গ্যালারীতে বসে অনেক দূর থেকে দেখতাম তিনি পায়ে পায়ে উঠছেন বেদীর ওপর। অবাক হয়ে চেয়ে থাকতাম সেদিকে। কিরকম জানি সব গোলমাল হয়ে যেত মাথার ভেতরটা। দেবদূতের মতো ওঁর চেহারাটা দেখে মনে হতো যেন দেবলোক থেকে নেমে এলেন এইমাত্র। কিন্তু ভাবতেও পারতাম না দেবসুন্দর এই মানুষটাই বেত নাচিয়ে অমন নির্দয় ভাবে কি ভাবে শাসন করেন আমাদের স্কুলে পৌঁছেই।
চীনের প্রাচীরের মতো টানা লম্বা বিশাল এই পাঁচিলের এক জায়গায় যেন ভুরু কুঁচকে কপালে অজস্র ভাঁজ ফেলে কটমট করে আমাদের দিকে চেয়ে থাকত পাঁচিলের চাইতেও প্রকান্ড একটা ফটক। ফটক না বলে তাকে লোহার পাত আর বন্টু আঁটা একটা বিকট দৈত্য বলা উচিত। কাঁটাওলা দৈত্য বললে আরও ভাল হয়। কেননা, তার সারা গা থেকে ঠেলে বেরিয়ে থাকত খোঁচা খোঁচা বল্লমের ফলা। ভয়ঙ্কর চেহারার এই ফটকটাকে দেখলেই বুক গুর গুর করে উঠত আমার।
সপ্তাহে তিনবার আমাদের কুচকাওয়াজ করে বের করার জন্যে, তিনবার একই ভাবে ঢোকাবার জন্যে। সেই সময়ে বিশাল কজাগুলোর প্রতিটার কাঁচ কাঁচ আওয়াজ কান পেতে শুনতাম আমি। অদ্ভুত সেই আওয়াজে আমার গা শিরশির করত ঠিকই — তবুও কান খাড়া করে থাকতাম। কেন জানি মনে হতো, কাঁচ কাঁচানিগুলো আসলে কদাকার ওই গেট-দানবের মনের কথা অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে প্রতিটা বিশ্রী শব্দের মধ্যে।
বেজায় বুড়ো স্কুল বাড়িটার কোথাও যে কোনো ছন্দ ছিল না। পুরো স্কুল চৌহদ্দিটাই ঠিক এরকম ছন্দহীন, বেখাপ্পা, এলোমেলো। এরই মধ্যে। তিন-চারটে বড়-সড় মাঠকে আমরা খেলার মাঠ বানিয়ে নিয়েছিলাম। খুব মিহি কাঁকর দিয়ে সমতল করে রাখা হয়েছিল মাঠগুলোকে। আশ মিটিয়ে লাফ ঝপ করতাম এখানেই। অন্য কোথাও নয়।
খেলার মাঠগুলো ছিল স্কুল-বাড়ির পেছন দিকে। কাঁকর ছাড়া আর কিছুর বালাই সেখানে ছিল না। গাছ বা বেঞ্চি তো নয়ই। সে তুলনায় বেশ সাজানো-গোছানো ছিল বাড়ির সামনের দিকটা। বাস্কের মধ্যে থাকত ফুলগাছ, ঝোঁপঝাড়গুলোও কেটে ছেটে কায়দা করে রাখা হয়েছিল। কালেভদ্রে এখান দিয়ে যেতাম আমরা।
যেমন–ধরুন, স্কুলে প্রথম ভর্তি হওয়ার সময়ে, অথবা স্কুলের পাঠ চুকিয়ে একেবারে চলে যাওয়ার সময়ে, অথবা কারও বাবা-মা কিম্বা বন্ধুবান্ধব এলে। ছুটিছাটার সময়ে অভিভাবকদের সঙ্গে বাড়ি ফেরার সময়ে খুশির প্রাণ গড়ের মাঠ হয়ে যেত এক টুকরো সাজানো এই বাগানটার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময়ে।
মাঠ-ঘাট, পাঁচিল আর ফটককে কিন্তু টেক্কা দিয়েছে খোদ বাড়িটা। আদ্দিকালের এই বাড়ির আগাপাশতলা আজও একটা বিরাট রহস্য হয়ে রয়ে গেছে আমার কাছে। মোট পাঁচটা বছর কাটিয়েছি এই বাড়িতে। পাঁচ বছরেও ভালভাবে চিনে উঠতে পারিনি ঠিক কোন চুলোয় আছে আমার নিজের ঘর, অথবা আরও আঠারো জন ছেলের ঘর। বিদঘুঁটে এই বাড়ি যার। পরিকল্পনায় তৈরি হয়েছে, তার মাথায় গোলমাল ছিল নিশ্চয়। নইলে এত সিঁড়ি বানাতে গেলেন কেন? একটা ঘর থেকে বেরোতে গেলে, অথবা অন্য একটা ঘরে ঢুকতে গেলে কয়েক ধাপ সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা না করলেই নয়। গলিপথেরও অন্ত নেই। বুড়ো বাড়ির শাখা-প্রশাখার যেমন শেষ নেই, অলিগলিরও তেমনি গোনাগাঁথা নেই।
কে যে কখন কোন দিকে মোড় নিচ্ছে, কোথায় শুরু হয়ে কোথায় শেষ হচ্ছে– তা পাঁচ বছরেও হিসেবের মধ্যে আনতে পারিনি বলেই আজও মনে হয় আদি অন্তহীন অসীমকে কেউ যদি কল্পনায় আনতে চান বুড়ো বিটকেল স্কুল-বাড়িটায় ঢুকে যেন একবার পথ হারিয়ে আসেন। যেমন পথ হারাতাম আমি বহুবার বহুবার!
বটবৃক্ষের মতন সুপ্রাচীন এই স্কুল-ইমারতের মধ্যে সবচেয়ে বড়ঘর ছিল একটাই– স্কুল-ঘর। আমার তো মনে হয়, তামাম দুনিয়া ঘুড়লেও এতবড় স্কুল-ঘর আর পাওয়া যাবে না। শুধু বড় বলেই নয়- পেল্লায় এই ঘরখানাকে কোনোকালেই ভুলতে পারব না এর হাড়-হিম করা চেহারার জন্যে। ঘরটা খু-উ-উ-ব লম্বা, বেজায় সরু এবং দারুণ নিচু। একটা মাত্র ওক কাঠের কড়িকাঠ ঠেকিয়ে রেখেছে মাথার ওপরকার ছাদ।
দুপাশের গথিক জানালাগুলো দেখলেই মনে পড়ে যায় সেকালের অসভ্য বর্বর গথ মানুষদের কথা –যাদের নাম থেকে এসেছে গথিক শব্দটা। টানা লম্বা এই তেপান্তর-সম ঘর অনেক দূরে যেখানে একটি মাত্র মোড় নিয়েছে, ঠিক সেইখানে আছে একটা চৌকোনা ঘেরা জায়গা– তার এক-একটা দিক আট থেকে দশ ফুট তো বটেই। পবিত্র এই ঘেরাটোপে বসে গুরুগিরি করার সময়ে চেলাদের সামনে বেত আছড়াতেন আমাদের অধ্যক্ষ রেভারেন্ড ডক্টর ব্রান্সবি। ঘেরাটোপের দরজাটাও বিদঘুঁটে –যেমন বিরাট, তেমনি কদাকার। এ-দরজা যখনই খুলে যেত, বুকের রক্ত ছলাৎ করে উঠত আমাদের সবার। দূর থেকে অবশ্য রীতিমতো সমীহ করে চলতাম গুরুমশায়ের এই পবিত্র জায়গাটাকে।
ভীষণ ভয় হতো প্রায় এই রকমই আরও দুটো ঘেরা জায়গা দেখলে। যে দুজন মাতব্বর আমাদের মার্চ করিয়ে চরাতে নিয়ে যেত মাঠে-ঘাটে, তারা বসত এইখানে। অধ্যক্ষর ঘেরাটোপের অনেক দূরে দূরে এই দুটো ঘেরা জায়গায় একটায় বসত ইংরেজি শেখানোর মাস্টার, আর একটায় অঙ্ক শেখানোর মাস্টার। মাস্টার না বলে রাখাল বলাই উচিত এদের মাঠে চরানোর সময় সেরকমই মনে হতো আমাদের।
টানা লম্বা ঘরখানার বাকি অংশ জুড়ে রয়েছে রাশিরাশি বেঞ্চি, টেবিল, ব্ল্যাকবোর্ড –ভাঙাচোরা এবং বইয়ের পাহাড়। একদিকে বিরাট একটা বালতি ভর্তি জল, আর একটা মান্ধাতার আমলের দানবিক আকৃতির ঘুড়ি। বেঞ্চিগুলোর সারা গায়ে ছুরি দিয়ে খোদাই করা কিম্ভুতকিমাকার ছবি আর অদ্ভুত অদ্ভুত নামধাম নিয়ে গবেষণা করতে করতেই সময় কেটে যেত আমাদের।