Site icon BnBoi.Com

স্বাধীনতা যুদ্ধে অচেনা লালবাজার – সুপ্রতিম সরকার

স্বাধীনতা যুদ্ধে অচেনা লালবাজার - সুপ্রতিম সরকার

০. অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের রোমহর্ষক বীরগাথা

ভূমিকা
 . . .

যে লেখকের প্রথম বই ‘গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার’ প্রকাশমাত্রই বিপুল সমাদর পেয়েছে পাঠকমহলে, তাঁর দ্বিতীয় বইয়ের মুখবন্ধ লেখা বড় একটা সহজ কাজ নয়। ‘অচেনা লালবাজার’-এর কাহিনিগুলি শুধু অগ্নিযুগের তরুণ-তরুণীদের অসমসাহসের আখ্যানই নয়, এই বইয়ের পাতায় পাতায় প্রতিফলিত হয়েছে নিজেরাই নিজেদের দেশের ভাগ্যনিয়ন্তা হওয়ার প্রবল আকুতিও, যা প্রবাহিত হত সে যুগের বিপ্লবীদের শিরায়-উপশিরায়। সেই প্রেক্ষিতেই আমার ধারণা, এই বইটি সর্বস্তরের পুস্তকপ্রেমীর কাছে সংগ্রহযোগ্য হিসাবে বিবেচিত হতে চলেছে। এবং সেই কারণেই এই বইয়ের মুখবন্ধের রচয়িতা হওয়ার সুযোগও সহজে উপেক্ষা করা যায় না। অতএব, এই কয়েক লাইন।

বইটিতে দশটি কাহিনি রয়েছে, যার মধ্যে নয়টি অগ্নিযুগের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদের সংগ্রামের প্রামাণ্য দলিল। একটি কাহিনির কেন্দ্রে বিরাজ করছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।

‘অচেনা লালবাজার’-এ লিপিবদ্ধ কাহিনিগুলি পড়তে পড়তে অশ্রু সংবরণ করা সত্যিই কঠিন হয়ে পড়ে। কী অনায়াসেই না অকল্পনীয় ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন সে যুগের তরুণ-তরুণীরা! অর্থ নয়, প্রচার নয়, যাঁদের একমাত্র চালিকাশক্তি ছিল দেশপ্রেমের মহতী আদর্শ। এই বইটিতে ধরা রয়েছে নাম-না-জানা বিপ্লবীদের নিঃস্বার্থ ত্যাগের খতিয়ান, যার সিংহভাগই দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্থান পায়নি ইতিহাস বইয়ের পাতায়।

এই বই কিন্তু ইতিহাসের পুনর্লিখনের প্রয়াস নয়। প্রয়াস বরং অজানা-অচেনা বিপ্লবীদের অপঠিত-অকথিত বীরগাথাকে প্রাপ্য সম্মান দেওয়ার। কলকাতা পুলিশের মহাফেজখানা থেকে লেখক তাঁর অননুকরণীয় ভঙ্গিতে তুলে এনেছেন কাহিনিগুলি। বিজয়ী বা বিজিতের দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিহাসযাপন নয়, এই বই বস্তুত পূর্বপুরুষের প্রতি উত্তরপুরুষের শ্রদ্ধানিবেদন।

নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, ‘প্রকৃত নেতা তাঁরাই, যাঁরা দেশের স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকেন।’ এই বইটি সেই প্রকৃত নেতাদেরই ত্যাগের উদযাপন। আশা করি, শুধু বর্তমানই নয়, আগামী প্রজন্মকেও প্রেরণা জোগাবে অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের কাহিনিগুলি।

আজ থেকে ঠিক বিয়াল্লিশ বছর আগে, ১৯৭৬ সালের ১৬ জুন, দক্ষিণ আফ্রিকার সোয়েটো-অভ্যুত্থানের সময় তোলা একটি ছবির কথা মনে করিয়ে দিই, যে ছবিতে হেক্টর পিটারসন নামের বারো বছরের এক মৃত্যুপথযাত্রী বালককে কোলে নিয়ে ছুটতে দেখা গিয়েছিল এক ক্রন্দনরত যুবককে, যে ছবি নাড়িয়ে দিয়েছিল সমগ্র বিশ্বকে। প্রভাবের অভিঘাতে এই ছবিটি তুলনীয় ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় তোলা সেই পুলিৎজ়‌ার পুরস্কারবিজয়ী ছবিটির সঙ্গে। যে ছবিতে নাপাম বোমা নিক্ষেপের মারণ-প্রতিক্রিয়ায় এক বিবস্ত্রা বালিকাকে অসহায়ভাবে কাঁদতে দেখা গিয়েছিল। যে ছবির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল যুদ্ধের অবসানে।

আমাদের দেশের হেক্টর পিটারসনদের কাহিনিও জানা প্রয়োজন সবার। কলকাতা পুলিশের সংগ্রহশালা এবং সুপ্রতিমের লেখনীর মধ্যস্থতায় সেই প্রয়োজনের কিয়দংশ মিটবে বলেই আমার বিশ্বাস। ছবিটি (সৌজন্য: উইকিপিডিয়া) ভাগ করে নিচ্ছি আপনাদের সঙ্গে।

এই বইয়ের একটি কাহিনিও যদি পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করতে পারে, এ প্রকাশনা সার্থক। কলকাতা পুলিশ-পরিবারের পক্ষ থেকে অগ্নিযুগের নাম-না-জানা বিপ্লবীদের জানাই সশ্রদ্ধ স্যালুট।

রাজীব কুমার আই.পি.এস.
নগরপাল, কলকাতা
১৬ জুন, ২০১৮

.

লেখকের কথা
 . . .

এ বই অন্য লালবাজার নিয়ে, অচেনা লালবাজার নিয়ে। এ বই অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের নিয়ে, অচেনা বিপ্লবীদের নিয়ে।

সূত্রপাত কলকাতা পুলিশের ফেসবুক পেজ থেকে। যেখানে ‘পুরনো সেই দিনের কথা’ শীর্ষকে গত বছরের শেষ দিকে পোস্ট করা হত অগ্নিযুগের বঙ্গজ বিপ্লবীদের বীরগাথা। কীভাবে সহিংস জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে যেনতেনপ্রকারেণ দমনের চেষ্টা করত প্রাক-স্বাধীনতা আমলের লালবাজার, থাকত তার অনুপুঙ্খ বিবরণও। কলকাতা পুলিশের মহাফেজখানায় সংরক্ষিত বিস্তর নথিপত্র ঘেঁটে লেখা সেই পোস্টগুলি পাঠকদের আগ্রহ জাগিয়েছিল। বইয়ের আকারে প্রকাশিত হোক,অনুরোধ জানিয়েছিলেন অনেকে। এ বই সেই দাবিপূরণ। ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের পর থেকে যে কয়েক দশকের সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে ইতিহাসবিদরা ‘অগ্নিযুগ’ বলে অভিহিত করেন, তা নিয়ে বই রয়েছে প্রচুর। গবেষণাও বিস্তর। ইতিহাসচর্চার সেই সামগ্রিক প্রেক্ষাপটকে এই বই মৌলিক স্তরে সমৃদ্ধ করবে, এমন দাবি করার অবকাশ নেই। ‘অচেনা লালবাজার’-এ শুধু ফিরে দেখা তৎকালীন পুলিশ প্রশাসনের কর্মপদ্ধতি-রণনীতি-কলাকৌশল, ফিরে দেখা সে সময়ের অসমসাহসী বিপ্লবীদের শৌর্য-বীর্য-ত্যাগ।

‘বিপ্লবী’ বলতে তাঁদের কথাই মুখ্যত, যাঁরা কাব্যে উপেক্ষিত। ইতিহাসেও। যাঁদের জন্য বরাদ্দ থেকেছে বিস্মৃতি, যাঁদের অচিন্তনীয় সাহস এবং দেশের জন্য নিঃস্বার্থ আত্মবলিদানের কাহিনি ঠাঁই পায়নি পাঠ্য ইতিহাসের পাতায়। গবেষকরা নিশ্চিত জানবেন কানাইলাল ভট্টাচার্য বা বীরেন দত্তগুপ্তের নাম, ইতিহাসবিদদের স্মরণে থাকবে হাবু মিত্র বা সুশীল সেনকে। কিন্তু আমার-আপনার মতো গড়পড়তা সাধারণরা?

সত্যিটা স্বীকার্য, ক্ষুদিরাম-প্রফুল্ল চাকী-মাস্টারদা-বাঘা যতীন-প্রীতিলতা-মাতঙ্গিনী-বিনয়-বাদল-দীনেশ-এর বাইরেও ছিলেন অশ্রুত-অপঠিত-অকথিত অনেকে, যাঁদের নামই শোনেনি সংখ্যাগরিষ্ঠ। যাঁদের জন্ম বা মৃত্যুদিনের উদযাপন নেই, নেই আবক্ষমূর্তিতে মাল্যদানের সমারোহ। তাঁদের নিয়েই বই। বই যত না, তার চেয়েও বেশি বোধহয় পূর্বপুরুষের ঋণ শোধের চেষ্টা সীমিত সাধ্যে। যত না বই, তার থেকেও বেশি বোধহয় দায়। পরবর্তী প্রজন্মকে জানানোর দায়, কতটা ত্যাগের মূল্যে এসেছিল কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। দশটি কাহিনি রয়েছে বইয়ে। যার মধ্যে ন’টিতে রয়েছে বিপ্লবীদের সঙ্গে সেকালের লালবাজারের সম্মুখসমরের আখ্যান। একমাত্র বিনয়-বাদল-দীনেশ ছাড়া বাকি আটটি কাহিনির কুশীলবরা আমপাঠকের অচেনা। বা, চেনা যদিও হয়, সে চেনা ক্ষণস্থায়ী খুচরো আলাপের, গভীর সখ্যের নয়।

একটি কাহিনি, পাঠক লক্ষ করবেন নিশ্চিত, বিপ্লবের সঙ্গে সম্পর্কহীন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। একবারই লালবাজারে বিশ্বকবির পদার্পণের সম্ভাব্য পটভূমি তৈরি হয়েছিল ঘটনার ঘনঘটায়। হোক বিপ্লবের সঙ্গে সম্পর্করহিত, রবীন্দ্রনাথ তো! ‘অচেনা লালবাজার’-এ থাকবেন না, হয়? বরেণ্য দেশনায়কদের নিয়ে ইতিহাসধর্মী গল্প-উপন্যাসের সংখ্যা নেহাত কম নয় বাংলা সাহিত্যে। কিন্তু একেবারেই অনামীদের নিয়ে লেখাপত্র চোখে পড়ে না বিশেষ। যদি বা পড়ে, অধিকাংশই হয় ইতিহাসের আপাতনীরস তথ্যস্রোত, নয়তো আবেগের উচ্ছ্বাস।

এ বইয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা থেকেছে আদ্যন্ত তথ্যনিষ্ঠ থেকেও থ্ৰিলারধর্মিতা বজায় রাখার, যাতে পাঠক ইতিহাসবিমুখতায় আক্রান্ত না হন, অথচ রেশ থেকে যায় স্মৃতিতর্পণের। চেষ্টাই মাত্র। কতটা হয়েছে, আদৌ হয়েছে কিনা, পাঠক বলবেন।

ফেসবুকের পোস্টগুলি বইয়ের আকারে প্রকাশিত হোক, আন্তরিক ভাবে চেয়েছিলেন কলকাতার নগরপাল শ্রীরাজীব কুমার। আগাগোড়া বলে এসেছেন, ‘পরের প্রজন্মের জানা দরকার, ভীষণভাবে জানা দরকার নাম-না-জানা বিপ্লবীদের এই ত্যাগের খতিয়ান। বই হওয়া দরকার।’ লেখার সময় উৎসাহ জুগিয়েছেন অনিঃশেষ। কৃতজ্ঞতার শেষ নেই তাঁর কাছে। এ বই দিনের আলো দেখল তাঁরই উৎসাহে-উদ্যোগে।

অশেষ ধন্যবাদ কলকাতা পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার শ্রীনীহার রায়কে, যিনি ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে কত যে নথি, কত যে বই অক্লান্ত সরবরাহ করে গিয়েছেন, হিসেব নেই কোনও। অনুজ সহকর্মী ইন্দ্রজিৎ দত্তকে ধন্যবাদ, ম্যানুস্ক্রিপ্ট টাইপই শুধু নয়, লেখকের হাজার বায়নাক্কা হাসিমুখে সামলানোর জন্যও।

ইতিহাস নিয়ে লেখাপত্রে তথ্যপ্রমাদের একটা ভয় থাকেই। যদি থেকে যায় তথ্যের কোনও ভুলভ্রান্তি, দায় শুধুমাত্র লেখকেরই।

‘অচেনা লালবাজার’ পেশ করলাম পাঠকের দরবারে। বাহ্যিক বিচারে বই, আসলে শ্রদ্ধার্ঘ্য।

০১. শুধু নামেই ‘সুশীল’

—আরে, এ যে নেহাতই বাচ্চা! He’s just a child!

—রাইট স্যার, স্টিল মাইনর। কিন্তু তেজ আছে ষোলো আনা। নিষেধ করলেও শুনছিল না। উলটে অফিসারের গায়ে হাত তুলেছে!

—হোয়াট?

—ইয়েস স্যার, ছুটে এসে ধাক্কা দিয়েছে। ঘুসি মেরেছে। সাহসটা ভাবুন একবার! কাস্টডি করে দিই?

—না… জুভেনাইল… কিন্তু হি মাস্ট পে ফর হোয়াট হি হ্যাজ় ডান। Do something, take him downstairs, গুনে গুনে পনেরো ঘা বেত লাগাবেন। Cane him! No less than fifteen times! তারপর ছেড়ে দেবেন।

—রাইট স্যার।

হিড়হিড় করে টানতে টানতে তিনতলা থেকে নীচে নিয়ে যাওয়া হয় একরোখা কিশোরকে। অনুতাপের লেশমাত্র নেই যার চোখেমুখে। বরং ফুঁসছে তখনও।

—এ মেনে নেওয়া যায় না.. কিছুতেই না! একটা বাচ্চা ছেলেকে সবার সামনে ওইভাবে বেত দিয়ে একটার পর একটা..

—হুঁ… মানুষ নয়… নরপশু একটা।

প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের বিবৃতি

—সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। একে উচিত শিক্ষা না দিতে পারলে আন্দোলনের মেরুদণ্ড বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না।

—মানছি। কিন্তু শিক্ষাটা কী সেটা তো ভাবতে হবে, আর কে কীভাবে দেবে, সেটাও..

—একটাই শিক্ষা হয় ওই অমানুষের। মৃত্যু! বেঁচে থাকার অধিকার নেই আর।

—একমত। কিন্তু চাইলেই তো হল না। সর্বক্ষণ সান্ত্রি-পেয়াদারা ঘিরে রেখেছে। কাছে যাওয়াই মুশকিল। ওই পাহারার মাঝে ওকে মারতে যাওয়া মানে আত্মহত্যা।

—কিন্তু উপায় তো একটা করতে হবে। হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব এর পরও?

—কী উপায়?

—আমার একটা প্ল্যান ঘুরঘুর করছে মাথায় …

—কী প্ল্যান?

.

পুরনো সেই দিনের কথা। সূত্রপাত এক শতকেরও বেশি আগে, লালবাজার চত্বরে। দেশ তখনও স্বাদ পায়নি কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার। ‘ইউনিয়ন জ্যাক’-কে কক্ষচ্যুত করতে ঢের দেরি আছে ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকার।

বিংশ শতকের প্রথম দশকে বাংলায় স্বদেশি আন্দোলন তখন ক্রমে তীব্র থেকে তীব্রতর। ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার সর্বব্যাপী ক্ষোভ বিপ্লবীদের উদ্বুদ্ধ করছে অত্যাচারী শাসককে সশস্ত্র আক্রমণে। ‘অনুশীলন সমিতি’ এবং ‘যুগান্তর’-এর মতো গুপ্ত সংগঠনগুলি সক্রিয়তার তুঙ্গে তখন। যে সক্রিয়তায় রাশ টানতে একাধিক সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হচ্ছে মরিয়া ব্রিটিশ প্রশাসন।

পাশাপাশি ‘বন্দে মাতরম’-এর মতো জাতীয়তাবাদী পত্রিকাগুলিতে দেশাত্মবোধক নিবন্ধ এতটাই উদ্দীপনা জাগাচ্ছে জনমানসে, প্রভাবে-প্রসারে এতটাই বিস্তার তার দেশপ্রেমী আবেদনের, লেখক এবং প্রকাশক, উভয়ের উপরই নির্বিচারে নেমে আসছে রাজদণ্ড। শাসকের রাজদণ্ড। যা বেশ কিছুকাল আগে, ‘পোহালে শর্বরী, বণিকের মানদণ্ড’ ছেড়ে দেখা দিয়েছিল অকপট।

এখন যেখানে লালবাজারের অবস্থান, তখন তার একটি অংশে ছিল চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত। যা একাধিক সাড়া-জাগানো মামলার বিচারপর্বের সাক্ষী। ম্যাজিস্ট্রেটের আসনে সে-সময় Douglas Hollinshed Kingsford। উচ্চশিক্ষিত, ট্রিনিটি কলেজের কৃতী ছাত্র। ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে (আইসিএস) যোগদান ১৮৯৪ সালে। একাধিক জেলায় গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করার পর ১৯০৫ সালে কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হলেন। বঙ্গভাষা আয়ত্ত করে ফেলেছিলেন অল্পদিনেই। সরকারি বাসস্থান শুরুর দিকে ছিল হাঙ্গারফোর্ড স্ট্রিটে, পরে স্থানান্তরে কিড স্ট্রিটে।

কিংসফোর্ড নিজের মেধা এবং দক্ষতার সিংহভাগ কাজে লাগাতেন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি নির্মমতায়। ১৯০৭-এর ২৪ জুলাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত (স্বামী বিবেকানন্দের ভাই)-কে এক বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করলেন। অপরাধ? ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় দুটি রচনা প্রকাশ করেছেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে। ব্রিটিশ বিচারক শাসিত দেশের স্বাধীনতাকামীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হবেন না, প্রত্যাশিত। ‘দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা’-র ‘সমান আঘাতে’ কাঁদার প্রশ্ন নেই, স্বাভাবিকই। কিন্তু কিংসফোর্ড সাহেবের ক্রিয়াকলাপ ছিল নিষ্ঠুরতায় মাত্রাহীন।

মামলা হল ‘বন্দে মাতরম’ পত্রিকার বিরুদ্ধেও। অভিযোগ একই, শাসকের শোষণের সোচ্চার বিরুদ্ধাচরণ। সেই মামলার বিচার চলাকালীন অনেকে, অধিকাংশই প্রাণোচ্ছল তরুণ, ভিড় করতেন আদালত চত্বরে। বিপিনচন্দ্র পাল যখন পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক অরবিন্দ ঘোষের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যদান করতে অস্বীকার করলেন, মামলা নাটকীয় মোড় নিল।

শুনানির দিনগুলিতে হাজারে হাজারে মানুষ ভিড় জমাতে শুরু করলেন বর্তমানের লালবাজার প্রাঙ্গণে। জনস্রোত আর স্বদেশি স্লোগানের যুগলবন্দি সামলাতে ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ প্রায়ই নির্দয় লাঠি চালাতে শুরু করল সাধারণের উপর। নির্বিচার এবং মায়া-মমতাবর্জিত।

দমনপীড়ন সহ্যসীমা অতিক্রম করল ১৯০৭-এর ২৬ অগস্ট। মামলার শুনানি চলছে। বাইরে যথারীতি লোকারণ্য এবং পাল্লা দিয়ে ‘বন্দে মাতরম’-এর নির্ঘোষ। জমায়েত ক্রমশ বাড়ছে কলেবরে। আবেগের লাভাস্রোত নিয়ন্ত্রণে অন্য দিনের মতোই পুলিশ লাঠি চালাল ইনস্পেকটর E B Huey-এর নেতৃত্বে। রুখে দাঁড়াল বছর পনেরোর রোগাসোগা চেহারার এক কিশোর। সুশীল সেন। পালটা কয়েক ঘা দিল ইনস্পেকটরকে। অসম যুদ্ধে নতিস্বীকার করতেই হল সুশীলকে। ধরে-বেঁধে নিয়ে যাওয়া হল ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে।

কিংসফোর্ড দেখলেন, শুনলেন এবং বললেন, ‘আরে, এ তো নেহাতই বাচ্চা! একে সবার সামনে পনেরো ঘা বেত মেরে ছেড়ে দাও।’ ১৮৯৯-এর ‘Whipping Act’-এ এমন বেত্রাঘাতের বিধিনিয়ম ছিল।

আদেশ পালিত হল। ইতিহাসবিদদের লেখনীতে চিত্রিত রয়েছে সে দৃশ্য। লালবাজার চত্বরে পনেরো বছরের কিশোরের পিঠে একের পর এক বেতের ঘা আছড়ে পড়ছে। আর প্রতিটি আঘাতের সঙ্গে জোর বাড়ছে সুশীলের স্লোগানের, ‘বন্দে মাতরম!’ প্রহারের পাশবিকতায় নিষ্ফলা ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল স্তম্ভিত জনতা। কিংসফোর্ড মনুষ্যত্বকে প্রহসনে পরিণত করেছিলেন অক্লেশে।

এই নৃশংস ঘটনা তীব্র অভিঘাতের সৃষ্টি করল বাংলা জুড়ে। বিপ্লবীরা কিংসফোর্ডের নাম দিলেন ‘কসাই কাজি’। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর মতো তথাকথিত ‘নরমপন্থী’-রাও সোচ্চার হলেন প্রতিবাদে, আর ‘কট্টরপন্থী’-রা সিদ্ধান্ত নিলেন, ‘এ অপরাধের ক্ষমা নেই!’ কিংসফোর্ড-হত্যার ছক কষা শুরু হল।

—আমার একটা প্ল্যান ঘুরঘুর করছে মাথায়।

—কী প্ল্যান?

.

সুশীলের জন্ম শিলং-এ, ১৮৯২ সালে। বাবা কৈলাশচন্দ্র সেন ছিলেন শিলং-এর আইজি (কারা)-র কার্যালয়ে প্রধান করণিক। শৈশব থেকে কৈশোরে পা রাখা দেশব্যাপী ব্রিটিশ-বিরোধিতার আবহে। তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী ছিলেন সুশীল। শিলং-এর গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে ডবল প্রোমোশন পেয়েছিলেন। ১৯০৫ সালে সিলেটের জ্ঞানেন্দ্রনাথ ধরের গুপ্ত সংগঠনে যোগ দিলেন। বিশেষ প্রশিক্ষণ নিলেন বক্সিং আর লাঠিখেলায়। ১৯০৬-এ সিলেটে অনুষ্ঠিত হল সুর্মা ভ্যালি পলিটিক্যাল কনফারেন্স। যেখানে বিপিনচন্দ্র পালের বক্তৃতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে চলে এলেন কলকাতায়। ভর্তি হলেন ন্যাশনাল স্কুলে। জিমন্যাস্টিক্সের পাঠ নেওয়া শুরু করলেন বিপিনবিহারী গাঙ্গুলীর কাছে।

১৯০৭-এর অগস্টে আদালত প্রাঙ্গণে ঘটল বেত্রাঘাতের ঘটনা। বিপ্লবীদের কাছে রাতারাতি নায়কের মর্যাদায় উন্নীত হলেন সুশীল। সংবর্ধিত হলেন কলেজ স্কোয়ারে। অকুতোভয় কিশোরকে দেখতে উপচে পড়ল ভিড়। এই ঘটনা নিয়ে কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ লিখলেন তুমুল জনপ্রিয় হওয়া গান, যা তখন মুখে মুখে ঘুরত বিপ্লবীদের।

(আমার) যায় যাবে জীবন চ’লে আমায়—

বেত মেরে কি ‘মা’ ভোলাবে?

আমি কি মা’র সেই ছেলে?

সুশীল ক্রমে আরও জড়িয়ে পড়লেন বিপ্লবী কার্যকলাপে। অসমসাহসী কিশোরকে শরিক করা হল কিংসফোর্ড-নিধনের চিত্রনাট্যে। দায়িত্ব পড়ল অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেটের বাসস্থানের পারিপার্শ্বিক খুঁটিনাটি সরেজমিনে একাধিকবার দেখে আসার। দেখে তো এলেন, অতঃকিম?

তখন জল্পনা চলছিল প্রশাসনিক মহলে কিছুদিন ধরেই, কলকাতা থেকে বদলি হয়ে যেতে পারেন কিংসফোর্ড। সম্ভাব্য বদলির আগেই শত্রুনিকেশে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন বিপ্লবীরা। পরিকল্পনা প্রস্তুত হয়েছিল প্রভূত সময়ব্যয়ে। প্রয়োগে আর বিলম্ব অনুচিত, সিদ্ধান্ত হল সর্বসম্মত।

.

সরকারি চাকুরের কর্মস্থান স্থানান্তরের সময় যা স্বাভাবিক, তুঙ্গে থাকে ব্যস্ততা তল্পিতল্পা গোটানোর। পরবর্তী কর্মস্থলে নির্দিষ্ট সময়ে যোগদানের সময়সীমা থাকে, যা লঙ্ঘিত হলে ঊর্ধ্বতনের রক্তচক্ষুর সম্মুখীন হওয়া অবধারিত। উপস্থিত অস্থাবর সম্পত্তি নিয়ে যেনতেনপ্রকারেণ গন্তব্যে প্রস্থানই তখন অগ্রাধিকার পায়, বহনযোগ্য গৃহসামগ্রীর সুচারু পারিপাট্য নয়।

কিংসফোর্ড সাহেবের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটেনি। মুজফ্‌ফরপুরে বদলির আদেশ এসেছে। নতুন দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হবে যত দ্রুত সম্ভব। সময়াভাবে রওনা দিয়েছিলেন কোনওমতে লটবহর মালবাহী ট্রাকে গচ্ছিত করে।

.

নাশকতামূলক কাজকর্মে আজকাল আকছার ব্যবহৃত হয় Improvised Explosive Devices (IED)। রেডিয়ো, সাইকেল, টিফিনবক্স, হাতঘড়ি, ল্যাপটপ এবং আরও নানাবিধ দৈনন্দিন ব্যবহার্য সামগ্রী ব্যবহার করে বিস্ফোরণ ঘটানোর উদাহরণ রয়েছে অসংখ্য। গোপনও কিছু নয়, ইন্টারনেটে মজুত পর্যাপ্ত তথ্যভাণ্ডার।

আলোচ্য ঘটনা একশো বছরেরও বেশি আগের, যখন না ছিল প্রযুক্তির অবাধ আনুকূল্য, না ছিল বহির্জগৎ সম্পর্কে অনায়াস তথ্যস্রোত। সে না-ই বা থাকুক, চিন্তার অভিনবত্ব কবে আর সময়ের আজ্ঞাবহ থেকেছে? বিংশ শতকের প্রথম দশকেই বিপ্লবীরা কিংসফোর্ড হত্যায় প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন IED, তৈরি হয়েছিল বই-বোমা।

কিংসফোর্ডের পুস্তকপ্রীতি সুবিদিত ছিল। বিদায়ী উপহার-উপঢৌকন জমা হবেই ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কিড স্ট্রিটের বাড়িতে। উপহার হিসাবেই পৌঁছে দেওয়া হবে সুদৃশ্য মোড়কে বই। কিংসফোর্ড খুলবেন, খোলার সঙ্গে সঙ্গেই ভিতরে রাখা বোমা ফাটবে সশব্দ তীব্রতায় এবং ঘটবে কার্যসিদ্ধি, এই ছিল হত্যার নীল নকশা।

নকশা রূপায়ণের দায়িত্ব ন্যস্ত হল মেদিনীপুরের বিপ্লবী হেমচন্দ্র দাসের উপর। হেমচন্দ্র ১৯০৬ সালের জুলাইয়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন। বিদেশের বিভিন্ন বিপ্লবী সংগঠনগুলির সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো এবং তাদের কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত হওয়াই ছিল উদ্দেশ্য। নানা ধরনের বোমা তৈরির কৌশল শিখলেন ফ্রান্সে। দেশে ফিরলেন ১৯০৭ –এ। সঙ্গে আনলেন ব্রাউনিং পিস্তল আর বোমা বানানোর ম্যানুয়াল। এবং ফিরেই যোগ দিলেন কলকাতায় বারীন ঘোষের গুপ্ত সমিতিতে। দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন পূর্ণ উদ্যমে। এহেন হেমচন্দ্রের উপরই যে ভার পড়বে বই-বোমা তৈরির, আশ্চর্য কী!

হেমচন্দ্র লেগে পড়লেন কাজে। কোন বইয়ের ভিতর রাখা হবে বোমা? এমন কোনও বই হতে হবে, যা হাতে নিলে কিংসফোর্ডের উৎসাহের উদ্রেক হবে অবধারিত। বাধ্য হবেন পাতা উলটোতে। কী হতে পারে সেই বই? অনেক ভেবে বিপ্লবীরা সিদ্ধান্ত নিলেন, কিংসফোর্ড পেশায় বিচারক, পড়াশুনোর নিয়মিত অভ্যেস রয়েছে, আইনের বই পাঠানোই ভাল।

কী বই? Herbert Broom-এর লেখা ‘Commentaries on the Common Law: Designed as its Introductory to its Study’, পৃষ্ঠাসংখ্যা ১০৭৫। হেমচন্দ্র বইয়ের প্রথম ৮০ পাতা আর শেষের প্রায় ৪০০ পাতায় হাত দিলেন না। বাকি প্রায় ৬০০ পাতার প্রত্যেকটি নিপুণ ভাবে কেটে একটি চৌকো খোপ তৈরি করলেন। খোপ তো হল, এবার আসল কাজ। বোমার রসদ ভরা হল ক্যাডবেরি কোকোর কৌটোয়। বিস্ফোরক বোঝাই সেই কৌটো রাখা হল বইয়ের ভিতরের খোপে। হেমচন্দ্র একটি স্প্রিং দিয়ে জুড়লেন বইটিকে। এমন ভাবে জুড়লেন, যাতে কিংসফোর্ড বইটি খোলা মাত্রই স্প্রিং-এর সাহায্যে বোমার রসদ (পিকরিক অ্যাসিড আর ফালমিনেট অফ মার্কারি) সক্রিয় হবে মুহূর্তে, ঘটবে তীব্র বিস্ফোরণ। এবং অতীত হয়ে যাবেন ‘কসাই কাজি’।

বিপ্লবী পরেশ মৌলিক সরকারি কর্মচারীর পরিচয়ে কিংসফোর্ডের বাড়ির সান্ত্রিদের কাছে পৌঁছে দিলেন প্যাকেট। সাহেবের বদলির পর এমন বিদায়-উপহার অনেকই আসছে, বিন্দুমাত্র সন্দেহ না করেই প্যাকেট পৌঁছল অন্দরমহলে। সেটা ১৯০৮-এর জানুয়ারি মাস।

কিন্তু বিধি বাম! মাসদুয়েকের মধ্যেই মুজফ্‌ফরপুরে বদলি হয়ে গেলেন কিংসফোর্ড, জেলা ও দায়রা আদালতের বিচারপতি হিসাবে। গোছগাছের তাড়াহুড়োয় বইয়ের প্যাকেট খোলাই হল না। ট্রাকবন্দি হয়ে বই-বোমা পাড়ি দিল মুজফ্‌ফরপুর।

এবং দুর্ভাগ্য বিপ্লবীদের, নতুন কর্মস্থলে পৌঁছেই তুমুল ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কিংসফোর্ড। বদলির সময় পাওয়া অন্য অনেক উপহারের সঙ্গে বই-বোমাও স্থান পেল বাংলোর আস্তাবলের কাছে একটি গুদামে। কে কী উপহার দিয়েছে, পরে সময়মতো খুলে দেখবেন, এমনটাই ভাবলেন কিংসফোর্ড। আইনের মোটা বইটি পড়ে রইল প্যাকেটসুদ্ধ। খোলা হল না। আয়ুবৃদ্ধি ঘটল সাহেবের।

প্রাথমিকভাবে হতোদ্যম হয়ে পড়লেও হাল ছাড়লেন না বিপ্লবীরা। মুজফ্‌ফরপুরে গিয়েই হত্যা করা হবে কিংসফোর্ডকে, সিদ্ধান্ত হল। বারীন ঘোষ নির্বাচন করলেন দুই ঘাতককে। সুশীল সেন এবং প্রফুল্ল চাকী। যথাক্রমে ‘দুর্গাদাস সেন’ এবং ‘দীনেশচন্দ্র রায়’ ছদ্মনামে সুশীল-প্রফুল্ল সরেজমিনে ঘুরেও এলেন মুজফ্ফরপুর। দুই দফায় খুঁটিয়ে দেখে এলেন কিংসফোর্ডের বাংলোর অবস্থান। সাহেবের দৈনন্দিন গতিবিধির সম্পর্কে তৈরি করলেন সম্যক ধারণা।

চূড়ান্ত যাত্রার কয়েকদিন আগে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন সুশীলের বাবা। সিলেটের বাড়িতে কৈলাশচন্দ্র সেন তখন প্রায় মৃত্যুশয্যায়। একরোখা সুশীল জেদ ধরলেন, কিংসফোর্ড-নিধন সাঙ্গ করে তবেই যাবেন বাবাকে দেখতে। বারীন ঘোষ, হেমচন্দ্র দাস এবং অন্য বিপ্লবীরা বহু চেষ্টায় নিরস্ত করলেন সুশীলকে। পাঠালেন সিলেটে, বাবাকে শেষ দেখা দেখতে। সুশীলের পরিবর্তে অন্য এক তরুণ মুজফ্‌ফরপুর পাড়ি দিলেন কিংসফোর্ড-হত্যার লক্ষ্যে। নাম? ক্ষুদিরাম বসু।

.

কিংসফোর্ডকে হত্যার উদ্দেশ্যে ১৯০৮-এর ৩০ এপ্রিল ক্ষুদিরাম-প্রফুল্ল চাকীর দুঃসাহসিক অভিযানের দিনলিপি বহুআলোচিত, বহুপঠিত। বিস্তারিত নিষ্প্রয়োজন।

এই লেখার নিরিখে প্রাসঙ্গিক তথ্য এটুকুই, কিংসফোর্ড-হত্যার ব্যর্থ অভিযানের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কলকাতা শহরের বিভিন্ন জায়গায় বিপ্লবীদের গোপন ডেরাগুলিতে চিরুনিতল্লাশি চালিয়েছিল পুলিশ। সেই তল্লাশির সূত্রেই গ্রেফতার হয়েছিলেন অরবিন্দ-বারীন ঘোষ সহ অনেকে। উদ্ধার হয়েছিল প্রচুর গুলি-বন্দুক-অস্ত্রশস্ত্র-বোমা। শুরু হয়েছিল আলিপুর বোমা মামলা। এবং এই মামলার তদন্তেই পুলিশ হদিশ পেয়েছিল কিংসফোর্ডের বাংলোর গুদামঘরে একরাশ উপহারসামগ্রীর মধ্যে পড়ে থাকা বই-বোমার। আলিপুর বোমা মামলায় ধৃত এক বিপ্লবীকে জিজ্ঞাসাবাদের সূত্রে পুলিশ জানতে পেরেছিল ‘কসাই কাজি’-কে হত্যার পরিকল্পনার ইতিবৃত্ত। বছর গড়িয়ে তখন ১৯০৯-এর ফেব্রুয়ারি। বই-বোমা পাঠানোর পর প্রায় এক বছর অতিক্রান্ত।

ব্রিটিশ সরকারের ‘Sedition Committee’-র রিপোর্টে লেখা হয়েছিল, ‘A well known revolutionary, when in custody, said that a bomb had been sent to Mr. Kingsford in a parcel. The parcel did not contain a book; but the middle portion of the leaves had been cut away and the volume was thus in effect a box and in the hollow was contained a bomb with spring to cause the explosion if the book was opened.’

বই-বোমার কথা জানামাত্রই কলকাতা পুলিশ তড়িঘড়ি তারবার্তা পাঠিয়েছিল কিংসফোর্ডকে। বোমা বিশেষজ্ঞ Major Muspratt Williams-কে সদলবলে মুজফ্‌ফরপুর পাঠানো হয়েছিল যুদ্ধকালীন দ্রুততায়। বাংলোর গুদাম থেকে যথোচিত সতর্কতায় বই-বোমা আনা হয়েছিল কলকাতায়। নিষ্ক্রিয় করা হয়েছিল তৎকালীন নগরপাল Fredrick Loch Halliday-র কিড স্ট্রিটের বাসভবন সংলগ্ন বাগানে। বোমা নিষ্ক্রিয়করণের পর মেজর উইলিয়ামস ১৯০৯-এর ২৮ ফেব্রুয়ারি রিপোর্ট পেশ করেছিলেন সরকারকে, ‘…I proceeded to Muzaffarpore on the evening of the 22nd, arriving there next morning at 10 AM and was met by Mr. Kingsford, ICS and Mr. Armstrong, Superintendent of Police…. I placed the bomb in my own hand bag, having first wrapped it in cotton wool, and I padded it all round with cotton wool taken out of a cushion. I then caught the afternoon train back to Calcutta on the morning of 24th… I took the bomb to the compound of Mr. F L Halliday, CIE, MVO, Commissioner of Police, and was accompanied by Mr. Denham, who kindly assisted me in conducting operation, as also did Mr. Halliday.’

রিপোর্টে উইলিয়ামস লিখেছিলেন স্পষ্ট, কার্যকারিতায় কী মারাত্মক প্রাণঘাতী হতে পারত ওই বই-বোমা, ‘There is no doubt this would have been a most destructive bomb, had it exploded.’

বই-বোমাটি সংরক্ষণ করা হয়েছিল সযত্নে। রক্ষিত আছে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোডে আমাদের পুলিশ মিউজিয়ামে, ভারতের ইতিহাসে IED ব্যবহারের সম্ভবত প্রথম নিদর্শন হিসাবে।

.

সুশীল স্বাধীনতা আন্দোলনে আরও সক্রিয়ভাবে অংশ নেন পরবর্তী জীবনে। অরবিন্দ ঘোষের প্রেরণায় উচ্চশিক্ষায় মনোনিবেশ করেন। ম্যাট্রিকে চতুর্দশ স্থান, স্নাতক স্তরে রসায়নে স্বর্ণপদক। প্রেসিডেন্সি কলেজে পাঠরত অবস্থায় ইডেন হিন্দু হস্টেলে আলাপ যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ওরফে বাঘা যতীনের সঙ্গে, ফের উজ্জীবিত হওয়া দেশকে স্বাধীন করার ব্রতে।

বীরোচিত মৃত্যুবরণ ১৯১৫-য়। নদিয়ায় এক গোপন সশস্ত্র অভিযান চলাকালীন। ব্রিটিশ বাহিনীর চক্রব্যূহে আটকে পড়েছিল ছ’জনের দলটি। নেতৃত্বে ছিলেন সুশীল। মজুত গুলিও প্রায় শেষ। সুশীলের দু’পায়েই গুলি লেগেছিল। চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়েছিলেন। পরিস্থিতির বিচারে আপাতদৃষ্টিতে তিনটি রাস্তা খোলা ছিল। এক, পুরো দলটিরই আত্মসমর্পণ। দুই, অসম যুদ্ধ অব্যাহত রেখে মৃত্যুকে সমবেত স্বেচ্ছা-আহ্বান। এবং তিন, গুলিবিদ্ধ সুশীলকে ফেলে রেখে পশ্চাদপসরণ, যা কোনও অবস্থাতেই করতেন না সহযোদ্ধারা।

চতুর্থ রাস্তা দেখিয়েছিলেন সুশীল স্বয়ং। বিভ্রান্ত সহযোদ্ধাদের দ্রুত বোঝাতে পেরেছিলেন, সবাই মিলে শহিদ হলে অভীষ্ট অধরাই থেকে যাবে চিরতরে। একজনের মৃত্যু তবু শ্রেয় দলগত আত্মহননের তুলনায়। লড়াইটা অন্তত আগামীতে জারি রাখবে বাকিরা। সঙ্গীরা অনুরোধ রেখেছিলেন। ব্রিটিশ শাসকের নয়, সতীর্থদের বুলেটেই অবশিষ্ট প্রাণবায়ু নিঃশেষিত হয়েছিল তেইশ বছরের সুশীল সেনের। মৃতদেহ খুঁজে পেতে যাতে পুলিশের কালঘাম ছুটে যায়, চিহ্নিতকরণ হয় দুঃসাধ্য, সে পথও মৃত্যুর আগে সঙ্গীদের বাতলে দিয়েছিলেন সুশীল। পরিকল্পনা মতো সুশীলের মৃতদেহ খণ্ডিত করে বিভিন্ন জায়গায় পুঁতে দিয়েছিলেন সতীর্থরা। হদিশই পায়নি পুলিশ।

সুশীল ‘সুশীল’ বালক ছিলেন না। সেই ছেলে ছিলেন না, যাঁকে বেত মেরে মা-ভোলানো যাবে।

০২. কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা

—না, মা আসবে না। কিছুতেই না। আমি কিছুতেই মায়ের সঙ্গে দেখা করব না। তোরা বারণ করে দে।

—কেন এমন করছিস? মাসিমা কয়েক মিনিটের জন্য তোকে দেখতে চাইছেন শুধু …

—বললাম তো না …

—না কেন? ছেলের সঙ্গে মা একবার শেষ দেখা করতে পারবে না? কীসের এত জেদ তোর?

—জেদ নয়, ভয়। মা যদি কান্নাকাটি শুরু করে, আমি সামলাতে পারব না নিজেকে। বোঝার চেষ্টা কর।

—তোরও বোঝার চেষ্টা করা উচিত।

—বেশ, তোরা বোঝা মা’কে। আসুক, কিন্তু কোনও কান্নাকাটি চাই না। কোনও চোখের জল নয়। আমি ওতে দুর্বল হয়ে পড়ব।

—কাঁদবেন না, আমরা বোঝাব মাসিমাকে। তুই শুধু হ্যাঁ বল …

—হুঁ …

.

জেল-চত্বরে আলোচনা হচ্ছে যথাসম্ভব নিচু গলায়। প্রায় ফিসফিস করেই।

—কী! সব বলে দেবে বলেছে? বলে দিলে যে সর্বনাশ হবে!

—সে কি আর জানি না! শেষে কিনা এইভাবে বিশ্বাসঘাতকতা!

—কিন্তু খবরটা সত্যি তো? শিয়োর? স্বীকারোক্তি দেবে?

—একশো শতাংশ। ওকে বিশ্বাস করাটা মারাত্মক ভুল হয়েছিল। আর খবরের সত্যি-মিথ্যে? বুঝে গেছে সবাই। আলাদা ওয়ার্ডে ট্রান্সফার করছে ওকে। পাছে আমরা ওর কোনও ক্ষতি করি। পাহারা বসছে সেলের সামনে।

—তাতে কী? পাহারা-টাহারা যা বসায় বসাক। গদ্দারির সাজা মৃত্যু। সবাইকে ফাঁসিয়ে পার পেয়ে যাবে এভাবে?

—কীভাবে মারা হবে? কে মারবে?

—সেটা সবাই মিলে ঠিক করতে হবে। অস্ত্র জোগাড় করাটা প্রথম কাজ।

—অত সোজা নাকি এখানে আর্মস ঢোকানো?

—সোজা তো সেভাবে দেখতে গেলে কিছুই নয়। কাজটা কঠিন, কিন্তু রাস্তা নিশ্চয়ই একটা বেরবে।

—আমার তো ইচ্ছে করছে এক্ষুনি গিয়ে ওর গলা টিপে ধরতে …

—ওই বোকামোটা করতে গেলে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যেতে কয়েক মিনিট লাগবে। মরতে হলে ওকে মেরে মরিস।

—হুঁ … মেরেই মরব। একটা রিভলভার পেলেই …

—হ্যাঁ, আর্মস চাই, যেভাবেই হোক।

.

প্রায় সবারই প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ সম্পূর্ণ। লালবাজারের লক-আপ থেকে নগরপালের চেম্বারে এক এক করে পেশ করা হয়েছে অভিযুক্তদের। বাকি শুধু একজন। যাঁকে সশস্ত্র প্রহরায় ঢোকানো হয়েছে নগরপাল Fredrick Loch Halliday-র ঘরে। এই মধ্যতিরিশের লোকটি অন্যদের থেকে আলাদা, এক ঝলক দেখেই মনে হয় হ্যালিডে সাহেবের। আয়ত চক্ষু, প্রশান্ত মুখমণ্ডল। শরীরী ভাষায় উদ্বেগ নিরুদ্দেশ। নগরপাল প্রশ্ন ছুড়ে দেন সরাসরি।

—‘Aren’t you ashamed of being involved in this cowardly, dastardly activity?’

যুবক নিরুত্তাপ।

—‘What right have you to assume that I was involved?’

নগরপাল ঝাঁঝিয়ে ওঠেন।

—‘I am not assuming, I know everything.’

যুবক অবিচলিত। শান্ত উত্তর আসে।

—‘What you know or do not know is your concern. I wholly deny having any connection with these murderous acts.’

.

১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ, সর্বজনজ্ঞাত তথ্য, জনমানসে উৎপন্ন করেছিল তীব্র ক্ষোভ। যা অনুঘটক হয়ে দেখা দিয়েছিল উগ্র জাতীয়তাবাদের উন্মেষে, বিপ্লবীদের একাধিক গুপ্ত সমিতির স্থাপনে আর ‘যুগান্তর’এবং ‘বন্দে মাতরম’-এর মতো দেশাত্মবোধক প্রকাশনার পাঠকসংখ্যা বৃদ্ধিতে। অত্যাচারী শাসকদের কয়েকজনকে চিহ্নিত করে সশস্ত্র আক্রমণ এবং হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন বিপ্লবীরা। ১৯০৭-এর শেষার্ধ থেকে ১৯০৮-এর এপ্রিলের মধ্যে একাধিক চেষ্টা হয়েছিল শাসকনিধনের।

বাংলার তৎকালীন লেফটেন্যান্ট গভর্নর ছিলেন Sir Andrew Fraser। ১৯০৭-এর ৬ ডিসেম্বরে তাঁর ট্রেনযাত্রার সময় রেললাইনে বিস্ফোরণের চেষ্টা ব্যর্থ হল। চন্দননগরের তৎকালীন মেয়র L Tardivel স্বদেশি আন্দোলনকে যেনতেনপ্রকারেণ দমনের বিষয়ে বিশেষ কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টাও ব্যর্থ হল।

উপর্যুপরি তৃতীয় ব্যর্থতা এল কলকাতার তৎকালীন চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস কিংসফোর্ডকে বই-বোমা পাঠিয়ে হত্যার প্রচেষ্টায়। মোড়কসুদ্ধ বই-বোমা পাড়ি দিল কিংসফোর্ডের পরবর্তী কর্মস্থল মুজফ্‌ফরপুরে। বদলির আদেশ এসেছিল তড়িঘড়ি, সময় হয়নি প্যাকেট খোলার।

কিংসফোর্ডের ভবলীলা সাঙ্গের চেষ্টা অবশ্য অব্যাহত ছিল। দুই তরুণ, ক্ষুদিরাম বসু আর প্রফুল্ল চাকী, রওনা দিলেন মুজফ্‌ফরপুর। বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের তৈরি বোমা নিয়ে।

পরের কাহিনি বহুশ্রুত, বহুপঠিত। ১৯০৮-এর ৩০ এপ্রিলের রাতে দুই বিপ্লবীর বোমা ছোড়া ঘোড়ার গাড়ি লক্ষ্য করে, যাতে কিংসফোর্ড নন, ছিলেন দুই ইউরোপীয় রমণী। ঘটনাস্থলেই উভয়ের মৃত্যু এবং একটু পিছনের গাড়িতে থাকা কিংসফোর্ডের ফের রক্ষা পাওয়া বরাতজোরে।


.

দুই নিরপরাধ শ্বেতাঙ্গের মৃত্যুর ঘটনায় তীব্র চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হল ব্রিটিশ প্রশাসনে। প্রবল প্রত্যাঘাতের প্রস্তুতি শুরু করল শাসক, বিন্দুমাত্র কালক্ষেপ না করে।

ঘটনার পরদিনই জরুরি বৈঠক ডাকলেন নগরপাল হ্যালিডে। উপস্থিত সিআইডি-র ডিআইজি প্লাউডেন সাহেব। উপস্থিত গোয়েন্দাবিভাগের এবং স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের সমস্ত উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা। দীর্ঘ আলোচনার পর রূপরেখা প্রস্তুত হল নৈশতল্লাশির। তৈরি হল একাধিক দল, প্রতিটির নেতৃত্বে ঊর্ধ্বতন অফিসার এবং বিশ্বস্ত ‘ইনফর্মার’। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাকভোরে পুলিশ হানা দিল কলকাতার বিপ্লবীদের সম্ভাব্য ডেরাগুলিতে।

মানিকতলার ৩২, মুরারিপুকুর রোডের বাগানবাড়িটি যে আদতে বিপ্লবীদের উগ্রপন্থী কার্যকলাপের সূতিকাগার, এমন তথ্য ছিলই গোয়েন্দাদের কাছে। এবং তথ্যে গরমিল ছিল না বিশেষ। অরবিন্দ ঘোষের ভাই বারীন্দ্র সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমেই স্বাধীনতা লাভে বিশ্বাসী ছিলেন। সেই চূড়ান্ত অভীষ্টে পৌঁছনোর লক্ষ্যে তরুণ বিপ্লবীদের নানাবিধ প্রশিক্ষণ দেওয়ার কর্মকাণ্ড বারীন শুরু করেছিলেন মুরারিপুকুরের বাড়িটিতে। যোগশিক্ষা, গীতা-উপনিষদ পাঠের পাশাপাশি চলত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিপ্লবী আন্দোলন সম্পর্কে নিয়মিত ক্লাস। লাঠিখেলা-কুস্তি-জুজুৎসু তো ছিলই, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার এবং বিস্ফোরক তৈরির প্রক্রিয়া সিংহভাগ জুড়ে থাকত পাঠক্রমের।

২ মে-র ভোরের আলো ফোটেনি তখনও। ওয়াটারলু স্ট্রিট থানার ইনস্পেকটর J L Frizzoni-র নেতৃত্বে পুলিশ হানা দিল মুরারিপুকুর রোডের বাড়িতে। তল্লাশিতে উদ্ধার হল বিপুল পরিমাণে গুলি-বন্দুক-অস্ত্রশস্ত্র-বোমা-বিস্ফোরক তৈরির সামগ্রী। গ্রেফতার হলেন বারীন ঘোষ সহ ১৪ জন। পুলিশের নৈশ অভিযান চলল ৪৮ গ্রে স্ট্রিট, ৩৮/৪ নবকৃষ্ণ স্ট্রিট, ১৫ গোপীমোহন দত্ত লেন, ১৩৪ হ্যারিসন রোড, ৩০/২ হ্যারিসন রোড এবং ২৩ স্কট লেনেও। বাজেয়াপ্ত হল পর্যাপ্ত পরিমাণে অস্ত্র-বোমা-কার্তুজ, জাতীয়তাবাদী পুস্তিকা-প্রবন্ধ-নথিপত্র।

বিপ্লবীদের সহিংস কর্মকাণ্ডে যিনি ছিলেন বোমা বানানোর প্রধান কারিগর, সেই হেমচন্দ্র দাস গ্রেফতার হলেন ৩৮/৪ নবকৃষ্ণ স্ট্রিট থেকে। তল্লাশির নেতৃত্বে ছিলেন Superintendent C F Merriman. ১৩৪, হ্যারিসন রোডের একটি আয়ুর্বেদিক ওষুধের দোকানে বিপ্লবীরা গোপনে মজুত রাখতেন বিস্ফোরক পদার্থ। Southern Division-এর Superintendent of Police Griffith Bowen-এর তত্ত্বাবধানে তছনছ করে দেওয়া হল সেই দোকান।

অরবিন্দ ঘোষকে পুলিশ গ্রেফতার করল ৪৮ গ্রে স্ট্রিট থেকে। নগরপাল হ্যালিডের বিশেষ আস্থাভাজন Superintendent Richard Creagan ভোর পৌনে পাঁচটা নাগাদ হানা দিলেন দলবল নিয়ে। গ্রেফতারির বর্ণনা ধরা রয়েছে অরবিন্দের স্বরচিত ‘কারাকাহিনী’ বইটিতে। অংশবিশেষ তুলে দিলাম।

‘শুক্রবার রাত্রিতে আমি নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাইয়াছিলাম, ভোরে প্রায় ৫টার সময় আমার ভগিনী সন্ত্রস্ত হইয়া ঘরে ঢুকিয়া আমাকে নাম ধরিয়া ডাকিল, জাগিয়া উঠিলাম। পরমুহুর্ত্তে ক্ষুদ্র ঘরটী সশস্ত্র পুলিশে ভরিয়া উঠিল; সুপারিন্টেন্ডেন্ট ক্রেগান, ২৪ পরগণার ক্লার্ক সাহেব, সুপরিচিত শ্রীমান বিনোদকুমার গুপ্তের লাবণ্যময় ও আনন্দদায়ক মূর্ত্তি, আর কয়েকজন ইনস্পেক্টর, লাল পাগড়ি, গোয়েন্দা, খানাতল্লাসীর সাক্ষী। হাতে পিস্তল লইয়া তাহারা বীরদর্পে দৌড়াইয়া আসিল, যেন বন্দুক-কামানসহ একটি সুরক্ষিত কেল্লা দখল করিতে আসিল। শুনিলাম, একটি শ্বেতাঙ্গ বীরপুরুষ আমার ভগিনীর বুকের উপর পিস্তল ধরে, তাহা স্বচক্ষে দেখি নাই। বিছানায় বসিয়া আছি, তখনও অর্দ্ধনিদ্রিত অবস্থা, ক্রেগান জিজ্ঞাসা করিলেন, “অরবিন্দ ঘোষ কে, আপনিই কি?” আমি বলিলাম, “আমিই অরবিন্দ ঘোষ”। অমনি একজন পুলিশকে আমাকে গ্রেপ্তার করিতে বলেন। তাহার পর ক্রেগানের একটী অতিশয় অভদ্র কথায় দুজনের অল্পক্ষণ বাকবিতন্ডা হইল। আমি খানাতল্লাসীর ওয়ারেন্ট চাহিলাম, পড়িয়া তাহাতে সহি করিলাম। ওয়ারেন্টে বোমার কথা দেখিয়া বুঝিলাম, এই পুলিশ সৈন্যের আবির্ভাব মজঃফরপুরের খুনের সহিত সংশ্লিষ্ট। কেবল বুঝিলাম না আমার বাড়ীতে বোমা বা অন্য কোন স্ফোটক পদার্থ পাইবার আগেই body warrant এর অভাবে কেন আমাকে গ্রেপ্তার করে। তবে সেই সম্বন্ধে বৃথা আপত্তি করিলাম না। তাহার পরেই ক্রেগানের হুকুমে আমার হাতে হাতকড়ি, কোমরে দড়ি দেওয়া হইল। একজন হিন্দুস্থানী কনস্টেবল সেই দড়ি ধরিয়া পিছনে দাঁড়াইয়া রহিল। ………… ক্রেগানের কথায় ভাবে প্রকাশ পাইল যে, তিনি যেন হিংস্র পশুর গর্ত্তে ঢুকিয়াছেন, যেন আমরা অশিক্ষিত হিংস্র স্বভাববিশিষ্ট আইনভঙ্গকারী, আমাদের প্রতি ভদ্র ব্যবহার করা বা ভদ্র কথা বলা নিষ্প্রয়োজন। তবে ঝগড়ার পর সাহেব একটু নরম হইয়া পড়িলেন। বিনোদ বাবু তাঁহাকে আমার সম্বন্ধে কি বুঝাইতে চেষ্টা করেন। তাহার পর ক্রেগান আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘আপনি নাকি বি-এ পাশ করিয়াছেন? এইরূপ বাসায় এমন সজ্জাবিহীন কামরায় মাটিতে শুইয়াছিলেন, এই অবস্থায় থাকা কি আপনার মত শিক্ষিত লোকের পক্ষে লজ্জাজনক নহে?’’ আমি বলিলাম, ‘‘আমি দরিদ্র, দরিদ্রের মতই থাকি।’’ সাহেব অমনি সজোরে উত্তর করিলেন, ‘‘তবে কি ধনী লোক হইবেন বলিয়া এই সকল কাণ্ড ঘটাইয়াছেন?’’ দেশহিতৈষিতা, স্বার্থত্যাগ বা দারিদ্র ব্রতের মাহাত্ম্য এই স্থুলবুদ্ধি ইংরেজকে বোঝান দুঃসাধ্য বিবেচনা করিয়া আমি সে চেষ্টা করিলাম না।’

শহর জুড়ে নৈশতল্লাশিতে উল্লাসকর দত্ত, কানাইলাল দত্ত এবং আরও অনেকে ধরা পড়লেন। সবারই নিশিযাপন লালবাজারের লক আপে।

পরদিন সকালে হ্যালিডে সাহেব নিজে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন আটক বিপ্লবীদের। চেষ্টা করলেন অরবিন্দ ঘোষের থেকে স্বীকারোক্তি আদায়ের।

—‘Aren’t you ashamed of being involved in this cowardly, dastardly activity?’


.

মামলার পোশাকি নাম, Emperor vs Barindra Kumar Ghosh and others, অধিক পরিচিত মানিকতলা বোমা মামলা বা আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলা হিসাবে। বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে পুলিশি অভিযান জারি থাকল মে মাস জুড়ে। শ্রীরামপুরের জমিদার পরিবারের নরেন্দ্রনাথ গোস্বামী সক্রিয় সদস্য ছিলেন বারীনের গুপ্ত সমিতির। গ্রেফতার হলেন। সম্পর্কে অরবিন্দ-বারীনের মামা হতেন মেদিনীপুরের বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। যিনি বাংলার রেনেসাঁ-যুগের অন্যতম দিকপাল ব্যক্তিত্ব রাজনারায়ণ বসুর ভ্রাতুষ্পুত্র ছিলেন। সত্যেনের মেদিনীপুরের বাড়ি থেকে একটি পুরনো বন্দুক ও কুকরি উদ্ধার করল পুলিশ। এবং অস্ত্র আইনে মামলা দায়েরের পাশাপাশি তাঁকে জড়িয়ে দেওয়া হল আলিপুর মামলাতেও। প্রায় জনা চল্লিশেক বিপ্লবীর ঠাঁই হল আলিপুর জেলে, পরে যা প্রেসিডেন্সি জেল নামে পরিচিত হয়।

আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে চিরকালীন দিকচিহ্ন এক। এই বহুচর্চিত মামলা নিয়ে লেখালেখি হয়েছে অনেক, পূর্ণাঙ্গ বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে একাধিক বই এবং পত্র-পত্রিকায়। সে বিবরণীর বিস্তার এই লেখার প্রতিপাদ্য বিষয় নয়। ইতিহাসের সড়কপথে শুধু ফিরে দেখা মামলা চলাকালীন আলিপুর জেলের অভ্যন্তরে বঙ্গজ বিপ্লবীদের এক দুঃসাহসিক কীর্তিকে, যা আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল দেশের পূর্ব থেকে পশ্চিমে, উত্তর থেকে দক্ষিণে।

২৪ পরগনার তৎকালীন জেলাশাসকের কাছে জবানবন্দি নথিবদ্ধ করার কাজ চলছিল মামলার প্রাথমিক পর্বে। নরেন্দ্রনাথ গোস্বামীর বয়ান নথিভুক্ত হওয়ার অব্যবহিত পরেই দাবানলের মতো খবর ছড়িয়ে পড়ল আলিপুর জেলে। অরবিন্দ তো বটেই, এ ছাড়াও সুবোধচন্দ্র মল্লিক, চারুচন্দ্র দত্ত সহ আরও অনেকের নাম জড়িয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন নরেন। শুধু তাই নয়, সম্মত হয়েছেন রাজসাক্ষী হতে। বিনিময়ে বেকসুর খালাস হতে চলেছেন মামলা থেকে। আপাতত জেলবন্দি বিপ্লবীদের রোষ থেকে বাঁচাতে নরেনের থাকার ব্যবস্থা হচ্ছে ইউরোপিয়ান ওয়ার্ডে। সর্বক্ষণের প্রহরায় নিযুক্ত হচ্ছেন হিগেনস্ নামের জেলকর্মী।

নরেন ছিলেন শ্রীরামপুরের জমিদারবাড়ির সন্তান। সম্ভ্রান্ত এবং বিত্তবান পরিবারের অসংখ্য স্বাধীনতাকামীর স্বেচ্ছায় আন্দোলনে যোগ দিয়ে অকল্পনীয় কৃচ্ছ্রসাধনের বহু উদাহরণ রয়েছে, কিন্তু নরেনের বিপ্লবী হওয়াটা বহুলাংশে হুজুগই ছিল। সাময়িক সাধ হয়েছিল বিপ্লবী হওয়ার, দীর্ঘস্থায়ী পীড়ন সহ্য করার সাধ্য ছিল না। মামলায় অভিযুক্তদের রাখা হয়েছিল জেলের ৪৪ ডিগ্রি ওয়ার্ডে। সার দিয়ে কুঠুরি চুয়াল্লিশটি, আলো-বাতাসের পর্যাপ্ত প্রবেশের উপর প্রাকৃতিক নিষেধাজ্ঞা বলবৎ সেখানে। বিলাসব্যসনে আশৈশব অভ্যস্ত নরেন দ্রুত পরাভব স্বীকার করেছিলেন ইন্দ্রিয়সুখের কাছে। বিপ্লবের থেকে কারামুক্তি অধিক কাঙ্ক্ষিত মনে হয়েছিল। সে হলই বা বিশ্বাসভঙ্গের বিনিময়ে।

প্রেক্ষিতের প্রয়োজনে উল্লেখ্য, আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলার জেলবন্দি বিপ্লবীদের মধ্যে পরবর্তী কর্মপন্থা নিয়ে মতবিরোধ ছিল নরেনের স্বীকারোক্তি-উত্তর পর্যায়ে। বারীনের বরাবরের বিশ্বাস উগ্রপন্থায়। অহিংসায় তাঁর তীব্র বিরাগ। ছক কষছিলেন জেলে গুলি-বোমা-বন্দুক গোপনে আমদানি করে পালানোর। পক্ষান্তরে, সত্যেন বসু-কানাইলাল দত্ত-হেমচন্দ্র দাসের কাছে অগ্রাধিকার ছিল নরেনকে বিশ্বাসঘাতকতার চরম শাস্তি দেওয়া। ওঁরা বারীনকে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দিলেন না পরিকল্পনা, সাহায্য চাইলেন জেল পালানোর অস্ত্র সরবরাহে। কথোপকথন হল বারীনের অজ্ঞাতে।

—হুঁ, মেরেই মরব। একটা রিভলভার পেলেই …

—হ্যাঁ, আর্মস চাই। যেভাবেই হোক।


.

‘আর্মস’ জোগাড় হল। জেলে বন্দিদের সঙ্গে বন্ধুপরিজনদের সাক্ষাতের দিনটি নির্দিষ্ট ছিল প্রতি রবিবার। বহিরাগতদের আপাদমস্তক খানাতল্লাশির দায়িত্বে যে জেলকর্মীরা থাকতেন, যৎসামান্য উৎকোচের বিনিময়ে তাঁদের দলে টানলেন বারীন।

চন্দননগরের বিপ্লবী সুধাংশুজীবন রায় ২৩ অগস্ট বারীনের সঙ্গে দেখা করতে এলেন সাক্ষাৎপ্রার্থী হিসাবে। প্রহরীদের প্রশ্রয়ে গরাদের মধ্য দিয়েই বারীনের হাতে চালান করে দিলেন রিভলভার। তার পরের রবিবার, ৩০ অগস্ট, একই প্রক্রিয়ায় চন্দননগরেরই শ্রীশচন্দ্র ঘোষের মাধ্যমে দ্বিতীয় রিভলভার হাতে এল বারীনের। একটি দিলেন কানাইলাল দত্তকে। অন্যটি পৌঁছল জেল হাসপাতালে অসুস্থ অবস্থায় চিকিৎসাধীন সত্যেন বসুর কাছে। যিনি দিনকয়েক আগে নরেনের কাছে খবর পাঠিয়েছেন, ‘এভাবে আর পারা যাচ্ছে না, আমিও রাজসাক্ষী হতে চাই’, এবং বার্তা পেয়ে নরেন দেখাও করে গিয়েছেন সত্যেনের সঙ্গে। জানিয়েছেন, ব্রিটিশ সরকার রাজসাক্ষ্যের বিনিময়ে সত্যেনকে মুক্তি দিতে প্রস্তুত।

পয়লা সেপ্টেম্বর নরেনের ফের এক প্রস্থ স্বীকারোক্তির দিন ঠিক হয়েছিল। সত্যেন-কানাই সিদ্ধান্ত নিলেন, আর দেরি করা চলে না। রিভলভার হাতে আসার পর ৩০ অগস্ট সন্ধেবেলায় কানাইলাল পেটে অসহ্য ব্যথার অভিনয় করে ভর্তি হলেন হাসপাতালে। অনুরূপ দাস নামে এক জেলকর্মী মারফত সত্যেন ৩০ তারিখ রাত্রেই খবর পাঠালেন নরেনকে, ‘জরুরি প্রয়োজন। কানাইও রাজসাক্ষী হতে চায়। কাল সকালে দেখা করা বিশেষ দরকার হয়ে পড়েছে।’


.

৩১ অগস্ট, ১৯০৮। আলিপুর জেল হাসপাতাল। ঘড়ির কাঁটায় সকাল পৌনে সাতটা।

নরেন এলেন হাসপাতালে, সঙ্গে প্রহরী হিগেনস্। সত্যেন এবং কানাই বেরিয়ে এলেন তিনতলার ওয়ার্ডের করিডরে। তিনজনে মিনিটখানেকের আলোচনা চলল, অদূরেই দাঁড়িয়ে হিগেনস্। যিনি চমকে উঠলেন হঠাৎ গুলির আওয়াজে। দেখলেন, কোমরে গোঁজা রিভলভার থেকে নরেনকে লক্ষ্য করে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি চালিয়ে দিয়েছেন সত্যেন-কানাই।

একটু দূরেই ছিল ডিসপেনসারি। রক্তাক্ত নরেন ছুটতে শুরু করলেন সেদিকে, কাতর আর্তনাদ শোনা গেল, ‘বাঁচাও, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে!’ হিগেনস্ ধাওয়া করলেন, কানাই ফের গুলি চালালেন। লাগল হিগেনসের কবজিতে। কয়েকজন বন্দি এবং হাসপাতাল-কর্মীও চেষ্টা করলেন প্রতিরোধের। কানাই শূন্যে গুলি চালালেন এবার, ‘এক পা এগোলে সবাইকে খুন করব!’

নরেন আর হিগেনস্ তখনও মরিয়া চেষ্টা করছেন বাঁচার। আহত অবস্থাতেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে দু’জনে ছুটলেন জেল গেটের দিকে। রিভলভার হাতে পিছনে দৌড়লেন সত্যেন-কানাই। সিনেমাতেই শুধু দেখা যায় এমন দৃশ্য। জেলের চত্বরে সাতসকালে রিভলভার উঁচিয়ে গুলি চালাতে চালাতে দুই রক্তাক্ত ব্যক্তিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে তাড়া করছে দুই তরুণ।

জেল গেটের কাছাকাছি দৃশ্যটা চোখে পড়ল জেলর এবং তাঁর কয়েকজন সহকর্মীর। যাঁরা লিন্টন নামের এক ইউরোপিয়ান বন্দিকে নিয়ে আসছিলেন হাসপাতালের দিকে। রিভলভার তাক করে ফের হুমকি দিলেন কানাই, ‘বাধা দিলে গুলি করে মারব তোদের!’

জেলর এবং সঙ্গীরা সবাই দাঁড়িয়ে গেলেন স্থাণুবৎ, লিন্টন ছাড়া। যিনি ধস্তাধস্তিতে জড়ালেন সত্যেনের সঙ্গে। গুলি চালালেন সত্যেন, লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। কানের পাশে গুলির শব্দ শুনলেন লিন্টন পরের মুহূর্তেই। তাকিয়ে দেখলেন, নরেন মুখ থুবড়ে পড়ছেন জেলের রাস্তা-সংলগ্ন ড্রেনে। হিগেনস্ নিরাপদ দূরত্বে পালাতে পেরেছেন ততক্ষণে।

লিন্টন ছিলেন দশাসই চেহারার, ছিল দুর্দান্ত শারীরিক সক্ষমতা। সত্যেনের রিভলভার কেড়ে নিতে সমর্থ হলেন, ছুড়ে দিলেন দূরে। কানাই ফের ট্রিগারে চাপ দিলেন, টার্গেট এবার লিন্টন। দ্রুত মাথা সরিয়ে প্রাণে বাঁচলেন লিন্টন এবং ঝাঁপালেন কানাইয়ের উপর। কানাইয়ের রিভলভারও হাতাহাতিতে ছিটকে গেল দূরে। অস্ত্রচ্যুত বিপ্লবীদের কব্‌জা করে ফেললেন জেলকর্মীরা।

নরেনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। একটি-দুটি নয়, মোট ন’টি বুলেট প্রবেশ করেছিল শরীরে। ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া দেহে মৃত্যুর আগমন ছিল সময়ের অপেক্ষা মাত্র।

নরেন-হত্যাকে স্রেফ বিশ্বাসভঙ্গের শাস্তি হিসাবে দেখলে ভুলই হবে একটু। ঘটনার আইনি তাৎপর্য ছিল অপরিসীম। রাজসাক্ষীকে যদি জেরার সুযোগই না পান বিবাদী পক্ষের আইনজীবী, নিরর্থক হয়ে যায় বয়ান, চূড়ান্ত বিচারে মূল্যহীন হয়ে যায় জবানবন্দি। নরেনের মৃত্যুতে প্রমাণমূল্য হারিয়েছিল তার স্বীকারোক্তি। যা অরবিন্দ সহ বাকি অভিযুক্তদের পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারত বিচারপর্বে।

ঘটনার বিবরণ জানিয়ে বাংলার মুখ্যসচিবকে চিঠি লিখলেন নগরপাল।

Letter of the Commissioner of Police, Calcutta on the day of Alipore Jail Murder (Aug 31, 1908) Government of Bengal, Political Department, Confidential File No. 160 (1-16) of 1908 Confidential No 1876-C. dated 31st August, 1908

To

The Chief Secretary to the Government of Bengal, Calcutta.

Sir,

I have the honour to report that this morning at about 7 a.m. an under-trial prisoner named Norendra Nath Goswami, who had turned approver in the prosecution of some 34 persons now pending trial before the Sessions Judge of Alipore on charges under Sections 121. 121.A, I. P. C. etc., was shot by two co-undertrial prisoners named Kanai Lal Dutt and Satyendra Nath Bose in the Jail Hospital of the Alipore Central Jail.

It appears that the prisoner Norendra Nath Goswami who had been intentionally kept separate from the other prisoners confined in the European Ward was brought, from that ward, to the Jail Hospital by a European Convict Overseer named Higgens. Norendra Nath had apparently previously arranged to meet, at that time, in the Hospital, two fellow prisoners, who were already patients in the Jail Hospital, named Kanai Lal Dutt and Satyendra Nath Bose. He had apparently been approached by the second of these prisoners, who had pretended that he also wished to make a statement; and his visit was really in order to get this statement. Evidently it was however part of a plot to get Norendra Nath within striking distance for it appears that almost immediately on Narendra Nath’s arrival on the landing, at the head of the staircase leading to the second story of the Hospital, these two prisoners opened fire on him with two revolvers which they had secreted on their persons. Higgens the Convict Overseer attempted to arrest one of them and was shot through the wrist.

Norendra Nath although shot in several places was not mortally hit and fled down the stairs, out of the Hospital Compound and along an alley way towards the gate.

The prisoner Kanai Lal Dutt pursued him and shot him fatally through the back. He was then secured by a Eurasian Prisoner named Linton.

The District Magistrate, Mr. Marr immediately commenced a judicial enquiry in the case.

A Police investigation has been started but the accused have not as yet been questioned by the Police as to how they came into possession of the weapons.

The accused Kanai Lal Dutt is a native of Jantipara Serampore, Hooghly and Satyendra Nath Bose is a native of Midnapore where he was head of the “National Volunteers”.

A telegram has been sent to the Director, Criminal Intelligence, Simla, and a copy of this letter has also been sent to him.

A further report will be submitted.

I have the honour to be,

Sir,

your most obedient servant,

F L Halliday

Commissioner of Police, Calcutta.


.

নরেন হত্যা মামলার নিষ্পত্তি হল যুদ্ধকালীন দ্রুততায়। জুরি তাঁদের রায়ে কানাইকে দোষী সাব্যস্ত করলেন। ম্যাজিস্ট্রেট ফাঁসির সাজা শোনালেন ৯ সেপ্টেম্বর। সত্যেনের ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতা ছিল। দণ্ডাদেশ নির্ধারণে মামলা পাঠানো হয়েছিল হাইকোর্টে। উচ্চ আদালত মৃত্যুদণ্ডই বরাদ্দ করেছিল সত্যেনের জন্যও।

কানাইকে ফাঁসির সাজা শোনানোর সময় বিচারক প্রথামাফিক জানালেন, উচ্চ আদালতে রায়ের বিরুদ্ধে আবেদনের সুযোগ রয়েছে। কানাইয়ের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘আবেদন? কীসের আবেদন?’

কুড়ি বছর বয়সি কানাইয়ের ফাঁসির দিন ধার্য হল ১৯০৮-এর ১০ নভেম্বর। কাকভোরে জেলে উপস্থিত হলেন খোদ নগরপাল হ্যালিডে সহ লালবাজারের পদস্থ কর্তারা। সকাল ছ’টায় কানাইলালকে নিয়ে যাওয়া হল ফাঁসির মঞ্চে। কানাই ছিলেন অচঞ্চল, তাপ-উত্তাপহীন। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে পাওয়া যায়, কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে দেওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত ছিলেন স্মিতহাস্য।

ফাঁসির সময় উপস্থিত ছিলেন, এমন একজন ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার পরে বারীনকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘How many more do you have like him?’

এমন আরও কতজন আছে কানাইয়ের মতো? নিরুত্তর ছিলেন বারীন, মৃদু হেসেছিলেন শুধু।

আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলার গতিপ্রকৃতি তুমুল আগ্রহের জন্ম দিয়েছিল বঙ্গসমাজে। নরেন-হত্যায় অভিযুক্ত দুই যুবককে কেন্দ্র করেও সর্বস্তরে স্রোত বইছিল সহানুভূতির। যা অজানা ছিল না প্রশাসনের। কানাইলালের মরদেহ নিয়ে মূল রাজপথ দিয়ে শোভাযাত্রার অনুমতি দিলেন না নগরপাল। টালি নালার পার্শ্ববর্তী গলিঘুঁজি দিয়েই শ্মশানযাত্রা হবে, নির্দেশ জারি হল। আইনশৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কায় ফোর্ট উইলিয়াম থেকে তলব করা হল রিজার্ভ ফোর্সের তিনশো জওয়ানকে।

কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে কি আর বলপূর্বক রাশ টানা যায়? গিয়েছে কখনও? মরদেহ যখন পৌঁছল গলির গলি তস্য গলি পেরিয়ে কেওড়াতলা মহাশ্মশানে, মাত্রাছাড়া আকার নিয়েছে প্রতীক্ষারত জনসমাগম। আট থেকে আশি নেমে এসেছে রাস্তায়, শহিদবরণে। আশেপাশের বাড়িগুলির বারান্দা থেকে পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে অঝোরে।

মহিলারা প্রস্তুত ফুল-মালা-ঘি-চন্দন নিয়ে। বয়স্কদের অধিকাংশের হাতে ভগবদ্‌গীতা। তরুণদের সম্মিলিত ‘বন্দে মাতরম’-এর গর্জন পরিণত শব্দব্রহ্মে। শহিদের দেহ ছুঁতে চাওয়ার আকুতিতে উত্তাল অপ্রশস্ত পথপরিসর। যানচলাচল স্তব্ধ জনস্রোতে।

তুঙ্গস্পর্শী উন্মাদনাকে কোনওমতে নিয়ন্ত্রণে এনে যখন শেষকৃত্য সম্পন্ন হল যুবকের, ফের ঘটল আবেগের অগ্ন্যুৎপাত। পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাওয়া দেহের ছাইভস্ম দখলে নিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল উন্মত্ত জনতা। ক্রোধ-ক্ষোভ-শোকের বিরল ত্র্যহস্পর্শের সাক্ষী থাকল শ্মশানপ্রাঙ্গণ।


.

সত্যেনের ফাঁসির দিন নির্দিষ্ট হয়েছিল ২১ নভেম্বর। কানাইলালের শেষকৃত্যের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সত্যেনের অন্তিম ক্রিয়াকর্ম সম্পন্ন হবে জেল প্রাঙ্গণেই। তা-ই হয়েছিল। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ছাব্বিশ।

ফাঁসির দিনকয়েক আগে ছেলের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন সত্যেনের মা। সত্যেন রাজি ছিলেন না।

—না, মা আসবে না। কিছুতেই না। আমি মায়ের সঙ্গে দেখা করব না।

—না কেন?

—মা কান্নাকাটি করলে দুর্বল হয়ে পড়ব। বেশ, আসুক, কিন্তু কোনও চোখের জল নয়।

প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন গর্ভধারিণী। জেলে পুত্রের সঙ্গে শেষ সাক্ষাতে এক বিন্দুও অশ্রুব্যয় করেননি।


.

মূল মামলার বিচারপর্বের চাপান-উতোরের বিবরণী দিয়ে দীর্ঘায়িত করছি না লেখা। রায় ঘোষিত হয়েছিল ১৯০৯-এর ৬ মে। মোট ৩৭ জন অভিযুক্তের মধ্যে বারীন ঘোষ এবং উল্লাসকর দত্তের ফাঁসির সাজা হয়েছিল, উচ্চ আদালতে যা হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে। হেমচন্দ্র দাস সহ দশজনেরও হয়েছিল দ্বীপান্তরের সাজা। চারজনের সাজা হয়েছিল দশ বছরের কারাবাসের, তিনজনের সাত বছরের। বাকিরা মুক্তি পেয়েছিলেন।

আর অরবিন্দ ঘোষ? মামলার সওয়াল-জবাব কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর ব্যারিস্টার চিত্তরঞ্জন দাশ অবতীর্ণ হয়েছিলেন অভিযুক্তদের প্রধান আইনজীবী হিসাবে। বিচারের অন্তিম পর্বে অরবিন্দ প্রসঙ্গে চিত্তরঞ্জন পেশ করেছিলেন আবেগমথিত বক্তব্য। সাধ্যমতো বঙ্গানুবাদ রইল।

‘ধর্মাবতার, আমার চূড়ান্ত আবেদন এই, অভিযুক্তের তকমা দেওয়া এই মানুষটি আজ শুধু এই আদালতের সুবিচারের প্রত্যাশী নন, তিনি মুখাপেক্ষী ইতিহাসের ন্যায়ালয়ের।

আমার আবেদন, এই মামলার বিতর্কের অভিঘাত সময়ের প্রলেপে ক্ষীণতর হয়ে পড়ার দীর্ঘদিন পরও, এই আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাওয়ার বহুকাল পরও, এই মানুষটির প্রয়াণের দীর্ঘদিন পরও, ওঁকে মানুষ মনে রাখবে দেশপ্রেমের কাব্যরচয়িতা হিসাবে, জাতীয়তাবাদের দিকদর্শক হিসাবে। মানবতার পূজারি হিসাবে। ওঁর বাণী দেহত্যাগের বহুদিন পরও ধ্বনিত হবে দেশদেশান্তরে।

অতএব আমার আবেদন ধর্মাবতার, মানুষটি আপনার এজলাসে দাঁড়িয়ে নেই শুধু, দাঁড়িয়ে আছেন ইতিহাসের ন্যায়ালয়ে।’

বিচারকের আসনে ছিলেন Charles Porten Beachcroft, যিনি অরবিন্দের সঙ্গে একই বছরে বিলেতে Indian Civil Service পরীক্ষায় বসেছিলেন। উভয়েই উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, মেধাতালিকায় অরবিন্দের স্থান ছিল বিচক্রফ্‌টের আগে। বিচক্রফ্‌ট সাহেব সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ পর্যালোচনার পর লিখেছিলেন—

I now come to the case of Arabinda Ghose, the most important accused in the case. He is the accused, whom more than any other the prosecution are anxious to have convicted and but for his presence in the dock there is no doubt that the case would have been finished long ago. It is partly for that reason that I have left his case till last of all and partly because the case against him depends to a very great extent, in fact almost entirely, upon association with other accused persons…

The point is whether his writings & speeches, which in themselves seem to advocate nothing more than the regeneration of his country, taken with the facts proved against him in this case are sufficient to show that he was a member of the conspiracy. And taking all the evidence together I am of opinion that it falls short of such proof as would justify me in finding him guilty of so serious a charge.

বেকসুর খালাস পেয়েছিলেন অরবিন্দ। মুক্তিপ্রাপ্তির নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থেকে গিয়েছিল নরেন গোস্বামীর ঘাতক-যুগলের। কানাইলাল দত্ত এবং সত্যেন বোস, যাঁরা ফাঁসিকাঠে প্রাণ দিয়েছিলেন দশদিনের ব্যবধানে।

সে অবশ্য শারীরিক মৃত্যু মাত্র। আসলে তো ‘মৃত্যুহীন প্রাণ’।

০৩. কেউ মনে রাখেনি, কেউ মনে রাখে না!

সিনেমায় যেমন হয়, যেভাবে হয়!

রাজপথ দিয়ে আঠারো-উনিশের যুবক দৌড়চ্ছে মরিয়া। ধাওয়া করছে পুলিশ। যুবকের হাতে উদ্যত রিভলভার। মাঝেমাঝেই পিছন ফিরে আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে হুংকার দিচ্ছে, ‘খবরদার!’

হুমকিতে অবশ্য কাজ হচ্ছে না বিশেষ। পুলিশ পিছু হঠার কোনও লক্ষণ দেখাচ্ছে না। উর্দিধারীদের নেতৃত্বে থাকা অফিসার বুঝতে পারছেন বিলক্ষণ, যুবককে ধরে ফেলা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। কতক্ষণ দৌড়বে এভাবে? আর দৌড়ে পালাবেই বা কোথায়? দেখাই তো যাচ্ছে, হাঁফাচ্ছে।

জানুয়ারির কলকাতায় সন্ধে জাঁকিয়ে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন। ঘড়ির কাঁটা পাঁচটা ছাড়িয়ে সাড়ে পাঁচের দোরগোড়ায়। অফিসফেরতা মানুষের ভিড় থমকে গেছে আচমকাই, স্তব্ধ হয়ে দেখছে রিভলভার হাতে ঊর্ধ্বশ্বাস দৌড় যুবকের। যার সঙ্গে ব্যবধান দ্রুত কমে আসছে তাড়া করে আসা পুলিশবাহিনীর।

দম তো ফুরিয়ে আসছেই। মাথাও আর কাজ করছে না যুবকের। পুলিশ ধরে ফেলল বলে! কী করবে এখন? কী করা উচিত? আরে, উলটোদিক থেকেও তো দু’জন ছুটে আসছে। গায়ে উর্দি, মানে পুলিশ! এবার?

‘দাদা’-র কথা মনে পড়ে যুবকের। ‘ইংরেজদের হাতে ধরা দেওয়ার থেকে মৃত্যু ভাল,’ প্রায়ই বলে থাকেন ‘দাদা’। ঠিকই! ধরে ফেললে পুলিশ দগ্ধে দগ্ধে মারবে। তার চেয়ে ঢের ভাল, নিজেই নিজেকে শেষ করে দেওয়া। রিভলভার তো আছেই সঙ্গে। একটা বুলেট নিজের মাথায়, ব্যস, খেল খতম!

.

বলে কী ছোকরা!

স্তম্ভিত বললে কমই বলা হয়, একেবারে বাক্‌রুদ্ধ হয়ে যান আলিপুর আদালতের দীর্ঘদিনের কর্মী। এইসব বিপ্লবী ছেলেপুলের কাজকারবার সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা আছে তাঁর। প্রায়ই পুলিশ এদের কাঠগড়ায় তোলে রাষ্ট্রদ্রোহের নানান মামলায়। ভয়ডর এদের বিশেষ নেই, জেনে গিয়েছেন এতদিনে। কিন্তু তা বলে এই! ঘণ্টাখানেক পরে বিচারক রায় শোনাবেন। ফাঁসির হুকুম হতে যাচ্ছে নিশ্চিত। সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র হেলদোল তো নেই-ই, উলটে আবদার করছে একগাল হেসে!

—স্যার, খুব খিদে পেয়ে গেছে। জেলের একঘেয়ে খাবার তো রোজই খাই, ফিরে গিয়ে সেটাই জুটবে। আজ কচুরি-শিঙাড়া খেতে খুব ইচ্ছে করছে, দিন না একটু ব্যবস্থা করে কোর্টের ক্যান্টিন থেকে…

এজলাসে উপস্থিত পুলিশ-উকিল-মোক্তারদের হতচকিত মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলেন যুবক। কোর্ট লক-আপের ভিতরে দাঁড়িয়ে ফের আর্জি জানান ভালমন্দ খাওয়ার।

—জানি স্যার, নিয়ম নেই। কিন্তু একদিন না হয় একটু নিয়ম ভাঙলেন। অস্ত্রশস্ত্র তো আর চাইছি না, সামান্য কচুরি-শিঙাড়া। আর হ্যাঁ, কয়েকটা রসগোল্লা হলে ভাল হয়। শেষে একটু মিষ্টিমুখ আর কী…

মিষ্টিমুখ? কচুরি-শিঙাড়া? এজলাসে, খুনের আসামিকে? কেউ কখনও শুনেছে? এমন পরিস্থিতিতে কস্মিনকালেও পড়েনি পুলিশ। অফিসাররা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলেন খানিক। আসামির বিচিত্র দাবির কথা জানিয়ে ফোন গেল লালবাজারে। স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা চার্লস টেগার্টের নির্দেশ পৌঁছল, ‘Fair enough. He will be sent to the gallows anyway in about a month’s time. ফাঁসি তো হবেই ওর। যা খেতে চাইছে, দাও। খুশি থাকুক, ওকে একটু দরকারও আছে আমাদের।’

আদালতে যখন মধ্যাহ্নভোজের বিরতি, প্লেটে করে কচুরি-শিঙাড়া-রসগোল্লা সাজিয়ে দেওয়া হল আসামির সামনে। দিব্যি গুছিয়ে বসলেন যুবক, খেলেন পেটপুরে এবং বিরতির পর ফের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে পড়লেন নিয়মরক্ষার দণ্ডাদেশ শুনতে। নিয়মরক্ষা ছাড়া কী? জানাই তো আছে, কী সাজা ঘোষণা করবেন বিচারক।

.

—একে তোরা গুরু মানিস? এই লোকটাকে?

ইংরেজি খবরের কাগজের একটা পাতা যুবকের চোখের সামনে মেলে ধরেন পুলিশ অফিসার। প্রতিটি শব্দে ঠিকরে বেরোয় বিদ্রুপ।

—কী রে… দ্যাখ ভাল করে… স্বরূপ দ্যাখ লোকটার… আর একে তোরা গুরু মানিস… ‘দাদা’ বলিস… এর এক কথায় তোর মতো ছেলেপুলেরা হাসতে হাসতে প্রাণ দিতে রাজি হয়ে যাস!

জেলের কুঠুরিতে যুবক তখন স্তব্ধবাক্। একদৃষ্টে চেয়ে থাকেন খবরের কাগজের পাতার দিকে। ছবিটার দিকে। অফিসারের কথাগুলো কানে বিঁধতে থাকে তিরের মতো।

—দ্যাখ ছবিটা, পড় খবরটা… কী হল? নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিস না তো?

নিজের চোখকে অবিশ্বাস করতে সত্যিই ভারী ইচ্ছে হয় উনিশ বছরের বিপ্লবীর। এ কী করে সম্ভব? হতেই পারে না! ‘দাদা’ এমন কাজ করতেই পারেন না! কিন্তু খবরটা? ছাপার অক্ষর? সেটাই বা কী করে মিথ্যে হয়? স্পষ্ট লেখা আছে, খুনের মামলায় তার বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহে ‘দাদা’ সাহায্য করেছেন পুলিশকে, জবানবন্দি দিয়েছেন। সঙ্গের ছবিটায় ‘দাদা’র পরিচিত দৃপ্ত চেহারাটা। ভাবনায় ছেদ পড়ে অফিসারের বক্রোক্তিতে।

—আমি তোকে আগেই বলেছিলাম, এই ‘দাদা’-ই তোদের মতো বাচ্চা ছেলেদের সর্বনাশ করছে। আর তোরাও আগুপিছু না ভেবে বোকার মতো ফাঁসিতে ঝোলার জন্য রেডি হয়ে যাচ্ছিস। লালবাজারের বড়কর্তাদের সঙ্গে তোদের ‘দাদা’-র যে গোপনে দহরম মহরম আছে, সে-কথা জানিস? ওর দেখবি কিস্যু হবে না। বড়জোর দু’-এক বছরের জেল। আর তোর? প্রাণটাই চলে যাচ্ছে ক’দিন পরে। ভেবে দ্যাখ, তোর ফাঁসির সাজা তো আর বদলাবে না, কিন্তু তোদের ‘দাদা’ নাটের গুরু হয়েও বারবার পার পেয়ে যাবে আর তোরা ফাঁসবি, এটা মেনে নিবি?

যুবক শুনতে থাকেন দু’হাতে মুখ ঢেকে। অফিসার বলেই চলেন।

—তুই ধরা পড়ার দিন থেকেই জানি আমরা, খুনটা যদিও তুই করেছিস, কিন্তু প্ল্যানটা ‘দাদা’-র। ওর কথাতেই করেছিস যা করার। অথচ শুরুর দিন থেকে তোতাপাখির মতো বলে আসছিস, ‘যা করেছি একাই করেছি, কারও নির্দেশে নয়।’ এখনও সময় আছে, সত্যিটা বল। তুই শাস্তি পেলে ওরও পাওয়া উচিত। লোকটার স্বরূপ তো জেনেই গেলি, এবার অন্তত বল!

যুবক মাথা তোলেন। চোখেমুখে অভিমান-হতাশা-রাগের ত্রিকোণমিতি। ভুল তো কিছু বলছেন না অফিসার। যে ‘দাদা’-র নির্দেশে চোখকান বুজে জান কবুল করা, তিনিই হাত মেলালেন পুলিশের সঙ্গে? তা হলে আর সত্যিটা গোপন করে কী লাভ? মনস্থির করে ফেলেন বেদনাহত যুবক।

—বলছি স্যার। পুরোটাই ‘দাদা’-র কথায় করেছি। আমাকে বলেছিল…

অফিসার বেরিয়ে আসেন কুঠুরি থেকে, উত্তেজনা যথাসম্ভব চেপে রেখে। দ্রুত খবর পাঠান লালবাজারে, ‘Mission accomplished. কনফেস করেছে। আমরা যেমন ভেবেছিলাম, তা-ই। অ্যাকশনটা ছেলেটা করেছে, কিন্তু আসল কলকাঠি নেড়েছে ওদের ‘‘দাদা’’… বাঘা যতীন! ছবি আর খবরটা দেখে ফাইনালি ছোকরা ভেঙে পড়েছে।’

এক মুহূর্তও দেরি করেন না চার্লস টেগার্ট। হাতে সময় কম। সদলবলে রওনা দেন লালবাজার থেকে। গন্তব্য, আলিপুর জেলের সেই কুঠুরি, যেখানে ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত এক যুবক কেঁদে চলেছেন অঝোরে।

.

‘তুমি সরকারের শ্যাম আমাদের শূল

(কবে) তোমার ভিটেয় চরবে ঘুঘু

দেখবে চোখে সরষে-ফুল।’

ছড়াটা তখন মুখে মুখে ফিরত বাংলার বিপ্লবীদের। বানানো হয়েছিল সিআইডি-র এক ডাকসাইটে ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেন্ট অফ পুলিশ-কে নিয়ে। সামসুল আলম।

১৯১০ সালের কথা লিখছি। বহুচর্চিত আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলার রায় বেরিয়েছে ১৯০৯-এর ৬ মে। প্রধান অভিযুক্ত অরবিন্দ ঘোষ মুক্তি পেয়েছেন। বারীন ঘোষ এবং উল্লাসকর দত্তের ফাঁসির সাজা হয়েছে। হেমচন্দ্র দাস সহ দশজনের শাস্তি হয়েছে দ্বীপান্তরের। চারজনের সাজা হয়েছে দশ বছরের কারাবাসের। তিনজনের সাত বছর। রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন করেছেন সাজাপ্রাপ্তরা। সেই আবেদনের শুনানি চলছে তখন।

এই মামলায় পুলিশের তরফে সরকারি কৌঁসুলি মিস্টার নর্টনের ডান হাত ছিলেন সিআইডি-র ডিএসপি সামসুল আলম। অভিজ্ঞ অফিসার, ব্রিটিশ সরকারের চোখের মণি বললেও এতটুকু অত্যুক্তি হয় না। খোদ টেগার্টেরও প্রিয়পাত্র ছিলেন।

কারণও ছিল ব্রিটিশরাজের নেকনজরে পড়ার। শুধু আলিপুর মামলায় নয়, রাষ্ট্রদ্রোহের যে-কোনও মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ঘুঁটি সাজানোয় বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল সামসুল সাহেবের। খারাপ কাজগুলো খুব ভাল করে করতে পারতেন। মিথ্যে সাক্ষী জোগাড় করায় যেমন করিতকর্মা, তেমনই পটু কচিকাঁচাদের মগজধোলাই করে ‘রাজসাক্ষী’ হতে রাজি করানোয়।

আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলা তৎকালীন ব্রিটিশ প্রশাসনের কাছে ‘প্রেস্টিজ ইস্যু’-তে পরিণত হয়েছে তখন। গ্রেফতার হওয়া বিপ্লবীদের শাস্তিবিধানের জন্য প্রবল সক্রিয় লালবাজার।

হাইকোর্টের শুনানিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ আরও ঠাসবুনোট করার কাজ চলছে জোরকদমে। যে কাজের অন্যতম প্রধান কুশীলব ডিএসপি সামসুল। যিনি বুঝে গিয়েছেন, ওই মামলায় সরকারের মুখ রাখতে পারলে কেরিয়ারে উত্তরোত্তর শৃঙ্গ আরোহণ অবধারিত। সারাদিন পড়ে থাকতেন মামলার নথিপত্র নিয়ে। ঘাঁটতেন আইনের বইপত্র, খুঁটিয়ে জরিপ করতেন জবানবন্দি। নর্টন সাহেবের সঙ্গে হাইকোর্টে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেত আলোচনায়।

এহেন পুলিশ অফিসার যে দ্রুত বিপ্লবীদের খতমতালিকায় ঢুকে পড়বেন, স্বাভাবিকই। বিপ্লবীরা জানতেন, সামসুলকে সরিয়ে দেওয়া মানে মামলার খুঁড়িয়ে চলা। এত খেটেখুটে কেসের নথিপত্র তৈরি করার মতো অফিসার কই আর তেমন? ‘সরকারের শ্যাম’ এবং বিপ্লবীদের ‘শূল’ সামসুলকে ‘চোখে সরষে-ফুল’ দেখানোর ছক কষা শুরু হয়ে গেল।

বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে বিপ্লবীদের নানা গোষ্ঠীর যে বিবিধ দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ডে সে-সময় ব্যতিব্যস্ত ব্রিটিশ প্রশাসন, তার অলিখিত সর্বাধিনায়ক তখন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। অগ্রজদের কাছে ‘যতীন’, অনুজ সহচরদের কাছে ‘দাদা’। এমন এক ব্যক্তিত্ব, যাঁর কথায় হেলায় জীবন বাজি রাখতে প্রস্তুত তরুণ তুর্কি অনুগামীরা। এবং যাঁকে ছলে-বলে-কৌশলে দীর্ঘ কারাবাসে বাধ্য করতে তুমুল আগ্রাসী পুলিশবাহিনী। স্ট্র্যাটেজি পরিষ্কার, সেনাপতিকে খতম করতে পারলে ভাল, না পারলে অন্তত জেলবন্দি রাখো বহু বছর। নেতৃত্বহীন সৈন্যদল এমনিতেই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়বে।

সামসুল-হত্যার দায়িত্ব বাঘা যতীন দিলেন তাঁর বিশেষ স্নেহভাজন যুবক বীরেনকে। বীরেন্দ্রনাথ দত্তগুপ্ত। ঢাকার বিক্রমপুরে জন্ম। পাথরে কোঁদা চেহারা। উজ্জ্বল চোখদুটি নজর কাড়ে প্রথম দর্শনেই। কিশোরবেলা থেকেই একাধিক বিপ্লবী গোষ্ঠীর সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ, দেশকে স্বাধীন করার ব্রতে উদ্বুদ্ধ হওয়া। বিডন স্ট্রিটের জ্ঞানেন্দ্রনাথ মিত্র ছিলেন যতীনের অত্যন্ত আস্থাভাজন। জ্ঞানেন্দ্রর মাধ্যমেই যতীনের সংস্পর্শে আসেন যুবক বীরেন।

দুর্দমনীয় সাহস ছিল উনিশ ছুঁইছুঁই বীরেনের। ছিল একরোখা আবেগ। বাঘা যতীন যখন সামসুল-নিধনের জন্য তাঁকে বেছে নিলেন, আনন্দে বীরেন প্রায় আত্মহারা। কত শত ছেলে তো ‘দাদা’-র আশেপাশে থাকে, এতজনের মধ্যে তাঁর উপরই দায়িত্ব পড়েছে ওই পাষণ্ড পুলিশ অফিসারকে খুনের, এ তো পরম সৌভাগ্য!

সামসুলের সম্ভাব্য আততায়ী হিসাবে বীরেনকে বেছে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হল নিধন-প্রস্তুতি। খুনের সিদ্ধান্ত নিলেই তো হল না, রূপায়ণের রসায়ন নিখুঁত হওয়া জরুরি। সামসুল শুধু দাপুটে অফিসারই ছিলেন না, বুদ্ধিও ধরতেন যথেষ্ট। জানতেন, বিপ্লবীরা তাঁকে ব্যঙ্গ করে ছড়া বেঁধেছেন, পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার সুযোগও খুঁজছেন। চলাফেরায় সদাসতর্ক থাকতেন। সঙ্গে সশস্ত্র দেহরক্ষী থাকত। নিজেও সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র রাখতেন অষ্টপ্রহর। বাড়ি থেকে অফিস যেতেন যে রাস্তা দিয়ে, অফিস থেকে বাড়ি ফিরতেন সম্পূর্ণ অন্য রাস্তা দিয়ে। নির্দিষ্ট রুটিন মেনে কিছু করতেন না। না কর্মক্ষেত্রে, না পারিবারিক জীবনে।

বীরেনের ভাল করে চেনা দরকার সামসুলকে, বাঘা যতীনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী সতীশচন্দ্র সরকারের উপর দায়িত্ব পড়ল। সতীশ সব চিনিয়ে দিলেন বীরেনকে। ডিএসপি সাহেবের বাড়ি-অফিস তো বটেই, আলিপুর কোর্ট এবং হাইকোর্ট চত্বরও, যেখানে ইদানীং নর্টন সাহেবের সঙ্গে দিনের অনেকটা সময় কাটান সামসুল।

চেনা তো হল, কিন্তু অস্ত্রের ব্যবস্থা? যতীন বন্দোবস্ত করলেন। সুরেশচন্দ্র মজুমদার (আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা, ডাকনাম ছিল পরান) পরিচিত ছিলেন যতীনের। তিনি একটি ছ’ঘরার রিভলভার দিয়েছিলেন যতীনকে। আগ্নেয়াস্ত্রটি সুরেশ সরিয়েছিলেন বছর পাঁচেক আগে, ১৯০৫-এর ডিসেম্বরে। পূর্বপরিচিত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট রায়বাহাদুর পি সি মৌলিকের হেফাজত থেকে। সুরেশের সঙ্গে যতীনের আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন যতীনেরই এক মামা, ললিত চ্যাটার্জী। যিনি ছিলেন পেশায় আইনজীবী এবং আদ্যন্ত দেশপ্রেমিক। ললিতবাবুর আর একটি পরিচয়, সম্পর্কে অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের দাদু।

১৯১১ সালে সিআইডি-র বড়কর্তা Mr. F C Daly তাঁর রিপোর্টে লিখেছিলেন, ‘The weapon with which the murder was committed belonged to a Deputy Magistrate of Cuttack District, who had lost it when he visited Calcutta and which was stolen by a youth named Suresh Mazumdar@Poran. Poran later made it over to Jatin Mukherjee who had employed Biren Dutta Gupta to commit the deed.’

.

প্রথম চেষ্টা চৌরঙ্গিতে। জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহের শুরুর দিকে। হাইকোর্ট থেকে বেরিয়ে সামসুল অন্য একটি মামলার তদন্ত-তদারকিতে গিয়েছিলেন। পিছু নিয়েছিলেন বীরেন। ভাবেননি, স্থানীয় থানার এত পুলিশ থাকবে ডিএসপি সাহেবের সঙ্গে। গুলি করা তো দূরের কথা, কাছেপিঠে ঘেঁষাই যথেষ্ট কঠিন ছিল। কার্যসিদ্ধি হল না সেদিন।

হল ১৯১০-এর ২৪ জানুয়ারি।

সামসুল সাহেব দুপুরের একটু পরে এসেছেন হাইকোর্টে। নর্টন সাহেবের ঘরে বসেছেন অন্যদিনের মতোই। সঙ্গে এনেছেন একগুচ্ছ ফাইলপত্র, যাতে গচ্ছিত রয়েছে আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলার গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র। আলোচনা শেষ হল বিকেল পাঁচটা নাগাদ। দেহরক্ষীকে প্রস্তুত হতে বললেন সামসুল।

—বেরব এবার। গাড়ি রেডি আছে তো?

গাড়ি ‘রেডি’ ছিল। ‘‌রেডি’ ছিলেন বীরেনও। সতীশচন্দ্র সরকারের সঙ্গে দুপুরে কর্নওয়ালিস স্কোয়ারে মিলিত হয়েছেন। হাতবদল হয়েছে লোডেড রিভলভার এবং একটি ছুরি। সতীশ কোর্ট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন বীরেনকে।

সামসুলের দৈনন্দিন গতিবিধি সপ্তাহদুয়েক খুঁটিয়ে দেখার পর বীরেন ঠিক করে নিয়েছিলেন, মারলে হাইকোর্ট থেকে বেরনোর সময়ই মারবেন। কোর্ট বলে কথা, পুলিশ-টুলিশ থাকবে অনেক। ঝুঁকিও প্রচুর, কিন্তু এ ছাড়া উপায় নেই। বাকি সময় গাড়িতেই যাতায়াত সামসুলের, আর সিআইডি-র অফিসের আনাচেকানাচে ঢের বেশি পুলিশি নজরদারি। যখন বেরবেন কোর্ট থেকে, সেটাই মাহেন্দ্রক্ষণ।

সামসুল বেরলেন সরকারি কৌঁসুলির ঘর থেকে। সামনে হাঁটছেন অ্যাডভোকেট জেনারেল, যিনিও নর্টন সাহেবের ঘরে আলোচনায় যোগ দিয়েছিলেন। পিছনে সশস্ত্র দেহরক্ষী। পূর্ব দিকের সিঁড়িতে প্রথম পা রাখতে যাবেন, সাক্ষাৎ যমদূতের মতো মুখোমুখি হাজির হলেন বীরেন।

অল্পবয়সি আগন্তুকের এভাবে পথ আটকে দাঁড়ানোয় ক্ষণিকের জন্য অপ্রস্তুত সামসুল। দেহরক্ষী ততক্ষণে দেখে ফেলেছেন, যুবক পরনের ফতুয়ার মধ্য থেকে বার করছেন রিভলভার। বাধা দেওয়ার আগেই ‘দ্রাম’! করমর্দনের দূরত্ব থেকে গুলি চালিয়ে দিয়েছেন বীরেন। সামসুলের বক্ষস্থল ভেদ করল বুলেট, শেষ নিশ্বাস ফেলার আগে শুধু অস্ফুটে বলতে পেরেছিলেন, ‘পাকড়ো!’

পাকড়াতে ধাওয়া করল পুলিশ। আদালত চত্বর এবং আশেপাশের এলাকায় তখন ত্রাহি ত্রাহি রব। সামসুলের গুলিবিদ্ধ প্রাণহীন দেহকে ঘিরে যেমন ভিড় জমে গেছে, তেমনই চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে বাইরে। ‘খুন! খুন!’ চিৎকারে আতঙ্ক গ্রাস করেছে হাইকোর্টের বাইরের রাস্তাকে। যেখানে চকিত ক্ষিপ্রতায় নেমে এসেছেন বীরেন। দৌড়ে পালাচ্ছেন।

কিন্তু ওই জনাকীর্ণ এলাকায় পালাবেন কোথায়? এক অশ্বারোহী পুলিশ তাড়া করল পিছনে, আটকে গেল কোর্ট এবং অফিসফেরত জনতার ভিড়ে। কোনও ভয়ংকর অপরাধ হয়েছে বুঝি, এই ভেবে কিছু পথচারীও তাড়া করলেন বীরেনকে। শূন্যে গুলি ছুড়তে বাধ্য হলেন বীরেন। জনতা পিছু হঠল, পুলিশ নয়। সদলবলে তাড়া করলেন আদালত চত্বরে ডিউটিতে থাকা এক অফিসার। খবর পৌঁছল লালবাজারে, ‘DSP Samsul Alam shot dead in High Court by unknown youth.’ পড়িমরি করে রওনা দিল রিজার্ভে থাকা সশস্ত্র বাহিনী। কতটুকুই বা দূরত্ব হাইকোর্ট থেকে লালবাজারের?

হাইকোর্টের পাশের ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রিট ধরে ছুটতে ছুটতে যখন বীরেন পৌঁছলেন হেস্টিংস স্ট্রিটে (বর্তমানের কিরণশংকর রায় রোড), দম ফুরিয়ে এসেছে। মাথা কাজ করছে না আর। পিছনে যারা তাড়া করছে, তাদের সঙ্গে ব্যবধান তো কমে এসেছেই, উলটোদিক থেকেও দেখতে পাচ্ছেন কয়েকজন পুলিশকে দৌড়ে আসতে। এবার?

মুহূর্তের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন বীরেন। দ্বিধা কাটিয়ে যখন স্থির করলেন, আত্মহত্যাই শ্রেয়, ততক্ষণে একজন সার্জেন্ট উলটোদিক থেকে প্রায় মুখোমুখি চলে এসেছেন। রিভলভার মাথায় ঠেকানোর আগেই যিনি বীরেনের হাত চেপে ধরলেন। পিছনের পুলিশবাহিনীও ততক্ষণে পৌঁছে গিয়েছে। নিজেকে শেষ করে দেওয়ার সুযোগ পেলেন না বীরেন। ধরা দিতে হল। রিভলভার, কার্তুজ এবং ছোরা, বাজেয়াপ্ত হল সব।

সামসুল-হত্যার নেপথ্যের চক্রীদের পরিচয় জানতে বিরামহীন নির্যাতন চলল বীরেনের উপর। জিজ্ঞাসাবাদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয় করলেন সিআইডি এবং স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের পোড়-খাওয়া অফিসাররা। বৃথা চেষ্টা, বীরেন মুখ খুললেন না। বাজিয়ে গেলেন একই কাটা রেকর্ড, ‘ডিএসপি সাহেবের উপর রাগ ছিল, উনি বিপ্লবীদের গ্রেফতার করে অত্যাচার করেন বলে। যা করেছি, একাই করেছি। কারও নির্দেশে নয়। প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলাম, নিয়েছি।’

অভিযুক্ত দোষ কবুল করে নিয়েছে। জানিয়ে দিয়েছে, আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছুই বলার নেই। বিচারপর্ব সাঙ্গ হল দ্রুত। মৃত্যুদণ্ডের আদেশ শোনালেন বিচারক, ফাঁসির দিন নির্ধারিত হল ১৯১০-এর ২১ ফেব্রুয়ারি। অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করার পর বিচারক যখন গেলেন মধ্যাহ্নভোজের বিরতিতে, রায় দান বিকেলের জন্য মুলতুবি রেখে, নির্বিকার বীরেন সহাস্য আবদার করে বসলেন কোর্ট লক-আপেই।

—আজ কচুরি-শিঙাড়া খেতে খুব ইচ্ছে করছে, দিন না একটু ব্যবস্থা করে কোর্টের ক্যান্টিন থেকে…

নির্দেশ এল লালবাজার থেকে।

—যা খেতে চাইছে দাও। খুশি থাকুক, ওকে একটু দরকারও আছে আমাদের।

‘দরকার’ বলতে বাঘা যতীনকে জেলবন্দি করে রাখার ছক। খুনের মামলায় জড়িয়ে ফাঁসিকাঠ পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা। সামসুল-হত্যার কিছুদিন আগে হাওড়ায় কয়েকটি দুঃসাহসিক ডাকাতি হয়েছিল। সেই ডাকাতিগুলির সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে যতীন গ্রেফতার হয়েছিলেন ১৯১০-এর ২৭ জানুয়ারি, ২৭৫ আপার চিৎপুর রোড থেকে। ললিতকে একই মামলায় পুলিশ গ্রেফতার করে কৃষ্ণনগর থেকে, সুরেশ মজুমদারকে কলকাতা থেকে। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪০০ ধারায় মামলা রুজু হয়, যে মামলা ‘Howrah gang case’ নামে খ্যাত। অভিযুক্তদের ঠাঁই হয় হাওড়ার জেলে।

টেগার্ট হীনতম অপকর্ম করলেন সামসুল-নিধন মামলায় বাঘা যতীনকে জড়াতে। বীরেন হাজার জেরাতেও যখন মুখ খুলছেন না কিছুতেই, ইংরেজি খবরের কাগজের একটি পাতা ছাপালেন। এবং কাজটা করলেন এত নিখুঁত এবং বিশ্বাসযোগ্যভাবে, সন্দেহ হওয়ার প্রশ্নই নেই কোনও। সেই পাতায় ফলাও করে খবর ছাপলেন, বাঘা যতীন সামসুল-মামলায় বীরেনের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহে সাহায্য করেছেন। খবরের সঙ্গে যতীনের ছবি। যে পাতাটি পুলিশ বীরেনকে দেখাল ১৯ ফেব্রুয়ারির সাতসকালে, আবেগমিশ্রিত উস্কানি চলল লাগাতার।

—লালবাজারের বড়কর্তাদের সঙ্গে তোদের ‘দাদা’-র যে গোপন দহরম মহরম আছে, সে কথা জানিস? ওর দেখবি কিস্যু হবে না। বড়জোর দু’-এক বছরের জেল। আর তোর? প্রাণটাই চলে যাচ্ছে দু’দিন পরে। একে তোরা গুরু মানিস?

.

মানসিক চাপ একটা পর্যায়ের পর অসহনীয় হয়ে উঠল। বীরেন ভেঙে পড়লেন, ‘বলছি স্যার। পুরোটাই ‘দাদা’-র কথায় করেছি। আমাকে বলেছিল…’

টেগার্ট সহ অফিসাররা ছুটলেন আলিপুর জেলে। হাতে সময় কম, কাল বাদে পরশু বীরেনের ফাঁসি। যুদ্ধকালীন দ্রুততায় বীরেনের জবানবন্দি লিপিবদ্ধ হল। সামসুল হত্যামামলায় নাম ঢুকল বাঘা যতীনের। হাওড়া জেল থেকে যতীনকে তড়িঘড়ি নিয়ে আসা হল আলিপুর জেলে, যেখানে পুলিশের বিশেষ আবেদনে রাতারাতি বসে গেল চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাস।

যতীনের কৌঁসুলি পালটা চাল চাললেন। সাফ জানালেন, তিনি বীরেনকে ‘cross-examine’ করতে অপারগ, কারণ নিজের মক্কেলের সঙ্গে মামলার ব্যাপারে কথা বলার ন্যূনতম সময়টুকুও পাননি।

পুলিশকর্তারা ছুটলেন ছোটলাটের কাছে। বীরেনের ফাঁসির দিন পিছিয়ে দেওয়ার আর্জি নিয়ে। দিনটা সপ্তাহখানেক পিছিয়ে গেলে যতীনের কৌঁসুলির সময়াভাবের যুক্তি আর ধোপে টিকবে না। আর্জি নাকচ হয়ে গেল। ফাঁসির দিন বদলাল না। ২১ ফেব্রুয়ারি হওয়ার কথা, সেদিনই হবে। সেদিনই হয়েছিল।

ব্রিটিশ সরকার তবু শেষ চেষ্টা করেছিল বীরেনের ফাঁসির পরেও। আদালতে পেশ করা হয়েছিল যুক্তি, খোদ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যখন নথিভুক্ত হয়েছে বীরেনের জবানবন্দি, যতীনের কৌঁসুলি বীরেনকে জেরা করতে না পারলেও সেই জবানবন্দি গ্রাহ্য হওয়া উচিত খুনের মামলায়। যে যুক্তি নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন হাইকোর্টের বিচারপতি।

ফাঁসির আগের দিন তীব্র মনোকষ্টে ছিলেন বীরেন। দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি কখনও, ‘দাদা’-র বিরুদ্ধে জবানবন্দি দিতে হবে। কোথাও কি কোনও ভুল হয়ে গেল?

‘ভুল’ যে হয়েছে, সেটা বীরেনকে সেই রাতেই জানিয়ে দিয়েছিলেন জেলে কর্তব্যরত এক সহৃদয় পুলিশ অফিসার। যাঁর মায়া হয়েছিল বীরেনের উদ্‌ভ্রান্ত দশা দেখে, যিনি চাননি একটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা মনে পুষে রেখে ফাঁসির মঞ্চে উঠুন যুবক। ইংরেজদের নকল খবরের কাগজ ছাপানোর বিবরণ শুনে তীব্র অনুশোচনা গ্রাস করেছিল বীরেনকে। ওই অফিসারকেই জানিয়েছিলেন কাতর আর্তি, যতীনের কাছে যেন বার্তা পাঠানো হয় তাঁর ক্ষমাভিক্ষার।

সে বার্তা বীরেনের ফাঁসির পর পৌঁছেছিল বাঘা যতীনের কাছে। না পৌঁছলেও চলত অবশ্য। যতীন নিশ্চিত জানতেন, কোনও ভাবে চরম বিভ্রান্ত না হলে বীরেন তাঁর নাম মুখে আনতেনই না।

.

প্রায় একশো আট বছর হয়ে গেল বীরেন দত্তগুপ্তের মৃত্যুর। বাংলার অগ্নিযুগ-বিষয়ক ইতিহাসবিদ বা গবেষকরা জানবেন বীরেনের নাম, কিন্তু আমার-আপনার মতো গড়পড়তা সাধারণেরা? শুনেছি আদৌ বীরেনের নাম, মনে রেখেছি ত্যাগের খতিয়ান?

প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও তো জানা!

০৪. দ্য গ্রেটেস্ট ডে-লাইট রবারি

—গুলি যে শেষ হয়ে আসছে…

—হুঁ, কতক্ষণ টানা যাবে আর?

—খুব বেশি হলে মিনিট পনেরো… ঘিরে ফেলেছে আমাদের, পালানোর পথ নেই আর।

প্রতিক্রিয়ায় ঝাঁঝিয়ে ওঠেন যুবক, আঘাত-প্রত্যাঘাতের রণভূমিতে যিনি অবিসংবাদিত নেতা।

—পালানোর কথা উঠছে কেন? পালানো নয়, সুযোগ থাকলে ট্যাকটিক্যাল রিট্রিট করা যেত হয়তো…

—রিট্রিটের কথাই বলছি… সে সুযোগও তো দেখছি না…

—শেষ অবধি লড়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।

—হ্যাঁ… আরে! সামলে! খেয়াল করো.. ডানদিক থেকে একটা প্ল্যাটুন এগোচ্ছে…

—দেখেছি! ফায়ার!

গুলি এবং পালটা গুলির আওয়াজে নদীতীরবর্তী জঙ্গলের নৈঃশব্দ্য বশ্যতা স্বীকার করেছে তখন।

.

কলেজ স্ট্রিটের নিকটবর্তী মার্কাস স্কোয়ারের পশ্চিম দিকে মাড়োয়ারি হস্টেল। যার একটি অপ্রশস্ত ঘর প্রায় মেক-আপ রুমে পরিণত। চেয়ারে বসে এক যুবক। ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে আরেক যুবক। যিনি, প্রায় ঘণ্টাখানেক হয়ে গেল, মগ্ন হয়ে কাঁচি চালাচ্ছেন চেয়ারে আসীন যুবকের চুলে। যিনি ঠায় বসে থাকতে থাকতে সামান্য অধৈর্য এতক্ষণে।

—আর কত ছোট করবে? এ তো বাটিছাঁট হয়ে যাচ্ছে পুরো…

—চুপ করে বসো তো, বিহারিদের চুল আরও ছোট হয়।

—এর থেকে ভাল, ন্যাড়াই করে দাও।

—দরকার হলে করতাম। আপাতত এই যথেষ্ট।

—বাঁচা গেল, এবার উঠতে পারি?

—হ্যাঁ। খইনির ডিবেটা দেরাজে রাখা আছে, ওটা ভুলো না।

—খইনির বদলে পান চলবে?

—না। খইনিই। খেতে হবে না, ডিবেটা সঙ্গে রাখবে। মাঝে মাঝে খাওয়ার ভান করতে পারো। আর হাতের চেটোয় চুনের দাগটা যেন থাকে।

—বুঝলাম। আর কিছু?

—আর একটা জিনিস শুধু। এই ধুকধুকিটা গলায় ঝুলিয়ে নিয়ো।

—কী এটা?

—বললাম তো… ধুকধুকি… পিতলের জিনিস… ভেরি কমন ইন বিহার।

সাজসজ্জা সম্পূর্ণ হলে আয়নার সামনে দাঁড়ালেন যুবক এবং নিজের চেহারা দেখে চমকিত। দেখে কে বলবে, নিখাদ বঙ্গসন্তান! এ তো পাক্কা বিহারি দেখাচ্ছে!

.

সুঠাম চেহারার যুবককে দৃশ্যতই উত্তেজিত দেখায়। সোজাসাপটা বলে দেয় সঙ্গীদের, এসব আকাশকুসুম কল্পনা।

—মাথা খারাপ হয়েছে তোমাদের? এটা হয় না… জাস্ট ইম্পসিবল!

—এত উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই। কেন হয় না? কীসের ইম্পসিবল?

—এই মিটিংটা লালবাজারের কাছে হচ্ছে মানে তোমরা ধরে নিচ্ছ অ্যাকশনটাও লালবাজারের নাকের ডগায় করা যাবে? অত সোজা?

—ঠিকঠাক প্ল্যান করলে না পারার কিছু নেই।

—একচুল এদিক-ওদিক হলে কী হতে পারে ভেবেছ? পুলিশ হেডকোয়ার্টার একশো মিটারের মধ্যে। টহলদারি ইদানীং বেড়ে গেছে। সাদা পোশাকের পুলিশ চারপাশে ছড়িয়ে থাকে সর্বক্ষণ। ভাবলে অন্য রাস্তা নিশ্চয়ই বেরবে।

—হতে পারে। কিন্তু সময় কোথায় হাতে? যা করার খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। আর এমন সুযোগও বারবার আসবে না। ঝুঁকি নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।

—I disagree. তোমরা যা ভাল বোঝো করো। আমি এর মধ্যে নেই। Hope you can pull this off.

লালবাজার থেকে ঢিলছোড়া দূরত্বের ছাতাওয়ালা গলিতে চলছিল গোপন বৈঠক। মতানৈক্যের জেরে মিটিং ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন দীর্ঘদেহী যুবক। সন্ধ্যা পেরিয়ে তখন রাত। ঘড়ির কাঁটা পা রেখেছে নয়ের ঘরে।

বাকিরা বসে পড়লেন ম্যাপ নিয়ে। এলাকার ভূগোল জানা প্রয়োজন পুঙ্খানুপুঙ্খ। মানচিত্রে লাল দাগ পড়তে লাগল কিছু দিকচিহ্নে। ডালহৌসি স্কোয়ার… লালবাজার…কাস্টমস হাউস… ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্ট্রিট… মলঙ্গা লেন… হিন্দ সিনেমা…

.

থমথম করছে স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের প্রধান চার্লস টেগার্টের চোখমুখ। হাতে ধরা ‘The Statesman’, প্রথম পাতার হেডলাইন, ‘The greatest daylight robbery’।

টেগার্টের বাক্যবাণ বর্ষিত হয় সহকর্মীদের উপর।

—So gentlemen, how has all this happened right under our noses? You think there is anything more embarrassing than this?

ইলিসিয়াম রো (বর্তমানে, লর্ড সিনহা রোড)-র স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের দফতরে বৈঠক চলছে জরুরি। টেগার্টের তিরস্কারে অফিসাররা নতমস্তক। নিশ্চুপ এতটাই, পিন পড়লে মনে হবে বোমাবর্ষণ হচ্ছে বুঝি।

—Officers, I want recovery. At any cost and within the quickest possible time. Do whatever it takes. I won’t take any excuses this time. They just can’t get away with this.

অফিসাররা শুনলেন এবং বুঝলেন, পেশাদারি অহংয়ে আঘাত লেগেছে দোর্দণ্ডপ্রতাপ টেগার্টের। এই মামলায় সামান্যতম ঢিলেমিও বরদাস্ত করবেন না টেগার্ট। ক্ষুরধার বুদ্ধি এবং কর্মনৈপুণ্যের যোগফলে যিনি তখনই ব্রিটিশ প্রশাসনে প্রায় কিংবদন্তিসম।

.

১৯১৪ সালের মধ্যভাগ। অস্থিরতা ক্রমবর্ধমান বিশ্বের রাজনীতিতে। পরিবর্তন ঘটছে বিভিন্ন দেশের পারস্পরিক সম্পর্কের রসায়নে। দ্রুত মেরুকরণে পটভূমি প্রস্তুত হচ্ছে সম্মুখসমরের। ২৮ জুন অস্ট্রিয়ার আর্চডিউকের হত্যার প্রতিক্রিয়ায় সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি।

প্রহর গোনা শুরু হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের। যুযুধান দেশের বন্ধুরাষ্ট্রগুলি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ল একে একে। জার্মানির নেতৃত্বে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি-বুলগেরিয়ার ‘কেন্দ্রীয় শক্তি’ বনাম সার্বিয়া-রাশিয়া-ফ্রান্স-জাপান-ইংল্যান্ডের ‘মিত্রশক্তি’। যুদ্ধের সূচনা হল । যা স্থায়ী হয়েছিল দীর্ঘ চার বছরেরও বেশি। মিত্রশক্তির শিবিরে ক্রমে যোগ দিয়েছিল ইতালি-রোমানিয়া-আমেরিকাও।

বিশ্বযুদ্ধের এই অনিশ্চিত প্রেক্ষাপটে রাসবিহারী বসু এবং যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের (বাঘা যতীন) মতো বঙ্গজ বিপ্লবীরা পরিকল্পনা করতে শুরু করলেন সশস্ত্র অভ্যুত্থানের। ব্রিটিশরাজকে লাগাতার আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত করে তোলার এই হল প্রকৃষ্ট সময়, একমত হলেন বাংলার বিপ্লবীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ।

ব্রিটিশ প্রশাসনের অজ্ঞাত ছিল না বিপ্লবীদের এই সক্রিয়তা। যুদ্ধের আবহের সুযোগ নিয়ে গুপ্ত সমিতিগুলি যাতে শাসককে বিব্রত না করতে পারে, তৎপর ছিল রাষ্ট্রযন্ত্র। তল্লাশি এবং অভিযান জারি ছিল নিরন্তর। বিপ্লবীদের আশু প্রয়োজন ছিল পর্যাপ্ত পরিমাণে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের, যা ব্যতিরেকে সশস্ত্র বিপ্লবের স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে যাওয়া অবধারিত।

১৮৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত আত্মোন্নতি সমিতির আখড়া ছিল ওয়েলিংটন স্কোয়ারের উত্তর-পূর্ব কোণে। নেতৃত্বে ছিলেন বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী, অনুকূলচন্দ্র মুখার্জী এবং আরও অনেকে। ১৯১৪-র অগস্টের শুরুতে অনুকূল খবর পেলেন, ২৬ অগস্ট ‘Tactician’ নামের জাহাজে রাষ্ট্রের বরাত দেওয়া প্রচুর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র কলকাতায় আসছে। বিখ্যাত অস্ত্র আমদানিকারক কোম্পানি R B Rodda-র ২, ওয়েলেসলি প্লেসের অফিসের পিছন দিকে ভ্যান্সিটার্ট রো-র গুদামে। আমদানির মধ্যে রয়েছে মাউজার পিস্তল আর তার গুলি।

কার্যকারিতার অভিনবত্বে মাউজার ছিল বিপ্লবীদের কাছে উৎকৃষ্ট হাতিয়ার। মাউজার পিস্তলের ‘effective range’ ছিল ৫০০ গজ। একে পিস্তল হিসাবে যেমন ব্যবহার করা যেত, পিস্তল রাখার জন্য কাঠের যে খোল আছে সেটি পিস্তলের সঙ্গে জুড়ে নিলে দূরপাল্লার রাইফেলের মতো কাঁধের উপর রেখে করা যেত গুলি নিক্ষেপ।

বিপ্লবীরা এই সুযোগ হারাতে চাইলেন না। সিদ্ধান্ত হল অস্ত্র লুঠের, সম্মতি মিলল বিপিনবিহারী এবং বাঘা যতীনের। ২৪ অগস্ট লালবাজারের অদূরেই ছাতাওয়ালা গলিতে এক গুপ্তসভায় মিলিত হলেন বিপ্লবীরা। সে সময় ঢাকার হেমচন্দ্র ঘোষের ‘মুক্তিসংঘ’-এর প্রতিনিধি হিসাবে কলকাতায় কাজ করছিলেন শ্রীশ পাল এবং হরিদাস দত্ত। শ্রীশ পালের উপর দায়িত্ব ন্যস্ত হল অভিযানের পরিকল্পনার।

ঠিক কীভাবে অস্ত্র লুঠের চেষ্টা হবে, বুঝিয়ে বললেন শ্রীশ। সব শুনে বেঁকে বসলেন বৈঠকে উপস্থিত নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, যিনি পরবর্তীকালে এম এন রায় হিসাবে বিখ্যাত হবেন। স্পষ্ট জানালেন, এই অভিযান অলীক কল্পনা ব্যতীত কিছু নয়।

—I disagree. তোমরা যা ভাল বোঝো করো। আমি এর মধ্যে নেই। Hope you can pull this off.

নরেন্দ্রনাথ বেরিয়ে গেলেন। বাকিরা বসলেন ম্যাপ নিয়ে। শ্রীশ বুঝিয়ে দিলেন ভৌগোলিক খুঁটিনাটি।

—ম্যাপটা মন দিয়ে দেখো সবাই… এইখানে লালবাজার… আর এই হল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্ট্রিট…

.

২৬ অগস্ট, ১৯১৪। সকাল সোয়া এগারোটা। ডালহৌসির অফিসপাড়ায় প্রাত্যহিক তাড়াহুড়োর পরিচিত দৃশ্যপট। গাড়িঘোড়া অবিরাম, নিত্যযাত্রীদের ওঠানামা, বাতাসে ব্যস্ততার গন্ধ।

রডা কোম্পানির বিশ্বস্ত কর্মচারী শ্রীশ চন্দ্র (হাবু) মিত্র যাবতীয় নথিপত্র নিয়ে হাজির কাস্টমস হাউসের সামনে (বর্তমানে নেতাজি সুভাষ রোডের যেখানে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অফিস, তার অদূরেই)। হাবুর আদবকায়দা ছিল সাহেবি। ট্রাউজার, ধোপদুরস্ত হাফ শার্ট, পায়ে চকচকে বুটজুতো। বাহারি গোঁফ একটা ভারিক্কি ভাব এনেছিল বলিষ্ঠ চেহারায়। প্রথম দর্শনে সমীহের উদ্রেক হওয়া সঙ্গত।

সাতটি গোরুর গাড়ি আনা হয়েছে মালপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য। সপ্তম গাড়িটি মিনিটপাঁচেক দেরি করেছে আসতে। বিরক্ত হাবু বাজখাঁই ধমক দিয়েছেন গাড়োয়ানকে, ‘উল্লু কে পাটঠে, জলদি কিউঁ আয়ে নেহি!’ গাড়োয়ান কাঁচুমাচু মুখে অধোবদন।

২০২টি কাঠের পেটি খালাস হল মালসমেত। ১৯২টি পেটি বোঝাই হল প্রথম ছ’টি গাড়িতে। দেরিতে আসা সপ্তম গাড়িতে বাকি ১০টি। সব কয়টি পেটিতেই কোম্পানির আদ্যক্ষর ‘RBR’।

লালবাজার থেকে বড়জোর একশো-দেড়শো মিটার দূরত্বের কাস্টমস হাউস থেকে সাতটি গাড়ির সারি রওনা দিল ভ্যান্সিটার্ট রো-র গুদামের উদ্দেশে। পঞ্চম এবং ষষ্ঠ গাড়ির মাঝামাঝি পায়ে হেঁটে তদারকিতে হাবু। মূল সড়ক থেকে ডানদিকে গুদামের রাস্তা ধরল প্রথম ছ’টি গাড়ি। সপ্তম গাড়ি সবার অলক্ষ্যে সোজা চলল পুবদিকে। ম্যাঙ্গো লেন, ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্ট্রিট, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট পেরিয়ে চাঁদনি চকের পাশ দিয়ে ওয়েলিংটনের নিকটস্থ মলঙ্গা লেনের পথে। মিশন রো অথবা গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউয়ের অস্তিত্ব ছিল না তখন।

গোরুর লেজ মুড়িয়ে দ্রুত চালাচ্ছিলেন সপ্তম গাড়ির গাড়োয়ান। ছোট ছোট করে ছাঁটা চুল। পকেটে খইনির ডিবে। হাতের চেটোয় চুনের দাগ। গলায় ধুকধুকি। সাজটা জব্বর হয়েছে। গত রাতের কথা ভেবে নিজের মনেই হেসে ফেলেন।

—আর কত ছোট করবে? এ তো বাটিছাঁট হয়ে যাচ্ছে পুরো।

—চুপ করে বসো তো। বিহারিদের চুল আরও ছোটও হয়।

.

গুদামে পৌঁছে হিসাব মিলাতে গিয়ে মাথায় হাত হাবুর। সাত নম্বর গাড়িটা কোথায়? ওটাতেই তো আসল জিনিস ছিল। রওনা হওয়ার আগে চালান দেখে মিলিয়ে নিয়েছিলেন। দশটা পেটি ছিল। আটটায় নম্বর ছিল ৩৯৬ থেকে ৪০৩। প্রতিটিতে ৫০০০ করে মাউজারের গুলি। ৪০৪ নম্বর পেটিতে ছিল ৬০০০ গুলি। বাকি একটি পেটির নম্বর ছিল ৮২৮, যার মধ্যে ছিল .৩০০ বোরের ৫০টি মাউজার পিস্তল। সব মিলিয়ে ৪৬,০০০ গুলি আর পঞ্চাশটা মাউজার লোপাট? সর্বনাশ!

সপ্তম গাড়ির খোঁজে তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে গেলেন হাবু। এবং সেই যে গেলেন, গেলেন তো গেলেন, আর ফিরলেন না। ফেরার কথাও ছিল না।

তিনিই তো লুঠের প্রধান কুশীলব!

শ্রীশ চন্দ্র (হাবু) মিত্রের জন্ম ১৮৯০ সালে হাওড়ার রসপুর গ্রামে। শৈশব-কৈশোর অতিবাহিত মধ্য কলকাতার মলঙ্গা অঞ্চলের ১৪, দাস লেনের মাতুলালয়ে। লেখাপড়ার সঙ্গে সংস্রব ছিল না বিশেষ। ছোটবেলা থেকেই ‘বাপরে কী ডানপিটে ছেলে!’ ভয়ডরহীন দস্যিপনার জন্য এলাকায় নামডাক ছিল হাবুর।

আত্মোন্নতি সমিতির অনুকূলচন্দ্র মুখার্জী থাকতেন ৩৯, মলঙ্গা লেনে। দেশপ্রেমের মন্ত্রে সদ্য যুবকদের দীক্ষিত করা ছিল তাঁর অন্যতম কাজ। পাড়ার ডানপিটে ছেলে হাবুর উপর নজর পড়ল অনুকূলের। নিয়ে গেলেন সমিতির আখড়াতে। প্রশিক্ষণ চলল মুষ্টিযুদ্ধ-লাঠিখেলা-শারীরিক কসরতের। বছরদুয়েক পরে হাবু যখন শক্তসমর্থ, J F Madan কোম্পানির স্টোরকিপারের পদে বহাল হতে সহায়তা করলেন অনুকূল।

বিপিনবিহারী গাঙ্গুলীর এক সুহৃদ রডা কোম্পানির কর্মী ছিলেন। যাঁর মধ্যস্থতায় ১৯১৩ সালের অগস্ট মাসে রডা কোম্পানিতে চাকরি হল হাবুর। মাসিক বেতন সাকুল্যে তিরিশ টাকা। কর্মনিষ্ঠায় অল্পদিনেই কোম্পানির কর্ণধার Mr. Prike-এর অত্যন্ত বিশ্বস্ত হয়ে উঠলেন হাবু। Jetty clerk-এর পদে উন্নতি হল দ্রুত, দায়িত্ব পেলেন আমদানি হওয়া মাল খালাসের। ১৯১৪ সালের অগস্ট পর্যন্ত অন্তত ৪০বার মাল খালাস করেছিলেন নিখাদ পেশাদারিত্বে। মালিকের বিশ্বাস আর আস্থা অর্জন করেছিলেন অনায়াসে।

জাহাজে মাউজার পিস্তল আর গুলি আমদানির খবর হাবুই জানালেন অনুকূলচন্দ্রকে। অস্ত্র লুঠের নিখুঁত ছক কষলেন বিপ্লবীরা। ছাতাওয়ালা গলির গোপন সভায় হাবুও ছিলেন। সভা শেষের কিছু পরে, সেই রাতেই আবার বৈঠক বসল হাবু মিত্রের বাড়িতে। সিদ্ধান্ত হল, অনুকূল একটি গোরুর গাড়ির ব্যবস্থা করবেন। বিহারি গাড়োয়ানের বেশে সেই গাড়ি চালাবেন হরিদাস দত্ত। গাড়ির অদূরে কোমরে গোঁজা রিভলভার সমেত দু’পাশে হাঁটবেন শ্রীশ পাল এবং খগেন দাস। চার বিপ্লবী— সুরেশ চক্রবর্তী, বিমান ঘোষ, আশুতোষ রায় এবং জগৎ ঘোষের উপর দায়িত্ব পড়ল ডালহৌসি স্কোয়ারের আশেপাশে সাদা পোশাকের গোয়েন্দাদের উপর নজর রাখার। কোনওরকম বিপদের আভাস পেলেই যাঁরা চিৎকার করে গান ধরবেন হরিদাস দত্ত-শ্রীশ পালদের সতর্ক করে দিতে।

ঘটনার আগের রাতে হরিদাস দত্তকে পরম যত্নে গাড়োয়ানের সাজে সাজিয়েছিলেন আদতে দুমকার বাসিন্দা প্রভুদয়াল হিম্মতসিংকা। যিনি ছিলেন আদ্যন্ত দেশপ্রেমিক, নানাবিধ সমাজসেবামূলক ক্রিয়াকর্মে নিবেদিত। প্রখ্যাত সলিসিটর হয়েছিলেন পরবর্তী কালে।

এতটাই চাতুর্যের সঙ্গে সম্পন্ন হয়েছিল লুণ্ঠনপর্ব, কোম্পানির মালিক Mr. Prike ওয়াটারলু স্ট্রিট থানায় (তখনও হেয়ার স্ট্রিট থানার পত্তন হয়নি) দিনতিনেক পরে অভিযোগ জানানোর আগে পর্যন্ত ঘুণাক্ষরেও কিছু টের পায়নি লালবাজার। গাফিলতির অভিযোগে কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেই সরকার, জানতেন Prike সাহেব। তিনদিন হন্যে হয়ে খোঁজখবর করেও যখন হদিশ মিলল না খোয়া যাওয়া অস্ত্রের, পুলিশে অভিযোগ দায়ের করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না।

নগরপাল Fredrick Loch Halliday সহ লালবাজারের কর্তাব্যক্তিদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল খবর জানাজানি হওয়ার পর। বিশ্বযুদ্ধের বাজারে এত অস্ত্র বিপ্লবীদের হাতে চলে গেল দিনেদুপুরে, কলকাতা পুলিশের সদর দফতরের নাকের ডগা দিয়ে, বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে? লালবাজার সর্বশক্তি প্রয়োগ করল অস্ত্র উদ্ধারে। গোয়েন্দাদের রাতের ঘুম অন্তর্হিত হল টেগার্টের হুংকারে।

—Officers.. I want recovery. At any cost and within the quickest possible time. Do whatever it takes. I won’t take any excuses this time. They just can’t get away with this.

২৭ সেপ্টেম্বর ৩৪, শিবঠাকুর লেন থেকে গ্রেফতার হলেন হরিদাস দত্ত। উদ্ধার হল গুলিভর্তি ট্রাঙ্ক। বিপ্লবী হরিদাস দত্তের স্মৃতিচারণে লিপিবদ্ধ আছে গ্রেফতারির পর তাঁকে থানায় নিয়ে আসার পরের দৃশ্য। খবর পেয়েই টেগার্ট সহ কর্তারা চলে এলেন থানায়। হরিদাসকে দেখেই টেগার্টের মন্তব্য সহাস্য, ‘Hello Royal Bengal Tiger! Now you are bagged!’

উদ্ধার হওয়া ট্রাঙ্ক খোলার পর উচ্ছ্বাস অবশ্য ক্ষণস্থায়ী হল টেগার্টের। গুলি গোনার পর দেখা গেল, সব মিলিয়ে ২১,২০০ রাউন্ড। পরের দিন ৬১/১/১ কানুলাল লেনে বিপ্লবীদের গোপন ডেরা থেকে উদ্ধার হল আরো ১,০৪০ রাউন্ড। বছরের বাকি কয়েক মাসে দুটি পিস্তল এবং আরও ৯৬০ রাউন্ড গুলি বিভিন্ন জায়গায় খানাতল্লাশির পর। সব মিলিয়ে ২৩,২০০। বাকি গুলি? পিস্তল? কোথায় গেল?

পুলিশের বার্ষিক প্রশাসনিক প্রতিবেদনে ঘটনার বিবরণ ছিল বিস্তারে।

On the 26th August 50 Mauser pistols and 46,000 rounds of ammunition were stolen by Srish Chunder Mittra, the Customs House sirkar of Messrs. R B Rodda & Co. This sirkar was entrusted by the firm with the necessary documents and papers for clearing a consignment of arms and ammunition from the Custom House and took delivery of the goods. One cart containing the abovementioned Mauser pistols and ammunition was diverted from a string of seven carts on the way from Custom House and was eventually traced to an iron yard off Wellington Street where it was found that the arms ammunition had been removed from the carts and stolen. Srish Chundra Mittra disappeared and has not since been found. These weapon and ammunition passed into the hands of anarchists and have been used in dacoity and theft cases. Two pistols and 23,200 rounds of ammunition have since been recovered. Ten persons were prosecuted in connection with this theft and conspiracy to steal, of whom six were discharged and four convicted and sentenced to two year’s rigorous imprisonment each during the current year. The question as to what action was to be taken against the firm responsible for this large loss of arms and ammunition was still under the consideration of the Government at the close of the year.

.

বাকি অস্ত্র এবং গুলি পাচার হয়ে গিয়েছিল লুঠের দিনই। পরিকল্পনামাফিক হরিদাস দত্ত গোরুর গাড়ি নিয়ে পৌঁছেছিলেন মলঙ্গা লেনের কাছে কান্তি মুখার্জীর লোহার গুদামের কাছে একটি মাঠে। বিপিনবিহারীর নির্দেশমতো তিন বিপ্লবী, সতীশ দে, বসন্ত দাস এবং জগৎ গুপ্ত কুলির বেশে পৌঁছলেন মাঠে। যুদ্ধকালীন ক্ষিপ্রতায় কয়েকটি ঠিকাগাড়িতে সমস্ত পেটি বোঝাই করে নিয়ে গেলেন ৩, জেলেপাড়া লেনে ভুজঙ্গভূষণ ধরের বাড়িতে। মাঝরাত পর্যন্ত চলেছিল পিস্তল আর গুলি নতুন কেনা বেশ কয়েকটি স্টিলের ট্রাঙ্কে ভরার কাজ। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল কাঠের পেটিগুলি।

বিপিনবিহারীর তত্ত্বাবধানে বাংলার বিভিন্ন বিপ্লবী দলের কাছে পরের কয়েকদিনে পৌঁছে গেল অত্যাধুনিক মাউজার এবং পর্যাপ্ত গুলি। যার কিয়দংশ পৌঁছেছিল বাঘা যতীনের কাছেও, যিনি তখন আক্ষরিক অর্থেই ব্রিটিশ সরকারের ত্রাস হয়ে উঠেছেন। বুড়িবালামের তীরে ১৯১৫-র ৯ সেপ্টেম্বর বিশাল ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে বাঘা যতীন এবং তাঁর চার সঙ্গীর বহুশ্রুত লড়াইয়ে ব্যবহৃত হয়েছিল লুঠ হওয়া কয়েকটি মাউজার এবং গুলি। অসম যুদ্ধে মরণপণ লড়েছিলেন বাঘা যতীন, চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী, জ্যোতিষ পাল, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত এবং নীরেন দাশগুপ্ত। নতিস্বীকার অনিবার্য ছিল গুলি ফুরিয়ে আসার পর।

—গুলি শেষ হয়ে আসছে..

—হুঁ, কতক্ষণ টানা যাবে আর?

বহুপঠিত তথ্য, ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান চিত্তপ্রিয়। পরের দিন হাসপাতালে গুরুতর আহত বাঘা যতীনের প্রয়াণ। জ্যোতিষের ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়, নীরেন আর মনোরঞ্জনের ফাঁসি।

১৯১৭-র সেপ্টেম্বরের মধ্যে বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পুলিশ ৩১টি মাউজার পিস্তল এবং প্রায় সাতাশ হাজার গুলি উদ্ধার করেছিল। তবে তার আগে বিস্তর ক্ষতি যে হয়ে গিয়েছিল ইংরেজদের, তা নিহিত রয়েছে পরিসংখ্যানে। লুঠের মাউজার পিস্তল আর গুলি দিয়ে সারা বাংলায় ৪৪টি রাজনৈতিক ঘটনায় বিপ্লবীদের হাতে নিহতের সংখ্যা ছিল ২৭, আহত ৪৪।

রাজদ্রোহের বারুদ মজুতই ছিল, অগ্নিসংযোগের জরুরি কাজটি করেছিল অস্ত্র লুঠের সফল অভিযান। যার নেপথ্য নায়ক ছিলেন হাবু মিত্র। শত চেষ্টাতেও যাঁকে ধরতে পারেনি পুলিশ। শ্রীশ পাল, অনুকূলচন্দ্র মুখার্জী সহ অনেকে গ্রেফতার হয়েছিলেন। বিচারের পর ঘটেছিল সাজাপ্রাপ্তি। হাবু ছিলেন অধরাই। কোথায় পালিয়েছিলেন? কী হয়েছিল পরিণতি?

লুঠের ঘটনার রাতেই দার্জিলিং মেল ধরেছিলেন হাবু। রংপুরের কুড়িগ্রামের বিপ্লবী ডাক্তার সুরেন্দ্র বর্ধনের বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন কিছুকাল। পুলিশি নজর এড়াতে ডাক্তার বর্ধন এরপর হাবুকে পাঠিয়ে দেন আসামের গোয়ালপাড়ায় রাভা উপজাতিদের হেফাজতে। কিছুদিন পরে জানতে পারেন, হাবু মণিপুরের দিকে রওনা দিয়েছেন। পরবর্তী ঘটনাবলি নিয়ে প্রামাণ্য তথ্য নেই। সুরেন্দ্র বর্ধনের লেখনীতে, ‘আমার মনে হয়, হাবুর যেরূপ দুঃসাহস, ভারতবর্ষ পেরিয়ে যাইতে চেষ্টা করা অসম্ভব নয়। ঐ সময়ে কোন দুর্ঘটনা হওয়াও অসম্ভব নয়।’

দুর্ভাগ্যের, হাবু মিত্রের কোনও ছবির সন্ধান পাওয়া যায় না।

.

বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে বন্দিত নায়কের তালিকা দীর্ঘ। ক্ষুদিরাম-প্রফুল্ল চাকী-বাঘা যতীন-বিনয়-বাদল-দীনেশের মতো বরণীয়দের জন্য ইতিহাস বরাদ্দ রেখেছে প্রাপ্য সমাদর। কলকাতা পুলিশের সংগ্রহে থাকা ইতিহাসযাপনে তবু মনে হয়, ওঁরা তো চিরপ্রণম্যই, তবে ভাবীকালের কৃপাদৃষ্টি প্রাপ্তির মানদণ্ডে হয়তো কিঞ্চিৎ ভাগ্যবানও বটে।

হাবু মিত্রের মতো কত অনামী-অজানা-অচেনা বিপ্লবী ছিলেন এই বাংলায়। অপরিমেয় অবদান ছিল অগ্নিযুগের উথালপাথালে, অথচ বিস্মৃত ‘কত প্রাণ হল বলিদান’-এর বহুবচনে, ‘কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা’র সমষ্টিতে। নেপথ্যচারী পার্শ্বনায়করা কাব্যে উপেক্ষিত থেকে গেছেন। ইতিহাসেও। আবক্ষ মূর্তি নেই এঁদের। নেই জন্ম বা মৃত্যুজয়ন্তী পালনের সাদর সমারোহ।

তবু মনে রেখো।

০৫. লেখা আছে অশ্রুজলে

—এটা ঠিক করছিস না… এটা আত্মহত্যা।

শয্যাশায়ী যুবক শোনেন এবং প্রত্যুত্তরে হাসতে চেষ্টা করেন।

—তোরা বারবার এক কথা বলছিস কেন? বলেছি তো, দেখাব না ডাক্তার।

—দেখাব না বললেই হল? তুই এভাবে সুইসাইড করবি আর সেটা আমাদের দেখতে হবে? এত ইমোশনাল হলে লড়াইটা জারি থাকবে কী করে?

শরীরে দৃশ্যতই যন্ত্রণার অনায়াস আধিপত্য, তবু সিদ্ধান্তে অনড়ই থাকেন যুবক।

—দয়ার দান নেওয়ার থেকে মৃত্যু ভাল। দাক্ষিণ্য চাই না ওদের। কুকুর-ছাগলের মতো ব্যবহার করার আগে এরপর ওদের ভাবতে হবে… এটাও তো লড়াই-ই…

—কিচ্ছু ভাববে না ওরা… মেডিক্যাল রিপোর্টে লিখে রাখবে তুই রিফিউজ় করেছিস চিকিৎসা। আমরা আইনি পথে কিছুই করতে পারব না।

—লিখুক যা খুশি, তোরা জোর করিস না আমাকে আর…

যন্ত্রণায় ফের কুঁকড়ে যায় যুবকের শরীর। ঘিরে থাকা বন্ধুদলকে অসহায় দেখায়। অবশ্যম্ভাবী পরিণতির প্রহর গোনা ছাড়া উপায়?

.

অধস্তন সহকর্মীর গলায় উত্তেজনার আঁচ সচকিত করে উর্দিধারী অফিসারকে।

—স্যার, ডানদিকে দেখুন…

—কী?

—ওই যে…

অফিসার ঝটিতি দৃষ্টিপথ ঘোরান ডানদিকে। এবং দেখেই তড়িতাহত প্রায়। যুগপৎ বিস্ময়ে এবং অভাবিত প্রাপ্তির পুলকে। এ তো মেঘ না চাইতেই জল! কালবিলম্ব করা নির্বুদ্ধিতা হবে বুঝে সতর্ক করেন দেহরক্ষীকে।

—বনবিহারী, সাবধানে। একে ধরতেই হবে। Prize catch, ব্যাটা প্রচুর জ্বালিয়েছে। আমি গিয়ে সোজা মাথায় রিভলভার ঠেকাব, তুমি কভার দেবে পিছন থেকে।

—ওকে স্যার।

—ছেলেটা কিন্তু মহা বিচ্ছু। ডেঞ্জারাস। গোলমাল দেখলেই গুলি চালাবে। অর্ডারের অপেক্ষা করার কোনও দরকার নেই। ক্লিয়ার?

—রাইট স্যার।

—আর শিউপ্রসাদ… তুমি ঠিক আমার কয়েক পা পিছনে থাকবে…

—জি সাব।

উত্তর কলকাতার হেদুয়ার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা অন্যমনস্ক যুবকের কয়েক পা দূরত্বে ক্ষিপ্র পদচারণায় পৌঁছন উর্দিধারী। কোমরের হোলস্টার থেকে রিভলভার বের করার আগেই বিপত্তি। এমনটা যে হতে চলেছে, কল্পনার অতীত ছিল লালবাজারের ডাকসাইটে অফিসারের।

কল্পনাতীত ছিল পথচলতি কতিপয় এলাকাবাসীরও। কলকাতা সাক্ষী থাকবে এহেন শিহরণ-জাগানো দৃশ্যের, কে ভেবেছিল?

শীতের নিরপরাধ সকাল। ঘড়িতে সাড়ে ছ’টা। শহর সবে পাশ ফিরে শুচ্ছে। আড়মোড়া ভাঙতেও দেরি আছে কিছু।

.

—থোড়া জলদি সর্দারজি…

শিখ ট্যাক্সিচালককে তাড়া দেন আরোহীদের একজন। কিঞ্চিৎ বিরক্ত চালক অ্যাকসিলেটরে চাপ বাড়ান পায়ের। গাড়িতে ওঠা ইস্তক মিনিটে মিনিটে শুনতে হচ্ছে, ‘জলদি চলিয়ে!’ এদের এত তাড়া কীসের? দু’-পাঁচ মিনিট এদিক-ওদিক হলে কী এসে যাবে?

গার্ডেনরিচ ক্রসিংয়ের কাছে আসতেই চাপা স্বরে বলে ওঠেন এক আরোহী, ‘রোখ দিজিয়ে ইয়াহাঁ।’

উলটোদিক থেকে একটা ছ্যাকড়া গাড়ি আসছে দুলকি চালে ঢিকিরঢিকির। দেখতে পেয়েই গাড়ির আরোহীরা সহসা উত্তেজিত, ‘রোখ দিজিয়ে সর্দারজি!’

কিন্তু এখানে থামাতে বলছে কেন? কৌতূহল চেপে রাখতে পারেন না চালক।

—ইয়াহাঁ? আপ লোগ তো অউর দূর যানেওয়ালে থে না?

উত্তরে কড়া ধমক শুনতে হয় চালককে।

—সওয়াল মত কিজিয়ে… ওহ গাড়ি কে সামনে লাগাইয়ে ট্যাক্সি… জলদি…

সন্দেহ হলেও কিছু করার ছিল না আর। আরোহীদের কোমরে গোঁজা পিস্তল ততক্ষণে উঠে এসেছে হাতে। ধাতব আগ্নেয়াস্ত্র নজরে পড়ে ট্যাক্সিচালকের, সভয়ে নির্দেশ পালন করেন বিনা বাক্যব্যয়ে।

.

১৯১৫ সালের প্রথমার্ধ। বিশ্বযুদ্ধের উত্তাপ অনুভূত হচ্ছে বাংলার বিপ্লবী ক্রিয়াকর্মের গতিপ্রকৃতিতেও। ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রবল পরাক্রান্ত জার্মানির সহায়তা নেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন বাঘা যতীনের নেতৃত্বে সমমনোভাবাপন্ন বিপ্লবীকুল। সাম্প্রতিক অতীতে ১৯১৪ সালের অগস্টে ডালহৌসির অদূরে অবস্থিত R B Rodda Co.-এর অস্ত্র লুঠের সফল অভিযানে বিপ্লবীরা উদ্দীপিত যেমন, দমনপীড়ন নীতির দৃঢ়তর প্রয়োগে তেমনই স্থিরসংকল্প পুলিশ প্রশাসন। ধরপাকড়-তল্লাশি অব্যাহত পূর্ণ মাত্রায়। গুপ্তচর বাহিনীর সক্রিয়তা তুঙ্গে। মহানগরীতে বিপ্লবীদের এক ইঞ্চিও জমি ছাড়তে রাজি নয় ‘যুদ্ধং দেহি’ লালবাজার।

ক্ষমতাধর রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে স্রেফ আবেগনির্ভর লড়াই ক্ষণস্থায়ী হতে বাধ্য, সম্যক উপলব্ধি করলেন বাঘা যতীন-বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী-রাসবিহারী বসু এবং অন্য নেতৃবর্গ। প্রয়োজন সাংগঠনিক শক্তির প্রসারের, প্রয়োজন অস্ত্রের নিয়মিত জোগানের। এবং এই দ্বৈত চাহিদা মেটাতেই সর্বোপরি প্রয়োজন অর্থের।

সশস্ত্র অভ্যুত্থানে বিশ্বাসী বঙ্গজ বিপ্লবীদের যিনি তখন অলিখিত সর্বাধিনায়ক, সেই বাঘা যতীন একাধিক গোপন বৈঠক করলেন। বার্তা দিলেন দ্ব্যর্থহীন, রাজশক্তিতে বলীয়ান প্রতিপক্ষের সঙ্গে যুঝতে সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত থাকতে হবে। এবং পরিস্থিতির সার্বিক বিচারে অগ্রাধিকারের শীর্ষে রাখতে হবে যে-কোনও মূল্যে দ্রুত অর্থাগমকে।

সে না হয় হল, কিন্তু কী উপায়ে হবে অর্থাগম?

.

১২ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৫। বেলা দ্বিপ্রহর। মান্ধাতার আমলের জরাজীর্ণ ছ্যাকড়া গাড়ি ঢিমেতালে এগোচ্ছে গার্ডেনরিচের দিকে। আরোহী বলতে Messrs Bird & Co-র এক নিচুতলার কর্মচারী এবং দুই দারোয়ান।

বার্ড কোম্পানির টাকাভর্তি দশটি পাটের বস্তা রয়েছে গাড়িতে। গন্তব্য বদরতলার South Union Mill, উদ্দেশ্য পাটকলের কর্মচারীদের মাসিক বেতন পৌঁছে দেওয়া। শম্বুকগতির গাড়ির দুলুনির সঙ্গে সঙ্গত দিচ্ছে শীতের দুপুররোদ। ঝিমুনির আয়েশি আমেজ গ্রাস করেছে আরোহীদের।

ঝিমুনিতে ছেদ পড়ল গার্ডেনরিচ মোড়ের কাছাকাছি আসতেই। পথরোধ করে দাঁড়াল একটি ট্যাক্সি, যার চালকের আসনে ভয়ার্ত চেহারার এক মধ্যবয়সি শিখ। যিনি একটু আগেই তীব্র ধমক শুনেছেন—

—সওয়াল মত কিজিয়ে… ওহ গাড়ি কে সামনে লাগাইয়ে ট্যাক্সি… জলদি…

ট্যাক্সি থেকে লাফিয়ে নামেন চারজন যুবক। প্রত্যেকের হাতে উদ্যত পিস্তল। আরও জনাতিনেক ভোজবাজির মতো আবির্ভূত আগ্নেয়াস্ত্র হাতে, অকুস্থলের আশেপাশেই যাঁরা অপেক্ষমাণ ছিলেন এতক্ষণ। ঘোড়ার গাড়ি থেমে গেল বাধ্যত। পরের মিনিটদশেকের মধ্যে কর্মচারী ও দারোয়ানদের মাথায় রিভলভার ঠেকিয়ে গাড়ি থেকে নামানো, টাকাভর্তি থলিগুলি ট্যাক্সিতে ওঠানো, চালককে বলপূর্বক নামিয়ে দিয়ে সাতজনের দলের ট্যাক্সি নিয়ে চম্পট দেওয়া।

লুঠ করা থলিগুলির ওজন নেহাত কম ছিল না। ৩৪০০ টাকা ৩৪০টি নোটে, চাঁদির এক টাকা হিসাবে ১৩,৩০০ টাকা, আধুলি ৯৪০ টাকার। বাকি সব চার-আনা, দু-আনা এবং খুচরো পয়সা। সব মিলিয়ে ১৮,০০০ টাকা।

ট্যাক্সি চলতে শুরু করল দক্ষিণ শহরতলির বারুইপুরের দিকে। মধ্যপথে রাজপুরের কাছে একটি টায়ার অকেজো হয়ে গেল, সেই অবস্থাতেই সুবুদ্ধিপুর অবধি চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হল মোটরগাড়ি। বারুইপুরের একটি দোকান থেকে দুটি তোরঙ্গ কিনে ভরা হল টাকাপয়সা।

ট্যাক্সি পড়ে রইল স্থানীয় একজনের জিম্মায়। যাঁকে বলা হল, কলকাতা থেকে মেরামতির যন্ত্রপাতি নিয়ে ফিরবেন আরোহীরা। বারুইপুর স্টেশন থেকে দুটি ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে তুলে দেওয়া হল টাকাভর্তি ট্রাঙ্ক। পথবদল করে যাত্রা এরপর উত্তরে, সুন্দরবন অভিমুখে। নৌকাযাত্রায় পেচুয়াখালি পৌঁছে দিনদুয়েকের আত্মগোপন, অতঃপর টাকীতে সদলে উপস্থিত হওয়া ১৫ ফেব্রুয়ারির সকাল এগারোটায়।

আরও দুটি ট্রাঙ্ক কিনে সমানভাবে ভর্তি করা হল টাকাপয়সা। বিবিধ ঘুরপথ ব্যবহার করে সাতজনের দল পাতিপুকুর স্টেশনে পৌঁছল রাত আটটা নাগাদ। সেখান থেকে তিনটি গাড়ি ভাড়া করে ২০ নম্বর ফকিরচাঁদ মিত্র স্ট্রিটের গোপন ডেরায়। পরবর্তী কাজ ছিল লুঠের টাকা বিভিন্ন বিপ্লবী গোষ্ঠীর কাছে নির্বিঘ্নে পৌঁছে দেওয়া বাঘা যতীনের নির্দেশমাফিক।

গার্ডেনরিচের ডাকাতির আকস্মিকতায় হতচকিত পুলিশের ঘোর কাটতে না কাটতেই দশদিনের মাথায় ফের হানা দিল ডাকাতদল। এবারও মোটরগাড়িতে সওয়ার হয়ে, টার্গেট বেলেঘাটার চাউলপট্টি রোডের বর্ধিষ্ণু চালকল মালিক ললিতমোহন বৃন্দাবন শাহ। যিনি ব্রিটিশ প্রশাসনের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ব্যবসায়ী বলে পরিচিত। ছ’-সাতজনের দলটি পিস্তল হাতে ২২ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ চড়াও হল ললিতমোহনের বাড়ি। সংলগ্ন অফিসঘরে আসীন ক্যাশিয়ার চাবি দিতে অস্বীকার করলেন ক্যাশবাক্সের এবং তৎক্ষণাৎ কোমরের নীচে গুলিবিদ্ধ হলেন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় ললিতমোহনের কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে ২২,০০০ টাকা লুঠ হয়ে গেল মিনিটপাঁচেকের মধ্যে।

গার্ডেনরিচের ডাকাতিতে জড়িত বিপ্লবীদলের নেতৃত্বে ছিলেন বাঘা যতীনের অত্যন্ত বিশ্বস্ত অনুগামী নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, যিনি পরবর্তীকালে এম এন রায় হিসাবে বিখ্যাত হয়েছিলেন। পরিকল্পনা এবং রূপায়ণের নানা পর্যায়ে সঙ্গী ছিলেন অতুলকৃষ্ণ ঘোষ, সরোজভূষণ দাস, ফণীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, বিমানচন্দ্র ঘোষ, রজনীকান্ত বসু, প্রকাশচন্দ্র বসু, বিজয়কৃষ্ণ ঘোষ, গোপালচন্দ্র দত্ত, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত, নীরেন দাশগুপ্ত প্রমুখ। বেলেঘাটার ঘটনাতে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল ফণীন্দ্রনাথ-মনোরঞ্জন-নীরেন ছাড়াও চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী এবং বাঘা যতীনের অনুগত একাধিক বিপ্লবীর।

বিড়ম্বিত লালবাজার পূর্ণশক্তিতে প্রত্যাঘাত করবে, প্রত্যাশিতই ছিল। ১৮ ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যায় শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ের ফড়িয়াপুকুরের কাছে সাদা পোশাকের গোয়েন্দাদের হাতে গ্রেফতার হলেন নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। ২৪ ফেব্রুয়ারি পুলিশ হানা দিল ২০ ফকিরচাঁদ মিত্র স্ট্রিটের সেই বাড়িটিতে, যেখানে টাকাভর্তি ট্রাঙ্ক নিয়ে ১৫ ফেব্রুয়ারির রাতে উঠেছিলেন বিপ্লবীরা। রডা কোম্পানির লুঠ হওয়া একটি মাউজার পিস্তল এবং কিছু কার্তুজ ওই বাড়ি থেকে উদ্ধার হল। গ্রেফতার হলেন চার বিপ্লবী, হীরালাল বিশ্বাস, নিরঞ্জন দাস, পতিতপাবন ঘোষ এবং রাধাচরণ প্রামাণিক।

দুটি অভিযানেরই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সাব-ইনস্পেকটর সুরেশচন্দ্র মুখার্জী, যিনি তখন লালবাজারের কর্তাদের বিশেষ আস্থাভাজন। দুর্দান্ত সাহসী সুরেশের গোপন চরের সংখ্যা ছিল ঈর্ষণীয়। শহরে বিপ্লবীদমন অভিযানগুলিতে তাঁর উপস্থিতি ছিল একরকম আবশ্যিকই। কুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল গ্রেফতারের পর বিপ্লবীদের চরম নির্যাতনের ব্যাপারেও। নরেন্দ্রনাথ এবং অন্য সঙ্গীদের গ্রেফতারির পর বাঘা যতীন সিদ্ধান্ত নিলেন, সুরেশকে আর বাঁচিয়ে রাখা যায় না। রচিত হল নিধনের চিত্রনাট্য। যা অভিনীত হল কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে, হেদুয়া পার্কের ঢিলছোড়া দূরত্বে।

২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৫।

দিনকয়েক পরেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসব, স্বয়ং ভাইসরয়ের উপস্থিতিতে। অনুষ্ঠানের মহড়ার তদারকিতে কাকভোরেই বেরিয়েছেন সাব-ইনস্পেকটর সুরেশচন্দ্র মুখার্জী। সঙ্গী সাব-ইনস্পেকটর বনবিহারী মুখার্জী এবং দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত দেহরক্ষী শিউপ্রসাদ। খুঁটিয়ে দেখে নিচ্ছেন ভাইসরয়ের যাত্রাপথ। কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে পৌঁছনোর পর হঠাৎই চাপা স্বরে বনবিহারী দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সুরেশের।

—স্যার, ডানদিকে দেখুন…

—কী?

সুরেশের দৃষ্টিপথ ধাবিত হয় ডানদিকে, স্নায়ু সজাগ হয়ে ওঠে চকিতে। অন্যমনস্কভাবে ওই যে যুবক দাঁড়িয়ে আছে, তাকে তো হন্যে হয়ে খুঁজছেন গত কয়েক মাস ধরে। চিত্তপ্রিয়! চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী, বাঘা যতীনের ছায়াসঙ্গী অনুচরদের অন্যতম। এ তো মেঘ না চাইতেই জল!

—একে ধরতেই হবে। Prize catch, ব্যাটা প্রচুর জ্বালিয়েছে। আমি গিয়ে সোজা মাথায় রিভলভার ঠেকাব, তুমি কভার দেবে পিছন থেকে।

—রাইট স্যার।

দ্রুত পদক্ষেপে সঙ্গীদের নিয়ে চিত্তপ্রিয়র সামনে পৌঁছলেন সুরেশ, চেপে ধরলেন শার্টের কলার। এবং পরমুহূর্তেই কোমরে গোঁজা রিভলভার বের করে গুলি চালালেন চিত্তপ্রিয়। কপালের ফের, গুলি ছুটল না। মিসফায়ার!

আশেপাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন সঙ্গী বিপ্লবীরা, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত, নীরেন দাশগুপ্ত, নরেন ঘোষচৌধুরী। লক্ষ রাখছিলেন ঘটনাপ্রবাহের উপর । বিপদ বুঝে দৌড়ে এলেন ত্রয়ী, নরেন পিছন থেকে গুলি চালালেন সুরেশকে লক্ষ্য করে। নির্ভুল নিশানা, সুরেশ ভূপতিত হলেন। পথমধ্যে শায়িত অফিসারের শরীরে বিপ্লবীদের বুলেট বিঁধল একাধিক।

ব্যর্থ হল সুরেশের সঙ্গীদের প্রতিরোধও। শিউপ্রসাদের ঊরুতে গুলি লাগল। বনবিহারীকে লক্ষ করে ছোড়া গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল অল্পের জন্য। প্রাতঃভ্রমণে বেরনো মুষ্টিমেয় পথচারীদের স্তম্ভিত দৃষ্টির সামনে শূন্যে গুলি ছুড়তে ছুড়তে পালালেন বিপ্লবীরা। অপারেশন সফল।

হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই মৃত্যু হল সুরেশের। যিনি জানতেন না, বিপ্লবীদের পরিকল্পনাই ছিল সেই সকালে ইচ্ছাকৃত ভাবে সুরেশের দৃষ্টিগোচর করা চিত্তপ্রিয়কে। পুলিশের ‘সন্ধান চাই’-এর তালিকার শীর্ষস্তরে থাকা বিপ্লবী নজরে এলে সুরেশ গ্রেফতারের চেষ্টা করবেনই, চলে আসবেনই ক্লোজ় রেঞ্জে এবং তখনই করা হবে অতর্কিত আক্রমণ। আত্মরক্ষার ন্যূনতম সুযোগ দেওয়া হবে না অত্যাচারী অফিসারকে।

.

মোটরগাড়িতে আরোহীর বেশে সওয়ার হয়ে ডাকাতি। কলকাতায় এই অভিনব পদ্ধতিতে ডাকাতি কখনও ঘটেনি ইতিপূর্বে। উপর্যুপরি দু’বার। দশদিনের ব্যবধানে। রেশ কাটতে না কাটতেই প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশ-হত্যা। এরপর কী? কোথায়-কবে-কখন?

লালবাজারের শীর্ষমহলে কাঁপুনি ধরে গিয়েছিল বললে হয়তো অতিশয়োক্তি হবে, কিন্তু এটুকু লেখাই যায় দ্বিধাহীন, জোড়া ডাকাতি এবং পুলিশ অফিসার খুনের যৌথ অভিঘাতে ব্রিটিশ শাসনাধীন কলকাতা পুলিশের সোর্স নেটওয়ার্ক এবং অপরাধদমনে দক্ষতা নিয়ে দেখা দিয়েছিল অস্বস্তিকর প্রশ্নচিহ্ন। সরকারের কাছে কর্তাদের বিস্তর জবাবদিহি করতে হয়েছিল পুলিশি ব্যর্থতার।

নগরপালের নেতৃত্বে উচ্চপদস্থ অফিসারদের একাধিক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হল নজরদারি ব্যবস্থা ঢেলে সাজার। ফলত, ‘Taxi Dacoities’ বা ‘Motor Dacoities’ রুখতে কলকাতা পুলিশের ইতিহাসে সেই প্রথম চালু হল প্রধান সড়কগুলিতে লোহার বা বাঁশের ড্রপগেট বসিয়ে গাড়ি তল্লাশি করার বিধিনিয়ম। যাকে বর্তমান পুলিশি পরিভাষায় ‘নাকাবন্দি’ বলা হয়।

আমূল পরিবর্তন ঘটল টহলদারির প্রচলিত ব্যবস্থায়ও। বিশেষ গাড়িতে যথেষ্টসংখ্যক সশস্ত্র পুলিশকর্মী মোতায়েন করে শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম, শুরু হল ‘Armoured Car’ এবং ‘Flying Squad’-এর ‘Round-the-clock patrolling’। শহরে ঢোকার এবং বেরনোর রাস্তাগুলিতে সশস্ত্র প্রহরা চালু হল। নজরদারিতে প্রাধান্য পেল উত্তর এবং পূর্ব কলকাতা। শহরের মূলত যে অংশে বিপ্লবীদের গোপন আস্তানার সংখ্যাধিক্য। চিৎপুর, টালা, বেলগাছিয়া, মানিকতলা, নারকেলডাঙা এবং হাওড়া ব্রিজে যখন-তখন যাকে-তাকে ধরে এবং যে-কোনও গাড়িকে থামিয়ে শুরু হল খানাতল্লাশি। থানায় থানায় বসল সাইরেন।

১৯১৫-র বার্ষিক পুলিশ প্রতিবেদনে লিপিবদ্ধ রয়েছে তৎকালীন নজরদারি ব্যবস্থার ভোলবদলে জোড়া ডাকাতি এবং হেদুয়ার খুনের গুরুত্ব।

Political Crime.—The present year has been marked by an outbreak of serious political crime of a new form, namely motor-car dacoities, and in addition here have been three cases of murder by the anarchist party, two of the victims being police officers. Special preventive measures in the shapes of patrols, alarms and traffic barriers were taken to deal with this particular form of crime, and the activities of the anarchist party have been checked by arrests in Calcutta and the neighbourhood under the defence of India Act.

The Special Branch assisted the local police in the investigation of 17 cases during the year. Details of the most important are given below:-

Garden Reach Taxi Dacoity Case. — On the 12th February 1915 at 2 P.M. a sircar and two durwans of Messrs. Bird & Co., Calcutta, were conveying Rs. 18,000 in cash in a ticca gharri to the South Union Mill when their gharry was stopped in Garden Reach by four armed Bengalis in a taxi. The occupants of the gharry were compelled to make over their cash under threats of being shot and the dacoits then decamped in the taxi throwing out the chauffeur as they drove off. They were eventually traced through the Sundarbans back to Calcutta and four of them were arrested in the Northern Town, one with a loaded mauser pistol but no property was recovered. Two of the accused were subsequently put on trial, one being convicted and sentenced to seven years’ rigorous imprisonment and the other acquitted. The chauffeur, a Sikh employe of the Indian Taxi Company, was an accomplice and has since been interned in jail.

Belliaghatta Motor Dacoity. — On the 22nd February 1915 at about 09.30 P.M. a band of 15 Bengali youths armed with pistols attacked the counting house of Lalit Mohan Brindabun Shah at 25, Chaulpatti Road, Belliaghalla, in motor cars and looted Rs. 19,000 in Government Currency notes. The cashier was wounded by a revolver shot and taxi driver shot dead by the dacoits. The numbers of the stolen notes could not be correctly given by the complainant and he and his servants declared their inability to identify any of the dacoits, so it was impossible to get evidence to prosecute. The taxi used, together with a mauser pistol and ammunition was found subsequent to the dacoity in a lane near Circular Road and latter enquiries have given a clue to the gang who committed this crime, 5 of whom have been interned.

Cornwallis Street Murder case. — On the 28th February at 06.30 A.M. Sub-Inspector Suresh Chandra Mukherjee of the Special Branch was shot dead his orderly was severely wounded in Cornwallis Street by three Bengali youths, Chittapriya Roy Chaudhury, Narendra Das and Manoranjan Sen. The Sub-Inspector had just arrested the first–named who was being sought for. All the accused absconded after the commission of the crime and were not traced until November when they were captured by the Balasore Police.

.

বিচারপর্ব শুরু হল গার্ডেনরিচ এবং বেলেঘাটার ঘটনায় ধৃতদের। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য অন্তর্বর্তী জামিনে মুক্ত হয়ে ফেরার হয়ে গেলেন। নাগাল পেল না লালবাজার। ফকিরচাঁদ মিত্র স্ট্রিট থেকে ধৃত চারজনের বিরুদ্ধে প্রথমে অস্ত্র আইনে মামলা করেছিল পুলিশ। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে যাঁদের দু’জনকে গার্ডেনরিচ ডাকাতির মামলায়ও জড়িয়ে দেওয়া হল। যাঁরা আদতে অংশই নেননি ওই ডাকাতিতে। পতিতপাবন ঘোষ এবং রাধাচরণ প্রামাণিক।

অস্ত্র আইনের মামলায় জামিনে মুক্ত ছিলেন পতিতপাবন। ডাকাতির মামলায় ফের গ্রেফতার হলেন। যে গ্রেফতারি চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াল বাঘা যতীন সহ নেতৃস্থানীয়দের। পতিতপাবন ছিলেন অত্যন্ত সক্রিয় বিপ্লবী। ভবিষ্যতের সশস্ত্র অভিযানগুলিতে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার কথা। তাঁর কারাবাস পরিকল্পনায় বিঘ্ন ঘটাবে। পতিতপাবনের মুক্ত থাকা একান্ত জরুরি। এখন উপায়?

উপায় বাতলালেন বিবাদী পক্ষের আইনজীবী। যিনি বাদী পক্ষের আইনজীবীদের সঙ্গে দফায় দফায় আপস-আলোচনার পর জানালেন, পতিতপাবনের মুক্তির উপায় একটিই। অন্য অভিযুক্ত, অর্থাৎ রাধাচরণ, যদি ডাকাতির ঘটনায় আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দেন, তবেই মামলা থেকে পতিতপাবন অব্যাহতি পেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে অবশ্য রাধাচরণের দণ্ডাদেশের মেয়াদ দু’ বছর (অস্ত্র আইনে দোষীদের সাজার মেয়াদ) থেকে বেড়ে দাঁড়াবে সাত বছরের সশ্রম কারাবাসে।

দেশমুক্তির ব্রতে উদ্বুদ্ধ বিপ্লবীরা আর কবে শাস্তির লঘু-গুরুর তোয়াক্কা করেছেন? রাধাচরণ সানন্দে রাজি হলেন দোষ কবুল করতে, দণ্ডিত হলেন সাত বছরের হাজতবাসে। পতিতপাবন মুক্তি পেলেন।

রাধাচরণ প্রামাণিকের (১৮৮৫-১৯১৭) জন্ম মাদারীপুরে (ফরিদপুর)। ছাত্রাবস্থায়, ১৯১১ সালে, বিপ্লবী পূর্ণচন্দ্র দাসের (যাঁর নামে দক্ষিণ কলকাতার পূর্ণদাস রোড) প্রেরণায় স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান এবং ক্রমে বাঘা যতীনের ‘যুগান্তর’ গোষ্ঠীর একনিষ্ঠ সদস্য হয়ে ওঠা।

রাধাচরণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন কারাবাসের দ্বিতীয় বছরে। চোখ আক্রান্ত হল সংক্রমণে, দৃষ্টিশক্তি ক্ষীয়মাণ হতে শুরু করল।

জেল কর্তৃপক্ষের কাছে দণ্ডিতের প্রাপ্য চিকিৎসার আবেদন করলেন রাধাচরণ। এবং ইংরেজ জেলর প্রাথমিক মৌখিক প্রতিক্রিয়ায় সটান প্রত্যাখ্যান করলেন আর্জি। মন্তব্যে ঝরে পড়ল চূড়ান্ত তাচ্ছিল্য আর অবজ্ঞা, ‘কীসের চিকিৎসা? অমন খুনে ডাকাতের অন্ধ হয়ে যাওয়াই ভাল।’ সেই মুহূর্তেই রাধাচরণ সিদ্ধান্ত নিলেন, দণ্ডাদেশ পালনকালে জেল কর্তৃপক্ষের থেকে কোনও অবস্থাতেই কোনওরকম চিকিৎসা গ্রহণ করবেন না।

চোখের অবস্থার ক্রমাবনতি তো ঘটলই, সপ্তাহকয়েক পর গুরুতর পেটের অসুখে আক্রান্ত হলেন রাধাচরণ। কিন্তু অটুট থাকলেন ধনুর্ভাঙা পণে, বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়পরিজনদের শত উপরোধেও রাজি হলেন না জেল হাসপাতালের চিকিৎসা গ্রহণে। শারীরিক অবস্থা যখন ক্রমে আরও সংকটজনক রাধাচরণের, টনক নড়ল জেল কর্তৃপক্ষের। একরকম চক্ষুলজ্জার খাতিরেই অনুরোধ করলেন ওষুধবিষুধ খেতে। কর্ণপাত করলেন না বত্রিশ বছরের তরুণ বিপ্লবী। উপরন্তু স্বেচ্ছায় চিকিৎসা-প্রত্যাখ্যানের মুচলেকা লিখে দিলেন। আসলে মুচলেকা নয়, নিজের মৃত্যু-পরোয়ানাই।

—দয়ার দান নেওয়ার থেকে মৃত্যু ভাল। দাক্ষিণ্য চাই না ওদের। এটাও তো লড়াই।

লড়াই-ই, তবে দ্বিমুখী। একটি ব্যাধির বিরুদ্ধে, অন্যটি মর্যাদারক্ষার। প্রথমটিতে রাধাচরণ পরাভূত হয়েছিলেন অনিবার্য, দ্বিতীয়টিতে শহিদোচিত জয়লাভ।

এমন কত যে লড়াই, কত যে ত্যাগ, অজানা-অচেনাদের নিঃস্বার্থ আত্মবলিদানের কত যে অশ্রুত-অকথিত-অপঠিত আখ্যান অগ্নিযুগের বঙ্গদেশে।

লেখা আছে অশ্রুজলে।

০৬. গোললাইন সেভ!

এ কাহিনির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ নেই অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের, সম্পর্ক নেই লালবাজারের সঙ্গে সম্মুখসমরের। তবু এই আখ্যানের অন্তর্ভুক্তির কারণ, এমন একজন এই অশ্রুত-অকথিত কাহিনির কেন্দ্রে, ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে যাঁর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব অনস্বীকার্য। সে বঙ্গভঙ্গের তীব্র বিরোধিতায় সোচ্চার হওয়াতেই হোক, বা জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে নাইটহুড উপাধি ত্যাগে, অথবা স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে মনস্বী দিকনির্দেশে। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। যাঁর লালবাজারে আগমনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল একবার। প্রেক্ষিত ভিন্ন, কিন্তু সময়কাল অগ্নিযুগেরই।

.

সদাপ্রশান্ত মুখমণ্ডলে আজ যেন একটু বিষণ্ণতার প্রলেপ। অন্যদিন প্রসন্ন মেজাজে ঠাট্টা-রসিকতা করেন, আজ মানুষটি কিঞ্চিৎ নিষ্প্রভ যেন। চিন্তিত হয়ে পড়েন বাকিরা। কী হল? অসুস্থ? নাকি অন্য কারণ কোনও?

সান্ধ্য সাহিত্যবাসর বসেছে রোজকার মতো। কবি সত্যেন্দ্রনাথ পড়ে শোনাচ্ছেন তাঁর নতুন লেখা। দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ বাগচী খাতা খুলে পাঠ করছেন কাব্য-সমালোচনা। খোলা গলায় গান ধরছেন দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভিন্ন ধারার গল্প সোৎসাহে শোনাচ্ছেন মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়। কিন্তু আসরের যিনি মধ্যমণি, তিনিই আজ আনমনা। নিজের নতুন রচনা শোনান অন্যদিন, আজ দৃশ্যতই নিরুৎসাহ। আসরে উপস্থিত সদ্যযুবক সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় পেশায় পুলিশ কোর্টের উকিল, নেশায় সাহিত্যানুরাগী। দ্বিধা কাটিয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেললেন।

—কী হয়েছে গুরুদেব? শরীর খারাপ?

রবীন্দ্রনাথ ম্লান হাসেন উত্তরে।

—না… তবে তোমাদের রবি ঠাকুর আর তেমন লেখা লিখতে পারবেন না।

সবাই সমস্বরে হাঁ-হাঁ করে ওঠেন।

—কেন? কী হল?

—যে ঝরনা-কলমে তোমাদের রবি ঠাকুর লেখেন, সেটি হারিয়ে গিয়েছে। কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

—সে কী! কোথায় গেল? ভাল করে খুঁজে দেখেছেন?

—না দেখে কী আর বলছি …

তাল কেটে যায় জোড়াসাঁকোর নিত্য সন্ধ্যার আসরের। পছন্দের কলম বেপাত্তা হয়ে যাওয়ায় সাহিত্য-আলোচনায় সেদিন আর মন বসছে না রবীন্দ্রনাথের। গান-গল্প-কবিতার জমায়েতে একটা নান্দনিক আবহের প্রয়োজন হয়। গৃহস্বামীর ঔদাসীন্যে সেটাই অন্তর্হিত।

.

মাসদুয়েক পরের দৃশ্য। আতর্নাদ ভেসে আসছে থানার ভিতর থেকে।

—আর কোনওদিন করব না হুজুর, এই কান মুলছি।

থানার বড়বাবু শোনেন। এবং পরমুহূর্তেই প্রচণ্ড ধমক দেন বাজখাঁই গলায়।

—চোপ! তুই তো যখনই ধরা পড়িস, একই কথা বলিস। কান মুলিস আর নাক মুলিস। স্বভাব যায় না ম’লে।

যার উদ্দেশে তর্জনগর্জন, সেই চোর বাবাজীবন নিরুত্তর। কোমরে দড়ি। হাঁটু মুড়ে বসে মাটিতে। চোখমুখ দেখে অনুমান করা যায়, কিছুক্ষণ আগেই অকৃপণ চড়থাপ্পড় হজম করতে হয়েছে। না হজম করে উপায়ই বা কী? এই বড়বাবুর জ্বালায় নিশ্চিন্তে ‘ইধার কা মাল উধার’ করার জো নেই। কোত্থেকে যে খবর পেয়ে যায় কে জানে!

মাসদুয়েক আগে এই অফিসারই ধরেছিল বেলগাছিয়া থেকে। আর এবার টালায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে হানা দিয়ে বমালসমেত। গতবার জামিন পাওয়ার পর কিছুদিন ঘাপটি মেরে থেকে তবেই ফের কাজে নেমেছিল। যাতে চট করে সন্দেহ না হয় পুলিশের।

দিব্যি চলছিল মাঝরাতে সিঁদ কেটে আর ভরদুপুরে ফাঁকতালে এর-ওর বাড়ি থেকে জিনিসপত্র হাতিয়ে। শেষ পর্যন্ত ঠিক ধরে ফেলল! পুলিশের তো শুনি বদলির চাকরি, এই বড়বাবুর বদলি হবে না? কতদিন হয়েছে এই থানায়?

ভাবনায় ছেদ পড়ে পিঠে লাঠির ঘায়ে।

—আর মারবেন না হুজুর…

—মারের আর কী দেখেছিস এখনও? কোনটা কোন বাড়ি থেকে চুরি করেছিস বল শিগগির, না হলে পিটিয়ে চামড়া তুলে দেব!

চোরের আস্তানা থেকে উদ্ধার হয়েছে সামগ্রী হরেকরকম। কাপড়চোপড়-গয়নাগাটি-বাসনকোসন-ঘড়ি-সোনার বোতাম-কলম-দোয়াত। থানার টেবিলে ছড়ানো রয়েছে চোরাই মাল।

—হুজুর, এটা কলুটোলার কাছে দোতলা বাড়ি থেকে… ওইটা ফলপট্টির পাশে যে ডাক্তারবাবু বসেন, তাঁর চেম্বার থেকে… আর এইটা…

বড়বাবু নোট করতে থাকেন গম্ভীর মুখে। তালিকা শেষ হলে হাঁক দেন অধস্তন অফিসারকে।

—গাড়ি লাগাতে বলো, বেরব। এ ব্যাটাকেও তোলো গাড়িতে। এই… ওঠ!

ঘাড় ধরে চোরকে গাড়িতে তোলেন থানার জমাদার। বড়বাবু জাঁকিয়ে বসেন সামনের সিটে। ড্রাইভার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। উত্তর আসে দ্রুত।

—প্রথমে কলুটোলা, তারপর ফলপট্টি, তারপর …

সন ১৯১৮। পুলিশ কোর্ট তখন ছিল লালবাজার চত্বরে। যেখানে বর্তমানে ট্র্যাফিক বিভাগ আর রিজার্ভ ফোর্সের বিভিন্ন শাখার অফিস, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের পশ্চিম প্রান্ত ঘেঁষে সেই তিনতলা লালরঙা বাড়িটিতে।

আদালতের কর্মকাণ্ডের আয়োজন প্রতিটি তলাতেই। একতলায় অফিসকাছারি, করণিকদের বসার ব্যবস্থা। দোতলায় পরিপাটি বার লাইব্রেরি এবং সেকেন্ড আর থার্ড প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্ট। পাবলিক প্রসিকিউটরের অফিসও। তিনতলায় চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাস ছাড়াও ফোর্থ আর ফিফ্থ ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্ট। উকিলবাবুদের ব্যস্তসমস্ত আনাগোনায় আর মামলা-মকদ্দমার সওয়াল-জবাবে দিনভর গমগম করত পুলিশ কোর্ট। সেই কোর্ট, যা অগ্নিযুগের বহু ঘাত-প্রতিঘাতের প্রত্যক্ষদর্শী।

এই নিবন্ধের বিষয় অবশ্য অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা নন। ‘অচেনা লালবাজার’-এর এক ভিন্ন অধ্যায়। যার কেন্দ্রে অবস্থান আমাদের সর্বক্ষণের শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গী স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের।

শুরুর অনুচ্ছেদে যাঁর প্রসঙ্গ উল্লেখিত, সেই সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় ওকালতি করতেন এই পুলিশ কোর্টেই। ব্রিটিশ সরকারের চাকরি গ্রহণে ঘোর অনীহা ছিল ছাত্রজীবন থেকেই। সাহিত্যসাধনায় জীবন অতিবাহিত করবেন, এই ছিল অভীষ্ট। সে বাসনায় বাধা দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, যাঁর অতীব স্নেহভাজন ছিলেন সৌরীন্দ্র। সদ্যযুবককে বুঝিয়েছিলেন কবি, ওকালতিকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করতে। আর সাহিত্যকে রাখতে নেশার অধিষ্ঠানে।

সৌরীন্দ্রমোহন সেদিন নিয়মমাফিক কোর্টে। হঠাৎ দেখলেন, গোপালবাবু প্রায় ছুটতে ছুটতে আসছেন, হাতে ধরা একটি কাগজ। গোপাল ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বাড়ির কর্মচারী। ব্যাংকে যাওয়া-আসা, ছোটখাটো ফাইফরমাশ খাটা, এসব করতেন নিষ্ঠাভরে। বিশ্বাসভাজন ছিলেন কবির। সৌরীন্দ্র অবাক হলেন, এই মাঝদুপুরে গোপালবাবু হঠাৎ কোর্টে? কবির কিছু হল না তো?

—আপনার কাছেই এসেছি। কবির ভারী বিপদ। এই দেখুন!

হাঁফাতে হাঁফাতে হাতে-ধরা কাগজটি সৌরীন্দ্রকে ধরিয়ে দেন গোপাল। কাগজটিতে এক ঝলক চোখ বুলিয়েই সৌরীন্দ্র বাক্‌রুদ্ধ।

রবীন্দ্রনাথের নামে আদালতের সমন! থার্ড প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট আনিসুজ্জামান খাঁ সাহেবের সই রয়েছে, আছে কাছারির সিলমোহরও। সারবস্তু, ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৯ ধারায় দায়ের হওয়া চুরির মামলায় সাক্ষী দিতে শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অমুক তারিখে আদালতে হাজিরা দেওয়ার হুকুম।

—কিন্তু কী চুরি গেছে গুরুদেবের? ব্যাপারটা কী?

একটু ধাতস্থ হয়ে প্রশ্ন করেন সৌরীন্দ্র। ‘ব্যাপারটা’ পরিষ্কার হয় গোপালের উত্তরে।

—কবির ঝরনা-কলম। হারিয়ে গিয়েছিল মাসদুয়েক আগে।

—হ্যাঁ হ্যাঁ, সে তো জানি। উনি বলেছিলেন আমাদের।

—হারায়নি আসলে, চুরি হয়েছিল। চোর ধরা পড়েছে কয়েকদিন আগে।

—তারপর?

.

জোড়াসাঁকো থানার বড়বাবুর গাড়ি এলাকায় চক্কর দিচ্ছে চোরসমেত। কোন বাড়ি থেকে কী কী জিনিস হাতিয়েছে, কাঁচুমাচু মুখে দেখিয়ে দিচ্ছে চোর। কলুটোলা–ফলপট্টি ঘুরে গাড়ি ঢুকল একটি গলিতে।

—এখানে কোন বাড়ি? বল!

বড়বাবুর দাপটে জবুথবু চোর চটপট জবাব দেয়।

—আর একটু এগিয়ে…

—কতটা এগিয়ে?

—সামনেই… এই তো… এই বাড়িটা হুজুর…

গাড়ি থামল চোরের দেখানো বাড়ির সামনে। এবং বাড়ি দেখে বজ্রাহত বড়বাবু! নিজেকে সামলে নিতে মিনিটখানেক, তারপর চোরকে এই মারেন কী সেই মারেন!

—ঠিক বলছিস? এই বাড়ি?

—হ্যাঁ হ্যাঁ… এই বাড়ি। কলমটা এখান থেকেই চুরি করেছিলাম একদিন দুপুরবেলায়। বাড়িতে তখন লোকজন বিশেষ ছিল না।

—আর বাড়ি পেলি না চুরি করার? আশেপাশে তো আরও অনেক বাড়ি আছে, সেখানেও লোকজন থাকে না দুপুরের দিকে। সব ছেড়ে তোর এই বাড়িতেই নজর পড়ল হতভাগা! করলি তো করলি, এখানে!

ক্রুদ্ধ বড়বাবুর প্রবল চপেটাঘাতে চোখে সরষেফুল দেখে চোর। কান-মাথা ভোঁ-ভোঁ করছে। বড়বাবু এত রেগে গেল কেন হঠাৎ? কীসে আলাদা এই বাড়ি? কোনও রাজা-মহারাজা থাকে নাকি? হোমরাচোমরা কেউ? চুরির সময় কি অত বাছবিচার করা যায়? কে থাকে এখানে?

যিনি থাকেন, তিনি তখন বাড়ির দোতলার বারান্দায় পায়চারি করছেন। জোড়াসাঁকো থানার বড়বাবু দেখা করতে চাইছেন শুনে নীচে নেমে এলেন। একটু বিস্ময় নিয়েই, হঠাৎ পুলিশ কেন?

—গুরুদেব, আপনাকে বিরক্ত করার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। কিন্তু বাধ্য হয়েই আসতে হল।

রবীন্দ্রনাথ তাকান কৌতূহলী দৃষ্টিতে।

উদ্ধার হওয়া ঝরনা কলমটি বড়বাবু দেখান রবীন্দ্রনাথকে। কবি শিশুসুলভ উচ্ছ্বাসে প্রগলভ হয়ে ওঠেন।

—এই তো আমার কলম! এ কলমে আমি লিখি। ক’দিন হল, হারিয়েছে— কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না। কোথায় পেলেন? কে নিয়েছিল?

রবীন্দ্রনাথের সংক্ষিপ্ত বয়ান নিজের নোটবইয়ে লিপিবদ্ধ করে বেরনোর উদ্যোগ করেন বড়বাবু। কবিগুরু জিজ্ঞাসা না করে পারেন না, আমার কলম কবে পাব?

এক্ষুনি কলম ফেরত দেওয়ার ব্যপারে অপারগ, বড়বাবু জানিয়ে দেন সবিনয়ে।

—কোর্টে কলমের মকদ্দমা হবে— সে মকদ্দমা হয়ে গেলেই আপনি আপনার কলম পাবেন।

রবীন্দ্রনাথকে সামান্য বিমর্ষ দেখায়। সাধে কী বলে, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা আর পুলিশে ছুঁলে…।

বড়বাবু আইনের ব্যাখ্যা দেন, কলমটি ‘stolen and recovered’ প্রপার্টি। আদালতে চোরাই মাল আগে আইনি পদ্ধতিতে শনাক্ত হবে। তারপরই কলম ফিরিয়ে দেওয়া হবে বিচারকের লিখিত নির্দেশে।

কবি আর কথা বাড়ান না। আইনের কচকচিতে কোনওকালেই বিশেষ রুচি নেই তাঁর। বেশ, আইনি প্রক্রিয়ার সমাপন পর্যন্ত না হয় অপেক্ষাই করবেন। কলমটা অন্তত পাওয়া গেছে, ভেবে নিশ্চিন্ত বোধ করেন।

নিশ্চিন্ত অবশ্য বেশিদিন থাকতে পারলে তো! জোড়াসাঁকো থানার জমাদার কয়েকদিন পর সকালে ঠাকুরবাড়িতে এসে রবীন্দ্রনাথের হাতে ধরিয়ে গেলেন আদালতের সমন। কলম চুরির মামলায় সাক্ষ্য দিতে হাজিরা দিতে হবে লালবাজার প্রাঙ্গণে অবস্থিত আদালতে।

সমন দেখেই অবসন্নের মতো ইজিচেয়ারে বসে পড়লেন রবীন্দ্রনাথ। গোপালকে ডেকে বললেন তৎক্ষণাৎ আদালতে যেতে।

—এখনই কাছারিতে যাও সৌরীনের কাছে। গিয়ে তাঁকে বলবে এ তলব বন্ধ করা চাই। না হলে তাঁদের রবি ঠাকুর হার্টফেল হয়ে মারা যাবে। বন্ধ করতে না পারেন যদি, তা হলে বোলো, খাট কিনে দলবল নিয়ে যেন তিনি এবাড়িতে আসেন।

গোপালের মুখে বৃত্তান্ত শুনে বিচলিত হয়ে পড়লেন সৌরীন্দ্রমোহন। ছুটলেন ম্যাজিস্ট্রেটের ঘরে, শোনালেন সমন-কাহিনি আনিস সাহেবকে। যিনি নিজে সাহিত্যরসিক এবং অকৃত্রিম রবীন্দ্রভক্ত। সব শুনে বেশ কয়েক মিনিটের জন্য আনিস বাক্‌রহিত। ডেকে পাঠালেন কোর্ট ইনস্পেকটর শরৎকুমার ঘোষকে। এবং যিনি হাজির হতেই ক্ষোভ উগরে দিলেন সরোষে।

—এ আপনি কী করেছেন শরৎবাবু? কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই আপনার?

শরৎবাবু হতভম্ব। কী এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ করলেন! আনিস সাহেব ঠান্ডা মাথার মানুষ, সুভদ্র প্রকৃতির। তিনি এমন রেগে আগুন কেন?

—কী করলাম স্যার?

সমনটি এবার শরৎবাবুর দিকে প্রায় ছুড়েই মারেন আনিস সাহেব।

—কী করেছেন নিজেই দেখুন! দেখুন দেখুন! তুচ্ছ একটা কলম-চুরির মামলায় সাক্ষী দিতে রবীন্দ্রনাথকে তলব করেছেন এই পুলিশ কোর্টে। এতে তাঁর কতখানি অপমান হয়েছে, কোনও ধারণা আছে আপনার?

—কী করব স্যার? অফিসারের রিপোর্টে রবীন্দ্রনাথের ছাড়া আর কারও নাম না থাকলে আমি কী করব? তিনি ওই কলম শনাক্ত করেছেন নিজে। আমি তো নিরুপায়! তাঁকেই তো শনাক্ত করতে হবে আদালতে। তা ছাড়া স্যার, আইন তো সকলের জন্যই সমান। সে রবীন্দ্রনাথই হন আর …

বেজায় রেগে গিয়ে শরৎবাবুকে থামিয়ে দেন আনিস সাহেব।

—‘সকলে’ আর রবীন্দ্রনাথ এক হলেন? আর আইন অত দেখাবেন না। আমি আপনার থেকে আইন বেশি বই কম জানি না। আইন মানুষের জন্য। রবীন্দ্রনাথ একজনই হন। তাঁর জন্য আইনের একটু ব্যতিক্রম ঘটলে মহাপাপ হবে না কিছু। সৌরীন্দ্রবাবু, যে ভদ্রলোক ঠাকুরবাড়ি থেকে এসেছেন সমন নিয়ে, তিনি নিশ্চয়ই ওই কলমটি অনেকবার দেখেছেন। চিনতে পারবেন নিশ্চয়ই দেখলে?

সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়েন সৌরীন্দ্রমোহন। আনিস নির্দেশ জারি করেন তৎক্ষণাৎ।

—ব্যস, তা হলে মিটেই গেল। শরৎবাবু, গুরুদেবের নামে যে সমন গিয়েছিল, সেটি আমি বাতিল করলাম। রবীন্দ্রনাথ যাঁকে পাঠিয়েছেন, তাঁর নামে নতুন সমন জারি করুন। তিনি এসে সাক্ষ্য দেবেন মামলায়, কলম শনাক্ত করবেন।

শরৎবাবু বেরিয়ে গেলেন হুকুম তামিলে, আর আনিস সাহেব সখেদে হাত চেপে ধরলেন সৌরীন্দ্রের।

—না জেনে আমি মহাপাতকের মতো কাজ করে ফেলেছি মিস্টার মুখার্জী। এককাঁড়ি কাগজ নিয়ে এসে মুখের সামনে ধরে কাছারির লোক, সইয়ের জন্য। রুটিন কাগজে সই করে দিই রুটিনমাফিক। কার নামে সমন, তা দেখার অবসর থাকে না সবসময়। আমার হয়ে দয়া করে রবীন্দ্রনাথের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবেন। বলবেন, তাঁকে প্রণাম জানিয়ে হাতজোড় করে ক্ষমা প্রার্থনা করছি, তিনি যেন প্রার্থনা মঞ্জুর করেন।

বাকি ঘটনা উদ্ধৃত করি সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের (যাঁর আর এক পরিচয়, ছিলেন কিংবদন্তি গায়িকা সুচিত্রা মিত্রের পিতা) ‘উকিলের ডায়েরি’ বইটি থেকে। যেখানে রয়েছে ঘটনাক্রমের সরস বিবরণী।

‘ব্যাপারের নিষ্পত্তি তখনই হয়ে গেল। গোপালবাবু চলে গেলেন এবং কোর্টের পর আমি গিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে রিপোর্ট দিলে, হেসে তিনি বললেন, তোমার জন্য আজ রবি ঠাকুর অকালমৃত্যু থেকে বেঁচে গেল। আমাদের দেশে কথা আছে, রাজদ্বারে শ্মশানে চ যস্তিষ্ঠতি সঃ বান্ধবঃ। তুমি রাজদ্বারে থেকে বান্ধবতার যে পরিচয় দিলে, তার জন্য প্রাণ খুলে আশীর্বাদ করি, —তোমার জয় হোক!’

.

কলকাতা পুলিশের শতাব্দীবিস্তৃত ইতিহাসে লালবাজার প্রাঙ্গণ কৃতার্থ হয়েছে বহু মনীষীর পদধূলিতে। যাঁদের অধিকাংশেরই আগমন অগ্নিযুগের দিনগুলিতে, হয় কারাবরণ করে, নয় কোনও মামলায় আসামি বা সাক্ষী হিসাবে আদালত-হাজিরায়। লালবাজারে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের পদার্পণ ঘটলে ধন্য হয়ে যেত কলকাতা পুলিশের সদর দফতর, সংশয়ের অবকাশ নেই কোনও। তবে তলিয়ে ভাবলে মনে হয়, লালবাজারে কবির সম্ভাব্য উপস্থিতির যে প্রেক্ষিত তৈরি হয়েছিল, তা যে চূড়ান্ত পরিণতি পায়নি, ভালই হয়েছিল একপ্রকার। নোবেলজয়ী বিশ্ববন্দিত কবি সাক্ষীর কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান নিজের চুরি হয়ে যাওয়া কলম শনাক্ত করতে, সে ভারী বিড়ম্বনার দৃশ্য হত।

ভাগ্যিস হয়নি। ফুটবলের পরিভাষায় বললে, ‘গোললাইন সেভ!’

০৭. স্যার চার্লস টেগার্ট বনাম…

একটা কাগজ-কলম হবে?

—নিশ্চয়ই। আর কিছু লাগলে বলতে পারো। কিছু খেতে ইচ্ছে করলে বলো, ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

শীর্ণকায় শ্যামবর্ণ যুবক মৃদু হাসেন।

—না না, কাগজ-কলম হলেই চলবে। চিঠি লিখব একটা।

প্রহরী বিনা বাক্যব্যয়ে চলে যান খাতা-পেন আনতে। কী ধাতুতে যে গড়া এই ছেলেটি! কাল বাদে পরশু ফাঁসি। এই সময়টায় জেল কর্তৃপক্ষের নির্দেশই থাকে, মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্তের যাবতীয় ইচ্ছে যথাসাধ্য পূরণ করার। ছেলেটির প্রতি মায়াই পড়ে গেছে গত এক মাসে। ভারী শান্ত স্বভাবের। একে খুনি ভাবতে মন সায় দেয় না কিছুতেই। বই পড়ে প্রচুর। আর একটি ছোট্ট কালীমূর্তির সামনে ধ্যান করে সময় কাটায় চুপচাপ। নিজের কৃতকর্মের জন্য কোনও অনুতাপ নেই। কোনও বিশেষ ইচ্ছের কথাও বলে না হাজার প্রশ্ন করলেও। মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টা পরে ফাঁসিকাঠে উঠতে হবে, বোঝা দুষ্কর হাবভাব দেখে। রোজ যেমন থাকে, তেমনই। কোনও হেলদোল নেই। কাল বাদে পরশু ফাঁসি। ভয় করছে না ওর?

—এই নাও কাগজ আর কলম। এতে হবে তো?

একগাল হাসে যুবক।

—হ্যাঁ হ্যাঁ… চিঠিটা পৌঁছে দেওয়ার একটা ব্যবস্থা যদি…

—সে ব্যবস্থা হবে… তুমি লেখো।

নিশ্চিন্ত দেখায় যুবককে, লিখতে বসেন শেষ চিঠি।

‘শ্রীচরণেষু মা…’

.

বিশাল বাংলোয় সান্ত্রি-পেয়াদার ছড়াছড়ি। বন্দুক উঁচিয়ে নজরদারি অষ্টপ্রহর। অপরিচিত কারও প্রবেশের উপর কড়া নিষেধাজ্ঞা। বাড়ির বাসিন্দা যিনি সপরিবারে, তাঁর নিরাপত্তায় কোনওরকম কার্পণ্য করেনি সরকার।

যাঁর জন্য এই নিশ্ছিদ্র আয়োজন, তিনি অবশ্য খুবই ডাকাবুকো প্রকৃতির। ভোরে ওঠা বরাবরের অভ্যাস। ভয়ডরের সঙ্গে সম্পর্ক নেই বিশেষ। নিরাপত্তারক্ষী ছাড়াই বেরিয়ে যান প্রাতঃভ্রমণে। কিড স্ট্রিট থেকে বেরিয়ে পার্ক স্ট্রিট হয়ে চৌরঙ্গি, হেঁটে আসেন দ্রুতপায়ে। আশৈশব স্বাস্থ্যসচেতন, শারীরিক সক্ষমতার ব্যাপারে আপসহীন। ঘোড়ায় চড়ে কাকভোরে বেরিয়ে পড়েন কোনও কোনও দিন। সুঠাম চেহারার অশ্বারোহীকে চষে বেড়াতে দেখা যায় ময়দানের আদিগন্ত সবুজে। কখনও রিভলভার নিয়ে শুটিং প্র্যাকটিসে নেমে পড়েন সাতসকালে। আজ যেমন।

প্রশস্ত ছাদে মহড়া চলছে। পূর্ণবয়স্ক একটি লোকের ছবি আঁকা ক্যানভাসে, লোকটির হাতে উদ্যত পিস্তল। লক্ষ্যবস্তু ওই ছবিই। ওটাই টার্গেট। রাখা হয়েছে ছাদের এক প্রান্তে। দুই সাহেব পাশাপাশি দাঁড়িয়ে চল্লিশ মিটার দূরত্বে। কোমরের হোলস্টারে গোঁজা রিভলভার।

নিশানায় চোখ রেখে ধীরেসুস্থে পালা করে যে গুলি ছোড়া হচ্ছে, এমন নয়। বাস্তবের লড়াইয়ে অত সময় পাওয়া যায় না আগ্নেয়াস্ত্র তাক করার। সাহেবযুগল তাই মহড়ার সময় চেষ্টা করেন যতটা সম্ভব বাস্তবসম্মত পরিস্থিতিতে নিজেদের নিশানা যাচাই করে নেওয়ার। টার্গেটের দিকে পিছন ফিরে গল্পগুজব করতে করতেই হঠাৎ একজন চিৎকার করে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সঙ্গীর।

—There! Fire!

সঙ্গে সঙ্গে অন্যজন যথাসাধ্য ক্ষিপ্রতায় ঘুরে দাঁড়িয়ে রিভলভার বার করে গুলি ছোড়েন টার্গেটে। এভাবেই চলতে থাকে ঘণ্টাখানেক। চলতে থাকে নিশানার চুলচেরা বিচার। মাথা-বুক-পেটের ‘killing zone’-এ গুলি না লাগলে বিমর্ষ হয়ে পড়েন সাহেবরা। শরীরের নিম্নাংশে লাগলে তো শত্রু আহত হবে বড়জোর, প্রাণহানির সম্ভাবনা কম। ফের শুরু হয় লক্ষ্যভেদের মহড়া। গুলি যাতে ঝাঁঝরা করে দিতে পারে ক্যানভাসে আঁকা প্রমাণ সাইজের মানুষটির বক্ষস্থল বা তার আশেপাশের অংশ।

—Let’s start afresh Colson.

—Right Charles!

.

খুনের ‘কী-কখন-কোথায়’ ঝালিয়ে নেওয়ার কাজ চলছে।

—এমন সুযোগ আর আসবে না। মনে আছে তো গোপী… ব্যাটা একেবারে মৃত বলে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত গুলি চালিয়েই যাবি।

তথ্য সংগৃহীত হয়েছে কয়েকমাস ধরে বিস্তর খেটেখুটে। পরিকল্পনা প্রস্তুত হয়েছে একাধিক বৈঠকে আলাপ-আলোচনার পর। প্রয়োগের সময় এসেছে এবার। চূড়ান্ত আঘাতের প্রাক্‌মুহূর্তে বিপ্লবীদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে মধ্য কলকাতার এক গোপন ডেরায়। বক্তার ভূমিকায় বিপ্লবী অনন্ত সিংহ।

—কয়েকটা জরুরি জিনিস আবার বলে দিই। ভোর ছ’টায় কিড স্ট্রিট থেকে মর্নিং ওয়াকে বেরোয়। সঙ্গে একটা টেরিয়ার কুকুর থাকে। আক্রমণটা হবে কিড স্ট্রিট থেকে চৌরঙ্গির মাঝামাঝি জায়গায়। বেড়াতে যাওয়ার সময় বা ফেরার সময়, যখন আমাদের সুবিধে।

গুলি গোপীমোহন করবে। বহুদিন ধরে ফলো করেছে সকালে। চেনে লোকটাকে। একহাতে রিভলভার থাকবে, অন্যহাতে পিস্তল। ধরো যদি গোপীর গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়, তবে খোকা গুলি করবে। খোকা… তুমি দাঁড়িয়ে থাকবে গোপীর থেকে পঞ্চাশ-ষাট গজ দূরে।

টার্গেট যদি পূর্বদিকে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট দিয়ে পালাতে চায় তবে আমি গুলি চালাব। অপেক্ষা করব গোপীর থেকে সত্তর-আশি গজ দূরে।

খোকা ইউরোপিয়ান পোশাক পরবে। সঙ্গে রিভলভার তো থাকবেই। আর থাকবে টাইম বোমা, যা লোশন দিয়ে সাত সেকেন্ডের মধ্যে ফাটানো যায়। একইরকম বোমা আর রিভলভার আমার সঙ্গেও থাকবে। আমি থাকব বাঙালির বেশে।

গোপীর সাজ হবে মুসলমানের মতো। মাথায় ফেজ টুপি। আর মুখের কাটা দাগটা ঢেকে রাখতে উলের স্কার্ফ পরবে। গোপী সফল হলে তো চুকেই গেল, না হলে আমি বা খোকা আক্রমণ করব, যেদিকে ব্যাটা দৌড়বে প্রাণ বাঁচাতে, ধাওয়া করে মারব।

জুলুদা, আপনার কাছে মাউজার পিস্তল থাকবে। আপনি সাইকেলে করে ঘুরে ঘুরে নজর রাখবেন এলাকায়। দরকারমতো সাহায্য করবেন আমাদের। আর খেয়াল রাখবেন সাদা পোশাকের চরগুলোর উপর। সব জায়গায় ছড়িয়ে থাকে ওরা।

একটানা অনেকটা বলে দম নেন অনন্ত। তাকান গোপীমোহনের দিকে।

—কী রে গোপী? পারবি তো?

সাদামাটা দোহারা চেহারার যুবক রিভলভারে হাত বোলাতে বোলাতে সটান তাকান প্রশ্নকর্তার দিকে। চোখ দুটি ঝকঝক করছে উত্তেজনায়। উত্তর আসে অবশ্য আপাতনিরুত্তাপ গলায়।

—তোমাদের সন্দেহ আছে কোনও? তোমরা তো জানোই ওই লোকটাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য আমি যে-কোনও ঝুঁকি নিতে পারি। ওই লোকটার আর একদিনও বেঁচে থাকার অধিকার নেই।

.

ওই লোকটা! যাঁর বেঁচে থাকার অধিকার নেই বলে মনে করতেন অগ্নিযুগের বঙ্গজ বিপ্লবীদের একটা বড় অংশ। যাঁর নামের আদ্যক্ষর থেকে ‘কোডনেম’ তৈরি করেছিলেন বিপ্লবীরা। CAT! Charles Augustus Tegart।

টেগার্টের জন্ম উত্তর আয়ারল্যান্ডে, ১৮৮১ সালে। মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজে কেটেছিল ছাত্রাবস্থার কিছু সময়। ভারতীয় পুলিশে (Imperial Police) যোগ দেন ১৯০১ সালে। প্রথম পোস্টিং পাটলিপুত্রে। বিহার এবং ওড়িশা তখন বাংলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯০৬ সালে বদলি হয়ে এলেন কলকাতায়, গোয়েন্দা বিভাগের Acting ডেপুটি কমিশনার হিসাবে। সেই থেকে টানা পঁচিশ বছর কর্মরত কলকাতা পুলিশে এবং উল্কাসদৃশ উত্থান।

স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের পত্তন এবং তার পরিকাঠামোগত বুনিয়াদ স্থাপনে সিংহভাগ কৃতিত্ব ছিল টেগার্টের। কলকাতা তো বটেই, রাজ্য জুড়ে বিস্তৃত ছিল তাঁর দুর্ধর্ষ ‘সোর্স নেটওয়ার্ক’। সঙ্গে যোগ হয়েছিল ক্ষুরধার বুদ্ধি এবং দুর্দমনীয় সাহস। ফলত তৎকালীন ব্রিটিশ প্রশাসনে ক্রমে হয়ে উঠেছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং কিংবদন্তিসম। পুলিশ কমিশনারের পদে উন্নীত হয়েছিলেন ১৯২৩ সালে, লাগাতার আট বছর ছিলেন কলকাতা পুলিশের অবিসংবাদিত সর্বাধিনায়ক।

স্যার চার্লস টেগার্ট ছিলেন এক বহুবিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। স্রেফ পেশাদারি মানদণ্ডের নির্মোহ বিশ্লেষণ বলবে, অফিসার হিসাবে যে-কোনও সরকারের কাছে তিনি সম্পদবিশেষ। যে বিপ্লবীদের তিনি বরাবরের চক্ষুশূল ছিলেন, তাঁদের একাধিকের লেখনীতেও ধরা রয়েছে টেগার্টের কর্মদক্ষতার প্রতি সম্ভ্রম, ‘টেগার্টের কাছে কলকাতাবাসীর একটি কারণে কৃতজ্ঞ থাকার কারণ ছিল। তিনি কলকাতাকে গুন্ডামুক্ত করিয়াছিলেন।’ প্রবল বিপ্লবী-বিদ্বেষী হওয়া সত্ত্বেও টেগার্টও শোনা যায় শ্রদ্ধাশীল ছিলেন অগ্রগণ্য দেশব্রতীদের প্রতি। ঘনিষ্ঠ মহলে বলতেন, ‘বাঘা যতীন বা অরবিন্দ ঘোষের মতো নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক যদি ইংল্যান্ডে জন্মাতেন, জীবদ্দশাতেই সে দেশে সসম্মানে তাঁদের আবক্ষমূর্তি বসানো হত।’

রসজ্ঞানও পূর্ণ মাত্রায় ছিল টেগার্ট সাহেবের। একটি কাহিনির উল্লেখ করি। এক মহিলা মামলায় হেরে খুব চটেছেন। রাগে ফুটছেন টগবগ। সেই অবস্থায় এলেন টেগার্টের সঙ্গে দেখা করতে। দরখাস্ত করতে চান বন্দুকের লাইসেন্সের।

টেগার্ট প্রশ্ন করলেন মহিলাকে, কী প্রয়োজনে বন্দুক রাখতে চান?

—আমার প্রয়োজন? বন্দুক দিয়ে প্রথমে আমি টেগার্টকে গুলি করে মারতে চাই। তারপর যে ম্যাজিস্ট্রেট আমার মামলা করেছে, তাকে গুলি করব।

টেগার্ট উত্তর দিলেন সহাস্য।

—বেশ তো! কিন্তু লাইসেন্স তো দেওয়া যাবে না আপনাকে। যারা অন্তত দু’বারের বেশি ব্যবহার করবেন বন্দুক, লাইসেন্স শুধু তাদেরই দিয়ে থাকি আমরা!

তৎকালীন শহর কলকাতায় গুন্ডাদমনে টেগার্টের পারদর্শিতার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছি আগে। কলকাতা পুলিশে অতিবাহিত দীর্ঘ কর্মজীবনে কত দাগী অপরাধীকে যে নিজস্ব সোর্স মারফত পাওয়া গোপন খবরের ভিত্তিতে জেলে পুরেছেন, কত দুঃসাহসিক অভিযানে যে নিজে নেতৃত্ব দিয়েছেন অকুতোভয়, হিসাব নেই সত্যিই।

সত্যের স্বার্থে আরও স্বীকার্য, যে দেশ স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করে, সেখানে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিতদের ভাগ্যে কখনওই কৃতজ্ঞতা বরাদ্দ হয় না, জোটে না বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন। সরকারি নীতি যতই অপ্রিয় হোক, তার রূপায়ণে সরকারি চাকুরে তো দায়বদ্ধ থাকবেনই। বিবেক সায় না দিলেও থাকবেন, বাধ্যত।

তবু টেগার্ট অন্য ব্রিটিশ অফিসারদের তুলনায় কেন বহুলাংশে নিন্দিত, ধিক্কৃত? কারণ সহজবোধ্য। মাত্রাছাড়া উচ্চাকাঙ্ক্ষী টেগার্ট ছিঁচকে চোর বা বেপরোয়া ডাকাত বা ত্রাস সৃষ্টিকারী স্থানীয় গুন্ডাদের সঙ্গে বিভাজনরেখা মুছে দিয়েছিলেন দেশপ্রেমিক বিপ্লবীদের।

চোর-ডাকাত-গুন্ডাদের সঙ্গে বিপ্লবীদের গোত্রের ফারাকটি তিনি বিলক্ষণ জানতেন। কিন্তু সরকারের প্রিয়পাত্র হওয়ার নিরন্তর তাগিদে সচেতনভাবেই বিসর্জন দিয়েছিলেন সকল শুভবুদ্ধি। নিছক বিপ্লবীদের গ্রেফতারিতেই ক্ষান্ত থাকতেন না, দমনপীড়নের নিষ্ঠুরতাকে এক অশ্রুতপূর্ব পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। রাজদ্রোহীদের নির্মম নির্যাতন ক্রমে মজ্জাগত হয়ে উঠেছিল তাঁর। অত্যাচারের নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছিলেন চর্চিত অনুশীলনে।

‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’-র নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন বরাবর। উদাহরণ? এক বিপ্লবীকে গ্রেফতার করার পরিকল্পনা চলছে তখন। টেগার্ট ‘অপারেশন’-এর খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দিচ্ছেন অফিসারদের। যাঁদের মধ্যে একজন প্রশ্ন করলেন, ও তো fire open করতে পারে।

টেগার্ট জবাব দিলেন নির্বিকার।

—তোমরা তাকে fire open করতে দেবে কেন? তার আগেই তোমরা fire করবে।

—কিন্তু স্যার, ধরুন গুলি করলাম, মরে গেল লোকটা। আর তারপর দেখলাম, লোকটার কাছে আগ্নেয়াস্ত্র ছিলই না। তখন? আইনত পুলিশ ওভাবে নিরস্ত্র লোকের উপর গুলি চালাতে তো পারে না। আত্মরক্ষার জন্য গুলি চালানো যায়। কিন্তু নিরস্ত্র লোকের ক্ষেত্রে সে যুক্তি তো খাটবে না। Firearms-ই যদি না থাকে?

—In that case you are to find out one.

নির্দেশ জলের মতো পরিষ্কার। অস্ত্র না থাকলে না থাকবে, মৃতদেহের হাতে বা পকেটে বা অন্যত্র অস্ত্র গুঁজে দিতে হবে। যাতে আত্মরক্ষার্থে গুলি চালানোর যুক্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় অকাট্য।

টেগার্ট এমনই ছিলেন। বিপ্লবী-দমনে নীতি-নৈতিকতার তোয়াক্কা করেননি কখনও। বিপ্লবী-বিদ্বেষ কী কল্পনাতীত তীব্র ছিল টেগার্টের, এই নিবন্ধের প্রারম্ভিক অনুচ্ছেদে ইঙ্গিত রয়েছে। রয়েছে নগরপাল থাকাকালীন কিড স্ট্রিটের বাংলোর ছাদে রিভলভার নিয়ে মহড়ার প্রসঙ্গ।

—Let’s start afresh Colson.

—Right Charles!

স্বামীকে নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন টেগার্টের সহধর্মিণী ক্যাথেরিন। পাণ্ডুলিপিতে টাইপ করা পৃষ্ঠার সংখ্যা ৩৪০। ‘Memoir of an Indian Policeman’ শীর্ষক সেই বই শেষ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। অপ্রকাশিত বইটির ভূমিকা লিখেছিলেন S G Taylor, যিনি এক সময় বাংলার ইনস্পেকটর জেনারেল অফ পুলিশ ছিলেন। পাণ্ডুলিপিতে স্বামীর বীরগাথা রচনা করেছিলেন ক্যাথেরিন। সেখানেই পাওয়া যায় সেই শুটিং প্র্যাকটিসের বিবরণ—

‘He had a life-size sketch of Bengali assassin, levelling a pistol, made on canvas which was kept on the roof and when another officer (usually Mr. Colson, who succeeded him as Commissioner) joined in the practice. It was the custom for one or the other of them, while they did the morning exercise, to give a sudden unpremeditated yell; on this the other had to switch round with his automatic and shoot the canvas gunman in some vital part of his anatomy.’

এহেন টেগার্ট যে বিপ্লবীদের খতমতালিকার শীর্ষে বিরাজ করবেন একচ্ছত্র, প্রত্যাশিতই। তাঁর প্রাণনাশের একাধিক চেষ্টা হয়েছে সমসময়ে। যার একটির পরিকল্পনা করেছিলেন বিপ্লবী চতুষ্টয়, অনন্ত সিংহ, দেবেন্দ্রচন্দ্র দে (খোকা), যাঁর নামে এন্টালির ডি সি দে রোড, গোপীমোহন সাহা (কিছু নথিপত্রে ‘গোপীনাথ সাহা’ রয়েছে, তবে পুলিশ রিপোর্টে এবং মামলা-সংক্রান্ত কাগজপত্রে যেহেতু ‘গোপীমোহন’ আছে, সেই নামটিই ব্যবহৃত এ লেখায়) এবং নগেন্দ্রনাথ সেন (জুলু)।

—এমন সুযোগ আর আসবে না গোপী… মনে আছে তো… ব্যাটা একেবারে মৃত নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত গুলি চালিয়েই যাবি।

.

সকাল ছ’টা নাগাদ ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে দাঁড়িয়ে একটু নার্ভাসই লাগে অনন্তর। সব প্ল্যানমাফিক হবে তো? গোপীকে দিব্যি দেখতে পাচ্ছেন, মাথায় ফেজ টুপি, উলের স্কার্ফ জড়িয়েছে কথামতো। খোকা দৃষ্টিপথের বাইরে। জুলুদা নিশ্চয়ই চরকিপাক খাচ্ছে সাইকেলে।

টেনশন কমাতে একটা সিগারেট ধরান অনন্ত। স্রেফ টেনশন কমাতেই নয় অবশ্য, অন্য উদ্দেশ্যও ছিল। সে যুগে বিপ্লবীদের মধ্যে ধূমপানের তেমন চল ছিল না। টেগার্টের জীবনরক্ষায় সদাসতর্ক সাদা পোশাকের পুলিশকর্মীরা ছড়িয়ে থাকে তাঁর প্রাতঃভ্রমণের যাত্রাপথে। সিগারেট ঠোঁটে থাকলে সন্দেহের উদ্রেক হওয়ার সম্ভাবনা কম। ধূমপানে অনভ্যস্ত অনন্তর দম আটকে আসে কাশিতে। কী করে যে এই ধোঁয়া গেলে লোকে?

অপেক্ষা করতে করতে অনন্ত ভাবেন, এই বুঝি গোপীর পিস্তল গর্জে উঠবে, হবে শত্রুনিকেশ। কোথায় কী? সময় যেন আর কাটতে চায় না। কোনও গোলমাল হল?

‘গোলমাল’ যে একটা হয়েছে, অচিরেই জানান দিল সাইকেল নিয়ে ভগ্নদূতের মতো জুলুদার আবির্ভাব।

—এক্ষুনি ডেরায় ফিরে যাও। খোকার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। আগুন লেগে গেছে ওর গায়ে। প্রোগ্রাম বাতিল।

অনন্ত হতাশায় ডুবে যান এবং আন্দাজ করতে পারেন ঠিক কী ঘটেছে খোকার সঙ্গে। বোমাতে অগ্নিসংযোগের জন্য পকেটে লোশনের শিশি ছিল। ইয়েলো ফসফরাস আর কার্বন ডাইসালফাইডের মিশ্রণে প্রস্তুত এই লোশনটি খুবই বিপজ্জনক। লোশনটির বিন্দুমাত্রও যদি শিশি থেকে বেরিয়ে পোশাকের কোন সামান্য অংশও ভিজিয়ে দেয়, তবে কার্বন ডাইসালফাইড দ্রুত উড়ে গিয়ে শুধু ফসফরাস পড়ে থাকবে। আর বাতাসের অক্সিজেনের সংস্পর্শে এলে ফসফরাস জ্বলে উঠবেই, জানা কথা।

ঘটেছিল তেমনটাই। কলকাতার রাজপথে ইউরোপিয়ান বেশভূষায় সজ্জিত এক যুবকের পোশাকে আগুন জ্বলছে দেখে থমকে গিয়েছিলেন পথচারীরা।

—সাহেব, ক্যা হুয়া? আগ ক্যায়সে লাগা?

—সিগ্রেট সে লাগ গিয়া…

ফসফরাসের আগুন খুবই বেয়াড়া প্রকৃতির। জল দিয়েও চাপা দেওয়া মুশকিল। যতক্ষণ জলে ভিজে থাকবে, ঠিক আছে। জল একটু শুকিয়ে গেলেই আগুন ফের মাথাচাড়া দেবে। ফসফরাস নিঃশেষিত না হওয়া পর্যন্ত নিভবে না।

খোকা রাস্তার হাইড্র্যান্ট থেকে জলের ধারা দিয়ে আগুনকে বশে আনার চেষ্টা চালালেন আপ্রাণ। বুঝতে পারছিলেন, আরও ভয়ংকর বিপদ ঘটে যেতে পারে যে-কোনও সময়। প্যান্টের পকেটে রয়েছে পিকরিক পাউডার ভর্তি একটা তাজা বোমা। তাতে gun cotton ফিউজ় লাগানো। কোনওভাবে আগুনের সংস্পর্শে এলেই বিস্ফোরণ ঘটবে এবং মুহূর্তের মধ্যে ভবলীলা সাঙ্গ। বোমাটাকে বার করে কোনওমতে ভিজিয়ে ফেললেন খোকা। টেগার্টকে মারতে গিয়ে নিজেরই প্রাণ নিয়ে টানাটানি তখন।

অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছে টেগার্ট-নিধন অপারেশন। তালতলার ডেরায় মিলিত হয়েছেন হতোদ্যম চার বিপ্লবী। খোকা স্যুট খুলে বালতির জলে ডুবিয়ে দিয়েছেন। তবু ধোঁয়া বেরচ্ছে। অনন্ত তীব্র বকাঝকা করছেন খোকাকে।

—কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই তোর? সব সময় অসাবধান। বুকপকেটে সোজা করে রাখতে পারলি না শিশিটা? তোর আহাম্মকির জন্য সব প্ল্যান ভেস্তে গেল।

জুলুদা থামান উত্তেজিত অনন্তকে।

—যা হয়ে গেছে, হয়ে গেছে। ও নিয়ে ভেবে লাভ নেই। তবে শিক্ষা নেওয়ার আছে আমাদের… টেকনিক্যাল দিকগুলোর ব্যাপারে এবার থেকে ঢের বেশি সতর্ক থাকতে হবে আমাদের। খোকা তো আজ মরতে মরতে বেঁচে গেল। কী রে গোপী… তুই গোঁজ হয়ে বসে আছিস কেন? মন খারাপ করিস না। টেগার্ট তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। আবার সুযোগ আসবে…

গোপীমোহন উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না। রাগে মুখ থমথম করছে তার। চোখদুটি রক্তাভ। মাথার শিরা দপদপ করছে। স্বপ্নপূরণের উত্তেজনায় আগের রাতে দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি। টেগার্টকে গত তিন মাস ধরে দূর থেকে অনুসরণ করেছে সে। কেমন দেখতে, কী পোশাক কখন পরেন, হাঁটার ভঙ্গিটাই বা কীরকম, সব। শেষে তীরে এসে তরী ডুবল অসাবধানে। জুলুদা বলছে, আবার সুযোগ আসবে। আর অনন্তদা গতকাল বলছিল, এমন সুযোগ আর আসবে না। কার কথা বিশ্বাস করবে? মাথা আর কাজ করছে না তার। কারও ভরসায় আর থাকবে না সে। যা করার, একাই করবে এবার। একাই মারবে টেগার্টকে।

এবং একাই মরিয়া চেষ্টা করলেন গোপীমোহন, কিছুদিন পর। সঙ্গী বিপ্লবীদের কাউকে ঘুণাক্ষরেও কিছু জানতে না দিয়ে।

.

১২ জানুয়ারি, ১৯২৪। সকাল সোয়া সাতটা, বড়জোর সাড়ে সাত। সাদা ধুতি আর ঝোলা খাকি শার্ট পরিহিত গোপীমোহন দাঁড়িয়ে রয়েছেন পার্ক স্ট্রিট আর চৌরঙ্গি রোডের সংযোগস্থলে। ঘোরাঘুরি করছেন ইতস্তত। যেমন রোজই করেন টেগার্টকে অসতর্ক মুহূর্তে পেয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে। সাহেব অতি ধূর্ত। রোজ মর্নিং ওয়াকে বেরোন না। যে ক’দিন বেরোন, রোজ আলাদা রাস্তা দিয়ে ফেরেন। তা ছাড়া সাদা পোশাকের টিকটিকিরা তো থাকেই আশেপাশে।

স্নায়ু হঠাৎই সজাগ হয়ে ওঠে গোপীর। আরে, মোড়ের বড় দোকান ‘Hall and Anderson’-এর সামনে কে দাঁড়িয়ে উনি? দোকান খোলেনি এখনও, বাইরে থেকেই কাচের শো-কেসে সাজিয়ে রাখা জিনিসপত্রে চোখ বোলাচ্ছেন দীর্ঘদেহী ভদ্রলোক। কে উনি? ভীষণ চেনা লাগছে তো!

কাছে গিয়ে পিছন থেকে এক ঝলক দেখেই নিশ্চিত হয়ে যান গোপী। আরে, যা ভেবেছি তা-ই, এ তো স্বয়ং টেগার্ট! দাঁড়ানোর ওই ভঙ্গি তার ভীষণ পরিচিত। খয়েরি রঙের লম্বা ওভারকোটটাও। অবশেষে! অবশেষে নাগালের মধ্যে প্রবল পরাক্রমী পুলিশ কমিশনার! যাঁকে খতম করা মানে ব্রিটিশরাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কাঁপুনি ধরিয়ে দেওয়া।

উত্তেজনার বশে এক মুহূর্তও দেরি করলেন না গোপীমোহন। সোজা গিয়ে দাঁড়ালেন কয়েক হাত পিছনে, তড়িঘড়ি চাপলেন ট্রিগার। টেনশনে গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। আওয়াজে সচকিত সাহেব ঘুরে তাকানোর আগেই ফের ছুটল বুলেট। এবার লক্ষ্যভেদ। ফুটপাথে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা দেহে বুলেটবৃষ্টি করলেন গোপী। ঝুঁকি নেওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। মৃত্যু নিশ্চিত করতেই হবে।

ততক্ষণে লোক জমে গেছে আশেপাশে। পার্ক স্ট্রিট ধরে ছুটলেন গোপী। ধাওয়া করলেন কিছু পথচারী, পিছু নিল একটি ট্যাক্সিও। যা লক্ষ্য করে গোপী গুলি ছুড়লেন, পথচলতি একটি মোটরগাড়ি থামিয়ে চেষ্টা করলেন উঠতে। চালক অসম্মত হতে গুলি চালালেন ফের। লক্ষ্যভ্রষ্ট হল বুলেট। একটি ঘোড়ার গাড়ির পাদানিতে উঠে পালানোর শেষ চেষ্টা ব্যর্থ হল। ধরে ফেলল পুলিশ। গোপীর কাছ থেকে উদ্ধার হল একটি বড় পিস্তল, একটি রিভলভার এবং চল্লিশটি তাজা কার্তুজ।

লালবাজার নিয়ে যাওয়ার পথে এক প্রস্থ এলোপাথাড়ি মারধর প্রথমে। তারপর আসামিকে সোজা নিয়ে যাওয়া হল নগরপালের ঘরে। এবং ঢুকেই পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল গোপীমোহনের। এ কী! কমিশনারের চেয়ারে স্বমহিমায় বসে টেগার্ট! যাঁকে একটু আগেই বুলেটে বুলেটে ঝাঁঝরা করে দিয়ে এসেছেন প্রকাশ্য রাজপথে!

স্তব্ধবাক্ গোপীমোহনের দিকে তাকিয়ে তখন বিদ্রুপের হাসি ছুড়ে দিচ্ছেন কমিশনার— ‘So you thought you’d killed Charles Tegart?’

গোপী অচিরেই বুঝলেন, মারাত্মক ভুল করে ফেলেছেন। টেগার্ট ভেবে খুন করে ফেলেছেন অনেকটা তাঁরই মতো দেখতে এক নিরপরাধ ইংরেজ নাগরিককে। নাম Ernest Day, এক বেসরকারি সংস্থার আধিকারিক। মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই। টেগার্ট জীবিত এবং বহাল তবিয়তেই। যাকে বলে, ‘alive and kicking’!

চোখে অন্ধকার দেখেন গোপী, বসে পড়েন মুখ ঢেকে। এত বড় ভুল কী করে হল? একটা নির্দোষ লোককে মেরে ফেললাম, আর টেগার্টের শরীরে এবারও আঁচড়টুকুও কাটা গেল না?

পরের দিনের খবরের কাগজে শিরোনাম, ‘Mistaken identity saves Tegart’, আর বাংলা কাগজে, ‘দৈবক্রমে স্যার চার্লস টেগার্টের জীবনরক্ষা। চৌরঙ্গীর উপর মিঃ আর্নেস্ট ডে নৃশংসভাবে নিহত। গোপী সাহা নামে একজন যুবক ঘটনাস্থলে ধৃত’।

এভাবেই কতবার যে বেঁচে গেছেন টেগার্ট! ভাগ্যের অলৌকিক কৃপাদৃষ্টি ছিল তাঁর উপর। গাড়ি লক্ষ্য করে ছোড়া বোমা কখনও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে অল্পের জন্য, কখনও কোনও অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা থাকলেও যাননি শেষ মুহূর্তে, সশস্ত্র বিপ্লবীদের ওত পেতে থাকার গোপন খবর পেয়ে। ১৯৩০ সালের ২৫ অগস্ট যখন লালবাজারে আসছেন বেলা এগারোটা নাগাদ, ডালহৌসির কাছে টেগার্টের গাড়ি লক্ষ্য করে বোমা ছোড়েন দুই বিপ্লবী, দীনেশচন্দ্র মজুমদার এবং অনুজাচরণ সেনগুপ্ত। প্রবল শব্দে বোমা ফাটে গাড়ির বাঁ দিকে। এক চুলের জন্য রক্ষা পান টেগার্ট। পকেটে রাখা বোমা ফেটে অকুস্থলেই প্রাণ হারান অনুজা। পালানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয় দীনেশের।

১৯৩১ সালে কলকাতা ছাড়লেন টেগার্ট, ‘Secretary of State’s Indian Council’-এ মনোনীত হয়ে। বাংলার বিপ্লবীদের চিরকালীন আক্ষেপ হয়ে রইল টেগার্ট-হত্যায় ব্যর্থতা।

.

গোপীমোহনের বাঁচার রাস্তা ছিল না কোনও। ভবিতব্য ছিল মৃত্যুদণ্ডই। কারাবাসকালীন নির্যাতন সহ্য করেছিলেন অকথ্য। বিচারপর্বের শেষে ফেব্রুয়ারির ১৬ তারিখ সেশন জজ মি. পিয়ার্সনের এজলাসে যখন ফাঁসির রায় ঘোষিত হচ্ছে, আদালতে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমি টেগার্টকে মারতে চেয়েছিলাম। একজন নিরপরাধ মানুষকে মেরেছি বলে অনুশোচনার শেষ নেই আমার। মৃতের পরিবারের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। কিন্তু টেগার্টের ক্ষমা নেই। অত্যাচারী কমিশনারের প্রাণনাশ নিশ্চয়ই করবেন আমার কোনও দেশপ্রেমিক সহযোদ্ধা, যিনি আমার অসম্পূর্ণ কাজ সম্পন্ন করবেন, আমার থেকে অনেক বেশি যত্নবান হবেন হত্যার সময়। আমার প্রতি বিন্দু রক্ত ভারতের প্রতিটি ঘরে আমার মতো একনিষ্ঠ বিপ্লবী গড়ে তুলুক।’

মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দিন ধার্য হয়েছিল ১৯২৪-এর পয়লা মার্চ। ‘ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান’-এর দীর্ঘ তালিকায় যুক্ত হল হুগলির যুবক গোপীমোহন সাহার নাম। যাঁর নামে একটি সেতু রয়েছে শ্রীরামপুরে।

গোপীমোহনের ফাঁসিতে প্রবল প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, শুধু বাংলায় বা পূর্ব ভারতে নয়, দেশ জুড়ে। ১৯২৪-এর ২ জুন সিরাজগঞ্জে প্রাদেশিক কংগ্রেস সম্মেলনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ গোপীমোহনের আত্মবলিদানকে শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রস্তাব আনলেন। অহিংসার আদর্শে একনিষ্ঠ কংগ্রেসে ‘সন্ত্রাসবাদীদের প্রভাব বৃদ্ধি’-র ইঙ্গিতে নড়ে চড়ে বসল ব্রিটিশ প্রশাসন। বাংলার তৎকালীন ‘Intelligence Branch’ (আইবি)-র গোপন রিপোর্ট ‘Brief note on the alliance of Congress with terrorism in Bengal’-এ বলা হল—

‘গোপী সাহা প্রস্তাব পাস। কংগ্রেসের মধ্যে সন্ত্রাসবাদী প্রভাব বৃদ্ধি।

১৯২৪ সালে স্বরাজ্য পার্টির সন্ত্রাসবাদী সভ্যরা কর্পোরেশনের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসাররূপে সুভাষচন্দ্র বসুর মনোনয়ন সমর্থন করে এবং লক্ষ করবার বিষয় যে তাঁহার এই পদে নিয়োগের পর কর্পোরেশনের বহু চাকরি সন্ত্রাসবাদীদের দেওয়া হইতেছে।

সিরাজগঞ্জ কংগ্রেস কনফারেন্সে শ্রী সি আর দাশ তাঁহার সন্ত্রাসবাদী সমর্থকদের সাহায্যে তাঁহার হিন্দু-মুসলমান প্যাক্ট প্রস্তাব এবং তাঁহাদের এই সমর্থনের বিনিময়ে তিনি মিঃ ডে-র আততায়ী গোপী সাহার প্রশংসা সম্বলিত ঘৃণ্য প্রস্তাব পাস করাইয়াছেন। যাহার অর্থ বাংলার যুবকদের সেই আততায়ীর উদাহরণ অনুসরণ করিতে উত্তেজিত করা।’

সরকারের সমর্থক ইংরেজি পত্র-পত্রিকাগুলিতে তুমুল হইচই শুরু হল গোপীমোহনের সমর্থনে প্রাদেশিক কংগ্রেসে পাশ হওয়া প্রস্তাব নিয়ে। কংগ্রেস মুখে অহিংস স্বাধীনতা আন্দোলনের কথা বলে। সন্ত্রাসের নিন্দা করে। অথচ এক নিরপরাধ নাগরিকের খুনিকে সেই কংগ্রেসেরই প্রাদেশিক সম্মেলন শহিদের মর্যাদা দিচ্ছে? এ কেমন দ্বিচারিতা, প্রশ তোলা হল সরকারপক্ষের তরফে।

প্রশ্নের উত্তর দিতে আসরে নামলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন। প্রস্তাবটি যে ভাবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল, তা ছিল এরকম, ‘Although eschewing all kinds of violence and accepting the character and basic principle of non-violence, this conference make known its respect for Gopimohon Saha for the noble self sacrifice which he bearing in mind a high and noble ideal, has made for the preservation of the interests of the motherland.’

অর্থাৎ, ‘এই সম্মেলন সমস্ত প্রকারের হিংসার পরিপন্থী এবং অহিংসার নীতি আদর্শে বিশ্বাসী। তবু, গোপীমোহন সাহাকে শ্রদ্ধা জানাই তাঁর মহৎ আত্মবলিদানের জন্য। তাঁর এই আত্মত্যাগের নেপথ্যে ছিল দেশমাতৃকার স্বার্থরক্ষার মহতী আদর্শ।’

চিত্তরঞ্জন জানালেন, প্রস্তাবটি পাশ হয়েছিল বাংলায়। ইংরেজি অনুবাদের গোলমালে ভুল বার্তা প্রচারিত হচ্ছে। আসল প্রস্তাবটির ইংরেজি অনুবাদ হওয়া উচিত এরকম—

‘This conference, while denouncing (or dissociating itself from) violence (every kind of himsas) and adhering to the principle of non-violence, appreciates Gopimohon Saha’s ideal of self-sacrifice, misguided though that is in respect of the best interest of the country, and expresses its respect for this self-sacrifice.’

মানে, বাংলার পাশ হওয়া মূল প্রস্তাবে শুধু বলা হয়েছিল, ‘এই সম্মেলন সমস্ত রকম হিংসাকে নিন্দনীয় মনে করে (হিংসা থেকে দূরত্ব বজায় রাখতেও অঙ্গীকারবদ্ধ) এবং বিশ্বাস রাখে অহিংসার নীতি-আদর্শে। গোপীমোহন যদিও দেশের স্বার্থরক্ষার নিরিখে সেই আদর্শ থেকে দিকভ্রষ্ট হয়েছিলেন, তবুও তাঁর আত্মবলিদানকে এই সম্মেলন প্রশংসার যোগ্য মনে করছে এবং তাঁকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে।’

টেগার্ট স্বয়ং অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিলেন চিত্তরঞ্জনের ব্যাখ্যা শুনে। ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছিলেন, এ স্রেফ ভাষার কারসাজি ছাড়া কিছু নয়। এ তো নিন্দার মোড়কে প্রশংসাই।

গোপীর ফাঁসির কয়েক সপ্তাহ পরে টেগার্ট ডাকঘরের মাধ্যমে একটি টাইপ করা নোটিস পান।

BANDE MATARAM

Notice

The public is hereby informed that the Bengal Revolutionary council has passed a resolution of a campaign of ruthless assassination of Police Officers. Anyone in any way actively or passively putting obstruction to our comrade when in action or retiring or helping the government of this country as by taking brief from the government or giving evidence in favour of prosecution etc. when such comrade is in the hands of the government, or inciting the government to take repressive measures shall be considered as doing acts highly prejudicial to the best interest of our country and from the moment any such action taken by anyone, he shall be considered as condemned to be despatched forthwith.

PRESIDENT-IN-COUNCIL, RED BENGAL

.

গোপীমোহনের কাহিনিতে পূর্ণচ্ছেদ পড়ার আরও বাকি ছিল। সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটিতে তীব্র বিতর্ক হয় গোপীর বিষয়ে দলের অবস্থান নিয়ে। গোপীর সপক্ষে যুক্তি সাজিয়েছিলেন চিত্তরঞ্জন। বিপক্ষে ছিলেন অহিংসার আদর্শে স্থিত মহাত্মা গাঁধী। চিত্তরঞ্জনের প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়েছিল সামান্য কয়েকটি ভোটে। গোপীর সমর্থনে ভোটের সংখ্যা দেখে স্তম্ভিত গাঁধীজি বুঝেছিলেন, এ জয় একপ্রকার হারারই সামিল। বলতে বাধ্য হয়েছিলেন ‘Defeated and humbled.’

মৃত্যুর দিনদুয়েক আগে প্রেসিডেন্সি জেলের প্রহরীর থেকে গোপী চেয়ে নিয়েছিলেন কাগজ-কলম। শেষ চিঠি লিখেছিলেন গর্ভধারিণীকে। যার নির্যাস তুলে দিলাম নীচে।

‘শ্রীচরণেষু মা,

সর্বশক্তিমানের কাছে প্রার্থনা কোরো ভারতের প্রতিটি সংসার যেন তোমার মতো মা লাভ করে ধন্য হয় আর তাঁরা যেন তোমার গোপীর মতো সন্তান প্রসব করেন, যারা অক্লেশে প্রাণ দেবে দেশের জন্য।

তোমার স্নেহের গোপী।’

০৮. ৮ ডিসেম্বর, ১৯৩০

পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ নয়। গুলি ছিটকে এল প্রায় পনেরো মিটার দূরত্ব থেকে। অব্যর্থ নিশানায় যাঁর শরীরে বিঁধল বুলেট, তিনি মুখ থুবড়ে পড়লেন মাটিতে। এবং আর উঠলেন না।

দ্বিতীয় বুলেট নিশানাচ্যুত হল। এবার যাঁকে লক্ষ্য করে ছোড়া, তাঁর বুকে নয়, লাগল কাঁধে। যিনি ক্ষতস্থানে হাত চেপে বসে পড়তে পড়তেই সশস্ত্র রক্ষীদের উদ্দেশে চিৎকার করে উঠলেন, ‘There he is! Get him!’

কর্তাদের একজন মাটিতে পড়ে গুলিবিদ্ধ। দেখলেই বোঝা যাচ্ছে, প্রাণহীন। আরেকজনের কাঁধে আঘাত করেছে বুলেট। হতভম্ব রক্ষীরা আতঙ্কের ঘোর কাটিয়ে যতক্ষণে তাড়া করলেন সাদামাটা ফতুয়া আর ধুতি পরা আততায়ীকে, দেরি হয়ে গেছে কিছুটা। উল্কাবেগে ছুটেছেন যুবক, চলে গেছেন নাগালের বাইরে। আপ্রাণ ধাওয়া করেও ব্যর্থ হল বাহিনী। কাউকে তাড়া করা নেহাত সহজও নয় ওই থিকথিকে ভিড়ের মধ্যে।

ভিড় অবশ্য স্বাভাবিকই। ঢাকা মেডিক্যাল স্কুল এবং হাসপাতালের জনাকীর্ণ প্রাঙ্গণ। আশেপাশের জেলা থেকে আসা রোগীদের ভিড় অবিশ্রান্ত। যা সামলাতে হিমশিম ডাক্তারবাবুরা। অ্যাম্বুলেন্স ঢুকছে-বেরচ্ছে, স্ট্রেচার নিয়ে ব্যস্তসমস্ত চলাচল হাসপাতালের কর্মীদের। আর বইখাতা নিয়ে ছাত্রদের আসা-যাওয়া তো আছেই। আছে এদিক-সেদিক পড়ুয়াদের জটলা-আড্ডা-হইহল্লা। যেমন হয়ে থাকে।

ওই ভিড়ের মধ্যে দিয়েই পালিয়ে গেলেন যুবক। এমন কাণ্ড ঘটিয়ে, যা কল্পনাতীত ছিল ব্রিটিশ প্রশাসনের। যা বাংলায় তো বটেই, সাড়া ফেলে দিল সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশ্বাসী বিপ্লবীদের মধ্যে আসমুদ্রহিমাচল।

হত্যাকারী অজ্ঞাতপরিচয় থাকলেন না। নামধাম জানা গেল সহজেই। পাওয়া গেল ছবি। খোঁজখবর দিতে পারলে আর্থিক পুরস্কারের প্রতিশ্রুতিসহ ‘সন্ধান চাই’-এর হাজার হাজার ছবি ছাপানো হল ফেরারি যুবকের। ছবির নীচে বড় বড় অক্ষরে পলাতকের নাম।

বিনয়কৃষ্ণ বসু।

.

আলিপুর সেন্ট্রাল জেল

কলিকাতা

১৮ জুন, ১৯৩১

বউদি,

তোমার দীর্ঘ পত্র পাইলাম। অ-সময়ে কাহারও জীবনের পরিসমাপ্তি হইতে পারে না। যাহার যে কাজ করিবার আছে, তাহা শেষ হইলেই ভগবান তাহাকে নিজের কাছে টানিয়া লন। কাজ শেষ হইবার পূর্বে তিনি কাহাকেও ডাক দেন না।

তোমার মনে থাকিতে পারে, তোমার চুল দিয়া আমি পুতুল নাচাইতাম। পুতুল আসিয়া গান গাহিত, ‘কেন ডাকিছ আমার মোহন ঢুলী?’ যে পুতুলের পার্ট শেষ হইয়া গেল, তাহাকে আর স্টেজে আসিতে হইত না। ভগবানও আমাদের নিয়া পুতুল নাচ নাচাইতেছেন। আমরা এক একজন পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে পার্ট করিতে আসিয়াছি। পার্ট করা শেষ হইলে প্রয়োজন ফুরাইয়া যাইবে। তিনি রঙ্গমঞ্চ হইতে আমাদের সরাইয়া লইয়া যাইবেন। ইহাতে আপশোস করিবার আছে কি?

ভারতবাসী আমরা নাকি বড় ধর্মপ্রবণ। ধর্মের নামে ভক্তিতে আমাদের পণ্ডিতদের টিকি খাড়া হইয়া উঠে। কিন্তু তবে আমাদের মরণকে এত ভয় কেন? বলি ধর্ম কি আছে আমাদের দেশে? যে দেশে মানুষকে স্পর্শ করিলে মানুষের ধর্ম নষ্ট হয়, সে দেশের ধর্ম আজই গঙ্গার জলে বিসর্জন দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া উচিত। সবার চেয়ে বড় ধর্ম মানুষের বিবেক। সেই বিবেককে উপেক্ষা করিয়া আমরা ধর্মের নামে অধর্মের স্রোতে গা ভাসাইয়া দিয়াছি। একটা তুচ্ছ গোরুর জন্য, না হয় একটু ঢাকের বাদ্য শুনিয়া আমরা ভাই-ভাই খুনোখুনি করিয়া মরিতেছি। এতে কি ‘ভগবান’ আমাদের জন্য বৈকুণ্ঠের দ্বার খুলিয়া রাখিবেন, না ‘খোদা’ বেহেস্তে স্থান দিবেন?

যে দেশ জন্মের মত ছাড়িয়া যাইতেছি, যার ধূলিকণাটুকু পর্যন্ত আমার কাছে পরম পবিত্র, আজ বড় কষ্টে তার সম্বন্ধে এসব কথা বলিতে হইল।

আমরা ভাল আছি। ভালবাসা ও প্রণাম লইবে।

স্নেহের ছোট ঠাকুরপো।

.

আলিপুর সেন্ট্রাল জেল

কলিকাতা

৩০ জুন, ১৯৩১

মা,

যদিও ভাবিতেছি কাল ভোরে তুমি আসিবে, তবু তোমার কাছে না লিখিয়া পারিলাম না।

তুমি হয়তো ভাবিতেছ, ভগবানের কাছে এত প্রার্থনা করিলাম, তবুও তিনি শুনিলেন না! তিনি নিশ্চয় পাষাণ, কাহারও বুক-ভাঙা আর্তনাদ তাঁহার কানে পৌঁছায় না। ভগবান কি আমি জানি না, তাঁহার স্বরূপ কল্পনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তবু এ-কথাটা বুঝি, তাঁহার সৃষ্টিতে কখনও অবিচার হইতে পারে না। তাঁহার বিচার চলিতেছে। তাঁহার বিচারের উপর অবিশ্বাস করিও না, সন্তুষ্ট চিত্তে সে বিচার মাথা পাতিয়া নিতে চেষ্টা কর। কি দিয়া যে তিনি কি করিতে চান, তাহা আমরা বুঝিব কি করিয়া?

মৃত্যুটাকে আমরা এত বড় করিয়া দেখি বলিয়াই সে আমাদিগকে ভয় দেখাইতে পারে। এ যেন ছোট ছেলের মিথ্যা জুজুবুড়ির ভয়। যে মরণকে একদিন সকলেরই বরণ করিয়া লইতে হইবে, সে আমাদের হিসাবে দুই দিন আগে আসিল বলিয়াই কি আমাদের এত বিক্ষোভ, এত চাঞ্চল্য?

যে খবর না দিয়া আসিত, সে খবর দিয়া আসিল বলিয়াই কি আমরা তাহাকে পরম শত্রু মনে করিব? ভুল, ভুল। ‘মৃত্যু’ মিত্ররূপেই আমার কাছে দেখা দিয়াছে। আমার ভালোবাসা ও প্রণাম জানিবে।

—তোমার নসু

.

আলিপুর সেন্ট্রাল জেল

৩০. ৬. ৩১. কলিকাতা।

স্নেহের ভাইটি,

তুমি আমাকে চিঠি লিখিতে বলিয়াছ, কিন্তু লিখিবার সুযোগ করিয়া উঠিতে জীবন-সন্ধ্যা হইয়া আসিল।

যাবার বেলায় তোমাকে কি বলিব? শুধু এইটুকু বলিয়া আজ তোমাকে আশীর্বাদ করিতেছি, তুমি নিঃস্বার্থপর হও, পরের দুঃখে তোমার হৃদয়ে করুণার মন্দাকিনী-ধারা প্রবাহিত হউক।

আমি আজ তোমাদের ছাড়িয়া যাইতেছি বলিয়া দুঃখ করিও না, ভাই। যুগ যুগ ধরিয়া এই যাওয়া-আসাই বিশ্বকে সজীব করিয়া রাখিয়াছে, তাহার বুকের প্রাণস্পন্দনকে থামিতে দেয় নাই। আর কিছু লিখিবার নাই। আমার অশেষ ভালবাসা ও আশিস জানিবে।

তোমার দাদা

বউদির কাছে তিনি ‘স্নেহের ঠাকুরপো’। ছোটভাইয়ের কাছে ‘স্নেহশীল দাদা’। আর মায়ের কাছে আদরের ‘নসু’।

দীনেশচন্দ্র গুপ্ত।

.

—মাস্টারমশাই, ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্ল চাকীর ঘটনাটা আর একবার বলুন না…

শিক্ষক সস্নেহে হাসেন কিশোর ছাত্রের দিকে তাকিয়ে।

—গত পরশুই তো শুনলি। আর কতবার শুনবি?

—আর একবার শুধু… দোহাই আপনার…

মাস্টারমশাই ফের বলতে শুরু করেন অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে ক্ষুদিরাম-প্রফুল্ল চাকীর অকুতোভয় অভিযানের কথা। ছাত্র শুনতে থাকে নিষ্পলক। বিপ্লবীদের উপর ইংরেজদের অত্যাচারের বিবরণ শুনে কখনও রাগে থমথম করে মুখ, কখনও কেঁদেই ফেলে।

এই ছাত্রটিকে বিশেষ স্নেহ করেন মাস্টারমশাই। আর পাঁচজনের থেকে আলাদা। ভারী ডাকাবুকো। স্কুল শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও আবদার করে বিপ্লবীদের গল্প শোনার। আর শুনতে শুনতে যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে যায়।

মাস্টারমশাই বড় একটা অবাক হন না। শুনেছেন ছেলেটির পরিবারের কথা। জানেন, তাঁর এই কিশোর ছাত্রটির দুই কাকা, ধরণীনাথ গুপ্ত এবং নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত আলিপুর বোমা মামলায় গ্রেফতার হয়েছিলেন অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে। বোঝেন, এ ছেলের শিরা-ধমনীতে স্বদেশব্রতের স্রোত বইছে।

ক্ষুদিরাম কীভাবে হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে উঠলেন, সেই কাহিনির পুনর্কথনের মধ্যেই মনে হয় মাস্টারমশাইয়ের, এই ছেলেটিকে সমিতিতে ভর্তি করে নিলে হয় না? বয়স কম, কিন্তু সমিতির কাজে যা দরকার, সেটা তো আছে পূর্ণ মাত্রায়। দেশের জন্য নিখাদ আবেগ। আর বিদেশি শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস।

—এই শোন, সমিতিতে আসিস তো কাল সন্ধের দিকে একবার…

চোখে খুশি উপচে পড়ে ছেলেটির। সমিতির কাজ করার ভীষণ ইচ্ছে তার। মাস্টারমশাইকে বলতে সাহসে কুলোচ্ছিল না এতদিন। যদি না বলে দেন!

হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে বাড়ির দিকে রওনা দেয় কিশোর।

আসল নাম সুধীর গুপ্ত। সে নামে কেউ ডাকে না অবশ্য। সবাই ডাকনাম ধরেই ডাকে। বাদল।

বাদল গুপ্ত।

.

সাল, ১৯২৮। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে স্বাধীনতাকামী তরুণদের নিয়ে গঠিত হল ‘Bengal Volunteers’। সামগ্রিক নেতৃত্বে থাকলেন মেজর সত্য গুপ্ত। সর্বাধিনায়ক (GOC—General Officer Commanding) সুভাষচন্দ্র বসু স্বয়ং। ক্রমে Bengal Volunteers (B.V.) হয়ে উঠল বাংলার সবচেয়ে সক্রিয় বিপ্লবী সংগঠন। যার শাখা ছড়িয়ে পড়ল জেলায়-জেলায়, শহরে-শহরে, গ্রাম-গ্রামান্তরে।

শৌর্যের অনুশীলন, শৃঙ্খলার পাঠ এবং দেশের জন্য যে-কোনও ত্যাগস্বীকারে প্রস্তুত থাকা—এই ত্রিমুখী লক্ষ্যেই পথ চলা শুরু B.V.-র। বঙ্গজ বিপ্লবীদের মধ্যে নেতৃস্থানীয়দের অধিকাংশই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন এই সংগঠনের সঙ্গে।

কাকে ছেড়ে কার কথা লিখি? চট্টগ্রামে মাস্টারদা সূর্য সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী। ময়মনসিংহে সুরেন্দ্রমোহন ঘোষ। ঢাকায় মদনমোহন ভৌমিক। কলকাতায় বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী, ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত প্রমুখ। বরিশালে সতীন সেন এবং মনোরঞ্জন গুপ্ত। রাজশাহিতে প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ী এবং আরও অনেকে।

তিরিশের দশকের শুরুর দিক তখন। বিপ্লবীদের উপর পুলিশের দমন-পীড়ন নীতি ক্রমশ অসহনীয় পর্যায়ে চলে গিয়েছে। চলছে কথায় কথায় ধরপাকড়, মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে জেলবন্দি রাখা, জেলে পাশবিক নির্যাতন। Bengal Volunteers-এর শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নিলেন, প্রতিবাদ প্রয়োজন, প্রয়োজন সশস্ত্র প্রত্যাঘাতের।

প্রত্যাঘাতের সূচনা ১৯৩০-এর ২৯ অগস্ট সকালে। ঢাকা মেডিক্যাল স্কুল এবং হাসপাতালে। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় চিকিৎসাধীন এক পুলিশ অফিসারকে দেখতে এসেছিলেন ঢাকার তৎকালীন ইনস্পেকটর জেনারেল অফ পুলিশ মিস্টার লোম্যান। সঙ্গে ছিলেন সুপারিন্টেেন্ডন্ট অফ পুলিশ মিস্টার হডসন।

দুই উচ্চপদস্থ পুলিশকর্তা যখন হাসপাতালের ভিড়ের মধ্যে দিয়ে হাঁটছেন সশস্ত্র রক্ষী-পরিবেষ্টিত, ঢাকা মেডিক্যাল স্কুলেরই এক ছাত্র সবার অলক্ষ্যে কাছাকাছি পৌঁছে গেলেন। পনেরো মিটার দূরত্ব থেকে পরপর দুটো গুলি ছুড়লেন। যার প্রথমটা লক্ষ্যভেদ করল অব্যর্থ। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারালেন লোম্যান, যিনি বিপ্লবীদের উপর অকথ্য অত্যাচারে চার্লস টেগার্টের সমকক্ষ হয়ে উঠেছিলেন প্রায়। দ্বিতীয় গুলির নিশানা ছিলেন হডসন। যাঁর কাঁধে বিঁধল বুলেট। ক্ষতস্থান চেপে মাটিতে বসে পড়তে পড়তে যিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘There he is! Get him!’

হাসপাতালের প্রতিটি ইঞ্চি-সেন্টিমিটার হাতের তালুর মতো চিনতেন বিনয়। পুলিশের সাধ্য কী, তাঁকে ধরে, তা-ও আবার ওই ভিড়ের মধ্যে? ফেরার হলেন বাইশ বছরের বিনয়।

বিনয়কৃষ্ণ বসুর জন্ম ১৯০৮-এর ১১ সেপ্টেম্বর। মুনশিগঞ্জ জেলার রোহিতভোগ গ্রামে। ম্যাট্রিকুলেশনের পর ডাক্তারি পড়তে পড়তেই বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষের সংস্পর্শে আসা এবং গুপ্ত সংগঠন ‘মুক্তিসংঘ’-য় যোগদান। বিপ্লবী কার্যকলাপে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়ায় শেষ হয়নি ডাক্তারি পড়া।

পলাতক বিনয়ের সন্ধান পেতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করল ব্রিটিশরাজ। প্রকাশ্যে খুন করেছে আইজি-কে, একে ধরতেই হবে যে করে হোক। ছবি ছাপিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হল রাজ্যের সর্বত্র। বাসস্ট্যান্ডে-রেলস্টেশনে-হাটেবাজারে-রাস্তাঘাটে, কোথায় নয়? বিনয় ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন, খবর ছিল পুলিশের কাছে। ঢাকা থেকে ছাড়া প্রতিটি ট্রেন স্টেশনে স্টেশনে থামিয়ে শুরু হল মরিয়া চিরুনিতল্লাশি।

ওই নিশ্ছিদ্র নজরদারির মধ্যে যেভাবে বিনয় ঢাকা থেকে পালিয়ে এলেন কলকাতায়, রোমহর্ষক। পুলিশের নজর এড়িয়ে লোম্যান-নিধনের নায়ককে কলকাতায় নিয়ে আসার দায়িত্ব নিলেন বিনয়ের সতীর্থ বিপ্লবী সুপতি রায়।

গ্রাম্য চাষির সাজে সুপতি সাজালেন বিনয়কে। ছেঁড়া লুঙ্গি, ছেঁড়া গেঞ্জি, মাথায় নোংরা গামছা জড়ানো। বিনয় ছিলেন গৌরবর্ণ, সুপুরুষ। চেহারায় আভিজাত্যের সিলমোহর। ছদ্মবেশ যতই নিখুঁত হোক, চাষির বেশে বেমানানই লাগছিল বিনয়কে। কিন্তু কী আর করা! নকল সাজে কতটাই বা বদলানো যায় আসল চেহারা?

সুপতি নিজেও বারকয়েক সাজ বদলালেন। কখনও জমিদারপুত্রের বেশভূষা, কখনও চাষির। পুলিশের ট্রেন-তল্লাশি থেকে বাঁচতে কখনও দু’জনে গা ঢাকা দিলেন প্ল্যাটফর্মের ওয়েটিং রুমে, কখনও ট্রেনযাত্রায় চাদরমুড়ি দিয়ে অসুস্থ রোগীর ভূমিকায় অভিনয় করতে হল বিনয়কে। কিছু পথ ট্রেনে, কিছু পথ স্টিমারে অতিক্রম করে দু’জনে পৌঁছলেন দমদম স্টেশনে। শিয়ালদহে নামার ঝুঁকি নেওয়া গেল না। বিনয়ের ছবিতে ছবিতে স্টেশন-চত্বর ছয়লাপ, খবর পাঠিয়েছিলেন কলকাতার বিপ্লবীরা।

সুপতির কাজ ছিল নিরাপদে বিনয়কে কলকাতাস্থিত নেতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। দুরূহ কাজটি সম্পন্ন করলেন নিখুঁত। ৩ সেপ্টেম্বর বেলা দশটা নাগাদ বিনয়কে নিয়ে সুপতি উপস্থিত হলেন ওয়েলেসলি স্কোয়ারের উত্তর দিকে ৭নং ওয়ালিউল্লা লেনে। যেখানে একটি দোতলা বাড়িতে গোপন আস্তানায় অপেক্ষায় ছিলেন বিপ্লবী হরিদাস দত্ত এবং রসময় শূর। যাঁরা সোল্লাসে জড়িয়ে ধরলেন বিনয়কে।

.

স্বাধীনতা আন্দোলনে বাদল গুপ্তের হাতেখড়ি Bengal Volunteers থেকেই। ঢাকার বিক্রমপুর অঞ্চলের পূর্ব শিমুলিয়া গ্রামে জন্ম ১৯১২ সালে। ছাত্রাবস্থা কেটেছিল বানারিপাড়া হাইস্কুলে। যে স্কুলের মাস্টারমশাই নিকুঞ্জ সেন নিজে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে এবং যাঁর প্রভাবেই বাদলের যোগ দেওয়া B.V.-র সংগঠনে। যাঁর কাছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিপ্লবীদের গল্প শুনতেন বাদল।

—মাস্টারমশাই, ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্ল চাকীর ঘটনাটা আর একবার বলুন না…

ওই কিশোর বয়সেই বাদল পরিচয় দিলেন চমকপ্রদ সাংগঠনিক ক্ষমতার। ক্রমে সমিতিতে উন্নীত হলেন পদমর্যাদার গুরুত্বে। নিকুঞ্জ সেন এবং অন্য নেতারা বুঝে গেলেন, বয়স আঠারো না ছাড়ালে কী হয়, এ ছেলে বড় দায়িত্ব নেওয়ার জন্য তৈরি।

তৈরি ছিলেন দীনেশ গুপ্তও। ১৯১১ সালে তদানীন্তন ঢাকা জেলার যশোলং গ্রামে জন্ম দীনেশের। ডাকনাম নসু। চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে দীনেশ ছিলেন তৃতীয়। ১৯২৬ সালে ম্যাট্রিকে উত্তীর্ণ হওয়ার পর বেড়াতে আসেন মেদিনীপুরে কর্মরত দাদা যতীশচন্দ্র গুপ্তের বাড়িতে। মেদিনীপুর শহরে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলার স্বপ্ন লালনের শুরু তখন থেকেই।

স্বপ্ন পরিণতি পেয়েছিল বছরদুয়েক পর, যখন পরম যত্নে মেদিনীপুরে Bengal Volunteers-এর শাখা গড়ে তুলেছিলেন একক প্রচেষ্টায়। অসামান্য সংগঠক ছিলেন দীনেশ। শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহসই হোক বা বিপ্লবী আদর্শের গ্রামভিত্তিক প্রচার, মেদিনীপুর B.V. ছিল তখনকার বাংলায় অগ্রগণ্য। দীনেশ গুপ্তের প্রশিক্ষিত বিপ্লবীরাই ডগলাস, বার্জ এবং জেমস পেডি— এই তিনজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে হত্যা করে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলেছিলেন স্থানীয় প্রশাসনকে।

সাহিত্য বড় প্রিয় ছিল দীনেশের। পড়তে ভালবাসতেন আশৈশব। রবীন্দ্রনাথের অন্ধ অনুরাগী। রবিঠাকুরের অজস্র কবিতা-গান ছিল মুখস্থ।

এক অগ্রজ বিপ্লবীর গ্রন্থিত স্মৃতিচারণায় ধরা আছে দীনেশ গুপ্তের নিখাদ রবীন্দ্রপ্রেম। কথোপকথন চলছে অগ্রজের সঙ্গে অনুজের।

—দীনেশ, তুমি কবিতা ভালবাসো?

—বাসি।

—লেখো না কেন?

—ভালবাসি বলেই লিখি না। কারণ, দু’-একটা লিখে দেখেছি, ও আমার হয় না।

—আচ্ছা দীনেশ, তুমি তো ভীষণ চঞ্চল ছেলে, কোন বস্তু পড়বার সময় তুমি শান্ত হয়ে যাও?

—কবিতা।

—গীতার শ্লোকগুলোও কবিতা। তবে একদিন বলেছিলে কেন যে, গীতা পড়বার সময় তোমায় কষ্ট করে মন বসাতে হয়?

—গীতা পড়তে ভাল লাগে, কিন্তু দু’লাইন পড়লেই কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধের কথা মনে পড়ে, আর তখুনি ভাবতে বসি, কবে আমাদের যুদ্ধ শুরু হবে, কবে আমি সে যুদ্ধের সৈনিক হব! ব্যস, গীতাপাঠ খতম হয়ে যায়।

—কিন্তু কার কবিতা তুমি স্থির হয়ে পড়ো?

—রবীন্দ্রনাথের।

—কেন?

—রবীন্দ্রনাথের কবিতার মধ্যেই আমি ‘গীতা’র বাণী আমার মাতৃ-কণ্ঠে খুঁজে পাই, আরও পাই এই পৃথিবী ও তার অগণিত মানুষকে, পাই আলো-বাতাস জীব-জন্তু ও সবুজ গাছগুলোকে।

—রবীন্দ্রনাথের কবিতা তোমাকে চঞ্চল করে না?

—অভিভূত করে, ক্ষিপ্ত করে না। ভাল লাগে এত বেশি যে, আমার রক্তধারা বিবশ হয়ে আসে, মনে রোমাঞ্চ লাগে। আমি স্থির হই।

.

সাহিত্যরস উপভোগের থেকে ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ অবশ্য তখন বাকি রয়েছে দীনেশের।নেতৃস্থানীয়রা দীনেশ আর বাদলকে ডেকে পাঠালেন কলকাতায়। বিনয় আগেই এসে পৌঁছেছেন। বিনয়-বাদল-দীনেশের উপর দায়িত্ব দেওয়া হল দুঃসাহসিক কাজের। এমন কাজ, যা আগামীতে দুঃস্বপ্নেও তাড়া করবে ইংরেজদের।

কী কাজ? বাংলার আইজি (প্রিজ়নস) তখন লেফটেন্যান্ট কর্নেল নরম্যান সিম্পসন। কারাবন্দি বিপ্লবীদের উপর নির্মম নির্যাতন করে পৈশাচিক আনন্দ পেতেন সিম্পসন। রাজদ্রোহের মামলায় কেউ জেলে এলেই তাঁকে যথেচ্ছ লাঠিপেটা করা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল আইজি সাহেবের। কখনও কখনও দাগি কয়েদিদের লেলিয়ে দিতেন বিপ্লবীদের উপর। তাঁর নির্দেশেই রাজবন্দি সুভাষচন্দ্র বসুকে একবার জেলের গুন্ডা-কয়েদিরা নির্মম ভাবে মেরেছিল। সুভাষের সহবন্দি তখন দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন, কিরণশংকর রায়, সত্য গুপ্ত প্রমুখ। সকলেই সেদিন মার খেয়েছিলেন অল্পবিস্তর।

এই সিম্পসনের কী করে আর বাঁচার অধিকার থাকে? জল্লাদ সাহেবকে প্রাণে মারতে হবে, কিন্তু কোথায়, কী ভাবে? যাতায়াতের পথে বা অন্য কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে মারাই যায় নিখুঁত ছক কষতে পারলে, কিন্তু সেটা স্রেফ আর পাঁচটা বিচ্ছিন্ন সশস্ত্র আক্রমণের মতোই বিবেচিত হবে। লক্ষ্য তো তা নয়। লক্ষ্য এমন তীব্রতম অভিঘাত তৈরি করা, যাতে থরহরিকম্প হবে ব্রিটিশ সরকার, যাতে আপাদমস্তক নড়ে যাবে অত্যাচারী শাসকের মনোবল।

সিদ্ধান্ত হল অভূতপূর্ব। সিম্পসনকে হত্যা করা হবে তাঁর অফিসে, খোদ রাইটার্স বিল্ডিংয়ে। সেই রাইটার্সে, যা বাংলায় ব্রিটিশরাজের প্রশাসনিক সদর দফতর, যা ইংরেজ প্রভুত্বের সদম্ভ প্রতীক হয়ে বিরাজমান তৎকালীন ডালহৌসি স্কোয়ারে। বার্তা দিতে হবে, অন্যায় অত্যাচারের ক্ষমা নেই। প্রয়োজনে শাসকের রাজদরবারেই অভিনীত হবে প্রতিশোধের নাট্যরূপ। ক্ষমতা থাকলে বাঁচাক সিম্পসনকে।

জানাই ছিল, কাজ সম্পন্ন হলেও অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব। মৃত্যু বা গুরুতর আহত হওয়া নিশ্চিত বিনয়-বাদল-দীনেশের, যাঁরা সম্ভাব্য ঘাতক হিসাবে নিজেদের নির্বাচনে আপাদমস্তক রোমাঞ্চিত তখন। যাঁদের তখন ‘জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য, চিত্ত ভাবনাহীন।’

পরিকল্পনার খুঁটিনাটি জানলেন মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন। কেনা হল বিদেশি সাজপোশাক। জোগাড় হল আগ্নেয়াস্ত্র এবং যথেষ্ট পরিমাণে কার্তুজ। ওয়ালিউল্লা লেন থেকে বিনয়কে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল মেটিয়াবুরুজে রাজেন্দ্রনাথ গুহের বাড়িতে। রাজেন্দ্রনাথ যে গোপনে বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত, খুব বেশি লোক জানতেনই না। বিপ্লবী রসময় শূর রাতের অন্ধকারে বিনয়ের সঙ্গে দেখা করে আসতেন।

বাদল আর দীনেশকে রাখা হল নিউ পার্ক স্ট্রিটের এক গোপন আস্তানায়। তত্ত্বাবধানে থাকলেন নিকুঞ্জ সেন, বাদলের স্কুলের ‘মাস্টারমশাই’।

‘অপারেশন সিম্পসন’-এর দিন স্থির হল ৮ ডিসেম্বর। খিদিরপুরের পাইপ রোডের কাছে মিলিত হবেন ত্রিমূর্তি, এমনই ঠিক হল। নিকুঞ্জ নির্দিষ্ট সময়ে নিউ পার্ক স্ট্রিটের ডেরায় পৌঁছলেন এবং স্তব্ধ হয়ে গেলেন ঘরের দৃশ্য দেখে। অভাবনীয়!

ইউরোপীয় সাজে সজ্জিত হয়ে তৈরি বাদল-দীনেশ। একটু পরেই রওনা হওয়ার কথা মৃত্যুযাত্রায়, অথচ ভ্রুক্ষেপহীন দীনেশ পাঠ করছেন রবীন্দ্র-কবিতা। বাদল শুনছেন মন্ত্রমুগ্ধ।

‘যে মস্তকে ভয় লেখে নাই লেখা, দাসত্বের ধূলি

আঁকে নাই কলঙ্কতিলক।’

….

‘তার পরে দীর্ঘ পথশেষে

জীবযাত্রা-অবসানে ক্লান্তপদে রক্তসিক্ত বেশে

উত্তরিব একদিন শ্রান্তিহরা শান্তির উদ্দেশে

দুঃখহীন নিকেতনে।’

নিকুঞ্জের উপস্থিতি টের পেতেই সচকিত হয়ে ওঠেন বাদল।

—মাস্টারমশাই, আমরা রেডি।

দীনেশ বন্ধ করলেন কাব্যগ্রন্থ। দুই বন্ধু উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার ছেড়ে। কোটের পকেটে রাখা রিভলভার আর গুলি ঠিকঠাক রয়েছে কিনা শেষবারের মতো দেখে নিলেন। বাদল পকেটে ঢুকিয়ে নিলেন পটাশিয়াম সায়ানাইডের শিশি। হ্যাঁ, প্রস্তুতি সম্পূর্ণ। এবার রওনা দেওয়া যেতে পারে।

নিকুঞ্জ সেনের সুহৃদ বিপ্লবী ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত-রায়ের ‘ভারতে সশস্ত্র বিপ্লব’ বইটিতে বিস্তারে লিপিবদ্ধ আছে রাইটার্স যাত্রার প্রাক্‌মুহূর্তে দীনেশের কবিতাপাঠের অনুপুঙ্খ বর্ণনা।

যাত্রা হল শুরু। ঘড়িতে বেলা বারোটা। পাইপ রোডে বিনয়কে নিয়ে পৌঁছলেন রসময় শূর। তার কয়েক মিনিটের মধ্যে বাদল-দীনেশকে নিয়ে হাজির হলেন নিকুঞ্জ। তিন যুবক উঠে বসলেন একটি ট্যাক্সিতে। রওনা দিল ট্যাক্সি। গন্তব্য রাইটার্স। তিন বিপ্লবীর ‘The last ride together’।

.

বাকি ইতিহাস বহুপঠিত-বহুচর্চিত-বহুআলোচিত। যার ইতিবৃত্ত সবিস্তার নথিভুক্ত রয়েছে সে যুগের স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের ফাইলে। ‘Shooting outrage in Writers Buildings on 8.12.30, Murder of IG Prisons’। ফাইল নম্বর 59/19/30। সেই ফাইল এবং সংশ্লিষ্ট প্রামাণ্য নথি থেকে রইল ঘটনাপ্রবাহ। ঠিক কী ঘটেছিল, কখন ঘটেছিল, এবং কী ভাবে?

৮ ডিসেম্বর, ১৯৩০।

রাইটার্স বিল্ডিং-এর মেন গেটের সামনে যখন ট্যাক্সিটা এসে থামল, ঘড়িতে সোয়া বারোটা। গেটে প্রহরারত পুলিশ অফিসার দেখলেন, ট্যাক্সি থেকে নামছেন তিন যুবক। ধোপদুরস্ত ইউরোপিয়ান সাজপোশাক ত্রয়ীর। টুপি-কোট-টাই-ট্রাউজার-বুটজুতো। ড্রাইভারের ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে তিনজন সপ্রতিভ ভঙ্গিতে যখন ঢুকলেন, সন্দেহের উদ্রেক হওয়ার ন্যূনতম কারণ পেলেন না পুলিশ অফিসার বা তাঁর সহযোগী কনস্টেবলরা।

সিঁড়ি দিয়ে যখন প্রত্যয়ী পদক্ষেপে দোতলায় উঠছেন বিনয়-বাদল-দীনেশ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সিম্পসন তখন নিজের চেয়ারে বসে একটি চিঠি লিখছেন। পাশে দাঁড়িয়ে ব্যক্তিগত আপ্তসহায়ক জে সি গুহ আর হেড চাপরাশি ভাগল খান। দরজার বাইরে সহকারী চাপরাশি ফাগু সিং।

রাইটার্সের দোতলার বারান্দা। লম্বা, পশ্চিম থেকে চলে গেছে পূর্বে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডান দিকে বেশ কিছুটা গিয়ে পশ্চিমপ্রান্তের শেষে সিম্পসনের অফিস। অন্য দিনের মতোই চেহারা সেদিনের করিডরের। সার দিয়ে অফিসঘর সাহেবদের, যার সামনে ভাবলেশহীন মুখে দাঁড়িয়ে আরদালিরা। ফাইলপত্র বগলে করণিকদের হেঁটে যাওয়া ধীরেসুস্থে। অফিসারদের দর্শনপ্রার্থী যাঁরা, তাঁরা ঘরগুলির সামনে বেজার মুখে অপেক্ষমাণ। কে জানে কখন ডাক আসবে!

তিন যুবক দ্রুতপায়ে হেঁটে এসে থামলেন সিম্পসন সাহেবের ঘরের সামনে। ফাগু সিং তাকাল জিজ্ঞাসু চোখে।

—সাব সে মিলনা হ্যায় আপ লোগো কো?

বিনয় উত্তর দিলেন।

—হ্যাঁ, সাহেব আছেন?

—আছেন, তবে ব্যস্ত। অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল আপনাদের? ভিজিটিং কার্ড থাকলে দিন। না থাকলে ওই রেজিস্টারে নাম লিখুন। আমি জানিয়ে রাখছি সাহেবকে। ওঁর সময় হলে ডাকবেন। ততক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।

আর অপেক্ষা! ভাগল খান বেরিয়ে এসেছেন ভিতর থেকে তখন। দুই চাপরাশিকেই ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়লেন ত্রয়ী। কোটের ভিতরে থাকা রিভলভার উঠে এল হাতে।

সিম্পসন মুখ তুলে দেখলেন, তিন যুবক টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে, রিভলভার তাক করে। আপ্তসহায়ক গুহমশাই আতঙ্কে পিছিয়ে গেলেন কয়েক পা। এবং দাঁড়িয়ে দেখলেন বজ্রাহত, তিন মূর্তির রিভলভার থেকে ছিটকে আসা একঝাঁক গুলি ঝাঁঝরা করে দিয়েছে সিম্পসনের শরীর। নড়ারও সুযোগ পাননি আইজি প্রিজ়নস। টেবিলেই ঢলে পড়েছেন, নিমেষে নিঃশেষিত হয়েছে প্রাণবায়ু।

সংবিৎ ফিরে পেয়ে গুহবাবু দৌড়লেন দরজার দিকে, ভয়ার্ত আর্তনাদ সমেত। দীনেশ রিভলভার তাক করলেন, কিন্তু ট্রিগারে চাপ দিলেন না। পড়িমরি করে দরজা ঠেলে বারান্দায় বেরিয়েই আপ্তসহায়ক ছুটলেন পশ্চিম দিকে। গলা ফাটিয়ে ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ চিৎকার করতে করতে। ফাগু সিং ছুটলেন পাশের ঘরের এক অফিসারের কাছে। নাম মিস্টার টাফনেল ব্যারেট। যিনি ফোন করলেন ঢিলছোড়া দূরত্বের লালবাজারে, ‘Shootout here in Writers! Simpson shot dead. Armed reinforcement needed at the earliest.’

কলকাতা পুলিশের নগরপাল তখন স্যার চার্লস টেগার্ট। গাড়ি ডাকা মানে অমূল্য কয়েক মিনিট বরবাদ। লালবাজারে উপস্থিত রিজার্ভ ফোর্সের সশস্ত্র জওয়ানদের নিয়ে নগরপাল দৌড়লেন রাইটার্সে। লালবাজার থেকে রাইটার্স পায়ে হেঁটেই লাগে বড়জোর দু’-তিন মিনিট। দৌড়লে তো মিনিটখানেক। বাহিনীসহ পৌঁছে গেলেন টেগার্ট।

বাংলার ইনস্পেকটর জেনারেল অফ পুলিশ ক্রেগের অফিস ছিল তিনতলায়। রিভলভার হাতে তিনিও ততক্ষণে নেমে এসেছেন দোতলায়। কোথায় আততায়ীরা? যারা অবলীলায় খুন করল সিম্পসনকে?

কার্যসিদ্ধির পর বিনয়-বাদল-দীনেশ তখন হেঁটে চলেছেন রাইটার্সের বারান্দা দিয়ে। পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে। হাতে রিভলভার তিনজনেরই। করিডরের ঘরে ঘরে তখন ‘সেই বার্তা রটি গেছে ক্রমে’। শুনশান হয়ে গেছে বারান্দা। যে যেখানে পেরেছেন, ঢুকে পড়েছেন। কোনও ঘর থেকে কৌতূহলী মুখ উঁকিঝুঁকি মারলেই গুলি চালাছেন তিন বিপ্লবী। বেশ কয়েকটি ঘরের কাঁচের শার্সি ভেঙে পড়েছে ঝনঝন করে। স্তব্ধ বারান্দায় বীর ত্রয়ীর কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে ‘বন্দে মাতরম’। ব্রিটিশরাজের প্রশাসনিক ভরকেন্দ্র মুখরিত জাতীয়তাবাদী স্লোগানে, যা দূরতম কল্পনাতেও কেউ কখনও ভাবেনি।

ফোর্ড নামের এক সার্জেন্ট সেদিন রাইটার্সে এসেছিলেন ব্যক্তিগত কাজে। সঙ্গে অস্ত্র ছিল না। সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে লক্ষ করছিলেন সব। ইনস্পেকটর জেনারেল ক্রেগ দোতলায় নেমে এসে গুলি চালালেন তিন যুবককে লক্ষ্য করে। গুলি লাগল না। ফোর্ড রিভলভার কেড়ে নিলেন ক্রেগের হাত থেকে। ফায়ার করলেন। নিশানাভ্রষ্ট।

বিনয়-বাদল-দীনেশ গতি বাড়ালেন। চেম্বারের গুলি শেষ হয়ে এসেছে। রি-লোড করা প্রয়োজন। থামলেন একটা ঘরের সামনে, যেখানে বসেন পদস্থ আধিকারিক মিস্টার নেলসন। পাশেই ছিল পাসপোর্ট অফিস। বিনয়-বাদল রিভলভারে গুলি ভরতে সেখানে ঢুকলেন। যে কয়েকজন কর্মী ছিলেন ঘরে, ছুটে বেরিয়ে এলেন ভয়ে।

দীনেশ যখন মিস্টার নেলসনের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে রিভলভার রি-লোড করছেন দ্রুত, দরজা ঠেলে উঁকি দিলেন নেলসন। ঝটিতি ফায়ার করলেন দীনেশ, গুলি লাগল নেলসনের ঊরুতে। তাড়া করে নেলসনের ঘরে ঢুকে পড়লেন দীনেশ। নেলসন শক্তসমর্থ চেহারার অধিকারী ছিলেন, আহত অবস্থাতেই ধস্তাধস্তি শুরু হল দীনেশের সঙ্গে। কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেন রিভলভার। গুলির আওয়াজে পাশের পাসপোর্ট অফিস থেকে লোডেড রিভলভার নিয়ে বেরিয়ে এলেন বিনয়-বাদল। নেলসনের মাথায় রিভলভারের বাঁট দিয়ে সজোরে আঘাত করলেন বিনয়। নেলসন মাটিতে পড়ে গেলেন। এবং দ্রুত সামলে নিয়ে রক্তাক্ত অবস্থাতেই কোনওমতে বেরলেন ঘর থেকে।

সাড়ে বারোটা থেকে পৌনে একটার মধ্যে যখন রাইটার্সের অলিন্দ দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলেন তিন বঙ্গসন্তান, পুলিশ আক্ষরিক অর্থেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। লালবাজার থেকে বাড়তি সশস্ত্র পুলিশ এসে পজিশন নেওয়ার আগে পর্যন্ত ইনস্পেকটর জেনারেল ক্রেগ এবং সার্জেন্ট ফোর্ড ছাড়া কারও সাহসে কুলোয়নি যুবক ত্রয়ীর মোকাবিলা করার। অথচ তিনতলাতেই ছিল এক ডজন পদস্থ পুলিশ অফিসারের ঘর। দোতলায় নেমে আসার একাধিক সিঁড়িও ছিল। ত্রাস সঞ্চারিত হয়েছিল এতটাই, কর্তাদের কেউ নামেননি। নামার চেষ্টাও করেননি।

পরিস্থিতি বদলাল বাড়তি বাহিনী আসার পর। পাসপোর্ট অফিসের সংলগ্ন যে ঘরটিতে তখন বিনয়-বাদল-দীনেশ, তা কার্যত ঘিরে ফেলল পুলিশ। দীনেশ দরজা ফাঁক করে দু’রাউন্ড গুলি চালালেন পুলিশকে লক্ষ্য করে। পুলিশ সতর্ক ছিল, গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। পালটা ফায়ার করলেন পুলিশ অফিসার জোনস। দীনেশের গলা থেকে যন্ত্রণাকাতর ‘উঃ’ ছিটকে বেরল। গুলি সম্ভবত লেগেছে কাঁধে।

ঘরের ভিতর তিন যুবক। বাইরে দরজার দু’দিকে সশস্ত্র পুলিশ। দীর্ঘ অলিন্দের দখল নিয়ে ফেলেছে উর্দিধারীরা। পরস্পরের মধ্যে দৃষ্টিবিনিময় হয় বিপ্লবীত্রয়ীর। প্রাণ নিয়ে বেরনো দুঃসাধ্য হবে, জানাই তো ছিল। ধরা পড়া যখন প্রায় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে, শেষ হয়ে এসেছে গুলির ভাণ্ডার, প্রস্তুতি শুরু হল মৃত্যুবরণের।

বাদল পকেট থেকে বের করলেন পটাশিয়াম সায়ানাইডের শিশি। ঢেলে দিলেন গলায়। মিনিটখানেকের মধ্যেই নিষ্প্রাণ দেহ ঝুঁকে পড়ল টেবিলের উপর। বাইরে দাঁড়ানো পুলিশ পরপর দুটো গুলির আওয়াজ শুনল ঘরের ভিতর থেকে। বিনয় আর দীনেশ দু’জনেই গুলি চালিয়েছেন নিজেদের মাথা লক্ষ্য করে।

পূর্ব দিকের দরজার নীচের ফাঁক দিয়ে ডেপুটি কমিশনার বার্টলে দেখলেন, দুটি দেহ পড়ে আছে মাটিতে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে। পুলিশ ঢুকল দরজা ঠেলে।

ঘরের উত্তর-পূর্ব কোণে একটা টেবিল। যার সামনের চেয়ারে বাদল গুপ্তের প্রাণহীন দেহ। মাথা ঢলে পড়েছে টেবিলে। বিনয় আর দীনেশ, দু’জনেই পড়ে আছেন মেঝেতে। দীনেশ সংজ্ঞা হারিয়েছেন। বিনয়ের জ্ঞান রয়েছে তখনও। দীনেশের শুধু মাথা নয়, কাঁধেও বুলেটের ক্ষত, জোনসের ছোড়া গুলিতে।

দীনেশের পাশে পড়ে .৪৫৫ বোরের Webley রিভলভার। চেম্বারে দুটো কার্তুজের খোল। একটা ‘মিসফায়ারড’, অন্যটা ‘ফায়ারড’। বিনয়ের ট্রাউজারের পিছনের পকেটে একটা পাঁচ চেম্বারের .৩৪ বোরের Ivor Johnson রিভলভার। চেম্বারে পাঁচটি ‘ফায়ারড’ কার্তুজের খোল। বাদলের দেহের পাশে পড়ে দুটো .৩২ বোরের ছ’ঘরা আমেরিকান রিভলভার, কিছু কার্তুজ এবং পটাশিয়াম সায়ানাইডের শিশি।

মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরও বেশ কিছু কার্তুজের খোল। তিনটি বিদেশি টুপি। জাতীয় কংগ্রেসের দুটি পতাকা ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে। আর একটি পতাকা বিনয়ের ট্রাউজারের পিছনের পকেটে। রাইটার্সের অলিন্দ থেকেও উদ্ধার হল প্রায় গোটা কুড়ি বুলেট হেড।

বাদলের দেহ রওনা দিল মর্গে। বিনয় আর দীনেশকে নিয়ে ছুটল পুলিশের গাড়ি, গন্তব্য মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। লালবাজারের কর্তারা দিব্যি বুঝতে পারছিলেন, এদের বাঁচিয়ে রাখা দরকার, সুস্থ হলে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যাবে অনেক অজানা তথ্য।

বাংলা তথা ভারত কাঁপিয়ে দেওয়া এই ঘটনা পরের দিন দেশের সমস্ত খবরের কাগজের প্রথম পাতার সিংহভাগ দখল করে নিল। ৯ ডিসেম্বরের আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদন তুলে দিলাম নীচে।

[মঙ্গলবার, ২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৩৩৭; ইং ৯-১২-১৯৩০]

‘গুলির আঘাতে বাঙ্গলার কারা-বিভাগের ইন্সপেক্টর-জেনারেল নিহত

গতকাল বেলা ১২টার সময় কলিকাতার বুকের উপর রাইটার্স বিল্ডিংয়ে এক বিষম দুঃসাহসিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হইয়া গিয়াছে। ৩ জন বাঙ্গালী যুবক বাঙ্গলার কারা-বিভাগের ইন্সপেক্টর-জেনারেল লেফটেন্যান্ট কর্নেল সিমসনকে গুলি করিয়া হত্যা করিয়াছে।

বেলা ১২-১৫ মিঃ —১২-৩০ মিনিটের মধ্যে ৩ জন বাঙ্গালী যুবক কারাগার-বিভাগের ইন্সপেক্টর-জেনারেলের অফিসে (রাইটার্স বিল্ডিং) আসিয়া উপস্থিত হয়। কর্নেল সিমসন তখন তাঁহার খাস মুন্সির (পারসন্যাল এ্যাসিস্ট্যান্ট) সঙ্গে তাঁহার অফিসে বসিয়া কথা বলিতেছিলেন। যুবকত্রয় তাঁহার সহিত সাক্ষাতের অভিলাষ ব্যক্ত করিলে চাপরাশি তাহাদিগকে উপরোক্ত কারণে অপেক্ষা করিতে বলে এবং কী কাজের জন্য তাহারা দেখা করিতে চায়, তাহা যথারীতি এক টুকরা কাগজে লিখিয়া দিতে বলে। কিন্তু যুবকগণ ইহা করিতে অস্বীকৃত হয় এবং তাহাকে এক পার্শ্বে ঠেলিয়া ভিতরে প্রবেশ করে এবং দ্রুতগতিতে কর্নেল সিমসনের প্রতি ৫/৬ বার গুলি নিক্ষেপ করে। গুলির আঘাতে কর্নেল সিমসন তৎক্ষণাৎ মৃত্যুমুখে পতিত হন। …

কর্নেল সিমসনের ঘর হইতে বাহির হইয়া আততায়ীরা বারান্দা দিয়া চলিয়া আসে। দৌড়াবার সময় তাহারা অফিসগুলির কাঁচের জানালায় এবং সিলিং-এ গুলি করিতে থাকে। রাজস্ব-সচিব মিঃ মারের অফিসের জানালায় গুলির চিহ্ন রহিয়াছে। মিঃ জে. ডব্লিউ. নেলসনের অফিসে গুলির চিহ্ন রহিয়াছে।

অতঃপর তাহারা পাসপোর্ট অফিসে প্রবেশ করে এবং একজন আমেরিকানকে গুলি করে। কিন্তু গুলি ব্যর্থ হয়। কোন চাপরাশীর গায়ে গুলি লাগে নাই।

অতঃপর আততায়ীগণ নেলসন সাহেবের ঘরে প্রবেশ করে এবং তাঁহার ঊরুদেশে গুলি করে। তাঁহার আঘাত গুরুতর নহে।…

।। শেষ খবর ।।

শেষ খবরে জানা যায়, একজন আততায়ী আত্মহত্যা করিয়া মরিয়াছে, অপর দুইজন আশঙ্কাজনক অবস্থায় অবস্থান করিতেছে। একজনকে বিনয়কৃষ্ণ বসু বলিয়া নিশ্চিতরূপে জানা গিয়াছে। সে নাকি এই মর্মে এক মৃত্যুকালীন জবানবন্দী দিয়াছে যে, সে-ই বিনয়কৃষ্ণ বসু এবং সে-ই মিঃ লোম্যানকে হত্যা করিয়াছে। আততায়ীগণ তিনজনই ইউরোপীয় পোশাকে ভূষিত হইয়াছিল। বারান্দা দিয়া গুলি করিতে করিতে অগ্রসর হইবার সময় উহারা বন্দে মাতরম্ ধ্বনি করিতেছিলেন।…’

.

ডাক্তারদের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও বিনয় বাঁচলেন না। শহিদ হলেন ১৩ ডিসেম্বর। মৃত্যুর দু’দিন আগে বিনয়ের বাবা ব্রিটিশ সরকারের কাছে ছেলেকে শেষ দেখার আর্জি জানালেন। ছেলের মৃত্যু যে অবশ্যম্ভাবী, বুঝে গিয়েছিলেন। আর্জি মঞ্জুর করেছিল সরকার।

দীনেশকে বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টার কসুর করলেন না চিকিৎসকরা। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলেন দীনেশ। স্পেশ্যাল ট্রাইব্যুনাল গঠিত হল সেশনস জজ Ralph Reynolds Garlick-এর নেতৃত্বে। শুরু হল মামলার বিচারপর্ব। নামেই বিচার, আসলে প্রহসন। যে প্রহসনের অনিবার্য পরিণতি ছিল মৃত্যুদণ্ড।

গার্লিক তাঁর রায়ের শেষাংশে লিখলেন, ‘The punishment of murder is death. We are asked to refrain from passing the death sentence on the ground that the case is not free from doubt. But though there is some doubt about particular incidents of the story, we have no doubt at all that Dinesh was one of the three men who murdered Col Simpson…… We unanimously find Dinesh Chandra Gupta guilty of murder and sentence him under Sec 302 IPC to be hanged by the neck until he is dead.’

আলিপুর জেলে ১৯৩১-এর ৭ জুলাই ভোর পৌনে চারটেয় ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান গেয়েছিলেন উনিশ বছরের দীনেশ। জেলের কুঠুরি থেকে ফাঁসির মঞ্চ পর্যন্ত রাস্তাটুকু অতিক্রমের পথে দৃপ্ত কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল ‘বন্দে মাতরম!’

দীনেশের ফাঁসির আদেশ বঙ্গজ বিপ্লবীদের ক্ষোভের আগুনে ঘৃতাহুতির কাজ করেছিল। ফাঁসির হুকুম রদ করার আবেদন জানিয়ে গণস্বাক্ষরিত আর্জি গভর্নরের কাছে জমা পড়েছিল অসংখ্য। প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল সে আর্জি।

আইনশৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কায় দীনেশের ফাঁসির দিনক্ষণ গোপন রাখতে মরিয়া চেষ্টা করেছিল ব্রিটিশ প্রশাসন। সে চেষ্টা সফল হয়নি। পরের দিন সকালে দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের ‘Advance’ কাগজের হেডিং, ‘Dauntless Dinesh Dies at Dawn!’ শিরোনামটি দিয়েছিলেন পত্রিকার তৎকালীন চিফ সাব-এডিটর শ্রীইন্দু মিত্র।

আনন্দবাজার পত্রিকার ৭-৭-৩১, ২২শে আষাঢ়, ১৩৩৮-এর সংস্করণেও ছাপা হয়েছিল খবর, ‘সোমবার শেষরাত্রিতে দীনেশ গুপ্তের ফাঁসি হইয়া গিয়াছে। মঙ্গলবার প্রাতে কলিকাতার প্রতি রাস্তার মোড়ে বহু পুলিশ দেখা যায়। ইহা হইতেই প্রবল অনুমান হয় যে, ফাঁসি হইয়া গিয়াছে।’

দীনেশের মৃত্যুদণ্ডের নেপথ্যে যিনি ছিলেন পুরোধা, সেই Ralph Reynolds Garlick-কে অচিরেই প্রাণ দিতে হয়েছিল। জয়নগরের বিপ্লবী কানাইলাল ভট্টাচার্য ১৯৩১-এর ২৭ জুলাই, দীনেশের ফাঁসির কুড়ি দিনের মধ্যে, ভরা এজলাসে গুলি করে খুন করেছিলেন গার্লিক সাহেবকে।

কারাবাস চলাকালীন আত্মীয়পরিজনদের একাধিক চিঠি লিখেছিলেন দীনেশ। যাতে ধরা রয়েছে উনিশের যুবকের চিন্তার ব্যাপ্তি, জীবনদর্শনের গভীরতা।

বউদিকে যেমন লিখছেন, ‘যে দেশে মানুষকে স্পর্শ করিলে মানুষের ধর্ম নষ্ট হয়, সে দেশের ধর্ম আজই গঙ্গার জলে বিসর্জন দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া উচিত’, ভাই-কে তেমনই দিশা দেখাচ্ছেন জীবনবোধের, ‘যুগ যুগ ধরিয়া এই যাওয়া-আসাই বিশ্বকে সজীব করিয়া রাখিয়াছে, তাহার বুকের প্রাণস্পন্দনকে থামিতে দেয় নাই।’ আর সান্ত্বনার পরশ দিতে চাইছেন শোকাচ্ছন্ন মা-কে, ‘তাঁহার বিচার চলিতেছে। তাঁহার বিচারের উপর অবিশ্বাস করিও না, সন্তুষ্ট চিত্তে সে বিচার মাথা পাতিয়া নিতে চেষ্টা করো।’

ফাঁসির আগের সন্ধ্যায় গর্ভধারিণীকে লেখা শেষ চিঠি তুলে দিলাম হুবহু।

আলিপুর সেন্ট্রাল জেল,

কলিকাতা

৫টা সন্ধ্যা

৬.৭.৩১

মা,

তোমার সঙ্গে আর দেখা হইবে না। কিন্তু পরলোকে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করিব।

তোমার জন্য কিছুই কোনওদিন করিতে পারি নাই। সে না-করা যে আমাকে কতখানি দুঃখ দিতেছে, তাহা কেউ বুঝিবে না, বুঝাইতে চাই-ও না।

আমার যত দোষ, যত অপরাধ দয়া করিয়া ক্ষমা করিও।

আমার ভালবাসা ও প্রণাম জানিও।

—তোমার নসু।

বিনয়-বাদল-দীনেশ। স্বাধীনতার পর ডালহৌসি স্কোয়ার নতুন ভাবে চিহ্নিত হওয়া যাঁদের নামে, ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে যাওয়া যাঁদের অসমসাহসী রাইটার্স অভিযান।

বিনয়কৃষ্ণ বসু। জন্ম: ১৯০৮, সুধীর (বাদল) গুপ্ত। জন্ম: ১৯১১, দীনেশচন্দ্র গুপ্ত। জন্ম: ১৯১২

প্রয়াত ব্যক্তিদের মৃত্যুকাল লেখাই রীতি। এই লেখায় যা অনুসরণ করার কোনও প্রয়োজন দেখছি না। ওঁরা মৃত্যুঞ্জয়ী। কী এসে যায় শারীরিক পূর্ণচ্ছেদে, অমরত্বের আশ্বাস যখন বিস্তৃত স্থান-কাল-পাত্রের সীমানা ছাড়িয়ে?

০৯. বিচারপতি তোমার বিচার

জঙ্গল ঠিক বলা যায় না। গাছগাছালি আর ঘন ঝোপঝাড় বেশ কিছুটা অংশ জুড়ে। তপসিয়া থেকে পায়ে হেঁটে লাগল মাত্র মিনিট সাতেক। সবে আলো ফুটেছে ভোরের। রাতের গন্ধ এখনও মুছে যায়নি পুরো। চারদিকে একবার তাকায় উনিশ বছরের যুবক। কলকাতায় সে এসেছে আগে বেশ কয়েকবার। এই জায়গাটার কথা জানাই ছিল না। শহরের মধ্যেই, অথচ কে বলবে শহর? এত শান্ত, এত সবুজ? কিন্তু সুনীলদা এই কাকভোরে এখানে নিয়ে এল কেন?

—একটা পরীক্ষা নেব আজ… দেখি পাশ করতে পারিস কিনা… ওই গাছটা দ্যাখ…

বেশ দশাসই চেহারা গাছটার। লম্বায় যেমন, চওড়াতেও। একবার দেখলে বেশ একটা সমীহ জাগে। আরেকবার দেখতে ইচ্ছে হয়, সময় নিয়ে। সুনীল সোজা চলে গেলেন গাছের সামনে। পকেট থেকে বার করলেন চক, প্রকাণ্ড গুঁড়ির গায়ে বৃত্ত আঁকলেন একটা।

—এই হল তোর চাঁদমারি। চেম্বারে ছ’টা গুলি আছে। মানে চান্স ওই ছ’টাই। দূরে গিয়ে দাঁড়া… আরও পিছনে… হ্যাঁ… এইবার ঠিক আছে…

সুনীল রিভলভার হাতে তুলে দেন যুবকের। পিঠ চাপড়ে দেন একটু। আগ্নেয়াস্ত্র হাতে পজিশন নেন যুবক, সাতপাঁচ চিন্তা ধেয়ে আসে। স্নায়ু চঞ্চল হয়ে ওঠে।

লক্ষ্যভেদের পরীক্ষা? সুনীলদা আগে বলেনি কেন? বললে মানসিকভাবে কিছুটা প্রস্তুত থাকা যেত। এভাবে হুট করে বললে হয়? নাকি ইচ্ছে করেই আগে বলেনি? কত তাড়াতাড়ি মনকে তৈরি করতে পারি, পরখ করছে? তবে করছে যখন, নিশ্চয়ই কোনও দায়িত্ব দেওয়ার কথা ভাবছে। শিরা-ধমনীতে উত্তেজনার স্রোত টের পান যুবক। এবং নিজেই নিজেকে তিরস্কার করেন নিরুচ্চার… এখন উত্তেজিত হলে টার্গেট মিস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা… মনঃসংযোগ দরকার। নির্দিষ্ট দূরত্বে দাঁড়িয়ে রিভলভার তাক করেন। পাখির চোখ ওই চক দিয়ে আঁকা বৃত্ত।

সুনীল পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। দেখছেন।

ছ’টার মধ্যে দুটো লক্ষ্যভ্রষ্ট। চারটে ‘বুলস আই’। বিঁধেছে একদম সাদা বৃত্তের মাঝখানে। সুনীল গুঁড়ির কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন। শান্ত পায়ে ফিরে এসে জড়িয়ে ধরেন যুবককে… ‘সাবাশ!’

—আমি তা হলে অ্যাকশনের জন্য ফিট, সুনীলদা?

সুনীল হেসে পিঠে হাত রাখেন, ‘অত উতলা হলে চলে?’

.

বিয়েবাড়ির ব্যস্ততাকেও যেন হার মানিয়ে দেবে আয়োজন। সাতসকালেই ভিড় জমিয়েছে ছাত্র-যুবকেরা। তেরঙা পতাকায় সাজানো হচ্ছে সমিতির ঘর। কিন্তু মাঝারি আয়তনের ঘরে কী করে অত লোক ধরবে? খবর তো ছড়িয়েই পড়েছে, আশেপাশের গ্রাম থেকেও ছেলেছোকরারা আসবে দল বেঁধে। বাইরে মঞ্চ বাঁধা ছাড়া উপায় নেই। কাজও শুরু হয়ে গিয়েছে কাঠের পাটাতন তৈরির, সাদা চাদরে মুড়ে দিয়ে চেয়ার-টেবিল পাতার।

হন্তদন্ত হয়ে তদারকিতে সমিতির কর্তাব্যক্তিরা, যাঁদের বিয়েবাড়ির আগের সন্ধ্যার কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার মতো দেখাচ্ছে। হ্যাঁ রে, মাইক তো এখনও এল না? রাস্তায় যে কাগজের পতাকা দিয়ে চেন ঝোলানোর কথা ছিল একটাও তো দেখছি না? আখড়ার ঘরটা ভাল করে ঝাঁট দেওয়ার সময় হল না কারও? তাড়াতাড়ি কর বাবা তোরা, উনি আর ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যে এসে পড়বেন যে!

‘উনি’-ই প্রধান অতিথি আজ জয়নগর ব্যায়াম সমিতির বার্ষিক সভায়। ‘উনি’ আসছেন শুনেই উৎসাহের বান ডেকেছে এলাকার সর্বত্র। ‘ওঁকে’ স্বাগত জানাতেই সীমিত সাধ্যে আয়োজনের আড়ম্বর।

গাড়ি যখন ঢুকল ব্যায়াম সমিতির অপ্রশস্ত রাস্তায়, কালো মাথায় ঢেকে গিয়েছে যেদিকে দু’চোখ যায়। জয়ধ্বনি উঠছে মুহুর্মুহু। সৌম্যকান্তি দীর্ঘদেহী মানুষটি গাড়ি থেকে নামলেন। দৃঢ় পদচারণায় উঠলেন মঞ্চে। শুরুতেই উচ্চারণ করলেন, ‘বন্দে মাতরম!’

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু! পরিচিত চেহারাটা দেখে উল্লাসে ফেটে পড়ল জনতা, সহস্র কণ্ঠের আওয়াজে ধ্বনিত হল ‘বন্দে মাতরম’!

ব্যায়াম সমিতির কর্তা সুনীল চ্যাটার্জীর নজর আটকে যায় একেবারে সামনের সারিতে জয়ধ্বনি দিতে থাকা যুবকের উপর। শক্তসমর্থ চেহারা, উজ্জ্বল দুটি চোখ। গলার শিরা ফুলিয়ে স্লোগান দিচ্ছে মুষ্টিবদ্ধ হাত ঝাঁকিয়ে। কে ছেলেটা? মুখটা চেনা লাগছে, এলাকারই নিশ্চয়ই, কিন্তু সমিতির আখড়ায় দেখেননি কখনও। এর মতো ছেলেই দরকার এখন। নেতাজি ফিরে যাওয়ার পর খোঁজ নিতে হবে। কে ছেলেটা?

.

—মা.. কলকাতার বাইরে যাচ্ছি কয়েকদিনের জন্য। ফিরতে দেরি হতে পারে।

—কোথায় যাচ্ছিস? ফিরতে দেরি হবে মানে? কত দেরি, কী কাজ? সঙ্গে কে যাচ্ছে? মায়ের প্রশ্নবাণে বিরক্তই বোধ করে ছেলে।

—এখনই বলা যাবে না কত দেরি হবে। সমিতির কাজ আছে।

মধ্যবয়সি মহিলা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, কথা বাড়ান না আর। এতদিনে বুঝে গেছেন, হাজারবার জিজ্ঞেস করলেও আর জবাব পাওয়া যাবে না। মাসকয়েক হল এই এক নতুন হুজুগে মেতেছে ছেলে। কী? না, সমিতি!

টানাটানির হতদরিদ্র সংসার, স্বামী গত হয়েছেন। বড়ছেলে তবু কলকাতায় একটা মোটামুটি চাকরি জুটিয়েছে। যত চিন্তা এখন ছোটছেলেকে নিয়েই। পড়াশুনোয় কোনওদিনই বিশেষ মনোযোগ ছিল না, কিন্তু বয়স আঠারো পেরিয়ে উনিশ। চাকরিবাকরির কিছু একটা চেষ্টাচরিত্র তো করতে হবে এবার। তা না, দিনরাত ওই সমিতিতে পড়ে থাকা। পাড়ার লোকে বলাবলি করে, ওটা নামেই ব্যায়াম সমিতি। আসলে নাকি ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের আখড়া।

শোনার পর থেকেই ভয় আরও গাঢ় হয়েছে মনে। ছেলে ছোট থেকেই যা ডাকাবুকো প্রকৃতির, কোনও বিপদে জড়িয়ে পড়বে না তো ওই স্বদেশিদের পাল্লায় পড়ে? এই যে বলছে, ফিরতে দেরি হবে…কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে, কিচ্ছুটি বলবে না। ভয় হবে না? ছেলের অবশ্য তাতে থোড়াই কেয়ার।

—চিন্তা কোরো না মা.. বলছি তো..বেশি দেরি হলে চিঠি লিখব..

.

‘Lt. Col. Simpson was shot dead. Mr J W Nelson, judicial secretary, was wounded in the leg. Another bullet narrowly missed Mr. A. Marr, Finance member….’

উপরের উদ্ধৃতি ১৯৩০-এর ৯ ডিসেম্বরের ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে। প্রসঙ্গ, ৮ ডিসেম্বরের রোমহর্ষক ‘অলিন্দ-যুদ্ধ’, রাইটার্স বিল্ডিংয়ে বিনয়-বাদল-দীনেশের দুঃসাহসিক অভিযান। সর্বজনবিদিত, সিম্পসনকে হত্যা করার পর বাদল আত্মহত্যা করেন পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে। বিনয় আত্মহত্যার চেষ্টা করেন গুলি চালিয়ে এবং ১৩ ডিসেম্বর প্রয়াত হন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ত্রয়ীর মধ্যে দীনেশ গুপ্ত শুধু বেঁচে যান, বিষ খাওয়া এবং গুলি চালিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করার পরেও।

ব্রিটিশ সরকার চিকিৎসাধীন দীনেশের পরিচর্যায় বিন্দুমাত্র ত্রুটি করেনি। বরং পরম যত্নে তাঁকে বাঁচিয়ে তুলেছিল, যাতে স্পেশ্যাল ট্রাইব্যুনালের বিচার-প্রহসনের সাতপাকে বেঁধে ফেলা যায় অকুতোভয় যুবককে, মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দৃষ্টান্তমূলক বার্তা পৌঁছে দেওয়া যায় বিপ্লবীদের কাছে। ১৯৩১–এর ৭ জুলাইয়ের শেষ রাতে ফাঁসিকাঠের পাটাতন সরে গিয়েছিল দীনেশের পায়ের তলা থেকে।

সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়েছিল, ‘Dauntless Dinesh Dies at Dawn.’। কলকাতা কর্পোরেশনের সভায় গৃহীত হয়েছিল প্রস্তাব, ‘This corporation records its sense of grief at the execution of Dinesh Chandra Gupta who sacrificed his life in the pursuit of his ideal.’

দীনেশের ফাঁসি বঙ্গজ বিপ্লবীদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বারুদে অগ্নিসংযোগের কাজ করল। দীনেশের নিজের হাতে গড়া মেদিনীপুর শাখার Bengal Volunteers (বিভি)-এর বিপ্লবীরা ফেটে পড়লেন ক্রোধে। যত দ্রুত সম্ভব প্রত্যাঘাতের সিদ্ধান্ত হল। যার পরিণতিতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কর্নেল জেমস পেডিকে হত্যা করলেন যতিজীবন ঘোষ এবং বিমল দাশগুপ্ত। বিমলকে চিহ্নিত করল পুলিশ, কিন্তু ধরতে পারল না। বিমল ফেরারি হলেন।

পেডি-হত্যা ছিল প্রতিশোধস্পৃহার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া মাত্র। আসল লক্ষ্য ছিলেন স্পেশ্যাল ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট Ralph Reynolds Garlick, যিনি দীনেশ গুপ্তের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছিলেন। যিনি বিচারাধীন বিপ্লবীদের প্রতি বরাবরই ছিলেন খড়গহস্ত, রাজদ্রোহের যে-কোনও মামলায় অভিযুক্তের প্রতি ছিলেন মাত্রাছাড়া নির্মম।

এহেন গার্লিক সাহেবকে কৃতকর্মের ফল পেতেই হবে, সংকল্প করলেন বিপ্লবীরা। কিন্তু করবে কে কাজটা?

.

কানাইলাল ভট্টাচার্য। উনিশ বছরের চনমনে যুবক, বাড়ি জয়নগর থানার মজিলপুর অঞ্চলে। যাকে জয়নগর ব্যায়াম সমিতির বার্ষিক সভায় চোখে পড়ল এলাকার নেতৃস্থানীয় বিপ্লবী সুনীল চ্যাটার্জীর। নেতাজির নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে সোৎসাহে। কে ছেলেটা? খোঁজ নিতে হবে সভা মিটে গেলে, সাতদা-কেও বলতে হবে।

‘সাতদা’। সাতকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়। পেশায় হোমিয়োপ্যাথি ডাক্তার। চেম্বার বারুইপুরে। রোগীর আনাগোনা লেগেই আছে অবিশ্রান্ত। আর যাওয়া-আসা ছেলের দলের। চব্বিশ পরগনার বিপ্লবী দলগুলির সর্বজনশ্রদ্ধেয় অভিভাবক। সুনীল অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন সাতদা-র। জয়নগর-মজিলপুরে ব্যায়াম সমিতির প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে রয়েছে সাতদা-রই আশীর্বাদ। স্বয়ং নেতাজি বিশেষ পছন্দ করেন সাতকড়ি ডাক্তারকে। সাতদা-রই অনুরোধে জয়নগরে সুভাষচন্দ্র বসুর পদার্পণ ব্যায়াম সমিতির বিপ্লবীদের উৎসাহ দিতে।

গার্লিক-নিধনের ছক কষা শুরু হল। সুনীল চ্যাটার্জীর উপর দায়িত্ব দিলেন সাতদা, উপযুক্ত ছেলে খুঁজে বার করার। নির্দেশ স্পষ্ট, অ্যাকশন করতে যাওয়ার সময় শুধু রিভলভার নয়, বিষও থাকবে সঙ্গে। কাজ হাসিলের পর পালাতে পারলে ভাল, না পারলে আত্মহত্যা। ধরা দেওয়া যাবে না, কোনও পরিস্থিতিতেই না।

‘ছেলে’ খুঁজে পেতে বিশেষ কষ্ট করতে হল না সুনীলকে। ততদিনে কানাই যোগ দিয়েছে ব্যায়াম সমিতিতে, দীক্ষিত হয়েছে বিপ্লবের মন্ত্রে। সমিতির একঝাঁক তরুণ তুর্কি তখন অ্যাকশনের জন্য মরিয়া। তাত্ত্বিক আলোচনায় তেমন আগ্রহ নেই তাদের, উৎসাহ নেই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায়। মূলধন বলতে শুধু আবেগ আর সাহস। দেশের জন্য কিছু করতে হবে, তাতে মরতে হলে হবে। এই দলে সকলের মধ্যে সহজেই আলাদা করা যায় কানাইকে। পেটানো চেহারা তার, শরীরচর্চার জন্য ব্যায়াম সমিতিতে হাজিরার প্রয়োজন নেই এমনিতে। প্রায় প্রতিদিনই সন্ধের পর সুনীলদা’র কাছে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে, ‘কাজ দেবে না কিছু? কুস্তি-লাঠিখেলা ভাল লাগছে না আর। চান্স দিয়ে দেখোই না একবার অ্যাকশনের, রিভলভার চালানোটা রপ্ত করে ফেলেছি।’

‘চান্স’ এল ১৯৩১–এর জুলাইয়ে। হাজরা রোডে একটি মেসের তিনতলায় একটি ঘর ভাড়া করে রেখেছিলেন সুনীল। কলকাতায় এলে ওখানেই উঠতেন, চলত বিপ্লবীদের গোপন বৈঠক। বাকি সময় ঘর থাকত তালাবন্ধ। সুনীলের নির্দেশে তাঁর দুই সহযোগী কানাইকে জয়নগর থেকে নিয়ে এলেন কলকাতায়। সেদিন ২৫ জুলাই। হঠাৎ তলবে কানাই অবাক, কিছুটা উত্তেজিতও। ঘটনাচক্রে কানাইয়ের মা-ও তখন কলকাতায়, বড়ছেলের বাড়িতে উঠেছেন। সুনীলকে প্রশ্নে প্রশ্নে অতিষ্ঠ করে তুললেন কানাই, উত্তরে জুটল মৃদু হাসি আর পিঠ চাপড়ানি, ‘ঠিক সময়ে সব জানতে পারবি। কাল ভোরভোর উঠবি, একটা জায়গায় নিয়ে যাব।’

‘জায়গা’ বলতে তপসিয়ার কাছে, গাছপালা-ঝোপঝাড়ে ভর্তি ভূখণ্ড। যেখানে কানাইয়ের হাতে রিভলভার তুলে দিয়ে লক্ষ্যভেদের মহড়া নিলেন সুনীল, ‘এই হল তোর চাঁদমারি, চেম্বারে ছ’টা গুলি আছে। মানে চান্স ওই ছ’টা…’

কানাই এতক্ষণে আন্দাজ করে ফেলেছে, তাকে বাছা হয়েছে কোনও অ্যাকশনের জন্য। সুনীলদা এখনও পুরোটা ভাঙছে না, দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর নিয়ে এসেছে আলিপুর কোর্টে। ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছে সব, ‘এইটা মুনসেফ কোর্ট, এখানে সাব-জজরা বসেন। এই বড় ঘরটা হল বার লাইব্রেরি। আর এই লম্বা জায়গাটায় টাইপিস্টরা বসেন। সব ভাল করে দেখে রাখ, কোথা দিয়ে ঢুকলাম আর কোন দিক দিয়ে বেরব। বেরনোর আগে সেশন জজের এজলাসটা দেখিয়ে দিই চল। গার্লিক সাহেব যেখানে বসেন।’

গার্লিক সাহেব! শরীরে অ্যাড্রিনালিনের বাড়তি ক্ষরণ নিমেষে টের পায় কানাই। সেই গার্লিক, যে বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তের ফাঁসির হুকুম দিয়েছিল? সুনীলদার হাত চেপে ধরে কানাই।

—সুনীলদা! তা হলে কি…

সুনীল রাশ টানেন সঙ্গী যুবকের উত্তেজনার।

—বলেছি না উতলা হবি না! ঠান্ডা মাথায় দেখে নে ঘরটা।

ঘরের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে রিভলভারধারী সার্জেন্ট। প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে একাধিক চিঠি সম্প্রতি পেয়েছেন গার্লিক। সরকার নিরাপত্তা বাড়িয়ে দিয়েছে এজলাসে। উকিল-মোক্তার বা সাধারণ মানুষ, যে-ই ঢুকছে ঘরে, সার্জেন্টের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আগে জরিপ করে নিচ্ছে আপাদমস্তক। এজলাসে ঢুকে একটা বেঞ্চে বসেন সুনীল। পাশে কানাই, যে শান্তভাবে তখন চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে ঘরের ডাইনে-বাঁয়ে-সামনে-পিছনে। কয়েকটা তাগড়াই চেহারার লোক জজসাহেবের পিছনে দাঁড়িয়ে। ওরা কারা? সাদা পোশাকের পুলিশ?

শ্রাবণের কলকাতায় তখন বর্ষার একচ্ছত্র দাপট। কোর্ট থেকে ফেরার পথে কানাইয়ের জন্য এক জোড়া ক্যাম্বিসের জুতো কিনলেন সুনীল। ছাতা জয়নগর থেকে নিয়েই এসেছে কানাই। মেসে ফেরা হল যখন, বিকেল গড়িয়ে সন্ধে।

—কানাই… এক কাজ কর.. চট করে মায়ের কাছ থেকে ঘুরে আয় একবার.. মাসিমা তো এখন তোর দাদার বাড়িতে, না?

—হ্যাঁ।

—বলবি… কলকাতার বাইরে যাচ্ছিস কাজে। ফিরতে দেরি হতে পারে।

রাতের খাওয়া মায়ের কাছেই সারলেন কানাই। অগ্রাহ্য করলেন উদ্বিগ্ন প্রশ্নমালা।

—চিন্তা কোরো না মা .. বললাম তো, বেশি দেরি হলে চিঠি লিখব।

.

মেসে ফেরার পর সব খুলে বললেন সুনীল। কানাই যা আন্দাজ করেছিল, তা-ই। গার্লিক সাহেবকে হত্যা করে দীনেশের ফাঁসির বদলা! কাগজ-কলম বার করে কানাইয়ের হাতে দিলেন সুনীল।

—নে… লেখ…

—কী?

—লেখ… ‘বন্দে মাতরম! ধ্বংস হও; দীনেশ গুপ্তর অবিচারে ফাঁসি দেওয়ার পুরস্কার লও: ইতি—বিমল গুপ্ত।’

—লিখলাম… এর পর?

—এই লেখাটা, মানে চিরকুটটা.. রাখবি ডান পকেটে, আর এই পটাশিয়াম সায়ানাইডের প্যাকেট বাঁ পকেটে। ছ’ ঘরা এই রিভলভারটা ছাতার মধ্যে। খেয়াল রাখিস, loaded কিন্তু! Suicide squad-এর যে তালিকা পুলিশের কাছে আছে, তাতে কানাইলাল ভট্টাচার্যের নাম নেই। কেউ চেনে না তোকে। এটা অ্যাডভান্টেজ। ভগবান না করুন, যদি তুই পালাতে না পারিস, বিষটা মুখে ফেলে দিবি। পুলিশ তোর পকেটে চিরকুট পাবে, ভাববে, তুই-ই ম্যাজিস্ট্রেট পেডি-র হত্যাকারী পলাতক বিমল দাশগুপ্ত। ভুল ভাঙবে, কিন্তু আসল আততায়ীর হদিশ পাবে না। বুঝলি?

কানাই মাথা নাড়েন, আর সুনীল বলতে থাকেন।

—তুই আগে যাবি, বেরবি বারোটা নাগাদ। আমি একটু পরে যাব ট্যাক্সিতে। একবার উপরে গিয়ে দেখেও আসব তোকে। তারপর নীচে অপেক্ষা করব গাড়িতে। তোকে একটু সাজিয়েও দেব কাল।

.

২৭ জুলাই, ১৯৩১। রণসাজ সম্পূর্ণ কানাইয়ের। নেহাতই গোবেচারা গ্রাম্য যুবকের বেশ। এলোমেলো চুল, কোঁচা-দোলানো হেটো ধুতি আধময়লা। গলা-আঁটা অপরিষ্কার শার্ট। তার উপর কোট। পায়ে নতুন সাদা ক্যাম্বিসের জুতো। হাতে ছাতা, যার মধ্যে গুলিভরা আগ্নেয়াস্ত্র। বেলা বারোটা নাগাদ আলিপুরগামী ট্রামে উঠে বসলেন কানাইলাল ।

সেশনস কোর্টের গাড়িবারান্দার নীচে যখন সুনীল চ্যাটার্জীকে নিয়ে একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল, ঘড়িতে বেলা একটা। চালক প্রেম সিং বহুদিনের পরিচিত সুনীলের। প্রেম সিং জানে, এঁরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়ছেন, বিপজ্জনক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত। বাড়তি ঔৎসুক্য দেখায় না কখনও। ডাকলেই চলে আসে, সে দিন হোক বা রাত। আজ যেমন। সুনীলবাবু ডাকতেই অন্য সওয়ারিদের তোয়াক্কা না করে হাজির।

সুনীল উপরে উঠলেন। এজলাসে গার্লিক সাহেব নেই, লাঞ্চে গেছেন। একটু পরেই আসবেন। কানাই সুবোধ বালকের মতো বসে আছে আমজনতার ভিড়ে। সাজ এত নিখুঁত হয়েছে, সন্দেহ করার কোনও কারণ খুঁজে পায়নি এজলাসের দোরগোড়ায় দাঁড়ানো সার্জেন্ট। সুনীল নেমে আসেন, চড়ে বসেন ট্যাক্সিতে।

—সিংজি… ইঞ্জিন চালু রাখুন… বললেই স্টার্ট দেবেন।

.

কাঁটায় কাঁটায় দুটোয় গার্লিক ফের এলেন এজলাসে। সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়াল সবাই। গার্লিক বসলেন, শুনানি শুরু হল।

—Me Lord… my humble submission before the Learned Court is that…

উকিলের সওয়াল শুনতে শুনতে যখন মাথা নিচু করে একমনে কিছু নোট করছেন গার্লিক, কানাই ঠিক করলেন, এই হল মোক্ষম সময়। নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয় উঠে দাঁড়ানোর মুহূর্তে, এই লোকটা দীনেশ গুপ্তের প্রাণ নিয়েছে, কত বিপ্লবীকে বাধ্য করেছে কারাবাসে, একে খতম করার সুযোগ পাওয়াটাই তো পরম প্রাপ্তি। ক’জন পায়?

কেউ কিছু বোঝার আগেই কানাই দ্রুত উঠে পড়েন, চকিত ক্ষিপ্রতায় পৌঁছে যান সাক্ষীর শূন্য কাঠগড়ায়। ঘরটা বিশেষ বড় নয়। সামান্যই দূরত্ব কাঠগড়া থেকে জজসাহেবের টেবিলের। সিলিং লক্ষ্য করে প্রথম গুলি… শব্দে সচকিত গার্লিক মুখ তুলতে না তুলতেই কানাই লাফ দিয়ে উঠলেন কাঠগড়ার রেলিংয়ের উপর। সেখান থেকে এক লাফে গার্লিকের টেবিলে, এর চেয়ে ঢের লম্বা লাফ সে হেসেখেলে দিয়ে থাকে ব্যায়ামের আখড়ায়। মাত্র কয়েক হাতের দূরত্ব থেকে সোজা গার্লিকের কপাল লক্ষ্য করে গুলি। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই। লক্ষ্যভেদ, এজলাসেই সম্পন্ন গার্লিক-নিধন।

সাদা পোশাকের পুলিশ গুলি চালাল অভাবিত ঘটনার ঘোর কাটিয়ে। লক্ষ্যভ্রষ্ট। কানাইয়ের পালটা গুলি লাগল পুলিশের কাঁধে। সার্জেন্ট ততক্ষণে ছুটে এসেছেন আওয়াজ পেয়ে। গুলি চালিয়েছেন কানাইকে লক্ষ্য করে। লাগল পেটে আর পায়ে। ভূপতিত কানাইয়ের শরীরে আরও কয়েক রাউন্ড গুলিবর্ষণ অতঃপর। ততক্ষণে পটাশিয়াম সায়ানাইডের শিশির পুরোটাই গলায় ঢেলে দিয়েছেন বীর বিপ্লবী। এজলাসেই মৃত্যু।

আদালতে তুলকালাম তখন। প্রাণভয়ে লোকজন ছুটে বেরচ্ছে এজলাস থেকে। বহির্মুখী জনতার ঠেলাঠেলিতে উলটে পড়েছে চেয়ার-টেবিল-বেঞ্চ। কাগজপত্র লন্ডভন্ড। পাশের ঘর থেকে ফোন গিয়েছে লালবাজারে, সশস্ত্র বাহিনী প্রয়োজন। হাসপাতাল থেকে তলব করা হয়েছে অ্যাম্বুল্যান্স।

কোর্টের বাইরে ট্যাক্সিতে তখন ঠায় বসে সুনীল। ছটফট করছেন টেনশনে। কাজটা হল? কানাই ফিরছে না কেন এখনও? তখনও জানেন না, যাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা, সে এজলাসে পড়ে প্রাণহীন। লোকজনের ভীতসন্ত্রস্ত ছোটাছুটি দেখে এক আইনজীবীকে সুনীল জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে?’

উত্তর এল ঝটিতি।

—Garlick shot dead. Assailant shot dead too!

সুনীল শুনলেন এবং কথা বাড়ালেন না। শান্ত ভঙ্গিতে নির্দেশ দিলেন চালককে।

—সিংজি… গাড়ি স্টার্ট করুন।

.

পুলিশের রিপোর্টে ঘটনার বিবরণ যেমনটা ছিল, তুলে দিলাম হুবহু।

On 27th July 1931 at 2 p. m., Mr. R. R. Garlick, I. C. S., Senior Sessions Judge, 24 parganas, was while sitting in Court, fatally shot through the head by a Bengali Youth.

The assassin, who was immediately shot down by the Sergeant on duty, committed suicide while lying wounded under the table, by swallowing cyanide of potassium from a phial which was found on the floor. The Police Surgeon, who held the postmortem examination, was of opinion that death was due to hydro-cyanic acid poisoning. A bullet of .450 bore, which was extracted from the body, was evidently that fired from the revolver of the Sergeant. In the left hip pocket of the deceased was found a slip of paper with a bullet hole through it, on which was written ‘Bande Mataram; Cursed be your Court, whose injustice condemned Dinesh Gupta to execution. Receive the reward for it. – Bimal Gupta’; while in the other pocket were found 14 live revolver cartridges of .380 bore.

The revolver which was found in the possession of the assailant is a 6-chambered .380 bore, with fall out cylinder, marked ‘Jupitre’ with trade mark ‘E.C.’ and bearing the number 15621 on heel of butt and also the word ‘Eiber.’ It bears Spanish proof mark and the cylinder rotates from right to left. The four live cartridges in the revolver and the fourteen live cartridges found in the coat pocket of the assassin bear the base mark ‘S. & W. .38 Spl.’ and each charged with 16 grs. black power and weighing 140 grs.

The photograph of the deceased assassin was definitely identified by a deponent on 29th October 1932 as that of one Kanai Lal Bhattacharji, son of Nagendra Nath, of Majilpur police-station Joynagar. 24-Parganas.

Mr. Garlick was the President of the Special Tribunal which on 2nd February 1931 convicted and sentenced to death Dinesh Ch. Gupta for the murder of Lt. Col. N. Simpson, I M S Inspector-General of Prisons, Bengal, at Writers’ Buildings, Calcutta, on 8th December 1930.

Sunil Chatarji’s group of the Jugantar Party was responsible for this outrage. (File 439/31)

.

লালবাজারের কর্তারা ছুটে এলেন, মৃত কানাইয়ের পকেট থেকে উদ্ধার হল সেই চিরকুট… ‘ধ্বংস হও…।’ কে এই বিমল গুপ্ত? পেডি-হত্যার ফেরারি আসামি বিমল দাশগুপ্ত? বিমলের আত্মীয়স্বজনদের খবর দিল পুলিশ। জানা গেল অচিরেই, আততায়ী বিমল নন। তবে কে?

‘কে’, জানতে চেষ্টার কসুর করেনি লালবাজার। ব্যর্থ হয়ে বিজ্ঞাপন দিতে হয়েছিল কাগজে, ‘A reward is hereby declared, worth Rupees Five Hundred to be given to one who can identify the murderer of Mr. Garlick.’

সাড়া মেলেনি বিজ্ঞাপনে। ঘটনার এক বছর তিন মাস পর মৃতদেহের ছবি দেখে কানাইলালকে চিহ্নিত করেছিলেন একজন। উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল বিপ্লবীদের। গার্লিক নিহত, অথচ পুলিশ অন্ধকারে ছিল এক বছরেরও বেশি।

কানাই মা-কে বলে গিয়েছিলেন, দেরি হলে চিঠি লিখবেন। মা অধীর অপেক্ষায় ছিলেন। চিঠি আসেনি। দুঃসংবাদ এসেছিল।

.

কানাই একা নন। তাঁর মতো এমন যে কত, যাঁরা অগ্রপশ্চাৎ ভাবেননি দেশের জন্য হাসতে হাসতে জীবন বাজি রাখার আগে, যাঁদের না ছিল অমরত্বের প্রত্যাশা, না ছিল ইতিহাসে ঠাঁই পাওয়ার সুপ্ত বাসনা। যাঁদের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে ধারাবাহিক কার্পণ্য করেছে ইতিহাসও। প্রত্যাশিত পরিণাম— বিস্মৃতি!

কেউ মনে রাখেনি, কেউ মনে রাখে না!

 ১০. কে ওই মেয়েটি?

এই প্রথম!

ছবিতে দেখেছেন আগে। চাক্ষুষ এই প্রথম। যুবতী হাতে তুলে নেন ধাতব আগ্নেয়াস্ত্র, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকেন বারবার। রোমাঞ্চ আর উত্তেজনা পাল্লা দিয়ে দৌড়তে শুরু করে শিরা-উপশিরায়। এই তা হলে রিভলভার, আসল! কিন্তু গুলি কোথায়, কার্তুজ? তর সয় না যুবতীর, জিজ্ঞেস করেই ফেলেন।

—দিদি… বুলেট?

‘দিদি’ হাসেন সস্নেহে, টের পান একুশ বছরের যুবতীর ছটফটানি।

—বুলেট পরে। কীভাবে যন্ত্রটা ব্যবহার করবি সেটা আগে দেখিয়ে দিই। ভাল করে বুঝে না নিলে এ যন্ত্র কিন্তু পোষ মানার নয়। দে ওটা আমায়…

অনিচ্ছা সত্ত্বেও রিভলভারের হাতবদলে বাধ্য হন যুবতী। খুঁটিনাটি বোঝাতে শুরু করেন ‘দিদি’।

—বুলেট চাইছিলি না? বুলেট ঢোকাতে হয় চেম্বারে। এই হল চেম্বার। এইভাবে খুলবি আর একটা একটা করে গুলি ঢোকাবি এই পাঁচটা ফুটোর মধ্যে। এবার চেম্বারটা দ্যাখ কীভাবে বন্ধ করছি। হল বন্ধ? ব্যস, তোর রিভলভার এখন লোডেড।

যুবতী শুনতে থাকেন অখণ্ড মনোযোগে।

—এইটা হল ব্যারেল, ট্রিগার টিপলে যেখান থেকে গুলি ছুটবে। একটা কথা সবসময় মনে রাখবি, লোড যখন করবি, মানে বুলেট ভরবি যখন চেম্বারে, ব্যারেলের মুখ কক্ষনো নিজের দিকে রাখবি না, নেভার! কোনওভাবে অসাবধানে ট্রিগারে হাত পড়ে গেলে নিজেই অক্কা পাবি। ভরবি সাইড করে, এইভাবে।

শুটিংয়ে আসল কথা কিন্তু ‘গ্রিপ’, তুই কীভাবে ধরছিস অস্ত্রটাকে। লক্ষ কর, আমি কীভাবে ধরছি। আঙুলগুলোর পজিশন দ্যাখ মন দিয়ে। ধরলি? এবার নিশানা। এই যে সামান্য উঁচু জিনিসটা ব্যারেলের সামনের দিকে দেখছিস, একে বলে ‘‌ফোরসাইট ইউ’। টার্গেটের সঙ্গে এটাকে স্ট্রেট লাইনে রাখলে মিস হওয়ার সম্ভাবনা কম। ধর, আমি তোকে গুলি করব মাথায়… একটু দূরে গিয়ে দাঁড়া… দ্যাখ… তোর মাথার সঙ্গে কীভাবে স্ট্রেট লাইনে ‘align’ করছি ‘ফোরসাইট ইউ’…

গুলি যখন করবি, গায়ের জোরে ট্রিগার চাপবি না। সামান্য চাপই যথেষ্ট। আর হ্যাঁ, যেটা মোস্ট ইম্পরট্যান্ট, কাঁধ থেকে হাতের কবজি অবধি পুরো সোজা রাখবি, টানটান। একদম ‘locked’ থাকবে ওই অংশটা, ‘muscle movement’ হবে মিনিমাম। যা বললাম, বুঝলি? গুলি না ভরে, যেভাবে বললাম, কয়েকদিন ‘dry practice’ করলেই দেখবি সড়গড় হয়ে যাবে। এবার, এই নে তোর বুলেট।

কাঁধের ঝোলা থেকে মহিলা বার করেন চামড়ার ছোট থলি, উপুড় করে দেন টেবিলে। ঠনঠন শব্দে ছড়িয়ে পড়ে এক ডজন কার্তুজ। যুবতী চেম্বারে বুলেট ভরার মহড়া শুরু করেন। এক… দুই… তিন… চার।

‘দিদি’ দেখতে থাকেন নিষ্পলক। একটু পরে ধীর গলায় জিজ্ঞেস করেন, কী রে, পারবি তো?

যুবতী চোখ তুলে তাকান। হাসিখুশি মুখটা বদলে গিয়েছে কঠিন সংকল্পে। ‘দিদি’ আর একটি প্যাকেট বার করেন ঝোলা থেকে।

—এটা রেখে দে।

—কী এটা?

—পটাশিয়াম সায়ানাইড।

.

কী আছে এখানে আজ? কোনও হোমরাচোমরা আসছেন? এত পুলিশ কেন?

কলেজ স্ট্রিট চত্বরে সেদিন সকাল থেকেই তুঙ্গ ব্যস্ততা। অন্যদিন বেলা বাড়তে কখনওসখনও দেখা মেলে জোড়াসাঁকো থানার টহলদারি গাড়ির। আজ অন্য ছবি। ভোর থেকেই এলাকায় চক্কর দিচ্ছে পুলিশের একাধিক গাড়ি। রাস্তার মোড়ে মোড়ে মোতায়েন সশস্ত্র পুলিশকর্মী। যারা বন্দুক উঁচিয়ে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। সাদা পোশাকে কিছু বলিষ্ঠ চেহারার লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে যত্রতত্র। সজাগ দৃষ্টি তাঁদের। এক ঝলক দেখলেই বোঝা যায়, এরা পথচারী নন। প্লেন ড্রেসে পুলিশই। লালবাজারের বড়কর্তারা সরেজমিনে ঘনঘন দেখে যাচ্ছেন পুলিশি ব্যবস্থা।

ব্যাপারটা কী? এত সাজসাজ রব? কেষ্টবিষ্টু আসছেন কোনও? কে?

স্বয়ং বড়লাট! বাংলার তৎকালীন রাজ্যপাল মহামহিম স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলে আয়োজিত সমাবর্তন উৎসবের প্রধান অতিথি। তিনিই মানপত্র তুলে দেবেন সফল ছাত্রছাত্রীদের হাতে। বহু গণ্যমান্য অতিথির সমাবেশ ঘটতে চলেছে অনুষ্ঠানে। নিরাপত্তা নিয়ে ন্যূনতম ঝুঁকি নিতে নারাজ কলকাতা পুলিশ। বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে তৈরি হয়েছে নিশ্ছিদ্র চক্রব্যূহ। মাছিও গলতে পারবে না হাজার চেষ্টা করেও।

কলেজ স্ট্রিটে গাড়ি ঢুকছে একের পর এক, থামছে মূল প্রবেশদ্বারের সামনে। আমন্ত্রিতরা ঢুকছেন। ঢুকছে ছাত্রছাত্রীরাও দল বেঁধে, হইহল্লা করতে করতে। পোশাক আলাদা আজ। রোজকার ধুতি-শার্ট-প্যান্ট বা শাড়ির উপরে আজ কালো গাউন। ডিগ্রি নেওয়ার শুভমুহূর্তের প্রচলিত পরিধান। অন্যরকম সাজে ভারী সুন্দর লাগছে ছেলেমেয়ের দলকে। আজ তো ওদেরই দিন!

.

হাঁফাতে হাঁফাতে বেথুন কলেজের গেটে এসে পৌঁছন ইলা সেন। কলেজেরই ছাত্রী, উত্তেজনায় গলা কাঁপছে।

—এইমাত্র খবর পেলাম, প্রেসিডেন্সির পিকেটারদের মেরে সরিয়ে দেবে পুলিশ। লালবাজার থেকে ফোর্স রওনা দিয়েছে। প্রয়োজনে নাকি গুলি চালাবে।

—সে কী! এক্ষুনি চল!

আইন অমান্য আন্দোলনের সমর্থনে বেথুন কলেজের সামনে পিকেটিং করছিলেন ছাত্রীরা। শুধু বেথুনেরই নন, অন্য কলেজের ছাত্রীরাও রয়েছেন। ইলার মুখে খবর পেয়েই দৌড়লেন দল বেঁধে। গন্তব্য, প্রেসিডেন্সি কলেজ। যেখানে ছাত্রদের ‘বন্দে মাতরম’ স্লোগানে তখন ঝনঝনিয়ে উঠেছে বইপাড়া।

ছাত্রীরা যখন পৌঁছলেন, রণভূমির চেহারা নিয়েছে কলেজ স্ট্রিটের এ মাথা থেকে ও মাথা। পুলিশের সঙ্গে প্রবল ধস্তাধস্তি শুরু হয়েছে ছাত্রদের। পিকেটিং কিছুতেই চলতে দেবে না উর্দিধারীরা, আর ছাত্ররাও যেনতেনপ্রকারণে জারি রাখবে আইন অমান্য আন্দোলন। রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে গোলমালের জেরে। বাস-ট্রাম দাঁড়িয়ে স্থাণুবৎ।

লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে গিয়েও লাভ হচ্ছে না যখন বিশেষ, বাহিনীর নেতৃত্বে থাকা অফিসার নির্দেশ দিলেন সশস্ত্র সিপাইদের, গুলিচালনার প্রস্তুতি নিতে।

ছাত্রীদল সিদ্ধান্ত নিলেন মুহূর্তের মধ্যে। গুলি চালাবে? বললেই হল? চালাক দেখি! দেখি, কত গুলি আছে ওদের? হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়ে গেলেন ছাত্রদের সামনে। চালাক গুলি, তবে আগে আমাদের উপর।

সে এক দৃশ্য! মানবশৃঙ্খল তৈরি করে ফেলেছে একদল কলেজছাত্রী। ঘিরে রেখেছে প্রেসিডেন্সির বিক্ষোভরত ছাত্রদের। বিনা যুদ্ধে এক সেন্টিমিটারও জমি ছাড়ার প্রশ্নই নেই। ছাত্রীদের এহেন রণং দেহি মূর্তিতে হতচকিত হয়ে পড়ল পুলিশ, স্তিমিত হয়ে পড়ল আগ্নেয়াস্ত্রের আস্ফালন।

অফিসার থামালেন সিপাইদের। একদল নিরস্ত্র কলেজছাত্রীর উপর গুলি চালানো অসম্ভব। হিতে বিপরীত হবে। প্রতিবাদের আগুন শুধু শহরে নয়, ছড়িয়ে পড়বে দেশব্যাপী। এ ঝুঁকি নেওয়া যায় না। পিছু হঠতে বাধ্য হল পুলিশ। ব্যাক টু লালবাজার।

ফিরে যাওয়ার আগে অফিসার সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকান ছাত্রীব্যূহের একদম মাঝখানে দাঁড়ানো মেয়েটির দিকে। যে অবিচলিত ভঙ্গিতে একটু আগেই তাঁর চোখে চোখ রেখে চোস্ত ইংরেজিতে বলেছে, ‘Break the cordon if you must… but be sure, over our dead bodies!’

‘অবরোধ সরাতে হলে সরান, কিন্তু আমাদের মৃতদেহের উপর দিয়ে যেতে হবে!’ কে মেয়েটি? বয়স তো দেখে মনে হচ্ছে খুব বেশি হলে আঠারো-উনিশ। এই সহজাত সাহস এত অল্প বয়সে আসে কোথা থেকে?

ভাবতে ভাবতেই গাড়িতে স্টার্ট দেন অফিসার। জয়ধ্বনি কানে আসে ছাত্রছাত্রীদের। বন্দে মাতরম! কানে আসে সমস্বরে রবিঠাকুরের গান, ‘নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়, খুলে যাবে এই দ্বার…’

.

কটকের Ravenshaw Collegiate School-এর প্রধান শিক্ষক বেণীমাধব দাস। স্ত্রী সরলা আর দুই মেয়েকে নিয়ে সংসার। কল্যাণী বড়, তার চার বছরের ছোট বীণা। ইনিই সেই বেণীমাধব, যাঁর বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকার অভিযোগ এনেছিল স্কুলে স্বদেশি ভাবধারা প্রচারের, রাতারাতি বদলি করে দেওয়া হয়েছিল কৃষ্ণনগরে। ইনিই সেই প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক, যাঁর দেশপ্রেমের আদর্শ গভীর প্রভাব ফেলেছিল কটকের ওই স্কুলেই পাঠরত ছাত্র সুভাষচন্দ্রের চেতনায়-মননে।

কল্যাণী-বীণার শৈশব এবং কৈশোরে বাবা-মা ছাড়াও প্রভাব ছিল বড়মামার। অধ্যাপক বিনয়েন্দ্রনাথ সেনের। যাঁর প্রতিষ্ঠিত নীতি-বিদ্যালয়ের প্রভাব সে যুগে জাতির চরিত্রগঠনে ছিল সুদূরপ্রসারী।

বাবা সন্ধেবেলা গল্প বলতেন বিভিন্ন দেশের বরণীয় সমাজবিপ্লবীদের, শোনাতেন দেশের জন্য তাঁদের নিঃস্বার্থ ত্যাগস্বীকারের কাহিনি। দুই বোন ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুনত মন্ত্রমুগ্ধ।

সরলা তাড়া দিতেন মেয়েদের…

—হ্যাঁ রে, তোরা শুবি না? অনেক রাত হল, কাল স্কুল আছে তো!

—মা… প্লিজ় আর একটু… বাবা গল্পটা শেষ করুক।

প্রশ্রয়ের হাসি হাসতেন সরলা। ভাবতেন, ওদের এসব শোনাই উচিত, তবে না চরিত্রের বুনিয়াদ মজবুত হবে। স্বামী-কন্যাদের সঙ্গে নিজেও যোগ দিতেন গল্পে।

সরলার বিরল সংগঠনী ক্ষমতা ছিল। ভাইয়ের প্রতিষ্ঠিত নীতি-বিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ তো ছিলই, পাশাপাশি দুঃস্থ মহিলাদের জন্য ‘পুণ্যাশ্রম’ গড়ে তুলেছিলেন একক প্রচেষ্টায়।

সেটা বিংশ শতকের প্রথমার্ধ। কল্যাণীর জন্ম ১৯০৭ সালে, বীণার’১১-য়। উদারমনস্ক শিক্ষিত পরিবারে এমন মা-বাবার ভাবধারায় বেড়ে ওঠা দুই কিশোরী যে গতানুগতিক জীবনে আকৃষ্ট হবেন না, দেশব্যাপী স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমিতে যে পরাধীনতার গ্লানিতে অবধারিত আক্রান্ত হবেন, স্বাভাবিকই ছিল।

কল্যাণীর ছিল মায়ের মতোই সাংগঠনিক দক্ষতা। ১৯২৮ সালে বিএ পাশ করার পর কলকাতায় এলেন এমএ পড়তে। সহপাঠী সুরমা মিত্র, কমলা দাশগুপ্ত প্রমুখের সহযোগিতায় গড়ে তুললেন ‘ছাত্রীসংঘ’। সভানেত্রী সুরমা, সম্পাদিকা কল্যাণী। কলকাতার স্কুল-কলেজের ছাত্রীদের নিয়ে সংগঠন। ক্রমে ব্যাপ্তি বাড়ল, যোগ দিলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত, সুহাসিনী গাঙ্গুলী, সুলতা করের মতো ছাত্রীরা, যাঁরা পরে সক্রিয় অংশ নেবেন দেশমুক্তির সংগ্রামে। এলেন কল্যাণীর সহোদরা বীণাও, যিনি তখন এলগিন রোডের St Johns Diocesan Girls’ Higher Secondary School-এর ছাত্রী।

‘ছাত্রীসংঘ’-র মেয়েদের দিন কাটত হইহই ব্যস্ততায়। সারাদিন ক্লাস করার পর কোনওদিন লাঠিখেলায় মেতে ওঠা ‘যুগান্তর’ গোষ্ঠীর বিপ্লবী দীনেশ মজুমদারের তত্ত্বাবধানে। কোনওদিন ছুরি চালানোর অনুশীলন লাগাতার। কখনও দল বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়া কলেজ স্কোয়ারের পুকুরে। কখনও দ্রুত সাইকেল চালানোর মহড়া। পাশাপাশি ফার্স্ট এইড-এর প্রাথমিক পাঠ নিয়মিত।

দেশে চলছে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তির নিরন্তর সংগ্রাম,‘ছাত্রীসংঘ’ সেই লড়াইয়ের আঁচমুক্ত থাকে কী করে? যে-কোনও পরিস্থিতির মোকাবিলায় নিজেদের মানসিক এবং শারীরিক ভাবে তৈরি রাখতে স্কুল-কলেজের একঝাঁক ছাত্রী ছিলেন দৃঢ়সংকল্প। জন্মভূমির হিতার্থে যে-কোনও ত্যাগস্বীকারে প্রস্তুত।

দেশ জুড়ে তখন চলছে আইন অমান্য আন্দোলন। কলেজে কলেজে শুরু হল পিকেটিং। ‘বন্দে মাতরম’ স্লোগানে মুখর হয়ে উঠল শহরের বিভিন্ন কলেজ ক্যাম্পাস। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রদের লাগাতার এবং সোচ্চার পিকেটিং চিন্তায় ফেলল লালবাজারকে।

কড়া হাতে দমনের সিদ্ধান্ত হল। অনেক হয়েছে, ছাত্র আন্দোলন এর বেশি বাড়তে দেওয়া যায় না। ফোর্স রওনা দিল কলেজ স্ট্রিটে। নির্দেশ স্পষ্ট, লাঠিপেটায় মিটে গেলে ভাল, না মিটলে প্রয়োজনে গুলি। পরের ঘটনাক্রম লিখেছি আগে, বেথুন কলেজের গেট থেকে ছাত্রীদের প্রেসিডেন্সি যাত্রা, মানবশৃঙ্খল গড়ে তোলা এবং কিংকতর্ব্যবিমূঢ় পুলিশের রণে ভঙ্গ দেওয়া।

ছাত্রীদলের নেতৃত্বে থাকা মেয়েটিকে দেখে চমৎকৃত হয়েছিলেন লালবাজারের পোড়খাওয়া অফিসার। কে ওই মেয়েটি, যে উদ্যত বন্দুকের নলকে উপেক্ষা করে সটান বলেছিল, ‘over our dead bodies?’ কী নাম ওই দৃপ্ত যুবতীর?

.

বীণা দাস। দিদি কল্যাণী ছিলেন স্থিতধী সংগঠক। বীণা তুলনায় বেশি আবেগপ্রবণ, বেপরোয়া। মিষ্টি স্বভাবের জন্য স্কুলে তুমুল জনপ্রিয়। ছাত্রীরা তো বটেই, স্কুলের সিস্টাররাও চোখে হারান বীণাকে। পরীক্ষায় প্রথম স্থান তো বাঁধাই, বিতর্কে-আবৃত্তিতে-গল্প লেখায় ধারেকাছে কেউ নেই। সিস্টারদের অনেক আশা প্রিয় ছাত্রীকে নিয়ে। অধ্যাপনা করবে, নাকি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে (ICS) বসবে? মেয়ের যা এলেম, যে পেশাতেই যাক, সিদ্ধিলাভ অনিবার্য।

বীণা অবশ্য প্রথামাফিক ‘ভাল মেয়ে’ হওয়ায় তীব্র অবিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন ততদিনে। চারদিকে যা ঘটছে, নিয়মনিষ্ঠ জীবনের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসানোতে মন সায় দিচ্ছে না কিছুতেই। বেথুন কলেজে ভর্তি হলেন স্কুলের পাট চুকিয়ে। দুই সহপাঠী, সুহাসিনী দত্ত এবং শান্তি দাশগুপ্ত ছিলেন একটি ছোট বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত। যাঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আলাপে বীণা যেন হাতে চাঁদ পেলেন। যোগ দিলেন বন্ধুদের গোষ্ঠীতে, দেশের জন্য সীমিত সাধ্যে কিছু করার সুযোগ পেয়ে আনন্দে আত্মহারা প্রায়।

তিরিশের দশকের প্রথমার্ধ। সে বড় অস্থিরতার সময় বাংলায়। বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ডে ব্যতিব্যস্ত ব্রিটিশ প্রশাসন। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের দুঃসাহসিক প্রয়াস আলোড়ন ফেলে দিয়েছে দেশময়। কয়েকমাস পরে অগস্টের ২৫ তারিখে দোর্দণ্ডপ্রতাপ পুলিশ কমিশনার টেগার্টকে হত্যার ব্যর্থ চেষ্টা হল ডালহৌসি স্কোয়ারে। নিহত হলেন অনুজাচরণ সেনগুপ্ত। গ্রেফতার হলেন দীনেশ মজুমদার।

ঢাকায় ইনস্পেকটর জেনারেল লোম্যানকে গুলি করে হত্যা করে বিপ্লবী বিনয় বসু তখন পলাতক। কিছুদিন পরে ফের আবির্ভাব বিনয়ের, দীনেশ গুপ্ত ও বাদল গুপ্তের সঙ্গে।’৩০-এর ডিসেম্বরের ৮ তারিখে রাইটার্সের বিখ্যাত অলিন্দ যুদ্ধে ত্রিমূর্তির অভিযান, গুলি করে হত্যা অত্যাচারী পুলিশ অফিসার সিম্পসনকে।’৩১-এর শেষার্ধে দুই স্কুলকিশোরী শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরী ঘটাল এক অভাবনীয় ঘটনা। কুমিল্লার ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে হত্যা করে দ্বীপান্তরিত হল যাবজ্জীবন।

প্রত্যাঘাতে প্রতিহিংসাই দস্তুর ছিল ব্রিটিশ সরকারের। ধরপাকড় শুরু হল বেপরোয়া। বীণাদের ছোট দলটির অনেকেও গ্রেফতার হলেন। বিচলিত বীণা স্থির করলেন, এবার এমন কিছু করবেন, এবং একাই করবেন, যাতে ভিত নাড়িয়ে দেওয়া যায় প্রশাসনের। আতঙ্ক গ্রাস করে পুলিশকে।

কিন্তু কী করবেন? চিন্তা করতে থাকেন সারারাত। নিদ্রাহীন।

একসময় ভাবনা আসে বিদ্যুৎঝলকের মতো, উঠে পড়েন ধড়মড়িয়ে। আজই একবার ‘দিদি’র বাড়ি যাওয়া দরকার।

.

—তুই যা বলছিস, ভেবেচিন্তে বলছিস? অত সোজা নয়…

কমলা দাশগুপ্ত প্রথমে হেসেই উড়িয়ে দেন বীণার পরিকল্পনা। কমলার জন্ম ঢাকায়, ১৯০৭ সালে। বেথুন কলেজে বিএ পড়ার সময় বিপ্লবী গোষ্ঠীর সংস্পর্শে আসেন, স্নাতকোত্তর পড়াকালীন যোগ দেন ‘যুগান্তর’ দলে। দলের প্রয়োজনে বাড়ি ছেড়ে থাকতেন একটি মেয়েদের হস্টেলের ম্যানেজার হিসাবে। বোমা-পিস্তল রাখা এবং বিপ্লবীদের সরবরাহ করার কাজ করতেন হস্টেল থেকেই। পিস্তল ব্যবহারে ছিলেন সিদ্ধহস্ত।

বীণা তাঁর সহপাঠী কল্যাণীর ছোট বোন, বেথুনেরই ছাত্রী। কমলা খুব স্নেহ করেন হাসিখুশি স্বভাবের মেয়েটিকে। দেশপ্রেমের আদর্শে স্থির, কিন্তু একটু বেশি আবেগপ্রবণ। এত বড় সিদ্ধান্ত কি স্রেফ আবেগের বশে নেওয়া উচিত?

—আবেগ দিয়ে সব লড়াই হয় না বীণা, তা ছাড়া এটা বিরাট ঝুঁকি হয়ে যাবে। ধরা পড়বিই, জীবনটাই হয়তো জেলে কেটে যাবে। লড়াইটাই করতে পারবি না আর।

—শুধু আবেগ দিয়ে তো লড়ছি না দিদি। লড়ছি তো বুদ্ধি দিয়েও। ধরা পড়ব, সেটাও জানি। পালানোর জন্য তো যাচ্ছি না ওখানে। যে-কোনও শাস্তির জন্য প্রস্তুত। তুমি আর ‘না’ কোরো না, একটা রিভলভার জোগাড় করে দাও।

—যদি ফাঁসি হয় তোর?

—আমি হাসতে হাসতে চলে যাব, দেখো তুমি।

—যদি দ্বীপান্তর হয়, পারবি সহ্য করতে?

—হলেও কোনও চিন্তা নেই। ওখানে তো শান্তি-সুনীতি আছে, ওদের পড়িয়ে দিব্যি সময় কাটবে।

—পুলিশের অত্যাচার যদি সহ্য করতে না পারিস?

—সে সুযোগ ওরা যাতে না পায় সেই চেষ্টা তো করবই। পটাশিয়াম সায়ানাইড তো থাকছেই পকেটে।

কমলা বুঝে যান, এ মেয়ে মনস্থির করে ফেলেছে। একে আর বোঝানো বৃথা। তবু বোঝালেন পরের কয়েকদিন আপ্রাণ। বীণা অনড় থাকলেন সিদ্ধান্তে। ঘনিষ্ঠ সহযোগী সুধীর ঘোষের সঙ্গে পরামর্শ করলেন কমলা। রিভলভার কেনার ২৮০ টাকা জোগাড় করলেন, যা দিয়ে সুধীর ব্যবস্থা করলেন আগ্নেয়াস্ত্রের। পাঁচ চেম্বার বিশিষ্ট .৩৮০ বোরের বেলজিয়ান রিভলভার। কমলা যা হাতে তুলে দিলেন বীণার, সঙ্গে কার্তুজ আর পটাশিয়াম সায়ানাইড। বিশদে বুঝিয়ে দিলেন অস্ত্র ব্যবহারের পদ্ধতি।

—এইটা হল ব্যারেল, ট্রিগারে চাপ দিলে যেখান থেকে গুলি ছুটবে… শুটিংয়ে আসল কথা কিন্তু ‘গ্রিপ’… তুই কীভাবে অস্ত্রটাকে ধরছিস…

.

৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩২। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হল গমগম করছে। তিলধারণের স্থান নেই।

—আজ আমরা সমবেত হয়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক সমাবর্তন উৎসবে। উপস্থিত ছাত্রছাত্রীদের কাছে আজ এক গর্বের দিন। গর্ব আমাদেরও, কারণ, আজকের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করছেন বাংলার মহামান্য রাজ্যপাল স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসন। যাঁর কাছে আমরা সবিশেষ কৃতজ্ঞ তাঁর মহামূল্যবান সময়ের কিছুটা আমাদের জন্য ব্যয় করতে সম্মত হওয়ায়।’

চতুর্থ সারিতে বসা বীণার কানে একটা শব্দও ঢুকছে না। চারপাশে একবার তাকায়। হলভর্তি লোক মনোযোগ দিয়ে শুনছে উপাচার্যের স্বাগত ভাষণ। বিরক্ত লাগে বীণার। এত মন দিয়ে কী শুনছে এরা? একই থোড়-বড়ি-খাড়া, খাড়া-বড়ি-থোড়ই তো চলে আসছে বছরের পর বছর। কখন শেষ হবে এই চর্বিত চর্বণ? কখন শুরু হবে রাজ্যপালের অভিভাষণ?

কালো গাউনের ভিতরের ডান দিকের পকেটে রাখা আগ্নেয়াস্ত্রের উপর একবার হাত বুলিয়ে নেয় সে। পটাশিয়াম সায়ানাইড রাখা আছে বাঁ দিকের পকেটে। আলতো ছুঁয়ে দেখে। মনে মনে আর একবার ঝালিয়ে নেয় প্ল্যান।

স্ট্যানলি জ্যাকসনকে মারতে হবে, যখন ভাষণ দিতে উঠবেন, শুরু করবেন বক্তৃতা। এখন মঞ্চের মধ্যমণি হয়ে বসে আছেন মাঝের চেয়ারে। দু’পাশে আরও আটটা চেয়ারে বাকি বিশিষ্টরা। এখন কিছু করা মুশকিল। ঠিকই করে এসেছে সে, যখন বক্তৃতা দেবেন পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে, তখনই মোক্ষম সময়। কিন্তু ভাষণটা শুরু হবে কখন? আর কত দেরি? উসখুস করতে থাকে সে। শুভস্য শীঘ্রম।

—এখন বক্তব্য পেশ করবেন প্রধান অতিথি স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসন, যাঁর মূল্যবান উপদেশ ছাত্রছাত্রীদের আগামীদিনের চলার পথে পাথেয় হয়ে থাকবে।

বীণার স্নায়ু টানটান হয়ে ওঠে নিমেষে। অবশেষে! উপস্থিত সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, ব্রিটিশরাজের প্রভুত্বে প্রকাশ্য আঘাত হানার। রিভলভারে শেষবারের মতো হাত বুলিয়ে নেয় বীণা। কী কী যেন বলেছিল কমলাদি? গ্রিপটাই আসল… ফোরসাইট ইউ… আর যেন কী? মনে পড়ছে না কেন? কতবার ড্রাই প্র্যাকটিস করেছে গত সপ্তাহে, হিসাব নেই কোনও। তবু গুলিয়ে যাচ্ছে কেন শেষ সময়ে? গলাটাও একটু শুকিয়ে গেছে যেন। একটু জল পেলে ভাল হত। এমন হচ্ছে কেন? ভয়?

মানসিক অস্থিরতায় চিরকাল যা করে এসেছেন, সেটাই করেন বীণা। বাবাকে স্মরণ করেন। বেণীমাধব প্রায়ই বলেন, জীবনে অনেক ঝড়ঝাপটা আসবে, ভয় পাবি না কখনও। ভয়কে জয় করা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। আদর্শে যদি বিশ্বাস স্থির থাকে, ‘ভয়’ নিজেই ভয় পেয়ে পালাবে। বুক চিতিয়ে দাঁড়াবি ‘ভয়ের’ সামনে।

রাজ্যপালকে খুন করেছে আদরের মেয়ে, এটা জানলে কি বাবা খুশি হবেন? মনে হয় না। বরং ৬৭/১ একডালিয়া রোডের বাড়িতে বসে বাবা দুঃখ পাবেন খুব, মা-ও। বেণীমাধব নিখাদ দেশপ্রেমিক, কিন্তু উগ্র সহিংস আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলেন না কোনওদিন। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি, সহিংস না হয়ে উপায়ই বা কী আর? শাসকের উগ্র দমনপীড়নের মুখে কতদিন আর অহিংস থাকা যায়? কতদিন অন্য গাল বাড়িয়ে দেওয়া যায় এক গালে থাপ্পড় খাওয়ার পর? বীণা উঠে পড়েন চেয়ার ছেড়ে।

—Ladies and Gentlemen, distinguished guests and my dear students…

It is indeed a privilege for me…

মধ্যপথে থেমে যান দীর্ঘদেহী রাজ্যপাল। ওই কালো গাউন পরা মেয়েটি চেয়ার ছেড়ে ওভাবে ছুটে আসছে কেন তাঁর দিকে? কী বার করছে ওটা? আরে, ওটা তো রিভলভার!

জ্যাকসন ছিলেন শারীরিক ভাবে অত্যন্ত সক্ষম। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ক্রিকেটার ছিলেন। ইংল্যান্ডের হয়ে কুড়িটা টেস্ট খেলেছিলেন। মূলত ব্যাটসম্যান এবং পার্টটাইম বোলার। পরিসংখ্যান, টেস্ট কেরিয়ারে মোট রান ১৪১৫, গড় ৪৮.৭৯। পাঁচটি সেঞ্চুরি সহ। উইকেট ২৪, গড় ৩৩.২৯।

প্রথম বুলেট যখন ছিটকে এল বীণার রিভলভার থেকে, জ্যাকসন মাথা সরালেন নিমেষে, বাউন্সারে ‘ডাক’ করার ভঙ্গিতে। বাঁচিয়ে দিল স্বভাবজাত ক্রিকেটীয় রিফ্লেক্স, মাথার দু’ ইঞ্চি পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল বুলেট। হুলুস্থুল পড়ে গেল সেনেট হলে। উপাচার্য হাসান সুহরাওয়ার্দী চকিতে মঞ্চ থেকে নেমে চেপে ধরলেন বীণার ঘাড়। প্রথম গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় বীণাকেও দিশেহারা দেখাচ্ছে তখন। ট্রিগার চাপলেন মরিয়া, পরপর তিনবার। জ্যাকসন ততক্ষণে সরে গিয়েছেন একপাশে, গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। সেনেট হলে উপস্থিত সাদা পোশাকের পুলিশ ঘটনার আকস্মিকতার ঘোর কাটিয়ে ধরে ফেলল একুশ বছরের যুবতীকে। পটাশিয়াম সায়ানাইডের প্যাকেটে হাত দেওয়ার আগেই।

খবর ছড়িয়ে পড়ল উল্কাগতিতে। ডিগ্রি নেওয়ার অনুষ্ঠানে গভর্নরের উপর গুলি চালিয়েছে এক ছাত্রী। অল্পের জন্য প্রাণরক্ষা হয়েছে রাজ্যপালের।

পরের দিনের কাগজে হেডিং : ‘Girl assassin shoots at Governor, misses target.’

.

বীণাকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হল ইলিসিয়াম রো (বর্তমানের লর্ড সিনহা রোড)-র অফিসে। সেখান থেকে লালবাজার। জিজ্ঞাসাবাদে শারীরিক নির্যাতন ততটা ছিল না, যতটা ছিল অসম্মানজনক প্রশ্নাবলিতে মানসিক নির্যাতন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বীণা মুখ খুললেন না পুলিশকর্তাদের শত চেষ্টাতেও। সন্দেহের বশবর্তী হয়ে পুলিশ ধরল কমলাকেও, মার্চের পয়লা তারিখ। ছয় বছরের কারাবাস বরাদ্দ হল কমলা দাশগুপ্তের।

বীণার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হল ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৭ (খুনের চেষ্টা) ধারা এবং অস্ত্র আইনে। ডায়াসেশন স্কুলের হস্টেলের একটি ঘরে লুকিয়ে রেখেছিলেন কিছু গুলি। যা উদ্ধার করল পুলিশ। বীণা নির্দ্বিধায় দোষ কবুল করে নেওয়ায় বিচারপর্ব সম্পন্ন হল দিনসাতেকের মধ্যেই। রায় বেরল ১৫ ফেব্রুয়ারি। নয় বছরের সশ্রম কারাদণ্ড।

কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বীণা ঘোষণা করলেন সদর্পে, ‘হ্যাঁ, আমি রাজ্যপালকে মারতে চেয়েছিলাম। দুর্ভাগ্য, পারিনি। স্ট্যানলি জ্যাকসন আমার পিতৃপ্রতিম, তাঁর বা তাঁর পরিবারের প্রতি আমার কোনও ব্যক্তিগত বিদ্বেষ নেই, কখনও ছিল না। কিন্তু তিনি এমন এক সরকারের প্রতিভূ, এমন এক শাসনব্যবস্থার মূর্ত প্রতীক, এমন এক supreme symbol, যা আমার দেশকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ রেখেছে দমনপীড়নের মাধ্যমে। আমি আঘাত হানতে চেয়েছিলাম সেই প্রতীকের উপর।’

জ্যাকসন বেঁচে গিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু চেষ্টা বৃথা যায়নি বীণার। তাঁর অকুতোভয় অভিযান যে ব্রিটিশ সরকারকে আমূল নাড়িয়ে দিয়েছিল, সমসময়ের নথিপত্রে তার প্রমাণ মেলে। শাসকের বিরুদ্ধে শাসিতের ক্রোধ-ক্ষোভ-ঘৃণা কোন অসহনীয় পর্যায়ে গেলে কলেজছাত্রী রাজ্যপালকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় কনভোকেশনে, বুঝতে বাকি থাকেনি প্রশাসনের। রাতারাতি নিরাপত্তা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারীদের। যাঁদের সাময়িক হলেও আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল প্রাণভয়।

কারাবাসের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার দু’বছর আগে রাজবন্দিনি হিসাবে মুক্তি পান বীণা, ১৯৩৯ সালে। যোগ দেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে। সক্রিয় অংশ নেন ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে। ফের গ্রেফতার বরণ, তিন বছরের কারাবাস। Bengal Provincial Legislative Assembly (স্বাধীনতার পর West Bengal Legislative Assembly)-র সদস্যা ছিলেন ১৯৪৬-৫১। স্বাধীনতা যখন আসন্ন, লিখেছিলেন নিজের জীবনকথা, ‘শৃঙ্খল-ঝঙ্কার’। সহযোদ্ধা বিপ্লবী যতীশ ভৌমিকের সঙ্গে বিবাহ স্বাধীনতা প্রাপ্তির বছরে।

শেষ জীবন কাটিয়েছিলেন পাহাড়ের কোলে, হৃষীকেশে। প্রয়াণ ১৯৮৬-র ২৬ অক্টোবর। অবহেলায়, একাকী, লোকচক্ষুর অন্তরালে।

.

অগ্নিযুগের বাংলায় নারীশক্তির ভূমিকা এবং অবদান নিয়ে বইপত্র আছে কিছু। গবেষণাও যে অমিল, এমন নয়। কিন্তু বীণা দাসের মতো অগণিত দেশব্রতী নারী আত্মত্যাগের যে দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছেন স্বাধীনতা সংগ্রামের অভিযাত্রায়, তা যে প্রাপ্য প্রচার এবং মূল্যায়ন থেকে অনেকাংশে বঞ্চিতই থেকেছে ইতিহাসের পাতায়, লেখাই যায় সংশয়হীন।

ভুল শুধরে নেওয়ার সময় এসেছে। সময় এসেছে বাংলার বিপ্লবী নারীদের অবদানের পুনর্মূল্যায়নের। সময় এসেছে মনে রাখার, ‘অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’।

Exit mobile version