Site icon BnBoi.Com

বিপজ্জনক খেলা – রকিব হাসান

বিপজ্জনক খেলা

বিপজ্জনক খেলা

০১.

মনটা খারাপ হয়ে গেছে ওদের। হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন আন্ট জোয়ালিন। অথচ রকি বীচ থেকে যখন রওনা দিয়েছিলেন, তখন দিব্যি সুস্থ। রাস্তায় গাড়ি চালাতে চালাতে পেটব্যথা শুরু হলো। শোরটাউনে পৌঁছতে পৌঁছতে একেবারে কাহিল। তার বোন মিস কিশোর থ্রিলার ভায়োলার বাড়িতে থেকে যেতে বাধ্য হয়েছেন। ডাক্তার ডাকা হয়েছে। এসে ওষুধপত্র দিয়ে গেছেন। বলে গেছেন, আগামীদিনের আগে ভাল হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

মিস ভায়োলার বাড়িতে অবশ্য এমনিতেও উঠত ওরা–আন্ট জোয়ালিন, তিন গোয়েন্দা এবং কোরি ড্রিম। এখানে থেমে গোস্ট আইল্যান্ডে যাওয়ার অপেক্ষা করত। প্রতিদিন একবার করে দ্বীপে যায় লঞ্চটা। ধরতে না পারলে পরের দিনের জন্যে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।

কোরি ড্রিম তিন গোয়েন্দার বান্ধবী, এক স্কুলে একই ক্লাসে পড়ে। আন্ট জোয়ালিন কোরির খালা। গরমের ছুটিতে গোস্ট আইল্যান্ডে বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছিলেন ওদের। তিন গোয়েন্দার ওখানে যাওয়ার দুটো কারণ–ছুটি কাটানো এবং ভূত দেখা। কোরির দৃঢ় বিশ্বাস, গোস্ট আইল্যান্ডের একমাত্র হোটেল নাইট শ্যাডো-তে ভূত আছেই। যেমন নাম দ্বীপের, তেমনি হোটেলের। কৌতূহল ঠেকাতে পারেনি গোয়েন্দারা। যেতে রাজি হয়ে গেছে।

ভাল রোদ ঝলমলে দিন দেখে রওনা হয়েছে ওরা। পথে যে এ রকম একটা অঘটন ঘটবে কে ভাবতে পেরেছিল?

কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিরাশ হতে হলো না। সেদিনই সন্ধ্যার লঞ্চ ধরতে ওদের রাজি করালেন আন্ট জোয়ালিন। বললেন, তোরা চলে যা। কাল শরীর ভাল হয়ে গেলে আমিও যাব। না পারলে পরশু।

অহেতুক আন্ট ভায়োলার বাড়িতে বসে থাকার মানে হয় না। শোরটাউনে দেখার কিছু নেই। সুতরাং কোরিকে নিয়ে লঞ্চঘাটে রওনা হলো। তিন গোয়েন্দা।

ট্যাক্সি নিয়ে ছোট্ট শহরের সরু রাস্তা ধরে লঞ্চঘাটে পৌঁছল ওরা। রাস্তায় লোকজন তেমন নেই। যা আছে, বেশির ভাগই টুরিস্ট। ডকের শেষ মাথায় একধারে একটা ছোট কাঠের সাইনবোর্ডে লেখা: গোস্ট আইল্যান্ড টুরস। নিচে তীরচিহ্ন দিয়ে বোঝানো হয়েছে কোন ঘাট থেকে দ্বীপে যাওয়ার লঞ্চ ছাড়ে।

সেদিকে এগিয়ে গেল ওরা।

ছোট একটা বোট থেকে লাফিয়ে নেমে এল হাসিখুসি এক তরুণ। হেসে জিজ্ঞেস করল, গোস্ট আইল্যান্ডে যাবে?

কিশোর জবাব দিল, হ্যাঁ।

আমি এই লঞ্চের সারেং। এসো।

ব্যাগ-সুটকেস নিয়ে লঞ্চে উঠে পড়ল তিন গোয়েন্দা। হাত ধরে কোরিকে উঠতে সাহায্য করল সারেং। শুধু ওরাই। আর কোন যাত্রী দেখল না। অবাক লাগল কিশোরের।

সামনের দিকে এগিয়ে গেল তিন গোয়েন্দা। সরু কাঠের বেঞ্চের নিচে ঢুকিয়ে দিল ব্যাগগুলো। সবজে-ধূসর ঢেউ লঞ্চের কিনারে বাড়ি মারছে ছলাৎ ছল ছলাৎছল। খানিক দুরে সৈকতের বালিতে ফেলে দেয়া আবর্জনায় খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে চার-পাঁচটা সী গাল।

ওরা উঠতেই আর দেরি করল না সারেং। ডকের সঙ্গে বাঁধা লঞ্চের দড়িটা খুলে দিয়ে এঞ্জিন স্টার্ট দিল। বিকট গর্জন করে উঠল পুরানো এঞ্জিন। জেটির কাছ থেকে সরে যেতে শুরু করল লঞ্চ।

কেবিনের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে কিশোর। বাতাস ভেজা ভেজা। ঠাণ্ডা।

আচমকা ভীষণ দুলে উঠল লঞ্চ। জেটি থেকে সরে আসতেই বিশাল ঢেউ ধাক্কা মেরেছে। সীটে বসেও প্রচণ্ড ঝাঁকি খেল যাত্রীরা। সাংঘাতিক দুলুনি।

মজা পেয়ে হেসে উঠল কোরি। হাসিটা সংক্রামিত হলো অন্য তিনজনের মাঝে।

ভয় পাচ্ছ? হেসে জিজ্ঞেস করল সারেং। আজ অতিরিক্ত ঢেউ।

দারুণ! মুসা বলল। মনে হচ্ছে নাগরদোলায় চড়ছি।

রেলিঙের কাছে গিয়ে দাঁড়াল কোরি। আধ মিনিটেই অর্ধেক কাপড় ভিজিয়ে সরে চলে এল। বৃষ্টির ছাটের মত এসে গায়ে লাগে পানির কণা।

শোরটাউন থেকে বেশি দূরে না দ্বীপটা। বেশিক্ষণ লাগল না পৌঁছতে। তীরের দিকে তাকিয়ে ডকের এপাশ ওপাশ খুঁজল মুসা, কই? আমাদের না নিতে আমার কথা? কেউ তে এল না।

কোরি বলল, বুঝতে পারছি না। হয়তো দেরি দেখে ফিরে গেছে।

সারেঙের দিকে ফিরল কিশোর, আসতে দেরি করেছি নাকি?

আর দিনের চেয়ে কিছুটা তো দেরিই।

হু, কোরির দিকে তাকাল কিলোর। তারমানে মেলবয়েস লোক পাঠিয়েছিলেন ঠিকই। লঞ্চ না দেখে ফিরে গেছে।

ডকে ভিড়ল লঞ্চ। লাফ দিয়ে দিয়ে নামল ওরা। সারেং নামল না। ওপর থেকে ওদের ব্যাগ-সুটকেসগুলো বাড়িয়ে দিল এক এক করে।

দমকা বাতাসে ওদের দুই পাশে ধুলোর ঘূর্ণি উড়ল।

দ্বীপ বটে একখান! আনমনে বিড়বিড় করল সারেং

চারপাশে তাকাল কিশোর। শেষ বিকেলের রোদে এত সুন্দর লাগছে জায়গাটাকে, বাস্তব মনে হয় না। আকাশের গোলাপী রঙ রাঙিয়ে দিয়েছে সাগরের পানিকে। ঢেউ আছড়ে পড়ছে সাদা বালিতে। ডকের দুদিকে বহুদূর লম্বা হয়ে ছড়িয়ে গেছে সৈকতটা।

সরু একটা রাস্তা এঁকেবেঁকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠে ঢুকে গেছে। পাইনবনের ভেতর। ওপর দিকে তাকালে বন ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না।

হোটেলটা কই? জানতে চাইল কিশোর।

শেষ ব্যাগটা মুসার হাতে তুলে দিল সারেং। শার্টের আস্তিন দিয়ে কপালের ঘাম আর নোনা পানি মুছল। হাত তুলে বনের দিকে দেখিয়ে বলল, ওখানে।

বনের ভেতর দিয়ে যেতে হবে? ঘাবড়ে গেল মুসা। ভূতের ভয় তার ষোলো আনা। আসার ইচ্ছেও ছিল, আবার না-ও। ভুতকে ভয় পায়, এদিকে দেখার কৌতূহলও সামলাতে পারেনি।

হ্যাঁ, সারেং বলল। এই রাস্তা ধরে চলে যাবে। লঞ্চের দড়ি খুলতে আরম্ভ করল সে। একটা গেটহাউস দেখতে পাবে। হোটেলটার চারপাশ, ঘিরে বেড়া দেয়া। যাও, পেয়ে যাবে গেট।

দড়ির খোলা মাথাটা ডেকে ফেলে দিয়ে এঞ্জিন স্টার্ট দিল সে। দ্রুত সরিয়ে নিতে শুরু করল ডকের কাছ থেকে। ওর এই তাড়াহুড়াটা ভাল লাগল না মুসার। বনের দিকে তাকাল। যাব কি করে? শাটলবাস আছে?

তার কথার জবাব দিল না সারেং। অনেক সরে গেছে। বিকট শব্দ করছে। এঞ্জিন। ওদের দিকে একবার হাত নেড়ে লঞ্চের নাক ঘুরিয়ে দিল সে। একটিবারের জন্যেও আর ফিরে তাকাল না।

.

০২.

লোকজন তো কাউকেই দেখছি না, নিজের ব্যাগটা হাতে নিয়েও আবার নামিয়ে রাখল কিশোর।

আমাদের কথা ভুলেই গেল কিনা কে জানে, কোরি বলল।

দাঁড়িয়ে না থেকে চলো হাঁটি।

একটা জিনিস অবাক লাগেনি তোমাদের? রবিন বলল, লঞ্চে আমরা ছাড়া আর কোন যাত্রী ছিল না। একজন টুরিস্টও এল না কেন?

সমুদ্রের অবস্থা খারাপ দেখে সাহস পায়নি হয়তো, অনুমান করল। মুসা।

মনে হচ্ছিল সাগরটা যেন ইচ্ছে করে ঠেলে আসতে চেয়েছে আমাদের। দিকে, কালো ছায়া পড়ল কোরির মুখে! এখানে আসতে বাধা দিচ্ছিল আমাদের।

খাইছে! গলা কেপে উঠল মুসার। ওরকম করে বোলো না। আমার ভয় লাগছে।

আরে কি সব ফালতু কথা শুরু করলে, বনের দিকে তাকিয়ে আছে। কিশোর। কেউ আসে কিনা দেখছে।

ফালতু দেখলে কোথায়? তর্ক শুরু করল কোরি। সুস্থ মানুষ, হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে গেলেন আন্ট জোয়ালিন। সাগরের ঢেউ ঠেলে এসেছে। আমাদের দিকে। এসবই খারাপ লক্ষণ : নিজের অজান্তেই হাত উঠে গেল। গলার লকেটটার কাছে। আঙুলগুলো চেপে ধরল কাচের তৈরি মানুষের খুলির। মত দেখতে রঙিন লকেটটা। রকি বীচের এক অ্যানটিক শপ থেকে জোগাড় করেছে সে। দোকানদার বলেছে, বহু পুরানো জিনিস। প্রাচীন একটা কবরে পাওয়া গেছে। এটা যার গলায় পরা থাকবে. ড্রাকুলার মত সাংঘাতিক ভূতও। তার কিছু করতে পারবে না।

উফফ, বিরক্ত হয়ে বলল কিশোর, এক মুসার যন্ত্রণাতেই বাঁচি না, আরও একজন যুক্ত হলো। অই কোরি, তোমার ওই ভুত, অশুভ লক্ষণ, এসব নিয়ে লেকচার থামাবে?

ভূত দেখতেই কিন্তু এখানে এসেছ তোমরা।

ও একটা কথার কথা। আমি এসেছি আসলে বেড়াতে। ভুত যদি থাকেই, মুসাকে নিয়ে দেখিয়ে দিয়ে। পরে এখন চলো যাওয়া যাক

কেন, শাটলবাসের জন্যে অপেক্ষা করবে না  মুসার দিকে আড়চোখে তাকাল রবিন।

শাটলবাস না, কচু আসবে এখানে মুখ ঝামটা দিয়ে বলল কোরি। তার চেয়ে বরং হাত নাড়ো, ট্যাক্সি চলে আসুক।

ঠাট্টা করছ নাকি? মনে হচ্ছে যেন মোড়ের কাছে বসে তোমার অপেক্ষা করছে গাড়িওয়ালা, কিশোর বলল এখানকার সুবিধা-অসুবিধা আন্ট জোয়ালিন তো সবই বলে দিয়েছেন। এখন বিরক্ত হও কেন?

কিন্তু ডকের কিনার থেকেই যে খাড়া পাহাড়ে চড়তে হবে একথা বলেনি. বিশাল দুটো সুটকেসে জিনিসপত্র ভরে নিয়ে এসেছে কোরি। এরকম বোঝা বইতে হবে জানলে আনত না বিরক্তমুখে নিচু হয়ে দুহাতে তুলে নিল দুটো সুটকেস।

নিজের ক্যানভাসের ব্যাগটা কাঁধের ওপর ফেলল মুসা। হাত বাড়াল কোরির দিকে, একটা দাও আমাকে। তুমি দুটো নিতে পারবে না।

কিন্তু দিল না কোরি। বলল, না, পারব।

চাপাচাপি করল না মুসা ঠিক আছে, না পারলে দিয়ে দিয়ে।

রাস্তা ধরে উঠতে শুরু করল, ওরা ঢুকে পড়ল পাইনবনে। কিছুদূর এগোতে পাথরের একটা গেটহাউজ দেখা গেল দুপাশ থেকে উঁচু লোহার শিকের বেড়া চলে গেছে দুদিকে। সারেং বলেছে হোটেলের পুরো সীমানাই ঘিরে রেখেছে ওটা। গেটহাউজে কোন লোক পড়ল না। বেড়ার গায়ে সাইনবোর্ডে বড় বড় ইংরেজিতে অক্ষরে লেখা–

হোটেল নাইট শ্যাডো
প্রাইভেট প্রপার্টি

গেটে তালা থাকলেই হয় এখন, রবিন বলল, ঢুকতে আর হবে না।

কি যে বলো না, অস্বস্তি চাপা দিতে পারল না কোরি, তালা থাকবে কেন?

আছে কিনা দেখলেই তো হয়, লম্বা পা ফেলে আগে আগে গিয়ে গেটের সামনে দাঁড়াল মুসা। ঠেলা দিল পাল্লায়।

নড়ল না ওটা।

একপাশের পুরানো আমলের হাতল দেখিয়ে বলল রবিন, ওটা ঘোরাও। খুলে যাবে।

ঘুরিয়ে আবার ঠেলা দিল মুসা। খুলল না গেট।

তালা দেয়া! নাটকীয় ভঙ্গিতে হাত থেকে সুটকেস দুটো ছেড়ে দিল। কোরি। আমি জানতাম, এমন কোন কিছুই ঘটবে।

আরে এত অধৈর্য হচ্ছ কেন? গেটহাউজের ভেতর উঁকি দিয়ে দেখে বলল কিশোর, ফোন আছে। হোটেলে ফোন করে তালা খুলে দিতে বলব।

আকাশের দিকে তাকাল কোরি। এত তাড়াতাড়ি অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে কেন?

অন্ধকার হচ্ছে না। গাছপালার ছায়ার জন্যে অন্ধকার লাগছে। আলো ঢুকতে পারছে না ঠিকমত, দেখছ না?

সরু কাচের দরজা ঠেলে খুলে গেটহাউজে ঢুকল কিশোর। ফোন তুলে নিল। কুঁচকে ফেলল ভুরু।

দরজায় মাথা ঢুকিয়ে দিয়েছে মুসা। কি হয়েছে?

ডায়াল টোন নেই।

ইন্টারকম ফোন হতে পারে। হোটেলের রিসিভারে সরাসরি লাইন দেয়া।

তাতে কি? ডায়াল টোন তো থাকবে। রিসিভার রেখে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল কিশোর।

তারমানে বাইরেই আটকা পড়লাম, মুসার গলায় অস্বস্তি।

পড়লে পড়ব, দুষ্টু হাসি খেলে গেল কিশোরের মুখে। আজকের রাতটা নাহয় সৈকতেই কাটাব। বেড়াতেই তো এলাম।

ভাল হবে! উত্তেজনায় চকচক করে উঠল কোরির চোখ।

তা তো হবেই, মুখ গোমড়া করে ফেলেছে মুসা। খাব কি?

অ্যাই, গেট খোলা যাবে, বলে উঠল রবিন।

ঝট করে ফিরে তাকাল কিশোর, কি করে বুঝলে?

ওই যে, হুড়কো। ওটা সরালেই হয়। কারও অপেক্ষা না করে নিজেই হুড়কোটা সরিয়ে দিল রবিন। খুলে ফেলল পাল্লা।

চলো চলো, ঢুকে পড়ি! চিৎকার করে তাড়াতাড়ি সুটকেস দুটো তুলে নিল কোরি। দেরি করলে যেন আবার বন্ধ হয়ে যাবে গেট।

সৈকতে রাত কাটানো আর হলো না তাহলে আমাদের, কিশোরের কণ্ঠে কৃত্রিম হতাশা।

সারা গ্রীষ্মকালই পড়ে আছে সামনে, গেটটা খুলতে পেরে খুব খুশি রবিন, যত ইচ্ছে সৈকতে রাত কাটাতে পারব।

ঢাল বেয়ে উঠে চলল ওরা। দুধারে গাছপালা। মাথার ওপর পাখির কলরব। সামনে দিয়ে দৌড়ে চলে গেল একটা খরগোশ।

গাছপালার ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ল হোটেলটা।

দারুণ তো! বলে উঠল রবিন।

দাঁড়িয়ে গেল সবাই। তাকিয়ে আছে। বিশাল পুরানো আমলের বাড়ি। সাদা দেয়াল। ঢালু লাল টিনের চাল। সাজানো লন। মূল বাড়ি থেকে দুটো শাখা বেরিয়ে উঠে গেছে দুদিকের পাহাড় চূড়ায়। বড় লাল সদর দরজাটার দুদিকে দুটো পর্দা টানা বারান্দা। দুই সারি করে চেয়ার পাতা।

আরও কাছে এগিয়ে হোটেলের পেছনে উপসাগরটা চোখে পড়ল ওদের। কাঠের সিঁড়ি নেমে গেছে সৈকতে। ছোট ডকে কয়েকটা নৌকা বাধা।

খাইছে! দারুণ একটা সৈকত, চোখ বড় বড় করে বলল মুসা।

হ্যাঁ, কিশোর বলল, খুব সুন্দর।

আন্ট জোয়ালিন যতটা বলেছে, তারচেয়ে সুন্দর, হাঁ করে তাকিয়ে আছে কোরি।

ওই দেখো একটা নুইমিং পুল, হাত তুলল রবিন। কত্তবড় দেখেছ! পেছনের ওটা কি? পুলহাউজ নাকি?

কিন্তু লোকজন তো কাউকে দেখছি না, নিচের ঠোঁট কামড়াল কিশোর।

সামনে বিছিয়ে থাকা রাজকীয় হোটেলটার দিকে তাকিয়ে আছে কোরি। তাই তো!

পুলেও কেউ নেই।

ডিনারে বসেছে হয়তো, মুসা বলল। আমারও এখন ওখানেই বসার ইচ্ছে।

কিন্তু আলো কই? ঘরে আলো নেই। বারান্দায় কেউ নেই। সৈকতে কেউ হাঁটছে না। হোটেলের সামনেও নেই কেউ। অস্বাভাবিক লাগছে না?

তাই তো! বলল কোরি।

মুখ দেখে মনে হলো চিন্তায় পড়ে গেছে কিশোর।

দামী পাথরে তৈরি সিঁড়ি বেয়ে লাল দরজাটার কাছে উঠে গেল ওরা। ডাবল ডোর। বিশাল কাঠামো। দরজা খোলার চেষ্টা করল কোরি। খুলল না। বেল বাজাল শেষে।

বাড়ির ভেতরে ঘণ্টা বাজল কোনখানে।

দুই মিনিট অপেক্ষা করল কোরি। তারপর আবার বাজাল।

কয়েক ইঞ্চি ফাঁক হলো পাল্লা। ফ্যাকাসে চেহারার এক প্রৌঢ়কে উঁকি দিতে দেখা গেল। উষ্কখুষ্ক চুল। বিরক্তমুখে ওদের দিকে তাকিয়ে খড়খড়ে শুকনো গলায় বলল, যাও এখন। হোটেল বন্ধ।

দরজাটা টেনে আবার লাগিয়ে দিল সে।

.

০৩.

চিন্তিত ভঙ্গিতে লাল দরজাটার দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর।

রবিন বলল, ভুল হোটেলে চলে এলাম তো?

দরজার পাশে দেয়ালে গাঁথা ব্রোঞ্জের, চকচকে প্লেটটা দেখাল কিশোর। তাতে লেখা:

হোটেল নাইটশ্যাডো।
এসটাবলিশড ১৮৫৫

এক নামের দুটো হোটেল আছে তাহলে, বলল রবিন। চলো, আমাদেরটা খুঁজে বের করি।

হাত নেড়ে মুসা বলল, আরে নাহ, এত ছোট দ্বীপ। আর হোটেল তুলবে কোথায়? তা-ও আবার এক নামে দুটো। এটাই।

জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে নিজের সুটকেসে লাথি মারল কোরি, নাহ, কিছু বুঝতে পারছি না। কোন রকম ফাঁক রাখেননি আন্ট জোয়ালিন। ফোনে কয়েকবার করে কথা বলেছেন হোটেলের মালিকের সঙ্গে…

কিন্তু এখানে তো লোকই নেই, মুসা বলল। খালি হোটেল। বোর্ডার নেই। হোটেল বন্ধ। লোকটা ঠিকই বলেছে।

আর কি কর্কশ গলা লোকটার, নাক কুঁচকাল রবিন। আরেকটু ভাল করে বলতে পারল না?

আমার কি মনে হয় জানো? কোরি বলল। লোকটা নিশ্চয় মাটির নিচের ঘরে কোন দানব বানাচ্ছে। আজ রাতে প্রাণ সঞ্চার করবে ওটাতে। তাই কারও নাক গলানো পছন্দ করছে না।

চমকে গেল মুসা। খাইছে! ফ্রাঙ্কেনস্টাইন! লোকটাকে লাগলও কিন্তু ডক্টর

আরে দূর, থামো তো! হাত নেড়ে থামিয়ে দিল ওকে কিশোর। কিসের মধ্যে কি। জ্বালাবে তোমরা, বুঝতে পারছি।

ওদেরকে অবাক করে আবার হাঁ হয়ে গেল দরজাটা। লম্বা, সুদর্শন চেহারার একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। সাদা এলোমেলো চুল, সাদা গোফ। গায়ে সাদা সাফারি শার্ট, পরনে সাদা প্যান্ট। ওদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। চোখের কালো মণি দুটো ঝিলমিল করে উঠল তারার মত।

গুড ইভনিং, ভারী গমগমে কণ্ঠস্বর। হাসিটা মোছেনি মুখ থেকে। ওদের দিকে তাকিয়ে পরিচিত কাউকে খুঁজলেন যেন।

কথা বলতে গেল কোরি। ওকে থামিয়ে দিয়ে বললেন তিনি, আমার চাকর উলফের ব্যবহারে কিছু মনে কোরো না। তোমাদের বয়েসী ছেলেমেয়েদের ও পছন্দ করে না। কোরির দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাদের এখানে একা দেখে আমারও অবাক লাগছে। জোয়ালিন এল না? ওরও তো আসার কথা ছিল।

হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ল, জবাব দিল কোরি। শোরটাউনে– ছোটখালার বাড়িতে আছে। আমাদের চলে আসতে বলল। কাল শরীর ভাল হলে আন্টি আসবে। আপনাকে ফোন করে বলেনি কিছু?

ও, তুমি নিশ্চয় কোরি, কোরির প্রশ্নের জবাব দিলেন না তিনি। লম্বা একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে ওর হাতটা চেপে ধরে ঝাঁকালেন। চেহারায় অনেক মিল আছে।

থ্যাংক ইউ, অনিশ্চিত ভঙ্গিতে বলে কোনমতে হাতটা ছাড়িয়ে নিল কোরি।

এক্সকিউজ মী। আমিও তো উলফের মত অভদ্র হয়ে গেলাম দেখি। ঢুকতেই দিচ্ছি না তোমাদের, বলে তাড়াতাড়ি দরজা থেকে সরে দাঁড়ালেন তিনি। নিজের পরিচয়টা দিয়েই ফেলি। আমি ব্যারন রোজার সাইমন ডি মেলবয়েস। মেলবয়েস দি থার্ড। এই হোটেলের মালিক।

রোজার সাইমন মেলবয়েস? ভুরু কুঁচকে ফেলল রবিন। ব্ল্যাক ফরেস্ট টাউনের গোস্ট লেনে আমাদের একটা বাড়ি আছে। সেখানে পথের মাথায়। একটা অনেক বড় পোড়া বাড়ি…

ওটা ছিল আমার দাদার ভাইয়ের, মেলবয়েস বললেন। রহস্যময় একজন মানুষ ছিলেন তিনি, নিশ্চয় শুনেছ। ব্ল্যাক ফরেস্টে বহুদিন যাই না। এখানেই থাকি এখন। অনেক বদলে গেছে নাকি ব্ল্যাক ফরেস্ট?

খুব একটা না।

ব্ল্যাক ফরেস্ট গোরস্থানের লাশেরা সব এখনও কফিনেই রয়েছে তো? মাথা পেছনে ছুঁড়ে দিয়ে, চোখ বুজে হেসে উঠলেন মেলবয়েস। কেন এ প্রশ্ন করলাম নিশ্চয় বুঝতে পারছ। ওখানকার লাশ মাঝে মাঝেই ভূত হয়ে কফিন থেকে বেরিয়ে আসার বদনাম আছে তো।

পরস্পরের দিকে তাকাল মুসা আর কোরি। চোখে অস্বস্তি।

সামনের লবিতে ঢুকল সবাই। চারপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগল কিশোর। বিশাল লবি। প্রচুর আসবাবপত্র। ডার্ক উডের দেয়াল। কাঠের তৈরি বড় বড় কড়িবরগা। একদিকের দেয়াল ঘেঁষে রাখা হয়েছে অনেকগুলো চেয়ার-টেবিল। ডার্ক উড, নরম মখমল আর চামড়ার গদির ছড়াছড়ি। হোটেলটাকে গ্রীবাস না বলে হান্টিং লজ বললেই মানায় ভাল।

ব্যাগ-সুটকেসগুলো এখানেই রেখে দাও, মেলবয়েস বললেন। তোমাদের ঘর গোছাচ্ছে উলফ। গুছিয়ে এসে এগুলো নিয়ে যাবে।

বোর্ডাররা কই? জানতে চাইল কোরি।

নেই। হোটেল বন্ধ। গোফের এককোণ ধরে টানতে টানতে কোরির দিকে তাকিয়ে বললেন মেলবয়েস। বোঝার চেষ্টা করলেন ওর কি প্রতিক্রিয়া হয়। তোমার আন্টি আমার চিঠি পায়নি?

চিঠি?

হ্যাঁ। গত সপ্তা থেকে ফোন খারাপ। সেজন্যে চিঠি দিয়ে জানিয়েছি। হোটেলের ডাইনিং রূম আর ওল্ড উইঙের কয়েকটা ঘর মেরামত করতে হচ্ছে আমাদের। নতুন করে আসবাব দেব ঘরে ঘরে, জোয়ালিন জানে। এতদিনে শেষ হয়ে যেত কাজ। কিন্তু কাজের মাঝখানে হঠাৎ করে চলে গেল ওরা। জোয়ালিনকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলাম, আরও দুতিন সপ্তা পরে আসে যেন তোমাদের নিয়ে। ততদিনে কাজ শেষ হয়ে যাবে আমাদের। হোটেল চালু করে ফেলব।

তারমানে চিঠিটা পায়নি আন্টি, হতাশ কণ্ঠে বলল কোরি। শুধু শুধুই কষ্ট করে এলাম আমরা এতটা পথ।

অত দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই, মেলবয়েস বললেন। কাল বিকেলে লঞ্চ না আসা পর্যন্ত নিশ্চিন্তে থাকো। উলফ খুব ভাল রান্না করতে পারে। খাওয়ার অসুবিধে হবে না তোমাদের। ইচ্ছে করলে সুইমিং পুল আর সৈকতে সাঁতারও কাটতে পারবে।

কিন্তু মন ভাল হলো না কোরির। কত কিছুই না করবে ভেবে রেখেছিল। সৈকতে রাত কাটানো, চিংড়ি ধরে কয়লার আগুনে ঝলসে খাওয়া, অনেক ছেলেমেয়েদের সঙ্গে হই-চই করে পার্টি দেয়া, সাগরে সাঁতার কাটা, আরও কত কি। কিন্তু সব গেল। গরমের ছুটিটাই মাটি।

তোমরা খেয়ে বেরিয়েছ? জানতে চাইলেন মেলবয়েস।

না, সারারাত না খেয়ে থাকার ভয়ে তাড়াতাড়ি জবাব দিল মুসা।

ওর ভঙ্গি দেখে হেসে উঠল রবিন আর কিশোর। কোরিও হেসে ফেলল।

এসো, ডাইনিং রূমে, বলে লম্বা লম্বা পা ফেলে জমিদারি চালে হাঁটতে শুরু করলেন মেলবয়েস। উলফকে বলি কিছু রান্না করে দিতে।

অনেক বড় কার্পেট বিছানো একটা ঘরে ঢুকলেন তিনি। সুইচ টিপে কয়েকটা ঝাড়বাতি জ্বেলে দিলেন। ঘরের একধারে বড় জানালার পাশে দুটো লম্বা টেবিল পাতা। টেবিলকুথে ঢাকা। চীনামাটি আর রূপায় তৈরি প্রচুর কাপ প্লেট, গ্লাস-বাটি সাজিয়ে রাখা। ঘরে আরও অনেকগুলো টেবিল আছে। ওগুলোর দুই ধারে যেসব চেয়ার ছিল, সব উল্টে রাখা হয়েছে। বায়ের দেয়ালের কাছে বাঁশ বাধা। কাঠের মঞ্চ। দাগ লাগা ক্যানভাসের কাপড় ঝুলে আছে। দেয়ালের কাগজ ছেঁড়া। ছাতের খানিকটা জায়গার প্লাস্টার খসানো। রাজমিস্ত্রিরা কাজ শেষ না করেই চলে গেছে বোঝা যায়।

সেদিকে দেখিয়ে গজগজ করে বললেন মেলবয়েস, আর সপ্তা দুই কাজ করলেই হয়ে যেত। কিন্তু বেশি পয়সার লোভ দেখিয়ে শোরটাউনের এক শয়তান লোক বিল্ডিং মেরামতের জন্যে ডেকে নিয়ে গেছে ওদের। কবে যে ফিরে আসবে এখন, কোন ঠিক নেই।

ডাইনিং রূমের পেছনের দেয়ালে বিশাল এক জানালা। সেটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল কিশোর। আরিব্বাবা, কি দেখা যাচ্ছে!

সূর্য ডুবছে। পেছনের আঙিনায় ছড়ানো অসংখ্য ডেক চেয়ার, টেবিল আর বড় বড় ছাতা। তার ওপাশ থেকে শুরু হয়েছে সৈকত। কালো হয়ে আসা আকাশের পটভূমিতে রূপালী-ধূসর। তারও পরে উপসাগরের জল যেন জল নয়, শিল্পীর তুলিতে আঁকা বিচিত্র রঙের ছবি।

এত সুন্দর! পাশ থেকে বলে উঠল রবিন।

মুসা আর কোরিও দেখছে অপরূপ সূর্যাস্ত।

পেছন থেকে জিজ্ঞেস করলেন মেলবয়েস, কোরি, তোমার আন্টির শরীর কি খুব বেশি খারাপ?

কি জানি! ডাক্তার ডাকতে তো কোনমতেই রাজি হলো না। একটা ফোন করতে পারলে জানা যেত।

পারবে। কাল সকালে। লাইন ঠিক হয়ে গেছে, কিন্তু হোটেলের সুইচবোর্ড নষ্ট। পাইরেট আইল্যান্ড থেকে কাল লোক এসে ঠিক করে দিয়ে যাবার কথা।

কাশতে কাশতে ঘরে ঢুকল উলফ। সাদা রুমাল দিয়ে ঠোঁট মুছল। জানালার কাছে দাঁড়িয়েই ওর দিকে ফিরে তাকাল সবাই।

বেঁটে, রোগাপাতলা একজন মানুষ। কড়া মাড় দিয়ে ইস্তিরি করা খাটো হাতা সাদা শার্ট গায়ে, পরনে কালো প্যান্ট। কালো চুলের ডগা এমন করে মাথার দুই পাশে ছড়িয়ে আছে, যেন কতদিন ধরে আঁচড়ায় না। চোখা চেহারা, ছোট ছোট ধূসর চোখ, খাড়া নাক। চোয়ালের হাড় বেরিয়ে আছে। ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে আশপাশে যা কিছু দেখছে সব কিছুতেই তার বিরক্তি।

ও আমাদের উলফ, হেসে পরিচয় করিয়ে দিলেন মেলবয়েস, আগেই তোমাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। সাক্ষাঙ্কারটা নিশ্চয় পছন্দ হয়নি তোমাদের?

লাল হয়ে গেল উলফ। কিন্তু তার চেহারার ভাব বদল হলো না।

উলফ, মেলবয়েস বললেন, আমাদের মেহমানদের খিদে পেয়েছে। রান্নাঘরে কি আছে?

মুরগীর মাংস, অনেকটা চি-চি করে পাতলা গলায় কথা বলে, মনিবের ভারী গলার ঠিক উল্টো। সালাদও বানিয়ে দেয়া যায়। এমন ভঙ্গিতে শেষ কথাটা বলল সে, যেন বানানো না লাগলেই খুশি হত।

খুব ভাল, উলফের ইচ্ছার পরোয়া করলেন না ব্যারন। বিশাল হাত নেড়ে প্রায় মুরগী খেদানোর মত করে ওকে তাড়ালেন ঘর থেকে।

মাথা নিচু করে কোনদিকে না তাকিয়ে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের বড় দরজাটার দিকে চলে গেল উলফ।

.

০৪.

বসো তোমরা, একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লেন ব্যারন। কথা বলতে ভাল লাগছে। বোর্ডাররা চলে যাওয়ার পর খুব নির্জন হয়ে পড়েছে জায়গাটা। হোটেলে যখন লোক গমগম করে, দারুণ ভাল লাগে আমার।

চেয়ার টেনে বসল কিশোর। ব্যারনের দিকে তাকাল।

জুলাইয়ের শেষ দিকে আশা করি আবার চালু করে ফেলতে পারব, বললেন তিনি। যদি ঠিকমত ফিরে আসে শ্রমিকরা। আমি আর আমার ভাই। মিলারের ধারণা ছিল, মার্চে কাজ ধরলে গরমের ট্যুরিস্ট সীজনের আগেই সেরে ফেলতে পারব। কিন্তু ভুল হয়ে গেছে। ব্যাটারা যে টাকার লোভে এভাবে আমাদের ডুবিয়ে দিয়ে পালাবে ভাবতেই পারিনি।

এক এক করে সবার মুখের দিকে তাকালেন তিনি। আমার ভাই মিলার খুব মেজাজী মানুষ। সব সময় বিষণ্ণতায় ভোগে। কালো হয়ে গেল তার মুখ। তা ছাড়া রোগটা ইদানীং অতিরিক্ত বেড়ে গেছে। বেশি মানুষ থাকলে নিচেই নামে না। অনেকটা সেকারণে, তাকে কিছুটা শান্তি দেয়ার জন্যেই বলতে পারো হোটেলটা কিছু দিনের জন্যে বন্ধ করে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এই সুযোগে মেরামতটা সেরে ফেলব। এভাবে বন্ধ করলে ব্যবসার বিরাট ক্ষতি। কিন্তু কি করব? ভাই আগে না টাকা…

ট্রেতে করে খাবার নিয়ে এল উলফ।

একটা প্লেটে বড় এক টুকরো মাংস তুলে নিল মুসা। আমরা আপনাদের সাহায্য করতে পারি। দেয়াল মেরামতের কিছু কিছু কাজ করে দিতে পারব।

হ্যাঁ, সালাদের বাটি থেকে চামচ দিয়ে নিজের প্লেটে সালাদ তুলে নিতে লাগল রবিন। আন্ট জোয়ালিন আমাদের বলেছেন, হোটেলের মালিকের সঙ্গে, অর্থাৎ আপনার সঙ্গে নাকি কথা হয়েছে তাঁর–গরমকালটা হোটেলে পার্ট টাইম চাকরি দেয়া হবে আমাদের। তাতে থাকাখাওয়ার জন্যে আর ভাবনা থাকবে না। পকেট থেকে নগদ পয়সা খরচ করতে হবে না।

বলেছি হয়তো। ঠিক মনে করতে পারছি না, ব্যারন বললেন। যাই। হোক, তোমাদের প্রস্তাবটা কিন্তু মন্দ না।

কিন্তু আমার কাছে মন্দই লাগছে, মুখ নিচু করে বলল উলফ। যার কাজ তাকেই সাজে। অপেশাদার দিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাজ হয় না।

কাজটা তো কঠিন কিছু নয়, তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন ব্যারন। দেয়াল থেকে কিছু কাগজ ছিঁড়তে হবে…আরও কিছু টুকটাক.. আমার তো ধারণা ওই পয়সালোভী চামার শ্রমিকগুলোর চেয়ে ভাল পারবে এরা।

শক্ত হয়ে গেল উলফের চোয়াল। কাজটা নিরাপদ নয় মোটেও, কোরির দিকে তাকাল সে।

চমকে গেল কোরি। কি বলতে চায় লোকটা? মিস্ত্রির কাজে নিরাপত্তার প্রশ্ন কেন উঠছে?

পরের লঞ্চে ওদের ফিরে যাওয়াটাই ভাল মনে করি আমি, উলফ বলল।

কিন্তু আমি মনে করি না, তর্ক শুরু করলেন ব্যারন। কয়েকটা ছেলেমেয়েকে কাজ করতে দেখলে খুশিই হবে মিলার। জানালা দিয়ে বাইরের কালো হয়ে আসা আকাশের দিকে তাকালেন তিনি। হাসি হাসি ভঙ্গিটা চলে গেছে তার।

না। চলে যাওয়াই ভাল, থেমে থেমে একটা একটা করে শব্দ উচ্চারণ করল উলফ। যেন কোন ছোট্ট ছেলেকে বোঝাচ্ছে।

না। ভাল নয়। বরং কয়েকটা ছেলেমেয়েকে এখানে কাজ করতে দেখলেই আমার ভাল লাগবে, কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন হলো না ব্যারনের।

কান খাড়া করে ফেলল কিশোর। ব্যারন একবার বললেন মিলারের ভাল লাগবে। এখন বলছেন আমার ভাল লাগবে। কথাবার্তাগুলো কেমন গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে।

সব কিছু মেরামত করে আবার যখন হোটেল খুলব আমরা, উলফ বলল, অনেক ছেলেমেয়ে আসবে তখন। তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে তার কণ্ঠ। অধৈর্য হয়ে উঠেছে।

বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না মুসার। এসেছে যখন, কয়েকদিন থেকে যেতে পারলে ভাল হত। ব্যারনকে রাজি করানোর জন্যে বলল, আমাদের মধ্যে কিন্তু কোন ফাঁকি পাবেন না। আন্তরিক ভাবে খাটব। আমরা।

রবিনেরও ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। আমাদের কাজ দেখে আপনি খুশি হবেন, কথা দিতে পারি।

ঠিক আছে তাহলে, গোঁফের কোণ ধরে এক টান মারলেন ব্যারন। উলফের দিকে তাকালেন, ওরা থাকছে। কাঠমিস্ত্রির কাজ করবে। আমি ওদের বহাল করলাম।

কি প্রতিক্রিয়া হয় দেখার জন্যে উলফের দিকে তাকাল কিশোর।

কোন প্রতিক্রিয়া হলো না। ভাবলেশহীন চেহারা। খুদে খুদে ধূসর চোখে শূন্য দৃষ্টি। একটা মুহূর্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে হাত বাড়িয়ে তুলে নিল খালি ট্রে-টা। চি-চি করে বলল, ঠিক আছে, আমি যাই।

খুশি হয়ে উঠল মুসা আর রবিন। কোরির মুখেও হাসি। একসঙ্গে কলরব। শুরু করল তিনজনে। কিশোর তাকিয়ে আছে ব্যারনের দিকে। একটা হাত তুললেন তিনি। হাসিমুখে বললেন, আমি আশা করব আন্তরিক ভাবেই খাটবে তোমরা। তবে তোমাদের সময় সবটুকু কেড়ে নিতে চাই না আমি। কাজের সময় কাজ। বাকি সময়টা পুলে সাঁতার কেটে, সৈকতে বেড়িয়ে কাটাতে পারবে, বাধা নেই। ফুর্তি করার জন্যেই তো এসেছ তোমরা, তাই না?

হ্যাঁ, হ্যাঁ! সমস্বরে চিৎকার করে উঠল মুসা, রবিন আর কোরি।

কিশোরের দিকে তাকালেন ব্যারন, তুমি কিছু বলছ না কেন?

অ্যাঁ!..হ্যাঁ, আমারও ভাল লাগবে।

লাগারই কথা। এখানে তোমাদের বয়েসী যারা বেড়াতে আসে, সবারই ভাল লাগে।

মুখের হাসিটা বজায় রেখে পেছনে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন ব্যারন। লম্বা, সাদা চুলে আঙুল চালালেন। কোরির দিকে তাকিয়ে বললেন, কাল। তোমার আন্টির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করব। ও না আসাতে খারাপই লাগছে।

কালকে নাগাদ চলে আসতে পারে। ভায়োলা আন্টি খুব ভাল নার্স।

ট্রে রেখে এঁটো বাসন-পেয়ালা নিয়ে যেতে ফিরে আসছে উলফ। তাকে বললেন ব্যারন, শোনো, ওদের ঘর দেখিয়ে দাও।

জবাব না দিয়ে টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল উলফ। বাসন-পেয়ালাগুলো জড়ো করতে গিয়ে ইচ্ছে করে আছড়ে ফেলতে লাগল একটার ওপর আরেকটা।

নিউ সেকশনে ওদের থাকার ব্যবস্থা করেছ নাকি? জানতে চাইলেন ব্যারন।

নিচের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল উলফ, না, ওল্ড উইং।

পলকের জন্যে হাসিটা চলে গেল ব্যারনের মুখ থেকে। পরক্ষণে ফিরে এল আবার। ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললেন, রাতটা গিয়ে সেঁটে ঘুম। দাও। কাল সকালে দেখা হবে। তখন কাজের কথা বলব।

তাকে ধন্যবাদ জানাল ছেলেমেয়েরা। তারপর কথা বলতে বলতে উলফের পেছনে চলল একটা করিডর ধরে। আলো খুব কম এখানে। কীটনাশক তার একধরনের বদ্ধ ভাপসা গন্ধ বাতাসে।

পুরানো বাড়িতে এ রকম গন্ধ থাকে, জানে মুসা। আর ওগুলোই হয় ভূতের আস্তানা।

কোন দিকে না তাকিয়ে সোজা হেঁটে চলেছে উলফ। একটা মোড় ঘুরল। আরেকটা লম্বা করিডর পেরোল। দুই ধারে সারি সারি বদ্ধ দরজা। আবার একটা মোড় ঘুরল। থামল না।

অবাক লাগছে মুসার। কোথায় ওদের নিয়ে চলেছে লোকটা?

অবশেষে একটা খোলা দরজার সামনে থামল উলফ। দরজায় ব্রোঞ্জের প্লেটে নম্বর লেখা রয়েছে: ১৩২-সি।

বাইরে থেকে যতটা মনে হয়, মুসা বলল, ভেতরটা তারচেয়ে অনেক বড়।

তার মন্তব্যের জবাব দিল না উলফ। এখান থেকে চারটা ঘর তোমাদের জন্যে রেডি করেছি। কে কোনটাতে থাকবে নিজেরাই ঠিক করে নাও।

থ্যাংক ইউ, মোলায়েম স্বরে বলল কোরি।

দেখো, তোমাদের এখানে থাকাটা আমার ভাল লাগছে না, উলফ বলল।

কি?

এখানে থাকা তোমাদের জন্যে বিপজ্জনক।

কি বলতে চান? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

ছুতোর মিস্ত্রির কাজ, কিশোরের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল উলফ, খুব কঠিন। মিস্টার মেলবয়েস বুঝতে পারছেন না।

কিন্তু খাটতে তো আমাদের আপত্তি নেই, মুসা বলল, যত কঠিনই হোক, আমরা করব।

এখানে থাকতে ভাল লাগবে না তোমাদের, কিশোরের দিকে তাকিয়ে আছে উলফ। খালি থাকলে সাংঘাতিক বিপজ্জনক হয়ে ওঠে এই বাড়ি। পুরানো তো। পুরানো বাড়ি সব সময়ই খারাপ।

আপনারা থাকতে পারলে আমরাও পারব, কোন অসুবিধে হবে না, কোরি বলল, আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।

নিশ্চিন্ত থাকতে পারছি নানানা রকম ব্যাপার ঘটে এখানে, বিশেষ করে হোটেলের গেস্টদের বেলায় এমন সব ব্যাপার যা তোমাদের বলতে পারছি না, কণ্ঠস্বর খাদে নেমে এল উলফের।

জায়গাটাতে কোন সমস্যা আছে নাকি? জানতে চাইল কোরি। ভূতের উপদ্রব?

তাকিয়ে রইল উলফ কোরির দিকে। কতটা বলা যায় ওদের চিন্তা করছে। যেন। দেখো, আমি তোমাদের সাবধান করছি…

আসল কথা বলছেন না কেন? ভুত আছে? দেখেছেন?

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত চুপ করে রইল উলফ। তারপর অনিচ্ছাসত্ত্বেও বলল, অদ্ভুত অনেক কিছুই দেখতে হয় আমাকে, রহস্যময়, শীতল শোনাল ওর কণ্ঠ। বিচিত্র হাসি ফুটল পাতলা ঠোঁটে। ভূত বিশ্বাস করো নাকি তোমরা?

কিশোর বা রবিন কিছু বলে ফেলার আগেই তাড়াতাড়ি বলল মুসা, করি।

কোরি বলল, প্লীজ, বলুন না, কি দেখেছেন?

বাঁচতে চাইলে এখান থেকে চলে যাও, কোরির প্রশ্নের জবাব দিল না। উলফ। কালই।

ছায়ায়, ঢাকা পড়েছে ওর মুখের বেশির ভাগ অংশ। চেহারা দেখে মনের ভাব বোঝার উপায় নেই। তবে ওর কণ্ঠস্বরই বলে দিল, মিথ্যে ভয় দেখাচ্ছে না সে। আচমকা ঝটকা দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। আর একটা কথাও না বলে যেন নিঃশব্দে ভেসে চলে গেল অন্ধকার, শূন্য করিডর ধরে।

.

০৫.

কোরি কোথায়? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

বুঝতে পারছি না, রবিন বলল। চোখে মিররড় সানগ্লাস। কাচের ভেতর। দিয়ে মুসার দিকে তাকিয়ে আছে। সৈকতের কিনারে গোড়ালি পানিতে হেঁটে বেড়াচ্ছে মুসা।

সকালে নাস্তার সময় এল না, উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল কিশোর। দুপুরে খাওয়ার সময়ও দেখা নেই। গেল কোথায়?

গেছে হয়তো কোথাও ভূতপ্রেত খুঁজতে, ঠোঁট উল্টে বলল রবিন। কিংবা হোটেলের পুরানো কোন কামরায় ধ্যানে বসে প্রেতাত্মার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে। ওর তো এইই কাজ।

মেয়েটা কেমন অদ্ভুত…

আমি শুনে ফেলেছি! পেছন থেকে শোনা গেল তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর।

চিত হয়ে ছিল কিশোর। লাফ দিয়ে উঠে বসে ফিরে তাকাল। গোলাপী বিকিনি পরেছে কোরি। হাতে একটা ক্যানভাসের বড় বীচ ব্যাগ। চোখেমুখে রাগ।

কোরি…না বলে কোথায় চলে গেলে তুমি….আমরা এদিকে চিন্তায় বাঁচি না

সে তো দেখতেই পাচ্ছি। তোমাদের সব কথাই আমি শুনেছি। আমি কেমন অদ্ভুত, তাই না?

কোরি…

আমি পাগল? আধিভৌতিক ব্যাপারে আমার কৌতূহল তোমাদের কাছে আমাকে হাস্যকর করে তুলেছে, এই তো বলতে চাও?

তোমাকে হাস্যকর না করলেও, জবাব দিল রবিন, তোমার কাজকর্মকে যে হাস্যকর করেছে, এটা ঠিক।

ভুরু কুঁচকে গেল কোরির।

আরে বসো বসো, নিজের পাশে মাটিতে বিছানো ক্যানভাসে চাপড় দিল কিশোর। এই রবিন, বাজে কথা বোলো না তো। দেখি সরো, কোরিকে জায়গা দাও। বসো, কোরি। এত সুন্দর দিনটা রাগারাগি করে নষ্ট কোরো না।

কিন্তু তাই বলে আমাকে নিয়ে হাসাহাসি সহ্য করব? মেজাজ দেখিয়ে ক্যানভাসের ওপর বসে পড়ল কোরি।

সারাদিন ছিলে কোথায়? জানতে চাইল কিশোর।

ঘুম থেকেই উঠেছি দেরি করে, ব্যাগ থেকে বড় একটা তোয়ালে টেনে বের করল কোরি। তারপর হোটেলের মধ্যে এখানে ওখানে ঘোরাঘুরি করেছি খানিকক্ষণ। আন্ট জোয়ালিনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি পারিনি। মেলবয়েস বললেন, লঞ্চ আসার সময় হলে গাড়ি নিয়ে ডকে যাবেন আন্টিকে নিয়ে আসতে।

যদি আজকে আসেন।

হ্যাঁ।

জায়গাটা কিন্তু ভারি সুন্দর! কিশোরের পাশে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল রবিন। C. কোরি তখনও নানা জিনিস বের করছে। সানট্যান লোশনের শিশিটা বের করে রাখল একপাশে। সাঁতার কাটতে যাবে কেউ?

নাহ, মাথা নাড়ল কিশোর। আমার বসে থাকতেই ভাল লাগছে। মুসাকে গিয়ে বলো, তোমার সঙ্গে নামবে।

দেখো, একটা পাখি, ওপর দিকে তাকিয়ে আছে রবিন। ইস, আমিও যদি ওরকম করে উড়তে পারতাম!

কোরি আর কিশোর দুজনেই মুখ তুলে তাকাল। ধূসর আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে বড় একটা পাখি।

বাজপাখি, কোরি বলল।

এখানে বাজও আছে নাকি? পাখিটার সঙ্গে সঙ্গে নজর সরছে তার। চশমার কাঁচে ফ্যাকাসে নীল আকাশের প্রতিবিম্ব।

মনে হয় না, কোরি বলল। পাখিটাকে বেমানান লাগছে এখানে। এই দ্বীপের সব কিছু রঙিন, ঝলমলে, সুন্দর। অন্য কোনখান থেকে উড়ে এসেছে হয়তো মাছের আশায়। ক্ষণিকের জন্যে মনে হলো বাজপাখির ডানায় ভর করে অবাঞ্ছিত- অশুভ কোন কিছু কালো ছায়া ফেলতে এসেছে দ্বীপের সাদা সৈকতে। ভাবনাটাকে জোর করে মন থেকে তাড়াল সে।

পানিতে দাঁড়িয়ে আছে এখনও মুসা। ওদের দিকে পেছন করে। নীলচে সবুজ পানি এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে বালি। চিকচিক করছে রোদে। ওর ডানে ঢেউয়ে ক্রমাগত দোল খাচ্ছে নিচু একটা কাঠের ডকে বাধা দুটো ক্যানু। ওদের দুদিকে ধনুকের মত গোল হয়ে বেঁকে গেছে সৈকত।

পেছনে বালির টিলার ওপরে রয়েছে হোটেলটা। সাদা দুর্গের মত বিছিয়ে থেকে যেন পাহারা দিচ্ছে সবকিছুকে। ডাইনিং রূমের বড় জানালার কাছে ঝিলিক দিচ্ছে বিকেলের সোনালি রোদ। বাড়িটার দুদিক থেকে শুরু হয়েছে। পাইন বন। নীলচে-সবুজ। মৃদু বাতাসে সুগন্ধ ছড়িয়ে দুলছে যেন তার ঘোরে।

উফ, বিশ্বাস করতে পারছি না আমি! দেখতে দেখতে বলে উঠল কোরি। এত সুন্দর। ভাল লাগছে অন্য কেউ নেই দেখে। স্বাধীনভাবে দ্বীপে ঘুরে বেড়াতে পারব আমরা। যা ইচ্ছে করতে পারব।

হ্যাঁ, একমত হলো রবিন। আমার কাছে তো স্বর্গ মনে হচ্ছে।

হাত বাড়িয়ে একমুঠো বালি তুলে নিয়ে ঝরঝর করে নিজের পায়ে। ছাড়তে লাগল কোরি। আজ যে আমাদের ছুটি দিয়ে দিয়েছেন এজন্যে মিস্টার মেলবয়েসকে একটা ধন্যবাদ দেয়া দরকার।

হ্যাঁ, খুব ভাল লোক। গায়ে জমিদারের রক্ত আছে দেখেই বোঝা যায়।

কিন্তু উলফের ব্যাপারটা কি বলো তো? এরকম ভদ্র মালিকের ওরকম বুনো চাকর! উদ্ভট স্বভাব!

সকালে নাস্তা দেয়ার সময় মুখটাকে কিরকম করে রেখেছিল দেখেছ? একেবারে মরা চিংড়ি।

ওর সমস্যাটা কি? কাল রাতে ভয় দেখিয়ে তাড়াতে চাইল কেন আমাদের?

ভূত আছে ইঙ্গিত দিল, কোরি বলল, কিন্তু খোলাসা করল না কিছুই।

আমার তো মনে হলো অন্য ইঙ্গিত দিয়েছে, কিশোর বলল।

অন্য কি?

বুঝতে পারলাম না।

কিন্তু আমার বিশ্বাস, ভূতের কথাই বলেছে। এই দ্বীপে ভূত থাকাটা অসম্ভব কিছু নয়। সাড়ে তিনশো বছর আগে সেই ঔপনিবেশিক আমল থেকে এসে এখানে আস্তানা গেড়েছে মানুষ। খুনখারাপি হয়েছে প্রচুর। প্রেতাত্মা। থাকতেই পারে। শোরটাউনের আশেপাশে যত পুরানো বাড়ি, সরাইখানা, দুর্গ আর হোটেল আছে, সবগুলোতে ভূতের বদনাম। আমার মনে হয় না। মিথ্যে কথা বলেছে উলফ, কিংবা আমাদের শুধু শুধু ভয় দেখাতে চেয়েছে। কিছু না থাকলে আমাদের সাবধান করতে আসত না।

আচমকা উঠে দাঁড়াল কোরি।

কি হলো? জানতে চাইল রবিন।

একটা জিনিস ফেলে এসেছি।

কি?

জবাব না দিয়ে হাঁটতে শুরু করল কোরি। দ্রুত হেঁটে চলল হোটলের দিকে।

সেদিকে তাকিয়ে মন্তব্য করল রবিন, উলফের মত কোরিও আরেকটা উদ্ভটা চরিত্র…

আস্তে! শুনতে পেলে আবার রেগে যাবে।

ওর সঙ্গে জিনার স্বভাবের অনেক মিল, তাই না?

জবাব দিল না কিশোর।

*

সেদিন বিকেলে আকাশটাকে রক্তের রঙে রাঙিয়ে দিয়ে পাইন বনের আড়ালে যখন অস্ত গেল সূর্য, আকাশে দেখা দিল রূপালী চাঁদ, সৈকতে ফিরে এল। আবার ওরা। ফুরফুরে বাতাস শরীর জুড়িয়ে দিচ্ছে।

ইস্, কি একখান সূর্যাস্ত! আবার বালিতে গড়িয়ে পড়ল রবিন। এভাবে গড়াগড়ি করার নেশা হয়ে গেছে যেন তার। আকাশের দিকে চোখ।

পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে মুসা আর কিশোর। সাগরের পানিতে আকাশের প্রতিবিম্ব দেখছে।

আমার কি মনে হচ্ছে জানো? স্বপ্নিল হয়ে উঠেছে কিশোরের সুন্দর দুটো চোখ। কোন স্বপ্নের জগতে পৌঁছে গেছি!

কোরির হাতে ডোরাকাটা একটা চাদর। এই, ধরো তো একটু, চাদরটা বিছাই।

চাদর বিছাতে ওকে সাহায্য করল কিশোর। দুই কোণে দুটো বড় পিকনিক বাস্কেট চাপা দিয়ে দিল যাতে বাতাসে উড়তে না পারে।

চাদরের ওপর বসে পড়ে একটা বাস্কেটের দিকে হাত বাড়াল মুসা, খিদে পেয়ে গেছে আমার। কি দিয়েছে উলফ?

উম..দাঁড়াও, অনুমান করতে দাও আমাকে, কোরি বলল, কি হতে পারে? টিউনা মাছের স্যান্ডউইচ?.

ঢাকনা তুলল মুসা। ভেতরে তাকিয়ে বলল, হয়নি। আবার বলো।

গলদা চিংড়ি।

হ্যাঁ, হয়েছে। দারুণ সুগন্ধ! মুরগীর রোস্টও আছে।

আরেকটা ঝুড়ির ঢাকনা সরাল রবিন। বড় এক পাত্র সালাদ বের করল। আর বড় বড় দুটো ফ্রেঞ্চ ব্রেড। ম। আভন থেকে বের করেই ঝুড়িতে ভরে দিয়েছে উলফ।

মুখ গোমড়া করে রাখুক আর যাই করুক, নাক দিয়ে খাবারের সুগন্ধ টানতে টানতে বলল কোরি, খাবারগুলো ভালই দিচ্ছে।

চীনামাটির বাসন, রূপার চামচ, কাপড়ের ন্যাপকিন বের করে চাদরে নামিয়ে রাখল রবিন। সুন্দর করে ওগুলো ঝুড়িতে সাজিয়ে দিয়েছে উলফ। দুটো মোমও দিয়েছে।

আকাশের লালিমা মুছে কালো হয়ে যাচ্ছে। উজ্জ্বল হতে শুরু করেছে। চাঁদ। তীরে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের ছলাৎছল বাজনার মত লাগছে। খেতে আরম্ভ করল ওরা।

সিনেমার মত লাগছে আমার কাছে! কোরি বলল।

এত সুন্দর দৃশ্য সিনেমাতে নেই, বলল রবিন।

হোটেলের দিকে তাকাল কোরি। আকাশের পটভূমিতে কালো দেখাচ্ছে। বাড়িটা। শুধু দোতলার দুটো জানালায় আলো জ্বলছে। তাকিয়ে রয়েছে যেন বেড়ালের চোখের মত।

খাওয়ার পর সাতরাতে নামলে কেমন হয়? প্রস্তাব দিল মুসা।

বেদিং সুট তো পরে আসিনি, রবিন বলল।

তাতে কি? হাসল মুসা। খালি গায়ে নামব।

চাঁদনী রাতে সাগরে সাঁতার কাটার স্বপ্ন দেখেছি আমি বহুদিন, কিশোর বলল।

তার মানে তুমিও নামবে?

অসুবিধে কি?

বালির ঢিবির ওপর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠল কোরি, কে যেন আসছে!

ফিরে তাকাল অন্য তিনজন। অন্ধকার ছায়ায় মিশে ভূতের মত দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা মূর্তি।

ভয় পেয়ে গেল কোরি। জিজ্ঞেস করল, কে ওখানে?

০৬.

ছায়া থেকে চাঁদের আলোয় বেরিয়ে এল মুর্তিটা।

অবাক হলো কোরি। মিস্টার মেলবয়েস!

ঢিবির মাথায় দাঁড়িয়ে থেকে ওদের উদ্দেশে হাত নাড়লেন তিনি। ধবধবে সাদাঁ পোশাকে ভূতুড়ে লাগছে তাঁকে। ভয়টা এখনও কাটেনি কোরির। বিশ্বাস করতে পারছে না সত্যি মানুষ কিনা। পরীক্ষা করার জন্যে হাত নেড়ে ডাকল, আসুন না?

অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে নেমে আসতে শুরু করলেন ব্যারন। খাওয়া বন্ধ করে মুসাও তাকিয়ে রয়েছে হাঁ করে। ভূত বুঝলে দেবে দৌড়।

কাছে এসে দাঁড়ালেন তিনি। হাতে একটা মদের বোতল। আরেক হাতে গ্লাস।

আন্ট জোয়ালিন এসেছে? উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইল কোরি।)

না, জবাব দিলেন ব্যারন। লঞ্চ এসেছে, কিন্তু তোমার আন্টি আসেননি। অত ভয়ের কিছু নেই। সামান্য পেটব্যথা তো, সেরে যাবে। আরও একআধ দিন বোনের ওখানে কাটিয়ে আসার ইচ্ছে।

কিন্তু ফোন করল না কেন?

সকালে ফোন যখন খারাপ ছিল তখন হয়তো চেষ্টা করেছে। ফোন খারাপ ভেবে পরে আর করেনি। আজ রাতটা যাক, তাকে আর বিরক্ত করব না। কাল সকালে যদি না করে আমরাই খোঁজ নেব। প্রসঙ্গটা বাদ দেয়ার জন্যে খাবারগুলোর ওপর চোখ বোলালেন তিনি। বাহ, উলফ তো নাস্তাটাস্তা ভালই দিচ্ছে তোমাদেরকে।

হেসে জবাব দিল কিশোর, নাস্তা নয়, একেবারে ভূরিভোজ।

উলফ কিন্তু আমাদের বাবুর্চি নয়। বাবুর্চির নাম মনিকা। আগামী শুক্রবারের আগে আসবে না। মৃদু হেসে বললেন ব্যারন, এত কাজ একহাতে করতে হচ্ছে বলে অভিযোগের পর অভিযোগ করে চলেছে উলফ। তবে রান্না করতে তার খারাপ লাগছে না এটাও বুঝতে পারছি।

সে তো বোঝাই যাচ্ছে, রুটি চিবাতে চিবাতে বলল মুসা। কিন্তু এত বেশি পেট ভরিয়ে রাখছে আমাদের, আলসে হয়ে যাচ্ছি। কাল কোন কাজই করতে পারব না।

হ্যাঁ, দশ পাউন্ড ওজন বেড়ে গেছে আমার, কোরি বলল।

ভয় নেই, কালই সেটা খসিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করব, হেসে বললেন ব্যারন। চাদরের একধারে বসে বোতল থেকে মদ ঢাললেন গ্লাসে। গ্লাসটা তুলে ধরলেন ওদের দিকে। তোমাদের সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।

লম্বা চুমুক দিলেন গ্লাসে। গম্ভীর হয়ে বললেন, মিলারও আমাদের সঙ্গে থাকলে এখন ভাল হতো, আচমকা বদলে গেছে কণ্ঠস্বর। কত করে বললাম আসতে। এল না।

আপনার ভাই কি অসুস্থ? জানতে চাইল কিশোর।

প্রশ্নটা যেন অবাক করল ব্যারনকে। অসুস্থ? মোটেও না। অতিমাত্রায় বিষণ্ণ। আমরা মেলবয়েসরা এমনিতেই একটু খেয়ালী।

শুনেছি আমি, রবিন বলল। ব্ল্যাক ফরেস্টের সবাই জানে আপনার পূর্বপুরুষদের কাহিনী। আমাদের বাড়ির চিলেকোঠা থেকে মেলবয়েস ম্যানসন দেখা যায়।

চোখ বুজে যেন পূর্বপুরুষদের কীর্তিকলাপের দৃশ্য দেখার চেষ্টা করলেন। মেলবয়েস। হ্যাঁ, অনেক গল্প আছে ওদেরকে নিয়ে। ভয়ঙ্কর সব কাহিনী। চোখ মেলে তাকালেন রবিনের দিকে।

একঝলক হালকা বাতাস ওদের ঘিরে নেচে নেচে বয়ে গেল।

রোজার মেলবয়েস কি আপনার দাদা ছিলেন? জিজ্ঞেস করল রবিন।

আরেক চুমুক মদ খেলেন ব্যারন। না। আমার দাদার ভাই। আমার গ্রেট-আঙ্কেল।

তার নামে নাম রাখা হলো কেন আপনার? জানতে চাইল কোরি।

তার নামে রাখা হয়েছে কথাটা ঠিক না, বিচিত্র হাসি খেলে গেল ব্যারনের ঠোঁটে। চাঁদের আলোয় রহস্যময় দেখাল হাসিটা। আমার বাবার নামও ছিল রোজার।

পাইনবনে ডেকে উঠল কি একটা জানোয়ার। দীর্ঘ, বিষণ্ণ চিৎকার।

তাদের সম্পর্কে বলুন না কিছু, অনুরোধ জানাল কোরি। শোনার জন্যে সামনে ঝুঁকে বসল।

হ্যাঁ, বলুন না, রবিনও আগ্রহী হয়ে উঠল। আসলে কি ঘটেছিল গোস্ট লেনের সেই পুরানো প্রাসাদটাতে?

আমিও খুব বেশি কিছু জানি না, ব্যারন বললেন। আমার জন্মের বহু আগে ঘটেছিল সেসব ঘটনা। বালির ঢিবির ওপরে হোটেলটার দিকে তাকালেন তিনি। মিলার এলে ভাল হতো। এসব গল্প আমার চেয়ে ভাল বলতে পারত সে।

আপনি যা পারেন বলুন, শোনার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে রবিন। পুড়ল কি করে বাড়িটা? রোজার মেলবয়েসের সম্পর্কে যা শোনা যায় সব কি সত্যি?

শব্দ করে হাসলেন ব্যারন। গ্লাসটা নামিয়ে রাখলেন চাদরে। সব কটা চোখ এখন তার দিকে। বাতাসে দুলে উঠে কাত হয়ে গেল মোমের শিখা। নিভু নিভু হলো, কিন্তু নিভল না।

রবিনের দিকে তাকালেন ব্যারন, তুমি নিশ্চয় শুনেছ, ব্ল্যাক ফরেস্টে প্রথম যারা বসতি করেছিল তাদের একজন ছিলেন আমার গ্রেট-আঙ্কেল রোজার মেলবয়েস। বিরাট ধনী ছিলেন তিনি। কোথায় পেয়েছিলেন এত, টাকা কেউ জানে না। কোথা থেকে ব্ল্যাক ফরেস্টে গিয়েছিলেন তিনি, তা-ও জানে না কেউ।

দেখতে তিনি কেমন ছিলেন? জিজ্ঞেস করল কোরি। আপনার মত?

তা-ও জানে না কেউ। আমাদের পরিবারের সবারই ছবি আছে, শুধু তাঁরটা বাদে। সেটাও আরেক রহস্য।

গ্লাস তুলে চুমুক দিলেন তিনি। ঠোঁট চাটলেন। তারপর বললেন, বিশাল ওই প্রাসাদ শহর থেকে এতদূরে কেন বানালেন, সেটাও রহস্য। ব্ল্যাক ফরেস্টে তখনও আজকের মত শহর গড়ে ওঠেনি, ভাল কোন রাস্তা ছিল না। বনের মধ্যেই বাড়ি বানালেন তিনি। বাড়িতে যাওয়ার একটাই পথ ছিল, গাছপালার ভেতর দিয়ে সরু একটা রাস্তা। বাড়িটা বানানোর সময় শ্রমিকেরা। যাতায়াতের জন্যে নিজেরাই তৈরি করেছিল রাস্তাটা।

গোপনীয়তা পছন্দ করতেন নাকি? জানতে চাইল কিশোর।

নাঃ…অন্তত ব্ল্যাক ফরেস্টে আসার পর প্রথমদিকে তো নয়ই। বরং রোজার মেলবয়েস আর তার সুন্দরী স্ত্রী ভেরোনিকা ছিলেন শহরের প্রাণ। সব জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন। প্রায়ই বড় বড় পার্টি দিতেন। লোক গমগম করত বাড়িতে। মোমের আলোয় কমলা রঙ লাগছে ব্যারনের চেহারা। মেলবয়েসরা খুব বিখ্যাত ছিল তখন। লোকে পছন্দ করত তাদের। শহরটার জন্যে অনেক করেছে। লাইব্রেরির জন্যে টাকা দিয়েছেন রোজার মেলবয়েস, ব্ল্যাক ফরেস্টের প্রথম হাসপাতালটা তার করা।

গ্লাসে চুমুক দেয়ার জন্যে থামলেন ব্যারন।

কোরির দিকে তাকাল কিশোর। হতাশা দেখতে পেল ওর মুখে। যেন ভয়াবহ কোন ভূতের গল্প আশা করেছিল সে।

রোজার আর ভেরোনিকার দুটো খুব সুন্দরী মেয়ে ছিল, ব্যারন বলতে লাগলেন আবার। মেয়েদের অসম্ভব পছন্দ করতেন রোজার। অতিরিক্ত। আর দশটা মেয়ের মত লেখাপড়া শেখার জন্যে স্কুলে যেতে দেননি ওদের। বাড়িতে টিচার রেখে দিয়েছিলেন। যা চাইত ওরা, দিয়ে দিতেন তিনি। কোন কিছুতেই না করতেন না। এক বছর এক মেয়ের জন্মদিনে ইউরোপ থেকে সমস্ত জন্তু-জানোয়ার সহ একটা আস্ত সার্কাস পার্টি ভাড়া করে নিয়ে এসেছিলেন তিনি।

খাইছে! বলে উঠল মুসা।

অ্যাই, বাধা দিয়ো না তো! অধৈর্য ভঙ্গিতে হাত নাড়ল কোরি।

আমার গ্রেট-আঙ্কেল মনে করেছিলেন, এত টাকা আছে যখন, জীবনটা বুঝি সুখেই কেটে যাবে, সাগরের কালো পানির দিকে তাকিয়ে বললেন। ব্যারন। কণ্ঠে বিষাদের ছোঁয়া। কিন্তু তা আর কাটল না। একদিন বনে খেলতে গিয়ে আর ফিরে এল না তাঁর দুই মেয়ে। রাতেই খোঁজাখুজি করা হলো। পাওয়া গেল না ওদের। পরদিন সকালেও না। সাত দিন পর বনের মধ্যে পাওয়া গেল ওদের লাশ। শরীরের মাংস আছে, কিন্তু হাড় নেই। কোন। অদ্ভুত উপায়ে আস্ত বের করে নেয়া হয়েছে কঙ্কালটা।

তা কি করে সম্ভব? বলে উঠল কিশোর।

আমি জানি না। লোকে তো তাই বলে।

খুনীকে ধরতে পেরেছিল পুলিশ? কোরি জিজ্ঞেস করল।

আমি বলতে পারব না। পুলিশকে ওকাজ করার জন্যে আদৌ ডাকা হয়েছিল, তাই বা কে জানে, রহস্যময় কণ্ঠে জবাব দিলেন ব্যারন। ওই ঘটনার পর থেকে আলো নিভে গেল প্রাসাদের। রাতে আর বাড়ির জানালায় আলো জ্বলতে দেখত না কেউ। সব বদলে গেল। ভেরোনিকাকে আর কোনদিন শহরে দেখা যায়নি। লোকে বলে, পুরো পাগল হয়ে গিয়েছিলেন নাকি তিনি। সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকতেন। কখনও বেরোতেন না। রাতের বেলা বাড়ির কাছে কেউ গেলে শুনতে পেত অদ্ভুত সব চিত্তার, চেঁচামেচি। তাদের ধারণা ভেরোনিকার ঘর থেকে আসত। আর মেলবয়েস? তার যেন জীবনটাই থেমে গিয়েছিল। সমস্ত টাকা খুইয়ে ফেললেন তিনি। দামী দামী সমস্ত ছবি, জিনিসপত্র সব নীলামে উঠল, ঠেলা গাড়িতে ভরে নিয়ে যাওয়া হলো। তাকেও এরপর আর কোনদিন শহরে দেখা যায়নি। তারপর একদিন রহস্যময় ভাবে পুড়ে ছারখার হয়ে গেল বাড়িটা।

মেলবয়েসই পুড়িয়েছিলেন নাকি? জানতে চাইল কোরি।

তা-ও জানি না। আসল ঘটনাটা কি ঘটেছিল, কেউ জানে বলে মনে হয় না। সবই অনুমান। কেউ বলে পাগল হয়ে গিয়ে ভেরোনিকা আগুন দিয়েছিলেন বাড়িতে। কেউ বলে মেলবয়েস নিজেই দিয়েছিলেন। অভিশপ্ত বাড়িসহ নিজেকে শেষ করে দেয়ার জন্যে। ওই বাড়ির সবচেয়ে কাছে যে বাড়িটা ছিল, মেলবয়েসদের প্রতিবেশী, সে তার ডায়রিতে লিখে গেছে। সেরাতে কি ঘটেছিল প্রাসাদে। লেখাটা আমি পড়েছি। রাত দুপুরে নাকি দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠেছিল প্রাসাদে। কয়েক ঘণ্টা ধরে জুলল নরকের আগুনের মত। পরদিন লোকে যখন দেখতে এল, পোড়া ছাই ছাড়া আর কিছুই দেখল না।

সাগরের দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন ব্যারন।

মেলবয়েস আর ভেরোনিকার কি ঘটেছিল? জানার জন্যে তর সইছে না। কোরির।

আগুনে পুড়ে মারা গেছেন ভেরোনিকা, ব্যারন বললেন। ব্ল্যাক ফরেস্টের গোরস্থানে কবর দেয়া হয়েছে তাকে। কোন নামফলক লাগানো হয়নি তাতে। আর মেলবয়েসের কি হয়েছে কেউ বলতে পারে না। তাঁকে আর কখনও দেখেনি কেউ।

বাতাসে কাত হয়ে গিয়ে আবার লাফিয়ে সোজা হলো মোমের শিখা। শীত লাগল কোরির। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, গরম কাপড় নিয়ে আসিগে। কিশোর, তোমাদের জন্যে কিছু লাগবে?

উম, আমার জন্যে আনতে পারো, রবিন বলল।

ব্যারনের দিকে তাকাল কোরি, আমি না আসা পর্যন্ত আর কোন গল্প বলবেন না, প্লীজ! বালির ঢিবির ঢাল বেয়ে প্রায় দৌড়ে হোটেলের দিকে উঠে গেল সে। অদৃশ্য হয়ে গেল অন্ধকারে।

সাংঘাতিক এক গল্প শোনালেন, কিশোর বলল। মানুষের শরীর থেকে কঙ্কাল উধাও হয়ে যায়, এরকম কথা আর শুনিনি।

ভ্যাম্পায়ারের কাজ নয়তো? জিজ্ঞেস করতে গিয়ে গলা কেঁপে উঠল মুসার।

ভ্যাম্পায়ার হয় কি করে? রবিন বলল, তাহলে রক্ত থাকত না শরীরে। হাড় থাকবে না কেন?

তাহলে এমন কোন ভূত হতে পারে, যে হাড় খায়! ভয়ে ভয়ে বলল মুসা।

এর অন্য কোন ব্যাখ্যা আছে, কিশোর বলল। কিংবা লোকে বানিয়েও বলতে পারে। সাতদিনে লাশ এতটাই ফুলে গিয়েছিল, মনে হয়েছে হাড় নেই। লোকে সেটাকে রঙ চড়িয়ে বানিয়ে দিয়েছে উদ্ভট এক ভয়াল কাহিনী।

এই শুরু হলো তোমার যুক্তি দেয়া, রেগে গেল মুসা। উল্টোপাল্টা যুক্তি দিয়ে কাহিনীটাকে নষ্ট করছ কেন?

উল্টোপাল্টা নয়, এটাই ঠিক। কারণ ভূত বলে কিছু নেই।

হেসে উঠলেন ব্যারন। বাতাসে দুলে উঠল তার কোটের কোণা। চাঁদের আলোয় মনে হলো ডানা মেলতে চাইছে ওটা। বললেন, লোকে তো কত কথাই বলে। রোজার মেলবয়েস ভ্যাম্পায়ার ছিলেন, একথাও বলেছে অনেকে। মুসার দিকে তাকালেন, আমি যেরকম পোশাক পরে এসেছি, আমাকেও আবার ভুত মনে হচ্ছে না তো তোমার? ন

মাথা নাড়ল মুসা। কথা বেরোল না তার মুখ থেকে।

সবাই চুপচাপ। অনেকক্ষণ পর নীরবতা ভাঙলেন ব্যারন। ঠাণ্ডা পড়ছে। ওঠা উচিত

কথা শেষ হলো না তার। শোনা গেল তীক্ষ্ণ চিৎকার।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল সবাই।

আবার শোনা গেল চিৎকার। রাতের বাতাসকে চিরে দিল।

হো-হো-হোটেল থেকে আসছে! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।

কোরি! বলল কিশোর।

.

০৭.

দমকা বাতাস নিভিয়ে দিল মোমের আলো।

বালির ঢিবি বেয়ে উঠতে শুরু করল কিশোর। পিছু নিল মুসা আর রবিন।

চিৎকার থেমে গেছে।

ওপরে উঠে ফিরে তাকাল কিশোর। ব্যারনও উঠে আসছেন। তবে ওদের চেয়ে অনেক ধীর। এখনও একশো-গজ নিচে রয়ে গেছেন।

আবার ছুটল সে। পুল হাউজের পাশ কাটিয়ে, সুইমিং পুলের ধার দিয়ে ছুটে চলল অন্ধকার বাড়িটার দিকে। পেছনের দরজা দিয়ে একটা ছায়ামূর্তি বেরিয়ে ছুটে আসতে লাগল ওর দিকে।

কথা বলার জন্যে মুখ খুলেও মূর্তিটাকে চিনতে পেরে থেমে গেল। কিশোর। কোরি! কি হয়েছে?

আ-আমি…আমি ওকে দেখেছি! ঘোরের মধ্যে কথা বলছে যেন কোরি।

কি দেখেছ? জানতে চাইল রবিন। হাঁপাচ্ছে। সে আর মুসা দুজনেই এসে দাঁড়িয়েছে কিশোরের পাশে।

চিৎকার করলে কেন? ওদের পেছনে শোনা গেল ব্যারনের অস্থির কণ্ঠ।

আমি ওকে দেখেছি, আবার একই কথা বলল কোরি।

সাদা কোটের কোণা উড়িয়ে দৌড়ে কাছে এসে দাঁড়ালেন ব্যারন।

উলফও বেরিয়ে এল।

আমি-আমি ভূতটাকে দেখেছি! কোরি বলল।

গুঙিয়ে উঠল মুসা। কো-কো-ক্কোথায়?

এমন ভাবে চিৎকার করে উঠলে… হাত দিয়ে বুক চেপে ধরলেন ব্যারন।

সরি। আপনাআপনি বেরিয়ে গেল মুখ দিয়ে

ভেতরে চলো সবাই। বলে ব্যারনের হাত চেপে ধরে টেনে নিয়ে চলল উলফ।

ওদের অনুসরণ করল তিন গোয়েন্দা আর কোরি। মিনিটখানেকের মধ্যেই লবিতে জমায়েত হলো। চামড়ায় মোড়া বড় একটা চেয়ারে বসল, কোরি। তার পাশে ব্যারন। দম নিতে কষ্ট হচ্ছে এখনও।

বায়ের করিডরের দিকে হাত তুলে কোরি বলল, হলঘরে দেখলাম ওটাকে। একজন মহিলার ভূত। দেয়াল ভেদ করে বেরিয়ে এল।

দেখতে কেমন? জানতে চাইল উলফ।

চমকে দিল কিশোরকে। কিশোর জানত না ঠিক ওর পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে লোকটা।

কপালের ওপর এসে পড়া একগাছি চুল আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে। সামনের দেয়ালটার দিকে তাকিয়ে রইল কোরি। যেন ভূতের চেহারা, মনে করার চেষ্টা করছে। পুরানো আমলের পোশাক পরা। সাদা নাইটগাউন। লম্বা কালো বেনি। বয়েস কম। খুব সুন্দরী।

চেয়ারে নড়েচড়ে বসল সে। অস্বস্তি বোধ করছে। নজর এখনও সামনের দেয়ালের দিকে। ওর চোখ দুটোই বেশি নাড়া দিয়েছে আমাকে। বাপরে বাপ! কি বড় বড়। টকটকে লাল। মুখটা ফ্যাকাশে। মোমের মত।–.. আরও কিছু বলতে চাইল সে। কথা আটকে গেল।

আলতো করে ওর হাতটা চাপড়ে দিয়ে ব্যারন বললেন, শান্ত হও। উলফ, এক কাপ চা দাও না ওকে।

দেব। বলল, কিন্তু জায়গা ছেড়ে নড়ল না উলফ।

লাল চোখ মেলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল সে, কোরি বলল। আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে মনে হলো। বরফের মত ঠাণ্ডা হয়ে গেল। হঠাৎ সবকিছু। ঘর। ঘরের বাতাস। সব। চিৎকার করে উঠলাম। দেয়ালে মিশে গেল ওটা। ঘাড়ে কিসের যেন ঠাণ্ডা ছোঁয়া লাগল। আবার চিৎকার করে উঠলাম।

দেয়ালের দিকে তাকিয়ে চুলের গোছা আঙুলে পেঁচাতে থাকল সে।

রবিনের দিকে তাকাল কিশোর। রবিন কি ভাবছে বোঝার চেষ্টা করল। ভূত দেখেছে কোরি, এ কথা বিশ্বাস করতে পারছে না সে। নিশ্চয় কেউ ভয় দেখাতে চেয়েছে ওকে।

কেরির দিকে ফিরল সে। এখনও ভয় পাচ্ছ?

ওর কথা যেন শুনতেই পায়নি কোরি। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছে।

হোটেলের পুরানো অংশে অনেক রহস্যময় ঘটনা ঘটেছে বলে শোনা যায়, ব্যারন বললেন। কিন্তু…

ও আবার আসবে, আচমকা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল কোরি। ভূতটা ফিরে আসবে। আমার যেন কেমন লাগছে!

*

ঘুম আসছে না কিশোরের।

নরম বালিশে মাথা রেখে চিত হয়ে শুয়ে ভাবতে লাগল। সিলিঙে নানা রকম ছায়ার খেলা। বাইরে কালো নির্মেঘ আকাশ, তারায় ভরা। সাদা কোমল চাঁদটা যেন ভেসে রয়েছে উপসাগরের ওপরে।

ব্যারনের গল্পটার কথা ভাবছে সে। বনের মধ্যে ফুটফুটে দুটো ছোট্ট মেয়ের লাশ। হাড় নেই। পোড়া বাড়ি। খেপা মহিলা ভেরোনিকা। উন্মাদ রোজার ডি মেলবয়েস। তার বংশধর একই নামের বর্তমান ব্যারন, মেলবয়েস ডি থার্ড। ব্যারনের চাকর উলফ। মানে নেকড়ে! রাখার জন্যে আর কোন নাম খুঁজে পায়নি যেন ওর বাবা। নামের আকাল পড়েছিল যেন। লোকটা অদ্ভুত। নেকড়ের সঙ্গে মিল নেই মোটেও। বরং চেহারার দিকে তাকালে বিখ্যাত সেই ক্লাসিক ছবির দানবটার স্রষ্টার কথা মনে পড়ে–ড. জেকিল।

কোরির কথা ভাবল। সত্যি, কি ভূত দেখেছে সে? কিছু একটা তো দেখেছে নিশ্চয়। নইলে অমন করে চিৎকার করত না।

নাহ, ঘুমাতে আর পারবে না! বিছানা থেকে নেমে পড়ল সে। চাঁদটা চলে এসেছে যেন ঠিক তার জানালার বাইরে। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। রূপালী জ্যোৎস্না ঘরে ঢুকে আলোর একটা আয়তক্ষেত্র তৈরি করেছে। কার্পেটে।

আলো মাড়িয়ে আলমারির কাছে গিয়ে শার্টটা বের করে গায়ে দিল সে। রান্নাঘরে যাবে। কোক-টোক কিছু পায় কিনা দেখবে।

দরজা খুলে সরু হলওয়েতে বেরিয়ে এল। বাতাসে কার্পেট ক্লীনার আর পোকা মারার ওষুধের গন্ধ। খুব মৃদু আলো জ্বলছে। রাতের বেলা ডিম লাইট জেলে রেখে উজ্জ্বল আলোগুলো সব নিভিয়ে দেয়া হয়।

হেঁটে চলল সে। রবারসোল স্যান্ডেল পরা থাকায় শব্দ হলো না। দুপাশের দরজাগুলো আগের মতই বন্ধ।

মোড় নিয়ে আরেকটা করিডরে বেরোল। বিচিত্র এক রকম গন্ধ। আবছা অন্ধকার। একই রকম নিঃশব্দ। যেন স্বপ্নের মধ্যে হেঁটে চলল সে।

ঠিক এই সময় কানে এল শব্দটা।

থমকে দাঁড়াল সে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে ফেলল। মেঝের মচমচ না তো?

আবার হলো শব্দটা। আরেকটু জোরে। সেই সঙ্গে শেকলের ঝনঝনানি।

শেকল? ভুল শুনছে না তো?

আবার হলো শব্দটা। এগিয়ে এসে থেমে গেল।

আবার মচমচ। মৃদু গোঙানি। মানুষের গোঙানির মত। হালকা বাজনার শব্দ ভেসে এল। বীণা বাজাচ্ছে কেউ। ফিসফিস করে ওর নাম ধরে ডাকল কে যেন।

দূর! সব আমার কল্পনা, নিজেকে বোঝাল সে। বাতাসের শব্দ। সরু হলওয়েতে দমকা বাতাস এসব কারসাজি করছে।

করুণ সুরে বেজেই চলল বীণা। ফিসফিস করে তার নাম ধরে ডাকল। একটা ছোট্ট মেয়ে। একেবারে কানের কাছে।

ঘটনাটা কি? মোড়ের অন্যপাশে কেউ আছে নাকি? হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল সে। পার হয়ে এল মোড়টা। কানে এল মানুষের কণ্ঠ। জোরে জোরে কথা বলছে।

হাঁ করে ঢোক গিলে পানি খাওয়ার মত বাতাস গিলতে শুরু করল সে। যে ঘর থেকে কথা শোনা যাচ্ছে, তার দরজায় নম্বর নেই। নিচের ফাঁক দিয়ে চিলতে আলো এসে পড়েছে বাইরে।

ভূতুড়ে ফিসফিসানি থেমে গেছে।

এগিয়ে গিয়ে দরজায় কান পাতল সে।

ব্যারনের কণ্ঠ। চিনতে কোন অসুবিধে হলো না। রেগে রেগে কথা বলছেন কারও সঙ্গে। তর্ক করছেন।

কিশোর অনুমান করল, এটা ব্যারনের ঘর। করিডরের শুরুতে প্রথম ঘর। পাশে চওড়া সিঁড়ি নেমে গেছে। মেইন লবি আর হোটেলের অফিসে যাওয়া যায় ওটা দিয়ে।

শোনো! যা বলি শোনো! চিৎকার করে উঠলেন ব্যারন।

না, আমি শুনব না! সমান তেজে জবাব দিল আরেকটা কণ্ঠ।

মহিলা কণ্ঠ।

বিস্ময়ে নিচের চোয়াল ঝুলে পড়তে লাগল কিশোরের।

প্লীজ, আমার একটা কথা রাখো! কাঁদতে শুরু করল মহিলা, তোমার পায়ে ধরি, পার্টি দিয়ো না! প্লীজ, দিয়ো না!

দরজার বাইরে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিশোর। কিন্তু আর কিছু শোনা গেল না।

কি নিয়ে তর্ক করছে ওরা? কিসের পার্টি? মহিলাটি কে?

ঘরের মধ্যে পায়ের শব্দ শোনা গেল। দরজার দিকে এগিয়ে আসছে। চট করে ওখান থেকে সরে এসে হলওয়ে ধরে দৌড় দিল কিশোর। যে-ই বেরোক, তার চোখে পড়তে চায় না।

.

০৮.

পরদিন। সুন্দর, ঠাণ্ডা একটা সকাল। ডাইনিং রূমের বিশাল জানালা দিয়ে সোনালি রোদ এসে ছড়িয়ে পড়েছে ঘরের ভেতর। আকাশের রঙ ঘন নীল।

নাস্তা খেতে খেতে গতরাতের কথা সঙ্গীদের জানাল কিশোর।

হু, মাথা দুলিয়ে বলল কোরি, আমার কথা তাহলে বিশ্বাস হচ্ছে এতক্ষণে।

বিশ্বাস কাল রাতেই করেছি, কিশোর বলল। কিন্তু যাকে দেখেছ সে ভূত নয়, রক্তমাংসের জলজ্যান্ত একজন মানুষ, যে কথা বলে, তর্ক করতে পারে। মহিলাটি কে সেটাই ভাবছি এখন।

ব্যারনের রাধুনী হতে পারে, রবিন বলল, মনিকা।

না, মনিকা নয়। ব্যারন বলেছেন শুক্রবারের আগে আসবে না সে।

ওটা ভূত ছাড়া আর কেউ নয়, জোর দিয়ে বলল কোরি। হতে পারে বহুকাল আগে মেলবয়েসদের কারও স্ত্রী ছিল ওই মহিলা। অপঘাতে মরে ভূত হয়েছেরাত দুপুরে এসে ব্যারনের সঙ্গে তর্ক জুড়েছে

উলফ এসে ঢুকল ডাইনিং রূমে। মুখ সেই একই রকম গোমড়া। হাতে একটা লাল রঙের টুলবক্স। ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুটি করল। কাজ শুরু করতে চাও?

কোরি জিজ্ঞেস করল, উলফ, হোটেলে কোন মহিলা আছে?

প্রশ্নটা অবাক করল উলফকে। মুখটাকে এমন করে ফেলল যেন বোলতায় কামড়ে দিয়েছে। দ্রুত সামলে নিয়ে বলল, না, নেই। কেন?

ব্যারনের সঙ্গে কোন মহিলা দেখা করতে এসেছে?

চোখ দেখেই বোঝা গেল এসব প্রশ্নে খুব বিরক্ত হচ্ছে উলফ। না, কেউ দেখা করতে আসেনি। রলিন মারা যাওয়ার পর আর কোন মহিলা ঢোকেনি। ব্যারনের ঘরে। রলিন ছিল তার স্ত্রী।

টুলবক্সটা নিয়ে ঘরের পেছনের অংশে চলে গেল উলফ। কিশোরের দিকে তাকাল কোরি। চোখে বিস্ময়। কিন্তু প্রসঙ্গটা নিয়ে আলোচনা করা গেল না। আর। এখন কাজের সময়।

এখান থেকে কাজ শুরু করবে তোমরা, দেয়াল জুড়ে থাকা লাইটহাউজের বিশাল একটা পেইন্টিং সরাল উলফ। ওয়ালপেপার সরাবে। সিরিশ দিয়ে ঘষে মসৃণ করবে।

*

সারাটা সকাল কাজ করল ওরা। পুরানো বাদামী রঙ ঘষে ঘষে তুলল। গরম হয়ে উঠেছে ঘরটা। মেঝেতে ছড়িয়ে আছে বাদামী রঙের শুকনো কণা। বাতাসেও উড়ছে। ঘামে আঠা হয়ে গেছে শরীর। উলফ ঠিকই বলেছে–পরিশ্রমের কাজ। সাগরের নোনা হাওয়া কাঠের অনেক গভীরে ঢুকিয়ে দিয়েছে রঙ, তোলা খুব মুশকিল।

সাড়ে এগারোটা নাগাদ কোরি বলল, একটা কোক খাওয়া দরকার। আন্টিকেও ফোন করতে হবে। ও মই থেকে লাফ দিয়ে নেমে এল মুসা। কোরির সঙ্গে সঙ্গে এগোল। ওদের পেছনে গেল রবিন। কিশোর বলল, তোমরা যাও। আমি এটুকু শেষ করে আসি।

কথা বলতে বলতে যাচ্ছে তিনজনে। রান্নাঘরে ঢুকে যেতে আর শোনা গেল না। মইয়ে দাঁড়িয়ে নিজের কাজে মন দিল কিশোর। সিরিশ দিয়ে ঘষতে ঘষতে হাতের পেশী ব্যথা হয়ে গেছে। কিন্তু থামল না। ঘষেই চলল।

দশ কি পনেরো মিনিট পর কানে এল পদশব্দ। মুসারা নিশ্চয় ফিরে এসেছে।

ফিরে তাকিয়েই স্থির হয়ে গেল কিশোরের হাত।

মুসারা নয়। অবিকল ব্যারনের মত দেখতে একজন অপরিচিত লোক এসে দাঁড়িয়েছেন। সাদা চুল, সাদা গোঁফ। কিন্তু ব্যারনের মত হাসিখুশি নন, বরং উল্টো। পোশাকও পরিচ্ছন্ন নয়। কানা জলদস্যুদের মত এক চোখ কালো কাপড়ে ঢাকা। পরনে ঢোলা জিনস। প্যান্টের হাটুতে দাগ। গায়ে। সাফারি জ্যাকেট। অসংখ্য পকেট তার। কাগজ, কলম, রুমাল আর নানা। রকম জিনিসে উঁচু হয়ে আছে সেগুলো। ডান হাতে একটা হান্টিং রাইফেল। নল ধরে বাটটা ঠেকিয়ে রেখেছেন মেঝেতে। ভয়ানক বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে রাইফেলটাকে লাঠির মত ব্যবহার করে কাঠের মেঝেতে ঠুকঠুক শব্দ তুলে এগিয়ে এলেন কিশোরের দিকে।

হাই, হাসিমুখে বলল কিশোর।

জবাবে ঘোৎ করে উঠলেন তিনি। কালো একটা চোখ মেলে তাকিয়ে। রইলেন কিশোরের দিকে।

আমি কিশোর পাশা। আশা করল নিজের পরিচয় দেবেন ভদ্রলোক। দিলেন না দেখে জিজ্ঞেস করল, আপনি নিশ্চয় মিলার মেলবয়েস?

ব্যারন মিলার ডি মেলবয়েস, রাইফেলে ভর দিয়ে কিছুটা সামনে ঝুঁকে কুঁজো হয়ে দাঁড়ালেন তিনি। গলাটা তার ভাই রোজারের মত গমগমে হলেও অতটা মসৃণ নয়। আচরণ ভদ্র তো নয়ই, বুনো।

চেহারা এক, অথচ দুই ভাইয়ের মধ্যে অত অমিল হয় কি করে?–ভাবল কিশোর। বলল, আমরা বেড়াতে এসেছি এখানে। আমি আর আমার তিন বন্ধু। থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে কাজ করে দিচ্ছি। মিলারের দৃষ্টির সামনে অস্বস্তি বোধ করছে সে।

শুনেছি, কিছুতেই সহজ হচ্ছেন না ভদ্রলোক। রাইফেলটাকে লাঠির মত ব্যবহার করে হেঁটে গেলেন জানালার কাছে। বাইরে তাকিয়ে রইলেন। উজ্জ্বল, রোদে আরও স্পষ্ট দেখা গেল তার পোশাকগুলো। অতিরিক্ত কুঁচকানো আর ময়লা।

রোজার বলেছেন, তাঁর ভাই বিষণ্ণতা রোগে ভুগছেন। কেন এই বিষণ্ণতা? আলাপ জমানোর জন্যে বলল কিশোর, দিনটা খুব সুন্দর, তাই না? জায়গাটাও দারুণ আপনাদের। মই থেকে নামবে কি নামবে না সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না সে।

কোথায় সুন্দর? বিরক্তকণ্ঠে প্রায় খেঁকিয়ে উঠলেন মিলার। প্রচণ্ড গরম! সাগরের দিকে তাকিয়ে থেকে নল ধরে ধীরে ধীরে ঘোরাচ্ছেন রাইফেলটা।

ঘরের মধ্যে গরম।

জবাব দিলেন না মিলার। অস্বস্তি আরও বাড়ল কিশোরের। ইচ্ছে করেই এমন পরিস্থিতি তৈরি করছেন তিনি যাতে সহজ হতে না পারে সে? মুসারা এত দেরি করছে কেন?

তোমার বন্ধুরা কোথায়? জিজ্ঞেস করলেন মিলার।

কাজ করতে করতে ঘেমে গেছিল, পানি খেতে গেছে। আমি এই কোণাটা শেষ করে যাব, হাত তুলে দেখাল কিশোর।

দেখার জন্যে ঘুরলেন না মিলার। বিষণ্ণকণ্ঠে বললেন, জায়গাটা অতিরিক্ত চুপচাপ।

হবেই। এতবড় জায়গা। মাত্র পাঁচ-সাতজন লোক।

তার কথাটা মনে হয় পছন্দ হলো না মিলারের। মুখটাকে বিকৃত করে ঘনঘন রাইফেল ঠুকতে লাগলেন মেঝেতে। এগিয়ে আসতে শুরু করলেন। মইয়ের কাছে।

ভয় পেয়ে গেল কিশোর। মই থেকে টান মেরে ফেলে দেবেন না তো?

কিন্তু মইয়ের ফুটখানেক দূরে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। এক পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে সশব্দে নাক ঝাড়লেন, গোফ মুছলেন, রুমালটাকে দলা পাকিয়ে ভরে রাখলেন আরেক পকেটে। কিশোরের দিকে চোখ তুলে বললেন, মন দিয়ে কাজ করো।

হ্যা করছি… ভয়ে ভয়ে বলল কিশোর। কি বললে আবার খেপে যান। কে জানে।

আমার ভাইকে দেখেছ?

না তো। সকালে নাস্তা খেতেও আসেননি।

হু! ওর সঙ্গে কথা ছিল।

ঠিক আছে, আমার সঙ্গে দেখা হলে তাকে বলব আপনি খুঁজছিলেন।

মন দিয়ে কাজ করো! হ্যাঁ, ভাল কথা, তোমরা কি পার্টিতে যোগ দিতে এসেছ নাকি?

পার্টি! চমকে গেল কিশোর। মোচড় দিয়ে উঠল পেটের মধ্যে। গতরাতের মহিলার কথা মনে পড়ল–প্লীজ, তোমার পায়ে ধরি, পাটি দিয়ো না! কেন মানা করছিল মহিলা? পার্টিকে এত ভয় কেন তার?

কিসের পার্টি? জানতে চাইল কিশোর।

কর্কশ কণ্ঠে মিলার বললেন, থেকে যাও। পার্টিতে যোগ দিতে হবে তোমাদের। পালানোর চেষ্টা কোরো না।

*

সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যায় খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়ল ওরা রবিনের মাথা ধরেছে। কোরির গা ম্যাজম্যাজ করছে কথাই বলতে পারল না কোনমতে খাওয়া শেষ করে ঘরে চলে গেল দুজনে

এত তাড়াতাড়ি শুতে যেতে ইচ্ছে করছে না কিশোরের। মুসারও না। ডাইনিং রূমে বসে রইল ওরা।

মিলারকে কি সত্যি পাগল মনে হয়েছে তোমার, কিশোর? জিজ্ঞেস করল মুসা।

পাগল কিনা জানি না, তবে আচরণ কেমন অদ্ভুত।

সেজন্যেই কোরি ভাবছে, ও ভূত।

যা খুশি ভাবুকগে। কারও আচরণ অদ্ভুত হলেই সে ভূত হয়ে যায় না। ভুলে যাচ্ছ কেন, মিলার বিষণ্ণতা রোগে ভুগছেন। সে যাকগে। আন্ট জোয়ালিনের ব্যাপারটা কি বলো তো? কোরি নাকি একবারও যোগাযোগ করতে পারেনি তাঁর সঙ্গে?

এটাও আমার কাছে রহস্যময় লাগছে।

একটা মুহূর্ত চুপ করে রইল কিশোর। চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল, বাইরে একটু ঘুরে আসিগে। রঙের মধ্যে শ্বাস নিতে নিতে মাথাটা গরম হয়ে গেছে।

মুসাও বেরোল ওর সঙ্গে। হাঁটতে হাঁটতে চলে এল চন্দ্রালোকিত সৈকতে।

অপূর্ব দৃশ্য। হলদে আলোয় ঝলমল করছে বালি। তীরে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের ভাঁজগুলোকে কালচে দেখাচ্ছে।

কি পরিষ্কার আলো দেখো, মুগ্ধকণ্ঠে বলল কিশোর। সব স্পষ্ট।

স্যান্ডেল খুলে বালিতে পা রেখে দেখো। ঠাণ্ডা। খুব আরাম লাগে।

পানির কিনারে এসে দাঁড়িয়ে গেল কিশোর। ফিরে তাকাল হোটেলের দিকে। বালির ঢালের লম্বা ঘাসগুলোতে ঢেউ তুলছে বাতাস। মনে হচ্ছে ওগুলোও তরল পদার্থ। চাঁদের আলো সবকিছুকেই কেমন অন্য রকম করে তুলেছে।

ডকের দিকে একটা খসখস শব্দ হলো। পই করে ঘুরে তাকাল সে। ডকের ওপরে ছোট্ট পাথরের টিলার কাছে হয়েছে শব্দটা।

কিসের শব্দ? মুসাও শুনতে পেয়েছে।

কেউ নজর রাখছে নাকি? চলো তো দেখি।

আমার ভয় করছে।

ভূতের ভয়?

সবদিকে নজর থাকে ওদের। নিজে অদৃশ্য থেকে সবখানে হাজির হতে পারে একমাত্র ওরাই..

চলো তো দেখি।

বালির ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করল কিশোর। নিচে কেউ থাকলে এখান থেকে দেখা যাবে।

কিন্তু অনেকখানি উঠেও কাউকে দেখতে পেল না। কোন শব্দও নেই। কেবল তীরে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের ছলাৎছল আর ঢেউয়ের মধ্যে বয়ে যাওয়া বাতাসের কানাকানি।

ক্লান্ত লাগছে। হাঁটতে আর ভাল লাগছে না। হোটেলে ফিরে চলল। দুজনে।

.

০৯.

পরদিন সকালে নাস্তার পর আবার কাজে লাগল ওরা।

দেয়াল ঘেঁষে রাখা মঞ্চটাতে ওঠা দরকার। ছাতের ঠিক নিচে দেয়ালে দশ বর্গফুটমত জায়গার রঙ ঘষতে হবে। কিন্তু সবাই একসঙ্গে উঠতে পারবে না ওটাতে। মাত্র দুজনের জায়গা হয়।

মুসা বলল, আমি আর রবিন উঠে ঘষতে থাকি। আমাদের হাত ধরে গেলে তোমরা দুজন উঠো।

খালি খালি বসে থাকব? কিশোর বলল। মঞ্চের পাশে একটা মই ঠেস দিয়ে তাতে উঠে কাজ করা যায়।

কোরি গেছে তার আন্টিকে ফোন করতে।

একটা ইলেকট্রিক স্যান্ডার দিয়েছে আজ উলফ। হাতে ঘষার চেয়ে এটা দিয়ে ঘষা অনেক সহজ। অনেক দ্রুত অনেক বেশি জায়গা ঘষা যায় যন্ত্রটা দিয়ে। যথেষ্ট ভারী। অন্য তিনজনের চেয়ে সহজে তুলে ধরে রাখতে পারবে মুসা, কারণ তার গায়ে শক্তি বেশি। সুতরাং ওটা নিয়ে মঞ্চে উঠে পড়ল সে।

রবিন উঠল তার পাশে। মঞ্চটার অবস্থা বিশেষ সুবিধের লাগছে না আমার। নড়ছে, দেখছ? দুলছে। ভেঙে পড়বে না তো?

রবিনের সন্দেহটাকে গুরুত্ব দিল না মুসা। স্যান্ডার ঠেসে ধরতে গেল দেয়ালে। এই সময় ফিরে এল কোরি। মুখ থমথমে।

পেয়েছ? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

না। রিং হচ্ছিল ঠিকই। কেউ ধরল না। ভায়োলা আন্টি নাহয় হাসপাতালে গেছে। কিন্তু আন্ট জোয়ালিন?

রোজার মেলবয়েস কি বললেন? শোরটাউনে যাবেন?

ঠোঁট ওল্টাল কোরি, জানি না। ফোন রেখে তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলাম। কোথাও খুঁজে পেলাম না।

স্যান্ডারটা দেয়ালে ঠেসে ধরল মুসা। বিকট শব্দ করে রঙ তুলতে লাগল যন্ত্রটা। পাশে দাঁড়িয়ে টেনে টেনে দেয়ালের কাগজ ছিঁড়তে শুরু করল মুসা।

যন্ত্র দিয়ে কাজ করার ফলে বাতাসে রঙের কণা এত বেশি উড়ছে, শাস নিতে কষ্ট হতে লাগল দুজনের। ব্যাপারটা লক্ষ করে একটা আলমারি থেকে গিয়ে দুটো মাস্ক বের করে আনল কিশোর। হাত লম্বা করে বাড়িয়ে দিল রবিনের হাতে। একটা নিজে রেখে আরেকটা মুসাকে দিল রবিন।

কাজ করতে করতে পাশে সরে গেল মুসা। দুলে উঠল মঞ্চ। কাত হয়ে যাচ্ছে একপাশে।

চিৎকার করে উঠল রবিন, আরি, পড়ে যাচ্ছে তো!

ঠেকানো গেল না কোনমতে। মড়মড় করে ভেঙে পড়ল মঞ্চ। মুসার হাত থেকে স্যান্ডারটা উড়ে গিয়ে পড়ল কিশোরের পায়ের কাছে। আরেকটু হলে তার পা-টা হেঁচত। মেঝেতে পড়ে গেল মুসা আর রবিন।

দৌড়ে এল কোরি আর কিশোর।

কোনমতে উঠে বসল রবিন। হাতে মুঠো করে ধরা রয়েছে এখনও একটুকরো কাগজ। দেয়ালের দিকে চোখ পড়তে চিৎকার করে উঠল, আরে দেখো দেখো! একটা দরজা!

চোখ তুলে তাকাল বাকি তিনজন। দেয়ালের গায়ে যেখান থেকে কাগজ ছিঁড়েছে রবিন, সেখানে একটা দরজার খানিকটা দেখা যাচ্ছে।

এগিয়ে গেল কিশোর। টান দিয়ে নিচের দিকের বাকি কাগজটুকু ছিঁড়ে ফেলল। বেরিয়ে পড়ল পুরো দরজাটা। বিড়বিড় করে বলল, দরজা ঢেকে দিয়েছিল কেন? আশ্চর্য!

সরো! সরো ওটার কাছ থেকে! চিৎকার করে উঠল কোরি। আমি পড়েছি, ভূতের উপদ্রব ঠেকানোর জন্যে ভূতুড়ে ঘর কিংবা সুড়ঙ্গের দরজা এ ভাবে ফুলআকা কাগজ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। তাহলে নাকি ওসব দরজা দিয়ে। আর বেরোতে পারে না ভূত।

রসুনের মালা ড্রাকুলার মত ভূতকে ঠেকায় শুনেছি, কিন্তু ফুলআঁকা কাগজ দরজাটার দিকে এগিয়ে গেল কিশোর।

দেখো, আমি তোমাকে মানা করছি! সাবধান করল কোরি। যেয়ো না! বের করে এনো না ভূতটাকে…

চকচকে মসৃণ কাঠের দরজাটার একপাশে ফ্রেমে বাঁধাই একটা ছোট ছবি ঝোলানো। মঞ্চের আড়ালে ঢাকা পড়ে ছিল। সেটাকে ঝুলন্ত অবস্থায় রেখেই কোণা ধরে সামান্য সরাতে বেরিয়ে পড়ল দরজার নব। হাসি ফুটল কিশোরের মুখে। নব ধরে মোচড় দিতে খুলে গেল দরজার পাল্লা।

কোরির দিকে ফিরে তাকাল সে। হাসি ছড়িয়ে পড়েছে মুখে।

ঢুকো না! কোরির দুচোখে ভয়। আমি এখনও বলছি, ভাল চাইলে বন্ধ করে দাও ওই দরজা!

মুসার দিকে তাকাল কিশোর।

হ্যাঁ-না কিছু বলল না মুসা। কোরির ভয়টা তার মধ্যেও সংক্রামিত হয়েছে। ঢোকা উচিত কিনা বুঝতে পারছে না।

রবিন বলল, খুলেই যখন গেছে, চলো দেখি কি আছে?

ওর মুখের কথা শেষ হতে না হতেই তীক্ষ্ণ একটা চিৎকার দিয়ে ফড়ফড় করে বেরিয়ে এল কি যেন।

লাফ দিয়ে সরে গেল কোরি। মুসা হতভম্ব।

জানালার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল রবিন, বাদুড়। ওই জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেল। হাসতে হাসতেই বলল, কোরি, ভ্যাম্পায়ার নয়, শিওর থাকতে পারো। দিনে বেরোয় না ভ্যাম্পায়ারেরা। সূর্য ডোবার আগে বেরোতে পারে না।

ইয়ার্কি মেরো না! ঝাঁঝিয়ে উঠল কোরি। যখন পড়বে ভূতের খপ্পরে তখন বুঝবে মজা!

যত ভয়ই পাক, কিশোর, রবিন আর মুসাও যখন ঢুকে গেল ভেতরে, আগ্রহ এবং কৌতূহল কোনটাই ঠেকাতে না পেরে কোরিও ঢুকে পড়ল ওদের পেছনে। অন্ধকারে আবার কিচকিচ করে উঠল কয়েকটা জীব। ফড়ফড় করতে লাগল মাথার ওপর। চামচিকে আর ছোট জাতের বাদুড়ে বোঝাই হয়ে। আছে জায়গাটা।

বাদুড় আমার সাংঘাতিক ভয় লাগে, অন্ধকারে ফিসফিস করে বলল কোরি। মাকড়সা আর তেলাপোকাকেও।

শুয়াপোকাকে ভয় লাগে না? হেসে জিজ্ঞেস করল রবিন। বড় কালো কালো শুয়াপোকা? লম্বা লম্বা কাটার মত লোম, কিলবিল করে

মাগো! গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল কোরি। দোহাই লাগে। তোমার রবিন, আর বোলো না..প্লীজ! উফ, দেয়ালেই হাত দিতে পারব না। আর।

ওর চিৎকারে মাথার ওপর ফড়ফড় করতে লাগল আবার বাদুড়ের ঝাক।

শক্ত করে গলার লকেটটা চেপে ধরল কোরি। অন্ধকারে কেউ দেখতে পেল না সেটা।

ধীরে ধীরে চোখে সয়ে এল অন্ধকার। পেছনের খোলা দরজাটা দিয়ে অতি সামান্য আলো আসছে। আবছামত দেখা যাচ্ছে এখন ভেতরটা। কংক্রীটে তৈরি সরু, নিচু ছাতওয়ালা একটা সুড়ঙ্গে ঢুকেছে ওরা।

মুসা, কিশোর বলল, আলমারিতে টর্চ আছে। নিয়ে এসো তো দুটো। ঢুকেছি যখন ভাল করেই দেখে নিই কি আছে না আছে?

ভয়ের ভান করে রবিন বলল, না না, এগিয়ে না আর! বলা যায় না, কখন কাউন্ট ড্রাকুলার কফিন চোখে পড়ে যায়! এ ফালতু কথা বোলো না তো! লাফ দিয়ে দরজার দিকে সরে গেল কোরি। আমি যাব না!

ওর পাশ কেটে বেরিয়ে গেল মুসা। আলমারি খুঁজে দুটো টর্চ বের করে নিয়ে এল।

মুসার কাছ থেকে একটা টর্চ নিল কিশোর। আগে আগে এগোল।

যাব না বললেও কৌতূহল দমাতে পারল না কোরি। এগিয়ে চলল তিন গোয়েন্দার সঙ্গে।

রোজার এসে যদি জিজ্ঞেস করেন, কাজ ফেলে কোথায় গিয়েছিলাম। আমরা, রবিন বলল, কি জবাব দেব?

সত্যি কথাই বলব, জবাব দিল কিশোর। সুড়ঙ্গটা দেখে কৌতূহল হয়েছিল। ভেতরে কি আছে দেখতে গিয়েছিলাম। স্বাভাবিক কৌতূহল এটা। তিনি কিছু মনে করবেন না। একটু চিন্তা করে বলল, তবে একটা কথা ভাবছি। এটার কথা কি উলফ জানে?

শুকনো গলায় কোরি বলল, আমার ভয় লাগছে!

সেটা তো বুঝতেই পারছি।

শূন্য সুড়ঙ্গ। পায়ের নিচে কংক্রীটের মেঝে। দেয়াল ছুঁয়ে দেখল কিশোর। ঠাণ্ডা। ভেজা ভেজা।

ওই দেখো! হাত তুলল মুসা।

ওর বলার ভঙ্গিতে চমকে গেল কোরি। আবার চিৎকার করে উঠল। তাকিয়ে দেখল দেয়াল বেয়ে এগিয়ে আসছে একটা বড় পোকা। গোঁ গো শুরু করল সে। যেন চোখ উল্টে দিয়ে পড়ে যাবে। ওয়াক ওয়াক করে বলল, আমার বমি আসছে!

নাহ, তোমাকে সঙ্গে নিয়ে এগোনোই তো মুশকিল! বিরক্ত হয়ে বলল কিশোর। যাও, তুমি চলে যাও, আমাদের সঙ্গে আর যাওয়া লাগবে না!

ঠিক আছে, আর চেঁচাব না। কিন্তু আধমিনিট পরেই বড় একটা মাকড়সা দেখে আবার চিৎকার করে উঠল কোরি। টারান্টুলা! ব্ল্যাক উইডো। স্পাইডার! পিষে ফেলো! কামড়ে দিলে সর্বনাশ!

আরে কিসের টারান্টুলা? ধমক লাগাল কিপোর। খেয়ে আর কাজ পেল না। এখানে টারান্টুলা আসবে কোত্থেকে? না চিনেই চেঁচামেচি। একেবারে সাধারণ মাকড়সা।

ডানে মোড় নিল সুড়ঙ্গ। ঢালু হয়ে গেছে মেঝে। গলিঘুপচির অভাব নেই। ওসবের মধ্যে না ঢুকে সোজা এগিয়ে চলল ওরা।

মুসা বলল, আমার মনে হয় সাগরের দিকে গেছে সুড়ঙ্গটা। পানির ধারে গিয়ে শেষ হয়েছে।

বানিয়েছিল কারা? রবিনের প্রশ্ন। জবাবটাও নিজেই দিল, বোধহয় প্রাচীন চোরাচালানির দল। রাতে জাহাজ থেকে গোপনে মাল খালাস করে। এনে হোটেলে লুকিয়ে রাখত।

টর্চের আলো সামনে ধরে রেখে সাবধানে নিচে নামতে লাগল কিশোর। আরও কয়েক মিনিট এগোনোর পর দেখা গেল দুভাগ হয়ে গেছে সুড়ঙ্গ। মূল সুড়ঙ্গটা বাঁয়ে মোড় নিয়ে সোজা এগিয়েছে। ওটা থেকে বেরিয়ে আরেকটা সুড়ঙ্গ চলে গেছে ডানে।

রসিকতা করে কিশোরকে জিজ্ঞেস করল মুসা, কোনদিকে যাব এবার, ক্যাপ্টেন কিড?

চলো আগে ডানেরটা ধরেই যাই, কোরি বলল।

কেন, কোন বিশেষ কারণ?

না না, তাড়াতাড়ি জবাব দিল কোরি, কোন কোন ভূত বিশেষজ্ঞ বা দিকটাকে অশুভ মনে করে তো…

আর কিছু বলা লাগল না। মুহূর্তে ডান দিকে ঘুরে গেল মুসা।

কয়েকশো গজ এগোনোর পর চিৎকার করে উঠল কোরি।

কি হলো? জানতে চাইল কিশোর।

মুখে কি জানি লাগল!

আলো ফেলল কিশোর। মাকড়সার জাল। তুমি কি ভেবেছিলে?

জবাব দিল না কোরি।

কি আর ভাববে, হাসতে হাসতে বলল রবিন, ভ্যাম্পায়ারের ছোঁয়া।

জালে দুলন্ত হালকা বাদামী মাকড়সাগুলো দেখতে দেখতে উত্তেজিত হয়ে উঠল কিশোর, সৈকতে বাস করে এসব মাকড়সা, পানির কিনারে। তারমানে বাইরে থেকে এসেছে এগুলো। আর বাইরে থেকে যেহেতু এসেছে, ঢোকার পথ আছে। এবং ঢোকার পথ মানেই বেরোনোর পথও।

গতি বাড়িয়ে দিল ওরা।

আঁকাবাঁকা সুড়ঙ্গের আরও কয়েকটা মোড় ঘুরে এসে দাঁড়াল একটা কাঠের দরজার সামনে। কয়েক ইঞ্চি ফাঁক হয়ে আছে। ওপাশে ঘন অন্ধকার।

দরজায় হাত রাখল কিশোর। এক মুহূর্ত দ্বিধা করে ঠেলা দিল। কাচকোচ আওয়াজ তুলে খুলে গেল পাল্লা। টর্চের আলোয় দেখা গেল ছোট একটা ঘর। মাঝখানে একটা কাঠের টেবিল। দুই পাশে বেঞ্চ পাতা। টর্চের আলোয় দেখা গেল দেয়ালগুলোতে লাল রঙ লেগে আছে। যেন রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।

টেবিলের দিকে চোখ পড়তে খাইছে! বলে উঠল মুসা। হাত থেকে খসে গেল টর্চ।

কিশোরের টর্চটা জ্বলছে।

বিড়বিড় করে কোরি বলল, মরার খুলি!

এগিয়ে গেল কিশোর। চটচটে কি যেন লেগে রয়েছে। আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখল। আঠা আঠা জিনিস। গন্ধ শুকল। কিছু বুঝতে পারল না।

প্রোটোপ্লাজম! ফিসফিস করে বলল কোরি। ভূতেরা যেখান দিয়ে চলে, সেখানে নরকঙ্কাল দেখলেই তাতে লাগিয়ে রেখে যায়। এবার তো বিশ্বাস করবে আমার কথা? খানিকক্ষণ আগে এখানে বসে ছিল একটা ভূত, মরার খুলিতে করে নিশ্চয় কফি কিংবা চা খেয়েছে, এটা তারই প্রমাণ।

হেসে ফেলল রবিন, অতিরিক্ত ভূতের সিনেমা আর ভূতের গল্প পড়ার ফল এসব। ধরতে গেল খুলিটা। নাড়া লাগতেই গড়িয়ে গেল ওটা। চোখ দুটো ওর ঘুরে গেল সে দিকে। ঝটকা দিয়ে হাতটা সরিয়ে আনল সে।

মাগো! খেয়ে ফেলল! বলে চিৎকার দিয়েই পেছন ফিরে দৌড় মারতে গেল মুসা।

খপ করে তার হাত ধরে ফেলল কিশোর। আরে থামো! কি করছ। পাগলের মত?

মুসাকে শান্ত হওয়ার সময় দিল সে। আগেই লক্ষ করেছে দরজার পাশে সুইচবোর্ড আছে। আলো জ্বেলে দিল। তুলে নিল মাটিতে পড়ে যাওয়া টর্চটা।

আর কিছু দেখার নেই। ফিরে চলল ওরা ডাইনিং রূমে।

সুড়ঙ্গটা যেখানে দুভাগ হয়েছে সেখানে পৌঁছে রবিন জিজ্ঞেস করল, বাঁয়েরটায় ঢুকবে না?

ঘড়ি দেখল কিশোর, নাহ, এখন আর সময় নেই। কাজে অনেক ফাঁকি দিয়েছি। মিস্টার রোজার জানতে পারলে রাগ করবেন।

যে দরজা দিয়ে ঢুকেছিল সেটার কাছে ফিরে এল ওরা।

কিন্তু দরজা বন্ধ। শত ঠেলঠেলিতেও খুলল না। আটকে গেছে কোন কারণে। এই সময় লক্ষ করল কিশোর, আলো কমে এসেছে টর্চের। ফুরিয়ে এসেছে ব্যাটারি।

শঙ্কিত কণ্ঠে রবিন বলল, আটকা পড়লাম না তো!

*

দরজায় দুই হাতে কিল মারতে মারতে চিৎকার করে উঠল কোরি, অ্যাই, শুনছেন? কেউ আছেন ওপাশে? দরজাটা খুলুন!

জবাব দিল না কেউ।

পদশব্দের আশায় কান পেতে রইল ওরা। কেউ এগিয়ে এল না।

বাইরে থেকে তালা আটকে দেয়নি তো? ককিয়ে উঠল কোরি।

দরজার কাছ থেকে সরে গেল কিশোর। বেরোনোর অন্য কোন পথ নিশ্চয় আছে। সময় থাকতে থাকতে সেটা খুঁজে বের করা দরকার। টর্চ নিভে গেলে মহাবিপদে পড়ব।

কি করবে? জিজ্ঞেস করল রবিন।

সুড়ঙ্গের অন্য মাথা দিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করব।

মৃদু প্রতিবাদ করতে চাইল কোরি, কিন্তু কেউ তার কথা শুনল না। ফিরে চলল আবার ওরা।

সুড়ঙ্গের মাথাটা যেখানে দুই ভাগ হয়েছে সেখানে পৌঁছে এবারও ডানের সুড়ঙ্গটায় ঢুকল ওরা। কারণ কিশোরের ধারণা এটা দিয়ে সৈকতে বেরোনো যাবে। প্রায় গা ঘেঁষাঘেষি করে এগোল সরু সুড়ঙ্গ ধরে। ব্যাটারি ফুরিয়ে যাবার ভয়ে একনাগাড়ে জ্বেলে না রেখে মাঝে মাঝে টর্চ জ্বেলে পথ দেখে নিচ্ছে মুসা আর কিশোর।

পার হয়ে এল দরজাটা।

কিছুদূর এগোনোর পর আবার ভাগ হয়ে গেল সুড়ঙ্গ।

ডানেরটা দেখিয়ে বলল কোরি, এটাতেই ঢুকি, কি বলো?

সেটাতে ঢুকল ওরা। কিছুদূর এগোনোর পর মনে হলো অনেক বড় বাক নিয়েছে,সুড়ঙ্গটা। ঘুরে এগোচ্ছে। ছাত থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি ঝরে পড়ছে কংক্রীটের মেঝেতে। অসংখ্য মাকড়সার জাল। হাতে, মুখে, মাথায় জড়িয়ে যাচ্ছে।

চলেছে তো চলেছেই। পথ আর ফুরায় না। রবিন বলল, এ কোথায় চলেছি? বেরোনোর পথ পাওয়া যাবে তো?

কোথাও না কোথাও পথ একটা নিশ্চয় আছে, দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল কিশোর। কারণ সুড়ঙ্গগুলো মানুষের তৈরি।

আই, কোরি বলল, পথ ভুল করে একই সুড়ঙ্গ দিয়ে ঘুরে মরছি না তো আমরা? বার বার একই জায়গায় ঢুকছি না তো?

পথ হারিয়েছি বলতে চাও? শঙ্কিত স্বরে বলল মুসা।

কিংবা এমনও হতে পারে ফাঁদ পেতেছিল কেউ আমাদের জন্যে। সেই ফাঁদে ধরা দিয়েছি আমরা। সুড়ঙ্গগুলো সব একই রকম লাগছে দেখতে। কোনদিনই আর এখান থেকে বেরোতে পারব না আমরা।

.

১০.

পারতেই হবে; দৃঢ়কণ্ঠে বলল কিশোর। বেরোনোর পথ না পাওয়া পর্যন্ত এগিয়েই যেতে হবে আমাদের। নানা রকম প্রশ্ন মনে–কে বন্ধ করল দরজাটা? কেন করল? কি লাভ তার? কিন্তু প্রশ্নগুলো নিয়ে ভাবার সময় নেই। এখন।

একটা মোড় ঘুরে অন্যপাশে আসার পর দেখা গেল ক্রমশ খাড়া হয়ে ওপরে উঠে গেছে সুড়ঙ্গ। কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে এটা? বেরোনোর পথ সত্যি পাওয়া যাবে তো? সন্দেহ দেখা দিল কিশোরের। শুধু শুধু ঘুরে মরছে না তো?

আতঙ্ক এসে চেপে ধরতে শুরু করল। বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করছে। হৃৎপিণ্ডটা।

দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেছে নিশ্চয়, টর্চের আলো ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখে বলল মুসা। আলো কমে যাওয়ায় চারপাশে ছায়া বাড়ছে এখন। উলফ আমাদের খোঁজাখুঁজি করবে।

কি জানি! অনিশ্চিত শোনাল রবিনের কণ্ঠ।

তোমার কি মনে হয় সে-ই দরজাটা আটকে দিয়েছে? বুকের ওপর দুই হাত আড়াআড়ি চেপে ধরেছে কোরি। ভেজা বাতাসে ঠাণ্ডা লাগছে।

অসম্ভব কি?

সামনে কমে আসছে অন্ধকার। একটা মোড় ঘুরতেই আলো দেখা গেল। আলোর দুটো ঝিলমিলে বর্শা তেরছা হয়ে মেঝেতে এসে পড়েছে। দেখেই দৌড় দিল মুসা। পেছনে ছুটল অন্যরা।

ছোট একটা দরজা। তার ফাঁক দিয়ে আলো আসছে। ঠেলে খুলতে দেরি হলো না। হুড়মুড় করে বাইরে বেরিয়ে এল সবাই। অন্ধকার থেকে উজ্জ্বল সূর্যালোকে এসে চোখই মেলতে পারল না প্রথমে।

কিশোরের অনুমান ঠিক। সৈকতে বেরিয়েছে ওরা। উঁচু একটা ঢিবির ঢালে এমন জায়গায় এমন ভাবে রয়েছে সুড়ঙ্গমুখটা, সাগর থেকে দেখা যাবে না। নিচে সৈকতে দাঁড়িয়েও নয়। দেখতে হলে ঢাল বেয়ে উঠে আসতে হবে।

তাজা বাতাস কেমন লাগছে? হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

রোদ যে এত চমৎকার বুঝতে পারিনি কোনদিন, আকাশের দিকে মুখ তুলে বলল রবিন।

এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রোদ আর বাতাস খেলে পেট ভরবে না, তাগাদা দিল মুসা, হোটেলে যাওয়া দরকার।

হাসাহাসি করতে করতে ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করল ওরা। বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়ে মুখে যেন খই ফুটছে। উঠে এল হোটেলের পেছনের নির্জন। আঙিনায়। সুইমিং পুলের পাশ কাটাল। কাচের দরজা ঠেলে পা রাখল ঘরের ভেতর।

ডাইনিং রূমে ঢুকেই থমকে দাঁড়াল কিশোর। তাকিয়ে রয়েছে মঞ্চটার দিকে। যেখানে ছিল ওটা সেখানে নেই। ঠেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সুড়ঙ্গে ঢোকার দরজার কাছে।

কেন খোলা যায়নি দরজাটা বুঝতে অসুবিধে হলো না কারও। মঞ্চটা দিয়ে ইচ্ছে করেই আটকে দেয়া হয়েছে যাতে সুড়ঙ্গের ভেতর থেকে শত ঠেলাঠেলিতেও না খোলে।

বোঝা গেল না কে করেছে এই অকাজটা।

*

বিকেলটা সৈকতে কাটিয়ে উত্তেজনা দূর করার চেষ্টা করল ওরা। পারল না। থেকে থেকে মনে আসছে কেউ একজন ইচ্ছে করে ওদেরকে সুড়ঙ্গে আটকে মারতে চেয়েছিল। কে লোকটা? উলফ? মিলার?

মিস্টার রোজারকে কথাটা জানানো দরকার, কিশোর বলল। সবাই একমত হলো ওর সঙ্গে।

কিন্তু ডিনারের সময় পাওয়া গেল না ব্যারনকে। খেতে এলেন না তিনি। চামচ দিয়ে এক টুকরো মাংস নিয়ে সবে মুখে দিয়েছে কিশোর, এই সময় রাইফেলে ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঘরে ঢুকলেন মিলার। রাগে মুখ। লাল। এলোমেলো চুল। সেই সাফারি জ্যাকেটটাই পরে আছেন এখনও। বুকের কাছে ভোলা। নিচে হলদে স্পোর্টস শার্টের দুটো বোম নেই।

মিস্টার মিলার…এই যে, আমার বন্ধুরা:…সকালে দেখা হয়নি আপনার সঙ্গে, অস্বস্তি কাটানোর জন্যে কথা শুরু করতে গেল কিশোর।

এমন ভঙ্গিতে তাকালেন মিলার, যেন ওকেও চিনতে পারছেন না। মুসা, রবিন আর কোরির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল সে।

আনমনে ঘোৎ-ঘোৎ করলেন কেবল মিলার। হাত মেলালেন না। বিড়বিড় করে কি বললেন বোঝা গেল না। রাইফেলটা মেঝেতে শুইয়ে রেখে তার ভাই রোজারের চেয়ারটায় বসে খাবারের প্লেট টেনে নিলেন। হাপুস হুপুস করে খেতে শুরু করলেন নিতান্ত অভদ্রের মত।

সবাই হাঁ করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সুপ শেষ করে সালাদের বাটিটা টেনে নিলেন। চামচের পর চামচ মুখে পুরে আধ চিবান দিয়ে দিয়েই গিলে ফেলতে লাগলেন।

শেষে আর সহ্য করতে না পেরে ভয়ানক অস্বস্তি দূর করার জন্যে কথা শুরু করল কিশোর, আপনার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে? …তিনি খেতে আসবেন না?

কিশোরের দিকে তাকিয়ে থেকে মুখভর্তি খাবার চিবাতে থাকলেন মিলার। গিলে নিয়ে কোনমতে বললেন, না, রোজার এখানে নেই, বলেই আবার বড় এক চামচ সালাদ মুখে পুরলেন।

কোথাও গেছেন?

মাথা ঝাঁকিয়ে দায়সারা জবাব দিলেন মিলার। সশব্দে সালাদ চিবাতে লাগলেন।

অবাক লাগছে কিশোরের। এত বুনো কেন এই লোক? ভাইয়ের ঠিক উল্টো! দুই যমজ ভাইয়ের মধ্যে স্বভাবের এতটা পরিবর্তন কল্পনা করা যায় না।

কিশোরকে তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে অবশেষে ঘোৎ-ঘোৎ করে বললেন মিলার, রোজার গেছে শহরে। শোরটাউন। তারপর আরও কি যেন বললেন, এতই অস্পষ্ট, বোঝা গেল না কিছু।

আমার আন্টির খোঁজ নিতে গেলেন নাকি? জানতে চাইল কোরি।

ভাল একটা চোখের দৃষ্টি কোরির ওপর স্থির করে মিলার বললেন, আন্টি? হ্যাঁ, তোমার আন্টি।

আবার খাওয়ায় মন দিলেন তিনি। সালাদ শেষ করে আস্ত একটা মুরগীর রোস্ট আর আলুভাজার বাটিটা টেনে নিয়ে খেতে শুরু করলেন। কারও জন্যে একটুও অবশিষ্ট না রেখে শেষ করে ফেললেন পুরোটাই।

তার এই কাণ্ড দেখে তাজ্জব হয়ে গেল সবাই।

কিন্তু কারও পরোয়া করলেন না তিনি। কোন রকম ভদ্রতার ধার ধারলেন না। খাওয়া শেষ করে জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে কাত হয়ে তুলে, নিলেন রাইফেলটা। চেয়ার থেকে উঠে সেটাতে ভর দিয়ে চলে গেলেন ডাইনিং রুম থেকে।

হাঁপ ছেড়ে বাচল যেন সবাই।

এ তো রাক্ষস, বলে উঠল মুসা। এর সঙ্গে খেয়ে আমিও পারব না।

রোজার না বললেন বিষণ্ণতা রোগ আছে? কোরি বলল।

আছেই তো, কিশোর বলল, নইলে এমন আচরণ করে নাকি কেউ!

বিষণ্ণতা না ছাই! মুখ ঝামটা দিয়ে বলল কোরি। আস্ত এক উন্মাদ!

মিলারের সমালোচনা চলছে, এই সময় রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল উলফ। মুখটা আগের চেয়ে গোমড়া। বলল, কি, বলেছিলাম না এখানে থাকা নিরাপদ নয়? এখনও সময় আছে, পালিয়ে যাও।,

আর না পালালে? ভুরু নাচাল মুসা। ভূত ছাড়া আর কিছুকে ভয় পাই না আমি। সত্যি করে বলুন, ভূত আছে কিনা? আপনাদের ওই মিলার ভূতফুত না তো?

দেখো, আমার কথা না শুনে ভুল করছ তোমরা… দরজার দিকে তাকিয়ে থমকে গেল উলফ। বড় বড় হয়ে গেল চোখ।

ফিরে তাকাল কিশোর। রাইফেলে ভর দিয়ে ফিরে আসছেন মিলার। উলফের দিকে তাকিয়ে গর্জে উঠলেন, থামলে কেন? চালিয়ে যাও তোমার বক্তৃতা।

কুঁকড়ে গেল উলফ। জ্যাকেটের মধ্যে গুটিয়ে ফেলতে চাইল যেন শরীরটা। না, স্যার, আমি তো কিছু বলছি না…

জ্বলন্ত এক চোখ মেলে উলফের দিকে তাকিয়ে রইলেন মিলার। বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতে পারল না উলফ। চোখ নামাতে বাধ্য হলো।

বরফের মত ঠাণ্ডা গলায় মিলার বললেন, তোমার ডিউটি রান্নাঘরে, সেখানেই যাও।

যাচ্ছি, স্যার! ভীত ইঁদুরের মত রান্নাঘরের দিকে ছুটে চলে গেল উলফ। পালিয়ে বাচল যেন।

সন্তুষ্টির হাসি ফুটল মিলারের ঠোঁটে। উলফকে ভয় দেখাতে পেরে খুশি হয়েছেন। এই প্রথম তার মুখে হাসি দেখল কিশোর। উলফ এত ভয় পায় কেন মিলারকে? রোজারকে পায় না। তার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথা বলে।

এমনকি অনেক সময় চাপাচাপিও করে। তাতে মনে হয় মনিব-ভূতের স্বাভাবিক সম্পর্কের চেয়ে কিছুটা বেশিই সম্পর্ক রোজারের সঙ্গে। অথচ তারই ভাই মিলারকে দেখলেই যেন গুটিয়ে যায় উলফ।

উলফকে তাড়িয়ে ছেলেমেয়েদের দিকে ঘুরলেন মিলার। পলকে মিলিয়ে গেল হাসিটা। কুঁচকে গেল ভুরু। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত একভাবে তাকিয়ে থেকে রাইফেলে ভর দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন। পা টানতে টানতে বেরিয়ে গেলেন আবার ঘর থেকে।

*

খাওয়ার পর ডাইনিং রূমের বড় জানালাটার ধারে বসে কথা বলছে ওরা। ঘণ্টাখানেক পর ঘরে ঢুকলেন রোজার। সেই সাদা পোশাক পরনে। হেসে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছ তোমরা? জবাবের অপেক্ষা না করেই বললেন, শোরটাউনে গিয়েছিলাম।

হ্যাঁ, মিস্টার মিলার বলেছেন আমাদের, কোরি বলল। আন্টি কেমন। আছে?

ভাল। ফোন করেছিলেন। মিলার ধরেছিল। আমরা হোটেল বন্ধ করে দিয়েছি জেনে আর আসেননি। দুদিন ভালমত বিশ্রাম নেয়ার জন্যে থেকে গেছেন। তোমরা কাজ করছ এখানে, সেটাও জানানো হয়েছে তাঁকে। সবই করেছে মিলার, কেবল তোমাদের বলতে ভুলে গেছে, খবরটা। দুশ্চিন্তায় রেখে দিয়েছে। আজকাল আর কোন কথা মনে থাকে না ওর।

যাক, আন্টি তাহলে ভালই আছে। একটা দুশ্চিন্তা গেল। কিন্তু আমি যে ফোন করলাম, ধরল না কেন? বাড়িতে কেউ ছিল না নাকি?

কি জানি, জিজ্ঞেস করিনি। ভায়োলা চলে যায় হাসপাতালে। তোমার আন্টিও বোধহয় সাগরের ধারে হাওয়া খেতে বেরিয়েছিল, তুমি যখন ফোন করেছিলে ওই সময়।

তাই হবে। খবরটা এনে দেয়ার জন্যে অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

ও ঠিক আছে। কোন খবর না পেয়ে দুশ্চিন্তা আমারও হচ্ছিল। জোয়ালিন বললেন, কাল-পরশু নাগাদ চলে আসবেন এখানে।…তো ঠিক আছে, তোমরা গল্প করো। আমি যাই।

১১.

পরদিন সকালে নাস্তা খেতে এল না কোরি। অস্বাভাবিক লাগল না সেটা তিন গোয়েন্দার কাছে। এর আগেও এমন করেছে সে। দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছে। কাজ করার চেয়ে বিছানায় পড়ে থাকাটা ওর কাছে বেশি পছন্দের। ওকে নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাল না কেউ।

ডিমভাজায় চামচ বসিয়ে দিয়ে বিশাল জানালাটা দিয়ে সাগরের দিকে তাকাল মুসা। সাঁতার কাটার দিন নয় আজ। আকাশের অবস্থা ভাল না।

কিশোর আর রবিনও তাকাল। ভারী মেঘে ধূসর হয়ে আছে আকাশ। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। জোরাল বাতাস বালির ঢিবিতে জন্মানো ঘাসের মাথাগুলোকে চেপে নুইয়ে দিচ্ছে।

না বেরোতে পারলে নেই, কিশোর বলল। ঘষাঘষির কাজ যতটা পারি সেরে ফেলব।

আজকেও যদি আবার আরেকটা সুড়ঙ্গমুখ বেরিয়ে পড়ে? রবিনের প্রশ্ন।

অবাক হব না। পুরানো বাড়ি। সুড়ঙ্গ, গুপ্তকুঠুরি থাকতেই পারে।

সারাটা সকাল একনাগাড়ে কাজ করল ওরা। দেড়টায় লাঞ্চ খাওয়ার আগে আর থামল না।

রান্নাঘরের বড় সিংকে হাত ধুতে ধুতে কিশোর বলল, কোরি কি এখনও উঠল না? এতক্ষণ তো ঘুমানোর কথা নয়।

ওর ঘরে গিয়ে দেখা দরকার, মুসা বলল।

কি জানি, রোজার কিংবা মিলারের সঙ্গে গিয়ে হয়তো আড্ডা দিচ্ছে, বলল রবিন। ওদের কাউকেও তো দেখলাম না।

তা ঠিক। নৌকা নিয়ে ব্যারনের সঙ্গে শোরটাউনেও চলে যেতে পারে, আন্টির সঙ্গে দেখা করার জন্যে।

ও তা কেন যাবে? প্রশ্ন তুলল কিশোর। আন্টি যে ভাল আছেন, শুনলই।

কেন, তোমার কিছু সন্দেহ হচ্ছে নাকি?

বুঝতে পারছি না, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। তবে ব্যাপারটা স্বাভাবিক লাগছে না আমার কাছে।

নাস্তার পর উলফেরও আর দেখা মেলেনি। ওদের লাঞ্চের জন্যে রেফ্রিজারেটরে ঠাণ্ডা স্যান্ডউইচ আর ড্রিংকস রেখে গেছে। ডাইনিং রূমের ধূসর আলোয় দ্রুত খাওয়া শেষ করল ওরা। বাইরে মেঘের ঘনঘটা। কালো আকাশ। সকাল থেকে সেই যে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, থামছে না আর। কমছে, বাড়ছে, কমছে, বাড়ছে–চলছে এভাবেই।

খাওয়ার পর আবার কাজে লাগল ওরা। দেয়াল থেকে আরও অনেক কাগজ ছিঁড়ল। কিন্তু আর কোন গুপ্তদরজা বেরোল না। আগের দিনের দরজাটা তৈমনি লাগানো রয়েছে। ভোলার কথা একটিবারের জন্যে মনেও করল না কেউ। অন্ধকার সুড়ঙ্গে উঁকি দেয়ার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই আর।

সাড়ে চারটা নাগাদ যন্ত্রপাতি গুছিয়ে রেখে গোসল করতে চলল। নিজের ঘরে ঢোকার আগে কোরির দরজায় থামল কিশোর। টোকা দিল।

সাড়া নেই।

থাবা দিয়ে জোরে জোরে কোরির নাম ধরে ডাকল।

জবাব মিলল না।

নব ঘুরিয়ে ঠেলা দিতেই খুলে গেল পাল্লা। ভেতরে আলো জ্বলছে। অগোছাল বিছানা। কিছু পোশাক এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে চেয়ারের হাতলে, কিছু বিছানায়। কিন্তু কোরি নেই।

কোরি? চিৎকার করে ডাকল কিশোর। বাথরূমে আছ নাকি?

কোন জবাব পাওয়া গেল না।

*

ডাইনিং রুমে বসে ডিনার খাচ্ছে ওরা, এই সময় সামনের দরজা দিয়ে রোজারকে ঢুকতে দেখল। ওদের দিকে তাকালেন না তিনি। দ্রুত হেঁটে চলে। যাচ্ছেন।

মিস্টার মেলবয়েস? ডাক দিল কিশোর। কোরিকে দেখেছেন কিনা জিজ্ঞেস করবে।

কিন্তু শুনতেই যেন পাননি ব্যারন। সোজা চলে গেলেন নিজের ঘরের দিকে।

কোরির জন্যে কিন্তু রীতিমত দুশ্চিন্তা হচ্ছে এখন আমার, কিশোর বলল। দুই সহকারীর দিকে তাকিয়ে।

দুশ্চিন্তাটা বাড়িয়ে দিতেই যেন রান্নাঘর থেকে খাবারের ট্রে হাতে ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল উলফ, মেয়েটা কোথায়?

ওকে দেখেননি?

মাথা নাড়ল উলফ।

আমরা তো ভাবলাম মিস্টার রোজারের সঙ্গে নৌকায় করে শোরটাউনে। চলে গেছে।

না, সাহেবের সঙ্গে যেতে দেখিনি ওকে। সাহেব তো গেলেন ওয়ার্কারদের সঙ্গে কথা বলে জেনে আসতে কবে নাগাদ হোটেলের কাজ করতে আসছে ওরা।

ভয় পেয়ে গেল কিশোর। রান্নাঘরে যাচ্ছে উলফ। তার দিকে তাকিয়ে রইল। আচমকা ফিরে তাকাল মুসা আর রবিনের দিকে। আর বসে থাকা যায় না। কোরিকে খুঁজতে যাব আমি। তোমরা আমার সঙ্গে যাবে, না ভাগাভাগি হয়ে খুঁজবে?

একসঙ্গে থাকাই ভাল, মুসা বলল। ওর ঘর থেকে শুরু করা যাক। নাকি?

মাথা নাড়তে নাড়তে আনমনে নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল রবিন, কোথায় আছে ও?

সত্যি সত্যি ভূতের খপ্পরে পড়েনি তো? ভয়ে ভয়ে বলল মুসা।

ভূত না কচু, কিশোর বলল। আঙুল তুলে মঞ্চটা দেখিয়ে বলল, ওটাও কি ভূতে নিয়ে রেখে এসেছিল দরজার কাছে?

কিশোর ঠিকই বলেছে। মুসার দিকে তাকাল রবিন। কোন মানুষের কাজ। হয় উলফ, নয়তো মিলার।

উঠে দাঁড়াল কিশোর। আর দেরি করা ঠিক হবে না।

কোরির ঘর থেকে খোঁজা শুরু করল ওরা। কোন সুত্র নেই। জিনিসপত্র, কাপড়-চোপড় দেখে বোঝা গেল না কোনটা নিখোঁজ হয়েছে কিনা। রাতে বিছানায় ঘুমিয়েছে কিনা তা-ও বোঝার উপায় নেই।

বিছানার অন্য পাশে গিয়েই চিৎকার করে ডাকল রবিন, এই, দেখে। যাও!

তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল কিশোর আর মুসা। বিছানার পায়ের কাছে মেঝেতে চক দিয়ে আঁকা বিচিত্র কিছু নকশা আর চিহ্ন।

পেন্টাকল এঁকেছে! অবাক হয়ে বলল কিশোর। কাছেই পড়ে থাকতে দেখল একটা পুরানো বই। হাতে নিয়ে দেখল। জনৈক ভূত-গবেষকের লেখা। কি করে ভূত তাড়াতে হয়, কি করে ডেকে আনতে হয়, লিখে রেখেছে। কোথাও কোথাও নকশা এঁকে বুঝিয়ে দিয়েছে।

ভুরু কুঁচকে মুসা বলল, খাইছে, ভূতকে ডেকে এনেছিল নাকি কোরি! শেষে ভুতেই গাপ করে দিল!

গম্ভীর হয়ে আছে কিশোর। জবাব দিল না।

কোরির ঘর, বাথরূম তন্নতন্ন করে খুঁজেও সন্দেহজনক আর কিছু পাওয়া গেল না।

ওল্ড উইঙে হলওয়ের দুই পাশে যত ঘর আছে, সবগুলোতে খুঁজে দেখা হলো। লবি আর রেকর্ড রূমেও পাওয়া গেল না কোরিকে। অফিস রূমে ঢুকল। অন্ধকার। নীরব। টর্চ জ্বেলে খুঁজে দেখল। নেই সে।

হোটেলের পেছনের আঙিনায় বেরিয়ে এল ওরা। বৃষ্টি থেমেছে। তবে আকাশ মেঘে ভারী হয়ে রয়েছে এখনও বাতাস গরম, ভেজা ভেজা।

সুইমিং পুলের কাছে এসে দেখা গেল বৃষ্টির পানিতে কানায় কানায় ভরে গেছে। কোরির নাম ধরে চিৎকার করে ডাকল কিশোর। জবাব পাওয়া গেল না। আরও কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর বলল, রোজার মেলবয়েসকে জানাতে। হবে।

রবিন বলল, পুলিশকে জানানো দরকার।

পুলিশ পাবে কোথায়? মুসা বলল, তার জন্যে শোরটাউনে যেতে হবে। কিংবা ফোন করতে হবে।

পাইরেট আইল্যান্ডেও পুলিশ আছে।

গোস্ট আইল্যান্ডের পাশের দ্বীপ পাইরেট আইল্যান্ড। গোস্ট আইল্যান্ডের চেয়ে বড়। মোটরবোটে যেতে দশ মিনিট লাগে।

ওখানে পুলিশ আছে জানলে কি করে? জিজ্ঞেস করল মুসা।

উলফের কাছে।

দ্রুতপায়ে হোটেলে ফিরে চলল ওরা।

*

ঘুমিয়ে পড়েননি তো? হোটেলে ঢুকে বলল রবিন।

হাতঘড়ি দেখল কিশোর। মাথা নাড়ল। মনে হয় না। মোটে তো সাড়ে আটটা।

ব্যারনের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল ওরা। টোকা দিতে যাবে কিশোর, এই সময় ভেতর থেকে ভেসে এল তীক্ষ্ণ চিত্তার।

পরক্ষণেই আরেকটা চিৎকার শোনা গেল। অন্য কণ্ঠ।

তারপরেই শুরু হলো তর্কাতর্কি। রেগে রেগে কথা বলছে দুজন মানুষ। মিলারকে ধমক মারছেন রোজার। থেকে থেকে ঘোৎ-ঘোৎ করে উঠছেন। মিলার। চাপা গলায় জবাব দিচ্ছেন দুএকটা

দুজনকে থামানোর চেষ্টা করল একজন মহিলা।

কিশোরের হাত খামচে ধরল মুসা। ফিসফিস করে বলল, শুনলে?

পাগল! আস্ত পাগল! মহিলা বলল।

কে পাগল? খেঁকিয়ে উঠলেন মিলার।

তোমরা দুজনেই। বদ্ধ উন্মাদ! দুজনকেই তালা দিয়ে রাখা দরকার।

দেখো কথাবার্তা একটু সাবধানে…

অ্যাই, থামো! ধমক দিয়ে ভাইকে থামিয়ে দিলেন রোজার।

দেখো, ওর পক্ষ নেবে না বলে দিলাম। ও তোমার সাহায্য চায় না। তুমি একটা গাধা। একটা রামছাগল।

মুখ খারাপ করছ কেন? মহিলা বলল।

সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠলেন রোজার, আরে কি করছ! আরে!

মুসার দিকে তাকাল কিশোর। ভেতরে মারামারি বাধতে যাচ্ছে মনে হচ্ছে।

যত কথাই বলো তোমরা, দুই ভাইয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমান তেজে চেঁচিয়ে উঠল মহিলা, আমি তোমাদের পার্টিতে থাকছি না।

না থেকে যাবে কোথায়? রাগে খসখসে হয়ে গেছে মিলারের কণ্ঠস্বর। যাওয়ার উপায় নেই তোমার।

রোজার বললেন মহিলাকে, কি করব বলো? কত বোঝানো বোঝালাম ওকে–পায়ে ধরা বাকি রেখেছি শুধু। শুনল না। মিলার, শোনো…

না, কোন কথা শুনব না আমি! ষাড়ের মত চিৎকার করে উঠলেন মিলার। তোমাদের সাবধান করে দিচ্ছি….

প্লীজ, মিলার, ভীতকণ্ঠে বলল মহিলা, নামাও ওটা! নামাও।

আরে করছ কি? রোজারও আঁতকে গেছেন কোন কারণে।

না না, মিলার! প্লীজ! রীতিমত আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে এখন মহিলা।

দোহাই তোমার, মিলার, ভয় পেয়ে গেছেন রোজারও, মাপ চাই আমি। তোমার কাছে! তুমি না আমার ভাই…

গুলির প্রচণ্ড শব্দ হলো ঘরের মধ্যে।

তারপর সব চুপ।

.

১২.

দরজার দিকে পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে শুনে হলওয়ে দিয়ে দৌড় মারল কিশোর। দেখাদেখি রবিন আর মুসাও ছুটল। তাড়াতাড়ি লুকিয়ে পড়ল একটা অন্ধকার কোণে।

ঝটকা দিয়ে খুলে গেল রোজারের ঘরের দরজা। রাইফেল হাতে বেরিয়ে এলেন মিলার। পরনে সেই সাফারি জ্যাকেট। উদভ্রান্তের মত ছুটে গেলেন একদিকে। একটামাত্র চোখ দিয়ে মনে হয় ঠিকমত দেখতে পাননি, ধাক্কা খেলেন গিয়ে উল্টোদিকের দেয়ালে। ঘুরে দাঁড়াতেই দেখে ফেললেন তিন গোয়েন্দাকে। বিশ্বাস করতে পারলেন না যেন নিজের চোখকে। ওদের এখানে আশা করেননি।

অ্যাক্সিডেন্ট! অস্বাভাবিক উঁচু গলায় ওদের বললেন তিনি। আমার ভাই রোজারের একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।

রাইফেলটা ঘোরালেন চারপাশে। ভঙ্গি দেখে মনে হলো যেন যে কোন দিক থেকে শত্রু ছুটে আসার ভয় পাচ্ছেন। সেই অদৃশ্য শত্রুকে ঠেকানোর জন্যে তৈরি হয়েছেন।

সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শোনা গেল। ওপরে উঠে এল উলফ। জিজ্ঞেস করল, মিস্টার মিলার? কি হয়েছে?

টলতে শুরু করলেন মিলার। একপাশের দেয়ালে গিয়ে পড়লেন। সামলে নিলেন কোনমতে। অ্যাক্সিডেন্ট! একটা সাংঘাতিক অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেছে রোজারের!

ভুরু কুঁচকে গেল উলফের। নিচের চোয়াল ঝুলে পড়ল। অ্যাক্সিডেন্ট?

ডাক্তার ডাকুন, জলদি! চিৎকার করে বলল কিশোর। মিস্টার রোজারকে গুলি করেছেন উনি! এগিয়ে এসে রোজারের ঘরের দরজা খোলার জন্যে হাত বাড়াল সে।

খবরদার! গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন মিলার। যাও এখান থেকে। সরো!

এরকম হঠাৎ রেগে যাবেন মিলার, ভাবতে পারেনি কিশোর। ঢোক গিলে বলল, কিন্তু একটা মানুষ গুলি খেয়ে পড়ে আছে ভেতরে একজন মহিলাও আছেন…

তাতে তোমার কি? ভাগো এখান থেকে! দরজা জুড়ে দাঁড়ালেন মিলার। একচোখে কালো পট্টি। আরেক চোখে আগুন।

ডাক্তার ডাকতে বাধা দিচ্ছেন কেন? সামলে নিয়েছে কিশোর। মিলারের ধমকের পরোয়া না করে বলল, ভাইকে তো গুলি করলেন…

ডাক্তার ডেকে আর কোন লাভ নেই এখন।

মানে? লাল হয়ে গেছে উলফের মুখ।

দেরি হয়ে গেছে অনেক। রোজার মরে গেছে।

হাঁ করে মিলারের দিকে তাকিয়ে রইল উলফ। এগিয়ে গেল এক পা।

রাইফেল বাগিয়ে ধরলেন মিলার। প্রয়োজনে উলফকে গুলি করতেও দ্বিধা করবেন না।

উলফ বলল, অ্যাক্সিডেন্ট নয়, আপনি ভাল করেই জানেন…

না, জানি না, রাগত স্বরে বললেন মিলার, এটা অ্যাক্সিডেন্টই…

না, অ্যাক্সিডেন্ট নয়! মিস্টার রোজারকে গুলি করে মেরেছেন আপনি।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত চোখে চোখে তাকিয়ে রইল দুজনে। তারপর ঝটকা দিয়ে রাইফেল তুলে কাঁধে ঠেকালেন মিলার। উলফকে নিশানা করলেন।

আরে একি করছেন! পাগল হয়ে গেলেন নাকি? চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।

*

সরান ওটা! শান্তকণ্ঠে বলল উলফ।

লোকটার স্নায়ুর জোর দেখে অবাক হলো কিশোর। মাত্র তিন ফুট দূরে ওর বুকের দিকে তাকিয়ে আছে রাইফেলের নল। কিন্তু ভয় পাচ্ছে না।

মিস্টার মিলার, আবার বলল উলফ, সরান ওটা। আপনি জানেন, আমাকে গুলি করতে পারবেন না।

জবাব দিলেন না মিলার। আস্তে আস্তে নামালেন রাইফেলটা।

উলফ বলল, আসুন আমার সঙ্গে। ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করি? আগেও যেমন বহুবার করেছি। আমাদের মেহমানদের অহেতুক ভয় দেখাচ্ছেন আপনি। ওদের ঘুমোতে দিচ্ছেন না।

কিন্তু দেরি হয়ে গেছে তো অনেক… বিড়বিড় করলেন মিলার।

না, হয়নি। এখনও সময় আছে। আসুন।

দ্বিধা করলেন মিলার। রাইফেলটা লাঠির মত করে ধরে ভর দিলেন তাতে। আবার আমার সঙ্গে চালাকি করছ না তো?

না না, করছি না।

জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মিলার। মাথা কাত করলেন, ঠিক আছে। চলো।

তিন গোয়েন্দার দিকে ফিরল উলফ, এই, তোমরা ঘরে যাও। শুতে যাও। আর এখানে দাঁড়িয়ে থেকো না।

মিলারকে নিয়ে সিঁড়ির দিকে রওনা হয়ে গেল সে।

*

রোজারের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল কিশোর।

কোথায় যাচ্ছ? জিজ্ঞেস করল রবিন।

জবাব না দিয়ে রোজারের ঘরের দরজা খুলে ফেলল কিশোর। ঢুকে পড়ল ভেতরে। বারুদের গন্ধ এসে ধাক্কা মারল নাকে। বড় একটা সিটিং রম। ঝকঝকে ক্রোমের আসবাবপত্র, সাদা চামড়ায় মোড়া গদি। কাচের কফি টেবিলে রাখা রূপার একটা কেটলি আর কয়েকটা চীনামাটির কাপ পিরিচ। কাউচের পেছনে সাদা একটা কাঠের টেবিল।

পেছনের দেয়ালে দুটো দরজা। অন্য ঘরে যাওয়ার জন্যে নিশ্চয়। রবিন। বলল, রোজার কোথায়?

ঘরে রোজারও নেই, মহিলাও নেই। মেঝেতে রক্তও নেই।

ভেতরের ঘরে আছে হয়তো, মুসা বলল।

কিন্তু চিৎকার তো এঘরেই শুনলাম।

গুলি খাওয়ার পর হামাগুড়ি দিয়ে ভেতরের ঘরে চলে গেছেন…

মেঝেতে সাদা কার্পেট পাতা। একফোঁটা রক্তের দাগ নেই।

এগিয়ে গিয়ে বায়ের দরজাটা খুলে ফেলল কিশোর। ভেতরে উঁকি দিল। ছোট একটা বেডরূম। টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। এলোমেলো হয়ে আছে চাদর, বালিশ সব। খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিন স্তূপ করে রাখা হয়েছে একপাশের দেয়াল ঘেষে। আরেকপাশে একটা বুকসেলফ। তাকের বই সব এলোমেলো। কুচকানো, ময়লা কয়েকটা শার্ট-প্যান্ট অযত্নে ফেলে রাখা হয়েছে মেঝেতে।

এটা নিশ্চয় মিলারের ঘর, অনুমান করল সে।

কই, রোজার তো এখানে নেই! কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে বলল বিস্মিত মুসা।

ঘুরে দাঁড়াল কিশোর। তাড়াতাড়ি গিয়ে ডানের দরজাটা খুলল। এটাও বেডরূম। আগেরটার চেয়ে বড়। এটা অন্যটার একেবারে বিপরীত। জিনিসপত্র সব নিখুঁতভাবে গোছানো। ঝকঝকে পরিষ্কার।

এখানেও নেই কেউ! এতক্ষণে কথা বলল কিশোর। মিস্টার রোজার নেই। মহিলাও নেই।

অসম্ভব! গেল কোথায়? বিড়বিড় করল মুসা। ভয় ফুটুল চোখে। এই, ভূতের কারবার না তো! একটা লাশ এভাবে গায়েব হয়ে যেতে পারে না। সেই সঙ্গে একজন জ্যান্ত মানুষ…

একজন নয়, মনে করিয়ে দিল রবিন, দুজন। কোরিকেও খুঁজে পাচ্ছি না আমরা।

.

১৩.

টোয়াইলাইট জোনে প্রবেশ করলাম নাকি আমরা? ধপ করে বিছানায় মুসার পাশে বসে পড়ল রবিন।

কথা বোলো না, আমাকে ভাবতে দাও, ওদের সামনে পায়চারি করতে করতে বলল কিশোর। মাথা গরম হয়ে গেছে আমাদের। ঠিকমত চিন্তা করতে পারছি না। সেজন্যেই উল্টোপাল্টা মনে হচ্ছে সব।

কিশোর, প্লীজ, এভাবে পায়চারি কোরো না। মাথাটা আরও গরম হয়ে যাচ্ছে আমার।

বোঝার চেষ্টা করছি আমি, আনমনে বলল কিশোর। রবিনের কথা যেন শুনতেই পায়নি। পায়চারি থামাল না। বাইরে দাঁড়িয়ে ঘরের মধ্যে তিনজন মানুষকে কথা বলতে শুনেছি আমরা। তর্কাতর্কি করছিল। তারপর গুলির শব্দ। এবং তারপর ঘর থেকে ছুটে বেরোলেন মিলার।

লাশটাকে টেনেহিঁচড়ে কোথাও সরিয়ে ফেলেছেন মিলার, অস্বস্তিতে বিছানায় নড়েচড়ে বসল রবিন। আশেপাশেই কোথাও আছে।

থমকে দাঁড়াল কিশোর। দুই সহকারীর দিকে তাকিয়ে বলল, তাহলে আরও ভালমত খোঁজা উচিত আমাদের। বিছানার নিচে। আলমারির ভেতর।

কিন্তু যদি মিলার চলে আসেন? দরজার দিকে তাকিয়ে বলল রবিন। রাইফেলটা এখনও তার কাছে। আমাদের ঘরে দেখলে রেগে গিয়ে গুলি করে বসতে পারেন। একটা খুন ইতিমধ্যেই করে ফেলেছেন…

জলদি সারতে হবে আমাদের। তিনজন তিন ঘরে খুজব, তাতে তাড়াতাড়ি হবে। তোমরা অন্য ঘরে যাও, আমি এখানে খুঁজি। এটা নিশ্চয় মিলারের ঘর।

কিন্তু কিশোর

যাও, দেরি কোরো না! বিছানার নিচে উঁকি দেয়ার জন্যে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল কিশোর

বেশ, অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠে দাঁড়াল রবিন। মুসা, এসো।

ওরা দুজন বেরিয়ে আসার দুই মিনিটের মাথায় দরজায় এসে দাঁড়াল কিশোর। উত্তেজিত স্বরে বলল, দেখে যাও! কি পেয়েছি।

চমকে গেল মুসা। লাশটা নাকি?

জবাব না দিয়ে দ্রুত আবার মিলারের ঘরে ফিরে এল কিশোর। পেছন পেছন এসে ঢুকল অন্য দুজন।

এই দেখো, বড় একটা ফটো অ্যালবাম তুলে দেখাল কিশোর।

দেখার জন্যে কাছে এসে দাঁড়াল মুসা আর রবিন।

দেখতে দেখতে রবিন বলল, পুরানো ছবি। যে রকম কালো হয়ে গেছে, মনে হয় একশো বছরের পুরানো।

না, এত পুরানো নয়, একটা ছবিতে আঙুল রাখল কিশোর, দেখো তো এটা চিনতে পারো কিনা?

নাইট শ্যাডোর সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা বড় সেডান গাড়ি। ফিফটির। মডেল। সুন্দর রোদ ঝলমলে দিন। অলঙ্করণ করা দামী গাড়িটায় ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুজন মানুষ–একজন পুরুষ, আরেকজন মহিলা।

এ তো রোজার মেলবয়েস, রবিন বলল। চুল এত কালো, চেনাই যায় না।

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল কিশোর। সঙ্গের মহিলাটিকে চিনতে পারো নাকি দেখো তো?

খাইছে! চিনে ফেলল মুসা। এ তো কোরির আন্টি! আন্ট জোয়ালিন।

হ্যাঁ। অবাক লাগছে না? তারমানে জোয়ান বয়েসে খাতির ছি দুজনের…

হলওয়েতে শব্দ হলো। হাত কেঁপে গেল কিশোরের। অ্যালবামটা মেঝেতে পড়ে গেল। তোলার চেষ্টা করল না। দরজার দিকে তাকিয়ে রইল।

কেউ এল না।

বেরোনো দরকার, ফিসফিস করে বলল রবিন। মিলার কখন ঢুকে পড়েন…

হ্যাঁ, ওর সঙ্গে একমত হলো মুসা। অ্যালবামের ছবি দেখে কোন। লাভ হবে না আমাদের। বরং তাড়াতাড়ি গিয়ে পুলিশকে খবর দেয়া দরকার। ওরা এসে খোঁজাখুঁজি যা করার করুক।

নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। এখানে কোথাও একটা ট্র্যাপোর আছে নিশ্চয়। রোজারকে গুলি করার পর লাশটা ওই পথে সরিয়ে ফেলেছেন হয়তো মিলার। মহিলাও ওখান দিয়েই পালিয়েছে।

কিন্তু রক্ত কই? প্রশ্ন তুলল রবিন। এক ফোঁটা রক্তের দাগও তো নেই কোথাও।

এটাই গোলমাল করে দিচ্ছে সব। কিছু বুঝতে পারছি না!

কিশোর, আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক না। এসব কথা বাইরে গিয়েও আলোচনা করতে পারব আমরা। মিলার ঢুকে পড়লে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

দাঁড়াও, আরেকটু দেখে নিই।

খুঁজতে শুরু করল কিশোর। দেয়ালে থাবা দিয়ে দেখল ফাপা আছে। কিনা। টেবিল ল্যাম্প উল্টে দেখল। ড্রেসার-ড্রয়ারের নব ঘুরিয়ে দেখল।

কি করছ তুমি? জানতে চাইল রবিন।

দেখছি গুপ্তদরজা খোলার কোন গোপন সুইচ আছে কিনা, দেয়ালে একটা লাইট সুইচ দেখে সেটা টিপে দিল কিশোর। আরি দেখো দেখো!

বুকসেলফটা রিভলভিং ডোরের মত ঘুরতে আরম্ভ করেছে। অর্ধেক ঘুরে থেমে গেল। বইয়ের তাক চলে গেল অন্যপাশে, এপাশে চলে এল একটা ডেস্ক।

আবার সুইচ টিপল কিশোর। ডেস্কটা ঘুরে আবার বুক শেলফটা ঘুরে এপাশে আসতে শুরু করতেই সুইচ টিপে অফ করে দিল সে। মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেল ঘোরা। ফাঁক দিয়ে দেখা গেল অন্যপাশে আরেকটা ঘর।

ফাঁকটা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল কিশোর। ফিরে তাকিয়ে বন্ধুদের বলল, এটা স্টাডিরূম। দেখে যাও।

লাশটা আছে? উঁকি দিল রবিন। কিন্তু অন্ধকারের জন্যে কিছু দেখতে পেল না। টেবিলে পেপারওয়েট চাপা দেয়া একটা কাগজের দিকে চোখ পড়তে স্থির হয়ে গেল দৃষ্টি। হাত বাড়িয়ে তুলে নিল কাগজটা। একবার পড়েই হাত কাঁপতে শুরু করল। কিশোর।

কি?

জলদি এসো! কি লিখেছে দেখো!

এপাশে বেরিয়ে এল কিশোর। রবিনের গা ঘেঁষে এল মুসা।

জোরে জোরে পড়তে শুরু করল রবিন,

ডিয়ার জোয়ালিন,
মর্মান্তিক এই খবরটা তোমাকে জানাতে কি যে কষ্ট লাগছে আমার বলে। বোঝাতে পারব না। তোমার বোনঝি কোরি আর ওর তিন বন্ধু কিশোর, মুসা এবং রবিন হঠাৎ করে দ্বীপ থেকে রহস্যজনকভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। ওদের কি হয়েছে, কোথায় গেছে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

কি যে মানসিক যন্ত্রণা হচ্ছে আমার বলে বোঝাতে পারব না। পাইরেট আইল্যান্ডের পুলিশকে খবর দিয়েছি। ওরা এসে দ্বীপের প্রতিটি ইঞ্চি খুঁজে দেখেছে। কিছুই পায়নি। কোন সুত্র নেই। দিনেরাতে বহুবার ফোনে তোমার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। না পেরে শেষে এই চিঠি লিখে জানাতে বাধ্য হলাম।

ঘটনাটা অদ্ভুত। মাথামুণ্ড কিছু বুঝতে পারছি না। পুলিশ কোন আশা দিতে পারছে না। রহস্যময় এই ঘটনায় ওরাও পুরোপুরি বিমূঢ় হয়ে গেছে। ছেলেমেয়েগুলোর বাবা-মাকে যে কি জবাব দেব ভেবে ভয়ে পালাতে ইচ্ছে করছে আমার। তোমার মুখোমুখি হওয়ার সাহসও আমার নেই।

যাই হোক, ওদেরকে খুঁজে বের করার সাধ্যমত চেষ্টা আমি করছি। ওদের এই উধাও হওয়ার রহস্য ভেদ না করা পর্যন্ত আমি ক্ষান্ত হব না। সারাক্ষণ দোয়া করছি, ছেলেমেয়েগুলো সুস্থ অবস্থায় ফিরে আসুক। কিন্তু বুঝতে পারছি, সেটা ঘটার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। অতীতেও এধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে এই দ্বীপে। হারানো মানুষকে আর জ্যান্ত ফিরে পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে তাদের গলিত লাশ, কিংবা শুকনো কঙ্কাল। কি আর বলব, বলো? দ্বীপের এই বদনামের কথা তুমি তো সবই জানো।

মুখ তুলল রবিন। কাঁপা গলায় বলল, নিচে সই করেছেন মিলার মেলবয়েস! তারিখটা আজ থেকে দুদিন পরের!

.

১৪.

আমাদের খুন করার প্ল্যান করেছে সে! চোখ বড় বড় হয়ে গেছে মুসার।

কিশোরের দিকে তাকিয়ে বলল রবিন, দাঁড়িয়ে আছ কেন এখনও? চলো না পালাই!

পাগল! বদ্ধ উন্মাদ! রবিনের হাত থেকে কাগজটা নিয়ে নীরবে আরেকবার পড়ল কিশোর। বিশ্বাস হতে চাইছে না তার। রসিকতা করেনি তো?

কার সঙ্গে করবে? কেন?

আমাদের খুন করতে চায় কেন?

কি করে বলব? পাগলের তো কত রকম ইচ্ছেই থাকে। অকারণেও অনেক কিছু করে। লোকটা একটা স্যাডিস্ট।

হু! নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল কিশোর, উলফও কি এতে জড়িত আছে নাকি? নইলে রোজারকে খুন করা হয়েছে শুনেও পুলিশে খবর দেয়নি কেন?

দেয়নি, কি করে বুঝলে? জিজ্ঞেস করল মুসা।

তাহলে এতক্ষণে পুলিশ চলে আসার কথা। পাইরেট আইল্যান্ড থেকে আসতে ওদের দশ-বারো মিনিটের বেশি লাগবে না।

আমরাও তো খবরটা দিতে পারি।

কি ভাবে? রবিনের প্রশ্ন। ফোন করতে গেলেই দেখে ফেলবে উলফ। ওদিকেই রয়েছে সে আর মিলার।

তাহলে নৌকা নিয়ে নিজেরাই চলে যেতে পারি পাইরেট আইল্যান্ডে। ঘাটে তো নৌকা বাধাই আছে।

আমাদের ব্যাগট্যাগ সব, সঙ্গে নিয়ে চলে যাব। একবার বেরোতে পারলে এখানে ফিরে আসার আর কোন মানে হয় না।

কিন্তু কোরির কি হবে? চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। ওকে এখানে ফেলে যেতে পারি না। মিলার ওকে দেখলেই খুন করবেন।

কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে ওকে? রবিন বলল, তাড়াতাড়ি গিয়ে পুলিশ নিয়ে এলে ওরাই ওকে খুঁজে বের করবে। উলফ আর মিলার এসে আমাদের আটকে ফেলার আগেই পালানো দরকার। চলো চলো, আর দেরি করা যায় না।

দাঁড়িয়েই রইল কিশোর। সমস্ত প্রশ্নের জবাব না জেনে যেন বেরোতে ইচ্ছে করছে না তার। বলল, কিন্তু উলফ যদি আমাদেরকে মারার প্ল্যানই করে থাকে, তাহলে শুরু থেকেই জায়গা দিতে চাইল না কেন? কেন সময়। থাকতে আমাদের পালাতে বলল?

আরে বাবা, এসব কথা তো বাইরে গিয়েও ভাবা যাবে! পুরোপুরি অধৈর্য হয়ে পড়েছে রবিন। ভয়ে ভয়ে তাকাতে লাগল দরজার দিকে। মিলার ঢুকে পড়লে আর রক্ষা থাকবে না। কিশোরের হাত ধরে টান দিল সে, এসো।

হলওয়েতে বেরিয়ে এল ওরা। এদিক ওদিক তাকাল। কাউকে চোখে পড়ল না। ফিসফিস করে কিশোর বলল, সামনে দিয়ে বেরোনো যাবে না। উলফ কিংবা মিলারের চোখে পড়ে যেতে পারি। পেছন দিক দিয়ে পথ আছে, দেখেছি। ওটা দিয়ে বেরোব।

আমিও দেখেছি, মুসা বলল। কিন্তু ওটা তো রান্নাঘর দিয়ে গিয়ে বেরিয়েছে। যদি উলফ থাকে সেখানে?

থাকবে না। খেতে তো আর নিয়ে যায়নি মিলারকে। কথা বললে ওরা। ডাইনিং রুমে বসে বলবে।

যার যার ঘরে ঢুকে দ্রুতহাতে ব্যাগ গুছিয়ে নিল ওরা। ঘর থেকে বেরিয়ে পা টিপে টিপে চলে এল হলওয়ের মাথায়। কয়েক ধাপ সিঁড়ি আছে। নিচে আরেকটা করিডর। নামতে শুরু করল। মচমচ করে উঠছে পুরানো কাঠের সিঁড়ি। ওদের মনে হচ্ছে বোমা ফাটার শব্দ হচ্ছে যেন। মিলার কিংবা উলফের চলে আসার ভয়ে সারাক্ষণ সন্ত্রস্ত রইল।

সিঁড়ির গোড়ায়, করিডর এগিয়ে গেছে রান্নাঘরের দিকে। করিডরের একপাশে আরেকটা দরজা, অর্ধেক খোলা। সেটার কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেল। কিশোর। কান পাতল কেউ আছে কিনা বোঝার জন্যে। কারও কথা শোনা গেল না। কানে আসছে শুধু ওদের নিঃশ্বাসের শব্দ।

ঘরের মধ্যে উজ্জ্বল আলো জ্বলছে। কৌতূহল হলো কিশোরের। কেউ যদি না-ই থাকবে আলো কেন? সাবধানে ভেতরে উঁকি দিল সে। কোনও ধরনের স্টোর রূম ওটা। একধরনের তেলতেলে ভাপসা গন্ধ। ভালমত দেখে বুঝল, স্টোর রূম নয়, ট্রফি রূম। শিকার করা জন্তু-জানোয়ারের স্টাফ করা। আস্ত দেহ সাজানো রয়েছে টেবিল আর বেদীতে। দেয়ালে বসানো হরিণ, ভালুক, আর নেকড়ের মাথা। আরেকদিকের দেয়ালে চোখ পড়তেই অস্ফুট শব্দ করে উঠল কিশোর।

কি হলো? জানতে চাইল মুসা।

নীরবে হাত তুলে দেখাল কিশোর।

তাকাল মুসা আর রবিন। পাথর হয়ে গেল যেন মুহূর্তে।

দেয়ালে হরিণের মাথার মতই বসানো রয়েছে চারজন মানুষের কাটা মুণ্ড।

*

বাইরে উষ্ণ রাত। ঝিঁঝির কর্কশ চিৎকার। গাঢ় অন্ধকার।

পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে ওরা। উলফের চোখে পড়েনি। বেরিয়েই দৌড় দিল সৈকতের দিকে।

লম্বা ঘাসে পা লেগে হুবহুস শব্দ হচ্ছে। কেয়ারই করল না। ঢাল, বালি, ঘাসের বাধা, কোনটারই পরোয়া করল না। একটাই ভাবনা, কোনভাবে নৌকার কাছে পৌঁছে যাওয়া। ধরা পড়লে ভাগ্যে কি ঘটবে বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। আরও তিনটে মানুষের মাথা যোগ হবে ট্রফি রূমের দেয়ালে বসানো চারটে মাথার সঙ্গে।

কিশোর ভাবছে হতভাগ্য মানুষগুলো কে ছিল? নিশ্চয় হোটেলের গেস্ট। কোন কারণে হোটেল যখন বন্ধ ছিল, তিন গোয়েন্দার মতই হয়তো তখন এসেছিল বেড়াতে। উন্মাদ খুনী মিলারের পাল্লায় পড়ে আর ফিরে যেতে পারেনি। মরে গিয়ে ট্রফি রূমের শোভা বাড়াচ্ছে ওরা।

হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই ঠাণ্ডা হয়ে আসতে চাইল হাত-পা। কোরিকে ইতিমধ্যেই খুন করে ফেলেনি তো মিলার? করে হয়তো গুম করে রেখেছে কোনখানে। ওদের তিনজনকেও শেষ করার পর ধীরেসুস্থে মুণ্ড কেটে নেবে। আর ভাবতে চাইল না সে।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই ডকের গেটে পৌঁছে গেল ওরা। গেট খোলার জন্যে পাল্লা ধরে টান দিয়েই থেমে গেল মুসা। খাইছে! আটকানো!

ডিঙিয়ে যাব, রবিন বলল।

যাওয়া যাবে না। গেটের ওপর কাঁটা বসানো।

তাহলে?

চিন্তিত ভঙ্গিতে কিশোর বলল, হোটলে ফেরা ছাড়া উপায় নেই।

কি বলছ!

হ্যাঁ, আর কোন উপায় নেই।

তর্ক করল না মুসা বা রবিন। কিশোর যখন বলেছে, নিশ্চয় না ভেবে বলেনি।

দেরি না করে ছুটল আবার ওরা।

কিছুদূর এসে ফিরে তাকাল হোটেলের দিকে। ওপরতলার আলো দুটোও এখন নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে আছে বাড়িটা। কালো। আকাশের পটভূমিতে হালকা কালো এক বিশাল ছায়ার মত দেখাচ্ছে।

ঢালে জন্মে থাকা লম্বা ঘাসের পরে বন। সেদিক দিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে ওদের। হোটেল থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকতে চায়।

বৃষ্টিতে ভেজা ঢাল বেয়ে নামাটা তেমন কঠিন না হলেও ওঠা খুব মুশকিল। তার ওপর সঙ্গে রয়েছে ব্যাগের বোঝা। কয়েক মিনিটেই হাঁপিয়ে গেল।

মেঘের ফাঁকে উঁকি দিল মলিন চাঁদ। ঘোলাটে আলোয় অন্ধকার কাটল কিছুটা। বনের মধ্যে একটা পেঁচা ডেকে উঠল।

বালির ঢিপির মাথায় সবার আগে উঠল রবিন। ডকের দিকে তাকিয়েই থমকে গেল।

সেটা লক্ষ করল কিশোর। কাছে উঠে এসে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে?

হাত তুলে দেখাল রবিন।

ডকের দিকে তাকিয়ে একই অবস্থা হলো কিশোরেরও। চাঁদের আলোয় দেখা গেল, ছোট্ট ডকে যেখানে নৌকাগুলো বাধা থাকত, সেখানটা এখন। খালি। একটা নৌকাও নেই।

খাইছে! মুসার মনে হচ্ছে বরফের মত শীতল একটা হাত খামচি দিয়ে ধরেছে তার মেরুদণ্ড। যাব কি করে?

যেতে পারব না, বিড়বিড় করে বলল কিশোর। দ্বীপ থেকে বেরোনোর পথও বন্ধ করে দিয়েছে।

.

১৫.

কোন রকম জানান না দিয়ে বৃষ্টি এল। ভিজিয়ে দিতে লাগল ওদের। আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাল কিশোর। আবার কুচকুচে কালো হয়ে গেছে আকাশটা। মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে চাঁদ।

কালো আকাশটাকে চিরে দিয়ে গেল বিদ্যুতের শিখা। গুড়গুড় মেঘ ডাকল।

ইস, একেবারে ভিজে গেলাম! বক্সের শব্দকে ছাপিয়ে চিৎকার করে : উঠল কিশোর।

এভাবে ভেজা ঠিক হচ্ছে না। সরে যাওয়া দরকার কোথাও, রবিন বলল। কিন্তু কোথায় যাব?

আরেকবার বিদ্যুৎ চমকাল। দিনের আলোর মত আলোকিত করে দিল। চতুর্দিক। বজ্রপাতের শব্দ। হাত দিয়ে মাথার পানি মোছার চেষ্টা করল কিশোর। মাথা থেকে মুখ বেয়ে গড়িয়ে নামছে পানি। চোখের সামনে জমে গিয়ে দৃষ্টি আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে।

বিকট শব্দে বাজ পড়ল আবার। থরথর করে কেঁপে উঠল মাটি। সাদা। আলোয় দেখা গেল বালির ঢিবিতে জন্মানো ঘাসগুলো বাতাসের ঝাঁপটায় আন্দোলিত হচ্ছে। একবার এদিক মাথা নোয়াচ্ছে, একবার ওদিক। ওদের মতই ঝড়বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে।

পুলহাউজে চলে গেলে কেমন হয়? কিলোর বলল।

সুইমিং পুলের পেছনে লম্বা ঘরটায় সাঁতার কাটার পোশাক আর পুল পরিষ্কারের জিনিসপত্র রাখা হয়। দুর্গন্ধ আর ধুলাবালি-ময়লা নিশ্চয় আছে। কিন্তু মাথা গোঁজার ঠাই তো হবে।

মুসা বলল, চলো, যাই।

দৌড়াতে শুরু করল ওরা। ভেজা মাটিতে পা পিছলে আছাড় খেল। কিশোর। তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল আবার। ব্যাগটা মনে হচ্ছে কয়েক মন ভারী। আবার ছুটল মুসা আর রবিনের পেছনে। ঘরের দরজাটায় এখন তালা। দেয়া না থাকলেই হয়।

নাহ, তালা নেই।

পাল্লা ঠেলে খুলে ফেলল মুসা। হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়ল তিনজনে। এত জোরে হাঁপাচ্ছে কিশোর, ফুসফুসটা যেন ফেটে যাবে। বাতাসে ক্লোরিনের কড়া গন্ধ। বদ্ধ থাকায় অতিরিক্ত গরম। চালে ঝমঝম শব্দ তুলেছে বৃষ্টির ফোঁটা।

বাতি জ্বালার জন্যে সুইচ টিপল মুসা। আলো জ্বলে উঠল।

না না, জলদি নেভাও! চিৎকার করে উঠল কিশোর। মিলার দেখতে পেলে…

জানালা নেই। আলো বেরোবে কোন দিক দিয়ে?

আর কিছু বলল না কিশোর। ভিজে কপালের সঙ্গে লেপ্টে আছে চুল।

হাত দিয়ে মাথা থেকে পানি মুছতে মুছতে রবিন বলল, আপাতত তো। ঢুকলাম। এরপর কোথায় যাব?

এখানে ফোনটোন আছে নাকি? চারপাশে তাকাতে লাগল কিশোর।

থাকার সম্ভাবনা খুব কম, তবু যদি থাকে? এই আশায় খুঁজতে শুরু করল ওরা। লম্বা, নিচু চালার নিচে লাগানো উজ্জ্বল ফ্লোরেসেন্ট লাইটের আলোয় সবুজ দেখাচ্ছে ভেজা শরীরগুলোকে, মনে হচ্ছে সাগর থেকে উঠে। আসা তিনটে জলজন্তু।

টেলিফোন সেট পাওয়া গেল না।

এখন এই দ্বীপ থেকে বেরোব কি করে? চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল রবিন। ইচ্ছে করেই ডকের গেটে তালা লাগিয়ে রেখেছেন মিলার। নৌকাগুলো সরিয়ে ফেলেছেন।

কে বলল? পেছনে বোমা ফাটাল যেন গমগমে কণ্ঠ।

ভীষণ চমকে গেল তিন গোয়েন্দা। নিজের অজান্তেই ছোট্ট চিৎকার বেরিয়ে এল রবিনের মুখ দিয়ে। কিশোরও চিৎকার করতে যাচ্ছিল, কিন্তু। আটকে গেল গলায়। কুঁকড়ে গেল মুসা।

দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন মিলার মেলবয়েস। হাতে সেই হান্টিং রাইফেল। লাঠির মত ধরে তাতে ভর দিয়ে রেখেছেন। আরেক হাতে ছাতা। গায়ের হলদে রঙের রেইন স্নিকারের ঝুল গোড়ালি ছুঁই ছুঁই করছে।

ছাতাটা মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রাইফেল হাতে এগিয়ে এলেন কয়েক পা। আলোর নিচে ভয়ঙ্কর লাগছে চেহারাটা। সাদা চুল এলোমেলো হয়ে আছে। ঘাড়ের কাছে বেশ কিছু চুল খাড়া। এক চোখে কালো কাপড়। আরেকটা ভাল চোখ জ্বলছে। ঠোঁটের এককোণ বেঁকে গেছে বিচিত্র হাসিতে।

কি পচা একটা রাত। কিন্তু এখানে কি করছ তোমরা?

কেউ জবাব দিল না।

কিশোর ভাবছে, এত তাড়াতাড়ি আমাদের খুঁজে পেল কি করে? কিভাবে জানল আমরা এখানে আছি?

কি, কথা বলছ না কেন? মিলারের হাসিটা মুছে গেল ঠোঁটের কোণ থেকে।

বজ্রপাতের শব্দ যেন মুখ খুলে দিল কিশোরের। কোনমতে বলে ফেলল, আমরা চলে যাচ্ছি।

চলে যাচ্ছ? জবাবটা অবাক করল মিলারকে। রাইফেলে ভর দিয়ে। আরেক হাতে গাল চুলকালেন।

হ্যাঁ। এখানে আর থাকব না আমরা, মূসা বলল।

মুসার কথায় আহত হয়েছেন মনে হলো মিলার। কিন্তু তোমরা তো যেতে পারবে না।

পারতে হবে, দৃঢ়কণ্ঠে জবাব দিল কিশোর। চমকের প্রথম ধাক্কাটা অনেকখানি সামলে নিয়েছে। দরজাটা খোলা রেখে দিয়েছেন মিলার। সেদিকে তাকাল। বিদ্যুৎ চমকাল, আকাশে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কড়াৎ করে বাজ পড়ল। বেড়ে গেল বৃষ্টির বেগ।

ওদের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ একটা মুহূর্ত নীরব হয়ে রইলেন মিলার। নড়লেন না। কিন্তু তোমাদের তো যাওয়া হবে না, কঠিন, শীতল গলায় বললেন তিনি, পার্টিতে যেতে হবে। আমি নিজে তোমাদের দাওয়াত দিতে এলাম।

পার্টি? পেটের মধ্যে একধরনের শুন্য অনুভূতি হলো কিশোরের।

হ্যাঁ, পার্টি। শুরু হতে বেশি দেরি নেই, মিলারের একমাত্র চোখটা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কয়েক পা এগিয়ে এলেন। সরে যেতে চাইল কিশোর। কিন্তু দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।

পার্টি শুরু করার জন্যে অপেক্ষা করছি আমি আর রোজার, বিচিত্র হাসিটা ফিরে এল মিলারের ঠোঁটের কোণে। কি ধরনের পার্টি, অনুমান করতে পারো?

মিস্টার মিলার, রবিন বলল, দয়া করে আমাদের যেতে দিন। এসব পার্টিফার্টিতে যেতে চাই না আমরা। আপনাদের যা ইচ্ছে করুনগে…

কি ধরনের পার্টি, অনুমান করতে পারো? রবিনের কথা যেন কানেই যায়নি তাঁর। বলতে পারবে না তো? ঠিক আছে, বলেই দিই, হান্টিং পার্টি। খেকখেক করে হাসতে লাগলেন তিনি। হায়েনার হাসির মত লাগল রবিনের কাছে। এ মৌসুমে কাদের শিকার করব আমরা জানো? হাসিটা বাড়ছে তার।

বুঝে ফেলল কিশোর। মেরুদণ্ড বেয়ে শিরশির করে নেমে গেল ঠাণ্ডা শিহরণ। কল্পনায় ভেসে উঠল ট্রফি রূমের চারটে নরমুণ্ড।

কি করতে চাইছেন মিলার, মুসা আর রবিনও বুঝেছে। তাঁর হাতে হান্টিং রাইফেল। তিনি শিকারী, ওরা শিকার।

পাগল! উন্মাদ হয়ে গেছেন আপনি! কথাগুলো যেন বিস্ফোরিত হয়ে বেরিয়ে এল কিশোরের মুখ থেকে।

ঝট করে রাইফেলটা তুলে নিলেন মিলার।

সরে যাওয়ার চেষ্টা করল কিশোর। কিন্তু লুকানোর জায়গা দেখতে পেল না।

আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলা উচিত হয়নি তোমার! রেগে গেছেন মিলার। তোমাকে এলাম পার্টিতে দাওয়াত করতে, আর তুমি করছ আমাকে অপমান!

পার্টির দরকার নেই, অনুরোধ করে বলল মুসা, বেরোতে দিন আমাদের।

আমাকে পাগল বলছ কেন? আমি কি পাগল? রাইফেলটা আরও উঁচু করে ধরলেন মিলার। কিশোরকে নিশানা করলেন। দুপা আগে বাড়লেন আরও

মরিয়া হয়ে উঠল কিশোর। কোন রকম চিন্তাভাবনা না করে ছুটে গেল সামনের দিকে। একথাবায় সরিয়ে দিল নলের মুখ।

গুলি ফুটল বিকট শব্দে।

চিৎকার করে উঠলেন মিলার। রাইফেলের ধাক্কা এবং সেই সঙ্গে কিশোরের হাতের ঠেলা লেগে পেছনে উল্টে পড়ে গেলেন। একটা টেবিলের কোণায় বাড়ি খেল মাথা।

তার ওঠার অপেক্ষা করল না আর তিন গোয়েন্দা। ব্যাগগুলো যেখানে রেখেছিল সেখানেই রইল। খোলা দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে এল ওরা। মুষলধারা বৃষ্টির মধ্যে।

১৬.

এদিক দিয়ে! চিৎকার করে বলল মুসা।

সেদিকে ছুটল কিশোর। ভেজা মাটিতে জুতো পিছলে যাচ্ছে। মুসার পেছন পেছন বনে ঢুকে পড়ল। ফিরে তাকাল। ওর ঠিক পেছনেই রয়েছে রবিন। গাছপালার ফাঁক দিয়ে পুলহাউজটা দেখা যাচ্ছে। এখনও বেরোয়নি মিলার।

থামল না ওরা। যতটা সম্ভব দূরে সরে যাওয়া দরকার। বনের ভেতরের আঁকাবাঁকা পথ ধরে ছুটছে বৃষ্টি কমেছে। গুঁড়ি গুঁড়ি পড়ছে এখন। কিন্তু। বাতাসে পাতা নড়লেই ঝরঝব করে বড় বড় ফোঁটা বৃষ্টির মত ঝরে পড়ছে গায়ে।

চাঁদের ওপর থেকে সরে গেল মেঘ। গাছের মাথার ওপর দেখা গেল ফ্যাকাসে চাঁদ। ভূতুড়ে রূপালী করে তুলল বনভূমিকে। ভেজা পাতাগুলোকে কেমন বিকৃত দেখাচ্ছে। মাটি থেকে হালকা ধোয়ার মত উঠছে গরম বাষ্প।

যাচ্ছি কোথায়? জিজ্ঞেস করল রবিন।

কথা বোলো না, জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে কিশোর, ছুটতে থাকো। কপালে ডালের বাড়ি খেয়ে আঁউক করে উঠল। ব্যথাটা এতই তীব্র, দাঁড়িয়ে গেল নিজের অজান্তে। ডলতে শুরু করল কপাল।

একঝলক দমকা বাতাস আবার পানির ফোঁটা ফেলল গায়ে। সরে যাওয়ার চেষ্টা করল। পারল না। ভিজে চুপচুপে হয়ে গেল।

বনের ভেতর আরও খানিকক্ষণ দৌড়াল ওরা। পথ শেষ হয়ে গেল হঠাৎ। সামনে যেন হুমকি হয়ে দাঁড়িয়ে পথরোধ করে দিল কাটাঝোপ।

যাচ্ছি কোথায় আমরা? আবার জিজ্ঞেস করল রবিন। এভাবে দৌড়ে লাভটা কি?

বড় একটা গাছের নিচে দাঁড়াল ওরা। মাটি এখানে অনেকটাই শুকনো। গাছের পাতা এত ঘন, বৃষ্টির পানি নিচে পড়তে বাধা পেয়েছে।

দমকা বাতাস বয়ে গেল। জোরো রোগীর মত কাঁপিয়ে দিয়ে গেল গাছের পাতা।

পাগলটা কি আসবে নাকি? গাছের গায়ে পিঠ দিয়ে দাঁড়াল রবিন।

কান পেতে আছে তিনজনেই। কোন শব্দ নেই, শুধু বাতাসের ফিসফাস আর ওদের ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া।

জানোয়ারের মত খুঁজে বের করে আমাদের খুন করবে সে, কিশোর বলল। দেয়ালের চারটে নরমুণ্ড আবার চোখের সামনে ভেসে উঠল ওর। আগের বছরের হান্টিং পার্টিতে ওদেরকেও নিশ্চয় এভাবেই দ্বীপময় তাড়িয়ে নিয়ে খুন করেছেন মিলার।

আসলেই এ ভাবে দৌড়াদৌড়ি করার কোন মানে হয় না, শার্টের হাতা দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে গিয়ে বাড়ি লাগা জায়গাটায় ব্যথা পেল কিশোর। কেয়ার করল না। একটা প্ল্যান দরকার আমাদের।

এ দ্বীপ থেকে বেরিয়ে যেতে হবে, রবিন বলল। পেছনে তাকিয়ে দেখল মিলার আসছেন কিনা।

সে চেষ্টা তো ইতিমধ্যেই করেছি, হাতে বসা একটা মশাকে থাপ্পড় মারল কিশোর। নৌকা ছাড়া যাব কি নিয়ে?

গাছের বাকল দিয়ে বানিয়ে নিতে পারি, মুসা বলল, আমাজানের ইনডিয়ানদের মত।

হাত নেড়ে ওর কথাটা উড়িয়ে দিল কিশোর, ফ্যান্টাসি বাদ দাও এখন। গাছ কাটবে কি দিয়ে? বাধবে কি দিয়ে? কাটার শব্দ শুনে মিলার চলে আসবে না? তা ছাড়া অত সময় কই?

চুপ হয়ে গেল মুসা। ভাবতে লাগল তিনজনেই। বৃষ্টি এখন পুরোপুরি থেমে গেছে।

রবিন বলে উঠল, পাইরেট আইল্যান্ডের পুলিশকে একটা ফোন করা। গেলেই হত …

ফোনগুলো রয়েছে সব হোটেলে। চাপড় মেরে আরেকটা মশা তাড়াল কিশোর।

তাহলে ওখানেই যাওয়া উচিত আমাদের, মুসা বলল।

পাগল নাকি! ওর কথাটা নাকচ করে দিল রবিন।

ও ঠিকই বলেছে, মুসার সঙ্গে একমত হলো কিশোর। চুপি চুপি হোটেলে ঢুকে পুলিশকে ফোন করব।

কিন্তু উলফ আর মার্টিন যদি…

আমরা হোটেলে ঢোকার সাহস করব এটা এখন কল্পনাও করবে না ওরা। চটাস করে বাহুতে চাপড় মারল মুসা, শালার মশা!

কল্পনা করবে না এটা বলা যায় না, গাল থেকে টিপে একটা মশা মারল কিশোর। উলফ নিশ্চয় জানে না আমরা কোথায় আছি। রান্নাঘর কিংবা ডাইনিং রূমেই হয়তো এখন বসে আছে সে।

দুজনেই বন্দুক নিয়ে তেড়ে আসবে না তো আমাদের? কেঁপে উঠল রবিনের গলা। চটাস চটাস চাপড় মারতে আরম্ভ করেছে সে-ও। উফ, ড্রাকুলার বাচ্চা সব! খেয়ে ফেলল!…যেমন মনিব, তেমনি তার চাকর। দুজনেই হয়তো মানুষ শিকারে আনন্দ পায়। এ দ্বীপের সবাই রক্তলোভী। দেখছ না মশাগুলোর কাণ্ড!

উপায় এখন একটাই, কিশোর বলল, রিস্ক নিতে হবে। যত তাড়াতাড়ি পারি গিয়ে হোটেলে ঢুকে ফোন করে আবার পালাব। ওরা না আসা পর্যন্ত লুকিয়ে থাকব কোথাও।

কোথায়?

জানি না, অধৈর্য শোনাল কিশোরের কণ্ঠ, হোটেলের ভেতরই কোনখানে।

বনের মধ্যে লুকিয়ে থাকাটা বরং নিরাপদ।

কতক্ষণ? মুসার প্রশ্ন।

হোটলের মধ্যেও বেশিক্ষণ লুকিয়ে বাঁচতে পারব না আমরা, মুসার। কথার পিঠে বলল কিশোর। ওরা আমাদের খুঁজে বের করবেই। যে ভাবেই হোক বাঁচার একটা বুদ্ধি বের করতে হবে। আরেকটা কথা ভুলে গেলে চলবে, না, কোরিকে খুঁজে পাইনি আমরা এখনও। হোটেলে গিয়ে কোনমতে আগে একটা ফোন যদি করতে পারি, পরের ভাবনা পরে ভাবব।

আরও কয়েক সেকেন্ড আলোচনার পর রওনা হলো ওরা। কিশোর বলল, রাস্তা থেকে সরো। যতটা সম্ভব গাছপালার আড়ালে থেকে এগোব…

কথা শেষ হলো না তার। বাতাসে ঝরে পড়ল পানির ফোঁটা। পরক্ষণে শোনা গেল গুলির শব্দ।

চমকে মুখ তুলে তাকাল সবাই। সামনে দুটো গাছের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন মিলার। রাইফেলটা ওদের দিকে তাক করা। গুলি করেছেন ওদের লক্ষ্য করেই।

.

১৭.

আবার গুলি করলেন মিলার।

বিকট শব্দ গাছের গায়ে বাড়ি খেয়ে খেয়ে ফিরল দীর্ঘ সময় ধরে। মনে হলো যেন চতুর্দিক থেকে গুলি চলছে।

বুকে কিংবা মাথায় গুলি লাগার অপেক্ষায় ছিল কিশোর। লাগল না দেখে মুসা আর রবিনের দিকে তাকাল। কার গায়ে লেগেছে? ওরাও কেউ আর্তনাদ করল না। দেরি না করে প্রায় ডাইভ দিয়ে লুকাল এসে একটা গাছের। আড়ালে। উপুড় হয়ে পড়ায় হাঁটুতে ব্যথা পেল।

হামাগুড়ি দিয়ে একটা ঝোপের মধ্যে ঢুকে পড়ল তিনজনেই। এখানে। থাকলেও বাঁচতে পারবে না। নিঃশব্দে বেরিয়ে এল ঝোপের অন্যপাশে। লাফিয়ে উঠে দৌড় দিল। দুহাতে গাছের ডাল সরাতে সরাতে ছুট লাগাল প্রাণপণে।

আবার শোনা গেল গুলির শব্দ।

খুব কাছে থেকে।

তারপর শোনা গেল কুৎসিত, কর্কশ হাসি। খুব মজা পাচ্ছেন উন্মাদ মিলার।

একটা বিখ্যাত গল্পের কথা মনে পড়ল রবিনের–দা মোস্ট ডেঞ্জারাস গেম! লেখকের নামটা এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না। ঝড়ের মধ্যে জাহাজডুবী হয়ে বনে ছাওয়া এক দ্বীপে উঠতে বাধ্য হয় এক নাবিক। দুর্গের মত এক পুরানো বাড়িতে ওঠে রাতের আশ্রয়ের জন্যে। প্রথমে খুব খাতিরযত্ন করে তাকে বাড়ির মালিক। তারপর হাতে একটা অস্ত্র ধরিয়ে দিয়ে বলে পালিয়ে যেতে। রাইফেল আর শিকারী কুকুর হাতে নাবিকের পিছু নেয় সে, খুন করার জন্যে। রাতের অন্ধকারে তাড়া খেয়ে ভীত জানোয়ারের মত বনের মধ্যে প্রাণভয়ে ছুটাছুটি করতে থাকে বেচারা নাবিক…অবিকল সেই গল্পের নকল চলছে এখন, ওদের ওপর। ওই ভয়ঙ্কর গল্প পড়েই কি হান্টিং পাটির উদ্ভট আইডিয়া মাথায় এসেছে মিলারের?

আতঙ্কে মাথা গরম হয়ে যাওয়ার অবস্থা হলো ওর। মনে হচ্ছে বাস্তবে ঘটছে না এই ঘটনা। সামনে পথজুড়ে থাকা ঝোপঝাড়, পিচ্ছিল ভেজা মাটি, চাঁদের আলোয় বিকৃত দেখানো ওই যে পাতাগুলো, কোনটাই বাস্তব নয়। রাইফেলের শব্দ, গুলি ফোঁটার পর প্রতিধ্বনি, সবই ঘটছে যেন ভয়াবহ কোন দুঃস্বপ্নে।

শিকারের উত্তেজনায় হেসে ওঠা মিলারের ওই শিকারী-হাসিও অবাস্তব।

কিশোরের চিৎকারে বাস্তবে ফিরে এল সে। কিশোর বলছে, অ্যাই দেখো, কোথায় বেরিয়েছি আমরা।

সাগরের কিনারে চলে এসেছে ওরা। ঝোড়ো বাতাসে ফুঁসে ওঠা বড় বড় ঢেউ চাঁদের আলোয় রূপালী হয়ে ভীমবেগে এসে আছড়ে পড়ছে নীলচে-সাদা বালিয়াড়িতে।

থমকে দাঁড়িয়ে পানির দিকে তাকিয়ে রইল ওরা। সমতল, সরু এখানে সৈকত। কোথাও একটা বালির ঢিপিও নেই যে তার আড়ালে লুকাতে পারবে।

এখানে থাকা যাবে না, কিশোর বলল।

হ্যাঁ, একেবারেই খোলা, মুসা বলল।

গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে মিলারের আসার অপেক্ষা করছে ওরা। কান পেতে আছে গুলির শব্দের জন্যে। কার গায়ে বুলেট লাগবে প্রথমে কে জানে!

যাব কোথায়? কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে রবিনের। মোছার চেষ্টা করল না আর। চুলে আটকে আছে ভেজা পাতা। সেটাও সরাল না।

হোটেলেই ফিরে যাব, বলল কিশোর। বাঁচার এটাই একমাত্র উপায়।

সে-ই ভাল, মুসা বলল। এখানে থাকলে ডানাভাঙা হাঁসের মত গুলি করে মারবে।

শব্দ কিসের? শোনার জন্যে ঘাড় কাত করল রবিন।

মূসা আর কিশোরও কান পাতল।

তীরে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের একটানা গুমগুম ছাড়া আর কোন শব্দ কানে ঢুকল না।

রাইফেলের গুলি হলো না আর। প্রতিধ্বনি নেই।

গাছের আড়াল থেকে ভেসে এল না উন্মাদের অট্টহাসি।

দাঁড়িয়ে থাকলে সময় নষ্ট। কিশোর বলল, চলো।

ফিরে এসে আবার বনে ঢুকল ওরা। সাবধান রইল আগের বার যেখান দিয়ে চলেছিল সেখানে যাতে আর না যায়। রাস্তায় উঠল না। গাছের আড়ালে আড়ালে খুব সাবধানে, নিঃশব্দে এগিয়ে চলল বাষ্প ওঠা গরম বনের ভেতর দিয়ে।

ভীত জানোয়ারের মত–ভাবল কিশোর। পা কাঁপতে শুরু করল হঠাৎ। ক্লান্তি, নাকি ভয়ে কাহিল হয়ে গেছে, বুঝতে পারল না। ভাঁজ হয়ে এল হাটু। বসে পড়ল ভেজা মাটিতে।

এগিয়ে এল মুসা। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, কি হলো?

না, কিছু না। পা দুটো চলতে চাইছে না আর। বেশি সাঁতরালে যেমন মাংসপেশীতে খিচ ধরে যায়, তেমন।

হু। জিরিয়ে নাও খানিক। ঠিক হয়ে যাবে।

শান্তিতে বসারও উপায় নেই। কোনদিক দিয়ে বেরিয়ে চলে আসবেন মিলার, বোঝা যাচ্ছে না। তবু হাঁটতে যখন পারছে না, না বসে উপায় কি?

কয়েক মিনিট বিশ্রাম নিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। হাঁটু ভাজ হচ্ছে না আর। গোড়ালির ওপরের মাংসে খিচধরা ভাবটাও কমেছে। পা বাড়াল আবার।

কি, অসুবিধে হচ্ছে? জিজ্ঞেস করল মুসা।

মাথা নাড়ল কিশোর, না। চলো।

যতটা সম্ভব দ্রুত হেঁটে হোটেলের পেছন দিকে চলে এল ওরা। সামনে একচিলতে বালিতে ঢাকা জমি পেরোলে গিয়ে পড়বে ঘাসের মধ্যে। তারপর ঢাল বেয়ে উঠতে হবে।

জমিটা পেরোল ওরা। সামনে পাহাড়ের মত উঁচু বালির ঢিবির দিকে তাকিয়ে দমে গেল কিশোরের মন। বেয়ে ওঠা বড় কঠিন আর ভীষণ পরিশ্রমের কাজ।

কিন্তু উঠতেই হবে।

ওঠার পর কি দেখবে? মিলার কি কোনভাবে আন্দাজ করে ফেলেছেন। ওরা হোটেলে ফিরে যাচ্ছে? সেখানে গুলিভরা রাইফেল নিয়ে তৈরি হয়ে বসে আছেন? অন্ধকারে ওদের যাতে কায়দামত পেতে পারে, সেই সুযোগের জন্যেই কি সব আলো নিভিয়ে দেয়া হয়েছে?

উলফ কোথায়? হান্টিং পার্টিতে যোগ দিয়েছে কি সে-ও?

এমনও হতে পারে মিলার যখন বনের মধ্যে ওদের তাড়া করে ফিরছেন, হোটেলে তখন রাইফেল হাতে ঘাপটি মেরে বসে আছে উলফ। ওদের ঢুকতে দেখলেই দেবে গুলি মেরে।

ভাবনাটা অস্থির করে তুলল কিশোরকে। বলল, ছড়িয়ে পড়ো। রাইফেল হাতে উলফ কিংবা মিলারকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে যে যেদিকে পারো। ঝেড়ে দৌড় মারবে। নিশানা করতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ে যাবে তাহলে ওরা।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও একে অন্যের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেল ওরা। মাথা নিচু করে, পিঠ বাঁকিয়ে উঠতে শুরু করল ঢাল বেয়ে। পেছন থেকে গায়ে এসে লাগছে বাতাস।

পেছনের আঙিনায় উঠে এল কিশোর। পুল হাউজের দরজাটা খোলা। তবে আলো নেভানো। সারা বাড়ির সমস্ত আলো নেভানো।

অন্ধকারে শিকার করতেই ভালবাসেন বোধহয় মিলার।

কাছেই একটা জোরাল শব্দ হলো। গুলির শব্দ ভেবে আরেকটু হলে চিৎকার করে উঠেছিল কিশোর। বুকের মধ্যে এত জোরে লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা, মনে হচ্ছে পাঁজর ভেঙে বেরিয়ে আসবে। মুহূর্তের জন্যে চোখের সামনে সব যেন সাদা হয়ে গেল। দম নিতে কষ্ট হচ্ছে।

বুঝতে পারল কিসের শব্দ। একটা ধাতব ডেকচেয়ার সিমেন্টে বাধানো চত্বরে উল্টে ফেলেছে বাতাস।

শব্দটা রবিন আর মুসার কানেও গেছে। ওরা দুজনও যে যেখানে ছিল দাঁড়িয়ে গেছে পাথর হয়ে। কান পেতে আছে। মিলারের কানেও কি গেছে চেয়ার পড়ার শব্দ? ভাবছেন ওরাই ফেলেছে? তাহলে খুজতে চলে আসবেন। এদিকে।

অপেক্ষা করতে লাগল ওরা।

এলোমেলো দমকা বাতাসে আরেকটা চেয়ার উল্টে পড়ল।

হোটেলের দিকে কোন নড়াচড়া নেই। রাইফেল হাতে এগিয়ে এলেন না মিলার।

চলো, ফিসফিস করে বলল কিশোর।

লম্বা দম নিয়ে হোটেলের দিকে পা বাড়াল সে।

মিনিটখানেকের মধ্যেই অন্ধকার ডাইনিং রূমে ঢুকে পড়ল ওরা। বদ্ধ বলে বাইরের চেয়ে এখানে গরম কম। নিঃশব্দে পাশ কাটিয়ে এল মিস্ত্রিদের মঞ্চটার। লবির ডাবল ডোরটার দিকে এগোল।

কেউ নেই, লবিতে উঁকি দিয়ে কিশোরের কানের কাছে ফিসফিস করে বলল রবিন।

দুজনেই বোধহয় বনে চলে গেছে, অনুমান করল মুসা।

গেলেই ভাল, বিশ্বাস করতে পারছে না কিশোর।

দেয়াল ঘেঁষে থেকে লবির দিকে এগোল ওরা।

সামনের ডেস্কে যে ফোনটা আছে, রবিন বলল, সেটাই ব্যবহার করতে পারব আমরা।

লবিতে ঢুকে টেলিফোনের কাছে এসে দাঁড়াল ওরা।

রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল মুসা। ডায়াল টোন নেই, হতাশ ভঙ্গিতে রিসিভারটা ধরিয়ে দিল কিশোরের হাতে। দেখো।

সর্বনাশ! ফিসফিস করে কথা বলার কথা ভুলে গিয়ে প্রায় চিৎকার করে উঠল রবিন। ফোন খারাপ হলে করবটা কি?

রিসিভার কানে চেপে ধরে বার কয়েক ক্রেডল খটখট করল কিশোর। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, টোন এসেছে!

জলদি করো! উত্তেজনায় কিশোরের কাঁধ খামচে ধরল মুসা।

নম্বর দেখব কি করে? অন্ধকারে তো কিছু দেখা যাচ্ছে না…

কোমরে ঝোলানো টর্চটা খুলে নিল মুসা। আলো ফেলল সেটের ওপর। করো।

নম্বরও তো জানি না। রবিন, জলদি গাইড দেখো।

নম্বর বলল রবিন।

বোতামগুলো দ্রুত টিপে দিয়ে মুসাকে বলল কিশোর, লাইট নেভাও।

অপারেটর, অন্যপাশ থেকে কিশোরের কানে ভেসে এল একটা নাকি কণ্ঠ।

পাইরেট আইল্যান্ড পুলিশকে দিন, প্লীজ!

জরুরী? সন্দেহ ফুটল নাকি কণ্ঠটায়।

হ্যাঁ। প্লীজ, তাড়াতাড়ি করুন।

এক মিনিট।

অন্যপাশে খটাখট শব্দ হচ্ছে। ঘাড় ঘুরিয়ে হোটেলে ঢোকার দরজার দিকে তাকাল কিশোর। মিলারকে ঢুকতে দেখলেই ঝট করে বসে পড়বে ডেস্কের আড়ালে।

অনেক সময়, যেন দীর্ঘ এক যুগ পর কানে বেজে উঠল একটা ভোতা গলা, পুলিশ! কণ্ঠটা এমন কেন? যেন মাউথপিসে রুমাল চাপা দিয়ে কথা বলছে।

ভাবার সময় নেই। তাড়াতাড়ি বলল কিশোর, অ্যাঁ!…হালো, আমাদের সাহায্য দরকার। এখুনি।

শান্ত হোন। কি সাহায্য?

কয়েকজন লোক পাঠান এখানে। ফাঁদে ফেলে আমাদের খুন করার চেষ্টা চলছে…

কোনখান থেকে বলছেন?

আঁ?..নাইট শ্যাডো…গোস্ট আইল্যান্ড। প্লীজ, এখুনি পাঠান। সাংঘাতিক বিপদে রয়েছি আমরা। ও আমাদেরকে খুন করতে চাইছে।

নাইট শ্যাডো? ওপাশে মনে হয় নামটা লিখে নিচ্ছে পুলিশ।

বড় বেশি ধীরে কাজ করছে মনে হলো কিশোরের। বলল, তাড়াতাড়ি করুন, প্লীজ।

শান্ত হোন। বিশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাব আমরা। আরও কমও লাগতে পারে।

কট করে কেটে গেল লাইন।

ওরা আসছে, দুই সহকারীকে জানাল কিশোর।

কতক্ষণ লাগবে? জানতে চাইল রবিন।

বিশ মিনিট। বা তারও কম।

এই সময়টুকু উলফ আর মিলারের কাছ থেকে পালিয়ে থাকতে পারলেই বেঁচে যাব, মুসার কণ্ঠে স্বস্তি। চলো, লুকিয়ে পড়ি।

কোথায় লুকাব? রবিনের প্রশ্ন।

কেউ কোন জবাব দেয়ার আগেই দপ করে জ্বলে উঠল লবির লাইট। অফিসের খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল একজন মানুষকে।

খাইছে! হাঁ করে তাকিয়ে আছে মুসা। দৌড়ানো দেয়ার কথাও ভুলে গেছে।

.

১৮.

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন রোজার মেলবয়েস। পরনে, সেই সাদা স্যুট। গলায় লাল রুমাল জড়ানো। উজ্জ্বল আলোর দিকে মুখ করে চোখ মিটমিট করছেন। দ্বিধায় পড়ে গেছেন মনে হলো।

কয়েক সেকেন্ড কেউ কোন কথা বলল না। তারপর চিৎকার করে উঠল রবিন, মিস্টার মেলবয়েস! আপনি বেঁচে আছেন।

কি বলছ? এগিয়ে এসে ডেস্কের ধার খামচে ধরলেন তিনি। অবাক হয়েছেন। বেঁচে আছি মানে?

হুড়াহুড়ি করে তার কাছে গিয়ে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা। খুব খুশি হয়েছে। এই দ্বীপে একমাত্র তিনিই ওদের বন্ধু।

সাদা গোফের কোণ টানতে টানতে বললেন তিনি, তোমাদের এখানে দেখতে পাব ভাবিনি।

আমরাও ভাবিনি আপনাকে দেখব, রবিন বলল। আপনি ঠিক আছেন তো?

আছি, প্রশ্নটাও যেন অবাক করল তাঁকে। না থাকার কি কোন কারণ আছে? এখানে হচ্ছেটা কি?

এখানে… বলতে যাচ্ছিল রবিন।

কিন্তু বাধা দিয়ে বললেন রোজার, এত রাতে তোমরা এখানে কেন? ঘরে কি হয়েছে? চেহারার এই অবস্থা কেন! ভিজে চুপচুপে, সারা গায়ে কাদামাটি– •এখানে করছটা কি তোমরা?

আপনি আমাদের সাহায্য করুন, তাড়াতাড়ি বলল রবিন। পুলিশকে ফোন করেছি আমরা…

সতর্ক হয়ে উঠল ব্যারনের চোখজোড়া। পুলিশ?

উলফ আর আপনার ভাই মিলার…

কোথায় ওরা?

কোরিকেও পাওয়া যাচ্ছে না, মুসা বলল। মিলার আর উলফ রাইফেল নিয়ে তাড়া করেছে আমাদের। বনের মধ্যে গুলিও করেছিল।

দ্বিধান্বিত ভাবটা অনেক কমল। গাল ডললেন ব্যারন। রবিনের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, নিশ্চয় আরেকটা হান্টিং পার্টি?

হ্যাঁ। তাই তো বললেন মিস্টার মিলার, রবিন বলল। আপনি আমাদের বাঁচান। থামান ওদের।

থামাব? অদ্ভুত হাসি খেলে গেল ব্যারনের মুখে। পিছিয়ে গেলেন এক পা। ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার বললেন, থামাব?

হ্যাঁ। আমাদের খুন করতে চায় ওরা। একমাত্র আপনিই আমাদের বাঁচাতে পারেন…

থেমে গেল রবিন। বদলে যাচ্ছে ব্যারনের চেহারার ভাব। হাসিটা। বাড়ছে। হাসছেন কেন ওরকম করে? ওই অদ্ভুত হাসি মুখটা বিকৃত করে দিয়েছে। চেহারাটাও কেমন অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে।

মুসাও তাজ্জব হয়ে গেছে। বেঁচে আছেন তো রোজার? না মরে ভূত হয়ে গেছে।

জিজ্ঞেস করল কিশোর, আপনার কি অসুস্থ লাগছে, ব্যারন?

চমৎকার কথা বলেছ–ওদের থামান! থামান ওদের! হাহহাহহাহ! পাগলের মত হেসে উঠলেন রোজার।

আপনার শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে বোধহয়। আপনি বসুন।

এমন করছেন কেন? ব্যারনের এই পরিবর্তন দেখে রবিনও অবাক। কি যে হলো: আজকের রাতটাই যেন কেমন…

ওদের থামাব? ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ব্যারন, কেন থামাব? মাথার চুল খামচি দিয়ে ধরে টানতে শুরু করলেন। হ্যাঁচকা টানে গলা থেকে রুমালটা খুলে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। কোটের বোতাম খুলে ফেললেন।

আতঙ্কিত হয়ে পড়ল রবিন। ব্যারন! কি হয়েছে আপনার? অমন করছেন কেন?

কথাটা কানেই তুললেন না ব্যারন। কোট খুলে ছুঁড়ে ফেললেন ডেস্কে। দুই হাতে ভর দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়ালেন ডেস্কের ওপর। কয়েক সেকেন্ড ওভাবে থেকে প্যান্টের পকেট হাতড়াতে শুরু করলেন। বের করে আনলেন একটুকরো কালো কাপড়। চোখে বাঁধার সেই কাপড়টা। বেঁধে দিলেন চোখের ওপর। এলোমেলো করে দিলেন মাথার সমস্ত চুল। মিলারের কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন, হান্টিং পার্টি! হান্টিং পার্টি! কোন কিছুর বিনিময়েই পার্টি আমি বন্ধ করব না।

পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিন গোয়েন্দা। পায়ে শেকড় গজিয়ে গেছে। যেন। স্তব্ধ বিস্ময়ে বোবা হয়ে তাকিয়ে আছে সামনের পরিবর্তিত মানুষটার দিকে।

বুঝতে অসুবিধে হলো না কিশোরের, এই লোক রোজার নন, তার ভাই মিলার। কোন কারণে রোজার সেজেছিলেন। হয়তো ওদের বোকা বানানোর জন্যেই।

.

 ১৯.

হান্টিং পার্টি বন্ধ করব? ভয়ঙ্কর মূর্তি নিয়ে ওদের মুখোমুখি হয়েছেন এখন মিলার। রোজারের ভদ্র, সৌজন্যে ভরা চেহারা উধাও হয়েছে, সেই জায়গায় বেরিয়ে এসেছে মিলারের বন্য, হিংস্র মুখ। পেছনে মাথা হেলিয়ে অট্টহাসি হেসে ওদের দিকে এক পা এগিয়ে এলেন। তোমরা আমাকে হান্টিং পার্টি বন্ধ করতে বলছ?

মিস্টার রোজার মানে, মিলার-প্লীজ! অনুরোধ করল কিশোর।

গটমট করে একটা চেয়ারের কাছে হেঁটে চলে গেলেন মিলার। ঠেস দিয়ে রাখা রাইফেলটা তুলে নিলেন। তার দিকে তাকিয়ে ছিল বলে এতক্ষণ চোখে পড়েনি ওদের।

রাইফেলটা চোখের সামনে এনে দেখতে লাগলেন মিলার। পানি মুছলেন ব্যাট থেকে।

এদিক ওদিক তাকাল কিলোর। পালানোর পথ নেই। ডাইনিং রূমে যাওয়ার দরজাটা খোলা। কিন্তু ওটা দিয়ে বেরোতে হলে মিলারের পাশ কাটিয়ে যেতে হবে। আর তা করতে গেলে দরজার কাছে যাওয়ার আগেই গুলি খাবে।

ইস, গাধার মত ইচ্ছে করে এসে ধরা দিলাম ভাবল সে। মরার জন্যে। এবার আর মুক্তি নেই। মিলারের হান্টিং পার্টি শেষ হওয়ার পথে।

চোখের সামনে আবার ভেসে উঠল ট্রফি রূমের দেয়ালে বসানো চারটে নরমুণ্ড। আরও তিনটে যোগ হবে ওগুলোর সঙ্গে। ভয়ঙ্কর দৃশ্যটা মন থেকে দূর করার জন্যে ঘনঘন মাথা নাড়তে লাগল সে।

ওদের দিকে রাইফেল ঘোরালেন মিলার।

পুলিশ কই? ভাবল কিশোর। এতক্ষণে তো পৌঁছে যাওয়ার কথা।

জিজ্ঞেসপনি আকাশটা যেন হাত টোকা।

ওরা না আসা পর্যন্ত ঠেকানো দরকার মিলারকে। কথা বলানো দরকার, যাতে গুলি করার কথা ভুলে থাকে।

রাইফেলের সিলিন্ডার চেক করলেন মিলার। সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, লোডেড।

এ সব করে পার পাবেন না আপনি! চিৎকার করে উঠল রবিন। নিজের কানেই বোকা বোকা লাগল কথাটা।

কিশোর বলল মিলারকে, ব্যাপারটা নিয়ে একটু আলোচনা করতে পারি তো আমরা, নাকি?

আড়চোখে মুসা আর রবিনের দিকে তাকাল সে। দরজার দিকে ঘন ঘন। তাকাচ্ছে ওরা। পুলিশ আসে কিনা দেখছে বোধহয়। রবিনের চেহারা ফ্যাকাসে। ঠোঁটের ওপর বিন্দু বিন্দু ঘাম। জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট মুছছে। মুসা। বার বার ঢোক গিলছে। হাত ঢোকানো প্যান্টের পকেটে।

আলোচনা? প্রশ্নটা যেন অবাক করেছে মিলারকে।

আপনি…আপনি সত্যি এখন গুলি করবেন আমাদের? কোনমতে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

রাইফেল নামালেন মিলার। না… বিড়বিড় করে কি বললেন আরও, বোঝা গেল না। টান মেরে শার্টের কয়েকটা বোতাম ছিড়লেন। রাইফেলটা মাটিতে নামিয়ে তাতে ভর দিলেন। আরেক হাতে খোলা বুক চুলকালেন। একমাত্র ভাল চোখটা কিশোরের ওপর নিবদ্ধ।

জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। স্বস্তির। রবিনের চেহারা থেকেও দুশ্চিন্তা কমে গেল। গুলি করবেন না বলেছেন মিলার।

কিন্তু কিশোর স্বস্তি পেল না। এই পাগলের কথায় বিশ্বাস নেই। গুলি করবেন না?

মাথা নাড়লেন মিলার। লবিতে চোখ বোলালেন। রোজার গেল কই?

রোজার? জবাব দিল না কিশোর। তাকিয়ে আছে মিলারের মুখের দিকে। আশ্চর্য! ভাইকে গুলি করে মারার কথাটা বেমালুম ভুলে গেলেন নাকি? পাগল তো। যেতেই পারেন। মনে করাল না সে। আলোচনা চলুক। সময় নষ্ট হোক। ততক্ষণে পুলিশ চলে আসবে।

কোথায় ও? রাগত কণ্ঠে জানতে চাইলেন মিলার। আমার এই ভাইটাকে কোনদিন আর পার্টি পছন্দ করাতে পারলাম না। স্পোর্টস ও একদম বোঝে না।

শিকার পছন্দ করেন না নাকি তিনি?

বোঝে না, এটাই হলো কথা। সেজন্যেই আজ পার্টি শুরুর আগেই ওকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। আমি চাইনি বাধা দিয়ে আমার সমস্ত মজা। নষ্ট করুক।

নাহ, বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছেন মিলার। গুলি করার পর বলেছিলেন রোজার মরে গেছে, এখন বলছেন সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। বুক কাঁপছে কিশোরের। এই পাগলকে বিশ্বাস করে কে! বলছেন বটে ওদেরকে বেরোতে দেবেন, কিন্তু যদি না দেন? অকারণেই খেপে গিয়ে এখনই গুলি শুরু করেন? বাইরে বেরোনোর ছুতো খুঁজতে লাগল সে। বলল, চলুন না সবাই মিলে তাকে খুঁজে বের করি। আমরা কি দেখব গিয়ে? মুসা আর রবিনের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল কিশোর, ওরা ওর চালাকিটা ধরতে পেরেছে। কিনা।

যাবে কোথায় ও, ঠিকই ফিরে আসবে, তিক্তকণ্ঠে বললেন মিলার। জঘন্য হয়ে উঠেছে মুখের ভঙ্গি। ওকে সরানোর কত চেষ্টাই না করলাম। কিন্তু ঠিকই বেঁচে যায়। ফিরে ফিরে আসে।

আমাদের কি বেরোতে দেবেন? মুসা জিজ্ঞেস করল। কিশোরের পেছনে দাঁড়িয়ে একটা হাত রাখল ওর কাঁধে হাতটা বরফের মত শীতল।

হ্যাঁ।

সত্যি দেবেন? বিশ্বাস করতে পারছে না কিশোর।

হ্যাঁ, হাসি ফুটল মিলারের মুখে।

হঠাৎ যেন শরীরটা পালকের মত হালকা হয়ে গেল কিশোরের। মনে হলো শূন্যে ভাসতে শুরু করেছে। ভাসতে ভাসতে চলে যাচ্ছে হোটেল থেকে দূরে, দ্বীপ পেরিয়ে, সাগর পেরিয়ে…

একঘন্টা আগে বেরোতে দেব তোমাদের, হাসছেন মিলার।

ওপর থেকে মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ল যেন কিশোর। কি করবেন?

এক ঘণ্টা সময় দেব, ঘড়ি দেখলেন মিলার। তারপর তোমাদের পিছু নেব। আলফ্রেড হিচককের বইতে সেই গল্পটা পড়োনি? দা মোস্ট ডেঞ্জারাস গেম?

কিন্তু…আ-আ-আপনি…

শিকারের এটাই আনন্দ। শিকারকে সুযোগ দেয়া। এ ধরনের স্পোর্টস খুব ভাল লাগে আমার।

দরজার দিকে তাকাল কিশোর। পুলিশ আসছে না কেন এখনও?

কথা বলার আর সময় নেই, ঘড়ি দেখলেন আবার মিলার। মুখ তুলেই চিৎকার করে উঠলেন, রেডি, গো! খেলা শুরু!

মিলার..প্লীজ… হাত তুলল কিশোর।

মুসার ঠাণ্ডা হাতটা এখনও খামচে ধরে আছে তার কাধ।

রবিন পাথর।

গুলি করবেন না, প্লীজ! আবার অনুরোধ করল কিশোর।

ভয়ানক রাগে লাল হয়ে গেল মিলারের মুখ। ঝটকা দিয়ে রাইফেল তুলে বাট ঠেকালেন কাঁধে। দেয়াল সই করে ট্রিগার টিপে দিলেন। দুবার। বদ্ধ জায়গায় কামানের গর্জনের মত শব্দ হলো।

চিৎকার করে উঠল রবিন।

যাও; বেরোও! তার চিৎকার ছাপিয়ে শোনা গেল মিলারের গলা। খেলা শুরু! তাকিয়ে আছেন রাইফেলের নলের দিকে। দুটো নলের মুখ দিয়েই ধোয়া বেরোচ্ছে।

হিংস্র লোকটার সামনে থাকার সাহস হলো না, আর গোয়েন্দাদের। দৌড় দিল দরজার দিকে।

.

২০.

আবার ছোটার পালা। কিন্তু যাবে কোনদিকে?

লবি থেকে বেরিয়ে অন্ধকার ডাইনিং রূমে ঢুকল ওরা। চোখ মিটমিট করে দৃষ্টির সামনে থেকে অন্ধকার দূর করতে চাইল কিশোর। বদ্ধ, ভাপসা, ভারী বাতাসে দম আটকে আসতে চাইছে।

ঘরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেল তিনজনে। বড় জানালাটা দিয়ে আকাশ চোখে পড়ছে। রাতের আকাশ, কিন্তু তারা নেই। মেঘে ঢাকা। ঘর আর বাইরে অন্ধকারের কোন তফাৎ নেই।

বাইরে চলে যাবে? বনে ঢুকে পড়বে আবার? বনই হলো তাড়া খাওয়া জানোয়ারের আশ্রয়স্থল।

কোথায় যাব? ফিসফিস করে জানতে চাইল মুসা।

লবির দরজার দিকে ফিরে তাকাল কিশোর। মিলার বেরোন কিনা। দেখল।

বেরোলেন না।

কিশোরের হাত খামচে ধরল মুসা। সুড়ঙ্গটায় ঢুকে পড়লে কেমন হয়?

ঠিক! সমর্থন করল কিশোর। পুলিশ না আসাতক লুকিয়ে থাকতে পারব ওখানে।

পুলিশ! কোথায় ওরা? বিশ মিনিটের বেশি হয়ে গেছে।

আমারও মনে হচ্ছে ওখানেই নিরাপদ, ভীতকণ্ঠে বলল রবিন।

অন্ধকারে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে এগোল ওরা। খুঁজে বের করল মঞ্চটা। ফিসফিস করে কিশোর বলল, ধরাধরি করে এমনভাবে সরাতে হবে, যাতে শব্দ না হয়…

ঘরের অন্যপ্রান্তে খসখস শব্দ হলো।

মিলার নাকি?

অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে মঞ্চটা খুঁজতে শুরু করল কিশোরের চোখ। সয়ে এসেছে। আবছামত দেখতে পাচ্ছে চেয়ার-টেবিলগুলোর অবয়ব।

কেউ নেই।

মঞ্চটা সরাল ওরা। সতর্ক থাকার পরেও শব্দ হয়েই গেল। চুপচাপ দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করল কেউ আসে কিনা। এল না। দরজাটা খুলল তখন।

সুড়ঙ্গের মধ্যে আরও বেশি গরম। বাতাসে আর্দ্রতা বেশি। আঠা হয়ে যায় শরীর। ছত্রাকের গন্ধ।

পিঠ চুলকাচ্ছে কিশোরের। দুই কাঁধ ব্যথা করছে। পায়ে তো ব্যথা আছেই। অন্ধকারে আঁকাবাকা সুড়ঙ্গে পাগলের মত দৌড় দেয়ার ইচ্ছেটা। অনেক কষ্টে রোধ করল। তাড়াতাড়ি ছুটে কোন লাভ নেই।

রবিনও বুঝতে পারছে সেটা। মনের ভাবনাটাকেই প্রকাশ করে ফেলল, লুকানো হয়তো যায়, কিন্তু পালাতে পারব না।

ওর কাঁধে হাত রাখল মুসা, ভয় পাচ্ছ?

তুমি পাচ্ছ না?

পাচ্ছি।

হাঁটো, কিশোর বলল। এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটাও ঠিক নয়।

বেশি দূরে যাওয়াটাও ঠিক হবে না, রবিন বলল। পুলিশ এলে শুনতে পাব না।…মুসা, টর্চটা জালো তো। কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না।

কোমরে হাত দিয়েই বলে উঠল মুসা, যাহ, গেল!

কি?

আনতে মনে নেই। লবির টেবিলেই রয়ে গেছে।

দারুণ! মরণ বোধহয় আজ ঠেকাতে পারলাম না।

দৌড়ে গিয়ে ডাইনিং রূমের আলমারি থেকে খুঁজে নিয়ে আসব নাকি?

না, সময় নেই, বাধা দিল কিশোর। হাঁটতে থাকো।

এগিয়ে চলল ওরা। কান পেতে রেখেছে। মিলার পিছু নিলে যাতে শুনতে পায়। মুখে, মাথায় জড়িয়ে যাচ্ছে মাকড়সার জাল। হাত দিয়ে সরাতে গিয়ে জ্যান্ত মাকড়সা লাগছে হাতে। কিলবিল করে উঠে যাচ্ছে গায়ের ওপর। থাবা দিয়ে সরাতে গিয়ে একটাকে ভর্তা করে দিল মুসা। ভেজা চটচটে পদার্থ লেগে গেল হাতে। প্যান্টে ডলে মুছল হাতটা।

কতক্ষণ হাঁটল ওরা বলতে পারবে না। অন্ধকারে সময়ের হিসেব রাখা কঠিন। ঢালু হয়ে আসছে সুড়ঙ্গের মেঝে। আচমকা চেঁচিয়ে উঠল মুসা, খাইছে!

কি?

কি হয়েছে?

জানতে চাইল রবিন আর কিশোর।

দরজা!

কি করে বুঝলে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

এই তো, কাঠ। হাত দিলেই বোঝা যায়…নিশ্চয় ওই ঘরটা, যেটাতে মড়ার খুলি… ভয়ে কথাটা আর শেষ করল না মুসা।

কাছে সরে এল কিশোর। কই, দেখি?

ঠেলা দিতে খুলে গেল পাল্লা। ভেতরে ঢুকে পড়ল তিনজনে। দরজার পাশে দেয়ালে হাত রাখতে সুইচবোর্ডটা পেয়ে গেল কিশোর। আলো জ্বলল। ছাত থেকে ঝুলে থাকা মৃদু পাওয়ারের একটা বাল্ব।

ছোট ঘর। যে ঘরটাতে খুলি দেখেছিল, সেটা নয়। এটা অন্য ঘর। একটা বড় বিছানা আছে। একটা নাইটস্ট্যান্ড, দুই ড্রয়ারের ড্রেসার এবং একটা টেলিফোনও আছে।

আরেকবার ফোন করে দেখো না পুলিশকে, গলা থেকে মাকড়সার জাল টেনে সরাতে সরাতে বলল রবিন, ওরা লোক পাঠাল কিনা?

কথাটা মন্দ না। রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল কিশোর।

নীরব। ডায়াল টোন নেই।

ডেড, আনমনে বলল সে।

হু, আমাদের মত, বিড়বিড় করল মুসা। পার্থক্য শুধু এটা হয়ে গেছে, আমাদের হতে বাকি আছে…

কিশোরের দিকে তাকাল রবিন, এখানকার সব ফোনই কিন্তু একটা সুইচবোর্ডের ভেতর দিয়ে গেছে। মনে নেই সেদিন, গেট থেকে ফোন করার সময়…

ঝট করে রবিনের দিকে ফিরে তাকাল কিশোর। বড় বড় হয়ে গেছে। চোখ। তাই তো! ইস, কি বোকা আমি! সামনের অফিসে রয়েছে। সুইচবোর্ডটা।

তাতে কি হয়েছে? মুসার প্রশ্ন।

কি হয়েছে এখনও বুঝতে পারছ না? রিসিভারে আঙুলগুলো চেপে বসেছে কিশোরের। সমস্ত কল যায় সুইচবোর্ডের ভেতর দিয়ে। পাইরেট আইল্যান্ডে পুলিশকে যে ফোন করেছি সেটাও গেছে। রিসিভারটা ক্রেডলে রেখে দুর্বল ভঙ্গিতে বিছানায় বসে পড়ল সে।

অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছিল মিলার, রবিন বুঝে ফেলেছে। মুখ কালো হয়ে গেছে তারও। মুসার দিকে তাকাল, ওর মুখের রহস্যময় হাসিটা লক্ষ করোনি?

আমি করেছি, হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল কিশোর, এতক্ষণে বুঝলাম পুলিশ এল না কেন। ওদের সঙ্গে কথাই বলতে পারিনি। বলেছি মিলারের সঙ্গে। কণ্ঠস্বরটা অমন ভোঁতা শোনাচ্ছিল কেন এখন পরিষ্কার। রিসিভারে রুমাল চেপে ধরে কথা বলছিল।

হু, পাগল হলেও বুদ্ধি ঠিক আছে ষোলোআনা, তিক্তকণ্ঠে বলল মুসা। ধপ করে কিশোরের পাশে বসে পড়ল সে। তারমানে আমাদের উদ্ধার। করতে আর আসছে না কেউ।

নাহ, দরজার দিকে তাকাল কিশোর। যা করার আমাদের নিজেদেরই করতে হবে এখন। ছাতের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করল, আন্ট জোয়ালিন!

কি?

আন্ট জোয়ালিনের কথা বলছি। কোরি যতবার ফোন করেছে, ততবার সুইচবোর্ডের কাছে বসে বোর্ডটা কন্ট্রোল করেছে মিলার। একটা কলও আন্ট জোয়ালিনের কাছে যেতে দেয়নি। সেজন্যেই মিস ভায়োলার বাড়িতে ফোন করে কোন জবাব পায়নি কোরি। আন্ট জোয়ালিন এখানে আসেন এটা চায়নি মিলার। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় সে খুশি হয়েছে। তার পার্টির ব্যাপারে নাক গলাতেন তিনি, ঝামেলা তো অবশ্যই করতেন…

চলো এখান থেকে বেরিয়ে যাই, উঠে দরজার কাছে চলে গেল মুসা। ডাইনিং রূমের খুব কাছাকাছি রয়েছি আমরা। যে কোন সময় চলে আসতে পারে পাগলটা।

কোথায় যাব? হাতের তালুতে থুতনি ঠেকিয়ে বসে রইল কিশোর।

সৈকতে। ওখানেই তো পালিয়েছিলাম।

কি হবে তাতে?

হয়তো হবে না কিছু। কিন্তু এখানে যেমন, ফাঁদে আটকা পড়া ইঁদুরের অবস্থা তো আর হবে না। দৌড়াদৌড়ি করার অন্তত সুযোগ থাকবে।

উঠে দাঁড়াল কিশোর। ঘরটা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে আলোটা নিভিয়ে দিল। তাতে আগের চেয়ে অন্ধকার লাগল সুড়ঙ্গটা। গরমও বেশি লাগছে কেন যেন। বদ্ধ বাতাসে বিশ্রী একধরনের ভাপসা গন্ধ।

ওই দেখো, হাত তুলে ফিসফিস করে বলল মুসা।

কিশোরও দেখল। সামনে কয়েক গজ দূরের একটা দরজার ফাঁক দিয়ে হলদে আলো আসছে।

পাতলা আলোর ফালিটার দিকে তাকিয়ে আছে ওরা, এই সময় ঘরের ভেতর পায়ের শব্দ শোনা গেল। তারপর কাশি।

খাইছে! ভয়ে কেঁপে উঠল মুসার গলা। ভূত না তো?

Exit mobile version