‘ওগুলো বারবার তৈরি করে একদম মুখস্থ হয়ে গেছে৷ আর ওগুলো নিয়ে খেলতে ভালো লাগে না৷ টু ইজি, টু বোরিং…৷’
মা শ্রেয়সী তখন ছেলের পক্ষ নিয়ে বলেন, ‘দাও না নতুন একটা কিনে! পুরোনোগুলো আর কতবার খুলবে আর কতবার তৈরি করবে?’
কথাটা ঠিকই৷ ব্লকের বাক্সের ভেতরে রঙিন টুকরোগুলোর সঙ্গে যে-জিনিসটা তৈরি করতে হবে তারও রঙিন ছবি দেওয়া থাকে৷ একটা নয়, অনেকগুলো ছবি৷ সেই ছবিগুলো বুঝিয়ে দেয় কীভাবে জিনিসটাকে ধাপে-ধাপে তৈরি করতে হবে৷
বুয়ান শুরু করেছিল খুব সহজ ব্লক দিয়ে৷ যেমন, কুকুর, বেড়াল, মাছ, বাড়ি এইসব৷ তারপর ও তৈরি করেছে ট্রেন, প্লেন, ট্র্যাক্টর, তাজমহল, জাহাজ, ক্রেন—আরও কত কী! এখন ও বলতে গেলে ব্লক-এক্সপার্ট৷ তৈরি করার জিনিসটা যত কঠিন হবে, ব্লকের বাক্সে পলিমারের টুকরোর সংখ্যা হবে তত বেশি, তার বাক্সটাও হবে বেশ বড়, আর জিনিসটার দামও হবে বেশি৷ ফলে রণবীর আর শ্রেয়সী এখন বুয়ানের জন্য নতুন কোনও ব্লক কিনতে বেশ কিন্তু-কিন্তু করেন৷
রণবীর ছেলের মাথায় হাত-টাত বুলিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, ‘শোন, তোর এখন ক্লাস ফাইভ৷ পড়ার চাপ কত বেড়ে গেছে! তুই কত বড় হয়ে গেছিস! এখন এইসব ব্লক-টক নিয়ে খেলা তোর মানায়!’
বুয়ান ছলছলে চোখে মায়ের দিকে তাকাল৷ আঙুল তুলে দেখাল দোকানের একটা র্যাকের দিকে৷ সেখানে পরপর ব্লকের বাক্স সাজানো—ছোট-বড় নানান বাক্স৷ তারই মধ্যে একটা বড় বাক্স লক্ষ্য করে আঙুল তুলেছে বুয়ান৷ সেই বাক্সটার ওপর খুব সুন্দর একটা রোবটের ছবি৷ ছবির ওপরে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে ‘রোবট-ফ্রেন্ড জুনো’৷ আরও লেখা আছে যে, এটা টকিং রোবট—অর্থাৎ, জুনো কথা বলতে পারে৷ ওর শরীরে ব্যাটারি লাগানোর ব্যবস্থা আছে৷ এ ছাড়া রয়েছে স্পেশাল রিমোট কন্ট্রোল ইউনিট৷
বাক্সের ওপরে জুনোর রঙিন ছবিটা এত জীবন্ত যেন বুয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে এবং হাসছে৷
সুতরাং অন্যান্যবারের মতো এবারেও বুয়ানের আবদারের কাছে রণবীর-শ্রেয়সী হেরে গেলেন৷ রোবট-ফ্রেন্ড জুনো চলে এল ওদের বাড়িতে৷ আর তারপর? তারপর নাওয়া-খাওয়া মাথায় উঠল বুয়ানের৷ সেইসঙ্গে পড়াও৷ রোবট-ফ্রেন্ডের ব্লক নিয়ে ও মেতে উঠল৷ বাক্সের ভেতরে দেওয়া ছবি দেখে-দেখে পলিমারের টুকরোগুলো একের পর এক জুড়তে লাগল৷ ধাপে-ধাপে তৈরি হতে লাগল জুনো৷
যে-সন্ধেয় ব্লকের বাক্সটা ও কিনে এনেছিল তারপর চব্বিশ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই বুয়ানের কাজ শেষ৷ ওর পড়ার টেবিলে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক রংচঙে রোবট৷ উচ্চতায় আট ইঞ্চি মতন৷ কী সুন্দর দেখতে! বড়-বড় গোল-গোল চোখ৷ মাথায় কালো টুপির মতো চুল৷ নীল রঙের জামা৷ লাল রঙের প্যান্ট৷ বুকে লাগানো রয়েছে ছোট-ছোট রঙিন এল. ই. ডি.৷ হাত আর পা মেটালিক৷ তাতে অনেকগুলো জয়েন্ট৷ জয়েন্ট রয়েছে কাঁধ আর গলাতেও৷
সবমিলিয়ে জুনোকে দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে৷
রোবট তৈরির কাজ শেষ হওয়ার পর মা-বাবাকে ডেকে নিয়ে এল বুয়ান৷
‘দ্যাখো, দ্যাখো, জুনোকে কী সুন্দর দেখতে!’
রণবীর আর শ্রেয়সী হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন রোবটটার দিকে৷ সত্যিই ভীষণ আদুরে আর সুন্দর দেখতে জুনোকে৷
রণবীর বললেন, ‘যাকগে৷ রোবট চেয়েছিলে, পেয়ে গেছ৷ এবার তো একটু পড়াশোনায় বোসো! কাল বিকেলের পর আমার কাছে ম্যাথস নিয়ে বসবে৷’
শ্রেয়সী ছেলেকে বললেন, ‘কাল সকাল দশটায় ম্যাডাম পড়াতে আসবেন তোর মনে আছে তো? ম্যামের কাছে হোমটাস্কের কাজ যতটা পারবি এগিয়ে নিবি—!’
বুয়ান একেবারে অন্য জগৎ থেকে মায়ের দিকে শূন্য চোখে তাকাল৷ হোমটাস্ক! সেটা আবার কী জিনিস?
‘কী রে, অমন হাঁ করে চেয়ে আছিস কেন? হোমটাস্ক! হোমটাস্ক! জুনোকে পেয়ে সব ভুলে গেলি?’
সত্যিই মনে-মনে রোবটদের জগতে চলে গিয়েছিল বুয়ান৷ মায়ের কথায় ঝটকা খেয়ে ফিরে এল পড়াশোনার রুক্ষ বাস্তবে৷ চটপট ঘাড় নেড়ে বলল যে, কাল ও ম্যামের কাছে অনেকখানি হোমটাস্ক সেরে নেবে৷
তারপর কাঁচুমাচু মুখে রণবীরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাপি, মোড়ের মাথায় সুরেনকাকুর দোকান থেকে এইরকম চারটে ব্যাটারি এনে দেবে? প্লিজ!’
বাক্সের গায়ে ব্যাটারির ছবি দিয়ে মাপ লেখা ছিল৷ সেটা রণবীরকে দেখাল বুয়ান৷
রণবীর ছোট্ট করে ‘হুঁ’ বললেন, তারপর: ‘ব্যাটারি এনে দিচ্ছি, কিন্তু লেখাপড়ার কথাগুলো ভুলে যেয়ো না৷’
একগাল হাসল বুয়ান৷ বলল, ‘জানো, বাপি, ব্যাটারি লাগিয়ে দিলেই জুনো হেঁটে-চলে বেড়াবে, কথাও বলবে!’
আশ্চর্য! রোবট পেয়ে ছেলেটা সব ভুলে গেল না কি?
রণবীর বললেন, ‘ব্যাটারি তো হবে, কিন্তু পড়ার কথাগুলো তুই শুনতে পেয়েছিস তো?’
‘শুনেছি, শুনেছি!’ ব্যস্তভাবে বলল বুয়ান৷ তারপর বাপিকে ছোট্ট ঠেলা মেরে বলল, ‘যাও না, বাপি, ব্যাটারিগুলো এনে দাও না তাড়াতাড়ি!’
রণবীর আর দেরি না করে ব্যাটারি কিনতে বেরোলেন৷
পড়ার টেবিলের সব বইপত্র সরিয়ে প্রথমেই জুনোর চলা-ফেরার জায়গা তৈরি করল বুয়ান৷ তারপর টেবিলের ওপরে জুনোকে দাঁড় করিয়ে ওর রিমোটের বোতামগুলো দেখতে লাগল৷ সেখানে ‘মুভ’, ‘স্টপ’, ‘স্লিপ’, ‘টক’ ইত্যাদি বেশ কয়েকটা বড় মাপের বোতাম রয়েছে৷ এক-একটা বোতামের এক-একরকম রং৷ প্রত্যেকটা বড় বোতামের সঙ্গে রয়েছে তিনটে কি চারটে করে ছোট-ছোট বোতাম৷ যেমন, ‘মুভ’ বোতামের ঠিক ওপরেই রয়েছে চারটে ছোট বোতাম৷ বোতামে লেখা রয়েছে ‘মোড ওয়ান’, ‘মোড টু’ ইত্যাদি৷ বোঝাই যাচ্ছে, এই বোতামগুলো রোবটের মুভমেন্টের স্টাইল সিলেক্ট করার জন্য৷