Site icon BnBoi.Com

বাঙালী হিন্দুর বর্ণভেদ – নীহাররঞ্জন রায়

বাঙালী হিন্দুর বর্ণভেদ - নীহাররঞ্জন রায়

০১. বাঙালী হিন্দুর বর্ণভেদ

বাঙালী হিন্দুর বর্ণভেদ

নিবেদন

বর্তমান নিবন্ধে আমি বাঙালী হিন্দুর বর্ণভেদের গোড়ার কথা বলিতে চেষ্টা করিয়াছি। বলা বাহুল্য, আমার দৃষ্ট ঐতিহাসিকের এবং ঐতিহাসিক বিচার ও যুক্তি-পদ্ধতি অনুযায়ী যে-সব সাক্ষ্যপ্রমাণ গ্রাহ্য আমি যথাসম্ভব তাহাই ব্যবহার করিয়াছি। বিষয়টি জটিল, উচ্চতর বর্ণসমাজে আচরিত এবং প্রচলিত ধারণ ও বিশ্বাস ইহাকে জটিলতর করিয়াছে। তৎসত্ত্বেও আমার জ্ঞানবুদ্ধি অনুযায়ী ঐতিহাসিক সত্য অবিকৃতভাবে উপস্থিত করিতে চেষ্টা করিয়াছি এই বিশ্বাসে যে, আমার দেশবাসী স্বচ্ছ ও নির্মোহ দৃষ্টি লইয়া এই জটিল সমস্যাটি বুঝিতে চেষ্টা করিবেন।

ইতি শ্রাবণ ১৩৫২
নীহাররঞ্জন রায়

.

বর্ণাশ্রম প্রথার জন্মের ইতিহাস আলোচনা না করিয়াও বলা যাইতে পারে, বর্ণবিন্যাস ভারতীয় সমাজ-বিন্যাসের ভিত্তি। খাওয়া-দাওয়া এবং বিবাহ ব্যাপারের বিধিনিষেধের উপর ভিত্তি করিয়া আর্যপূর্ব ভারতবর্ষের যে সমাজ-ব্যবস্থার পত্তন ছিল তাহাকে পিতৃপ্রধান আর্যসমাজ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া ঢালিয়া সাজাইয়া নুতন করিয়া গড়িয়াছিল। এই নূতন করিয়া গড়ার পশ্চাতে একটা সামাজিক ও অর্থনৈতিক যুক্তি কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু সে-সব আলোচনা বর্তমান ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক। যে-যুগে বাংলা দেশের ইতিহাসের সূচনা সে-যুগে বর্ণাশ্রম আদর্শ গড়িয়া উঠিয়াছে, ভারতীয় সমাজের উচ্চতর এবং অধিকতর প্রভাবশালী শ্রেণীগুলিতে তাহা স্বীকৃত হইয়াছে, এবং ধীরে ধীরে তাহা পূর্ব ও দক্ষিণ ভাবতবর্ষে বিস্তৃত হইতেছে। বর্ণাশ্রমের এই সামাজিক আদর্শের বিস্তারের কথাই এক হিসাবে ভাবতবর্ষে আর্য সংস্কার ও সংস্কৃতির বিস্তা্রের ইতিহাস, কারণ ঐ আদর্শের ভিতরই ঐতিহাসিক যুগের ভারতবর্ষের সংস্কার ও সংস্কৃতির সকল অর্থ নিহিত। বর্ণাশ্রমই আর্যসমাজের ভিত্তি, শুধু ব্রাহ্মণ্য সমাজেরই নয়, জৈন এবং বৌদ্ধ সমাজেরও। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া আর্যপূর্ব ও অনার্য সংস্কার এবং সংস্কৃতি এই বর্ণাশ্রমের কাঠামো এবং আদর্শের মধ্যেই সমন্বিত ও সমীকৃত হঠযাছে। বস্তুত, বর্ণাশ্রমগত সমাজ-বিন্যাস এক হিসাবে যেমন ভারত-ইতিহাসের প্রধান বৈশিষ্টা, তেমনই অন্য দিকে এমন সর্বব্যাপী এমন সবগ্রাসী এবং গভীর অর্থবহ সমাজ-ব্যবস্থা ও পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। প্রাচীন বাংলার সমাজ-বিন্যাসের কথা বলিতে গিয়া সেই জন্য বর্ণবিন্যাসের কথা বলিতেই হয়।

বর্ণাশ্রম প্রথা ও অভ্যাস যুক্তিপদ্ধতিবদ্ধ করিয়াছিলেন প্রাচীন ধৰ্ম স্বত্র ও স্মৃতিগ্রন্থের লেখকেরা। ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্র এই চাতুবর্ণ্যের কাঠামোর মধ্যে তাঁহারা সমস্ত ভারতীয় সমাজ-ব্যবস্থাকে বাঁধিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। এই চাতুর্বর্ণ প্রথা অলীক উপন্যাস, এ সম্বন্ধে সন্দেহ নাই। কারণ ভারতবর্ষে এই চতুৰ্বর্ণের বাহিরে অসংখ্য বর্ণ, জন ও কোম ছিল, প্রত্যেক বর্ণ, জন ও কোমের ভিতর আবার ছিল অসংখ্য স্তর উপস্তর। ধর্মসূত্র ও স্মৃতিকারেরা নানা অভিনব অবাস্তব উপায়ে এই সব বিচিত্র বর্ণ, জন ও কোমের স্তর-উপস্তর ইত্যাদি ব্যাখ্যা করিতে এবং সবকিছুকেই আদি চাতুৰ্বর্ণের কাঠামোর যুক্তিপদ্ধতিতে বাঁধিতে চেষ্ট৷ করিয়াছেন। সেই মনু-যাজ্ঞবল্ক্যের সময় হইতে আরম্ভ করিয়া পঞ্চদশ ষোড়শ শতকে রঘুনন্দন পর্যন্ত এই চেষ্টার কখনও বিরাম হয় নাই। একথা অবশ্যস্বীকার্য যে স্মৃতিকারদের রচনার মধ্যে সমসামযিক বাস্তব সামাজিক অবস্থার প্রতিফলন আছে, সেই অবস্থার ব্যাখ্যার একটা চেষ্টা আছে; কিন্তু যে-যুক্তিপদ্ধতির আশ্রয়ে তাহা করা হইয়াছে অর্থাং চাতুর্বর্ণ্যের বহির্ভূত অসংখ্য বর্ণ, জন ও কোমের নরনারীর সঙ্গে চাতুর্বৰ্ণাকৃত নরনারীর যৌনমিলনের ফলে সমাজের যে বিচিত্র বর্ণ ও উপরর্ণের, বিচিত্ৰত্র সংকব বর্ণের সৃষ্টি করা হইয়াছে, তাহা একান্তই অনৈতিহাসিক এবং সেই হেতু অলীক। তৎসত্ত্বেও স্বীকার করিতেই হয় আর্যব্রাহ্মণ্য ভারতীয় সমাজ আজও এই যুক্তিপদ্ধতিতে বিশ্বাসী, এবং সুদূর প্রাচীন কাল হইতে আদি চাতুর্বর্ণ্যের যে কাঠামো ও যুক্তিপদ্ধতি অনুযায়ী বর্ণব্যাখ্যা হইয়া আসিয়াছে সেই ব্যাখ্যা প্রয়োগ করিয়া হিন্দুসমাজ আজও বিচিত্র বর্ণ, উপবর্ণ ও সংকর বর্ণের সামাজিক স্থান নির্ণয় করিম থাকেন। বাংলাদেশেও তাহার ব্যতিক্রম হয় নাই, আজও হইতেছে না।

এই সব বিচিত্র বর্ণ, উপবর্ণ, সংকর বর্ণ সকল কালে ও ভারতবর্ষের সকল স্থানে এক প্রকারের ছিল না, এখনও নয়; সকল স্মৃতিশাস্ত্রে সেইজন্য এক প্রকারের বিবরণ ও পাওয়া যায় না। প্রাচীন স্মৃতিগ্রন্থগুলির একটিও বাংলাদেশে রচিত নয়; কাজেই বাংলার বর্ণবিন্যাসগত সামাজিক অবস্থার পরিচয় ও তাহাতে পাওয়া যায় না, আশা করাও অযৌক্তিক এবং অনৈতিহাসিক। বস্তুত, একাদশ শতকের আগে বাংলাদেশে বাংলাদেশের সামাজিক প্রতিফলন লইয়া একটিও স্মৃতিগ্রন্থ বা এমন কোনও গ্রন্থ রচিত হয় নাই যাহার ভিতর সমসাময়িক কালের বর্ণবিন্যাসের ছবি কিছুমাত্র পওয়া যাইতে পারে। বিশ্বাসযোগ্য ঐতিহাসিক সাক্ষ্য-প্রমাণ স্বীকার করিলে বলিতেই হয়, এই সময় হইতেই বাঙালী স্মৃতি ও পুরাণকারের সজ্ঞানে ও সচেতন ভাবে বাংলার সমাজ-ব্যবস্থাকে প্রাচীনতর ব্রাহ্মণ্য স্মৃতির আদর্শ ও যুক্তিপদ্ধতি অনুযায়ী ভারতীয় বর্ণবিন্যাসের কাঠামোর মধ্যে বাঁধিবার চেষ্টা আরম্ভ করেন। কিন্তু এই সজ্ঞান সচেতন চেষ্টার আগেই, বহুদিন হইতেই, আর্যপ্রবাহ বাংলাদেশে প্রবাহিত হইতে আরম্ভ করে; এবং আর্যধর্ম ও সংস্কৃতির স্বীকৃতির সঙ্গে সঙ্গেই বর্ণাশ্রমের যুক্তি এবং আদর্শ ও স্বীকৃতি লাভ করে। সেইজন্য প্রাচীন বাংলার বর্ণবিন্যাসের কথা বলিতে হইলে বাংলার আর্যীকরণের সূত্রপাতের সঙ্গে সঙ্গেই তাহা আরম্ভ করিতে হয়।

০২. উপাদান-বিচার

আর্যীকরণের তথা বাংলার বর্ণবিন্যাসের প্রথম পর্বের ইতিহাস নানা সাহিত্যগত উপাদানের ভিতর হইতে খুঁজিয়া বাহির করিতে হয়। সে-উপাদান রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, মনু-বৌধায়ন প্রভৃতি স্মৃতি ও সূত্রকারদের গ্রন্থে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। বৌদ্ধ ও জৈন প্রাচীন গ্রন্থাদিতে ও এ-সঙ্গন্ধে কিছু কিছু তথ্য নিহিত আছে। উত্তরবঙ্গে এবং বাংলাদেশের অন্যত্র গুপ্তাধিপত্য প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে আর্যীকরণ তথা বাংলার বর্ণবিন্যাসের দ্বিতীয় পর্বের সূত্রপাত। এই সময় হইতে আবম্ভ করিয়া একেবারে ত্রয়োদশ শতকের শেষ পর্যন্ত বর্ণবিন্যাস-ইতিহাসেব প্রচু্র উপাদান বাংলার অসংখ্য লিপিমালায় বিদ্যমান। বস্তৃত, সন-তারিখযুক্ত এই লিপিগুলির মত বিশ্বাসযোগ্য নির্ভরযোগ্য যথার্থ বাস্তব উপাদান আর কিছু হইতেই পারে না; এইগুলির উপর নির্ভর করিয়াই বাংলার বর্ণবিন্যাসের ইতিহাস রচনা করা যাইতে পারে, এবং তারা করাই সর্বাপেক্ষ নিরাপদ। বতর্মান নিবন্ধে আমি তাহাই করিতে চেষ্টা করিব। সঙ্গে সঙ্গে সমসাময়িক দু-একটি কাব্যগ্রন্থের, যেমন রামচরিতের সাহায্যও লওয়া যাইতে পারে। ইহাদের ঐতিহাসিকতা অবশ্যস্বীকার্য।

তবে, সেন-বর্মণ আমলে বাংলাদেশে প্রচুর স্মৃতি ও ব্যবহার গ্রন্থ রচিত হইয়াছিল। সেগুলি কখন কোন রাজার আমলে ও পোষকতায় কে রচনা করিযাছিলেন তাহা সুনির্ধারিত ও সুবিদিত। সমস্ত স্মৃতি ও ব্যবহার গ্রন্থ কালের হাত এড়াইয়া আমাদের কালে আসিয়া পৌঁছায় নাই; অনেক গ্রন্থ লুপ্ত হইয়া অথবা হারাইয়া গিয়াছে। কিছু কিছু যাহা পাওয়া গিয়াছে তাহার মধ্যে ভবদেব ভট্টের ও জীমূতবাহনের কয়েকটি গ্রন্থই প্রধান। এই সব স্মৃতি ও ব্যবহার গ্রন্থের সাক্ষ্য প্রামাণিক বলিয়া স্বীকার করিতে কোনও বাধা নাই; এবং লিপিমালায় যে-সব তথ্য পাওয়া যায়, সে-সব তথ্য এই স্মৃতি ও ব্যবহার গ্রন্থের সাহায্যে ব্যাখ্যা করিলে অনৈতিহাসিক বা অযৌক্তিক কিছু করা হইবে না।

স্মৃতি ও ব্যবহার গ্রন্থ ছাড়া অন্তত দুইটি অর্বাচীন পুরাণ-গ্রন্থ বৃহদ্ধর্মপুরাণ ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, গোপালভট্ট-আনন্দভট্টকৃত বল্লালচরিত, এবং বাংলার কুলজী গ্রন্থমালায় হিন্দুযুগের শেষ অধ্যায়ের বর্ণবিন্যাসের ছবি কিছু পা ওয়া যায়। কিন্তু ইহাদের একটিকেও সমসামযিক সাক্ষ্য বলিয়া স্বীকার করা যায় না। সেইজন্য ইতিহাসের উপাদান হিসাবে ইহার কতখানি নির্ভরযোগ্য সে-বিচার আগেই একটু সংক্ষিপ্ত ভাবে করিয়া লওয়া প্রযোজন।

 

বৃহদ্ধর্মপুরাণব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ

বৃহদ্ধর্ম ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের (১) ঐতিহাসিক নির্ভরযোগ্যতা সম্বন্ধে কিছু কিছু বিচারালোচনা হইয়াছে।(২) প্রথমোক্ত পুরাণটিতে পদ্মা ও বাংলাদেশের যমুনা নদীর উল্লেখ, গঙ্গার তীর্থমহিমার সবিশেষ উল্লেখ, ব্রাহ্মণের মাছমাংস খাওয়ার বিধান (যাহা ভারতবর্ষের আর কোথাও বিশেষ নাই) ব্রাহ্মণেতব সমস্ত শূদ্রবর্ণের ছত্রিশটি উপ ও সংকর বর্ণে বিভাগ (বাংলার থাকথিত ‘ছত্রিশ জাত’ যাহা ভারতবর্ষে আর কোথাও দেখা যায় না) ইত্যাদি দেখিয়া মনে হয় এই পুরাণটির লেখক বাঙালী না হইলেও বাংলাদেশের সঙ্গে তাহার সবিশেষ পরিচয় ছিল। ক্ষত্রিম এবং বৈশ্য বর্ণের পৃথক অনুল্লেখ, ‘সৎ’ ও ‘অসৎ’ পর্যায়ে শূদ্রদের দুই ভাগ, ব্রাহ্মণদের পরেই অম্বষ্ঠ (বৈদ্য) এবং করণ (কায়স্থ)দের স্থান নির্ণয়, শংখকার (শাঁখারী), মোদক (ময়রা), তন্তুবায়, দাস (চাষী), কর্মকার, সুবর্ণবণিক ইত্যাদি উপ ও সংকর বর্ণের উল্লেখ প্রভৃতি ও এই অনুমানের সমর্থক। বাংলাদেশের বাহিরে অন্যত্র কোথাও এই ধরনের বর্ণব্যবস্থা এবং এই সব সংকর বর্ণ দেখা যায় না। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ সম্বন্ধে ও প্রায় একই কথা বলা চলে; বস্তুত, বৃহদ্ধর্মপুবাণ ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের বর্ণব্যবস্থার চিত্র প্রায় এক এবং অভিন্ন, এবং তাহা যে বাংলাদেশ সম্বন্ধেই বিশেষভাবে প্রযোজ্য ইহা ও অস্বীকার করা যায় না। এই দুই গ্রন্থের রচনাকাল নির্ণয় করা কঠিন; তবে এই কাল দ্বাদশ শতকের আগে নয় এবং চতুর্দশ শতকের পরে নয় বলিয়া অনুমিত হইয়াছে।(৩) এই অনুমান সত্য বলিয়াই মনে হয়। যদি তাহা হয় তাহা হইলে বলা যায়, এই দুই পুরাণে বাংলার হিন্দুযুগের শেষ অধ্যায়ের বর্ণবিন্যাসের ছবির একটা মোটামুটি কাঠামো পাওয়া যাইতেছে।

 

বল্লালচরিত

বল্লালচরিত নামে দুইখানি গ্রন্থ প্রচলিত। একখানির গ্রন্থকার আনন্দভট্ট; নবদ্বীপের রাজা বুদ্ধিমন্ত খাঁর আদেশে তাঁহার গ্রন্থপনি রচিত হয়। রচনাকাল ১৫১০ খ্ৰীষ্টাব্দ।(৪) আনন্দভট্টের পিতা দাক্ষিণাত্যগত ব্রাহ্মণ, নাম অনন্তভট্ট। আর একখানি গ্রন্থ পূর্বখণ্ড, উত্তরখণ্ড ও পবিশিষ্ট এই তিন খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম এবং দ্বিতীয় খণ্ডের রচল্লিতার নাম গোপালভট্ট, গোপাভট্ট নাকি বল্লালসেনের অন্যতম শিক্ষক ছিলেন, এবং বল্লালের আদেশানুসারে ১৩০০ শকে নাকি গ্রন্থখানি রচিত হয়। তৃতীয় খণ্ড রাজার ক্ৰোধোৎপাদনের ভয়ে গোপালভট্ট নিজে লিখিয়া যাইতে পারেন নাই; দুই শত বৎসর পর ১৫০০ শকে আনন্দভট্ট তাহা রচনা করেন।(৫) দ্বিতীয় গ্রন্থটিতে নানা কুলজীবিবরণ, বিভিন্ন বর্ণের উৎপত্তিকথা ইত্যাদি আছেই, তাহা ছাড়া প্রথম গ্রন্থে বল্লাল কর্তৃক বণিকদের উপর অত্যাচার, সুবর্ণবণিকদের সমাজে ‘পতিত’ করা এবং কৈবর্ত প্রভৃতি বর্ণের লোকদের উন্নীত করা প্রভৃতি যে-সব কাহিনী বর্ণিত আছে তাহারও পুনঃবিবৃতি আছে। দ্বিতীয় গ্রন্থে বল্লালের যে তারিখ দেওয়া হইয়াছে তাত বল্লালের যথার্থ কাল নয়; কাজেই গোপালভট্ট বল্লালের সমসাময়িক ছিলেন একথাও সত্য নহে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় এই গ্রন্থটিকে বলিয়াছিলেন ‘জাল’; আর শাস্ত্রী মহাশয় সম্পাদিত প্রথম গ্রন্থটিকে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় বলিয়াছিলেন ‘জাল’।(৬)

বল্লালচরিতের কাহিনীটি সংক্ষিপ্তাকালে উল্লেখযোগ্য।
“সেনরাজ্যে বল্লভানন্দ নামে একজন মস্তবড় ধনী বণিক ছিলেন। উদন্তপুরীর রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিবার জন্য বল্লালসেন বল্লভানন্দের নিকট হইতে একবার এক কোটি নিষ্ক ধার করেন। বারবার যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর বল্লাল আর একবার শেষ চেষ্টা কবিবার জন্য প্রস্তুত হন, এবং বল্লভানন্দের নিকট হইতে আরও দেড় কোটি সুবর্ণ (মুদ্রা) ধার চাহিয়া পাঠান। বল্লভানন্দ সুবর্ণ পাঠাইতে রাজী হন, কিন্তু তৎপরিবর্তে হরিকেলির রাজস্ব দাবি করেন। বল্লাল ইহাতে ক্রদ্ধ হইয়া অনেক বণিকের ধনরত্ব কাড়িয়া লন এবং নানাভাবে তাহদের উপর অত্যাচার করেন। ইহার পর আবার সৎশূদ্রদের সঙ্গে এক পংক্তিতে বসিযা আহার করিতে তাঁহাদের আপত্তি আছে বলিয়া বণিকেরা রাজপ্রাসাদে এক আহারের আমন্ত্রণ অস্বীকার করে। এই প্রসঙ্গেই বল্লাল শুনিতে পান যে বণিকদের নেতা বল্লভানন্দ পালরাষ্ট্রের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করিতেছেন, এবং মগধের রাজা তাহার জামাতা। বল্লাল অতিমাত্রায় ক্রুদ্ধ হইয়া সুবর্ণবণিকদের শূদ্রের স্তরে নামাইয়া দিলেন, তাহাদের পূজা অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করিলে, তাহাদের কাছ হইতে দান গ্রহণ করিলে কিংবা তাহাদের শিক্ষাদান করিলে ব্রাহ্মণেরাও ‘পতিত’ হইবেন, সঙ্গে সঙ্গে এই বিধানও দিয়া দিলেন। বণিকের তখন প্রতিশোধ লইবার জন্য দ্বিগুণ ত্রিগুণ মূল্য দিয়া সমস্ত দাসভৃত্যদের হাত করিয়া ফেলিল। উচ্চবর্ণের লোকের বিপদে পড়িয়া গেলেন। বল্লাল তখন বাধ্য হইয়া কৈবর্তদিগকে জলচল সমাজে উন্নীত করিয়া দিলেন, তাহাদের নেতা মহেশকে মহামাগুলিক পদে উন্নীত করিলেন। মালাকার, কুম্ভকার এবং কর্মকার, ইহারাও সৎশূদ্র পর্যায়ে উন্নীত হইল। সূবর্ণবণিকদের পৈতা পরা নিষিদ্ধ হইয়া গেল; অনেক বণিক দেশ ছাডিয়া অন্যত্র পলাইয়া গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে বল্লাল উচ্চতর বর্ণের মধ্যে সামাজিক বিশৃংখল দেখিয়া অনেক ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়কে শুদ্ধিযজ্ঞের বিধান দিলেন। ব্যবসায়ী নিম্নশ্রেণীর ব্রাহ্মণদের ব্রাহ্মণত্ব একেবারে ঘুচিয়া গেল, তাহারা ব্রাহ্মণ-সমাজ হইতে ‘পতিত’ হইলেন।“

কাহিনীটির ঐতিহাসিক যাথার্থ্য স্বীকাব করা কঠিন; কিন্তু ইহাকে একেবারে অলীক কল্পনাগত উপন্যাস বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া আরও কঠিন। গ্রন্থদুটিকেও ‘জাল’ বলিয়া মনে করিবার যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান নাই। সেনবংশ ‘ব্রহ্মক্ষত্ৰ’ বংশ; বল্লাল সেন কলিঙ্গরাজ চোড়গঙ্গের বন্ধু ছিলেন (সমসাময়িক তাহারা ছিলেনই); বল্লালের সমযে কীকটমগধ পালবংশের করায়ত্ত ছিল এবং তাহার আমলেই পালবংশের অবসান হইয়াছিল; বল্লাল মিথিলায় সমরাভিযান প্রেরণ করিয়াছিলেন— বল্লালচরিতের এই সব তথ্য অন্যান্য স্বতন্ত্র সুবিদিত নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্যপ্রমাণ দ্বারা সমর্থিত। এই সব হেতু দেখাইয়া কোনও কোনও ঐতিহাসিক যথার্থই বলিয়াছেন, বল্লালচরিত ‘জাল’ গ্রন্থ নয়, এবং ইহার কাহিনী একেবারে ঔপন্যাসিকও নয়। তাহাদের মতে ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে প্রচলিত লোক-কাহিনীর উপর নির্ভর করিয়া বল্লালচরিত এবং এই জাতীয় অন্যান্য গ্রন্থ রচিত হইয়াছিল; কেহ কেহ ইহাও মনে করেন যে “The Vallala charità contains the distorted echo of an internal disruption caused by the partisans of the Pāla dynasty which proved an important factor in the collapse of the Sena rule in Bengal.” এই মত সর্বথা নির্ভরযোগ্য।(৭) তবে, এই কাহিনীকে যতটা বিকৃত প্রতিধ্বনি বলিয়া মনে করা হয় আমি ততটা বিকৃত বলিয়া মনে করি না। আমরা জানি কৈবর্তরা পালরাষ্ট্রের প্রতি খুব প্রসন্ন ছিলেন না, একবার তাঁহারা বিদ্রোহী হইয়া এক পালরাজাকে হত্যা করিয়া বরেন্দ্রী বহুদিন তাঁহাদের করায়ত্তে রাখিয়াছিলেন। কাজেই সেই কৈবর্তদের প্রসন্ন করা এবং তাঁহাদের হাতে রাখিতে চেষ্টা করা বল্লালের পক্ষে অস্বাভাবিক কিছু ছিল না, বিশেষত মগধের পালদের সঙ্গে শত্রুতা যখন তাঁহাদের ছিলই। দ্বিতীয়ত, অন্যান্য সাক্ষ্যপ্রমাণ হইতে সেন-রাষ্ট্রেব সামাজিক আদশের, স্মৃতি ও পুরাণ গ্রন্থাদিতে সমসাময়িক সমাজ-বিন্যাসের যে পরিচয় আমরা পাই তাহাতে স্পষ্টই মনে হয় সমাজে বণিকদের স্থান খুব শ্লাঘ্য ছিল না। বৃহদ্ধর্মপুরাণে তাঁতী, গন্ধবণিক, কর্মকার, তৌলিক, (সুপারি ব্যবসায়ী), কুমার, শাঁখারী, কাঁসারী, বারজীবী (বারুই), মোদক, মালাকার সকলকে উত্তম সংকর পর্যায়ে গণ্য করা হইয়াছে, অথচ স্বর্ণকার-সুবর্ণবণিকেরা ধীবর-রজকের সঙ্গে জল-অচল মধ্যম সংকর পর্যায়ে। ইহার তো কোনও যুক্তিসংগত কারণ খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। বল্লালচরিতে এ সম্বন্ধে যে ব্যাখ্যা পাওয়া যাইতেছে তাহাতে একটা যুক্তি আছে; রাষ্ট্ৰীয় ও সামাজিক কারণে এইরূপ হওয়া খুব বিচিত্র নয়। ইহাকে একেবারে উড়াইয়া দেওয়া যায় কি? সেন-বর্মণ আমলে এইরূপ পর্যায় নির্ণয় যে হইয়াছে স্মৃতিগ্রন্থগুলিই তাহার সাক্ষ্য। লোকস্মৃতি এক্ষেত্রে একেবারে মিথ্যাচরণ করিয়াছে, এমন মনে হইতেছে না। বল্লালচরিত-কাহিনী একেবারে অক্ষরে অক্ষরে সত্য না হইলেও ইহার মূলে যে একটি ঐতিহাসিক সত্য নিহিত আছে, এ সম্বন্ধে সন্দেহ করিবার কারণ দেখিতেছি না।

 

কুলজীগ্রন্থমালা

বল্লালচরিতের ঐতিহাসিক ভিত্তি কিছুটা স্বীকার করা গেলেও কুলজী গ্রন্থের ঐতিহাসিকত্ব স্বীকার করা অত্যন্ত কঠিন। বাংলাদেশে কুলজী গ্রন্থমালা সুপরিচিত, সুআলোচিত। ব্রাহ্মণ-কুলজীগ্রন্থমালায় ধ্রুবানন্দ মিশ্রের মহাবংশাবলী বা মিশ্র গ্রন্থ, নুলো পঞ্চাননের গোষ্ঠকথা, বাচস্পতি মিশ্রের কুলরাম, ধনঞ্জয়ের কুলপ্রদীপ, মেলপনায় গণনা, বারেন্দ্র কুলপঞ্জিকা, কুলার্ণব, হরিমিশ্রের কারিক, এডু মিশ্রের কাবিকা, মহেশের নির্দোষ কুলপঞ্জিকা এবং সর্বানন্দ মিশ্রের কুলতত্বার্ণব প্রভৃতি গ্রন্থ সমধিক প্রসিদ্ধ। ধ্রুবানন্দের মহাবংশাবলী পঞ্চদশ শতকের রচনা বলিয়া অনুমিত; মুলে পঞ্চানন এবং বাচস্পতি মিশ্রের গ্রন্থের কাল ষোড়শ-সপ্তদশ শতক হইতে পারে। বাকি কুলজীগ্রন্থ সমস্তই অর্বাচীন। বস্তুত, কোন কুলজী গ্রন্থেরই রচনাকাল পঞ্চদশ শতকের আগে নয়; অধিকাংশ কুলজীগ্রন্থ এখনও পাণ্ডুলিপি আকারেই পড়িয়া আছে, এবং নানা উদ্দেশ্যে নানা জনে ইহাদের পাঠ অদলবদলও করিয়াছেন, এমন প্রমাণও পাওয়া গিযাছে। বৈদ্য-কুলজী গ্রন্থের মধ্যে রামকান্তের কবিকণ্ঠহার এবং ভরত মল্লিকের চন্দ্র প্রভা সমধিক খ্যাত; ইহাদের রচনাকাল যথাক্রমে ১৬৫৩ ও ১৬৭৩ খ্ৰীষ্টাব্দ। কাযস্থ এবং অন্যান্য বর্ণেরও কুলজী ইতিহাস পাওয়া যায়, কিন্তু সেগুলি কিছুতেই সপ্তদশঅষ্টাদশ শতকের আগেকার রচনা বলিয়া মনে করা যায় না। উনবিংশ শতকের শেষপাদ হইতে আরম্ভ করিয়া একান্ত আধুনিক কাল পর্যন্ত বাংলা দেশের অনেক পণ্ডিত এই সব পাণ্ডুলিপি ও মুদ্রিত কুলজীগ্রন্থ অবলম্বন করিয়া বাংলার সামাজিক ইতিহাস রচনার প্রয়াস করিয়াছেন, এবং এখনও অনেক কৌলীন্য মযাঁদাগর্বিত ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থ বংশ এই সব কুলজীগ্রন্থের সাক্ষ্যের উপরই নিজেদের বংশমযাঁদ প্রতিষ্ঠা করিয়া থাকেন। বস্তুত, বাংলার কৌলীন্যপ্রথা একমাত্র এই কুলশাস্ত্র বা কুলজী গ্রন্থমালার সাক্ষ্যের উপরই প্রতিষ্ঠিত।

একান্ত সাম্প্রতিক কালে উচ্চশ্রেণীর সামাজিক মযাঁদা যে ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত তাহাকে আঘাত করা অত্যন্ত কঠিন। নানা কারণেই ঐতিহাসিকের এই সব কুলজীগ্রন্থমালার সাক্ষ্য বৈজ্ঞানিক যুক্তিপদ্ধতিতে আলোচনার বিষয়ীভূত করেন নাই, যদিও অনেকে তাঁহাদের সন্দেহ ব্যক্ত করিতে দ্বিধা করেন নাই। ইহাদের ঐতিহাসিক মূল্য প্রথম বিচার করেন স্বৰ্গত রমাপ্রসাদ চন্দ মহাশয়।(৮) খুব সাম্প্রতিক কালে শ্রীযুক্ত রমেশচন্দ্র মজুমদার মহাশয় এই সব কুলজীগ্রন্থের বিস্তৃত ঐতিহাসিক বিচার করিয়াছেন; তাহার সুদীর্ঘ বিচারালোচনার যুক্তিবত্তা অবশ্যস্বীকার্য।(৯) কাজেই এখানে একই আলোচনা পুনরুত্থাপন করিয়া লাভ নাই। আমি শুধু মোটামুটি নির্ধারণগুলি সংক্ষেপে উল্লেখ করিতেছি মাত্র।

প্রথমত, ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে যখন কুলশাস্ত্রগুলি প্রথম রচিত হইতে আরম্ভ করে তখন মুসলমান-পূর্ব যুগের বাংলার সামাজিক বা রাষ্ট্ৰীয় ইতিহাস সম্বন্ধে বাঙালীর জ্ঞান ও ধারণা খুব অস্পষ্ট ছিল৷(১০) কোন ও কোন ও পারিবারিক ইতিহাসের অস্তিত্ব হয়ত ছিল, কিন্তু আজ সেগুলির সত্যাসত্য নির্ধারণ প্রায় অসম্ভব। এই সব বংশাবলী এবং প্রচলিত অস্পষ্ট রাষ্ট্ৰীয় ও সামাজিক জনশ্রুতির উপর নির্ভর করিয়া, অর্ধসত্য অর্ধকল্পনার নানা কাহিনীতে সমৃদ্ধ করিয়া এই কুলশাস্ত্রগুলি রচনা করা হইয়াছিল। পরবর্তী কালে এই সব গ্রন্থোক্ত কাহিনী ও বিবরণ বংশমযাঁদাবোধসম্পন্ন ব্যক্তিদের হাতে পড়িয়া নানা উদ্দেশ্যে নানাভাবে পাঠ-বিকৃতি লাভ করে এবং নূতন নূতন ব্যাখ্যা ও কাহিনীদ্বারা সমৃদ্ধতর হয়। কাজেই ঐতিহাসিক সাক্ষ্য হিসাবে ইহাদের উপর নির্ভর করা কঠিন। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে, প্রায় দুই শত আড়াই শত বৎসর মুসলমানাধিপত্যের পর বর্ণহিন্দুসমাজ নিজের ঘর নূতন করিয়া গুছাইতে আরম্ভ করে, রঘুনন্দন তখনই নূতন স্মৃতিগ্রস্থাদি রচনা করিয়া নূতন সমাজনির্দেশ দান করেন; চারদিকে নূতন আত্মসচেতনার আভাস স্বম্পষ্ট হইয়া উঠে। কুলশাস্ত্রগুলির রচনা ও তখনই আরম্ভ হয়, এবং প্রচলিত ধর্ম ও সমাজব্যবস্থাকে প্রাচীনতর কালের স্মৃতিশাসনের সঙ্গে যুক্ত করিয়া তাহার একটা সুসঙ্গত ব্যাখ্যা দিবার চেষ্টা ও পণ্ডিতদের মধ্যে উদগ্র হইয়া দেখা দেয়। সেন-বর্মণ আমলই স্মৃতিরচনা ও স্মৃতিশাসনের প্রথম সুবর্ণযুগ; কাজেই কুলশাস্ত্রকারেরা সেই যুগের সঙ্গে নিজেদের ব্যবস্থা-ইতিহাস যুক্ত করিবেন তাহা ও কিছু আশ্চর্য নয়!

দ্বিতীয়ত, কুলশাস্ত্রকাহিনীর কেন্দ্রে বসিয়া আছেন রাজা আদিশূর। আদিশূর কর্তৃক কোলাঞ্চ-কনৌজ (অন্যমতে, কাশী) হইতে পঞ্চ ব্রাহ্মণ আনয়নের সঙ্গেই ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থ ও অন্যান্য কয়েকটি বর্ণ-উপরর্ণের কুলজী কাহিনী এবং কৌলীন্য প্রথার ইতিহাস জড়িত। কৌলীন্যপ্রথার বিবর্তনের সঙ্গে বল্লাল ও লক্ষ্মণসেনের নামও জড়িত হইয়া আছে, এবং রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ কুলজীর সঙ্গে আদিশূরের পৌত্র ক্ষিতিশূরের এবং ক্ষিতিশূরের পুত্র ধরাশূরের; বৈদিক-ব্রাহ্মণ কুলকাহিনীর সঙ্গে বৰ্মণরাজ ও শ্যামবৰ্মণ  এবং হরিবর্মণের নামও জড়িত। একাদশ শতকে দক্ষিণবাঢ়ে এক শূববংশ রাজত্ব করিতেন, এবং রণশূর নামে অন্তত একজন রাজার নাম আমরা জানি। আদিশূর, ক্ষিতিশূর এবং ধরাশূরের নাম আজও ইতিহাসে অজ্ঞাত। সেন ও বর্মণ রাজবংশদ্বয়ত খুবই পরিচিত। কিন্তু আদিশূরই বাংলায় প্রথম ব্রাহ্মণ আনিলেন, তাঁহার আগে ব্রাহ্মণ ছিল না, বেদের চর্চা ছিল না, কুলজী গ্রন্থগুলির এই তথ্য একান্তই অনৈতিহাসিক, অথচ ইহারই উপর সমস্ত কুলজী কাহিনীর নির্ভর। পঞ্চম শতক হইতে আরম্ভ করিয়া বাংলা দেশে ব্রাহ্মণের কিছু অভাব ছিল না, বেদ-বেদাঙ্গচর্চাও যথেষ্টই ছিল; অষ্টম শতকের আগেই বাংলার সর্বত্র অসংখ্য বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের বসবাস হইয়াছিল আর অষ্টম হইতে আরম্ভ করিয়া দ্বাদশ শতক পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল হইতে অসংখ্য ব্রাহ্মণ যেমন বাংলায় আসিয়া বসবাস আরম্ভ করিয়াছিলেন, তেমনই বাংলার ব্রাহ্মণ-কায়স্থেরা বাংলার বাহিরে গিয়া ও বিচিত্র সম্মাননা লাভ করিয়াছিলেন। বঙ্গজ ব্রাহ্মণদের কোনও কাহিনী কুলশাস্ত্রগুলিতে নাই, অথচ (পূর্ব) বঙ্গেও অনেক ব্রাহ্মণ গিয়া বসবাস করিয়াছিলেন, এ-সম্বন্ধে লিপি প্রমাণ বিদ্যমান। রাঢ়ীয়, বারেন্দ্র এবং সম্ভবত বৈদিক ও গ্রহবিপ্র ব্রাহ্মণদের অস্তিত্বের খবর অন্যতর স্বতন্ত্র সাক্ষ্যপ্রমাণ হইতেও পাওয়া যায়। রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র একান্তই ভৌগোলিক সংজ্ঞা; বৈদিক ব্রাহ্মণদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে আদিশূর-পূর্ব লিপিপ্রমাণ বিদ্যমান; আর গ্রহবিপ্রেরা তো বাহির হইতে আগত শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণ বলিয়াই মনে হয়। ইহাদের সম্পর্কে কুলজীর ব্যাখ্যা অপ্রাসঙ্গিক এবং অনৈতিহাসিক। বৈদ্য ও কায়স্থদের ভৌগোলিক বিভাগ সম্বন্ধেও একই কথা বলা চলে। কৌলীন্য প্রথার সঙ্গে বল্লাল ও লক্ষ্মণসেনের নাম অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িত, অথচ এই দুই রাজার আমলে যে-সব স্মৃতি ও ব্যবহার গ্রন্থ রচিত হইয়াছিল, ইহাদের নিজেদের যে-সব লিপি আছে তাহার একটিতেও এই প্রথা সম্বন্ধে একটি ইঙ্গিতমাত্রও নাই, উল্লেখ ত দুরের কথা; তাহা ছাড়া, এই যুগের ভবদেব ভট্ট, হলায়ুধ, অনিরুদ্ধ প্রভৃতি প্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত এবং অসংখ্য অপ্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণের যে-সব উল্লেখ সমসাময়িক গ্রন্থাদি ও লিপিমালায় পাওয়া যায় তাঁহাদের একজনকেও ভুলেও কুলীন কেহ বলেন নাই। বল্লাল ও লক্ষ্মণের নাম কৌলীন্যপ্রথা উদ্ভবের সঙ্গে জড়িত থাকিলে তাহার নিজের কেহ তাহার উল্লেখ করিলেন না, সমসাময়িক গ্রন্থ ও লিপিমালায় তাহার উল্লেখ পাওয়া গেল না, ইহা খুবই আশ্চর্য বলিতে হইবে। আদিশূরকাহিনী এবং কৌলীন্যপ্রথার সঙ্গে ব্রাহ্মণদের গাঞী বিভাগও অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। গাঞীর উদ্ভব গ্রাম হইতে; যে গ্রামে যে-ব্রাহ্মণ বসতি স্থাপন করিতেন তিনি সেই গ্রামের নামানুযায়ী গাঞী পরিচয় গ্রহণ করিতেন। বন্দ্য, ভট্ট, চট্ট প্রভৃতি গ্রামের নামের সঙ্গে উপাধ্যায় বা আচার্য জড়িত হইয়া বন্দ্যোপাধ্যায়, ভট্টাচার্য, চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি পদবীর সৃষ্টি। বস্তুতঃ বন্দ্য, ভট্ট, চট্ট ব্রাহ্মণদের এই সব গ্রামনামায় পরিচয় অষ্টম শতক-পূর্ব লিপিগুলিতেই দেখা যাইতেছে। কাজেই এই সব গাঞী পর্যায়-পরিচয় স্বাভাবিক ভৌগোলিক কারণেই উদ্ভূত হইয়াছিল এবং তাহার সূচনা ষষ্ঠ-সপ্তম শতকেই দেখা গিয়াছিল—আদিশূরকাহিনী বা কৌলীন্য প্রথার সঙ্গে উহাকে যুক্ত করিবার কোনও সঙ্গত কারণ নাই। বৈদ্য এবং কোনও কোনও ব্ৰাহ্মণ কুলজীতে আদিশূর এবং বল্লালসেনকে বলা হইয়াছে বৈদ্য। এ-তথ্য একান্তই অনৈতিহাসিক। সেনের নিঃসন্দেহে ব্ৰহ্মক্ষত্রিয়; ইঁহারা এবং সম্ভবত শূরেরাও অবাঙালী। কাজেই বাঙালী বৈদ্য সংকরবর্ণের সঙ্গে ইহাদের যুক্ত করিবার কোনই কারণ নাই।

কুলজী গ্রন্থগুলিতে নানা প্রকার গালগল্প ও বিচিত্র অসংগতি ত আছেই। সাম্প্রতিক পণ্ডিতেরা তাহা সমস্তই অঙ্গুলি নির্দেশে দেখাইয়া দিয়াছেন। আমি শুধু কয়েকটি ঐতিহাসিক যুক্তি সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করিলাম। এইসব কারণে কুলশাস্ত্রের সাক্ষ্য ঐতিহাসিক আলোচনায় নির্ভরযোগ্য বলিয়া মনে হয় না। তবে ইহাদের ভিতর দিয়া লোকস্মৃতির একটি ঐতিহাসিক ইঙ্গিত প্রত্যক্ষ করা যায়, এবং সে-ইঙ্গিত অস্বীকার করা কঠিন। পঞ্চদশ-ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে যে বর্ণ, উপবর্ণ সমাজ-ব্যবস্থা, যে-স্মৃতিশাসন বাংলাদেশে প্রচলিত ছিল তাহার একটা প্রাচীনতর ইতিহাস ছিল, এবং লোকস্মৃতি সেই ইতিহাসকে যুক্ত করিয়াছিল শূর, সেন ও বর্মণ রাজবংশগুলির সঙ্গে—পাল, চন্দ্র বা অন্য কোনও রাজবংশের সঙ্গে নয়, ইহা লক্ষণীয়। আমরা নি:সংশয়ে জানি সেন ও বর্মণ বংশদ্বয় অবাঙালী; শূরবংশও সম্ভবত অবাঙালী; ইহাও আমরা জানি সেন এবং বর্মণ রাষ্ট্র ও রাজবংশ দুটির ছত্রছায়ায়ই এবং তাঁহাদের আমলেই বাংলাদেশে ব্রাহ্মণ্য স্মৃতি ও ব্যবহাব-শাসন, পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মানুশাসন সমস্ত পরিবেশ ও বাতাবরণ, সমস্ত খুঁটিনাটি সংস্কার লইয়া সর্বব্যাপী প্রসার ও প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কুলজীগ্রন্থগুলির ইঙ্গিতও তাহাই। এই হিসাবে লোকস্মৃতি মিথ্যাচরণ করিয়াছে বলিয়া মনে হইতেছে না। দ্বিতীয়ত, কোনও কোনও বংশের প্রাচীনতর ইতিহাস পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে বিদ্যমান ছিল বলিয়া মনে হয়, এবং কুলজী গ্রন্থাদিতে তাহা ব্যবহৃতও হইয়াছে। এই রকম কয়েকটি বংশের সাক্ষ্য স্বাধীন স্বতন্ত্র প্রমাণদ্বারা সমর্থনও করা যায়।(১১) কুলজীগ্রন্থে রাঢ়ীয়, বারেন্দ্র, বৈদিক ও গ্রহবিপ্র, ব্রাহ্মণদের এই চারি পর্যায়ের বিভাগ ও স্বাধীন স্বতন্ত্র প্রমাণদ্বার সমর্থিত। কুলশাস্ত্রগ্রন্থমালায় ব্রাহ্মণদের বিভিন্ন শাখার বিচিত্র গাঞীর বিভাগের অন্তত কযেকটি গাঞীর নাম লিপিমালায় এবং সমসাময়িক স্মৃতিসাহিত্য গ্রন্থে পাওয়া যায়।(১২) এইসব কারণে মনে হয়, কুলজীগ্রন্থমালার পশ্চাতে একটা অস্পষ্ট লোকস্থতি বিদ্যমান ছিল, এবং এই লোকস্মৃতি একেবারে পুরোপুরি মিথ্যাচার নয়। তবে, কুলশাস্ত্রগুলির ঐতিহাসিক ইঙ্গিতটুকু মাত্রষ্ঠ গ্রাহ, তাহাদের বিচিত্র খুঁটিনাটি তথ্য ও বিবরণগুলি নয়।

 

চর্যাগীতি

এই সব ব্রাহ্মণ্য গ্রন্থাদি ছাড়া আর একটি উপাদানের উল্লেখ করিতে হয়; এই উপাদান সহজিয়াতন্ত্রের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একটি গ্রন্থ, চযাঁচর্যবিনিশ্চয় বা চযাঁগীতি। এই গ্রন্থ বিভিন্ন বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য কর্তৃক গুহা তান্ত্রিক সাধনা সম্বন্ধীয় সন্ধাভাষায় রচিত কয়েকটি (৫০টি) পদের সমষ্টি। পদ গুলি প্রাচীনতম বাংলা ভাষার নিদর্শন; ইহাদের তিব্বতী ভাষারূপও কিছুদিন হইল পাওয়া গিয়াছে। যাহাই হউক, ইহাদের রচনার কাল দশম হইতে দ্বাদশ শতকের মধ্যে বলিয়া বহুদিন পণ্ডিতসমাজে স্বীকৃত হইয়াছে। এই পদ গুলির যত গুহ্য অর্থই থাকুক, কিছু কিছু সমাজসংবাদও ইহাদের মধ্যে ধরা পড়িয়াছে, এবং বিশেষভাবে ডোম, চণ্ডাল প্রভৃতি তথাকথিত অন্ত্যজ পর্যায়ের বর্ণসংবাদ। সমসাময়িক সাক্ষ্য হিসাবে ইহাদের মূল্য অস্বীকার করা যায় না।(১৩)

—————————-
(১) বৃহদ্ধর্মপুরাণ, Bib. Ind. edn; বঙ্গবাসী মুদ্রাযন্ত্র প্রকাশিত একটি সংস্করণও বিদ্যমান। উত্তরখণ্ডের ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ অধ্যায়ে এবং অন্ত খণ্ডের ইতস্তত বর্ণসংবাদ বিক্ষিপ্ত। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, জীবানন্দ বিন্যাসাগর সং। প্রথমভাগে ব্রহ্মখণ্ডের দশম অধ্যায়ের ১৬-২১ এবং ৯০-১৩৭ শ্লোকে বর্ণবিন্যাস-সংবাদ নিবদ্ধ।
(২) ভারতবর্ষ মাসিকপত্র, ১৩৩৬-৩৭, ২য় খণ্ড, ৬৭৩ পৃ., ১৩৩৭ ৩৮, ১ম খণ্ড, ৯৪ পৃ.। History of Bengal, I., D. U. : pp. 5’7-574, Paul, P. C., Early History of Bengal Vol. II, 59-61.
(৩) ২নং পাদটীকা দ্রষ্টব্য।(৪) Vallala-Charita, ed. Haraprasad Sastri, Asiatic Society of Bengal. 1904.
(৫) Vallala-Charita, ed. by Harischandra Kaviratna, 1889.
(৬) Intro. to the English trans. of the Vallalacharita by Haraprasad Sastri, pp. v.-vi.; Ep. Ind. XV, p. 281; যতীন্দ্রমোহন রায়, ঢাকা।
(৭) H B (D.V.), I, pp. 239-4 I
(৮) Chanda, R. P., Indo-Aryan Races, Chap. V.
(৯) ভারতবর্ষ মাসিক পত্রিকা, ১৩৪৬, কাতিক—ফাল্গুন, “বঙ্গীয় কুলশাস্ত্রের 3\fa <ifa 35 5[a] “; HB (D U.), pp. 623-34
(১০) Majumdar, R. C., “An Indigenous History of Bongal,” ln Proc, of the Ind, Hist. Records Commission, XVI, 59 ff.
(১১) History of Bengal, (D. U.), pp. 630 31, footnotes.
(১২) lbid., pp. 635-37 and footnotes
১৩ বৌদ্ধ গান ও দোহা, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সং, বঙ্গীয় সাহিত পরিষৎ, Md. Sahidullah Buddhist Mystic Songs; Bagchi, P. C., Materials for a Critical Edition of the Caryapadas; চযাঁপদ, মণীন্দ্রমোহন বসু সং, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।

০৩. আর্যীকরণের সূচনা : বর্ণবিন্যাসের প্রথম পর্ব

বাঙালীর ইতিহাসের যে অস্পষ্ট ঊষাকালের কথা আমরা জানি তাহা হইতে বুঝা যায়, আর্যীকরণের সূচনার আগে এই দেশ অষ্ট্রিক ও দ্রাবিডভাষাভাষী—অষ্ট্রিক ভাষাভাষীই অধিকসংখ্যক,— খুব স্বল্পসংখ্যক অন্যান্য ভাষাভাষী, কৃষি ও শিকারিজীবি, গৃহ ও অরণ্যচারী, অসংখ্য কোমে বিভক্ত লোকদের দ্বারা অধ্যুষিত ছিল। সাম্প্রতিক নৃতাত্বিক গবেষণায় এই তথ্য উদঘাটিত হইয়াছে যে এইসব অসংখ্য বিচিত্র কোমদের ভিতর বিবাহ ও আহার-বিহারগত সম ও আচারগত নানাপ্রকার বিধিনিষেধ বিদ্যমান ছিল; এবং এই সব বিধিনিষেধকে কেন্দ্র করিয়া বিচিত্র কোমগুলির পরস্পবের ভিতর যৌন ও আহারবিহার সম্বন্ধগত বিভেদ-প্রাচীরেরও অন্ত ছিল না।(১৪) পরবর্তী আর্য ব্রাহ্মণ্য বর্ণবিন্যাসেব মূল অনেকাংশে এইসব যৌন ও আহার-বিহার সঙ্গন্ধগত বিধিনিষেধকে আশ্রয় করিয়াছে, তাহা প্রায় অনস্বীকার্য; তবে আর্য-ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ও সংস্কৃতি গুণ ও কর্মকে ভিত্তি করিয়া তাহাদের চিন্তা ও আদর্শানুযায়ী এইসব বিধিনিষেধকে ক্রমে ক্রমে কালানুযায়ী প্রয়োজনে যুক্তি ও পদ্ধতিতে প্রথাশাসনগত করিয়া গডিয়াছে, তাড়াও অস্বীকার করিবার উপায় নাই। সমাজ ও নৃতাত্বিক গবেষণাব নির্ধারণানুযায়ী বিচার করিলে ভারতীয় বর্ণবিন্যাস আর্যপূর্ব ও আর্য্য-ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ও সংস্কৃতির সম্মিলিত প্রকাশ। অবশ্যই এই মিলন একদিনে হয় নাই; বহু শতাব্দীর নানা বিরোধ, নানা সংগ্রাম, বিচিত্র মিলন ও আদানপ্রদানের মধ্য দিয়া এই সমন্বয় সম্ভব হইয়াছে। এই সমন্বয়-কাহিনীই এক হিসাবে ভারতীয় হিন্দু সংস্কৃতির এবং কতকাংশে ভারতীয় মুসলমান সংস্কৃতিরও ইতিহাস। যাহাই হউক, বাংলা দেশে এই বিরোধ-মিলনসমন্বয়েব সূচনা কি ভাবে হইয়াছিল তাহার কিছু কিছু আভাস প্রাচীন আর্য ব্রাহ্মণ্য ও আর্য-বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থাদিতে পাওয়া যায়। বলা বাহুল্য, এই সব গ্রন্থের সাক্ষ্য এক পক্ষীয়, এবং তা হাতে পক্ষপাত দোষ নাই এমনও বলা চলে না; আর্যপূর্ব জাতি ও কোমদের পক্ষ হইতে সাক্ষ্য দিবার মতন কোনও অকাট্য প্রমাণ উপস্থিত নাই। তাহা ছাড়া, বাংলা দেশ উত্তর-ভারতের পূর্ব প্রত্যন্ত দেশ; আর্য-ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ও সংস্কৃতির স্পর্শ ও প্রভাব এদেশকে আক্রমণ করিয়াছে সকলের পরে, তখন তাহা উত্তর-ভারতের আর প্রায় সবত্রই বিজয়ী, সুপ্রতিষ্ঠিত ও শক্তিমান। অন্যদিকে, তখন সমগ্র বাংলা দেশে আর্য পূর্ব সংস্কার ও সংস্কৃতিসম্পন্ন বিচিত্র কোমদের বাস; তাহারাও কম শক্তিমান নয়। তাহাদের নিজস্ব সংস্কার ও সংস্কৃতিবোধ গভীর ও ব্যাপক। কাজেই এইদেশে আর্য-ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ও সংস্কৃতির বিজয়াভিযান বিনা বিরোধ ও বিনা সংঘর্ষে সম্পন্ন হয় নাই। বহু শতাব্দী ধরিয়া এই বিরোধ-সংঘর্ষ চলিয়াছিল, ইহা যেমন স্বভাবতই অনুমান করা চলে, তেমনিই ঐতিহাসিক সাক্ষ্য দ্বারাও তাহা সমর্থিত। লিপি প্রমাণ হইতে মনে হয়, গুপ্ত আমলে আর্য-ব্রাহ্মণ্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে ব্রাহ্মণ্য বর্ণবিন্যাস, ধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতি এদেশে সম্যক স্বীকৃতই হয় নাই। তাহার পরেও ব্রাহ্মণ্য বর্ণবিন্যাসের নিম্নস্তরে ও তাই বি বাহিরে সংস্কার ও সংস্কৃতির সংঘর্ষ বহুদিন চলিয়াছিল; সেন-বর্মণ আমলে (একাদশ-দ্বাদশ শতকে) বর্ণসমাজের উচ্চস্তরে আর্যপূর্ব লোক সংস্কৃতিব পরাভব প্রায় সম্পূর্ণ হয়। কিন্তু তাহা সত্বেও বাঙালী সমাজের অন্তঃপুরে এবং একান্ত নিম্নস্তরে এই সংস্কার ও সংস্কৃতির প্রভাব আজও একেবারে বিলুপ্ত হয় নাই—ব্রাহ্মণ্য বর্ণবিন্যাসের আদেশ সেখানে শিথিল দৈনন্দিন জীবনে, ধর্মে, লোকাচারে, ব্যবহারিক আদর্শে, ভাবনা-কল্পনায় আজও সেখানে আর্যপূর্ব সমাজের বিচিত্র স্মৃতি ও অভ্যাস সুস্পষ্ট। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে শিল্পে, ধর্মে বতর্মান বাঙালীর ধ্যানে মননে আচারে ব্যবহারে এখনও সেই স্মৃতি বহমান, একথা কখনও ভুলিলে চলিবে না।

ঐতরেয় আরণ্যক গ্রন্থের “বয়াংসি বঙ্গাবগধাশ্চেরপাদা’ এই পদে কেহ কেহ বঙ্গ, মগধ, চের এবং পাণ্ড্য কোমের উল্লেখ আছে বলিয়া মনে করেন; এই সব কোমকে বলা হইয়াছে ‘বয়াংসি’ বা ‘পক্ষী-বিশেষাঃ’, এবং ইহারা যে আর্য-সংস্কৃতির বহির্ভূত তাহাও ইঙ্গিত করা হইয়াছে।(১৫) এই পদটির পাঠ ও ব্যাখ্যা এইভাবে হইতে পারে কিনা এ সম্বন্ধে মতভেদের অবসর বিদ্যমান। কিন্তু ঐতরেয় ব্রাহ্মণ গ্রন্থে পুণ্ড্র, প্রভৃতি জনপদের লোকদিগের যে ‘দস্যু’ বলা হইয়াছে এ সম্বন্ধে সন্দেহের কোন কারণ নাই। এই দুইটি ছাড়া আর কোনও প্রাচীনতম গ্রন্থেই প্রাচীন বাংলার কোনও কোমের উল্লেখ নাই। বুঝা যাইতেছে, সেই সুপ্রাচীন কালে আর্যভাষীরা তখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে পরিচিতই হন নাই; পরবর্তী সংহিতা ও ব্রাহ্মণ গ্রন্থাদি রচনার সময় তাহারা পুণ্ড্র, বঙ্গ, ইত্যাদি কোমের নাম শুনিতেছেন মাত্র। ঐতরেয় ব্রাহ্মণের একটি গল্প এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। ঋষি বিশ্বামিত্র একটি ব্রাহ্মণ বালককে পোষ্যপুত্ররূপে গ্রহণ করেন—দেবতার প্রীত্যর্থে যজ্ঞে বালকটিকে আহুতি দিবাব আয়োজন হইয়াছিল, সেইখান হইতে বিশ্বামিত্র তাহাকে উদ্ধার করিয়া আনিয়াছিলেন। যাহা হউক, পিতার এই পোষ্যপুত্র গ্রহণ বিশ্বামিত্রের পঞ্চাশটি পুত্রের সমর্থন লাভ করেন নাই। ক্রুদ্ধ বিশ্বামিত্র পুত্রদের অভিসম্পাত দেন যে তাঁহাদের সন্তানেরা যে উত্তরাধিকার লাভ করিবে তাহা একেবারে পৃথিবীর প্রান্ততম সীমায় (বিকল্পে : তাঁহাদের বংশধরেরা একেবারে সব নিম্ন বর্ণ প্রাপ্ত হইবেন)। ইহারাই ‘দস্যু’ আখ্যাত অন্ধ্র, পুণ্ড্র, শবর, পুলিন্দ, এবং মুতিব কোমের জন্মদাত।(১৬) এই গল্পের ক্ষীণ প্রতিধ্বনি মহাভারতের এবং কতিপয় পুরাণের একটা গল্পেও শুনিতে পাওয়া যায়।(১৭) অন্যত্র ভীমের দিগ্বিজয় প্রসঙ্গে বাংলার সমুদ্রতীরবাসী কোমগুলিকে বলা হইয়াছে ‘ম্লেচ্ছ’; ভাগবত পুরাণে কিরাত, হূণ, অন্ধ্র, পুলিন্দ, পুক্কস, আভীর, যবন, থস এবং সূহ্ম কোমের লোকদের বলা হইয়াছে ‘পাপ’।(১৮) বৌধায়নেব ধৰ্মসূত্রে আবট্ট (পাঞ্জাব), পুণ্ড্র (উত্তরবঙ্গ) সৌবীর (দক্ষিণ পঞ্জাব ও সিন্ধুদেশ), বঙ্গ (পূর্ব বাংলা), কলিঙ্গ (উড়িষ্যা) প্রভৃতি কোমের লোকদের অবস্থিতি নির্দেশ করা হইয়াছে আর্যবহির্ভূত দেশের প্রত্যন্ততম সীমায়; ইহাদের বলা হইয়াছে “সংকীর্ণ যৌনয়ঃ” এবং এই সব দেশ একেবারে আর্য-সংস্কৃতির বাহিরে, এই সব জনপদে কেহ স্বল্প কালের প্রবাসে গেলেও ফিরিয়া আসিয়া তাহাকে প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইত।(১৯) স্পষ্টই দেখা যাইতেছে, বৌধায়নের কালে বাংলাদেশের সঙ্গে পরিচয় যদি বা হইয়াছে, যাতায়াতও হয়ত কিছু কিছু আরম্ভ হইয়াছে, কিন্তু তখনও আর্যব্রাহ্মণ্য সংস্কারের দৃষ্টিতে এই সব অঞ্চলের লোকেরা ঘৃণিত এবং অবজ্ঞাত। এই ঘৃণা ও অবজ্ঞা প্রাচীন আর্য জৈন ও বৌদ্ধ গ্রন্থাদিতেও কিছু কিছু দেখা যায়। আচাবঙ্গ = আয়ারঙ্গ সূত্রের একটি গল্পে পথহীন রাঢ়দেশে মহাবীর এবং তাহার শিষ্যদের লাঞ্ছনা ও উৎপীড়নের যে-বর্ণনা আছে, বজ্রভূমিতে যে অখাদ্য কুখাদ্য ভক্ষণের ইঙ্গিত আছে তাহাতে এই ঘৃণা ও অবজ্ঞা সুম্পষ্ট।(২০) বৌদ্ধ আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প-গন্থে গৌড়, পুণ্ড্র, সমতট ও হরিকেলের লোকদের ভাষাকে বলা হইয়াছে ‘অসুর’ ভাষা এই সব বিচিত্র উল্লেখ হইতে স্পষ্টই বুঝা যায়, ইহা্রা এমন একটি সুদীর্ঘকালের স্মৃতি-ঐতিহ্য বহন করে যে-কালে আর্য ভাষাভাষী এবং আর্যসংস্কৃতির ধারক ও বাহক উত্তর ও মধ্যভারতের লোকে বা পূর্বতম ভারতের বঙ্গ, পুণ্ড্র, রাঢ়, সূহ্ম প্রভৃতি কোমদের সঙ্গে পরিচিত ছিল না, যে-কালে এইসব কোমদের ভাষা ছিল ভিন্নতর, আচার-ব্যবহার অন্যতর। এই অন্যতর জাতি, অন্যতর আচার-ব্যবহার, সভ্যতা ও সংস্কৃতি এবং অন্যতর ভাষাভাষী লোকদের সেইজন্যই বিজেতা, উন্নত ও পরাক্রান্ততর জাতিসুলভ দর্পিত উন্নাসিকতায় বলা হইয়াছে, ‘দস্যু’, ‘ম্রেচ্ছ’, ‘পাপ’, ‘অসুর’ ইত্যাদি।

কিন্তু এই দর্পিত উন্নাসিকতা বহুকাল স্থায়ী হয় নাই। নানা বিরোধ সংঘর্ষের ভিতর দিয়া এই সব দস্যু, ম্লেচ্ছ, অসুর, পাপ কোমের লোকদেব সসে আর্যভাষাভাষী লোকদের মেলামেশা হইতে ছিল। এই সব বিরোধ সংঘর্ষের কিছু কিছু আভাস পাওয়া যায় ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত নানা পৌরাণিক গল্পে—রামায়ণে রঘুর দিগ্বিজয়, মহাভারতে কর্ণ, কৃষ্ণ ও ভীমের দিগ্বিজয়, আচারঙ্গসূত্রে মহাবীরের রাঢ়দেশে জৈনধৰ্ম প্রচার, ইতাদি প্রসঙ্গে। ইহাদের মধ্য দিয়াই আর্য ও আর্যপূর্ব সংস্কৃতির মিলনপথ প্রশস্ত হইতেছিল এবং আর্যপূর্ব সংস্কৃতির ‘ম্রেচ্ছ’ ও ‘দস্যু’রা আর্যসমাজে স্বীকৃতি লাভ করিতেছিল। এই স্বীকৃতি লাভ ও আর্যসমাজে অন্তর্ভূক্তির দুইটি দৃষ্টান্ত আহরণ করা যাইতে পারে। রামায়ণে দেখা যাইতেছে,(২২) মৎস্য-কাশী-কোশল কোমেব সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গ-অঙ্গ-মগধ কোমের রাজবংশগুলি অযোধ্যা রাজবংশের সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হইতেছেন। ইহাপেক্ষা ও আর একটি অর্থবহ গল্প আছে বায়ু ও মৎস্যপুরাণে, মহাভারতে। এই গল্পে অসুররাজ বলির স্ত্রীর গর্ভে বৃদ্ধ অন্ধ ঋষি দীর্ঘতমসের পাঁচটি পুত্র উৎপাদনের কথা বর্ণিত আছে; এই পাঁচপুত্রের নাম অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র এবং সূহ্ম; ইহাদের নাম হইতেই পাঁচ পাঁচটি কৌম জনপদের নামের উদ্ভব।(২৩)

প্রাথমিক পরাভব ও যোগাযোগের পর বাংলাদেশের এইসব দস্যু ও ম্লেচ্ছ কোমগুলি ধীরে ধীরে আর্যসমাজ ব্যবস্থায় কথঞ্চিৎ স্বীকৃতি ও স্থান লাভ করিতে অরম্ভ করিল। এই স্বীকৃতি ও স্থানলাভ যে একদিনে ঘটে নাই, তাহা তো সহজেই অনুমেয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া একদিকে বিরোধ ও সংঘর্ষ অন্যদিকে স্বীকৃতি ও অন্তর্ভূক্তি চলিয়াছিল— কখনও ধীর শান্ত, কখনও দ্রুত কঠোর প্রবাহে, এ সম্বন্ধে সন্দেহ নাই। রাষ্ট্ৰীয় ও অর্থনৈতিক পরাভব ঘটিয়াছিল আগে, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরাভব ঘটিয়াছিল ক্রমে ক্রমে, অনেক পরে, এ সম্বন্ধেও সন্দেহের অবসর কম। মানবধর্মশাস্ত্রে আযাঁবর্তের সীমা দেওয়া হইতেছে পশ্চিম সমূদ্র হইতে পূর্ব সমূদ্র তীর পর্যন্ত, অর্থাং প্রাচীন বাংলাদেশের অন্ততঃ কিয়দংশ আযাঁবর্তের অন্তর্গত, এই যেন ইঙ্গিত।(২৪) মনু পুণ্ড্র, কোমের লোকদের বলিতেছেন ‘ব্রাত্য’ বা পতিত ক্ষত্রিয়, এবং তাগাদের পংক্তিভুক্ত করিতেছেন দ্রাবিড, শক, চীন প্রভৃতি বৈদেশিক জাতিদের সঙ্গে। মভাভারতের সভাপর্বে।(২৫) কিন্তু বঙ্গ ও পুণ্ড্রদের যথার্থ ক্ষত্রিয় বলা হইয়াছে; জৈন প্রজ্ঞাপনা গ্রন্থেও বঙ্গ এবং রাঢ় কোম দুটিকে আর্য কোম বলা হইয়াছে।(২৬) শুধু তাহাই নয়, মহাভারতেই দেখিতেছি, প্রাচীন বাংলার কোনও কোনও স্থান তীর্থ বলিয়া স্বীকৃত ও পরিগণিত হইতেছে, যেমন পুণ্ড্র ভূমিতে করতোয়াতীর, সূহ্মদেশের ভাগীরথী সাগর-সঙ্গম।(২৭) অর্জুন অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গের তীর্থস্থানসমূহ পরিভ্রমণকালে ব্রাহ্মণদিগকে নানা প্রকারে উপহৃত করিয়াছিলেন; বাৎস্যায়ন তাঁহার কামসূত্রে (৩য়-৪র্থ শতক) গৌড়-বঙ্গের ব্রাহ্মণদের উল্লেখ করিয়াছেন। অর্থাৎ বাংলা এবং বাঙালীর আর্যীকরণ ক্রমশঃ অগ্রসর হইতেছে, ইহাই এইসব পুরাণকথার ইঙ্গিত। এই ইঙ্গিতের সমর্থন পাওয়া যায় মভাভারত ও পুরাণগুলিতে। বায়ু ও মংস্যপুরাণে, মহাভারতে বঙ্গ, সূহ্ম, পুণ্ড্রদের তো ক্ষত্ৰিয়ই বলা হইয়াছে, এমন কি শবর, পুলিন্দ এবং কিরাতদেরও। (২৮) কোনও কোনও বংশ যে ব্রাহ্মণ পর্যায়েও স্বীকৃত ও অন্তর্ভূক্ত হইয়াছিল, ঋষি দীর্ঘতমসের গল্পটি তাহার কতকট প্রমাণ বহন করে। অধিকাংশ বিজিত লোকই স্বীকৃত ও অন্তর্ভূক্ত হইয়াছিল শূদ্রবর্ণ পর্যায়ে, এ সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ নাই। মনু বলিতেছেন, পৌণ্ড্রক ও কিরাতেরা ক্ষত্রিয় ছিল, কিন্তু বহুদিন তাহার ব্রাহ্মণদের সঙ্গে সংস্পর্শে না আসায় তাহারা ব্রাহ্মণ্য পুজাচার প্রভৃতি পরিত্যাগ করিয়াছিল, এবং সেই হেতু তাহাদের শূদ্র পর্যায়ে নামাইয়া দেওয়া হইয়াছিল। (২৯) অন্যান্য কোমদের ক্ষেত্রেও বোধ হয় এইরূপ হইয়া থাকিবে। মনু কৈবর্তদদের বলিয়াছেন সংকর বর্ণ, কিন্তু বিষ্ণুপুরাণ তাহাদের বলিতেছে “অব্রহ্মণ্য,” অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্য সমাজ বহির্ভূত। কিন্তু একদিকে স্বীকৃতি অন্তর্ভূক্তি এবং আর একদিকে উন্নীত অবনীতকরণ যাহাই চলিতে থাকুক না কেন, এ-তথ্য সুস্পষ্ট যে আর্য সংস্কৃতির প্রভাব বিস্তাবের সঙ্গে সঙ্গে আর্য বর্ণবিন্যাসও বাংলা দেশে ক্রমশঃ তাহার মূল প্রতিষ্ঠিত করিতেছিল। শুধু ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বীরাই যে আর্য সংস্কৃতি ও সমাজব্যবস্থা বাংলাদেশে বহন করিয়া আনিয়াছিলেন তাহাই নয়, জৈন ও বৌদ্ধধমাবলম্বীরাও এ-সম্বন্ধে সমান কৃতিত্বের দাবি করিতে পারেন। তাঁহারা বেদবিরোধী ছিলেন সন্দেহ নাই, কিন্তু আর্য সমাজ-ব্যবস্থা বিরোধী ছিলেন না, এবং বর্ণব্যবস্থাও একেবারে অস্বীকার করেন নাই।(৩০)

মৌর্য ও শুঙ্গাধিপত্যের সঙ্গে সঙ্গে এবং তাহাকে আশ্রয় করিয়া আর্য সংস্কৃতি সমাজব্যবস্থা ক্রমশঃ বাংলাদেশে অধিকতর প্রসার লাভ করিয়াছিল সন্দেহ নাই, বিশেষতঃ ব্রাহ্মণ্যধররমাবলম্বী রাষ্ট্রের আদিপত্যকালে। কিন্তু, মহাস্থান লিপির গলদন পুরাদস্তুর বাংলা নাম বলিয়াই মনে হইতেছে; প্রাকৃত গলদনকে সংস্কৃত গলদন বলিলেও তাহার দেশজ রূপ অপরিবর্তিতই থাকিয়া যায়। লিপিটির ভাষা প্রাকৃত; মৌর্য আমলের সবলিপির ভাষাই ত তাহাই; কিন্তু বঙ্গে যে আর্য সামাজিক আদর্শ গৃহীত ও স্বীকৃত হইতেছিল তাই সুস্পষ্ট। বোধ হয় এই সময় হইতেই ব্যবসা-বাণিজ্য, ধৰ্ম প্রচার, রাষ্ট্রধর্ম প্রভৃতিকে আশ্রয় করিয়া অধিকতর সংখ্যায় উত্তর ভারতীয় আর্যভাষীরা বাংলাদেশে আসিয়া বসবাস আরম্ভ করিতে থাকে। কিন্তু আর্য, বৌদ্ধ, জৈন এবং সর্বোপরি ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতির পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা গুপ্তকালের আগে হইয়া ছিল বলিয়া মনে হয় না, এবং আর্য বৰ্ণব্যবস্থা ও বাংলাদেশে বোধ হয় তাহার আগে দানা বাঁধিয়া গড়িয়া উঠে নাই।

বাংলাদেশের অধিকাংশ জনপদ গুপ্তসাম্রাজ্যভুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালী সমাজ উত্তরভারতীয় আর্য-ব্রাহ্মণ্য বর্ণ ব্যবস্থান অন্তর্ভূক্ত হইতে আরম্ভ করে। এই যুগের লিপিমালাই(৩১) তাহার নিঃসংশয় সাক্ষ্য বহন করিতেছে। লিপিগুলি বিশ্লেষণ করিলে অনেকগুলি তথ্য জানা যায়।

———————
(১৪) দৃষ্টান্তস্বরূপ দ্রষ্টব্য, Census Report of India, 1931., vol. I, part I, Section on Caste.
(১৫) ঐতরেয় আরণ্যক ২.১.১; Aita. Ara., ed. Keith, 101, 200.
(১৬) ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, ৭৷১৩-১৮
(১৭) মহাভারত, সভাপর্ব, ৫২৷১৭; বায়ু পুরাণ, ৯৯৷১১৷৮৫…; মৎস্যপুরাণ, ৪৮৷৭৭…
(১৮) মহাভারত, ২।৩০; ভাগবতপুরাণ, ২৪।৪।১৮
(১৯) বোধায়ন, ১।১।২৫-৩১
(২০) আচারঙ্গ সূত্র ১।৮।৩ , S. B. E. XXII. 84, 264
(২১) Ed. Ganapati Sastri, ২২ পটল, পৃ. ২৩২-৩৩
(২২) রামায়ণ, ২।১০।৩৬-৩৭
(২৩) মহাভারত, সভাপর্ব ৫২৷১৭; বায়ুপুরাণ ৯৯৷১১।৮৫…; মৎস্যপুরাণ, ৪৮।৭৭…
(২8) মানবধর্মশাস্ত্র,
(২৫) ৫২।১৭
(২৬) lnd. Ant. p. 375
(২৭) বনপর্ব ৮৫।২-৪, ১।২১৬, কামসূত্র, ৬।৩৮, ৪১
(২৮) মহাভারত, ১।১০৪, ২।৫১, ১৪।২৯, বিষ্ণুপুরাণ, ৪।৮।১; মৎস্যপুরাণ, ৪৮।১।৪, মনুস্মৃতি, ১০।৪৪।
(২৯) মনুস্মৃতি, ১০।৪৪
(৩০) Rhys Davids, Buddhist India.
(৩১) এই পর্বে যে-সমস্ত লিপি হইতে তথ্য সংগৃহীত হইয়াছে তাহার তালিকা ও সূচীর জন্য পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য।

০৪.০ গুপ্ত পর্বের বর্ণ বিন্যাস

প্রথমেই সংবাদ পাওয়া যাইতেছে অগণিত ব্রাহ্মণ এবং ব্রাহ্মণ্য প্রতিষ্ঠানের। ১ নং দামোদরপুর লিপিতে (খ্ৰীষ্টাব্দ ৪৪৩-৪৪) জনৈক কর্পটিকনামীয় ব্রাহ্মণ অগ্নিহোত্র যজ্ঞকাৰ্য সম্পাদনের জন্য ভূমিক্রয় প্রার্থন করিতেছেন; ২ নং পট্টোলি দ্বা্রা (৪৪৮-৪৯) পঞ্চ মহাযজ্ঞেব জন্য আর এক ব্রাহ্মণকে ভূমি দেওয়া হইতেছে; ধনাইদহ পট্টোলির (৪৩২-৩৩) বলে কটকনিবাসী এক ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণ কিছু ভূমি লাভ করিতেছেন; ৩ নং দামোদরপুর পট্টোলিতে (৪৮২-৮৩) পাইতেছি নাভক নামে এক ব্যক্তি কয়েকজন প্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণ বসাইবার জন্য কিছু ভূমি ক্রয় করিতেছেন; ৪ নং দামোদরপুর লিপিতে সংবাদ পাওয়া যাইতেছে, নগরশ্রেষ্ঠ রিভূপাল হিমালয়ের পাদদেশে ডোঙ্গাগ্রামে কোকামুখস্বামী, শ্বেতবরাহস্বামী এবং নামলিঙ্গের পূজা ও সেবার জন্য ভূমিক্রয় করিতেছেন; বৈগ্রাম পট্টোলির (৪৪৭-৪৮) সংবাদ, ভোয়িল এবং ভাস্কর নামে দুই ভাই গোবিন্দস্বামীর নিত্য পূজার জন্য ভূমি ক্রয় করিতেছেন; ৫ নং দামোদর পট্টোলিতে (৫৪৩-৪৪) দেখিতেছি শ্বেতবরাহস্বামীর মন্দির সংস্কারের জন্য ভূমি ক্রয় করিতেছেন অযোধ্যাবাসী কুলপুত্ৰক অমৃতদেব। এ সমস্ত লিপিই পুণ্ড্র বর্ধনভূক্তির অন্তর্গত ভূমি সম্বন্ধীয়। এই অনুমান নিঃসংশয় যে পঞ্চম শতকে উত্তরবঙ্গে ব্রাহ্মণ্যধর্ম স্বীকৃতি লাভ করিয়াছে, এই ধর্মের দেবদেবীরা পূজিত হইতেছেন, ব্রাহ্মণদের বসবাস বিস্তত হইতেছে, অব্রাহ্মণেরা ব্রাহ্মণদের ভূমিদান করিতেছেন, আনিয়া বসবাস করাইতেছেন, এবং অযোধ্যাবাসী ভিন-প্রদেশী আসিয়াও এইদেশে মন্দির সংস্কার করাইবার জন্য ভূমি ক্রয় করিতেছেন। যে সব ব্রাহ্মণেরা অসিতেছেন তাহাদের মধ্যে বেদবিদ ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণও আছেন। উত্তরবঙ্গের সংবাদ বোধ হয় আরও পাওয়া যায় কামরূপরাজ ভাস্করবর্মণের নিধনপুর লিপিতে। লিপিটি সপ্তম শতকের, পট্টোলি কর্ণসুবর্ণ জয়স্কান্ধাবার হইতে নির্গত; দত্তভূমি চন্দ্রপুরি বিষয়ের ময়ূরশান্মলাগ্রহার ক্ষেত্র, এবং এই ভূমিদানকার্য ভাস্করের চারি পুরুষ পূর্বে বুদ্ধপ্রপিতামহ ভূতিবর্মণদ্বারা (আনুমানিক ষষ্ঠ শতকের প্রথম পাদ) প্রথম সম্পাদিত হইয়াছিল। চন্দ্রপুরি বিষয় বা ময়ূরশাল্মল অগ্রহার কোথায় তাহা আজও নিঃসংশয়ে নির্ণীত হয় নাই; তবে উত্তরবঙ্গের পূর্বতন সীমায় (রংপুর জেলায়) কিংবা একেবারে শ্রীহট্ট জেলার পঞ্চখণ্ড (লিপির আবিষ্কার স্থান) অঞ্চল, এ দুয়ের এক জায়গায় হওয়াই সম্ভব, যদিও রংপুর অঞ্চল হওয়াই অধিকতর যুক্তিযুক্ত বলিয়া মনে হয়। যাহাই হউক, এই লিপিতে দেখা যাইতেছে ময়ূরশাল্মল অগ্রহারে ভূতিবর্মণ ভিন্ন ভিন্ন বেদের ৫৬টি বিভিন্ন গোত্রীয় অন্তত ২০৫ জন ‘বৈদিক’ বা ‘সাম্প্রদায়িক ব্রাহ্মণের বসতি করাইয়াছিলেন। ব্রাহ্মণের সকলেই বাজসনেয়ী, ছান্দোগ্য, বাহ্বৃচ্য, চারক্য এবং তৈত্তিরীয়, এই পাঁচটি বেদ-পরিচয়ের অন্তর্গত, তবে যজুর্বেদীয় বাজসনেয়ী-পরিচয়ের সংখ্যাই অধিক। চারক্য এবং তৈত্তিরীয়েরাও যজুর্বেদীয়; বাহ্বৃচ্য ঋগ্বেদীয়; ছান্দোগ্য সামবেদীয়। ইঁহাদের অধিকাংশের পদবী স্বামী। স্পষ্টই দেখা যাইতেছে, ষষ্ঠ শতকের গোড়াতেই উত্তরপূর্ব-বাংলায় (ভিন্ন মতে, শ্ৰীহট্ট অঞ্চলে) পুরাদস্তুর ব্রাহ্মণ-সমাজ গড়িয়া উঠিয়াছে। পূর্বোক্ত অন্যান্য লিপির সাক্ষ্যও তাহাই। ভূমি দান-বিক্রয় যে সব গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে নিম্পন্ন হইতেছে তাহদের মধ্যে অনেক ব্রাহ্মণের দর্শন মিলিতেছে; ইঁহাদের নামপদবী শর্মণ এবং স্বামী দুইই পাওয়া যাইতেছে।

পশ্চিমবঙ্গের খবর পাওয়া যাইতেছে বিজয়সেনের মল্লসারুল লিপি (ষষ্ঠ শতক) এবং জয়নাগের বপ্যঘোষবাট লিপিতে (সপ্তম শতক)। শেষোক্ত লিপিটিদ্বারা মহাপ্রতীহার সূৰ্যসেন বপ্যঘোষবাটনামক একটি গ্রাম ভট্ট ব্রহ্মবীর স্বামী নামে এক ব্ৰাক্ষণকে দান করিতেছেন, এই লিপিতেই খবর পাওয়া যাইতেছে কুককুট গ্রামের ব্রাহ্মণদেব ভট্ট উন্মীলন স্বামী এবং প্রবলি স্বামী নামে আরও দুইটি ব্রাহ্মণের দেখা এখানেও মিলিতেছে। এক্ষেত্রেও নাম-পদবী স্বামী। মল্লাসারুল লিপিতে সংবাদ পাওয়া যাইতেছে, দৈনিক পঞ্চ মহাযজ্ঞ নিম্পন্নের জন্য মহারাজ বিজয়সেন বৎসস্বামীনামক জনৈক ঋগ্বেদীয় ব্রাহ্মণকে কিছু ভূমি দান করিতেছেন। স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে রাঢ় রাষ্ট্রেও ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও বর্ণব্যবস্থা যষ্ঠ-সপ্তম শতকেই স্বীকৃত ও প্রসারিত হইয়াছে। এই তথ্যের প্রমাণ আর ও পাওয়া যায় সদ্য আবিষ্কৃত শশাঙ্কের মেদিনীপুর লিপি দুইটীতে। মেদিনীপুর জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে দণ্ডভূক্তিদেশে ও যে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও বর্ণব্যবস্থা স্বীকৃত হইয়াছিল তাহা সিদ্ধান্ত করা যায় ইহাদের সাক্ষ্যে।

মধ্য ও পূর্ব বঙ্গেও এই যুগে অনুরূপ সংবাদ পাওয়া যাইতেছে। গোপচন্দ্রের একটি পট্টোলিদত্ত ভূমির দানগ্রহীত হইতেছেন লৌহিত্য তীরবাসী জনৈক কান্বগোত্রীয় ব্রাহ্মণ, ভট্টগোমীদত্ত স্বামী। যে-মণ্ডলে (বারকমণ্ডলে; ফরিদপুর জেলায়) দত্ত ভূমির অবস্থিতি তাহার শাসনকর্তাও ছিলেন একজন ব্রাহ্মণ, তাঁহার নাম বৎসপাল স্বামী। এই বংশের আর এক রাজা ধর্মাদিত্যের একটি পট্টোলিদত্ত ভূমির দানগ্রহীতা হইতেছেন ব্রাহ্মণ চন্দ্রস্বামী, আর একটির জনৈক বসুদেব স্বামী। শেষোক্ত পট্টোলিতে গর্গস্বামী নামে আর এক ব্রাহ্মণের ভূমিরও খবর পাওয়া যাইতেছে। তখনও বারকমণ্ডলের শাসনকতা একজন ব্ৰাহ্মণ, নাম গোপালস্বামী। ধর্মাদিত্যের প্রথম পট্টোলিটিতে গ্রামবাসিদের মধ্যেও দুইজন ব্রাহ্মণের উল্লেখ আছে বলিয়া মনে হয় একজনের নাম বৃহচ্চট, আর একজনের কুলস্বামী। মহারাজ সমাচার দেবের ঘুগ্রাহাটি লিপির দত্তভূমির দানগ্রহীতা ও একজন ব্রাহ্মণ, নাম সুপ্রতীক স্বামী এবং দান-গ্রহণের উদ্দেশ্য বলিচরুসত্ৰ প্রবতন। যষ্ঠ শতকের ফরিদপুর ছাড়িয়া সপ্তম শতকের ত্রিপুরার লোকনাথ লিপির সাক্ষ্য ও একই প্রকার; এখানে ও দেখিতেছি জনৈক ব্রাহ্মণ মহাসামন্ত প্রদোষশর্মণ অনন্তনারায়ণ মন্দির প্রতিষ্ঠা এবং ২১১ জন চাতুবির্দ্য ব্রাহ্মণের বসতি করাইবার জন্য পশুসংকুল বনপ্রদেশে ভূমিদান গ্রহণ করিতেছেন। গ্রামকুটম্বি অর্থাং গৃহস্থদের মধ্যে শর্মা ও স্বামী পদবীযুক্ত অনেক নাম পাইতেছি, যথা মঘশর্মা, হরিশর্মা, রুষ্টশর্মা, অহিশর্মা, গুপ্তশর্মা, ক্রমশর্মা, শুক্রশর্মা, কৈবর্তশর্মা, হিমশর্মা, লক্ষ্মণশর্মা, নাথশর্মা, অলাতস্বামী, ব্রহ্মস্বামী, মহাসেনভট্টস্বামী, বামনস্বামী, ধনস্বামী, জীবস্বামী, ইত্যাদি।

শুধু যে ব্রাহ্মণেরাই ভূমিদান লাভ করিতেছেন তাহাই নয়; জৈন ও বৌদ্ধ আচার্যরা এবং তাঁহাদের প্রতিষ্ঠানগুলিও অনুরূপ ভূমিদান লাভ করিয়াছেন। পঞ্চম শতকে উত্তরবঙ্গে পাহাড়পুর অঞ্চলে প্রাপ্ত একটি লিপিতে দেখিতেছি (৪৭৮-৭৯ খ্ৰী) জনৈক ব্রাহ্মণ নাথশর্মা এবং তাহার স্ত্রী রামী এক জৈন আচার্য গুহনন্দির বিহারে দানের জন্য কিছু ভূমি ক্রয় করিতেছেন। ষষ্ঠ শতকে (গুনাইঘর লিপি, ৫০৭-৮ খ্রী) ত্রিপুরা জেলায় জনৈক মহাযানাচার্য শান্তিদেব প্রতিষ্ঠিত আর্য অবলোকিতেশ্বরের আশ্রম বিহারের মহাযানিক অবৈবর্তিক ভিক্ষুসংঘের জন্য মহারাজ রুদ্রদত্ত কিছু ভূমি দান করিতেছেন। এই লিপিটিতেও একজন ব্রাহ্মণ কুমারামাত্য বেরজ্জ স্বামীর সংবাদ পাইতেছি। সপ্তম-অষ্টম শতকে ঢাকা জেলার আস্রফপুর অঞ্চলে দেখিতেছি জনৈক বৌদ্ধ আচার্য বন্দ্য সংঘমিত্র তাঁহার বিহার ইত্যাদির জন্য স্বয়ং রাজার নিকট হইতে প্রচু্র ভূমিদান লাভ করিতেছেন।

 ০৪.১ ব্রাহ্মণদের পদবী ও গাঞি পরিচয়

উপরোক্ত তথ্য বিশ্লেষণ হইতে দেখা যাইতেছে শর্মণ ও স্বামী পদবী ছাড়া ব্রাহ্মণদের বোধ হয় অন্য পদবী-পরিচয়ও ছিল। যেমন, বৃহচ্চট নামে চট্ট, ভট্ট গোমিদত্ত স্বামী, ভট্ট ব্রহ্মবীর স্বামী, ভট্ট উন্মীলন স্বামী, ভট্ট বামন স্বামী, মহাসেন ভট্ট স্বামী, এবং শ্রীনেত্ৰ ভট (ভট্ট) প্রভৃতি নামে ভট্ট, এবং বন্দ্য জ্ঞানমতি ও বন্দ্য সংঘমিত্র নামে বন্দ্য। বৃহচ্চট্টের চট্ট নামের অংশমাত্র বলিয়া মনে হইতেছে না। ব্রহ্মবীর, উন্মীলন, বামন এবং মহাসেন যে ব্রাহ্মণ তাহা তাহাদের স্বামী পদবীতেই পরিশগকার; কিন্তু তাহার পরেও যখন তাঁহাদের নামের পূর্বে অথবা মধ্যে ভট্ট ব্যবহৃত হইতেছে তখন ভট্ট যেন তাঁহাদের “গাঞি” পরিচয় বলিয়াই মনে হইতেছে। পরবর্তী কালের ভাট অর্থ এই ক্ষেত্রে গ্রহণেযাগ্য বলিয়া মনে হয় না। শ্রীনেত্র ভট স্পষ্টই শ্রীনেত্র ভট্ট এবং এক্ষেত্রে ভট্ট ব্যবহৃত হইয়াছে নামের পরে। বন্দ্য পূজনীয় অর্থে ব্যবহৃত হইয়া থাকিতে পারে, অন্ততঃ আচার্য বন্দ্য সংঘ মিত্রের ক্ষেত্রে; কিন্তু বন্দ্য জ্ঞানমতির ক্ষেত্রেও কি তাহাই? এক্ষেত্রেও বন্দ্য “গাঞি” পরিচয় হওয়া অসম্ভব নয়। চট্ট, ভট্ট এবং বন্দ্য, এই কটিই যে রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদের অসংখ্য “গাঞি” পরিচয়ের মধ্যে তিনটি, এ-তথ্য পববর্তী স্মৃতি ও কুলজী গ্রন্থে জানা যায়। ষষ্ঠ-সপ্তম শতকেই এই “গাঞ্চি” পরিচয়ের রীতি প্রচলিত হইয়াছিল, ইহা অসম্ভব এবং অনৈতিহাসিক নাও হইতে পারে।

ব্রাহ্মণদের শর্মণ-শর্মা পদবী-পরিচয় বাংলাদেশে আজও সুপ্রচলিত। কিন্তু স্বামী পদবী-পরিচয় মধ্যযুগের সূচনা হইতেই অপ্রচলিত হইয়া গিয়াছে। নিধনপুর লিপি্র সাক্ষ্য ও শ্ৰীহট্ট অঞ্চলের লোকস্মৃতি হইতে মনে হয়, ঐ লিপির দুই শতাধিক স্বামী পদবীযুক্ত ব্রাহ্মণেরা বৈদিক (পরবর্তী কালে, সাম্প্রদায়িক) ব্রাহ্মণ বলিয়া পরিচিত ছিলেন। অনুমান হয়, ইঁহারা সকলেই বাংলাদেশের বাহির হইতে—পশ্চিম বা দক্ষিণ হইতে—আসিয়াছিলেন। ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে তো এখনও ব্রাহ্মণোদের স্বামী পদবী সুপ্রচলিত। প্রাচীন কালেও তাহাই ছিল। উত্তর-ভারতেও যে তাহা ছিল তাহার প্রমাণ গুপ্তযুগের শিলামালায়ই পাওয়া য্যা। পরবর্তী কালের কুলজী-গ্রন্থে বৈদিক ব্রাহ্মণদের দুটি শাখার পরিচয় পাওয়া যায় : পাশ্চাত্য ও দাক্ষিণাত্য। এই সব স্বামী পদবীযুক্ত ব্রাহ্মণেরা পাশ্চাত্য ও দাক্ষিণাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণ হওয়া অসম্ভব নয়। ধনাইদহ পট্টোলির দানগ্রহীতা বরাহস্বামী ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণ, এবং তিনি আসিয়াছিলেন উড়িষ্যান্তর্গত কটক অঞ্চল হইতে। গোপচন্দ্রের একটি পট্টোলির দানগ্রহীতা ব্রাহ্মণটির নাম গোমিদত্ত স্বামী। তিনি কান্বগোত্রীয় এবং লৌহিত্য-তীরবাসী। লৌহিত্য-তীরবর্তী কামরূপের ব্রাহ্মণেরা তো আজও নিজেদের পাশ্চাত্য বৈদিক বলিয়া পরিচয় দিয়া থাকেন। অবশ্য, স্বামী পদবীর উপর নির্ভর করিয়া এসম্বন্ধে নিঃসংশয় সিদ্ধান্ত কিছু করা চলে না। বাহির হইতে ব্রাহ্মণেরা যে বাংলাদেশে আসিতেছেন তাহার প্রত্যক্ষ প্রমাণ অযোধ্যবাসী কুলপুত্ৰক অমৃতদেব স্বয়ং।

এই সব ব্রাহ্মণদের ছাড়া পঞ্চম হইতে অষ্টম শতক পর্যন্ত লিপিগুলিতে রাজকর্মকারচী, গ্রামবাসী গৃহস্থ, প্রধান প্রধান লোক, নগরবাসী, শ্ৰেষ্ঠী, সার্থবাহ এবং অন্যান্য লোকের নাম-পরিচয়ও পাওয়া যাইতেছে। কয়েকটি নামের উল্লেখ করা যাইতে পারে; যথা, চিরাতদত্ত, বেত্রবর্মণ, ধৃতিপাল, বন্ধুমিত্র, ধৃতিমিত্র, শাম্বপাল, রিশিদত্ত (লক্ষণীয় এই যে, নামটির বানান ঋষিদত্ত উচিত ছিল; সংস্কৃত রীতিপদ্ধতি তখনও অভ্যস্ত হয় নাই বলিয়া মনে করা চলে), জয়নন্দি, বিভুদত্ত, গুহনন্দি, দিবাকরনন্দি, ধৃতিবিষ্ণু, বিবোচন, রামদাস, হরিদাস, শশিনন্দী, দেবকীর্তি, ক্ষেমদত্ত, গোষ্ঠক, বর্গপাল, পিঙ্গল, সুংকুক, বিষ্ণুভদ্র, খাসক, রামক, গোপাল, শ্ৰীভদ্র, সোমপাল, রাম, পত্রদাস, স্থায়ণপাল, কপিল, জয়দত্ত, শণ্ডক, রিভূপাল, কুলবৃদ্ধি, ভোয়িল, ভাস্কর, নবনন্দী, জয়নন্দী, ভটনন্দী, শিবনন্দী, দুর্গাদত্ত, হিমদত্ত, অর্কদাস, রুদ্রদত্ত, ভীম, ভামহ, বৎসভোজিক, নরদত্ত, বরদত্ত, বস্পিয়ক, আদিত্যবন্ধু, জোলারি, নগিজোদক, বুদুক, কলক, সূর্য, মহীপাল, খন্দবিদুর্গ, গবিক, মণিভদ্র, যজ্ঞপাত, নাদভদক, গণেশ্বর, জিতসেন, রিভূপাল, স্থাণুদত্ত, মতিদন্ত, বিপ্ৰপাল, স্কন্দপাল, জীবদত্ত, পবিক্রক, দামুক, বংসকুণ্ড, শুচিপালিত, বিহিতঘোষ, শূরদত্ত, প্রিয়দত্ত, জনার্দন, কুণ্ড, কবণিক, নবনাগ, কেশব, ইটিত, কুলচন্দ্র, গরুড়, আলূক, অনাচার, ভাশৈত্য, শুভদেব, ঘোষচন্দ্র, অনমিত্র, গুণচন্দ্র, কলসখ, দুর্লভ, সত্যচন্দ্র, প্রভূচন্দ্র, রুদ্রদাস, অর্জুন-বপ্প (সোজাসুজি অর্জুনের বাপের সংস্কৃত রূপ, এই ধরনের ডাক-নাম আজও বাংলার পাড়াগাঁয়ে প্রচলিত), কুণ্ডলিপ্ত, নাগদেব, নয়সেন, সোমঘোষ, জন্মভূতি, সূর্যসেন, লক্ষ্মীনাথ, শ্রীমিত্রাবলি, বর্ণটিয়োক, শর্বান্তর, শিখর, পুরদাস, শক্ৰক, উপাসক, স্বস্তিমোক, সুলদ্ধ, রাজদাস, দুর্গগট ইত্যাদি। এই নামগুলি বিশ্লেষণ করিলে কয়েকটি তথ্য লক্ষ্যগোচর হয়। প্রথমত, অধিকাংশ নামের রূপ সংস্কৃত; কতকগুলি নামের দেশজ রূপ হইতে সংস্কৃতীকরণ হইয়াছে, যেমন বস্পিযক, খন্দবিদুৰ্গ গরিক, অর্জুন-বপ্প, বর্ণটিয়োক, দুর্গ্‌ গট ইত্যাদি; আর কতকগুলির নামরূপ দেশজই থাকিয়া গিয়াছে, যেমন, জোলারি, নগিজোদক, কলক, নাদভদক, দামুক, আলূক, কলসখ, ইটিত, সুং’কুক, খাসক ইত্যাদি। ‘অক্‌’ বা ‘ওক্‌’ প্রত্যয় জুড়িয়া দিয়া দেশজ বা ভাষা শব্দের নামকে সংস্কৃত ক-কারান্ত পদ রূপে দেখাইবার যে রীতি আমরা পরবর্তী কালে বাংলা দেশে প্রচলিত দেখিতে পাই (যেমন “সদুক্তিকর্ণামৃত” গ্রন্থে গৌড় বঙ্গের কবিদের নাম-পরিচয়ে, এবং অন্যত্র) তাহাও এই যুগেই প্রতিষ্ঠিত হইয়া গিয়াছে, যথা, খাসক, রামক, বম্পিযক, বর্ণটিযোক, নগিজোদক, নাদভদক, স্বস্তিয়োক ইত্যাদি। দ্বিতীযত, ব্যক্তিগত নামে জনসাধারণ সাধারণত কোন ও পদবী ব্যবহার করিত না, শুধু পূর্ব নামেই (forename) পরিচিত হইত (তেমন নামে  সংখ্যাই অধিক), যেমন, পিঙ্গল, গোপাল, শ্রীভদ্র, রাম, কপিল, বিরোচন, দেবকীৰ্তি, গোষ্ঠক, শণ্ডক, ভোয়িল, ভাস্কর, ভামহ, বুদ্ধক, সূর্য, পরিক্রক, করণিক, কেশব, গরুড়, অনাচার, ভাশৈত্য, দুর্লভ, শবান্তর, শিখর, শক্রুক, উপাসক, সুলব্ধ, গরুড় ইত্যাদি। তৃতীয়ত, এই নামগুলির মধ্যে কতকগুলি অন্ত্যনামের (৪urname) পবিচয় পাওয়া যাইতেছে যেগুলি এখনও বাংলাদেশে নাম-পদবী হিসাবে ব্যবহৃত হয়, যেমন, দত্ত, পাল, মিত্র, নন্দি-নন্দী, বর্মণ, দাস, ভদ্র, সেন, দেব, ঘোষ, কুণ্ডু, পালিত, নাগ, চন্দ্র, এমন কি দাম (দা), ভূতি, বিষ্ণ, যশ, শিব, রুদ্র ইত্যাদি। অধিংকাংশ ক্ষেত্রেই যে এগুলি অন্ত্যনাম এসম্বন্ধে সন্দেহ করা চলে না, তবে কোন কোন ক্ষেত্রে নামেরই অংশ হিসাবে ব্যবহৃত হইয়াছে, এই অনুমানও হয়তো করা চলে। চতুর্থত, এই সব অন্ত্যনাম আজকাল যেমন বর্ণজ্ঞাপক, পঞ্চম-অষ্টম শতকে তেমন ছিল না, তবে ব্রাহ্মণেতর বর্ণের লোকেরাই এই অন্ত্যনামগুলি ব্যবহার করিতেন; ব্রাহ্মণের শুধু শর্মণ বা স্বামী পদবী এবং ভট, চট্ট, বন্দ্য প্রভৃতি “গাঞি” পরিচয় গ্রহণ করিতেন, এইরূপ অনুমান বোধ হয় করা যায়। বাংলাদেশে ব্রাহ্মণ ভিন্ন অন্য তথাকথিত ‘ভদ্র’ জাতের মধ্যে (বৃহদ্বর্ম পুরাণোক্ত উত্তম সংকর ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণোক্ত সৎশূদ্র জাতের মধ্যে) চন্দ্র, গুপ্ত, নাগ, দাস, আদিত্য, নন্দী, মিত্র, শীল, ধর, কর, দত্ত, রক্ষিত, ভদ্র, দেব, পালিত প্রভৃতি নামাংশ বা পদবীর  ব্যবহার এই সময় হইতে আরম্ভ হইয়া হিন্দু আমলের শেষেও যে চলিতেছিল তাহার প্রমাণ পাওয়া যায় “সদুক্তিকর্ণামৃত”-গ্রন্থের গৌড়বঙ্গীয় কবিদের নামের মধ্যে।(১) একথা সত্য বাংলার বাহিরে, বিশেষভাবে গুজরাত-কাথিয়াবাড় অঞ্চলে প্রাচীন কালে এক শ্রেণীর ব্রাহ্মণদের মধ্যে দত্ত, নাগ, মিত্র, ঘোষ, এবং বর্মণ ইত্যাদি অন্তনামের ব্যবহার দেখা যায়। কিন্তু বাংলায় এই লিপিগুলিতে এই সব অন্ত্যনাম যে-সব ক্ষেত্রে ব্যবহার হইতেছে, তাহাদের একজনকেও ব্রাহ্মণ বলিয়া মনে হইতেছে না, ব্রাহ্মণেরা যেন সর্বত্রই শর্মণ বা স্বামী এই অন্ত্যনামে পরিচিত হইতেছেন, অথবা ভট্ট, চট্ট, বন্দ্য প্রভৃতি উপ বা অন্ত্য নামে।

লিপিগুলিতে অনেক ব্যক্তিনামের উল্লেখ যেমন আছে, তেমনই আছে অনেক স্থান নামের উল্লেখ। এই নাম গুলি বিশ্লেষণ করিলেও দেখা যায়, কতকগুলি নামের রূপ পুরাপুরি সংস্কৃত, যেমন, পুণ্ড্রবর্ধন, কোটীবস, পঞ্চনগরী, নব্যাবকাশিকা, সূবর্ণবীথি, ঔদম্বুরিক (বিষয়), চণ্ডগ্রাম, কর্মান্তবাসক, শিলাকুণ্ড, পলাশবৃন্দক, স্বচ্ছন্দ পাটক ইত্যাদি। কতকগুলি নামের দেশজরূপ হইতে সংস্কৃতীকরণ হইয়াছে, যেমন, বারিগ্রাম, পৃষ্ঠম-পোট্টক, গোষাটপুঞ্জক, খাড়(টা)পার, ত্রিবৃতা,  ত্রিঘট্টিক, বোল্লবায়িকা ইত্যাদি। আবার, কতকগুলির নাম এখনও দেশজ রূপেই থাকিয়া গিয়াছে, যেমন, কুট্‌কুট্‌, নাগিরট্ট, ডোঙ্গা (গ্রাম), কণমোটিকা ইত্যাদি। মনে হয়, ব্যক্তি-নামের ক্ষেত্রে যেমন স্থাননামের ক্ষেত্রেও তেমনই, আর্যীকরণ দ্রুত অগ্রসর হইতেছে।

——————–
(১) সদুক্তিকর্ণামৃত, সংকলয়িতা, শ্রীধরদাস (১২০৬) Ed by Ramavatara Sarma and Haradatta Sarma. Lahore. 1936.  শ্রীসুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, “সদুক্তিকর্ণামৃত” বিশ্বভারতী পত্রিকা, কার্তিক-পৌষ, ১৩৫০।

 

Exit mobile version