Site icon BnBoi.Com

একাত্তর এবং আমার বাবা – হুমায়ূন আহমেদ

Ekattor Ebong Amar Baba By Humayun Ahmed

ভূমিকা : একাত্তর এবং আমার বাবা

প্রায় হঠাৎ করেই হুমায়ূন আহমেদের এই পাণ্ডুলিপিটি আবিষ্কৃত হয়েছে। সে যখন এটি লিখেছিল তখনো সে হুমায়ূন আহমেদ হয়নি। ঠিক কখন এটি লিখেছে কেউ সেটি ভালো করে বলতে পারে না। অনুমান করা হয় একাত্তরেই সে এটি লিখেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে মারা যাওয়া আমার বাবার মৃত্যুর ঘটনাটিই ছিল মূল বিষয়—তার কারণ সে ঠিক যে-জায়গায় শেষ করেছে তার পরের অংশটুকু আমার লেখা। হুমায়ূন আহমেদ সম্ভবত প্রথম অংশটুকু শেষ করে বাকিটুকু আমাকে লিখতে বলেছে, কারণ শেষ দিনটিতে আমি আমার বাবার সাথে ছিলাম; তাই শুধু আমিই সেটি লিখতে পারব। আমার স্মৃতিশক্তি খুবই দুর্বল তাই আমি কিছুতেই মনে করতে পারিনি কখন এটি লিখেছি। আমার ভাইবোন বা মাও সেটি মনে করতে পারেনি কাজেই সঠিক সময়টি বলা যাচ্ছে না, অনুমান করছি। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই স্মৃতিচারণমূলক লেখাটি লেখা হয়েছিল।

এটি প্রায় ব্যক্তিগত ডায়েরির মতো, কাজই এটাকে বই হিসেবে প্রকাশ করা উচিত হবে কি না সেটা নিয়ে অনেক চিন্তা ভাবনা করা হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের লেখা যেখানে শেষ হয়েছে, তার পরে আমার লেখা অংশটুকু জুড়ে দেওয়া হবে কি না সেটা নিয়ে আমার মা, ভাই, বোন সবার সাথে আলোচনা হয়েছে। আমি নিজের অংশটুকু জুড়ে দিতে খুবই অনিচ্ছুক ছিলাম কিন্তু আমাদের পরিবারের সবাই পুরো লেখাটুকু পূর্ণাঙ্গ করার জন্যে শেষ অংশটুকু যুক্ত করে দেয়া উচিত বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছে, তাই এই প্রথমবার হুমায়ূন আহমেদের একটি লেখার সাথে আমার লেখা জায়গা করে নিয়েছে।

আমি জানতাম হুমায়ূন আহমেদ একজন জনপ্রিয় লেখক। লেখকদের বেলায় শব্দটা জনপ্রিয় না হয়ে পাঠকপ্রিয় হওয়ার কথা, যারা পাঠক শুধু তারাই লেখকের ভক্ত হতে পারে অন্যদের তো আর সেই সুযোগ নেই। কিন্তু কোনো এক রহস্যময় কারণে হুমায়ূন আহমেদ শুধু পাঠকপ্রিয় ছিল না, সে অসম্ভব জনপ্রিয় মানুষ ছিল। কেমন করে সে সাধারণ মানুষের কাছেও জনপ্রিয় হলো আমি মাঝে মাঝে সেটা নিয়ে ভেবেছি, মনে হয় সেটি ঘটেছে তার বহুমাত্রিক প্রতিভার জন্যে। বাংলাদেশে টেলিভিশনের জন্যে সে যে-নাটকগুলো লিখেছে তার জনপ্রিয়তা ছিল অবিশ্বাস্য। আমি তখন দেশের বাইরে, তাই নিজের চোখে দেখিনি কিন্তু শুনেছি যখন টেলিভিশনে তার নাটক দেখানো হতো তখন বাংলাদেশের পথঘাট নাকি জনশূন্য হয়ে যেতো। মনে হতো বুঝি কারফিউ দেয়া হয়েছে। তার নাটকের চরিত্রকে ফাঁসি দিয়ে যেন মারা না হয় সেজন্য দেশে আন্দোলন হয়েছিল। চলচ্চিত্র তৈরি করার তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না, তারপরও সে অসাধারণ কিছু ছবি তৈরি করেছিল। প্রকৃতির জন্যে গভীর একটি মায়া ছিল, বড়ো ছেলে নুহাশের নামে সে নুহাশ পল্লী তৈরি করেছে; সেটি এই দেশের মানুষের কল্পনার একটি ভূখণ্ড। সাধারণ মানুষ খুব বেশি জানে না আমরা জানি, সে খুব সুন্দর ছবি আঁকতে পারত আর চমৎকার ম্যাজিক দেখাতে পারত। সবচেয়ে বড়ো কথা মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম হিসেবে তার মুক্তিযুদ্ধের জন্য গভীর এক ধরনের ভালোবাসা ছিল। একটা সময় ছিল যখন টেলিভিশনে মানুষের মুখে রাজাকার শব্দটি উচ্চারিত হওয়া নিষিদ্ধ ছিল, তখন সে টিয়াপাখির মুখে তুই রাজাকার কথাটি টেলিভিশনে উচ্চারিত করিয়েছিল। তরুণ প্রজন্মকে সে জোছনার আলো আর আকাশ ঝাপিয়ে বৃষ্টিকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিল। তরুণ তরুণীদের সে ভালোবাসতে শিখিয়েছিল। সম্ভবত সে-কারণেই তার ভক্ত শুধু ভালো কিছু বোদ্ধা পাঠকের মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল না, তার জন্যে এই দেশের সকল স্তরের মানুষের ছিল গভীর এক ধরনের ভালোবাসা।

আমি সেই ভালোবাসার কথা জানতাম কিন্তু সেটি যে কত গভীর কিংবা কত বিস্তৃত সেটি কখনো কল্পনা করতে পারিনি। তার মৃত্যুর পর আমি প্রথমবার সেটি অনুভব করতে পেরেছিলাম। একজন লেখকের জন্যে একটি দেশের মানুষ এত গভীরভাবে, এত তীব্রভাবে ভালোবাসা পেতে পারে সারা পৃথিবীতে সম্ভবত তার খুব বেশি উদাহরণ নেই। আমি নিজে নানা কিছু নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম বলে তখন জানতে পারিনি, পরে শুনেছি তাকে সমাহিত করার পুরো বিষয়টি কয়েকদিন টেলিভিশনে সরাসরি দেখানো হয়েছিল। শুধু তাই নয়, এই দেশের সকল মানুষ টেলিভিশনের সামনে বসে সেটি দেখেছে।

তার জনপ্রিয়তার বিষয়টি একটু বিস্তৃতভাবে বলছি কারণ এই উপলব্ধির সঙ্গে এই বইটি প্রকাশনায় একটি সম্পর্ক আছে। হুমায়ূন আহমেদ যখন এই স্মৃতিচারণমূলক লেখাটি লিখেছে তখনো সে প্রকৃত হুমায়ূন আহমেদ হয়ে ওঠেনি। লেখাটির মাঝে দুর্বলতা আছে, ছেলেমানুষী আছে, ভুল তথ্য আছে, প্রচুর বানান ভুল আছে–হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকলে এটিকে ছাপার অক্ষরে দেখাতে চাইত কি না আমার জানা নেই। কিন্তু তার জন্যে এই দেশের মানুষের এত গভীর আগ্রহ রয়েছে যে, আমার মনে হয়েছে তরুণ হুমায়ূন কেমন করে লিখত সেটি হয়তো তাদেরকে দেখতে দেয়ার একটি সুযোগ করে দেয়া দরকার। প্রায় অর্ধশত বছর আগে লেখা কাগজগুলো বিবর্ণ হয়ে গেছে, লেখা অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে তারপরও আমি এই বইয়ে ভুলভ্রান্তিসহ তার নিজের হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিটি তুলে দিয়েছি।

তার নিজের হাতে লেখা কোনো পাণ্ডুলিপি সেভাবে রক্ষা করা হয়েছে কি না আমি নিশ্চিত নই—তাই আমার মনে হয়েছে অন্তত এক জায়গায় সেটি সংরক্ষিত থাকুক। একুশ বছরের একটি তরুণ কেমন করে লিখত সেই তথ্যটি অনেকের কাছে কৌতূহলোদ্দীপক হতেই পারে। ভবিষ্যতে কেউ যদি গবেষণা করতে চায় এখান থেকে নিশ্চিত অনেক তথ্য পেয়ে যাবে।

এই পাণ্ডুলিপিটি মুক্তিযুদ্ধের সময় লেখা। মুক্তিযুদ্ধের সেই শ্বাসরুদ্ধকর সময়টি এখানে খুব চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। এটি মূলত আমাদের পরিবারের কথা, কাজেই পড়ার সময় একাত্তরের সেই সময়ের ছবিটুকু আবার আমার চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল। যারা একাত্তর দেখেনি, তারা এটি পড়ে সেই দুঃসহ সময়ের অনুভূতিটুকু খানিকটা হলেও অনুভব করতে পারবে। মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক সময়টাতে সারা দেশে একটা বিশৃঙ্খল পরিবেশ ছিল। এই লেখাটিতে সেটি খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একটা মহকুমার দায়িত্বে থাকা আমার পুলিশ অফিসার বাবা অত্যন্ত জটিল একটা সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের টানাপোড়নের মাঝে কীভাবে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছেন সেটিও এখানে খুব স্পষ্ট।

হুমায়ূন আহমেদ অসাধারণ কথাশিল্পী হলেও সে খুবই দুর্বল ইতিহাসবিদ। আমি সবাইকে সতর্ক করে দিই, তার কোনো লেখা থেকে কেউ যেন কখনো কোনো ঐতিহাসিক তথ্য খুঁজে বের করার চেষ্টা না করে। আমি লক্ষ করেছি কোনো একটা বিচিত্র কারণে সত্য ঘটনার খুঁটিনাটি নিয়ে সে কখনো বিন্দুমাত্র মাথা ঘামাত না। তার নানা বইয়ের নানা স্মৃতিচারণে অনেক কিছুই আছে, যেখানে সে একটু কষ্ট করে নির্ভুল সঠিক তথ্য দিতে চেষ্টা করেনি। আমি সেটা ভালো করে জানি, কারণ আমাকে নিয়ে কিছু একটা লিখতে গিয়ে মাঝে মাঝে সে এমন চমকপ্রদ কিছু কথা লেখে যা প্রায় সময়েই অনেক অতিরঞ্জিত। বৈজ্ঞানিক তথ্যও তাকে বলে দেওয়ার পরেও শুদ্ধ করার চেষ্টা করে নি। আমার একজন বয়স্ক আমেরিকান বন্ধু আমাকে বলেছিল, Dont ruin a good story with facts–হুমায়ূন আহমেদ হচ্ছে এই দর্শনের সবচেয়ে বড় অনুসারী! সে ছোটোখাটো সত্য দিয়ে কখনোই মজার একটা গল্প নষ্ট করেনি!

এই বইয়ের যে সব তথ্য সঠিক নয় বলে আমি নিশ্চিতভাবে জানি তার কয়েকটা উদাহরণ এইরকম :

ক) তার নিজের উপন্যাসের যে কাহিনিটি বর্ণনা করা হয়েছে সেটি নন্দিত নরকের কাহিনী নয়। সেই কাহিনীটি শঙ্খ নীল কারাগারের। সম্ভবত নন্দিত নরকে নামটি তার প্রিয় নাম, ভেবেছিল এই বইয়ে এই নামটিই দেবে, শেষ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি দিয়েছিল তার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাসের। (পৃষ্ঠা ৬৬-৬৭)।

খ) পঁচিশে মার্চ রাতে পিরোজপুর থানায় আমার বাবা একা ওয়ারলেস রুমে যুদ্ধ শুরুর ঘটনা শুনেন নি আমরা সবাই তার সাথে ছিলাম। (পৃষ্ঠা ৭৪-৭৫)

গ) আমার বাবাকে ফিরে পাওয়ার চিঠিটি নাজিরপুরের ওসি লিখেনি— লিখেছিল পিরোজপুরের ওসি। (পৃষ্ঠা ১৪২/১৪৩)

খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আরো বের করা সম্ভব, কিন্তু আমার ধারণা–কী বলতে চাইছি সেটা এই উদাহরণগুলো দিয়েই বোঝা সম্ভব। কাজেই ইতিহাসবিদরা তাকে ক্ষমা করে দেবেন।

এই বইটির দ্বিতীয় ভাগে আমার অংশটুকু জুড়ে দেয়া হয়েছে শুধুমাত্র আমার বাবার জীবনের পরিসমাপ্তির ঘটনাটুকুর পুরোটা পূর্ণ করার জন্যে। যেভাবে লিখেছিলাম মোটামুটি সেভাবেই আছে, বোঝার সুবিধের জন্যে কোথাও হয়ত একটি-দুটি শব্দ যোগ করেছি কোথাও বাদ দিয়েছি। দীর্ঘদিন পর, সেই টিন-এজ বয়সের লেখা পড়ে আমি নতুন করে এক ধরনের কষ্ট অনুভব করেছি। একাত্তরে লক্ষ লক্ষ পরিবার এই কষ্টের ভেতর দিয়ে গিয়েছে। অসংখ্য পরিবার পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে–আমরা খুব ভাগ্যবান যে, আমরা টিকে গেছি। আমার ধারণা আমরা যে-টিকে আছি এ-ব্যাপারে আমার মায়ের একটা খুব বড়ো ভূমিকা আছে।

হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতিচারণের পাণ্ডুলিপির মাঝে দুটি পৃষ্ঠা নেই। একটি সত্যি সত্যি হারিয়ে গেছে। অন্যটি দেখে মনে হয় সম্ভবত পৃষ্ঠাসংখ্যা দেওয়ার সময় ভুল করার কারণে পৃষ্ঠা সংখ্যার এই গরমিল।

হুমায়ূন আহমেদ এই পাণ্ডুলিপির কোনো নাম রেখে যায়নি। সে নিজে নাম দিলে খুব চমৎকার একটা নাম দিতে পারত। আমি পাণ্ডুলিপির বিষয়বস্তুর সাথে মিল রেখে এর নামকরণ করেছি ‘একাত্তর এবং আমার বাবা’। এখানে একাত্তর যেটুকু আছে আমার বাবাও প্রায় ততখানিই আছেন। আমার মনে হয়েছে এই লেখাটি ছিল আমাদের বাবার জন্যে হুমায়ূন আহমেদের এক ধরনের শ্রদ্ধার্ঘ্য।

হুমায়ূন আহমেদ যখন এটি লিখেছে তখন সে পুরোনো বানান রীতিতে লিখেছে, এখানে যেহেতু হুবহু তার হাতের লেখার অংশটুকু আছে তাই পাঠকদের কাছে উপস্থাপনের জন্যে ছাপা অংশটুকুতে প্রমিত বাংলা বানান রীতি প্রয়োগ করে এক ধরনের সমতা বিধানের চেষ্ঠা করা হয়েছে। এ-ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করেছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জফির সেতু। তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই।

এই বইয়ে হুমায়ূন আহমেদের পাণ্ডুলিপিটা খুঁজে বের করার জন্য আমি ভাতৃবধূ রীতার কাছে কৃতজ্ঞ। আমার অংশটুকু প্রায় কাকতালীয়ভাবে ছোটোবোন শিখুর কাছে ছিল। তাদের দুজনের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। বইটির প্রচ্ছদ তৈরী করে দিয়েছে অনুজ আহসান হাবীব। প্রচ্ছদে বাবার ছবিটি এসেছে বড়বোন সুফিয়া হায়দারের সংগ্রহ থেকে। হুমায়ূন আহমেদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ছবিটি দিয়েছে ছোট বোন রোখসানা আহমেদ। এটি হুমায়ূন আহমেদের শেষ বই, এ বইটিতে কীভাবে কীভাবে জানি পরিবারের সবার ভালোবাসার স্পর্শ রয়েছে।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

সবখানে একটা ঝড়ের আভাস

সবখানে একটা ঝড়ের আভাস দেখছিলাম। হলের ছেলেরা বইপত্র নিয়ে বাড়ি চলে যাচ্ছিল। রাস্তাঘাটে লোকজন চলছে, অথচ যানবাহন নেই। এখানে-সেখানে ব্যারিকেড সাজিয়ে সকলেই কিছু একটার জন্যে অপেক্ষা করছে। আমার ভালো লাগছিল না। সকলের হাবভাব, রাজনৈতিক-পরিস্থিতি ইত্যাদি দেখে আমি বেশ শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলাম। ছোটো ভাইবোন দুটিকে নিয়ে বাসায় চলে যেতে চাচ্ছিলাম। অথচ ওরা দু-জনেই স্বভাবে আর মানসিক গঠনে আমার উলটো। যখন রোকেয়া হলে শেফুর (হুমায়ূন আহমেদের বোন সুফিয়া হায়দার) সঙ্গে দেখা করতে যাই তখন তার উল্লসিত ভাব দেখে বিস্মিত হই। বলি,

কিরে ভয় লাগে না? আয় বাসায় চলে যাই।

সবাই হলে আছে, আমি কেন খামাখা যাব?

হেসেই উড়িয়ে দেয় সে। আমি তবু জোর করি। বলি, কিন্তু যদি কিছু হয়।

তুমি বড়ো ভীতু।

ভীতু মানুষকে ভীতু বলে গাল দেবার সুবিধা এই যে, তাতে সে রাগ করতে পারে না। মনের খবর প্রকাশ হয়ে যায় দেখে বিব্রত হয় শুধু। আমিও তাই বিব্রত মুখেই ফিরে আসি।

হলেও আমার কিছু করার নেই। অনার্স থিওরি পরীক্ষা দিয়ে দিয়েছি, প্রাকটিকেলের ফার্স্ট পেপারও হয়ে গিয়েছে। গণ্ডগোল শুরু হয় এর মধ্যেই। ইয়াহিয়ার জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতুবি, প্রতিবাদে দেশব্যাপী হরতাল এবং একে অনুসরণ করে গ্রেফতার, গুলি, কারফিউ।

আমার রাজনৈতিক নিস্পৃহতার জন্যেই আমি এ-সমস্ত থেকে দূরে ছিলাম। শুচিবাইগ্রস্তদের মতোই আমি রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করতাম। সংসারে যে-সমস্ত লোক বিজ্ঞাপন, অবিশ্বাস্য, মর্মন্তুদ, বিশ্বাস করুন আর নাই করুন জাতীয় খবরগুলো খবরের কাগজের হেডলাইনের খবরের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে পড়ে আমি সব সময় সেই দলের। যার ফলস্বরূপ আমি সবার ওপরই বিরক্ত হয়ে উঠছিলাম। ইয়াহিয়ার ওপর বিরক্তি–কেন সে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন পিছিয়ে দিলো। মুজিবরের ওপর বিরক্তি দুই একদিন পিছিয়েছে তাতে এত হইচই এর কি আছে। আসল কারণ পরীক্ষাগুলো দিয়ে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতে আমি উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলাম।

ছোটো ভাই ইকবাল (মেজো ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল) তখনো হলে সিট পায়নি। আমার সঙ্গেই থাকত। রাজনীতি বিষয়ে তার কতটুকু আগ্রহ ছিল জানি না কিন্তু মিটিং, মিছিল এই সমস্তে তার উৎসাহ ছিল। শহীদ মিনারে ফুল দেয়ার জন্যে রাত তিনটায় বেরিয়ে যাওয়ার মধ্যে এর প্রমাণ মেলে। তার জন্যে উদ্বেগ ভোগ করতে হতো। সব সময় ভয় হতো এই বুঝি কোনো একটা ঝামেলায় পড়ল।

আবহাওয়া তখন খুব গরম যাচ্ছে। চারিদিকে মিটিং, মিছিল, বিক্ষোভ। শামুকের মতোই এ-সমস্ত থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিজের খোলেই নিজেকে আবদ্ধ করে রেখেছিলাম। আমি যখন টমাস হার্ডির ‘এ পেয়ার অব ব্লু আইস’ পড়ে চোখের জলে বালিশ ভিজিয়ে ফেলছি তখন শুনতাম ছেলেরা মিছিল করে যাচ্ছে। ভয় হতো এই বুঝি এসে বলবে ‘কি রে তুই গাধার মতো ঘুমুচ্ছিস আয় আমাদের সাথে।’ এর হাত থেকে বাঁচার জন্যেই রুমের সামনে লিখে রেখেছিলাম ‘Examinee, Don’t disturb, নীরবতাই কাম্য।’

দুপুরে ইকবাল এসে খবর দিল ফার্মগেটে গুলি হয়েছে। বিকেলের দিকে এল ইকবালের বন্ধু খাজা। নাটক না করে কিছুই বলতে পারে না। সে চোখ বড় বড় করে হাত নেড়ে মাথা দুলিয়ে যা বলল তা হলো হাইকোর্টের সামনে বাঙালি পুলিশ আর মিলিটারিতে সিরিয়াস ফাইট। দুই পক্ষেই গুলাগুলি, একশর উপর জখম। বলা বাহুল্য তার কথা বিশ্বাস হলো না। তবে কিছু একটা যে হয়েছে তার আঁচ পেলাম। সন্ধ্যা নাগাদ খবর পাওয়া গেল দুই পক্ষে মতান্তর হয়েছে ঠিকই। পুলিশরা রাইফেল ফেলে দিয়ে বলেছে ডিউটি করব না। দাবানলের মতোই খবর ছড়িয়ে পড়ল। মিলিটারি পুলিশ সংঘর্ষ। ছেলেরা উৎসাহে টগবগ করে ফুটতে লাগল। পুলিশ অফিসারের ছেলে হিসেবে আমি এতে যথেষ্ট গৌরববোধ করছিলাম। আমার হাবভাবে এমন প্রকাশ পাচ্ছিল যে আমি নিজেই এই গণ্ডগোলের সৃষ্টি করে মিলিটারির পিলে চমকে দিয়েছি।

অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছিল। মিলিটারির ট্রাক, জিপ আর পশ্চিমা ই.পি.আর-দের নড়াচড়া চোখে পড়ার মতোই। হল থেকে যখনই দৈত্যের মতো ট্রাকগুলো দেখা যেত তখনই ‘দুর!’ ‘দুর!’ ধ্বনি উঠত সমস্ত হলগুলো থেকে। অতিরিক্ত উৎসাহীরা ছড়া কাটত

‘একটা দুইটা মিলিটারি ধর
সকাল বিকাল নাস্তা কর।’

পুলিশের গাড়িগুলোও অবশ্য এ-থেকে রেহাই পেত না। তবে তারা প্রায়ই ‘জয় বাংলা’ বলে চেঁচিয়ে বাজিমাত করত। ছেলেরা তখন ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বাংলা’ বলে ষাড়ের মতোই চেঁচাতে থাকত।

শেফুর কাছ থেকে মজার মজার খবর পেতাম। কোনো এক মেয়ে বাড়ি থেকে চিঠি পাচ্ছে না কেলে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। কারা নাকি একটা মিলিটারি গাড়ির ওপর গরম পানি ঢেলে দিয়েছে উপর থেকে। আবার আরেকজন তিন তালা থেকে থুতু ফেলেছে এক পুলিশের গায়ে। অধিকাংশ গল্প গল্পই। অবিশ্বাস্য এবং হাস্যকর। বসে বসে শুনতে ভালোই লাগত। মেয়ে হলের ভিজিটার্স রুমটা যদিও সবদিক থেকেই ভিজিটারদের ডিসকারেজ করবার জন্যেই তৈরি তবু ছেলেরা সেখানে গেলে বড়ো একটা উঠতে চাইত না। মেয়েরা সেটা ভালো করেই জানত। শেফু যাতে আমাকে ঐ সব ছেলেদের দলে না ফেলে, যাতে না-ভাবে দাদাভাই (হুমায়ূন আহমেদকে তার ছোটো ভাইবোন দাদাভাই বলে ডাকত) দেখি বসে থাকতে থাকতে শিকড় গজিয়ে ফেলল সেই দিকে আমার কড়া নজর ছিল তাই তার সঙ্গে আমার কথা হতো অল্পই।

কি রে ভাল?

হ্যাঁ।

চল বাসায় চলে যাই।

না।

রাতে গুলির শব্দ শুনে ভয় লাগে?

উঁহু মজা লাগে।

আচ্ছা তা হলে যাই।

আচ্ছা।

আহসান খবর দিলো আর্ন উল্লাহ হলের তিনজন ছাত্রকে গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়েছে লামা থাকতেন আহসান উল্লায়। দু-জন একই হোস্টেলের রুমমেট হিসেবে দু-বছর কাটানোয় সম্পর্কটা ছিল। বন্ধুসুলভ। দু-জনেই সস্তা ধরনের রসিকতা উৎসাহের সঙ্গে নিঃসংকোচেই বলাবলি করতাম। অবশ্য মাঝে মাঝে তিনি যে মামা এটি তার মনে পড়ে যেত। অভিভাবকসুলভ গাম্ভীর্যে খোঁজ-খবর নিতেন আমাদের। ছাত্র গ্রেফতারের কথা শুনেই মনে হলো তিনজনের একজন মামা রুহুল আমিন (মামা এবং সহপাঠী) নয়তো! তিনটার দিকে খোঁজ নিতে বেরুলাম। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি সত্যি যদি তাই হয় তবে উত্তেজনার একটা খোরাক পাওয়া যায়। ফলাও করে গল্প করতে পারি। মামার গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দিতে পারছিলাম না। তার স্বভাব অনেকটা সেই জাতীয় বৈষ্ণবদের মতো যারা মুরগি খায় এবং নিজেদের এই বলে প্রবোধ দেয় যে গঙ্গাজলে বেঁধেছি কাজেই কোনো দোষ নেই। তিনি কোনো রাজনৈতিক মতবাদে জড়িত নন। অথচ একটি রাজনৈতিক সংস্থা থেকে ইলেকশন করে হলো সংসদের মেম্বার। মিছিল-টিছিল সমর্থন করেন না অথচ সব মিছিলের মাঝামাঝি থাকেন যাতে সামনে এবং পিছনে যে-কোনো দিক থেকেই বিপদ আসলে পগার পার হতে পারেন। অথচ দেখা গিয়েছে এই জাতীয় লোকগুলোই সবার আগে বিপদে পড়ে। সযতনে সমস্ত ঝামেলা এড়িয়ে তীরে এসে তরী ডোবায়।

গিয়ে দেখি মামা উপুড় হয়ে শুয়ে ঘরোয়া পড়ছেন। আশাভঙ্গ হলো। উঠে বসে আমার দিকে চেয়ে বলল ‘চল চা খেতে খেতে আলাপ হবে।’ চায়ে চুমুক দিতে দিতে মামা বললেন, কাল আমার ওপর দিয়ে বড় বিপদ গেছে। মিলিটারির তাড়া খেয়ে কম করে হলেও দেড় মাইল দৌড়েছি। রাস্তায় ইটের বাড়ি লেগে দেখ নখের অবস্থা।

হলে ফিরে এসে শুনি শহরে হঠাৎ করে curfew দেয়া হয়েছে। ঘণ্টাখানেক পরই নিউ মাকের্ট আর আজিমপুরের দিক থেকে গুলির শব্দ শোনা যেতে লাগল। অথচ ইকবাল এখনো ফেরেনি। হলের গেট বন্ধ করে দেওয়া হলো। ছেলেরা উত্তেজিত হয়ে হলের ভিতরই ঘোরাফেরা করতে লাগল। সন্ধ্যা হলো, রাস্তাঘাট যা নজরে পড়ে তা জনমানবহীন। হলের মেইন সুইচ অফ করে দেয়া হলো। আলোতে হলের লবিতে দাঁড়ানো ছেলেদের দূর থেকে দেখতে পেয়ে যদি গুলি ছুঁড়ে এই ভয়ে। আমি ইকবালের জন্যে উদ্বিগ্ন বোধ করছিলাম। একবার ভাবি তার বন্ধু খাজার কাছেই আছে হয়ত। আরেকবার ভাবি হয়ত মামার কাছে গিয়ে আটকা পড়েছে। রেডিওর খবর শুনতে গেলাম নিচে। গুলির শব্দ এবার খুব কাছেই শোনা গেল। দমকলের গাড়িগুলো ঢং ঢং করে ঘণ্টা পিটতে পিটতে যাচ্ছে। Ambulance এর গাড়িগুলো যাচ্ছে তারস্বরে সাইরেন বাজাতে বাজাতে। একটি ছেলে হঠাৎ বলে উঠল কার্ফিউ দিয়ে মেয়েদের হলে যদি মিলিটারি ঢুকে পড়ে তবে কিন্তু করার কিছু নেই। শেফুর কথা মনে হতেই ধুকটা ধ্বক করে উঠল। সত্যি তো গত আন্দোলনে এমনি দু-একটা ঘটনা ঘটেছিল। কার্ফিউ আওয়ারে মিলিটারি অনেক ভদ্র বাড়িতে জোর করে ঢুকে পড়েছিল। উৎকণ্ঠায় পাথর হয়ে নিজের ঘরে এসে দেখি ইকবাল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। আছে। চাবি সঙ্গে না থাকায় ভিতরে ঢুকতে পারছে না।

‘কার্ফিউর ভিতর আসলি কী করে?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি।

‘আমি কার্ফিউর আগেই এসেছি। নিচে মামুনের (মো. মামুন, পরবর্তীকালে অর্থনীতির অধ্যাপক) সঙ্গে গল্প করছিলাম।’

দুঃশ্চিন্তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে অডহাউসের Pig have wing পড়তে লাগলাম মোমবাতি জ্বালিয়ে। পাশের রুমে বাজি রেখে কনটাক্ট ব্রিজ খেলা হচ্ছিল তার হইচই আর নিচ থেকে উত্তেজিত রাজনৈতিক আলোচনার আওয়াজেও আমার পাঠে বিঘ্ন হলো না।

রাত বারোটার দিকে নিচে প্রবল উত্তেজনার আভাস পেলাম। হইচই ভীত সন্ত্রস্ত্র দৌড়াদৌড়ি, ডাক্তার ডাক্তার চিঙ্কার। আমি ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসি। বারেন্দায় নানাজি নজরুল ইসলামের (দূর সম্পর্কের নানা, একজন মুক্তিযোদ্ধা) সঙ্গে দেখা।

‘আরে তুমি, নিচে যাও দেখ গিয়ে কাণ্ড’ দৌড়ে নিচে গিয়েতো আমি হতভম্ব। দু-জন লোককে মেঝেতে শুইয়ে রাখা হয়েছে, রক্তে মেঝে ভেসে যাচ্ছে। অ্যামবুলেন্সের জন্য ছেলেরা পাগলের মতো টেলিফোন করছে। খবরে জানতে পারলাম এরা একজন চিটাগাং রেস্টুরেন্টের বয় অন্যজন রিকশাওয়ালা। কার্ফিউ ব্রেক করতে গিয়ে একজন বুকে অন্যজন পায়ে গুলি খেয়েছে। যারা তাদের বয়ে এনেছে তারা ইউনিভার্সিটিরই ছাত্র। অ্যামবুলেন্স এলো অনেক পর, লোক দু-টিকে নিয়ে চলে গেল সাইরেন বাজাতে বাজাতে।

কার্ফিউ ভাঙল ভোর ৯টায়। দৌড়ে গেলাম রোকেয়া হলে। সেখানে গেটের কাছে খুব ভীড়। সবাই এসেছে আত্মীয় স্বজনের খোঁজে। হল থেকে পরিচিতদের সরিয়ে নিতে। মেয়েরা বিবর্ণ মুখে হল ছেড়ে চলে যাচ্ছে। দেখলাম শেফুর অবিচল সাহসেও চিড় ধরেছে। সে নিজ থেকেই বলল, চল বাসায় চলে যাই। ঠিক হলো পরদিন বিকেলে ঢাকা ছাড়ব। তার সঙ্গে আরো কয়েকজন মেয়ে যাবে। তাদের সঙ্গে কোনো অভিভাবক নেই। তারা চাঁদপুর নেমে যাবে।

সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় বাসা থেকে টাকা নিয়ে কেউ আসে নি। নিজেদের সঞ্চিত পুঁজিও শেষ। আমি জিনিসপত্র গোছগাছ করছি বেয়ারা এসে খবর দিলো নিচে আপনার একজন গেস্ট এসেছে, মেয়ে গেস্ট। শেফু ছাড়া কে আর হবে। নিচে নেমে দেখি আমার ক্লাসমেট ‘ছাগী’  (প্রকৃত পরিচয় জানা যায়নি)। তার ‘ছাগী’ নামটির একটু ইতিহাস আছে। ছাগল যেমন যা পায় তাই চিবিয়ে দেখে। শুকনো চটিজুতা থেকে অঙ্ক বই সবই তার কাছে সমান প্রিয়। এই মেয়েটির স্বভাব তেমনি। সে যে কোনো ছুঁতোয় যে কোনো ছেলের সঙ্গে আলাপ করবেই। মেয়েদের সঙ্গে তার কোনো খাতির নেই তার যত উৎসাহ ছেলেদের নিয়ে। আমাদের ক্লাসের নিতান্ত ভ্যাবাগঙ্গারাম ছেলে সফিক যেদিন নতুন টেট্রনের শার্ট পরে এসেছিল সেদিন মেয়েটি তার শার্টে হাত দিয়ে কাপড় পরীক্ষা করতে করতে জিজ্ঞেস করেছিল কি টেট্রন পাকিস্তানি না জাপানি? আমরা ছেলেরা সবাই তাকে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করতাম। বিশেষ করে আমি, কারণ জনপ্রিয় ছাগী নামটি আমারই দেয়া এবং ভদ্রমহিলাও এটি ভালো করে জানেন।

‘শুনলাম আপনি পরীক্ষা না দিয়েই চলে যাচ্ছেন?’

মুখে হাসি টেনে আমি বললাম, ‘হ্যাঁ কোত্থেকে শুনলেন?’

‘আপনার বোনের কাছ থেকে। আচ্ছা আপনিও বরিশালে যাবেন?’

‘হ্যাঁ পিরোজপুরে।’

‘আমি কুষ্টিয়া যাব। এদিকে রেল আবার বন্ধ। অবশ্য যশোহর থেকে বাসে যাওয়া যায় খুলনা থেকে যশোহর পর্যন্ত বাসসার্ভিস আছে। আচ্ছা পিরোজপুর থেকে খুলনা কতদূর?’

‘বেশি দূর না, কাছেই।’

আচ্ছা আমি যদি আপনাদের সঙ্গে যাই আপনাদের অসুবিধা হবে? খুলনা পর্যন্ত যেতে পারলেই হবে, খুলনায় আমার এক খালু থাকেন।

আমি আমতা আমতা করি—

‘আমি সেইদিনই চলে যাব। শুধু একজন লোক দেবেন খুলনা পর্যন্ত।’

‘বেশত আসেন আসেন?’

‘আর মনে করেন রাস্তায় কোনো অসুবিধা হলো যাতে আমার পিরোজপুরে দুই একদিন থাকা লাগে।’

‘না অসুবিধা হবে না কিছু?’

অপরিচিত মেয়ে দেখে আম্মা হয়ত বা সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকাতে পারেন কিন্তু আদর যত্ন কম হবে না বরংচ একটু বেশিই হবে। তবে বাসা ছোটো এই একমাত্র অসুবিধা আমাদের নিজেদেরই কুলোয় না। ঠিক হলো সে পরদিন ভোরে আমাদের সঙ্গেই যাবে। শেফুর রুম নাম্বার জানত না সেটি জানিয়ে দিলাম।

বাসায় রওনা হবার আগে পরীক্ষার্থী ৪/৫ জন মিলে গেলাম Head of the department (রসায়ন বিভাগীয় অধ্যাপক মোকাররম হোসেন) এর সঙ্গে দেখা করতে। স্যার বেরিয়ে এলেন। কাঁদ-কাঁদ মুখ উদ্ভ্রান্ত চেহারা। বসতে বললেন। সংকুচিত ভাবেই বসলাম। স্যার করুণ কণ্ঠে বললেন— ‘শুনেছ বোধ হয় তোমাদের Department থেকে বহু দামি chemicals কাল রাতে একদল ছেলে ডাকাতি করে নিয়ে গিয়েছে।’ ঘটনাটা জানতাম না কাজেই বিস্মিত হলাম।

‘chemicals নিয়ে ওরা কী করবে স্যার?’

যা যা নিয়েছে তা দেখে মনে হয় হাই এক্সপ্লোসিভ বোমা তৈরি করবে। তবে সঙ্গে আরো সব দামি দামি chemicals নিয়েছে যার কোনো দরকারই হবে না। আমার এত কষ্টে জোগাড় করা chemicals—স্যারের মুখ করুণ হয়ে উঠল। অস্পষ্ট ভাবে বললেন, কিছু একটা হবে। আমার মেয়ে একটা পশ্চিম পাকিস্তানে হ্যাসবেন্ডের কাছে আছে। সব সময় ভয়ে ভয়ে আছি।

আমরা পরীক্ষার কথাতে আসতেই বললেন—নিরাপদ জায়গায় যেতে চাচ্ছ, যাও। সব ঠিক না হলে পরীক্ষা হবে না। পরীক্ষার জন্যে ভেব না। কথা শুনে মনে হলো তিনি ঝুলছেন বড়ো কোনো ভাবনা ভাবো। আমরা বেরিয়ে আসলাম। স্যার হাঁটতে হাঁটতে গেট পর্যন্ত আসলেন। কী ভাবছিলেন তিনি, কে বলবে।

চারিদিকে তখন আলোচনার বিষয়বস্তু একটি–শেখ সাহেব ৭ তারিখে রেসকোর্সে ভাষণ দেবেন। না-জানি কী দেন না-জানি কী বলেন। উৎকণ্ঠায় শহর ঝিমিয়ে। খবরের কাগজগুলি আগুনের মতো তেতে আছে। এদিকে সামরিক আইন প্রশাসক হয়ে এলেন। Lt. gen. টিক্কা। ঈদগার মাঠে বোমাবর্ষণ করে যিনি ইতিমধ্যেই বিভীষিকার নায়ক হয়ে রয়েছেন। ছাত্ররা যেন উত্তেজনায় পাগল হয়ে যাবে। এদিকে বাঙালি বিহারি একটা ঝামেলা প্রায় পেকে উঠছে। শেখ সাহেব ধমক দিলেন–

‘ভাষা যাই হোক, বাংলাদেশে যে-ই বাস
করবে সেই বাঙালি। তাদের জান-মাল
আমাদের কাছে এক পবিত্র আমানত।’

ঝামেলাটা থেমে গেল বটে কিন্তু বিহারিরা ফুঁসতে লাগল।

ঢাকা থেকে বেরিয়ে পড়ার জন্যে আমি অস্থির হয়ে উঠছি। বাসা থেকে কোনো খবর নেই। শেফু মেয়ে, নতুন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে— এদিকে ঢাকায় গণ্ডগোল। শুধু আমরা তিনজনই নই, মেজে বোন শিখু (মেজো বোন মমতাজ শহীদ) কুমিল্লায়। ফরিদা বিদ্যায়তনের হেডমিসট্রেস-এর বাসায় থেকে পড়াশুনা করছে। এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি। তার জন্যেও চিন্তা। শিখুর সঙ্গে কথা বলার জন্যে গেয়ে Telephone exchange এ। সে যেখানে আছে সেখানে Telephone নেই তবে কাছেই তার বান্ধবীর বাসা। সৌভাগ্যক্রমে প্রদির টেলিফোন নাম্বার জানা ছিল। গিয়ে দেখি ভো ভো Telephone exchange খালি। সমস্তই বন্ধ। অথচ essential service হিসেবে এটা খোলা থাকার কথা।

বেলা দুটোর দিকে হলের সামনে আমি আর ইকবাল রিকশা নিয়ে দাঁড়ালাম। ইকবাল গেল শেফুর খোঁজে। গিয়েছে তো গিয়েছেই, শেফুর দেখা নেই। পাঁচ মিনিট দশ মিনিট করে আধঘণ্টা পার হলো। অথচ লঞ্চ ছাড়বে গোটা চারেকের দিকে। যখন ধৈর্য্যের বাঁধ প্রায় ভেঙে পড়ছে তখন দেখা গেল শেফু হাসতে হাসতে আসছে, গেট পর্যন্ত এসেই বিদায়, কোনো কথা না বলেই। রাগে যখন মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। তখন সে নেমে এলো সঙ্গে তিনটি মেয়ে। তারা তিনজনই চাঁদপুর যাবে। বাসা লঞ্চঘাট থেকে আধমাইল, তারা তিনজন যাবে কাজেই ভয়ের কিছু নেই। আল্লাহর দয়া, ছাগীর দেখা নেই। জিজ্ঞেস করলাম ‘কিরে শেফু আমাদের ক্লাসের কারো সঙ্গে দেখা হয়েছিল?’

‘হুঁ।’

‘কিছু বলেছিল?’

না।

টার্মিনেলে পৌঁছে দেখি লঞ্চ এই ছাড়েতো এই ছাড়ে। তাড়াহুড়া করে উঠলাম। তিল ধারণের জায়গা নেই। ছেলেরা তবু না হয় কোনোমতে গেল কিন্তু মেয়েরা? সবাই পালাচ্ছে ঢাকা থেকে। শেফু কাঁদো কাঁদো হয়ে হঠাৎ বলল, ‘আর দুটি মেয়ে কই?’ সত্যিতো ইতিউতি করে খুঁজি চারিদিক। ধু-ধু করছে কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। ‘আমি, আমি একা কি করে বাসায় যাব’ সঙ্গী মেয়েটি কেঁদে ফেলে আর কি। সত্যিতো রাত এগারোটায় পৌঁছবে চাঁদপুর, এই মেয়ে একা একা কী করবে। সিটি বাজিয়ে লঞ্চ ছেড়ে দিলো। শেফু অভয় দিলো ‘আপা আমাদের বাসায় চলেন। সেখান থেকে লোক দিয়ে আপনাকে পাঠাব।’

কেবিনের পাশে হাঁটার রাস্তায় একটা চাদর বিছিয়ে ফেলা গেল। আমরা দুভাই কোনো মতে এঁটে বসলাম সেখানে। মেয়েদের বসার সমাধানও হয়ে গেল ভালোভাবেই। কেবিনে-বসা ভদ্রলোকেরা উৎসাহিত হয়েই মেয়েদের তাদের কেবিনে ডাকল। এরাতো আর গ্রামের জবুথবু লাজুক মেয়ে নয় যে, ছেলেদের কেবিনে ডেকেছে বলে লজ্জায় পড়ে যাবে। ইউনিভার্সিটির ঝকঝকে মেয়ে হাসতে হাসতেই কেবিনে ঢুকে পড়ল। সেখানে আরো দু-জন এই উপায়েই কেবিনে আশ্রয় নিয়েছিল। কাজে কাজেই গল্প, তর্ক, হাসাহাসি শুরু হলো। ঘন ঘন চা আর বিসকুট আসতে লাগল। বলাবাহুল্য ভদ্রলোকরা উদার হস্তে খরচ করতে লাগলেন এবং মেয়েদের অতি সামান্য রসিকতায় হেসে গড়াগড়ি খেতে লাগলেন।

আমি বাইরে বসে এদের গল্প শুনছি। আলাপের ধারা গড়াতে গড়াতে শাড়ি-গয়না সেখান থেকে সোনার দাম, সোনার দাম থেকে দেশের অবস্থা, দেশের অবস্থা থেকে বর্তমান পরিস্থিতিতে নিজ নিজ অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতার একটি গল্প চমৎকার লাগল। গল্পটির কথক ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয় সে ইউনিভার্সিটির সেই ধরনের মেয়ে University-তে পড়াটা যাদের কাছে। একটা দামি-গয়না। গয়না যেমন রূপ লাবণ্য বৃদ্ধি করে বলে ধারণা, Universityর ছাত্রী এই ছাপটা তেমনি মেয়েদের মধ্যে একটা আলাদা সৌন্দর্য এনে দেয় বলে এদের ধারণা। যাদের আসল গায়ের রং বাদামি প্রলেপের আড়ালে নিজেদের কাছে পর্যন্ত আচ্ছন্ন। ছেলেদের সঙ্গে মিছিলে যোগ দিতে যারা ভীষণ উৎসাহী; উৎসাহটা অবশ্য নিজেকে বিজ্ঞাপিত করার জন্যে যে, দেখো আমরা কেমন প্রগতিবাদী, কেমন অনায়াসে ছেলেদের সঙ্গে মিশছি। গল্পটি এই রূপ:

যারা মিলিটারির গত কিছু দিনের ইতস্তত গুলি বর্ষণে আহত হয়েছে তাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত অভিমত নেবার জন্যে রোকেয়া হলের কয়েকজন মেয়ে মিলে হাসপাতালে গেল। সেখানে অনেক বুলেটবিদ্ধই পড়ে আছে। মেয়েরা প্রত্যেকের কাছেই যাচ্ছে, সান্ত্বনা দিচ্ছে এবং বলছে তাদের খাতায় কিছু একটা লিখে দিতে। কেউ দিচ্ছে কেউ-বা জানাচ্ছে, আমি লিখতে জানি না। যাই হোক সহযাত্রী মেয়েটি তার খাতা নিয়ে একটি ছেলের কাছে দাঁড়াল। দেখেই মনে হচ্ছে ছেলেটি শিক্ষিত হয়ত কোনো কলেজের বা স্কুলের উঁচু ক্লাসের ছাত্র। গলা পর্যন্ত সাদা চাদরে ঢাকা।

‘দিন না আমার খাতায় কিছু লিখে। কেন আপনি মিছিলে এসেছিলেন, কি করে গুলি লাগল এই সব।’ ছেলেটি কোনো কথা বলে না। শুধু তাকিয়ে থাকে। আবার অনুরোধ করে, দিন না একটা কিছু লিখে ছেলেটি তবুও নীরব। এমন সময় নার্স আসে বৈকালিক আহার নিয়ে। টান দিয়ে চাদরটি সরাতেই দেখা। যায় ছেলেটির ডান হাত কজি পর্যন্ত কেটে বাদ দেয়া হয়েছে সেখানে। নিপুণ ব্যান্ডেজ। দুঃখ ও লজ্জায় মেয়েটি পালিয়ে আসে।

গল্পে গল্পে রাত হয়ে গেল। দূরে চাঁদপুরের আলো দেখা যাচ্ছে। চাঁদপুর যাত্রী মেয়েটির সঙ্গে সঙ্গে আমরাও উদ্বিগ্ন হলাম। সমস্যাটি মিটল হঠাৎ করেই। লঞ্চেই ইকবালের বন্ধু কবি বলাকা মুখার্জির সঙ্গে দেখা। সে যাচ্ছে কুমিল্লা ভায়া চাঁদপুর। কিন্তু যখন তাকে মেয়েটির সামনে হাজির করা হলো এবং বলা হলো কোনো ভয় নেই সে আপনাকে চাঁদপুরে বাসায় রেখে তারপর যাবে। মেয়েটির মুখ কিন্তু আনন্দে উদ্ভাসিত হওয়ার বদলে আরো যেন আমশি মেরে গেল। বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগল, ছেলেটির বাড়ি কোথায়, কোথায় যাবে, কী পড়ে। ভালো করে তার চেহারার দিকে তাকিয়ে মেয়েটির উদ্বেগের সঙ্গে ব্যাখ্যা খুঁজে পেলাম। তার চেহারায় কবি সুলভ নির্লিপ্ততার বদলে নাট্যকার সুলভ ক্ষিপ্ততার ছাপটাই প্রবল। ছোটো চোখ, পাতলা ঠোঁট, কিঞ্চিৎ ঝুলন্ত নাক–সব মিলিয়ে এমন একটি ধারণা হয় যে, এইমাত্র কিছু একটা অন্যায় করে পুলিশের ভয়ে আত্মগোপন করে। আছে। যাই হোক বলাকা মেয়েটিকে নিয়ে নেমে গেল। আমরা হুলারহাটে পৌঁছলাম ভোর পাঁচটায়। সেখানে শুনি শেখ মুজিবের আহ্বানে যানবাহনে হরতাল চলছে।

খুশি মনেই হাঁটতে হাঁটতে বাসায় পৌঁছলাম। সদর দরজা খোলা। ঢুকে দেখি দুটি পালঙ্ক একত্রে করে মস্ত বিছানা তৈরি করে সবাই শুয়ে। আব্বা সাধারণত দেরিতে ওঠেন। সেদিন যেন আমাদের জন্যেই ঘুম ভেঙেছে সকালে। সবাইকে দেখে ছেলে মানুষের মতো। খুশি হয়ে উঠলেন

আরে দেখো কে এসেছে, এই ওঠো না। আম্মা উঠলেন। আব্বা সিগারেট ধরিয়ে খুশি সরে ঢাকার কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। একটু পরে পরেই বলতে লাগলেন ‘যাক সবাই এসে গেছে, হাজার শুকুর। আর ভয় নাই। আর ভয় নাই।’ আব্বা তার চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী চড়া ভল্যুমে রেডিও ছেড়ে দিলেন। শেফু যখন আব্বা। আম্মাকে পা ছুঁয়ে সালাম করল তখন আনন্দে আব্বার চোখে পানি এসে গিয়েছে।

(প্রথম পর্ব সমাপ্ত)

আগুনের মতো ভাষণ হলো শেখ সাহেবের

৭ তারিখে আগুনের মতো ভাষণ হলো শেখ সাহেবের। তার সেই বিখ্যাত চার দফা পূর্বশর্তের অপূর্ব ভাষণ :

‘…আমি যদি তোমাদের কাছে না
থাকি তোমাদের উপর আমার আদেশ
রইল, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, তোমাদের
যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত হও, রক্ত
যখন দিতে শিখেছি আরো দেব। বাংলাকে
মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহু…’

কাউকে ভয় দেখাতে হলো না, জোর করতে হলো না বন্ধ হয়ে গেল স্কুল-কলেজ কোর্ট-কাছারি। সরকাপ্পি বেসরকারি সমস্ত অফিসেই। তালা ঝুলল। শুধুমাত্র শেখ সাহেবের অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে। সবাই বুঝতে পারছে ঝড় আসছে। বহুদিনের সঞ্চিত সমুদ্রের বিশাল জলরাশি ফুলে উঠছে। বাঁধ দিয়ে এ ঠেকানো যাবে না।

এদিকে সময় আর কাটে না। সময় কাটানোর জন্যেই একটা উপন্যাস লিখতে শুরু করলাম। অসফল প্রেমের ওপর ভিত্তি করে নিতান্তই সহজ-সরল উপন্যাস। মহৎ আদর্শ কিছু নেই, সমাজনীতি রাষ্ট্রনীতির কোনো সমস্যাও নেই। লিখতে লিখতে দেখলাম পরিচিত সব চরিত্র কলমে উঠে আসছে। উপন্যাসে বাবার চরিত্র হয়ে উঠল আমার আব্বার চরিত্রেরই অনুলিপি। নায়কতো নিজেই, নায়িকারাও খুব একটা কল্পনার নয় সময় কাটতে লাগল হু হু করে। ছোটোবোনের নামে দু-একটা কবিতাও লিখে পাঠালাম দৈনিক পাকিস্তানে। ছাপাও হলো। অসমাপ্ত পরীক্ষা, দেশের পরিস্থিতি সমস্তই আমার মন থেকে মুছে গেল। ঘাড় গোজ করে অনবরত লিখে চলেছি। এক-একটা পরিচ্ছেদ শেষ হয়, সবাইকে পড়ে শুনাই। চলবে, মন্দ নয় এই জাতীয় মন্তব্যে উৎসাহেও ভাটা পড়ে না।

আব্বাও কিছুটা বিশ্রাম পেলেন। মফস্বলে মফস্বলে ঘোরাটা বন্ধ হলো। কাজের মধ্যে সকালে ঘুম থেকে উঠে খবর শোনা, অফিসের কাগজপত্র দেখতে দেখতে চা খাওয়া, মাঝে মাঝে Court-এ যাওয়া, দুপুরের দিকে অল্পকিছু খেয়ে একটু ঘুম। বিকেলে বারান্দায় চেয়ার পাতা হতো। প্রাত্যহিক বৈকালিক আসরের নিয়মিত সদস্য ছিলেন ডাক্তার সাহেব, কোর্ট ইন্সপেকটর সাহেব, SDPRO সাহেব। ঘনঘন চা পাঠানো হতো। আব্বা মেজাজি মানুষ, মেজাজে থাকলে ভালো গল্প। করতে পারতেন, গল্প করতে ভালোও বাসতেন। তাঁর আসল উৎসাহ ছিল occultstudy-তে কাজেই সবরকম রাজনৈতিক আলোচনা শেষ হতো ভূত, প্রেত, জ্বিন, পামিস্ট্রি আর এসট্রোনমিতে এসে। এই আসরে রাজনৈতিক নেতারাও আসতেন। ন্যাপ মনোনীত প্রাদেশিক পরিষদের প্রার্থী আলী হায়দার খান (পরবর্তীকালে বোন সুফিয়া হায়দারের স্বামী) তাদের মধ্যে অন্যতম। সে আব্বার বিশেষ প্রিয়পাত্র ছিল। অনেক ব্যাপারেই আব্বা তার ওপর নির্ভর করতেন। আব্বার রাতটা কাটত SDO সাহেবের (নাম মহিবুল্লাহ শাহ। বাড়ি সম্ভবত বেলুচিস্তান) বাসায়। ভদ্রলোকের বাড়ি সিন্ধু। আব্বার সঙ্গে তার কোনোই মিল ছিল না। না চরিত্রে, না বয়সে বা স্বভাবে কিন্তু মিল ছিল আত্মিক। ‘সিন্ধ থেকে চিঠি লিখেছে ছোটো ভাই আপনি যদি আসতেন তবে পড়ে শুনাতাম।’ ‘বহুদিন চিঠি পত্র পাই না, মন বড় খারাপ, আপনি যদি আসেন তবে মনটা একটু হালকা হয়।’ ‘সুন্দরবন দেখতে যাব আমরা কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানি বন্ধুও এসেছেন, আপনি যদি সঙ্গে আসেন।’ এই জাতীয় Telephone আসত প্রায়ই।

বেচারা একা একা থাকে; রবীন্দ্র সংগীতের এক পাঁজা রেকর্ড দিয়ে আসলেন আব্বা। রবীন্দ্রসংগীতের অর্থ বুঝতে পারছেন না নিজেই গানগুলোর ভাবো অনুবাদ করে দিলেন। পিরোজপুরে ভালো দুধ পাওয়া যাচ্ছে না, বাসা থেকে একসের একসের দুধ পাঠাতে লাগলেন।

আগেই বলেছি আমাদের সময় খুব ভালো কাটছিল। অবশ্য এর অর্থ এই নয় যে, খুব হইচই করে দিন কাটছিল! স্বাভাবিক যেমন কাটে তেমনি। সন্ধ্যার পর বেড়াতে যেতাম সবাই মিলে। বাসার ডানপাশ দিয়ে যে-রাস্তাটা হুলারহাট পর্যন্ত গিয়েছে সেই রাস্তা ধরে হাঁটতাম। টি.বি. হসপিটাল, টাউন কমিটি পেরিয়েও অনেক দূর যাওয়া হতো দুপাশেই বিস্তীর্ণ মাঠ, দূরে রেখার মতো অস্পষ্ট গ্রাম, অসংখ্য নারিকেলের শাখা বাতাস লেগে কাঁপছে, অপূর্ব লাগত। এক রাতের কথা খুব মনে পড়ে। আটটার দিকে বেড়াতে বেরিয়েছি, হিন্দুপাড়ার ভিতর দিয়ে রাস্তাটা গিয়েছে। চাঁদ উঠেছে; খুব নরম জোছনা। হাঁটছি। হঠাৎ শুনতে পেলাম হিন্দুপাড়ায় গান হচ্ছে। উঠোনে পাটি বিছিয়ে বসেছে সবাই–

‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে
ফুল ডোরে বাঁধা ঝুলনা।’

চমৎকার লাগছিল। আম্মা তাড়া দিচ্ছিলেন—‘কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গান শোনা। কিন্তু শেফুর খুব ভালো লাগছিল তার জোরাজুরিতেই সম্পূর্ণ গানটি শুনলাম। এরপর যত রাতে ঐ বাড়ির পাশ দিয়ে গিয়েছি ততবার মনে মনে গান শুনব প্রতীক্ষা করেছি। আর শোনা যায়নি।

যখন বেড়ানো শেষ করে ফিরে আসতাম দূর থেকেই আমাদের বাসাটা নজরে পড়ত। পুরানো আমলের নকশাকাটা হলুদ দালান ভেতরে টিউব লাইটের নীল আলো জ্বলছে। সামনের পুকুরে একটা নীলচে পরিষ্কার প্রতিবিম্ব পড়েছে। নিজেরা বলাবলি করতাম পিরোজপুরের তাজমহল যমুনার জলে প্রতিবিম্বিত হয়েছে।

মাঝে মাঝে হতো নৌকা ভ্রমণ। প্রকাণ্ড সরকারি নৌকায় শুয়ে বসে বেড়ানো। গান বাজছে টেপ রেকর্ডে কিংবা গাইছে শেফু, শিখু। মাঝিরা চায়ের জল চড়িয়েছে। নৌকা চলছে মন্থর গতিতে। নদীর জল আয়নার মতো ঝক ঝক করছে, দূরে ছবির মতো সুন্দর সবুজ গ্রাম, সন্ধ্যা নামছে ধীরে ধীরে, নদীর পানি গাঢ় হলুদবর্ণ ধারণ করেছে, গাছের পাতা শেষের রোদ লেগে সোনার মতো জ্বলছে। মনটা উদাস হয়ে উঠত।

গল্পের আসরগুলো হতো ভারি মজার। প্রধান বক্তা আমি, তারপরই বলতেন আম্মা। আব্বা এই আসরে প্রায়ই থাকতেন না। যেদিন থাকতেন সেদিন বলতেন শুধু তিনিই, আমাদের শোনার পালা। কয়েকটি গল্প ছিল তার খুবই প্রিয়। এগুলো সবসময়ই বলতেন। তার বলার কায়দায় কোনোদিন সেগুলো পুরোনো মনে হতো না। একটি গল্প এই ধরনের

আমি তখন কলকাতায় কেশব দাস স্ট্রিটের এক মেসে থাকি। সঙ্গে আছেন দুদু মিয়া (সম্পর্কে নানা)। একদিন এক বইয়ে পড়লাম কালো মশারিতে খুব সুনিদ্রা হয়। কই পাই কালো মশারি? রং করে সেই সমস্যার সমাধান হলো। একদিন বিকেলে মেসে এসে দেখি মশারিও নেই, দুদু মিয়াও নেই। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। দুদু মিয়ার দেখা নেই। পরে শুনলাম সে গিয়েছে হক সাহেবকে কালো নিশান দেখাতে। কালো নিশান এত তাড়াতাড়ি করে কোথায় পাবে। মশারিটাই নিয়ে গিয়ে ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে।

আব্বার গল্পের আসরে মাত্র দু-জন গল্প বলার সুযোগ পেত। একজন স্বেচ্ছায় বলতেন, অন্য জনকে নিয়ে জোর করে বলানো হতো। তারা হলো আম্মা আর ছোটো ভাই শাহীন। শাহীনের গল্প ছিল দুটো, আব্বা এই গল্পগুলো বারবার শুনতেন এবং প্রতিবারই সমান আনন্দ পেতেন। আমাদের কাছে একঘেয়ে লাগলেও আব্বার আনন্দ দেখে আমাদের ভালো লাগত। শাহীনের গল্পটি এই :

“আমার বন্ধু আজাদের খুব বুদ্ধি। ক্লাসে তাকে স্যার জিজ্ঞেস করেছেন, ‘আযাদ কাল আসনি কেন?’ আযাদ উত্তরে একটা মস্ত গল্প শুরু করল—‘স্যার আমি পরশু বিকেলে আব্বার সঙ্গে গিয়েছিলাম মেলায় সেখানে শহীদের আব্বা একটা দোকান দিয়েছে। ঐযে স্যার ঐ কোণার দিকে। হলুদ শার্ট সে হলোশহীদ। আমার আব্বা। সেই দোকান থেকে আমাকে একটা মোটর গাড়ি কিনে দিয়েছেন। শাহীন দেখেছে সেই গাড়ি। ঐযে কোণার দিকে ও হলো শাহীন। তারপর স্যার সার্কাসের ভেতরই মউত কা কুয়া দেখলাম। মউত কা কুয়া হলো একটা কুয়া যার ভিতরে মোটর সাইকেল চালায়। ঐটা দেখে বাসায় আমি একটা মউত কা কুয়া বানিয়েছিলাম কাল সারাদিন সেইখানে আমার মোটরগাড়ি চালিয়েছিলাম। তাই আসতে পারি নাই।”

আম্মাও খুব ভালো গল্প করতে পারতেন। তাছাড়া চমৎকার অনুকরণও করতে পারতেন। তাঁর গল্প অবশ্য অধিকাংশই স্মৃতিচারণ। নিজের কথা, নিজের গ্রামের বন্ধুদের কথা, আমাদের ছোটোবেলার কথা, চমৎকার লাগে শুনে। তাঁর একটি চমৎকার স্মৃতি কথা লিখছি এইখানে, যাতে তাঁর স্মৃতির মিষ্টি দিকটা সুন্দর ফুটেছে।

“নতুন বিয়ে হয়েছে তখন। বাবার বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। অনেকদিন তোর আব্বার কোনো খবর নেই। মনটা কিছু বিক্ষিপ্ত। রাত তিনটার দিকে তোর নানু ডেকে তুললেন, ‘জামাই এসেছে।’ তোর আব্বা তখন এই প্রথম বারের মতো একটা গ্রামোফোন কিনে এনেছে। তাকে ঘিরে ফজলু, নজরুল (বড় মামা এবং মেজো মামা) এরা। হঠাৎ গান বেজে উঠল। আমার জীবনে প্রথম শোনা গ্রামোফোনের গান। আর সেকি চমৎকার গান–

‘..কোনো এক গাঁয়ের বধুর কথা তোমায়
শুনাই শোনো
রূপকথা নয় সে নয়…’

গভীর রাত, সবাই নিঝঝুম হয়ে গান শুনছে। কি যে ভাল লাগলো আমার।”

গল্পের আসরে আমার ভূমিকাটা প্রায়ই পড়ুয়ার। হাসির গল্প পড়ে শুনাননা। পড়ানোর বিরক্তিকর কাজটা আনন্দেই করতাম যখন দেখতাম এতে অন্যদের খারাপ লাগছে না।

একদিকে চলছে অসহযোগ আন্দোলন, অন্যদিকে আমাদের গতানুগতিক জীবনধারা। হাসি গান আর গল্পে ঠাসা সুখী জীবন।

এর মধ্যেই বাসায় একদিন জিন আনা হলো। ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কিছুতেই বিশ্বাস করা চলে না। তবু সম্পূর্ণ হেসে উড়িয়ে দিতেও কিছু বাধা আছে। উদ্যোক্তা হলেন C.G. সাহেব। যে লোক জিন আনবে তাকে বরিশাল থেকে খবর পাঠিয়ে আনাননা হলো। আব্বার উৎসাহই সবচে বেশি। ঘর পরিষ্কার করে, গোলাপজলে ধুয়ে, দরজা-জানালা বন্ধ করে ভদ্রলোক আসন করে বসলেন বাতি নিভানো হলো। আমরা ভয়ে কাঠ হয়ে অপেক্ষা করছি। ভদ্রলোক কোরান আবৃত্তি করতে লাগলেন। আর সত্যি সত্যি জ্বিন এলো শেষ পর্যন্ত। কথা বার্তাও হলো। প্রথম ভাবলাম হয়ত ভেন্ট্রিলোকুইজম– যার সাধ্য এক জায়গা থেকে এমনভাবে কথা বলা যায়, যাতে মনে হয় ভিন্ন দিক থেকে কথা ভেসে আসছে। কিন্তু তবু রহস্য থেকেই যায় কারণ প্রায় সবসময়ই ভদ্রলোকের কোরান আবৃত্তি আর জিনের কথা বার্তা একই সঙ্গে শোনা যাচ্ছিল। তাছাড়া এই জিনই o.c সাহেবের বাসায় রাগ হয়ে আড়াইমণি চালের বস্তা নিমিষের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলেছিল এবং o.c সাহেবকে বলেছিল যে তার হৃৎপিণ্ড একটু লম্বাটে ও ডিফেকটিভ (সঠিক তথ্য সেরকম প্রমাণ নেই)। বড়ো ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা Euctrocardiograph করে o.c সাহেব সত্যি তার হৃৎপিণ্ডের এই দোষ জানতে পেরেছিলেন।

জিনের সঙ্গে আমাদের নিম্নলিখিত কথাবার্তা হলো :

আব্বা : আসসালামু আলায়কুম

জিন : অলায়কুম আসসালাম

আব্বা : জনাব, দেশের বর্তমান অবস্থা দেখে আমরা সবাই খুব বিচলিত। শেষ পর্যন্ত কী হবে বলবেন দয়া করে?

জিন : আমরা তো অতি সাধারণ জীব, ভবিষ্যৎ বলার ক্ষমতা আমাদের নাই। অতি সামান্য যা ক্ষমতা আছে তাতে বুঝি জয় হবে। আপনাদেরই। তবে সামনে বড়ো বিপদ, দেশের এবং অন্যান্য সবার। মহাবিপদ। হাত তুলে দোয়া করি।

(দোয়া চলল)

আমি : আপনারা কোথায় থাকেন বলবেন কি?

জিন : কোহকাফ নগর।

আমি : মানুষ যে চাঁদে গিয়েছে তা বিশ্বাস করেন?

জিন : কিছুক্ষণ চুপচাপ। গিয়েছে নাকি?

আব্বা : জিনদের সম্বন্ধে আমার অনেক কিছু জানতে ইচ্ছা হয়, আপনি জানাবেন কি?

জিন : এই সম্বন্ধে পরে আলাপ করব। আপনি নির্জনে আমার কথা চিন্তা করবেন। আমি আসব।

দেশের রাজনৈতিক পট আবার পরিবর্তিত হলো। সমস্ত ক্ষমতা জনগণের নির্বাচিত দেশবরেণ্য নেতা শেখ মুজিবের হাতে। দৌড়ে এল ইয়াহিয়া। সকাল-বিকাল শেখ সাহেবের সঙ্গে সুদীর্ঘ মিটিং। আশার আলো দেখতে পেল সবাই। ইয়াহিয়া-শেখ মুজিব আলোচনার অগ্রগতি খবরের কাগজে হেডিং বেরুল। দু-জনের হাসিহাসি মুখের ছবিও ছাপা হলো বিভিন্ন কাগজে।

আব্বা ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে উঠছিলেন। সারাটা দিন কাটাতেন খবর শুনে। অনিশ্চয়তা তার বুকে পাথরের মতো চেপে বসছে। কাজ ছাড়া যে-মানুষ একদণ্ড থাকতে পারে না তার জন্য কর্মশূন্য এমন জটিল পরিস্থিতি অস্বস্তিকরই বটে।

এমনি অস্বাভাবিক পরিবেশেই আমার প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত লোকে’র শেষপর্ব লিখে শেষ করলাম। আম্মার পড়া হলে আব্বা চেয়ে নিলেন পড়তে। আমি দুরুদুরু বক্ষে অপেক্ষা করছি আব্বার মন্তব্য শুনতে। এবার উপন্যাসের কাহিনি চুম্বকটা বলছি–

সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের কাহিনি। স্নেহপ্রবণ আত্মকেন্দ্রিক বড়ো মেয়ে। বিয়ের বয়স হয়েছে অনেকদিন কিন্তু টাকা, রূপ আর মনমতো পাত্রের অভাবে বিয়ে হয়নি। আবেগপ্রবণ নায়ক। ছোট দুই বোন চঞ্চল প্রজাপতি, হাসি খুশি। বাবা নিরীহ মানুষ, হৃদয়ে তার অফুরন্ত স্নেহ অথচ তার খোঁজ রাখে না কেউ। বড়োলোকের খেয়ালি মেয়ে কিটকিকে ভালো লাগল নায়কের। ভালো লাগাটা একতরফা নায়কেরই। কিটকির সহজ ভদ্রতাকে ভালোবাসা ভেবে ভুল করল সে। শেষ অঙ্কে দেখা গেল বড়ো মেয়ে তার নিঃসঙ্গ দিন কাটাচ্ছে। ছেলেটি বিয়ে করেছে সহজ সাধারণ একটি মেয়েকে। বাবাও আজ সঙ্গীহীন। অথচ পৃথিবী তেমনি চলছে, চাঁদের নরোম জোছনা তেমনি ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীতে। অঝোর ধারায় নেমেছে বৃষ্টি। উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীরা আজ নির্লিপ্ত স্মৃতিচারণে ব্যস্ত। সমস্ত পেয়েও আজ যেন কেউ কিছু পায়নি।

করুণ রসপ্রধান উপন্যাস। যেখানে রুনুর চরিত্রটা খুব দরদ দিয়েই লিখেছি। রুনু নায়কের ছোটোবোন। বাস্তব উপাদান নিয়ে এটা তৈরি করেছি বলে বেশ বাস্তবানুগও বটে। নিজের ধারণা খুব ভালোই হয়েছে। আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি আব্বা কী বলেন। দেখলাম তিনি খুব উৎসাহ নিয়েই পড়ছেন। দুপুরে উপন্যাস হাতে অফিসে চলে গেলেন। পড়া শেষ হলে বললেন না কিছুই, শুধু শেফুকে জিজ্ঞেস করলেন, তোর দাদা ভাইয়ের বইটা পড়েছিস?

রাতে শুয়ে আমাকে ডাকলেন। বললেন, তোর উপন্যাস খুব মন দিয়েই পড়েছি। দুই এক জায়গায় একটু অসংলগ্ন হয়েছে… বলে দু একটা টেকনিকেল ত্রুটি দেখিয়ে দিলেন, তারপর বললেন, ‘বেশ হইছেরে, আমার খুব ভালো লেগেছে, রুনুর ডাইরির অংশটা পড়তে পড়তে চোখে পানি এসে যায়। আমারও একটা উপন্যাস লেখার বহুদিনের সখ। তবে আমার ধৈর্য থাকে না আর সময়ই-বা কই!’

রাতে শুয়ে শুয়ে আব্বার কথাই ভাবছিলাম। সম্পূর্ণ নিজের পরিকল্পনায় তার একটা বই ছাপাব এবং সেটি ছাপায়, প্রচ্ছদে সব দিক থেকেই হবে অনবদ্য। অবশ্য এই ভাবনার পিছনে একটু কারণও ছিল। আব্বা তার সামান্য সঞ্চয় থেকেই একটি বই ছাপিয়েছিলেন। সেটি সেই কারণেই ছাপায়, প্রচ্ছদে, কাগজে খুব নিকৃষ্ট মানের হয়ে তার মনোবেদনার কারণ হয়েছিল। রচনা ভালো হওয়া সত্ত্বেও তা কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি।

রহুল মামা বেড়াতে আসলেন এই সময়টাতে। হইচই আর আমোদ চরমে উঠল। সোনায় সোহাগার মতো নানাও এসে হাজির। তাদের আগমন উপলক্ষে পারিবারিক দেয়াল পত্রিকা সুনিলিত সাগরিত’ (পারিবারিক পত্রিকা, কারো জন্ম বা বিয়ে উপলক্ষে প্রকাশিত হয়। নামটি হুমায়ূন আহমেদের দেওয়া।) এর বিশেষ সাক্ষী বের করল এর সম্পাদিকা মমতাজ আহমেদ শিখু। সেও বহুদিন কুমিল্লায় থেকে এসেছে। কাজেই তার উৎসাহ প্রায় বল্গা ছাড়া। আমাদের খাঁটি আনন্দে কিছুটা ভেজাল মিশল। মামা কোনো এক অজ্ঞাত কারণে রাগ করে খুলনা চলে গেলেন তার ভাইয়ের কাছে। আব্বা বললেন, ‘সবুর করো দেখবে দুদিন পর রহুল সেখান থেকে রাগ করে আবার এখানে এসে পড়বে।’

নানাও চলে গেলেন খুলনা; খুশি মনেই গেলেন। এদিকে ঝামেলা প্রায় মিটে গেছে। VOA থেকে বলা হলো শেখ মুজিব আর ইয়াহিয়ার ভেতর একটা আপোষ হয়েছে। ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি হয়েছেন। ইয়াহিয়া। আমার মন খারাপ হয়ে গেল আবার পরীক্ষা দিতে হবে ভেবে। শেফু, শিখু, ইকবালও মুখ কালো করে ঘুরতে লাগল সব ঠিক হয়ে যাবে আবার হোস্টেলের নিরানন্দ একঘেঁয়ে জীবন।

(২য় পর্ব সমাপ্ত)

ঝড় উঠল সত্যি সত্যি

ঝড় উঠল সত্যি সত্যি। অবরুদ্ধ জলতরঙ্গে বিক্ষোভ তৈরি করতে সৃষ্টি পরিকল্পনা সফল করতে এগিয়ে এলেন লে. জে. টিক্কা।

গভীর রাতে হইচই শুনে ঘুম ভাঙল। অফিসের টেলিফোন অনবরত বেজেই চলেছে। বাইরে বহু লোকের পদচারণা। মাইকের ঘোষণা–

‘মহাবিপদ, মহাবিপদ, সবাই আসুন থানার সামনে হাজির হোন। মহাবিপদ মহাবিপদ।’

আব্বা আগেই উঠেছেন। আম্মাও উঠেছেন। শেফু, ইকবাল, শিখুর ঘুমও ভেঙেছে। আমি আব্বা আর ইকবাল দৌড়ে চললাম থানায়। সঙ্গে আছে অফিসের পাংখাপুলার রশীদ, (পরবর্তীকালে পরিবারকে অনেক সাহায্য করেছে; একাত্তরের পরে আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।) রাত তখন দুইটা। থানার সামনে অনেকেই জড়ো হয়েছে। সবাই ভীত সন্ত্রস্ত কি জানি কি হলো। বেশ শীত করছিল। থানার o.c র সঙ্গে আলাপ করে আব্বা গেলেন wireless opgrpor-এর ঘরে। সেখান থেকে যখন বের হলেন তখন তাকে দেখে মনে হচ্ছিল একটা মরা মানুষ বের হয়েছে ক্লান্ত গলায় বললেন, wireless-এ খবর এসেছে মিলিটারিরা রাজারবাগ পুলিশ হেড কোয়ার্টার আক্রমণ করেছে। খুলনায় তারা পুলিশ লাইন ঘিরে আছে। কুমিল্লার পুলিশ ওয়ারলেস dead, চিটাগাং এ তুমুল যুদ্ধ চলছে। কিন্তু কেন এটা হচ্ছে কেউ বুঝতে পারছে না।

চারিদিকে নানা জল্পনা। কেউ বলছে জেনারেল হামিদ ইয়াহিয়াকে গ্রেফতার করেছে। কেউ বলছে সৈন্যদের মধ্যে গণ্ডগোল লেগেছে। কেউ বলছে শেখ মুজিবকে গুলি করে মেরে ফেলেছে তাই এ ঝামেলা। আবার অনেকে বলছে আমেরিকার গ্রিন টুপ নেমেছে।

সেই রাতেই খেয়া বন্ধ করতে লোক ছুটল যাতে খেয়া পার হয়ে মিলিটারি বাগেরহাট দিয়ে না আসতে পারে। লোক ছুটল রাস্তায় ব্যারিকেড দিতে। রশীদও তাদের দলে ভীড়ে পড়ল। কোলাহল আতঙ্ক আর হতাশার মধ্যে ভোর হলো। রেডিও ধরল সবাই। কই কিছু নেই, একটানা সেতার বেজে চলছে। আতঙ্কিত লোকজন আকাশবাণী শুনতে চেষ্টা করল। সেখানে রীতিমত প্রভাতী অনুষ্ঠান চলছে। এত সব যে হয়ে যাচ্ছে তার কোনো খবর নেই।

সকাল দশটায় সামরিক নির্দেশাবলি প্রচারিত হলো। ইয়াহিয়া ভাষণ দিলেন এগারোটায়–

‘…শেখ মুজিবকে বিচর্বিচারে আমি ছেড়ে দেবো না। আওয়ামী লীগ দেশের শত্রু। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করলাম। এবং আমার দেশ প্রেমিক সেনাবাহিনী তাদের পূর্ব সুনাম অক্ষুন্ন রেখে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে এগিয়ে এসেছে…’

চারিদিক থমথম করছে। আতঙ্ক বুকের ওপর চেপে বসেছে। এই বুঝি মিলিটারি এসে পড়ল। আব্বা হতবুদ্ধি, S.P. বরিশাল নিশ্রুপ। পাকিস্তান রেডিও থেকে তখন অনবরত নাত-এ রসুল আর হামদ প্রচারিত হচ্ছে।

দুপুরে আচ্ছন্নের মতো বসে রয়েছি ট্রানজিসটার হাতে। কী করব ভেবে পাচ্ছি না। কলকাতা স্টেশন ধরে রেখেছি। হঠাৎ সেখান থেকে গীতিকা অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ রেখে হঠাৎ বলা হলো পূর্ব বাংলায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। পূর্ব-পাকিস্তান রাইফেলস, পূর্ব বাংলা রেজিমেন্ট, পূর্ব-পাকিস্তান পুলিশ, পূর্ব-পাকিস্তান আনসার, পূর্ব-পাকিস্তান মুজাহিদস দুর্জয় প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তুলেছে। তারপর বাজান হলো সেই বিখ্যাত গান ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’

বিকেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ ওয়ারলেস থেকে বলা হলো EPR-এর জোয়ানরা এখানে প্রচুর মিলিটারি মেরেছে বন্দি করেছে আরো অনেক। তারা এগিয়ে চলেছে কুমিল্লার দিকে। আরো খবর পাওয়া গেল তুমুল লড়াই চলছে কুমিল্লায়, চিটাগাং-এ। আচ্ছন্নের মতো কাটল আরো একটি দিন। ২৮ তারিখ রাতে রেডিওর নব ঘুরাচ্ছি যদি কোন বিদেশি স্টেশন কিছু বলে হঠাৎ শুনতে পেলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। শরীরের সমস্ত রক্ত উত্তেজনায় ফুটতে লাগল। বাইরে তখন তুমুল উত্তেজনা, তুমুল হইচই ‘স্বাধীন বাংলা বেতার। স্বাধীন বাংলা বেতার।’ অল্প সময়ের অনুষ্ঠান অথচ আগুন দিয়ে ঠাসা।

‘… ওরা জানে না আমরা কি চিজ। জানে না EPR কি জিনিস? আমরা ওদের টুটি টিপে ধরেছি। তুমুল যুদ্ধ চলছে। জয় আমাদের সুনির্দিষ্ট। এই ছোট্ট অনুষ্ঠানটা বাঙালিদের চরম আর ভয়াবহ হতাশায় কি আনন্দের সওগাতই না এনে দিলো। আব্বার অর্ডারলি নাজিমত কেঁদেই ফেলল আনন্দে। রেডিও centre-টা কোথায় তাই নিয়ে জল্পনা-কল্পনা। ঘোষকের বাড়ি কোথায় তাই নিয়ে বাজি ধরাধরি। কেউ বলছে নোয়াখালি কেউ বলছে সিলেট। মিছিল বের হয়েছে ‘স্বাধীন বাংলার জয়’ ‘জয় বাংলার জয়।’

খুলনা শহরের অদ্ভুত সব খবর পাচ্ছি। কারা তৈরি করেছে সেসব কে জানে তবে তা থেকে পরিস্ফুটিত হচ্ছে একটা জিনিস তা হলো বাঙালি জাতীয়তাবোধ। খবরগুলো আনে নাজিম। হাসিহাসি মুখে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। ভাবটা এই রকম যে একটা খবর জানি তবে মরে গেলেও বলব না। আমরা জানতে চাই কী খবর নাজিম ভাই তখনই হাত পা নেড়ে নাজিম ভাইয়ের খবর বলা শুরু হয়। দু একটা খবর এই ধরনের :

১। খুলনা শহরের সদর রাস্তায় কে যেন একবস্তা অড়হড়ের ডাল ঢেলে ফেলে দিয়েছে। ফলস্বরূপ মিলিটারি যখন পার হতে যাচ্ছে। তখনই পা পিছলে আলুর দম।

২। ট্রেঞ্চে বসে গুলাগুলি চলছে। একদিকে পশ্চিমা মিলিটারি অন্যদিকে বাঙালি ই.পি.আর। ফায়ার ব্রিগেডের লোকরা তক্কে তকে ছিল হোস পাইপ দিয়ে দিয়েছে মিলিটারির ট্রেনে পানি ভরতি করে। মিলিটারিগুলি হাঁসফাঁস করে মরছে।

৩। একদল মিলিটারি যাচ্ছিল রাস্তা বেয়ে। পথে নজর পড়ল এক ভিমরুলের চাকের ওপর। এটা কী রে বাবা? বোমা নয়তো? মারল সেখানে এক গুলি। ঝাঁকে ঝাঁকে ভিমরুল উড়ে এলো। ফলস্বরূপ তিন মিলিটারি খতম এর ভেতর দুজন আবার মেজর।

ঠিক এই সময় আওয়ামীলীগ নেতার বিবেচনায় একটা বড়ো ভুল হলো। পিরোজপুর ট্রেজারি থেকে আড়াই শত রাইফেল লুট হয়ে গেল। যার সুদুরপ্রসারী কুফল আওয়ামী লীগ নেতারাই দেখে গেলেন। পুলিশের সঙ্গে সম্পর্কও খারাপ হয়ে গেল জনসাধারণের। আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে মহকুমা পুলিশ প্রধান হিসেবে মতভেদ হয়ে গেল আব্বার।

রাইফেলগুলো ছিল আনসারদের। ঠিক হয়েছিল সে-সব আনসারদের দিয়ে দেওয়া হবে। সেই সমস্ত আনসারদের, যারা সত্যিকার অর্থেই যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। তাদের পাঠানো হবে বাগেরহাটে। সারা রূপসার তীরে যে-EPR দলটা আছে তাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে খুলনার মিলিটারিদের উপর আক্রমণ চালাবে। স্থানীয় পুলিশ, বিভিন্ন থানা থেকে পুলিশ এনে নিজেদের ঘাঁটি সুরক্ষিত করে রাখবে যাতে মিলিটারি আক্রমণের সমুচিত জবাব দেওয়া যায়। এইরূপ আলাপ আলোচনা যখন চলছে ঠিক তখনি আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্য এনায়েত হুসেন শ তিনেক লোক নিয়ে ট্রেজারি ঘেরাও করলেন। ১৬ জুন armed police যারা ট্রেজারি দিন রাত পাহারা দিত তারা কী করবে ভেবে পেল না। আব্বা দৌড়ে গেলেন সেখানে বললেন, এইভাবে রাইফেল ডাকাতের হাতে পড়ে মহা মুশকিল হয়ে যাবে। বন্দুক আমরাও ধরব। আমাদের বিশ্বাস করো তোমরা। রাইফেল লুট হয়ে গেল। এবং সেই দিনই পঞ্চাশের বেশি রাইফে আর দুই হাজার রাউন্ড গুলি চলে গেল ডাকাতের হাতে। এবং বলা বাহুল্য এর ফল পরখ করল সবাই। আওয়ামী লীগের এই ভুল চালে পুলিশ সবাই ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠল। ট্রেজারি গার্ডের ১৬ জন পুলিশের মধ্যে দশ জন armed police পালিয়ে গেল পরদিনই।

থানা আর টাউন আউট পোস্ট থেকে একজন দুইজন করে পুলিশ সরতে থাকল। আব্বা কী করবেন ভেবে পেলেন না। বরিশালের এস.পি জানালেন ওয়ারলেস করে সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশ মেনে চলেন।

পিরোজপুরে তখন চরম বিশৃঙ্খলা। রাইফেল হাতে ছেলেরা যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। দোকানপাট থেকে জোর করে জিনিসপত্র নিয়ে। আসছে। চাঁদা উঠানো হচ্ছে বড়ো হাতে। ডাকাতি শুরু হয়েছে। আসেপাশের গ্রামগুলোতে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে নকশালদের বিরোধ ধূমায়িত হচ্ছে। নেতৃত্বের চিহ্ন নেই কোথাও। বন্দুক হাতে পেয়ে সবাই নেতা। অবস্থার অবনতি হচ্ছে দ্রুত গতিতে। বিশেষ করে নকশাল-আওয়ামী লীগ বিরোধ। আওয়ামী লীগ বলছে দু-দলের উদ্দেশ্য যখন এক তখন এক সঙ্গেই আসুক তারা। নকশালদের কথা হলো আমাদেরটা আমরাই দেখব। তারপর নকশালরা যা শুরু করল তা মুক্তিসংগ্রামকে বহুলাংশে ক্ষতি করল। টাকাপয়সা, পেট্রল, কেরসিন, চাল, ডাল, তেল, মশলা ইত্যাদি যার কথাই মনে হতে লাগল তাই তারা জমাতে লাগল পর্বতপ্রমাণ। সমস্তই বন্দুক দেখিয়ে। অতিষ্ঠ হয়ে উঠল সবাই। সরকারি অফিসাররা হলো তাদের খেলার পুতুল। বন্দুক হাতে তাদের দিয়ে যা ইচ্ছা তা করাতে লাগল। একটা উদাহরণ দিচ্ছি–

রাত ন টার দিকে একদল নকশাল ছেলে হাজির হলো বাসায়। তাদের সবার হাতেই রাইফেল। কী চাই? আব্বাকে দরকার। আব্বা বেরিয়ে এলেন।

ফজলু : চাচাজান (আব্বাকে চাচা ডাকত তাদের সবাই) আমরা একটা জরুরি কাজে এসেছি আপনার কাছে।

আব্বা : কী কাজ?

ফজলু : আপনি আমাদের একটা প্রাইভেট টেলিফোনের ব্যবস্থা করে দেবেন আর আপনাদের যে-ওয়ারলেসটা আছে সেটা আমাদের দিয়ে দেবেন।

আব্বা : বল কী?

ফজলু : চাচাজান সেটি আপনাকে করতেই হবে।

যাই হোক শেষ পর্যন্ত আব্বা ওদের একটা প্রাইভেট টেলিফোনের ব্যবস্থা করে দিলেন ইঞ্জিনিয়ার T & T-কে বলে। ওয়ারলেসটা অবশ্য রয়ে গেল।

যাই হোক বন্দুক হাতে ছেলেদের প্রথম যারা সংঘবদ্ধ করল তাদের মধ্যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের 2nd লেফটেন্যান্ট জিয়া আর একজন নেভাল অফিসারের দান খুবই বেশি। বেসামরিক দিক থেকে সাহায্য করলেন আলী হায়দার খান আর তরুণ ফোর্থ অফিসার মিজানুর রহমান।

Training camp খোলা হলো। সুসংঘবদ্ধ করে সত্যিকার অর্থেই ভালো Training দেয়া হলো। কিন্তু ইতিমধ্যে বড় দেরি হয়ে গেছে। ডাকাতের দল বন্দুকহাতে গ্রাম থেকে গ্রামাঞ্চলে অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। খুন তখন নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার।

আলী হায়দার খানের নেতৃত্বে মহকুমার অভ্যন্তরীণ শান্তিরক্ষার জন্যে একটা কমিটি গঠন করা হলো। তারা গ্রামে গ্রামে শান্তি রক্ষার জন্যে রক্ষিবাহিনী গঠন করে বেড়াতে লাগল। তাদের যাতায়াতের জন্যে ছিল পুলিশের মোটরবোট। সে দলটা বেরুত তাদের মধ্যে ছিল। আলী হায়দার, কোর্ট ইন্সপেক্টর, দু-জন আর্মড কনস্টেবল, আলী হায়দার এর ভাগ্নে বাদশা এবং আমি বলতে বাধা নেই ব্যাপারটা হতো একটা প্লেজার ট্রিপ। স্পিড বোটে গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে বেড়াতে চমৎকার লাগত। অবশ্য এই বেড়ানোর একটা মহৎ উদ্দেশ্যও ছিল সেটি হলো গ্রামবাসীকে এই স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্বন্ধে অবহিত করা।

দেখলাম হিন্দুদের ভাগ্য বিপর্যয় শুরু হয়েছে। সমস্ত বড়ো বড়ো হিন্দুবাড়ি ডাকাতি হয়ে যাচ্ছে। ডাকাতি ছাড়া আরো অনেক কুৎসিত ব্যাপারও হচ্ছিল। উঠোনে হ্যাজাক জ্বালিয়ে কমবয়সী মেয়েদের তার চারদিকে ন্যাংটো করে দাঁড়া করে রাখা থেকে শুরু করে, সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া ছিল খুবই কমন।

রাতের বেলা শহরও পাহারা দিতে হতো। ছয় জনের একটা গ্রুপ করে বন্দুক হাতে শহরে টক্কর মারতে হতো। এই পাহারার ব্যাপারটা আমার বেশ লাগত। নির্জন শহর ঘুমিয়ে, আমরা ক-জন জেগে জেগে অচেনাসব রাস্তা-ঘাটে হাঁটছি। স্নান জোছনা পড়েছে শহরে, বাতাসে নারিকেলের পাতা কাঁপছে। অল্প শীত বেশ লাগত।

শিখু কেন জানি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। সমস্ত দিন পড়ে পড়ে ঘুমাত। তার অবস্থা দেখে আব্বা শঙ্কিত হয়ে ডাক্তার ডাকালেন, অষুধ পত্র কেনা হলো। অথচ আব্বা নিজেও খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছিলেন। খেতে পারতেন না, রাতে ঘুমুতে পারতেন না। অতি সামান্য খবরেও ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়তেন। মনে আছে আকাশবাণী থেকে সাড়ে আটটায় অধ্যাপক সমর গুহ যখন বলছিলেন–

‘… বাঙালির একটি মাত্র অপরাধ, বাঙালি চেয়েছে, স্বাধীকার। জনগণ-মন অধিনায়ক শেখ মুজিব বলেছেন বঞ্চিত মানুষের কথা…’

অতি সাধারণ আবেগের কথা, তবু তাই শুনে আব্বার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছিল।

আম্মা কিন্তু খুব নিশ্চিন্ত ছিলেন। তিনি বলতেন সব যাই হোক, আমাদের কিছু হবে না। তিনি খুব দৃঢ়তার সঙ্গেই এ-কথা বলতেন এবং আমরা তার কথা আন্তরিকভাবেই বিশ্বাস করতাম। তার কারণও ছিল। আম্মার ক্ল্যারিওভ্যানসি ক্ষমতা কিছু পরিমাণে ছিল। ভবিষ্যতের প্রায় ঘটনাই আগেআগে টের পেতেন। আগেও অনেকবার তার এই ক্ষমতা প্রয়োগ করে আমাদের বিস্মিত করেছেন। তার। একটা উদাহরণ এখানে দিচ্ছি।

আম্মা দুপুরে পানটান খেয়ে পালঙ্কে বসে আমাদের সঙ্গে গল্প করছেন। বলছেন, গত রাতে আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি। একটা বাচ্চা মেয়ে আমাকে এসে বলছে আমাকে চিনছেন না? আমি রাবেয়ার মেয়ে। আপনাদের এখানে থাকব কয়দিন। বলা শেষ হতেই পর্দা সরিয়ে বাচ্চা মতো একটা মেয়ে ঢুকে বলল সে রাবেয়ার মেয়ে, এখানে কয়েকদিন থাকত এসেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা বিস্মিত হয়েছিলাম। এমনকি এই ক্ষমতার জন্যেই তার ওপর আমাদের বিশ্বাস ছিল প্রখর। তাঁর সম্বন্ধে আরো একটি কথা বলবার লোভ সামলাতে পারছি না। তিনি কোথাও কিছু নয় অথচ খুব মিষ্টি। ফুলের গন্ধ পেতেন। আমার ছোটোবোন শেফুও তা পেত। তাদের দু-জন সম্বন্ধে এইটুকু কথা বলা চলে যে, দু-জনই চূড়ান্ত রকমের ধর্মনিষ্ঠ। ধর্মের সব অনুশাসনই যে শুধু গভীরভাবে বিশ্বাস করত তাই নয়, যথাযথ নিষ্ঠার সঙ্গে পালনও করত।

প্রথম দিককার কথায় ফিরে আসি। আমাদের সাফল্যের প্রথম দিনগুলোতে যখন স্বাধীন বাংলা বেতার, কলকাতা বেতার, BBC, VOA, আর রেডিও অস্ট্রেলিয়া একটির পর একটি সাফল্যের খবর দিচ্ছে, ঠিক তখনই একটা খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল। টিক্কা খান ইজ ডেড। টিক্কা খান হ্যাস গন। খবরটা এসেছে মগবাজার থেকে চাঁদপুর টেলিফোনে। টেলিফোন অপারেটররা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই খবরটা চারিদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছিল। থানায় আব্বাই প্রথম এ-খবর রিসিভ করে খুশিতে নাকি ‘জয় বাংলা’ বলে লাফিয়ে উঠলেন। মস্ত মিছিল বেরুল ই.পি. আর এর গুলিতে টিক্কা খান মরেছে। দু-একজন গরিব-দুঃখীদের পয়সা বিলালো এই উপলক্ষে। বিকেলের দিকে টিক্কা খানকে কীভাবে মারা হলো সে সম্বন্ধে অদ্ভুতসব গল্প নাজিম ভাই আনতে লাগলেন–

‘ই.পি. আর এর মেজর আব্দুল গফুর মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়ে সটান ঢুকে পড়েছিল টিক্কা খানের কনফারেন্স রুমে। ঢুকেই গুলি। সে নিজেও আর বেরিয়ে আসতে পারে নাই।’

BBC থেকেও যখন বলা হলো টিক্কা আহত। তখন টিক্কার মৃত্যু সম্বন্ধে সবাই নিঃসন্দেহ হয়ে বুকে হাতির বল পেল।

বাঙালির প্রতিরোধে ভাঙন ধরল ক্রমে। আকাশপথে জলপথে সৈন্য আসতে লাগল। যুদ্ধজাহাজ ইফতিখার আর বাবর থেকে ক্রমাগত শেল বর্ষিত হতে লাগল। বাঙালি অধিকৃত বন্দর চাটগাঁয় স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে মুহুর্মুহু বিদেশের বিবেকসম্পন্ন মানুষের কাছে সাহায্যের জন্য আকুল আবেদন জানানো হতে লাগল। বলা হতে লাগল যার যা অস্ত্র আছে নিয়ে এগিয়ে আসুন। এমনকি খুন্তি, দা, কুড়াল, মরিচের গুঁড়া। শুনতে শুনতে দুঃখে চোখে পানি এসে যায়, ভাবি কতটুকু অসহায় হলেই না এমন বলা যায়।

পিরোজপুরের কথা বলতে গেলেই আরেকজন এর কথা বলা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সে হচ্ছে প্রাক্তন সামরিক বাহিনীর একজন গেরিলা যুদ্ধের trainee. তার নাম (নাম সম্ভবত হাশেম) মনে নেই। এইখানে তাকে গেরিলা বলেই উল্লেখ করব। লোকটার গড়ন হালকা পাতলা, পেটা শরীর, চোখের তারা বেড়ালের মতো, বেশ লম্বা, গায়ের বর্ণ গাঢ় কালো। প্রথম থেকেই তার উন্মাদনা ছিল আকাশ ছোঁয়া। মুক্তিবাহিনীর সংগঠনে তাদের ট্রেনিং হওয়ানোয় সে মেশিনের মতোই। খাটছিল। তার ৬ জন বিশ্বস্ত অনুগামী নিয়ে সে একটা গেরিলা স্কোয়াডও করেছিল। সবার আস্থাও সে অর্জন করেছিল। কি করে তার একটা ছোট্ট উদাহরণ দিচ্ছি।

সবাই ঘুমিয়ে রয়েছি, রাত হবে তিনটা। গেরিলা এসে কড়া নাড়ল। দরজা খুলে দিলাম আমি। কী ব্যাপার? ব্যাপার খুব গুরুতর। ট্রেজারি লুট করবার জন্যে আলী হায়দার নাকি তার দলবল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আব্বা চিন্তিত মুখে তার বক্তব্য শুনছেন। সে বলে চলল, স্যার আমি ট্রেজারির পাশের রাস্তা দিয়ে আসছিলাম। হঠাৎ আলী হায়দার আমায় হল্ট বলে থামাল। দেখি আলী হায়দার তার জনাকয় বন্ধু নিয়ে ট্রেজারির চারপাশে ঘুরঘুর করছে। আলী হায়দার বলল এ রাস্তা ছেড়ে অন্য রাস্তায় যেতে। আমি অন্য রাস্তায় দৌড়ে আপনার কাছে এসেছি। আব্বা তার সিনসিয়ারিটির জন্য তার কাঁধে হাত রেখে তাকে ধন্যবাদ দিলেন। তারপর বললেন, আলী হায়দার ট্রেজারি রক্ষার জন্যেই এই ব্যবস্থা নিয়েছে। আলাপ-আলোচনা করেই এটা ঠিক করা হয়েছে চিন্তার কিছু নেই। পরদিন ভোরে গেরিলা আবার এলো। বিষম উত্তেজিত। ফায়ার ব্রিগেডের গাড়িতে করে এসেছে। উত্তেজনার কারণ সে একজন স্পাই ধরে ফেলেছে। একে মেরে ফেলবে কি-না তাই নিয়ে পরামর্শ করতে এসেছে আব্বার সঙ্গে। আব্বা শুধু বললেন-এ যে স্পাই বুঝলেন কী করে? এবার সে একটি প্রস্তাব করল। স্যার আপনারতো দুটো রিভলবার, একটা আমাকে দিয়ে দেন যদি তবে আমি গেরিলাযুদ্ধে কাজে লাগাতে পারি। আব্বা পরিষ্কার না বলে দিলেন। গেরিলা চলে গেল। আমার মনে হলো কাজটা বুঝি ঠিক হলো না। আব্বাকে বললাম, সমস্ত রাইফেল যখন তাদের হাতে তখন বাড়তি একটা রিভলবার কি আর ক্ষতি করবে। সে গেরিলা ফাইটার। রিভলবার সত্যিকার অর্থেই সে কাজে লাগাতে পারবে, দুটো রিভলবারেরও আপনার প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া ওদের হাতেই ক্ষমতা কাজেই সম্প্রীতি নিয়ে বেঁচে থাকতে হলে এদের হাতে রাখা কর্তব্য। আব্বা আমার যুক্তিতে টলে গিয়ে গেরিলাকে ডেকে পাঠিয়ে নিজের Personal রিভলবার ৬ রাউন্ড গুলি দিয়ে দিলেন। এবং তার চাকরি জীবনে অন্যের কথা শুনে এই প্রথম হয়ত একটা বড় ধরনের ভুল করলেন। কেন সে কথা পরে বলছি।

এদিকে শেখ মুজিবের গ্রেফতার নিয়েও তুমুল হইচই হচ্ছে। স্বাধীন বাংলা বলছে তিনি গ্রেফতার হননি, তিনি সমগ্র মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনা করছেন। আকাশবাণী বলছে ২৫ শে মার্চের পরেও বিভিন্ন বেতার থেকে তার কণ্ঠ শোনা গিয়েছে। BBC-র একজন জাপানি সাংবাদিকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলল তিনি হয়ত-বা গ্রেফতার হন নি। বহুরকম গুজব শোনা যায় তার সম্বন্ধে। কেউ বলছে আই বি ব্রাঞ্চের আই, জি আগেই ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে তাকে সরিয়ে ফেলেছে। কেউ বলছে দু-জন বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর রাত ৯টার দিকে তাকে নিয়ে সরে পড়েছে। যদি সাংবাদিক গ্রিনের কথা অনুযায়ী শেখ মুজিব গ্রেফতার হয়েছেন এবং বলেছেন তাঁর প্রতিবেশীকে যে ‘আমি যদি ধরা না দেই তবে আমার খোঁজে সমস্ত ঢাকা তছনছ করে ফেলবে, এরচে গ্রেফতার হওয়াই ভালো।’

এমনি সময় খবর এলো যশোহর sector পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছে। চিটাগাং থেকে বাংলা বাহিনী সরে গিয়েছে। নেভির জোয়ানরা গানবোটে করে ঢুকে পড়েছে গ্রামের ভিতর। শেলবর্ষণে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে একটির পর একটি জনপদ। পরোক্ষভাবে অত্যাচারের চিত্র দেখতে পাচ্ছি। নদীর স্রোতের মতো লোক পালিয়ে আসছে খুলনা থেকে। তাদের দুঃখ-কষ্ট আর হতাশার কথা বর্ণনা নাই-বা করলাম।

রাতে ভালো ঘুম হয় না। বিকট সব দুঃস্বপ্ন দেখি। মাঝে মাঝে উড়োখবর আসে মিলিটারিজাহাজ হুলারহাটে ভিড়ছে। শুনে আতঙ্কে বুকের রক্ত জমে যায়। কি করা যায় ভেবে পাই না। শহরের লোকেরা। এস্তে ঘুরে বেড়ায়। অন্ধকার রাতি ভয়াবহ দুর্যোগের মতো বুকের ওপর চেপে বসে। আবার ভোর হয়, আবার আসে রাত্রি। এই বিভীষিকার মধ্যেও একটা আশার খবর পাওয়া গেল হঠাৎ। আকাশবাণীর প্রভাতী সংবাদে বলা হলো—‘সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট পদগের্নি ইয়াহিয়ার কাছে ব্যক্তিগত চিঠি পাঠিয়ে গণহত্যা বন্ধ করে রাজনৈতিক সমাধান করতে বলেছেন। বাংলার অবিসাংবাদিত নেতা শেখ মুজিবের জীবনের নিরাপত্তা সম্বন্ধেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।’ আব্বা ঘুমিয়ে ছিলেন, তাকে ঘুম থেকে জেগে তুলে এই খবর শোনালাম। মুহূর্তে তার চোখমুখ থেকে দুশ্চিন্তার ছায়া অপসারিত হলো, বললেন—‘এইবার ইয়াহিয়া টাইট হবে। আর আমাদের ভয় নাই।’

পুরোনো স্মৃতির কথা লিখতে গিয়ে চোখ পানিতে ভরে ওঠে। একটা সুগভীর বেদনা অনুভব করি। প্রেসিডেন্ট পদগর্ণির চিঠিতে কোনো কাজ হয়নি। তবে আমাদের চরম হতাশায় বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে তারাই প্রথম খোলাখুলিভাবে আমাদের কথা বলেছে। তাদের সহানুভূতিটুকুতো পেয়েছি। তাই তাদের প্রতি আজ আমাদের অনেক ভালোবাসা, অনেক কৃতজ্ঞতা। জয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। জয় সোভিয়েত ইউনিয়নের বীর জনগণ।

দু-দিন পরের কথা। রাত্রিকালীন ডিউটি সেরে ফিরছি। সঙ্গে আলী হায়দার, তার ভাগ্নে বাদশা, নকশাল গ্রুপের একটি ছেলে। রাত হবে আড়াইটা। দেখি বাসায় আলো জ্বলছে, বসার ঘরে অনেক লোকের ভীড়। আমাদের পায়ের শব্দে আব্বা বেরিয়ে এলেন। আমাকে দেখে ভীষণ খুশি হয়ে গেলেন, আয়, ভিতরে আয় বলে ডাকলেন। আলী হায়দারের দিকে ফিরে বললেন, হায়দার সাহেব একটা ব্যাপার হয়েছে, কাল আপনার সঙ্গে আলাপ হবে। আব্বার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল তার বুক থেকে একটা মস্ত বোঝা নেমে গেছে।

[লেখকের লেখা ৫০ নং পৃষ্ঠাটি হারিয়ে গেছে।]

কারণ আপনি যে আমাকে প্রাইভেট রিভলবার দিয়েছেন এটা সে জেনেছে এবং সে সন্দেহ করছে যে, রিভলবার দেয়া হয়েছে তাকে যুদ্ধ করার জন্যে। গেরিলা আরো বলল, আপনার ছেলে যে তার সঙ্গে রাতে গিয়েছে তাকেও হয়ত মেরে ফেলবে, আজ রাতেই মারবার কথা। আব্বা টেলিফোন ০.c. সাহেবের হাতে দিতে বললেন। দেওয়া হলে বললেন গেরিলাকে এরেস্ট করে রিভলবার আর গুলিগুলো রিকভার করতে। ০.c, জানাল মাত্র তিন রাউন্ডগুলি পাওয়া গেছে। বাকি গুলি নাকি সে প্র্যাকটিস করেছে। আম্মা বললেন নিশ্চয়ই সে গুলি করে কোনো মানুষ মেরেছে।

আমার মনের যে কি অবস্থা হলো তা আমিই জানি। সম্পূর্ণ ব্যাপারটার জন্যে আমিই দায়ী আব্বা আমাকে কিছুই বললেন না। রাতে এক ফোঁটা ঘুমও হলো না। সারারাত ছটফট করলাম, আর শুধু বললাম, আল্লা তুমি দয়া কর, এই নিয়ে আর যেন কোনো নতুন ঝামেলা না হয়। মনে ভয় এই বুঝি বুলেটের আঘাতে মৃত একটি লাশ বেরিয়ে পড়ে।

শেষ পর্যন্ত সত্যি সত্যি একটা লাশ পাওয়া গেল। খুনি গেরিলা। খুন করেছে ছুরি মেরে। তাকে গ্রেফতার করা হলো।

দেশের কথা বাদ দিয়ে তখন শুধু নিজেদের কথাই ভাবতে লাগলাম। আব্বার যাতে কোনো বিপদ না হয় শুধু সেই দোয়াই করতে লাগলাম। মনে আতঙ্ক এই বুঝি যে-কোনো কিছু বলে আব্বাকে জড়িয়ে ফেলে। শেষ পর্যন্ত মেজর জলিলের নির্দেশে বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন সুবাদার গেরিলাকে গুলি করে হত্যা করা হয় হত্যাপরাধে। গেরিলা কাহিনির যবনিকাপতন হলো। তার লাশ নিতে। কেউ এল না। শেষে আনসাররাই কবরখানায় কবর দিলো তাকে। পরদিনই কুকুর সেই লাশ তুলে ফেলল। গোস্তের টুকরা মুখে করে ঘুরে বেড়াতে লাগল শহরময়।

এই সময়ই পাকিস্তানবাহিনী নির্বিচার বোমাবর্ষণ করে চলল, বগুড়া, সিলেট, চিটাগাং, ময়মনসিং, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, যশোর, কুষ্টিয়া আর দিনাজপুরে। স্বাধীংলা বেতার স্তব্ধ, স্রোতের মতো লোক আসছে খুলনা থেকে, এই স্রোতেই এসে পড়লেন রহুল মামা তার ভাবিকে নিয়ে। আব্বা খুশি হয়ে বললেন, এসে পড়েছ তোমরা। যাক হাজার শুকুর একটা বাজে স্বপ্ন দেখেছিলাম তোমাদের নিয়ে। অসংখ্য খবর শুনলাম তাঁর কাছ থেকে, যেগুলো তিনি সযতনে ডাইরিতে লিখে রেখেছেন। তার দু-একটা এই ধরনের :

বাবা একটু পানি দেবেন? ২৭ শে মার্চ আলমের আব্বা ঢাকা থেকে জয়দেবপুর যাচ্ছেন। রাস্তায় অসংখ্য মৃতদেহ ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। আর ভিতর থেকে এই কথা কটি একজন আহত আলমের আব্বাকে লক্ষ্য করে বলল। তিনি পানি না দিয়েই পালিয়ে আসলেন। কারণ মিলিটারিরা তার দিকে তাকিয়েছিল এবং তারা চায়না বাঙালি বাঙালিকে দয়া করুক।

খুলনার একটি মসজিদে ক-জন লোক নামাজ পড়ছিল। বাইরে গোলমালের শব্দে বেরিয়ে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে বুলেট উড়ে আসে তাদের ওপর। ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান।

ভদ্রলোকের নাম আই. সি. বিশ্বাস। T.B. clinic-এর ডাক্তার। মিলিটারির ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। স্ত্রীকে সিঁদুর পরতে দিতেন না, হাতে শাঁখা-নোয়াও নেই যাতে সন্দেহ না হয় যে, সে হিন্দু। বেশিদিন পালিয়ে থাকতে না পেরে শেষমেষ মুসলমান হয়ে গেলেন। এখন তিনি মোহাম্মদ ইয়াকুব খান।

একটি কুকুরকে দেখলাম একটি মৃতদেহ টেনে নদীর পানি থেকে শুকনায় উঠিয়ে পরম তৃপ্তিতে লেজ দুলিয়ে দুলিয়ে খাচ্ছে। সাবাস পাকিস্তান।

পিরোজপুরে দ্বিতীয় খুনটি করল উত্তেজিত মানুষ। যাকে মারল তার একটিমাত্রই দোষ, সে অবাঙালি। অবাঙালিরা যে-নির্যাতন চালাচ্ছে তার খবর আসত হরদম। বাঙালির sentiment আগুন হয়ে জ্বলছিল। হতভাগ্য বিহারিটা সেই আগুনকেই প্রজ্বলিত করল শুধু।

পিরোজপুরে কিছু অবাঙালি পরিবার ছিল। তাদের নিরাপত্তার জন্যে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হলো। এর উদ্যোক্তা হলেন আলী হায়দার খান আর আব্বা নিজে। পুলিশের মধ্যে একজন পশ্চিম পাকিস্তানি কনস্টেবল ছিল, তাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। 0.c সাহেবের বাসায় তার নিরাপত্তার জন্যে আব্বা বিশেষভাবেই উদ্বিগ্ন ছিলেন। সিন্ধের SDO সাহেব তার অনেক আগেই আশঙ্কা আঁচ করে বরিশালের ADC-র বাসায় আশ্রয় নিয়েছেন। গভীর রাতে টেলিফোন এলো একবার। করেছেন বরিশালের SDPO মহিবুল্লাহ শাহ–

‘ভাল আছেন SDPO সাহেব?

‘জি, আপনি ভালো?’

‘আছি আর কি। আপনাকে একটা কথা বলবার জন্যে phone করেছিলাম।

‘বলুন।’

‘বাংলা স্বাধীন হবে’ বলতে বলতে হাউ মাউ করে শিশুর মতই কেঁদে উঠলেন তিনি।

পিরোজপুরের বাসা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে চলে এলাম নাজিরপুর। আব্বা সেখানেই রইলেন।

নাজিরপুরের বাসাটা ছিল একটা বাংলো বাড়ি। হসপিটেলের মেডিকেল অফিসারের কোয়ার্টার। চমৎকার পরিবেশ সামনে নদী, চারিদিকেই ভীষণ খোলামেলা। বড়ো সড়ক ধরে হাঁটতে কি যে চমৎকার লাগত। চারিদিকে সবুজে সবুজে একেবারে সয়লাব। দিন কাটত গল্পের বই পড়ে আর তাস খেলে। নিজেদের সুবিধার জন্যে তাদের তাস খেলা শিখিয়ে নিয়েছিলাম। পাড়ার হিন্দু বৌ-ঝিরা বেড়াতে আসত। আম্মার সঙ্গে ভারি খাতির হলো, তাদের বাসায় আম্মাকে ধরে নিয়ে যেত। যুদ্ধের কথা শুধু মনে পড়ত খবর শোনার বেলা। মামির তখন Pregnancy first period. যা-ই মুখে দেন বমি করে ফেলে দেন। শুধু তাই নয় কেন জানি না কারো সঙ্গে কথা বলেন না, চোখ তুলে তাকান না। কি অসুবিধা তাও বলেন না। সে ভারি বিশ্রী পরিস্থিতি। আম্মা তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। দেশের এমন নাজুক পরিস্থিতিতে মামির ভূমিকাটা আমাদের সবার খুব খারাপ লাগছিল।

এদিকে আব্বা আছেন একা একা। রান্না বান্নার জন্য আছে রশীদ। রাতে আমাদের বাসাতেই থাকেন কোর্ট ইন্সপেক্টর। নাজেম ভাইও থাকেন। আম্মারই ব্যবস্থা। সেইখানেই খাওয়ার ব্যবস্থা।

এদিকে নাজিরপুরের o/c আমাদের বেশ যত্ন করছিল। সকাল বিকাল খোঁজ নিত। রাতে দু-জন পুলিশ এসে পাহারা দিত। দুধ পাঠাত নিজের বাড়ি থেকে। লোকটাকে একটুও ভালো লাগত না।

ধূর্ত চেহারা, নোংরা জামা কাপড়, ভিজে বেড়াল ভিজে-বেড়াল ভাব। সব মিলিয়ে ভীষণ বাজে। তার মতে, সমস্ত দুর্গতির মূলে মুজিবুর এবং মুজিবুর একটা জন্মচোরা।

নাজিরপুর বাসায় একজন ডাক্তার আসত। গ্রাম্য কোয়াক। হোমিওপ্যাথি, এলোপ্যাথি, কবিরাজি হাকিমি সমস্ত মিলিয়ে তার ডাক্তারিবিদ্যা। নাড়ু গোপাল নাড়ু গোপাল চেহারা। একবার আসলে আর নড়তে চাইত না। মামির নাড়ি ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকত। রোগিনীর জন্যে ঔষধত বটেই পথ্য পর্যন্ত পাঠাত। নিজে সে জামাতে ইসলামের একনিষ্ঠ পাণ্ডা। তার ধারণা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া মানেই সমস্ত মুসলমানের হিন্দু হয়ে যাওয়া। তার যুক্তি ছিল হাস্যকর আর উদ্ভট ‘বাঙালির স্বভাব খারাপ কাজেই বাঙালিরা গোলামই করবে। বেশি ‘জয় বাংলা’ বলেছ যে তাই আল্লাহ্ টাইট করতে মিলিটারি পাঠিয়েছেন’ এই জাতীয়।

যাই হোক দিন মন্দ কাটছিল না। টেলিফোনে আব্বার সঙ্গে আলাপ হতো। বিদেশীরা বাংলাদেশ সম্বন্ধে কে কি বলেছে শুনতে চাইতেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে।

মাঝে মাঝে নাজিরপুর আসতেন। একদিন থেকেই আবার চলে যেতেন। প্রায়ই তার সঙ্গে থাকত আলী হায়দার। আব্বা ছেলেটিকে বড়ো পছন্দ করতেন।

আব্বার কিছু সময় আমাদের সঙ্গে থাকার ইচ্ছে থাকলেও থাকতে পারতেন না। পিরোজপুরের এস.ডি.ও রাজ্জাক সাহেব তাহলেই বলতেন, SDPO সাহেব আমাদের একা রেখে আপনি চলে গেলে আমরা কী করে থাকি?

একদিন বিকেলে খুব গোলাগুলির শব্দ শোনা যেতে লাগল। সন্ধ্যা হতেই দেখা গেল দূরে কোথায় লক লক করছে আগুন। আকাশ গাঢ় রক্তবর্ণ। খবর পেলাম ঝালকাঠি বাজার মিলিটারিরা পুড়িয়ে দিয়েছে। রাতে নাজিরপুরের o/c এসে অভয় দিতে চাইল আমাদের। বলল, ও কিছু নয় ও কিছু নয়, লাল মেঘ। আমরা সবাই কিন্তু ভয় পেয়েছিলাম। এত কাছে মিলিটারি কখন পিরোজপুরে আসে কে জানে। খতমে ইউনুস পড়তে শুরু করলাম সবাই মিলে।

তার একদিন পরই নকশাল আর আওয়ামী লীগের ভিতর তিনঘণ্টাব্যাপী গুলি বিনিময় হলো পিরোজপুরে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছে রেগুলার আর্মি, এক্স আর্মি, পুলিশ, আনসার আর কিছু নেভাল অফিসার। নকশালরাই কিন্তু জিতল অথচ এরা দলে মাত্র কুড়ি-পঁচিশজন। বন্দুক হাতে তারা সমস্ত শহরে আধিপত্য বিস্তার করে আওয়ামী লীগদের শহরের বাইরে বের করে দিলো। অথচ আওয়ামী লীগের হাতে তখন স্টেনগান, ব্রেটাগান, টমি গানের মতো অস্ত্র। নকশালদের সম্বল নাইট্রো গ্লিসারিনের হাই এক্সপ্লোসিভ বোমা, যা তারা নিজেই তৈরি করেছে আর গোটা পনেরো রাইফেল।

ইকবাল সন্ধ্যাবেলা আব্বাকে টেলিফোন করতে গেল। ফিরে এসে বলল আব্বা ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়েছেন। বলেছেন আমরা যেন সকাল-বিকাল তার সঙ্গে আলাপ করি, শফু-শিখুও যেন করে।

পরদিন সকালে আমি টেলিফোন ধরলাম।

‘কি রে বাচ্চু এত ককেলি সকাল-বিকাল টেলিফোন করতে আর তোরা চুপচাপ।’

‘করব আব্বা, সকাল-বিকালই করব।’

‘মন বড় খারাপ থাকে, একটা দিন যায় আর মনে হয় আরেকটা দিন বাঁচলাম। তোরা কথা বললে তাও একটু ভাল লাগে।’

নকশাল-আওয়ামী গণ্ডগোল মিটেছে আব্বা?’

‘হ্যাঁ উপরে উপরে মিটমাটই। মনি ভালো আছে?’

‘জি।’

‘ভয়-টয় লাগে?’

‘না। টেলিফোন রাইখা দিব?’

‘কি এত তাড়াতাড়ি। বিদেশি খবর টবর বল…’

বরিশাল শহর মিলিটারি দখল করে নিলো অল্প আয়াশে। তিন দিক থেকে সাড়াশি আক্রমণ চালিয়ে, উপর থেকে বোমা বর্ষণ করে মুক্তিবাহিনীকে হটিয়ে দিলো। চারিদিকে সবাই এতে ভয় পেয়ে গেল। আলী হায়দার একদিন এসে আমাদের সরিয়ে নিলো বাবলায়। এক ব্যারিস্টারের আত্মীয় এই পরিচয়ে সে ব্যারিস্টারের বাড়ি নিয়ে তুললেন আমাদের। প্রকাণ্ড দোতালা বাড়ি, বাড়ির মালিক মোবারক খান প্রবীণ বয়স্ক লোক, তিনি পরম সমাদরে আমাদের গ্রহণ করলেন। চারিদিক থেকে লোক ভেঙে পড়ল আমাদের দেখতে। ‘আহা এই দুঃসময়ে কি কষ্টেই না এরা পড়েছে।’ সবার মুখে এই কথা। ‘কি যত্নের মানুষ এরা কি দিয়ে এদের সমাদর করি।’

কিন্তু কেন জানি না এত যত্ন এত সমাদর সত্ত্বেও আমি খুব দমে গিয়েছিলাম। হয়ত জায়গাটির পরিবেশই মনের ওপর কাজ করছিল। জায়গাটা কেমন যেন দম বন্ধ করা। চারিদিকে ঘন বন জঙ্গলে আচ্ছন্ন, একটুকুও খোলামেলা নয়। কেমন একটা দমবন্ধ করা ভাব। দু-দিনেই আমি হাঁপিয়ে উঠলাম। আলী হায়দার সেই আমাদের রেখেই পালিয়েছে আর খোঁজ নেই। বলে গেছে under ground-এ থাকতে হচ্ছে, তবে কাছাকাছিই আছি। আমরা একেবারে একা পড়ে গেলাম। থাকার বন্দোবস্ত হলো দুই ভাগে। মেয়েরা দু-তলায়। ছেলেরা নিচের তলায়। বাড়িতে কঠিন পর্দা, কাজেই আমরা আম্মা আর শেফু শিখুর সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম। তৃতীয় দিনে আলী হায়দার আবার এল। হাসি তামাশায় বেশ কাটল দিনটা। রাতে খেতে বসেছি কে এসে যেন বলল, খুব খারাপ স্তর, পিরোজপুরে ট্রেজারি লুট করেছে নকশালরা। আওয়ামী লীগের সঙ্গে খুব গোলাগুলি হয়েছে। বেশ কয়েকজন মরেছে। বুকের ভিতর ধ্বক করে উঠল। ভাত বিস্বাদ হয়ে গেল। আলী হায়দার যদিও বারবার বলছে ও কিছু নয়, সব জায়গায় ট্রেজারি লুট হয়েছে; তবুও তার মুখ আতঙ্কে কালো হয়ে উঠল। আলী হায়দারকে জিজ্ঞেস করে জানলাম আব্বা বাবলায়, আমাদের বর্তমান ঠিকানা জানেন না। এই বিপদে কোথায় যাবেন তিনি? দারুণ দুঃশ্চিন্তায় রাত কাটল। পরদিন খুব সকালেই ইকবাল আর ইউনুসকে পাঠালাম নাজিরপুর। সেখান থেকে টেলিফোনে আব্বার সঙ্গে আলাপ করবে। আমি আর রহুল মামা চললাম পিরোজপুর। প্রায় আট মাইল রাস্তা। মানসিক উৎকণ্ঠায় খুব দ্রুত গতিতেই হাঁটছিলাম দু-জন। কোনোরকমে পিরোজপুরে পৌঁছতে পারলে বাঁচি। রাস্তায় অনেক পরিবারের সঙ্গে দেখা হলো তারা সবই শহর ছেড়ে গ্রামে এসে পড়ছে। অনেকেই আমাদের শহরে যেতে মানা করল। এরা সবাই নকশালদের ওপর বিষম ক্ষ্যাপা বলছে, এরা নকশাল নয় টাকশাল। শহরের উপকণ্ঠে আসতেই দেখা হলো জনাকয় বন্দুকধারী লোকের সঙ্গে। তারা আমাদের দেখে থমকে দাঁড়াল। আমার দিকে তাকিয়ে একজন বলল–

‘আপনি SDPO সাহেবের ছেলে?’

‘জি।’

‘চেহারায় অদ্ভুত মিল। মুখ দেখেই চিনেছি। কোথায় যাচ্ছেন?’

‘আব্বার খোঁজে পিরোজপুর।’

‘আরে তাঁর সঙ্গে কাল রাতে দেখা হয়েছে আমার। তিনি তো আপনাদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন। পাগলের মতো। ঠিকানা জানেন না তো।’

‘আপনি বরংচ নাজিরপুর যান। শহরে গিয়ে মরবেন নাকি?’

ফিরে চললাম, মনে দারুণ উদ্বেগ। কি মুশকিল আলী হায়দার ঠিকানাটা পর্যন্ত জানায়নি। এখন কি উপায়। ঘামতে ঘামতে পরিশ্রমে আধমরা হয়ে পৌঁছলাম। শুনলাম ইকবাল এসেছে, খবর এনেছে আব্বা রওনা হয়েছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো এসে পড়বেন।

আব্বা আসলেন সন্ধ্যা নাগাদ। সে ছবিটা খুব স্পষ্ট মনে আছে। খোঁচা খোঁচা দাড়িগোঁফ, উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি, পাগলের মতো চাউনি, মুখ শুকিয়ে কালো হয়ে উঠেছে। ক্লান্ত আর অবসন্ন পায়ে তিনি উঠে আসলেন। সঙ্গে নাজিম ভাই আর দু-জন বন্দুকধারী জোয়ান। আব্বা বিছানায় বসে হাঁপাতে লাগলেন। গল গল করে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে তার কপাল বেয়ে। ঘন ঘন জিব বের করে ঠোঁট ভিজাচ্ছেন। কাছে বসে মোবারক খান অসংখসংলগ্ন প্রশ্ন করে আব্বাকে বিরক্ত করতে লাগল। তিনি ক্লান্তগলায় প্রতিটির জবাব দিতে লাগলেন। আম্মা একটা পাখা নিয়ে তাকে হাওয়া করতে লাগলেন। আমি তাকে বিশ্রাম দেয়ার জন্যেই মামাকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে চলে গেলাম। মনটা অনেক হালকা।

[এখানে পৃষ্ঠা নম্বরের ধারাবাহিক পাতা নেই, তবে মনে হয় পৃষ্ঠা হারিয়ে যায়নি; পৃষ্ঠা নম্বর দিতে ভুল হয়েছে।]

ট্রেজারি লুট সম্বন্ধে আব্বা বিশেষ কিছু বললেন না। তিনি কেমন যেন বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। যা বললেন তার থেকে এইটুকু বুঝা যাচ্ছিল যে, দু-জন নকশাল রোববার সকালে হঠাৎ দুটি স্টেনগান হাতে এস,ডি,ও আর ট্রেজারি অফিসারের ঘরে ঢুকে পড়ে। তারপর বলে ট্রেজারি খুলে দাও, নয়তো মর গুলি খেয়ে। সকাল ৯টায় দিনে দুপুরে ৯ ট্রাঙ্ক টাকা নিয়ে যায় তারা, আব্বাকে একদল নকশাল ঘিরে রাখে। আওয়ামী লীগ টাকাটা নিজেদের কাছে রাখতে গিয়ে বাধা দেয়, তাতে প্রচুর গুলি বর্ষণ হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি তাজুল ইসলাম মেশিনগান দিয়ে খটাখট গুলিবর্ষণ করে চলে নকশালদের ওপর। তিনজন নকশাল মারা পড়ে এতে।

আব্বা সারাটা দিন ঘুমিয়ে কাটালেন। শিখু তার বুকে হাত বুলিয়ে দিলো। নামাজের সময়গুলাতে যন্ত্র চালিতের মতো উঠে শুধু নামাজ পড়লেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কিরে নমাজ? নমাজ পড়লি না। সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ বাদশা এল। হাতে মস্ত এক রামদা। আমাদের আর হায়দারের খোঁজে এসেছে। সে যা বলল তা শুনে আমরা স্তম্ভিত। সে বলল এস.ডি.ও আর ট্রেজারি অফিসারকে আওয়ামী লীগের মুক্তিবাহিনী গ্রেফতার করে আটকে রেখেছে তাদের গেরিলা ট্রেনিংক্যাম্পে। সেখানে তাদের কিছুই খেতে দেওয়া হয় না, কারো সঙ্গে কথা বলতে দেয়া হয় না। বাদশা খবর পেয়ে তাদের উদ্ধার করে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছে। আব্বা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, যাক তারা দুইজন বেঁচে আছে আর ভয় নাই। রাত ৯টার দিকে এল আলী হায়দার। আব্বা খুব খুশি হলেন। বললেন, হায়দার সাহেব ট্রেজারি লুটের পিছনে অনেক রুই-কাতলা আছে, যদি বেঁচে থাকি তবে একদিন নিশ্চয়ই বলব।

রহুল মামাকে নিয়ে পরদিন চলে গেলাম শ্রীরাম কাটির বাজারে। দু-একটা জিনিস কিনতে। সেখানেই শুনলাম পিরোজপুরে মিলিটারি এসেছে। হুলারহাটে ৬ জনকে গুলি করে মেরেছে নেমেই।

খবর শুনে আব্বার কেনো ভাবান্তর হলো না। আর চুপচাপ হয়ে গেলেন। মোবারক খান (বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ মারা যাবার পর মোবারক খান বাড়ি থেকে পুরো পরিবারকে বের করে দিয়েছিল) প্রচুর যত্ন করেছে আব্বাকে। এটা খাওয়াচ্ছে, সেটা খাওয়াচ্ছে। মুখে এক বুলি এত বড় অফিসার আমার ঘরে কি দিয়ে যত্ন করি।

পরদিন ভোর ৯টায় একটা ছেলে এসে হাজির নাজিরপুরের o.c–র একটা চিঠি হাতে। চিঠি আমিই প্রথম পড়লাম, চমৎকার চিঠি। অনেকটা এই ধরনের :

‘… স্যার, আমাদের তো আল্লা ছাড়া কোনো ভরসা নাই আপনি আল্লার নাম নিয়েই পিরোজপুরে যান। এ-ছাড়া এই বিদেশ বিভূইয়ে আমরা কী করতে পারি? পিরোজপুরের o.c আমায় টেলিফোনে জানিয়েছেন কোনো ভয় নাই। তা ছাড়া খুলনারেঞ্জের DIG সব পুলিশ অফিসারদের বেলা বারোটার আগে হাজির হতে বলেছেন।’

বারোটার আগে জয়েন করতে হলে সময় নেই। আম্মা আব্বাকে ডেকে তুললেন। আব্বা চিঠি পড়েন আর জিজ্ঞেস করেন, কিরে যাব পিরোজপুরে? সবাইকেই প্রশ্ন। আমরা সবাই বলি, কোনো ভয় নাই যান। মিলিটারি এডমিনিস্ট্রেশন চালু করতে চাইছে কাউকে কিছু বলবে না। আব্বা নিজেও বলেন ঠিকিইতো, কই পালাব? আজ পালালে ছেলেপেলেসহ কালই ধরিয়ে দেবে। আব্বা আশা আর। আশঙ্কায় দুলতে দুলতে সেভ করলেন। চিড়া খেলেন। কাপড় পরলেন। নৌকা ঠিক হলো। আব্বার মুখ দেখে মনে হলো সাহস পাচ্ছেন। আব্বাকে সাহস দেবার জন্যে ইকবাল চলল সঙ্গে।

আমি আর আব্বা

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

যখন আমি আর আব্বা নৌকা করে রওনা দিই তখন আর সবাই নদীতীরে দাঁড়িয়ে আছে। একেবারে চুপচাপ রওনা দেওয়াটা আমার খারাপ লাগল। আমি ভাবলাম যাওয়ার সময় একটা কিছু আলাপ করে আবহাওয়াটা সহজ করি। শেফুকে জিজ্ঞাসা করলাম–আজ কয় তারিখ, পাঁচ না?

হ্যাঁ–পাঁচ।

লাকি ডেট, তাই না?

আমি জানতাম পাঁচ তারিখ নিউমোরলজি অনুযায়ী আমাদের জন্যে লাকি ডেট তবু সবার সামনে কথাটা বলে আতঙ্ক দুর্ভাবনা কমাতে চাইলাম। নৌকায় রওনা দিলাম। নৌকাটা ছিল ভাঙা–পানি উঠছিল সাংঘাতিক, একটু পরে পরে আমি পানি সেঁচছিলাম। বহুক্ষণ নৌকায় যেতে যেতে আব্বা একটাও কথা বলেন নি। একবার জিজ্ঞেস করলেন, সেকেন্ড আর ফোর্থ অফিসার কোনো গ্রামে আছে আমি জানি কি না? আমি গ্রামের নাম বললাম। আব্বা হিন্দু মাঝিটাকে জিজ্ঞেস করলেন, পথে পড়বে নাকি? মাঝি জানাল যে পড়বে না। আমার সঙ্গে আব্বার আর কোনো কথা হয়নি–পথে শুধু এক চেয়ারম্যান আব্বার সঙ্গে খানিক আলাপ করেছিল। চেয়ারম্যান তখন খুব ব্যস্ত, চারদিক ভয়ানক লুটপাট। আব্বা তাকে বললেন আপনারা এটা বন্ধ করেন বাকিটুকু আমরা ঠিক করব। তখন চেয়ারম্যান আরও খানিকক্ষণ আলাপ করল, নৌকা থামেনি, কাজেই আলাপ বেশিক্ষণ চলতে পারে নি। পথে আরেকজন লোকের সঙ্গে দেখা। শক্তসমর্থ শরীর, মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। আব্বাকে দেখে ভারি অবাক হলো, স্যার? আপনি যাচ্ছেন?

আব্বা হাসলেন, বললেন, দেখে আসি। লোকটার বিশ্বাস হয় না, জিজ্ঞেস করল, সত্যি যাচ্ছেন? সাহস পান?

আলাপ চালানোর জন্যে সে নৌকার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে লাগল, মিলিটারি সম্পর্কে তার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা জানাল। আমরা যাচ্ছি মিলিটারির কাছে, তাই তার সব কথা বিশ্বাস করলাম না।

আমাদের নৌকা যখন কালীগঙ্গা নদীতে পড়ল তখন চারিদিকে আঁতিপাতি করে খুঁজেও আমি আর একটাও নৌকা দেখলাম না। হুলারহাট ডকটা একেবারে নির্জন। আমার কেমন খারাপ লাগল–একটু ভয় ভয়ও। নদী দিয়ে একটা সাদা লঞ্চ আসছিল–ওপরে পাকিস্তানি পতাকা। দেড়মাস পরে আবার আমি ভাবলাম গানবোটই নাকি কে জানে। নৌকা হুলারহাটে পৌঁছালে আমরা উপরে উঠে দেখি রশিদ মাথায় একটা টুপি চাপিয়ে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণ যে ভয় ভয় লাগছিল রশিদকে দেখে সেটা একটু দূর হলো। রিকশা চেপে রওনা দিলাম। রশিদ মাঝে সাইকেল চালাতে চালাতে মিলিটারির গল্প করছিল। তার মুখ থেকে শুনলাম সেকেন্ড অফিসার আর ফোর্থ অফিসার সকালেই এসে গেছেন। পিরোজপুরে পৌঁছে মিলিটারির পজিশন নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে এসেছে, ফাঁকা আওয়াজ করেছে, কয়েকটা দলে ভাগ হয়ে গিয়ে আস্তে আস্তে অগ্রসর হয়েছে অর্থাৎ রীতিমত যুদ্ধাভিযান। আমাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেছে।

এস.ডি.পি.ও কাহা?

রশিদ জানাল, সে বলল, গ্রামে ট্যুরে গিয়েছেন।

মিলিটারি বলেছে, ও ভাগ গিয়া!

রশিদের মতে মিলিটারিরা টাউনে কোনো অত্যাচার করে নি–মেজর সাহেব নাকি খুব ভাল মানুষ! শুধু কয়েকজন হিন্দুর বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। বাসায় পৌঁছে দেখি প্রকাণ্ড একটা পাকিস্তানি পতাকা শোভা পাচ্ছে। শুধু বাসায় না যেদিকে তাকানো যায় শুধু পাকিস্তানের পতাকা, বাসায়, দোকানে, রিকশায় এমনকি মানুষের পকেটে!

বাসায় ড্রয়িংরুম ফাঁকা, আসবাবপত্র শোয়ারঘরে গাদা করা। দুটো পালঙ্ক জড়ো করে জোড়াবিছানা, সবমিলিয়ে এক শ্রীহীন অবস্থা। আব্বা ও.সি.কে ফোন করে জানতে চাইলেন এখন কি করা। ওসি অভয় দিয়ে অফিসে চলে আসতে বললেন। আব্বা পোশাক পরলেন রশিদ সাহায্য করল। আব্বার ডান হাতের বোম খানিকটা কি ভাবে ছিঁড়ে গিয়েছিল, কিভাবে সেটা কাউকে বলেন নি, রশিদ সেটা ম্যানেজ করে দিলো। আব্বা একটা ডাইরি নিয়ে অফিসে গেলেন।

বাসায় চারিদিক থেকে ধূয়া উড়ছে–দুমদাম শব্দে হিন্দুদের ঘরবাড়ি ভাঙা হচ্ছে–সে এক বিশ্রী ব্যাপার। আমি খানিকক্ষণ হরিণটাকে আদর করলাম। গোসল করে Wodehouse-এর একটা বই বের করলাম। রশিদ চা তৈরি করে দিলো, তার সুট করে আনা সম্পত্তি দেখাল। তখনই আমি প্রথম জানতে পারলাম মিলিটারিরা লুট করাচ্ছে। এখন আর লুট করা অপরাধ নয়, আইনগতভাবেও নয় নৈতিকভাবেও নয়। আমার মনটাই তেতো হয়ে গেল।

ভাত রাঁধা হলো, তরকারী কুখাদ্য–কৃমির মতো লম্বা লম্বা আতপ চাউল। আমি একলাই খেয়ে ফেললাম, আব্বা কখন আসেন ঠিক নেই। কিন্তু আব্বা আসলেন একটু পরেই। ইজিচেয়ারে বসলেন, মুখটা ভারি চিন্তাক্লিষ্ট। কথা না বলে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন। ডাক্তার সাহেব আসলেন, তার মুখও কেমন বিবর্ণ উদ্ভ্রান্ত-উদ্ভ্রান্ত। ডাক্তার সাহেব আরেক কথা বললেন, মিলিটারি এসেই দু-জনকে মেরেছে, দুজনকে গুলি করেছে দৌড় দেওয়ার অপরাধে ইত্যাদি ইত্যাদি। আব্বা কোনো আলাপে বেশি উৎসাহ দেখালেন না, বার বার জিজ্ঞেস করলেন সেকেন্ড আর ফোর্থ অফিসার কই, কী ব্যাপার?

ডাক্তার সাহেব জানালেন তারা দুজন এসেছে খুব সকালে, সারা গায়ে কাদামাখা পাগলের মতো চেহারা। প্রথমে দেখা করেছেন আফজাল সাহেবের বাড়িতে, তিনি পাঠিয়েছেন হাসপাতালে। হাসপাতালে ডাক্তার সাহেব তাদের পোশাক বদলে দিলেন বাসায় এনে খেতে দিলেন দুধ, তারা খেতে চাইল না। তারপর দিলেন চা। চা খেলেন, কিন্তু দু-জনের কেউই স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। একটু পরে কয়েকজন মিলিটারি আসল তাদের খোঁজে। ডাক্তার সাহেব জানালেন, তারা অসুস্থ। মিলিটারিরা বলল, রিকশায় বসতে পারবে তো, তাহলেই হবে। তারপর রিকশায় বসিয়ে তাদের নিয়ে গেল।

রশিদকে আব্বা একই কথা জিজ্ঞেস করলেন, রশিদ, সেকেন্ড অফিসার আর ফোর্থ অফিসার কই?

কেন স্যার? তারা তো তাদের বাসাতেই আছে। সেকেন্ড অফিসারের বাসাতেই মিলিটারিরা আশ্রয় নিয়েছে, কাজেই সেখানে গিয়ে সন্দেহ মিটানো সম্ভব ছিল না। আব্বা বারবার জানতে চাইছিলেন, তারা কি অ্যারেস্ট হয়েছে নাকি বাসাতেই আছে। কিন্তু কেউই এর সঠিক উত্তর বলতে পারল না, মিলিটারির এখন পর্যন্ত খারাপ রিপোর্ট নেই। আমরা ধরে নিলাম তারা বাসাতে ভালোই আছে। সেকেন্ড অফিসার আর ফোর্থ অফিসার সম্পর্কে আব্বার কৌতূহল। ওদের সম্পর্কে আমার জিজের কৌতূহল ছিল না, তাই ও ব্যাপারে আমি বিশেষ গুরুত্ব দিই নি।

আব্বা গোসল করলেন, নামাজ পড়লেন, সেই অখাদ্য খাবার খেলেন। তারপর বিছানায় শুয়ে বললেন, বাবা আমায় চারটার সময় ডেকে দিবি। মিটিংয়ে যেতে হবে।

আমি বললাম, ঠিক আছে।

বারটার সময় আব্বাকে ডাকতে গিয়ে দেখি আব্বা মোটেই ঘুমাননি–বিছানায় শুয়ে শুয়ে তাকিয়ে আছেন মাত্র। সারা দুপুর আব্বার মুখ চিন্তায় যে-রকম ভারাক্রান্ত হয়েছিল

এখন তা আর নেই, বরং সমস্যা মিটে গেলে যে-রকম প্রফুল্লতা ফিরে আসে সেরকম প্রফুল্ল। আব্বা নিজেই উঠলেন–নামাজ পড়লেন, তারপর পোশাক পরে নিলেন, আমি বোতাম লাগিয়ে ভাঁজ ঠিক করে আব্বাকে সাহায্য করলাম। আব্বা যাবার সময় বাইরের ঘরের দরজার কাছে এসে আমাকে বললেন, বাবা, আমার জন্যে দোয়া করিস।

ডাক্তার সাহেবও মিটিংয়ে যাবেন, আব্বা যাবার সময় তাকেও ডেকে নিলেন।

আমার কোনো কাজ নেই। রশিদ কার ঘর লুট করে পুরো এক ড্রাম চাল এনেছে। আমাকে মাথায় দেবার সুগন্ধি তেল সেধেছে, তালা, তাস, পুরানো র‍্যাদ, লুট করতে কিছু বাকি রাখে নি। বারান্দায় বসে দেখলাম, হাসপাতাল থেকে গুলি খেয়ে মৃত এক রোগির লাশ রিকশায় সরানো হলো।

আমি বিকেলে বাসার সামনে এসে বসলাম। ডাক্তার সাহেবের বাসা থেকে, বাবু আফরিন ওরা এতদিন পরে আমাকে দেখে ছুটে এল, আমার সঙ্গে তাদের হাজারো রকম ছেলেমানুষি গল্প।

একটু পরে দেখলাম কুলির মাথায় করে এক লাখ টাকা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ট্রেজারি লুটের টাকা! কোত্থেকে জানি জোগাড় করা হয়েছে। আরও কিছুক্ষণ পর দেখলাম রিকশা করে মিলিটারি আসছে। তারা নকশালদের ধরে আনছে। ফজলুর হাত পিছমোড়া করে বাঁধা আড়ষ্টভাবে বসে আছে–খালি গা। মুখের ভাব উদ্ধত। আরও কয়জন ছেলে, একজনের চোখ বাঁধা। সবাইকে চিনি না। খবর নিয়ে জানলাম কোননা বাড়িতে লুকিয়ে ছিল গ্রামবাসীরা ধরে দিয়েছে।

সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। ডাক্তার সাহেবের বাসা থেকে এক গ্লাস দুধ পাঠালেন খালাম্মা। আমার গিয়ে দেখা করা উচিত কিনা ঠিক করতে পারলাম না। সন্ধ্যার দিকে কোর্ট ইন্সপেক্টর সাহেব রশিদকে দিয়ে তার বিছানা নিয়ে গেলেন।

বেশ আঁধার হয়ে এসেছে তখর। রশিদ এসে বলল, আফজল সাহেবের বাসায় যে মুনশি থাকে, সে বলেছে সেকেন্ড আর ফোর্থ অফিসারকে নাকি গুলি করে করে মেরে ফেলেছে।

ধ্বক করে আমার বুক কেঁপে উঠল। এই প্রথম আমার আব্বার জন্য চিন্তা হলো। আব্বা এখনো আসেন নি।

দৌড়ে গেলাম ডাক্তার সাহেবের বাসায়। ডাক্তার সাহেব হতচেতনের মতো বেঞ্চে শুয়ে আছেন। আমাকে দেখে উঠে বসলেন।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, চাচা ওরা সেকেন্ড আর ফোর্থ অফিসারকে নাকি গুলি করে মেরেছে?

আমিও এ-রকম কথা শুনে এসেছি, এসেই শুয়ে পড়েছি।

আব্বা–তাহলে আব্বা–

তোমার আব্বা এখনো আসেননি?

তারপর রশিদকে পাঠালেন থানায় খবর আনতে। আমি খবরাখবর নিলাম। মিটিংয়ে কে কে ছিল, কে কী বলেছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। রশিদ খবর আনল সবাই চলে এসেছে। আবার যাবে একটু পরে। আব্বা কর্নেলের সঙ্গে আলাপ করছেন এখনো আসেন নি। খালাম্মা তাদের বাসায় থাকতে বললেন, আমি বললাম, না-না, আব্বা আছেন তো, আমার ভয় করবে না–

কারফিউর সময় হয়ে আসছে আমি বাসায় চলে এলাম। যতই সময় পার হতে লাগল, ততই দুশ্চিন্তায় আমার হতে পা ঠাণ্ডা হয়ে আসতে লাগল। আমি প্রতি মুহূর্তে আশা করছিলাম এই বুঝি দরজায় ধাক্কা শুনব, আর খুলেই দেখব আব্বা দাঁড়িয়ে আছেন। আস্তে আস্তে আটটা বাজল, এখনো আব্বার দেখা নেই। আমি মনকে প্রবোধ দিলাম, আব্বার কিছু হয় নি, আব্বা ভাল আছেন। কর্নেলের সঙ্গে আলাপ করছেন। হঠাৎ কর্কশ স্বরে এক ঝাঁক গুলির তীব্র আওয়াজ হলো, খুব কাছে। সাথে সাথে আঁ-আঁ-আঁ করে কে যেন চেঁচিয়ে উঠল। আমি শিউরে উঠে পর মুহূর্তে বুঝতে পারলাম, মানুষের চীৎকার নয় কাক। আমার সারা শরীর শীতল হয়ে উঠল। আশে পাশে এখানে সেখানে গুলির আওয়াজ, প্রতিটা গুলির শব্দ আমার স্নায়ুকে ভয়ানক আঘাত দিয়ে দিয়ে একেবারে দুর্বল করে তুলল। আমি বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার দোয়া, দোয়া ইউনুস পড়তে চাইলাম, মনে পড়তে চাইল না, মুখে আটকে যেতে লাগল।

মনকে প্রবোধ দিচ্ছিলাম আব্বা কর্নেলের সঙ্গে আলাপ করছেন। আসবেন আরেকটুকু পরে। অশুভ চিন্তা মনে আসতে চাইলেই আমি সেটাকে জোর করে সরিয়ে দিচ্ছিলাম, এইভেবে যদি কয়েকজনকে গুলি করে মারতে চায় তাহলে এলোপাথাড়ি আওয়াজ হবে না, আওয়াজ করতে হবে সুনির্দিষ্ট। একটু পরে পরে। দশটার দিকে আটটা গুলির আওয়াজ শুনলাম, সুনির্দিষ্ট শব্দ, একটার পর একটা আমার মনে হলো আমি মাথা ঘুরে পড়ে যাব।

আমার চিন্তা করার ক্ষমতা নেই, ভাববার সময় নেই, শুধু প্রার্থনা করছি–আল্লাহ বাঁচাও–তুমি প্রাণ ভিক্ষা দাও…

রশিদ আর ইসমাইল বারবার আমাকে ভাত খেয়ে নিতে বলল ভাবখানা আমাকে এখন ভাত খাওয়াতে পারলেই একটা মস্তকিছু কাজ উদ্ধার হয়ে যাবে!

আমি থানায় ফোন করি নি, ভয় লাগছিল–যদি শুনতে পাই আর সবাই ফিরে এসেছে শুধু আব্বা আসেন নি। এমন সময় টেলিফোন বাজল, নাজিরপুরের ও. সি. আব্বাকে খুঁজছেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের পরিবারকে নাজিরপুরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে নৌকা পাঠাতে হবে কি না–

আমি বললাম, না না এখন না। কি ভেবে বললাম, জানি না।

এগারোটার সময় আমি ফোন করলাম থানায়। জিজ্ঞেস করলাম, আব্বা সামনে আছেন?

না তো, এখনো আসেন নি!

না? ও.সি. সাহেব, সি.আই সাহেব…

তারা তো সবাই ও.সি. সাহেবের বাসায় ঘুমিয়ে আছে।

আমার সবকিছু জিজ্ঞেস করা ফুরিয়েছে।

বাকি রাতটা কেটেছে অবর্ণনীয় দুশ্চিন্তায়। লিখে সেটা প্রকাশ করা যায় না। দরকারও নেই— এদেশে একজন মানুষের দুঃখ কষ্ট দুশ্চিন্তার কোনো মূল্য নেই, এটা নতুন নয়, অভাবনীয়ও নয়।

সকালে রশিদ খবর আনতে গেল। খবর নিয়ে এল কাঁদতে কাঁদতে। চোখের পানিতে বুক ভেসে যাচ্ছে, আমার বুঝতে বাকি রইল না সে কি খবর এনেছে। বললো, ভাই আপনে বাড়ি যান। ছোটো জমাদার বলেছে গত রাতে সাহেবকে গুলি করেছে।

এরপরে বহুবার বহুভাবে এ-খবর শুনেছি কিন্তু প্রথম বার শুনে আমার প্রতিক্রিয়া হয়েছিল একটু অদ্ভুত, আমি শুধু যন্ত্রের মতো মনে মনে নিজেকে বলছিলাম, পৃথিবীর সব দুঃখ সময়ের সাথে কমতে থাকে। দুঃখ সময়ের সাথে কমতে থাকে। আমার অবাক লাগছিল। এইভেবে সময়ও কি আমায় এই দুঃখের ওপর প্রলেপ বুলাতে পারবে?

আমি প্রথমে গেলাম ও.সি. সাহেবের বাসায়। ঢুকলাম অবাঞ্ছিতের মতো। সি.আই, কোর্ট ইন্সপেক্টর কিংবা ও.সি, সাহেব আমার দিকে তাকালেন নিরুৎসুকের মতো। আমার বক্তব্যেও তাদের যেন কোনো কৌতূহল নেই। আমি চেষ্টা করলাম, কান্না আটকিয়ে রাখতে, তবু গলার আওয়াজ হলো ভাঙা ভাঙা, চাচা, আব্বাকে নাকি গুলি করেছে, তাহলে ডেড বডি…

এ-খবরেও তারা চমকালো না। কোথা থেকে শুনেছ এ-ধরনের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল, আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর পেলাম না। এ ব্যাপারটা অসম্ভব এ-রকম আশ্বাসও দিলো না। একরকম উপেক্ষিত হয়ে বের হয়ে এলাম। রাস্তায় নেমে কান্না চাপতে পারলাম না।

কাঁদতে কাঁদতে বাসায় এসে ঢুকলাম।

খালি বাসায় বারান্দায় বলে আমি কাঁদতে লাগলাম, হরিণটা বার বার এসে আমাকে শুঁকে শুঁকে গেল। রশিদ ইসমাইল আমায় সান্ত্বনা দিচ্ছিল—মানুষের কষ্টের সময় সান্ত্বনাবাক্য যে কি খারাপ লাগে আমি আগে জানতাম না।

ডাক্তার সাহেবের বাসা থেকে আমার জন্যে নাস্তা পাঠান হলো, ডাক্তার সাহেব আমায় ডেকে নিয়ে তাদের ঘরে বসালেন। খালাম্মা। খুবই সহজ সরল মানুষ, আমায় ছেলেমানুষ ভেবে অবাস্তব সব কথা বলে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। নিজের ছেলে মেয়েদের বলছিলেন, যাও, তোমার ইকবাল ভাইয়ের কাছে গিয়ে বসে গে। যে-শিশুরা গত বিকেলে সারাক্ষণ আমার কোলের ওপর বসে কাটিয়েছে, এখন তারাই আমার কাছে ঘেঁষল না, পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে উঁকি মারতে লাগল।

আমি সারাক্ষণই কাঁদছিলাম। প্রথম সান্ত্বনা পেলাম ডাক্তার সাহেবের কাছে। আমায় একসময় বললেন তুমি এখনই কাঁদছ কেন? আগে সত্যি জেনে নাও তোমার আব্বা মারা গেছেন কি না। আমি চোখ মুছলাম, সত্যিই তো আমি কেন ভাবছি আব্বাকে গুলি করা হয়েছে? কী প্রমাণ আছে? ডাক্তার সাহেব আফজল সাহেবকে বললেন খবর আনতে, আমি অধীর হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। যখন ফিরে। এলেন আমি জিজ্ঞেস করলাম। উত্তরে তারা বললেন, তিনি জানতে পারেন নি। তবে কর্নেলকে বলে এসেছেন ট্রায়াল ছাড়া যেন বিচার করা না হয়।

আমার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব তখনো বাকি। আম্মাদের কাছে এই খবর নিয়ে পৌঁছাতে হবে। কোনো পাকা খবর নেই আব্বাকে নিয়ে গেছে এতটুকু মাত্র জানি, তারপর কি হয়েছে কে জানে। দুপুরে ভাত খেলাম ডাক্তার সাহেবের বাসায়। নয় মাইল হেঁটে এই খবর নিয়ে যেতে হবে। শক্তির দরকার।

সব টাকা ছিল আব্বার কাছে। তাই ডাক্তার সাহেবের কাছ থেকে টাকা নিলাম। ট্রেজারি লুট হয়েছে কাজেই নতুন নোট কেউ নিতে চায় না। ডাক্তার সাহেব বেছে বেছে পুরানো নোট দিলেন। শার্টপ্যান্ট না পরে লুঙ্গি আর শার্ট পরলাম, রশিদ মাথায় পরিয়ে দিলো তার টুপি। তারপর রওনা দিলাম।

পিরোজপুর থেকে হুলারহাট পর্যন্ত সাড়ে তিন মাইল রিকশায় যাওয়া যায়, কিন্তু আমাকে এ-জায়গাটুকুও হেঁটে যেতে হলো। সব রিকশাওয়ালারা নাকি লুট করতে বের হয়েছে। রাস্তা চিনি না তাই সঙ্গে রয়েছে ইসমাইল।

নয় মাইল যেতে যেতে আমি কখনো কখনো হাঁটা ছাড়া আর সবকিছু ভুলে গেলাম, কিন্তু যখনই সব মনে পড়ত তখনই মনে হতো আমার বুক ফেটে যাবে। আমি কোন মুখে আম্মাদের এ-খবর জানাব, এ-খবরের পর তাদের কি অবস্থা হবে ভেবে আমি অস্থির হয়ে পড়লাম। আমি জেনেছি আস্তে আস্তে, তারা সেটা জানবে হঠাৎ করে একবারে। কি সাংঘাতিক একটা আঘাত পাবে।

যতই বাবলা গ্রাম কাছে আসতে লাগল ততই আমার পা আটকে আসতে লাগল। পথে ছিন্নমূল অসহায় হিন্দু পরিবারগুলোকে দেখেও আমার অনুভূতির কোনো তারতম্য হলো না। বাবলা খালের সাঁকোটা পার হতেই খাঁ সাহেবের একজন ছেলে সঙ্গ নিলো। জিজ্ঞাসা করল, কী খবর? আমি বললাম, ভালো।

বাড়িতে পৌঁছে আমার মনে হলো যদি এ-খবর আগেই পৌঁছে যেত তাহলে আমার কিছু বলতে হতো না। কিন্তু এখনো কোনো খবর পৌঁছেনি। খবর দেওয়ার জন্যে আমি ঘরে ঢুকলাম।

প্রথমে শেফু পরে আম্মা নামলেন। শেফু জিজ্ঞেস করল, কী। খবর?

খারাপ খবর। তোরা কিছু শুনিস নি? শেফুর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, না! কী?

আমি এক নিশ্বাসে সব বলে দিলাম। আব্বা মিটিংয়ে গিয়ে আর ফিরে আসেন নি, কেউ কেউ বলছে গুলি করে দেওয়া হয়েছে। আম্মা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর সিঁড়িতেই বসে পড়ে মুখে আঁচল গুঁজলেন, কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলেন, আমি নিজের হাতে মেরে ফেলেছি। আমি নিজের হাতেমেরে ফেলেছি।

প্রথমবারের মতো আমাদের পূৰ্বিারের সবার কান্নার শব্দ হাহাকার করে উঠল।*

[* স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বলেশ্বরী নদীর তীর থেকে ফয়জুর রহমানের দেহাবশেষ। উদ্ধার করে জানাজা পড়িয়ে পিরোজপুরের কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।]

Exit mobile version