Site icon BnBoi.Com

গোয়েন্দা ইন্দ্রনাথ রুদ্র সমগ্র – অদ্রীশ বর্ধন

গোয়েন্দা ইন্দ্রনাথ রুদ্র সমগ্র

 

গোয়েন্দা ইন্দ্রনাথ রুদ্র সমগ্র

 

০১. ডিভোর্সি ললনা কল্পনা চিটনিস

আমি ইন্দ্রনাথ রুদ্র, লিখে যাচ্ছি আমার এই কাহিনি, নিজের কলমে। বড় গোপন কাহিনি যে। মৃগাঙ্ককে দিয়ে লেখালে সে তাতে জল মেশাবে অথবা কল্পনার রং মেশাবে। তার ওপর আছে কবিতা বউদির টিটকিরি। সে আর এক জ্বালা।

পুরুষ মানুষ যে ভীষ্ম হয়ে থাকতে পারে, সহজ এই ব্যাপারটা আমার এই অন্তর-টিপুনি দেওয়া বউদিটি কিছুতেই বুঝতে চায় না। মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা রাখতে হয় বইকি। নইলে কি সমাজের মধ্যে থাকা যায়? মেয়েরা আছে বলেই আমরা এই পুরুষরা টিকে আছি। নইলে কোনকালে ফৌত হয়ে যেতাম। তবে হ্যাঁ, একটু গা বাঁচিয়ে চলতে হয়। সেটা একটা আর্ট। ঈশ্বরের কৃপায়, আমি সে আর্টে আর্টিস্ট।

কল্পনা চিটনিস গ্যাংটকের মেয়ে। মানুষ হয়েছে ব্যাঙ্গালোরে। বিয়ে করেছিল কলকাতার রবি রে-কে। ওদের একটা ছেলেও হয়েছিল। ছেলেটার নাম সোমনাথ। তারপর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। সোমনাথের বয়স এখন দশ।

কল্পনা সিকিম-গ্যাংটক-ব্যাঙ্গালোর-কলকাতা-গুজরাতের কালচারে মিশ খাওয়া এক আশ্চর্য কন্যা। তার সবুজ পাথরের মতো আশ্চর্য চোখে যখন তখন সবুজ বিদ্যুৎ নেচে নেচে যায়। ঝকঝকে মুক্তোর মতো সারি সারি দাঁতে ফুটফুটে বোদ্দর যখন তখন ঝলসে ওঠে। কথায় শোনা যায় জলতরঙ্গ, দেহতরঙ্গে মণিপুরী নৃত্য। বডি ল্যাঙ্গুয়েজে বড় পোক্ত এই কল্পনা। একটা জীবন্ত প্রহেলিকা।

সে আমাকে ভালবাসে। আমি মনে মনে তা বুঝি। কিন্তু আমি তাকে সেহ করি, আমার ছোট বোনের মতো। সে জানে, আমি ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাই সীমার বাইরে কখনও পা দেয় না। ফলে, আমাদের মধ্যেকার সম্পর্কটা বড় মধুর–সীমার মাঝে অসীম তুমি, বাজাও আপন সুর।

কল্পনা আমার কাছে একদিন একটা প্রবলেম নিয়ে এসেছিল। আমি নাকি প্রবলেম-শুটার ওর চোখে। আমার কাছে আমি একটা ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো।

সে যাক। কল্পনা এসে বললে, দাদা, ঘর তো ভাঙল। এখন ছেলেটাকে তো বড় করতে হবে।

আমি হুশিয়ার হয়ে গেলাম। বললাম, তা তো বটে। তা তো বটে! কল্পনা নিশ্চয় থট-রিডার। মন-পঠন বিদ্যায় পোক্ত। সব মেয়েরাই তাই হয়। আমার মতে, ওদের অগোচর কিছু থাকে না। যষ্ঠ ইন্দ্রিয় শুধু ওদেরই আছে।

মুক্তো দাঁতে কাঞ্চনজঙ্ঘার কিরীট একটু দেখিয়ে আর হাসিতে অল্প কিরণ ছড়িয়ে কল্পনা বলেছিল, পাহাড়ি জায়গায় থাকতে হবে। ছেলেকে নিয়ে একলা থাকা যায়?

হুঁশিয়ার হয়ে গেলাম। বললাম, পাহাড়ি মেয়ে তুমি, পাহাড়ে থাকতে ভয় কিসের?

ও বললে, তা নয়, ইন্দ্রদা। এমনই একটা কাজ নিয়েছি, যে কাজে হামেশাই ঘরের বাইরে থাকতে হবে। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘোরার কাজ। বাড়িতে সোমনাথ একলা থাকবে কী করে? একা রেখে যাওয়াটা কি সমীচীন?

দেবকন্যা স্টাইলে এমনই ললিত ভঙ্গিমায় প্রস্তাবনাটা উপস্থাপন করেছিল কল্পনা যে, আমি কানাগলিতে আটকে গেছিলাম। স্মার্টলি বলেছিলাম, কী করাতে হবে?

আমার সঙ্গে থাকতে হবে। আলাদা ফ্ল্যাটে। কাছাকাছি দু’টো ফ্ল্যাটে।

ভাইবোনের মতো—ওর চোখের তারায় আমার ছায়া দেখতে দেখতে আমি সাত পাকে বাঁধা না থাকার আভাস দিয়ে গেছিলাম।

মধুর হেসে ও বলেছিল, আপনি বড় ভীতু। তাই হবে।

হ্যাঁ, আমি ভীতু। তাই হোক।

এই হল সূচনা। এই কাহিনির আগের কাহিনি। এবার আসা যাক আসল কাহিনিতে।

 

তারপর আমাদের এক অঞ্চলে থাকা শুরু হয়েছিল এমন একটা জায়গায়, যার পাশেই একটা গভীর খাদ।

ঘটনার শুরু যে সময়টা থেকে, সেই সময়টায় বড্ড বেশি শব্দহীন হয়েছিল অত গভীর খাদটা। শিকারি পাখি-টাখি ছিল না একটাও। অন্য সময়ে মাথার ওপর দিয়ে ভেসে ভেসে যায় বাতাসে গা এলিয়ে দিয়ে—সেদিন কোনও আকাশচারীকে দেখতে পাইনি। বুনন কুকুরের মতো দেখতে নেকড়েগুলোর গান-টান শোনা যাচ্ছিল না। দরজার সামনের তালঢ্যাঙা পাইন গাছে যে পাচাটা থাকে, সেই মহাশয়ও আমার নাম-টাম জিজ্ঞেস করেনি। আমার চাইতে চৌকস যে কোনও মানুষ এই সবই যে আসন্ন বিপদের পূর্বাভাস, তা আঁচ করে ফেলত নিশ্চয়। কিন্তু আমার ব্রেনে সেই সিগন্যাল আসেনি।

কনকনে ঠাণ্ডাটা বড় ভাল লাগছিল বলেই কুঁদ হয়েছিলাম। বহু নিচের গ্যাংটকের দিকে চোখের পাতা না ফেলে তাকিয়েছিলাম। হিমালয়ের মহান সৌন্দর্য এমনই একটা আবেশ রচনা করে গেছিল মনের মধ্যে যে, এই নৈঃশব্দ্য যে, আগুয়ান ডেঞ্জারের রেড সিগন্যাল, তা বুঝতে পারিনি। অথচ আমার বোঝা উচিত ছিল। আত্মহারা হয়ে যাওয়াটা আমার ধাতে নেই। সেদিন তা হয়েছিলাম। কাজটা ভাল করিনি।

হেঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, খতম হল ক’জন?

পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছিল দুমদাম ঘুষোঘুষির আওয়াজ আর গাঁক-গাক চেঁচানির মতো গলাবাজি। সোমনাথের গলা ভেসে এল সব আওয়াজ ছাপিয়ে, কী?

তোর হিরোইন জানে মারল ক’জনকে?

কথাটা যার দিকে ছুঁড়ে দিলাম, সে রয়েছে আমার কাছ থেকে বিশ ফুট দূরে। আমি কিচেনে, সোমনাথ লিভিংরুমে। তাই চেঁচাতে হল ফুসফুস ফাটিয়ে। ওকেও কথা বলতে হচ্ছে চিল-চিৎকার করে। এইভাবেই চলছে পাঁচদিন ধরে। কেন না, সোমনাথের মা সোমনাথকে সামলানোর ভার আমার ওপর ছেড়ে দিয়েছে। মামা। সামলাক ভাগ্নেকে। এর মধ্যে রঙ্গ কিসসু নেই। কিন্তু কঙ্গো ড্যান্সে পোক্ত এই ভাগ্নেকে সামাল দেওয়া কি চাট্টিখানি কথা।

আমি অবশ্য জীবনের এই নতুন অধ্যায়ের নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের দিকে মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছি। গোয়েন্দাগিরি করে করে এত হেদিয়ে গেছি যে, লোকালয় থেকে কিছুদিন দূরে থাকতে পারলে বাঁচি।

লম্বা লম্বা পা ফেলে গিয়ে দাঁড়ালাম লিভিংরুমের সামনে। বললাম, তোর ওই যন্তরে ভলুম কন্ট্রোল নেই?

সোমনাথ তখন যে বস্তুটা নিয়ে তন্ময় হয়ে রয়েছে, তার নাম গেমস ফ্রীক। এতই নিবিষ্ট যে আমার দিকে চোখ তুলে তাকানোর সময়ও নেই। গেমস ফ্রীক এক হাতে, কন্ট্রোল নাড়ছে আর এক হাত দিয়ে। অ্যাকশন ফুটে ফুটে উঠছে বিল্ট-ইন কমপিউটার স্ক্রীনে। বস্তুটা ওকে দিয়েছি গতকাল। সেই থেকে এক নাগাড়ে খেলেই চলেছে। খেলুক। কিন্তু খুব যে একটা আমোদ পাচ্ছে, তা নয়। কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে আমারও।

খেলাটা এনে দিয়েছিলাম ওর খপ্পর থেকে একটু রেহাই পাওয়ার জন্যে। গুতিয়ে গুতিয়ে আমাকে নিয়ে যেত পাহাড়ি জায়গায়—মার্শাল আর্ট শেখবার মতলবে। আশ্চর্য এই মল্লশিল্প জানা থাকলে আখেরে কাজ দেয়। তাই ওকে কিছু কিছু শিক্ষা দিয়ে গেছি। আবার সক্কালবেলা স্কুলেও নিয়ে গেছি, বিকেলবেলা স্কুল থেকে নিয়ে এসেছি। বাকি সময়টা সিকিমের রান্না বেঁধেছি। ব্রুস উইলির মুভি দেখেছি। মামা-ভাগ্নের অট্ট অট্ট হাসিতে ঘর প্রায় চৌচির হয়েছে। আর এখন গেছে আমার চোখের আড়ালে—যাতে আমি দেখতে না পাই। বিটকেল গেম যে ওকে খিটকে করে তুলেছে তা তো মুখ দেখেই বুঝতে পারছি। বসলাম পাশের সোফায় বললাম, চল, এক চক্কর ঘুরে আসি।

প্রস্তাবটা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আর এক কান দিয়ে বের করে দিল বিচ্ছু সোমনাথ। আবার এলাম অন্য কথায়, আমার গপ্পো শুনবি? তোর মায়ের কথা?

আমার গাপ্পো মানে ডেঞ্জারাস মানুষদের সঙ্গে আমার কাজ কারবারের কথা। এই তো সেদিন, গরমের শেষের দিকে, কল্পনা আর সোমনাথকে খুনের ফিকিরে ছিল ভুটিয়া গুণ্ডা দোঙ্গা জং! মানুষ মেরে বড় উল্লাস পায় দোঙ্গা জং। একেবারে পিশাচ। তার খপ্পর থেকে বাঁচবার জন্যেই নাকি আমার দ্বারস্থ হয়েছিল কল্পনা। কি করে ফেরাই? জানি ও আমাকে মনে মনে ভালবাসে। ডিভোর্সের আগে থেকেই ওর মনে রং ধরিয়ে ফেলেছি আমার অজান্তে। সোমনাথের বয়স যখন মাত্র ছ’বছর, তখনই আর পুরোনো বর নিয়ে ঘর করতে পারেনি কল্পনা। এই হিমালয় অঞ্চলেই দ্রৌপদী নামে একটা গোত্র আছে। বাড়ির এক বউ সব ক’টা ভাইকে বিয়েও করতে পারে। তিব্বতী আর নেপালি মেয়েরা তো এ ব্যাপারে অনেক আগুয়ান। রাখঢাক রাখে না সোয়ামি বদল করা বা একাধিক গোপন অথবা প্রকাশ্য সোয়ামি রাখার ব্যাপারে। কল্পনা চিটনিসের রক্তে রয়েছে সেই টান। ফলে, ছ’বছরের ছেলেকে নিয়ে ছেড়েছে এক স্বামীকে। খুনে গুণ্ডা পিছনে লেগেছে সেই থেকে। রঙ্গমঞ্চে আমার আবির্ভাব তারপরেই। ঠেঙারে ঠেকাতে। কিন্তু মালাবদলের ব্যাপারে আমি নেই। আমি যে ভীষ্ম। নির্ভেজাল। ব্যাসদেব নই। এই ভদ্রলোকের ‘সৎকর্ম’, মায়ের হুকুমে, কারও অজানা নয়। সুতরাং সেই পুণ্য প্রসঙ্গ থেকে বিরত রইলাম।

ঢ্যাঁটা সোমনাথ মা’কে নিয়েও কথা বলতে চাইল না আমার সঙ্গে। কথা ঘুবিয়ে দিল অন্যদিকে—ওই দ্যাখো, মামা। নষ্টরানি খেপেছে।

নষ্টরানি যাকে বলছে সে একটা কালিকা টাইপের মেয়েছেলে। যেমন কালো, তেমনি মারকুটে। এলো চুল পাকিয়ে পাকিয়ে বহু বল্লমের মতো ঝুলিয়ে রেখেছে পিঠে। ভীষণাকৃষ্ণা করাল রূপে একাই লড়ে যাচ্ছে তিন-তিনজন পেশিপুষ্ট জোয়ানের সঙ্গে। আশপাশে কাঁটা ঝোপ, দূরে দূরে খোঁচা খোঁচা পাহাড়। রুদ্রাণীর গলা চিরে যে হিস-হিস লড়াই-চিকার ঠিকরে আসছে, তা ইলেকট্রনিক হুঙ্কার…কিন্তু গায়ের রক্ত জল করে দেয়।

আমি বলেছিলাম, শয়তানের কারখানায় তৈরি মেয়েছেলে মনে হচ্ছে।

সোমনাথ বললে, বদলা নিচ্ছে রানি। ওর বোনকে যে বেচে দিয়েছে বদমাস মেয়ে-কারবারিরা।

বাচ্চাদের ইলেকট্রনিক খেলার মধ্যেও মেয়েপাচারের গল্প। গোল্লায় গেল দেশটা। আমার চোখের সামনেই করালী কন্যার ছুরির কোপে তিন দুশমনের রক্ত ছিটিয়ে গেল কমপিউটার স্ক্রীনে। বীভৎস।

কন্ট্রোলের স্টপ বোতাম টিপে-দিলাম। বন্ধ হল নারকীয় খেলা। বললাম, সোমনাথ, তুই আর তার মা বিপদের মধ্যে আছিস। কিন্তু আমি তো আছি।

তুমি তো আগলে রেখেছ—আমাকে আর মাকে।

আমার চোখে চোখে চেয়ে চেয়ে বলে গেল দশ বছরের সোমনাথ। সরল চাহনি। কিন্তু কথাটা বক্র। বহু রকমের অর্থবহ। যার ঔরসে জন্ম, মা তাকে ভালবাসে না। বাসে আমাকে। সোমনাথের তা অজানা নয়। ছোটরা বোঝে অনেক। ওদের মনের তল খুঁজে পায় ক’জন?

মনের ভেতরকার মোচড়টাকে বাইরে টেনে না এনে হাসিমুখে বললাম, মা তো ক’দিন পরেই ফিরবে। চ, খাবি চ।

খেলাটা শেষ করে নিই। নষ্টরানি কি মার মারছে, মামা।

দ্যাখ।

চলে এলাম কিচেন রুমে। শুনে গেলাম নষ্টরানির চিল-চিৎকার। বেধড়ক পিঠছে। রসিয়ে রসিয়ে রণরঙ্গিনী সেই মূর্তি দেখছে সোমনাথ। নিশ্চয় মা’কে কল্পনা করে নিচ্ছে সেই জায়গায়। দুশমন সংহার করছে মা।

মিনিট তিনেক পরেই মোবাইলে ভেসে এল কল্পনার কণ্ঠস্বর। কাজের মধ্যে একটু ফুরসৎ পেয়েই ছেলের খোঁজ নিচ্ছে। সামলাতে পারছি তো দামাল ভাগ্নেকে?

কল্পনা কাজ করে লোকাল টেলিভিশন স্টেশনে। নিউজ কমেন্টেটর। এখানে সেখানে গিয়ে চালু ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে খবর বলে যায় মুখে মুখে। আইন পড়া আছে। পড়েছে ব্যাঙ্গালোরে। আমার সঙ্গে ওর আলাপ সেইখানেই। ডিভোর্সের আগে একটা কুটিল কেসের কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে গিয়ে।

ছেলের খবর নিয়ে আর আমার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছেটা মিটিয়ে নিয়ে লাইন ডিসকানেক্ট করে দিল কল্পনা।

গেলাম লিভিংরুমে, সোমনাথকে, খবরটা দেওয়ার জন্যে। কিন্তু ঘর ফাকা। বাড়ির বাইরে গেলাম। এখানকার পাইন গাছের তলায় খেলতে ভালবাসে সোমনাথ। কিন্তু কেউ নেই সেখানে। মুখ হাঁ করে রয়েছে পাশের গিরিখাদ। হাঁক দিলাম গলা চড়িয়ে, সোমনাথ?

জবাব দিল না সোমনাথ।

মা টেলিফোন করেছিল। কাজ শেষ। এবার আসছে।

সোমনাথ নিশ্চুপ।

বাড়ির এ পাশ ও পাশ দেখে নিয়ে ফিরে গেলাম ভেতরে। গেস্ট রুমে উকি মারলাম। কেউ নেই। বাথরুমেও কেউ নেই। ফের গেলাম রাস্তায়। এ রাস্তায় গাড়ি আসে কম। পাশেই তো খাদ।

সোমনাথ! মা ফোন করেছিল। বাড়ি ফিরছে।

মায়ের ভয় দেখালাম। ছেলে কিন্তু অভিমানী। জবাব দিল না।

গঞ্জালো নামে এক বিদেশি ভদ্রলোক থাকেন পাশের বাড়িতে। এই দেশটাই এখন তার স্বদেশ। মাতৃভূমির নাম মুখেও আনেন না। তাঁর দুই ছেলে সোমনাথের সমবয়সি। তাদের সঙ্গে খেলতে গেলে সোমনাথ আমাকে বলে যায়। একটু নিচের ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ডে গেলেও আমাকে জানিয়ে যায়। খোলা রাস্তায় কদাচ যায়। খাদের ধারের সরু রাস্তার ওপর কল্পনার এই বাড়ি থেকেই খাদ দেখা যায়, তাই খাদের ধারেও ছেলেটা একা কখনও যায় না।

ফোন করলাম পাশের বাড়ির মিস্টার গঞ্জালোকে। সোমনাথ সেখানেও নেই। ঘড়ি দেখলাম। কল্পনা ফোন করেছিল চারটে বাইশে। এখন চারটে আটত্রিশ। এইটুকু সময়ের মধ্যে উবে গেল ছেলেটা। জানলা দিয়ে তাকালাম পাহাড়ের দিকে। কিন্তু পাহাড় তো ফাঁকা।

টেলিফোন এল মিস্টার গঞ্জালোর। তার ছেলেরাও দেখেনি সোমনাথকে। উনি নিজেই বেরোচ্ছেন খুঁজতে। প্রতিবেশী সজ্জন হলেই জগত সুন্দর। সুতরাং আমার চিন্তা কিসের?

চিন্তা কিন্তু কুটকুট কামড় বসিয়ে গেল মনের মধ্যে। একটু পরেই পাহাড় থেকে ফোন করে গঞ্জালো সাহেব জানালেন, সোমনাথ ওখানেও নেই।

এবার আমি নিজেই উঁকি দিলাম খাদের মধ্যে। কিনারা খুব গড়ানে নয়। তবু যদি গড়িয়ে গিয়ে যায়, এই চিন্তায় নরম মাটিতে পা বসিয়ে বসিয়ে নামতে নামতে হাঁক দিলাম আবার, সোমনাথ, কোথায় তুই?

ঢালু খাদের এদিকে সেদিকে ওয়ালনাট গাছ আছে অনেক। ঠিক যেন খাদের বাঁকা আঙুল। সোমনাথকে অনেকবার গল্পচ্ছলে বলেছিলাম, এইসব গাছের গায়ে একটা কুঁড়েঘর বানিয়ে নিলে খাসা হতো। তাই আবার ডাক দিলাম–সোমনাথ! কোথায় তুই?

মনে হল যেন অনেক দূর থেকে একটা গলা ভেসে এল। পা ভেঙে পড়ে আছে হয়তো কোথাও।

সোমনাথ! সোমনাথ!

গাছের পাতার খসখস আওয়াজ ছাড়া কোনও শব্দ নেই। তারপরেই আবার গলাবাজি। যান্ত্রিক স্বর। এবার চিনলাম। গেমস ফ্রিক খেলার সেই কালিকারানি চেঁচিয়ে যাচ্ছে। গেলাম সেখানে। পেলাম গেমস ফ্রিক। সোমনাথ নেই।

 

কল্পনার চোখে মুখে নাকে চিবুকে সিকিমি টান থাকতে পারে, কিন্তু কথাবার্তায় খাঁটি বাঙালি। শিক্ষাদীক্ষা যে এই কলকাতায়। মঙ্গোলীয় বাঙালি ছাঁচে ঢালাই হয়ে গেছে। ফলে, সে সত্যিই একটা বস্তু। নইলে বাঙালি বর জুটিয়ে নেয়। এখন আমাকে কজায় আনার ফিকিরে আছে।

সোমনাথ দশে পা দিয়েছে। শিক্ষাদীক্ষা বাংলা আর ইংরেজিতে চলনসই, কানাড়া ভাষাও জানে। স্কুলে শিখেছে। তাই একটা চিরকুটে বাংলায় লিখলাম, সোমনাথ, এখানে থাকবি। তোকে খুঁজতে যাচ্ছি।

চিরকুট রাখলাম কিচেন ঘরের মেঝেতে। তারপর গাড়ি হাঁকিয়ে গেলাম গিরিপথ দিয়ে ওকে খুঁজতে। সূর্য ঢলে পড়ছে। ছায়ার জগত বেড়েই চলেছে। যেন শলি ঢেলে ভরাট করা হচ্ছে খাদের গভীরতা।

হয়তো তেড়ালি মচকেছে ছেলেটার। খাদ বেয়ে উঠতে পারেনি। পা টেনে টেনে নেমে গেছে আরও নিচে। ঠাঁই নিয়েছে কারও ডেরায়। পাহাড় যে ওর। আত্মীয়। পাহাড়েই আছে। উবে যায়নি। দশ বছর যার বয়স, সে এভাবে নিপাত্তা হয় না।

বাড়ির নিচের রাস্তায় পৌঁছে গাড়ি পার্ক করে রাখলাম। রাস্তায় নামলাম। আলো আরও তাড়াতাড়ি চম্পট দিচ্ছে। অন্ধকার গাঢ়তর হচ্ছে। চোখ চালাতে বেগ পাচ্ছি। হেঁকে ডাকলাম, সোমনাথ?

এখানে বাড়ি আছে তিনটে। প্রথম দুটোয় নেই সোমনাথ। তৃতীয় বাড়ির মালকিন বললে, পিছনের চত্বরটা দেখে যেতে। না, সেখানেও নেই ছেলেটা!

আবার স্টিয়ারিং ধরলাম। দু’পাশ দেখতে দেখতে যাচ্ছি। একটার পর একটা আলো জ্বলে উঠছে রাস্তায়। রাস্তা তো একটা নয়, অনেক। ছেলেটা কোন রাস্তায় সেঁধিয়েছে, বুঝব কী করে। মহা মুশকিলে পড়লাম। দু’বার গাড়ি দাঁড় করালাম। দুজন পথচারীকে জিজ্ঞেস করলাম। না, কেউ দেখেনি জিনস আর সোয়েটার গায়ে দেওয়া কোনও ছেলেকে। এদিকে যে ঠাণ্ডা বাড়ছে। সোয়েটার এখন যথেষ্ট নয়।

বাড়ি ফিরলাম। সোমনাথ ফেরেনি। রান্নাঘরের মেঝেতে চিরকুট পড়েই আছে। কেউ ছোঁয়নি।

টহলদার প্রাইভেট সিকিউরিটিকে ফোনে জানিয়ে দিলাম। পাহাড়ি অঞ্চল তো। বেআইনি কাববারের ডিপো। তাই প্রাইভেট সিকিউরিটির বেশ রমরমা।

অনেকটা হালকা হলাম। ওরা ফোনে ফোনে খবর নেবে। সজাগ হয়ে গেল গোটা অঞ্চল।

ঠিক এই সময়ে বাড়ি ফিরল কল্পনা। অনেকটা পথ এসেছে গাড়িতে। ব্ল্যাক বিজনেস স্যুট ধসক গেছে। মুখে শ্রমক্লান্ত হাসি, সোমনাথ কোথায়?

ঘড়ি দেখলাম। ছ’টা বেজে দু’মিনিট। মোবাইলে কথা বলেছিলাম ঠিক একশো মিনিট আগে। বললাম, সোমনাথকে পাওয়া যাচ্ছে না।

কল্পনার মঙ্গোলীয় চোখ দুটো একটু বিস্ফারিত হল। মুখে কথা নেই। মা যে। ভেতরে যে কি হচ্ছে, বাইরে ফোটাচ্ছে না। আমি ছোট্ট করে রিপোর্ট দিলাম। যা-যা করেছি ছেলেটার খোঁজে, সব বললাম। সব শেষে বললাম, এবার পুলিশকে টী

টেলিফোনটা বেজে উঠল ঠিক এই সময়ে! কল্পনা ছিটকে যাওয়ার আগেই আমি গেলাম। রিসিভার তুললাম। অপর দিক থেকে অমার্জিত কণ্ঠস্বরে বললে, ইন্দ্রনাথ রুদ্র নিশ্চয়? গুড। সোমনাথ এখন আমাদের খপ্পরে। ফিরিয়ে দেব। দাম চাই।

কত? গলা না কাঁপিয়ে বলেছিলাম।

ডিম, বলেই রিসিভার নামিয়ে রাখল ছেলে চোর।

 

০২. অনিক্স পাথরের ডিম

আগের শীতে কলকাতার শিল্পমেলায় সেই প্রথম চিন আর পাকিস্তান আসর জমিয়ে বসেছিল। ছিল বাংলাদেশও। কিন্তু চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে শুধু পাকিস্তান। পাথরের শিল্পকর্ম দেখিয়ে। অনিক্স পাথর থেকে যে এত রকম জিনিস তৈরি হতে পারে, তা বুঝি জানা ছিল শুধু মোগল আমলে অথবা ভারত ভাগের আগে। এখন সে সব জিনিস আর আসে না। দেখার জন্যে হায়দ্রাবাদের সালারজাঙ মিউজিয়াম অথবা মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের মারবেল প্যালেসে যেতে হয়। কিন্তু অনিক্স পাথর কুঁদে এত বিস্ময় সামগ্রী সে সব জায়গাতেও এমনভাবে জড়ো করা হয়নি, যে-ভাবে করা হয়েছিল ময়দানের শিল্পমেলায়।

ব্রিটিশ আমলে বাহারি কিন্তু বিপুল মূল্যের বস্তুগুলো চলে যেত প্রাসাদ সাজাতে। এখন যাচ্ছে গুজরাতি-মাড়োয়ারিদের অট্টালিকায়, আলিপুর-টালিপুর অঞ্চলের অভিজাত পরিবারদের বড় বড় নয়নসুন্দর সৌধগুলো তো তারাই কিনে নিয়েছে। গোটা বড়বাজার হাতের মুঠোয় এনে ফেলেছে। উত্তর কলকাতাতেও অনুপ্রবেশ ঘটছে। এই পৃথিবীর সেরা দশ ধনীর নাম করতে গেলে কলকাতার এই আধুনিক ধনীদের নাম এসে যায়। তৃতীয়জনই তো মাড়োয়ারি নন্দন। খাস কলকাত্তাই পিলে। মিত্তাল।

ময়দানের শিল্পমেলায় এরা এসেছিল। ভিড় করেছিল তেহরান, ইরান, মূলতান, বেলুচিস্তান থেকে পাথরের কারিগর ব্যবসায়ীরা। স্টল উপছে পড়েছে তাদের চোখ ধাঁধানো শিল্প সামগ্রীতে—থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছিল স্টলের বাইরে-মাঠের ওপর।

কড়া সিকিউরিটির ব্যবস্থা অবশ্যই ছিল। কলকাতার নামযশ তো অকারণে হয়নি। মরু উদ্যান যে।

সেই সুনাম রক্ষাও করেছিল কলকাতা। হাত সাফাই বিদ্যায় মহাপটু শিল্পীরা ভানুমতীর খেল দেখিয়ে দিয়েছিল তাবড় তাবড় রক্ষীদের বোকা বানিয়ে দিয়ে। কলকাতা যে সেরা ম্যাজিশিয়ানের শহর।

উধাও হয়ে গেছিল এক বাক্স অনিক্স পাথরের ডিম।

সাইজে হাঁসের ডিমের মতো, কিন্তু চেহারায় একটু অন্যরকম। সারা গায়ে রকমারি রঙের শিরা-উপশিরা। পাথরের বুক কেটে তৈরি তো, তাই। ঝিকিমিকি দ্যুতি সর্বাঙ্গে। এক-একটা বাক্সে সাজানো ছ’টা করে ডিম। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলে তাক লেগে যায়। বারে বারে দেখতে ইচ্ছে যায়। ঘরে নিয়ে গিয়ে রাখতে ইচ্ছে যান। দাম তো অতি সামান্য। মাত্র পঞ্চাশ টাকা-এক-একটা পিস।

শিল্পরসিক কিন্তু সীমিত রেস্তর বঙ্গতনয় এবং তনয়ারা এই ডিম কিনেছে অনেক। কিন্তু ছ’টি ডিম সমেত একটা প্যাকেট নগদ মূল্য দিয়ে এক ব্যক্তি নিয়ে যায়নি। ম্যাজিক দেখিয়ে মেরে দিয়েছে। ঈগলচক্ষু নজরদারিদের চোখে ধুলো দিয়ে।

বোধহয় ত্রাটক যোগে সিদ্ধ ছিল সেই ব্যক্তি। সেই যোগ, যার অভ্যাসে পুরাকালের মুনিঋষিরা সম্মোহন করতেন বনের পশুদেরও।

যোগী-তস্কর কিন্তু বড় অল্পে তুষ্ট! অনেক মূল্যবান অনিক্স পাথরের সামগ্রী নিচয় থেকে ভ্যানিশ করে দিয়েছিল শুধু ছ’টি ডিম। মাত্র ছ’টি ডিম।

সংবাদ মাধ্যমকে এই চৌর্য পর্ব জানানো হয়নি। তাহলে ঢি ঢি যত না পড়ত, তার চেয়ে বেশি সজাগ হয়ে যেত ডিম-জাদুকর। কিন্তু আমি জেনেছিলাম। কেননা, ডিম ছ’টা অনিক্স পাথরের খোলস ধারণ করে গোপন করে রেখেছিল পৃথিবী সেরা বেশ কিছু হিরে। সিকিউরিটিতে যারা ছিল, এ সংবাদ তাদের ছিল না। জানানো হয়নি। জানতাম শুধু আমি। আমার ওপর সেই ভার দেওয়া হয়েছিল বলে।

না, আমার চোখে ধূলো দেওয়া যায়নি। আমি জানি সেই ডিমের গতিপথ, গন্তব্যস্থল এবং বর্তমান অবস্থান।

এই ডিমই চাওয়া হয়েছিল টেলিফোনে। সোমনাথ গায়েব হয়েছে এই কারণেই। অলমতিবিস্তরেণ। প্রসঙ্গটা নিয়ে সবিস্তার হওয়া যাবে পরে…যথাসময়ে। গুপ্ত রহস্য যে! যতক্ষণ গুপ্ত থাকবে, ততক্ষণ সে এই কাহিনি পড়বেন। জেনে গেলেই ছুঁড়ে ফেলে দেবেন। কারণ, আমি লেখক নই বন্ধুবর মৃগাঙ্কর মতো!

 

 

০৭. যমজ হিরে

অভিশপ্ত এই হিরে জগত বড় বেশি টেনে ধরেছিল রবিকে। তাই বুঝি এমন মন্দ ভাগ্য কৃষ্ণমেঘ রচনা করে গেছে ওর বিবাহিত জীবনে। মনে হয় বুঝি এক কল্পিত নাটক, যার মধ্যে সত্যের ছিটেফোঁটাও নেই। নিছক মিথ্যানৃত্য নিয়ে বুঝি রচনা করতে বসেছি এই কাহিনি।

কিন্তু তা তো নয়। হে পাঠক, হে পাঠিকা, বিশ্বাস করুন, এই আপাত আজব কাহিনি অলীক নয়। রতি পরিমাণেও। শিহরণ যদি জাগ্রত হয়, জানবেন তার মূলে আছে নিখাদ সত্য…এবং তা অবিশ্বাস্য।

হিরে নিয়ে, হিরের জন্মকথা নিয়ে শ্বাসরোধী ঘটনামালা সাজিয়ে যাওয়ার পরেই পকেট থেকে একটা পেপার প্যাকেট বের করে আমার সামনে রেখেছিল হিরে বণিক রবি রে। আদতে হিরে বণিক—মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ তার বহিরাবরণ। ছদ্মবেশ। বড় খলিফা…বড় ধুরন্ধর এই রবি রে।

পেপার প্যাকেটটা আমার সামনে রেখে দ্রিমি দ্রিমি মন্থর স্বরে রবি বলেছিল, ইন্দ্র, অ্যাংগোলায় যারা হিরে খুঁজে বের করে, এদের বলা হয় গ্যারিমপিরোস। জাতে এরা পর্তুগিজ। একদিন মোলাকাত ঘটল এমনই এক গ্যারিমপিরোসের সঙ্গে। পরনে টি-শার্ট আর জিনস। এই যে পেপার প্যাকেটটা তোর সামনে রাখলাম, এটা পেয়েছিলাম তার কাছেই।

প্যাকেট খুলে বের করেছিল একটা হিরের দানা-মুরগিকে যে দানা খেতে দেওয়া হয়—সাইজে চেহারায় সেইরকম।

এই দ্যাখ। বলে, পেপার প্যাকেট খুলে হিরের দানাটা আমাকে দেখিয়েছিল রবি রে। চোখের পাতা ফেলতে ভুলে গেছিলাম আমি।

রবি আমার নিথর চক্ষু তারকার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে গেছিল—ইন্দ্র, ছোট্ট এই পাথরটার ওজন সাড়ে তিন ক্যারাট। আদতে হিরে কিনা, তা যাচাই করার জন্যে আমার হাতে তুলে দিয়েছিল টেন পাওয়ার ম্যাগনিফাইং গ্লাস–হিরে বাণিজ্যে যে জিনিসটা অপরিহার্য। হিরে চিনতে হলে, বিশেষ এই আতস কাচ দরকার ‘ আমি সেই কাচের মধ্যে দিয়ে যা দেখেছিলাম, তা আমার চক্ষু চড়কগাছ কবার পক্ষে যথেষ্ট।

আমি বলেছিলাম, রবি, তুই তো একটা পয়মাল। সহজে তাজ্জব হোস না। কি দেখেছিলি?

দেখেছিলাম দুটো হিরে গায়ে গায়ে জুড়ে রয়েছে। গলে গিয়ে জুড়ে গেছে। ধরণী তার জঠরের কল্পনাতীত তাপ দিয়ে দুটো দু’রকমের হিরেদের একসঙ্গে জুড়ে রেখে দিয়েছে।

আজ, এতদিন পরে, সেই কাহিনি লিখতে বসে আমার মনে হচ্ছে, রবি যেন ওর ভবিষ্যৎ প্রত্যক্ষ করেছিল সেই যমজ হিরের মধ্যে। দুটো দুরকমের হিরে। একটা ও নিজে, আর একটা ওর ভাগ্যাকাশের শনি নক্ষত্র-কল্পনা।

রোমন থাক। সেদিনের কথায় আসি।

রবি বলে গেছিল—যমজ হিরে নিয়ে শুরু হয়েছিল দর কষাকষি! খনি শ্রমিক গ্যারিমপিয়োস যে হিরে বণিকের সামনে যমজ হিরে দেখিয়েছিল, তার নাম কাবেনজেলি। ছোট্ট একটা পকেট ক্যালকুলেটর বের করে সে খুটখাট করে হিরের দাম ফুটিয়ে তুলেছিল স্ক্রীনে। সাড়ে সাতশ ডলার। টেবিলের ওপর দিয়ে ক্যালকুলেটর ঠেলে দিয়েছিল হিরে যে খুঁড়ে তুলেছে—তার দিকে। সে দাম চেয়েছিল ২২০০ ডলার। ক্যালকুলেটর যাতায়াত করেছে টেবিলের এদিক থেকে ওদিকে। ওদিক থেকে এদিকে। দাম উঠেছে পড়েছে নিঃশব্দে—মুখে কোনও কথা নেই। শেষ পর্যন্ত রফা হয়েছিল ১৬০০ ডলারে। যমজ হিরে আমার পকেটে এল ২০০০ ডলারের বিনিময়ে। মস্ত ঝুঁকি নিলাম। হিরে ব্যবসাতে আজ যে রাজা, কাল সে ফকির হয়ে যেতে পারে, ফকির হয়ে যেতে পারে রাজা।

রবির চোখে চোখ রেখে আমি বলেছিলাম, তুই কি হয়েছিস?

যমজ হিরেকে পকেটে চালান করতে করতে রবি বলেছিল, এই মুহূর্তে রাজা। কেন না, ডবল দামের খদ্দের এসে গেছে হাতে।

বেরসিকের মতো আমি বলে ফেলেছিলাম, রবি, হিরে নিয়ে তুই কি শুধু দালালিই করেছিস? খনি থেকে হিরে তোলা দেখিসনি?

অট্টহেসে রবি তখন বলে গেছিল ওর দুর্ধর্ষ জীবনের অনেক গুপ্ত কাহিনি। যে সব কাহিনি প্রকাশ্য হলে ওর জীবন বিপন্ন হতে পারে। হিরে তোলার জাহাজে চেপে ও পাড়ি দিয়েছে মরুভূমির উপকূল থেকে আঠারো মাইল দূরের সমুদ্রে। সেই মরুভূমির নাম নামিবিয়া। দেখেছে কীভাবে সতেরো ফুট চওড়া ড্রিল ঢুকে যাচ্ছে দক্ষিণ আটলান্টিকের তিনশো ফুট গভীরে। টেনে তুলছে প্রতি ঘণ্টায় তিনশো মেট্রিক টন সমুদ্রতল—একটানা-বিরামবিহীনভাবে—দিনে আর রাতে-সাতদিন, সাতৃরাত।

ভাসমান খনি? নিরুদ্ধ নিঃশ্বাসে বলেছিলাম আমি।

হ্যাঁরে! গত দশ কোটি বছরে অরেঞ্জ নদী কত হিরে ধুইয়ে নামিয়েছে সাগরের জলে, তার একটা হিসেব করে নেওয়া হয়েছিল আগেই—পরিসংখ্যান হিসেব। সেই হিসেবেই ভাসমান খনি ভেসেছিল সাগরের জলে মাসে উনিশ হাজার ক্যারাটের হিরে তোলার টার্গেট নিয়ে…

উনিশ হাজার ক্যারাট!

আজ্ঞে।

হিরের ঝলকানি চোখ ঝলসে দেয়নি?

দূর! হিরে তো দেখিনি।

তবে?

শুধু পাথর আর সাগরের জঞ্জাল!

 

 

 

 

১১. আট লাখ হিরে শ্রমিকের দেশ—এই ভারত

উইপোকা আর লাল কাঁকড়া বিছে পাহারা দিয়ে চলেছে হিরের যে খনি অঞ্চল, তা নিয়ে আরও কথা বলতে ভুলেই গেছিল কুশলী বক্তা রবি রে। মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ লাইনটাই তো বকমবাজদের লাইন-আজকাল অবশ্য মেয়েরাও এই লাইনে লাইন দিয়ে নামছে। ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নাম-টামও করে ফেলেছে। কেন না, সুধী ব্যক্তি মাত্রই জানেন, ঈশ্বর মহোদর নারীজাতিকে জিহ্বা সঞ্চালনের ক্ষমতা কিঞ্চিৎ অধিক দিয়েছেন, সেই সঙ্গে দিয়েছেন কণ্ঠস্বরের তীক্ষ্ণতা। বুদ্ধিমত্তার ক্ষিপ্রতা এর সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ায় দশভুজা হতে পারে শুধু তারাই…

যাচ্চলে, আবার কল্পনা-কাহিনিতে চলে আসছি নাকি? যত নষ্টের গোড়া অবশ্য সেই সবুজময়না—কিন্তু তার আগে আরও কিছু বলে নেওয়া যাক…, যা-যা জেনেছিলাম মহা ডানপিটে রবি রে’র পেট থেকে…

 

হিরের খনির ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে হেঁট হয়েছিল বলে ধমক খেয়েছিল রবি রে। তারপর কি হয়েছিল, সে প্রসঙ্গে আর না গিয়ে চলে এসেছিল এই পৃথিবীর ডায়মণ্ড বাজারে হৃৎপিণ্ড যেখানে, সেইখানে-অ্যান্টওয়ার্প রেলরোড স্টেশনের পাশের তিনটে রাস্তায়-কালাহারির কথা আধাখাচড়া রেখে দিয়ে এমন একটা জায়গায়—হিরে যেখানে উড়ছে। খনি থেকে তোলা এবড়ো-খেবড়ো অতিশয় অসুন্দর। হিরেদের শতকরা আশিভাগের লেনদেন হচ্ছে সরু সরু তিনটে রাস্তায় আর এই বিশাল হিরে বাজারের শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে রয়েছে বিশ্বের অন্য অন্য শহরেও।

আমি প্রকৃতই জ্ঞান বুভুক্ষুর মতো জানতে চেয়েছিলাম, রবি, সে শহরগুলো কোথায় রে?

নিউইয়র্কে, লণ্ডনে, তেল আভিভে, আর বোম্বাইতে।

বোম্বাইতে!

অপেরা হাউস ডিসট্রিক্টে কখনও যাসনি?

সেটা কোথায়?

বোম্বাইতে।

বম্বে যে একটা ডায়মণ্ড সিটি, আমার তা অজানা ছিল না। এত বুক নয় এই ইন্দ্রনাথ রুদ্র। বম্বে একা এখন আর ডায়মণ্ড সিটি নয়, এই গৌরব ছড়িয়ে পড়েছে ইণ্ডিয়ার অন্য অন্য শহরেও।

যেমন, ব্যাঙ্গালোরে।

ব্যাঙ্গালোরের সুনাম অনেক দিক দিয়ে। ছিল গার্ডেন সিটি, হল আইটি সিটি, এখন শুতে চলেছে ডায়মণ্ড সিটি…শুধু একজনের উদ্যমে। তার নাম শ্রীযুক্ত রবি রে। এত লম্বা কাহিনি সেই কাহিনিরই ভূমিকা।

রবি অনেকদিন ধরেই স্বপ্ন দেখেছিল, এই পৃথিবীর সেরা সম্পদ নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে, ভারতকে আবার সেই রত্নময় ভারতের জায়গায় নিয়ে যাবে।

বাঙালির ব্রেন যখন খেপে ওঠে, তখন সে পারে না, এমন কিছু নেই। ওষুধ বিক্রির সুযোগকে হাতিয়ার করে ও ঢুকে গেছিল হিরের জগতে…এই ভারতের হীরক দুনিয়ায়…যে দুনিয়ায় আট লাখ শ্রমিক নানা শহরে বসে আকাটা হিরে কেটেকুটে খাসা হিরে বানিয়ে চলেছে…সাইজে এক ক্যারাটের কম হলেও ঝকমকে হিরের কণা বের করেছে…রমণীর নাকের জেল্লা বাড়িয়ে দিচ্ছে…ফলে, শুধু নাক নেড়েই কেল্লা মেরে দিচ্ছে মেয়েরা। ‘

মূলে রয়েছে আট লাখ হিরে কারিগর!

আমি হাঁ হয়ে গেছিলাম রবিব হিম্মৎ কাহিনি শুনে। কি অসাধারণ বুকের পাটা। যে বাজারে গুজব ভাসছে হাওয়ায়, যেখানে হিরের দাম ঠিক হয়ে যায় শুধু চোখের ইশারা আর একটি মাত্র হিব্রু শব্দ উচ্চারণের মধ্যে দিয়ে, সেই বাজারে বাংলার ছেলে জাঁকিয়ে বসেছিল শুধু ব্রেন আর ব্যক্তিত্ব খাটিয়ে।

আমি আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করেছিলাম, হিব্রু শব্দটা কী রে?

মজল।

মা-মানে?

গুড লাক।

সিক্রেট শব্দটা ডায়মণ্ডের সমতুল্য। একটু-আধটু ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে, ডায়মণ্ড মহোদয়রা কক্ষনো জানতে দেয় না কোন ডায়মণ্ড কোন খনিতে আবির্ভূত হয়েছিল। চেহারা দেখে চেনা যায় না। কোন মুলুকের মাল। চেহারা দেখে চরিত্র বুঝতে হবে-জন্মস্থান জানা যাবে না। পাকেও তো পদ্ম ফোটে।

রবি রে ওর ডায়মণ্ড চক্ষুর নৃত্য দেখিয়ে বলেছিল, মাই ডিয়ার ইন্দ্রনাথ রুদ্র, ওই যে একটা কথা আছে না, স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম দেবা ন জানস্তি, ডায়মণ্ডদের ক্ষেত্রে কথাটা খাটে। জলুস দেখে কেউ বলতে পারবে না–কোন মুলুকের মাল। তুই তো সূত্রান্বেষী ইন্দ্রনাথ রুদ্র–

ক্ষীণ স্বরে বলেছিলাম, মৃগাঙ্ক থাকলে তোর এই বিশেষণটা লুফে নিত।

বাগড়া পেয়ে থমকে গিয়ে চোখ পাকিয়ে রবি বলেছিল, কোন বিশেষণটা?

সুত্রান্বেষী। একদা আমাকে ছিদ্রান্বেষী বিশেষণ দিয়ে একখানা জম্পেস গল্প বানিয়েছিল। সূত্রান্বেষী…সূত্রান্বেষী…গুড অ্যাডজেক্টিভ।

বিরক্ত হয়েছিল রবি। এটা আমার ইচ্ছাকৃত। কথার টানা স্রোতকে হঠাৎ হঠাৎ ঘুলিয়ে দিতে হয়। আচমকা আচমকা বাগড়া পড়লে অনেক অনিচ্ছার কথা ফুসফাস করে বেরিয়ে আসে। চতুর পাঠক এবং চতুরা পাঠিকা, আপনারা এই টেকনিক বাস্তব জীবনে কাজে লাগিয়ে দেখতে পারেন। রতিপতির বাণ যখন মানব মনকে শিথিল করে দেয়, তখন এইভাবে আলটপকা ঢিল মেরে দেখতে পারেন-অনেক কদর্য কাহিনি বেরিয়ে এলেও আসতে পারে। এই জগতের যারা মাতাহারি, তারা জানে এই গুপ্ত কৌশল। জানে কল্পনা চিটনিস…।

যাচ্চলে, ঘুরে ফিরে সবুজনয়না ফের চলে এসেছে লেখনী অগ্রে…

এবার টেনে কলম চালাচ্ছি। শী বলছিলাম? ও হ্যাঁ, হিরে দেখে অতি ওস্তাদ জহুরিও বলতে পারে না, ধরণীর কোন খনন ভূমিতে ঝিকিমিকি পাথরটির প্রথম আবির্ভাব ঘটেছে। আদিভূমি অজানা থেকে গেলেও হিরের টুকরোর সার্টিফিকেট দিতে কসুর করে না ডায়মণ্ড এক্সপার্টরা। লক্ষ কোটি হিরে-পাথর এই মুহূর্তে পাইপলাইন দিয়ে স্রোতের আকারে বয়ে চলেছে, অথচ তাদের প্রত্যেকেই উৎসবিহীন। এবড়ো-খেবড়ো আকৃতি ঝেড়ে ফেলে ঝকঝকে চকমকে হয়ে উঠছে, কিন্তু কোনমতেই জানতে দিচ্ছে না ধরণীর কোন কোণ থেকে তারা এসেছে।

উৎস অজানা, কিন্তু ঔৎসুক্য কারোরই কম থাকেনি। অ-রূপ পাথরটাকে রূপময় করে তোলার ব্যাপারে। সার্টিফিকেট না পেলে বুনো পাথরে দাম চড়বে কী করে? স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো রবি বলে গেছিল এবড়ো-খেবড়ো অতি কদাকার একখানা পাথরকে মেজে ঘষে কেটে কুটে কীভাবে ৫৮ দিকওয়া হিরে বানানো হচ্ছে। এ দৃশ্য দেখবার সৌভাগ্য ওর হয়েছিল নিউইয়র্কে—মানহাট্টান ডিসট্রিক্টের ঠিক মাঝখানে—কড়া পাহাবায় রাখা ওয়ার্ক রুমে এক অপরাহ্নে। হিরে কারিগর ঘুরিয়ে যাচ্ছিল একটা চাকা–পুরনো দিনের গানের রেকর্ড গ্রামোফোনের ওপর বাই বাই করে ঘুরত যেভাবে—সেইভাবে। ঘুরন্ত চাকায় তেল আর হীরক-চূর্ণের আস্তরণ…কুমোরের চাকা ঘুরছে বলে মনে হয়েছিল রবির…বাংলার ছেলে তো…হিরে-কারিগরের সঙ্গে কুমোরের মিল খুঁজে পেয়েছিল মনের মধ্যে…মিল থাকার কারণও ছিল যথেষ্ট…এক তাল মাটিকে যেমন টিপে টুপে মূর্তির অবয়ব ইত্যাদি এনে দেয় কুমোর, প্রায় সেই একই পন্থায় হিরে-কারিগর আকাটা হিরেকে কেটেকুটে খাসা হিরে বানাচ্ছে…একপাশের ফ্ল্যাম্পে আটকানো রয়েছে অধরা হিরে…দু’মাস ধরে সাজাচ্ছে বদখৎ বৃহৎ হীরকখণ্ডকে—খনি থেকে যখন এসেছিল কাটাই-ঘরে, তখন সেই হিরে ছিল অস্বচ্ছ, অর্ধ-আয়তাকার একটা চাই…একপ্রান্ত আর এক প্রান্তের চেয়ে থ্যাবড়া…

অস্বচ্ছ? এই পর্যন্ত শুনে আমি মুখ খুলে ফেলেছিলাম, হিরে আবার অস্বচ্ছ হয় নাকি?

হয় বন্ধু, হয়। ভেতরের ত্রুটি চেপে রেখে দেওয়ার জন্যেই হীরকজননী সত্তানতুল্য হিরেকে ঈষৎ ধোঁয়াটে রেখে দেয়।

ধোঁয়াটে হিরে!

আজ্ঞে। মনে হয় যেন এক তাল কুয়াশা জমাট হয়ে রয়েছে ভেতরে। ঘুরন্ত সেই হিরোকে কয়েক মিনিট অন্তর চোখের সামনে তুলে ধরে অন্তর্ভেদী চোখে চেয়ে থাকে হিরে-কাটিয়ে…আমি যাকে দেখেছি, এ ব্যাপারে তার মতো ওস্তাদ খুবই কম আছে এই দুনিয়ায়…তিরিশ বছর ধরে শুধু হিরে কাটছে…কাটছে…কাটছে। যে হিরেটাকে দেখেছিলাম গ্রামোফোন ডিস্কের মতো চাকার ওপর ঘুরতে, সেটার পিছনে লেগেছিল মাস দেড়েক…একখানা হিরে কাটতে দেড় মাস।

বিড় বিড় করে বলেছিলাম, সাধারণ হিরে নিশ্চয় নয়।

একেবারেই নয়। সত্যিই অসাধারণ। জীবনে এমন হিরে আমি দেখিনি, ইন্দ্র। আর আমাকে তা দেখানোর জন্যে, আমার চোখ তৈরি করার জন্যে—দেওয়া হয়েছিল দুর্লভ এই সুযোগ।

যোগ্য বলেই প্রশংসাটা করেছিলাম অন্তর থেকে। রবি রে অকারণে রবি রশ্মি হয়নি। হীরক রশ্মির জগতে ও দুম করে চলে আসেনি। জীবন বিপন্ন করে দেখেছে, অন্তরশক্তিকে জাগ্রত করেছে-তবেই না, অধুনা ব্যাঙ্গালোরের ডায়মণ্ড কমপ্লেক্সের জনক হতে পেরেছে। হৃদয়জাত শক্তি দিয়ে চিনেছে পৃথীজাত পাথরকে…

কিন্তু চিনতে পারেনি ত্রাটক যোগসিদ্ধা কল্পনা চিটনিসকে।

দম নিয়ে ফের শুরু করেছিল রাব—এই যে দিনের পর দিন একটা মাত্র হিরে পাথরকে অনবরত মেজে ঘযে কেটেকুটে যাওয়া,এর মধ্যে আসল আর্টটা কি জানিস?

অপচয় যাতে কম হয়, আলটপকা বলে দিয়েছিলাম আমি।

দ্যাটস রাইট; খুশি উপচে পড়া চোখে বলেছিল রবি রে, কাটতে গিয়ে, পালিশ করতে গিয়ে যেন বেশি হিরে ধুলো হয়ে না যায়—

টুক করে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সেই ধুলো থেকে কি হিরে ভস্ম তৈরি হয়?

হিরে ভস্ম!

যা খেয়ে নাকি নবাব-বাদশারা হারেম ম্যানেজ করে যেত।

স্টুপিড! হচ্ছে হিরে-কথা, চলে গেল হারেমে। ইন্দ্র, তোর মতিগতি বিশুদ্ধ নয়

নীরব থাকাই শ্রেয় মনে করলাম।

সেকেণ্ডে কয়েক ব্যাজার থাকবার পর ঝেড়ে উঠল রবি। বললে, ইদ্র, যে হিরেটাকে সেদিন রিভলভিং স্টেজে নেচে নেচে কাটাই হতে দেখেছিলাম, মামুনি হিরে সেটা নয়। একখানা পাথরে আটান্নটা দিক-এক-একদিকে এক-রকম জলুস। সে যে রোশনাই, না দেখলে তুই ধারণায় আনতে পারবি না।

আনতে চাইও না। তুই বলে যা।

জুল জুল করে আমার চোখের দিকে চেয়ে রইল রবি। চোখে চোখে কথা যখন হল না, অর্থাৎ আমার হিরে-নিরেট মাথায় যখন ওর মনের কথা জাগ্রত হল না, তখন বাচন আকারে যে কথাটা বলেছিল রবি, তা এই–

ইন্দ্র, হিরেটা সাইজে ঠিক একটা ডিমের মতো।

অশ্বডিম্বের মতো নয় নিশ্চয়।

নিতান্ত অসময়ে নেহাৎই অপ্রাসঙ্গিক এইরকম অনেক রসিক আমি করে ফেলি। বাক্য বীরাঙ্গনা কবিতা বউদি তখন আমার ওপর তেড়ে ওঠে। হে সুবুদ্ধি পাঠক এবং হে জ্ঞানবতী পাঠিকা, আপনারা দয়া করে সেই ইচ্ছা সম্বরণ করুন। কথার খই অনেক সময়ে খেই ধরিয়ে দেয়।

রবি একটু বিরক্ত হয়েছিল। কিন্তু হীরক-উপাখ্যানে নিমগ্ন থাকার ফলে তা নিমেষে কাটিয়েও উঠেছিল। বলেছিল, ডিম। হিরের ডিম। হিরে-ইতিহাসে এমন অতিকায় ডিম আর জন্মায়নি।

বলতে বলতে স্মৃতির কুয়াশার আবিল হয়ে গেছিল হীরক উপাধ্যায় রবি রে।

আমি ওর ঘোর কাটানোর জন্যে আলতোভাবে বলেছিলাম, অজ্ঞর অজ্ঞতা ক্ষমাঘেন্না করে একটা প্রশ্নের জবাব দিবি?

প্রশ্নটা যে রকম, জবাবটা সেই রকম হবে।

তেড়ে উঠছে দেখে, আলতোভাবে পেশ করেছিলাম কৌতূহলটা, হিরে কি চেঁচায়?

অদ্ভুত চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল রবি। তারপর বললে, সত্যিই তুই ভাল গোয়েন্দা।

থ্যাঙ্কস ফর দ্য সার্টিফিকেট। কিন্তু…হিরে কি চেঁচায়?

হ্যাঁ, চেঁচায়…মাঝে মাঝে…কাটাই করার সময়ে। জননীর জঠর থেকে বেরিয়ে এসে শিশু যেমন কেঁদে ওঠে, হিরে তেমনি কাঁদে…রূপান্তর ঘটানোর সময়ে।

অ, বলে নিশ্চুপ রইলাম সেকেণ্ড কয়েক।

আর একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম তারপরেই—হিরে কি খানখান হয়ে যেতে পারে বেমক্কা ঠোক্করে?

বিপুল বিস্ময়ে চেয়ে রইল রবি। বললে তারপরে, আঁচ করলি কী করে? হিরে তো কঠিনতম পদার্থ এই পৃথিবীতে…হিরেকে ভাঙা যায় না—এইটাই তো সবাই জানে। ইন্দ্র, তুই একটা জিনিয়াস। হ্যাঁ, হিরেও খান খান হয়ে যেতে পারে—বেঠিক জায়গায় ঠোক্কর খেলে।

হিরে কঠিন মানুষদের মতো—আমি দার্শনিক হওয়ার চেষ্টা করেছিলাম।

হীরকপ্রতীম রবি রে কিন্তু দর্শন-ফর্শনের ধার ধারে না। বললে, এই জন্যেই একজন ঘুরন্ত চাকার নিচে লম্বা হয়ে শুয়ে থাকে। হিরে হাত ফসকে গেলে যেন। মাটিতে না আছড়ে পড়ে—লুফে নিতে পারে তার আগেই।

মুখখানাকে বোক চন্দরের মতো করে আমি জানতে চেয়েছিলাম, মস্ত হিরেকে কি কেটে খানকয়েক করা হয়েছিল?

হ্যাঁ…হ্যাঁ…তেড়াবেঁকা ছিল যে আকাটা হিরে।

ক’টা হিরে বেরিয়েছিল?

ছটা।

ছ’টা! খনির হিরের মূল ওজন তাহলে ছিল কত?

দু’শ পঁয়ষট্টি দশমিক বিরাশি ক্যারাট।

পেল্লায় হিরে যে। ডায়মণ্ড মার্কেট কাঁপানো হিরে। বন্ধু, এবার বল তো, এ হিরে কোথাকার হিরে?

কঙ্গোর হিরে।

 

এই আখ্যায়িকার নামকরণে একটু ভুল করেছি। নাম রাখা উচিত ছিল ‘হিরের ডিম’।

তবে হ্যাঁ, ক্ষুরধার বুদ্ধি প্রয়োগে পাঠক এবং পাঠিকা নিশ্চয় আঁচ করে ফেলেছেন, অনিক্স পাথরের ডিমের সঙ্গে হিরের ডিমের কোথায় যেন একটা মিল আছে।

সবুর…সধুর…আর একটু।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Exit mobile version