Site icon BnBoi.Com

নাটক (নজরুল) – কাজী নজরুল ইসলাম

নাটক (নজরুল) - কাজী নজরুল ইসলাম

ঈদ

মহবুব, শমশের, মাহতাব, গুলশন, বিদৌরা।
(মাহতাব গাহিতেছিল)

(গান)

বিদায়-বেলায় সালাম লহো মাহে রমজান রোজা।
(তোমার)
ফজিলতে হালকা হল গুণাহের বোঝা॥
ক্ষুধার বদলে বেহেশ্‌তি ঈদের সুধা তুমি দিলে,
খোদার সাধনার দুঃখে কী সুখ তুমি শিখাইলে,
(তুমি)
ইশারাতে খোদার পাওয়ার পথ দেখালে সোজা॥
ভোগ-বিলাসী মনকে আনলে পরহেজগারীর পথে,
দুনিয়াদারি করেও মানুষ যেতে পারে জান্নাতে;
কিয়ামতে তোমার গুণে ত্রাণ করবেন বদরুদ্দোজা।

মহবুব॥
মাহতাব। আজ ঈদের ভোরে আবার রোজার গান কেন?
মাহতাব॥
মহবুব! মহ্‌বুবের রোজা ফুরায়, মাহতাবের রোজা ফুরায় না। রোজার তৃষ্ণা তার যায় না; রোজা ফুরালে যে ঈদ ফুরিয়ে যাবে! তুমি মহবুব, তোমার হয়তো রোজা শেষ হয়ে গেছে।
বিদৌরা :
মহবুব ভাই এত সকালে?
মহবুব :
বিদৌরা! আজ ভোরে কীসের খুশিতে মন যেন শিউলি-ঝরা আঙিনার মতো রেঙে উঠেছে। এই নাও – আমার রুমালের ঝরা শিউলি তোমার আঁচলে উঠে বেঁচে উঠুক।
বিদৌরা :
দাদাভাই, মহবুব ভাই, তোমরা কোথাও যেয়ো না। আমি খোর্মা, সেমাই, আর আতরদানি এনে দিই।
শমশের :
(ঘরে প্রবেশ করিতে করিতে) শমশের ঘরে এল–বিদৌরা! আমার জন্য গোলাপ-পানি আর সূর্মা!
বিদৌরা :
শমসেরকে আমার ভয়ানক ভয়, ও কেবল গলায় পড়বার জন্য ছটপট করে বেড়ায়।

(দূরে গুলশনের হাসি)

শমশের :
ও নিশ্চয় গুলশনের হাসি।
মাহতাব :
গুলশনের বুকেই যত বুলবুলের ভিড় কিনা। আচ্ছা শমশের, এই ঈদের মানে কী জান?
মহবুব :
মাহতাব! দোহাই, আজ রসের ঈদ, আনন্দের ঈদ, আজ আর তত্ত্ব নয়। তত্ত্বের কথা শুনব বকরীদে। এক মাসের উপোসি রসনা আজ রসের তৃষ্ণায় অধীর হয়ে উঠেছে।
শমশের :
মাহতাব যে সেই রসের পিয়ালা, সেই খুশির পিয়ালা, মহবুব!
মহবুব :
হাঁ,তা বটে। তবে ওর খুশির কথায় আমার কিন্তু মাঝে মাঝে গলা খুশখুশ করে।
মাহতাব :
সেমাই খোর্মা চা আসছে মহবুব – তোমার গলা খুশখুশানি বন্ধ হবে।
শমশের :
মাহতাবের অর্থাৎ চাঁদের জ্যোৎস্না পান করে চকোর-চকোরী আর শাপলা ফুল। মাহতাব সকলের জন্য নয়। বলো মাহতাব কী বলছিলে? সত্যি এই এক মাস উপোস করে কী লাভ হয়।
মাহতাব :
শমশের! আমরা যে ক্ষীর-সন্দেশ, বা পোলাও-কোর্মা মসজিদে পাঠাই, তা কি আল্লাহ্ খান? ওই ক্ষীর-সন্দেশ, ফিরনিই শিরনি হয়ে ফিরে আসে আমাদের কাছে। আমাদের অশুদ্ধ দেহ-মনের দান আল্লাহ্‌র নামে নিবেদিত হয়ে শুদ্ধ হয়ে ফিরে আসে। এ আল্লাহ্‍র পরীক্ষা। তাঁর রহম ও রহমত, কৃপা ও কল্যাণ পেতে হলে আমাদের দেহ-মনকে মাঝে মাঝে উপবাসী রাখতে হয়। এই উপবাসে দেহ-মনের ভোগের তৃষ্ণা যখন চলে যায়, তখনই ঈদের অর্থাৎ নিত্য-আনন্দের চাঁদ, পরমোৎসবের চাঁদ ওঠে।
শমশের :
সত্যি, এক মাস রোজা রেখে ঈদের যে অপূর্ব আনন্দ পাই–তা বৎসরের আর কোনোদিন পাওয়া যায় না।
মাহতাব :
হ্যাঁ, এ তো দেহের রোজা, মনের রোজা রাখলে অর্থাৎ তাকে ভোগের থেকে ফিরিয়ে রাখলে দুর্ভোগ কমে যায় – শান্তি আনন্দ আল্লাহ্‌র কাছ থেকে নেমে আসে।
গুলশন :
চা সেমাই সব যে ঠান্ডা হয়ে গেল। এর মধ্যে মহবুব ভাই-ই সব চেয়ে চালাক। ও রসও পান করছে, তত্ত্বও শুনছে। তোমরা তত্ত্ব-বিলাসী, তোমাদের রসের খোরাক জুড়িয়ে গেল।
মহবুব :
গুলশনই বুলবুলকে চেনে। এইবার ওরা রস গিলুক, আমি গিলে ফেলেছি। তুমি গানের রস পরিবেশন করো।
গুলশন :
আমার আবার গান। শমশের হয়তো রাগে ঝলমলিয়ে উঠবে।
শমশের :
ভয় নাই গুলশন, কাছে মাহতাব আছে –প্রেমে গলিয়ে দেবে।
(গুলশনের গান)

নাই হল মা বসন ভূষণ এই ঈদে আমার।
আল্লা আমার মাথার মুকুট, রসুল গলার হার॥
নামাজ রোজার ওড়না শাড়ি
ওতেই আমায় মানায় ভারী,
কলমা আমার কপালে টিপ
নাই তুলনা তার॥
হেরা গুহার হিরার তাবিজ
কোরান বুকে দোলে,
হাদিস ফেকাহ্ বাজুবন্দ,
দেখে পরান ভোলে।
হাতে সোনার চুড়ি যে মা
হাসান হোসেন মা ফাতেমা,
(মোর) অঙ্গুলিতে অঙ্গুরি,মা,
নবির চার ইয়ার॥

শমশের :
সাবাস গুলশন। ঈদ মোবারক হো! ঈদ মোবারক – গুলশন মোবারক!
গুলশন :
বিদৌরা, মোবারক বলো! নইলে পর্দার আড়ালে তার রাগ তিন পর্দা চড়ে যাবে।
বিদৌরা :
শমশের ভাই! ভয়ে আসিনি, যা ঝলমল করছ।
শমশের :
বিদৌরা, মোবারক! মহবুব মোবারক! না বিদৌরা, গুলশন এসে শমশেরের ঝলমলকে মলমল করে তুলেছে।
মহবুব :
সব মোবারক হল– মাহতাব মোবারক হো, বললে না যে কেউ। মাহতাব মানে চাঁদ, এই মাহতাব, এই চাঁদই আমাদের নিরাশার আঁধার রাতে ঈদের চাঁদ এনেছে।
শমশের :
নিশ্চয়ই! আমি তো ওরই হাতের শমশের, তলোয়ার!
মহবুব :
আমি তো ওরই প্রেমে মহবুব।
গুলশন :
আমি ওরই রচিত গুলশন–শীর্ণ প্রান্তরকে ওরই আদর, ওরই যত্ন গুলশনের ফুলবনে পরিণত করেছে। বিদৌরা, চুপ করে রইলি যে।
বিদৌরা :
আল্লাহ্ জানেন, ওই মাহতাবের মহিমাই আমায় বিদৌরা করেছে।
মহবুব :
এসো, আমরা সকলে মিলে ওই আল্লাহ্‌র দান মাহাতবকে মোবারকবাদ দিই।
সকলে :
ঈদ মোবারক হো! মাহতাব মোবারক হো! মাহতাব মোবারক।
শমশের :
আজকার ঈদগাহে তুমিই তো আমাদের ইমাম।
মাহতাব :
আল্লাহু আকবর! আমি ইমাম নই, আমি মুয়াজ্জিন। আমি আজান দিয়ে তোমাদের আনন্দের ঈদগাহে ডেকে এনেছি। মুয়াজ্জিন যে কেউ হতে পারে, ইমাম হয় আল্লাহ্‌র ইচ্ছায়।
মহবুব :
আমরা যদি বলি, আল্লাহ্‌র সেই ইচ্ছা তোমাতে অবতরণ করেছে।
মাহতাব :
আল্লাহ্ আমায় সব অহংকার, সব প্রলোভন থেকে রক্ষা করুন। ইমাম তোমাদের মাঝেই লুকিয়ে আছেন। তিনিই এই নবযুগের সর্বভ্রাতৃত্বের ঈদগাহে আত্মপ্রকাশ করবেন আল্লাহ্‌র ইচ্ছায়। জমায়েত সেদিন সার্থক হবে। সেই দিন আমরা এই মহামিলনের ঈদগাহে সর্ব জাতিধর্ম, হানাহানি ঈর্ষা ভেদ ভুলে সর্বধর্মের পূর্ণ সমন্বয় – সেই পরম নিত্য পরম পূর্ণ সনাতন আল্লাহ্‌কে একসাথে সিজদা করব – নামাজের শেষে অশ্রুসিক্ত চোখে পরস্পরকে আলিঙ্গন করব । কোথায় সেই সর্বত্যাগী ফকির, কোথায় সেই মহাভিক্ষু? এক আল্লাহ্ জানেন। আমি তাঁর বান্দা, হুকুম-বরদার! যেদিন তাঁর হুকুম আসবে – সেদিন এই বান্দা তাঁর সিংহাসনের দিকে শির উঁচু করে ক্রন্দন করে উঠবে – আল্লাহ্, তোমার নিত্য দান তোমার হুকুম-বরদার বান্দা হাজির।
মহবুব :
ইনশাআল্লাহ্ !মা শা আল্লাহ্। জাজা কাল্লাহ্‌! আল্লাহ্‌র হুকুম-বরদারই অন্যকে হুকুম করতে পারে। সেই সর্বত্যাগী ফকিরই সামান্য জীবকে ইমাম করে তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে পারেন। তিনি যে সকলের, তাই সকলকে ছেড়ে, জামাতকে ছেড়ে আগে গিয়ে দাঁড়ান না। আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় ইমাম হয়, আল্লাহ্‌ তো ইমাম হন না। আপনি যে আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় আপনার সকল ইচ্ছা সেই পূর্ণ পরম ইচ্ছাময়কে সমর্পণ করেছেন। এক আল্লাহ্‌র ইচ্ছাই সকল ইমামকে পরিচালিত করে। মাহতাব ভাই, ক্ষমা করো, তুমি কি আল্লাহ্‌র সেই গোপন ইচ্ছা ?
মাহতাব :
(হাসিয়া) আল্লাহ্‌ জানেন। তোমরা যখন আমাকে এইসব কথা বলছিলে, আমার প্রতি অণু-পরমাণু কেঁপে আল্লাহ্‌র উদ্দেশে বলছিল, ‘আল্লাহ্‌তুমি জান, আমাদের ব্যক্ত-অব্যক্ত সর্ব-অস্তিত্ব তোমার ইচ্ছায় সৃষ্ট হয়, পরিবর্তিত হয়। আমরা যদি সুন্দর হই, সে যে তোমার সাধ, তোমার ইচ্ছা, তোমার লীলা, তোমার বিলাস। তাই তোমরা যে ভালোবাসা প্রেম শ্রদ্ধা আমায় দাও, তা আমি আল্লাহ্‌কে নিবেদন করে দিই। আমার সর্ব-অস্তিত্বের যে তিনি একমাত্র অধিকারী।”
বিদৌরা :
আচ্ছা মাহতাব ভাই, এই যে এত ছেলেমেয়ে কী যেন অজানা আকর্ষণে তোমায় জড়িয়ে ধরতে চায়, প্রেম দেয়, মালা দেয় – তুমি তার কিছুই গ্রহণ কর না?
মাহতাব :
চাঁদকে দেখে ফুল ফোটে, চকোর-চকোরী কাঁদে। চাঁদ ফুল ফুটায়, চকোরীকে কাঁদায় – কিন্তু সে ফুলের গন্ধ কি সে চকোরীর কাঁদন দেখে বিচলিত হয়? ওই ফুলের গন্ধ চকোরীর ক্রন্দন, চাঁদকে ছুঁয়ে আল্লাহ্‌র কাছে চলে যায়। চাঁদ যদি ওই দান নিত, তাহলে চাঁদ শুকিয়ে মরা তারার মতো ঘুরে বেড়াত আঁধারের প্রেতলোকে। নদীতে যে ফুল ঝরে, নদী কি তা নেয়? সেই ফুল নদী তার প্রিয়তম মহাসাগরকে দেয়। উপনদী নদীতে পড়ে, সেই উপনদীর জল কি নদী নেয়? সেই উপনদীর জলকে সমুদ্রের জলে পৌঁছে দেয়।
গুলশন :
এ কী করুণ বৈরাগ্য তোমার। কেন, কেন তুমি নিজেকে এত বেদনা দাও? কেন এমন নিষ্ঠুরেরর মতো তুমি নিজেকে অবহেলা কর, বঞ্চিত কর? তোমার এই নিজেকে এই অবহেলাই আমাদের এমন করে কাঁদায়!
মাহতাব :
(হাসিয়া) আমি খুলে বলি। তোমরা যে প্রেম আমায় দাও, তা যদি আমার কামনার অগ্নিতে পুড়ে দগ্ধ হয়ে যেত, তাহলে তোমরাও আমাকে হারাতে, আমিও তোমাদের হারাতাম। আল্লাহ্‌কে দিয়েছি বলেই তোমাদের প্রেম আজ এত বিপুল প্রবাহের আকার ধারণ করেছে। তোমাদের দেওয়া প্রেম আল্লাহ্‌কে দিয়েছি বলে সেই প্রেম আজ সকলে পাচ্ছে। আল্লাহ্‌ যে সর্বময়। যেখানে আল্লাহ্‌ নাই, তাঁর অস্তিত্বও নাই; যেখানে অস্তিত্ব সেইখানেই আল্লাহ্‌। কাজেই আল্লাহ্‌র দেওয়া তোমাদের এই প্রেম তাঁকে দিলে তাঁর সকল অস্তিত্ব অর্থাৎ সমস্ত জড় জীব ফেরেশতা মানুষ সেই প্রেমের স্বাদ পায়। সেই প্রেমে তারা গলে যায় – তাদের সমস্ত মন্দ ভালো হয়ে যায়।
গুলশন :
বুঝলাম। কিন্তু তুমি কী পেলে?
মাহতাব :
আমি আল্লাহকে পেলাম। অর্থাৎ তাঁরই অস্তিত্ব তাঁর ইচ্ছার সৃষ্টি তোমাদের সকলকে পেলাম। তাই আমার ঈদ ফুরায় না। আমার ঈদ ফুরায় আবার আসে। নদী যেমন সাগরকে নিত্য পেয়ে আবার নিত্য তার পানে ‘পাইনি পাইনি’বলে কেঁদে কেঁদে ধায়, আমার মিলন-বিরহ তাঁর সাথে তেমনি নিত্য। এ বোঝাবার ভাষা নাই; নদী হও, তখন বুঝবে। বিরহের রোজা না রাখলে কি প্রেমের চাঁদ দেখতে?
মহবুব :
ভাগ্যিস তুমি স্নিগ্ধ চাঁদ, প্রখর সূর্য নও, তা হলে এতক্ষণ গলে মোম হয়ে যেতাম। বিদৌরা! একী! তুমি কাঁদছ কেন? চাঁদের এত স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নাও এমন করে গলায়!গোসলের সময় হয়ে গেল, আল্লাহ্‌র লীলা-সাগরে অবগাহন করলাম তবু গোসল করতেই হবে, এও তাঁরই ইচ্ছা। এখন তাঁরই ইচ্ছায় ‘এল ঈদ ঈদ’ গানটা গাও তো।

(বিদৌরার গান)
এল ঈদল-ফেতর এল ঈদ ঈদ ঈদ।
সারা বছর যে ঈদের আশায় ছিল নাকো নিঁদ॥
রোজা রাখার ফল ফলেছে দেখ রে ঈদের চাঁদ,
সেহরী খেয়ে কাটল রোজা, আজ সেহেরা বাঁধ।
ওরে বাঁধ আমামা বাঁধ।
প্রেমাশ্রুতে ওজু করে চল ঈদগাহ মসজিদ॥
(আজ)
ছিটায় মনের গোলাব-পাশে খুশির গোলাব-পানি
(আজ)
খোদার ইস্কের খশবু-ভরা প্রাণের আতর-দানি।
ভরল হৃদয়-তশতরিতে শিরনি তৌহিদ॥
(দেখ)
হজরতের হাসির ছটা ঈদের চাঁদে জাগে,
সেই চাঁদেরই রং যেন আজ সবার বুকে লাগে।
(এই)
দুনিয়াতেই মিটল ঈদে বেহেশ্‌তি উমিদ॥

কবির লড়াই

(পল্লিগ্রামে এক রকম লড়াই আছে,তাকে বলে কবির লড়াই। এতে একজন দেয় চাপান আর একজন দেয় কাটান। আমাদের এই লড়াই-এর প্রথম কবিয়াল যে লোকটিকে আসর থেকে করেছিল, সে ছিল কয়ালি অর্থাৎ সে ধান মাপত, সে ভুল করে কবিয়ালের খাতার বদলে ধানের হিসাবের খাতা এনে বলে যাচ্ছে, আর কবিয়ালও তাই গেয়ে যাচ্ছে। প্রথমে ঢুলির বাজনা হচ্ছে।)

কবি – বড় সংকটে পড়েছি মা গো, দাও মা পদতরি
তরে যাই
প্র– ১৩২৫ শে পৌষ গুজরতে খোদ খেদু মোড়ল,
সাড়ে সতেরো আড়ি ধান –
কবি – ১৩২৫ শে পৌষ গুজরতে খোদ খেদু মোড়ল
সাড়ে সতেরো আড়ি ধান –
ওরে নারে নারে ওরে নারে নারে
কয়ালি কি কওয়ালি, ধানের খাতার হিসাব বলে
কুল মান মোর সব খোয়ালি, কয়ালি কি কওয়ালি।
ষাঁড়ের মাথার ঢুস্ মারতে এসেছে ওই ভেড়া,
পাহাড়ে মাথা ঠুকতে এল টেকো মাথা নেড়া।
(লাগাও চাঁটি টাক ভেঙে যাক)
পেরথম ভাগ পড়েননি কো, এলেন কবি-গান গাইতে,
নামতে নারে ডোবায়, এলো সমুদ্দুরে নাইতে।
(নাকানি চোপানি নাকানি চোপানি)

চাপান দিয়ে বাবুরা সব শুন অতঃপর
এই চাপানেই কাঁপন দিয়ে আসবে বাছার জ্বর।
(ধর ধর লেপ ঠেসে ধর, ধর ধর লেপ ঠেসে ধর মালোয়ারি জ্বর)
বলি ভূতের বাপের নাম কী, আর ডিম দেয় কোন ঘোড়ায়,
দশটা মুণ্ড নিয়ে রাবণ কেমন করে ঘুমায়?
শিবের মাথায় গঙ্গা, হয় না কেন সর্দি,
বলতে পারলে বলব কবি, নয় একদম রদ্দি।
(মুড়ি কুড় কুড় কাঁকুড় কাঁকুড়
মুড়ি কুড় কুড় কাঁকুড় কাঁকুড়
ঝিনেদা চলে যা ঝাঁ।
ঝিনেদা চলে যা ঝাঁ।
ঝিনেদা চলে যা ঝাঁ।

(যার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছিল, তার নাম গুমানি)
কবি – বলি গুমানি নাম নিয়ে তুই গুমান করিস এত,
ওই নামের প্রথম অক্ষর কী, জানে সকলে তো।
(হায় হায় মরি মরি গুমানি করি রে)
গুমানি তোর মানি গেলে রইবে বাকি কি,
পায়ে মাড়ালে নাইতে যে হয়; বলব না নাম ছিঃ
(ধর ধর ল্যাজ ঠেসে ধর–
ধর ধর ল্যাজ ঠেসে ধর–
নাক টেনে ধর ল্যাজ ঠেসে ধর;
মিনসে জবরজং মিনসে জবরজং
মিনসে কেমন সং॥)
(গুমানি এসে চাপানের কাটান দিচ্ছে)
নেই কো ডানা উড়ে এলি সাবাস, জীবন উড়ে।
আমার ভয়ে জীবন এবার যায় বুঝি তোর উড়ে॥
(উড়ে উড়ে যাক, উড়ে উড়ে যাক,
জীবন উড়ে উড়ে যাক,
উড়ে কটকে পুরীতে উড়ে যাক
উড়ে যাক উড়ে যাক উড়ে যাক॥)
বুড়ো বলদ লড়তে আসে এঁড়ে দামড়ার সাথে,
আর ব্যাং বলে আজ চিত করব হাতিকে এক লাথে॥
ভূতের বাপের নাম? আবাগে, আর তাইতে মহাশয়
আবাগের বেটা ভূত, গাল দিয়ে লোকে কয়।
ভেবেছিলি ঘোড়ার ডিমের প্রশ্নে করিব ঠান্ডা,
ঘোড়ার মধ্যে পক্ষীরাজ ঘোড়াতে দেয় আন্ডা॥

(হলি ঠান্ডা, গণ্ডা গণ্ডা ঘোড়ার আন্ডা দেখে যা
দেখে যা দেখে যা দেখে যা
দেখে যা দেখে যা দেখে যা॥)
বেলের আঠায় শিবের জটায় ওয়াটার প্রুফ হয়ে
ওরে, বেলেস্তারা হয়ে –
সর্দি হয় না শিব ঠাকুরের গঙ্গা মাথায় লয়ে
শিবের গঙ্গা মাথায় লয়ে।
(আর) রাবণ রাজার দশ মুণ্ডের নয়টা ছিল শোলার,
ভয় দেখাতে এই মতলব ওই রাক্ষসেরই পোলার॥
শোবার সময় শোলার মুখোস-মাথা রাখত খুলে
এবার আমি যদি চাপান দিই তুই ছুটবি রে লেজ তুলে
(ছোট ছোট লেজ তুলে ছোট কাছা খুলে ছোট
বনে ও বাদাড়ে, পগারে পাহাড়ে ছুটে যা
ছুটে যা, ছুটে যা, ছুটে যা॥)
মোর গুমানি নামের প্রথম আখর নিয়ে –
বাহাদুরি করলি তো খুব একবার আমি শোনাই ইয়ে।
তোর গুরুর গোড়ায় কী, তোর গুরুর গোড়ায় কী,
তোর সাগুর শেষে কী? আর মাগুর মাছের মাঝে কী খাস?
বেগুনের মাঝখানে খাস, তারে কি কয় ছিঃ –
ওরে ছিঃ, গুড়ের প্রথম অক্ষর কি, ছিঃ, ওরে ছিঃ –
তোর গুরুর গোড়ায় কী, তোর গুরুর গোড়ায় কী?
(খাস খাস পাতি হাঁস, খাস খাস)
যাবা বাপ দিল্লি যাবা, দিল্লিকা ওই লাড্ডু খাবা
কুমড়ো ছাঁচি কুমড়ো, কুমড়ো চালকুমড়ো
বজ্রযোগিনী যাবা না ভগিনী
যাবিনে যাবিনে যা, যাবিনে যাবিনে যা॥)

কলির কেষ্ট

(বাঁশির সুর)
কেডা রে –? কেডা? উ– কেলিকদম্ব গাছের এই ডাল ওই ডাল কইরা লাফ দিয়া বেড়াইত্যাছে? ও– ঘোষ পাড়ার হেই বখাইটা পোলাটা না? উ – হুঁ,– আবার পিরুক পিরুক কইরা বাঁশি বাজান হইত্যাছে – নাইম্যা আইস – নাইম্যা আইস। ভদ্-দুপুর বেলা মাইয়াগো ছান ঘাটের কাছে – অ্যাঁ – হ্যাঁ-হ্যাঁ, আবার কেষ্ট সাজছেন? যিনি কেষ্ট সাজছেন, নামো শিগগির নামো – পোড়াকপাইল্যা নামো –

তুমি নামো হে নামো
শ্যাম হে শ্যাম।
কদম্ব-ডাল ছাইড়া নামো
দুপুরি রৌদ্রে বৃথাই ঘামো
ব্যস্ত রাধা কাজে
শ্যাম হে শ্যাম।

আ রে, তোমার ললিতা দেবী কী করতেয়াছে জাননি? তোমার ললিতা দেবী?

আরে ললিতা দেবী সলিতা পাকায়,
বিশাখা ঝোলে হিজল-শাখায়;
আর বৃন্দা দূতী কী করছে জান ? বৃন্দা দূতী ?
বৃন্দা দূতী পিন্ধা ধুতী
গোষ্ঠে গেছেন তোমার ‘পোস্ট’
সাজিয়া রাখাল সাজে
আর চন্দ্রা গেছেন অন্ধ্র দেশে
মান্দ্রাজি জাহাজে।

আবার ইতি উতি চাও ক্যা ? ইতি উতি চাইবার লাগছ ক্যা? অ্যাঁ?
আমি কমু না, কোনখানে তোমার যমুনা তা আমি কমু না?

আরে ইতি উতি চাও বৃথাই
আমি কমু না কোথায় তোমার যমুনা
কইলকাতা আর ঢাকা রমনার
লেকে পাবে তার নমুনা।

আরে, তোমার যমুনা ল্যাক হইয়া গ্যাছে গিয়া ! বুঝলা?

হালার যমুনা হইয়া গ্যাছে গিয়া
কলেজে ফিরিছে শ্রীদাম সুদাম

শ্রীদাম সুদাম কলেজে যাইত্যয়াছে আর তুমি এখানে বাজাইত্যাছ অ্যাঁ? পোরা কপাইল্যা –

কলেজে ফিরিছে শ্রীদাম-সুদাম
মেরে মাল-কোঁচা খুলিয়া বোতাম,
লাঙল ছাড়িয়া বলরাম
ডাম্বেল মুদ্‍গর ভাঁজে;
ওহে শ্যাম হে শ্যাম
আরে তুমি নামো
পোড়া কপাইল্যা নামো॥

কালোয়াতি কসরত

গাব্বুসের বাপ : আইগ্যা পেন্নাম ওই পতিতুন্ডী ঠাউর ! আইগ্যা, তুমি আপনি যাইবার লাগছে কই? কহা হাহা! ওদিক পানে যাইও না ঠাউর ! ময়লা আছেন – ময়লা আছেন–মানুষের ময়লা!
পতিতুন্ডী : কে ও? গাববুসের বাপ? হল্লারে বিল্লা। নক্কুরে খাইছিল! রামচন্দ্র! বাবা গাব্বুসের বাপ। বাইচ্যা থাহ বাবা বাইচ্যা থাহ বাবা। তুমি না কইলে এহনি আমি ওই ময়লাতে পারা দিচ্ছিলাম। তা হেরে কি কয়, মুই যাইত্যাচি বৈকুণ্টু তলাপাত্রের বাড়িত। তলাপাত্র বুঝলি? বেডপ্যান, বেডপ্যান। কলা বুঝছ? হেই তলাপাত্রের বাড়িতে কালোয়াতি গান হইব – হেরে হুনবার যাইতেছি।
গাব্বুসের বাপ : কালো হাতির গান? আইগ্যা কী যে কন। মুই তো বাপের জন্মেও কালো হাতির গান তো হুনছি না। সার্কাসে কালো হাতির নাচ দেখছি – গান তো হুনছি না। মো গো গরিব গ কি যাইবার দিব?
পতিতুন্ডী : (হাসিয়া) আরে, কালো হাতির গান নয়; কালোয়াতি গান। আইও মোর লগে, যাইবার দিব না কীসের লাইগ্যা।
গাব্বুসের বাপ : আইগ্যা ওই ওইল। আপনারা যারে আতি কন, আমরাও হিরে আতি কই। চলেন আইগ্যা।

[ওস্তাদের গান হচ্ছে – ওস্তাদজি তখন বাঙলা গান ধরেছেন]

গান

(আরে হাঁ)  ভক্ত তব ডাকে মেনকা-নন্দিনী
         সব কুচু হামার হারাইয়া মা গো
     তোমার নাম জপি জগদম্বা গো,
     মহামাইয়্যা আইস্যা সনধ্যা আঁধিয়ারা
             নাইশো আনন্দিনী॥

(গানের মাঝে গাব্বুসের বাপের হাউ হাউ রবে ক্রন্দন।)
পতিতুন্ডী : এরি ও গাব্বুসের বাপ! কাঁদবার লাগছস কীসের লাইগ্যা। চুপ দাও।
গাব্বুসের বাবা : আইগ্যা, ওস্তাদজির দাড়ি দেইখা আমার পাঠাডারে কথা মনে পইর‍্যা গেছে গো। কাল থনে আমার পাঠাডারে বিছরাইয়্যা পাইতেছি না। তেনার মুখে ওস্তাদজির মুখের লাহান দাড়ি আছিল। হেও ওইহুন

গুল-বাগিচা

গুল-বাগিচায় নৌ-বাহারের মরসুম। যৌবনের এই গুল-বাগিচার বুলবুলি, গোলাপ, চম্পা, চামেলি, ভ্রমর, প্রজাপতি, নহর, লতাকুঞ্জ, শারাব, সাকি – চির-তাজা। এখানে চির-বসন্ত বিরাজিত। সাকির হাতে শিরাজির পেয়ালা, কবির বুকে দিলরুবা, রবাব, বেণু, আর গজল-গানের দীওয়ান। এই গুলিস্তানের কবি চির-তরুণ, চির-কিশোর। কবির অঙ্গে হেলান দিয়ে লীলায়িত-দেহা কবির মানসী প্রিয়া। ফিরোজা রং-এর ওড়না, গোধূলি-রঙের পেশোয়াজ-পরা সুর্মামাখা ডাগর চোখে তার বিকশিত প্রেমের নিলাজ আকুতি। এই শীর্ণা তন্বী কবি-প্রিয়ার হাতে মৌন বীণা, অধরে অভিমান, পায়ের কাছে পড়ে গোলাপকুঁড়ির গুচ্ছ। চঞ্চল কবিকে তার বিশ্বাস নেই, কোনো প্রেমের বন্ধনে যেন এই চঞ্চলকে বাঁধা যায় না। এই আনন্দ-বিলাসী প্রজাপতিটাকে সে তার কিংখাবের বক্ষ-আস্তরণে দিবানিশি লুকিয়ে রাখতে চায়, – প্রতি মুহূর্তেই হারাই-হারাই ভয়ে তার প্রেম চকিত, বেদনা-বিহ্বল। আকাশে চাঁদ – পৃথিবীর বুলবুলিস্তানে কবি – কাউকেই ধরা যায় না।
কবি ভাবেন – যৌবন আর ফুল সকালে ফুটে সন্ধ্যায় যায় ঝরে। ফুলের মালাকে মিলন-রাতের শেষে স্রোতে ফেলে দিতে হয়। – এই তার নিয়তি।
প্রতি মুহূর্তের আনন্দকে স্বীকার করে নিতে হয় তার উদ্ভবের শুভ মুহূর্তে। এ লগ্ন বয়ে গেলে, আর তা ফিরে আসে না। তাই সে হাতের ফুলকে যখন অভিনন্দিত করে, তখন না-ফোটা গোলাপের জন্য সে কাঁদে। যে ফুল ঝরে গেল, সেই মৃত ফুলের শবকে ধরে সে অতীতের শ্মশানে কাঁদে না।
কবি তাঁর উন্মনা মানসীর আঁখি-প্রসাদ পাওয়ার জন্য গেয়ে ওঠেন –

(গান)
আধো-আধো বোল, লাজে-বাধো-বাধো বোল
বলো কানে কানে।

যে-কথাটি আধো-রাতে মনে লাগায় দোল –
বলো কানে কানে॥

যে-কথার কলি প্রিয়া আজও ফুটিল না,
শরমে মরম-পাতে দোলে আনমনা,
যে-কথাটি ঢেকে রাখে বুকের আঁচল –
যে-কথা লুকায়ে থাকে লাজ-নত চোখে,
না বলিতে যে-কথাটি জানাজানি লোকে,
যে-কথাটি ধরে রাখে অধরের কোল –
বলো কানে কানে॥

যে-কথা বলিতে চাও বেশ-ভূষার ছলে,
বলে দেয় যে-কথা তব আঁখি পলে পলে,
যে-কথা বলিতে গিয়া গালে পড়ে টোল –
বলো কানে কানে॥
কবির কাব্যলক্ষ্মী আনমনে কপোলে ঝুমকো-চাঁপার পরশ বুলাতে বুলাতে গোলাপ-লতার বুলবুলির পানে চেয়ে থাকে। বাহিরে-পাওয়ার ব্যর্থতা তার মনে তোলে অশান্তির ঝড়। তাই সে তার সুন্দরের বিগ্রহ অন্দর-দেউলে প্রতিষ্ঠিত করে আনন্দ পেতে চায়। বাহিরের সুন্দর ঘুরে বেড়ায় বাহির-ভুবনে; অন্তরের সুন্দরের চরণ নেই–নিশ্চয় চারণকে বাঁধবার এই বোধ হয় সহজতম উপায়। তাই সে তার সুন্দরের অনুনয়ের বিনিময়ে ওঠে –

(গান)
মন দিয়ে যে দেখি তোমায়
তাই দেখিনে নয়ন দিয়ে
পরান আছে বিভোর হয়ে
তোমার নামের ধেয়ান নিয়ে॥

হৃদয় জুড়ে আছে বলে
এড়িয়ে চলি নানান ছলে;
আছ আমার অন্তরে, তাই
অন্তরালে রই লুকিয়ে॥

আমার কথা শুনাই না গো
তোমার কথা শোনার আশায়;
ভরে আছে অন্তর মোর
বন্ধ তোমার ভালোবাসায়।

তোমায় ভালো বাসতে পেরে
পেয়েছি মোর আনন্দেরে,
অমর হলাম প্রিয়, তোমার
বিরহেরই সুধা পিয়ে॥
কবি আর তাঁর মানসী দ্রাক্ষা-কুঞ্জে চোখে চোখে কথা কয়; সুরে সুরে মনের ভাবের মালা গাঁথে – এ ওর গলায় দেয়; আর সাকি পরিবেশন করে তাদের আনন্দের শিরাজি। তার আপন হৃদয়-পেয়ালা থাকে শূন্য, তাকে মুখ-ভরা হাসি নিয়ে তাদের বাসি হৃদয়কে সঞ্জীবনী-সুধা দিয়ে জীবন্ত করতে হয়। ও যেন ব্রজের ললিতা। রাধা-কৃষ্ণের মিলন ঘটিয়ে তিনি তাঁর উপবাসী মনের প্রসাদ পান। তাই সাকির তৃষিত-আত্মা যে গান গেয়ে ওঠে, তারই ভাষা ফুটে ওঠে কবির রবাবে।

(গান)
(যবে) আঁখিতে আঁখিতে ওরা কহে কথা
দু-টি বনের পাখি।
শুধু শিরাজি ঢালি, আমি চোখের বালি
আমি পাষাণ সাকি॥
রিক্ত ওদের হৃদয়-পেয়ালায়
আমি অমৃত ঢালি,
আমারই অন্তর শুধু পাইল না প্রেম-মধু
রহিল খালি।
(আমি) রহি আভরণ-হীনা বাঁধি ওদের
হাতে প্রেমের রাখি॥
আমি হাসিয়া রচি যার কুঞ্জ-বাসর
দুয়ারে দাঁড়ায়ে তারই জাগি রাতি;
আমি শিয়রে রহি হায় নিজেরে দহি
যেন মোমের বাতি।
আমি গাঁথিয়া মালা, দিই সখীর হতে,
দেখি কে দেয় কার মালা কার গলাতে;
শিরাজি ঢালিতে হায় পেয়ালা ভাঙিয়া যায়
নিরালায় বন্ধুর মিলন-ছবি
আমি হৃদয়ে আঁকি॥
ফুল-চোর বুলবুল কেবলই গুঞ্জন-গানে গুল-বাগিচা প্রতিধ্বনিত করে তোলে। তার নিবেদনের বাণী যেমন অশান্ত, তেমনই মধুর, তেমনই ব্যাকুল। তার স্তব্ধ গানের সুর দখিন হাওয়ার বুকে আবর্ত তোলে, সে যেন ফাল্গুন-মাসের ঘূর্ণি হাওয়া। কবিতার উদাসীনা ধরা-না-দেওয়া প্রিয়ার শ্রবণে কেবলই গানের দুল দুলতে থাকে –

মোর প্রিয়া হবে এসো রানি, দিব
খোঁপায় তারার ফুল।
কর্ণে দুলাব তৃতীয়া তিথির
চৈতি চাঁদের দুল॥
কণ্ঠে তোমার দুলাব বালিকা
হংস-সারির দুলানো মালিকা,
বিজলি-জরিন ফিতায় জড়াব
মেঘ-রং এলোচুল॥
রামধনু হতে লাল রং ছানি
আলতা পরাব পায়;
চাঁদ হতে এনে চন্দন, প্রিয়
মাখাব তোমার গায়।
গোলাপ-ফুলের পাপড়ি আনিয়া
রচিব তোমার বাসর, লো প্রিয়া
তোমারে ঘিরিয়া কাঁদিবে আমার
কবিতার বুলবুল॥
কবির কাব্যশ্রী যাকে ঘিরে সুষমায় বিভূষিত হয়ে ওঠে, সেই কবিতার দেবী কবির টলমল হৃদয়-কমলে টলতে টলতে গেয়ে ওঠেন –

সাকি! বুলবুলি কেন কাঁদে গুল-বাগিচায়।
ও কি মধু যাচে, কেন আসে না কাছে
অকরুণ পিয়াসে কেন মুখ-পানে চায়॥
ওর
করুণ বিলাপ শুনি লতার গোলাপ আমি
ঝুরিয়া মরি।
আমি কাঁটা-লতায় বাঁধা কুলবধূ, হায়
যাই কেমন করি!
ও যে-শিরাজি মাগে, দিতে ভয় লাগে,
তাহা সঞ্চিত থাক অন্তর-পেয়ালায়॥
কত চামেলি হেনা ওর আছে চেনা,
আমি কণ্টক-বিজড়িত গোলাপ-কলি,
মোর ডাক-নাম ধরে কেন ডাকে ঘুম-ঘোরে
ভিখারির বেশে চাহে প্রেমাঞ্জলি।
ও কি
বুঝিতে পারে না মোর মৌন ভাষা,
রক্তিম হৃদয়ের ভালোবাসা,
ঝরার আগে সাকি ওরে আমি পাব না কি
শুধু ক্ষণিকের তরে তৃষিত হিয়ায়॥

বহু রস-পিয়াসি বৈচিত্র্য-বিলাসী কবি-মন যায় সাকির পাশে। তার না-বলা বাণী সে যেন তার অতীন্দ্রিয় শ্রবণ দিয়ে শুনতে পায়।
প্রেমের কণ্টক-বিদ্ধ কবি সাকির দ্বারে গিয়ে ফিরে আসে। মুক্তপক্ষ মুক্ত আকাশের পাখিকে ডাকে নীড়ের মায়া। গুল-বাগের ছায়া-কুঞ্জে প্রেমের যে শান্ত নীড় রচেছে কবি-মানসী, তার মায়া মুক্তপক্ষের পাখা কণ্টক-বিদ্ধ করেছে – বহু-রূপের পিয়াসি-চিত্ত এক-রূপে আত্মস্থ হয়ে আজি শান্তি পেতে চায়। সাকি গুল-বাগিচার বুলবুলের হৃদয়ের প্রসাদ অনুভব করে। ভীরু কবিকে উদ্দেশ করে সে গেয়ে ওঠে –

(গান)
মুখের কথায় নাই জানালে
জানিয়ো গানের ভাষায়।
এসেছিলে মোর কাছে, হে পথিক,
কীসের আশায়॥
আপন মনের কামনারে
রাখলে আড়াল অন্ধকারে
আপনি তুমি করলে হেলা
আপন ভালোবাসায়॥
সাধ ছিল যে-হাত দিয়ে গো
পরিয়ে দেবে হার,
দ্বিধা ভরে সেই হাতে, হায়
করলে নমস্কার!
নিশুত রাতে বলো সুরে
কেন থাক দূরে দূরে,
কেন এমন গোপন কর
বুক-ভরা পিয়াসায়॥

ঝিলিমিলি

প্রথম দৃশ্য

[মির্জা সাহেবের দ্বিতল বাড়ির উপর-তলার প্রকোষ্ঠ। মির্জা সাহেবের ষোড়শী মেয়ে ফিরোজা রোগশয্যায় শায়িতা। সব জানালা বন্ধ, শুধু পশ্চিম দরজা খোলা। বাহিরে বৃষ্টি হইতেছে। পার্শ্বে বসিয়া মির্জা সাহেবের পত্নী হালিমা বিবি মেয়েকে পাখা করিতেছেন। বাদলায় ও বেলাশেষের অন্ধকারে ঘরের আঁধার গাঢ়তর হইয়া উঠিতেছিল। হালিমা বিবি উঠিয়া হারিকেন জ্বালিলেন।]

ফিরোজা :
মা!
হালিমা :
(ছুটিয়া আসিয়া ফিরোজার মুখের কাছে মুখ রাখিলেন) কী মা! সোনা আমার!
ফিরোজা :
বাতি নিবিয়ে দাও!
হালিমা :
কেন মা? বড্ড আঁধার যে! ভয় করবিনে।
ফিরোজা :
উঁহুঁ। তুমি আমায় ধরে বসে থাকো। (মা-কে জড়াইয়া ধরিল) বাতি বিশ্রী লাগে।
হালিমা :
তা তো লাগবেই মা‌! (দীর্ঘশ্বাস গোপন করিলেন) আচ্ছা, আমি কাগজ আড়াল করে দিই। কেমন?
ফিরোজা :
না। তুমি নিবিয়ে দাও। (রোগশীর্ণ কণ্ঠে চিৎকার করিয়া উঠিল) দাও শিগগির!
হালিমা :
কেঁদো না মণি, মা আমার! এই আমি নিবিয়ে দিচ্ছি। (বাতি নিবাইতে গেলেন। ততক্ষণে কতকগুলো বাদলা পোকা আসিয়া বাতি ঘিরিয়া নৃত্য করিতেছিল। ফিরোজা তাহাই এক মনে দেখিতে লাগিল।)
ফিরোজা :
নিবিয়ো না, মা! আমি বাদলা পোকা দেখব!
হালিমা :
(হাসিয়া ফিরিয়া আসিলেন) খ্যাপা মেয়ে! আচ্ছা নিবাব না। পোকা যে গায়ে মুখে এসে পড়বে মা, বাতিটা একটু সরিয়ে রাখি।
ফিরোজা :
(চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল) না! আমি বলছি, বাদলা পোকা দেখব!
হালিমা :
(কন্যাকে চুমু দিলেন) লক্ষ্মী মা আমার! অত জোরে কথা কোয়ো না! ওতে অসুখ বেশি হয়! আমি বাতি সরাচ্ছি নে।
ফিরোজা :
(চুপ করিয়া বাদলা পোকা দেখিতে লাগিল) মা, আমায় একটা বাদলা পোকা ধরে দাও না!
হালিমা :
ছি মানিক! পোকা ছুঁতে নেই! তুই আজ অমন করছিস কেন ফিরোজা?
ফিরোজা :
(কান্নার সুরে) দাও বলছি। নইলে চেঁচিয়ে রাখব না কিছু।
হালিমা :
লক্ষ্মী, মা! কেঁদো না। এই দিচ্ছি। (একটা বাদলা পোকা ধরিয়া মেয়ের হাতে দিলেন। ফিরোজা হাতে করিয়া এক মনে বাদলা পোকা দেখিতে লাগিল।)
ফিরোজা :
এই যা! পাখা খসে গেল! আ-হা-রে! আচ্ছা মা! বাদলা পোকার খুব লাগল?
হালিমা :
তা লাগল বইকী!
ফিরোজা :
তা হলে ছেড়ে দিই ওকে। মা, তুমি ওকে নীচে রেখে এসো (হালিমা বাদলা পোকা নীচে রাখিয়া আসিলেন) … মা, বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে, না?
হালিমা :
হাঁ মা, খুব বৃষ্টি। শুনছ না ঝমঝমানি?
ফিরোজা :
আমার খুব ভালো লাগে ওই বৃষ্টির শব্দ। … মা, আব্বা কোথায়?
হালিমা :
বাইরে, দহলিজে বোধ হয়।
ফিরোজা :
এখন যদি আমি খুব জোরে কাঁদি, আব্বা শুনতে পাবেন?
হালিমা :
ছি মা, কাঁদবে কেন? ওঁকে ডেকে পাঠাব?
ফিরোজা :
না, না, ডেকো না। মা খুব লক্ষ্মী মেয়ে! আচ্ছা মা, তুমি যদি এখন গান কর, আব্বা শুনতে পাবেন?
হালিমা :
ওরে দুষ্টু! বুঝেছি তোমার মতলব। … না, মা, এখন কি আর গান করে, তোর আব্বা শুনলে রাগ করবেন।
ফিরোজা :
এত বৃষ্টিতে শুনতে পাচ্ছেন কিনা! মা, লক্ষ্মী মা, সোনা-মা, আস্তে আস্তে গাও না! সেই বৃষ্টি ঝরার গানটা।
হালিমা :
আচ্ছা, গাচ্ছি আস্তে আস্তে। এখন কি আর গান আসে রে ফিরোজা। সেই কখন ছেলেবেলায় গেয়েছি গান। এখানে এসেই তা ভুলতে চেষ্টা করেছি। তোর আব্বা বড্ডো রাগ করেন গান শুনলে।
ফিরোজা :
আচ্ছা মা, গান শুনেও কেউ রাগে? আব্বা আচ্ছা মানুষ যা হোক!
হালিমা :
আগে কিছুদিন রাগ করতেন না। … গান তো প্রায় ভুলেই যাচ্ছিলাম। কেবল তোর জন্যেই আজও দু-একটা মনে আছে।
ফিরোজা :
আব্বা আগে রাগ করতেন না মা, তুমি গান করলে?
হালিমা :
না! ………. তুই এখন গান শোন।

ঝরে ঝরঝর কোনো গভীর গোপন-ধারা এ শাঙনে।
আজি রহিয়া রহিয়া গুমরায় হিয়া একা এ আঙনে॥
ঘনিমা ঘনায় ঝাউ-বীথিকায় বেণু-বন-ছায় রে
ডাহুকিরে খুঁজি ডাহুক কাঁদে রে আঁধার গহনে॥
কেয়া-বনে দেয়া তূণীর বাঁধিয়া
গগনে গগনে ফেরে গো কাঁদিয়া
বেতস-বিতানে নীপ-তরুতলে
শিখী নাচ ভোলে পুছ-পাখা টলে।
মালতী লতায় এলাইয়া বেণি কাঁদে বিষাদিনী রে,
কাজল-আঁখি কে নয়ন মোছে তমাল-কাননে॥

ফিরোজা :
মা! জানলাটা খুলে দাও। আমি মেঘ দেখব!
হালিমা :
লক্ষ্মী মা! জানলা খোলে না। ঠান্ডা লাগবে। আমি বরং একটা গান করি, তুমি শোনো।
ফিরোজা :
না মা। আর গান আমি সইতে পারব না। খোলো না মা, জানলাটা। (হালিমা দক্ষিণের জানালা খুলিতে গেলেন) ওটা না মা, ওই পুব-দিককার জানলাটা খোলো। পুবের হাওয়ায় কদম ফোটে, না মা?
হালিমা :
ও-দিককার জানলা খুললে তোর আব্বা আমায় আর জ্যান্ত রাখবেন না, ফিরোজ! এই দক্ষিণের জানলাই খুলি। (দক্ষিণের বাতায়ন খুলিলেন। দূরে বনের আভাস দেখা যাইতেছে। বৃষ্টিধারায় বন ঝাপসা হইয়া আসিতেছে।)
ফিরোজা :
(দীর্ঘশ্বাস মোচন করিয়া পাশ ফিরিল। আবার পাশ ফিরিয়া আগেকার মতো করিয়া শুইয়া জানালার দিকে তাকাইয়া থাকিল। বোধ হয় সে কাঁদিতেছিল।) মা!
হালিমা :
মা আমার! তুই কাঁদছিস ফিরোজ?
ফিরোজা :
আচ্ছা মা, আব্বা তোমায় খুব ভালোবাসেন?
হালিমা :
জানি না। (চক্ষু মুছইলেন)
ফিরোজা :
আগে খুব ভালোবাসতেন?
হালিমা :
বাতিটা এখন সরিয়ে রাখি? তোর চোখে লাগছে, না?
ফিরোজা :
আচ্ছা রাখো। কিন্তু তুমি বলো …
হালিমা :
(বাতি সরাইয়া রাখিলেন।) এখন একটু চুপ করে ঘুমাও তো ফিরোজা। বকলে আবার অসুখ বাড়বে।
ফিরোজা :
আচ্ছা, তুমি না-ই বললে। আমি সব বুঝি। আব্বা কক্ষনো কাউকে ভালোবাসেননি। নইলে মানুষ কখনো এমন নীরস আর নিষ্ঠুর হয়!
হালিমা :
তুই কি থামবি নে ফিরোজা? লক্ষ্মী মা আমার, কেন মন খারাপ করছ এত, বল তো! আজ যে তোকে চুপ করে থাকতে বলে গেছে ডাক্তার।
ফিরোজা :
আচ্ছা মা, কাল থেকে ওই পুব-দিককার জানলাটা খুলবে তো, তখন তো আর আব্বা বকবেন না?
হালিমা :
(শিহরিয়া উঠিলেন। কান্নায় তাঁহার গলা ভাঙিয়া আসিল।) ও কী কথা বলছিস ফিরোজ?
ফিরোজা :
কাল আর ও-জানলা খুলতে বলব না মা! (বালিশে মুখ লুকাইল।)
হালিমা :
(হঠাৎ পাথরের মতো স্থির হইয়া গেলেন। কণ্ঠ তাঁহার অশ্রুবিকৃত হইয়া উঠিল।) বুঝেছি রে হতভাগি, সব বুঝেছি। তুই আমাদের বড়ো শাস্তি দিয়ে যাবি। … মা, এই আমি খুলে দিচ্ছি পুব-জানলা, তুই অত অধীর হসনে। (পুব-জানালা খুলিয়া দিতেই সম্মুখের বাড়ির মৃদু-আলোকিত বাতায়ন দেখা গেল। বাতায়নপথে কে যেন ছটফট করিয়া ফিরিতেছে। দূর হইতে তাহাকে ছায়ামূর্তির মতো দেখাইতেছিল। ছায়ামূর্তি নিশ্চল হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। মনে হইল যেন এই বাতায়ন-পানেই সে অচঞ্চল দৃষ্টিতে তাকাইয়া আছে। হালিমা আড়ালে চক্ষু মুছিলেন।)
ফিরোজা :
(ব্যাকুল দৃষ্টিতে বাতায়ন-পথে তাকাইয়া রহিল।) মা, বাঁশি বাজছে না? উঁহুঁ কে যেন কাঁদছে! (অস্থির হইয়া) বাইরে কে কাঁদে মা? মা, মা, শোনো!
হালিমা :
কই মা, কিছু না। ও বৃষ্টির ঝরঝরানি। … হুঁ … না …হাবিব বুঝি গান করছে এসরাজ বাজিয়ে।
ফিরোজা :
আহ! বৃষ্টিটা যদি থামত, গানটা শুনতে পেতাম … বৃষ্টি থেমে আসছে – না মা?
হালিমা :
হাঁ মা, বৃষ্টিটা ধরে এল।
ফিরোজা :
মা – মা! এইবার শুনতে পাচ্ছি গান। আহ! একটু শব্দ না হয় যেন। মা তুমি চুপ করে শোনো। (বাতায়ন হইতে গান ভাসিয়া আসিতেছিল।)

গান

হৃদয় যত নিষেধ হানে নয়ন ততই কাঁদে।
দূরে যত পলাতে চাই, নিকট ততই বাঁধে॥
স্বপন-শেষে বিদায়-বেলায়
অলক কাহার জড়ায় গো পায়,
বিধুর কপোল স্মরণ আনায়
ভোরের করুণ চাঁদে॥
বাহির আমার পিছল হল কাহার চোখের জলে।
স্মরণ ততই বারণ জানায় চরণ যত চলে।
পার হতে চাই মরণ-নদী
দাঁড়ায় কে গো দুয়ার রোধি,
আমায় – ওগো বে-দরদি –
ফেলিলে কোন্ ফাঁদে॥

[গান শেষ হইলে বাতায়নের আলো উজ্জ্বলতর হইয়া উঠিল। সেই আলোকে এক প্রিয়দর্শন তরুণের মূর্তি স্পষ্ট হইয়া দেখা দিল। সে স্থির দৃষ্টিতে এই দিকেই তাকাইয়া আছে।]

ফিরোজা :
মা – মা-মণি! ঘরের বাতিটা খুব উজ্জ্বল করে দাও। যেন আমায় খুব ভালো করে দেখা যায় ও-বাড়ি হতে। (বাহিরে কাহার পদশব্দ শোনা গেল।)
হালিমা :
ওরে ফিরোজ! বন্ধ কর, বন্ধ কর, পুব-জানালা। তোর আব্বা আসছেন। (মির্জা সাহেব গৃহে প্রবেশ করিতেই একটা দমকা হাওয়ায় প্রদীপ নিবিয়া গেল। হালিমা আবার বাতি জ্বালাইলেন।)
মির্জা সাহেব :
আর জানলা বন্ধ করতে হবে না। আমি বহুক্ষণ থেকেই তোমাদের কীর্তি দেখছি। দেখ, আর যা-ই কর, ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেতে চেষ্টা, কোরোনা। (হালিমা নিরুত্তর) … আর ওই বাঁদর ছোঁড়াটাকেই বা কী বলি! এক গাছা কাঁচা বেত নিয়ে বেতিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত … (ক্রোধে বদ্ধমুষ্ঠি হইয়া দাঁত কড়মড় করিয়া উঠিলেন।) দিনরাত গান আর গান! বাঁশি আর এসরাজ! স্থিরচিত্তে একটু ‘কোরান তেলাওত’ করবার কী নামাজ পড়বার জো নেই। হতচ্ছাড়া পাজি কোথাকার! ওই বিশ্ব-বখাটে আবার বলে, পাশ করবে বি.এ.। ও তো ফেল করেই আছে। ওই রত্নের সঙ্গে দেব মেয়ের বিয়ে!
হালিমা :
দেখো, তোমার পায়ে পড়ি, আজ একটু আস্তে কথা কও, আজ ফিরোজা কেমন যেন করছে!
মির্জা সাহেব :
(পুব-দিককার জানালাটা বন্ধ করিতে করিতে) হুঁ। … তা এমন করে জানলা খুলে তাকিয়ে থাকলে যে-কোনো আইবুড়ো মেয়েরই অসুখ করে।…দেখ, তুমিই ফিরোজার মাথা খেলে। আর ওই বুড়ো বয়সেও তোমায় গান গাওয়া অভ্যেস গেল না। কী ভুলই করেছি স্কুলে-পড়া মেয়ে বিয়ে করে!
হালিমা :
সত্যি, এ ভুল না হলে দুইজনই বেঁচে যেতাম। আমি এ কথা-ভাবতেও পারিনে যে, কোনো কোনো গ্র্যাজুয়েট গোঁড়ামিতে কাঠ-মোল্লাকেও হার মানায়।
মির্জা সাহেব :
শরিয়তের বিধি-নিষেধ মানাকে তুমি গোঁড়ামি মনে কর, এ অভিযোগ তো বহুবার শুনেছি, হালিমা। আর কোনো নতুন কথা শোনাবার থাকে তো বলো।
হালিমা :
আছে। তোমার মতো শরিয়তের টিন-বাঁধানো হৃদয়ে তা কি লাগবে? …একটু আগে গানের খোঁটা দিচ্ছিলে। কিন্তু তুমি ভুলে যাচ্ছ যে,আমি গান গাইতে পারি জেনেই তুমি আমায় বিবাহ করে কৃতার্থ হয়েছিলে!
মির্জা সাহেব :
ভুলিনি সেকথা। কিন্তু তখন জানতাম না যে তোমার গান শুধু চোখের জল, শুধু ব্যথা। কেন গান শরিয়তে নিষিদ্ধ, তা আমার চেয়ে কেউ বেশি বুঝবে না! শরিয়তে যিনি সংগীত নিষিদ্ধ করেছিলেন, তিনি জানতেন এর ব্যথা দেওয়ার পীড়া দেওয়ার শক্তি কত।
হালিমা :
আমি এও জানি, যিনি এই শরিয়তের স্রষ্টা, তিনি গান শুনে আনন্দও পেয়েছেন। যাক, তর্ক করবার স্থান এ নয়। মেয়েটাকে একটু শান্তিতে মরতে দেবে কি?
মির্জা সাহেব:
দেখ, জীবনে হয়তো শান্তি দিইনি তোমাদের। আমার বিশুষ্ক জীবনে তোমাদের জন্যে হাসির ফুল ফোটাতে পারিনি, শুধু কাঁটাই ফুটিয়েছি। কিন্তু মরণেও তোমাদের অশান্তি হানব, এত বড়ো গালি আমায় না-ই দিলে!

(হালিমা চমকিয়া উঠিলেন, ফিরোজা পাশ ফিরিয়া জলসিক্ত চোখে তাহার বাবার দিকে তাকাইল – মির্জা সাহেব পায়চারি করিতে লাগিলেন।)
ফিরোজা :
আব্বা! আমার পাশে এসে বসো।
মির্জা সাহেব :
(কাঁপিয়া উঠিলেন)…হালিমা! তুমি ফিরোজাকে দেখো, আমি ডাক্তার ডাকতে চললাম।
ফিরোজা :
আব্বা! আব্বা! দেখছ না কীরকম ঝড়-বৃষ্টি শুরু হল আবার। তুমি যেয়ো না। আমি আর ওষুধ খাব না। একটু কাছে এসে বসো আজ লক্ষ্মীটি।
মির্জা সাহেব :
(হঠাৎ শুষ্ক হইয়া উঠিলেন।) কিন্তু আমি থাকলে তো তোমার অসুখ আরো বেড়ে উঠবে মা!
ফিরোজা :
না, আজ আর বাড়বে না। তুমি এসো (মির্জা সাহেব তাহার শয্যাপার্শ্বে বসিয়া তাহার ললাটে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিলেন) … আব্বা, আজ আমি খুব যা-তা বকব, তুমি কিছু বলবে না বলো।
মির্জা সাহেব :
আচ্ছা মা, বলো।
ফিরোজা :
তুমি ওই পুব-জানলাটা খুলতে দাও না কেন?
মির্জা সাহেব :
(হঠাৎ কঠোর হইয়া উঠিলেন) ও ব্যাটা পাজি, নচ্ছার, বাঁদর!…কিন্তু মা, তুমি ভালো হয়ে ওঠো। ও যদি বি. এ. পাশ করতে পারে এবার, তাহলে ওই বাঁদরের গলাতেই মোতির মালা দেব – এও তো বলে রেখেছি।
ফিরোজা :
কিন্তু আমি তো আর ভালো হব না আব্বা।
মির্জা সাহেব :
(শিহরিয়া উঠিলেন) না, মা, ভালো হবে। এখনই তো ডাক্তার আসবে।
ফিরোজা :
উঁহুঁ, কিছুতেই ভালো হব না আমি।…আচ্ছা আব্বা, তুমি ওকে এ-বাড়ি আসতে দাও না কেন?
মির্জা সাহেব :
(হঠাৎ বিছানা হইতে উঠিয়া চিৎকার করিয়া) আমি ওকে খুন করব। শয়তান আমার মেয়েকে খুন করেছে।
(বাহির দ্বারে করাঘাত শোনা গেল)
হাবিব :
আমি এসেছি। আমায় খুন করুন। … মা, একটিবার দোর খুলে দিন।
মির্জা সাহেব :
খবরদার! কেউ দোর খুলো না। বেরোও পাজি এখান থেকে।
হাবিব :
পাশের খবর বের হয়েছে।
মির্জা সাহেব :
পাশ করেছ?
হাবিব :
এখনও খবর পাইনি। তার করেছি। হয়তো এখনই খবর আসবে।
মির্জা সাহেব :
মিথ্যাবাদী! আগে খবর আসুক, তারপর এসো। এখন বেরোও। মেয়ের অসুখ বেড়েছে।
হালিমা :
আহা, দাও না বাছাকে আসতে। একটু দেখে যাবে বই তো নয়! কদিন থেকে ছেলেটা যেন ছটফটিয়ে মরছে।
মির্জা সাহেব :
হাঁ, আর সেই দুঃখে নতুন নতুন গান গাওয়া হচ্ছে। চুপ করো তুমি। (চিৎকার করিয়া) এখনও দাঁড়িয়ে আছ?
হাবিব :
আছি। আমায় খুন করবেন বলেছিলেন। খুন করুন, তবুও একবার দোর খুলুন মির্জা সাহেব।
মির্জা সাহেব :
দেখেছ ব্যাটার মতোলব। নিশ্চয় সাথে পুলিশ নিয়ে এসেছে। আমায় বলিয়ে নিতে চায় যে, আমি খুন করব বলেছি। আমি কখখনো খুন করব বলিনি, তুমি লক্ষ্মী-ছেলের মতো বাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়ো।
ফিরোজা :
কেন এত অপমান সইছ আমার জন্যে, তুমি যাও। আমি তোমায় পেয়েছি।
হাবিব :
পেয়েছ?
ফিরোজা :
হাঁ, পেয়েছি।
হাবিব :
কিন্তু, আমি তো পাইনি।
ফিরোজা :
কাল পাবে। আমি আজ তোমার উদ্দেশে যাব পুব-জানলা দিয়ে। তুমি তোমার বাতায়নের ঝিলিমিলি খুলে রেখো।
হাবিব :
কিন্তু তোমার বাতায়ন তো রুদ্ধ।
ফিরোজা :
যখন যাব তখন আপনি খুলে যাবে।
হাবিব :
তবে যাই আমি।
ফিরোজা :
যাও। যাওয়ার কালে আমার ঝিলিমিলি-তলে সেই যাওয়ার গানটা শুনিয়ে যাও।
[হাবিবের গাহিতে গাহিতে প্রস্থান]
শুকাল মিলন-মালা, আমি তবে যাই।
কী যেন এ নদী-কূলে খুঁজিনু বৃথাই॥
রহিল আমার ব্যথা।
দলিত কুসুমে গাঁথা,
ঝুরে বলে ঝরা পাতা –
নাই কেহ নাই॥
যে-বিরহে গ্রহতারা সৃজিল আলোক,
সে-বিরহে এ-জীবন জ্বলি পুণ্য হোক।
চক্রবাক চক্রবাকী
করে যেমন ডাকাডাকি,
তেমনই এ-কূলে থাকি
ও-কূলে তাকাই॥
ফিরোজা :
মা! মা! আমার কেমন করছে! মাগো, তুমি আমায় ধরো! আব্বা, তুমি যাও। তোমায় ভালো লাগে না। … মা! মা! এত বাতি জ্বলে উঠল কেন! (মূর্ছিত হইয়া পড়িল)
হালিমা :
ওগো, তোমার পায়ে পড়ি, যাও ডাক্তারকে দেখ একটু! মা! সোনা মা আমার! লক্ষ্মী মা! ফিরোজ!
মির্জা সাহেব :
ফিরোজ! মা! তুই ফিরে আয়! আমি হাবিবকে ফেরাতে যাচ্ছি।
[বিদ্যুৎবেগে বাহির হইয়া গেলেন।]

দ্বিতীয় দৃশ্য

[স্থান স্বপ্নপুরি। সাদা মেঘের পাল-টাঙানো সপ্তমী চাঁদের পানসিতে চড়িয়া হাবিব ও ফিরোজা ভাসিয়া চলিতেছে। শ্বেত-মরালীর সারি ডানা দিয়া দাঁড় টানিতেছে। তাহাদের ভিড় করিয়া ঘিরিয়াছে চকোর-চকোরী। ময়ূরকণ্ঠী আলোতে হাবিবের মুখ এবং ফিরোজার মুখ রাঙিয়া উঠিয়াছে। সারা আকাশ যেন জুঁই-বাগানের মতো বিকশিয়া উঠিয়াছে।]

ফিরোজা :
এ আমরা কোথায় এসেছি, হাবিব?
হাবিব :
(হাসিয়া) ছি, নাম ধরে ডাকতে নেই এখানে! এখানে আসতে হয় নাম ছারিয়ে, সকল নামের দিশা ছড়িয়ে। এখানে হাবিবও আসতে পারে না, ফিরোজাও আসতে পারে না।
ফিরোজা :
তবে যে আমরা এসেছি।
হাবিব :
একবার চাঁদের জ্যোৎস্না-মুকুরে ভালো করে নিজের মুখ দেখো দেখি।
ফিরোজা :
(সভয়ে) এ কী, আমি যে আমায় চিনতে পারছিনে! এ আমি কে?
হাবিব :
(হাসিয়া) কার মতো বোধ হয়?
ফিরোজা :
এ যেন – এ যেন সকলের মুখ! এ যেন শকুন্তলার, এ যেন মালবিকার, এ যেন মহাশ্বেতার মুখ! এ যেন লায়লির, এ যেন শিরীর মুখ!
হাবিব :
সত্যিই তাই, তোমার মুখে আজ নিখিল-বিরহিণী ভিড় করেছে। এখানে আসতে হয় শুধু ‘প্রিয়’ আর ‘প্রিয়া’ হয়ে। এখানে নর-নারী অ-নামিক। এ লোকে নর-নারীর পরিচয়-সংকেত ‘প্রিয়’ আর ‘প্রিয়া’। এখানে ডাকতে হয় শুধু ‘প্রিয়তম’ বলে।
ফিরোজা :
(লজ্জায় রাঙিয়া উঠিল, চাঁদকে ঘিরিয়া রামধনুর সাত-রঙা শোভা বিজলির মতো খেলিয়া গেল!) যাও! (কানে কানে) চকোর-চকোরী শুনতে পাবে যে!
হাবিব :
শুনুক। ধরায় আমাদের যে কথা কানাকানি হয়ে আছে, তারায় তারায় আজ তারই জানাজানির হুল্লোড় পড়ে গেছে। দেখছ না প্রিয়তম! কত নব নব তারা জন্ম লাভ করল সৃষ্টির নীহারিকা-লোকে, শুধু ওই কানে-কথাটি শুনবার লোভে। ওই কানে-কথা শুনবে বলেই তো চন্দ্রলোকে এত চকোর-চকোরীর ভিড়!
ফিরোজা :
এ কোন লোক, প্রিয়তম? (চাঁদ দুলিয়া উঠিল)
হাবিব :
দেখলে? চাঁদ দুলে উঠল তোমার ‘প্রিয়তম’ ডাকের নেশায়! …এ স্বপ্ন-লোক।
ফিরোজা :
স্বপ্ন-লোক! তাহলে এ-স্বপ্ন টুটে যাবে? আবার তোমায় হারাব?
হাবিব :
হয়তো হারাবে, হয়তো হারাবে না; জানিনে। তো … এ স্বপ্ন-লোক এত ক্ষণিক বলেই এত সুন্দর।…না, না, এ স্বপ্ন-লোক চিরদিনের, এ সুন্দরের আকাঙ্ক্ষা-লোক, এর কি মৃত্যু আছে? এর কি শেষ আছে?
ফিরোজা :
তবে ভয় হয় কেন? এখনই এর শেষ হয়ে যাবে মনে করে?
হাবিব :
ওই শেষের ভয় – ওই হারাবার ভয় আছে বলেই এত মধুর এ-লোক। তাই তো এমন জড়িয়ে ধরে আছি পরস্পরকে। চোখের পাতা ফেললেই এ স্বপ্ন টুটে যাবে ভয়েই তো এমন পলক-হারা হয়ে চোখে চোখে চেয়ে থাকি। ওই হারাবার ভয়েই তো চন্দ্র-সূর্য গ্রহ-নক্ষত্র এমন বিপুল আবেগে পরস্পর পরস্পরের দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে না – পায়ে পায়ে ঘুরে ফিরছে।
ফিরোজা :
তাহলে এই বেহেশ্‌ত?
হাবিব :
এই বেহেশ্‌ত।
ফিরোজা :
তাহলে আর যারা বেহেশ্‌তে এসেছে তারা কই? শিরী, লায়লি, জুলেখা? আর ফরহাদ, মজনু, ইউসুফ?
হাবিব :
আমাকে ভালো করে দেখো দেখি।
ফিরোজা :
(সভয়ে হাবিবকে জড়াইয়া ধরিল) ওগো, একী! তোমার এত বিপুলতা আমি সইতে পারব না। তুমি যেন নিখিল-পুরুষ, তুমি যেন অনন্তকাল ধরে কাঁদছ।
হাবিব :
(হাসিয়া ফিরোজার কপোলে তর্জনী ও মধ্যমা অঙ্গুলি দিয়া মৃদু আঘাত করিতে লাগিল) ভয় নেই, প্রিয়তম! আর একবার দেখো, তুমি যাকে দেখতে চাইবে তাকেই দেখতে পাবে আমার মুখে।
ফিরোজা :
(তাকাইয়া স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিল) আচ্ছা বেহেশ্‌তের হুরপরি কই?
হাবিব :
তুমি ইচ্ছা করলেই তারা আসবে। এখানে বাসনা দিয়ে তাদের সৃজন করতে হয়।
ফিরোজা :
তারাও সব তাহলে আমাদের মধ্যে?
হাবিব :
হাঁ, এখানে – এই স্বর্গলোকে – শুধু দুটি নরনারী – তুমি আর আমি – অনন্তকাল ধরে মুখোমুখি বসে আছে। তাদের চোখে পলক নেই। বুঝি পলক পড়লেই বিশ্ব কেঁদে উঠবে। হারিয়ে যাবে সুন্দর এ স্বর্গলোক। হারিয়ে যাব আমি আর তুমি।
ফিরোজা :
(হাবিবকে জড়াইয়া ধরিল) প্রিয়তম!
হাবিব :
(ফিরোজার কপোলে কপোল রাখিয়া) প্রিয়তম!
[চন্দ্র সাথে দোল খাইতে লাগিল। চকোর-চকোরী উন্মত্ত হইয়া উঠিল। হাবিব ও ফিরোজ চাঁদের সাথে দোল খাইতে খাইতে অস্ত গেল।]

তৃতীয় দৃশ্য

[মির্জা সাহেবের অন্দরমহল। ফিরোজা পালঙ্কে মূর্ছিতা। ঘরে ডাক্তার, হালিমা, মির্জা সাহেব। … ভোর হইয়া আসিয়াছে। আকাশ তখনও মেঘাচ্ছন্ন! মেঘলা আকাশ চিরিয়া ‘বউ কথা কও’ পাখির স্বর দূর হইতে দূরান্তরে মিশিয়া গেল। প্রদীপ-শিখা ম্লান হইয়া উঠিয়াছে। হালিমা বারে বারে অঞ্চলে চক্ষু মুছিতেছেন ও কন্যার মুখের দিকে তাকাইয়া দেখিতেছেন। মির্জা সাহেব অস্থিরভাবে পায়চারি করিয়া ফিরিতে ফিরিতে হঠাৎ পুবের জানালাটা পরিপূর্ণরূপে খুলিয়া দিলেন। হাবিবদের বাড়ি প্রেতমূর্তির মতো দাঁড়াইয়া রহিয়াছে দেখা গেল। হাবিবদের কামরার বাতায়ন রুদ্ধ। শুধু ঝিলিমিলি খোলা। ঝিলিমিলির ফাঁক দিয়া নিবু-নিবু দীপশিখার মলিন আলো কান্নার মতো করুণ হইয়া দেখা দিতেছে। ভিতরের আর কিছু দেখা যাইতেছে না। ডাক্তার বারে বারে নাড়ি দেখিতেছেন । শেষে হাতে একটা ইঞ্জেকশন দিয়া ডাক্তার কাহাকেও কিছু না বলিয়া চোখ মুছিতে মুছিতে বাহিরে উঠিয়া গেলেন।]

ফিরোজা :
(নড়িয়া উঠিল) মাঃ!
হাবিব :
(ছুটিয়া গিয়া ফিরোজার উপর যেন হুমড়ি খাইয়া পড়িয়া গেলেন) মা! মা আমার! ফিরোজ! ফিরে এসেছিস! মানিক আমার! জাদু আমার!
মির্জা সাহেব :
ফিরোজ! মা! আবার চললুম খুঁজতে তাকে। ওই সকাল হয়ে এল। আল্লাহ। এবারটি আমায় মাফ করো। আমি তোমার ইঙ্গিত বুঝেছি হালিমা। মাকে আমার ধরে রেখো। আমি হাবিবকে খুঁজতে চললাম। (ঝড়ের বেগে বাহির হইয়া গেলেন)
ফিরোজা :
মা-মণি খুব কেঁদেছ বুঝি? ও কী! পুব-জানলা খুললে কে?
হালিমা :
(ললাটে গভীর চুম্বন আঁকিয়া দিলেন) তোমার আব্বা।
ফিরোজা :
মা, আব্বাকে ডাক।
হালিমা :
তিনি যে হাবিবকে ডাকতে গেলেন, মা! আজ তোদের বিয়ে (মা ম্লান হাসি হাসিলেন)।
ফিরোজা :
(উজ্জ্বল হাসি হাসিয়া) মা, তুমি আব্বাকে খুব ভালোবাস?
হালিমা :
(হাসিয়া) আজ তোর সাথে সাথে প্রথম ভালোবাসলুম। (মুখ ফিরাইলেন)।
ফিরোজা :
(মার হাতে চুমু খাইল) দুষ্ট মেয়ে। তাহলে তোমাদেরও আজ বিয়ে হল। তাহলে আমি তোমাদের কে হলাম।
হালিমা :
খ্যাপা মেয়ে। তুই আমাদের মা হলি। হল তো?
ফিরোজা :
(হঠাৎ সোজা হইয়া উঠিয়া হাবিবের ঝিলিমিলির পানে তাকাইয়া থাকিল) মা! মা! ও জানলা বন্ধ কেন?
হালিমা :
অভিমানী ছেলে – রাত্রে কোথায় চলে গেছে। যাবে আর কোথায়? এক্ষুণি হয়তো আসবে। তোমার আব্বা ওকে না নিয়ে ফিরছেন না।
ফিরোজা :
(শয্যায় ছিন্নকণ্ঠ কপোতীর মতো লুটাইয়া পড়িল) মা! মা গো! সে আর ফিরবে না। আমার স্বপ্নই তাহলে সত্য হল। ওই অস্তচাঁদের চোখে তার অশ্রু লেগে রয়েছে। মা! মা! ও কী? ও কার গান?

(দূরে হাবিবের ক্লান্ত কণ্ঠের করুণ বিলাপ-গীতি শোনা যাইতেছিল।)

গান

স্মরণ-পারের ওগো প্রিয় তোমায় আমি চিনি যেন!
তোমার চাঁদে চিনি আমি, তুমি আমার তারায় চেন॥
নতুন পরিচয়ের লাগি
তারায় তারায় থাকি জাগি
বারে বারে মিলন মাগি
বারে বারে হারাই হেন॥
নতুন চোখের প্রদীপ জ্বালি চেয়ে আছি নিরিবিলি,
খোলো প্রিয় তোমার ধরার বাতায়নের ঝিলিমিলি।
নিবাও নিবু-নিবু বাতি,
ডাকে নতুন তারার সাথি,
ওগো আমার দিবস-রাতি
কাঁদে বিদায়-কাঁদন কেন॥
ফিরোজা :
মা! মা! চাঁদের পার হতে ভেসে আসছে ও-গান। ও-গান স্বপন-লোকের, ও-গান বেহশ্‌তের। মা – গো – !
হালিমা :
হাবিব! হাবিব! ছুটে আয় বাপ আমার! তোর ফিরোজা চলে যায়। মা! মা আমার রে! (লুটাইয়া পড়িলেন)
হাবিব :
(ঝড়ের বেগে দ্বারে করাঘাত হানিয়া) মির্জা সাহেব। দোর খুলুন! খোলো দ্বার! ‘তার’ পেয়েছি। আমি বি. এ পাশ করেছি। খোলো দ্বার। (দ্বারে পদাঘাত করিল, দ্বার ভাঙ্গিয়া পড়িল।) মা! মা! ফিরোজ কই, আমি পাশ করেছি। এই দেখো ‘তার’ – পারদর্শিতার সহিত পাশ!
হালিমা :
হাবিব! হাবিব! ফিরোজ আমার চলে গেছে।
হাবিব :
(ক্রন্দন-উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে চিৎকার করিয়া উঠিল) চলে গেছে?
হালিমা :
চলে গেছে – ওই পুব-জানলা দিয়ে। বললে, চললাম ওই জানলার ঝিলিমিলি খুলতে।
হাবিব :
মা! আমি তাকে খুঁজতে চললাম। ওই অস্ত-চাঁদের চোখে তার ইঙ্গিত দেখতে পেয়েছি। [ঝড়ের বেগে চলিয়া গেল।]

বনের বেদে

প্রথম খণ্ড
(গান)
ছন্ন-ছাড়া বেদের দল আয়রে আয়
কাল-বোশেখির ঝড়-তুফান
আনরে তোর দৃপ্ত পায়॥
বর্শা কই তির ধনুক
কাঁপিয়ে তোল মাটির বুক
হুমড়ি খেয়ে নীল-আকাশ
দেখরে মোদের সঙ্গ চায়॥

সর্দার :
ঝুমরো!
ঝুমরো :
সর্দার!
সর্দার :
এই পাহাড়তলির বন। এইখানে আমাদের কিছুদিন থাকতে হবে। উঁচু-মাথা আমার হেঁট করেছে – সে শয়তানকে এই দুনিয়া থেকে সরাতেই হবে। এই বনে সে ডেরা গেরেছে, আমি খবর পেয়েছি – তাকে খুঁজে বের করতেই হবে – এই বন আমি পাঁতি পাঁতি করে খুঁজব – কোথায় সে লুকিয়ে থাকবে? তোরা এইখানেই তাঁবু ফেল – আমি আসছি।
ঝুমরো :
আচ্ছা সর্দার! কী সুন্দর এই বন! যেন আমার কত কালের চেনা। কী মিষ্টি বাতাস এ বনের – কী মিষ্টি এখানকার পাখির গান। আহা কারা গাইতে গাইতে এইদিকে আসছে –
‘আয় লো বনের বেদিনি আয় আয় আয়।
সিন্ধুতে তটিনীতে জাগায়ে তরঙ্গ
কাঁপাইয়া মেদিনী॥

দ্বিতীয় খণ্ড
আকাশের ঘোমটা ধরে টান
তার কোলের খোকা চাঁদকে ধরে আন
মেঘের ঝাঁপি খুলে নাচাবি বিজলি-সাপিনী॥
নিশি-রাতের আঁচল থেকে কুসুম কেড়ে নে
তৃষ্ণা মিটা লো নিংড়ে পাহাড় ঝরনা এনে
পলার মালা আন সাগর ছেঁচে
আয় বনের ঘাগরি পরে ঘূর্ণি নেচে
আঁখির চাওয়ায় লুটাবে পাখি

মৌরী :
মিতিন! দেখেছিস একটা লোক লুকিয়ে আমাদের দেখচে – চল আমরা চলে যাই –
ঝুমরো :
হাসে নাচে গায় ঝাঁক বেঁধে যায় জংলা পাখি।
বিঁধব কারে তীর দিয়ে গো কারে পিঁজরায় রাখি॥
নিঠুর আমার খেলা
দিনের বেলায় আঘাত হেনে
কাঁদি রাতের বেলা
যেন সুন্দর-বনের বাঘ চমকে ওঠে
দেখে বন-হরিণীর ডাগর আঁখি॥

তৃতীয় খণ্ড
মৌরী :
বেদের দুলাল! তুই পাখি শিকার করিস কেন?
ঝুমরো :
বেদের মেয়ে! তুই সাপ নাচাস কেন?
মৌরী :
সাপ নাচাই? সাপের মতো চোখ যার – তাকে বশ করতে – শুনবি –

বাঁকা ছুরির মতো বেঁকে উঠল যে তোর আঁখি।
বেদের দুলাল আমার সাথে সাপ খেলাবি নাকি?
তোর জোড়া-ভুরুর ধনু আমি চিনি
পাখি আমি নই বেদিয়া আমি যে সাপিনী
ভয় করি না হাসিকে
ডর লাগে তোর বাঁশিকে
তোর মনের ঝাঁপি খোলা পেলে সেথায় গিয়ে থাকি॥

মৌরী :
শুনলি তো? আচ্ছা বেদের-দুলাল তুই ফুল পাড়তে পারিস – ওই গাছের আগায় কত ফুল দেখেছিস – আমায় পেড়ে দিবি?
ঝুমরো :
ফুলের দাম দিবি তো?
মৌরী :
দাম? যা!
ঝুমরো :
আচ্ছা দাম নাই দিলি – আমি যে ফুল পেড়ে দেব – তাই দিয়ে বিনি সুতোর মালা গেঁথে আমায় দিবি তো?
মৌরী :
বারে! তা হলে তো দাম দেওয়া হয়েই গেল। দাম পেলে চলে যাবি – আর দাম না পেলে পাওয়ার আশায় আবার ফিরে আসবি।
ঝুমরো :
ফিরে এলে যদি দেখা পাই – তাহলে দাম চাইনে – তাহলে কাল আবার ফিরে আসবি?
মৌরী :
জানি না!
ঝুমরো :
(তির ছোঁড়া ও ফুল পাড়ার শব্দ) এই নে একডাল ফুল তির দিয়ে পেড়ে দিলাম – তোর আঁচলের ডালি কই?

চতুর্থ খণ্ড
মৌরী :
চুপ, ঝোপের আড়ালে মিতিন আড়ি পেতে রয়েছে –
ঝুমরো :
তুই চুপ করে আমার পানে চেয়ে থাক –

নিম-ফুলের মউ পিয়ে ঝিম হয়েছে ভোমরা
মিঠে হাসির নূপুর বাজাও গো ঝুমুর নাচো তোমরা
কভু কেয়া কাঁটায় কভু বাবলা আঠায়
বারে বারে প্রজাপতির পাখা জড়ায়
দেখে হেসে লুটিয়ে পড়ে ফুলের দেশের বউরা।

মৌরী :
যাঃ ! মিতিন সব দেখে ফেলেছে – কী লজ্জা – আমি পালাই –
ঝুমরো :
তাহলে আমিও যাই – হ্যাঁ ভালো কথা – বেদের মেয়ে, তোর নাম?
মৌরী :
আমার নাম মৌরী – বেদের ছেলে, তোর নাম?
ঝুমরো :
আমার নাম ঝুমরো –
মৌরী :
আবার আসিস।

পঞ্চম খন্ড
মৌরী :
মিতিন! ওই সে পাহাড়-চুড়োয় বসে বাঁশি বাজাচ্ছে – তুই যা ওকে ডেকে আন – আজ দু বেলা ওকে দেখিনি। আমি বসে গাই সে শুনতে পাবে আমার মাথার দিব্যি দিয়ে তাকে একবার আসতে বল –

নিশি ভোরের বেলা কাহার পাহাড়ি–বাঁশি বাজে।
তার বাঁশরির সুর বেদের নিঠুর তিরের মতো আসি বাজে॥
আমি তো নহি বনের পাখি
গাঁয়ের কন্যা ভিন গাঁয়ে থাকি
কেন নূপুর বাজায়ে কুসুম ঝরায়ে ঘুম ভাসায়ে চলে যায়
সে উদাসী বন-মাঝে॥
আসি রোজ সকালে আমার চাঁপার ডালে
কী যেন বেড়ায় খুঁজি
চাঁপার মুকুল দেখে অমনি দাঁড়ায় বেঁকে
সোনার নূপুর ভাবে বুঝি!
দূরে ত্রিকূট পাহাড়-চূড়াতে
ভোরের চাঁদ কাঁধে আমার সাথে
নিশীথে নিদ্রাহীন – আনমনা সারাদিন॥

ষষ্ঠ খণ্ড
ঝুমরো :
একী মৌরী তুই কাঁদছিস? কী হয়েছে তোর?
মৌরী :
কী হয়েছে তোর? কেন এসেছিলি তুই আমার সামনে – কেন হেসেছিল – কেন তুই …
ঝুমরো :
ও! তাই বল – আসতে দেরি হয়েছে বলে – শোন আমাদের সর্দারকে লুকিয়ে আসতে হয় কিনা তাই – আচ্ছা আমি আজই সর্দারকে বলে তার দল ছেড়ে দিয়ে তোকে নিয়ে ঘর বাঁধব – তুই আর কাঁদিসনি – আমি তোকে ছেড়ে যাব না– যাব না…
সর্দার :
হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ তোকে ছেড়ে যাব না – তোকে নিয়ে ঘর বাঁধব – ঝুমরো তুই জানিস বেদেরা ঘর বাঁধে না – ঘর তাদের বাঁধতে মানা – সারা দুনিয়াটাই তাদের ঘর….. আর কার সাথে তোর মিতালি – আমার দুশমন সেই রঘু সর্দারের মেয়ে সাথে – ঠিক করেছিস – যে আগুন সে আমার বুকে জ্বেলেছে – সেই আগুন রেখে গেলাম তার মেয়ের বুকে জ্বেলে – চল এখুনি আমরা এ বন ছেড়ে চলে যাব।
মৌরী :
ওগো কার পাপে কার সাজা – ওকে নিয়ে যেয়ো না – ওকে ছেড়ে আমি বাঁচব না…
সর্দার :
হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ প্রতিশোধ – বেদের প্রতিশোধ – উঠাও ডেরা –
মৌরী :
উঃ …. মা –

উঠাও ডেরা এবার দূরে যেতে হবে।
নিবিড় হলে মনের বাঁধন
গভীর ব্যথা পেতে হবে॥
কোথায় শূন্য মরুভূমি
ডাকো মোদের ডাকো তুমি
চিড়িয়াখানায় সিংহ গেলে
নিঠুর চাবুক খেতে হবে
বেদের মেয়ের চোখের জল বনের ঝরা ফুল
বেদের মেয়ে কাঁদে ভাসে নদীর দুকূল।

বাঙালি ঘরে হিন্দি গান

সঙ্গীত : ‘গহরী গহরী নদিয়া’ … কও।
ছাত্রী : ‘গহড়ী গহড়ী’
সঙ্গীত শিক্ষক : আরে আরে ! ‘ড়’ না, ‘গহড়ী’ না ‘গহরী’! ‘ব’ এ বিন্দু ‘র’।
ছাত্রী : ও! বুঝতে পেরেছি।
শিক্ষক : হ্যাঁ! কও দেহি।

(গান)

গহরী গহরী নদিয়া

ছাত্রীর ঠাকুরমা : আহা-হা -হা ! কী গানই গাইতেছে বিমলী! নদিয়ায়, নবদ্বীপের গান! বিমলী কি গান গাইতাছে মাস্টার? গৌর নিতাই নদিয়ায় না?
শিক্ষক : আইজ্ঞা হ্যাঁ। এইটা হইল হিন্দি গান। গহরী গহরী নদিয়ায়।
ঠাকুরমা : অর মানেডা কি হইল?
শিক্ষক : আইজ্ঞা, ওই যে গহরজান বাইজি, গহরজান বাইজি নদিয়া যাইতাছেন, গানে তাই কইতাছেন।
ঠাকুরমা : কী কও? নদিয়ায় বাইজি নাচব? গৌর নিতাই যেহানে নাচছে সেহানে কি না বাইজি নাচব? অরে পিঠ্‌ঠার বারি মাইরা খেদাইমু।
ছাত্রী : আঃ কী কর ঠাকুরমা? ও কি সত্য সত্যই নদিয়ায় যাইতাছে নাকি? গানে কইতাছে।
ঠাকুরমা : তুই র! তুই কী বুঝস? ধর্ম নষ্ট হইব না?
শিক্ষক : অ ! আচ্ছা, তবে থাক, তবে থাক। এই গানটা থাক। ধর্ম যদি নষ্ট হয় তবে এই গানটা থাক। আচ্ছা এই গানটা শোনেন দেহি:

(গান)

অ্যাই, সাঁইয়া নাহি বোলুঙ্গী
কও দেহি :
(ছাত্রী ও শিক্ষক উভয়ের গান)
সাঁইয়া নাহি বোলুঙ্গী

ঠাকুরমা : এ আবার কোন ছাতার গান গাইতে আছ? অডার মানে কী?
শিক্ষক : আইজ্ঞা, এইডার মানে হইল গিয়া এই, সাঁইয়ারে কইতাছে যে আমি নামুম, একটা লুঙ্গি লইয়া আসি । সাঁইয়া নাহিব, লুঙ্গি, সাঁইয়ার কাছে লুঙ্গি চাইতাছে।
ঠাকুরমা : কী কও! বামুনের বাড়ি লুঙ্গি কও! এই গান তুমি মিয়াঁ সাহেবদের বাড়ি গিয়া শিখাও গিয়া। আরে কাপড় না চাইয়া চাও কিনা লুঙ্গি! কী ছাতার লুঙ্গির গান…
শিক্ষক : আঃ ! আচ্ছা মুশকিল পড়ছি এই বুড়িটারে লইয়া আচ্ছা, আচ্ছা, এই গানটা শোনেন দেহি – আমার মনে হয় ই গানটা আপনার ভালো লাগবই, এইটা শোনেন দেহি, এই দেখেন:

(গান)

বিছুনানা মোরি বাজে ঝনন
সাসহুঁ জাগে, ননদহুঁ জাগে
আউর জাগে সব কুটুমকে লোগুয়া
মহম্মদ শা সাথ সদারঙ্গ জাগে,
ক্যায়সে মিলুঁ ম্যায় হরিকে চরণ॥

ঠাকুরমা : আহা-হা হা ! এই না কয় গান! হরির চরণ বাতলাইবার চায়। অর মানেডা তাই না মাস্টর? হরির চরণ বাতলাইবার চায় না?
শিক্ষক : আজ্ঞে না, তা ঠিক না, আজ্ঞে হাঁ – আজ্ঞে হ হ – ঠিক তাই-ই তাই-ই, তবে কিনা – আমাদের শ্রীরাধিকা, আমাদের শ্রীরাধিকা কইতাছেন যে বিছুনানা বাজে ঝন ঝন ঝন ঝন অর্থাৎ কিনা বিছানা ঝন ঝন কইরা বাজতাছে।
ঠাকুরমা : আরে হ হ, বাত হইলে ওই রকম বাজে।
শিক্ষক : আজ্ঞে হ, আজ্ঞে হ, বাত হইলে ওই রকম বাজে; আর কইতাছেন কী – কইতাছেন শাশুড়ি জাগে, ননদিনি জাগে, কুটুমে জাগে, হগ্‌গলে জাগে।
ঠাকুরমা : জাগব না? ঘরের বউ হইয়া পরের কাছে যায় : নিশ্চয় জাগব। হাজার বার জাগব।
শিক্ষক : আজ্ঞে হ, এরা তো জাগতেই আছেন; আর জাগতে আছেন কে? জাগতে আছেন মহম্মদ শা, জাগতে আছেন সদারঙ্গ মিয়াঁ; সদারঙ্গ মিয়াঁরে লইয়া মহম্মদ শা জাগতে আছেন। তাই রাধিকা কইতাছেন যে কেমন কইরা হরির কাছে যাইমু?
ঠাকুরমা : কী কও? সদারঙ্গ মিয়াঁ আইল কোন থাইক্যা? মিয়াঁ সাহেবেরে উইঠ্যা যাইবার কও। আমাগো রাধা শ্রীহরির কাছে যাইবার পথ পাইতেছ না।
শিক্ষক : আজ্ঞে, উনি যাইবেন কেমন কইর‍্যা ? গানটা যে ওঁরই লেখা।
ঠাকুরমা : আচ্ছা, আচ্ছা, মিয়াঁ সাহেবের মুরগি কিন্যা খাইবার পয়সা দিমু। ওঁরে এখনই উইঠ্যা যাইবার কও।
শিক্ষক : আমি কি ওনারে উঠাইতে পারি?
ঠাকুরমা : তুমি না পার পুলিশে খবর দাও, চৌকিদারে খবর দাও, থানায় খবর দাও, আমাগো দারোয়ান ডাকতে হইব মাস্টর, আমাগো দারোয়ান ডাকতে হইব।
শিক্ষক : কী কপালই করছি রে বাবা গান শিখাইতে আইসা।

বাসন্তিকা

কুশীলব
(পুরুষ)
ফাল্গুনী হৃদয়-রাজ্যের রাজা
দখিন হাওয়া ওই মন্ত্রী
কোকিল ওই দূত
পঞ্চশর ওই সেনাপতি
ভ্রমর, মৌমাছি, প্রজাপতি দোয়েল শ্যামা… বৈতালিক দল।

(নারী)
বাসন্তিকা ফুলের দেশের রানি
চৈতালি রানির প্রিয় সহচরী

প্রথম দৃশ্য
প্রেক্ষাগৃহের সম্মুখে ধোঁয়া রঙের যবনিকা। সেই যবনিকার এক পাশে অস্পষ্ট শ্বেতকরবীর গাছ আঁকা। গাছ থেকে কতক ফুল ঝরে পড়েছে, কতক ফুল ঝর-ঝর। আরেক পাশে আঁকা পল্লবহীন শিমুলতরু – তাতে দু-একটি কুঁড়ি দেখা দিয়েছে। যেন শীত ফুরিয়েছে, বসন্ত আসছে। … যবনিকা তোলার সঙ্গে সঙ্গে রাজাধিরাজ ফাল্গুনীর অগ্রদূত কোকিল মুহুর্মুহু কু্হুস্বরে রাজার আগমনবার্তা ঘোষণা করল। দূরে মৃদঙ্গ বীণা বেণুকা বেজে উঠল।
ভ্রমর, মধু-মক্ষী, প্রজাপতি, দোয়েল, শ্যামা প্রভৃতি বৈতালিকদল সমস্বরে গেয়ে উঠল :

(গান)
এল ওই বনান্তে পাগল বসন্ত।
বনে বনে মনে মনে রং সে ছড়ায় রে
চঞ্চল তরুণ দুরন্ত॥
বাঁশিতে বাজায় সে বিধুর
পরজ-বসন্তের সুর
পাণ্ডু কপোলে জাগে রং নব অনুরাগে,
রাঙা হল ধূসর দিগন্ত॥
কিশলয়-পর্ণে অশান্ত
ওড়ে তার অঞ্চলপ্রান্ত,
পলাশকলিতে তার ফুলধনু লঘুভার
ফুলে ফুলে হাসি অফুরন্ত॥
এলোমেলো দখিনা মলয় রে
প্রলাপ বকিছে বনময় রে,
অকারণ মনোমাঝে বিরহের বেণু বাজে
জেগে ওঠে বেদনা ঘুমন্ত॥

চৈতালি :
ভয় কী সম্রাজ্ঞী! তব কণ্ঠের বিভব
সীমাহীন মহীয়ান বৈচিত্রে সুরের!
বহুরূপী কণ্ঠে তব বহু সুরে গান
শুনিয়াছি বহুবার, মেনেছি বিস্ময়।
গাহো গান আনন্দের। যদি সে পথিক
সত্যই আসিয়া যায়, সে যেন জানিতে
না পারে তোমার সখী মরমের কথা।
সে যেন আসিয়া হেরে, তুমি মূর্তিমতী
আনন্দ-প্রতিমা, তুমি সম্রাজ্ঞী বনের।
রাজাই সে হয় যদি, এসে দেখে যাক
রানির মহিমা তব, শির নত করি
উদ্দেশে সে নিবেদন করুক প্রণাম।

বাসন্তিকা :
সেই ভালো, গাহি গান আমি আনমনে,
এই অবসরে তুই বনরাজ্যে মোর
বিশৃঙ্খল যাহা কিছু অসুন্দর যত
সংযত সুন্দর করি রাখিবি সাজায়ে।
অসুন্দর কোনো কিছু হেরি রাজ্যে মোর
সুন্দরের আঁখি যেন ব্যথা নাহি পায়।

(গান)
দোলা লাগিল দখিনার বনে বনে।
বাঁশরি বাজিল ছায়ানটে মনে মনে॥
চিত্তে চপল নৃত্যে কে
ছন্দে ছন্দে যায় ডেকে,
যৌবনের বিহঙ্গ ওই ডেকে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে॥
বাজে বিজয়ডঙ্কা তারই এল তরুণ ফাল্গুনী।
জাগো ঘুমন্ত দিকে দিকে ওই গান শুনি।
টুটিল সব অন্ধকার
খোলো খোলো বন্ধ দ্বার,
বাইরে কে যাবি আয় সে শুধায় জনে জনে॥

চৈতালি :
রানি রানি। শোনো ওই দূরাগত গান,
কে যেন পথিক বুঝি পরান-পসারি
পরানের পসরা সে যায় হেঁকে গানে।
প্রথম দিনের দেখা তব সে তরুণ
এ যদি লো সেই হয় কী করিবে তবে?
মুখপানে চেয়ে রবে নির্নিমেষ আঁখি?

বাসন্তিকা :
কী মধুর কণ্ঠ, শোনো, শোনো লো চৈতালি,

শুনিতে দে প্রাণ ভরি, চল অন্তরালে।

দ্বিতীয় দৃশ্য
(গান গাইতে গাইতে ফাল্গুনীর প্রবেশ)
আমার গানের মালা আমি করব কারে দান।
মালার ফুলে জড়িয়ে আছে করুণ অভিমান॥
চোখে মলিন কাজল লেখা
কণ্ঠে কাঁদে কুহুকেকা
কপোলে যার অশ্রু লেখা
একা যাহার প্রাণ।
মালা করব তারে দান॥
কথায় আমার কাঁটার বেদন
মালায় সূচির জ্বালা,
কণ্ঠে দিতে সাহস না পাই
অভিশাপের মালা
এই অভিশাপের মালা।
বিরহে যার প্রেম আরতি
আঁধার লোকের অরুন্ধতী
নাম-না জানা সেই তপতী
তার তরে এই গান।
মালা করব তারে দান॥

চৈতালি :
রহিতে পারি না আর-অন্তরালে,
কন্ঠে মম স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠে গান।
পত্রাবগুন্ঠনে কুঁড়ি রহিতে কি পারে
ভ্রমর আসিয়া সবে শোনায় গুঞ্জন।

বাসন্তিকা :
চৈতালি! চৈতালি! শোন, শোন মাথা খাস
যাসনে উহার কাছে, ওরে ও চপলা
কী জানি কী কহিবি যে বুঝি মোর নামে,
সত্য-মিথ্যা কত কথা বিদেশির কাছে।
(কুঞ্জান্তরাল হতে গান গাইতে গাইতে চৈতালির প্রবেশ)

বাসন্তিকা :
হৃদয় এমনই সখী, যাহারে সে চায়
তারে সে চিনিতে পারে আঁখির পলকে।
এমনই রহস্যময় পৃথিবীর প্রেম,
যখন সে আসে – আসে সহসা সহজে।
দেখিসনি তুই কি লো, এল সে যেমনই
রাজ্য মোর পূর্ণ হল রাজ-সমারোহে
রাজ্যের ঐশ্বর্য যত ছিল বনভূমে
লুটায়ে পড়িল সব তার পদতলে॥

চৈতালি :
মনের ঐশ্বর্য তব, বনের সে নহে
লুটাইল যাহা সেই পথিকের পায়।
আমি দেখি নাই তার রাজ-সমারোহ,
হয়তো দেখেছ তুমি – এমনই নয়ন!
একের নয়নে যার রূপ সীমাহীন,
অন্যের নয়ন সখী তাহাতে বিরূপ।
বাসন্তিকা :
রাখ সখী, কখা আর ভালো নাহি লাগে।
মনে হয়, চুপ করে বসে শুধু ভাবি।

চৈতালি :
ভাবনার অঙ্কুরেই এত, এ ভাবনা
ক্রমে যবে হবে মহিরুহ সুবিশাল
সহস্র শিকড় দিয়ে বাঁধিবে তোমায়
তখন কী হবে হায়, তাই আমি ভাবি।
ভালো, কথা নাহি কব, তুমিও কোয়ো না।
তার চেয়ে গাহো গান, আমি বসে শুনি।

(বাসন্তিকার গান)

কত জনম যাবে তোমার বিরহে
স্মৃতির জ্বালা পরান দহে॥
শূন্য গেহ মোর শূন্য জীবনে
একা থাকারই ব্যথা কত সহে ওগো॥
দিয়েছি যে জ্বালা জীবন ভরি হায়,
গলি নয়ন-ধারায় ব্যথা বহে॥

তৃতীয় দৃশ্য
পঞ্চশর :
শুনিতেছ, কি মধুর গান আসে ভেসে?

চৈতালি :
তোমাদের রাজার বন্দনা গাহিতেছে
বনলক্ষ্মী। বলিতে কি পার বন্ধু তুমি
কী করিছে রাজা-রানি কুঞ্জে নিরালায়?

দখিন হাওয়া :
আমি যদি চলে যাই এই স্থান ত্যজি
যা করিবে নিরালাতে তোমার দু-জন
তেমনই একটা কিছু। বেশি কিছু নহে।

চৈতালি :
বড়ো লঘু চিত্ত তুমি দক্ষিণের হাওয়া,
ডেকে আনি পুষ্পলতা সখীরে আমার
সমুচিত শাস্তি দেবে, হবে তব সাথি।
শুনিতে হবে না আর তব হা-হুতাশ।

দখিন হাওয়া :
কাজ নাই, তার চেয়ে তুমি গাহো গান,
যে গান শুনিয়া কুঞ্জ-মাঝে রাজা-রানি–
বুঝিতে পারিবে মোরা বেশি দূরে নাই,
উৎসাহ দেবার তরে নিকটেই আছি।
বুঝিতেছি সব কিছু, দেখি না যদিও
উপভোগ করিতেছি মনশ্চক্ষু দিয়ে।

চৈতালি :
তা হলে আমিও গাই উৎসাহের গান।
জ্বালাইলে কবে রানি! হায়, পরিচয়
না হতেই মনে মনে মান অভিমান
পরিচয় ঘন হলে আরও কত হবে!
প্রেমিকা তো নহি, তাই কিছু নাহি বুঝি।

বাসন্তিকা :
আঁখি-বিনিময়ে আঁখি চিনি লয় যারে
পলকে যে জিনি লয় সকল হৃদয়
সে বহু জনমের সাথি, বন্ধু, সখা।
চৈতালি! রহস্য এর তুই বুঝিবি না।
জন্মে জন্মে নব নব রূপে তার সাথে
বিরহ-মিলন, হয় নব জানাজানি।
ব্যথা দিয়ে চলে যায় জন্মান্তর পারে,
একজন চলে যায় – সাথি তার খোঁজে
আসে নব রূপ ধরি তারই পিছু পিছু।
আত্মার আত্মীয় যার সাথি প্রিয়তম
শুধু সেই জানে সখী রহস্য ইহার।
হৃদয় বরিয়া লয় হৃদি-দেবতারে।
(দূরে কোকিলের অবিরল কুহুধ্বনি)

চৈতালি :
ওই বুঝি এল তব হৃদিরাজদূত
মুহুর্মুহু কুহুস্বরে কাঁপায়ে কান্তার।
মর্মরিয়া লতাপাতা দখিনা পবন
সহসা আসিল ওই, উতলা কানন।
সহচর অনুচর দূত এল যবে
রাজাও আসিছে পিছে মনে লাগে মোর।
উষসীর আগমনে বুঝি লো যেমন
তপনের উদয়ের আর নাহি দেরি।

বাসন্তিকা :
চৈতালি! কী হবে তবে? সত্যই সে যদি
এসে পড়ে, হেরে মোরে বিরহ-বিধুরা
কী হবে, এ মুখ সখী কেমনে লুকাই,
তুই বলে দে লো সখী, কী করিব আমি!
প্রণয় মধুর – যত রহে সে গোপন,
প্রকাশের লজ্জা তার অতি নিদারুণ।
লজ্জায় মরিয়া যাব, সে যদি লো বোঝে
ইঙ্গিতেও মোর পোড়া মরমের ব্যথা!
(পঞ্চশর ও চৈতালির গান)

পঞ্চশর :
বন-দেবী এসো গহন বনছায়ে।
চৈতালি :
এসো বসন্তের রাজা নূপুর-মুখর পায়ে॥
পঞ্চশর :
তুমি কুসুম-ফাঁদ
চৈতালি :
তুমি মাধবী চাঁদ
উভয়ে :
আমরা আবেশ ফাল্গুনের
ভাসিয়া চলি স্বপন-নায়ে॥
পঞ্চশর :
কল্পলোকের তুমি রূপরানি লো প্রিয়া
অপাঙ্গে ফোটাও জুঁই চম্পা টগর মোতিয়া।
চৈতালি :
নিঠুর পরশ তব (হায়) যাচিয়া জাগে বনভূমি,
ফুলদল পড়ে ঝরি তব চারুপদ চুমি।
উভয়ে :
(মোরা) সুন্দরের পথ সাজাই
ঝরা কুসুম-দল বিছায়ে॥
দখিন হাওয়া :
তোমরা পরোক্ষে বুঝি এই ছল করি
কয়ে নিলে তোমাদেরও অন্তরের কথা।
চৈতালি :
তুমি বড়ো লঘু, বন্ধু! চলো আলাপন
করি গিয়ে দূরে মোরা কুঞ্জের বাহিরে।

(সকলের প্রস্থান)

ফাল্গুনী :
ছল করি উহাদেরে লয়ে গেল দূরে
চৈতালি তোমায় সখী। কেন নত চোখে
চেয়ে আছ? কথা কও চাহো মুখপানে।

(বাসন্তিকার গান)

অঞ্জলি লহো মোর সংগীতে
প্রদীপ-শিখাসম কাঁপিছে প্রাণ মম
তোমায়, হে সুন্দর বন্দিতে।
সংগীতে সংগীতে॥
তোমার দেবালয়ে কী সুখে কী জানি
দুলে দুলে ওঠে আমার দেহখানি
আরতি নৃত্যের ভঙ্গিতে।
সংগীতে সংগীতে॥
পুলকে বিকশিল প্রেমের শতদল
গন্ধে রূপে রসে টলিছে টলমল।
তোমার মুখে চাহি আমার বাণী যত
লুটাইয়া পড়ে ঝরা ফুলের মতো
তোমার পদতল রঞ্জিতে।
সংগীতে সংগীতে॥

চতুর্থ দৃশ্য

বাসন্তিকা :
কেন ক্লান্ত আঁখি তব? কেন বার বার
চাহিতেছ মোর মুখে? এই তো তোমার
বাহুর বন্ধনে আমি আছি নাথ বাঁধা।
বিষাদিত ছলছল আঁখি হেরি তব
মনে বড়ো ভয় লাগে, আমি বড়ো ভীরু।
আছ মম বুকে, তবু কাঁদে কেন প্রাণ।
ফাল্গুনী : গান
পিয়া পিয়া মোরে ভোলো, ভোলো ভালোবাসা!
হেরো উষার বুকে কাঁদে প্রভাতি তারা
তব বেণির মালা ম্লান, সুরভিহারা
আজি ফুরাল ফাগুন এল যাবার বেলা,
ভাঙে ভুলের মেলা, ভাঙে ফুলের খেলা।
পিয়া পিয়া মোরে ভোলো, ভোলো ভালোবাসা॥
তব মৃণাল-ভুজে আর বেঁধো না মোরে
ভীরু চাঁদের মতো আজও হাসি অধরে
অনুরাগের কাজল আঁকি আঁখির তীরে
চাহি মুখের পানে বোলো, ‘আসিয়ো ফিরে’।
পিয়া পিয়া মোরে ভোলো, ভোলো ভালোবাসা॥
ফিরে আসিবে আবার নব চাঁদের তিথি,
মালা তোমারই গলে দেবে নব অতিথি,
রবে তারই বুকে মোর প্রথম প্রণয়
আজি ফুরাল ফাগুন, এল যাবার সময়!
পিয়া পিয়া মোরে ভোলো, ভোলো ভালোবাসা॥

বাসন্তিকা :
বসন্তের রাজা মোর! হৃদয়ের নাথ!
একী তব অরুন্তুদ অকরুণ গান?
অকারণ কেন মোরে দেখাও এ ভয়?
তুমি কি জান না নাথ, তুমি চলে গেলে
ফুরাইবে রাজ্যে মোর বসন্ত-উৎসব?

ফাল্গুনী :
আমি চিরচঞ্চল পথিক ঘরছাড়া,
বন্ধুহারা, উদাসীন, বিরাগী প্রেমিক।
সাথি মম পঞ্চশর দক্ষিণ সমীর,
ক্ষণিকের পথভোলা পথিক এরাও।
দুদিনের পিককুল মোর অগ্রদূত।
প্রজাপতি অলি – এরা মোর বৈতালিক।
ক্ষণিকের অতিথি যে আমরা সকলে,
কেন ভুলিতেছ প্রিয়া? নাই সাধ্য নাই,
এর বেশি পৃথিবীতে থাকিবার আর।
বসন্ত হয় অবসান, দিগন্তে বিদায়ের বেণু
ওই শোনো বাজি ওঠে সকরুণ রবে।
আমারে যে যেতে হবে। জনমে জনমে
এমনই আসিব কাছে দু-দিনের লাগি,
না মিটিতে সাধ শেষে চলে যেতে হবে!
বিধির বিধান ইহা, যথা ভলোবাসা!
মিলন ক্ষণিক সেথা, অনন্ত বিরহ।

বাসন্তিকা :
যেতে নাহি দিব আমি। তুমি রাজা, বীর,
আমারে বধিয়া যাও তব রাজ্যে ফিরে।
না, না, তব পায়ে পড়ি, থাকো ক্ষণকাল
পরুষ বচন আর কভু শোনাব না।

(গান)

মিনতি রাখো রাখো, পথিক থাকো থাকো
এখনই যেয়ো না গো না না না।
ক্ষণিক অতিথি বিদায়ের গীতি
এখনই গেয়ো না গো, না না না॥
চৈতি পূর্ণিমা চাঁদের তিথি
পুষ্প-পাগল এ বনবীথি
ধুলায় ছেয়ো না গো–না না না॥
বলি বলি করে হয়নি যা বলা,
যে কথা ভরিয়া ছিল বুকের তলা,
সে কথা না শুনে সুন্দর অতিথি হে
যেতে চেয়ো না গো, না না না॥

ফাল্গুনী :
তবু মোরে যেতে হবে! ছিঁড়িবে হৃদয়;
করিতে হইবে তবু ছিন্ন এই ডোর।
ভালোবেসে কাঁদি আমি কাঁদিয়া কাঁদাই
এ মোর আত্মার ধর্ম! হে প্রিয়া বিদায়!

(গান)

বল্লরি ভুজবন্ধন খোলো!
অভিসার-নিশি অবসান হল॥
পাণ্ডুর চাঁদ হেরো অস্তাচলে
জাগিয়া শ্রান্ত তনু পড়েছে ঢলে
মল্লিকা মালা ম্লান বক্ষতলে,
অভিমান-অবনত আঁখি তোলো॥
উতল সমীর আমি নিমিষের ভুল
কুসুম ঝরাই কভু ফোটাই মুকুল।
আলোকে শুকায় মোর প্রেমের শিশির
দিনের বিরহ আমি, মিলন নিশির॥
হে প্রিয় ভীরু এ স্বপন-বিলাসীর
অকরুণ প্রণয় ভোলো ভোলো॥ (প্রস্থান)

বাসন্তিকা :
কোথা তুমি প্রিয়তম ফাল্গুনী কিশোর?
নিশীথের ক্ষণিকের সুখ-স্বপ্নসম
আসিয়া গেলে কি চলি না মিটিতে সাধ?
দূরে ওই ওড়ে যেন বৈশাখী ঝড়ের
বিজয়-কেতন তার। বাসন্তী উৎসব
শেষ হোক আজি তবে। ঝরা ফুলদল,
বিরহের রৌদ্রদাহে মোর বনভূমি
পুড়ে যাক, উড়ে যাক, হোক ছারখার।
যোগিনীর গৈরিক নিশান নীলাম্বরে
এবার উড়ুক তবে। বিস্মৃতির ধূলি
ছেয়ে দিক রাজ্য মোর শস্য পুষ্পময়॥

(গান)

ভোরে স্বপনে কে তুমি দিয়ে দেখা
লুকালে সহসা।
মোর তপনের রাঙা কিরণ যেন
ঘিরিল তমসা॥
না ফুটিতে মোর কথার কুঁড়ি
চপল বুলবুলি গেলে উড়ি
গেলে ভাসিয়া ভোরের সুর যেন
বিষাদ-অলসা॥
জেগে দেখি হায় ঝরা ফুলে আছে ছেয়ে
তোমার পথতল
ওগো অতিথি, কাঁদিছে বনভূমি
ছড়ায়ে ফুলদল।
মুখর আমার গানের পাখি
নীরব হল হায় বারেক ডাকি
যেন ফাগুনের জোছনা-হসিত রাতে
নামিল বরষা॥

[গানের মাঝে উঠল ধূলি-গৈরিক ঝড়, গানের শেষ দিকে ‘বাসন্তিকা’ ও রঙ্গমঞ্চ আর দেখা গেল না। সেই অন্ধকারেই গানের শেষ হল।]

 বিদ্যাপতি (পালা – নাটিকা)

চরিত্র :
দেবী দুর্গা, দেবী গঙ্গা, কবি বিদ্যাপতি, শিবসিংহ (মিথিলার রাজা), লছমী (মিথিলার রানি), অনুরাধা (বিষ্ণু-উপাসিকা), বিজয়া (বিদ্যাপতির কনিষ্ঠা ভগ্নী), ধনঞ্জয় (রাজ-বয়স্য)।

প্রথমখণ্ড
কাল – পঞ্চদশ শতাব্দী
[মিথিলার কমলা নদীর তীরে বিসকি গ্রাম। তাহারই উদ্যানবাটিকায় দেবী দুর্গামন্দির। কবি বিদ্যাপতি দুর্গাস্তব গান করিতেছেন।]

(স্তব)
জয় জগজ্জননী, ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর-বন্দিতা,
জয় মা ত্রিলোকতারিণী।
জয় আদ্যাশক্তি পরমেশ্বরী নন্দনলোক-নন্দিতা
জয় দুর্গতিহারিণী॥
তোমাতে সর্বজীবের বসতি, সর্বাশ্রয় তুমি মা,
ক্ষয় হয় সব বন্ধন পাপতাপ তব পদ চুমি মা।
তুমি শাশ্বতী, সৃষ্টি-স্থিতি, তুমি মা প্রলয়কারিণী॥
তুমি মা শ্রদ্ধা প্রেমভক্তি তুমি কল্যাণ-সিদ্ধি,
ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ তুমি তন-জন-ঋদ্ধি।
জয় বরাভয়া ত্রিগুণময়ী দশপ্রহরণধারিণী
জয় মা ত্রিলোকতারিণী॥

অনুরাধা :
ঠাকুর! ঠাকুর!
বিদ্যাপতি :
(মন্দির-অভ্যন্তর হইতে) কে?
অনুরাধা :
আমি অনুরাধা, একটু বাইরে বেরিয়ে আসবে?
বিদ্যাপতি :
(মন্দিরদ্বার খুলিয়া বাহিরে আসিয়া – বিরক্তির সুরে) একটু অপেক্ষা করলেই পারতে অনুরাধা। এত বড়ো ভক্তিমতী হয়ে তুমি মায়ের নামগানে বাধা দিলে?
অনুরাধা :
আমায় ক্ষমা করো ঠাকুর। অত্যন্ত প্রয়োজনে আমি তোমার ধ্যানভঙ্গ করেছি। আমার কৃষ্ণগোপালের জন্য আজ কোথাও ফুল পেলাম না। তোমার বাগানে অনেক ফুল, আমার গিরিধারীলালের জন্য কিছু ফুল নেব? আমার গোপালের এখনও পূজা হয়নি।
বিদ্যাপতি :
তুমি তো জান অনুরাধা, এ বাগানে ফুল ফোটে শুধু আমার মায়ের পায়ে অঞ্জলি দেওয়ার জন্য। এ ফুল তো অন্য কোনো দেবদেবীকে দিতে পারিনে! (মন্দিরদ্বার বন্ধ করিয়া দিলেন; মন্দির-অভ্যন্তরে স্তব-পাঠের মৃদু গুঞ্জন শোনা গেল।)
অনুরাধা :
(অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে) ঠাকুর! ঠাকুর! তুমি কি সত্যই এত নিষ্ঠুর? তবে কি আমার ঠাকুরের পূজা হবে না আজ? আমার কৃষ্ণগোপাল! আমার প্রিয়তম! তুমি যদি সত্য হও আর আমার প্রেম যদি সত্য হয়, তা হলে আজ এই বাগানের একটি ফুলও অন্য কারুর পূজায় লাগবে না। এই বাগানের সকল ফুল তোমার চরণে নিবেদন করে গেলাম।
(প্রস্থান)
বিদ্যাপতি :
(গুনগুন স্বরে)
মা! আমার মনে আমার বনে
ফোটে যত কুসমদল
সে ফুল মাগো তোরই তরে
পূজতে তোরই চরণতল॥

বিজয়া :
দাদা। পূজার ফুল এনেছি। দোর খোলো।
বিদ্যাপতি :
(দ্বার খুলিয়া) দে। বিজয়া, মা এখন কেমন আছেন রে?
বিজয়া :
আমার তো ভালো মনে হচ্ছে না দাদা, কেমন যেন করছেন। আচ্ছা দাদা, অনুরাধা কাঁদতে কাঁদতে গেল কেন? তুমি কেন যেন তাকে দু-চোখে দেখতে পার না।
বিদ্যাপতি :
হাঁ, আমি ওকে এক-চোখোমি করে এক চোখেই দেখি। আমি পুজো সেরেই আসছি। (বিজয়া চলিয়া গেল; বিদ্যাপতি মন্দিরদ্বার বন্ধ করিয়া দিলেন; ভিতর হইতে স্তবপাঠের শব্দ শোনা গেল।)
বিদ্যাপতি :
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ –
[অন্তরিক্ষ হইতে প্রত্যাদেশ]

ক্ষান্ত হও বিদ্যাপতি! ও ফুল শ্রীকৃষ্ণ-চরণে নিবেদিত। বিষ্ণু-আরাধিকা যে ফুল শ্রীহরির চরণে নিবেদন করে গেছে, সে ফুল নেবার অধিকার আমার নেই।
বিদ্যাপতি :
মা! মা! এ তোর মায়া, না সত্য?
দেবীদুর্গা :
শোনো পুত্র! তুমি হয়তো জান না যে, আমি পরমা বৈষ্ণবী। জগৎকে বিষ্ণুভক্তি দান করি আমিই।
বিদ্যাপতি :
তোর ইঙ্গিত বুঝেছি মহামায়া। তবে তোরই ইচ্ছা পূর্ণ হোক ইচ্ছাময়ী। আমি আজ থেকে বিষ্ণুরই আরাধনা করব।

[গান]
আমার শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে জপব আমি শ্যামের নাম
মা হল মোর মন্ত্রগুরু, ঠাকুর হলেন রাধাশ্যাম॥

বিজয়া :
(কাঁদিতে কাঁদিতে) দাদা! দাদা! শিগগির এসো। মা আমাদের ছেড়ে স্বর্গে চলে গেলেন।
বিদ্যাপতি :
বিজয়া! বিজয়া! মা নেই, মা চলে গেলেন? (দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া শান্ত স্বরে) হ্যাঁ, – মা তো আমার নেই। আমি এই মুহূর্তে মাতৃহারা হলাম। আমার ভুবনের মা আমার ভবনের মা, দু-জনেই একসঙ্গে ছেড়ে গেলেন।

দ্বিতীয় খণ্ড
[মিথিলার রাজ-অন্তঃপুরের উদ্যানবাটিকা]

বিদ্যাপতি :
মিথিলার রাজা শিবসিংহের জয় হোক!
রাজা শিবসিংহ :
স্বাগত বিদ্যাপতি! বন্ধু! তোমার মাতৃশোক ভুলবার যথেষ্ট অবসর না দিয়ে স্বার্থপরের মতো রাজধানীতে ডেকে এনেছি। আমার অপরাধ নিয়ো না সখা।
বিদ্যাপতি :
মহারাজ! আমি আপনার দাসানুদাস। শুধু আমি কেন, আমরা পুরুষানুক্রমে মিথিলার রাজ-অনুগ্রহে ও আশ্রয়ের স্নিগ্ধ শীতল ছায়ায় লালিত-পালিত। আপনার আদেশ আমার সকল দুঃখের ঊর্ধ্বে।
রাজা :
তুমি জান সখা, রাজসভার বাইরে তুমি ওভাবে কথা বললে আমি কত বেদনা পাই। আমরা সহপাঠী বন্ধু, আমাদের সে বন্ধুত্বকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছে এই তুচ্ছ রাজ-সিংহাসন। আর তোমরা তো রাজ-অনুগৃহীত নও বন্ধু, মিথিলার রাজারাই তোমাদের কাছে ঋণী, অনুগৃহীত। তোমরা পুরুষানুক্রমে প্রধানমন্ত্রী হয়ে মিথিলার রাজা ও রাজ্যকে নিয়ন্ত্রিত করেছ।
বিদ্যাপতি :
আমায় ক্ষমা করো সখা। এই রাজসভার বাইরে যখন তোমায় দেখি, তখন ইচ্ছা করে তোমায় আগের মতো করেই বক্ষে জড়িয়ে ধরি। তবু কীসের যেন সংকোচ এসে বাধা দেয়।
রাজা :
বিদ্যাপতি! রাজা ও মন্ত্রীর সম্পর্ক ছাড়াও আমরা আজ বেদনার তীর্থে হয়ে গেছি এক পরমাত্মীয়। তুমি হারিয়েছ তোমার মাকে; আমিও হারিয়েছি আমার দেবতুল্য পিতা দেবসিংহকে।
রানি লছমী :
তুমি তো শুধু রাজমন্ত্রীই নও বিদ্যাপতি। তুমি রাজকবিও। মিথিলা তথা ভারতের শ্রেষ্ঠ কবি!
বিদ্যাপতি :
মহারানি এখানে আছেন, তা তো বল নাই সখা।
রাজা :
রানি লছমী দেবীর অনুরোধেই তোমায় এত তাড়া দিয়ে এনেছি বন্ধু। তোমার কণ্ঠের গান না শুনলে নাকি ওঁর সে-দিনটাই ব্যর্থ। এত শ্রদ্ধা তোমার ওপর, তবু মাঝে ওই পর্দাটুকু উঠল না। ওই নিরর্থক লজ্জার আরবরণ আমাকেই লজ্জা দেয় বেশি।
বিদ্যাপতি :
দেবীরা চিরকাল যবনিকার অন্তরালেই থাকতে ভালোবাসেন, বন্ধু! ওঁরা হলেন অন্তর-লোকের অসূর্যম্পশ্যা, বাইরের আলোর রূঢ়তা ওঁদের জন্য নয়।
রাজা :
তবু যাকে দেখা যায় না, অথচ কথা শুনতে পাওয়া যায় তাকে যে লোক চিরকালই ভয় পেয়ে থাকে বিদ্যাপতি!
রানি লছমী :
তার মানে আমি পেতনি, এই তো! বেশ, আমি তাই। কবি! আর কথা নয়, এবার আলাপন হোক শুধু গানে গানে।
বিদ্যাপতি :
মহারানির আদেশ শিরোধার্য। কোন গান গাইব, দেবী?
রানি :
আমার সেই প্রিয় গান – ‘জনম জনম হাম রূপ নেহারলুঁ, ও গানটা আমার কাছে কখনও পুরানো হল না।
বিদ্যাপতি :

[গান]
জনম অবধি হাম রূপ নেহারলুঁ, নয়ন ন তিরপিত ভেল।
লাখ লাখ যুগ হিয় হিয় রাখলুঁ, তবু হিয় জুড়ন ন গেল!
দেখি সাধ না ফুরায় গো!
হিয়া কেন না জুড়ায় গো
হিয়ার উপরে গিয়া
হিয়া তবু না জুড়ায় গো!

তৃতীয় খণ্ড
[অনুরাধার গীত]

সখী লো –
অব মথুরাপুর মাধব গেল।
গোকুল-মানিক কো হরি লেল॥
(হরি হরিয়া নিল কে)
গোকুলে উছলল করুণাক রোল
নয়নক সলিলে বহয়ে হিলোল।
শূন ভেল মন্দির, শূন ভেল নগরী,
শূন ভেল দশদিশি শূন ভেল সগরী।
কৈছন যাওব যমুনা-তীর
কৈছে নেহারব কুঞ্জ-কুটির।
নয়নক নিন্দ গেও, বয়ানক হাস,
সুখ গেও পিয়া সঙ্গ, দুখ হম পাশ।
পাপ পরান মম আন নাহি জানত
কানু কানু করি ঝুরে।
বিদ্যাপতি কহ নিকরুণ মাধব
রাধারে কাঁদায়ে রহি দূরে॥

রানি :
রাজা! কে যায় পথে অমন করুণ সুরে গান গেয়ে? ওকে এখানে ডাকো না!
বিদ্যাপতি :
মহারানি! আমি ওকে জানি। আমি যেখানে যাই, ও আপনি এসে হয় আমার প্রতিবেশিনী। ওর নাম অনুরাধা। গিরিধারীলাল শ্রীকৃষ্ণ ওর জপমালা।
রানি :
তা হলে তুমিই ওকে ডেকে আনো না, কবি!
বিদ্যাপতি :
আমি যাচ্ছি দেবী, কিন্তু জানি না ও আসবে কি না।
(বিদ্যাপতির প্রস্থান)
রাজা :
রানি! এখন বোধ হয় বুঝতে পেরেছ – বিদ্যাপতি হঠাৎ কেন বিষ্ণু-উপাসক হয়ে উঠল!
রানি :
সত্যিকার ভালো না বাসলে কারুর কণ্ঠ এত মধুময় এত আবেগবিহ্বল হয় না। ও যেন মূর্তিমতী কান্না।

(গান গাহিতে গাহিতে অনুরাধার প্রবেশ)
সজল নয়ন করি পিয়া পথ হেরি হেরি
তিল এক হয় যুগ চারি।
(যেন শত যুগ মনে হয়
তারে এক তিল না হেরিলে শত যুগ মনে হয়)
বিধি বড়ো দারুণ তাহে পুন ঐছন
দরহি করলুঁ মুরারি।
আন অনুরাগে পিয়া আনদেশে গেলা
পিয়া বিনু পাঁজর ঝাঁঝর ভেলা।
নারীর দীরঘশ্বাস পড়ুক তাহার পাশ
মোর পিয়া পাশে উড়ি যাওঁ
সব দুখ কহু তার পাশে।
আনি দেহ মোর পিউ রাখহ আমার জিউ
কো আছ করুণাবান।

বিদ্যাপতি :
বিদ্যাপতি কহে ধৈরজ করো চিত

তুরিতহি মিলব কান॥
রানি :
অনুরাধা, কী মিষ্টি নাম তোমার! তুমি আমার কাছে থাকবে? বিদ্যাপতি! তুমি যদি অনুমতি দাও, অনুরাধাকে আমার কাছে রেখে শ্যাম নাম শুনি।
বিদ্যাপতি :
আমি তো ওর অভিভাবক নই; দেবী! ও আমার ছোটো বোন বিজয়ার বন্ধু।
রানি :
ওর বাবা-মা কোথায় থাকেন?
বিদ্যাপতি :
গতবার দেশে যখন মড়ক লাগে, তখন ওর বাবা-মা দুজনেই মারা যান। যে বিসকি গ্রাম মহারাজ আমায় দান করেছেন, ওর বাবা ছিলেন সেই গ্রামের বিষ্ণু-মন্দিরের পুরোহিত। এখন ওর অভিভাবিকা, বন্ধু – সব বিজয়া।
রানি :
ওর বিয়ে হয়নি?
বিদ্যাপতি :
না। (হাসিয়া) ও বলে বিয়ে করবে না।
অনুরাধা :
বা রে, আমি বুঝি তোমার গলা ধরে বলেছি যে, আমি বিয়ে করব না। না মহারানি, ঠাকুর জানেন না, আমার বিয়ে হয়েছে।
বিদ্যাপতি :
তোমার বিয়ে হয়েছে? কার সাথে?
অনুরাধা :
সে তুমি জান না, বিজয়া জানে।
রানি :
আমিও হয়তো জানি। তুমি থাকবে ভাই আমার কাছে? আমার সখী হয়, আমার বোন হয়ে? আর তার বদলে আমি তোমার বরকে ধরে এনে দেব।
অনুরাধা :
তা কি প্রাণ ধরে দিতে পারবে রানি। যে ঠাকুর আমার, সে যে তোমারও।
বিদ্যাপতি :
মহারাজ! ওদের নিভৃত আলাপনের কমল-বনে আমাদের উপস্থিতি মত্ত মাতঙ্গের মতোই ভীতিজনক। আমরা একটু অন্তরালে গেলেই বোধ হয় সুশোভন হত।
রাজা :
চলো বিদ্যাপতি, তোমার ইঙ্গিতই সমীচীন।
(পশ্চাতে রানির ও অনুরাধার হাসির শব্দ)

কবি! এইখানে এসো! এই ঝোপের আড়াল থেকে ওদের দুই দেবীকে দিব্যচক্ষে দর্শন করা যাবে।
বিদ্যাপতি :
মহারাজ, যে নিজে থাকতে চায় গোপন, তাকে জোর করে প্রকাশের বর্বরতা আমার নেই।
রাজা :
আঃ! কবি হয়ে তুমি কী করে এমন বদরসিক হলে বলো তো? ওই দেবীর দল যখন চিকের আড়াল থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমাদের দেখতে থাকেন তাতে কোনো অপরাধ হয় না, আর আমরা একটু আড়াল-আবডাল থেকে উঁকি-ঝুঁকি মেরে দেখলেই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে? আরে এসো এসো।

চতুর্থ খণ্ড
রানি :
(একটু দূরে) অনুরাধা, তোমার কবিকে দিয়ো আমার এই কণ্ঠহার!
অনুরাধা :
রানি!
রানি :
রানি নয় অনুরাধা, লছমী। তুমি আমায় লছমী বলে ডেকো। রানির কারাগারে আমার ডাক-নামের হয়েছিল মৃত্যু। তোমার বরে সে নাম আমার বেঁচে উঠুক।
অনুরাধা :
লছমী! তুমি সত্যই লছমী। রূপে লছমী, গুণে লছমী, গোলোকের অধীশ্বরী – লক্ষ্মী।
লছমী :
আর তুমি বুঝি ব্রজের দূতী?
অনুরাধা :
বেশ, তোমার দূতিয়ালিই করব। এই চাকরিই আমি মেনে নিলাম। তোমার কণ্ঠহার আমি যথাস্থানে পৌঁছে দেব, নিশ্চিন্ত থেকো।

(অনুরাধার গান)
ধন্য ধন্য ধন্য রমণী ধন্য জনম তোর।
সব জন কানু কানু করে ঝুরে
সে কানু তোর ভাবে বিভোর।
[উদ্যান-অন্তরালে বিদ্যাপতি ও রাজা শিবসিংহ]

রাজা :
বিদ্যাপতি! বিদ্যাপতি! দেখেছ? ওদের দুইজনের মুখে গোধূলির আলো পড়ে ঠিক বিয়ের কনের মতো সুন্দর দেখাচ্ছে। বিদ্যাপতি, বিদ্যাপতি, আরে তুমি যে নির্বাক নিষ্পন্দ হয়ে গেলে!
বিদ্যাপতি :
অপরূপ পেখলুঁ বামা।

কনকলতা অবলম্বনে উঠল

হরিণীহীন হিমধামা॥
[এ কী অপরূপ রূপ-ফাঁদ!
স্বর্ণলতিকা ধরি উঠিয়াছে যেন ওই কলঙ্কহীন এ চাঁদ]
নলিন নয়ান দুটি অঞ্জনে রঞ্জিত
এ কী ভুরু-ভঙ্গিবিলাস,
চকিত চকোর জোড় বিধি যেন বাঁধিল
দিয়া কালো কাজরপাশ।
গুরু গিরিবর পয়োধর পরশিছে
গ্রীবার গজমোতি হারা,
কাম কম্বু ভরি কনক কুম্ভ পরি
ঢালে যেন সুরধুনী-ধারা।
পুণ্য প্রয়াগ-জলে যে করে যজ্ঞ শত
পায় এরে সেই বহুভাগী।
বিদ্যাপতি কহে, গোকুল-নায়ক
গোপীজন-অনুরাগী॥

রাজা :
সাধু! সাধু কবি! বিদ্যাপতি! এ কি তোমার গান, না তোমার আত্মার গান?

পঞ্চম খণ্ড
[ বিদ্যাপতি-ভবন ]

বিদ্যাপতি :
বিজয়া!
বিজয়া :
দাদা! ডাকচ!
বিদ্যাপতি :
হাঁ, অনুরাধা কোথায় রে?
বিজয়া :
কী জানি। সে কি বাড়ি থাকে? কেন মরতে ওকে এনেছিলুম। সকাল হতে না হতে রানির যানবাহন এসে ওকে নিয়ে যায়। ও মাঝে মাঝে পালিয়ে আসে আমার কাছে, আর অমনি সাথে সাথে আসে রানির চেড়িদল। রানির অনুগ্রহ তাকে গ্রহের মতো গ্রাস করেছে।
বিদ্যাপতি :
হুঁ। হ্যাঁরে বিজয়া, সেদিন অনুরাধা বলছিল ওর বিয়ে হয়ে গেছে! সত্যিই কি ওর বিয়ে হয়েছিল?
বিজয়া :
(সক্রোধে) জানি না। আচ্ছা দাদা, তুমি কবি, সাধক – তুমি তো মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থল পর্যন্ত দেখতে পাও, অনুরাধার দিকে কখনও চোখ ফিরিয়ে দেখেছ কি?
বিদ্যাপতি :
তা দেখিনি! কিন্তু ভুল তো তুইও করে থাকতে পারিস, বিজয়া, ওর স্বামী যদি থাকেই, সে পৃথিবীর মানুষ নয়, ওর স্বামী গিরিধারীলাল শ্রীকৃষ্ণ।
বিজয়া :
হ্যাঁ গো হ্যাঁ, ওই নামের ছলনা করে ও যাকে পূজা করে, আমি তাকে জানি। তুমি ইচ্ছা-অন্ধ, তাই দেখতে পাও না।
বিদ্যাপতি :
তার মানে, তুই বলতে চাস, ওর প্রেমের জ্যোতি আমার চোখে পড়ে আমার দৃষ্টিকে ঝলসে দিয়েছে, এই তো?
বিজয়া :
হ্যাঁ, ওর প্রেমের জ্যোতি এত প্রখর যে, সেই জ্যোতির পশ্চাতে বেদনাতুর নারীমূর্তিকে তুমি দেখতে পাচ্ছ না! আমি চললাম, দেখি হতভাগিনি কোথায় গেল!

[দূরে অনুরাধার গান]
সখী লো মন্দ প্রেম পরিণামা।
বৃথাই জীবন করলু পরাধীন,
নাহি উপকার একঠামা!
কেন বিধি নিরমিল এই পোড়া পিরিতি,
কাহে গড়িল মোরে করি কুলবতী।
বলিতে না পারি, হায় চলিতে না পারি,
পিঞ্জর মাঝে যেন বন্দিনী শারি॥
বিদ্যাপতি :
অনুরাধা!
অনুরাধা :
ঠাকুর!
বিদ্যাপতি :
এ কী, তোমার চোখে জল কেন রাধা?
অনুরাধা :
জল? কই, না তো! বিজয়া! বিজয়া! (চলিয়া গেল।)
বিদ্যাপতি :
আমায় এ কী পরীক্ষায় ফেললে, প্রেমের ঠাকুর! তোমাতে নিবেদিত যে-প্রাণ সে-প্রাণ কেন এত বিচলিত হয় মানবীর চোখের জল দেখে?
বিজয়া :
দাদা! রানির নাকি হুকুম, অনুরাধাকে এখন রাত্রেও রানির কাছে থাকতে হবে । এ রানির অত্যাচার। তুমি মিথিলার প্রধানমন্ত্রী, এর প্রতিকারের কি কোনো শক্তি নেই তোমার?
বিদ্যাপতি :
অনুরাধাকে ডাকো তো। আমি সব শুনে ব্যবস্থা করছি।
বিজয়া :
তোমায় ব্যবস্থা করতেই হবে, দাদা। নইলে আমিই রাজার কাছে আবেদন করব।

[বিদ্যাপতির গুনগুন স্বরে গান]

অনুরাধা :
আমায় ডাকছিলে ঠাকুর? বিজয়া আমায় পাঠিয়ে দিলে।
বিদ্যাপতি :
রাধা। রানি কি তোমায় রাত্রেও তাঁর কাছে থাকতে বলেছেন?
অনুরাধা :
হাঁ। রানি বলেন, দূতীর দূতিয়ালির প্রয়োজন রাত্রেই বেশি। তবে এ ওঁর আদেশ নয়, আবদার।
বিদ্যাপতি :
কীসের দূতিয়ালি, রাধা?
অনুরাধা :
ঠাকুর! তুমি আমায় কী মনে কর! পাগল, নির্বোধ বা ওইরকম একটা কিছু, না? তুমি যে এত যত্ন করে রোজ তোমার নবরচিত গানগুলি শেখাও, তুমি কি মনে কর আমি তার মানে বুঝি না? আর আমি কি শুধু রানির দূতিয়ালিই করি? আমি কি তোমার দূতিয়ালি করিনে?
বিদ্যাপতি :
আমি তোমার কাছে আর আত্মগোপন করব না, রাধা। সত্যিই তোমার সুরের সেতু বয়ে হয় আমাদের মিলন। তবে, তুমি তো জান, আমার এ প্রেম নিষ্কলুষ, নিষ্কাম। – তোমায় একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?
অনুরাধা :
বলো।
বিদ্যাপতি :
তুমি কি সত্যিই আমায় ভালোবাস?
অনুরাধা :
না।
বিদ্যাপতি :
না? আঃ, তুমি আমায় বাঁচালে অনুরাধা।
অনুরাধা :
তোমায় আমি ভালোবাসি না, কিন্তু আমি ভালোবাসি তাকে, যাকে তুমি ভালোবাস। ঠাকুর! ঠাকুর! আমাকে এই বর দাও যেন জন্মে জন্মে তোমার ভালোবাসার জনকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে পারি। তুমি যাকে ভালোবেসে সুখ পাও, তারই দাসী হতে পারি। আর দিনান্তে একবার শুধু ওই চরণ বন্দনা করতে পারি।
বিদ্যাপতি :
অনুরাধা! এমনি করেই তুমি বৃন্দাবনে ললিতারূপে শ্রীকৃষ্ণে আত্মনিবেদন করেছিলে। কোনোদিন শ্রীকৃষ্ণকে নিজের করে চাওনি। শ্রীকৃষ্ণের যাতে প্রীতি, সেই শ্রীমতীর সাথে বারে বারে তাঁর মিলন ঘটিয়েছিলে। তোমার সংযম ও তোমার প্রেমের কাছে সেদিন ভগবানের প্রেমও বুঝি হয়েছিল ম্লান।
বিজয়া :
অনুরাধা! আজ কী গান শিখলি সই? এ কী, তুই মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে পড়ে কাঁদছিস্? (সক্রোধে) দাদা!
বিদ্যাপতি :
ভয় নেই বিজয়া; আমি ওকে আঘাত করিনি। (হাসিয়া) ওর দশা হয়েছে!
বিজয়া :
অনুরাধা! তুই যদি ফের দাদার কাছে আসিস, তা হলে তোর ওপর বড়ো দিব্যি রইল। চলে আয় ওখান থেকে!

[ বিজয়ার গান ]
তোরে সেই দেশে লয়ে যাব –
যথা না শুনিবি শ্যামনাম।
যথা শ্যামের স্মিরিতি নাই
শ্যামের পিরিতি নাই,
যথা বাজে না শ্যামের বাঁশি
নাই ব্রজধাম॥

ষষ্ঠ খণ্ড
[রাজ-উদ্যান – প্রভাত]

রাজা :
আমার মুখের দিকে অমন হাঁ করে চেয়ে কী দেখেছ ধনঞ্জয়?
ধনঞ্জয় :
ভয় নেই মহারাজ! ভয় নেই! আপনি মেঘ নন, আর আমিও চাতক পক্ষী নই। মহারাজ যদি অভয় দেন, তা হলে একটি কথা জিজ্ঞাসা করি।
রাজা :
(হাসিয়া) তুমি আমার বয়স্য। তোমার তো সাতখুন মাপ। বলো কী বলতে চাও –
ধনঞ্জয় :
মহারাজ! বৃন্দাবনের আয়ান ঘোষের সাথে আপনার কি কোনো কুটুম্বিতা ছিল?
রাজা :
তার মানে?
ধনঞ্জয় :
তার মানে আর কিছু নয়, মহারাজ! চেহারা তো দেখিনি, তবে তার বুদ্ধির সঙ্গে আপনার বুদ্ধির অদ্ভুত সাদৃশ্য আছে।
রাজা :
(সক্রোধে) ধনঞ্জয়!
ধনঞ্জয় :
দোহাই মহারাজ! আমার মাথা কাটা যাক, তাতে দুঃখ নেই; কিন্তু আপনার অরসিক বলে বদনাম রটলে লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাবে!
রাজা :
(হাসিয়া) আচ্ছা বলো, কী বলছিলে?
ধনঞ্জয় :
আমি বলছিলাম মহারাজ, আপনার ওই প্রধানমন্ত্রী বিদ্যাপতির কথা। ছিলেন দুর্গা-উপাসক ঘোর শাক্ত, হলেন পরম বৈষ্ণব, কৃষ্ণভক্ত। ছিলেন রাজমন্ত্রী – কঠোর রাজনীতিক, হলেন কবি – শান্তকোমল প্রেমিক।
রাজা :
তাতে তোমার কি ক্ষতিবৃদ্ধি হল, ধনঞ্জয়!
ধনঞ্জয় :
কিছু না, মহারাজ! ক্ষতিবৃদ্ধি যা হবার, তা হচ্ছে রাজার, আর তাঁর রাজ্যের। এ-ক্ষতিও হচ্ছিল এতদিন গোপনে, তাকেও দিনের আলোকে টেনে আনলে বিন্দে-দূতী।
রাজা :
বিন্দে-দূতী? সে আবার কে?
ধনঞ্জয় :
আজ্ঞে ওই হল, আপনারা যাকে বলেন অনুরাধা, আমাদের মতো দুর্জন তাকেই বলে বিন্দে-দূতী!
রাজা :
অর্থাৎ সহজ ভাষায় তোমার কথার অর্থ এই যে, কবি বিদ্যাপতি হচ্ছেন নন্দলাল, আমি হচ্ছি আয়ান ঘোষ, আর শ্রীমতী হচ্ছেন –
ধনঞ্জয় :
দোহাই মহারাজ! মাথা আর ঘাড়ের সন্ধিস্থলে বিচ্ছেদের ভয় যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ ও-পাপ কথা কোন সাহসে উচ্চারণ করি!
রাজা :
ধনঞ্জয়, আয়ান ঘোষের গোপ-বুদ্ধি আর তোমাদের রাজার ক্ষাত্র-বুদ্ধিতে যথেষ্ট প্রভেদ আছে। তোমরা কী বোঝ জানি না, আমি কিন্তু সব শুনি, সব দেখি, সব বুঝি।
ধনঞ্জয় :
মহারাজ পরম উদার। আপনার ধনবল জনবলও অপরিমাণ, তবু মহারাজ, জটিলা-কুটিলার মুখ বন্ধ করতে তা কি যথেষ্ট?
রাজা :
দেখো ধনঞ্জয়, চোর যতক্ষণ ঘরের আশেপাশে ঘোরে, ততক্ষণ জাগ্রত বলবান গৃহস্থ তাকে ভয় করে না। হ্যাঁ, তবে তাকে লক্ষ রাখতে হয় যে, ঘরে সিঁদ না কাটে। তা ছাড়া, এইসব নখদন্তহীন কবিদের নিরুপদ্রব প্রেমকে আমার ভয় নেই। ওরা দূরে থেকে খানিক দীর্ঘনিশ্বাস ফেলবে, দুটো কবিতা কী গান লিখবে, ব্যাস! ওর চেয়ে এগিয়ে যাবার দুঃসাহস ওদের নেই! তুমি কি এর বেশি কিছু লক্ষ করেছ? –
ধনঞ্জয় :
আজ্ঞে, তা মিথ্যে বলতে পারব না। মহারানি প্রত্যহ রাজসভায় এসে চিকের আড়াল টেনে বসেন হয়তো রাজকার্য দেখতেই এবং সে চিক গলিয়ে একটা চামচিকেরও যাবার উপায় নেই। তবু বিদ্যাপতির ওই পর্দামুখী আসনটা অনেকেরই চক্ষুশূল-স্বরূপ হয়ে উঠেছে।
রাজা :
ধনঞ্জয়! আমি লক্ষ রেখেছি বলেই ওদের মাঝের পর্দাটুকু আজও অপসারিত হয়নি। তোমরা নিশ্চিন্ত থেকো, আর সকলকে জানিয়ে দিয়ো যে, ওদের চেয়ে আমার দৃষ্টির পরিসর অনেক বেশি। ওরা দেখে শুধু রাজসভা আর রাজ-অন্তঃপুর, আর আমাকে দেখতে হয় সমগ্র রাজ্য।
ধনঞ্জয় :
আচ্ছা মহারাজ! তারই পরীক্ষা হোক।
রাজা :
কী পরীক্ষা করবে বলো তুমি?
ধনঞ্জয় :
আমি বলি কী, কোনোরকমে দিন-কতকের জন্য রানিকে আটকে রাখুন, তিনি যেন রাজসভায় না আসেন। তার পর রানির অবর্তমানে বিদ্যাপতিকে কিছু নতুন পদ রচনা করে গাইতে বলুন। মহারাজ, আপনার অনুগ্রহে প্রধানমন্ত্রী হয়ে উঠেছেন প্রধান গায়ক, আর রাজসভা হয়ে দাঁড়িয়েছে বাবাজির আখড়া। মহারাজ, দাসের অপরাধ নেবেন না।
রাজা :
তোমার ইঙ্গিত বুঝেছি। আচ্ছা ধনঞ্জয়, তাই হবে।
ধনঞ্জয় :
যাবার বেলায় একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে যাই মহারাজ, একদা শ্যাম বনে গিয়ে শ্যামারূপ ধারণ করে আয়ান ঘোষের চোখে ধুলো দিয়েছিলেন!
রাজা :
আমার চোখের পর্দা আছে ধনঞ্জয়। এ-চোখে কেউ ধুলো দিতে পারবে না।

সপ্তম খণ্ড
[বিদ্যাপতির বাটীর পুষ্পোদ্যান]

অনুরাধা :
ঠাকুর! আজ দু-দিন থেকে তোমার মুখে হাসি নেই, চোখে দীপ্তি নেই, কণ্ঠে গান নেই! কী হয়েছে তোমার?
বিদ্যাপতি :
কেন তুমি ছলনা করছ অনুরাধা? তুমি তো সবই জান। আজ দু-দিন ধরে রাজসভায় আমার লাঞ্ছনার আর সীমা নেই। এই দু-দিন রাজাকে একটি নূতন পদও শোনাতে পারিনি। আর তাই নিয়ে শত্রুপক্ষ আমায় বিদ্রুপবাণে জর্জরিত করেছে।
অনুরাধা :
হা হরি! এ দু-দিনে একটা গানও লিখতে পারলে না? তোমার সুরের ঝরনা হঠাৎ এমন শুকিয়ে গেল কেন?
বিদ্যাপতি :
তুমি তো জান রাধা, আমার কাব্যের প্রেরণা, সুরের প্রাণ সবই লছমী দেবী। যেদিন তাঁর উপস্থিতি অনুভব না করি, সেদিন আমার দুর্দিন। সেদিন আমার কাব্যলোকে, সুরলোকে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ!
অনুরাধা :
আচ্ছা ঠাকুর, তুমি তো রানিকে একটুও দেখতে পাও না, তবু কী করে বুঝতে পার যে রানি রাজসভায় এসেছেন? রানি কি কোনো ইঙ্গিত করেন?
বিদ্যাপতি :
না না, অনুরাধা, লছমী তো ইঙ্গিতময়ীরূপে দেখা দেননি আমায়, তিনি আমার অন্তরে আর্বিভূতা হন সংগীতময়ীরূপে। তাঁর আবির্ভাব অনুভব করি আমি আমার অন্তর দিয়ে। যেদিন রানি রাজসভায় আসেন, সেদিন অকারণ পুলকে আমার সকল দেহমন বীণার মতো বেজে ওঠে। শত গানের শতদল ফুটে ওঠে আমার প্রাণে। আমি তখন আবিষ্টের মতো গান করি। সে আমার আত্মার গান নয়, ও গান পরমাত্মারূপী শ্রীকৃষ্ণের গান!
অনুরাধা :
ঠাকুর, আমার প্রণাম নাও। তোমার পা ছুঁয়ে আমি ধন্য হলাম। আমি কাল ভোরেই তোমাকে দেখাব তোমার কবিতালক্ষ্মীকে।
বিদ্যাপতি :
পারবে? পারবে তুমি অনুরাধা? (হঠাৎ আত্মসংবরণ করিয়া) এ কী করে সম্ভব হবে জানিনে, তবু জানি রাধা – এ শুধু তোমার দ্বারাই সম্ভব হতে পারে। তুমিই আমার বন্ধ-স্রোত সুরধুনীকে মুক্ত করতে পার।
অনুরাধা :
উতলা হোয়ো না ঠাকুর! তোমার মনস্কামনা পূর্ণ হবে। আমি দূতী, আমার অসাধ্য কিছু নেই।
বিদ্যাপতি :
অনুরাধা, তুমি হয়তো মনে করছ, আমি কী ঘোর স্বার্থপর, পাষণ্ড, তাই না?
অনুরাধা :
নিশ্চয়ই! পাষাণ না হলে ঠাকুর হবে কী করে? শুধু নেবে, দিতে জানবে না, মাথা খুঁড়ে মরলেও থাকবে অটল, তবে তো হবে দেবতা, তবেই না পাবে পূজা!
বিদ্যাপতি :
অনুরাধা! আমি যদি তোমার প্রেমের এক বিন্দুও পেতাম, তা হলে আজ আমি জগতের শ্রেষ্ঠ কবি হতে পারতাম।
অনুরাধা :
না ঠাকুর, তা হলে তুমি হতে আমার মতোই উন্মাদ। সকলের আকাঙ্ক্ষা সমান নয়, ঠাকুর! কেউ বা পেয়ে হয় সুখী, আর কেউ বা সুখী হয় না-পেয়ে –
বিদ্যাপতি :
তোমার প্রেমই প্রেম, অনুরাধা, যা পায়ে শৃঙ্খলের মতো জড়িয়ে থাকে না, সে প্রেম দেয় অনন্তলোকে অনন্ত-মুক্তি।
অনুরাধা :
অত শত ঘোর-প্যাঁচের কথা বুঝিনে, ঠাকুর! আমি ভালোবেসে কাঁদতে চাই, তাই কাঁদি। বুকে পেলে কান্না যাবে ফুরিয়ে, প্রেম যাবে শুকিয়ে – তাই পেতে চাইনে। বুকের ধনকে বিলিয়ে দিই অন্যকে। আমি চললাম ঠাকুর, আমি চললাম। আমি কাল সকালে তোমার কবিতালক্ষ্মীকে দেখাব!

[অনুরাধার গান]
হাম অভাগিনি, দোসর নাহি ভেলা।
কানু কানু করি যাম বহি গেলা।
মনে মোর যত দুখ কহিব কাহাকে।
ত্রিভুবনে যত দুখ নাহি জানে লোকে।
জনম অবধি মোর এই পরিণাম
আমিই চাহিব শুধু, চাহিবে না শ্যাম!

বিদ্যাপতি :
ভণয়ে বিদ্যাপতি, শুন ধনি রাই

কানু সমঝাইতে হাম চলি যাই॥

অষ্টম খণ্ড
[রাজ–অন্তঃপুর]

[অনুরাধার গান]
এ ধনি করো অবধান
তোমা বিনা উনমত কান॥
(কানু পাগল হল গো
তোমারে না হেরি কানু পাগল হল গো)

রানি :
কানু পাগল হল, না তুই পাগল হলি অনুরাধা?
অনুরাধা :
(গান) শুন শুন গুণবতী রাধে!

মাধবে বধিয়া তুই কী সাধিবি সাধে?
(তুই কোন সাধ সাধিবি?
মাধবে বধিয়া তুই কোন সাধ সাধিবি?)

রানি :
সতিনকে কাঁদাব! বুঝলি?
অনুরাধা :
(গান) এতহুঁ নিবেদন করি তোরে সুন্দরী

জানি ইহা করহ বিধান।
হৃদয়-পুতলি তুহুঁ সে শূন্য কলেবর
তুহুঁ বিদ্যাপতি-প্রাণ।

রানি :
আ মল! বিদ্যাপতি-বিদ্যাপতি বলে ছুঁড়ি যে নিজেই পাগল হলি! বিদ্যাপতির বিদ্যাটুকু বাদ দিয়ে তাঁর ঘর জুড়ে বসলেই তো পারিস।
অনুরাধা :
তা হলে তোমার কী দশা হবে সখী?
রানি :
এক কৃষ্ণকে নিয়ে ষোলো হাজার গোপিনী যদি সুখী হতে পারে, আমরা দু-জন আর সুখী হতে পারব না?
অনুরাধা :
সেই প্রেমময়ী গোপিনীদের চরণে কোটি কোটি প্রণাম করি ভাই! আমরা তাঁদের পায়ের ধুলো হবারও যোগ্য নই।
রানি :
সে-কথা যাক। অনুরাধা, আমার একটা কথা জানতে বড়ো সাধ হয়। তিনি কি একবারও তোকে আমার কথা জিজ্ঞাসা করেন না?
অনুরাধা :
একবারও না।
রানি :
না ভাই লক্ষ্মীটি, লুকোসনে। মহারাজার আদেশে আমি আজ দু-দিন রাজসভায় যেতে পাইনি। তাঁকে একবার দেখতে পাইনি, তাঁর গান শুনিনি। মনে হচ্ছে যেন তাঁকে কত জন্ম দেখিনি।
অনুরাধা :
তারও ওই দশা! রোজ নতুন গান লিখেই চিৎকার করে আমায় ডাকতে থাকে – ওই গানটা লিখে নেবার জন্য। আজ দু-দিন ধরে বেচারি একেবারে নিশ্চুপ।
রানি :
হুঁ। (দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া) আচ্ছা, গান লিখিয়ে সে আমার কাছে গাইতে বলে না?
অনুরাধা :
উঁহু।
রানি :
দূর পোড়ারমুখি! সত্যি বল না ভাই, মাথা খাস।
অনুরাধা :
তুমি যদি কাল ভোরে ঠিক এইখানে – এই মাধবীকুঞ্জে তাকে দেখতে পাও, তাহলে কী করবে?
রানি :
তোর মনের কথা হয়তো বুঝেছি। আচ্ছা অনুরাধা, বিদ্যাপতি তোর বর হলে তুই কী করিস বল তো।
অনুরাধা :
রান্না করি কান্না করি। মাঝে-মঝে ঝগড়া করি, কাজে বাগড়া দিই, আর রাত্তির বেলায় পা টেপাই।
রানি :
দোহাই তুই থাম। তোর মুখে যে পোকা পড়বে। তুই কী লো?
অনুরাধা :
তোমার বোন – সতিন। আর সতিনে নাড়ে-চাড়ে, বোন সতিনে পুড়িয়ে মারে। আচ্ছা ভাই লক্ষ্মী, তুমি যদি ওকে পাও তা হলে কী কর?
রানি :
আমার ঠাকুর ঘরে রেখে পূজা করি।
অনুরাধা :
মাগো কী শাস্তি!
রানি :
শাস্তি কী লো?
অনুরাধা :
শাস্তি নয় তো কী? রাতদিন পাষাণ-মূর্তি হয়ে তোমার মন্দিরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, হাঁটু ভেঙে গেলেও বসতে পারবে না, একে শাস্তি ছাড়া কী বলব?
রানি :
তবে কি তুই বলিস বুকে পুরে রাখতে, কিংবা দিন-রাত মান-অভিমানের পালা গাইতে?
রাজা :
রানি, তোমাদের পালা-গানে কি আমি দোয়ারকি করতে পারি! যেয়ো না অনুরাধা, আমাদের মতন দু-চার জন দুর্জন বাধা জমায় বলেই প্রেমের আকর্ষণী সংগীত এত বেড়ে যায়। প্রেম যখন গদাই-লশকরি ঢিমেতালে চলতে থাকে, তখন তার শত্রুপক্ষই ন্যাজ মলে তাকে তাতিয়ে তোলে।
অনুরাধা :
মহারাজ কি আমায় লছমী দেবীর ছোটো বোন মনে করেছেন?
রাজা :
আরে, সে সৌভাগ্য হলে তো তোমায় ডাইনে নিয়ে বসতাম। লছমী দেবী বামে বসে হতেন বামা – আর তুমি হতে ডাইনে।
অনুরাধা :
আর এই দুই অবলার মাথায় চাঁটি দিয়ে মহারাজ হতেন তবলাবাদক না? তা মহারাজ যখন এমন মধুর অধিকারই দিলেন – তখন আবার বলতে ইচ্ছা করছে – আমি তা হলে আপনাকে নিয়ে সেতারের সুর বাঁধা অভ্যাস করতাম।
রাজা :
রানি, তোমার এই সখীটি যেমন মুখরা, তেমনই রসিকা। আর, হবে না? কবির কাছে তালিম পাচ্ছে।
রানি :
রাজা, রাজা, তুমি হাসছ –, কিন্তু তোমায় এত ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেন? তোমার চোখে মুখে রক্ত নেই!
রাজা :
ঠিক মড়ার মতো, না রানি? ওটা তোমার চোখের ভুল। রানি, আমার একটা কথা রাখবে?
রানি :
রানি :
রাজা :
আমাকে কাল ভোরেই যেতে হবে আমার রাজ্যের সীমান্ত পেরিয়ে। আমি যখন থাকব না, তখন যেন আমার প্রিয় সখা বিদ্যাপতির কোনো অযত্ন না হয়।
রানি :
আমি বুঝতে পারছি, রাজা। তুমি অসুস্থ, তুমি একটু চুপ করে শোও। তোমার সেবা করার কর্তব্য থেকে আমায় বঞ্চিত কোরো না।
রাজা :
কর্তব্য–সেবা–তাই করো রানি, তাই করো! লোকে যা চায় ভগবান তাকে তার সব কিছু দেন না। এই বঞ্চিত করেই তিনি টেনে নেন সেই হতভাগ্যকে তাঁর শান্তিময় কোলে। যাকে ভালোবাসার কেউ নেই, সে যদি ভগবানের চরণে আশ্রয় না পায় তার মতো দুর্ভাগ্য বুঝি আর কেউ নেই।
রানি :
তুমি কবে ফিরবে?
রাজা :
বহুবার তো গেছি রানি, আবার ফিরে এসেছি। আবার হয়তো আসব তোমার সেবা নিতে। তোমায় বঞ্চিত আমি করব না।
রানি :
রাজা! তুমি কেন অমন করছ? তোমার সেই বুকের ব্যথাটা বুঝি আবার বেড়েছে! ভোর হয়ে এল, তুমি একটু চুপ করে শোও, আমি আসছি এখনই!

নবম খণ্ড
[ রাজ-উদ্যান, প্রভাত ]

বিদ্যাপতি :
মহারাজ! আমি গান শোনাতে এসেছি। আজ আমার গানের বাঁধ, প্রাণের বাঁধ, সুরের বাঁধ ভেঙে গেছে। ভগীরথের মতো সুরের অলকানন্দাকে আমি আহ্বান করে এনেছি।
রাজা :
এসো! এসো বন্ধু, এসো বিদ্যাপতি! এত আনন্দ তো তোমার কোনোদিন দেখিনি বিদ্যাপতি! আজ তিন দিন ধরে তুমি ছিলে বাণীহীন, মূক। হঠাৎ আজ ভোরে তোমার এত কবি-প্রেরণা এল কোত্থেকে, বলো তো?
বিদ্যাপতি :
তা জানি না মহারাজ, আমার প্রাণ শোনাতে চায় গান। নিখিল জগৎকে আজ সে গানে গানে পাগল করে দিতে চায়, ডুবিয়ে দিতে চায়, ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায়। আজ আর তোমার আদেশের অপেক্ষা রাখব না রাজা, আজ গান গাইব স্বেচ্ছায়!
[গান]
আজু রজনি হাম ভাগে পোহায়লুঁ –
পেখলুঁ পিয়া-মুখ-চন্দা।
জীবন-যৌবন সফল করি মানলুঁ
দশ দিশি ভেল নিরদ্বন্দ্বা॥
আজু মঝু গেহ গেহ করি মানলুঁ
আজু মঝু দেহ ভেল দেহা।
আজু বিহি মোহে অনুকূল হোয়ল
টুটল সবহুঁ সন্দেহা॥
সোই কোকিল অব লাখ লাখ ডাকউ
লাখ উদয় করু চন্দা।
পাঁচ বাণ অব লাখ বাণ হউ
মলয় পবন বহু মন্দা॥
অব মঝু যব পিয়া সঙ্গ হোয়ত
তবহুঁ মানব নিজ দেহা।
বিদ্যাপতি কহ অলপ ভাগি নহ
ধনি ধনি তুয়া নব লেহা॥

রাজা :
অপূর্ব! সাধু কবি, সাধু! তুমি শুধু রানির কণ্ঠহার পেয়েছিলে, আজ তোমায় রাজার কণ্ঠহার দিয়ে ধন্য হলাম। লজ্জিত হোয়ো না কবি, তোমার বুকের তলে যে লুকানো থাকে রানির দেওয়া কণ্ঠহার, সেকথা আর কেউ না জানলেও আমি জানি। এই রাজ-উদ্যানে এত ভোরে তুমি আমি ছাড়া তো আর কেউ নেই বন্ধু! আর, অন্তরালে যদি কেউ থাকেনই, তিনি তোমার আত্মীয় নন। বিদ্যাপতি, অন্তরিক্ষের দেবী চোখের সুমুখে এসে আবির্ভুতা না হলে মানুষের কণ্ঠে এমন গান আসে না। দেবীর দয়া বন্ধু, এ দেবীর দয়া।
বিদ্যাপতি :
মহারাজ কি আমায় বিদ্রুপ করছেন? তা করুন, তবু আমার আজকের আনন্দকে মলিন করতে পারবেন না। এ আনন্দ এই শুভ্র প্রভাতের মতোই অমলিন।
রাজা :
তা জানি বলেই তোমায় শ্রদ্ধা করে আজও বন্ধু বলেই সম্ভাষণ করি বিদ্যাপতি!… আজ থেকে আমার রাজ্যে তুমি পরিচিত হবে ‘কবি-কণ্ঠহার’ নামে।

দশম খণ্ড
[ দৃশ্য পূর্ববৎ ]

ধনঞ্জয় :
এই কণ্ঠহার-এর মাঝে এই অধম কণ্টক-হাড় কি আসতে পারে, মহারাজা?
রাজা :
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই! এসো ধনঞ্জয় এসো! আজ আমার সভাকবির পরিপূর্ণ প্রকাশের শুভ প্রভাত। এই শুভ প্রভাতে আমি কবিকে দিয়েছি আমার কণ্ঠহার। প্রার্থনা করো, যেন আমার সভাকবির আসন হয় বিশ্ব কবি-সভার সর্বোচ্চ স্থানে।
ধনঞ্জয় :
ও-রকম প্রার্থনা আমি করব না, মহারাজ! মানুষের আসনের উচ্চতার একটা সীমা আছে, তাকে অতিক্রম করে বসলেই আমরা তাকে বলি শাখা-মৃগ। যাক। মহারাজের আজকের আনন্দটা কি সত্যিকার?
বিদ্যাপতি :
তুমি তা বুঝবে না ধনঞ্জয়। যে প্রদীপ তিলে তিলে পুড়ে বুকের স্নেহ-রসকে জ্বালিয়ে অপরকে দান করে আলো, সেই প্রদীপই জানে এই আত্মদানের – আপনাকে নিঃশেষে বিলিয়ে দেওয়ার কী অপার আনন্দ!
রাজা :
ঠিক বলেছে কবি – আরতির প্রদীপ নিববার আগে যেমন করে শেষবার তার উজ্জ্বলতম শিখা মেলে দেবতার মুখ দেখে নিতে চায় – তেমনি করে আমার অন্তর-দেবতা শ্রীকৃষ্ণের মুখ দেখে নিতে চাচ্ছে আমার শ্রান্ত প্রাণ-শিখা। তুমি এমন গান শোনাতে পার কবি, যা আমার অন্তিম সময়ে শুনতে ইচ্ছা করবে?
ধনঞ্জয় :
মহারাজ! এইবার কিন্তু অরসিকের মতো কথা আরম্ভ হল এবং কাজেই আমাকে সরে পড়তে হল।
রাজা :
ধনঞ্জয়! ধনঞ্জয় চলে গেলে? আঃ বাঁচলাম! বিদ্যাপতি, আমায় একটু ধরবে? এখানে উঠে এলাম কী করে জানিনে, আর বোধ হয় এখান থেকে উঠে যেতেও পারব না!
বিদ্যাপতি :
তুমি এমন করছ কেন সখা? তোমার কি কোনো অসুখ করেছে?
রাজা :
সখা! প্রেমের বৃন্দাবন; আমরা – আমি, তুমি, লছমী, অনুরাধা – জনম জনম ধরে লীলা-সহচর-সহচরী। সেই প্রেমলোকের গান যেদিন তুমি প্রথম শুনালে, সেই দিন আমার মনে পড়ে গেল প্রেম-লোকনাথ শ্রীকৃষ্ণকে। তুমি কাকে লক্ষ করে সে গান লিখেছিলে জানিনে, কিন্তু তোমার গানের মন্ত্রে আমি উপাসনা করতে লাগলাম – রাধাশ্যামের যুগলমূর্তি। আমি আমার উপাস্য দেবতাকে পেয়েছি, তাই তাঁর বিরহ আর সহ্য করতে পারছিনে, বন্ধু! আমি আমার কানুর বাঁশরি শুনতে পেয়েছি।
বিদ্যাপতি :
রাজা!
রাজা :
(হাসিয়া) তুমি ঠকে গেলে বন্ধু! তুমি গড়লে তরণি, আর আমি তাই চুরি করে গেলাম বৈতরণি পেরিয়ে। বিদ্যাপতি! তুমি কাঁদছ? কেঁদো না সখা, তুমিও আসবে দু-দিন পরে আমাদের চির-লীলানিকেতন বৈকুণ্ঠধামে। জান বিদ্যাপতি, কাল সারারাত্রি ঘুমোইনি, আমার প্রিয়তম শ্রীকৃষ্ণকে ডেকেছি আর কেঁদেছি। আজ ভোরে সেই অশান্তের আহ্বান ভেসে এল কানে – ‘ওরে আয়, আমার প্রিয় আমার বুকে চলে আয়!’ রানি বলছিলেন রাজবৈদ্যকে খবর দিতে, এমন সময়ে এলে তুমি – ভবরোগের বৈদ্য। তুমি এখন গাও সখা – আমার মাধবের নাম গান –

[বিদ্যাপতির গান]

মাধব,
বহুত মিনতি করি তোয়।
দেই তুলসীতিল দেহ সমর্পলুঁ-
দয়া জনু ছোড়বি মোয়॥
গণইতে দোষ গুণ-লেশ না পাওবি
যব তুঁহু করবি বিচার,
তুঁহু জগন্নাথ জগতে কহায়সি
জগ-বাহির নহি মুই ছার॥
কিয়ে মানুষ পশু পাখি কিয়ে জনমিয়ে
অথবা কীটপতঙ্গ
করম-বিপাকে গতায়তি পুন পুন
মতি রহু তুয়া-পরসঙ্গ।
ভণয়ে বিদ্যাপতি অতিশয় কাতর
তরইতে ইহ ভবসিন্ধু –
তুয়া পদ-পল্লব করি অবলম্বন
তিল এক দেহ দীনবন্ধু॥

রাজা :
আহা, আবার বলো সখা – আবার বলো :

মাধব! তরইতে ইহ ভবসিন্ধু –
তুয়া পদপল্লব করি অবলম্বন
তিল-এক দেহ দীনবন্ধু!

আঃ আমার মাথা কার কোলে?
রানি :
রাজা! আমি দাসী – লছমী।
রাজা :
লছমী! ওঃ! কে কাঁদে আমার পায়ে পড়ে?
অনুরাধা :
রাজা! আমি, আমি – অনুরাধা। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ বিষ্ণু-উপাসক, পরম প্রেমিক – তুমি, আমায় পায়ের ধুলো দিয়ে যাও, আমি ওই চরণধূলির প্রসাদে – মুক্ত হয়ে যাই!
রাজা :
অনুরাধা! আমি যে কৃষ্ণকে পেয়েছি ধ্যানে, সে কৃষ্ণকে তুমি যে রেখেছ বুকে পুরে। অনুরাধা – অনুরাধা – কী মধুর নাম! এই তো আমার বৃন্দাবন। বিদ্যাপতি, নারায়ণ, লছমী, অনুরাধা – কৃষ্ণনাম গান – এরই মাঝে যেন জন্মে জন্মে আসি – শ্রীকৃষ্ণ মাধব মা-ধ-ব…(রাজার মৃত্যু)
বিদ্যাপতি, অনুরাধা, লছমী :

একাদশ খণ্ড
(বিদ্যাপতির ভবন – নিশীথ রাত্রি)

[অনুরাধার গান]

মাধব! কত পরবোধব রাধা!
হা হরি হা হরি কহতহি বারবার
অব জিউ করব সমাধা॥
ধরণি ধরিয়া ধনি জতনহি বইসই
পুনহি উঠই নাহি পারা,
সহজহি বিরহিণী জগমাহা তাপিনী
বৈরী মদন-শরধারা।
অরুণ নয়ন-লোর তীতল কলেবর
বিলোলিত দীঘল কেশা।
মন্দির বাহির করইতে সংশয়
সহচরী গণতহি শেষা॥

বিদ্যাপতি :
অনুরাধা! তুমি একা এখানে গান করছ? বিজয়া কোথায়?
অনুরাধা :
জানি না ঠাকুর! তোমায় রানি ডাকছেন। একবার যাবে?
বিদ্যাপতি :
রানি – আমায় ডাকছেন? এত রাত্রে? কেন বল তো?
অনুরাধা :
ভয় হচ্ছে, না আনন্দ?
বিদ্যাপতি :
দুই-ই! রাজা শিবসিংহের স্বর্গারোহণের পর এক বৎসর কাল রানির প্রতিভূ হয়ে রাজ্য চালালাম, এই এক বৎসর অবগুণ্ঠিতা রানির মুখের দিকে চাইতে পারিনি। কেবলই ভয় হয়েছে, যদি রানির চোখে চোখ পড়ে – আর চোখ ফিরাতে না পারি। তাই নতনেত্রে – কর্তব্য করে গেছি। রাজ-সিংহাসনে দেখেছি শুধু দু-খানি নিরাভরণ রাঙাচরণ, আর মনে হয়েছে ও চরণ সত্যসত্যই সকল দেবতার আরাধেয়। এই এক বৎসর রানি আমায় কেবল আদেশই করেছেন – রানির মতো মহিমাগম্ভীর কণ্ঠে! তাই অনুরাধা, আজ এই অন্ধকার নিশীথে তাঁর ডাক শুনে ভয় আনন্দ দুই-ই হচ্ছে।
অনুরাধা :
তা হলে আমি কী বলব গিয়ে?
বিদ্যাপতি :
আমি তোমার কথার ইঙ্গিতে বুঝলাম অনুরাধা, যে আমার যাওয়া উচিত নয়। তুমি সর্বদা রানির কাছে থাক। তুমি হয়তো রানির ভাবান্তর লক্ষ করেছ। রাজা জীবিত নেই, রানিই এখন রাজ্যেশ্বরী, স্বাধীনা। – হুঁ তুমি বলো অনুরাধা, আমি যেতে পারব না। তোমাকে দিয়ে মিথ্যা বলাব না।
অনুরাধা :
ঠাকুর, একটু পা দুটো এগিয়ে দাও দেখি। থাক থাক, তোমরা পাথরের জাত, আমিই এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করি।

[গান]
নাথ, দরশ সুখে বিধি কৈল বাদ
অঙ্কুরে ভাঙল বিধি অপরাধ।
সুখময় সাগর মরুভূমি ভেল,
জলদ নেহারি চাতক মরি গেল!

[হঠাৎ ভীষণ ঝড়-বৃষ্টি]
বিজয়া :
দাদা! ভীষণ বৃষ্টি নামল যে। ঘরে বৃষ্টির ছাঁট আসছে। দোর জানালাগুলো বন্ধ করে দিই?
বিদ্যাপতি :
না, খোলা থাক। অন্ধকারের কালোর সাথে মেঘের কালো মিলে কী অপরূপ কৃষ্ণমূর্তি ধারণ করেছে প্রকৃতি, দেখেছিস বিজয়া?
বিজয়া :
তুমি দেখো দাদা, আমার ঘুম পাচ্ছে, আমি চললাম। [প্রস্থান]

[বিদ্যাপতির গান]
এ সখী, হমারি দুখের নাহি ওর!
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর॥
ঝম্পি ঘন গরজন্তি সন্ততি ভুবন ভরি বরিখন্তিয়া।
কান্ত পাহুন কাম দারুণ সঘনে খরশর হন্তিয়া॥
কুলিশ কত শত পাত মোদিত ময়ূর নাচত মাতিয়া,
মত্ত দাদুরি ডাকে ডাহুকি ফাটি যাওত ছাতিয়া॥
তিমির দিগ ভরি ঘোর যামিনী অথির বিজুরিক পাঁতিয়া,
বিদ্যাপতি কহে কৈসে গোঁয়ায়বি হরি বিনু দিনরাতিয়া॥

দ্বাদশ খণ্ড
[ দূরে লছমীর গান ]

সজনী! কো কহ আওব মাধাই।
বিরহ-পয়োধি পার কিয়ে পাওব
মঝু মনে নাহি পতিয়াই॥
এখন তখন করি দিবস গোঙায়লুঁ –
দিবস দিবস করি মাসা,
মাস মাস করি বরখ খোয়ায়লুঁ
খোয়ায়লুঁ এ তনুক আশা॥

[বিদ্যাপতির গান]

অঙ্কুর তপন তাপে যদি জারব কি করব বারিদ মেহে।
এ নব যৌবন বিফলে গোঙায়বঁ কি করব সো পিয়া লেহে॥
বিদ্যাপতি :
কে? রানি?
রানি :
আমি লছমী, চরণের দাসী।
বিদ্যাপতি :
তুমি? এই নিশীথ রাত্রে ঝড়-বৃষ্টির মাঝে তুমি একা এলে?
লছমী :
হ্যাঁ, একা। আর থাকতে পারলাম না বলেই তো আমার দুখের দোসরের অভিসারে বেরিয়েছি। বিদ্যাপতি! চার বছর ধরে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে আজ তোমার কাছে পরাজয় স্বীকার করতে এলাম। রাজা যেদিন আমাদের সকল প্রেমকে ম্লান করে চলে গেলেন, সেইদিন থেকেই এই এক বছর তোমায় ভুলতে চেয়েছি, তোমার প্রেম – তোমার গান – তোমার সকল কিছুকে উপেক্ষা করতে, অবহেলা করতে চেয়েছি। যত ভুলতে চেয়েছি, তুমি হয়েছ তত নিকটতম। এ কী দুর্বার আকর্ষণ তোমার! আমি ক্ষতবিক্ষত হলাম নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে করে, আর পারিনে। আমায় ঠাঁই দাও ওই চরণে।
বিদ্যাপতি :
রানি! তুমি কি সেই লছমী, না তার কঙ্কাল, প্রেত? সত্যই তুমি আজ একা – তোমার প্রেম তোমায় ছেড়ে গেছে!
রানি :
বিদ্যাপতি! প্রিয়তম! সত্যই আজ আমি নিঃসম্বল, তুমি ছাড়া ত্রিজগতে আজ আর আমার কেউ নেই। তুমি আমায় তাড়িয়ে দিয়ো না!
বিদ্যাপতি :
রানির মহিমা প্রেমের মহিমাকে তুমি এমন করে পদদলিত করবে লছমী, এ আমার স্বপ্নেরও অতীত ছিল। শোনো রানি – আমি চেয়েছিলাম তোমাকেই – রাজা যদি জীবিত থাকতেন হয়তো তোমাকেই, শুধু তোমাকেই চাইতাম। কিন্তু আজ আর তোমাকে চাই না। রাজার মৃত্যু তাঁর অচিন্তনীয় ত্যাগ আমাকে সত্যকার প্রেমের পথ দেখিয়ে দিয়েছে। পাথর কুড়াতে গিয়ে আমি পেয়েছি পরশ-মানিক। তাঁর ছোঁয়ায় আমার সকল কাম হয়ে গেছে সোনা। তোমার মধ্য দিয়ে আমি পেয়েছি সত্য-কার লছমী দেবীকে – নারায়ণীকে, নারায়ণকে।
রানি :
নিষ্ঠুর! তুমি আমায় প্রত্যাখ্যান করছ? তুমি তা হলে এতদিন গানে গানে সুরে সুরে আমায় প্রতারণা করেছ? নির্মম ব্যাধের জাত তোমরা, বাঁশির সুরে ডেকে হরিণীকে বধ করাই তোমাদের ধর্ম।
বিদ্যাপতি :
দেবী! আমি তোমায় প্রতারণা করিনি। প্রত্যাখ্যানও করছিনে। তুমি যা চাও আমার সে প্রেম তো তুমি পেয়েছ।
রানি :
না, পাইনি; পেলে আমার অন্তরে এ হাহাকার থাকত না। শোনো বিদ্যাপতি, আমি চাই না শূন্য প্রেম – যাকে ধরা-ছোঁয়া যায় না, আমি চাই তোমাকে – তোমার প্রাণ-মন-দেহ-আত্মা – তোমার সকল কিছুকে।
বিদ্যাপতি :
আমি তো বলেছি, আমার কামনা একদিন ছিল – আজ আর নেই। এই কামনাশূন্য-দেহ নিয়ে শবসাধনা করে তোমারও মুক্তি হবে না, আমারও হবে অধোগতি। তোমার এই প্রেম শ্রীকৃষ্ণে – অর্পণ করো, তুমি সুখী হবে, শান্তি পাবে। আর তা না পারলেও তোমার প্রেম যদি সত্য হয়, আমাকে ভালোবেসে তুমি শ্রীভগবানের করুণা লাভ করবে।
রানি :
আমি চাই না, চাই না অন্যকিছু, চাই না মুক্তি। আমি চাই তোমাকে – স্বর্গে হোক, নরকে হোক, যেখানে হোক আমি চাই কেবল তোমাকে বিদ্যাপতি, তোমাকে। আমি তোমাকে পেতে চাই আমার বক্ষে, আমার চক্ষে, আমার প্রতি অঙ্গ দিয়ে তোমার প্রতি অঙ্গের পরশ পেতে!
বিদ্যাপতি :
লছমী! লছমী! ছাড়ো! ছাড়ো! যেতে দাও, পালিয়ে যেতে দাও আমাকে এখান থেকে।… তুমি প্রেম-অপভ্রষ্টা মায়াবিনী রূপ ধরে আমায় শ্রীভগবানের পথ থেকে ফিরাতে এসেছ। এ কী জ্বালাময় তোমার স্পর্শ! উঃ – আমি পালিয়ে গিয়ে এই তপস্যাই করব লছমী; যেন তোমাকে এই নীচে থেকে ঊর্ধ্বে টেনে তুলতে পারি। (ছুটিয়া চলিলেন)
লছমী :
বিদ্যাপতি! বিদ্যাপতি! নিষ্ঠুর!

ত্রয়োদশ খণ্ড
[ভীষণ ঝড়বৃষ্টির মধ্যে বিদ্যাপতি ছুটিয়া চলিয়াছেন]

অনুরাধা :
ঠাকুর! ঠাকুর! ও পথে নয় এই দিকে, এই দিকে –এসো!
বিদ্যাপতি :
কে? কে তুমি চলেছ, আমার আগে দীপ জ্বালিয়ে – পথ দেখিয়ে?
অনুরাধা :
(তীক্ষ্ণ হাসি হাসিয়া) আমি বিষ্ণুমায়া!
বিদ্যাপতি :
অনুরাধা! অনুরাধা! নিয়ে চলো, নিয়ে চলো আমায় এই ঝড়বৃষ্টি কৃষ্ণরাতের অন্ধকারের মধ্য দিয়ে। নিয়ে চলো সেইখানে, যেখানে নেই মানুসের লালা-সিক্ত কামনা-সিক্ত ভালোবাসা। যেখানে আছে অনন্ত প্রেম, অনন্ত ক্রন্দন, অনন্ত অতৃপ্তি।
অনুরাধা :
এসো কবি, এসো সাধক! এই অশান্ত কৃষ্ণ নিশীথিনীর পরপারেই পাবে অশান্ত কিসোর চিরবিরহী শ্রীকৃষ্ণকে। ওই শোনো তাঁর মধুর মুরলীধ্বনি! (দূরে করুণ বাঁশির সুর)
বিদ্যাপতি :
অনুরাধা দাঁড়াও, দাঁড়াও! কে যেন আমার পা জড়িয়ে ধরেছে। উঃ রাধা! রাধা! আমায় কৃষ্ণ-সর্পে দংশন করেছে! জ্বলে গেল, জ্বলে গেল! সকল দেহ আমার বিষে জ্বলে গেল।
অনুরাধা :
(ছুটিয়া আসিয়া) ঠাকুর! ঠাকুর! দেখছ! ওই কৃষ্ণ-সর্পের মাথায় কী অপূর্ব মণি জ্বলছে! ও কৃষ্ণ-সর্প নয় ঠাকুর! তোমায় দংশন করেছে কৃষ্ণবিরহ। ওই বিরহিণী যাকে দংশন করে, তার মুক্তির আর বিলম্ব থাকে না। ঠাকুর! আমার শ্রীকৃষ্ণ! আমার গিরিধারীলাল! আমার প্রিয়তম! (শেষ কথাকটি বলিতে বলিতে অনুরাধা নিরুদ্দেশ হইয়া গেল।)
বিদ্যাপতি :
অনুরাধা! অনুরাধা! কোথায় নিরুদ্দেশ হলে তুমি? অনুরাধা! বুঝেছি, বুঝেছি তুমি বিষ্ণুমায়া! আমি মনে মনে চেয়েছিলাম গঙ্গায় ডুবে লছমীর স্পর্শ-পাপ স্খালন করতে – তাই তুমি ভুলিয়ে এনেছ গঙ্গার বিপরীত পথে – আলেয়ার আলো দেখিয়ে। বুঝেছি, তোমার মায়ায় ভুলেছিলাম আমি আমার আরাধ্যা দেবীকে। সেই পাপে আমার এই শাস্তি – এই সর্প-দংশন, এই ভীষণ মৃত্যু। – কিন্তু আমি যাব, আবার গঙ্গার পথেই যাব। যতক্ষণ শেষ নিশ্বাস থাকবে আমার, ততক্ষণ ছুটিব পতিতপাবনীকে স্মরণ করে। (ছুটিয়া চলিলেন)
রানি :
অনুরাধা! অনুরাধা! কেন আমায় ভাগরথীর কূলে ডেকে আনলি? বল মায়াবিনী তোর কী ইচ্ছা?
অনুরাধা :
তোমার জন্ম-জন্মান্তরের চাওয়াকে যদি চাও লছমী, তা হলে আমার সাথে এসো। পারবে আমার সাথে গঙ্গায় ঝাঁপ দিতে?
রানি :
তোর ইঙ্গিত বুঝেছি অনুরাধা। এই কলুষিত চিত্ত নিয়ে আমি শরণ নিয়েছিলাম আমার মুখর দেবতার – তাই দেবতা হলেন বিমুখ। তাই চাস এই পতিতপাবনীর জলে আমার এই পাপ-দেহের বিসর্জন। তবে তাই হোক। আমি যেন জন্মান্তরে – পরজন্মে, আমার বিদ্যাপতি – আমার নারায়ণকে আমার করে পাই। মা গো পতিতপাবনী।–
(দুই জনে গঙ্গার জলে ঝাঁপাইয়া পড়িলেন)
বিদ্যাপতি :
মা গো। পতিতপাবনী ভাগীরথী আমি তোর কোলের আশায় এত পথ ছুটে এলাম, তবু তোর কোলে আমার এই পাপ-তাপিত বিষ-জর্জরিত দেহ রাখতে পারলাম না মা! অঙ্গ আমার অবশ হয়ে এল। আর চলতে পারি না, মা! মাকে ডেকে, মৃত্যু উপেক্ষা করে সন্তান এল এতদূর পথ, আর তুই এতটুকু পথ আসতে পারলি না মা ভক্ত ছেলের ডাকে? মা! মা! মা গো! (দূরে গঙ্গার কলকল শব্দ) এ কী! এ কী! কোথা হতে ভেসে আসে দু-কূলপ্লাবী জোয়ারের কলকল সংগীত? তবে কি মা সন্তানের অন্তিম প্রার্থনা শুনেছিস! মা মকরবাহিনী সকল কলুষনাশিনী মা গো ! এ কী শীতল স্নিগ্ধ স্পর্শ তোর মা! আমার সকল মন-প্রাণ যেন জুড়িয়ে গেল। কাল-কেউটের দংশনজ্বালা জুড়িয়ে গেল মা তোর মাতৃ-করস্পর্শে। কে? কে? তুমি মা পরমেশ্বরী?
মা ভগীরথী :
বিদ্যাপতি! পুত্র আমার! আমার শাপ-ভ্রষ্ট সন্তান তুমি, আমি তোমার ডাকে তোমাকে কোলে তুলে নিতে এসেছি তোমার আপন ঘরে নন্দন – লোকে।
[লছমী ও অনুরাধা দূরে স্রোতে ভাসিয়া আসিতেছে – দূরে লছমীর গান নিকটতর হইতে লাগিল।]

সজনী, আজু শমন দিন হয়।
নব নব জলধর চৌদিকে ঝাঁজিল
প্রাণ দেহে নাহি রয়॥
বরষিছে পুন পুন অগ্নি-দাহন যেন
জানিনু জীবন লয়।

[বিদ্যাপতির গান]

বিদ্যাপতি কহে, শুন শুন লছমী, মরণ মিলন মধুময়॥
লছমী :
কে? বিদ্যাপতি?
বিদ্যাপতি :
লছমী? তুমি?
অনুরাধা :
হ্যাঁ ঠাকুর! নিয়ে এসেছি আমি তোমার জীবন-মরণের সাথি লছমীকে। পবিত্র সুরধুনী-ধারায় স্নাত হয়ে তোমরা উভয়ে হয়েছ নির্মল। তাই মায়ের কোলে, মরণকে পুরোহিত করে হল তোমাদের মিলন। (বলিতে বলিতে অনুরাধা দূরে ভাসিয়া যাইতে লাগিল।)
লছমী :
অনুরাধা! সখী! আর তুই কি আমাদের ছেড়ে এমনি দূরে ভেসে যাবি?
অনুরাধা :
লছমী! সখী! আমি যেন জন্ম-জন্ম কালস্রোতে ভেসে এমনই যুগলমিলন দেখে মরতে পারি! (ভাসিয়া যাইতে যাইতে অনুরাধার কণ্ঠে গান ভাসিয়া আসিল–)

তোমার যাহাতে সুখ
তাহে আমার সুখ
সুন্দর মাধব হমার।
কোটি জনম যেন তুহার সুখের লাগি
ডারি দেই এ জীবন ছার॥
[ভীষণ স্রোত আসিয়া সকলকে ডুবাইয়া দিল।]

[যবনিকা পতন]

বিদ্যাপতি (রেকর্ড – নাটিকা)

প্রথমখণ্ড

[মিথিলার কমলা নদীর তীরে গ্রাম। তাহারই উদ্যানবাটিকা দেবীদুর্গা মন্দির। কবি বিদ্যাপতি দুর্গাস্তব গাহিতেছেন।]

(স্তব)
নমস্তে শরণ্যে শিবে সানুকম্পে
নমস্তে জগদ্‌ব্যাপিকা বিশ্বরূপে
নমস্তে জগদ্‌বন্দ্য পদারবিন্দে
নমস্তে জগত্তারিণি ত্রাহি দুর্গে॥

অনুরাধা।
ঠাকুর! ঠাকুর!
বিদ্যাপতি।
(মন্দির-অভ্যন্তর হইতে) কে?
অনুরাধা।
আমি অনুরাধা, একটু বাইরে বেরিয়ে আসবে?
বিদ্যাপতি।
(মন্দির দ্বার খুলিয়া বাহিরে আসিল। বিরক্তির সুরে) একটু অপেক্ষা করলেই পারতে, অনুরাধা। এত বড়ো ভক্তিমতী হয়ে তুমি মায়ের নামগানে বাধা দিলে?
অনুরাধা।
আমায় ক্ষমা করো, ঠাকুর। অত্যন্ত প্রয়োজনে আমি তোমার ধ্যান ভঙ্গ করেছি। আমার কৃষ্ণগোপালের জন্য আজ কোথাও ফুল পেলুম না। তোমার বাগানে অনেক ফুল, আমার গিরিধারীলালের জন্য কিছু ফুল নেব? আমার গোপালের এখনও পুজো হয়নি।
বিদ্যাপতি।
তুমি তো জান অনুরাধা, এ বাগানে ফুল ফোটে শুধু আমার মায়ের পায়ে অঞ্জলি হওয়ার জন্য। এ ফুল তো অন্য দেব-দেবীকে দিতে পারিনে।
(মন্দির দ্বার বন্ধ করিয়া দিলেন, মন্দির অভ্যন্তরে স্তব পাঠের মৃদু গুঞ্জন শোনা গেল)
বিদ্যাপতি।
(গুনগুন স্বরে)
মা আমার মনে আমার বনে
ফোটে যত কুসুমদল
সে ফুল মাগে তোরই তরে
পুজতে তোরই চরণতল॥
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ –
অনুরাধা।
(অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে) ঠাকুর! ঠাকুর! চলে গেলে। তুমি কি সত্যিই এত নিষ্ঠুর? তবে কি আমার ঠাকুরের পুজো হবে না আজ? আমার কৃষ্ণগোপাল, আমার প্রিয়তম! তুমি যদি সত্য হও, আর আমার প্রেম যদি সত্য হয়, তা হলে আজ এই বাগানের একটি ফুলও অন্য কারুর পূজায় লাগবে না। এই বাগানের সকল ফুল তোমার চরণে নিবেদন করে গেলাম।
(প্রস্থান)
দেবীদুর্গা।
ক্ষান্ত হও বিদ্যাপতি! ও ফুল শ্রীকৃষ্ণ চরণে নিবেদিত। বিষ্ণু আরাধিকা যে ফুল শ্রীহরির চরণে নিবেদন করে গেছে, সে ফুল নেবার অধিকার আমার নেই।
বিদ্যাপতি।
মা! মা!
দেবীদুর্গা।
শোনো পুত্র, তুমি হয়তো জান না যে আমি পরমা বৈষ্ণবী, জগৎকে বিষ্ণুভক্তি দান করি আমিই।
বিদ্যাপতি।
তোর ইঙ্গিত বুঝেছি, মহামায়া। তবে তোরই ইচ্ছা পূর্ণ হোক ইচ্ছাময়ী; আমি আজ থেকে বিষ্ণুরই আরাধনা করব।
[ বিদ্যাপতির গীত ]
আমার শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে জপব আমি শ্যামের নাম॥
মা হল মোর মন্ত্রগুরু, ঠাকুর হলেন রাধাশ্যাম॥
বিজয়া।
দাদা! দাদা! শিগগির এসো। মা আমাদের ছেড়ে স্বর্গে চলে গেলেন।
বিদ্যাপতি।
অ্যা! বিজয়া! বিজয়া! মা নেই! মা চলে গেলেন?

দ্বিতীয় খণ্ড
[মিথিলার রাজা শিবসিংহের উদ্যানবাটিকা]

বিদ্যাপতি।
মিথিলার রাজা শিবসিংহের জয় হোক।
শিবসিংহ।
স্বাগত বিদ্যাপতি। বন্ধু! তোমার মাতৃশোক ভুলবার যথেষ্ট অবসর না দিয়ে স্বার্থপরের মতো রাজধানীতে ডেকে এনেছি। আমার অপরাধ নিয়ো না সখা।
বিদ্যাপতি।
মহারাজ! আমি আপনার দাসানুদাস। শুধু আমি কেন, আমরা পুরুষানুক্রমে মিথিলার রাজ-অনুগ্রহ ও আশ্রয়ের স্নিগ্ধ শীতল ছায়ায় লালিত পালিত। আপনার আদেশ আমার সকল দুঃখের ঊর্ধ্বে, মহারাজ!
রাজা।
তুমি জান সখা, রাজসভার বাইরে তুমি ওভাবে কথা বললে আমি কত বেদনা পাই! আমরা সহপাঠী বন্ধু, তোমরা তো রাজ অনুগৃহীত নও, বন্ধু, মিথিলার রাজারাই তোমাদের কাছে ঋণী, অনুগৃহীত। তোমরা পুরুষানুক্রমে প্রধানমন্ত্রী হয়ে মিথিলার রাজা ও রাজ্যকে নিয়ন্ত্রিত করেছ।

রানি লছমী।
তুমি তো শুধু রাজমন্ত্রীই নও, বিদ্যাপতি। তুমি রাজকবি। মিথিলা তথা ভারতের শ্রেষ্ঠ কবি।
বিদ্যাপতি।
মহারানি এখানে আছেন তা তো বল নাই, সখা?
রাজা।
রানি লছমী দেবীর অনুরোধেই তোমায় এত তাড়া দিয়ে এনেছি, বন্ধু! তোমার কণ্ঠের গান না শুনলে ওঁর সে দিনটাই নাকি হয় বৃথা। এত শ্রদ্ধা তোমার ওপর, তবু মাঝের ওই পর্দাটুকু আর উঠল না। এ নিরর্থক লজ্জার আবরণ আমাকেই লজ্জা দেয় বেশি। আর কথা নয় কবি, এবার আলাপন হোক শুধু গানে গানে।
বিদ্যাপতি।
মহারানির আদেশ শিরোধার্য। কোন গান গাইব দেবী?
রানী।
আমার সেই প্রিয় গান ‘জনম জনম হাম রূপ নেহারলুঁ’ ও গানটা আমার কাছে কখনও পুরানো হল না!

[বিদ্যাপতির গীত]
জনম অবধি হাম রূপ নেহারলুঁ নয়ন ন তিরপিত ভেল।
লাখ লাখ যুগ হিয় হিয় রাখলুঁ, তবু হিয় জুড়ন ন গেল!
দেখি সাধ না ফুরায় গো,
রূপ যত দেখি তত কাঁদি সাধ না ফুরায় গো
হিয়া কেন না জুড়ায় গো, হিয়ার উপরে গিয়া
হিয়া তবু না জুড়ায় গো।

তৃতীয় খণ্ড
[অনুরাধার গীত]

সখী লো!
অব মথুরাপুর মাধব গেল।
গোকুল মানিক কো হরি লেল,
হরি হরিয়া নিল কে?

লছমী।
রাজা! কে যায় পথে অমন করুণ সুরে গান গেয়ে? ওকে এখানে ডাক না!
বিদ্যাপতি।
মহারানি। আমি ওকে জানি। আমি যেখানে যাই, ও আপনি এসে হয় আমার প্রতিবেশিনী। ওর নাম অনুরাধা, গিরিধারীলাল শ্রীকৃষ্ণ ওর জপমালা।
লছমী।
তাহলে তুমি ওকে ডেকে আনো না, কবি।
বিদ্যাপতি।
আমি যাচ্ছি দেবী কিন্তু জানি না ও আসে কি না?

[অনুরাধার গীত]
নয়নক নিন্দ গেও বয়ানক হাস,
সুখ গেও পিয়া সঙ্গ দুখ হম পাশ,
পাপ পরান মম আন নাহি জানত
কানু কানু করি ঝুরে।

লছমী।
অনুরাধা! কী মিষ্টি নাম তোমার! তুমি আমার কাছে থাকবে? বিদ্যাপতি! তুমি যদি অনুমতি দাও তা হলে অনুরাধাকে আমার কাছে রেখে শ্যাম-নাম শুনি!
বিদ্যাপতি।
আমি তো ওর অভিভাবক নই, দেবী। ও আমার ছোটো বোন বিজয়ার বন্ধু।
লছমী।
ওর বাপ মা কোথায় থাকেন?
বিদ্যাপতি।
গতবার দেশে যখন মড়ক লাগে তখন ওর বাপ মা দু-জনেই মারা যান।
লছমী।
ওর বিয়ে হয়নি?
বিদ্যাপতি।
না!(হাসিয়া) ও বলে ও বিয়ে করবে না।
অনুরাধা।
বা রে, আমি বুঝি তোমার গলা ধরে বলতে গেছিলুম যে আমি বিয়ে করব না। না মহারানি, ঠাকুর জানেন না। আমার বিয়ে হয়েছে।
বিদ্যাপতি।
তোমার বিয়ে হয়েছে? কার সাথে?
অনুরাধা।
সে তুমি জান না, বিজয়া জানে।
লছমী।
আমিও হয়তো জানি! তুমি থাকবে ভাই আমার কাছে, আমার সখী হয়ে আমার বোন হয়ে? আর বদলে আমি তোমার বরকে ধরে এনে দেব।
অনুরাধা।
তা কি প্রাণ ধরে দিতে পারবে রানি? যে ঠাকুর আমার সে যে তোমারও।
বিদ্যাপতি।
মহারাজ! ওঁদের নিভৃত আলাপনের কমল বনে আমাদের উপস্থিতি মত্ত মাতঙ্গের মতোই ভীতিজনক। আমরা একটু অন্তরালে গেলেই বোধ হয় সুশোভন হত।
রাজা।
চলো বিদ্যাপতি, তোমার ইঙ্গিতই সমীচীন।
লছমী।
আর একটি গান গাও না ভাই।

[অনুরাধার গীত]
সজল নয়ন করি পিয়া পথ হেরি হেরি
তিল এক হয় যুগ চারি
(যেন শত যুগ মনে হয়
তারে এক তিলে না হেরিলে শত যুগ মনে হয়)
বিধি বড়ো দারুণ তাহে পুন ঐছন
দরহি করলুঁ মুরারি।

রাজা।
কবি! এইখানে – এই খানে এসো। এই ঝোপের অন্তরাল থেকে ওঁদের দুই দেবীকে দিব্যচক্ষে দর্শন করা যাবে।
বিদ্যাপতি।
মহারাজ! যে নিজে থাকতে চায় গোপন তাকে জোর করে প্রকাশ করার বর্বরতা আমার নেই।
রাজা।
আঃ! কবি হয়ে তুমি কি করে এমন বেরসিক হলে বলো তো? ওই দেবীর দল যখন চিকের আড়াল থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমাদের দেখতে থাকেন, তাতে কোনো অপরাধ হয় না, আর আমরা একটু আড়াল আবডাল থেকে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখলেই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?

চতুর্থ খণ্ড
লছমী।
অনুরাধা! তোমার কবিকে দিয়ো আমার এই কণ্ঠহার।
অনুরাধা।
বেশ! তা হলে আজ আমি আসি, রানি!
লছমী।
রানি নয়, রানি নয়, অনুরাধা, লছমী। তুমি আমায় লছমী বলে ডেকো। রানির কারাগারে আমার ডাক-নামের হয়েছিল মৃত্যু, তোমার বরে সে নাম আবার বেঁচে উঠুক।
অনুরাধা।
লছমী! লছমী! তুমি সত্যই লছমী। রূপে লছমী, গুণে লছমী, গোলোকের অধীশ্বরী লক্ষ্মী।
লছমী।
আর তুমি? তুমি বুঝি ব্রজের দূতী?
অনুরাধা।
হ্যাঁগো তোমার দূতিয়ালিই করব, এই চাকরিই আমি নিলাম, সখী! তোমার কণ্ঠহার যথাস্থানে দেব তুমি নিশ্চিন্ত থেকো।

[ অনুরাধার গীত ]
ধন্য ধন্য ধন্য রমণী জনম তোর।
সব জন কানু কানু করে ঝুরে
সে কানু তোর ভাবে বিভোর।

[উদ্যান-অন্তরালে বিদ্যাপতি ও শিবসিংহ]
রাজা।
বিদ্যাপতি! বিদ্যাপতি! দেখেছ? ওদের দু-জনের মুখে গোধূলির আলো পড়ে ঠিক বিয়ের কনের মতো সুন্দর দেখাচ্ছে! বিদ্যাপতি! বিদ্যাপতি! আরে? তুমি যে নির্বাক নিস্পন্দ হয়ে গেলে! বিদ্যাপতি!

[বিদ্যাপতির গীত]
অপরূপ পেখলুঁ বামা।
কনকলতা অবলম্বনে উঠল
হরিণীহীন হিমধামা॥
(একী অপরূপ রূপ-ফাঁদ!)
(স্বর্ণলতিকা ধরি উঠিয়াছে যেন ওই কলঙ্কহীন এক চাঁদ)
নলিন নয়ান দুটি অঞ্জনে রঞ্জিত
এ কী ভুরু ভঙ্গি-বিলাস
চকিত চকোর জোড় বিধি যেন বাঁধিল
দিয়া কালো কাজরপাশ!
গুরু গিরিবর পয়োধর পরশিছে
গ্রীবার গজমোতি হারা,
কাম-কম্বু ভরি কনক-কুম্ভ পরি
ঢালে যেন সুরধুনী-ধারা।

পঞ্চম খণ্ড
[বিদ্যাপতির ভবন]

বিদ্যাপতি।
বিজয়া!
বিজয়া।
দাদা! ডাকচ?
বিদ্যাপতি।
হ্যাঁ, অনুরাধা কোথায় রে?
বিজয়া।
কী জানি। সে কি বাড়ি থাকে? সকাল হতে না হতে রানির যানবাহন এসে ওকে নিয়ে যায়। ও মাঝে মাঝে পালিয়ে আসে আমার কাছে, আর অমনি সাথে সাথে আসে রানির চেড়িদল। রানির অনুগ্রহ ওকে গ্রহের মতো গ্রাস করেছে। আবার রানির নাকি হুকুম হয়েছে এখন থেকে রাত্রেও তাঁর কাছে থাকতে হবে। এ কিন্তু রানির অত্যাচার দাদা। হয় তুমি এর প্রতিকার করো, নইলে আমিই রাজার কাছে আবেদন করব।
বিদ্যাপতি।
হুঁ! হ্যাঁরে বিজয়া, সেদিন অনুরাধা বলছিল, ওর বিয়ে হয়ে গেছে। সত্যই কি ওর বিয়ে হয়েছিল?
বিজয়া।
(সক্রোধে) আমি জানি না। আচ্ছা দাদা, তুমি কবি, সাধক। তুমি তো মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থল পর্যন্ত দেখতে পাও। অনুরাধার দিকে কখনও চোখ ফিরিয়ে দেখেছ কি?
বিদ্যাপতি।
তা দেখিনি। কিন্তু ভুল তো তুইও করে থাকতে পারিস, বিজয়া। ওর স্বামীই যদি কেউ থাকেনই, সে এ পৃথিবীর মানুষ নয়, ওর স্বামী গিরিধারীলাল শ্রীকৃষ্ণ।
বিজয়া।
হ্যাঁগো হ্যাঁ, ওই নামের ছল করে ও যাকে পূজা করে আমি তাকে জানি। তুমি ইচ্ছা-অন্ধ, তাই দেখতে পাও না।

[অনুরাধার গীত]
সখী লো মন্দ প্রেম পরিণামা।

বিজয়া।
ওই যে হতভাগিনি আসছে।
বিদ্যাপতি।
তুই ওকে একবার আমার কাছে পাঠিয়ে দে তো!
বিজয়া।
দিচ্ছি দাদা!
বিদ্যাপতি।
আমায় এ কী পরীক্ষায় ফেললে, ঠাকুর!
অনুরাধা।
আমায় ডাকছিলে, ঠাকুর!
বিদ্যাপতি।
হাঁ রাধা! রানি কি তোমার রাত্রেও তাঁর কাছে থাকতে আদেশ করেছেন?
অনুরাধা।
হ্যাঁ, রানি বলেন দূতীর দূতিয়ালির প্রয়োজন রাত্রেই হয় বেশি। তবে এ তাঁর আদেশ নয়, আবদার।
বিদ্যাপতি।
দূতী! কীসের দূতিয়ালি রাধা?
অনুরাধা।
ঠাকুর! তুমি আমায় কী মনে কর? পাগল, নির্বোধ বা ওরকম একটা কিছু, না? তুমি যে এত যত্ন করে রোজ তোমার নব-রচিত গানগুলি শেখাও, তুমি কি মনে কর আমি তার মানে বুঝিনে? আর আমি কি শুধু রানিরই দূতিয়ালি করি? আমি কি লেখার গানেরও দূতিয়ালি করিনে?
বিদ্যাপতি।
আমি তোমার কাছে আর আত্মগোপন করব না, রাধা। সত্যই তোমার সুরের সেতু বেয়ে হয় আমাদের মিলন! তবে তুমি তো জান আমার এ প্রেম নিষ্কলুষ, নিষ্কাম। তোমায় একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?
অনুরাধা।
বলো।
বিদ্যাপতি।
তুমি কি সত্যিই আামায় ভালোবাস?
অনুরাধা।
না।
বিদ্যাপতি।
তুমি আমায় বাঁচালে, অনুরাধা!
অনুরাধা।
তোমায় আমি ভালোবাসিনে। কিন্তু আমি ভালোবাসি তাকে যাকে তুমি ভালোবাস। ঠাকুর! ঠাকুর! আমাকে এই বর দাও যেন জন্মে জন্মে তোমার ভালোবাসার জনকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে পারি; তুমি যাকে ভালোবেসে সুখ পাও, তারই দাসী হতে পারি। আর দিনান্তে একবার শুধু ওই চরণ বন্দনা করতে পারি।

ষষ্ঠ খণ্ড
[রাজগৃহ]

রাজা।
আমার মুখের দিকে অমন হাঁ করে চেয়ে কী দেখছ, ধনঞ্জয়?
ধনঞ্জয়।
ভয় নেই মহারাজ! ভয় নেই! আপনিও মেঘ নন, আর আমিও চাতক পক্ষী নই। মহারাজ যদি অভয় দেন, তা হলেই একটা কথা জিজ্ঞাসা করি।
রাজা।
বলো কী বলতে চাও।
ধনঞ্জয়।
আমি বলছিলাম, মহারাজ, বৃন্দাবনের আয়ান ঘোষের সঙ্গে কি আপনার কোনো কুটুম্বিতা ছিল?
রাজা।
তার মানে?
ধনঞ্জয়।
তার মানে আর কিছু নয় মহারাজ, চেহারা তো দেখিনি, তবে তার বুদ্ধির সঙ্গে আপনার বুদ্ধির অদ্ভুত সাদৃশ্য আছে।
রাজা।
ধনঞ্জয়!
ধনঞ্জয়।
দোহাই মহারাজ! আমার মাথা কাটা যাক তাতে দুঃখ নেই, কিন্তু আপনার অ-রসিক বলে বদমান রটলে লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাবে।
রাজা।
বটে! আচ্ছা বলো কী বলছিলে!
ধনঞ্জয়।
আমি বলছিলাম মহারাজ, আপনার ওই প্রধানমন্ত্রী বিদ্যাপতির কথা। তিনি ছিলেন দুর্গা-উপাসক, ঘোর শাক্ত, হলেন পরম বৈষ্ণব। কৃষ্ণভক্ত। ছিলেন রাজমন্ত্রী, কঠোর রাজনীতিক, হলেন কবি কান্ত-কোমল প্রেমিক।
রাজা।
তাতে তোমার কী ক্ষতি বৃদ্ধি হল ধনঞ্জয়?
ধনঞ্জয়।
কিছু না মহারাজ! ক্ষতি বৃদ্ধি যা হবার তা হচ্ছে রাজার আর তার রাজ্যের। এ ক্ষতিও হচ্ছিল এতদিন গোপনে, তাকেও আবার দিনের আলোয় টেনে আনলে বিন্দে দূতী।
রাজা।
বিন্দে দূতী? সে আবার কে?
ধনঞ্জয়।
আজ্ঞে ওই হল! আপনারা যাকে বলেন অনুরাধা, আমাদের মতো দুর্জন, তাকেই বলে বিন্দে দূতী!
রাজা।
অর্থাৎ সহজ ভাষায় তোমার কথার অর্থ এই যে, কবি বিদ্যাপতি হচ্ছেন নন্দলাল, আমি হচ্ছি আয়ান ঘোষ আর শ্রীমতী হচ্ছেন – !
ধনঞ্জয়।
দোহাই মহারাজ! মাথা আর ঘাড়ের সন্ধিস্থলে বিচ্ছেদের ভয় যতক্ষণ আছে ততক্ষণ ও পাপ কথা কোন সাহসে উচ্চারণ করি মহারাজ!
রাজা।
ধনঞ্জয়! আয়ান ঘোষের গোপবুদ্ধি আর তোমাদের রাজার ক্ষাত্রবুদ্ধিতে যথেষ্ট প্রভেদ আছে! তোমরা কী বোঝ জানি না, আমি কিন্তু সব শুনি, সব দেখি, সবই বুঝি।
ধনঞ্জয়।
মহারাজ পরম উদার। আপনার ধনবল জনবলও অপরিমাণ; তবু মহারাজ, জটিলা কুটিলার মুখ বন্ধ করতে তা কী যথেষ্ট?
রাজা।
দেখো ধনঞ্জয়, চোর যতক্ষণ ঘরের আশে পাশে ঘোরে ততক্ষণ জাগ্রত বলবান গৃহস্থ তাকে ভয় করে না। হ্যাঁ তবে তাকে লক্ষ রাখতে হয় যে ঘরে সিঁধ না কাটে! যাক তুমি কি আর কিছু লক্ষ করেছ?
ধনঞ্জয়।
আজ্ঞে তা মিথ্যে বলতে পারব না। মহারানি প্রত্যহ রাজসভায় এসে চিকের আড়াল টেনে বসেন হয়তো রাজকার্য দেখতেই এবং সে চিক গলিয়ে একটা চামচিকেরও যাবার উপায় নেই। তবু বিদ্যাপতির ওই পর্দামুখী আসনটা অনেকেরই চক্ষুশূল স্বরূপ হয়ে উঠেছে।
রাজা।
ধনঞ্জয়, আমি লক্ষ রেখেছি বলেই ওদের মাঝের পর্দাটুকু আজও অপসারিত হয় নি। তোমরা নিশ্চিন্ত থেকো আর তোমাদের সকলকে জানিয়ে দিয়ো যে, ওদের চেয়ে আমার দৃষ্টির পরিসর অনেক বেশি। ওরা দেখে শুধু রাজসভা আর রাজ-অন্তঃপুর, আর আমাকে দেখতে হয় সমগ্র রাজ্য।
ধনঞ্জয়।
আচ্ছা মহারাজ! তারই পরীক্ষা হোক।
রাজা।
কী পরীক্ষা করতে বলো তুমি?
ধনঞ্জয়।
আমি বলি কি কোনোরকমে দিন কতকের জন্য রানিকে আটকে রাখুন। তিনি যেন রাজসভায় না আসেন। তারপর রানির অবর্তমানে বিদ্যাপতিকে কিছু নতুন পদ রচনা করে গাইতে বলুন। মহারাজ আপনার অনুগ্রহে প্রধানমন্ত্রী হয়ে উঠেছেন প্রধান গায়ক আর রাজসভা হয়ে দাঁড়িয়েছে বাবাজির আখড়া। মহারাজ, দাসের অপরাধ নেবেন না।
রাজা।
তোমার ইঙ্গিত বুঝেছি। আচ্ছা ধনঞ্জয়, তাই হবে।
ধনঞ্জয়।
যাবার বেলায় একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে যাই, মহারাজ! একদা শ্যাম বনে গিয়ে শ্যামা রূপ ধারণ করে আয়ান ঘোষের চোখে ধুলো দিয়েছিলেন।
রাজা।
আমার চোখের পর্দা আছে ধনঞ্জয়, এ চোখে কেউ ধুলো দিতে পারবে না।

সপ্তম খণ্ড
[বিদ্যাপতির গৃহের পুষ্পোদ্যান]

অনুরাধা।
ঠাকুর আজ দু-দিন থেকে তোমার মুখে হাসি নাই, চোখে দীপ্তি নাই, কণ্ঠে গান নাই। কী হয়েছে তোমার?
বিদ্যাপতি।
কেন তুমি ছলনা করছ, অনুরাধা? তুমি তো সবই জান। আজ দু-দিন ধরে রাজসভায় আমার লঞ্ছনার আর সীমা নেই। এই দু-দিন রাজাকে একটি নূতন পদও শুনাতে পারিনি। আর তাই নিয়ে শত্রুপক্ষ আমায় বিদ্রুপবাণে জর্জরিত করেছে।
অনুরাধা।
হা হরি! এই দু-দিনে একটা গানও লিখতে পারলে না তোমার সুরের ঝরনা হঠাৎ এমন শুকিয়ে গেল কেন?
বিদ্যাপতি।
তুমি তো জান রাধা, আমার কাব্যের প্রেরণা সুরের প্রাণ সবই লছমী দেবী। যেদিন তার উপস্থিতি অনুভব না করি সেদিন আমার দুর্দিন। সেদিন আমার কাব্যলোকে সুরলোকে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ।
অনুরাধা।
আচ্ছা ঠাকুর, তুমি তো রানিকে একটুও দেখতে পাও না, তবু কী করে বুঝতে পার যে রানি রাজসভায় এসেছেন? রানি কি কোনো ইঙ্গিত করেন?
বিদ্যাপতি।
না না অনুরাধা! লছমী তো ইঙ্গিতময়ী রূপে কোনোদিন দেখা দেননি আমায়, তিনি আমার অন্তরে আবির্ভূতা হন সঙ্গীতময়ী রূপে। তাঁর আবির্ভাব অনুভব করি আমি আমার অন্তর দিয়ে। যেদিন রানি রাজসভায় আসেন, সেদিন অকারণ পুলকে আমার সকল দেহ-মন বীণার মতো বেজে ওঠে। শত গানের শতদল ফুটে ওঠে আমার প্রাণে। আমি তখন আবিষ্টের মতো গান করি। সে আমার আত্মার গান – ও গান পরমাত্মারূপী শ্রীকৃষ্ণের গান।
অনুরাধা।
ঠাকুর আমার প্রণাম নাও। তোমার পা ছুঁয়ে আমি ধন্য হলাম। আমি কাল ভোরেই তোমাকে দেখাব তোমার কবিতা-লক্ষ্মীকে।
বিদ্যাপতি।
পারবে? পারবে তুমি, অনুরাধা?
অনুরাধা।
উতলা হোয়ো না ঠাকুর। তোমার মনস্কামনা পূর্ণ হবে। আমি দূতী আমার অসাধ্য কিছু নেই।
বিদ্যাপতি।
অনুরাধা! তুমি হয়তো মনে করছ, আমি কী ঘোর স্বার্থপর পাষণ্ড না?
অনুরাধা।
নিশ্চয়ই। পাষাণ না হলে ঠাকুর হবে কী করে? শুধু নেবে দিতে জানবে না, মাথা খুঁড়ে মরলেও থাকবে অটল, তবে তো হবে দেবতা! তবেই না পাবে পূজা!
বিদ্যাপতি।
অনুরাধা! আমি যদি তোমার প্রেমের এক বিন্দুও পেতাম তা হলে আজ আমি জগতের শ্রেষ্ঠ কবি হতে পারতাম।
অনুরাধা।
না ঠাকুর, তা হলে তুমি হতে আমারই মতো উন্মাদ। সকলের আকাঙ্ক্ষা সমান নয় ঠাকুর, কেউ বা পেয়ে হয় খুশি আর কেউ বা খুশি হয় না-পেয়ে।
বিদ্যাপতি।
তোমার প্রেমই প্রেম অনুরাধা, যা পায়ে শৃঙ্খলের মতো জড়িয়ে থাকে না, যে প্রেম দেয় অনন্তলোকে অনন্ত মুক্তি।
অনুরাধা।
অত শত ঘোর প্যাঁচের কথা বুঝিনে ঠাকুর। আমি ভালোবেসে কাঁদতে চাই, তাই কাঁদি। বুকে পেলে কান্না যাবে ফুরিয়ে, প্রেম যাবে শুকিয়ে, তাই পেতে চাইনে। বুকের ধনকে বিলিয়ে দিই অন্যকে। আমি চললাম ঠাকুর। আমি চললাম। আমি কাল সকালে তোমার কবিতা-লক্ষ্মীকে দেখাব।

অষ্টম খণ্ড
(রাজ-অন্তঃপুর)

[অনুরাধার গীত]
এ ধনি কর অবধান,
তোমা বিনা উনমত কান।
(কানু পাগল হল গো। তোমারে না হেরি কানু পাগল হল গো)
লছমী।
কানু পাগল হল না তুই পাগল হলি রাধা?

[অনুরাধার গীত]
শুন শুন গুণবতী রাধে,
মাধবে বাঁধিয়া তুই কী সাধিবি সাধে?
(তুই কোন সাধ সাধিবি? মাধবে বাঁধিয়া তুই কোন্ সাধ সাধিবি?)
লছমী।
সতিনকে কাঁদব! বুঝলি?

[অনুরাধার গীত]
এতহুঁ নিবেদন করি তোরে সুন্দরী
জানি ইহা করহ বিধান।
হৃদয়-পুতলি তুহুঁ সে শূন্য কলেবর,
তুহুঁ বিদ্যাপতি-প্রাণ॥

লছমী।
আ-মল! বিদ্যাপতি, বিদ্যাপতি বলে ছুঁড়ি যে নিজেই পাগল হলি! বিদ্যাপতির বিদ্যাটুকু বাদ দিয়ে তার ঘর জুড়ে বসলেই তো পারিস।
অনুরাধা।
তা হলে তোমার কী দশা হবে সখী?
লছমী।
এক কৃষ্ণকে নিয়ে ষোলো হাজার গোপিনী যদি সুখী হতে পারে, আমরা দু-জন আর সুখী হতে পারব না কেন?
অনুরাধা।
সেই প্রেমময়ী গোপিনীদের চরণে কোটি কোটি প্রণাম করি ভাই, আমরা তাঁদের পায়ের ধূলি হবারও যোগ্য নই।
লছমী।
সে কথা থাক। অনুরাধা, আর একটা কথা জানতে বড়ো সাধ হয়। তিনি কি একবারও তোকে আমার কথা জিজ্ঞাসা করেন না?
অনুরাধা।
আধবারও না।
লছমী।
না ভাই লক্ষ্মীটি, লুকোসনে। মহারাজার আদেশে আমি আজ দু-দিন রাজসভায় যেতে পাইনি। তাঁকে একবারও দেখতে পাইনি, তাঁর গান শুনিনি। মনে হচ্ছে, যেন কত জন্ম তাঁকে দেখিনি।
অনুরাধা।
আচ্ছা ভাই, তুই যদি আজ ভোরে ঠিক এইখানে এই মাধবীকুঞ্জে তাঁকে দেখতে পাস, তা হলে কী করিস?
লছমী।
আমি গিয়ে তাঁর বামে দাঁড়াই, আর তুই মিলনের পালা গান গাস।
রাজা।
রানি!
অনুরাধা।
আসি আসি, সখী, মহারাজ আসছেন।
রাজা।
যেয়ো না যেয়ো না, অনুরাধা।
লছমী।
রাজা, তোমায় এত ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেন? তোমার চোখে মুখে যেন রক্ত নেই।
রাজা।
ঠিক মৃতের মতো না, রানি? না, ওটা তোমার চোখের ভুল। রানি আমার একটা কথা রাখবে?
লছমী।
বলো?
রাজা।
আমাকে কাল ভোরেই চলে যেতে হবে, চলে যেতে হবে দূরে বহু দূরে আমার রাজ্যের সীমান্ত পেরিয়ে। রানি আমি যখন থাকব না, তখন যেন আমার প্রিয় সখা বিদ্যাপতির কোনো অযত্ন না হয়।
লছমী।
আমি বুঝতে পারছি রাজা, তুমি অসুস্থ। তুমি একটু চুপ করে শোও, তোমার সেবা করার কর্তব্য থেকে আমায় বঞ্চিত কোরো না।
রাজা।
কর্তব্য! সেবা! বেশ তাই করো রানি! তাই করো! লোকে যা চায়, ভগবান তাকে তার সব কিছু দেন না। এই বঞ্চিত করেই তিনি টেনে নেন সেই হতভাগ্যকে তাঁর শান্তিময় কোলে। রানি যাকে ভালোবাসার কেউ নেই সে যদি ভগবানেরও চরণে আশ্রয় না পায়, তার মতো দুর্ভাগা বুঝি আর কেউ নেই।

[বিদ্যাপতির গীত]
আজু রজনী হাম ভাগে পোহায়লুঁ

মহারাজ! আজ আমি গান শোনাতে এসেছি। আজ আমার গানের বাঁধ, প্রাণের বাঁধ, সুরের বাঁধ ভেঙে গেছে।
রাজা।
এসো এসো বন্ধু, এসো বিদ্যাপতি!

নবম খণ্ড
[রাজ-উদ্যান]

রাজা।
এত আনন্দ তোমার কোনোদিন দেখিনি বিদ্যাপতি। আজ তিন দিন ধরে তুমি ছিলে বাণীহীন মূক। হঠাৎ আজ ভোরে হয়ে উঠলে আনন্দিত-কন্ঠ, সংগীত-মুখর। তোমার এত কবি-প্রেরণা এল কোথা থেকে, বন্ধু!
বিদ্যাপতি।
তা জানি না মহারাজ। আমার প্রাণ শুনাতে চায় গান। নিখিল জগৎকে আজ সে গানে গানে পাগল করে দিতে চায়, ডুবিয়ে দিতে চায়। ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায়। আজ আর তোমার আদেশের অপেক্ষা রাখব না রাজা, আজ গান গাইব স্বেচ্ছায়।

[বিদ্যাপতির গীত]
আজু রজনী হাম ভাগে পোহায়লুঁ
পেখলুঁ পিয়া-মুখ-চন্দা।
জীবন যৌবন সফল করি মানলুঁ
দশ দিশি ভেল নিরদ্বন্দ্বা
আজু মঝু গেহ গেহ করি মানলুঁ
আজু মঝু দেহ ভেল দেহা।
আজু বিধি মোহে অনুকূল হোয়ল
টুটল সবহুঁ সন্দেহা॥

রাজা।
অপূর্ব! সাধু, কবি, সাধু! তুমি শুধু রানির কণ্ঠহার পেয়েছিলে, আজ তোমায় রাজার কণ্ঠহার দিয়ে ধন্য হলাম। লজ্জিত হোয়ো না কবি, লজ্জিত হোয়ো না বন্ধু, তোমার বুকের তলে লুকানো থাকে রানির দেওয়া কণ্ঠহার, সে কথা আর কেউ না জানলেও আমি জানি। এই রাজ-উদ্যানে এত ভোরে তুমি আমি ছাড়া আর কেউ নেই বন্ধু। আর অন্তরালে যদি কেউ থাকে তিনি তোমার অনাত্মীয়া নন। বিদ্যাপতি, অন্তরিক্ষের দেবী চোখের সম্মুখে এসে আবির্ভূতা না হলে মানুষের কণ্ঠে এমন গান আসে না। দেবীর দয়া, বন্ধু, এ দেবীর দয়া!
বিদ্যাপতি।
মহারাজ! কি আমায় বিদ্রুপ করছেন? তা করুন তবু আমার আজকের আনন্দকে মলিন করতে পারবেন না। এ আনন্দ এই শুভ প্রভাতের মতোই অমলিন।
রাজা।
তা জানি বলেই তোমায় শ্রদ্ধা করে আজও বন্ধু বলেই সম্ভাষণ করি, বিদ্যাপতি! শোনো বন্ধু আজ থেকে আমার রাজ্যে তুমি পরিচিত হবে ‘কবি-কণ্ঠহার’ নামে।
ধনঞ্জয়।
মহারাজ, আজকের এই আনন্দটা কি সত্যিকার?

দশম খণ্ড
বিদ্যাপতি।
তুমি তা বুঝবে না ধনঞ্জয়। যে প্রদীপ তিলে তিলে পুড়ে বুকের সমস্ত স্নেহরসকে জ্বালিয়ে অপরকে দান করে আলো, সেই প্রদীপ ধনঞ্জয়, মাত্র সেই প্রদীপই জানে এই আত্মদানের, আপনাকে নিঃশেষে বিলিয়ে দেওয়ার, কী অপার আনন্দ!
রাজা।
ঠিক বলেছ কবি। আরতির প্রদীপ নিববার আগে যেমন করে শেষবার তার উজ্জ্বলতম শিখা মেলে দেবতার মুখ দেখে নিতে চায়, তেমনি করে আমার অন্তর-দেবতা শ্রীকৃষ্ণের মুখ দেখে নিতে চাইছে আমার শ্রান্ত প্রাণশিখা। তুমি এমন গান শুনাতে পার কবি, যা আমার অন্তিম সময়ে শুনতে ইচ্ছা করবে?
ধনঞ্জয়।
মহারাজ এইবার কিন্তু অরসিকের মতো কথা আরম্ভ হল এবং কাজেই আমাকে সরে পড়তে হল। (প্রস্থান)
রাজা।
ধনঞ্জয়! ধনঞ্জয়! চলে গেছে? আঃ বাঁচলাম! বিদ্যাপতি, আমায় একটু ধরো, এখানে উঠে এলাম কী করে জানি না; আর বোধ হয় এখানে থেকে উঠে যেতেও পারব না।
বিদ্যাপতি।
তুমি অমন করছ কেন সখা? তোমার কি কোনো অসুখ করেছে?
রাজা।
সখা। প্রেমের বৃন্দাবনে আমরা– আমি তুমি লছমী অনুরাধা, জন্ম জন্ম ধরে লীলা-সহচর-সহচরী। সেই প্রেমলোকের গান যেদিন তুমি শুনালে সেদিন আমার মনে পড়ে গেল আমার বিস্তৃত জন্মের কথা, মনে পড়ে গেল প্রেমলোকনাথ শ্রীকৃষ্ণকে। তোমার গানের মন্ত্রে আমি উপাসনা করতে লাগলাম রাধা-শ্যামের যুগল মূর্তি। আমি আমার উপাস্য দেবতাকে পেয়েছি, তাই তাঁর বিরহ আর সহ্য করতে পাচ্ছি না, বন্ধু। আমি যে আমার কানুর বাঁশরি শুনতে পেয়েছি।
বিদ্যাপতি।
রাজা?
রাজা।
তুমি ঠকে গেলে, বন্ধু। তুমি গড়লে তরণি আর আমি তাই চুরি করে গেলাম বৈতরণি পেরিয়ে। বিদ্যাপতি, তুমি কাঁদছ? কেঁদো না সখা! তুমিও আসবে দু-দিন পরে আমাদের চিরলীলা-নিকেতনে, বৈকুণ্ঠধামে। জানো বিদ্যাপতি, কাল সারারাত আমি ঘুমোইনি আমার প্রিয়তম শ্রীকৃষ্ণকে ডেকেছি আর কেঁদেছি। আজ ভোরে সেই অশান্তের আহ্বান ভেসে এল কানে। সে আমায় ডাকছে, ওরে আয় আয়; আমার প্রিয়, আমার বুকে চলে আয়। রানি বলছিলেন রাজবৈদ্যকে খবর দিতে, এমন সময় এলে তুমি ভবরোগের বৈদ্য।

একাদশ খণ্ড
রাজা।
তুমি এখন গাও সখা আমার মাধবের নাম গান।

[বিদ্যাপতির গীত]
মাধব! বহুত মিনতি করি তোয়।
দেই তুলসী তিল দেহ সমর্পলুঁ
দয়া জনু ছোড়বি মোয়।
গনইতে দোষ গুণ- লেশ না পাওবি
যব তুঁহুঁ করবি বিচার,
তুঁহু জগন্নাথ জগতে কহায়সি
জগ-বাহির নহি মুই ছার!
ভণয়ে বিদ্যাপতি অতিশয় কাতর
তরইতে ইহ ভবসিন্ধু
তুয়া পদ-পল্লব করি অবলম্বন
তিল এক দেহ দীনবন্ধু॥

রাজা।
আহা! আবার বলো, সখা, আবার বলো!

মাধব! তরইতে ইহ ভবসিন্ধু
তুয়া পদ-পল্লব করি অবলম্বন
তিল এক দেহ দীনবন্ধু! দীনবন্ধু –

আঃ আমার মাথা কার কোলে?
রানি।
রাজা! আমি দাসী, লছমী।
রাজা।
লছমী! ওঃ! কে কাঁদে আমার পায়ে পড়ে?
অনুরাধা।
রাজা! আমি – আমি অনুরাধা। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ বিষ্ণু উপাসক পরম প্রেমিক তুমি, আমায় পায়ের ধুলো দিয়ে যাও। আমি এ চরণ-ধূলির প্রসাদ মুক্ত হয়ে যাই!
রাজা।
অনুরাধা! অনুরাধা – অনুরাধা কী মধুর নাম। এই তো আমার বৃন্দাবন। বিদ্যাপতি নারায়ণ, লছমী, অনুরাধা, শ্রীকৃষ্ণ নাম গান এরই মাঝে যেন জন্মে জন্মে আমি শ্রীকৃষ্ণ-মাধব – (মৃত্যু)
বিদ্যাপতি।
অনুরাধা!
লছমী।
রাজা! রাজা!

দ্বাদশ খণ্ড
(বিসকি গ্রাম – বিদ্যাপতির ভবন – দেবীদুর্গা মন্দির)

[বিদ্যাপতির গীত]

হে নিঠুর তোমাতে নাই আশার আলো।
তাই কি তোমার রূপ কৃষ্ণ কালো?
তুমি ত্রিভঙ্গ তাই তোমার সকলই বাঁকা,
চোখে তব কাজলের ছলনা মাখা।
নিষাদের হাতে বাঁশি সেজেছে ভালো॥

বিজয়া।
দাদা! তোমার দুটি পায়ে পড়ি, উঠে একটু কিছু মুখে দাও। আজ সাত দিন ধরে নিরম্বু উপবাস করে মায়ের মন্দিরে হত্যা দিয়ে পড়ে আছ, তুমি যোগী ভক্ত – তুমি সব পার কিন্তু আমি যে আর পারিনে, দাদা!
বিদ্যাপতি।
এই সাত দিন কি তুইও কিছু খাসনি, বিজয়া?
বিজয়া।
না।
বিজয়া।
দাদা। মায়ের প্রসাদ এনেছি, তাই একটু খাও।
বিদ্যাপতি।
বিজয়া! আজ আমার উপবাসের সপ্তমী, কাল অষ্টমী – সেই মহাষ্টমীতে মায়ের পায়ে আত্মবলিদান দিয়ে মায়ের হাতে প্রসাদ গ্রহণ করব। তুই এখন যা।
(বিজয়ার প্রস্থান)
বিদ্যাপতি।
মা যোগমায়া! পাষাণী! আর আমায় কত পরীক্ষা করবি মা! আমার যারা প্রাণের প্রিয়তম তাদের হরণ করে তাদের আর আমার মাঝে চিরবিচ্ছেদের যবনিকা টেনে দিলি। আমায় নিয়ে এ কী খেলা খেলছিস মা?
যোগমায়া।
পুত্র বিদ্যাপতি! ওঠো প্রসাদ গ্রহণ করো। এই সাত দিন ধরে তোমার সাথে আমিও উপবাসী!
বিদ্যাপতি।
না আমি আহার গ্রহণ করব না – যতদিন না জানতে পারি কোন অভিশাপে আমার এই শাস্তি?
যোগমায়া।
শোনো পুত্র। তোমরা সকলেই ছিলে গোলোকধামের অধিবাসী, মহাবিষ্ণুর লীলা সহচর-সহচরী। তোমরা ধরণিতে নিষ্কাম প্রেম প্রচারের করভিক্ষা করেছিলে শ্রীকৃষ্ণের কাছে, তাই পবিত্র প্রেমের ও শ্রীকৃষ্ণের কীর্তনের জন্য ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছ। তোমাদের যাবার সময় হল, বৎস। তোমাদের দেহে মনে ধরণির যে ধূলি লেগেছে তা ধুয়ে দেবেন স্বয়ং দেবী ভাগীরথী। তুমি এখনই যাও গঙ্গার পথে, সেই পথে শ্রীকৃষ্ণ-বিরহ কৃষ্ণ-ফণী রূপে তোমায় দংশন করবে। তার পর হবে তোমাদের চির-মিলন, মৃত্যুকে পুরোহিত করে গঙ্গার পবিত্র বক্ষে।

ত্রয়োদশ খণ্ড
[গঙ্গাবক্ষে ঝড়বৃষ্টি]

বিদ্যাপতি।
কে? কে তুমি চলেছ আমার আগে আগে দীপ জ্বালিয়ে পথ দেখিয়ে?
অনুরাধা।
ঠাকুর, আমি অনুরাধা!
বিদ্যাপতি।
অনুরাধা! অনুরাধা! নিয়ে চলো, নিয়ে চলো আমায়! এই ঝড়বৃষ্টি? কৃষ্ণরাতের মধ্য দিয়ে সেইখানে, যেখানে আছে অনন্ত প্রেম, অনন্ত ক্রন্দন, অনন্ত অতৃপ্তি।
অনুরাধা।
এসো কবি! এসো সাধক! এই অশান্ত কৃষ্ণ-নিশীথিনীর পরপারেই পাবে অশান্ত কিশোর চির-বিরহী শ্রীকৃষ্ণকে।
বিদ্যাপতি।
অনুরাধা! দাঁড়াও দাঁড়াও! কে যেন আমার পা জড়িয়ে ধরেছে! উঃ! রাধা! রাধা! আমায় কৃষ্ণসর্পে দংশন করেছে, জ্বলে গেল, বিষে আমার সকল দেহ জ্বলে গেল, জ্বলে গেল।
অনুরাধা।
ঠাকুর! ঠাকুর! দেখেছ ওই কৃষ্ণসর্পের মাথায় কী অপূর্ব মণি জ্বলছে। ও কৃষ্ণসর্প নয় ঠাকুর, তোমায় দংশন করেছে কৃষ্ণ-বিরহ! ওই বিরহ-ফণী যাকে দংশন করে তার মুক্তির আর বিলম্ব থাকে না।
বিদ্যাপতি।
অনুরাধা! অনুরাধা! কোথায় গেল অনুরাধা! চলে গেছে। আমি যাব! আবার গঙ্গার পথেই যাব। যতক্ষণ শেষ নিশ্বাস থাকে আমার ততক্ষণ ছুটব পতিতপাবনীকে স্মরণ করে! মাগো! পতিতপাবনী ভাগীরথী! আমি তোর কোলের আশায় এত পথ ছুটে এলাম, তবু তোর কোলে আমার এই পাপ-তাপিত বিষ-জর্জরিত দেহ রাখতে পারলাম না, মা। অঙ্গ আমার অবশ হয়ে এল, আর চলতে পারি না, মা! মাকে ডেকে মৃত্যু উপেক্ষা করে সন্তান এল এতদূর পথ, আর তুই এইটুকু পথ আসতে পারবি না মা ভক্ত ছেলের ডাকে? মা! মাগো!
গঙ্গা।
বিদ্যাপতি!
বিদ্যাপতি।
এ কী – মকরবাহিনী কলুষনাশিনী মাগো – তবে কি সন্তানের অন্তিম প্রার্থনা শুনেছিস মা! আঃ! আমার প্রাণ-মন-দেহ জুড়িয়ে গেল মা, তোর মাতৃকরস্পর্শে।
গঙ্গা।
বিদ্যাপতি, আমি এসেছি তোমাদের নিয়ে যেতে, তোমাদের আপন গেহে, নন্দনলোকে। ওই তোমার লছমী অনুরাধার সাথে আসছে – বৎস, তোমাদের লীলা শেষ, কার্য শেষ। শ্রীকৃষ্ণের লীলা-সাথী – তোমরা যুগে যুগে আস, ফিরে চলো বৎস তাঁর প্রেমময় কোলে।

[অনুরাধার গীত]
সজনী আজু শমন দিন হয়।

চতুর্দশ খণ্ড
[অনুরাধার গীত]

সজনী আজু শমন দিন হয়।
নব নব জলধর চৌদিকে ঝাঁজিল
প্রাণ দেহে নাহি রয়॥
বরষিছে পুনঃপুনঃ অগ্নিদাহন যেন
জানিনু জীবন লয়।

[বিদ্যাপতির গীত]
বিদ্যাপতি কহে শুন শুন লছমী
মরণে মিলন মধুময়॥

লছমী।
কে? বিদ্যাপতি?
বিদ্যাপতি।
লছমী? তুমি?
অনুরাধা।
হ্যাঁ, ঠাকুর! আমি নিয়ে এসেছি তোমার জীবন-মরণের সাথি লছমীকে। পবিত্র সুরধনী-ধারায় স্নাত হয়ে তোমরা উভয়ে হলে নির্মল, তাই তো মা পতিতপাবনীর কোলে হল তোমাদের চিরমিলন।

[গীত]

শেষ হল মোর কাজ, হে কিশোর! আমারে লহো এবার।
লছমী।
অনুরাধা! সখী! কোথায় চলছিস তুই? তুই কি আমাদের ছেড়ে এমনি দূরে দূরেই ভেসে যাবি।
অনুরাধা।
লছমী! সখী! আমি যেন জন্মে জন্মে কালস্রোতে ভেসে এমনই যুগল মিলন দেখে মরতে পারি।

[গীত]
তোমার যাহাতে সুখ তাহে আমার সুখ
সুন্দর মাধব হমার!
কোটি জনম যেন তুহার সুখের লাগি
ডারি দেই এ জীবন ছার॥

বিলাতি ঘোড়ার বাচ্চা

 

স্বামী : অ গিন্নী! বলি ও গ্যাদারের মা! আরে হুনছনি? চিঁহি চিঁহি, চিঁহি চিঁহি, চিঁহি।
স্ত্রী : গ্যাদাইয়্যা রে। ছুইট্যা আয়রে, ছুইট্যা আয়। আরে ঘরে ঘোড়া ঢুকছে! হেই, হেই।
স্বামী : আরে, আরে – ঘোড়া না, ঘোড়া না। আরে আমি, আমি। তা দেখ, হে হে! আজক্যা বাড়িতে আসনের সময় দুইটা টাকা দিয়া একটা লটারির টিকিট কিনছি।
স্ত্রী : কী কও? লেখার চিঠি? লেখার চিঠি কিইন্যা দুইটা টাকা জলে দিছ?
স্বামী : না রে আমার পোড়া কপাল! আরে লেখার চিঠি না, লটারির টিকিট! বিলাতের ময়দানে ঘোড়দৌড় হইব। এই টিকিটের যেই ঘোড়া, হেয় যদি ফাস্ট হয় তবে আমি পঞ্চাশ হাজার টাকা পামু।
স্ত্রী : পঞ্চাশ হাজার টাকা?
স্বামী : হ্যাঁ।
স্ত্রী : কয় দশে পঞ্চাশ হাজার টাকা হয় গো? আর ঘোড়া ফাস্ট হইব? অ! বিলাতের ঘোড়া বুঝি ইস্কুলে পড়ে?
স্বামী : আ আমার পোড়া কপাল। আরে ঘোড়ায় ইস্কুলে পড়ব ক্যান? দৌড় দিয়া যদি আমার ঘোড়া হগগলের আগে যায় তবেই হেই ঘোড়া ফাস্ট হইব।
স্ত্রী : ও সে জানি বুঝলাম; তা তোমার ঘোড়া ফাস্ট হইব কেমন কইরা, তুমি রইলা এই দ্যাশে, ঘোড়া রইল বিলাতে – অরে খেদাইয়া লইয়া যাইব কেডা?
স্বামী : আ আমার পোড়া কপাল। আরে হেই দেশে সাহেব ঘোড়ার সব সাহেব সহিস আছে, হেরাই ঘোড়া খেদাইয়া লইয়া যাইব। দেখো, আজকে অফিসে বইসা বইসা একটা ঘোড়া-পূজার গান লিখছি। শোনবা, শোনবা নাকি? তা শোনো। দেখো, এই প্রথমে গাই ঘোড়া-পূজার মন্ত্র, দেখো :

     ওঁ নমস্তে শ্রী বিলাতি অশ্ব সায়েব হর্স নমোনমঃ
     চতুষ্পদ একপুচ্ছ শৃঙ্গহীন জীব আদর্শ
            সায়েব হর্স নমোনমঃ॥
অ্যাই, আরে পঙ্খিরাজের বাচ্চা আমার ঘোড়া ছুইট্যা যাও।
ক্যাতরাইয়া দুই চক্ষুরে ঘোড়া ছ্যাতরাইয়া তাজ পাও॥
স্বর্গপানে ল্যাজ উঠাইয়া, (ছোট) চিঁহি চুঁহু চিঁহি চুঁহু ডাইক্যা
আমরা দুজন রাত্র জাগুম ছোলা ভিজাইয়া রাইখ্যা (রে)
ফাস্ট যদি না হও ঘোড়া, (তোমার) ঘোড়ানীর মাথা খাও
            (হালা) পট পটাইয়া খাও॥

স্ত্রী : দেখো, ঘোড়ার টাকা পাইলে আমি একশো ভরি সোনা দিয়া গহনা গড়ামু।
স্বামী : কী কও? না, না তা হইব না, তা হইব না। আগে আমি জমি কিনুম, জায়গা কিনুম, বাড়ি করুম, ঘর করুম, তারপর সব।
স্ত্রী : কিছুতেই না, আমি যদি একবাপের বিটি হই, তবে আমার গয়না আগে হইব। তারপর অন্য কিছু।
স্বামী : কিছুতেই না, কিছুতেই না। আমি যদি এক বাপের ব্যাটা হই তবে এক লাঠি দিয়া তোমার মাথা ভাইঙ্গা…..
স্ত্রী : অ! আর একটা বউ ঘরে আনবা, না? এই তোমার লেখার চিঠি রইল আমার আঁচলে বান্ধা – ওরে উনানে দিয়া পুড়াইয়া ছাইভস্ম কইর‍্যা দুই পা দিয়া মাড়াইয়া……
স্বামী : দেখো, দেখো, দেখো – ভালো হইব না, ভালো হইব না। টিকিট দাও, টিকিট দাও, শিগগির টিকিট দাও।
স্ত্রী : মা গো! বাবা গো! গেছি গো! ওগো কে কোথায় আছ গো! দৌড় দিয়া আহ গো! ওগো মাইর‍্যা ফেলাইল গো। ওরে, গ্যাদাইরা রে, ছুইট্যা আয় রে, ছুইট্যা আয়। ওরে তোর বাপেরে বিলাতি ঘোড়ার ভূতে পাইছে রে, বিলাতি ঘোড়ার ভূতে পাইছে।
স্বামী : কেডা রে? কেডা রে? বাইরে কান্দে কেডা পোলারে।
একটি বাচ্চা ছেলে : আমি। আমি বিলাতি ঘোড়ার বাচ্চা – গ্যাদাইরা।
স্বামী : ও? ঘোড়ার বাচ্চা!

বিষ্ণুপ্রিয়া

চরিত্র

পুরুষ :
শ্রীগৌরাঙ্গ (নিমাই), শ্রী নিত্যানন্দ, শ্রীঅদ্বৈত, শ্রীবাস, মুকুন্দ, গদাধর, ঈশান, সনাতন মিশ্র, চন্দ্রশেখর আচার্য, যাদব, বুদ্ধিমন্ত।
স্ত্রী :
শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া, শচীমতা, সর্বজয়া, মালিনী, সীতাদেবী, কাঞ্চনা, অমিতা, নদীয়া নাগরীগণ, কুল-ললনাগণ।

প্রথম দৃশ্য
(শ্রীগৌরাঙ্গ-বিষ্ণুপ্রিয়ার বিবাহ-বাসর। সবেমাত্র কন্যা সম্প্রদান হইয়া গিয়াছে। বিপুল জনগণের (কন্যাপক্ষ ও বরপক্ষের) মুহুর্মুহু আনন্দ-ধ্বনির সহিত অজস্র যন্ত্রের মধুর সংগীত ও বাদ্যধ্বনি শুনা যাইতেছে। হুলু ও শঙ্খধ্বনির যেন বিরাম নাই।)
জনৈকা কন্যাপক্ষীয় দাসী :
বর কনেকে এখন বাসর-ঘরে নিয়ে এসো না গো! কন্যা সম্প্রদান তো কখন হয়ে গেছে। ওদের ছাদনাতলায় ধরে রেখে যেন সব ঠাকুর দেখছেন।
বরপক্ষীয় জনৈক লোক :
হ্যাঁ গো ঠাকরুন! আমরা ঠাকুরই দেখছি, এই যুগল-মিলন তো তোমরা মেয়ের দল সারারাত ধরে প্রাণ ভরে দেখবে আর আমরা বেচারা পুরুষের দল বাইরে বসে কড়িকাঠ গুনব।
অন্য আর একজন :
বেঁচে থাক দাদা। জোর বলেছিস। যুগল-মিলনের এই গোলোক- ধামে ঠাকুর এক-চোখোমি করতে পারবে না। আর করলেও আমরা তা মানব কেন। আধাআধি বখরা করো – রাজি আছি। অর্ধেক রাত আমরা দেখব – অর্ধেক রাত তোমাদের ছেড়ে দেব।
অন্য আর একজন বরপক্ষীয় লোক :
হেরে গেছে! হেরে গেছে। আমাদের বর বড়ো – বর বড়ো!
কন্যাপক্ষীয় দুইজন :
কক্‌খনো না, কনে বড়ো। এই আমরা তুলে ধরলাম কনেকে।
বরপক্ষীয় দুইজন :
পিঁড়ি যতই উঁচু কর না দাদা, আমাদের বরের নাগাল পাচ্ছ না-পুরো পাঁচ হাত লম্বা বর।
যাদব :
কাকিমা মানা করছেন, তোমরা দিদিকে এত উঁচুতে তুলো না, দিদি পড়ে যাবে।
কন্যাপক্ষীয় দাসী :
ওগো, মা ঠাকরুনরা বলছেন, তোমাদের বরই বড়ো। এখন ওদের বাসর-ঘরে আনতে ছেড়ে দাও।
বরপক্ষীয় লোক :
হেরে গেছে! কনে হেরে গেছে! দুয়ো! দুয়ো!
যাদব :
(মুখ ভ্যাঙচাইয়া) হেঁরেঁ গেঁছেঁ। হেঁরেঁ গেঁছেঁ। কখ্‌খনো না, দিদি বড়ো, জামাইবাবু ছোটো!
বরপক্ষীয় লোক :
তোমরা যতই চ্যাঁচাও, আমরা যুগল-মিলনের গান না গেয়ে ছাড়ছিনে। কনেকে বরের বাম-পাশে দাঁড় করাও, আমরা দেখি, যুগল-মিলনের গান গাই তারপর, – না কি বল বুদ্ধিমন্ত!
বুদ্ধিমন্ত :
নিশ্চয়! তাহলে মুকুন্দ তুমিই গানটা গাও আর আমরা ধুয়া ধরি।

(মুকুন্দের গান)
একী অপরূপ যুগলমিলন হেরিনু নদিয়া-ধামে
বিষ্ণুপ্রিয়া লক্ষ্মী যেন রে গোলোক-পতির বামে॥
একী অতুলন যুগল-মুরতি
যেন শিব-সতী হর-পার্বতী
জনক-দুহিতা সীতা দেবী যেন বেড়িয়া রয়েছে রামে॥
গৌরের বামে গৌর-মোহিনী
(যেন) রতি ও মদন চন্দ্র-রোহিণী
(তোরা) দেখে যারে আজ মিলন-রাসে
যুগল রাধা শ্যামে॥

(হুলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনি, উভয়পক্ষীয় লোকের আনন্দ-চিৎকার, মধুর বাদ্যধ্বনি ইত্যাদি)

দ্বিতীয় দৃশ্য
বাসর ঘর

(বাসর-ঘরে নদিয়া নাগরীগণ ও কুলমহিলাগণের হুলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনি, কলগুঞ্জন, বলয়-কিঙ্কিণির সুমধুর ঝংকার।)

জনৈক মহিলা :
মাগো মা অনেক বিয়েও দেখেছি, বরযাত্রীও দেখেছি, কিন্তু এমন আদেখ্‌লে বরযাত্রী আর দেখিনি। ওরাই তো আদ্ধেক রাত্তির করে দিলে, তার ওপর বর-কনের খাওয়া-দাওয়া নিয়ে গেল ঘণ্টাখানেক।
অন্য একজন মহিলা :
যা বলেছ দিদি, সব রস ওরাই নিংড়ে নিল ওদের কেঠো হাত দিয়ে। আমাদের দিল ছিবড়ে চিবুতে।
পূর্ব মহিলা :
নে লো নে,বাকি যেটুকু রাত আছে তাও হট্টগোল করে কাটিয়ে দিসনে। নাও, জামাইয়ের বামে একবার কনেকে নিয়ে বসাও দেখি। আহা, কি মানিয়েছে-ওলো তোরা দেখ, একবার নয়ন ভরে দেখ। সোনার গৌরের পাশে সোনার পিত্তিমে। বিয়ের এত আলো যেন এদের রূপের কাছে মিটমিট করছে।
অন্য একজন পুরস্ত্রী :
কী গো বর মশাই ? আজ যে বড়ো জিভ উলটে নিম্নমুখো হয়ে বসে আছ। তোমার চঞ্চলতায় নাকি সারা নবদ্বীপ কম্পমান, তোমার দাপটে নাকি গঙ্গার স্রোতে কাদা উঠে, আর আজ আমাদের সখীকে দেখে একেবারে গুটিসুটি মেরে বসে আছ। ভয় হচ্ছে নাকি?
নিমাই :
আজ বাসর-ঘরে আপনারই কর্ণধারিণী। আমার দেহ-তরির মাত্র দুটি কর্ণ, আর তা দেখে আপনাদের শত কর্ণধারিণীর দুশো হাত উসখুস করছে; তাই ভয় হচ্ছে – তরি আমার ভরা-ডুবি না হয়।
জনৈক মহিলা :
ওলো, চঞ্চলের মুখ খুলেছে। সাবধান! ভালো করে সব কর্ণ ধরিস, পাশে রয়েছে বিষ্ণুপ্রিয়া জোয়ারের টানের মতো। তাই বুঝি ওঁর ভরসা যে, আমাদের হাত থেকে কর্ণ ছাড়িয়ে চলে যাবেন।
জনৈক কিশোরী :
এই চঞ্চল আমাদের কম জ্বালিয়েছে, ভাই। গঙ্গায় এঁর জ্বালায় সোয়াস্তিতে নাইবার উপায় ছিল না। দল বেঁধে সাঁতরে গঙ্গাজলকে যেন দধি-কাদা করত। কখন যে কলশি নিয়ে মাঝগঙ্গায় ভাসিয়ে দিত, মেয়েদের কাপড় নিয়ে পুরুষদের ঘাটে, পুরুষদের কাপড় নিয়ে মেয়েদের ঘাটে রেখে আসত, আমরা টেরও পেতাম না। তারপর কুমীর হয়ে ডুব-সাঁতার দিয়ে পায়ে ধরে টান। আমরা কিছু ভুলিনি, আজ কড়ায়-গণ্ডায় তার শোধ নেব। বুঝলে চঞ্চল পণ্ডিত?
নিমাই :
আমায় পণ্ডিত বলে গালাগালি করছেন কেন? তার চেয়ে কঠিন করাঘাত ঢের মিষ্টি। যে চুরি করতে ভয় পায় না, শাস্তি নিতেও তার ভয় নেই।
অমিতা :
তুই এমন এলিয়ে পড়েছিস কেন লা বিষ্ণুপ্রিয়া? ক্লান্ত যদি হয়ে থাকিস বরের গায়ে হেলান দিয়ে বস না!
বিষ্ণুপ্রিয়া :
(চুপিচুপি) ভাই অমিতা! আমার কিছু ভালো লাগছে না। বাসর-ঘরে আসবার সময় কেমন যেন অজ্ঞানের মতো এলিয়ে পড়েছিলাম।
অমিতা :
তা তো পড়বিই। এত সুন্দর বর পেলে সবাই মুর্ছে যায়।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
যাঃ! শুনবে যে! না ভাই শোন–সেই সময় হোঁচট খেয়ে আমার আঙুল দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে।
অমিতা :
মাগো! কীহবে! এ কী অলুক্ষণে কথা গো!
দু-একজন মহিলা :
কী রে, কী হল অমিতা! কী বলছিস তোরা।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
চুপ! চুপ! বলিসনে কাউকে।
অমিতা :
কিচ্ছু না। এমনি। তোমরা চোরের শাস্তি দিচ্ছ দাও না। হ্যাঁ তারপর? কী করলি তুই?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
আমি বোধ হয় উহ্ করে উঠেছিলাম। অমনি উনি ওঁর ডান পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে আমার পায়ে আঙুল চেপে ধরলেন। অমনি রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে গেল। বেদনাও আর রইল না। তবু কেন যেন আমার বুক কাঁপছে ভাই ভয়ে।
বিধুমুখী :
কী হয়েছে মা! তোমার মুখ চোখ অমন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে কেন?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
কিচ্ছু না, কাকিমা। সত্যি,কিছু হয়নি।
অমিতা :
সারাদিন উপোস করেছে, তারপর খেয়েই এই হট্টগোল। তুমি যাও কাকিমা, আমরা আছি। বেশি ক্লান্ত হলে ওকে আমরা শুইয়ে দেব।
একজন মহিলা :
ইস্! শুইয়ে দিলেই হল আর কী। আমরা বুঝি যুগল-মিলন দেখব না। ছাদনাতলায় শুভদৃষ্টির সময় যেমন হেসে দুজন চোখ চাওয়া-চাওয়ি করেছিলে, তেমনি করে আর একবার চাও, নইলে ছাড়ছিনে।
নিমাই :
তা যত ইচ্ছে চিমটি কাটুন, ও অপকর্ম এত লোকের সামনে করতে পারব না।
উক্ত মহিলা :
কী! অমন সুন্দর মুখের দিকে চাওয়া বুঝি অপকর্ম। লুকিয়ে লুকিয়ে এর মধ্যে তো একশোবার দেখে নিলে, আমাদের চোখ তোমাদের চোখের মতো ডাগর না হলেও দেখতে পাই।
নিমাই :
তাহলে আবার ধরা পড়ে গেছি। চোরের আবার শাস্তি চলুক।
জনৈক তরুণী :
এবার শাস্তি হাত দিয়ে নয়, কথা দিয়ে।
অন্য একজন তরুণী :
শুধু কথার বাণ নয় লো, তাতে সুরের বিষ মিশিয়ে।
নিমাই :
প্রমীলার দেশে যখন এসে পড়েছি তখন আর উপায় তো নেই। আঁখি বাণ সহ্য করেও যদি বেঁচে থাকতে পারি, বাক্যবাণও বোধ হয় সইবে।
জনৈক তরুণী :
তাহলে বীর প্রস্তুত হও।

(গান)
প্রেম-পাশে পড়লে ধরা চঞ্চল চিত-চোর
শাস্তি পাবে নিঠুর কালা এবার জীবন-ভোর॥
মিলন রাসের কারাগারে
প্রণয়-প্রহরী রাখব দ্বারে
চপল চরণে পরাব শিকল নব অনুরাগ-ডোর॥
শিরীষ-কামিনী ফুল হানি জরজর করিব অঙ্গ
বাঁধিব বাহুর বাঁধনে দংশিবে বেণি-ভুজঙ্গ
কলঙ্ক-তিলক আঁকিব ললাটে হে গৌর-কিশোর॥
(হুলুধ্বনি, আনন্দধ্বনি ইত্যাদি–বাহিরে বাদ্য।)

তৃতীয় দৃশ্য
নিমাই পন্ডিতের ভবন

(কাঞ্চনা বিষ্ণুপ্রিয়াকে ফুলসজ্জায় সজ্জিত করিতেছে ও গুনগুন করিয়া গান করিতেছে। গানের শব্দ শোনা যাইতেছে না, তবে তাহার করুণ সুরে সারা গৃহ যেন ভরপুর হইয়া উঠিয়াছে।)
বিষ্ণুপ্রিয়া :
তুমি কেবলই গান করছ আর আমায় ফুলের গয়না পরাচ্ছ, তুমি কে ভাই? কতবার জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার নাম তো বললে না। এখন কেউ নেই, এসো এইবেলা আমরা সই পাতিয়ে নিই। লোক এসে পড়লে আর কথা বলতে পারব না।
কাঞ্চনা :
সতিনের সঙ্গে সই পাতালে দুঃখ পাবে ভাই।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
সতিন?
কাঞ্চনা :
হ্যাঁ সতিন। শুধু আমি নই ভাই, এই নদিয়া নগরের সকল কিশোরী কামিনী তোমার সতিন। তোমার ভাগ্যের ঈর্ষা করে, রূপের হিংসা করে।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
(হাসিয়া) ওঃ। সেই সতিন! তাহলে তোমায় সতিন বলে ডাকব?
কাঞ্চনা :
চুপ! দেয়ালেরও কান আছে। কেউ শুনতে পাবে এখন। আর অমনি সে ছুটে এসে আমাকে দেখিয়ে বলবে, ও নয়, আমিই তোমার সতিন। আচ্ছা ভাই গৌর-প্রিয়া–
বিষ্ণুপ্রিয়া :
(কাঞ্চনার মুখের কথা কাড়িয়া লইয়া) আমার নাম গৌর-প্রিয়া নয়, আমি বিষ্ণুপ্রিয়া।
কাঞ্চনা :
এতদিন বিষ্ণুপ্রিয়া ছিলে, এখন গৌর-প্রিয়া হয়েছ।

(সুরে)
তার কে গড়িল গৌর-অঙ্গ
চাঁদে চন্দন মাখিয়া গো
আমি শান্তি না পাই তারে কোথাও রাখিয়া গো
এই বুঝি হবে চুরি সদা ভয় ভয়
হৃদয়ে পাইয়া তবু কাঁপে এ হদয়
নয়নে পেয়ে যে চাঁদে তবু এ নয়ন কাঁদে
কোথা পাব হেন ঠাঁই যথা আর কেহ নাই
থাকিবে দুজন, গৌর আর গৌর-প্রিয়া গো॥
শচীমাতা :
পাগলি মেয়ে, বসে বসে গান গাচ্ছিস বুঝি? বউমাকে সাজানো হল?
কাঞ্চনা :
হ্যাঁ মা, কখন সাজানো হয়ে গেছে। দেখ দেখি কেমন মানিয়েছে।
শচীমাতা :
আহা মরে যাই! কী সুন্দর সাজাতে পারিস তুই কাঞ্চনা। চিরএয়োতি হয়ে বেঁচে থাকো মা। তোমার স্বামীকে ফিরে পাও। আমি আসি, তোমরা তাহলে ফুলশয্যার ব্যবস্থা করো।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
তোমার নাম কাঞ্চনা? কী মিষ্টি নাম। যেমন দেহের কাঞ্চন বর্ণ তেমনই নাম। আর গুণ –
কাঞ্চনা :
কোনো গুণ নাই তার কপালে আগুন।
কয়েকটি তরুণী :
মাগো! পান সাজতে সাজতে হাত আমাদের চুনে খেয়ে ফেললে। কাঞ্চনা বেচারি একা – ওলো দেখে যা, কী সুন্দর সুন্দর ফুলের গয়না দিয়ে কাঞ্চনা বউকে সাজিয়েছে। আহা! যেন দুগ্‌গো পিত্‌তিমে।
দুই-তিনজন :
চমৎকার!
একজন :
কাঞ্চনা আর জন্মে বৈকুণ্ঠের মালিনী ছিলি ভাই!
অন্য একজন :
কাঞ্চনা দিদি! মা মাসিমা কেউ নেই, এইবেলা এই ফুলসাজের একটা গান গেয়ে শোনা না ভাই! নতুন বউ জানুক যে তুই শুধু মালিনী নস – গানে – কী বলব ভাই? নাচেতে উর্বশী – গানে – গানে –
অন্য একজন মেয়ে :
সরস্বতী। নে ভাই, এইবেলা টুক করে গেয়ে নে, নইলে ভিড় জমলে তুইও গাইবিনে, আমরাও শুনতে পাব না।

(কাঞ্চনার গান)
মুকুল-বয়সি কিশোরী সেজেছে ফুল্ল ফুল-মুকুলে।
শিরে কৃষ্ণচূড়ার মুকুট, গলে মালতীর মালা দুলে॥
যুথী ফুলের সিঁথি-মোর, দোলন-চাঁপার দুল
কটিতটে চন্দ্রহার হলুদ-গাঁদার ফুল
অশোক-কুঁড়ির রাঙা নূপুর রাঙা চরণ-মূলে॥
কদম-ফুলের রত্ন-বাজু বকুল ফুলের চুড়ি
হাতে শোভে কেয়ূর কাঁকর কুন্দ বেলের কুঁড়ি।
আসবে কবে বনমালী ঘুমে ফুল-বালা পড়ে ঢুলে॥

চতুর্থ দৃশ্য
শচীমাতা :
নিমাই! এ ঘর ও ঘর করে কী খুঁজছিস বাবা?
নিমাই :
(আমতা আমতা করিয়া) কী যেন খুঁজছিলাম মা, খুঁজতে খুঁজতে ভুলে গেছি।
শচীমাতা :
(হাসিয়া) তুই থির হয়ে বস দেখি। আমি বউমাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। (যাইতে যাইতে) বউমা! নিমাইকে পান দিয়ে এসো তো মা।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
ছি ছি ছি ছি! মা কী মনে করছেন বলো তো। পড়াতে পড়াতে পাঁচ বার তো পান চাইতে বাড়িতে এলে।
নিমাই :
এবার কিন্তু পান চাইতে আসিনি । পড়াতে বসে কীসের যেন সূত্র ভুলে গেলাম–তাই একটা বই খুঁজতে এলাম॥
বিষ্ণুপ্রিয়া :
তুমি ভারী দুষ্টু! তুমি কখ্‍খনো বই খুঁজতে আসনি। আমি জানি তুমি কী খুঁজতে এসেছ।
নিমাই :
বউ খুঁজতে, – লক্ষ্মী?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
আচ্ছা, তুমি আমায় আমার সতিনের নাম ধরে ডাক কেন বলো তো? লক্ষ্মী তো তোমার প্রথম স্ত্রীর নাম ছিল। তুমি দিদি কে খুব ভালোবাসতে, না?
নিমাই :
খুব ভালোবাসলে সে কি ছেড়ে যেতে পারত? তাই এবার বিয়ে করে তোমাকে নিয়ে আবার খুব ভালোবাসার সাধনা আরম্ভ করেছি।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
যাও! সত্যি বলো না, কেন আমায় যখন তখন ওই বলে ডাক ?
নিমাই :
যিনি লক্ষ্মী তিনিই বিষ্ণুপ্রিয়া, যে বিষ্ণুপ্রিয়া সে-ই লক্ষ্মী। আচ্ছা, এবার থেকে তোমায় প্রিয়া বলে ডাকব, তাহলে খুশি হবে তো?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
তোমার পায়ে পড়ি, ওতে আমার আরও লজ্জা করবে, তার চেয়ে তুমি বরং লক্ষ্মীই বোলো।
নিমাই :
আরে, আমি কি পাড়ার লোক ডেকে সভা করে, তোমায় প্রিয়া বলে ডাকব? এই আড়ালে আড়ালে –দুজনে যখন এমনি একা থাকব, তখন। আমি অনেক দিন থেকে ভাবছি তোমায় একটা কথা জিজ্ঞাসা করব প্রিয়া, তুমি সত্য করে বলবে?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
ও কী কথা বলছ তুমি। তুমি যে স্বামী, নারায়ণ, তোমার কাছে মিথ্যা বললে যে আমার মরলেও স্থান হবে না।
নিমাই :
আমি দোজবরে বলে কি তোমার মনে কোনোরূপ দুঃখ আছে?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
(অশ্রু ছল ছল কণ্ঠে) তোমার পায়ে পড়ি, তুমি অমন কথা বোলো না, ও-কথা শুনলেও পাপ হয়। আমি তোমার এই পা ছুঁয়ে বলছি–তোমার মুখে শোনবার আগে ও-কথা আমার স্বপ্নেও মনে হয়নি। তুমি কেন এ কথা বললে বলো! ও-কথা মনে আসবার আগে যেন আমার মরণ হয় – মরণ হয় –
নিমাই :
ওকী! এই সামান্য কথায় এমন করে কাঁদতে আছে? তুমি এত কষ্ট পাবে জানলে আমি কখনই এ-কথা বলতাম না। আমি এমনি রহস্য করে বললাম মাত্র, আর অমনি মানিনীর মানে আঘাত লাগল। আচ্ছা,আর একটি কথার উত্তর দাও দেখি। বিয়ের আগে তুমি আমায় ভালোবেসেছিলে?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
যাও! কে তোমাকে এ কথা বললে? তুমি সকলের অন্তর্যামী কিনা।
নিমাই :
নিশ্চয়ই। আমি যখন স্বামী অর্থাৎ কিনা নারায়ণ, কাজেই অন্তর্যামীও। নইলে তোমার অন্তরের কথা কী করে জানলাম?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
তুমি কিছু জান না। জানলে বিয়ের আগে অমন করে কাঁদতে না।
নিমাই :
ও! তোমার সঙ্গে বিয়ের আগে একবার সম্বন্ধ ভাঙে ভাঙে হয়েছিল, সেই কথা বলছ বুঝি? তাতে কিন্তু আমার কোনো দোষ ছিল না। আমাকে না জানিয়েই মা কাশী মিশ্রকে পাঠিয়ে ছিলেন সম্বন্ধ ঠিক করতে। তাই তোমাদের গণক ঠাকুরকে বলেছিলাম, আমি বিয়ের কিছু জানিনে। কিন্তু তারপর আমি তো আবার লুকিয়ে লোক পাঠিয়েছিলাম বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করতে।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
সে তোমার দয়া। সবাই বলে, তুমি করুণাময়। নইলে আমার কী দশা হত তাই ভাবি।
নিমাই :
তাহলে তোমারও দশা পাবার অবস্থা হয়েছিল বলো। তাই তো বলি, রোজ রোজ গঙ্গার ঘাটে আমার মাকে তোমার এত ঘটা করে প্রণাম করার মানে কী। আর দিনে দশবার করে গঙ্গার ঘাটে আসারই বা হেতু কী?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
তুমি পণ্ডিত মানুষ, ন্যায়শাস্ত্রবিদ, তাই ধোঁয়া দেখলেই সেখানে আগুনের সন্দেহ কর। আমার বয়ে গেছিল তোমাকে দেখতে যাবার জন্য। আমি যেতুম মাকে দেখতে।
নিমাই :
কিন্তু মা তো থাকতেন তোমার ঘাটেই, তুমি হাঁ করে আমি যে ঘাটে সাঁতার কাটতাম সেদিকে চেয়ে থাকতে কেন?

[দূরে কাঞ্চনার গান]
সিনান করিতে গিয়েছিনু সই সেদিন গঙ্গাতটে।
উদয় হলেন গৌরচন্দ্র অমনি হৃদয় পটে॥
নির্মল মোর মনের আকাশে
উঠিয়া সে চাঁদ মৃদু হাসে,
তারে লুকাইতে নারি, সখী ভয়ে মরি, বুঝি কলঙ্ক রটে॥

নিমাই :
(এক লাইন গানের পর) আমি পালালুম কিন্তু। তোমার মুখরা সখীকে আমার বড়ো ভয়। ও কোন দিন আমাকে ধরিয়ে দেবে দেখছি।
[প্রস্থান]

পঞ্চম দৃশ্য
কাঞ্চনা :
পণ্ডিতমশাই ভয়ে পালিয়ে গেলেন বুঝি?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
কার ভয়ে কাঞ্চনা?
কাঞ্চনা :
ধরা পড়ার ভয়ে।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
দূর পোড়ামুখী! আচ্ছা ভাই কাঞ্চনা, তুই যখন তখন ওকে কঠিন কথা শুনাস, তোর ভয় করে না?
কাঞ্চনা :
একটুকুও না। ওই দুরন্ত পণ্ডিত মশাইটি চিরকাল আমার কাছে জব্দ। ছেলেবেলায় ওর ভয়ে আর সব মেয়ে অস্থির থাকত, কিন্তু আমায় দেখলেই উনি একেবারে কেচোঁটি হয়ে যেতেন। আমি বলতাম, তোমাদের সকলের সঙ্গে আড়ি, আর আমার সঙ্গে ভাব কেন? উনি বলতেন – ভক্তিকে ভগবান বড়ো ভয় করেন।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
আচ্ছা, ভয় না হয় নাই করলি, পর-পুরুষ বলে লজ্জাও হয় না?
কাঞ্চনা :
ওঁর সঙ্গে আমার এই ভাব তো লুকানো ছাপানো নয় ভাই গৌর-প্রিয়া, সারা নদিয়ার লোক জানে ওঁর-আমার এই প্রীতি। আমি এই পাড়ারই মেয়ে। ছেলেবেলা থেকে ওঁকে দেখেছি, আজন্ম ওঁর সঙ্গে খেলেছি – আর আমাদের সে খেলায় লজ্জার কিছু ছিল না। তা ছাড়া ওঁকে আমার কখনও পর-পুরুষ বলে মনে হয় না, যখনই দেখেছি মনে হয়েছে উনি আমার পরম পুরুষ।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
কাঞ্চনা, তোর মতো প্রেম যদি পেতাম –
কাঞ্চনা :
তাহলে ওঁর টোল এতদিন উঠিয়ে দিতে, আর রাতদিন উনি তোমারই পাঠশালায় প্রেমের পাঠ নিতেন, এই তো?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
যাঃ! তোর সঙ্গে কথায় সরস্বতীও হার মেনে যায়–
কাঞ্চনা :
আর তোমার গুণে যে লক্ষ্মী স্বর্গে পালালেন।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
তুই আমাকে সতিনের কথা মনে করিয়ে দিস কেন বল তো? আচ্ছা ভাই, দিদি খুব সুন্দরী ছিলেন, না? আর তোর সঙ্গে ওঁর বুঝি আমার চেয়েও বেশি ভাব ছিল?
কাঞ্চনা :
হ্যাঁ, সুন্দরী খুবই ছিলেন, তবে তোমার মতো না। ওঁর রূপে চাঁদের জ্যোতির চেয়ে সূর্যের তেজ বেশি ছিল। আর ভাব আমার এতটুকু ছিল না ওঁর সঙ্গে। যখন তখন ওঁর সঙ্গে ঝগড়া করতাম আর বলতাম – ঠাকরুন তুমি বৈকুণ্ঠের অধীশ্বরী। আমাদের ব্রজেশ্বরীর আসবার সময় হল, এবার তুমি সরে পড়ো না। এ রসের ব্রজে ব্রজেশ্বরী আর গোপিনিদের লীলা তুমি সইতে পারবে না। ঠাকরুন ভালো মানুষ, এই সব শুনে এবং বুঝে স্বর্গে চলে গেলেন।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
কাঞ্চনা, কেন তুই ওঁর কথা এলেই ওঁকে ভগবান ভেবে কথা বলিস বল তো? তোর কথা শুনে আমার বড়ো ভয় হয়, সই। উনি যদি সত্যি সত্যিই ভগবান হয়ে যান তাহলে আমার কী অবস্থা হবে? আমি কোথায় দাঁড়াব? এক একবার আমারও মনে হয় উনি ছল করে মানুষ সেজে এসেছেন। ওঁর চোখ মুখ রূপ গুণ সব যেন বলে দেয়, আমি কারুরই নই – আমি একা।
কাঞ্চনা :
সত্যিই উনি পরম একাকী। আমাদের নিয়ে যে ওঁর এই লীলা এ ওঁর অসীম দয়া। তোমার কেন ভয় হয় গৌর-প্রিয়া জানি না, আমার কিন্তু ভয় হয় না। না, না, ভয় হয় বলেই তুমি ব্রজেশ্বরী, গৌরবক্ষ-বিলাসিনী। তুমি যে প্রেমময়ী তাই মধুর রূপ ছাড়া তাঁর অন্য রূপের কল্পনাও করতে পার না। আমরা সাধারণ মানুষ, – তাই দেবতাকে প্রিয়রূপে ভাবতে পারি না।
নিমাই :
যাক। আমি আর পণ্ডশ্রম করে মরি কেন, কাল থেকে টোলের ছাত্রদের বলে দেব, এই ঘরেই তারা ভাগবতের পাঠ নেবে।
কাঞ্চনা :
(চিৎকার করিয়া) মা দেখে যাও, আবার আমাদের জ্বালাতন করছে। তোমার ছেলেকে সামলাও, নইলে ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।
শচীমাতা :
নিমাই! আবার কেন ওদের সঙ্গে লাগতে গেলে বাবা? ওরা দুটিতে আপনার মনে আলাপ করছে –
নিমাই :
আলাপ নয় মা প্রলাপ, একবার শুনে যাও না এসে।
শচীমাতা :
তা ওরা যা ইচ্ছা বকুক, তোর তাতে কাজ কী বাপু? আমি তখন থেকে কলা আর দুধ নিয়ে বসে আছি – আয় খেয়ে নে।
কাঞ্চনা :
মা, দুধকলা খাইয়ে ওঁকে পুষছ – বুঝবে যখন দংশন করে চলে যাবে।
[ বলিতে বলিতে প্রস্থান।]

ষষ্ঠ দৃশ্য
শচীমাতা :
বউমা! একী মা লক্ষ্মী। বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাঁদছ? ছি মা! কাঁদতে নেই, নিমাই-এর আমার অমঙ্গল হবে। এইমাত্র খবর পেলুম, নিমাই কাল গয়া থেকে ফিরে আসবে। পাগলি মেয়ে, বললাম দুদিন মায়ের কাছে গিয়ে থেকে এসো, তবু খানিকটা মন ভালো থাকবে। তা আমায় ছেড়ে যেতে চাইল না।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
মা, উনি যে যাবার সময় তোমার কাছে থেকে তোমার সেবা করতে বলে গেছেন। আর, তোমাকে মা পেয়ে আর কেউ যে আমার মা ছিল, তা ভুলেই গেছি।
শচীমাতা :
ও-কথা বলিসনে মা। আমার বেয়ান শুনতে পেলে আমায় ডাইনি বলবে। – এই কাঞ্চনা আসছে – তোমরা দুটি সখীতে বসে গল্প করো – হ্যাঁ মা, আর ওকেও বলো যে আমার নিমাই কাল ফিরে আসবে – আমি যাই – মালিনী সইকে, সর্বজয়াকে জানিয়ে আসি খবরটা।

[কাঞ্চনার গান]
প্রথম যৌবনে এই প্রথম বিরহ গো।
(তাই) সহিতে না পেরে রাই, কাঁদে অহরহ গো।
(ফুল) শয্যারে মনে হয় কন্টক শয্যা
কাঁদিতে পারে না, যত ব্যথা তত লজ্জা,
প্রবাসী বঁধুরে ঘরে আসিতে কহো গো॥

বিষ্ণুপ্রিয়া :
কাঞ্চনা সই, তোর গান এখন রাখ। শোন, মা বলে গেলেন, উনি কাল আসবেন।
কাঞ্চনা :
(সুরে) কাল কাল করে গেল কতকাল
কালের নাহিকো শেষ –
কাল নাই যথা বন্ধুরে লয়ে
যাব আমি সেই দেশ।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
সত্যি বলছি, মা এইমাত্র ছোটো মাসিকে খবর দিতে গেলেন। মা-র সে কী খুশি ভাই, যত হাসেন তত কাঁদেন।
কাঞ্চনা :
আমার কিন্তু না-আসা পর্যন্ত বিশ্বাস হয় না, ভাই। যদি আসেন তাহলে বুঝব এবার নবদ্বীপে এসে ঠাকুর ভদ্রলোক হয়েছেন। ভদ্রলোকের যে কথা রেখে চলতে হয় এ জ্ঞান তো ওঁর ব্রজে ছিল না, আর ও-জ্ঞান হবেই বা কোত্থেকে! গয়লা ছোঁড়াদের সঙ্গে গোরু চরিয়ে কে কবে ভদ্রলোক হয়েছে?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
না ভাই লক্ষ্মীটি, ঠাট্টা রাখ। এখন কী করব বল দেখি? আমার বুকের ভিতর যেন কেমন করছে, শরীর কাঁপছে।
কাঞ্চনা :
করবে আর কী। এসো, দুই সখীতে গলা ধরে ধেই ধেই করে নাচি। এতদিন যে বিরহ আমাদের কাঁদিয়েছে, সেই বিরহের বুকে বসে তার দাড়ি উপড়াই।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
তোর কথা আমার কিছু ভালো লাগছে না, কাঞ্চনা। কাল যদি ভোর না হতেই এসে পড়েন, তখন ফুল পাব কোথা। এখনও সন্ধ্যা লাগেনি, তুই পাড়ায় গিয়ে কার বাড়িতে কী ফুল পাওয়া যায়, দেখ না লক্ষ্মীটি।
কাঞ্চনা :
আচ্ছা, আমি চললাম। আমি কিন্তু বেছে বেছে সেই ফুল আনব, যে ফুলে কাঁটা আছে। (প্রস্থান)
শচীমাতা :
এই ঘরে বেয়ান, এই ঘরে তোমার মেয়ে। সর্বজয়া, মালিনী সই, তোমরাও এসো বউমার ঘরে – বউমা, বউমা, দেখো আমার দুই বেয়ানকে, তোমার মাকে, খুড়িমাকে ধরে এনেছি।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
একী! মা! খুড়িমা!
মহামায়া :
আহা! মা আমার এই কদিনে কী রকম শুকিয়ে গেছে, দেখেছিস বিধু।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
আমার কোলে বসে থাকতে লজ্জা করচে মা, নীচে নেমে বসি।
মহামায়া :
ওরে তোর কোলে ভগবান যদি সন্তান দেন, তখন বুঝবি সন্তানকে কোলে নিয়ে মায়ের কত সুখ।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
আমি বুঝি এখনও খুকি আছি? ওই দেখো ছোটো মাসিমা, রাঙা মাসিমা আসছেন এ-ঘরে।
শচীমাতা :
ওতে লজ্জার কী আছে বউমা? নিমাই যেদিন বিয়ে করে প্রথম তোমায় নিয়ে এল ঘরে, আমিই যে সেদিন লজ্জার মাথা খেয়ে অত লোকের মাঝে তোমায় কোলে নিয়ে নেচেছিলাম। বউমা, এই যে, তোমার মাসিমারা এসেছেন, প্রণাম করে ওঁদের পান এনে দাও।
সর্বজয়া, মালিনী :
(একজনের পরে অন্যজনে) থাক থাক মা, বেঁচে থাকো চির-এয়োতি হয়ে।
যাদব :
দিদি! দিদি! কাল জামাইবাবু আসছেন। আমাকে যাবার সময় বলে গেছিলেন, তোমার জন্য লাল শাড়ি আনবেন।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
(চুপে চুপে) আঃ! যাদব, চুপ কর।
নিমাই :
মা! মা! আমি এসেছি – আর তোমার জন্য গয়া থেকে এনেছি কৃষ্ণপ্রেম।

সপ্তম দৃশ্য
(তাহার পরদিন দুপুরবেলা)

শচীমাতা :
নিমাই! তোর কী হয়েছে বাবা? গয়া থেকে পিতৃতর্পণ করে এসে কেবলই কাঁদছিস। এই দুপুর পর্যন্ত বউমা কতবার এসে ঘুরে গেল, একবার তাকে ডেকে দুটো কথাও বললিনে? তোর চোখের জলে যে ঘর উঠোন কাদা হয়ে উঠল, বাপ।
নিমাই :
(অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে) মা, গয়া থেকে এসে আমার আর কিছু ভালো লাগছে না।
শচীমাতা :
কেন বাবা, কী জন্য কিছু ভালো লাগছে না? নদিয়ার শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত বলে তোর খ্যাতি, সহস্র পড়ুয়া তোর ছাত্র, কন্দর্পের মতন রূপ, বৈকুণ্ঠের লক্ষ্মীর মতো আমার বউমা, তোর আবার দুঃখ কিসের, বাবা? আমি কত আশা করে বসেছিলাম, গয়ার কত গল্প শুনাবি এসে। কিন্তু এসে অবধি কেবলই অঝোর নয়নে কাঁদছিস। ভগবান আমাকে চিরদিন দুঃখ দিলেন। পর পর সাত মেয়ে মারা যাবার পর তোর দাদা বিশ্বরূপ এল আমার কোলে। কিশোর বয়সে সে আমাকে কাঁদিয়ে সন্ন্যাসী হয়ে চলে গেল, তারপর তোর বাবা স্বর্গে গেলেন। তুই ছাড়া এখন যে আর আমার কেউ নেই, মানিক। তোকে পেয়েই আমার সকল দুঃখ ভুলে ছিলাম। তুই যদি সুখী না হোস, তা হলে আমার আর এ জীবনে কাজ কী!
নিমাই :
কী করব, মা, আমি যে আর কিছুতেই অশ্রু সংবরণ করতে পারছিনে। আমি কেবলই দেখছি নব-জলধর শ্যাম সুন্দরকান্তি পরম মনোহর এক কিশোর কেবলই বাঁশি বাজিয়ে বাজিয়ে আমায় ডাকছে। গয়া থেকে ফেরার পথে কানাই নাটশালা গ্রামে প্রথম দেখি সেই দুরন্ত কিশোরকে বাঁশিতে তার সে কী অশান্ত আহ্বান, মা, তা না শুনলে বোঝাতে পারব না। সে বাঁশি বাজাতে বাজাতে চলে গেল বৃন্দাবনের পথে। আমিও ছুটলাম, কিন্তু পারলাম না তার সাথে যেতে – আমায় সকলে ধরে নিয়ে এল নদীয়ায়। মা, তুমি এখন যাও, বাইরে মুরারি গুপ্ত বসে আছেন, আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করে আসছি।

অষ্টম দৃশ্য
(নিমাই-এর বহির্বাটী)

নিমাই :
মুরারি, আমাকে চিনতে পারছ?
মুরারি :
তোমাকে চিনেছি যখন তুমি তোমাকে চেননি তখন থেকে। তোমার মনে নেই? তখন আমি যোগবাশিষ্ট পড়ি। রাস্তায় সহপাঠীদের সাথে ঈশ্বরে বিশ্বাসীদের ঘোর নিন্দা করতে করতে চলেছি, এমন সময় তুমি ভীষণ বিদ্রুপের হাসি হেসে উঠলে। তখন তোমার বয়স পাঁচ বৎসরের বেশি হবে না।
নিমাই :
হ্যাঁ, তারপর? আমার কিন্তু বিন্দু-বিসর্গ মনে নেই।
মুরারি :
এইরূপে, বারবার তুমি মুখ ভেঙচে আমাকে বিদ্রুপ করায় আমি রেগে গিয়েছিলাম, জগন্নাথ মিশ্রের ঘরে এক অকাল-কুষ্মান্ড জন্মগ্রহণ করেছে। তাই শুনে তুমি যেন বললে, আচ্ছা এর শাস্তি পাবে। তারপর (মুরারি অভিভূতের মতো বলিতে লাগিলেন) দুপুরে যখন খেতে বসেছি তখন শঙ্খধ্বনির মতো কার কণ্ঠস্বর ভেসে এল ‘মুরারি’! আমি চমকিত হয়ে চেয়ে দেখি, তুমি গৌরসুন্দর নবনটবর শিশুরূপে আমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে।
নিমাই :
তুমি ভক্তলোক, তাই ভক্তিবলে অন্য কাউকে দেখেছ। যাক, বলো।
মুরারি :
তুমি আরক্ত নয়নে আমার পানে চেয়ে বললে, ভগবানকে ভক্তি ছাড়া শুষ্ক জ্ঞানচর্চায় যারা পেতে চায়, আমি তাদের থালায় প্রস্রাব করি। বলে আমার থালে প্রস্রাব করে কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে। তারপর তোমায় দেখি শ্রীগঙ্গাধর পণ্ডিতের টোলে। সেখানে আমায় কেবল সিলেটি-বাঙাল বলে খ্যাপাতে। তোমার যন্ত্রণায় যখন আমি টোল ছাড়ব ছাড়ব করছি, তখন একদিন তর্কের ছলে আমার অঙ্গে শ্রীহস্ত বুলালে, আর অমনি আমার সকল প্রাণ মন তোমার পায়ে যেন লুটিয়ে পড়ল।
নিমাই :
আজ কি মনে করে এসেছ?
মুরারী :
তুমি ডেকেছ, নইলে তোমার সান্নিধ্য লাভ করতে পারে এমন ক্ষমতা কার আছে? আজ ভোরে স্বপ্ন দেখছিলাম, তুমি এসে আমায় ডাকছ– ‘মুরারি। তুমি আমায় যে রূপে দেখতে চেয়েছিলে, আজ সেই মহাপ্রকাশের উদয়-উষা দেখবে, এসো।’ আজ এসে তোমার কান্না-অরুণ চোখে সেই উদয়-উষার জবাকুসুমসঙ্কাশ দ্যুতি দেখলাম। তুমি নিজে ধরা না দিলে তোমায় ধরবে কে? তুমি নিজে দেখা না দিলে তোমায় দেখতে পাবে কার সাধ্য?
নিমাই :
মুরারি! শুনছ! কে বাঁশি বাজায়, ওই–ওই–দেখেছ–ওই মূর্তিই আমি দেখেছিলাম গয়া থেকে ফেরার পথে –

(সুরে)
নব কিশলয়-শ্যামল তনু ঢল ঢল অভিরাম
অপরূপ রূপ-মাধুরী হেরিয়া মুরছিত কোটি কাম।
গলে বনমালা শিরে শিখী-পাখা
পীতধড়া-পরা ত্রিভঙ্গ বাঁকা
বাজায় মুরলী রাধা রাধা বলি
নওল কিশোর শ্যাম॥

নিমাই :
ওই পালিয়ে যায় – মুরারি – মুরারি ধরো ওই চঞ্চলকে – ধরো ওই কৃষ্ণকে – কৃষ্ণ–কৃষ্ণ। (মূর্ছা)
মুরারি :
ঈশান! ঈশান! শিগগির জল আন, প্রভু মূর্ছা গেছেন।

নবম দৃশ্য
(বিষ্ণুপ্রিয়ার কক্ষ)

ঈশান :
দিদিলক্ষ্মী! বলি এমনি করে পড়ে পড়ে কাঁদলে কি এর কিনারা হবে? না, দাঠাউরকেও ঘরে বেঁধে রাখা যাবে? এই শালার পাঁচ ভূতে মিলে আমার সোনার ঠাকুরকে পাগল করে নাচিয়ে নিয়ে ফিরছে। দিদিলক্ষ্মী, যদি এজ্ঞে কর, তাহলে ওই বুড়ো ঈশানই ওই ভূতের বাপের ছেরাদ্দ করে ছাড়বে। যতসব আবাগের বেটা ভূত – এমন সোনার সংসার ছারেখারে দিলে গা!
বিষ্ণুপ্রিয়া :
ঈশান, কারুর দোষ নয়। দোষ আমার অদৃষ্টের। আমার ওঁকে ধরে রাখার ক্ষমতা নেই বলেই ওঁকে সংসারে রাখতে পারলাম না।
ঈশান :
বলি, তোমার ক্ষমতাটা কীসে কম হল, দিদিলক্ষ্মী ? থাকত আমার গিন্নি বেঁচে, তাহলে তোমায় এমন বুদ্ধি বাতলে দিয়ে যেত যে, দাঠাউর আর একদণ্ড তোমায় ছেড়ে যেতে পারত না।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
দিদিমা বশীকরণ-মন্ত্র জানতেন নাকি ঈশানদা?
ঈশান :
মেয়েদের আবার মন্তর-ফন্তর লাগে নাকি, দিদিলক্ষ্মী, ভগবান তোমাদের সবচেয়ে বড়ো তুক দিয়েছেন, মান আর চোখের জল। এই দুই তুকের জোরে ভগবান পর্যন্ত কাবু, তা ঠাউর তো কোন ছার! যৈবনকালে আমি একবার রাগের মাথায় বাড়ি ছেড়ে দুদিনের জন্য পেলিয়েছিলাম, আর তাই পাড়ার লোকে রটিয়ে দিলে আমি সন্ন্যেসী হয়ে গিয়েছি। তারপর দিদিলক্ষ্মী, রাগ পড়লে বাড়ি যখন ফিরলাম, তখন সে যা কুরুক্ষেত্রকাণ্ড বাধল তা কইবার নয়। বেড়ালের লড়ুই দেখেছ?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
দিদিমা কি আঁচড়াতে কামড়াতে পারতেন?
ঈশান :
তারও বাড়া দিদিলক্ষ্মী, তারও বাড়া। চুল ছিঁড়ে, কাপড় ছিঁড়ে, কেঁদে কেটে, মাথা কুটে – বলি তাতেও কি রাগ থামে – শেষে দিদিলক্ষ্মী আমায় ধরে দে ধনাদ্ধন দে ধনাদ্ধন।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
বল কী ঈশানদা, দিদিমণি তোমায় মারতে লাগল? সোয়ামির গায়ে হাত তুললে?
ঈশান :
আরে দিদিলক্ষ্মী, উনাকে যে তখন ভূতে পেয়েছিল। উনার কি তখন জ্ঞানগম্মি ছিল? আর ও-বয়সে পরিবারের মার কি গায়ে লাগে? আমার মনে হতে লাগল যেন পুষ্পবিষ্টি হচ্ছে।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
তুমি এইরকম পুরুষমানুষ, ঈশান দা? তোমায় ধরে মারলে আর তুমি চুপ করে সয়ে গেলে?
ঈশান :
দিদিলক্ষ্মী, কইলে পাপ হয়, নইলে দাঠাউরকে দু-একটা ঠোনাঠুনি দিয়ে দেখ দেখি ওঁর কেমন মিষ্টি লাগে। এই আশিটা বছর বয়স হল, তবু সেদিনের কথা মনে হলে সুখে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। আমি বলি কী দিদিলক্ষ্মী, চোখের জলের অনুপান দিয়ে ওই ওষুধ অল্প মাত্রায় একটু দিয়ে দেখবে নাকি?
নিমাই :
কী ঈশান? কোন ওষুধের কথা বলছ? মাথায় তো মধ্যমনারায়ণ তেল মাখতে শুরু করেছ, এখন বাকি হাতে-পায়ে শিকল-বেড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা, তারই পরামর্শ আঁটছ বুঝি?
ঈশান :
এজ্ঞে, দাঠাউর! আমি দিদিলক্ষ্মীকে বলছিলাম, মধ্যমনারায়ণ তেল মাথায় না দিয়ে তোমার সঙ্গী ওই উনাদের মাথায় দিলে কাজ দিত। কী করি, বৈষ্ণব মানুষ, দিদিলক্ষ্মীও গো-বেচারি মুখচোরা মানুষ, নইলে ভূত তাড়াবার ওষুধ আমার কিছু জানা ছিল।
নিমাই :
কী ঈশানদা! ওঁরা ভক্ত লোক, ওঁদের নিন্দা করলে পাপ হয়।
ঈশান :
দাঠাউর! তোমায় তেনারা নারায়ণ বলেন, ভগবান বলেন। কিন্তু ভগবানের কি এই বিচার হল? আমি ছেলেবেলা থেকে তোমায় কোলেপিঠে নিয়ে মানুষ করলুম, তোমায় একদণ্ড না দেখলে আমার মনে হত যেন আকাশের সুয্যি নিভে গেছে। – যাক, আমার কথা না হয় বাদই দিলাম, তোমার অমন দয়াময়ী দুঃখিনী মা, এই বৈকুন্ঠের লক্ষ্মীর মতো বউ – এনারা তোমার কেউ নয়? আমরা ছাড়া বিশ্ব-সংসারের আর সবাই হল তোমার আপনার জন?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
ছিঃ ঈশানদা, ওঁকে অমন করে বোলো না। উনি যাতে সুখী হন – আমার তাতেই সুখ।
ঈশান :
তুমি থামো দিদিলক্ষ্মী, আমি জন্মে থেকে এ বাড়ির চাকর, দাঠাউর তো দুধের ছেলে, ওঁর বাবা-মা পর্যন্ত কেউ আমাকে একদিনের জন্য একটা কথা বলতে পারেনি। আজ যদি রেগে দাঠাউর আমায় তাড়িয়ে দেয় –
নিমাই :
ওকী কথা বলছ ঈশান দা! তোমার পায়ের ধুলো পেলেও যে সে পরম ভক্ত হয়ে উঠবে – আমি তোমায় তাড়িয়ে দেব? তোমার পায়ে পড়ি, তুমি অমন কথা বোলো না –।
ঈশান :
হরেকিষ্ট! হরেকিষ্ট! দা ঠাউর, একী করলে তুমি? আমার পা ছুঁলে! কোটি জন্মেও যে আমার এ পাপের ক্ষয় হবে না। চিরটাকাল তুমি তোমার ধুলোমাখা পা নিয়ে আমার বুকে খেলা করেছ – ওই রাঙা পায়ের ধুলো পেয়ে চোখের জলে বুক ভেসে গেছে – হায় হরি – আজ তুমি এ কী করলে? যাই, দৌড়ে গঙ্গায় ডুব দিয়ে আসি।

(যাইতে যাইতে) হরেকিষ্ট, হরেকিষ্ট!

দশম দৃশ্য
(নিমাই-এর ভবন)

[একজন ভিখারি দ্বারে দাঁড়াইয়া গান করিতেছে –]

বিদায় দে মা, একবার দেখে আসি
(যে)
বৃন্দাবনে রাখাল সনে কালো শশী বাজায় বাঁশি॥

সারাদিনের কাজের মাঝে

দেখি যে সেই রাখাল-রাজে
(ওমা)
বাজে শুনি নিশীথ রাতে তারই বাঁশি মন-উদাসী॥

শচীমাতা :
বাবা, তোমার পায়ে পড়ি, আমার বাড়িতে এসে রোজ রোজ ওই গান গেয়ো না। তোমার যদি অন্য গান জানা না থাকে, তোমায় গান করতে হবে না, এমনি ভিক্ষা পাবে।
ভিখারি :
মা গো! শ্রীকৃষ্ণ জানেন, আমি ইচ্ছা করে এ গান গাই না তোমার বাড়িতে। তোমার বাড়ির দোরে এলেই আমার দু-চোখ দিয়ে জল পড়তে থাকে। কে যেন জোর করে আমায় এই গান গাওয়ায়।
ঈশান :
দেখো বাবাজি বৈষ্ণব, অপরাধ হয় হবে, কিন্তু ফের যদি এসে ওই গান গাও, আমি তোমার গাবগুবাগুব ভেঙে, ঝোলা ছিঁড়ে, টিকি উপড়ে, ন্যাড়া মাথায় ঘোল ঢেলে ছাড়ব। ত্রিসংসারের লোক কি জোট পাকিয়েছে এই সোনার সংসার ছারেখারে দেওয়ার তরে? একে মনসা, তায় ধুনোর গন্ধ। এমনেই দাঠাউরের মুখে ঘর ছাড়ব রব লেগেই আছে – তার ওপর –
বিষ্ণুপ্রিয়া :
ঈশান দা!
ঈশান :
রও দিদিলক্ষ্মী। তুমি চোখ রাঙিয়ো না, এ বাড়িতে আমি বেহ্মা বিষ্ণুকে ভয় করি না। এই সোনার সংসারে আগুন লাগাবার জন্য যত হনুমান লেগে পড়েছে। সব হনুমানের আমি ল্যাজ কাটব তবে আমার নাম ঈশান।
নিমাই :
মা! মা! আমার দাদা ফিরে এসেছেন। এই দেখো, আমার দাদা বিশ্বরূপ।
শচীমাতা :
নিমু! কী বললি! আমার বিশ্বরূপ ফিরে এসেছে? এই কি আমার বিশ্বরূপ, আমার হারানো মানিক?
নিত্যানন্দ :
হ্যাঁ মা, আমিই তোমার বিশ্বরূপ। মন্দ লোকে আমায় মাতাল অবধূত বলে, আর দুষ্ট লোকে বলে নিত্যানন্দ।
শচীমাতা :
যে যা বলে বলুক তুই-ই আমার বিশ্বরূপ, আয় বাপ আমার কোলে আয়। ওরে! এত সুখ কি আমার সইবে? নারায়ণ! নারায়ণ!
নিমাই :
দেখলে মা, আমি গয়ায় না গেলে কি দাদা আসতেন, না তুমিই বিশ্বরূপ দেখতে পেতে?
শচীমাতা :
ওরে আমি বিশ্বরূপ দেখতে চাইনে। আমার কোল জুড়ে এমনি শিশু হয়ে, মানুষ হয়ে তোরা থাক, ওই আমার স্বর্গ মোক্ষ সব। যাক বাবা, আমার খ্যাপা নিমাই এত দিন অসহায় ছিল, এখন তুমিই তাকে দেখো। এতদিনে নারায়ণ আমার নিমুর জন্য দুর্ভাবনা দূর করলেন।
নিত্যানন্দ :
দোরের আড়াল থেকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছেন আর কাঁদছেন, ও মা লক্ষ্মীটি কে মা? – ও কী মা, তোমার চোখে জল কেন? তোমার লুকিয়ে থাকবার কোনো প্রয়োজন নেই, মা লক্ষ্মী। এইবার যে তোমারও প্রকাশের দিন এল। মা, এসো এসো, একবার নয়ন ভরে যুগল-মিলন দেখি।
শচীমাতা :
লজ্জা কী বউমা, এসো, এ যে আমার নিমুর দাদা, এসে প্রণাম করো।
নিত্যানন্দ :
দোহাই মা লক্ষ্মী, ওটি হতে দিচ্ছিনে। আমার পায়ের ধুলো অত সস্তা নয়। ওই পদ্মফুলের পাপড়ির মতো হাতে কি এই অবধূতের পায়ের ধূলো লাগাতে আছে। যে হাত দিয়ে নারায়ণের সেবা হয়, সেই হাতে পায়ের ধূলা! একবার নদের চাঁদের বামে গিয়ে দাঁড়াও তো মা, আমার সন্ন্যাস সার্থক হোক, জীবন ধন্য হোক দেখে। ওকী, পালালে? আচ্ছা মা লক্ষ্মী, আজ পালালে পালাও, কিন্তু যুগল-মূর্তি আমি দেখবই।
শচীমাতা :
ওমা! ছেলেকে কোলে নিয়ে বসেই আছি, খেতে যে দিতে হবে তা মনেই নেই। আয় বাপ, তোরা দু-ভাইয়ে এসে খাবি। ঈশান!
ঈশান :
(অশ্রু গদগদ কণ্ঠে) মা?
শচীমাতা :
একী বাবা ঈশান, তুমি অমন ম্লান মুখে দাঁড়িয়ে কেন? এ যে আমার বিশ্বরূপ, আমার বিশু, নিমাই ওকে ধরে এনেছে। চিনতে পারছ না? আমি দেখি গিয়ে কী আছে ঘরে।
ঈশান :
চিনেছি, মা। তবে আর কাউকে বিশ্বাস হয় না। তুমি যাও মা, আমি জায়গা করে দিচ্ছি।
নিত্যানন্দ :
ঈশানদা, আমাকে সন্দেহ হচ্ছে বুঝি?
ঈশান :
সত্যি করে বলো দেখি, তুমি কে? তুমি বিশ্বরূপ না বিষ-রূপী কেউ?
নিমাই :
ঈশানদা-র দিবারাত্রির সন্দেহ আর ভয়। এ বাড়িতে যে আসে তাকেই সে চোর বলে সন্দেহ করে।
নিত্যানন্দ :
ওর সন্দেহ ভুল নয় কানাই – থুড়ি – প্রভু, থুড়ি নিমাই। সোনার গৌরকে চুরি করার জন্যে ত্রিভুবনের চোর যে নদিয়ায় এসে জুটবে, তাতে আর সন্দেহ কী?
ঈশান :
ঠিক – ঠিক বলেছে সন্ন্যাসী ঠাউর। শুধু চোর-ডাকাত বাটপাড়-জোচ্চোরে নদিয়া ভরে উঠল – সকলের চোখ আমাদের এই সোনার গৌরাঙ্গের উপর। ডাকিনী-যোগিনী, ভূত-পেরেত, পিশাচ,যক্ষি-রক্ষি সব যেন জোট বেঁধে এসেছে। কী বলব, আমার হাতের খেঁটে লাঠি আমার হাতেই রইল, তা দিয়ে একটা মাথা ভাঙতে পারলেও আমার মনের জ্বালা কিছু কমত। যাই, খাবার জায়গাটা করে দিই গিয়ে।

নিত্যানন্দ :
(গান)
কানাইরে কই তোর চূড়া বাঁশরি!
তুই নাকি সেই নন্দদুলাল
এলি নদিয়ায় ব্রজ পাশরি?

নিমাই :
(গান)
কী পুছসি আমারে ভাই
এবার চূড়া বাঁশরি নাই।
ব্রজের খেলা বাঁশির তান
নদের খেলা হরি-গান;
ব্রজের বেশ ধড়া চূড়া, নদের বেশ কৌপীন পরা
ব্রজের খেলা রাখাল হয়ে, নদের খেলা ধূলি লয়ে।

নিত্যানন্দ :
(গানে) নদিয়াতে বিষ্ণুপ্রিয়া, ব্রজের রাই কিশোরী॥

একাদশ দৃশ্য

(নিমাই আহার করিতেছেন, শচীদেবী সম্মুখে বসিয়া–বিষ্ণুপ্রিয়া পরিবেশন করিতেছেন।)
শচীমাতা :
নিমাই, তুই খাবার অন্য দিকে চেয়ে কী ভাবিস বল তো? ভাবতে হয়, খাওয়া শেষ হলে ভাবিস।
(আড়ালে)কাঞ্চনা :
মা কি কিছু বুঝতে পারেন না সই?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
কী বুঝতে পারেন না, কাঞ্চনা?
কাঞ্চনা :
তুমি যখন পরিবেশন কর, তখন উনি খাওয়া ভুলে হাঁ করে তোমাকেই গিলতে থাকেন দুচোখ দিয়ে। এরই মধ্যে চোখের মাথা খেয়েছ? তাও দেখতে পাও না?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
যাঃ, তুই কী যে বলিস কাঞ্চনা?
কাঞ্চনা :
হ্যাঁ গো হ্যাঁ, তোমার পায়ের পাঁইজোরের শব্দ শুনলেই উনি উৎকর্ণ হয়ে ওঠেন। দেখছ না, এর মধ্যে তো একশোবার মুখের গ্রাস হাতে নিয়ে তোমাকে আড়চোখে দেখে নিলেন। মা ধমকে তাঁর এই মধুর ভাবটা নষ্ট করে দিলেন।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
পোড়ামুখী, আস্তে, মা শুনতে পাবেন।
শচীমাতা :
বাবা নিমাই, কাল রাত্রে আমি এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি।
নিমাই :
কী স্বপ্ন, মা বলো।
শচীমাতা :
তুই আর নিত্যানন্দ দুইজনে যেন পাঁচ বছরের ছেলে হয়ে হুল্লোড় করে বেড়াচ্ছিস বাড়িতে। এমন সময় দুইজন যেন ঠাকুর ঘরে ঢুকলি। তুই হাতে করে বলরাম নিয়ে বেরিয়ে এলি, আর নিত্যানন্দ বেরিয়ে এল হাতে শ্রীকৃষ্ণ নিয়ে। তারপর আমার সামনে চারজন মিলে মারামারি হুল্লোড় করতে লাগলি। বলরাম আর কৃষ্ণ যেন বলছেন, তোমরা এ ঘর থেকে বেরোও। এ ঘরের ক্ষীর ননী দই সন্দেশ এসব আমাদের। তোমরা কেন ভাগ বসাতে এসেছ এখানে? নিতাই বললে – সে কাল আর নেই ঠাকুর – যে কালে ক্ষীর ননী লুটে খেয়েছ – এখন তোমরা বেরোও – এ গোপের বাড়ি নয়, ব্রাহ্মণের বাড়ি। বলরাম বললেন, – তা হলে আমাদের দোষ নেই, আমরা কিন্তু মেরে তাড়াব তোমাদের। নিতাই বললে তোমার শ্রীকৃষ্ণকে আমার ভয় নেই। গৌরচন্দ্র বিশ্বম্ভর আমার ঈশ্বর। এই বলে চারজনে কাড়াকাড়ি করে ঠাকুরঘরের সব খাবার খেতে লাগল। কেউ কারুর মুখের, কেউ কারুর হাতের খাবার কেড়ে নিয়ে খেতে লাগল। এমন সময় নিতাই ডেকে উঠল – ‘মা, আমার বড়ো খিদে পেয়েছে, খেতে দাও, ওরা সব কেড়ে খেয়ে নিলে।’এমন সময় ঘুম ভেঙে গেল।
নিমাই :
মা, তুমি অপূর্ব স্বপ্ন দেখেছ। এ স্বপ্নের কথা কাউকে বোলো না যেন। তোমার ঘরের ঠাকুর বড়ো জাগ্রত। উনি যে প্রত্যক্ষ দেবতা সে বিশ্বাস আমার আরও দৃঢ় হল তোমার স্বপ্নের কথা শুনে। অনেকবার আমি দেখেছি, মা, ঠাকুরঘরের নৈবেদ্যের সামগ্রীর প্রায় অর্ধেক থাকে না। কে যেন খেয়ে চলে যায়। তোমার বউ-এর ওপর আমার সন্দেহ ছিল, আমি লজ্জায় এতদিন বলিনি। এখন দেখছি প্রত্যক্ষ ঠাকুরই নৈবেদ্যে খান। যাক, ঠাকুর তোমার বউমাকে বাঁচালেন, তোমার বউ-এর ওপর মিথ্যা সন্দেহ এতদিনে আমার ঘুচল।
শচীমাতা :
ওমা! নিমাই বলিস কী? আমার বউমা লক্ষ্মী, ওর অভাব কী যে, সে চুরি করে খাবে?
নিমাই :
উনি যদি লক্ষ্মীই হন মা, তাহলে তো নারায়ণের নৈবেদ্য ওঁর ভাগ আছে। যাক – নিত্যানন্দ প্রভুকে আজই নিমন্ত্রণ করে খাওয়াও, কারণ স্বপ্নে তিনি তোমার কাছে অন্নভিক্ষা করেছেন।
শচীমাতা :
হায় আমার পোড়া কপাল! ছেলেকেও নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতে হয়?
নিমাই :
সন্ন্যাসীর যে আপন ঘর থাকতে নেই, মা। তাতে তিনি ধর্মভ্রষ্ট হন। দাদা শ্রীবাস আচার্যের বাড়িতেই আছেন। ও তো আমাদের নিজেরই ঘর।
শচীমাতা :
হুঁ, মালিনী সই-এর কপাল ভালো। যাক, আমি যাই, বলে আসি পাগল ছেলেকে ওবেলা খেতে।
ঈশান :
আমি তাহলে চললাম মা আজকের মতো।
নিমাই :
কেন ঈশানদা, তুমি যাবে কেন?
ঈশান :
যাবে কেন, সে এসে তো সমস্ত ভাত ডাল বাড়িময় ছড়াবে, ন্যাংটা হয়ে নাচবে, তারপর বাকি সকড়ি নিয়ে আমার মুখে মাথায় মাখাবে। রাত্তিরে গঙ্গাচান করলে আমায় সর্দি জ্বরবিকারে ধরবে।
নিমাই :
ঈশানদা, নিত্যানন্দ প্রভু যাঁকে স্পর্শ করেন তার জ্বর বিকার চিরকালের জন্য ছেড়ে যায়। তোমার ভয় নাই।

দ্বাদশ দৃশ্য
নিমাই :
নিত্যানন্দ ঠাকুর! তোমায় বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু চুপ করে সুবোধ বালকের মতো খেয়ে দেয়ে সুড়সুড় করে ফিরে আসবে। উৎপাত কোরো না যেন।
নিত্যানন্দ :
শ্রীবিষ্ণু! শ্রীবিষ্ণু! পাগলেই চঞ্চলতা করে। তুমি নিজে পাগল কিনা, তাই সকলকেই পাগল মনে কর।
ঈশান :
এই যে মাতোয়াল ঠাকুর এসেছেন। দাঁড়াও, ছিচরণ দুটো ধুইয়ে দিই, তারপর বাড়িতে ঢোকো। (পা ধোয়াইতে ধোয়াইতে) ওই পায়ের তো আর গুণের ঘাট নেই, ত্রিভুবনের বনের ময়লা কাদা পাঁক মেখে এসেছেন। পৃথিবীতে যা কিছু নোংরা সব বুঝি তোমার ছিচরণে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। বৈতরণি পার হবার বুঝি আর কিছু পেলে না সব, এই অবধূতের চরণতরি ছাড়া?
শচীমাতা :
এই যে দুই ভায়ে এসেছ। আমি কখন থেকে পথ চেয়ে বসে আছি। বউমা, ভাত আনো।
নিতাই :
মা! এ ভাতের থালা না পর্বত? তুমি ভুল করেছ মা, আমি তো গিরি-গোবর্ধন ধারণ করিনি, আর বিশ্বম্ভরও আমি নই, বিশ্বম্ভর ওই নিমাই।
শচীমাতা :
নে এখন ফষ্টিনষ্টি রেখে খেতে বস দেখি। তুই-ই বা কীসে কম বাবা? নিমাই বিশ্বম্ভর, তুইও তো আমার বিশ্বরূপ। একী! একী! তোদের দুজনের অন্ন তিন ভাগ হল কেন? তোদের মাঝে কে ওই পঞ্চমবর্ষের দিগম্বর কৃষ্ণবর্ণ শিশু। ওই সুন্দর শিশুকেই তো কাল স্বপ্নে দেখেছিলাম। একী, কোথায় নিমাই, নিতাই কই! চতুর্ভুজ কৃষ্ণ ও শুক্লবর্ণ পরম মনোহর এক শিশু – হস্তে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম-শ্রীহল-মুষল – বক্ষে শ্রীবৎস কৌস্তুভ, কর্ণে মকরকুণ্ডল – তাদের জায়গায় বসে আহার করছে। ওই–ওই– আমার পুত্র, পুত্রের হৃদয়ে আমার বধূমাতা – বিষ্ণুবক্ষে লক্ষ্মীর মতো বিরাজ করছে। একী মায়া! একী স্বপ্ন! নারায়ণ! নারায়ণ! একী খেলা তোমার? (মূর্ছা)
নিমাই :
অবধূত ঠাকুর, মা মূর্ছা গেলেন, ধরো! ধরো!
ঈশান :
মাতোয়াল ঠাকুর, ধরা পড়েছ। ধরা পড়েছ! আমি দেখেছি আমি চিনেছি তোমাদের! একী দেখলাম – একী দেখলাম আমি! আমি এখনও বেঁচে আছি তো? আমার জ্ঞান আছে তো? ঠাকুর! দাও, দাও তোমার উচ্ছিষ্ট আমার মাথায় মাখো, মুখে মাখো। তোমার পা ধোওয়া জল আমি ফেলিনি – রেখে দিয়েছি ঘড়ায় করে, ওকি আমি ফেলতে পারি? এই – এই আমি তা সব খেয়ে ফেলব, এক ফোঁটাও কাউকে দিচ্ছিনে। (জল পান) আজ চতুর্দশলোকে আমার মতো ভাগ্যবান আর কে আছে? অমৃত – অমৃত-কলশ পেয়েছি আমি – অমৃত-কলশ। (মূর্ছা)

ত্রয়োদশ দৃশ্য
[ ভোরবেলা – কাঞ্চনা গাইতেছে বিষ্ণুপ্রিয়ার শয়নকক্ষ-দ্বারে ]
ফিরে যাও গৌরসুন্দর চঞ্চল মতি
(তুয়া মনে কীসের পিরিতি)
এমন সোনার দেহ পরশ করিল কে
না জানি সে কোন রসবতী॥
অলসে অরুণ-আঁখি ঘুমে প্রেমে মাখামাখি
(আজু) রজনিতে হলে কার পতি
বদন-কমল কেন মলিন হইল হেন
ধোঁয়া দিয়ে করেছে কে তোমার আরতি॥
নদিয়া-নাগরী সনে নিশি যাপি নিরজনে
আসিলে হে নিলাজ কেমন করে।
সুরধুনী-তীরে গিয়া মার্জনা করগে হিয়া
তবে সে আসিতে দিব ঘরে॥

নিমাই :
আমি হরি-বাসর-বাসী অমিয় সাগরে ভাসি
কহে সখী বহু কটু ভাষ
থাকি না যথায় গিয়া হৃদে মোর বিষ্ণুপ্রিয়া
সেই মোর রাস-রানি আমি তাঁরই দাস।

বিষ্ণুপ্রিয়া :
তাই তো বলি, কাঞ্চনা এত ভোরে কার সাথে কলহ করছে?
কাঞ্চনা :
যার জন্যে চুরি করি সেই বলে চোর। এক ঘণ্টা ধরে যে দোরগোড়ায় চ্যাঁচালাম, তা একবার ফিরে দেখলে না। মনে করলাম পাশ-বালিশটাকেই বুঝি পণ্ডিতমশাই মনে করে নিশ্চিন্তে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছ। এখন তো একজনের কণ্ঠস্বর শুনে ঘুম ভাঙতে এতটুকু দেরি হল না। বলি সারারাত ঘুমিয়েছ না অমনি জেগেই কাটিয়েছ।
নিমাই :
ঝড় উঠেছে, দেহ-তরি নিয়ে এই বেলা সরে পড়ি।
কাঞ্চনা :
সরে পড়লে চলবে না ঠাকুর। আজ তুমি স্পষ্ট করে বলো, তোমার মনে কী আছে। সারা নদিয়া আজ তোমার প্রেমে পাগল, তোমার করুণায় নাকি ত্রিভুবন ডুবুডুবু, নদে ভেসে যায়। শুধু আমার এই সখীটিই চরায় ঠেকে থাকলেন কেন? তোমার প্রেম-সমুদ্রের এক বিন্দু বারি পেলে যে বেঁচে যায় তাকে এ বঞ্চনা কেন?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
(কাতর স্বরে) কাঞ্চনা!
কাঞ্চনা :
তুমি থামো। পাপ হয় আমার হবে। উনি ভগবান। পৃথিবীর দুঃখীকে উদ্ধার করতে এসেছেন, শুধু তুমি ছাড়া। রাম পৃথিবী ত্রাণ করেছেন সীতাকে সঙ্গে নিয়ে – বর্জন করে নয়। শ্রীকৃষ্ণ রাধাকে নিয়ে, সত্যভামা, রুক্মিণী প্রভৃতিকে নিয়েই ভূ-ভার হরণ করেছেন। ইনি যদি নারায়ণই হন তবে লক্ষ্মীকে এত বেদনা দেন কোন অপরাধে, কোন শাস্ত্রমতে?
নিমাই :
আমি সত্যই অপরাধী, কাঞ্চনা, তাই তোমার সখীর কাছে মার্জনা ভিক্ষা করতে এসেছি।
কাঞ্চনা :
তা হলে বলো, দেহি পদ-পল্লবমুদারম।
নিমাই :
(সুরে) দেহি পদ-পল্লবমুদারম।
নিতাই :
দেখেছি যুগল মিলন দেখেছি – দেখেছি।

[ নিত্যানন্দের গান ও নৃত্য ]
এই যুগল-মিলন দেখব বলে ছিলাম আশায় বসে।
আমি নিত্যানন্দ হলাম পিয়ে মধুর ব্রজ-রসে।
রাই বিষ্ণুপ্রিয়া আর কানাই গউর
হেরো নদিয়ায় যুগল রূপ সুমধুর
তোরা দেখে যা দেখে যা, মধুর মধুর।
মধুর রাই আর মধুর কানাইর দেখে যা
দেখে যা মধুর মধুর।
[তাণ্ডব নৃত্য]

ঈশান :
এই হয়েছে! মাতোয়াল ঠাকুর আবার খেপেছে। ও বাব্বাঃ! ঠাকুর যে একেবারে দিগম্বর মূর্তিতে নেচে বেড়াচ্ছে গো! ও দাঠাউর! ধরো ধরো! সন্ন্যাসী ঠাউর যে ন্যাংটা হয়ে নেচে বেড়াচ্ছে গো। মুখ দিয়ে ফেনা উঠছে যে! বুড়ো লোক আমি কি সামলাতে পারি এই পাগলা হাতিকে!
নিমাই :
(হাসিয়া) একী হচ্ছে প্রভু! ছিঃ ! ছিঃ ! নাও কাপড় পরো।
নিতাই :
হ্যাঁ, হ্যাঁ, এইবার আমি যাব।
নিমাই :
আরে, যাওয়ার কথা কে বলেছে ? কাপড় পরো।
নিতাই :
আর খেতে পারব না। আমার ক্ষুধাতৃষ্ণা মিটে গেছে।
নিমাই :
আরে, আমি কী বলছি আর তুমি কী উত্তর দিচ্ছ।
নিতাই :
এই নিয়ে দশবার গেলুম, আর যেতে পারব না।
নিমাই :
আমার মাথা আর মুণ্ড! তাতে আমার কী দোষ?
নিতাই :
মা এখানে নেই। (উন্মত্ত হাসি ও নৃত্য)
শচীমাতা :
নিতাই, ঘরে এসো, সন্দেশ খাবে।
নিতাই :
?

বসন – বসন দে। মা ডাকলেন – শিগগির কাপড় আন।
শচীমাতা :
হল ভালো, ছিল এক পাগল, তার দোসর জুটল এসে উন্মাদ।
নিতাই :
তোমার বাবা পাগল, তোমার মা পাগল, তোমাদের গুষ্টি পাগল মা, তা আর ছেলেরা কোন ভালো হবে?

[অসমাপ্ত]

 শিল্পী

প্রথম দৃশ্য

[রোগ-শয্যায় শায়িত লায়লি – অস্তমান সপ্তমীর চাঁদের মতো ক্ষীণপ্রভ। গভীর অন্ধকার রাত্রি। শিয়রে বিমলিন-জ্যোতি তৈল-প্রদীপ আর চিত্র-অঙ্কনরত স্বামী।]

লায়লি :

তোমার ছবি আঁকা হল? – (চিত্রকর নীরবে-একমনে ছবি এঁকে চলেছে) – ওগো শুনছ?

চিত্রকর :

(চমকে উঠে) অ্যাঁ! আমায় ডাকছিলে লায়লি?

(লায়লি অভিমানে দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে চোখের জল গোপন করল। চিত্রকর আবার একমনে চিত্র আঁকতে লাগল।)

লায়লি :

(পাশ ফিরে গভীর দীর্ঘ-নিশ্বাস মোচন করে) দোহাই! তুমি অন্য ঘরে ছবি আঁক গিয়ে! আমার বড্ড বিশ্রী লাগছে! (শেষের কথা কয়টা বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ল)

 

(চিত্রকরের হাত হতে তুলি পড়ে গেল – লায়লির কান্না-দীর্ণ স্বরের তীব্রতায়)

চিত্রকর :

(সবিস্ময়ে) লায়লি! তুমি কাঁদছ?

লায়লি :

(তীব্রস্বরে) না! রহস্য করছি! তুমি একটু অন্য ঘরে উঠে যাবে? দয়া করে আমায় একটু একলা থাকতে দাও!

চিত্রকর :

(উদাসীনভাবে) আচ্ছা, আমি যাচ্ছি। তোমার রোগ-যন্ত্রণা আর বাড়াতে চাইনে তোমার কাছে থেকে। (চলে যাওয়ার উপক্রম করল।)

লায়লি :

যেয়ো না। দুটো কথা আছে, শুনে যাও।

চিত্রকর :

(বসে পড়ে) বলো।

লায়লি :

ওখানে না। আমার পাশে এসো বসো।

চিত্রকর :

(লায়লির পাশে বসে) বলো। (আনমনে লায়লির কপোল ও ললাট হতে অলকগুচ্ছ তুলে দিতে লাগল।)

লায়লি :

সত্যি করে বলো দেখি, তুমি বিয়ে করেছিলে কেন?

চিত্রকর :

বিয়ে করার জন্যই।

লায়লি :

হেঁয়ালি রাখো। তুমি শিল্পী, তুমি কেন আমাকে তোমার দুঃখের সাথি করে তোমার স্বচ্ছন্দ জীবনকে এমন বোঝা করে তুললে? আমি জানি আর তুমিও জান, তুমিও শান্তি পাচ্ছ না, আমিও সোয়াস্তি পাচ্ছিনে, আমাদের এই টানাটানির জীবন নিয়ে।

চিত্রকর :

তুমি সেরে ওঠো, তারপর সব কথা বলব। আজ নয়।

লায়লি :

না, তুমি আজই বলো। মরতেই যদি হয়, তবে ও-জিনিসটা যত তাড়াতাড়ি হয়, ততই ভালো। জীবনে অনেক টানাহেঁচড়া করেছি, মরণে আর ওটা সইবে না।

চিত্রকর :

সব কথা কি সব সময় মানুষ বলতে পারে লায়লি? … আমি কি শুধু শিল্পীই? আমি কি সিরাজ নই? বিয়ে তোমায় করেছে মানুষ-সিরাজ, শিল্পী-সিরাজ নয়।…তোমাতে আমাতে দ্বন্দ্ব কোন্খানে, জান? তুমি চাও শুধু মানুষ-সিরাজকে, শিল্পী-সিরাজকে তুমি দু-চোখে দেখতে পার না। অথচ আমি মানুষ-সিরাজ যতটুকু, তার অনেকগুণ বেশি শিল্পী-সিরাজ।

লায়লি :

(অনেকক্ষণ ভেবে) ধরে নিলুম, তোমার কথাই সত্যি। তা হলেও, আমার মাঝে কি শুধু রক্ত-মাংসের মানুষেরই ক্ষুধা পরিতৃপ্তির সমাপ্তি আছে, আনন্দবিলাসী শিল্পীর ধেয়ান-লোকের কোনো কিছুই নেই?

চিত্রকর :

আছে। তোমাকে আমার ধেয়ান-লোকে পাই, যখন তুমি থাক আমার ধরা-ছোঁয়ার আড়ালে। তখন তুমি শুধু আমার অঙ্ক-লক্ষ্মী নও, শিল্পী-সিরাজের হৃদয়-লক্ষ্মী, ধেয়ানের ধন।… যে ফুলের মালা সন্ধ্যায় লাগে ভালো, নিশিশেষে তা যদি বাসি ঠেকে, লায়লি তার জন্য অপরাধী তুমিও নও, আমিও নই। চির-সুন্দরের তরে নিত্য নব-তৃষা মানুষের চিরকেলে অপরাধ। এই তৃষা যার যত প্রবল, সে সুন্দরের তত বড়ো ধেয়ানী। মানুষের শৃঙ্খলিত সমাজে হয়তো সেই আবার তত বড়ো অপরাধী।…মস্ত ভুল করেছি লায়লি, স্বর্গের সুন্দরকে ধুলার আবিলতায় নামিয়ে।

লায়লি :

আমিও বুঝতে পারিনে, অপরাধ কার কতটুকু। তোমার কলঙ্কে যখন দেশ ছেয়ে গেছে, তখনও আমি তোমায় ভালোবেসেছি সকলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। সবাই যখন বড়ো করে দেখত তোমার কলঙ্ক, আমি তখন দেখেছি তোমার জ্যোৎস্না। আমি কতদিন অহংকার করে বলেছি, ‘কলঙ্কী চাঁদকে দেখে সাগরের বুকেই জোয়ার জাগে, খানা-ডোবা চাঁদকে চেনেও না, তাদের বুকে জোয়ারও জাগে না।… কিন্তু আজ কেন মনে হচ্ছে, আমিও তোমায় ভালোবাসিনি, তোমার যশ, তোমার খ্যাতিকে ভালোবেসেছি। নইলে সাগরে জোয়ার তো শুধু পূর্ণিমার চাঁদকে দেখেই জাগে না, অমানিশির নিরুজ্জ্বল চাঁদকে দেখেও সে সমান উতলা হয়।

চিত্রকর :

দূরে থেকে তুমি ভালোবেসেছিলে – শিল্পীকে, কাছে এসে পেতে চাও সিরাজকে – মানুষকে।…এটাই তোমাদের নারীর ধর্ম। তোমরা আকাশের জ্যোতিষ্ক হতে চাও না – হতে চাও মাটির ফুল। তোমরা শুধু দূরের সুন্দরের ধ্যানেই তৃপ্ত হতে পার না, নিকটের নির্মমকেও পেতে চাও। যে বিরহে তোমরা বেদনা-ক্ষুণ্ন বিষাদিনী, সেই বিরহে পুরুষ হয়ে ওঠে ধেয়ানী তপস্বী। তোমরা কাঁদ, পুরুষ ধ্যান করে। তোমরা যেখানে কর অভিসম্পাত, পুরুষ সেখানে করে স্তব।

লায়লি :

কী জানি, তোমাদের সব কথা সব সময় বোঝা যায় না। আজও বুঝি না।… আমার দুঃখ এইটুকু যে, আমার বলতে তোমার কাছে কিছু পেলুম না। শিল্পী-সিরাজ তো সকলের। সেখানে আর একার দাবি অস্বাভাবিক আবদার, তা বুঝি। কিন্তু যদি দেখি, সিরাজ শুধু শিল্পীই, সে মানুষ-শিরাজ নয়, সেখানে আমার সান্ত্বনা কোথায়? দূরের মানুষ অল্প নিয়েই খুশি থাকতে পারে, আমার পোড়াকপাল – আমি যে তোমার নাকি সহধর্মিণী, নইলে কীসের দুঃখ আমার?

চিত্রকর :

উপায় নাই লায়লি, উপায় নাই! যাদের আমি একদিন আমার সকল হৃদয়-মন দিয়ে চেয়েছি, আজ তারা সবাই আমার কাছে পুরাতন হয়ে উঠেছে। শিল্পী-আমারই জয় হল। মানুষ আমি বহুদিন হল মরে গেছি, মানুষের সুখ-দুঃখ হাসি-কান্না কেন যেন আর আমায় বিচলিত করতে পারে না। শুধু মনে হয় প্রাণ ভরে সুন্দরকে দেখে যাই, রেখায় রেখায় রঙে রঙে তাকে অমর করে যাই। আমরা শিল্পীরা তো চির-নূতন করে রেখেছি, চির-যৌবন দিয়েছি সুন্দরকে, আমাদের মনের নবীনতা দিয়ে, যৌবন দিয়ে।…যখন মনে করি, তুমি আমার কেউ নও, মনে হয় কোন লোকের যেন অপরিচিতা, তখন তুমি সুন্দর। যখন তোমায় পাই বাহুর বন্ধনে বুকের পাশে, তখন তুমি নারী – প্রজাপতির পাখার রং-এর মতো ছুঁলেই রং যায় মুছে।

লায়লি :

আমি যদি মরে যাই, তোমার দুঃখ হবে না? তুমি কাঁদবে না?

চিত্রকর :

না। শয্যাপার্শ্বে বাহুর বন্ধনে যাকে ধরতে পারিনি, তাকে ধরব ধেয়ানের গোপন-লোকে। আমার তুলির রেখায় রেখায় রঙে রঙে তোমায় দান করব চির-বৈচিত্র্য, চির-নবীনতা, চির-যৌবন। মরলোকের বধূ আমার হবে অমর লোকের অপ্সরি। আমার গৃহলক্ষ্মী হবে নিখিল-শিল্পীর বিশ্বলক্ষ্মী!

লায়লি :

ওগো দোহাই তোমার! আমি চাইনে অত গৌরব, অত মহিমা! তুমি আমায় বাঁচিয়ে তোলো! আমি বাঁচতে চাই। তোমায় পেতে চাই ! মরতেই যদি হয়, এত দারুণ তৃষ্ণা নিয়ে মরতে চাইনে। আমি মরতে চাই স্বামীর কোলে, পুত্র-কন্যা আত্মীয়-স্বজনের মাঝে। যেতে চাই বাড়ি-ভরা ক্রন্দনের তৃপ্তি নিয়ে। এমন করে এই মাঠের মাঝে শূন্য ঘরে এক পাষাণের পায়ের তলে পড়ে মরবার আমার সাধ নেই!

চিত্রকর :

(অস্থিরভাবে পায়চারি করতে করতে) উপায় নেই লায়লি, উপায় নেই! সত্যিই আমি নিরুপায়। (বাহিরে দরজায় কাহার করাঘাত শোনা গেল) কে?

 

(বাহিরের শব্দ।) আমি তোমার বন্ধু।

লায়লি :

(চিৎকার করে) খুলো না! দোর খুলো না! আমি চিনেছি, ও কে। ও ডাইনি, ও চিত্রা।

চিত্রকর :

ছিঃ লায়লি! তুমি শিক্ষিতা সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে, এ কী ব্যবহার তোমার?

চিত্রা (বাহির হতে) :

আমি ভিতরে যাব না বন্ধু, তুমি বেরিয়ে এসো।

লায়লি :

যাও! তোমার বাইরের ডাক এসেছে। তোমার সুন্দরের ধ্যান আমি ভাঙব না। আমায় ক্ষমা করো। আমি যেদিন থাকব না ওই চিত্রার মাঝেই আমাকে স্মরণ করো।

[চিত্রকর ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল। ঘরের প্রদীপও সাথে সাথে নিভে গেল।]

 

দ্বিতীয় দৃশ্য

[লায়লির পিত্রালয়। নদীতীরে সুরম্য অট্টালিকার নির্জন প্রকোষ্ঠে লায়লি ও চিত্রকর। সপ্তমী চাঁদের পানসে জ্যোৎস্না বাতায়ন-পথে এসে শিল্পীর চোখে-মুখে পড়ে তাকে বন্দি দেবকুমারের মতো সুন্দর দেখাচ্ছিল। শিল্পী নদীর ঢেউয়ে চাঁদের খেলা দেখছিল]

লায়লি :

‘লায়লি’ মানে জান?

চিত্রকর :

(উদাস স্বরে) জানি – নিশীথিনী।

লায়লি :

সত্যিই আমি নিশীথিনী – অমা-নিশীথিনী। চাঁদ নেই, তারা নাই, – অন্ধকার আর আকাশ!

চিত্রকর :

(হেসে) আর একজন লায়লি ছিল, তার প্রেমিকের নাম ছিল মজনু, অর্থাৎ উন্মাদ।

লায়লি :

জানি।

চিত্রকর :

কিন্তু সে লায়লি এ লায়লির মতো সুন্দর ছিল না।

লায়লি :

(তীব্র স্বরে) দোহাই! আর বিদ্রুপ কোরো না। ও প্রশংসা চিত্রাকে করো, সে খুশি হবে।

চিত্রকর :

হয়তো হবে। তবু মনে হয়, তুমি সুন্দর, চিত্রা অপূর্ব।

লায়লি :

তার মানে?

চিত্রকর :

তুমি ধরার চাঁদ, চিত্রা আকাশের চাঁদ। ওই নদীর ঢেউ-এ চাঁদের লীলা দেখছ? ওকে বোঝা যায় না, ও কেবলই রহস্য।

লায়লি :

এই কথা বলবার জন্যেই কি এখানে এসেছ? যদি তাই এসে থাক, তবে দয়া করে তুমি ফিরে যাও। তোমার আর চিত্রার মাঝে গিয়ে আমি দাঁড়াতে চাইনে। আমি বহু কষ্টে বেঁচে উঠেছি।

চিত্রকর :

কীজন্য এসেছিলাম লায়লি, তা আর মনে নেই। এখন মনে হচ্ছে ওই চাঁদ ওই নদী আর ওই নদীর জলে চাঁদের খেলা দেখতেই এসেছি যেন। (অনেকক্ষণ ধরে কী ভাবলে) কদিন থেকে এও মনে হচ্ছিল, তুমি আমায় ডাকছ। সত্যি কি তুমি ডেকেছিলে আমায়?

লায়লি :

মা তাই বলেন। যখন রোগ খুব বেড়েছিল, তখন নাকি তোমায় ডাকতাম অজ্ঞান অবস্থাতেও।

চিত্রকর :

কি জানি লায়লি, কিছু বুঝিনে। অদ্ভুত এই মানুষের মন। কাছে থাকলে যাকে মনে হয় বোঝা, দূরে থেকে সে-ই কী করে এমন আকর্ষণ করে, বুঝতে পারিনে। আমার মাঝে এই যে মানুষের আর শিল্পীর দ্বন্দ্ব বেধেছে এর একটা হেস্তনেস্ত করতেই এসেছি এখানে – একেবারে ‘মরিয়া হইয়া’।

লায়লি :

কী জানি, আমার ভয় করছে কেন তোমাকে দেখে অবধি। মনে হচ্ছে কী একটা সংকল্প করছ তুমি মনে মনে। তুমি কি কোথাও চলে যেতে চাও?

চিত্রকর :

তাই। আমি চলে যাব বলেই এসেছি। মানুষ কেবলই পিছু টানছে – শিল্পী কেবলই ইঙ্গিত করছে দূরের পানে – যে পথে বাঁশির সুর যায় উধাও হয়ে, ফুলের সুবাস যায় হাওয়ায় মিশে। মনে হয় ওই কোকিল, পাপিয়া ‘বউ কথা কও’ – সকলে আমার বন্ধু, ওরা আসে গান করে, আবার চলে যায়।

তারলায়লি :

তারা আবারও আসে, আবার গান করে।…দেখো, আমি অনেক ভেবে দেখেছি, তোমাকে জোর করে ধরে রেখে আমারও শান্তি নেই। তুমি যেখানে ইচ্ছা ঘুরে বেড়াও, শুধু মাঝে মাঝে আমায় দেখা দিয়ে যেয়ো। (বলতে বলতে কন্ঠরোধ হয়ে গেল)

চিত্রকর :

আসব, আপনা থেকেই আসব। আর যদি না আসি, ভুলে যেয়ো।

লায়লি :

(শান্তস্বরে) তাই ভুলে যাব। আজই এখনই যাও, তাহলে, ওই চাঁদ ডোবার আগেই।

চিত্রকর :

(ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল) লায়লি!

লায়লি :

দাঁড়াও! যাবার আগে একটা জিনিস উপহার দেবো, নেবে?

চিত্রকর :

দাও। (লায়লি অন্য ঘর হতে একটি চিত্র এনে চিত্রকরকে দিয়েই চলে যাচ্ছিল) একি! এ চিত্র কে আঁকলে?

লায়লি :

(চলে যেতে যেতে) আমি!

চিত্রকর :

অ্যাঁ! তুমি?

লায়লি :

হাঁ, ওই আমার দীর্ঘ বিরহের তপস্যার স্মৃতি।

চিত্রকর :

এই দীর্ঘ দিন মাস শুধু আমারই ছবি এঁকেছে? যে তোমার জীবনকে ব্যর্থ…

লায়লি :

(মুখের কথা কেড়ে নিয়ে) ব্যর্থ করনি শিল্পী। কিন্তু সেকথা তুমি বুঝবে না (চলে গেল)।

চিত্রকর :

(চিত্রখানা ললাটে স্পর্শ করিয়ে) তুমি সুখী হবে, তুমি সুন্দরের সান্নিধ্য লাভ করেছ (ধীরে ধীরে নেমে দূর জ্যোৎস্না-ধৌত পথে মিলিয়ে গেল। লায়লি বাতায়ন-পথে তাই দেখতে দেখতে মূর্ছিতা হয়ে পড়ে গেল)।

 

তৃতীয় দৃশ্য

[শৈল-নিবাস। সন্ধ্যা]

চিত্রা :

আচ্ছা সিরাজ, একটা কথা বলব, তুমি সত্য করে উত্তর দেবে?

চিত্রকর :

‘সিরাজ’ নয় চিত্রা, শিল্পী বলো, বলো, বন্ধু বলো – যা বরাবর বলেছ।

চিত্রা :

আর কিছু না? তুমি শুধু শিল্পীই? শুধু আনন্দ-লোকের নিঃসঙ্গ স্বপ্নচারী তুমি? এই মাটির মদির গন্ধ তোমায় মাতাল করে তোলে না?

চিত্রকর :

তোলে চিত্রা। সে শুধু নিমেষের জন্য। তারপর উড়ে চলি ঊর্ধ্বে, আরও ঊর্ধ্বে, যে ঊর্ধ্বলোক হতে পৃথিবীর চিহ্ন মুছে যায়। ঊর্ধ্বে, নিম্নে চারপাশে শুধু আকাশ, শুধু সুনীলের শান্ত উদার শূন্যতা, সেইখানে উঠে গাই আনন্দের গান। সেইখানে বসে রচনা করি আমার চিত্রলেখা।

চিত্রা :

আচ্ছা, আমায় চিত্রা বল কেন? আমি তো চিত্রা নই।

চিত্রকর :

জানি। কিন্তু তুমি যে আমার সুন্দরের প্রতীক। আমার শিল্পী-লক্ষ্মী, ধেয়ান-প্রতিমা তুমি।

চিত্রা :

তুমি এমন করে বল বলেই তো তোমায় কাছে – আরও কাছে পেতে ইচ্ছে করে – যেমন করে আমার নোটন-পায়রাগুলিকে বুকে জড়িয়ে চুমু খাই তেমনই করে। আমিও তোমায় শাপভ্রষ্ট দেবকুমার শিল্পী বলেই জানতাম। তাই তোমার কাছে এসেছিলাম শ্রদ্ধার পূজাঞ্জলি নিয়ে। তুমি মুগ্ধ চোখে চেয়ে দেখলে। আমার রূপের প্রশংসা শুনতে শুনতে আমার বিরক্তি ধরে গেছে, তবু ওই চাওয়া দেখে মনে হল, আমার এত রূপ সার্থক হল এতদিনে। মনে হল, এত রূপ ধরবার মতো শুধু এই দুটি চোখই আছে পৃথিবীতে। তোমার স্তব-গানে আমার হৃদয় শতদলের মতো বিকশিত হয়ে উঠল! (দীর্ঘশ্বাস মোচন করে) হায় উদাসীন! তুমি আমায় বুঝবে না। তুমি বিকশিত শতদলের শোভা দেখ শুধু, বেদনায় শতদল বিকশিত হয়ে ওঠে সে বেদনার কী বুঝবে তুমি?

চিত্রকর :

সত্যি চিত্রা, শিল্পী চাঁদ পাখি – এরা আর সব বোঝে, শুধু বোঝে না বেদনা।

চিত্রা :

তুমি পাষাণ অ্যাপোলো। তবু জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করে, সত্যি তোমার মনে আর কোনো লোভ নেই? যে ফুল কাননে ফোটে, তাকে কাননেই ঝরতে দিতে চাও, মালা করে গলায় পরাতে ইচ্ছা করে না?

চিত্রকর :

না বন্ধু, ফুলের সুবাসই আমার পক্ষে যথেষ্ট, তাঁকে গলায় জড়িয়ে ফাঁসি পরবার সাধ আমার নহে।

চিত্রা :

আমি অন্যের হলে তোমার দুঃখ হবে না?

চিত্রকর :

হবে। সে দুঃখ আমার জন্য নয়, তোমার জন্য। সুন্দর ফুল এমনি ঝরে পড়ে তা সওয়া যায়, কিন্তু তাকে জোর করে বৃন্তচ্যুত করে কাঁটা বিঁধে মালা করতে দেখলে আমার কষ্ট হয়।

চিত্রা :

(দীর্ঘশ্বাস ফেলে ম্লান স্বরে) ও-ব্যথা তো সকলের জন্যে। একা-আমার জন্য তোমার কোনো ব্যথাই নেই?

চিত্রকর :

(আকুল স্বরে) না চিত্রা। আমি শিল্পী, হৃদয়হীন নির্বেদ উদাসীন শিল্পী!

চিত্রা :

(সজল কণ্ঠে) তা হলে আমি যাই?

চিত্রকর :

(শান্ত স্বরে) যাও।

চিত্রা :

তোমার একটা কিছু দেবে আমায় – তোমায় মনে রাখবার মতো কিছু?

চিত্রকর :

(তার তুলি নিয়ে) এই নাও।

চিত্রা :

এ কী? তুলি? তুমি আর ছবি আঁকবে না?

চিত্রকর :

(সাশ্রুনেত্রে) না চিত্রা! আমার এই তুলি বহু হৃদয়ের রক্তে রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে, আর পারি না!

চিত্রা :

(সবিস্ময়ে) এ কী শিল্পী?

চিত্রকর :

এই সত্যি চিত্রা! জীবনে এই প্রথম অশ্রু এল আমার চোখে। যেই তুমি চলে যেতে চাইলে, অমনি কেন আমার এই প্রথম মনে হল, এমন সুন্দর বিশ্ব কে যেন তার স্থূল হস্ত দিয়ে মুছে ফেলছে! – আমি চললাম চিত্রা!

চিত্রা :

(হাত ধরে) কোথায় যাবে বন্ধু?

চিত্রকর :

(ধীরে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সেই হাতে চুম্বন করে) যে-পথে পৃথিবীর কোটি কোটি ধূলিলিপ্ত সন্তান নিত্যকাল ধরে চলেছে, সেই দুঃখের, সেই চিরবেদনার পথে। (প্রস্থান)

সেতু-বন্ধ

–কুশীলবগণ–

ইঁট, কাঠ পাথর, লোহা, যন্ত্র, যন্ত্রী,
ভারবাহী পশু ও মানুষ, পীড়িত মানবাত্মা,
সেতু, মেঘ, বৃষ্টিধারা, তরঙ্গ,
পদ্মা, জলদেবী, মীনকুমারী,
ঝড়, বজ্রশিখা,
বন্যা…

প্রথম অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য

মেঘলোক

[মৃদঙ্গ বাজাইতে বাজাইতে ‘মেঘ’-এর প্রবেশ। ‘মেঘ’-এর নীলাঞ্জন অনুলিপ্ত অঙ্গ, উচ্ছৃঙ্খল ঝামর চুল স্কন্ধদেশ ছাইয়া ফেলিয়াছে। চূড়ায় বঙ্কিম শিখীপাখা ফিকে-নীল ফিতা দিয়া বাঁধা। ললাটে বহ্নিশিখা-রঙের প্রদীপ-রক্তচন্দন যেন বজ্রাগ্নি। স্নিগ্ধ নয়নে ঘন কাজল ঝলমল করিতেছে, – যেন এখনই জল ঝরিয়া পড়িবে। গলায় হলুদ-রাঙা রাখি দিয়ে বাঁধা গম্ভীর নিনাদী মৃদঙ্গ। পরনে পেনসিল দিয়া ঘষা শ্লেট রঙের ধড়া ও ঢিলা নিমাস্তিন । দুই হাতের মণি-বন্ধে কাঁচা সোনার বলয়-কঙ্কণ। মৃদঙ্গে আঘাত হানার বিরতিতে দুই বাহু ঊর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত হইতেছে, সুবর্ণ-কঙ্কণ-বলয় বিজুরির ঝিলিক হানিতেছে। পৃষ্ঠদেশ ব্যাপিয়া সাতরঙা বিরাট জলধনু।
অন্তরীক্ষ হইতে স্নিগ্ধ-গম্ভীর কন্ঠের একতান-সংগীত ভাসিয়া আসিতেছে – সেই গানের তালে তালে ‘মেঘ’-এর মৃদঙ্গ বাদন ও নৃত্য]

গরজে গম্ভীর গগনে কম্বু
নাচিছে সুন্দর নাচে স্বয়ম্ভু॥
সে নাচ-হিল্লোলে জটা-আবর্তনে
সাগর ছুটে আসে গগন-প্রাঙ্গনে।
আকাশে শূল হানি
শোনাও নব-বাণী
তরাসে কাঁপে প্রাণী
প্রসীদ শম্ভু॥
ললাট-শশী টলি জটায় পড়ে ঢলি,
সে শশী-চমকে গো বিজলী ওঠে ঝলি
ঝাঁপে নীলাঞ্চলে মুখ দিগঙ্গনা,
মুরছে ভয়-ভীতা নিশি নিরঞ্জনা।
আঁধারে পথ-হারা
চাতকী কেঁদে সারা,
যাচিছে বারিধারা,
ধরা নিরম্বু॥

[গান করিতে করিতে একদল নৃত্যপরা কিশোরীর বেশে ‘বৃষ্টিধারা’র প্রবেশ। তাদের পরনে মেঘ-রং কাঁচুলি, ধানী-রং ঘাঘরা – পাড় জরির। নীল জমিনে সাদা ডোরা-কাটা কাপড়ের হালকা উত্তরীয়। পায়ে ছড়া নুপূর, কারুর পায়ে পাঁইজোর গুজ্‌রি। সবুজ আলতা-ছোপানো পদতল। হাতভরা সোনালি-রং রেশমি চুড়ি, কঙ্কণ, কেয়ূর। শ্রোণিতে ফোটা-কদমের ঢিলে চন্দ্রহার। বুকে জুঁই-চামেলির গোড়ে মালা। আঁখি-পাতার কূলে কূলে চিকন কাজললেখা। কপোল কেতকিপরাগ-পাণ্ডুর। জোড়া ভুরু লুলিতে অলকে হারাইয়া গিয়াছে। ভুরু-সন্ধিতে কাঁচপোকার টিপ। কর্ণমূলে শিরীষ-কুসুম। কারুর কটিতে ছোট্ট গাগরি, কারুর হাতে ফুল-ঝারি। কেহ বিলম্বিতবেণি, কেহ আলুলায়িত কুন্তলা। বিলম্বিত-বেণি কিশোরীরা আনমনে স্খলিত মন্থরগতিতে পদচারণা করিয়া ফিরিতেছে, মুক্ত-কুন্তলা বালিকারা নাচিয়া নাচিয়া ফিরিতেছে, জড়াজড়ি করিয়া – ঘুরিয়া ফিরিয়া। এক কোণে একটি বালিকা একরাশ কেয়াফুল বুকে জড়াইয়া পা ছড়াইয়া উদাস চোখে চাহিয়া আছে। ‘বৃষ্টিধারা’র নৃত্য-গানের ছন্দে ছন্দে অন্তরীক্ষ হইতে রাশি রাশি জুঁই, চামেলি, বেলি, বকুল, দোপাটি, টগর ঝরিয়া ঝরিয়া পড়িতেছে। ওই গানের তালে তালে ‘মেঘ’-এর মৃদঙ্গ বাদন ও নৃত্য।]
বৃষ্টিধারার গান

অধীর অম্বরে গুরু গরজন মৃদঙ বাজে।
রুমু রুমু ঝুম মঞ্জরির-মালা চরণে আজ উতলা যে।

এলোচুলে দুলে দুলে বন-পথে চল আলি,
মরা গাঙে বালুচরে কাঁদে যথা বন-মরালী।

উগারি গাগরি-ঝারি
দে লো দে করুণা ডারি,
ঘুঙট উতারি বারি
ছিটা লো গুমোট সাঁঝে॥

তালিবন হানে তালি, ময়ূরী ইশারা হানে;
আসন পেতেছে ধরা মাঠে মাঠে চারা-ধানে।

মুকুলে ঝরিয়া পড়ি আকুতি জানায় যূথি,
ডাকিছে বিরস শাখে তাপিতা চন্দনা তূতী।
কাজল-আঁখি রসিলি
চাহে খুলি ঝিলিমিলি,
চল লো চল সেহেলী
নিয়ে মেঘ-নটরাজে॥

[বৃষ্টিধারার বালিকাদের নাম – রেবা, চিত্রা, কঙ্কা, চূর্নী, মঞ্জু, নীরা, বিন্দু, নীপা, কৃষ্ণ, চম্পা, অশ্রু, মন্দা।]
মেঘ :
ওগো নৃত্যপরা নূপুরিকার দল! তৃষ্ণাতুরা ধরার আবেদন কি এতদিনে পৌঁছোল তোমাদের দরবারে? চাতকীর চক্ষু যে বিশুষ্ক হয়ে উঠল তোমাদের করুণা যেচে যেচে!
মন্দা :
(সেই আনমনা বালিকাটি, যে একরাশ কেয়া বুকে করে বসে ছিল) সত্যি বলেছ রাজা, দিদিদের আর নূপুর পরাই হয় না। কাজল ঘষে ঘষে চোখে জল ভরে এল, তবু কাজল পরাই আর শেষ হয় না! আমি তো কোন সকালে উঠে কেতকী-বিতানে এসে পথ চেয়ে বসে আছি। (বেণি জড়াইতে জড়াইতে) বেণিটাও জড়াবার ফুরসৎ পাইনি!
রেবা :
তোর বাপু সব-তাতেই অতিরিক্ত তাড়া-হুড়ো। আমরা বলি, নটরাজের মাদলই আগে বেজে উঠুক, ঝলুকই আগে বিজলির ইঙ্গিত – তা না – মেঘ না চাইতেই জল! ভোর না হতেই বেরিয়েছেন পাড়া বেড়াতে! একবার তমালতলায়, একবার কদম-শাখায়, একবার পাহাড়তলির শাল-বীথিকায়, একবার কেয়াবনের নাগ-পল্লিতে –
মন্দা :
আর তোমরাই বা কীসে কম রেবাদি? ঘুমুর বাঁধছ তো বাঁধছই! ঝিল্লি বেচারি সন্ধে থেকে সুর দিয়ে হয়রান! কেশ এলো করছ তো করছই! কত যে বিজুলি-ফিতে ছিঁড়ল – কত যে লোধ ফুলের প্রাণ গেল গাল রাঙাবার রেণু জোগাতে!
বিন্দু :
তুই থাম মন্দা! আচ্ছা রাজা, আজ যে অসময়ে তোমার মৃদঙ্গে তালি পড়ল! আমরা সব কেউ সাগর-দোলায় কেউ শৈল-শিরে ঘুমুচ্ছি হঠাৎ জেগে দেখি কিরণমালা পূর্বে-হাওয়ায় পালকি নিয়ে হাজির, হাতে তার নীপের শাখা।
মেঘ :
তোমাদের অভিযানে বেরুতে হবে, বিন্দু!
বৃষ্টিধারার সকলে :
অভিযানে বেরুতে হবে? আবার কার বিরুদ্ধে অভিযান, রাজা? এবার কোন্ দৈত্যপুরী ভাঙবে?
মেঘ :
গন্ধর্ব-লোকের পদ্মাদেবী আমাদের স্মরণ করেছেন। তাঁর বুকের উপরে বাঁধ বাঁধবার জন্যে নাকি দুর্দান্ত যন্ত্রপতির ষড়যন্ত্র চলেছে। পদ্মা এ অপমান সইবেন না। তিনি আমাদের সাহায্য চান।
চিত্রা :
ওমা, কী হবে? যন্ত্রপতির স্পর্ধা তো কম নয়! তার রাজ্য পশ্চিম হতে ক্রমেই পূর্বে প্রসারিত হয়ে চলেছে উন্মত্ত বুভুক্ষায় – তা দেখছি, তাই বলে সে-ঔদ্ধত্য যে পদ্মাকেই লাঞ্ছনা হানতে এগুবে – এ বার্তা শুধু নতুন নয় রাজা – অদ্ভুত!
কঙ্কা :
এই অতিদর্পীকে একটা অতি বড়ো শাস্তি না দিলে আর চলে না, রাজা!
চূর্ণী :
তোমার ব্রহ্মাস্ত্র নিশিত বজ্র, তোমার সেনাপতি পবন, তার মারণসেনা বন্যা তুফান ঝঞ্ঝা – সব প্রস্তুত তো রাজা?
মঞ্জু :
হাঁ, সব প্রস্তুত বইকী! ওলো চূর্নী, রাজার কঠিন বজ্র যে এখন শ্রীমতী বিদ্যুল্লতার গলায় কোমল হার হয়ে ঝলমল করছে। বলি রাজা, তোমার হাতের বজ্র ভেঙে কি শেষে প্রিয়ার গলার হার গড়ালে? হা কপাল! যেমন রাজা, তেমনই সেনাপতি! সেনাপতি পবনদেব ওদিকে ফুল-কুমারীর মহলে মহলে ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছেন! মালতীর কানে ফুঁ, মল্লিকার গালে সুড়সুড়ি, কামিনীর চোখের পাতায় চুমকুড়ি, কমলের খোঁপা ধরে টান – এই তো বীরবরের কীর্তি! উপযুক্ত রাজার উপযুক্ত সেনাপতি!
মেঘ :
(হাসিয়া) সত্যিই আমার সেনাপতির ধনুর্বাণ কামদেব চুরি করেছেন, মঞ্জু! আর আমার বজ্রাগ্নি লুকিয়েছে (মঞ্জুর কপোলে মৃদু অঙ্গুলি আঘাত হানিয়া) তোমাদের ওই কালো আঁখি-কোণে!
নীরা :
বেশ তো রাজা, তালে এ অভিযানে আর তোমার হিমালয় ছেড়ে যাবার দরকার কি? শুধু আমরাই যাই না কেন, দেখি এ আঁখির আগুনে যন্ত্ররাজ দগ্ধ হয় কি-না!
মেঘ :
অমন কাজ কোরো না নীরা, কোরো না! ও হতভাগ্য, যত পুড়বে তত খাঁটি হবে, তত ওর শান্তি বাড়বে। তোমাদের আঁখির আগুনে – ওর কঠিন হিয়া গলবে না, নীরা! কত অশ্রুই না ঝরছে নিরন্তর অনন্ত আকাশ গলে ওর প্রতপ্ত ললাটে, তবু ওই অশান্ত দৈত্য-শিশু শান্ত হল না। পুড়িয়ে ওর কিছু করতে পারবে না, আগুনই ওর প্রাণ। ওকে ভেঙে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
নীপা :
তোমায় যদি পথে পথে ভাসিয়ে নিয়ে বেড়াতে পারি রাজা, ওই দৈত্যটাকে আর পারব না?
কৃষ্ণা :
ওরে নীপা, আমাদের রাজা হল দেবতা – উপরের মানুষ, তাই ওকে পলকা হাওয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে বেড়ানো দুরূহ নয়, কিন্তু ওটা যে হল দৈত্য, তাইতো ও এত ভার! ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভয়েই তো ও এমন করে চোখ-কান বুঁজে মাটি কামড়ে পড়ে আছে! তাই তো ও স্থানু। ওকে ভাসানো অত সহজ হবে না!
অশ্রু :
ঠিক বলেছিস কৃষ্ণা! ফুল সুন্দর বলেই একটু ছোঁয়ায় ঝরে যায়, একটু ফুঁয়ে উড়ে যায়! আর ওই দৈত্যটা কুৎসিত, তাইতো ও হয়ে উঠল বোঝা, ওর আসন হল অটল। ওর পায়ে মাথা খুঁড়লে শুধু ললাটই হবে ক্ষত, আসন এক বিন্দু টলবে না!
মেঘ :
দেব-দানবের এ-যুদ্ধ চিরন্তন, অশ্রু! ওই মায়াবী দৈত্যটা হাজার রূপ ধরে হাজার বার আমাদের স্বর্গ আক্রমণ করেছে, প্রতিবারেই ওদের আক্রমণ আমরা প্রতিহত করেছি। আমাদের একমাত্র ভয়, ওরা ঘোর মায়াবী! কোন্ ছিদ্র দিয়ে যে স্বর্গপুরী প্রবেশ করবে – তার ঠিক-ঠিকানা নেই। ওদের রূপার কাঠির ছোঁয়ায় কত রূপের পুরী পাষাণ-পুরী হয়ে উঠল। ও কাঠি যাকে ছোঁবে, সেই হয়ে যাবে জড়। ও-রূপার কাঠি জাদু জানে! ওরা যদি তাই দিয়ে একবার এ-স্বর্গকে ছুঁতে পারে, তাহলে এর সমস্ত আনন্দ এক মুহূর্তে পাষাণ হয়ে যাবে, এর পারিজাতমালা শুকিয়ে উঠবে!
অশ্রু :
তাহলে কী উপায় হবে রাজা! ও যদি আমাদের আনন্দপুরী ছুঁয়ে দেয়? তুমি খুব বিপুল করে প্রাচীর গাঁথ না কেন আমাদের স্বর্গ ঘিরে!
মেঘ :
ওরে বাস্ রে! তাহলে কি আর রক্ষা আছে! ওরা তো তাই চায়। তারই জন্যে তো ওরা আমাদের নিরন্তর রাগিয়ে তুলছে। প্রাচীর তুললেই তো ওদের ভাঙবার পশুত্বটাকে প্রচণ্ড করে তোলা হবে। আমরা একটা কিছু আড়াল তুললেই ওরা সেইটে অবলম্বন করে উঠে আসবে স্বর্গে। অবলম্বন পাচ্ছে না বলেই তো ওরা মাঝপথ থেকে হতাশ হয়ে ফিরে ফিরে যাচ্ছে, এ স্বর্গলোকের সীমা খুঁজে পাচ্ছে না।
চম্পা :
কিন্তু রাজা গন্ধর্বলোক তো প্রাচীর তুলেই ওদের আক্রমণ প্রতিহত করতে চাচ্ছে।
মেঘ :
মূর্খ ওরা, তাই ওদের আজ কী দুর্দশা হয়েছে দেখ। যন্ত্ররাজের যে পথ কিছুতেই মাটি ছাড়িয়ে উঠতে পারছিল না, দেয়াল তুলে গন্ধর্বলোক সেই পথকে স্বর্গের দুয়ার পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে! ওই দেয়াল ধরেই ওরা ওদের উপর এসে পড়েছে দলে দলে।
চম্পা :
রাজা, এইবার যদি ওরা স্বর্গে এসে পড়ে?
মেঘ :
ভয় নেই চম্পা। আমাদের এ অলখপুরীর দশ দিক মুক্ত। তাই তো ওরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে, পথ খুঁজে পাচ্ছে না। বন্ধদ্বার দুর্গেই পড়ে শত্রুর পরিপূর্ণ আক্রোশ। আড়ালের ইঙ্গিতে শত্রুকে আহ্বান করার মতো দুর্বুদ্ধি আর নেই। নিম্নে দৃষ্টিপাত করে দেখ, কী বীভৎস ওই যন্ত্রী-সেনা – ইঁট, কাঠ, পাথর, লোহা, চুন, সুরকি, ধুলো-বালি! – ওদের সংখ্যা করা যায় না – কেবল স্তূপ আর স্তূপ! প্রাণ যেন হাঁপিয়ে ওঠে! সব প্রাণহীন! আর প্রাণহীন বলেই অন্যেরে প্রাণে মারতে ওদের বাজে না! ওই দেখো, গন্ধর্বলোকের প্রাচীর ধরে ওরা কীরকম ছেয়ে ফেলছে ওদের দেশ – মারীভয়ের মতো! এ সুবিধা যদি না করে দিত গন্ধর্বলোক, তাহলে ও পাপ অন্ধকারের নীচেই পড়ে থাকত মুখ থুবড়ে।
চিত্রা :
কিন্তু রাজা, যন্ত্ররাজের ওই সেতু-বন্ধকে এত ভয়েরই বা হেতু কী? অমনি সেতুবন্ধ দিয়েই তো সীতার উদ্ধার হয়েছিল!
মেঘ :
উদ্ধারই বটে, চিত্রা! ওই সেতুবন্ধে পদার্পণে পাপে আগুনে পুড়েও সীতার কলঙ্ক পুড়ল না – শেষে পাতাল প্রবেশ করে উদ্ধার খুঁজতে হল।
রেবা :
বুঝেছি রাজ, সকল বন্ধন ও বন্ধনী হতে মুক্ত রাখাই হয়তো আমাদের স্বর্গপুরীর শ্রেষ্ঠ আত্মরক্ষা!
মন্দা :
আচ্ছা রাজা, যন্ত্ররাজের এই সেতুবন্ধের উদ্দেশ্য কী?
মেঘ :
এই সেতুবন্ধ যে পাতালপুরীর সীতার উদ্ধার করবে না মন্দা, ও করতে চায় স্বর্গলক্ষ্মীকে বন্দিনী। ওই সেতুবন্ধ স্বর্গ-প্রবেশের লঙ্ঘন-সোপান। ওই সেতুবন্ধের লৌহ-বর্ম দিয়ে সে স্বর্গলক্ষ্মীর কেশাকর্ষণ করে টেনে নিয়ে যাবে – তাই বলে তার সমুদ্ধত কৃষ্ণ-পতাকা!
কৃষ্ণা :
তাহলে ওকে দুঃশাসনের মতো মারও খেতে হবে, রাজা!
মেঘ :
ঠিক বলেছ কৃষ্ণা, অনাগত সে দিন এল বলে। এখন চলো, পদ্মা দেবীর নিরাশা-শুষ্ক কূল পানে। যন্ত্রপতির আয়োজন দেখে তার পর সেনাপতি পবন-দেবকে খবর দেওয়া যাবে। সে ততক্ষণ ফুলমহলায় বিশ্রাম করে নিক।

[নৃত্য-গান করিতে করিতে মেঘ ও বৃষ্টিধারার প্রস্থান।]

হাজার তারার হার হয়ে গো
দুলি আকাশ-বীণার গলে।
তমাল-ডালে ঝুলন ঝুলাই
নাচাই শিখী কদম-তলে॥
‘বউ কথা কও’ বলে পাখি
করে যখন ডাকাডাকি,
ব্যথার বুকে চরণ রাখি
নামি বধূর নয়ন-জলে॥
ভয়ংকরের কঠিন আঁখি
আঁখির জলে করুণ করি,
নিঙাড়ি নিঙাড়ি চলি
আকাশ-বধূর নীলাম্বরী।

লুটাই নদীর বালুতটে,
সাধ করে যাই বধূর ঘটে,
সিনান-ঘাটের শিলা-পটে
ঝরি চরণ-ছোঁয়ার ছলে॥

দ্বিতীয় দৃশ্য

[যন্ত্রপতির রাজসভা। বিশাল লৌহমঞ্চে বিশালকায় যন্ত্রপতি উপবিষ্ট। পশ্চাতের আঁধার-কৃষ্ণ যবনিকা জুড়িয়া ভীতপ্রদ রক্তাক্ত অট্টালিকার পর অট্টালিকা – জীবজন্তু-তরুলতা-পরিপূর্ণ। বিরাট অমঙ্গলের প্রতীকসম ঊর্ধ্বে প্রসারিত-পক্ষ বিপুল শকুনি – ভীষণ দৃষ্টিতে নিম্নে চাহিয়া আছে। যন্ত্রপতির কঠিন মুখে রক্ত আলো পতিত হইয়া তাহাকে আরও ভীষণ করিয়া তুলিয়াছে। মস্তকে লৌহ-মুকুট। মুকুটমণি – ইলেকট্রিক-টর্চ। সর্বাঙ্গ ঘিরিয়া লৌহ-জালির সাঁজোয়া। দক্ষিণ করে স্থূল লৌহদণ্ড, বামকরধৃত দীর্ঘ শৃঙ্খলে বদ্ধ ক্ষুধিতদৃষ্টি সিংহ, হিংস্রমতি শার্দুল, শাণিত-নখর ভল্লুক ও কুটিল-ফণা ভুজঙ্গী – পদতলে পড়িযা ঘুমাইতেছে। প্রাসাদচূড়ায় কৃষ্ণপতাকায় ‘সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতা’ কাটিয়া তাহারই নীচে লেখা হইয়াছে – ‘বিদ্বেষ শোষণ পেষণ!’]
‘যন্ত্র’ – বিপুল স্থূলকায়, কদাকার, অন্ধদৃষ্টি। বড়ো বড়ো নখদন্ত। দক্ষিণ হস্তে জাঁতাকল, বাম হস্তে প্রকাণ্ড সিগার – বেয়াদবের মতো তাহারই পুঞ্জীভূত ধূম মুখ দিয়া অবিরত বাহির করিতেছে। মস্তকে চিমনি-আকৃতির লম্বা টুপি। পৃষ্ঠদেশ ব্যাপিয়া বিরাট চক্র। রক্ত-বস্ত্র, রক্ত-দেহ। তাহার পৃষ্ঠে চক্রের সাথে সাথে সেও অনবরত ঘুরিযা ফিরিতেছে।
ইঁট, কাঠ, পাথর, যেন নেশা খাইয়া ঝিমাইতেছে। কেবল লৌহের উজ্জ্বল কঠিনদৃষ্টি।
ইঁটের পরনে পিরান ও সুর্কি-রং চাহারখানার ঢিলে আরবি পায়জামা। মাথায় লালরঙা চৌকো টুপি, খর্বকায়, অলস-দৃষ্টি সিমেন্ট-রং-রঞ্জিত মুখ। পায়ে চৌকো বুট।
কাঠ। স্থূল কর্কশ বস্ত্র শীর্ণকায় দীর্ঘাকৃতি, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, বিশুষ্ক মুখ। শির নাঙ্গা। ম্লান দৃষ্টি, নখ চুল বড়ো বড়ো।
পাথর। মুখ চোখ বস্ত্র ধূমল বর্ণ। স্থূল কদাকার, কতকটা কচ্ছপের মতো। যেন শুধু পেট আর মাথা। শিরে জবড়জং কৃষ্ণ-উষ্ণীষ। হাত পা ভারী ভারী। মুখ চ্যাপটা, চোখ ছোটো।
লোহা। আলকাতরা-রং – দীর্ঘাকৃতি, বলিষ্ঠ-দেহ, কঠোর-দৃষ্টি, বদ্ধ-মুষ্ঠি তিক্ত-কণ্ঠ। আঁট-সাট জামা।
[যন্ত্র, ইঁট, কাঠ, পাথর, লোহা বদ্ধাঞ্জলি হইয়া বন্দনাগীত গাহিতেছে।]

গান

নমো হে নমো যন্ত্রপতি নমো নমো অশান্ত।
তন্ত্রে তব ত্রস্ত ধরা, সৃষ্টি পথভ্রান্ত॥
বিশ্ব হল বস্তুময়
মন্ত্রে তব হে,
নন্দন-আনন্দে তুমি
গ্রাসিলে মহাধ্বান্ত॥

শংকর হে, সে কোন্ সতী-শোকে হয়ে নৃশংস
বসেছ ধ্যানে, হয়েছ জড়, সাধিতেছ এ ধ্বংস।
রুক্ষ তব দৃষ্টি-দাহে
শুষ্ক সব হে,
ভীষণ তব চক্রাঘাতে
নির্জিত যুগান্ত॥
যন্ত্র :
আর তো আমাদের পথ এগোয় না রাজা, সামনেই খরস্রোতা পদ্মা – স্বর্গের নিষেধ-বাণীর মতো।
যন্ত্রপতি :
ওকে ওর গতি লঘু করতে বলো!
যন্ত্র :
জানি রাজা, বহু স্রোতস্বতী তোমার আদেশ পালন করেছে, কিন্তু পদ্মা তাদের সম্রাজ্ঞী!
যন্ত্রপতি :
তুমি ভুলে যাচ্ছ সেনাপতি যে, আমিও সম্রাট। ওকে বলো – এ আমার আদেশ!
যন্ত্র :
যে-মন্দাকিনী ইন্দ্ররাজের ঐরাবতকে তৃণকণার ন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল – এ তারই জ্যেষ্ঠা কন্যা। তার তরঙ্গ-সেনার হুহুংকারে প্রলয়-নর্তনে ধরণি প্রকম্পিত!
যন্ত্রপতি :
ধরণি প্রকম্পিত হতে পারে – আমি নয়। ওকে খবরটা পৌঁছে দাও – ওর বুকের উপর দিয়ে প্রস্তুত হবে আমার পথ!
যন্ত্র :
সে খবর সে শুনেছে, রাজা। তার তরঙ্গ-সেনা পর্যন্ত এ খবর শুনে ফেনা ছুঁড়ে বিদ্রুপ করে!
ইঁট :
মনে হয়, যেন গায়ে থুথু দিয়ে অপমান করলে!
যন্ত্র :
আরে বাপু, তুমি থামো! – রাজা, এ অভিযানে তোমায় অধিনায়কত্ব করতে হবে।
যন্ত্রপতি :
তুমি কি ওর হাঙ্গর-কুমির দেখে ভয় পেয়ে গেলে সেনাপতি?
যন্ত্র :
না রাজা, আমার ভয় শক্ত-কিছু নিয়ে নয়, ভয় আমার ওই তরল তরঙ্গসেনাকে। ও যদি কামড়াত, তাহলে আমার ভয়ের কিছু ছিল না, কিন্তু ও তো কামড়ায় না – শুধু সমস্তক্ষণ ঠেলে! ধরতে গেলে আঙুলের ফাঁক দিয়ে যায় গলে!
পাথর :
আজ্ঞে, বেটা একে মনসা, তাতে আবার ধুনোর গন্ধ ওই পবন ব্যাটা। ও যখন এসে যোগ দেয়, তখন আমার এই কাবুলি বপুখানিকেও তুর্কি নাচন নাচিয়ে ছাড়ে!
ইঁট :
আজ্ঞে, আর আমাকে তো সুরকি-গুঁড়ো করে দেয়!
কাঠ :
আমার খাতির ততোধিক! কান ধরে নাকানি-চুবানি খাওয়াতে খাওয়াতে যখন দেয় রাম-ছুট, তখন দু-পাশের লোক বলে – মড়া ভেসে যাচ্ছে।
লোহা :
(সগর্বে) আমি বরং গলায় কলসি বেঁধে ডুবে মরি, তবু ওদের মতো ভেসেও যাই না, ভেঙেও পড়ি না!
পাথর :
হাঁ, তাই থাপ্পড় কষিয়ে তোমার মুখটা দেয় নয়ের মতো করে বেঁকিয়ে – তার পর বেশ করে বালি চাপা দিয়ে – দেয় জ্যান্ত কবর!
যন্ত্র :
চুপ করো সব! – তোমাদের সমবেত শক্তি দিয়ে ওকে প্রতিরোধ করতে হবে – একলা যে যাবে তাকেই অকূলে ভাসতে হবে!
কাঠ :
ভাসতে হয় তো সকলেই হবে সেনাপতি, তবে এবার সকলে একসাথে ভাসব – এই যা সান্ত্বনা! বাবা, পদ্মার যে চেহারা দেখে এসেছি তা মনে করলে এখনও কাঠ হয়ে যেতে হয়! স্রোত তো নয় – যেন লাখে লাখে পাহাড়ে অজগর ফোঁসাচ্ছে – মোচড় খাচ্ছে। তার পর কুমিরগুলো যেন খেজুর-গুঁড়ির ঢেঁকি। (অন্য দিকে চাহিয়া) হাঙরগুলোর মুখ কিন্তু আমাদের সেনাপতিরই মতো!
যন্ত্র :
দেখো, তুমি বড়ো হালকা। তোমাদের দুর্বলতায় রাজা ক্রুদ্ধ হচ্ছেন।
যন্ত্রপতি :
সেনাপতি, আমি এখন চললাম। তোমরা প্রস্তুত হও – পদ্মাকে শাসন করতেই হবে। [প্রস্থান]
পাথর :
আচ্ছা সেনাপতি, রাজার অত আক্রোশ কেন ওই জলধারার ওপর? ওকে কি না বাঁধলেই নয়? আমরা ওকে কি ডিঙিয়ে যেতে পারিনে? তা হলে খাসা হত কিন্তু! ধরি মাছ, না ছুঁই পানি। তখন একবার দেখে নিতাম – ওর তরঙ্গ-সেনা কত লাফাতে পারে? আমরা হাত ধরাধরি করে দাঁড়ালে বোধ হয় ওকে আলগোছে ডিঙিয়ে যেতে পারি।
যন্ত্র :
সে চিন্তার ভারটা আমার উপরেই ছেড়ে দাও। তোমাদের যা বলি তাই করো এখন। – আমাদের যন্ত্রপতি স্বর্গ জয় করতে চান, তাঁর যন্ত্ররথের পথের বাধা ওই বিপুল স্রোতধারা – ও যেন স্বর্গের গড়খাই – ওর তরঙ্গ যেন স্বর্গের সীমান্তরক্ষী সৈন্য। ওকে জয় করতে পারলেই স্বর্গজয় সহজ হয়ে উঠবে।
ইঁট :
স্বর্গের সরস্বতীকে তো আগেই বন্দী করেছি সেনাপতি, তাঁর বীণার তারকে বেতার-যন্ত্রের কাজে লাগিয়েছি – তাঁর পদ্মবনকে করেছি কাঠ-গুদাম! স্বর্গে আর আছে কী?
যন্ত্র :
(পাথরের প্রতি) দেখো, তোমায় ভারিক্কি বলেই জানতাম – তোমাকেও দেখছি হালকা কাঠের ছোঁয়াচ লাগল! – (কাঠের প্রতি) দেখো, তোমার হালকা হওয়ায় কিন্তু একটা সুবিধাও আছে। তোমায় তরঙ্গ সহজে ডুবাতে পারে না। ভেসে এক জায়গায় কূলে ঠেকবেই!
পাথর :
আজ্ঞে, ডুবলে কিন্তু ভরাডুবি!
যন্ত্র :
আঃ, থামো তুমি! (কাঠের প্রতি) দেখো, তোমায় নৌকা হয়ে দেখে আসতে হবে – কোথায় পদ্মার তরঙ্গ-সেনা উদাসীন, কোথায় ওর গতিবেগ লঘু।
লোহা :
আচ্ছা, সেনাপতি, পদ্মাকে কি বন্দিনী করবে?
যন্ত্র :
না। তা করতেও পারব না, আর পারলেও করতাম না। আমরা পদ্মাকে চাই না – চাই স্বর্গলক্ষ্মীকে। এই স্রোতের জল সেই স্বর্গের প্রাণধারা। এই প্রাণ-ধারার গতিবেগ সংযত করা ছাড়া একেবারে বন্ধ করলে যার জন্যে এই অভিযান, হয়তো সেই স্বর্গলক্ষ্মীকে হারাব – এবং পাব দক্ষযজ্ঞের সতীকে! আমাদের রাজমন্ত্রী কৌটিল্য তা হতে দেবেন না।
কাঠ :
কই সেনাপতি, মন্ত্রী কৌটিল্যকে তো দেখতে পেলুম না কখনও।
যন্ত্র :
সবচেয়ে মূল্যবান যে, তাকে রাখতে হয় সবচেয়ে গোপনে। মন্ত্রী কৌটিল্যই হল আমাদের রাজ্য-রক্ষার রক্ষাকবচ। আমরা সকলে, মায় রাজা পর্যন্ত, ওই কৌটিল্যেরই অস্তিত্বের প্রত্যক্ষ নিদর্শন।
পাথর :
ঠিক বলেছে সেনাপতি, দুর্বুদ্ধি যিনি, তিনি থাকেন দেখার অতীত হযে। ষড়যন্ত্রকে দেখতে যাওয়া দুরাশা!
ইঁট :
আমারও তাই মনে হয়, সেনাপতি, জগৎটাকে সৃষ্টি যেই করুক – ওর মালিক যেই হোক – ওকে চালায় কিন্তু শয়তান!
যন্ত্র :
ওহে, তোমাদের কথাবার্তায় রাজদ্রোহের গন্ধ পাচ্ছি। রাজার এবং ভগবানের দোষ-ত্রুটি নিয়ে আলোচনা করলে তার শাস্তি কী, জান?
কাঠ :
জেল কিংবা নরক। – এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায় দেখ!
যন্ত্র :
এই! চুপ! চুপ! ওই রাজা আসছেন, শুনলে আর রক্ষে থাকবে না।
যন্ত্রপতি :
সেনাপতি! আজই যাত্রা করো পদ্মাতীরে তোমার সৈন্য-সামন্ত নিয়ে। সৈন্য পরিচালনের ভার আমিই গ্রহণ করব। (ইঁট, কাঠ, পাথর, লোহার প্রতি)!প্রিয় সৈনিকগণ! তোমাদেরই আত্মদানে আমার এই বিশাল সাম্রাজ্য। এর যা কিছু গৌরব, যা কিছু প্রতিষ্ঠা – সব তোমাদেরই। আমাদের এ যুদ্ধ স্বর্গ-মর্ত্যের চিরন্তন যুদ্ধ। এ যুদ্ধ জড় ও জীবের, বস্তু ও প্রাণের, মৃত্যু ও মৃত্যুঞ্জয়ের! অমৃতে আমাদের অধিকার নেই, তাই আমরা অমৃতকে তিক্ত করে তুলতে চাই! যে-বেদনা আজ মহাজড়, সেই বেদনার বিক্ষোভে দেবতার আনন্দকে পঙ্কিল করে তুলতে চাই। প্রকৃতিকে আমরা বশীভূত করেছি – এইবার স্বর্গরাজ্য জয়ের পালা। আমাদের পথের প্রধান প্রতিবন্ধক ওই মুক্ত স্রোতস্বতী – আনন্দলোকের গোপন প্রাণ-ধারা। ওকে বাঁধব না – ওর বুকের উপর দিয়ে চলে যাব আমাদের চলার চিহ্ন এঁকে। –স্বর্গের আনন্দলক্ষ্মী করবে এই জড় জগতের পরিচর্যা – এই দম্ভের দীপ্ত তিলক তোমরা পরাও এই মর্ত্যলোকের লাঞ্ছিত ললাটে। অহংকারের এই উদ্ধত পতাকা স্বর্গের বুকে প্রতিষ্ঠা করো, বীর!
সকলে :
জয় যন্ত্রপতি কী জয়! জয় যন্ত্রপতি কী জয়!!
যন্ত্র :
সৈন্যগণ, গাও আমাদের সেই যাত্রাপথের কুচকাওয়াজের গান!

গান

চরণ ফেলি গো মরণ ছন্দে
মথিয়া চলি গো প্রাণ।
মর্ত্যের মাটি মহীয়ান করি
স্বর্গেরে করি ম্লান॥
চিতার বিভূতি মাখিয়া গায়
লজ্জা হানি গো অন্নদায়,
বাঁধিয়াছি বিদ্যুল্লতায়,
দেবরাজ হতমান॥
পাতাল ফুঁড়িয়া করি গো মাতাল
রসাতল-অভিযান॥

তৃতীয় দৃশ্য

[সিংহাসনারূঢ়া মকর-বাহিনী পদ্মা। পরনে জল-তরঙ্গ শাড়ি, হাওয়ায় কেবলই ঝিলমিল করিতেছে। গায়ে কাঁচা রৌদ্র-কিরণের উড়ুনি। কাশ-বন চামর ঢুলাইতেছে। বেলা-ভূমে হাঙ্গর কুম্ভীর প্রহরীর কার্য করিতেছে। দুই তীরে বালুচরের শ্বেত পর্দা ঝুলানো। অগণিত মীন-সেনা সিংহাসনের চারিপাশে পায়চারি করিয়া ফিরিতেছে। জলদেবী গণ বন্দনা-গান গাহিতেছে।]

নমো নমো নমো হিম-গিরি –সূতা
দেবতা-মানস-কন্যা।
স্বর্গ হইতে নামিয়া ধূলায়
মর্ত্য করিলে ধন্যা॥
আছাড়ি পড়িছ ভীষণ রঙ্গে
চূর্ণি পাষাণ ভীম তরঙ্গে,
কাঁপিছে ধরণি ভ্রুকুটি ভঙ্গে,
ভুজঙ্গ-কুটিল বন্যা॥
কূলে কূলে তব কন্যা কমলা
শস্যে-কুসুমে হাসিছে অচলা,
বন্দিছে পদ শ্যাম-অঞ্চলা
ধরণি ঘোরা অরণ্যা॥

[জলদেবীদের নাম –তরঙ্গিণী, সলিলা, অনিলা, তটিনী, নির্ঝরিণী, বালুকা।]
পদ্মা :
তোদের এ গান থামা, তরঙ্গিণী। এ বন্দনা-গান আজ আমার গায়ে বিদ্রুপের মতো বিঁধছে।
তরঙ্গিণী :
জানি মা, তোমার বেদনা কত বিপুল। কিন্তু যন্ত্রপতির এ স্পর্ধার দণ্ড কি আমরা দিতে অসমর্থ, মা?
পদ্মা :
আপাতত তো তাই মনে হচ্ছে তরঙ্গিণী। কত বাধাই না দিলাম। যন্ত্রপতির অগণিত সেনা-সামন্ত আজও আমার বালুচরের তলে তাদের সমাধি রচনা করে পড়ে রয়েছে, তবু তো তাকে আটকে রাখতে পারলাম না। সে আমার বুকের ওপর দিয়ে তার উদ্ধত যাত্রা-পথ রচনা করে গেল। (অদূরে সেতু-বন্ধ দেখা যাইতেছিল, সেই দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া) ওই দেখেছিস তার সেতু-বন্ধ? ও যেন কেবলই আমার মাথায় চড়ে বিদ্রুপ করছে! অসহ্য তরঙ্গিণী, অসহ্য এ অপমান!
সলিল :
কী চতুর ওই যন্ত্রপতিটা, মা! কাপুরুষ – আমাদের ভয়ে আমাদের নাগালের বাইরে ওর পথ রচনা করেছে। পেতাম ওকে তরঙ্গের মুখে, তা হলে ওর ওই আকাশস্পর্শী স্পর্ধার মুখের মতো শাস্তি দিয়ে ছাড়তাম!
বালুকা :
তাহলে এতদিন ওই বালুচর হত ওর সমাধি।
পদ্মা :
যুদ্ধজয় শুধু শক্তি দিয়ে হয় না, সলিলা, শক্তির চেয়ে বুদ্ধিরই বেশি প্রয়োজন বড়ো যুদ্ধে।
অনিলা :
আচ্ছা মা, ওর পথ না হয় আমাদের নাগালের ঊর্ধ্বেই রইল, কিন্তু ও-পথের মূল তো রয়েছে আমাদেরই বুকের উপর প্রোথিত। সে-মূলকে কি আমরা উপড়ে ফেলতে পারিনে?
পদ্মা :
আমার শক্তিহীন তরঙ্গ-সেনাকে সে কথা জিজ্ঞেস করো অনিলা। সে চেষ্টা আমাদের ব্যর্থ হয়েছে। প্রথমবার – কেন, বহুবারই আমরা তাদের ও পথমূলকে উচ্ছেদ করেছি, কিন্তু আর পারা গেল না। ওর বিপুল ভারকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার শক্তি আর আমার তরঙ্গসেনার রইল না!
নির্ঝরিনী :
আচ্ছা, মা আমরা তো পারলাম না। কিন্তু আমাদের এ-অপমান – এই পরাজয় দেখে স্বর্গের দেবতারা কী করে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে রইলেন, তাই ভাবছি। তুমি আকাশের দেবতাদের আহ্বান করো না একবার!
পদ্মা :
আমি দেবরাজ ইন্দ্রের সাহায্যও চেয়েছি, নির্ঝরিণী। দেবরাজ তাঁর মেঘ-রথে চড়ে দেখেও গেছেন সব। তিনিও যে যন্ত্রপতির এই অতি বিপুল স্থূলকায় দেখে বিস্মিত – হয়তো বা ভীতও হয়েছেন। আমার মরাল দূতী এই সেদিন ফিরে এসেছে। তিনি বলেছেন, এর জন্য তাঁকে বড়ো রকম প্রস্তুত হতে হবে। পরাজয়ের লজ্জাকে তাঁর অতিমাত্রায় ভয়!
তটিনী :
কিন্তু মা, অসুরের হাতে দেবরাজের পরাজয় তো বহুবারই হয়ে গেছে।
পদ্মা :
বারে বারে পরাজিত হয়েই তো তাঁর এত ভয়, তটিনী! তাঁর পরাজয়ের পথ অনুসরণ করে যদি অসুরের দল আবার স্বর্গ আক্রমণ করে!
[হঠাৎ ঊর্ধ্বে মেঘের দামামা-ধ্বনি শোনা গেল। পদ্মাদেবী উৎকর্ণ হইয়া উঠিলেন।]
পবন :
(হাঁপাইতে হাঁপাইতে আসিয়া) দেবী! স্বর্গে দামামা বেজে উঠেছে। আমার অগ্রজ দেবরাজ সেনাপতি ঝঞ্ঝা তাঁর সৈন্যসামন্ত নিয়ে এসে পড়লেন বলে! আদেশ দিন দেবী, আমি আমাদের সৈন্যসামন্তদের প্রস্তুত হতে বলি।
পদ্মা :
(উত্তেজনায় দণ্ডায়মান হইয়া) তুমি প্রস্তুত হও সেনাপতি! এখনই তরঙ্গ-সেনাদলকে কূলে কূলে দামামা-ধ্বনি করতে বলো। সকলে যেন তাদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত থাকে। আমি দেবরাজ সেনাপতিকে অভ্যর্থনা করে আনি। জয় মা ভবানী! (পদ্মা শ্বেতমরালীর ডানায় চড়িয়া ঊর্ধ্বে উড়িয়া গেলেন। তরঙ্গ-সেনা, হাঙ্গর, কুমির, মীনদল, জলদেবীগণ অতি ব্যস্ততা-সহকারে বাহির হইয়া গেল। পশ্চিম গগন অন্ধকার করিয়া কৃষ্ণমেঘ দেখা দিল। দেখিতে দেখিতে মেঘ সারা আকাশ ছাইয়া ফেলিল। ঊর্ধ্বে ভীষণ শনশন শব্দে ঝঞ্ঝা আসিয়া উপস্থিত হইল। পদ্মার জল সম্ভ্রমে বিস্ময়ে স্তব্ধ হইয়া যেন দেবরাজ সেনাপতিকে অভিবন্দনা জ্ঞাপন করিল।)
[ঝঞ্ঝার উচ্ছৃঙ্খল ঝামর-কেশ ত্রস্ত স্কন্ধ হইতে স্খলিত হইয়া ধরায় লুটাইয়া পড়িতেছে। হস্তে ধূলি-গৈরিক পতাকা। কর-খর্পরে ধূমায়িত অগ্নি। বক্ষদেশে বিদ্যুতের যজ্ঞোপবীত। চরণে খর-ধ্বনি নূপুর। নয়নে বজ্রাগ্নি-জ্বালা। বাহুতে ছিন্ন শৃঙ্খল। দিগন্ত-ছাওয়া কুটিল ভ্রু-ভঙ্গি। নিযুত বাসুকি কোটি ফণা বিস্তার করিয়া ছত্র ধরিয়াছে। তাহাদের নিশ্বাসের শব্দে স্বর্গ-মর্ত্য শিহরিয়া উঠিতেছে। – যেন দ্বিতীয় প্রলয়ের শংকর।]

অন্তরীক্ষে গান

হর হর শংকর! জয় শিব শংকর!
দানব-সন্ত্রাস জয় প্রলয়ংকর!
জয় শিব শংকর॥
নিপীড়িত জন-মন-মন্থন দেবতা!
আনো অভয়ংকর স্বর্গের বারতা!
জাগো মৃত্যুঞ্জয় সংঘাত-সংহর।
জয় শিব শংকর॥
এসো উৎপীড়িতের রোদনের বোধনে
বজ্রাগ্নির দাহ লয়ে রোষ-নয়নে॥
ভীম কৃপাণে লয়ে মৃত্যুর দণ্ড
দৈত্যারি-বেশে এসো উন্মাদ চণ্ড
ধ্বংস-প্রতীক মরু-শ্মশান-সঞ্চর!
জয় শিব শংকর॥

[ঊর্ধ্বে ঝঞ্ঝা, পদ্মা, বজ্রশিখা, মেঘ, পবন। নিম্নে তরঙ্গ-সেনা, সেতু জলদেবীগণ, মীনকুমারীগণ, ভারবাহী পশু ও মানুষ, পীড়িত মানবাত্মা।]
ভারবাহী মানুষ :
(অন্তরীক্ষ লক্ষ করিয়া) জাগো দেবতা! আর এ ভার বইতে পারিনে। যন্ত্র-রাজা আমাদের ক্ষুধার অন্নের বিনিময়ে আমাদের সর্বস্ব হরণ করেছে। আমাদের আত্মাকে হত্যা করে পশু করে তুলেছে। আমাদের পিঠে হয়েছে কুব্জ, আমাদের দেহ হয়েছে রোগ-জীর্ণ, খর্ব। আমাদের কর্তব্য হয়েছে ওদের ভার বহন। জাগো, দেবতা, জাগো!
ভারবাহী পশু :
জাগো রুদ্র জাগো! নিপীড়িত কুলিরও অধম হয়েছি আমরা। যন্ত্ররাজের পশুত্ব আমাদেরও নীচে গিয়ে পৌঁছেছে। ক্ষুধায় তৃষ্ণায় ওষ্ঠাগত-প্রাণ আমরা। আমরা দিবসে হই তার ভারবাহী, নিশীথে হই ক্ষুধার আহার্য। জাগো রুদ্র, এই অপমৃত্যুর হাত হতে আমাদের রক্ষা করো!
পদ্মা :
ওই শোনো, শোনো দেবরাজ-সেনাপতি! নিম্নে পীড়িত মানবাত্মা, ভারবাহী পশুর ক্রন্দন-ধ্বনি! আমারই কূলে ওরা ওদের শান্ত নীড় রচনা করেছিল। যন্ত্রপতি ওদের ধরে আমারই সর্বনাশ করিয়েছে। হানো তোমার বজ্রাঘাত, আর আমি সইতে পারিনে!
ঝঞ্ঝা :
মাভৈঃ! ভয় নাই দেবী। যন্ত্ররাজের পাপের ভরা পূর্ণ হয়েছে। ওকে আরও অগ্রসর হতে দিতে দিলে আমাদের স্বর্গের সদর-দ্বারে গিয়ে সে হানা দিবে। আমি বিধাতার ইঙ্গিত নিয়ে এসেছি। (বজ্রকে দেখাইয়া) ওই দেখো তার মৃত্যুদণ্ড – জ্বলন্ত অগ্নি-শিখায় লিখা! – পবন! মেঘরাজ! – তরঙ্গসেনা! – বন্যাধারা! সকলে প্রস্তুত তো?
[ঊর্ধ্বে ও নিম্নে সমবেত কণ্ঠের জয়ধ্বনি উত্থিত হইল। সেতু-বন্ধ কাঁপিয়া উঠিল।]
এইবার আমাদের প্রলয়-নাচের পালা শুরু হোক।… দেবী! তুমি নিম্নে গিয়ে তোমার তরঙ্গসেনা বন্যাধারাকে পরিচালিত করো। … পবন! তুমি তোমার পরিপূর্ণ গতিবেগ নিয়ে সেতু-বন্ধের ঊর্ধ্বদেশ আক্রমণ করেো। বন্যা-ধারাকে, তরঙ্গ-সেনাদলকে পশ্চাতে থেকে শক্তি দাও, সাহস দাও, পরিচালিত করো, ওদের মাঝে আরও আরও গতিবেগ সঞ্চারিত করো। মেঘ! তুমি সাগর শূন্য করে সকল গিরি-শির রিক্ত করে জলধারা বর্ষণ করো! তরঙ্গ-সেনা তোমার শক্তিতে, অধীর উন্মাদনায় উন্মত্ত ফেনায়মান হয়ে উঠুক!… বজ্রশিখা! তুমি তোমার অগ্নিদণ্ড নিয়ে সেতু-বন্ধের শিরোদেশে, পদমূলে আঘাতের পর আঘাত করো। – ধরণিধর বাসুকীকে খবর দাও, সে তার ফণা আস্ফালন করে ধরণিকে কাঁপিয়ে তুলুক। ভেঙে ফেলুক ওই অসুরের দম্ভ সেতু-বন্ধ!
[ঊর্ধ্বে নিম্নে ঘন ঘন জয়ধ্বনি উঠিতে লাগিল – “জয় গন্ধর্ব-লোকের জয়! জয় দেবরাজ ইন্দ্রের জয়! জয় মা ভবানী! জয় শংকর”!… পৃথিবী টলমল করিয়া উঠিল। ঘন ঘন বজ্রপাত ও অবিরল ধারে বৃষ্টি হইতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে পদ্মার ঢেউ ভীম নর্তনে দুই কূল প্লাবিয়া তুলিল। তরঙ্গ-সেনাদলের গিরিমাটি-রাঙা উত্তরীয় পবন-বেগে উৎক্ষিপ্ত হইয়া উঠিল। জলদেবীগণ, মীনকুমারীগণ, হাঙ্গর, কুমির – সকলে উন্মত্ত হইয়া উঠিল। সকলে সেতুবন্ধে আঘাত করিতে লাগিল। ক্রমে শত শবভারবাহী মানুষ ও পশুর দল হাতুড়ি শাবল গাঁইতি এবং শৃঙ্গ লইয়া সেতুবন্ধকে আক্রমণ করিল। সেতুবন্ধ কাঁপিয়া উঠিল।]
সেতু :
জয়, যন্ত্ররাজের জয়! সাবধান স্বর্গ স্বর্গ-বিলাসীর দল! ও-আঘাত আমার অচেনা নয়। বহুবার ওর শক্তি পরীক্ষা করেছি। (হঠাৎ বজ্রাঘাতে টলমলায়মান হইয়া) উঃ! যন্ত্ররাজ! আর পারিনে। দেবতাই বুঝি জয়ী হল!
(বাষ্পরথে সসৈন্যে যন্ত্ররাজের আগমন)
যন্ত্ররাজ :
জাগো যন্ত্ররাজ-সেনা, জাগো! স্বর্গের চক্রান্তকে চিরদিনের মতো ব্যর্থ করতে চাই। আজকার জয় দিয়ে স্বর্গরাজ্য জয়ের কল্পনা বাস্তবে পরিণত করতে হবে। জাগো যন্ত্রী, জাগো সেনাদল!
[ইঁট, কাঠ পাথর প্রভৃতি যন্ত্ররাজ-সেনার ও সেনাপতি যন্ত্রের ঘন ঘন জয়ধ্বনি করিতে লাগিল।…দেবাসুরের ভীষণ রণ-কোলাহল ক্লেদে ধরণি আকাশ পঙ্কিল ধূম্রাক্ত হইয়া উঠিল।]
ঝঞ্ঝা :
কোথায় নিশিত পাশুপতাস্ত্র! জাগো! দেবতার উদ্যত দণ্ড হয়ে যন্ত্ররাজের বক্ষ ভেদ করো। সাবাস! (পাশুপতাস্ত্র নিক্ষেপ ও যন্ত্ররাজের পতন। সঙ্গে সঙ্গে সেতুবন্ধও ভীষণ শব্দে পদ্মাগর্ভে নিপতিত হইল।)
পদ্মা :
জয় মা ভবানী। জয় দেব-শক্তির! গন্ধর্ব-লোকের জয়! (যন্ত্ররাজের বুকে ত্রিশূল হানিয়া) আজ হতে মর্ত্যে পশুর রাজত্বের অবসান হল! (যন্ত্ররাজের বিকট আর্তনাদে আকাশ যেন ফাটিয়া চৌচির হইয়া গেল।)
ঝঞ্ঝা :
জয় দেবরাজ ইন্দ্রের! জয় মন্দাকিনী-সূতা পদ্মাদেবী! আজ গন্ধর্ব-লোকের সাথে স্বর্গও অসুর-ত্রাস থেকে মুক্ত হল। জয় শিব শংকর!
[তরঙ্গ-সেনাদল দলে দলে আসিয়া পতিত সেতুবন্ধের উপর পড়িয়া তাহাকে গ্রাস করিতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে বিপুল সেতুবন্ধ পদ্মাগর্ভে লীন হইল। উৎক্ষিপ্ত তরঙ্গ গগন-চুম্বন-প্রয়াসী হইয়া উঠিল।…দেখিতে দেখিতে মেঘ কাটিয়া গিয়া পূর্ব গগন রাস-রঙা রামধনু-শোভিত হইয়া উঠিল। অস্তপাট সোনার গোধূলি-রঙে রাঙিয়া উঠিল। সূর্যদেব সহস্র কর বর্ষণ করিয়া পৃথিবীকে আশীর্বাদ করিলেন। পদ্মা তরঙ্গ-শিরে একরাশ ছিন্ন শতদল লইয়া স্বর্গের পানে তুলিয়া ধরিলেন, ঝঞ্ঝার ধূর্জটি-কেশে পরাইয়া দিলেন। দূর মেঘ-লোকে বিজয়-দামামা-ধ্বনি শ্রুত হইতে লাগিল।]
যন্ত্র :
(মৃত্যু-কাতর কণ্ঠে) আমার মৃত্যু নাই। দেবী! আজ তোমারই জয় হল। দেবতার মতো দানবও বলে, – ‘সম্ভবামি যুগে যুগে।’ আমি আবার নতুন দেহ নিয়ে আসব। আবার তোমার বুকের ওপর দিয়ে আমার স্বর্গজয়ের সেতু নির্মিত হবে।
পদ্মা :
জানি যন্ত্ররাজ! তুমি বারেবারে আসবে, কিন্তু প্রতিবারেই তোমায় এমনি লাঞ্ছনার মৃত্যু-দণ্ড নিয়ে ফিরে যেতে হবে!

যবনিকা

Exit mobile version