে বের করে ফেলতে পারব।

গোলাকার জায়গাটার দিকে হাঁটতে হাঁটতে কিশোর জিজ্ঞেস করল, আমাদেরকে বের করলে কি করে? পায়ের ছাপ দেখে?

কাঁধ সামান্য কুঁজো করে হাঁটছে জন। নজর নিচের দিকে। চাকার দাগগুলো দেখছে। দাদা, আমাকে আজ সকালে গান গাওয়া অনুষ্ঠান থেকে মুক্তি দিয়েছেন। তোমাদের জন্যে চিন্তা করছেন তিনি। আমার চাচীর গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে। পড়লাম। রাস্তায় দেখলাম তোমাদের যে পিকআপটা দেয়া হয়েছিল সেটা নষ্ট হয়ে। পড়ে আছে। তোমাদের জুতোর ছাপ অনুসরণ করে আসাটা কিছুই না। প্রথমে চোখে পড়ল দুই জোড়া জুতোর ছাপ তোমাদের পিছু নিয়েছে, তারপর তিন জোড়া। তাড়া করেছিল তোমাদের। তোমরা দৌড়ে পালিয়েছ, দুবার লড়াই করেছ, এক জায়গায় মুসার কাছ থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছ। বুটের দাগ শুধু তোমাদের পিছু নিয়েছে তারপর থেকে, মুসার পিছু নেয়নি।

এত কিছু বলতে পারলে শুধু চিহ্ন দেখেই? অবাক হয়ে বলল কিশোর।

এ-তো সহজ কাজ। আমি বনের ছেলে, এমনিতেই বন আমার পরিচিত। তার ওপর ট্র্যাকিং শিখেছি চাচার কাছে। সাংঘাতিক ভাল ট্র্যাকার ছিল আমার চাচা।

ট্র্যাকিং করে অনুমান করতে পেরেছ আমাদের পিকআপটাকে কে স্যাবোটাজ করেছে?

কি বললে? চমকে গেল জন।

বোল্টটা করাত দিয়ে কেটে কিভাবে ওদেরকে খুন করার চেষ্টা করা হয়েছিল বলল কিশোর।

মাথা নোয়াল জন। এরকম একটা কাজ কে করল? মুখ তুলল। তোমরা বেঁচে আছ দেখে খুব ভাল লাগছে আমার। মুসা নিশ্চয় ওস্তাদ ড্রাইভার।

একসাথে মাথা ঝাঁকাল রবিন আর কিশোর।

কিশোর, দেখাও না…, কিশোরের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারা করল রবিন।

অ্যাঁ, হ্যাঁ! ইঙ্গিতটা বুঝতে পারল কিশোর। প্রিয়জনের মৃত্যুসংবাদ দেয়াটা কঠিন। তবু সত্যি কথাটা জানাতেই হবে। পকেট থেকে রূপার বাকলসটা বের করে জনকে দেখাল সে, দেখ তো, চিনতে পার কিনা?

হাত বাড়িয়ে জিনিসটা নিল জুন। সে যেটা পরেছে অবিকল সেটারই মত দেখতে। আমার চাচার। মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, কোথায় পেলে?

উপত্যকায়, হাত তুলে একটা দিক দেখাল কিশোর। একটা কঙ্কালের পাশে। আসার পথে নিশ্চয় হাড়গুলো দেখে এসেছ?

চোখ বন্ধ করে মাথা ঝাঁকাল জন। শক্ত হয়ে গিয়ে আবার ঢিলে হয়ে গেল চোয়াল।

এইবার আমি বুঝতে পেরেছি, আমার ভিশন কোয়েস্টের মানে কি ছিল? কি বোঝাতে চেয়েছেন ঈশ্বর! ঠিক জায়গায়, কিন্তু আশীর্বাদ ছাড়া। ঠিক জায়গায়, অর্থাৎ ইনডিয়ানদের পবিত্র এলাকাতেই রয়েছে, কিন্তু তার আত্মা অশান্তই থেকে গেছে, পরপারের ঠিক জায়গায় যেতে পারেনি।

একটা মুহূর্ত নীরব হয়ে রইল তিনজনে।

হাড়গুলো দেখার জন্যে থেমেছিলে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

না। তোমাদের জন্যে ভাবনা হচ্ছিল।

আরও খারাপ খবর আছে তোমার জন্যে। খুলিটাতে বুলেটের ফুটো দেখেছি।

গুলি করা হয়েছে? কে করল? কেন করল?

হ্যারিস হেরিং-এর দুর্ঘটনার কথা বলল কিশোর। তিন গোয়েন্দা আর রবিনের বাবাকে খুন করে যে দুর্ঘটনার মত করে সাজাতে চায়, সেকথাও বলল।

তুমি বোঝাতে চাইছ, জন বলল, তোমাদের মতই চাচাও কিছু সন্দেহ করেছিল, এই জায়গাটা দেখে ফেলেছিল বলেই তাকে মরতে হয়েছে?

হতে পারে।

চুপ করে ভাবল জন। বলল, অনুষ্ঠানে দাদা জেনেছেন, বিদেশী ডাইনী এসে আমাদের অসুস্থ করে তুলেছে। ডাইনীর লোভ খুব বেশি, সে যা চায় সেটা দিয়ে দিলেই কেবল তাকে ধ্বংস করা সম্ভব।

তাহলে জোনসই সেই ডাইনী।

কিন্তু যা চায় সেটা দিয়েই ধ্বংস করতে হবে, এর মানে কি? বুঝতে পারছে না রবিন।

জানি না, হাত ওল্টাল জন। চাচার বাকলসটা পকেটে রেখে দিল। চলো, খুঁজে বের করি। চওড়া একটা চাকার দাগ দেখিয়ে বলল, এটা মিস্টার জোনসের উইনিব্যাগোর দাগ। এসো। দাগটাকে অনুসরণ করে দুলকি চালে ছুটতে আরম্ভ করল সে।

ওর পেছনে ছুটল কিশোর আর রবিন। জনের ট্র্যাকিঙের ক্ষমতা দেখে বিস্মিত হয়েছে। সরু রাস্তা ধরে এসে বার্চ আর পাইনের জঙ্গলে ঢুকল ওরা। গতি কমাল জন। সতর্ক হয়ে চলতে লাগল এখন থেকে।

বাতাসে পাইনের সুগন্ধ বেশিক্ষণ খাঁটি থাকতে পারল না, ভেজাল ঢুকে নষ্ট হয়ে গেল, গুহার কাছে যে দুর্গন্ধ পেয়েছে, সেই একই দুর্গন্ধ এখানেও।

এ থেমে গেল জন। পাওয়া গেছে। মিস্টার জোনসের উইনিব্যাগো। ওটা নিয়েই আমাদের গাঁয়ে যায়, খাবার, গুলি, দিয়ে আসে। বাচ্চাদের জন্যে খেলনা নিয়ে যায়।

পথের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে আছে দামি অনেক বড় গাড়িটা। গুহার কাছ থেকে সরিয়ে এনে বর্জ্য পদার্থের বিষক্রিয়া-সীমানার বাইরে এনে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। গাছপালার ভেতরে।

ওটার দিকে পা বাড়াতে গেল জন।

দাঁড়াও! ওর হাত ধরে ফেলল কিশোর। ভেতরে লোক থাকতে পারে। ওদের কাছে রাইফেল আছে।

মাটিতে জুতোর ছাপ দেখাল জন। সোলের নিচে চারকোনা খোপ খোপ করা। সেই ছাপ পড়েছে ধুলোতে। গাড়ির দিকে এগিয়ে গেছে।

চিনতে পেরেছ? জিজ্ঞেস করল সে।

মাথা নাড়ল কিশোর আর রবিন। পারিনি।

মুসা। ওকে রেখে সবাই চলে গেছে। এই যে দেখো, বুটের দাগ।

মুসাকে ধরে ফেলেছে! গুঙিয়ে উঠল কিলোর।

জনের দিকে উদ্বিগ্ন চোখে তাকাল দুই গোয়েন্দা। এসো, পা বাড়াল আবার জন।

সাবধানে যাও, হুঁশিয়ার করল কিশোর। জোনস কাছাকাছিই থাকতে পারে।

পা টিপে টিপে গাড়ির কাছে চলে এল তিনজনে। জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিল। দুজন মানুষকে দেখা গেল ভেতরে। ধাতব কিচেন চেয়ারে বেঁধে রাখা হয়েছে। মুখে কাপড় গোঁজা। একজন মুসা। আরেকজন…

বাবা! চিৎকার করে উঠল রবিন।

.

১৫.

প্রথমেই মুসা আর মিলফোর্ডের মুখের কাপড় টেনে বের করা হলো।

বাবা, ঠিক আছ তুমি?

এখন হলাম, মলিন হাসি ফুটল মিলফোর্ডের ঠোঁটে। কপালের জখমটার ফোলা কমেনি, আরও লাল হয়েছে। ডাক্তার ছাড়া হবে না। এখান থেকে বেরিয়ে গিয়েই আগে ডাক্তার ডাকবে, কোমল গলায় বাবাকে কথা দিল রবিন।

তোমাকে ধরল কি করে, মুসা? বাঁধন খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

নেতিয়ে রয়েছে সহকারী গোয়েন্দা। গাধা যে আমি, মাথায় গোবর পোরা, সে জন্যেই ধরেছে! বনের ভেতর দিয়ে কোন শর্টকাট রয়েছে, ডক চেনে, আমার অনেক আগেই এসে ওর ট্রাকগুলো বের করে নিয়েছে।

বাঁধনমুক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন মিলফোর্ড আর মুসা। হাত-পা ঝাড়া দিয়ে, ডলে ডলে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করতে লাগলেন।

থ্যাঙ্কস, বলতে বলতেই হাত বাড়িয়ে রবিনের মাথা থেকে নীল ক্যাপটা নিয়ে মাথায় চাপালেন মিলফোর্ড। কিছু মনে করলে না তো?

আরে না না, কি যে বলো। তোমার জন্যেই তো রেখেছিলাম, হাসতে হাসতে বলল রবিন। এতদিন পর খুশির হাসি ফুটেছে তার মুখে। তারপর মনে পড়ল জনের সঙ্গে বাবার পরিচয় নেই। পরিচয় করিয়ে দেয়া দরকার।

দ্রুত সেরে উঠল মুসা। হাত-পা ঝাড়া দিয়ে, কয়েকটা লাফ দিয়ে, শরীরের আড়ষ্টতা বিদেয় করে দিয়ে এগিয়ে গেল গাড়িতে রাখা রেফ্রিজারেটরের দিকে। খিদেয় মরে যাচ্ছি আমি। ডালা খুলে বের করল মাখন, রুটি আর ফলের রস।

সবাই গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল খাবারের ওপর।

ভেতরে জায়গা বেশি নেই, জিনিসপত্রে ঠাসাঠাসি, তারই ভেতরে কোনমতে হেঁটে বেড়াতে লাগলেন মিলফোর্ড। মাথা ঘুরে উঠল। টলে পড়ে যাচ্ছিলেন, কোনমতে তাক ধরে সামলালেন। ধপ করে বসে পড়লেন আবার চেয়ারে। তোমাদেরকে দেখে খুশি লাগছে। আমি যখন ছিলাম না তখন কি কি ঘটেছে বলো তো?

সব কথা খুলে বলল রবিন। শেষে বলল, হ্যারিস হেরিং মারা গেছে, বাবা। জোনস তাকে খুন করেছে।

আদেশ দিয়েছে জোনস, মিলফোর্ড বললেন, আর কাজটা সেরেছে ডক। হেরিঙের পিছে লেগে ছিল, জেনে গিয়েছি সে আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। হিলারি সেসনার ইলেকট্রিক্যাল সিসটেমে গোলমাল করে দিয়েছিল আমাকে খুন করার জন্যে। কেবিনের ফায়ার ওয়ালের পেছনে জট পাকিয়ে থাকা একগাদা তারের মধ্যে ছোট একটা বোমা রেখে দিয়েছিল। স্বীকার করেছে সব।

ইলেকট্রনিক ফিউজ ব্যবহার করেছিল নিশ্চয়, মুখভর্তি খাবারের ফাঁক দিয়ে কোনমতে বলল কিশোর। ফলে মাটিতে থেকেই ওটা ফাটাতে পেরেছে জোনস।

তা-ই করেছে। এমন জায়গায় নামাতে চেয়েছে আমাকে, যেখানে নির্ঘাত মারা পড়ব। আর যদি ক্র্যাশ ল্যাণ্ড করে মারা না-ও যাই, আমাকে হাতে পেয়ে যাবে সে। খুন করতে পারবে। তাতে বরং সুবিধে বেশিই তার, মারার আগে জেনে নিতে পারবে খবরটা আর কে কে জানে। তারপর দেখল, প্লেনে অনেক লোক ঢুকে বসে আছে। ভয় পেয়ে গেল সে। ভাবল, বুঝি আমরা চারজনেই খবরটা জানি। এটা তার জন্যে খুবই খারাপ। পুরো পাঁচ লাখ ডলারের মামলা, কিছুতেই এটা হাতছাড়া করতে চাইল না। দরকার হলে সবাইকে খুন করবে, তবু যেন কোন রকম তদন্ত না হয় এখানটায়।

ওই সাংঘাতিক কেমিক্যাল জমিয়ে রেখে এত টাকা আয় করবে সে? মুসা অবাক।

হ্যাঁ। ছোট ব্যবসায়ী সে, এত টাকার লোভ সামলাতে পারল না। এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি বহু কোম্পানিকে জরিমানা করেছে। কেন করেছে জান? বর্জ্য পদার্থ বৈধ উপায় নিয়ে গিয়ে ফেলে দিয়ে আসাটা অনেক খরচের ব্যাপার। কাজেই অনেক কোম্পানিই টাকাটা বাঁচাতে অসৎ পথ ধরে। তারপর ধরা পড়ে জরিমানা দেয়। হপ্তা দুই আগে ইপিএ একটা কোম্পানিকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছিল। ওরা এতই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল, শহরের নর্দমায় বর্জ্য ঢেলে দিতেও দ্বিধা করেনি।

সর্বনাশ! আঁতকে উঠল কিশোর। ভয়ানক ব্যাপার ঘটে যেত তো তাহলে! নর্দমার মুখ বন্ধ, সিউয়ারেজু শ্রমিকের মৃত্যু, চাষের খেতের ক্ষতি, সবই হতে পারত। টাকার জন্যে এতটা নিচে নামতে পারে মানুষ!

এর চেয়েও নিচে নামে। যা-ই হোক, ওই ঘটনার পর সম্পাদক সাহেব আমাকে একটা বিশেষ দায়িত্ব দিলেন। বর্জ্য পদার্থ কোথায় কোথায় ঢালা হয় তার ওপর সচিত্র প্রতিবেদন করতে হবে, ধারাবাহিকভাবে ছাপা হবে ওটা। হ্যারিস হেরিং কাগজকে টেলিফোন করে বলেছে একজন সাংবাদিক পাঠাতে, কথা বলতে চায়। প্রথমে তো নামই বলতে চায়নি আমাকে, এতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ওর আশঙ্কা ছিল, নাম ফাঁস হয়ে গেলে ওকে খুন করে ফেলা হবে। শুধু বলল, একটা। অটো কোম্পানিতে চাকরি করে। খরচ কমানর জন্যে বেআইনী ভাবে বর্জ্য সরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছে কোম্পানিটা। জোনসের ট্রাকের পিছু নিয়ে কোথায় বর্জ্য ফেলা হয়, দেখেও এসেছে হেরিং। সেটা গোপনে সংবাদপত্রকে জানিয়ে দিয়ে জনসাধারণকে হুশিয়ার করে দিতে চায়।

দরজার গায়ে হেলান দিয়ে কথা শুনছিল জন। মিলফোর্ড থামলে বলল, আমাদের উপত্যকাটার সর্বনাশ করে দিয়েছে ব্যাটারা! মাটি নষ্ট করেছে, পানি নষ্ট করেছে, মাছ জন্তুজানোয়ার খাওয়ার অযোগ্য করে দিয়েছে, বিষাক্ত করে দিয়েছে বাতাস, শ্বাস নিতে পারি না আমরা। অসুস্থ হয়ে পড়ছি। আমার চাচাকে খুন করেছে ওরা।

বিষাক্ত বর্জ্যের ব্যাপারে অনেক কথাই যেতে আরম্ভ করেছে সরকারের কানে, মিলফোর্ড বললেন। ব্যবস্থা একটা করবেই। তবে তোমার চাচার ব্যাপারে কোন কথা কানে আসেনি আমার। বুঝতে পারছি না ওরাই করেছে কিনা কাজটা।

গাড়ির সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে ড্রাইভারের আসনে বসল কিশোর। বলল, আঙ্কেল, আপনার প্রতিবেদনের জন্যে যথেষ্ট তথ্য জোগাড় হয়ে গেছে?

অনেক কিছুই পেয়েছি, বললেন তিনি। শুরুটা ভালই হয়েছে। এখানে। জোনসের অনেক রেকর্ডপত্র রয়েছে, ড্রয়ারে, বের করে কেবল পড়ার অপেক্ষা। এই গাড়িটাই ওর অফিস। সব সময়ই ঘুরে বেড়ায়। সচল অফিস বলে ওকে সন্দেহ করে ধরাটা কঠিন হয়ে পড়েছিল।

এখন তো সহজ হয়ে গেছে, মুসা বলল। কিশোর, সরো ওখান থেকে। ব্যাটার অফিসটাই চালিয়ে নিয়ে চলে যাব।

আমি চালাব, চেয়ার থেকে উঠতে গেলেন মিলফোর্ড।

না, আপনার শরীর ভাল না। আমিই পারব।

রবিনও বাবাকে উঠতে দিল না। মুসা ঠিকই বলেছে, বাবা।

আমি ঠিকই আছি, আবার উঠতে গেলেন মিলফোর্ড। চক্কর দিয়ে উঠল মাথা। চেয়ারের পেছনটা খামচে ধরলেন। বসে পড়তে হল আবার। নাহ্, মনে। হচ্ছে সত্যিই খারাপ আমার শরীর।

চাবিগুলো কোথায়? পাচ্ছি না তো। মিলফোর্ডের দিকে তাকাল কিশোর, জানেন, কোথায় রেখেছে?

জোনসের কাছেই আছে বোধহয়।

নিরাশ হলো কিশোর। ড্রয়ারের চাবির কথা জিজ্ঞেস করেছে সে।

মুসা জিজ্ঞেস করল গাড়ির চাবিটার কথা। সেটা কোথায় তা-ও বলতে পারলেন না মিলফোর্ড। তবে তাতে একটুও দমল না সহকারী গোয়েন্দা। চাবি ছাড়াই কি করে স্টার্ট দিতে হয় জানা আছে তার। দরজার দিকে পা বাড়াল সে, হুড তুলে কিছু কাজ করতে হবে ইঞ্জিনের তারে।

দাঁড়াও! বদলে গেছে জনের কণ্ঠস্বর। মুসাকে দেখে সেদিন গাছের ছায়ায় যেমন অনড় হয়ে গিয়েছিল, সেরকম ভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। চোখ বন্ধ করে শব্দ শোনার চেষ্টা করছে। লোকের সাড়া পাচ্ছি।

হুড়াহুড়ি করে জানালার কাছে চলে এল গোয়েন্দারা। বাইরে তাকাল। ঠিকই বলেছে জন। গাছপালার ভেতরে নড়াচড়া দেখা যাচ্ছে। ঝিক করে উঠল ধাতব কিছুতে রোদ লেগে। রাইফেলের নলে লেগেছে, একথা বলে দিতে হল না ওদেরকে।

অ্যামবুশ করেছে ওরা! নিঃশ্বাস ভারি হয়ে গেছে কিশোরের।

ঢোক গিলল রবিন।

জোনসকে দেখলাম মনে হল! মিলফোর্ডও জানালা দিয়ে তাকিয়ে রয়েছেন।

শয়তান ডকটাকেও দেখেছি! মুসা বলল।

ওই লোকটা সব চেয়ে বিপজ্জনক! রবিনের কণ্ঠে অস্বস্তি। খুন করতে ওর একটুও হাত কাঁপে না!

আরি, আমাদের মোড়লচাচাকেও দেখছি! চোখ বড় বড় হয়ে গেছে জনের। নিওমো কয়েলও আছে?

হালকাপাতলা লোকটার কথা মনে পড়ল কিশোরের, যে মালটিকে ইশারা করেছিল পিকআপ রেডি হয়েছে জানিয়ে। জিজ্ঞেস করল, নিওমো মোড়লের সহকারী, তাই না?

সব সময় না, জন বলল। মাঝে মাঝে কাজে সাহায্য করে। দুজনের। হাতেই ওয়াকি-টকি আছে। রাইফেল আছে! মোড়লচাচার হাতে রাইফেল থাকাটা মারাত্মক। নিশানা বড় সাংঘাতিক!

রাগার টেন বাই টোয়েন্টি টু হান্টিং রাইফেল! বিড়বিড় করল কিশোর। আতঙ্কিতই হয়ে পড়েছে প্রায়। এতগুলো লোক আর শক্তিশালী অস্ত্রের মুখ থেকে বেঁচে বেরোবে কি করে?

মালটি বলেছে, তোমাদের মোড়ল নাকি গাঁয়ের জন্য নানা রকম জিনিস কিনে নিয়ে আসে, রবিন বলল। মোটর ইঞ্জিনের পার্টসের মত দামি জিনিসও আনে। তার একটা নতুন গাড়ি দেখেছি, অনেক দামি। এখন বোঝা যাচ্ছে। জোনসের কাছ থেকে ভাল টাকা পায় সে, মুখ বন্ধ রাখার জন্যে।

কালো হয়ে গেছে জনের মুখ। বিশ্বাসই করতে পারছি না! এত ভাল একজন মানুষ…

গাড়ির ভেতরে টানটান উত্তেজনা।

এই ভাল মানুষদের নিয়েই সমস্যা, মিলফোর্ড বললেন। দেখে মনেই হয় না। এরা খারাপ কিছু করতে পারে। মোড়লকে ফাঁসানোর মত কোন প্রমাণ নেই আমাদের হাতে। নিওমোকে ধরার মতও নেই।

তাহলে কে আমাদের ব্রেক নষ্ট করে দিয়ে মেরে ফেলেছিল আরেকটু হলেই? রেগে গিয়ে বলল মুসা।

ওর দিকে তাকিয়ে রইল জন। তারপর ঘুরে তাকাল আরেক দিকে, জানি না। এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না মোড়ল কিংবা নিওমো এরকম কাজ করতে পারে।

ওসব আলোচনার অনেক সময় পাব, আবার ড্রাইভারের সীটের দিকে রওনা হলো কিশোর। এখন একটাই কাজ, বেরিয়ে যেতে হবে এখান থেকে।

একটা ঝাড়ু রাখার আলমারি দেখিয়ে নিজেকেই যেন জিজ্ঞেস করল মুসা, ওর মধ্যে বন্দুক-টক আছে?

থাকলেও লাভ নেই, মিলফোর্ড বললেন, এম সিক্সটিনের বিরুদ্ধে বন্দুক দিয়ে কিছুই করতে পারবে না। তাছাড়া ওখানে কিছু রেখেছে বলেও মনে হয় না। অন্য উপায় করতে হবে আমাদের।

ড্যাশবোর্ডের নিচে হাতড়াচ্ছে কিশোর। ঝড়ের গতিতে ভাবনা চলেছে। মাথায়। মেরিচাচী প্রায়ই বলেনঃ সব রকম বিপদের জন্যে সব সময় তৈরি থাকলে মানুষের বিপদ অনেকটাই কমে যায়। কিশোরও মানে সেকথা। জোনসকে দেখে যা মনে হয়েছে, অনেকটাই মেরিচাচীর স্বভাব। সব কিছুর জন্যেই যেন তৈরি থাকে সব সময়। এই গাড়িটাকে যখন অফিস বানিয়েছে, অনেক কিছুর জন্যই তৈরি করে রেখেছে:হ্যাঁ, এই তো, যা ভেবেছিল। পেয়ে গেল জিনিসটা। হাতটা ড্যাশবোর্ডের নিচ থেকে বের করে এনে মুঠো খুলল। ছোট একটা ম্যাগনেটিক কেস, যার মধ্যে লোকে গাড়ির বাড়তি চাবি রাখে, একটা হারিয়ে গেলেও যাতে প্রয়োজনের সময় দ্বিতীয়টা পেয়ে যায়।

গাড়ির ভেতরের উত্তেজনা মুহূর্তের জন্যে সহজ হলো। হাসি-মুখে চাবিটা মুসার হাতে তুলে দিল কিশোর। প্রায় লাফ দিয়ে গিয়ে ড্রাইভিং সীটে বসল মুসা।

মুসা, দুর্বল কণ্ঠে বললেন মিলফোর্ড, তোমাকে যে রাস্তা দিয়ে এনেছে ডক, সেই রাস্তা দিয়েই চলে যাও। গুলি করে টায়ার ফাটিয়ে দিলেও থামবে না, বসা টায়ার নিয়েই চালাবে। মোট কথা, কোন কারণেই থামবে না। তোমার একমাত্র লক্ষ্য হবে, চালিয়ে যাওয়া। ডায়মণ্ড লেকে যাব আমরা!

বাবার দিকে তাকিয়ে রয়েছে রবিন। সহজে ভয় পান না তার বাবা। এখন পেয়েছেন। পরিস্থিতি খুবই খারাপ।

মুসা বলল, সবাই মাথা নামিয়ে রাখো। শক্ত করে ধরে থাকো কিছু।

মেঝেতেই শুয়ে পড়ল সকলে, মিলফোর্ড সহ। জন সতর্ক, সাংঘাতিক সতর্ক, গভীর দুর্গম বনে চলার সময় যেমন থাকে। রবিন ভাবছে, রকি বীচে আর কি কোনদিন ফিরে যেতে পারবে? যেতে পারবে ট্যালেন্ট এজেন্সি কিংবা পাবলিক লাইব্রেরিতে? বার দুই ঢোক গিলল কিশোর। মনে মনে বলছে, খোদা, এবার যেন। ফোর্ড পিকআপটায় চড়ার মত দুর্গতি না হয়।

আর মুসা, ভারি একটা দম নিয়ে আস্তে মোচড় দিল ইগনিশনে। জেগে গেল ইঞ্জিন।

.

১৬.

স্টিয়ারিঙের ওপর ঝুঁকে রয়েছে মুসা। যতটা সম্ভব গুলির নিশানা থেকে সরে থাকতে চাইছে। কয়েকটা মোচড় দিয়েই গাড়ির নাক ঘুরিয়ে ফেলল, ছুটল খোলা জায়গাটার দিকে। জোনসের চওড়া মুখে বিস্ময় দেখতে পেল সে।

তারপরই ছুটে আসতে লাগল বুলেট। বিধতে লাগল গাড়ির শরীরে। একপাশ দিয়ে ঢুকে আরেক পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল।

এই, সবাই ঠিক আছ? চিত্তার করে জিজ্ঞেস করল মুসা।

আছি! চারটা কণ্ঠই জবাব দিল।

আরও একঝাঁক বুলেট এসে বিধল গাড়ির শরীরে। আরেক ঝাঁক ধুলো ওড়াল রাস্তায় লেগে। মাটির কণা লাফিয়ে উঠল। চাকা ফুটো করতে চাইছে।

বার্চ আর পাইন বনের ভেতর থেকে বেরিয়ে গেছে সরু রাস্তাটা, সেটা ধরে ছুটেছে মুসা।

জোনসের পাশে এসে দাঁড়ালেন গভীর চেহারার মোড়ল, উত্তেজিত হয়ে কথা বলছেন। হাত তুলে গুলি থামানর নির্দেশ দিল জোনস। বেল্ট থেকে ওয়াকি-টকি খুলে নিয়ে কথা বলতে শুরু করল।

পাশ দিয়ে গাড়িটা ছুটে বেরোনর সময় এদিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত কাণ্ড করল সে, রাগ দেখানর পরিবর্তে একটা হাসি দিল। রহস্যময়, শয়তানি হাসি। কারণটা বুঝতে পারল না মুসা। ওরা পালিয়ে যাচ্ছে। ধরে রাখতে পারছে না। তাহলে হাসল কেন লোকটা?

আমাদেরকে কিছু করছে না ওরা! চেঁচিয়ে সঙ্গীদেরকে জানাল মুসা।

আঁকাবাঁকা সরু পথ ধরে তীব্র গতিতে চলেছে গাড়ি। অ্যাক্সিলারেটর চেপে ধরে রেখেছে মুসা। গতিবেগ আর বাড়ানোর সাহস করতে পারছে না। রাস্তায় একটু পর পরই বাঁক, বিশ-পঁচিশ গজের বেশি দেখা যায় না মোড়ের জনে) রাস্তাও খারাপ। এপাশ ওপাশ ভীষণ দুলছে গাড়ি। গাছের ডালে ঘষা লাগছে।

এতক্ষণে জোনসের হাসির কারণটা বুঝতে পারল মুসা। ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল।

কি হলো? চিৎকার করে উঠল কিশোর।

সামনে রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে জোনস কোম্পানির বিশাল এক ট্রাক। হিলারি কিংবা অন্য কেউ চালান দিয়ে এসেছিল বোধহয়, তাকে রেডিওতে নির্দেশ দিয়েছে জোনস। মুসা যেটা চালাচ্ছে সেটাও অনেক বড় গাড়ি। ট্রাকটা যেভাবে। পথ জুড়ে রয়েছে, তাতে ছোট ফোক্সওয়াগেনকেও পাশ কাটিয়ে নেয়ার জো নেই। এটা তো অসম্ভব।ট্রাকের সামনে পেছনের বাম্পারের সঙ্গে গাছ ছুঁয়ে আছে।

ফাঁদে পড়েছি! চিৎকার করে জানাল মুসা।

স্কিড করে থেমে গেল গাড়ি। ট্রাকের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল হিলারি, হাতে এম-১৬, মুসার দিকে তাক করা। বেল্টে ঝুলছে ওয়াকি-টকি।

জানালার কাছে উঠে এল গাড়ির ভেতরের চারজন।

এবার? গুঙিয়ে উঠল রবিন।

নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে আরম্ভ করেছে কিশোর।

অ্যাই, ঘটে যদি কিছুটা বুদ্ধিও থাকে, চেঁচিয়ে আদেশ দিল হিলারি, আর খেপামি কোরো না। ভালয় ভালয় নেমে এসো। তোমাদেরকে মারতে মানা করেছে। বস্, বেঁচে গেলে। তাই বলে গোলমাল সহ্য করব না।

দলবল নিয়ে এখুনি চলে আসবে জোনস, মিলফোর্ড হুঁশিয়ার করলেন।

একটা বুদ্ধি এসেছে মাথায়, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর। আমি হিলারির নজর সরিয়ে রাখি, তোমরা সব সারি দিয়ে নেমে একেকজন একেকদিকে পালাও…

অ্যাই, কথা কানে যায় না! ধমক দিয়ে বলল হিলারি। জলদি নাম!

সাবধান! মিলফোর্ড বললেন।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। দরজার হাতল ধরে দ্বিধা করল। তারপর লম্বা দম নিয়ে টান দিয়ে খুলে ফেলল পাল্লা। দুহাতে মাথা চেপে ধরে প্রচণ্ড মাথা ব্যথার অভিনয় শুরু করল। ওওওহ! ওওওহ! ককাতে লাগল সে। মাটিতে নেমে টলতে টলতে এগোল হিলারির দিকে। মরে যাচ্ছি! ব্যথায় মরে যাচ্ছিরে বাবা!

ভুরু কুঁচকে ফেলেছে হিলারি। মোরগের মত গলা লম্বা আর মাথা কাত করে তাকিয়ে রয়েছে। চোখে সন্দেহ। কিশোরের দিকে তাক করেছে এখন রাইফেল।

আমি মরে যাচ্ছি! টলতে টলতে আরও দুই পা আগে বাড়ল কিশোর। বাঁচান আমাকে! মরে গেলাম!

সরো! চেঁচিয়ে উঠল হিলারি।

আরেকটু এগোল কিশোর। টলে পড়ে যাচ্ছে যেন এরকম ভঙ্গি করে প্রায় পায়ের ওপর গিয়ে পড়ল হিলারির। ধরে সামলানর জন্যে চেপে ধরল ওর রাইফেল ধরা হাত। ঠেলে রাইফেলের নল সরিয়ে দিল আরেক দিকে।

তাকিয়েই ছিল মুসা। লাফিয়ে নামল মাটিতে। পেছনে রবিন, জন আর মিলফোর্ড।

জুডোর এক প্যাঁচে হিলারিকে মাটিতে ফেলে দিল কিশোর। শরীর দিয়ে চেপে ধরল।

সরো! সরো! চেঁচাতে লাগল হিলারি।

পালাচ্ছে! পেছন থেকে জোনসের চিৎকার শোনা গেল! ধরো ওদেরকে!

দলবল নিয়ে ছুটে আসতে লাগল সে।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। বনের দিকে দৌড় দিয়েছে রবিন আর মিলফোর্ড। মুসা যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে বনে ঢোকার মুখটার দিকে। সেদিকেই ছুটল গোয়েন্দাপ্রধান। ঝড়ো হাওয়ার মত ছুটছে জন, জোনস কোম্পানির একটা ট্রাকের দিকে।

মোড়লও ছুটছেন, কিশোরকে ধরার জন্যে। জনের চেয়ে কম ছুটতে পারেন না। দ্রুত কমছে দুজনের মাঝের দূরতু। সাঁ করে ঘুরে গিয়ে গুহার দিকে ছুটল কিশোর। আরেকটা বুদ্ধি করেছে। একটু আগে জোনসের ওপর কতটা রেগে গিয়েছিলেন মোড়ল, দেখেছে। সেই রাগটাকেই কাজে লাগাতে চায়।

সব চেয়ে কাছে যে গুহাটা রয়েছে সেদিকে ছুটল কিশোর। পেছনে তাড়া করছেন মোড়ল।

ঢুকে পড়ল কিশোর।

চিৎকার করে ডাকলেন মোড়ল, বেরোও! জলদি বেরোও! ওটা পবিত্র জায়গা! তোমাদের ঢোকার অধিকার নেই।

তাহলে জোনস আর তার লোকেরা ঢুকল কি ভাবে? চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

ওরা আমাদের মানুষকে সাহায্য করে। ঈশ্বর সেটা বুঝবেন। আমাদের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে উঠেছিল। মিস্টার জোনস আসাতে বেঁচেছি।

বাঁচলেন আর কই? অসুখে তো মরতে চলেছেন।

সেটা মিস্টার জোনসের দোষ নয়। বেরোও!

আসুন ভেতরে, ডাকল কিশোর। দম নিয়ে দেখুন, কেমন নাক আর গলা জ্বালা করে। মারাত্মক বিশাক্ত বর্জ্য পদার্থ রয়েছে এই ড্রামগুলোতে।

ড্রামগুলোর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন মোড়ল, না, তা হতে পারে না। মিস্টার জোনস বলেছেন, এগুলোতে বিস্ফোরক রয়েছে। আমাকে রেখেছেন পাহারাদার। এখানে বাইরের কেউ ঢোকার চেষ্টা করলে তাকে জানাতে বলেছেন। ব্যবসায় প্রতিযোগিতা এখন বেশি, অনেক প্রতিযোগী আছে তার। ওরা তার ক্ষতি করার চেষ্টা করছে। সে জন্যেই সব কথা বাইরের লোকের কাছে গোপন রাখতে বলেছেন। ওয়াকি-টকি দিয়েছেন যোগাযোগ করার জন্যে। জায়গাটার ভাড়া দেন। তিনি, সেই টাকায় গাঁয়ের লোকে.দরকারী জিনিস কিনতে পারে। এখানে জিনিস রাখার অধিকার তার আছে। যা খুশি রাখুক, আমাদের নাক গলানর কিছু নেই। থামলেন মোড়ল। বিষণ্ণ স্বরে বললেন, ভাড়ার টাকাটা এখন আমাদের খুবই দরকার। গাঁয়ের দুঃসময় যাচ্ছে।

কিন্তু বিষাক্ত বর্জ্য যে অসুস্থ করে ফেলছে আপনাদেরকে একথাটা ভেবেছেন?

কিশোরের চারপাশে একপাক ঘুরলেন মোড়ল। রাইফেলের নল নেড়ে আদেশ দিলেন, বেরোও!

জোনস হল সেই বিদেশী ডাইনী, যার কথা বলেছেন শামান, গুহামুখের দিকে এগোতে এগোতে বলল কিশোর। আবার রোদের মধ্যে বেরিয়ে বলল, আপনি আসলে ভয় দেখাচ্ছেন আমাকে। আমি জানি, গুলি করতে পারবেন না।

দ্বিধা করলেন মোড়ল। তারপর রাইফেলের নল কিশোরের পিঠে ঠেসে ধরে ঠেলে নিয়ে চললেন জোনসরা যেখানে অপেক্ষা করছে সেখানে।

বনের ভেতরে রবিন আর মিলফোর্ডের পিছু নিয়েছে নিওমো।

ডকের সঙ্গে নদীর কিনারে লড়ছে মুসা। এম-১৬টা কেড়ে নিতে চায়।

ভাতিজা! চিৎকার করে জনকে ডাকলেন মোড়ল।

ট্রাকের ড্রাইভিং সিটে চেপে বসেছে জন। ইঞ্জিন স্টার্ট দেয়ার চেষ্টা করছে।

খোলা দরজার কাছে গিয়ে তার দিকে রাইফেল তাক করল হিলারি।

ভাতিজা, বোকামি কোরো না! আবার বললেন মোড়ল। নেমে এস!

আটকা পড়েছে সবাই, বুঝতে পারছে কিশোর। যে কোন মুহূর্তে এখন। ওদেরকে গুলি করে মেরে ফেলার আদেশ দিতে পারে জোনস। ওদের বাঁচিয়ে রাখার আর কোন কারণ নেই।

ওদেরকে সরিয়ে দেয়ার পর নিশ্চিন্তে আবার এই উপত্যকার রাজা হয়ে বসবে। জোনস। বাধা দেয়ার কেউ থাকবে না। দুষিত করতে থাকবে উপত্যকার পরিবেশ, অসুস্থ হতে থাকবে গাঁয়ের লোক। মরবে। ডাইনী খোঁজা চালিয়ে যাবে ইনডিয়ানরা, কিন্তু খুঁজে আর পাবে না। ঠেকাতেও পারবে না। গান গাওয়া উৎসব চালিয়ে যেতে থাকবে ওরা, একের পর এক মেসেজ পাঠাতে থাকবে ঈশ্বরের কাছে, লাভ হবে না কিছুই।

মেসেজ! অনুষ্ঠানের সময় জনকে দিয়ে মেসেজ পাঠিয়েছে গান গাওয়া ডাক্তারঃ ডাইনী যা চায়, তাকে তাই দিয়ে দাও, ধ্বংস হয়ে যাবে সে!

দ্রুত চারপাশে তাকাল কিশোর। জোনস ডাইনী হয়ে থাকলে এখন সে চাইছে ওরা সবাই ধরা পড়ুক। আশার আলো উঁকি দিল তার মনে…মস্ত ঝুঁকি হয়ে। যাবে..কিন্তু আর কোন উপায়ও নেই।

জন! মুসা! রবিন! চিৎকার করে ডাকল কিশোর। সবাই চলে এস! ধরা দাও!

কক্ষণো না! বলেও শেষ করতে পারল না মুসা, ধা করে তার পেটে রাইফেলের বাঁট দিয়ে বাড়ি মারল ডক।

জনেরও নামার ইচ্ছে নেই। কিন্তু হিলারির রাইফেলের দিকে তাকিয়ে ইচ্ছেটা করতেই হল।

ঝোপের ভেতর থেকে মিলফোর্ডের কলার ধরে টেনে বের করে আনল নিওমো। রবিন বেরোল তার পাশে। বাধাও দিল না, কিছু করতেও গেল না।

এই, চলে এসো তোমরা! আবার ডাকল কিশোর। আর কোন উপায় নেই আমাদের!

অবাক হয়েছে সবাই। রেগে গেছে মুসা আর জন। কেবল রবিন বুঝতে পারছে, কোন ফন্দি করেছে কিশোর পাশা। ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে সবাই জোনস যেখানে দাঁড়িয়ে আছে।

আপনি জানেন, মোড়লকে বলল কিশোর, জোনস আমাদের মেরে ফেলবে!

না, মোড়লের এখনও ধারণা, কিশোর ঠিক কথা বলছে না, মারবে না। কেবল বের করে দেবে এই এলাকা থেকে।

বের করে দেয়ার জন্যেই কি আমাদের যে পিকআপটা দিয়েছিলেন, তার ব্রেক নষ্ট করে দিয়েছিল?

কি বললে? জবাবের অপেক্ষা না করেই বললেন মোড়ল, পিকআপটাকে পড়ে থাকতে দেখে এসেছি। কিন্তু… চৌকোনা গম্ভীর মুখটাতে এই প্রথম সন্দেহ ফুটল।

খোলা জায়গাটায় হাজির হলো সবাই। জোনের বাকসটা দেখিয়ে মোড়লকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, ওরকম বাকলস আর কে পরত, বলুন তো?

জনের চাচা, জবাব দিলেন মোড়ল।

জন, দেখাও, কিশোর বলল।

পকেট থেকে বাকলস বের করে মোড়লকে দেখাল জন। উপত্যকায় পেয়েছে। এটা কিশোর। একটা কঙ্কালের পাশে। কঙ্কালের খুলিতে গুলির ফুটো।

চমকে গেল ডক। জোনসের দিকে ফিরে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, আমি বার বার বলছি এগুলোকে শেষ করে দেয়া দরকার, ওই বুড়ো ইনডিয়ানটার মত, নইলে গোলমাল করবেই! আপনি শুনছেন না! আমি আর এসবের মধ্যে নেই, চললাম!

ট্রাকের দিকে দৌড় দিল ডক।

এই, দাঁড়াও, গাধা কোথাকার! জোনস বলল।

থামল না ডক। জোনস আর কিছু বলার আগেই রাইফেল তুললেন মোড়ল। গুলির শব্দ হলো একবার।

হাত থেকে উড়ে চলে গেল ডকের এম-১৬। ওটাতেই গুলি করেছেন তিনি। ডকের দিকে ছুটল মুসা।

পাঁই করে ঘুরলেন মোড়ল। রাইফেল তাক করলেন জোনসের দিকে।

দাঁড়ান! দাঁড়ান! হাত থেকে রাইফেল খসে পড়ল জোনসের। পিছিয়ে গেল।

শয়তান! রাগে চেঁচিয়ে উঠলেন মোড়ল, এগিয়ে গেলেন জোনসের দিকে, তুমি আমার ভাইকে খুন করেছ! এখন এই ভাল মানুষগুলোকে খুন করতে যাচ্ছিলে! ধাম করে রাইফেলের বাঁট দিয়ে বাড়ি মারলেন লোকটার পেটে।

ব্যথায় ককিয়ে উঠল জোনস। বাঁকা হয়ে গেল শরীর। থামলেন না মোড়ল। প্রচণ্ড এক ঘুসি মারলেন জোনসের চোয়ালে। একটা মুহূর্ত বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে রইল লোকটার চোখ। তারপরই বুজে এল চোখের পাতা। বেহুশ হয়ে পড়ে গেল মাটিতে।

কারাতে-লাথি মেরে বসল রবিন, হিলারির চোয়ালে। মেরেই গোড়ালিতে ভর দিয়ে পাক খেল একবার, যে পা-টা ভোলা ছিল ভোলাই রইল, সোজা, টানটান। আরেকবার কারাতের মাই-গেরি লাথি খেল হিলারি, হজম করতে পারল না, টু শব্দটি না করে ঢলে পড়ল বসের পাশে।

ডকের হাত চেপে ধরে হ্যাঁচকা টানে তাকে ঘুরিয়ে ফেলেছে মুসা। ভারসাম্য হারাল লোকটা। কনুই দিয়ে তার বুকে কষে এক মাই হিজি-আতি লাগাল সে। আরেকটা লাগাতে যাচ্ছিল, ত্রাহি চিৎকার শুরু করল ডক, থাম! থাম! দোহাই তোমার, আর মের না! আমার কোন দোষ নেই! জোনস যা করতে বলেছে, করেছি! কসম!

এত অনুনয় করলে আর মারে কি করে? লোকটাকে টেনে নিয়ে এল মুসা, ধাক্কা দিয়ে বসিয়ে দিল মাটিতে, বেহুশ বসু আর তার সহকর্মীর পাশে।

তোমাদের কাছে ঋণী হয়ে গেলাম, তিন গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে বললেন মোড়ল ডুম সোবল। মিস্টার জোনস যে এত বড় শয়তান, কল্পনাই করতে পারিনি!

করবেন কি করে? মিলফোর্ড বলল। ভীষণ ধূর্ত লোক। আপনাদেরকে সাহায্য করছে বলে বলে ভুলিয়ে রেখেছিল। ঠেকার সময় উপকার পেয়েছেন, ফলে আপনারাও তার ওপর নরম ছিলেন।

আসলে, কিশোর বলল, ঋণী যদি হতে হয় কারও কাছে, গান গাওয়া ডাক্তারের কাছে হোন। শামানের মেসেজটা কি ভাবে কাজে লাগিয়েছে বুঝিয়ে বলল সে।

এদিক ওদিক তাকাতে লাগল জন। নিওমো কোথায়?

নিঃশব্দে কখন বনে ঢুকে গেছে ইনডিয়ান লোকটা, খেয়ালই করেনি কেউ।

ওকেও টাকা খাইয়েছে জোনস, মোড়ল বললেন জনকে, টাকা খাইয়ে দলে নিয়ে নিয়েছে। ওই ব্যাটাই পিকআপের ব্রেকটা খারাপ করে রেখেছিল। আরেকটু হলেই মেরে ফেলেছিল বেচারাদের।

তাহলে তো পালানোর চেষ্টা করবে।

যাবে কোথায়? ধরবই আমি ওকে, দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করলেন মোড়ল। এগুলোকে বেঁধেছেদে এখন ট্রাকে তোলো…

জোনসের গাড়িটায় তুলতে হবে, মিলফোর্ড বললেন। ওটাতে জরুরী দলিলপত্র আছে। নিয়ে যাব পুলিশের কাছে। প্রমাণ এবং আসামী একসাথে পেয়ে গেলে পুলিশের সুবিধে হবে।

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানালেন মোড়ল। জন যাবে আপনাদের সাথে। কাছের থানাটা কোথায় দেখিয়ে দেবে।

নিওমোর কি হবে? জানতে চাইল মুসা।

আমাদের নিজেদেরও পুলিশ আছে, মোড়ল বললেন।

চাচা হলেন আমাদের পুলিশ প্রধান, বলল জন।

আমেরিকান সরকারের সঙ্গে আমাদের যে চুক্তি হয়েছে, তাতে কিছু শর্ত দেয়া আছে, মোড়ল জানালেন। তার মধ্যে একটা হল, আমাদের সমাজে যেসব অপরাধ ঘটবে, সেগুলোর সাজা দেবার ভার আমাদের, পুলিশ নাক গলাতে আসবে না। আসামীদেরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার ক্ষমতাও আছে আমাদের।

দাদা হলেন আমাদের বিচারক, জানিয়ে দিল জন।

জোনস আর দুই সহচরের হাত-পা বেঁধে গাড়িতে ভোলা হলো। মোড়ল গিয়ে বড় ট্রাকটাকে রাস্তা থেকে সরালেন। গাড়ির ড্রাইভিং সীটে বসল মুসা। জানালা দিয়ে মুখ বের করে ফিরে তাকাল। বিদায় জানিয়ে হাত নাড়লেন ডুম। এই প্রথম তার গম্ভীর মুখে হাসি দেখতে পেল সে।

ঘুরে দাঁড়ালেন মোড়ল। হালকা পায়ে ঢুকে পড়লেন বনের ভেতর।

.

ডায়মণ্ড লেকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল গোয়েন্দাদেরকে জন। এই রাস্তাটার কথাই তিন গোয়েন্দাকে বলেছিল তার বোন মালটি, মাত্র আগের দিন, অথচ ছেলেদের মনে হল সেটা হাজার হাজার বছর আগের কথা।

ডায়মণ্ড লেকে পৌঁছল ওরা। ছোট, সুন্দর একটা পার্বত্য শহর। চকচকে সুইমিং পুল পেরিয়ে এল ওরা, গল্ফ কোর্সের পাশ কাটাল। টেনিস কোর্ট, ঘোড়া রাখার জায়গা, ব্যাকপ্যাক কাঁধে পাহাড়ে ঘুরতে বেরোনো ভ্রমণকারী, ছবির মত সুন্দর দামি দামি বাংলো দেখল। ব্যক্তিগত বিমানবন্দরের ওপর ঘুরছে বড় একটা লিয়ারজেট বিমান।

যাক, জোরে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল মুসা, এলাম শেষ পর্যন্ত।

আমার খিদে পেয়েছে, ঘোষণা করল কিশোর।

হায় হায়, আমার খিদেটা তোমার পেটে চলে গেল কি করে! হেসে বলল সহকারী গোয়েন্দা! খিদে খিদে তো কেবল আমি করতাম!

মিস্টার মিলফোর্ড বললেন, আমার একটা টেলিফোন দরকার প্রথমে। তারপর গোসল।

রবিন বলল, আমার ডাক্তার দরকার। বলে জানালা দিয়ে মুখ বের করতেই দেখল পথের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে তিনটি সুন্দরী কিশোরী মেয়ে। ওর দিকে চোখ পড়তেই হাসল। হাত নাড়ল একজন। রবিনও তার জবাব দিল। শিস দিয়ে উঠল একটা মেয়ে।

জন তো অবাক। মেয়েরা শিস দেয়? উল্টো হয়ে গেল না ব্যাপারটা?

মুচকি হাসল মুসা। রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল, তিন গোয়েন্দার অভিধানে উল্টো বলে কোন কথা নেই। এই তো, আমার খিদে কিশোরের পেটে চলে গেল, যে খেতেই চায় না। রবিনের দিকে তাকিয়ে মেয়েরা শিস দেয়, অথচ চিরকাল জেনে এসেছি মেয়েদের দিকে তাকিয়েই ছেলেরা শিস দেয়…

তোমরা আসলেই স্পেশাল, জন বলল। একটা কাজ করা দরকার। দাদাকে গিয়ে বলতে হবে, তোমাদের জন্যে যাতে একটা অনুষ্ঠান করে। তোমাদের ওপর অশুভ শক্তির নজর পড়েছে, সে জন্যেই এত বিপদ গেল। সেটা কাটানো দরকার। তোমরা যাবে তো?

নিশ্চয়ই! সাথে সাথে জবাব দিল মুসা। তোমাদের রান্না সত্যিই চমৎকার! আর তোমার বোন মালটি খুব ভাল মেয়ে!

কি ব্যাপার, মুসা, পেছন থেকে ডেকে জিজ্ঞেস করল রবিন। ঘটনাটা কি?

না, কিছু না! লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি বলল মুসা।

কিশোর তাকিয়ে রয়েছে সিয়েরা মাদ্রের বরফে ঢাকা নীলচে সাদা চূড়ার দিকে। স্বপ্নিল হয়ে উঠেছে তার সুন্দর মায়াময় চোখ। বিড়বিড় করে আনমনে বলল, প্রেমে যদি সত্যিই পড়তে হয় কারও, তাহলে ওগুলোর…ওই বরফে ছাওয়া পাহাড়, রূপালি ঝর্না, নীল আকাশ, চিল…

অ্যাই, কি বিড়বিড় করছ? জিজ্ঞেস করল রবিন।

চমকে যেন স্বপ্নের জগৎ থেকে ফিরে এল গোয়েন্দাপ্রধান, অ্যাঁ!…না, কিছু না!…ও, থানা এসে গেছে?

‘ডায়মণ্ড লেক পুলিশ স্টেশন’ লেখা বাড়িটার ওপর চোখ পড়েছে তার।

Exit mobile version