Site icon BnBoi.Com

দুনিয়া কাঁপানো ভূতের গল্প – অনীশ দাস অপু

দুনিয়া কাঁপানো ভূতের গল্প

দুনিয়া কাঁপানো ভূতের গল্প

 

ভূমিকা

বইয়ের নাম দেখেই অনুমান করা যাচ্ছে এতে কি ধরনের গল্প আছে। এ বইয়ে যাদের গল্প রয়েছে তারা প্রায় সকলেই বিশ্বখ্যাত হরর রাইটার। প্রচুর ভালো ভালো ভূতের গল্প লিখেছেন তাঁরা। সেসব গল্প থেকে সেরা গল্পটি বাছাই করা খুবই দুঃসাধ্য কাজ। তবু আমি চেষ্টা করেছি এ সংকলনে এ লেখকদের খুব ভালো গল্প দিতে।

এডগার অ্যালান পোর যে দুটি গল্প এখানে দেওয়া হয়েছে তা তাঁর সেরা ভৌতিক গল্পগুলোর মধ্যে সেরা। গাই প্রেস্টনের গা ছমছমে সরাইখানার ভূত-এর বিষয়েও আমার একই ধারণা! রোজমেরি টিম্পারলির ক্রিসমাস মিটিং তাঁর সবচেয়ে সাড়া জাগানো ভূতের গল্প। রাসকিন বন্ড প্রচুর ভূতের গল্প লিখেছেন। বানরের প্রতিশোধ তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি। গি দ্য মোপাসাঁর লাশ এর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। লাফসাডিও হিয়ার্ন জগদবিখ্যাত হয়ে আছেন চাইনিজ এবং জাপানি ভূতের গল্প লিখে। তাঁর দারুণ একটি জাপানি ভৌতিক গল্প এ বইতে সন্নিবেশিত হলো। আলজারনন ব্ল্যাকউডের সেরা একটি ভূতের গল্প এ সংকলনে দেওয়া হলো। আশা করি সবকটা গল্পই কিশোর পাঠকদের মুগ্ধ ও চমকিত করবে!

অনীশ দাস অপু

 

 

এক ভয়ংকর রাত – লাফসাডিও হিয়ার্ন

অনেক অনেক দিন আগে জাপানের ছোট একটি গায়ে বাস করত এক গরিব চাষা এবং তার বউ। তারা দুজনেই ছিল বেজায় ভালোমানুষ। তাদের অনেকগুলো বাচ্চা। ফলে এতগুলো মানুষের ভরণপোষণ করতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠে যেত চাষার। বড় ছেলেটির বয়স যখন চৌদ্দ, গায়ে-গতরে বেশ বলিষ্ঠ, সে বাপকে কৃষিকাজে সাহায্য করতে নেমে পড়ল। আর ছোট মেয়েগুলো হাঁটতে শেখার পরপরই মাকে ঘরকন্নার কাজে সহযোগিতা করতে লাগল।

তবে চাষি-দম্পতির সবচেয়ে ছোট ছেলেটি কোনো শক্ত কাজ করতে পারত না। তার মাথায় ছিল ক্ষুরধার বুদ্ধি-সে তার সবকটা ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে চালাক ছিল। কিন্তু খুব দুর্বল শরীর এবং দেখতে নিতান্তই ছোটখাটো ছিল বলে লোকে বলত ওকে দিয়ে কোনো কাজ হবে না। কোনো কাজেই লাগবে না সে। বাবা-মা ভাবল কৃষিকাজের মতো কাজ করা যেহেতু ছোট ছেলের পক্ষে সম্ভব নয় কাজেই ওকে পুরোহিতের কাজে লাগিয়ে দেওয়া যাক। বাবা-মা একদিন ছোট ছেলেকে নিয়ে গায়ের মন্দিরে চলে এল। বুড়ো পুরোহিতকে অনুনয় করল, তিনি যেন তাদের ছেলেটিকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন এবং ওকে পড়ালেখা শেখান। যাতে বড় হয়ে সে মন্দিরে যজমানি (পুরোহিতগিরি) করতে পারে।

বৃদ্ধ ছোট ছেলেটির সঙ্গে সদয় আচরণ করলেন। তাকে কিছু কঠিন প্রশ্ন করা হলো। ছেলেটি এমন চতুর জবাব দিল যে তাকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করতে কোনো আপত্তি করলেন না ধর্মগুরু। তিনি ওকে মন্দিরের টোলে ভর্তি করে দিলেন। ওখানে ধর্ম শিক্ষা দেওয়া হতো।

বৃদ্ধ পুরোহিত ছেলেটিকে যা শেখালেন, সবকিছু দ্রুত শিখে নিল সে। সে গুরুর অত্যন্ত বাধ্যগত ছাত্র। তবে তার একটা দোষ ছিল। সে পড়ার সময় ছবি আঁকত। এবং তার ছবির বিষয়বস্তু ছিল বেড়াল। ওই সময় মন্দিরে বেড়ালের ছবি আঁকার ব্যাপারে নিষেধ ছিল।

একা যখন থাকত ছেলেটি, তখনই এঁকে ফেলত বেড়ালের ছবি। সে ধর্মগুরুর ধর্মীয় বইয়ের মার্জিনে ছবি আঁকত, মন্দিরের সমস্ত পর্দা, দেয়াল এবং পিলারগুলো ভরে গিয়েছিল বেড়ালের ছবিতে। পুরোহিত বহুবার তাকে এসব ছবি আঁকতে মানা। করেছেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা! ছেলেটি ছবি আঁকত কারণ না এঁকে পারত না। ছবি না আঁকলে কেমন অস্থির লাগত তার। সে ছিল অত্যন্ত প্রতিভাবান একজন। চিত্রকর। ছবি এঁকেই একদিন নাম কামানোর স্বপ্ন দেখত ছেলেটি। এ জন্য ধর্মশিক্ষায় মন দিতে পারত না। ভালো ছাত্র হবার খায়েশও তার ছিল না। ভালো। ছাত্র হতে হলে বই পড়তে হয়। কিন্তু পড়ার চেয়ে আঁকাআঁকিই তাকে টানত বেশি।

একদিন এক দেবতার পোশাকে বেড়ালের ছবি আঁকতে গিয়ে ধর্মগুরুর কাছে হাতেনাতে ধরা খেল ছেলেটি। বুড়ো খুবই রেগে গেলেন। বললেন, তুমি এখনই এখান থেকে চলে যাও। তুমি কোনো দিনও পুরোহিত হতে পারবে না। তবে চেষ্টা। করলে একদিন হয়তো বড় মাপের চিত্রকর হতে পারবে। তোমাকে শেষ একটি উপদেশ দিই শোনো। উপদেশটি কখনো ভুলো না। রাতের বেলা বড় জায়গা এড়িয়ে চলবে; ঘুমাবে ছোট জায়গায়!

গুরুর এ কথার মানে কিছুই বুঝতে পারল না ছেলেটি। এ কথার মানে ভাবতে ভাবতে সে তার ছোট বোঁচকা গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল মন্দির থেকে। গুরুকে তাঁর কথার অর্থ জিজ্ঞেস করার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু ধমক খাওয়ার ভয়ে প্রশ্ন করল না। শুধু বিদায় বলতে পারল।

মনে দুঃখ নিয়ে মন্দির ছেড়েছে ছেলেটি। কোথায় যাবে, কী করবে বুঝতে পারছে না। যদি বাড়ি যায়, পুরোহিতের কথা না শোনার অভিযোগে বাপ ওকে বেদম পিটুনি দেবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই বাড়ি যাওয়ার চিন্তা নাকচ করে দিল সে। হঠাৎ পাশের বাড়ির গাঁয়ের কথা মনে পড়ল। এখান থেকে চার ক্রোশ দূরে। ওই গাঁয়ে বিশাল একটি মন্দির আছে। মন্দিরে তরুণ-বুড়ো অনেক পুরোহিত আছেন। ছেলেটি শুনেছে ওখানেও একটি টোল আছে। সেখানে ধর্ম শিক্ষা দেওয়া হয়। সে ঠিক করল ওই গাঁয়ে যাবে। মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের হাতে পায়ে ধরে বসবে তাকে টোলে ভর্তি করানোর জন্য। ওর কাতর অনুরোধ নিশ্চয় ফেলতে পারবেন না পুরোহিত।

কিন্তু ছেলেটি জানত না বড় মন্দিরটি বহু আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। ওখানে একটা পিশাচ এসে আস্তানা গেড়েছে। পিশাচের ভয়ে পুরোহিতরা অনেক আগেই মন্দির ছেড়ে পালিয়েছেন। গাঁয়ের কজন সাহসী মানুষ পিশাচটাকে মারতে গিয়েছিল। তারা এক রাতে ছিল ওই মন্দিরে। কিন্তু পরদিন কাউকে জীবিত পাওয়া যায়নি। তাদের রক্তাক্ত, খাবলানো শরীর পড়ে ছিল মন্দিরের চাতালে। তারপর থেকে ভুলেও কেউ ওই মন্দিরের ছায়া মাড়ায় না। পরিত্যক্ত মন্দিরটি এখন হানাবাড়িতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এসব কথা তো আর ছেলেটি জানত না। সে মন্দিরের টোলে ভর্তি হওয়ার আশায় পথ চলতে লাগল।

চার ক্রোশ পথ পাড়ি দিয়ে গায়ে পৌঁছুতে পৌঁছুতে সন্ধ্যা নেমে এল। গ্রামের মানুষ এমনিতেই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে, মন্দিরে পিশাচের হামলা হওয়ার পর থেকে তারা সূর্য পশ্চিমে ডুব না দিতেই ঘরের দরজা এঁটে, বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ে। আর মন্দির থেকে ভেসে আসা বিকট, বীভৎস সব চিৎকার শুনে শিউরে শিউরে ওঠে।

মন্দিরটি গাঁয়ের শেষ প্রান্তে, একটি টিলার ওপরে। ছেলেটি মন্দিরে আলো জ্বলতে দেখল। ভুতুড়ে মন্দিরে কেউ পুজো দিতেই যায় না, আলো জ্বালা দূরে থাক। তবে লোকে বলে পিশাচটা নাকি সাঁঝবেলা আলো জ্বেলে রাখে পথ ভোলা পথচারীদের আকৃষ্ট করার জন্য। আলোর হাতছানিতে দূর গাঁ থেকে আসা মুসাফির আশ্রয়ের খোঁজে মন্দিরে ঢুকলেই পিশাচের শিকার হয়।

ছেলেটি মন্দিরের বিশাল, কারুকাজ করা পুরু কাঠের দরজার সামনে দাঁড়াল। আঙুলের গাঁট দিয়ে টুক টুক শব্দ করল। কেউ সাড়া দিল না। আবার নক করল সে। জবাব নেই। মন্দিরের সবাই এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ল নাকি! অবাক হয় ছেলেটি। একটু ইতস্তত করে দরজায় ধাক্কা দিল সে। ক্যাআআচ শব্দে মেলে গেল কপাট। ভেতরে ঢুকল ছেলেটি। মাটির একটি প্রদীপ জ্বলছে কেবল। কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছে না।

ছেলেটি ভাবল কেউ না কেউ নিশ্চয় আসবে। সে মেঝেতে বসে পড়ল। অপেক্ষা করছে। ছেলেটি লক্ষ করল মন্দিরের সবকিছুই ধুলোয় ধূসর হয়ে আছে। মাকড়সার জালে ছেয়ে গেছে প্রায় পুরোটা জায়গা। বোঝাই যায় অনেক দিন ঝাঁট পড়েনি। হয়তো ঝাঁট দেওয়ার লোক নেই। ছেলেটি মনে মনে আশান্বিত হয়ে উঠল পুরোহিত তাকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করবেন ভেবে। কারণ ঘর ঝাঁট দেওয়ার জন্য হলেও তো ওদের একজন লোক লাগবে।

জানালায় বড় বড় পর্দা ঝুলতে দেখে খুশি হয়ে গেল ছেলেটি। বাহ্, ছবি আঁকার চমৎকার ক্যানভাস পাওয়া গেছে। রঙ-পেন্সিলের বাক্স সে সঙ্গেই নিয়ে এসেছে। দ্বিরুক্তি না করে বেড়ালের ছবি আঁকতে বসে গেল।

পর্দাগুলো ভরে ফেলল সে বড় বড় বেড়ালের ছবিতে। পথ চলার ক্লান্তিতে তার ঘুম এসে গেল। সে পুঁটুলি খুলে চাদর বিছিয়ে মেঝেতেই শুয়ে পড়ার তোড়জোর করছিল, এমন সময় মনে পড়ে গেল ধর্মগুরুর কথা : রাতের বেলা বড় জায়গা এড়িয়ে চলবে; ঘুমাবে ছোট জায়গায়!

মন্দিরটি প্রকাণ্ড; আর সে একা। গুরুর কথাগুলো মনে পড়তে, অর্থ না বুঝলেও, এবার তার কেমন ভয় ভয় করতে লাগল। সে ঘুমানোর জন্য ছোট ঘর খুঁজতে লাগল। ক্ষুদ্র একটি কুঠুরিও পেয়ে গেল। কুঠুরির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। তারপর ছিটকিনি লাগিয়ে শুয়ে পড়ল মেঝেতে। একটু পরেই ঘুমিয়ে গেল।

গভীর রাতে ভয়ংকর একটা শব্দে জেগে গেল সে। মারামারি করছে কারা যেন। ফাঁচর্য্যাচ, অপার্থিব আওয়াজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জান্তব চিৎকার। এমন ভয় পেল ছেলেটি, দরজার ফাঁক দিয়েও মন্দিরের ভেতরে তাকাতে সাহস পেল না। তার। কেবলই মনে হচ্ছিল তাকালেই এমন ভয়াবহ কিছু একটা সে দেখবে যে হার্টফেল হয়ে যাবে। সে মেঝেতে গুটিসুটি মেরে পড়ে রইল। নিশ্বাস নিতেও ভুলে গেছে।

আলোর যে সূক্ষ্ম রেখা ঢুকছিল দরজার ছিলকা দিয়ে তা হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল। ছেলেটি বুঝতে পারল নিভে গেছে মন্দিরের বাতি। নিকষ আঁধারে ডুবে গেল ঘর। তবে ভীতিকর শব্দগুলো চলল বিরতিহীন। ফোঁস ফোঁস নিশ্বাসের আওয়াজ, রক্ত হিম করা গলায় কে যেন আর্তনাদ করে উঠছে মাঝে মাঝে। গোটা মন্দির থরথর করে কাঁপছে। বোঝা যাচ্ছে দরজার বাইরে মরণপণ লড়াইয়ে মেতে উঠেছে দুটি পক্ষ। অনেকক্ষণ পরে নেমে এল নীরবতা। কিন্তু ছেলেটি ভয়ে নড়ল না এক চুল। অবশেষে ভোর হলো। সোনালি আলো দরজার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ল ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে।

লুকানো জায়গা থেকে খুব সাবধানে বেরিয়ে এল ছেলেটি। তাকাল চারদিকে। দেখল মন্দিরের মেঝেতে রক্ত আর রক্ত! রক্তের পুকুরের মাঝখানে মরে পড়ে আছে গরুর চেয়েও আকারে বড় একটি দৈত্যকার ইঁদুর। মন্দিরের পিশাচ!

কিন্তু এটাকে হত্যা করল কে? মানুষজন কিংবা অন্য কোনো প্রাণী দেখা যাচ্ছে । হঠাৎ ছেলেটি লক্ষ করল সে গতরাতে পর্দায় যেসব বেড়ালের ছবি এঁকেছে, সবকটা বেড়ালের গায়ে রক্ত মাখা! সে তক্ষুনি বুঝতে পারল পিশাচ ইঁদুরটাকে তারই আঁকা বেড়ালরা হত্যা করেছে। এবং এখন সে বুঝতে পারল বৃদ্ধ পুরোহিতের সেই সাবধান বাণীর মানে-রাতের বেলা বড় জায়গা এড়িয়ে চলবে; ঘুমাবে ছোট জায়গায়।

ওই ছেলেটি বড় হয়ে খুব বিখ্যাত চিত্রকর হয়েছিল। আর তার আঁকা বেড়ালের সেই ছবিগুলো এখনো ওই মন্দিরে আছে!

 

কালো বিড়াল – এডগার অ্যালান পো

ছেলেবেলা থেকেই আমি পশুপাখি খুব ভালোবাসি। আমার স্বভাবও ছিল শান্ত। জম্ভজানোয়ার পুষতে ভীষণ ভালোবাসতাম। বড় হলাম কিন্তু স্বভাব পালটাল না।

বিয়ে করলাম অল্পবয়সে। বেশ মনের মতো বউ পেলাম। স্বভাবটি মিষ্টি। শান্ত। জম্ভজানোয়ার পোষার শখ আমার মতোই। আমাদের শখের চিড়িয়াখানায় একটা বেড়ালও ছিল। কালো বেড়াল।

শুধু কালো নয়, বেড়ালটা বেশ বড়ও বটে। বুদ্ধিও তেমনি। বেড়ালের মগজে যে এত বুদ্ধি ঠাসা থাকতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস হয় না। বউ কিন্তু কথায় কথায় একটা কথা মনে করিয়ে দিত আমাকে। কালো বেড়ালকে নাকি ছদ্মবেশী ডাইনি মনে করা হতো সেকালে। আমি ওসব কুসংস্কারের ধার ধারতাম না।

বেড়ালটার নাম পুটো। অষ্টপ্রহর আমার সঙ্গে থাকত, পায়ে পায়ে ঘুরত, আমার হাতে খেত, আমার কাছে ঘুমোত। প্লুটোকে ছাড়া আমারও একদিন চলত না।

বেশ কয়েক বছর পুটোর সঙ্গে মাখামাখির পর আমার চরিত্রের অদ্ভুত একটা পরিবর্তন দেখা গেল।

ছিলাম ধীর, শান্ত। হয়ে উঠলাম অস্থির, অসহিষ্ণু, খিটখিটে। মেজাজ এমন তিরিক্ষি হয়ে উঠল যে বউকে ধরেও মারধর শুরু করলাম। প্লুটোকেও বাদ দিলাম না।

এক রাতে মদ খেয়ে বাড়ি এসে দেখি দুটো আমাকে এড়িয়ে যেতে চাইছে। আর যায় কোথা! মাথায় রক্ত উঠে গেল আমার। খপ করে চেপে ধরলাম। ফ্যাস করে সে কামড়ে দিল আমার হাতে। আমি রাগে অন্ধ হয়ে গেলাম। পকেট থেকে ছুরি বার করে পুটোর টুটি ধরলাম এক হাতে, আরেক হাতে ধীরে সুস্থে উপড়ে আনলাম একটা চোখ।

ভোরবেলা ঘুম ভাঙবার পর একটু অনুতাপ হলো বৈকি। উত্তেজনা মিলিয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে কিন্তু দুটো আমার ছায়া মাড়ানো ছেড়ে দিল। চোখ সেরে উঠল দুদিনেই। কিন্তু আমাকে দেখলেই সরে যেত কালো ছায়ার মতো।

আস্তে আস্তে মাথার মধ্যে পশু প্রবৃত্তি আবার জেগে উঠল। যে বেড়াল আমাকে এত ভালোবাসত, হঠাৎ আমার ওপর তার এত ঘৃণা আমার মনের মধ্যে শয়তানি প্রবৃত্তিকে খুঁচিয়ে তুলতে লাগল। সে কিন্তু কোনো দিন ক্ষতি করেনি আমার। তা সত্ত্বেও ওকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার জন্য হাত নিশপিশ করতে লাগল আমার।

একদিন সত্যি সত্যিই ফাঁসি দিলাম প্লুটোকে। বাগানের গাছে লটকে দিলাম দড়ির ফাঁসে। ও মারা গেল। আমিও কেঁদে ফেললাম। মন বলল, এর শাস্তি আমাকে পেতেই হবে।

সেই রাতেই আগুন লাগল বাড়িতে। রহস্যময় আগুন। জ্বলন্ত মশারি থেকে বউকে নিয়ে বেরিয়ে এসে দেখলাম পুড়ছে সারা বাড়ি।

দেখতে দেখতে পুড়ে ছাই হয়ে গেল গোটা বাড়ি। খাড়া রইল শুধু একতলার একটা দেয়াল। পাড়ার সবাই অবাক হয়ে গেল সাদা দেয়ালের ওপর একটা কালো ছাপ দেখে। ঠিক যেন একটা কালো বেড়াল। গলায় দড়ির ফাঁস।

একরাতেই ফকির হয়ে গেলাম আমি। কালো বেড়ালের স্মৃতি ভোলার জন্য আবার একটা বেড়ালের খোঁজে ঘুরতে লাগলাম সমাজের নিচুতলায়। একদিন একটা মদের আড্ডায় দেখতে পেলাম এমনি একটা বেড়াল। বসেছিল পিপের ওপর-অথচ একটু আগেও জায়গাটা শূন্য ছিল। অবিকল প্লটোর মতোই বড়, মিশমিশে কালো। শুধু বুক ছাড়া। সেখানটা ধবধবে সাদা।

বেড়ালটার মালিকের সন্ধান পেলাম না। তবে আমি গায়ে হাত দিতেই যেন আদরে গলে গেল সে। বাড়ি নিয়ে আসার পরের দিন সকালবেলা লক্ষ করলাম-একটা চোখ নেই।

সেই কারণেই আরও বেশি করে আমার বউ ভালোবেসে ফেলল নতুন বেড়ালকে। মনটা ওর নরম। মমতায় ভরা-তাই।

যা ভেবেছিলাম, আমার ক্ষেত্রে ঘটল কিন্তু তার উল্টো। ভালোবাসা দূরের কথা-দিনকে দিন মনের মধ্যে ক্রোধ আর ঘৃণা জমা হতে লাগল নতুন বেড়ালের প্রতি। কোত্থেকে যে এত হিংসা-বিদ্বেষ রাগ মনে এল বলতে পারব না।

বেড়ালটার আদেখলেপনাও বাড়ল তালে তাল মিলিয়ে। যতই মাথায় খুন চাপতে লাগল আমার ওর প্রতি-ততই আমার গায়ে মাথায় কোলে চাপার বহর বেড়ে গেল হতভাগার। প্রতিবারেই ভাবতাম, দিই শেষ করে। সামলে নিতাম অতি কষ্টে।

বউ কিন্তু একটা জিনিসের প্রতি বারবার দৃষ্টি আকর্ষণ করত আমার। তা হলো কালো বেড়ালের সাদা বুক। প্লটোর সঙ্গে তফাত শুধু ঐ জায়গায়। সাদা ছোপটা দেখতে অবিকল ফাঁসির দড়ির মতো!

একদিন পুরোনো বাড়ির পাতাল ঘরে গেছি বউকে নিয়ে। অভাবের তাড়নায় গিয়ে পারতাম না। ন্যাওটা বেড়ালটা পায়ে পায়ে আসছে। পায়ে পা বেঁধে পড়তে পড়তে সামলে নিলাম নিজেকে। কিন্তু সামলাতে পারলাম না মেজাজ। ধা করে একটা কুড়াল তুলে নিয়ে টিপ করলাম হতচ্ছাড়া বেড়ালের মাথা-বাধা দিল আমার বউ।

বউ বাধা না দিলে সেদিনই দফারফা হয়ে যেত নতুন বেড়ালের। কিন্তু সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল বউয়ের ওপর। অমানুষিক রাগ। কুড়ালটা মাথার ওপরে তুলে বসিয়ে দিলাম ওর মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে মারা গেল স্ত্রী।

সমস্যা হলো লাশটা নিয়ে। অনেক ভেবেচিন্তে দেয়ালের মধ্যে রক্তমাখা দেহটা খাড়া করে দাঁড় করিয়ে ইট দিয়ে গেঁথে ফেললাম। প্লাস্টার করে দিলাম। বাইরে থেকে ধরবার কোনো উপায় রইল না।

বড় শান্তিতে ঘুমালাম সেরাত্রে-বেড়াল ছাড়া। কুড়াল নিয়ে খুঁজে ছিলাম তাকে বধ করবার জন্য-পাইনি।

দিন কয়েক পরে পুলিশ এসে সারা বাড়ি খুঁজল। আমি সঙ্গে রইলাম। একটুও বুক কাঁপল না। চার-চারবার নিয়ে গেলাম পাতালকুঠুরির সেই দেয়ালের কাছে।

তারপর যখন মুখ চুন করে ওরা চলে যাচ্ছে, বিজয়োল্লাসে ফেটে পড়লাম আমি। হাতের পাটি দিয়ে খটাস করে মারলাম দেয়ালের ঠিক সেইখানে যেখানে নিজের হাতে কবর দিয়েছি বউকে।

.

আচমকা একটা বিকট কান্নার আওয়াজ ভেসে এল ভেতর থেকে। সারা বাড়ি গমগম করতে লাগল সেই আওয়াজে। দেখলাম, আমার মরা বউয়ের মাথার ওপর বসে রয়েছে সেই কালো বেড়ালটা-যার বুকের কাছটা সাদা!

 

 

 

 

 

রোজমেরি হার্ট বিছানায় শুয়ে তাকিয়ে আছে ম্যান্টলপিসের ওপর ঝোলানো পোর্ট্রেটটির দিকে। বহু বছর ছবিটি চিলেকোঠায় নানির ঘরে ছিল, আজ সকালে রোজমেরির ঘরে আনা হয়েছে ওটা।

নানি মারা গেছেন তাই অন্যান্য অনেক জিনিসের মতো পোর্ট্রেটটিও বংশাধিকার সূত্রে পেয়ে গেছেন রোজমেরির মা।

এ ছবিটি তোমার প্রপিতামহের প্রপিতামহের, মিসেস হার্ট বলেছেন মেয়েকে। নেবে এটা? তোমার ঘরে টাঙিয়ে রাখবে।

সত্যি দেবে আমাকে? উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে রোজমেরি।

তা হলে খুব মজা হবে। ওঁকে দারুণ লাগছে আমার। অভিজাত… রাজকীয়। মায়ের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল সে। তুমিও অবশ্য তাই।

হেসে উঠলেন মিসেস হার্ট, মেয়ের কাঁধ চাপড়ে বললেন, রাজকীয়-ফাজকীয় বুঝি না তবে উনি ছিলেন আমার প্রপিতামহ। কাজেই চেহারায় মিল থাকতেই পারে। ব্যক্তিজীবনে ওঁর মতো হতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করব আমি। উনি খুব সাহসী ছিলেন; রানি ভিক্টোরিয়ার সময়ে যুদ্ধ করেছেন।

উনি সৈনিক ছিলেন নাকি? আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল রোজি। তার পাঠ্য বিষয়ের মধ্যে ইতিহাসও আছে, প্রাচীনকালের ইতিহাস পড়ার সময় সেই সময়ে যেন চলে যায় ও, নিজেকে ইতিহাসের একটা অংশ মনে হতে থাকে। রানি বা রাজকুমারী জাতীয় কিছু একটা ভাবে রোজমেরি নিজেকে।

প্রপিতামহ ক্রিমিয়ার যুদ্ধে মারা গেছেন, বলল ওর মা। সাংঘাতিক আহত হয়েও ব্যাটল অভ ইঙ্কারম্যানে দল নিয়ে গেছেন তিনি, যুদ্ধ করেছেন রাশানদের বিরুদ্ধে। নিজের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেননি কখনো। ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বীরের মতো যুদ্ধ করেছেন। ইতিহাস বলে, ওই যুদ্ধে জয়ী হওয়ার পেছনে প্রপিতামহের বিরাট ভূমিকা ছিল।

.

সেদিন সারাক্ষণ নিজের পূর্বপুরুষের কথা ভাবল রোজমেরি। কিন্তু তাঁকে তো শুধু প্রপিতামহ গ্রেগরি বলে ডাকা যাবে না, সংক্ষিপ্ত একটা নাম দেওয়া উচিত। অনেক ভেবে রোজমেরি ঠিক করল তাঁর পূর্বপুরুষকে শুধু গ্রেগরি নামেই ডাকবে। কারণ গ্রেগরি তার কাছে রক্ত মাংসের মানুষের মতোই বাস্তব মনে হচ্ছে। যেন ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু।

রাতের বেলা, ঘুমুবার সময় বিচিত্র এক অনুভূতি জাগল রোজমেরির। আগে আলো নিভিয়ে অন্ধকারে ঘুমাতে তার খুব ভয় লাগত। মাকে অবশ্য এ কথা কখনো বলেনি রোজি মা হাসাহাসি করবে বলে। সত্যি তো, দশ বছরের একটা মেয়ে আলো নিভিয়ে ঘুমাতে ভয় পায় শুনলে সবাই হাসবে।

তবে আজ ভয় লাগছে না। মাথার ওপর গ্রেগরির ছবি আছে বলেই হয়তো। যে লোক যুদ্ধে সেনাপতিত্ব করতে পারেন তিনি সহজেই তার আত্মীয়, ছোট একটি মেয়ের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারবেন। কাজেই রোজমেরির ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বরং, ওকে আরও সাহসী হতে হবে। ভয় পেলে নিজের পূর্বপুরুষকে লজ্জায় ফেলে দেওয়া হবে।

বিছানায় কিছুক্ষণ গড়াগড়ি দিয়ে গায়ের চাদর সরিয়ে নিঃশব্দে নেমে পড়ল রোজমেরি, দাঁড়াল জানালার সামনে, পর্দা সরাল। এরকম কাজ আগে কখনো করেনি সে। জানালা সব সময় বন্ধ রেখেছে রোজি। কারণ চাঁদের আলো পড়ে দেয়ালে ভ্যাম্পায়ার আকৃতির যেসব নকশা তৈরি করে, রোজমেরি খুবই ভয় পায়।

জানালা থেকে সরে এল রোজমেরি, তাকাল পোর্ট্রেটের দিকে। গ্রেগরির চোখ ওকে অনুসরণ করছে। বিছানায় লাফ দিল রোজমেরি, হাসল পূর্বপুরুষের দিকে তাকিয়ে।

গুড নাইট, গ্রেগরি, বলল সে। তারপর বিন্দুমাত্র ইতস্তত না করে সুইচ টিপে আলো নেভাল রোজমেরি, একটু পরে ঘুমিয়ে পড়ল।

সেরাতে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখল রোজমেরি। তার স্বপ্নে জ্যান্ত হয়ে ছবির ফ্রেম থেকে নেমে এলেন গ্রেগরি। রোজমেরি দেখল দৃশ্যপট বদলে গেছে। সে চলে এসেছে ক্রিমিয়ার যুদ্ধের সেই সময়ে। গ্রেগরি বিশাল তরবারি নিয়ে বীর বিক্রমে শত্রুর বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। কিন্তু বেশিক্ষণ লড়াই করা সম্ভব হলো না। আহত হয়ে পড়ে গেলেন মাটিতে। রোজমেরি ছুটে গেল তাঁর কাছে। তিনি মৃত্যুর আগে বলে গেলেন, রোজমেরি, সাহস রাখো। ভয়ের কিছু নেই।

ঘুম ভেঙে গেল রোজমেরির। স্বপ্নটাকে তার খুব বাস্তব মনে হতে লাগল। ভয়ে ভয়ে সে পোর্ট্রেটের দিকে তাকাল। ভেবেছে ওখানে গ্রেগরির ছবির বদলে রাশান। কোনো সৈনিককে দেখবে।

না, গ্রেগরি আছেন আগের জায়গাতেই। শান্ত, স্থির ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে।

স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল রোজমেরি। তুমি তা হলে এখনো ওখানে আছ। বেশ।

সাহস রাখো। পোর্ট্রেটকে যেন বলতে শুনল রোজমেরি।

স্কুলের কাউকে গ্রেগরি সম্পর্কে কিছু বলল না রোজমেরি। ব্যাপারটা গোপন থাকল। তবে গ্রেগরি তার মনে সত্যি সাহস এনে দিলেন। একটা ছোট্ট ঘটনাই এর প্রমাণ।

রোজমেরিদের স্কুলে একটি খেলা খেলে সবাই। প্রথমে বৃত্তাকারে দাঁড়ায় মেয়েরা, একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মাঝখানে, ঘোরাতে থাকে একটি রশি, রশির অন্য পাশ চাপা থাকে পাথর দিয়ে। এখন ঘুরন্ত ওই রশি এক লাফে পার হয়ে যেতে হবে। টাইমিংটা এক্ষেত্রে নিখুঁত হওয়া চাই। আর এখানটায় রোজমেরির গড়বড় হয়ে যায়। সে রশি পার হতে গিয়ে প্রতিবার আছাড় খেয়েছে। আর ক্লাসসুদ্ধ মেয়ে হেসে উঠেছে, সেইসাথে পিটি টিচার মিস ব্রিগসের কঠিন ধমক তো আছেই।

তবে এবার ঠিকঠিক রশি পার হয়ে গেল রোজমেরি। সে যখন লাফ দেবে ঠিক করেছে, ঠিক সেই মুহূর্তে গ্রেগরির গলা শুনতে পেল, ওকে অভয় দিচ্ছেন তিনি, মাথা ঠান্ডা রাখতে বলছেন। তারপর বলে উঠলেন : এখন! লাফাও!

লাফ দিল রোজমেরি এবং চমৎকারভাবে রশি পার হয়ে গেল। মিস ব্রিগস স্বীকার করতে বাধ্য হলেন আগের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে রোজমেরির। কিন্তু রোজমেরি তো জানে কৃতিত্বটা আসলে কার।

সেদিন স্কুল লাইব্রেরিতে গিয়ে ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ওপর বই খোঁজ করল রোজমেরি।

অত কঠিন বই তুমি কিছুই বুঝতে পারবে না, খুকি, লাইব্রেরিয়ান বলল ওকে। সত্যি পড়বে?

মাথা দোলাল রোজি। জি, কারণ আমাদের পরিবারের একজন ওই যুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। তাঁর ছবি আছে আমার কাছে। আমি যুদ্ধটি সম্পর্কে জানতে চাই।

টিফিন পিরিয়ডে খেলার মাঠে বসে ইঙ্কারম্যানের যুদ্ধ সম্পর্কিত লেখা সমস্ত তথ্য গোগ্রাসে গিলল রোজমেরি। শিউরে উঠল যুদ্ধের ভয়াবহতার কথা জেনে। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের কথাও আছে, উনি যুদ্ধাহত মানুষের সেবা করেছেন। গ্রেগরির সাথে কি ফ্লোরেন্সের সাক্ষাৎ হয়েছিল, ভাবল সে।

রোজমেরি ঠিক করল বড় হয়ে সে নার্স হবে, মানুষের সেবা করবে। কল্পনায় দেখল হাসপাতালের একটি ওয়ার্ডে সে হেঁটে যাচ্ছে, বিছানায় শুয়ে থাকা রোগীদের কুশল জিজ্ঞেস করছে। তারপর দেখল সম্পূর্ণ সাদা পোশাকে সে চার্চে যাচ্ছে, সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে তরবারি হাতে লম্বা এক সৈনিক, অপেক্ষা করছে তার জন্য।

বই পোকা! খেলার মাঠে এক মেয়ে ঠাট্টা করে ডাকল রোজমেরিকে। সাথে সাথে কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে এল রোজি। বইয়ের আরেকটি পাতা ওল্টাতেই গ্রেগরির নাম চোখে পড়ল তার। তার পূর্বপুরুষের নাম সত্যি আছে ইতিহাস বইতে! ক্যাপ্টেন গ্রেগরি হ্যাঁসকস। আবার কল্পনার ডানায় ভর করল। রোজমেরি। দেখল টিভিতে কুইজ প্রতিযোগিতা হচ্ছে। প্রশ্নকর্তা জিজ্ঞেস করলেন, ক্যাপ্টেন গ্রেগরি হ্যাঁসকস কে ছিলেন?

প্রত্যেকে তার বাযারে চাপ দিল, প্রথম জন বলল, ব্যাটল অভ ইঙ্কারম্যানের হিরো ছিলেন তিনি।

গর্বে বুক ফুলে গেল রোজমেরির। আমাকে আর কেউ ভীতু বলতে পারবে না, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল সে। আমি ক্যাপ্টেন হ্যাঁসকসের নাম রক্ষা করব।

.

মাকে বইটি দেখানোর জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠল রোজমেরি, ছুটল বাড়ির দিকে। মা সাধারণত দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকেন তার জন্যে। আজ তাঁকে দেখা যাচ্ছে না। কলিংবেল টিপল রোজমেরি, অপেক্ষা করছে। অনেকক্ষণ পরেও কারও সাড়াশব্দ না পেয়ে ভয় লাগল ওর। মা কি কোথাও গেছেন? ফেরার পথে অ্যাক্সিডেন্ট করেছেন? নাকি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন?

হঠাৎ ঝড়াং করে খুলে গেল দরজা, চৌকাঠে এসে দাঁড়াল কুৎসিত দর্শন, বিশালদেহী এক লোক।

এতক্ষণে স্কুল থেকে ফেরার সময় হলো, খুকি! বলল সে বিশ্রী হেসে।

এক পা পিছিয়ে গেল লোকটা, ভেতরে ঢুকতে দিল রোজমেরিকে। মাকে এই সময় দেখতে পেল সে। ম্লান, বিবর্ণ, থরথর করে কাঁপছেন ভয়াল দর্শন লোকটার পেছনে দাঁড়িয়ে।

ওহ্, রোজি, আমার সোনা, প্রায় ডুকরে উঠলেন তিনি, তারপর লোকটাকে বললেন, এবার তুমি চলে যাও, প্লিজ। বললামই তো আমাদের এখানে তোমার কোনো কাজ নেই। দয়া করে চলে যাও!

রোজি, বলল লোকটা। বেশ সুন্দর নাম। লোকটার গলায় এমন কিছু ছিল, ভয় পেয়ে গেল রোজমেরি, তুমি দেখতেও ভারী সুন্দর। ঘুরে দাঁড়াল সে মিসেস হার্টের দিকে। আপনি নিশ্চয়ই চান না আপনার মেয়ের কোনো ক্ষতি হোক? ধরুন, ওর সুন্দর মুখখানায় যদি একটা খুরের পোচ দিই? ঘোঁতঘোঁত করে উঠল লোকটা শেষের দিকে। দেব নাকি?

রোজমেরির কানে কানে কে যেন ফিসফিস করে বলল, সাহস রাখো। মনে মনে জবাব দিল সে। সাহস রাখছি। গ্রেগরি। অবশ্যই সাহস হারাব না।

গলায় জোর এনে রোজমেরি লোকটাকে বলল, তুমি এক্ষুনি এখান থেকে চলে যাও। নইলে আমি পুলিশ ডাকব।

খ্যাক খ্যাক হেসে উঠল লোকটা। কীভাবে ডাকবে, খুকি? ফোনের লাইন কেটে দিয়েছি। শোনো, ফ্যাচফ্যাচ কোরো না। আমার কিছু টাকা দরকার। দিয়ে দাও। সুবোধ বালকের মতো চলে যাব।

শিরদাঁড়া টানটান করে লোকটার মুখোমুখি দাঁড়াল রোজমেরি। তুমি খামোখাই তর্ক করছ। আজকাল বাড়িতে কেউ টাকা-পয়সা রাখে না-লোকে চেক ব্যবহার করে।

মিসেস হার্টের দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচালো লোকটা। খুব চালাক মেয়ে বানিয়েছেন তো!

রোজমেরি মায়ের দিকে তাকাল। বসে আছেন তিনি চেয়ারে, ভয়ে সাদা মুখ। ভয় পেয়ো না, মাম্মি, শান্ত গলায় বলল সে। ড্যাডি এক্ষুনি চলে আসবে।

অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল লোকটা। তুমি সত্যি খুব চালাক, রোজি। তোমার বাবা মারা গেছে অনেক আগে, সেকথা জানি না ভেবেছ? সব খবর নিয়েই এসেছি।

হঠাৎ চেহারা বদলে গেল লোকটার, থমথমে হয়ে উঠল। সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না, বেশ বুঝতে পারছি, হিসহিস করে বলল সে। দেখাচ্ছি মজা!

এক লাফে পৌঁছে গেল মিসেস হার্টের পেছনে, পেছন দিয়ে চেপে ধরল গলা। রোজমেরি স্থির দাঁড়িয়ে রইল, আপনাআপনি শক্ত হয়ে গেল মুঠো। লোকটাকে থামাতে হবে। কিন্তু কীভাবে? কীভাবে? আগে তোমার মাকে শেষ করব তারপর তোমাকে, বিচ্ছু মেয়ে, শুয়োরের মতো ঘোঁতঘোঁত করছে সে, মিসেস হার্টের গলায়। শক্ত আঙুলগুলো চেপে বসল।

গ্রেগরি, গ্রেগরি, ওকে থামাও। মৃগীরোগীর মতো চেঁচিয়ে উঠল রোজমেরি ।

হতভম্ব দেখাল লোকটাকে, মিসেস হার্টের গলা ছেড়ে দিল। কী বললে তুমি? খেঁকিয়ে উঠল সে। গ্রেগরি আবার কে?

রোজমেরিই প্রথমে দেখতে পেল গ্রেগরিকে। মায়ের চেয়ারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। পরনে ক্যাপ্টেনের ইউনিফর্ম, হাতে ব্যাটেল অভ ইঙ্কারম্যানের সেই ভারী তরবারি যা দিয়ে বহু শত্রু ঘায়েল করেছেন তিনি। ক্যাপ্টেনকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে রোজমেরি, মা বা লোকটা কি দেখতে পাচ্ছে না?

শিউরে উঠলেন মিসেস হার্ট। খুব ঠান্ডা লাগছে। রোজমেরি বুঝতে পারল গ্রেগরির উপস্থিতি টের পেয়েছেন মা। কিন্তু লোকটা? রোজমেরির চিৎকার শুনেই কি সে ওভাবে দমে গেল?

হঠাৎ লোকটার গোটা শরীর ঝাঁকি খেল, হাত মুঠো করল সে, ঘনঘন ঢোক গিলল, কাউকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করছে। হঠাৎ দুলে উঠল শরীর, ধপ করে বসে পড়ল চেয়ারে।

ওহ্, মাই গড, আমার হার্ট, গুঙিয়ে উঠল সে। আমার বোধহয় হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে।

মুখ আর শরীর কুঁকড়ে গেল তার, অনবরত গোঙাচ্ছে, চাপ দিয়ে ধরছে বুক।

বাঁচাও! আমাকে বাঁচাও! আর্তনাদ করে উঠল লোকটা। মনে হচ্ছে কেউ আমাকে ছুরি মেরেছে। সিধে হলো সে যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পেতে, পরক্ষণে দড়াম করে পড়ে গেল মেঝেতে।

.

কিছুক্ষণ পর পুলিশ আর অ্যাম্বুলেন্স এল রোজমেরিদের বাড়িতে, শয়তান লোকটার লাশ নিয়ে গেল। হইচই কমলে দোতলায় উঠে এল রোজমেরি, দাঁড়াল পোর্ট্রেটের সামনে।

ওহ্, গ্রেগরি, তুমি সত্যি দারুণ। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। চোখে জল নিয়ে বলল ও। গ্রেগরি তাকিয়ে আছেন ওর দিকে, মুখে হাসি। চোখ মুছে রোজমেরিও হাসল। ফিসফিস করে বলল, ব্যাপারটা শুধু আমরা দুজনেই জানি, তাই না?

এমন সময় বাতাস এসে নাড়িয়ে দিল পর্দা। আর ছবিটি সত্যি সত্যি চোখ পিটপিট করে উঠল রোজমেরির দিকে তাকিয়ে।

 

 

 

 

Exit mobile version