মাঝে মাঝে কারও ব্যাধি মৃত্যু বা শারীরিক লাঞ্ছনা, ছাড়া দিন এমনি করেই গড়িয়ে যাচ্ছিল। বন্দিদের ভেতরে নানা বয়সের ও স্বভাবের মেয়ে ছিল। চৌদ্দ পনেরো বছরের মেয়ে থেকে চল্লিশ বছরের যৌবনোত্তীর্ণ মহিলাও ছিলেন। কেউ প্রায় সব সময়েই কাঁদতো, কখনও নিরবে কখনো সুর করে, তবে জোরে না। আওয়াজ বাইরে গেলে কঠোর শাস্তি পেতে হতো। কেউ না কেঁদে শুধুই চুপ করে থাকতো। মনে হতো বোবা হয়ে গেছে। কেউ কেউ গল্প করতো, হাসাতেও। নিস্তরঙ্গ জীবনে এমনি মৃদু কম্পন কখনও কখনও অনুভূত হতো।
খাবার আসতো টিনের বাসনে। বেশির ভাগ সময়েই ডাল-রুটি অথবা তরকারি নামের ঘ্যাট-রুটির সঙ্গে দেওয়া হতো। ভাত কখনও দেয় নি। যে মেয়েলোকটা খাবার দিতো সে বলতো কার কি জাত, তাই গোশতো দেওয়া হয়না। মনে মনে হাসলাম কারণ শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত তো পড়ে ফেলেছি। বিশ বছর ঘর করা সহজ কিন্তু হেঁসেলে ঢুকতে দেওয়া বড় কঠিন কাজ। তাই বিছানায় নিতে বাধা নেই কিন্তু গোমাংসে বোধ হয় বাধা আছে। না, পাকিস্তানিদের যতোটা হৃদয়হীন ভাবতাম ওরা প্রকৃতপক্ষে তা নয়। নইলে এমন করে জাত বাঁচাবার মহানুভবতা দেখানো কি সোজা কথা? যাক যার যা জাত তা অন্তরে রেখে দাও। দেহ তো মহাজনের ভোগে উৎসর্গ হয়েছে।
প্রথম প্রথম বাইরের কোনও খবর পাই নি। কিন্তু এ জায়গাটায় এসে এমন একটা জমাদারণী পেলাম যে ফিসফিস করে অনেক খবর আমাদের বলতে। প্রথমে জানলাম জায়গাটার নাম ময়মনসিংহ। কাছেই কমলগঞ্জ নাকি এক গঞ্জে খুব যুদ্ধ। হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে। যুদ্ধ যে হচ্ছে সেটা টের পেলাম এই শয়তানদের কথাবার্তা থেকে। আমরা যারা প্রথম দিকে একসঙ্গে ছিলাম তারা কিন্তু একসঙ্গে নেই। একেক সময় একজন অথবা একাধিক জনকে বেছে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হতো। জানতামও না কে কোথায় যাচ্ছি, কেনই-বা যাচ্ছি। তবে আজকাল আমাদের ক্যাম্পের থেকেই গোলাগুলির শব্দ শোনা যেতো। ভাবতাম এদিক ওদিক হয় একটা হয়ে গেলেই হয়। হয় বাঁচবো না হয় মরবো, এমনভাবে মরে বেঁচে থাকার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেলেই বাঁচি।
একদিন হঠাৎ করে ভোররাতে সব কিছু ফেলে আমাদের জিপে করে কোথায় যেন নিয়ে গেল। যেখানে এলাম সেখানে কিছু তবু আর আমাদের জন্য কাঁচা বাঁশ ও দরজার বেড়া দেওয়া একটা বড় ঘর ও সঙ্গে টয়লেট। তবে বেড়ার ফাঁক দিয়ে বেশ আলো দেখা যায়। দিন-রাত বোঝা যায়। চারিদিকে নিঝুম মনে হয়, দিনের বেলা দিনের বেলা এখানে লোকজন প্রায় থাকেই না। কিন্তু রাঁধুনিটা বললো ওসব কথা মাথায় এনে পালাবার চেষ্টা করো না। জান খোয়া যাবে। ওরা একটু দূরেই গাছপালা দিয়ে ঝোঁপের মতো করে এখানেই থাকে। ওখান থেকেই তোপ দাগে। ভাবলাম তাহলে কি ওই হেডকোয়ার্টার মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে গেছে? আল্লাহ তাই যেন হয়। এখন সকাল-বিকাল বেশ শীত শীত করে, রাতে কম্বল পায়ে দিতে হয়। কখনও কখনও দিনেও ঠাণ্ডা লাগে। তাতে মনে হয় নভেম্বর বা ডিসেম্বর মাস হবে। ইস কতোদিন হয়ে গেল। এসেছি মে মাসে, আর আজ বছরের শেষ। আর কতো?
গোলাগুলির শব্দ প্রায় বন্ধ। রোজই রাতে ভারী ট্যাঙ্কের শব্দ পাই। মনে হয় এখান থেকেও জিনিসপত্র সরাচ্ছে। তাহলে যাচ্ছে কোথায়? কিন্তু না, সব আশা ব্যর্থ করে দিয়ে আবার আকাশ থেকে বোমা পড়ার শব্দ! কারা বোমা ফেলেছে? এ তো যুদ্ধ নয়, এক পক্ষই বোমা ফেলে চলেছে।
কোনও কথা কোথাও গোপন থাকে না। ফিসফিসানীর মাধ্যমে জানলাম ভারতীয়রা বোমা ফেলছে। কিন্তু ওরা কেন? আমরা আবার কার হাতে গিয়ে পড়বো? এ ক্যাম্পে একজন বয়স্ক হাবিলদার ছিল। প্রায় ষাটের কাছে বয়স। জাতিতে পাঠান হলেও লোকটার মনে মায়া মমতা আছে। আমার সঙ্গে কেন জানি না ভালো ব্যবহার করতো। আমি ভোগ্যপণ্য হলেও এতোদিন আমার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে। কিন্তু আজ তিনদিন ওকে খুবই গম্ভীর ও ভারাক্রান্ত দেখছি। সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম, খান সাহেব তোমার কি হয়েছে? বললো, পিয়ারী যুদ্ধ শেষ হয়ে এসেছে। খুশি হয়ে বললাম, এবার তাহলে তোমরা দেশে ফিরে যাবে? খুব আনন্দ হচ্ছে না? কিন্তু আমাকে কোথায় ফেলে যাবে? লায়েক খান মাথা নেড়ে জবাব দিলো, না বেগম, দেশে ফিরে যাবো না। তোমার দেশেই আমার কবর হবে। আমরা হেরে গেছি। কয়েক দিনের ভেতর হয় আমাদের মেরে ফেলবে, না হয় বন্দি কবে। মুক্তির হাতে পড়লে বাঁচবার কোনো আশা নেই। আনন্দে উত্তেজিত হলেও বুদ্ধিহারা হলাম না। বললাম, সায়েব আমাকে শাদি করো, আমি তোমাকে মুক্তির হাত থেকে বাঁচাবো। লায়েক খান বোকা নয়, মাথা নেড়ে বললো, তা হবে না বিবি। ওরা আমাদের একজনকেও রাখবে না। পাঠান পুত্র বিষাদভরা কণ্ঠে বললো, তাছাড়া তুমি বেঁচে যাবে। দেশওয়ালার সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে, ঘর বসাবে, সুখে থাকবে। তুমি খুব ভালো মেয়ে। দেখো আমার কথা সত্যি হবে।
এবার জিদ ধরলাম, মা তোমার আমাকে বিয়ে করতে হবে। কারণ জানতাম, এ না হলে আবার না জানি কাদের হাতে গিয়ে পড়বো। আমার সমাজ আমাকে নেবে না এ আমি জানি। কারণ যেদিন ধরে এনেছিল সেদিন যখন কেউ এগিয়ে আসে নি আজও কেউ হাত ধরে নিয়ে যাবে না। কিন্তু বাবা, বড় ভাইয়া, লালু ওরা আসবে না। হঠাৎ দেখি আমার দু’গাল বেয়ে চোখের জলে বন্যা নেমেছে আর পিতৃস্নেহে লায়েক খান আমাকে কাছে নিয়ে চোখের জল মুছে দিচ্ছে। কাছে নিয়ে বললো, ঠিক আছে, এখন তো যুদ্ধ শেষ। ক্যাম্পের মৌলবী সাহেবকে বলে দেখি যদি রাজি হয়। আর কেউ জানবে না, শুধু তুমি আমি আর মৌলবী সাহেব।