জাফরাগঞ্জ
জাফরাগঞ্জ প্রাসাদ ভাগীরথীর তীরে, মুর্শিদাবাদ কেল্লা থেকে আধ মাইল উত্তরে অবস্থিত। মীরজাফর মসনদে বসার আগে এখানেই থাকতেন। তাই এটি মীরজাফরের প্রাসাদ হিসেবেও পরিচিত। সম্ভবত তাঁর নাম অনুসারেই এর নাম জাফরাগঞ্জ। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে এর নামকরণ হয় মুর্শিদাবাদের প্রতিষ্ঠাতা মুর্শিদকুলি জাফর খানের নাম অনুসারে। সে যাই হোক, মীরজাফর নবাব হওয়ার পর মনসুরগঞ্জে সিরাজদ্দৌল্লার হীরাঝিল প্রাসাদে বসবাস করতে শুরু করেন এবং তাঁর পুত্র মীরণকে জাফরাগঞ্জের ভবন দিয়ে দেন। এই জাফরাগঞ্জেই সিরাজকে হত্যা করা হয়, এটিই সিরাজের বধ্যভূমি। তাই যে ভবনে সিরাজের নৃশংস হত্যাকাণ্ড হয়, তাকে মুর্শিদাবাদবাসীরা ‘নেমকহারামের দেউরি’ বলে আখ্যা দিয়েছে। এই প্রাসাদেই ইংরেজদের সঙ্গে মীরজাফর ও মীরণের গুপ্তসন্ধি হয় এবং ওয়াটস বোরখা পরে লুকিয়ে পাল্কি করে এখানে মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করতে আসেন। জাফরাগঞ্জেই মীরজাফর, মীরণ ও মীরজাফরের বংশধরদের সমাধি। মীরজাফর পত্নী মুন্নি বেগমের সমাধিও এখানে।২২
জগৎশেঠের প্রাসাদ
জগৎশেঠদের প্রাসাদ ছিল মহিমাপুরে। এখন তার বিশেষ কিছু অবশিষ্ট নেই, প্রায় সবটাই ধ্বংসস্তূপে পরিণত। অথচ জগৎশেঠদের এই প্রাসাদের সঙ্গে মুর্শিদাবাদ তথা বাংলার ইতিহাসের বহু স্মরণীয় ঘটনা বিজড়িত। এই প্রাসাদে বসেই বাংলায় দু-তিনটে রাষ্ট্রবিপ্লবের পরিকল্পনা করা হয়েছিল কারণ শেঠরা ছাড়া বাংলায় কোনও রাজনৈতিক পালাবদল সম্ভব ছিল না। পলাশি যুদ্ধের পর ইংরেজদের পক্ষে ওয়াটস ও ওয়ালস চুক্তির শর্তানুযায়ী কী ভাবে টাকাপয়সার লেনদেন হবে তা নিয়ে মীরজাফর ও দুর্লভরামের সঙ্গে আলাপ আলোচনায় বসেন এই প্রাসাদেই। কয়েকদিন পরে আবার ক্লাইভ, ওয়াটস, স্ক্র্যাফ্টন, মীরণ, দুর্লভরাম মীরজাফরকে সঙ্গে নিয়ে এখানে আসেন এবং জগৎশেঠের সামনে লেনদেন সম্পর্কে কথাবার্তা পাকা করেন। উমিচাঁদ তাঁর অংশ প্রাপ্তির আশায় ঘরের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন। সভা শেষ হলে ক্লাইভ স্ক্র্যাফ্টনকে জানালেন যে এবার উমিচাঁদকে প্রতারণার কথা ফাঁস করা যেতে পারে। স্ক্র্যাফ্টন বাইরে এসে উমিচাঁদকে দেশীয় ভাষায় জানান যে লাল কাগজের চুক্তিটি জাল, তিনি নবাবের ধনসম্পদের কিছুই পাচ্ছেন না। এতে নাকি উমিচাঁদ মুর্ছা যান এবং তিনি পাগল হয়ে যান। তবে আমরা দেখিয়েছি যে এটা মোটেই সঠিক নয়।২৩
এ ছাড়া, মুর্শিদাবাদে আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পুরাকীর্তি ও ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান আছে। মীরজাফরের পত্নী মুন্নি বেগম একটি সুন্দর মসজিদ নির্মাণ করেন। চকবাজারে এটি তৈরি করা হয় বলে একে চক মসজিদ বা মুন্নি বেগমের মসজিদও বলা হয়। সৈয়দাবাদের আর্মানিরা ১৭৫৮ সালে একটি গির্জা প্রতিষ্ঠা করেন। তখনই এটি তৈরি করতে খরচ হয় ২ লক্ষ ৩৬ হাজার টাকা। এর পূর্বদিকে আরেকটি গির্জা তৈরি হয়েছিল ১৬৬৫ সালে। সেটি নষ্ট হয়ে গেলে নতুন গির্জাটি তৈরি হয়। হীরাঝিলের কাছে ছিল মোরাদবাগ প্রাসাদ। পলাশির যুদ্ধের পর মুর্শিদাবাদে এসে ক্লাইভ এখানে অবস্থান করেন এবং মীরণ এসে তাঁকে মনসুরগঞ্জ বা হীরাঝিলের প্রাসাদে মীরজাফরের কাছে নিয়ে যান। ওয়ারেন হেস্টিংস মুর্শিদাবাদ দরবারে ইংরেজ প্রতিনিধি হয়ে আসার পর মোরাদবাগের প্রাসাদেই থাকতেন। বাংলার ইংরেজ গভর্নর ভ্যানসিটার্ট মীরজাফরকে সরিয়ে মীরকাশিমকে নবাব করবার জন্য যখন মুর্শিদাবাদে আসেন, তিনিও তখন এই প্রাসাদে ওঠেন।২৪
সবশেষে, হাজারদুয়ারি। এই ইমারতটি অবশ্য স্বাধীন নবাবি আমলের নয়। তা হলেও মুর্শিদাবাদের স্থাপত্যের কথা বলতে গেলে হাজারদুয়ারির কথা বাদ দেওয়া যায় না। এটিই মুর্শিদাবাদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ইমারত। তাই খুব সংক্ষেপে এটির একটু বিবরণ দিচ্ছি। ভাগীরথীর তীরে মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুরের এই বিশাল প্রাসাদ। ইতালীয় ভাস্কর্যের অনুকরণে এটির নকশা করেন ‘বেঙ্গল কোর অফ ইঞ্জিনিয়ার্স’-এর জেনারেল ডানকান ম্যাকলিয়ড (Duncan Mcleod)। তাঁর তত্ত্বাবধানে এটির নির্মাণকার্য সম্পন্ন হয়। ১৮২৯ সালে এর ভিত্তি স্থাপন হয় এবং নির্মাণকার্য সম্পূর্ণ হয় ১৮৩৭ সালে। এটি ত্রিতল ইমারত, শীর্ষে একটি গম্বুজ দিয়ে পরিবৃত। এর হাজারটি দরজা বলে নাম হাজারদুয়ারি। যে চত্বরে এটি অবস্থিত তার নাম নিজামত কিল্লা। এর মধ্যে প্রাসাদ ছাড়াও ইমামবারা, মদিনা, ঘড়িঘর, তিনটি মসজিদ এবং অনেকগুলি কক্ষ।২৫
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
১. নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃ. ১৮
২. P. C. Majumdar, Musnud of Murshidabad, pp. 172-73.
৩. Ibid., p. 172.
৪. A. H. Dani, Muslim Architecture in Bengal, p. 276.
৫. Ibid.
৬. নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃ. ২৩।
৭. রিয়াজ, পৃ. ২৯০-৯১; তারিখ-ই-বংগালা, পৃ. ৭৩।
৮. O’ Malley, Bengal Distict Gazetteers, Murshidabad, pp. 209-10.
৯. নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃ. ৯৬-৯৭।
১০. P. C. Majumdar, Musnud of Murshidabad, pp. 186-87; নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃ. ৯৫-৯৯।
১১. P. C. Majumdar, Musnud of Murshidabad, p. 188.