Site icon BnBoi.Com

দ্য পার্ল – জন স্টেইনবেক

দ্য পার্ল

 

দ্য পার্ল

 

দ্য পার্ল – জন স্টেইনবেক

হতদরিদ্র মুক্তো-ডুবুরি কিনো। বেচারা পয়সার অভাবে একমাত্র সন্তানের সুচিকিৎসা করাতে পারছে না। এমনি যখন অবস্থা, হঠাৎ করেই অপূর্ব সুন্দর এক মূল্যবান মুক্তো পেয়ে গেল ও, সাগরে ডুব দিয়ে। মুক্তো পেয়ে নানান রকমের রঙীন স্বপ্নে ছেয়ে গেল ওর অন্তর। ও ভাবছে, আর সবাইও বুঝি ওর মতই আনন্দে আত্মহারা। কিন্তু আসলেই কি তাই? সমাজে সব মানুষই কি কিনোর মত সরল আর সাদাসিধে? কুটিল চরিত্রের মানুষ কি নেই?

কিনোর মুক্তো মুখোশ খুলে দিল সমাজপতিদের।

——

০১. কাক ভোরে ঘুম ভাঙল কিনোর

কাক ভোরে ঘুম ভাঙল কিনোর। আকাশে তখনও তারাদের ঝিকিমিকি। সবে কুকুরুকু শুরু করেছে মোরগের পাল, আর শুয়োরগুলো ছোঁক ছোঁক করছে খাবারের খোঁজে। কাঠের ছোট বাসাটার বাইরে, ঝোপে-ঝাড়ে পাখিদের কলগুঞ্জন আর ওড়াওড়ি।

চোখ মেলল কিনো। দরজা দিয়ে চুইয়ে ঢোকা আলোর ম্লান রশ্মির উদ্দেশে চেয়ে রইল। এরপর ওর নজর গেল বাক্সটার দিকে, ওর ছেলে কয়োটিটো যেখানে ঘুমোচ্ছ। ছাদ থেকে টানা রশিতে ঝুলছে বাক্সটা। সবার শেষে কিনোর দৃষ্টি গেল হুয়ানা, অর্থাৎ ওর স্ত্রীর দিকে। মাদুরে ওর পাশে শুয়ে রয়েছে হুয়ানা। শালটায় তার পুরো শরীর আর মুখের অর্ধেকখানি ঢাকা পড়েছে। হুয়ানার চোখ দুটো খোলা। কিনো ঘুম ভেঙে কোনদিনই স্ত্রীর চোখ বোজা দেখেনি। চোখ তো নয় খুদে খুদে তারা যেন দুটো। চেয়ে চেয়ে কিনোর ঘুম ভাঙ্গা দেখছিল ও।

সাগরতীরে ঢেউ ভাঙছে শুনতে পাচ্ছে কিনো। নিস্তব্ধ প্রহরে, তরঙ্গের আছড়ে পড়ার শব্দ মধুর সঙ্গীত হয়ে বাজল ওর কানে। বাতাসে ঠাণ্ডার বেজায় দাপট, ফলে নাক পর্যন্ত কম্বল টেনে রেখেছে কিনো। ঘাড় কাত করে হুয়ানার দিকে চাইল ও। নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছে সে। ঝুলন্ত বাক্সটার কাছে এগিয়ে গেল এবার। ঝুঁকে পড়ে আদর করল বাচ্চাকে। মুহূর্তের জন্যে চোখ মেলল কয়েটিটো, তারপর আবার বুজে ফেলে ঘুমোতে লাগল।

ছোট্ট চুলোটার কাছে চলে এল হুয়ানা। এক খণ্ড কয়লা ফেলে দিতে থাকল, অাগুন যতক্ষণ না ধরল ওটায়। এবার আগুনে খড়ি জুগিয়ে দিল। সটান উঠে দাঁড়িয়েছে কিনো, কাঁধ-মাথা মুড়ে নিয়েছে কম্বলে। পায়ে স্যান্ডেল গলিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। ঠায় দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় লক্ষ্য করল সে।

একটু পরে, দরজার বাইরে গুটিসুটি মেরে বসে পড়ে, কম্বলটা টেনে টুনে হাঁটু ঢাকল। সাগরের ও-ই উঁচুতে ঝুলে থাকা লালচে মেঘরাজি দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে ওর। একটা নধর ছাগল কাছিয়ে এসে কৌতূহলী চোখে কিনোকে লক্ষ্য করছে। কিনোর পেছনে, উজ্জ্বল আলো বিলোচ্ছে আগুন। আগুনের শিখা আর আভা দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে পাচ্ছে সে। ছোট্ট বাড়িটার ফাঁক-ফোকর গলেও অগ্নিস্ফুলিঙ্গ দেখা যাচ্ছে। নাস্তার জন্যে কর্নকেক তৈরি করতে ব্যস্ত হুয়ানা।

সূর্যটা হঠাৎ ফুঁড়ে বেরোল সাগরের বুক চিরে। জ্বলন্ত ভাস্কর চোখ ঢাকতে বাধ্য করল কিনোকে। কর্নকেকের সুঘ্রাণ নাকে আসছে ওর। হাড় জিরজিরে, সন্ত্রস্ত এক কুকুর কিনোর পাশে এসে জবুথুবু হয়ে শুয়ে পড়ল। অদ্ভুত সুন্দর এক ভোর, আর দশটা ভোরের মতই।

হুয়ানা কয়েটিটোকে বাক্স থেকে তুলে নিচ্ছে, তার আওয়াজ পেল কিনো। বাচ্চাটাকে মুখ ধুইয়ে নিজের শাল দিয়ে মুড়িয়ে দিল হুয়ানা। বাচ্চাকে বুকের কাছে ধরে এখন দুধ পান করাচ্ছে। এসব খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলো দেখতে হয় না, এমনিতেই বুঝতে পারে কিনো। পুরানো এক গান ধরেছে হুয়ানা। অনেক রকম ভাবে এ গানটা গাইতে পারে ও। কি যেন এক আশ্চর্য প্রশান্তি আছে গানটার মধ্যে, এ গান শুনলে কিনো আশ্বস্ত বোধ করে; কয়োটিটোও কান্না ভুলে যায়।

কিনোর বাসা ঘিরে কাঠের বেড়া। বেড়ার ওপাশে আরও কিছু ঘরবাড়ি। ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে, নাস্তার আয়োজন চলছে শব্দে টের পাওয়া যায়। কিন্তু এ শব্দগুলোর সঙ্গে কিনোর বাসার নিত্যকার শব্দের বিস্তর ফারাক। ওর পড়শীদের বউদের সাথেও অবশ্য হুয়ানার কোন মিল নেই।

ঠাণ্ডা খানিকটা কমে এসেছে, ফলে মাথা থেকে কম্বলের ঘোমটা সরাল কিনো। রীতিমত শক্তিশালী এক যুবক সে। কালো চুল ঝুলে পড়ে ওর বাদামী কপাল ছুঁয়েছে। কঠোর, উজ্জ্বল একজোড়া চোখ ওর, পুরু গোঁফ।

সূর্যের হলদে আলো এসে পড়েছে বাড়িটার ওপর। কাঠের বেড়াটার কাছে, মোরগ লড়াই বেধে গেছে। এক মুহূর্ত মোরগ দুটোকে লক্ষ্য করল কিনো। এবার ওর দৃষ্টি কাড়ল পর্বতমালার উদ্দেশে উড়ে-যাওয়া পাখির ঝাঁক। ঘুম ভেঙে জেগে উঠছে পৃথিবী। সিধে উঠে দাঁড়িয়ে ছোট্ট বাসাটার ভেতর গিয়ে ঢুকল কিনো।

চুলোর কাছে বসে ছিল হুয়ানা। কিনোকে ঘরে ঢুকতে দেখে উঠে পড়ল। কয়েটিটোকে তার দোলনায় শুইয়ে দিল আবার। এবার কালো চুল আঁচড়ে নিয়ে, সবুজ রঙের চিকন রিবন দিয়ে পেছনে বেঁধে রাখল।

কিনো চুলোর ধারে বসে গরম গরম কর্নকেক খাচ্ছে। নাস্তায় কর্নকেক আর দুধ ছাড়া অন্য কিছু খায় না সে। ওর খাওয়া শেষ হলে, হুয়ানা এল চুলোর কাছে। নাস্তা করতে বসল ও। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই সুখী, পরিতৃপ্ত। কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছে না কেউ।

কাঠের খুদে বাড়িটা ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে, রোদের তেজ বাড়াতে। দেয়ালের ফুটো দিয়ে আলোর ছটা ঘরে এসে পড়ছে। কয়েটিটোর গায়েও সূর্যকিরণ এসে পড়েছে। দোলনায় নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে বাচ্চাটা। হঠাৎ দেখা গেল কি যেন একটা দড়ি বেয়ে নেমে আসছে। কিনো আর হুয়ানা মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থেকে লক্ষ্য করছে ওটাকে। একটা কাঁকড়া বিছে, লেজটাকে পেছনে খাড়া করে রেখেছে। লেজের আগা দিয়ে দংশন করলে আর রক্ষে নেই, নিশ্চিত মৃত্যু। কাউকে কামড় দিতে চাইলে বিছে তার মাথার ওপর দিয়ে ভাঁজ করে আনে লেজটাকে।

নাক দিয়ে ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাস পড়ছিল কিনোর, শব্দটা বন্ধ করার জন্যে মুখ খুলল ও। রশি বেয়ে ধীরেসুস্থে নেমে আসছে সাক্ষাৎ যম, এগোচ্ছে দোলনাটার উদ্দেশে। নীরবে প্রার্থনা করতে শুরু করেছে মা। নিঃসাড়ে ঘর পেরিয়ে এদিকে চলে এল কিনো, দুহাত সামনে বাড়িয়ে। দৃষ্টি স্থির ওর কাকড়াবিছেটার ওপর। বিছেটার নিচে, ঝুলন্ত বাক্সে, হেসে উঠে শূন্যে হাত তুলে দিল কয়োটিটো। হাতটা লক্ষ্য করে থমকে গেল শিকারী। মাথার ওপর দিয়ে লেজটা মুড়ে আনছে ওটা। লেজের ডগায় হুলটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে কিনো।

স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে থেকে, ধীরে, অতি ধীরে হাতটা বাড়াল ও। বিছেটার লেজ ভাজ খেয়েছে আবারও। ঠিক সে মুহূর্তে, কিনোর হাত দড়ি স্পর্শ করতে খসে পড়ল ওটা। ঝটিতি থাবা মারল কিনা, কিন্তু বিছেটা ওর আঙুল ফাঁকি দিয়ে, সোজা গিয়ে বাচ্চাটার কাঁধের ওপর পড়ল। আর যায় কোথায়, সঙ্গে সঙ্গে দংশাল কয়োটিটোকে।

পশুর মত গর্জন ছাড়ল কিনো। বিছেটাকে তুলে নিয়ে চেপে ধরল দুহাতের তালুতে। তারপর মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পিটিয়ে মারল। ওদিকে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে তখন কয়েটিটো।

বাচ্চাকে কোলে তুলে নিল হুয়ানা। লাল ক্ষতটা খুঁজে নিয়ে মুখ রাখল ওখানে, চুষছে। যতখানি সম্ভব বিষ বের করে থুথু দিয়ে মেঝেতে ফেলল।

মা আবার জখমে মুখ দিতে আর্তচিৎকার করতে লাগল কয়েটিটো। কিনো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। আর কিইবা করার আছে তার।

বাচ্চাটার কান্নার শব্দ কানে যেতে পড়শীরা বেরিয়ে এল যার যার বাড়ি থেকে। কিনোর ভাই, হুয়ান টমাস, তার ইয়া মোটা স্ত্রী অ্যাপোলোনিয়া আর চার সন্তানকে নিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল। প্রতিবেশীরা সবাই ঘরের ভেতর উঁকিঝুঁকি মারছে। ছোট এক ছেলে এক পড়শীর দুপায়ের ফাঁক দিয়ে কি হচ্ছে দেখার চেষ্টা করছে। সামনের লোকেরা ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছে পেছনের লোকেদের।

বিছে! বলল তারা। বাচ্চাটাকে বিছেয় কামড়েছে!

মুহূর্তের জন্যে ক্ষতস্থান থেকে মুখ সরাল হুয়ানা। লালচে জখমটা ক্রমেই বড় হচ্ছে। উপস্থিত সবাই কাঁকড়াবিছেকে হাড়ে হাড়ে চেনে। বিছের দংশনে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে বড় মানুষ, কিন্তু সহজেই মারা পড়তে পারে শিশুরা। জখম প্রথমটায় বড় হতে থাকে, তারপর শুরু হয় জ্বর আর পেট ব্যথা।

কামড়ের ব্যথাটা কমে যাচ্ছে। এখন আর চেঁচামেচি করছে না কয়োটিটো, নীরবে কাঁদছে। হুয়ানা ছোটখাট হলেও শক্ত ধাঁচের মহিলা। খেয়ে না খেয়ে প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে পারে। অসুখ হলে কক্ষনো ডাক্তার ডাকতে বলে না। কিন্তু এমুহূর্তে বড় অদ্ভুত এক কাণ্ড করল ও।

ডাক্তার, বলল। যাও, ডাক্তার নিয়ে এসো।

০২. ডাক্তার আসবে না

ডাক্তার আসবে না, দরজায় দাঁড়ানো প্রতিবেশীরা বলল।

না, হুয়ানাকে বলল কিনে। ডাক্তার আমাদের এখানে আসবে না।

হুয়ানা কিনোর দিকে চাইল। ওর চোখজোড়া শীতল, নিস্পৃহ। কয়েটিটো হুয়ানার প্রথম সন্তান। তার সাত রাজার ধন মানিক।

তাহলে আমরাই যাব, বলল সে। শালের এক প্রান্ত দিয়ে মাথা ঢাকল হুয়ানা। শালের অন্য কিনারা রাখল

বাচ্চাটার চোখের ওপর। দোরগোড়ায় সমবেত মানুষগুলো পেছনে চেপে দাঁড়ালে হুয়ানা বেরিয়ে পড়ল। কিনো আর হুয়ানা গেট পেরিয়ে ছোট পথটা ধরল। ওদের অনুসরণ করছে পড়শীরা। কিনো আর হুয়ানার সাথে তারাও ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে।

শহরের প্রাণকেন্দ্রে দ্রুত পা চালিয়ে চলে এল ওরা। মাটিতে কালো কালো ছায়া ফেলেছে জ্বলন্ত সূর্য। সমস্ত লোকজন আর তাদের কালো ছায়ারা শহরের উদ্দেশে হনহন করে এগিয়ে চলেছে।

কাঠের ছোট বাসাগুলো ছাড়িয়ে পাথুরে বাড়ি শুরু হয়েছে, সেখানে এসে হাজির হলো দলটা। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড দেয়াল ঘেরা বাগান রয়েছে শহরের এ অঞ্চলে। দেয়ালের ওপর লটকে রয়েছে নানা রকমের লাল, সাদা ফুল। বাগানে খাচাবন্দী পাখিরা গান গাইছে, শুনতে পাচ্ছে হুয়ানা অার কিনো।

গরীব মানুষগুলো স্কয়্যার পেরিয়ে, গির্জার সামনে দিয়ে হেঁটে এসেছে। অনুসরণকারীর সংখ্যা ইতোমধ্যে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। সবার মুখে কয়োটিটো আর বিছের কামড়ের কথা। জনতা জানে ওরা স্বামী-স্ত্রী বাচ্চাটাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছে।

গির্জার সামনে বসে থাকা ভিখিরির দল কিনো আর হুয়ানার দিকে চেয়ে ছিল। হুয়ানার নীল রঙা শতচ্ছিন্ন স্কার্ট, আর অসংখ্য ফুটোঅলা শালটা দেখেছে ওরা। কিনোর ছেড়া কম্বলটার দিকেও তাদের কৌতূহলী দৃষ্টি ছিল। লোকটা গরীব, স্পষ্ট বোঝা যায়। দেখি তো কি হয়, এই ভেবে ভিখিরিরাও পিছু নিয়েছে ওদের।

শহরের নাড়ী-নক্ষত্র ভিখিরিগুলোর জানা। ছোট-বড় সমস্ত অপরাধের খুঁটিনাটি তাদের নখদর্পণে। গির্জার বাইরে ঘুমায় ওরা। ওদের অজান্তে এ শহরে কিছুই ঘটার জো নেই।

ভিখিরিরা ডাক্তারটিকেও চেনে। সে যে কী চিজ ভাল করেই জানা আছে তাদের। লোকটা টাকা ছাড়া দুনিয়ায় আর কিছু বোঝে না। রোগীর রোগ সারাতে পারে না লোকটা, তাও তাদের জানা। গির্জার ভেতর লাশগুলো ওদের নাকের ডগা দিয়েই তো ঢোকে।

গির্জায় এখন কেউ নেই। টাকাঅলা কেউ গির্জায় ঢোকেনি, ব্যবসা মন্দা, ফলে কিনো আর হুয়ানাকে অনুসরণ করছে ভিখিরিরা। কুড়ের হদ্দ, মোটা ডাক্তারটা কি চিকিৎসা দেয় বাচ্চাটিকে জানতে আগ্রহী ওরা।

ডাক্তারের বাড়ির প্রকাণ্ড ফটকটার কাছে এসে থেমেছে জনতা। বাড়ির ভেতর থেকে রান্নার সুঘ্রাণ ভেসে আসছে। কিনোর মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে ডাক্তারটির কথা।

লোকটা কিনোর স্বগোত্রীয় নয়। প্রায় চারশো বছর ধরে কিনোর গোত্রের ওপর লুটপাট আর অত্যাচার চালাচ্ছে ডাক্তারের গোত্র। প্রচণ্ড ক্রোধ আর ভীতি অনুভব করে কিনো, যখনই প্রতিপক্ষের কারও সামনাসামনি হয়। কিনো অনুভব করছে, কথা বলার চাইতে বরং ডাক্তারটিকে খুন করাই সহজ হবে তার পক্ষে। ডাক্তারের গোত্রের লোকেরা এমনভাবে কিনোর গোত্রের মানুষদের সাথে কথা বলে, তারা যেন জন্তু-জানোয়ার।

দরজায় টোকা দিতে ডান হাত তুলল কিনো। ভেতর ভেতর রাগ ফেনিয়ে উঠছে ওর। ঠোঁটজোড়া পরস্পরের সাথে শক্ত হয়ে চেপে রয়েছে, কিন্তু তারপরও বাঁ হাতে হাট খুলে নিল ও। গেটে টোকা দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল কিনো। হুয়ানার কোলে ডুকরে কেঁদে উঠল কয়োটিটো। মৃদু কণ্ঠে বাচ্চার সাথে কথা বলল হুয়ানা। জনতা কাছিয়ে এল কি হয় দেখতে। শুনতেও।

মুহূর্ত পরে, মস্ত গেটটা কইঞ্চি ফাঁক হলো। গেট যে খুলেছে সে কিনোর এক জ্ঞাতি ভাই। ইন্ডিয়ান ভাষায় তার সাথে কথা বলল কিনো।

আমার বাচ্চাটাকে, বলল কিনো। বিছেয় কামড়েছে।

গেট লেগে যেতে শুরু করল। কিনোর জ্ঞাতি ভাই, অর্থাৎ কাজের লোকটা, ইভিয়ান ভাষায় কথা বলতে গররাজি।

একটু দাঁড়াও, স্প্যানিশে বলে গেটটা লাগিয়ে দিল লোকটা। সাদা দেয়ালে ছায়া পড়েছে জনতার।

নিজের কামরায় বিছানার ওপর বসে ছিল ডাক্তার। লাল সিঙ্কে তৈরি ড্রেসিং গাউন তার পরনে। কাপড়টা এসেছে প্যারিস থেকে। সুদৃশ্য কাপ থেকে গরম চকোলেট পান করছে লোকটা। আলতো হাতে কাপটা ধরে রয়েছে সে। অসন্তুষ্ট দেখাচ্ছে তাকে।

ডাক্তারের পাশে, টেবিলে খুদে এক কলিং বেল আর কিছু সিগারেট। কামরার আসবাবপত্র, পর্দা সবই ভারী আর কালচে। ঘরে লটকানো ছবিগুলো ধর্মের বাণী প্রচার করছে। তবে বিশাল এক রঙীন ছবিও রয়েছে। ডাক্তারের স্ত্রীর। ভদ্রমহিলা মারা গেছেন।

ডাক্তার আরেক কাপ চকোলেট পান করল, একটা বিস্কুট মুখে দিল। গেট খুলতে-যাওয়া লোকটা খোলা দরজার কাছে এসে অপেক্ষা করছে।

কি? ডাক্তার বলল।

বাচ্চা নিয়ে এক ইন্ডিয়ান এসেছে, বলল লোকটা। বাচ্চাটাকে বিছেয় কামড়েছে।

ডাক্তার ধীরে ধীরে কাপটা নামিয়ে রাখল, খেপে উঠছে সে।

ইন্ডিয়ানদের বাচ্চাদের ভাল করা ছাড়া আর কি কোন কাজ নেই আমার? গর্জে উঠল। আমি কি পশুর ডাক্তার?

এবার দুমুহূর্ত কি যেন ভেবে নিয়ে আবার বলল, ইডিয়ানদের কাছে পয়সা থাকে না। যাও, গিয়ে দেখে এসো ওর কাছে আছে কিনা।

যাই, স্যার।

কাজের লোকটা গেট সামান্য ফাঁক করে অপেক্ষমাণ জনতার উদ্দেশে চাইল। এবার ইন্ডিয়ান ভাষায় কথা বলল লোকটা।

তোমার টাকা আছে? জানতে চাইল।

কম্বলের নিচে হাত দিল কিনো। বের করে আনল এক টুকরো কাগজ। কাগজটা আস্তে আস্তে খুলল ও, লোকটা যাতে মুক্তো আটখানা দেখতে পায়। ধূসর, হতশ্রী মুক্তোগুলো প্রায় মূল্যহীন। ওগুলো হাতে নিয়ে গেটটা ফের বন্ধ করল ভূত্য। খুব দ্রুত ফিরে এল সে এবার। গেট খুলে মুক্তো ফিরিয়ে দিল কিনোর হাতে।

ডাক্তার বাসায় নেই, বলল। রোগী দেখতে চলে গেছেন। লজ্জিত বোধ করছিল, তাই ঝট করে গেট বন্ধ করে দিল লোকটা।

উপস্থিত সব লোক লজ্জায় অধোবদন, তারা কেউ কিনোকে সাহায্য করতে পারছে না। ধীরে ধীরে সরে পড়তে লাগল জনতা। গির্জার সিড়িতে ফিরে গেল ভিখিরির দল। বাড়ি ফিরে গেল কিনোর বন্ধু-বান্ধবরা। কিনো আর হুয়ানার কথা এবং লজ্জাবোধ ভুলে যেতে চেষ্টা করল তারা।

গেটটার সামনে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল স্বামী-স্ত্রী। ধীরেসুস্থে মাথায় হ্যাটটা চাপাল কিনো। তারপর আচমকা দুম করে এক ঘুসি মেরে বসল গেটের গায়ে। চোখ নামাতে, আঙুলের ফাঁক গলে রক্ত গড়াতে দেখল ও। অবাক হয়ে গেল কিনো।

০৩. মুক্তো-ডুবুরিদের কাঠের বাসাগুলো

মুক্তো-ডুবুরিদের কাঠের বাসাগুলো সাগরতীরের কাছে, শহরের ডান প্রান্তে। বাড়িগুলোর সামনে ক্যানু রয়েছে। কিনো হুয়ানাকে নিয়ে শ্লথ পায়ে নিজেদের ক্যানুর কাছে এল। যাবতীয় সম্পত্তির মধ্যে ক্যানুটাই কিনোর সবচাইতে মূল্যবান সম্পদ। ক্যানুটা বহু পুরানো। কিনোর বাপ-দাদার ছিল ওটা। উত্তরাধিকার সূত্রে এখন জিনিসটা কিনোর।

যার ক্যানু আছে তার না খেয়ে মরার ভয় নেই। প্রতি বছর ক্যানুটায় প্রলেপ মাখায় কিনো, ওর বাবা শিখিয়েছিল। ক্যানুর বাইরেটায় প্রলেপ ক্রমান্বয়ে শক্ত হয়ে, ওটাকে শক্তিশালী আর নিরাপদ করে তোলে।

ক্যানুর তলদেশে ডাইভিং স্টোন, ঝুড়ি আর দড়ি নামিয়ে রাখল কিনো। তারপর কম্বলটা ভাঁজ করে সেটাও রাখল।

ব্লাঙ্কেটে কয়োটিটোকে শোয়াল হুয়ানা। শাল দিয়ে ঢেকে দিল বাচ্চাটাকে, রোদে যাতে কষ্ট না পায়। কয়োটিটো এখন শান্ত। কিন্তু ক্ষতস্থানটা ওর ক্রমেই আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে, হুয়ানা লক্ষ্য করল বিষ ঘাড়ের কাছে উঠে কানের লতি অবধি পৌঁছে গেছে। কয়েটিটোর মুখের চেহারায় তপ্ত আর লালচে ভাব।

কিছু বাদামী রঙের উদ্ভিদ সাগরের পানি থেকে জোগাড় করে, বাচ্চাটার কাঁধের ওপর রাখল হুয়ানা। এই উদ্ভিদের উপকারিতা ডাক্তারের ওষুধের চাইতে কোন অংশে কম নয়। কিন্তু যেহেতু পয়সা লাগে না, লোকের এর ওপর বিশ্বাস নেই।

পেটের ভয়ানক ব্যথাটা এখনও ধরেনি কয়োটিটোকে। হুয়ানা হয়তো সময় মত বিষটুকু টেনে নিতে পেরেছিল। কিন্তু সে এখনও তার একমাত্র সন্তানের জন্যে উদ্বিগ্ন। হুয়ানা সরাসরি খোদার কাছে কয়োটিটোর জন্যে প্রার্থনা করেনি। তার বদলে, ঘুরপথে দোয়া করেছে, কিনো যাতে একটা মুক্তো খুঁজে পায়। তখন ডাক্তারের ফী মেটাতে পারবে ওরা।

কিনো আর হুয়ানা ক্যানুটা ঠেলে বেলাভূমি থেকে পানিতে নামাল। এবার ওতে চড়ে বসল হুয়ানা এবং নৌকার পেছন দিকে ধাক্কা দিল কিনো।

ক্যানুর পাশে পাশে পানিতে হাঁটল কিনো, ওটা যতক্ষণ না চড়াও হলো খুদে খুদে ঢেউয়ের মাথায়। এরপর কিনো আর হুয়ানা বৈঠা মেরে সামনে বাড়াল ওটাকে। পানি কেটে তরতর করে এগোল ক্যানু। অন্যান্য মুক্তো-ডুবুরি আগেই চলে গেছে সাগরে। কমুহূর্ত বাদেই, মুক্তো খেতের আশপাশে তাদের দেখতে পেল কিনো।

কিনোর সাথে দুটো দড়ি। ভারী এক পাথরে বাঁধা রয়েছে একটা। আর অপরটা বাঁধা এক ঝুড়িতে। শার্ট, প্যান্ট খুলে নিল কিনো, ক্যানুর তলদেশে হ্যাটটার সঙ্গে রেখে দিল ওগুলো। পানি এখানে তেলের মত মসৃণ। এক হাতে পাথর নিল কিনো, অপর হাতে ঝুড়ি। ক্যানুর এক পাশ দিয়ে পা দুখানা নামিয়ে দিতে, পাথরটা টেনে ওকে নামিয়ে নিল সাগরতলে। কিনোর পেছনে বুদ্বুদ উঠল, পানি যতক্ষণ না পরিষ্কার হয়ে দৃশ্যমান হলো, উঠতেই থাকল। চোখ তুলে চাইল ও। সাগরের পানি আয়নার মত ঝকঝকে। ক্যানুর নিচটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ও।

সাবধানে নড়াচড়া করছে কিনো, পানি যেন কাদা আর বালিতে ঘোলাটে হয়ে না পড়ে। ওর পাথরটার গায়ে পা রাখল। দ্রুত কাজ করে সাগরতল থেকে ঝিনুক টেনে তুলছে কিনা।

কিনোর গোত্রের লোকজন, বর্তমানে অস্তিত্ব আছে কিংবা অতীতে ঘটে গেছে, এমন সব বিষয় নিয়ে গান গায়। মাছ, উত্তাল সাগর, শান্ত সাগর, আলো, আঁধার, চাঁদ, সূর্য-এ সবই তাদের গানের উপজীব্য। সবাই গাইতে জানে এ গানগুলো। ঝুড়ি ভরার সময়, কিনোর মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগল সাগরের নানা গান। দম বন্ধ করে রেখেছে কিনো, শুনতে পাচ্ছে নিজের হৃৎস্পন্দন।

আশপাশ দিয়ে ছোট ছোট মাছ সাঁতরে যাচ্ছে, তাই দেখে আরেকটা গান মনে পড়ল কিনোর। এ গানটি হচ্ছে যদি লেগে যায়। কারণ ঝুড়িতে ও যে ঝিনুকগুলো ছুঁড়ে দিচ্ছে, তার কোনটার মধ্যে মুক্তো আছে কে বলতে পারে। কপাল ভাল হলে লেগেও যেতে পারে। কিনো জানে হুয়ানা মাথার ওপর ক্যানুতে বসে দোয়া-দরুদ পড়ছে। সে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছে তার স্বামী যেন মস্ত বড় এক মুক্তো আবিষ্কার করে, কয়োটিটোর জন্যে যাতে ওষুধ কিনতে পারে।

কিনো পানির নিচে দুমিনিটেরও বেশি থাকতে পারে, এ নিয়ে তার গর্বের শেষ নেই। ঝিনুকের খোলগুলো শক্ত হয়ে এঁটে রয়েছে, কিনো যে নাড়াচাড়া করছে ওগুলোকে, তাই। কিনার সামান্য ডান ঘেঁষে, ছোট্ট এক পাথুরে টিলা ছেয়ে রয়েছে খুদে ঝিনুকে। তবে এগুলো এখনও আহরণের উপযোগী হয়ে ওঠেনি। এবার কিনোর চোখ পড়ল, কাছেই ছোট্ট এক পাথরের পাশে। ইয়া বড় এক ঝিনুক পড়ে আছে ওখানে।

ওটার খোলটা ঈষৎ ফাঁক হয়ে রয়েছে লক্ষ্য করল। ভেতরে, চকচক করে উঠল কি যেন, এবং তার পরমুহূর্তে ঝট করে লেগে গেল খোল। পাথর থেকে লাথি মেরে পা দুটো ছাড়াল কিনো। পানির ওপর উঠে এল ঝিনুক নিয়ে, সূর্যালোকে ঝিকিয়ে উঠছে কালো চুল। ক্যানুর পাশ দিয়ে একটা বাহু নামিয়ে ঝিনুকটা তলদেশে রেখে দিল সে।

কিনো ওঠার সময় হুয়ানা নৌকাটাকে স্থির রাখল। উত্তেজনায় চকচক করছে কিনোর চোখজোড়া, পাথরটা আস্তে আস্তে টেনে তুলল সে। এবার ঝিনুক ভর্তি ঝুড়িটা টেনে তুলে নিল। কিনোর উত্তেজিত ভাব-ভঙ্গি লক্ষ্য করল ওর বউ। হুয়ানা এমন ভান করছে, বড় ঝিনুকটা যেন চোখেই পড়েনি। হুয়ানা বিশ্বাস করে, মনপ্রাণ দিয়ে কিছু চাইলে, ভাগ্য মুখ ফিরিয়ে নেয়। কিনো ধীরেসুস্থে তার ছোট, শক্তপোক্ত ছোরাটার ফলা বের করল। শ্বাস আটকে বসে রইল হুয়ানা। ঝুড়িটার দিকে চিন্তামাখা চোখে চেয়ে রইল কিনো। সবার শেষে হয়তো বড় ঝিনুকটা খুলবে, ভাবল হুয়ানা। খুদে এক ঝিনুক নিয়ে মাংস কাটল ও, ভেতরটা পরখ করল। তারপর ছুঁড়ে ফেলে দিল সাগরে।

এবার বড় ঝিনুকটার দিকে চাইল ও। ক্যানুর তলদেশে বসে, ঝিনুকটা হাতে নিয়ে দীর্ঘক্ষণ চেয়ে রইল ওটার দিকে। কালো-বাদামী আলো ঝিকোচ্ছে ঝিনুকটা থেকে। কিনো এখন অনুভব করছে ঝিনুকটা সে খুলতে চাইছে না। ভেতরে চকচকে যে জিনিসটা ওর নজরে পড়েছিল সেটা হয়তো খোলেরই একটা অংশ। পানির নিচে, মানুষ অবাস্তব কত কিছুই তো দেখে।

হুয়ানার দুচোখ কিনোর ওপর স্থির, তর সইছে না তার। কয়োটিটোর ঢেকে রাখা মাথার ওপরে একটা হাত রাখল ও।

খুলে ফেলো, মৃদু স্বরে বলল। কিনো চট করে ছোরা ঢোকাল খোলের মধ্যে। ঝিনুকটা বুজে যেতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু কিনো জোর খাটাতে খুলে গেল। দেহটা নড়ে উঠে নিথর হয়ে গেল ঝিনুকটার। মাংসটুকু তুলে ফেলতে ভেতরে পাওয়া গেল প্রকাণ্ড এক মুক্তো। সূর্যের ছটা পড়ে রুপালী দ্যুতি ঠিকরাচ্ছে মুক্তোটা। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় মুক্তো এটা।

শ্বাসরুদ্ধ হুয়ানা অস্ফুট শব্দ করে উঠল। মুক্তোর গান তখন জোরালো সুরে বাজছে কিনোর মাথার মধ্যে। চকচকে মুক্তোটা কিনোর সব স্বপ্ন সত্যি করবে। ঝিনুক থেকে মুক্তোটা বের করে তালুতে ধরে রইল ও। উল্টেপাল্টে অনিন্দ্যসুন্দর জিনিসটা পরখ করছে সে। হুয়ান একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে কিনোর হাতের দিকে। ওই হাতটাই আঘাত হেনেছিল পাষাণ ডাক্তারটার বাড়ির গেটে। সাগরের নোনা পানি লেগে এখন ধূসর-সাদা রং ধারণ করেছে জখমি জায়গাটা।

সাত-পাঁচ না ভেবেই, কয়োটিটোর কাছে গেল হুয়ানা, বাবার কম্বলে শুয়ে রয়েছে বাচ্চাটা। ঔষধি তুলে ফেলে কাটা পরীক্ষা করল ও।

কিনো, চেঁচিয়ে উঠল সহসা।

কিনো চোখ তুলে চাইতে লক্ষ্য করল, কাঁধ থেকে মিলিয়ে যাচ্ছে বিষ; চলে যাচ্ছে কয়েটিটোর দেহ থেকে। কিনোর হাত এবার মুঠো করে ধরল মুক্তোটা। মাথাটা পেছনে ঝটকা দিয়ে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল সে। চোখ ঘুরছে, দেহ আড়ষ্ট, আকাশের দিকে মুখ তুলে চিৎকার করছে কিনো। অন্যান্য ক্যানুর লোকেরা হাঁ করে চেয়ে রইল ওর দিকে। তারপর দ্রুত বৈঠা। মেরে চলে এল এদিকে।

০৪. বাতাসের গতিতে চাউর হয়ে যায় খবর

বাতাসের গতিতে চাউর হয়ে যায় খবর।

কিনো, হুয়ানা আর অন্যান্য ডুবুরিরা কিনোর খুদে কাঠের বাসাটায় এল, ততক্ষণে রাষ্ট্র হয়ে গেছে কিনো দুনিয়ার সবচেয়ে বড় মুক্তোটা খুঁজে পেয়েছে। বাচ্চারা বলতে পারার আগেই তাদের মায়েরা খবর জেনে বসে আছে।

কাঠের বাড়িগুলোতে তো বটেই বড়লোকদের পাথরের বাড়িতেও ছড়িয়ে গেছে সংবাদটা। পাদ্রীর কানে কথাটা যেতেই, গির্জার মেরামতির চিস্তা ঘাই মারল তার মাথায়। মুক্তোটার মূল্য কত হতে পারে ভাবনা চলল মগজে। কিনো কখনও কয়োটিটোকে গির্জায় নিয়ে এসেছিল কিনা মনে করার চেষ্টা করলেন। আচ্ছা, কিনো আর হুয়ানার বিয়ে কি পড়িয়েছিলেন তিনি?

দোকানদারদের কানে মুক্তোর খবর পৌঁছলে, অবিক্রিত জিনিসপত্রের দিকে প্রথমেই আশান্বিত দৃষ্টি চলে গেল তাদের।

বলাবাহুল্য, ডাক্তারের কানেও খবরটা গেছে। বৃদ্ধা এক মহিলার চিকিৎসা করছিল তখন সে। মহিলার রোগ আর কিছু না, বার্ধক্যজনিত; কিন্তু ডাক্তার সে কথা ফাঁস করবে কেন? বৃদ্ধা মহিলার পকেট কাটতে হবে? কিনোর মুক্তোর কথা শুনে দীর্ঘক্ষণ ও নিয়ে মাথা ঘামাল ডাক্তার।

ওর বাচ্চার চিকিৎসা করব আমি, মনে মনে আওড়াল। বিছের কামড়ের দাওয়াই দেব।

গির্জার সামনে বসে থাকা ভিখিরিদেরও অজানা রইল না খবরটা। খুশিতে হেসে উঠল ওরা। ওদের জানা আছে, গরীব কোন লোক সহসা আঙুল ফুলে কলাগাছ হলে কাঙালিদের ভিক্ষে দেয়।

ডুবুরিদের কাছ থেকে মুক্তো কেনে ব্যবসায়ীরা। বায়ার বলা হয় এদের। শহরে খুদে খুদে অফিস নিয়ে বসে থাকে। কেউ মুক্তো নিয়ে এলে, দর কষাকষি করে খুব অল্প দামে বেচতে বাধ্য করে। মুক্তো কেনা হলে পর, একাকী বসে থাকে ব্যবসায়ীরা। আঙুলে নেড়েচেড়ে দেখে মুক্তোগুলো। কিন্তু এরা আসলে মুক্তোর মালিকানা পায় না। মস্ত বড় এক মুক্তো ব্যবসায়ী এসব ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের পয়সা দিয়ে কাজ করায়।

কিনোর মুক্তোর খবর পৌঁছে গেল এদের কানে। উদাস হয়ে গেল তারা, আহা, প্রকাণ্ড মুক্তোটার মালিক যদি হতে পারত। প্রত্যেক ছোট ব্যবসায়ীই মনে মনে সান্ত্বনা পায়, ধনী ব্যবসায়ীটি তো আর চিরদিন বেঁচে থাকবে না। লোকটা মারা গেলে কাউকে না কাউকে তার স্থান নিতে হবে। আমার টাকা থাকলে আমিই হতে পারতাম অমন বড় ব্যবসায়ী, ভাবে সবাই।

কিনোর প্রতি আগ্রহী এখন অনেকে। মুক্তো পাওয়ার খবর শুনে সবার মনেই কিছু না কিছু প্রতিক্রিয়া হয়েছে। সবার স্বপ্নে ভাগ বসিয়েছে কিনোর মুক্তো। তাদের আশা-আকাক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছে মুক্তোটা।

একজন মাত্র মানুষ সবার স্বপ্নসাধ পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর সে লোকটি হচ্ছে কিনো। কাজেই সে বেচারা নিজের অজান্তেই অনেকের শত্রু হয়ে গেছে।

মুক্তোর খবরটা শহরে যেন অশুভ এক ছায়া ফেলেছে। আর সেই অশুভ ছায়াটা যেন হুল তুলেছে শহরবাসীকে দংশাবে বলে। কাঁকড়াবিছের বিষে গোটা শহর এখন বিষাক্ত হওয়ার অপেক্ষায়।

কিনো আর হুয়ানা কিন্তু এসব কথা ঘুণাক্ষরেও জানে না। তারা মহা আনন্দিত, উত্তেজিত। তাদের ধারণা, আর সবাইও বুঝি তাদের মতই আনন্দে আত্মহারা। বিকেলে, পাহাড় টপকে সূর্যটা যখন টুপ করে সাগরে পড়েছে, কিনো তখন তার কাঠের বাড়িতে বসে। তার পাশে বসা হুয়ানা। বাসায় গিজগিজ করছে প্রতিবেশী। কিনোর হাতে ধরা মুক্তোটা উষ্ণ আর প্রাণবন্ত অনুভূতি ছড়াচ্ছে। পড়শীরা মুক্তোটা চেয়ে চেয়ে দেখছে। আশ মিটছে না যেন কারও। মানুষের কপাল এতখানি খোলে কিভাবে পরস্পর আলোচনা করছে তারা। কিনোর ভাই, হুয়ান টমাস, ওর একপাশে বসে।

তুই তো এখন ধনী মানুষ, কি করবি ভাবছিস? জানতে চায় সে।

মুক্তোটায় চোখ রাখল কিনো। হুয়ানা মাথা নিচু করে মুখ লুকাল শালে, প্রতিবেশীরা যাতে ওকে দেখতে না পায়।

দ্যুতি ছড়ানো মুক্তোটার দিকে চেয়ে কত অপূর্ণ স্বপ্নের কথাই বিভোর হয়ে ভাবছে কিনো। মুক্তোটার মধ্যে সে নিজের, হুয়ানার আর কয়োটিটোর ছবি দেখতে পাচ্ছে। গির্জায় গেছে ওরা। পাদ্রীর খরচ মেটাতে পারবে, ফলে এতদিনে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সারছে।

আমরা গির্জায় যাব-বিয়ে করতে, বলল কিনো।

মুক্তোর মধ্যে ফুটে উঠেছে সুবেশ কিনো পরিবারের ছবি। বিয়ের কল্পনা করছে কিনো। হুয়ানার পরনে নয়া শাল আর নয়া স্কার্ট। লম্বা ঝুলের স্কার্টের নিচ দিয়ে পায়ে জুতোও দেখা যাচ্ছে হুয়ানার। কিনোর গায়ে সাদা রঙের নতুন পোশাক, আর হাতে নতুন হ্যাট। কয়োটিটোর পায়েও জুতো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানী করা নীলরঙা নাবিক স্যুট আর ছোট্ট এক ক্যাপ পরেছে ওর বাচ্চা। ঝকমকে মুক্তোটার মধ্যে এ সব কিছুই পরিস্কার লক্ষ্য করছে কিনা।

নতুন কাপড় কিনব আমিরা, স্বপ্নাচ্ছন্নের মত বলল সে।

আরও কি কি কিনবে তার স্বপ্নজাল বুনতে লাগল এবার কিনো। পয়সা হয়েছে যখন, একটা রাইফেল কিনবে। রাইফেল হাতে ওই তো মুক্তোর গায়ে ছবি দেখা যাচ্ছে কিনোর। বড় সুখকর সব ছবি ফুটে উঠছে কিনোর মনের পর্দায়।

একটা রাইফেল কিনতে পারি, মৃদু সুরে বলল কিনো। মানে কিনব আরকি।

প্রতিবেশীরা, নীরবে কিনোর কথা শুনছিল, মাথা নাড়ল। পেছন দিকে বসে থাকা এক লোক নরম সুরে আওড়াল, রাইফেল। কিনো রাইফেল কিনবে।

কিনোর দিকে চাইল হুয়ানা। চোখ বিস্ফোরিত ওর। কিনোর মধ্যে কি যেন এক আশ্চর্য ক্ষমতা এসে গেছে, অনুভব করছে ও।

মুক্তোটার দিকে চেয়ে থেকে, আরেকটি স্বপ্ন দেখতে ব্যস্ত এখন কিনো। স্কুলে খুদে এক ডেস্কের পেছনে বসে আছে ওর আদরের কয়েটিটো সোনামণি। একবার পথে যেতে যেতে, স্কুলের খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে একটা ডেস্ক দেখেছিল কিনো। কয়োটিটোর গায়ে জ্যাকেট, ধবধবে সাদা কলার আর সিল্কের মোটাসোটা টাই। মস্ত বড় এক কাগজে কি সব যেন লিখছে ও। পড়শীদের দিকে তাকাল কিনে।

আমার ছেলে ইসকুলে যাবে, বলল সে, এবং নীরব হয়ে গেল প্রতিবেশীরা।

হুয়ানা বিস্মিত চোখ মেলে চাইল। কিনোর দিকে চেয়ে রয়েছে উজ্জ্বল দৃষ্টিতে। এবার চট করে কোলের বাচ্চাটার দিকে চাইল।

এ কি সত্যিই সম্ভব? ভাবল ও।

আমার ছেলে বই খুলে পড়বে, কথার খেই ধরে কিনে। আমার ছেলে লিখতে শিখবে। অঙ্কও শিখবে। ওর সাথে সাথে আমাদেরও সব শেখা হয়ে যাবে।

মুক্তোটায় চোখ রাখল আবারও কিনো। দেখতে পেল, কাঠের ছোট্ট বাসাটায় আগুনের পাশে বসে ও আর হুয়ানা, ওদিকে বিশাল এক বই খুলে বসেছে কয়েটিটো।

মুক্তাটা আমাদের সব সাধ-আহ্লাদি পূরণ করবে, বলল কিনো।

জীবনে কোনদিন একসঙ্গে এত কথা বলেনি ও, সহসা ভয় পেয়ে গেল। ভীতিবোধের ফলে মুক্তোটা শক্ত করে মুঠোয় চেপে ধরল।

কিনোর মুক্তো দেখার পর থেকে পড়শীরা উপলব্ধি করছে, তারা দর্শনীয় কিছু একটা দেখেছে। আগামী বহু বছরের গাল-গল্পের খোরাক পেয়ে গেছে সবাই। কিনোর স্বপ্ন সার্থক হলে, প্রতিবেশীরা বলতে পারবে, কিনোর চোখ কিভাবে প্রভা ছড়িয়েছিল। তারা বলাবলি করবে, কী এক অদ্ভুত ক্ষমতা কিনোর ভেতর প্রবেশ করে তাকে আশ্চর্য শক্তিশালী করে তুলেছিল।

আর যদি কিনোর স্বপ্ন ব্যর্থ হয়, তবে ভিন্ন ইতিহাস রচনা করা হবে। তখন বলা হবে, নির্বোধের পাগলামি ভর করেছিল কিনোর ওপর, আর তাই কত আগডুম বাগড়ম কথাই না বলেছিল উজবুক লোকটা।

বন্ধ মুঠোর দিকে তাকাল কিনো। ছড়ে যাওয়া জায়গাটা সাদা হয়ে আছে।

সন্ধে লেগে আসছে, ঘন হচ্ছে অন্ধকার। হুয়ানা শালে পুরে বহন করছে বাচ্চাটাকে। ও উঠে গিয়ে অাগুনে কয়েক টুকরো খড়ি জোগাল। উস্কে-ওঠা অাগুন পড়শীদের চেহারায় খেলা করে যাচ্ছে। বাসায় যাওয়ার সময় হয়েছে সবাই টের পাচ্ছে। কিন্তু ওঠার নাম করছে না কেউ। আঁধার গাঢ় হলে, আগুন যখন প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ছায়া ফেলল দেয়ালে, পরস্পরের সাথে ফিসফাস করতে শুরু করল ওরা।

পাদ্রী আসছেন। ওই যে, এসে পড়েছেন।

পুরুষরা হ্যাট খুলে সরে দাঁড়াল দোরগোড়া ছেড়ে। মহিলারা শালে মুখ ঢেকে মাথা নোয়াল। কিনো আর তার ভাই, হুয়ান টমাস সটান উঠে দাঁড়াল। ভেতরে প্রবেশ করলেন পাদ্রী। বয়স্ক লোক তিনি, চুল পাকিয়ে ফেলেছেন। চোখজোড়ায় ওঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। সবাই তার কাছে শিশুর মতন, এবং তিনি তাদের সাথে কথাও বলেন ছেলে ভুলানো ভঙ্গিতে।

কিনো, মৃদু স্বরে বললেন পাদ্রী। নামজাদা এক লোকের নামে তোমার নাম। গির্জার একজন মহান পাদ্রী ছিলেন তিনি।

পাদ্রী এরপর তাঁর কথাগুলোয় গুরুত্ব আরোপ করলেন।

মানুষকে তিনি বহু কিছু শিখিয়েছেন। তোমার জানা নেই? প্রশ্ন করলেন পাদ্রী। বইতে সবই লেখা আছে।

কয়োটিটোর মাথার দিকে চট করে দৃষ্টি চলে গেল কিনোর। একদিন ওর ছেলেও বইয়ে কি লেখা আছে সব জানবে। এ মুহূর্তে খুব একটা স্বস্তি বোধ করছে না ও। পড়শীদের উদ্দেশে চেয়ে বুঝতে চাইল, অন্যরকম অনুভূতি কেন হচ্ছে তার। পাদ্রী কথার সুতো ধরলেন।

শুনলাম তুমি নাকি মস্ত এক মুক্তো পেয়েছ।

মুঠো খুলে মুক্তোটা মেলে ধরল কিনো। ওটার আকৃতি আর সৌন্দর্য দেখে শ্বাস চাপলেন পাদ্রী।

খোদাকে, যিনি তোমাকে এটা দান করেছেন, শুকরিয়া জানাতে ভোলোনি নিশ্চয়ই, বললেন তিনি। খোদার কাছে প্রার্থনা করলে ভবিষ্যতে তিনি এমনি আরও দেবেন।

কিনো নীরবে মাথা নাড়ে, কিন্তু হুয়ানা এবার নম্র সুরে আলোচনায় যোগ দেয়।

করব, ফাদার, আর আমরা বিয়েটাও করে নেব। কিনো তাই বলেছে। হুয়ানা পড়শীদের দিকে চাইতে তারা সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল।

তোমাদের মাথায় প্রথমেই ভাল ভাল চিন্তা এসেছে জেনে খুব খুশি হলাম, বললেন পাদ্রী। খোদা তোমাদের মঙ্গল করুন, বাছারা।

পাদ্রী ঘুরে দাঁড়ালেন, এবং লোকজন তাঁকে পথ ছেড়ে দিল। কিনোর হাত শক্ত করে চেপে ধরল মুক্তোটা। চারধারে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল ও। আতঙ্কবোধটা ক্রমেই আবারও গ্রাস করছে ওকে।

পড়শীরা বিদায় নিলে চুলোর পাশে বসল হুয়ানা। খুদে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ওপর সেদ্ধ বিনের পাত্রটা চাপাল ও। কিনো দরজা অবধি হেঁটে গিয়ে উঁকি দিল বাইরে। প্রতিবেশীদের চুলোয় রান্না চড়েছে ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে। আকাশে আজ তারার মেলা। গা হিম হয়ে এল ওর, নাক ঢেকে নিল কম্বলে।

রোগাটে কুকুরটা ওর কাছে এসে গা ঝাড়া দিল। কিনো চোখ নামাল, কিন্তু আসলে ও কুকুরটাকে দেখছে না। বড্ডো নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে ওর নিজেকে, মোটেও নিরাপদ বোধ করছে না সে। নিশাচর কীট-পতঙ্গ কী এক অশুভ তান ধরেছে মনে হলো ওর। শিউরে উঠল কিনো। কম্বলটা ভালমত টেনে দিল নাক পর্যন্ত। মুক্তোটা তখনও হাতে ধরা ওর। জিনিসটা উষ্ণ আর মসৃণ ঠেকল ওর তালুতে।

পেছনে হুয়ানার অস্তিত্ব টের পাচ্ছে কিনো। কেক বানাচ্ছে ও আগুনের কাছে বসে। কমুহূর্তের জন্যে নিরাপত্তার অনুভূতি হলো কিনোর। এরপর আবার ভয়টা জাঁকিয়ে বসল মনের মধ্যে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতে সাহস পাচ্ছে না কিনো। পরিকল্পনা করা বিপজ্জনক, জানা আছে তার। বেশি বেশি পরিকল্পনা করে যে, তার কপালে খারাবি থাকে।

মুক্তো বেচে হাতে টাকা পেতে চায় কিনো। স্কুলে পাঠাতে চায় ছেলেকে। কত পরিকল্পনাই না আছে তার মাথার মধ্যে। কিন্তু সে সঙ্গে বিপদের আশঙ্কাও কি নেই? কিন্তু টাকাটা যে ওর ভীষণ দরকার। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থেকে, রাতের আঁধারের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল ও।

০৫. কিনো দরজায় দাঁড়িয়ে

কিনো দরজায় দাঁড়িয়ে, লক্ষ্য করল দুজন লোক এদিকেই আসছে। একজনের হাতে একটা টর্চ, মাটি আর লোকটির দুপাআলোকিত ওটার আলোয়। কিনোর কাঠের বেড়ার ফাঁক গলে ঢুকে দরজার কাছে চলে এল ওরা। কিনো এবার দেখতে পেল দুজনের একজন হচ্ছে সেই ডাক্তার আর অপরজন তার ভৃত্য।

তুমি সকালে যখন গেছিলে আমি তখন বাসায় ছিলাম না, ফ্যাকাসে হেসে বলল ডাক্তার। তোমার বাচ্চার খবর শুনে আর দেরি করিনি, ছুটতে ছুটতে চলে এসেছি।

কিনো দরজায় ঠায় দাঁড়িয়ে, ঘৃণায় জ্বলছে দুচোখ ওর। আবারও ভয় লেগে উঠল কিনোর। ভয় পাওয়ার কারণ, ডাক্তারের গোত্র শত শত বছর ধরে অত্যাচার-নিপীড়ন চালিয়েছে ওর পূর্বপুরুষদের ওপর।

আমার বাচ্চা সেরে গেছে প্রায়, ফট করে বলে বসল কিনো।

মুচকি হাসল ডাক্তার, হাসিটা যদিও তার চোখ স্পর্শ করল না।

মাঝে মাঝে হয় কি, বলল লোকটা, বিছের কামড় খাওয়া বাচ্চাকে দেখলে মনে হয় বাহ, সেরে গেছে বুঝি, কিন্তু তারপর হঠাৎ করে…

ঠোঁটে মৃদু শব্দ করল ডাক্তার, দেখাল মৃত্যু কত অতর্কিতে হানা দিতে পারে।

কখনও কখনও, কথার খেই ধরে ডাক্তার, পা শুকিয়ে যায়, চোখ অন্ধ হয়ে যায়, পিঠ বাঁকা হয়ে যায়। আমি ডাক্তার, আমি তো জানি, বন্ধু, বিছের কামড় কী জিনিস। চিন্তা কোরো না, আমি তোমার বাচ্চাকে সারিয়ে দেব।

ভয়টা আরও জেঁকে বসল কিনোর বুকে। বিছের কামড় সম্পর্কে তার কোন অভিজ্ঞতা নেই। ডাক্তার লোকটা কত শত বই পড়েছে। ও হয়তো ঠিকই বলছে। নিজের ওপর তো বটেই, ডাক্তারের ওপরও রেগে উঠছে কিনো। কেন বই পড়তে শেখেনি সেজন্য নিজের প্রতি রাগ। আর ডাক্তার ব্যাটা বেশি জানে কেন, সেজন্যে তার ওপর চাপা ক্ষোভ।

ইতিকর্তব্য ঠিক করতে পারছে না কিনো। ও স্থিরনিশ্চিত ডাক্তারটা মিছে কথা বলছে। কিন্তু ছেলের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে এমন কিছু তো করতে পারে না সে বাপ হয়ে। পিছু হটে লোক দুটোকে তার ছোট্ট বাড়িটার ভেতর ঢুকতে দিল।

হুয়ানা ডাক্তারকে দেখে সিধে উঠে দাঁড়াল। শাল দিয়ে মুখ ঢেকে দিল বাচ্চাটার। ডাক্তার ওর সামনে গিয়ে দুহাত বাড়িয়ে দিতে, বাচ্চাকে বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরল ভীতা মা। কিনোর দিকে চাইল হুয়ান। আগুনের ছায়া নেচে বেড়াচ্ছে স্বামীর মুখের ওপর। কিনো মাথা নাড়তে ডাক্তারের হাতে বাচ্চাকে ছাড়ল মা।

টর্চটা ধরো, বলল ডাক্তার। চাকর লোকটা টর্চ উচিয়ে ধরতে রোগীর কাঁধের ক্ষতটা পরখ করে দেখল ডাক্তার। এক মুহূর্ত কি যেন ভেবে, কয়োটিটোর চোখের পাতা টেনে চোখ নিরীখ করল। বাচ্চাটা তার হাতে ছটফট করে উঠতে মাথা ঝাঁকাল ডাক্তার।

এমনটাই ভেবেছিলাম, বলল ডাক্তার। বিষ ভেতরে চলে গেছে। এর অবস্থা খারাপ হতে থাকবে। এসো, দেখে যাও!

বাচ্চাটার চোখে চোখ রাখল ডাক্তার। কিনো লক্ষ্য করল চোখটা ঈষৎ নীলচে। এটাই কয়েটিটোর চোখের স্বাভাবিক রং কিনা জানা নেই কিনোর। ডাক্তারকে বিশ্বাস করবে কি না বুঝে উঠতে পারছে না সে। এখন আর কিছু করারও তো নেই।

ব্যাগ থেকে বড়ি ভর্তি পিচ্চি এক শিশি বের করল ডাক্তার। এবার কয়োটিটোকে কোলে নিয়ে ওর ঠোঁটজোড়া চেপে ধরে রইল, বাচ্চাটা যতক্ষণ না মুখ খোলে। মুখ খুলতেই, ডাক্তারের গোদা গোদা দুটো আঙুল, রোগীর জিভের যতটা গভীরে পারে ফেলে দিল একটা বড়ি। কয়েটিটো এখন আর উগরে দিতে পারবে না ওষুধ। ডাক্তার এরপর জগ থেকে খানিকটা পানি ঢেলে দিল কয়েটিটোর মুখের ভেতর। বাচ্চাটার চোখ আরেকবার পরীক্ষা করে ওকে এবার মার কোলে ফিরিয়ে দিল।

ঘন্টা খানেকের মধ্যে বিষক্রিয়া শুরু হবে, ডাক্তার বলল। ওষুধটা হয়তো এ যাত্রা বাঁচিয়ে দিতে পারে বাচ্চাটাকে। আমি এক ঘণ্টার মধ্যে আবার আসছি। ভাগ্যিস সময় মত এসেছিলাম।

ডাক্তার গভীর করে শ্বাস টেনে ঘরত্যাগ করল। টর্চ হাতে অনুসরণ করল তার ভৃত্য।

কয়েটিটোকে শালের নিচে গুঁজে দিল হুয়ানা। বাচ্চাটার জন্য উদ্বেগ আর আতঙ্ক অনুভব করছে ও। কিনো এগিয়ে এল। শাল তুলে বাচ্চাকে দেখল। চোখের পাতার নিচেটা দেখার জন্যে হাত বাড়াল কিনো। এবার খেয়াল হলো মুক্তোটা তখনও হাতে ওর। দেয়াল লাগোয়া এক বাক্স থেকে এক টুকরো কাপড় বের করল ও, মুক্তোটা মুড়িয়ে রাখল ওতে। এরপর ছোট্ট বাসাটার এক কোণে গিয়ে, মেঝেতে আঙুল দিয়ে খুদে এক গর্ত তৈরি করল। মুক্তোটা ভেতরে রেখে, ধুলো-বালি দিয়ে গর্তের মুখ বুজিয়ে দিল। চুলোর কাছে বসে থাকা স্ত্রীর দিকে এগিয়ে গেল এবার।

ওদিকে বাড়িতে, চেয়ারে আরাম করে বসে, হাতঘড়িতে নজর বুলাল ডাক্তার। কাজের লোকটা চকোলেট আর কেক নিয়ে এল। খাবারের দিকে একবার মাত্র দৃষ্টি দিল ডাক্তার, খিদে নেই তার।

পড়শীরা যার যার বাসায়, কিনোর মুক্তোর আলোচনায় ব্যস্ত। একে অপরকে মুক্তোর আকার দেখাচ্ছে তারা। পরস্পরকে বলছে রত্নটার অনিন্দ্যসুন্দর সৌন্দর্যের কথা। পড়শীরা আগ্রহ ভরে অপেক্ষা করছে, মুক্তোটা কিনো আর হুয়ানাকে কতখানি বদলে দেয় নিজের চোখে দেখবে। প্রতিবেশীরা ভাল করেই জানে, মুক্তোর লোভেই ডাক্তারটা এসেছে কিনোর বাসায়।

বড্ড গরম পড়েছে আজ রাতে। লিকলিকে কুকুরটা কিনোর দরজায় এসে ভেতরে উঁকি দিল। কিনো ওটার দিকে চাইতে গা ঝাড়া দিল। কিনে চোখ ফেরাতে, কুকুরটা শুয়ে পড়ল মাটিতে। ঘরের মধ্যে ঢুকল না জানোয়ারটা, কিনো খাবার খাচ্ছে লক্ষ্য করছে।

খাওয়ার পর্ব সারা হলে, হুয়ানা হঠাৎ কথা বলে উঠল।

কিনো, বলল সে।

হুয়ানার দিকে চাইল কিনো, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ত্বরিত ওর কাছে চলে এল। হুয়ানা আতঙ্কিত, লক্ষ্য করল ও। নিচের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে দাঁড়িয়ে রইল কিনো। আলো কম, কিছু দেখতে পেল না। লাথি মেরে আগুনে খড়ি ফেলে আগুন উস্কে দিল কিনো। পরমুহূর্তে বাচ্চার মুখটা চোখে পড়ল ওর। মুখ আর ঠোঁটজোড়া লাল হয়ে গেছে কয়েটিটোর। হঠাৎ, কয়োটিটোর গলা আর পেট নড়ে উঠল। বোঝা যাচ্ছে ভয়ানক অসুস্থ বাচ্চাটা।

ডাক্তার জানত ও অসুস্থ হয়ে পড়বে, বলল কিনো।

ওষুধের কথা মনে পড়ল ওর। কোন সন্দেহ নেই, ডাক্তারটাই কয়োটিটোকে অসুস্থ বানিয়েছে। এপাশ-ওপশি দুলে একটা গান ধরল হুয়ানা। ওর বিশ্বাস, গানটা বিপদ-আপদ দূরে সরিয়ে রাখবে। মার কোলে দুলছে কয়েটিটো, নাভিশ্বাস উঠে গেছে তার।

চকোলেট আর কেকগুলো সাবাড় করল ডাক্তার। আঙুল থেকে কেকের গুড়ো ঝেড়ে ঘড়ি দেখল। এবার উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগটা তুলে নিল।

বাচ্চাটার অসুস্থতার খবর ঘরে ঘরে জানাজানি হয়ে গেছে। অসুখবিসুখ, খিদের জ্বালার মতই, গরীব মানুষের চিরশত্রু।

কেউ কেউ মৃদু সুরে বলল, সৌভাগ্যের সঙ্গে সঙ্গে খারাপ বন্ধু-বান্ধবও জুটে পড়ে। সবাই মাথা নাড়ল এবং রওনা দিল কিনোর বাসার উদ্দেশে। রাতের আঁধারে দ্রুত পা চালিয়ে, আবারও কিনোর বাড়িতে এসে হাজির হলো পড়শীরা। সবার মুখে এক কথা, সুখ আর দুঃখ হাত ধরাধরি করে চলে। বৃদ্ধা মহিলারা হুয়ানার পাশে বসে তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছে।

সবই আল্লার ইচ্ছা, বলছে তারা।

চাকরটাকে পেছনে নিয়ে, ডাক্তার এসে ঘরে ঢুকল। বৃদ্ধা মহিলার সঙ্গে সঙ্গে পিছু হটে গেল। ডাক্তার এবার বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিল। গভীর মনোযোগে কয়েটিটোকে পরীক্ষা করে রোগীর মাথায় হাত রাখল ডাক্তার।

বিষটা এখনও এখানে আছে, বলল লোকটা। তবে আমি মনে হয় নামিয়ে দিতে পারব। সাধ্যমত চেষ্টা করব আমি।

কাপে করে খানিকটা পানি আনতে বলল সে। সামান্য ওষুধ ওতে গুলে বাচ্চাটার মুখে ঢেলে দিল। কয়েটিটো কেশে উঠে কান্না জুড়ে দিল। ভীতিমাখা চোখে চেয়ে রয়েছে কাতর মা। কাজের ফাঁকে অল্প স্বল্প কথাবার্তাও বলল ডাক্তার।

এই রোগের চিকিৎসা আগেও করেছি আমি, বলল সে।

ধীরে ধীরে, ডাক্তারের বাহুতে ছটফটানি বন্ধ করল বাচ্চাটা। গভীর করে শ্বাস টেনে ঘুমিয়ে পড়ল ক্লান্ত, ছোট্ট রোগী। মার কোলে বাচ্চাকে ফিরিয়ে দিল ডাক্তার।

ও এখন ভাল হয়ে যাবে, বলল লোকটা। আমার চিকিৎসায় কাজ হয়েছে।

ব্যাগ বন্ধ করে ডাক্তার কথা বলল অাবারও।

ফীটা কখন দিতে পারবে?

মুক্তা বেচে নিই, তারপর, জবাব দিল কিনো।

ও, মুক্তো আছে বুঝি তোমার কাছে? তা কেমন সেটা, কি জাতের? ডাক্তারের সে কি উৎসাহ।

এবার সবকজন প্রতিবেশী একসাথে কথা বলে উঠল।

দুনিয়ার সেরা মুক্তাটা খুঁজে পেয়েছে ও, জানাল ওরা, সবকটা আঙুল গোল করে আকারটা দেখাল।

কিনো বেজায় ধনী হয়ে যাবে, বলল পড়শীরা। কেউ কখনও ওরকম মুক্তা চোখে দেখেনি।

তাই নাকি, জানতাম না তো? সাধু সাজল ডাক্তার। নিরাপদ জায়গায় রেখেছ তো জিনিসটা? চাইলে আমার কাছে আমানত রাখতে পারো।

আধ বোজা চোখে ডাক্তারের দিকে তাকাল কিনো।

ওটা নিরাপদ জায়গাতেই আছে, বলল। কাল ওটা বেচে আপনার ফী মিটিয়ে দেব।

কিনোর চোখের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল ডাক্তার। মুক্তোটা এবাড়িরই কোথাও না কোথাও লুকানো আছে জানে সে। তার মনে আশা, কোথায় লুকিয়েছে সেদিকে একবার না একবার চাইবেই কিনো।

বেচতে পারার আগেই চুরি গেলে খুব দুঃখজনক হবে ব্যাপারটা, বলল ডাক্তার। ঘরের কোণে, মেঝের দিকে ঝট করে দৃষ্টি চলে গেল কিনোর, নজর এড়াল না ডাক্তারের।

ডাক্তার আর পড়শীর বিদায় নিলে পর, চুলোর পাশে বসে কান পেতে রাতের গুঞ্জন শুনতে লাগল কিনো। ছোট ছোট ঢেউ ভাঙছে সৈকতে, কোথায় যেন হাঁক-ডাক ছাড়ছে কুকুরের পাল। ছাদের ফোকর গলে বাতাস চলাচল করছে, কানে আসে প্রতিবেশীদের কথাবার্তার টুকরো শব্দ। ডুবুরিরা সারা রাত একটানা ঘুমোয় না। মাঝে মাঝেই ঘুম ভেঙে, খানিক গল্প-গুজব করে, তারপর আবার ঘুম দেয়।

একটু পরে উঠে পড়ে দরজার কাছে এল কিনো। রাতের বাতাসের ঘ্রাণ নিয়ে, কান খাড়া করল কেউ আসে কিনা শোনার জন্যে। আঁধারে দৃষ্টি চলে গেল। মনে মনে ভয় পাচ্ছে সে। কেন জানি মনে হচ্ছে, মুক্তোটা চুরি করতে লোক আসতে পারে আজ রাতে। ঘরের প্রান্তে, গুপ্তস্থানটার কাছে এসে দাঁড়াল কিনা। রত্নটা তুলে নিয়ে মাদুরের কাছে এল। মেঝেতে আরেকটা খুদে গর্ত করল ও। গর্তের ভেতর মুক্তোটা রেখে ওটাকে ঢেকে দিল। অবারও।

হুয়ানা, চুলোর পাশে বসে ছিল, সাবধানী দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছে কিনোকে।

কাকে ভয় পাচ্ছ তুমি? জানতে চাইল।

সবাইকে, জবাব দিল কিনো।

একটু পরে, মাদুরে গা এলিয়ে দিল স্বামী-স্ত্রী। সে রাতে দোলনায় শোয়াল না হুয়ানা কয়োটিটোকে। বুকের ওপর উপুড় করে ফেলে বাচ্চার মুখ ঢেকে রাখল শাল দিয়ে। নিভন্ত আগুনটা এক সময় ধীরে ধীরে মরে গেল।

ঘুমের মধ্যেও মাথায় চিন্তা পাক খাচ্ছে কিনোর। স্বপ্ন দেখছে কয়োটিটো পড়তে পারে। আরও দেখল এই বাড়ির সমান মস্ত এক বই নিয়ে বসেছে তার ছেলে। বইটার অক্ষরগুলো একেকটা ইয়া বড় বড় কুকুরের সমান। স্বপ্ন যখন ফুরাল আঁধার তখনও কাটেনি। মাদুরে ছটফট করছে কিনো। ও নড়াচড়া করতে, হুয়ানার চোখ খুলে গেল। কিনো এবার সজাগ হয়ে আঁধারে কান পেতে শুয়ে রইল।

ঘরের ওই কোণটা থেকে মৃদু একটা শব্দ হলো না? কে যেন নড়াচড়া করছে আওয়াজ পেল কিনো। শ্বাস বন্ধ করে শুনতে চেষ্টা করল ও। অনাহুত আগন্তুকটিও দম আটকে রয়েছে, জানা আছে ওর। কিনোর একবার মনে হলো সে স্বপ্ন দেখছে না তো? কিন্তু হুয়ানার হাত ওর গা স্পর্শ করতে উৎকর্ণ হলো আবারও। শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ কানে এল ওর। শুকনো মাটি খামচাচ্ছে কার যেন আঙুল স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।

হঠাৎই মাথায় রাগ উঠে গেল কিনোর। ছোরায় আস্তে করে হাতটা চলে গেল ওর। এবার রাগী বেড়ালের মত শব্দ লক্ষ্য করে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে, হাতে উদ্যত ছোরা। কার যেন জামার ছোঁয়া লাগতে সবেগে ছোরা চালিয়ে দিল। তবে কারও গায়ে লাগেনি। আবারও ঘাই মারতে জামা চিরে ছোরা চলে গেছে টের পেল। মাথায় এবার প্রতিপক্ষের বাড়ি পড়ল কিনোর। দপ করে আগুন ধরে গেল যেন জায়গাটায়। ওই যে, লোকটা ছুটে পালাচ্ছে। পদশব্দ মিলিয়ে যেতে ফের নিস্তব্ধ চারদিক। উষ্ণ রক্ত গড়িয়ে নামছে মুখ বেয়ে, হুয়ানা ডাকছে ওকে খেয়াল হলো কিনোর।

কিনো! কিনো! আকুল স্বরে ডাকছে হুয়ানা। ভীষণ ভয় পেয়েছে সে।

আমি ঠিক আছি, বলল কিনো। ব্যাটা পালিয়েছে।

আস্তে আস্তে শয্যার কাছে ফিরে এল কিনো। চুলোয় এরমধ্যেই অাগুন ধরাতে ব্যস্ত হুয়ানী। একটুকরো জ্বলন্ত অঙ্গার আর কিছু ছোটখাট খড়ি খুঁজে পেয়েছে। ফুঁ দিয়ে দিয়ে আগুনটা উস্কে দিতে লাগল ও। শীঘ্রিই অল্প একটুখানি আলো ঘরের ভেতর নাচতে লাগল। হুয়ানা এবার একটা মোমবাতি নিয়ে, অগ্নিশিখা থেকে ওটা ধরিয়ে, চুলোর কাছে বসিয়ে দিল। ত্ৰস্ত হাতে কাজ সারছে হুয়ানা, আর তারই ফাঁকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। শালের খুঁটি পানিতে ভিজিয়ে স্বামীর মাথা থেকে রক্ত মুছে দিল।

কিছু হয়নি, বলল কিনো, কিন্তু কণ্ঠস্বর কঠোর আর শীতল ওর। হঠাৎ ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠল হুয়ানা।

ওগো, মুক্তাটা অলক্ষুণে! চেঁচিয়ে উঠল। ওটা আমাদের সর্বনাশ করে ছাড়বে। তুমি ওটা ফেলে দাও! পাথর দিয়ে, এসো, ওটাকে ভেঙে চুরমার করে দিই। মুক্তোটা সাগরে ছুঁড়ে ফেলে দাও তুমি।

আগুনের ম্লান আলোয়, হুয়ানার ঠোঁট আর চোখজোড়া ভীত-সন্ত্রস্ত দেখাচ্ছে। কিন্তু কিনোর মুখের চেহারায় এখন অদ্ভুত এক দৃঢ়তা।

এরকম সুযোগ আর আসবে না, বলল ও। আমাদের ছেলেকে ইসকুলে পাঠাতে হবে না? আমি চাই না ও আমার মত বেহদ্দ গরীব থাকুক। জীবনে ওকে অনেক উন্নতি করতে হবে।

হুয়ান আবারও চিৎকার করে উঠল।

মুক্তাটা আমাদের ধ্বংস করে দেবে। আমাদের বাচ্চাটাও রেহাই পাবে না।

চুপ করো তো! ধমক দিল কিনো। কাল সকালেই তো মুক্তাটা বেচে দেব। তখন আর ভয় কিসের? এবার একটু শান্ত হও, বউ।

খুদে আগুনটার দিকে যখন চাইল, কিনোর চোখের কালো মণি দুটো ধকধক করে জ্বলছে। হাতে তখনও ছুরিটা ধরা ওর। ছুরিটা চোখের কাছে তুলে ধরে ওটার উদ্দেশে চাইল সে। হালকা রক্তের একটা দাগ ধরা পড়ল ওর চোখে। মাটিতে ঘষে ঘষে ফলাটা পরিষ্কার করল ও।

ভোরের বাতাস বইছে গাছ-গাছালির ফাঁকে ফাঁকে, সাগরের বুকে। বেলাভূমিতে আছড়ে পড়ছে খুদে খুদে উর্মি। কিনো তার মাদুরটা টেনে মুক্তোটা তুলে নিল গর্ত থেকে। রত্নটা হাতে ধরে রেখে দীর্ঘক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে রইল। মুক্তোটার শোভা আবারও স্বপ্নাবিষ্ট করে তুলল ওকে। কী অপরূপ জিনিসটা, আহা। ভবিষ্যতে সুখ কেনা যাবে এটা দিয়ে। দীপ্তিমান মুক্তোটা সবধরনের রোগ-বালাই আর বিপদ-আপদ ঠেকিয়ে রাখবে। কিনোর পরিবারকে আর কোনদিন খিদের জ্বালা সইতে হবে না।

মুক্তোটার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে, চোখ থেকে ক্রোধের দৃষ্টি মুছে গেল ওর, সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল আশ্চর্য এক স্নিগ্ধতা। হুয়ানা স্বামীর দিকে চাইতে তার মুখে হাসি লক্ষ্য করল। হাসি ফুটল হুয়ানার মুখেও। বুক ভরা আশা নিয়ে নতুন দিনটা শুরু করল ওরা।

০৬. ভোরে কিনো মুক্তো বেচতে যাবে

সবাই জানে, ভোরে কিনো মুক্তো বেচতে যাবে। গোটা শহরে উত্তেজনা। গির্জার ভিখিরি থেকে শুরু করে মুক্তো ব্যবসায়ীরা পর্যন্ত সবাই উত্তেজিত। মুক্তো ব্যবসায়ীরা যার যার অফিসে একাকী বসে রয়েছে, তারা প্রত্যেকে ছোট ছোট মুক্তো নাড়াচাড়া করছে আর কিনোর কথা ভাবছে। কেউ মুক্তো বিক্রি করতে চাইলে, উত্তেজনা মাত্রা ছাড়ায় ব্যবসায়ীদের। খুশির সীমা থাকে না তার, সবচাইতে কমে দাঁও মারতে পারে যে। সব কজন ব্যবসায়ীই মনে মনে ঠিক করে রেখেছে কি দাম সাধবে।

হলদে সূর্যটা সেদিন সকালে তীব্র আলো বিলাচ্ছে। এক সারে সৈকতে পড়ে আছে ক্যানুগুলো, কিন্তু আজ আর ডুবুরিরা মুক্তোর খোঁজে ডুব দেয়ার নাম করছে না। কিনো মুক্তো বেচবে স্বচক্ষে দেখতে চায় তারা।

সাগরপারের কাঠের বাসাগুলোয়, অনেক সময় নিয়ে নাস্তা সারল পড়শীরা। নিজেরা অমন মুক্তো খুঁজে পেলে কি কি করবে তার জল্পনাকল্পনা চলল।

একজন বলল, মুক্তো বেচা সমস্ত টাকা সে গির্জায় দান করে দেবে।

আরেকজন জানাল, সব টাকা বিলিয়ে দেবে শহরের গরীবদের মাঝে।

পড়শীরা কামনা করছে, টাকা-পয়সা যাতে কিনোর মাথা বিগড়ে না দেয়, সে যেন আর দশজন ধনী লোকের মতন লোভী হয়ে না ওঠে। প্রতিবেশীরা সবাই তাকে ভালবাসে। কেউ চায় না মুক্তোটা তার ধ্বংস ডেকে আনুক।

কিনো একটা লক্ষ্মী বউ পেয়েছে, বলাবলি করে পড়শীরা। আর ওর বাচ্চাটাও খুব সুন্দর। ভবিষ্যতে আরও ছেলেমেয়ে হবে। আমরা চাই না মুক্তাটা ওদের সবার সর্বনাশ করুক।

কিনো আর হুয়ানার কাছে, জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সকাল হচ্ছে আজকেরটা। কয়োটিটোকে তার সেরা পোশাকটা পরানো হয়েছে। হুয়ানা পরিপাটী করে তার চুল আঁচড়ে লাল রিবনে বেঁধেছে। তারপর প্রিয় স্কার্টটা পরেছে। কিনোর পরনের পোশাক পুরানো হলেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। আগামীকাল, কিংবা হয়তো আজ বিকেলে, নতুন জামা-কাপড় উঠবে ওর গায়ে।

পড়শীরাও সেজেগুজে তৈরি। কিনোর দরজার দিকে লক্ষ্য তাদের। কখন বেরোবে ওরা অপেক্ষা করছে।

কিনো আর তার বউও চাইছে পড়শীরা তাদের সঙ্গে শহরে আসুক। আজকের বিশেষ এই দিনটিতে বন্ধু-বান্ধবদের পাশে চায় ওরা।

যত্নের সঙ্গে শালটা গায়ে জড়াল হুয়ানা। শালের এক কিনারে এমনভাবে জড়িয়ে নিল কয়েটিটোকে, সে যাতে বাহুর নিচে ঝোলে। কিনো ওর প্রকাণ্ড ঐ হ্যাটটা মাথায় চাপল। ওটা ঠিকঠাক মাথায় বসল কিনা দেখে নিল। অবিবাহিত লোকেদের মত মাথার পেছনদিকে কিংবা পাশে হ্যাট পরতে চায় না সে। আবার বুড়োমানুষদের মতন মাথার সঙ্গে লেপ্টে থাকুক জিনিসটা তাও পছন্দ নয়। সামনের দিকে একটুখানি ওঠানো থাকবে। হ্যাটটা, যাতে বোঝা যায় কিনো একজন শক্তিশালী যুবক। হ্যাট পরা নিয়ে লোকের কথার তো শেষ নেই।

এবার মহার্ঘ মুক্তোটা পুরানো, নরম এক পশুর চামড়ায় মুড়ে, ছোট্ট এক চামড়ার থলেয় পুরল ও। কিনোর পকেটে স্থান পেল থলেটা। বাঁ কাঁধে ভাঁজ করা কম্বলটা ফেলার পর তৈরি হলো সে যাত্রার জন্যে।

ঘরে বাইরে পা রাখল ও। হুয়ানা, কয়েটিটোকে বইছে, পিছু পিছু বেরোল। ওরা স্বামী-স্ত্রী ছোট রাস্তাটা দিয়ে শহরের উদ্দেশে পা বাড়াতে, প্রতিবেশীরা যার যার বাসা থেকে বেরিয়ে এল। ছেলে-বুড়ো সবাই আজ উৎসবের আমেজে রয়েছে। কিন্তু দিনটা যেহেতু বেজায় গুরুত্বপূর্ণ, মাত্র একজন লোক কিনোর পাশাপাশি হেঁটে চলল। এ লোক কিনোর ভাই, হুয়ান টমাস।

হুশিয়ার থাকিস, ব্যবসায়ীরা যেন ঠকাতে না পারে, বলল হুয়ান টমাস।

থাকব, জানাল কিনো।

ন্যায্য দাম কত বুঝব কি করে আমরা? জবাব চাইল হুয়ান টমাস। অন্যান্য শহরে ব্যবসায়ীরা কত টাকা সাধে জানি না তো।

তা ঠিক, বলল কিনো, কিন্তু জানবই বা কিভাবে? ওসব শহরে তো যাইনি কখনও।

তোর জন্মের আগে, কিনো, বলে ভাই, মুক্তার জন্যে বেশি দাম আদায়ের একটা বুদ্ধি আঁটে গাঁয়ের বুড়োরা। রাজধানীতে কোন লোক মারফত মুক্তা পাঠাতে পারলে, ভাল দাম পাওয়া যাবে মনে করেছিল। তারা।

জানি আমি, মাথা নেড়ে বলল কিনো। বুদ্ধিটা মন্দ ছিল না।

বুড়োরা রাজধানীতে যাওয়ার জন্যে একটা লোককে ঠিক করে, বলল হুয়ান টমাস। সমস্ত মুক্তা তার হাতে শহরে পাঠানো হয়। কিন্তু সে লোক আর ফিরে আসেনি। একই কাণ্ড আরেক লোকও যখন করল, তখন মানুষ আবার পুরনো কায়দায় ফিরে গেল।

জানি, বলল কিনো। বাবার মুখে শুনেছি। বুদ্ধিটা ভাল ছিল, কিন্তু ওটা গির্জার উপদেশের বিরুদ্ধে যায়। পাদ্রী বলেন, খোদা মানুষকে পাঠিয়েছেন দুনিয়ার খানিকটা অংশ পাহারা দিয়ে রাখার জন্যে। আমাদের উচিত নিজের নিজের জায়গা থেকে না নড়া।

হ্যাঁ, আমিও শুনেছি, বলে হুয়ান টমাস। পাদ্রী প্রতি বছরই কথাটা বলেন।

কিনো পাদ্রীর কথা অনেক বছর ধরেই মন দিয়ে শুনছে। কিন্তু পাদ্রী, ওই ডাক্তারটার মতই, অন্য গোত্রের মানুষ। যে গোত্র কিনোর পূর্বপুরুষদের রক্ত শুষে খেয়েছে কয়েকশো বছর ধরে। পাদ্রীর কথা শোনে ঠিকই কিনো, কিন্তু অন্তর থেকে লোকটাকে সে বিশ্বাস করে না।

শহরমুখী জনতার স্রোত এমুহূর্তে নীরব। দিনটার ভাবগাম্ভীর্য রক্ষা করছে তারা। বাচ্চা-কাচ্চাদের সামলে রাখা হচ্ছে। চেঁচামেচি কিংবা খেলাধুলা করতে গেলেই ধমক জুটছে কপালে। এমন এক মহান দিবসের সাক্ষী হওয়ার জন্যে, এক বৃদ্ধ তার ভাতিজার কাঁধে সওয়ার হয়ে সবার সঙ্গে চলেছে।

কাঠের বাসাগুলো পেছনে ফেলে সারবন্দী জনতা শহরে এসে পৌঁছল। শহরে, রাস্তাগুলো খানিকটা চওড়া আর বাড়ি-ঘরের পাশে সরু সরু ফুটপাথ। ভিখিরির দল যথারীতি, শহরাগতদের লক্ষ্য করে পিছু নিল। খদ্দেররা দৌড়ে শোভাযাত্রায় মিশে যেতে বাধ্য হয়ে ঝাঁপ ফেলতে হলো দোকানিদের। রাস্তায় প্রতিফলিত হচ্ছে সূর্যচ্ছটা। এমনকি একরত্তি নুড়িগুলো অবধি ছায়া ফেলছে মাটিতে।

মুক্তো ব্যবসায়ীদের ঘুপচি অফিসে আলো আঁধারি পরিবেশ, মিছিলের খবর পৌঁছে গেল সেখানে।

ওদের অফিসের ছোট ছোট জানালায় গরাদ দেয়া, ফলে ভেতরটায় আবছায়া। কিনোর জন্যে প্রস্তুত হলো ব্যবসায়ীরা। ডেস্কে তড়িঘড়ি করে কাগজপত্র নামিয়ে রাখল তারা, কিনো এলে যাতে ব্যস্ত দেখে তাদের। নিজেদের মুক্তো সরিয়ে রাখল লোকগুলো, ছোট মুক্তোর পাশে বড় মুক্তো আরও বেশি মূল্যবান দেখাবে কিনা তাই। সবার জানা হয়ে গেছে কিনোর মুক্তোটার আকৃতি।

হোঁতকা এক লোক তার অফিসে বসে অপেক্ষা করছে। লোকটার মুখের চেহারায় সহৃয় ও বন্ধুভাবাপন্ন অভিব্যক্তি। এ লোক সবাইকে শুভ সকাল! বলে অভিবাদন জানায়। লোকের হাত ঝাঁকিয়ে দিয়ে মজার মজার কথা বলে। কিন্তু হলে হবে কি, অাদতে লোক সে সুবিধের নয় অসৎ।

আজ সকালে, ফুলদানিতে ফুল রেখেছে লোকটা। তার ডেস্কে রাখা কালো কাপড়টার পাশে ফুলদানিটা স্থান পেয়েছে। সযত্নে দাড়ি কামিয়েছে সে, হাত দুটো আচ্ছা মতন ধুয়ে ফর্সা বানিয়েছে।

অফিসের দরজা খুলে রেখেছে সে, গানের সুর ভাঁজছে গুনগুন করে, আর একটা মুদ্রা নিয়ে খেলা করছে আনমনে। দুআঙুলের মাঝে মুদ্রাটা নাড়াচাড়া করছে, দরজার বাইরে দৃষ্টি চলে গেল তার। আগুয়ান পায়ের আওয়াজ কানে আসছে। কিনো দরজা দিয়ে কামরায় প্রবেশ করতে, লোকটা ডেস্কের নিচে চট করে চালান করে দিল মুদ্রাটা।

শুভ সকাল, বন্ধু আমার, বলল মোটা লোকটা। আমি তোমার জন্যে কি করতে পারি?

উজ্জ্বল রোদ থেকে এইমাত্র আধো অন্ধকারে প্রবেশ করেছে কিনো, ঘরের ভেতরটা পরিষ্কার দৃষ্টিগোচর হলো না তার। ক্রেতা লোকটির মুখে মৃদু হাসি লেগে রয়েছে, কিন্তু চোখজোড়া কঠোর হয়ে উঠেছে। ডেস্কের নিচে, তার বাঁ হাত মুদ্রাটা নিয়ে তখনও খেলা করে চলেছে।

একটা মুক্তা এনেছিলাম, বলল কিনে।

হুয়ান টমাস কিনোর পাশে দাঁড়ানো। পড়শীরা দরজায় গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে কি হয় উৎসুক দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছে। কিনোর পায়ের ফাঁক দিয়ে মজা দেখছে কয়েকটা শিশু-কিশোর।

একটা মুক্তো এনেছ, বলল ব্যবসায়ী, অনেকে তো এক ডজন আনে। দেখি, কি এনেছ। মনে ধরলে ন্যায্য দামই পাবে, ঠকাব না।

ডেঞ্চের নিচে মুদ্রার খেলা দ্রুততর হলো।

আস্তে আস্তে চামড়ার থলেটা বের করল কিনো, ওটা থেকে ধীরে ধীরে তুলে নিল পশুর নরম চামড়ার টুকরোটা। কিনো এবারে ডেস্কের কালো কাপড়টার ওপর সযত্নে নামিয়ে রাখল রত্নটা। মোটা ব্যবসায়ীর মুখের ওপর দৃষ্টি স্থির ওর। মুখের চেহারার ভাব এতটুকু পরিবর্তন হলো না লোকটার, কিন্তু ডেস্কের তলায় আঙুল ফস্কে গেল মুদ্রাটা; নিঃশব্দে পড়ে গেল মেঝেতে। লোকটার ডান হাত এবার কালো কাপড়ে রাখা মুক্তোটা স্পর্শ করল। দুআঙুলে রত্নটা তুলে নিয়ে কাছ থেকে পরখ করছে সে।

শ্বাস চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে কিনো ও তার সঙ্গীদের। অন্যান্য দর্শকরা অনুচ্চস্বরে কথাবার্তা বলছে।

মুক্তাটা যাচাই করছে, বলাবলি করছে তারা। এখনও দাম বলেনি। ওদের মধ্যে দর-দাম হয়নি এখনও।

কালো কাপড়ের ওপর মুক্তোটা রেখে দিল ব্যবসায়ী। তর্জনী দিয়ে ওটায় চাপ দিয়ে বিষণ্ণ হাসি ফুটিয়ে তুলল মুখে।

আমি দুঃখিত, বন্ধু, বলে, কাঁধ ঝাঁকাল সামান্য, বোঝাতে চাইল তার কিছু করার নেই।

খুব দামী মুক্তা, বলল কিনা।

ব্যবসায়ী আঙুলে নাড়াচাড়া করছে রত্নটা, ফলে ওটা কাপড়ের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

এই মুক্তোটা অতিরিক্ত বড়, বলল লোকটা। কে কিনবে এটা? কেউ কিনবে না। আমি দুঃখিত।

কিনো ওর কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না।

এটা দুনিয়ার সেরা মুক্তা! বলে উঠল সে। এ জিনিস কেউ চোখেও দেখিনি!

মুক্তোটা বড়, দেখতেও সুন্দর, কিন্তু দাম পাবেন না, বলল ব্যবসায়ী। আমি বড়জোর একহাজার পেসো দিতে পারি।

কিনোর মুখখানা কালো আর হিংস্র হয়ে উঠল।

পঞ্চাশ হাজারেও এ জিনিস পাবে না, বলে উঠল। কথাটা আপনি নিজেও জানেন, কিন্তু আমাকে ঠকানোর জন্যে মিথ্যে কথা বলছেন!

ওর সাধা দাম শুনে লোকে নানা কথা বলছে শুনতে পেল ব্যবসায়ী। খানিকটা ভয় পেয়ে গেল সে।

যাও না, অন্যদের কাছেও যাচাই করে দেখো না, চট করে বলল হোঁদল কুতকুত। আমার কথাই শুনতে হবে এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে। আরও তো অফিস আছে, তাদের কাছে যাও। কিংবা চাইলে তাদের এখানে নিয়ে আসতে পারো। তাহলেই বুঝতে পারবে আমরা ঘোঁট পাকিয়েছি কিনা। অ্যাই, ছোড়া!

পেছনের দরজা দিয়ে উঁকি দিল লোকটার ভৃত্য।

যা তো, গর্জে উঠল লোকটা। আর সব ব্যবসায়ীদের এখানে ডেকে নিয়ে আয়। কেন ডেকেছি বলবি না। শুধু বলবি তারা এলে আমি খুশি হব।

মোটা ব্যবসায়ী ডেস্কের নিচে হাত নিয়ে, তার প্রিয় মুদ্রার খেলাটা আবারও চালু করল।

কিনোর প্রতিবেশীরা পরস্পরের সঙ্গে মৃদু সুরে আলোচনা করছে। মুক্তোটায় কোন খুঁত রয়েছে মনে করে ভয় পাচ্ছে তারা। মুক্তোটা বিরাট কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু এর রঙটাও তো কেমন অদ্ভুত কিসিমের। রংটার কথা, কিনো ওটা খুঁজে পাওয়ার পর থেকেই মাথায় আছে পড়শীদের। এক হাজার পেসো মন্দ কি? যার কিছুই নেই তার জন্যে এক হাজার পেসে তো অনেক। কিনো মেনে নিলেই তো তার পকেটে চলে আসছে এতগুলো টাকা। গতকাল পর্যন্ত যেখানে তার কিছুই ছিল না।

কিন্তু কিনোর মুখখানা কঠোর, চোয়াল শক্ত। চারপাশে ওর বুনো জন্তুজানোয়ার এমনি অনুভূতি হচ্ছে। প্রতিকূল পরিবেশে নিজেকে বড় অসহায় বোধ হচ্ছে ওর। আশ্চর্য সুন্দর মুক্তোটা দ্যুতি ছড়াচ্ছে কালো কাপড়ের ওপর এবং ব্যবসায়ী লোকটা সেদিক থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারছে না।

দরজায় দাঁড়ানো লোকজন সরে, অপর তিন ব্যবসায়ীকে অফিসটিতে প্রবেশ করতে দিল। জনতা এমুহূর্তে থম মেরে গেছে। ঘটনা স্বচক্ষে অবলোকন করতে চায় তারা, যা কথাবার্তা হবে শুনতে চায়। কিনো নিশ্চুপ এবং সতর্ক। কে যেন জামা ধরে টানছে টের পেয়ে ঘুরে চাইল। হুয়ানার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল ওর। চোখ ফেরানোর পর মনোবল ফিরে পেল সে।

সওদাগরের একে অন্যের দিকে ভুলেও তাকাচ্ছে না। এমনকি মুক্তোটার অস্তিত্ব সম্পর্কেও যেন কিছু জানে না তারা। মোটা লোকটা অবশেষে নীরবতা ভঙ্গ করল।

আমি এ লোককে তার মুক্তোর জন্যে একটা দাম বলেছি, বলল সে। কিন্তু ওর মনে হচ্ছে আমি ন্যায্য দাম বলিনি। আপনারা যদি এটা-এই মুক্তোটা-দেখে একটু দামটা বলতেন তবে ও একটা ধারণা পেত।

শুনলে তো, কিনেকে উদ্দেশ্য করে বলল মোটকু। আমি কত বলেছি ওদের জানাইনি।

প্রথম ক্রেতা বেঁটে মতন রোগাটে এক লোক। মুক্তোটা দুমুহূর্ত লক্ষ্য করে দুআঙুলে তুলে নিল সে। তারপর কালো কাপড়টার ওপর ছুঁড়ে দিল।

তাই দেখে হৃৎপিণ্ডটা গলার কাছে উঠে এল কিনোর।

আমি এটার জন্যে এক পয়সাও দিতে রাজি নই, ঘোষণা করল সে। মাগনা দিলেও নেব না। এটা আসল মুক্তো নয়!

দ্বিতীয় বণিক নম্রভাষী বেঁটে খাটো মানুষ। মুক্তোটা হাতে নিয়ে সাবধানে পরখ করে দেখল। পকেট থেকে একটা কাঁচ বের করে আবারও যাচাই করল। তারপর গলার ভেতর হেসে উঠল।

সেরা মুক্তো প্লাস্টারে তৈরি হয়, বলল সে। আমি এগুলো ভাল করেই জানি। এই মুক্তোটা নরম, কয়েক মাসের মধ্যেই রঙ চটে যাবে। দেখুন।

কিনোকে কাঁচটা দিল সে। কাঁচ ভেদ করে কোনদিন মুক্তো দেখেনি কিনো। মুক্তোটা বড় অদ্ভুত দেখাল ওর চোখে।

তৃতীয় ব্যবসায়ী কিনোর হাত থেকে মুক্তোটা নিল।

আমি একজনকে চিনি যার এধরনের জিনিস পছন্দ, বলল লোকটা। আমি পাঁচশো পেসো দিতে পারি। হয়তো একশো লাভ থাকবে।

লোকটার হাত থেকে মুক্তোটা প্রায় ছিনিয়ে নিল কিনো। চামড়ায় ভরে রেখে দিল ওটা ছোট থলেটার ভেতর। তাই দেখে ডেস্কের পেছনে বসে থাকা মোটা ব্যবসায়ীর মুখে কথা ফুটল।

লোকে আমাকে গাধা ভাবতে পারে, বলল সে, কিন্তু তারপরও একহাজার পর্যন্ত দিতে পারি আমি।

থলেটা পকেটে চালান করে দিল কিনো।

করে কি? হাহাকার করে ওঠে মোটা।

আপনারা আমাকে ঠকাচ্ছেন! ক্ষুদ্ধ কিনো বলে। মুক্তা আমি এখানে বেচব না। রাজধানীতে নিয়ে যাব।

চকিতে পরস্পর চোখাচোখি হলো ব্যবসায়ীদের। বেশি কম বলে ফেলেছে বুঝতে পারছে ওরা। মুক্তোটা হাতাতে না পারলে বড় ব্যবসায়ী খেপে বোম হয়ে যাবে, তখন তাকে সামলাবে কে? ডেস্কে বসা মোটা কথা বলল আবার।

পনেরোশো পর্যন্ত ওঠা যায়, বলল সে।

কিন্তু কিনো তখন জনতার ভিড় ঠেলে বেরিয়ে যাচ্ছে। ক্রুদ্ধ কিনো যখন হনহনিয়ে হাঁটা দিল, তার কানে তখন রক্তের উত্তাল প্রবাহ।

পেছন পেছন ছুটতে হলো হুয়ানাকে, স্বামীর নাগাল পেতে।

০৭. সাঁঝ ঘনালে

সাঁঝ ঘনালে, পড়শীরা তাদের ঘরে, সেদিনের ঘটনাগুলো নিয়ে আলোচনা করতে বসল। ওরা কেউ আগে কোনদিন এত সুন্দর মুক্তো চোখে দেখেনি। তাদের সবার ধারণা, কিনোর মুক্তোটা যেমন শোভাময় তেমনি দামী। কিন্তু ক্রেতারা একমত হয়নি ওদের সাথে। এবং তারা মুক্তোর দর-দাম ওদের চাইতে ভাল বোঝে।

ওরা মুক্তার ব্যাপারে কেউ কারও সাথে কথা বলেনি, বলাবলি করে প্রতিবেশীরা। সবাই বলল মুক্তাটা কম দামী।

আগেভাগেই ওরা আলাপ সেরে রাখেনি তো? একজনের মনে প্রশ্নের উদয় হয়।

তাহলে তো বলতে হয়, অন্যরা জবাব দেয়। সারা জীবনভর আমাদের ঠকিয়ে যাচ্ছে ওরা।

কারও কারও মতে কিনোর উচিত ছিল, পনেরোশো পেসো হাত পেতে নেয়া। এত টাকা জন্মে কোনদিন দেখেনি সে। বোকামিই করল হয়তো। রাজধানী শহরে গিয়ে হয়তো কোন ক্রেতা পেলই না, কে বলতে পারে। তখন আর শহরের ব্যবসায়ীরা ওকে আগের দাম দেবে না।

আবার অন্যদের ধারণা, কিনো বলিষ্ঠ এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ওর সাহসের কারণে আমরা সবাই সুফল ভোগ করব, বলে তারা। কিনোর জন্যে গর্ববোধ হচ্ছে তাদের।

নিজের ছোট্ট বাসাটায়, মাদুরে বসে বসে আকাশ-পাতাল ভাবছে কিনো। চুলোর কাছে; এক পাথরের নিচে লুকিয়ে রেখেছে ও মুক্তোটা। ভয়ভয় ভাবটা আবারও গ্রাস করছে ওকে। বাড়ি ছেড়ে অাজ অবধি দূরে কোথাও যায়নি সে। অচেনা মানুষ-জন, বিদেশ-বিভুই চিরদিনই আতঙ্কিত করে ওকে। বিশেষ করে, রাজধানী শহরটাকে ওর বড় ভয়, কখনও যায়নি তো।

এখান থেকে রাজধানীর তাও প্রায় একহাজার মাইলের দূরত্ব; সাগর পাড়ি দিয়ে, পাহাড়ী পথ ধরে, পৌঁছতে হবে সেখানে। প্রতি মাইল পথ অপরিচিত আর বিপদসঙ্কুল। কিন্তু কিনো অনুভব করছে, পুরানো দুনিয়াকে পেছনে ফেলে ওকে নতুন জীবনের সন্ধানে যেতেই হবে। ওর ভবিষ্যৎ-স্বপ্ন নিছক কল্পনা হয়ে থাকবে, ভাবতেই পারে না কিনো।

আমি যাব, ঘোষণা করল ও।

হুয়ানা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল স্বামীর দিকে। একটু পরে সংবিৎ ফিরে পেয়ে, ছেলেকে গোসল করাল। তারপর তাকে খাইয়ে-দাইয়ে, বেশ কিছু কর্নকেক বানাল রাতের জন্যে।

ইতোমধ্যে হুয়ান টমাস এসে কিনোর পাশে বসেছে। দীর্ঘক্ষণ টু শব্দটি করল না কিনোর ভাই। অবশেষে মুখ খুলল কিনা।

আর কি করার ছিল আমার? বলে উঠল ও। সব ব্যাটা বাটপাড়!

ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে হুয়ান টমাস। কিনোর চাইতে বয়সে বড় সে, অভিজ্ঞ। কিনো বড়ভাইয়ের মতামত জানতে সাগ্রহে অপেক্ষা করছে।

আমার জানা নেই, বলল হুয়ান টমাস। শুধু এটুকু জানি, সারা জীবন লোকে আমাদের ঠকিয়ে খাচ্ছে, তবু তো বেঁচে আছি। তুই ওদের কাছে মুক্তা বেচলি না। তুই চাইছিস গোটা সমাজ বদলে দিবি। তোর জন্যে আমার ভয় হয়।

খিদের কষ্ট ছাড়া আর কোন কিছুকে ভয় কি আমার? জবাব চায় কিনে। কিন্তু বড়ভাই দুপাশে মাথা নাড়ে আস্তে আস্তে।

সবারই তো পেটের চিন্তা, বলল হুয়ান টমাস। কিন্তু ধর, তোর মুক্তাটা যদি অনেক দামীও হয়, তুই কি মনে করিস ন্যায্য দাম পাবি?

মানে? কি বলতে চাইছ তুমি?

আমি নিজেও জানি না, মৃদু স্বরে বলে হুয়ান টমাস। কিন্তু তোর জন্যে আমার ভয় করছে। নতুন দুনিয়ায় পা রাখতে যাচ্ছিস তুই, অথচ রাস্তা চিনিস না।

আমি যাচ্ছি। শিগগিরিই যাচ্ছি।

হ্যাঁ, বলল হুয়ান টমাস। তা যা, কিন্তু তোর কি ধারণা, রাজধানী শহরে সব ফেরেশতারা বসে আছে? এখানে, এই শহরে, তোর বন্ধু-বান্ধব আছে, আমি আছি। কিন্তু রাজধানীতে কে আছে, বল?

কিন্তু আমি কি করব তুমিই বলো, বলল কিনো। ব্যবসায়ীরা আমাদের চিরটাকাল ঠকিয়েছে। আমার ছেলেটাকে তো একটা সুযোগ দিতে হবে। ওরা আমার বাচ্চাটাকেও ঠকিয়ে খেতে চাইছে। বন্ধুরা আমার পাশে থাকবে।

থাকবে, যতক্ষণ না নিজেদের ওপর বিপদ আসে, বলল হুয়ান টমাস। এবার সটান উঠে দাঁড়িয়ে যোগ করল, খোদাকে ভুলিস না, তিনি তোর সাথে থাকবেন।

মাথা নিচু করে বসে রইল কিনো। ভাইয়ের কথাগুলো বড় শীতল শুনিয়েছে ওর কানে।

হুয়ান টমাস চলে গেছে অনেকক্ষণ, মাদুরে বসে এখনও সাত-পাঁচ ভেবে চলেছে কিনো। ক্লান্তি অনুভব করছে সে, বোধ করছে হতাশা। ইতিকর্তব্য ঠিক করতে পারছে না। সন্ধ্যা রাতের নানা অস্কুট শব্দ বাজছে ওর কানে।

কিনোর উদ্দেশে চাইল হুয়ানা। বুঝতে পারছে মেয়েটি, এমুহূর্তে কিনোকে নীরবে সঙ্গ দিলেই তার সবচেয়ে বেশি উপকার করা হবে। ভয় পাচ্ছে ও, তাই কয়েটিটোকে বুকে চেপে ধরে বিপদনাশী এক গান ধরল।

কিনোর মধ্যে নড়াচড়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। হুয়ানার জানা আছে, খিদে পেলে নিজেই খাবার চাইবে ওর স্বামী।

কিনোর চোখের দৃষ্টি স্থির-অবিচল। বাসার বাইরে কিসের যেন শব্দ হলো মনে হলো ওর। বাইরে অশুভ কিছু যেন ওঁত পেতে রয়েছে ওর জন্যে। কৃষ্ণবর্ণ, অভিশপ্ত জিনিসটা ওকে যেন ঘরের বাইরে টেনে বের করে, লড়াই করতে আহ্বান জানাচ্ছে। সড়াৎ করে ডান হাতটা শার্টের ভেতর চলে গেল কিনোর। ছোরাটা জায়গা মতই আছে। চোখজোড়া বিস্ফারিত ওর। সিধে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার উদ্দেশে এগিয়ে গেল ও।

স্বামীকে ফেরাতে চেষ্টা করল হুয়ানা। একটা হাত তুলেছিল, কথা বলার জন্যে হাঁ হয়ে গিয়েছিল ওর মুখ।

অন্ধকারের দিকে দীর্ঘক্ষণ চেয়ে থেকে, তারপর বেরিয়ে এল কিনো। হুয়ানা শুনতে পেল, বাতাসে কি যেন একটা সাঁ করে উড়ে এসে আঘাত হানল কিনোকে। মুহূর্তের জন্যে ভয়ে হাত-পা পেটের ভেতর সেঁধিয়ে গেল হুয়ানার। পরমুহূর্তে বুনো বেড়ালীর মতন দাঁত বেরিয়ে পড়ল ওর

আক্রমণের ভঙ্গিতে।

কায়েটিটোকে আলগোছে মেঝেতে শুইয়ে দিয়ে, চুলোর ধার থেকে একখণ্ড পাথর তুলে নিল হুয়ানা। তারপর ছুটে বেরিয়ে গেল বাইরে।

মাটিতে পড়ে রয়েছে কিনো।

আশপাশে কাউকে চোখে পড়ল না হুয়ানার। বাতাসের আর ঢেউয়ে শব্দ ছাড়া চারদিক সুনসান। কিন্তু টের পেল ও, কেউ একজন ছিল ধারেকাছে-কাঠের বেড়ার ওপাশে কিংবা বাড়ির আবছায়ায় ঘাপটি মেরে।

পাথরটা ফেলে দিয়ে দুহাতে স্বামীকে জড়িয়ে ধরল হুয়ানা। তাকে উঠে দাঁড়িয়ে বাসায় হেঁটে যেতে সাহায্য করল। কিনোর মুখ বেয়ে দরদর করে রক্ত গড়াচ্ছে। কান থেকে চিবুক অবধি ওর বিশ্রীভাবে কেটে গেছে। এপাশওপাশ মাথা দোলাল কিনো। ওর জামা-কাপড় ছিড়ে গেছে জায়গায় জায়গায়। মাদুরে বসিয়ে, হুয়ানা কিনার মুখ থেকে রক্ত মুছিয়ে দিল ওর স্কার্ট দিয়ে। কিনোর জন্যে এরপর খানিকটা পানি নিয়ে এল, কিন্তু দুপাশে তখনও মাথা নেড়ে যাচ্ছে ওর স্বামী।

কে ছিল ওটা? শুধাল হয়না।

জানি না, বলে কিনো। দেখতে পাইনি।

কিনোর মুখের জখম পানি দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করে দিল হুয়ানা। কিনো সামনে ফাঁকা দৃষ্টিতে চেয়ে বসে রইল।

কিনো, স্বামী আমার, বলে উঠল হুয়ানা, কিন্তু কিনোর দৃষ্টি যেমনকে তেমন রইল। আমার কথা শুনতে পাচ্ছি তুমি?

পাচ্ছি, ক্লান্তি ফুটল কিনোর কণ্ঠে।

ওগো, আকুল কণ্ঠে বলল হুয়ানা। মুক্তাটা অপয়া। এসো, আমরা ওটাকে ধ্বংস করে দিই, নইলে ওটাই আমাদের ধ্বংস করবে! পাথর দিয়ে ভেঙে দুটুকরো করে দিই এসো। আর না হয় সাগরে ছুঁড়ে ফেলে দিই চলো! কিনো, মুক্তাটা অলক্ষুণে, অপয়া!

হুয়ানা যখন এসব বলছে, আলো ফিরল কিনোর চোখে। ধকধক করে জ্বলছে চোখজোড়া, মুখখানা কঠোর হয়ে উঠেছে।

না, দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা দিল ও। আমি শেষপর্যন্ত লড়াই করব। দেখো, আমিই জিতব! ভাগ্যলক্ষ্মীকে এভাবে পায়ে ঠেলতে পারি না আমরা।

দুম করে মাদুরের ওপর কিল মারল কিনো। কেউ আমাদের সৌভাগ্য ছিনিয়ে নিতে পারবে না।

হুয়ানার দিকে চাইল কিনো। রাগ অনেকটা পড়ে এসেছে ওর। হাত রাখল বউয়ের কাঁধে।

বিশ্বাস করো, বলল ও, আমি সাহসী পুরুষমানুষ। সকালবেলা, ক্যানু নিয়ে আমরা সাগরে ভেসে পড়ব, তারপর পায়ে হেঁটে হোক, যেভাবে হোক পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে রাজধানীতে গিয়ে হাজির হব। তুমি থাকবে আমার সাথে। অমিদের কেউ ঠকাতে পারবে না দেখে নিয়ো।

ওগো, অবসাদগ্রস্ত কণ্ঠে বলল হুয়ানা। আমার ভয় করছে। বীরপুরুষরাও তো মারা পড়ে। তারচেয়ে চলো, সাগরের জিনিস সাগরে ফেলে দিই।

তারপর চুপ করে গেল হুয়ানা।

একটু ঘুমিয়ে নাও, বলল কিনো। আলো ফুটলেই রওনা দেব আমরা। তুমি ভয় পাচ্ছি আমার সাথে যাওয়ার কথা শুনে?

না তো, জবাব দিল হুয়ানা। হুয়ানার গালে কিনোর হাতের আলতো, উষ্ণ ছোঁয়া লাগল।

একটু ঘুমিয়ে নেয়া যাক, নরম সুরে বলল ও।

০৮. আঁধারে চোখ মেলে চাইল কিনো

আঁধারে চোখ মেলে চাইল কিনো। কাছেই কিসের যেন নড়াচড়া টের পেল, কিন্তু স্থির রইল ও, একচুল নড়ল না। আঁধার ভেদ করে দেখার চেষ্টা করছে। ছোট্ট বাসাটার খুদে গর্তগুলো দিয়ে চুইয়ে ঢুকেছে চাঁদের আলো।

চাঁদের বিভায়, হুয়ানা আলগোছে উঠে পড়ছে মাদুর ছেড়ে লক্ষ্য করল কিনো। চুলোর উদ্দেশে ওকে যেতে দেখল সে। হুয়ানা পাথরটা সরাতে মৃদু একটু শব্দ হলো। এবার সে নিঃশব্দে দরজার দিকে যাচ্ছে। মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়িয়ে, ঝুকে পড়ল কয়েটিটোর দোলনার ওপর। এবার পা টিপে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। কিনো ভয়ানক রেগে গেছে। ধড়মড় করে উঠে পড়ে অনুসরণ করল হুয়ানাকে। সাগরের উদ্দেশে হুয়ানার চলমান পদশব্দ নিস্তব্ধ রাতে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে কিনা।

অনুগমনরত কিনোর মাথায় আগুন ধরে গেল।

ঝোপ-ঝাড়ের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে, পাথর মাড়িয়ে অবিচল এগিয়ে চলেছে হুয়ানা।

হঠাৎ করে কিনোর অশুয়ান পায়ের আওয়াজ পেয়ে, পড়ি কি মরি করে দৌড় দিল সে।

হাত শূন্যে, মুক্তোটা এক্ষুণি ছুঁড়ে ফেলে দেবে সাগরের জলে। কিনো ঝাপিয়ে পড়ে শক্ত করে চেপে ধরল হাতটা, তারপর মোচড় মেরে কেড়ে নিল মুক্তোটা।

চটাস করে এক চড় পড়ল হুয়ানার গালে। পাথরের ওপর সে মুখ থুবড়ে পড়ে যেতে, কষে এক লাথি মারল কিনো। চাঁদের উদ্ভাসিত আলোয়, ছোট ছোট ঢেউ বয়ে যাচ্ছে হুয়ানার দেহের ওপর দিয়ে, লক্ষ্য করল কিনে। পানিতে, হুয়ানার পায়ের কাছে ফুলে ভেসে উঠছে স্কার্টটা।

কিনো নিচের দিকে চেয়ে হিংস্র কুকুরের মতন দাঁত খিচাল। বিস্ফারিত, আতঙ্কিত চোখ তুলে চাইল হুয়ানা। কসাইয়ের সামনে দাঁড়ানো ভেড়ার মত লাগছে ওর নিজেকে। কিনো ওকে এখন মেরে ফেলতে চাইলেও ঠেকাতে পারবে না। মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করছে হুয়ানা। একটু পরে হুঁশ ফিরে পেল যেন কিনো। হুয়ানা কি করতে যাচ্ছিল ভেবে দুর্বল হয়ে পড়ল। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা-ভাবনা করতে পারছে না ও। ঘুরে দাঁড়িয়ে টলতে টলতে ঝোপের মধ্যে দিয়ে ফিরে চলল।

হঠাৎ, শুনতে পেল কে যেন ছুটে আসছে ওর দিকে। আতঙ্কিত কিনো ঘুরে দাঁড়াল। ছোরাটা বের করে চালিয়ে দিতে, ওটা ঘ্যাঁচ করে গেঁথে গেল প্রতিপক্ষের দেহে। আর্তনাদ ছেড়ে এবার কে যেন টান মেরে মাটিতে ফেলে দিল ওকে, পকেট হাতড়াচ্ছে ওর লোভীর মত। মুক্তোটা ধস্তাধস্তির ফলে, ছোট্ট পাথুরে পথটার ওপর গড়িয়ে পড়ল। চাঁদের আলোয় ঝিকোচ্ছে ওটা।

ওদিকে পানিতে পড়ে রয়েছে হুয়ানা। মুখ আর শরীরের একটা পাশে ভয়ানক যন্ত্রণা হচ্ছে তার। কোনমতে হাঁটুতে ভর দিয়ে বসল। কিনোর ওপর রাগ হচ্ছে না ওর। কিনোকে হুয়ানার প্রয়োজন, ওকে ছাড়া বাঁচবে না সে। কিনোকে অতখানি বোঝে না, কিন্তু এটা জানে লোকটাকে ভালবাসে সে। কিনোকে অনুসরণ করবে ও। হয়তো বাঁচাতে পারবে কিনোকে এই অভিশপ্ত মুক্তোটার হাত থেকে।

সাগরের পানিতে মুখ ধুয়ে, ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়াল হয়না। তীর ধরে শ্লথ পায়ে কিনোর খোজে চলল। দক্ষিণ দিক থেকে ভেসে এসেছে কয়েক খন্ড মেঘ। তাদের ফাঁক-ফোকর গলে মাঝেমধ্যে উঁকি দিচ্ছে চাঁদ। কাজেই আলো আঁধারির মধ্যে হাঁটতে হচ্ছে হুয়ানাকে। পিঠটা ভেঙে পড়ছে ব্যথায়, নুয়ে পড়েছে মাথা। ঝোপ-ঝাড়ের মধ্য দিয়ে যখন এগোচ্ছে চাদঁ তখন মেঘে ঢাকা। আলো ফুটলে, পাথুরে পথটার ওপর ঝকমক করতে দেখল ও মস্তবড় মুক্তোটাকে। হাঁটু গেড়ে বসে ওটা তুলে নিল হুয়ানা।

এক টুকরো মেঘের আড়াল নিল আবার চাঁদ। হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে হুয়ানা ভাবছে, আবারও সাগরে ফিরে যাবে কিনা। মেঘের ওপাশ থেকে চাঁদ ফুড়ে বেরোতে, হুয়ানা লক্ষ্য করল, ওর সামনে পায়ে চলা পথটার ওপর দুজন পুরুষ লোক পড়ে রয়েছে। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল হুয়ানা। কিনো না ওটা? অপর লোকটা অপরিচিত। গলা বেয়ে রক্তের নদী বইছে তার।

একটু নড়ে উঠে কথা বলার চেষ্টা করল কিনো। ধীরে ধীরে নড়াচড়া করছে ওর হাত-পা, আধ মরা কোন জন্তুর চার পায়ের মতন লাগছে দেখতে।

পথের ওপর এক লোক মরে পড়ে আছে। এবং তার পাশে পড়ে রয়েছে কিনোর ছোরা। রক্তে মাখামাখি ওটা।

পুরানো জীবনের জন্যে হুতাশ উঠল হুয়ানার মনে। মুক্তোটা পাওয়ার আগে কত নিশ্চিন্ত-নিঝঞাট ছিল তাদের জীবন।

কিন্তু রত্নটা পাওয়ার পর থেকে যেন শনির দশায় পেয়েছে ওদেরকে। মুক্তো তো নয় যেন রাহু একটা। অলক্ষুণে কত ঘটনাই তো ঘটে গেল। আর এখন, কিনো কিনা এক লোককে খুন করে বসে আছে। বাচ্চা নিয়ে পালানো ছাড়া ওদের স্বামী-স্ত্রীর এ মুহূর্তে আর কি করার আছে? এ তল্লাট ছেড়ে পালিয়ে যেতে হবে ওদের।

হুয়ানার জ্বালা-যন্ত্রণা নিমেষে দূর হয়ে গেছে। রাস্তার ওপর থেকে টেনে হিচড়ে, লাশটা এক ঝোপের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল সে। এবার স্বামীর কাছে গিয়ে ভেজা স্কার্ট দিয়ে তার মুখ মুছিয়ে দিল। শেষমেষ, কথা ফুটল কিনোর মুখে।

ওরা মুক্তটা কেড়ে নিয়ে গেছে, বলল। আমার সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।

অসুস্থ বাচ্চাকে যেভাবে দেবে, তেমনিভাবে স্বামীকে সান্ত্বনা দিল হুয়ানা।

এই যে, তোমার মুক্তা, বলল ও। রাস্তার ওপর পড়ে পেয়েছি। আমার কথা শুনতে পাচ্ছ এখন? এই যে, তোমার মুক্তা আমার কাছে। বুঝতে পারছ আমার কথা? এক লোককে খুন করে ফেলেছ তুমি। পালাতে হবে আমাদের। লোকে আমাদের পিছু নেবে। কিনো, বুঝতে পারছ কিছু? ভোরের আলো ফোটার আগেই আমাদের এখান থেকে সরে পড়তে হবে।

কে যেন হামলা করে আমার ওপর, বলে কিনে। আত্মরক্ষার জন্যে ওকে আঘাত করি আমি।

তোমার কথা কেউ বিশ্বাস করবে মনে করেছ?

না, বলল কিনো, গভীর শ্বাস টেনে বুক ভরে নিল। তুমি ঠিকই বলেছ!

দৃঢ়তা-বলিষ্ঠতা ফিরে পাচ্ছে কিনো।

যাও, বাসায় গিয়ে কয়েটিটোকে নিয়ে এসো, বলল ও। সমস্ত শস্যদানাও নিয়ে আসবে। পানিতে ক্যানু ভাসাচ্ছি, এ এলাকা ছেড়ে পালাব আমরা।

কিনো ওর ছোরাটা তুলে নিয়ে, হুয়ানাকে রেখে রওনা হলো। সৈকতের উদ্দেশে ছুটতে ছুটতে অবশেষে ক্যানুর কাছে এসে থামল। মুখ হাঁ হয়ে গেছে, চাঁদের আলোয় নৌকার তলদেশে মস্ত এক গর্ত আবিষ্কার করে। রাগে দেহে মত্ত হাতির জোর অনুভব করল কিনে। শক্ত প্লাস্টারে তৈরি ও দাদার আমলের এই ক্যানু। কোন্ হতচ্ছাড়া জানি ওটার দফারফা করে ছেড়েছে।

যে কোন মুক্তো-ডুবুরির জন্যে, নৌকার ক্ষতি হওয়া মানে পেটে লাথি পড়া। এমনকি মানুষ খুন করাটাকেও এখানে এত বড় পাপ হিসেবে দেখা হয় না। নৌকার ছেলেপুলে নেই, এবং সে অসহায়, যুদ্ধ করতে পারে না। ক্ষতিগ্রস্ত নৌকা আবার সারিয়ে তোলা প্রায় অসম্ভব একটা কাজ।

ক্ষুব্ধ, ব্যথিত কিনো এখন করতে পারে না হেন কাজ নেই।

কিনোর জীবনে বেঁচে থাকার এখন একটাই উদ্দেশ্য। আত্মগোপন করে লড়াই করা। পরিবারের জন্যে যুদ্ধ করতে হবে ওকে। সমুদ্রতট ধরে ছুট দিল ও উর্ধ্বশ্বাসে, ঝোপ-ঝাড় এড়িয়ে পথ করে নিয়ে বাসার কাছাকাছি এসে হাজির হলো।

ধলপহরের আলোয় মোরগের পাল সবে ডাকাডাকি শুরু করেছে, জেগে উঠছে লোকালয়। প্রথম ধোঁয়ার রেখা পাক খেয়ে উঠে যাচ্ছে কাঠের বাসাগুলোর ওপরে। নাস্তা তৈরি হচ্ছে ঘরে ঘরে। ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে।

ঝোপে-ঝাড়ে পাখিদের কলরোল। চাঁদের কিরণ ফিকে হয়ে আসছে, ক্রমেই ঘন হচ্ছে দখিনা মেঘরাজি। বাতাসে বৃষ্টির গন্ধ পাচ্ছে কিনা।

তড়িঘড়ি বাসার উদ্দেশে এগোনোর সময়, সহসা খুশি-খুশি হয়ে উঠল কিনোর মন। এখন ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা-ভাবনা করতে পারছে সে। চিন্তা তো একটাই। সটকে পড়তে হবে। জামার ভেতর রাখা প্রকাণ্ড মুক্তোটায় হাত ছোয়াল ও। এবার টের পেল ছোরাটা ওর গলায় ঝুলছে।

হঠাৎ, সামনে ক্ষীণ আলো লক্ষ্য করল কিনো, তারপর লম্বা এক অগ্নিশিখা লকলক করে বাতাসে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। দিনের বেলার মত পরিষ্কার হয়ে উঠেছে রাস্তাটা উদ্ভাসিত আলোয়, জোরালো শব্দ করছে অগ্নিশিখাটা।

ওর মাথা গোঁজার ঠাই, কাঠের বাসাটায় আগুন লেগেছে, খিঁচে দৌড় দিল কিনো। মাত্র অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পুড়ে ছাই হয়ে যায় এ ধরনের বাসা।

কিনো দৌড়াচ্ছে, মুখোমুখি পড়ে গেল কোলে কয়োটিটোকে নিয়ে ছুটে আসা হুয়ানার। কাঁদছে অসহায়-নিস্পাপ বাচ্চাটা। হুয়ানার চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছে, আতঙ্কে।

কি ঘটেছে নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছে কিনো। তাই হুয়ানাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। হুয়ানা নিজে থেকেই বলল।

কয়েকজন লোক আসে বাসায়, জানাল হুয়ানা। মুক্তাটা খুঁজছিল। না পেয়ে আগুন দেয়।

কিনোর মুখ আলোকিত আগুনের উজ্জ্বল আভায়।

কারা ছিল ওরা?

জানি না, বলল হুয়ানা। দেখতে পাইনি।

বাড়ি-ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে আসছে পাড়া-প্রতিবেশী। কাঠের জ্বলন্ত খড়ি খসে অন্যান্য বাসায় যাতে না পড়ে সে চেষ্টায় প্রাণান্ত পরিশ্রম করে চলেছে তারা।

কিনোর হঠাৎ ভয় লেগে উঠল। আলোর ঔজ্জ্বল্য ওকে ভড়কে দিয়েছে। ঝোপের ভেতর পড়ে থাকা মৃতদেহটার কথা মনে পড়ে গেল ওর।

বাহু ধরে টেনে হুয়ানাকে বাড়িটার ছায়ায় নিয়ে এল সে। পড়শীদের চোখে পড়তে চাইছে না। হুমকি-ছড়ানো আগুনের কাছ থেকে বউকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল।

ওরা স্বামী-স্ত্রী ত্বরিত পৌঁছে গেল হুয়ান টমাসের বাসায়। হুয়ানাকে টানতে টানতে ভেতরে প্রবেশ করল কিনো। বাইরে নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিচারে শোরগোল করছে।

পড়শীদের ধারণা, কিনো হয়তো সপরিবারে জ্বলন্ত বাসাটার ভেতরে রয়েছে।

০৯. হুয়ান টমাসের বাসাটা

হুয়ান টমাসের বাসাটা প্রায় অবিকল কিনোরটার মতনই। এ পাড়ার বেশিরভাগ বাসাই দেখতে একরকমের। প্রতিটা বাসাতেই ফুটি ফাটা ভরা কিনো আর হুয়ানা দেয়ালের ফুটো দিয়ে আগুনের শিখা দেখতে পাচ্ছে। দাউ দাউ আগুনে ওই যে ধসে পড়ল ওদের বাড়িটার ছাদ।

এবার বন্ধু-বান্ধবদের চেঁচামেচিতে আর হুয়ান টমাসের স্ত্রী, অ্যাপোলোনিয়ার আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠল বাতাস। অ্যাপোলোনিয়ার কান্নার কারণ তাদের স্বজন মারা পড়েছে। পরিবারের কেউ মারা গেলে মহিলারা এভাবেই হাহাকার করে থাকে।

আরে, হঠাৎ অ্যাপোলোনিয়ার খেয়াল হলো, সে পুরানো শাল পরে রয়েছে। অমনি সেরা শালটা গায়ে চড়ানোর জন্যে ছুটতে ছুটতে বাড়িতে ঢুকল।

ভাবী দেয়াল লাগোয়া এক বাক্সের দিকে চাইতে, শান্ত-অনুত্তেজিত কণ্ঠে কথা বলে উঠল কিনো।

ভাবী, আমরা এখানে, বলল ও। কান্নাকাটি করে লাভ নেই।

ভূত দেখার মত চমকে উঠল অ্যাপোলোনিয়া। তো-ত্তোমরা? এখানে ঢুকলে কিভাবে?

অত প্রশ্ন কোরো না, বলল কিনো। হুয়ান টমাসকে এখানে ডেকে আনো। আর সাবধান, কেউ যেন না জানে। ব্যাপারটা খুব জরুরী।

কিনোর উদ্দেশে একদৃষ্টে চেয়ে রইল ভাবী। আচ্ছা, বলল শেষমেষ।

কমুহূর্ত পরে স্ত্রীর সঙ্গে বাসায় ফিরল হুয়ান টমাস। একটা মোমবাতি জ্বেলে কোণায় দাঁড়ানো কিনোদের কাছে এল।

অ্যাপোলোনিয়া, বলল হুয়ান টমাস। দরজার কাছে যাও। কেউ যাতে ভেতরে ঢুকতে না পারে।

হুয়ান টমাস শুধু বয়সেই নয়, বুদ্ধিশুদ্ধিতেও কিনোর চাইতে বড়। পরিস্থিতি বুঝে কাজ করার ক্ষমতা রাখে সে।

এখন বল দেখি ঘটনাটা কি?

আঁধারে আমার ওপর হামলা হয়, বলল কিনো। ধস্তাধস্তি করতে গিয়ে একজনকে খুন করে ফেলেছি।

কাকে? চট করে প্রশ্ন করে বড় ভাই।

চিনি না, বলল কিনো। ভীষণ আঁধার ছিল তখন-কিছু ঠাহর হয় না। অবশ্য পরে চাঁদের আলোতেও চিনতে পারিনি।

লোকটা মুক্তার জন্যে এসেছিল, বলল হুয়ান টমাস। মুক্তাটা অপয়া, কিনো। ওটা তোর বেচে দেয়া উচিত ছিল। চাইলে এখনও হয়তো পারবি।

ভাই, বলল কিনো। খুব খারাপ ঘটনা ঘটে গেছে। মৃত্যুর চেয়েও খারাপ। আমার বাড়িটা তো পুড়িয়েছেই, ক্যানুটাও বরবাদ করে দিয়েছে। তার ওপর ঝোপের মধ্যে লাশ পড়ে আছে। আমার ওপর নজর রাখছে শত্রুরা, বাগে পেলেই খতম করে দেবে। তুমি আমাদের লুকিয়ে রাখো, ভাই, আশ্রয় দাও।

তীক্ষ্ণ চোখে ভাইয়ের দিকে চেয়ে থেকে বুঝতে পারল কিনো, হুয়ান টমাস ভয় পাচ্ছে।

বেশিক্ষণ লুকিয়ে রাখতে হবে না, অভয় দিয়ে বলল কিনো।

ভাবিস না, ব্যবস্থা একটা করে ফেলব, হুয়ান টমাস আশ্বাস দিল।

আমি তোমাকে বিপদে ফেলতে চাই না, বলল কিনো। আজ রাতেই গা ঢাকা দেব আমি।

বেশ তো, বলল হুয়ান টমাস, ডাক ছাড়ল স্ত্রীর উদ্দেশে।

অ্যাপোলোনিয়া, দরজাটা লাগিয়ে এখানে এসো। সে এলে বলল, কিনারা এখানে আছে কেউ যেন না জানে।

বাড়িটার অন্ধকার কোণে, সারাটা দিন চুপচাপ বসে থাকল কিনো আর হুয়ানা। পড়শীদের কথা-বার্তা কানে আসছে ওদের। দেয়ালের ফুটো দিয়ে তাদের দেখতেও পাচ্ছে ওরা।

ওদের ভাঙা নৌকাটার বিষয়ে আলোচনা করছে পড়শীরা।

হুয়ান টমাস বাইরে বেরিয়ে গেল প্রতিবেশীদের সাথে কথা বলার জন্যে। কিন্তু তার ভাইয়ের হাতে অচেনা লোকটার হত্যাকাণ্ডের কথা ভুলেও মুখে আনল না।

আমার মনে হয় উপকূল ধরে দক্ষিণে চলে গেছে ওরা, একজনকে উদ্দেশ্য করে বলল হুয়ান টমাস। আরেকজনকে বলল, কিনো সাগর ছেড়ে থাকতে পারবে না। সাগর আমাদের রক্তে। ও হয়তো আরেকটা নৌকা খুঁজে পেয়েছে। এবার আরেকটু জুড়ে দিল ও। বেচারী অ্যাপোলোনিয়া দুঃখে বিছানা নিয়েছে।

সে দিন, সাগরের বুকে আর সাগরপারের ঝোপ-ঝাড়ের ওপর দিয়ে, জোরদার বাতাস বয়ে যাচ্ছিল। কাঠের ছোট ছোট বাসাগুলোও বাতাসের কবল থেকে রেহাই পেল না। আজ সাগরে কোন নৌকাই নিরাপদ নয়।

কিনো তো মারা পড়বে, পড়শীদের একজন বলল। সাগরে যদি নৌকা ভাসিয়ে থাকে।

অন্যরা সায় জানাল তার কথায়।

হুয়ান টমাস পড়শীদের সাথে আলাপ সেরে যতবারই ফেরে, কিছু না কিছু নিয়ে আসে কিনো আর হুয়ানার জন্যে। ছোট্ট এক থলে ভর্তি লাল বিন আর কিছু চাল এনেছে। এক কাপ শুকনো গোলমরিচ আর খানিকটা লবণ, এবং লম্বা, ভারী এক ছোরাও নিয়ে এসেছে।

ছোরাটা দেখে খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল কিনোর চোখ। ধার পরখ করতে গিয়ে আঙুল কেটেই বসেছিল প্রায়।

বাতাসের দাপটে ঢেউয়ের মাথায় মাথায় সাদা ফেনার মুকুট। ভীতসন্ত্রস্ত জন্তু-জানোয়ারের মত থরথর করে কাপছে গাছ-গাছালি। বেলাভূমি থেকে বালি উড়ে গিয়ে সাগরের ওপর মেঘের মত তৈরি করেছে। বাতাসের ঝাপটায় বৃষ্টির মেঘ উড়ে চলে গেছে কোথায়, আকাশ এখন স্বচ্ছ-নির্মল।

সন্ধে ঘনালে, ভাইয়ের সাথে আলোচনা করল হুয়ান টমাস।

কোথায় যাবি ঠিক করেছিস কিছু?

উত্তরে বলল কিনো। শুনেছি ওদিকে নাকি শহর আছে।

সাগরতীরের ধারে-কাছে ঘেঁষবি না, পরামর্শ দিল হুয়ান টমাস। লোকজন চোখ রাখছে। শহরের লোকেরা তোকে তন্নতন্ন করে খুঁজছে। মুক্তাটা এখনও সঙ্গে আছে?

আছে, জবাব দিল কিনো। ওটা হাতছাড়া করব না। চোখের দৃষ্টি ওর কঠোর আর নিষ্ঠুর হয়ে গেছে।

কয়োটিটো অল্প একটু কেঁদে উঠতে, গান গেয়ে ওকে শান্ত করল হুয়ানা।

আজকের দিনটা ভাল, বলল হুয়ান টমাস। তোদের ট্রাক বাতাসে মুছে যাবে।

চাঁদ ওঠার আগে, রাতের আঁধারে গা ঢাকা দিল কিনো আর হুয়ানা।

হুয়ানা পিঠে বহন করছে কয়োটিটোকে। শালে মোড়ানো বাচ্চাটা, মার কাঁধে এক গাল পেতে, ঘুমিয়ে কাদা। শালের একটা প্রান্ত দিয়ে হুয়ানার নাক ঢাকা, রাতের কনকনে বাতাস থেকে রক্ষা পাচ্ছে এর ফলে।

বিদায়ের আগে কিনোর দুগালে চুমো খেয়েছে হুয়ান টমাস।

অাল্লাহর নামে রওনা দে, বলেছে সে। মুক্তাটা পথে কোথাও ফেলে দিস।

ভাই, মুক্তাটা আমার জীবন-মরণ হয়ে দাড়িয়েছে, জবাবে বলেছে কিনো। ওটা ছুঁড়ে ফেলে দিলে জীবনটাও খোয়াব। ভাল থেকো তোমরা।

তেজী বাতাস খড়-কুটো, বালি আর নুড়িপাথর উড়িয়ে নিয়ে এদিক সেদিক ফেলছে। কিনো আর হুয়ানা মুখ ঢেকে হাঁটছে।

আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার। তারার আলোয় দুনিয়া উদ্ভাসিত।

সাবধানে পা চালাচ্ছে স্বামী-স্ত্রী। শহরে যেতে চায় না ওরা, কারও চোখে পড়তে চায় না। শহরটার পাশ কাটিয়ে উত্তরমুখো ঘুরল দুজনে। বালিময় যে রাস্তাটা ধরে এগোচ্ছে, জঙ্গলের মধ্য দিয়ে গিয়ে পরের শহরটায় মিশেছে সেটা।

দুপায়ে বালির ঝাপ্টা অনুভব করছে কিনো। ওদের পায়ের চিহ্ন মুছে যাবে বালির বুক থেকে, মনে মনে খুশি হয়ে উঠল ও। নক্ষত্রের আলোয়, বনের সরু রাস্তাটা দেখতে পাচ্ছে। কানে আসছে হুয়ানার পায়ের আওয়াজ। কিনো এতটাই হনহনিয়ে হাঁটছে, নাগাল পেতে রীতিমত ছুটতে হচ্ছে হুয়ানাকে।

আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের মত অন্ধকার রাতকে কিনোরও বড় ভয়। শিকারযোগ্য জানোয়ারের দশা এখন কিনোর। দ্রুত আর সতর্কতার সঙ্গে নড়াচড়া করছে সে। গাছ-পালার আর ঝোপ-ঝাড়ের ফাঁকে ফাঁকে বয়ে যাচ্ছে শনশন বাতাস। অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে ওঠে। আঁধার ভেদ করে হেঁটে চলেছে কিনো আর হুয়ানা।

চাঁদ শেষমেষ ওদের ডান দিকে মাথা তুলল। আলো দেখে স্তব্ধ হলো বাতাস, ফিরে এল গুমোট ভাবটা।

কিনো আর হুয়ানা ছোট্ট একফালি পথটা দেখতে পাচ্ছে সামনে। চাকার দাগ গভীর হয়ে দেবে বসেছে ওটার ওপর। বাতাস থম মেরে গেছে, ফলে ওদের পায়ের ছাপ খুঁজে পেতে কষ্ট হবে না অনুসরণকারীদের।

একটানা সারা রাত হাঁটল ওরা, কোথাও থামল না।

ভোরে, দিনের বেলাটা লুকিয়ে থাকার জন্যে একটা জায়গার খোঁজ করল কিনো। রাস্তার ধারে মিলল তেমনি এক গুপ্তস্থান। ঝোপের মধ্যে কোন এক জানোয়ার গর্ত তৈরি করেছিল। রাস্তা থেকে কারও চোখে পড়ার ভয় নেই। হুয়ানা বসে পড়ে বাচ্চাকে দুধ খাওয়াল, আর কিনো ফিরে গেল রাস্তাটায়। গাছের একটা ডাল ভেঙে নিয়ে, সাবধানে ঝাঁট দিয়ে মুছে দিল ওদের ট্র্যাক।

আলো ফুটছে একটু একটু করে। এ রাস্তা দিয়ে এক মালগাড়ি আসছে, শব্দ পেল কিনো। রাস্তার পাশে ঝোপের আড়ালে উবু হয়ে বসে, দুচাকার ভারী এক মালগাড়িকে পেরিয়ে যেতে দেখল ও। ওটা অতিক্রম করে যাওয়ার পর, রাস্তায় ফিরে এসে মালগাড়ির ট্র্যাক পরখ করে দেখল কিনো। ওর নিজের পায়ের ছাপ মুছে গেছে লক্ষ্য করল। মাটি আরেকবার ঝাঁট দিয়ে হুয়ানার কাছে ফিরে এল ও।

ভাবীর তৈরি করে দেয়া কর্নকেক থেকে কটা স্বামীকে দিল হুয়ানী। তারপর ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিল, ওদিকে কিনো বসে রইল পাহারায়।

গনগনে সূর্যটা দেখা দিল এবার। সাগরের ধারেকাছে নেই ওরা, বাতাস ভয়ানক শুকনো আর উত্তপ্ত। গায়ে আগুনের ছ্যাকা লাগছে যেন। গাছগাছালির গন্ধ ভেসে আসছে গরম বাতাসে। সূর্য মাথার ওপর চড়লে সজাগ হলো হুয়ানা। গাছের জটলার দিকে এবার আঙুলের ইশারা করল কিনো।

ওই গাছটার কাছ থেকে সাবধান, বউকে বলল ও। ওটাকে ছুঁয়ো না। এটা স্পর্শ করে চোখে হাত দিলে, অন্ধ হয়ে যাবে।

এরপর আরেকটা গাছ ইঙ্গিতে দেখাল কিনো। ওটার জাল ভেঙো না, বলল। ভাঙলে লাল রক্ত ছুটে আসবে, আর ওই রক্ত দুর্ভাগ্য বয়ে আনবে।

মাথা নেড়ে সামান্য হাসল হুয়ানা। এসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তারও জানা আছে।

কিনো, ওরা কি আমাদের পিছু নেবে? প্রশ্ন করল হুয়ানা। আমাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে?

করবে না আবার, বলল কিনো। আর বাগে পেলে মুক্তাটাও কেড়ে নেবে।

ব্যবসায়ীরা হয়তো ঠিক কথাই বলেছিল, আমতা আমতা করে বলল হুয়ানা। মুক্তাটা কম দামী। আমরা হয়তো ভুলই করেছি।

পকেটে হাত ভরে স্পর্শ নিল কিনো, তারপর বের করে আনল রত্নটা। রোদ পড়ে ঝিক করে উঠল ওটা।

না, বলল কিনো। দামী না হলে চুরি করার চেষ্টা করত না।

কে তোমার ওপর হামলা করেছে বুঝলে কিছু? জানতে চাইল হুয়ানা। ব্যবসায়ীদের কেউ?

কে জানে, জবাব দিল কিনো। দেখতে তো পাইনি।

মুক্তোটার দিকে চোখ রেখে আবারও স্বপ্নে-কল্পনায় বিভোর হলো কিনো। কি কি চাই তার স্বপ্ন দেখতে চেষ্টা করল ও। কিন্তু স্বপ্ন এলে তো। চোখের সামনে শুধু ভেসে উঠছে, মুক্তো পাওয়ার পর থেকে ভয়ঙ্কর যেসব ঘটনা ঘটেছে তার ছবি।

এটা বেচে একটা রাইফেল কিনব, বলল ও।

রাইফেলের ছবি মনের পর্দায় ফোটাতে চাইল কিনো, কিন্তু ভেসে উঠল কেবল মৃত্যুর দৃশ্য। খুন করে এসেছে যাকে, তার মুখখানা কেবল ফুটে উঠছে কল্পনায়।

গির্জায় বিয়ে হবে আমাদের, চট করে বলল কিনো।

বিয়ের কথা ভাবতে গিয়ে, কেবল হুয়ানার ছবি ফুটে উঠছে মানসপটে। হুয়ানার মুখে রক্ত…ও যেখানটায় আঘাত করেছিল।

কিনো তরাস খেয়ে গেছে। আমাদের ছেলেকে লেখাপড়া শেখাতে হবে, বলল ও।

মুক্তোর দিকে চোখ রেখে, ছেলে বই পড়ছে, এ ছবিটা ফোটাতে চেষ্টা করল মনের পর্দায়। কিন্তু তার বদলে, কয়েটিটোকে অসুস্থ করে দিয়েছিল যে হতচ্ছাড়া ডাক্তারটা, তার কথা প্যাঁচ খেয়ে রইল মগজে।

অগত্যা এসব চিন্তা বাদ দিয়ে মুক্তোটা ফের পকেটে ঢোকাল কিনো।

১০. গরমের জ্বালায় অতিষ্ঠ কিনো আর হুয়ানা

গরমের জ্বালায় অতিষ্ঠ কিনো আর হুয়ানা ঝোপের ছায়ায় আশ্রয় নিল।

খুদে পাখির তুড়ুক তুড়ুক চলেফিরে বেড়াচ্ছে আশপাশে।

হ্যাট দিয়ে চোখ ঢাকল কিনো, মাছির উপদ্রব থেকে রক্ষা পেতে মুখ ঢেকে নিল কম্বলে। তারপর দিল ঘুম।

কিন্তু হুয়ানার চোখে ঘুম নেই। মুখ ব্যথা করছে এখনও ওর, কিনোর বেমক্কা চড় খেয়ে। হুয়ানার কাটা চিবুকের চারপাশে ভনভন করছে ইয়া বড় বড় মাছি।

কয়োটিটোর ঘুম ভাঙতে, ওকে মাটিতে শোয়াল হুয়ানা। হাত-পা ছুঁড়ে খেলা করছে বাচ্চাটা, দুচোখ ভরে দেখছে গর্বিত মা। কয়োটিটো হাসল মার দিকে চেয়ে, পাল্টা হাসল হয়না। বাচ্চার সাথে খানিক খেলা করে, তারপর পানি পান করতে দিল ও।

স্বপ্ন দেখছে কিনো। অস্থিরভাবে নড়চিড়া করে গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠল আচমকা। লড়াইয়ের ভঙ্গিতে দুহাত খুঁড়ছে ও। হঠাৎ উঠে বসল ধড়মড় করে। হাপরের মত ওঠানামা করছে বুক।

উৎকর্ণ হলো কিনো, কিন্তু অরণ্যের গান ছাড়া আর কোন শব্দ বাজল না কানে।

কি হলো? হুয়ানা জানতে চাইল।

চুপ!

স্বপ্ন দেখছিলে তুমি।

হয়তো তাই।

চোখের পাতা আর এক হলো না কিনোর। হুয়ানা ওকে একটা কর্নকেক দিতে, খাওয়া থামিয়ে কান খাড়া করল আবারও। ভয় হচ্ছে কিনোর। কাঁধের ওপর দিয়ে জঙ্গলের দিকে চাইল সে, ছোরাটা শক্ত মুঠোয় ধরল। কয়োটিটো এসময় অস্ফুট শব্দ করে উঠতে কিনো বলল, থামাও ওকে।

কি ব্যাপার গো? হুয়ানা প্রশ্ন করল।

জানি না।

হঠাৎ, কিসের যেন নড়াচড়া দৃষ্টি কাড়ল ওর। কিনো মাথা নামিয়ে গাছের ফাঁক দিয়ে চাইল। লক্ষ্য করল বহু দূরে, তিনজন লোক। দুজন হাঁটছে এবং তৃতীয় লোকটা ঘোড়ার পিঠে। লোকগুলো কাকে খুঁজছে বুঝতে বেগ পেতে হলো না। ধড়াস করে উঠল কিনোর বুকের ভেতরটা।

পায়ে হাঁটছে যে লোক দুটো, তারা গভীর মনোযোগে জমি পরখ করছে। ওদের একজন থমকে দাড়িয়ে ইশারায় কি যেন দেখাল। এরা ট্র্যাকার।

পাথুরে পাহাড়ে ভেড়ার পায়ের ছাপ অনুসরণ করতে পারে এই ট্র্যাকাররা। মাড়ানো, ছেড়া এক টুকরো ঘাসের ডগা, কিংবা বালিতে ক্ষীণতম চিহ্নও ওদের সতর্ক নজর এড়ায় না। শিকারী কুকুরের মত ধূর্ত ওরা। ঘোড়সওয়ার লোকটার নাক কম্বল দিয়ে ঢাকা। হাতে রাইফেল।

গাছের মত ঠায় দাঁড়িয়ে রইল কিনো। শ্বাস বইছে কিনা ওর বোঝার উপায় নেই। যেখানকার ট্রাক মুছে দিয়েছিল, স্বভাবতই চোখ চলে গেল সেখানে। ঝাট দেয়ার চিহ্ন কিছু ফাঁস করে দেবে না তো ট্র্যাকারদের কাছে? এদেরকে চেনে কিনো। পোড় খাওয়া শিকারী ওরা, এখন কিনোকে শিকার করতে এসেছে।

ট্র্যাকাররা হঠাৎ কি একটা দেখে ঝুঁকে পড়ল। অশ্বারোহী স্থির বসে অপেক্ষা করছে। উত্তেজিত কুকুরের মত তর্জন করে উঠল ট্র্যাকার দুজন। ধীরে ধীরে ছোরাটা টেনে বের করে তৈরি হলো কিনো। ইতিকর্তব্য ঠিক করা হয়ে গেছে তার। ওকে ট্র্যাকাররা খুঁজে পেলে, ঘোড়সওয়ারের উদ্দেশে ঝাঁপ দেবে ও। ওই লোকটাকে ঝটপট খুন করে রাইফেলটা ছিনিয়ে নিতে হবে। বাঁচার এই একটাই সুযোগ। লোকগুলো কাছিয়ে আসতে, চোয়াল শক্ত হলো কিনোর।

ঘোড়ার খুরের শব্দ হুয়ানার কানেও গেছে। বাচ্চাটা ডুকরে কেঁদে উঠল এসময়। কয়োটিটোকে শালের নিচে টেনে নিয়ে, ওকে দুধ পান করতে দিল দুয়ানা।

ট্র্যাকাররা কাছিয়ে এল। ওদের আর ঘোড়াটার পা কেবল দেখতে পাচ্ছে কিনো গাছের ফাঁক-ফোকর দিয়ে। এবারে, নোংরা পায়ের সাথে সাথে, পুরানো-জীর্ণ জামা-কাপড়ও চোখে পড়ল।

আরেকটু কাছে এসে থমকে দাঁড়াল ট্র্যাকার দুজন। অশ্বারোহী লোকটাও থেমে দাঁড়িয়েছে। ঘোড়াটা মাথা ওপর-নিচ করে, নাক দিয়ে শ্বাস টানার খোঁৎ জাতীয় জোরাল শব্দ করল।

ট্র্যাকাররা এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে জানোয়ারটার দিকে চাইল, ওটার কান লক্ষ্য করছে। ঘোড়াটা বিচিত্র কোন সাড়া-শব্দ পায় কিনা দেখতে চাইছে ওরাI

শ্বাস চেপে স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে কিনো, লড়াই করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। দীর্ঘক্ষণ রাস্তার ওপর ঝুঁকে বসে রইল ট্র্যাকার দুজন। তারপর সটান উঠে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে সরে যেতে লাগল। মাটিতে সর্বক্ষণ তীক্ষ্ণ নজর ওদের, অনুগমন করছে অশ্বারোহী। অল্প একটু রাস্তা দৌড়চ্ছে ট্র্যাকাররা, থেমে দাড়িয়ে জমি পরখ করে, তারপর আবার ছুটছে।

ওরা ফিরে আসবে, জানে কিনো। কিনোর ট্র্যাক খুঁজে না পাওয়া অবধি, এভাবেই বিরতি নিয়ে খুঁটিয়ে মাটি পরীক্ষা করবে।

বনের ভেতর ফিরে এল কিনো। ট্র্যাক আড়াল করেনি ও। আসলে, এত বেশি ঝোপ মাড়িয়েছে আর পাথর নড়িয়েছে যে আড়াল করা সম্ভব হয়নি।

কিনো এতটাই ভয় পেয়েছে, ছুটে পালিয়ে যেতে মন চাইছে ওর। আসবে ওরা, যে কোন মুহূর্তে। বউ-বাচ্চাকে নিয়ে এখন যথাসম্ভব দ্রুত দৌড় দেয়া উচিত ওর। হুয়ানার কাছে নিঃসাড়ে এবং ত্বরিত ফেরত এল কিনো। ওকে আসতে দেখে, চোখ তুলে চাইল হুয়ানা।

ট্র্যাকার! বলল কিনো। এসো!

হঠাৎই আবিষ্কার করল কিনো ওর সমস্ত আশা-ভরসা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে।

ওদের কাছে ধরা দেব নাকি? বলল।

লাফিয়ে উঠে স্বামীর বাহুতে হাত রাখল হুয়ানা।

পাগল হলে? তোমার সাথে মুক্তা আছে, বলল। তুমি কি ভেবেছ ওরা। তোমাকে শহরে জ্যান্ত ফিরিয়ে নিয়ে যাবে?

আস্তে আস্তে পকেটে একটা হাত ঢুকল কিনোর। ওরা মুক্তাটা হাতিয়ে নেবে, বলল শান্ত সুরে।

এসো, তাগাদা দেয় হুয়ানা। জলদি এসো!

কিনোকে পাথরের মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাড়া লাগাল হুয়ানা।

আমাকেও কি ওরা ছেড়ে দেবে নাকি? বলল। তোমার দুধের বাচ্চাটাকেও বাঁচতে দেবে না।

টনক নড়ল এবার কিনোর। ঠোঁট দৃঢ়বদ্ধ হলো ওর, দুচোখ ভরে উঠল রাগে আর ঘৃণায়।

চলো, বলল ও। পাহাড়ে যাব আমরা। ওখানে হয়তো লুকিয়ে থাকতে পারব।

খাবারের ছোট ছোট থলেগুলো, আর পানির বোতলটা বাঁ হাতে তুলে নিল কিনো। ডান হাতে ধরা ওর ছোরাটা। হুয়ানা স্বামীকে অনুসরণ করছে। ঝোপ-ঝাড় ভেদ করে উচু পর্বতমালার উদ্দেশে হনহনিয়ে হেঁটে চলেছে ওরা।

কিনো এতটাই ভড়কেছে, ট্র্যাক আড়াল করার কথাও ওর মাথায় এল না। শশব্যস্তে হাঁটছে ওরা। নুড়ি পাথর ওদের পায়ের ধাক্কায় গড়াচ্ছে, গাছের পাতা গায়ে বেধে খসে পড়ছে। আকাশের পটভূমিতে, ওই তো, মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে সুউচ্চ পর্বতমালা। প্রাণভয়ে ভীত জানোয়ারের মত ওদিক লক্ষ্য করে ছুটল ওরা।

এখানকার জমিতে পানি নেই। ভাঙাচোরা পাথর আর শুকনো পাতা মাড়িয়ে অবিচল হেঁটে চলেছে স্বামী-স্ত্রী। এই খরমরুতে গা পুড়ে যেতে চায়।

সামনে, শীতল ছায়া বিছিয়ে যেন নিরাপত্তা দিচ্ছে পাথুরে পাহাড়সারি। যতটা দ্রুত পারে পা চালাচ্ছে কিনো। কি ঘটবে জানে তো সে।

শিকারীরা একটু পরেই ট্র্যাক খুঁজে পাবে। তারপর ওদের গুপ্তস্থানটা আবিষ্কার করবে। ঝরা পাতার আর ভাঙা পাথরের বদৌলতে ওদেরকে স্বচ্ছন্দে অনুসরণ করবে লোকগুলো। ধরে ফেলবে কিনো আর হুয়ানাকে। শহরে আর ফিরে যেতে হবে না স্বামী-স্ত্রী-বাচ্চাকে। অশ্বারোহী লোকটা এমনি এমনি রাইফেল আনেনি।

ছোট্ট পথটা খাড়া হয়ে গেছে এমুহূর্তে, পাথরগুলো আগের চাইতে বড়।

কিন্তু কিনোর পরিবার অনেকটা পেছনে ফেলে এসেছে এখন ট্র্যাকারদের। একটু জিরিয়ে নিতে থামল ওরা। বিশাল এক পাথরে চড়ে দাঁড়িয়ে পেছনে দৃষ্টি রাখল কিনো। ট্র্যাকারদের পাত্তা পেল না। এমনকি দীর্ঘদেহী ঘোড়সওয়রিটিকেও দেখা যাচ্ছে না।

পাথরের ছায়ায় বসে পড়েছে হুয়ানা। মুখের কাছে বোতল ধরতে চুকচুক করে পানি খেল কায়েটিটো। পাথর থেকে নেমে পড়ে হুয়ানার দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল কিনো। ধারাল পাথরে লেগে পা কেটেকুটে গেছে হুয়ানার। ঝটপট স্কার্ট দিয়ে পা দুখানি ঢাকা দিল ও। তারপর স্বামীর দিকে পানির বোতলটা বাড়িয়ে ধরতে, সে মাথা নাড়ল। তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে কিনোর, কিন্তু পানির পরিমাণ এতই অল্প, খেতে মন উঠল না।

হুয়ানা, বলল কিনো। আমি পাহাড়ে যাব, তুমি লুকিয়ে থেকো। ট্র্যাকাররা আমাকে পিছু নিয়ে পাহাড়ে যাবে। ওরা চলে গেলে, উত্তরে রওনা দেবে তুমি। আমি পরে এসে যোগ দেব।

মুহূর্তের জন্যে কিনোর দিকে অপলকে চেয়ে রইল হুয়ানা।

না, ঘোষণা করল এবার। আমরা তোমার সাথে যাব।

একা গেলে আমি তাড়াতাড়ি যেতে পারব, ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল কিনো। তুমি আমার সাথে গেলে কয়েটিটোর বিপদ বাড়বে বই কমবে না।

না।

যা বলছি করো, বলল কিনো। তোমাকে লুকিয়ে থাকতে হবে।

না, আবারও বলল হুয়ানা।

হুয়ানার উদ্দেশে চেয়ে রইল কিনো। ওর মুখের চেহারায় ভীতির কিংবা দুর্বলতার চিহ্নমাত্র নেই। হুয়ানার জ্বলজ্বলে চোখজোড়া কিনোর মনোবলও ফিরিয়ে দিল। আবার যখন ওরা হাঁটা ধরল, ভয়-ভীতি কোথায় পালিয়েছে।

ক্রমেই চড়াই বাইছে হুয়ানা আর কিনো। সমতল পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটছে ওরা, ট্র্যাক রেখে যাচ্ছে না। কিন্তু কিনো জানে, হারিয়ে ফেললেও ট্রাক খুঁজে বের না করা পর্যন্ত থামবে না ট্র্যাকাররা। কাজেই সরাসরি পাহাড়ের উদ্দেশে যাচ্ছে না ও। প্রতিপক্ষের জন্যে কষ্টসাধ্য করে তুলতে চাইছে, খোঁজার কাজটা। প্রায়ই পাথর ছেড়ে অন্যান্য জায়গায় ছাপ ফেলছে সে। তারপর আবার ফিরে এসে পাহাড়ী ঢাল বেয়ে উঠে যাচ্ছে হুয়ানার কাছে। রাস্তাটা যেন ফুরোবে না, উঠছে তো উঠছেই। ভারী শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে হুয়ানার আর কিনোর।

প্রবেশ করতে সূর্য হেলে পড়ল পশ্চিমে। উপত্যকাটা অন্ধকার, ছায়াময় কয়েকটা ছোটখাট ঝোপ-ঝাড়ের দেখা মিলল। পানি ফুরিয়ে গেছে। কিনোর মনে হলো, ঝোপের আশপাশে পানি পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু উপত্যকাটা ওদের জন্যে বিপজ্জনক, কেননা শত্রুপক্ষও পানির খোঁজ করবে।

কিনো ঠিকই ভেবেছিল। ঝোপের জটলার কাছে একটা ডোবা। পাহাড়চূড়া থেকে বরফ গলা ঝর্ণাধারা নেমে এসে ওটার সৃষ্টি করেছে। ডোবাটার পাশে ঝোপ-ঝাড় আর লম্বা লম্বা দূর্বা ঘাস জন্মেছে। ছোট্ট, বালুময় তীরটায় অসংখ্য জন্তু-জানোয়ারের পায়ের ছাপ। এখানে পানি খেতে আসে ওরা।

পানির কাছে ওরা যখন পৌঁছল, সূর্য তখন পাহাড়ের ওপাশে ডুব মেরেছে। এখান থেকে দূরবর্তী সাগর দেখা যায়। ওরা স্বামী-স্ত্রী শারীরিক-মানসিক ধকলে ভয়ানক ক্লান্ত। হাঁটুর ওপর ধপ করে বসে পড়ে বাচ্চার মুখ ধুইয়ে দিল হুয়ানা। তারপর বোতল ভরে নিয়ে পানি খাওয়াল।

তৃষ্ণার্ত কিনো আঁজলা ভরে পানি তুলে আকণ্ঠ পান করল। তারপর সটান হলো ডোবার ধারে। খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে উঠে দাঁড়াল ও। দৃষ্টি প্রসারিত করল পাহাড়ের গা বরাবর নিচের দিকে। যা দেখল তাতে জমে গেল সে। পাহাড়ের পায়ের কাছে পৌঁছে গেছে ট্র্যাকাররা। যদিও বহু দূরে এখনও ওরা। কিনোর চোখে এখনি থেকে ওদেরকে পুতুলের মত দেখাল।

হয়না ঘুরে চাইল, কিনো কি করছে দেখতে।

আর কদূর? স্বামীকে থম হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শুধাল।

সন্ধে নাগাদ এখানে পৌঁছে যাবে।

চোখ তুলে উপত্যকার দিকে তাকাল কিনো, ঝর্ণাধারা নামছে যেখান থেকে।

আরও উচুতে উঠে যেতে হবে আমাদের, বলল ও।

১১. চেয়ে ছিল কিনো

চেয়ে ছিল কিনো, বেশ কয়েকটা গুহা লক্ষ্য করল। পাথুরে পাহাড়টির প্রায় ত্রিশ ফিট মত ওপরে ওগুলো। হাঁচড়ে পাঁচড়ে পাথর বেয়ে উঠতে শুরু করল কিনো। বাতাসে ক্ষয়ে ক্ষয়ে তৈরি হয়েছে কয়েক ফিট গভীর এই গুহাগুলো। সবচেয়ে বড়টার মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে শুয়ে পড়ল কিনো। বাইরে থেকে দেখা যাবে তার ভয় নেই। বুকে হেঁটে গুহাটা ছেড়ে বেরিয়ে এসে, তরতর করে নিচে নেমে এল ও।

ওখানে চলো, হুয়ানাকে বলল। আমাদের ওখানে খুঁজে নাও পেতে পারে।

বিনাবাক্যে মেনে নিল হুয়ানা। পানির বোতলটা ভরে নিল। কিনো ওকে গুহায় উঠতে সাহায্য করল। এরপর খাবারের প্যাকেটগুলো নিচে থেকে নিয়ে এল কিনো, চালান করল হুয়ানার হাতে। গুহামুখে চারদিকে নজর রাখতে বসল হুয়ানা।

হুয়ানা লক্ষ্য করল কিনো ওদের ট্রাক মোছার কোন চেষ্টাই করল না। তার বদলে, ডোবার পাশের পাথরে উঠে খুদে চারাগুলো টেনে তুলতে লাগল। শখানেক ফিট ওঠার পর, আবারও নেমে এল কিনো। গুহামুখে গিয়ে মেশা পাথরগুলো সাবধানী দৃষ্টিতে পরখ করল। কোন চিহ্ন ফেলে যাচ্ছে না লক্ষ্য করে উঠে এল গুহায়, গুটিসুটি মেরে বসে পড়ল হুয়ানার পাশে।

যে চিহ্নগুলো রেখে এলাম ট্র্যাকাররা ওগুলো অনুসরণ করবে, বলল কিনো। ওরা ওখানে উঠে গেলে, আমরা নেমে যাব। কিন্তু ভয় হচ্ছে, কয়োটিটো না কেঁদে ওঠে। ও কাঁদলেই কিন্তু সর্বনাশ।

কাঁদবে না, বলল হুয়ানা। বাচ্চাটাকে দুহাতে তুলে ধরে চোখের দিকে চাইল। কয়েটিটোও মার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে।

কাঁদা চলবে না বুঝতে পেরেছে ও, বলল হুয়ানা।

গুহামুখের কাছে শুয়ে কিনো। পাহাড়ের ছায়া জমির ওপর দিয়ে বিস্তার পেয়ে পৌঁছে গেছে সাগর অবধি। একটু পরে গোটা চরাচর গ্রাস করল ছায়া।

দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করল কিনো আর হুয়ানা। সন্ধের আগে ডোবার কাছে পৌঁছতে পারল না অনুসরণকারীরা। এখন তিনজনই পায়ে হাঁটছে, ঘোড়াটা যেহেতু পাহাড়ের পাশ বেয়ে উঠতে পারবে না। গুহার ভেতর থেকে পুতুলের মত দেখাচ্ছে লোকগুলোকে। ডোবার কাছে, ছোট্ট তীরটায় ট্র্যাকার দুজন ঘোরাফেরা করছে। কিনোর ট্র্যাক পাহাড় বেয়ে উঠে গেছে লক্ষ্য করল ওরা। রাইফেলধারী বসে পড়ল বিশ্রাম নিতে। অন্য লোক দুজনও তার দেখাদেখি বসল। ওদের সিগারেটের আগুন দেখতে পাচ্ছে কিনো। লোকগুলো খেতে বসেছে, ওদের কথাবার্তার অস্ফুট শব্দ মাঝেমধ্যে ভেসে আসছে বাতাসে।

রাত ঘনাল উপত্যকায়। নিশাচর জন্তুর পানি খেতে এসেছিল ডোবার কাছে। কিন্তু মানুষের গন্ধ পেয়ে আঁধারে সটকে পড়েছে। পেছনে শব্দ শুনতে পেল কিনো। ফিসফিস করছে হুয়ানা, কয়োটিটো। বাচ্চাটাকে চুপ থাকতে বলছে। শাল দিয়ে বাচ্চার মাথা মুড়ে রেখেছে সে।

নিচে, ডোবার কাছে দিয়াশলাই জ্বালল একজন। অন্য দুজন ঘুমাচ্ছে, কুকুরের মত কুণ্ডলী পাকিয়ে। তৃতীয় জন পাহারা দিচ্ছে। দিয়াশলাইয়ের আগুনের আলোয় লোকটার রাইফেল দেখতে পেল কিনো। নিভে গেল কাঠি, কিন্তু কিনোর জানা থাকল প্রতিপক্ষের অবস্থান।

নিঃশব্দে গুহার ভেতর এসে ঢুকল ও। উজ্জ্বল একজোড়া তারার মত জ্বলছে হুয়ানার চোখ। গুড়ি মেরে ওর কাছ ঘেঁষে এল কিনো, মুখ নিয়ে এল কানের কাছে। ওদের মোকাবিলা করার একটা রাস্তা আছে, বলল।

তুমি মারা পড়বে। ওদের সাথে রাইফেল আছে।

রাইফেলঅলাকে কায়দা করতে পারলে আর চিন্তা নেই, জবাবে বলল কিনো। অন্য লোক দুটো ঘুমাচ্ছে।

শালের তল থেকে বেরিয়ে এসে কিনোর বাহু চেপে ধরল হুয়ানার হাত।

তারার আলোয় তোমার গায়ের সাদা জামা দেখে ফেলবে ওরা।

না, তারার আলোকে ভয় পাচ্ছি না, বলল কিনো। কিন্তু চাঁদ ওঠার আগে যেতে হবে আমাকে।

হুয়ানাকে বলার মত সান্ত্বনার বাণী হাতড়াচ্ছে কিনো। ওরা আমাকে মেরে ফেললে, বলল ও। চুপচাপ এখানে বসে থেকো। ওরা ফিরে গেলে ডুবুরিপাড়ায় চলে যেয়ো।

গলা কেঁপে গেল হুয়ানার। খোদা তোমার সহায় হোন।

কিনো কাছ থেকে হুয়ানার আয়ত চোখজোড়া খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করল, এবার হাত বাড়াতে কয়োটিটোকে খুঁজে পেল। বাচ্চাটার মাথায় এক মুহূর্ত স্থির হলো ওর হাত। হুয়ানার গাল স্পর্শ করল তারপর ও। শ্বাস চেপে স্বামীকে গুহা থেকে বুকে হেঁটে বেরিয়ে যেতে লক্ষ্য করল হুয়ানা। একদম একা হয়ে যাচ্ছে, কেমন করে উঠল বুকের ভেতরটা ওর।

গুহামুখের কাছে মুহূর্তের জন্যে দাঁড়িয়ে থাকল কিনো। আকাশের বিপরীতে ওকে দেখতে পাচ্ছে হুয়ানা। সাদা পোশাক খুলে ফেলেছে গা থেকে কিনো। মিশমিশে অন্ধকারে কিনার বাদামী চামড়া কারও দৃষ্টি কাড়বে না। গলায় মস্ত ছোরাটা ঝুলিয়েছে কিনো, হাত দুটো যাতে মুক্ত থাকে। সামনে ঝুঁকে পড়ে দুমুহূর্ত চেয়ে রইল কিনো। তারপর সহসাই, মিশে গেল রাতের আঁধারে।

গুড়ি মেরে গুহামুখের কাছে এসে বাইরে উঁকি দিল হুয়ানা। নীড় থেকে যেন গলা বাড়িয়েছে, কোন পাহাড়ী পাখি। কয়েটিটো হুয়ানার পিঠে বাঁধা কম্বলের নিচে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মার কাঁধে আর ঘাড়ে বিশ্রাম পাচ্ছে ওর মাথা। নিঃশব্দে দোয়া পড়ে চলেছে হুয়ানা।

হুয়ানা গুহার বাইরে চোখ রাখতে, আঁধার খানিকটা পাতলা হয়েছে লক্ষ্য করল। পুবে আলো পাচ্ছে আকাশ। নিচে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে, রাইফেলধারীর আলোকিত সিগারেট দেখতে পেল ও।

পাথর বেয়ে ধীরেসুস্থে নামছে কিনো৷ পিঠের দিকে ঝুলিয়েছে ছোরাটা, পাথরে যাতে বাড়ি না খায় ওটা। আঙুলে আর পায়ের পাতায় ভর দিয়ে নেমে যাচ্ছে কিনো, পড়ে যাতে না যায় তাই চেপে থাকছে পাথরের সাথে। যে কোন শব্দ, এমনকি নুড়ি পাথর খসে পড়লেও, সচকিত করে দেবে শত্রুদের। আর রাইফেলধারী কোন কারণে ওপরদিকে চাইলেই হয়েছে। কিন্তু আজ রাতটা অতখানি নিস্তব্ধ নয়। কীট-পতঙ্গ কোরাসে গান গেয়ে ভরাট করে রেখেছে উপত্যকা।

উতরাই ভেঙে ধীরে আর নিঃশব্দে নেমে যাচ্ছে কিনো। ওর একটা পা কয়েক ইঞ্চি নড়ে, তারপর দুপায়ের পাতা ভরিসাম্য রক্ষা করে পাথরের ওপর। অপর পা একটু এগোয় তো একটা হাত সামান্য নেমে যায় নিচের দিকে। এরপর অপর হাত নেমে যায়, কিনোর গোটা দেহ যতক্ষণ পর্যন্ত না অতি ধীরে নড়াচড়া করে। মুখ হাঁ কিনোর। এরফলে শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ হওয়ার আশঙ্কা নেই।

নিচে নিশ্চিন্তে বিশ্রামরত লোকগুলো শব্দ শুনে চোখ তুললে, পাথরের পটভূমিতে কিনোর আদল দেখতে পাবে। ধীরে, খুব ধীরে নড়তে চড়তে হচ্ছে কিনোকে। কোনমতেই লোকগুলোর সন্দেহ জাগানো চলবে না। বহুক্ষণ লেগে গেল উতরাই বাইতে। নিচে নামার পর, ছোট এক গাছের আড়াল নিল সে। বুকের মধ্যে ধুপধাপ লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ড, দুহাত আর মুখখানা ঘামে ভিজে পিচ্ছিল। ঝুঁকে পড়ে বুক ভরে শ্বাস টানল কিনো।

লোকগুলোর সাথে এখন ওর আর মাত্র বিশ ফিট ফারাক। জমির চরিত্র মনে করার চেষ্টা করল ও। রাস্তায় বড় কোন পাথর ছিল কি? পা দুখানা ভাল করে ডলে নিল কিনো, পাহাড় বেয়ে নামার পর থেকে থরথর করে কাঁপছে ওদুটো।

পুবাকাশে এবার দৃষ্টি প্রসারিত করল ও।

শীঘ্রিই চাঁদ উঠছে। তার আগেই আক্রমণ শানাতে হবে ওকে।

উপত্যকায় ঘন হচ্ছে আলো। ঘুমন্ত লোক দুটোকে দেখতে পাচ্ছে কিনো। পাহারাদারটিকে প্রথমেই খসাতে হবে ওর। নিঃশব্দে, কাঁধের ওপর ছোরার হাতল বাগিয়ে ধরল কিনো।

কিন্তু দেরি করে ফেলেছে ও। সিধে হয়ে দাঁড়াতে, পুবে উদয় হলো চাঁদ। গাছটার পেছনে লুকাতে বাধ্য হলো আবার কিনো।

আঁধার কেটে যাচ্ছে উপত্যকায়। ডোবার কাছে, পাহারাদার লোকটা ছোট্ট এক টিলায় চড়ে বসে আছে। শোভা উপভোগ করছে চাঁদের। ফস করে আরেকটা কাঠি জ্বালতে, নিমেষের জন্যে আলোটা ঝিকিয়ে উঠল ওর মুখের চেহারায়। কিনোর আর দেরি করার উপায় নেই। লোকটা মাথা ফেরানো মাত্র, লাফিয়ে পড়বে ও। পা দুখানা তৈরি ওর। ঠিক এমনি সময়, অনেক ওপর থেকে, চ্যাঁ করে কেঁদে উঠল একটা বাচ্চা। প্রহরী ঘাড় কাত করল শোনার জন্যে, তারপর সটান উঠে দাঁড়াল। মাটিতে শোয় একজন ট্র্যাকার নড়েচড়ে উঠল অস্থির ভাবে। এবারে উঠে বসে চারধারে দৃষ্টি বুলাতে লাগল।

কি ব্যাপার? ও কিসের শব্দ? সজাগ হয়ে প্রশ্ন করল ও।

কে জানে, দ্বিতীয় লোকটা ঘুম ভেঙে বলল। বুনো কুকুরের বাচ্চা হতে পারে। কুকুরছানারা তো বাচ্চাদের মত করেই কাঁদে।

কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ে, জ্বলে গেল যেন কিনোর চোখজোড়া। বাচ্চার কান্নার শব্দ আবারও ভেসে এল। পাহারাদারের দৃষ্টি পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে গেল অন্ধকার গুহাটার উদ্দেশে।

ওখানে মনে হয় কোন বুনো কুকুর আছে, বলল লোকটা।

নড়াচড়ার শব্দ পেল কিনো, লোকটা রাইফেলের গুলি বর্ষাতে তৈরি হতে।

কুকুর হলে এতে ঠাণ্ডা মেরে যাবে, বলল সে। গুহার উদ্দেশে তাক করল অস্ত্র।

রাইফেলটা গর্জে উঠতে সামনে ঝাঁপ দিল কিনো। ওর বিশাল ছোরাটা গেঁথে গেল লোকটার বুকে। মাথায় খুন চেপে গেছে এখন কিনোর। এক হাতে রাইফেল চেপে ধরেছে সে। অপর হাতে ছোরাটা টেনে বের করে অনিল লোকটার বুক থেকে।

দ্রুত দেহ ভঙ্গি বদলে নিল কিনো। পাঁই করে ঘুরে দাঁড়িয়ে আঘাত হানল দ্বিতীয় লোকটার মাথায়। তৃতীয় জন শরীর হেঁচড়ে সরে গেল জলাশয়ের উদ্দেশে। তারপর পাথর স্থূপ বেয়ে ঝর্ণাধারার উৎস লক্ষ্য করে উঠে যেতে লাগল। লোকটার হাত আর পা জড়িয়ে গেল ঝোপের গায়ে। চড়াই ভাঙতে গিয়ে চেঁচাতে লাগল সে। কিন্তু কিনো এ মুহূর্তে নির্দয়-নিষ্ঠুর। রাইফেলের লক্ষ্যস্থির করে গুলি চালিয়ে দিল। চিত হয়ে, ঝপাং করে জলাশয়ের পানিতে পড়ল লোকটা। ডোবার কাছে এসে দাঁড়াল কিনো। চাঁদের আলোয়, লোকটার আতঙ্কিত চোখজোড়া দেখতে পেল। দুচোখের মাঝখান বরাবর দ্বিতীয় গুলিটা চালাল ও।

স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে, ওপরে, গুহার দিকে চোখ তুলে তাকাল কিনো। কোথাও কোন একটা গোলমাল হয়েছে। পোকা-মাকড় এ মুহূর্তে কোলাহল ভুলে একদম থম মেরে আছে। উৎকর্ণ হলো কিনো। শব্দটা ওর চেনা। পাহাড়ী গুহাটার অভ্যন্তর থেকে শোকাকুল বিলাপধ্বনি কানে আসছে। কণ্ঠস্বরটা হুয়ানার। আপনজনের মৃত্যু ঘটলে এভাবে কাঁদে মানুষ।

১২. অনেক দিন পর

অনেক দিন পর। শহরের সবার আজও মনে আছে কিনো আর আ হুয়ানার ফিরে আসার দিনটির কথা। রীতিমত সাড়া পড়ে যায় চারদিকে সেদিন। জনাকয় বৃদ্ধ নিজের চোখে ওদের ফিরে আসতে দেখেছে। অন্যরা ও ঘটনার কথা শুনেছে বাপ-দাদার মুখে। কিন্তু দিনটার কথা স্মরণ করে সবাই।

একদিন শেষ বিকেলে, কয়েকটা বাচ্চা ছেলে দৌড়তে দৌড়তে খবরটা নিয়ে শহরে এসে ঢোকে। সবাই বাসা থেকে বেরিয়ে আসে কিনো আর হুয়ানাকে স্বচক্ষে দেখার জন্যে।

সূর্য পাটে বসেছে তখন, মাটিতে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে ছায়া। কিনো ও হুয়ানার মুখ, আর লম্বা, কালো ছায়ার ছবি জ্বলজ্বল করে আজও সবার স্মৃতিতে।

বালি ভরা রাস্তাটা ধরে শহরে প্রবেশ করে ওরা। কিনো আর হুয়ানা পাশাপাশি হাঁটছিল। সূর্য ছিল তাদের পেছনে, আর সামনে ছিল নিজেদের দীর্ঘ ছায়া।

কিনোর হাতে ছিল রাইফেল। হুয়ানা ভারী বস্তার মত কাঁধে বইছিল ওর শালটা। শালে চাপ চাপ রক্তের দাগ।

হুয়ানার মুখের চেহারায় অসংখ্য রেখা আর ক্লান্তির ছাপ চোখে পড়ে সবার। ওর বিস্ফারিত চোখের দৃষ্টি ছিল ফাঁকা, ভাবলেশহীন। কিনোর পাতলা ঠোট দুটো পরস্পর দৃঢ়বদ্ধ ছিল। লোকে বলে সেদিন নাকি ওকে হিংস্র পশুর মত ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছিল। জনতা ঠেলাঠেলি করে সরে দাঁড়িয়ে পথ করে দেয় ওদের।

শহরের মধ্য দিয়ে হাঁটছিল কিনো আর হুয়ানা, কিন্তু কিছুই বুঝি তাদের চোখে পড়ছিল না। ডানে-বায়ে কোনদিকে দৃষ্টিক্ষেপ করেনি তারা। আশেপশে নয়, পিছে নয়, সোজা নাক বরাবর ছিল তাদের দৃষ্টি।

পাশাপাশি হাঁটছিল স্বামী-স্ত্রী, শহরের বুক চিরে চলে এসেছিল মুক্তোডুবুরিদের লোকালয়ে। পড়শীরা ওদের ঘাটায়নি, পথ ছেড়ে দিয়েছে।

হুয়ান টমাস হাত তুলেছিল, কিন্তু মুখে কিছু বলেনি। ওর ওঠানো হাত যেমনকে তেমন শূন্যেই ছিল।

ভস্মীভূত বাড়িটার পাশ কাটায় কিনো আর হুয়ানা, কিন্তু একটিবারও ফিরে তাকায়নি ওটার দিকে। ঝোপ-ঝাড়ের ভেতর দিয়ে পথ করে নিয়ে, সাগরের কাছে চলে আসে ওরা। কিনোর ভাড়া ক্যানুটার যে অস্তিত্ব আছে, ওদের হাবে-ভাবে মনেই হয়নি। পানির কাছে এসে থেমে দাঁড়ায় ওরা, একদৃষ্টে চেয়ে থাকে সাগরের পানে।

তারপর কিনো রাইফেলটা মাটিতে নামিয়ে রেখে, পকেটে হাত ভরে। বের করে আনে দামী মুক্তোটা।

মুক্তোটার দিকে চোখ রেখে ভয়ঙ্কর ঘটনাগুলো একে একে স্মরণ করে সে। মুক্তোটার ভেতর, ক্রুর-কুটিল মানুষের মুখ আর আগুনের লেলিহান শিখা দেখতে পায় কিনো। পাহাড়ী জলাশয়ে মৃত ওই লোকটার আতঙ্কে বিস্ফারিত চোখজোড়া ফুটে ওঠে ওর মানসচোখে। মাথায় রক্ত মেখে গুহায় পড়ে রয়েছে কয়েটিটো, দেখতে পায় কিনো। ওহ, কী কুৎসিত আর অশুভ এই মুক্তোটা।

হুয়ানার উদ্দেশে যখন ফিরল, হাত অল্প অল্প কাঁপছে কিনোর। মুক্তোটা বাড়িয়ে ধরল বউয়ের দিকে। হুয়ানা কাঁধে তখনও একমাত্র সন্তানের লাশ বহন করছে। পলকের জন্যে কিনোর হাতে ধরা রত্নটার দিকে চেয়ে রইল সে। তারপর সরাসরি, স্বামীর চোখে চেয়ে শান্ত সুরে বলল, না, কাজটা তোমাকেই করতে হবে।

কিনো হাত শূন্যে তুলে যতটা দূরে পারে ছুঁড়ে দেয় মুক্তোটা। পড়ন্ত বেলার ম্লান আলোয়, ঝিক করে ওঠে জিনিসটা। ওই যে, সাগরে টুপ করে গিয়ে পড়ল। বহুক্ষণ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকে ওরা, বহতা পানির গতি লক্ষ্য করে।

সেদিন গোধূলিলগ্নে, সবুজ আয়নার মতন চিকচিক করছিল সাগরের পানি। নয়নাভিরাম সবুজাভ পানিতে পড়ে, সাগরের অতলে তলিয়ে গেছে মুক্তোটা। চিরতরে হারিয়ে গেছে কিনো আর হুয়ানার জীবন থেকে।

***

Exit mobile version