Site icon BnBoi.Com

ভোলগা থেকে গঙ্গা – রাহুল সাংকৃত্যায়ন

ভোলগা থেকে গঙ্গা - রাহুল সাংকৃত্যায়ন

 ০১. নিশা (দেশ : ভোল্‌গা নদীর তীর ।। কাল ৬০০০ খৃষ্টপূর্ব)

বেলা দ্বিপ্রহর, অনেক দিন পরে আজ সূর্যের দেখা পাওয়া গেল। এখন দিনগুলি পাঁচ ঘন্টার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, তবুও এ সময় রোদের তীব্রতা নেই; মেঘঝঞ্চাহীন, তুষার ও কুয়াশামুক্ত সূর্যের সুদূরবিস্তারী কিরণ দেখতে মনোহ্তা–তার স্পর্শ এক আনন্দানুভূতির সঞ্চার করে। আর চারিদিকের দৃশ্য? ঘন নীল আকাশের নীচে পৃথিবী রয়েছে কর্পূরের মতো সাদা তুষারে ঢাকা। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে আর তুষারপাত না হওয়ার জন্য পূর্বের দানা-দানা তুষারকণাগুলি কঠিন জমাট হয়ে গেছে। এই হিমবসনা ধরিত্রী দিগন্তপ্রসারী নয়, বরং উত্তর থেকে দক্ষিণে কয়েক মাইল পর্যন্ত চলে গিয়েছে আঁকাবাঁকা রূপালী রেখার মত, যার দু’ধারে পাহাড়ের উপর নিবিড় অরণ্যরেখা। আসুন, এই বনরাজিকে আরও কাছে গিয়ে দেখি। এই তরুশ্রেণীর মধ্যে মূলত দুই ধরনের বৃক্ষাদি আছে। একটির নাম ভুর্জ-শ্বেত বল্কলধারী এবং বর্তমানে নিষ্পত্র; অপরটি পাইন-উত্তুঙ্গ ও ঋজু। শাখাগুলি সমকোণে ছড়িয়ে গেছে চারিদিকে। সূচ্যগ্র পাতাগুলি হরিৎ বর্ণ-কোনোটা ঘন গাঢ় সবুজ আর কোনোটা ফিকে। তুষারের অজস্র দান থেকে গাছগুলি নিষ্কৃতি পায়নি, গাছের কোণে তুষারের স্তূপ সাদা কালোয় রূপ-রেখা সৃষ্টি করে কার যে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে! এ ছাড়া চারিদিকে ভয়ঙ্কর নীরবতার অখণ্ড রাজত্ব বিদ্যমান। কোনোদিক থেকেই শোনা যায় না ঝিঁঝির ঝঙ্কার, পাখীর কাকলী বা পশুর কোলাহল।
আসুন, পাহাড়ের সর্বোচ্চ শিখরস্থিত পাইন গাছের ওপর উঠে চারিদিকটা দেখি। হয়ত ওখানে গেলে বরফ, জমি ও পাইন ছাড়া আরও কিছু দেখতে পাওয়া যেতে পারে। বড় বড় বৃক্ষরাজির দিকে তাকিয়ে মনে হতে পারে যে এখানে কি কেবল এ রকম গাছই জন্মায়? এই জমিতে কি ছোট ছোট চারা গাছ বা ঘাস জন্মায় না? কিন্তু সে সম্বন্ধে আমরা কোনো মতামত দিতে পারি না। শীত প্রায় শেষ হয়ে এল। এই বড় বড় গাছের গুঁড়িগুলি কতখানি বরফের স্তুপে ঢাকা পড়েছে তা বলা শক্ত, আমাদের কাছে মাপবার কিছু নেই। এই বরফের স্তূপ আট হাত অথবা তার চেয়েও বেশি হতে পারে। বরফ এ বছর বেশি পড়েছে–এ অভিযোগ সকলেরই।
পাইনের ওপরে এসে কি দেখা যাচ্ছে? দেখছি সেই বরফ, সেই বনরাজি আর সেই উঁচু-নীচু পার্বত্য-ভূমি। হ্যাঁ, পাহাড়ের অপর পারে এক জায়গায় ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। জনপ্রাণী-শব্দশূণ্য বনভূমির মধ্যে ধোঁয়ার কুণ্ডলী কৌতুহল জাগিয়ে তোলে। আসুন ওখানে গিয়ে নিজেদের কৌতূহল মিটিয়ে আসি।ত
ধোঁয়া অনেক দূর। স্বচ্ছ মেঘশূণ্য আকাশের পটভূমিতে কত কাছেই না মনে হচ্ছিল। যাই হোক, হাঁটতে হাঁটতে আমরা তার কাছে পৌঁছে গেছি, গন্ধ পাচ্ছি আগুনে পোড়া চর্বি আর মাংসের। শব্দও শোনা যাচ্ছে–শোনা যাচ্ছে শিশুদের কলরব। আমাদের খুব সাবধানে শ্বাস বন্ধ করে পা টিপে টিপে যেতে হবে। না হলে ওরা জানতে পারবে! জানতে পারলে–কে জানে, ওরা কিম্বা ওদের কুকুরগুলো কি রকম অভ্যর্থনা করবে!
হ্যাঁ, সত্যি সত্যিই ছোট ছোট শিশুরা রয়েছে–এক থেকে আট বছরের মধ্যে এদের বয়স! একটি ঘরের মধ্যে জনা ছয়েক ছোট ছেলেমেয়ে। একে ঠিক ঘর বলা যায় না — স্বাভাবিক পর্বতগুহা মাত্র। এই গুহাগৃহের পাশে ও পেছনে কতদূর পর্যন্ত অন্ধকার বিস্তৃত জানি না, আর জানার চেষ্টা করাও উচিত নয়! পূর্ণবয়স্ক একটি বৃদ্ধাকে দেখা যাচ্ছে–তার জটাধরা ধোঁয়াটে শনের মতো সাদা চুলগুলি এলোমেলোভাবে মুখে এসে পড়ছে, বুড়ি হাত দিয়ে মাঝে মাঝে মুখ থেকে সেগুলি সরিয়ে দিচ্ছে। ভুরুত চুলগুলিও পেকে সাদা রঙ ধরছে। সাদা মুখের চামড়া কুঁচকে জায়গায় জায়গায় ঝুলে পড়েছে, গুহার ভেতরে আগুনের তাপ ও ধোঁয়া দুই আছে– বিশেষ করে যেখানে আছে শিশুগুলি ও তাদের দিদিমা। মাতামহীর দেহে কোন আবরণ নেই, নেই কোন কাপড়-চোপড়ের বালাই! শীর্ণ কঙ্কালসার হাত দুটি পায়ের কাছে মাটিতে পড়ে আছে, চোখ কোটরাগত, ফিকে নীল চোখ দুটি তার জ্যোতিহীন, কিন্তু মাঝে মাঝে ঝক্‌মক করে ওঠে, এতে মনে হয় এগুলি এখনো একেবারে নিষ্প্রভ হয় নি। কান দুটি তো খুবই সজাগ। মনে হচ্ছে দিদিমা যেন শিশুদের কথা মন দিয়ে শুনছে। এইমাত্র একটি শিশু চীৎকার করে উঠল, দিদিমা সেদিকে তাকাল। এক বছর ও দেড় বছরের দুটি শিশু, মাথায় দু’জনেই সমান। দু’জনেরই চুল পিঙ্গল বর্ণ। এদের চুলের রঙ বৃদ্ধার চেয়ে আরো সুন্দর ও উজ্জ্বল। এদের নধরকান্তি দেহ, দুধে আলতায় রঙ, বড় বড় চোখ, ঘন নীল তারা। ছেলেটি চীৎকার করে কাঁদছে, মেয়েটি দাঁড়িয়ে চুষিকাঠির মতো একটি হাড় চুষছে।
দিদিমা কম্পিত স্বরে ডাকল, “অগিন! আয়। এখানে আয় অগিন! এই যে তোর দিদি এখানে।”
অগিল উঠল না। একটি বছর আটেকের ছেলে এসে অগিনকে কোলে করে মাতামহীর কাছে নিয়ে গেল। এই ছেলেটিরও চুল অন্যদের মতো উজ্জ্বল স্বর্ণাভ তবে কিছু বেশি লম্বা এবং জট পাকানো। দেহের বর্ণ গৌর, তবে শিশুদের মতো পরিপুষ্ট নয়। গায়ের এখানে ওখানে ময়লা জমে আছে। ছেলেটি ছোট শিশুটিকে এনে মাতামহীর কাছে দাঁড় করিয়ে বলল, “দাদী! রোচনা হাড় কেড়ে নিয়েছে, অগিন তাই কাঁদছে।”
ছেলেটি এই বলে চলে গেল। মাতামহী তার শীর্ণ হাতে শিশুটিকে তুলে নিল। অগিন তখনও কাঁদছিল। তার চোখের জলের ধারায় গালের ময়লা কেটে গিয়েছে, সেখানে উঁকি মারছে গৌরবর্ণের ওপরে সোনালী রেখা। মাতামহী অগিনের মুখে একটি চুমু খেয়ে বলল, “অগিন! কেঁদো না, আমি রোচনাকে মারছি।”
এই বলে মাতামহী খালি হাতটা চর্বিমাখা মাটির ওপর আঘাত করল। অগিনের কান্না তখনও থামেনি, চোখের জলও ফুরোয়নি। মাতামহী তার ময়লা হাত দিয়ে অগিনের মুখ মুছিয়ে দিলে–তার হাতের ময়লাতে শিশুর রক্তাভ গাল কালো হয়ে গেল। অগিনকে শান্ত করার জন্য মাতামহী তার নিজের শুকনো স্তনটি মুখে তুলে দিল। অগিনের কান্না বন্ধ হল, সে মাতামহীর স্তন চুষতে লাগল। এই সময় বাইরে কথাবার্তা শোনা গেল। শিশুটি শুকনো স্তন ছেড়ে সেইদিকে তাকাল।
কার যেন মিষ্টি গলার স্বর–“অ-গি-ই-ন!”
অগিন আবার কেঁদে উঠল। দুটি স্ত্রীলোক একটি কোণের দিকে তাদের মাথা থেকে কাঠের বোঝা ফেলে একজন রোচনার কাছে অপরজন অগিনের কাছে ছুটে গেল। ক্রন্দনরত অগিন আরো জোরে চেঁচিয়ে উঠল “মা” “মা” বলে। মা তার ডান হাতটি খালি রেখে ডানদিকের স্তনের ওপর থেকে লোমযুক্ত বলদের চামড়ার আবরণটি খুলে ফেলল। শীতের দিনে খাওয়া-দাওয়া ভালো নেই বলে তরুণীর দেহ যথেষ্ট মাংসল নয়, কিন্তু সৌন্দর্যে অসাধারণ। ময়লাহীন আরক্তিম গালের উজ্জ্বল আভা, জটাবিহীন সোনালী কেশদাম, তন্বী দেহ, পরিপুষ্ট বুকের ওপর গোল গোল শ্যামল– মুখ স্তন, কৃশ কটি, আকর্ষণীয় নিতম্ব, পরিপুষ্ট পেশল জানু, পরিশ্রমে গড়ে ওঠা পায়ের ডিম। সেই অষ্টাদশী তরুণী অগিনকে দু’হাতে তুলে তার মুখ চোখ গাল অজস্র চুমুতে ভরে দিল। অগিন কান্না ভুলে গেল। তার দুটি রক্তাভ ঠোঁটের আড়ালে কচি দাঁতগুলি চিক্‌-চিক্‌ করছে, চোখ দুটি আধ-বোঁজা, গালে টোল পড়েছে। একটি বৃষভ-চর্মের ওপর বসে তরুণী তার কোমল স্তনটি তুলে দিল অগিনের মুখ। এই সময় তরুণীটিও রোচনকে নিয়ে তার কাছে উপবেশন করল, দেখলেই বোঝা যায় ওরা দু’জন সহোদরা।

২.
গুহার মধ্যে এদের নিভৃত গল্প-গুঞ্জনে ব্যস্ত রেখে আমরা বাইরে এসে দেখছি বরফের ওপর চামড়ার আবরনে আচ্ছাদিত অনেকগুলি পায়ের চিহ্ন। আসুন, আমরা ওদের এই পদচিহ্ন দ্রুত অনুসরণ করি। পায়ের সারি গিয়ে মিশেছে পাহাড়ের ওপাশের জঙ্গলে। আমরা দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলেছি। কিন্তু চলমান পায়ের রেখা বহ্ন করে নিয়ে চলেছে টাট্‌কা পায়ের ছাপ। আর আমরা চলেছি শুভ্র তুষারক্ষেত্র অতিক্রম করে, আবার কখনও বা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। পাহাড়ের ওপর দিয়ে এসে পড়েছি অন্য কোনো হিমক্ষেত্রে- সর্বশেষে আমাদের নজরে পড়ল একটি বৃক্ষলতাহীন পাহাড়ের ওপরে। এখানে নীচে থেকে ওঠা শুভ্র হিমরাশি গিয়ে মিশেছে নীল নভোমণ্ডলে–আর নীলাকাশের পটভূমিতে মানবমূর্তি দেখা যাচ্ছে, এই মানুষের সারি গিয়ে অন্তর্হিত হচ্ছে পাহাড়ের প্রান্তে। মূর্তিগুলির পেছনে যদি নীলাকাশ না থাকত তা’হলে আমরা কিছুতেই মানুষগুলিকে দেখতে পেতাম না। ওদের শরীর ঢাকা আছে বরফের মতই সাদা বৃষচর্মে, তাদের হাতের অস্ত্রগুলিও যেন ধবধবে সাদা। এই পরিব্যাপ্ত শ্বেত তুষারের ক্ষেত্রে আন্দোলিত মূর্তিগুলিকে কি করে চিনে ওঠা যায়!
আরো কাছে গিয়ে দেখা যাক। সবার আগে রয়েছে একজন স্ত্রীলোক, বলিষ্ট তার দেহ– বয়স চল্লিশ-পঞ্চাশের মধ্যে। তার নগ্ন দক্ষিণ বাহুর দিকে তাকালেই বোঝা যায় সে খুব বলবতী। মাথার চুল, অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি সামাদের গুহায় দেখা পূর্বোক্ত তরুনীদ্বয়ের মতোই- তবে আকারে বোড়। বাঁ হাতে একটি ছুঁচলো তিন হাত লম্বা ভূর্জ গাছের মোটা কাঠ। ডান হাতে কাঠের হাতলে দড়ি দিয়ে বাঁধা পাথরের কুঠার, শিকারের জন্য ঘষে ঘষে শান দেওয়া হয়েছে, তার পেছনে রয়েছে চারজন পুরুষ ও দু’জন স্ত্রীলোক। একজন পুরুষের বয়স মেয়েটির চেয়ে কিছু বেশি, আর বাকী সকলেই চৌদ্দ থেকে ছাব্বিশের মধ্যে। বয়স্ক পুরুষটির মাথার চুল লম্বা এবং রঙ আর সকলের মতো স্বর্ণাভ-শুভ্র, সারা মুখ দাড়ি গোঁফে ঢাকা। পূর্বোক্ত স্ত্রীলোকটির মতো শরীরের গঠন বলিষ্ঠ এবং তারও কাছে স্ত্রীলোকটির মতোই দুটি অস্ত্র আছে। বাকি তিনজন পুরুষের মধ্যে দু’জনের মুখ দাড়ি-গোঁফে ঢাকা, কিন্তু বয়স কম। স্ত্রীলোক দুটির মধ্যে একজনের বয়স বাইশ, অপর জন ষোড়শী–হয়ত বা আরো কম। আমরা আগের গুহায় মাতামহীকে দেখেছি। এদের সকলকে মিলিয়ে দেখলে মনে হয়ে যেন এরা সকলেই একই ছাঁচে গড়া। হাতে কাঠ, হাড় ও পাথরের অস্ত্রাদি এবং তাদের অভিযান দেখে মনে হয়, তারা যেন যুদ্ধে যাচ্ছে।
পাহাড় থেকে নামার পথে প্রথম স্ত্রীলোকটি হচ্ছে মা। সে বাঁ দিকে ঘুরল, আর সকলে তাকে নীরবে অনুসরণ করল। বরফের ওপর দিয়ে চলার সময় তাদের চামড়ায় ঢাকা পায়ের কোনো শব্দ হচ্ছিল না। সামনে দিকে ঝুঁকে-পড়া একটি পাহাড়–তার চারপাশে কতকগুলি ঢিলা। শিকারীরা এবার তাদের গতি একেবারে কমিয়ে দিল। তারা সতর্কতার সঙ্গে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো, তারপর অতি ধীরে সন্তর্পণে দূরে দূরে পায়ের পাত ফেলা ঢিলার দিকে এগোতে লাগল। মা সকলেও আগে গুহামুখে গিয়া পৌঁছাল। গুহার বাইরের সাদা বরফের দিকে ভালো করে তাকাল–সেখানে কোন কিছুর পায়ের চিহ্ন পড়েছে কি-না? দেখল কোনো চিহ্ন নেই। সে একলাই গুহামধ্যে প্রবেশ করল; কয়েক পা এগিয়ে গুহার একটি বাঁক দেখা গেল, আরল খুবই কম। কিছুক্ষণ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থেকে অন্ধকারকে চোখ-সওয়া করে নিল, তারপর এগুলো। সেখানে দেখতে পেল, তিনটি ধূসর রঙ-এর ভাল্লুক–বাবা, মা ও তাদের বাচ্চা নীচের দিকে মুখ করে নিশ্চলভাবে পড়ে আছে–মরে গিয়াছে কি-না অনুমান করা যায় না। জীবনের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
মা পা টিপে টিপে ফিরে এল। মায়ের উৎফুল্ল মুখ দেখে পরিবারের আর সকলেই ব্যাপারটা আন্দাজে বুঝে নিল। বুড়ো ও কড়ে আঙুল চেপে মা তিনটি আঙ্গুল তুলে দেখাল। তারপর মা আবার গুহার মধ্যে প্রবেশ করল। অস্ত্রাদি বাগিয়ে তার পিছনে চলল দু’জন পুরুষ। বাকি সবাই দমবন্ধ করে সেইখানেই অপেক্ষা করতে লাগল। গুহার মধ্যে গিয়ে মা দাঁড়াল মরদ ভাল্লুকটির কাছে, আর দু’জন পুরুষের মধ্যে একজন মাদী ভাল্লুকটির কাছে, অপরজন বাচ্চাটির কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তিনজনে একই সঙ্গে ভাল্লুকের উদরে সুতীক্ষ্ণ কাঠের বর্শা দিয়ে বিদ্ধকরে হৃৎপিণ্ড পর্যন্ত যখন করল। জন্তুগুলো আর নড়াচড়া করাবার অবসর পেল না। তাদের শীতকালের ছ’মাস নিদ্রাভঙ্গের তখনও একমাস বাকি। কিন্তু শিকারীদের পক্ষে তখন তা জানার উপায় ছিল না। তাদের তাই সতর্ক হয়েই কাজ করতে হয়। ডান্ডার তীক্ষ্ণ ফলাটি আরো তিন চার বার সজোরে আঘাত করে ভাল্লুকগুলিকে উল্‌টে দিল। তারপর নির্ভয়ে ভাল্লুক তিনটির পা ও মুখ ধরে বাইরে টেনে আনল। সকলেই খুশী হয়েছে, এতক্ষণে তাদের প্রাণ-খোলা হাসি ও গলা-ছেড়ে চীৎকার শোনা গেল।
বড় ভাল্লুকটিকে চিৎ করে ফেলে মা চমকির পাথরের ছুরিটা চামড়ার পোষাক থেকে বার করে পুনরায় ভাল্লুকটির প্রথম আঘাত স্থানের ক্ষত থেকে সরু করে পেটের চামড়াটা চিরে ফেলল। পাথরের ছুরি দিয়ে এত পরিষ্কারভাবে চামড়া চেরা খুবই অভ্যস্ত ও মজবুত হাতের কাজ। তারপর মা নরম হৃৎপিণ্ড থেকে একখণ্ড মেটে কেটে নিজের মুখে পুরল এবং আর একখণ্ড সর্বকনিষ্ঠ ছেলেটির মুখে দিল। সবাই ভাল্লুকটির চারদিকে ঘুরে বসল আর মা তাদের সবাইকেই কলিজার মাংস খণ্ড খণ্ড করে কেটে ভাগ করে দিতে লাগল। একটি ভাল্লুকের মেটের খাওয়া শেষ করে অন্যটির কলিজা কাটবার যখন উদ্যোগ করহচিল তখন দলের ষোল বছরের মেয়েটি বাইরে এসে একখণ্ড বরফ তুলে মুখে পুরে দিল; এই সময় দলের প্রবীণ পুরুষটিও বেরিয়ে এসে বরফের টুকরো তুলে মুখে দিল এবং ষোড়শী মেয়েটির হাত চেপে ধরল। মেয়েটি প্রথমটা একটু ইতস্তত করে শান্ত হল। পুরুষটি তাকে বাহুবেষ্টিত করে এক পাশে চলে গেল। এরা দু’জনে যখন হাত-ভর্তি বরফকণা নিয়ে কাটা ভাল্লুকের কাছে ফিরে এল তখন তাদের চোখ মুখের রঙ উজ্জ্বল, গাল রক্তিমাভ।
পুরুষটি বলল, “এবার দাও আমি কাটি, তুমি শ্রান্ত হয়ে পড়েছ।”
মা তার হাতে ছুরিটি তুলে দিল। তারপর একটু নত হয়ে পাশে উপবিষ্ট চব্বিশ বছরের যুবকটির মুখে চুমু খেয়ে তার হাত ধরে বেরিয়ে গেল।
এরা সকলে মিলে তিনটি ভাল্লুকের মেটে খেয়ে ফেলল। চার মাসের অনাহারী নিদ্রিত ভাল্লুকগুলোর চর্বি বিশেষ কিছুই ছিল না। তবে বাচ্চা ভাল্লুকটির মাংসই শেষ পর্যন্ত দেখা গেল নরম ও উপাদেয়। তাই তার অনেকখানি মাংস এরা খেয়ে ফেলল। তারপর সবাই পাশাপাশি শুয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে নিল।
এবার তাদের ঘরে ফেরার পালা; মদ্দা ও মাদী ভাল্লুক দুটির চার পা চামড়ার দড়িতে বেঁধে লাঠিতে ঝুলিয়ে দু’জন করে কাঁধে নিল, বাচ্চাদিকে কাঁধে নিল ষোড়শী তরুণী, পাথরের কুড়াল হাতে নিয়ে মা আগে আগে চলল।
এইসব বন্য মানুষগুলির সময়ের হিসাব ছিল না, ঘড়ির কাঁটার কোন জ্ঞান না থাকলেও এ ধারণা তাদের ছিল যে আজকের রাত চাঁদনী রাত হবে। তারা কিছুদূর যাবার পরে সূর্য দিগন্তে অস্তমিত হল বলে মনে হলেও আসলে কিন্তু তখনো সূর্যাস্ত হয় নি–আরো কয়েক ঘণ্টা গোধূলির আলো রইল। সূর্যকিরণের শেষ গোধূলির আলো মিলিয়ে যেতে না যেতে বিশ্বচরাচর শুভ্র জ্যোৎস্নালোকে ভরে গেল।
তাদের গুহাশ্রয় তখনো অনেক দূরে। পথে চলতে চলতে মা হঠাৎ প্রান্তরের মধ্যে থমকে দাঁড়াল, কান পেতে কিছু শুনতে লাগল। ষোল বছরের মেয়েটি ছাব্বিশ বছরের ছেলেটির কাছে গিয়ে বলল। “গুর্‌র, গুর্‌র, বৃক্‌, বৃক্‌” অর্থাৎ নেকড়ে বাঘ।
মা মেয়েটির কথায় মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলল, ‘বহু বৃক্‌, বহু বৃক্‌” অনেক নেকড়ে। তারপর উত্তেজিত কণ্ঠে রুদ্ধশ্বাসে মা আবার বলল, “প্রস্তুত হও।”
শিকার মাটিতে রেখে সকলে নিজ নিজ হাতিয়ার শক্ত করে ধরল এবং প্রতি দু’জনে পিঠে পিঠ দিয়ে চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি নিবন্ধ করে দাঁড়াল; নিমিষের মধ্যে সাত আটটি নেকড়ে বাঘের একটি দল লক্‌লকে জিভ বার করে তাদের দিকে এগিয়ে এল, তারা কাছে এসে গজরাতে গজরাতে চারিদিকে বৃত্তাকারে ঘুরতে লাগল। মানুষের হাতে কাঠের বর্শা ও পাথরের কুঠার দেখে নেকড়েগুলো তাদের আক্রমণ করতে অতস্তত করতে লাগল। ইতিমধ্যে চক্রের মাঝখানের সর্বকনিষ্ঠ ছেলেটি তার লাঠির সাথে বাঁধা কাঠের ফলক খুলে নিজের কোমরে বাঁধা শক্ত চামড়ার দড়ি কাঠে বেঁধে ধনুক তৈরি করে ফেলল। কে জানে কোথায় নিজের কাছে লুকিয়ে রেখেছিল ছুঁচলো পাষাণ ফলকের তীর। সে চব্বিশ বছরের যুবকটির হাতে তীর ধনুক দিয়ে তাকে দাঁড় করিয়ে দিল চক্রের মধ্যস্থলে নিজের জায়গায়, আর নিজে গিয়ে তার জায়গায় দাঁড়াল। চব্বিশ বছরের যুবকটি তখন ধনুকের গুণকে আরো শক্ত করে বেঁধে নিল, তারপর তীর ছুঁড়ে একটি নেকড়ের পেটে বিদ্ধ করল। নেকড়েটি গড়িয়ে পড়ে গেল, কিন্তু পরে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার যখন মরিয়া হয়ে আক্রমণের উদ্যোগ করছিল, যুবকটির দ্বিতীয় তীর গিয়ে লাগল–আঘাতটা হল মারাত্মক। নেকড়েটাকে নিশ্চল অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে অন্যগুলি তার কাছে এগিয়ে এলো, তার দেহ থেকে ঝরে-পড়া গরম তাজা রক্ত পান করতে লাগল; আর পরক্ষণেই মৃতদেহ খণ্ড খণ্ড করে তার মাংস খেতে শুরু করল।
জানোয়ারগুলিকে ভোজন উৎসবে ব্যস্ত রেখে দলটি নিজেদের শিকার তুলে নিয়ে সতর্কতার সঙ্গে দ্রুত পায়ে এগুতে লাগল। এবার মা চলছে সবার পিছনে, আর বার বার পিছনে ফিরে চারিদিকে নজর রাখছিল। আজ তুষারপাত হয়নি, তাই চাঁদনী রাতের আলোতে নিজেদের পদচিহ্ন অনুসরণের কোনো অসুবিধা হচ্ছিল না। তাদের গিরিগুহা থেকে যখন তারা আধ মাইল পথ দূরে, তখন নেকড়ের পাল আবার তাদের ঘিরে ধরল। আরা শিকারগুলো মাটিতে রেখে হাতিয়ার বাগিয়ে দাঁড়াল। ধনুকধারী কয়েকটি তীর ছুঁড়ল, এবার কিন্তু একটাকেও বিদ্ধ করা সম্ভব হল না। কারণ, নেকড়েগুলি এক জায়গা থেকে অপর জায়গায় প্রতি মুহূর্তে স্থানবদল করে বেড়াচ্ছিল। কিছুক্ষণ পাঁয়তারা করবার পরে চারটে নেকড়ে একসঙ্গে ষোড়শীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। মা তার পাশেই ছিল। সে একটি নেকড়ে পেটে তার বর্শা ঢুকিয়ে মাটিতে ফেলে দিল। কিন্তু অন্য তিনটে নেকড়ে মেয়েটির উরুতে নখ দিয়ে মাটিতে ফেলে মুহূর্তের মধ্যে পেট চিরে নাড়িভুঁড়ি বার করে ফেলল। সকলের নজর যখন এই ষোল বছরের মেয়েটিকে বাঁচাবার দিকে–সেই সময়েই অন্য তিনটে নেকড়ে চব্বিশ বছরের যুবকটির অরক্ষিত পিঠের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, আর আত্মরক্ষার সামান্য সুযোগটুকুও না দিয়ে তার পেট চিরে ফেলল। যখন অন্য সকলে আবার যুবকটিকে বাঁচাবার জন্য ব্যস্ত, সেই অবসরে নেকড়েগুলো ষোড়শীর ক্ষত-বিক্ষত দেহ প্রায় হাত পঁচিশেক দূরে টেনে নিয়ে গেল। মা চেয়ে দেখল মৃতপ্রায় নেকড়ে বাঘটির পাশে চব্বিশ বছরের যুবকটিও শেষ নিশ্বাস ফেলছে। মুমূর্ষূ নেকড়েটির মুখে ডাণ্ডা ঢুকিয়ে দিয়ে, একজন সামনের পা চেপে ধরছে আর সকলে তার ক্ষতস্থানে মুখ লাগিয়ে লবণাক্ত রক্ত পান করছে। নেকড়ের কণ্ঠনালি কেটে দিয়ে মা তাদের কাজ আরো সহজ করে দিল। ব্যাপারগুলি ঘটে গেল কয়েক মুহূর্তের মধ্যে। তারা জানত যে মেয়েটিকে খাওয়া শেষ করে নেকড়েগুলি আবার তাদের ওপর আক্রমণ করবে। তাই তারা মৃতপ্রায় যুবকটিকে সেখানে ফেলে রেখে তাদের তিনটি ভাল্লুক ও মৃত নেকড়েটিকে কাঁধে তুলে নিয়ে ছুটতে লাগল এবং নিরাপদে নিজেদের গুহায় পৌঁছাল।
গুহার মধ্যে আগুন দাউদাউ করে জ্বলছিল, তারই লাল আভায় শুয়ে ঘুমাচ্ছিল শিশুরা আর তরুণীদ্বয়। শিকারীদের ফিরে আসার শব্দ পেয়ে বৃদ্ধা ভারী গলায় জিজ্ঞেস করল “নিশা-আ-আ এলি?”
“হ্যাঁ” বলে মা প্রথমে এক কোণে তার অস্ত্র-শস্ত্র রেখে চামড়ার পোষাকটি খুলে সম্পূর্ণ দিগম্বরী হল, অন্যেরাও শিকারগুলো মাটিতে রেখে তার মতো চামড়ার পোষাক ছেড়ে নগ্ন দেহের প্রতি রোমে আগুনের আরামদায়ক উত্তাপ উপভোগ করতে লাগল।
এখন গোটা ঘুমন্ত পরিবারটি জেগে উঠল। সামান্য শব্দে জেগে ওঠার অভ্যাস ছেলেবেলা থেকেই এদের মজ্জাগত। খাদ্য রসদ যা পাওয়া যেত তা খুব হিসাবের সঙ্গে খরচ করেই মা তার এই গোষ্ঠীকে এ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখেছে। হরিণ, খরগোস, বনগরু, ভেড়া, ছাগল, ঘোড়া, প্রভৃতি শিকার করার সুযোগ শীত আরম্ভ হওয়ার আগেই পাওয়া যায়, কারণ শীতের দিনে এইসব প্রাণী দক্ষিণের গরম প্রদেশে চলে যায়। মায়ের পরিবারেরও আরো কিছুটা দক্ষিণে যাওয়ার দরকার ছিল। কিন্তু ঐ সময়টাতেই ষোড়শী তরুণীটি অসুস্থ হয়ে পড়ে। সেই যুগের মানব সমাজের নিয়ম অনুসারে পরিবারের মা অর্থাৎ গোষ্ঠীর কর্ত্রী একজনের জন্য পরিবারের সকলের জীবন বিপন্ন করতে পারত না–তা বিধেয় ছিল না। কিন্তু মায়ের আন্তরিক দুর্বলতা প্রকাশ পেল এই মেয়েটির অসুখের সময় এবং তার ফলে আজ তাকে একজনের বদলে পরিবারের দু’জনকে হারাতে হল। শিকারযোগ্য প্রাণীদের এই অঞ্চলে ফিরে আসবার এখনো দু’মাস বাকি। এর মধ্যে না জানি আবার কত জনকে হারাতে হয়। তিনটি ভাল্লুক এবং একটি নেকড়ের মাংস বাকি শীতকালের খোরাকের পক্ষে যথেষ্ট নয়।
ছোট ছেলেমেয়েগুলি খুবই উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে–বেচারিরা খালি পেটেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। মা আগে নেকড়ের মেটে কেটে ছোটদের মধ্যে ভাগ করে দিতে লাগল, ছেলেরা গোগ্রাসে চেটেপুটে খাচ্ছিল। এই অবসরে মা খুব সতর্কতার সঙ্গে নেকড়ের চামড়াটে ছাড়িয়ে ফেলল, কারণ লোমশ চামড়া খুবই দরকারী। মাংস কাটার সময় যারা খুব ক্ষুধার্ত তারা খানিকটা কাঁচা খেয়ে নিল। তারপর আগুনে ঝলসে নিয়ে খেতে লাগল। প্রত্যেকেই তাদের মাংস পোড়া থেকে এক কামড় খাবার জন্য মাকে অনুরোধ করতে লাগল।
মা বলল, “ব্যাস, আর তোমরা সকলে পেট ভরে খাও, কাল কিন্তু এতটা পাবে না।” মা উঠে গুহার একটি কোণ থেকে চামড়ার থলি নিয়ে এসে বলল, “এইটুকু মধুএ সুবরা আছে, আজ সুরা পান, নৃত্য ও ফূর্তি কর।”
ছোটদের এক-আধ ঢোক দেওয়া হল, বড়রা পেল বেশি বেশি। ক্রমেই মদোন্মত্ত উল্লাস দেখা দিল, চোখ হল লাল, আর হাসির উঠল ফোয়ারা। এদের মধ্যে কেউ একজন গান ধরল, প্রবীণ লোকটি একটা লাঠির ওপর কাঠি দিয়ে বাজাতে আরম্ভ করল–আর সকলে মিলে নাচ জুড়ে দিল। আজ হল অবারিত আনন্দের রাত। পরিবার ছিল মাতৃশাসনে কিন্তু সে রাজ্যে অন্যায় বা অসাম্য ছিল না। বুড়ি মাতামহী ও প্রবীণ পুরুষটি ছাড়া বাকি সকলেই মায়ের সন্তান-সন্ততি। মা এবং প্রবীণ পুরুষটি আবার বৃদ্ধা মাতামহীর সন্তান, কাজেই এদের মধ্যে ‘এটা আমার’, ‘ওটা তোমার’ এই প্রশ্ন ওঠেনি। বস্তুত সে যুগে তখনো মানুষের মনে সম্পত্তিবোধ সৃষ্টি হয়নি। তবে এ কথা ঠিক যে, মায়ের অধিকার ছিল সমস্ত পুরুষের ওপর আর সে অধিকার সর্বাগ্রহণ্য। চব্বিশ বছরের যে যুবকটি নেকড়ের আক্রমণে মারা গেল সে ছিল মায়ের পুত্র ও পতিও বটে। তার মৃত্যুতে মায়ের মনে কোনো কষ্ট হয়নি তা নয়, তবে সে যুগে মানুষ অতীতের চেয়ে বর্তমানের কথা বেশি ভাবতে বাধ্য হত। মায়ের এখন দু’জন স্বামী বর্তমান–তার অপর সন্তানের বয়স চৌদ্দ মাত্র, তবে সে অল্পকালেই স্বামী হবে তা কেউ বলতে পারে না। মা চব্বিশ বছরের যুবকটিকে ভালোবাসত বেশি। তাই তিনজন তরুণীর ভাগে পঞ্চাশ বছরের পুরুষটি ছিল।
শীত শেষ হবার আগেই বৃদ্ধা মাতামহী একদিন চিরনিদ্রায় নিদ্রিত হল। শিশুদের তিনটিকে নেকড়ে বাঘে নিয়ে গেছে আর প্রবীণ লোকটি বরফ গলার সময় তুষারস্রোতে ভেসে গেল। এইভাবে ষোলজনের পরিবারের মাত্র ন’জন বেঁচে রইল।

৩.
এখন বসন্তকাল। দীর্ঘদিনের হিম-মৃত্যুতে ঢাকা প্রকৃতি আবার নবজীবনে মঞ্জরিত হয়ে উঠেছে। গত ছ’মাস যে ভূর্জ গাছ ছিল নিষ্পত্র–তাতে নবপল্লব জন্ম নিচ্ছে। বরফ গলে যাওয়ার পর পৃথিবী আবার হয়ে উঠেছে শ্যামল, বসন্তের মৃদুমন্দ বাতাসে বনষ্পতি ও ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধে ছড়াচ্ছে অপূর্ব মাদকতা। দিগন্তব্যাপী সারা পৃথিবী নতুন করে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। কোথাও গাছে গাছে শোনা যেতে লাগল পাখীদের কাকলী, কোথাও বা ঝিঁঝি পোকার একটানা ডাক। গলে যাওয়া বরফের স্রোতে ধারে বসে কোথাও বা নানাজাতীয় জলচর পাখী ছোটখাট পোকা-মাকড় খুঁটে খাচ্ছে, আবার কোথাও বা রাজহংসগুলিকে প্রণয়-ক্রীড়া-রত দেখা যাচ্ছে। এখন এই শ্যামল পার্বত্য বনের মধ্যে দেখা যাবে দলে দলে হরিণগুলোকে ছুটে বেড়াতে। কোথাও ভেড়া, কোথাও ছাগল, রক্তমৃগ বা গরু চরে বেড়াচ্ছে আর এদের শিকারের জন্য ওৎ পেতে বসে আছে নেকড়ে আর চিতাবাঘ।
শীতের সময় নদী হয়ে যায় অবরুদ্ধ জমাট বরফ। শীতের অবসানে আবার বিগলিত ধারায় প্রবাহিত হয়। অবরুদ্ধ নদীর মতোই যে মানুষের দল আটকে পড়েছিল তারাও দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। আপন আপন অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে, চামড়া ও ছোট ছেলেমেয়েদের বোঝা ঘাড়ে করে গৃহ-অগ্নি নিয়ে মানুষের দল আরও উন্মুক্ত অঞ্চলে অগ্রসর হতে থাকল। যতই দিন যেতে লাগল–পশু ও বনষ্পতির মতোই মানুষের শুক্‌নো কুঞ্চিত চামড়ার নীচে আবার মেদ-মাংস জমতে লাগল, কখনও কখনও তাদের পোষা রোমশ কুকুরগুলো হরিণ বা ছাগল ধরে আনত, আবার কখনও বা তারা নিজেরাই ফাঁদ পেতে তীর বা কাঠের বর্শা দিয়ে জানোয়ার শিকার করত। নদীতে মাছও ছিল প্রচুর, ভোলগার তীরবর্তী অধিবাসীদের জাল কখনও খালি উঠত না।
এই সময় রাত্রে ঠাণ্ডা পড়ত, তবে দিনের বেলা থাকত গরম। বর্তমানে আরও কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে মিলে ভোল্‌গার তীরে নিশা পরিবার বসবাস করছিল। নিশার পরিবারের মতো অন্যান্য পরিবারগুলিও মায়েদের ছিল। এদের পরিবার পিতৃশাসিত নয়, পরিবারগুলি মাতৃশাসিত। তার কারণও ছিল, তখন কে কার পিতা তা বলা আদৌ সম্ভব ছিল না। নিশার বয়স বর্তমানে পঞ্চান্ন। তার আটটি মেয়ে ও ছ’টি ছেলের মধ্যে চার মেয়ে এবং তিনটি ছেলে বেঁচে আছে। তারা যে নিশার সন্তান তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কারণ প্রসবের সাক্ষী স্বয়ং বর্তমান, কিন্তু কে যে পিতা তা বলা যায় না। নিশার পূর্বে তার মা অর্থাৎ বৃদ্ধ মাতামহীর যখন শাসন ছিল, তখন তার পরিণত বয়সে অনেকগুলি স্বামী ছিল। এই স্বামীদের কেউ বা ভাই-স্বামী বা পুত্র-স্বামী। তারা আবার বহুবার নিশার সঙ্গে নাচ গানের সময় প্রেমপ্রার্থী হয়েছে। তারপর নিশা যখন নিজে কর্ত্রী হল তখন তার নিরস্তর পরিবর্তনশীল কামনাকে প্রত্যাখ্যান করবার সাহস তার ভাই বা পুত্রদের ছিল না। এই জন্যই নিশার জীবিত সাত সন্তানের কে কার পিতা বলা অসম্ভব। নিশার পরিবারে এখন সে নিজেই সবচেয়ে বড়–বয়স ও প্রতিপত্তি দুই দিক দিয়েই। অবশ্য এই কর্তৃত্ব আর বেশিদিন থাকবে না। দ’এক বছরের মধ্যে সে নিজেও বুড়ি দিদিমাতে পরিণত হবে। আর মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে বলিষ্ঠা শক্তিশালিনী কন্যা হচ্ছে লেখা–সে তার স্থান দখল করবে। অবশ্য এই অবস্থাতে লেখার সঙ্গে তার বোনদের ঝগড়া অনিবার্যভাবেই বাঁধবে। প্রত্যেক বছরই কিছু লোক নেকড়ে বা চিতাবাঘের মুখে, ভাল্লুকের থাবায়, বুনো ষাঁড়ের সিং-এ, ভোলগার স্রোতে যেখানে প্রাণ হারাচ্ছে সেই ক্ষয়িষ্ণু পরিবারকে রক্ষার দায়িত্ব হচ্ছে প্রতি পরিবারের রাণী মায়ের! অবশ্য লেখার বোনদের মধ্যে হয়ত কেউ কেউ স্বাভাবিকভাবেই স্বতন্ত্র পরিবার গড়ে তুলবে। এই রকম ভাবে পরিবারের শাখা বেরিয়ে যাওয়া তখনি বন্ধ হবে যখন পুরুষ হবে দলের কর্তা। অনেক পুরুষের একজন স্ত্রীর বললে, একজন পুরুষ অনেক স্ত্রীর স্বামী হবে।
পরিবারের কর্ত্রী নিশা লক্ষ্য করেছে তার মেয়েদের মধ্যে লেখাই শিকারে সবচেয়ে পটু। পাহাড়ে চড়তে পারে হরিণের মত দ্রুত গতিতে। একদিন সকলের নজরে পড়ল উঁচু পাহাড়ের শৃঙ্গদেশে একটি মৌচাকের ওপর। এত উঁচু যে মধুকর ভাল্লুকও সেখানে পৌঁছতে পারেনি। কিন্তু লেখা লাঠির পরে লাঠি বেঁধে টিকটিকির মতো সেগুলো বেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ওপরে উঠে রাত্রে মশাল জ্বেলে হুলো মাছিগুলোকে পুড়িয়ে মৌচাক ফুটো করে দিয়ে তার নীচে থলি ধরল। তাতে কম করে হলেও ত্রিশ সেরের কম মধু পড়েনি। শুধু নিশা পরিবার নয়, লেখার এই দুঃসাহসিকতার প্রশংসা অন্যান্য পরিবারগুলিও করেছিল। কিন্তু মা নিশা এতে আনন্দিত হল না। মা দেখল যে তার পুত্রেরা এখন লেখাত ইঙ্গিতে নাচতে যতটা উৎসাহ পায়, ততটা আগ্রহান্বিত নয় তার কথায়। অবশ্য খোলাখুলিভাবে তাতে অবজ্ঞা করার সাহস এখনো তাদের হয়নি।
কিছুকাল ধরেই নিশা একটা উপায় উদ্ভাবনের চেষ্টা করছিল। অনেক সময় তার ইচ্ছা হত লেখাতে ঘুমন্ত অবস্থায় মেরে ফেলতে, কিন্তু সে সাহস পেত না। সে জানত লেখা তার চেয়ে শক্তিশালিনী। সে অন্যের সাহায্য চাইতে পারে, কিন্তু তাকে অন্যরা সাহায্য করবে কেন? পরিবারের সব পুরুষই লেখার প্রেম-প্রার্থী, কৃপার পাত্র হতে চায়। নিশার অন্য মেয়েরাও তাকে সাহায্য করবে না, কারণ তারা ভয় করত লেখাকে। তারা জানত যদি এই ধরনের কোন ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয় তা’হলে তাদের সকলকেই অসহ্য কষ্ট পেয়ে মরতে হবে। নির্জনে বসে বসে নিশা ভাবছিল। সহসা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠল, লেখাকে পরাস্ত করার উপায় সে খুঁজে পেয়েছে। বেলা তখন এক প্রহর। নিশা ও পরিবারের অন্যান্য সকলেই নিজ নিজ তাঁবুর পেছনে বসে অথবা শুয়ে, নগ্নদেহে রোদ পোহাচ্ছিল। নিশা বসেছিল তাঁবুর সামনে, লেখার তিন বছরের ছেলেটি খেলছে তার সামনে।
নিশার হাতে ছিল পাতার ঠোঙা-ভর্তি লাল স্ট্রবেরী ফল। পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে ভোলগা নদী, নিশার সমুখের জমি ঢালু হতে হতে ভোলগার জলে গিয়ে মিশেছে। নিশা একটা ফল মাটিতে গড়িয়ে দিল–ছেলেটি দৌড়ে গিয়ে সেটা কুড়িয়ে খেল। আবার একটি ফল নিশা গড়িয়ে দিল, এটা কুড়িয়া নিতে ছেলেটি আরো কিছুদূর এগিয়ে গেল। আরও একটি ফল গড়িয়ে দিল–আরো দূরে গেল ছেলেটি। এভাবে দ্রুততালে একটার পর একটা ফল নিশা গড়িয়ে দিতে লাগল। ক্রমেই ছেলেটি তা কুড়িয়ে নিতে আরো দ্রুত আরো দূরে যেতে লাগল। এমনি করে হঠাৎ পা পিছলে ভোলগার খরস্রোতে ছেলেটি পড়ে গেল। সেইদিকে চেয়ে নিশা চিৎকার করে উঠল। লেখা কিছুদূরে বসে সব দেখছিল। সে ছুটে এসে নদীর খরস্রোতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ছেলেটি তখনো একবার ভাসছে একবার ডুবছে–লেখা তাকে ধরে ফেলল। ছেলেটি ইতিমধ্যে বেশ খানিকটা জল খেয়ে নেতিয়ে পড়ছে। তা’ছাড়া ভোলগার বরফ-গলা ঠাণ্ডা জল ছুঁচের মত তার গায়ে বিঁধছিল। অনেক কষ্টে লেখা তার ছেলেকে নিয়ে স্রোতের বিরুদ্ধে এগিয়ে আসতে লাগল। এক হাতে তার ছেলে, অন্য ও পা দিয়ে সে সাঁতার কেটে এগোবার চেষ্টা করছিল। হঠাৎ সে টের পেল এক জোড়া বলিষ্ঠ হয়াত তার গলা চেপে ধরেছে। লেখার আর বুঝতে বাকি রইল না–কে সে? অনেক দিন ধরেই লেখা লক্ষ্য করছিল তার প্রতি নিশার আচরণের পরিবর্তন। আজ দেখল সুযোগ বুঝে নিশা তার পথের কাঁটা সরিয়ে ফেলতে উদ্যত। লেখা তখনো নিশাকে নিজের শক্তির পরিচয় দিতে পারত কিন্তু তার হাতে ছিল ছেলে। লেখাকে বাধা দিতে দেখে নিশা নিজের দেহের সমস্ত ভার দিয়ে লেখার মাথার ওপর নিজের বুকটাকে চেপে ধরল। এতক্ষণ পর লেখা প্রথম জলের নীচে তলিয়ে গেল। প্রাণপণে ওপরে উঠবার চেষ্টা করতে গিয়ে ছেলেটা হাত থেকে ফস্‌কে গেল। ইতিমধ্যে নিশা লেখাকে বেশ সঙ্কটজনক অবস্থায় এনেছিল। কিন্তু হঠাৎ নিশার গলার নাগাল পেয়ে লেখার তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করে হাত দিয়ে নিশার গলা চেপে ধরল। লেখা ততক্ষণে নিজেও অজ্ঞান হয়ে গেছে আর তার দেহের গুরুভার নিশাকেও জলের নীচে টেনে নিচ্ছিল–নিশার তখন বাধা দেবার সামর্থ ছিল না। তবু নিশা কিছুটা চেষ্টা হয়ত করত কিন্তু এখন সবই বিফল। দু’জনে দু’জনার দ্বারা পিষ্ট হয়ে ভোলগার স্রোতে তলিয়ে গেল। পরে নিশা পরিবারের কর্ত্রী-মা হল পরিবারের সবচেয়ে বলিষ্ঠ স্ত্রীলোক রোচনা।*

——————-
* আজ থেকে ৩৬১ পুরুষ আগেকার কথা। তখন ভারত, ইরান এবং ইউরোপের জাতিগুলি ট্রাইব স্তরে ছিল। সেটা ছিল মানব সমাজের প্রারম্ভিক কাল।

০২. দিবা (স্থান : মধ্য ভোলগা তট ।। কাল : ৩৫০০ খৃষ্টপূর্ব)

দেশ মধ্য ভোলগা তট।।

‘‘দিবা! রোদ বড় কড়া, দ্যাখ তোর সারা গা ঘামে ভিজে গেছে। আয়, এই শিলা খণ্ডের ওপর বসি।’’

‘‘বেশ তাই হোক, শুরশ্রবা-অ’’ এই বলে দিবা সুরশ্রাবার সঙ্গে এক বিশাল পাইন গাছের ছায়ায় শিলা খণ্ডের ওপর বসল।

গ্রীষ্মকাল, সময় মধ্যহ্ন। হরিণের পেছনে এত ছুটোছুটির পর দিবার ললাটে অরুণাভ মুক্তার মত স্বেদবিন্দু ঝরবে—তাতে আর আশ্চর্য কী? কিন্তু েএ স্থানটি এমনই যে ক্লান্তি দূর হতে মোটেই সময় লাগে না। পাহাড়ের নীচ থেকে মাথা পর্যন্ত শ্যামল আস্তরণে আচ্ছাদিত। বিশাল পাইন বৃক্থ আপন শাখা ও সূচালো পত্রাবলী বিস্তার করে সূর্যকিরণের গতিরোধ করছে, নিচে স্থানে স্থানে বিচিত্র বনৌষধি, লতাগুল্ম ও নানবিধ গাছ-গাছড়া পুষ্পস্মভারে মুকুলিত হয়ে আছে।ক্ষণকাল বিশ্রামের পর তরুণ-তরুণীর শ্রান্তি বিদূরিত হল। চারিদিকে রঙ বেরঙ-এর ফুল, অপূর্ব মধুর গন্ধ তাদের মন হরণ করছিল। তরুণ যুবকটি আপন ধনুর্বাণ ও পাথরের কুঠার শিলা খণ্ডের ওপর রাখল, ক্ষণকাল পরে পার্শ্বস্তিত কলকল শব্দ প্রবাহিত স্ফটিকস্বচ্ছ জলস্্রোতের পাশে এসে সাদা বেগূনী ও লাল রঙ-এর ফুল আহরণ করতে লাগল। তরুণী আপন অস্ত্রাদি রেখে তার দীর্ঘ সোনালী চুলে হাত দিয়ে অনুভব করল যে চুলের গোড়া তখন ভিজে। একবার নীচের দিকে তাকিয়ে প্রবাহিতা ভোলগার প্রশান্ত রুপ দেখে নিল।পাখীর কলগুঞ্জনে আকৃষ্ট হয়ে চোখ ফেরাতে গিয়ে দৃষ্টি আবদ্ধ হল পুষ্পচয়নরত তরুণের প্রতি। যুবকের চুলও সোনালী, তবু তরুণী তার নিজের কেশরাশির সঙ্গে তুলনা করতে চাইল না। সে জানত তার নিজের কেশদাম অনেক সুন্দর। তরুণের মুখমণ্ডল ঘণ পিঙ্গল বর্ণ গুম্ফ শুশ্রুতে ঢাকা, তার উপরে নাসিকা কপোল ও ললাটের অরুনিমা দেখা যাচ্ছিল্। তরুণীর দৃষ্টি এবার পুরুষটির পুষ্ট রোমশ বাহুর ওপর পড়ল। তার মনে পড়ে গেল, একদিন সুরশ্রবা তার শক্ত হাত দিয়ে পাথরের কুঠারের ঘায়ে হিংস্র শূকরের কোমর ভেঙে দিয়েছিল। সেদিন মনে হয়েছিল পুরুষের হাত কতই না কর্কশ ও কঠিন, আর আজ পুষ্পচয়নরত সেই বাহুকেই মনে হচ্ছে কেমন কোমল। তবে এ কথা ঠিকই যে, বাহুর শক্ত পেশী ও তার সঞ্চালনে স্ফীত মনিবন্ধের শিরা আজও সেই শক্তির পরিচয় দিচ্ছে। একবার তরুণীর মনে হল, উঠে গিয়ে বাহুযুগলকে চুম্বন করে। হ্যাঁ, এই মূহুর্তে তা খুব প্রিয় মনে হচ্ছিল। এইবার যুবকের উরুদ্বয়ের দিকে দিবার নজর পড়ল।প্রতি পদক্ষেপে গতির তরঙ্গ লীলায়িত হচ্ছিল। একেবারেই চর্বিহীন পেশীবহুল উরু। শক্তিমান জঙ্ঘা এবং ক্ষীণ কটি দিবার কাছে অতি লোভনীয় মনে হচ্ছিল। সুর অনেকবারই দিবার ভালবাসা পাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে—অবশ্য মুখে নয় ভাবে ভঙ্গীতে; নাচের কলা-কৌশল দেখিয়ে দিবাকে খুশী করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তার ‘জনের’ অন্য যুবকেরা যখন দিবার সঙ্গে নাচের সুযোগ পেয়েছে, যখন হয়ত দিবার অধর চু্ম্বনের অনুমতি পেয়েছে কিম্বা বহুবার হয়ত তাদের অঙ্কশায়িনী হয়েছে থখন হতভাগ্য সুর একটি চুম্বন, একটি আলিঙ্গন—এমন কি নৃত্যের সময় একবার হাতে হাত ধরবার সুযোগও পায়নি।সুর অঞ্জলি-ভরা ফুল নিয়ে দিবার দিকে এগিয়ে আসছিল।কি অপূর্বই না দেখাচ্ছিল। তার দিকে তাকিয়ে এখানে বসে আজ দিবার মনে ক্ষোভ জেগে উঠল। কেন সে এতদিন সুরের কথা ভাবেনি । অবশ্য এর জন্য দিবাকে দোষ দেয়া যায় না—অপরাধ যদি কারুর থাকে তা সুরের। তার মুখচোরা লজ্জা এতদিন তার মুখ ফোটাতে দেয়নি। সুর কাছে দিবা হাসিমুখে বলল,‘‘কি সুন্দর ফুলগুলো, কি সুমিষ্ট এ গন্ধ!’’

উপলখণ্ডের ওপর ফুলগুলো রেখে সুর বলল,‘‘তোমার ওই সোনালী চুলে এই ফুলগুলো গুঁজে দিলে তবেই এর সৌন্দর্য পরিপূর্ণ হবে।’’

‘‘আচ্ছা সুর!সত্যিই কি আমার জন্যে এই ফুলগুলি তুমি এনেছ?’’

‘‘হ্যা দিবা। এই ফুলগুলো দেখে তোমার মুখের দিকে তাকালাম—মনে পড়ল জলপরীদের কথা।’’

‘‘জলপরী?’’

‘‘হ্যাঁ! জলপরীরা খুবই ভালো। তারা খুশী হলে সমস্ত মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে—আর যদি রুষ্ট হয় প্রাণ নিতেও ছাড়ে না।’’

‘‘আমাকে কি ধরণের জলপরী মনো হয়, সুর!’’

‘‘রুদ্রাণী নয়।’’

‘‘কিন্তু, আমি তো তোমার ওপর কখনো সোহাগ দেইনি।’’ দিবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে গেল।

ক্ষণকাল পরে সুরশ্রবা বলল, ‘‘না দিবা!তুমি আমার ওপর কখনও রুষ্টা হওনি।

তোমার মনে পড়ে কি আমাদের ছেলেবেলার কথা?’’

‘‘তখনো তুমি কিন্তু এমনি লাজুক ছিলে।’’

‘‘তবে ‍তুমি আমার ওপর কখনও বিরুপ হওনি?’

‘তখন আমি তোমাকে নিজে থেকেই তোমাকে চুমু খেতাম।’’

‘‘কিন্তু যখন আমার যৌবনের উন্মেষ হল, যখন সারা ‘জন’-এর তরুণকুল আমাকে পাবার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠল সেই সময় থেকে আমি তোমার কথা ভুলে গেলাম।’’

‘‘তোমার কোনো দোষ ছিল না দিবা।’’

‘‘তবে দোষটা কার?’’

‘‘আমারই। আমাদের ‘জন’-এর ছেলেরা চুমু খেতে চাইলে তুমি তা দিয়েছ,তারা যখন তোমার প্রেমালিঙ্গন কামনা করেছে তাও দিয়েছ। আমাদের সুন্দর সবল যে কোন যুবক মৃগয়ায় শৌর্য কিংবা নাচে কুশলতা দেখেয়েছে—তুমি কথনো তাদের নিরাশ করনি।’’

‘‘কিন্তু সুর!তুমিও তো তাদেরেই মতো—বরং তাদের চেয়েও কর্মঠ, ক্ষিপ্রগতি, সুগঠিত তোমার দেহ—আমি তোমার কামনাকে তো নিরাশ করেছি।’’

‘‘আমি তো কখনও কামনা প্রকাশ করিনি,দিবা!’

‘মুখে করনি বটে! মনে পড়ে ছেলেবেলার কথা, তখন তুমি কিছুই প্রকাশ করতে না কিন্তু তোমার মনের কথা বুঝতে পারতাম। তারপর দিবা সুরকে ভুলে গেল।

দিবা কথনও সুরকে—দিন কখনও সূর্যকে ভুলে থাকতে পারে? না সুর! দিবা আর কথনও তোমাকে ভুলে থাকবে না।’’

‘‘ তা’হলে ছেলেবেলার সেই দিবা-সুর হয়ে উঠব আমরা আবার।’’

ছোট শিশুর মতো নগ্ন মনোরম মূর্তি পরিপূর্ণভাবে পরস্পরের অধরে অধর মিলিয়ে দিল। আর দিবা, সুরের তিসি ফুলের মতো নীল চোখ দুটোর ওপর তার দৃষ্টি নিবন্ধ রেখে চুমু খেতে খেতে বলল ‘তুমি আমার আপন মায়ের ছেলে—আর আমি তোমাকেই ভুলে ছিলাম।’’

দিবার চোখ জলে ভরে উঠল। সুর দিবার গাল নিজের চোখের জলের ধারায় মুছিয়ে ‍দিয়ে বলল, ‘‘না তুমি তো আমায় কথনও বঞ্চিত করনি, দিবা। তুমি যখন বড় হয়ে উঠলে তোমার কণ্ঠস্বর, তোমার চোখ, তোমার সারা দেহে যখন পরিবর্তন দেখা দিল তখন আমি তোমার কাছ থেকে দুরে সরে গেলাম।’’

‘‘মনের দিক দিয়ে নিশ্চয়ই নয় সুর?’’

‘‘দিবা, সে কথা……’’

‘‘না, তোমাকে বলতেই হবে। ‍তুমি বল আর কখনও ‍তুমি আমায় দেখে লজ্জা পাবে না?’’

‘‘না, আর কথনও তোমার কাছে আমার লজ্জা-ভয় থাকবে না।……আচ্ছা, এবার আমি তোমার চুলে ফুলগুলো সাজিয়ে দিই?’’

সুর লম্বা গাছের ছাল থেকে আঁশ বার করে সেই সুতোয় লাল, সাদা, বেগুনি প্রভৃতি নানা রঙ-এর ফূল নিয়ে একটি সুন্দর মালা গাঁথল। ‍দিবার চুলের রাশ একত্র করে তা পিঠের ওপর ছড়িয়ে দিল। গরমের দিনে ভোলগার তীরবাসী তরুণ-তরুণীরা প্রায়ই জলে নেমে স্মান করত সাঁতার কাটত। তাই দিবার চুলে কোন জট ছিল না। সুর নিচের গাঁধা মালাটি দিবার চুলে তিন ভাঁজ করে, কটিবন্ধে মেঘলা জড়ানোর মতো করে দু‘পাশে সাজিয়ে দিয়ে একটা প্রান্ত তার কপালের ওপর ঝালরের মতো ঝুলিয়ে দিল—তার দু‘পাশে রইল দুটো রক্তবর্ণের আর মাঝখানে সাদা রঙ-এর ফুলের সারি।

দিবা তখনো সেই শিলাখণ্ডের ওপর বসেছিল, সূর একটু দুরে তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল। কত সুন্দরই না দেখাচ্ছিল দিবাকে। আরও একটু পেছনে সরে এসে সূর দেখতে লাগল—আরও সুন্দর দেখাল দিবাকে। তবে দুরে চলে আসার জন্যে ফুলের আর গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল না। ফিরে এসে সুর দিবার পাশে বসল, নিজের গালের সঙেগ গাল মিলিয়ে দিল। দিবা সাথীর চোখে চুমু খেল্ আর নিজের ডান হাত সূরের কাঁধের ওপর রাখল। সূর তার বাঁ হাত দিয়ে দিবার কটিদেশ জড়িয়ে ধরে বলল,‘‘দিবা! এই ফুলগুলে আগের চেয়েও কিন্তু অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে।’’

‘‘ফুল না আমি?’’

সূরের মুখে কোনো উত্তর যোগাল না, ক্ষণকাল মৌন থেকে সে বলল, ‘‘আমি যখন তোমাকে দূর থেকে দেখছিলাম তখন তোমাকে কতই না সুন্দর দেখাচ্ছিল, তারপর আরও একটু দূর গেলাম—আরও অনেক বেশী সুন্দর লাগল।’’

‘‘আর যদি ভোলগা তট থেকে দূরে দেখতে—তা’হলে?’

‘‘না, না অতদূর থেকে নয়’’—এই কথা বলার সময় সূরের চোখে ‍দুশ্চিন্তার ঝলক নেমে এল। সে আবার বলল, ‘‘বেশী দূরে গেলে ফুলের গন্ধ পাওয়া যায় না, আর তোমার মুখটাও অস্পষ্ট হয়ে যায়।’’

‘‘তুমি তা’হলে কিভাবে আমাকে দেথতে চাও? দূর থেকে না কাছ থেকে?’’

‘‘কাছে থেকে। দিনের মধ্যেই সূর্য থাকে উজ্জ্বল—দিবার কাছে থাকবে সূর?’’

‘‘আচ্ছা, আজ তুমি আমার সঙ্গে নাচবে তো!’’

‘‘নিশ্চয়ই।’’

‘‘আজ সারাদিন আমার সঙ্গে থাকবে?

‘‘অবশ্যই।’’

‘‘সারারাত?’

‘‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।’’

‘‘তাহলে আজ জন-এর কোন পুরুষকে কাছে থাকতে দেব না।’’—এই বলে দিবা সুরকে আলীঙ্গনাবদ্ধ করল।

এই সময় শিকারী তরুণ-তরুণীরা ফিরে এল। তাদের সাড়া পেয়েও এরা দুজনে আগের মতোই দৃঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে রইল।

নবাগতাদের একজন বলল, কিরে দিবা! আজ তুই সুরকেই সাথী করে নিলি?’’

ওদের দিকে ফিরে তাকিয়ে দিবা বলল,‘‘হ্যাঁ, এই দেখ, সুর আমাকে ফুল দিয়ে সাজিয়েছে।’’

একটি তরুণী কলকণ্ঠে বলল, ‘‘সুর তুমি তো বেশ ফুল সাজাতে পার? আমার চুলও সাজিয়ে দাও না?’’

দিবা প্রতিবাদ করে বলল, ‘‘আজ নয়, আজ সুর আমার—আমার একার।’’

তরুণী বলল ‘‘বেশ কাল সুর আমার।’’

‘‘না, কালও সুর আমার থাকবে।’’

তরুণী এবার রাগত স্বরে বলল, ‘‘রোজ রোজ সুর তোমারই থাকে না-কি? এ ঠিক না, দিবা।’’

দিবা ‍নিজের ভুল বুঝতে পারল। বলল, ‘‘রোজ নয়, শুধু আজ আর কাল।’’

ক্রমে আরো শিকারী সেখানে এসে হাজির হল। একটা বিরাট কালো কুকুর এল তাদের সঙ্গে—আর এসেই সূরের পা চাটতে লাগল। সূরের মনে পড়ে গেল তার নিজের শিকার করা ভেড়াটার কথা। দিবার কানের কাছে ফিস্ ফিস্ করে কি বলে এক দৌড়ে চলে গেল।

 

কাঠের দেওয়াল এবং খড়ের ছাওনি দেওয়া এক বিশাল কুটির। পাথরের কুঠার ধারাল হলেও তাই দিয়ে ভারী কাঠের গুঁড়ি কাটা সম্ভব হয়নি। কুড়ুলের ব্যবহার করলেও-বড় বড় কাঠ কাটার ব্যাপারে আগুনের সাহায্য নিতে হয়েছে। আর এত বড় কুটির? নিশা নাম্নী পুরাকালের কোনো স্ত্রীলোকের বংশধরদের নামেই নিশা-জনের উৎপত্তি। হ্যাঁ নিশা-জনের সমস্ত লোকজনই এখানে বাস করে।সমগ্র জন গোষ্টি এক ছাউনির নীচে বাস করে, একই সঙ্গে শিকার করে, ফল মধু সবই একত্রে আহরণ করে। সবাই একজনকে, কর্ত্রীকে মানে। গোষ্ঠী পরিচালিত হয় সমষ্টিগতভাবে—সমিতির দ্বারা। পরিচালনা—হ্যাঁ, এই পরিচালনায় জনের ব্যক্তি বিশেষের জীবনের কোনো ঘটনাই সমষ্টি জীবনের বাইরে ছিল না। শিকার, নাচ-প্রেম, গৃহ –নির্মাণ, চামড়ার গাত্রবাস তৈরী—সমস্ত কাজই জনসমিতির পরিচালনায় হত। আর এই সমস্ত কাজে জন-মাতাদের প্রাধান্যই ছিল প্রবল। নিশা জনে দেড়শ নরনারী বাস করে। তবে কি এরা একই পরিবাভুক্ত? এ অর্থে তাদের সবাইকে একটা পরিবার-ভুক্ত বলা চলে আবার অ্য অর্থে কয়েকটি পৃথক পরিবারের সমষ্টিও বলা চলে। মাতার জীবনকালের তাদের কন্যাদের যে সন্তানাদি হয় তার দ্বারা আবার ছোট ছোট শাখা পরিবারের সৃষ্টি হয়। কারণ মাতার নামেই সন্তানরা পরিচিত হয়। উদাহরণস্বরুপ বলা যেতে পারে, দিবার সন্তানরা দিবা-পুত্র বা দিবা-কন্যা বলেই পরিচিত। কিন্তু, খাদ্য মাংস বা ফল বা মধু যাই তারা সংগ্রহ করুক না কেন তা দিবা সন্তানদের ব্যক্তিগত নিজস্ব সম্পত্তি হবে না। জনের স্ত্রী পুরুষ সকলে একত্রে সম্পত্তি অর্থ্যাৎ খাদ্যবস্তু প্রভৃতি সংগ্রহ করে—আর সকলে মিলেই তা ভোগ করে। যদি কিছুই আহরণ করা সম্ভব না হয়, তবে একসঙ্গে সকলেই অনাহারে থাকবে। জন থেকে পৃথক করে ব্যক্তি বিশেষের কোনো বিশেষ অধিকার থাকে না। জনের বা গোষ্টীর আজ্ঞা এবং রীতিনীতি পালন করা তাদের কাছে নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করার মতোই সহজ বলে মনে হতো।

এই কুটিরটাও তাদের অস্থায়ী বাসস্থান। কারণ যখন শিকারযোগ্য জীব এখান থেকে চলে যাবে, ফলমূলের অভাব ঘটবে তখন সারা গোষ্টীর মানুষেরা এ জায়গা ছেড়ে নতুন অঞ্চলে সরে যাবে। বহু যুগের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা থেকে তারা জানে,কোথায় কথন শিকার পাওয়া যাবে। এখান থেকে চলে যাবার পর ছাউনি পড়ে যাবে কিন্তু কাঠের দেওয়াল কয়েক বছর পর্যন্ত টিকে থাকবে। নতুন জায়গায় গিয়ে এরা অনুরুপভাবে পরিত্যক্ত দেওয়ালের ওপর খড়ের ছাউনি দিয়ে নতুন ঘর বানাবে আর তারই একাংশে জিনিস –পত্র রাখা ও অপরাংশ রান্নার কাজে ব্যবহার করবে। এরা এখন হাতে-গড়া মাটির বাসন তৈরী করতে শিখেছে। কখনো বা কাঁচা মাংস খায়—আবার তাজা মাংস পুড়িয়েও খায়, তবে শুকনো মাংস সেঁকে খাওয়ার রীতি নেই—তা নিষিদ্ধ। ভোল্‌গার এই অংশে মধু পাওয়া যায় যথেষ্ট আর তার জন্যে মধুপায়ী ভাল্লুকের সাক্ষাৎও মিলত প্রচুর। নিশাগোষ্ঠী আহার এবং মদ্য পানের জন্য মধু সংগ্রহ করত।

মধুর সংগীতের আওয়াজ আসছে, ঘরে গানের আসর বসেছে। নারী-পুরুষ সকলেই গলা ছেড়ে সজীব কণ্ঠে গান ধরেছে। চামড়া পিটিয়ে যখন গাত্রবস্ত্র তৈরী করত তা হত সেই কর্মরত মানুষের সংগীত। তখনকার দিনে সমস্ত গোষ্ঠীরন লোক কোনো কাজ শুধু যে সম্মিলিতভাবেই করত তা নয়, পরন্তু তা সম্পাদন করত মনোরঞ্জক ভঙ্গিমা সহকারে । তা ছিল সম্মিলিত কাজের একটি অঙ্গ। সংগীতের মূর্ছনা কর্মের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়, কিন্তু এই গান কর্মকালীন গান নয়। এখন বিশ্রামকালীন আনন্দের গান হচ্ছে। একবার নারীকণ্ঠের সুললিত সুর-লহরী শোনা যাচ্ছে—আবার শোনা যায় পুরুষ কণ্ঠের পুরুষ ও গম্ভীর সুর।

কুটিরের এক অংশে গোষ্টীর স্ত্রী-পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ, একত্রে সমবেত হয়েছে। ছাউনির মাঝখানের ছাত কাটা আছে, আর তারই নিচে পাইন কাঠের আগুন জ্বলছে। স্ত্রী পুরুষ সুললিত তালে গান গাইছে, গানের পদে এই শব্দগুলো বোঝা যাচ্ছে—’’

‘‘অ-ন্ত-ন্ত-গ-লী-ীী-এ-সে—’

মনে হচ্ছে এরা যেন আগুনের কাছে প্রার্থনা করছে। গোষ্ঠীর নেত্রী ও জন-সমিতির লোকেরা আগুনের মধ্যে মাংস, চর্বি, ফল ও মধু আহতি দিতে আরম্ভ করল। বর্তমানে জনের হাতে অনেক শিকার সঞ্চিত হয়েছে, প্রচুর ফল ও মধু আহরিত হয়েছে-আর এই ঋতুতে কেউ জানোয়ার বা শত্রুর দ্বারা নিহত হয়নি। তাই আজ জনের মানুষেরা পূর্ণিমার রাত্রে অগ্নি-দেবতার কাছে কৃতাঞ্জলিপুটে প্রার্থনা নিবেদন করছে। জনের নেত্রী এক পাত্র সোমরস আগুনে সমর্পণ করল এবং গোষ্ঠীর সবাই আগুনের চারপাশে ঘিরে দাঁড়াল। জন্মের সময় মানুষ যেমন উলঙ্গ হয়ে পৃথিবীতে আসে—এরা সেই জন্ম থেকে আজও নিরাবরণ, সেইভা্বেই এখানে এসেছে। এখন শীতকাল নয়—গরমের সময়, মৃত পশুর চামড়ায় নিজের দেহ আবৃত করার দরকার মনে করে না।

কিন্তু, কি সুন্দর সুডৌল এদের শরীর্। কারও ভুঁড়ি গজায়নি, কারও শরীরে চর্বি জমে দেহ স্থুল হয়নি। একেই বলে দেহসৌন্দর্য—সুন্দর স্বাস্থ্য! এদের সকলের মুখশ্রী একই ছাঁচের। আর, না-হবেই বা কেন? এরা সকলেই নিশা সন্তান—পিতা-পুত্র-ভাইদের দ্বারা জাত। সকলেই স্বাস্থ্যবান এবং বলিষ্ঠ। অস্বাস্থ্য এবং ক্ষীনকল ব্যক্তি বেঁচে থাকতে পারে না, এই প্রকৃতি ও শিশু জগতের শত্রুতার মধ্যে টিকে থাকা সম্ভব নয়। গোষ্ঠী কর্ত্রী উঠে কুটিরের বড় ঘরটায় গেল। অন্যান্য সকলে কুটিরের মাটিলেপা মেঝেতে এসে বসল।

চামড়ার থলির পর থলি ভতি হয়ে সোমরস আসতে লাগল। কারও কাছে চষক (পেয়ালা) মাটির পাত্র, কেউবা নিয়েছে ভাঁড়, কারও হাতে মাথার খুলি, আবার কেউ হয়ত জোগাড় করেছে গাছের পাতার ঠোঙ্গা। তরুণ-তরূণী, প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সবাই পানাহারে মত্ত হল। সব দলে দলে পৃথক হয়ে বসে খাচ্ছিল। অবশ্য এটা সাধারণ রীতি নয়। বৃদ্ধদের মনে পড়ছিল, তাদের বয়সকালে তারা জীবনের আনন্দ কিভাবে উপভোগ করেছে। তারা জানে এখন তরুণ-তরুণীদের পালা, কোনো কোনো তরুণ-তরুণী অবশ্য বৃদ্ধদের মুখে মদের পাত্র তুলে ধরছিল, যারা জীবন সাহাহ্নে পৌছেছে, তাদের কাছে পৌছে দিচ্ছিল যৌবনের হাতছানি। ওই দেখুন দিবাকে। তাকে ঘিরে কত তরুণ-তরুণী বসে আছে। তার হাত আজ রিভুর কাঁধে। সূর বসেছে আজ দামার সঙ্গে।

পান-আহার, নৃত্যগীত এ সবের পর একই ঘরের মধ্যে প্রেমিক-প্রেমিকারা অঙ্কশয্যায় শয়ন করে রইল। সকালে উঠে কতক স্ত্রী-পুরুষ ঘরের কাজে লাগবে, কতক শিকারে বেরুবে, আর কিছু লোক যাবে ফল আহরণে। রক্তিম কপোল ছোট ছোট শিশুরা কেউ মায়ের কোলে, কেউ বিছানো চামড়ার ওপর শুয়ে রইল। আবার কেউ বা একটু বয়স্ক বালক বালিকার কোলে-কাঁধে চেপে ঘুরতে লাগল, কেউ কেউ ভোল্‌গার বালুতটে লাফালাফি করে বেড়াতে লাগল।

নিশার ‍যুগের তুলনায় এ যুগের বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা অনেক বেশী শান্ত ও সন্তুষ্ট। গোষ্ঠী বা জন এখন আর একজন মায়ের অধীনে নয়। পরন্তু অনেক জীবিতা মায়ের ছেলেমেয়ে এখন একত্রে এক গোষ্টীতে বা বৃহৎ পরিবারে সমবেত হয়েছে এবং এখানকার কর্ত্রী-মায়ের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ নয়—রাজত্ব একচ্ছত্র নয়। জন-সমিতি এখন দণ্ড-মুণ্ডের কর্তা। তাই আর আর কোনো নিশার আপন কন্যাকে জলে ডুবিয়ে মারবার দরকার হয় না।

 

দিবা এখন চার পুত্র এবং পাঁচ কন্যার জননী, বয়স পঁয়তাল্লিশ। এখন সে নিশা-গোষ্ঠীর কর্ত্রী মায়ের পদে অধিষ্ঠিতা। গত 25 বছরে নিশা-গোষ্ঠীর লোক সংখ্যা তিন গুণ বেড়ে গেছে । এই বাড়বাড়ন্তের জন্য সূর যখন দিবাকে চুমু খেয়ে অভিনন্দন জানাতে গিয়েছে, দিবা জবাব দিয়েছে, ‘‘এ সবই অগ্নির দয়ায়—সূর্য দেবতার কৃপায়। অগ্নি ও সূর্য যারই সহায় হন, সে সেখানেই থাক—ভোল্‌গার স্রোতের মতোই তার ঘরে মধুর বন্যা বইবে; দলে দলে হরিণ আসবে বনে—তার আহার যোগাবার জন্যে।’’

নিশা জনের সমস্যাও বেড়েছে অনেক। আগে তারা যে সমস্ত জঙ্গলে আস্তানা গাড়ত এখন আর সেইরকম ছোট জঙ্গলে তাদের কুলোয় না। তাদের ‘জন-দম’ (যৌথবাসগৃহ) গুলিই যে তিনগুণ বাড়াতে হয়েছে শুধু তাই নয়, মৃগয়াক্ষেত্রের পরিধিও দরকার তিনগুণ। বর্তমানে তারা যে মৃগয়ায়ভূমির কাছে আস্তানা নিয়েছে, তার ওপারে ঊষা-জনের মৃগয়াক্ষেত্র। উভয়ের সীমানার মাঝখানে ছিল একটি অনধিকৃত ভূমি। নিশা-গোষ্ঠীর লোকেরা সময়ে সময়ে শুধু যে অনধিকৃত ভূমিতে শিকার করত তা নয়—পরন্তু তারা ঊষা-গোষ্ঠীর মৃগয়াভূমিতে কয়েকবার শিকার করতে গিয়েছে। জন-সমিতি (গোষ্ঠীর মন্ত্রনা পরিষদ) দেখল যে এতে করে ঊষা-গোষ্ঠীর সঙ্গে নিশা পরিবারের সংঘর্ষ বেধে যেতে পারে, কিন্তু এর প্রতিকারের কোনো উপায় ছিল না। একদিন তো দিবা স্পষ্টভাবে ‘জন-সমিতিকে বলল, ‘‘ভগবান যখন আমাদের এতগুলি জীব দিয়েছেন তখন এইসব বন-জঙ্গলে তাদের খাদ্যও নিশ্চয় পূর্ণ থাকবে। এইসব মৃগয়াক্ষেত্র ছাড়া এতগুলো মুখে আহার যোগানো সম্ভব নয়। এইসব জঙ্গলে যে সমস্ত ভাল্লুক, গরু, ভেড়া আছে তা কিছুই ছাড়া যায় না—যেমন ছেড়ে দিতে পারি না এই ভোল্‌গার মাছ।’’

ঊষা-গোষ্ঠী দেখল যে নিশা-জন অন্যায়ের পর অন্যায় করে চলেছে। একবার দু‘বার ঊষা-জনের জন সমিতি নিশা-গোষ্ঠীর জন-সমিতির সঙ্গে আলাপ আলোচনা করল, স্মরণ করিয়ে দিল, এই দুই জনের মধ্যে আবহমান কাল ধরে কোন সংঘর্ষ হয়নি; এ কথাও বলল যে প্রতিকার শীতের তারাই এখানে এসে থাকে। কিন্তু অনাহারে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে ‍যদি নিশা-গোষ্ঠীকে ন্যায়ের শপথ নিতে হয়—তা কি করে সম্ভব! সকল আইন যখন বিফল তখন জঙ্গল আইনের আশ্রয় নিতে হয়। উভয় গোষ্ঠীই ভেতরে ভেতরে যুদ্ধের প্রস্তুতি চালাতে লাগল। একের খবর অপরের পাবার উপায় ছিল না। কারণ এই সময়ে জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ আপন-আপন গোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত। নিশা-জনের একটি দল একদিন পাশের বনে ঊষা-জনের মৃগয়াভূমিতে শিকার করতে গেল। ঊষা-গোষ্ঠীর লোকেরা লুকিয়ে বসেছিল, তারা আক্রমণ করল। নিশা-গোষ্ঠীর লোকেরা বীরত্বের সঙ্গে লড়ল কিন্তু তারা আগে থেকে প্রস্তুত হয়ে বেশী সংখ্যায় আসেনি। আপন দলের বহু মৃতকে ফেলে আহতদের সঙ্গে নিয়ে শিকারীর দল পালিয়ে এল। জন-মাতা সমস্ত শুনল, জন-সমিতি আলোচনা করল, তারপর সাধারণ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হল। সমস্ত ঘটনা তাদের সামনে উপস্থিত করা হল। মৃত ও আহতদের ভাই ছেলেরা, মা-মেয়ে-বোনেরা রক্তাক্ত প্রতিহিংসার জন্য উত্তেজিত করতে লাগল। রক্তের প্রতিশোধ নিতে না পারা এবং জন-ধর্মের বিরোধিতা করা—কেউ বর্জন করতে পারত না। সমগ্র গোষ্ঠী সমবেতভাবে সিদ্ধান্ত নিল, মৃতের রক্তের প্রতিশোধ নিতে হবে।

নাচের বাজনা ‍যুদ্ধের বাজনায় পরিবর্তিত হল। শিশু ও বৃদ্ধদের রক্ষার জন্য কয়েকজন স্ত্রী-পুরুষকে রেখে বাকি সকলে যুদ্ধযাত্রা করল; ধনুক-পাষাণ-কুঠার, কাঠের বল্লম ও কাঠের মুদগর আর দেহরক্ষার জন্য কঠিন ও দৃঢ় চামড়ার বর্ম আবরণ। সামনে চলল বাদকেরা, প্রধনা হিসেবে সেই যুদ্ধের পরিচালিকা। বাজনার আওয়াজে দিগন্ত ধ্বনিত ও অনুরণিত হল, লোকের কোলাহলে বনভূমি মুখরিত হল, পশুপক্ষীরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে এদিক সেদিক পালাতে শুরু করল।

একটু পরেই তারা অনধিকৃত বনভূমিতে এসে পৌছাল। কোনো সীমারেখা না থাকা সত্ত্বেও এই সমস্ত গোষ্ঠীর লোকেদের সীমান্ত সম্পর্কে ভালোভাবেই জ্ঞান ছিল এবং এ ব্যাপারে মিথ্যা বলতে পারত না। মিথ্যা তখন মানব-সমাজে অপরিচিত আর সে বিদ্যা আয়ত্ব তাদের পক্ষে কঠিন ছিল। অপর গোষ্ঠীর শিকারীরা আপন গোষ্ঠীতে গিয়ে খবর দিল, এবং ঊষা-জনের যোদ্ধারা হাতিয়ারে সুসজ্জিত হয়ে ময়দানে এল। ঊষা-গোষ্ঠী বস্তুত ন্যায় চেয়েছিল। তারা চেয়েছিল, আপন মৃগয়াক্ষেত্র রক্ষা করতে। আর আপন ভূমি রক্ষার জন্যই তাদের সংগ্রাম। কিন্তু নিশা-গোষ্ঠী এই ন্যায়-অন্যায় বিচার করতে প্রস্তুত ছিল না। উষা-গোষ্ঠীর মৃগয়াক্ষেত্রে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে যুদ্ধ আরম্ভ হল। উভয় পক্ষ থেকেই পাথরের ফলাযুক্ত বাণ শন-শন করে বর্ষিত হতে লাগল, কুঠারের-কুঠার, বল্লমে-বল্লমে, মুদগরে-মুদগরে যুদ্ধ হতে থাকল, উভয় পক্ষের লোকই আহত হল। হাতিয়ার ভেঙে বা হাত থেকে পড়ে গেলে হাতে হাতে-দাঁতে বা মাটি কুড়িয়ে নেওয়া পাথরের সাহায্যে ‍যুদ্ধ চলতে লাগল।

নিশা-গোষ্ঠীর জনসংখ্যা ঊষা-গোষ্ঠীর দ্বিগুণ, কাজেই ঊষা-গোষ্ঠীর পক্ষে জয়লাভ ছিল অসম্ভব। কিন্তু একটি বালকও জীবিত থাকা পর্যন্ত তাদের যুদ্ধ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। এক প্রহর দিন অর্থ্যৎ সূর্য ওঠার তিন ঘণ্টা পর যুদ্ধ শুরু হয়েছিল—ঊষা গোষ্ঠীর দুই-তৃতীয়াংশ লোক বনের মধ্যেই নিহত হল। গোষ্ঠী-যুদ্ধে আহত শত্রুকে ছেড়ে যাওয়া নিতান্ত অধর্মের কাজ। অবশিষ্ট এক-তৃতীয়াংশ ভোল্‌গা তটে তাদের শেষ শক্তি দিয়ে যুদ্ধ করে প্রাণ দিল। কয়েকজন জননী শিশু ও বৃদ্ধদের নিয়ে আবাসভূমি ছেড়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করল, কিন্তু তখন আর সময় ছিল না, প্রতিহিংসা-পরায়ণ শত্রুরা তাদের অনুসরণ করে ধরে ফেলল—স্তন্যপায়ী শিশুদের ধরে ধরে পাহাড়ের ওপর আছড়ে গুড়িঁয়ে দিল, বৃদ্ধ স্ত্রী-পুরুষদের গলায় পাথর বেঁধে ভোল্‌গার জলে ডুবিয়ে দিল। তাদের বাসগৃহে রক্ষিত মাংস, ফল, মধু ও সুরা এবং অন্যান্য দ্রব্যসম্ভার বাইরে এনে অবশিষ্ট জীবিত শিশু ও স্ত্রী লোকদের ঘরে বন্ধ করে আগুন লাগিয়ে দিল। প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখার লেলিহান আভার মধ্যে দাঁড়িয়ে জীবন্ত মানুষের আর্তনাদ বিজয়ঢ নিশা-গোষ্ঠীর লোকদের উল্লসিত করে তুলল। তারা অগ্নি দেবতাকে কৃতজ্ঞতা জানাল, শত্রুর সঞ্চিত মদ ও মাংসে দেবতা ও নিজেদের পরিতৃপ্ত করর।

দিবা খুবই উল্লসিত হয়ে উঠল। তিন তিনটি মায়ের বুক থেকে ছিনিয়ে আনা শিশুকে পাথরে আছড়ে মেরেছে। আজ পানাহারের পর শুরু হল নৃত্য। আগুনের সামনেই দিবা তার তরুণ ছেলে বাসুকে নিয়ে নাচতে শুরু করে দিল। নাচের তালে তালে দুই উলঙ্গ নরনারী পরস্পরকে আলিঙ্গন আর চুম্বন করতে লাগল—কখনও বা ছাড়াছাড়ি হয়ে নিজেদের নিজস্ব নাচের ভঙ্গিমা দেখাতে লাগল। সকলেই বুঝল আজ রাতে বাসুই হবে নেত্রী দিবার ক্রীড়া ও শয্যাসঙ্গী। বাসু তার জয়োন্মাত্তা মায়ের কামনাকে অবহেলা করতে চাইল না।

নিশা গোষ্ঠীর মৃগয়াভূমি এখন চারগুণ বেড়ে গেল আর শীতকালে তারা কোথায় থাকবে সে চিন্তাও দূর হল। তবু একটা দুশ্চিন্তা তাদের রয়ে গেল—ঊষা গোষ্ঠী জীবিত অবস্থায় যে ক্ষতি করতে পারেনি এখন মৃত্যুর পর প্রেতযোনি পেয়ে তাদের প্রতিশোধ নেবে। যে ঘরে জীবিতদের পোড়ানো হয়েছেল সেই ঘরটা ভূতের আড্ডা হল। নিশা-গোষ্টীর কেউ একা সেখান দিয়ে যেতে সাহস পায় না। বহুবার শিকারীরা না-কি দেখেছে শত শত উলঙ্গ নরনারী জ্বলন্ত আগুনের সামনে নাচছে। বাসভূমি পরিবর্তনের প্রয়োজনে যেদিন ওই পোড়াঘরের সামনে দিয়ে যেতে হয়েছে—সংখ্যায় তারা বেশী ছিল আর দিনের আলো ছিল বলে রক্ষে। দিবা তো কয়েকবারেই দেখেছে যে অন্ধকারের ভেতর দিয়ে দুগ্ধপোষ্য শিশু মাটি থেকে এসে তার হাত ধরে ঝুলছে—ভয়ে সে চিৎকার করে উঠেছে।

 

দিবার বয়স এখন সত্তরের ওপর। এখন সে আর নিশা-জনের কর্ত্রী নয়—তবু গোষ্ঠী সকলেই তাকে সম্মান করে। তার বিশ বছরের নেতৃত্বে সে বংশের বৃদ্ধি এবং কল্যাণের জন্য অনেক কিছু করেছে। এই বিশ বছরে জনকে অপর গোষ্ঠীর সঙ্গে অনেকবার ‍যুদ্ধ করতে হয়েছে, তাতে ক্ষয়-ক্ষতি ও জনহানি হয়েছে। এখন তাদের দখলে পর্যাপ্ত মৃগয়াভূমি—তাতে কয়েক মাস স্বচ্ছন্দে চলে যায়। দিবার কাছে এ সবই ভগবানের কৃপা বলে মনে হয়। দিবার মনে ভয় এখনো কাটেনি—হাত ঝোলা মৃত স্তন্যপায়ী শিশুরা এখনো মাঝে মাঝে তার রাতের ঘুম ঘুচিয়ে দেয়।

শীতকাল এসে পড়েছে। ভোল্‌গার স্রোত জমাট হয়ে গেছে—তার ওপর কয়েক মাসের সঞ্চিত তুষার স্তুপের দিকে দূর থেকে তাকালে মনে হয় রৌপ্যচূর্ণের অথবা পেঁজা তুলোর আঁকাবাঁকা রেখা চলে গেছে। অপর দিকে বনভূমিতে হিমশীতল নির্জীবতা ও স্তব্ধতা বিরাজ করছে। নিশা-গোষ্ঠীর লোকসংখ্যা আরও বেড়েছে। তাই তাদের খাদ্যের প্রয়োজন বেড়েছে। এই সময়ের মধ্যে কাজ করার লোকও অনেক বেড়েছে—কাজের দিন তাদের খাদ্যভান্ডারে প্রভুত পরিমাণ খাদ্য সংগ্রহ করতে পারে। এমন কি শীতকালেও পোষা কুকুর নিয়ে নিশা পরিবারের ছেলেমেয়েরা শিকারে বেরুলে কিছু না কিছু পেয়েই থাকে।

শিকারের একটি নতুন উপায় তারা বার করেছে—হরিণ, গরু, বুনোঘোড়া নিজেদের খাবারের খোঁজে এ-বন ও বন-ঘুরে বেড়ায়। বনে থাকতে শিকারীরা লক্ষ্য করেছে যে মাটিতে বীজ পড়লে তাতে অঙ্কুর জন্মায়। তাই তারা ভিজে মাটির ওপরে ঘাসের বীজ ছড়াতে শুরু করল। ফলে সেখানে ঘাস জন্মাল, তৃনভোজী পশুরাও আসতে আরম্ভ করল—ক্রমে তারা একই অঞ্চলে বেশীদিন থাকতে লাগল।

একদিন ঋক্ষশ্রবার শিকারী কুকুরটা একটা খরগোশের পেছনে তাড়া করল—ঋক্ষশ্রবাও ছুটল তার পেছন পেছন। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেল, তাই সে আপন চামড়ার আবরণটি খুলে কাঁধের ওপর ঝুলিয়ে নিল। ইতিমধ্যে কুকুরটা কখন দৃষ্টির বাইরে চলে গেছে। তুষারের ওপর পায়ের ছাপ পড়েছে—তাই পদচিহ্ন দেখা গেল। ঋক্ষ হাঁপাতে হাঁপাতে একটা গাছের গুড়িঁতে বিশ্রামের আশায় বসে পড়ল। পূর্ণ বিশ্রামের আগেই কুকুরটার ডাক শুনতে পেয়ে ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ে আবার দৌড়াতে লাগল। ক্রমেই সে শব্দটার কাছে এসে পড়ল; আরও কাছে এসে দেখতে পেল যে পাইন গাছে হেলান দিয়ে একটি অপূর্ব সুন্দরী তরুণী দাঁড়িয়ে আছে। সাদা চামড়ার একটি পোষাক তার পরনে—সাদা শিরস্ত্রানের নীচে আলুলায়িত কেশগুচ্ছগুলি দেখা যাচ্ছে। আর তার পায়ের কাছে পড়ে আছে একটা খরগোশ। ঋক্ষ এসে পৌছালে কুকুরটআ জোড়ে ডাক ছাড়তে ছাড়তে তার কাছে এল। ঋক্ষ মেয়েটির মুখের দিকে চাইল। মেয়েটি একটু হেসে জিজ্ঞাসা করল, ‘‘বন্ধু’’ এ কুকুরটি কি তোমার?’’

‘‘হ্যাঁ আমার! কিন্তু তোমাকে তো এর আগে কখনও দেখিনি!’’

‘‘আমি কুরু বংশের মেয়ে। এ এলাকাটা আমাদেরই।’’

‘‘কুরুবংশ!’’

কুরু-গোষ্ঠী শুনে ঋক্ষর মনে কিছুটা বিদ্বেষ জন্মাল। কুরুরা তাদের প্রতিবেশী এবং কয়েক বছর ধরে বিরোধ চলছে। বিরোধ কয়েকবার যুদ্ধের পর্যায়ে উঠেছে। কুরুরা অবশ্য ঊষা-গোষ্ঠীর চেয়ে বেশী বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে। তারা বুঝেছিল যে, যুদ্ধে জেতবার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই পালানোই শ্রেয় ও কার্যকরী বলে স্থির করেছে। অস্ত্রের জোরে রক্ষা না পেলেও—পালিয়ে বেঁচেছে। নিশা বংশের যোদ্ধারা প্রতিজ্ঞা নিয়েছিল, তারা কুরুবংশ ধ্বংশ করবে—কিন্তু এখনো সে প্রতিজ্ঞা পালিত হয়নি।

তরুণী বলল, ‘‘তোমার কুকুরটি এই খরগোশটি মেরেছে—এটা তুমি নিয়ে যাও।’’

‘‘কিন্তু কুরদের মৃগয়াক্ষেত্রে মেরেছে।’’

‘‘হ্যাঁ তা মেরেছে। কিন্তু আমি কুকুরের মালিকের প্রতিক্ষায় ছিলাম।’’

‘‘প্রতীক্ষায়!’’

‘‘হ্যাঁ, মালিকের হাতে খরগোশটি দেব বলে।’’

কুরু-কুলের নাম শুনে ঋক্ষর মনে যে বিদ্বেষের সঞ্চার হয়েছিল তা সুন্দরীর নম্র আলাপে বিদুরিত হল। প্রত্যুপকারের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বলল, ‘‘শুধু শিকার নয়, তুমি আমার কুকুরকে ফিরিয়ে দিয়েছ। এই কুকুর আমার খুব প্রিয়।’’

‘‘কুকুরটা সত্যিই অনেক সুন্দর।’’

‘‘সারা গোষ্ঠীর মাছে থাকলেও আমার ডাক শুনতে পেলে ছুটে আসে।’’

‘‘তার নাম?’’

‘‘শম্ভু!’’

‘‘তোমার নাম, বন্ধুবর?’’

‘‘ঋক্ষশ্রবা, রোচনা পুত্র!’’

‘‘রোচনা পুত্র? আমার মা’র নামও রোচনা ছিল। ঋক্ষ, খুব তাড়া না থাকলে একটু বস।’’

ধনুক ও পরিধান বরফের ওপর রেখে সুন্দরীর পায়ের কাছে বসতে বসতে ঋক্ষ বলল, ‘‘তোমার মা বেঁচে নেই?’’

‘‘না! নিশা-গোষ্ঠীর যুদ্ধে মারা গেছে। আমাকে খুব ভালবাসত।’’ বলতে বলতে তরুণীর চক্ষু আর্দ্র হয়ে এল।

ঋক্ষ নিজের হাতে তরুণীর অশ্রু মুছিয়ে দিয়ে বলল, ‘‘কি বিচ্ছিরি এই যুদ্ধ!’’

‘‘হ্যাঁ, কত প্রিয়জনের বিচ্ছেদ সইতে হয়।’’

‘‘কিন্তু, এখনো তো যুদ্ধ মিটছে না!’’

‘‘একের উচ্ছেদ ছাড়া কি করে থামবে?’’ তরুণী বলল, ‘‘শুনেছি নিশা-পুত্রেরা আবার আক্রমণ করবে। আমি ভাবছি ঋক্ষ তোমার মতোই ওরাও তো তরুণ!’’

‘‘তোমার মতো সুন্দরী মেয়েও তো কুরু-গোষ্ঠীতে আছে।’’

‘‘তবু আমাদের একে অন্যকে মারতে হবে ঋক্ষ, এ কোন ধারা?’’

ঋক্ষের মনে পড়ল তিন দিন পর তাদের গোষ্ঠী কুরুগণের ওপর আক্রমণ করবে। ঋক্ষ কিছু বলার আগেই তরুণী বলল, ‘‘কিন্তু আমরা আর যুদ্ধ করব না।’’

‘‘লড়বে না? কুরুরা আর যুদ্ধ করবে না!’’

‘‘ঠিকই। আর লড়বে না। আমাদের লোক এত কমে গেছে যে, আমাদের জেতবার আর কোন আশাই নেই।’’

‘‘কুরুরা তবে কি করবে?’’

‘‘এই ভোল্‌গা তট ছেড়ে চলে যাবে। ভোল্‌গা মায়ের ধারা আমাদের কত প্রিয়। একে আর দেখতে পাব না—তাই আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে এখানে বসে বসে এর সুপ্ত ধারাকে দেখছি।’’

‘‘তুমি তা‘হলে আর ভোল্‌গাকে দেখবে না?’’

‘‘সাঁতারও কাটতে পাব না। এই শান্ত জলস্রোতে সাঁতার কেটে কি আনন্দই না পেতাম’’—সুন্দরীর কপোলে চোখের জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ল।

‘‘কত ক্রুর, কত নিষ্ঠুর এই যুদ্ধ!’’ উদাস স্বরে ঋক্ষ বলল।

‘‘কিন্তু এই ‘‘জন’’-এর ধর্ম!’’ রোচনা বলল।

‘‘আর এই বর্বর ধর্মও বটে!’’ ঋক্ষ জবাব দিল।

০৩. অমৃতাশ্ব (স্থান : মধ্য এশিয়া, পামীর (উত্তর কুরু) ।। কাল-৩০০০খৃষ্টপূর্ব)

করগনার সবুজ শ্যামল পাহাড়, স্থানে স্থানে প্রবাহিত নদী বা ঝরনাধারা, তা যে কত সুন্দর সে শুধু তারাই জানে যারা দেখেছে কাশ্মীরের সুষমা। শীতের অবসানে বসন্ত এসেছে, আর বসন্তের অপরুপ সৌন্দর্য এই পার্বত্য উপত্যকাকে করে তুলেছে মর্তের স্বর্গ, পশুর পাল গিরিগুহার শীতের আবাস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে বিস্তৃত গোচারণ ভূমিতে। দূরে দেখা যাচ্ছে ঘোড়ার লোমের তৈরী তাঁবু—তার মধ্যে যেগুলি খুব লাল সেখান থেকে ধোঁয়া উঠছে। একটি তাঁবু খেকে জল-ভরার চামড়ার মশক কাঁধে করে একটি তরুণী বেরিয়ে এল, সে পাথরের ওপর দিয়ে নদীর তীরের দিকে এগুতে লাগল। তাঁবু থেকে বেশী দূরে সে যায়নি এমন সময় একটি পুরুষ তার সামনে এসে দাঁড়াল। তরুণীর মতোই তার শরীর একটি পাতলা সাদা পশমের কম্বলে ঢাকা। কম্বলের দুইটি প্রান্ত এমনভাবে ডান কাঁধের ওপরে গেরো দিয়ে বাঁধা যে শুধু ডান হাত, কাঁধ আর বুকের অধর্র্ধাংশ অনাবৃত। পুরুষটির চুলগুলি পিঙ্গল, গোঁফটি সুন্দরভাবে পাকানো। পুরুষটিকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল মেয়েটি। মুচকি হেসে পুরুষটি বলল, ‘‘সোমা আজ দেরী করে জল ভরতে যাচ্ছ?’’

‘‘হ্যাঁ। ঋজ্রাশ্ব। কিন্তু পথ ভুলে ‍তুমি এদিকে কোথায়?’’

‘‘ভুলিনি সখি! আমি তোমার কাছেই এসেছি।’’

‘‘আমার কাছে? অনেক দিন পরে।’’

‘‘আজ সোমার কথা মনে পড়ল!’’

‘‘তা বেশ ভালোই, আমাকে জল নিয়ে ফিরতে হবে, অমৃতাশ্ব খেতে বসেছে!‘‘

দু‘জনেই কথা বলতে বলতে নদী তীর পর্যন্ত গিয়ে ঘরে ফিরল!

ঋজ্রাশ্ব বলল, ‘‘অমৃতাশ্ব বেশ বড় হয়ে গেছে।’’

‘‘হ্যাঁ, ‍তুমি তো অনেকদিন দেখনি।’’

‘‘ওর চার বছর বয়স  থেকে।’’

‘‘এখন তার বয়স বারো। সত্যিই বলছি ঋজ্রাশ্ব, রুপে সে তোমারই মতো।’’

‘‘কি জানি, সে সময় আমি ছিলাম তোমার কৃপার পাত্র। তা অমৃতাশ্ব এতদিন কোথায় ছিল?’’

‘‘বাহলকে দাদামহাশয়ের কাছে।’’

তরুণী জলভর্তি মশকটি নামিয়ে রেখে নিজের স্বামী কৃচ্ছ্রাশ্বকে ঋজ্রাশ্বের আসার খবর দিল। তারা স্বামী স্ত্রী দু‘জনে এবং পেছনে অমৃতাশ্ব তাঁবু থেকে বাইরে এল। ঋদাশ্ব সসম্মানে অভিবাদন জানিয়ে বলল, ‘‘বল বন্ধু কৃচ্ছ্রাশ্ব, কেমন ছিলে তুমি?’’

‘‘অগ্নি দেবতার কৃপায় ভালোই আছি ঋজ্রাশ্ব। এস খাওয়া যাক। এক্ষুনি সিদ্ধি কেটে মধু আর অশ্বিনী-ক্ষীর যোগে এই সোমরস তৈরী হয়েছে।

‘‘মধু সোম? কিন্তু এত সকালে কি করে?’’

‘‘আমি ঘোড়ার চারণভূমিতে যাচ্ছি। বাইরে দেখছ না ঘোড়া তৈরী?’’

‘‘তা‘হলে আজকে সন্ধ্যায় ফিরবার ইচ্ছা নেই?’’

‘‘নাও ফিরতে পারি। তাই এ সোমের মশক আর অশ্ব-মাংস সঙ্গে নেব।’’

‘‘অশ্ব-মাংস!’’

‘‘হ্যাঁ, কৃচ্ছ্রাশ্ব! তোমার নামটা কিন্তু উল্টো।’’

‘‘মা বাবার সময় আমাদের অশ্বের কৃচ্ছ্রতা ছিল, তাই আামার নাম কৃচ্ছ্রাশ্ব।’’

‘‘কিন্তু এখন তো ঋদ্ধাশ্ব হওয়া উচিত।’’

‘‘আচ্ছা, ভেতরে চল।’’

‘‘এই পাইন গাছের নীচে সবুজ ঘাসের ওপরই বসি না কেন, বন্ধু!’’

‘‘ঠিকই। সোমা, তুমি তা‘হলে নিয়ে এস, সোম আর মাংস। এখানেই বসে বন্ধুকে তৃপ্ত করি।’’

‘‘কিন্তু কৃচ্ছ্র, ‍তুমি তো ঘোড়ার পালের দিকে যাচ্ছিলে যে?’’

‘‘আজ না হয় কাল যা্ব। বস ঋজ্রাশ্ব!’’

সোমা ভাঙের মশক এবং চষক নিয়ে এল। দু‘বন্ধুর মাছে অমৃতাশ্বও বসে পড়ল। সোমা ভাঙ ও চষক মাটিতে রেখে বলল, ‘‘একটু অপেক্ষা কর, বিছানা এনে দিচ্ছি।’’

‘‘না সোমা, এই নরম ঘাস বিছানার চেয়েও ভালো।’’—ঋজ্রাশ্ব বলল।

‘‘আচ্ছা, বল তো ঋদ্র! লবণ দিয়ে সেদ্ধ-করা মাংস খাবে, না পোড়া-মাংস খাবে? আট মাসের বাছুরের মাংস খুবই নরম।’’

‘‘আমি তো বাছুরের পোড়ানো মাংসই পছন্দ করি। আমি কখনও কখনও গোটা বাছুর আগুনে পোড়াই। পোড়াতে দেরি হলেও কিন্তু মাংস খুব সুস্বাদু হয়। তোমাকে কিন্তু সোমা! ঠোঁটের স্পর্শে আমার চষক মিষ্টি করে দিতে হবে।’’

‘‘হ্যাঁ—হ্যাঁ সোমা! ঋজ্র দীর্ঘ দিন পরে এসেছে।’’—কৃচ্ছ্রাশ্ব বলল।

‘‘আমি এখুনি আসছি, জোর আগুন আছে, মাংস পোড়াতে দেরি হবে না।’’

কৃচ্ছ্রাশ্বকে চষকের পর চষক নিঃশেষ করতে দেখে ঋজ্রাশ্ব বলল, ‘‘এত তাড়া কিসের?’’

‘‘সিদ্ধি হচ্ছে অপূর্ব! সোমার হাতে তৈরী সিদ্ধি খাওয়া অপূর্ব!যেন অমৃত। এ সিদ্ধি লোককে অমর করে। সিদ্ধি পার কর এবং অমর হও।’’

‘‘তুমি কি অমর হতে চাও? যে রকম চষকের পর চষক নিঃশেষ করে চলেছ, তাতে অচিরেই মৃত্যুর পর অমরত্ব লাভ করবে।’’

‘‘কিন্তু তুমি তো জান ঋজ্র, সিদ্ধি আমি কত ভালোবাসি!’’

এই সময় সোমা চামড়ায় করে পোড়ানো তিন টুকরা মাংস নিয়ে এসে বলল, ‘‘কৃচ্ছ্র! সোমাকে কি ‍তুমি ভালোবাসো না!’’

কৃচ্ছ্র স্বর পরিবর্তন করে বলল, ‘‘সোমা ও সোম দুটিকেই আমি ভালোবাসি।’’ তার চোখ লাল হয়ে উঠছিল। সে বলল, ‘‘সোমা, আজ তোমার কিসের চিন্তা?’’

‘‘হ্যাঁ, আজকে তো আমি ঋদ্রের।’’

‘‘অতিথি না পুরানো বন্ধু?’’—কৃচ্ছ্র হাসতে চেষ্টা করে বলল।

ঋজ্রাশ্ব সোমার হাত ধরে নিজের পাশে বসিয়ে সোমপূর্ণ চষক তার মুখের কাছে ধরল। সোমা দু‘ঢোক পান করে বলল, ‘‘এখন তুমি খাও ঋদ্র! অনেক দিন পরে আজ আবার সুদিন ফিরেছে।’’

ঋজ্রাশ্ব পুরো চষকটি এক নিঃশ্বাসে পার করে পা্ত্রটি মাটিতে রেখে বলল, ‘‘তোমার ঠোটের স্পর্শে সোম না জানি কতই মিষ্টি হয়।’’

কৃচ্ছ্রাশ্বের ভেতর সোমের প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। সে অত্যন্ত তাড়াতাড়ি নিজের চষকটি ভর্তি করে নিয়ে সেই পেয়ালা সোমার দিকে এগিয়ে দিয়ে আড়ষ্ট গলায় বলল, ‘‘তা‘হলে সোমা, এটাও মধুর বানিয়ে দাও!’’

সোমা ঠোঁট দিয়ে স্পর্শ করে চষক ফিরিয়ে দিল। অমৃতাশ্ব বৃদ্ধদের প্রেমালাপে রস পেল না, তাই বয়স্ক বালক বালিকাদের সঙ্গে খেলতে চলে গেল। কৃচ্ছ্রাশ্বের মাথা ঝুঁকে পড়ছিল, সে ঢুলু ঢুলু চোখে বলল, ‘‘সোমা আমি গান গাই…’’

‘‘হ্যাঁ, তোমার মতো গায়ক কুরুদের মধ্যে আর কেউ কি আছে?’’

‘‘ঠি-ই-ক ব-লে-এ-ছ, আ-মা-র জু-উ-ড়ি-ই-নে-ই। বেশ তা—তা হোলে…’’

‘‘থাক, কৃচ্ছ্র! দেখছ না তোমার গান শুনে সমস্ত পশু-পক্ষী জঙ্গল ছেড়ে প্রাণভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।’’

‘‘হু-হু-ম-ম’’

এটা সোম খাওয়ার সময় নয়। সাধারণত তার সময় সুর্যাস্তের পরে; কিন্তু কৃচ্ছ্রাশ্বের তো কোনো একটি বাহানার দরকার নেই। সে বেহুঁশ হয়ে পড়ায় সোমা ও ঋজ্রাশ্ব চষক রেখে দিল এবং দু‘জনে নদীর ধারে একটি টিলার ওপর গিয়ে বসল। পাহাড়ের মধ্যে যেখানটা কিছুটা সমতল সেখান থেকে নদী প্রবাহিত হচ্ছিল। নদী ছিল ছোট-বড় উপখণ্ডে ভরা। তার ওপর জলের আঘাত লাগায় শব্দ হচ্ছিল। পাথরের আড়ালে মাছগুলিকে চলতে ফিরতে দেখা যাচ্ছিল। পাখীর সুমিষ্ট সঙ্গীত আর ফুলের সুগন্ধি মৃদৃমন্দ বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসছিল। অনেকদিন পরে তারা দু‘জনে এই স্বর্গীয় ভূমিতে অতীত দিনের প্রেমালাপের পুনরাবৃত্তি করছিল। তাদের মনে পড়ছিল সে-দিনগুলির কথা, যখন কিনা সোমা ছিল ষোড়শী পিঙ্গলা-কেশী। বসন্ত উৎসবের সময় ঋজ্রাশ্বও ছিল তার প্রেমিকদের একজন। তখন সোমার প্রণয়াভিলাষীদের ভেতর বেশ প্রতিযোগীতা ছিল। কিন্তু জয়মাল্য জুটল কৃচ্ছ্রাশ্বের অদৃষ্টে। অন্যান্য সকলের মতো ঋশ্বকেও পরাজয় স্বীকার করে নিতে হল। আজ সোমা কৃচ্ছ্রাশ্রের স্ত্রী কিন্তু সেই প্রাণপূর্ণ যুগে স্ত্রীলোক পুরুষের একচেটে জঙ্গম সম্পত্তি হতে স্বীকার করেনি, এর জন্য অস্থায়ী প্রেমিক গ্রহণ করার অধিকার ছিল। অতিথি এবং বন্ধুর নিকট নিজের স্ত্রীকে সেবা করতে পাঠানো তখন সর্বমান্য সদাচার বলে গণ্য হত। তাই আজ সোমা ঋজ্রের।

সন্ধ্যায় গ্রামের নরনারী মহাপিতরের বিস্তৃত আঙ্গিনায় জড়ো হল। সোমা মধু সুরা এবং সুস্বাদু গো-অশ্ব মাংস নিয়ে ‍যাচ্ছিল। মহাপিতরের পুত্রের আজ জন্ম উৎসব। কৃচ্ছ্র নিজে বেসামাল অবস্থায় ছিল তাই তার বদলে সোমা এবং ঋশ্ব উপস্থিত ছিল। অনেক রাত পর্যন্ত গান, গীত, নৃত্য করে মহোৎসব হল। সোমার গান এবং ঋশ্বের নৃত্য কুরু-জন সর্বদাই ভালোবাসত।

 

 ‘‘মধুরা! ‍তুমি ক্লান্ত হওনি তো?ৎৎ

‘‘না, আমি ঘোড়ায় চড়তে ভালোবাসি।’’

‘‘কিন্তু সেই দস্যুরা তোমাকে কি খারাপভাবে আটক করেছিল?’’

‘‘হ্যাঁ, বাহলীকরা পক্থদের শুধু গরু এবং ঘোড়াই নয় পরন্তু তারা মেয়েদেরও লুট করতে এসেছিল।’’

‘‘হ্যাঁ, পশু-লুণ্ঠন দুটি‘জন’- এর মধ্যে চিরস্থায়ী শত্রুতার সৃষ্টি করে। কিন্তু কন্যা লুট করলে শত্রুতা ক্ষণস্থায়ী হয়, কারণ শেষ পর্যন্ত শ্বশুড়কে জামাতার সমাদর করতেই হয়।’’

‘‘কিন্তু তোমার নাম আমার মনে নেই।’’

‘‘অমৃতাশ্ব; কৃ্চ্ছ্রাশ্ব-পুত্র, কৌরব।’’

‘‘কৌরব! কুরু আমার মামার কুল।’’

‘‘মধুরা এখন তুমি নিরাপদ। বল—কোথায় যাবে?’’

মধুরার মুখে আনন্দের রেখা ফুটে উঠে অচিরেই বিলীন হয়ে গেল দেখে অমৃতাশ্ব কথার মোড় ঘুরিয়ে বলল, ‘‘অতীতে পক্থদের কন্যারা আমাদের গাঁয়েও এসেছে।’’

‘‘সমস্তই লুট করে তো?’’

‘‘না, তাদের ভেতর অধিকসংখ্যক মাতুল কন্যা ছিল।’’

‘‘তা‘হলেও মেয়েদের লুট-পাট করা আমার খুব খারাপ লাগে।’’

‘‘আর আমিও এটা খারাপ মনে করি, মধুরা! বিশেষ করে যেখানে স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে প্রেমের সম্ভাবনা আছে কি-না—আমার জানা নেই।’’

‘‘মাতুল কন্যা বিয়ে করা এর চেয়ে ভালো। কেন না তা‘হলে প্রথম হতেই পরিচিত হওয়ার সুযোগ মেলে।

‘‘তোমার এ রকম কোন প্রেমিক ছিল না-কি, মধুরা?’’

‘‘না, আমার কোন পিসীমা নেই।’’

‘‘অন্য কোন লোক?’’

‘‘স্থায়ীভাবে নয়।’’

‘‘তুমি কি আমাকে ভাগ্যবান করতে পার?’’

মধুরার সলজ্জ দৃষ্টি নত হয়ে গেল। অমৃতাশ্ব বলল, ‘‘মধুরা! এ রকম জনপদও আছে যেখানে স্ত্রী অন্যের নয়, নিজের।’’

‘‘তোমার কথা বুঝলাম না, অমৃতাশ্ব!’’

‘‘স্ত্রীলোককে কেউ লুট করে না কিম্বা স্থায়ী পত্মী করে রাখতে পারে না, সেখানে স্ত্রী পুরুষ সবাই সমান।’’

‘‘পুরুষের মতো মেয়েরাও সমানে অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে?’’

‘‘হ্যাঁ, স্ত্রীর সে স্বাধীনতা আছে।’’

‘‘কোথায় সে ‘জনপদ’ অমৃতাশ্ব—অঃঅমৃতাশ্ব!’’

‘‘তুমি আমায় অমৃত বল মধুরা! সে ‘জনপদ’ পশ্চিমে, এখান থেকে অনেক দূরে!’’

‘‘অমৃত, ‍তুমি কি সেখানে গিয়েছ?’’

‘‘হ্যাঁ, সেখানে নারী আজীবন স্বাধীনভাবে থাকে, যে রকম জঙ্গলে মৃগ স্বতন্ত্র বিচরণ করে, পাখি গাছে গাছে স্বাধীনভাবে উড়ে বেড়ায়।’’

‘‘নিশ্চয়ই খুব সুন্দর‘জনপদ’? সেখানে কেউ মেয়েদের লুট করে না তো?’’

‘‘স্বাধীন! বাঘিনীকে জীবন্ত কে লুট করতে পারে?’’

‘‘আর পুরুষ, অমৃত?’’

‘‘পুরুষ ও স্বাধীন।’’

‘‘ছেলে মেয়েরা?’’

‘‘মধুরা সেখানকার সংসার অন্য রকমের—সমস্ত গ্রাম নিয়ে একটি পরিবার।’’

‘‘সেখানে পিতার কর্তব্য কি?’’

‘‘পিতা কে তা বলা যায় না। সেখানে নারী পত্মী নয়, স্বচ্ছন্দ তার প্রেম।’’

‘‘তা‘হলে সেখানে কেউ পিতাকে জানে না?’’

‘‘ঘরের সমস্ত পুরুষই পিতা।’’

‘‘এ কেমন প্রথা?’’

‘‘এ জন্যই সেখানে নারী স্বতন্ত্র, তারা যোদ্ধা, শিকারী!’’

‘‘আর গরু-ঘোড়া পালনের কি ব্যবস্থা?’’

‘‘গরু-ঘোড়া জঙ্গলে থাকে, যেভাবে এখানে থাকে হরিণ।’’

‘‘আর ছাগল, ভেড়া?’’

‘‘সেখানকার মানুষ পশুপালন জানে না। শিকার,মাছ এবং জঙ্গলের ফলমূল খেয়ে দিন কাটায়।’’

‘‘শুধু শিকার! তাহলে কি তাদের দুধ জোটে না?’’

‘‘জোটে শুধু মানুষের দুধ, তাও আবার শৈশবেই।’’

‘‘ঘোড়ায় চড়ে না?’’

‘‘না। আর চামড়া ছাড়া তারা অন্য কিছু পরিধেয়ও জানে না।’’

‘‘তারা নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পায়?’’

‘‘তা‘হলেও সেখানকার স্ত্রীলোকেরা স্বাধীন। পুরুষের মতোই তারা ফল সংগ্রহ করে, শিকার কলে, যুদ্ধের সময় শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে।’’

‘‘আমিও এ জিনিষ পছন্দ করি। আমি অস্ত্র চালাতে শিখেছি কিন্তু পুরুষের মতো যুদ্ধে যাওয়ার সুযোগ কোথায়?’’

‘‘পুরুষরা এ কাজ নিজ হস্তে গ্রহণ করেছে। গরু,ঘোড়া, ছাগল, ভেড়া তারা পালন করে; তারা স্ত্রীকে পশু-পত্মী নয়, গৃহপত্মী করেছে।’’

‘‘আর মেয়েদের লুট্ করার উপযুক্ত করে তৈরী করেছে। সেখানে মেয়েদের লুট করা হয় নাত তো, অমৃত!’’

‘‘একটি ‘জন’-এর ছেলেমেয়েরা সর্বদাই সেই জনের ভেতর থাকে। ‘জন’-এর বাইরে যেতে দেওয়া হয় না, গ্রহণ করাও হয় না।’’

‘‘এ কি রকম প্রথা?’’

‘‘সে সব এখানে চলতে পারে না।’’

‘‘তাই বলে মেয়ে লুট চলতে থাকবে?’’

‘‘হ্যাঁ, মধুরা! আচ্ছা, তখন তুমি কি বলছিলে যেন?’’

‘‘কোন বিষয়?’’

‘‘আমার প্রেম সম্বন্ধে।’’

‘‘আমি তোমার বশীভূত, অমৃত!’’

‘‘কিন্তু আমি তোমাকে লুট করে নিয়ে যেতে চাই না।’’

‘‘তুমি কি আমাকে যুদ্ধ করতে দেবে?’’

‘‘যতদূর পর্যন্ত আমার পক্ষে সম্ভব।’’

‘‘আর শিকার করতে?’’

‘‘যতদূর আমার ক্ষমতা আছে।’’

‘‘ব্যাস এটু্কুই…?’’

‘‘কেন না আমাকে মহাপিতরের আদেশ পালন করতে হবে। নিজের দিক থেকে যদি বল মধুরা—আমি তোমাকে স্বাধীন মনে করব।’’

‘‘প্রেম করা না করার জন্যও?’’

‘‘প্রেম আমাদের সম্বন্ধ স্থাপন করছে। আচ্ছা তার জন্যেও।’’

‘‘তবে অমৃত, আমি তোমার প্রেম গ্রহণ করছি।’’

‘‘তা‘হলে আমরা কুরু‘জনে’ চলে যাব না-কি পক্থ ‘জনে’?’’

‘যেখানে তোমার খুশি।’’

অমৃত ঘোড়া ফিরিয়ে মধুরার নির্দেশিত পথে পক্থ গ্রামে পৌছাল। গ্রামে কোনো তাঁবুতে কেউবা মারা গিয়েছে;কেউ জখম হয়েছে, কারুর কন্যা লুণ্ঠিত হয়েছে। চারিদিকে হল্লা হচ্ছিল।

মধুরার মা কাঁদছিল এবং বাবা তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। এ সময় অমৃতাশ্বর ঘোড়া গিয়ে গিয়ে তাদের তাঁবুর বাইরে দাঁড়াল।

অমৃতাশ্ব নীচে নামার পর মধুরা লাফিয়ে পড়ল এবং অমৃতাশ্বকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলে ভেতরে গেল। হঠাৎ একাকী কন্যাকে দেখে বাপ মা প্রথমটায় বিশ্বাস করতে পারল না। মা তাকে জড়িয়ে ধরল তার চোখের জলে মেয়ের মুখ ভেসে যেতে লাগল। মা শান্ত হলে, বাবার প্রশ্নের উত্তরে মধুরা বলল, ‘‘বাহলীকরা পক্থ কন্যাদের লুট করে নিয়ে যাচ্ছিল। আমাকে লুট করে যে নিয়ে যাচ্ছিল সে একটু পিছিয়ে পড়েছিল। সেই সুযোগে আমি ঘোড়া থেকে লাফিয়ে পড়ি। ঠিক সে সময় একটি তরুণ অশ্বারোহী এসে উপস্থিত হল, সে বাহলীককে যুদ্ধে আহবান করে জখম করে মাটিতে ফেলে দিল। সেই কুরু তরুণ আমাকে এখানে পৌছিয়ে দিতে এনেছে।’’

পিতা বলল, ‘‘সেই কুরু তরুণ তোমাকে নিয়ে যেতে চাইল না?’’

‘‘বলপূর্বক নয়।’’

‘‘কিন্তু আমাদের জনপদের নিয়ম অনুসারে ‍তুমি তার।’’

‘‘বাবা, আমি তাকে ভালোবাসি!’’

মধুরার পিতা বাইরে এসে অমৃতাশ্বকে অর্ভ্যথনা করে তাকে তাঁবুর ভেতর নিয়ে গেল।গ্রামবাসীরা সব কথা শুনে আশ্চর্য বোধ করল। সকলের সম্মান ও সহানুভুতির মধ্যে অমৃতাশ্ব মধুরাকে সঙ্গে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বিদায় নিল।

 

অমৃতাশ্ব তখন নিজ কুরু-গ্রামের মহাপিতর। তার পঞ্চাশশাধিক অশ্ব, গরু ও অনেকগুলি ছাগল আর ভেড়া ছিল। তার চার ছেলে  ও মধুরা পশুপালন এবং গৃহকাজ করত। গ্রামের দরিদ্রশ্রেণীর কিছু লোকও তার ওখানে কাজ করত। তবে ভৃত্যের মতো নয়, আপন লোকের মতোই। একজন কুরুকে আর একজন কুরুর সমতা স্বীকার করতে হত। অমৃতাশ্ব যে সব গ্রামে চলাফেরা করত সে সব গ্রামে পঞ্চাশটির অধিক পরিবার বাস করত। তাকে তাদের ঝগড়ার আপোষ এবং মামলার বিচার করতে হত। যুদ্ধ—যা প্রায়ই ঘটত তাতে মহাপিতরকে সৈন্যদলের প্রধানের কাজ করতে হত। বস্তুত, যুদ্ধে সফলতা লাভ করলেই সে সময় মানুষ মহাপিতরের পদ লাভ করত। অমৃতাশ্ব বড় যোদ্ধা ছিল। পক্থ, বাহলীক ও অন্যান্য জনের সঙ্গে যুদ্ধে সে নিজের বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিল। মধুরাকে সে যে কথা দিয়েছিল তা পালন করেছিল। মধুরা অমৃতাশ্বের সঙ্গে শুয়োর, বাঘ শিকারই শুধু করত না, যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করত। যদিও কেউ কেউ এ সব পছন্দ করত না—তারা বলত স্ত্রীলোকের কাজ হল ঘরে।

অমৃতাশ্বকে প্রথম যেদিন মহাপিতর নির্বাচন করা হয় সেদিন কুরু-পুরে মহোৎসব পালন করা হল। সেদিন তরুণ-তরুণীরা অস্থায়ী প্রণয় বন্ধনে আবদ্ধ হল। গ্রীষ্মের দিনে নদীর উপত্যাকার এবং পাহাড়ের ওপরে গরু, ঘোড়ার পাল মনের সুখে বিচরণ করছিল।গ্রামবাসীরা ভুলেই গেল যে তাদেরও শত্রু আছে। পশু-ধন হতেই তাদের শত্রু সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। কুরুজন ভোল্‌গার তীরে যে যুগে বাস করত, তখন তাদের নিকট পশু ধন ছিল না। তাদের জঙ্গল থেকে আহার্য সংগ্রহ করতে হত। শিকার, মধু কিংবা ফল না পেলে তারা অনাহারে থাকত। আর এখন! কুরুগণ আহারের জন্য কিছু পশু, গরু, ঘোড়া, ছাগল, গাধা ইত্যাদি স্থায়ীভাবে রাখে। তাদের শুধু মাংস, দুধ, চামড়াই নয় এই পশুগুলো পশমের বস্ত্র পর্যন্ত সরবরাহ করে। কুরু স্ত্রীগণ সুতো কাটতে আর কম্বল বুনতে কুশলী! তাদের কুশলতা সমাজে বেশীদিন পূর্বসম্মান অধিকার করে থাকতে পারল না। এখন স্ত্রীর নয় পুরুষের রাজ্য। পুরুষ শাসিত সমাজে সম্পদের অধিকার, সামাজিক ব্যবস্থা অনেক বদলে গেল। স্ত্রীর রাজ্যে যেখানে একাধিক পরিবার একত্রে বাস করত, একসঙ্গে কাজ করত, সেখানে আজকের ভিন্ন ভিন্ন পরিবারের, ভিন্ন ভিন্ন পশু-সম্পদ এবং ভিন্ন ভিন্ন লাভ লোকসান। হ্যাঁ, সকলের বিপদের সময় ‘জন’ আবার পুরনো ‘জন’-এ রুপ নিত।

অমৃতাশ্ব মহাপিতর নির্বাচিত হল। মহাপিতরের মহোৎসবে মত্ত ‘জন’-এর লোকেরা নিজেদের পশু-ধনের প্রতি কোনো নজর রাখল না। বাদ্যের শব্দে নৃত্যপর তরুণরা কেবল সোম-সুরা এবং সুন্দরী তরুণীদের কথাই মনে করতে পারত। এক প্রহর রাত আর বাকি কিন্তু নৃত্যগীত তখনও বন্ধ হওয়ার কোনো উপক্রম নেই। ঠিক সেই সময় চারদিক থেকে কুকুরগুলিকে জোরে চীৎকার করতে করতে উপত্যকার ওপরের দিকে ছুটতে দেখা গেল। অমৃতাশ্ব পরিমিত সোম পান করত, আর তাতেই আনন্দ পেত। চোখে লাল রঙ ফুটে ওঠে বটে, কিন্তু সেই সঙ্গে বেহুঁস হয়ে পড়ে না। কুকুরগুলির ডাক শুনে সে উঠে দাঁড়াল। কাঠের হাতলযুক্ত নিজের পাষাণ মুদগর বাগিয়ে নিল এবং নদীর যেদিক হতে শব্দ আসছিল সেদিক চলতে শুরু করল। সামান্য অগ্রসর হওয়ার পর অস্তগামী চাঁদের আলোতে একটি স্ত্রীলোককে আসতে দেখা গেল। সে দাঁড়িয়ে পড়ল। মূর্তি, নিকটবর্তী হলে দেখা গেল—সে মধুরা। মধুরা তখনও ঘন-ঘন শ্বাস নিচ্ছিল, সে উত্তেজিত স্বরে বলল,‘‘পুরুরা আমাদের পশুগুলিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে!’’

‘‘তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে? আর আমাদের ছেলেরা নেশায় চুর! তুমি কতদূর ওদের পেছনে পেছনে গিয়েছিলে, মধুরা?’’

‘‘একেবারে কাছে নয়—যতদূর থেকে দেখা যায় সেই পর্যন্ত।

‘‘আমাদের সমস্ত পশু নিয়ে যাচ্ছে?’’

‘‘ওদের দেখে মনে হল—চারিদিকে ছড়ানো পশুদের একত্র করে নিয়ে যাচ্ছে।’’

‘‘তুমি কি মনে করছ, মধুরা?’’

‘‘দেরী করবার আর সময় নেই।’’

‘‘কিন্তু আমাদের সব ছেলরা নেশায় মত্ত!’’

‘‘যারা চলতে সক্ষম তাদের নিয়ে এখনই আক্রমণ করা চাই।’’

‘‘হ্যাঁ, ঠিক কথা; কিন্তু, মধুরা, আমার সঙ্গে তোমার যাওয়া উচিৎ নয়। এই খবরেই অর্ধেক লোকের নেশা কেটে যাবে এবং বাকি লোকদের দই খাওয়াতে হবে। যখনই যার নেশা কেটে যাবে তখনই তাকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো চাই।’’

‘‘আর কুরু মেয়েরা?’’

‘‘আমি কুরুদের মহাপিতর হিসাবে এই আদেশ দিচ্ছি, তারাও যুদ্ধক্ষেত্রে যাক! সেই প্র্রাচীন প্রথাকে আবার আমাদের জাগিয়ে তুলতে হবে।’’

‘‘আমি আগে যাবার চেষ্টা করব না; তবে তাড়াতাড়িই কাজ সারতে হবে।’’

মহাপিতরের আদেশে বাজনা একদম বন্ধ হল। নর-নারী মহাপিতরের চারিদিকে জড়ো হল। সত্যি-সত্যিই গো-অশ্ব চুরির কথা শুনে তাদের মধ্যে অনেকের নেশা কেটে গেল। তাদের চেহারায় প্রণযের কোমলভাব কেটে গিয়ে বীরভাব প্রকাশ পেল, মহাপিতর মেঘগম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘‘কুরু নর-নারীগণ! পুরু শত্রুর কাছ থেকে আমাদের সম্পদ ছিনিয়ে নিতে হবে। তোমাদের মধ্যে যাদের চেতনা আছে, নিজ নিজ হাতিয়ার নিয়ে ঘোড়ায় সওয়ার হও এবং আমাকে অনুসরণ কর, যারা নেশায় এখনও নিঝুম হয়ে আছ তারা মধুরার কাছ থেকে দই নিয়ে খাও আর নেশা কাটার সঙ্গে সঙ্গে চলে এস। কুরুনারীগণ! আজ তোমাদেরও যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে নির্দেশ দিচ্ছি। প্রাচীন কালের কুরু রমনীগণ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করত—এ কথা আমরা বৃদ্ধদের কাছে শুনেছি। আজ তোমাদের মহাপিতর অমৃতাশ্ব তোমাদের এই আদেশ দিচ্ছে।’’

মূহুর্তে মধ্যে চল্লিশটি ঘোড়া সংগ্রহ হল। পুরুরা যতগুলি পশু জড়ো করতে পেরেছিল তা‘ তারা উপত্যকার অপর পারে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। পুরো দু‘ঘণ্টা্ পশ্চাৎধাবনের পর ঊষার আলো ফোটার সময় কুরুগণ তাদের দেখতে পেল। ঘোড়া আর গরুর দল-গুলিকে একত্রিত একটি পাহাড়ের ওপর তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়াটা সহজ কাজ ছিল না। পুরু অশ্বারোহীগণ তাদের চামড়ার চাবুক বাতাস এবং পাথরের ওপর আঘাত করে ভয়াতুর করছিল। অমৃতাশ্ব দেখল যে, পুরুরা সংখ্যায় প্রায় শ‘খানেক হবে। মাত্র চল্লিশটি ঘোড়া নিয়ে যুদ্ধ শুরু করা উচিত কি অনুচিত তা নিয়ে বেশীক্ষণ অযথা মাথা ঘামাতে চাইল না। শিংয়ের লম্বা ভল্ল বাগিয়ে অমৃতাশ্ব শত্রুর ওপর আক্রমণের নির্দেশ দিল। কুরু বীর এবং বীরাঙ্গণাগণ সম্মুখে ঘোড়া ছোটাল। তাদের দেখা মাত্রই পুরুরা কিছু লোককে পশুগুলিকে আটকিয়ে রাখবার জন্যে ছেড়ে দিল। পুরুগণ নীচের দিকে ছূটতে লাগল্ এবং ঘোড়ার পুরো সুযোগ গ্রহণের জন্য নদী তীরের একটি উন্মুক্ত মাঠে দাঁড়িয়ে কুরুদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। অমৃতাশ্বের সে মূর্তি তখন সত্যিই দেখবার মতো । অমৃতাশ্বের ঘোড়া অমৃত, এখন দু‘জনকেই অভিন্ন মনে হচ্ছিল। তার হরিণের সুতীক্ষ্ণ ভল্ল একবার যার শরীরে লাগত, দ্বিতীয় আঘাতের জন্য তাকে ঘোড়ার ওপর বসে থাকতে হত না। পুরুগণ ধর্নুবাণ ও পাষাণ-পরশুর ওপর বেশী নির্ভর করে ভুল করেছিল। যদি তাদের কাছে অত শিংয়ের ভল্ল থাকত তা‘হলে নিশ্চয়ই কুরুরা তাদের মোকাবিলা করতে পারত না। যুদ্ধ এক ঘণ্টা চলছে, পুরুগণ তখনও সংগ্রাম করছিল। কিন্তু তাদের এক তৃতীয়াংশ যোদ্ধা হতাহত হয়েছে, এটাই হল ভয়ের কারণ। ঠিক এই সময় ত্রিশজন কুরু অশ্বারোহী যুদ্ধক্ষেত্রে এসে হাজির হল। কুরুদের সাহস অনেক বেড়ে গেল। পুরুগণ ভয়ানকভাবে প্রাণ হারাতে লাগল। নিজেদের অবস্থা খারাপ দেখে যে অশ্বারোহীদের লুণ্ঠিত পশুগুলিকে আগ্‌লাবার জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল তারাও এসে হাজির হল কিন্তু ঠিক এই সময়ে চল্লিশ জনের একটি কুরু নারীর দল নিয়ে মধুরা এসে যুদ্ধে যোগ দিল; দেড় ঘণ্টা তুমুল যুদ্ধ হল। অধিকাংশ পুরু হতাহত হল আর কিছু পালিয়ে গেল। আহতদের শেষ করে কুরুবাহিনী পুরুদের গ্রামের দিকে এগিয়ে গেল। গ্রাম চার ক্রোশের ওপর! সমস্ত গ্রাম জনশূণ্য। লোকজন তাঁবু ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে। তাদের পশুগুলো এখানে-ওখানে বিচরণ করছে। সর্বপ্রথম কুরুদের বোঝাপড়া করতে হবে পুরুদের সঙ্গে। পুরুগণ বিপন্ন হল চারিদিক থেকে ঘেরাও হয়ে। উত্তরের দিকে পালিয়ে যাওয়ার সুবিধেও ছিল না। উপত্যকা ক্রমশ:ই সঙ্কীর্ণ হয়েছে আর চড়াইও ছিল খুব কষ্টকর। তবু প্রাণের দায়ে নর-নারী ঘোড়ায় করে পালাচ্ছিল। অবশেষে এমন জায়গায় গিয়ে পৌছাল যে ঘোড়া আর সামনের দিকে চলতে পারে না। লোকজন পায়ে হেঁটে চলতে লাগল। কুরুগণ তাদের খুব কাছে এসে পড়ল। বৃদ্ধ, স্ত্রী ও শিশুরা তাড়াতাড়ি এগুতে পারছিল না, তাই তাদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেবার জন্য কিছু পুরু যোদ্ধা একটি সঙ্কীর্ণ জায়গায় দাঁড়াল। কুরুরা তাদের সমস্ত শক্তি কাজে লাগাতে পারছিল না। এ জন্যই পুরুদের হাত থেকে রাস্তা উন্মুক্ত করতে কয়েক দিন সময় লাগল। পুরু এবং কুরু উভয় দলই পায়ে হেঁটে আসছিল। কিন্তু পুরুদের ভেতর পুরুষের সংখ্যা দশ-বার জনের বেশী ছিল না। একদিন কিছু সাহসী স্ত্রীলোকদের সঙ্গে নিয়ে একটি দুরূহ পথ ধরে ওই উপত্যকা ত্যাগ করল এবং পাহাড় পেরিয়ে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে গেল। পুরুদের শিশু, বৃদ্ধ ও স্ত্রীলোকেরা প্রাণের ভয়ে লুকিয়ে বেড়াচ্ছিল—কুরুরা শেষ পর্যন্ত তাদের পাকড়াও করল। বন্দী করে রাখা তখনকার পিতৃতান্ত্রিক যুগের আইন-বিরুদ্ধ কাজ ছিল। তাই শিশু থেকে আরম্ভ করে সমস্ত পুরুকুলকে তারা মেরে ফেলল এবং স্ত্রীগণকে সঙ্গে নিয়ে গেল। পুরুদের সমস্ত পশু-ধনও তারা করায়ত্ত করল। এখন সেই হরিৎ নদীর উপত্যকায় নীচ থেকে ওপর পর্যন্ত কুরুদে চারণভূমি। এক পুরুষ পর্যন্ত মহাপিতর একাধিক পত্নী গ্রহণ করবার বিধান দিলেন এবং এই সময় কুরুদের ভেতর সর্বপ্রথম সপত্নী দেখা গেল।

০৪. পুরুহুত (স্থান : বক্ষু উপত্যকা (তাজিকিস্তান) ।। কাল : ২৫০০খৃষ্টপূর্ব)

বক্ষুর কলকল ধ্বনি মুখরিত ধারা বয়ে চলছে। এর দক্ষিণতটের জলধারা থেকেই পাহাড় শুরু হয়েছে, কিন্তু বামদিকে বেশী ঢালু হওয়ার দরুণ উপত্যকা প্রশস্ত বলে মনে হচ্ছে। দূর থেকে দেখলে গাঢ়-সবুজ উত্তুঙ্গ পাইন-বৃক্ষরজির কালো ছায়া ব্যতীত আর কিছুই দেখা না। কিন্তু কাছে এলে দেখা যায় এদের সুচাগ্র পত্রবিশিষ্ট শাখাসমূহ, নীচ থেকে ক্রমশ ছোট হয়ে উপরের দিকে উঠে গেছে। পাইন বৃক্ষশ্রেণীর নীচে অন্যান্য রকমারি বনস্পতি বিরাজ করছে। গ্রীষ্মের শেষ কিন্তু বর্ষা এখনও শুরু হয়নি।

বক্ষুর বাম-তট ধরে হেঁটে চলছিল একটি তরুণ, পরণে তার পশমের এক গাত্রাবরণ—তার ওপর কয়েক ভাঁজে জড়ানো কোমরবন্ধনী। নীচে পশমের পাজামা এবং বহুবিমুনী যুক্ত চপ্পল। মাথা থেকে টুপীটা খুলে পিঠের উপরকার ঝুড়িতে রাখল, দীর্ঘ উজ্জল পিঙ্গল কেশরাশি তার পিঠের ওপর ছড়িয়ে পড়ে হাল্কা হাওয়ায় ফুরফুর করে উড়তে লাগল।তরুণের কোমরে চামড়ার খাপে মোড়া তামার তরবারি। পিঠের ওপর বৃক্ষ-শাখা নির্মিত ঝুড়ি, তার ভিতর অনেক প্রয়োজনীয় জিনিসের মধ্যে খোলা ধনুক এবং বাণপূর্ণ তুণীর রেখে দিয়েছিল। তরুণের হাতে একটি দণ্ড, সেটাকে ঝুড়ির নীচে ঠেকিয়ে দাঁড়ানো অবস্থাতেই মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিচ্ছিল। অধিকতর চড়াই আরম্ভ হয়েছে এখন। তার সামনে ছাড় মোটা মোটা ভেড়া চলছিল, এদের পিঠের উপর ঘোড়ার লোমের তৈরী ছাতুভরা বড় বড় থলি। তরুণের পেছন পেছন আসছিল এক লাল রঙ-এর লোমশ কুকুর। বিহগকুলের মধুর স্বরে প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠছিল পর্বত; তরুণের ওপর তার প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছিল এবং শিস দিতে আরম্ভ করছিল সে। একটি খাড়াই-এর ওপর থেকে এক সূক্ষ্ম রুপালী ঝর্ণার ধারা ঝরছিল। খাড়াই-এর প্রান্তদেশ কেটে কে নযন কাঠের নালা তৈরী করে রেখেছিল। শ্রান্ত ভেড়ার পাল জল খেতে আসল। তরুণ দেখল কাছেই আঙ্গুর লতায় আঙ্গুরের গুচ্ছ। ঝুড়ি নামিয়ে আঙ্গুর ছিঁড়ে খেতে লাগল—কাঁচা আঙ্গুর ফলে টক একটু বেশী। পাকতে এখনও মাসখানেক দেরী, তবু তরুণ পথিকের কাছে এই-ই ভালো লাগছিল। সম্ভবত সে অত্যন্ত পিপাসার্ত ছিল এবং তাড়াতাড়ি এসেই শীতল জল পান করা ক্ষতিকর মনে করে কিছু্টা অপেক্ষা করছিল।

জলপানের পর ভেড়াগুলো চারিদিককার সবুজ ঘাসের ওপর চরে বেড়াতে লাগল। লোমস কুকুরটা অতিরিক্ত গরম বোধ করছিল, কাজেই সে তার প্রভু বা ভেড়ার পাল কারও অনুকরণ না করে ঝর্ণার জলের মধ্যে বসে পড়ল। তার পেট হাপরের মতো ওঠা-নামা করছিল। আর তার লম্ভা লাল জিভ মুখ থেকে বেরিয়ে থরথর করে কাঁপছিল। ঝর্ণার নীচে মুখ রেখে এক নি:শ্বাসে তরুণ তার পিপাসা দূর করল। তারপর চোখে জল দিয়ে সামনের চুল গোড়া পর্যন্ত ভিজিয়ে মুখ ধুয়ে নিল। তার অরুণাভ গাল এবং লাল ঠোঁট দুটো ঢেকে ফেলবার জন্য সবে মাত্র পিঙ্গল রোমরাজির উদগম হতে আরম্ভ করেছে। খুশী মনে ভেড়াগুলোকে চরতে দেখে ঝুড়ির পাশে বসে পড়ল সে। কান খাড়া করে স্থিরদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকা কুকুরের চোখের ভাব পরখ করে ঝুড়ির এক পাশ দিয়ে হাত ‍ঢুকিয়ে দিল, তারপর একখণ্ড খণ্ড ভেড়ার মাংস বের করে কোমরবন্ধনী থেকে প্রলম্বিত চামড়ার খাপে মোড়া ধারালো তামার ছুরি দিয়ে কেটে কিছু নিজে খেল আর কিছুটা কুকুরকে খাওয়াতে লাগল। এমন সময় কাঠের ঘণ্টার খট্‌খট্‌আওয়াজ শোনা গেল। তরুণ দূর থেকে দেখল—ঝোপের আড়ালে অর্ধেক ঢাকা অবস্থায় এক গাধাকে আসতে। তার পিছনে পিছনে এক ষোড়শী তরুণী তারই মতো পোষাক ও পিঠে ঝড়ি নিয়ে আসছে। হাল্কাভাবে শিস্‌দিতে লাগল তরুণ। সে যখনই কিছু ভাবতে থাকে—তার মুখ থেকে নি:শ্বাসের মতোই স্বত:স্ফুর্তভাবে এমনি শিসের আওয়াজ বেরিয়ে পড়ে। ষোড়শীর কানে একবার অন্তত শিসের আওয়াজ পৌছাল এবং সেইদিক লক্ষ্য করে তাকালও কিন্তু তরুণের দেহ লতাগুল্মের আড়ালে ছিল। তরুণ যদিও হাত পঞ্চাশ দূরে থেকে দেখছিল, তবু ষোড়শীর মুখের হাল্কা অথচ সুন্দর এক ছাপ তার অন্তস্থলে রেখাপাত করছিল, তাই উন্মুখ আগ্রহে জানবার প্রতীক্ষায় বসে রইল—কোথায় চলেছে ওই তরুণী। এ-ধারে বক্ষুর ওপরে আর কোনো বসতি নেই এ কথা তরুণ জানত, কাজেই সেও যে প্রথাচারিণী তা বুঝতে পারল। অপরিচিত ষোড়শীকে দেখে কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করল, তরুণ ‘চুপ’ বলতেই সেখানে চুপ করে বসে গেল। ষোড়শীর গাধাটি জল খেতে লাগল, তরুনী তার পিঠ থেকে ঝুড়ি খুলতেই তরুণটি এগিয়ে এসে শক্ত হাতে সেটাকে নামিয়ে নিচে রেখে দিল। মৃদু হেসে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তরুণী বলল, ‘‘বড্ড গরম আজ।’’

‘‘গরম নয়, চড়ািই পেরিয়ে আসবার জন্যে এ রকম মনে হচ্ছে। একটু বিশ্রাম নিলেই ঘাম শুকিয়ে যাবে।’’

‘‘এই সময়টাতে দিনগুলো বেশ ভালো থাকে।’’

‘‘আর দশ-পনের দিনের মধ্যে বৃষ্টি হবার ভয় নেই।’’

‘‘বৃষ্টিকে আমার সত্যিই বড় ভয়। নালার জলে আর পিছল কাদায় রাস্তাগুলো এত বিশ্রী হয়ে যায়!’’

‘‘গাধাগুলোর পক্ষে পথ চলা আরও মুশকিল হয়ে পড়ে।’’

‘‘বাড়িতে আমাদের ভেড়া নেই বলে আমি গাধা নিয়ে বেরিয়েছি। আচ্ছা, বন্ধু তুমি কোথায় যাবে?’’

‘‘পাহাড়ের ওপর, আজকাল আমাদের ঘোড়া, গরু ভেড়া সব ওখানেই আছে।’’

‘‘আমিও ঐখানেই যাচ্ছি। আমি ছাতু, ফল, নুন এইসব পৌছে দিতে যাচ্ছি।’’

‘‘তোমার পশুদের কে দেখছে সেখানে?’’

‘‘আমার প্রপিতামহ, আর ভাইবোনেরাও আছে।’’

‘‘বাবার ঠাকুর্দা! সে নিশ্চয় খুবই বুড়ো?’’

‘‘খুবই বুড়ো। এত বুড়োমানুষ বোধহয় কোথাও দেখা ‍যায় না।’’

‘‘তবে পশুদের কি করে দেখাশোনা করে?’’

‘‘এখনও খুব শক্ত সমর্থ আছে। তার চুল, ভ্রু সব সাদা হয়ে গেছে, কিন্তু দাঁত এখনও প্রায় নতুনের মতো রয়েছে। দেখলে পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বয়স বলে মনে হয়।’’

‘‘তা‘হলে তো তাকে ঘরেই বসিয়ে রাখা উচিত।’’

‘‘রাজীই হয় না। আমার জন্মের আগে থেকে সে গাঁয়ে যায়নি কখনো।’’

‘‘গাঁয়ে যায়নি!’’

‘‘যেতে চায় না। গাঁ-কে সে ঘৃণা করে। বলে, ‘মানুষ এক জায়গায় বন্দী হয়ে থাকবার জন্যে জন্মায়নি।’ অনেক প্রাচীন কাহিনী আমাদের শোনায়। আচ্ছা তোমার নাম কি বন্ধু?’’

‘‘পুরুহুত মাদ্রীপুত্র পৌরব। আর তোমার নাম বোন?’’

‘‘রোচনা মাদ্রী।’’

‘‘তা‘হলে তুমি তো আমার মাতুলকুলের লোক! তোমরা উত্তরমাদ্র না নিম্ন?’’

‘‘উত্তরমাদ্র।’’

বক্ষু নদীর বামতটে পুরুদের গ্রাম, কিন্তু তার নিম্নভাগ—যা নীচের সমতলভূমির সঙ্গে মিশেছে—মমুদের অধিকারে ছিল। দক্ষিণতটে উপরিভাগ মাদ্র এবং নিম্নভাগ পরশুদের অধিকারে ছিল। ভূমি এবং জনসংখ্যার বিচারে পুরুরা মাদ্রদের চেয়ে ছোট ছিল না। পুরুদের নিম্নে অবস্থিত মাদ্রদের নিম্নমাদ্র বলা হত। রোচনা উচ্চমাদ্রের বংশ।

এইসব জানবার পর দু‘জনেই আরও অধিক আত্মীয়তা অনুভব করল। পুরহুত বলল, ‘‘রোচনা, আজ কিন্তু আমরা পাহাড়ের ওপর পৌছাতে পারব না। কিন্তু একলা আসবার সাহস তুমি কোত্থেকে পেলে?’’

‘‘হ্যাঁ, আমি জানতাম যে রাতে চিতাবাঘের হাত থেকে গাধাগুলোকে বাঁচানো মুশিকিল, কিন্তু বুড়ো মানুষটির জন্য খাওয়ার জিনিস আনবার দরকার ছিল পুরহুত। আমার ওপর তিনি অনেকখানি ভরসা করেন। আমি ভেবেছিলাম যে রাস্তায় আরও কেউ হয়ত জুটে যাবে, আজকাল ওপরে অনেক লোকই যায়। আর এও মনে করেছিলাম রাত্রে আগুন জ্বালিয়ে নিলেই কাজ চলে যাবে।’’

‘‘রাস্তায় চলতে চলতে আগুন জ্বালানো সম্ভব নয়। তোমার কাছে কি অরণী আছে?’’

‘‘আছে।’’

‘‘থাকলেও অরনী ঘর্ষণ করে আগুন জ্বালানো সহজ কাজ নয়। যা‘হোক আমার কাছে এক পবিত্র অরণী আছে, পিতামহের আমল থেকে আমাদের ঘরে এটা ব্যবহৃত হচ্ছে। এই অরণীর আগুনে বহু যজ্ঞ, বহু দেবপূজার অনুষ্ঠান হয়েছে। অগ্নিদেবতার মন্ত্রও আমার জানা আছে, কাজেই এ দিয়ে তাড়াতাড়িই আগুন জ্বলে যায়।

‘‘তা ছাড়া আমরা এখন দু‘জন পুরুহুত,কাজেই আমাদের সামনে আসবার মতো সাহস চিতাবাঘের হবে না।’’

‘‘আর আমার কুকুরও তো রয়েছে, রোচনা ।’’

‘‘কুকুর!’’

‘‘হ্যাঁ, আমার এই লাল শিকারী কুকুর।’’

কুকুরটাকে ডাকতেই সে দাঁড়িয়ে তার প্রভুর হাত চাটতে লাগল। রোচনাও আদর করে ডাকল তাকে। সে এসে তার গা শুঁকতে লাগল, তারপর রোচনা যখন তার পিঠে হাত দিল তখন লেজ নাড়তে নাড়তে সে তার পায়ের ওপর বসে পড়ল। পুরুহুত বলল, ‘‘ও খুব বুদ্ধিমান, রোচনা।’’

‘‘খুব বলিষ্ঠও বটে।’’

‘‘হ্যাঁ, ভাল্লুক, নেকড়ে, চিতা কাউকেই ভয় করে না।’’

ভেড়া এবং গাধাগুলো এতক্ষণে প্রচুর ঘাস খেয়েছে, ক্লান্তিও দূর হয়ে গেছে, তাই দুই পথিক আবার পথ চলা শুরু করল। কুকুরটা পিছন পিছন চলল। চলার পথ যদিও এঁকে-বেঁকে তেরছাভাবে ওপরে উঠেছে, তবুও চড়াই অত্যন্ত কঠিন ছিল, এ জন্য অত্যন্ত সাবধানে ধীরে ধীরে পা ফেলে এগিয়ে চলছিল তারা। পুরুহুত কখনও সরস লাল স্ট্রবেরী ফল, কখনও বা করমচা ফল ছিঁড়ছিল এবং রোচনাকেও তার ভাগ দিচ্ছিল। ভালো ভালো ফলগুলো এখনও তেমন পাকেনি, পুরুহুতকে তাই কিছুটা নিরাশ হতে হচ্ছিল। সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা এমনি আলাপ করতে করতে ওপরে উঠল। ঘন গুল্মরাজির নীচ দিয়ে কল-কল স্বরে ধাবিত এক ঝর্ণাধারা তাদের নজরে এল, তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। পাশেই একটুখানি খোলা জায়গা, সেখানে পড়ে রয়েছে আধপোড়া কাঠের গুঁড়ি আর ছাই। খুব খুশী হয়ে বলল, ‘‘রোচনা রাতের বিশ্রামের জন্য এর থেকে ভালো জায়গা সামনে আর পাওয়া যাবে না। কাছেই জল রয়েছে, আর প্রচুর ঘাস এবং শুকনো কাঠ। এ ছাড়াও সকালে এখান থেকে যে সব পথিক রওনা হয়েছে, তারা ছাই চাপা দিয়ে আগুনও রেখে গেছে।’’

‘‘হ্যা পুরুহুত, এর চেয়ে ভালো জায়গা পাওয়া যাবে না। আজ এখানেই থাকা যাক। পরের ঝর্ণা পর্যন্ত পৌছাতে অন্ধকার হয়ে যাবে।’’

পুরুহুত বসে পরে তাড়াতাড়ি নিজের ঝুড়িটা নীচে নামিয়ে পাথরের গায়ে ঠেস দিয়ে রাখল, তারপর রোচনার ঝুড়িটা নামাল। দু‘জনে মিলে গাধাগুলোর পিঠ থেকে বোঝা নামাল এবং তাদের জিন্‌খুলে দিল। গাধাগুলো দু‘তিনবার গড়াগড়ি খেয়ে চরতে চলে গেল। ভেড়ার বোঝা নামাতে কিছু দেরী হল, কারণ তাদের জোর করে ধরে আনতে হচ্ছিল। মশক হাতে রোচনা ঝর্ণার জল ভরতে গেল। পুরুহুত পাতা এবং কাঠের টুকরো দিয়ে আগুল জ্বালাল, তারপর বড় বড় কাঠের খণ্ড দিয়ে বড় রকমের অগ্নিকুণ্ড তৈরী করল। রোচনা যখন জল নিয়ে ফিরল, তখন পুরুহুত এক তামার পাত্র সামনে রেখে গরুর একখণ্ড পা ছুরি দিয়ে কাটছে। রোচনাকে দেখে সে বলল, ‘‘কাল সন্ধ্যায়র মধ্যে আমরা ওপরে পৌছে যাব রোচনা। তোমার গোষ্ঠ তো তবে আর বেশী দুর হবে না?’’

‘‘এই পাহাড়ের মাথায় আমরা যেখানে পৌছাই, সেখান থেকে তিন ক্রোশ পূবে।’’

‘‘আর আমার ছ‘ক্রোশ পুবে। তা‘হলে তো তোমর প্রপিতামহের গোষ্ঠ আমার যাবার পথেই পড়বে। ‘’

‘‘তুমিও তবে তাকে দেখতে পাবে। তার সঙ্গে কি করে তোমার দেখা হবে এইটেই ভাবছিলাম।’’

‘‘আর তো মাত্র এক দিন আছে, সিকি ঠ্যাং-ই যথেষ্ট একদিনের জন্যে।’’

‘‘আমার কাছেও বাছুরের আধখানা ঠ্যাং আছে। আজকাল মাংস বেশীদিন রেখে দিলে দুর্গন্ধ হয়।’’

‘‘নুন দিয়ে মাংস রাধলে কি রকম হবে?’’

‘‘খুব ভালো হবে। আর আমার কাছে গুড়ের রসও রয়েছে, পুরুহুত। মাংস, গুড়ের রস আর শেষে কিছুটা ছাতু মিশিয়ে দিলেই চমৎকার সুপ তৈরী হবে। শুতে যাবার আগেই সুপ খাব আমরা।’’

‘‘আমি একলা হলে সুপ বানাতাম না রোচনা, বড় সময় লাগে ওতে। কিন্তু এখন সেই সময়টা আমি পশুগুলোকে বাঁধতে এবং কথাবার্তা বলেই কাটিয়ে দেব।’’

‘‘প্রপিতামহ আমার রান্না সুপ বড়ই পছন্দ করেন, পুরুহুত। তোমার এ তামার কড়াই কি সুন্দর!’’

‘‘হ্যাঁ, তামার, কিন্তু অনেক দাম রোচনা। এই কড়াই-এর পিছনে একটা ঘোড়ার দাম খরচ হয়েছে; কিন্তু রাস্তায় বেশ কাজে আসে এগুলো।’’

‘‘তোমার ঘরে নিশ্চয়ই তা‘হলে অনেক পশু আাছে পুরুহুত?’’

‘‘হ্যাঁ রোচনা, ধানও আছে। এইজন্যই তো এক ঘোড়ার মুল্যের এই কড়াই। আচ্ছা নাও এইবারে মাংস কাটা আমার শেষ হয়ে গেছে। জল আর নুন দিয়ে মাংস আগুনে চড়িয়ে দাও, আর আমি ওই দিকটাতেও কাঠের আগুন তৈরী করি। তারপর কিছু ঘাস কেটে আমাদের গাধা আর ভেড়াগুলোকে তার মাঝখানে বাঁধতে হবে। জান তো আমাদের কাছে বাছুরের মাংস যেমন লাগে, চিতার কাছে গাধার মাংস তার চেয়ে মিষ্টি।’’ তার কুকুরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘আয় তুইও ততক্ষণ এটা চাটতে থাক।’’ কিছুটা মাংসসুদ্ধ একটা হাড় কুকুরের সামনে ছুঁড়ে দিল পুরুহুত। কুকুরটা লেজ নাড়াতে নাড়াতে পায়ের নীচে হাড়ের টুকরো চেপে দাঁত দিয়ে ভাঙবার চেষ্টা করতে লাগল।

পুরুহুত ওপরের গাত্রবাস এবং কোমরবন্ধনী খুলে ফেলল। হাতাবিহীন জামার নীচে তার প্রশস্ত বক্ষ এবং পেশীবহুল বাহুযুগল জানিয়ে দিতে চায় এই বিশ বছর বয়স্ক তরুণের দেহে অপরিসীম শক্তি। কাজ করবার সময় পুরুহুতের লোমরাজি কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল।ঝুড়ির ভেতর থেকে কোদাল বের করে এক লহমায় একগাদা ঘাস সংগ্রহ করে ফেলল। তারপর কাণ ধরে গাধাগুলোকে নিয়ে এসে খুঁটো গেড়ে বাঁধল এবং তাদের সামনে ঘাস ছড়িয়ে দিল। ভেড়াগুলোর ব্যবস্থা একই হল।

কাজ শেষ করে পুরুহুতও আগুনের কাছে এসে বসল্ কড়াই থেকে সিদ্ধ মাংসখণ্ড তুলে চামড়ার ওপরে রাখতে যাচ্ছিল রোচনা। পুরুহুত ‍ঝুড়ির ভিতর থেকে এক টুকরো চামড়া বের করে বিছিয়ে দিল। তারপর কাঠের এক সুন্দর চষক এবং পেটের চামড়ায় তৈরী বোতল বের করে রাখল, সেই সঙ্গে বাঁশীটাও মাটিতে পড়ে গেল। যেন কোনো কোমল শিশু মাটিতে পড়ে গেছে এবং ব্যথা লাগবার ভয়ে তার মা কেঁপে উঠছে—এমনিভাবে তাড়াতাড়ি বাঁশীটাকে তুলে কাপড়ে মুছল। তারপর তাকে চুমু খেয়ে ‍ঝুড়ির ভিতর রাখতে গেল। রোচনা চেয়ে চেয়ে দেখছিল। সে বলে উঠল, ‘‘পুরুহুত, তুমি বাঁশী বাজাতে পার?’’

‘‘এই বাশী আমার বড়ই প্রিয় রোচনা, আমার প্রাণটাই যেন এই বাঁশীর সঙ্গে বাঁধা।’’

‘‘আমাকে বাঁশী শোনাও পুরুহুত।’’

‘‘এখন না, খাওয়ার পরে।’’

‘‘এখন একটু শোনাও, খাওয়ার পরে আবার শুনব।’’

‘‘আচ্ছা—’বলে পুরুহুত বাঁশীতে ঠোট লাগিয়ে আটটি আঙ্গুল যখন তার ছিদ্রগুলোর ওপর দিয়ে চালাতে শুরু করল, তখন বিশাল বৃক্ষরাজির ছায়া থেকে বেরিয়ে নি:শব্দ পদসঞ্চারী সন্ধ্যার অন্ধকার আর স্তব্ধতার মাঝে দিগন্ত প্রতিধ্বনিত করা মধুর ধ্বনি চারদিকে মায়াজাল বিস্তার করতে লাগল। রোচনা সমস্ত কিছু ভুলে তন্ময় হয়ে শুনতে লাগল সেই ধ্বনি। কোন উর্বশীর বিয়োগব্যথায় ব্যাকুল পুরুরবার বেদনাপূর্ণ গান বাঁশীতে বাজিয়ে চলেছিল পুরুহুত! গান শেষ হয়ে গেলে রোচনার মনে হল,যেন স্বর্গ থেকে সোজা ধরণীতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে।

আনন্দাশ্রু পূর্ণ চোখে সে বলল, ‘‘তোমার বাঁশীর গান বড় মধুর পুরুহুত, বড়ই মধুর। আমি এমন বাঁশী কখনও শুনিনি। কি সুন্দর এই সুর!’’

‘‘লোকে এই কথাই বলে রোচনা, কিন্তু আমি বুঝতে পারি না। বাঁশীতে ঠোট লাগানো মাত্রই আমি সব ভুলে যাই। এই বাঁশী যতক্ষণ আমার কাছে থাকে ততক্ষণ পৃথিবীর কোন কোনো কিছুই আমি চাই না।’’

‘‘আচ্ছা—এস পুরু, নইলে মাংস জুড়িয়ে যাবে।’’

‘‘রোচনা, আমি যখন রওনা হই, তখন মা এই দ্রক্ষাসুরা দিয়েছিলেন, অল্পই আছে। মাংসের সঙ্গে পান করলে বেশ লাগবে।’’

‘‘সুরা েতোমর খুব প্রিয়, পুরু?’’

‘‘প্রিয় বলা যায় না রোচনা। প্রিয় জিনিসে অরুচি হয় না। কিন্তু আমার চোখদুটো একটু লাল হয়ে উঠলেই আর এক ঢোকও পান করতে পারি না।’’

‘‘আমারও ঠিক এমনি মনে হয় পুরু। নেশায় চুর লোক দেখলে আমার বড় ঘৃণা হয়।’’—বলতে বলতে রোচনা নিজের কাঠের পেয়ালা বের করে নীচে রাখল।

তিনভাগের একভাগ মাংস কুকুরকে দেওয়া হয়েছিল। ওরা দু‘জন অনেক দেরীতে পানাহার শেষ করল। চারিদিকে ঘন অন্ধকারের আস্তরণ ছড়িয়ে পড়েছে। মোটা কাঠের গনগনে আগুনের লাল আভা আর তার আশেপাশের কিছু জায়গা ছাড়া আর কিছুই সেখানে দেখা যাচ্ছিল না। তবে কিছু আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল—মনে হয় পোকামাকড়ের ডাক। গল্প-গুজব এবং মাঝে মাঝে বাঁশী বাজানো চলতে লাগল। শেষ কয়েকঘণ্টার মধ্যে ছাতু দিয়ে মাংসের সুপ তৈরী হয়ে গেল। দু‘জনেই নিজ নিজ পেয়ালা নিয়ে গরম গরম সুপ পান করল। অনেক রাত হয়ে গেলে ওরা ঠিক করল ঘুমোবে। চামড়ার বিছানা তৈরী করে রোচনা নিজের পরিচ্ছদ খুলতে লাগল। পুরুহুত আগুনের ওপর আরও কাঠ সাজিয়ে দিল, পশুগুলোর সামনে ঘাস এগিয়ে দিল, তারপর বনদেবতার কাছে প্রার্থনা শেষ করে পরিচ্ছদ খুলে ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন সকালে উঠে দু‘জনেই অনুভব করল যেন একরাত্রীর ভিতরে দু‘জনের মধ্যে সহোদর ভাই-বোনের সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে গেছে। রোচনা উঠবার পর পুরুহুত নিজেকে সংযত রাখতে পারল না। বলল, ‘‘তোমার মুখে আমার চুমু দিতে ইচ্ছা করছে, রোচনা বোন!’’

‘‘আমারও, পুরু! এ জগতে আমরা পরস্পর ভাইবোন।’’

রোচনা বিম্রস্ত এলোচুলের রাশি পিছনের দিকে সরিয়ে দিয়ে পুরুহুত তার গাল-দুটোতে চুমু দিল, দু‘জনের মুখমণ্ডল প্রসন্ন হয়ে উঠল এবং চোখ জলে ভরে এল। তারপর মুখ ধুয়ে সামান্য ছাতু এবং শুকনো মাংস খেয়ে পশুগুলোর পিঠে বোঝা চাপিয়ে তারা যাত্রা করল। কথাবার্তায় সময় এত তাড়াতাড়ি কেটে গিয়েছিল যে তারা বুঝতেই পারেনি কখন ওপরে এসে পৌচেছে।

রোচনা মাদ্র প্রপিতামহের কাছে পুরুহুতের পরিচয় দিলে সে পুরুদের বীরত্বের প্রশংসা করতে করতে তাকে অর্ভ্যথনা করল।

এই গিরিপথে মাদ্রদের একটি ছোট গ্রাম। সমস্ত ঘরই তাঁবু অথবা খড়ের ছাউনি। নীচের দিকে ঢালু এবং খাড়া পাহাড়ের ওপর কেবল ঘন পাইনের জঙ্গল কিন্তু এই পর্বতচুড়ায় বৃক্ষের চিহ্নমাত্র নেই। এখানে ভূমি সমতল, ওপরে সবুজ ঘাসের পুরু গালিচা বিস্তৃত। এই সবুজভূমির কোথাও ভেড়া, কোথাও বা ঘোড়ার দল চরে বেড়াচ্ছিল। এদেরই মধ্যে কোথাও কোথাও এদেরই ছোট ছোট বাচ্চারাও লাফিয়ে লাফিয়ে খেলা করছিল। এই সমতল ভূমিকেই দেখে মাদ্রবাবা বলেছিলেন, ‘মানুষ এক জায়গায় বন্দী হয়ে থাকবার জন্য জন্মলাভ করেনি।’ মাদ্রবাবার তাঁবু এখানেই পড়েছে এ মাসে। ঘাস কমে গেলে অন্য কোথাও চলে যাবে। এখানে দুধ, দই মাখন এবং মাংসের প্রাচুর্য। তাবুর ভেতরে এইসব জিনিসই রয়েছে। পনেরো বিশ দিন অন্তর গ্রাম থেকে লোক এসে এখান থেকে মাখন ও মাংস নিয়ে যায়। শীতের দিনে এই পাহাড়ের চূড়ায় বরফ পড়তে থাকে। প্রপিতামহ পারলে এখানেই থেকে যেত কিন্তু বরফ খেয়ে থাকতে পারে না, এ জন্য তাকে আঁকা-বাঁকা রাস্তা ধরে কিছুটা নিচে চলে আসতে হয়। আর পশুরা চলে যায় নীচের গ্রামে। বৃদ্ধকে কিন্তু গ্রামে যাওয়ার কথা বললেই তেড়ে মারতে আসে।বেলা থাকতেই দুই পথিক তাঁবুতে পৌচেছিল। জিনিসপত্র নামিয়ে নেবার পর বৃদ্ধ সফেন ঘোড়ার দুধে ভরা কাষ্ঠ পেয়ালা তাদের সামনে রাখল, তিন-চার পেয়ালাতেই পথের ক্লান্তি দূর হল। সন্ধ্যার সময় রোচনার ভাই-বোন এবং গাঁয়ের অন্যান্য তরুণ রাখালরা ঘোড়া, গরু, বাছুর নিয়ে এসে পড়ল। এদিকে রোচনা তার সেই বুড়ো প্রপিতামহের কাছে ‍পুরুহুতের বাঁশীর প্রশংসা করছিল। তার মতো গম্ভীর লোকও পুরুহুত কে ছাড়তে রাজী নয়। সে এবং গোষ্ঠীর সমস্ত তরুণই বাঁশী অত্যন্ত ভালোবাসে। রাত্রে যখন নৃত্যানুষ্ঠান চলল, পুরুহুতও তখন বাঁশীর যাদু দেখিয়ে দিল।

সকালে উঠে পুরুহুত যাবার কথা বলল, ‍কিন্তু প্রপিতামহ তাকে এত তাড়াতাড়ি যেতে দেবে কেন। দুপুরে খাওয়ার পরে বৃদ্ধ নিজের কথা আরম্ভ করলে এবং কথারাম্ভ হল ঝুড়ির পাশে পড়ে থাকা তামার কড়াইকে কেন্দ্র করে। বৃদ্ধ বলল, ‘‘এই তামা এবং ক্ষেতগুলোকে দেখলে আমার সারা অন্তর জ্বলে ওঠে। যখন বক্ষুতটে এইসব জিনিসের আমদানী হয়েছে, তখন থেকে পাপ-অধর্ম ছেয়ে গেছে, দেবতারাও রুষ্ট হয়েছেন, মহামারী বেড়ে গেছে—প্রবল হয়ে উঠেছে হানাহানি।’’

‘‘তা‘হলে কি আগে এ সব জিনিস ছিল না দাদু?’’—পুরুহুত প্রশ্ন করল।

‘‘না বাবা, এইসব জিনিস আমার ছোটবেলাতেই শুরু হয়েছে একটু একটু করে। আমার ঠাকুর্দা তো এ সবের নাম পর্যন্ত শোনেনি, সে সমস্ত কিছুই পাথর, হাড়, শিং কিম্বা, কাঠ থেকে তৈরী হত।’’

‘‘কাঠ কি ‍দিয়ে কাটত দাদু?’’

পাথরের কুড়ুল দিয়ে।’’

‘‘তা‘হলে তো অনেক সময় লাগত, আর এত সুন্দর করে কাটা যেত না নিশ্চয়ই?’’

‘‘এত তাড়াহুড়োর তাগিদই তো সমস্ত কাজ মাটি করেছে, এখন তোমরা ছ‘মাসের খাবার অথবা অর্ধেক জীবন কাটাবার মতো একটা ঘোড়া দিয়ে একখানা তামার কুড়ুল নাও, তারপর জঙ্গলের পর জঙ্গল কেটে উজার কর অথবা গাঁ-এর পর গাঁ কে নিশ্চিহ্ন করে ফেল! কিন্তু গাঁগুলো জঙ্গলের গাছ-গাছালির মতো নিরস্ত্র নয়। তাদের কাছেও অমনি তীক্ষ্ম কুড়ুল রয়েছে। এ তাম্র-কুঠার যুদ্ধকে আরো ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। এর আঘাতে বিষাক্ত ক্ষতের সৃষ্টি হয়। আগে তীরের ফলা পাথরে তৈরী হত। এই তামার ফলা দিয়ে দুধের ছেলরা বাঘ শিকার করতে চায়। এখন আর লোকে কুশলী ধনুর্ধর হতে চাইবে কেন?’’

‘‘তোমার একটা কথার সঙ্গে আমি একমত দাদু—মানুষ একজায়গায় থাকবার জন্যে জন্মায়নি।’’

‘‘হ্যাঁ বাছা, প্রথম দিনের ময়লার ওপর রোজ রোজ ময়লা ফেলা খুবই খারাপ।

আমাদের তাঁবু এখানেই রয়েছে। পশুরা এখানকরা ঘাস খেয়ে ফেলবে। এর আশেপাশে মানুষ এবং পশুর মলমূত্র জমে উঠতে থাকবে, আর সেই সময় আমরা এই জায়গা ছেড়ে চলে যাব—যেখানে নতুন নতুন সবুজ ঘাস প্রচুর মিলবে, জলহাওয়া অনেক বেশী নির্মল হবে।’’

‘‘হ্যা দাদু, আমিও এমনি ভালোবাসি—এই মাটিতেই আমার বাঁশীর সুর আরো মিষ্টি হয়ে ওঠে।’’

‘‘ঠিক বলেছ বাছা! আগে আমরা এই তাঁবুর মেলাকেই গাঁ বলতাম, আর এইসব মেলা এক জায়গায় এক বছর কেন তিন মাসও থাকত না, কিন্তু এখানকার গাঁ পুত্র-পৌত্র এমন কি একশ‘ পুরুষের বলতি হিসাবে তৈরী হচ্ছে। পাথর, কাঠ আর মাটির দেওয়াল তোলা হয়, ফলে ভিতরে হাওয়া ঢুকতে পারে না। অগ্নিকে দেবতা বলা, বায়ুকে দেবতা বলা আজ শুধু মুখের কথায় দাঁড়িয়ে গেছে, আজ আর আমাদের হৃদয়ে তাদের জন্য সেই শ্রদ্ধা-সম্মান নেই। এই জন্যেই এখন বহু নতুন নতুন রোগের উৎপত্তি। হে মিত্র, হে নাসত্য, হে অগ্নি! ‍তুমি যে এই মানবকুলের ওপর ক্রোধ বর্ষণ করছ, তা ঠিকই।’’

‘‘কিন্তু দাদু, এই তামার কুড়ুল, তামার খাঁড়া, তামার শল্য ছাড়া আমরা কি করে বেঁচে থাকব? এ সব ত্যাগ করলে শত্রুরা আমাদের একদিনেই গ্রাস করবে।’’

‘‘আমি স্বীকার করি বাছা, দু‘মাসের আহার অথবা আজীবন কাটাবার মতো ঘোড়া খুশী মনে বেচে লোকে তামার খাঁড়া কেনেনি। ঐ নিম্নমাদ্র এবং পরশুরা বক্ষু মাতার গায়ে কলঙ্গের দাগ লাগিয়েছে। বক্ষু নদী কতদূর পর্যন্ত বয়ে গেছে তা আমি জানি না, মিথ্যাবাদীরা অবশ্য বলে, পৃথিবীর প্রান্তে যে অপার জলরাশি রয়েছে সেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে। এ কথা আমরাও জানি যে, মাদ্র আর পরশুদের দেশ শেষ হতেই বক্ষু নদী পাহাড় ছেড়ে সমতলভূমিতে চলে যায়, আর তারপরেই হল মিথ্যাবাদী। দেবশত্রুদের দেশ। তারা বলে সেখানে না-কি বড় বড় ঠ্যাংওয়ালা ছোটখাটো পাহাড়সদৃশ জন্তু আছে, কি যেন তাদের নাম বাবা?—স্মৃতিশক্তি এখন ক্ষীণ হয়ে আসছে আমার।’’

‘‘উট বলে দাদু। কিন্তু পাহাড়ের মতো উঁচু হয় না। একদিন এক নিম্নমাদ্র উটের বাচ্চা নিয়ে এসেছিল। বলল, ছ‘মাসের বাচ্চা, আকারে সে তো আমাদের ঘোড়ার মতোই ছিল।’’

‘‘হ্যাঁ বাছা, বাইরের দেশ থেকে যারা ঘুরে আসে, তারা বড় বেশী মিথ্যা বলতে শেখে। তারা বলত—কি যেন ওর নাম?’’

‘‘উট।’’

‘‘হ্যাঁ হ্যাঁ উট। বল তো উটের গলা কি এত লম্বা যে, সে বক্ষুর এপারে দাঁড়িয়ে ওপারের ঘাস খেতে পারে!’’

‘‘এ মিথ্যা কথা, তাই না দাদু?’’

‘‘হ্যাঁ বাবা, সেই বাচ্চার গলা ঘোড়ার থেকে সত্যিই লম্বা ছিল; কিন্তু ঘাস খাওয়ার কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা…’’

‘‘এই মিথ্যাবাদী মাদ্র এবং পরশুরাই তামার কুড়ুল, তামার খাঁড়ার জিগীর তুলেছে। পরশুরা আমাদের উত্তর-মাদ্রের ওপর ওইসব অস্ত্র নিয়েই হামলা করেছিল। এ ঘটনা ঘটে আমাদের আমলে। আমাদের লোকেরাও নিম্নমাদ্রদের কাছ থেকে দুটো করে ঘোড়ার বিণিময়ে তামার কুড়ুল কিনেছিল।’’

‘‘তামার কুড়ুল-এর সামনে পাষাণ-কুঠার ‍কিছুই কাজের নয়, তাই না দাদু?’’

‘‘হ্যাঁ, একেবারে কিছুই নয় বাছা! এই জন্যই বাধ্য হয়ে আমাদের তাম্র-অস্ত্র নিতে হয়েছিল। আর যখন পুরুদের ওপর নিম্নমাদ্ররা আক্রমণ চালাল, তখন তোমাদের লোকেরা আমাদের কাছ থেকে তাম্র-অস্ত্র খরিদ করল। উত্তর-মাদ্র এবং পুরুদের মধ্যে কখনও ঝগড়ার খবর শোনা যায়নি কিন্তু পরশু এবং নিম্নমাদ্রেরা সব সময়েই দস্যুবৃত্তি চালিয়ে এসেছে, সর্বদাই পুরনো ধর্মকে ছেড়ে নতুন নতুন কথা বলেছে, আর তারই ফলে আমাদের লোকেদেরও প্রাণরক্ষার জন্য সেই একই ব্যাপার করতে হয়েছে। আমি বুঝি যে, যতক্ষণ পর্যন্ত নিম্নমাদ্র এবং পরশুগণ তামার অস্ত্রপাতি ত্যাগ না করে, ততক্ষণ আমাদের অধিবাসীদের পক্ষে সে সব ত্যাগ করা আত্মহত্যারই সামিল। কিন্তু তামার এতটা প্রসার যে খুবই খারাপ, তাতে কোন সন্দেহ নেই বাছা! আর এই পাপের প্রসারে সাহয্য করছে ঐ দুটো দল—দেবতার আর্শীবাদ এরা কোনোদিনই পাবে না। ঘোর অন্ধকারময় পাতালে প্রবেশ করতে হবে ওদের। ওদের দেখাদেখি, ওদের ভয়ে আমাদের মাটি পাথরের গ্রাম তৈরী করতে হয়েছে। কিন্তু নিম্নমাদ্র আর পরশুরা এই ব্যবস্থা নষ্ট করে দিয়ে এইসব তামার অস্ত্র দিয়ে মাটি মায়ের বুক চিরে দেবার বুদ্ধি কোত্থেকে পেল! এমন পাপ কেউ করেনি। মাটিকে আমরা মা বলি বাছা।’’

‘‘হ্যাঁ দাদু, মাটিকে মা বলি, দেবী বলি, তাকে পূজাও করি।’’

‘‘আর সেই মায়ের বুক নিজ হাতে চিরে দিয়েছে ওই সব পাপীরা। আরও কি সব করেছে—নাম ভুলে যাচ্ছি, স্মৃতিশক্তি ঠিক কাজ করছে না বাছা।’’

‘‘কৃষি, চাষ।’’

‘‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, কৃষি আর চাষ চালু করেছে ওরা, গম বোনে, ধান বোনে এ সব শোনাই যায়নি আগে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা কখনও ধরিত্রী মায়ের বুক চেরেনি, কখনও দেবীর অপমান করেনি। ধরিত্রী মাতা আমাদের পশুকুলের আহারের জন্য ঘাস দিত। জঙ্গলে রকমারী মিষ্টি ফল ছিল, আমরা খেলেও সব ফুরাতো না। কিন্তু এই মাদ্রদের পাপ আর তার দেখা দেখি আমাদের কৃত পাপের ফলে এই এক মানুষ উচু ঘাস আজ কোথায়? আগেকার মতো সেই পুষ্ট গরু, যা দিয়ে একটা গোটা মাদ্র-গোষ্ঠীর একদিনের পর্যাপ্ত আহার হয়ে যেত—তা এখন কোথায়? সেই গরু, সেই ঘোড়া সেই ভেড়া ‍কিছুই নেই। জঙ্গলের হরিন আর ভাল্লুকও এখন আর অত বড় হয় না। মানুষ আর আগের মতো বেশী দিন বাঁচে না। এই সবই ধরিত্রী দেবীর কোপের ফল ছাড়া আর কিছুই নয়।’’

‘‘দাদু, তুমি কতগুলো শীত দেখেছ?’’

‘‘একশ‘র ওপরে বাছা! এক সময়ে আমাদের গাঁয়ে দশটি তাঁবু ছিল, আর এখন মাটি-পাথরের দেয়ালে তৈরী এক‘শ ঘর হয়ে গেছে সেখানে। যখন ক্ষেত ছিল না, তখন আমাদের চলতি ফিরতি ঘর, চলতি-ফিরতি গাঁ হত। কিন্তু যখন ক্ষেত চালু হল, তখন হরিণের মুখ থেকে শস্য রক্ষার জন্যে ক্ষেত মানুষকে বেঁধে রাখবার খুঁটিতে পরিণত হল। কিন্তু বাছা, মানুষ এক জায়গায় বন্দী হয়ে থাকবার জন্য জন্ম নেয়নি। দেবতারা যা মানুষের জন্য সৃষ্টি করেনি, নিম্নমাদ্র আর পরশুরা সে সব তৈরী করছে।’’

‘‘কিন্তু দাদু, আমরা কি এখন ইচ্ছা করলেও এইসব চাষ-আবাদ ছেড়ে দিতে পারি? ধানই যে আমাদের অর্ধেক খাদ্য আজ।’’

‘‘সে কথা স্বীকার করি কিন্তু ধান আমাদের পূর্বপুরুষেরা খেত না; এখান থেকে পঁচিশ ক্রোশ দূরে গমের বন আছে, সেখানে আপনাআপনিই গম জন্মায়। ফসল ধরে তারপর ঝরে ‍যায়, সেগুলো গরুরা খায়, তাদের দুধ বেড়ে যায়। ঘোড়ারা খেয়ে মোটাসোটা হয়ে ওঠে। প্রতি বছর আমাদের পশুরা সব সেখানে যায়। ধরিত্রী মা মানুষের জন্য ধান সৃষ্টি করেনি—তার দানা আমাদের ক্ষেতের গম থেকে ছোট—পশুকুলের জন্যই ওগুলো। আমার ভয় যে, কোনোরকমে এই জংলী গম নষ্ট হয়ে না যায়! আমাদের খাওয়ার জন্য এই সব গরু রয়েছে; ঘোড়া, ভেড়া, ছাগল রয়েছে; জঙ্গলের ভেতর ভাল্লুক, হরিণ, শুয়োর, নানা রকমের শিকার রয়েছে, আঙ্গুর প্রভৃতি কত রকমের ফল রয়েছে। এইসব আহার ধরিত্রী মা আমাদের খুশী মনেই দিত; কিন্তু এই সর্বনাশা নিম্নমাদ্র আর পরশু এরা পুরনো সেতু ভেঙ্গে ফেলে নতুন সড়ক তৈরী করছে। আর তাদের এই পাপ কাজে মানুষের ওপর দেবতার কোপদৃষ্টি পড়েছে। জানি না বাছা এখন বক্ষুবাসীদের ভাগ্যে আর কী কী দূর্দশা লেখা রয়েছে। আমি তো পঁচিশ বছর থেকে পাহাড়ের চূড়ো ছেড়ে গাঁয়ে যাই নি কখনও। শীতের সময় নীচের দিকে ছাউনিতে চলে যাই। যে সব লোক পূর্বপুরুষের বাঁধা সেতুকে ভেঙে ফেলতে চাইছে তাদের মধ্যে কেন যাব! পূর্বপুরুষের মুখনি:সৃত বাণীও আমি এতদিন গোপন রেখেছিলাম, এখনও যার শিখবার দরকার, সে-ই আমার কাছে চলে আসে। কিন্তু সেইসব বাণী অমান্য করে চলবার লোক বেড়েই চলেছে। এখন শুনতে পাচ্ছি মাদ্র-পরশুদের খেতে থেকেও পেট ভরছে না। এখন এরা বক্ষুবাসীদের আহার পরিধান বয়ে নিয়ে কোথায় দিয়ে আসছে, আর তার জায়গায় কি পাওয়া যাচ্ছে?—দ্যাখ একটা ঘোড়ার বিনিময়ে কেনা এই কড়াই। ক্ষুধায় মরতে থাকলে কি এই কড়াইতে পেট ভরবে? এখন পেটের আহার এবং দেহের পোষাকের বদলে তাদের ঘরে ঘরে দেখতে পাবে এইসব কড়াই।’’

‘‘এ ছাড়া আর একটা কথা শুনেছি দাদু, নিম্নমাদ্রদের স্ত্রীলোকেরা না-কি কানে এবং গলায় হলদে আর সাদা গয়না পরতে শুরু করেছে। একটা কানের গহনার দাম না-কি একটা ঘোড়া, ওগুলো তামা নয়, সোনা বলে, আর সাদা-সাদা গুলোকে বলে রুপো।’’

‘‘কেউ মার দেয় না এইসব অধর্মীদের! সারা বক্ষুজনমণ্ডলের সর্বনাশ করে ছাড়বে! আমাদের স্ত্রীরাও ওদের দেখাদেখি দুই ঘোড়ার বিনিময়ে কর্ণকুণ্ডল পড়বে। হে দয়ালু অগ্নি! আর বেশীদিন আমাকে মানুষের মধ্যে রেখনা, পিতৃলোকে নিয়ে চল আমাকে।’’

‘‘আরও একটা গুরুতর পাপ রয়েছে দাদু! নিম্নমাদ্র আর পরশুরা কোনখান থেকে মানুষ ধরে ‍নিয়ে আসে, আর তাদের দিয়ে তামার খাঁড়া, কুড়ুল তৈরী করায়। এরা অত্যান্ত দক্ষ শিল্পী দাদু। কিন্তু নিম্নমাদ্র আর পরশুরা এদের যখন খুশি পশুর মতো বেচে দেয়, আবার দরকার মতো নিজেদের কাছে রাখে। ক্ষেতের কাজ, কম্বল বোনার কাজ, আরও অন্যান্য নানা রকমের কাজ এইসব ধরে আনা লোকদের দিয়ে করায়। এদের দাস বলা হয়।’’

‘‘মানুষ কেনা-বেচা! কিন্তু আমরা তো খাবার, পোষাক বেচাও অন্যায় মনে করতাম। আমাদের পূর্বপুরুষরা ভাবতেও পারেনি, যে এই মাদ্র কলঙ্ক এত দূর নীচে নেমে যাবে। আঙ্গুলে ‍যদি পচ ধরে তো তার ওষুধ হল তাকে কেটে ফেলা; না হলে সমস্ত শরীরটাই পচে যাবে। এই মাদ্র-পরশুদের বক্ষুতটে থাকতে দেওয়া পাপ বাছা। আমি আর বেশীদিন এ সব দেখবার জন্যে বেঁচে থাকব না।’’

মাদ্র দাদুর কথাবার্তা বড়ই মনোরঞ্জক ছিল, কিন্তু পুরুহুতের এও বোঝবার ক্ষমতা ছিল যে নতুন হাতিয়ার সৃষ্ট হয়েছে,তাকে ত্যাগ করে মানব এবং পশুর শত্রুতার মাঝে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। তৃতীয় দিনে যখন পুরুহুত বিদায় নিতে গেলে তখন বৃদ্ধ তার ললাট এবং ভ্রু চুম্বন করে তাকে আর্শীবাদ করল। রোচনা বহুদূর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল তাকে এবং বিদায়ের মুহুতের্  একে অপরের দুই গণ্ডকে অশ্রুসিক্ত করে দিল।

মাদ্র দাদুর কথাই সত্য প্রমাণিত হল, যদিও তা পঁচিশ বছর পর। নিম্নমাদ্র এবং পরশুরা দিনের পর দিন ওপরের বাসিন্দা পুরু আর উত্তর মাদ্রদের দাবিয়েই চলল। এই ওপরের বাসিন্দা জনগণের মধ্যে কাপড়, কম্বল-বোনা স্ত্রী-পুরুষ সবাই স্বাধীন; এদের খাওয়া পরায় বেশী খরচ লাগে, এবং তার ফলে তাদের হাতে বোনা দ্রব্য সুক্ষ্ম হলেও বেশী দামের হয়, কিন্তু নিচের মাদ্র আর পরশুদের কাছে ক্রীতদাস; যাদের তৈরী জিনিস ভালো না হলেও দামে সস্তা। সেখানকার ব্যবসায়ীরা যখন এইসব জিনিস উট অথবা ঘোড়ার পিঠে বোঝাই করে দেশে দেশে নিয়ে যেত, তখন সেগুলো যথেষ্ট বিক্রী হত। ওপরের বাসিন্দাদের কাছেও এখন তামার জিনিস অধিকতার সংখ্যায় প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। একে তো ওগুলো বছর বছরই সস্তা হয়ে পড়ছিল, দ্বিতীয়ত মাটি-কাঠের জিনিস থেকে ওগুলা দীর্ঘস্থায়ী। পঁচিশ বছর আগে যেখানে তামার কড়াই ব্যবহৃত হয় না। সোনা-রুপার ব্যবহারও অনেক বেড়েছে। আর এই সবের বিনিময়ে জনসাধারণকে তার আহার্য, কম্বল, চামড়া, ঘোড়া অথবা গরু বেচতে হচ্ছে, ফলে তাদের অবস্থা ক্রমেই খারাপ হয়ে পড়ছিল। ওপরের বাসিন্দা কিছু লোক নিজেরাই ব্যবসা করার চেষ্টা করছিল, কেননা তাদের সন্দেহ হচ্ছিল যে, নীচের পড়শীরা তাদের ঠকিয়ে নিচ্ছে, কিন্তু বক্ষুর নীচে যাবার রাস্তা নীচের অধিবাসীদের আবাসভুমির ভিতর দিয়েই গিয়েছে এবং তারা এ রাস্তার যাতায়াত করতে দিতে চায়নি। এই নিয়ে ছোটো-খাটো ঝগড়াও হয়ে গেছে। অনেক বারই উত্তর-মাদ্র এবং পুরুরা বাইরের দেশসমুহে যাবার অন্য রাস্তা বের করতে চেয়েছে, কিন্ত ‍তাতে তারা সফল হয়নি। ওপরের আর নীচের উপত্যকার মধ্যে এই সংঘর্ষে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল যে, নীচের লোকেরা নিজেদের মধ্যে প্রয়োজনীয় একতা বজায় পারতা না; ওপরের অধিবাসীরা একতাবদ্ধ হয়ে আক্রমণ, প্রতি আক্রমণ চালাতে পারত। এইসব যুদ্ধে আপর বীরত্ব এবং বুদ্ধিমত্তার জন্যে পুরুহুত নিজ গোষ্ঠীর প্রিয়পাত্র ছিল, আর মাত্র ত্রিশ বছর বয়সেই সে পুরু-গোষ্ঠী কর্তৃক গোষ্ঠী-নেতা নির্বাচিত হয়েছিল। পুরহুত পরিষ্কার বুঝেছিল যে, নিম্ন মাদ্রদের এই অন্যায় ব্যবসা যদি বন্ধ না করা যায় তো উপরবাসীদের কোনো কিছুই আশা নেই আর। তামার ব্যবহার কমে যাবার বদলে দিন দিন বেড়েই চলেছিল। হাতিয়ার, বাসনপত্র বা গয়নাতেই শুধু নয়, লোকে এখন বিনিময়ের কাজেও মাংস বা কম্বল বয়ে নিয়ে যাবার বদলে তামার তলোয়ার বা ছুরি নিয়ে যাওয়াই বেশী পছন্দ করছে। নিজ গোষ্ঠীর বৈঠকে পুরুহুত তাদের দুঃখের কারণ বিশ্লেষণ করে দেখাল যে, তার মূলে রয়েছে নিম্ন মাদ্রদের অন্যায় ব্যবসা। সকলেই এ বিষয়ে একমত হল যে, পথের কাঁটা মাদ্রদের সরিয়ে না দিলে তাদের হাতে খেলার পুতুল হয়ে খাকতে হবে। হয়ত বা এমন দিন আসবে যখন তাদের পরশু ও নিম্নমাদ্রদের দাসে পরিণত হতে হবে—পুরু এবং উত্তর মাদ্রের নেতৃবৃন্দের মিলিত বৈঠক এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হল। দুই গোষ্ঠী সম্মিলত হয়ে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য পুরুহতকে সম্মিলিত বাহিনীর সেনাপতি নির্বাচিত করল এবং তাকে ইন্দ্র উপাধীতে ভূষিত করল।  এইভাবে পুরুহুতই প্রথম ইন্দ্র হল। প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে পুরুহুত সেনাবাহিনী গঠন করতে লাগল। ইন্দ্র হয়েই সে অস্ত্র নির্মান-ব্যবস্থায়র জন্য দু‘জন দাস লৌহ-কারিগরকে আপনার আশ্রয়ে এনে রাখল। ওপরের বাসিন্দারা তাদের সঙ্গে খুব ভালভাবে কথাবার্তা বলতে লাগল, আর তাদের সহায়তায় নিজেরা লৌহ-শিল্পী হয়ে উঠল। তাদের প্রতিবেশীরা নিজেদের লোহার দাসদের ফিরিয়ে দেবার কথাই শুধু বলল না, লড়াইও করবে বলল। কিন্তু নীচের অধিবাসীদের মধ্যে ব্যবসায়ের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে যোদ্ধা-সুলভ পরাক্রম কমে এসেছিল। লড়াইতে সফল হতে না পেরে তারা তামা দেওয়া বন্ধ করে দিল। কিন্তু শীগগিরই তারা বুঝতে পারল যে এতে করে তাদের ব্যবসা মাটি হয়ে যাচ্ছে। এদিকে উত্তর মা্দ্র আর পুরুরা আগের কেনা কড়াই এবং অন্যান্য বাসনপত্র থেকে নিজেদের প্রয়োজনীয় অন্য এক পুরুষ ধরে সরবরাহ করতে সক্ষম ছিল।

অবশেষে ইন্দ্র এবং তার দুই গোষ্ঠী, নিম্নমাদ্র ও পুরশুদের ধ্বংশ করার সংকল্প গ্রহণ করল, পুরুহুত স্বয়ং লৌহকারের কাজ শিখেছিল, এবং তার উপদেশ মতো খড়্গ, ভল্ল এবং বাণ-ফলকের কিছুটা উন্নতি হয়েছিল। বলিষ্ঠ এবং কুশলী যোদ্ধাদের শত্রুর আঘাত থেকে রক্ষা করবার জন্য বহু তামার ঢাল তৈরী করিয়েছিল। ইন্দ্র ঠিক করল যে, প্রথমে শুধু এক শত্রুকে আত্রমণ করা হবে, আর সেই আক্রমণের লক্ষ্য হিসেবে পরশুদেরই বেছে নিল সে!শীতের দিনে পরশুরা অধিক সংক্যায় ব্যবসা উপলক্ষে বাইরে চলে যেত। ইন্দ্র এই সময়টাকেই সবচেয়ে সুবিধাজনক মনে করল। উত্তর মাদ্র এবং পুরুগণ যোদ্ধাবৃন্দকে রণকৌশল শেখাল। যদিও পরশু আর উত্তর মাদ্রদের সঙ্গে শত্রুতা বহুদিন ধরেই চলে আসছিল, কিন্তু তারা বুঝতেই পারেনি যে এমন আচম্‌কা তাদের ওপর শত্রুর এমন এক ভয়ঙ্কর আক্রমণ আরম্ভ হবে যে বক্ষু উপত্যকা থেকে তাদের নাম পর্যন্ত মুছে যাবে। ইন্দ্র স্বয়ং তার নেতৃত্বে বাছাই করা উত্তর মাদ্র আর পুরু যোদ্ধাদের নিয়ে আক্রমণ করল।

যুদ্ধের উদ্দেশ্য বুঝতে পরশুদের দেরী হল না, এবং বুঝবার পর তারা প্রাণপণ বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করল। কিন্তু সেই দ্রুত আক্রমণের মুখে তার সমস্ত পরশু গ্রাম একসঙ্গে যুদ্ধ করতে সক্ষম হল না। ইন্দ্রের সৈন্যরা একের পর এক গ্রাম অধিকার করে হাজার হাজার পরশুকে হত্যা করল—কাউকেই বন্দী করে রাখল না। এদিকে নিচের মাদ্ররা যখন সঙ্কটকে উপলব্ধি করতে পারল, তখন আর সময় নেই। পরশুদের কয়েকটি মাত্র গ্রাম অবশিষ্ট রয়ে গিয়েছিল। তাদের জন্য কিছু সৈন্য রেখে পুরুহুত কুরু-ভূমি তে চলে এল। নিম্ন মাদ্ররা পাল্টা আক্রমণ করল, কিন্তু তাদেরও পরশুদের দশা হল। নিম্নমাদ্র এবং পরশুদের যে কোনো লোক-শিশু, তরুণ, বৃদ্ধ হাতের কাছে এল তাকেই ওরা মেরে ফেলল। স্ত্রীলোকদের আপন স্ত্রীদের সঙ্গে সামিল করে নিল। অধিকৃত দাসদের মধ্যে যারা নিজ দেশে ফিরে যেতে চাইল,তাদের ফিরে যেতে দেওয়া হল, কিছু নিম্নমাদ্র এবং পরশু স্ত্রী-পুরুষ প্রাণ বাঁচিয়ে বক্ষু-উপত্যকা ছেড়ে পশ্চিমের দিকে চলে যায়। তাদের বংশধরেরাই পরে পরশু(পাসিয়ান) এবং মাদ্র (মিতিয়ান) নামে প্রসিদ্ধ হয়েছে। এদের পূর্বপুরুষদের ওপর ইন্দ্রের নেতৃত্বে যে অত্যাচার হয়েছিল, তা এরা ভুলতে পারেনি। এই জন্য ইরানীরা ইন্দ্রকে তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু বলে মনে করে। সমগ্র বক্ষু উপত্যকা উত্তর মাদ্র ও পুরুদের হাতে এসেছিল। বক্ষুর দক্ষিণ এবং বাম তট আপেোষে ভাগ করে নিল এই দুই দল।বক্ষুবাসীগণ প্রাণপনে চেষ্টা করছিল নতুনকে সরিয়ে পুরনো ব্যবস্থা পুন:স্থাপন করবার, কিন্তু এরা তামা ছেড়ে পাথরের হাতিয়ারের প্রত্যাবর্তন ঘটাতে পারেনি। তামার জন্য বক্ষুর পাহাড়ী উপত্যকার বাইরে ব্যবসা বিস্তার করা একান্ত প্রয়োজনীয় ছিল—বিজয়ী পুরু এবং উত্তর মাদ্রদের। কিন্তু দাসত্বকে তারা কখনোই মেনে নেয়নি, এবঅং বাইরের লোককে কখনও বক্ষু উপত্যকায় স্থায়ী অধিবাসী হয়ে দেয়নি। বহু শতাব্দী পরে যখন ইন্দ্র পুরুহুতকেও লোকে ভুলতে আরম্ভ করল অথবা তাকে দেবতার রুপে কল্পনা করতে লাগল, তখন এতটা বংশবৃদ্ধি হয়ে গেছে যে সকলের ভরণ-পোষণ করতে আর বক্ষু উপত্যকা সক্ষম নয়। এ জন্য তার বহু অধিবাসীকেই বাধ্য হয়ে দক্ষিণের দিকে চলে যেতে হল।

আগে এক গোষ্ঠী অপরের থেকে স্বতন্ত্র হয়ে থাকত, মহাপিতরের প্রাধাণ্য থাকলেও তার সব কিছুই জনতার ওপর নির্ভর করত। কিন্তু বক্ষুতটের শেষ-সংঘর্ষ একাধিক গোষ্ঠীর এক সেনাপতি ইন্দ্রকে জন্ম দিয়েছিল।’’

০৫. পুরুধান (দেশ : উপরিস্বাত ।। কাল : ২০০০ খৃষ্টপূর্ব)

সুবাস্তর বাঁদিকে সবুজে ঢাকা পর্বতমালা, পাহাড় থেকে আছড়ে-পড়া ঝর্ণার ধার, আর দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে আন্দোলিত গমের ক্ষেতে সুশোভিত এই অঞ্চল গড়ে উঠেছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতিচ্ছবি হয়ে। কিন্তু এই অঞ্চলের আর্যভাষীদের সবচেয়ে বেশি গর্ব ছিল পাথরের দেওয়াল ও পাইন শাখার আচ্ছাদিত গৃহচূড়া নির্মিত নিজেদের বাসস্থান সম্পর্কে। আর এই জন্যই এই প্রদেশের নামও তারা দিয়েছিল সুবাস্তু, অর্থাৎ স্বাতসুন্দর গৃহসজ্জিত প্রদেশ। বক্ষুতট পরিত্যাগ করে আর্যভাষীগণ পারমীর ও হিন্দুকুশের দুর্গমগিরিপথ এবং কুনার ও পঞ্জ-কোরার নদী অতিক্রম করে এসেছিল। অতীতের সেই স্মৃতি সম্ভবত অনেক দিন অম্লান ছিল। মঙ্গলপুরের (মঙ্গলোরের) ইন্দ্র উৎসব হচ্ছে আজ। উৎসবের এই বিরাট প্রস্তুতির কারণও বোধহয় ইন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞান– কারণ আপন ইন্দ্রের পরিচালনায় দুর্গম পার্বত্যপথ তারা একদিন নিরাপদেই অতিক্রম করেছিল।
মঙ্গলপুরের পুরুরা তাদের সুন্দর ঘরগুলি পাইন শাখায় ও রঙ বেরঙের পতাকায় সাজিয়েছিল। পুরুধান তার ঘর সাজাচ্ছিল এক বিশেষ ধরনের রক্ত পতাকা দিয়ে। তা দেখে প্রতিবেশী সুমেধ বলল। ‘‘মিত্র পুরু। তোমার পতাকাগুলো বেশ হালকা ও চিকন দেখছি। আমাদের এখানে তো এ রকম কাপড় বোনা হয় না, এতে বোধহয় অন্য কোনো ধরনের ভেড়ার লোম ব্যবহার করা হয়েছে?’’
‘‘না, এ-তো কোনো ভেড়ার লোমে বোনা হয়নি সুমেধ!’’
‘‘তা’হলে?’’
‘‘এ এক রকমের পশম— গাছে জন্মায়। আমরা ভেড়ার গা থেকে পশম নিয়ে কাপড় বুনি, আর এই পশম জন্মায় জঙ্গলের গাছে।’’
‘‘এ রকম শোনা যায় বটে কিন্তু নিজের চোখে এ ধরনের গাছ কখনও দেখিনি।’’
উরুর ওপর তকলী ঘষে সেটা ঘুরিয়ে দিয়ে ভেড়ার লোমের ফেটি লাগাতে লাগাতে সুমেধ বলল, ‘‘কী ভাগ্যবান তারা, যাদের গাছে এই পশম জন্মায়। আচ্ছা, আমাদের এখানে ওই গাছ লাগানো যায় না?’’
‘‘তা বলতে পারি না। কতটা শীত-তাপ সে গাছ সহ্য করতে পারে তাও জানি না। কিন্তু সুমেধ। মাংস তো আর গাছে জন্মাতে পারে না।’’
‘‘কোনো দেশে যদি গাছে পশম জন্মাতে পারে— কে জানে হয়ত এমন দেশও আছে যেখানে গাছেই খাবার মাংস পাওয়া যায়। যাক্, এ কাপড়ের দাম কত?’’
‘‘পশমী কাপড়ের চেয়ে অনেক কম, তবে টেকে না বেশীদিন।’’
‘‘কোথায় খরিদ করলে?’’
‘‘অসুরদের কাছ থেকে। এখান থেকে প্রায় পঞ্চাশ ক্রোশ দূরে তাদের দেশ, সেখানকার লোকেরা গাছের পশমের কাপড় পরে।’’
‘‘এত সস্তা যখন, তখন আমরাই বা পরি না কেন?’’
‘‘ওই কাপড়ে শীত কাটে না।’’
‘‘তবে অসুররা পরে কি করে?’’
‘‘ওদের দেশে ঠাণ্ডা কম, বরফ পড়েই না।’’
‘‘আচ্ছা পুরু, তুমি কেবল দক্ষিণ দিকেই ব্যবসা করতে যাও কেন?’’
‘‘লাভ বেশী হয়— সেই জন্যেই! আর বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্রও পাওয়া যায়। তবে খুব কষ্টও হয়। ওদিকে গরম প্রচণ্ড, একটু ঠাণ্ডা জলের জন্য প্রাণ ছটফট করে।’’
‘‘ওখানকার লোকেরা সব কেমন পুরুধান?’’
‘‘লোকগুলো বেঁটে বেঁটে, রঙ তামাটে। বড়ই কুৎসিত। আর নাক আছে কি নেই সেটা বোঝা যায় না— খুব চেপ্টা ও ভোঁতা। আর সবচেয়ে খারাপ হল যে, সেখানে মানুষ কেনা-বেচা চলে।’’
‘‘কি বললে? মানুষ কেনা-বেচা!’’
‘‘হ্যাঁ, ওরা এই ব্যবসাকে বলে দাস-ব্যবসা।’’
‘‘দাস ও তাদের প্রভুদের মধ্যে কি চেহারার কোনো পার্থক্য আছে?’’
‘‘না। তবে দাসরা খুব গরিব ও পরাধীন— দেহ-মন সবই প্রভুদের অধীনে।’’
‘‘ইন্দ্র রক্ষা করুন, এমন লোকের মুখ যেন দেখতে না হয়।’’
‘‘মিত্র সুমেধ! তোমার তকলী তো ঘুরছেই— যজ্ঞে যাবে না?’’
‘‘যাব না কেন! ইন্দ্রের দয়াতেই তো আমরা নধর পশু আর মধুর সোমরস পাচ্ছি। এমন কোন হতভাগা আছে যে এই ইন্দ্রপূজায় মিলিত হবে না?’’
‘‘তোমার বউটির খবর কি? তাকে তো আজকাল দেখা-ই যায় না!’’
‘‘কেন, তুমি তার প্রেমে মজেছ না-কি, পুরুধান?’’
‘‘মজবার কথা হচ্ছে না। তুমি তো জেনেশুনেই বুড়ো বয়সে তরুণীর সঙ্গে প্রণয়ের জিদ ধরেছিলে!’’
‘‘পঞ্চাশে লোক বুড়ো হয় না।’’
‘‘কিন্তু পঞ্চাশ আর বিশ বছর বয়সের পার্থক্য কত, জান?’’
‘‘বেশ তো, সে তা’হলে তখনই আমাকে প্রত্যাখ্যান করলেই পারত!’’
‘‘তুমি তখন গোঁফ-দাড়ি মুড়িয়ে চেহারা করেছিলে যেন আঠারো বছরের ছোকরা! আর ঊষার মা-বাপের নজর ছিল তোমার পালিত পশুদের ওপর।’’
‘‘এ সব কথা বন্ধ কর পুরু। তোমরা ছেলেছোকরা তো খালি…।’’
‘‘বেশ, এ সব কথা না হয় বলব না। ওদিকে কিন্তু বাজনা আরম্ভ হয়ে গেছে— উৎসব এ বার শুরু হবে।’’
‘‘দিলে তো এখানে দেরি করিয়ে— বেচারা সুমেধ এখন গাল খাক আর কি।’’
‘‘বেশ তো চল, ঊষাকেও সঙ্গে নেওয়া যাক্।’’
‘‘সে কি এখনো বাড়ি বসে আছে না-কি।’’
‘‘যাক্, এই পশম আর তকলীটা রেখে চল এখন।’’
‘‘আরে, এগুলো সঙ্গে থাকলে যজ্ঞের কিছু অঙ্গহানি হবে না।’’
‘‘এই জন্যেই তো ঊষা তোমায় পছন্দ করে না।’’
‘‘পছন্দ ঠিকই করে— অবশ্য তোমরা মঙ্গলপুরের তরুণরা যদি তাকে পছন্দ করতে না দাও— তা’হলে আমার আর দোষ কি?’’
কথা বলতে বলতে দুই সঙ্গী শহরের সীমা ছাড়িয়ে এগুতে লাগল যজ্ঞ-বেদির দিকে। পথে যে কোনো যুবক বা যুবতীর সঙ্গে পুরুধানের চোখাচোখি হয়— সেই মুচকি হেসে চলে যায় ; পুরুধানও চোখ ঠেরে মাথা ঘুরিয়ে নেয়। এই অবস্থায় একজন তরুণকে সুমেধ পাকড়াও করে বকে উঠল, ‘‘এই তরুণরাই হচ্ছে মঙ্গলপুরের কলঙ্ক।’’
‘‘কি ব্যাপার, মিত্র !’’
‘‘মিত্র-টিত্র নয়, ওরা আমাকে দেখে হাসছে।’’
‘‘আরে, বন্ধু, ও তো বদমাস— তুমিও সেটা জান। ওর কথা ভাবছ কেন?’’
‘‘আমি তো মঙ্গলপুরের কাউকে ভালো দেখি না।’’
যজ্ঞ-বেদির পাশে বিস্তৃত ময়দান—তাতে এখানে-ওখানে মঞ্চ এবং পাইন পাতায় সজ্জিত তোরণ প্রস্তুত হয়েছিল অতিথিদের স্বাগত জানাবার জন্য। গ্রামের বহুসংখ্যক স্ত্রী-পুরুষ বেদির চতুর্দিকে জমায়েত হয়েছিল কিন্তু আসল বড় সমাবেশটা সন্ধ্যার পরই হওয়ার কথা, তখন সারা পুরু-জনের স্ত্রী পুরুষ এই উৎসবে যোগ দেবে— স্বাত নদীর অপর পারের মাদ্র-জনের স্ত্রী-পুরুষেরাও আসবে।
ঊষা দুই বন্ধুকে আসতে দেখে তাড়াতাড়ি তাদের কাছে গিয়ে সুমেধের হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে তরুণী প্রেমিকার মতো চটুল ভঙ্গীতে বলল, ‘‘প্রিয় সুমেধ। সারা সকাল তোমায় খুঁজে খুঁজে আমি প্রায় শেষ হয়ে গেলাম, তবু তোমার পাত্তাই নেই।’’
‘‘কেন, আমি কি মরে ভূত হয়েছিলাম!’’
‘‘এমন কথা মুখে এনো না। বেঁচে থেকে আমাকে বিধবা বানিয়ো না।’’
‘‘পুরু-জনের বিধবাদের ভাবনা কি, দেবরের অভাব নেই।’’
‘‘কেন, সধবাদের কাছে দেবররা কি বিষতুল্য?’’—পুরুধান প্রশ্ন করল।
সুমেধ বলল, ‘‘ঠিক বলেছ পুরু। ও আমাকে শেখাতে এসেছে। নিজে কোন ভোরে বেরিয়েছে—না জানি এর মধ্যে কত ঘর ঘুরে এসেছে। সন্ধ্যার পর এ বলবে আমার সঙ্গে নাচ, ও বলবে— না আমার সঙ্গে। এই নিয়ে বেধে যাবে ঝগড়া, রক্তারক্তি। আর এই বঊ-এর জন্যে বদনাম হবে বেচারা সুমেধের।’’
ঊষা সুমেধের হাত ছেড়ে দিয়ে চাউনি ও কন্ঠের স্বর বদলে চিৎকার করে বলল, ‘‘তুমি কি আমাকে বাক্সে বন্ধ করে রাখতে চাও না-কি? যাও না— রান্না ভাঁড়ারের ভার নাও গে, আমিও নিজের পথ দেখে নিই।’’ যাবার সময় পুরুধানকে একান্তে মুচকি হাসির ইসারা দিয়ে বেদি সংলগ্ন ভিড়ের মধ্যে ঊষা হারিয়ে গেল।

বছরে একটা বিশেষ দিন বলে এই দিনটা গণ্য হত। বক্ষু তটে (অক্সাসের তীরে) স্বাত উপত্যকায় অতীতের পুরু-জনের প্রথা অনুসারে পশুপালের সেরা ঘোড়াটি বলি দেওয়া হত। সারা স্বাত উপত্যকায় এই সময় ঘোড়া খাওয়ার রেওয়াজ ছিল না—তবু ইন্দ্রপূজার বলি হিসাবে সকলেই ভক্তিভরে প্রসাদ নিত। জনের মহাপিতর—যাকে এখানে জনপতি বলা হয়—আজ আপন জনপরিষদের সঙ্গে সঙ্গে ইন্দ্রপূজার প্রিয় অশ্বমেধ যজ্ঞে যোগ দিত। এই বলিদানের সব বিধি-বিধান প্রত্যেকেরই জানা। বক্ষু উপত্যকায় অধিবাসীরা যে মন্ত্র পড়ে ঘোড়া ইন্দ্রের নামে উৎসর্গ করত— তা তাদের সবটাই মুখস্থ ছিল। বাদ্য ও মন্ত্রস্তুতির সঙ্গে অশ্বকে স্পর্শ করে এবং প্রক্ষালন থেকে বলি পর্যন্ত সমস্ত ক্রিয়া সম্পন্ন হল। তারপরে ঘোড়াটির চামড়া ছাড়িয়ে তার দেহ খণ্ড খণ্ড করে কাটা হল— পরে কয়েক খণ্ড মাংসে মশলা মাখিয়ে আহুতি হিসাবে আগুনের মধ্যে দেওয়া হল।
যজ্ঞের বলি, প্রসাদ বিতরণ করতে করতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। ইতিমধ্যে যজ্ঞভূমি নর-নারীতে ভরে গেছে। এই দিন সকলেই আপন আপন শ্রেষ্ঠ বসন-ভূষণে সজ্জিত হয়ে এসেছে। মেয়েদের দেহে ছিল সূক্ষ্ম রঙিন কম্বল—কোমরের কাছে বাঁধা কারুকার্যখচিত নানা রঙের কোমরবন্ধনী, আর নীচে সুন্দর লোমবস্ত্রের আবরণ। প্রায় প্রত্যেকের কানেই সোনার কুণ্ডল। বসন্ত শেষ হয়ে আসছে—সারা উপত্যকায় ফুল যেন আজকের দিনটিকে লক্ষ্য করে বিকশিত হয়েছে। আজকের রাত নর-নারীর স্বচ্ছন্দ বিহারের রাত—ইচ্ছামতো প্রণয় ও কামনা-ভোগের রাত। রাত্রে যখন উৎসবের সজ্জায় সুসজ্জিতা ঊষা পুরুধানের হাতে হাত মিলিয়ে ঘুরছিল তখন সুমেধের নজরে পড়ল, কিন্তু কি বা করতে পারে সে— হতাশ ভঙ্গীতে মুখ ঘুরিয়ে নিল। ইন্দ্রের উৎসবের দিনে নর-নারীর যথেচ্ছ মিলনে রাগ করার পর্যন্ত অধিকার কারুর নেই।
রাতে মধু ও ভাঙ-এর নদী বয়ে যাচ্ছিল। সারা গাঁয়ের মানুষ জড়ো করেছে, ভোগ দেওয়ার জন্য সুস্বাদু গোমাংস আর সোমরস। সর্বত্রই অভিনব প্রেমের মাদকতাপূর্ণ জড়ানো কন্ঠের সম্ভাষণ আর যুগ্ম তরুণ-তরুণীর পদচারন নজরে পড়ছে। এক টুকরো মাংস মুখে পুরে এক পেয়ালা সোমরসে গলা ভিজিয়ে নিচ্ছে। বাজনা বেজে উঠছে—আর বাজনার তালে তালে নাচছে তারা। শ্রান্ত হলে বিশ্রামের পর অপর গ্রামের আগন্তুকদের গিয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। সারা গোষ্ঠীর লোকদের উদ্যোগে উৎসবের আয়োজনও বিরাট—আর নাচের জন্য আসরও ছিল বিস্তৃত। ইন্দ্র উৎসব ছিল যুবজনের মহোৎসব। এদিন তাদের কোনো কিছু করতেই বাধা-নিষেধ ছিল না।

২.

উপরি-স্বাতের এই অংশ পশু এবং শস্যসম্ভারে পরিপূৰ্ণ – এখানকার লোকেরা সুখী এবং সমৃদ্ধ । এদের যে সব জিনিসের অভাব সোনা-রূপা ও কয়েকটি রত্ন যার অভাব দিন-দিনই বেড়ে চলেছে। এইসব জিনিসের জন্য স্বাত এবং কুভা (কাবুল) নদীর সঙ্গমস্থলে অসুর-নগর রয়েছে। মনে হয়, এই আর্যভাষীরা অসুর-নগরকে পুষ্কলাবতী (=চরসদদা) নামে ডাকে আর আমরাও এখানে এই নামকে স্বীকার করে নিচ্ছি। শীতের মাঝামাঝি —স্বাত, পঞ্জকোরা, এবং অন্যান্য উপত্যকাবাসী পাহাড়ী গোষ্ঠীসমূহ, যথা পুরু, কুরু, গান্ধার, মাদ্র, মল্ল, শিবি, উশীনার ইত্যাদি – নিজ নিজ ঘোড়া, কম্বল এবং অপরাপর বস্তু নিয়ে পুষ্কলবতীর বহির্ভাগে অবস্থিত ময়দানে ডেরা (তাঁবু) বেঁধে বসত। বহু শতা্ব্দী ধরে এই নিয়ম ভালোভাবেই চলে আসছিল, এ বছর পুরুদের যে সার্থ (ক্যারাভান) বা বণিকদল পুষ্কলাবতী গেল তাদের নেতা ছিল পুরুধান।  এদিকে কয়েক বছর থেকে পাহাড়ীদের ধারণা হচ্ছিল যে, অসুররা ভয়ানক ঠকাচ্ছে। অসুর নাগরিকেরা এই পাহাড়িদের চেয়ে বেশি চতুর, এ বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই। তবে নীল চোখ বিশিষ্ট আর্যভাষী ঘোড়সওয়ার কখনই নিজেকে অসুর নাগরিকদের চেয়ে হীন বলে মানতে রাজী ছিল না। ধীরে ধীরে যখন আর্যভাষীদের মধ্যে থেকে পুরুত্থানের মতো বহু লোক অসুরদের ভাষা বুঝতে শিখল এবং তাদের সমাজে চলাফেরা করবার সুযোগ পেল। তখন জানল, অসুররা আর্যভাষীদের পশু-মানব বলে মনে করে।

অসুরদের নগরগুলি সুন্দর, সেখানে পাঁকা ইটের বাড়ি, স্নানাগান, সড়ক ইত্যাদি তৈরী হত। আর্যভাষীরাও পুষ্কলাবতীর সৌন্দর্যকে অস্বীকার করত না। অসুর তরুণীর নাক, কেশ ও উচ্চতা পছন্দ মতো না হলেও তাদের সৌন্দর্যকে তারা মানতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু এ কথা তারা কখনোই স্বীকার করত না যে, দেবদারু-সমাচ্ছাদিত পর্ত-মেখলার মাঝে অবস্থিত চিত্র-বিচিত্র কাঠের অট্টালিকা যুক্ত মঙ্গলপুরের সুসজ্জিত স্বচ্ছগৃহপংক্তি থেকে কোনো অংশে হীন। পুষ্কলাবতীতে এক মাস কাটানোও তাদের পক্ষে মুশকিল হত, এবং বারবার আপনি জন্মভূমির কথা স্মরণে আসত। যদিও ওই স্বাত নদী পুষ্কলাবতীর ধারা দিয়েও বয়ে চলেছে, কিন্তু তারা দেখত নদীর জলে সেই স্বাদ নেই। তাদের বক্তব্য ছিল, অসুরদের স্পর্শে এই পবিত্ৰ জল কলুষিত হয়ে গেছে। সে যাই হোক না কেন, আর্যভাষীরা কোনো রকমেই অসুরদের আপনি সমকক্ষ বলে মানতে রাজী ছিল না। বিশেষ করে যখন তারা হাজার হাজার দাস-দাসী এবং ঘরে বসে আপন দেহ বিক্রয়কারিণী বেশ্যাদের দেখত। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আর্ভাষীদের অসুরদের মধ্যে অসুরদের আর্যভাষীদের মধ্যে বহু মিত্র ছিল। অসুরগণের রাজা পুষ্কলাবতী থেকে কিছু দূরে সিন্ধুতটের পার্শ্ববর্তী কোনো নগরে বাস করত। এ জন্য পুরুধান তাকে কোনোদিন চোখে দেখেনি। হ্যা, রাজার স্থানীয় অমাত্যকে দেখেছিল সে – বেঁটে, মোটা আর অত্যন্ত অলস, সুরার প্রভাবে তার চোখের পাতা সর্বদাই বুজে থাকত। সারা দেহে বহুবিধ সোনা-রূপার অলংকারে সজ্জিত এই  রাজকর্মচারীটি পুরুধানের চোখে কুরূপতা এবং বুদ্ধিহীনতার প্রতীক বলে মনে হত। যে রাজ্যের এমন প্রতিনিধি তার প্রতি পুরুধানের মতো লোকের উঁচু ধারণা থাকতে পারে না। পুরুধান শুনেছিল যে, সে অসুররাজের শালা এবং এই একটি মাত্র গুণের জোরে সে এই পদে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছে।

কয়েক বছরের সাময়িক সংস্পর্শ হেতু অসুররাজের ভিতরকার বহু দুর্বলতা পুরুত্থানের চোখে ধরা পড়ে। উচ্চশ্রেণীর অসুররা আপন অধীনস্থ ভট্ট এবং দাসদের শক্তির জোরে শত্রুর সঙ্গে বোঝাপড়া করতে চায়। দুর্বল শক্রকে জয় করতে এরা ভালোভাবেই সফল হয়, কিন্তু বলবান শক্রুর সামনে লড়তেই পারে না। অসুরদের শাসক, রাজা, সামন্ত ভোগ বিলাসকেই জীবনের একমাত্ৰ উদ্দেশ্য বলে মনে করত। প্রত্যেক সামন্তরেই শত শত স্ত্রী এবং দাসী থাকত। স্ত্রীদের তারা দাসীর মতো করেই রাখত। হালে কিছু পাহাড়ী স্ত্রীকেও বলপূর্বক অসুররাজা আপন অন্তপূরে এনে রেখেছিল। এর ফলে আর্যভাষী জনের ভিতরে প্রবল উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু অসুবিধা এই ছিল যে, অসুররাজের রাজধানী সীমান্ত থেকে বহুদূরে, আর্যভাষী-জনের পক্ষে সেখানে উপস্থিত হওয়া মুখের কথা নয়। তাই আর্যভাষী রমণীদের অসুরদের নিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে আর্যভাষী জনেরা কিংবদন্তী বলেই মনে করত।পুষ্কলাবতীর রাজার কাছ থেকে নানাপ্রকার অলঙ্কার, কার্পাস-বস্ত্র, অস্ত্র-শস্ত্র এবং অপরাপর দ্রব্যসম্ভার, সুব্যস্ত কুনারের উপরিভাগে কাঠার ছাউনিতে পৌছাতে আরম্ভ করেছিল। সুবাস্তুর স্বর্ণকেশী আর্যভাষী রমণীরা দক্ষ অসুর শিল্পীদের হাতে গড়া অলঙ্কারে মুগ্ধ হয়ে প্রতি বছর অধিকতর সংখ্যায় পুষ্কলাবতী আসতে আরম্ভ করল।

সুমেধ বেচারা সত্যি সত্যি উষাকে বিধবা বানিয়ে চলে গিয়েছিল, ঊষা এখন তার খুড়তুতো দেবীর পুরুত্থানের পত্নী। এ বছর সেও পুষ্কলাবতীতে এসেছিল। পুষ্কলাবতীর নগরাধিপতির লোকজনেরা আর্যভাষীদেরে তাঁবুর ভিতর বহু সুন্দরী সেই খবর আপন প্রভুর কাছে পৌঁছে দিল। তারা ঠিক করুল, সার্থ যখন ফিরে যেতে থাকবে তখন পাহাড়ে ঢুকতেই হামলা করে তাদের লুট নিয়ে যাবে। যদিও এই কাজ বুদ্ধিহীনতার লক্ষণ, কারণ পীতকেশীরা অত্যন্ত যুদ্ধকুশল – এ খবর তাদেরও জানা ছিল। কিন্তু নগরাধিপতির মগজে বুদ্ধির লেশমাত্র ছিল না। নগরের বড় বড় শেঠ সাহুকারেরা তাকে ঘৃণা করত। যে ব্যাপারীর সঙ্গে পুরুধানের মিত্ৰতা ছিল, তার সুন্দরী কন্যাকে হালে নগরাধিপতি জবরদস্তি করে নিজের ঘরে নিয়ে এসেছিল, এ জন্য সে তার সারা জীবনের শত্রু হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ঊষাও এই অসুর সওদাগরের বাড়ি কয়েকবার গিয়েছে। যদিও ওই সওদাগর পত্নীর একটি কথাও সে বুঝতে পারত না, তবুও পুরুধানের দোভাষীর কাজে এবং শেঠগিন্নীর ব্যবহারে দুই নারীর ভিতর সখিত্ব সুদৃঢ় হয়ে উঠেছিল। বিদায় নেবার দিন দুই আগে সওদাগর তার বড় গ্রাহক পুরুধানকে নিমন্ত্রণে আপ্যায়িত করল। সেই সময় সে পুরুধানের কানে নগরাধিপতির ঘূণ্য মতলবের কথা জানিয়ে দিল।

সমস্ত আর্যভাষী সাৰ্থ নায়ককে ডেকে সারারাত পরামর্শ করল পুরুধান। যাসের হাতে অস্ত্র কম ছিল, তারা নতুন অস্ত্র কিনল। বিক্রি করবার জন্যে আনীত ঘোড়া এবং অন্যান্য ভারী মোট তারা বেচে দিল। শুধু নিজেদের চড়বার ঘোড়া এবং অন্যান্য কেনা জিনিসপত্র, যেমন অলঙ্কার এবং অন্যান্য ধাতব দ্রব্য রেখে কিছুটা হালকা হল। আর্যভাষী রমনীদের মধ্যে অলঙ্কার-প্রতি অত্যন্ত প্রবল ছিল, কিন্তু এই সময় পর্যন্ত তাদের শিক্ষায় নৃত্যগীতের সঙ্গে শস্ত্ৰ-শিক্ষাও চলে আসছিল, এ জন্য সঙ্কটের সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারাও আপন-আপন খড়গ এবং চামড়ার ঢাল তুলে নিল ।

পুরুধানের এ খবর জানা ছিল যে, অসুর সৈন্য সীমান্তের গিরিবর্তে আগে থেকে রাস্তা আটকে আক্রমণ করবে এবং সেই সময় তাদের এক অংশ পিছন থেকেও ঘিরে ফেলতে চাইবে। এ জন্য পুরুধান পুরোদস্তুর তৈরী হয়ে গেল, আর প্রথমেই খবর পাওয়া গেল বলেই এটা সম্ভব হয়েছিল। যদিও শক্রকে জানতে না দেবার জন্য তারা পুঙ্খলাবতী থেকে দু-একদিন আগে পিছে রওনা দিল, কিন্তু ঠিক হল যে অজার (অবাজই) দ্বারে সকলেই এক সঙ্গে পৌঁছাবে। দ্বার যখন ক্রোশ দুই বাকি পুরুধান তখন পাঁচশ জন সওয়ারীকে আগে পাঠাল। যে সময় সওয়ারীরা দ্বারের ভিতরে এগুতে যাচ্ছে ঠিক সেই সময়ে অসুর সৈন্যরা তাদের ওপর বাণ খুঁড়তে আরম্ভ করল। আক্রমণের সংবাদ সত্যে পরিণত হল, সওয়ারীরা পিছু হট আপন সার্থ-নায়কদের সংবাদ দিল। পুরুধান প্রথমে পিছন থেকে এগিয়ে আসা শক্রর সঙ্গে বোঝাপড়া করতে চাইল। এতে সুবিধাও ছিল, কারণ যদিও অসুরেরা প্রতি বছর আর্যভাষীদের কাছ থেকে হাজার হাজার ঘোড়া কিনেছিল বটে কিন্তু তখনো পর্যন্ত সুদক্ষ অশ্বারোহী সৈনিক হয়ে উঠতে পারেনি।

সাৰ্থ রক্ষার জন্য বহুসংখ্যক উটকে সেখানে ছেড়ে বাকি সওয়ারীদের সঙ্গে পেছনের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। অসুর-সেনা প্রত্যাশা করেনি যে, পীতকেশীরা এভাবে পাল্টা মার দেবে। গীতকেশীদের দীর্ঘ বল্লম এবং খড়গের সামনে তারা বেশীক্ষণ দাঁড়াতে পারল না, কিন্তু আর্যরা এদের শুধু পরাজিত করেই ছাড়তে চাইল না। তারা এইসব বোঁচা নাক, কালো অসুরদের বুঝিয়ে দিতে চাইল যে, পীতকেশীদের ওপর নজর দেওয়া কি ভয়ঙ্কর বিপদের কাজ। অসুর-সেনাদের পলায়ন করতে দেখে পুরুধান সার্থকে খবর পাঠাল এবং নিজে ঘোড়সওয়ার নিয়ে পুষ্কলাবতীতে এসে পড়ল। অসুর সেনানীদের মতো তাদের নগরাধিপতিও এমনটি আশা করেনি। অসুরেরা তাদের পূর্ণ শক্তিকে সংগঠিত করবার সুযোগ পেল না এবং সহজেই অসুর-দুর্ এবং নগরাধিপতি, পীতকেশীদের অধিকারে চলে এল।

তারা খুব নিষ্ঠুরভাবে অসুর পুরুষদের বধ করল। আর নগরাধিপতিকে নগরের চৌরাস্তায় এনে অসুর প্রজাদের সামনে তার এক-একটি অঙ্গচ্ছেদ করে হত্যা করল। স্ত্রীলোক, শিশু এবং ব্যাপারীদের তারা মারল না।ওই সময়ে অসুরদের যদি দাস ইচ্ছা থাকত তবে এত অধিকসংখ্যক অসুর নিহত হত না। পুষ্কলাবতীর বহুলাংশ তারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলল। অসুর দুর্গর এই প্রথম পতন ঘটল। অসুর এবং পীতকেশীদের মহান বিগ্রহের, দেবাসুরের সংগ্রাম – এইভাবেই সূত্রপাত হল।

পুরুধান ফিরে এসে অজাগিরিবর্তে অসুর সৈন্যবাহিনীকে নির্মুল করল। তারপর সমগ্ৰ গীতকেশী সাৰ্থ আপনি আপনি জন্ম-ভূমিতে ফিরে গেল। কয়েক বছরের জন্য পুষ্কলাবতীর ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল। গীতকেশীর অসুর-পণ্য নিতে অস্বীকার করুল, কিন্তু তামা, পিতলকে কতদিন দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে?

 ০৬. অঙ্গিরা (স্থান: গান্ধার (তক্ষশিলা) ।। কাল ১৮০০ খৃষ্টপূর্ব)

(১)

“এই সুতি কাপড় একেবারেই অকেজো এতে না আটকায় শীত, না রোখে বর্ষা!” নিজের গা থেকে ভিজে কাপড়টি খুলতে খুলতে যুবকটি বালল।

দ্বিতীয় তরুণটি তার আপন পরিধেয় দরজার কপটে মেলে দিতে দিতে বলল, “কিন্তু যাই বল, গ্রীষ্মকালের পক্ষে এগুলো ভালো”- সন্ধ্যা হতে তভনও দেরি কিন্তু ইতিমধ্যেই অগ্নিকুণ্ডের কিনারায় লোক জুটতে শুরু করেছিল। তরুণদ্বয় ধোঁয়া-ভরা অগ্নিকুণ্ডের পাশে না বসে জানালার ধারে গিয়ে বসল, ঠান্ডা হাওয়া থেকে আত্মরক্ষার জন্যে দুটো কম্বল নিজেদের গায়ে জড়িয়ে নিল।

প্রথম তরুণটি বলল, “আমরা এখনো এক যোজন পথ হাঁটতে পারতাম, তা’হলে কাল ভোরে গান্ধারনগর (তক্ষশিলায়) পৌছতে পারতাম, কিন্তু এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে পথ চলা বড় কষ্টকর।”

দ্বিতীয় তরুণ বলল, “শীতের আগমনকালীন ঋতুর এই পরির্বতন খুবই খারাপ লাগে – এখন বর্ষায় চারিদিক ছেয়ে যাবে। অথচ এই বৃষ্টি না হলে কৃষকেরা ইন্দ্রের কাছে প্রার্থনা করবে — পশুপালকেরা করবে কান্নাকাটি।”

প্রথম জন উত্তর দিল, “মিত্র, ঠিকই বলেছ। একমাত্র আমাদের মতো পথিকরাই এই বৃষ্টি পছন্দ করে না। আর সকলে তো সর্বদা পথে থাকে না!” এমন সময় তার সঙ্গীটির গলায় ক্ষতচিহের প্রতি নজর পড়ায় সে প্রশ্ন করল, “তোমার নাম কি বন্ধু ?”

“পাল মাদ্র। আর তোমার?”
“বরুণ সৌবীর।”
“তাহলে তুমি পূর্বদিক থেকেই আসছ?”
“হ্যাঁ মাদ্রদেশ থেকে। আর তুমি দক্ষিণ থেকে তো? আচ্ছা বন্ধু বল তো আমরা যে শুনেছি অসুররা না-কি এখনো আর্যভাষীদের সঙ্গে লড়াই করছে?”
“একমাত্র সমুদ্রতটে একটি শহরকে কেন্দ্র করে এই লড়াই চলছে। আমাদের মঘবা ইন্দ্র কিভাবে অসুরদের একশ’ নগর দুর্গ ধ্বংস করেছিল – তার কথা কি জান,বন্ধু?”
“শুনেছি, অসুরদের নগর-দুর্গ তাম্র নির্মিত ছিল।”                                                                                                                                                                                                                                         “অসুরদের এত তামা নেই যে তা দিয়ে তারা দুর্গ বানাবে। এই গুজব ছড়িয়ে পড়ল কি করে তা অবশ্য জানি না। তাদের বাড়ি-ঘর ইট দিয়ে বানানো শহরের চারপাশেৱ মোটা দেওয়ালও ইঁটের। মাটি আগুনে পুড়িয়ে লালচে রঙ-এর ইট হয়। কিন্তু তা মাটির চেয়ে চারগুণ শক্ত – তামার মাতো মজবুদ। তবু ইট আর তামার তফাৎ অনেক। অনেকে ভুল করে ইটকে হয়ত তামা মনে করে।”
“তুমি যাই বল বরুণ, আমরা কিন্তু তাম্রদুর্গের কথাই শুনেছি।”
“আমাদের ইন্দ্রকে দুর্গ ধ্বংস করতে অনেক কষ্ট ও শক্তিক্ষয় করতে হয়েছে—তাই বোধহয় এ দুর্গ তাম্রনির্মিত বলে কথিত হয়েছে।”
“তা ছাড়া সম্বরের শৌর্যবীর্যের কত না কাহিনী আমাদের কানে এসেছে। সমূদ্রের মধ্যে তার নাকি ঘর, আকাশ পথে তার রথ উড়ে চলত।”

“রথের কথা ডাহা মিথ্যা, একেবারেই আজগুবি। তা’ছাড়া অশ্বারোহী যোদ্ধা হিসাবে অসুরেরা দুর্বল। এখনও, তাদের উৎসবের সময় অশ্বরথের জায়গায় বৃষরথ নিয়ে আসে। আমরা যুদ্ধে জিতেছি। ঘোড়ার জোরে – ভালো ঘোড়সওয়ার হতে না পারলে যুদ্ধে আমরা অসুরদের হারাতে পারতাম না। সম্বর প্রায় দুশো বছর হল মারা গেছে। আকাশপথে উড়ে যাওয়া দূরের কথা, তার কাছে অশ্বরখ পর্যন্ত ছিল না।”
“সম্বর যদি এতই সাধারণ মানুষ ছিল, তবে ওই অসুর শক্ৰকে পরাজিত করায় আমাদের ইন্দ্রের এত নামডাক কেন?”
“কারণ, সম্বর ছিল খুব বড় বীর। সৌবীর নগরে আমি তার স্বর্ণখচিত তাম্রকবচ, (বর্ম) দেখেছি – সেটা যেমন দৃঢ়, তেমনিই বিশাল। অসুররা সাধারণভাবে বেঁটে গড়নের কিন্তু সম্বর ছিল বিরাটাকায়, খুবই বলিষ্ঠ। আর আমাদের মঘবা ইন্দ্র ছিল পাতলা ছিপছিয়ে জোয়ান মানুষ। সিন্ধু নদের তীরে এখনো দেখতে পাবে পুরনো দিনের অসুর নগরীর অবশেষ। মনে কর সেইসব দিনের কথা, দুর্গের মধ্যে থেকে কিছু তীরন্দাজ হাজার হাজার আক্রমণকারীকে হটিয়ে দিত। ওই দুর্গগুলো ছিল দুর্ভেদ্য – আর এই অপরাজেয় পুরীকে ধ্বংস করেছিল আমাদের মঘবা ইন্দ্ৰ।”
“আচ্ছা বরুণ, দক্ষিণে কি অসুরদের শক্তি অটুট আছে?”
“তোমাকে কি বলিনি, সমুদ্রতটর শেষ দুর্গাও অসুরেরা হারিয়েছে। আমরা তা ধ্বংস করেছি। ওই যুদ্ধে আমিও যোগ দিয়েছিলাম।” কথা বলতে বলতে বরণের মুখমণ্ডলে রক্তিমাভা ফুটে উঠল। সে তার দীর্ঘ সোনালী চুলের গোছা হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলল, “অসুরদের সর্বশেষ দুর্গের পতন ঘটে গেছে।”
“এই যুদ্ধে আমাদের ইন্দ্র কে ছিল?”
“ইঞ্জের পদ আমরা বিলোপ করেছি।”
“বিলোপ করেছ?”
“হা, আমরা দক্ষিণের আর্যভাষীরা ক্ৰমেই শঙ্কিত হচ্ছিলাম।” “শঙ্কিত হচ্ছিল! কেন ?”
“আর্যভাষীরা সেনানায়ককে সর্বেসর্বা বলে মেনে চলতে রাজী নয়। যুদ্ধের সময় সেনানায়কের আদেশ যতই শিরোধার্য হোক না কেন, আর্যভাষীরা সব সময় তাদের জন-পরিষদকে সর্বোচ্চ স্থান দেয় যেখানে স্বাধীনভাবে প্রত্যেকে নিজের চিন্তাধারা উত্থাপন করবার অধিকারী।”
“হ্যাঁ, ঠিকই তো, এ অধিকার আছে।”
“কিন্তু অসুরদের প্রথা অন্য রকম। তার ইন্দ্রকে রাজা বলে মনে করে। আর এই রাজা নিজেকেই সব কিছু মনে করে – নিজের ওপরে জন-পরিষদকে স্থান দেয় না।অসুররাজের মুখ দিয়ে একবার যা বেরিয়ে গেল তা সমস্ত অসুরের অবশ্য পালনীয়, আর সেটা পালন না করলে মৃত্যুবরণ করতে হবে।”
“না, এ ধরনের ইন্দ্ৰকে আমরা কখনও স্বীকার করতে পারি না।”
“কিন্তু অসুরেরা এই ধরনের ইন্দ্রকেই বারবার মেনে এসেছে। তারা তাদের রাজাকে মানুষের ঊর্ধ্বে দেবতার আসনে বসিয়েছিল। জীবিত মানুষ রাজাকে পূজো পর্যন্ত করত। আর এই পূজার অনুষ্ঠানের কথা বললে তুমি তা বিশ্বাসই করবে না।”

“হ্যাঁ, আমি নিজেই দেখেছি অসুর পুরোহিতরা মানুষকে গাধা বানিয়ে ছাড়ে।”

“তারা জনসাধারণকে গাধার চেয়েও ছোট মনে করে। তুমি বোধহয় শুনেছ তারা লিঙ্গপূজা করে। শরীরের এই প্রভঙ্গ দুটি নর-নারীর সুখ-সম্ভোগের এবং ভবিষ্যবংশ সৃষ্টির কারণ বটে, কিন্তু তাকে পূজা করা আহম্মুকি নয়? অনেক জায়গায় আবার মাটির লিঙ্গ গড়ে পূজা করা হয়।”
“আহম্মুকি তো বটেই।”
“আর অসুররাজারা এই ধরনের পূজায় বিশেষ আসক্ত। আমার মনে হয়, এর মধ্যে একটা মস্ত চালাকী আছে, বিশেষত অসুররাজারা আর তাদের পুরোহিতরা মুর্থ হয় না, তারা আমাদের আর্যভাষীদের চেয়ে চতুর। তাদের মতো নগর বা দুর্গ বানাতে আমাদের অনেক শিখতে হয়েছে। তাদের দোকান-পাট, পুষ্করিনী, প্রাসাদ, রাজপথ- এ সমস্ত জিনিস তুমি আমাসের এই ভূখণ্ডে দেখতে পেতে না। আমি উত্তর সৌবিরের পরিত্যক্ত অসুর নগরী ও অধুনা বিজিত অসুর নগরটি দেখেছি। আমরা তাদের পুরনো নগরগুলি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হইনি – বিশেষ করে এই নতুন নগর, যা সম্বর প্রতিষ্ঠা করেছিল বলে প্রবাদ আছে তা তো দেবপুরীর সমতুল্য।”

“বল কি, দেবপুরী?” “সত্যি বলছি। পৃথিবীর কোনো জিনিসের সঙ্গেই এর তুলনা হয় না। একটি পরিবারের বাসোপযোগী থাকবার গৃহের কথাই ধর না কেন। তাতে আছে – সুসজ্জিত বৈঠকখানা, চুন্নী সমেত রান্নাঘর, তার ধোঁয়া বেরবার আলাদা ব্যবস্থা, চত্বরে বাঁধানো কূপ, স্নানের ঘর, শোবার ঘর আর তা’ছাড়া আছে আলাদা গোলাঘর। দু-তিন তলার বাড়ি দেখেছি — সেখানে সাধারণ লোকেরাই থাকত। এর সঠিক বর্ণনা দেওয়া শক্ত, তুলনা করতে হয়।”

“পূব দেশেও অসুর নগরী আছে, সেগুলো আমাদের মাদ্রদেশ (বর্তমানে শিয়ালকোট) থেকে অনেক দূরে।”
“আমি তাও দেখেছি বন্ধু। এ রকম নগর যারা নির্মাণ করেছে, যারা পরিচালনা করেছে – তারা যে আমাদের থেকে অনেক বুদ্ধিমান ও চতুর। এটা স্বীকার করতেই হবে। তুমি সমুদ্রের কথা শুনেছি কখনো?”

“নাম শুনেছি।”
“নাম শুনে বা বর্ণনা শুনে তুমি মহাসাগর সম্পর্কে কোনো ধারণা করতে পারবে না। সাগরের তীরে দাঁড়িয়ে যখন তুমি দেখবে তার নীল জলরাশি আকাশ স্পর্শ করেছে— তখন তোমার চেতনায় আসবে – কিছুটা অনুমান করবে।”

“আকাশ পর্যন্ত কি সাগর পৌছাতে পারে, বরুণ?” “হাঁ, তাই হয়। তোমার দৃষ্টি যতদূর যাবে – তুমি দেখবে বিশাল জলরাশি, তরঙ্গের পর তরঙ্গে ক্রমেই ওপরে উঠছে – ফেনিল জলরাশি ক্রমেই আঞ্চাশ স্পর্শ করছে। উভয়ের বর্ণও এক, সমুদ্র নীলাকাশের মতোই নীল। আর দিগন্তহীন সাগরে অসুররা তাদের বড় বড় নৌকা নির্ভয়ে ভাসিয়ে দেয়- মাস, বছর অতিক্রম করে সমুদ্রপথে ঘুরে বেড়ায়, আর সমুদ্র পার থেকে রত্ন-ভাণ্ডার সংগ্রহ করে। অসুরদের সাহস ও কুশলতার এও একটা নজির। এছাড়াও আর একটি ব্যাপার আছে যা তুমি কোনোদিন শোননি। অসুররা মুখ ছাড়াই কথা বলতে পারে।”
“এ্যাঁ! শব্দ না করে? কি বলছ বন্ধু?”
“হ্যাঁ বিনা শব্দে। মাটি ও পাথর দিয়ে চামড়া বা কাপড়ের ওপর দাগ কেটে যাবে।
– অন্য অসুররা একটা শব্দ না শুনে বা মুখের দিকে না তাকিয়েই ওই সমস্ত সঙ্কেত বুঝতে পারবে। আমরা যা দু’ঘন্টা কথা বলে বোঝাতে পারব না, তা তারা পাঁচ দশটা সঙ্কেতে বুঝিয়ে দেবে। আর্যরা এ বিদ্যা জানত না। এখন তারা এইসব সক্ষেত বুঝতে চেষ্টা করছে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে শিখেও কায়দা করতে পারছে না।”
“এ কথা নিঃসন্দেহ যে, অসুররা আমাদের চেয়ে বুদ্ধিমান।”
“দেখ না কেন! এখন আমরা তাদের সর্বত্রই কারিগর, মৃৎশিল্পী, তন্তুবায়, রথ প্রস্তুতকারক ও কর্মকার হিসাবে দেখতে পাই। তারা যে আমাদের চেয়ে গুণী তাতে আর সন্দেহ কি?”

“আর তুমিই তো বলছ অসুরা বীরও বটে।”
হ্যাঁ বীর তো বটেই। তবে তাদের সংখ্যা খুবই কম। আর্যভাষীদের মতো ওদের বাচ্চারা মায়ের পেট থেকে পড়েই তরবারি নিয়ে খেলতে শেখে না। ওদের মধ্যে আছে কারিগর, বণিক, দাস প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণী। তেমনি সেনানী বা যোদ্ধা হচ্ছে আলাদা শ্ৰেণী। যোদ্ধাশ্রেণী ছাড়া আর কেউ অস্ত্রবিদ্যা শেখে না। যারা যুদ্ধবিদ্যা শেখে না, যোদ্ধারা তাদের হেয় জ্ঞান করে। আর দাসদাসীরা পশু অপেক্ষা হীন জীবন যাপন করে। অসুররা শুধু এদের বেচাকেনাই করত না, তারা এদের দেহ এবং জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলত।”
‘তাদের যোদ্ধা কত?”
“শতকরা একজনও হয়ত তাদের সৈন্য নয়, কিন্তু দাসের সংখ্যা অনেক বেশী – শতকরা চল্লিশ জন। আর তাদের শিল্পী এবং কৃষকরাও অর্থ-দাস, শতকরা দশ জন হবে ব্যবসায়ী আর বাকীরা বৃত্তিধারী।”

“তাই তো অসুররা আর্যভাষীদের কাছে হেরে গেল।” “হ্যাঁ, ওদের হেরে যাওয়ার এটা একটা প্রধান কারণ। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, তারা রাজাকে দেবতা বলে মানত, তাকে জনসাধারণের চেয়ে অনেক ওপরে স্থান দিয়েছিল।”
“আমরা এ ব্যবস্থা কখনই মানব না।”
“এইজন্যেই তো আমাদের ইন্দ্রের পদ বিলোপ করতে হল। মঘবার পর এক ইন্দ্র অসুর রাজার মতো হতে চেয়েছিল। আর সে কি একা, তারপর আরও অনেকে ইন্দ্র হবার চেষ্টা করেছিল। আর কয়েকজন আর্যভাষীও তাদের সাহায্য করতে গিয়ে ধরা পড়ল।”
“সাহায্য করতে গেল!”
“হ্যাঁ, তাই সমগ্র জন-পরিবারের স্বার্থবিবেচনা করে সৌবীর-জন সিদ্ধান্ত নিল যে, এরপর আর কাউকে ইন্দ্র করা হবে না। বজ্ৰ ধারণ করে যে দেবতা তার নামের সঙ্গে মিশে এই নামের মোহ মানুষকে বিভ্রান্ত করছিল –ইন্দ্ৰপদ তুলে দেওয়ার সেটাও কারণ বটে।”
“বন্ধু, সৌবীর-জন ভালো কাজই করেছে।”
“কিন্তু আর্যভাষীদের সুনামে কলঙ্ক আরোপ করার জন্যে কিছু লোক আছে যারা অসুরদের সবকিছুকেই প্রশংসা করতে ক্লান্তিবোধ করেনা। তাদের অনেক কিছুই প্রশংসনীয়, আমি নিজেও তার সমাদর করি। আমরা তাদের হাতিয়ার দেখেই আমাদের অস্তু বানিয়েছি, তাদের বৃষভ-রথ দেখেই তো আমাদের মঘবা ইন্দ্র তার অশ্বরথ নির্মাণ করেছিল। একজন তীরন্দাজের পক্ষে ঘোড়ার চেয়ে রথে বসে যুদ্ধ করা অনেক বেশী সুবিধাজনক। রথে বেশী তৃণ রাখতে পারে, শক্রর তীর থেকে আত্মরক্ষার জন্য আবরণও রাখতে পারে। আর্যরা অসুরদের বর্শা, গদা, শক্তি প্রভৃতি অস্ত্রাদি সম্পর্কে অনেক শিক্ষা নিয়েছে। অসুরদের নগরপরিকল্পনা থেকে আমরা অনেক কিছু গ্ৰহণ করেছি। তাদের কাছ থেকে সমুদ্রযাত্রা আমাদের শিখতে হবে, কারণ তামা ও অন্যান্য ধাতুরত্ন সাগরতীর থেকে আসে; এখনো এই ব্যবসা অসুর ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া। আমরা যদি তাদের থেকে স্বতন্ত্র হতে চাই তা’হলে সাগরে নৌ-চালনা শিক্ষা করতেই হবে। তবু এমন অনেক বিষয় আছে যা অসুরসের কাছ থেকে নেওয়া বিপদজনক -যেমন লিঙ্গপূজা।”
“কিন্তু লিঙ্গপূজা কোন আর্যভাষী স্বীকার করে নেবে।”
“আর বলো না বন্ধু! আমাদের মধ্যে এমন অনেকে আছে, যারা বলছে অসুরদের মতো আমাসেরও পূরেহিত দরকার। আমাদের এখানে অসুরদের মতো পুরোহিত, ব্যবসায়ী, কৃষক ও শিল্পীদের মধ্যে কোনো প্ৰভেদ নেই, সবাই সব কাজ খুশীমতো করতে পারে। কিন্তু অসুররা আলাদা আলাদা শ্রেণীবিভাগ করেছে। এখন একবার যদি আমাদের মধ্যে পুরোহিত সৃষ্টি করতে দাও তো দেখবে কিছুদিনের মধ্যেই লিঙ্গপূজাও শুরু হয়ে যাবে। লাভ ও লোভের জন্যে আর্যভাষী পুরোহিতদেরও ওই কাজই শুরু করতে হবে।”
“এ তো অত্যন্ত খারাপ হবে, তা’হলে বরুণ!”
“গত দু’শো বছর অসুরদের সংস্পর্শে এসে আর্যদের মধ্যে কতই না পাপ প্রবেশ করেছে। আর তাই দেখে বৃদ্ধরা ক্রমেই হতাশ হচ্ছে। আমি অবশ্য নিরাশ হইনি। আমি বিশ্বাস করি, যদি অতীতের মহান দিনগুলির কথা আর্যভাষী জনদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া যায়, যদি তাদের ভালো করে বোঝানো যায় – তবে তারা পথভ্রষ্ট হবে না। শুনেছি তক্ষশিলায় অঙ্গিরা নামে এক ঋষি আর্যভাষীদের প্রাচীন বিদ্যা জানেন। তিনি আর্যমার্গে চলবার শিক্ষা দেন। আমি আর্ভাষীদের বিজয়ের জন্য তরবারি ধরেছি। এখন আর্য রীতি-নীতি রক্ষার জন্যে কিছু শিক্ষার প্রয়োজন।”
“কি আশ্চর্য! আমিও তো চলেছি ঋষি অঙ্গিরার কাছে যুদ্ধবিদ্যা শিখতে।”
“খুব ভালো, কিন্তু তুমি তো পূর্বদিকের আর্যভাষী জনদের কথা কিছুই বলনি।”
“পুবদেশের আর্যভাষী জন দাবাগ্নির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। গান্ধারের পরের ভূখন্ড আমাদের মাদ্ররা দখল করেছে। তারপরের অঞ্চল দখল করেছে মল্লরা, এবং ক্রমশ কুরু, পঞ্চাল প্রভৃতি জন বড় বড় প্রদেশ আপন করতলগত করেছে।”
“তা’হলে আর্যভাষীরা ওখানে সংখ্যায় অনেক বেশী।” “খুব বেশী নয়। তবে যতই তারা এগিয়ে চলেছে ততই অসুর ও অন্যান্য জাতির সম্মুখীন হচ্ছে।”
“অন্যরা আবার কারা।”
“অসুরদের গায়ের রঙ তামাটে। কিন্তু পূর্বদিকে এক রকম লোক আছে — তাদের কোল বলা হয় – তারা কয়লার মতো কালো। এই কোলেরা গ্রামেও থাকে, জঙ্গলেও আছে। বন্য কোলেরা নানা রকমের পাথরের অস্ত্র তৈরী করে।”
“তা’হলে তো মনে হয় এই অনার্যদের সঙ্গে খুবই লড়াই করতে হচ্ছে।”
“বড় ধরনের সামনা-সামনি যুদ্ধ খুব কম হয়। আর্যভাষীদের ঘোড়া দেখলেই অনার্যরা পালিয়ে যায়। কিন্তু রাতে আমাদের আক্রমণ করে। এর প্রতিশোধ নেবার জন্যে অনেক সময় ক্রুর ব্যবহার করতে হয়। ফলে অসুর এবং কোলদের গ্রাম প্রায় জনশূন্য হয়ে গেছে। এখন তারা ক্ৰমেই পূবদিকে পালিয়ে যাচ্ছে।”

“তা’হলে, তোমাদের ওখানে অসুরদের রীতি-নীতির প্রভাবের কোনো ভয় নেই?”

“মাদ্র-জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভয় নেই, মল্লদের বেলাও এ কথা বলা যায়। আরও আগের কথা বলতে পারি না, আমাদের ওখানের অনার্যরা জঙ্গলের বাসিন্দাই রয়ে গেল।”
দুই বন্ধু এইভাবে রাত্রি পর্যন্ত তাদের পরস্পরের খবরাখবর ও গল্পে মশগুল ছিল। অতিথিশালার পরিচারিকা এসে খাওয়া-দাওয়ার কথা জিজ্ঞেস না করলে তাদের কথা হয়ত শেষই হত না। এই অতিথিশালাটি নির্মিত হয়েছিল গ্রামবাসীদের খরচে – পথিকদের বিশেষ করে শ্বেতজাতির পথিকদের বিশ্রামের জন্য নির্মিত এ কথা অবশ্য বলার কোনো দরকার হয় না। যাদের কাছে আহার্য কিছু থাকত না, তাদের জন্য চাল-ভাজা ও গোমাংসের সুরুয়ার ব্যবস্থা হত। কোনো পথিকের কাছে খাদ্যবস্তু থাকলে তা সে অতিথিশালার রক্ষকের কাছে দিলে সে রান্না করে দিত, আর তা না থাকলে সমতুল্য কিছু দিতে হত। এই অতিথিশালাটি সোমরসের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। দুই বন্ধু গো-মাংস এবং মদ্য একত্রে পানাহার করে তাদের বন্ধুত্ব দৃঢ় করে নিল।

(২)

ঋষি অঙ্গিরা সিন্ধুনদের পূর্ব-পারের এই গান্ধারের জন-এর শ্ৰেষ্ঠ সম্মানের অধিকারী হয়েছিল, সে একদা জন-পতি পর্যন্ত ছিল। পুষ্কলাবতীর (চরসদ্দা) প্রথম যুদ্ধের পর অসুররা পিছু হটতে শুরু করে। পরবর্তী পুরুষে গান্ধার জনের একটি শাখা কুনার তীর থেকে এসে পশ্চিম গান্ধার অঞ্চল অধিকার করল। তাই অসুররা পশ্চিম গান্ধার দেশ দ্রুত ত্যাগ করতে লাগল। মাত্র তিরিশ বছর যেতে না যেতেই গান্ধার ও মাদ্ররা সিন্ধু নদের পূর্বপারের ভূ-খণ্ড জয় করল। বিজিত দেশ তারা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিল; বিতস্তা থেকে সিন্ধুর মধ্যকার ভূমি পেল গাদ্ধার জন আর বিতস্তা থেকে ইরাবতীর মধ্যকার ভূখণ্ড দখল করল মাদ্র-জন। কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এ দুটি অঞ্চলই দখলকারীদের নামানুসারে পূর্ব গান্ধার ও মাদ্র জনপদ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করল। এই প্রারম্ভিক দেবাসুর যুদ্ধে উভয় জাতিই অমানুষিক নৃশংসতার পাল্লা দিয়েছিল, যার পরিণামে গান্ধারভূমিতে একটি অসুরও অবশিষ্ট ছিল না। মাদ্রদের ভূখণ্ডেও খুব অল্পসংখ্যক অসুর অবশিষ্ট ছিল। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিরোধেরও আস্তে আস্তে ভঁটা পড়তে লাগল। পীতকেশীরাও তাদের যুদ্ধের সময়কার নিষ্ঠুরতা কমিয়ে দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, বরুণ সৌবীরের বর্ণনা অনুযায়ী গীতকেশীদের ওপর অসুরদের নানা প্রকার প্রভাব পড়তে লাগল। ঋষি অঙ্গিরা বক্ষু উপত্যকা থেকে আগত আৰ্য্যদের অতীত ঐতিহ্যের শুধুমাত্র বড় পণ্ডিতই ছিল না, সে চাইত আর্যভাষীরা তাদের রক্ত ও আচার-ব্যবহারের বিশুদ্ধতা বজায় রাখুক। এই কারণেই পূর্বগান্ধার দেশে অশ্ব-মাংস খাওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সে আবার সেখানে অশ্বপালন প্রথা পুনরায় চালু করল। ঋষি অঙ্গিরার এ আর্যপ্রীতি, আর্য ঐতিহ্য ও আর্য শিক্ষায় তার অনুরক্তি এবং যুদ্ধবিদ্যায় অসাধারণ কুশলতার খ্যাতি, তাকে এমনি প্রথিতযশা করে তুলেছিল যে, সুদূর জনপদ থেকে আর্য কুমারগণ তার কাছে শিক্ষাগ্রহণের জন্য আসত। কিন্তু সেদিন কে জানত যে, অঙ্গিরা রোপিত গান্ধারপুরের এই বিদ্যা-অঙ্কুর ভাবীকালে একদিন তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয়-রূপ বিশাল মহীরূপে পরিণতি লাভ করবে। কে জানত, এই মহীরূহের ছায়ায় সুমিস্ট ফললাভের প্রয়াসে সহস্ৰ যোজন পথ দূর থেকে আর্যগাথার ভক্তরা ছুটে আসবে।
ঋষি অঙ্গিরার বয়স ৬৫ বছর। পলিত কেশ, কটি বিলম্বিত শ্বেত উজ্জ্বল শ্মশ্রু এবং সৌম্য মুখমণ্ডল ঋষির আকৃতিকে আকৰ্ষণীয় করে তুলেছে। সেদিন থেকে কয়েক শতাব্দী পরে কালি-কলম ও ভূৰ্জপত্রে লেখার রীতি মানুষের আয়ত্তে এসেছিল। তখন ছিল শ্রুতি ও স্মৃতির যুগ, তাই সব শিক্ষাই প্রদও হত মৌখিকভাবে, বিদ্যাধীরা পুরাতন সংগীত ও কাহিনী বার বাৱ আবৃত্তি করে – স্মরণে রাখত। দূর দেশ হতে আগত বিদ্যার্থীরা দীর্ঘদিনের উপযোগী নিজেদের খাদ্য-বস্ত্র আনতে পারে না। ঋষি অঙ্গিরাকেই খাদ্য বস্ত্রের ব্যবস্থা করতে হত। এর জন্যে তার নিজের জমি চাষ করার পরও বিদ্যার্থীদের দিয়ে জংলা জমি চাষ করে নতুন আবাদ করেছিল। তাইতেই সারা বছরের উপযোগী যথেষ্ট গম উৎপাদনের ব্যবস্থা হয়েছিল। তখনো পর্যন্ত পুষ্প উদ্যান করার রেওয়াজ হয়নি। কিন্তু বনের জংলী ফলমূল যখন পাকবার সময় হত তখন সে নিজের শিষ্যমণ্ডলী নিয়ে সেখানে তা আহরণে যেত, তখন তারা ফুলও সংগ্রহ করত। চাষের কাজে, বীজ বপন, ফসল কাটা অথবা ফুল ফল জ্বালানী কাঠ সংগ্রহের সময় বিদ্যার্থীরা বক্ষুর তীরে সুবাস্তুর তটভূমিতে রচিত গানগুলি পরম আদরে উচ্চ রাগিণীতে সমবেতভাবে গাইত। অঙ্গিরার অশ্বশালাও ছিল গান্ধারের মধ্যে সবচেয়ে বড়। দূর-দূরান্তের শিষ্য বা পরিচিত ব্যক্তিদের কাছে অনুরোধ পাঠাত ভালো জাতের ঘোড়া ভেট আনবার জন্য, উচ্চশ্রেণীর ঘোটক-ঘোটকী সংগ্রহ করে ভালো জাতের ঘোড়ার বংশবৃদ্ধির ব্যবস্থা করত। পরবর্তীকালের বিখ্যাত সিন্ধী-ঘোটক সৃষ্টি হয়েছিল তারই অশ্বশালা থেকে। এ ছাড়া তার হাজার হাজার গরু ও ভেড়া ছিল। শিষ্যদের বিদ্যাভ্যাসের সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক পরিশ্রমের কাজও করতে হত। অঙ্গিরা নিজেও কাজ করত কারণ কায়িক পরিশ্রম না করলে সকলের খাদ্য-বস্ত্রের সংস্থান হতে পারে না।
তক্ষশিলার পূর্বদিকের অধিকাংশ পাহাড় ছিল সুজলা সুফলা। একদিন বরুণ ও পাল একদল বিদ্যার্থীর সঙ্গে পশুচারণ ভূমিতে কাজে লিপ্ত ছিল। তাঁবু থেকে অনতিদূরে শ্বেত ও লোহিতাভ বর্ণের গো-বৎস খেলে বেড়াচ্ছিল। ঋষি অঙ্গির শিষ্যদের মাঝে বসে তকলি কাটছিল আর অতীত ও বর্তমানের আর্য ও অনার্যের রীতি, নীতি, শিল্প ও বাণিজ্যের মধ্যে কোনটা গ্রহণীয় আর কোনটা বর্জনীয় – তার ব্যাখ্যা করছিল।

“বৎস! যা কিছু নতুন তা সবই পরিত্যাগ করতে হবে, অথবা প্রাচীন হলেই তা গ্ৰহণযোগ্য – এই ধরনের কথা খুবই ভুল। আর এই আপ্তবাক্যকে কাজে লাগানো তো একেবারেই অসম্ভব। কক্ষু নদীর তটভূমিতে আর্যরা যেদিন পাথরের অস্ত্রাদি ছেড়ে উন্নত ধরনের তামার অস্ত্র ব্যবহার করতে শিখল সেদিন কত লোকই না নতুন হাতিয়ারের বিরুদ্ধতা করেছিল।”
শিষ্য বরুণ প্রশ্ন করল, “পাথরের অস্ত্রাদি দিয়ে কিভাবে কাজ চলত?”
“বৎস, আজ তামার প্রচলন হয়েছে তাই তামার হাতিয়ার খুবই তীক্ষ্ণ মনে হচ্ছে। ভবিষ্যতে এর চেয়েও তীক্ষ্ণ কোনো ধাতুর হাতিয়ার গড়া হবে তখন আবার মানুষ হয়ত তোমার মতো প্রশ্ন করবে তামার হাতিয়ার দিয়ে কিভাবে কাজ চালাত।মানুষ যখন যে হাতিয়ার সংগ্রহ করতে পারে, তখন তাই দিয়ে কাজ চালিয়ে নেয় — সেইভাবেই তারা অভ্যস্ত হয়। যখন পাথরের কুড়ুল দিয়ে যুদ্ধ করত, তখন উভয় পক্ষের যোদ্ধাদের পাথরের হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু ছিল না। কিন্তু যে-ই একপক্ষ তামার তরবারির ব্যবহার শিখল তখনই অপর পক্ষের কাছে পাথরের কুড়ুল ত্যাগ করে তামার তরবারি ব্যবহার করা অপরিহার্য হয়ে উঠল। আর তারা যদি তা না করত, এ দুনিয়াতে তাসের কোনো চিহ্ন থাকত না। তাই আমি বলছিলাম, সমস্ত নতুন চিন্তাধারা পরিত্যাজ্য এ কথা খুবই ভুল। আমি নতুনদের বিরোধী হলে এত সুন্দর সুন্দর ঘোড়া, গরু প্রতিপালন করতে পারতাম না। আমি জেনেছিলাম যে, ভালো ঘোড়ার বাচ্চা পেতে হলে ভালো জাতের ঘোটক ঘোটকীর মিলন চাই। তাই আজ পঁয়ত্রিশ বছর পরে এ-জাতীয় শ্রেষ্ঠ ঘোটক-ঘোটকী দেখতে পাচ্ছ।

“অসুররা ক্ষেতের জমি ভালোভাবেই দেখা-শোনা করত, তাতে ভালো সার দিত। তারা পাহাড়ী নদী থেকে খাল কেটে সেচের যে ব্যবস্থা করত – তা যে খুব উঁচু ধরনের এ কথা আমরা স্বীকার করি। তাদের শহর গড়ার কায়দা ও চিকিৎসার নানা রকম ভালো ব্যবস্থা আমরা গ্রহণ করেছি। এ কথা ভাবলে চলবে না যে, এটা নুতন না পুরনো, এটা আৰ্য না অনার্য – খাওয়া-পরা ও জীবনধারণের মানকে উন্নত ও সহজ করার জন্যে যত রকম জিনিস পাওয়া যায়, তাকে স্বীকার করে কাজে প্রয়োগ করতে হবে। আগে আর্যরা কার্পাস তুলার ব্যবহার জানত না, সূতী বস্ত্রের নাম পর্যন্ত শোনেনি। কিন্তু এখন আমরা শ্ৰীষ্মকালে সূতী বস্ত্র পরি, গরমের দিনে এই কাপড় খুবই আরামদায়ক। এইভাবে নতুন জিনিস আমরা যেমন গ্রহণ করেছি তেমনি অনেক কিছু বর্জনও করেছি। এমন অনেক জিনিস আছে যেগুলো বিষের ন্যায় পরিত্যাগ করা উচিত। অসুরদের লিঙ্গপূজা, তাদের ধর্ম অনুসরণ করা যেমন আমাদের পক্ষে নিন্দনীয়, তেমনি তাদের জাতি-বিভাগও বর্জনীয়। জাতি-বিভাগের জন্যেই মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে অস্ত্ৰধারণ করে নিজেদের রক্ষা করতে পারে।এতে শুধু নিজেদের মধ্যে ছোট ও বড়, উঁচু-নীচু এই চিন্তার তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। এ কথাও ঠিক যে, অসুরসের সঙ্গে আমাদের রক্তের মিশ্রণ হওয়া উচিত নয়, কেন না, তাতে আমাদের অসুরবৃত্তি গ্রহণেরই পথ উন্মুক্ত হবে। আর এর ফলে আর্যভাষীদের মধ্যেও নানা শিল্প ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ছোট ও বড় জাতিবিভাগ দেখা দেবে।”
পাল প্রশ্ন করল, “রক্তের সংমিশ্রণকে প্রত্যেকটি আর্যভাষী খুব অনুচিত কাজ বলে মনে করে কি?”
জবাবে ঋষি,“ হ্যা, তবে এর জন্যে তারা ততো বেশী মনোযোগ দিতে রাজী নয়। আর্যভাষীরা অসুর কিম্বা কোল স্ত্রীসের সঙ্গে সমাগম করে।”
বরুণ, “সীমান্তের লোকেরা এ কথা বলেই থাকে যে, আমাদের যোদ্ধারা অসুরপুরীর বারাঙ্গনাদের কাছে হামেশাই যাতায়াত করে।”
ঋষি বলল, কথাটা ঠিক। কিন্তু, এর পরিণাম কি? এর ফলে বাড়বে বর্ণ-সঙ্করতা।

অসুরদের মধ্যেও পীতকেশ বালক-বালিকা জন্ম নেবে। ভ্রমবশত আর্যরা এদের নিয়ে আসবে নিজেদের পরিবার পরিজনদের মধ্যে, তখন আর্য-রক্তের বিশুদ্ধতা কোথায় থাকবে? আর এই রক্ত-শুদ্ধতার জন্য চাই সমস্ত আর্য স্ত্রী-পুরুষের জাতীয় সচেতনতা। আর এর জন্য চাই, আর্যদের মধ্যে দাসপ্রথা কিছুতে প্রবেশ করতে না পারে, তার ব্যবস্থা। কারণ, এর মতো রক্তের শুদ্ধতা নষ্টকারী সর্বনাশা জিনিস আর কিছুই নেই। আর্য জনপদে অনার্যরা যাতে কিছুতেই প্রবেশ করতে না পারে তারও ব্যবস্থা অবলম্বন করা উচিত। সবচেয়ে বিপদজনক ও সকল মন্দের মূলে আছে অসুরদের রাজ-প্ৰথা, আর এরই অপর অঙ্গ হচ্ছে পুরোহিত প্রথা। অসুর-জন তাদের সমস্ত অধিকার হারিয়ে বসে আছে। অসুর জনের কোনো স্বাধীনতা নেই, অসুর-রাজা যা বলবে সেই মতো কাজ করা অসুররা ধর্ম বলে মনে করে। অসুরদের পুরোহিতরা শেখায় যে, জনগণের ভালো-মন্দের সমস্ত দায়িত্ব নিয়েছে। ওপরে ভগবান, আর নীচে তার প্রতিনিধি রাজা। এই ধর্মমত অনুসারে সাধারণের কিছু বলবার বা করবার নেই। ধরিত্রীতে স্বয়ং রাজাই হচ্ছে দেবতা। তাই আমি যখন শুনলাম, শিবি-সৌবীররা ইন্দ্ৰ পদ তুলে দিয়েছে তখন খুবই আনন্দিত হয়েছিলাম। যদিও এ কথা ঠিকই যে অসুর-রাজের স্থান ইন্দ্র কোনোদিনই অধিকার করতে পারেনি। আর্যদের মধ্যে ইন্দ্রের স্থান হচ্ছে – জন কর্তৃক নির্বাচিত একজন বড় যোদ্ধা বা সেনাপতি মাত্র। জনের ওপর শাসন করার কোনো অধিকার তার নেই। তবুও ওই পদ থেকে ভবিষ্যতে বিপদের আশঙ্কা ছিল এবং কিছু লোক ওই পদের আড়াল থেকে আর্যভামীদের মধ্যে রাজ-প্রথা কায়েমের চেষ্টাও করেছিল।আর্যভাষীরা যদি নিজেদের আর্যত্ব বজায় রাখতে চায় তা’হলে কাউকেই রাজ-অধিকারে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না, আর উচিতও হবে না।  কিন্তু যেদিন অসুরদের মতো রাজপদের সৃষ্টি হবে সেই দিনই অসুরদের মতোই পুরোহিতদেরও আবির্ভাব ঘটবে। আর এ-সব হলেই বুঝবে যে, আর্যভাষীদের আর্যত্ব নষ্ট হয়েছে। সমগ্র জন পরিশ্রম করবে, আর সেই আর সেই পুরশ্রমের ফলভোগ করবে রাপদে আসীন একজন ব্যক্তি। এর ওপর আছে পুরোহিত, পুরোহিতকে উৎকোচ দিতে পারলে ভগবানের আশীর্বাণী পাওয়া যাবে। এইভাবে রাজা ও পুরোহিতে মিলে সমগ্ৰ জনকে তাদের দাস করে ছাড়বে। আমাদের আর্যভাষীদের প্রাচীন রীতি-নীতিকে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে আঁকড়ে থাকতে হবে। এবং যেখানেই কোনো আর্যজন ব্যতিক্রম ঘটাবে — তাদের আর্য-শ্রেণী থেকে দূর করে দিতে হবে।”

(৩)

সৌবীরের (তৎকালীন সৌবীর দেশ বর্তমান করাচীর কাছে) দক্ষিণ অঞ্চল থেকে এখানে নানা রকমের দুঃসংবাদ আসতে থাকায় বরুণ ক্রমেই চিন্তান্বিত হয়ে পড়ছিল। সে বুঝতে পারছিল যে, অসুরদের শেষ দুর্গের পতনের সঙ্গে সঙ্গে আর্যদের নিজেদের মধ্যে এক ভয়ংকর আত্মকলহের ঝড় আসন্ন।বরুণ কয়েকবারই সৌবীরেরে সমস্যা নিয়ে গুরুর সঙ্গে আলোচনা করেছিল। ঋষি অঙ্গিরার বক্তব্য ছিল যে, হতে পারে এই ঝগড়ার সূত্রপাত সৌবীরের মধ্যেই শুরু হয়েছে, কিন্তু এ কথা ঠিকই যে, এই বিরোধ একদিন সারা আর্য

জনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। আর্যভাষীরা চিরকাল জনের (সমষ্টির) অধিকারকে ব্যক্তির অধিকারের ওপর স্থান দিয়েছে। কিন্তু পাশাপাশি অসুরদের রাজসত্তার এই নিরঙ্কুশ স্বেচ্ছাচারিতা ও ভোগবিলাসিতার নিদর্শন অনেক আর্যভাষী নেতাকে ক্ষমতালোভী ও আত্মসর্বস্ব করে তুলবার আশঙ্কা হয়ে দেখা দিয়েছিল। এই দুই মনোবৃত্তির সংঘাতও ছিল অবশ্যম্ভাবী, আর যে জনপদে অসুররা সংখ্যায় বেশী – সংঘর্ষের সম্ভাবনাও সেখানে বেশী; কারণ পরাজিত অসুররা আর্যদের এই আত্মঘাতী সংঘর্ষ থেকে লাভবান হতে চেষ্টা করবে এবং সেটা খুবই স্বাভাবিক।

সৌবীরপুর থেকে দুঃসংবাদ আসতে থাকায় বরুণ আট বছরের আবাসন্থল গান্ধারপুর  ছেড়ে দেশে ফিরতে মনস্থ করল। এখানে আসার পথে ঋষি শিষ্যদের মধ্যে প্রথম যাকে পথ-চলা সঙ্গী হিসাবে পেয়েছিল সেই পুরাতন বন্ধু পাল মাদ্র তার সহযাত্রী হল। গান্ধারপুরের সীমানা অতিক্রম করে তারা লবণ-পাহাড়ের পথ ধরে সিন্ধু জনপদে প্রবেশ করল। লবণের খনিতে কর্মরত ব্যাপারী ও শ্রমিকদের মধ্যে অসুরদের সংখ্যা বেশী, আর এদের প্রভাব গীতকেশী আর্যভাষীদের ওপর পড়েছিল। আর্যরা ইতিমধ্যেই অলস ও আরামপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা নিজেদের কাজগুলো অনার্য কারিগর দিয়ে করিয়ে নিত। তারা ভাৰত তরবারি নিয়ে অস্ত্রচালনা করা বা অশ্বারোহণ করাই তাদের একমাত্র উপযুক্ত কাজ। অসুর-রাজ যেমন অন্যের ওপর নিজে প্রতিপত্তি দেখাত তেমনি একইভাবে অনার্যদের ওপর ছোট ছোট প্রতিপত্তি খাটাতে গিয়ে আর্দের মনে রাজসত্তার অঙ্কুর উদগমের ভূমি প্রস্তুত হতে লাগল। দুই বন্ধু ধীর পদে লবণ-পাহাড় অতিক্রম করে এসে পৌঁছাল সৌবীর সীমান্তে (এই স্থানকে বর্তমানে মূলতান বলা হয়), এখানকার অবস্থা কিছুটা উন্নত মনে হল।এখানকার সমস্ত অধিবাসী আর্য আর জনের পক্ষে সেটা ছিল খুবই গর্বের ব্যাপার। এখানকার ভীষণ গরম সহ্য করে জনপদকে এরা পুরোপুরি আর্যভাষী জনপদে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। বরুণ ও পাল সিন্ধু নদের ওপর দিয়ে নৌকা বেয়ে চলেছিল, তাই সময়টা গ্রীষ্মের মাঝামাঝি হলেও পুরো কষ্টটা তারা পায়নি। তবু সৌবীর নগরের আবহাওয়া ছিল অত্যাধিক গরম, তার প্রভাব অবশ্যই কিছুটা পড়েছে।

আর্যরা তখন পর্যন্ত অক্ষর আবিষ্কার করতে পারেনি। তখন এদের মধ্যে লেখার সঙ্কেত (লিপি)প্রচলিত হয়নি।তারই বরুণ মাঝে মাঝে সৌবীরের পখথকদের মারফতে তার মিত্রদের কাছে যে সমস্ত সংবাদ পাঠাত তা পুরোপুরি কোনোদিনই পৌঁছাত না। এই সময় অসুরদের মধ্যে প্রচলিত লিপির কথা তার মনে আসত।

সৌবীরপুরে পৌঁছে সে বুঝতে পারল যে, অবস্থা অনেক দূর গড়িয়েছে। খাস সৌবীরপুরে সুমিত্রের সমর্থক কম ছিল; কিন্তু দক্ষিণ সৌবীরপুরে অসুরদের শেষ দুর্গ ধ্বংসকারীদের মধ্যে বহু আৰ্য সুমিত্রের পক্ষ গ্রহণ করবার জন্য প্রস্তুত ছিল। এই শেষ দুর্গটির পতনের পর সেনাপতি সুমিত্র অসুর নাগরিকদের প্রতি অতিরিক্ত অনুকম্পা দেখিয়েছিল বলে বরুণ সেই সময় তার খুব প্রশংসা করেছিল। কিন্তু এখন সে বুঝতে পারল যে, সেটা ছিল সুমিত্রের একটি চালমাত্র। সুমিত্র জানত যে, অসুররা আর কোনোদিনই আর্যদের বিরুদ্ধে মাথা তুলতে পারবে না। তাই তাদের ওপর এই অনুকম্পা দেখিয়ে সাগরপারের সার্থবাহ অসুরদের সম্পত্তি ও তাদের শক্তির সাহায্যে নিজের ব্যক্তিগত লোভ চরিতার্থ করতে পারবে৷

সুমিত্র তখনো সমুদ্রতীরের অসুরপুরী আপন সৈন্য দিয়ে দখল করে রেখেছিল আর কাল্পনিক যুদ্ধ পরিচালনার অজুহাত সৃষ্টি করে সেখান থেকে ফেরবার নাম পর্যন্ত করত না।সাধারণ দলপতিদের সঙ্গে দেখা করে বরুণ বুঝতে পারল যে, তাদের কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই, তারা ভাবত ব্যক্তিগত আক্রোশের ফলে কোনো কোনো জন-নায়ক সুমিত্রের বিরোধিতা করছে। বরুণ যখন জনের শাসনভারপ্রাপ্ত প্রধান জন-নায়কের সঙ্গে দেখা করল। তখন সে বরুণকে সমস্ত কথা বুঝিয়ে বলল এবং বলল যে, সুমিত্রের উদ্দেশ্য যদিও তার কাছে খুবই স্পষ্ট, তবু এ কথা ঠিকই যে, জনের সাধারণ মানুষ এখনো সুমিত্রের আসল মতলবের কথা জানে না, তারা তাকে অন্যভাবেই দেখে।

অসুরপুরী আক্রমণের সময় বরুণ ছিল সুমিত্রের সাহসেনাপতি। ইতিমধ্যে যদিও ন’টা বছর কেটে গেছে; তবু আজও তার তরবারি চালনার প্রশংসা থেমে যায়নি। জনকে বোঝাবার আগে নিজেই অসুরপুরীতে গিয়ে সুমিত্র সম্পর্কে সঠিক সংবাদ নিয়ে আসা মনস্থ করল। এই উদ্দেশ্যে দুই বন্ধু একদিন দক্ষিণ সৌবীর যাত্রী একটি নৌকায় আরোহণ করল। তারা নিজেদের গাদ্ধারদেশীয় বণিকের বেশে সুসজ্জিত করেছিল। অসুরপুরী দেখে তাকে কিছুতেই আর্যভাষীদের নগরী বলে মনে হয় না – তা সত্যি সত্যি অসুরদের পুরী ছিল। তখনো তা আৰ্যনগরী হয়নি। শহরের পণ্যবীথি প্রাসাদমালায় পূর্ণ ছিল, ছিল সমুদ্রযাত্রী অসুর বণিকদের নিয়ে আসা নানা দেশের বাণিজ্য সম্ভার। বহু সামন্ত অসুর-পরিবার তাদের আপন আপনি পল্লীতে আগের মতোই বসবাস করছিল, তাদের গৃহে পূর্ণের মতো শৃঙ্খলিত বন্দী দাস-দাসী অপেক্ষা করছে বিক্রি হওয়ার জন্যে। এইসব দেখতে দেখতে ওদের মনে প্রশ্ন উঠল, এই পরিবেশে বিজয়ী আর্যরা কোথায়? সুমিত্র নিজেও অসুর-রাজের পুরাতন ব্রাজপ্রাসাদে বাস করে।

একদিন বরুণ, পাল মাদ্রকে সুমিত্রের কাছে পাঠাল — গান্ধার বণিকের কাছ থেকে উপঢৌকন নিয়ে যাবার ছিল করে। পাল ফিরে এসে বলল, পীতকেশ ও গৌরবর্ণ বাদ দিলে সুমিত্ৰ এখন পুরোপুরি একটি অসুর-রাজ বনে গেছে। তার প্রাসাদ আর আর্যভাষী সেনাপতির সরল অনাড়ম্বর বাসস্থান নয়, রৌপ্য অলঙ্কারে ঝলমল অসুর- রাজের প্রাসাদকক্ষের মতোই সুসজ্জিত। তার পার্শ্বচর সৈনিকদের মধ্যেও অনাড়ম্বরতার কোনো চিহ্ন নেই। সপ্তাহ যেতে না যেতেই তারা ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট করে বুঝল – এখন আর্যভাষী সেনানায়কদের খবর নিতে হলে অসুর কন্যাদের নৃত্য ও সূরাপানের আড্ডাগুলিতে সন্ধান করতে হবে। বহু আর্যভাষী রমণী তাঁদের স্বামীদের কাছে এসে গৃহসংসার পাততে চায়, কিন্তু নানা অজুহাত দেখিয়ে তাদের আসতে মানা করা হচ্ছে। সুমিত্র তার স্ত্রীর কাছ থেকে বহু অনুরোধ পাওয়া সত্ত্বেও তাকে আসতে নিষেধ করেছে, এদিকে সে নিজে অসুর পুরোহিতের কন্যাকে প্রেম সমর্পণ করছে। শুধু তাই নয়, এ নগরীর বহু অসুর-সুন্দরী তার অন্তঃপুরচারিণী। নিজের পার্শ্বচর আর্য সৈনিকদের জন্যে এ ব্যাপারে তাঁর পূর্ণ শিথিলতা ছিল। কিন্তু অন্য আর্যভাষীরা যদি এখানে যাতায়াত শুরু করত তাহলে অনার্থ দাসদের দিয়ে দাঙ্গা বধিয়ে দিত ফলে বাইরের আর্যভাষীরা এখানে আসা বন্ধ করেছে।

বরুণ পুরোপুরি খবরাখবর নিয়ে তার বন্ধুর সঙ্গে চুপচাপ সৌবীরপুরে ফিরে এল। সৌবীরপুরে এসে জন-নায়কদের বলল যে, সুমিত্র ইতিমধ্যে তার শক্তি যথেষ্ট দৃঢ় করেছে। অসুরপুরের শুধু আৰ্যশক্তিই নয় – অসুরদের বিরুদ্ধেও আমাদের যুদ্ধ করতে হবে, আর এ জন্যে তৈরী হয়েই সমস্ত কথা সাধারণ মানুষকে বলতে হবে।

বরুণ ছিল নাচের আসরের প্রিয় পাত্র। বছরের পর বছর যে সমস্ত স্ত্রীরা স্বামীদের জন্যে বৃথাই অপেক্ষা করে বিরহ সহ্য করছে তারা যখন এই সুন্দর নর্তকের মুখে তাদের স্বামীদের কীর্তিকলাপ শুনল তখন তা সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করল। ক্ৰমেই এক থেকে অপর কান খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কথাটা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। বরুণ নিজে ছিল  একজন কবি, পতি-বিরহিনী আর্য রমনীদের জীবনীতে অসুর কন্যাদের প্রতি অভিশাপ বর্ষণ উপলক্ষে সুমিত্রের বিলাসপূর্ণ ব্যক্তিস্বার্থ-সর্বস্ব জীবনের আলেখ্য নিয়ে সুন্দর সুন্দর গান রচনা করল। এই গান ক্রমেই দাবানলের মতো সারা সৌবীরের আর্য গ্রামগুলিতে ছড়িয়ে গেল —মুখে মুখে গীত হতে লাগল। কিছু কিছু আর্য স্ত্রীরা যাতে তাদের স্বামীর কাছে যায় তার ব্যবস্থা করা হল। স্বামীদের কাছে তিরস্কৃত হয়ে তাদের ফিরে আসার পরিণাম আরও খারাপ হল। এবার সুমিত্ৰকে সৌবীরপুরে ফিরে আসতে বলা হল এবং সে ফিরে আসতে অস্বীকার করায় তার স্থলে বরুণকে সেনানায়ক নিযুক্ত করে বৃহৎ আর্যবাহিনীর সেনাপতি হিসাবে বরুণকে পুরোভাগে রেখে অসুরপুরীতে অভিযান শুরু হল। বরুণের আগমন বার্তায় সুমিত্রের সৈন্যদের মধ্যে ভাঙন ধরুল এবং অনেকেই নিজেদের অনার্য ব্যবহারের জন্যে অনুতপ্ত হল। অবশিষ্ট সৈন্যদের সাহায্যে সুমিত্রর জিতবার আশা ছিল না, তাই সে বরুণের হাতে নগর সমর্পণ করে সৌবীরপুরে ফিরে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করল। এইভাবে আর্য-জন প্রথমবারের কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হল। বরুণ অসুরদের প্রতি কোনো প্রকারের দয়া প্রদর্শন করল না। অসুরদের কাছে কোনো অস্ত্র না থাকা সত্ত্বেও এবং তারা কোনো যুদ্ধ না করলেও বরুণ তাদের রেহাই দিল না। আর্যরা যাতে অসুরদের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকতে পারে তার জন্যে এক আলাদা আর্যনগরী নির্মাণ করে ঋর্ষি অঙ্গিরা বর্ণিত – শিক্ষাকে কাজে লাগানো হল।*

[*প্রায় দেড়শত পুরুষ আগেকার কাহিনী।]

০৭. সুদাস (স্থান: কুরু-পঞ্চাল (উত্তর প্রদেশের পশ্চিম) ।। কাল: ১৫০০ খৃষ্টপূর্ব)

বসন্তকাল শেষ হয়ে আসছিল। চন্দ্ৰভাগা নদীর তীরে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে পাকা সোনালী গমের শীষগুলি হাওয়ায় দোল খাচ্ছিল, আর এদিক সেদিক থেকে স্ত্রী-পুরুষ গান গাইতে গাইতে ক্ষেতের ফসল কাটছিল। কাটা ক্ষেতের যে সব জমিতে নতুন ঘাসের উদগম হয়েছে সেখানে বাচ্চাসমেত ঘোড়াগুলিকে চরবার জন্যে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রখর রৌদ্রের মধ্যে একজন ক্লান্ত পথিককে আসতে দেখা গেল তার পরনে মলিন ছিন্ন বসন, মাথায় একটি পুরনো চাদর। প্রখর রৌদ্রের মধ্যে ছিন্ন উষ্ণীষে ঢাকা সোনালী চুলের জট দেখা যাচ্ছিল—পুরনো চাদরে শরীর আবৃত, কোমরে জড়ানো ছিলো অন্তর্বাস—হাঁটু পর্যন্ত একখণ্ড কাপড়।

হাতের লাঠির ওপর ভর করে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে চলছিল, পিপাসায় গলার তালু পর্যন্ত শুকিয়ে গিয়েছে। তবু পরবতী গ্রামে পৌছাবেই এই পণ নিয়ে সে এগিয়ে চলছিল, কিন্তু পথের ধারে একটি কুয়া ও ছোট শমীবৃক্ষ দেখে তার পূর্ব প্রতিজ্ঞ ভেঙে গেল। প্রথমে সে উষ্ণীব বস্ত্র খুলল পরে উলঙ্গ হয়ে পরণের ধুতি খুলে একত্রে বেঁধে কৃয়ার মধ্যে একটি প্রান্ত ফেলে দিল, কিন্তু জলের নাগাল পেল না। একান্ত নিরাশ হয়ে শেষ পর্যন্ত গাছের। ছায়ায় গিয়ে বসল। তার মনে হতে লাগল আর কোনোদিন সে উঠতে পারবে না। ঠিক। সেই সময়ই এক কাঁধে একটি মশক, অন্য কাঁধে দড়ি আর হাতে চামড়ার কলসী নিয়ে হাজির হল একটি কুমারী মেয়ে। তরুণীটি কুয়ার কাছে এসে কলসীটা যখন জলে ডেবাতে যাচ্ছে, তার চোখ পড়ল পথিকের দিকে। পথিকের মুখের চেহারা ফ্যাকাসে, ঠোঁট দুটো গেছে, চোয়াল গেছে চুপসে–কিন্তু তা সত্ত্বেও তারুণ্যের দীপ্তি তার মুখমণ্ডলে স্পষ্ট ফুটে বেরুচ্ছিল।

মাথাভরা সোনালী চুলে শিরস্ত্ৰাণ, পরণে কঁচুলি ও অন্তর্বাস আর শরীরের উপরাং উত্তরীয় দিয়ে ঘেরা– সাধারণ হলেও শালীনতা সম্পন্ন বেশভূষার সজ্জিত কুমারীকে পথিক দেখল। রৌদ্রে পথ চলার ফলে তরুণীটির মুখ রক্তিমাও, আর তাঁর কপাল ও ঠোঁটের ওপর দিয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছিল। তরুণীটি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে অপরিচিত পুরুষটির দিকে তাকিয়ে। দেখল, তারপর মাদ্রদেশের মেয়েদের সহজাত মৃদু হাসিতে মুখখানিকে উদ্ভাসিত করে যুবকের অর্ধেক তৃষ্ণা মিটিয়ে মধুস্বরে প্রশ্ন করল, ‘ভাই আমার মনে হচ্ছে তুমি খুবই তৃষ্ণার্তা।’

পথিক ক্ষীণকণ্ঠে বলল, ‘হ্যাঁ আমি খুবই তৃষ্ণাৰ্তা।’

‘বেশ, আমি তোমায় জল এনে দিচ্ছি।’

তরুণীর জলপাত্র ভর্তি হল। ততক্ষণে পথিকও আস্তে আস্তে উঠে তার পাশে এসে দাঁড়াল। তার দীর্ঘ দেহ ও মোটা হাড়ের চেহারা লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে, তার শরীরে অসাধারণ পৌরুষ বিদ্যমান। মাশকের সঙ্গে চামড়ার গেলাসটি ভরে তরুণী পথিকের হাতে দিল। পথিক এক চুমুক জল কোনো রকমে ঢোকা গিলে খেয়ে মাথা নিচু করে একটু বসে। রইল। তারপর এক নিশ্বাসে গেলাসের সমস্ত জলটাই শেষ করল। সঙ্গে সঙ্গে তার হাত থেকে গেলাসটা ছিটকে গড়িয়ে পড়ল আর নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করেও পেছনে ঢলে পড়ল। তরুণী কিছুক্ষণের জন্য হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। তারপর তরুণের চোখের দিকে চেয়ে বুঝল, সে অজ্ঞান হয়ে গেছে। বুঝতে পেরেই সে চট করে নিজের মাথায় বাঁধা শিরস্ত্রাণের কাপড়টি জলে ভিজিয়ে চক্ষু ও কাঁপাল মুছে দিতে লাগল। এইভাবে কিছুক্ষণ। কাটার পর যুবকটি চোখ খুলল। তরুণীটিকে সেবা করতে দেখে লজ্জা ও কুষ্ঠার সঙ্গে বলল, ‘তোমাকে এইভাবে কষ্ট দেওয়ার জন্যে আমি খুবই দুঃখিত।’ ‘আমার কোনো কষ্ট হয় নি, আমি ভয় পেয়েছিলাম। এই রকম কেন হল ভেবে?’

‘বিশেষ কিছু নয়, পেটটা একেবারে খালি তার ওপর অত্যধিক তৃষ্ণায় বেশি জল খেয়েছিলাম–তাই। কিন্তু এখন আর কোনো কষ্ট নেই।’

‘তোমার পেট একেবারে খালি?’ এই কথাগুলি বলে পথিককে জবাব দেবার কোনো অবসর না দিয়ে তরুণী এক দৌড়ে এক পত্র দই, ছাতু ও মধুনিয়ে উপস্থিত হল। তরুণের চেহারায় সঙ্কোচ ও লজ্জার ভাব দেখে কুমারী বলল, ‘পথিক, কোনো সঙ্কোচ কর না। কয়েক বছর হল, আমার ভাই ঘর ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়েছে, তোমার চেহারার সঙ্গে তার অনেকটা মিল আছে তাই তোমাকে সাহায্য করার সুযোগ পেয়ে আমার সেই হারানো ভাইএর কথাই মনে পড়ছে।’ [* প্ৰায় দেড়শত পুরুষ আগেকার কাহিনী।]

পথিক পত্র নিয়ে নিল। তরুণী বালতি থেকে জল দিল। যুবকটি সেই জলে ছাতুগুলে পান করল। খাওয়া-দাওয়ার পর তার চেহারা থেকে পথশ্রমের চিহ্ন প্রায় অর্ধেকটা মুছে। যেতে তার মুখে ফুটে উঠল একটা কৃতজ্ঞতার ভাব। কিভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা যায়–সে ভাবছিল।

তরুণী তার মনের ভাব আঁচ করেই বলল, ‘সঙ্কোচ করার কোনো দরকার নেই। বোধহয় তুমি অনেক দূর থেকে আসছি, তাই না?’

‘ হ্যাঁ, অনেক দূর, পূর্বদিক–পঞ্চাল থেকে।’

‘কোথায় যাবে?’

‘এখানে ওখানে–যেখানে হোক।’

‘তবু?’

‘এখন তো আমি কাজ খুঁজছি, যাতে খাওয়া-পরার ব্যবস্থাটা হতে পারে।’

‘কোন করব না? চাষের সব কাজই পারি। মাড়াই করতেও জানি। গরু, ঘোড়ার রাখালিতাও পারি। আমার শরীরে শক্তিও যথেষ্ট, এখন একটু কাহিল হয়ে পড়েছি বটে কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে আবার কঠিন পরিশ্রমের উপর্যুক্ত স্বাস্থ্য আমি ফিরে পাব। এটা বলতে পারি যে, আমার কাজে কোনোদিনই কোনো মালিক অখুশী হয়নি।’

‘তা’হলে আমার মনে হচ্ছে আমার বাবা তোমাকে কাজ দেবে। জলের পাত্র ভরে নিই, তুমি আমার সঙ্গে চল।’

তরুণটি মশক বয়ে নিয়ে যাবার জন্যে চেষ্টা করল, কিন্তু তরুণী কিছুতেই রাজী হল না। ক্ষেতের ওপর একটি লাল তাঁবু আর বাইরে বসেছিল প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ জন স্ত্রী-পুরুষ। এদের মধ্যে তরুণীর পিতা কে, পথিক সেটা আন্দাজ করতে পারল না। সকলেরই সাদা কাপড়, হরিতাভ কেশ, গৌরবর্ণ গায়ের রঙ ও প্রাণবস্তু মুখ। তরুণী জল-ভরা মশক ও বালতিটি রাখল, তারপর ষাট বছরের বৃদ্ধ কিন্তু বলিষ্ঠ দেহ পুরুষের কাছে গিয়ে বলল, ‘পিতা, এই পরদেশী তরুণ কাজ চাইছে।’

‘হে কন্যা! ক্ষেতের কাজ করতে চায় কি?’

‘ হ্যাঁ, যেখানে হোক।’

‘তাহলে এখানেই কাজ করুক। অন্যরা যা মজুরী পায় সেও তাই পাবে।’

তরুণ কথাবার্তা সবই শুনছিল। বৃদ্ধ তাকে ডেকে নিয়ে কথাগুলি আবার বলল, সে রাজী হল। বৃদ্ধ পুনরায় তাকে বলল, ‘এস আগন্তুক, আমরা এখন মধ্যাহ্ন ভোজন করছি—তুমিও যোগ দাও।’

‘হে আৰ্য! আমি এখনি খেয়েছি, তোমার মেয়ে আমাকে দিয়েছে।’

‘আৰ্য-টার্জ নই, আমার নাম জেতা, ঋজু-পুত্র মাদ্র। এস তুমি যা পার খাও ও পান। কর। অপালা, মেরীয় (ঘোটকীর দুধে তৈয়ারী কাঁচা মদ) দাও তো। রৌদ্র-তাপে দগ্ধ হলে শরীরে বল এনে দেবে। হে তরুণ! এখন আর কোনো কথা নয়। সন্ধ্যায় আমরা আলাপআলোচনা করব। তোমার নামটা বলা।’

‘সুদাস পঞ্চাল।’

‘সুদাস নয়, সুন্দা–সুন্দর দান দেয় যে! তোমরা পূর্ব-দেশের লোকেরা ঠিকমতো শব্দের উচ্চারণ করতে পার না। তোমার দেশ পঞ্চাল জনপদে? ভালো কথা। অপালা, এই পূর্ব-দেশের লোকেরা একটু বেশি লাজুক হয়। একে ভালো করে খাওয়াও, যাতে সন্ধ্যার মধ্যে কিছু কাজ করার উপর্যুক্ত হয়ে উঠতে পারে।’

অপালার উপরোধ সুদাস দু’তিন পাত্র মেরায় আর রুটি গলাধঃকরণ করল। গত দুদিন তার পেটে কিছু পড়েনি। তাই ক্ষুধাবোধও কমে গেছে। সূর্যের তেজ যতই কমতে লাগল সুদাসের শরীরেও তত বল ফিরে আসতে লাগল আর সন্ধ্যার কাজ শেষ হবার আগে দেখা গেল, ক্ষেতে গম কাটার ব্যাপারে সে কারুর পেছনে পড়ে রইল না।

জেতার ক্ষেত যে খুবই বড় ছিল তা মাড়াই করার জন্য উপস্থিত দুই শতের বেশি। লোক দেখে বোঝা যায়। ক্ষেতের এক প্রান্তে রন্ধন কাজে ব্যাপৃত লোকেরা ব্যস্ত। একটা পুষ্ট ষাঁড় আজ কাটা হয়েছে তার কিছু হাড়, নাড়িতুড়ি আর কিছুটা মাংস টুকরো করে বড় ডেকচিতে সন্ধ্যা হবার ঘণ্টা দিনেক আগেই চাপানো হয়েছিল। বাকিটা নুনের সঙ্গে জলে ফুটিয়ে রাখা হচ্ছে। ঘরগুলোর পাশেই বড় সমতলভূমি–মাড়াই এর কাজ হয়। জলের জন্য কাঁচা পাতকুয়া আর জলভর্তি কুণ্ড ছিল। স্ত্রী-পুরুষেরা এখানে হাত মুখ ধুচ্ছিল–কেউ কেউ অবগাহন করে নিল। রাত্রের অন্ধকার ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে জলের ধারে সারি দিয়ে বসা স্ত্রী পুরুষের সামনে রুটি, মাংসখণ্ড ও পাত্রভর্তি মদ দেওয়া হল। সুদাসের লাজুকতার কথা মনে রেখে অপালা তাকে তার পাশেই বসিয়েছিল, সুদাসকে দেখে তার নিরুদ্দিষ্ট ভাই-এর কথাই মনে পড়ছিল। খাওয়ার পর নাচ-গান শুরু হল। আজকের রাতের নৃত্য আসরে সুদাস যোগ দেয়নি বটে, কিন্তু পরবর্তীকালে এই নৃত্যসভায় সে সর্বপ্রয় গায়ক ও নর্তক হয়েছিল।

মাস দেড়েক ফসল কাটা, মাড়াই ও বাঁধার কাজ চলতে লাগল। সপ্তাহ দুই যেতে না যেতে সুদাসকে যেন আর চেনাই যায় না–একেবারে নতুন মানুষ। তার গালে স্বাভাবিক রক্তাভা দেখা দিল। হাড় আর শিরাগুলো মাংস ও চামড়ার মধ্যে ঢাকা, পড়ে গেছে। প্রথম সপ্তাহের শেষে জেতা তাকে এক প্রস্থ কাপড় উপহার দিয়েছে।

ফসল মাড়াই-এর কাজ প্রায় শেষ হয়ে এল। পিতা-পুত্রী ও সুদাস সমেত মোট জনা ছয়েক তখনও কাজ করছিল–বাকি সকলে ফসলের ভাগ নিয়ে চলে গেছে। এইসব লোকদের জমির পরিমাণ খুবই কম, তাই তারা নিজেদের ফসল কাটার পর জেতার জমিতে এসে কাজ করত।

একদিন সন্ধ্যার পর জেতা সুদাসের সামনে পূর্ব-দেশ সম্বন্ধে আলোচনা শুরু করল। অপালা পাশে বসে শুনতে লাগল। জেতা বলল, ‘সুন্দা’ পূর্ব-দেশে আমি খুব বেশীদূর পর্যন্ত যাইনি বটে, কিন্তু পঞ্চালপুরে (অহিচ্ছত্ৰে) আমি গেছি। সেখানে শীতকালে আমি ঘোড়া বিক্রী করতে যেতাম।

‘পঞ্চাল (রোহিলখণ্ড) তোমার কেমন লাগল, হে আর্যবৃদ্ধ!’

’জনপদ হিসাবে মন্দ নয়, আমাদের এই মাদ্র দেশের মতোই সুরক্ষিত ও সম্পন্ন বরং ক্ষেতের উর্বরতার দিক থেকে এখানকার চেয়ে বেশি সুফলা, কিন্তু…’

‘কিন্তু কি?’

‘ক্ষমা কর সুন্দা–ওখানে মানুষ থাকে না।’

‘মানুষ থাকে না! তাহলে থাকে কারা–দেবতা না দানব?’

‘আমি এইটুকুই শুধু বলব যে, ওখানে মানুষ থাকে না।’

‘আর্যবৃদ্ধ! আমি রাগ করব না, আমায় বল, কেন তোমার এই ধারণা?’

‘তুমি এখানে দু’শো নর-নারীকে আমার ক্ষেতে কাজ করতে দেখেছ?’

‘হ্যাঁ, সে তো দেখতেই পাচ্ছি।’

‘তারা আমার জমিতে কাজ করে। জমিতে কাজ করে বেতন পায় কিন্তু কখনও কি দেখেছি মাথা নিচু করে তাদের হীনতা প্ৰকাশ করতে?’

‘না, বরং মনে হয় সকলেই যেন তোমার পরিবারের মানুষ।’

‘হ্যাঁ, একেই মানুষ বলে। তারা আমার পরিবারেরই লোক। সকলেই মান্দ্রের নরনারী। পূর্ব-দেশেও এই রকম দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে দাস ও স্বামী সম্পর্ক, মানুষ নেই, বন্ধু পাওয়া যায় না।’

‘আর্যবৃদ্ধ! তুমি সত্য বলেছ। মানবতার মূল্য শতদ্রু পেরিয়ে এই মাদ্রভূমিতে এসে দেখছি। মানুষের মধ্যে বাস করতে পাওয়াটা আনন্দ ও সৌভাগ্যের কথা।’

‘পুত্ৰ, তোমার কথায় আমি খুশি হয়েছি। তুমি আমার কথায় রাগ করনি। আপন আপন জন্মভূমিকে সকলেই ভালোবাসে, তা হল দেশপ্ৰেম।’

‘কিন্তু প্রেম মানে দোষ-ত্রুটি সম্পর্কে চোখ বুঁজে থাকা নয়!’

‘আমি কুরু-পঞ্চাল দেশে যাবার সময় বহুবার এ কথা ভেবেছি, এ দেশের পণ্ডিতদের সঙ্গে আলোচনাও করেছি। এইসব দোষ কি করে এল। তার কারণ, বুঝতে পেরেছি, কিন্তু। প্ৰতিকার কি করে হবে জানি না।’

‘কারণগুলো কি আর্যবৃদ্ধ?’

‘যদিও পঞ্চালদের বাসস্থানকে পঞ্চাল জনপদ বলা উচিত, কিন্তু পঞ্চলের অর্ধেক অধিবাসীও পঞ্চাল-জনের নয়।’

‘ হ্যাঁ, বাইরে থেকে আসা আগন্তুকও অনেক আছে।’

‘আগন্তুক নয় পুত্র! আদি-নিবাসী অনেক আছে। ওখানকার শিল্পী, কারিগর, ব্যবসায়ী,ওখানকার দাস, সকলেই পঞ্চাল-জনের লোকেরা ওখানে পৌঁছবার অনেক আগে থেকেই বাস করত। তাদের গায়ের রঙ দেখেছ?’

‘হ্যাঁ, পঞ্চাল-জন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কালো অথবা তাম্রবর্ণ।’

অপালা প্রশ্ন করল, ‘পঞ্চাল-জনের গায়ের রঙ কি মাদ্রদের মতোই গৌরবর্ণ।’

সুদাস উত্তর দিল, ‘কম বেশি হবে।’

জেতা বলল, ‘হ্যাঁ কম বা বেশি। কেননা অন্যের সঙ্গে রক্ত সংমিশ্রণের ফলে এই পরিবর্তন ঘটেছে। আমার ধারণা, যদি মাদ্রদের মতোই ওখানে শুধু পিঙ্গল কেশ আর্যরা বাস. করত তাহলে হয়ত শুধু মানুষ দেখা যেত। আর্য ও আর্য-ভিন্ন দুই উঁচু-নীচু ধারণা থেকেই ভিন্ন বর্ণের সৃষ্টি হতে পারে।’

‘তুমি ঠিকই বলেছ। তুমি বোধহয় জান, এই আর্য-ভিন্নদের অর্থাৎ যাদের আগে অসুর বলা হত তাদের মধ্যে উঁচু-নীচু ও প্রভুর সম্বন্ধ বিদ্যমান ছিল।’

‘হ্যাঁ, কিন্তু পঞ্চালেরা সকলেই তো আর্য-জনের এক রক্ত এক শরীর থেকে জন্মলাভ করেছে। কি করে তাদের মধ্যে উঁচু-নীচু ভেদাভেদ এসে অনুপ্রবেশ করল! পঞ্চলের রাজা দিবোদাস একবার আমার কাছ থেকে ঘোড়া কিনেছিল, আমাকে তার সামনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সুগঠিত দেহ গৌরবর্ণের যুবক, কিন্তু মাথায় এক ভারী মুকুট, তাতে লাল হলদে। রঙ। কানে বড় বড় কুণ্ডল। তার আঙ্গুলো ও গলায় নানা অলঙ্কার। তাকে দেখে আমার মন, করুণায় ভরে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল পূৰ্ণচন্দ্রকে যেন রাহু গ্ৰাস করেছে। তার সঙ্গে তার স্ত্রীও ছিল, তাকে যে-কোনো মাদ্র সুন্দরীর মতোই দেখাচ্ছিল। কিন্তু লাল-হলদে অলঙ্কারে বেচারী নুয়ে পড়েছিল।’

সুদাসের বুক দুরদুর করে উঠল। তার মনের চাঞ্চল্য যাতে মুখে ফুটে না ওঠে তারই চেষ্টা সে প্রাণপণে করতে লাগল, কিন্তু তাতে সফল না হয়ে কথাটা ঘুরিয়ে দেবার জন্যে বলল, ‘আর্যবৃদ্ধ! পঞ্চালরাজ কি তোমার ঘোড়াগুলো কিনল?’

‘হ্যাঁ, কিনল। তো বটেই, ভালো দামও দিল। কত দিয়েছে এখন আর মনে নেই। কিন্তু দেখতে দেখতে আমার জ্বর আসছিল, পঞ্চাল-জনের রাজার সম্মানে নতজানু হয়ে যেভাবে বন্দনা করছিল তা দেখে কার না গা ঘেন্নায় শিউরে ওঠে। যদি মাথাও কেটে নেওয়া হয় তবু। কোনো মাদ্র ওইভাবে মাথা নোয়াতে পারবে না।’

‘তোমাকে তো আর ওই রকম করতে হয়নি, আর্যবৃদ্ধ?’

‘আমাকে বললে ওইখানেই খুনোখুনী হয়ে যেত। পূর্ব-দেশের রাজারা কোনো ওই ধরনের হুকুম করতে সাহস পায় না। তবে ওখানে, ওটা তাদের সনাতন রীতি।’

‘কোন বলুন তো?’

‘কেন, জানতে চাও? সে এক বিরাট কাহিনী। যখন পশ্চিম থেকে এগোতে এগোতে পঞ্চাল-জনের লোকেরা যমুনা, গঙ্গা ও হিমালয়ের মধ্যবতী দেশে বসতি স্থাপন করল তখন তারা মাদ্র-জনের মতো একটি পরিবারের মতো থাকত। তারপর অসুরদের সঙ্গে ওদের মেলামেশা বাড়তে লাগল আর তাদের অনুকরণে পঞ্চাল-জনের লোকেদের মধ্যে অনেক সর্দার, রাজা বা পুরোহিত হবার জন্য লালায়িত হতে লাগল।’

‘কিন্তু লালায়িত হল কেন?’

‘লোভের জন্য, নিজে মেহনত না করে অন্যের পরিশ্রমের ফল ভোগ করার জন্যে। এই রাজা ও পুরোহিতরাই পঞ্চালদের মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি করেছে–এরাই আর তাদের মানুষ থাকতে দেয়নি’–কথা বলতে বলতে জেতা নিজের কাজে চলে গেল।

 

২.

মাদ্রপুরে (শিয়ালকোট) জেতার পরিবারের মধ্যে সুদাস চার বছর কাটিয়ে দিল। জেতার স্ত্রী ইতিপূর্বেই মারা গেছে। বিবাহিতা ভগ্নী ও কন্যাদের মধ্যে দু’একজন মাঝেমধ্যে এসে থাকত। কিন্তু গৃহের স্থায়ী বাসিন্দা ছিল জেতা, সুদাস আর অপালা। অপালার বয়স এখন বছর কুড়ি। উভয়ের ব্যবহারে বেশ বোঝা যেত যে, অপালা ও র মধ্যে পারস্পরিক প্রেম বিদ্যমান। মাদ্রপুরের সুন্দরীদের মধ্যে অপালার যথেষ্ট খ্যাতি ছিল আর সেখানে সুন্দর তরুণের অভাব ছিল না। যারা তার প্রেম প্রার্থনা করত। আবার সুদাসের মতো। সুপুরুষ যুবকের জন্যে সুন্দরী তরুণীরও অভাব ঘটত না। কিন্তু এখানকার লোকেরা সর্বদাই দেখেছে। সুদাসকে অপালার সঙ্গে আর অপােলাকে সুদাসের সঙ্গে নাচতে। জেতাও এ কথা জানত, এর পরিণামের কথা ভেবে সে খুশীও হত যদি সুদাস স্থায়ীভাবে তাদের মধ্যে বসবাস করতে রাজী হয়। কিন্তু সুদাস মাঝে মাঝে তার বাবা মা সম্বন্ধে উৎকণ্ঠিত হয়ে। পড়ে তাতেই জেতার ভাবনা, কারণ সে জানত, সুদাস মা-বাপের একমাত্র সন্তান।

চন্দ্ৰভাগা নদীর অপর নাম ছিল প্রেমিক-প্রেমিকদের নদী। একদিন অপালা ও সুদাস সেখানে স্নান করতে গেছে। এর আগেও অনেকবারই স্নানের সময়ে সুদাস অপালার নগ্ন। শারীরিক সৌন্দর্য দেখেছে, কিন্তু প্রায় পঞ্চাশটি নিরাভরণ দেহের সুন্দরীর নগ্ন সৌন্দর্যের। পাশে অপলার সৌন্দর্য দেখে মনে হল যে, আজই যেন প্রথম সে তার সঙ্গিনীর অপরূপ : লাবণ্যময়ী রূপ-মাধুরীর পূর্ণ পরিচয় পেল। ফিরবার পথে সুদাসকে মৌন দেখে অপালা প্রশ্ন করল, ‘সুদাস! আজ যে তুমি কথা বলছি না, খুব পরিশ্রান্ত না-কি? চন্দ্রভাগার খরস্রোতে দু’বার সাঁতরে পাড়ি দিলে পরিশ্রম তো হবেই।’

‘পরিশ্রম তো তোমারও হয়েছে অপােলা! তুমিও একবার পাড়ি দিয়েছ, আর আমি মাত্র দু’বার; সময় পেলে দশবার এপার-ওপার করতে পারতাম।’

‘জল থেকে উঠবার সময় আমি দেখছিলাম তোমার বুকের ছাতিটা চওড়া হয়েছে; তোমার হাত পায়ের পেশীগুলিও যেন দ্বিগুণ স্ফীত।’

‘সীতার কাটা খুবই ভালো এতে শরীর বলিষ্ঠ ও সুন্দর হয়। কিন্তু অপালা তোমার, সৌন্দর্যের সঙ্গে কারও তুলনা হয় না। তুমি ত্ৰিভুবনের মধ্যে অনুপম সুন্দরী।’

‘নিজের চোখ দিয়েই দেখে বলছি তো সুদাস?’

‘হ্যাঁ! মোহের বশবতীর্ণ হয়ে বলছি না। অপালা!’

‘বেশ! কিন্তু তুমি কোনোদিন আমার চুম্বন প্রার্থনা করনি, অথচ তুমি জান, মাদ্র তরুণীরা এ জিনিস খুবই উদারভাবে বিতরণ করে থাকে।’

‘সে তো তোমাকে দেখে আমি আমার ভাই শ্বেতপ্রবাহকেই দেখতে পাই।’

‘তাহলে এখন আর চুমু দেবে না?’

‘চাইলে কেন দেব না?’

‘আর চাইলে তুমি আমার হবে?’

‘ও কথা বলো না। সুদাস! অস্বীকার করলে আমিই দুঃখ পাব।’

‘কিন্তু এ দুঃখ আসতে না দেওয়া তোমারই হাতে।’

‘আমার নয়, তোমারই হাতো।’

‘কি ভাবে?’

‘তুমি কি সারা জীবনের জন্যে আমার পিতার এই ঘরে থাকতে প্রস্তুত?’

সুদাস বহুদিন থেকেই এই মুহূর্তটির আশঙ্কা করছিল, যখন মধুভরা ওই মুখ থেকে এই কঠিন প্রশ্নটি শুনতে হবে। বিদ্যুতের মতো কথাটা মৰ্মস্থলে আঘাত করল এক মুহূর্তের জন্য মুখটা স্নান হয়ে উঠেছিল। দ্বিধা ও সঙ্কোচে। কিন্তু তার মনোভাব অপালাকে বুঝাতে না দিয়ে সে শান্তভাবে বলল, ‘আপালে, তোমায় আমি ভালোবাসি।’

‘তা আমি জানি, আর তুমিও আমার মনের কথা জােন। আমি চিরকালের জন্যই তোমার হয়ে থাকতে চাই, তাতে আমার বাবাও খুশী হবে। কিন্তু তার জন্যে তোমায় পঞ্চাল থেকে চিরবিদায় নিতে হবে!’পঞ্চাল চিরকালের জন্যে ছেড়ে দেওয়া আমার পক্ষে কঠিন নয়; কিন্তু সেখানে রয়েছে আমার বৃদ্ধ মাতা-পিতা। আমি ছাড়া মায়ের আর কোনো সন্তান নেই। মাকে আমি কথা দিয়েছিলাম, মৃত্যুর আগে তার সঙ্গে দেখা আমি করবই।’

‘মাকে যে কথা দিয়েছ তার খেলাপ করাতে আমি চাই না, সুদাস! তোমার প্রতি আমার যে প্রেম তা চিরকালই থাকবে; এমন কি তুমি যদি আমায় ফেলে চলে যাও,.. তা’হলেও আমি অপেক্ষা করব তোমার জন্য–জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করব।–কিন্তু আমাদের নিজেদের কাছে করা প্রতিজ্ঞা আমরা দু’জনেই ভাঙতে পারি না।’

‘তোমার মনের কথা বল, অপালে!’

‘মানবভূমি ছেড়ে অ-মানবভূমিতে কখনো যাব না।’

‘অ-মানবভূমি, পঞ্চাল জনপদ?’

‘হ্যাঁ, যে দেশে নারীর স্বাধীনতা নেই–সে দেশে মনুষ্যত্বের মূল্য নেই।’

‘তোমার সঙ্গে আমি একমত।’

‘আর এই জন্যেই তোমাকে এই চুম্বন দিচ্ছি।’ এই বলে অপালা তা অশ্রুসিক্ত গালটি। সুদাসের ঠোঁটের ওপর চেপে ধরল। সুদাসের চুম্বন শেষ হলে অপালা তার ঠোঁট দিয়ে সুদাসের ঠোঁটে দীর্ঘ চুমু খেল। তারপর বলল, ‘তুমি যাও, একবার মায়ের সঙ্গে দেখা করে এস; তোমার জন্যে আমি এই মাদ্রপুরে অপেক্ষায় থাকব।’

অপালার এই অকৃত্রিম কথাগুলি শুনে সুদাসের নিজের ওপর অসীম ঘৃণা জন্মল, যা কোনোদিনই সে মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি। ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মা বোপকে দেখতে যাওয়ার অনুমতি চাইল, পিতা-পুত্রী উভয়েই সম্মতি দিল।

প্রস্থানের আগের দিনটা অপালা বেশি বেশি করে সুদাসের আশেপাশে অনুক্ষণ ঘুরতে। থাকল। তাদের দু’জনেরই পদ্ম পাপড়ির মতো নীল চোখ দুটো জলে ভেসে যাচ্ছিল, আর ওরা তা গোপন করছিল না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তারা চুম্বনে, নিভৃতে নীরব হয়ে চোখে চোখ রেখে বসে রইল, আবার কখনও দৃঢ় আলিঙ্গনে পরস্পরকে আবদ্ধ করল।

যাবার মুহূর্তে অপালা শেষবারের মতো তার কণ্ঠালগ্ন হয়ে বলল, ‘আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকব, সুদাস!’

 

৩.

সুদাস তার মাকে ভালোবাসত গভীরভাবে। পিতা দিবোদাস ছিলেন একজন প্রভাবশালী রাজা—যাঁর গুণগানে বিশ্বমিত্র ও ভরদ্বাজ শ্লোক লিখেছেন। এই শ্লোকগুলি লিপিবদ্ধ আছে ঋগ্বেদে, (ঋগ্বেদ, ৬/২৬/২, ২৫) এগুলো সংগৃহীত হওয়াও ঋগ্বেদে স্থান পাওয়ায় নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে, ঋষিদের চাটুকারের অভাব ছিল না।

সুদাসের ভালোবাসা ছিল তার মায়ের জন্য। সে ভালোভাবেই জানত, তার মায়ের মতো দিবোদাসের আরো স্ত্রী আছে, আছে অসংখ্য দাসী। পঞ্চলের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী-রাজার জ্যেষ্ঠ পুত্রের মা-হিসাবে বিশেষ সম্মান পেলেও বৃদ্ধ দন্তহীনার জন্যে। রাজার অন্তরে কোনো প্রেম ছিল না; দিবোদাসের অন্তঃপুরে রাত্রিবাসের জন্য নিত্য নব তরুণীর আনাগোনা ছিল। সুদাস মায়ের একমাত্র পুত্র হলেও তাঁর পিতার একমাত্র পুত্র ছিল। না। তার অনুপস্থিতিতে বৈমাত্ৰেয় ছোট ভাই প্ৰতর্দন দিবোদাসের উত্তরাধিকারী হত।

বছরের পর বছর কেটে যাবার পর সুদাসকে না দেখে মা তাকে দেখবার আশা ছেড়েই দিয়েছিল। আর অনবরত চোখের জল ফেলতে ফেলতে চোখের দৃষ্টি হয়েছিল ক্ষীণ সুদাস একদিন কাউকে খবর না দিয়ে, বাবার সঙ্গে দেখা না করে মায়ের সামনে এসে হাজির হল। মাকে নিষ্প্রভ চোখ দুটো মেলে সুদাসের দিকে চেয়ে থাকতে দেখে সুদাস বলল, ‘মা! আমি তোমার সুদাস।’

শুনে মায়ের চোখ দুটো দীপ্ত হয়ে উঠল। কিন্তু নিজের জায়গা থেকে একটুও না নড়ে বলল, ‘তুই সত্যিই যদি আমার সুদাস, তবে আমার দৃষ্টির বাইরে দূরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তোর দু’হাত দিয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরছিস্ না কেন? তোর দু’হাত দিয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরছিস্ না কেন? আমার কোলে মাথা রাখছিস না কেন?’

সুদাস মায়ের কোলে মাথা রাখল। মা হাত বুলিয়ে দেখল। নিজের চোখের জলে সুদাসের গাল, কপাল, চুল ভিজিয়ে দিয়ে বার বার চুমু খেতে লাগল। মায়ের চোখের জল বন্ধ করতে না পেরে সুদাস বলল, ‘মা! আমি তো এখন তোমার কাছে এসে গেছি, তবু কাঁদছ কেন তুমি?’

‘আজকের দিনটা, শুধু আজকের দিনটা আমায় কাঁদতে দাও। আজ আমি একটু কেঁদে নি। এই আমার শেষ কান্না সুদাস, আমার চোখের মণি!’

খবর গিয়ে পৌঁছাল অন্তঃপুর থেকে রাজার কানে। রাজা, এল দৌড়ে, সুদাসকে আলিঙ্গন করল, আনন্দীশ্রী বইতে লাগল তারও চোখে।

দিন কাটতে লাগল, দিন থেকে মাস গেল। বছর গেল–দুটো বছর শেষ হল। মাবাপের সামনে সুদাস মুখের প্রসন্নতা বজায় রাখার চেষ্টা করত, কিন্তু নির্জনে তার কানে সেই বজ্রচ্ছেদিকা ধ্বনি বেজে উঠত : ‘আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করে থাকব।’ আর–তার চোখের সামনে ভেসে উঠত সেই কম্প্রমান রক্তাভ ওষ্ঠদ্বয়–চোখের দৃষ্টি যতক্ষণ না ঝাপসা হয়ে উঠত, সে যেন অপালাকে দেখতে পেত! মনের দোটানায় ছিঁড়ে পড়ত। একদিকে অপালার অকৃত্রিম প্রেম অপরদিকে বৃদ্ধ মায়ের বাৎসল্য-ভরা হৃদয়। মায়ের হৃদয় বিদীর্ণ করে চলে যাওয়া নিজের কাছে আত্মসর্বস্ব নিচ কাজ বলে মনে হত। তাই সে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করল, মা বেঁচে থাকা পর্যন্ত পঞ্চাল ছেড়ে যাবে না। কিন্তু রাজ-পুত্রের মতো বিলাসিতার জীবন সে মেনে নিতে পারছিল না। সে বুঝেছিল এটা তার সামর্থ্যের বাইরে। অইতার প্রতি তার সশ্রদ্ধ ব্যবহার বজায় রেখে তার আদেশ পালনের চেষ্টা করত।

একদিন বৃদ্ধ রাজা পুত্রকে ডেকে বললেন, ‘বৎস সুদাস! আমার দিন শেষ হয়ে এসেছে। আর আমার পক্ষে পঞ্চলের শাসনভার বহন করা সম্ভব নয়।’

‘তাহলে আর্য এই ভার পঞ্চালদের ওপর দিচ্ছ না কেন?’

‘পঞ্চালদের? তোমার অভিপ্ৰায় আমি বুঝতে পারলাম না।’

‘আৰ্য, এ রাজ্য আসলে পঞ্চালদেরই। আমাদের পূর্ব পুরুষেরা পঞ্চাল-জনের সাধারণ লোক ছিল। তখন পঞ্চলের কোনো রাজা ছিল না। পঞ্চাল-জনের সাধারণ লোকেরাই শাসন চালাত। যেমন আজও মল্ল, মাদ্র অথবা গান্ধার-জনের লোকেরা চালায়। তারপর প্রপিতামহ বধ্যশ্ব; আত্মসুখের লোভ, ভোগের লোভ, অপরের পরিশ্রমের ফল ভোগের লোভে পড়েছিল। একদা সে হয়ত জন-পতি ছিল, পরে হয়ত সেনাপতি হয়েছিল, আর কয়েকটা যুদ্ধে জয়লাভ করে সারা জনের সম্মান লাভ করল। সেই সবের সুযোগ জনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করল। জন-শাসন খতম করে অসুরদের মতো ব্যক্তি-শাসন রাজত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করল। অনসুরদের মতোই পুরোহিতদের সৃষ্টি করল, বশিষ্ঠ বা বিশ্বামিত্রের পূর্ব পুরুষকে পুরোহিত পদ ঘুষ দেওয়া হল, তার পরিবর্তে সেই সব পুরোহিতরা সাধারণ মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে প্রচার শুরু করে দিল—ইন্দ্ৰ অগ্নি, সোম, বরুণ, বিশ্বদেব এবং অন্যান্য দেবতারা রাজাকে পাঠিয়েছে পৃথিবীর প্রজাকে শাসন করার জন্যে। কাজেই জনের সাধারণ মানুষ যেন রাজার হুকুম মেনে চলে আর যথাবিহিত সম্মান করে। এর সবটাই ছিল বেইমানি। ডাকাতির ভাগ বাঁটোয়ারা। পিতা! আমাদের পূর্ব পুরুষ যে রাজত্ব গড়ে গেছে তা বিশ্বাসহন্তার রাজত্ব। তাদের নাম পর্যন্ত আমাদের ভুলে যেতে হবে-তাদের প্রতি আমাদের কোনো রকম কৃতজ্ঞতা বা মোহ থাকা উচিত নয়।’

‘না পুত্র! বিশ্ব (সারা) জনকে আমি আমার রাজকৃত (রাজা করার অধিকারী) বলে স্বীকার করি। অভিষেকের সময় জনের সাধারণ লোকেই রাজচিহ্ন পলাশদণ্ড দেয়।’

‘রাজার অভিষেকের উৎসব একটা তামাশা মাত্র। সত্যি সত্যি কি জনের লোকেরা (প্রজারা) রাজার মালিক? না! আর এ কথা খুবই স্পষ্ট, যখন আমি দেখি, রাজা নিজের জনের সঙ্গে একত্ৰে সকলের সমান হয়ে বসে না, আহার করে না, কাজও করে না। মাদ্র বা গান্ধার জন-পতি কি এ রকম করতে পারত?’

‘আমরা যদি তাদের মতো থাকি তাহলে যে কোনো শত্ৰু, যে-কোনো সময় আমাদের হত্যা করবে বা বিষ দিয়ে মেরে ফেলবে।’

‘চোর বা অপহারকদেরই এ ভয় হতে পারে। জন-পতি চোর নয়, অপহারকও নয়। বস্তৃত তারা জনের শ্রেষ্ঠ সন্তান, তাদের ব্যবহারও সেইরকম–তাই তাদের ভয় নেই। আর রাজাদের কথা আলাদা, তারা জনের অধিকার অপহরণকারী, তাই সব সময়েই জনকে ভয় করে চলতে হয়। রাজাদের রাত্রিবাসের অন্তঃপুরের জন্য, সোনা-দানা রক্ষার জন্য সংগ্ৰহ করতে হয় ক্রীতদাস। রাজাদের রাজভোগ নিজের পরিশ্রমে অর্জিত নয় অপরের পরিশ্রম অপহরণ করে তা ভোগ করে।’

‘পুত্র! তুমি কি এর জন্য আমাকে দোষী সাব্যস্ত করছ?’

‘আৰ্য, তা মোটেই নয়! তোমার এ আসনে বসলে ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক আমাকেও তোমার মতো হতে হবে। তাই আমার পিতা দিবোদাসকে আমি দোষী সাব্যস্ত করছি না।’

‘তুমি যে পঞ্চাল-জনের হাতে রাজ্য ফিরিয়ে দিতে বলছ, তা কি সম্ভব? তোমাকে বুঝতে হবে, জনের অধিকার অপহারকা কেবলমাত্র পঞ্চালরাজ দিবোদাসই নয়; অপহারকদের মধ্যে আছে সামন্তরা। রাজা বড় হতে পারে। কিন্তু জনের সম্মিলিত শক্তির সামনে পঙ্গু। এদিকে আছে সামন্ত ও উগ্র রাজপুত্র (রাজবংশ-জাত সন্তানরা) এবং সেনাপতি ছাড়াও প্রধান সামন্ত হচ্ছে পুরোহিত।’

‘হ্যাঁ, পুরোহিতদের ক্ষমতার কথা জানি। জ্যেষ্ঠ পুত্র ছাড়া অন্যান্য পুত্ররা তো রাজপদ পায় না। তাই তারা পুরোহিত (ব্রাহ্মণ) হয়। আমার ছোট ভাই প্রতর্দনও হয়ত তাই হবে। রাজা ও পুরোহিতদের মধ্যে এখন রাজবেদী (সিংহাসন) ও যজ্ঞবেদী নিয়ে বাঁটোয়ারা হচ্ছে। আমি দেখতে পাচ্ছি, ভবিষ্যতে ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণ দুটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠী গড়ে উঠবে। মাদ্র ও গান্ধার দেশে যুদ্ধ ও যজ্ঞ উভয় কাজ একই লোক করতে পারে, কিন্তু পঞ্চালপুরের যুদ্ধবৃত্তি বাধ্যশ্ব পৌত্র দিবোদাসের হাতে, আর যজ্ঞ বিশ্বামিত্রের করায়ত্ত। ইতিমধ্যেই জনের অধিকার তিন ভাগে বঁটায়ারা হয়েছে। জনের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে রাজা ও পুরোহিতরা ক্ষমতার অধিকারী হিসাবে, জনের অধিকার হরণের অংশীদার হিসাবে, বৈবাহিক বন্ধনের দ্বারা এক হতে পারে; কিন্তু এখন এরা আলাদা আলাদা শক্তি হিসাবে গণ্য তাই স্বার্থের সংঘাত শুরু হয়েছে এবং ভবিষ্যতে পৃথক গোষ্ঠীতে পরিগণিত হতে চলেছে। এই কারণেই ব্ৰাহ্মণ ক্ষত্রিয়ের সখ্য পুনঃস্থাপনের প্রয়াস দেখা দিয়েছে। জনের সাধারণ মানুষ এই দুই শ্রেণীর বাইরে। আজ এই বিশাল জনের নাম বদলে বিশ্ব (বিট) বা প্রজা বলা হচ্ছে। কি বিড়ম্বনা দেখ, একদিন যে জন (পিতা) ছিল, তাকে প্রজা (পুত্র) আখ্যা দেওয়া হয়েছে। আর্য! একে কি তুমি প্রবঞ্চনা বলবে না?’

‘পুত্র! এ ছাড়াও আরো অনেকে আছে যাদের তুমি গণনার মধ্যে ধরনি।’

‘হ্যাঁ, আর্য জনের বাইরের প্রজাবৃন্দ, যেমন শিল্পী, ব্যবসায়ী, দাসদাসী। হয়ত এই কারণেই জনকে ক্ষমতাচ্যুত করায় সামন্তরা সফল হয়েছে। অনার্য প্রজারা যখন দেখে যে তাদের শাসক-জনের লোকেরা অন্যের দ্বারা নিগৃহীত হচ্ছে তখন তারা খুশীই হয়। আরএই ব্যাপারটাকেই রাজারা ন্যায়বিচার বলে জাহির করে।’

‘পুত্র! তুমি হয়ত ভুল বলছ না; কিন্তু আমায় বল তো, রাজ্য কার হাতে ছেড়ে দেব? চোর-অপহারক-সামন্ত ব্যবসায়ী এদের সকলকেই কি দেওয়া হবে? কেননা আৰ্য-জন ও অনাৰ্য প্ৰজা যারা সংখ্যায় যথেষ্ট তারা কি রাজ্যশাসন করতে পারবে? আর এদিকে ধর্মসামন্ত ও রাজা-সামন্তরা শুকনের মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে প্রজাদের ওপর—তাদের গ্রাস করার জন্যে তারা প্রস্তুত হয়েই আছে। মাত্র ছ-সাত পুরুষ আগেই কুর পঞ্চাল জনের হাত থেকে ক্ষমতা অপহৃত হয়েছে, জনের শাসনের কথা লোকে এখনও ভুলে যায় নি। সে সময় কোনো দিবোদাসের রাজত্ব ছিল না, তখন এই দেশকে পঞ্চালাঃ অর্থাৎ সারা পঞ্চালবাসীর দেশ বলা হত, দেশটা ছিল তাদেরই। কিন্তু আজ আর সেই অবস্থায় ফিরে যাবার পথ। নেই।’

‘হ্যাঁ, পথে বলিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্রের মতো অনেক কুমীর লুকিয়ে আছে।’

‘এতে প্রমাণ হয় যে, আমি পরবশ হয়েছি, কালের গতি বদলাতে পারিনি, কাল কি ঘটবে তাও জানি না। কিন্তু আমি এতেই খুশী যে সুদাসের মতো পুত্র আমারই সন্তান। এক। সময় আমিও তরুণ ছিলাম। তখন পর্যন্ত বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্রের শ্লোক মানুষের জীবনের ওপর এত মায়াজাল ছড়াতে পারেনি। আমি ভাবতাম, রাজা যে দসু্যুবৃত্তি করে সেটা কমাতে হবে; কিন্তু নিজের দুর্বলতার জন্যে তা পারিনি। সে সময় তোমার মা-ই ছিল যথাসর্বস্ব। তারপর আমি যখন ভগ্নীমনোরথ ও নিরাশ হয়ে পড়লাম তখন এই পুরোহিতরা শুধু নিজেদের কবিতা ও স্ততিগাথাই নয় নিজেদের কন্যাদের পাঠিয়ে আমাকে জড়িয়ে দিল। আমার অন্তঃপুর শত, শত দাসীকন্যায় ভরে গেল–এর তুলনা কেবল ইন্দ্রের সঙ্গেই চলতে পারে। দিবোদাসের এই অধঃপতন থেকে তুমি শিক্ষা নাও, সতর্ক হও এবং যত্নের সঙ্গে চেষ্টা কর। হয়ত তোমার সামনে পথের সন্ধান মিলবে; দুসুবৃত্তির অবসান সম্ভব হবে, কিন্তু সুদাসের মতো সহৃদয় শাসককে সরিয়ে হৃদয়হীন প্রবঞ্চক, প্ৰতর্দন-এর মতো শঠের হাতে রাজ্য দিলে পঞ্চলের ভালো হবে না। আমি পিতৃলোকে গিয়েও তোমার সযত্ন চেষ্টা লক্ষ করে সুখী হব।’

 

৪.

দিবোদাস দেবলোক প্ৰয়াণ। সুদাস এখন পঞ্চলের রাজা। ঋষিমণ্ডলী তার চারদিকে ঘুরতে শুরু করল। সুদাস বুঝল, ইন্দ্র বরুণ অগ্নি সোম প্রভৃতি দেবতার নাম নিয়ে এই শ্বেতশ্মশ্রু বৃদ্ধর লোকদের কিভাবে অন্ধবানিয়ে রাখে। তাদের শক্ত খপ্পরের আওতার পরিধি তার জানা ছিল। যাদের উপকার করবে বলে সে ঠিক করেছিল—সেই প্রজারাই তাকে ভুল বুঝল। অতীতের কথা মাঝে মাঝে তার মনে হত-ছিন্নবস্ত্ৰে, নগ্নপদে বিদেশে ঘুরে বেড়াবার সেই দিনগুলোর কথা। সেদিন তার মনে শান্তি ছিল অনেক বেশি। মুক্ত স্বাধীন সুদাসের হৃদয়ের ব্যথা বোঝবার মতো, তার প্রতি সহানুভূতি অনুভব করার মতো কোনো দরদী তার পাশে ছিল না। পুরোহিত ও ঋষিরা তাদের পৌত্রীদের, আর প্রদেশ সামন্তরী কুমারী মেয়েদের তার অন্তঃপুরে নিয়মিত পাঠাত। কিন্তু সুদাস নিজেকে আগুন লাগা ঘরে বসে থাকার মতো মনে করত। চন্দ্ৰভাগা নদীর তীরে অপেক্ষমানা সেই নীলনয়নী অপালার কথা সে ভুলতে পারত না।

সুদাস তার সমস্ত প্রজাদেরই-আর্য অনার্য নির্বিশেষে সকলেরই কল্যাণ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা ছিল। কিন্তু তার আগে তার দরকার হল–ঈশ্বরের কৃপার দিকে চেয়ে আছে যে প্রজা-সাধারণ, তাদের কাছে প্রমাণ করা যে, সুদাস ভগবানের করুণা লাভ করতে সমর্থ। আর এই অনুগ্রহ লাভের একমাত্র উপায় পুরোহিতদের প্রশংসাভাজন হওয়া। শেষ পর্যন্ত পুরোহিতদের কাছ থেকে এই প্রশংসা-বাণী আদায় করার জন্য তাকে হিরণ্য-সুবর্ণ, পশু-ধান্য, দাস-দাসী দান করা ছাড়া উপায় ছিল না। এইসবের পরেও চর্বিযুক্ত মাংস এবং সুস্বাদু মদ খাওয়ার পর পুরোহিতরা সিদ্ধান্ত করল, সত্যিই সুদাসের নামের যা অর্থসুদাতা তা সার্থক। এই সমস্ত চাটুকরেরা সুদাসের বদান্যতা সম্পর্কে অসংখ্য শ্লোক লিখেছিল–আজও সেগুলো ঋগ্বেদে পাওয়া যায়। কিন্তু কে বলতে পারে, এই সমস্ত স্তুতিবাদের রচয়িতাদের সুদাস কি গভীর ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখত! সুদাসের যশোগান অনতিবিলম্বে শুধু উত্তর পঞ্চালে, অর্থাৎ বর্তমান রুহেলাখণ্ডে সীমাবদ্ধ রইল না–আরও দূরে ছড়িয়ে পড়ল। নিজের ভোগ শূন্য জীবন দিয়ে সে যথাসাধ্য সমস্ত প্রজার কল্যাণার্থের কাজ করে চলেছিল। ।

পিতার মৃত্যুর কয়েক বছর পর তার মাতারও মৃত্যু হল। অভ্যস্ত হয়ে উঠবার আগে যে বেদনা অহোরাত্র তার হৃদয়ে বহ্নিমান ছিল তা আজ যেন বিপজ্জনক দুষ্ট ক্ষতের মতো তাকে পেয়ে বসল। প্রতি মুহূর্তে সে যেন দেখতে পেত, অপালা জলভরা চোখ আর কম্প্রমাণ ঠোঁট দুটি নিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে বলছে, ‘আমি অপেক্ষা করে থাকব তোমা্র জন্যে–এই মাদ্রপুরে।’ সুদাসের চোখের সমস্ত জলও তার এই জ্বলন্ত চিন্তাকে নেভাতে। পারত না। একদিন মৃগয়ার ছলে সে পঞ্চালপুর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল।

যে পুরাতন গৃহে সে অপালার প্রেমলাভ করেছিল সেটি সেদিনও দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু জেতা বা তার প্রিয় কন্যার দেখা সে পেল না। দু’জনেই তখন গতায়ু হয়েছে। অপােলা মাত্র এক বছর আগে মারা গেছে। অপালার যে ভাই নিরুদ্দিষ্ট হয়েছিল, সে পরে ফিরে এসে সপরিবারে বাস করতে শুরু করছে; কিন্তু এই পরিবারের সঙ্গে নতুন করে সম্বন্ধ স্থাপন করার তার কোনো ইচ্ছা ছিল না। অপালার এক বান্ধবীর সঙ্গে সুদাসের দেখা হল। সে। কাঁদতে কাঁদতে সুদাসকে মৃত্যুর কতকগুলো রঙ্গীন পোষাক–ঘাঘরা, শাল, কাঁচুলি এবং ওড়না দেখিয়ে বলল, ‘আমার বান্ধবী তার শেষ দিনে সুদাসের নিকট প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সে তার জন্যে এখানে অপেক্ষা করে থাকবে।’

সুদাস পোষাকগুলো নিয়ে তার বুকে চেপে ধরল। অপালার দেহের ঘ্রাণ তখনও সেই পোষাকের ভাঁজে ভাঁজে।’ *

———–
* ১৪৪ পুরুষ আগেকার কাহিনী। এই সময় আদি ঋষিরা-বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র ও ভরদ্বাজ ঋগ্বেদের শ্লোকসমূহ রচনা করেছিলেন। আর পঞ্চালভূমির রাজন্যবর্গ এইসব আর্যপুরোহিতদের সাহায্যে পুরাকালের গণতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থার মূলে চূড়ান্তভাবে আঘাত হানতে পেরেছিল।

 ০৮. প্রবাহণ (স্থান: পঞ্চাল (উত্তরপ্রদেশ)।। কাল: ৭০০ খৃষ্টপূর্ব)

‘একদিকে ঘন নিবিড় সবুজ বন, মহুয়ার মাদক গন্ধ, পাখীর কুজন, অন্যদিকে প্রবাহিণী গঙ্গার স্বচ্ছ ধারা, তীরে আমাদের হাজার হাজার কপিলা-শ্যামা গাভীগুলি চারে বেড়াচ্ছে, আর হুংকার দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে বিশাল বলিষ্ঠ বৃষভ। প্রবাহণ! এই মনোরম দৃশ্য? দেখে নয়ন তৃপ্ত করা উচিত। তুমি দেখছি দিনরাতই সাম গান (উদ্‌গীথ) গাইছ, অথবা বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র মন্ত্র আবৃত্তি করছ।’

‘লোপা, তুমি যে চোখ দিয়ে এই দৃশ্য দেখ– আমি তোমার সেই চোখের দিকে তাকিয়েই তৃপ্তি পাই।’

‘হুঁ! কথায় তোমার সঙ্গে পারা মুকিল—খুব কথা বানাতে পারো। যখন তোমার সহপাঠীদের সঙ্গে মারালের মতো সুর করে পুরনো শ্লোক ও মন্ত্রের পাঠ পড়তে দেখি তখন মনে হয় আমাদের প্রবাহণ স্তন্যপায়ী শিশুই থেকে যাবে।’

‘তাই না-কি! প্রবাহণ সম্পর্কে তোমার সত্যিই এই ধারণা?’

‘ধারণা যাই হোক, তবে আমার এ ধারণাও আছে যে, প্রবাহণ আমার আর সব সময়ের জন্যে প্রবাহণ আমারই থাকবে।’

‘এই আশা ও বিশ্বাসেই, লোপা, প্রভূত শ্রম ও বিদ্যার্জনের শক্তি পাই। আমি নিজের মনকে জোর করে সংযত করতে অভ্যস্ত। তা না হলে কতবার আমার মন পুরনো গাথা, মন্ত্র, উদ্‌গীথগুলি বার বার মুখস্থ করার হাত থেকে রেহাই পেতে চেয়েছে। মন যখন পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, শরীর যখন অবসন্ন, তখন মনে হয় সব কিছু ছেড়ে দিয়ে বসে। থাকি, সেই সঙ্কট মুহূর্তে লোপার সঙ্গে কয়েক মুহূর্ত মিলনের আশাই আমার প্রেরণা জোগায়।’

‘আর এই সময়টার জন্য আমিও সর্বদাই অপেক্ষা করে থাকি।’

লোপার পিঙ্গল চোখ দুটির দৃষ্টি নিবন্ধ ছিল দূর লক্ষ্যে হাওয়ায় তার দীর্ঘ স্বর্ণাভ কেশরাশি উড়ছিল। মনে হচ্ছিল লোপা যেন কোনো সুদূরে হারিয়ে গেছে। প্রবাহণ। তার চুলগুলির ওপর আঙ্গুল বুলাতে বুলাতে বলল, ‘তোমার তুলনায় নিজেকে আমার বামন মনে হয়?’

‘বামন! না গো না, প্রবাহণ।’ —বলতে বলতে লোপা তার সুডৌল গাল প্রবাহণের গায়ের ওপর রেখে বলতে লাগল, ‘একদিন আমি তোমার ওপর অভিমান করতাম–মনে পড়ে? যেদিন তুমি পিসীমার সঙ্গে এলে আমাদের বাড়ি, আমি আমার শিশু চোখ দিয়ে আর এক আট বছরের বালককে দেখেছিলাম। তখন আমার বয়স তিন কি চার। কিন্তু সেই স্মৃতি সেদিনের শিশু-চিত্তকে রঞ্জিত করতে এতটুকু ভুল করে না। আজও মনে পড়ছে–এখনো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, তোমার সেই স্বর্ণােভ কুঞ্চিত কেশ, টিকোলো নাক, পাতলা রাঙা ঠোঁট, বড় বড় উজ্জ্বল নীল চোখ, আর তপ্ত গৌরবরন দেহ। আমার কেমন লজ্জা হল। মা তোমাকে আদর করে চুমু খেয়ে বললেন, পুত্র প্রবাহণ, এ তোমার মামাত বোন। ওর লজ্জা হয়েছে, ওর লজ্জা দূর কর।’

‘আর আমি তোমার কাছে এগিয়ে গেলাম। তুমি মামীমার সুগন্ধিত কেশরাশির আড়ালে মুখ লুকিয়ে ফেললে।’

‘আমি মুখ লুকালেও মা-র চুলের ফাঁক দিয়ে দেখছিলাম তুমি কি করা। বাড়িতে মা, ও দাসদাসীদের সন্তানেরা ছাড়া আর কেউ ছিল না। বাবার বিদ্যাপীঠ তখনও গড়ে ওঠেনি। আমার একলা মনে হত, তাই তোমাকে দেখে কী খুশীই না হয়েছিলাম!’

‘তবু তুমি মুখ লুকিয়েছিলে। আমি তোমায় দু’চোখ ভরে দেখছিলাম। তোমার শিশুনেত্ৰে ভালোই দেখাচ্ছিল। কাছে গিয়ে তোমার কাঁধে হাত রাখলাম। আমার মনে পড়ে। কি, মা ও মামীম কি বলেছিল? দু’জনেই মুচকি হেসে বলে উঠল, ‘হে ব্ৰহ্মা আমাদের সাধ পূর্ণ কর।’ তখন সাধ পূর্ণ কর প্রার্থনার মানে বুঝিনি।’

‘না প্রবাহণ, আমার মনে পড়ছে না। আমার পক্ষে এইটাই যথেষ্ট যে, আমার কাঁধের ওপর তোমার নরম হাতের স্পর্শ এখনও মনে আছে।’

‘আর তুমি সঙ্কোচে একেবারে জড়সড়ো হয়ে গেলে।’

‘তুমি আমার হাতটা তোমার হাতের মধ্যে নিয়েছিলে, কিন্তু মুখে শব্দ ছিল না, যেন ঠোঁট দুটো সেলাই করা। তখন মা কি বলেছিল মনে আছে?’

‘মামীমার প্রতিটি কথাই মনে আছে, তাঁকে কি আমি কখনও ভুলতে পারি! মা আমাকে গাৰ্গ মুমার কাছে রেখে ফিরে গেল, কিন্তু মামীমার অপার স্নেহ আমার মায়ের স্থান দখল করেছিল। মামীমাকে আমি কেমন করে ভুলব?’ প্রবাহণের চোখে জল ভরে এল, সে লোপার ঠোঁটে চুমু দিয়ে বলল, ‘লোপা তোমার মতোই মামীমার মুখ ছিল; আমরা দু’জনে এক বিছানায় শুতাম। রাত্রে কতবারই না। আমার চোখের পাতা খুলে যেত, কিন্তু মামীমাকে আসতে দেখলেই আবার চোখ বুজতাম। যখন মামীমার মৃদু নিশ্বাসের সঙ্গে তাঁর ঠোঁটের স্পর্শ গালে পেতাম তখন চোখ মেলতাম। মামীমা বলত, ‘বৎস জেগে আছে!’। তারপর তোমার গালে চুমু খেত, কিন্তু তুমি বেঁহুস হয়ে ঘুমোতে।’

লোপার চোখও অশ্রুপূর্ণ হয়ে এলো, সে উদাস স্বরে বলল, ‘মাকে আমি এত, কম দেখেছি যে মনেই পড়ে না।’

‘ হ্যাঁ, তুমি যে কথা বলছিলো। যেদিন প্রথম এই বাড়িতে এলাম সেদিনের কথা। আমাকে তোমার সামনা-সামনি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তোমার মা বলল, বৎস! এই তোমার বোন–তুমি ওর সঙ্গে ঘোড়া-ঘোড়া খেল।’

‘ হ্যাঁ, তুমি আমাকে ঘোড়া-ঘোড়া খেলতে ডাকলে। আমি মা-র চুলের ভেতর থেকে আমার মুখ বের করলাম। তুমি তারপর ঘোড়া হলে, আমি তোমার পিঠে চেপেছিলাম।’

‘আর আমি তখনই তোমাকে পিঠে চাপিয়ে বাইরে নিয়ে গেলাম।’

‘আমি খুব দুষ্ট ছিলাম, না?’

‘তুমি সব সময়ই ভয়হীন ছিলে, লোপা! মামার ভয়ে আমি নিজের পড়াশুনায় লেগে থাকতাম আর যখন ক্লান্ত হয়ে পড়তাম তখন তোমার কাছে চলে আসতাম।’

‘তোমাকে দেখার জন্যে আমিও তোমার কাছে এসে বসতে লাগলাম।’

‘আমার মনে হচ্ছে লোপা, তুমি যদি আমার অর্ধেক পরিশ্রম করতে, তাহলে মামার শিষ্যদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হতে পারতে।’

‘কিন্তু তোমার থেকে শ্ৰেষ্ঠ নয়!’ লোপা প্রবাহণের চোখ দুটির দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে বলল, ‘আমি তোমার চেয়ে এগিয়ে যেতে চাই না।’

‘কিন্তু তাতে আমি বেশি খুশী হতাম।’

‘না, আমাদের দু’জনার আপনি আপন পৃথক সত্তা কিছু নেই।’

‘লোপা, তুমি আমায় উৎসাহ দিয়েছ আমার শরীরে শক্তি দিয়েছ। পড়া মুখস্থ করতে এবং অন্যকে দিয়ে মুখস্থ করাতে খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত ভুলে যেতাম। তুমি আমাকে পাঠগৃহের সেই অন্ধকার থেকে জোর করে টেনে বার করতে, কখনও বা উদ্যানে কখনও বা গঙ্গার ধারে নিয়ে যেতে। এ-সব আমার খুবই ভালো লাগত। কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে আমি চেয়েছিলাম তিনখানি বেদ ও ব্রাহ্মণের সমস্ত বিদ্যা আয়ত্ত করার কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করতে।’

‘তোমার সে কাজ তো শেষ হয়েছে। বাবা বলেন, প্রবাহণ এখন আমার সমতুল্য।’

‘তা আমিও বুঝতে পারছি। ব্ৰাহ্মণ্য-বিদ্যা আয়ত্ত করতে আর সামান্যই বাকি কিন্তু বিদ্যা শুধু ব্ৰাহ্মণ্যতেই শেষ হয় না।’

‘এই কথা আমিই তোমায় বলতে চাইছিলাম। আচ্ছা, এখনও কি তুমি পলাশ-দণ্ড আর রুক্ষ কেশ নিয়ে চলবে?’

‘কিছু ভাবতে হবে না লোপা! পলাশ-দণ্ড এখন ছাড়লেই হল। আর আমার এই ষোল বছরের রুক্ষ চুলগুলিতে অনায়াসে তুমি সুগন্ধি তেল দিতে পার।’

‘প্রবাহণ, রুক্ষ চুলের ওপর এত বেশি জোর দেওয়া হয় কেন? যদি সংযমের কথা বল–তুমি তো আমার ঠোঁটে চুমু খেতে কখনও ছাড়নি।’

‘তার কারণ ছোটবেলার অভ্যাস।’

‘তাহলে আচার্যকুলের অন্যান্য ছাত্ররা এ ব্ৰত কি কঠোরভাবে পালন করে?’

‘হ্যাঁ লোপা, তা না করে কোনো উপায় নেই বলে করে। এ-সব হল সম্মান প্রতিষ্ঠার জন্য। সাধারণ মানুষ একে ব্ৰাহ্মণ কুমারদের কঠিন তপস্যা বলে মনে করে।’

‘তাই যদি হয় তবে কুরুরাজ আমার বাবাকে জনপদ, হীরে, সোনা, দাস-দাসী, ঘোড়া, রথ উপটৌকন দিয়ে চলেছেন কেন? আমাদের অনেক দাসী আছে, আবার কিছুদিন। আগে কুরুরাজ আরও তিন জন দাসী পাঠিয়েছেন তাদের তো কোনো কাজই নেই।’

‘ওদের বেচে দাও লোপা। ওরা তরুণী। এক-এক জনের জন্য তিরিশ নিষ্ক (স্বর্ণমুদ্রা) পেয়ে যাবে।’

‘আমার আপশোস হয়; আমরা ব্ৰাহ্মণ, শিক্ষিত এবং জ্ঞানী, যেহেতু আমাদের জ্ঞানার্জনের সুযোগ আছে। কিন্তু যখন আমি এ-সব ক্রীতদাসদের দেখি তখন ব্ৰহ্মা, ইন্দ্র বরুণ ও অন্যান্য দেবতাদের ওপর ক্রুদ্ধ হই। আজ দেবকুল, বশিষ্ঠ ভরদ্বাজ, ভুণ্ড, অঙ্গিরা ও ঋষিদের এবং বাবার মতো আজকের সমস্ত শ্রোত্রিয় ব্ৰাহ্মণ মহাশালদের (ধনিক) বিরুদ্ধে আমার ঘৃণা জেগে ওঠে। সর্বত্রই ব্যবসা, দরকষাকষি, লাভ, লোভ। সে দিন কালিদাসীর স্বামীকে বাবা কোশলাদেশীয় এক বণিকের হাতে পঞ্চাশ নিষ্কে বেঁচে দিলেন। কালী আমার কাছে কান্নাকাটি করায় আমি তার হয়ে বাবাকে অনেক বললাম। তিনি বললেন, ‘সমস্ত দাসদের ঘরে রেখে দিলে স্থান সন্ধুলান হবে না। আর যদি বিনা কাজে রাখা হয় তাহলে ঐ টাকাগুলোও লোকসান।’ বিদায়ের পূর্ব রাত্রে তারা স্বামী-স্ত্রী কি কান্নাটাই না কাঁদল। তাঁদের দু’বছরের সেই মেয়েটি-সকলে যাকে দেখলে বলে বাবার চেহারার সঙ্গে মিল আছে সেই বাচ্চাটাও কি কান্নাটা কাঁদল! কিন্তু কালীর স্বামীকে বেচে দেওয়া হল। যেন সে মানুষ নয়, পশু। ব্ৰহ্মা যেন তাকে আর তার শত শত প্রজাকে এই জন্যই সৃষ্টি করেছেন। এ আমি মানতে রাজী নই প্রবাহণ! আমি তোমার মতো বেদ মুখস্থ করিনি। কিন্তু তা শুনে এই বুঝেছি। যে, চোখে দেখতে পাওয়া যায় না, এই রকম বস্তু বা শক্তির প্রলোভন বা ভয় দেখানো। হয়েছে।’

‘প্রবাহণ লোপার আরক্ত গালটি নিজের চোখের সঙ্গে চেপে বলল, ‘আমাদের প্ৰেম, মতভেদ রাখার জন্যই হয়েছে।’

‘মতভেদ আমাদের প্রেমকে আরও গাঢ় করেছে।’

‘ঠিক বলেছ লোপা! অন্যে যদি এ কথাই বলত তাহলে আমি রাগ করতাম, কিন্তু সেই কথাগুলিই যখন দেখি যে তোমার মুখ দিয়ে আমার সমস্ত দেবতা, ঋষি এবং আচার্যদের ওপর তীক্ষ্ণ বাণের মতো নিক্ষিপ্ত হচ্ছে, তখন তোমার ও অধরে চুম্বন করতে বার বার ইচ্ছা হয় কেন?’

‘তার কারণ হল, আমাদের নিজেদের মধ্যেই দুটো মতের দ্বন্দ্ব চলছে। আমরা এ দ্বন্দের প্রতি সহিষ্ণু, কেননা আমরা একে অপরকে আমাদের অভিন্ন সত্তা বলে মনে করি।’

‘তুমি তো কখনও শিবির দোশালা, কাশীর চন্দন, সামুদ্রিক মুক্ত দিয়ে নিজেকে বিভূষিতা করনি। এ-সবে তোমার এত উদাসীনতা কেন প্রিয়ে?’

‘ওগুলোতে কি আমায় সুন্দর দেখাবে…?’

‘আমার কাছে তুমি সর্বদাই সুন্দর।’

‘তাহলে এই বোঝা চাপিয়ে শরীরকে কষ্ট দিয়ে লাভ কি? সত্যি বলছি, তুমি যখন একটা ভারী বোঝাকে মুকুট বলে মাথায় পর তখন আমার খুবই খারাপ লাগে।’

‘অথচ অন্য মেয়েরা কাপড় গয়নার জন্যে কতই না ঝগড়া করে।’

‘আমি সে রকম মেয়ে নাই।’

‘তুমি হচ্ছে সেই রকম মেয়ে যে পঞ্চাল রাজার হৃদিরাজ্য শাসন করে!’

‘আমি প্রবাহণের স্ত্রী, পঞ্চালদের রাণী নই।’

‘বেশ তাই প্রিয়তমা! কিন্তু এমন দিনের কথা আমরা কল্পনাও করিনি। আমি যে পঞ্চাল রাজপুত্র–এ কথা মামা গোপন রেখেছিলেন।’

‘বেশ তাই প্রিয়তমে! কিন্তু এমন দিনের কথা আমরা কল্পনাও করিনি। আমি যে পঞ্চাল রাজপুত্র–এ কথা মামা গোপন রেখেছিলেন।’

‘সে সময় বাবা আর কি করতে পারতেন? পঞ্চাল রাজার শতেক রাণীর মধ্যে পিসীমা অন্যতমা। আর তোমার চেয়ে বয়সে বড় ছিল পঞ্চাল রাজের দশটি ছেলে। তাই কে ভেবেছিল তুমি একদিন পঞ্চাল রাজ-সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হবে।’

‘আচ্ছা লোপা, এই রাজভবন তোমার মোটেই পছন্দ হচ্ছে না কেন?’

’যেহেতু, গার্গ্য ব্ৰাহ্মণের প্রাসাদে–যেখানে পড়ানো হত বেদ আর ব্ৰাহ্মণ্য–আমার ক্লান্তি ও বিরক্তি এসেছিল সেখানেই। আমাদের জন্যে ঐ প্রাসাদ ছিল বটে, কিন্তু ক্রীতদাসদাসীদের জন্যে? আর আমাদের সেই বিদ্যাপীঠের প্রাসাদের তুলনায় এই রাজপ্রাসাদ হাজার গুণের বড়। এই প্রাসাদের একমাত্ৰ তুমি আর আমি ছাড়া বাকি সবাই দাসদাসী। দু’জন অদাসের জন্যে দাসদাসীতে ভরা এই ভবন অ-দাস ভবন হয়ে যায় না। কিন্তু প্রবাহণ আমার খুব আশ্চর্য লাগে তোমার কঠোর হৃদয় দেখে।’

‘তাই তো কঠোর বাক্য-বাণ সহ্য করতে পারছি।’

‘না, মানুষের এ রকম হওয়া উচিত নয়।’

‘আমি শুধু মানুষ হতে চাইনি, চেয়েছিলাম যোগ্য মানুষ হতে! যদিও যোগ্যতা অর্জনের সময় এ কথা এক মুহূর্তের জন্যেও মনে হয় নি যে, আমাকে একদিন এই রাজভবনে আসতে হবে।’

‘তোমার অনুশোচনা হচ্ছে না, আমার সঙ্গে প্রেম করার জন্যে?’

‘শিশু জন্মমাত্র বিনা আয়াসে মাতৃস্তন পায়–আমিও বিনা প্রয়াসে তোমার প্রেম লাভ করেছি। তোমার ভালোবাসা আমার প্রতিদিনের অভ্যন্ত জীবন, শরীরের অঙ্গ।‘

‘আমি সংসারী পুরুষ, তবু আমি তোমার প্রেমের কদর বুঝি। মনের গতি সব সময় এক রকম থাকে না। যখন কোনো অবসাদ আসে, জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে দাঁড়ায় তখন তোমার প্রেম ও সুবিচার আমাকে মস্ত সম্বল যোগায়।’

‘কিন্তু আমি তোমার যতটা অবলম্বন হতে চাই–তা যে হতে পারছি না। আর এর জন্যে আমি বেদনা বোধ করি, প্রবাহণ।’

‘তার কারণ, রাজ্যশাসন করার জন্যেই আমার জন্ম হয়েছিল।’

‘কিন্তু একদিন তো তুমি মহাব্ৰাহ্মণ হতে চেয়েছিলে!’

‘তখন আমার জানা ছিল না যে, পঞ্চালপুর রাজভবনের উত্তরাধিকারী আমি।’

‘কিন্তু রাজকার্যের বাইরেও যে তুমি হাত দিচ্ছ, এতে তোমার দরকার কি?’

‘অর্থাৎ ব্ৰহ্মা থেকে ব্ৰহ্মের কল্পনা! লোপী, এটা কিন্তু রাজকার্যের বাইরে নয়। রাজ্যকে অবলম্বন দেওয়ার জন্যেই আমাদের পূর্বপুরুষরা বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্রকে এতটা সম্মানের পদে অধিষ্ঠিত করেছিল। এই সমস্ত ঋষিরা-ইন্দ্র, অগ্নি, বরুণ প্রভৃতি দেবতাদের নামে জনগণকে রাজজ্ঞা পালন করতে শেখাত। তখনকার দিনে রাজারা সাধারণের বিশ্বাসভাজন হওয়ার জন্যে বড় বড় ব্যয়সাধ্য যজ্ঞ করত। আজকাল আমরাও করে থাকি এবং ব্ৰাহ্মণকে দক্ষিণা দিই। এই যজ্ঞ ও পুরোহিতদের মূল্যবান জিনিস দক্ষিণা দেওয়ার মধ্য দিয়ে জনগণের মনে দেবতাদের অলৌকিত শক্তির ওপর বিশ্বাস সৃষ্টি করাতে চায়, মানুষের মনে এই ধারণা জন্মাতে চায় যে, সুগন্ধিত তণ্ডুল, গোবৎসের নরম মাংসের সুপ, সূক্ষ্ম বস্ত্ৰ, মুক্তার ভুষণ যা কিছু আমরা ব্যবহার করি এ সমস্তই ঈশ্বরের অনুগ্রহ।’

‘পুরনো দেবতারাই তো যথেষ্ট, তবে এই নতুন ব্ৰহ্মের আমদানির প্রয়োজন কি?’

‘পুরুষানুক্রমে বহু যুগ ধরে কেউ ইন্দ্র, ব্ৰহ্মাকে প্রত্যক্ষ দেখেনি। তাই এখন অনেক লোকের মনেই সন্দেহ হতে আরম্ভ করেছে।‘

‘তা’হলে ব্ৰহ্ম সম্পর্কে সন্দেহ হবে না কেন?’

‘সেই জন্যেই ব্ৰহ্মের রূপ বর্ণনা আমি এমনভাবে করেছি যে, তাকে প্রত্যক্ষ দেখার কথাই উঠবে না। দেবতারা ছিল সাকার-আমার কল্পিত ব্ৰহ্ম নিরাকার। নিরাকার তাই যত্রতন্ত্র সর্বত্রই বিরাজমান–তাই তা দেখবার প্রশ্ন ওঠে কি? প্রশ্ন ওঠে শুধু সাকার দেবতাদের সম্পর্কে।’

‘তুমি যে নিরাকার ব্রহ্মের কথা বলছ তাতে উদ্দালক আরুণির মতো ব্ৰাহ্মণদেরও মতিভ্রম ঘটায়। তোমার মতলবটা কি, তুমি কি প্রজাদের ভ্রমাচ্ছন্ন রাখতে চাও?’

‘লোপা! তুমি তো আমায় জান, তোমার কাছে কি-ই বা লুকোতে পারি? এই যে রাজশক্তি একে হাতের মুঠোর মধ্যে রাখার জন্য এর প্রয়োজন আছে। যারা সন্দেহ করবে তাদের বিদ্যাবুদ্ধিকেই এ দিয়ে খাটো করা যাবে–তাদের নিজেদের জ্ঞান সম্পর্কে নিজেদেরই সন্দেহ জাগবে। কারণ, যারা দেবতার যজ্ঞ বা পূজার প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করে তারা আমাদের ঘোরতর শত্রু।’

‘কিন্তু তুমিও তো বলছি, ব্ৰহ্ম সত্তাহীন নয়–ব্রহ্মের সত্তা ও দর্শনের কথাও বলছ।’

‘সত্তা আছে, কাজেই অনুভব-গ্ৰাহ্য হওয়া চাই। কিন্তু তা ইন্দ্রিয় দ্বারা নয়, কারণ তাহলেই সন্দেহবাদীরা ইন্বিয় দ্বারা (চক্ষুষ) দেখতে চাইবে। তাই আমি বলেছি, ব্রহ্মের দর্শন পেতে হলে সূক্ষ্ম ইন্দ্ৰিয় দ্বারাই সেটা সম্ভব, আর সূক্ষ্ম ইন্দ্ৰিয় লাভ করতে হলে চাই। সাধনা। আর সাধনার যে ফিরিস্তি দেওয়া হয়েছে তাতে মানুষ ছাপান্না পুরুষ ধরেও বিশ্বাস। অটুট রাখতে পারবে–ভ্ৰমাচ্ছন্ন থাকবে। আমি পুরোহিতদের স্থূল হাতিয়ারকে নিষ্ফলা ভেবেই এ হাতিয়ার আবিষ্কার করেছি। লোপা, তুমি কি কখনও শবরদের পাথর ও তামার হাতিয়ার দেখেছ?’

‘হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের জঙ্গলে গিয়ে দেখেছি।’

‘যমুনার ওপরে আমরা গিয়েছিলাম বটে। আচ্ছা শবরদের পাথর ও তামার হাতিয়ার আমার কালো লোহার সামনে টিকতে পারে?’

‘না, পারে না।’

‘পারে না তো! তাই বলছিলাম, বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্রের পুরনো দেবতারা বা ব্ৰাহ্মণদের যাগ-যজ্ঞ আগেকার বুদ্ধিমানদের যাও বা সন্তুষ্ট করতে পারত এখন তা সন্দেহবাদী তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমান জ্ঞানী লোকদের কাছে ব্যৰ্থ।’

‘তাদের কাছে তোমার সৃষ্ট এই ব্ৰহ্ম-তাও কিছু না। তুমি ব্ৰাহ্মণ জ্ঞানীদের ধরে ধরে শিষ্য বানোচ্ছ, তাদের ব্ৰহ্মজ্ঞান শেখাচ্ছ, অথচ তোমারই ঘরে বসে তোমার কথাকে সরাসরি মিথ্যা বলে মনে করি।’

‘কারণ, তুমি আসল ব্যাপারটা আমার আসল রহস্য (উপনিষদ) জান।’

‘ব্রাহ্মণ যদি জ্ঞানীই হবে, তবে কেন তোমার রহস্য তারা জানবে না?’

’সেটা তো তুমিও দেখতে পাচ্ছ। কোনো ব্ৰাহ্মণ হয়ত উপনিষদ পরীক্ষা করে দেখতে পারে, কিন্তু তারাও আমার উপনিষদকে আত্মস্বার্থে উপর্যুক্ত হাতিয়ার বলে মনে করবে। ওদের পৌরোহিত্য ও গুরুগিরির ওপর মানুষের অবিশ্বাস এসে গেছে যার পরিণাম সব রকম দক্ষিণা হতে বঞ্চিত হওয়া। ফলে চড়ার জন্য অশ্বরথ, খাবার জন্য উত্তম খাদ্য, থাকার জন্য প্রাসাদ এবং ভোগের জন্য সুন্দরী দাসী থেকে বঞ্চিত হওয়া।’

‘এ তো ব্যবসা।’

‘ব্যবসা তো নিশ্চয়ই। আর এতে লোকসানের ভয় নেই। এই জন্যই জ্ঞানী ব্ৰাহ্মণ সমিধ (যজ্ঞকাষ্ঠ) হাতে আমার কাছে শিষ্য হতে আসে। আর আমিও ব্রাহ্মণদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে তাদের ব্রহ্মজ্ঞান প্রদান করি।’

‘এ অত্যন্ত নিকৃষ্ট চিন্তা, প্রবাহণ!’

‘তোমার কথা স্বীকার করি। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য সব থেকে উপযোগী পন্থা। বশিষ্ঠ এবং বিশ্বামিত্রের নৌকা হাজার বছরও কাজ দেয়নি। কিন্তু প্রবাহণের নির্মিত নৌকায় দু’হাজার বছর পরও পরাধনভোগী রাজা ও সামন্তরা পার হতে পারবে। যজ্ঞরূপী নৌকাকে আমি অদৃঢ় বলে মনে করি, লোপা! তাই আমি এ দৃঢ় নৌকা নির্মাণ করেছি। এর সাহায্যে ব্ৰাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়গণ মিলিতভাবে ঐশ্বৰ্য ভোগ করতে পারবে। কিন্তু, ব্রহ্মের থেকেও বড় হবে আমার দ্বিতীয় আবিষ্কার, লোপা!’

‘কোন আবিষ্কার?’

‘মরে গিয়ে আবার এ পৃথিবীতে ফিরে আসা—পুনর্জন্ম!’

‘এ তো সবচেয়ে বড় জালিয়াতি!’

‘কিন্তু খুব কার্যকরী পন্থা। একদিকে সামন্ত, ব্রাহ্মণ এবং ব্যবসায়ীদের হাতে অপার ভোগরাশি সঞ্চিত হবে, অন্যদিকে সাধারণ প্রজা নিঃশেষ হয়ে যাবে। আবার এ সব নির্ধনদের, যেমন শিল্পী, কৃষক এবং দাসদাসীদের বিক্ষুব্ধ করার জন্যে কিছু লোক প্রচার শুরু করেছে, ‘তুমি তোমার শ্রমশক্তি অন্যকে দিয়ে কষ্ট করছ। ওরা তোমাকে বিশ্বাস করাতে চায় যে, তুমি কষ্ট ও ত্যাগ করলে মরে স্বর্গে যাবে। কিন্তু কেউ স্বর্গে মৃত জীবকে সুখভোগ করতে দেখেনি।’ এরই জবাব হল, এ সংসারে উঁচু-নিচু ভাব, ছোট-বড় জাতি, ধনী নির্ধনের যে প্রভেদ, তা হল পূৰ্বজন্মকৃত ফল। আমি এভাবে পূর্বেকীর সুকর্ম-দুষ্কর্মের ফল প্রত্যক্ষভাবে দেখিয়ে দিয়েছি।’

‘এভাবে চোরও তার চুরি করা জিনিসকে পূর্বজন্মের রোজগার বলতে পারে।’

‘কিন্তু তার জন্য আমরা প্রথম থেকেই দেবতা, ঋষি এবং জনসাধারণের বিশ্বাসের সহায়তা গ্রহণে কৃতকার্য হয়েছি। সে জন্যেই অপহৃত জিনিসকে পূর্বজন্মের রোজগার বলে স্বীকার করা হবে না। বিনা পরিশ্রমলব্ধ ধনকে আমরা প্রথমে দেবতার কৃপায় পাওয়া বস্তু বলে চালতাম। কিন্তু যখন দেখলাম, দেব-কৃপার ওপর সন্দেহ শুরু হয়েছে, তখন আমাদের একটা নতুন ব্যাখ্যা উপস্থিত করা প্রয়োজন হল। ব্ৰাহ্মণদের চিন্তাশক্তিও লোপ পেয়েছে। প্রাচীন ঋষিদের মন্ত্র মুখস্থ করতেই চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর কাটিয়ে দেয়, ফলে অন্য কোনো গভীর বিষয় কখন আর চিন্তা করবে!’

‘প্রবাহণ! তুমিও কি মুখস্থ করতে দীর্ঘ সময় এভাবে কাটিয়ে দাওনি?’

‘মাত্র ষোল বছর। চব্বিশ বছর বয়সে আমি ব্রাহ্মণদের বিদ্যা শেষ করে বইয়ের সংসারে প্রবেশ করেছিলাম। এখানে আমি পড়াশুনার প্রচুর সুযোগ পেয়েছি। রাজ্য শাসনের খুঁটিনাটি বিষয়গুলি জানার পর আমি দেখলাম, ব্ৰাহ্মণদের নির্মিত পুরনো নৌকা বর্তমানের জন্য অদৃঢ়।’

‘তাই তুমি দৃঢ় নৌকা নির্মাণ করেছ?’

‘সত্যি কি মিথ্যা সেটা আমার প্রশ্ন নয়; আমার প্রশ্ন হল, কার্যোপযোগিতা নিয়ে। সংসারে ফিরে আসা পুনর্জন্মের কথা আজ নতুন মনে হচ্ছে ঠিকই, আর তুমি এর অন্তৰ্গঢ় স্বাৰ্থও জান। কিন্তু, আমার ব্রাহ্মণ চেলারা তো এই নিয়ে এখন থেকেই মাতামাতি শুরু করেছে। পিতরদের এবং দেবতাদের (পিতৃ-যান, দেব-যান) পথ বুঝবার জন্য এখনি মানুষ বার বছর পর্যন্ত গরু চরাতে প্ৰস্তুত। তুমি আমি থাকব না, কিন্তু এমন সময় আসবে যখন সমস্ত দরিদ্র প্রজা এই পুর্নজন্মের আশীয় সারা জীবনের তিক্ততা, কষ্ট এবং অন্যায়কে হাসিমুখে মেনে নেবে। স্বৰ্গ ও নরক বুঝবার এ কেমন সোজা উপায় আবিষ্কার করেছে, বল তো লোপা?’।

‘কিন্তু, নিজের স্বার্থের জন্য মানুষকে চির-সর্বনাশের পথে ঠেলে দিচ্ছ।’

‘বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্ৰও পেটের দায়ে বেদ রচনা করেছিল, উত্তর পঞ্চালের রাজা দিবোদাসের শবর-দুর্গ অধিকারের পর কবিতা রচিত হয়েছিল। পেটের সংস্থান করা অন্যায় নয়। আমরা যখন হাজার হাজার বছরের জন্য আপন পুত্রপৌত্ৰাদি, ভাই-বন্ধুদের পেটের সংস্থান করি তখন শাশ্বত যশের ভাগী হই।(১) প্রবাহণ এমন কাজই করছে, যা পূর্বগামী ঋষিগণও করতে পারেননি–ধর্মের অন্ন ভক্ষণকারী ব্রাহ্মণরাও পারেনি।’

‘তুমি অতি নিষ্ঠুর প্রবাহণ।’

‘কিন্তু আমি আমার কাজ যোগ্যতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছি।’

—————–

(১) ত্বং তদুক্‌থমিন্দ্ৰ বর্হণাক : প্রয়চ্ছতা সহাসা শূর-দৰ্ষি।
অবগিরেৰ্দাসং শংবরং হন্‌ প্ৰাবী দিবোদাসং চিত্রভিরূতী।। (ঋগ্বেদ ৬। ২৫। ২৫)।

২.

প্রবাহণের মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু তার ব্ৰহ্মবাদ ও পুর্নজন্ম অথবা পিতৃযানবাদ বিজয়দুন্দুতি বাজিয়ে সিন্ধু থেকে আরম্ভ করে সদানীরা (গণ্ডক) পর্যন্ত জয়ধ্বনি তুলেছিল। যজ্ঞের প্রভাব তখনও কমেনি, কারণ ব্ৰহ্মজ্ঞানীরা তখনও পর্যন্ত এগুলো করতে বিশেষ উৎসাহ পেত। ক্ষত্রিয় প্রবাহণের আবিষ্কৃত ব্ৰহ্মবাদে ব্রাহ্মণরা পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিল এবং এই বিদ্যায় কুরু কুলের যজ্ঞবল্ক্যের খ্যাতি যথেষ্ট ছড়িয়ে পড়েছিল।

এক সময়ে মন্ত্রের কর্তা এবং যজ্ঞের প্রতিষ্ঠাতা বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র এবং ভরদ্ধাজের জন্ম যে দেশ দিয়েছিল–সেই কুরু পঞ্চালেই যাজ্ঞবল্ক্য এবং তার সঙ্গী ব্ৰহ্মবাদী-ব্ৰহ্মবাদিনীদের জয়-জয়কার হল। ব্ৰহ্মবাদীদের পরিষদ ক্রমে যজ্ঞের চেয়ে বেশি খ্যাতিসম্পন্ন হয়েছিল। রাজারা রাজসূয় ইত্যাদি যজ্ঞের সঙ্গে একটি করে ব্ৰহ্মবাদীদের পরিষদ রচনা করত, কখনো বা পরিষদ আলাদা করেও ডাকা হত। তাতে হাজার হাজার গরু ঘোড়া এবং দাসদাসী (বিশেষ করে দাসী, কেননা রাজাদের অন্তঃপুরে প্রতিপালিতাদাসীদের ব্ৰহ্মবাদীরা বেশি পছন্দ করত) পরিষদের এক এক যুদ্ধ বিজেতাদের পুরষ্কার দেওয়া হত।

যাজ্ঞবল্ক্য অনেকগুলি পরিষদে বিজয়ী হয়েছিল। এবার সে বিদেহ (তির্হুত) এর জনক পরিষদে খুব বড় রকমের একটা জয়লাভ করল, এবং তার শিষ্য সোমশ্ৰবা হাজার গরু তাকে দান করল। যাজ্ঞবল্ক্য বিদেহ থেকে আরম্ভ করে কুরু পর্যন্ত সেই গরুগুলিকে হাঁকিয়ে আনার কষ্ট স্বীকার করবে কেন? সেগুলিকে ব্ৰাহ্মণদের মধ্যে ভাগ করে দিল। এ জন্য ব্ৰহ্মবাদী যাজ্ঞবল্ক্যের প্রচুর খ্যাতি হল। হ্যাঁ, হীরে-মুক্তা সোনা, দাসদাসী এবং অশ্বরথএ সমস্ত অবশ্যই সে নিজের সঙ্গে নিয়ে এসেছিল।

ষাট বছর হল প্রবাহণের মৃত্যু হয়েছে তখন যাজ্ঞবল্ক্য জন্মায়নি। কিন্তু একশ’ বছর বয়স অতিক্রম করেও লোপা এখনও কর্মক্ষম আছে, পঞ্চালপুরের বাইরে রাজ-উদ্যানে ললিতা আম-কলা-জাম গাছগুলির ছায়ায় থাকতে সে পছন্দ করত। আজীবন সে প্রবাহণের চিন্তাধারার বার বার বিরোধিতা করেছে, কিন্তু এই সূদীর্ঘ ষাট বছরে সে প্রবাহণের দোষগুলো ভুলে গেছে। আজ তার স্মৃতিপটে জেগে রয়েছে–সারা জীবনের প্রেম। বৃদ্ধার চোখের জ্যোতি ম্লান হয় নি। ব্ৰহ্মবাদীদের ওপর আজও সে খাপ্পা। একদিন পঞ্চালপুরে ব্ৰহ্মবাদিনী গার্গী এসে উঠল। রাজোদ্যানের পাশেই গার্গীকে বিশেষ সম্মানের সঙ্গে থাকতে দেওয়া হল। জনকের পরিষদে যজ্ঞবল্ক্য যেভাবে ধোঁকা দিয়ে তাকে পরাস্ত করেছিল, গার্গী তা ভুলতে পারেনি। যদি আর কোনো প্রশ্ন কর তবে তোমার মাথা থাকবে না, গার্গী!’ গার্গী ভেবেছিল ওটা কথার কথা! ও কাজ শুধু উগ্রলোহিত–পাণিরাই (অপরের রক্তে যে হাত রাঙায়) করতে পারে।

গার্গী লোপার পিতৃকুলের মেয়ে। লোপা তার বিশেষ পরিচিত। যদিও ব্রহ্মবাদ সম্বন্ধে তার মত উলুটো। এ-বার যাজ্ঞবল্ক্য তার বিরুদ্ধে যে রকম নিচ অস্ত্র প্রয়োগ করেছে তাতে গার্গী একেবারে রেগে আগুন। তাই যখন তার প্রপিতামহের পিসীমার কাছে এল, তখন তার মনোভাবের নিশ্চয়ই কিছুটা পরিবর্তন হয়েছিল। লোপা কাছে এলে গার্গীর কপালে ও চোখে চুমু খেয়ে আলিঙ্গন করে জিজ্ঞেস করল, ‘শরীর কি রকম আছে?’

গার্গী বলল, ‘আমি বিদেহ থেকে এসেছি, পিসী!’

‘মল্লযুদ্ধ করতে গিয়েছিলি কি মা?’

’হ্যাঁ, মল্লযুদ্ধই হয়েছে পিসীমা। ব্ৰহ্মবাদীদের পরিষদ মল্লযুদ্ধ ছাড়া আর কিছুই নয়। মল্লযুদ্ধের মতোই ওখানে প্রতিন্দ্বন্দ্বীকে ছলে-বলে পর্যুদস্ত করার চেষ্টা হয়।’

‘তাহলে তো কুরু-পঞ্চলের অনেকেই ব্ৰহ্মবাদী আখড়ায় নেমে থাকবে।’

‘কুরু-পঞ্চাল তো এখন ব্ৰহ্মবাদীদের দুর্গ।’

‘আমার সামনেই ব্ৰহ্মবাদীদের একটি ছোট স্ফুলিঙ্গ নিক্ষেপ করেছিল প্রবাহণ, আর তাও সৎ উদ্দেশ্যে নয়। আজ তা দাবানল হয়ে সমস্ত কুরু-পঞ্চালদের জ্বলিয়ে এখন বিদেহ পর্যন্ত পৌঁছেছে।’

‘পিসীমা আমি তোমার কথার সত্যতা এখন কিছুটা বুঝতে পারছি। বস্তুত, এটা ভোগ অর্জনের একটা প্রশস্ত পথ। বিদেহে যাজ্ঞবল্ক্য লক্ষ-লক্ষ টাকার সম্পত্তি পেয়েছে, অন্য সব ব্ৰাহ্মণেরও প্রচুর ধন-রত্ন নিয়ে এসেছে।’

‘এ যে যজ্ঞের থেকেও বেশি লাভের ব্যবসা, মা! আমার স্বামী একেই রাজা ও ব্ৰাহ্মণদের মজবুত নৌকা বলত। তাহলে যাজ্ঞবল্ক্য জনকের পরিষদে বিজয়ী হল, আর তুমি কিছুই বলতে পারলে না?’

‘যদি বলারই কিছু না থাকত। তবে গঙ্গায় এত দূর নৌকা পাড়ি দেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল?’

‘নৌকাতে এলে! রাস্তায় চোর-ডাকাত ধরেনি?’

‘না পিসীমা! নৌকার সারিতে যোদ্ধারা সঙ্গে থাকে। আমরা ব্ৰহ্মবাদীরা কখনো এত মুর্থ নই যে, একলা-দোকলা নিজেদের প্রাণ সঙ্কটময় করে পথ চলব।’

‘যাজ্ঞবল্ক্য তাহলে সকলকেই পরাস্ত করেছিল?’

‘একে পরাস্ত করা বলে না।’

‘কেননা, প্রশ্নকর্তারা যাজ্ঞবল্ক্যের জবাব শুনে চুপ করে থাকতে বাধ্য হয়েছে।’

‘তুমিও?’

‘হ্যাঁ, আমিও। কিন্তু তার কথার ধমকে আমাকে চুপ করতে হয়েছে।’

‘কথার ধমকটা আবার কি?’

‘ব্ৰহ্ম সম্বন্ধে প্রশ্ন করে যাজ্ঞবল্ক্যকে এমনভাবে নাস্তানাবুদ করেছিলাম যে তার বেরোবার পথ ছিল না। তখন সে আমাকে এমন কথা বলল, যা আমি কখনও তার কাছে শুনব বলে আশা করিনি!’

‘কি কথা গো মেয়ে?’

‘সোজাসুজি আমায় ধমক দিয়ে বলল, গার্গী আবার যদি কোনো প্রশ্ন কর, তা’হলে আর তোমার মাথা থাকবে না।’

‘তুমি ও রকম হবে সে আশা করিনি। কিন্তু আমি সব কিছুই আশঙ্কা করেছিলাম, গার্গী। যাজ্ঞবল্ক্য প্রবাহণের উপর্যুক্ত প্ৰশিষ্য। প্রবাহণের মিথ্যাবাদকে সে ষোলকলায় পূর্ণ করেছে। তুমি যে আর কোনো প্রশ্ন করনি, সেটা ভালোই করেছ।’

‘তুমি কি করে জানলে পিসীমা’।

‘নিজের চোখে তোমার কাঁধের ওপর মাথাটা দেখতে পাচ্ছি।’

‘তাহলে পিসীমা, তুমি কি বিশ্বাস করছ যে, আমি যদি আর কোনো প্রশ্ন করতাম, তবে আমার মাথা পড়ে যেত?’

‘নিশ্চয়ই। তবে, যাজ্ঞবল্ক্যের ব্ৰহ্ম-বলে নয়, অন্য লোকের মাথা যেভাবে পড়তে দেখা যায়, সেইভাবে।’

‘না পিসীমা, তা কি কখনও হতে পারে?’

‘হতে পারে না? তুই এখনও শিশু আছিস, গার্গী। তুই ভাবিস এ ব্ৰহ্মবাদ আর কিছুই নয়। খালি মনের পাখা মেলে কল্পনা, মনের বিলাস। না, গাণী–তা নয়। এর পেছনে রাজারাজড়াদের, ব্ৰাহ্মণ ও পরিশ্রম-ভোগীদের মস্ত বড় স্বাৰ্থ লুকানো আছে। যে লগ্নে এই ব্ৰহ্মবাদ জন্মলাভ করেছিল সেই সময় এর জন্মদাতা আমার পাশেই শয়ন করত। যোদ্ধারহাতে লোহার কৃপাণ যেমন শক্তি যোগায় তেমনি এই ব্ৰহ্মবাদ রাজসত্তাও ব্রহ্মণ্যসত্তাকে দৃঢ় করেছে।’

‘পিসীমা, আমি কিন্তু এইভাবে বুঝিনি।’

‘তুমি কেন, অনেকেই বোঝেনি। তবে বিদেহরাজ জনক এর রহস্য (উপনিষদ) বুঝে। আর যাজ্ঞবল্ক্য এটা ভালোই বুঝে–যেমন আমার পতি প্রবাহণ বুঝত। প্রবাহণ কোনো দেবতা, দেবলোক, পিতৃলোক, যজ্ঞ বা ব্ৰহ্মবাদে নিজে বিশ্বাস করত না। তার অখণ্ড বিশ্বাস ছিল ভোগে, আত্মসুখে। সে নিজের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ভোগেই অর্পণ করেছিল। মরবার তিনদিন আগেও বিশ্বামিত্র কুলের পুরোহিতের সুবৰ্ণকেশী কন্যা তার রূতিগৃহে এসে রাত্রিবাস করেছিল। এদিকে বাঁচবার কোনো আশাই ছিল না, তবু সে বিশ বছরের তরুণী সুন্দরীর সঙ্গে রাত্রিবাস করত।’

‘পরিষদে জয়লাভ করে যাজ্ঞবল্ক্য যে সমস্ত গাভী পেয়েছিল তা দান করে দেয় ব্ৰাহ্মণদের মধ্যে কিন্তু বিদেহ রাজার কাছ থেকে পাওয়া সুন্দরী দাসীদের অন্তঃপুরে নিয়ে এসেছে, পিসীমা।’

‘আমি তো সেই কথাই বলছিলাম, যাজ্ঞবল্ক্য প্রবাহণের পাক্কা চেলা। ও ব্ৰহ্মবাদ দেখলি তো? আর তুই দেখছিস দূর থেকে। যদি কাছ থেকে দেখবার সুযোগ পেতিস বেটি, তাহলে ওদের আসল চরিত্র বুঝতে কোনো মুস্কিল হত না।’

‘তবে কি পিসীমা, তুমি সত্যি সত্যিই মনে কর যে, আমি যদি আর কোনো প্রশ্ন করতাম তাহলে আমার মাথা পড়ে যেত?’

‘নিশ্চয়ই! কিন্তু যাজ্ঞবল্ক্যের ব্ৰহ্মতেজে নয়। দুনিয়াতে কত মাথাই না নিঃশব্দে দেহত্যুত হয়েছে!’

‘আমার মাথা ঘুরছে।’

‘আজ? আমার মাথা ঘুরছে তখন থেকে যখন আমার জ্ঞান হয়েছে। সমস্ত ছলনা, খালি কথার কারসাজি। প্রজাদের পরিশ্রমার্জিত ফল বিনা পরিশ্রমে ভোগের পথই হল। রাজবাদ, ব্ৰহ্মবাদ ও যজ্ঞবাদের মূল কথা। এই জালিয়াতি থেকে প্রজাদের কেউ বাঁচতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত ওরা নিজেরা সচেতন না হচ্ছে। আর তাদের সচেতন হতে দেওয়া এ স্বাৰ্থবাদীরা মোটেই পছন্দ করে না।’

‘মানব হৃদয় কি আমাদের এ প্রবঞ্চনাকে ঘৃণা করতে প্রেরণা দেবে না?’

‘দেবে মা দেবে! আর আমি একমাত্র সেই আশাতেই বেঁচে আছি।’*

———-

* ১৪৪ পুরুষ আগেকার কাহিনী। এই সময় আদি ঋষিরা-বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র ও ভরদ্বাজ ঋগ্বেদের শ্লোকসমূহ রচনা করেছিলেন। আর পঞ্চালভূমির রাজন্যবর্গ এইসব আর্যপুরোহিতদের সাহায্যে পুরাকালের গণতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থার মূলে চূড়ান্তভাবে আঘাত হানতে পেরেছিল।

০৯. বন্ধুল মল্ল (কাল : ৪৯০ খৃষ্টপূর্ব)

পূর্ণ বসন্ত কাল। গাছগুলির পাতা ঝরে গিয়ে নবপল্লবিত হয়েছে। শাল বৃক্ষগুলি তার শ্বেতপুষ্পের সুগন্ধ ছড়িয়ে বনভূমি আমোদিত করছে। সূর্য-কিরণ প্রখর তেজে দীপ্ত হতে এখনও দেরী আছে। শালের গহন বনে শুকনো পাতার ওপর মানুষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। দু’জন তরুণ-তরুণী পথ চলতে চলতে থমকে দাঁড়িয়ে নিরীক্ষণ করতে লাগল একটি বড় বলীক (উই টিপি)। তরুণীর গৌরকান্তি মুখের ওপর কুঞ্চিত পিঙ্গল কেশরাশি চারিদিকে বেপরোয়ার মতো ছড়িয়ে থাকার সৌন্দর্য যেন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। তরুণ তার বলিষ্ঠ হাতখনি তরুণীর কাঁধের ওপর রেখে বলল, ‘মল্লিকা! এই বলীক দেখে এত তন্ময় হলে কেন?’

‘দেখ এটা কত উঁচু, প্রায় দুই মানুষ সমান হবে।’

‘হ্যাঁ, ঠিকই, এটা সাধারণ উই টিপির চেয়ে বড়, কিন্তু বলীকের উচ্চতা এর চেয়ে বেশি দেখা যায়। তোমার হয়ত মনে হতে পারে বর্ষা শুরু হলে এর থেকে কি সত্যিই আগুন ও ধোঁয়া বেরোয়?’

‘না, ওটা বোধহয় কিংবদন্তী মাত্র। কিন্তু এই পিঁপড়ের মতো ছোট এবং কোমল রক্তমূখী সাদা পোকাগুলি কেমন করে এত বড় বল্মীক তৈরি করল?’

‘মানুষের শরীরের উচ্চতার সঙ্গে যদি তার হাতে-গড়া বাসস্থান মাপা যায় তাহলে তাও এই রকমই কয়েক গুণ বড় হবে। এ একটা উইপোকার কাজ নয়। শত সহস্ৰ উইপোকা মিলিতভাবে এই কাজ সম্পন্ন করেছে। মানুষও এইভাবেই মিলিত হয়ে নিজের কাজ করে।’

‘তাই আমিও ঔৎসুক্যের সঙ্গে লক্ষ্য করছিলাম যে, এদের নিজের মধ্যে কতই না মিল। এদের আমরা কত ক্ষুদ্র প্রাণী ভেবে থাকি, এরাও শত সহস্ৰ এক সঙ্গে মিলে নিজেদের জন্যে প্রাসাদোপম বাসস্থান নির্মাণ করেছে। আমার দুঃখ হয়, আমাদের মন্ত্ররা এই উইয়ের কাছে থেকে কোনো শিক্ষাই গ্ৰহণ করেনি।’

‘মানুষ মিলে-মিশে থাকতে কারুর চাইতে কম যায় না, বরং মানুষ যে আজ শ্ৰেষ্ঠ প্রাণী হতে পেরেছে তারও কারণ হচ্ছে একতা। আর এই জন্যেই মানুষ আজ এত বড় বড় নগর ও গ্রাম তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে; তাই তাদের জলযান দিগন্তহীন সমুদ্র পাড়ি দিয়ে দ্বীপ-দ্বীপান্তরের ধনরত্বে সংগ্রহ করেছে; আর এই জন্যেই হাতী-গণ্ডার-সিংহ মানুষের কাছে হার মানতে বাধ্য হচ্ছে।’

‘কিন্তু মানুষের ঈর্ষা? এই ঈর্ষা যদি মানুষের না থাকত–কত ভালো হত।’

‘তুমি মল্লদের ঈর্ষার কথা মনে করে বলছ?’

‘হ্যাঁ, তারা যে তোমায় ঈর্ষা করে। আমি কখনো তোমাকে অন্যের নিন্দা বা অপকার করতে দেখিনি, তোমার মধুর ব্যবহারে দাস ও কর্মকাররা পর্যন্ত কত খুশী–তবু বহু সন্ত্রান্ত মন্ত্র তোমার প্রতি প্ৰতিহিংসা পোষণ করে।’

‘কারণ, তারা আমায় দেখছে সর্বজনপ্রিয়া হতে। আর গণে (প্রজাতন্ত্রে) সর্বজনপ্রিয়কেই লোকে হিংসা করে, সর্বজন-প্রিয়রাই তো গণ-প্রধান বলে গণ্য হয়।’

‘কিন্তু তোমার গুণাবলী দেখে তাদের প্রসন্ন হওয়া উচিত। মন্ত্রদের মধ্যে কেউ তক্ষশিলায় এত সম্মান পেয়েছে বলে আজ পর্যন্ত শোনা যায় নি। তারা কি জানে না যে, কৌশলরাজ প্রসেনজিৎ পত্রের পর পত্র পাঠাচ্ছেন তোমাকে আহবান করে?’

‘আমরা এক সঙ্গে দশ বছর তক্ষশিলায় পড়াশুনা করেছি, তিনি তাই আমাকে স্নেহ করেন এবং আমার গুণগ্রাহী।’

‘কুসীনারার মন্ত্ররা নিশ্চয়ই সেটা জানে। মহালিচ্ছবি যখন এখানে এসে তোমার সঙ্গে ছিল তখন কুসীনারার অনেক লোকই তোমার গুণকীর্তন শুনেছে তার কাছে।’

‘কিন্তু মল্লিকা! আমার প্রতি তারাই ঈৰ্ষা করে, যারা আমার গুণের কথা জানে। গুণী এবং সর্বপ্ৰিয়া হওয়াটাই হল প্রজাতন্ত্রের ঈর্ষার বড় কারণ। আমি নিজের জন্যে মোটেই ভাবি না, কিন্তু আমার দুঃখ এই জন্যে যে, এত কষ্ট করে মন্ত্রদের সেবার জন্যে তক্ষশিলাতে অস্ত্ৰ-বিদ্যা শিখেছিলাম, তা কোনো কাজে লাগাতে পারলাম না। আজ যেমন বৈশালীর লিচ্ছবীিদের কৌশল এবং মগধ নিজেদের সমতুল্য মনে করে, তখন কিন্তু কুসীনারা কোশলরাজকে নিজেদের চেয়ে বড় বলে স্বীকার করত না। আমি ভেবেছিলাম যে, পাবা অনুপিয়া ও কুসীনারাদি ন’টি মল্লকে আমরা স্নেহবন্ধনে বেঁধে লিচ্ছবিদের মতো নিজেদের একটি সম্মিলিত সুদৃঢ় মল্ল প্রজাতন্ত্র গঠন করব। ন’টি মল্ল যদি পরস্পর মিলিত হত তাহলে প্ৰসেনজিৎ আমাদের দিকে চোখ তুলে চাইতেও সাহস করত না। তা আর হল না, এটাই আমার দুঃখ।’

বন্ধুলের গৌরকান্তি স্নান হওয়াতে মল্লিকার দুঃখ হল, সে তার মনকে বিষয়ান্তরে নিয়ে যাবার জন্যে বলল, ‘প্রিয়তম, তোমার বন্ধুরা শিকারে যাবার জন্যে হয়ত তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছে, আর আমিও যেতে চাই। ঘোড়ায় চড়ে যাবে–না পায়ে হেঁটে?’

‘গবয় (নীলগাই) শিকার ঘোড়ায় চড়ে হয় না মল্লিকা, আর হাঁটু পর্যন্ত অন্তর্বােস পরে তিন্ন হাত লম্বা এলোমেলো উত্তরাসঙ্গ উড়িয়ে আর এই রকম নীটস্কো খুস্কো কাল-নাগিনীর মতো চুল দুলিয়ে কেউ শিকার করতে যায়?’

‘এ-সব বুঝি তোমার ভালো লাগে না?’

‘খারাপ!’ বলার সঙ্গে সঙ্গে মল্লিকার টুকটুকে ঠোঁটে চুম্বন করে বন্ধুল বলতে লাগল, ‘মল্লিকা নামের সঙ্গেও যার মিল আছে তাকেও আমার খারাপ লাগতে পারে না, কিন্তু শিকার করতে গেলে জঙ্গলে ঝোঁপের মধ্যে ছুটোছুটি করতে হয় যে।’

‘আচ্ছা, তাহলে তোমার সামনেই বেঁধে ফেলি।’ এই বলে মল্লিকা অন্তর্বাস কষে পরল, আর চুলগুলি সামনে খোঁপা বেঁধে বলল, ‘আমার চাদর দিয়ে পাগড়ী বেঁধে দাও, বন্ধুল!’

পাগড়ী বেঁধে দিয়ে বন্ধুল তার কাচুলির ভেতর থেকে উন্নত ক্ষুদ্র-বিল্ব-স্পর্ধী স্তন অর্ধালিঙ্গন করে বলল, ‘আর এ স্তন?’

‘সব মল্লকুমারীদেরই স্তন হয়।’

‘কিন্তু এ কত সুন্দর?’

‘তাতে কি! কেউ কি এ জিনিস কেড়ে নেবে?’

‘এ যে বন্ধুলের তা তারা জানে।’

‘না, মল্লিকা! তোমার আপত্তি না থাকলে আমি চাদর দিয়ে বেঁধে দি।’

‘কাপড়ের বাইরে থেকে দেখে কি তোমার তৃপ্তি হচ্ছে না?—মল্লিকা মুচকি হেসে বন্ধুলের মুখে চুম্বন করে বলল। বন্ধুল তার কাচুলিটা সরিয়ে দিয়ে শুভ্ৰ স্ফটিকশিলার মতো বুকের ওপর সেই আরক্ত সুডৌল স্তন চাদর দিয়ে বেঁধে দিল। মল্লিকা আবার কাচুলিটি পরে বলল, ‘এখন তো তোমার বিপদ কেটে গেছে বন্ধুল?’

‘বন্ধুলের নিজের জিনিসের জন্যে কোনো ভয় নেই প্রিয়ে! তুমি এখন খুব দ্রুত ছুটলেও ও দুটো বেশি দুলবে না।’

‘সমস্ত মল্ল তরুণ-তরুণীরা শিকারী বেশে সজ্জিত হয়ে এই তরুণ-যুগলের প্রতীক্ষা করছিল। তারা আসতেই সবাই ধনুক, খড়গ, ভল্ল বাগিয়ে রওনা হল। নীলগাই-এর মধ্যাহ্ন। বিশ্রামের জায়গা তাদের মধ্যে কারো কারো জানা ছিল। তাদের প্রদর্শিত পথ ধরেই মল্লরা চলল। বড় বড় গাছের অল্প পত্ৰহীন ছায়ার নিচে নীলগাইয়ের একটি দল বসে রোমন্থন করছিল। যুথপতি একটি বড় নীলগাই, খাড়া কান আগু পিছু করে পাহাড় দিচ্ছিল। মন্ত্ররা দু’দলে ভাগ হয়ে গেল—এক দল হাতিয়ার বাগিয়ে একটি গাছের আড়ালে গিয়ে বসল। অন্য দলটি আবার দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে জায়গাটি ঘিরবার জন্যে এগোতে লাগল। যেদিক থেকে এই দু’দল মিলাবার জন্য অগ্রসর হচ্ছিল সে ধার থেকেই বাতাস আসছিল। নীলগাইটি তখনও তার হরিণের মতো ছোট লেজটি নাড়ছিল, দল দুটি মিলাবার আগেই অন্যান্য গাইগুলিও উঠে দাঁড়িয়ে নাক ফুলিয়ে কান সামনের দিক করে চঞ্চল হয়ে সেদিকে দেখতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যেই বুঝতে পারল যে, তারা বিপদগ্ৰস্ত হয়ে পড়েছে, তাই বাতাসের গতির সঙ্গে তারাও ছুটতে লাগল। তখনও পর্যন্ত বিপদ স্বচক্ষে দেখেনি। তাই মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে দেখছিল।

লুকিয়ে থাকা শিকারীদের কাছে এসে একবার তারা পেছন দিকে তাকিয়ে, এমন সময় ধনুকের টঙ্কার শোনা গেল। যুথপতি নীলগাইটির ঠিক কলিজা লক্ষ্য করে বন্ধুল অব্যৰ্থ শরসন্ধান করল। সঙ্গে সঙ্গে মল্লিকা এবং আরও অনেক বাণ ছুড়ল। কিন্তু বন্ধুলের বাণ ব্যর্থ হলে শিকার যে পালাত–সে কথা নিশ্চিত। নীলগাইটি সেখানেই পড়ে গেল। দলের অন্যান্য গরুগুলি ছত্রভঙ্গ হয়ে এদিকে সেদিক ছুটিল, বন্ধুল কাছে গিয়ে দেখল শিকার শেষ নিশ্বাস নিচ্ছে। রক্তের চিহ্ন অনুসরণ করে চলতে চলতে এক ক্রোশ দূরে আর একটি গবয়কে মাটিতে লুটানো অবস্থায় পাওয়া গেল এই সাফল্যের জন্যে আজকের বনভোজনে আনন্দ-উচ্ছাস বেশি।

কিছু লোক নিধুম আগুন প্ৰজলিত করতে লেগে গেল, আর মন্ত্র স্ত্রীলোকেরা রান্নার জন্য হাঁড়িপাত্র প্রস্তুত করল। কিছু পুরুষ নীলগাই-এর চামড়া খুলে মাংসখণ্ড কাটতে লাগল। সর্ব প্রথম আগুনে পোড়ানো কলিজা ও সুরা-চষক (মদের পাত্র) সকলের সামনে। পরিবেশন করা হল। মাংস কাটতে বন্ধুলের দু’হাত আটকা ছিল, তাই মল্লিকা নিজের হাতে ওর মুখে মাংস ও মদের পেয়ালা তুলে দিল।

সন্ধ্যা হয়ে এল, তখনও মাংস রান্না শেষ হয় নি। অগ্নিকুণ্ডের পোড়া-কাঠ স্কন্ধাগ্নি (কাঠের গুড়ির আগুন) তখনও নিভে যায় নি, তার লাল আভা যথেষ্ট ছিল। সেই রক্তিম সন্ধ্যায় মল্লরা নাচতে ও গাইতে শুরু করল। মল্লিকা, কুসীনারার সুন্দরতম তরুণী, শিকারীবেশে পূর্ণ সাফল্যের সঙ্গে স্বীয় নৃত্যকৌশল প্রদর্শন করল।

কুসীনারার সংস্থাগার (প্রজাতন্ত্রভবনের সভাগৃহ) আজ জনাকীর্ণ। গণসংস্থার (প্রতিনিধি পরিষদের) সকল সদস্য সদস্যশালার মধ্যে উপবিষ্ট। অনেক দর্শনেছু নর-নারী বাইরের মাঠে দাঁড়িয়েছিল। সদস্যশালার মাথার দিকের একটি উঁচু বেদীতে সভাপতি বসেছিল এসে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ভন্তেগণ! (পূজ্যগণ) শোন, আজ যে কাজের জন্যে আমরা এই সভায় উপস্থিত হয়েছি, তা আমি সকলের কাছে বলছি। আয়ুম্মান বন্ধুল তক্ষশিলা থেকে যুদ্ধবিদ্যা অর্জন করে মল্লদের গৌরব-বর্ধন করে ফিরে এসেছে। তার অস্ত্ৰনৈপুণ্যের কথা কুসীনারার বাইরের লোকও জানে। চার বছর হল সে এখানে এসেছে। আমি গণসংস্থার ছোটখাটো কাজগুলি তাকে করতে দিয়েছি, এবং সে প্রত্যেকটি কাজই খুব তৎপরতার ও সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করেছে। গণের এখন উচিত তাকে একটা স্থায়ী পদে। নিযুক্ত করা-উপসেনাপতির পদের জন্য আমি তার নাম প্রস্তাব করছি। ভন্তে গণ! শোন, গণের পক্ষ থেকে আয়ুষ্মান বন্ধুলকে উপসেনাপতির পদে নিযুক্ত করার প্রস্তাব হচ্ছে। যে এ প্রস্তাবের পক্ষে সে নীরব থাক, আর যে বিরুদ্ধে–সে বলতে পোর। ভন্তে গণ! আবার বলছি, আয়ুষ্মান্য বন্ধুলকে গণের পক্ষ থেকে উপসেনাপতির পদ প্ৰদান করার প্রস্তাব করছি। যে এতে রাজী আছে সে নীরব থাক। আর যার আপত্তি আছে সে বলতে পার। ভন্তে গণ! আমি তৃতীয়বার বলছি, আয়ুষ্মান্য বন্ধুলকে গণসংস্থা সহকারী সেনাপতি নিযুক্ত করার প্রস্তাব। করছি। যে আয়ুষ্মান এতে রাজী আছে সে নীরব থাক আর যে রাজী নয়। সে তার বক্তব্য বলতে পার।‘

এমন সময় একজন সদস্য, রোজ মল্ল–চাদর সরিয়ে দিয়ে ডান কাঁধ খালি করে উঠে দাঁড়াল! সভাপতি জিজ্ঞাসা করল, ‘আয়ুষ্মান তুমি কিছু বলতে চাও? ঠিক আছে, তোমার বক্তব্য বল।’

রোজ মন্ত্র সকলকে সম্বোধন করে বলল, ‘ভন্তে গণ! আমি আয়ুষ্মান বন্ধুলের যোগ্যতা? সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ পোষণ করি না। তবে, আমি বিশেষ কোনো কারণে তাকে সহকারী ; সেনাপতি করার প্রস্তাবের বিরোধিতা করছি। আমাদের গণের নিয়ম আছে যদি কাউকে। উচ্চপদে নিযুক্ত করা হয় তবে তার পরীক্ষা গ্ৰহণ করতে হবে। আমি তাই মনে করি আয়ুষ্মান বন্ধুলের বেলায়ও সে নিয়ম প্রয়োগ করা হোক।’

রোজ মন্ত্র বসার পরে আরও দু’তিন জন সদস্যও একই কথা বলল। আবার কিছু সদস্য পরীক্ষা গ্রহণের যে কোনো প্রয়োজন নেই তার ওপর বিশেষ জোর দিল। অবশেষে গণপতি বলল, ‘ভন্তে গণ! শোন, আয়ুষ্মান্য বন্ধুলকে সহকারী সেনাপতি নিযুক্ত করতে গণের মধ্যে কিছুটা মতভেদ দেখা দিয়েছে। তাই ছন্দ (ভোট) নেওয়া প্রয়োজন। শলাকা-গ্ৰহাপক (শলাকা বিতরণকারী) ছন্দ-শলাকা (ভোট গুণবার কাঠি) নিয়ে তোমাদের কাছে যাচ্ছে। তার এক হাতের ডালিতে লাল কাঠি এবং অন্য হাতের ডালিতে কালো কাঠি। লাল কাঠি হল প্রস্তাবের পক্ষে আর কালো কাঠি হল প্রস্তাবের বিপক্ষে। সে আয়ুম্মান রোজ মল্লের পক্ষে অর্থাৎ মূল জ্ঞপ্তির (প্রস্তাব)। বিরোধী, সে কালো কাঠি, এবং মূল জ্ঞপ্তির যে পক্ষেসে লাল কাঠি নেবে।’

শলাকা-গ্ৰহাপক ছন্দ-শলাকাগুলি নিয়ে একে এক প্রত্যেক সদস্যের কাছে গেল। সকলেই নিজ নিজ ইচ্ছানুসারে একটি করে শলাকা নিল; শলাকা-গ্ৰহাপক ফিরে এলে গণপতি বাকি শলাকাগুলি গণনা করল। দেখা গেল, লাল শলাকা বেশি আর কালো কম। তার অর্থ হল, সদস্যগণ কালো শলাকাই বেশি নিয়েছে।

গণপতি ঘোষণা করল, ‘ভন্তে গণ! শোন, কালো শলাকা অধিক সংখ্যক সদস্য নিয়েছে। তাই আমি ঘোষণা করছি যে গণ আয়ুষ্মান্য রোজ মল্লের সঙ্গে একমত। এখন তোমরা ঠিক কর আয়ুষ্মান বন্ধুলের কিভাবে পরীক্ষা গ্রহণ করা হবে!’

ছন্দ-শলাকা ওঠবার পরে অনেকক্ষণ ধরে তর্ক-বিতর্ক চলল, শেষে ঠিক হল যে, বন্ধুল মলুকে কাঠের সাতটা খোটা এক সঙ্গে তরবারী দিয়ে কাটতে হবে।

নির্দিষ্ট দিনে কুসীনারার স্ত্রী-পুরুষের সমাগমে মাঠ ভরে গেল। মন্ত্রিকাও সেখানে উপস্থিত। সাতটি শক্ত কাঠের খোঁটা পাশাপাশি পুঁতে দেওয়া হল। গণপতি আদেশ করার পর বন্ধুল তরবারি বাগিয়ে নিল। সমস্ত জনমণ্ডলী রুদ্ধ নিশ্বাসে দেখতে লাগল। বন্ধুল মল্লের। সুদৃঢ় হাতে সেই ঋজু, দীণু খ দেখে লোকে তার সাফল্য সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত ছিল। বিদ্যুতের মতো উজ্জ্বল বন্ধুলের তরবারী লোকে উঠতে নামতে দেখল—প্রথম খোটা কাটল, তারপর দ্বিতীয়, তৃতীয় এইভাবে ষষ্ঠ খোটা কাটবার সময় বন্ধুলের কানে একটা ধাতব শব্দ ভেসে এল। তাঁর ভ্রূ কুঞ্চিত হয়ে উঠল এবং হতাশায় তার তরবারি থেমে রইল। বন্ধুল তাড়াতাড়ি একবার সবগুলো খোঁটার মাথা দেখে নিল। রাগে তাঁর শরীর কাঁপছিল, মুখ লাল হয়ে গেল, কিন্তু সে একদম চুপ করে রইল।’

গণপতি ঘোষণা করল যে, সপ্তম-খোঁটার মাথা খণ্ডিত হয় নি। কিন্তু তবু লোকের সহানুভূতি বন্ধুল মল্লের প্রতিই ছিল।

ঘরে ফিরে মল্লিকা বন্ধুলের রক্তিম এবং গভীর চেহারা লক্ষ্য করে তাকে সান্ত্বনা দিতে চাইল। বন্ধুল বলল, ‘মল্লিকা! আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। এ রকম যে করা হবে তা আমি আশা করিনি।’

‘প্রত্যেকটা খোঁটার মধ্যে লোহার শলাকা ছিল। পঞ্চম খোঁটাটা কাটা পর্যন্ত আমি জানতে পারিনি। ষষ্ঠ খোটা কাটার পর আমি ঝিন্‌-করে ওঠা পরিষ্কার একটা শব্দ শুনতে পাই আমি ধোঁকাবাজী বুঝতে পারলাম। যদি শব্দটা শুনতে না পেতাম তাহলে সপ্তম খোটাও নিশ্চয় কাটতে পারতাম। কিন্তু শব্দ শোনার পর আমার মন বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ল।’

‘এ রকম বিশ্বাসঘাতকতা যারা করেছে তারা খুবই নীচ!’

’কে এ রকম করেছে তা আমি জানতে পারিনি। রোজ মল্লের ওপর আমার কোনো রাগ নেই। কেননা সে উচিত কথাই বলেছিল, আর তার মতের সঙ্গে গণের বেশির ভাগ সদস্য একমত ছিল। কিন্তু আমার দুঃখ ও রাগ হচ্ছে এই জন্যে যে, কুসীনারায় আমাকে স্নেহ করার লোকের এত অভাব!’

‘তা’ হলে বন্ধুল তুমি কুসীনারার ওপর অসন্তুষ্ট হয়েছ?’

‘কুসীনারা আমার মাতৃতুল্য, এ দেশ আমাকে লালন-পালন করে বড় করেছে। কিন্তু এখন আমি আর কুসীনারায় থাকব না।’

‘কুসীনারা ছেড়ে চলে যেতে চাও?’

‘হ্যাঁ! কারণ, কুসীনারায় এখন বন্ধুল মল্লের কোনো প্রয়োজন নেই।’

‘তাহলে কোথায় যাবে?’

’মল্লিকা, তুমি আমার সঙ্গী হবে?’ – উদ্বিগ্ন মুখে বন্ধুল জিজ্ঞাসা করল।

’আমি তোমার ছায়ার মতো, বন্ধুল!’ মল্লিকা বন্ধুলের লাল চোখ দুটিতে চুম্বন করল আর মুহূর্তের মধ্যে তার রুক্ষতা বিলীন হয়ে গেল।

‘মল্লিকা! তোমার হাত আমাকে দাও।’ মল্লিকার হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বন্ধুল বলল, ‘তোমার এ হাত আমার শক্তির উৎস, এ হাত পেলে বন্ধুল যে কোনো জায়গায়। নিৰ্ভয়ে ঘুরে বেড়াতে পারে।’

‘প্রিয়তমা! তবে কোথায় যাবে ঠিক করলে এবং কবেই বা যাবে?’

‘মুহূর্তকালও আর দেরী করতে চাই না, কেননা খোঁটার মধ্যে লৌহশিলাকার খবর গণপতি পাবেই এবং তারপর আবার সে আমার পরীক্ষার দিন ঠিক করবে। কাজেই লোকের উৎসাহ প্ৰকাশ পাবার আগেই আমাদের যাত্রা করা চাই।’

‘অন্যায়ের বিচার হতে কেন দিচ্ছ না?’

‘কুসীনারা আমার সম্বন্ধে তার মত প্ৰকাশ করেছে, মল্লিকা! এখানে আমার প্রয়োজন নেই-অন্তত এ সময়। কুসীনারায় যখন আমার প্রয়োজন হবে, তখন আবার ফিরে আসব।’

সঙ্গে নিয়ে চলার উপযোগী প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বন্ধুল এবং মল্লিকা সেই রাতেই কুসীনারা ছেড়ে চলে গেল। দ্বিতীয় দিন অচিরাবতীর (রান্তী নদীর) তীরে অবস্থিত ব্ৰাহ্মণদের মল্লগ্রামে। (মলীও, গোরখপুর) পৌঁছাল। সেখানে বন্ধুলের একজন বন্ধুও ছিল, কিন্তু বন্ধুল তার সঙ্গে দেখা করল না। সে গ্রামে গিয়েছিল। এই ভেবে যে, সেখান থেকে নৌকাযোগে শ্রাবন্তী (সহেট-মহেট, গোঞ্জ জিলা) চলে যাবে। মল্লগ্রামে শ্ৰেষ্ঠী সুন্দত্তের লোক বাস করত; তার সাহায্যে নৌকা যোগাড় করা সহজ হল।

 

২.

শ্ৰাবস্তীর রাজধানীতে কৌশলরাজ প্রসেনজিৎ নিজ সহপাষ্ঠী বন্ধুল মল্লকে স্বাগত জানোল। তক্ষশিলায় থাকতেই প্ৰসেনজিৎ ইচ্ছা প্ৰকাশ করেছিল যে, ‘আমি রাজা হলে, বন্ধুল তোমাকে আমার সেনাপতি হতে হবে।’ রাজা হওয়ার পর সে অনেকবার এর জন্যে বন্ধুলকে লিখে জানিয়েছিল, কিন্তু বন্ধুল কোশল-কাশীর মতো সমৃদ্ধশালী এবং বিশাল রাজ্যের সেনাপতি হওয়ার চাইতে স্বীয় জন্মভূমি কুসীনারার গণের একজন সাধারণ উপসেনাপতির মর্যাদাকেই ওপরে স্থান দিয়েছিল। কিন্তু এখন কুসীনারাই তাকে বিতাড়িত < করল, তাই প্ৰসেনজিতের প্রস্তাব শর্তসাপেক্ষে গ্রহণ করতে সে রাজী হল।

বলল, ‘আমি তোমার প্রস্তাব গ্রহণ করতে রাজী। কিন্তু কয়েকটি শর্ত থাকবে।’

‘সানন্দে তা বলতে পার বন্ধু।’

‘আমি মল্লপুত্র বোধহয় তা তুমি জানি।’

‘হ্যাঁ জানি, এবং আমি তোমাকে কখনও মল্লদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বলব না।’

‘আচ্ছা, আর আমার কোনো শর্ত নেই।’

‘মল্লদের সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক আছে আমি তা সর্বদাই বজায় রাখতে চাই, বন্ধু! তুমি বোধহয় জান যে, আমার কোনো রাজ্য-বিস্তারের বাসনা নেই। তবে যদি কোনো কারণে মল্লদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়, তাহলে তুমি স্বাধীনভাবে যে কোনো একপক্ষ গ্ৰহণ করতে পারবে বন্ধু। আমি তোমার জন্যে আর কি করতে পারি?’

‘না, মহারাজ! এই যথেষ্ট।’

 

৩.

বন্ধুল মল্ল কৌশল সেনাপতি নিযুক্ত হল। প্রসেনজি যে রকম নম্র ও উদ্যমহীন রাজা তাতে তার এ রকম একজন সেনাপতিরই প্রয়োজন ছিল। বাস্তবিকই যদি বন্ধুল মল্লকে সে না পেত তাহলে হয়ত মগধ এবং ‘বৎস’ তার রাজ্যের বেশ কিছুটা অংশ অধিকার করে নিত।

শ্রাবস্তী নগরে পৌঁছাবার কিছুকাল পরে মল্লিকার গর্ভলক্ষণ প্রকাশ পেল। বন্ধুল একদিন জিজ্ঞাসা করল, ‘প্রিয়ে তোমার কোনো জিনিসের দোহদ (সাধ) হলে বল।’

‘হ্যাঁ, দোহদ হয় প্রিয়তমা! কিন্তু সেটা বড় দুষ্কর।’

‘বন্ধুল মল্লের পক্ষে কিছুই দুষ্কর নয় মন্ত্রিকা! বল, তোমার কিসের দোহদ।’

‘মল্লদের?’

‘না বৈশালীর লিচ্ছবিদের।’

‘ঠিকই বলেছ। মল্লিকা! তোমার দোহদ খুবই দুষ্কর। কিন্তু যত দুষ্করই হোক বন্ধুল মন্ত্র। সেটা পূর্ণ করবেই। কাল সকালে প্রস্তুত থেক, আমরা দু’জনেই রথে যাব।’

পরের দিন পাথেয় নিয়ে, খড়গ, ধনুক ইত্যাদিতে সজ্জিত হয়ে দু’জনেই রথে যাত্রা করল। কয়েক সপ্তাহ ধরে সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে একদিন বন্ধুলের রথ বৈশালীর দ্বারে গিয়ে প্রবেশ করল, যেখানে একদল লিচ্ছবির ঈর্ষার জন্যে বন্ধুলের সহপাঠী মহালি বন্ধ হয়েছিল। মহালি ছিল সেখানকার একজন অধ্যক্ষ। বন্ধুল একবার ভাবল যে মহালির সঙ্গে দেখা করবে, কিন্তু তাতে মল্লিকার দোহন্দু-এ বিঘ্ন ঘটতে পারে ভেবে সে নিজের ইচ্ছা দমন করল।

অভিষেক পুষ্করিণীর ঘাটে কড়া পাহারা। সেখানে লিচ্ছবি পুত্রদের জীবনে মাত্র একবারই স্নান করবার (অভিষেক পাবার) সৌভাগ্য ঘটত-তাও আবার যখন তাকে লিচ্ছবি প্রজাতন্ত্রের ৯৯৯ জন সদস্যের কোনো একটি শূন্যস্থানে নির্বাচিত করা হত তখনই। প্রহরীগণ বাধা দিলে বন্ধুল তাদের চাবুক মেরে তাড়িয়ে দিল এবং মল্লিকাকে স্নান করিয়ে রথে তুলে খুব তাড়াতাড়ি বৈশালী থেকে বেরিয়ে পড়ল। খবর পেয়ে পাঁচ শ’ লিচ্ছবি রথী বন্ধুলের পিছু ধাওয়া করল। মহালি তা শুনে তাদের নিষেধ করল, কিন্তু গর্বিত লিচ্ছবিরা কারুর নিষেধ শোনবার পাত্র ছিল না।

দূরে রথের চাকার শব্দ শুনে মল্লিকা পেছনে ফিরে দেখে বলল, ‘প্রিয়তম! অনেকগুলি রথ পেছনে তাড়া করে আসছে।’

‘প্রিয়ে! রথগুলি যখন একটি রেখার মতো সোজা আসবে তখন আমাকে বলবে।’

মল্লিকা ঠিক সময় মতোই বলল। প্রাচীন ঐতিহাসিকরা বলেন যে, বন্ধুল তখন সজোরে একটি তাঁর নিক্ষেপ করেছিল। আর সে তাঁর না-কি পাঁচ শ’ লিচ্ছবির কোমরবন্ধ। ভেদ করে বেরিয়ে গিয়েছিল। লিচ্ছবিগণ বন্ধুলের কাছে উপস্থিত হয়ে যুদ্ধ করতে আহ্বান জানাল। বন্ধুল তখন বিনীতভাবে বলল, ‘আমি তোমাদের মতো মৃত লোকদের সঙ্গে যুদ্ধ করি না।’

‘আচ্ছা, অন্তত একবার পরীক্ষা করে দেখা যে আমরা কি রকম মৃত।’

‘আমি দু’বার কখনও তাঁর ব্যয় করি না! যাও, ঘরে ফিরে গিয়ে প্রথমেই প্রিয়জনদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ কর এবং তারপর কোমরন্ধ খুলো’–বলে বন্ধুল মল্ল মল্লিকার হাত থেকে রথের রশি নিল এবং তীরবেগে রুথ চালিয়ে লিচ্ছবিদের চোখের আড়ালে চলে গেল।

ঘরে ফিরে কোমরবন্ধ খোলার পর সত্যি-সত্যিই পাঁচ শ’ লিচ্ছবি যোদ্ধা মারা গেল।

 

৪.

শ্ৰাবস্তী জম্বু-দ্বীপের মধ্যে তখন সব চাইতে বড় নগরী ছিল। প্রসেনজিতের রাজ্যে শ্রাবন্তী ছাড়াও সাকেত এবং বারাণসী নামে দুটি মহানগরী ছিল। শ্রাবন্তীর সুদত্ত (অনাথপিণ্ডদ), মৃগার এবং সাকেতের অর্জনের মতো আরও অনেক কোটিপতি ব্যবসায়ী কাশী কৌশলের সম্মিলিত রাজ্যে বাস করত। তারা ব্যবসায়ের জন্যে তামলিপ্ত হতে আরম্ভ করে পূর্ব সমুদ্র (বঙ্গোপসাগর) এবং ভরুকচ্ছ (ভরোঁচি) ও সুপ্পারক (সোপারা) হয়ে পশ্চিম সমুদ্র (আরব সাগর) দিয়ে সুদূর দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত যেত। ব্ৰাহ্মণ সামন্তরা (মহাশালেরা) ক্ষত্রিয়, সামন্তদের সমতুল্য ছিল না বটে, কিন্তু তবুও সমাজের মধ্যে তারা উচ্চস্থান অধিকার করে ছিল। ঐশ্বর্যে সামন্তরা তাদের কাছে খুবই নগণ্য ছিল। সুদত্ত জেত রাজকুমারের উদ্যান।’জেতবন’ অজস্র কার্যাপণ (মুদ্রা) দিয়ে ক্রয় করেছিল এবং গৌতম বুদ্ধের জন্যে সেখানে জেতবন বিহার তৈরি করেছিল। মৃগারের পুত্র পুন্নবর্ধনের বিবাহে প্রসেনজি নিজে সদলবলে সাকেতে গিয়ে কন্যার পিতা অৰ্জ্জুন শ্ৰেষ্ঠীর অতিথি হয়েছিল। অৰ্জ্জুনের কন্যা তথা মৃগারের পুত্রবধূ বিশাখা নিজের হারের মূল্য দিয়ে সহস্র প্রকোষ্ঠের একটি সাততলা বিশাল বিহার নির্মাণ করে তার নাম রেখেছিল ‘পূর্বারাম মৃগার মাতা প্রাসাদ’। দেশ-দেশান্তরের ধন-রত্ন জড় হয়ে এইসব শ্ৰেষ্ঠীর কাছে আসত।

জৈবলী, উদালক এবং যাজ্ঞবল্কা ঋষিগণ যজ্ঞবাদকে গৌণ, দ্বিতীয় স্থান দিয়েও বাস্তবিক নিস্তারের জন্যে ব্ৰহ্মবাদের সুদৃঢ় নৌকা নির্মাণ করেছিল। জনকের মতো নৃপতিগণও বড় রকমের পুরস্কার দিয়ে ব্ৰহ্মসম্বন্ধনীয় শাস্ত্রার্থ-পরিষদ আহবান করতে লাগল, আর এগুলির মধ্যে থেকেই বেদের বাইরে চলার পথ প্রশস্ত হল। তখন দেশের মধ্যে স্বতন্ত্র চিন্তাধারার জোয়ার এসেছিল। আর বিচারক (তীর্থঙ্কর) বিচার (মতবাদ) সাধারণ সভায় লোকের নিকট উপস্থিত করত। কোথাও তার স্বরূপ মামুলি উপদেশ (অববাদ সূক্ত) রূপে হত, কোথাও কোনো বাদের আহ্বান ঘোষণা রূপে জম্বুর (জাম্) শাখা পুঁতে বেড়াত। প্রবাহণ ছাপ্পান্ন পুরুষকে ভুলিয়ে রাখার জন্যে ব্ৰহ্ম-সাক্ষাৎকারের অনেকগুলি উপায় উদ্ভাবন করেছিল, যেমন প্ৰব্ৰজা (সন্ন্যাস), ধ্যান তপ ইত্যাদি। তখন উপনিষদের শিক্ষার বাইরের আচাৰ্যও নিজ স্বতন্ত্র বিচারের সঙ্গে প্ৰব্ৰজ্যা (সন্ন্যাস) ও ব্রহ্মচর্যের ওপর বিশেষ জোর দিত। অজিত কেশকম্বল একেবারেই জড়বাদী ছিল। সে ভৌতিক (জড়) পদার্থ ছাড়া আত্মা, ঈশ্বরভক্তি, নিত্য-তত্ত্ব অথবা স্বৰ্গ-নরক-পুর্নজন্মবাদ মানত না; তবুও সে নিজে গৃহত্যাগী ব্ৰহ্মচারী ছিল। তখনকার সামন্ত শাসনকর্তার সহানুভূতির পাত্র তো সে ছিলই না; বরং তাদের রোষানলের হাত থেকে বাঁচবার জন্যেও নিজের জড়বাদকে ধর্মের রূপ দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেছিল। ব্ৰাহ্মণ-সামন্ত, লৌহিত্য-ও পায়াসীর মতো রাজন্য সামন্তগণ কিন্তু জড়বাদী ছিল। আর তারা তাদের মতবাদের জন্যে এতই প্রসিদ্ধ ছিল যে, জড়বাদকে পরিত্যাগ করা লজ্জাজনক কাজ মনে করত। তবুও তাদের জড়বাদ সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর ছিল না।

জড়বাদের প্রচার সত্ত্বেও ব্রাহ্মণ-ক্ষত্ৰিয় সামন্তগণের ও ধনুকের ব্যবসায়ীদের বেশি। আস্থা ছিল গৌতম বুদ্ধের অনাত্মবাদের ওপর-বিশেষত কৌশলের। এর বিশেষ একটি কারণ হল যে, গৌতম নিজে কৌশলের অন্তর্গত শাক্য গণের (শাক্য-প্রজাতন্ত্র) অধিবাসী ছিল। সেও জড়বাদীদের মতো বলত-আত্মা, ঈশ্বর ইত্যাদি নিত্যবস্তু পৃথিবীতে নেই, সর্ব বস্তুই উৎপন্ন হয় এবং অচিরেই বিলীন হয়ে যায়। সংসার কতকগুলি বস্তুর প্রবাহ নয়, বরং ঘটনাবলীর স্রোত। তার প্রচারিত মতবাদ জ্ঞানীরা খুবই যুক্তিসঙ্গত ও হৃদয়গ্রাহী বলে মনে করত। কিন্তু ওই অনাদিবাদে লোক-মর্যাদা, ধনী-গরীব, দাস-স্বামীর প্রভেদ নষ্ট হয়, তাই অজিতের জড়বাদ সামন্ত ও ব্যবসায়ী শ্রেণীর মধ্যে প্রিয় হতে পারল না। গৌতম বুদ্ধ নিজের অনাত্মবাদ ও জড়বাদের মধ্যে আর কিছু যোগ করে তার তিক্ততা কিছুটা দূর করল। তার মতে আত্মা নিত্য না হলেও চেতনা-প্রবাহ স্বৰ্গ কিংবা নরকের মানুষের মধ্যে এক দেহ হতে আর এক দেহে-এক শরীর-প্রবাহ হতে আর এক শরীর প্রবাহে সঞ্চারিত হয়। এ বিচার অনুযায়ী প্রবাহণ রাজার আবিষ্কৃত হাতিয়ার ছিল, আর তার জন্যেই পুনর্জন্মবাদের পুরোপুরি স্থিতির জায়গা হল। যদি গৌতম বুদ্ধ নিছক জড়বাদেরই প্রচার করত তা’ হলে নিশ্চয়ই শ্রাবস্তী, সাকেত, কৌশাম্বী, রাজগৃহ, ভদ্রকার শ্ৰেষ্ঠীরা অজস্র টাকা ব্যয় করত না এবং ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় সামন্তরা ও রাজারা তার পায়ের ধূলি সেবার জন্যে ভীড় করত না। শ্রাবস্তীর উচ্চশ্রেণীর স্ত্রীলোকদের গৌতমবুদ্ধের মতবাদে অগাধ বিশ্বাস ছিল। প্রসেনজিতের পাটরাণী মল্লিকা দেবী বৌদ্ধধর্মের প্রতি খুব অনুরক্ত ছিল। তার নগরস্থিত শ্ৰেষ্ঠীর, পুত্রবধু তার সখী বিশাখা বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন-স্বরূপ পূর্বারামের মতো একটি মহা-বিহার নির্মাণ করে বুদ্ধদেবকে দান করেছিল। সেনাপতি বন্ধুল মল্লের স্ত্রী পাটরাণী মল্লিকার অত্যন্ত প্রিয় সখী ছিল, তার অনুপ্রেরণায় সেও বুদ্ধের উপদেশাবলী শুনে কিছুদিন পরে বুদ্ধের উপাসিকা হয়ে পড়ল।

মল্লিকার অবস্থা খুবই সমৃদ্ধশালী ছিল। কৌশলের মতো রাজ্যের সেনাপতির ঘর সমৃদ্ধ হওয়াটা স্বাভাবিক। মল্লিকার দশটি বীরপুত্র। তারা প্রত্যেকেই রাজসেনা বাহিনীর উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিল। বন্ধুল মল্ল এক যুগ পর্যন্ত রাজার ওপর নিজের প্রভাব বিস্তার করেছিল। এর মধ্যে অনেকেই তার শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অন্য জনপদের কোনো লোককে এত উচ্চপদে কাজ করতে দেখে তারা পছন্দ করত না। ঈৰ্ষাপরায়ণ লোকেরা রাজার কাছে তার নামে অপবাদ রটাতে শুরু করল। রাজাও কিছুটা বোকাবুদ্ধির লোক ছিল। তারা রাজার কাছে গিয়ে এই বলে উসূকাল যে, বন্ধুল মল্ল রাজাকে নির্বোধ বলে প্রচার করছে। শেষটায় রাজার কাছে এমন কথাও বলল যে, সেনাপতি রাজ্য কেড়ে নিতে চেষ্টা করছে। প্ৰসেনজিতেরও সেটা ঠিক বলে মনে হল। তখন রাজা ও বন্ধুল মল্ল তাদের নিজ নিজ শক্ৰদের হাতে। খেলতে লাগল।

চিন্তাক্লিষ্ট বন্ধুলকে একদিন মল্লিকা জিজ্ঞেস করল, ‘প্রিয়! তুমি এত কি ভাবছ?’

‘রাজা আমার ওপর সন্দেহ করতে শুরু করেছে।’

‘তাহলে সেনাপতির পদে ইস্তফা দিয়ে চল না কুসীনারা চলে যাই। সেখানে আমাদের জীবিকার্জনের জন্যে কর্মান্ত (ক্ষেত্র) আছে।’

‘এর অর্থ হল রাজাকে শত্রুর হাতে ছেড়ে দেওয়া। দেখছি না, মগধরাজ অজাতশত্রু। কতবার কাশী আক্রমণ করল। আমরা একবার তাকে বন্দী করেছিলাম। মহারাজ উদারতা দেখিয়ে রাজকন্যা বজ্রার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে তাকে ছেড়ে দিল। কিন্তু অজাতশত্রু সমগ্র জম্বু দ্বীপের রাজচক্রবর্তী হতে চায়, সে এ বিয়েতে চুপ হওয়ার পাত্র নয়। তার গুপ্তচরে রাজধানী ছেয়ে গেছে। আমাদের জন্য প্ৰতিবেশী অবন্তিরাজার জামাতা বৎসরাজ উদয়নের উদ্দেশ্যও ভালো নয়-সেও সীমান্তে প্রস্তুত হচ্ছে। এ সময়ে শ্রাবন্তী ছেড়ে চলে যাওয়াটা খুবই কাপুরুষের কাজ মল্লিকা!’

‘আর এটা মিত্রদোহের কাজও বটে।’

‘মল্লিকা! আমি নিজের কথা চিন্তা করি না। যুদ্ধে অনেক বার আমি মৃত্যু কবলিত হয়েও বেঁচে গিয়েছি। তাই কখনও যদি মৃত্যু আমাকে গ্রাস করে, তা হলেও সেটা আমার কাছে বড় কথা হবে না।’

পাটরানী মল্লিকা ছিল মালীর কন্যা। সাধারণ এক মালীর মেয়ে হয়েও নিজের গুণে প্রসেনজিতের পাটরাণী হয়েছিল-কিন্তু সে বেঁচে নেই। থাকলে লোকের কথায় রাজার কান এতটা ভারী হত না। একদিন রাজা সীমান্তে বিদ্রোহ দমনের নাম করে বন্ধুল মল্লের পুত্রদের পাঠিয়ে দিল। তারা জয়লাভ করে যখন ফিরছিল তখন উল্টো খবর দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে বন্ধুল মল্লকে পাঠাল। এই চক্রান্তে বন্ধুল আর তার দশ পুত্রই এক জায়গায় প্রাণ দিল। যখন এ ঘটনার সংবাদ মল্লিকার কাছে পৌঁছাল। তখন সে বুদ্ধ ও তার ভিক্ষুসংঘকে ভোজন করাতে যাচ্ছিল। তার তরুণী পুত্রবধুরা খুব ভক্তি সহকারে নানা রকম খাবার তৈরি করেছিল। মল্লিকার হৃদয় দগ্ধ হতে লাগল। কিন্তু সে নিজেকে এতদূর সংযত করল যে, তার চোখ দিয়ে এতটুকু অশ্রুকণা গলিত হওয়া তো দূরের কথা, মুখ পর্যন্ত স্নান হল না! : সে চিঠিটা নিজের আঁচলে বেঁধে সমস্ত সংঘকে ভোজন করাল। ভোজনের পরে বুদ্ধের উপদেশাবলী শ্রদ্ধার সঙ্গে শুনল। তারপর চিঠিটা পড়ে শোনাল। বন্ধুলের পরিবারে যেন বজ্ৰপাত হল। মল্লিকার খুবই ধৈৰ্য কিন্তু সেই তরুণী বিধবাদের সান্ত্বনা দেওয়া বুদ্ধের পক্ষেও সহজ কাজ ছিল না।

কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর প্রসেনজিৎ সত্য ঘটনা জানতে পেরে খুবই শোকার্তা হলেন। কিন্তু তখন আর কিছু করবার উপায় ছিল না। প্রসেনজিতের মনের সান্ত্বনার জন্য বন্ধুলের ভাগিনেয় দীর্ঘকারায়ণকে নিজের সেনাপতি নিযুক্ত করল।

 

৫.

শীতকাল, কপিলাবাস্তুর আশেপাশের ক্ষেতে গম, ভুট্টা ও হলুদ রঙ-এর সরষে ফলেছে। আজ নগর খুবই সাজানো হয়েছে, কোনো কোনো জায়গায় তোরণ তৈরি হয়েছে, বিশেষ করে সংস্থাগারটিকে বেশি করে সাজানো। তিন দিন কঠোর পরিশ্রমের পরে আজ একটুখানি অবসর পেয়ে কয়েকজন দাস একটি ঘরের কোণে বসে গল্প করছিল।

কাকু বলল, ‘আমাদের দাসদের জীবন কি কোনো মানুষের জীবন? আমরা মানুষ না হয়ে যদি গরু হয়ে জন্মাতাম তা হলেও ভালো ছিল। তখন তো আর আমাদের মানুষের মতো অনুভূতি থাকত না।’

‘ঠিকই বলেছ কাকু!’ কাল আমার প্রভু দণ্ডপাণি লোহা লাল করে আমার স্ত্রীকে ছ্যাকা দিয়েছে।’

‘কেন ছ্যাঁকা দিল?’

‘কেন করল, সে কথা তার কাছে কে জিজ্ঞাসা করবে? তারা তো দাসদের পতি-পত্নী সম্বন্ধও মানতে রাজি নয়। এ সত্ত্বেও এই দণ্ডপাণি নিজেকে নিগংঠক শ্রাবক (জৈন) বলে। সে এমনি নিগংঠক যে মাটির কীট সরাবার জন্যে নিজের কাছে ময়ুরের পাখনা রাখে। দোষের মধ্যে হল যে, আমার মেয়ে কিছুদিন ধরে কঠিন অসুখে ভুগে অজ্ঞান হয়ে পড়লে আমার স্ত্রী সেই সংবাদ আমাকে দিতে এসেছিল। হতভাগী মেয়ে শেষ পর্যন্ত বাঁচল না। তা মরে গিয়ে ভালোই হয়েছে। সংসারে আমাদের মতোই তো ওকেও বাঁচতে হত! সত্যিই কাকু, আমাদের দাসদের কোনো জীবনই নয়! শুধু এই নয়, আমার মনিব বলছিলেন যে, এ ধুমধাম শেষ হলেই আমার স্ত্রীকে বেচে দেবে।’

‘তবে ওই কষাই দণ্ডপাণি লোহা দিয়ে দাগিয়েও কি তৃপ্তি পেল না?’

‘না ভাই। বার বছর পরে মেয়েটিকে পঞ্চাশ নিষ্কে (স্বর্ণমুদ্রা) বেচে দেওয়ার কথা ছিল। বিশ্বাস কর, আমরা জেনেশুনেই না-কি তার পঞ্চাশ নিষ্ক নষ্ট করে দিয়েছি।’

‘এ কথাও স্বীকার করতে হবে, আমাদের দাসদের বাপ মায়ের হৃদয়ও নেই।’

তাদের কথার মাঝে একটি বৃদ্ধ দাস বলল, ‘আর এও একজন দাসীরই পুত্র, যার সম্বর্ধনার জন্যে এতসব তোড়জোড় হচ্ছে।’

‘কে দাদা?’

‘এই কোশল রাজকুমার বিদুডভ।’

‘দাসীর পুত্র?’

‘হ্যাঁ, মহানাম শাক্যের সেই বুড়ি দাসীকে জানো না? আমাদের মতো কেলো নয়–নিশ্চয়ই কোনো শক্যের ঔরস-জাত হবে!’

‘ হ্যাঁ, ঐ দাসীর পেটে মহানামের একটি মেয়ের জন্ম হয়। তার রঙ খুবই ফর্সা আর দেখতেও খুব সুন্দরী; তাকে যেন শাক্যকন্যা বলেই মনে হত।’

‘মনে না হবার কারণ কি? মেয়ে যদি সুন্দরী হয়-তা সে দাসীকন্যা হোক না কেন, মালিক তাদের খুবই যত্নে লালনপালন করে।’

‘কোশলরাজ প্রসেনজিৎ কোনো এক শাক্য কুমারীকে বিয়ে করতে চাইল, কিন্তু শাক্যরা নিজেদের কুলীনশ্রষ্ঠ মনে করে, তাই তারা কেউই নিজ কন্যাকে রাজার সঙ্গে বিয়ে দিতে চাইল না। কিন্তু পরিষ্কার করে এ কথা বলার জো নেই, পাছে কৌশলরাজ রাগ করেএ ভয়ও ছিল। শেষ পর্যন্ত মহানাম তার দাসী কন্যাকে শাক্যকুমারী বলে পরিচয় দিয়ে প্ৰসেনজিতের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিল। সেই বার্ষভ-ক্ষত্রিয়ার পুত্র বিদুডভ রাজকুমার।’

‘কিন্তু এখন তো এও শাক্যদের মতোই আমাদের রক্তপিপাসু হবে!’

***

বাজনা বাজতে লাগল, শাক্যরা কৌশল-রাজকুমারকে মহা ধুমধামের সঙ্গে স্বাগত জানাল, যদিও মনে মনে দাসীপুত্র বলে সকলে তাকে ঘৃণা করত। বিদুডভ নিজ মাতুলকুলের সম্বর্ধনা গ্ৰহণ করে মাতামহ মহানামের আশীৰ্বাদ নিয়ে খুশী মনে কপিলাবাস্তু থেকে বিদায় নিল। দাসীপুত্রের পদার্পণে সংস্থাগার অপবিত্র হয়েছিল, তাই তার শুদ্ধির প্রয়োজনে দাসদাসীরা ধুয়ে মুছে শুদ্ধি করতে লেগেছিল। একজন দাস বিদুডভের উদ্দেশ্যে গালি পাড়ছিল। এদিকে বিদুড়ভের একজন সৈনিক নিজের ভল্ল সংস্থাগারে ফেলে গিয়েছিল, তাই নিতে এসে এই সব কটুক্তি শুনতে পেয়ে সব কথা বিদুডভকে জানোল। সে কপিলাবাস্তু শাক্যহীন করুবার প্রতিজ্ঞা করল, আর তা পরবর্তীকালে করেও ছিল। তার ক্রোধের অনুলক্ষ্য ছিল প্ৰসেনজিৎ, যে তাকে দাসীর গর্ভে জন্ম দিয়েছিল।

দীর্ঘকারায়ণ নিজের মামা ও মামাতো ভাইদের মৃত্যুকে ভুলতে পারল না। অন্য দিকে প্রসেনজিৎ তার সমস্ত ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করবার জন্য অধিক মাত্রায় বিশ্বাস ও মধুরতা। দেখাতে চাইছিল। একদিন মধ্যাহ্ন ভোজনের পর তার বুদ্ধদেবকে স্মরণ হল। কয়েক যোজন দূরে শাক্যদের কোনো এক গ্রামে বুদ্ধদেব অবস্থান করছেন শুনে প্রসেনজিৎ দীর্ঘকারায়ণ সব কিছু সৈন্য নিয়ে সেখানে রওনা হল। বুদ্ধদেবের বাসগৃহে যাবার সময় তার মুকুট, খড়গ ও অন্যান্য রাজ চিহ্নগুলি কারায়ণের হাতে দিয়েছিল। বিদুডভের সঙ্গে কারায়ণের যোগ ছিল। রাণীকে সেখানে ত্যাগ করে রাজ্য মধ্যে গিয়ে বিদুড়ভকে রাজা বলে ঘোষণা করুল; আর নিজে রওনা হল শ্রাবন্তীর পথে।

অনেকক্ষণ পর্যন্ত বুদ্ধের উপদেশ শুনে প্রসেনজিৎ বাইরে এল। রাণী তাকে সব কথা বলল। সব শুনে সেখান থেকে প্রসেনজিৎ রাজগৃহ (রাজগীর) গিয়ে নিজের আত্মীয় মগধরাজ অজাতশত্রুর কাছ থেকে পরামর্শ ও সাহায্য নেওয়া ঠিক করল। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে দীর্ঘ পথশ্রমে পথিমধ্যেই শরীর অচল হয়ে পড়ল, সন্ধ্যার গোধূলি লগ্নে যখন রাজগৃহে পৌঁছল তখন নগরদ্বার বন্ধ হয়ে গেছে। সেই রাত্র নগর উপান্তে একটি কুটিরে প্রসেনজিতের মৃত্যু হল। সকালে রানীর বিলাপ শুনে অজাতশত্রু ও বজ্রা ছুটে এল, তখন জাঁকজমকের সঙ্গে শবদাহ করা ছাড়া আর কি-ই বা করবার ছিল!

বন্ধুলকে হত্যার এই হল প্রতিশোধ-দাসপ্রথার এই হল পরিণাম। *

————–

* আজ থেকে একশ’ পুরুষ আগেকার একটি ঐতিহাসিক কাহিনী। এই সময় সামাজিক বৈষম্য খুবই বেড়ে গিয়েছিল। ধনী ব্যবসায়ী-শ্রেণী সমাজের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছিল। এই সময়ের মধ্যে জন্মেছেন অনেক পথ প্রদর্শক–যারা নরক থেকে মানুষকে উদ্ধার করে পরলোকের পথ দেখান। কিন্তু যে নরকের অগ্নিকুণ্ড গ্রামে দাউদাউ করে জ্বলছিল তার দিকে সবাই চোখ বুজে ছিল।

 ১০. নাগদত্ত (কাল : ৩৩৫ খৃষ্টপূর্ব)

“বিষ্ণগুপ্ত! উচিত কাজের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। আমরা মানুষ তাই আমাদের কিছু কর্তব্য আছে। আর সেই জন্যে আমাদের উচিত-অনুচিত সম্বন্ধে খেয়াল রাখা দরকার।”

“কর্তব্য কি ধর্ম নয়?”

“আমি ধর্মকে ছলনা বলে মনে করি। ধর্ম কেবলমাত্র পরম্বাপহারীদের শাস্তিতে পরের ধনকে উপভোগের সুগোগ দেয়। ধর্ম কি কখনও গরীব এবং দূর্বলের কোনো খবর রাখে? পৃথিবীতে এমন কোন জাত নেই যারা ধর্ম মানে না। দাসেরও যে মানুষ—ধর্ম কি তা কখনও স্বীকার করে? দাসেদের কথা ছেড়েই দিলাম, কিন্তু স্ত্রী-জাতির প্রতি—তা সে অ-দাস হোক না কেন, ধর্ম কি কখনও ন্যায় করেছে? টাকা হলেই তুমি দু-চার-দশ কিংবা একশ বিয়ে করতে পার। সেই স্ত্রী দাসী ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না; ধর্ম কিন্তু একে উচিত কাজ বলেই মনে করে। আমি যে কর্তব্যের কথা বলছি সেটা ধর্মজাত কর্তব্য নয়, সুস্থ মানুষের মন যেটাকে কর্তব্য বলে মনে করে।”

*আজ থেকে একশ’পুরুষ আগেকার একটি ঐতিহাসিক কাহিনী। এই সময় সামাজিক বৈষম্য খুবই বেড়ে গিয়েছিল। ধনী ব্যবসায়ী-শ্রেণী সমাজের মধ্যে গুরুত্বপূর্ন স্থান অধিকার করে ছিল। এই সময়ের মধ্যে জন্মেছেন অনেক পথ প্রদর্শক—যাঁরা নরক থেকে মানুষকে উদ্ধার করে পরলোকের পথ দেখান। কিন্তু যে নরকের অগ্নিকুণ্ড গ্রামে গ্রামে দাউদাউ করে জ্বলছিল তার দিকে সবাই চোখ বুঁজে ছিল।

“তা’হলে আমি বলব যে, প্রয়োজনীয় যা কিছু তাই হল কর্তব্য।”

“তবে তো উচিত-অনুচিতের মধ্যে কোনো প্রভেদ থাকবে না।”

“থাকবে বন্ধু! আমার প্রয়োজনীয় কথার অর্থ শুধু একজনের প্রয়োজন নয়।”

“একটু পরিষ্কার করে বল,বিষ্ণুগুপ্ত!”

“আমাদের এই তক্ষশিলা গান্ধারের কথাই ধর না কেন! আমাদের কাছে নিজ স্বতন্ত্রতা কত প্রিয় এবং সেটা খুব স্বাভাবিকও বটে। কিন্তু আমাদের দেশ এত ছোট যে তার পক্ষে বড় শত্রুর মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। যতদিন পর্যন্ত মাত্র, পশ্চিম গান্ধারের মতো ছোট ছোট প্রজাতন্ত্রগুলি আমাদের প্রতিবেশী ছিল ততদিন সুখেই ছিলাম। কখনও কখনও যু্দ্ধ হত বটে কিন্তু পরিণামে সামান্য কিছু লোকই মরত শুধু। আমার স্বাতণ্ত্রা অপহৃত হয়নি। কারণ আরও ছিল, তক্ষশিলা জয় করা—কণ্টকাকীর্ণ রাজ্য জয় করা কারও পক্ষে সহজ ছিল না। কিন্তু যখন পার্শবরা (ইরাণী) পশ্চিমের প্রতিবেশী হয়ে দাঁড়াল তখন আমাদের স্বাতন্ত্র্য শুধু তাদের ক্বপার ওপর নির্ভর করে রইল। এখন আমাদের স্বতন্ত্রতা রক্ষার জন্য আবশ্যক পার্শবদের মতো শক্তিশালী হওয়া।”

“শক্তিশালী হওয়ার জন্য কি করা উচিত?”

“ক্ষুদ্র প্রজাতন্ত্রে কাজ হবে না। ছোট-ছোট স্বতণ্ত্র জনপদের জায়গায় বিশাল রাজ্য কায়েম করতে হবে।”

“সে বিশাল রাজ্যে ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র জনপদের কি কোনো স্বাধিকার থাকবে?”

“সকলেই রাজ্যকে আপন বলে মনে করবে।”

“খুবই গোলমালের কথা বিষ্ণুগুপ্ত! দাস কি কখনও প্রভূকে আপন মনে করে?”

“তবে শোন বন্ধু নাগদত্ত,স্থান পাওয়াটা শুধু ইচ্ছা বা খেয়ালের ওপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে যোগ্যতার ওপর।যদি তক্ষশিলা—গান্ধারদের যোগ্যতা থাকে তবে তারা ওই বিশাল রাজ্যও শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করবে। তা না হলে সাধারণভাবেই থাকবে।”

“গোলামের স্থান অধিকার করে?”

“কিন্তু বন্ধু! দারয়োশ রাজ্য পশ্চিম গাণ্ধাররা যে স্থান পেয়েছে তার থেকে এ গোলাম স্থান অনেক ভালো হবে। আচ্ছা আমার বক্তব্য ছেড়েই দাও। তুমিই বল না, আমাদের স্বতন্ত্রতা রক্ষা করার জন্য কি করা উচিত। এ কথা খুবই সত্যি যে, আমাদের মতো ক্ষুদ্র জনপদের পক্ষে আপন অস্তিত্ব রক্ষা করা দীর্ঘকাল আর সম্ভব নয়।”

“আমি বলব বিষ্ণুগুপ্ত! প্রথমত আমাদের নিজস্ব গণ-স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখা উচিত যা কোনো রাজার বশ্যতা স্বীকার করবে না। কিন্তু আমি জানি, আমাদের মতো একটি ক্ষুদ্র গণের (রাষ্টের) পক্ষে স্বতণ্ত্রতা রক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই আমাদের কর্তব্য হল, সমস্ত উত্তরাপথের (গান্ধারের) গণগুলিকে (রাষ্ট্রগুলিকে) সংঘবব্ধ করা।”

“ সে সংঘে প্রত্যেকটি গণ স্বতণ্ত্র থাকবে—না, সংঘ সর্বোপরি থাকবে?”

“গণকে আমি সর্বোচ্চ বলে মনে করি আর সেইভাবেই গাণ্ধার, মাদ্র, মল্ল এবং শিবি প্রভূতি গণগুলির আপন শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করতে হবে।”

“কেমন করে তা স্বীকার করবে? শেষ পর্যন্ত তো গণকে বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সৈন্য রাখতেই হবে, বলি (কর) আদায় করতে হবে।”

“গণ(প্রজাতন্ত্র) যেমন তার কাজ সাধারণ মানুষের দ্বারা পরিচালনা করে, তেমনি সংঘ তার কাজ চালাবে গণগুলি সাহায্যে।”

“গণের মধ্যে প্রথম থেকেই আমরা এক জনের (গোষ্ঠী) এক রক্তের পরিবার হিসাবে বাস করে আসছি। আর অনাদিকাল থেকে এই পরিবার অর্থাৎ গণকে মেনে চলতে অভ্যস্ত। কিন্তু গণগুলির মিলিত সংঘ একটি নতুন জিনিস। এখানে রক্তের কোন সম্বন্ধ নেই, বরং এদের মধ্যে অনাদিকাল হতে চলে আসছে রক্তক্ষয়ী দ্বন্ধ ও প্রতিদ্বন্ধিতা। এ ক্ষেত্রে কেমন করে আমরা সবাইকে দিয়ে সংঘের নিয়ম-কানুন স্বীকার করাতে সক্ষম হব? বন্ধ! তুমি যদি এদের পারস্পরিক সম্পর্ক বিচার করে দেখতে তা’হলে আর তুমি এ কথা বলতে না। যদি বাধ্য করা হয়, তা’হলে সংঘের কথা না হয় ধরলাম যে গণগুলি মেনে নেবে, কিন্তু বাধ্য করাবার শক্তি আসবে কোথ্থেকে?”

“আমি মনে করি যে, সে শক্তি ওরিই মধ্যে থেকে সৃষ্টি করা উচিত।”

“আমি ও মনে করি যে গণগুলির ভেতর থেকে যদি সে শক্তি সৃষ্টি হত তা’হলে খুবই ভালো হত। কিন্তু পার্শবদের কাছে বারবার মার খেয়ে বুঝেছি যে, শক্তি ভিতর থেকে স্বষ্টি হবে না। তাই আমাদের প্রয়োজন, অন্য উপায়ে সে শক্তি সৃষ্টি করা।”

“রাজাকে মেনে নিয়েও?”

“শুধু তক্ষশিলা নয়। তক্ষশিলা গান্ধারের মতো জনপদগুলির জন্য একজন রাজা অর্থাৎ রাজচক্রবর্তীকেও স্বীকার করে নিলে কোনো ক্ষতি নেই।”

“তা’হলে পার্শব দারয়োশকেই বা কেন রাজা বলে মেনে নাও না?”

“পার্শব দারয়োশ যে আমাদের লোক নয় তা তুমি নিজেও ভালোভাবেই জানো। আমার জম্বূদ্বীপের লোক।”

“আচ্ছা, তা’হলে নন্দকে স্বীকার করে নাও।”

“আমরা যদি উত্তরাপথের সব গণগুলিকে সংঘবদ্ধ করতে না পারি, তা’হলে নন্দকে স্বীকার করে নিতে আপত্তি করা উচিত নয়। পশ্চিম গান্ধারদের মতো দারয়োশের অধীন হওয়া ভালো—না নিজেদের জম্বুদ্বীপের চক্রবর্তীর অধীনতা স্বীকার করা ভালো?”

“বিষ্ণুগুপ্ত তুমি এখনও রাজ-শাসিত দেশ দেখনি, যদি দেখতে তা’হলে বুঝতে যে, সেখানে সাধারণ লোকেরও দাসদের অপেক্ষা বেশী অধিকার নেই।”

“স্বীকার করছি। আমি পশ্চিম গান্ধার ছাড়া আর কোথাও যাইনি; কিন্তু দেশ ভ্রমণের ইচ্ছা আমার খুবই আছে। আমি লেখাপড়া শেষ করে পর্যটনে বার হব। বিদেশী দাসত্বের হাত থেকে বাঁচতে হলে ক্ষুদ্র গণ্ডী ভেঙে ফেলা সম্পর্কে দ্বিমত থাকতে পারে না। পোরাস আর দারয়োশদের সফলতার এই হল চাবিকাঠি।”

“তারা কতটা সাফল্য লাভ করেছে তা আমি কাছে থেকে দেখেছি।”

“কাছে থেকে?”

“হ্যাঁ, আমি প্রাচীতে মগ্ধ পর্যন্ত দেখেছি। আর নন্দের রাজত্ব, যা আমাদের পূর্ব গান্ধারের (তক্ষশিলা) তুলনায় নরক, তাও দেখেছি। গরীবদের দাবিয়ে দেওয়ার শক্তি তার আছে এবং মেহনতকারী কৃষক, শিল্পী ও দাসেরা যে তাতে কত নিপীড়িত তার বর্ণনা করা যায় না।”

“এ সবের কারণ হল নন্দের রাজ্যে তক্ষশিলার মতো কোনো স্বাভিমানী স্বতন্ত্রতাপ্রেমী, গণ (প্রজাতন্ত্র) সম্মিলিত হয়নি।”

“সম্মিলিত হয়েছে, বিষ্ণুগুপ্ত! লিচ্ছবিদের গণ গান্ধার থেকেও শক্তিশালী ছিল, কিন্তু এখন বৈশালী মগধের চরণদাসী আর লিচ্ছবিরা মগধ-শিকারীদের জবরদস্ত ডালকুত্তা। বৈশালীতে দেখবে, দেশটা উজাড় হয়ে যাচ্ছে; গত দেড়শ’বছরের মধ্যে জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশও এখন অবশিষ্ট নেই। শতাব্দী ধরে অর্জিত স্বতন্ত্রতা, স্বাভিমানী ভাব—এ সব এখন মগ্ধ রাজার সৈন্য বানাবার কাজে লাগানো হচ্ছে। একবার বড় রাজ্যের হাতে নিজেকে অর্পণ করলে তার হাত থেকে রেহাই পাওয়া বড় মুস্কিলের ব্যাপার।’

“বন্ধু নাগদত্ত! আমিও একদিন এই মতই পোষণ করতাম, কিন্তু এখন আমি মনে করি যে, ছোট ছোট গণের যুগ আর নেই। আর বড় গণ (প্রজাতন্ত্র) ও সংঘ গড়ে তোলবার চিন্তা স্বপ্নমাত্র। যুগের প্রয়োজনাকেই মেনে চলা উচিত। কিন্তু তুমি কি পশ্চিমের যাবার জন্য তৈরি হচ্ছ?”

“হ্যাঁ, প্রথমে পার্শবদের দেশ। আমাদের মতো তাদেরও গণ আছে, তাই নিজের চোখে দেখতে চাই যে কিভাবে তারা মহান দারয়োশ ও তার বংশধরদের উদ্দেশ্য সফল হতে দেয়নি।”

“আর আমিও যাচ্ছি! প্রাচ্যকে দেখব। দেখব যে, সমস্ত জম্বুদ্বীপকে একত্রিত করার শক্তি মগধের আছে কি নেই। চল, আমরা পড়া শেষ করে ধর্নাজন ও পরিবারপোষণ করা যায় এমন জায়গায় গিয়ে কাজ করি। বন্ধু, তুমি আয়ুবেদশাস্ত্র পড়ে বৈত্য হয়ে ভালোই করেছ, কেন না কোথাও গিয়ে থাকবার পক্ষে এ খুবই লাভজনক বিদ্যা। আমি জানি না বলে এখন অনুতাপ হচ্ছে।”

“তুমি ওর চেয়ে ও লাভজনক জ্যোতিষ বিদ্যা এবং সামুদ্রিক তন্ত্রমন্ত্র জানো।”

“মিত্র! তুমি তো জানো, এ বিদ্যা স্রেফ ফাঁকিবাজী।”

“কিন্তু বিষ্ণূগুপ্ত, এই বিদ্যা সত্য কি মিথ্যা তাতে চাণক্যের কি যায় আসে!”

ছেলেবেলা থেকে এক সঙ্গে খেলাধূলা ও পড়াশুনার সাথী—তক্ষশিলার নাগদত্ত কাপ্য এবং বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্যের বিদ্যার্থী জীবনের এই শেষ দেখা। একাধিকবার তক্ষশিলা পার্শবদের হস্তগত হয়েছিল, আর তার স্বাধীনতা বাঁচাবার জন্য দু’জনেই নিজ নিজ বিবেচনা অনুসারে পথ খুজে বেড়াচ্ছিল।

 

চারিদিক বৃক্ষ-বনস্পতিবিহীন, ছোট ছোট নগ্ন পাহাড়। সেখানে সবুজের আশায় চোখ পিপার্সাত হয়ে উঠছিল। পাহাড়ের মাঝখানটায় বিস্তীর্ণ উপত্যকা—তার মধ্যেও কচিৎ কোথাও জল এবং বনস্পতির চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল। এই উপত্যকার ধারে ধারে সার্খের (ক্যারাভ্যাম) রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে সর্বদা লোক যাওয়া-আসা করত। আর সার্থ এবং তার পশুদের আরামের জন্য পাস্থাশালা নির্মিত হয়েছিল। আশেপাশের অবস্থা দেখে এ রকম আশা করা যেত না যে এই পান্থশালায় সমস্ত  সুখ-সুবিধা আছে। এই মরুভূমিতে এত জিনিস কোথা থেকে আসা তা জানা যায়নি। এই পর্বতের মধ্যে একাধিক পান্থশালা ছিল; তাদের কোনোটা সাধারণ রাজকর্মচারীদের জন্য, কোনোটা সৈনিকদের আবাসস্থল, কিছু ব্যবসায়ীদের জন্য, আর একটা থাকত বাদশাহ্‌দের প্রাস্থ-প্রাসাদ হিসেবে। সেখানে শাহ্‌আর তাঁর ক্ষত্রপরা বিশ্রাম করত।

আজ বাদশাহী পাস্থ-প্রাসাদের কেউ এসেছে। পান্থশালার আস্তাবলে ঘোড়া বাঁধা, আঙ্গিনায় অনেক দাস-কর্মচারী। কিন্তু সকলের চেহারায় ঐদাস্যের ভাব ফুটে উঠছিল। এত লোকের সমাগমেও পান্থ-প্রাসাদ আশ্চর্য রকমের নীরবতায় মগ্ন। এমন সময় দরজা দিয়ে হস্তদস্ত হয়ে তিনজন রাজকর্মচারী বেরিয়ে এল এবং তারা সাধারণ পান্থশালার মধ্যে ঢুকে পড়ল। তাদের বহু মূল্যের বস্ত্র ও আভিজাত্যপূর্ণ চেহারা দেখার সঙ্গে সঙ্গে অন্য লোকেরা ভয় ও সম্মানের সঙ্গে একধারে সরে দাঁড়াল। সেখানে কোনো বৈদ্য আছে কিনা তারা প্রশ্ন করল। অবশেষে সাধারণ পান্থশালার খবর পাওয়া গেল যে, সেখানে একজন হিন্দু বৈদ্য আছে।

এখানে এমনিতেই বৃষ্টি কম তাতে বর্ষাঋতু অনেক আগেই শেষ হয়েছে। মনাক্কা, বাদাম, আঙ্গুর, খরমুজের মতো ফল সস্তায় বিক্রী হচ্ছিল। রাজকর্মচারীটি যখন বৈম্ভের নিকট গেল তখন সে একটি বড় খরমুজ কাটছিল। তার আশেপাশে তারেই মতো ভিক্ষুকের বেশে আরও অনেক বসে ছিল, তাদের সামনেও খরমুজ। রাজকর্মচারীকে দেখেই অন্যান্যরা ভর্য়াত হয়ে সরে দাঁড়াল।

একজন বলল,“প্রভূ! ইনি হিন্দু বৈদ্য।”

বৈদ্যের ময়লা কাপড়ের দিকে তাকিয়ে রাজকর্মচারীর মুখে একটু বিরক্তি প্রকাশ পেল। পুনরায় সে তার চেহারার প্রতি তাকাল। তার চেহারা ওই কাপড়ের সঙ্গে মানাচ্ছিল না। তার মূখে ভয় ও দৈন্যের লেশমাত্র নেই। তার নীল চোখের দীপ্তি রাজকর্মচারীটিকে প্রভাবিত করল। তার ললাটের কুঞ্চিত ভাব বিলীন হয়ে গেল। সে কিছুটা শিষ্ট স্বরে প্রশ্ন করল,“তুমি বৈদ্য?”

“হ্যাঁ।”

“কোথাকার?”

“তক্ষশিলার।”

তক্ষশিলার নাম শুনে রাজকর্মচারী আরও নম্র হয়ে বলল, “আমাদের বক্ষু-সোগ্দেরক্ষত্রপের স্ত্রী শাহানশাহের বোনের অসুখ। তুমি তার চিকিৎসা করতে পারবে?”

“কেন পারব না,আমি তো বৈদ্য।”

“কিন্তু, তোমার এই পোশাকে?”

“পোশাকে তো আর চিকিৎসা করবে না, চিকিৎসা করব আমি।”

“কিন্তু, এ খুব বেশী ময়লা।”

“আজ আমার এগুলি বদলাবারই কথা। এক মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা কর”—বলে বৈদ্য পরিহিত বস্ত্রের চেয়ে পরিস্কার একটি পশমের চোগা পরল, এবং হাতে ঔষধের মোড়ক ভর্র্তি একটি চামড়ার থলি নিয়ে রাজকমচারীর সঙ্গে চলল।

বাদশাহী পান্থশালার অঙ্গনে গাধার বিষ্ঠা কিংবা ভিখারী ঠগদের কোনো আস্তানা ছিল না। সেখানকার সব জায়গাই পরিষ্কার। ওপরে যাওয়ার সিঁড়িতে নানা রঙের গাল্‌চে বিছানো, সিঁড়ির দু’দিকটায় সুন্দর কারুকার্য করা এবং ঘরের মেঝেতে মহামূল্যবান ফরাস বিছানো। দরজায় দ্বিধাবিভক্ত সূক্ষ্ম পর্দা ঝোলানো, তার পাশে মার্বেল পাথরের মূর্তির মতো অনেক সুন্দরী নীরবে দাঁড়িয়ে। দরজায় গিয়ে রাজকর্মচারী বৈদ্যকে দাঁড়াবার জন্য ইশারা করল এবং একটি সুন্দরীর কানে কানে কিছু বলল। সে খুব আস্তে আস্তে দরজা খুলল। ভিতরকার পর্দার জন্য সেখানটায় কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই তরুণী ফিরে  এল এবং বৈদ্যকে তার সঙ্গে যেতে বলল।

ঘরের ভিরে ঢুকতেই মধুর সুগন্ধের সুরভি বৈদ্যের নাকে এল। ক্ষিপ্র দৃষ্টিতে সে ঘরের চারিদিকে তাকাল। গৃহসজ্ঝার নিপুণতায় সূক্ষ্ম রুচির পরিচয় বহন করছিল। ফরাস, পর্দা, মসনদ, দীপদানী, চিত্র এবং মূর্তিগুলি সবই এ রকম ভাবে সাজানো ছিল যে, বৈদ্যি ইতিপূর্বে কখনও দেখেনি। সম্মুখে একটি গদীর ওপর দেওয়ালের পশে দু’তিনটি মসনদ ছিল, তার একটিতে একজন মাঝারি বয়সের বয়সের স্থুলকারয় পুরুষ বলে। তার আকর্ণবিস্তৃত গোঁফে শাদা রঙ ধরেছি। তার পিঙ্গল চোখে রাত্রি  জাগরণও তীব্র দুশ্চিন্তার ছাপ। তার  কাছে এক অনুপম সুন্দরী রমণী উপবিষ্ট যার রঙ মাখনের  মতোই নয়, মাখনের চেয়েও অধিক কোমল বলে মনে হচ্ছিল। তার কপোলের ওপরটা ছিল হালকা লাল কিন্তু এখন তা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। পাতলা  ঠোঁটের সঙ্গে শুক চঞ্চুরই উপমা দেওয়া যায়। ধমুকের মতো বাঁকা ক্ষীণ ভ্রু-যুগল সোনালী ;তায় দীর্ঘ পক্ষবিশিষ্ট নীল চোখ বিষন্ন ও আরত্তিম । কেশদাম সুবর্ণ সূক্ষ জালে সজ্জিত। সোনালী ভেলভেটের কাঁচুলি ও লাল লালোয়ার তার অঙ্গাবরণ। সেই অনিন্দাকান্তি অঙ্গে মণিমুত্তার অলস্কার বাহূল্য মনে হচ্ছিল। এ দু’জন ছাড়াও ঘরের ভেতর আরও অনেক সুন্দরী দাড়িয়ে ছিল। তাদের চেহারা ও বিনীতভাব দেখে বৈদ্য বুঝতে পারল যে, এরা সবাই ক্ষত্রপের অন্তঃপুরপরিচারিকা। পুরুষ বলতে সেখানে শুধু ক্ষত্রপই ছিল। সে একবার বৈদ্যের মাথা হতে পা পর্যন্ত দেখল কিন্তু তার নীল নেত্রের  দিকে তাকিয়ে ক্ষত্রপের বুঝতে অসুবিধা হল না যে, ‍যদি আমি আমার পোশাক একে পরিয়ে দিই তা’হলে এই পশুপুরীর (পর্সপোলীস) সুন্দরতম তরুণদের মধ্যে তাকে ও একজন বলে গণ্য করা যাবে।

ক্ষত্রপ বিনীতভাবে বলল,“তুমি তক্ষশিলার বৈদ্য?”

“হ্যাঁ, মহাক্ষত্রপ!”

“আমার স্তীর খুব অসুখ। কাল থেকে অবস্তা অত্যন্ত খারাপের  ‍দিকে। আমার নিজের দু’জন  বৈদ্যের ঔষধের কোনো ফলই দেখা যাচ্ছে না।”

“আমি ক্ষত্রপের স্তীকে দেখবার পর বৈদ্যদের সঙ্গে কথা বলতে চাই।”

“তারা এখানে উপস্তিত আছে ।  আচ্ছা, তবে চল-ভেতরে যাই।”

শ্বেতপাথরের দেওয়াল থেকে যেমনি শ্বেত পর্দাটা সরিয়ে দেওয়া হল, তখনই ভেতরে যাবার রাস্তা দেখা গেল! ক্ষএপ এবং ষোড়শী আগে আগে—বৈদ্য তাদের পেছনে পেছনে চলল। ভিতরে হাতীর দাঁতের পায়াওয়ালা একটি পালঙ্কে বিছানা, তার ওপর ফেনসদৃশ কোমল সাদা শয্যার ওপর রোগিণী শুয়ে ছিল। তার শরীর শ্বেত কদলী-মৃগচর্মের আবরণে ঢাকা শুধুমাত্র চিবুকের উপরিভাগ খোলা। ক্ষত্রপকে আসতে দেখে পরিচারিকা সরে দাঁড়াল। বৈদ্য কাছে গিয়ে দেখল, রোগিণীর চেহারার সঙ্গে ষোড়শীর চেহারায় অবিকল মিল কিন্তু তার তরুণ সৌন্দর্যের স্থলে রোগিণীর ভেতর প্রৌঢ়াবস্থার প্রভাব এবং তার ওপর আবার দীর্ঘ রোগভোগের ঝড়-ঝাপটার চিহ্ন। তার লাল টুকটুকে ঠোঁট এখন ফিকে, পরিপুষ্ট গাল বসে গিয়েছে। চোখ কোটরে ঢুকে গেছে। ক্ষত্রপ মুখ কাছে নিয়ে গিয়ে বলল,“অফ্‌শা!”

রোগিণী একটুখানি চেয়েই আবার চোখ বন্ধ করল।

বৈদ্য বলল, “আংশিক মূর্চ্ছা।” সে তার হাত বের করে নাড়ী দেখল—বড় কষ্টে নাড়ী পেল। শরীর প্রায় ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল।

ক্ষত্রপ, বৈদ্যের মুখ গম্ভীর হতে দেখল। বৈদ্য একটু ভেবে বলল,“একটুখানি দ্রাক্ষা সুরা চাই, যত বেশী পুরনো হয় ততই ভালো।”

ক্ষত্রপের নিকট এর অভাব ছিল না। রক্তের মতো লাল পুরনো দ্রাক্ষা সুরায় পরিপূর্ণ শুভ্র কাঁচের ঘড়া নিয়ে আসা হল—আর তার সঙ্গে এল মণিমুক্তা খচিত সোনার চষক (পেয়ালা)। বৈদ্য একটি পুঁটলী খুলল এবং ডান হাতের আঙ্গুলের বড় নখ দিয়ে এক রত্তি ওষুধ বের করে রোগিণীকে হাঁ করাতে বলল। হাঁ করাতে ক্ষত্রপের বেশী কষ্ট হল না। সে ঔষধ মুখের ভেতর ঢেলে দিয়ে এক ঢোক সুরা মুখে ঢেলে দিল, রোগীকে গিলতে দেখে বৈদ্য সন্তুষ্ট হয়ে ক্ষত্রপকে বলল, “এখন আমি বাইরে মহাক্ষত্রপের বৈদ্যদের সঙ্গে দেখা করতে চাই, কিছুক্ষণ পরে মহাক্ষত্রপানী চোখ মেলবেন তখন আমার কাছে থাকা প্রয়োজন।” বৈদ্য অন্য ঘরে পার্শব বৈদ্যদের সঙ্গে পরামর্শ করল। রোগিণী সোগ্দ (পার্শব) থেকে আসার সময় যে জর নিয়ে এসেছিল, তখন হতে আজ পর্যন্ত অবস্থা পার্শব বৈদ্যরা বর্ণনা করল। এই সময় পরিচারিকা এসে সংবাদ দিল যে প্রভুপত্নী মহাক্ষত্রপকে ডাকছেন। মহাক্ষত্রপের চেহারার ওপর দিয়ে নতুন আশার ঝলক বয়ে গেল। বৈদ্যকে সঙ্গে করে ভেতরে গেল। ক্ষত্রপানীর চোখ সম্পূর্ণ খোলা—তার চেহারায় জীবনের স্পন্দন দেখা যাচ্ছিল।

ক্ষপত্র বলল,“এ কথা আমাকে এ হিন্দু বৈদ্যও বলেছিল।”

আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠে ক্ষত্রপানী বলল,“হিন্দু বৈদ্য শুনেছে—কি আমার অসুখ; আমার অসুখ কি সেরে গেছে বৈদ্য?”

“হ্যাঁ, অসুখ সেরে গেছে, কিন্তু মহাক্ষত্রপানী! একটু বিশ্রাম নিতে  হবে। আমি ভাবছি যে কত তাড়াতড়ি আপনাকে পর্শুপুরী যাওয়ার উপযুক্ত করে তোলা যায়; আমার নিকট অভূতপূর্ব রসায়ন আছে, হিন্দুদের রসায়ন আপনাকে দিচ্ছি। একটু একটু দ্রাক্ষা এবং ডালিমের রস দিয়ে খেতে হবে।”

“বৈদ্য! তুমি রোগ চেন, অন্যরা তো গাধার চেয়ে গাধা! তোমার নির্দেশ মতোই চলব। রোশনা!”

ষোড়শী সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “মা।”

“বেটি! তোমার চোখের জল মুছে ফেল। ওই হাকিমগুলো আমাকে মেরে ফেলত। কিন্তু এখন আর কোনো চিন্তুা নেই। হিন্দু বৈদ্যকে অহ্বর মজদা পাঠিয়েছেন। এর যেন কোনো কষ্ট না হয়। বৈদ্য আমাকে যা খেতে বলবে তা তুমি নিজ হাতে আমাদে দিও।”

বৈদ্য রোশানাকে কয়েকটি  কথা বলে বাইরে চলে গেল। ক্ষত্রপের চেহারা ম্লান হয়ে গিয়েছিল। বৈদ্য কিছু ঔষধ ভুর্জপত্রের টুকুরোয় বেঁধে ক্ষত্রপের নিকট দিয়ে যখন নিজে পান্থশালায় ফিরে যেতে চাইল তখন ক্ষত্রপ বলল,“আমাদের সঙ্গেই তুমি থাক।”

“কিন্তু আমি দরবারে থাকবার পদ্ধতি জানি না।”

“তবুও মানুষের-সঙ্গে থাকার আচার-ব্যবহার তুমি ভালোই জানো। ভিন্ন ভিন্ন জাতির ভিন্ন আচার ব্যবহার।”

“আমি থাকলে আপনার পরিচারিকাদের কষ্ট হবে।”

“আমি একদম আলাদা একটি তোমাকে দিচ্ছি। ‍ুমি কাছে থাকলে আমি নিশ্চিত থাকব।”

“মহাক্ষত্রপানীর জন্য আর কোনো চিন্তার কারণ নেই। হাকিমরা অসুখ ঠিকমতো নির্ধারণ করতে পারেনি। আমি আর দু’ঘণ্টা পরে এলে বাঁচবার কোনো আশা ছিল না। কিন্তু তাঁর অসুখ সেরে গেছে।”

ক্ষত্রপের আগ্রহের জন্য বৈদ্য বাদশাহী পান্থশালায় থাকতে রাজী হল।

ক্ষত্রপানী চতুর্থ দিন থেকে উঠে বসতে লাগল এবং তোর চেহারার ম্লানতা খুব তাড়াতাড়ি মিলিয়ে যেতে লাগল। সবচেয়ে প্রসন্ন হল রোশনা। দ্বিতীয় দিন সে ক্ষত্রপের দেওয়া তার নিজের মহামূল্য দু’বছরের চোগাটি (পরিধেয় বস্ত্রখণ্ড) এনে বৈদ্যকে দিল। আজকের এই চোগা, সোনালী কোমর বন্ধনী আর স্বর্ণখচিত পাদুকায় সজ্জিত নাগদত্তের সঙ্গে সেদিনের সেই খরমুজ-খাওয়া লোকটির মিল ছিল না।

ক্ষত্রপানী এখন লঘু আহার গ্রহণ করতে আরম্ভ করেছে। ষষ্ঠ দিনের সন্ধ্যাবেলা সে বৈদ্যকে ঢেকে পাঠাল। বৈদ্যকে মহাক্ষত্রপানী কাছে এল বসতে বলল এবং বসার পরে বলল,“বৈদ্য! আমি তোমার নিকট বড়ই কৃতজ্ঞ। এই নির্জন পথিমধ্যে মজদা তোমাকে আমায় বাঁচাবার জন্য পাঠিয়েছেন। তোমার জন্মস্থান কোথায়?”

“তক্ষশিলা।”

“তক্ষশিলা ! খুব প্রসিদ্ধ নগর, বিদ্যার জন্য বিখ্যাত। তুমি তার রত্ন!”

“না, আমি সেখানকার একজন সাধারণ নতুন বৈদ্য।”

“কিন্তু তারুণ্য গুণের বৈরী নয়। তোমার নাম কি বৈদ্যরাজ?”

“না প্রদত্ত কাপ্য।”

“পুরো নাম বলা আমার পক্ষে কষ্টকর। নাগ বলাই যথেষ্ট, কেমন?”

“যথেষ্ট, মহাক্ষত্রপানী!”

“তুমি কোথায় যাচ্ছ?”

“এখন তো যাচ্ছি পর্শুপুরী(পর্সপোলীস)।”

থাকতে পেতে। কিন্তু সোফিয়া! তুমি আমাকে প্রভু বলো না। দাসপ্রথার কথা শুনলে আমার গায়ে জ্বর আসে।”

“কিন্তু আমি যে তোমার দাসী।”

“তুমি দাসী নও। আমি ক্ষত্রপ-দম্পতিকে বলে দিয়েছি যে, সোফিয়াকে আমি দাসত্ব বন্ধন থেকে মুক্ত করলাম।”

“তা’হলে এখন আর আমি দাসী নই!”

“না, তুমি এখন আমার মতোই স্বতন্ত্র ও স্বাধীন এবং এখন তুমি যেখানে যেতে চাইবে আমি তোমায় সেখানে পৌছিয়ে দিতে চেষ্টা করব।”

“কিন্তু, যদি তোমার কাছেই থাকতে চাই, তা’হলে তাড়িয়ে দেবে না তো?”

“সম্পূর্ণভাবে সেটা তোমার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে।”

“দাসত্ব মানুষকে কতই না খর্ব করে? পিতৃগ্রহে আমি আমাদের দাসদের দেখেছি, তারা আমোদ-প্রমোদ করত; কিন্তু আমি কখনও বুঝতে পারিনি যে তাদের হাসির মধ্যে এত ব্যথা লুকিয়ে ছিল। আমি যখন নিজে দাসী হলাম তখন অনুভব করলাম—দাসত্ব কি রকম নরক!”

“তুমি কেমন করে দাসী হলে, সোফী? যদি কষ্ট না হয় তবে বল।”

“আমার বাবা এথেন্স নগরের একজন সম্ভ্রান্ত নাগরিক ছিলেন। যখন স্যাসিযেনিয়ার রাজা ফিলিপ আমাদের নগর জয় করল, তখন বাবা পরিবারের লোকদের নিয়ে নৌকায় করে এশিয়ায় পালিয়ে এলেন। আমরা মনে করেছিলাম যে সেখানে আশ্রয় পাব, কিন্তু যে নগরে গিয়ে আমরা অবতরণ করলাম,কয়েক মাস বাদেই পার্শবরা তার ওপর আক্রমণ করল। নগরের পতন হল, আর পালানো-দৌড়ানোর মধ্যে কে কোথায় গিয়েছে, কত নাগরিককে পার্শবরা বন্দী করেছে জানি না। আমি দেখলাম, আমি সেই বন্দীদের একজন। আমি সুন্দরী ছিলাম, তার ওপর বয়সে তরুণী বলে তারা আমাকে সেনাপতির নিকট পাঠিয়ে দিল। সেনাপতির নিকট হতে বাদশার কাছে এলাম। বাদশার নিকট আমার মতো শত শত তরুণী ছিল, সে নিজের বোন আসছে শুনে আমাকে তার কাছে পাঠিয়ে দিল। যদিও আমি দাসী, কিন্তু নিজের রুপের জন্য খাস মহলের দাসী ছিলাম। তার জন্যই আমার অনুভূতি সাধারণ দাসীদের মতো হতে পারেনি, তবুও আমি জানি যে  এর কি যাতনা! আমারও মনে হত যে আমি মানবী নয়।”

“তা’হলে সোফী, তোমার বাবার সঙ্গে আর দেখা হয়নি?”

“এখনও তিনি বেচে আছেন বলে আমার মনে হয়।এখন তো আমি হাওয়ায় ওড়ানো শুকনো ঝড়ো-পাতা। প্রিয় এথেন্স নগর ধ্বংস হয়ে গেছে, বাবা যদি এখনও জীবিত থাকেন তা’হলেও আমাদের মিলনের স্থান কোথায়?”

“এথেন্স কি মহানগরী, সোফিয়া?”

“একদিন ছিল! কিন্তু এখন তা ধ্বংসপ্রাপ্ত, আমাদের ‘গণ’ একদিন মহান দারয়োশদের কঠোর শিক্ষা দিয়েছিল তাকে ক্ষুদ্র ফিলিপ মাথা নত করতে বাধ্য করেছে।”

“কেন এমন হল সোফিয়া?”

“পার্শবদের অনেক আক্রমণের প্রতিকার করেও এথেন্সের কিছু মনীষীদের মাথায় খেয়াল চাপল যে, যতদিন পর্যন্ত আমরা পার্শবদের তুলা একটি বড় রাজ্য প্রতিষ্ঠা না করতে পারছি ততদিন আমাদের নিস্তার নেই।”

“আহা, তক্ষশিলা! তুমিও বিষ্ণুগুপ্তের মতো লোক সৃষ্টি করেছ!”

“তক্ষশিলা, বিষ্ণুগুপ্ত—এ সব কি, নাগ!?”

“তক্ষশিলা! আমার জন্মভূমি, আমাদের ‘গণ’ও মহানদারয়োশ এবং তাদের উত্তরাধিকারীদের অনেকবার মেরে তাড়িয়ে দিয়েছিল কিন্তু আমার সহপাঠী বিষ্ণুগুপ্ত এখন সেই কথাই বলছে যা একদিন ফিলিপের সাহায্যকারী এথেন্সের নাগরিকরা বলেছিল।”

“তক্ষশিলা ও কি আমাদের মতো ‘গণ’?”

“হ্যাঁ, ওইরুপ ‘গণ’! আর আমাদের তক্ষশিলায় কেউ দাস নেই, সেখানকার জমিতে পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে সকলেই অ-দাস হয়ে যায়।”

“আহা, করুণাময়ী তক্ষশিলা! তাই নাগ, আমি প্রথম দিন থেকেই দেখছি যে দাসদের সঙ্গে ব্যবহার করতে তুমি জান না।”

“আর আমি কখনও তা তোমাকে জানতেও দেব না। আমি বিষ্ণুগুপ্তকে বলেছি যে, যদি তুমি মগধকে তক্ষশিলা গ্রাস করতে সাহায্য কর তা’হলে তক্ষশিলার পবিত্র ভূমি দাসত্বের কলঙ্ক-মুক্ত থাকবে না!”

“মগধ কি নাগ!”

“হিন্দের (হিন্দুস্থানের) ম্যাসিডোনিয়া—তক্ষশিলার পূর্বে এক বিশাল হিন্দুরাজ্য। পার্শবদের আক্রমণ আমরা প্রতিরোধ করে আসছি, কিন্তু জিতে জিতেও আমরা দুর্বল এবং হারার মতো হয়ে গেছি। বস্তুত তক্ষশিলা একা পার্শব শাহানশাহের মোকাবিলা করতে পারে না, কিন্তু আমি এর প্রতিরোধের একমাত্র প্রতিকার হিসেবে বলেছি, নিজেদের সমস্ত গণগুলিকে সংঘবদ্ধ হতে।”

“কিন্তু নাগ! আমাদের দেশে এও করে দেখা হয়েছে। আমাদের মতো হেল্লা জাতিকে দিয়ে ‘গণ-সংঘ’ তৈরী করে পার্শবদের মোকাবিলা করেছে কিন্তু সে সংঘ স্থায়ী হতে পারল না। ‘গণ-সংঘের’ মধ্যে নিজ নিজ গণের স্বতন্ত্রতার ওপর এত নজর যে, সেখানে সংঘকে ছেড়ে দিতে কেউ রাজি নয়।”

“তা’হলে কি আমিই ভুল প্রমাণিত হব এবং বিষ্ণুগুপ্ত সঠিক!”

“হ্যাঁ। সে বলে, আমাদের শত্রু যতটা শক্তিশালী গণের সীমা নষ্ট করে যদি একটি মহান ‘গণ’ তৈরী করা যায় তবে হয়ত সম্ভব হতে পারে, কিন্তু ‘গণ’ এ কথা স্বীকার করতে রাজী হবে না।”

“হয়ত তোমার বন্ধু ঠিকই বলেছে, নাগ! কিন্তু আমরা শেষ পর্যন্ত এথেন্সের স্বতন্ত্রতা ছেড়ে দেবার কথা মনে আসতে দিইনি।”

“তা’হলে সোফিয়া! ‘গণ’ হয়েও এথেন্স কেন এ দাসত্বকে স্বীকার করল?”

“নিজের পতন শীঘ্র ডেকে আনার জন্য। ধনীর লোভের জন্যই দাস-প্রথার প্রভাব বাড়ল এবং আস্তে আস্তে মালিকের চেয়ে দাসদের সংখ্যা বেড়ে গেল।”

“এখানে পার্শবদের ভেতর সব চেয়ে কোন প্রথা খারাপ বলে মনে হয়?”

“দাসত্ব, যা আমাদের ওখানেও ছিল। আর বাদশা এবং ধনীদের অন্তঃপুর।”

“তোমাদের ওখানে এ রকম হয় না?”

“আমাদের ওখানে ম্যাসিডোনিয়ার রাজা ফিলিপও একাধিক বিয়ে করতে পারে না। এখানে তো ছোট রাজকর্মচারীও বহু বিবাহ করে।”

“আমাদের দেশেও একধিক বিয়ে দেখা যায়, যদিও তার সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু আমি একে স্ত্রীজাতির দাসত্বের নিদর্শন বলে মনে করতাম। এথেন্স যদি দাসত্ব-প্রথা চালু করে থাকে তবে তক্ষশিলাও বহুবিবাহ প্রথা চালু রেখে সেই একই অন্যায় করেছে।”

“আর অল্পসংখ্যক ঘরেই সম্পদ জমা হওয়া?”

“আমি বিষ্ণুগুপ্তকে বলেছিলাম,‘গণ’-এ এত ধনররত্ন থাকতেও কেন অন্যের শ্যীবৃদ্ধি হচ্ছে না। তুমি রাজার মতো জলের ন্যায় ধন-সম্পদ উড়িয়ে দিতে পার না। এখানে তো তুমি দেখছ সোফী! মূল্যবান মৃগচর্ম, মণি, মুক্তা ইত্যাদি বস্তুর সঙ্গে কি রকম ব্যবহার। এ গোলাপী গাল, এ প্রবাল অধর একবার মনেও করে না যে, এগুলি উৎপন্ন করতে কত সহস্র লোক না খেয়ে মরেছে! আমাদের ঘরের পড়ে যাওয়া জল নিয়েই সমুদ্রের জলরাশি। মাটিতে যারা সোনা ফলায় তারা মরছে না খেয়ে, আর সোনাকে যারা মাটি করে দেয় তারা খাবার নষ্ট করছে। আমি যতবার বাদশার কছে গিয়েছি—প্রত্যেকবারই ফেরবার সময় আমার মাথা ধরেছে। আমি সমস্ত সমৃদ্ধি ভেতর শীতে জমে, গরমে জল হয়ে মরবার মাসুষ ওই কর্মকারদের দুঃখের নিশ্বাস ফেলতে শুনি, আমাকে সতর্ক করে যাওয়া তাদের লাল মদিরা প্রজাদের রক্ত রুপে দেখা যাচ্ছে। পশুপুরীতে আমার তিক্ততা এসেছে তাই তাড়াতাড়ি এখান থেকে পালাতে চাই!”

“কোথায় যেতে চাইছ নাগ?”

“প্রথমে তোমার মতামত জানতে চাই।”

“কোথায় আমি বলব!”

“যবন-লোক(গ্রীস)?”

“খুব ভালো হয়।”

“তবে সেদিকেই যাব।”

“কিন্তু, রাস্তায় আবার আমাকে কেউ যদি কেড়ে নেয় এবং তারপর নাগের মতো ত্রাণকর্তা যদি না পাই!” সোফিয়ার কণ্ঠস্বর খুবই নরম, তার সুন্দর আয়ত নয়ন বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল।

নাগদত্তের তার কানের ওপর ঝুলে-পড়া সোনালী চুলগুলিকে স্পর্শ করে বলল,“আমি তার উপায় ঠিক করে রেখেছি কিন্তু তার জন্যে তোমারও সম্মতি প্রয়োজন।”

“কি?”

“ক্ষত্রপ, ক্ষত্রপানী এবং শাহানশাহার নিকট হতে আমার জন্য চিঠি নিয়ে নেব যে, এ শাহানশাহার সম্মানিত হিন্দু বৈদ্য।”

“তা’হলে আর আমাকে কেউ কেড়ে নেবে না?”

“আর যদি তুমি পৃথিবীসুদ্ধ লোককে দেখাবার জন্য বৈদ্যের স্ত্রী হতে চাও, তা’হলে চিঠিতে তোমার নামও লিখিয়ে নেব।”

সোফিয়া ছল-ছল চোখে নাগদত্তের হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, “নাগ! তুমি কত উদার, তোমার মনের গভীরতা তুমি জানাতে চেষ্টা কর না। তুমি কত সুন্ধর কিন্তু তুমি কখনও এখানে তোমার প্রতি আকৃষ্টা পুষ্পরাগ এবং নীলিমা চোখে দেখনি? নাগ! রোশনা কতবার আমারকাছে তোমার জন্য প্রেম নিবেদন করেছে! তার কোন এক আধমরা ভাই আছে তাই তার বাপ-মা চায় রোশনকে তার সঙ্গে বিয়ে দিতে, কিন্তু সে চায় তোমাকে।”

“ভালোই হয়েছে যে আমি জানিনি, জানলে অস্বীকার করতে হত। সোফিয়া! আমি প্রাসাদপোষিতাদের জন্য নয়। আমি বোধহয় কারুর জন্যেই নয়। আমার সঙ্গে যে প্রেম করবে তার সুখ-নিদ্রার সুযোগ ঘটবে না। কিন্তু যদি তুমি চাও তবে শাহানশাহার চিঠিতে তোমার নাম নিজ স্ত্রী বলে লিখিয়ে নেব। যবন দেশে যদি তোমার কোনো প্রিয়পাত্র জুটে যায় তা’হলে তোমাকে নিজের পথ দেখতে হবে।”

বৈদ্য নাগদত্তের সব জায়গা থেকেই ডাকা আসত। সে হিন্দু বৈদ্য পার্শব শাহান-শাহ দারয়োশের একদা চিকিৎসক ছিল, আর তার চিকিৎসা ছিল অদ্ভুত রকমের।

পর্শুপুরীতে থাকাকালীন সে যবন-ভাষা শিখেছিল, তার ওপর সোফিয়া তার সহচারিণী। সে ম্যাসিডোনিয়া ঘুরে দেখল এবং ফিলিপের পুত্র অলিকসুন্দরের গুরু আরিস্টোটলের সঙ্গে পরিচিত হল।

নাগদত্ত নিজেও একজন দার্শনিক কিন্ত ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে আরিস্টোটলের শাহানশাহী তত্ত্বের সঙ্গে তার মতভেদ ছিল। তবুও সে আরিস্টোটলের প্রতি বিশেষ সম্মান দেখিয়ে ম্যাসিডোনিয়া থেকে বিদায় নিল। আরিস্টোটলের যে চিন্তাধারা তার পছন্দ হয়েছিল তা হল, সত্যের পরীক্ষার জন্য বুদ্ধি নয়, জাগতিক পাদর্থেরই প্রয়োজন। আরিস্টেটল প্রয়োগ-প্রমাণিত বস্তুকে উচ্চে স্থান দিত। নাগদত্তের আফসোস ছিল এ জন্য যে, ভারতীয় দার্শনিকরা সত্যকে মন থেকে সৃষ্টি করতে চায়। নাগদত্ত অরস্তর শিষ্য মনস্বীর অনেক প্রশংসা তার গুরুর মুখে শুনেছে এবং সে নিজেও কতবার তার বিষয়ে কথাবার্তা বলেছে। সেই তরুণের  মধ্যেশুধুমাত্র অসাধারণ শৌষই ছিল না ছিল অসাধারণ বিচারশক্তিও। নাগদত্ত এথেন্স গিয়ে ফিরে আসার জন্য আরিস্টেটলের কাছ থেকে ছুটি নিয়েছিল, কিন্তু যবন দার্শনিকের সঙ্গে এই তার শেষ দেখা,তা সে কি করে জানবে!

বীরের জননী, গণতন্ত্রের বিজয়ধ্বজাধারিণী এথেন্স নগরে সে ততটাই শ্রদ্ধা ও প্রেমের সঙ্গে উপস্থিত হল যতটা যে তক্ষশিলার জন্য করত। নগর পুনরায় উর্বর হয়েছিল কিন্তু সোফিয়া বলল যে, এখন সেই পুরনো এথেন্স নেই। বেন্স জুপিটারের  মন্দির এখনও অমর কারকার্যের সুন্দর কীর্তিতে অলঙ্কৃত। কিন্তু সোফিয়া একদিন এথেন্স নাগরিকদের প্রাণে যে উৎসাহ,যে জীবন-স্পন্দন দেখেছিল আজ আর তা নেই।

সোফিয়ার বাবার জমির ওপর তৈরী ঘরের মালিক একজন ম্যাসিডোনিয়ার ব্যবসায়ী। সে ঘর দেখে সোফিয়া এতদূর উদ্বিগ্ন হল যে, সে নিজেই তার স্বভাব-গাম্ভীর্যের বিরুদ্ধাচরণ করল। কিন্তু, সে কথা কম বলত। কখনও তার চোখ অশ্রুজলে ভরে যেত আবার কখনও সে পাথরের মূর্তির মতো হয়ে থাকব। নাগদত্ত বুঝতে পারল যে, নিজের প্রিয় বাল্যস্থানের ঐ রকম অবস্থা দেখে তার মনে বিকার জন্মেছে। শেষটায় সোফিয়ার মর্মান্তিক শোকচ্ছায়া নাগদত্তকেও আচ্ছন্ন করে ফেলল।

যখন সোফিয়া প্রকৃতিস্থ হল তখন সে একদম বদলে গেল। নিজের সাজ-সজ্জার ওপর তার কখনও বিশেষ খেয়াল ছিল না। কিন্তু এখন সে গণতন্ত্রী এথেন্সের তরুণীদের মতো নিজের খোলা সোনালী চুলগুলিকে ফুলের মালা দিয়ে খোঁপা বাঁধতে লাগল। তার শরীরের ওপর যবন-সুন্দরীদের পা পর্যন্ত ঝোলানো বিশেষ পছন্দ-করা সুন্দর কঞ্চুক এবং পায়ে অনেকগুলি ফিতা-যুক্ত স্তান্ডেল পরল। তার  সুন্দর সাদা কপাল, লাল টুকটুকে ঠোঁটের তারুণ্যে—সৌন্দর্য এবং স্বাস্থ্যের অদ্ভুত সংমিশ্রণ ছিল। নাগদত্ত আশ্চর্য হল না বরং অপার আনন্দ লাভ করল।

এ ব্যাপারে নাগদত্ত একদিন প্রশ্ন করায় সোফিয়া বলল; “প্রিয় নাগ! আমি এতদিন পর্যন্ত জীবনটাকে একমাত্র শোক এবং অতীত চিন্তার বস্তু বলে মনে করে এসেছি কিন্তু এখন সে ধারণা আমার ভুল বলে মনে হচ্ছে। জীবন সম্বন্ধে এ রকম একপেশে দৃষ্টিভঙ্গী জীবনের মূল্যকে কমিয়ে দেয় ্বংে কার্য-ক্ষমতাকেও দুর্বল করে ফেলে। নাগ! শেষ পর্যন্ত তুমিও তক্ষশিলার ভবিষ্যতের জন্য কম চিন্তা করছ না, তবে তুমি মাথা ঠাণ্ডা রেখেই উপায় উদ্ভাবনের জন্য সমস্ত শক্তি নিয়োগ করছ।”

“সোফী! তোমাকে এতটা আনন্দিত দেখে আমি খু্বই খুশি।”

“কেন আনন্দ হবে না, আমি এথেন্সে ফিরে এসে নিজের প্রিয়কে খুঁজে পেয়েছি।”

নাগদত্ত হর্ষোল্পাসে পুলকিত হয়ে বলল,“খুবই আনন্দের কথা যে, তুমি এতদিন পরে নিজের প্রেয়কে ফিরে পেয়েছ।”

“নাগ! আমি দেখছি যে তুমি মানুষ নও, দেবতাদের চেয়েও বড়, ঈর্ষা তোমাকে স্পর্শ করতে পার না।”

“ঈর্ষা! ঈর্ষার এখানে প্রয়োজন কি? সোফী! আমি কি তোমাকে যবন দেশে পৌঁছে দেবার দাসিয়ত্ব নিইনি? আমি কি তোমাকে বলিনি যে, ‍তুমি সেখানে গিয়ে তোমার প্রিয়কে খুঁজে নিও?”

“হ্যাঁ তা বলেছিলে।”

“তোমার এ অস্বাভাবিক আনন্দ দেখে আমার মনে হচ্ছিল যে, তুমি নিশ্চয়ই অসাধারণ কোনো প্রিয় বস্তু পেয়েছ।”

“তোমার মনে করাটা ঠিকই নাগ!”

“তা’হলে তোমার প্রিয়তমকে এখানে নিমন্ত্রণ করবার কিংবা যদি সে এখানে না আসতে পারে তবে সেখানে গিয়ে দেখা করবার অনুমিত আমাকে দাও।”

“কিন্তু, তুমি এতটা উতলা হচ্ছ কেন?”

“সত্যিই কি আমি অস্থির হচ্ছি? তুমি ভূল বলছ না?” নাগদত্ত নিজেকে সামলিয়ে নিতে চেষ্টা করল।

সোফিয়ার ভয় হতে লাগল যে পাছে সে অশ্রু সম্বরণ করতে না পারে। সে অন্যদিকে মুখফিরিয়ে বলল, “দেখা করতে পার কিন্তু তোমাকে এথেন্সের তরুণের বেশ ধারণ করতে হবে।”

“বেশ, কাল তুমি যে নতুন স্যাণ্ডেল কিনে এনেছআমি তা পরে নেব।”

“যাও, পরে এস, ইতিমধ্যে আমি আমার প্রিয়তমের জন্য মালা নিয়ে নিচ্ছি—লিদিয়া তার জন্যে মালা গাঁথছে।”

“বেশ”—বলে নাগদত্ত অন্য ঘরে চলে গেল। সোফিয়া বৈঠকখানার বড় আয়নার সামনে দাঁঢ়াল। সে নিজের কাপড় এবং ফুলে ভূষণের ওপর একবার হত বুলাল, আর একগাছা মালা আয়নার পিছনে রেখে আস্তে করে ঘরের দরজায় গিয়ে বলল,“নাগ! দেরী হয়ে যাচ্ছে, আমার প্রিয়তম আবার কোনো প্রমোদশালায় চলে না যায়!”

“তাড়াতাড়ি করছি সোফী?”

“আমি সাহায্য করব?”

“সে তোমার দয়া।”

নাগদত্ত নতুন স্যান্ডেল পরল। নাগদত্তের মুখের দিকে চাইতে সোফিয়ার সাহস হল না। সে তার হাত ধরে বলল,“ প্রথমে আয়নায় নিজের নতুন পোশাক দেখে নাও।”

“তুমি তো দেখে দিয়েছ সোফী! সেটাই ভালো। বিনীত পোশাকই প্রয়োজন।”

“হ্যাঁ, আমার তো বিনীত-পোশাক বলেই মনে হচ্ছে কিন্তু একবার দেখে নেওয়াটা মন্দ নয়।” সোফিয়া নাগদত্তকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল, নাগদত্ত তার নিজের পোশাক দেখতে লাগল। তখন সোফিয়া মালা বের করে বলল, “এ মালা ইম প্রিয়তমের জন্য তৈরী করেছি।”

“বেশ সুন্দর মালা সোফী!”

“জানি না, তার কি রকম লাগবে—তার দূসর চুলে লাল টুকটুকে গোলাপ মালা।”

“সুন্দর দেখবে।”

“তোমার মাথার ওপর রেখে একটু দেখব?”

“সেটা তোমার ইচ্ছা। আমারও চুল ধূসর।”

“তাই তো পরীক্ষা করে নিতে চাই।” মালা নাগদত্তের মাথার ওপর রেখে তাকে জিজ্ঞাসা করল,“তা’হলে তুমি আজ আমার প্রিয়তমকে দেখতে চাও নাগ? এখুনি দেখতে চাও তো এই দেখ।”

আয়নায় নাগদত্তের প্রতিবিম্ব পড়ল। সোফিয়া জলভরা চোখে বলল, “এই আমার প্রিয়তম!” আর পরক্ষণেই নিজের বাহুপাশে নাগদত্তকে বেঁধে তার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট মিলিয়ে দিল। নাগদত্ত কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। সোফিয়া তখন ঠোঁট সরিয়ে নিজের  কপোল নাগদত্তের কপোলের সঙ্গে মিলিয়ে বলল,“আমার প্রিয়তম!”

“সোফী! আমি নিজেকে তোমার যোগ্য বলে মনে করি না।”

“নিজেকে আমি জানি। নাগ, এখন থেকে আমৃত্যু তোমার সঙ্গেই থাকব।”

নাগদত্তের অশ্রুর বাঁধ ভেঙে পড়ল, সে বলল, “মৃত্যু পর্যন্ত!”

সলামীসের উপসাগর, যেখানটায় যবন নৌ-সৈন্যরা পার্শবদের বড় একটা যুদ্ধে পরাজিত করেছিল। নাগদত্তের খুবই ইচ্ছা ছিল সেটা দেখার। দু’জনেই পথা চলছিল। নাগদত্ত নিজের ভেতর নতুন উৎসাহ পাচ্ছিল এবং আস্তে আস্তে তার মন তক্ষশিলার দিকে ধাবিত হচ্ছিল। যখন দু’জনে রাস্তায় একটি গাছের নীচে বিশ্রাম করছিল তখন সোফিয়া বলল, “নাগ! ফিলিপ মারা গেছে, অলিকসুন্দর ম্যাসিডোনিয়ার রাজা হয়েছে আর সে শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী তৈরী করছে।”

“হ্যাঁ, সে সমস্ত যবন সাগরের (ভূমধ্য) পার্শ্ববর্তী অঞ্চল অধিকার করতে চাইছে। তার মধ্যে পূর্ব এবং দক্ষিণ (মিশর) অঞ্চল তো পার্শবদের হাতে।”

“তার মানে হল যে, সে পাশবদের সঙ্গে যু্দ্ধ করতে চায়।”

“আর এইভাবে গণতন্ত্রী যবনদের নিকট হতে নিজ রাজ্যে প্রতিষ্ঠায় সাহায্য নিয়ে এক ঢিলে দু’পাখী মারতে চায় সোফিয়া! শাহানশাহের যবন সাগর থেকে হটে যেতে হবে যদি স্বাদীনতা-প্রেমী যবনগণকে রাজভক্ত করানো সম্ভব হয়।”

“এ সবই আরিস্টোটলের শিক্ষা যা, তার সাহস বাড়াল!”

“র্দাশনিক আরিস্টোটল!”

“হ্যাঁ,আর তার গুরু প্লেটো একটি আর্দশ ‘গণ’-এর কল্পনা করেছিল কিন্তু সেও তাতে সাধারণ জনাতাকে রাখতে চেয়েছিল। আরিস্টোটল আদর্শ গণের জায়গায় আদর্শ রাজচক্রবর্তীর কল্পনা করে। কি জানি এই যবন-চক্রবর্তীর সন্ধানে বেরিয়েছে।”

“যবন এবং হিন্দু চক্রবর্তীদের সিন্ধুতীরে মিলন হবে না-কি?”

“হবে,প্রথম কিংবা দ্বিতীয় পুরুষে। কিন্তু পৃথিবী তখন কত ছোট হয়ে যাবে!”

সমুদ্র তীর হতে তারা নৌকায় করে সলামীসের দিকে রওনা হল। সমুদ্র শান্ত, বাতাস একেবারেই বন্ধ। সোফী এবং নাগদত্ত দু’জনেই বিগত শতাব্দীর ধ্বংস করতে সাহায্য করেছিল। অনেক দূর চলে যাওয়ার পর খুব বড় তুফান উঠল। দু’জনেরই মনে হল, যেন বিগত শতকের ঐতিহাসিক তুফান কিন্তু তখনই তাদের দৃষ্টি ভয়ভীত নৌকারোহীদের ওপড় পড়ল। আর দেখল যে পাল ছিঁড়ে গেছে এবং নৌকা ডুবছে।

সোফিয়া নাগদত্তকে নিজের বাহুপাশে বেঁধে বুকে বুক মিলিয়ে রইল। হাসি মুখে সে বলল,“মৃত্যু পর্যন্ত আমরা এক সঙ্গে থাকব।”

“হ্যাঁ, মৃত্যু পর্যন্ত”—বলে নাগদত্ত সোফিয়ার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট মিলিয়ে দিল আর দু’জনেই দু’জনের বাহু বন্ধনে আবদ্ধ হল!

পর মূহুর্তে নৌকা উল্টে গেল—সত্যিই মৃত্যু পর্যন্ত সাথী হয়ে রইল তারা!

১১. প্রভা (কাল : ৫০ খৃষ্টপূর্ব)

সাকেত কখনও কোনো রাজার রাজধানীতে পরিণত হয়নি। বুদ্ধের সমসাময়িক কৌশল-রাজ প্রসেনজিতের একটি রাজপ্রাসাদ এখানে ছিল, কিন্তু রাজধানি ছিল ছয় যোজন দূরে অবস্থিত শ্রাবন্তীতে (সহেট-মহেট)। প্রসেনজিতের জামাতা অজাতশত্রু কৌশলের স্বাধীনতা হরণ করার সঙ্গে সঙ্গে শ্রাবন্তীরও সৌভাগ্য বিলুপ্ত হল। অতীতে সরযুতটে অবস্থিত সাকেত পূর্ব (প্রাচী) থেকে উত্তরের (পাঞ্জাব) যোগাযোগ পথে অবস্থিত থাকায় শুধু জলপথের বাণিজ্রের জন্যই নয়, স্থলপথের বাণিজ্যেরও এক বড় কেন্দ্র ছিল। বহুদিন পযণ্ত তার এই অবস্থা অটুট ছিল। বিষ্ণগুপ্ত  চাণক্যের শিষ্য মৌর্ষ মগ্ধ রাজ্যকে প্রথমে তক্ষশিলা পর্যন্ত, পরে যবনরাজ সেলুকাসকে পরাজিত করে হিন্দুকুশ পর্বতমালা থেকে পশ্চিমে হিরাত এবং আমুদরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিল। চন্দ্রগুপ্ত ও তার মৌর্যবংশের শাসনেও সাকেত বাণিজ্য কেন্দ্রের বেশী কিছু ছিল না। মৌর্যবংশ-ধ্বংসকারী সেনাপতি পুষ্যমিত্র প্রথমে সাকেতকে রাজধানীর মর্যাদা দিয়েছিল, কিন্তু তাও সম্ভবত পাটলীপুত্রের প্রাধন্যকে ক্ষুণ্ণ করে নয়। পুষ্যমিত্র অথবা তার শুঙ্গবংশের শানসকালে বাল্মীকি যখন রামায়ণ রচনা করেন, তখন অযোধ্যার নাম প্রচারিত হল। এইভাবেই সাকেত অযোধ্যা বলে পরিচিত হয়। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, অশ্বঘোষ বাল্মীকির কাব্যের রসাস্বদন করেছিলেন। কালিদাস যেমন চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের আশ্রিত কবি ছিলেন, তেমনি বাল্মীকিও যদি কখনও শুঙ্গবংশের আশ্রিত কবি ছিলেন, তেমনি বাল্মাকীও যদি কখনও শুঙ্গবংশের আশ্রিত কবি থেকে থাকেন অথবা কালিদাস যেমন চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য এবং কুমারগুপ্ত এই দুই পিতা-পুত্রকে তাঁর ‘রঘুবংশ’-এ রঘু এবং ‘কুমারসম্ভব’-এ কুমার রুপে চিত্রিত করেছেন, তেমনি বাল্মীকি যদি শুঙ্গবংশের রাজধানীর মহিমাকে উন্নীত করবার জন্যই বৌদ্ধ জাতকের দশরথের রাজধানীকে বারাণসী থেকে সরিয়ে সাকেত বা অযোধ্যায় এনে থাকে এবং শুঙ্গসম্রাট পুষ্যমিত্র বা অগ্নিমিত্রকেই রামরুপে মহিমান্বিত করে থাকেন—তবে বিস্ময়ের কিছু নেই।

সেনাপতি পুষ্যমিত্র আপন প্রভুকে হত্যা করে সমগ্র মৌর্য সাম্রাজ্যকে অধিকার করতে সমর্থ হয়নি। সারা পাঞ্জাব যবনরাজ মিনান্দরের দখলে চলে গেল; এবং পুষ্যমিত্রের পুরোহিত ব্রাহ্মণ পতঞ্জলি-পুষ্যমিত্রের সময়ে এই নগরের নাম সাকেতই ছিল—অযোধ্যা নয়।

পুষ্যমিত্র, পতঞ্জলি এবং মিনান্দরের সময় থেকে আমরা আরও দুশ’বছর পিছিয়ে আসছি। এই সময়েও সাকেতে বড় বড় শ্রেষ্ঠী বসবাস করত। লক্ষ্মীর বসতি ফলে সরস্বতীরও অল্পবিস্তর আগমন হতে লাগল এবং ধর্ম ও ব্রাহ্মণেরা স্বভাবতঃই এসে পড়ল। এইসব ব্রাহ্মণদের মধ্যে ধন-বিদ্যা সম্পন্ন একটি কুল ছিল। এই কুলাধিপতির নাম মুছে গিয়েছে কালের প্রবাহে, কিন্তু কুলাধিপত্মীর নাম অমর করে রেখেছে তার পুত্র। এই ব্রাহ্মণীর নাম সুবর্ণাক্ষী, তার চোখ ছিল সোনার মতো কাঁচাহলুদ রঙ-এর। তৎকালে কাঁচাহলুদ রঙ বা নীল রঙ-এর চোখ সারা ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় জাতের মধ্যেই দেখতে পাওয়া যেত। কাঁচাহলুদ রঙ-এর চোখ থাকা কোন দোষের ছিল না। ব্রাহ্মণী সুবর্ণাক্ষীর এক পুত্র তার মতোই সুবর্ণনেত্র এবং পিঙ্গল কেশধারী ছিল। তার গায়ের রঙ ছিল মায়ের মতোই সুগৌর।

সময়টা বসন্তকাল। আমের মঞ্জরী চারিদিকে আপন সুগন্ধ ছড়িয়ে দিচ্ছে। বৃক্ষরাজি পুরনো পত্রসমূহ ত্যাগ করে নতুন পত্রাবলীতে ভূষিত হয়েছে। চৈত্রের শুক্লানবমী তিথি। সাকেতের নর-নারী সন্তরণ প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে সাকেতবাসীরা বসন্তোৎসব পালন করে। এই সাঁতার প্রতিযোগতিরায় তরুণ-তরুণী উভয়েই একঘাটে নগ্নদেহে অংশগ্রহণ করে। তরুণীদের মধ্যে বহুসংখ্যক কর্পূরশ্বেত যবনী (গ্রীক-নারী) ছিল, যাদের সুন্দর-সুডৌল দেহ যবন শিল্পীর নির্মিত অনুপম মর্মর মূর্তির অনুরূপ।

আর ছিল সোনালী বা পীত কেশধারিণী সুবর্ণাক্ষী ব্রাক্ষণকুমারীগণ, সৌন্দর্যের দিক থেকে তারা যবনীদের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। এ ছাড়া ছিল ভ্রমরকৃষ্ণ কেশবিশিষ্টা ধূসরবর্ণা বহুসংখ্যক বৈশ্য তরুণী, তাদের তারুণ্যের মাদকতাও কম আকর্ষণীয় ছিল না। আজকের দিনে সাকেতের প্রতিটি কোণ থেকে কৌমার্যরুপরাশি সরযুতীর এসে উপস্থিত হয়েছে। তরুণীদের মতো নানা কুলের তরুণেরাও গাত্রাবরণ উম্মেচন করে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়বাড় জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। তাদের ব্যায়ামপুষ্ট সুডৌল সুন্দর দেহ কর্পূরশ্বেত, ধূসর প্রভূতি বিভিন্ন রঙের। তরুণ-তরুণীদের সৌন্দর্য উপভোগ করবার জন্য আজকের এই প্রতিযোগিতা মহোৎসবের চেয়ে বড় আর কোনো উৎসবেরই অনুষ্ঠান হত না। প্রতি বছর এই উৎসবের ভিতর দিয়ে কতজনেই না স্বয়স্বরা হয়ে উঠত। বাপ মায়েরা এ বিষয়ে তরুণ-তরুণীদের উৎসাহিতই করতেন। তখনকার দিনে এটাই ছিল সর্বজনমান্য শিষ্টাচার।

নৌকা থেকে প্রতিযোগী তরুণ-তরুণীরা সরযূর জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সরষূর নীল জলে কেশরাশিকে জলের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে দু’হাতে জল কেটে কেটে এগিয়ে যেত লাগল। এদের কাছে কাছে থেকে বহু ক্ষুদ্র নৌকা চলছে। নৌকার আরোহীরা প্রতিযোগী তরুণ-তরুণীদের উৎসাহ দিচ্ছে বা কেউ ক্লান্ত হয়ে পড়লে তাকে নৌকায় তুলে নিচ্ছে।

হাজার হাজার সন্তরণকারীর মধ্যে কারও পক্ষে ক্লান্ত হয়ে হার স্বীকার করাই স্বাভাবিক ছিল। সকল প্রতিযোগীই সর্বোগ্রে যাবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছিল। নদীতটে পৌঁছাবার যখন কিছুটা বাকী, তখন বহু প্রতিযোগীই শিথিল হয়ে পড়তে লাগল। পিঙ্গল এবং পাণ্ডুশ্বেতকেশী দু’জনেই সকলের আগে গিয়ে সমগতিতে পাশাপাশি চলতে আরম্ভ করেছে।  তীরের দিকে আরও  এগিয়ে গেল তারা-সকলেই ভাবছিল, এদের ভেতর থেকে কেউ একজন আগে বেরিয়ে যাবে; কিন্তু দেখল দু’জনেই গতিই সমান। নৌকা-রোহীদের মধ্যে কেউ কেউ এ-ও শুনল যে, ওদের মধ্যে একজন অপরকে আগে যাবার জন্য উৎসাহ দিচ্ছে।

দু’জনে এক সঙ্গেই তীরে এসে পৌঁছাল। এদের মধ্যে একজন তরুণ, অপরটি তরুণী। উপস্থিত সকলেই হর্ষধ্বনি করে অভিনন্দন জানাল। ওরা দু’জন আপন আপন পোশাক পরে নিল। দর্শকরা সোৎসাহে পুষ্পবর্ষণ করেছে, তরুণ-তরুণী দু’জন পরস্পরকে কাছ থেকে দেখছিল। উপস্থিত সকলে তাদের শুধু সন্তরণ কৌশলেরই নয়, সৌন্দর্যেরও প্রশংসা করতে লাগল।

কে একজন প্রশ্ন করল,“কুমারীকে তো আমি চিনি, কিন্তু কে এই তরুণ সৌম্য?”

“সুবর্ণাক্ষীপুত্র অশ্বঘোষের নাম শোনোনি?”

“না, আমি নিজেদের পুরোহিত কুলকেই শুধু জানি। আমরা হলাম ব্যবসায়ী, এত খবর রাখবার ফুরসৎ কোথায়?”

তৃতীয়, জন বলল,“আরে সাকেত থেকে অশ্বঘোষের বিদ্যার খ্যাতি দূর-দূরান্তর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, সমস্ত বেদ এবং সকল বিদ্যাতেই পারদর্শী।”

প্রথম, “কিন্তু ওর বয়স তো চব্বিশের বেশী হবে না।”

তৃতীয়,“হ্যাঁ, ওই রকম হবে। এর কবিতা লোকে সুর করে পড়ে আর গায়।’

দ্বিতীয়, জন জিজ্ঞেস করল,“এই কি সেই কবি অশ্বঘোঘ, যার প্রেমগীতি আমাদের তরুণ-তরুণীদের মুখে মুখে ফেরে?”

তৃতীয়,“হ্যাঁ, এই সেই অশ্বঘোষ। কিন্তু কুমারীর কি নাম সৌম্য?”

প্রথম, “সাকেতে আমাদের যবন-কুল-প্রমূখ এবং কোশলের বিখ্যাত  ব্যবসায়ী দত্তমিত্রের পুত্রী প্রভা।”

দ্বিতীয়,“তাই বল! এ রকম সৌন্দর্য খুব কমই দেখা যায়। দেহের গড়নে কত কোমল মনে হয়, অথচ সাঁতার কি পটু!”

প্রথম,“এর মা-বাপ দু’জনেরই চমৎকার স্বাস্থ্য, দু’জনেরই বেশ বলিষ্ঠ দেহ।”

নগরোদ্যানে গিয়ে বিশেষ সম্মানের সঙ্গে সকলের কাছে এই দুই প্র্রতিযোগীর পরিচয় দেওয়া হল, এবং দু’জন লজ্জাবনত মুখে পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হল।

সাকেতের পুষ্পোদ্যান ছিল পুষ্যমিত্রের শাসনের স্মারক। এর র্নিমাণ কাজে সেনাপতি প্রচুর অর্থ এবং শ্রম নিয়োগ করেছিলেন। যদিও এখন পুষ্যমিত্র বংশের শাসন আর নেই, সাকেতও অন্য কোনো রাজার রাজধানীতে পরিণত হয়নি, তবু নিগমকে (নগর-সভা) সাকেতের গৌরব মনে সুরক্ষিত করে রাখা হয়েছে, যেমন রাখা ছিল দুশ’বছর আগের পুষ্যমিত্রের শাসনকাল। উদ্যানের মধ্যস্থলে এক পুষ্করিণী। পুষ্করিণীয় স্বচ্ছ নীল জলে নানা বর্ণের পদ্ম ফুটে থাকত এবং হংসমিখুনের দল সাঁতার কেটে ফিরত, চারিদিকে শ্বেতপাথরের বাঁধানো ঘাট যায় সোপানশ্রেণী স্ফাটকের মতোই স্বচ্ছ। সরোবরের ধার ঘেঁষে সবুজ দূর্বাচ্ছাদিত প্রশস্ত তটভুমি। এর ওপর কোথাও গোলাপ, জুঁই, বেল ইত্যাদি ফুলের কেয়ারি, আবার কোথাও তমাল, বকুল, অশোক বৃক্ষের ছায়া। আবার কোথাও বা লতাগুল্মে ঘেরা কুমার-কুমারীগণের ক্রীড়াক্ষেত্র। উদ্যান মধ্যে মাটি, পাথর আর সবুজে আচ্ছাদিত কয়েকটি মনোরম পাহাড়। উদ্যানের কোনো কোনো জায়গায় ফোয়ারা থেকে ঝরণা-ধারায় জল উৎসারিত হচ্ছে।

অপরাহ্ণে এক লতাগুল্মের কাছে সাকেতের তরুণ-তরূণীদিগের ভিড়, কিন্তু চারিদিকে নীরবতা। সকলেই লতাগুল্মের দিকে কান পেতে ছিল, আর লতাগুল্মের ভিতরে শিলাচ্ছাতিদ আসনে বসে সেই তরুণ, এক মাস আগে সন্তরণ প্রতিযোগিতায় যে এক তরুণীর সঙ্গে যুগ্মবিজয়ী হয়েছিল। তার দেহে মস্বণ সুক্ষ্ম কাপড়েরর পোশাক, দীর্ঘ পিঙ্হল কেশরাশি মাথায় জটার আকারে বাঁধা, হাতে বীণা—তরুণের আঙ্গুল স্বচ্ছন্দ গতিতে মনোহর সুর সৃষ্টি করে চলেছে। অর্ধনুদ্রিত নয়নে স্বরচিত গীত গেয়ে গাওয়ার তাগিদ ছিল, কারণ গায়ক-কবি জানে, তার শ্রোতাদের মধ্যে প্রাকৃত প্রেমিকের সংখ্যাই বেশী। কবি নিজের নবরচিত ‘উর্বশী-বিয়োগ’ গেয়ে শোনাল—উর্বশী লয়প্রাপ্ত হয়ে গেল আর পুরুরবা উর্বশীকে আপ্সরা (জলবিহারিণী) বলে ডাকতে ডাকতে পর্বত, সরোবর, বন, সকল জায়গায় খুঁজে ফিরতে লাগল। অপ্সরার দর্শন সে পেল না, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর বাতাসে ভেসে এল। গানে পুরুরবার অশ্রুবর্ষণের সময় গায়কেরও চোখের জল গড়িয়ে পড়তে লাগল এবং সমগ্র শ্রোতুমণ্ডলী ও অভিভূত হয়ে পড়ল সেই গান শুনে।

সঙ্গীত শেষ হবার পর এক এক করে সবাই চলে যেত লাগল। অশ্বঘোষ বাইরে এলে কিছু তরুণ-তরুণী তাকে ঘিরে দাঁড়াল। তার মধ্যে আর্ট্র আরক্ত-নয়না প্রভাও ছিল। একজন তরুণ এগিয়ে এসে বলল, “মহাকবি!”

“মহাকবি! আমি যে কবিই নই সৌম্য!’

“আমাকে আমার শ্রদ্ধা নিবেদন করতে দাও কবি। সাকেতে আমাদের যবনদের একটি ছোট নাট্যশালা রয়েছে।”

“নাচের জন্য? আমারও নাচের সখ আছে।”

“নাচের জন্যেই শুধু নয়, ওখানে আমরা অভিনয়ও করে থাকি।”

“অভিনয়!”

“হ্যাঁ কবি, কিন্তু যবন-রীতির অভিনয়ে এক বিশেষত্ব আছে। তাদের অভিনয়ে বিভিন্ন স্থান-কালের পরিচায়ক বড় বড় চিত্রপট থাকে, আর সমস্ত ঘটনাকেই বাস্তবের রুপে দেখাবার চেষ্টা করা হয়।”

“কি পরিতাপের কথা, সৌম্য! সাকেতে জন্মগ্রণণ করেও আমি এমন অভিনয় এখনও দেখলাম না!”

“আমাদের অভিনয়ের দর্শক এখানকার যবন-পরিবার এবং কিছু ইষ্ট মিত্র—এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ, এ জন্য বহু সাকেতবাসী যবন-অভিনয়…..”

“নাটক বলা উচিত, সৌম্য!”

“হ্যাঁ, যবন-নাটক। আজ আমরা এক নাটক মঞ্চস্থ করব। আমাদের ইচ্ছা ‍তুমিও আমাদের নাটক দেখ।”

“নিশ্চয়ই। তোমাদের মতো মিত্রগুলীর অসীম অনুগ্রহ।”

অশ্বঘোষ ওদের সঙ্গে চলল। নাট্যশালায় মঞ্চের কাছে তাকে বসতে দেওয়া হল। অভিনয় হচ্ছিল কোনো এক যবন বিয়োগান্ত নাটক প্রাকৃত ভাষায়, যবন কুলপুত্র-পুত্রীগণ বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করছিল। অভিনেতা এবং অভিনেত্রীগণের পোষাক-পরিচ্ছদও ছিল যবন-দেশীয়দের মতো। বিভিন্ন দৃশ্যপট যবনরীতি অনুযায়ী অঙ্কিত ছিল। নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করছিল অশ্বঘোষের পরিচিতা প্রভা। তার অভিনয় কৌশল দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল সে। অভিনয়ের মাঝে বিরতির সময় পূর্বপরিচিত যবন তরুণ ‘উর্বশী-বিয়োগ’ গানের অনুরোধ জানাল। কোনো রকম আপত্তি না করে বীণা হাতে অশ্বঘোষ রঙ্গমঞ্চের ওপর উঠে এল। তারপর স্বরচিতা গানের গভীরতায় নিজে কাঁদল অপরকেও কাঁদাল। নাটক শেষ হয়ে যাবার পর সমস্ত অভিনেতা, কুমার-কুমারীদের সঙ্গে কবির পরিচয় করানো হল। অশ্বঘোষ বলল, “সাকেতে থেকেও আমি এই অনুপম বলা সম্বন্ধে অজ্ঞ রয়ে গেছি। মিত্রমণ্ডলীর কাছে আমি অসীম কৃতজ্ঞ যে, তোমরা আমাকে এক অজ্ঞাত প্রভালোক দর্শন করালে।”

‘প্রভালোক’ কথাটি উচ্চারণ করার সময় কয়েকজন-তরুণী প্রভার দিকে তাকিয়ে মুখে টিপে হাসল। অশ্বঘোষ পুনরায় বলল, “আমার একটা কথা মনে হচ্ছে। তোমরা যেমন আজ যবন-নাটকের প্রাকৃত রূপান্তর অভিনয় করলে—মনে হয়, চেষ্টা করলে আমরা স্বদেশের কথা নিয়ে চমৎকার নাটক চরনা করতে পারি।”

“আমাদেরও পূর্ণ আস্থা আছে কবি, তুমি ইচ্ছা করলে মুল যবন-নাটক থেকেও ভালো নাটক রচনা করতে পার।”

“এতটা বল না, সৌম্য! যবন-নাট্যকারদের শিষ্য হওয়ার যোগ্যতাই যথেষ্ট, আমি তাই চেষ্টা করব। আচ্ছা আমি যদি ‘উর্বশী-বিয়োগ’ নিয়ে নাটক লিখি?”

“তা’হলে আমরা তার অভিনয়ও করতে প্রস্তুত, কিন্তু পুরূরবার ভুমিকায় তোমাকেই অভিনয় করতে হবে।”

“আমার আপত্তি নেই, সামান্য অভ্যাস করলে তেমন মন্দ অভিনয় করব না।”

“আমরা চিত্রপটও তৈরী করিয়ে নেব।”

“চিত্রপটের ওপর আমাদের পুরূরবার দেশের দৃশ্য অঙ্কিত করতে হবে। চিত্র অঙ্কন আমিও কিছু কিছু করি। সময় পেলে আমিও সাহায্য করতে পারব।”

“তোমার নির্দেশ মতো দৃশ্যাঙ্কন করা হবে। পাত্র-পাত্রীর বেশভূষা সম্বন্ধেও তোমাকেই নির্দেশ দিতে হবে, সৌম্য!”

“আর পাত্র-পাত্রী নির্বাচন?”

“পাত্র-পাত্রী তো এখনই ঠিক করা যাবে না, সৌম্য! তবে তাদের সংখ্যা কম রাখতে হবে।”

“কত রাখা উচিত?”

“ষোলো থেকে কুড়ি জন আমরা অনায়াসে সংগ্রহ করতে পারবে।”

“আমি ষোলো পর্যন্তই রাখার চেষ্টা করব।”

“পুরূরবা তো তুমিই সাজবে, সৌম্য! আর উর্বশী-চরিত্র আমাদের প্রভাকে দিয়ে কেমন হবে? আজ তো তুমি আর অভিনয় দেখলে।”

“আমার অনভ্যস্ত চোখে নিখুঁত মনে হয়েছে অভিনয়।”

“তা’হলে প্রভাকেই উর্বশী হতে হবে। আমাদের দলে যাকে যে কাজ দেওয়া হবে তাকে তাই করতে হয়।”

প্রভার চোখ কিঞ্চিৎ কুঞ্চিত হয়ে উঠেছিল, কিন্তু দলপতি তরুণের “কি প্রভা?” বলার পর প্রভা সংযত হয়ে জবাব দিল, “আচ্ছা।”

অশ্বঘোষ, যবন-তরুণ বুদ্ধপ্রিয়ের সঙ্গে কয়েকটি যবন নাটকের প্রাকৃত রূপান্তর পড়ল এবং তাদের কলাকৌশল নিয়ে আলাপ-আলোচনা করল। যবন কলাবিদ্যাকে স্মরণীয় করে রাখবার জন্যে নাটকের চিত্রপট সমূহের সে নামকরণ করল যবনিকা। সংস্কৃত, প্রাকৃত,গদ্যপদ্য দু’রকমভাবেই লিখল সে। এই সময় প্রাকৃত ও সংস্কৃতের এতটা আবেদন ছিল যে, সম্ভান্ত্র পরিবারগুলোতে তা অনায়াসবোধ্য ছিল। এই ‘উর্বশী-বিয়োগ’ হল প্রথম ভারতীয় নাটক এবং অশ্বঘোষ প্রথম ভারতীয় নাট্যকার। এটাই কবির প্রথম প্রয়াস, তবু তা পরবর্তী ‘রাষ্ট্রপাল’, ‘সারিপুত্ত’ ইত্যাদি নাটক থেকে কম সুন্দর হয়নি।

রঙ্গমঞ্চ তৈরীর সময়, অভিনয় অভ্যাসকালে খাওয়া-দাওয়ার কথাও মনে থাকত না তরুণ কবির। এই সময়গুলোই সে জীবনের সুন্দরতম সময় বলে মনে করত। প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রভা আর সে পরস্পরের সঙ্গ লাভ করত। সাঁতারের প্রতিযোগিতার দিন তাদের হৃদয়ে যে প্রেমবীজ রোপিত হয়েছিল এখন তাই অঙ্কৃরিত হতে থাকল ধীরে ধীরে। যবন তরুণ-তরুণীর অশ্বঘোষকে আত্মীয়র মতোই দেখত কাজেই এ ব্যাপারে সহায়ক হওয়াই তারা সৌভাগ্য মনে করত। একদিন অশ্বঘোষ নাট্যশালার বাইরে অবস্থিত ক্ষুদ্র উদ্যানে এসে একটা আসনের ওপরে বসল। এই সময়ে প্রভাও সেখানে এসে হাজির হল। প্রভা তার স্বাভাবিক মধুর কণ্ঠে বলল, “উর্বশী-বিয়োগ’ রচনা করবার সময় তোমার মনে কি ছিল কবি?”

“উর্বশী আর পুরূরবার কাহিনী।”

“কাহিনী তো আমিও জানি, কিন্তু উর্বশীকে অপ্সরা রূপে তুমি বার-বার সম্বোধন করছিলে কেন!”

“উর্বশী যে অপ্সরাই ছিল, প্রভা!”

“তা ছাড়া তুমি উর্বশীর বিয়োগের পর নদী, সরোবর, পর্বত, বন সব জায়গাতে পুরূরবাকে বিহ্বল অণ্বেষণকারীরূপে চিত্রিত করেছ।”

“পুরূবাকে ঐ অবস্থায় ওটাই স্বাভাবিক ছিল।”

“সব শেষে ‘উর্বশী-বিয়োগ’-এর গায়ক লতাকুঞ্জে বসে অশ্রুধারাকে বীণার মতো গীতসঙ্গী করে নিয়েছিল কেন?”

“গায়ক ও অভিনেতার এমনি তন্ময়ভাবে এসে যাওয়াই স্বাভাবিক,প্রভা!”

“উহু,তুমি আমাকে সত্যি কথাটাই বলতে চাইছ না।”

“কেন? তোমান কি মনে হয়?”

“আমার মনে হয়, তুমি পুরাণের কোনো উর্বশীর গান রচনা করনি।”

“তবে?”

“তোমার উর্বশী হচ্ছে—উর-বশী (হৃদয়ের অধিষ্ঠাত্রী), আর সেই অপ্সরা ছিল—অপ অর্থাৎ সরযূর জল, সরা অর্থে সন্তরণকারিণী।”

“তারপর?”

“তোমার উর্বশীকে পুরূরবা হিমালয়ের মতো পর্বত বা কোনো বনভূমি, নদী, সরোবর, এ সব খুঁজে ফেরেনি, তোমার পুরূরবা উর্বশীকে খুঁজে ফিরছিল সাকেতের সরষু নদীতে, পুষ্পোদ্যানের ভিতরকার সরোবর, আর লতাগুল্মের ভিতরে।”

“তারপর?”

“পুরাণোল্লিখিত কোনো পুরূরবার দুঃখে বিগলিত হয়ে তোমার চোখের জল ঝরেনি, জল ঝরেছিল তোমার নিজেরই তপ্ত হৃদয়কে শান্ত করতে।”

“এ-বারে আমিও একটা কথা বলব প্রভা?”

“বল, এতক্ষণ তো আমিই অনর্গল বকে গেলাম।”

“সেদিন লতাকুঞ্জ থেকে বেরিয়ে আসবার সময় আমি তোমার এই মনোহর নীল নয়ন দুটি আমার চেয়েও আরক্ত এবং সিক্ত দেখেছিলাম।”

“তোমার গান দিয়ে আমাকে কাঁদিয়েছিলে কবি।”

“আর তোমার বিরহ দিয়ে আমাকে গীত রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল।”

“কিন্তু কবি, তোমার গানের উর্বশী ছিল পাষাণী! অন্তত তুমি সেইভাবেই তাকে চিত্রিত করেছিল।”

“তার কারণ, আমি নিরাশ হয়ে পড়েছিলাম।”

“কি ভেবে?”

“আমার মনে হয়েছিল এই অচিরপ্রভাকে (বিদ্যুৎ) আমি আর কখনও দেখবার সৌভাগ্য লাভ করব না—সে কবেই হয়ত ভুলে গেছে আমাকে।”

“তুমি এতটা নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলে কবি?”

“যতক্ষণ পর্যন্ত আত্মবিশ্বাসের অন্য কোনো অবলম্বন না পাওয়া যায়, ততক্ষণ নিজেকে নিঃস্ব ছাড়া আর কিছুই ভাবা যায় না প্রভা।”

“তুমি শুধু সাকেতেরই নও, এই বিস্তৃত ভূখণ্ডের মহিমান্বিত কবি। সাকেতের সন্তরণ প্রতিযোগিতায় বিজেতা বীর তুমি। তোমার বিদ্যার খ্যাতি সাকেতবাসীর মুখে মুখে। আর তোমার সম্পর্কে তরুণীদের মনোভাব বলতে গেলে বলতে হয়, সাকেতের সুন্দরীগণ তোমাকে চোখের মণি করে রাখতে চায়।”

“কিন্তু ও সবে কি হবে? আমার কাছে আমার উর্বশীই সবটুকু। সেই সন্তরণ প্রতিযোগিতার পর যখন দু’সপ্তাহ তার দখো পেলাম না, তখন আমার মনে হতে লাগল যেন এ জীবনের কোনো মূল্য নেই। সত্যি বলছি, আমার হৃদয়কে এত দুর্বল হয়ে পড়তে আর কখনও দেখিনি। আর িএক সপ্তাহ যদি তোমাকে দেখতে না পেতাম হা’হলে কি যে করে বসতাম বলতে পারি না।”

“এত স্বার্থপর হয়ো না। তুমি তোমার দেশের এক অমর কবি। দেশ তোমার কাছে কত আশা রাখে। তুমি কি জানো, তোমার এই ‘উর্বশী-বিয়োগ’ নাটকের কত খ্যাতি?”

“আমি তো কিছুই শুনিনি।”

“গত সপ্তাহে এক ব্যবসায়ী ভরূকচ্ছ (ভড়ৌচ) থেকে এখানে এসেছিল। ভরূকচ্ছে যবন নাগরিকেরা বহু সংখ্যায় বাস করে। আমরা সাকেতের যবনরা তো হিন্দু বনে গেছি, কিন্তু ভরূকচ্ছাবাসী যবনেরা আপন ভাষা বিস্মত হয়নি। যবন দেশগুলো থেকে ভরূকচ্ছতে ব্যবসায়ী এবং বিদ্বান ব্যক্তিদের আগমন হয়ে থাকে। আমার এই বন্ধুটি যবন-সাহিত্যে পণ্ডিত, সে তোমার এই নাটকের অনুলিপি পড়ে শ্রেষ্ঠ দুই যবন-নাট্যকার এমপীদোকল এবং য়ুরোপিদ্‌এর প্রতিভার সঙ্গে তোমার তুলনা করেছে। সে এই নাটকের অনুলিপি নিয়ে গেছে। ভরূকচ্ছ থেকে মিশরে অনবরতই জলপোত যাতায়াত করে। এইসব কথা যখন আমার কানে এল, তখন অসীম গর্বে আমার বুক ভরে উঠল।”

“তোমার হৃদয়ের এই গর্বটুকুই আমার জীবনসর্বস্ব,প্রভা!”

“তোমার নিজের মূল্য তুমি জানো না, কবি।”

“আমার এই মূল্যের উৎস তুমিই প্রভা! আর এখন তা আমার অজানা নেই।”

“না না, এটা উচিত নয়। প্রভার প্রেমিক অশ্বঘোষ আর মহান কবি অশ্বঘোষকে পৃথক দৃষ্টিতে দেখাই তোমার কর্তব্য। প্রভার প্রেমিক অশ্বঘোষের জন্য যা কিছু চাও কর, কিন্তু মহান কবিকে এর অনকে উর্ধ্বে উঠতে হবে, সমগ্র বিশ্বের দরবারে তার প্রতিভাকে ছড়িয়ে দিতে হবে।”

“তুমি যেমন বলবে আমি সেইভাবেই চলব প্রভা।”

“নিজেকে এত বড় সৌভাগ্যশালিনী রূপে কখনই কল্পনা করতে পারিনি।”

“কেন?”

“মনে হত, তুমি আমাকে ভুলে গিয়ে থাকবে।”

“এত সাধারণ ছিলে তুমি?”

“তোমার সামনে তাই ছিলাম, এখনও আছি।”

“তোমাকে দেখেই কবিতার এক নতুন উৎসের সন্ধান পেলাম আমি। আমার কবিতায় এখন নতুন প্রেরণা, নতুন আনন্দ। ‘উর্বশী-বিয়োগ’ গীত আর নাটক দুই-ই তোমার প্রেরণায় প্রাণবন্ত। নাটককে আমি স্বদেশের নিজস্ব বস্তুরূপে গড়ে তুলছি প্রভা! কিন্তু তুমি কেন ভাবলে যে, আমি তোমাকে ভুলে যাব?”

“কোনো দিক থেকেই আমি নিজেকে তোমার উপযুক্ত ভাবতে পারিনি। তারপর যখন তোমার গুণাবলীর পরিচয় পেলাম তখন তোমার আশা একবারেই ত্যাগ করলাম। সাকেতের সুন্দরীদের শুধু তোমার নামেই উণ্মাদ হয়ে উঠতে দেখতাম—এ থেকেও নিশ্চয়ই আশা করবার কিছু ছিল না। তা’ছাড়া শুনেছিলাম তুমি উচ্চ কুলের ব্রাহ্মণ। যদিও আমি ব্রাহ্মণকুলের পরবর্তী উচ্চকুলজাত যবন-রাজপুত্রের কন্যা, তবু যে ব্রাহ্মণকুল মাতা-পিতা থেকে সাত পুরুষ উর্ধ্ব পর্যন্ত সম্পর্কিতের খোঁজ-খবর না নিয়ে বিয়ে করে না তার কি করে আমাদের প্রেমকে স্বাগত জানাবে?”

“বড় দুঃখের বিষয় প্রভা, অশ্বঘোষ তোমায় এইভাবে ব্যথিত করে তুলেছিল।”

“তা’হলে তুমি…” প্রভা বলতে বলতে থেমে গেল।

প্রভার অশ্রুপূর্ণ নয়ন চুম্বন করে, তার কণ্ঠলগ্ণ হয়ে অশ্বঘোষ বলল, “ অশ্বঘোষ চিরদিন তোমরাই থাকবে প্রভা। তুমি আর তাকে পর ভাবতে পারবে না।”

প্রভার দুই চোখ বেয়ে টস্‌টস্‌করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল, আর অশ্বঘোষ তার কণ্ঠলগ্ন হয়ে সেই জল মুছিয়ে দিতে থাকল।

‘উর্বশী-বিয়োগ’ একাধিকবার অতি চমৎকারভাবে অভিনীত হল। সাকেতের সমস্ত সম্ভ্রান্ত নর-নারী এই নাটকের অভিনয় দেখল। এর আগে তারা কোনোদিন ভাবতেই পারেনি যে, নাট্যকলা এত পূর্ণ, অভিনয় এত উচ্চশ্র্রেণীর হতে পারে। শেষ দৃশ্যে যবনিকা পতনের পর কয়েকবারই অশ্বঘোষ মঞ্চে উঠে বলেছে, ‘আমি এই নাটকের সব কিছুই যবন রঙ্গমঞ্চ থেকে সংগ্রহ করেছি’, কিন্তু তার নাটক এতটা স্বদেশী প্রভাবাপন্ন ছিল যে, কেউই তার কোনোখানে বিদেশীয়ানার এতটুকুও গন্ধ পায়নি।

অশ্বঘোষের সংস্কৃত ও প্রাকৃত গীত এবং কবিতা সাকেত এবং কোশলের সীমা অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়েছিল, কিন্তু নাটক ছড়িয়ে পড়ল আরও অনেক দূর পর্যন্ত। উজ্জয়িনী, দশপুর, সুপ্পারক, ভরূকচ্ছ, শাকলা (শিয়ালকোট), তক্ষশিলা, পাটলিপুত্র  ইত্যাদি মহানগরীর যেখানে বহুল সংখ্যায় যবনরা বসবাস করত এবং তাদের নাট্যশালা ছিল সে সব জায়গায় অশ্বঘোষের নাটক দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। রাজা-রাজড়া, ব্যবসায়ী সকলের দ্বারা সমানভাবে সমাদৃত হল সেইসব নাটক।

 

রঙ্গমঞ্চে অশ্বঘোষের অভিনয় এবং যবন কন্যার সঙ্গে তার প্রেমের ব্যাপার অশ্বঘোষের পিতা-মাতার কাছে অজানা  থাকবার কথা নয়। কথাটা শুনে অশ্বঘোষের পিতা রীতিমতো চিন্তিত হলেন এবং সুবর্ণক্ষীকেও বুঝিয়ে বললেন। মাতা যখন পুত্রকে বললেন যে, আমাদের ব্রাহ্মণকুলের পক্ষে এমন সম্বন্ধ করা অধর্ম, তখন ব্রাহ্মণ্যধর্মের সমগ্র শাস্ত্রে সুপণ্ডিত অশ্বঘোষ মাতাকে পুরাণ থেকের ঋষিদের আচরণের শত শত প্রমাণ দিল (যার থেকে কিছু অংশ পরে সে নিজের ‘বজ্রচ্ছেদিকা’র লিপিবদ্ধ করেছে—যা বজ্রদিকোপনিষদ্‌নামে উপনিষদগুলির মধ্যে অঙ্গীভূত হয়ে রয়েছে)।

সব শুনে মা বললেন, “এ সব ঠিকই বাবা, কিন্তু আজকের ব্রাহ্মণেরা এই পুরাণোক্ত আচরণকে মানতে চায় না।”

“তা’হলে ব্রাহ্মীপদের জন্য আমি এক নতুন সদাচার উপস্থিত করব।”

মা অশ্বঘোষের যুক্তিসমূহতের সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না, কিন্তু যখন সে বলে বসল যে, প্রভার আর আমার জীবন কখনও স্বতন্ত্র হয়ে থাকতে পারে না, তখন তিনি পুত্রের পক্ষে মত দিয়ে বললেন, “তুইই আমার যথাসর্বঙ্গ বাবা।”

অশ্বঘোষ একদিন প্রভাকে মা’র কাছে পাঠিয়ে দিল। মার তার রূপ আর গুণের পরিচয় পেয়ে এবং তার বিনম্র স্বভাবে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে আশীর্বাদ করলেন। কিন্তু অশ্বঘোষের পিতা একে স্বীকার করে নিতে পারছিলেন না।

তিনি একদিন অশ্বঘোষকে ডেকে বললেন, ‘পুত্র, আমাদের শ্রোত্রিয়দের শ্রেষ্ঠ হল ব্রাহ্মণকুল। পঞ্চাশ পুরুষ থেকে শুধু কুলীন ব্রাহ্মণ কন্যারাই আমাদের ঘরে বধূ রূপে আসছে। আজ যদি তুমি প্রভাকে বিবাহ কর তো আমরা এবং পরবর্তী বংশধরেরা চিরকালের জন্য সমাজে জাতিভ্রষ্ট হয়ে থাকব।”

অশ্বঘোষের পক্ষে প্রভাকে ত্যাগ করা একেবারেই অচিস্ত্যনীয় ব্যাপার বুঝে অশ্বঘোষের পিতা প্রভার পিতামাতার কাছে গিয়ে অনুনয়-বিনয় করলেন, কিন্তু তাঁদের কিছুই করবার ছিল না। পরিশেষে তিনি প্রভার কাছেই তাঁদ নিবেদন পেশ করলেন। প্রভা বলল,“আমি অশ্বঘোষের কাছে আপনার কথা বলব।”

প্রভা আর অশ্বঘোষ পরস্পরের অভিন্ন সাথী। কি সরযূতীর, কি পুষ্পোদ্যান, কি নৃত্যশালা-নাট্যশালা, কিম্বা অপর কোনো জায়গায় একজন থাকলে আর একজনও থাকবেই। সূর্যের প্রভার মতোই প্রভা অশ্বঘোষের হৃদয়-পদ্মকে বিকাশিত কররে রেখেছে। রূপালী চাঁদের আলোয় প্রায়ই তারা সরষূতীরে যেত। সেকানে তারা জীবনের বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করত। এমনি এক জ্যোৎস্নালোকে একদিন সরষুর কালো জলের ধারে শ্বেত শিলাসনে বসে অশ্বঘোষ আপন আনসপটে প্রভার চিত্র অঙ্কন করছিল। তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল, “প্রভা তুমিই আমার কবিতা, তোমারই প্রেরণা পেয়ে আমি ‘উর্বশী-বিয়োগ’ লিখেছি। তোমার রূপরাশি আমাকে বহু সুন্দর কাব্য রচানায় উদ্বদ্বু করবে। কবিতা হল অন্তরের অভিব্যক্তি, বাইরের জিনিস নয়; কিন্তু বাইরের অভিব্যক্তিই যে অন্তরে বিকাশিত হয় এ তত্ত্ব তুমিই আমাকে শিখিয়েছ।”

অশ্বঘোষের কথা শুনতে শুনতে প্রভা সেই শীতল শিলাসনের ওপর শুয়ে পড়ল। অশ্বঘোষ সযন্তে তার মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিল। ওপর দিকে তাকিয়ে আয়ত দৃষ্টি মেলে প্রভা অশ্বঘোষের শ্রীমণ্ডিত মুখখানা দেখতে লাগল। অশ্বঘোষের কথা শেষ হলে প্রভা বলল,“তোমার সব কথাই আমি মেনে নিতে রাজি। সাকার-সৌন্দর্য থেকে প্রেরণা না পেলে কাব্য কখনও পূর্ণ রূপে বিকাশিত হতে পারে না। আমি তোমার কাব্যের মূর্তিময় প্রকাশ, আবার আমিই বিকাশিত করছি তোমার অন্তরের কাব্যরূপকে। কিন্তু     কবিতা তো শুধু আমার সৌন্দর্যের কথা নয়। সে দিন আমি বলেছিলাম, তোমার ভিতরে দু’জন অশ্বঘোষকেই উপলিদ্ধ করতে হবে। আবার দুয়ের মধ্যে মহান যুগকবি অশ্বঘোষকেই মূখ্য হয়ে উঠতে হবে। কারণ, সে শুধু একটি ব্যক্তির নয়, সমগ্র বিশ্বজনের সে প্রতিনিধি। কালকারামের সেই বিদ্বান ভিক্ষুর কথা মনে আছে? পরশু যাঁকে’ আমরা দু’জনে দেখতে গিয়েছিলাম?”

“অদ্ভুত মেধাবী মনে হয় তাঁকে।”

“ঠিকই, আর বহু দেশও ঘুরেছেন। তাঁর জম্ম মিশরের সেকেন্দ্রিয়া নগরে।”

“তা আমি শুনেছি;  কিন্তু একটা কথা আমি বুঝতে পারি না প্রভা, যবনরা কেন বৌদ্ধধর্মকে মেনে  চলে!

“কারণ, ব্যেদ্ধধর্ম যবনদের স্বতন্ত্র প্রকৃতি এবং স্বাধীন মনোবৃত্তির অনুকূল।”

“কিন্তু বৌদ্ধধর্ম তো সকলকেই বৈরাগী, তপস্বী এবং ভিক্ষুতে পরিণত করে!”

“বৌদ্ধদের মধ্যে গৃহী অপেক্ষা ভিক্ষুর সংখ্যা অনেক কম এবং বৌদ্ধ গৃহী গার্হস্থ্য জীবরনর রসগ্রহণে কারও অপেক্ষাই পশ্চাৎপদ নয়।”

“এই দেশে আরও কত ধর্ম প্রচলিত রয়েছে, বৌদ্ধধর্মের প্রতিই যবনদের এত পক্ষপাতিত্ব কেন? এ কথাও ঠিক বুঝতে পারি না।”

“এখানে বৌদ্ধর্মই সবচেয়ে উদার। আমাদের পূর্বজগণ যখন ভারতে এল, তখন সকলেই ম্লেচ্ছ বলে তাদের ঘৃণা করত। আমি কিন্তু আক্রমণকারী যবনদের কথা বলছি না, এখানে যারা বসতি স্থাপনকল্পে  এসেছিল বা ব্যব্সার সূত্রে যাতায়াত করত, তাদের সম্বদ্ধেও এই মনোভাব ছিল। কিন্তু বৌদ্ধরা তাদের মোটেই ঘৃণা করত না। যবনেরা বস্তুত নিজ দেশেও বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে পরিচিত হয়ে গিয়েছিল। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পৌত্র অশোকের সময় বহু বৌদ্ধ ভিক্ষু যবনদের ভিতর ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের ধর্মরক্ষিত এ দেশে এসে ভিক্ষু হননি, মিশরের বিহারেই তিনি ভিক্ষু হয়েছিলেন।”

“আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই প্রভা।”

“নিশ্চয়ই দেখা করবে। তিনি তোমাকে আরও গভীর দার্শনিক তত্ত্ব বলতে পারবেন শুধু বৌদ্ধধর্মের সম্বন্ধেই নয়, যবন-দর্শন সম্বন্ধেও।”

“যবনদের ভিতরও দার্শনিক রয়েছেন?”

“অনেক মহান দার্শনিক আছেন, যাঁদের বিষয়ে ভদন্ত ধর্মরক্ষিত তোমাকে বলতে পারবেন।  কিন্তু বৌদ্ধ-দর্শনের কথা শুনে প্রভার প্রতি যেন তোমার বৈরাগ্য না আসে প্রিয়তম।” –এই বলে প্রভা আপনর বাহুপাশে অশ্বঘোষকে বেধেঁ ফেলল।

“কালকারামের কিচু কিছু কথা আমার কাছেও খুব আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। ভাবছিলাম , যদি আমাদের সমগ্র দেশ কালকারামের মতো হত?”

প্রভা বলল, “না প্রিয়তম, আমাকে ছেড়ে তুমি কালকারামে চলে যেও না।”

“প্রাণ থাকতে তোমাকে ছেড়ে যবন ধর্মরক্ষিত, পারশী সুমনের দেশ-দেশান্তরের বিদ্বান ভিক্ষু বাস করেন আর আমাদের দেশের ব্রাক্ষণ থেকে চন্ডাল পর্যন্ত সমস্ত কুলের ভিক্ষুরাও বাস করেন। সবাই এক সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া । করেন, এক সঙ্গেই জ্ঞানার্জনে সমাবিষ্ট হন। কালকারামের সেই কৃষ্ণবর্ণ বৃদ্ধ ভিক্ষুর নাম কি প্রভা?”

“মহাস্থবির ধর্মসেন। সাকেতের সমস্ত বিহারবাসী ভিক্ষুদের প্রধান।”

“শুনেছি, চন্ডাল কুলে তাঁর জম্ম। অথচ আমার আপন কাকা ভিক্ষু শুভগুপ্ত তাঁর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তাঁকে প্রণাম করেন। ভেবে দেখ, কোথায় এক শ্রোত্রিয় ব্রাক্ষণ কুলজাত বিদ্ধা্ন শুভগুপ্ত , আর কোথায় চন্ডালপুত্র ধর্মসেন?”

“কিন্তু মহাস্থবির ধর্মসেনও প্রগাঢ় পান্ডিত্যের অধিকারী।”

“আমি প্রাক্ষণ্যধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে বলছি, প্রভা?……….”

“বৃদ্ধ তাঁর ভিক্ষু-সঙ্গকে সমুদ্র আখ্যা দিয়েছেন , যিনিই এই সঙ্গে যোগ দেন তিনিই তাঁর নাম-রুপ ছেড়ে সমুদ্রে বিলীন হয়ে যান।”

“বৌদ্ধ গৃহীরাও কেন এমনি করে না?”

“বৌদ্ধ গৃহীরা দেশের অন্যান্য গৃহী লোকদের থেকে স্বতস্ত্র হয়ে থাকতে পারে না। তা’ছাড়া তাদের ঘাড়ে পারিবারিক বোঝাও থাকে।”

“আমার তো মনে হয় কালকারামের ভিক্ষুদের মতো নগর এবং গ্রামের সমস্থ লোক ‍যদি জাতিভেদ শূন্য, বর্ণভেদ শূন্য হয় হবে খুবই ভালো।”

“একটা কথা তোমাকে আমি বলিনি প্রিয়তম। তোমার পিতা একদিন আমার সামনে উপস্থিত হয়ে বলেছিলেন, আপনার কথা আমি অশ্বঘোষের তুমি মুক্তি দাও।”

“যেন তুমি মুক্তি দিলেই তিনি তাঁর পুত্রকে ফিরে পাবেন! তুমি কি বললে?”

“আমি বলেছিলাম, আপনার কথা আমি অশ্বঘোষের কাছে বলব।”

“আর তাই আজ বললে তুমি। ব্রাক্ষণদের পাষশুতাকে আমি অসীম ঘৃণা করি- ঘৃণায় আমার সর্বাঙ্গ জলতে থাকে । তাঁরা বলে বেড়ায়, আমরা বেদ-শাস্ত্রকে অনুসরণ করি, কিন্তু বহু পরিশ্রম এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে সমগ্র ব্রাক্ষণ্য-বিদ্যা অধ্যয়ন করেও কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না, কি তারা অনুসরণ করে।পুরাণের্ কোনো ঋষিবাক্য উদ্বৃত করলে বলবে-আজকাল এ সবের প্রচলন নেই। হয় ‍যুক্তির পথে চল, নয় তো ঋষিবাক্য অনুসরণ কর! পুরাতন বেদনীতি যদি কউ ভঙ্গ করে ,তবেই না নতুন রীতি প্রবর্তিত হয়। ভশু, কাপুরুষ , স্বার্থপররা পুষ্ট বাছুরের মাংস আর মোটা দক্ষিণা পেলেই খুশী। আশ্রয়দাতা রাজা এবং সামন্তগণ যাতে প্রসন্ন হয় সেই কাজেই এরা সদা প্রস্তুত।”

“দরিদ্র হলে কাউকেও নিজেদের ধর্মে স্থান দেয় না এরা…”

“হ্যাঁ, অন্যান্য দেশ থেকে আগত যবন, শক, আভীর ইত্যাদি জাতিসমূহকে এরা ক্ষত্রিয় বলে রাজপুত্র বলে স্বীকার করে নিয়েছে, করাণ, তাদের হাতে ক্ষমতা এবং অর্থ ছিল। তাদের কাছে থেকে এরা মোটা-মোটা দক্ষিণা পেত। কিন্তু স্বদেশের শুদ্র, চণ্ডালদের চিরতরে দাস করেই রেখেছে এরা। যে ধর্ম মানুষের হৃদয়কে উদার করে তুলতে পারে না, যে ধর্মের বিকাশ শুধু টাকার থলি বা শাসন-ক্ষমতার অপেক্ষায় পড়ে থাকে, আমি তাকে মানুষের পক্ষে অত্যন্ত কলঙ্কজনক মনে করি। জগৎ পরিবর্তনশীল, ব্রাহ্মণদের প্রাচীন ধর্মগ্রস্থ থেকে আজকের গ্রন্থাবলী পর্যন্ত সমস্ত পড়ে তাদের আচার ব্যবহারেও পরিষ্কার পরিবর্তন দেখতে পেয়েছি! কিন্তু এদের সঙ্গে কথা বল, দেখবে এরা সমস্ত কিছুকেই শাশ্বত সনাতন প্রতিপন্ন করতে চাইছে। একে এক ধরনের জড়তাই আখ্যা দেওয়া যায় প্রভা।”

“তোমার এই সমস্ত বিষোদগারের কারণ আমি নই তো!”

“কারণ হওয়া তো প্রশংসারই কথা প্রভা! তুমি আমার কবিতায় নতুন প্রাণ, নতুন প্রেরণার সঞ্চার করেছ। আমার অন্তদৃষ্টিতেও নতুন প্রাণ, নতুন প্রেরণা সৃষ্টি করে তুমি আমার উপকার করেছ। এতদিন ভাবতাম যে, জ্ঞানের সর্বোচ্ছ শিখরে আমি আরোহণ করেছি, এই মিথ্যা দম্ভের সহজ স্বীকৃতি হল ব্রাহ্মণকুল। কিন্তু আজ বুঝতে পারছি, জ্ঞানসমুদ্রের পরিধি ব্রাহ্মণদের শ্রুতি আর তাদের তাল এবং ভূর্জপত্রের পুথিতেই সীমাবদ্ধ নয়, সে এ সবের চেয়ে অনেক বিশাল।”

“আমি সামান্য এক নারী মাত্র।”

“সামান্য নারী বলেই যদি কেউ তাকে নীচ বলে, তবে সে আমার ঘৃণার পাত্র।”

“যবনকুলে নারীদের সম্মান অন্যদের চেয়ে বেশী। যদি কেউ নিঃসন্তান থেকে মরেও যায় তবু এক স্ত্রী বর্তমানে সে দ্বিতীয় বিবাহ করতে পারে না।”

“আর এই ব্রাহ্মণেরা শত শত বিবাহ করে বেড়ায় শুধু দক্ষিণা লাভের আশায়, ছিঃ! কোনো যবন যে ব্রাহ্মণ্যধর্মকে মানে না এতে আমি খুব খুশী।”

“বৌদ্ধ হলেও পূজাপাঠের জন্য আমাদের মধ্যে ব্রাহ্মণেরা আসে।”

“স্বার্থরক্ষার জন্য যবনদের যখন ক্ষত্রিয় বলে অভিহিত করেছে,তখন দক্ষিণার আশায় এটুকুই বা করবে না কেন!”

“আমি কি তোমার ব্রাহ্মণত্বের অহঙ্কার ভেঙ্গে দেবার কারণ হয়ে দাঁড়ালাম?”

“তাতে মন্দ কিছু হয়নি। ব্রাহ্মণত্বের দম্ভ যদি তোমার আমার মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে চায় তো সে দম্ভ আমার কাছে ঘৃণার বস্তু।”

“তুমি আমাকে এত ভালোবাসো জেনে বড় সুখী হলাম।”

“তোমার প্রেমে বঞ্চিত থাকলে অশ্বঘোষ এক নিষ্প্রাণ জড়পিণ্ডে পরিণত হবে।”

“তা’হলে আমার প্রেমের পুরষ্কার, বরদান করতে পার তুমি?”

“ঐ প্রেমটুকু বাদে আর সব কিছু ছেড়ে দিতে পারি।”

“আমার প্রেম যদি অমর অশ্বঘোষ, মহান যুগকবি অশ্বঘোষকে এতটুকুও নীচে নামিয়ে এনে থাকে, তবে ধিক্‌আমার সে প্রেম।”

“পরিষ্কার করে বল প্রিয়!”

“প্রেমের পথে আমি বাধা সৃষ্টি করতে চাই না, কিন্তু আমি তাকে তোমার অমর প্রতিভার সহায়ক রূপে দেখতে চাই। তাই বলছিলাম আমি যদি না থাকি….”

তড়িতাহিত মতো উঠে অশ্বঘোষ প্রভাকে দৃঢ়ভাবে বুকে চেপে ধরল, তার কণ্ঠলয় হয়ে প্রভা দেখল যে, সে কাঁদছে। কিছুটা শান্ত হলে প্রভা বলল,“শোন আমার প্রেম তোমার কাছে বড় জিনিসের প্রত্যাশা রাখে, সেটা তোমাকে দিতে হবে।”

“তোমাকে অদেয় আমা কিছুই নেই প্রিয়ে।”

“কিন্তু তুমি আমার কথা শেষ করতে দাওনি….”

“তুমি যে বস্ত্রবাক্য উচ্চারণ করতে যাচ্ছিলে!”

“কিন্তু এই বজ্রবাক্য শাশ্বত অশ্বঘোষের হিতকল্পে উচ্চারণ তো করতেই হবে। আমার প্রেম চায়, মহান কবি অশ্বঘোষের আপন অমর কবি-প্রতিভার মতো প্রভার প্রেমকেও যেন অমর বলে মনে করে, তাকে যেন শুধু প্রভার রক্ত-মাংসের দেহ দিয়ে বিচার না করে। অমর অশ্বঘোষের প্রভা শাশ্বত তরুণী, শাশ্বত সুন্দরী। শুধু এইটুকুই আমি তোমাকে দিয়ে উপলদ্ধি করাতে চাই।”

“তা’হলে মূর্তিময়ী প্রভার বদলে কল্পলোকের প্রভা আমার সামনে থাকবে?”

“আমি উভয়কেই মূর্তিময়ী মনে করি, পার্থক্য শুধু  এতটুকু যে, দু’জনের মধ্যে একজন এক শ’  অথবা পঞ্চাচ বছর বেঁচে থাকবে আর অন্যজন থাকবে চিরজীবী হয়ে। তোমার প্রভা তোমার ‘উর্বশী-বিয়োগ’-এ অমর হয়ে থাকবে কিন্তু আমার প্রেমকে অমর করে রাখতে হলে তোমাকে অমর অশ্বঘোষের দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। রাত অনেক হয়ে গেছে, সরষূর-জল যেন ঘুমিয়ে পড়েছে, আমাদেরও ঘরে ফেরা উচিত।”

“অমর প্রভার একটি চিত্র আমি আমার মানসপটে অঙ্কিত করে নিলাম।”

“শুধু এইটুকুই আমি চাই প্রিয়তম”—এই বলে রেশমের মতো কোমল কেশপাশ অশ্বঘোষের কপোলতলে বুলিয়ে দিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে  রইল প্রভা।

প্রশন্ত এক অঙ্গনের চারিদিকে বারান্দা এবং পিছনে চারতলা এক অট্টালিকা। বারান্দায় ভিজে কাপড় শুকোচ্ছে। অঙ্গনের এক কোণে একটি কুয়া এবং স্নানের ঘর। অঙ্গনের অন্যান্য স্থানে বহু রকমের গাছপালা, তার মধ্যে একটি অশ্বথ গাছ। গাছের মূলে বাঁধানো বেদী আর একটু দুর পাথরের দেওয়াল। দেওয়ালের ওপর সহস্র দীপ রাখবার স্থান। হাঁটু গেড়ে বসে এই সুন্দর বৃক্ষ বন্দনা করে প্রভা বলল, “প্রিয়, এ হচ্ছে সেই জাতে বৃক্ষ যার নীচে বসে সিদ্ধার্থ গৌতম আপন সাধনা, আপন চিন্তায় দ্বারা মনকে ভ্রান্তিমুক্ত করে বোধপ্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং সেই থেকে এ গাছ বুদ্ধের নামে খ্যাত হয়েছে । সেই পবিত্র স্মৃতি স্মরণ করে আমি এই বৃক্ষের সামনে মাথা নত করি।”

“আপন সাধনা, আপন চিন্তায় দ্বারা সমনে ভ্রান্তিমুক্ত করে বৌধিক মার্গ অর্জনের প্রতীক! এ রকম প্রতীককে পূজা করা উচিত প্রিয়ে! এ রকম প্রতীকের পূজা আপন সাধনায় আত্ম-বিজয়েরই পূজা।”

এরপর দু’জনেই ভদন্ত ধর্মরক্ষিতের কাছে গেল। তিনি অঙ্গনের এক বকুল বৃক্ষের নীচে উপবিষ্ট ছিলেন। নবপুষ্পিত ফুলের মধুর সৌরভ ছড়িয়ে পড়ছিল। বৌদ্ধ উপাসিকার ন্যায় প্রভা পঙ্কপ্রতিষ্ঠিত হয়ে (হাঁটু গেড়ে বসে, হাতের পাতা এবং কপাল মাটিতে ঠেকিয়ে) তাঁকে বন্দনা করল। অশ্বঘোষ দণ্ডায়মান অবস্থাতেই শ্রদ্ধা নিবেদন করল। তারপর দু’জনে মাটির ওপর রক্ষিত চর্মাসনে বসে পড়ল। সাধারণ শিষ্টাচারের কথাবার্তার পর অশ্বঘোষ দর্শনের কথা তুলল। ধর্মরক্ষিত বললেন, “ব্রাহ্মণকুমার, বৌদ্ধধর্মে দর্শনকেও বন্ধন এবং দৃঢ়বন্ধন (দৃষ্টিসংযোজন) বলা হয়েছে।”

“তবে কি বৌদ্ধধর্মে দর্শনের কোনো স্থান নেই, ভদন্ত?”

“বুদ্ধের ধর্মই দর্শনময়, কিন্তু বুদ্ধ একে নদী পার হবার ভেলা মনে করতেন।”

“কি বললেন, ভেলা মনে করতেন?”

“হ্যাঁ, খেয়াবিহীন নদী পার হতে হলে লোক ভেলার সাহায্যে পার হয়। কিন্তু পার হবার পর সেই ভেলা মাথায় করে নিয়ে যায় না।”

“আপন ধর্মের সপক্ষে যে পুরুষ উচ্চকণ্ঠে  এত বড় কথা বলবার স্পর্ধা রাখেন, তিনি নিশ্চয়ই সত্যের অন্তর্নিহিত শক্তিকে উপলদ্ধি করেছেন। ভদন্ত, বুদ্ধের দর্শন থেকে এমন কিছু বলুন যাতে আমরা নিজেদের চলার সঠিক পথ খুঁজে নিতে পারি।”

“অনাত্মবাদ, কুমার! ব্রাহ্মণেরা আত্মাকেই নিত্য, ধ্রুব, এবং শাশ্বত তত্ত্বকে স্বীকার করেন না। এ জন্যেই তাঁর দর্শনকে অনাত্মবাদ, অর্থাৎ অবিরাম উৎপত্তি আর বিনাশের সংঘর্ষে যে অনিত্যতা তারই দর্শন বলা হয়।”

“এই একটা বাণীই আমাদের পক্ষে যথেষ্ট ভদন্ত! ধর্ম এবং অনাত্মবাদ ভেলার ন্যায়, এই বাণী প্রচার করেছেন যে বু্দ্ধ—তাঁকে শত শত অশ্বঘোষ প্রণাম জানাচ্ছে। অশ্বঘোষ যা খুঁজে মরছিল তা সে পেয়ে গেছে। আমি নিজের ভিতরে এমনই এক চিন্তালহরী অনুভব করছিলাম কিন্তু রূপ দেবার মতো ভাষা এর আগে আমি খুঁজে পাইনি। লোকে বুদ্ধের শিক্ষাকে যথাযথ পালন করলে পৃথিবীর রূপ আজ বদলে যেত।”

“ঠিকই বলছে কুমার! আমাদের যবন দেশগুলোতে মহান দার্শনিকগণ জন্মগ্রহণ করেছেন যাঁদের ভিতর পিথাগোরাস এবং হেরাক্লিটাস ছিলেন ভগবান বুদ্ধের সমসাময়িক আর সক্রেটিস, প্লেটো, দেমোক্রেটাস, আরিস্টোটল—এরাঁ জন্মগ্রহণ করেন কিছুকাল পরে। এইসব যবন দার্শনিকদের সকলেই ছিলেন অত্যন্ত চিন্তাশীল ব্যক্তি। কিন্তু একমাত্র হেরাক্লিটাস ছাড়া আর কেউেই শাশ্বতবাদ, নিত্যবাদের উর্ধ্বে উঠতে পারেননি।বর্তমান সম্বন্ধে তাদের মোহ ছিল বড় বেশী। তার কারণ , ভবিষ্যৎকে তাঁরা বর্তমানের নাগপাশে বেঁধে রাখতে চাইতনে। হেরাক্লিটাস অবশ্য বুদ্ধের মতোই, জগৎকে এক মুহূর্তের জন্যও স্থির, অঞ্চল বলে স্বীকার করতেন না, বুদ্ধের মতোই চির-চলমান বলে তিনি জগৎকে মনে করতেন—কিন্তু এর পেছনে ছিল তাঁর ব্যক্তিগত স্বার্থ।”

“দর্শন-বিচারে ব্যক্তিগত স্বার্থ!”

“উদর নামক জিনিসটি সকলেরই আছে কুমার! হেরাক্লিটাসের সময়ে আমাদের এথেন্স নগরে গণ-শাসন ছিল, অর্থাৎ এথেন্স কোনো রাজার অধীন রাজ্য ছিল না। প্রথমে হেরাক্লিটাসদের পরিবারের মতো বড় বড় সামন্ত পরিবারেরা গণ-শাসনের কর্ণধার ছিলেন। পরে তাঁদের হটিয়ে দিয়ে ব্যবসায়ী-শেঠরা শাসনভার নিজেদের হাতে তুলে নেয়। হেরাক্লিটাস এতে মোটেই খুশী হননি, তিনি পরিবর্তন চেয়েছিলেন সত্যি, কিন্তু এগিয়ে চলার পথে নয়, পিছনে ফিরিবার জন্যে।”

“পরিবর্তন আমাদের চাই, কিন্তু সেটা এগিয়ে যাবার জন্য, পিছিয়ে পড়ার জন্য নয়—আমার মনে হয় ভদন্ত, অতীত চিরকালই মৃত।”

“খুবই খাঁটি কথা! বুদ্ধ পরিবর্তন চাইতেন উন্নততর জগৎ প্রতিষ্ঠার জন্য। এই ভবিষ্যৎ জগতের প্রতীক হিসাবে তিনি ভিক্ষুসঙ্ঘকে সংগঠিত করেছেন। যেখানে জাতিভেদে, শ্রেণীভেদ নেই, উঁচু-নীচুর ভেদ নেই। যেখানে সকলেই সমান, যেখানে সবাইকেই সমান শ্রম করতে হবে। তুমি আমাদের মহাস্থবির ধর্মসেনকে বাইরে ঝাড়ু হাতে কাজ করতে দেখেছ?”

“ঐ ঘোর কৃষ্ণবর্ণ বৃদ্ধটি?”

“হ্যাঁ, উনিই আমাদের ভেতরে শ্রেষ্ঠ, আমরা প্রতিদিন পঙ্ক-প্রতিষ্ঠিত হয়ে তাঁকে বন্দনা করি। সমগ্র কোশল দেশের ভিক্ষসঙ্ঘগুলির উনিই নায়ক।”

“শুনেছি, উনি না-কি চণ্ডাল কুলজাত?”

“ভিক্ষুসঙ্ঘ কুলবিচার করে না, কুমার। তারা বিচার করে গুণের। নিজ বিদ্যা এবং গুণের জোরেই আজ উনি আমাদের নায়ক, আমাদের পিতা। শুধু নিজের পেট ভরানোর মতো সামান্য ভিক্ষাও যদি তিনি লাভ করেন, তবু সঙ্গীদের ভাগ না দিয়ে কখনই তা গ্রহণ করেন না তিনি এবং এই হল বুদ্ধের শিক্ষা। পরিধেয় তিন খণ্ড কাপড়, মাটির তৈরী  এক ভিক্ষাপাত্র, একটি সূচ, জল পান করবার একটি পাত্র, একটি চিরুণী আর এক কোমর বন্ধনী—এই কয়টি জিনিস ছাড়া আমাদের আর সব কিছু সঙ্ঘের সাধারণ সম্পত্তি। আমাদের কোনো বিহারে যে জমি রয়েছে, তাও সঙ্ঘেরই। কাউকে ভিক্ষুসঙ্ঘে গ্রহণ করতে হলে সঙ্ঘ বহু পরীক্ষা নিরীক্ষার পর তা করে, কিন্তু একবার যে সঙ্ঘে প্রবিষ্ট হয়েছে, ভিক্ষুতে পরিণত হয়েছে, সে সঙ্ঘের আর সবারই সমান।”

“সারা দেশটাই যদি এমনই এক সঙ্ঘে পরিণত হত!”

“সে কি করে হবে কুমার? রাজা বা ধনীর দল কেন অন্যকে তাদের সমান হতে দেবে! ভিক্ষুরা একাবর একজন দাসকে সঙ্ঘে ঢুকিয়েছিল। সঙ্ঘে আসবার পরই সে আর দাস রইল না, হয়ে গেল সকলের সমান। কিন্তু এরপরই তার প্রভু এসে হল্লা সুরু করে দেয়। রাজা নিজে হাজার হাজার দাসের প্রভু। তিনিই বা তাঁর সম্পত্তির ওপর এ ধরনের হস্তক্ষেপ সহ্য করবেন কেন? এ সবের বিরুদ্ধে কি আর করতে পারি, কাজেই নির্দেশ দিতে হল, কোনো দাসকে আর সঙ্ঘের ভিতর নেওয়া হবে না। অসাম্যের বিশাল সমুদ্রের মাঝে আমাদের সঙ্ঘ এক ক্ষুদ্র দ্বীপমাত্র। দারিদ্র্য এবং দাসত্ব যতদিন অটুট থাকবে, ততদিন আমাদের সঙ্ঘগুলিকে নিরাপদ মনে করা চলে না।”

শরতের পূর্ণিমা। সন্ধ্যা থেকেই চাঁদের আলো পূর্ব দিগন্ত থেকে উঠে আসছে। অন্তমিত সূর্যের লাল আভা যেমন নীল দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে, চাঁদের শীতল রূপালী আলোও তেমনি নীল আকাশকে উদ্ভাসিত করে তুলেছে। আজকাল অশ্বঘোষ বেশীরভাগ সময়ই প্রভাদের বাড়ি থাকে। দু’জনে ছাদের ওপর বসেছিল, প্রভা বলে উঠল, “সরষুর তরঙ্গ-লহরী আমাকে ডাকছে প্রিয়তম! সেই লহরী, যা তোমাকে প্রথম আমার কাছে টেনে এনেছিল এবং প্রথম প্রেমডোরে আমরা বাঁধা পড়েছিলাম। সে দিনটি দু’বছর আগের, কিন্তু আজও মনে হয় যেন গতকালে গটনা। কত চাঁদনী-রাতই না আমরা সরযুতীরে কাটিয়েছি, কি মুধর ছিল সেইসব রাতগুলো! আজও তেমনি মধুযামিনী প্রিয়ে! চল, আমরা সরষুতীরে যাই।” দু’জনে চলতে লাগল। নদী এখান থেকে দুরে। চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত বালুকারাশির ওপর দিয়ে অনেক দুর হাঁটল তারা। প্রভা তার চটি জোড়া আগেই তাহে তুলে নিয়েছে, পায়ে নীচে কোমল বালুকারাশির সুখস্পর্শ অনুভব করতে লাগল। দু’হাতে অশ্বঘোষের কটি বেষ্টন করে প্রভা বলল, “সরযু-সৈকতে এই বায়ুর স্পর্শ কি অপূর্ব, না প্রিয়তম?”

“হ্যাঁ, পায়ের নীচে বেশ চমৎকার সুড়সুড়ি দেয়!”

“এক অদ্ভুত অনুভতি না? রোমাঞ্চ লাগে যেন!”

“আমি কতবার ভেবেছি, আমরা দু’জনে পালিয়ে যাই! চলে যাই সেই দেশে যেখানে আমাদের প্রেমকে ঈর্ষা করার কেউ থাকবে না। যেখানে তুমি আমাকে প্রেরণা জোগাবে আর আমি রচনা করব সুন্দর গীত। তারপর বীণা বাজিয়ে সেই গীত এক সঙ্গে গাইব দু’জনে। এখানে এমন রাত্রে আমার বীণা তো সঙ্গে আনতে পারি না প্রভা, লোক জমে যাবে। আর তাদের মধ্যে হয়ত দেখব বহু ঈর্ষাকলষিত নয়ন!”

“মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, যদি আমি না থকি…”

প্রভাকে দৃঢ়ভাবে বুকে চেপে ধরে অশ্বঘোষ বলল, “ না না প্রিয়ে, কখনেই তা হতে পারে না, আমরা এমই এক সঙ্গে চিরদিন থাকব।”

“অন্য কিছু ভেবে আমি এ কথা বলছিলাম প্রিয়তম। ধর, তুমি মারা গেলে আমি একা হয়ে গেলাম। জগতে এ রকম ঘটনা ঘটে তো নিশ্চয়ই।”

“ঘটে!”

“তোমার মৃত্যুর কথায় তো অধীর হয়ে উঠলে না তুমি! তোমার অবর্তমানে আমার ওপরেই শুধু শোকের পাহাড় ভেঙ্গে পড়বে—এই ভেবে, না?”

“তুমি নিষ্ঠুর কথা শোনাচ্ছ কেন প্রভা!”

অশ্বঘোষের অধর চুম্বন করে প্রভা বলল, “জীবনে পূর্ণিমাই শুধু নয়, জীবনে অমানিশারও আগমন হয। আমি শুধু এইটুকুই বলতে চাইছিলাম, একের অবর্তমানে অপরের কর্তব্য কি। তুমি না থাকলে আমি কি করব জানো?”

মাথা নীচু করে দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে অশ্বঘোষ বলল,“বল।”

“নিজের জীবনকে কিছুতেই শেষ করে দেব না আমি। ভগবান বুদ্ধ আত্মহত্যাকে পাপপূর্ণ মূর্খের কাজ বলে অভিহিত করেছেন। তুমি তো দেখেছ, ইতিমধ্যেই বীণার ওপর কতটা দখল আামার এসে গেছে।”

“অনেকখানি প্রভা! কতবার তোমার হাতে বীণা ‍তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে গান গেয়েছি আমি।”

“হ্যাঁ, কোনোদিনি হয়ত নশ্বর অশ্বঘোষ বিলীন হয়ে যাবে আমার দৃষ্টি থেকে, কিন্তু আমি যুগ-যুগান্তরের অমর কবি অশ্বঘোষের আরাধানা করে চলব। তোমারই বীণায় তোমার রচিত গান গাইব। জীবনভোর গান গেয়ে ফিরব দেশে-বিদেশে, যতদিন না আমাদের যুগ্ম জীবনপ্রবাহ অন্য কোনো দেশকালে এসে সাকার-সম্মিলনের ভিতর দিয়ে প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমি না থাকলে তুমি কি করবে?”

কথাগুলো শুনে অশ্বঘোষের অন্তস্থল থেকে সুরু করে সারা দেহ কেঁপে উঠল খরখর করে, প্রভা অনুভব করল সে কম্পন। কথা বলবার চেষ্টা করল অশ্বঘোষ, কিন্তু কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেছে তার, চোখে জল। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর ক্ষীণকণ্ঠে বলল,“জীবনে এমন দিন সত্যই বড় সাংঘাতিক, কিন্তু আমিও আত্মহত্যা করব না প্রভা। তোমার প্রেমের প্রেরণা আমার হৃদয়ে যে গানের সঞ্চার করবে, তাই আমি গেয়ে চলব জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। আমি যে তোমারই অমর অশ্বঘোষ।”

“সরষুর-ধারা ঘুমিয়ে পড়েছে প্রিয়তম, চল আমরা এবারঘরে ফিরি।”

গ্রীষ্মকাল । মাতা সুবর্ণাক্ষী রোগে পড়লেন। অশ্বঘোষ দিনরাত মায়ের কাছে থাকে। দিনের বেলা প্রভাও থাকে। চিকিৎসায় কোনো ফল হল না, সুবর্ণাক্ষীর অবস্থা সস্কটজনক হয়ে উঠল। আর এক পূর্ণিমার রাত এসে গেল, রুপালী চাঁদের আলো ছড়িয়ে চারিদিকে। এই চাঁদের আলোতেই সুবর্ণাক্ষী ছাদের ওপর যেতে চাইলেন। তাঁর পালস্ক উঠল সেখানে। তাঁর কস্কালসার শরীর দেখে অশ্বঘোষের হৃদয় ব্যথায় ভরে উঠতে লাগল। ধীরে স্পষ্ট কণ্ঠে মা বললেন, “কি সুন্দর জ্যোৎস্না!”

অশ্বঘোষের কানে প্রভার কথা বেজে উঠল,‘সিরযুর তরঙ্গ-লহরী আমাকে ডাকছে।’বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল অশ্বঘোষের । মা আবার বললেন,“প্রভা কোথায় বাবা?”

“তাদের বাড়িতে মা, সন্ধ্যা পর্যন্ত তো এখানেই ছিল।”

“প্রভা !মা আমার !ওকে তুই কখনও ভুলিস না বাবা…..” কথা হবার আগেই একটা কাশির দমকে সুবর্ণাক্ষীর দেহ নিশ্চল হয়ে গেল। সুবর্ণাক্ষী গত হলেন। সুবর্ণাক্ষী পুত্রের বুক ফেটে হাহাকার উঠল। রাত দিন সমানে কাঁদল সে।

পরদিন মধ্যাহ্ন পর্যন্ত মায়ের দাহকর্মেই কেটে গেল। তারপর প্রভার কথা মনে পড়ল। সে দত্তমিত্রের বাড়িতে গেল। প্রভার মা-বাবা ভেবেছিলেন, সে অশ্বঘোষের কাছেই গেছে। গত রাত্রের আঘাতেই অশ্বঘোষের হৃদয় জর্জরিত হয়ে উঠেছিল, এখন  সে আরও অধরি হয়ে পড়ল। অশ্বগোষ প্রভার শয়নকক্ষে ঢুকল । সব জিনিসই ঠিকমতো সাজানো রয়েছে। শয্যার ওপর থেকে সাদা চাদরটা টেনে তুলল সে, সেখানে দেখতে পেল নিজের একখানা ছবি। ছবিখানা তৈরী করিয়েছিল প্রভা এক নবাগত যবন চিত্রকরকে দিয়ে। এই ছবির জন্য অনিচ্ছসত্ত্বেও অশ্বঘোষকে বহু সময় স্থির হয়ে বসে থাকতে হয়েছিল। ছবির ওপর একটি স্নান জুঁই ফুলের মালা । ছবির নীচে প্রভার মুদ্রাস্কিত তালপত্র-লেখ রয়েছে। অশ্বঘোষ চিঠিখানা তুলে নিল। সুতো ‍দিয়ে বাঁধা ছিল সেটা। সুতোর বাঁধুনি আটুকাবার জন্য যে কালো মাটি লাগানো হয়েছিল তা তখনও ভালো করে শুকোয়নি। সুতো কেটে চিঠি খুলতেই প্রভার সুন্দর হস্তাক্ষরে লম্বা পাতার ওপর লেখা পাঁচটি পংত্তি জলজল করে উঠল-

“প্রিয়তম, প্রভা বিদায় নিয়ে যাচ্ছে, সরষুর জলরাশি আমার ডাক দিয়েছে, তাই আমি চলেছি। আমার প্রেমের প্রতিদারে তুমি একটি প্রতিজ্ঞা করেছিলে মনে আছে?প্রভার চির-তারুণ্য, শাশ্বত সৌন্দর্য আমি রেখে যাচ্ছি তোমার কাছে। পাকাচুল, ভাঙাদাঁত লোলচর্ম প্রভাকে আর তোমায় দেখতে হবে না। আমার প্রেম, আমার এই অবিনশ্বর যৌবন তোমাকে প্রেরণা জুগিয়ে চলবে। এই প্রেরণাকে তুমি হেলায় নষ্ট কর না, প্রিয়তম। এ কথা ভেব না, আমি তোমার আত্নীয়-স্বজনের তিরস্কারের ভয়ে আম্নহত্যা করছি। শুধু তোমাকে কাব্য-প্রেরণা জোগাবার জন্যেই আমি এই পথে আমার অক্ষুন্ন যৌবনকে তোমার কাছে রেখে গেলাম। প্রিয়তম, প্রভা তার কল্পনায় তোমাকে শেষ আলিঙ্গন আর চুম্বন দিয়ে যাচ্ছে।”

বারে বারে চোখের জল মুছে চিঠিখানা পড়ল অশ্বঘোষ। শেষে চিঠিখানা তার হাত থেকে পড়ে গেল। খাটের ওপর বসে পড়ল সে। সব কিছুই যেন শূন্য হয়ে গেছে তার। তম্নয় হয়ে সে যেন হুদস্পন্দন স্তব্ধ হবার প্রতীক্ষা করতে লাগল। মর্মর মুতির মতো শূন্য দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রিইল। বহুক্ষণ পর প্রভার বাবা-মা ঘরে এসে ঢুকলেন। অশ্বঘোষের এই অবস্থা দেখে বড়ই শস্কিত হয়ে পড়লেন তাঁরা । তারপর চিঠিখানা তুলে পাঠ করলেন। প্রভার মা তীব্র আর্তনাত করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। দত্তমিত্রের চোখ থেকে নীরব অশ্রুধারা  নেমে এল। অশ্বঘোষ তাকিয়ে রইল তেমনি স্থির শূন্য দৃষ্টি মেলে। বহুক্ষণ পর্যন্ত তাকে এই অবস্থায় দেখার পর প্রভার মা-বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে  গেলেন । সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমে এল, অশ্বঘোষ বসে রয়েছে সেই একই অবস্থায়। চোখের  জল শুকিয়ে গেল। তার হৃদয়ের ভিতরটাও পাথর হয়ে গেছে যেন। এইভাবে বসে থাকতে থাকতে অনেক রাতে ঘুমিয়ে পড়ল সে।

সকলে প্রভার মা এসে দেখলেন , অশ্বঘোষ প্রকৃতিস্থ হয়ে কি যেন চিন্তা করছে বসে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “কেমন আছ?”

“সম্পুর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছি মা। প্রভা যে কাজ আমাকে  সঁপে দিয়ে গেছে এ বারে আমি তাই সম্পন্ন করব। আমি বুঝতাম না, কিন্তু প্রভা জানত , সে আমার কর্তব্য বলে দিয়ে গেছে।–আম্নহত্যা নয় মা, প্রভা আত্নদান করে গেছে। এ কথা ঠিকই যে, এই আত্নদানকে আমি আম্নহত্যা বলে প্রচার করতে পারি, কিন্তু এত অকৃতজ্ঞ আমি হতে পারব না।”

প্রভার মা তাকে উঠে দাঁড়াতে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, “কোথায় যাচ্ছ বাবা?”

“ভদন্ত ধর্মরক্ষিতের সঙ্গে দেখা করতে, আর সরধুকে দেখতেও বটে।”

“ভদন্ত ধর্মরক্ষিত নীচেই বসে আছেন । আর সরধু দেখতে আমিও যাব তোমার সঙ্গে।” কথা বলতে বলতে গলা ধরে গেল তাঁর

নীচে  গিয়ে ধর্মরক্ষিতকে পস্কপ্রতিষ্ঠিত হয়ে বন্দনা করে অশ্বঘোষ বলল, “ভদন্ত, এ-বারে আমাকে সঙ্গে গ্রহণ করুণ।”

“বৎস, তোমার শোক নিদারুণ।”

“শোকের তাড়নায় আমি বলছি না, প্রভা…..জম্ন্য আমাকে তৈরী করে গিয়েছে।”

“ত’হলেও তোমাকে কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে, সঙ্গ এত তাড়াতাড়ি তোমাকে গ্রহণ করবে না।”

“প্রতীক্ষা আমি করব ভদন্ত, কিন্তু সঙ্গের আশ্রয়ে থেকে।”

“প্রথমে তোমার পিতার কাছ থেকে সম্মতি আনতে হব। মাতা-পিতার সম্মতি ছাড়া সঙ্গ কাউকে ভিক্ষু হিসাবে গ্রহণ করে না।”

“তা’হলে আমি অনুমতি নিয়েই আসব।”

ঘর থেকে বেরিয়ে  এল অশ্বঘোষ। প্রভার মা তার সুস্থ মস্তিকের কথাবার্তা শোনার পরও শস্কিত হয়েই ছিলেন, তাই তিনিও পিছে পিছে এলেন । নৌকা করে সরযুর জলে সারা দিন দু;জনে খোঁজার পরও কোনো চিহ্ন পাওয়া গেল না প্রভার
। পরের দিন আরও এগিয়ে গিয়ে খোঁজ হল, কিন্তু কোথাও কিছু নেই।

বাড়ি গিয়ে অশ্বঘোষ পিতার কাছে ভিক্ষু হওয়ার জন্য অনুমতি চাইল, কিন্তু একমাত্র পুত্রকে কি করে  তিনি অনুমতি দেবেন এ পথে যাবার জন্য ! অশ্বঘোষ বলল, “মা আর প্রভার শোকে অস্থির হয়ে আমি এ পথ করতে ‍যাচ্ছি না বাবা। নিজের  জীবনে আমি যে কর্মধারা গ্রহণ করছি, এইট তার রাস্তা । তুমি দেখছ না আমার কন্ঠস্বরে, আমার আচরণে কোথাও চিত্তবিকারের এতটুকু লক্ষণ নেই। আমি আর একটা কথাই শুধু বলব-যদি আমাকে জীবিত দেখতে চাও তবে সম্মতি দাও পিতা।”

“কাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ভাববার সময় দাও……”

“আমি সাতদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে রাজী  পিতা ।”

পরের দিন চোখের জলে ভেসে  অশ্বঘোষকে ভিক্ষু হবার সম্মতি দিলেন তিনি।

সাকেতের আর্ষ সর্বান্তিবাদ সঙ্গ অশ্বঘোষকে ভিক্ষুরুপে গ্রহণ করল। মহাস্থবির ধর্মসেন হলেন অশ্বঘোষের উপাধ্যায় এবং ভদন্ত ধর্মরক্ষিত হলেন তার আচার্য । নৌকাযোগে ভদন্ত ধর্মরক্শিতের পাটলিপুত্র যাবার কথা ছিল , তাঁর সঙ্গে অশ্বঘোষও সাকেত ত্যাগ করল।

পাটলিপুত্রস্ত অশোকারামে (মঠ) ভিক্ষু অশ্বঘোষের দশ বছর কেটে গেল । ‘বৌদ্ধধর্ম, বৌদ্ধদর্শন এবং যবন-দর্শন সম্পকে গভীর অধ্যায়ন করল সে। মগধের মহাসঙ্গের বিদ্বান মশুলীতে অশ্বঘোষের স্থান ছিল অনেক উঁচুতে । এই সময় পশ্চিম থেকে শক সম্রাট কণিক পূর্বাষ্ণল জয় করবার জন্য পাটলিপুত্রে এসে উপস্থিত হল। পাটলিপুত্র এবং মগধ এই সময় বৌদ্ধধর্মের প্রধান কেন্দ্র ছিল্ বৌদ্ধধর্মের প্রতি কণিকের ছিল প্রগাঢ় শ্রদ্ধা। গাদ্দারে নিয়ে যাবার জন্য ভিক্ষুসঙ্ঘ থেকে একজন বিদ্ধান ব্যক্তিকে চেয়ে পাঠাল কণিক। সঙ্ঘ অশ্বঘোষকে পাঠিয়ে দিল।

রাজধানী পুরুষপুর (পেশোয়ার) গিয়ে অশ্বঘোষ দেখল, সেখানে শক, যবন, তুসস্ক, পারশী তথা ভারতীয় সংস্কৃতির একত্র সমাবেশ। যবন নাট্যকলাকে অশ্বঘোষ আগেই ভারতীয় সাহিত্যে স্থান দিয়েছিল। যবন-দর্শনের গভীর অনুশীলনের পর, তার বহু বিশেষত্ব, বিশ্লেষণ-শৈলী এবং অনুকূল তত্ত্বসমূহকে নিয়ে ভারতীয় দর্শন, বিশেষ করে বৌদ্ধদর্শনকে সে সমৃদ্ধ করে তোলে। বৌদ্ধদের যবন-দর্শন গ্রহণ করবার পথও প্রশন্ত করে দেয় অশ্বঘোষ। তার পরে অপরাপর ভারতীয় দার্শনিকেরাও এই চেষ্টা করেছে এবং বৈশেষিক আর ন্যায়ের পথে সকলের আগে আগে চলেছে। পরমাণু , সামান্য দ্রব্যগুণ, অবয়বী ইত্যাদি তত্ত্ব এরা যবনদের নিকট থেকেই গ্রহণ করেছে।

অশ্বঘোষের হৃদয়কে বিশাল করে দিয়েছিল প্রভা, কাজেই তার কাছে আম্নপর ভেদ ছিল না।  প্রভার প্রেরণায় সে বহু কাব্য আর নাটক লেখে। তার অনেক কিছুই আজ লুপ্ত হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও প্রকৃতি তার প্রতি অত্যন্ত প্রসন্ন ছিল, তাই উনিশ শত বছর পরে মধ্য এশিযার মহাবালুাকরাশি গোবী অশ্বঘোষের ‘সারিপুত্ত’প্রকরণকে (নাটক) মানুষের হাতে তুলে  দেয় [জর্মন ভারত-তাত্ত্বিক অধ্যাপক লুডার্স ১৯১১ খৃষ্টব্দে সারিপুত্ত প্রকরণ নাটকের তালপত্রে  লিখিত খন্ডিত পুতি আবিষ্কার করেন]। অশ্বঘোষের ‘বুদ্দ-চরিত্র;আর‘সৌন্দরান্দ’দুই অমর কাব্য।

প্রভার কাছে যে প্রতিজ্ঞা করেছিল তাকে যথাযথভাবেই পালন করেছিল সে এবং প্রভার অম্লান সৌন্দর্যরাশি তার কাব্যকে সুন্দরতম করে তুলেছিল। জম্মভূমি সাকেত এবং মাতা সুবর্ণাক্ষীকে কখনও সে বিষ্মত হয়নি। আপন গ্রস্থসমূহে সর্বদাই নিজের নাম লিখত ‘সাকেতবাসী আর্ষ-সুবর্নাক্ষী পুত্র অশ্বঘোষ’।

আমার ভাগ্যচক্ত যেন কেমন! কখনও এক জায়গায় স্থির থাকতে পারিনি। সংসার মরঙ্গ আমাকে সর্বদা চষ্ণল এবং বিহবল করে রেখেছে। জীবনে মধুর দিনও এসেছে যদিও তিক্ত দিনগুলোর তুলনায় সংখ্যায় কম আর পরিবর্তন তো যেন বর্ষাশেষে বাদলা দিনের মতো, বৃষ্টি আর রৌদ্রে লুকোচুরি । জানি না, এই পরিবর্তনের চক্ত কেন ঘুরছে।

পশ্চিম উত্তরাপথ গাদ্ধারে এখনও মধুপর্কে বাছুরের মাংস দেওয়া হয়। কিন্তু মধ্যদেশে (উত্তপ্রদেশ, বিহার) গোমাংসের নাম করা পাপ, এখানে গো-ব্রাক্ষণ রক্ষা করাই শ্রেষ্ট ধর্ম। আমি বুঝে উঠতে পারি না, একই ধর্মে এত বৈপরীত্য কেন! এক জায়গার অধর্ম কি অপর জায়গায় ধর্ম রুপে চলতে থাকবে; অথবা এক জায়গার পরিবর্তন আগে সাধিত হয়েছে, অন্যত্র পরে তার অনুকরণ করবে?

অবন্তীর (মালবা) এক গ্রামে ক্ষিপ্রা নদীতটে আমি জম্মগ্রহণ করেছি। আমার কুলের লোকের নিজেদের পরিব্রাজক বলে, যদিও এদের আপন ক্ষেত-খামার , ঘর-বাড়ি বয়ে গেছে এবং সেগুলো আপন স্বন্ধে বহন করে স্থানান্তরে নিয়ে যাওয়া চলে না । আমাদের কুলের লোকেদের দেহের গড়ন এবং রঙ ও রুপ গ্রামের অন্যান্য লোকজন থেকে কিছুটা পৃথক। আমরা অধিকতর দীর্ঘ, গৌর এবং সেই সঙ্গে আমাদের উৎকর্ষ অন্যদের কাছে ছিল অসহ্য।

১২. সুপর্ণ যৌধেয় (কাল : ৪২০ খৃষ্টাব্দ)

আমার ভাগ্যচক্ত যেন কেমন! কখনও এক জায়গায় স্থির থাকতে পারিনি। সংসার মরঙ্গ আমাকে সর্বদা চষ্ণল এবং বিহবল করে রেখেছে। জীবনে মধুর দিনও এসেছে যদিও তিক্ত দিনগুলোর তুলনায় সংখ্যায় কম আর পরিবর্তন তো যেন বর্ষাশেষে বাদলা দিনের মতো, বৃষ্টি আর রৌদ্রে লুকোচুরি । জানি না, এই পরিবর্তনের চক্ত কেন ঘুরছে।

পশ্চিম উত্তরাপথ গাদ্ধারে এখনও মধুপর্কে বাছুরের মাংস দেওয়া হয়। কিন্তু মধ্যদেশে (উত্তপ্রদেশ, বিহার) গোমাংসের নাম করা পাপ, এখানে গো-ব্রাক্ষণ রক্ষা করাই শ্রেষ্ট ধর্ম। আমি বুঝে উঠতে পারি না, একই ধর্মে এত বৈপরীত্য কেন! এক জায়গার অধর্ম কি অপর জায়গায় ধর্ম রুপে চলতে থাকবে; অথবা এক জায়গার পরিবর্তন আগে সাধিত হয়েছে, অন্যত্র পরে তার অনুকরণ করবে?

অবন্তীর (মালবা) এক গ্রামে ক্ষিপ্রা নদীতটে আমি জম্মগ্রহণ করেছি। আমার কুলের লোকের নিজেদের পরিব্রাজক বলে, যদিও এদের আপন ক্ষেত-খামার , ঘর-বাড়ি বয়ে গেছে এবং সেগুলো আপন স্বন্ধে বহন করে স্থানান্তরে নিয়ে যাওয়া চলে না । আমাদের কুলের লোকেদের দেহের গড়ন এবং রঙ ও রুপ গ্রামের অন্যান্য লোকজন থেকে কিছুটা পৃথক। আমরা অধিকতর দীর্ঘ, গৌর এবং সেই সঙ্গে আমাদের উৎকর্ষ অন্যদের কাছে ছিল অসহ্য। আমার মা গ্রামের স্ত্রীলোকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠা সুন্দরী ছিলেন, তাঁর সুগৌর মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে-পড়া বাদামী চুলে—বড়ই সুন্দর লাগত। আমাদের পরিবারের লোক নিজেদের ব্রাহ্মণ বলত,কিন্তু আমি লক্ষ্য করতাম গ্রামের লোকের তাতে সন্দেহ রয়ে গেছে। সন্দেহের কারণও ছিল্ এইস্থানে ব্রাহ্মণদের ভিতর সুরাপান মহাপাপ বলে গণ্য হত, কিন্তু আমাদের গ্রহে তা বরাবর তৈরী হত িএবং পান করা হত। উচ্চকুলে স্ত্রী-পুরুষের সম্মিলিত নাচ-গান এখানে অশ্রুতপূর্ব, কিন্তু আমাদের কুলের সাতটি পরিবার—যারা একই বংশজাত, সন্ধ্যা হলেই খোলা জায়গায় এক সঙ্গে মিলিত হতাম। শৈশবে আমি ভাবতাম, সকল জায়গাতেই এই একই নিয়ম,কিন্তু গ্রামের অন্যান্য বালকদের সঙ্গে খেলতে গিয়ে তাদের বিদ্রুপ বাক্যে বুঝতে পারলাম যে, তারা আমাদের অদ্ভুত ধরনের মানুষ বলে মনে করে এবং আমাদের কৌশীদ্যকে স্বীকার করলেও ব্রাহ্মণত্বকে সন্দেহ করে। আমাদের গ্রামখানা বেশ বড়, দোকান এবং ব্যবসায়ীদের বাড়িঘরও ছিল। গ্রামে কিছু নাগর পরিবার ছিল, লোকে তাদের বেনে বলত, কিন্তু তারা আমাদের মতোই নিজেদের ব্রাহ্মণ বলত। কিছু নাগর-কন্যা বিবাহসুত্রে আমাদের কুলে এসেছিল, গ্রামের লোকদের আমাদের ব্রাহ্মণ বলে স্বীকার না করবার এটাও একটা কারণ। তাদের ব্ক্তব্য, ব্রাহ্মণের পান-ভোজন-বিবাহ রীতি অবহেরা করে আমরা কি করে ব্রাহ্মণ থাকতে পারি? আমার খেলার সাথী ছেলেদের যদি কখনও আমার ওপর রাগ হত তবে আমাকে ‘জুঝওয়া’ বলে অবজ্ঞায় নাক সিঁটকাত। এ সম্বন্ধে মাকে আমি অনেকবার প্রশ্ন করেছি, কিন্তু তিনি আমার প্রশ্নকে বরাবর এড়িয়ে গিয়েছেন।

দশ বছর বয়স হল আমার, গ্রামের েএক ব্রাহ্মণ গুরুর পাঠশালায় পড়তে যেতে লাগলাম। আমার সহপাঠীরা প্রায় সকলেই ব্রাহ্মণ—লোকের কথা অনুসারে সকলেই খাঁটি ব্রাহ্মণ। এরা ছাড়া আমি এবং অপর দুই নাগর বিদ্যার্থী ছিলাম। সহপাঠীরা আমাদের আধা-ব্রাহ্মণ বলে ডাকত। বিদ্যার্থীগণের মধ্যে আামি সবচেয়ে তীক্ষুধী ছিলাম এবং আমার প্রতি গুরুর বিশেষ স্নেহ ছিল। আামদের কুলে স্বভাব আমার মধ্যেও ছিল, এবং কারও কথা সহ্য না করে  তার সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করতাম। একদিন আমার এক সহপাঠী বিদ্রুপ করে বলল, “ব্রাহ্মণ হয়েছে, জুঝওয়া কোথাকার!” আমার কাকার  বাল্যকপুত্র আমার পক্ষ নিতে এসেছিল, তাকেও বলল,“যবন কোথাকার, নাগর ব্রাহ্মণ হয়েছে!” শৈশবে ছোট ছেলেদের এমনি খোঁটা দিতে শুনেছি, কিন্তু তখনও সে সব আমাকে  এত তীব্রভাবে আঘাত করেনি, অথবা ওতে এত কিছু ভাববারও অবকাশ হয়নি! আমরা তিনজন ছাড়া পাঠশালায় আরও ত্রিশজন বিদ্যার্থী এবং চারজন বিদ্যাথিণীও ছিল। এরা দেখতে আমাদের মতো ফর্সা বা দীর্ঘকায় নয়, তবু তারা এমন ভাব দেখাত যেন আমরা তাদের তুলনায় নিন্মশ্রেণীর মানুষ!

সেদিন ঘরে ফিরে এলে আমাকে বড়ই বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। আমার শুষ্ক অধর দেখে মা আমার মুখ-চুম্বন করে বললেন, “আজ এত বিমর্গকেন তুই?”

মা অত্যন্ত আগ্রহ প্রকাশ করাতে আমি বললাম, “মা, আমাদের কুলে কি এমন দোষ আছে , যে জন্য লোকে আমাদের ব্রাহ্মণ বলে স্বীকার করতে চায় না?”

“পুত্র, আমরা পরদেশী  ব্রাহ্মণ, এ জন্য তারা এ রকম ভাবে।”

“শুধু বাহ্মণ নয় মা, অব্রাহ্মণেরাও আমাদের ব্রাহ্মণত্বে সন্দেহ প্রকাশ করে।”

“ব্রাহ্মণেরা বলে বলেই অন্যরাও বলে।”

“আামাদের যজমানীও নেই; অন্র ব্রাহ্মণেরা পুরোহিতগিরি করে, ব্রাহ্মণ-ভোজনে যায়, আমাদের কুলে তাও দেখা যায় না। এ ছাড়া অন্য ব্রাহ্মণেরা তো আমাদের সঙ্গে পংক্তি ভোজনেও সম্মত হয় না। যদি এর কারণ জানো তবে বল মা।”

মা আমাকে অনেক বোঝাল কিনউত আমি সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। আমার চিত্ত যখন চঞ্চল, সে সময় আমার নাগর সহপাঠী এবং আত্মীয়দের আামার প্রতি সহানুভূতি ছিল। অথবা বলা যায়, আমরা পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলাম।

আরও কিছুকাল অতিবাহিত হল। আমি তের বছরের হয়ে উঠলাম এবং পাঠশালার শিক্ষা প্রায় সমাপ্ত হয়ে এল। বেদ, ঋগ্বেদ, ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, ব্যাকরণ, নিরুক্ত এবং কিছু কাব্যও আমি পড়েছিলাম। আমার প্রতি গুরুদেবের স্নেহ ক্রমশ বেড়েই চলেছিল। তাঁর কন্যা বিদ্যা আমার চেয়ে বয়সে ছোট ছিল। পাঠ মুখস্থ করতে আমি তাকে সাহায্য করতাম। গুরুদেব এবং গুরুপত্বীর ব্যবহার দেখে বিদ্যাও আমাকে খুব মান্য করত, আমাকে “ভাই-সুর্পণ’ বলে ডাকত। গুরু পরিবারে আমার কখনও দুঃসময় আসেনি, কারণ গুরুপত্নীর স্নেহ আমার কাছে মায়ের সমানই ছিল।

এই সময়ে আবার একদিন এক সহপাঠী আমাকে “জুঝওয়া’ বলে বিদ্রুপ করল সম্পূর্ণ অকারণেই। নিজেকে আমি তখন সকল দিক থেকে দুরে সরিয়ে রেখেছিলাম। লেখা-পড়ায় আমি অত্যন্ত তীক্ষ্ণধী ছিলাম বলে সহপাঠীদের ঈর্ষা হত, এ ছাড়া বিদ্রুপের আর কোনো কারণ ছিল না। আমার প্রকৃতি গম্ভীর হয়ে উঠেছিল। মন যে উত্তেজিত হত না, তা নয় কিন্তু আমি ধীরে ধীরে নিজেকে সংযত করতে শিখেছিলাম। আমার ঠাকুর্দার বয়স সত্তর বছরের ওপর। বহুবার আমি তাঁর কাছে দেশ-বিদেশের যুদ্ধ-অশান্তির কাহিনী শুনেছি। এত্ত শুনেছিলাম যে, তিনিই প্রথমে, আপন ভাই-এর সঙ্গে এই গ্রামে আসেন। ঠাকুর্দার কাছ থেকে আপন কুল সম্বন্ধে আসল কথা জানতে আমি দৃঢ়সঙ্কল্প হলাম।

গ্রামের পূর্বদিকে আমাদের আমবাগান ছিল। যথেষ্ট আম ফলেছিল সেখানে, যদিও পাকতে তখনও দেরী। সোনাদাসী ইতিমধ্যেই সেখানে নিজের ডেরা উঠিয়ে নিয়ে গেছে। শুনেছি, আমার ঠাকুর্দা যখন গ্রামে এলেন তকন সোনাকে তিনি কোনো দক্ষিণদেশীয় ব্যাপারীর কাছ থেকে চল্লিশ রৌপ্য মুদ্রা দিয়ে কিনেছিলেন। ঐ সময় দক্ষিণ-দেশ থেকে বহু ব্যবসায়ী বিক্রয় করবার উদ্দেশ্য দাস-দাসীদের সঙ্গে করে নিয়ে আসত। সোনা তখন যুবতী চিল, না হলে দাসীরা কখনেই অত মহার্ঘ হয় না। সোনার দেহের কালো চামড়া ঢিলে হয়ে পড়েছিল, মুখমণ্ডল কুঞ্চিত বলিরেখায় ভরে গিয়েছিল, কিন্তু লোকে বলে, একদিন সে সুন্দরী ছিল। সে ছিল ঠাকুর্দার অ্যন্ত প্রিয়পাত্রী; বিশেষ করে যখন নিরালয় শুধু দু’জনে একত্রে থাকত। লোকে অবশ্য এই ঘনিষ্ঠতার অন্য অর্থ করত। বিপত্নীক স্বাস্থ্যবান এক প্রৌঢ় ব্যক্তির ওপর সে সন্দেহ খুবই স্বাভাবিক। সন্ধ্যাবেলা ঠাকুর্দা বাগানে যেতেন, একদিন আমিও তাঁর সঙ্গে গেলাম। ঠাকুর্দা আপন মেধাবী পৌত্রকে বড়ই স্নেহ করতেন। কথা বলতে বলতে আমি এক সময় বললাম, “দাদু, আমি তোমার কাছ থেকে আমাদের কুল সম্বন্ধে সত্যি কথা জানতে চাই, কেন লোকে আমাদের খাঁটি ব্রাহ্মণ বলে স্বীকার করে না, কেন‘জুঝওয়া’ বলে বিদ্রুপ করে? মাকে আমি কতবার জিজ্ঞাসা করেছি, কিন্তু তিনি আমাকে এ সম্বন্ধে কিছুই বলতে চান না।”

“এ কথা তুমি কেন জিজ্ঞেস করছ ভাই?”

“বিশেষ প্রয়োজন আছে দাদু। যদি আমি আসল কথা সঠিকভাবে জানতে পারি, তবে নিজ কুলেয়  অপমানের প্রতিকার করতে পারব। ব্রাহ্মণদের সম্বন্ধে আমি এখন অনেক কিছু পড়ে ফেলেছি দাদু। আমার এতখানি বিদ্যাবল আছে যে, নিজের কুল সম্মান আমি অক্ষুণ্ণ রাখতে পারব।”

“সে কথা আমি ও বিশ্বাস করি। কিন্তু ভাই, তোমার মা বেচারীও আামার কুল সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানে না। কাজেই, সে যে কিছু বলতে চায় না—এমন ভেব না। পৃথিবীতে আমাদের কুলের স্থিতি এখন নাগদত্তের সঙ্গে সম্বন্ধসুত্রে আবদ্ধ। আমাদের বিবাহ ইত্যাদি ওদের সঙ্গেই হয়। অবন্তী এবং লাট-এ (গুজরাট) ওদের সংখ্যাও অনেক, এ জন্য ওদের সঙ্গেই আামদের ডুবতে-ভাসতে হয়। তোমার বংশ যৌধেয় অপেক্ষা নাগরদের সঙ্গেই অধিক সম্পর্কিত।”

“যৌধেয় কি দাদু?”

“আমাদের কুলের নাম ভাই। এই জন্যেই লোকে আমাদের ‘জুঝওয়া’ বলে।”

“যৌধেয়রা কি ব্রাহ্মণ ছিল না দাদু?”

“ব্রাহ্মণের চেয়েও শুদ্ধ আর্য ছিল।”

“কিন্তু ব্রাহ্মণ তো নয়!”

“এর উত্তরে এক কথায় ‘হ্যাঁ’  কি ‘না’ বলার চেয়ে তোমাকে যৌধেয়দের সম্পূর্ণ পরিচয় দেওয়াই ভাল। যৌধেয়রা শতদ্রু এবং যমুনার মধ্যবর্তী হিমালয় থেকে মরুভূমি পর্যণ্ত বিস্তৃত অঞ্চলের অধিবাসি এবং সমগ্র যৌধেয় পরিবারই এই অঞ্চলের অধিকারী ছিল।”

“সমগ্র যৌধেয় পরিবার?”

“হ্যাঁ, তাদের কোনো একজন রাজা ছিল না, তাদের রাজ্যকে গণরাজ্য বলা হত। গণ বা পঞ্চায়েতই সকল রাজকার্য চালাত। তারা এক রাজার শাসনাধীন রাজত্বের অত্যন্ত বিরোধী ছিল।”

“এমন-রাঝ্যের কথা তো কোনোদিন শুনিনি দাদু?”

“কিন্তু এমন দেশই ছির ভাই। আমার কাছে যৌধেয় গণরাজ্যের তিনটি মুদ্রা আছে, আমার বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলাম। দেশ ছেড়ে আাসবার সময় তাঁর সঙ্গে যে মুদ্রা ছিল, এগুলো তারই এক অংশ।”

“তুমি যৌধেয়দের দেশেই জন্মছিলে দাদু?”

“আমার বাবা-মাকে যখন দেশ ছাড়তে হল, আমি তখন দশ বছরের। আমার দু’জন বড় ভাই ও ছিল, যাদের বংশধরদের তু্মি এখানে দেখছ।”

“দেশ কেন ছাড়তে হল দাদু?”

“পুরকার থেকে ও জায়গা যৌধেয়দেরই ছিল। বহু প্রতাপশালী রাজা-মৌর্ষ, যবন, কেউেই রাজকর আদায় করা ছাড়া আমাদের গণরাজ্যকে কোনো আঘাত করেনি। চন্দ্রগুপ্ত, যিনি নিজেকে বিক্রমাদিত্য বলেন, এবং উজ্জয়িনীতে যাঁর দরবার বসে, সেই চন্দ্রগুপ্তের পূর্বপুরুষ যখন সিংহাসনে বসল, তখন তারা যৌধেয়দের উচ্ছেদ করল। যৌধেয়রা প্রতাপশালী সম্রাটকে কিছু কর দিত, কিন্তু সম্রাট তাতে খুশী হলেন না। তিনি বললেন, ‘আমি এখানে উপরিক (গর্ভনর) নিযুক্ত করব। এখানে আমার নিজের কুমারমাত্য (কমিশনার) থাকবে। আমি আমার সমগ্র রাজ্য যেভাবে শাসন করি, এখানেও তেমনি করব। আমাদের গণ-নায়কগণ অনেক করে বোঝাল যে,  যৌধেয়রা অনাদিকাল থেকে গণ-শাসন ছাড়া অপর কোনো-শাসন জানে না; কিন্তু  ক্ষমতামদমত্ত রাজা সে কথা মানে কেন? অবশেষে যৌধয়রা আপন ইষ্ট গণদেবীর সামনে শপথ গ্রহণ করে তরবারি ধরল। বহুবার তারা গুপ্ত-সেনানীকে মেরে হঠিয়ে দিল । যৌধেয়দের তুলনায় চার-পাচঁ গুণ বেশী সৈন্যনিয়েও গুপ্তসেনানীরাটি কতে পারত না। বিন্তু ব্রক্ষপুত্র থেকে মরু অষ্ণল পর্যন্ত বিস্তৃত সাম্রাজ্যের সমগ্র সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্দে যৌধেয়রা কতক্ষণ আপনাদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখতে পারে? গুপ্তদের সৈন্যেরা আমাদের শহর-গ্রাম সমস্ত ধ্বংস করে ‍ুদল, নারীদের নৃশংসভাবে হত্যা করল। আমাদের লোকেরা ত্রিশ বছর পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়েছিল। বেশী রে দিতেও তারা প্রস্তুত ছিল, কিন্তু চেয়েছিল, তাদের গণ-শাসন ব্যবস্থা যেন অক্ষুণ্ণ থাকে।”

“সৈন্য গণ-শাসন কেমন ছির দাদু?”

“সেই শাসনে প্রত্যেকটি যৌধেয় মাথা উঁচু করে চলত, কারও সমানে দীনতা প্রকাশ করতে তারা জানত না। যুদ্ধ তাদের কাছে একটা খেলাবিশেষ ছিল। এই জন্যই তাদের বংশের নাম যৌধেয় হয়েছে!”

“আমাদের মতো আরও কোনো যৌধেয় পরিবার এমনি রয়ে যায়নি?”

“হ্যাঁ আছে-হাওয়ায় উড়ে-যাওয়া শুকনো পাতার মতো ছড়িয়ে।”

“আর আমাদের মতো কেউ নাগর-বংশের সঙ্গে মিলে-মিশে আত্নবিস্থত হয়ে পড়েনি? তা’ছাড়া আমরা নিজদের ব্রাক্ষণ বলি কেন দাদু?”

“সে আরও প্রাচীন কথা ভাই। প্রথমে সর্বত্রই গণরাজ্য ছিল-রাজা বলে কিছুই ছিল না। সে সময় ব্রাক্ষণ আর ক্ষত্রিয়ের মাঝে কোনো প্রভেদ ছিল না।”

“ব্রক্ষ-ক্ষত্র একই বর্ণ ছিল দাদু?”

“হ্যাঁ, যখন প্রয়োজন হত লোকে পূজা-পাঠ করত, এবং প্রয়োজন মতো অস্ত্র ধরত। কিন্তু পরে বিশ্বামিত্র, বশিষ্ঠ এরা এসে বর্ণবিভাগ সুরু করল।”

“ঠিক কথা, তাই তো এক পিতার দুই পুত্রের মধ্যে কেউ রন্তিদেবের মতো ক্ষত্রিয়, কেউ গৌরিথীতির মতো ব্রাক্ষণ ঋষি হতে লাগলেন।”এমন কথা কোথাও কউ ‍লিখেছে ভাই?”

“হ্যাঁ দাদু, বেদ এবং ইতিহাসে এমন কথা পাওয়া যায়। সংকৃতি ঋষির ঐ দুই পুত্র ছিল। এরও কত বিচিত্র কথা পুরাণে পাওয়া যায়, যে সব কথা আজকালকার লোকে বিশ্বাস করে না। চর্মবতীর (চম্বল) তীরে দশপুর দেখেছ দাদু?”

“হ্যাঁ, অবন্তী (মালবা )কতবার গিয়েছি; ওখানেই তো?সেখানে আত্নীয়-স্বজনের বিয়ে উপলক্ষে কতবার না আমি গিয়েছি। ওখানে অনেক ঘর নাগর আছে, আর তাদের ভিতর অনেক বড় বড় ব্যবসায়ী আছে!”

“এই দশপুর রস্তিদেবের রাজধানী ছিল। আর চর্মণবতী নাম কি করে হল সে এক আশ্চর্য কাহিনী। ব্রাক্ষণ সংকৃতির পুত্র, কিন্তু নিজে ক্ষত্রিয় রাজা রস্তিদেব  অতিথিসেবার জন্য খুব প্রসিদ্ধ ছিল। সত্যযুগের ষোলো জন মহান রাজার মধ্যে একজন। রস্তিদেবের ভোজনশালার জন্য প্রতিদিন দু’হাজার করে গরু মারা হত। তাদের চামড়া রসুইখানায় রাখা হত। তা থেকে যে রস গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ত তাতে এক নদীর সৃষ্টি হয়। চর্ম থেকে উৎপত্তি বলে তার নাম চর্মণবতী।”

“বৎস, এ সব কি সত্যিই পুরাণে লেখা আছে?”

“হ্যাঁ দাদু, মহাভারতে পরিষ্কার লেখা আচে?”

“মহাভারতে ,অর্থাৎ পষ্ণম বেদে? গোমাংস ভক্ষণ!”

“রস্তিদেবের ওখানে অতিথিদের খাওয়ার জন্য এই গোমাংস রন্ধনের কজে দু’হাজার পাচক নিযুক্ত ছিল। সেই সঙ্গে ব্রাক্ষণ অতিথিদের সংখ্যাও এত বেড়ে উঠতে যে, মাংস কম পড়ে যাওয়ার বয়ে পাচকরা, মাংসের বদলে ঝোল বেশী করে নেবার অনুরোধ জানাত। মহাভারতেই আছে-

তত্র ম্ম সৃদাঃ ক্রাশান্তি সুমৃষ্টমণিকুলা
সৃপং ভৃয়িষ্ঠমশ্লীধ্বং নাদ্য মাংসং ‍যথা পুরা”

ব্রাক্ষণেরা গোমাংস খেত, কি বলছ ভাই?”

“মহাভারত হচ্ছে পষ্ণম বেদ-তাতে কি মিথ্যা লেখা হতে পারে দাদু!”

“দুনিয়া কি এত ওলোট-পালোট হয়ে গেল?”

“উল্টে-পাল্টেই যায় দাদু, তবু নিজেদের খাঁটি ব্রাক্ষণ বলা এই সব দিবান্ধরা সকলের চোখেই ধুলো দিতে চায়। আমি ্কন বুঝতে পেরেছি যে, আমাদের পূর্বজ যৌধেয়রা ব্রাক্ষণদের এই ছলাকৌশল ছড়াবার আগের যুগের ধর্ম এবং রীতিনীতি মেনে চলত।”

“হ্যাঁ, আর তারা কখনও ব্রাক্ষণকে নিজেদের চেয়ে উঁচু মনে করত না।”

“এখানে এসে তুমি পুত্র-ভ্রাত্বষ্পত্রের বিয়ে মাননীয় ব্রাক্ষণদের ছেড়ে নাগবদের সঙ্গে দিলে কেন?”

“দুটো কারণ ছিল। এক তো এই সব ব্রাক্ষণেরা আমাদের কুল সম্বন্ধে সন্দেহ করত; কিন্তু তাতে অবশ্য কিছু যেত-আসত না ইচ্ছে করলে আমরা খাঁটি ব্রাক্ষণ কন্যাকেই বিবাহ করতে পারতাম। নাগরদের সঙ্গে আমরা এই জন্যেই বিবাহস্বত্রে আবদ্ধ হলাম

*রাজ্ঞো মহানসে পূর্ব রস্তিদেবস্য বৈ দ্বিজ           মহানদী চমারাশরুৎক্লেদাত সংস্বজে যতঃ
অহন্যতনি বধোতে দ্বে সহস্রে গবাং তথা             ততশ্চর্ম দ্বতীত্যেবং বিখ্যাতা সা মহানদী”

“কিন্তু উত্তরাপথ (পাজ্ঞাব) এবং কাশ্মীরে এখনও হনেরা আছে, আচার্ষ!”

“বহূ ।ষ্ণল থেকেই তারা বিতাড়িত হয়েছে।”

“এমনিভাবেই ্ক রাজা অপরকে বিতাড়িত করে নিজ রাজ্য বিস্তৃত করে ।”

“কিন্তু গুপ্তবংশ গো-ব্রাক্ষণের রক্ষক।”

“আচার্য, মুঢ় ব্যক্তিদের ধোঁকা দেবার মতো এই সব কথা আমি আপনার মুখ থেকে শুনব আশা করি না। আপনি জানেন, আমাদের পুর্বজ ঋষিরা গো-রক্ষা করতেন গো-ভক্ষনের জন্য। ‘মেঘদুত’-এ আপনিই চর্মণবতীকে গো-হত্যা থেকে উদ্ভৃত রন্তিদেবের কীর্তি বলে বর্ণনা করেছেন-

“ব্যালম্বেথাঃসুরভিতনয়ালস্তজাং মানয়িষ্যন
স্রোতোমুর্ত্তা ডুবি পরিণতাং রস্তিদেবন্য কীর্তিম”

“তুমি ধুষ্ট সুপর্শ, যদিও তুমি আমার প্রিয় শিষ্য “

“আপনার তিরস্কার শুনতে আমি প্রস্তুত, কিন্তু আমি এটা সহ্য করতে রাজী নই যে আমার গুরু গণতন্ত্র হত্যাকারী গুপ্তরাজার সামনে চাটুকারের মতো পড়ে থাকবেন।”

“তুমি ওদের গণতন্ত্র-হত্যাকারী বলছ কেন সুপর্শ?”

“হ্যাঁ নন্দ, মৌর্ষ, শক আর হুনেরাও যে পাপ করেনি এই গুপ্তরা তাও করেছে। ভারতভুমি থেকে এরা, গণ-রাজ্যের নাম মুছে ‍দিয়েছে।”

“গণ-রাজ্য এ যুগের অনুকূল নয় সুপর্ণ। যদি সমুদ্রগুপ্ত এইসব গণ-রাজ্যকে কায়েম রাখতেন, তবে তিনি হুন এবং অপরাপর প্রবল শত্রুদের পরাস্ত করতে পারতেন না।”

“সফলতা! নিজ রাজ্য কায়েম করবার! ‍দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ম্যের্য হবার! কিন্তু চাণক্যের বিশ্ববিশ্রুত বুদ্ধির সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত মেীর্য –সাম্রাজ্যও বেশী দিন টেকেনি। বিক্রমাদিত্য আর কুমাগুপ্তও যাবৎচন্দ্রদিবাকর শাসন করবে না। কিন্তু এরা যে গণ-শাসনের চিহ্ন পর্যন্ত মুছে দিয়েছে তা কোন ধর্মকর্মের জন্য? অনাদিকাল থেকে চলে আসা গণ-রাজ্যের গণ-শাসনকে উচ্ছেদ করা কি অধর্মের কাজ নয়?”

“কিন্তু রাজা বিষ্ণুর অংশবিশেষ।”

“কুমার গুপ্ত নিজের সঙ্গে ময়ুরের চিত্র অস্কিত করবে এবং আগামী দিনের কোনো কবি তাকে কুমারের অবতার বলবে। এই ধোকাবাজী, এই বিকৃতি কিসের জন্যে? সুস্বাদু, দুগ্নধ চাল, আর মধুর মাংসসৃপের জন্যে, রাষ্ট্রের সমস্ত সুন্দরীকে আপন প্রমোদপুরে ঢুকাবার জন্যে, কৃষি আর শিল্পকর্মে নিষ্পেষিত মানুষের কষ্টোপার্জিত অর্থ আপন ভোগসুখে জলের মতো খরচ করবার জন্যে? আর এ জন্য আপনি গুপ্তদের ধর্ম-সংস্থাপক বলছেন!বিষ্ণু? হ্যাঁ, গুপ্তরা নিজেদের বৈষ্ণব বলে প্রচার করছে। ব্রাক্ষণেরা তাদের বিষ্ণুর অংশ বানাচ্ছে। মুদ্রার ওপর লক্ষীর মুর্তি অস্কিত করা হচ্ছে। বিষ্ণুর মুর্তি আর মন্দির তৈরীর জন্যে প্রজাদের তাতে মেরে, তাদের সর্বস্ব লুট করে প্রচুর টাকা খরচ করা হচ্ছে এই আশায় যে, গুপ্তবংশের রাজ্বত্ত অন্তকাল ধরে কয়েম থাকবে।”

“এ সব তুমি কি বলছ সুপর্শ! রাজার বিরুদ্ধে এত কঠোর কথা কেন বলছ?”

“হ্যাঁ আচার্য আজ আপনার সামনে বলছি, কোনোদিন পরমভট্টারক সহারাজের সামনেও বলব। জীবিতবস্থায় আমার পক্ষে এই ধোঁকাবাজী বরদাস্ত করা মুস্কিল। তবে এ ভবিষ্যতের কথা, কিন্তু আমি চাই আপনিও অশ্বঘোষের পদাস্ক ানসরণ করুন।”

“আমি নিছক কবি; অশ্বঘোষ কবি এবং মহাপুরুষ দুই-ই ছিলেন। তাঁর কাছে সংসারের সুখভোগের কোনো মূল্য ছিল না, আমি চাই বিক্রমাদিত্যের প্রমোদশালায় সুন্দরীদের মতো সুন্দরী, চাই রক্তবর্ণ দ্রাক্ষাসুরা, চাই প্রাসাদ এবং পরিচারক। আমি কেমন করে অশ্বঘোষ হতে পারি? আমি ‘রঘুবংশ’—এ ছদ্মনামে আমি গুপ্তবংশেরই প্রশংসা করেছি, যাতে প্রসন্ন হয়ে বিক্রমাদিত্য এই প্রসাদ দিয়েছেন, কাঞ্চনমালার মতো যবনসুন্দরী আমাকে প্রদান করেছেন—পনেরো বছর আমার সঙ্গে থেকে ও যে আমাকে তার সোনালী কেশ-পাশে বেঁধে রেখেছে। আমি এখন ‘কুমারসম্ভব’ রচনা করছি, দেখ এ কাব্য আরও কত কি এনে দেয় আমার হাতে।”

“আমি বিশ্বাস করি না আচার্য, আপনি যদি ‘বুদ্ধ-চরিত’ সৌন্দরান্দ’ লিতেন তবে আপনাকে বভুক্ষায় মরতে হত বা সর্বোতোভাবে ভোগসুখ থেকে বঞ্চিত হতেন। এ আপনার ভুল ধারণা, যে রাজার ক্ষতি না করলে আপনার জীবন সম্পূর্ণ রিস হয়ে যাবে। আগামী দিনের কবিদের জন্য আপনি অত্যন্ত কু-উদাহরণ রেখে যাচ্ছেন। সকলেই কবি কালিদাসকে অণুকরনের নামে নিজেদের দোষ ঢাকতে চাইবে।”

“মহৎ কাব্যও আমি রচনা করব।”

“কিন্তু এমন কিছুই লিখবেন না যাতে গুপ্তদের ভ্রষ্টাচার লোকে জানতে পারে।”

‘সে আমার দ্বারা হবে না সুপর্ণ, আমি বড় নরম হয়ে পড়েছি।”

“রাজানুষ্ঠি সকল পাপের সপক্ষে ধর্মের দোহাই তো দেবেন?”

“তারও  প্রয়োজন আছে। এ ছাড়া রাজশক্তি দৃঢ় হতে পারে না, বশিষ্ঠ আর বিশ্বামিত্রও এ ধরনের কাজ করা প্রয়োজন মনে করেছিলেন।”

“বশিষ্ঠ আর বিশ্বামিত্রও কবি কালিদাসের মতো প্রাসাদ এবং সুন্দরীর লোভে এই পাপ-পথে পা বাড়িয়েছিলেন।”

“সুপর্ণ, পুথিগত বিদ্যা ছাড়াও শুনলাম, যুদ্ধবিদ্যাও তুমি আয়ত্ত করেছ, যদি তোমার সম্মতি থাকে তবে মহারাজাধিরাজকে বলি। তোমাকে কুমারামাত্য বা সেনানায়কের পদে অভিষিক্ত দেখলে খুশী হব আমি, মহারাজাও খুশী হবেন।”

“আমি কারও কাছেই নিজেকে বিক্রয় করব না আচার্য।”

“আচ্ছা, রাজপুরোহিতের মধ্যে একটা স্থান যদি পাও?”

“ ব্রাহ্মণদের স্বার্থপরতায় আমার ঘৃণা ধরে গেছে।”

“কি করবে তা’হলে?”

“আপাতত আরও বিদ্রঅর্জনের আমার বাসনা।”

উচ্চয়িনীতে অবস্থানকালে আমি শুধু নিজের জ্ঞান-পিপাসা তৃপ্ত করবার সুযোগই পাইনি, সেই সঙ্গে বিস্তৃত এই সংসারকে জানবার সুযোগও হয়েছে। সেখানে থাকতে, কাছে থেকে সেই সঙ্গে বিস্তৃত এই সংসারকে জানবার সুযোগও হয়েছে। সেখানে থাকতে, কাছে থেকে আমি দেখেছি, কেমন করে ব্রাহ্মণেরা রাজার কাছে সম্পূর্ণভাবে নিজেদের বিক্রয় করে দেয়। এমন একটা সময় ছিল যখন অপরে স্বীকার না করলেও ব্রাহ্মণত্বের গর্ব আমার প্রবল ছিল। গ্রাম ছেড়ে আসবার পর আমি খাঁটি যবনদের দেখলাম, যারা প্রায়ই ভরূকচ্ছ থেকে উচ্চয়িনী আসত। সেখানে তাদের বড় বড় পন্যশালা ছিল, আমি বছ শক, আভীর পরিবারে গিয়েছি, যাদের পূর্ব পুরুষেরা এক শতাব্দী আগে উজ্জয়িনী, লাট (গুজরাট) এবং সৌরাষ্ট্রের শাসক মহাক্ষত্রপ ছিল। পাকা নারঙ্গী রঙ-এর গাল, রোমহীন মুখমণ্ডল এবং গোলাকার আঁখিযুক্ত হুনদেরও আমি দেখেছি—যুদ্ধে অত্যন্ত নিপুণ, কিন্তু অন্যদিকে তেমন প্রতিভা নেই। এইসবব রকমারি মানুষজন দেখবার সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান হল বৌদ্ধবিহার (মঠ), যা একাধিক সংখ্যায় উজ্জয়িনীর বহির্দেশে রয়েছে। আমার মাতুল-কুলের লোকেরা বৌদ্ধ ছিলেন, আর বহু নাগর-ভিক্ষু এইসব মঠে থাকতেন। এ জন্য আমাকে প্রায়ই সেখানে যেতে হত। ভরূকচ্ছতেও আমি একবার গিয়েছিলাম।

পুথি-পাঠ সমাপ্ত করে আমি দেশভ্রমণের সাহায্যে আমার জ্ঞান প্রসারিত করতে চােইলাম। এই সময় আমি জানতে পারলাম যে, বিদৃর্ভে অচিন্ত্যবিহার (অজান্তা) নামে এক প্রসিদ্ধ বিহার আছে সেখানে পৃথিবীর সকল দেশের বৌদ্ধ ভ্ক্ষিুরা এসে থাকেন। আমি সেখানে গেলাম।

এতদিন পর্যন্ত আমি যেখানেই গিয়েছি, আমার সঙ্গে প্রচুর সম্বল এবং সঙ্গী নিয়ে গিয়েছি। এই প্রথম বার আমি নিঃসহায় নিঃসম্বল অবস্থায় বেরিয়ে পড়লাম। পথে চোর-ডাকাতের ভয় ছিল না; গুপ্তদের এই ব্যবস্থার প্রশংসাই করতে হবে। কিন্তু গুপ্তশাসন কি দেশের প্রত্যেক পরিবারকে এতই সমৃদ্ধশালী করে রেখেছে যে, বাটপাড়ি, রাহাজানি সম্পূর্ণ উঠে গেল? গুপ্তরাজেরা কর আদায়ের ব্রাপারে পুর্বতন সকল শাসককেই হার মানিয়েছে। রাজপ্রাসাদ তৈরীর কাজে কখনও এত অর্থ ব্যয়িত হয়নি। পাহাড়, নদী, সরোবর এমন কি সমুদ্রকে সশরীরে উঠিয়ে এনে এরা আপন সুরম্য প্রাসাদের সংলগ্ন করে রাখবার প্রায়স পেয়েছে। এদের ক্রীড়া-উদ্যান সত্যিকারের বনের মতোই মনোরম। এখানে পিঞ্চরে আদ্ধ হিংস্র পশু আর খোলা জায়গায় হরিণের দল গুরে বেড়ায়। ক্রীড়াপর্বতের স্বাভাবিক পার্বত্য বন-উপবন, জলপ্রপাত তৈরী করা হয়েছে। সরোবরের সঙ্গে যুক্ত কৃত্রিম জলস্রোতের ওপর সেতু আর নৌকার বহর দেখা যা। হাতির দাঁত, সোনা, রূপা নানা রকম রেশমী বস্ত্র এবং মহার্ঘ গালিচার প্রাসাদের অন্তদেশে সজ্জিত রয়েছে। প্রাসাদকে সজ্জিত করতে চিত্রকর তার তুলির সৌন্দর্য সবটুকুই ঢেলে দিয়েছে। ভাস্কর তার মর্মর এবং ধাতু-নির্মিত মূর্তি সুন্দর রূপ বিন্যাস করেছে। বিদেশী যাত্রী এবং রাজদূতের মুখে আমি এই সব চিত্র এবং মূর্তির ভুরি ভুরি প্রশংসা শুনেছি, যাতে সত্যিই আমার শির গর্বোন্নত হয়ে উঠেছে। কিন্তু যখন আমি ক্ষুদ্র গ্রামের পর্ণ কুটিরের অবস্থা দেখি, তখন উজ্জয়িনী এই সব প্রাসাদ আমার দেহের রক্ত চঞ্চল করে তোলে! মনে হয়েছে, গ্রামের এই দারিদ্র্যের কারণ এইসব প্রাসাদ।

গ্রামের নিপুণ শিল্পীরা নানা রকমের জিনিস তৈরী করে থাকে। স্ত্রীলোকেরা মিহি সুতা কেটে এবং তস্তুবায়রা তা দিয়ে সুক্ষ্ম বস্ত্র  বয়ন করে। স্বর্ণকার, লৌহকার, চর্মকার আপন আপন শিল্প দক্ষতার পরিচয় দিয়ে থাকে। রাজপ্রাসাদের কলাচার্তুর্ধময় আসবাবাপত্রের নির্মাতারা এদেরই আত্মীয়স্বজন। কিন্তু যখন আমি এদের দেহ এবং বাসগৃহের অবস্থা দেখেছি তখন বুঝতে পারি,  এদেরই আত্মীয়স্বজন। কিন্তু যখন আমি এদের দেহ এবং বাসগৃহের অবস্থা দেখেছি তখন বুঝতে পারি, এদেরেই হস্তনির্মিত দ্রব্যসম্ভার এদের কাছে স্বপ্নময় স্বরূপ। এদের তৈরী শিল্প সামগ্রী গ্রাম থেকে নগর-শহরের সৌধ, প্রাসাদে চলে যায়। আবার সেখান থেকে অনেকে পশ্চিম সমুদ্রতীর ভরূকচ্ছ, আদিতীর্থ হয়ে পারস্য বা মিশররে পথ ধরে, অথবা পূর্ব সমুদ্রতীরে তাম্রলিপ্ত হয়ে যবদ্বীপ, সুবর্নদ্বীপ পৌঁছে যায়। ভাতরে সামুদ্রিক বাণিজ্য এত শক্তিশালী কোনোদিনই হয়নি, এবং আপন পণ্যের বিনিময়ে সমুদ্রপারের লক্ষ্মীও এত বেশী কখনও ভারতে আসেনি, কিন্তু এতে লাভ কার? সকলে চেয়ে বেশী গুপ্তরাজাদের, তারা সকল পণ্যের ওপর অত্যধিক শুল্ক আদায় করে; তাপরপ সামন্ত প্রভুদের মধ্যে যারা বড় বড় রাজপদ বা জায়গীরের অধিকারী, তার কারিগর এবং ব্যবসাদার দু’য়ের কাছে থেকেই লাভের অঙ্ক লোটে। ব্যবসাদারদের নাম সবশেষে করলেও এই তারাও লণ্ঠন-কর্মে নেহাত ছোট অংশীদার নয়। এদের সবাইকে দেখে আমার কাছে এ কথা পরিষ্কার হয়ে গেছে, গ্রামের কৃষক এবং কারিগরেরা এত গরীব কেন, এবং ছোট-বড় রাজপথ সমূহকে সুরক্ষিত রাখবার জন্য গুপ্তরাজাদের এত তৎপরতাই বা কেন? গ্রামে দারিদ্র্য আছে ঠিকই, তবে শহরের মতো হৃদয়-বিদারক দৃশ্য গ্রামে কমই দেখা যায়। এখানে পশুর মতো ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য দাসদাসিদের হাট বসে না, ওদের নয় শরীরে চাবুকের দাগ চোখে পড়ে না। আমার গুরু কালিদাস কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন, পূর্বজন্মের কর্মফলস্বরূপ লোকে দাস হয়। যেদিন তাঁর মুখে আমি এই কথা শুনি সেইদিনই পূর্বজন্ম সম্বন্ধে আমার সমস্ত বিশ্বাস উবে গেল। গুপ্তরাজারা যেভাবে ধর্মকে সকল রকমে আপন অস্তিত্ব দৃঢ় করবার কাজে লাগিয়েছে , তাতে এখন সকল চিন্তাশীল লোকেই মনেই এই অবিশ্বাস আসা স্বাভাবিক। কিন্তু যখন আমি সাধারণ প্রজাদের দেখতাম, তাদের এ বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন মনে হত—কেন? সম্ভবত তারা নিজেদের অসহায় মনে করত। গ্রামবাসীরা শুধু আপন গ্রামের খোঁজ-খবরটুকু রাখত—গ্রামের অঙ্গুষ্ঠ পরিমাণ জমির জন্য তারা যে ভাবে লড়াই করত সম্ভবত কুমারগুপ্তও নিজের কোনো প্রদেশের জন্য এত বিক্রমের সঙ্গে লড়তে পারত না। কিন্তু গ্রামের সীমার বাইরে যাই ঘটে থাক, িএরা তার কোনো খাঁজ রাখত না। একিট গ্রামের ঘটনা আমার মনে আছে। সেখানে প্রায় চল্লিশটি কুটির ছিল, সবই খড়ের ছাউনি। গরমের দিনে উনুন থেকে একটা ঘরে আগুন লেগে যায়। সারা গ্রামের লোক জল নিয়ে সেই ঘরের দিকে দৌড়ে গেল। কিন্তু একটি ঘরের এক দম্পতি ঘড়ায় জল ভরে আপন ঘরের কাছে বসে রইল। সৌভাগ্য-বশত গ্রামে এম গ্রত ঐ একটিই ছিল, না হলে গ্রামের একটা ঘরও সেদিন রক্ষা পেত না। সে সময় আমার যৌধেয় গণ-রাজ্যের কথা মনে পড়ে গেল, যেখানে রাষ্ট্রের সকল লোক আপন রাষ্ট্রের জন্য জীবন-মরণ পণ করতে কুণ্ঠিত হত না। এমনিতেই তো সমুদ্র গুপ্ত, চন্দ্রগুপ্ত, কুমারগুপ্তের দিগ্বিজয়ের জন্য লক্ষ লক্ষ লোক প্রাণ দিয়েছে, কিন্তু সে শুধু দাসের মতো অপরের লাভের জন্য—স্বাধীন মানুষের মতো নিজের এবং নিজ নিজ জনগণের হিতার্থে নয়।

জনসাধারণের মধ্যে মাত্র একশ’ বছরের এই ‍ুপ্তশাসনের প্রভাব লক্ষ্য করে আমার সমস্ত শরীর শিউরে উঠল । আমি ভেবে দেখলাম, ‍ুদি এমন শাসন-ব্যবস্থা কয়েক শতাবঈ ধরে চলে, তবে এই দেশ সম্পূর্ণভাবে দাসের দেশে পরিণত হবে। যারা শুধু আপন রাজার জন্যই রড়তে-মরতে জানবে, যাদের মন থেকে এ চিন্তা বিলুপ্ত হবে যাবে যে, সব মানুষেরই কিছেু অধিকার আছে।

অচিন্ত্যবিহার বড়ই রমণীয়্ অর্ধচন্দুাকার নদীপ্রবাহ হরিৎবসনা পাহাড়ী উপত্যকার পাশ কেটে বয়ে চলেছে। এই ক্ষুদ্র অথচ সদানীরনা পাহাড়ী নদীর বামসতটে অবস্থিত পাহাড় কেটে শিল্পীরা কত গুহাময় সুন্দর মন্দির, নিবাসস্থল এবং সভাগৃহ রৈী করেছে। এই সব গুহাভ্যন্তরেও রাজপ্রাসাদের মতো চিত্র মুর্তি ইত্যাদি সজ্জিত-যদিও তা বহু পুরুষের পরিশ্রমের ফলে এবং সম্ববত আগামী কয়েক শত পুরুষের জন্য্। চিন্ত্য-বিহারের ভিত্তি-চিত্র সুন্দর, মর্মর-শিল্প সুন্দর । কিন্তু এগুলো গুপ্ত রাজপ্রাসাদের প্রতিদ্বন্দী হয়ে দাঁড়াতে পারে না, আর সে জন্য আমাকে তত আকর্ষণও করে না। হ্যাঁ, আমার কাছে আকর্ষণ ছিল এখানকার ভিক্ষুমন্ডুলী। দেশ-দেশান্তরের লোক প্রেমভাবে এক হয়ে এক পরিবারের মতো বাস করছে এখানে আমি সুদুর চীনের ভিক্ষুদের দেখেছি, পারসিক এবং যবন ভিক্ষুদের দেখেছি, সিংহল, যব এবং সুবর্ণদ্বীপের লোকও এখানে যথেষ্ট রয়েছে। চম্পাদ্বীপ, কম্বোজদ্বীপের নাম আমি এখানে এসেই শুনলাম এবং তাদের প্রাণবান অধিবাসীরে স্বচক্ষে দেখলাম; কপিসা, উদ্যান, তুষার এবং কুচা-র কাষায়ধারী পীতকায় ভিক্ষুদেরও এখানে দেখলাম; বাহিরের দেশগুলো সম্বন্ধে জানবার আমার প্রবল আকাঙ্কা ছিল। যদি এই সব বিদেশী ভিক্ষুদের পৃথক পৃথক সময়ে পেতাম, তবে তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে আমি এক একটি বছর কাটিয়ে দিতাম। কিন্তু এক সঙ্গে এত অধিক সংখ্যায় সমবেত ভিক্ষুমন্ডলীর মধ্যে –বিপুল ভৈবববের মাঝে পড়া দরিদ্রনিধির মতোই আমি নিজেকে অসহায় মনে করতে লাগলাম!

আমি ‍দিঙনাগের নাম শুনেছিলাম। কালিদাস নিজে গুপ্তরাজ, রাজতন্ত্র এবং তাদের পরম-সহায়ক ব্রাক্ষণ্য ধর্মের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। আর কি অভিপ্রায় থেকে তা ছিলেন, সে কথা আগেই বলেছি। দিঙনাগকে তিনি তাঁর পরাক্রান্ত প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করতেন। করতেন বলতেন, ‘ এই দ্রাবিড় নাস্তিকের সমনে শুধু বিষ্ণু নয়, তেত্রিশকোটি দেবতারই সিনংহাসন টলে ওটে । রাজা ও ব্রাক্ষণের স্বার্থরক্ষার জন্য ধর্মের নামে আমি যা কিছু কুটকৌশল বের করি, তার রহস্য তার কাছে অজ্ঞাত থাকে না। মুস্কিল এই যে, বৃদ্ব বসুবন্ধুর দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের রাজধানী অযোধ্যায় বছর কয়েক কাটিয়েছিলেন- রাজদরবারী হয়ে নয়, স্বাধীন, সম্মানিত শুরুর মর্যাদা নিয়ে। পরে গুপ্তদের নীচতায় নিরাশ হয়ে আপন জম্নভুমি পুরুষপুরে চলে যান।

লৌহ-তীর অথবা খড়গ নয়, তার চেয়েও তীক্ষ্ণ জ্ঞান এবং তর্কের অস্ত্র বিতরণ করবার ব্রত দিঙরাগ গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ  করলেই চোখের সামনে ব্রাক্ষণত্বের সমস্ত মায়াজাল তাসের ঘরের মতো ধ্বসে পড়ে। আমি ছয় মাস অচিন্ত্যবিহারে ছিলাম। প্রতিদিন দিঙনাগের মুখ থেকে তাঁর সর্বব্যাপী উপদেশাবলী শুনতাম। দিঙরাগের মতো শুরু পাওয়ায় আমার গর্বের শেষ ছির না। তাঁর জ্ঞান অত্যন্ত গভীর, আর বাক্য ছিল জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো। সংসারের বিস্তীর্ণ মায়াজাল দেখে আমার মতোই তিনিও ক্রোধোম্নত্ত হয়ে উঠতেন।

একদিন তিনি বলেছিলেন “সুপর্ণ প্রজাশক্তির সহায়তায় হয়ত কিছু করা যেত, কিন্তু জনসাধারণ এখন পথভ্রষ্ট হয়ে বহু দুর চলে গেছ্  তথাগত জাতিবর্ণ-ভেদ উঠিয়ে দেওয়ার জন্য অতীব প্রয়াস করেছিলেন দেশের বাইরে থেকে যবন, শক, গুর্জর আভীর –যারাই আসত, ব্রাক্ষণরা তাদের ম্নেচ্ছ বলে ঘৃণা করত। কিন্তু তথাগতের সঙ্ঘ তাদের মানুষ বলেই স্বীকার করে নিত।কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত মনে হয়েছিল. এ দেশ থেকে জাতিভেদ প্রথা মুছে যাবে কিন্তু ভারতের দুর্ভাগ্য যে গুপ্ত সম্রাটরা এখন ব্রাক্ষণদের খপ্পরে এসে গেছে। গুপ্তরা যখন প্রথম ক্ষমতায় এল, তখন  ব্রাক্ষণরা তাদের ম্নেচ্ছ বলত। কিন্তু কালিদাস তাদের গৌরব বর্ধনের জন্য ‘রঘুবংশ’এবং ‘কুমারসম্ভব’ লিখলেন। গুপ্তরা আপন রাজবংশকে অনন্তকাল কায়েম রাখবার চিন্তায় পাগল হয়ে উঠেছে। ব্রাক্ষণরা তাদের এই আশায় ইন্ধন যোগাচ্ছে কিন্তু ভদন্ত বসুবন্ধু এমন কোনো আশা তাদের দিলেন না। তিনি লিচ্ছবী গণতন্ত্রের আদর্শে ভিক্ষুসঙ্ঘের অনুগামী ছিলেন। ব্রাক্ষণরা বৌদ্ধদের প্রবল পরাক্রান্ত প্রতিদ্বন্ধী বলে মনে করে। তারা জনে, সারা দেশের বৌদ্ধরা গোমাংস খায়। এই জন্য ব্রাক্ষনরা ভারতে গোমাংস বর্জন, গো-ব্রাক্ষণ রক্ষার আন্দোলন সুরু করে। বৌদ্ধরা জাতিবর্ণ ভেদ তুলে দিতে চায়। ব্রাক্ষণরা তাই বর্ণবহির্ভুত যবন, শক ইত্যাদিকে উচ্চবর্ণে অভিষিক্ত করতে থাকে। এই ফাঁদ এত জটিল যে , অনেক বৌদ্ধ-গৃহস্থ এতে জড়িয়ে আছে। এইভাবে প্রজাদের শক্তিকে ছিন্নভিন্ন করে তারা রাজশক্তি এবং ব্রাক্ষণ-শক্তিকে দৃঢ় করতে চায়। কিন্তু এর পরিণাম আম্নঘাতী হবে সুপর্শ, কারণ দাসেদের শক্তির ওপর ভিত্তি করে কোনো রাষ্ট্র শক্তিশালী হতে পারে না।”

আমি আপন যৌধেয়কুলের আত্নোৎসর্গের কাহিনী বলাতে আেোর্ষের হুদয় অভিভুত হয়ে গেল। যখন আমি য্যেধেয় গণকে পুরনুজ্জীবিত করবার আপন ইচ্ছা তাঁর সামনে প্রকাশ করলাম, তখন তিনি বললেন, “আমার শুভেচ্ছা এব আশীর্বাদ তোমার সঙ্গে রইল। উদ্যোগী প্ররুষসিংহের কোনো বিস্ন-বাধাকে ভয় করা উচিত নয়।”

তাঁর আশীর্বাদ নিয়ে আমি চলছি যেধেয় রাজ্যাভিসুখে। তাদের মৃত গণ-রাজ্যকে গুনরায় উদ্ধার করব, না হলে বালুতটে অস্কিত পদচিহ্নের মতো মিলিয়ে যাব।

১৩. দুর্মুখ (কাল : ৩৬০ খৃষ্টাব্দ)

আমার নাম হর্ষবর্ধন, শীলাদিত্য বা সদাচারের সুর্ষ আমার উপাধি। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত নিজে বিক্রমাদিত্য (পরাক্রমের সৃর্য ) উপাধি গ্রহণ করেছিলেন; আমি এই নম্র উপাধি গ্রহণ করেছি। বিক্রমে অপরকে দমন করে রাখার, অপরকে জয় করার চিন্তা  পেয়ে বসে; শীল-সদাচারে কাউকেও দাবিয়ে রাখার বা কারও ওপর অত্যাচার করার চিন্তা মনে আসে না। গুপ্তরা নিজেদের পরম ষ্ণৈব বলত। আমার জ্যেষ্ঠভ্রাতা রাজ্যবর্ধন –যাঁকে গৌড়-শশাস্ক বিশ্বসঘাতকতা করে তারুণ্যেই হত্যা করে এবং যাঁকে স্মরণ করে আজও আমার হৃদয় অধীর হয়ে ওঠে-পরম সৌগত ( পরম বৌদ্ধ ) ছিলেন তিনি। সুগত ( বুদ্ধ ) যেমন ক্ষমা-মুর্তি ছিলেন, তিনিও তেমনি! নিজেকে সর্বদা তাঁর চরণসেবী মনে করেও আমি পরম মাহেশ্বর অর্থাৎ শৈব হওয়া পছন্দ করেছি। কিন্তু শৈব হলেম আমার হৃদয়ে বুদ্ধভক্তি প্রবল, শুধু এই ভারতেই নয়, ভারতের বহির্জগৎ ও এ কথা জানে।

আমি, আমার রাজ্যের সকল ধর্মকেই সম্মান করেছি-প্রজারজ্ঞনের জন্যই শুধু তনয়, আপন শীল ( সদাচার ) সংরক্ষণের জন্যেও। প্রতি পষ্ণম বৎকরে আমি রাজকার্যের উদ্বৃত্ত ধন প্রয়োগে ত্রিবেণী তীরে ব্রাক্ষণ এবং শ্রমণদের মধ্যে বন্টন করতাম। এ থেকে ও প্রমাণিত হবে, আমি সকল ধর্মের সমান সমৃদ্ধি কামনা করেছি। এ কথা সত্য যে, আমি সমৃদ্রগুপ্তের মতো দিগ্নিজয়ের জন্য যাত্রা করেছিলাম কিন্তু সে এই শীলাদিত্য নাম ধারণ করার পূর্বে। তাই বলে এই কথা ভাববেন না যে, ‍যদি দক্ষিণাপথের রাজা পূলকেশীর বিরুদ্বে আমি অসফল না হতাম  তবে বিক্রমাদিত্যের মতোই কোনো পদবী আমিও ধারণ করতাম। আমি সারা ভারতের সম্রাট হয়েও , চন্দ্রগুপ্ত নয়-অশোকের কলিঙ্গিবিজয়ের মতো পশ্চাতা্প করে শীলতা দ্বারা মানুষকে জয় করতাম- আমার প্রকৃতি এমনই বিনয়নম্র ও কোমল।

রাজ্য গ্রহণ করতে ও আমি অস্বীকার করেছিলাম, কারণ স্থাম্বীশ্বরপতি  মহারাজ প্রভাকরবর্ধনের পুত্র, কান্যকুজাধিপতি পরমভট্রারক মহারাজাধিরাক রাজ্যবর্ধনের অমুজ হয়ে, আমি শুধু রাজ্যভোগ দেখে নয়, নিজে ভোগ করে তার অসারতা উপলব্ধি করেছি। যদি ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধের ক্ষত্রিয়োচিত শুভবুদ্ধি মনে জাগ্রত না হত তবে সম্ববত কান্যকুজ্ঞের সিংাসনে আমি বসতাম না। এর ফলে আমার বোন রাজ্যশ্রীর প্রতিপক্ষ মৌখরি বংশ এই রাজ্যের শাসক হত। আর বস্তুত আমার ভ্রাতার পুর্বে, গুপ্তরা চলে যাবার পর তারাই রাজ্যশাসন করত। এ সব আমি এই জস্যই বলছি যে, আমার পরবতীরা যাতে বুঝতে পারে যে হষূ স্বার্থাদ্ব হয়ে নিজ মস্তকে রাজমুকুট ধারণ করেনি। আমার দুঃখ হয় আমার দরবারী মোসাহেবরা (রাজা মোসাহেবদের সঙ্গ ছাড়তে পারে না, এই বড় মুস্কিল) আমাকে ও সমুদ্যগুপ্ত এবং চন্দ্রগুপ্তবিক্রমাদিত্যের রঙে রাঙিয়ে তুলতে চায়; কিন্তু এতে তারা আমার প্রতি খুবই অন্যায় অবিচার করেছে।

আমি রাজ্য গ্রহণ করেছি শুধু শীলতা এবং ধর্মপালনের জন্যে। বিদ্যা দানকে আমি শ্রেষ্ঠদান বলে মনে করেছি, এ জন্যে গুপ্তদের সময় থেকে চলে আসা ক্রমবর্দ্ধমান নালন্দার সমৃদ্ধিকে আমি আরও বাড়িয়ে তুলেছি, যাতে দশ জমস্র দেশী-বিদেশী পন্ডিত এবং বিদ্যার্থী সর্ববিধ সুযোগ সহ সেখানে বিদ্যাধায়ন করার সুবিধা লাভ করে। বিদ্বানের সম্মান লাভ করা আমার কাছে সব চেয়ে সন্তোষদায়ক, এ জন্য আমি চীনের বিদ্বান ভিক্ষু হয়েন সাঙকে সমস্ত অন্তর দিয়ে সম্মানিত করেছি। বার্ণের অপূর্ব কাব্যপ্রতিভা দেখে আমি তাকে লাম্পট্যের পথ থেকে সরিয়ে েএনে সুপথে চালনা করতে চেয়েছি, যদিম সে বেশী ওপরে উঠতে পারেনি শুধু চাটুকার কবি হিসাবেই রয়ে গেছে। কিন্তু মগধের এক ছোট অখ্যাত গ্রাম থেকে নিয়ে এসে তাকে বিশ্বের দরবারে উপস্থিত করার প্রয়াস আমার বিদ্যানুরাগেরই পরিচায়ক”।

আমি চেয়েছিলাম সকলেই আপন-আপন ধর্ম পালন করুক। স্ব-ধর্মের পথেই চলা উচিত কারণ এতে সংসারে শান্তি এবং সমৃদ্ধি বিরাজ করে এবং স্বর্গের সৃষ্টি হয়। সকল বর্ণের লোক নিজ নিজ বর্ণধর্ম পালন করুক, সকল আশ্রমের লোক আপন আশ্রম পালন করুক, সকল ধর্মমত আপন শ্রদ্ধা-বিশ্বাস অনুযায়ী পূজা-পাঠ করুক-এজ ন্য আমি সদা পযত্নশীল ছিলাম।

কামরূপ থেকে সৌরাষ্ট্র এবং বিন্ধা থেকে হিমালয় পযর্ন্ত বিস্তৃত নিজ রাজ্যে আমি ন্যায়রাজা স্থাপন করেছি। আমার অধিকারীরা (অফিসার) যাতে প্রজাবৃন্দের ওপর জুলুম করতে না পারে, এ জন্য আমি স্বয়ং চক্রভ্রমণে বের হতাম।

এমনই এক পর্যটনে ব্রাহ্মণ বাণ আমার আহবানে আমার কাছে এসেছিল। আমি জানি, সে আমার কীর্তির মহিমা কীর্তন করতেই চেয়েছিল। কিন্তু আমার পর্যটনের সময়েও আমার রাজৈশ্বর্ষ আড়ম্বের যে বর্ণনা সে লিপিবদ্ধ করেছে তা আমার নয়, কোনো বিক্রমাদিত্যের দরবারের হতে পারে। গোপনে গোপনে সে আমার জীবনী ( হর্শ্বচরিত) লিখছিল। ব্যাপারটা আমি আকদিন জানতে পেরে তাকে প্রশ্ন করলাম । লিখিত অংশ সে আমাকে দেখিয়েছিল, দেখে আমি খুব অসু্ন্তুষ্ট হলাম এবং তিরস্কার ও করলাম। যার পরিণামে সে আর তত উৎসাহের সঙ্গে লিখে যেতে পারল না। তার লেখা ‘কাদম্বরী’ আমার অপেক্ষাকৃত পছন্দ হয়েছিল। যদিও তাতে রাজদরবার, অন্তঃপুর, পরিচারক পরিচারিকা, প্রাসাদ, ভোগবিলাস ইত্যাদির এমন বর্ণনা দেওয়া হয়েছির যাতে লোকের অযথা ভ্রম হয় যে, এই সমগ্র বর্ণনা আমারই রাজদরবারের। আমার রাণীদের মধ্যে পারস্য কন্যার সঙ্গেই আমার গভীর প্রণয় ছিল। সে নৌশেরওয়াঁর নাতনিই শুধু নয়, উপরস্তু আপন রুপও গুণের দ্বরা যে কোনো পুরুষকে সে মোহাচ্ছন্ন করতে পারত! বাণ তাকেই মহাশ্বেতা বলে বর্ণনা করেছিল। আমার সৌরাষ্টী রাণীর যৌবন পেরিয়ে এসেছিল, তাকে খুশী রাখবার জন্য আামি তার আবাসস্থল সজ্জিত করতে কিছুটা বিশেষ আয়োজন করেছিরাম। একই বাণ ‘কাদম্বরী’ এবং তার নিবাস রুপে অস্কিত করল। বাণের রচনার এই দুট বিষয় ছাড়া বাকি সমস্ত বিষয় মোটেই আমার সম্বন্ধে প্রযোজ্য নয়, অথবা অম্যন্ত অতিশয়োত্তিপূর্ণ।

আমার অন্তিম সময়ে অনুভব করছি, বাণ আমার হিতৈষী বলে প্রমাণিত হবে না। বাণের ‘হর্ষচরিত’ শুধু নয়, ‘কাদম্বরী’তেও রাজ্য আর তার ঐশ্বর্ষ সম্বন্ধে যা কিছু বর্ণনা করা হয়েছে, লোকে সে সব আমার বিষয়ে বর্ণনা বলেই ধরবে। ‘নাগানন্দ’ ‘রত্বাবলী’ এবং প্রিয়দর্শিকা’ রাটককে আমার নামে লিখে সে তো আরও অনর্থ করেছে। লোকে বলবে, কীর্তির জন্য লালায়িত হয়ে আমি অপরের রচনা টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছি। বিশ্বাস করুন, বহুকাল পরে এই বিষয়টা আমি জানতে পেরেছি যখন হাজার হাজার বিদ্যার্থী আমার নামে এই প্রন্থাবলী পড়ে ফেলেছে এবং অনেকবার এগুলো অভিনতিও হয়ে গেছে। আমি আপন প্রজাদের সুখী দেখতে চেয়েছিলাম , তা আমি দেখেছি। নিজের রাজ্য শান্ত এবং নিরাপদ দেখতে চেয়েছিলাম, সে সাধও পূর্ণ হয়েছে। আমার প্রজারা সোনা বোঝাই করে নিশ্চিন্তে এক জায়গা থেকে অপর জায়গায় যেতে পারছে।

আমার কুল সম্বন্ধে এখনই লোকে বলতে সুরু করেছে যে, এটা না-কি বেণেদের কুল। সম্পুর্ণ ভূল কথা। আমি শ্যৈ-ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য-বেণে নই। এক সময় আমাদের শাতবাহন কুলের হাতে সমগ্র ভারতের শাসনবার ছিল। শাতবাহন রাজ্যের ধ্বংসের পর আমাদের প্রজাগণ গোদাবরী তীরস্থিত প্রতিষ্ঠানপুর ( পেঠন )ছেড়ে স্থানবীশ্বর ( থানেশ্বর )চলে আসে। শাতবাহন ( শালিবাহন )বংশ ককনও বেণে ছিল না, সমস্ত জগৎ এ কথা জানে, শক ক্ষত্রিয়ের সঙ্গে তাদের বিবাহাদি হত। রাজাদের যা কুল-লক্ষণ তার বিরোধী কিছু ছিল না। আমার প্রিয়া মহাশ্বেতাও পারসীক রাজবংশোদ্ভুতা।

আমার নাম বাণ। বহু কাব্য নাটক আমি  লিখেছ্ সাহিত্যের কষ্টি পাথরেই লোকে আমাকে কষে দেখতে চাইরে, এই জস্য আমাকে কয়েকটি কথা লিখে রেখে যেতে হচ্ছে, কারণ আমি জানি, বর্তমান রাজবংশের সময় পর্যন্ত এই ষেখা প্রকাশিত হবে না। আমি এগুলো নিরাপদে রাখবার ব্যবস্থা করেছি। আমার সম্বন্ধে ভবিষ্যুৎ মানুষের ভুল ধারণার হাত থেকে রেতাই পাব যদি তারা আমার প্রসিদ্ধ পুস্তকাবলী পড়বার আগে এই লেখাটা পড়ার সুযোগ পায়।

রাজা হষূ একদিন সারা সভার মাঝে আমাকে বুজঙ্গ লম্পট বলে বসলেন-আর এর ফলে লোকে আমায় ভুল বুঝতে পারে। আমি ছিলাম ধনী পিতার আদুরে ছেলে। ভাল ও কালিদাসের রচনাবলী পড়ে আমার মন রঙীন হয়ে উঠেছিল ।আমার রুপ, যৌবন ছিল; আর ছিল দেশভ্রমণের সখও। আমি চেয়েছিলাম যৌবনের ‘আনন্দ’ উপভোগ করতে; অবশ্য ইচ্ছা করলে পিতার ন্যায় ঘরে বসেই সেটা করতে পারতাম। কিন্তু আমার কাছে তা ভন্ডামী বলে মনে হল! ভেতরে ‍যখন লালসা স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে তকন নিজেকে জিতেন্দ্রিয়, সংযমী মহাত্না রুপে প্রকট করতে আমার খুবই খারাপ লাগত। সারা জীবন আমি এ সব পছন্দ করিনি। জীবনে যা কিছু করেছি সব সামনা-সামনি। আমার বাবা অবশ্য একবারই সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন –নিজের অসবর্ণ পুত্রকে স্বীকার করে, কিন্তু তাকেম তারুন্যের পাপ কলে গণ্য করা যায়।

আমি বুঝেছিলাম, যৌবনের আনন্দ যা আমি উপভোগ করতে চাই, নিজের জম্মভুমিতে থেকে সেটা সম্ভব নয়। কসল জাতি ও কুলের লোক ক্ষেপে উঠবে, আর পৈতৃক ধন সম্পত্তি ও খোয়াতে হবে। আমার মাথায় এক বিচিত্র পরিকল্পনা এল। আমি এক নাট্য-মন্ডলী গঠন করলাম, মগধের বাইরে গিয়ে। আমার এক গুণী ও কলাকুশলী তরুণ বন্ধু সেখানে ছিল। মূর্খ, ধুর্ত ও চাটুকার বন্ধু আমি কোনোদিন পছন্দ করি না। আমার নাট্য-মন্ডলীতে অনেক সুন্দরী তরুীকে নিয়ে এসেছিলাম, এদের সকলেই বারবনিতা ছিল না। ‘রত্নাবলী’ ‘প্রিয়দর্শিকা’ পুবৃতি নাটক এই নাট্য-মন্ডলীতে অভিনয় বারবার জন্যে লিখলাম। তারুণ্যের আনন্দের সঙ্গে আমি শিল্পকলার মিলন ঘটালাম, আর তা দেখে সহুদয় দর্মকেরা আমার প্রশংসাই করত। জীবনের আনন্দ আমি উভোগ করলাম , সঙ্গে সঙ্গে ‘রত্নাবলী’ ‘প্রিয়দর্শিকা’ ইত্যাদি আপনাদের সামনে উপস্থিত করলাম। যারা শুধু নিজের ব্যক্তিকেন্দ্রিক আনন্দ পূরণ করবার জন্যই সব কিছু করে, তারা ভোগী। লোকে বলবে, রাজা হর্ষকে তোষামোদ করার জন্যেই আপন নাটকসমূহ তার নামে প্রকাশ করেছি। কিন্দু তারা জানে  না। যে-সময় প্রবাসে বসে এইসব্ নাটক লিখি তখন হর্ষকে আমি শুধু নামেই জানতাম । সে সময় আমি এও জানতাম না যে, আগামী দিনে হর্ষ আমাকে আমন্ত্রণ করে তার দরবার িকবি করে রাখবে। আত্নগোপনের তাগিদে-শুধু নিজেকে গোপন করার জন্যেই এইসব নাটকের রচয়িতা হিসাবে আমি হর্ষে র নাম দিয়েছি। এইসব নাটক যারা পড়ে, তারা এর মূল্য জানে। এগুলো সম্পৃর্ণ মৌলিক রচনা। আমার দর্শকগণের মধ্যে গুনীজন থাকত বহুল সংখ্যায়। দলে দলে আসত পন্ডিত, রাজা, কলাবিদ। যদি তারা প্রকৃত নাজ্যকারের নাম জানতে পারত, তা’হলে আমি আর নাট্র-মন্ডলীর সূত্রধার হয়ে থাকতে পারতাম না, সকলেই মহাকবি বাণের পশ্চাদ্বাবন করতে সুরু করত। কামরুপ থেকে সিন্ধু এবং হিমালয় থেকে সিংহলের অনুরাধাপুর পর্যন্ত- হর্ষ চাড়া অন্যান্য প্রায় সকল রাজ-দরবারেই নাটক অভিয় করেছি। ভেবে দেখুন, যদি কামরুপেশ্বর, সিংহলেশ্বর বা কুন্ডুলেশ্বরের গোচরীভুত হত যে, আমিই নাটক রচনাকারী মহাকবি বাণভট্র তবে আমার পর্যটন, আমার আনন্দোপভোগে কি দশা হত?আমি কোনো রাজার দরবারী কবি হয়ে থাকতে চাইনি। হর্ষের রাজ্যে যদি আমার জম্মভুমি না হত, তবে তার দরবারী কবিও হতাম না, পিতার সম্পত্তিই আমার কাছে যথেষ্ট ছিল।

হর্ষের বর্ণনা অনুসারে আপনাদের মনে হতে পারে যে, আমি একজন গণিকাসক্ত লম্পট। বস্তুত আমার নাট্য-মন্ডুলীর মধ্যে গুণিকাদের স্থান খুবই নগণ্য। তবু যারা এসেছিল, তারা তাদের নৃত্য-গীত অভিনয়কলার সৌষ্ঠব গুণেই এসেছিল, এখানে তার উৎকর্ষের চর্চা হত আমার সময় নাট্যগগনের তারকার।ভ আসত ভিন্ন পথ ধরে। ভাবীকালে কি হবে জানি না, কিন্তু আমার সময় দেশের সব তরুণীরা- তা সে ব্রাক্ষণ কন্যা বা বেণিয়ার মেয়ে হোক না কেন, রাজা ও সামন্তবর্গের সম্পত্তি বলে গন্য হত।

আমার পিসীমাকে মগধের এক সামন্ত বলপূর্বক নিয়ে গিয়েছিল। তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে পিসীর আয়ুও শেষ হল বলা চলে। পিসীমা ফিরে এলেন আমাদের ঘরে। আমার প্রতি তাঁর অশেষ স্নেহ ছিল। আমি কোনোদিনই তাঁর সামন্ত-সম্বন্ধের ওপর কটাক্ষ করিনি। আর এই অবলার দোষ কি? সুন্দরী তরুণীদের প্রথম অধীকারী হত মুষ্টিমেয় সামন্ত। আর সুন্দরী তরুণীর সংখ্যা খুব বেশী ছিল তা নয়। সামন্ত রাজারা ছলে বলে কৌশলে যুবতীলে পাওয়ার চেষ্টা কত। াতির কাছে যাওয়ার পূর্ব রাত্রে কোথাও কোথাও সামন্তদের সঙ্গে রাত্রিবাস করতে হত; কারণ এরা যে তাদেরই সম্পত্তি! সাধারণ লোকে একে ধর্ম-মর্যাদা মনে করত।

ব্রাক্ষণ ও বেণিয়ারা আপন কন্যা , পত্নী ও বোনেদের ডুলিতে করে এক রাত্রের জন্যে রাজান্তঃপুরে পৌছে দিত। ডুলি না পাঠাবার অর্থই ছিল, সর্বনাশ ডেকে আনা। আর মেয়ে পছন্দ হলে তো কথাই ছিল না, রাজান্তঃপুরের প্রমোদগৃহে রাখা হত স্থায়ীবাবে। তারা যে রানী হত, তা মনে করার কারণ নেই, পরিচারিকার সম্মান কপালে জুটত। রাণী হওয়ার সৌভাগ্য শুধু রাজকুমারী এবং সামন্তকুমারীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। অন্তঃপুরের এই হাজার হাজার তরুণীর অধিকাংশই এমন ছিল, যারা মাত্র এক রাতের সন্যে রাজা অথবা সামন্তের সঙ্গলাভ করেছে। এই হতভাগিনী নারীদের যৌবন কিভাবে ব্যর্থ হয়েছে সেটা িএকবার ভেবে দেখুন? আমার নাট্যমন্ডলীর অভিনেত্রীরা আসত এইসব অন্তঃপুরের পমোদাগার থেকেই কিন্তু পালিয়ে বা চুপিচুপি নয়। ভালোই বলুন আর মন্দই বলুন, রাজা ও সামন্তবর্গকে কথার জালে নিজের পক্ষে টেনে আনতে আমি ছিলাম সিদ্ধবাক। অবশ্য রাজনীতি আমার বিষয়বুত ছিল না, আমায় তারিফ করে যে শত-শত পত্র পাঠাত রাজা ও সামন্তরা ,গেুলো আজও সাক্ষী হয়ে আছে। যখন কলা সম্বন্ধে প্রশংসায় এরা পষ্ণমূখ হত , আমি তখন বিলাপ করতে সুরু করতাম। বলতাম, æকি করব বলুন! কলাকুশলী তরুণী থাকা সত্বেও পাওয়া যায় না।”

æথাকা সত্তেও পাওয়া যায় না?”

একবার চুম্বন, পরে আলিঙ্গন বা এক রাতের শয্যাসঙ্গনী করার পর খোনে হাজার হাজার তরুণীকে অন্তঃপুরের বন্দিনী করে রাখা হয়, সেখানে কলাকুশলী তরুণী পাওয়া যাবে কেমন করে।?”

æঠিকই বলেছ, আচার্য! আমিও অনুভব করছি, কিন্তু একবার অন্তঃপুরের গ্রহণ করার পর এদের আমি বের করে ‍ুদই কি করে?”

তারপর  আমি তাদের পথ বাতলে দিতাম । রাজকন্যা , সামন্তকন্যা ও রাজান্তঃপুরিকাগণের জন্য নাচগান অপরিহার্য। আহার ও পানীয়ের তমো এ সব তাদের প্রয়োজন। আমার দলেন চতুর নারীদের আমি পাঠিয়ে দিতাম রাজা নিজেই কলাশিক্ষার জন্য আপন অন্তঃপুরকাদের উৎসাহিত করতেন। যাকে গ্রহণ করা আমার পয়োজন মনে হত তার কাছে অন্তঃপুরের দুঃখকষ্ট এবং কলাবিদের জীবনের আনন্দের বিশদভাবে বর্ণনা করা হত। সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও শোনানো হত যে, নাটাদের সম্মান রাজান্তঃপুরে কত বেশী, তারা কুশলী নটা হতে পারলে ভবিষ্যতে সুযোগও আছে! এ সব বলার পর অনেক তরণীর পক্ষেই সম্মত হওয়া স্বাভাবিক ছিল যদিও আমি তাদের ভেতর থেকে  যোগ্যতমাকেই বাছাই করে নিতাম। জীবনে মাত্র একটি রাত সম্ভোগের জন্য যেখানে রাজারা হাজার হাজার তরূণীকে অবরোধ করে রাখে, সেখানে অন্তঃপুরে পুরুষদের প্রবেশ নিষেধ করেও কিছু বন্ধ করা যায় নাÍবুড়ো কষ্ণুকী ব্রাহ্মণ তাদের তারণ্যের আনন্দ রোধ করতেও পারে না।

আমি যখন বিধবাদের ‘সতী’ হওয়ার বিরোধিতা করলাম তখন ভণ্ড শিরোমণি ব্রাহ্মণ এবং রাজারা মহা সোরগোল তুলল। তারা প্রচার করতে লাগল, আমি ভ্রূণ-হত্যা আমি একবারেই সমর্থন করি না কিন্তু এখানে এ কথা স্বীকার করতে আমার এইটুকু দ্বিধা নেই যে, আমি বিধবা-বিবাহ সম্পূর্ণ সমর্থন করি। প্রাক গুপ্তশাসনে আমাদের শ্রোত্রিয়গণ যেখানে গোমাংস বিনা কোনো আতিথ্যকে স্বীকার করতে চাইতেন না, সেখানে এখন গোমাংস ভক্ষণকে ধর্মবিরুদ্ধ বলে গণ্য করা হয়। যেখানে আমাদের ঋষিগণ বিধবাদের জন্য দেবরÍদ্বিতীয় বর, সম্পূর্ণ ধর্মসঙ্গত বলে মনে করতেন এবং কোনো ব্রাহ্মণী বা ক্ষত্রিয়া বিধবা-তরুণী ছয় মাস বা এক বছরের অধিক পতিবিধুরা থাকতে পারত না, সেখানে বিধবা-বিবাহকে এখন ধর্মবিরুদ্ধ বলে গণ্য হচ্ছে! গুপ্তরাজবংশের যুগেই এই জঞ্জালেরÍএই নতুন (হিন্দু) ধর্মের গোড়াপত্তন হয়, আর এর প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য আপন পাটরাণী করে রেখেছিলেন নিজেরই বড় ভাই রামগুপ্তর সধবা স্ত্রীকে।

তরুণী বিধবাদের স্ত্রী হিসাবে রাখতে চাইলে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরও আটকাতে পারেন না আর কোন মুখেই বা আটকাবেন যখন স্ব-স্ব পত্নী বর্তমান থাকতেও তাঁরা নিজেরাই পরস্ত্রীর পিছনে ছুটতে দ্বিধা করনেনি! তরুণীদের  বিধবা করে রাখার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম ভ্রুণ-হত্যা, কারণ সন্তান সৃষ্টি করে তাকে পালন করার অর্থেই হল বিধবা-বিবাহ স্বীকার করে নেওয়াÍযা থেকে লোকে রেহাই পেতে চায়। এই ভয়ে এখন ব্রাহ্মণ এবং সামন্তরা কৌলীন্য সিগ্ধ করার এক নতুন কৌশল আবিষ্কার করেছে। সে হল বিধবাদের জীবন্ত দগ্ধ করা। স্ত্রীলোকদের এইভাবে জীবন্ত পুড়িয়ে মারাকে এই সব লোক মহাপুণ্য বলে প্রচার কর। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ তরুণীকে বলপূর্বক অগ্নিসাৎ করতে দেখেও যে দেবতাদের হৃদয় বিগলিত হয় না, তারা পাথরের গড়া, নয়ত তাদের অস্তিত্বই নেই। এরা বলে বেড়ায় স্ত্রীলোকেরা সেচ্ছায় সতী হয়। র্ধূত, ভণ্ড, নরাধম! এত মিথ্যা কেন? এই সব রাজান্তঃপুরের শত শত স্ত্রীলোক, যারা পুরুষের সঙ্গ হয়ত সারা জীবনে একবার পেয়েছেÍযাদের তোমরা আগুনে পুড়িয়ে সতী বানাচ্ছ, তাদের মধ্যে- ক’জন আছে যাদের ঐ নরপশুদের সঙ্গে এতটুকু পণয় ছিল? আজীবনের জন্য যারা বন্দী করে রেখেছিলÍতাদের সঙ্গে প্রেম! আর ওদের বিয়োগে পাগল হয়ে আগুনে ঝাঁপ দেবার যে এক-আধটি দৃষ্টান্ত রয়েছে, সে পাগলামীরও দু’চার দিনে প্রশমিত করা যেতে পারে। আত্মহত্যা ধর্ম! রসাতলে যাক ভণ্ড পুরোহিত আর রাজাদের ধর্ম। প্রয়াগের-অক্ষয়বট থেকে যমুনার ঝাঁপিয়ে পড়ে মৃত্যুবরণ করাকে এরা ধর্ম আখ্যা দিয়েছে, যার ফলে প্রতি বছর এমনি হাজার হাজার পাগল মৃত্যুবরণ করে ‘স্বর্গ’Íএ উপস্থিত হচ্ছে। দোরখণ্ডের সৎপথে গিয়ে তুষারে জমে যাওয়াকে এরা ধর্ম আখ্যা দিয়েছে, যার ফলে প্রতি বছর শত সহস্র মানুষ সৎপথের শৈত্য ‘স্বর্গ’-যাত্রা করছে! এ সমস্ত অনাচারের বিরুদ্ধে আমি ঠিকমতো প্রতিবাদ করতে পারিনি কারণ আমাকে ব্রাহ্মণদের মধ্যে, রাজার আশ্রয়ে থাকতে হত। রাজার আশ্রিত হয়েছি, কিন্তু নিজে থেকে এই আশ্রয় গ্রহণ করিনি। আমার নিজের যে সম্পত্তি ছিল তাতে সংযত ভোগপূর্ণ জীবন যাপন করতে পারতাম। আমার সময়ের রাজা এবং ব্রাহ্মণদের চেয়ে আমি অনেক বেশী সংযমী হতে পারতাম। হর্ষ এবং অপর রাজগণের মতো আমি লক্ষ সুন্দরী উপভোগকারী হওয়ার আকাঙ্কা পোষণ করিনি। খুব বেশী হলে একশ’ সুন্দরী আছে যাদের সঙ্গে কোনো না কোনো সময়ে আমার প্রণয় হয়েছিল। কিন্তু আমার বাড়িঘর, সম্পত্তি সব কিছুই হর্ষের রাজ্যে অস্থিত। যখন তার কাছ থেকে দূতের পর দূত আসতে লাগল, তখন কি করে আমি তার দরবারে যেতে অস্বীকার করি? হ্যাঁ, আমিও যদি অশ্বঘোষ হতাম, সংসার সম্বন্ধে উদাসীন থাকতাম তা’হলে হর্ষের কোনো পরোয়া করতাম না।

হষেৃর সম্বন্ধে যদি আমার গোপন মতামত জিজ্ঞাসা করেন, তবে আমি বলব যে, তার সমেয় সে মন্দ লোক বা মন্দ রাজা ছিল না। আপন ভ্রাতা রাজ্যবর্ধনের সঙ্গে তার অত্যন্ত সম্প্রীতি ছিল। ভাইয়ের জন্য যদি ‘সতী’ হওয়ার বিধান ধর্মনায়কগণ দিত অথবা তার সামান্য ইঙ্গিত করত, তবে সেও তাই করে বসত। কিন্তু তার মধ্যে অনেক দোষও ছিল, এবং সব চেয়ে বড় দোষ ছিল মিথ্যা ঠাট দেখানোÍপ্রশংসার আকাঙ্ক্ষা থাকা সত্ত্বেও নিজেকে সে-সম্বন্ধে নিস্পৃহ দেখাত; সুন্দরীদের সম্বন্ধে কামনা থাকা সত্ত্বেও নিজেকে কামনা রহিত বলে জাহির করত। যশোস্পৃহা সত্ত্বেও যশ থেকে দুরে থাকার প্রয়াস পেত। হর্ষকে না জানিয়ে আপন নাটকসমূহকে ‘নিপুণ কবি হর্ষ’ এই নামে আমি নিজের লেখা নাটককে রাতদিনের সঙ্গ লাভের পরও সে কখনও আমাকে বলেনি, ‘বাণ, এখন এই নাটকগুলিকে তোমার নামেই প্রচারিত হতে দাও।’ এ কাজ তার পক্ষে একেবারেই সহজ ছিল। তার অধীন সামন্ত-দরবারে শুধু একবার ‘শ্রীহর্ষো নিপুণঃ কবি’ এই জায়গায় ‘শ্রীবাণো নিপুণঃ কবিঃ’ এই নামে নাটকের অভিনয় করালেই হত।

জগৎ যেমন রয়েছে তাকে ঠিক তেমনিভাবে চিত্রিত করায় আমার আগ্রহ। আমি বারোটি বছর যদি পর্যটনে না কাটাতাম, তবে সম্ভবত এই আগ্রহ জন্মাত না, জন্মালেও আমি সেটা চরিতার্থ করতে পারতাম না। আমি যেখানে অচ্ছোদ সরোবরের বর্ণনা দিয়েছি, সেখানে হিমালয়ের পর্বতের এক সুন্দর দৃশ্য আমার মানসপটে ছিল। কাদমরী-ভবনের বর্ণনায় হিমালয়ের দৃশ্য ছিল। বিদ্ব্যাটবতী নিজেরই দেখা এক বৃদ্ধ দ্রাবিড় ধার্মিককে আমি বসিয়েছি। কিন্তু শুধু এইটুকু চিত্রণে আমি আামার লেখনীকে বিশ্রাম দিতে চাইনি। রাজন্যবর্গের প্রাসাদ, অন্তুঃপুর এবং তাদের ধন-দৌলতের চিত্রণ আমি আামার গ্রন্থে করেছি; কিন্তু আমি পর্নকুটির এবং তার দুঃখদুর্দশাপূর্ণ জীবনকে চিত্রিত করতে পারিনি, যদি করতাম তবে ঐ সব রাজপ্রাসাদ এবং রাজসম্পদভোগীদের ওপর এমন গভীর কালিমা লেপন করতে হত যে, প্রতি পঞ্চম বছরে প্রয়াগে রাজকোষÍভুল বলা হল, উদ্ধৃত্তকোষ উজাড়-করা হর্ষ আমাকে শুধু লম্পট উপাধি দিয়েই সন্তুষ্ট থাকত না।

আমাকে লোকে দুর্মখ বলে, কেন না কটুসত্য বলা আমার অভ্যাস। আমাদের সময়ে আরও কটুসত্য বলার লোক যখন-তখন দেখা যেত; কিন্তু তারা সে সব কথা বলত পাগলামীর ছলে, যার ফলে অনেকেই তাদের সত্যিকারের পাগল মনে করত এবং অনেকে মনে করত শ্রীপর্বত থেকে আগত কোনো অদ্ভুত সিগ্ধপুরুষ বলে। আমিও এই শ্রীপর্বতের যুগে এক খাসা সিগ্ধপুরুষ সাজতে পারতাম; আর তা’হলে আমার নাম দুর্মুখ হত না।  কিন্তু এই লোকবঞ্চনা আমার কাম্য নয়। লোকবঞ্চনার কথা মনে করেই আমি নালন্দা ছেড়েছি, না হলে আমিও সেখানকার পণ্ডিত, মহাপণ্ডিত হয়ে যেতাম। সেখানে এক ব্যক্তিকে আমি অন্ধকার রাত্রিতে জলন্ত অঙ্গার নিক্ষেপ করতে দেখেছিলাম; কিনউত এত্ত দেখিছিলাম; কি রকমভাবে তাঁর শত্রুমিত্র সকলেই তাঁর পিছনে লেগেছে। সেই ব্যক্তি সম্বন্ধে আপনাদের হয়ত কৌতুহল জেগে থাকবে। তিনি তার্কিক শ্রেষ্ঠ, নালন্দায় বসে ভঙ্কানিনাদে তিনি বলেছিলেন, বুদ্ধির ওপর পুথিকে স্থান দেওয়া, ঈশ্বরকে সংসারের কর্তা মনে করা, ধর্মপালনের ইচ্ছা, জন্ম-জাতির অভিমান, পাপক্ষয় করার জন্য শীররকে সস্তপ্ত করাÍবিবেচনাহীন জড়ত্বের পঞ্চলক্ষণ এগুলি।

ধর্মকীর্তিকে আমি বলেছিলাম, æআচার্য’ আপনার অস্ত্র তীক্ষ্ণ, কিন্তু এত বেশী সুক্ষ্ণ হয়ে গেছে যে, লোকের নজরেই পড়বে না।”

বেদপ্রমাণ্যং কণ্যচিৎকর্তৃবাদঃ স্নানে ধর্মেচ্ছা জাতিবাদাবলেপ:।

সন্তাপারম্ভঃ পাপহানায় চেতি ধ্বস্তপ্রজ্ঞানাং পঞ্চালিদানি জাভ্‌য়েঃÍপ্রমাণবার্তিক ধর্মকীর্তি বললেন, æআমার অস্ত্রের দুর্বলতার কথা আমি নিজেও বুঝি। আমি যাকে ধ্বংস করতে চাই তার জন্য আমাকে সব কিছু ত্যাগ করে চোখ-ঝলসানো প্রচণ্ড অস্ত্র ধারণ করতে হবে। নালন্দার মহাস্থবির (সন্ত-মহন্ত) ইতিমধ্যেই আমার ওপর অসন্তুষ্ট। তুমি কি মনে কর একটি বিদ্যার্থী লাভেও আমি সমর্থ হতে পারব, যদি আমি বলতে আরম্ভ করি নালন্দা এক প্রহসন বিশেষ! এখানে এমন সব বিদ্যার্থী আসে, যারা বিশাল জগৎকে আলোকিত করতে পারে না, যারা আপন জ্ঞানলোকে অজ্ঞ-স্বল্পজ্ঞদের চোখেই শুধু ধাঁধার সৃষ্টি করতে পারে! শীলাদিত্য প্রদত্ত গ্রাম থেকে যারা সুগন্ধি চাল, মশলা, ঘি, খেজুর ইত্যাদি পায় তারা তার ভোগ-শিকাররূপী প্রজা-সাধারণকে বিদ্রোহী হওয়ার শিক্ষা কেমন করে দেবে?”

আচার্য, এই অন্ধকার থেকে উদ্ধার পাওয়ার কোন পথ কি পেয়েছেন?”

পথ? সকল রোগেরই মহৌষধ আছে, সকল রকম বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার রাস্তা অথবা কোনো না কোনো পথ আছে কিন্তু এই অন্ধকার রাত্রি থেকে উদ্ধার পাওয়ার রাস্তা অথবা বৈতরণীর সেতু একদিনে তৈরী হতে পারে না বন্ধু! কারণ এর নির্মাণকারীর সংখ্যাঅ কম এবং অপরদিকে অন্ধকারের দুর্ভেদ্যতা অত্যন্ত প্রবল।”

তা’হলে কি হতাশ হয়ে বসে পড়তে হবে?”

বসে পড়াটা লোকবঞ্চনা থেকে ভালো। দেখছ না, যাদের পথ-পদর্শক হওয়া উচিত তারাই কি রকম প্রবঞ্চক? আর এই অবস্থা শুধু মাত্র এই দেশেই নয়, সমগ্র বিশ্বেই। সিংহল, সুবর্ণদ্বীপ, যবদ্বীপ, কম্বোদ্বীপ, চীন, তুষার, (মধ্য এশিয়া) পারস্য কোন জায়গায় বিদ্বান ও বিদ্যার্থী নালন্দায় নেই? এদের সঙ্গে আলোচনা করেলেই বোঝা যায় যে দুনিয়া অন্ধকারে পূর্ণ হয়ে গেছেÍধিগ্ ব্যাপকং তমঃ!”

জলন্ত শব্দাঙ্গার নিক্ষেপ করে ধর্মকীর্তি এই ঘোর তমসাকে দুর করবার প্রচণ্ড চেষ্টা করেন; কিন্তু তৎকালে এর থেকে কোনো সুফল ফলতে আমি দেখিনি। আমি একাই উজ্জল দীপযষ্টি বহন করে চলতে কৃতসঙ্কল্প হলাম। এর একটা ফল এই হলে যে, আমি দুর্মুখ বনে গেলাম। এখানে এ কথা পরিষ্কার করে দিতে চাই যে, আপন রসনার ব্যবহারে আমাকেও রাজসত্তার ওপর প্রত্যক্ষ আক্রমন না-তরা সম্বন্ধে সচেতন থাকতে হত, না হলে দুর্মুখের মুখ দশ দিনেই বন্ধ করে দেওয়া হত! তা সত্বেও নিজিকে বাঁচিয়ে কখনও কখনও আমি বহু দূর পর্যন্ত অগ্রসর হতাম

মরণের পর মুক্তি এবং নির্বাণ-প্রাপ্তির যে-কথা তোমরা বল,কি অর্থ আছে তার?

যে লক্ষ লক্ষ দাসকে পশুরন্যায় আবদ্ধ রেখে ক্রয়-বিক্রয় করা হচ্ছে, তাদের কেন মুক্ত করার চেষ্টা কর না? প্রয়োগের মেলায় একবার রাজা শীলদিত্যকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, মহারাজ, আপনি যে বড় বড় বিত্তশালী মঠ এবং ব্রাহ্মণদের মাঝে প্রতি পঞ্চম বৎসরে এত ধন-দৌলত বিতরণ করছেন, সেগুলি যদি দাসদাসীদের মুক্ত করার কাজে লাগাতেন, হা’হলে কি তাতে কম পুণ্যের কাজ হত?”

একান্ত সময় আলোচনা করার কথা বলে শীলাদিত্য এ প্রশ্ন এড়াতে চেয়েছিল, কিন্তু সেই ‘অন্য সময়’ও আমি খুঁজে বর করলাম। রাজার ভগ্নী ভিক্ষুণী জোর করেই সে সুযোগ সৃষ্টি করে দিল। রাজ্যশ্রীর সামনে আমি দাসদাসীদের নরক-যন্ত্রণার চিত্র তুলে ধরলাম। তার হুদয় বিগলিত হয়ে গেল। তারপর যখন আমি বললাম যে, অর্থ দিয়ে এই সানতন বংশপরস্পরায় বন্দী মানুষের মুক্তি দান করা সবচেয়ে পুণ্যের কাজ, তখনই সে কথা তার মনে ধরে গেল। বেচারী সরল-হুদয়া স্ত্রীলোক, দাসস্থের আবরণে লুকায়িত বড় বড় স্বার্থের কথা সে কি জানে? সে কি করে জানবে যে, যেদিন মাটিকে স্বর্গে পরিণত করা যাবে, আকাশের স্বর্গ সেদিন হেলে পড়বে! আকাশ-পাতাল, স্বর্গ-নরগ কায়েম রাখার  জন্য, তাদের নামে লাভের কারবার চালানোর জন্য –পৃথিবীতে স্বর্গ-নরক, রাজা-ভিখারী, দাস-স্বামীর প্রয়োজন হয়।

রাজা নির্জনে বসে আলোচনা করল। প্রথমে সে বলল, “একবার অর্থব্যয় করে তাদের আমি মুক্ত করতে পারি, ক্নিতু দারিদ্র্যের চাপে সে মুক্তি বিকিয়ে যাবে।”

“ভবিষ্যতের জন্য মানুষের ক্রয়-বিক্রয় দন্ডনীয় করে দিন।”

এরপর সে চুপ করে ভাবতে লাগল। আমি তার সামনে ‘রাগানন্দের’ নাগের দৃষ্টান্ত তুলে ধরলাম, যে অপরের প্রাণরক্ষার  জন্য নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে চেয়েছিল। ‘নাগানন্দ’হর্ষরাজের সৃষ্ট নাটক বলে কথিত, সুতরাং কি জবাব দেবে সে? শেষকালে সে জানল যে, দাসদাসীদের মুক্ত করায় সে ততটা কীর্তিলাভের আশা রাখে না, যতটা  রাখে শ্রমণ-ব্রাক্ষণদের ঝুলি ভরায় বা বড় বড় মঠ মন্দির  নির্মাণে । এই দিন আমার কাছে পরিষ্কার  হয়ে গেল, সে শীলাদিত্য নয়- শীলান্ধকার।

বেচারা শীলাদিত্যকেই বা আমি কেন দোষ দিই? আজকাল কুলীন নাগরিক হওয়ার লক্ষণই হল যে, সকলেই পরস্পরকে বঞ্চনা করে চলেছে। পুরাতন বৌদ্ধগ্রন্থে বুদ্ধকালনি রীতিনীতির কথা পাঠ করে আমি জেনেছি, পূর্বে মদ্যপান জলপানেরই সামিল ছিল। মদ্যপান না করাকে সে সময় উপবাস-ব্রত বলে মনে করা হত। আজকাল ব্রাহ্মণেরা মদ্যপান নিষিদ্ধ করেছে এবং প্রকাশ্য মদ্য পান করায় শাস্তি পেতে হয়। এ সবের পরিণাম কি? দেবতার নামে সিদ্ধি-সাধনার নামে লুকিয়ে ভৈরবীচক্র চলছে। ব্রহ্মচর্য নিয়ে মহা সোরগোল সুরু হয়েছে, কিন্তু পরিণাম? ভৈরবীচক্রে আপন-পর সকল স্ত্রী ভোগাধিকারভুক্ত। এর চেয়েও জঘণ্য ব্যাপার, দেবতার বরদানে নামে সেখানে মাতা-ভগ্নী-কন্যা পর্যন্ত ভোগাধিকারভুক্ত হয়ে উঠেছে। আর পরিব্রাজক,ভিক্ষু এদের আখড়াগুলি অপ্রাকৃতির ব্যভিচারে আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছে।

যদি সত্যই এই জগৎকে দেখাশোনার কেউ থাকত, তবে এই বঞ্চনা, এই অন্ধকার এক মুহূর্তের জন্যও সে বরদাস্ত করত না।

একবার আমি কামরূপ গিয়েছিলাম। সেখানকার রাজা নালন্দার ভক্ত এবং মহাযানের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাবান। ইম বলেছিলাম, “মহাযাত্রী বোধিসত্বের ব্রতকে আপনি মান্য করেন, যে ব্রতে বলা হয়েছে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত একটিও প্রাণী বন্দী হয়ে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত নির্বাণ আমার কাম্য নয। মহারাজ আপনার রাজ্যে অনেক চণ্ডাল আছে, যারা দণ্ড হাতে নিয়ে নগরে আসে আর রাস্তায় আওয়াজ করতে করতে যায়। তার লোককে সচেতন করে দেয়, যাতের তাদের ছোঁয়া লেগে কেউ যেন অস্পৃশ্য না হয়। তারা হাতে করে পাত্র বয়ে নিয়ে চলে, যাতে তাদের অপবিত্র থুতু নগরেরপবিত্র মাটিতে না পড়ে। কুকুরকে স্পর্শ করলে মানুষ অপবিত্র হয় না, তার বিষ্ঠাও নগরকে চিরদুষিত কর রাখে না। তবে কি চণ্ডালেরা কুকুরের চেয়েও অধম?”

“কুকুরের চেয়ে অধম নয়। এদের মধ্যেও জীবন-প্রবাহ নিহিত আছে, যা বিকাশিত হয়ে বৌদ্ধিক উৎকর্ষে পৌঁছাতে পারে।”

“তা’হলে রাজ্যে ঢোল বাজিয়ে ঘোষণা করে দিন না যে, আজ থেকে কোনো চণ্ডালকে নগরে আসতে দণ্ড অথবা কিদানী বয়ে আনতে হবে না?”

“এ আমার শক্তির অতীত; সমাজ-ব্যবস্থা এমনভাবেই রচিত হয়েছে।”

“বোধিসত্বের ধর্মে—মহামানবের কি এই ব্যবস্থা?”

“কিন্তু এখানকার সকল প্রজা তো মহামন্ত্র অনুসরণ করে চলে না।”

“গ্রামে, শহরে সর্বত্র আমি ত্রিরত্বের জয়দুন্দুভি বেজে উঠতে দেখেছি।”

“হ্যাঁ, কথা তো ভালোই । যেদিন আমি এ কথা ঘোষণা করব, সেই দিনই আমার প্রতিদ্বন্দ্বীরা আমার বিরুদ্ধে এই বলে তুফান সৃষ্টি করবে যে, সনাতন কার থেকে চলে আসা এক সেতুকে আমি উড়িয়ে দিচ্ছি।”

“বোধিসত্বা-জীবনের মহিমা সম্বন্ধে অহনিশি যে উপদেশ প্রচারিত হচ্ছে, করাও ওপর কোনো প্রভাবই কি তার পড়েনি? আমি বিশ্বাস করি মহারাজ, নিশ্চয় এর প্রভাব পড়েছে, এবং যদি বোধিসত্বের ন্যায় আপনি আপনার সমস্ত কিছু ত্যাগ করার জন্য প্রস্তত হন, তবে আপনাকে অনুসরণ করে চলার পথিকও পাওয়া যাবে।”

“রাজ্যের ভিতরকার প্রশ্নই শুধু নয়, পরমভট্টারকদেবও অসন্তুষ্ট হয়ে উঠবেন।”

“শীলাদিত্য! যে ‘নাগানন্দ’ নাটকে বোধিসত্বের উজ্জ্বল চিত্র অঙ্কিত করেছে?”

“হ্যাঁ, প্রচলিত লোকাচার উঠিয়ে দেওয়া তাঁরও ক্ষমাতাধীণ নয়।”

“এমন কথা যদি তথাগত, যদি আর্য অশ্বঘোষ অথবা নাগার্জুন মনে করতেন?”

“তাঁদের সাহস ছিল, তবু রীতি বর্জন করে তাঁরাও বেশী দুর যেতে পারেননি।”

“বেশীদুর নয়, অল্প দুরই আপনি চলুন মহারাজ, কিছুদুর আপনি অগ্রসর হন।”

“আপনি কি আমাকে নিজ মুখ দিয়ে কাপুরুষ বলিয়ে ছাড়বেন?”

“কাপুরুষ বলছি না। কিন্তু শুনুন, ধর্ম আমাদের কাছে এক নাগপাশ বিশেষ!”

“আমার অন্যরকে জিজ্ঞাসা করলে আমি ‘হ্যাঁ’ বলব, রসনাকে জিজ্ঞাসা করলে সে পরিষ্কার ‘না’ বলবে অথবা একেবারেই মৌনব্রত ধারণ করবে।”

*                             *                             *

ব্রাহ্মণ্য ধর্মে আমার ঘৃণা ধরে গেছে! বস্তুত কামরূপ নৃপতির মতো বহু সদন্তঃকরণ লোককে কাপুরুষ রূপে সৃষ্টি করার অপরাধ এই ব্রাহ্মণ্য ধর্মের। যে দিন এই ধর্ম এ দেশ থেকে উঠে যাবে, সেদিন পৃথিবীর এক গুরুতর কলঙ্ক ঘুচে যাবে। নালন্দায় এসে বিদেশী ভিক্ষুদের কাছেআমি ‍শুনেছি, তাদের দেশে ব্রাহ্মণের ন্যায় কোনো সর্বশক্তিমান ধর্মনায়কের জাতি নেই। তাদের কথায় বুঝেছি যে, কেন সেই সব দেশে দণ্ড এবঙ মুখপাত্র বহনকারী চণ্ডালের দেখা পাওয়া যায় না। ব্রাহ্মণেরা আমাদের দেশে মানুষকে ছোট বড় জাতে এমনভাবে ভাগ করে দিয়েছে যে, কেউই নিজের চেয়ে নীচু জাতের লোকের সঙ্গে মিশতে প্রস্তুত নয়। এদের ধর্ম আর জ্ঞান নিছক রাহুকেতুর ছায়া বিশেষ।

নালন্দায় দেশেদেশান্তরের বিচিত্র সংবাদ পাওয়া যেত এ জন্য আমি দু-এক বছরনানা দেশ পর্যটন করে পুনরায় ছয় মাসের জন্য নালন্দায় চলে যেতাম। একবার এক পারসিক ভিক্ষু বলেছিলেন যে, তাঁর দশে কিছুকাল পুর্বে মজদ্‌ক নামে এক বিদ্বান ছিলেন, যিনি এক প্রকারের সঙ্ঘবাদের (যতদূর পযন্ত সম্পত্তির প্রশ্ন রয়েছে) প্রচার করেছিলেন। কিন্তু সেই সঙ্ঘবাদ এখন শুধু বিনয়পিটকে পঠনীয় বস্তু মাত্র। আজ বড় বড় বৈয়ক্তিক (পৌদগলিক) সম্পত্তি ভোগকারী ভিক্ষু রয়েছে। আচার্য মজদক ব্রহ্মচর্য এবং ভিক্ষুবাদ মানতেন না। তিনি মানুষের স্বাভাবিক জীবন—প্রেমিক-প্রেমিকা, পুত্র-পৌত্রের জীবনকেই শুধু স্বীকার করতেন; কিন্তু বলতেন সকল পাপের মুল হল ‘আমি’ এবং ‘আমার’। তিনি বলেছিলেন, ‘সম্পত্তি স্বতন্ত্র হওয়া উচিত নয়, প্রেম স্বেচ্ছানুযায়ী চলবে এবং সন্তান সকলের সম্মিলিত সম্পত্তি বলে গণ্য হবে। জীবে দয়া এবং সংযমের শিক্ষাও তিনি দিতেন। তাঁর মতবাদ আমার কাছে সুন্দর মনে হল। আমি যখন শুনলাম যে, মজদ্‌ক এবং তাঁর লক্ষ লক্ষ অনুচরকে মেরে এক পারসিক রাজা—নোলেরিয়াঁ, ন্যায়মূর্তি উপাধি ধারণ করেছে, তখন বুঝতে পারলাম, যতদিন পর্যন্ত রাজা থাকবে যতদিন তাদের দান-পুণ্যের সাহায্যে বেঁচে থাকা শ্রমণ-ব্রাহ্মণ থাকবে, ততদিন পৃথিবী স্বর্গে পরিণত হতে পারে না।

 ১৪. চক্রপাণি (কাল : ১২০০ খৃষ্টাব্দ)

এই সময় কনৌজ  ভারতের সবচেয়ে বড় সমৃদ্ধ নগর ছিল- তার জমকালো হাট-বাট, চৌরাস্তায়। মিষ্টন্ন, সুগন্ধি তৈল, অলস্কার এবং অন্যান্য বিহুবিধ জিনিসের জন্য সারা ভারহে প্রসিদ্ধ ছিল কনৌজ। ছ’শ বছর ধরে মৌখরি, বৈশ্য, প্রতিহার, গহড়বার মতো ভারতের তদানীন্তন সর্বোচ্চ রাজবংশগুলোর রাজধানী থাকার ফলে তার প্রতি শ্রদ্ধার ভাবও লোকের মনে সজ্ঞাত হয়েছিল। সেই কারণে হিন্দুরা নিজেদের পদবীর সঙ্গে কনৌজ শ্বদটি জুড়ে নিত। তাই আজও ব্রাক্ষণ, আহীর, কাঁছ ইত্যাদি বহু জাতির মধ্যে কান্যকুজ ব্রাক্ষণ, কান্যকুজ আহীর ইত্যাদি দেখা যায়। পদবীর আগে কনৌজ শ্বদটি যোগ হলে হিন্দুদের মধ্যে কুলজ মর্যাদা বৃদ্ধি পেত। হর্ষবর্ধনের সময় থেকে এই সময় পর্যন্ত জগতে বহু পরিবর্তন ঘটে গেছে, কিন্তু তখনকার চেয়ে এখন ভারতীয় মনোরাজ্যে অধিকতর কৃপমন্ডুকতা এসে বাসা বেঁধেছে।

হর্ষবর্ধরে সময়ে আরবে এক নতুন ধর্ম- ইসলাম জম্মলাভ করে। সেই সময় কে বলতে পেরেছিল,ইসলামের সংস্থাপকের মৃত্যুর (৬২২ খৃঃ ) একশ’ বছরের মধ্যেই এই ধর্ম সিন্ধু থেকে স্পেন পর্যন্ত ছেড়িয়ে পড়বে! এতদিন জাতি এবং রাজার নামে দেশবিজয়ের কথাই শোনা গিয়েছিল, এ-বার ধর্মের নামে দেশ জয়ে কথা প্রথম শোনা গেল। আপন শিকার-সমুহকে সতর্ক হবার সুযোগও সে দিল না এবং তাদের একের পর এক প্রাস করে ফেললে। সাসানিগণের ( ইরাণীগণের ) শক্তিশালী সাম্রাজ্য তআরবদের স্পর্শমাত্র কাগজের নৌকার ন্যায় গেল পড়ল, এবং ইসলাম সংস্থাপকের মৃত্যুর পর দুই শতাব্দী পার হতে না হতে ইসলামী রাজ্যের ধ্বজা পামীরের ওপর উড়তে লাগল।

ইসলাম প্রথমে সমগ্র দুনিয়াকে আপন আরবী উপজাতিগ্রলোর বিস্তৃত-রুপে রুপায়িত করতে চেয়েছিল, এবং সেই সঙ্গে উপজাতির সবলতা, সাম্যভাবও ভ্রাতৃত্বকে আপন অনুগামীগণের মধ্যে জাগ্রত করে তূলতে চেয়েছিল। এই সময় থেকে তিন হাজার বছর পুর্বেই দিক আর্ষভাষীদের পুর্বজগণ ৈএই অবস্থাকে অতিক্রম করে এসেছে।অতিবাহিত যুগের পুনরাবৃত্তি অসম্ভব। এই জন্য যেমন ইসলাম তার উপজাতিসমুহের পরবর্তী ধাপে অবস্থিত সামন্তযুগের সংস্পর্থে এসেছে এবং তার তরবারির সামনে আক্রান্তের রানৈতিক স্বাতস্ত্র্য বিলীন হয়ে গেছে, তেমনি ঐ সংস্পর্শে এসেই ইসলামী সমাজের উপজাতীয়তার স্বরুপও বিনষ্ট হয়ে গেছে। ইসলামের প্রধান শাসককে বহুকাল পর্যন্ত কেবল তার সংস্থাপকের খলিফা-উত্তরাধিকারী বলা হত। বস্তুত স সুলতান-নিরক্ষুশ রাজা হওয়া সত্ত্বেও। এখন অবশষ্য নামে নিজেদের সুলতান বলে জাহির করার মতো অনেকেই এসে ড় হয়েছে। এদের কাছে ইসলামের উপজাতীয়তা, তার সরলতা বা ভ্রাতৃভাবের বিশেষ কোনো মুল্য নেই। নতুন অষ্ণল জয় করতে প্রয়োজন হত অস্ত্রচালনাকারী সৈন্যের এবং অস্ত্রচালনাকারীরা ৈএই সময় সবাই আরব জাতের ছিল না। এইসব ন্যৈদের সুলতানের সামে লড়াই করার জন্য উৎসাহিত করা যেত না, এ জন্য স্বর্গস্থিত নানা প্রলোভনের সঙ্গে সঙ্গে পার্থিব আনন্দের ভাগও তাদের দেওয়া হত। লুটের মাল এবং বন্দীদের ওপর তাদের অধিকার ছিল, নব-জয়লব্ধ ভুমিতে বসতি করার স্বত্ত তাদের ছিল, পুর্বতন অত্যাচারী. প্রবুকুলের কবল থেকে মুক্তি পাবার, এমন কি তাদের অস্তিত্বকেও বিলুপ্ত করে দেবার ও অধিকার ছিল। বিজেতার ধ্বজাকে আপনজ্ঞানে সগর্বে বয়ে নিয়ে চলার মতো এত  সৈন্য বিজিতদের ভিতর থেকে কেউ কখনও লাভ করেনি। -যারা আক্রান্তদের ভিতর থেকেই নিজেদের জন্য ন্যৈ সংগ্রহ করতে সক্ষম, তাদের সম্মুখীন হওয়া সহজ কাজ নয়।

হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর একশ’ বছরও কাটেনি এমন সময় সিন্ধু িইসলাম শাসনে চলে গেল। বারাণসী থেকে সোমনাথ (গুজরাট ) পর্যন্ত সারা ভারত ইসলামী অস্ত্রের স্পর্শ অনুভব করতে লাগল। এই নতুন বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার জন্য প্রয়োজন ছিল নতুন কর্মপদ্দতির, কিন্তু হিন্দুরা নিজেদের পুরনো পথ পরিত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিল না। সমগ্র দেশকে যুদ্দের জন্য প্রস্তুত করার বদলে ভারতের ন্যৈবাহিনী তৈরী হল একমাত্র রাজপুতদের ( প্রাচীন ক্ষত্রিয় এবং এদের সঙ্গে বিবাহাদি সুত্রে আবদ্ধ শক, যবন, গুর্জর ইত্যাদি )নিয়ে। আবার অন্তবৈরিতা থেকে এরা মুক্ত ছিলনা এবং রাজবংশগুলোর মধ্যে নতুন-পুরাতন শক্রতার জন্য শেষ পর্যন্ত ও তারা পারস্পরিক সহযোহিতার ভিত্তিতে ইসলামী আক্রমণের বিরুদ্ েপ্রস্তুত হতে পারল না।

“মহারাজ কোনো চিন্তা করবেন না। স্ধিগুরু এমন সাধনা সুরু করেছেন যাতে তুর্কসেনা শুকনো পাতার মতো হাওয়ায় উড়ে যাবে।”

“আমার ওপর শুরু মিত্রপাদের (জগন্মিত্রানন্দ ) কি অসীম করুণা! আমার বা আমার পরিবারের যখনই কোনো সস্কট এসেছে, গুরুমহারাজ দিব্যবলে রক্ষা করেছেন।”

“মহারাজ, সিদ্ধগুরু হিমালয়ের ওপারে ভোট দেশ থেকে কান্যকুজের সস্কট দেখতে পেয়েছেন, এই জস্যই তিনি আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন।”

“কি অপার করুণা !”

“বলেছেন, তারিণী ( তারাদেবী) মহারাজের সহায়তা করবেন। তুকীদের সম্বদ্ধে আনি কিছু ভাববেন না।”

“তারা মায়ের ওপর আমার পুর্ণ আস্থা আছে। তারিণী, বরাভয়দারিনী ! স্নেচ্ছদের হাত থেকে রক্ষা কর মা।”

বৃদ্ধ মহারাজ জয়চন্দ্র ইন্দ্রভবনতুল্য আপন রাজপ্রাসাদে এক কর্পুরশ্বেত সিংহাসনে বসে রয়েছেন। চাজন সুন্দরী তরুণী রানী তাঁর পাশে বসে, এদের গৌর মুখমন্ডল থেকে ভ্রমরের চেয়েও কালো চুলের রাশ টেনে পিছনের দিকে খোঁপা করে বাঁধা । চুড়ামণি, কর্ণফুল, অঙ্গদ, কষ্কণ , চন্দ্রহার, মুক্তাহার , কাটকিস্কিনী, নুপুর ইত্যাদি নানা অলস্কারের ভার এদের গেতের ওজন অপেক্ষা বেশী । পণে সুক্ষ পাড়ি কাঁচুলী, কিন্তু বেশ বোঝা যায়, দেহ আবৃত করার জন্য এগুলো পরা হয়নি, হয়েছে দেহ-সৌষ্ঠব সুপ্রকট করে তুলে ধরার জন্যেই! কাঁচুলি ভেদ করে স্মনের স্ফীতি এবং অরুণিমা সুন্দর রুপে পরিস্ফুট। নীচে নাভি পর্যন্ত সমগ্র উদর অনাচ্ছাদিত; উরু জঙ্ঘার আকৃতি ও বর্ণ পরিষ্কারভা্বে দেখা যাচ্ছে। চুলের দুগন্ধি তৈল এবং নব প্রস্ফটিত জুঁই  ফুলের মালার সুগন্ধে সমগ্র পুরী আমোদিত। রাণীরা ছাড়াও পচিশ জনের বেশী তরুণী পরিচারিকা রয়েছে। এদের  মধ্যে কেই চামর, কউ মোরছল বা ব্যজন দোলাচ্ছে। কারও হাতে পানদান, কারও হাতে আয়নাম চিরুণী, কারও হাতে সুগন্ধ জলের ঝারি, কারও হাতে কাঁচের সুরাপত্রও সোনার পেয়লা, আবার কারও হাতে সাপের চামড়ার মতো মসৃণ কোমল তোয়ালে। কউ কউ মৃদঙ্গ, মুরজ, বীণা, বেণু ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বসে রয়েছে, কউ বা স্বর্ণদন্ডু হাতে এখানে সেখানে টহল দিচ্ছে। রাজা জয়চন্দ্র এবং আগন্তুক মিত্রপাদের শিষ্যু শুভাকর ছাড়া এখানে আর সবাই মহিলা , সবাই সুন্দরী ও তরুণী। মহারাজের নিকট বিদায় নিয়ে ভিক্ষু চলে গেল। রাজা এবং রাণীরা উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানালেন।

এখন শুধু নারীময় জগৎ। জয়চন্দ্র বৃদ্ধ, কিন্তু তাঁর অধপাকা লম্বা ‍চুল মাঝখান দিয়ে ভাগ করে যেভাবে পিছনের দিকে নিয়ে বাঁধা, বিরাট গোঁফ যে রকম যম্নসহকারে আঁচড়ানো, বস্তালস্কারে তাঁর দেহ যেভাবে সজ্জিত, তাতে মনে হয়, তিনি যৌবনকে অনবসিত বলেই মনে করেন। মহারাজের ইঙ্গিতে এক পরিচারিকা তাঁর সামনে ঝুঁকে মদের পেয়ালা এগিয়ে দিল, এবং জনৈকা রাণী সেই পেয়ালা মহারাজের সামনে তুলে ধরল। পেয়ালঅটি রাণীর ঠোঁটে লাগিয়ে তিনি বললেন, “তোমার উচ্ছিষ্ট না হলে আমি কেমন করে পান করব?” এরপর তাঁর প্রিয়তমা রাণীরা একে একে প্রসাদ দিল তাঁকে। মহারাজের  মুখাবয়ব থেকে তুকীদের চিন্তা বিদুরিত হয়ে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল। রাজার স্থল দেহ মসনদের ওপর ঢলে পড়লএবং কোনো রাণীকে তাঁর এপাশে কোনো রাণীকে ওপাশে টেনে তিনি বসালেন । কারও কোলে মাথা রাখলেন, কারও বুকের ওপর হাত রাখলেন। মদের পেয়ালা চলতে লাগল; কামোদ্দীপক হাসি-ঠাট্রাও চলতে থাকল। রাণীদের নাচের আদেশ দিলেন মহারাজা। বিষন্তনা, করস নিতদ্বিনী সুন্দরীরা ঘাঘরা গানের তালে তালে নাচ সুরু হল। একটা গান শেষ হলে রাজা সুন্দরীদের নগ্ন-নৃত্যেন্ত আদেশ দিলেন। নর্তকীরা বেশবুষা সব খুলে ফেলল, রইল শুধু পায়ের নুপুর। রানী এবং তরুনী পরিচারিকাদের সঙ্গে আলিঙ্গন, চুম্বন এবং হাস্য পরিহাস চলতে লাগল। নর্তকীদের মধ্যে যার নগ্নদেহ মহারাজকে আকর্ষণ করল, সে-ই এসে বসতে লাগল মহারাজের পাশে, অন্য একজন নগ্নিকা তার স্থান পুরণ করল। আর লাল হয়ে উঠল মহারাজের চোখ, কণ্ঠস্বরে সুরা প্রভাব বিস্তার করল; মহারাজ গান ধরলেন-

‘ধ্‌ধত,–তে রি তো- তোর্‌র্‌-তু—তুর্‌—কী—ঈ—।আ—া—ম্‌মার ইন্‌—ন্‌—দ্‌র-ও পুর্—র্‌—ঈ—তে—তে কো—কো—ওন্‌শ্‌—শালা—আ—স্‌—সে। স্‌—স্‌—সব্‌জোর্‌সে ন্‌—না—া—চো ।’

সকল রাণী আপন আপন বস্ত্রালস্কার খুলে ফেলল। ওদের তরুণ সুন্দর দেহের ওপর ঘনস্থল কবরী রাজার পছন্দ হল না। কবরী খুলে ফেলতে বললেন তিনি, সব ক’জনের মাথা থেকে কালনাগিনীর মতো দীর্ঘ বেণী নিতস্বের ওপর আকছড়ে পড়ল। মহারাজকে স্বয়ং সষ্ণুক খুলতে দেখে তাঁর পরিধেয় বস্ত্র খুলে দিল তরুণীরা। তাঁর লোলচর্ম শীর্ণ চিবুক, কাঁচা-পাকা গোঁফ, প্রসুতির স্তনের মতো ঝুলে পড়া বুক, মহাকুন্তের মতো উদর এবং শীর্ণ ঢিলে চর্মাবৃত ঊরু এবং জঙ্ঘা আর কর্কম লোমশ বাহু সাধারণ তরুণীরাও ঘৃণা না করে পারে না, কিন্তু এখানে এদের দেহ প্রাণ সবই এই বৃদ্ধের হাতে। কউ তাঁর দন্তহীন ঠোঁটে নিজের ঠোঁট চেপে ধরল , কেউ বা তাঁর দেহে আপন স্তনদ্বয় পীড়িত করতে লাগল, আবার কেউ তাঁর লোমশ বাহু নিজের কাঁধে বা গালে বুলিয়ে দিতে লাগল। কামোদ্দীপক গানের সঙ্গে সঙ্গে নাচ সুরু হল, রাণী এবং পরিচারিকাদের মাঝে দাঁড়িয়ে মহারাজও তাঁর বিশাল ভুড়ি নিয়ে রাচতে আরম্ভ করলেন।

“এস কবি কুল-তিলক।”—বলে রাজা এক আধাবয়সী পুরুষকে আসন দেখিয়ে দিলেন এবং সে বসবার কপর বড় দু’খিলি পান সসম্মানে এগিয়ে দিলেন।

কবির বয়স পষ্ণাশের ওপর কিন্তু তাঁর সুন্দর সুগৌর মুখমন্ডলে অতীত যৌবনের চাপ স্পট। গোঁফের রঙ কালো , পরণে শাদা ধুতি এবং শাদা চাদর ছাড়াও তাঁর গলায় সুন্দর এক রুদ্রাক্ষের মালা এবং কপালে ভস্মাষ্কিত চন্দ্রাকার তিলক। সোনার পাতে মোড়া সুগন্ধি পান মুখে দিয়ে কবি বলল,“দেব’যাত্রা কুশলেই সাঙ্গ হয়েছে? শরীর সুস্থ ছিল? রাত্তিরে আরামেই গুমিয়েছেন তো?”

“আমি এখন পুরুষত্বহীন হয়ে পড়েছি কবি-পৃঙ্গব।”

“মহারাজ, কবি শ্রীহর্ষকে আপনি খুব ব্যঙ্গ করলেন যাহোক।”

“পুঙ্গব তো ব্যঙ্গ নয়, প্রশংসাসুচক কথা।”

“পুঙ্গব বলদকেই বলে, মহারাজ।”

“জানি, কিন্তু সেই সঙ্গে শ্রেষ্ঠকেও পুঙ্গব বলে।”

“আমি তো একে বলদ অর্থে গ্রহণ করি।”

“এবং আমি শ্রেষ্ঠ অর্থে। আর তা’ছাড়া, তোমার মতো অন্তরঙ্গ ইয়ারের সঙ্গে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ না গেলে, কার সঙ্গে করা যাবে করি?”

“কিন্তু সে তো দরাবারে বসে নয়, মহারাজ।” নীচু গলায় শ্রীহর্ষ বলল কবির হাত ধরে দরবার কক্ষ থেকে বেরিয়ে ক্রীঢ়া-উদ্যানের দিকে চললেন জয়চন্দ্র।

গ্রীষ্ম সুরু হয়েছে—মনোরম বাতাস, সবুজ রঙয়ের গাছগুলোকে আন্দোলিত করছে। দীঘির সোপানের ওপর অবস্থিত শুভ্র শিলাসনে বসে পাশের আসনে কবিতে বলতে বললেন রাজা, এবং তারপর বাক্যলাপ আরম্ভ করলেন। “রাত্তিরের কথা তুমি কি জিজ্ঞেস করছিলে কবি? আমি এখন বেশ অনুভব করছি যে, আমি বুড়ো হয়ে পড়েছি।”

“কেন?”

“উলঙ্গ সুন্দরীরাও আমার কাম জাগাতে পারছে না।”

“তা”হলে তো আপনি পুরো যোগী হয়ে পড়েছেন, মহারাজ!”

“এই যোগীর কাছে থেকে এই ষোল হাজার সুন্দরী কি করবে?”

“বিলিয়ে দিন মহারাজ, নেবার মতো লোক অনেক জুটে যাবে; অথবা গঙ্গাতীরে জলকুশ দিয়ে ব্রাহ্মণদের দান করে দিন—সর্বেষামেব দানানাং  ভার্ষাদানং বিশিষ্যতে!”

“তাই করতে হবে। বৈদ্যরাজ চক্রপাণির বাজীকরণ নিষ্ফল হয়ে গেছে। এখন শুধুমাত্র তোমার কাব্যরসের আশাতেই আছি।”

“নগ্ন-সৌন্দর্য-রস যেখানে কিছু করতে পারেনি, কাব্যরস সেখানে কি করবে মহারাজ?

তা’ছাড়া আপনি এখন ষাটের ওপরে চলে এসেছেন।”

“আমি কনৌজে আসার পর দু’মাস কেটে গেছে, কিন্তু তুমি আমার সঙ্গে এতদিন দখো করনি কেন?”

“চৈত্রের নবরাত্রিতে আমি ভগবতী বিদ্ধ্যবাসিনীর চরণ দর্শনে গিয়েছিলাম।”

“ঐ পথেই তো আমার নৌকা এসেছে, যদি জানতাম তা’হলে ডেকে নিতাম।”

“অথবা ওখানে নেমে কুমারি-পূজায় ব্যাপৃত হয়ে যেতেন।”

“তা’হলে কবিবর, তুমিও কুমারী-পূজায় জন্যই ওখানে যাওনি তো!”

“মহারাজ, আমি ভগবতীর উপাসক—শাক্ত।”

“কিন্তু তুমি যেভাবে রাম-সীতার বন্দনা কর, তাতে মনে হয় যেন খাঁটি বৈষ্ণব।”

“অন্তঃ শাক্ত। বহিশ্যৈবাঃ সভামধ্যে চ বৈষ্ণবাঃ।”

“সভামধ্যে তুমি বৈষ্ণব তা’হলে?”

“হতেই হয় মহারাজ! আপনার মতো অন্যের জিভ টেনে ধরতে তো পারি না।”

“ধন্য হে তুমি বহুরূপী!”

“শুধু এইটুকুই নয় মহারাজ, আমি বুদ্ধকেও আমার আরাধ্য করে নিয়েছি।”

“সুগত—ভগবান তথাগতকেও?”
“ভগবান!”

“হ্যাঁ, কিন্তু এখানে বসে ও নাম শুনলে আমারও চক্ষুলজ্জা হয়!”

“মহারাজ, শাক্তদের সুবিধার জন্য সুগতের পূজা সরল করে দিয়েছি বজ্রযান রূপে।”

“ঠিক বলেছ বন্ধু, এই জন্যেই তো তাকে সহজিয়া বলা হয়।”

“এই সহজিয়া সিদ্ধগণের দোহা এবং গানে কোনো কবিত্বের স্ফুরণ আমি দেখতে পাই না; কিন্তু পঞ্চ ম-কার (মদ, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা, মৈথুন) প্রচার করে যতটা জন-কল্যাণ এরা করেছেন, তার জন্য আমি যথেষ্ট কৃতজ্ঞ।”

“কিন্তু আমার পক্ষে এখন আর এই পঞ্চ ম-কারের উপাসনা করা দুস্কর।”

“বজ্রযানের সঙ্গে নাগাজুর্নের মাধ্যমিক দর্শন—একেবারে যেন সোনায় সোহাগা।”

“তোমার কাব্যরস তো তবু চেখে দেখতে পারি, যদিও ওতেও কখনও কখনও মাথা ঘুরে যায়; কিন্তু এই দর্শনশাস্ত্র যেন পর্বতপ্রমাণ বোঝা  হয়ে চেপে বসে।”

“তা’হলে মহারাজ, নাগাজুর্নের দর্শন বহু মিথ্যা ধারণা দূর কর।”

“কিন্তু তুমি তো বেদাস্ত-বিশারদ কবি!”

“আমার গ্রন্থকে আমি বেদান্ত বলেই প্রসিদ্ধ করে নিয়েছি মহারাজ, কিন্তু ‘খণ্ডন-খণ্ড খাদ্য’-তে নাগার্জুনের চরণধুলিকেই বিতরণ করেছি সর্বত্র।”

“মনে তো থাকবেই না, তবু বল শুনি নাগার্জুনের মূল কথা কি?”

“সিদ্ধরাজ মিত্রপাদ তো নাগার্জুনের দর্শনেই বিশ্বাস করেন।”

“আমার দীক্ষাগুরু?”

“হ্যাঁ। নাগার্জুন বলেন—পাপ-পূণ্য, আচার-দুরাচার সবই কল্পনা, জগতের সত্তা-অসত্তা কিছুই প্রমাণ করা যায় না। স্বর্গ-নরক, বন্ধন-মোক্ষ সবই ভ্রম। পূজা, উপাসনা এগুলো মূর্খ লোকদের বঞ্চনা করার জন্য; দেবদেবী সম্বন্ধে লোকেত্তর সব ধারণাই অলীক।”

“আমিও তো এই দর্শনকে অনুসরণ করেই জীবন কাটিয়েছি কবি!”

“সকলেই কাটায় মহারাজ, মুর্খেরাই শুধু নগদ ছেড়ে ধারের পেছনে ছোটে!”

“কিন্তু এখন যে আমার নগদকে সামনে ফেলে রেখে শুধু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে হয় বন্ধু! কিন্তু তোমার এখনও বয়স পেরোয়নি বলেই মনে হয়।”

“আপনার চেয়ে আমি আট বছরের ছোট, তা’ছাড়া একটির বেশী বিয়েও করিনি।”

“বেশী বিয়ে করলে বিয়ের পাকেই ক্লান্ত হয়ে মারা পড়ে মানুষ!”

“আমার ঘরে একটি মাত্র ব্রাহ্মণীই আছে মহারাজ।”

“এবং তোমার ধারণা যে, সমগ্র দুনিয়া তাই বিশ্বাস করবে—কবি শ্রীহর্ষ সেই দাঁতভাঙা একটি বুড়ির প্রতি একান্ত অনুরক্ত!”

“বিশ্বাস করবে এবং করছেও মহারাজ! আমার গ্রন্থে আমি আমার সমাধিস্থ হয়ে ব্রহ্ম-সাক্ষাৎকারর কথা লিখেছি।”

“তোমাদের মাধ্যমিক দর্শনে তা’হলে ব্রহ্ম এবং তাঁর সাক্ষাৎকারের স্থানও আছে?”

“কিসের স্থান ওতে নেই মহারাজ!”

“প্রজাদের দৃষ্টি চিরকালের মতো অন্ধ করে রাখতে হবে তাই সব রকমের সাক্ষাৎকারের কথা তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া দরকার!”

“ধর্মের ওপর থেকে আপনার বিশ্বাস তবে উবে গেল মহারাজ?”

“সে আমি জানি না, আমি বুঝতেই পারি না, কখন বিশ্বাস আসে কখন চলে যায়। তোমাদের মতো ধর্মাত্মা, ব্রাহ্মণদের আচার-উপদেরশ দেখে-শুনে মন স্থির করাই আমার পক্ষে মুস্কিল। আমি শুধু এইটুকু বুঝি, দান-পূণ্য, দেবালয়-সুগতালয় নির্মাণ ইত্যাদি যা ‍খুশী ধর্মে বলে তা কর; কিন্তু জীবনের নগদ সম্পদকে হাত থেকে চলে যেতে দিও না।”

প্রেম এবং ধর্ম থেকে এঁদের আলোচনা রাজকার্যে এসে পড়ল। শ্রীহর্ষ বললেন, “মহারাজ কি পৃথ্বিরাজকে সাহায্য করতে সত্যিই অস্বীকার করেছেন?”

“তাকে সাহায্য করার কি দরকার আমার? নিজে গায়ে পড়ে ঝড়ের সঙ্গে লড়াই বাধিয়েছে সে,নিজেই ভুগবে তার ফল!”

“আমারও সেই মত মহারাজ, চক্রপণি মিছিমিছি ফালতু বিরক্ত করছে।”

“তার কাজ হল চিকিৎসা করা। সেখানেও সে কিছুই করে উঠতে পারছে না। তিনবার আমি বাজীকরণ চিকিৎসা করিয়েছি, কিন্তু সবই বিফলে গেছে। এখন উনি এসেছেন রাজকার্যে পরামর্শ দিতে!”

“ও একটা নিরেট মুর্খ, অনর্থক ওকে মাথায় তুলে রেখেছেন যুবরাজ।”

“ঠিক বলেছেন বৈদ্যরাজ! গহড়বারের মূল ঘুণ ধরাতে আরম্ভ করেছে শ্রীহর্ষ। বাবাকে সে অন্ধ কামুক বানিয়ে রেখেছে।”

!বিশ বছর আমি কন্যাকুত্তের রাজবৈদ্য, আমার ওষুধের কিছু গুণ অন্তত আছে।”

“ সে গুণের কথা সারা দুনিয়া জানে বৈদ্যরাজ।”

“কিন্তু বাজীকরণের ব্যাপারে মহারাজ খুশী ননা। অতিকামুক পুরুষের তারুণ্যকে ততদিন পর্যন্ত জীইয়ে রাখা যায় কুমার? এই জন্যই আহার-বিহারে সংযম অভ্যাস করার কথা লেখা হয়েছে। আমি তো মহারাজকে বলেছি যে, আমাকে মল্লগ্রাম (মালাঁও—গোরক্ষপুর) গিয়ে থাকতে দিন। কিন্তু উনি তাতেও রাজী নন।”

“বাবার দোষে  আমাকে ছেড়ে যাবেন না বৈদ্যরাজ। গহড়বারের যা কিছু আশা-ভরসা সবটাই আপনার ওপর।”

“আমাকে দিয়ে কিছু হবে না কুমার, হবে হরিশচন্দ্রকে দিয়ে। গহড়বার বংশে যদি জয়চন্দ্রের জায়গায় হরিশ্চন্দ্র থাকতেন তো কত ভালো হত। চন্দ্রদেবের সিংহাসনে হরিশন্দ্রেরই প্রয়োজন ছিল।”

“ অথবা যদি শ্রীহর্ষের জায়গায় বৈদ্যরাজ চক্রপাণি জয়ন্দ্রের প্রাণের বন্ধু হতেন! কিন্তু গহড়বার সুর্য অস্তমিত হওয়া পর্যন্ত আপনাকে থাকতেই হবে বৈদ্যরাজ।”

“অস্তমিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমিও অস্তে যাওয়ার জন্য প্রস্তত কুমার। কিন্তু শুধু গহড়বার সূর্য অস্ত যাবে না, হিন্দুদের সূর্যও অস্ত যাবে। আমরা মল্লগ্রামের ব্রাহ্মণেরা শুধু শাস্ত্র ও ধর্মাচরণেই অভিজ্ঞ নই, অসি চালনাতেও আমরা দক্ষ। এই জন্য আমারও ত্বকীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাই কুমার।”

“নিজের জামাইকে সাহায্য করতেও আমার পিতা রাজী নন। পথ্বিরাজ আমার আপন ভগ্নীপতি। তার সঙ্গে সংযুক্তার প্রণয় ছিল এবং নিজের ইচ্ছাতেই সংযুক্তা চলে গিয়েছিল। এতে বাবার অখুশী হওয়ার কারণ থাকতে পারে?”

“পৃথ্বিরাজ বীর, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।”

“ঠিক কথা। বীরত্বের জন্যই ত্বর্কী সুলতানের সঙ্গে লড়তে পারছে। না হলে আমাদের এই কান্যকুজ্বের তুলনায় কতটুকু তার রাজ্য? সুলতানের দৃষ্টি তো দিল্লীর ওপর নয়, কান্যকুব্জের ওপর। দু—শ’ বছর থেকে ভারতের সব চেয়ে বড় রাজ্য কনৌজ। কিন্তু তাঁকে বোঝাবে কে? বুঝবার মতো বুদ্ধির মাথা খেয়ে বসে আছেন বাবা।”

“এসময় যদি তিনি যুবরাজের হাতে রাজ্যের শাসনভার তুলে দিতেন!”

“আমার একবার মনে হয়েছিল বৈদ্যরাজ, যে বাবাকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে দিই কিন্তু আপনার শিক্ষার কথা মনে পড়ে গেল। বিশ বছর ধরে আপনার দেওয়া প্রতিটি শিক্ষা আমার কাছে হিতকারী বলে প্রতিপন্ন হয়েছে। এই জন্যেই তাঁর বিরুদ্ধে যেতে পারিনি আমি।”

“কান্যকুব্জের সিংহাসন জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে কুমার। সামান্য ভুল পদক্ষেপেই সমগ্র ইমারত ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। পিতাপুত্রের কলহের সময় এখন নয়।”

“এখন কি করা যায় বৈদ্যরাজ? আমাদের সমস্ত সেনাপতি ও সেনানায়কেরা ভীরু এবং অযোগ্য। তরুণ সেনানায়কদের মধ্যে অবশ্য যোগ্য এবং সাহসী কিছু লোক আছে, কিন্তু বুড়োরা পথ বন্ধ করে বসে আছে। মন্ত্রীদের ঐ একই অবস্থা, তারা রাজার প্রশস্তি গাওয়াকেই শুধু আপন কর্তব্য বলে জ্ঞান করে।”

“রাজান্তঃপুরে মেয়ে-বোনকে পাঠিয়ৈ যারা পদলাভ করে তাদের এই অবস্থাই হয়। কিন্তু অতীত নয়, ভবিষ্যতের চিন্তাই আমাদের করতে হবে এখন।”

“আমার হাতে ক্ষমতা থাকলে সমস্ত হিন্দু তরুণের হাতে অস্ত্র তুলে দিতাম।”

“কিন্তু এ হল বংশানুক্রমিক ত্রুটি, যাতে শুধু রাজপুতকেই যুদ্ধের অধিকারী করে রাখা হয়েছে। মহাভারতে দ্রোণ এবং রুপের মতো ব্রাহ্শণরাও যুদ্ধ করেছে’ কিন্তু পরে শুধু এক জাতির…”

“এই জাত-বেজাতের ব্যাপারটাও আমাদের সামনে এক বিরাট বাধা।”

“সবচেয়ে বড় বাধা, কুমার। পূর্বজগণের দ্বারা অনুষ্ঠিত সৎকাজের জন্য সর্বানুভব করা এক জিনিস কিন্তু চিরদিনের জন্য হিন্দুদের সহস্রভাগে ভাগ করে রাখা মহাপাপ।”

“এর ফল এখন ভুগতে হচ্ছে। কাবুল এখন আর হিন্দুদের হাতে নেই, লাগোরও গেছে, এ-বার দিল্লীর পালা।”

“আজ যদি আমরা পৃথ্বিরাজের সঙ্গে এক হয়ে যুদ্ধ করতে পারতাম?”

“উঃ, কি দুর্ভাগ্য, বৈদ্যরাজ!”

“দুর্ভাগ্যের বোঝা ভারী হয়ে আামদের নৌকা ডুবতে যাচ্ছে কিন্তু মোহাচ্ছন্ন আমরা! কিছুটা বোঝা নামিয়ে দিয়ে নৌকা হাল্কা করতে চাইছি না।”

“ধর্ম থেকে অজীর্ণ হয়েছে, বৈদ্যরাজ।”

“ধর্মের ক্ষয়রোগ! কি অত্যাচারই না আমরা করেছি? কোটি-কোটি বিধবাকে প্রতি বছর আগুনে পুড়িয়েছি। নর-নারীকে নিয়ে পশুর মতো বেচা-কেনা করেছি। দেবলয় এবং বিহারে সোনা-চাঁদি আর হীরামোতির বাহার বসিয়ে স্বেচ্ছ লুণ্ঠনকারীদের আমন্ত্রণ জানিয়েছি, আর শুত্রুর সঙ্গে মোকাবিলা করার সময় আত্মকলহে ডুবে থেকেছি। আপন ইন্দ্রিয়লালসা চরিতার্থ করার জন্য প্রজাদের শ্রমার্জিত সম্পদকে নিষ্ঠুরভাবে লুণ্ঠণ করেছি আমরা।”

“শুধু লালসা নয় বৈদ্যরাজ, উদ্মত্ততা। নিজের কাম-সুখ চরিতার্থ করতে প্রিয়তমা সহৃদয়া একজন স্ত্রী-ই যথেষ্ট, আর ইন্দ্রিয় লোলুপতাকে প্রশমিত করতে পঞ্চাশ হাজারও কিছুই নয়।এখানে ভালোবাসার কোনো স্থান থাকতে পারে না। গত সংক্রান্তির দিন বাবা যখন আপন অন্তঃপুরবাসিনী স্ত্রীলোকদের অনেককেই ব্রাহ্মণদের দান করে দিলেন, তখন তারা কেউই মহারাজের জন্যে একফোঁটা চোখের জলও ফেলেনি বরং ভিতরে ভিতরে খুশীই হয়েছে। ভামা আমাকে এ কথা বলেছে।”

“দান গ্রহণকারী ব্রাহ্মণের ঘরে খুব বেশী হলে একটি বা দুটি সতীন থাকতে পারে, ষোল হাজারের ভীড়ে সেখানে থাকবে না। অবশ্য একেও আমি দাসত্ব বলে মনে করি। স্ত্রী লোক কি একটা সম্পত্তি যে, তাকে এইভাবে দান করা যাবে?”

“আমাদের চেষ্টা করতে হবে সমবেতভাবে তুর্কীদের মোকাবিলা করার।”

“সে-সব তো মহারাজের হাতে। ভণ্ড শ্রীহর্ষ তাঁর কানের পাশে লেগে রয়েছে।”

অষ্টমীর রাত। সবে মাত্র চাঁদ উঠেছে; গোটা পৃথিবীটা আলোকিত হয়ে উঠতে এখনও দেরী। চারিদিকে অখণ্ড নিস্তব্দতা, তারই বুক চিরে মাঝে মাঝে পেচকের ভীতিপ্রদ ডাক শোনা যাচ্ছে। নিঃসীম এই নিস্তব্দথার মাঝে দু’জন লোক তীর থেকে দ্রুত যমুনার জলে নেমে পড়ল। মুখে আঙ্গুল দিয়ে তিনবার শিস দিল তারা। যমুনার অপর দিক থেকে একটি নৌকা আসতে দেখা গেল। নীরব-প্রবাহিত জলস্রোতে ধীরে ধীরে দাঁড় টেনে মাঝারি গোছের এক নৌকা পারে এসে ভিড়ল। লোক দু’জন নিঃশব্দে নৌকায় উঠে পড়ল। ভিতর থেকে কে যেন জিজ্ঞাসা করল,“সেনানায়ক মাধব?”

“হ্যাঁ আচার্য, আলহনও আমার সঙ্গে এসেছে। কুমার কেমন আছেন?”

“এখন পর্যন্ত তো জ্ঞান হয়নি; তার অবশ্য আমি সামান্য ওষুধ দিয়ে রেখেছি। কি জানি, জ্ঞান হলেই যদি রণক্ষেত্রে ফিরে যেতে চায়!”

“কিন্তু আচার্য, আপনার আদেশ কখনও অমান্য করতে পারেন না তিনি।”

“ সে আমিও বিশ্বাস করি; কিন্তু এই-ই ভালো, ক্ষতের ব্যাথাও এতে কমে যাবে।”

“ক্ষততে ভয়ের কিছু নেই তো, আচার্য?”

“না সেনানায়ক, ক্ষত আমি সেলাই করে দিয়েছি এবং রক্তস্রাব বন্ধ হয়ে গেছে। দুর্বলতা খুবই আছে, কিন্তু ভয়ের কিছু নেই আর। এ-বারে বল কি-কি কাজ শেষ করে এলে তুমি? মহারাজের শব রাজান্তুঃপুরে পাঠিয়ে দিয়েছ?”

“হ্যা।”

“এখন তবে  রাজান্তঃপুরের স্ত্রীলোকেরা মহারাজের সঙ্গে সহমরণে যাবে!”

“যার যাওয়ার সে যাবে।”

“আর সেনাপতি, তার খবর কি?”

“বুড়ো সেনাপতি তো মরতে মরতে শেষ পর্যন্ত উঠে দাঁড়াল। অবস্থা সঙ্গীন দেখে বহু সেনানায়ক পালিয়েছে, কিন্তু পালাবার কৌশল তারা জানে না। আমি আশা করি না যে, ওদের মধ্যে কেউ বেচেঁ আছে।”

“এ-সব ব্যাপার যদি তিন বছর আগে ঘটত এবং কুমার হরিশ্চন্দ্র যদি আমাদের রাজা আর তুমি মাধব কান্যকুব্জের সেনাপতি হতে!”

দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে মাধব বলল, “আপনার প্রতিটি কথা তীক্ষ্ণ ক্ষুরধার, আচার্য। মহারাজকে আপনি অনেক করে বুঝিয়েছিলেন যে, পৃথ্বিরাজের সঙ্গে এক হয়ে ত্বকীদের বিরুদ্ধে লড়াই করা উচিত, কিন্তু সে সবই অরণ্যে রোদন হয়েছে।”

“এখন আপসোশ করে কোনো লাভ নেই। কি কি ব্যবস্থা করলে বল।”

“পঞ্চাশ জন করে ভাগ করা সৈন্যদলে বোঝাই পাঁচশ নৌকা এখনই এসে পড়বে। গাগা, মোগে, সলখুর নেতৃত্বে গোটা সৈন্যবাহিনীটাকে ভাগ করে আমি আদেশ দিয়ে দিয়েছি যে, চন্দাবর থেকে পুবে সরে এসে তুর্কিদের সঙ্গে যুদ্ধ কর—সম্মুখ-সমরে কম এগুবে, অতর্কিত আক্রমণই বেশী চালাবে এবং পরিস্থিতি প্রতিকুল হয়ে পড়েছে দেখলে পুবদিক হঠে আসবে।”

“কনৌজের রাজপ্রাসাদ….?”

“সেখান থেকে জিনিস সরানো সম্ভব, সরিয়ে ফেলেছি আমি দু’দিনে আগে সঙ্গাতেই অনেকগুলো নৌকা নামিয়ে দিয়েছি।”

“এই জন্যই তোমাকে সেনাপতির রোষ থেকে বাঁচিয়েছিলাম মাধব। না হলে নিজের আগে, তোমাকেই সে মেরে ফেলত। তোমাকে এবং কুমারকে জীবিত দেখে আমি বড়ই সুখী। হিন্দুদের কিছু আশা রইল। শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত আমাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে, প্রতি পরমানু পরিমাণ শক্তি বুঝে-শুনে ব্যয় করে লড়তে হবে আমাদের।”

“কতকগুলো নৌকা আসছে বলে মনে হচ্ছে আচার্য?”

“সেনানায়ক আলহন, ওগুলো এলেই ওদের সব এখানে থেকে চলে যাওয়ার আদেশ দিয়ে দেবে।”

“আচ্ছা আচার্য’—বিনীতভাবে বলল আলহন।

“গলুয়ের ভিতরে চল আধব। ওখানে অন্ধকার রয়েছে—ইচ্ছা করেই আমি ওখানকার প্রদীপ নিভিয়ে দিয়েছি।” একটু এগিয়ে তিনি ডাকলেন, “রাধা!”

“বাবা!” এক তরুণী নারীকণ্ঠ থেকে আওয়াজ এল। চক্রপাপি মাধবের দিকে ফিরে বললেন, “কেউ বৈদ্যরাজ বলে, কেউ আচার্য, কেউ বা বাবা! এ-সব মনে রাখাও আমার পক্ষে মুশকিল হয়ে পড়েছে। তোমরা সবাই আমার ছেলেবেলার নাম ‘চক্কু’ বলে আমাকে ডাকবে।”

“উহু। স্ত্রীলোকের অভ্যাস বদলানো শক্ত, এ জন্য আমরা আপনাকে বাবা চক্রপাণি পান্তেয়র জায়গায়,শুধু বাবা বলব।”

“বেশ! চল, বাতি জ্বলে গেছে।”

সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামল দু’জনে। নৌকায় দুই-তৃতীয়াংশ জুড়ে পাটাতন, তার নীচে পর পর দুটো কুঠুরী; নৌকার একদিকে খানিকটা জায়গা খালি। দু’জনে একটা কুঠুরীর ভিতর ঢুকল। প্রদীপের মৃদু আলোয় একটা খাট দেখা যাচ্ছে। আকণ্ঠ সাদা শাল ‍মুড়ি দিয়ে একটা লোক শুয়ে রয়েছে। খাটের পাশে মোড়ার ওপর থেকে এক তম্বী উঠে দাঁড়াল। চক্রপাণি বললেন, “কুমারের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো ভামা?”

“না বাবা, শ্বাস-প্রশ্বাস নেই এক রকম ভাবেই চলছে।”

“ঘাবড়ে যাওনি তো তুমি?”

“চক্রপাণির ছত্র-ছায়ায় থেকে ঘাবড়াব? গহড়বার বংশ যদি প্রথমেই তাদের এই গুরু দ্রোণেচার্ষাকে চিনতে পারত!”

“আমাদের প্রধান সেনাপতি পরম সহায়ক মহারাজাধিরাজ হরিশ্চন্দ্রের সেনাপতি জানাল মাধব এসে গেছে দেখ।”

“মহাদেবী ভামা, আপনাদের সেবক মাধব সেবার জন্য উপস্থিত”—এই বলে অভিবাদন জানাল মাধব।

“মাধবের সঙ্গে অপরিচিত নই আমি। কুমারের পাশাখেলার সঙ্গীকে কি ভুলতে পারি কখনও?”

“আর যার অমিত বীর্ষ গহড়বার বংশের ধূলি-লুণ্ঠিত লক্ষ্মীকে পুনরায় তুলে ধরবার শক্তি রাখে ভামা!”

“আপনার মুখে “ভামা” ডাক কত মধুর শোনায় বাবা!”

“নিজের বাবার কথা মনে পড়ে যায় বোধহয়, না?”

“না বাবা, রাজকুলে আমাদের অন্য রকম আবহাওয়ার সৃষ্টি করতে হবে। উঃ কি মিথ্যা ঠাট, কি ভণ্ডামি! মানুষের মধ্যে সহজ সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। আমার শ্বশুরের সঙ্গে পুরাতন রাজকুলের নীতিকেও শেষ করে দিতে হবে।”

“শেষ হয়ে গেছে পুত্রী। বহুদিন আগেই শেষ হয়ে গেছে তা। কুমারের অন্তঃপুর দেখেছ তো তুমি?”

চোখের জল মুছে ভামা বলল, “আপনিই আমাদের মানুষ করেছেন বাবা।”

“না পুত্রী, কুমার হরিশ্চন্দ্রের জায়গায় এ যদি অন্য কেউ হত, তবে আমাকে শুধু শূণ্য চেয়েই থাকতে হত। এ সব কিছুই কুমার হরিশ্চন্দ্র…”

“বাবা!”

কুমারের চোখের পাতা অর্ধ উম্মীলিত হতে দেখা গেল। দৌড়ে তার কাছে গিয়ে ভামা বলল, “চন্দ্র আমার! রাহুর গ্রাসমুক্ত চাঁদ!”

“ঠিক বলেছ ভামা! কিন্তু এইমাত্র যেন বাবার গলার স্বর শুনতে পাচ্ছিলাম আমি?”

“বাবা?”

“সে বাবা নয়, যিনি গহড়বারের সূর্যকে ডুবিয়ে দিয়েছেন; এইবার যাকে তুমি বাবা বলে ডাকলে, আর আমিও যাকে বাবা বলেই ডাকব।”

প্রদীপের আলোয় কুমারের পাংশু চেহারা দেখে তার কপালে হাত রেখে চক্রপাণি বললেন, “শরীর কেমন আছে কুমার?”

“শরীর এত ভালো যে, মনে হয়, আমি যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে আহত হয়ে ফিরিনি।”

“ক্ষত কিন্তু খুব সাঙ্ঘাতিক ছিল কুমার!”

“হবে, কিন্তু আমার পীষুবপাণি বাবাও যে কাছে ছিল আমার!”

“একটু কম কথা বল ‍কুমার।”

“বাবা চক্রপাণির মুখের প্রতিটি কথা হরিশ্চন্দ্রের কাছে ব্রক্ষবাক্যতুলা।”

“কিন্তু এমন হরিশ্চন্দ্র চক্রপণির কোনোই কাজে আসবে না যে!”

“ এ হল শুধু হরিশ্চন্দ্রের শ্রদ্ধার কথা; কিন্তু বুদ্ধি-বিবেচনার প্রশ্ন যেখানে, সেখানে হরিশ্চন্দ্র ব্রহ্মবাক্যকেও যাচাই না করে গ্রহণ করবে না।”

“আর বাবা চক্রপাণিকে পেয়ে…—একটু  জল।”

তাড়াতাড়ি গ্লাসে জল গড়িয়ে দিল ভামা। নৌকা চলতে শুরু করেছে দেখে বাবা বললেন, “আমরা দ্বিতীয় রাজধানী বারাণসী চলেছি কুমার। সেনাপতি মাধব সৈন্যবাহিনীকে যথারীতি আদেশ দিয়েছে। সৈন্যরা এদিক থেকে তুর্কীদের গতিরোধ করবে। ওদিকে বারাণসীতে গহড়বার লক্ষ্মীর জন্য নতুন সৈন্য সংগ্রহ করব আমরা।”

“না বাবা, আগে যেমনটি বলতেন আপনি, সেই হিন্দু রাজলক্ষ্মী পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার আয়োজন করুন। পুনঃপ্রতিষ্ঠিত এই রাজলক্ষ্মী  এ-বার হিন্দুর রাজলক্ষ্মী হবে। হিন্দুর বাহুবলে জয় করেই একে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।”

“চণ্ডাল এবং ব্রাহ্মণের ভেদাভেদও ঘুচিয়ে দিতে হবে।”

“নিশ্চয়ই গুরু দ্রোণ।”

১৫. বাবা নুরদীন (কাল: ১৩০০ খৃষ্টাব্দ)

‘সে সব দিনকাল শেষ হয়েছে, যখন আমরা ভারতভূমিকে দুগ্ধবতী গাভীর চেয়ে বেশি। কিছু ভাবতে পারতাম না। তখনকার দিনে কৃষক, কারিগর, ব্যবসায়ী ও রাজাদের কাছ থেকে আদায় করে অনেক বেশি ধনদৌলত জমা হত আমাদের হাতে স্কুর্তি করে ওড়াতাম আর টাকা পাঠাতাম গোর দেশে। এখন আমরা আর গোরের অধীন নই, স্বাধীন খিলজী শাসক আমরা?’ কথাগুলো বলল একটি তীক্ষ্ণবুদ্ধি যুবক নিজের কালো দাড়ির ওপর হাত বুলোতে বুলোতে। তার সামনে বসে শুভ্ৰশ্বাশ্রমণ্ডিত সৌম্য সম্ভান্ত চেহারার একজন পুরুষ, পরনে সাদা আচকান, মাথায় বিরাট পাগড়ি।

বৃদ্ধ বলল, ‘কিন্তু জাঁহাপনা। মোড়ল, মাতব্বর, প্যাটেল, তালুকদার এদের স্বাৰ্থ যদি ক্ষুন্ন করা হয় তবে তারা বিগড়ে যাবে, আর খাজনা আদায় করার জন্য গ্রামে গ্রামে ফৌজ পাঠাবার সামৰ্থ্য আমাদের নেই।’

‘প্রথমে এই বিষয়ে আপনাকে মন স্থির করতে হবে যে, আপনারা ভারতের অধিবাসী। হয়ে ভারতবর্ষের শাসক রূপে এ-দেশে অবস্থান করবেন–না, উট ও খচ্চরের পিঠে। বোঝাই করে হীরা-মুক্ত লুণ্ঠনকারী গোর-গজনীর দাসু রূপে বাস করবেন!’

‘এখন ভারতবর্ষেই আমাদের বসবাস করতে হবে জাঁহাপনা।’ ‘হ্যাঁ, পূর্বতন শাসকদের মতো আমাদের অস্তিত্বের মূল এখন আর গোরে নেই। দিল্লীতে যদি কোনো বিদ্রোহ, অশান্তি শুরু হয় তবে আরব, আফগানিস্তান থেকে সাহায্য আমরা পাব না, অথবা কোথাও পালিয়ে গিয়েও নিস্তার পাব না।’

‘এ কথা স্বীকার করি জাঁহাপনা!’

‘সুতরাং এই আমাদের ঘর, এখন এখানেই থাকতে হবে, আর এ জন্য আমাদের–এমনভাবে এই ঘর তৈরি করতে হবে যাতে এখানকার লোকে সুখী এবং শান্ত থাকে। এখানকার প্রজাদের মধ্যে ক’জনই বা মুসলমান আছে? একশ’ বছরের ভেতর দিল্লীর আশপাশের জায়গাগুলোকেও আমরা মুসলমান করে তুলতে পারিনি। মোল্লা আবু মোহাম্মদ, আপনি কত দিনের ভেতরে সমগ্ৰ দিল্লী এবং এই দেশকে মুসলমানে রূপান্তরিত করতে পারেন, বলুন তো?’

সম্মুখে উপবিষ্ট তৃতীয় বৃদ্ধ দাঁতহীন ঠোঁটের নিচ থেকে নাভি পর্যন্ত প্রলম্বিত সাদা দাড়ির গোছা ঠিক করতে করতে বলল, ‘আমি নিরাশ হইনি। সুলতানে-জমানা। তবে। অশীতি বর্ষের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে, যদি জবরদস্তি করে মুসলমান করাতে চাই

‘এ জন্য ভারতে অধিষ্ঠিত মুসলমানেরা সমগ্ৰ ভারতবর্ষ মুসলমান হয়ে যাবার দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারে না। এক শতাব্দী আমরা এই ভাবেই কেটে যেতে দিয়েছি, এবং নিজেদের প্রজা-সম্বন্ধে কোনো কিছু না ভেবে যথাশক্তি শুধু জমির খাজনা বাণিজ্য শুল্ক এবং রাজস্ব আদায় করতেই চেয়েছি। তার পরিণাম হল-নবাবের খাজনা বাবদ এক টাকা আনে তো পাঁচ টাকা যায় তাহশীল আদায়কারীর পেটে। দুনিয়ার আর কোথাও দেখেছেন, গ্রামের কর্মচারীরা রেশমী পোশাক পরে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে বের হয়, ইরানের তৈরি তীর-ধনুক ব্যবহার করে! না-ওয়াজির-উল-মূলক আমার রাজ্যে এই ধরনের অবাধ লুণ্ঠন এখনই বন্ধ করতেত হবে।’

‘কিন্তু হুজুর! বহু হিন্দু, মুসলমান হয়েছে এই লোভেই। এ-বার তাহলে সে পথও বন্ধ, হয়ে যাবে।’–মোল্লা বলল।’

‘ইসলামও যদি এই ধরনের লুট এবং ঘুষের ব্যাপার সমর্থন করত, তবু সরকারী খাজনা এবং সরকারি সম্পত্তির স্বার্থে সে-সব বরবাদ করে দেওয়া হত। তাছাড়া যে সরকারের কর্মচারীরাই লুট করে তার আর আশা-ভরসা কি?’

‘রাজ্যের ভিত এদের দিয়ে মজবুত হতে পারে না, স্বীকার করতেই হবে জাঁহাপনা। কিন্তু আমি শুধু বিদ্রোহ ও বিপদের কথাই ভাবছিলাম।’–ওয়াজির বলল।

‘গ্রামের আমলারা তাই করে বসবে। যদি তাদের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়, এ কথা ঠিক। কিন্তু গ্রামে আমলার সংখ্যা বেশি—না কৃষকের সংখ্যা বেশি?—কৃষকের। আমলা তো প্রতি একশ’ কৃষকে মাত্র একজন। এই একশ’ কৃষকের রক্ত চুষেই ঐ একজন ঘোড়ায় চড়ে, রেশমী পোশাক পরে আর ইরানী তীর-ধনুক ব্যবহার করে। এই ধরনের রক্তচোষা বন্ধ করে আমরা কৃষকের অবস্থায় উন্নতি করব! তাদের সরকারের অনুগত করে তুলব। একজনকে অখুশী রেখে একশ’ লোককে খুশী করে তোলাই কি ভালো কাজ হবে না?’

‘ঠিকই বলেছেন হুজুর! এ বিষয়ে আমারও এখন আর সন্দেহ নেই যদিও হিন্দুস্থানের মুসলমান সুলতাগণের মধ্যে এক নতুন পন্থী আপনি অনুসরণ করতে যাচ্ছেন। এই পথেই হয়ত সাফল্য লাভ করা যাবে। এতে গ্রামের উচ্চশ্রেণীর কিছু লোককে শুধু অখুশী করে তুলব আমরা।’

‘গ্রামে এবং শহরে উচ্চশ্রেণীর সামান্য কিছু লোক অখুশী হয়ে উঠলে কিছু যায় আসে। না। এখন শাসনকার্যের পাকাপোক্ত ইমারতের বুনিয়াদ তৈরি করতে হবে।’

‘মোল্লা কি যেন চিন্তা করে বলল, ‘হুজুরআলী, আমিও এখন বুঝতে পারছি, গাঁয়ের সমগ্র কৃষকশ্রেণীর সুখ-সুবিধার প্রতি নজর রাখলে সরকারের পক্ষে সেটা লাভজনক হবে। গ্রাম এবং শহরের তাঁতীদের প্রতি সামান্য নজর দিয়েছি আমরা। পঞ্চায়েতকে মজবুত করে তুলতে তাদের সাহায্য করেছি, যাতে বেনে-মহাজনদের লুটের হাত থেকে রেহাই পায়। তারা। আগে প্রত্যেক আমলা এদের দিয়ে বেগার খাঁটিয়ে নিজেদের জন্য কাপড় তৈরি করাত, আমরা সে-সব বন্ধ করে দিয়েছি। এখন। আজ তার পরিণাম দেখতে পাচ্ছি-ধুনুরী, তাঁতী আর দর্জির ভিতর এমন লোক এখন আর দেখাই যায় না। যারা ইস্লামের আওতায় চলে আসেনি।’

‘তাহলে এখন নিজেই দেখলেন তো মোল্লাসাহেব, যে কাজে সাম্রাজ্যের মঙ্গল সাধিত হয়, তাতে ইসলামেরও মঙ্গল।’

‘কিন্তু এক বিষয়ে আমার আর্জি আছে জাঁহাপনা! আপনি হলেন আমিরউলু-মোমিনীন (মুসলমানদের নায়ক).’

‘সেই সঙ্গে হিন্দুদেরও সুলতান আমি, ভারতবর্ষে মুসলমানদের সংখ্যা তো খুব কম, সম্ভবত হাজারে একজন!’

‘হিন্দুরা অবিরাম ইস্লামের অপমান করে চলেছে। এদের এই আচরণ ভবিষ্যতে আরও বেড়ে যেতে পারে। কাজেই এই অপমানকর আচরণ বন্ধ করতে হবে এবং সে কাজটা আপনারই।’

‘অপমান? কেন তারা কি পবিত্র কোরান পদদলিত করেছে?’

‘না, এত বড় সাহস কেমন করে তাদের হবে।’

‘তবে কি মসজিদকে অপবিত্র করেছে তারা?’

‘না, না, সেও সম্ভব নয় তাদের পক্ষে।’

‘না, জাঁহাপনা! বরং যারাই আমাদের সুফিগণের সংস্পর্শে এসেছে, খোদী-রসূলকে তারা ঋষির মতোই দেখছে। কিন্তু এরা যে আমাদের চোখের সামনে বসেই এদের কাফের ধর্ম পালন করে চলেছে!’

‘যখন তাদের কাফের বলেই মনে করেন, তখন তাদের কাফেরোচিত আচরণে আপত্তি কেন? আমার চাচা সুলতান জালালউদ্দিন আমার মতো মনস্থির করতে পারেননি যে, নিজেকে তিনি ভারতবর্ষের স্থায়ী শাসক রূপেই গণ্য করবেন, না। সমগ্র ভারত মুসলমান নাহওয়া পর্যন্ত এক অস্থায়ী শাসক বলে মনে করবেন। কিন্তু তিনি একবার আপনার মতো এ প্রশ্নকারীকে কি জবাব দিয়েছিলেন জানেন?’

‘না হুজুর-আলা!’

‘বলেছিলেন, ‘বেওকুফ দেখতে পাওনা আমার মনূজিলের সামনে দিয়ে প্রতিদিন হিন্দুরা শাখ বাজিয়ে ঢোল পিটিয়ে নিজেদের মূর্তিপূজোর জন্য যমুনার তীরে যায়, আমার চোখের সামনেই তারা তাদের কাফের-ধর্মের অনুষ্ঠান করে, আমার এবং আমার শাহীরোবকে (বাদশাহী মর্যাদা)। খাটো করে দেখে, তারা আমার ধর্মের দুশমন (হিন্দু) যারা আমার রাজধানীতে আমারই চোখের সামনে বসে বিলাস-ব্যসনের মধ্য দিয়ে জীবন : কাটাচ্ছে এবং ধন-দৌলত আর উন্নত অবস্থার জন্য মুসলমানদের সঙ্গে নিজেদের ঠাটঠমক আর অহঙ্কার জহির করছে। আমার কাছে এ লজ্জার কথা। ধনদৌলত সমস্তই আমি তাদের হাতে তুলে দিয়েছি। তাই আমি নিজে দান হিসেবে তাদের দেওয়া সামান্য খড়কুটো নিয়েই খুশী রয়েছি।’—আমার মনে হয় এর চাইতে ভালো জবাব আমিও দিতে পারি না।’

‘কিন্তু সুলতানে-জমানা, ইসলামের প্রতিও তো সুলতানের কর্তব্য রয়েছে।’

‘এমন অপরাধও যে করেছে, যার সাজা হল ফাঁসি, সেও ইসলামের শরণে এলে আমি

তাকে গোলামী থেকে মুক্ত করে দেবার হুকুম দিতে পারি। কিন্তু সরকারি খাজনা থেকে তার খরিদ-মূল্য দিয়ে। এই দেশে কোটি কোটি টাকা গোলাম রাখায় ব্যয় হয়েছে কাজেই ও ছাড়া সমস্ত গোলামের মুক্তির কথা তো আপনি বলতেই পারেন না।’

‘না জাঁহাপনা, গোলাম রাখার ফরম্যাজ তো আল্লাহ্ তালাও দিয়েছেন।’

‘না, যদি আপনি বলেন তো আমি তখতের বিনিময়েও মুসলমান-অমুসলমান সমস্ত দাস-দাসীর মুক্তির ফরমান জারি করতে পারি।’

‘কিন্তু তাহলে শরীয়তের বিরুদ্ধাচরণ করা হবে।’

‘শরীয়তের বিরুদ্ধাচরণের কথা ছাড়ুন মোল্লাসাহেব, এই মুহূর্তে আপনি নিশ্চয় কোনো প্রিয় দাসীর কথা ভাবছেন! সবচেয়ে বেশি গোলাম রয়েছে মুসলমানদেরই ঘরে।’

‘আল্লাহতালা মোমিনদের এই অধিকার স্বীকার করে নিয়েছেন!’

’কিন্তু দাস-দাসীরাও যদি মোমিন হয়! তা হলেও আমাদের মনে হয় আপনি এই দুনিয়ার মুক্ত হাওয়ায় ওদের নিশ্বাস নিতে দেবেন না এবং বেহেস্তের আশায় ওদের বসিয়ে রাখবেন।’

‘আমার আর কিছু বলার নেই ইসলামী সাম্রাজ্যে ইসলামী শরীয়তের শাসন চালু হওয়ার উচিত, আমি শুধু এই টুকুই বলতে চাই।’

‘কিন্তু এই চাওয়াটুকুই যে বিরাট এর জন্য ইসলামী সাম্রাজ্যের অধিকাংশ প্রজাকেই মুসলমান হতে হবে। আপনাদের সামনে–আপনিও শুনুন ওয়াজির সাহেব, আমার সাফ মতামত। সুলতান মামুদের মতো এক বিদেশী সুলতান জবরদস্ত সৈন্যবাহিনী নিয়ে শান্তিপূর্ণ শহরসমূহ লুণ্ঠন করতে পেরেছিল, লুটের মাল উট এবং খচ্চরের পিঠে বোঝাই করে নিয়ে যেতে পেরেছিল, কিন্তু সে রকম কোনো কাজ করা কাচ্চাব্বাচ্চা নিয়ে দিল্লীতে অধিষ্ঠিত আমার মতো লোকের ক্ষমতার বাইরে। আমার সরকার কায়েম হয়েছে হিন্দু প্রজাদের রাজস্বের ওপর, কায়েম হয়েছে হিন্দু সিপাই, সেনানায়কদের ওপর নির্ভর করে—আমার সেনাপতি হিন্দু; পাঁচ হাজার সৈন্যের সেনানায়ক চিতোরের রাজা আমার সপক্ষে।’

‘কিন্তু জাঁহাপনা গোলাম সুলতানও তো দিল্লীতেই থাকতেন।’

‘আপনি বাধা দেবেন না! আমাকে চঞ্চল এবং বদমেজাজী বলা হয়, কিন্তু এইসব বিরোধী মতামত শোনা থেকে আমাকে বিরত করতে পারে না। গোলামদের সরকার এক রাতের পাখীর বাসার সামিল ছিল। মোঙ্গলদের সৃষ্ট তুফানে হিন্দুস্থানের ইসলামিক রাজত্ব কোনো মতে বেঁচে গেছে। হিন্দুরা জানত না যে, মোঙ্গলদের মতো দুশমন, মুসলমানেরা কখনও দেখেনি। তারা যদি মোঙ্গলদের সামান্য উৎসাহও দিত। তবে ভারতের মাটিতে নতুন ইসলামী সাম্রাজ্য দাঁড়াতেই পারত না। আপনারা জানেন না যে, চেঙ্গিসের বংশ দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য চীনের ওপর আধিপত্য করছে!’

‘জানি হুজুর-আলা।’–মোল্লা বলল।

’ঐ বংশ বৌদ্ধধর্মকেই অনুসরণ করে।’

‘বৌদ্ধধর্ম! এত সব মঠ-মন্দির জ্বলিয়ে, মাটিতে মিশিয়ে দেবার পরও কাফেরদের সাকার স্বরূপ ধর্ম ভারতের মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় নি!’

‘কাফেরদের সাকার স্বরূপ ধর্ম কেন?’

‘জাঁহাপনা, হিন্দুদের ব্ৰাহ্মণদের ধর্মে ও সিরাজনীহার (স্রষ্টা) আল্লাহ কথাও কিছু আছে, কিন্তু বৌদ্ধধর্ম তো তাঁকে একবারেই অস্বীকার করে।’

‘চেঙ্গিসের বংশ শুধু আজ নয়, কুবলাই খাঁর সময় থেকেই বৌদ্ধধর্মের বিশ্বস্ত অনুচর বলে মনে করে নিজেদের। শুধু তাই নয় চেঙ্গিসের ফৌজে, মোঙ্গলদের মধ্যে বহু সিপাহসালার এবং সৈন্য ছিল। বুখারা, সমরখন্দ বলখ ইত্যাদি ইসলামী দুনিয়ার শহরগুলোর মুসলমানী সভ্যতার সমস্ত কেন্দ্রকে বেছে বেছে নির্মূল করে দিয়েছে তারা; আমাদের নারীদের উচ্চ-নিচ বংশের বিচার না করে যথেচ্ছভাবে দাসীতে পরিণত করেছে; শিশুদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে—আর এই সমস্ত অত্যাচারকে প্ররোচিত করেছিল বৌদ্ধ মোঙ্গলরা। তারা বলত, আরবেরা আমাদের বিহারসমূহ ধ্বংস করেছে, আমাদের এ সবের প্রতিশোধ নিতে হবে। ভেবে দেখুন, যদি মোঙ্গলেরা ভারতীয় বৌদ্ধদের সঙ্গে মিলে হিন্দুদের দলে টানতে পারত তবে ইসলামের অবস্থা কি হত?

‘নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত জাঁহাপনা।’

‘এই জন্যই বালুর চরে আমাদের রাজ্যের ভিত স্থাপন করা উচিত নয়, গোলামদের নকল করতেও আমরা পারি না।’

ওয়াজীর এতক্ষণ পর্যন্ত চুপ করে ছিল, এইবার সে মুখ খুলল, ‘সরকার আলী! গ্রামের আমলাদের ক্ষমতা কমে গেলে অতদূর পর্যন্ত সাম্রাজ্য পৌছাবে কি করে?’।

‘যখন রেশমী-পরা ঘোড়ায়-চড়া আমলারা ছিল না, তখন কি করে কাজ চলত?’

‘আমি সে সম্বন্ধে খোঁজ করিনি।’

‘আমি করেছি। যখন শাসকেরা নিজেদের লুণ্ঠনকারী বলে মনে করল, তখন তারা লুণ্ঠনকারী আমলা নিযুক্ত করল। সব জায়গায় এমনই হয়, কিন্তু তার আগে সমস্ত গ্রামে পঞ্চায়েত থাকত, পঞ্চায়েত গ্রামের মধ্যে লড়াই-ঝগড়া থেকে শুরু করে সরকারের রাজস্ব দেওয়া পর্যন্ত সমস্ত ব্যবস্থাই করত। গ্রামের কোনো এক ব্যক্তিকে নিয়ে রাজার কোনো দুশ্চিন্তা ঘটত না। সে শুধু পঞ্চায়েতের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখত এবং জানত যে তার এবং খাজনা-দেনেওয়ালা কৃষকের মাঝে সম্বন্ধ স্থাপিত করবার জন্য এই পঞ্চায়েত রয়েছে।’

‘তাহলে জাঁহাপনা, একশ’ বছরের বেশি মৃত এই পঞ্চায়েতগুলোকে আবার আমাদের বাঁচিয়ে তুলতে হবে?’

‘এ ছাড়া দ্বিতীয় পথ নেই। যদি ইসলামী সাম্রাজ্যকে এ দেশে শক্তিশালী করে তুলতে হয়, তাহলে সূৰ্বতোভাবে প্রজাসাধারণকে সুখী ও সন্তুষ্ট রাখবার চেষ্টা করতে হবে, দিল্লীর সাম্রাজ্যে ইসলামী শরীয়তের জায়গায় সুলতানী শরীয়ত চালু করতে হবে। ইসলামের প্রচার মোল্লাদের কাজ, তাদের আমরা বৃত্তিদান করতে পারি। সুফিদেরও কাজ তাই এবং ভালোভাবেই কাজ করে যাচ্ছে তারা। তাদের মঠগুলোকে আমরা নগদ টাকা দিতে পারি অথবা সরকারি খাজনা থেকে রেহাই দিতে পারি।’

 

২.

বর্ষা শেষ হয়ে গিয়েছে, কিন্তু এখনও খালবিলগুলি জলে ভরে আছে। বড়-বড় বাঁধ দেওয়া ধানের ক্ষেতে জল জমে আছে, তার ভেতর সবুজ-সবুজ ধানের শিষ দুলছে। চারিদিকে সুদূর বিস্তৃত মগধের সবুজের মাঝখানে বড় হিলসা (পাটনা) গী। অবস্থিত, সেখানে কিছু ব্যবসায়ীদের ইটের পাকা বাড়ি, বাকি সব কৃষক এবং কারিগরদের খোলা বা খড়ের ঘর। এ ছাড়া ব্ৰাহ্মণদের কিছু বাড়ি আছে, তাদের অবস্থা অপেক্ষাকৃত ভালো। হিলসার মন্দিরসমূহ প্রায় একশ’ বছর আগে মহম্মদ বিন-বখতিয়ার খিলজির সৈন্যরাই বিধ্বস্ত করেছিল, তারপর থেকে সেই ভগ্নস্তুপগুলোকে যেখানে-সেখানে পূজা করছে হিন্দুরা। গায়ের পশ্চিম প্রান্তে বৌদ্ধদের মঠ, তার প্রতিমাগৃহ ভেঙে-চুরে গেলেও ঘর এখনও পর্যন্ত বাসযোগ্য। ভিতরে ঢুকে কেউ বলতে পারবে না যে, বৌদ্ধভিক্ষুরা তাদের ছেড়ে চলে গেছে।

সেদিন সন্ধ্যার সময় মঠের বাইরে পাথরের ছোট এক ঋটাতনের ওপর আধাবয়সী। এক পুরুষ বসে ছিল। বাদামী এক কৌপীনে তার শরীর ঢাকা। মাথা এবং ক্ৰ কামানো গোফ-দাড়ি খুব ছোট ছোট-মনে হয় এক সপ্তাহ আগে কামানো হয়েছিল। হাতে কাঠের মালা। দিনটা ছিল আশ্বিনের পূর্ণিমার দিন, গ্রামের নর-নারী সকলে খাবার, কাপড় এবং অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে এসে কৌপীন-পরা পুরুষের সামনে, রেখে হাত জোড় করে দাঁড়িয়েছিল। পুরুষটি স্থিত মুখে হাত তুলে আশীৰ্বাদ করছিল সবাইকে।

এ সব কি? হিলসার পুরনো বৌদ্ধ মঠ নষ্ট হয়ে গেলেও মঠের বাইরের ভক্তগণের হৃদয়ে শ্রদ্ধার ভাব ঠিকই ছিল। আজ হিলাসায় কৌপীনধারী বাবাকে দেখে কি বৌদ্ধভিক্ষু ছাড়া অন্য কিছু বলা যায়! সে অবিবাহিত, তার পূর্বতন চারজন গুরুও অবিবাহিত ‘ কেীপীনধারী ছিল। হিন্দু অথবা বৌদ্ধ থেকে মুসলমান হওয়া দশ-পাঁচ ঘর কারিগর একে সন্ন্যাসীর সমাধি বলত; ব্ৰাহ্মণ এবং কিছু ব্যবসায়ী একে মঠ বলত না, কিন্তু গ্রামের বাকি। সকলে এখনও মঠ বলে। এই বাবার আগের সন্ন্যাসীদের কোনো জাতবিচার ছিল না, আর নতুন বাবাগণেরও জাত নেই। এরা কৌপীন পারত, অবিবাহিত থাকত। অসুস্থ হলে এরা ঔষধ-পথ্য দেয়, মরন ও শোকের সময় এরা অলখ-নিরঞ্জন নির্বাণের উপদেশ দিয়ে সান্ত্বনা। প্রদান করে। এই জন্য আজ শরতের পূর্ণিমার নির্বাণ দিনে লোকে আগের মতোই এই মুসলিম ভিক্ষুদেরও পূজা দেয়। আর কারিগর মুসলমানেরা আগে যেমন বৌদ্ধ-ভিক্ষুদের আপন পূজ্য গুরু বলে মান্য করত, এখন তেমনি বাবা এবং তার কৌপীনধারী চেলাদের মান্য করে। r

মঠের পুরনো মোহান্তদের সমাধিগুলোকে বন্দনা করে গ্রামবাসীরা চলে গেল। রাত বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে রূপালী চাঁদের আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। এই সময় কারিগরদের ঘরের দিক থেকে দুটো লোকের সঙ্গে একজনকে আঙিনার দিকে আসতে দেখা গেল। কাছে এলে মৌলানা আবুল-আলাইকে বাবা চিনতে পারল। তার মাথায় সাদা পাগড়ি, পরনে লম্বা চোগা, পায়ে জুতোর ওপর পর্যন্ত পায়জামা। তার কালো দাড়ি হাল্কা হাওয়ায় দুলছে। উঠে দাঁড়িয়ে দুই হাত বাড়িয়ে মধুর স্বরে বাবা বলল, ‘আসুন মৌলানা আবুল-আলাই। আসূসালাম-আলায়কুম।’ মৌলানার শক্ত দুই হাতকে নিজের হাতে নিয়ে তাকে আলিঙ্গন করল।

মৌলানাও অনিচ্ছুকভাবে ‘ওয়ালেকুম সালাম’ বলল!

তাকে খোলা পাটাতনের কাছে নিয়ে গিয়ে বাবা বলল, ‘আমার তখৎ এই নগ্ন পাথর, বসুন।’ মৌলানা বসবার পর বাবাও বাসল, প্রথমে মৌলানাই কথারম্ভ করল।

‘শাহ সাহেব, যখন এখানে কাফেরদের ভিড় লেগেছিল, তখন আমি দাঁড়িয়ে দেখলাম। সেই তামাসা।’

‘তামাসা! একশ’ বার বলুন মৌলানা, কিন্তু ‘কাফের’ বলবেন না। আপনি, নূরের হৃদয়ে যেন শরাঘাত হয় এতে।’

‘এই হিন্দুরা কাফের নয় তো কি?’

‘সকলের ভেতরই ঐ নূর রয়েছে; নূর আর কাফের, আলো আর অন্ধকারের বিবাদের মতো–এরা এক জায়গায় থাকতে পারে না।’

‘আপনার এই সমস্ত তসৰ্ব্ববুফ (বেদান্ত) ইসলাম নয়, ঐন্দ্রজালিক ভেল্কি।’

‘আমরা কিন্তু আপনাদের ভাবধারাকে ইন্দ্ৰজাল বা ভেল্কি আখ্যা দিই না। আমরা ‘এক নদীর বহু ঘাট’-এর অস্তিত্ব স্বীকার করি। আচ্ছা আপনারা সকল মানুষকেই খোদার সন্তান বলে মনে করেন না?’

‘হ্যাঁ, মনে করি।’

‘আর এও মানেন তো যে তিনি সর্বশক্তিমান।’

‘নিশ্চয়ই।’

‘মৌলানা, আমাদের সর্বশক্তিমান মালিকের হুকুম ছাড়া যখন গাছের একটা পাতাও করতে পারে না, তখন আমি বা আপনি আল্লার এই সমস্ত সন্তানকে কাফের বলবার কে? আল্লাহ যদি ইচ্ছা করতেন তাহলে সকলকেই এক পথে চালাতেন। চান না বলেই সকল পথই সমান প্রিয় তার।’

‘শাহ সাহেব, আমাকে আপনার তসকবুফের মিথ্যাগুলো শোনাবেন না!’

‘কিন্তু মৌলানা, এ তো আমি ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকেই বলছি। আমরা সুফিরা আল্লা এবং তাঁর বান্দাদের মধ্যে কোনো পার্থক্যই স্বীকার করি না। আমাদের কলুমা (মহামন্ত্র) হল, ‘অনল-হক (আমিই সত্যদেব), ‘হাম-ও-স্ত’ (সবই ঐ ব্ৰহ্ম)!’

‘এটা কাফেরের ধর্ম।’

‘আপনি এ কথা মনে করেন, আগেও অনেকে এমনি মনে করত, কিন্তু সুফিরা আপন রক্ত ঢেলে এই সত্য প্রতিষ্ঠা করেছে এবং প্রয়োজন হলে ভবিষ্যতেও করবে।’

‘আপনাদের জন্যেই এখানে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হতে পারছে না।’ ‘আগুন এবং তলোয়ারের সাহায্যে তাকে প্রতিষ্ঠা করবার যে প্রচেষ্টা আপনাদের; তাকে আমরা অন্যায় মনে করেছি। ঠিকই কিন্তু তার বিরুদ্ধে তো রুখে দাঁড়াইনি, তবু কতটুকু সাফল্য আপনারা লাভ করেছেন শুনি!’

‘আপনারা ওদের ধর্মকেও সত্য বলে মনে করেন?’ ‘হ্যাঁ, কারণ মহানৃ সত্যকে কুলুঙ্গীতে তুলে রাখার শক্তি নিজের ভিতর অনুভব করি না। আমরা, ইসলাম যদি তার শহীদদের কাছে সত্যি হয় যদি তসৰ্ব্ববুফ প্রতিভাবন প্রেমিকের কাছে সত্যি হয়, তাহলে হিন্দুরাও আপনাদের তলোয়ারের নিচে হাসতে হাসতে গর্দান এগিয়ে দিয়ে হিন্দু ধর্মকেই সাচ্চা প্রমাণিত করেছে।’

‘হিন্দু-মার্গ সাচ্চা! হিন্দুদের মার্গ পূবের, আমাদের হল পশ্চিমের, সম্পূর্ণ উল্টো।’

‘এতই যদি উল্টো হবে তবে আজ সন্ধ্যায় গ্রামের মুসলমান মঠকে পূজা দিয়ে গেল কেন হিন্দুরা? আপনি মুসলমানদের মধ্যে হিন্দুয়ানীর গন্ধ-মাত্র সহ্য করতে চান মৌলানা?’

‘না, সহ্য করা চলবে না।’

‘তাহলে সধবা মুসলমান স্ত্রীদের সিন্দুর মুছিয়ে দিন গিয়ে।’

‘মোছাব।’

বাবা হেসে বললেন, ‘সিন্দুর মোছাবে! এই জুম্মন, বল দেখি আমাকে, তোমার বিবি সলিমা কি মেনে নেবে ব্যাপারটা?’,་

‘না বাবা। মৌলবী সাহেব জানেন না, সিন্দুর শুধু বিধবাদের কপাল থেকেই মোছা যায়।’ পাশেই দণ্ডায়মান জুম্মন উত্তর দিল।

বাবা তার কথা বলে যেতে লাগল, ‘ক্ষমা করুন মৌলানা আবুল-আলাই, আমরা সুফিরা কোনো সুলতানের ভিক্ষা অথবা কোনো আমীরের দয়ার দান নিয়ে এখানে বসিনি। আমরা কৌপীন আর লেংটি পরে এখানে এসেছিলাম। কোনো হিন্দুই আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্ৰ-ধারণ করেনি। এই মঠটাকেই ধরুন, আগে এটা বৌদ্ধ-বিহার ছিল। আমার পূর্বতন পঞ্চম গুরু বৌদ্ধ-শ্রমণদের চেলা ছিলেন। তিনি এসেছিলেন–বুখারা থেকে এবং বৌদ্ধ শ্রমণদের বেদান্ত দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে তাদের চেলা হয়েছিলেন। বেদান্তের বাণী সর্বক্ষেত্রেই এক; বাইরের পোশাকের এর কোনো পরিবর্তন হয় না–সে পোশাক বৌদ্ধদেরই হোক, হিন্দুর হোক বা মুসলমানেরই হোক। আমাদের ঐ গুরুর পরে এই মঠ মুসলমান নামধারী ফকিরদের জিন্মায় রয়েছে। পোশাক বদলানোর ওপর আমরা কোনো জোর দিইনি, আমরা লোককে প্রেম শিখিয়েছি, যার ফলে দেখতে পাচ্ছেন গ্রামের খুব কম লোকই আমাদের ঘৃণা করে দূরে সরে থাকে। পণ্ডিতগণের মধ্যে জড়তা ছিল, প্রেমের পথ তারা চিনতে পারেনি, আপনারাও যেমন চিনতে পারছেন না। আজ-আর এই জন্যেই জুম্মনের বাপ-দাদাকে হিন্দুর বদলে মুসলমান নাম ধারণ করতে হয়েছিল, তাই এদের কাছে আপনাদের খাতির রয়েছে।’

 

৩.

চৈত্র মাস শেষ হয়ে গিয়েছে। গাছে নতুন পাতা গজিয়ে উঠেছে। এ বছর খুব আম হয়েছে, আম গাছগুলোতে তাই পুরনো পাতাই রয়ে গেছে। নিচে খামারের উঠেন। সেখানে দুপুরের গরম আবহাওয়ার মধ্যেও দু’জন কৃষক মাড়াই করছে। এমন সময় একজন পরিশ্রান্ত পথিক ঘর্মািসক্ত হয়ে খামারের এক গাছের নিচে এসে বসল। তার মুখচোখের চেহারা দেখে তাকে ভিনদেশী বুঝতে পেরে মঙ্গল চৌধুরী তার কাছে এসে বলল, ‘রাম রাম ভাই, এই রোদুরে হাঁটা যথেষ্ট শক্তির কাজ।’

‘রাম রাম ভাই! কিন্তু পথ চলতে যাকে হবেই, তার রোদুর-ছায়ার বিচার করবার সময় কই?’

‘জল খাও ভাই, তোমার যেন মুখ শুকিয়ে গেছে, ঐ ঘটিতে ঠাণ্ডা জল রয়েছে।’

‘কি জাত তোমরা?’

‘আহীর। মঙ্গল চৌধুরী আমার নাম।’

‘চৌধুরী, আমি ব্ৰাহ্মণ, কুয়োটা দেখিয়ে দাও আমাকে।’

‘যদি আমার ছেলেকে দিয়ে জল আনাই-তাহলে হবে না পণ্ডিতজী?’

‘তাই দাও পাঠিয়ে, বড্ড শ্ৰান্ত হয়ে পড়েছি।’

‘ঘীসা, এদিকে আয় তো বাবা।’

মাড়াই বন্ধ রেখে মঙ্গল চৌধুরী গুড় আর কুয়ো থেকে টাটুকা জল নিয়ে আসতে বলল। ছেলেকে। এদের কাছে জিজ্ঞেস করে পথিক জানতে পারুল, দিল্লী এখান থেকে বিশ ক্রোশ দূর; কাজেই আজ আর সে পৌঁছাতে পারবে না। মঙ্গল চৌধুরী অত্যন্ত রসিক লোক। চুপ? করে থাকাই তার পক্ষে সবচেয়ে মুস্কিলের ব্যাপার।

চৌধুরী বলল, ‘আমাদের এখানে এ বছর ভগবানের কৃপায় চমৎকার ফসল হয়েছে। বৈশাখে। ফসল কাটা কঠিন ব্যাপার হবে। ওখানে ফসলের অবস্থা কি পণ্ডিতজী?’ ফসল মন্দ হয়নি চৌধুরী’

‘রাজা ভালো হলে দেবতারাও খুশী হয় পণ্ডিতজী! যখন থেকে নতুন সুলতান তখতে বসেছে তখন থেকেই প্রজারা বেশ সুখে আছে।’

‘তুমি কি সেই রকমই দেখছ, চৌধুরী?’

‘আরে, এই খামারের তো কিছুটা দেখছি। দু’বছর আগে এলে দেখতে পেতে এর চার ভাগের এক ভাগ ফসলও হয়নি।’

‘তাহলে উন্নতি হয়েছে, চৌধুরী!

‘উন্নতি হয়েছে সুলতানের কৃপাতেই পণ্ডিতজী। আগে আমরা কিষাণর না খেয়ে, না-পরে মারতাম আর কয়েকটা বদ লোক রেশমী পোশাক পরে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াত। গম এতটুকু হতে না হতেই তাদের ঘোড়া আমাদের ক্ষেতে এসে হাজির হত। কে প্রতিবাদ। করবে? আমাদের গ্রামগুলোর তো। ওরাই ছিল সুলতান!’

এই সময় মঙ্গল চৌধুরীর মতোই হাঁটু পর্যন্ত ধুতি, গায়ে এক ময়লা। ফতুয়া, মাথায় চাপা সাদা-টুপি পরিহিত অপর এক চৌধুরী এসে পড়ল এবং ওদের দু’জনের কথার মাঝেই বলে উঠল, ‘আরো এখন দেখছ তো চৌধুরী, কোথায় চলে গেল তাদের সেই বিরাট ক্ষমতা! এখন ব্যাটারা আবার দান পাবার আশায় বসে আছে। আমাকে বলছিল। সেই ব্ৰাহ্মণ—কি যেন নাম তার, চৌধুরী?’

‘সিব্বা।’

‘এখন কেন সিকবা বলছি, সে সময় তো পণ্ডিত শিবরাম বলতে! বলছিল, ‘চৌধুরী ছেদারাম, দু’মণ গম দাও, হাতে পয়সা হলে দাম দেব।’ মুখের ওপর তো না বলা যায় না, কিন্তু আমার তখনকার কথামনে পড়ল, যখন এই ব্ৰাহ্মণটা ভদ্রভাবে কথাও বলতে জানত না। ‘আরে ছিদে’ ছাড়া অন্য কোনো রকম সম্ভাষণ তার মুখ থেকে শুনি নি।’

‘আর এখন? তুমি হলে চৌধুরী ছেদারাম, আর আমি চৌধুরী মঙ্গলরাম। মঙ্গে’ আর ছিদে থেকে কোথায় চলে এসেছি আমরা আড়াই বছরের মধ্যে।’

‘আমি বলব, এ সবই সুলতানের দয়া, তা না হলে আমরা সেই মঙ্গে’ আর ছিদেই রয়ে যেতাম।’

‘সেই কথাই তো আমি বলছিলাম পণ্ডিতজীকে। আমাদের পঞ্চায়েতও ফিরে পেতাম, না। আমরা, দিনও চলত না আমাদের।’

‘চৌধুরী মঙ্গলরাম, তুমি কলম ধরতে জানো না, অথচ তুমি গ্রামের পঞ্চায়েতের সবকাজকর্মচালাও। আমলাদের কথা ছেড়ে দাও, এইসব বানিয়ারাও এক টাকা দিয়ে দুটাকার ফসল তুলে নিয়ে যেত। জ্যৈষ্ঠ মাস পার হতে না হতেই আমাদের ঘরে ইঁদুর চরে বেড়াত।’

‘আমরা তো তাই বলছি, আমাদের সুলতান লক্ষ বছর বেঁচে থাকুক।’

ব্ৰাহ্মণ পথিক অজ্ঞ আহীরদের মুখে এই তারিফ শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে পড়ল, কিছু একটা বলার সুযোগ খুঁজতে লাগল সে। গুড় আর জল খাওয়ার পর সে আরও উতলা হয়ে উঠল! চৌধুরীদের কথা শেষ হচ্ছে না দেখে মাঝখানেই সে বলে উঠল, ‘সুলতান আলাউদ্দিন তোমাদের পঞ্চায়েত ফিরিয়ে দিয়েছে…’

‘হ্যাঁ পণ্ডিত মুখে ফুল-চন্দন পড়ােক। কিন্তু পণ্ডিত, জানি না কে আমাদের সুলতানের নাম অলাভদীন দিয়েছে। আমরা তো নিজেদের গায়ে লাভদীন বলি তাকে!’

‘তোমাদের যা খুশী নাম রাখ চৌধুরী! কিন্তু জানো, সুলতান হিন্দুদের ওপর কি ভয়ানক অত্যাচার করছে?’

‘আমাদের মেয়েরা গায়ে চাদর না দিয়েও রাত দিন বুক ফুলিয়ে ক্ষেতে-খামারে ঘুরে বেড়ায়। কই, কেউ তো তাদের টেনে নিয়ে যায় না!’

‘ইজ্জতওয়ালা ঘরের ইজ্জত নষ্ট করে তারা।’

‘তাহলে আমরা হলাম। সব বেইজ্জতওয়ালা কিন্তু তোমাদের সেই চোথামারা ইজ্জতওয়ালা কারা, পণ্ডিত?’।

‘তুমি অভদ্রভাবে কথা বলছি, চৌধুরী মঙ্গলরাম!’

‘কিন্তু পণ্ডিত, তোমার বোঝা উচিত যে, যখন থেকে আমরা পঞ্চায়েত ফিরে পেয়েছি, তখন থেকে আমাদের ইজ্জতও ফিরে এসেছে। এখন আমরা বুঝি, বড়-বড় আমলার দল হয়েছে, তারা সকলেই অত্যাচারী, তাছাড়া তাদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু।’

চৌধুরী ছেদারাম বলে উঠল, ‘আমাদের বলা হয় হিন্দু-মুসলমান-এরা দু’জত আলাদা। কিন্তু দেখনি চৌধুরী, নিজেদের হিন্দু ব্ৰাহ্মণ-বলা এইসব লোকেরা নিজেদের ধ বৌদের সাত-পর্দায় ঢাকা বেগম বানিয়ে রাখছে।’

‘হ্যাঁ! অথচ আমার ঠাকুর্দা বলত যে, কনৌজ এবং দিল্লীর রাণীকে খোলা মুখে ঘোড়ায় চড়তে দেখেছে।’

ব্ৰাহ্মণ বলল, ‘কিন্তু চৌধুরী, সে সময় আমাদের ইজ্জত নষ্ট করবার মতো কোনো সলমান এ দেশে ছিল না।’

‘আজও আমাদের ইজ্জত ক্ষেতে-খামারে ঘুরে বেড়ায়, কেউ নষ্ট করে না তাকে।’

‘আর যদি কখনও নষ্ট হয়ে থাকে তো সে ঐ ব্ৰাহ্মণ সিকাবাদেরই চালে।’

‘বেকার বসে-খাওয়া এইসব লোক অন্যের ইজ্জত নষ্ট করা ছাড়া আর কি করবে!’

‘এ হিন্দু-মুসলমানের প্রশ্ন নয়। পণ্ডিত, এ হল যারা পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খায় তাদের কাজ। পাকা হিন্দু আমরাই পণ্ডিত। আমাদের মেয়ে-বউরা কোনোদিন সাত পর্দার আড়ালে থাকবে না।’

ব্ৰাহ্মণ আর একবার সাহস করে বলল, ‘আরো চৌধুরী, তোমরা তো জানো না, সুলতানের সেনাপতি মালিক কাফুর দক্ষিণে গিয়ে আমাদের মন্দির ভেঙে দিয়েছে, সব দেবমূর্তি পায়ের তলায় গুড়িয়েছে।’

‘আমরা অনেক শুনেছি পণ্ডিত, একবার নয়, হাজারবার শুনেছি যে মুসলমানী রাজত্বে হিন্দুদের ধর্ম বিপন্ন। কিন্তু আমরা দিল্লীর খুবই কাছে থাকি পণ্ডিত, না হলে হয়ত আমরাও বিশ্বাস করে নিতাম। আমাদের বিশ ক্রোশের মধ্যে তো কোনো মন্দির ভাঙা হয়নি, কোনো দেবমূর্তিকেও পায়ের তলায় মাড়ানো হয়নি।’

‘হ্যাঁ, মঙ্গলরাম এ সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা, আমি অনেকবারই দশহরা দেখতে দিল্লী গিয়েছি। কি বিরাট মেলা হয়। সেখানে, অর্ধেকের বেশি সেখানে স্ত্রীলোক। হিন্দুদের মেলা কাজেই মেলার লোক বেশিরভাগই হিন্দু। দেবমূর্তি সাজিয়ে সুলতানের অলিন্দের নিচে দিয়ে নিয়ে শঙ্খ, নাকাড়া আর শিঙা বাজাতে বাজাতে হিন্দুরা যায়।’

‘ঠিক কথাই বলেছ ছেদারাম, এ-সব মিথ্যাই। শেঠ নিক্কামল সুলতান-প্রাসাদ থেকে একশ’ গজ দূরেই এক বড় মন্দির তৈরি করাচ্ছে। কত লক্ষ টাকা লাগবে কে জানে। গতবারে পাথর আসতে দেখেছিলাম। আমি। এ-বারে দেখে এসেছি। এক কোমর সমান দেয়াল উঠে গেছে। সুলতানের যদি ভাঙার ইচ্ছাই থাকবে, তাহলে নিজের চোখের সামনে। মন্দির উঠতেই বা দেবে কেন?’

‘হ্যাঁ চৌধুরী, রাজায় রাজয় লড়াই হয়; লড়াইতে কেউ কারও অপেক্ষায় থাকে না। আগে কিছু হয়ত হয়ে গেছে, তাই নিয়ে এখন হল্লা বাধানো হচ্ছে। একশ বছর আগে আমাদের আশে-পাশে এমনি ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু আজ কোথাও কিছু শোনা যায় না।’

‘আমার মনে আছে যখন আমরা গ্রামের কয়েকজন লোক হাকিমের তাঁবুতে গিয়েছিলাম। সে বলেছিল, আগের সুলতানেরা এক রাত্রি বাস করতে আসত এখানে, আর এখন আমাদের সুলতান লাভদীন, আমাদের সুখ-দুঃখের চিরসাখী-এই জন্য প্রজাদের লণ্ঠন করে না সে, বরং তাদের সুখী দেখতে চায়।’

‘এখন শুধু এটা চাওয়ার কথা নয় বরং চারিদিকেই লোকেরা সুখী হয়ে উঠেছে।’

 

৪.

দিল্লীর বাইরে এক নির্জন কবর। তার কাছে কিছু নিম এবং তেঁতুলের গাছ জন্মেছে। অগ্রহায়ণের ঠাণ্ডা রাত। কাঠের আগুনের কাছে দুজন ফকির বসেছিল, এর মধ্যে একজন আমাদের পূর্ব-পরিচিত নুরদীন। দ্বিতীয় ফকির নিজের সাদা দাড়ি এবং গোঁফের ওপর হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ‘বাবা, পাঁচ বছরের ভিতর আবার হরিখানায় দুধের নদী বয়ে যেতে আরম্ভ করেছে।’

‘ঠিক বলেছ বাবা জ্ঞানদীন, এখন কিষাণদের চেহারা বেশ হাসিখুশী।’

‘ক্ষেত-খামার যখন হেসে ওঠে, তখন মুখের চেহারাতেও হাসি ফোটে।’ ‘আমলারা গেছে, কিন্তু এই বানিয়া-মহাজনেরা মরলে শান্তির বাঁশরী বাজত।’ ‘প্রচুর লোটে ওরা। আর ওদের এই বড়-বড় মঠ, বড়-বড় মন্দির, সদাব্রত সবই এই লুটের অর্থেই চলছে।’

‘জ্ঞানী-ধ্যানী, পীর-পয়গম্বর, মুনি-ঋষি ছাড়া ধর্মের পথে কে চলবে? অথচ তাদের কাছে একটা কম্বল, একটা কৌপীন ছাড়া আর কি থাকে?’

‘যতদিন পর্যন্ত গরীবের শ্রমে বড় হওয়া লোক থাকবে ততদিন পর্যন্ত মানুষ ভাইভাই হতে পারবে না। আর সুলতানও মানুষে মানুষে শক্রিতা বাড়িয়ে তোলবার একটা যন্ত্র মাত্র, অথচ তার মান-মৰ্যাদাও জনসাধারণের শ্রম-বিনা টিকতে পারে না।’

‘সেই দিনের আশায় আমরা থাকব বন্ধু; যেদিন এই সমস্ত গোলকধাঁধাঁর খেলা শেষ হয়ে যাবে এবং পৃথিবীতে প্রেমের রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবে।’

১৬. সুরৈয়া (কাল : ১৬০০ খৃষ্টাব্দ)

বর্ষর কর্দমাক্ত বারিধারা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সমতলভূমির ওপর দিয়ে মন্থরগতিতে জলের ধারা গড়িয়ে চলেছে, বেগে ছুটে চলেছে ঢালু জমির ওপর দিয়ে, আর উচ্ছল আবেগে ফুলে উঠে বিস্তৃত পাহাড়ী জলস্রোতের রূপ ধারণ করছে নদী-নালাগুলোর বুকে। বৃক্ষগুলি যেন এখনও পর্যন্ত জলভরা মেঘ ধরে রেখেছে, ওগুলো থেকে এখনও বড়-বড় ফোঁটা ঝরে পড়ছে টুপ্‌টাপ শব্দে। প্রবল বর্ষা এখন গুড়ি-গুড়ি বর্ষণ ধারায় রূপান্তরিত হয়েছে।

এক শমীবৃক্ষ থেকে কিছুটা দূরে শ্বেতবসনা এক তরুনী দাঁড়িয়েছিল। তার মাথার ওপর থেকে সাদা চাদর খসে পড়েছে এবং দ্বিধাবিভক্ত ভ্রমরকৃষ্ণ কেশের মধ্য দিয়ে। হিমালয়ের গভীর অরণ্যানীতে প্রবাহিত গঙ্গার রূপালী ধারার মতোই সিঁথির সরল রেখা দেখা যাচ্ছে। কানের পাশে কুঞ্চিত কালো কুন্তল থেকে এখনও দু-এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছে। তরুণী তুষার শুভ্ৰ গন্তীর মুখমণ্ডল থেকে বড়-বড় কালো চোখ দুটো যেন দূরস্থিত কোনো চিত্রপট নিরীক্ষণ করছে। আজানুলম্বিত রেশমী পোশাক জলে ভিজে বুকের সঙ্গে সেঁটে রয়েছে, যার নিচে লাল কীচুলীতে বাধা সুগোল স্তনযুগল স্পষ্টভাবে উপচে পড়ছে মনোরম ভঙ্গিমায়। সরু কোমর থেকে গোড়ালি পর্যন্ত পায়জামা-তাঁর আঁটোসাটো নিম্নাং জঙ্ঘা প্রদেশের সুডৌল আকৃতি পরিস্ফুট হয়ে রয়েছে। কৰ্দমাক্ত সাদা মোজার ওপর লাল রঙ-এর জুতো। জলে ভিজে সে দুটো আরও নরম এবং সম্ভবত হেঁটে চলারই অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে।

একটি তরুণকে তরুণীর দিকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। তার পাগড়ী, আচকান সবই সাদা এবং ভিজে। কাছে এসে সে লক্ষ্য করল তরুণীর দৃষ্টি দূরে নিবদ্ধ। পায়ের শব্দ না করেই তরুণীর পাশে দু’হাত দূরত্বের মধ্যে এসে গেল সে। কিছু দূরে প্রবাহিত নালার কৰ্দমাক্ত জলধারা তরুণী স্থির দৃষ্টিতে দেখছিল। তরুণ ভেবেছিল, তার সহচরী এ-বারে তাঁর দিকে ফিরে তাকাবে। কিন্তু এক-এক মিনিটে এক একটা যুগ অতিবাহিত হয়ে চলল, তরুণীর দৃষ্টি তবুও নিশ্চল। কপালের ওপর থেকে গুঁড়ি-গুঁড়ি জলকণাগুলো মুছে ফেলবারও অবকাশ হল না তার। আর অপেক্ষা করতে না পেরে ; ধীরে ধীরে তরুণীর কাঁধের ওপর তার হাতটি রাখল। তরুণী মুখ ফেরাল, দূর-নিবদ্ধ দৃষ্টি ফিরে এল তার, উজ্জল হয়ে উঠল বড়-বড় কালো চোখ দুটো, রক্ত অধরপুটে মৃদু হাদির রেখা ফুটে বেরুল এবং ভিতর থেকে চিক্‌চিক করে উঠল সুসজ্জিত দন্তরাজি। তরুণের হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে সে বলল, ‘ ‘তুমি কতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছ কমল?’

‘বহুযুগ থেকে-সেই তখন থেকে, স্ৰষ্ট যখন সবেমাত্র জলের ভিতর থেকে বিশ্বসৃষ্টি শুরু করেছেন, পৃথিবী যখন তরল্যাবস্থায় ছিল এবং পর্বত বৃক্ষ বা প্ৰাণীসমূহের ভর বহন

‘থাম, কমল! তুমি তো সব সময়ই কাব্য কর।’

‘হায় সুরৈয়া, সত্যি কথাই তুমি বলেছ, মনে হচ্ছে আমার অদৃষ্ট কবিতা নেই।’

‘সুরৈয়া অন্য কোনো রমণীকে সঙ্গে রাখা পছন্দ করে না।’

‘এই হৃদয়ও তো ঐ কথা বলে। কিন্তু, তুমি অমন তন্ময় হয়ে কি ভাবছিলে?’

‘সবচেয়ে কাছে হল সুরাট, এখান থেকে মাত্র এক মাসের রাস্তা।’

‘আর এই জল কোথায় যায়?’

‘বাঙলার দিকে। সে আরও অনেক দূর, সম্ভবত দু’মাসের পথ।’

‘বেচারা, এই কাদাগোলা জলকে এতটা পথ চলতে হবে! আচ্ছা কমল, তুমি সমুদ্র দেখেছ?’

‘বাবার সঙ্গে একবার উড়িষ্যা গিয়েছিলাম আমি, তখন দেখেছি প্রিয়ে!’

‘কি রকম দেখতে?

‘দিগন্ত-বিস্তৃত এক কালো মেঘ যেন পড়ে রয়েছে সামনে।’

‘এই জলধারার অদৃষ্টও সমুদ্র সন্দর্শন রয়েছে! আচ্ছা ওখানে গিয়েও এর ঘোলা রঙ এমনটিই থাকবে?’

‘না। সুরৈয়া ওখানে একটি মাত্র রঙই দেখা যায়-ঘন নীল বা কালো।’

‘তুমি যদি নিয়ে যাও তো আমিও একদিন সমুদ্র দেখতে পাই।’

‘সুরৈয়া, তুমি আজ্ঞা করলে এই জলের সঙ্গেই যাত্রা করতে আমি প্রস্তুত।’

দুহাত দিয়ে কমলের গলা জড়িয়ে ধরে তার ভেজা গালে নিজের সিক্ত গাল চেপে ধরল। সুরৈয়া, তারপর কমলের উৎফুল্ল চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সমুদ্রে আমাকে যেতেই হবে, কিন্তু এই জলের সঙ্গে নয় কমল।’

‘মলিন জলধারার সঙ্গে নয়-তাই না প্রিয়তম?’

‘মলিন বলছি কেন কমল, আকাশ থেকে যখন পড়ে তখন কি এ মলিন ছিল?’

‘না। সুরৈয়া, চন্দ্ৰসূর্যের চেয়েও তখন নির্মল ছিল। তোমার ঐ সুন্দর অলকগুচ্ছ কেমন উজ্জল করে তুলেছে এই জলের ধারা। চাঁদের মতো শুভ্ৰ তোমার দুটো গাল কেমন মনোরম করে তুলেছে! আকাশ থেকে সোজা তোমার যে-সব অঙ্গে পড়েছে, সে সমস্ত স্থানেই তোমার সৌন্দর্যকে উজ্জ্বলতর করে তুলেছে।’

‘তাহলে তো এর এই মলিনতা নিজস্ব নয়। সাগর সঙ্গমের যাত্ৰাপথ রোধ করে। দীড়িয়েছে যে, তারই সঙ্গে সংঘর্ষে এই মলিনতা প্রাপ্ত হয়েছে। সোজা সাগরের জলে ঝরেপড়া ফোঁটাগুলোও কি এমনি হয় কমল?’

‘না প্রিয়তমা।’

‘এই জন্যেই তো এই মলিনতাকে আমি এর দোষ মনে না করে ভূষণ বলেই মনে করি। তুমি কি বল কমল?’

তোমার অধর আমার মনের কথাকেই ব্যক্ত করছে। সুরৈয়া।’

 

২.

আকাশের নীলিমার ছায়া সরোবরের অতল জলরাশিকে আরও নীল করে তুলেছে। অমল-ধবল শ্বেত পাথরের ঘাট আরও যেন সাদা হয়ে উঠেছে এই নীলিমার পটভূমিকায়। সবুজ দুর্ব ঘাসের মধ্যে সূক্ষ্মপত্রযুক্ত সবুজ বৃক্ষরাজি বড়ই সুন্দর দেখাচ্ছিল। বিশেষ করে এই বসন্তের মধ্যাহ্নবেলায়। বহু দূর প্রসারী বৃক্ষশ্রেণীর লতা-মণ্ডপ এবং ঝর্ণাধারায় সুসজ্জিত মনোরম উদ্যান। শাহীবাগ আজ তরুণ-তরুণীদের বসন্তোৎসবের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে এবং উন্মুক্ত এই উদ্যানে স্বর্গবিহারীদের মতো তারাও পরমানন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

পুস্করিণী থেকে দূরে বাগানের ধারে লালপাথরের ছাউনীর বাইরে চার ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে। সকলের মাথায়ই এক ধাঁচের পাগড়ী-সামনের দিকে কিছুটা প্রসারিত; হাঁটু পর্যন্ত লম্বা একই রকমের গলাবন্ধ জামা, একই রকমের সাদা কোমরবন্ধনী। সকলের একই রকমের গোফ, অধিকাংশই সাদা হয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ এরা বাগানের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর এগিয়ে এসে চারিদিক-খোলা ছাউনীর নিচে গদীর ওপর বসে পড়ল। চারিদিকে এক অখণ্ড নিঃস্তব্ধতা বিরাজ করছিল, এই বৃদ্ধের দল ছাড়া আর কেউই সেখানে নেই।

নীরবতা ভঙ্গ করে একজন বলে উঠল, ‘বাদশাহ সালামত!…’

‘কি ব্যাপার ফজল, এখনও কি আমি দরবারে অধিষ্ঠিত রয়েছি? আমি কি কখনও সাধারণ মানুষের মতো সহজভাবে থাকতে পারি না?’

‘ভুলে যাই…’

‘নাম ধরে ডাকো-বল জালাল বা আকবর, না হয়। শুধু বন্ধু বল!’

‘এ বড় মস্কিল বন্ধু জালাল, দু’রকমের জীবনযাপন করতে হয় আমাদের।’

‘দু’রকম নয়, চার রকম ভাই ফজলু!’

‘ভাই বীরু! তোর তারিফ করি আমি, সব সময়েই যেন সমস্ত কিছুর জন্য তৈরি থাকিস তুই, আমি তো যখন এক দুনিয়া থেকে অন্য দুনিয়ায় চলে আসি তখন মনটাকে। তৈরি করে নিতে অনেক সময় লেগে যায়। কি ভাই টোডর, ঠিক বলিনি?’

‘হ্যাঁ ভাই ফজলু, আমিও তাজব বনে যাই, কি অদ্ভুত মগজ ওর…’

‘বীরবলকেই হিন্দুস্থানের সমস্ত লোক ভারতের প্রতিটি ক্ষেত্রে কর্ণধার বলে জানে!’

‘কিন্তু টোডরমলও তো তাই! সেও কি সব জায়গায় পর্যবেক্ষণ চালায়নি?’

বীরবল, ‘চালাক বা না-চালাক, দুনিয়া আমার কথাই জানে, আর আমার এই মগজের প্রশংসা আমাদের জালুও করে।’

আকবর, ‘নিশ্চয়ই আর এ ব্যাপার শুধু সেই সব কাহিনীতেই শেষ নয়, বাদশাহ জালালুদ্দিন আকবরের বিভিন্ন বেশে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানো সম্বন্ধে যা প্রচলিত।’

বীরবল, ‘এ এক চমৎকার স্মৃতি মনে করিয়ে দিলে জল্লু ভাই। ঐ কাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে আমিও মারা যেতে বসেছি। বীরবল এবং আকবরের নামে যে কোনো রকমের কাহিনী রচনা করে বলে বেড়ানো এক সখের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন বহু কাহিনী আমি জমিয়ে ফেলেছি-প্ৰত্যেকটির জন্য আমি এক-এক আশরাফি মূল্য ধার্য করেছি।’

আকবর, ‘এই আশরাফির জন্যে কাহিনীগুলো তোমার মগজ থেকেই সোজা বেরিয়ে আসে না তো?’

বীরবল, ‘হতে পারে, কিন্তু তাতে কোনো তফাৎ নেই। সে ক্ষেত্রেও তো এ কথা বোঝা যাবে যে, কি রকম সব অর্থহীন কাহিনী আমাদের দু’জনের নামে রটানো হচ্ছে। রাগ করিস না ফজলু ভাই, শেঠ ছদামীমলের মতো আমি কঞ্জুষ নই।’

আবুল ফজল, ‘না রে বীরু, আমার ওপর মিছামিছি। রাগ করিস না, তোর গল্পগুলোকে তাই বড় ভয় করি আমি।’

বীরবল, ‘ হ্যাঁ, আমিই আইন-ই-আকবরীর মতো পুথি লিখে রেখে দিয়েছি কিনা!’

আবুল ফজল, ‘আইন-ই-আকবরী পড়ার মতে ক’টা লোক পাওয়া যাবে, আর বীরবলের গল্পগুলোকে মুখে মুখে ছড়াবার লোকই বা কত হবে?’

টোডরমল, ‘এ তো বীরু নিজেও জানে।’

আবুল ফজল, ‘যাহোক। তোমার আশবৃফিওয়ালা গল্প শোনাও বীরু!’

বীরবল, কিন্তু তোমরা সকলে তো প্রথমেই ধরে নিয়েছ যে, এ গল্প আশবৃফি দিয়ে কিনিনি আমি, আমার নিজের মগজ থেকেই বেরিয়েছে।’

‘আকবর, ‘কোনটা আসল আর কোনটা জাল সে আমরা বুঝতে পারি।’

বীরবল, ‘যেন আমার সব গল্পের ওপরেই ছাপ মারা আছে! বেশ, যা তোমাদের মর্জি। গল্প তো শুনিয়ে দিই। আমি। তবে গল্পের সারাংশটুকুই বলব শুধু–

‘আকবরের একবার খুব সখা হল হিন্দু হবার। বীরবলকে সে এই কথা জানাল; বীরবল বড়ই বিপদের মধ্যে পড়ল। বাদশাহকে সে না করতেও পারে না, অথচ তাকে হিন্দু বানাবার ক্ষমতাই বা তার কোথায়? দিন কয়েক গা ঢাকা দিয়ে থাকল। একদিন সন্ধ্যায় বাদশাহ-মঞ্জিলের খিড়কির কাছে ‘হিছ-ছো-ও’, ‘হিছ-ছো-’ করে জোর আওয়াজ হতে লাগল। বাদশাহ-মঞ্জিলের এই দিকটাতে এমন সময় কখনও কাপড় কাঁচার শব্দ শোনা যায় না। কৌতূহল বেড়ে গেলবাদশাহর। এক মজুরের পোশাক পরে যমুনাতীরে এল। পোশাক যতই বদলাক, বীরুর চোখে ধরা না পড়ে পারল না। সে যাহোক। ওখানে কাপড় আছড়ানো হচ্ছিল না, মোটাসোটা এক গাধাকে সোডা-সাবান দিয়ে রগুড়ে ধোয়া হচ্ছিল।’

‘মুচকি হাসিটুকু লুকিয়ে গলার আওয়াজ বদলে বাদশাহ জিজ্ঞেস করল, ‘কি করছ হে চৌধুরী?’

‘নিজের কাজ করছি ভাই, তোর কি দরকার তা দিয়ে?’

‘বড় অসময়ে ঠাণ্ডায় হাওয়ার মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছে। চৌধুরী-অসুখ করবে।’

‘কি করা যাবে, এই হল বাদশাহের হুকুম!’

বাদশাহ এবার হেসে উঠে স্বাভাবিক স্বরে বলল, চল বীরবল, আমি বুঝতে পেরেছি যে, মুসলমানের হিন্দু হওয়া গাধার ঘোড়া হবারই সামিল’।’

‘ভাই ফজল, এই গল্প শুনে মনে হয়, যেন আমার দেহের ভেতর সাপ ঢুকেছে।’

‘আকবর, ‘জীবন সায়াহ্নে, এসে আমাদের এইসব গল্প শুনতে হচ্ছে! আমাদের সারা জীবনের একাগ্র সাধনার পরিণাম কি শেষে এই দাঁড়াবো!’

আবুল ফজল, ‘আমরা শুধু আমাদের কালের ঝক্কিই বহন করতে পারি, কিন্তু আমাদের এই প্রচেষ্টার সাফল্য-অসাফল্য নির্ভর করছে বসন্তোৎসবরত ঐ সব যুবক যুবতীদের ওপর।’

টোডরমল, ‘কিন্তু আমরা মুসলমানকে হিন্দু বা হিন্দুকে মুসলমান বানাতে চাইনি।’

আবুল ফজল, ‘আমরা দু’জনকেই এক করে দেখতে চেয়েছি-এক জাতি এক প্রাণ বানাতে চেয়েছি।’

বীরবল, ‘মোল্লা আর পণ্ডিতেরা কিন্তু আমাদের ধারায় চিন্তা করে না। আমরা চাই ভারতবর্ষকে শক্তিশালিরূপে দেখতে। ভারতের অস্ত্ৰে তীক্ষ্ণতা আছে, ভারতীয় মস্তিষ্কে প্রতিভা রয়েছে, যুবকদের রয়েছে সাহস। কিন্তু ভারতবর্ষের দোষ, ভারতের দুর্বলতা হল তার ভিতরকার অনৈক্য, তার বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার প্রবণতা।’

আকবর, ‘এই তো আমার একমাত্র আকাঙ্ক্ষা ছিল বন্ধু, এতদিন পর্যন্ত আমরা এরই জন্যে সংগ্ৰাম করে এসেছি। আমরা যে সময় কাজ আরম্ভ করি।-চারিদিক অন্ধকারাচ্ছন্ন তখন, কিন্তু এখন তো আর তা বলা চলে না। এক পুরুষে যতটা করা সম্ভব আমরা সেটা যথাযথভাবে করেছি। কিন্তু এই গাধা-ঘোড়ার গল্প আজ পাথরের মতো চেপে বসেছে আমার অন্তরে।’

আবুল ফজল, ‘ভাই জালাল, নিরাশ হওয়াও আমাদের উচিত নয়। বৈরাম খায়ের সময়ের সঙ্গে তুলনা কর আজকের। সে সময় কি যোধাবাই তোমার স্ত্রী হয়ে হারেমে বসে বিষ্ণুর মূর্তি পূজা করতে পারত?’

আকবর, ‘তফাৎ সত্যিই আছে ফজল, কিন্তু লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে এখনও বহু দূর যেতে হবে আমাদের। ফিরিঙ্গি পাদরীদের কাছে আমি শুনেছি, তাদের দেশে সবচেয়ে বড় বাদশাহও একটির বেশি স্ত্রীলোককে বিয়ে করতে পারে না। এই প্রথা আমার কত ভালো লেগেছে, তা সেই সময়ের আমার কথাবার্তা থেকে তুমি বুঝে থাকবে টোডর। আমিও যদি এ দেশে এমন ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে পারতাম! কিন্তু এ বড় বিড়ম্বনার কথা যে, মন্দ কাজ করবার স্বাধীনতা বাদশাহের যতটা আছে, ভালো কাজের সময় ততটা নেই। যদি সম্ভব হত তবে সেলিমের মা ছাড়া আর কাউকে আমার হারেমে রাখতাম না। এ ব্যবস্থা যদি সেলিমের জন্য করতে পারতাম আজ!’

বীরবল, ‘প্রেম কেবল একজনের সঙ্গেই হতে পারে জালাল। মনোহর হংস-দম্পতি যখন দেখি, তখন বুঝতে পারি তাদের জীবন কত সুন্দর। আনন্দের দিনে যেমন পরস্পরের সাখী ওরা, বিপদের দিনেও ঠিক তেমনি।’

আকবুর, ‘আমার চোখ থেকেও একবার জল ঝরেছিল বীরু ভাই! সে-বার সিংহ। শিকারে গুজরাট গিয়েছিলাম। হাতীর পিঠে চড়ে বন্দুকের সাহায্যে সিংহ মারা কোনো বাহাদুরীর কাজ নয়। এ কথা আমি নিশ্চয়ই স্বীকার করব–সিংহের মতো থাবা এবং নখ যখন তোমার নেই, তখন ঢাল-তলোয়ার নিয়ে তার সামনে এগোতে পার তুমি, এর চেয়ে বেশি শক্তিশালী অস্ত্র নেওয়া বীরত্বের পরিচায়ক নয়। আমি কিন্তু বন্দুকের সাহায্যেই সিংহটিকে মারলাম। গুলি ওর মাথায় গিয়ে লাগল, আৰ্তনাদ করে সেখানেই পড়ে গেল। ঠিক সেই মুহূর্তে ঝোঁপের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল। তার সিংহিনী। অপরিসীম। ঘৃণার দৃষ্টিতে সে একবার আমার দিকে তাকাল, পরীক্ষণেই মৃত সিংহের গলা চাটতে লাগল। তৎক্ষণাৎ আমি শিকারীদের গুলি ছোড়া বন্ধ করতে বললাম এবং হাতী ফিরিয়ে আনলাম। আমার মনে সেদিন এত বড় আঘাত লেগেছিল যে, সিংহিনী যদি হামলাও করত। আমার ওপর তবু হয়ত বন্দুক তুলতাম না। আমি। বহুদিন পর্যন্ত বেদনাভিভূত হয়ে পড়েছিলাম আমি এবং সেই সময়েই বুঝতে পেরেছি যে, ঐ সিংহের যদি হাজার-পাঁচশ’ সিংহী থাকত, তবে অমান করে সেদিন গাল চাটত না কেউ।’

আবুল ফজল, ‘আমাদের দেশকে কত দূর পথ অতিক্রম করতে হবে, অথচ আমাদের গতি কি মন্থর! তাছাড়া এও তো আমাদের জানা নেই যে, আমরা অসমর্থ হয়ে পড়লে আমাদের ভার বহন করবার মতো কেউ রয়েছে কিনা!’

আকবর, ‘আমি চেয়েছিলাম হিন্দু, মুসলমান দুই জাতির মধ্যে রক্তের সম্পর্ক স্থাপিত হোক। এই সম্পর্কের কথা স্মরণে রেখেই প্ৰয়াগে ত্ৰিবেণী তটে কেল্লা তৈরি করিয়েছি আমি। গঙ্গা-যমুনা ধারার এই সঙ্গম আমার অন্তরেও এক বিরাট মিলনের স্পৃহা জাগ্রত করে তুলেছে। কিন্তু কত সামান্য সফলতা লাভ করেছি তা এখনও দেখতে পাচ্ছি না। বস্তুত যে কাজ শুধু বংশ পরম্পরাই অনুষ্ঠিত হতে পারে, এক পুরুষের মধ্যে তাকে গড়ে তোলা যায় না। একটা বিষয়ে চিরকালই আমার গর্ব থেকে যাবে যে, আমি যেমন বন্ধু পেয়েছি, তেমন বন্ধু খুব কম লোকের ভাগ্যেই জোটে। আকবর আর যোধাবাই মেহেরুন্নিসার মতো মিশ্র। বিবাহ ঘরে ঘরে দেখতে চাই আমি। অথচ এমন আর একটিও দেখতে পেলাম না।’

টোডরমল, ‘হিন্দুরাই এ বিষয়ে বেশি পশ্চাৎপদ বলে প্রমাণিত হয়েছে।’

বীরবল, ‘আর এখন তারা গাধাকে ঘষে-মেজে ঘোড়া বানাবার গল্প তৈরি করছে। কিন্তু, হিন্দু মুসলমানের যদি এতই তফাৎ থাকবে, তো ঘোড়া গাধা হয়ে যাচ্ছে কি করে! হাজার হাজার হিন্দুকে মুসলমান হয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে না কি?’

আকবর, ‘আমি তো সব সময়েই এটা দেখব বলে অপেক্ষা করে আছি যে, হিন্দু তরুণীরা নাম এবং ধর্ম ত্যাগ না করেই মুসলমান তরুণীদের বিয়ে করুক।’

আবুল ফজল, ‘এখানে আমি তবে একটা সুসংবাদ শোনাই জালাল! আমরা যে কাজ করে উঠতে পারিনি, আমার সুরৈয়া সে কাজ করেছে।’

সকলে উৎসুক নয়নে আবুল ফজলের দিকে তাকাল।’

তোমরা আরও কিছু শোনবার জন্যে উদ্‌গ্ৰীব হয়ে উঠেছ তো? আমাকে একটু বাইরে। থেকে আসতে দাও’–বলে আবুল ফজল বাইরে গিয়ে থামের পাশে দাঁড়িয়ে কি দেখল, তারপর ফিরে এসে বলল, ‘শোনার চেয়ে চোখে দেখাই ভালো, এস আমার সঙ্গে।’ সকলে থামের কাছে গেল। অশোক গাছের নিচে পাথরের ওপর উপবিষ্ট যুগল মূর্তির দিকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে আবুল ফজল বলল, ‘ঐ দেখ আমার সুরৈয়াকে।’

টোডরমল ‘আর ঐ আমার কমল! দুনিয়া আর আমাদের কাছে অন্ধকার নয়। ফজলু ভাই’–বলে টোডরমল দুহাতে আবুল ফজলকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করল।

এরা দু’জন যখন আলিঙ্গন-মুক্ত হল, তখন চার জনেরই চোখে জল। আকবর মৌনতা ভঙ্গ করে বলল, ‘তরুণদের এই বসন্তোৎসবের ব্যবস্থা অনেক বছর হতেই আমি করেছি।’ কিন্তু এত বছর পরে আজই প্রথম আসল বসন্তোৎসবের অনুষ্ঠান হল। আমার মন চাইছে,–ওদের দু’জনকে ডেকে কপালে আশিস-চুম্বন দিয়ে দিই। আমি। ওরা যদি জানে যে, গঙ্গাযমুনার সঙ্গমের মতো। ওদের ঐ মধুর মিলনকেও অন্তরের সঙ্গেই সমর্থন করি আমরা, তবে খুবই ভালো হয়।’

আবুল ফজল, ‘সুরৈয়া জানে, তার বাপ-মা এই প্রণয়কে সুখের বলে মনে করে।’

টোডরমল, ‘কমল সেটা জানে না। কিন্তু তুমি বড় ভাগ্যবান ফজলু। কারণ সুরৈয়ার মা তোমার সঙ্গে একমত। কমলের মা এবং সুরৈয়ার মা-দু’জনে যদিও অন্তরঙ্গ সখি, তবুও কমলের মা কিন্তু-কিছুটা প্রাচীনপন্থী, যাহোক, তাতে ক্ষতি নেই। কমল আর সুরৈয়াকে আমি প্ৰাণভরে আশীৰ্বাদ করব।’

আকবর, ‘সবচেয়ে আগে আমাকেই আশীৰ্বাদ করতে দেওয়া উচিত।’

বীরবল, ‘আর আমাকে তোমার সঙ্গে নেবে না জল্লু?’

আকবর, ‘নিশ্চয়ই, এমন ধোবী কোথায় পাওয়া যাবে?’

বীরবল, ‘আর এমন ঘোড়া বনে যাওয়া গাধাই বা কোথায়!’

আকবর, ‘আমাদের এই মিলন আজ কত মধুর। মাসে একদিনও যদি এমন আনন্দ লাভ করা যেত।’

 

৩.

ছাদের ওপর চারিদিকে দরজাযুক্ত এক সুসজ্জিত কামরা। কামরার ভেতরের দিকটায় ছাদ থেকে লাল, সবুজ সাদা, ঝাড় টাঙানো। দরজাগুলোতে দু’পাল্লা করে পর্দা দেওয়া। ভেতরের দিককার পর্দাগুলো বুটিদার গোলাপী রেশমের। মেঝের ওপরও সুন্দর ইরানী গালিচা পাতা। কামরার মাঝখানে সাদা গদির ওপর অনেকগুলো তাকিয়া বালিশ। গদির ওপর বসে দুটি তরুণী দাবা খেলছে। এদের মধ্যে একজন আমাদের পূর্ব পরিচিত। সুরৈয়া। আর লাল ঘাঘরা, সবুজ চেলী এবং হলদে ওড়না পরা অপর তরুণীটি বীরবলের তের বছরের কন্যা ফুলমতী। তারা খেলার চাল দেবার চিন্তায় এত মগ্ন হয়ে আছে যে, গন্দিরওপর এগিয়ে আসা পায়ের শব্দ শুনতে পেল না।’সুরৈয়া!–ডাক শুনে দু’জনেই চোখ তুলে তাকাল এবং তারপর উঠে দাঁড়াল।’কাকিম।’–বলে উঠে দাঁড়াল সুরৈয়া, আর কমলের মা তার গলা জড়িয়ে ধরে গালে চুমু দিল। সুরৈয়ার মা বলল, ‘তোর জন্যে রঙিন মাছ নিয়ে এসেছে কমল-যা পুকুরে ছেড়ে আয়। ততক্ষণ আমি মুনীর সঙ্গে খেলছি।’

‘মুন্নী বড় হুঁসিয়ার মা, আমাকে দু’বার মাত করে দিয়েছে। ছোট মেয়ে বলে ওকে উড়িয়ে দিয়ে না’ –এই বলে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সুরৈয়া।

প্রাসাদের পিছনের দিককার বাগানে পুকুরের ধারে কমল দাঁড়িয়ে ছিল। তার সামনে নতুন এক মাটির হাঁড়ি। কাছে এসে নিজের হাতের মধ্যে কমলের হাত নিয়ে সুরৈয়া বলল, ‘লাল আর গোলাপী মাছ নিয়ে এসেছি কমল?’

‘ হ্যাঁ, সোনালী রঙেরও এনেছি।’

‘দেখি একবার’–বলে সুরৈয়া সামনে ঝুঁকে হাঁড়িটা ঝাকাতে লাগল।

‘এগুলোকে আমি পুকুরে ছেড়ে দিচ্ছি, সেখানে থাকলে দেখতে আরও সুন্দর লাগবে। পুকুরের স্বচ্ছ জলের মধ্যে ওগুলোকে দেখ সুরৈয়া।’

ঠোঁটে এবং চোখে হাসি ফুটিয়ে পুকুরের কাছে এসে দাঁড়াল সুরৈয়া। কমল হাঁড়ি উপুড় করে মাছগুলো পুকুরে ছেড়ে দিল। পুকুরের স্বচ্ছ জলে তাদের লাল, গোলাপী, সোনালী রঙ সত্যিই বড় সুন্দর মনে হতে লাগল। কমল গম্ভীর স্বরে, বোঝাতে লাগল, ‘এগুলোকে আমি পুকুরে ছেড়ে দিলাম, এখানে দেখতে আরও সুন্দর লাগবে। এখনও এগুলো ছোট সুরৈয়া, কিন্তু বয়স হলেও ছয় আঙ্গুলের বড় হবে না।’

‘কিন্তু দেখতে বড় সুন্দর কমল।’

‘এই দেখ সুরৈয়া-এটার কি রং বলতে পার?’

‘গোলাপী।’

‘ঠিক যেমন তোমার দুটি গাল।’

‘ছোটবেলায় তুমি এমনি করেই বলতে, কমল।’

‘ছোটবেলোয় সুরৈয়াও যে ঠিক এমনিই ছিল।’

‘ছোটবেলায় তোমাকে বেশ মিষ্টি লাগত কমল।’

‘আর এখন?’

‘এখন খু-উ-ব মিষ্টি।’

‘আগের চেয়ে বেশি! কেন?’

‘কেন জানি না, যখন থেকে তোমার গলার স্বর বদলাতে লাগল, তোমার ঠোঁটের ওপর সূক্ষ্ম কালো গোঁফের রেখা দেখা দিতে লাগল, মনে হয় তখন থেকেই আমার প্রেম গম্ভীর হয়ে উঠল আরও।’

‘আর তখন থেকেই কমলকে দূরে-দূরে রাখতে আরম্ভ করলে তুমি।’

‘দূরে? দূরে রাখতে?’

‘নয় কেন-আগে আগে কেমন লাফিয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলতে।’

‘ও সব নালিশের ফিরিস্তি কমল, তার চেয়ে নতুন কোনো খবর বল।’ ‘

‘নতুন খবর হল, আমাদের প্রেমের ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেছে।’

‘কোথায়?’

‘দু’জনের বাড়িতে! আলি হজরৎ বাদশাহ সলামত পর্যন্ত জেনেছেন!’

‘বাদশাহ সালামত পর্যন্ত!’

‘ভয় পেলে না-কি সুরৈয়া?’

‘না, প্রেমের কথা তো একদিন প্রকাশিত হবেই। কিন্তু এখনই কি করে হল?’

‘এত কথা আমিও জানতাম না, কিন্তু শুনেছি কাকা-কাকিমাই একে প্রথম সমর্থন জানিয়েছেন, তারপর বাবা এবং বাদশাহ সলামত এবং সকলের শেষে মা।’

’মা?’

‘মা’র সম্বন্ধে সকলের ভয় ছিল। জানো তো, মা বড় প্রাচীনপন্থী?’

‘কিন্তু এখনও আমার গালের ওপর থেকে,কাকিমার চুমুর দাগ মোছেনি!’

‘হ্যাঁ, সকলের ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে! বাবা যখন তার কাছে বললেন তখন মা

‘তাহলে আমাদের প্রেম সকলের সদর-সমর্থন পেয়েছে?’

’আমাদের আপনজন সবার কাছেই পেয়েছে কিন্তু বাইরের দুনিয়া একে মানতে হয়ত রাজি নয়!’

‘এই বাইরের দুনিয়ার তুমি পরোয়া কর, কমল?’

‘একেবারেই নয়। সুরৈয়া, পরোয়া করি আমি শুধু ভবিষ্যৎ দুনিয়ার-যার জন্য এ পথ প্রদর্শন করতে যাচ্ছি আমরা আজ!’

‘বৌদিও সব কথা জানে কমল, রাত্রে তার ঘরে গিয়েছিলাম, ঠাট্টা করে আমায় বলল, ‘ঠাকুরঝি, আমি যে নন্দাইয়ের আশায় বসেছিলাম–আজ আমার সে সাধ পূর্ণ হতে চলেছে–তোমার নাম অবশ্য করেনি।’

‘এর মানে দাদাই বলেছেন বৌদিকে, আর ওদের দু’জনেরও বেশ সমর্থন রয়েছে আমাদের প্রেমে।’

‘তাহলে তোমার শ্বশুরকুলের সবাই তোমার অনুকুলেই কমল?’

’তোমারও বাহাদুরি-তুমি আমার মায়ের সমর্থন আদায় করেছ।’

‘কাকিমার পূজা-পাঠের কথাই তোমরা চিন্তা করেছ কমল, কিন্তু যদি জানতে যে আমাকে তিনি কত ভালোবাসেন, তবে সম্ভবত তাঁর সম্বন্ধে কোনো রকম সন্দেহই পোষণ করতে না।’

‘আমরা জানতাম বলেই তো তাঁর ওপর প্রয়োগ করার জন্য তোমাকেই চরম অস্ত্র রূপে ঠিক করে রেখেছিলেন বাবা। কিন্তু সে অস্ত্র প্রয়োগ করবার আগেই কেল্লা-ফাতে হয়ে গেল। এখন তো আমাদের বিয়েই হতে চলেছে।’

‘কোথায়?’

‘পণ্ডিতের কাছে নয়, মোল্লার কাছেও নয়। আমাদের আপনি পয়গম্বরের কাছে, যিনি ভারতবর্ষে নতুন ত্রিবেণীর দুর্গ নির্মাণ করেছেন।’

‘যিনি খাল, বিল, নদীনালাকে পবিত্র সমুদ্র পরিণত করতে চান! কিন্তু কবে কমল?’

‘পরশু, রবিবার সুরৈয়া।’

‘পরশু!’ সুরৈয়ার চোখের জল শিশির বিন্দুর মতো টলটল করে উঠল। তা মুছে দিয়ে তার চোখে চুমু দিল কমল। ওদের দু’জনের কেউই তখন জানতে পারল না, আরও চারটি চোখে তাদের মতো লুকিয়ে আনন্দাশ্রু বর্ষণ করেছ।

 

৪.

বসন্তের হাল্কা হাওয়া, প্রাক-সন্ধ্যার অস্তগামী সূর্যকিরণের লাল আভায় অগ্নিবৰ্ণ সাগরসব মিলিয়ে অপূর্ব এক দৃশ্য! সমুদ্রের বালুকাবেলায় বসে দুটি তরুণ হৃদয় এই দৃশ্য উপভোগ করছিল। উপভোগের এমনি এক পরম মুহূর্তে একজন বলল, ‘কি সুন্দর এই সমুদ্র।’

‘আমরা সকলেই যে সমুদ্রের সন্তান তাতে কোনো সন্দেহ আছে প্রিয়ে?’

‘না গো আমার কমলবরণ কমল, আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি যে এমন এক স্বৰ্গলোককে সমুদ্র আপন গর্ভে লুকিয়ে রেখেছিল।’

‘পরিপূর্ণভাবে না হলেও ভেনিসকে মানুষ স্বর্গে পরিণত করে ফেলেছে, এতেও কোনো সন্দেহ নেই।’

‘সাধুজী যখন বলতেন যে, আমাদের দেশের কুলবধুরা এবং কুলকন্যারা পুরুষের মতোই অবগুণ্ঠনহীন স্বাচ্ছন্দ্যে একদা ঘুরে বেড়াত, তখন তাঁর কথা আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। আজ দু’বছর হয়ে গেল আমরা এই স্বৰ্গরাজ্যে বাস করছি, এই ভেনিসের সঙ্গে দিল্লীর তুলনা করত। প্রিয়।’

‘যদি কেউ বলে যে, ফ্লোরেন্সের মতো সমৃদ্ধ রাজা রাজাহীন অবস্থায় টিকে থাকতে পারে। তবে আমরা সে কথা বিশ্বাস করতাম। কখনও!’

‘আর ভেনিসের মতো-নগরীকে কোনো রাণী কি পরিচালনা করতে পারে!’

‘দিল্লীতে কি আমরা এমন স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াতে পারতাম, সুরৈয়া!’

‘বোরখা ছাড়া? না প্ৰিয়তম, পাল্কির ভিতর আবরু রেখে সেখানে চলাফেরা করতে হয়। আর এখানে-হাত-ধরাধরি করে চললেও কেউ আমাদের দিকে তেমন দৃষ্টি দেয় না।’

‘গুজরাটে কিছু অনাবৃতমুখী কুলাঙ্গনাদের আমি দেখেছি। শুনেছি। দক্ষিণেও পর্দা প্রথা নেই।’

‘এ থেকেই বোঝা যায়, ভারত-ললনারাও একটা সময়ে পর্দামুক্ত ছিল। আমাদের দেশ আবার কখনও কি আমন হতে পারবে কমল?’

‘আমাদের পিতৃপিতামহরা তো আজীবন চেষ্টা করছেন। এই ছোট্ট দেশ ফ্লোরেন্স, মাত্র তিন দিনেই যাকে অতিক্রম করা যায়, তার দিকে একবার চেয়ে দেখ সুরৈয়া! এখানকার লোক কেমন গর্বের সঙ্গে মাথা উচিয়ে চলে। কারও সামনে মাথা নত করা বা কুর্নিশ করা এদের কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত।’রাজা’ শব্দটা শুনলে তারা থুথু ফেলে, রাজা এদের কাছে এক শয়তান অথবা অগ্নিশ্বাসনিক্ষেপকারী এক দৈত্য বিশেষ।’

‘কিন্তু কমল এ-সবের মধ্যে সত্যতাও কি কিছু নেই। ফ্লোরেন্সের কৃষকের সঙ্গে তুলনা কর ভারতবর্ষের কৃষকের, এখানে কি সেই নগ্ন-জীর্ণ কঙ্কালসার চেহারা কোথাও দেখা যায়?’

‘না প্রিয়ে, আর তার কারণ হল এই যে, এখানে শাহী শান্য-শোকতে কোটি-কোটি টাকা ব্যয় করা হয় না।’

‘ভেনিসের ধনকুবেররা অনেকেই আমাদের কোটিপতিদের হার মানায়।’

‘আমাদের কোটিপতিরা এক লাখের ওপর এক নিশান ওড়ায়! আমি ভাবতাম। চৌবাচ্চা-ভরা এত টাকা আর মোহর অন্ধকারে পড়ে থেকে কি লাভ হয়? টাকা তো এক হাত থেকে আর এক হাতে ঘোরা উচিত। এই গতিশূণ্যতার কারণে মিঠাঁই-মণ্ডা নিজের জায়গায় পড়ে শুকোয়, ফল নিজের জায়গায় পড়ে থেকে পাঁচে। গুদামের কাপড় পোকায় কাটতে থাকে। অথচ এইসব পুঁতে রেখে আমাদের শেঠেরা তার ওপর লাল নিশান ওড়ায়। লোকে বলে, এর যখন একশ’ নিশান রয়েছে, তখনও শেঠ ক্রোড়মল।’

সূর্যের রক্তিম আভা কিছুক্ষণ হল মিলিয়ে গেছে। চারিদিকে এখন অন্ধকারের ছায়া, সমুদ্রলহরী পাথরের গায়ে আছাড় খেয়ে একটানা শব্দ করে চলেছে, তরুণ-তরুণীরা এখনও বালুতটে ছেড়ে উঠতে চাইছে না। সমুদ্রকে সূরৈয়া ও কমল সত্যিকারের সঙ্গী বলে গ্রহণ করে নিয়েছে। যদিও তারা শুধু জলপথেই ভ্ৰমণ করেনি, তবু জানত, তাদের সম্মুখে অবস্থিত এই সমুদ্রের একাংশ ভারতের মাটি স্পর্শ করে আছে। তাই কখনও কখনও তাদের মনে প্রশ্ন উঠত, এপারের সঙ্গে মিলন ঘটানো যায় কি! অনেক রাতে ফিরতি পথ ধরল তারা। অন্ধকার এই রাত এবং সেই সঙ্গে নিজের অবস্থা উপলব্ধি করে। সুরৈয়া বলল, ‘আমাদের বাদশাহ নিজ রাজ্যে শান্তি স্থাপনের জন্যে যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন, এবং তাতে বহুলাংশে সফলতাও লাভ করেছেন। কিন্তু সেখানে কি এমন নিঃশঙ্ক হয়ে বেড়াতে পারি আমরা!–কেন পারি না কমল?’

‘এখানে সকলের অবস্থাই ভালো। কৃষকের ক্ষেতে আঙ্গুর, গম এবং অন্যান্য ফসল যথেষ্ট উৎপন্ন হয়।’

‘আমাদের দেশের জমিতেও তো সোনা ফলে!’

’কিন্তু সেই সোনা লুটবার লোকও যে আমাদের দেশে অনেক!’

‘আর একটা জিনিস দেখছ তো কমল, এখানে কারও বাড়ি গেলে সঙ্গে সঙ্গে কেমন মদের বোতল-গ্লাস এনে হাজির করে টেবিলে।‘

‘ভারতবর্ষে কিন্তু আমার বাবার এই জন্যেই বদনাম ছিল যে, তিনি বাদশাহর সঙ্গে বসে মদ্যপান করে থাকেন।’

‘আর আমার বির-রা আমাকে কি শেখাত জান! বলত ‘রাজপুতানীরা বড় নোংরা, তাদের ঘরে শুয়োর রান্না হয়।’ এখন আমার মনে হয়, ওখানকার অন্ধরা এখানে এলে বুঝত যে, দুনিয়ায় ছোট-বড় জাত বলে কিছু নেই।’

‘পান-ভোজনে জাত-পাতের বালাই নেই এখানকার দুনিয়ায়।’

‘ফ্লোরেন্স বেশ একুতাবদ্ধ দেশ, একদিন হয়ত ভারতবর্ষও এমনি একতাবদ্ধ হবে।’

‘সেটা তখনই হবে, যখন আমরা সবাই সমুদ্রকে জয় করতে পারব।’

‘সমুদ্র-বিজয়!’

‘ভেনিস সাগর-বিজয়িনী নগরী, সুরৈয়া। ভেনিসের এই খালের পথ, এই সুউচ্চ প্রাসাদসমূহ ঐ সমুদ্র-বিজয়েরই প্রাসাদ। সমুদ্র-বিজয়ে ভেনিস আজ আর একা নয়,–বহু প্রতিদ্বন্দ্বী তার রয়েছে। আমার কিন্তু এ কথাই মনে হয় যে, পৃথিবীতে এখন সমুদ্রজয়ীদের শাসনই প্রতিষ্ঠিত হবে। আমার নিজের মনও ঐ সমৃদ্ৰ-বিজয়ের দিকেই আকৃষ্ট হয়েছে বলে নিজেকে সৌভাগ্যবান বলে মনে করি আমি।’

‘তুমি কি সব অত বই নিয়ে রাতের পর রাত পড়াশুনা কর প্রিয়তম? তাছাড়া বইপত্র পাওয়া কত সহজ এখানে!’

‘আমাদের দেশেও সীসা রয়েছে, কাগজ এবং সুদক্ষ কারিগরও রয়েছে। কিন্তু আমরা এখনও ছাপার কাজ শিখিনি। আমাদের দেশে যদি ছাপাখানা খোলা হয়, তবে জ্ঞানার্জন অনেক সুলভ হয়ে উঠবে। এই যে এত বই পড়ছি, সপ্তাহের পর সপ্তাহ নাবিকদের মধ্যে কাটিয়ে দিচ্ছি, এর ফলে আমি ক্রমেই স্থির নিশ্চিত হয়ে উঠছি যে, সমুদ্র বিজয়ী দেশই বিশ্বজয়ী শক্তিরূপে বিরাজ করবে। প্রত্যহ স্নান না করার জন্য এই সব ফিরিদীদের আমাদের দেশের লোকেরা নোংরা বলে, কিন্তু এদের অনুসন্ধিৎসার প্রশংসা না করে থাকতে পারি না। ঘরে বসে ভূগোলের গল্প রচনা না করে এরা সর্বত্র ঘুরে বেড়িয়ে সম্যক জ্ঞানার্জন করে। এদের তৈরি মানচিত্র তো আমি তোমাকে দেখিয়েছি সুরৈয়া।’

‘সমূদ্র আমার বড় ভাল লাগে কমল!’

‘শুধু ভালো লাগা নয়। সুরৈয়া, সমুদ্রের ওপরই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। এই কাঠের জাহাজের ওপর রক্ষিত কামানটিকে দেখছ তো? এই সব জাহাজ বল এক একটা ভাসমান দুর্গ। মোঙ্গলরা তাদের জয়যাত্রার জন্য ঘোড়া এবং বারুদের কাছে সম্পূর্ণ ঋণী। আর এখন পৃথিবীতে যাদের কাছেই এইসব যুদ্ধজাহাজ থাকবে তারাই জয়ী হবে। এই জন্যই আমি এ বিদ্যা অর্জনের সঙ্কল্প করেছি।’

কমল এবং সুরৈয়ার সাধ পূর্ণ হল না। জলপথে ভারতবর্ষের দিকে যাত্রা করেছিল তারা, কিন্তু সেটা ছিল জলদস্যুদের যুগ। সুরাটে পৌঁছাবার মুখে জলদস্যুরা তাদের আক্রমণ করল। সঙ্গীদের নিয়ে কমল তার বন্দুক এবং কামান চালিয়ে যেতে লাগল দস্যুদের ওপর। দস্যুরা ছিল সংখ্যায় অনেক বেশি। কমলের জাহাজ গোলাবিদ্ধ হয়ে জলে ড়ুবে যেতে। লাগল। সুরৈয়া তার কাছেই ছিল, তার ঠোঁটে মৃদুহাসি ফুটে উঠল, তার মুখের শেষ কথা হল—‘সমুদ্র-বিজয়’!

 ১৭. রেখা ভগৎ (কাল : ১৮০০ খৃষ্টাব্দ)

কার্তিকের পূর্ণিমা। এই সময় গণ্ডক-স্নান (নারায়ণী) এবং হরিহর দর্শনের খুব ভিড়। দূর দূরান্ত থেকে গ্ৰাম্য নর-নারীরা বহু্যত্ন-সঞ্চিত অর্থ এবং ছাতু-চাল নিয়ে হরিহরক্ষেত্রে এসে পৌঁছায়। বাগানের মধ্যে কিছু বলদ, ঘোড়া আর হাতী বঁধু-এ সব দেখে তখন কে ভাবতে পেরেছিল যে, এটাই ভবিষ্যতে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মেলায় পরিণত হবে!

একখানা মোটা গামছা বিছিয়ে কাঁচালঙ্কা আর মূলো সহযোগে নুন-মাখা ছাতু পরম তৃপ্তির সঙ্গে আহার করে রেখা ভগৎ আর তার চার সঙ্গী এক আমগাছের নিচে কম্বলের ওপর। বসেছিল। রেখার মহিষ বিক্রয় হয়ে গেছে, সে থেকে থেকে ট্যাকে হাত দিয়ে বিক্রির। কুড়িটা টাকা দেখে নিচ্ছে। এই মেলায় এমন সব চোর এসেছে যার যাদুমন্ত্রে টাকা মেরে নেয়। রেখা আর একবার ট্যাকের ওপর হাত বুলিয়ে পরম নিশ্চিন্তের সঙ্গে কথা আরম্ভ করল, ‘আমাদের মোষ তো বিক্রি হয়ে গেল, তিনমাস ধরে খুব খাইয়ে-দাইয়ে আমি ওকে তৈরি করেছিলুম মৌলুভাই। ওরকম মোষের জন্যে বিশ টাকা দাম বেশি নয়। কিন্তু টাকাও আজকাল দেখতে দেখতে উড়ে যায়।‘

মৌলা, ‘ঠিকই! উড়েই যায়! এ ছাড়া টাকা-পয়সার। আজকাল অভাবও পড়ে গেছে চারিদিকে। এই কোম্পানীর রাজত্বে কোনো কিছুরই সুরাহা নেই। আমরা মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে মরে যাই, অথচ আমাদের ছেলেপুলেদের পেট–ভরা খাওয়া জোটে না এক সন্ধ্যাও!’।

রেখা, ‘এতদিন পর্যন্ত আমরা হাকিমকে নজর, বেগার এবং আমলা-পাইককে ঘুষ দেওয়ার ভিতর দিয়েই দিন কাটিয়েছি, কিন্তু জমি আমাদেরই ছিল।‘

মৌলা, ‘জমি-পুরুষ থেকে জঙ্গল কেটে জমি আবাদ করছি আমরা!’

সোবরণ, ‘মৌলুভাই, বাঘাক্ষেতের কথা জানো তো? ওখানে ভয়ানক জঙ্গল ছিল! আমাদের মুরিসূ ঘিনাবন বাবাকে ওখান থেকেই বাঘে ধরে নিয়ে যায়। সেই থেকেই ঐ জায়গার নাম ‘বাঘক্ষেত হয়েছে। প্রাণ দিয়ে আমরা সেই জমি আবাদ করেছি।’

রেখা ভোলাপণ্ডিতের দিকে তাকাল। ভোলাপণ্ডিতের রঙ কালো, পাতলা সাদা কাপড়ের পাগড়ী ঠিক করছিল। রেখা বলল, ‘ভোলাপণ্ডিত, তুমি তো সত্যযুগের কথা। জানো, বলতে পার, প্রজারা এমন দুৰ্দশায় আর কোনোদিন কি পড়েছে?’

মৌলা, ‘জানি আমরা তৈরি করেছি। চাষ-করা, বীজ-বোনা সব কাজে আমরা খেটেছি। অথচ আমাদের গ্রামের মালিক আমরা নই, রামপুরের মুন্সীজী।’

ভোলাপণ্ডিত, ‘অধর্মী রেখা ভগৎ, সর্বত্র অধৰ্ম। রাবণ এবং কংসের অত্যাচারকেও। হার মানিয়েছে কোম্পানী। পুরাণ ধর্মশাস্ত্রে লেখা আছে, রাজা পাবে কৃষকের কাছ থেকে এক দশমাংশ ফসল।’

‘মৌলা, ‘আমি তো অবাক হয়ে যাই পণ্ডিত! কোথাকার কে রামপুরের মুলী! তাকে আমাদের মালিক আর জমিদার বানিয়ে দিয়েছে?’

ভোলাপণ্ডিত, ‘সবই উল্টে গেছে মৌলু, প্রথমে প্রজাদের ওপর একজন রাজা ছিল। কৃষকেরা শুধু একজন রাজাকেই জানত। রাজা বহুদূরে আপন রাজধানীতে থাকত। শুধু ফসলের এক দশমাংশ পেলেই সে খুশী, তাও যখন ফসল হত তখন। কিন্তু এখন ফসল। হোক আর না হোক, নিজের হাড়মাংস বেচে, মেয়ে-বোনকে বেচে জমিদারের খাজনা ঠিক মতো দিতেই হবে।’

রেখা, ‘আর এই খাজনার কোনো হদিস পাওয়া যায় না পণ্ডিত। বছর-বছর খাজনা বেড়েই চলেছে! জিজ্ঞেস করবারও কেউ নেই যে, এমন অন্যায় কেন হচ্ছে।’

মুন্সী সদাসুখলাল পাটোয়ারী এসেছিল হরিহরক্ষেত্রে স্নান করতে, আর সস্তায় পেলে একটা গরু কিনতে। কিন্তু এ বছরের দুর্মুল্যতা দেখে কাঁপুনি ধরে গেছে তার। তার গায়ে ময়লা ছেড়া এক ফতুয়া এবং মাথায় টুপি। কানে এখনও খাগের মলম-দেখে মনে হয়, এখানেও বুঝি হিসাব লিখতে হবে তাকে। মসরিখের জমিদারের পাটোয়ারী বলে সে। ভাবছিল, এই আলোচনায় তার অংশগ্রহণ করা উচিত। কিনা। কিন্তু আলোচনা যখন গ্ৰাম্য রাজনীতি নিয়ে, তখন মুখ-কানওয়ালা মানুষের পক্ষে চুপ করে থাকা মুস্কিল!

দ্বিতীয়ত, দয়ালপুর গ্রাম তার মালিকের জমিদারীতে নয়। কাজেই দয়ালপুরের–কৃষকদের কথাবার্তায় অংশগ্রহণ করায় কোনো ক্ষতি আছে বলে সে মনে করল না। কলমটাকে আঙ্গুলে ঘোরাতে ঘোরাতে মুন্সীজী বলল, ‘কেউ জিজ্ঞেস করতে পারে কিনা বলছ পণ্ডিত? কে জিজ্ঞেস করবে? এখানে তো সবাই পরের ধন লুট করে খায়। যত পার। লুটে খাও। কোনো রাজা নেই। নাজিম সাহেবের দরবারে আমার মাসতুত বোনের এক জামাই থাকে, অনেক গোপন তথ্যই সে জানে। একশো-দুশো ফিরিঙ্গি ডাকাতের দল জেকে বসেছে। এই দলকেই তারা নাম দিয়েছে কোম্পানী।’

রেখা, ‘ঠিক বলেছ মুন্সীজী, ‘কোম্পানী বাহাদুর’ শুনে-শুনে আমরা ভেবেছিলাম,, কোম্পানী কোনো রাজা হবে বুঝি, কিন্তু আসল কথাটি আজ বুঝলাম।’

মৌলা, ‘সেই জন্যেই তো যেদিকে তাকাও সেই দিকেই দেখবে লুট চলছে। ন্যায় অন্যায়ের খোঁজ-খবর করবার কি কেউ আছে? এই রামপুরের মুন্সীজীর সাত পুরুষের কখনও দয়ালপুরের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না।’

সোবরণ, ‘আমার তো মৌলুভাই মাথায় ঢোকেনা যে, এই রামপুরের মুন্সী আমাদের গাঁয়ের মালিক হয়ে গেল কি করে! শুনতে পাচ্ছি দিল্লীর বাদশাহের সঙ্গে কোম্পানীর না-কি

মুন্সী, ‘দিল্লী নয় সোবরণ রাউৎ, মকসুদাবাদের (মুর্শিদাবাদের) নবাবের কাছ থেকে এই অঞ্চল কোম্পানী লিখিয়ে নিয়েছে। দিল্লীর তখৎ থেকে আমাদের এই অঞ্চলকে মাকসুদাবাদ আগেই ছিনিয়ে নিয়েছিল, সোবরণ রাউৎ।’

সোবরণ, ‘আমাদের এত কথা মনে থাকে না মুন্সীজী, আমরা তো শুধু দিল্লীর কথাই জানতাম। আচ্ছা মকসুদাবাদের হাতেও যখন রাজ্য এল, তখনও তো একটাই রাজা ছিল? আমাদের যেমন জুটত তেমনই খাজনা দিতাম। কিন্তু এখন একে দুই রাজার রাজ্য বলবে, না কি বলবে?’

রেখা, ‘দুই রাজাই হয়েছে সোবরণ ভাই–এক কোম্পানী-রাজ আর দ্বিতীয় রামপুরের মুন্সীজীর রাজ। জীতার এক পাল্লায় পিষলে বীচার আশা কিছুটা থাকে, কিন্তু দুপাটে পড়লে বাঁচা একেবারেই অসম্ভব। আর এ ব্যাপার তো আমরা নিজেদের চোখেই দেখতে পাচ্ছি। মুন্সীজী তুমিই বল! আমরা তো গেয়ো মুৰ্থ, আনাড়ী, তুমি এবং ভোলাপণ্ডিতই আমাদের মধ্যে জ্ঞানী।’ e

‘মুন্সী, ‘রেখা ভগৎ কথাটা বলেছি তুমি ঠিকই। জমিদার হল জীতার একটা পাল্লা। আর রাজার চেয়ে সে কোন বিষয়েই বা কম?’

রেখা, ‘কম কোন বরং এক-কাঠি বেশি মুন্সীজী। গায়ের পঞ্চায়েতের পরামর্শ কেউ নেয় এখন? রেওয়াজ মতো আমরা এখনও পাঁচজন মোড়ল ঠিক করে দিই, কিন্তু কোনো কাজে হাত দিতে পারে তারা? সবই জমিদার আর তার আমলা-গোমস্তারা করে। গায়ের ভেতর ঝগড়া বাধলে বাদী-বিবাদী দু’জনের কাছ থেকেই তারা জরিমানা আদায় করে। পনের বছরও তো কাটেনি সোবরণ রাউৎ মেয়ে-মরদের ঝগড়ায় কখনও মোষ বিক্রি করতে দেখেছ?’

সোবরণ, ‘আরে ভাই তখন তো সব কিছুই পঞ্চায়েতের হাতে ছিল। গাঁয়ের পঞ্চায়েত কোনো পরিবারকে উচ্ছন্নে যেতে দিত না, খুনের মামলা পর্যন্ত আপোসে মিটমাট করে দিত তারা। বাঁধি আর খালগুলোর অবস্থা দেখনি। মনে হয়, ওগুলোকে দেখবার বা ওগুলোর ভার নেবার এখন আর কেউ নেই। পঞ্চায়েত যদি এখনও সক্রিয় থাকত। তাহলে কি কোনোমতেই এমনটা হতে পারত?’

রেখা, ‘কোনোমতেই হত না সোবরণ রাউৎ। বৃষ্টি বেশি হলে এমন পরিষ্কার নালা নেই, যা দিয়ে অতিরিক্ত জল বেরিয়ে যেতে পারে।’

মুন্সী, ‘পঞ্চায়েতকে ধ্বংস করে কোম্পানী এ-সব তুলে দিয়েছে জমিদারের হাতে।’

রেখা, ‘আর জমিদারেরা যে কি করছে সে তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি।’

মুন্সী, ‘আমিও জমিদারের নিমক খাই রেখা ভগৎ। তুমি জানো, মসরিখের জমিদারের পাটোয়ারী আমি। কিন্তু এ অন্যায়ের সম্পত্তি, অন্যায়ের ধন যে খায় সে নির্বাংশ হয়ে যায়। আমাকেই দেখ, সাত ছেলে, ঘোড়ার মতো জোয়ান-সব মরে গেল!’

মুন্সীজীর চোখে জল দেখে সকলেরই হৃদয় সহানুভূতিতে ভরে উঠল।’সব মরে গোল রেখা ভগৎ ঘরে এখন জল দেবার জন্য একটা বাচ্চা মেয়েও নেই। আর আমার মালিক ছাপরার সেই রান্তীর পেছনে কিভাবে ঘুরছে। তার ইন্দ্ৰিয় শিথিল হয়ে পড়েছে।–এই যে দুটো বাচ্চাকে দেখছ, এদের লোকে তার সন্তান বলে জানে কিন্তু আসলে এরা নাপিতের ঔরসজাত।’

রেখা, ‘মালিকদের মধ্যে এ-রকম ঘটনা এখন অনেকেরই হচ্ছে।’

সোবরণ, ‘ক্ষেত গেল, গ্রাম গেল, সাত-সমুদ্র পারের দস্যুরা আমাদের ওপর দেশী ডাকাত লেলিয়ে দিল। পঞ্চায়েত গেল, যে সামান্য ফসল। আমরা ফলাই তাও কেড়ে নেওয়া হয়! আর যদি কখনও ঠিক মতো রোদ-বৃষ্টি হল, সামান্য ফসল ঘরে উঠল, তো মালিক, জমিদার, চৌকিদার, পাটোয়ারী গোমস্তার পেট ভরাতেই সব খতম।’

মুন্সী, ‘পাটোয়ারীদের লুটের কথা আমি জানি সোবরণ রাউৎ কিন্তু এও তোমরা ; জানো, জমিদার মাত্র আটআনা মাইনে দেয় পাটোয়ারীদের মাসে, আটআনা পয়সায় জিভও ভেজানো যায় না–এ কথা কি জমিদার নিজে জানে না?’

রেখা, ‘জানে মুন্সীজী, জমিদার অন্ধ নয়, সবই দেখতে পায়। কোম্পানী বাহাদুর ডাকাত-আমাদের ওপর এক নতুন ডাকাত জমিদারকে বসিয়ে দিয়ে গেছে। এতাতেও আমরা বেঁচে আছি কি করে?’

‘সোবরণ, ‘বেঁচে কোথায় আছি রেখা? পেট ভরে ভাত খেতে বা দেহে এক টুকরো কাপড় জড়াতে পারে-এমন লোক ক’টা দেখা যায় দয়ালপুরে?’

মুন্সী, ‘কোম্পানীর এতে কি এসে যায় সোবরণ রাউৎ? সে খাজনা বেঁধে দিয়েই খালাস, জমা দেওয়ার দিন ছাপরা গিয়ে জমিদারেরা টাকার তোড়া জমা দিয়ে আসে। দয়ালপুরে কৃষক মরুক আর বীচুক, কোম্পানীর পাওনা কড়ায়-গণ্ডায় আদায় করে দেওয়া

কাছ থেকে জমিদার পাঁচ টাকা নেবে-এক টাকা কোম্পানীকে দিয়ে বাকী চার টাকা নিজে গিলবে।’

রেখা, ‘হা ভগবান! তুমি কি ঘুমিয়ে আছ, না মরে গেছ? কেন তুমি সুবিচার করছ না? আমরা যে ধ্বংস হয়ে গেলাম!’

সোবরণ, ‘হ্যাঁ, শেষ হয়েই গেলাম রেখা, শোনোনি বারো-পরগণার লোকেরা একজোট হয়ে জমিদারকে তাদের মালিক বলে মানতে অস্বীকার করেছিল? তারা ছাপরা গিয়ে কোম্পানীকে বলেছিল, ‘আমাদের পঞ্চায়েত তোমাদের খাজনা মিটিয়ে দেবে, আমরা জমিদারকে মানব না।’ সাহেব কি জবাব দিয়েছে জানো? ‘অনাবৃষ্টি আর বন্যার সময়ও ঠিকমতো খাজনা দেবে? অনাবৃষ্টি, দুর্ভিক্ষ বা প্লাবনের সময় নিজেদের কাচ্চা-বাচ্চার প্রাণ। বঁচানোই মুস্কিল–তা কি ওরা জানে না, ফিরিঙ্গীর ঐ কথাটা বলতে ভগবানের ভয়ও হল না রেখা! এরপর সে কি বলেছিল জানো? ‘তোমরা তো কঙাল, খাজনা যদি না দাও তো কোম্পানী বাহাদুর কি নেবে তোমাদের কাছ থেকে? আমরা টাকাওয়ালা সম্রােন্ত লোককে জমিদার করে দিই, যাতে আমাদের খাজনা বাকী রাখলে তাদের ঘরবাড়ি নিলাম হয়ে যাবার, মান-সম্ভ্রম নষ্ট হবার ভয় থাকে।’

রেখা, ‘এই জন্যই তো ফিরিঙ্গীগুলোর সারা গায়ে শ্বেতী। বড় নির্দয় ওরা।’

‘সোবরণ, ‘বারো-পরগণাবাসীদের কোনো কিছুই নেই, কাজেই ওরা জীবনের বিনিময়ে লড়াই করে। কোম্পানী যদি বাহাদুরই হত, তবে বাহাদুরের মতোই লোকের সঙ্গে লড়ত। বারো-পরগণাবাসীদের কাছে বন্দুক’ই আছে আর কোম্পানীর লোকদের আছে কামান। এখান থেকে সেখান থেকে কালা-গোরা বহু পল্টনও এসে গেছে তাদের গ্রামের। পর গ্রাম জ্বলিয়ে দিয়েছে, নারী শিশুদেরও ছাড়েনি। বারো-পরগণার লোকদের আর কি করবার আছে?’

মৌলা, ‘চাষবাস তো এইভাবেই নষ্ট হয়ে গেল, তাঁতীদের মুখের অন্নও ঘুচাতে আরম্ভ করেছে সোবরণ রাউৎ। কোম্পানী এখন বিলাত থেকে কাপড় এনে বেচছে।’

মুন্সী, ‘ হ্যাঁ, কলের তৈরি সূতো, কলের তৈরি কাপড়। আমার এই ফতুয়া ঐ কাপড়ের তৈরি। তাঁতের কাপড় এত সস্তায় পাওয়া যায় না। কাজেই মান বাঁচাবার জন্যে এই জিনিসই। কিনতে হয়। এটা মান বাঁচাবারই প্রশ্ন-কিন্তু তুমি অমন করে হাসছ কেন রেখা? সরকারি জাজিমের ওপর বসতে হলে তখন বুঝতে।’

রেখা, ‘তোমার কথায় হাসিনি মুন্সীজী, হাসছি। এই জন্যে যে, কোম্পানী বাহাদুর রাজত্বও করেছে, আবার ব্যবসাও চালাচ্ছে। এমনি মজার রাজত্ব!’

ভোলাপণ্ডিত, ‘সত্য, ত্রেতা, দ্বীপর-তিন যুগ পার হয়ে গেছে। কলিযুগের পাঁচ হাজার বছর কেটে গেছে। কিন্তু এমন রাজত্ব কখনও ছিল বলে তো শুনিনি!’

মুন্সী, ‘নাজিমের দরবারে এক মুন্সী কোম্পানীকে ফিরিঙ্গী-ডাকাত আখ্যা দিয়েছে, আর একজন বলেছে, কোম্পানী হল ফিরিঙ্গী ব্যবসাদারদের আড্ডা। ওরা শুধু ব্যবসার জন্যেই নিজেদের দেশ থেকে এসেছে। প্রথমে এখানকার মাল ওখানে নিয়ে বেচত, কিন্তু এখন ওরা বিলাতে বড়-বড় কারখানা খুলেছে—সেখানে নিজেরাই মাল তৈরি করায় আবার নিজেরাই সেটা বিক্রি করে।’

মৌলা, ‘তাহলে বোঝা যাচ্ছে, কারিগরদেরও আর উন্নতির আশা নেই।’

 

২.

শীতের গঙ্গা সবুজ আকার ধারণ করে এবং তার স্বাভাবিক গাম্ভীর্যময় গতি আরও গভীর রূপ নেয়। এই সময় নৌকাড়ুবির ভয় কম থাকে এই জন্য ব্যাপারীরা এই সময়টাকে ব্যবসায়ের মরসুম বলে মনে করে। এই সময় গঙ্গার পারে ঘণ্টা কয়েক বসে থাকলেই দেখা যাবে, শত শত বড় নৌকা সামনে দিয়ে যাচ্ছে। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশতেই, কোম্পানীর মাল বোঝাই থাকে–তার মধ্যে বহু মালই আসে বিলাত থেকে এবং সেগুলো ওপরের দিকে যায়। আর পাটনা, গাজীপুর মির্জাপুরের মতো তেজারতী শহরের ঘাট থেকে দেখা যায়, গঙ্গার চারিধার বড় বড় নৌকায় ভর্তি।

পাটনা থেকে একটি বজরা নিচের দিকে যাচ্ছিল। এতে সোরা, জাজিম ইত্যাদি বহু জিনিস বিলাতে চালান যাবার জন্যে ছিল। এরই একটা নৌকায় যাচ্ছিল বঙ্গসন্তান তিনকড়ি দে আর বিলিতি সাহেব কোলম্যান। পাটনা থেকে কলকাতা যেতে এক সপ্তাহের বেশি সময় লাগে, সুতরাং তিনকড়ি দে আর কোলম্যানের ভিতর ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠল। যদিও প্রথমে একে অপরের সঙ্গে দেখা হলে সঙ্কুচিত হয়ে উঠত। তিনকড়ি দের কাছে জুলক্ষী, আঁটোসাটো প্যান্ট, ফিতায় ঝোলানো বোতাম এবং কালো কোট পরিহিত শ্বেতমুখ ভয় এবং ভক্তির বস্তু ছিল। কিন্তু কোলম্যানই প্রথম আলাপ শুরু করায় তিনকড়ির সাহস বেড়ে উঠছিল। আলাপ-আলোচনায় তিনকড়ি বুঝতে পারল যে, কোলম্যান কোম্পানীর সাহেবদের ঘোরতর বিরুদ্ধে এবং গর্ভনর থেকে আরম্ভ করে কোম্পানীর ছোট বড় কাউকেই গালাগাল দিতে দ্বিধা করে না। তিনকড়িও কোম্পানীর চাকরদের বরদাস্ত করতে পারত না। বিশ বছর কোম্পানীর বড় বড় দপ্তরে সে কেরানীর কাজ করেছে। গরীবের ঘরেই সে জন্মেছিল, কিন্তু সে ছিল তাদেরই একজন যাদের আশা সীমাবদ্ধ এবং লোভ যাদের আত্মসম্মানের সঙ্কীর্ণ গন্তীতে আবদ্ধ। অবশিষ্ট জীবনের মতো খাওয়া পরার মতো সংস্থান করে নিয়েছিল তিনকড়ি। কোনো পুরনো এজেন্টের দয়ায় সে চব্বিশ-পরগণা জেলায় চারখানা গ্রামের জমিদারী পেয়েছিল, যার আয়ের তুলনায় খাজনা ছিল অনেক কম। কিন্তু এই দয়াটুকু পাবার জন্য এমন কাজ তিনকড়ি করেছিল, যার পাপ জন্ম-জন্মান্তরে মোচন হবে না বলে তার বিশ্বাস। সাহেবকে খুশী করবার জন্যে গ্রামের এক সুন্দরী ব্ৰাহ্মণ তরুণীকে তুলে দিয়েছিল সাহেবের হাতে। সাহেবরা সে সময় খুব কমই বিলেত থেকে নিজেদের মেম সঙ্গে করে আনত। কারণ ছ’মাসের বিপদ ঘাড়ে করে সমুদ্ৰ-যাত্রা বড় সহজ ব্যাপার ছিল না।

তিনকড়ির বয়স পঁয়তাল্লিশ। তার সুঠাম কালো দেহের কাঠামো খুবই বলিষ্ঠ। রোজ সকালে উঠে সে আয়নায় নিজের মুখ দেখত। আর হাতের আঙ্গুলগুলো পরীক্ষা করত, • কোনদিন তার দেহে কুণ্ঠ রোগ ফুটে বেরুবে-সেই আশঙ্কায় সে থাকত, কারণ ব্ৰাহ্মণীর সতীত্বনাশের এই শাস্তি তার কপালে আছে বলে তার মনে হত। সাহেবদের খিটমিটি, ‘ গালাগালি আর পায়ের ঠোক্কর সয়ে সয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল! তাই চাকরির বয়স থাকলেও কাজে ইস্তফা দিয়ে সে গ্রামে ফিরে আসছিল। বিশ বছর নীরবে সহ্য করা অপমানের আগুনে তার অন্তর জ্বলে যাচ্ছিল। যখন সে কোলম্যানকে নিজের চাইতেও কোম্পানীর বড় শত্রু বলে বুঝতে পারল, তখন ধীরে ধীরে দু’জনের আলাপ চলতে লাগল। কোলম্যান একদিন বলছিল, ‘ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী তৈরি করা হয়েছিল বাণিজ্যের জন্য, কিন্তু পরে এরা লোককে লুট করতে শুরু করে। দেখছি না, যত সাহেব এখানে আসে, সবাই দুদিনের ভেতর লাখপতি হয়ে দেশে ফিরে যায়। ছোট-বড় সবারই এই অবস্থা। ক্লাইভ এই কাজই করেছে, কিন্তু তাকে কেউই ধরেনি। চেৎসিংহের রাণীরা অনাহারে মরে যাওয়া সত্ত্বেও লোভের তাড়নায় ওয়ারেন হেষ্টিংস তাদের কথা ভাববার অবকাশই পায়নি। আর অযোধ্যার বেগমদের কাঙাল বানিয়ে ছেড়েছে সে। কিন্তু আমাদের দেশবাসীরা তাকে ছাড়েনি। শাস্তির হাত থেকে সে বেঁচে গেছে, কিন্তু যা কিছু সে রোজগার করেছিল, কয়েক বছরের মামলায় সবই সে খুইয়েছে।’

‘মোকদ্দমা কে চালাল সাহেব?’

‘পাৰ্লিয়ামেণ্ট। আমাদের দেশে রাজা নিজের খুশীমতো চলতে পারে না। খুশীমতো চলার অপরাধে এক রাজার গর্দন আমরা কুড়াল দিয়ে কেটে ফেলেছি, আর সে কুড়াল এখনও রয়েছে। পার্লিয়ামেণ্ট হল পঞ্চায়েত বুঝলে মিঃ দে! এদের অধিকাংশ সদস্যকেই দেশের ধনী-মানীরা নির্বাচিত করে, আর কিছু বড়-বড় জমিদার বংশগত অধিকারে এর সদস্য হয়।’

‘জমিদারী প্ৰথা কতদিন থেকে চলে আসছে?’

‘আমাদের দেশে এ প্রথা কয়েক শ’ বছর ধরে চলে আসছে। আমাদের দেশের দেখাদেখি ভারতবর্ষে জমিদারী প্রথা কায়েম হয়েছে। সেখানেও জমির ওপর থেকে কৃষকের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ দেশে জমিদারী প্ৰথা কায়েম করেছে যে গভর্নর, তার নাম জানো?’

‘হ্যাঁ, কর্নওয়ালিস।’

‘ঠিক বলেছ। বিলাতের পয়লা নম্বরের কসাই জমিদার। এখানে এসে সে দেখল, যতদিন কৃষকেরা জমির মালিক থাকবে ততদিন অনাবৃষ্টি ও প্লাবনের সময় ঠিক মতো খাজনা আদায় হবে না। সে এ কথাও ভাবল, সাতসমূদ্র তেরনদীর পারের দেশ থেকে আগত ইংরেজদের এ দেশের কিছু লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হবে-আর তা হবে এমন সব লোকের সঙ্গে, যাদের স্বাৰ্থ ইংরেজদের স্বার্থের সঙ্গে একসূত্রে বাঁধা। জমিদার হল ইংরেজদের সৃষ্ট। কৃষক-বিদ্রোহে ইংরেজদের যেমন বিপদ, তেমনি জমিদারের বিপদ। জমিদারী, সম্পত্তি এবং সম্ভ্রম চলে যাওয়ারও সমূহ আশঙ্কা। এই জন্য ছোট-ছোট কৃষকদের মালিক বলে স্বীকার না করে যদি পঁচিশ-পঞ্চাশটা গ্রামের বড়-বড় মালিক জমিদার সৃষ্টি করা যায়, তবে তারা সুসময়-দুঃসময় সর্বদাই কাজে আসবে। এইভাবে বিলাতের এই কসাই ভারতবর্ষের কৃষকদের গলা কেটে রেখেছে।’

‘কেটে যে রেখেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই’-নিজের জমিদারীর কৃষকদের কথা মনে পড়ল তিনকড়ির।

‘জায়গীরদারদের জুলুমে সারা দুনিযার লোকই মরছে; তবে এদের দিনও ফুরিয়ে এসেছে। ফ্রান্সের রাজা-রাণীকে কয়েক বছর আগেই প্রজারা মেরে ফেলেছে। তাদের ক্ৰোধাগ্নিতে বহু জমিদার পুড়ে খাক হয়ে গেছে। জমিদারী প্রথা তুলে দেওয়া হয়েছে। সেখানকার লোকেরা সকল মানুষের জন্য সাম্য, মৈত্রী এবং স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। সে সময় আমি ফ্রান্সে ছিলাম। ফ্রান্সের রাজপ্ৰসাদের ওপর ফ্রান্সের প্রজাতন্ত্রের তেরঙা ঝান্ডা আমি নিজের চোখে উড়তে দেখেছি। ইংলণ্ডেও ফ্রান্সের মতোই অবস্থা হত, কিন্তু একটা ব্যাপার তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।’

‘কি ব্যাপার সাহেব?’

‘দেখছি না বিলিতি কারখানার তৈরি জিনিসে ভারতবর্ষের বাজার ছেয়ে গেছে? তোমাদের এখানে তাঁতীরা বেকার হয়ে পড়েছে আর আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা কারখানা খুলে তাতে জমিদারের অত্যাচারে খেতে-না-পাওয়া লোকদের কাজ দিয়েছে! তাদের তৈরি মাল এখানে পৌঁছাচ্ছে। এতদিন পর্যন্ত আমাদের দেশেও হাত দিয়েই কল চালানো হত, কিন্তু এখন স্টীম-ইঞ্জিন তৈরি হচ্ছে, আর ঐ কলের কাপড় অনেক সন্তায় পাওয়া যায়। ফলে তোমাদের দেশের কারিগররা তো একেবারেই ধ্বংস হয়ে গেল। তবে এখন এই সব কারখানায় মজুর হয়ে পেট চালাবার মতো কাজ তারা পেতে পারে। যদি এই কারখানাগুলো খোলা না হত, তবে আমাদের দেশেও ফ্রান্সের দশাই হত। মানুষকে মানুষের মতো বেঁচে থাকতে দিতে হবে, মিঃ দে। অপরকে যে পশু বলে মনে করে, নিজেকেই তার ছেলেপিলেসহ পশু হতে হয়।’

‘ঠিক বলেছ সাহেব। আমি নিজের কর্মচারী এবং চাকরীদের মানুষ বলেই মনে করতাম না। কিন্তু একই ব্যবহার যখন সাহেবরা করতে লাগল আমার সঙ্গে, তখন বুঝতে পারলাম যে, মানুষকে অপমান করা কত বড় পশুর কাজ।’

‘দাস-প্রথা তুলে দেবার জন্য বিলেতে প্রবল চেষ্টা হচ্ছে।’

‘বিলাতেও দাস-প্রথা চলতে দেওয়া হয়?’

করি, শীগগিরই এর বিরুদ্ধে আইন পাশ হয়ে যাবে।’

‘ধনীরা তো এ সব চায়ই না, আর আমাদের পার্লামেন্টে ধনীদেরই প্রভুত্ব, কিন্তু এখন। তাদের মধ্যেই কিছু লোক একে খারাপ বলে মনে করছে। যাই হোক না কেন, মানুষ কেনাবেচার যারা পক্ষপাতী নয়। তারাও পাপ-পূণ্যের বিচারেই যে একে উঠিয়ে দিতে চায় তা নয়। তারা সম্পূর্ণ অন্য কারণে চাইছে। আজকাল অনেক কারখানায় দাসেরা কাজ করছে,–তারা যে সব যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করে তার দাম অনেক, অথচ মূল্যবান যন্ত্রগুলির ওপর কোনো মমতা নেই দাস-শ্রমিকদের, তাই সূক্ষ্ম কাজের ভার দাসদের দেওয়া যায় না। যার। জীবন-মরণ নিয়ে তুমি রাতদিন খেলা করছ, সে তো সুযোগ পেলেই তোমার ক্ষতি করে প্ৰতিশোধ নিতে চাইবে।’

‘মা আর তার শিশুকে আলাদা করে যখন আমি বেচিতে দেখি, তখন আমার কাছে সেটা নিতান্তই অসহ্য মনে হয়।’

‘অসহ্য যার মনে হয় না, সে মানুষই নয় মিঃ দে!’

‘আমি ভাবছি ফ্রান্সের রাজাহীন রাজ্যের কথা-তাকে কি বলে সাহেব?’

‘প্রজাতন্ত্র।‘

‘প্রজাতন্ত্র কি রাজতন্ত্রের চেয়ে ভালো?’

‘প্রজাতন্ত্র সব চেয়ে ভালো ব্যবস্থা! শাহ শাহজাদা, বেগম আর শাহজাদীদের জন্যেই দেশের সম্পদের অধিকাংশ নিঃশেষ হয়ে যায়! পঞ্চায়েতী রাজ্যের সরকারের কাছ থেকে অধিক ন্যায়, নিরপেক্ষতা এবং সহানুভূতি পাওয়া যায়।’

‘ হ্যাঁ, আমি আগে আমার নিজের গ্রামের পঞ্চায়েতের কাজ দেখতাম, ওতে সত্যিই! বেশি ন্যায়নিষ্ঠা দেখা যেত। আর ব্যয়ের বাহুল্যে কেউই ধ্বংস হয়ে যেত না। কিন্তু যখন থেকে কর্নওয়ালিসের জমিদারেরা এসে পঞ্চায়েতকে ড়ুবিয়ে দিল, তখন থেকে লোকে শেষ

‘এ কথা ঠিকই বলেছ মিঃ দে, কিন্তু ফ্রান্সের জনতার উদ্দেশ্য প্রজাতন্ত্রের চেয়েও মহৎ ছিল, তারা মানুষ মাত্রেরই সাম্য, স্বাধীনতা এবং মৈত্রী এই তিন মূল ভিত্তির ওপর রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল।’

‘আমাদের দেশের জন্যেও?’

‘তোমরা কি মানুষ নও?’।

‘সাহেবদের চোখে তো আমরা সত্যিই মানুষ নই!’

‘যতদিন পর্যন্ত সমগ্র দুনিয়ার সাদা-কালো সমস্ত জাতির শাসনব্যবস্থা সাম্য-মৈত্রী স্বাধীনতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত না হবে, ততদিন মানুষ, মানুষ হিসেবে গণ্য হতে পারে না। কসাই কর্নওয়ালিস তার নিজের জাতের গোরা কৃষকদের মানুষ বলে মনে করত না। ফ্রান্সের রাজা, জমিদাররা তো খতম হয়ে গেছে, কিন্তু বানিয়ার দল-ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর জাতভাইরা রাজ্য দখল করে নিয়েছে, যার জন্য সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার আসল তেরঙা ঝাণ্ডা ফ্রান্সেও উড়তে পারেনি।’

‘তা’হলে ফ্রান্সে রাজপরিবারের জায়গায় ব্যবসায়ীদের রাজ্য স্থাপিত হয়েছে?’

‘হ্যাঁ, এবং ইংলেণ্ডের ব্যবসাদারেরাও সোরগোল বাঁধিয়ে দিয়েছে। তাদের বক্তব্য, যখন আমরা সাতসমুদ্র তের নদী পারে ভারতবর্ষের রাজ্য চালাতে পারছি, তখন আর ইংলেণ্ডে। পারব না!’ এ জন্য রাজ-শক্তিকে তারা নিজেদের হাতে তুলে নিতে চায়, যদিও রাজাকে সরিয়ে দিয়ে নয়।’

‘আপনি বলেছিলেন, ইংলেণ্ডের রাজার হাতে শাসন-ক্ষমতা নেই।’

‘হ্যাঁ! এটা গোর-ব্যবসায়ীদের চালাকি। আমার খুব দেশ-ভ্রমণের সখ ছিল। সুবি পেয়ে আমি কোম্পানীর চাকরি নিলাম। চাকরি যদি না করতাম তবে ব্যবসায়ীরা আমাকে সন্দেহ করত এবং দেশ পর্যটন আমার পক্ষে অসুবিধাজনক হয়ে পড়ত! তাই আমি দু’বছর কোম্পানীর দাসত্ব রূপ নরকে ছিলাম।’

‘ভালো মানুষের কাছে এটা সত্যিই নরক। এখানে সে-ই শুধু থাকতে পারে, যে সকল পাপেই সিদ্ধহস্ত, সমস্ত অপমান সহ্য করে শুধু টাকা রোজগারের জন্যেই যে সৃষ্টি হয়েছে। কর্নওয়ালিসের এক অনুচরের কৃপায় পাপের প্রতিদান হিসাবে চারটি গ্রামের এক জমিদারী। আমি পেয়েছিলাম, কিন্তু তার প্রতিফলও পেয়েছি আমি-আমার বউ, ছেলে মেয়ে সব মরে গেছে। ঐ জমিদারীর নামে আমার প্রাণ কাঁপে, আমিও আজ। আপনার সঙ্গে একমত। সাম্যমৈত্রী-স্বাধীনতার রাজ্যই পৃথিবীকে স্বর্গে পরিণত করতে পারে।’

‘কিন্তু এই একমত হওয়াতে বা তার আশা করাতে কিছু হবে না। এর জন্য ফ্রান্সের মতো সহস্ৰ সহস্ৰ লোককে আত্মবলি দিতে হবে। এই আত্মবলি চুপি চুপি দিলে কাজ হবে না। ভারতবষীয় সিপাইরাও তো ইংরেজের জন্যে লাখে লাখে আত্মবলি দিচ্ছে। এই আত্মবলি দিতে হবে নিজেদের মঙ্গলের জন্য এবং সব জেনে বুঝে।’

‘জেনে, বুঝে আত্মবলি!’

‘জানা-বোঝার মানে হল, ভারববাসীর পৃথিবী সম্পর্কে জ্ঞান দরকার। বিজ্ঞান মানুষের হাতে জোরালো শক্তি যুগিয়ে চলেছে। এই বিজ্ঞানের বিশেষ জ্ঞান দিয়ে মানুষ বন্দুক বোমা বানিয়েছে, নিজেকে সবল করে তুলছে। এই বিজ্ঞানই তোমাদের দেশকে ধ্বংস করে ইংলণ্ডে নতুন কলকারখানা এবং নতুন শহর তৈরি করে চলেছে। বিজ্ঞানের শরণতোমাদেরও নিতে হবে।’

‘তারপর?’

‘তারপর ভারতবর্ষের ছোঁয়াছুঁয়ি, জাত-পাত, হিন্দু-মুসলমান-সব কিছুর ভেদাভেদ মেটাতে হবে। দেখছি না, আমরা জাত-বিচার করি না।’

‘হ্যাঁ সেটা ঠিক কথা।’

‘ইংরেজদের মধ্যে ধনী দরিদ্র ছাড়া আর কি কোনো জাত-বিচার আছে?’

‘না। কিন্তু তারপর?’

‘সহমরণ বন্ধ করতে হবে। প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ স্ত্রীলোককে আগুনে পোড়ানো—তুমি কি মনে কর, একে ভগবান কোনোদিন ক্ষমা করবেন?’

কলকাতায় পৌঁছে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে-এই চিন্তায় কোলম্যান ও তিনকড়ি দে বিষণ্ণ বোধ করল। সবশেষে কোলম্যান বলেছিল, ‘বন্ধু আমরা উনবিংশ শতাব্দীতে এসে পড়েছি। পৃথিবীতে প্রচণ্ড ওলট-পালট চলেছে। এতে আমাদের অংশগ্রহণ করতে হবে। আর এ জন্য প্রথম প্রয়োজন হল, ছাপাখানা এবং সংবাদপত্র চালু করে দুনিয়ার হালচাল। সম্বন্ধে জনসাধারণকে ওয়াকিফহাল করা।’

এ বছর বর্ষা হয়নি। জ্যৈষ্ঠের মাটি শুকনো পড়ে রয়েছে। আউশ বা রবিশস্য এক ছটাকও হয় নি। পরিবারের পর পরিবার মরে গিয়েছে অথবা তল্পিতল্পা গুটিয়ে পালিয়েছে। শীর্ণ লম্বা বিলের জল শুকিয়ে গেলে দেখা গেল, পঁচিশ মাইল দূর-দূরান্তের লোককে তার : গহ্বরে মারে পড়ে থাকতে। এরা পদ্মমূল খুঁজতে এসেছিল। আর এর জন্য কতবার নিজেদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছে তার ঠিক নেই। পরের বছর বর্ষা যখন এল, প্রথম ফসলে রেখা হাত লাগল। গমের বীজ বুনতে বুনতে মঙ্গরীকে দেখে বিস্মিত হচ্ছিল সে। একটা বছরে যেন পৃথিবীতে কত পরিবর্তন ঘটে গেছে বলে মনে হচ্ছে। অধিকাংশ লোকই মরে গিয়েছিল, বহু পরিবারের লোকজন দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। রেখা এই ভেবে আশ্চর্য হল, কি করে তারা দুটি প্রাণী দেহ,মনকে এক করে রেখে এক সঙ্গেই বেঁচে আছে! অতীতে। অনাবৃষ্টির ফলে দুর্ভিক্ষ হয়েছে কিন্তু এত কষ্ট সম্ভবত রেখার পূর্বর্তী কৃষকদের ভোগ করতে হয়নি। সে সময় একমাত্র গর্ভনমেন্টই ছিল, আর দুর্দিনে তাকে খাজনা কম দিলেও চলত। এখন কোম্পানীর সরকারের নিচে জমিদারের জবরদস্ত সরকার রয়েছে, যাদের লস্কর-পেয়াদার কবল থেকে একটা খড়-কুটোও রেহাই পায় না। কোনো ফসল দেড়মাস বাঁচিয়ে রাখা যায় না, ফলে ভবিষ্যৎ আকালের জন্যে কৃষকেরা কিছুই সঞ্চয় করে রাখতে পারে না।

অগ্রহায়ণ মাসে মঙ্গরী যখন একটি ছেলের জন্ম দিল, তখন আরও বিস্মিত হল রেখা। তার নিজের বয়েস পঞ্চাশ হয়েছে বলে নয়, কারণ মঙ্গরীর বয়েস ত্রিশ বছর এবং আরও কয়েকটি মৃত সন্তানের জননী হয়েছিল সে। তার বিস্মিত হবার কারণ হল, দুর্ভিক্ষের দিনে যখন নিজের অস্থিচর্মকে জীইয়ে রাখাই মুস্কিল তখন মঙ্গরী এক নতুন প্রাণীকে কেমন করেজীইয়ে রেখে জন্ম দিল!

মাঘ মাসে রামপুরের জমিদার হাতী-ঘোড়া, পাইক-পেয়াদা সঙ্গে নিয়ে দয়ালপুরে এল। রেখা শুনেছিল, জমিদারের ঘরে একটি ছেলেমেয়েও শুকিয়ে যায়নি। দুর্ভিক্ষের সময়ে তার ঘরে সাত বছরের পুরনো চাল খাওয়া হয়েছে। জমিদারের কাছারি ছিল গ্রামের এক প্রান্তে, তার সামনে পঁচিশ একর জমি জুড়ে এক আমবাগান তৈরি করা হচ্ছিল। তাতে প্রয়োজনীয় জল-ঢালা ও মাটি খোঁড়ার কাজে দয়ালপুরবাসীদের বেগার দিতে হত। প্রতি ঘরের লোকের ওপর মালিক পঞ্চাশটি করে আমগাছের চারার ভার দিয়ে রেখেছিল। চারাগাছা শুকিয়ে গেলে একটির জন্য পাঁচ সিকি দণ্ড দিতে হত। রেখার পরবর্তীরা জমিদারের অত্যাচারকে সনাতন বলে মেনে নিতে আরম্ভ করেছিল। তাদের কাছে সোবরণ রাউৎ এবং রেখা ভগতের বাণত জমিদারের রূপ এবং গ্রামে পঞ্চায়েতের কাজ-এ সবই গল্প বলে মনে হত। আকালের পর মালিকের পেয়াদারা আরও উদ্ধৃঙ্খল হয়ে উঠেছিল। তারা ভাবত, কৃষকের মনোবল ভেঙে দিতে এবং মালিকের দাপট বাড়িয়ে তুলতেই আকালের আগমন হয়। আগ্রহায়ণ মাসে যখন রেখার চালে লাউগাছের ফল ধরতে শুরু করল, তখন থেকেই জমিদারের পেয়াদারা ঘোরাঘুরি করতে আরম্ভ করে। লোকে বলত, আকালের পর রেখার মেজাজ চড়ে গেছে। রেখার কাছে ওটা ভুল বলে মনে হত–কিন্তু কথাটা সত্যিই। বস্তুত, আকালের পরে গ্রামের অন্যান্য মানুষদের আত্মসম্ভ্রমবোধ যতটা নিচে নেমে গিয়েছিল, তার তুলনায় রেখা ছিল অনেক ওপরে। এই জন্যই তার ব্যবহার অন্যের কাছে রুক্ষ বলে মনে হত। পাইক-চৌকিদারকে নিজের ঘরের কাছে ঘুরতে দেখলে রেখা ভয়ানক রেগে যেত, যদিও মুখে সেটা প্রকাশ করত না। একদিন চৌকিদার দেওয়ানজীর জন্য লাউ পোড়বার জন্যে রেখার ঘরের চালের ওপর উঠল। রেখা ঘরে বসে ছেলে সুখারীকে কোলে নিয়ে আদর করছিল। চালের ওপর মচুমচ শব্দ হতেই সুখারীকে মাদুরের ওপর রেখে বাইরে এল। দেখল চৌকিদার চালার ওপর উঠে। লাউ, ছিড়ছে। তিনটি ইতিমধ্যেই ছিঁড়েছে, চতুর্থটি ছিড়বার জন্যে হাত বাড়িয়েছে। রেখার দেহে যেন আগুন জ্বলে উঠল। অর্ধেক গ্রাম শুনতে পায়, এমনি জোরে চীৎকার করে সে বলল, ‘কে হে?’

‘দেওয়ানজীর জন্যে লাউ পাড়ছি, দেখতে পাচ্ছি না?’ —মাথা না তুলেই উত্তর দিল চৌকিদার।

কর্কশস্বরে রেখা বলল, ‘হাত-পা আস্ত রাখতে চাও তো ভালোয় ভালোয় নেমে এস। —বলি শুনতে পাচ্ছ কথাটা?’।

‘মালিকের চাপরাশী জানো তো?’

‘খুব জানি! ভালো মানুষের মতো লাউগুলো ওখানে রেখে নেমে এস।’

চৌকিদার নিঃশব্দে নেমে এল। সব শুনে দেওয়ানজী তখনকার মতো রাগ চেপে রাখল। মাঘ মাসে মালিকের আগমনের অপেক্ষায় থাকল সে।

মালিক আসবার পর সেই চৌকিদার একদিন সন্ধ্যাবেলা রেখা ভগতের বাড়ি এসে বলল, ‘কাল সকাল থেকে দু’সের করে দুধ মালিকের বাড়িতে পৌঁছে দিতে হবে।’

‘আমার কাছে গরু মহিষ কিছুই নেই, দুধ কোথা থেকে দেব?’

‘যেখান থেকে হোক, মালিকের হুকুম।’

দেওয়ান অবশ্যই জানত, রেখার গরু-মহিষ কিছুই নেই। কিন্তু রেখাকে তার টিটু করতে হবে এখন। সন্ধ্যাবেলাতেই সে রেখার ঔদ্ধত্যের কথা মালিকের কাছে জানিয়ে দিয়েছে; আর এও বলেছে যে, সারা গ্রাম বিদ্রোহী হয়ে উঠছে। মালিক সেই রাতের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। তার করণীয় কর্তব্য সম্বন্ধে। সকালে রেখার কাছ থেকে দুধ এল না। পেয়াদা এলে রেখা তার নিজের গরু-মহিষ না থাকার কথা জানাল।

মালিক পাঁচজন গুপ্তপ্রকৃতির পেয়াদাকে হুকুম দিল, ‘যাও হারামজাদার মাগের দুধ দুইয়ে নিয়ে এস।’

গ্রামের কয়েকজন লোক সেখানে উপস্থিত ছিল। তারা ভাবল, পেয়াদারী রেখাকে ধরে আনবে। রেখাকে কোনো কিছু বলার বা শোনার সুযোগ না দিয়ে পেয়াদারা তাকে বেঁধে ফেলল। তারপর দু’জনে ঘরে ঢুকে মঙ্গরীকে ধরে আনল। নিরুপায় রেখা অগ্নিবৰ্ণ চোখে দেখতে লাগল-মঙ্গরীর আর্ত চিৎকারের মধ্যেই তার স্তন টিপে ধরে গ্লাসের মধ্যে সত্যি সত্যিই কয়েক ফোঁটা দুধ বের করল তারা।

পেয়াদারা রেখাকে বেঁধে রেখেই চলে গেল।

লজ্জায় মরে গিয়ে মঙ্গরী সেইখানেই মুখখুঁজে বসে রইল। কিছুক্ষণ পরে রেখা যেন কথা বলার শক্তি খুঁজে পেল। বলল, ‘লজ্জা করিস না মঙ্গরী। আজ আমাদের গ্রামের পঞ্চায়েত বেঁচে থাকলে বাদশাহও এমন বেইজ্জতি কাউকে করতে পারত না। কিন্তু এই বেইজ্জতির মজা আমি দেখাব। যদি আমার দেহে সাচ্চা আহীরের রক্ত থাকে তো এই দেওয়ান এবং রামপুরের মুন্সীর কুলে কাঁদবার কেউ থাকবে না। এই অপমানের প্রতিকার আমার এই হাতই করবে মঙ্গরী। আয়, আমার বাঁধন ছাড়িয়ে দে।’

মঙ্গরী জলভরা চোখেই রেখার বাঁধন খুলে দিল। ঘরের ভিতর গিয়ে রেখা সুখারীকে কোলে নিয়ে তার মুখে চুমা দিতে থাকল। তারপর মঙ্গরীকে বলল, ‘এখন থেকে যা নেবার আছে তা নিয়ে শীগগির পালা। আমি এই ঘরে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছি।’

রেখার গলার স্বর মঙ্গরীর অজানা ছিল না ছেলেকে কোলে নিল, আর দু-তিনখান কাপড় সঙ্গে নিল–তারপর রেখার পায়ে লুটিয়ে পড়ল।

রেখা অত্যন্ত কোমল স্বরে বলল, ‘শুধু তোর ইজ্জত নয়, সারা গ্রামের ইজ্জতের বদলা নিতে হবে। চলে যা, আর বড় হলে সুখারীকে বলিস তার বাপ কেমন ছিল। দেরী করিস না, আমি চললাম চুল্লী থেকে আগুন আনতে।’

মঙ্গরী বহু দূর পর্যন্ত ঘরটাকে দেখতে লাগল-যতক্ষণ পর্যন্ত তার চাল থেকে লেলিহান শিখা উঠতে আরম্ভ না করল, ততক্ষণ। লোকেরা গ্রামের প্রান্তে অবস্থিত রেখার ঘরের দিকে দৌড়াতে লাগল, আর রেখা খোলা তলোয়ার নিয়ে দৌড়াল জমিদারের কাছারীর দিকে। নিজেদের জীবন সংশয় দেখে চৌকিদার, পেয়াদারা পালাতে লাগল। মালিক এবং দেওয়ানকে মারবার সময় রেখা বলল, ‘তোমাদের জন্যে কাঁদবার লোকও রাখব না। শয়তানের দল!’

রেখা নিজের কথাকে সত্য প্রমাণিত করল। প্রতিজ্ঞা পূরণের চেয়েও বেশি করল সে। কসাই কর্নওয়ালিস না-জানি কতজন রেখাকে জন্ম দিয়েছিল!

 ১৮. মঙ্গল সিংহ (কাল : ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দ)

এরা দু’জনে আজ টাওয়ার দেখতে গিয়েছিল। সেখানে এরা সেই কুঠুরীগুলো দেখল। যার ভিতর সারা জীবন বন্দী থেকে রাজদ্রোহীরা পচে মরত। বন্দীদের দেহ টানা দিয়ে রাখবার যন্ত্র, কুড়াল এবং অন্যান্য সেই হাতিয়ারগুলো দেখল-যার সাহায্যে রাজা প্রমাণ করত, প্রজার জীবন-মরণ তারই হাতের মুঠোয় এবং পৃথিবীতে সে-ই সত্যিকারের ঈশ্বর–প্রেরিত যুবরাজ কিম্বা যমরাজ। কিন্তু সবচেয়ে যা আকর্ষণ করল। এদের, তা হল সেই স্থান, যেখানে ইংলেণ্ডের অনেক রাজরাণীর ছিন্নশির ধূলিলুষ্ঠিত হয়েছিল। এ্যানি রাসেল আজও তার কোমল হাত মঙ্গীর হাতে রেখেছিল। কিন্তু আজ সেই কোমলতা ভিন্ন রূপে প্রতীয়মান হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, এগারো বছর আগে (১৮৪৫) বৈজ্ঞানিক ফ্যারাডের আবিষ্কৃত ইলেক্ট্রসিটির মতো এক শক্তি এ্যানির হাত থেকে সারা শরীরে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। মঙ্গল সিংহ বলল, ‘এ্যানি, তুমি ব্যাটারী না-কি?’

‘এমন কথা কেন বলছি মঙ্গী?’

‘আমি যে সেই রকমই অনুভব করছি! ষোলো বছর আগে যখন আমি ইংলেণ্ডে পদার্পণ করি, তখন মনে হয়েছিল, অন্ধকার থেকে আলোতে এলাম। পৃথিবী এখানে বিশাল-লম্বাচওড়ায় বড় নয়, কিন্তু দূর ভবিষ্যৎ পর্যন্ত বিস্তৃত এক বিরাট জগৎ আমার চোখে পড়ল। চুকন্দরের চিনি (১৮০৮), বাষ্পীয় জাহাজ (১৮১৯), রেলওয়ে (১৮২৫), তার (১৮৩৩), দিয়াশলাই (১৮৩৮), ফোঁটো (১৮৩৯), বিজলী আলো (১৮৪৫)-এ-সব নতুন এবং আশ্চর্যজনক দেখবার জিনিস তো ছিলই কিন্তু যখন আমি কেন্ত্রিজে এ সম্বন্ধে পড়াশুনা এবং রসায়নাগারে এগুলোকে প্রত্যক্ষ প্রয়োগ করবার সুযোগ পেলাম, তখন বুঝতে পারলাম। পৃথিবীর অদৃষ্ট কি বিরাট এক ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে!’

‘ইংলণ্ডে এসে সত্যিই তোমার মনে হয়েছিল যে, অন্ধকার থেকে আলোতে এলে?’

‘সেই অর্থে, যার কথা আমি এখনই বললাম। ভারত ছাড়বার সময় আমার মনে শুধু দুটো উদ্দেশ্য ছিল। এক আমার প্রিয় ইষ্টদেব যিশুখৃষ্টর ভক্তবৃন্দের দেশ দর্শন করব। দ্বিতীয়ত, আমাদের কূলের হারিয়ে রাজলক্ষ্মীকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করব।’

‘কতবার আমি ভেবেছি, তোমার মুখে তোমার কথা শুনিব, কিন্তু বারম্বার কথায় কথায়। ভুলে গিয়েছি। আজ তোমার কথাই বল মঙ্গী।’

‘যে আমার জীবনের গতিকেই বদলে দিয়েছে তার কাছে বলতে আপত্তি কি! এ্যানি প্রিয়তমা, চল শান্ত টেমসের পারে। আমাদের গঙ্গার মতো অত বিরাট, অত সুন্দর নয় টেম্‌স, তবুও যখনই আমি টেম্‌সকে দেখি, তখনই গঙ্গার মধুর স্মৃতি আমাকে বিহ্বল করে তোলে। তুমি তো জানো এ্যানি, খৃষ্টানরা ভগবান যিশুখৃষ্ট ছাড়া আর কারও পূজাকে বিধর্ম বলে মনে করে এবং ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে। কিন্তু টেম্‌স আমাকে খৃষ্টান থেকে বিধর্ম করে দিয়েছে। আমি আমার মাকে অত্যন্ত ভক্তির সঙ্গে ফুল দিয়ে গঙ্গাকে প্ৰণাম করতে দেখেছি।’

দু’জন টেম্‌সের ধারে এসে পৌঁছাল। টেম্‌সের দিকে মুখ ঘুরিয়ে পাথরের চত্বরের ওপর ওরা বসল। সাদা টুপির ভেতর থেকে বেরিয়ে গালের ওপর এসে-পড়া এ্যানির সোনালী কেশগুচ্ছ হাওয়ায় উড়তে লাগল। মঙ্গল তাকে চুমু দিয়ে কথা আরম্ভ করল, ‘এই টেমসের পার থেকে বহুবার আমি গঙ্গাকে আমার মানস-তৰ্পণ নিবেদন করেছি।’

‘তোমার মা গঙ্গাকে পুষ্পার্য দিতেন?’

‘হ্যাঁ, খুব ভক্তিসহকারে, যেমন খৃষ্টানেরা প্ৰভু যিশুকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে। তখন আমি প্রথম খৃষ্টান হয়েছি, আমার কাছে এটা ঘূর্ণিত প্রথা বলে মনে হত। কিন্তু এখন আমি গঙ্গাকে অপমান করার পাপের জন্য অনুতপ্ত হচ্ছি।’

‘খৃষ্ট ধর্ম যে আদর্শকে নষ্ট করতে চেয়েছে, আমাদের কবিরা তাকে পুনরুজ্জীবিত করেছে। তুমি জানো, আমরা টেম্‌সকে পিতা বলে অভিহিত করি?’

‘আর আমরা বলি মা গঙ্গা…’

‘তোমাদের কল্পনা আরও মধুর মঙ্গী! তোমরা কথা বল আমাকে।’

‘বেনারস আর রামনগর গঙ্গার এপার আর ওপার-উভয়ের দূরত্ব সামান্যই। ষোলো বছর পর্যন্ত আমি গঙ্গাকে দেখেছি। বেনারসে একেবারে গঙ্গার ওপরেই আমাদের বাড়ি। তার নিচ থেকে ষাট ধাপ সিঁড়ি গঙ্গার জল পর্যন্ত নেমে গেছে। সম্ভবত যখন আমি প্রথম চোখ মেলি, তখনই মা আমাকে কোলো নিয়ে গঙ্গা দেখিয়েছেন। কেন জানি না, আমার মনে হয়, আমার রক্তে গঙ্গা বয়ে চলেছে। রামনগরে আমার ঠাকুর্দার কেল্লা, কিন্তু সেটা আমি একবার মাত্র দেখেছি।-নৌকা করে গঙ্গায় বেড়াবার সময়। ওর ভিতরে গিয়ে দেখবার ইচ্ছা আমার হত না, মা তো আরও যেতে চাইতেন না। বুঝতেই পারছি এ্যানি-যে একদিন ঐ কেল্লার যুবরাজ্ঞী ছিল আর আজ যে ইংরেজদের ভয়ে নাম বদলে বেনারসের এক। বাড়িতে জীবন কাটাচ্ছে, সে কেমন করে ঐ কেল্লার দিকে তাকাতে সাহস করবে? আমার ঠাকুর্দা চেৎসিংহকে দস্য ওয়ারেন হেষ্টিংস নাজেহাল করেছে–ইংলেণ্ডে হেষ্টিংস আপন কৃতকর্মের ফলও পেয়েছে কিছুটা, কিন্তু আমার ঠাকুর্দার প্রতি কিছুমাত্র ন্যায়-বিচার হয়নি, লুষ্ঠিত রাজ্য ফিরিয়ে দেওয়া বড় সহজ ন্যায়ের কাজ ছিল না, এ্যানি।’

‘তোমার মা কি এখনও বেঁচে আছেন?’

‘বেনারস থেকে প্রায়ই আমাদের পাদ্রীর চিঠি আসে, আমি তাঁর মারফৎ মাকে চিঠি লিখি। পাঁচ মাস আগেও তিনি জীবিত ছিলেন এ্যানি।’

‘ঐ আন্দোলনের সময় আমি ততটা সচেতন ছিলাম না, ওগুলোর স্মৃতি সামান্যই মনে আছে আমার। আমার কাকা রাসেল মন্ত্রীসভায় চাৰ্টিস্টদের ঘোরতর শত্রু ছিলেন। তাঁর মুখে বহুবার আমি ঐ বিপদজ্জনক আন্দোলনের কথা শুনেছি।’

‘প্রথমে তুমি খৃষ্টান ছিলে না তাহলে?’

‘না, আমার মা এখনও হিন্দু। আমি প্রথম প্রথম তাঁকেও খৃষ্টান করতে চাইতাম, কিন্তু এখন…’

‘এখন তুমিও তোমার মা’র সঙ্গে একত্রে মা গঙ্গাকে ফুল দিয়ে প্রণাম করবে?’

‘আর পাদ্রীরা বলবে, এ খৃষ্ট ধর্ম ছেড়ে দিয়েছে।’

‘তুমি খৃষ্টান হলে কি করে?’

‘অন্তরের প্রেরণা কিছুই ছিল না, বেনারসের ইংরেজ পান্ধী এবং পাদ্রিনীরা খৃষ্টান ধর্ম প্রচার করে বেড়ায়। কিন্তু বেনারস হল হিন্দুদের রোম। এ জন্য সেখানে তেমন সুবিধে করতে পারত না। একবার এক পাস্ত্রী ডাক্তার আমার মা’র অসুখের সময় চিকিৎসা করেন। তারপর তাঁর স্ত্রী আমাদের বাড়িতে যাতায়াত আরম্ভ করলেন। আমার মা’র সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল। আমি তখন খুব ছোট ছিলাম এবং তিনি আমাকে প্রায়ই কোলে। তুলে নিতেন………’

‘ছেলেবেলায় তুমি বোধহয় খুব সুন্দর ছিলে-তাই না মঙ্গী?’

‘তারপর সেই পাদ্রী মাকে বোঝালেন যে, ছেলেকে ইংরেজি পাড়াও। পাঁচ-ছ বছর। বয়স থেকেই পাস্ত্রী আমাকে ইংরেজি পড়াতে শুরু করলেন। মা নিজের পরিবারের অতীত বৈভবের কথা ভাবতেন এবং আশা করতেন, হয়ত ইংরেজি পড়ে ছেলে কুললক্ষ্মীকে ফিরিয়ে আনবার জন্য কিছু করতে পারবে। আমার বাবা আমার তিন বছর বয়সেই মারা গিয়েছিলেন। এ জন্য আমার মাকেই সব কিছু করতে হত। আমাদের সব সম্পত্তি ও রাজ্য চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বেদখল হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু মা’র কাছে তাঁর শাশুড়ীর দেওয়া। প্রচুর মণিমুক্তা ছিল। আর আমার মামাও মাকে সাহায্য করতেন। আট বছর বয়স থেকে আমি বেশি করে সেই পাদ্ৰী দম্পতির বাড়িতে থাকতে লাগলাম। হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে জানবার সুযোগ আমার খুব কমই মিলত আর যদি কিছু মিলত তো সেই পাদ্রিনীর মুখ থেকে। তিনি বলতেন, এ তোমার ভাগ্য যে তোমার মা বেঁচে গিয়েছেন। না হলে তোমার বাবা মরে যাওয়ার পর লোকে তোমার মাকে জীবন্ত দগ্ধ করে সতী বানাতে চাইত।’ আমার মাকে জীবন্ত দগ্ধ করার সঙ্গে হিন্দুধর্মকে এক মনে করার পর–তুমিই বুঝতে পার এ্যানি, আমার হৃদয়ে ঐ ধর্মের প্রতি অপরিসীম। ঘৃণা ছাড়া আর কোনো ভাবের উদ্রেক হতে পারে? এই সময় সতীদাহ প্ৰথা বন্ধ হতে দু’বছর (১৮২৯) বাকী ছিল। আমার মঙ্গলের কথা ভেবে পাদ্রিনীর কথা মা মেনে নিলেন এবং পড়ার জন্য কলকাতায় পাঠিয়ে দিলেন। কলকাতায় যখন পড়ছিলাম, তখন মা’র মনে সন্দেহ হল যে, আমাকে খৃষ্টান বানাবার জন্যেই পাদ্ৰিনী এই সব করছে। মা প্ৰথমে কিছু বুঝতে না পারায় ভালোই হয়েছিল, নইলে নিজের চোখ খুলবার সুযোগ পেতাম না।’

‘ভারতবর্ষে শিশুদের লেখাপড়া শেখানোর কথা কেউ কি ভাবে না?’

‘তেরশ বছর আগে যে বিদ্যা পড়লে লাভ ছিল এখনো সেই বিদ্যাই শেখানো হয়।’

‘তারপর ইংলণ্ডে আসবার জন্যে মার’ অনুমতি কি করে পেলে?’

‘অনুমতি! পাদ্রীর সাহায্যে আমি মাকে না বলেই চলে এলাম। কেম্বিজে পড়বার ব্যবস্থা করে দিলেন তিনি। এখান থেকে যখন আমি মাকে কুশল-সংবাদ পাঠালাম, তখন তিনি আশীৰ্বাদ জানালেন। তাঁর বয়স তখন পঞ্চান্ন। প্রত্যেক চিঠিতেই আমাকে দেশে চলে যেতে লিখতেন। তিনি।’

‘তুমি কি জবাব দিতে?’

‘জবাব আর কি দেব? তিনি ভাবতেন, আমি রাজধানীতে আছি, ইংলেণ্ডের রাণীর সঙ্গে আমার দেখাসাক্ষাৎ হচ্ছে এবং এক সময় আমি চেৎসিংহের সিংহাসনের অধিপতি হয়ে দেশে ফিরব।’

‘ঐ গঙ্গা-পূজারিণী বেচারী কি করে জানবেন যে, রাণী ভিক্টেরিয়ার সঙ্গে তোমার। দেখা না হয়ে হয়েছে সমগ্র দুনিয়ার যত মুকুট-শোভিত-শিরের ভয়ঙ্কর শক্র কার্ল মার্কস আর ফ্রিডরিশ এঙ্গেলসের সঙ্গে!’

‘যে সময় সমগ্ৰ ভারতবর্ষ পুঁজিবাদী দুনিয়া এবং তার শক্তি সম্বন্ধেই অজ্ঞ, তখন মার্কসের সাম্যবাদকে কি করে বুঝবেন তিনি!’

‘মার্কসের সঙ্গে ভারত সম্বন্ধে কখনও কিছু কথা হয়েছে তোমোর?’

‘বহুবার। আমার অবাক লেগেছে যে, এখানে বসে বসে ভারতের জীবন-প্রবাহ সম্বন্ধে কি অসাধারণ জ্ঞান তাঁর! কিন্তু এ কোনো ভানুমতীর খেলা নয়, গত তিনশ’ বছরের বিভিন্ন ইংরেজ ভারত সম্বন্ধে যতটা জ্ঞানার্জন করে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছে, সবই এই লণ্ডনে মজুত রয়েছে। আবর্জনার মতো পড়ে থাকা এই পুস্তকাবলী গভীর মনোযোগের সঙ্গে পড়েছেন। মার্কস। আর যখনই কোনো ভারতীয়ের এখানে দেখা পেতেন, তাকে জিজ্ঞাসা করে তাঁর অধীত জ্ঞান যাচাই করে দেখতেন।’

‘ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে মার্কসের কি অভিমত?’

‘ভারতের যোদ্ধাদের খুবই প্রশংসা করেন—আমাদের বুদ্ধিরও প্রশংসা করেন। কিন্তু আমাদের প্রাচীনপন্থীদের, ভারতের সব চেয়ে বড় শত্রু বলে তিনি মনে করেন। আমাদের গ্রামগুলোকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছোট-ছোট প্রজাতন্ত্র বলে মনে করেন।’

‘প্রজাতন্ত্র?’

‘সমগ্ৰ দেশ নয়, দেশের একটা জেলা, এমন কি এক সঙ্গে দুটো গ্রামও নয়, শুধু একটি একক গ্রাম। কিন্তু সব জায়গাতে নয়, যেখানে লর্ড কর্নওয়ালিস ইংরেজি ছাচে জমিদারী প্রথা কায়েম করেছে, সেখানকার প্রজাতন্ত্র প্রথমেই শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু প্রাচীন ভারতীয় গ্রামীণ প্রজাতন্ত্রকে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা পরিচালনা করে থাকে। পুলিশ আইন, সেচ, শিক্ষা, ধর্ম ইত্যাদি সমস্ত বিভাগই সে পরিচালনা করে, এবং অত্যন্ত বিবেচনা, বুদ্ধিমত্তা, ন্যায় এবং নিৰ্ভয়তার সঙ্গে। গ্রামের এক অঙ্গুলি পরিমাণ জমি বা দুর্বলতম মানুষের ইজ্জত রক্ষার জন্যেও আপন পঞ্চায়েতের হুকুমে গ্রামের শিশু-বৃদ্ধ সর্বদা প্রাণ দেবার জন্য প্রস্তুত থাকে। যখন দিল্লীর আশপাশে অল্প দূর পর্যন্তই মুসলমান শাসকদের রাজত্ব ছিল, এবং তারা নিজেদের মুসাফির বলে মনে করত, সেই সময়ে প্রথম প্রথম তারা পঞ্চায়েতের ক্ষতি করতে চাইত। পরে তারা পঞ্চায়েতের স্বায়ত্ব শাসনকে মেনে নিল। কিন্তু ইংরেজ শাসকবৃন্দ, বিশেষ করে ইংলণ্ডের জমিদার লর্ড কর্নওয়ালিসই গ্রামীণ প্রজাতন্ত্রকে বরবাদ করবার আওয়াজ তুলল, এবং বহুলাংশে সফলও হল। কিন্তু এতেও সম্ভবত ভাঙত না এই পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। গ্রামের প্রজাতন্ত্র এবং তার অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার ওপর সব চেয়ে বড় আঘাত এল ম্যানচেষ্টার ও ল্যাঙ্কাশায়ারের কাপড়, শেফিল্ডের লোহার জিনিস এবং এখান থেকে রপ্তানী-করা আরও বহু জিনিসপত্রের কাছ থেকে। ১৯২২ খৃষ্টাব্দের জুলাই মাসের ১০ তারিখে কলকাতায় প্রথম বাষ্পীয় পোত জলে নামল। সঙ্গে সঙ্গেই গ্রামের প্রজাতন্ত্রের অর্থনৈতিক অবশিষ্ট স্বাধীনতাটুকু নিশ্চিত হয়ে গেল। ভারতবর্ষের সূক্ষ্ম মলমল উৎপাদনের স্থান ঢাকা, দুই-তৃতীয়াংশ জনবিরল হয়ে পড়ল। গ্রামের তাঁতীদের অবস্থা হয়ে উঠল অবৰ্ণনীয়। যে ভারতীয় গ্রাম নিজেদের কামার, কুমার, জেলা, তাঁতী নিয়ে নিজেকে স্বাধীন মনে করত, তার এই সমস্ত কারিগর, তখন হাত গুটিয়ে ঘরে বসে অনাহারে মরতে লাগল। আর তাদের জন্যে ল্যাঙ্কাশায়ার, ম্যানচেষ্টার, বার্মিংহাম, শেফিল্ডের মাল পাঠানো হতে লাগল। শুধু কাপড়ের কথাই ধর। ১৮৮৪ খৃষ্ঠাব্দে ভারত থেকে ব্রিটেনে ১৮,৬৬,৬০৮ থান কাপড় এসেছে এবং ১৮৩৫ খৃষ্টাব্দে ৩,৭৬,০৮৬ থান। আর এখন আমাদের ওখানে ৮,১৮,২০,৯৫,১৭,৭৭,২৭৭ গজ বিলাতী কাপড় রপ্তানি হয়েছে। ঢাকাই মলমল বস্ত্র উৎপাদনকারী ভারতবর্ষ নিজেদের তুলা বিলাতে পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় কাপড় তৈরি করাচ্ছে! একেবারে হালের হিসাব অনুযায়ী ১৮৪৬-এ ১০,৭৫,৩০৯ পাউণ্ড তুলা ভারত থেকে এখানে এসেছে।’

‘কিন্তু মার্কস বলেন, বিদেশীদের এই অত্যাচারে আমাদের হৃদয় কেঁদে ওঠে, কিন্তু আমাদের বুদ্ধিমত্তা তৃপ্ত হয় প্রাচীনপন্থার এই পতনে।’

‘দুটোর মধ্যে তা হলে দু’ধরনের পরিণতি ঘটছে?’

’হ্যাঁ এ্যানি! সন্তান প্রসবের সময় মা কি ভয়ানক যন্ত্রণা ভোগ করেন, কিন্তু একই সঙ্গে। তিনি সন্তান প্রাপ্তির আনন্দও অনুভব করেন। ধ্বংস বিনা সৃষ্টি অসম্ভব। ছোট-ছেট ঐ সব প্রজাতন্ত্রকে ধ্বংস না করে বিরাট শক্তিশালী এক প্রজাতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করা যায় না। যতদিন-পর্যন্ত ভারতীয়দের আসক্তি কেবলমাত্র নিজ-নিজ গ্রামীণ প্রজাতন্ত্রের প্রতি সীমাবদ্ধ থাকবে, ততদিন সমগ্ৰ ভারতবর্ষের জন্য তারা আত্মত্যাগ করতে পারবে না। ইংরেজরা। নিজেদের ব্যবসার সুবিধার জন্যেই রেলওয়ে, টেলিগ্রাফ এই সমস্ত যন্ত্রকে শুধু ভারতে আমদানি করেছ, কিন্তু মার্কসের সিদ্ধান্তই সঠিক যে, রেলগাড়ি তৈরি এবং মেরামতের জন্য যদি ইংরেজ পুঁজিপতি ভারতীয় কয়লা এবং লোহাকে কাজে লাগাতে না পারে, তবে বেশি। দিন তারা সস্তায় এই সব জিনিস চালাতে পারবে না। আর ভারতীয়েরাও বিজ্ঞানের এই চমৎকারিতা চোখের সামনে দেখে কতদিন ঘুমিয়ে থাকবে?’

‘অর্থাৎ ভারতেও শিল্প এবং পুঁজিবাদের বিস্তার অপরিহার্য?’

‘নিশ্চয়ই, ইংলণ্ডে এখন আর সামন্তবাদী প্ৰভুত্ব নেই।’

‘হ্যাঁ সংস্কার আইন (১৮৩২ খৃঃ) ইংলণ্ডের শাসনভার পুঁজিপতিদের হাতেই তুলে দিয়েছে অথবা বলতে পার, পুঁজিপতিদের শাসনারূঢ় হবার সূচনা ঐ আইন।’

‘তুমি ঠিকই বলেছ। আচ্ছা চাৰ্টিস্টদের সভাসমূহ এবং পত্রিকাসমূহ কি তোমার ওপর কোনো রকম প্রভাব বিস্তার করেছিল এ্যানি?’

‘আচ্ছা এ্যানি, এইসব কথা বলার সময় তাঁকে কি তেমনি জোরালো বক্তা রূপে দেখা। যেত। যেমনটি দেখা গিয়েছিল পার্লামেন্টে বারো লক্ষ জনতার সহিযুক্ত সাধারণ দাবী প্রত্যাখ্যাত হওয়ার সময়?’

‘না প্রিয়, এখনও তিনি ভয় করেন, যদিও এই ১৮৫৬ সালে চাৰ্টিষ্টদের সম্বন্ধে বিশেষ কিছু শোনাই যায় না।‘

‘ভয় কেন পাবেন না, এ্যানি? পুঁজিপতি ব্যবসায়ীরা যেমন সামন্ত-শাসনকে ধ্বংস করে নিজেদের শাসন কায়েম করেছে, তেমনি মজুরেরাও এই পুঁজিপতিদের রাজ্য খতম করে। ছাড়বে এবং মানবতার রাজ্য কায়েম করবে। যেখানে ধনী-দরিদ্র, বড়-ছোট কালো-সাদার ভেদাভেদ ঘুচে যাবে।’

‘স্ত্রী-পুরুষের পার্থক্যও ঘুচাবে মঙ্গী?’

‘হ্যাঁ, স্ত্রীলোকেরাও পুরুষের জুলুমে মারা পড়ছে। আমাদের দেশে সামন্তবাদ এই সেদিন পর্যন্ত ও সতীপ্রথার নামে লক্ষ লক্ষ স্ত্রীলোককে প্রতি বছর আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে আর এখনও তারা যে রকম পর্দার আড়ালে বন্দী হয়ে, সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে পুরুষের জুলুম সহ্য করছে—সেটা মানবতার কলঙ্ক।’

‘আমাদের এখানকার স্ত্রীলোকদের তুমি হয়ত স্বাধীন ভেবে থাকবে, কেননা, আমাদের পর্দার আড়ালে বন্দী করে রাখা হয় না।’

‘স্বাধীন বলি না এ্যানি, শুধু এইটুকু বলি যে, তোমরা তোমাদের ভারতীয় বোনদের চেয়ে ঢের ভালো অবস্থায় আছ।’

‘গোলামীর আবার ভালো-মন্দা! পার্লামেন্টে ভোটের অধিকার নেই, বড়-বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চৌকাঠও আমরা পেরুতে পারি না। মুঠোর মধ্যে ধরা যায় এমন আঁট করে কোমর কষে, আর ষাট গজ কাপড় তা থেকে মাটিতে লুটিয়ে এমনি সব ঘাঘরা পরি আমরা-শুধু পুরুষদের খেলার পুতুল হবার জন্যে। সে যাহোক, তাহলে মার্কস এই আশা করেন যে, ভারতে শিল্প এবং পুঁজিবাদের প্রসার হবে, যার ফলে একদিকে জনগণের মধ্যে অধিকতর সাহসের সঞ্চার হবে, অপরদিকে ওখানেও গ্রামের বেকার, কৃষক, এবং কারিগরদের কারখানায় একত্রিত করা যাবে। তারপর তারা আপন শ্রমিক-সমিতি গড়ে লড়তে শিখবে এবং সাম্যবাদের ঝাণ্ডা নিয়ে ইংলণ্ডের মজুরদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মানুষের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করবে, এবং পৃথিবীকে পুঁজিপতিদের গোলামী থেকে মুক্ত করে সেখানে সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করবে। কিন্তু এ তো কয়েক শত বছরের ব্যাপার মঙ্গী!’

‘মার্কস এ কথাও বলেন, যদিও ইংরেজরা বিজ্ঞানের দান কলকারখানা থেকে ভারতবর্ষকে বঞ্চিত করে রেখেছে, তবুও বিজ্ঞানের অপরাপর দান যুদ্ধের অস্ত্ৰসমূহ দিয়ে ভারতীয় সৈন্যগণকে সুসজ্জিত করেছে। এই ভারতীয় সৈন্যেরা ভারতের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করতে বড় রকমের সহায়ক হবে।’

‘কিন্তু একি খুব শীঘ্র হতে পারে?’

‘খুব দূরের ব্যাপার নয় এ্যানি, সময় এসেই গেছে। কাগজে পড়নি, ৭ই ফেব্রুয়ারি (১৮৫৬ খৃষ্টাব্দ) অযোধ্যাকে ইংরেজ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়েছে?’।

‘হ্যাঁ, এবং নেওয়া হয়েছে বেইমানী করে।’

‘বেইমানী বা ইমানদারী নিয়ে তর্ক করার কিছু নেই। ইংরেজ ব্যবসায়ীরা সব কিছুই নিজেদের স্বার্থের জন্য করছে। কিন্তু অজ্ঞাতে তারা অনেক কিছু ভালোও করে ফেলেছে। তার গ্রামীণ প্রজাতন্ত্রকে ভেঙে আমাদের সামনে দেশের বিস্তৃত রূপ তুলে ধরেছে। তারা নিজেদের রেল, তার, জাহাজ দিয়ে আমাদের কুপমণ্ডুকতাকে ভেঙে বিশাল জগতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক স্থাপিত করেছে, অযোধ্যা অধিকার করায় কিছু পরিবর্তন আসবে, আর আমি তারই প্রতীক্ষায় আছি এ্যানি।

‘মার্কসের শিষ্যের কাছ থেকে আর কি আশা করা যেতে পারে?’

 

২.

গঙ্গার প্রশান্ত তট আবার অশান্ত হয়ে উঠতে চাইল। বিঠরের বিশাল প্রাসাদে পেশোয়ার উত্তরাধিকারী নানাসাহেব (ছোট) শুধু সিংহাসন থেকেই নয়, পেন্সন থেকেও বঞ্চিত হয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে অধিকতর সক্রিয় হয়ে উঠল। তার অনুচরেরা তারই মতো পদচ্যুত অপরাপর সামন্তদের কাছে রাত-দিন ছুটাছুটি করতে লাগল। এই সময় ইংরেজেরা আরও একটি বড় ভুল করে বসল। আর সে ভুল শুধু ভুলই নয়, নিত্য-নতুন পরিস্থিতির মধ্যে এ হল রীতিমতো প্ৰাণ নিয়ে টানাটানি। ইংরেজেরা আগের ছররা বন্দুকের জায়গায় আরও বেশি জোরদার কাতুর্জের বন্দুক তাদের সৈন্যবাহিনীর মধ্যে বণ্টন করল। এই কাতুর্জ বন্দুকে ভরবার সময় দাঁতে  কাটতে হত। অদূরদশী ইংরেজের শত্রু এই ব্যাপার থেকেই সুযোগ সংগ্রহ করে নিল। চারদিকে রব তুলে দিল যে, বন্দুকের কাতুর্জের ভিতর গরু এবং শুয়োরের চর্বি আছে, ইংরেজেরা জেনেশুনেই এই কাতুর্জ সিপাইদের দাঁতে কাটতে দিয়েছে, যাতে ভারতবর্ষ থেকে হিন্দু-মুসলমানের ধর্ম উঠে যায়, আর সকলেই খৃষ্টান হয়ে যায়।

কাশীরাজ চেৎসিংহের পৌত্র মঙ্গল সিংহের নাম সৈন্যদের মধ্যে বিদ্যুতের মতো কাজ করছে, এ কথা মঙ্গল সিংহ জানত, কিন্তু সে কখনও এই রহস্যকে উন্মুক্ত হতে দেয়নি। নানাসাহেব এবং অপর বিদ্রোহী নেতারা তার সম্পর্কে এইটুকুই জানত, সে ইংরেজ শাসনের পরম শত্ৰু, বিলেত গিয়ে সে ইংরেজদের বিদ্যা যথেষ্ট অধ্যয়ন করেছে। রাজনীতি সম্বন্ধে তার প্রগাঢ় জ্ঞান। বিলাতে থাকার ফলে তার ধর্ম নষ্ট হয়ে গেছে, যদিও খৃষ্টান ধর্মকেও সে মানে না।

বিদ্রোহী নেতাদের সযত্ন-রক্ষিত মনোভাব বুঝতে মঙ্গল সিংহের দেরী লাগল না। সে দেখল যে, পদচ্যুত সামন্তরা নিজ-নিজ অধিকারকে পুনরুদ্ধার করতে চাইছে এবং তার জন্য সকলের সাধারণ শত্রু ইংরেজকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিতে চায়। তাদের কাছে আত্মত্যাগী সৈন্যরা দাবার খুঁটির বেশি আর কিছুই নয়। ধর্ম নষ্ট হবার ভয়ে সিপাহীরা উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। কাতুর্জের চর্বি যদি দাঁতে  কাটতে না হত তাহলে সম্ভবত অনন্তকাল তারা কোম্পানীর জয়-জয়কার করে যেত, নিজেদের প্রাণও বিসর্জন দিত। আর হিন্দু মুসলমানের গ মধ্যে পার্থক্য-সে তো এতটুকুও কমেনি। উপরন্তু যদি বিদ্রোহ সফল হয়, তবে ধর্মের নামে। গর্বিত নিরক্ষর সিপাহী আল্লা এবং ভগবানের কৃপাপাত্র হবার আশায় নিজেদের আরও বেশি কঠোর ধাৰ্মিক বলে প্রমাণিত করবার চেষ্টা করবে। হয়ত গ্রাম এবং শহরগুলো লুণ্ঠন করতেও চাইবে তারা। যদিও এই ধরনের মনোবৃত্তি-সম্পন্ন সিপাহীদের সংখ্যা কমই ছিল এবং কম জায়গাতেই এমনি লুণ্ঠন চলেছিল। তা’হলেও সোরগোল এতটা বেশি হয়েছিল যে, গ্রামের লোকেরা ডাকাত পড়ার মতো আতঙ্কগ্ৰস্ত হয়ে উঠেছিল। দেশের মুক্তিদাতা সেনাবাহিনীর প্রতি এমন মনোভাব ভালো নয়। এ-সব জেনে মঙ্গল সিংহ প্রথমটায় নিরাশ হল। চেৎসিংহের সিংহাসন পুনরুদ্ধারের আশায় সে দেশে ফেরেনি, এসেছিল সাম্য-মৈত্রীস্বাধীনতার রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে। তাতে জাত-পাত, হিন্দু-মুসলমানের ভেদাভেদ, ইংরেজ পুঁজিপতিদের শাসনের মতোই অবাঞ্ছনীয়। কূপমণ্ডুক তাকে সংরক্ষিত করতে সে চায়নি, ভারতবর্ষের বহু শতাব্দী-ব্যাপী সঙ্কীর্ণ আবেষ্টনীকে ভেঙে তাকে বিশ্বের অভিন্ন অংশ রূপে প্রতিষ্ঠা করতে সে চেয়েছিল। ইংরেজ পুঁজিপতিদের শাসন এবং শোষণকে হঠিয়ে দিয়ে ভারতবর্ষের জনসাধারণকে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করে এক সুন্দর জগৎ নির্মাণে উদ্ধৃদ্ধ করতে চেয়েছিল। কাতুর্জের চর্বির মিথ্যা প্রচারকে সে সমর্থন করতে পারেনি। কারণ এর দ্বারা ভারতবর্ষে ধর্ম আবার তার শিকড় গেড়ে বসবে।

নানাসাহেব এবং অপরাপর নেতারা দামী বিলাতী মদ ওড়াত এবং সুযোগ পেলেই মদ। আর মাংস খেয়ে গৌরাঙ্গী সুন্দরীদের এঁটো ঠোঁট লেহন করবার জন্য লালায়িত হয়ে পড়ত। মজার ব্যাপার হল, এরাই ধৰ্মরক্ষার পবিত্র কর্তব্য নিয়ে বিক্ষুব্ধ সেনাবাহিনীর নেতৃপদ দখল করে বসল। এই সমস্ত দোষ-ত্রুটির সঙ্গে যখন একটা বিষয় মঙ্গল সিংহ চিন্তা করল, তখন আপন কর্তব্য স্থির করে ফেলতে তার দেরী হল না। যুগপৎ ইংরেজ-শাসক এবং ভারতীয় সামন্তদের গোলামীতে পিষ্ট হচ্ছিল ভারতবর্ষ, যার মধ্যে মজবুত এবং সুচতুর শাসন হল ইংরেজের। এদের হঠিয়ে দেবার পর শুধু স্বদেশী সামন্তদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে।–ভারতীয় জনসাধারণের পক্ষে যা অধিকতর সহজ কাজ।

জানুয়ারি মাস। রাত্রে বেশ ঠাণ্ডা পড়েছিল, যদিও লণ্ডনের তুলনায় সেটা কিছুই নয়। বিঠরে চারিদিকে স্তব্ধতা বিরাজ করছিল। কিন্তু পেশোয়ার প্রাসাদের প্রহরীরা স্ব-স্ব স্থানে। প্রহরায় নিযুক্ত। নিজেদের প্রভুর এক বিশ্বস্ত অনুচরের সঙ্গে এক অপরিচিত ব্যক্তিকে তারা মহলের ভিতর ঢুকতে দেখল। তারা আজকাল এমনি অপরিচিতদের প্রতি রাত্ৰেই মহলের ভিতরে ঢুকতে দেখে।

নানাসাহেবের সঙ্গে মঙ্গল সিংহের সাক্ষাৎ এই প্ৰথম নয়, কাজেই তারা একে অন্যকে বেশ ভালোভাবেই জানত। এখানে দিল্লীর বৃত্তিভোগী বাদশাহ, অযোধ্যার নবাব, জগদীশপুরের কুঁঅর সিংহ এবং অন্যান্য বহু সামন্তের প্রতিনিধিকে দেখতে পেল মঙ্গল সিংহ। ব্যারাকপুর (কলকাতা), দানাপুর, কানাপুর, লক্ষ্মৌ, আগ্রা, মীরাট প্রভৃতি ক্যান্টনূমেন্টের সিপাহীদের মধ্যে বিদ্রোহের ভাব কতদূর প্রাবল্য লাভ করেছে তা শোনাগেল। এটা আশ্চর্যের কথা যে, এত বড় শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে নেমে নিজেদের একটিও সৈন্য না রেখে এই সব সামন্তরা শুধু বিদ্রোহী সৈন্যদের ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে বসেছিল। আর যুদ্ধবিদ্যার কথা ধরলে প্রায় সমস্ত নেতারাই ছিল সে বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। তবুও নিজেরা সর্বাধিনায়কের পদ অধিকার করবার জন্য ব্যগ্র ছিল। অত্যন্ত আশাপূর্ণ স্বরে নানাসাহেব বলল, ‘ভারতবর্ষে ইংরেজ রাজত্ব নির্ভর করছে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর ওপর। সেই বাহিনী আজ আমাদের হাতে চলে আসছে।’

‘কিন্তু সমস্ত ভারতীয় সৈন্যই কি আমাদের দিকে আসছে নানাসাহেব? পাঞ্জাবী শিখদের বিদ্রোহ করার কোনো খবর এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। অপর পক্ষে অপরাপর ভারতীয় সৈন্যবাহিনী ইংরেজের পক্ষে লড়াই করে যেভাবে তাদের পাঞ্জাবকে পরাজিত করেছিল সে কথা স্মরণ করে পাঞ্জাবীরা তার প্রতিশোধই নিতে চাইবে। ইংরেজরাও বড় হাঁশিয়ার নানাসাহেব। না হলে পেশোয়া এবং অযোধ্যার নবাবের মতো দিলীপ সিংহকে যদি তারা কোথাও নজরবন্দী করে রাখত, তবে আজ সমস্ত শিখ পল্টনকে আমাদের পক্ষে নিয়ে আসা খুবই সহজ হত। যাহোক, আমাদের মনে রাখতে হবে, শিখ এবং নেপালী দেশীয় রাজ্যসমূহের পল্টনেরা আমাদের দিকে নেই। আর দেশের এই স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা আমাদের সঙ্গে নেই, তাদের বিরোধী বলেই ধরতে হবে।’

নানাসাহেব বলল, ‘আপনার কথা ঠিকই ঠাকুরাসাহেব। কিন্তু যদি সূচনাতেই আমরা সাফল্য লাভ করতে পারি, তবে কোনো দেশদ্রোহীরই আমাদের বিরুদ্ধে লড়বার সাহস হবে না।’

‘আরও একটি বিষয়ে আমাদের ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে। এখন থেকেই জনসাধারণকে বোঝাতে হবে যে, আমরা দেশের মুক্তিযোদ্ধা।’

পূর্বাঞ্চলের এক প্রতিনিধি বলল, ‘আমরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্ৰধারণ করব-এই ব্যাপারটাই কি এ কথা বোঝাবার পক্ষে যথেষ্ট নয়?’।

মঙ্গল সিংহ, ‘সমস্ত জায়গাতেই তো চব্বিশ ঘণ্টা অস্ত্ৰ ঝনৃঝন করবে না। আমাদের ‘ দেশে বহু কাপুরুষ রয়েছে যারা ইংরেজের অজেয়তা সম্পর্কে বিশ্বাসী। তারা নানা রকমের গুজব রটাবে। আমার মনে হয়, পূর্ব পশ্চিম এবং মধ্য–এই তিন ভাগে ভাগ করে তিনটি হিন্দী এবং উর্দু খবরের কাগজ আমাদের ছাপতে হবে।’

নানাসাহেব, ‘ইংরেজি কায়দা-কানুন আপনার বেশি পছন্দ ঠাকুরুসাহেব। কিন্তু খবরের কাগজ ছাড়াই আমরা কাতুর্জের ব্যাপারটা রটিয়ে কিভাবে জনসাধারণকে তৈরি করেছি তা তো দেখছেন!’

মঙ্গল সিংহ, ‘কিন্তু যুদ্ধের মধ্যে ইংরেজের চাকরেরা আমাদের বিরুদ্ধে যে সব কথা রটাবে, তার জন্য কিছু একটা করতে হবে নানাসাহেব। একদিনেই তো আমরা ইংরেজের গোটা শাসনযন্ত্রকে অধিকার করে নিতে পারব না। মনে করুন তারা গুজব রটিয়ে দিল যে, বিদ্রোহী সৈন্যরা, মনে রাখবেন আমাদের এই নামেই ডাকবে তারা-গ্রাম এবং শহর লুট করতে, ছোট ছেলেমেয়েদেরকে কেটে ফেলতে আসছে।’

নানাসাহেব, ‘এ কথা কি লোক বিশ্বাস করবে?’

মঙ্গল সিংহ, ‘যে কথা রটানো হবে এবং যে রটনার বিরুদ্ধে অন্য কোনো আওয়াজ উঠবে না। সে কথা লোকে বিশ্বাস করতে আরম্ভ করবেই।’

নানাসাহেব, ‘মনে হয়, কার্তুজের ব্যাপারে ধর্মবিদ্রোহী বলে ইংরেজদের এত বদনাম করে দিয়েছি যে ওদের কোনো কথাই কেউ বিশ্বাস করবে না।’ ‘

মঙ্গল সিংহ, ‘আমি কিন্তু একে যথেষ্ট মনে করি না। যাইহোক, আমাদের এই লড়াইকে ইংরেজেরা নিছক বিদ্রোহ বলে প্রচার করবে। কিন্তু দুনিয়ায় আমাদের মিত্র এবং ইংরেজের শত্রু অনেক, তারা আমাদের স্বাধীনতা কামনা করে–বিশেষ করে ইউরোপে এ রকম বহু জাতি আছে। এই জন্য আমাদের এই লড়াইকে সমগ্র ইউরোপীয় জনসাধারণের–বিরুদ্ধে জেহাদ রূপে আমরা দাঁড় করাব না এবং শান্তিপূর্ণ ইংরেজ বালবৃদ্ধ নারীদের ওপর হস্তক্ষেপ করব না। তাতে আমাদের কোনো লাভ হবে না, উল্টে দুনিয়া জুড়ে ভারতবর্ষের বদনাম হবে।

নানাসাহেব, ‘এ সব সেনাপতিদের মনে রাখবার কথা। কোন সময়ে কি করতে হবে, সে সম্বন্ধে তারা নিজেরাই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম।’

মঙ্গল সিংহ, ‘সবশেষে আমি বলতে চাই, যুদ্ধে যে সৈন্যরা নিজেদের জীবন পণ করছে এবং যে যুদ্ধ জনসাধারণের কাছ থেকেও সাহায্য আশা করছি, তাকে চর্বিযুক্ত কার্তুজের ঝগড়ায় সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়। আমাদের বলতে হবে, ইংরেজদের তাড়িয়ে দিয়ে কি ধরনের রাজত্ব কায়েম করব। সেই রাজত্বে সৈন্য এবং যে কৃষকশ্রেণী থেকে সৈন্যরা আসছে সেই কৃষককুল কি পাবে।’

নানাসাহেব, ‘ধর্মদ্রোহীদের শাসন উঠিয়ে দেওয়াই তো তাদের সন্তুষ্ট করবার জন্য পৰ্যাপ্ত।’

‘এ প্রশ্ন যদি আপনাকেই করা যায় তাহলে কি জবাব দেবেন। আপনি? আপনার মনে কি পেশোয়ার রাজধানী পুণাতে ফিরে যাবার ইচ্ছা নেই? নবাবজাদার অন্তরে কি লক্ষ্মেীর তখতের আকর্ষণ নেই? যখন আপনারা কার্তুজ এবং ইংরেজ-শাসন থেকে মুক্ত হবার চেয়েও বড় ইচ্ছা পোষণ করেন-যার জন্য আপনারা জীবনকে বাজী রাখতে চলেছেন, তখন আমি মনে করি, জনসাধারণের সামনেও ভবিষ্যৎ লাভের বিষয়ে কিছু বলে রাখা উচিত। যেমন, গ্রামে গ্রামে আমরা পঞ্চায়েত বানাব, যাতে সমস্ত গ্রামের প্রজাসাধারণ নির্বাচন করবে এবং বাদশাহের ওপরও যার ক্ষমতা থাকবে। জমিদারী প্রথা আমরা উঠিয়ে দেব এবং কৃষক আর সরকারের মাঝে কোনো স্বত্বভোগী থাকবে না। জায়গীর যারা পাবে তারা শুধু সরকারকে দেয় খাজনাই আদায় করতে পারবে। যাতে কেউ–বেকার বসে না থাকে সে জন্যে সেচকার্যের উপযোগী নালা আর বাঁধ তৈরি করব আমরা। তাতে কোটি-কৌটি মজুরের কাজ মিলবে, দেশের মধ্যে বহুগুণ বেশি তরিতরকারী জন্মাবে এবং কৃষি-কাজের জন্য অনেক নতুন জমি পাওয়া যাবে।’

মঙ্গল সিংহের কথাগুলোকে কেউ বিশেষ গুরুত্ব দিতে চাইল না। সকলের মতে ওগুলো সব রাজত্ব হাতে আসবার পরের কথা।

খাঁটিয়ার ওপর শোবার অনেকক্ষণ পরেও মঙ্গল সিংহের চোখে ঘুম এল না। সে ভাবছিল, এটা বৈজ্ঞানিক যুগ। রেল, তার, স্টিমারের যাদুকে সে স্বচক্ষে দেখছে। দিয়াশলাই, ফটোগ্রাফি এবং বিদ্যুতের যুগে মানব-সমাজে প্রবেশ করছে; কিন্তু এইসব লোক পুরনো যুগের স্বপ্ন দেখছে। তবুও এই ঘোর অন্ধকারের মাঝে একটা কথা স্পষ্ট বুঝতে পারল সে। এই লড়াই শুধু জনসাধারণের শক্তি দিয়েই পরিচালনা করা সম্ভব হবে, ফলে জনগণ আপন শক্তিকে চিনতে পারবে। বিলাতী পুঁজিপতিরা যেমন বিলাতের মজুরশ্রেণীর সাহায্য নিয়ে আপন প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরাস্ত করে মজুরদের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়েছে,–এই ভারতীয় সামন্তরাও ভারতীয় জনতা-সৈন্যবাহিনী ও কৃষককুলের সঙ্গে কাজ শেষ হয়ে গেলেই বিশ্বাসঘাতকতা করবে। কিন্তু এরা জনসাধারণের মন থেকে তাদের আত্মবিশ্বাসকে। ছিনিয়ে নিতে পারবে না। বাইরের শত্রুর কাছ থেকে বাঁচাবার জন্যে বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারকে কাজে লাগাবেই। রেল-লাইন, টেলিগ্রাফের লাইন, কলকাতায় প্রস্তুত স্টিমার এখন আর ভারত থেকে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে না। মঙ্গল সিংহের আস্থা অবক্ষয়ী সামন্তনায়কদের ওপর ছিল না, ছিল পৃথিবীতে মানব-সমাজের পরিবর্তনকারী শক্তিশালী জনগণের ওপরেই।

 

৩.

১০ই মে (১৮৫৭ খৃঃ) মঙ্গল সিংহ মীরাটের কাছে ছিল, এই সময় সৈন্যেরা বিদ্রোহের ধ্বজা ওড়াল। বাহাদুর শাহের প্রতিনিধিদের নামে একটা বাহিনীকে সে নিজের অধীনে রাখবার সুযোগ পেল। মঙ্গল সিংহের যোগ্যতা সম্পর্কে কারও কোনো সংশয় ছিল না, কিন্তু তারা জানত যে তার উদ্দেশ্য অন্যান্য নেতৃবর্গ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক, তাই তাকে দিল্লীর দিকে না পাঠিয়ে, পূর্বদিকে পাঠিয়ে দিল। তারা কেউ ভাবতে পারেনি, মীরাটের পূর্ব এবং পশ্চিমের ঐ রাস্তা ভারতবর্ষের মুক্তিযুদ্ধের ভাগ্যে কোনো পৃথক ফল প্রসব করবে না। দিল্লীর দিকে ধাবিত সৈন্যদের মঙ্গল সিংহের মতো নেতার প্রয়োজন ছিল-যে দিল্লীর প্রতিষ্ঠাকে পূর্ণভাবে যুদ্ধজয়ের কাজে লাগাতে পারত। মঙ্গল সিংহের বাহিনীতে এক হাজার সৈন্য ছিল। তারা ভাবত আমরা সকলেই জেনারেল। এদের এই কথাটা বোঝাতেই মঙ্গল সিংহের এক সপ্তাহ লেগে গেল যে, শুধু জেনারেলের বাহিনী কখনও যুদ্ধে জিততে পারে না। সৈন্যবাহিনীতে মঙ্গল সিংহ ছাড়া উচ্চ সৈনিক-বিদ্যা সম্বন্ধে ওয়াকিফয়াল দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি ছিল না। আর এই একই অবস্থা সমগ্ৰ বিদ্রোহী বাহিনীতে। এক জায়গায় থেকে শিক্ষা দেবার সুযোগ মঙ্গল সিংহের ছিল না। তখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, অধিকতর এলাকায় ইংরেজ শাসনকে দ্রুত ধ্বংস করা।

গঙ্গা পার হয়ে রোহেলখণ্ডে প্রবেশ করেই মঙ্গল সিংহ প্রত্যেক রাতে সৈন্যদের কাছে রাজনৈতিক আদর্শের কথা প্রচার করত। সৈন্যদের বুঝতে বেশি সময় লাগত, তাদের মনে নানা রকম সন্দেহ জাগত, মঙ্গল সিংহ সেগুলো দূর করে দিত। এরপর মঙ্গল সিংহ ফ্রান্সেরদুটো বিপ্লবের ইতিহাস (১৭৯২ ও ১৮৪৮ খৃঃ) শোনাল, এও বলল যে, কি করে ওয়েলসের মজুরশ্রেণী ভারত-শাসক এই ইংরেজ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল, এবং অসীম কৃতিত্বের সঙ্গে লড়েছিল। সংখ্যাবলের সাহায্যে পুঁজিপতিরা তাদের দমন করতে পেরেছিল। কিন্তু তাদের অর্জিত অধিকারকে ছিনিয়ে নিতে পারেনি। এইসব শুনে যুদ্ধরত তার সৈন্যদের আচরণ সম্পূর্ণ বদলে গেল।

এদের প্রত্যেকেই স্বাধীনতা-যুদ্ধের সাধক হয়ে উঠল, তারা গ্রাম-শহরে গিয়ে কথায়। এবং ব্যবহারে লোকের মনে বিশ্বাস এবং সম্মানের উদ্রেক করতে লাগল। ইংরেজদের খাজনার প্রতিটি পয়সা ঠিকমতো ব্যয় করা-প্রয়োজন হলে লোকের কাছ থেকে খাজনা আদায় করা, কিন্তু স্থানীয় পঞ্চায়েত কায়েম করে তার কাছ থেকে এবং লোককে বুঝিয়ে তাদের ইচ্ছা এবং ক্ষমতা অনুসারে-এসব কাজ তারা মঙ্গল সিংহের নির্দেশ অনুযায়ী করেছিল। কোনো জিনিসই বিনামূল্যে না নেওয়া এবং প্রত্যেকটি জায়গায় হাজার হাজার লোকের মধ্যে মঙ্গল সিংহের বক্তৃতা এগুলো এমনই ব্যাপার ছিল যার প্রভাবে দলে দলে তরুণীরা স্বাধীনতার সৈন্যদলে ভর্তি হবার জন্য আসতে লাগল।

মঙ্গল সিংহ সৈনিকদের শিক্ষার ব্যাপারে শুধু প্যারেডই নয়—গুপ্তচর, রসদ-সংগ্ৰহ ইত্যাদি বিষয়েও শিক্ষা দিতে লাগল, হাকিম এবং বৈদ্যের এক বাহিনীও সে সঙ্গে রাখল। সামন্তশাহী লুটতরাজ এবং দুনীতির পঙ্ক পরিষ্কার করবার জন্য শিক্ষিতদের মধ্যে দেশভক্তি জাগানো প্রয়োজন ছিল আর এই সময়ে সেটা সহজ কাজ ছিল না। তবুও দুটো দিন মঙ্গল সিংহের সঙ্গে যে থেকে গেছে, সে তার দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে পারেনি। সিপাহীদের মধ্যে মঙ্গল সিংহের আচরণ দেখে কেউ বলতে পারত না যে সেই অধিনায়ক। শেষ পর্যন্ত তার সৈন্য সংখ্যা দু’হাজার অবধি পৌঁছেছিল। তার ইঙ্গিতে প্ৰাণ দেবার জন্য পল্টনের প্রত্যেকটি প্ৰাণ সদা প্রস্তুত থাকত। মঙ্গল সিংহ সব সময়েই সিপাহীদের সঙ্গে একত্রে আহার করত, তাদেরই মতো কম্বলে শয়ন করত, আর বিপদের সময় সকলের আগে রপিয়ে পড়ত। বন্দী ইংরেজ স্ত্রী-পুরুষকে সে যথেষ্ট আরামে রেখেছিল। তারাও সেনাপতির ভদ্র আচরণ দেখে বিস্মিত হত, কারণ ঐ সময়ে ইউরোপেও কয়েদীদের সঙ্গে এই ধরনের ভদ্র ব্যবহার করা হত না। মঙ্গল সিংহ রোহেল্যখণ্ডের চারিটি জেলায় গেল এবং সব জায়গাতেই সুশাসন প্ৰতিষ্ঠা করল।

নানাসাহেব ৫ই জুন (১৮৫৭ খৃঃ) ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করল এবং দেড় মাস যেতে না যেতেই ১৮ই জুলাই ইংরেজদের কাছে তাকে পরাজয় স্বীকার করতে হল। হাওয়া ঘুরে গিয়েছে এটা বুঝতে মঙ্গল সিংহের দেরী হল না, তবুও আজাদীর ঝােণ্ডাকে সে জীবিতাবস্থায় ভুলুষ্ঠিত হতে দিল না। ইংরেজদের সৈন্যরা অযোধ্যায় নিরস্ত্র জনসাধারণকে নির্বিচারে হত্যা করতে শুরু করল, স্ত্রীলোকের প্রাণ, মান ইজ্জৎ পায়ের তলায় গুড়িয়ে ফেলল, এ সব শুনেও মঙ্গল সিংহ এবং তার সৈন্যেরা কোনো বন্দী ইংরেজের দেহে হস্তক্ষেপ করল না।

বর্ষাকাল শেষ হতে না হতে সব জায়গাতেই বিদ্রোহীদের হাত থেকে অস্ত্ৰ খসে পড়ল কিন্তু রোহেলখণ্ড এবং পশ্চিম অযোধ্যায় মঙ্গল সিংহ অস্ত্র উঁচিয়ে রাখল। চারিদিক থেকে ইংরেজ, গুর্থ এবং শিখ সৈন্যেরা তার ওপর আক্রমণ চালিয়ে চলেছিল। মুক্তিসেনার সংখ্যা দিনে দিনে কমে যেতে লাগল। ভবিষ্যতের কথা ভেবে অনেককে বাড়ি পাঠিয়ে দিল মঙ্গল সিংহ, কিন্তু মীরাট থেকে আগত এক হাজার সৈন্যের মধ্যে কেউই তার সঙ্গ ছাড়তে রাজি হল না। অবশেষে মঙ্গল সিংহ এমন এক ব্যাপার দেখল যা তার কাছে মৃত্যুকেও আনন্দময় করে তুলল। উৎসগীকৃত প্ৰাণ, দেশব্রতী তার এই ছোট বাহিনীতে ব্ৰাহ্মণ, রাজপুত, জাঠ, গুর্জর, হিন্দু-মুসলমানের সকল ভেদাভেদ চলে যেতে লাগল। সকলে এক সঙ্গে রুটি বানাতে লাগল এবং এক সঙ্গে খেতে লাগল। এই ভাবে তারা ভারতবর্ষের এক জাতিত্ত্বের উদাহরণ স্থাপন করল।

বিন্দী সিংহ, দেবরাম সদাফল পাণ্ডে, রহিম খাঁ ও গুলাম হোসেন-মীরাটের এই পাঁচজন সিপাহী মঙ্গল সিংহের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত রয়ে গিয়েছিল। যখন গঙ্গার দুদিক থেকে তার নৌকা আক্রান্ত হল, তখন বন্দী ইংরেজ নর-নারীদের অনুরোধে ইংরেজ জেনারেল ক্ষমা ঘোষণা করে শর্ত দিল যে, মঙ্গল সিংহ আত্মসমৰ্পণ করুক, কিন্তু মঙ্গল সিংহ গুলি চালিয়ে ইংরেজদের শর্ত প্রত্যাখ্যান করল। অবশেষে ছটি মৃদতেহ নিয়ে গঙ্গার বুকে ভাসমান মঙ্গল সিংহের নৌকা ইংরেজদের হাতে বন্দী হল। ইংরেজেরা সেদিন ভারতীয় বীরত্বের প্রতি অভিবাদন জানাল।

 ১৯. সফদর (কাল : ১৯২২ খৃষ্টাব্দে)

ছোটো সুন্দর বাংলো। বিশাল প্রাঙ্গণের এক ধারে লাল এবং গোলাপী রঙের বড় বড়। ফুল ফুটেছে। একদিকে ব্যাডমিন্টন খেলার ছোট লন। লনের সযত্ন-লালিত সবুজ ঘাসগুলোর ওপর হেঁটে বেড়ানোও এক আনন্দের বস্তু। তৃতীয় দিকে এক লতামণ্ডপ এবং চতুর্থ দিকে বাংলোর পেছনে খোলা বারান্দা, সন্ধ্যার সময় সফদর প্রায়ই সেখানে বসতেন।

বাংলোর বাইরের দেয়ালের প্রাচীর বেয়ে সবুজ লতা উঠেছে। সফদর সাহেব অক্সফোর্ডে এমনি এক লতামণ্ডিত গৃহ দেখেছিলেন, নিজের বাংলোর প্রাঙ্গণে মনোরমভাবেই এগুলোকে লাগিয়েছেন।

এ ছাড়া তাঁর দুটো মোটর গ্যারেজও রয়েছে। সফদর জঙ্গ-এর সব কিছুতেই হুবহু ইংরেজি ঢঙ। আধা ডজন চাকর-বাকর তীর-ইংরেজ অফিসারের চাকরীদের মতোই তাদের সব আদব-কায়দা। কোমরে লালপট্টি, আঁটো করে বাঁধা পাগড়িতে নিজ সাহেবের নাম-চিত্র (মনোগ্রাম)। খাওয়ার ব্যাপারে বিলিতি খানাই ছিল সফদর সাহেবের সবচেয়ে প্রিয় এবং খানসামাও সে জন্য রাখা হয়েছিল তিনজন।

সফদর তো সাহেব ছিলেনই, সাকিনাকেও চাকর-বাকর মেমসাহেব বলে ডাকত। সাকিনা ধনুকের মতো বাঁকা ভ্রুর অতিরিক্ত লোমরাজি কামিয়ে ফেলে আরও সূক্ষ্ণ করে নিয়েছিলেন এবং কলপ দিয়ে সেই বঙ্কিম ভ্রূ হয়েছে আরও সুন্দর। পনের মিনিট অন্তর লিপস্টিকে ঠোঁট রাঙানো তাঁর অভ্যাস–তবে বিলিতি মেয়েদের পরিচ্ছদ কখনই পছন্দ করতেন না সাকিনা।

গত বছর স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে সফদর সাহেব বিলেত যান। তাঁর ইচ্ছা ছিল যে, সাকিনাও স্কার্ট-পেটিকেট। পরেন। সাকিনা কিন্তু এতে রাজী হননি। আর বিলেতের নর-নারীরা। সাকিনার সৌন্দর্যের সঙ্গে তাঁর বেশভুষারও যে রকম তারিফ করেছিল, তাকে সফদরের অম্লার কোনো আফসোশ ছিল না। স্বামী-স্ত্রী দুজনের গায়ের রঙই এত পরিষ্কার যে, ইউরোপে সবাই তাঁদের ইতালীয়ান মনে করত।

১৯২১-এর শীতকাল। উত্তর ভারতের সমস্ত শহরের মতো লক্ষ্ণৌতেও শীতকালটাই সবচেয়ে সুন্দর। সফদর সাহেব আজ কাছারী থেকে ফিরেই বাংলোর পিছনের বারান্দায় বেতের চেয়ারে এসে বসেছেন। তাঁর মুখমণ্ডল আজ অপেক্ষাকৃত গভীর। সামনের ছোট টেবিলের ওপর তাঁর নোটবুক এবং আরও দু-তিনখানা বই রয়েছে। পাশে তিনখানা খালি চেয়ার। সফদারের পরনে কড়া ইস্ত্রী করা প্রথম শ্রেণীর ইংরেজি সুট। তাঁর গোফদাড়ি-বিহীন। মুখের এই সময়কার চেহারা দেখলেই বোঝা যায় সাহেব আজ কোনো গরুগম্ভীর চিন্তায় মগ্ন। এই সময় চাকর-বাকরেরা খুব কমই আসত মনিবের সামনে। এমনিতে সফদর সাহেব মোটেই রাগী নন তবে চাকর-বাকরেরা ধরে রেখেছিল যে, এ রকম সময় সাহেব একলা থাকতেই ভালোবাসেন।

সন্ধ্যে হয়ে এসেছে কিন্তু সফদর ঐ একই আসনে বসে রয়েছেন। একজন চাকর টেবিল ল্যাম্প এনে রাখল সামনে। বাংলোর দিক থেকে কার যেন আসার শব্দ পেলেন। সফদর। চাকরকে জিজ্ঞেস করতে সে বলল, ‘মাস্টার শঙ্কর সিংহ ফিরে যাচ্ছেন।’

দৌড়ে গিয়ে মাস্টারজীকে ডেকে আনবার আদেশ দিলেন সফদর।

মাস্টার শঙ্কর সিংহের বয়স এই ত্রিশ-বত্রিশ, কিন্তু ইতিমধ্যেই বার্ধক্যের ছাপা পড়ে গেছে। তাঁর চেহারায়। তাঁর গলাবন্ধ কালো কোট, পায়জামা, মাথায় গোল ফেল্ট-টুপি, ঠোঁটের ওপর ঝুলে-পড়া ঘন কালো গোফে তারুণ্যের কোনো চিহ্নই নেই। যদিও তাঁর উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টিতে প্রতিভা ফুটে ওঠে।

মাস্টারজী পৌঁছাতেই সফদর উঠে তাঁর হাত ধরলেন এবং চেয়ারে বসিয়ে বললেন, ‘শঙ্কর, দেখা না করেই ফিরে যাচ্ছিলে?’

‘ক্ষমা কর ভাই সাহেব, ভেবেছিলাম তুমি কোনো কাজে ডুবে রয়েছ।‘

‘মোকদ্দমার দলিলপত্রে একেবারে ড়ুবে থাকলেও আমার কাছে তোমার জন্য দু’মিনিট সময় সর্বদাই থাকে, আর আজ তো কোনো দলিলপত্রও নেই!’

শঙ্কর সিংহের প্রতি সফন্দরের নিবিড় স্নেহ ছিল, অপর কাউকে তিনি তার চেয়ে বড় বন্ধু বলে মনে করতেন না। সৈয়দপুর স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে লক্ষ্মৌতে বি. এ. পাশ করা পর্যন্ত দুজনেই মেধাবী ছাত্র ছিলেন। পরীক্ষায় কখনও কেউ দু’চার নম্বর বেশী পেতেন, কখনও বা কম। কিন্তু যোগ্যতার এই প্রতিদ্বন্দিতার ফলে তাঁদের মধ্যে কখনও ঝগড়া বা মনোমালিন্য হয়নি। একটি ব্যাপারে দু’জনের বন্ধুত্বকে নিবিড় করে তুলতে। সাহায্য করেছিল-তাঁরা দু’জনেই ছিলেন গৌতম-রাজপুত বংশের সন্তান। একজনের পরিবার আজ হিন্দু আর অন্যজন মুসলমান কিন্তু দশ পুরুষ আগে এই দুটো পরিবার শুধু যে হিন্দু ছিল তাই নয়, উপরন্তু দুটো বংশই পূৰ্বজে গিয়ে মিলে যেত। বিশেষ বিশেষ কারণে সংঘটিত পরিবারিক মিলন-সভাগুলোতে এখনও দুই পরিবারের লোককে একত্রিত হতে দেখা যেত।

সফদর পিতার একমাত্র পুত্র। একজন ভাই-এর অভাব তাই খুবই অনুভব করতেন তিনি। আর সেই অভাব পূরণ করেছিলেন শঙ্কর, কিন্তু এ সব তো বাইরের ব্যাপার। এগুলো ছাড়াও শঙ্করের মধ্যে এমন গুণ ছিল, যার জন্য পাকা সাহেব সফদর সাদাসিধে শঙ্করের প্রতি এতটা স্নেহপরায়ণ এবং শ্রদ্ধাবান। শঙ্কর ছিলেন অত্যন্ত নম্র প্রকৃতির কিন্তু খোসামোদ করতে জানতেন না। ফলে, প্রথম শ্রেণীতে এম.এ.পাশ করেও আজও তিনি সরকারী স্কুলের। সামান্য শিক্ষকই। তিনি যদি সামান্য একটু ইঙ্গিত করতেন। তবে আপরে তাঁর জন্য সুপারিশ করতে পারত এবং তাতে তিনি কোনো হাইস্কুলের হেডমাস্টার হয়ে যেতেন। কিন্তু তাঁকে দেখে মনে হয়, সারাজীবন সহকারী শিক্ষক হয়েই তিনি থাকতে চান। হ্যাঁ একবার অবশ্য বন্ধুর সাহায্য নিয়ে-ছিলেন-লক্ষীের বাইরে যখন বদলী করা হয়েছিল তাঁকে। বিনয়ের সঙ্গে আত্মসম্মান বোধও শঙ্কর সিংহের মধ্যে ছিল প্রবল, যাক অত্যন্ত সম্ভ্রম করে চলতেন। সফদর সাহেব। তাদের বারো বছর বয়সের বন্ধুত্ব আজ বিশ বছর পরেও ঠিক তেমনি আছে।

এ-কথা সে কথা করে দুটো চারটি কথাবার্তার পরই সোনালী ধান-রঙের শাড়ি এবং লাল ব্লাউজ পরিহিতা সাকিনা এসে হাজির হলেন।

শঙ্কর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, নমস্কার বৌদি!

মৃদু হেসে নমস্কার’ বলে জবাব দিলেন বৌদি। ধনী ‘স্যার’-এর গ্রাজুয়েট দুহিতা সাকিনা কোনো দিনই পর্দার আড়ালে থাকেননি, কাজেই শঙ্কর সিংহের সামনে আসা বা না-আসার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু সফন্দরের সঙ্গে শঙ্করকে নিঃসঙ্কোচে, কথাবার্তা বলতে। দেখলেই বিয়ের পর প্রথম মাস ছয়েক পর্যন্ত ত্ৰু কুঁচকে থাকত সাকিনার। পরিশেষে সফদরের কাছে তাঁকে স্বীকার করতে হয়েছে যে, শঙ্কর বাস্তবিকই স্নেহ-সম্মানের পাত্র। বর্তমানে তো শঙ্করের সঙ্গে সাকিনার খাঁটি দেওর-বৌদির সম্পর্ক। সাকিনা নিজেকে স্বেচ্ছায়ই সন্তানহীন করে রেখেছিলেন, কিন্তু মাঝে-মাঝে তিনি শঙ্করের শিশুপুত্রকে কাছে এনে রাখতেন।

এ দিকে গত ছ’বছর থেকে শঙ্কর বুঝতে পারছিলেন যে তাঁর ওপর ভগবান শঙ্করের কৃপা অসীম। তাঁর ঘরে দু’বছরের কম বয়সের কোনো না কোনো শিশু সব সময়েই রয়ে। যাচ্ছে বিগত ছ’বছরে।

গত এক সপ্তাহ ধরে সফদরের অস্বাভাবিক গভীৰ্য সাকিনাকে চিন্তিত করে তুলেছিল। আজকে শঙ্করকে দেখে বড়ই খুশী হলেন। কেননা তিনি জানতেন যে, সাহেবের মনের ভার লাঘব করতে একমাত্র শঙ্করের সাহায্য প্রয়োজকন, তাঁর দিকে তাকিয়ে সাকিনা বললেন, ‘ঠাকুরপো, তোমার তাড়া নেই তো? বৌদির হাতের চকোলেট পুডিং কেমন লাগবে?’

সফদর, ‘এ আজ জিজ্ঞেস করবার দরকার কি?’

সাকিনা, ‘আমি জেনে নিতে চাই ঠাকুরপো কখন যাবেন। তাঁর চলে যাবার তো কোনো ঠিক নেই!’

শঙ্কর, ‘এমন কথা বল না বৌদি! কখনো তোমার হুকুম অমান্য করেছি?’

সাকিনা, ‘কিন্তু হুকুম শোনার আগে সরে পড়া সেও তো এক অপরাধ।’

শঙ্কর, ‘আচ্ছা তাহলে খাবার এবং পুডিং খেয়ে যেতে হবে তোমাকে।’

তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলেন সাকিনা। সফদর এবং শঙ্করের বাক্যালাপও ক্রমশ গুরুতর–বিষয়ে প্রবেশ করল। সফদর বললেন, ‘সম্পূর্ণ নতুন এক বৈপ্লবিক যুগে আমরা প্রবেশ করেছি। শঙ্কর। আমার মতে ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দের পর এই প্রথম সমগ্ৰ ভারতভূমির ভিতসুদ্ধ টলমল করে উঠেছে।’

‘সাম্প্রতিক রাজনৈতিক আন্দোলনের কথা বলতে চাইছ?’

’রাজনৈতিক আন্দোলন কথাটা অত্যন্ত সাধারণ, শঙ্কর। ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দে কংগ্রেস যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন সেটা ইংরেজ আই-সি-এস সাহেবদের অবসর বিনোদনের প্রতিষ্ঠান ছিল, তখনও কংগ্রেসের বড়দিন-উৎসবের বক্তৃতা এবং সুরাপানকে ‘আন্দোলন’ আখ্যাই দেওয়া হত। তুমিও যদি তাকে আন্দোলন বলতে চাও তো আমি বলব, আন্দোলনের যুগ থেকে আমরা এখন বিপ্লবের যুগে প্রবিষ্ট হয়েছি।’

‘যেহেতু গান্ধীজি তিলক-স্বরাজ ফাণ্ডের জন্য এক কোটি টাকা তুলেছেন এবং ২ স্বরাজের দাবী নিয়ে খুব হৈ-চৈ শুরু করেছেন-এই জন্যে?’

‘কোনো এক বিশেষ ব্যক্তি বিপ্লব অথবা বিপ্লবী আন্দোলনের আধার হতে পারে না শঙ্কর। যে বিরাট পরিবর্তন বিপ্লব বয়ে আনে, তাও এক-আধা ডজন মহাপুরুষের সামর্থের বাইরে। আজকের এই আন্দোলনের মূল কারণ যখন আমি বিশ্লেষণ করি, তখন এই সিদ্ধান্তেই আমাকে পৌঁছাতে হয়। তুমি তো জানো শঙ্কর, ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দের স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতা ছিল পদচ্যুত সামনবতপ্রভুরা, কিন্তু সে যুদ্ধ চলেছিল সাধারণ লোকেরই প্রাণের বিনিময়ে। আমাদের দুর্বলতার জন্য আমরা সফল হতে পারিনি সে যুদ্ধে, পরাজিতদের ওপর কঠোর প্রতিশোধ নিল ইংরেজরা। সে যাক, আমি বলতে চাই যে, ১৮৫৭ সালের পরে এই প্রথম দেশের সমগ্র জনসাধারণকে স্বাধীনতার যুদ্ধে একতাবদ্ধ করা হয়েছে। ভারতীয় ইতিহাসের একজন কৃতী ছাত্র হয়ে তুমিই বল, এমন আর একটিও আন্দোলনের কথা কি তোমার জানা আছে, যাতে জনগণ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে?’

‘ভাই সফদর, নাগপুর কংগ্রেস (১৯২০ খৃঃ) এবং কলকাতা কংগ্রেস শেষ হয়ে গেছে। গ্রামে গ্রামে যে উত্তেজনার কথা তুমি বলছি, তা আমিও নিজের চোখেই দেখেছি এবং তাকে অভূতপূর্ব বলেই স্বীকার করি। কিন্তু প্ৰচণ্ড এই ঝড়ের পর, এই লক্ষ্মৌতেই বহুবার বিদেশী কাপড়ের স্তুপ পোড়ানোর পরও যা তোমার মনে বিশেষ কোনো রেখাপাত করেনি। সেই ব্যাপারেই আজ তুমি এমনভাবে কথা বলছি যেন এক আসন্ন বিপ্লবের সঙ্গে তুমি ভীষণভাবে জড়িত।’

‘তোমার কথা ঠিকই শঙ্কর। সত্যিই এই বিপ্লবের ঢেউ যেন দেহ থেকে আমার পাদুটোকে ভেঙে ফেলতে চাইছে। কিন্তু এই বিপ্লব-তরঙ্গকে ছোট রকমের এক স্থানীয় ঘটনা বলে আমি মনে করি না। বরং এ এক বিরাট গণ অত্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত হয়েই উঠেছে। সমস্ত যুগেই সবচেয়ে বড় বিপ্লবী শক্তি জনগণকে আশ্রয় করেই প্রকট হয়ে ওঠে।’

‘১৮৫৭ খৃষ্টাব্দ থেকে আরম্ভ করলে ভাই, মস্ত বড় জল ছড়িয়ে বসছ যে!’

‘ও কথা কেন, আমার বক্তব্য শুনবে কি শঙ্কর?’

‘ব’ল, আমি শুনিব। বৌদি পুডিং তৈরি করছেন, আর কোল রবিবার। শুধু কেউ গিয়ে বাড়িতে খবর দিয়ে এলেই হল যে, শঙ্কর এই লক্ষ্মৌতে বেঁচেই আছে এবং তার বৌদির হাতের পুডিং খেয়ে নাক ডাকাচ্ছে। ব্যসূ তারপর সারারাত ধরে নিশ্চিন্ত হয়ে তোমার কথা। শুনতে পারব আমি।’

‘শঙ্কর শুধু আমিই নই, ভারতের বাইরে সমস্ত জায়গায় রাজনীতির ছাত্ররা স্বীকার করে যে গত শতাব্দী এবং বর্তমান শতাব্দীতে ইংলণ্ডের রাজনীতিতে সকল পরিবর্তনই আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত, এবং নিয়ন্ত্রিত হয়েছে পৃথিবীর অপরাপর রাজশক্তির গতিবিধি দ্বারা। আর এই সব পরিস্থিতির কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এর-মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক কারণ। ১৮৫৭-র ঢেউ চলে যাবার পর আমাদের দেশ ঘুমিয়ে পড়েছিল একেবারে। অর্থাৎ আমাদের গতি তখন এত শ্লথ যে, তাকে ঐ ঘুমিয়ে-পড়া আখ্যাই দিতে হয়, কিন্তু অন্যান্য দেশে বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়ে গেল। এক হাজার বছর আগে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের সময় থেকে খণ্ড-বিখণ্ডিত ইটালী ১৮৬০ খৃষ্টাব্দে (২রা এপ্রিল) একটি যুক্তরাষ্ট্রে পরিণত হল, এবং ম্যাজিনী গ্যারিবাড়ীর মতো মহান আদর্শ আমাদের উপহার দিল। রোমান সাম্রাজ্যকে বিধ্বস্ত করতে সমর্থ হলেও যে জার্মান জাতি নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি, ১৮৬৬ খৃষ্টাব্দে তারা আংশিকভাবে এবং ফ্রান্স বিজয়ের পর ১৮৭০-এ (১৮ই জানুয়ারি) প্রায় সম্পূর্ণভাবে গ্রুশিয়ার নেতৃত্বে একটি যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ১৮৬৬ খৃষ্টাব্দের এই সব পরিবর্তন পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরাট পরিবর্তন। এরপর, ফ্রান্সের বিশাল শক্তিকে ১৮৭০ খৃষ্টাব্দে পরাস্ত করে প্যারিস এবং ভার্সাই-এর ওপরেও জার্মানী তার ধ্বজা ওড়াতে পেরেছিল, যার ফলে ইংলণ্ড এবং রাশিয়া। ভীত হয়ে বার্লিনের ওপর লক্ষ্য রাখতে লাগল। এটা তো হল বৈদেশিক শক্তিতে ভীতির ব্যাপার। কিন্তু এর চেয়েও বড় ভয় তাদের হল প্যারীর শ্রমিক রাজ্য প্যারী—কমুনকে দেখে-দোসরা এপ্রিল থেকে যে দেড় মাসের কিছু বেশি টিকে ছিল এবং প্রমাণ করে দিয়েছিল, শুধু জমিদার পুঁজিপতিরাই নয়, শ্রমিকরাও রাজ্যশাসন করতে সক্ষম।’

‘তুমি কি মনে কর ভারতের রাজনৈতিক ঘটনাবলীও এ সবের সঙ্গে জড়িত?’

‘রাজনৈতিক ঘটনাই শুধু নয়, আমাদের ইংরেজ শাসকবৃন্দের ভারত-সম্পর্কিত নীতি নির্ধারণেও এর প্রভাব বিদ্যমান। ইউরোপে জার্মানীর মতো এক দুর্জয় শক্তির উদ্ভব হতেই ফ্রান্স আর ইংলন্ডের প্রতিদ্বন্দ্ব রইল না। কারণ জার্মানী থেকেই এখন তার যত বিপদের আশঙ্কা। মৃত প্যারী-কমুন এবং ১৮৭২ খৃষ্টাব্দে অষ্ট্রিয়া বাদে জার্মানীর সকল রাষ্ট্রের মিলিত এক জীবন্ত যুক্তরাষ্ট্র আমাদের রাজতান্ত্রিক শাসকবৃন্দের চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল—এ! কথা আর বলার দরকার হয় না। একই সঙ্গে এই সময় আরও পরিবর্তন ঘটল। ১৮৭০ খৃষ্টাব্দে ইংলণ্ড সামান্য ব্যবসায়ী থেকে পুঁজিপতিতে রূপান্তরিত হল। কাঁচামাল কেনা থেকে আরম্ভ করে উৎপাদিত পণ্য বাজারে ছাড়া পর্যন্ত সকল পর্যয়েই মুনাফা-শিকারের একচেটিয়া ব্যবস্থা পাকা হয়ে গেল। ব্যবসাতে শুধু কারিগরদের কাছ থেকে মাল খরিদ করে এদিক-সেদিকে বেচে লাভ হয়। কিন্তু পুঁজিবাদে প্রতিটি পদক্ষেপেই লাভ। তুলা কিনতে গিয়ে লাভ, পরিষ্কার করিয়ে বস্তা-বন্দী করাতে লাভ, রেলে এবং জাহাজে চাপিয়ে নিয়ে যেতে পারলে লাভ, ম্যানূচেস্টারের মিলে সুতো-কাটা এবং কাপড় বোনায় লাভ, আবার তৈরি কাপড় জাহাজে করে ফিরিয়ে আনতে, জাহাজ কোম্পানী থেকে লাভ, রেলের লাভ—এই সমগ্র মুনাফার তুলনা করে কারিগরের হাতে বোনা মাল বিক্রি করা ব্যবসায়ীদের। লাভের সঙ্গে!’

‘হ্যাঁ ব্যবসা থেকে পুঁজিবাদে লাভ তো নিশ্চয়ই বেশি।’

‘১৮৭১ খৃষ্টাব্দে যখন ভার্সাইতে বিজয়ী জার্মানী গ্রুশিয়ার রাজা প্রথম ইউলিয়ামকে সমগ্র জার্মানীর কাইজার (সম্রাট) বলে ঘোষণা করল, তার পরের বছর (১৮৭২) ফোঁপে ওঠা ইংরেজ পুঁজিপতিরা টোরি প্রধানমন্ত্রী ডিস্‌রেইলীর মারফৎ সাম্রাজ্যবাদ ঘোষণা করল। এই ঘোষণা শুধু নতুন শব্দ নয়–খুবই সুচতুর তার লক্ষ্য এবং অভিসন্ধি। কল কারখানাও এত বেড়ে উঠেছিল যে, তার জন্য সুরক্ষিত বাজারের প্রয়োজন ছিল। এমন বাজার, যেখানে জার্মানী এবং ফ্রান্সের তৈরি মালের সঙ্গে প্রতিযোগিতার ভয় নেই। অর্থাৎ যে-সব বাজারের ইজারাদারী সম্পূর্ণ নিজের হাতের মুঠোয় থাকবে। এরই সঙ্গে সঙ্গে পুঁজি ও এতটা ফোঁপে উঠেছিল যে, তাকে মুনাফা-মৃগয়ায় খাটাবার জন্যও প্রয়োজন হল সংরক্ষিত স্থানের। আর এই সব কার্যসিদ্ধি অপর দেশকে সম্পূর্ণরূপে নিজের হাতের মুঠোয় আনতে পারলেই হতে পারে। ডিস্‌রেইলীর অভিধানে এই সবই ছিল সাম্রাজ্যবাদ শব্দের অর্থ। ভারতবর্ষে এই দুই বিষয়েই সুবিধা ছিল, আর ইউরোপ থেকে ভারতে আসবার সবচেয়ে সস্তা এবং সহজ পথ ছিল সুয়েজ খাল-১৮৬৯ খৃষ্টাব্দে যার খননকার্য শেষ হয়েছিল। ১৮৭৫ খৃষ্টাব্দে মিশরের কাছ থেকে ১,৭৭,০০০ শেয়ার চল্লিশ লক্ষ পাউণ্ড দিয়ে টেলিগ্রামে কিনে নিল ডিসরোইলী সাম্রাজ্য-বিস্তারে এটা হল তার দ্বিতীয় পদক্ষেপ। তারপর ১৮৭৭–এর ১লা জানুয়ারি দিল্লীতে দরবার বসিয়ে রাণী ভিক্টোরিয়াকে সম্রাজ্ঞী রূপে ঘোষণা করে ডিস্‌রেইলী সাম্রাজ্যবাদকে এত দূর এগিয়ে নিয়ে গেল যে, উদারনৈতিক দলের গ্র্যাডক্টোন প্রধানমন্ত্রী হয়েও ডিস্‌রেইলীর নীতি পরিবর্তন করতে সমর্থ হল না।’

‘আমরা এখনও ছাত্রদের পড়াই যে, মহারাণী ভিক্টেরিয়া ভারতসম্রাজী-কাইজার-ই–হিন্দ উপাধি ধারণ করে ভারতবর্ষকেই ধন্য করেছেন।’

‘ছ’বছর আগে প্রশিয়ার রাজাও এই কাইজার উপাধি ধারণ করেছিল। রোমান সম্রাজ্যের পতনের সময় থেকে পরিত্যক্ত শব্দের মূল্য হঠাৎ কেমন বেড়ে উঠল!’

‘রোমান শব্দ ‘কাইজার’কে শুধু ভারতবর্ষেই ব্যবহার করা আর ইংরেজিতে তার জায়গায় ‘এমূপ্রেসূ ব্যবহার করা-এর ভেতর আবার রহস্য নেই তো কোনো?’

‘থাকতে পারে! যাইহোক, ১৮৭১ খৃষ্টাব্দে আমরা সাম্রাজ্যবাদী যুগে প্রবিষ্ট হয়েছি। প্রথমে এল ইংলণ্ড। পরাজিত প্রজাতান্ত্রিক ফ্রান্স নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে ১৮৮১ খৃষ্টাব্দে তুসিনের (আফ্রিকা) ওপর অধিকার কায়েম করে সাম্রাজ্যবাদের পথ ধরল। আর নতুন ফ্যাক্টরী এবং পুঁজিপতিদের দ্বারা সমৃদ্ধ জার্মানীও ১৮৮৪ খৃষ্টাব্দে উপনিবেশের দাবী উত্থাপন করে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় তৎপর হল।’

‘কিন্তু ভারতে ইংরেজের নীতি পরিবর্তনের সঙ্গে এগুলোর কি সম্বন্ধ?’

‘নিত্য-নতুন আবিষ্কৃত যন্ত্র, ক্রমবর্ধমান কল-কারখানা এবং সেগুলি থেকে উৎপাদিত পুঁজির জন্য মৃগয়াক্ষেত্রের ব্যবস্থা একটা করতেই হবে। ১৮৭৪-৮০ খৃষ্টাব্দের ভিতর ডিস্‌রেইলী মন্ত্রীসভা সেটা সম্পাদন করে ফেলল। ১৮৮০-৯০ খৃষ্টাব্দের উদারনৈতিক গ্লাডক্টোন সরকারও ডিস্‌রেইলীর পথ থেকে পশ্চাদপসরণ করতে সমর্থ হল না। পুঁজির নগ্ন সাম্রাজ্যবাদী দানবতাকে কিছুটা ভদ্রবেশ পরাবার প্রয়োজন ছিল, যাতে জনসাধারণ সতর্ক হয়ে উঠতে না পারে। এই জন্যই ডিস্‌রেইলী ‘ভারত সম্রাজ্ঞীর অভিনয়ের অবতারণা। করেছিল। এরপর প্রয়োজন হল। উদারনৈতিকদের আরও কিছুটা উদারতা দেখানো। এই উদারতা নেমে এল আয়ার্ল্যাণ্ডের ‘হোম রুল’ রূপে। কিন্তু আয়ল্যাণ্ডের প্রশ্ন আজও অমীমাংসিত। ভারতীয়রা ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দে নিজেদের কংগ্রেসকে দীড় করাল। কংগ্রেস বস্তুত ব্রিটিশ উদারনৈতিক দলের ধর্মপুত্র রূপেই জন্মলাভ করল এবং এক যুগ পর্যন্ত আপন ধর্ম পুত্রকে ব্রিটিশরা সস্নেহে রক্ষা করল। কিন্তু ১৮৯৫ থেকে ১৯০৫ পর্যন্ত ব্রিটেনে পুনরায় টোরি সরকার প্রতিষ্ঠিত হল, তারা এলগিন এবং কার্জনের মতো সুযোগ্য সন্তান ভারতবর্ষে পাঠাল সাম্রাজ্যবাদের ভিত সুদৃঢ় করতে। কিন্তু ফল হল উল্টো।’

‘তুমি কি লাল লাজপৎ রায়, বাল গঙ্গাধর তিলক আর বিপিনচন্দ্ৰ পাল—এঁদের কথাই বলতে চাইছ?’

‘এই লাল, বাল, পাল-এঁরা ছিলেন বহির্বিশ্বের ঘটনাবলীর প্রতীক। রাশিয়াকে পরাভূত করে (ফেব্রুয়ারি, ১৯০৪) জাপান নিজেকে বৃহৎ শক্তিসমূহের পর্যায়ভুক্ত করে। ফলে কংগ্রেসের অস্পষ্ট বক্তৃতার জড়তা ভেদ করে ভারতীয় যুবকদের সামনে এগিয়ে যাবার প্রেরণা জোগায়। অর্ধশতাব্দী পর ভারতীয়গণ নিজেদের জন্য মরতে শিখল, এ বিষয়ে। আয়ার্ল্যাণ্ড এবং রাশিয়ার শহীদদের উদাহরণেও অনুপ্রাণিত হলাম আমরা। কাজেই বর্তমান ঘটনাবলীর কারণগুলির অনুসন্ধান শুধু ভারতবর্ষের ভেতর থেকে করতে গেলে ভুল হবে না কি?’

‘নিশ্চয়ই, দুনিয়ার সকল জায়গাই যে পরস্পর সম্বন্ধ যুক্ত।’

‘কোনো বিপ্লবী আন্দোলনের শক্তি নির্ভর করে দুটো বিষয়ের ওপর। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি তথা আন্তর্জাতিক দৃষ্টান্তসমূহ থেকে কতটা প্রেরণা লাভ করল এবং সে দেশের সবচেয়ে সংগ্রামী শ্রেণী কতটা পরিমাণে অংশগ্রহণ করল। প্রথম উৎসের উদাহরণ আমি দিয়েছি। দ্বিতীয় উৎস হল, মজুর-কৃষক জনগণ। বিপ্লবী-যুদ্ধ সেই চালাতে পারে-হারাবার মতো যাদের কিছু নেই। সাকিনার অধীর-সুধা, এই বাংলো এবং গাঁয়ে পৈতৃক জমিদারী হারাবার ভয় যাদের আছে বিপ্লবের সৈনিক সে হতে পারে না। এই জন্যই বলছিলাম যে, সর্বহারা জনতাই শুধু বিপ্লবের বাহন হতে পারে।’

‘এ বিষয়ে আমি তোমার সঙ্গে একমত।’

‘তাহলে জনতার অন্তরে যে উত্তেজনা আজ রয়েছে তাকে উপলব্ধি কর, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি থেকে কতটা প্রেরণা পাওয়া যাচ্ছে সে সম্বন্ধেও চিন্তা করে দেখ। গত মহাযুদ্ধ গোটা পৃথিবীতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে গেছে! সে যুদ্ধ ছিল সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধপুঁজি এবং উৎপাদিত পণ্যের সুরক্ষিত বাজার দখলে রাখবার বা বলপূর্বক অধিকার করতে যাবার পরিণাম। জার্মানীর ক্রমবর্ধমান উৎপাদনের সুরক্ষিত বাজারের জন্যে নতুন উপনিবেশ প্রয়োজন ছিল, কিন্তু পৃথিবী বণ্টন করা হয়েছিল আগে থাকতেই। তাই যুদ্ধ করেই উপনিবেশ ছিনিয়ে নেবার প্রয়োজন হল, আর উপনিবেশগুলির মালিক ইংল্যাণ্ড এবং ফ্রান্সের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধিল জার্মানীর। যুদ্ধে জার্মানী হেরে গেল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সাম্রাজ্যবাদের স্বপ্ন চুরমার করে দেবার জন্য অপর এক শত্রু জন্মলাভ করল-যার নাম সাম্যবাদ। সাম্যবাদের শাসনাধীনে উৎপাদন মুনাফাশিকারের যন্ত্র নয়, পরন্তু মানব সমাজকে সুখী এবং সমৃদ্ধ করে তোেলবার উপাদান। যন্ত্রের ক্রমোন্নতি সাধিত হয়, কলকারখানা প্রসার লাভ করে, পণ্য উৎপাদন বেড়ে যায় এবং তার জন্য প্রয়োজন হয় অতিরিক্ত বাজারের। আবার ঐ সব পণ্য ক্রয় করার জন্য অর্থেরও প্রয়োজন হয় যার জন্য ক্রেতার পুরো মজুরী লাভের সুযোগ থাকা উচিত। ক্রেতার আর্থিক সঙ্গতি যত কম থাকবে, পণ্যও সেই পরিমাণে অবিক্রীত পড়ে থাকবে বাজারে বা গুদামে। পণ্য উৎপাদন কমিয়ে দিলে কারখানা বহুলাংশে বন্ধ হয়ে যাবেই, মজুরেরা বেকার হয়ে পড়বে, মাল খরিদ করবার মতো পয়সাও তাদের হাতে থাকবে না। লোকে তখন মাল খরিদ করবে কি করে, কি করে কারখানাই বা চালু থাকবে। সাম্যবাদ বলে, মুনাফার বাসনা ত্যাগ কর। নিজ রাষ্ট্র বা সমগ্র পৃথিবীকে একক পরিবার বিবেচনা করে তার জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদন কর, প্ৰত্যেকের কাছ থেকে তার সামর্থ্যানুযায়ী শ্ৰম আদায় কর, প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার জীবন ধারণের উপযোগী আবশ্যকীয় সামগ্ৰী দাও। অবশ্য যতক্ষণ পর্যন্ত সকলের প্রয়োজন মেটাবার মতো কল-কারখানা এবং কারিগর সৃষ্টি না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত শ্রমের পরিমাণ অনুযায়ী পারিশ্রমিক দাও। আর এই ব্যবস্থা একমাত্র তখনই সম্ভব যখন ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে কিছু থাকবে. না, কারখানা এবং সমগ্র উৎপাদন যন্ত্রের ওপর থেকেই ব্যক্তির একচেটিয়া অধিকার বিলুপ্ত হয়ে যাবে।’

‘এ রকম কল্পনা সত্যই সুন্দর।’

‘এখন এ শুধু কল্পনা নয় শঙ্কর, পৃথিবীর এক ষষ্ঠাংশ। রাশিয়ায় ১৯১৭ খৃষ্টাব্দে ৭ই নভেম্বর সাম্যবাদী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। পুঁজিবাদী দুনিয়া অবশ্য আজও মানবতার এই একমাত্র আশা-ভরসার স্থলকে নির্মূল করতে চাইছে কিন্তু সোভিয়েত সরকার প্রথম অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গেছে, অবশ্য হাঙ্গেরীতে মাত্র। ছ’মাস পরে (মার্চ-আগষ্ট, ১৯১৮) ফ্রান্স এবং আমেরিকার পুঁজিপতিগণের সাহায্যে এই সোভিয়েত শাসনকে নিশ্চিহ্ন করে। ফেলা হয়েছিল। সোভিয়েত রাশিয়ায় মজুর-কৃষক রাজের অস্তিত্ব সমগ্র দুনিয়ার সামনে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্বরূপ, আর এই সোভিয়েত শাসন কায়েম করেছে যে বিরাট শক্তি তা সমস্ত দেশেই কাজ করে চলেছে। যুদ্ধ থেমে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই ইংরেজরা রাউলাটবিল পাশ করবার জন্য এত তাড়াহুড়া করেছিল। কেন?–এই বিশ্ববিপ্লবী শক্তিকে দমন করার জন্য। যদি ঐ বিপ্লবী শক্তি পৃথিবীকে রূপান্তরিত করবার জন্য দেশে তার বীজ বপন না করত, তাহলে ইংরেজরা রাউলাট বিল পাশ করত না আর গান্ধীও তার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতেন। না। সেই সঙ্গে ১৮৫৭-র পর থেকে চাপা পড়ে থাকা আগুন সারা দেশে জ্বলে উঠত না। এই জন্যই আমি বলছি, আমরা এক বিপ্লবী যুগে এসে পড়েছি।’

‘তাহলে তোমার মতো গান্ধী বিপ্লবী—নেতা? কিন্তু যে গান্ধী গোখেলের মতো উদারনৈতিক নেতাকে নিজের গুরু বলে মনে করেন, তিনি কি করে বিপ্লবী নেতা হতে পারেন সফফু ভাই?’

‘গান্ধীর আদর্শ এবং সমস্ত কাজকে আমি বিপ্লবধর্ম মনে করি না, শঙ্কর। বিপ্লবী শক্তির ভিত্তি সাধারণ মানুষকে তিনি যে সংগ্রামে আহবান করেছেন। আমি শুধু তাঁর সেই কাজটুকুকেই বিপ্লবধর্ম বলে মনে করি। তাঁর ধর্মের দোহাই-বিশেষ করে খিলাফৎ আন্দোলন সম্পর্কে তাঁর মনোভাবকে আমি বরং সরাসরি বিপ্লব-বিরোধী চাল বলেই মনে করি। কল-কারখানার যুগ ছেড়ে তাঁর অতীতে ফিরে যাবার প্রচেষ্টাকে আমি প্রতিবিপ্লবী বিচ্যুতি মনে করি। আর তাঁর স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেবার সিদ্ধান্তকেও আমি ঐ একই পর্যায়ে ফেলি।’

‘তোমার মঙ্গল হোক সফফু ভাই। তুমি যখন গান্ধীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছিলে আমার তো শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছিল তখন। আমি ভাবছিলাম, তুমিও আবার স্কুলকলেজগুলোকে শয়তানের আখড়া বলে বসবে!’

‘শিক্ষা-প্ৰণালী দোষযুক্ত হতে পারে শঙ্কর, কিন্তু আজকের স্কুল-কলেজে বসে বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচয় ঘটে আমাদের। বিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে আজ মানুষ বাঁচতে পারে না। আমাদের স্বাধীনতা যখনই আসুক না কেন, বিজ্ঞানের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে যাবেই। মানুষের ক্রমবর্ধমান ভবিষ্যৎ-সমৃদ্ধি বিজ্ঞানের ওপরই নির্ভরশীল-তাই বিজ্ঞানকে ছেড়ে অতীতের পথে পা বাড়ানো আত্মহত্যারই সামিল। স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দিয়ে চরকাতাঁতের স্কুল প্রতিষ্ঠা করার অর্থ দেশকে সম্পূর্ণ রূপে অন্ধকার যুগে নিয়ে যাবার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে বিপ্লবী সেনাদলে ভর্তি হওয়ার জন্য ছাত্রদের আহ্বান করা মোটেই অন্যায় নয়-এটা অন্তত তুমি স্বীকার করবে। শঙ্কর।’

‘নিশ্চয়। আর অন্যান্য বয়কটগুলোর বিষয়ে কি বল তুমি?’

‘আদালত বয়কট? সেটা কিন্তু ঠিকই। তার সাহায্যে আমরা বিদেশী আমাদের ক্ষমতার পরিধি এবং তীব্ৰ অসন্তোষের কথা জানাতে পারি। আর বিলিতি জিনিস বর্জন করা তো বিলিতি ব্যবসায়ীদের গালে এক প্রচণ্ড থাপ্পড় মারার সামিল। তাছাড়া এতে আমাদের স্বদেশী শিল্প প্রসারের প্রেরণাও মিলবে।’

‘আমি দেখতে পাচ্ছি ভাই সফফু বহু দূর পর্যন্ত এগিয়ে গেছ তুমি।’

‘এখনও যাইনি। কিন্তু আমি যেতে চাই।’

‘যেতে চাও?’

‘তুমি আগে বল আমরা এক বিপ্লবী যুগের ভিতর দিয়ে চলেছি কিনা?’

‘তোমাকে আমিই তো কতবার এ প্রশ্ন করেছি সফফু ভাই। রুশ-বিপ্লবের কথা শুনেই আমি খুঁজে-খুঁজে সাম্যবাদী-সাহিত্য পড়তে লাগলাম এবং নিজেদের সমস্যাগুলো সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে বিচার করতে শুরু করলাম। এতদিন পর্যন্ত আমি শুধু এই সন্দেহের মধ্যে ছিলাম যে, গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন এই মহানু উদ্দেশ্যের পরিপূরক কিনা। কিন্তু তুমি যখন বিপ্লবী জনতার দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে, অমনি আমার সন্দেহ দূর হয়ে গেল। গান্ধীকে আমি বিপ্লবের যোগ্য নায়ক বলে মনে করি না সফফু ভাই-তোমার কাছে খোলাখুলিই বলছি। কিন্তু জনতার শক্তির ওপরে আমি বিশ্বাস রাখি। ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দে। ; পদচ্যুত সামন্তগণ চর্বি, কার্তুজ আর ধর্ম বিপদগ্ৰস্ত-এই ধুয়া তুলে জনতার এক শক্তিশালী অংশকে দলে টেনে ছিল, কিন্তু আজ রুটির দাবীতেই সমগ্ৰ জনতা আন্দোলনের মাঝে এসে পড়েছে। আমার মনে হয় গণমনে উত্তেজনার এই কারণ যথার্থ, বিপ্লবের ধ্বনিটা খাঁটিইএবং গান্ধী যদি নিজের আসল ভূমিকায় অবতীর্ণ হন তবুও বিপ্লবের গতি ফেরাতে সক্ষম হবেন না। তিনি!’

‘আমি ঠিক করছি যে বিপ্লবী সেনাদলে ভর্তি হব, হব অসহযোগী।’

‘এত তাড়াতাড়ি!’।

‘তাড়াতাড়ি করলে তো অনেক আগেই লড়াইয়ের ময়দানে নেমে পড়তাম। অনেক বিচার-বিবেচনার পর আজ তোমার সঙ্গে আলোচনা করে আমি আমার সিদ্ধান্তের কথা প্রকাশ করেছি।’

সফদর যখন গম্ভীর স্বরে এই কথাগুলো বলছিলেন, শঙ্করের দৃষ্টি তখন কিছুটা দূরে সরে গিয়েছিল। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে সফদর আবার বললেন, ‘তুমি হয়ত ভাবছ, তোমার বৌদির অধর-রাগের কথা, তার রেশমী শাড়ির মখমলের পাড়টির কথা, অথবা এই বাংলা এবং তার খানসামাদের কথা! সাকিনার ওপর অবশ্য কোনো সিদ্ধান্ত জোর করে চাপিয়ে দেব না, তার ইচ্ছামতো সে জীবনযাপন করুক। তার জন্যে তার নিজের সম্পত্তি, এবং এই বাংলা রয়েছে। কিন্তু এখন থেকে আমার কাছে এসবের আর কোনো আকর্ষণই নেই।’

‘তোমার এবং বৌদির কথাই শুধু ভাবছি না। আমি ভাবছি আমার নিজের সম্বন্ধেও। আমার চলার পথে যে মানসিক বাধা ছিল সেটা দূর হয়ে গেছে। চল আমরা দুই ভাই এক সঙ্গেই বিপ্লবের আবর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ি।’

বিস্ফারিত দৃষ্টি মেলে সফ্‌দর বললেন, ‘অক্সফোর্ডে থাকাকালীন তোমার সম্বন্ধেই আমার ভয় ছিল শঙ্কর। এবারে তো আমি হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে গিয়ে দাঁড়াব!’

সার্কিনা এসে খেতে ডাকলে দুই বন্ধুর বৈঠক শেষ হল।

 

২.

এই রাত থেকে সফদরকে কিছুটা প্ৰফুল্ল দেখতে পেলেন সাকিনা। তিনি ভাবলেন যে, এটা হয়ত শঙ্করের সঙ্গে গল্প-গুজবের ফল। সফদরের কাছে সব চেয়ে মুস্কিলের ব্যাপার হল নিজের সিদ্ধান্তের কথা সাকিনাকে জানানো। এমনিতে সফদরও আদর-আহ্লাদের মাঝে লালিত হয়েছে। কিন্তু তা হলেও তিনি ছিলেন গায়ের লোক। নগ্ন দারিদ্র্যাকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে তাঁর নিজের ওপর বিশ্বাস জন্মেছে যে, যে-পরীক্ষায় তিনি অবতীর্ণ হতে যাচ্ছেন, তাতে নিশ্চয়ই উত্তীর্ণ হবেন। কিন্তু সাকিনার কথা স্বতন্ত্র। তাঁর। সম্বন্ধে এ কথাই বলা যেতে পারে যে, পা দিয়ে কখনও কঠিন মাটি স্পর্শ করেননি। তিনি। রবিবারেও তাই সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারলেন না। সফদর। সোমবার কোর্টে যখন নিকট বন্ধুদেরও তাঁর সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়ে গেল, তখন সাকিনাকে সব কথা জানানোর প্রয়োজন আরও প্রবলভাবে অনুভব করলেন তিনি।

সে রাতে তিনি লক্ষ্মেীর সর্বশ্রেষ্ঠ শ্যাম্পেন আনালেন। সাকিনা ভাবলেন, আজ কোনো’ বন্ধু আসবেন বুঝি! কিন্তু খাওয়ার পর যখন বেয়ারাকে শ্যাম্পেন খুলে আনার আদেশ সফদর দিলেন তখন সার্কিনার কিছুটা কৌতূহল হল। সাকিনার ঠোঁটে শ্যাম্পেনের গ্লাস তুলে ধরে সফ্‌দর বললেন, ‘সাকিনা, প্রিয়তমা, আমার কাছে এটাই তোমার শেষ প্রসাদ হয়ে দাঁড়াবে।’

‘তুমি মদ ছেড়ে দিচ্ছ?’

‘হ্যাঁ প্রিয়তমে, আরও অনেক কিছুই ছাড়ছি, কিন্তু তোমাকে নয়। এখন থেকে তুমিই। হবে আমার সুরা।’ এই কথার পর সাকিনার কাতর চেহারা লক্ষ্য করে সফদর বললেন, ‘সাকিনা আমার কাছে এস, আমরা শ্যাস্পেন পান করি এখন। আরও অনেক আলোচনাই রয়েছে আমাদের।’

সুরাপানে সাকিনার কোনোই ভাবান্তর হল না, যদিও সফদর ওমর-খৈয়াম থেকে অনেকটাই আবৃত্তি করে গেলেন। চাকর-বাকরেরা বিদায় নেবার পর সাকিনা যখন স্বামীর কাছে এসে অমঙ্গল আশঙ্কায় অভিভূত হয়ে শুয়ে পড়লেন, তখন নিজের কথা বলতে আরম্ভ করলেন সফদর–

‘সাকিনা, আমি এক গুরুতর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যদিও প্রথমেই আমি স্বীকার করছি যে, এমন একটা সিদ্ধান্ত নেবার সময় তোমাকেও কিছু বলবার সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল আমার। কিন্তু এই অপরাধ আমি কেন করেছি, আমার পরবর্তী কথাগুলো থেকেই সেটা বুঝতে পারবে, তুমি। সংক্ষেপে আমার সিদ্ধান্তের মূল কথা হল-আমি এখন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সৈনিক হতে চলেছি।’

কথাগুলো সাকিনার হৃদয়ে এসে যেন বজ্ৰঘাত করল, আর এজন্য মুখে কিছুই বলতে পারলেন না। তিনি। তাঁকে চুপ করে থাকতে দেখে সফদর আবার বললেন, ‘কিন্তু সাকিনা, তোমাকে আমি সুখস্বাচ্ছন্দ্যের ভিতর লালিত-পালিত হতে দেখেছি, কাজেই এ কৃচ্ছ্রসাধনের মাঝে তোমাকে টেনে আনতে চাই না।’

সাকিনার মনে হল যেন আর একবার নতুন করে আঘাত লাগল তাঁর ক্ষতস্থানে-এ আঘাত যেন প্রথম আঘাতকেও ভুলিয়ে দিল। আঘাতের পর আঘাতে আত্ম-সম্মান জেগে উঠল সাকিনার, তিনি বলে উঠলেন, প্রিয়তম তুমি কি সত্যিই আমাকে এতটা আরামপ্রিয় বলে মনে কর যে, তোমাকে কষ্ট সইতে দেখেই আমি পালঙ্কের ওপর বসে থাকতে চাইব? শোন সফদার, যদি প্ৰাণ দিয়ে আমি তোমাকে ভালোবেসে থাকি, তবে সে ভালোবাসা আমাকে তোমার সঙ্গে যে-কোনোখানে যাবার শক্তি জোগাবে। অধর-রাগ অনেক ব্যবহার করেছি। আমি, বহু সময় নিজেকে নিঃশেষ করে দিয়েছি শুধু সাজ পোশাকেই, কঠোর জীবনের সঙ্গে পরিচিত হতে কোনোদিনই চেষ্টা করিনি। আমি-এ সব সত্যি। কিন্তু তা হলেও তুমিই আমার সব সফদর। আমি চিরদিনই তোমার সঙ্গে থাকব। আর আমার বর্তমান জীবনের পথ প্রদর্শন যেমন তুমিই করেছিলে তেমনি আগামী জীবনেও তুমিই আবার আমার পথপ্রদর্শক হবে।’

সফদর কিন্তু এতটা আশা করেননি! যদিও তিনি জানতেন যে, সাকিনা অত্যন্ত দৃঢ়চেতা মেয়ে। সফদর আবার বলতে লাগলেন, ‘নতুন মোকদ্দমা নেওয়া আমি বন্ধ করে দিয়েছি। পুরনোগুলো অন্যের কাছে সোপর্দ করে দিচ্ছি। আশা করছি এই সপ্তাহের মধ্যেই আদালতের কাজ থেকে ছুটি পেয়ে যাব। আরও একটা খবর শুনবে সাকিনা? শঙ্করও আমার সঙ্গে আন্দোলনে ঝাঁপ দিচ্ছে। শঙ্কর একটি রত্ন বুঝলে সাকিনা! আমার সঙ্গে পৃথিবীর শেষ প্রান্তে এগিয়ে যেতে সে প্রস্তুত।’

‘শঙ্করের ত্যাগ কিন্তু তোমার চেয়েও বড় সফদর।’

‘আত্মত্যাগের জীবনই সে বরণ করে নিয়েছিল সাকিনা। এ পথ থেকে কোনোদিনই সরেনি সে। তা’না হলে খুবই বড় উঁকিল সে হতে পারত, অথবা নিজের চাকরীতেও যথেষ্ট উন্নতি করতে পারত।’

‘তার দুটি ছেলে যখন মারা যায়, তখন খুব কেঁদেছিলাম। আমি, কিন্তু এখন বুঝতে পারছি যে, চারটি থেকে দুটি বোঝা কমে যাওয়ায় ভালোই হয়েছে!’

‘আচ্ছা শঙ্করের এই সিদ্ধান্তকে চম্পা কিভাবে গ্ৰহণ করবে সাকিনা?’

‘চোখ বুজে মেনে নেবে সে। স্বামীকে কি করে ভালোবাসতে হয় সেই তো আমায় শিখিয়েছে সফদর!’

‘ভবিষ্যতের থাকা-খাওয়ার জন্য কিছু ব্যবস্থা আমাদের করে রাখতে হবে।’

‘এ সম্বন্ধে ভাববার অবকাশ পেলাম কই? তুমিই বল না কি করা যায়?’

‘আমাদের গায়ের শরীফন এবং মঙ্গলকে রেখে বাকি চাকরীদের দু’মাসের মাইনে দিয়ে বিদায় করে দিতে হবে। দু’খানা মোটরগাড়িই বেচে দেব।’

‘ভালোই হবে।’ ‘দু’একটি খাট আর কয়েকটা চেয়ার বাদে ঘরের সমস্ত আসবাবপত্র বিলিয়ে অথবা নীলাম করে দিতে হবে। লাটুস রোডে মাসীর যে বাড়ি পেয়েছি, সেখানেই থাকব গিয়ে, আর এই বাংলা ভাড়া দিয়ে দেব।’

‘খুব চমৎকার ব্যবস্থা।’

‘আমার আর তো কিছুই মনে পড়ছে না!’

‘আর আমার কাপড়-চোপড়-আমার বিলিতি পোশাক পরিচ্ছদগুলো?’

‘গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিচ্ছি। তাই ওসবের কথা বলছ? আমি কিন্তু ওসব পোড়ানোর পক্ষপাতী নই, বিশেষ করে সারা দেশেই যখন প্রচুর বিলাতী জমা কাপড় পোড়ানো হচ্ছে। তবে আমার নিজের জন্যে খদ্দরের পায়জামা-পাঞ্জাবী পর্শুর মধ্যে তৈরি হয়ে আসবে।’

‘তুমি বড্ড স্বার্থপর সফদর!’

‘খদ্দরের মোটা আর ভারী শাড়ি পরবে সাকিনা?’

‘তোমার সঙ্গে সব অবস্থাতেই আমি মানিয়ে চলতে পারব।’

‘দেখি তাহলে কি করা যায়। খুব ভালো হত। যদি ঐ সব জামা-কাপড় নীলামে বিক্ৰী করে দিয়ে সেই টাকায় গরীবদের জন্য কাপড় কিনে দিতে পারতাম।’

 

৩.

সফদরের মতো উদীয়মান ব্যারিস্টারের এই মহান ত্যাগের কথা চতুর্দিকে আলোচিত হতে লাগল। যদিও সফদর শঙ্করকেই প্রশংসার যোগ্যতর পাত্র বলে মনে করতেন। সারা অক্টোবর এবং নভেম্বর জুড়ে সফদর জনসাধারণের মধ্যে প্রচার চালাবার সুযোগ পেলেন। কখনও কখনও সাকিনা বা শঙ্কর তাঁর সঙ্গে থাকতেন। গ্রামের দিকে তাঁর মনোযোগ বেশি, কারণ গ্রামের কৃষক-মজুরের ওপর যতটা তাঁর আস্থা ছিল লেখাপড়া-জানা শহরের লোকের ওপর ততটা ছিল না। কিন্তু এক সপ্তাহের ভেতরই তিনি বুঝতে পারলেন যে, তাঁর উচ্চশ্রেণীর উর্দু গ্রামের এক-চতুর্থাংশ লোকও বুঝতে পারছে না। শঙ্কর কিন্তু প্ৰথম থেকেই গ্ৰাম্য ভাষায় বক্তৃতা আরম্ভ করেছিলেন। তাঁর সাফল্য দেখে সফদরও ওই ভাবে বক্তৃতা দেওয়া ঠিক করলেন। প্রথমে তাঁর কথাবার্তায় পুঁথিগত শব্দই বেশি থাকত কিন্তু শঙ্করের। সাহায্যে এবং নিজের পরিশ্রমে দু’মাস যেতে না যেতেই ভুলে যাওয়া বহু শব্দ এবং সেই সঙ্গে নতুন নতুন সর্বজন-বোধ্য শব্দ তিনি রপ্ত করে ফেললেন।

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে (১৯২১ খৃঃ) বহু রাজনৈতিক কৰ্মীসহ সফদর এবং শঙ্কর এক বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে ফৈজাবাদ জেলে প্রেরিত হলেন। চম্পা এবং সাকিনা গ্রেপ্তার এড়িয়ে কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন।

জেলে গিয়ে, এক ঘণ্টা নিয়মিত চরকা কাটতেন। সফদর। যারা তাঁর গান্ধী-বিরোধী রাজনৈতিক মতবাদের কথা জানত, তারা কটাক্ষ করত। সফদর কৈফিয়ৎ দিতেন, ‘বিলিতি কাপড় বয়কট করাকে আমি একটা রাজনৈতিক হাতিয়ার বলে মনে করি; সেই সঙ্গে এও আমি জানি যে, আমাদের দেশে এখনও পর্যাপ্ত কাপড় তৈরি হয় না, তাই কাপড় আমাদের তৈরি করতে হবে। তবে দেশের কারখানাগুলি যখন পর্যাপ্ত বস্ত্ৰ উৎপাদন করবে, তখন আর চরকা কাটার পক্ষপাতী থাকব না আমি।’

জেলের ভেতর অলসভাবে বসে থাকা লোকের সংখ্যাই ছিল বেশি। এই সমস্ত লোকেরা গান্ধীজির এক বছরে স্বরাজ আনার কথায় আস্থাবান হয়ে বসেছিল। তারা মনে করত, জেলে আসাতেই তাদের কাজ শেষ হয়ে গেছে। গান্ধীবাদী আদর্শে বিশ্বাসীদের মধ্যে তখন পর্যন্ত ভণ্ডামী, ধাপ্লাবাজী আর লোক-ঠকানো কমীিদের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। কাজেই বন্দীদের মধ্যে সাচ্চা দেশভক্তের সংখ্যাই ছিল বেশি। সফদর এবং শঙ্করের আক্ষেপ হত রাজনৈতিক জ্ঞান বাড়ানোর দিকে এদের দৃষ্টি নেই বলে। এদের অনেকে রামায়ণ, গীতা বা কোরান পাঠ করত, মালা হাতে নাম জপত, অনেকে শুধু তাস পাশা খেলেই সময় অতিবাহিত করত। একদিন গান্ধীবাদী রাজনীতি দিগগজ পণ্ডিত বিনায়কপ্ৰসাদের সঙ্গে দেখা করলেন সফদর এবং শঙ্কর। বিনায়কপ্ৰসাদ বললেন, ‘রাজনীতি ক্ষেত্রে অহিংসার প্রয়োগ গান্ধীজির এক মহান আবিষ্কার এবং অমোঘ অস্ত্র।’

‘আমাদের বর্তমান অবস্থায় এটা উপযোগী হতে পারে, কিন্তু অহিংসা কোনো অমোঘ অস্ত্ৰই নয়। পৃথিবীতে যত অহিংস পশু আছে তারাই অপরের শিকার হয়।’

‘পশুকুলে না হতে পারে, কিন্তু মানুষের মধ্যে অহিংসা এক অদ্ভুত শক্তির সঞ্চার করে।’

‘নতুন আবিষ্কারের ক্ষেত্রে কোনো নজির থাকে না।’

‘এটা নতুন আবিষ্কার নয়।’ শঙ্কর বলে উঠলেন, ‘বুদ্ধ, মহাবীরের মতো বহু ধর্মোপদেশক এই অহিংস নীতির ওপর জোর দিয়ে গেছেন।’

‘কিন্তু রাজনীতির ক্ষেত্রে নয়।’

সফদর, ‘রাজনীতির ক্ষেত্রে এর উপযোগিতা যে কিছুটা বেড়ে গেছে তা এই জন্যেই যে, মানবতা আজ কিছুটা উচ্চস্তরে উঠেছে। সংবাদপত্রগুলিতে নিরস্ত্রদের ওপর গুলি চালাবার খবর পড়ে আজ সবাই তার নিন্দা করে। জালিয়ানওয়ালাবাগে। গুলি চালিয়ে ইংরেজরা এর প্রত্যক্ষ পরিচয় পেয়েছে।’

‘তাহলে কি বলতে চান, অহিংসাত্মক-অসহযোগ স্বরাজ প্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্ট নয়?’

‘প্ৰথমে আপনি বলুন, স্বরাজের সংজ্ঞা কি?’

‘আপনিও তো স্বাধীনতার সংগ্রামে নেমেছেন, আপনিই বলুন না!’

‘আমি মনে করি স্বরাজ মানে মেহনতকারীর রাজত্ব-শুধুই মেহনতকারীর।’

‘তাহলে আপনার স্বরাজে মন-প্ৰাণ দিয়ে, অৰ্থ দিয়ে সাহায্য করা, কষ্ট করে রাবরণ করা-শিক্ষিত পুঁজিপতি এবং জমিদারদের কোনো অধিকার থাকবে না?’

‘এ তে আপনিই দেখেছেন-পুঁজিপতি এবং জমিদারেরা সালিশী-সভা বসাতেই ফুরসৎ পায় না। ওরা জেলে আসতে যাবে কোন দুঃখো! আর যদি কেউ.এসেও থাকে। তবে শ্রমজীবীদের স্বার্থের সঙ্গে তার স্বার্থকে আলাদা করে দেখা কখনই উচিত নয়।’

শঙ্কর এবং সফদর সর্বদাই বই পড়তেন, এবং দেশের আর্থিক সামাজিক সমস্ত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতেন। প্রথম দিকে তাঁদের কথা অন্যান্যরা খুব কমই শুনত। কিন্তু ৩১ ডিসেম্বর (১৯২১ খৃষ্টাব্দ) মধ্যরাত্রি পার হয়ে যাবার পরও যখন জেলের ফটক খুলল না, তখন তারা নিরাশ হয়ে পড়ল। যখন আতঙ্কিত, উত্তেজিত জনতা কর্তৃক চৌরীচৌরায় কয়েকজন পুলিশের লোকের হত্যার খবর শুনে গান্ধীজি সত্যাগ্ৰহ বন্ধ করে দিলেন তখন বহু লোকই নতুনভাবে চিন্তা করতে লাগল এবং তাদের মধ্যে থেকে কিছু লোক এগিয়ে এসে সফদর এবং শঙ্করের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হল যে, বিপ্লবী শক্তির একমত উৎস জনসাধারণ–গান্ধীজির মস্তিষ্ক নয়। জনসাধারণের এই শক্তিকে অবিশ্বাস করে গান্ধী নিজেকে বিপ্লব-বিরোধী বলে প্রমাণ করে দিয়েছেন।

২০. সুমের (কাল : ১৯৪২ খৃষ্টাব্দ)

১৯৪২ খৃষ্টাব্দের আগষ্ট মাস। এক নাগারে বর্ষা চলছে এবং কয়েকদিন হল সূর্যের সাক্ষাৎই মিলছে না। পাটনা শহরে গঙ্গা উজিয়ে আসছে-যে কোনো সময় বাঁধ ভেঙে শহরে ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা। এমন আশঙ্কাজনক অবস্থায় বাঁধের ওপর সর্বক্ষণ নজর রাখা বিশেষ জরুরী। শহরের যুবক ও ছাত্ররা গঙ্গার বাঁধ দেখা-শোনার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নিয়েছে। সুমের পাটনা কলেজের এম.এ. ক্লাসের প্রথম বর্ষের ছাত্র। সে দীপাঘাটের পাশে বাঁধি দেখা-শোনার দায়িত্বে রয়েছে। মাঝরাতে তার মনে হয়েছিল গঙ্গা ভীষণভাবে ফুলে উঠছে। সকালেও গঙ্গার বিশাল জলরাশিকে আটকাবার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় নি–বঁধ থেকে বিঘৎখানেক নিচ দিয়ে গঙ্গার জলরাশি প্রবাহিত হচ্ছিল। শহরের সাধারণ মানুষের মধ্যে আশু-বিপর্যয়ের এক গভীর আতঙ্ক। ঝুড়ি-কোদাল নিয়ে হাজার হাজার মানুষ তৈরি কিন্তু সকলের মনেই গভীর সন্দেহ-গঙ্গার বাঁধকে আর এক ইঞ্চিও উঁচু করা সম্ভব। কিনা। সকাল থেকেই সুমের ব্যাকুল চিন্তা নিয়ে টহল দিচ্ছিল, দুপুরে জল কিছুটা কমতে দেখে সে স্বস্তি পেল। তার নজরে পড়ল, বাঁধের যে এলাকাটুকু সে টহল দিচ্ছিল সেখানে। এক সৌম্যমূর্তি ভদ্রলোক তার মতোই ঐ অঞ্চলে তদারকির কাজ করছিলেন। সুমেরের বেশ কয়েকবার, ইচ্ছে হয়েছিল ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করার কিন্তু আশু-বিপর্যয়ের দুর্ভাবনা ক্লিষ্ট মন সাড়া দেয় নি। এখন জল নামছে, মেঘ সরছে, সুমেরের বাসি ইচ্ছেটা আবার জাগিয়ে উঠল।

সুমের একুশ বছরের তরুণ, উঁচু নাক, ফর্সা রঙ, আর ঐ ভদ্রলোকের বয়স চল্লিশের মতো, কিছুটা শিথিল স্কুল দেহ গায়ের রঙ কালো। সুমেরের পরণে খাকি প্যান্ট, হাফসার্ট, কাঁধে বর্ষাতি, পায়ে রবারের জুতো আর ঐ ভদ্রলোকের সাদা খদ্দরের পোশাক, মাথায় গান্ধী-টুপি এবং খালি পী। সুমের কয়েক পা এগিয়ে এসে হাসিমুখে বলল, ‘নমস্কার। জল এবার নামছে।’

‘আর বাদলা আবহাওয়াও কেটে যাচ্ছে।’

‘ক’দিন কি যে দুর্ভাবনা গেছে! এক জায়গায় পড়েছিলাম, আড়াই হাজার বছর আগে যখন পাটলিপুত্র নগরের পত্তন হয় তখন গৌতম বুদ্ধ ও তংরহের কথোপকথনে পাটলিপুত্রে। প্লাবনের কথা জানা যায়। বুদ্ধ, আগুন জল ও গৃহ-বিবাদ এই তিনটি জিনিসকে নগরের শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন।’

‘মনে হচ্ছে আপনি ইতিহাসের ছাত্র?’

‘না, আমি রাজনীতির ছাত্র তবে ইতিহাসের মূল গ্রন্থগুলি অনুবাদের মাধ্যমে পড়তে আমি ভালোবাসি।’

‘হ্যাঁ, জল গত কয়েকদিন ধরেই আমাদের শত্রু হিসাবেই হানা দিয়েছিল।‘

‘আগুনের ভয় তখন ছিল, যখন পাটলিপুত্রের অধিকাংশ বাড়ি-ঘর ছিল কাঠের আর ছিল শহরের আশপাশে বিপুল শালবন। অগ্নিকাণ্ড তখন প্রায়ই হত।’

‘আচ্ছা, আপনার নামটা জানতে পারি?’

‘আমার নাম সুমের, আমি পাটনা কলেজের ফিফথ ইয়ারের ছাত্র।’

‘আর আমার নাম হল রামবালক ওঝা। প্রায় কুড়ি বছর আগে আমি পাটনা কলেজের ছাত্র ছিলাম। এক বন্ধুর প্রভাবে এম, এ, ডিগ্ৰী না নিয়েই অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলাম। অবশ্য সৌজন্য আমার কোনো অনুশোচনা নেই কারণ আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি স্কুল কলেজের শিক্ষা একটা অনৰ্থকারী ব্যাপার।’

‘তবে আপনার অধীত বিদ্যা সব ভুলে গেছেন?’

‘কখনো কখনো বেমালুম ভুলে যাই। যদি একেবারে সাদা শ্লেট হয়ে যেতে পারতাম তাহলে খুবই ভালো হত-সত্যকে সুদৃঢ়ভাবে ধরে থাকা সম্ভব হত।’

‘অৰ্থাৎ আপনি বুদ্ধিমাৰ্গ ত্যাগ করে ভক্তির পথে চোখ বুজে চলতে চান?’

‘সুমেরবাবু আপনি কি ভক্তির পথকে নিন্দনীয় মনে করেন?’

‘ওঝাজী আমি বাবু নই, এক অভাজন মুচির ছেলে। জমিদারের জবরদস্তিতে বাস্তুভিটে হারিয়েছি। আমার মা কায়ক্লেশে বেঁচে আছেন মাত্র। এক সজ্জনের কৃপায় এইটুকু লেখাপড়া করতে পারছি। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, বাবু হবার কোনো যোগ্যতা আমার নেই।‘

‘সুমেরজী, আপনার শিষ্টাচারের এখন পর্যন্ত যে পরিচয় পেয়েছি তাতে আমি খুব খুশী। জানেন কি, গান্ধীজি তাঁর এক হরিজন শিষ্যকে আপনার মতো জীবনসংগ্রামে ব্ৰতী দেখে কি আনন্দই না পেয়েছিলেন!’

‘ওঝাজী আপনার সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে কথা বলতে চাই, সেজন্যে মনে হয় আমার মতামত আগেই জানিয়ে রাখা ভালো। হরিজন ‘শব্দটিকে আমি ঘৃণা করি আর ‘হরিজন’ পত্রিকাটি আমার মতে স্থিতস্বার্থের সংরক্ষক। ভারতে অন্ধকারকে স্থায়িত্ব দেওয়াই ঐ পত্রিকাটির কাজ। আর গান্ধীজিও আমার মতে জাতির ভয়ঙ্কর শত্রু।’

‘গান্ধীজি জাতির কোনো উপকার করেছেন বলে আপনি মনে করেন না?’

‘মজুরের ক্ষেত্রে কারখানার মালিক যে উপকার করে কারখানা খুলে, সেই ধরনের উপকার গান্ধীজিও করেছেন!’

‘গান্ধীজি কি শুধু মালিকদের স্বার্থেই কাজ করেছেন?’

‘জমিদার, পুঁজিপতি, দেশীয় রাজাদের ‘অভিভাবক’ বলার মানে অন্য কিছু কি হয়? আমাদের ওপর গান্ধীজির প্রীতি এই কারণেই যাতে আমরা হিন্দুসমাজের বাইরে চলে না যাই। পূণায় তিনি আমরণ অনশন করলেন–যাতে আমরা হিন্দুসমাজ ত্যাগ করে নিজেদের স্বতন্ত্র সত্তা গড়ে না তুলি। হাজার হাজার বছর ধরে হিন্দুদের সস্তা দাসের চাহিদা আমাদের জাতের লোকরাই যোগান দিয়েছে। আগে আমাদের দাস বলা হত, গান্ধীজি এখন ‘হরিজন’ বলে আমাদের উদ্ধার করতে চাইছেন। উচ্চশ্রেণীর হিন্দুদের বাদ দিলে ‘হরি’ আমাদের এক বড় দুশমন। এখন ভেবে দেখুন, সেই ‘হরি’-র জন হবার বাসনা আমাদের কেন হবে!’

‘তাহলে আপনি ঈশ্বরেও বিশ্বাস করেন না?’

‘কি দরকার? হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের পশুর চাইতেও নিকৃষ্ট, অচ্ছুৎ বলে মনে করা হচ্ছে এবং সে সব চলছে ইশ্বরের নাম নিয়েই। উচ্চবর্ণের হিন্দুরা কথায় কথায় অবতারের জন্ম দিয়ে রথ হাঁকিয়ে চলে আর আমাদের ঘরের মেয়েদের ইজ্জৎ লুণ্ঠিত হয়। শোনপুরের মেলায় জীবজন্তু কেনাবেচার মতো আমাদের নিয়েও বেচাকেনা হয়েছে। গালাগাল, প্রহার, অনাহারে মৃত্যু-আমাদের এসব কিছুকেই বলা হয়েছে ঈশ্বরের করুণা। কিন্তু হাজার হাজার বছরের এত অত্যাচার এত দুৰ্দশা যে ঈশ্বর দেখতে পায় না-তাকে মানতে যাব কোন যুক্তিতে।’

‘আপনি কি ডাঃ আম্বেদকরের পথ পছন্দ করেন?’

‘না, তবে ডাঃ আম্বেদকরও ভুক্তভোগী। কলেজ-জীবনের প্রথম-দ্বিতীয় বর্ষে আমাকেও হিন্দু ছাত্রদের হোষ্টেলে থাকতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু আম্বেদকরের পথ আর কংগ্রেসের অচ্ছুৎ-নেতাদের পথের মধ্যে আমি কোনো ফারাক দেখতে পাই না। উভয়ের পথই গান্ধী-বিড়লা-বাজাজদের পথের সঙ্গে মিশে গেছে। ওঁরা এখন চাইছেন কিছু অচ্ছুৎ পাঁচ-ছ’হাজারি তনুখাওয়ালা বানিয়ে দিতে। আছুৎদের মধ্যে থেকে বিড়লা-বাজাজ না হোক, অন্তত দু-চারজন হাজারীলাল হোক। কিন্তু দু-একজন অচ্ছুৎ যদি ছোটখাট জমিদার বনে যায় তা হলেও ভারতের দশ কোটি অচ্ছুৎদের শোচনীয় অবস্থার কিছুমাত্র পরিবর্তন হবে না।’

‘আপনি চান যাতে শোষণ বন্ধ হয়–তাই না।’

‘অবশ্যই। গরীবদের শ্রমে ফুলে-ফেপে ওঠা কিছুসংখ্যক মানুষের কর্তৃত্ব কেড়ে নিলেই আমাদের সমস্যার সমাধান সহজেই হতে পারে।’

‘সেই জন্যেই তো গান্ধীজি হাতে-তৈরি কাপড়, গুড় এবং হাতে-তৈরি সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন।’

‘বটে! বিড়লা আর বাজাজের টাকার জোরে? খাদি-সংঘের দু’এক লাখ টাকা ঘাটতি পড়লেই কোনো না কোনো শেঠ এসে চেক কেটে দেয় কেন? যদি গান্ধীর চরকার দাপটে ওদের কাপড়ের কল বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হত, মুনাফায় টান ধরত কিম্বা রেশমী শাড়ির চাহিদা কমে যেত তাহলে কোনো শেঠ-শেঠানী গান্ধী-ভজনা করতে এগিয়ে আসত না–বুঝলেন ওঝাজী! এ ব্যাপারে আমার কোনো মোহ নেই।’

‘জাপানীরা থাবা বাড়িয়েছে। আপনি কি চান, তারা এ দেশের কল-কারখানা ধ্বংস করে দিয়ে যাক? কত পরিশ্রম, কত বিঘ্ন-বাধা অতিক্রম করে ভারতীয়রা এইসব গড়ে তুলেছেন-এ ব্যাপারগুলোও বিবেচনা করুন, সুমেরজী।’

‘পরিশ্রম, বিঘ্ন-বাধা এগুলো অবশ্যই বিবেচনাযোগ্য। কিন্তু ব্যাপারটা কি, একদিকে গান্ধীবাদীদের বক্তব্য যে তারা কল-কারখানার অস্তিত্ব এক মুহূর্তের জন্যেও মানতে রাজী নয় অন্যদিকে এ দেশের মালিকশ্রেণী বিশ্বাস করে জাপানীরা এলেও তাদের কল কারখানার মালিকানা সুরক্ষিত থাকবে। জাপানের বেতারভাষ্য শুনে এ সম্পর্কে তাদের আস্থা বেড়ে গেছে।’

‘তারা দেশের অর্জিত সম্পদ রক্ষা করতে চায়।’

‘কটা ঘায়ে নুন দেবেন না ওঝাজী। দেশের সম্পদ না নিজেদের সম্পদের দিকে তাদের নজর? তাদের মুনাফা লুণ্ঠনের সুব্যবস্থা থাকলে ও সব কল-কারখানা ধ্বংস হয়ে গেলেও কিছু আসে যায় না তাদের।’

‘মালিকদের সম্পর্কে যদি আপনার কথা মেনেও নেওয়া যায় তা হলেও গান্ধীজির সততা সম্পর্কে সন্দেহ করা আপনার উচিত নয়।’ ‘

‘কথা এবং কাজের মিল কিম্বা অমিল এর দ্বারাই আমি ব্যক্তির সততা যাচাই করি। আমি গান্ধীর দুগ্ধপোষ্য শিশু নই। এগুরুজ-ফাণ্ডের জন্য গান্ধীর পাঁচ লাখ টাকা দরকার ছিল আর বোম্বাই-এর শেঠেরা। পাঁচ দিনের মধ্যেই সাত লাখ টাকা এনে গান্ধীর চরণে সমৰ্পণ করেছিল। পুঁজিপতিশ্রেণীর জন্য তিনি যা করেছেন তাতে ইংল্যাণ্ড আমেরিকার ব্যবসায়িরা দরকার হলে সাত কোটি টাকার থলি উপুড় করে দিতে দ্বিধা করবে না!’

‘এর কারণ ব্যবসায়ী শ্রেণীর আস্থা অর্জন করেছেন তিনি।’

‘ব্যবসায়ীরা ভগবানকেও ঘুষ দেয়, তাই মন্দিরের দরজায় লিখে রাখে ‘শুভ-লাভ’।’

‘চরকা-খাদিকে এই শোষণ-ব্যবস্থার শত্রু বলে আপনার মনে হয় না?’

‘আমি চরকা-খাদি এইসব ব্যাপারগুলোকে শোষণ-ব্যবস্থা কায়েম রাখার কূটকৌশল বলেই মনে করি।’

‘তাহলে কল-কারখানাকেই শোষণ-প্রক্রিয়ার শত্রু মনে করা উচিত।’

‘তবে শুনুন, এ সম্পর্কে আমার বক্তব্য। পাথরের হাতিয়ার নিয়ে যে সভ্যতা শুরু হয়েছিল আজকের মানুষ সেখান থেকে অনেকখানি এগিয়ে এসেছে। চরকা-র্তত সভ্যতার কোনো এক পর্যায়ে মানুষের অগ্রগতির সহায়ক হলেও আজ ওগুলো ব্যবহারিক যৌক্তিকতা হারিয়েছে। পাটনার যাদুঘরে দেখেছি। তালপাতায় লেখা পুথি। নালন্দার বিদ্যার্থীদের জন্য বইপত্তর লেখা হত তালপাতায়। ‘ফিরে চলো তালপাতার যুগে’-সাত জন্ম ধরে হেঁকে চলুন গান্ধীজি, দুনিয়া কিন্তু কলের কাগজ, মোনো টাইপ, রোটারি মেসিনে ছাপার যুগ থেকে তালপাতার যুগে ফিরে যাবে না। আর এই না যাওয়াটাই মঙ্গল। এ যেন ফ্যাসিস্ট হানাদারকদের ট্যাঙ্ক, বিমান, ডুবোজাহাজ ইত্যাদির বিরুদ্ধে পাথরের হাতিয়ার নিয়ে মোকাবিলা করতে বলছেন গান্ধীজি!’

‘আপনি দেখছি অহিংসার মহানূ সিদ্ধান্তও মানেন না!’

‘গান্ধীজির অহিংসা? ঈশ্বর রক্ষা করুন! যে অহিংসার মন্ত্রে কৃষক-মজুরদের ওপর সরকারের গুলি চালানোকে সমর্থন করা যায় আর ফ্যাসিষ্ট গুণ্ডাদের সামনে বৈষ্ণব বনে যেতে হয় তেমন অহিংসাকে বুঝে ওঠা আমার পক্ষে অসম্ভব। চরকা-খাদির ব্যাপারে আমার বক্তব্য শুনুন ওঝাজী, মিল মালিকেরা ভালোভাবেই জানে তাদের উৎপন্ন দ্রব্য সামগ্ৰীর সঙ্গে চরকা-তাঁতের উৎপাদন কোনো দিক থেকেই প্রতিদ্বন্দিতা করতে পারে না। তাই তারা মুক্তহস্তে খাদি-ফাণ্ডে খয়রাতি দিয়ে যাচ্ছে। চরকা-খাদি এই ব্যাপারগুলো হল শোষণমুখী সমাজ-ব্যবস্থার সত্যিকার শত্রু সাম্যবাদের পথে একটা বড় বাধা! কত লোক যে ভুলভাবে বুঝে বসে আছে-সাম্যবাদ এবং কল-কারখানার ওপর শ্রমিকশ্রেণীর অধিকার প্রতিষ্ঠার চেয়ে খাদি-উদ্যোগ পন্থাই ভালো। এই ভ্ৰান্তি যাতে সহজে নষ্ট না হয় সে জন্যে মিল-মালিকেরা সব খাদি-ভক্ত হয়ে উঠেছে।’

‘আপনার বক্তব্য গান্ধী নীতির ওপর প্রত্যক্ষ আক্রমণ।’

‘গান্ধীবাদী আদর্শের প্রতিটি বক্তব্য আমাদের মতো কোটি কোটি শোষিত মানুষের কাছে মারাত্মকভাবে ক্ষতিকর। মানুষকে গোলাম বানিয়ে রাখার, চিরস্থায়ী শোষণ-ব্যবস্থা চালু রাখার দালালদের গুদাম ঘরে আমরা চাই চিরকালের জন্যে তালা ঝুলিয়ে দিতে। আর গান্ধীজীর চেষ্টা-হল আমাদের ঠকিয়ে স্থিতস্বার্থের সেবা করা। ধনিকশ্রেণীর উচ্ছিষ্টজীবীদের যদি আমরা জ্বলন্ত আগুনে ফেলে দিতে পারতাম তাহলে খুবই ভালো হত; আর তা না পারলেও তাদের রাস্তা আমরা আটকে দিতে চাই। একদিকে জাতিভেদ প্রথা অন্যদিকে শোষণ-ব্যবস্থা এই দুইয়ে মিলে ভারতবর্ষে আমাদের অস্তিত্ব বিলোপ করে দিতে চাইছে! আর গান্ধীজি উদ্ভট দার্শনিকতার সাহায্যে এ সব কিছুর ব্যাখ্যা করছেন। এই সব সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে ‘হরিজন-উদ্ধার’ নিছক ধোঁকাবাজী ছাড়া আর কি? অবশ্য এর ফলে উচ্চবর্ণের কিছু লোকের জীবিকার ভালোই ব্যবস্থা হচ্ছে।’

‘আপনি কি চান না বর্ণহিন্দু এবং অচ্ছুতেরা এক হয়ে যাক?’

‘যুগের দাবীতেই আমরা হয়ত এক হব, কিন্তু গান্ধীজির প্রিয়-ধর্ম, ঈশ্বর, সনাতন পন্থা আমাদের ঐক্যের পথে প্রতিবন্ধক। ওঝাজী, আমাকে দেখুন-আমার গায়ের রঙ পাকা গমের মতো, পাতলা উন্নত নাক। আর আপনার রঙ কালো, নাক চ্যাপ্টা। এর তাৎপৰ্য, আমার শরীরে আপনার তুলনায় আর্য রক্তের পরিমাণ বেশি। আপনার পূর্ব পুরুষরা বর্ণবিভাগের লৌহপ্রাচীর তুলে ভেবেছিলেন যে, রক্তের সংমিশ্রণ ঘটতে দেবেন না, কিন্তু তাঁদের সে আশা পূর্ণ হয়নি। এর জ্বলন্ত উদাহরণ আপনি এবং আমি–ভোলগা আর গঙ্গা তটের রক্তধারা সময়ের প্রবহমান গতিতে মিশে একাকার হয়ে গেছে। তাই গায়ের রঙ নিয়ে ঝগড়া আর নেই। সব কিছুই ঠিক হয়ে যেত যদি ধর্ম, ঈশ্বর এবং সনাতনপন্থীরা এ–পথে বাধা হয়ে না থাকত। আর এখন শোষকশ্রেণী এবং তাদের প্রতিনিধি গান্ধীজি এসে আমাদের মিলনের পথকে আরও দুৰ্গম করে তুলেছেন।’

‘আচ্ছা, আপনি যখন চরকা-খাদি এ সবের ওপর আস্থা রাখেন না তখন কি মনে করছেন, বিদেশী সাম্যবাদ। ভারতের মাটিতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে?’

‘যা কিছু শোষকশ্রেণীর স্বার্থের প্রতিকূল তাকেই তারা বলে বিদেশী, বলে অসম্ভব। চিনির কারখানা, বাষ্পীয় জাহাজ, মোটর, কাচ, ফাউন্টেন পেন ইত্যাদি জিনিসগুলো কোটি কোটি টাকা মুনাফা নিয়ে আসে। সুতরাং ওগুলো আর বিদেশী নয়। বিদ্যুৎ শক্তির ব্যবহার, চলচ্চিত্র, রেডিও এ সবই তো বিদেশের জিনিস কিন্তু এখন স্বদেশী হয়ে গেছে যেহেতু ও সবের সাহায্যে এ দেশের মানুষকে খুব ভালোভাবে শোষণ করা যাচ্ছে। অর্থাৎ শোষণের তাবৎ উপকরণ বিদেশী হলেও কিছু আসে যায় না। কিন্তু সাম্যবাদ যেহেতু শোষণমুখী সমাজ-ব্যবস্থা ধ্বংসকারী এক অমোস শক্তি তাই এ দেশের শাসকবৃন্দরা সব সময়েইসাম্যবাদ বিদেশী ভাবধারা এ দেশের মাটিতে চলতে পারে না–এমন একটা প্রচার তার স্বরে চালিয়ে যাচ্ছে। ওঝাজী এর নাম কি সততা!’

‘সাম্যবাদ। ধর্ম-বিরোধী আর ভারত চিরকালই ধর্মপ্রাণ-এটা ভেবে দেখেছেন?’

‘স্কুল-কলেজের শিক্ষা। আপনি বেমালুম ভুলে গেছেন ওঝাজী-আপনাকে কি করে। বোঝাতে পারি! ধর্মের কথা যখন আপনারা বলেন তখন আপনাদের মনে কেবল হিন্দুধর্মের ব্যাপারটাই থাকে। গো-সেবা মণ্ডল সিদ্ধান্ত নিয়েছে মাংস ছাড়া গরুর সব কিছু খাওয়া চলবে এমন কি গোমূত্র গোবর পর্যন্ত। গান্ধীজি এই গো-সেবা মণ্ডলকে আশীৰ্বাদ জানিয়েছেন। ভারতে যদি গো-খাদক এবং গো-খাদক বিরোধীদের মধ্যে ভেদরেখা টানা হয় তবে দেখা যাবে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই গো-খাদক। আপনি তো জানেন আমাদের সম্প্রদায় গরু খায়, এর সঙ্গে যোগ করুন ভারতের সমগ্র জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ মুসলমানদের, কোটিখানেক খৃষ্টানদের এবং কয়েক লক্ষ বৌদ্ধকে। যদি গরু খাওয়া আর না-খাওয়া এতেই ধর্মধর্মের মীমাংসা হয়ে যেত তাহলে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের বাদ দিয়ে দুনিয়ার অন্যান্য সব ধর্মাবলম্বীরা অধাৰ্মিক? গান্ধীজির ভূতপূর্ব বন্ধু লর্ড হ্যালিফ্যাক্স ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি হিসেবে খ্যাতিমান। ধর্মের জিগীর তুলে তিনি সকলকে সাম্যবাদ থেকে দূরে থাকার জন্য প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। ওঝাজী, শোষকশ্রেণীর সবাই দারুণ রকম ধর্মপ্রাণ এবং শোষণ-বিরোধী যে-কোনো চিন্তাধারাকেই ধর্মের শত্রু হিসাবে ঘোষণা করা হয়।  হ্যাঁ, মেনে নিলাম সাম্যবাদী চিন্তাধারার জন্ম বিদেশে, কিন্তু খৃষ্টধর্ম, ইসলাম ধর্ম, রেল-তার-উড়োজাহাজ-কারখানা প্রভৃতি বিদেশ-জাত বস্তু আমাদের চোখের সামনে কেমন স্বদেশী হয়ে গেছে! সাম্যবাদও অদূর ভবিষ্যতে আমাদের কাছে বিদেশী ভাবধারা থাকবে না, যার প্রমাণ ইতিমধ্যেই পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠছে।’

 

২.

পাটনায় সান্ধ্যভ্রমণের দু’টি জায়গা-বাঁকীপুর ময়দান এবং হার্ডিঞ্জ পার্ক। দুটোর অবস্থাই এমন শোচনীয় যে কাউকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা তাদের আর নেই। তবু কিছু লোক আসে, যাদের পায়ের তলায় সর্ষে অথবা বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কিছুটা আড্ডা দিতে হয়। অন্ধকার ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে-তিন বন্ধুর কথা এখনও ফুরোয়নি। তিনজনে বাঁকীপুর ময়দানে চলে এসেছে। ওদেরই একজন বলল, ‘ভাই সুমের, আবার বলছি-আর একবার ভেবে দেখ। বড় ভয়ঙ্কর গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে চলেছ।’

‘মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে যাচ্ছি। তাই হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। কথাটা দেখ রূপ, এটা কোনো দ্বিধাজড়িত পদক্ষেপ নয়।’

‘তুমি হাওয়ায় ভাসবে ভাই। আমার কিন্তু ঘরের ছাদের কিনারায় দাঁড়ালেই বুক ঢিবঢিব করে।‘

‘কত লোকের সাইকেল চড়তেই ভয় লাগে, আর তুমি দিব্যি চলন্ত সাইকেলে দু’হাত তুলে দাঁড়িয়ে পড়।’

‘একটা কথা আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না, মজুরশ্রেণীর জন্য লড়াকু সুমের কেন এই সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে জীবনপণ করছে!’

‘ ‘কারণ একটাই। মজুরশ্রেণীর স্বাৰ্থ এবং এই মহাযুদ্ধের চূড়ান্ত পরিণাম এক বিন্দুতে এসে মিলিত হচ্ছে। এই যুদ্ধ শুধু সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের টানা-পোড়েন নয়, শোষকশোষিতের দ্বন্দ্বের এক নতুন অধ্যায় সূচনা করবে।’

‘এই যুদ্ধের জন্য সব চেয়ে বড় অপরাধী ইংরেজ পুঁজিপতিরা–এ কথাটা তুমি অস্বীকার করতে পার?’

‘বল্ডইউন, চেম্বারলেন যাদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে তারাই যে দায়ী, এ ব্যাপারে আম তোমার সঙ্গে এক মত। কিন্তু সাম্যবাদের প্রসারকে রুখবার জন্যে ওরাই তো হিটলার মুসোলিনীকে মদত দিয়েছে, শক্তিশালী হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। ভস্মাসুর শিবের বলে বলীয়ান হয়ে প্রথমে শিবের ওপরেই চড়াও হয়। এই মহাযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে সেই ধরনের তামাসা ঘটতে আমরা দেখলাম। কিন্তু এখন ভস্মাসুর শিবকে ছেড়ে আমাদের দিকে থাবা বাড়িয়েছে।’

‘আমি তো কোনো তফাৎ দেখছি না যুদ্ধের প্রথম অবস্থার সঙ্গে বর্তমানের।’

‘তফাৎ তো দেখতেই পাবে না-বেনিয়াগোষ্ঠীর লোক যে তোমরা। ফ্যাসিষ্ট শাসনেও বেনিয়াগোষ্ঠীর লোকের ঘি-মশলায় হাত পড়ে না। সোভিয়েত পরাজিত হলে মজুর কিষাণের সমস্ত আশা-ভরসা ধ্বংস হয়ে যাবে। ফ্যাসিষ্ট রাজত্বে মজুর-কৃষকরা তাদের ন্যায়সঙ্গত দাবী তুলবারই সুযোগ পায় না; তাদের অবস্থা ক্রীতদাসদের মতো হয়ে ওঠে। আমাদের কাছে সোভিয়েত রাশিয়া অনেকগুলি রাষ্ট্রের মধ্যে একটি রাষ্ট্র নয়–একমাত্র রাষ্ট্র। সারা বিশ্বের মেহনতী জনসাধারণের বন্ধন-মুক্তির একমাত্র আমার প্রদীপ। ঐ প্রদীপের শিখা নিভে গেলে সারা দুনিয়ায় ঘোর অন্ধকার নেমে আসবে। তাই আমাদের দেহে যতক্ষণ প্ৰাণ আছে ততক্ষণ ঐ ফ্যাসিষ্ট স্বৈরাচারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাব।’

‘কিন্তু সুমের, দেশে আরও অনেক সমাজবাদী রয়েছে, তারাও তো চায় জগৎকে শোষণমুক্ত করতে।’

‘সেবাগ্রাম থেকে প্ৰলম্বিত অন্ধকারে যে-সব সমাজবাদীদের অস্তিত্ব তাদের অভিভাবক শয়তান। হিটলারও নিজেকে সমাজবাদী বলে, গান্ধীর চেলারাও। কিন্তু সমাজবাদী বলে নিজেকে জাহির করলেই কি সমাজবাদী হওয়া যায়!–ভারতবর্ষ হিটলার-তোজের শাসনাধীনে এলে এ দেশ থেকে পুঁজিপতিরা খতম হবে না। বরং আরও বেশি শক্তিশালী হবে। ফ্যাসিষ্ট শাসনে সাম্যবাদীদের কি হাল হয় সেটা ইতালী ও জার্মানীর সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর দিকে তাকালেই বুঝতে পারবে। শুধু তাই বা কেন, ফ্রান্সে প্রতিদিন বহু কমিউনিস্টকে গুলি করে মারা হচ্ছে। যে নিজেকে মার্কসৃবাদী মনে করে ও এই যুদ্ধ থেকে। নিরাপদ দূরত্বে থাকতে চায় সে একই সঙ্গে নিজেকে এবং অপরকে প্রতারিত করে।’

‘তার মানে তুমি বলতে চাও, এ যুদ্ধে কেউ নিরপেক্ষ থাকতে পারে না?’

‘ঠিক তাই। যার মস্তিষ্ক যথাযথভাবে কাজ করছে তাকে একটা না একটা পক্ষ। অবলম্বন করতেই হবে। এই যুদ্ধের পরিণতিতে হয়। সাম্যবাদী শক্তি খতম হয়ে যাবে না। হলে এমন শক্তিশালী হয়ে উঠবে যে, হিটলার-মুসোলিনী-তোজো এমন কি তাদের পিতৃপুরুষগণ-বন্ডউইন, চেম্বারলেন, হ্যালিফ্যাক্সদের পর রাখার মতো জমি দুনিয়ায় থাকবে না। যাদের তোমরা নিরপেক্ষ ভাবিছ তাদের নিরপেক্ষতা একটা লোক-দেখানো ব্যাপার।

‘আমাদের এখানকার ইংরেজদের মনোভাব তুমি কি লক্ষ্য করছ?’

‘ওরা অন্ধ-ত্রিশ বছর আগেকার জমানার গাড্ডায় পড়ে আছে এবং থাকতে চাইছে ওদের ধারণা যুদ্ধের শেষে দুনিয়ার হাল থাকবে যথা পূর্বম। এটাই স্বাভাবিক, যারা আমাদের প্রগতিশীল আন্দোলনের প্রতি পদে পদে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তারা পুরনোকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইবেই। দেখতেই পাচ্ছ, এ দেশের শাসক ইংরেজরা এখন সভামঞ্চ থেকে. ‘ জনগণকে আত্মত্যাগের উপদেশামৃত বিতরণ করছেন। অথচ গভর্নর, গভর্নর জেনারেলদের খরচের বহর দেখলে মাথা ঘুরে যায়। এ দেশের একজন মজুরের আয়ের সঙ্গে ঐ সব রাজপুরুষদের গত ২৫ বছরের আয়ের একটা তুলনা করলেই অসাম্যের আশমান-জমিন ফারাকটা খুব সহজেই বোঝা যায়। যেমন–

ভাইসরায়ের আয় ২,৫০,৮০০ টাকা, দেশীয় মজুরের তুলনায় ১০,০০০ গুণ।
বাংলার গভর্নরের আয় ১,২০,০০০ টাকা, দেশীয় মজুরের তুলনায় ৪,৮০০ গুণ।

যুক্ত প্রদেশের গভর্ণরের আয় ১,২০,০০০ টাকা, দেশীয় মজুরের তুলনায় ৪,৮০০ গুণ।

বিহারের গভর্নরের আয় ১,০০,০০০ টাকা, দেশীয় মজুরের তুলনায় ৪,০০০ গুণ।

এর সঙ্গে রাহা-খরচ, ছুটির বেতন এ সব ধরলে দেখা যাবে বাংলার গভর্নরের আয় একজন দেশীয় মজুরের তুলনায় ৪২,২৩১ গুণ বেশি। এর পাশপাশি ইংল্যাণ্ডের অবস্থাটা দেখ, সেখানে কয়লাখনির একজন মজুরের সাপ্তাহিক বেতন আমাদের হিসাবে ৩৫ টাকার মতো। ক্ষেত মজুরের সাপ্তাহিক আয় ৪৫ টাকার কাছাকাছি। এর সঙ্গে ইংল্যাণ্ডের প্রধানমন্ত্রীর বেতনের যদি তুলনা করা যায় তাহলে তিনি স্বদেশের মজুরশ্রেণীর তুলনায় ৩৬ গুণ বেশি পান। আর সোভিয়েত রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর বেতন সে দেশের সর্বনিম্ন মজুরীর মাত্র ৬ গুণ বেশি। আমাদের শেঠগোষ্ঠীর আয়ের অঙ্ক হিসাব করলে তো মাথা খারাপ হয়ে যাবার যোগাড়।

‘এ দেখছি লুটতরাজের চাইতেও বেশি।’

‘অপরিণামদর্শী ইংরেজদের কাছ থেকে আমরা সামান্য কিছুও আশা করি না কিম্বা; তাদের বাঁচাবার জন্যে আমরা এ যুদ্ধে সামিল হইনি। আমাদের লড়াই আগামী দিনের পৃথিবীতে সব মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য-যেখানে শোষণহীন সমাজ-ব্যবস্থায় মানবতা সুউচ্চ মহিমায় প্রতিষ্ঠিত হবে।’

সমদ এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এ বার জিজ্ঞেস করল, ‘সুমের, তোমার অনেক কথার সঙ্গে আমি এক মত আবার কিছু ব্যাপারে ভিন্ন মত পোষণ করি। কিন্তু তোমার আদর্শকে আমি কি পরিমাণে শ্রদ্ধা করি সেটা তো তুমি জানো। এটা আমিও স্বীকার করি যে, এই বিশ্বযুদ্ধে আমরা কেউই নিরপেক্ষ থাকতে পারি না। কিন্তু তুমি বিমানবাহিনীতে ভর্তি হবার পর খবরটা আমাদের দিলে কেন?’

‘হ্যাঁ আগে খবর দিই, আর বাছাই-পর্বে ছাঁটাই হয়ে যাই! ভর্তি হয়ে ২৪ ঘণ্টা আকাশে। উড়ে তবেই তোমাদের জানিয়েছি। এখন জানাজানি হলে কোনো ক্ষতি নেই কারণ পরশু। আম্বালায় বিমান-চালনা প্ৰশিক্ষণ কেন্দ্রে চলে যাচ্ছি।’

‘তোমার মাকে খবর দিয়েছ?’

মা’র কাছে পাটনাও যা, আম্বালাও তাই। যতক্ষণ পরিষ্কারভাবে তাকে জানাতে না পারছি-আমি যুদ্ধের সৈনিক হিসাবে মৃত্যুর মুখে চলেছি ততক্ষণ তাঁর কাছে সবই এক। মাকে এখনই সব কথা খোলাখুলি লেখার অর্থ তাঁর সর্বক্ষণের ঘুম কেড়ে নেওয়া। আমি ঠিক করেছি, যতদিন বেঁচে থাকিব ততদিন তাঁকে নিয়মিত চিঠি দিয়ে যাব, আর এতেই তিনি শান্তি পাবেন।’

‘বারবার তোমার সাহসের কথাটাই ভাবছি।’

‘মানুষ হয়ে জন্মানোর মূল্য শোধ দেবার জন্য সদা-প্রস্তুত থাকতে হয় সমদ, তাছাড়া, যে আদর্শে আমি বিশ্বাসী তাতে আমার দায়িত্ব অনেক বেশি।’

‘তোমার ধারণা এই যুদ্ধের পরিণতিতে বিশ্বে বিরাট পরিবর্তন সূচনা করবো?’

আগের মহাযুদ্ধ পৃথিবীতে অনেক কিছু ঘটিয়ে দিয়েছে। রাশিয়ার সাম্যবাদী শক্তির উত্থান, পৃথিবীর এক ষষ্ঠাংশ মেহনতী মানুষের রাজ্য কায়েম করা বড় কম কথা নয়। তাই বর্তমান মহাযুদ্ধের শেষে-আমার বিশ্বাস, এই আকাশের নিচে এক নতুন পৃথিবী জেগে উঠবে। আমাদের সঙ্গে রয়েছে মহান সোভিয়েত, রয়েছে তার লালফৌজ, চীন, ইংলণ্ড আমেরিকার জনগণ সর্বস্ব পণ করে এই যুদ্ধে লড়ছে, তাই জয় আমাদের সুনিশ্চিত।’

সমদ ও রূপাকিশোরদের তল্লাটে পাকিস্তানের দাবী নিয়ে আলোড়ন উঠেছে। রূপকিশোর সেই প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলল, ‘গান্ধীবাদী স্বরাজ আসুক অথবা সাম্যবাদী স্বরাজ প্রতিষ্ঠা হোক, সেটা হবে গোটা ভারতবর্ষের জন্যে। মতভেদ থাকতে পারে, কিন্তু স্বরাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে অখণ্ড ভারতে—আর এতে কি কোনো দ্বিমত থাকতে পারে সুমেরবাবু?

‘রূপকিশোর, ভারতবর্ষ শব্দটি একটি জটিল ধারণা মাত্র। স্বাধীনতা আমরা চাই কিন্তু এই দেশের জনগণই ঠিক করবে তাদের স্বাধীনতার স্বরূপ। স্বাধীনতা আকাশ থেকে টুপ। করে এ দেশের পুঁজিপতিদের মুঠোর মধ্যে পড়লে সেটা তো আর দেশের জনসাধারণের স্বাধীনতা হবে না!’

রূপ, ‘তোমার আদর্শ মতো স্বাধীনতা না-হয় এল, কিন্তু সেই স্বাধীনতার জন্য অখণ্ড ভারতকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করা চলতে পারে না।’

সুমের, ‘রূপকিশোর, তুমি শব্দের গোলকধাঁধায় পড়ে গেছ। ভারত খণ্ডিত হওয়া বা অখণ্ডিত থাকা নির্ভর করছে সম্পূর্ণভাবে ভারতবাসীদের ওপর। একদা হিন্দুকুশ পার হয়ে আমুদরিয়া পর্যন্ত ভারত রাষ্ট্রের সীমা ছিল এবং ভাষা, রীতি-রেওয়াজ ও ইতিহাসের দিক থেকে আফগান জাতি ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত ছিল। দশম শতাব্দী পর্যন্ত কাবুল হিন্দুরাজ্য ছিল—অখণ্ড হিন্দুস্থানওয়ালারা হিন্দুকুশ পর্যন্ত থাবা বাড়াতে রাজি আছে?

সিন্দু নদীর পশ্চিমে বসবাদকারী আফগানদের যদি ইচ্ছার বিরুদ্ধে অখণ্ড ভারতরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করা না যায় তাহলে সিন্ধু, পশ্চিম পাঞ্জাব, কাশ্মীর, ও পূর্ববাংলার জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেন তাদের অখণ্ড ভারতরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে?’

রূপ, ‘তাহলে ওদের ভারতবর্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে দিতে হবে!’

সুমের, ‘নিশ্চয়ই। আমরা জনগণের জন্যে লড়াই করছি, এর অর্থ হল যে, সমগ্র দেশের জনগণের কোনো একটি অংশকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক পরাধীনতায় রাখা চলবে না। পাকিস্তানের দাবীর মীমাংসা করা হিন্দু নেতাদের কাজ নয়, ঐ প্রশ্নের সমাধানের দায়িত্ব মুসলমান–প্রধান প্রদেশগুলি জনসাধারণের। যদি আমরা জনগণের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে না পারি। তবে পুঁজিপতি-রাজ কায়েম হবে এবং স্বতন্ত্র পাকিস্তান রাষ্ট্রও গড়ে উঠবে। যদি কায়িক ও মানসিক শ্রমজীবী মানুষের রাজত্ব কায়েম করতে পারি। তবে এই ভারতবর্ষের বহু স্বতন্ত্র জাতিগোষ্ঠীর এক অখণ্ড রাষ্ট্র গড়ে উঠবে। কিন্তু তার আগেই ভাষাগতভাবে পৃথক আশীটির বেশি স্বতন্ত্র জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব যে এই বিশাল দেশে রয়েছে সেটা স্বীকার করে নিতে হবে।

‘আশীর বেশী? তুমি যে পাকিস্তানের দাবীকেও হার মানালে!’

‘যা বাস্তব তাকে অস্বীকার করি কি করে? আর মাতৃভাষা তাকেই বলে, যে ভাষায় কথা বলতে একটি বালকও ব্যাকরণে ভুল করে না। সোভিয়েত দেশ হল সত্তরটি জাতির সম্মেলনে এক বহুজাতিক রাষ্ট্র। সোভিয়েত দেশের দ্বিগুণ জনসংখ্যা অধুষিত ভারতবর্ষে যদি আশীটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তা থাকে।তবে অবাক হওয়ার কি আছে?’

‘তবে কি তুমি পাকিস্তানের দাবীর পক্ষে?’

‘যতদিন এ দেশের গরিষ্ঠসংখ্যক মুসলমান ঐ দাবী করবেন, ততদিন পর্যন্ত। এটা তো দেখাই যাচ্ছে সমস্ত মুসলিম নেতারা ঐ দাবীতে অনড়। অমুসলমানদের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের দাবীর বিরোধিতা করা ন্যায়সঙ্গত নয়। যদি মুসলমান-প্রধান প্রদেশের অধিকাংশ মানুষ অখণ্ড ভারতরাষ্ট্র থেকে পৃথক হয়ে যেতে চান তবে তাঁদের সে অধিকার মেনে নেওয়া উচিত।’

 

৩.

নিচে কালো সমুদ্রের জলরাশি যেন প্রাণহীন, সামনে সাদা মেঘের বিশাল পাহাড়। চলন্ত বিমানে বসে এমনিতে গতিবেগ অনুভব করা যায় না। অবশ্য সুমের তার সামনের গতি-পরিমাপক যন্ত্রে দেখল, সে ৩০০ মাইল বেগে উড়ে চলেছে। সুমের ভাবছিল, সুদূর অতীতে মানুষ যখন পাথরের অমসৃণ হাতিয়ার আবিষ্কার করেছিল সেই সময়ের কথা। নিশ্চয়ই সেদিনের মানুষ ঐ পাথরের অস্ত্ৰ হাতে নিয়েই নিজেকে প্রচণ্ড শক্তিধর মনে করেছিল। আর আজ মানুষ আকাশের অধীশ্বর। মানুষের অগ্রযাত্রার গতিবেগও কি প্রবল। সহসা তার মনে পড়ে-মানবতার ঘৃণ্যতম শত্রু ফ্যাসিষ্টদের কথা। যাদের চেষ্টা, মানব প্রগতির অবদানগুলির সাহায্য নিয়ে সমগ্র মানবজাতিকে গোলামীর শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রাখা। ঘৃণায় সুমেরের দেহমন রি-রি করে ওঠে, তার খেয়াল হল প্রতিবেশী ব্ৰহ্মদেশ জাপানী ফ্যাসিষ্টদের কবলে। ভাবনার গতিমুখ ঘুরে চলে স্বদেশের মাটিতে… কদমকুঁয়ার ঘর-বাড়ি, মানুষজন, সেখানে একটি মেয়ে যে তার প্রিয়া। তার বৃদ্ধা মা, যে অচ্ছুৎসমাজের মধ্যে আজন্ম বন্দী হয়ে থেকে তার মতো একটি ছেলেকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে।

এই সব নিকট-দূর স্বদেশের মানুষের জন্য ভাবনা ও ভালোবাসা থেকেই তার মনে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঘৃণার আগুন প্রচণ্ড তেজে জ্বলতে আরম্ভ করে। আর ঠিক সেই সময়েই সে সামনে দেখতে পেল সূর্য-চিহ্নিত তিনটি জাপানী বিমান। সুমের বেতারে খবর পাঠিয়ে দিল, ‘দুমিনিটের মধ্যেই জাপানী বিমানের মোকাবিলা করতে হবে।’ কথা-বলতে সময় লাগে, তার চেয়েও বেশি লাগে লিখতে কিন্তু চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে সুমেরের মেশিনগানের কার্যকরী আওতায় চলে এল জাপানী বিমান তিনটি।

ট্ট..ট্ট..ট্ট-নিখুঁত নিশানায় সুমেরের মেশিনগানের এক ঝাক গুলী বাতাস কেটে জাপানী বিমানগুলিকে বিদ্ধ করল আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফ্যাসিষ্ট দস্যুদের বিমান তিনটি সমুদ্রের বুকে আছড়ে পড়ল।

সুমেরের নিজের নৈপুণ্য প্রকাশ করার এটাই ছিল প্রথম সুযোগ। এই সাফল্যে সে খুব খুশী হল। ফিরতি পথে অন্য এক বৈমানিক শরীফকে বলল, ‘আমার নিজের দাম উশুল করে নিয়েছি। এই ভাবে আমরা প্ৰত্যেকে যদি তিনটি করে ফ্যাসিষ্ট বিমান ধ্বংস করতে পারি তা হলে আর কোনো ভাবনা নেই। এর পর যদি আমি মারাও যাই তবু সান্ত্বনা থাকবে যে, মৃত্যুর আগে আমার কর্তব্য কিছুটা পালন করতে পেরেছি।’

সুমের আরও ২০০ বার বিমান-যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল এবং প্রায় ১০০ জাপানী বিমান তার হাতে ধ্বংস হয়েছিল। জীবনের শেষ দিনে একটি বিরাট জাপানী বোমারু বিমান ধ্বংস করে সে বিরল কৃতিত্ব অর্জন করে। বোমারু বিমানটির পাহারাদার জঙ্গী বিমানগুলিকে ফাঁকি দিয়ে সে বোমারু বিমানটিকে ধ্বংস করে দেয়। সেই সঙ্গে সুমের ও তার–সঙ্গী বিমানচালকটিও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়

Exit mobile version