Site icon BnBoi.Com

হাড়ের পাশা – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (ভারত)

 ১. কিরীটী একটা ঘর খুঁজছিল

কিরীটী একটা ঘর খুঁজছিল শ্যামবাজার অঞ্চলে।

শুধু শ্যামবাজার অঞ্চলেই নয়, বিশেষ করে শ্যামবাজার ট্রামডিপোর কাছাকাছি কোন এক জায়গায় হলেই যেন ভাল হয়।

যে সময়কার কথা বলছি তখনও কলকাতা শহরে ভাড়াটে বাড়ি পাওয়ার বিভ্রাটটা এখনকার মত এতটা প্রকট হয়ে ওঠেনি। রাস্তায় যেতে যেতে অনেক ‘টু লেট’ই চোখে পড়ত।

নির্দিষ্ট অঞ্চলে দু’একটা ঘর যে কিরীটী পায়নি তাও নয়, কিন্তু ঠিক পছন্দসই হচ্ছিল না যেন।

বিশেষ করে নির্দিষ্ট একটি পরিধির মধ্যেই নয়, কিরীটী যে একটি ঘর খুজছিল ঐ অঞ্চলে—তার কারণও অবশ্য একটা ছিল কিন্তু সেটা ক্রমশঃ প্রকাশ্য।

এমন সময় অকস্মাৎ একদিন দ্বিপ্রহরে ডালহাউসী স্কোয়ার অঞ্চলে কলেজের একদা সহপাঠী সত্যশরণের সঙ্গে একটা চলমান ট্রামে দেখা হয়ে গেল কিরীটীর। এবং কথায় কথায় সত্যশরণ শ্যামবাজার অঞ্চলেই থাকে শুনে তাকেও ঘরের কথা বলায় সত্যশরণ বললে, আমরা ন্যায়রত্ন লেনে যে সেমি মেসবাড়িটায় থাকি সেইখানেই তো কিছুদিন হলো একটি ঘর খালি পড়ে আছে।

সত্যি কথা বলতে গেলে বাড়িটার মধ্যে দোতলায় সেই ঘরটিই সব চাইতে ভাল। আকারে বড়। দক্ষিণ খোলা।

চমৎকার, ঐ ঘরটা তাহলে আমার জন্য ঠিক করে দাও ভাই। কিরীটী অতি মাত্রায় যেন উৎসুক হয়ে ওঠে।

আরে সেজন্যে আটকাবে না। ঘরটা তো দেখেই আগে পছন্দ করো, তাছাড়া বাড়িওয়ালা মন্দ লোক নয়, ভাড়াও দেবে যখন।

পছন্দ ঠিক হয়ে যাবে ভাই। অন্ততঃ তোমার মুখে শুনে তাই মনে হচ্ছে। ঘরটা আজই পাওয়া যায় কিনা বল। তাহলে সন্ধ্যার পর তোমার সঙ্গে গিয়ে দেখা করবো!

ব্যাপার কি হে! তোমার যে একেবারে তর সইছে না। তোমার সে শিয়ালদার বাণীভবন মেস কি হলো?

সেখানে ঠিক সুবিধা হচ্ছে না ভাই। তাই অনেক দিন থেকেই ছেড়ে দেবো দেবো ভাবছি।

বেশ তাহলে চল। আমি তো এখন বাসাতেই ফিরছি। ঠিক আছে, তাই চল। শুভস্য শীঘ্রম। দ্বিপ্রহরের কর্মব্যস্ত কলকাতা শহর। ট্রাম চলছে ঠং ঠং ঘণ্টি বাজিয়ে শ্যামবাজার অভিমুখেই।

কিরীটী সত্যশরণের পাশে বসে মনে মনে ভাবছিল তারই দেওয়া সংবাদটির কথা।

ঘরটা দেখেই কিরীটীর বিশেষ পছন্দ হয়ে গেল।

ন্যায়রত্ন লেনে এমন একটি ঘর পাওয়া যাবে এবং একেবারে ঠিক এতটা মনোমত জায়গায় কিরীটী ভাবেনি—আশাও করেনি, অদ্ভুত যোগাযোগ।

দিন কয়েক আগে কিরীটীর পূর্বপরিচিত শ্যামপুকুর থানার ও. সি. বিকাশ সেনের ওখানে কিরীটী নিজেই ঘুরতে গিয়েছিল বলতে গেলে একপ্রকার তার নিজের কৌতূহলেরই তাগিদে।

গত তিন মাসের মধ্যে শ্যামবাজার ট্রামডিপোর আশেপাশে তিন-তিনটি অত্যন্ত রহস্যজনক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।

তিনজন নিহতের মধ্যে একজন অবাঙালী বেহারী মধ্যবয়সী, একজন অল্পবয়েসী পাঞ্জাবী মুসলমান ও সর্বশেষজন ৩৫/৩৬ বৎসর বয়স্ক বাঙালী যুবক।

এবং কোনবারই মৃতের দেহে কোনরুপ আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। কেবল প্রত্যেকেরই গলায় একটি সরু, কালো দাগ দেখা গিয়েছে মাত্র।

এবং করোনার্স রিপোর্ট হচ্ছে : শ্বাসরোধে মৃত্যু সংঘটিত হয়েছে।

নির্দিষ্ট একটি অঞ্চলের এবং বলতে গেলে নির্দিষ্ট একটি পরিধির মধ্যে গত তিন-চার মাসের মধ্যে তিন-তিনটি রহস্যজক হত্যাকাণ্ড এবং প্রত্যেকেরই শ্বাসরোধে মৃত্যু ও প্রত্যেকেরই গলায় একটি করে সরু কালো দাগ—সংবাদপত্রে প্রকাশিত ঐ সংবাদটি কিরীটীর কৌতূহলকে বিশেষভাবে নাড়া দেয়। এবং ঐ অঞ্চলের থানা অফিসার বিকাশের সঙ্গে কিছুটা পূর্ব পরিচয় থাকায় শেষ পর্যন্ত কৌতূহলের বশবতী হয়েই কিরীটী বিকাশের ওখানে গিয়ে এক সন্ধ্যারাত্রে হাজির হয়।

একথা সেকথার পর আসল কথা উত্থাপন করায় বিকাশ সেন বলেন, ব্যাপারটা যেন আগাগোড়াই মিস্টিরিয়াস কিরীটী। অনেক অনুসন্ধান করেও কোন হদিস করতে পারিনি আজ পর্যন্ত।

কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছ বিকাশ, তিন-তিনটি হত্যাব্যাপারে minutely observe করলে একটা কথাই মনে হয় না কি কোথায় যেন একটি অদৃশ্য যোগসূত্র ঐ হত্যা-ব্যাপারগুলোর মধ্যে বর্তমান আছে! কিরীটী জবাব দিয়েছিল।

তুমি যেন বেশ একটু interested বলেই মনে হচ্ছে রায় ঐ ব্যাপারে। বিকাশ জবাব দেন।

সত্যি কথা বলতে কি সেন, সেইজন্যই আমার আসা।

হ্যাঁ, তা বেশ তো, দেখ না, যদি কোন কিনারা করতে পার ব্যাপারটার। আমরা পুলিশ বাধ্য হয়ে হাত ধুয়েই বসে আছি ও ব্যাপারে।

বলা বাহুল্য সেই রহস্যপূর্ণ ব্যাপারটার একটা ভাল করে অনুসন্ধান করবার মতলবেই তারপর থেকে কিরীটী ঐ অঞ্চলে একটা থাকবার আস্তানা খুজছিল। কারণ তার ধারণাই হয়েছিল ঐ হত্যা ব্যাপারগুলোর পশ্চাতে বিশেষ কোন একটা রহস্য আছে। এবং ঐ রহস্যের কিনারা করতে হলে সর্বাগ্রে অকুস্থানের আশেপাশে বা নিকটে কোথাও তাকে কিছুদিন ডেরা বেধে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে।

ট্রাম চলেছে মন্থর গতিতে। কিরীটীর আত্মচিন্তায় বাধা পড়ল হঠাৎ সত্যশরণের কথায়।

তোমাকে একটা কথা পূর্বেই খুলে বলে রাখা ভাল কিরীটী। সত্যশরণ যেন একটু ইতস্ততঃ করতে থাকে কথাটা বলতে গিয়েও।

কি বল তো?

বলছিলাম কি ঘরটা পাওয়া যাবে ঠিকই। বাড়ীওয়ালাও ভাড়াটে পেলেই ভাড়াও দেবেন। কিন্তু

কিন্তু কি? বল না ভাই কি বলতে চাও?

বলছিলাম ঐ ঘরটা সম্পর্কেই। ঘরে যিনি পূর্বে ছিলেন, মানে আমাদের অনিলবাবু, আজ থেকে ঠিক একমাস আগে হঠাৎ একদিন ভোরে তাঁকে মেসের কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না, তারপর খুজতে খজতে মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয় শ্যামবাজার ট্রামডিপোর ঠিক সামনে বড় লাল দোতলা বাড়িটার গাড়িবারান্দার নিচে। সংবাদপত্রেও অবশ্য ব্যাপারটা প্রকাশিত হয়েছিল—পড়েছিলে কিনা জানি না।

সত্যশরণের কথায় কিরীটী চমকে ওঠে।

ঐ অঞ্চলের শেষ হত্যাকাণ্ডটির কথা মনের পাতায় সঙ্গে সঙ্গে ভেসে ওঠে। অদ্ভুত যোগাযোগ তো! মনের কৌতুহল দমন করে কিরীটী শান্তকণ্ঠে বলে, তাতে আর হয়েছে কি!

না, তাই বলছিলাম আর কি। হাজার হলেও বন্ধুমানষ তুমি, সব কথা তোমাকে আগে থাকতে খুলে বলাই ভাল। আর ঠিক তার পাশের ঘরেই আমি থাকি কিনা।

বটে! তা ভদ্রলোক মানে সেই অনিলবাবুর সঙ্গে তোমার নিশ্চয়ই আলাপ-পরিচয় ছিল সত্য? কিরীটী এবারে পাল্টা প্রশ্ন করে।

হ্যাঁ, তা একটু-আধটু ছিল বৈকি। পুলিশ অবশ্য সেজন্য আমাকে প্রশ্ন করে কম হয়রানি করেনি!

অনিলবাবু, তোমাদের ওখানে কতদিন ছিলেন?

তা প্রায় মাস দশেক তো হবেই। তাই তো বলছিলাম, শান্তশিষ্ট নিরীহ ভদ্রলোক, তিনি যে হঠাৎ ঐ ভাবে মারা যাবেন ভাবতেই পারিনি।

জীবন-মৃত্যুর কথা তো বলা যায় না সত্যশরণ। তাছাড়া কার জীবনে কখন কোন পথে যে কোন আকস্মিক ঘটনার আবির্ভাব ঘটে কেউ তো তা বলতে পারে না।

তা যা বলেছ ভাই!

তা ছাড়া হয়ত এমনও হতে পারে, তোমরা তার সম্পর্কে যতটুকু জানতে তার বাইরে এমন কোন ব্যাপার হয়ত তার জীবনে ছিল যেখানে তার ঐ আকস্মিক মৃত্যুর কোন যোগসূত্র ছিল।

কিরীটীর কথায় সত্যশরণ যেন হঠাৎ চমকে ওঠে, বলে আশ্চর্য! তুমি তুমি সেকথা জানলে কি করে কিরীটী?

কিরীটীও কম বিস্মিত হয়নি সত্যশরণ ঐভাবে হঠাৎ তার কথায় চমকে ওঠায়। নিছক কথার পিঠে কথা হিসাবেই কথাটা কিরীটী বলেছিল।

তাই পরক্ষণেই মৃদুকণ্ঠে বলে, এর মধ্যে আর জানাজানির কি আছে! এ তো অনুমান মাত্র। আর এমন কিছু অসম্ভবও নয়।

আমি অবশ্য পুলিসের কাছে বলিনি কিছুই। কারণ পুলিসের ব্যাপার তো জানই। তিলকে তাল করতে তারা সিদ্ধহস্ত। ওদের যত এড়িয়ে চলা যায় ততই বুদ্ধিমানের কাজ।

সত্যশরণের কথায় কিরীটী বেশ যেন একটু চাঞ্চল্য অনুভব করে এবং আরো একটু ঘেষে বসে প্রশ্ন করে, সত্যিই কোন interesting ব্যাপার কিছু ছিল নাকি তোমাদের সেই অনিলবাবুর জীবনে?

তেমন কিছু না অবশ্য। সত্যশরণ এবারে আমতা আমতা করে জবাব দেয়।

কিরীটী বুঝতে পারে, সত্যশরণ ঝোঁকের মুখে হঠাৎ কথাটা শুরু করে এখন কোন কারণে এড়িয়ে যেতে চাইছে তাকে।

কিরীটী তাই এবারে বন্ধুকে যেন একটু উৎসাহ দেবার চেষ্টা করেই কণ্ঠে আরো ঘনিষ্ঠতার সুর ঢেলে বলে, আহা, বলই না। শোনাই যাক না। প্রেম-ট্রেম ঘটিত কিছু নাকি?

আশ্চর্য, সত্যি তাই! But how the devil you could guess!

আন্দাজে অন্ধকারে ঢিলটা নিক্ষেপ করলেও লক্ষ্যভেদ করেছে। কিরীটী মৃদু হেসে জবাব দেয়, আরে এ আর এমন কি কঠিন ব্যাপার? Young man-ওইটাই তো স্বাভাবিক!

সত্যিই তাই। অনিলবাবুর জীবনে সাত বছরের এক মধুর প্রেমকাহিনী ছিল।

বটে!

বাধা বা সংকোচ যতটুকু ছিল হঠাৎ সেটা একবার অপসারিত হয়ে বলে চললো।

বিনতা দেবীর সঙ্গে ছিল অনিলবাবুর ভালবাসা। অবস্থার উন্নতি না করা পর্যন্ত বিবাহ হবে না, তাই চলেছিল ওঁদের উভয়ের অপেক্ষার পালা। অনিলবাবু প্রায়ই বলতেন আমাকে, ছোট একটি নিজস্ব নিরালা গৃহকোণ, ব্যাকে কিছু টাকা ও শান্ত নিরূপদ্রব জীবন। দীর্ঘ অপেক্ষার পর গত ফাগুনে তাদের বিবাহের সব স্থিরও একপ্রকার হয়ে গিয়েছিল, সামনের বৈশাখেই শুভকাজটা সম্পন্ন করবেন তাঁরা। এবং অনিলবাবুর আকস্মিক রহস্যজনক মৃত্যুর দিন দুই আগেই ঐ আসন্ন উৎসবের কথা নিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার আলোচনাও হয়েছিল।

অনিলবাবুর সেই পরিচিতা বিনতা দেবীর সঙ্গে তোমার আলাপ হয়নি?

না। ফটোই দেখেছি কেবল, সাক্ষাৎ পরিচয় ঘটেনি।

উভয়ের আসা-যাওয়া ছিল না?

ছিল। তবে একতরফা অনিলবাবুই যেতেন দেখতাম মধ্যে মধ্যে বিনতা দেবীর ওখানে। বিনতা দেবীকে কখনো আসতে দেখিনি এখানে।

অনিলবাবুর মৃত্যুর সংবাদ পেয়েও আসেনি?

না। তবে তাঁর দাদা এসেছিলেন ভাগলপুর থেকে। মেসে অনিলবাবুর জিনিসপত্র যা ছিল নিয়ে যেতে।

বিনতা দেবী কলকাতাতেই কোন স্কুলে বুঝি শিক্ষয়িত্রীর কাজ করতেন?

না। শুনেছি বাগনান গার্লস স্কুলের শিক্ষয়িত্ৰী তিনি।

ইতিমধ্যে গাড়ি শ্যামবাজারের কাছাকাছি এসে পড়ায় তখনকার মত আলাপ-আলোচনা বন্ধ হয়ে গেল। পরবর্তী স্টপেজে উভয়ে ট্রামগাড়ি থেকে অবতরণ করে।

২. ন্যায়রত্ন লেনে

অবশ্য ন্যায়রত্ন লেনে সত্যশরণের বর্ণিত নির্দিষ্ট বাসাটা ঠিক বাসা নয়, সেমি মেসবাড়ি, পূর্বেই সে কথা সত্যশরণ কিরীটীকে জানিয়েছিল।

বাড়িচা দোতলা; ওপরে ও নীচে চার ও তিন সর্বসমেত সাতটি ঘর। এবং বাড়িটা নাতিপ্রশস্ত গলির একপ্রকার শেষপ্রান্তে।

ওপরের তলার চারটি ঘরই মাঝারি আকারের। ছোটও নয় খুব, প্রশস্তও নয়। এবং চারটি ঘরের মধ্যে সর্বশেষ ঘরের আগের দক্ষিণখোলা ঘরটিই খালি ছিল। ঘরটা কিরীটীর পছন্দ হওয়ায় গৃহকর্তার সঙ্গে সত্যশরণই কিরীটীর হয়ে কথাবার্তা বলে সব ঠিক করে দিল এবং কিরীটী যথারীতি পরের দিনই দ্বিপ্রহরে এসে ঘরটি অধিকার করল।

ঘরটি তার পছন্দ হয়েছে এবং বলতে গেলে পূর্বের ভাড়ার চাইতে কয়টি টাকা কম ভাড়াতেই পাওয়া গিয়েছে সত্যশরণের সুপারিশে।

কিরীটীর ঘরে কিরীটী একা। বাকী তিনটি ঘরে সত্যশরণকে নিয়ে মোট ছয়জন বোর্ডার আছেন। সত্যশরণকে বাদ দিয়ে বাকী পাঁচজনের মধ্যে দুইজন হরবিলাস ও শ্যামবাবু, উভয়েই প্রৌঢ় এবং সর্বাপেক্ষা পুরাতন বাসিন্দা এ বাড়ির। এবং বলতে গেলে তাঁরাই বাকী বোর্ডারদের জুটিয়ে দোতলাটাকে সেমি মেসে পরিণত করেছেন। দুজনেই মার্চেন্ট অফিসে কাজ করেন এবং প্রতি শনিবার অফিস থেকে আর বাসায় না ফিরে সোজা একেবারে দেশের বাড়িতে চলে যান। শনি ও রবিবারটা সেখানে কাটিয়ে সোমবার ভোরের গাড়িতে ফিরে আর মেসে না গিয়ে সোজা একেবারে অফিস করতে চলে যান। এমনি করেই প্রতি শনি ও রবিবারটা দেশের বাড়িতে কাটিয়ে সোমবার ভোরের গাড়িতে ফিরে অফিস করেন ছাপোষা নিরীহ কেরানীর মত। এবং একেবারে ঘোরতর সংসারী ওঁরা দুইজন এক ঘরেই থাকেন।

আর তিনজনই অল্পবয়সী। জীবনবাবু একটা সিনেমার গেটকীপার। মাসে ত্রিশটি টাকা পান ও এক জায়গায় টিউশনি করেন। সুধাংশুবাবু, কোন একটি বিলাতী ঔষধের কোম্পানীর নন-মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ এবং রজতবাবু একটি নামকরা বিলাতী ইনসিওরেন্স কোম্পানীর ভ্রাম্যমাণ দালাল। সত্যশরণ বাসাটা সেমি মেস বলেছিল, কারণ ওখানে কেবল থাকবারই ব্যবস্থা আছে। আহারের কোন ব্যবস্থাই নেই। দুটি ভৃত্য আছে, বলাই ও রতন, বাবুদের প্রয়োজনমত দিনের বা রাত্রের আহার্য সামনের ট্রামরাস্তার ঠিক ওপরেই অন্নপূর্ণা হোটেল থেকে নিয়ে আসা থেকে চা জলখাবার ও অন্যান্য যাবতীয় সর্বপ্রকার ফুট-ফরমাসই খেটে থাকে। বেশীর ভাগ সময় বেলা বোর্ডাররা অবশ্য যে যার হোটেলে গিয়েই আহারপর্বটা সেরে আসেন প্রত্যহ।

অন্নপূর্ণা হোটেলটির ব্যবস্থাও ভালই। দামেও সস্তা এবং সাধারণ ডাল ভাত তরকারি মাছের ঝোল এবং মধ্যে মধ্যে মাংসও পাওয়া যায়।

অন্নপূর্ণা হোটেলটি অনেক দিনকার। এবং তার সামনের অংশে ছোটখাটো একটা পার্টিশন তুলে ও গোটা দুতিন ভাঙা নড়বড়ে টেবিল ও চেয়ার বেঞ্চ পেতে রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থাও একটা আছে। অন্নপূর্ণা হোটেল রেস্তোরাঁ।

অন্নপূর্ণা হোটেল ও রেস্তোরাঁর মালিক একজন ঢাকার লোক।

ভদ্রলোকের নাম ভূপতিচরাণু চাটুয্যে। সরু প্যাঁকাটির মত রোগা ডিগডিগে এবং কালো কালির মত গায়ের রং।

দাড়িগোঁফ কামানো, তেল-চকচকে ভাঙা তোবড়ানো একখানা মুখ। পানের রস ও দোক্তার মেছেতা পড়া ইদুরের মত ছোট ছোট দুপাটি দাঁত। গরুর মত দিবারাত্রই প্রায় সর্বদা মুখে পানের জাবর কাটছেন।

লোকটি কিন্তু ভারি অমায়িক ও মিশুকে প্রকৃতির। খদ্দেরের সুখ-দুঃখ সুবিধা-অসুবিধা বেশ বোঝেন। হৃদয় আছে লোকটার। এবং সেইজন্যই পাড়াতে হোটেল বনাম রেস্তোরাঁটি চলেও বেশ ভালই।

সত্যশরণদের মেসবাড়ি অর্থাৎ দোতলায় ওঠবার সিঁড়িটার কাছেই নীচের বাঁধানো উঠানের মধ্যে পার্টিশন তুলে উপরের তলার অধিবাসীদের কলপায়খানার ব্যবস্থা হয়েছে। মোট কথা ওপরের তলার বাসিন্দাদের সঙ্গে নীচের তলার অর্থাৎ বাড়িওয়ালা ও তাঁর পরিবারবর্গের কোন সম্পর্কই নেই, যদি ওপরের ঘরের জানালা ও বারান্দা থেকে নীচের তলার পার্টিশনের অপর পার্শ্বের বাঁধানো উঠানের প্রায় সবটাই এবং ঘরের সামনেকার বারান্দার কিছুটা অংশ চোখে পড়ে।

নীচের তলায় থাকেন সবটাই নিয়ে বাড়ির মালিক কবিরাজ শ্রীশশিশেখর ভিষগরত্ন সপরিবারে। শান্ত নির্বিরোধী ভদ্রলোক শশিশেখর ভিষগরত্ন।

কালো আলকাতরার মত গাত্রবর্ণ। মেদবহুল থলথলে চেহারা। পিঠ ও বুকভর্তি ঘন কুঞ্চিত রোমচর্যে মনে হয় যেন একটি অতিকায় রোমশ ভাল্লক। বিশেষ করে যখন তিনি বাইরের ঘরের তক্তপোশের ওপরে বিস্তৃত মলিন ফরাসের ওপরে বসে থাকেন একটি থেলো হুঁকো হাতে নিয়ে।

দাড়ি-গোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। মাথায় তৈলসিক্ত বাবরি চুল। কপালে আঁকা সর্বদাই একটি রক্তসিন্দরের বিপন্দ্রক। মুলোর মত সাদা ঝকঝুঁকে দন্তপাটি হাসতে গেলেই শুধু, যে বিকশিত হয়ে পড়ে তাই নয়, সেই সঙ্গে অতিরিক্ত তাম্রকট সেবনে অভ্যস্ত কালচে বর্ণের মাড়িটিও যেন খিঁচিয়ে ওঠে। তাতেই হাসিটা বিশ্রী কুৎসিত দেখায় আরো। কুৎসিত সেই হাসি শশিশেখরের পর কালচে ওঠপ্রান্তে যেন লেগেই আছে। কথায় কথায়ই তিনি হাসেন সেই কুৎসিত হাসি। তবে সশব্দ নয়, নিঃশব্দ। এবং কথা বলেন অত্যন্ত কম। স্বল্পভাষী। শশিশেখরকে কেউ বড় একটা কথা বলতেই দেখে না। ভদ্রলোকের সংসারে স্ত্রী যাকে কখনো বড় একটা দেখাই যায় না এবং গলাও যার বড় একটা শোনাই যায় না, মুখের উপরে সর্বদাই দীর্ঘ একটি অবগুণ্ঠন টানা। বাড়ির বাইরেও বড় একটা তাকে দেখা যায় না।

এবং একটি ছেলে অনিলশেখর, বয়স বাইশ-তেইশ হবে। আর একটি মেয়ে অমলা, বয়স বছর উনিশ-কুড়ির বেশী হবে না।

কি চেহারায় বা গাত্রবর্ণে কবিরাজ মশায়ের সঙ্গে তার ছেলে ও মেয়ে অনিলশেখর বা অমলার যেন কোন সৌসাদৃশ্যই নেই।

অনিলশেখর ও অমলার রূপ যেন ঝলমল করে। যেমনই সুঠাম সুন্দর চেহারা তেমনই উজ্জল গৌর গাত্রবর্ণ।

সংসারে আরো একটি প্রাণী আছে। কবিরাজ মশাইয়ের দুরসম্পর্কীয় ভাগ্নে দ্বিজপদ।

ছেলেটির বয়স তেইশ-চব্বিশের মধ্যেই। দ্বিজপদই কবিরাজ মশাইয়ের কম্পাউণ্ডার বা অ্যাসিস্টেন্ট। নীচের তলার তিনখানি ঘরের মধ্যে বাইরের প্রশস্ত ঘরটিতেই কবিরাজ মশাইয়ের রোগী দেখা হতে শুরু করে ডিসপেনসারীর, ঔষধের কারখানা এবং দ্বিজপদর থাকা-শোয়ার সব কিছু ব্যবস্থা।

ঘরের ২/৩ ও ১/৩ অংশের মধ্যে একটি কাঠের ফ্রেমে চটের পার্টিশন বসানো।

পার্টিশনের একদিকে খানচারেক পুরানো সেকেলে সেগুন কাঠের তৈরি ভারী বার্নিশ ওঠা আলমারি। তার মধ্যে তাকের উপরে সাজানো ছোট বড় মাঝারি নানা আকারের শিশি, বোতল, বয়ম, জার—নানাবিধ কবিরাজী তৈল, ভস্ম, গুলি, বটিচর্ণ প্রভৃতি ঔষধে ভর্তি।

সামনাসামনি বড় বড় দুটি তক্তপোশ, পাশাপাশি জোড়া দিয়ে উপরে একটি তৈল-চিটচিটে মলিন ফরাস বিছানো এবং তদুপরি অনুরুপ চারটি তাকিয়া।

শশিশেখর ভিষগরত্ন ঐ চৌকির ওপরে উপবিষ্ট অবস্থাতেই রোগীদের দেখা ও তাদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা চালান। একপাশে একটি বেঞ্চ পেতে রঙিন পুরাতন একটি শাড়ি দড়ির সাহায্যে টাঙিয়ে আড়াল তুলে

স্ত্রীরোগীদের দেখবারও ব্যবস্থা আছে।

বাড়িটার উপরের তলাটা ভাড়া দিয়ে, কবিরাজী ব্যবসা করে, নিজস্ব তৈরি পেটেন্ট দ্রাক্ষারিষ্ট, মহাবলচূর্ণ, অক্ষয় অমৃত সঞ্জীবনী সুধা, পারিজাত মোদক, মুক্তাভস্ম, মহাশান্তি বৃহৎ বনরাজী তৈল, ব্যাঘ্রাবল রসবটিকা, নয়নরঞ্জন সুর্মা ইত্যাদি সব বিক্রয় করে কবিরাজ মশায়ের যে বেশ দুপয়সা উপার্জন হয় সেটা তাঁর সচ্ছল অবস্থা দেখলেই অনুমান করতে একটুও কষ্ট হয় না। প্রতি মাসে ২রা তারিখে একটিবার করে সকালে কবিরাজ মশাইয়ের কাষ্ঠপাদুকার খটখট শব্দ উপরে ওঠবার সিঁড়ির মুখে ধ্বনিত হয়ে ওঠে।

বোর্ডারদের সামনে এসে একের পর এক দাঁড়ান দন্ত ও মাড়িযোগে নিঃশব্দ কুৎসিত তাঁর সেই পেটেন্ট হাসিটি নিয়ে।

দেহরোম ও মেদবাহুল্যের জন্যই বোধ হয় কবিরাজ মশাইয়ের গ্রীষ্মবোধটা একটু বেশিই। শীত গ্রীষ্মে কোন প্রভেদ নেই। কবিরাজ মশাই তন্ত্রমতে কালীসাধক।

কপালের রক্তসিন্দূরের ত্রিপুন্ড্রকটিই তার পরিচয়।

মাথার ঘন বাবরি চুল হতে উগ্র কটু একটা কবিরাজী তেলের গন্ধ কবিরাজ মশাই সামনে এসে দাঁড়ালেই যেন ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে জ্বালা ধরিয়ে দেয়।

গা পাক দিয়ে ওঠে, বমনোদ্রেক আনে।

কবিরাজ মশাই বলেন, তেলটি তাঁরই নিজস্ব আবিষ্কার। মহাশক্তি-দায়িনী বৃহৎ বনরাজী তৈল। মস্তিষ্ক শান্ত ও শীতল রাখার অব্যর্থ মহৌষধি।

উপরে এসে একটিমাত্র কথাই বলেন কবিরাজ মশাই, গরীব ব্রাহ্মণকে দয়া করুন।

ভাড়াটে ও বাড়িওয়ালা পরস্পরের মধ্যে মাসাতে একটিবার মাত্র ও ঐ একটি কথারই আদান-প্রদান ছাড়া আর কোন সম্পর্কই নেই।

ঘরভাড়া অবশ্য যে যার সকলেই চুকিয়ে দেন চাওয়া মাত্রই।

বলতে গেলে উপরের তলার অধিবাসীরা প্রতি মাসের দুই তারিখের ঐ সময়টির জন্য যেন পূর্ব হতে প্রস্তুতই হয়ে থাকেন।

 ৩. দিন পনের হলো

দিন পনের হলো কিরীটী এই বাড়ীতে এসেছে এবং ইতিমধ্যেই সকলের সঙ্গেই অল্পবিস্তর আলাপ-পরিচয়ও হয়ে গিয়েছে। সত্যশরণকে বাদ দিয়ে অন্যান্য বাদবাকি পাঁচজন সহবোর্ডারদের মধ্যে একমাত্র ইনসিওরেন্সের দালাল রজতবাবুই যেন কিরীটীর দৃষ্টি একটু বেশি আকর্ষণ করেছেন।

কিরীটীর ঘরের একপাশে থাকেন রজতবাবু ও অন্যপাশে সত্যশরণ।

রজতবাবুর বয়স যাই হোক না কেন, ৩০-৩১-এর বেশি নয় বলেই মনে হয়। রোগাটে ছিপছিপে গড়ন। উজ্জল শ্যাম গাত্রবর্ণ। চোখেমুখে বুদ্ধির একটা অদ্ভুত ধারালো তীক্ষ্ণদীপ্তি। চোখে সরু সোনার ফ্রেমে শৌখিন চশমা। ভদ্রলোকের বেশভূষাতেও সর্বদা একটা শৌখিন পরিচ্ছন্ন রুচির পরিচয় পাওয়া যায়। ইনসিওরেন্সের দালালীতে যে তাঁর অর্থাগমটা ভালই ভদ্রলোকের চাল-চলুন আচার-ব্যবহার ও রুচিবিলাস হতেই স্পষ্ট বোঝা যায়। হাতও বেশ দরাজ।

কারণ এই বাড়ির সহ-বোর্ডারদের প্রায়ই এটা ওটা পাঁচরকম দামী খাবার এনে খাওয়ান ও নিজেও খান এবং মধ্যে মধ্যে সিনেমা-থিয়েটারেও নিয়ে যান।

ভ্রাম্যমাণ দালাল, সেইজন্য মধ্যে মধ্যে দুচার-পাঁচদিনের জন্য এবং কখনোকখনো দশদিনের জন্য কলকাতার বাইরে বাইরে তাঁকে ঘুরে বেড়াতে হয়।

উপরের তলার অধিবাসীদের মধ্যে একমাত্র রজতবাবুরই নীচে কবিরাজ মশাইয়ের বহিঃ ও অন্দরমহলে যে যাতায়াত আছে, প্রথম দুচারদিনেই কিরীটীর সেটা নজর এড়ায়নি। এবং রজতবাবুর নীচের তলার ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে উপরতলার : বোর্ডার সিনেমার গেটকীপার জীবনবাবুর দুচারটে অম্লমধুর রসালো মন্তব্য যে কিরীটীর সদাসতর্ক শ্রবণেন্দ্রিয়কে এড়িয়ে গিয়েছে তাও নয়। কিরীটী লক্ষ্য করেছিল নীচের তলাকার অধিবাসীদের মধ্যে কবিরাজ মশাইয়ের ছেলে ও মেয়ে অনিলশেখর ও অমলা উভয়ের সঙ্গেই রজত বাবুর কিঞ্চিৎ বেশ যেন আলাপ-পরিচয় আছে। কেবলমাত্র অবগুণ্ঠনের অন্তরালবর্তিনী, নিঃশব্দচারিণী কবিরাজের গৃহিণীর সঙ্গে আলাপ-পরিচয় আছে কিনা সেটা জানবার সুযোগ হয়নি কিরীটীর। কবিরাজ-গৃহিণীকে তো কখনোও বাইরে বের হতে দেখা যেত না, কারণ শোনা যায় কবিরাজ মশায়ই নাকি সেটা পছন্দ করেন না। তাঁকে নিজেকেও বড় একটা বাইরে বের হতে দেখা যায় না। বেশীর ভাগ সময় সকাল সাতটা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত ও দ্বিপ্রহর দুটো থেকে বেলা পাঁচটা পর্যন্ত ও সন্ধ্যা সাড়ে ছটা থেকে রাত্রি এগারটা প্রত্যহই এবং কোন কোন রাত্রে বারোটা সাড়ে বারোটা পর্যন্ত কবিরাজ মশাই বাইরের ঘরেই থাকেন। এবং তিনি যে আছেন সেটা মধ্যে মধ্যে একটিমাত্র তাঁর কণ্ঠনিঃসৃত শব্দে জানা যেতঃ মাগো করালবদনী নৃমুণ্ডমালিনী, সবই তোর ইচ্ছা মা

প্রায় সদা নিঃশব্দ লোকটির বজ্রগম্ভীর কণ্ঠ হতে ঐ করালবদনী মৃমুণ্ডমালিনী শব্দ দুটি যেন সমস্ত নীচের তলাটা গম গম করে তুলত।

কবিরাজ ও তস্য গৃহিণীকে বাড়ির বাইরে না দেখা গেলেও দ্বিজপদ, ঝি সুন্দরী ও কবিরাজের ছেলে অনিলশেখর ও মেয়ে অমলাকে প্রায়ই আসতে যেতে দেখা যেত।

তাদের চেহারা চালচলন বেশভূষা কোনটারই যেন কোন সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যেত না কবিরাজের সংস্কৃতির সঙ্গে।

পরিচ্ছন্ন ছিমছাম বেশভূষা উভয়েরই।

অনিলশেখর বি. এ. ক্লাসের চতুর্থ বার্ষিকীর ছাত্র এবং মেয়ে অমলা আই. এ. ক্লাসের ছাত্রী।

একদিন সন্ধ্যার দিকে নিত্যকারের মত সাধ্যভ্রমণে বের হয়ে গলির মুখে নিম্নকণ্ঠে ঘনিষ্ঠভাবে আলোচনারত অমলা ও রজতবাবুকে দেখে কিরীটী বুঝতে পেরেছিল রজতবাবুর নীচের তলায় সত্যকারের আকর্ষণটি কোনখানে।

কিন্তু ন্যায়রত্ন লেনের উপর ও নীচের তলার অধিবাসীদের লক্ষ্য করার চাইতেও যে উদ্দেশ্যে কিরীটী খুঁজে পেতে কষ্ট করে ঐ অঞ্চলে এসে ডেরা বেধেছিল, কিরীটীর চিন্তাধারাটা বেশির ভাগ সময় বিক্ষিপ্ত ভাবে তারই মধ্যে আবদ্ধ থাকত বলাই বাহুল্য।

দিন পনের গত হয়ে গেল কিন্তু এখনো পর্যন্ত বিশেষ কোন কিছুই ঐ অঞ্চলের কিরীটীর অনুসন্ধিৎসু মনকে নাড়া দিতে পারেনি।

তবু তার সতর্কতার অভাব ছিল না। বাইরে থেকে বেকার শান্তশিষ্ট ও একান্ত নির্লিপ্ত তাকে মনে হলেও ভিতরে ভিতরে তার তীক্ষ্ণ শ্রবণ-মননশক্তি চারিদিকেই সমভাবে প্রক্ষিপ্ত হয়ে থাকত।

সকালে ও দ্বিপ্রহরে কিরীটী নিজের ঘর থেকে বড় একটা বেরই হত না। বের হত একেবারে সন্ধ্যা সাতটার পর। এবং রাত বারোটা, কখনো কখনো বা একটা দেড়টা পর্যন্ত আশেপাশে সমস্ত অঞ্চলটার পথে গলিতে সদাসতর্ক দৃষ্টিতে, অথচ বাইরে নির্লিপ্ত পথিকের মত ঘুরে ঘুরে বেড়াত।

এমনি করেই দিন চলছিল।

সহসা এমন সময় একদিন শান্তস্থির পুষ্করিণীর জলরাশিতে ছোট্ট একটি লোস্ট্রাঘাতে যেমন তরঙ্গ জাগে এবং ক্রমে সেই চক্রাকারে ক্রমবিস্তৃতমান তরঙ্গচক্র তটপ্রান্তে আছড়ে পড়ে শব্দ তোলে, ঠিক সেইভাবেই ব্যাপারটা শব্দায়িত হয়ে উঠলো আচমকা।

বিকেল চারটে হবে।

উপরের তলার সেমি-মেসের বোর্ডাররা কেউই তখন অফিস ও কর্মস্থল থেকে ফেরেন নি, একমাত্র রজতবাবু ব্যতীত। অবশ্য কিরীটী তার ঘরে নিত্যকারের মত দরজাটা ভেজিয়ে ঐদিনকার বহুবার পঠিত সংবাদপত্রটাই আবার উল্টে-পাল্টে দেখছিল।

রজতবাবু, দিন চারেক ছিলেন না মেসে। ঐদিন সকালের দিকে পাটনা থেকে ফিরেছেন টুর সেরে।

গুনগুন করে সর্বদাই প্রায় যতক্ষণ রজতবাবু তাঁর ঘরে থাকেন, গান করা তাঁর একটা অভ্যাস। এবং কিরীটী পাশের ঘর থেকে তাঁর সেই গুনগুনানি শুনেই বুঝতে পেরেছিল রজতবাবু, তাঁর ঘরেই আছেন। আর মাত্র মিনিট কুড়ি আগে যে রজতবাবু, নীচে নেমেছিলেন তাঁর জুতোর শব্দেই বুঝতে পেরেছিল কিরীটী।

হঠাৎ নীচের তলা থেকে, বলতে গেলে এখানে আসবার পর এই প্রথম কিরীটী ভিষগরত্নের নাতি-উচ্চ কর্কশ কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে সত্যিই চমকে ওঠে।

ভদ্রলোক! জেন্টেলম্যান! ঢের ঢের দেখা আছে আমার। ফের এ-বাড়িমুখো হয়েছে কি ঠ্যাং ভেঙে খোঁড়া করে দেবো জন্মের মতো। বেরোও! বেরিয়ে যাও!

কৌতূহলে কিরীটীর শ্রবণেন্দ্রিয় সজাগ ও উৎকর্ণ হয়ে ওঠে।

কবিরাজের চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় রজতবাবুর মেয়েলী ঢংয়ের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, আপনি বা অত চেচাচ্ছেন কেন বলুন তো মশাই! বিবাহ করবো তো আমি, আর বিবাহটা হবে অমলার সঙ্গে আপনি তো অবান্তর তৃতীয় পক্ষ।

বাঘের মতই যেন ভিষগরত্ন এবারে গর্জে উঠলেন, কি কি বললি বেটা! আমি তার জন্মদাতা বাপ, আমি তৃতীয় পক্ষ! আর তুই কোথাকার এক ভবঘুরে ইনসিওরেন্সের দালাল, তুই হলি প্রথম পক্ষ! বেরো। বেরো এখান থেকে

বেরিয়ে আমি নিশ্চয়ই যাবো। মনে রাখবেন কেবল স্রেফ ভদ্রতার খাতিরেই কথাটা বলতে এসেছিলাম, নচেৎ মেয়েও আপনার সাবালিকা এখন। এ বিয়ে আপনি চেষ্টা করলেও আটকাতে পারবেন না।

রজতবাবুর বক্তব্য শেষ হতে না হতেই ভিষগরত্নের কণ্ঠ আবার শোনা গেল, কালই তুই আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যাবি। নইলে তোর মত কুকুরদের কেমন করে শায়েস্তা করতে হয় তা আমি জানি। বেটা নচ্ছার পাজী ছুঁচো

থামুন থামুন-অত চেচাবেন না, হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেবো মশাই!

ওঃ, অথ বিবাহঘটিত! প্রেম-প্রাণ দেওয়া-নেওয়া ব্যাপার!

সেই চিরপুরাতন অথচ চিরনতুন পঞ্চশরের ফুলবাণ পর্ব!

হায় হায় সন্ন্যাসী! কি করছো তুমি পঞ্চশরের ভস্মরাশি বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়ে জানতে যদি! কিন্তু এ যে বেশ গুরুতর ব্যাপার!

প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ে, বিবাহটা শেষ পর্যন্ত যদি ঘটে যায়ই, ভদ্রলোক শৌখিন রজতবাবুর পক্ষে তাঁর রোমশ ভল্লুকাকৃতি কবিরাজ শ্বশুরমশাইটির তো একেবারে বদহজম ঘটাবে!

নাঃ, আজকালকার আধুনিক মতিগতির ছেলেমেয়েরা বড় বেশী যেন দুঃসাহসী হয়ে উঠেছে।

আবার রজতবাবুর কণ্ঠস্বর কিরীটীর কানে এলো, শুনুন মশাই, ভালর জন্যই বলছি, বেশী ঘাঁটাঘাঁটি করবেন না এ নিয়ে। অমলাকে আমি বিবাহ করবোই, আপনার পিতৃত্বের পেনাল-কোডের আইন-কানুন ধোপে টিকবে না। মিথ্যে মিথ্যে কেন ঝামেলা করছেন! ভালয় ভালয় রাজী হয়ে যান। ভদ্রভাবে ব্যাপারটা চুকেচুকে যাক, all expense আমার I promise!

কে তোমার promise চায় হে ছোকরা! দ্বিজপদ, আমার লাঠিটা দাও তো–কবিরাজ মশাই হাঁক দিলেন।

পূজ্যপাদ ভাবী শ্বশুরের লাঠি! ভাবী পত্নীর পুজনীয় পিতৃদেব হলেও এযুগের আধুনিক হবু জামাইয়ের বোধ হয় আর সাহসে কুলায় না। সবেগে প্রস্থান করলেন। বেচারী রজতবাবু!

এমনিতে বাইরে শৌখিন প্রকৃতির ও নিরীহ শান্তশিষ্ট দেখতে হলে হবে কি, রজতবাবু, ভদ্রলোকটিকে তো কিরীটীর মনে হচ্ছে এখন বেশ করিতকর্মাই।

ইতিমধ্যে একসময় কখন এক ফাঁকে দিব্বি সুন্দরী কবিরাজ-নন্দিনীর মনোরঞ্জন করে বসে আছেন এবং স্বয়ং পিতৃদেব হয়েও ভিষগরত্ন ব্যাপারুটির বিন্দুবিসর্গ টের পাননি।

কিরীটী সংবাদপত্রে আর মনোনিবেশ করতে পারে না।

এবং একটু পরেই রজতবাবুর পদশব্দ সিঁড়িতে আবার শোনা গেল।

কিরীটী বুঝতে পারে রজতবাবু, তাঁর ঘরে এসে প্রবেশ করলেন এবং আবার সঙ্গে সঙ্গে পদশব্দে বোঝা গেল বাইরে বের হয়ে গেলেন।

সেই যে রজতবাবু, গেলেন, দিন দুই আর ফিরলেন না মেসে।

কিন্তু আশ্চর্য, উক্ত ব্যাপার নিয়ে সেই দিন বা তার পরের দিনও নীচে ভিষগরত্নের অন্দরমহলে কোনপ্রকার সাড়া-শব্দ পাওয়া গেল না!

এমন কি পরের দিন দ্বিপ্রহরের দিকে কিরীটীকে একটু বের হতে হয়েছিল, ফিরবার পথে গলির মাথায় অমলার সঙ্গে চোখাচোখিও হয়ে গেল। সঙ্গে তার এক সহপাঠিনী বা বান্ধবী বোধ হয় ছিল। পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলতে বলতে কবিরাজ-গৃহের দিকেই আসছিল।

রজতবাবু, ফিরে এলেন দিন দুই পরে দ্বিপ্রহরে।

জ্যৈষ্ঠের শেষ। প্রখর রৌদ্রুতপ্ত দ্বিপ্রহরে আকাশটা যেন একটা তামার টাটের মত পুড়ে ঝাঁঝাঁ করছে। বাতাসে যেন আগুনের উগ্র একটা বিশ্রী ঝাঁজ।

দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে কিরীটী একটা টেবিলফ্যান চালিয়ে একজোড়া তাস নিয়ে পেসেন্স খেলছিল বাইরে থেকে রজতবাবুর গলা শোনা গেল।

ভিতরে আসতে পারি কিরীটীবাবু! আরে কে ও, রজতবাবু যে! আসুন আসুন।

দরজা ঠেলে রজতবাবু এসে কিরীটীর ঘরে প্রবেশ করলেন।

বেশভূষা যেন সামান্য একটু মলিন, মাথার চুল অযত্ন-বিন্যস্ত, মুখখানি কিন্তু বেশ প্রফুল্লই মনে হল।

হঠাৎ রজতবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে কেন যেন কিরীটীর মনে হয়, মাত্র এই দুই দিনেই ভদ্রলোকের বয়সটা যেন হু হু করে বেড়ে গিয়ে গালে ও কপালে বয়সের রেখা পড়েছে।

বসুন বসুন—তারপর কি খবর রজতবাবু? এ দুদিন ছিলেন কোথায়?

চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসতে বসতে ক্লান্ত অবসন্ন কণ্ঠে রজতবাবু বললেন, একটু কাজে গিয়েছিলাম বর্ধমানে।

কিরীটী উঠে টেবিলফ্যানটা একটু ঘুরিয়ে দিল রজতবাবুর দিকে। বললে, ইনসিওরেন্সের ব্যাপারে বোধ হয়?

না। দাদামশাইয়ের একটা বাড়ি আছে বর্ধমানে। মা যতদিন বেঁচে ছিলেন ঐখানেই তো ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর থেকে বাড়িটা তালা দেওয়াই পড়েছিল। কথাগুলো বলে একটু থেমে আবার বলতে লাগলেন, কলকাতায় আর নয়। ভাবছি, এবার সেখানে গিয়েই থাকবো।

কাজকর্মের আপনার অসুবিধা হবে না কলকাতা ছেড়ে গেলে?

মশাই। কলকাতা শহর তো নয় যেন একটা বাজার। ঘেন্না ধরে গিয়েছে আপনাদের এই ধুলো বালি ধোঁয়া আর ছত্রিশ জাতের মানুষের ভিড়ের কলকাতা শহরের ওপরে। মানুষ থাকে এখানে!

কিরীটী আজকে রজতবাবুর কথাগুলো শুনে যেন বেশ একটু অবাক হয়। কারণ কয়েকদিন আগেও রজতবাবুকে কিরীটী বলতে শুনেছে, ছোঃ ছোঃ আপনাদের গ্রাম্যজীবন আর সুবার্ব মাথায় থাক আমার! বেঁচে থাক আমার এ কলকাতা শহর। কথাটা বলছিলেন রজতবাবু সিনেমার গেটকীপার জীবনবাবুকে। আজকাল মানুষের সেরা তীর্থস্থান হল কলকাতা আর বোম্বাই—এই দুটি শহর, বুঝলেন মশাই!

কিন্তু কিরীটী মুখে জবাব দেয়, তা যা বলেছেন।

হঠাৎ পরক্ষণেই রজতবাবু, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, আচ্ছা চলি মশাই। দক্ষিণ পাড়ায় একটা জরুরী কাজ আছে, সেরে আসি।

রজতবাবু আর দাঁড়ালেন না। বের হয়ে গেলেন। হঠাৎ যেমন এসেছিলেন তেমনি হঠাৎই যেন প্রস্থান করলেন।

কেনই বা এলেন আবার হঠাৎ কেনই বা চলে গেলেন কিরীটী যেন ঠিক বুঝতে পারে না।

বর্ধমানে গিয়েছিলেন এই সংবাদটুকুই মাত্র কিরীটীকে দেবার এমনই বা কি প্রয়োজন ছিল! না, ভদ্রলোকের আরো কিছু বলবার বা কিছু জানাবার ছিল কিরীটীর কাছে। অন্যমনস্ক ভাবে কিরীটী তাসগুলো হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে।

দ্বিপ্রহরের স্তব্ধ নির্জনতায় একটা ক্লান্ত রিকশার ঘণ্টির ঠং ঠং শব্দ নীচে গলির পথে ক্রমে ক্রমে মিলিয়ে গেল।

বাইরে বারান্দায় রেলিংয়ের ওপরে বসে একটা কাক কর্কশ স্বরে কা কা করে ডাকছে।

 ৪. রাত তখন প্রায় সাড়ে বারোটা

ঐদিনই রাত তখন প্রায় সাড়ে বারোটা হবে।

নিত্যনৈমিত্তিক রাতের টহল সেরে কিরীটী ন্যায়রত্ন লেনের বাসায় ফিরছিল। নিঝুম নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে পাড়াটা। গলির মুখে গ্যাসের বাতিটাও যেন স্তিমিত মধ্যরাত্রির ক্লান্ত রাতজাগা প্রহরীর মত একচক্ষু, মেলে পিট পিট করে তাকিয়ে আছে একান্ত নির্লিপ্ত ভাবে।

গলিপথের শেষ পর্যন্ত শেষ গ্যাসের আলোটি পর্যাপ্ত নয়। অস্পষ্ট ধোঁয়াটে একটা আলোছায়ায় যেন রহস্য ঘনিয়ে উঠেছে গলিপথের শেষপ্রান্তে।

মধ্যগ্রীষ্ম রাতের আকাশের যে অংশটুকু মাথা তুলে উপরের দিকে তাকালে চোখে পড়ে সেখানে শুধু, ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত কয়েকটি ঝকঝকে তারা।

অন্যমনস্ক ভাবে শ্লথ পায়ে কিরীটী ফিরছিল। হঠাৎ থমকে দাঁড়াল কিরীটী। গলিপথের শেষ প্রান্তের প্রায় সমস্তটাই জড়ে একটা কালো রঙের সিডন বডি গাড়ির পশ্চাৎ দিকের অংশটা যেন সামনের শেষ পথটুকুর সবটাই প্রায় রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে।

আবছা আলো-আঁধারিতে গাড়ির পেছনের প্রজলিত লাল আলোটা যেন শয়তানের রক্তচক্ষুর মত ধকধক করে জ্বলছে।

এবং পথের মাঝখানে হঠাৎ দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গেই যেন কিরীটীর অন্যমনস্ক নিষ্ক্রিয়তাটা কেটে যায়।

সমস্ত ইন্দ্রিয় তার সজাগ ও সক্রিয় হয়ে ওঠে মুহূর্তে।

এই পরিচিত অপ্রশস্ত গলির মধ্যে এত রাত্রে অত বড় চকচকে গাড়িতে চেপে কার আবার আবির্ভাব ঘটলো!

সঙ্গে সঙ্গে কিরীটীর মনে পড়ে, ইতিপূর্বে আরো দুদিন এই গলিপথেই কোন গাড়ি ঠিক আসতে বা যেতে তার নজরে না পড়লেও গাড়ির টায়ারের কাদা-মাখা ছাপ তার চোখে পড়েছে।

তবে হয়ত এই গাড়িরই টায়ারের ছাপ ও দেখেছে! গাড়ির পিছনের নাম্বার প্লেটটার দিকে ও তাকাল।

W. B. B. 6690।

আবছা আলো-অন্ধকারেও গাড়ির কালো মসৃণ বডিটা চকচক করছে।

হঠাৎ কিরীটী আবার সর্তক হয়ে ওঠে গাড়ির দরজা খোলা ও বন্ধ করার শব্দে।

তারপরই কানে এলো দুটি কথা। আচ্ছা, তাহলে ঐ কথাই রইল। একটি চাপা পুরুষ-কণ্ঠ। দ্বিতীয় কণ্ঠটি কোন নারীর হলেও কথাগুলো স্পষ্ট শোনা গেল না। সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিনের শব্দ শোনা যায়। গাড়িটা ব্যাক করছে।

দ্রুতপদে কিরীটী পিছিয়ে গিয়ে ঐ গলির মধ্যেই বাড়ির মধ্যবতী সরু অন্ধকার প্যাসেজটার মধ্যে আত্মগোপন করে দাঁড়াল।

গাড়িটা ধীরে ধীরে ব্যাক করে গলিপথ থেকে বের হয়ে গেল। দামী গাড়ি, ইঞ্জিনের বিশেষ কোন শব্দই শোনা গেল না।

আরো চার-পাঁচ মিনিট বাদে কিরীটী আবার অগ্রসর হল বাসার দিকে অন্যমনস্কভাবে ভাবতে ভাবতে।

এবং একটু এগিয়ে যেতেই তার নজরে পড়লো নীচের তলায় কবিরাজ মশাইয়ের বাইরের ঘরের খোলা জানালাপথে তখনও আসছে আলোর একটা আভাস।

সদর দরজাটা বন্ধ কিন্তু গলির দিককার জানালা খোলা।

হঠাৎ কৌতুহলকে দমন করতে না পেরে কিছুমাত্র দ্বিধা না করে সতক পদসঞ্চারে শিকারী বিড়ালের মত পা টিপে টিপে আলোকিত বাইরের ঘরের জানালাটার সামনে এগিয়ে গেল কিরীটী।

জানালার নীচের পাট বন্ধ, উপরের পাটটা খোলা।

রাস্তা থেকে জানালা এমন কিছু উঁচু নয়, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তাকালেই ভিতরের সব কিছু সহজেই নজরে পড়ে।

জানালার কোণ ঘেষে দাঁড়িয়ে ত্যারচাভাবে কিরীটী আলোকিত কক্ষমধ্যে দৃষ্টিপাত করল। রোমশ ভল্লকের মত উদলো গায়ে জোড়াসন হয়ে কবিরাজ ভিষগরত্ন ফরাসের উপরে বসে আছেন।

আর তাঁর অদূরে ঘরের মধ্যেকার পার্টিশনের পর্দাটা তুলে দাঁড়িয়ে আছেন চিত্রাপিতের মত অপরূপ লাবণ্যময়ী এক নারী। বয়স কিছুতেই ত্রিশ-বত্রিশের বেশী হবে না বলেই মনে হয়।

পরিধানে ধবধবে সাদা কালো চওড়া শান্তিপুরী শাড়ি। মাথার অবগুণ্ঠন খসে কাঁধের উপরে এসে পড়েছে।

গলার চকচকে সোনার হারের কিয়দংশ দেখা যায়। হাতে সোনার চুড়ি। কপালে দুই টানা বঙ্কিম সুর ঠিক মধ্যস্থলে একটি সিন্দূরের টিপ, কিন্তু ঐ সামান্য বেশভূষাতেও তার রূপ যেন ছাপিয়ে যাচ্ছে।

কোন মানুষ নয়, যেন পটে আঁকা নিখুত একখানি চিত্র। মুগ্ধ কিরীটীর দুচোখের দৃষ্টি যেন বোবা স্থির হয়ে থাকে।

হঠাৎ চাপাকণ্ঠে সেই নারীচিত্র যেন কথা বলে উঠলো, যথেষ্ট তো হয়েছে, আর কেন! এবারে ক্ষমা দাও।

নিঃশব্দ কুৎসিত হাসিতে ভল্লুকসদৃশ ভিষগরত্নের মুখখানা যেন আরো বীভৎস হয়ে উঠলো মুহর্তে। কেবল একটি কথা সেই নিঃশব্দ কুৎসিত হাসির মধ্যে শোনা গেল, পাগল!

আচ্ছা তুমি কি! শয়তান না মানুষ!

আবার সেই কুৎসিত নিঃশব্দ হাসি ও সেই পুর্বোচ্চারিত একটিমাত্র শব্দ, পাগলী!

ছিঃ ছিঃ, গলায় দড়ি জোটে না তোমার!

দুঃসহ ঘৃণা ও লজ্জায় যেন ছিঃ ছিঃ শব্দ দুটি নারীকণ্ঠ হতে উচ্চারিত হল।

এবারে আর প্রত্যুত্তরে হাসি নয়। সেই পরিচিত দুটি কথা। মাগো! করালবদনী নৃমুণ্ডমালিনী সবই তোর ইচ্ছা মা

কবিরাজ মশাইয়ের কণ্ঠস্বর আবার শোনা গেল, যাও। যাও-ভিতরে যাও। পাগলামি করো না, আমার পূজার সময় হল।

এরপর আর ভদ্রমহিলা, দাঁড়ালেন না। কেবলমাত্র তীব্র তীক্ষ্ণ একটা কটাক্ষ হেনে মাথায় ঘোমটাটা তুলে দিয়ে নিঃশব্দে অন্দরেই বোধ হয় প্রস্থান করলেন। এবং যাবার সময় তাঁর দুচোখের দৃষ্টিটা যেন মুহূর্তের জন্য ধারালো ছুরির ফলার মত ঝিকিয়ে উঠলো বলে কিরীটীর মনে হলো।

ভিষগরত্ন মহিলাটির গমনপথের দিকে বারেকমাত্র তাকিয়ে আবার সেই নিঃশব্দ কুৎসিত হাসি হাসলেন দন্তপাটি বিকশিত করে। এবং নিম্নকণ্ঠে বললেন, মাগো করালবদনী নৃমুণ্ডমালিনী!

ভদ্রমহিলাটি কে? ইতিপূর্বে কিরীটী ওঁকে কখনও দেখেনি।

তবে কি উনিই কবিরাজ মশাইয়ের সেই অন্তঃপুরচারিণী সদা-অবগুণ্ঠনবতী সহধর্মিণী! কিন্তু যদি তাই হয়, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে খুব একটা প্রীতির সম্পর্ক আছে বলে তো মনে হল না কিরীটীর, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ক্ষণপূর্বের কথাগুলো শুনে!

আর অতবুড় চকচকে গাড়ি হাঁকিয়েই বা এই গভীর রাত্রে কে এসেছিল কবিরাজগৃহে!

দিনের বেলায় তো কখনো কাউকে অতবড় গাড়ি হাঁকিয়ে কবিরাজ-ভবনে কিরীটী আসতে দেখেনি আজ পর্যন্ত। এবং যেই হোক আগন্তুক, তাকে গাড়িতে বিদায় দিতে গিয়েছিল নিশ্চয়ই ঐ মহিলাই। কবিরাজ মশাই যাননি।

তিনি ঘরের মধ্যেই ছিলেন।

অনেক রাত পর্যন্ত কিরীটীর মাথায় ঐ চিন্তাগুলোই ঘোরাফেরা করতে থাকে বারংবার। কে ঐ মহিলা!

আর কেই বা সেই আগন্তুক নিশীথ রাত্রে গাড়ি হাঁকিয়ে এসেছিলেন কবিরাজ-ভবনে!

কিরীটী এই কয়দিনে পাড়ার দুচারজনের কাছ থেকে ও অন্নপূর্ণা রেস্তোরাঁয় চায়ের কাপ নিয়ে বসে বসে কবিরাজ মশাইয়ের সম্পর্কে যে সংবাদটকু আজ পর্যন্ত সংগ্রহ করতে পেরেছে তাতে করে এইটাই বোঝা যায় যে ভিষগরত্ন লোকটি মন্দ নয়। নির্বিবাদী, শান্তশিষ্ট ভদ্রলোক; পাড়ায় কারো সঙ্গে কোন ঝগড়া-বিবাদ নেই। কারো সাতেও নেই পাঁচেও নেই। নিজের কবিরাজী ব্যবসা ও ঔষধপত্র নিয়েই সর্বদা ব্যস্ত।

মিতভাষী কবিরাজ মশাই পাড়ার কারো সঙ্গেই বড় একটা মেশামেশি করেন না। যদিও তাঁর পুত্রকন্যার সঙ্গে অনেকেরই আলাপ-পরিচয় আছে পাড়ার মধ্যে।

কবিরাজ মশাইয়ের কথা ভাবতে ভাবতে নতুন করে আবার কিরীটীর অনিলবাবুর কথা মনে পড়ে।

কিরীটীর ঘরেই ভদ্রলোক ছিলেন।

ঐ মধ্যরাত্রির শান্ত নিস্তব্ধতায় একাকী ঐ ঘরের মধ্যে অদ্ভুত একটা অনুভূতি যেন কিরীটীর মনকে অক্টোপাশের ক্লেদাক্ত অষ্টবাহুর মত চারপাশ থেকে জড়িয়ে ধরতে থাকে।

মাত্র মাস দেড়েক আগে হঠাৎ একদিন প্রত্যুষে তাঁকে এ ঘরে আর দেখা গেল না এবং পরে তাঁর মৃতদেহ আবিষ্কৃত হল শ্যামবাজার ট্রাম ডিপোর পিছনের রাস্তায়। ভদ্রলোকের প্রেম ছিল একটি তরুণীর সঙ্গে।

বাগনান গার্লস স্কুলের একজন শিক্ষয়িত্ৰী। নাম বিনতা দেবী।

আচ্ছা, ভদ্রমহিলা অনিলবাবুর আজ পর্যন্ত কোন খোঁজখবর নিলেন না কেন?

হঠাৎ মনে হয় কিরীটীর, বাগনানে গিয়ে বিনতা দেবীর সঙ্গে একটিবার দেখা করলে কেমন হয়!

কথাটা মনে হবার সঙ্গে সঙ্গেই কিরীটী ঠিক করে ফেলে, কাল সকালে উঠেই সোজা সে একবার বাগনানে যাবে সর্বপ্রথম।

দেখা করবে সে বিনতা দেবীর সঙ্গে একবার।

সত্যি সত্যি পরের দিন সকালে উঠে কিরীটী সোজা হাওড়া স্টেশনে গিয়ে গোমো প্যাসেঞ্জারে উঠে বসল বাগনানের একটা টিকিট কেটে। বেলা সাড়ে নয়ট নাগাদ কিরীটী বাগনান স্টেশনে এসে নামল।

গালর্স স্কুলটির নাম বিদ্যার্থী মণ্ডল। এবং স্কুলটা স্টেশন থেকে মাইলখানেক দুরে ছোট্ট শহরের মধ্যেই।

ভাঙাচোরা কাঁচা মিউনিসিপ্যালিটির সড়কটি বোধ হয় শহরের প্রবেশের একমাত্র রাস্তা।

লোকজনকে জিজ্ঞাসা করতে করতে বেলা এগারটা নাগাদ কিরীটী স্কুলে গিয়ে পৌছাল।

এম. ই. স্কুল।

ছোট একতলা একটা বাড়ি। শতখানেক ছাত্রী হবে।

স্কুল তখন বসেছে। অফিস-ঘরে গিয়ে ঢুকল কিরীটী।

চোখে পুরু কাঁচের চশমা সুতা দিয়ে মাথার সঙ্গে পেচিয়ে বাঁধা, মাথায় টাক এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক একটা ভাঙা চেয়ারের উপর বসে টেবিলের ওপরে ঝুঁকে একটা মোটা বাঁধানো খাতায় কি যেন একমনে লিখছিলেন। সামনে আরো খান-দুই ভাঙা চেয়ার ও একটা নড়বড়ে ভাঙা বেঞ্চ।

ও মশাই শুনছেন! কিরীটী এগিয়ে গিয়ে ডাকে।

ভদ্রলোক মুখ তুলে তাকালেন পর লেন্সের ওধার থেকে।

ভদ্রলোক একটু বেশ কানে খাটো, কিরীটীর গলার শব্দটাই কেবল বোধ হয় গোচরীভূত হয়েছিল, বললেন, বগলাবাবু চলে গেছেন।

বগলাবাবু! বগলাবাবু, আবার কে?

কী বললেন, কাকে?

বলছি শুনছেন, কিরীটী এবারে কানের কাছে এসে একটু গলা উচিয়েই বলে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে স্মিতহাস্যে।

ভদ্রলোকও বোধ হয় এবারে শুনতে পান।

বললেন, কি বলছেন?

বিনতা দেবী বলে কোন শিক্ষয়িত্ৰী আপনাদের স্কুলে আছেন?

আছেন। কি প্রয়োজন?

প্রয়োজন আমার তাঁরই সঙ্গে।

তাহলে বসুন, এখন তিনি ক্লাসে। টিফিনে দেখা হবে।

টিফিন কখন হবে?

ঠিক একটায়। বলেই ভদ্রলোক আবার নিজ কাজে মনোনিবেশ করলেন।

অগত্যা কী আর করা যায়, কিরীটীকে বসতেই হল। একটা চেয়ার টেনে কিরীটী তার উপরে বসে আসিবার সময় স্টেশন থেকে কেনা ঐদিনকার সংবাদপত্রটা খুলে চোখ বুলাতে লাগল। সবে বেলা এগারটা। এখনো টিফিন হতে দুঘণ্টা দেরি!

খবরের কাগজটা খুলে বসলেও তার মধ্যে কিরীটী মন বসাতে পারছিল না।

বিনতা দেবীর কথাই সে ভাবছিল। হঠাৎ তো মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে এখানে চলে এলো!

ভদ্রমহিলা কোন টাইপের তাই বা কে জানে! তাকে কি ভাবে তিনি নেবেন তাও জানা নেই।

ভাল করে তিনি যদি কথাই না বলেন, কোন কথা না শুনেই যদি তাকে বিদায় দেন।

কিন্তু কিরীটী অত সহজে হাল ছাড়বে না। যেমন করে তোক তাঁর কাছ থেকে সব শুনে যেতেই হবে।

কিরীটী বসে বসে ভাবতে থাকে কি ভাবে ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা শুরু করবে।

কিন্তু বেলা একটা পর্যন্ত সৌভাগ্যক্রমে কিরীটীকে অপেক্ষা করতে হল না

মিনিট কুড়ির মধ্যেই একটি নারীকণ্ঠে আকৃষ্ট হয়ে কিরীটী মুখ তুলে তাকাতেই তেইশ-চব্বিশ বৎসর বয়স্কা এক তরুণীর সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল।

পাতলা দোহারা চেহারা। গায়ের বর্ণ উজ্জল শ্যাম। চোখ মুখ চিবুক বেশ ধারালো। মাথায় পর্যাপ্ত কেশ এলো খোঁপা করা। দুহাতে একগাছি করে সরু তারের সোনার বালা। পরিধানে সরু কালাপাড় একখানি তাঁতের শাড়ি।

কিরীটীর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই তরুণী দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে অদূরে লিখনরত উপবিষ্ট বন্ধের দিকে তাকিয়ে বললেন, অবিনাশবাবু, আমার মাইনেটা কি আজ পাবো?

অবিনাশবাবু, বোধ হয় শুনতে পাননি, বললেন, জমানো—জমানো টাকা আবার কোথা থেকে এলো আপনার?

জমানো টাকা নয়, বলছি মাইনেটা আজ মিলবে?

না, আজও ক্যাশে টাকা নেই। কাল-পরশু নাগাদ পেতে পারেন। হ্যাঁ ঐ ভদ্রলোকটি আপনাকে খুজছিলেন বিনতা দেবী।

আমাকে খুজছেন!

বিনতা দেবী যেন কতকটা বিস্ময়ের সঙ্গে কিরীটীর মুখের দিকে ঘুরে তাকালেন।

কিরীটী উঠে দাঁড়াল এবং নমস্কার করে বললে, আপনি অবিশ্যি আমাকে চেনেন না বিনতা দেবী। আমার নাম কিরীটী রায়। কলকাতা থেকে আসছি। আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল।

আমার সঙ্গে!

হ্যাঁ। অবশ্য বেশী সময় আপনার আমি নেবো না।

কি বলুন তো?

কথাটা একটু মানে, কিরীটী একটু ইতস্তত করতে থাকে।

বিনতা দেবী বোধ হয় বুঝতে পারেন। বললেন, চলুন পাশের ঘরে যাওয়া যাক।

পাশের ঘরটি ঠিক বসবার উপযুক্ত নয়। স্কুলের বাড়তি জিনিসপত্র ভাঙ্গাচোরা চেয়ার বোড় ইত্যাদিতে ঠাসা ছিল।

একপাশে একটা ছোট বেঞ্চ ছিল, তারই উপরে কিরীটীকে বসতে বলে বিনতা দেবীও তার পাশেই বসলেন নিঃসংকোচেই।

কিরীটী বিনতা দেবীর সপ্রতিভ ব্যবহারে প্রথম আলাপেই বুঝে নিয়েছিল ভদ্রমহিলার বিশেষ কোন সঙ্কোচের বালাই নেই।

বলুন কি বলছিলেন!

কিরীটী কোনরুপ ভণিতা না করেই স্পষ্টাস্পষ্টি সোজাসুজিই তার বক্তব্য শুরু করে, দেখুন আপনাকে আগেই বলেছি বিনতা দেবী, আমি আসছি কলকাতা থেকে এবং অনিলবাবুর আকস্মিক রহস্যজনক মৃত্যু সম্পর্কে

অনিল! চমকে কথাটা বলে বিনতা কিরীটীর মুখের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন।

হ্যাঁ। অনিলবাবু, আপনার যে বিশেষ পরিচিত ছিলেন তা আমি জানি।

কিন্তু আপনি

আমার একমাত্র পরিচয় একটু আগেই তো আপনাকে আমি দিয়েছি। তার বেশী বললেও তো আমাকে আপনি চিনতে পারবেন না। তবে ঐ সঙ্গে সামান্য একটু যোগ করে বলতে পারি মাত্র যে অনিলবাবুর মৃত্যুরহস্যটা জানবার আমি চেষ্টা করছি।

বিনতা অতঃপর কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। প্রায় মিনিট দুয়েক। তারপর মুখ তুলে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তা সেজন্য আমার কাছে আপনি এসেছেন কেন? আপনি কি পুলিসের কোন লোক?

না না-পুলিসের লোক ঠিক আমি নই। তবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে আমার।

কিন্তু সেজন্য আমার কাছে না এসে পুলিসের সাহায্য নিলেই তো আপনি পারতেন!

কথাটা ঠিক তা নয়।

তবে?

পুলিস অনেক সময় অনেক কিছুই জানতে পারে না। ঐ ধরনের হত্যারহস্যের সঙ্গে এমন অনেক কিছুই হয়ত রহস্য থাকে যা জানতে পারলে পুলিসের পক্ষেও অনেক জটিলতার সমস্যা হয়তো সহজেই মিলতে পারত। বুঝতে পারছেন বোধ হয় আমি ঠিক কি বলতে চাইছি আপনাকে!

বিনতা দেবী চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ। কিরীটী আবার ডাকে, বিনতা দেবী?

বলুন।

আপনি তাঁর বিশেষ পরিচিত ছিলেন। তাই আপনার কাছে এসেছি যদি তাঁর সম্পর্কে এমন কোন বিশেষ খবর

কি জানতে চান আপনি কিরীটীবাবু?

আমি কয়েকটা প্রশ্ন আপনাকে করবে, তার জবাব পেলেই আমি সন্তুষ্ট হবো।

কিন্তু, বিনতা দেবী ইতস্ততঃ করতে থাকেন।

আপনি কি তাঁকে—কিছু মনে করবেন না, ভালবাসতেন না?

প্রশ্নোত্তরে বিনতা দেবী কোন জবাব দেন না।

কেবল কিরীটী দেখতে পায় তাঁর চোখের কোল দুটি যেন হঠাৎ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে।

তাই বলছিলাম, আপনি কি চান বিনতা দেবী, তাঁর মৃত্যুর রহস্যটা উঘাটিত হোক?

চাই।

তবে বলুন, অনিলবাবুর মৃত্যুর কয়দিন আগে শেষবার কবে আপনার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল?

তার মৃত্যুর আগের দিন রবিবার কলকাতায় আমি গিয়েছিলাম। সেই সময়েই শেষবার আমাদের দেখা হয়েছিল।

আচ্ছা তাঁর মৃত্যুর আগে ইদানীং এমন কোন কথা কি তাঁর মুখে আপনি শুনেছেন বা তিনি আপনাকে বলেছেন বা তাঁর ঐ সময়কার ব্যবহারে এমন কোন কিছু আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল যেটা আপনার অন্যরকম কিছু মনে হয়েছিল! বুঝতে পারছেন নিশ্চয় আশা করি কি আমি বলতে চাইছি :

একটু চুপ করে থেকে বিনতা বললেন, না, তেমন কিছু মনে পড়ছে না। তবে

তবে? কিরীটী একটু যেন কৌতূহলী হয়ে ওঠে।

তবে শেষবার দেখা হওয়ার আগে এক শনিবার সে এখানে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসে কথায় কথায় বলেছিল, ন্যায়রত্ন লেনের বাসা নাকি

কি! কি বলেছিলেন অনিলবাবু?

বলেছিল ন্যায়রত্ন লেনের বাসা নাকি সে ছেড়ে দেবে।

একথা কেন বলেছিলেন?

তা তো জানি না। তবে বলেছিল বাসাটা নাকি ভাল না।

অন্য কোন কারণ বলেননি বাসাটা ছেড়ে দেবার?

না।

আচ্ছা বাড়িওয়ালা কবিরাজ মশাই সম্পর্কে বা তাঁর ফ্যামিলির অন্য কারো সম্পর্কে কোন কথা কি তিনি আপনাকে বলেছিলেন কখনো কোনদিন কোন কথাপ্রসঙ্গে?

না, তবে—

তবে কি?

তবে কবিরাজ মশাইয়ের পরিবারের সঙ্গে তার পরিচয় ছিল শুনেছিলাম তারই মুখে একদিন কথায় কথায়।

ও। আচ্ছা আপনি নিশ্চয়ই জানেন, অনিলবাবু, কতদিন ঐ ন্যায়রত্ন লেনের বাড়িতে ছিলেন ঘর নিয়ে?

তা মাস আষ্টেক হবে।

তার আগে কোথায় ছিলেন?

এক দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়ের বাসায় যাদবপুরে।

আর একটা কথা বিনতা দেবী, অনিলবাবুর ইদানীং আয় কি একটু বেড়েছিল?

কিরীটীর প্রশ্নে বিনতা ওর মুখের দিকে বারেকের জন্য চোখ তুলে তাকালেন এবং তাঁর ভাবে বোধ হল যেন একটু ইতস্তত করছেন। কিরীটী তাঁর ইতস্তত ভাবটা বুঝতে পেরে বলে, ভয় নেই আপনার বিনতা দেবী, নির্ভয়ে আমার কাছে সব কথা বলতে পারেন।

মৃদুকণ্ঠে জবাব দিলেন এবারে বিনতা দেবী, হ্যাঁ। অন্তত মুখে সে না বললেও হাবে-ভাবে-আচরণে সেটা আমার কাছে চাপা থাকেনি, তাছাড়া– কথার শেষাংশে পৌছে বিনতা যেন আবার একটু ইতস্তত করতে থাকেন।

তাছাড়া কি বিনতা দেবী?

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বিনতার মুখের দিকে তাকিয়ে কিরীটী শেষের কথাগুলো উচ্চারণ করল।

তাছাড়া অবস্থার সে উন্নতি করতে পারছিল না বলেই আমাদের বিবাহের ব্যাপারটা সে পিছিয়ে দিচ্ছিল বার বার এবং নিজে থেকেই উপযাচক হয়ে যেদিন সে আমার কাছে এসে আমাদের বিবাহের কথা তোলে আমি সেদিন একটু অবাক হয়েই তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সত্যিই কি এতদিনে তাহলে সে অবস্থার উন্নতি করতে পেরেছে?

তাতে তিনি কি জবাব দিলেন?

বিনতা প্রশ্নের জবাবে এবারে চুপ করে থাকেন।

হুঁ। তা আপনি আর কিছু জিজ্ঞাসা করেননি? কেমন করে অবস্থার উন্নতি হলো?

না।

কেন?

কারণ আমি আশা করেছিলাম সব কথা সে নিজেই খুলে বলবে। তা যখন বললো না, আমিও আর কিছু ও সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিনি।

নিজে থেকেও নিশ্চয়ই আর কিছু তিনি বলেননি?

না।

সামান্য আলাপ-পরিচয়েই কিরীটী বুঝতে পারে যথেষ্ট বুদ্ধি রাখেন ভদ্রমহিলা। এবং ভদ্রমহিলার সঙ্গে পরবর্তী কথাপ্রসঙ্গে বুঝতে কষ্ট হয় না যে, অনিলবাবুর ইদানীংকার ব্যবহারটা একটু কেমন যেন রহস্যজনক হয়ে উঠেছিল। অর্থ জন প্রতিপত্তির লিপ্সা মানুষ মাত্রেরই থাকে। তবে অনিলবাবুর যেন একটু বেশীই ছিল। কতদিন বিনতা বলেছেন, বেশী দিয়ে আমাদের কি হবে! তার জবাবে নাকি অনিলবাবু বলেছেন, সাধারণ ভাবে জীবনযাপন তো সকলেই করে। তার মধ্যে thrill কোথায়! এমনভাবে বাঁচতে আমি চাই যাতে দশজনের মধ্যে মাথা উঁচু করে আমি থাকতে পারি, সত্যিকারের সুখ ও প্রাচুর্যের মধ্যেই। অতি সাধারণ ভাবে বাঁচার মধ্যে জীবনের কোন মাধুর্যে উপভোগ করবার মত কিছু নেই। সেটা একপক্ষে মৃত্যুরই নামান্তর।

বিনতা দেবী আরো অনেক কথাই কিরীটীকে বললেন, যা থেকে কিরীটীর বুঝতে কষ্ট হয় না, তিনি অনিলবাবুকে সত্যি সত্যিই ভালবাসতেন। সে ভালবাসার মধ্যে কোন খাদ ছিল না। যদিচ অনিলবার ইদানীংকার ব্যবহারের মধ্যে তাঁর দিক থেকে একটা স্বার্থপরতার ভাব দেখা দিয়েছিল, তথাপি বিনতার ভালবাসায় কোন তারতম্য হয়নি।

বরং মনে মনে একটু আঘাত পেলেও মুখে কখনো সেটা অনিলবাবুকে জানতে দেননি তিনি।

আর অনিলবাবুকে বিনতা সত্যিকারের ভালবাসতেন বলেই তাঁর মৃত্যুর পরও তাঁর স্মৃতি নিয়েই কাটাচ্ছেন।

আড়াইটের ফিরতি ট্রেনটা না ধরতে পারলে ফিরতে রাত হবে তাই কিরীটী অতঃপর বিনতা দেবীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নমস্কার জানিয়ে স্টেশনের দিকে পা বাড়ায়।

 ৫. দুপুরের ট্রেনে

দুপুরের ট্রেনেই কিরীটী কলকাতা ফিরে এল।

ঐদিনটা শনিবার থাকায় অফিসের ছুটি হয়ে গিয়েছিল। সত্যশরণ তার ঘরেই ছিল।

কিরীটীকে তার ঘরে প্রবেশ করতে দেখে সত্যশরণ কিরীটীর ঘরে এসে ঢুকল। কিরীটী জামার গলার বোতামটা খুলছে তখন।

কিরীটী!

কে, সত্যশরণ, এসো এসো

গিয়েছিলে কোথায়?

এই কলকাতার বাইরে একটু কাজ ছিল—

এদিকে পাড়ার ব্যাপার শুনেছো তো সব?

না, কি বল তো?

আজ সকালে যে আবার একটি মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে এই পাড়ায়!

বল কি? কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী সত্যশরণের দিকে ফিরে তাকায়।

জামার বোতাম আর খোলা হয় না।

হ্যাঁ, এবারে অবিশ্যি একেবারে ট্রাম-রাস্তার উপরে ঐ যে মোড়ে চারতলা ব্যালকনীওয়ালা লাল বাড়িটা আছে, তারই বারান্দার নীচে মৃতদেহ পাওয়া গেছে এবারে।

বল কি? বাঙ্গালী?

হ্যাঁ।

এবং পোশাক দেখে মনে হয় বেশ ধনীই লোকটা ছিল। বাঁ হাতের দুই আঙুলে দুটো ধীরে-বসানো সোনার আংটি ছিল

কিরীটী রীতিমত উৎসাহী হয়ে ওঠে। তারপর?

তারপর আর কি! পুলিস এসে মৃতদেহ রিমুভ করে—

মৃতদেহের গলায় তেমনি সরু কালো দাগ ছিল?

সরু কালো দাগ!

কথাটা সত্যশরণ বুঝতে না পেরে বিস্মিত দৃষ্টি মেলে কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।

হ্যাঁ।

তা তো জানি না ঠিক।

ওঃ

হঠাৎ ঝোঁকের মাথায় কথাটা বলে কিরীটীও বেশ একটু অপ্রতিভ হয়ে গিয়েছিল।

সত্যশরণ জিজ্ঞাসা করে, মৃতদেহের গলায় কি সরু কালো দাগের কথা বলছিলে কিরীটী?

কিরীটী অগত্যা যেন কথাটা খোলাখুলি ভাবে না বলে একটু ঘুরিয়ে বলে, সংবাদপত্রে তোমরা লক্ষ্য করেছে কিনা জানি না, এর আগের আগের বার মৃতদেহের description প্রসঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল মৃতদেহের গলায় একটা সরু কালো দাগের কথা। তা পুলিস কাউকে arrest করেছে নাকি?

না। তবে আশেপাশের বাড়ির লোকদের অনেক কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করেছে শুনলাম।

মৃতদেহ প্রথম কার নজরে পড়ে?

তা ঠিক জানি না।

সন্ধ্যার দিকেই কিরীটী থানায় গেল বিকাশের সঙ্গে দেখা করতে।

বিকাশ তখন ঐ এলাকারই একটা মোটর-অ্যাকসিডেন্টের রিপোর্ট নিচ্ছিল। কিরীটীকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে বললে, এই যে কিরীটী, এসো বসো, এই রিপোর্টটা শেষ করে নিই কথা আছে।

রিপোর্ট শেষ করে ঘর থেকে সকলকে বিদায় করে দিয়ে বিকাশবাবু, বললেন, শুনেছো নাকি তোমাদের পাড়ার সকালের ব্যাপারটা?

সকালের ট্রেনেই কলকাতার বাইরে একটু গিয়েছিলাম। এসে শুনলাম।

আমি তো ভাই আজকের ব্যাপারে একেবারে তাজ্জব বনে গিয়েছি। এই কয় মাসে চার-চারটে মার্ডার একই এলাকায় বলে একটু থেমে যেন দম নিয়ে আবার বললেন, বড় সাহেবের সঙ্গে আজ তো একচোট হয়েই গিয়েছে। Inefficient, অমুক-তমুক, কত কি ডেকে নিয়ে গিয়ে আমাকে যাচ্ছেতাই করে বললেন অফিসের মধ্যে।

কিরীটী বুঝতে পারে অফিসে বড়কর্তার কাছে মিষ্টি মিষ্টি বেশ দুটো কথা শুনে বিকাশ বেশ একটু চঞ্চল হয়ে উঠেছে। সত্যই তো, একটার পর একটা খুন হয়ে যাচ্ছে অথচ আজ পর্যন্ত তার কোন কিনারা হল না!

কিরীটী হাসতে থাকে।

বিকাশ বলে, তুমি হাসছ রায়—

ব্যস্ত হয়ে তো কোন লাভ নেই। ব্যাপার যা বুঝছি, বেশ একটু জটিলই। সব কিছু গুছিয়ে আনতে একটু সময় নেবে। কিরীটী আশ্বাস দেয়।

বিকাশ কিরীটীর শেষের কথায় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, কিছু বুঝতে পেরেছো নাকি?

না, মানে

দোহাই তোমার, যদি কিছু বুঝতে পেরে থাকে তো সোজাসুজি বল। আমি ভাই সত্যিই বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েছি।

সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু তাড়াহুঁড়োর ব্যাপার তো নয় ভাই এটা। খুব ধীরে ধীরে এগুতে হবে।

তারপর আবার জিজ্ঞাসা করে কিরীটী বিকাশকে, হ্যাঁ ভাল কথা মৃতদেহের identification হয়েছে?

না, কই আর হলো! এখন পর্যন্ত কোন খোঁজই পড়েনি।

মৃতদেহ তো মর্গেই এখনো আছে তাহলে?

হ্যাঁ। কাল পোস্টমর্টেম হবে।

মৃতদেহের আশেপাশে বা মৃতদেহে এমন কিছু নজরে পড়েছে তোমার suspicion হওয়ার মত, বা কোন clue?

না, তেমন কিছু নয়—তবে কাল শেষরাত্রে বোধ হয় বৃষ্টি হয়েছিল, যেখানে মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে সেই বাড়ির ব্যালকনির ধার ঘেষে গাড়ির টায়ারের দাগ পাওয়া গিয়েছিল রাস্তায়।

আর কিছু? মানে মৃতদেহের জামার পকেটে কোন কাগজপত্র বা কোন রকমের ডকুমেন্ট বা

না।

মর্গে গিয়ে একবার মৃতদেহটা দেখে আসা যেতে পারে?

তা আর যাবে না কেন!

আজ এখনি?

এখুনি!

হ্যাঁ।

বিকাশবাবু কি একটু ভেবে বললেন, বেশ চল।

দুজনে থানা থেকে বের হয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা ময়নাঘরে এলেন।

ময়নাঘরের ইনচার্জ ডোমটা ময়নাঘরের সামনেই একটা খাটিয়া পেতে শুয়ে ছিল। ইউনিফর্ম পরিহিত বিকাশকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে সেলাম দিল।

আজ সকালে শ্যামবাজার থেকে যে লাশটা এসেছে সেটা দেখবো, ভিতরে চল।

কোমর থেকে চাবির গোছা বের করে ডোমটা দরজা খুলতেই একটা উগ্র ফর্মালীন ও অনেকদিনের মাংসপচা চামসে মিশ্রিত গন্ধ নাসারন্ধ্রে এসে ঝাপটা দিল।

হলঘরটা পার হয়ে দুজনে ডোমের পিছনে পিছনে এসে ঠাণ্ডাঘরে প্রবেশ করল।

একটা স্ট্রেচারের উপরে সাদা চাদরে ঢাকা মৃতদেহটা মেঝেতেই পড়েছিল।

ডোমটা চাদরটা সরিয়ে দিল। বেশ হৃষ্টপুষ্ট মধ্যবয়সী একজন ভদ্রলোক।

মুখটা যেন কালচে মেরে গিয়েছে। নিখুতভাবে দাড়ি-গোঁফ কামানো। ডান গালের উপরে একটা মটরের মত কালো আঁচিল।

পরিধানে ফিনফিনে আন্দির পাঞ্জাবি ও সরু কালোপাড় মিহি মিলের ধুতি।

আন্দির জামার তলা দিয়ে নেটের গেঞ্জি চোখে পড়ে।

কিরীটী নীচু হয়ে দেখলে, গলায় আধ ইঞ্চি পরিমাণ একটা সরু কালো দাগ গলার সবটাই বেড় দিয়ে আছে।

চোখ দুটো যেন ঠেলে কোটর থেকে বের হয়ে আসতে চায়, চোখের তারায় সাব-কনজাংটাইভ্যাল হিমারেজও আছে।

মুখটা একটু হাঁ করা; কষ বেয়ে ক্ষীণ একটা লালা-মিশ্রিত কালচে রক্তের ধারা জমাট বেধে আছে।

মৃতদেহ উল্টেপাল্টে দেখল কিরীটী, দেহের কোথাও সামান্য আঘাতের চিহ্নও নেই।

স্পষ্টই বোঝা যায় কোন কিছু গলায় পেচিয়ে শ্বাসরোধ করেই হত্যা করা হয়েছে।

ডান হাতের উপরে উল্কিতে A ইংরাজী অক্ষরটি লেখা। কিরীটী উঠে দাঁড়াল, চলুন বিকাশবাবু, দেখা হয়েছে।

মর্গ থেকে বের হয়ে কিরীটী আর বিকাশবাবুর সঙ্গে গেল না। বিকাশবাবুর ভবানীপুরের দিকে একটা কাজ ছিল, তিনি ভবানীপুরগামী ট্রামে উঠলেন।

কিরীটী শ্যামবাজারগামী ট্রামে উঠল।

রাত বেশী হয়নি। সবে সাড়ে আটটা।

কলকাতা শহরে গ্রীষ্মরাত্রি সাড়ে আটটা তো সবে সন্ধ্যা!

ট্রাম থেকে নেমে কিরীটী সোজা একেবারে অন্নপূর্ণা হোটেল রেস্তোরাঁয় এসে উঠলো।

এক কাপ চা দিয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিতে হবে।

রেস্তোরাঁ তখন চা-পিপাসীদের ভিড়ে বেশ সরগরম।

কিরীটী একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। একপাশে নিত্যকার মত ছোট একটা টেবিল নিয়ে কাউন্টারের মধ্যে বসে আছেন অন্নপূর্ণা হোটেল ও রেস্তোরাঁর আদি ও অকৃত্রিম একমাত্র মালিক ভূপতিচরণ।

রেস্তোরাঁটায় পাড়ার ছেলেদেরই বেশী ভিড়। নানা আলোচনা চলছিল খদ্দেরদের মধ্যে চা-পান করতে করতে ঐ সময়টায়।

হঠাৎ কানে এলো কিরীটীর, তার ডান পাশের টেবিলে চারজন সমবয়সী ছোকরা চা-পান করতে করতে সকালের ব্যাপারটাই আলোচনা করছে।

কিরীটী উদগ্রীব হয়ে ওঠে।

লাচুলওয়ালা পাঞ্জাবি ও সার্টের কমবিনেশন জামা গায়ে ৩০।৩২ বৎসরের একটি যুবক তার পাশের যুবকটিকে বলছে, তোদের বাড়ি তো একেবারে সাত নম্বর বাড়ির ঠিক অপজিটে, আর তুই তো শালা রাত্রিচর, তোরও চোখে কিছু পড়েনি বলতে চাস ফটকে?

সম্বোধিত ফটিক নামধারী যুবকটি প্রত্যুত্তরে বলে, একেবারে যে কিছুই দেখিনি মাইরি তা নয়, তবে ধেনোর নেশার চোখে খুব ভাল করে ঠাওর হয়নি।

কিরীটীর শ্রবণেন্দ্রিয় শিকারী বিড়ালের কানের মত সতর্ক সজাগ হয়ে ওঠে।

ধেনো! বলিস কি ফটকে! তোর তো সাদা ঘোড়া চলে না রে!

ফটিক তার বন্ধু রেবতীর কথায় ফ্যাক ফ্যাক করে হাসতে থাকে। বোঝা যায় কথাটা তার মনে লেগেছে। তারপর বলে, কি করি ভাই! জানিস তো অভাবে স্বভাব নষ্ট। গত মাস থেকে মা আর দুশোর বেশি একটা পয়সা দেয় না। শালা দুশো টাকা মাসের পনের তারিখেই ফুটুস ফুঁ! তাই ঐ ধেনোই ধরতে হয়েছে। কাল রাত্রে নেশাটাও একটু বেশী হয়েছিল

মুখবন্ধ ছেড়ে ব্যাপারটা বল তো! রেবতী বলে ওঠে।

তখন বোধ করি ভাই সাড়ে তিনটে হবে। নেশাটা বেশ চড়চড়ে হয়ে উঠেছে—

ফটিকের শেষের কয়েকটা কথা কিরীটী শুনতে পেল না, কে একজন খরিদ্দার চপের কিমার মধ্যে নাকি কাঠের গুঁড়ো পেয়েছে, সে চেচাচ্ছে, বলি ওহে বংশীবদন! আজকাল কিমার বদলে স্রেফ বাবা কাঠের গুঁড়ো চালাচ্ছ? ধর্মে সইবে না বাবা, ধর্মে সইবে না। উচ্ছন্নে যাবে।

ভূপতিচরণ হোটেলের মালিক হন্তদন্ত হয়ে প্রায় এগিয়ে এলেন, কি বলছেন স্যার! অন্নপূর্ণা হোটেল রেস্তোরাঁর প্রেস্টিজ নষ্ট করবেন না!

খানিকটা গোলমাল ও হাসাহাসি চলে। হোটেলের সবেধন নীলমণি ওয়েটার বংশীবদন একপাশে দাঁড়িয়ে থাকে বোকার মত। ফটিক তখন বলছে, এক পসলা তার আগে বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। জানালাটার কাছে দাঁড়িয়ে আছি। দিব্যি ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে দেখলাম পূর্বদিক থেকে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল–তারপর সেই গাড়ি থেকে একজন লোককে দেখলাম কি একটা ভারী মত জিনিস ধরে গাড়ি থেকে রাস্তায় নামিয়ে রাখল। তবে শালা গাড়িটা যখন চলে যায় না তখন দেখছি গাড়িটা একটা ট্যাক্সি

বলিস কি ফটকে! ট্যাক্সি!

হ্যাঁ। আর এ পাড়ারই ট্যাক্সি।

মাইরি!

তবে আর বলছি কি! W. B. T. 307। গঙ্গাপদর সেই কালো রঙের চকচকে প্রকাণ্ড ডিসোটো ট্যাক্সি গাড়িটা

তারপর?

তারপর আর কিছু জানি না বাবা। কোথায় মাঝরাতে কে কি করছে না করছে জেনে লাভ কি! সোজা গিয়ে বিছানায় লম্বা। ঘুম ভাঙল আজ সকালে প্রায় আটটায়, তখন আমার বোন চিনুর কাছে শুনি আমাদের বাড়ির সামনে নাকি হৈ-হৈ কাণ্ড! সাত নম্বর বাড়ির করিডরের সামনে কাল একটা লাশ পাওয়া গিয়েছে। পুলিস এসেছে—সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ল গত রাত্রির কথা। তাড়াতাড়ি উঠে আগে শালা জানালাটা বন্ধ করে দিলাম। তবু, কি বেটারা রেহাই দেয়! ধাওয়া করেছিল আমার বাড়ি পর্যন্ত। বললে, সামনের বাড়িতে থাকেন, দেখেছেন নাকি কিছু? স্রেফ বলে দিলাম—মাল টানা অভ্যাস আছে মশাই। অত রাত্রে কি আর জ্ঞানগম্যি থাকে!

কথাটা শেষ করে শ্রীমান ফটিক বেশ রসিয়ে রসিয়ে আবার হাসতে লাগল।

কিরীটীরও মনে পড়ে ন্যায়রত্ন লেনের মোড়ে অনেক দিন ওর নজরে পড়েছে ঝকঝকে ডিসোটো ট্যাক্সি গাড়িটা। নম্বরটা যার W. B. T. 307।

ড্রাইভিং সীটে মোটা কালোমত যে লোকটাকে বসে বসে প্রায়ই ঝিমুতে দেখা যায়, তার বসন্তের ক্ষতচিহ্নিত গোলালো মুখখানাও কিরীটীর মানসনেত্রে উঁকি দিয়ে গেল ঐ সঙ্গে।

ডিসটো ট্যাক্সি গাড়ি, W. B. T. 307

গাড়ির কথাটা ও নম্বরটা বার বার কিরীটীর মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে থাকে।

এই পাড়ায় গত কয়েক মাস ধরে যে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আজ পর্যন্ত চারচারটি রহস্যময় মৃত্যু কেবলমাত্র লাশের মধ্যে প্রমাণ রেখে গিয়েছে, ঐ W. B. T. 307 নম্বরের গাড়ির সঙ্গে কি তার কোন যোগাযোগ আছে?

পরের দিনও সন্ধ্যার পর কিরীটী আবার থানায় গেল।

বিকাশ একটা জরুরী কাজে যেন কোথায় বের হয়েছিলেন, একটু পরেই ফিরে এলেন।

কিরীটীকে বসে থাকতে দেখে প্রশ্ন করলেন, এই যে কিরীটী! কতক্ষণ?

এই কিছুক্ষণ। তারপর ময়না-তদন্ত হল?

বিকাশ বসতে বসতে বললেন, হ্যাঁ, ময়না-তদন্তও হয়েছে—লোকটার identityও পাওয়া গিয়েছে।

পাওয়া গিয়েছে নাকি?

হ্যাঁ। লোকটার নাম অরবিন্দ দত্ত। এককালে চন্দননগরের ঐ দত্তরা বেশ বর্ধিষ্ণু গৃহস্থ ছিল। এখন অবিশ্যি পড়তি অবস্থা। তিন ভাই-বীজেন্দ্র, মহেন্দ্র, অরবিন্দ। ঐ মানে অরবিন্দই ছোট সবার।

হ্যাঁ, তা লোকটার স্বভাব-চরিত্র কেমন ছিল ইত্যাদি কোনকিছু খোঁজখবর পেলে?

পেয়েছি, আর সেইখান থেকে মানে বীজেন্দ্রবাবুর ওখান থেকেই আসছি। বীজেন্দ্রবাবু আজ বছর দশেক হল আলাদা হয়ে পৈতৃক সম্পত্তির ভাগ হিসাবে কলকাতার ভবানীপুর অঞ্চলের বাড়িখানা নিয়ে বসবাস করছেন।

তা বীজেন্দ্রবাবুর সংবাদ পেলে কি করে?

সেও এক আশ্চর্য ব্যাপার!

কি রকম?

সেও এক ইতিহাস হে! বলে বিকাশ বলতে শুরু করেন, বলেছি তো বীজেন্দ্রবাবুরা চন্দননগরের বাসিন্দা। বছর আষ্টেক আগে বীজেন্দ্রবাবুদের এক বিধবা বোন ছিলেন সুরমা। সেই বোন ও দুই ভাই মহেন্দ্র ও অরবিন্দ কাশী যান। কাশীতে দত্তদের একটা বাড়ি আছে বাঙালীটোলায়। তাঁরা গিয়েছিলেন মাস দুই কাশীতে থাকবেন বলেই। মধ্যে মধ্যে তাঁরা ঐভাবে এক মাস কাশীর বাড়িতে গিয়ে নাকি কাটাতেন। যা হোক সেবারে চার মাস পরে দুই ভাই তাঁদের স্ত্রী পুত্র নিয়ে যখন ফিরে এলেন সুরমা ফিরল না তাঁদের সঙ্গে। ফিরে এসে ওঁরা রটালেন সুরমা নাকি কাশীতে হঠাৎ দুদিনের জ্বরে মারা গিয়েছে। কিন্তু আসল ব্যাপারটা তা নয়—সুরমা মরেনি, গৃহত্যাগ করেছিল এক রাত্রে।

বীজেন্দ্রবাবু, বললেন নাকি ও-কথা?

হ্যাঁ, শোন– বললাম তো একটা গল্প! অরবিন্দ মধ্যে মধ্যে কলকাতায় এসে দাদার এখানে উঠতেন। দু-চার দিন থেকে আবার চলে যেতেন। শুকনো জমিদারীর কোনরূপ আয় না থাকলেও অরবিন্দবাবুর অবস্থাটা কিন্তু ইদানীং বছর আষ্টেক মন্দ যাচ্ছিল না। বরং বলতে গেলে বেশ একটু অর্থসচ্ছলতাই ছিল তাঁর। যাহোক যা বলছিলাম, এবারে অরবিন্দবাবু, গত শনিবার মানে প্রায় আটদিন আগে কলকাতায় আসেন চন্দননগর থেকে। এবং অন্যান্য বারের মত দাদার ওখানেই ওঠেন। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার হঠাৎ রাত্রি দেড়টায় বাড়ি ফিরে দাদা বীজেন্দ্রবাবুকে ডেকে বলেন, সুরমার খোঁজ তিনি পেয়েছেন। এবং তখনই তিনি তাঁর দাদাকে সুরমা সম্পর্কে আট বছর আগেকার সত্য কাহিনী খুলে বলেন। বীজেন্দ্রবাবু এর আগে আসল রহস্যটা সুরমা সম্পর্কে জানতেন না।

তারপর?

তারপরের ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত –

কি রকম?

বৃহষ্পতিবার রাত্রের পর শেষ দেখা হয় অরবিন্দবাবুর সঙ্গে বীজেন্দ্রবাবুর শুক্রবার সকালে। তারপর আর দেখা হয়নি। এবং রবিবার সকালের ডাকে একখানা খামের চিঠি পান বীজেন্দ্রবাবু।

চিঠি! কার?

সুরমা দেবীর।

কি চিঠি?

এই দেখ সে চিঠি, বলতে বলতে বিকাশ চিঠিটা বের করে কিরীটীর হাতে দিলেন। খামের উপরে ডাকঘরের ছাপ আছে। শ্যামবাজার পোস্টঅফিসের ছাপ।

কিরীটী ছেড়া খাম থেকে ভাঁজকরা চিঠিটা টেনে বের করল। সংক্ষিপ্ত চিঠি।

শ্রীচরণেষু বড়দা,
ছোটদা মারা গিয়েছেন। তাঁর মৃতদেহ বেওয়ারিশ লাশ হিসাবে পুলিস মর্গে চালান
দিয়েছে। সৎকারের ব্যবস্থা করবেন। ইতি
আপনাদের হতভাগিনী বোন সুরমা

একবার দুবার তিনবার কিরীটী চিঠিটা পড়ল।

সুরমা গৃহত্যাগিনী বোন মৃত অরবিন্দ দত্তের! কিন্তু সে অরবিন্দর মৃত্যু সংবাদ জানলে কি করে?

নিশ্চয়ই অকুস্থানে সুরমা উপস্থিত ছিল, না হয় তার জ্ঞাতেই সব ব্যাপারটা ঘটেছে। অন্যথায় সুরমার পক্ষে ঐ ঘটনা জানা তো কোনমতেই সম্ভবপর নয়। লাশ পাওয়া গিয়েছে শ্যামবাজারেই।

চিঠির ওপরে ডাকঘরের ছাপও শ্যামবাজারের। তবে কি পলাতকা সুরমা শ্যামবাজারেই কোথায়ও আত্মগোপন করে আছে!

কিরীটীর চিন্তাসূত্রে বাধা পড়ল বিকাশের প্রশ্নে, কি ভাবছ কিরীটী?

কিছু না। হুঁ, ময়না-তদন্তের রিপোর্ট কি?

Throttle করে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি কিরীটী, বীজেন্দ্রবাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হবার পরে থেকে সমস্ত ব্যাপারটা যেন আরো গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে।

কিরীটী বলে, কিছু clue তো আমাদের হাতে এসেছে। এইবার তো মনে হচ্ছে আমরা তবু এগুবার পথ পেয়েছি।

কি বলছো তুমি কিরীটী?

আমি তোমাকে আরো একটা clue দিচ্ছি—এই অঞ্চলে একটা ডিসোটা ট্যাক্সি গাড়ি আছে। নম্বরটা তার W. B. T. 307। ট্যাক্সিটার ওপরে একটু নজর রাখ। হয়তো আরো এগিয়ে যেতে পারবে।

বিকাশ যেন বিস্ময়ে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে যান, কি বলছো তুমি! ট্যাক্সির ড্রাইভার গঙ্গাপদ যে আমার বেশ চেনা লোক হে? অনেকবার আমার প্রয়োজনে ভাড়ায় খেটেছে। তাছাড়া গঙ্গাপদ লোকটাও spotless, ওর সম্পর্কে আজ পর্যন্ত কোন রিপোর্টই তো পাইনি।

কিন্তু সেইটাই বড় কথা নয় বিকাশ। মৃদু হেসে কিরীটী বলে।

কিন্তু, বিকাশ তবু ইতস্তত করতে থাকেন।

বললাম তো, প্রদীপের নীচেই বেশী অন্ধকার। যাহোক আজ উঠি–আবার দেখা হবে।

কিরীটী আর দ্বিতীয় বাক্যব্যয় না করে ঘর ছেড়ে বের হয়ে এলো।

৬. কিরীটী বাসায় ফিরে এলো

কিরীটী বাসায় ফিরে এলো যখন রাত প্রায় নটা।

রজতবাবুর ঘরে আলো জ্বলছে দেখে কিরীটী দাঁড়ালো দরজাগোড়ায়। রজতবাবু তা হলে ফিরেছেন! পরশু যে সেই দক্ষিণ কলকাতায় কাজ আছে বলে চলে গিয়েছিলেন, এ দুদিন আর ফেরেননি। রজতবাবুর গলা কানে এলো, বেশ ভালো করে বাঁধ –রাস্তায় যেন আবার খুলে না যায়।

রজতবাবুর ঘরের দরজাটা অর্ধেকটা প্রায় খোলাই ছিল। সেই খোলা দ্বারপথে উঁকি দিয়ে কিরীটী দেখল, রজতবাবু মেসের ভৃত্য রতনের সাহায্যে বাক্স-বিছানা সব বাঁধাছাঁদা করছেন।

ঘরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করল কিরীটী, কি ব্যাপার রজতবাবু বাঁধাছাঁদা করছেন সব?

হ্যাঁ মিঃ রায়, এ বাসা ছেড়ে আমি আজ চলে যাচ্ছি।

চলে যাচ্ছেন!

তা নয়ত কি? মশাই অপমান সহ্য করেও পড়ে থাকবো?

তা কোথায় যাচ্ছেন?

বালিগঞ্জে—একেবারে লেক অঞ্চলে। দোতলার ওপরে একটা চমৎকার ফ্ল্যাট পাওয়া গিয়েছে—ভাড়াটা অবশ্য কিছু বেশী। তা কি করা যাবে, এ হতচ্ছাড়া জায়গায় কোন ভদ্রলোক থাকে। যেমন বাড়ি তেমনি বাড়িওলা! বেটা অভদ্র ইতর

কবিরাজ মশাইয়ের ওপরে বড্ড চটে গিয়েছেন দেখছি

চটবো না! অভদ্র ইতর কোথাকার!

মেসের দ্বিতীয় ভৃত্যও এসে ঘরে প্রবেশ করল, ট্যাক্সি এসে গেছে, বাবু!

ট্যাক্সি গলির মধ্যে এনেছিস তো?

হ্যাঁ স্যার একেবারে দোরগোড়ায় নিয়ে এসেছি। বলতে বলতে ভৃত্যের পশ্চাতে যে লোকটি ঘরে এসে প্রবেশ করল, কিরীটী কয়েকটা মুহূর্ত তার মুখের দিকে নিজের অজ্ঞাতেই তাকিয়ে থাকে।

বসন্ত-ক্ষতচিহ্নিত সেই গোলালো মুখ গঙ্গাপদর। W. B. T. 307-এর ড্রাইভার গঙ্গাপদ।

জিনিসপত্র কি কি যাবে? গঙ্গাপদ আবার প্রশ্ন করে।

বিশেষ কিছু নয়। এই যে দেখছো ঐ দুটো সুটকেসু ঐ বেডিংটা, ব্যাস!

অতঃপর ভৃত্যের সঙ্গে ধরাধরি করে গঙ্গাপদই মাল ট্যাক্সিতে নিয়ে গিয়ে তুলল।

রজতবাবুর ঘরটা খালি হয়ে গেল।

রাত দশটার সময় ঐ রাত্রেই সিঁড়িতে কবিরাজ মশায়ের খড়মের খটখট শব্দ ধ্বনিত হয়ে উঠলো।

কৌতুহল দমন করতে না পেরে কিরীটী বাইরে এসে দেখলে ভিষগরত্ন রজতবাবুর খালি ঘরটার দরজায় একটা তালা লাগাচ্ছেন। কিরীটীকে দেখে কবিরাজ মশাই বললেন, শুন্য ঘর থাকা ভাল নয় রায় মশাই। তাই তালাটা লাগিয়ে দিয়ে গেলাম। মূষিকের উপদ্রব হতে পারে।

আরো দিন দুই পরে। বেলা দ্বিপ্রহর। মেসের ভৃত্য বলাই আগেই চলে গিয়েছে, রতনও যাবার জন্য সিঁড়িতে নেমেছে, পিছন থেকে কিরীটীর ডাক শুনে রতন ফিরে দাঁড়াল।

রতন!

কি বলছেন? রতনের মুখে সুস্পষ্ট বিরক্তি। ভাবটা– যাবার সময় আবার পিছু ডাকা কেন!

যাবার পথে অন্নপূর্ণা রেস্তোরাঁয় বংশীবদনকে বলে যেও তো এক কাপ চা আমার ঘরে দিয়ে যেতে।

আজই প্রথম নয়। মধ্যে মধ্যে এরকম দ্বিপ্রহরে কিরীটীর চায়ের প্রয়োজন হয় এবং বখশিশের লোভে বংশীবদন দিয়েও যায় চা।

চার পয়সা চায়ের কাপের দামের উপর আরো তিন আনা উপরি লাভ হয় বংশীবদনের। পুরো একটা সিকিই দেয় কিরীটী।

যে আজ্ঞে। বলে রতন সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলে গেল।

মিনিট কুড়িক বাদেই বংশীবদন এক কাপ চা নিয়ে এসে কিরীটীর ঘরে প্রবেশ করল।

বাবু, চা

চা-পান করতে করতে কিরীটী বংশীবদনের সঙ্গে আলাপ চালাতে লাগল।

দুচারটা সাধারণ কথাবার্তার পর হঠাৎ কিরীটী প্রশ্ন করে, এ পাড়ার ট্যাক্সি ড্রাইভার গঙ্গাপদকে চিনিস বংশী?

কোন গঙ্গাপদ? ঐ যে হদকো মোটা কেলে লোকটা?

হ্যাঁ।

খুব চিনি। ডেকে দেবো নাকি লোকটাকে? গাড়ি চাই বুঝি?

হ্যাঁ, তোর সঙ্গে আলাপ আছে নাকি?

না। তবে কত্তার সঙ্গে খুব ভাব। মাঝে মাঝে রাত্রে কত্তার ঘরে আসে যে!

কে, ভূপতিবাবুর সঙ্গে?

হ্যাঁ।

তোর কত্তার ঘরে রাত্রে আর কে কে আসে রে?

ঐ গঙ্গপদই আসে বেশী। আর কই কাউকে তো আসতে দেখিনি বড় একটা, তবে মাঝে মাঝে এই মেসের রজতবাবু যেতেন।

রজতবাবু, যেতেন!

হ্যাঁ।

ট্যাক্সি বুঝি গঙ্গাপদরই?

বাবু, শুনেছি কোন এক বাবুর। গঙ্গাপদ তো মাইনে-করা লোক।

খুব ভাড়া খাটে ট্যাক্সিটা, নারে?

ছাই! ভাড়া আর খাটে কোথায়? তবে হ্যাঁ, মধ্যে মধ্যে সন্ধ্যারাত্রে চলে যায় ফেরে পরের দিন আবার সন্ধ্যায়!

ভাবছি কাল একবার ট্যাক্সিটা ভাড়া নেবো। পাঠিয়ে দিতে পারিস ওকে একবার?

কাল বোধ হয় ও যেতে পারবে না বাবু!

কেন?

কাল রাত্রে গঙ্গাপদ যে বলছিল, পরশু মানে কাল রাত্রে ভাড়ায় যাবে। ফিরবে পরদিন– সারা রাত ভাড়া খাটালে অনেক পায় কিনা।

চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। একটা সিকি ও চায়ের কাপটা নিয়ে বংশীবদন চলে গেল।

পরের দিন রাত তখন সোয়া আটটা হবে। কিরীটী এক কাপ চা নিয়ে রেস্তোরাঁর দরজার ধারে একটা টেবিলের সামনে বসে স্থির দৃষ্টিতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিল।

W. B. T. 307 ট্যাক্সিটা খোলা দরজা বরাবর রাস্তার ওধারে ফুটপাত ঘেষে লাইটপোস্টটার অল্প দূরে পার্ক করা আছে। এতদূর থেকেও আবছা অস্পষ্ট বোঝা যায় গাড়ির চালকের সীটে বসে আছে একজন ছায়ামূর্তি। কিরীটী অন্যমনস্কের মত চা-পান করলেও তার সদাজাগ্রত দৃষ্টি ছিল W. B. T. 307 ট্যাক্সিটার ওপরেই। বড় রাস্তার ঠিক মোড়েই সেই সন্ধ্যা থেকে আরো একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে।

ক্ৰমে ক্ৰমে রাতের প্রহর গড়িয়ে চলে। একটি দুটি করে রেস্তোরাঁর খরিদ্দার চলে যেতে থাকে। রাত প্রায় দশটার সময় কিরীটী হঠাৎ যেন চমকে ওঠে।

আপাদমস্তক চাদরে আবৃত্ত একটি নারীমূর্তি এসে W. B. T. 307 ট্যাক্সি গাড়িটার সামনে দাঁড়াতেই নিঃশব্দে ট্যাক্সির দরজাটা খুলে গেল।

নারীমূর্তি ট্যাক্সিতে উঠে বসল এবং উঠে বসবার সঙ্গে সঙ্গেই ট্যাক্সি স্টার্ট দিয়ে চলতে শুরু করে।

কিরীটীও আর মুহূর্ত বিলম্ব না করে রেস্তোরাঁ থেকে উঠে সোজা গিয়ে দ্রুতপদে বড় রাস্তার মোড়ে যে দ্বিতীয় ট্যাক্সিটা অপেক্ষা করছিল তার মধ্যে গিয়ে উঠলো।

বড় রাস্তায় পড়লেও W. B. T. 307 ট্যাক্সিটা ট্রামের জন্য আটক পড়ে তখনও বেশীদূর এগোতে পারেনি। কিরীটী ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই ট্যাক্সিটা চলতে শুরু করে। ইঞ্জিনে স্টার্ট দিয়ে ট্যাক্সিটা প্রস্তুত হয়েই ছিল পূর্ব হতে সঙ্কেতমত। কিরীটী চাপা গলায় ড্রাইভার মনোহর সিংকে কি যেন নির্দেশ দিল।

গ্রীষ্মের রাত্রি দশটায় কলকাতা শহর এখনো লোকজনের চলাচল ও যানবাহনের বৈচিত্র্যে সরগরম।

আগেকার গাড়িটা সোজা কর্ণওয়ালিস স্ট্রীট, কলেজ স্ট্রীট ধরে এগিয়ে গিয়ে বৌবাজারের কাছাকাছি বাঁয়ে বাঁক নিয়ে শিয়ালদহের দিকে এগিয়ে চলল। শিয়ালদহের মোড়ে এসে ডাইনে বেকে এবারে চলল সারকুলার রোড ধরে সোজা। জোড়াগির্জা ছাড়িয়ে সারকুলার রোডের কবরখানা ছড়িয়ে বাঁয়ে বেকল।

আগের গাড়িটা চলেছে এবারে আমীর আলি অ্যাভিনু ধরে।

হঠাৎ একসময় আগের গাড়ির স্পীডটা কমে এলো। সঙ্গে সঙ্গে মনোহরও তার পা-টা তুলে নেয় গাড়ির অ্যাকসিলারেটারের ওপর থেকে।

ট্রাম ডিপোটা ছাড়িয়ে বাঁ-হাতি একটা সরু গলির মুখে গাড়িটা দাড়াল।

গাড়ি থেকে পূর্ববর্তী সর্বাঙ্গে চাদরে আবৃত মহিলাটি নেমে গেলেন এবং ট্যাক্সিটাও সামনের দিকে চলে গেল। হাত-দশেক ব্যবধানে মনোহর তার ট্যাক্সি দাঁড় করিয়েছিল। বিকাশ প্রশ্ন করেন, ব্যাপার কি কিরীটীবাবু?

কিরীটী ট্যাক্সির দরজা খুলে নামতে নামতে বললে, নামুন-এবং মনোহরের দিকে ফিরে তাকে ও কনস্টেবলকে অপেক্ষা করতে বলে এগিয়ে চলল।

বিকাশ কিরীটীকে অনুসরণ করেন। সরু গলিপথ, গলির মুখে একটিমাত্র লাইটপোস্ট। গলির পথ জুড়ে অদ্ভুত একটা আলোছায়ার লুকোচুরি চলছে যেন।

কিন্তু গলির মুখে যতদূর দৃষ্টি চলে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না কিরীটী। তবু, কিন্তু কিরীটী গলির মধ্যে ঢুকে এগিয়ে চলে। ব্লাইণ্ড গলি। কিছুটা এগুতে শেষ হয়ে গিয়েছে। সামনেই নিরেট দেওয়াল। গলির দুপাশে দোতলা তিনতলা সব বাড়ি আলোছায়ায় যেন স্তুপ বেধে আছে।

সব কয়টি বাড়িরই দরজা বন্ধ। মাত্র একটি বাড়ির খোলা জানালাপথে খানিকটা আলোর আভাস লাগছে গলিপথে।

জানালাপথে উঁকি দিয়ে দেখল কিরীটী, সাহেবী কেতায় সোফা-সেট-কাউচে সুসজ্জিত ড্রয়িংরুম। এবং সেই ড্রয়িংরুমের মধ্যে একটি সোফার উপরে পাশাপাশি বসে একটি তরুণবয়স্ক পুরুষ ও একটি নারী।

চমকে ওঠে কিরীটী। কারণ পুরুষটিকে না চিনলেও নারীটীকে চিনতে তার কষ্ট হয়নি দেখা মাত্রই। সেই ভদ্রমহিলা! যাকে মাত্র কয়েকদিন পূর্বে রাত্রে ভিষগরত্নের বাইরের ঘরে অনবগুণ্ঠিতা দেখেছিল সে।

কিন্তু ভদ্রমহিলাটির আজকের সাজসজ্জার ও সে-রাত্রের সাজসজ্জার মধ্যে ছিল অনেক তফাৎ। গা-ভর্তি জড়োয়া গহনা, পরিধানে দামী সিল্কের শাড়ি।

অপূর্ব রূপ খুলেছে দামী সিল্কের শাড়ি ও জড়োয়া গহনায়। চোখ যেন একেবারে ঝলসে যায়। আর পুরুষটির পরিধেয় সাজসজ্জা দেখলে মনে হয় ধনী কোন গুজরাট দেশীয় লোক। কিন্তু চিনতে পারল না চোখে কালো চশমা থাকায়। পুরুষটি হঠাৎ স্পষ্ট বাংলায় বলে, এসেছ?

আমার গাড়ি বাইরে অপেক্ষা করছে-চল

কিন্তু মাল?

মালও গাড়িতেই আছে।

বেশ, তবে চল।

কিন্তু টাকাটা?

ও হ্যাঁ হ্যাঁ ভুলে গিয়েছিলাম একদম বলতে বলতে জামার পকেটে হাত চালিয়ে একতাড়া নোট বের করে মহিলার হাতে তুলে দিল পুরুষটি।

গুনতে হবে নাকি?

তোমার খুশি।

মহিলাটি মৃদু হেসে নোটগুলো এক এক করে সত্যই গুনে দেখল। সব একশো টাকার নোট। নোটগুলো গুনে ব্লাউজের মধ্যে চালান করে দিয়ে উঠে দাঁড়াল।

চল—

আর একটু বসবে না?

একটু কেন-সারারাতই তো থাকবো সঙ্গে সঙ্গে। চল—ওঠ।

যুবকটি উঠে দাঁড়ায়। কিন্তু মহিলাটি হঠাৎ বাধা দিয়ে বলে, একটু বোস আসছি।

মহিলাটি ভিতরে চলে গেল। যুবকটি বসে আছে। হঠাৎ পা টিপে টিপে কে একজন কালো মুখোশে মুখ ঢেকে সোফার উপরে উপবিষ্ট যুবকের অজ্ঞাতেই তার পশ্চাতে এসে দাঁড়াল এবং সঙ্গে সঙ্গে দপ করে ঘরের আলো গেল নিভে।

কি হল! আলো নিভে গেল যে! বিকাশ চাপা কণ্ঠে বলেন।

চুপ! কিরীটী সাবধান করে দেয়।

অন্ধকারে একটা চাপা গোঁ গোঁ শব্দ, একটা ঝটাপটি শোনা যাচ্ছে।

পরক্ষণেই কিরীটী আর দেরি না করে গিয়ে বন্ধ দরজার উপরে ধাক্কা দেয়।

দরজায় ধাক্কা দিতেই বুঝলে দরজা ভিতর হতে বন্ধ।

প্রচণ্ড বেগে ধাক্কা দিতে দিতে একসময় মট করে শব্দ তুলে ভিতরের খিলটা বোধ হয় ভেঙে দরজা খুলে গেল।

দুজনে হড়মড় করে অন্ধকার বাড়িটার মধ্যে প্রবেশ করে। পাশের ঘরে ঢুকে অন্ধকারে হাতের টর্চের আলো ফেলতেই কিরীটী চমকে উঠলো।

মেঝের উপরে পূর্বদৃষ্ট তরুণ যুবকটি উপুড় হয়ে পড়ে আছে।

ঘরের আলোর সুইচটা সন্ধান করে আলোটা জালানো হল। ভূপতিত যুবকটিকে তুলে ধরতে গিয়েই বোঝা গেল সে আর বেঁচে নেই। কিন্তু তার চোখের চশমাজোড়া খুলে ফেলতেই কিরীটী চমকে ওঠে। অস্ফুট কণ্ঠে তার শব্দ বের হয় একটি মাত্র, এ কি! রজতবাবু! এবং মৃত্যু তার পূর্বপূর্বের মতই। গলায় সেই সরু কালো দাগ।

বিকাশ বললেন, চেনো নাকি লোকটাকে?

হ্যাঁ। রজতবাবু– আমাদের মেসেই ছিল!

কিন্তু সেই মহিলাটি গেলেন কোথায়?

চল, বাড়িটা খুঁজে একবার দেখি। যদিও মনে হচ্ছে পাওয়া যাবে না আর।

সত্যিই তাই। বাড়ির মধ্যে দোতলার ও একতলার সব ঘরগুলিতেই তালাবন্ধ। কোথাও মহিলাটির সন্ধান পাওয়া গেল না।

চল, ফিরি।

কিরীটী ও বিকাশ দ্রুতপদে নিজেদের ট্যাক্সিতে এসে উঠে বসতেই মনোহর ইঙ্গিত করে দেখাল ওধারে ফুটপাথে W. B. T. 307 ট্যাক্সিটা তখনো দাঁড়িয়ে আছে। কিরীটী ঠিক করলো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে।

বেশীক্ষণ কিন্তু অপেক্ষা করতে হল না। দেখা গেল দুটো বাড়ির পরের গলির ভিতর থেকে একজন চাদরে আবৃত মহিলা বের হয়ে সোজা তাদের ট্যাক্সির দিকেই এগিয়ে আসছে।

নেহাৎ হিসাবেরই ভুল বোধ হল কিরীটীর।

অন্ধকারে ভুল ট্যাক্সির খোলা দরজা-পথে ট্যাক্সির মধ্যে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মহিলাটি ভুল বুঝতে পারলেও তখন আর ফিরবার পথ ছিল না। বিকাশের হাতে উদ্যত লোডেড পিস্তল।

কিন্তু মহিলাটি যেন নির্বিকার।

গোলমাল করে কোন লাভ হবে না। চুপটি করে বসে থাকুন। বলেই কিরীটী মনোহরকে নির্দেশ দিল সোজা থানার দিকে গাড়ি চালাতে।

ট্যাক্সিটা এসে থানার সামনে দাঁড়াতেই, সর্বাগ্রে কিরীটী বিকাশকে ডেকে চুপি চুপি কি কতকগুলো নির্দেশ দিয়ে ভদ্রমহিলাটিকে নিয়ে থানার ঘরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করল! ভদ্রমহিলাটি এতক্ষণ গাড়িতে সারাটা পথ একটি কথাও বলেননি। ওরাও তাঁকে কোন কথা বলবার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করেনি। কিরীটীর চোখের নিঃশব্দ ইঙ্গিতে সচল পাষাণমূর্তির মত ভদ্রমহিলা কিরীটীকে অনসরণ করে ঘরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করলেন।

কিরীটী একটি চেয়ার দেখিয়ে বললে, বসুন। যদি ভুল না হয়ে থাকে তো মনে হচ্ছে আপনিই বোধ হয় বীজেন্দ্রবাবু ও নিহত অরবিন্দবাবুদের বোন সুরমা দেবী!

ভদ্রমহিলা কিরীটীর কথায় বারেক চমকে ওর মুখের দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিলেন। কিন্তু প্রত্যুত্তরে একটি কথাও বললেন না। যেমন দাঁড়িয়ে ছিলেন তেমনি দাঁড়িয়েই রইলেন।

বসুন সুরমা দেবী!

ইতিমধ্যে বিকাশ এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে আর একটা চেয়ার টেনে বসলেন।

বসুন! আবার কিরীটী অনুরোধ জানাল।

এবং সুরমা দেবী এবারে একটা চেয়ারে উপবেশন করলেন।

বুঝতেই পারছেন নিশ্চয়, নেহাৎ ভাগ্যচক্রেই আপনি আমাদের মুঠোর মধ্যে এসে পড়েছেন! শুনেন সুরমা দেবী, আপনি হয়তো এখনো বুঝতে পারেননি যে আমরা আট-ঘাট বেধেই আপনাকে আজ সন্ধ্যার পর অনুসরণ করেছিলাম যখন আপনি ন্যায়রত্ন লেনের বাসা থেকে বের হয়ে ট্যাক্সিতে গিয়ে চাপেন।

কিরীটীর শেষের কথায় সুরমা উপর দিকে মুখ তুলে তাকালেন।

হ্যাঁ, আপনি মুখ বুজে থাকলেও অবশ্যম্ভাবীকে আপনি ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন না সুরমা দেবী। আমরা জাল যে মুহূর্তে গুটিয়ে আনবো সেই মুহূর্তেই আপনাদের দলের অন্যান্য সকলের সঙ্গে আপনাকেও তাদের মাঝখানে এসে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু আমি তা চাই না। আপনি যদি স্বেচ্ছায় সব স্বীকার করেন, আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি সকলের মধ্যে টেনে এনে আপনাকে দাঁড়াবার লজ্জা ও অপমান হতে নিষ্কৃতি দেবো। কারণ আমি বুঝতে পেরেছি, এই বিশ্রী ব্যাপারের মধ্যে যতটুকু আপনি আপনার ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হোক জড়িত হয়ে পড়েছেন, সেটা হয়ত আপনাকে একপ্রকার বাধ্য হয়েই হতে হয়েছে। আরো একটা কথা আপনার জানা দরকার। আমীর আলি অ্যাভিনুর বাড়িতে আজ কিছুক্ষণ পূর্বে রজতবাবুর হত্যা-ব্যাপারটাও আমরা স্বচক্ষে দেখেছি।

দ্বিতীয়বার চমকে সুরমা কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।

কয়েকটি মুহূর্ত অতঃপর স্তব্ধতার মধ্যে দিয়েই কেটে গেল।

কিরীটী সুরমা দেবীর মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পেরেছিল সোজাসুজি আক্রমণকে প্রতিরোধ করবার আর তাঁর ক্ষমতা নেই। কোন নারীই ঐ অবস্থায় নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারে না!

নিঃশব্দে মুখ তুলে তাকালেন সুরমা দেবী কিরীটীর মুখের দিকে আবার। দুজনের চোখের টি পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হল।

কিরীটী চোখে চোখ রেখেই প্রশ্ন করল, তাহলে কি ঠিক করলেন সুরমা দেবী?

সুরমা দেবী নিশ্চুপ।

বুঝতেই পারছেন আর চুপ করে থেকে কোন লাভ হবে না! মাঝ থেকে কেবল পুলিশের টানা-হেচড়াতে কেলেঙ্কারিই বাড়বে।

কি বলবো বলুন?

আপনার যা বলবার আছে—

আমার?

হ্যাঁ!

কয়েকটা মুহূর্ত আবার নিঃশব্দে মাথা নীচু করে বসে রইলেন সুরমা দেবী, তার পর মাথা তুলে ধীরে ধীরে বললেন, হ্যাঁ, বলবো।

তবে বলুন।

হ্যাঁ বলবো, সব কথাই বলবো। নইলে তো আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে না।

বলতে বলতে সুরমা দেবীর দুচোখের কোল বেয়ে দুটি অশ্রুর ধারা নেমে এলো।

সুরমা দেবী বলতে লাগলেনঃ

আপনারা তো আমার পরিচয় জানতেই পেরেছেন। তাই পরিচয় দিয়ে মিথ্যা সময় আমি নষ্ট করতে চাই না। সব বলছি, পনের বছর বয়সের সময় আমার বিবাহ হয়। এবং বিবাহের ঠিক দশ দিন পরেই, দুর্ভাগ্য আমার, সর্পাঘাতে আমার স্বামীর মৃত্যু হয় তাঁর কর্মস্থল ময়ূরভঞ্জে। তিনি ছিলেন ফরেস্ট অফিসার। আমার স্বামীর একটি ছোট জাঠতুত ভাই ছিল সত্যেন। সত্যেন মধ্যে মধ্যে আসত আমাদের বাড়িতে। স্বামীকে চেনবার আগেই তাঁকে ভাগ্যদোষে হারিয়েছিলাম। আমার তখন ভরা যৌবন। সেই সময় সত্যেন এসে আমার সামনে দাঁড়াল। শ্বশুরবাড়ির দিক দিয়ে আমার বৃদ্ধ শাশুড়ী ছাড়া আর কেউ ছিল না। তাই বিধবা হবার পরও মধ্যে মধ্যে সেখানে আমায় যেতে হতো। এবং গিয়ে দুচার মাস সেখানে থাকতামও। ক্রমে সত্যেনের সঙ্গে হলো ঘনিষ্ঠতা। বলতে বলতে সুরমা দেবী চুপ করলেন।

সুরমা দেবীর জবানবন্দীতেই বলি।

সত্যেনের সঙ্গে সুরমার ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতায় যা হবার তাই হল। সুরমা যখন নিজে বুঝতে পারল তার সর্বনাশের কথা, ব্যাকুল হয়ে উঠলো সে এবং লজ্জাসরমের মাথা খেয়ে তখুনি সত্যেনকে একদিন ডেকে সব কথা খুলে বলতে একপ্রকার বাধ্য হল!

সত্যেন লোকটা ছিল কিন্তু আসলে একটা শয়তান। সে বললে, আরে তার জন্যে ভয়টা কি। সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

ব্যবস্থা! কিসের ব্যবস্থা?

কিসের আবার! গোলমাল সব ঠিক হয়ে যাবে। কিছু ভেবো না তুমি। তার জন্যে ভয়টা কি! সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

সুরমা সত্যেনের কথায় রাজী হয় না। ইতস্তত করে বলে, দেখ একটা কাজ করলে হয় না?

কি?

আমি রাজী আছি। বিবাহটাই হয়ে যাক।

বিয়ে!

হ্যাঁ।

কেন, তুমি তো ক্ষেপেছো! বিয়ে করবো তোমাকে!

তার মানে?

ঠিক তাই।

কিন্তু এতদিন তো তুমি

পাগল না ক্ষেপা! ওসব বাজে চিন্তা ছেড়ে দাও সুরমা। আমার ব্যবস্থা তোমায় মেনে নিতেই হবে।

লোহার মত কঠিন ও ঋজু হয়ে এল সুরমার দেহটা মুহূর্তে। তীক্ষ্ণ গম্ভীর কণ্ঠে সে কেবল বলল, ঠিক আছে, তোমায় কিছু ভাবতে হবে না।

সুরমা ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল।

শোন শোন সুরমা— সত্যেন ডেকে বাধা দেয় সুরমাকে।

সুরমা কেবল বললে, চলে যাও এখান থেকে।

পরের দিনই সুরমা চন্দননগরে দাদাদের ওখানে চলে এলো। মা ও অরবিন্দ সমস্ত ব্যাপারটাই জানতে পারল। কেবল জানতে পারল না আসল ব্যক্তিটি কে। সুরমা কিছুতেই প্রকাশ করল না।

বোন সুরমাকে নিয়ে তারা চলে এলো কাশীতে।

সেইখানেই একদিন কবিরাজ চন্দ্রকান্তর সঙ্গে আলাপ হয় অরবিন্দর।

চন্দ্রকান্তকে দিয়েই তারা কাঁটা তুলবার ব্যবস্থা করলেন।

কিন্তু চন্দ্রকান্ত সে-পথ দিয়েই গেলেন না। কাশীতে তিনি মুক্তাভস্ম নাম দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চোরাই কোকেনের কারবার চালাচ্ছিলেন। এবং ঐ সময়টায় পুলিশ অত্যন্ত তৎপর হয়ে ওঠায় চন্দ্রকান্তও কাশীর ব্যবসা গুটিয়ে অন্যত্র কোথাও সরে যাবার মতলব করছিলেন। তাঁর সংসারে ছিল আগের পক্ষের একটি ছেলে ও মেয়ে।

চন্দ্রকান্ত বললেন, শোন সুরমা, তুমি যদি রাজী থাকো আমি তোমাকে বিবাহ করতে রাজী আছি—কেন ও মহাপাপে মা হয়ে নিজেকে জড়াবে! ভ্রূণহত্যা মহাপাপ।

সুরমা প্রথমটায় কবিরাজের প্রস্তাবে বিহ্বল হয়ে যায়। চন্দ্রকান্ত তাকে বিবাহ করে সম্মান দেবে! পরে অনেক ভেবে রাজী হয়ে গেল সুরমা চন্দ্রকান্তরই প্রস্তাবে। কারণ সে নিজেও ওই কথাটা ভাবতে পারছিল না।

এক রাত্রে সে গৃহ থেকে পালাল কবিরাজ চন্দ্রকান্তর সঙ্গে।

কবিরাজ সুরমাকে নিয়ে এসে একেবারে কলকাতায় উঠলেন কাশীর সমস্ত ব্যবসাপাট তুলে দিয়ে। কিন্তু যে আশায় সুরমা গৃহত্যাগ করলো সে আশা তার ফলবতী হল না।

জন্মমুহূর্তেই সন্তানটিকে সেই রাত্রেই চন্দ্রকান্ত যে কোথায় সরিয়ে দিল তার অজ্ঞাতে সুরমা তা জানতেও পারলে না আর।

বিবাহও হল না এবং সন্তানও সে পেল না। অথচ বন্দিনী হয়ে রইলো। সুরমা চন্দ্রকান্তর গৃহে তারই কূট চক্রান্তে।

সন্তানকে একদিন ফিরে পাবে, এই আশায় আশায় চন্দ্রকান্ত সুরমার গতিরোধ করে রাখল। শুধু তাই নয়, অতঃপর চন্দ্রকান্ত সুরমাকে দিয়েই তার ব্যবসা চালাতে লাগল। সুরমাকে টোপ ফেলে বড় বড় রুই-কাতলা গাঁথতে লাগল। সুরমা প্রথম প্রথম প্রতিবাদ জানিয়েছে, তার জবাবে চন্দ্রকান্ত বলেছে, আমার কথামত যদি না চল তো তোমার ছেলেকে একদিন হত্যা করে তোমার সামনে এনে ফেলে দেব।

চোখের জলের ভিতর দিয়েই সুরমা বলতে লাগলেন, সেই ভয়ে আমি সর্বদা সিটিয়ে থাকতাম কিরীটীবাবু। আর আমার সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সে যত কুৎসিত জঘন্য কাজ আমাকে দিয়ে করিয়ে নিত। শেষটায়, ওই চোরাই ব্যাপারে এলো একদিন সত্যেন।

সত্যেন!

হ্যাঁ। রজতবাবুর আসল নাম সত্যেন। ঘোমটার আড়ালে সে আমাকে দেখতে পায়নি, কিন্তু আমি তাকে চিনেছিলাম। আর ওই সত্যেনের সাহায্যেই ওই চন্দ্রকান্ত, যাকে আপনারা শশিশেখর বলে জানেন, তার অন্য এক অংশীদার অন্নপূর্ণা রেস্তোরাঁর মালিক ভূপতি চাটুয্যের সাহায্যে অতর্কিতে একটা কালো ফিতের সাহায্যে পিছন থেকে ফাঁস লাগিয়ে চোরাই কারবারের ব্যাপারটা যার কাছে এতটুকু জানাজানি হয়ে যেত বা আমার ওপরে যারই লোভ পড়ত তাকে হত্যা করতো। এমনি করেই দিনের পর দিন চলছিল নারকীয় কাণ্ড, এমন সময় একদিন আমার দুর্ভাগ্য ছোড়দাও এর মধ্যে এসে পড়লেন ঘটনাচক্রে।

লজ্জায় মুখ ঢাকলেন সুরমা।

তারপর আবার বলতে লাগলেন, এদিকে শয়তান সত্যেন তখন চন্দ্রকান্তর মেয়ে অমলাকে ভুলিয়েছে। সত্যেনের মিষ্টি কথায় অমলা ভুললেও আমি তো জানি তার মানে, সত্যেনের আসল ও সত্যকারের পরিচয়। আমি সতর্ক করে দিলাম চন্দ্রকান্তকে। চন্দ্রকান্ত আমার মুখে সব কথা শুনে কি যেন কী ভেবে রজতকে গালাগালি দিয়ে তাড়িয়ে দিল। তারপরই আমার হতভাগ্য ছোড়দাকে এক রাত্রে রেস্তোরাঁর মধ্যেই সেই ফিতের সাহায্যে ফাঁস দিয়ে হত্যা করলে ওরা। এবং রজতকে শেষ করার মতলব করলে। এদিকে ছোড়দার মৃত্যুতে আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম। দাদাকে চিঠি দিয়ে জানালাম তার মৃত্যুর কথা।

আমরা জানি সে চিঠির কথা। কিরীটী বলে।

জানেন?

হ্যাঁ। তারপর বলুন।

রজতকে তাড়াবার পর সে আসবে না জানতাম। তাই আমিই তাকে একটা চিঠি দিই চন্দ্রকান্তর পরামর্শমত—যে আমি নিজে টাকার বিনিময়ে ভুলিয়ে নিয়ে তার হাতে অমলাকে তুলে দেবো; এই আশ্বাস দিয়ে পার্ক সার্কাসের গার্ডেনের রজতের সঙ্গে ঝগড়ার পর তাকে ডেকে পাঠাই। এদিকে রজতের দ্বারা অনিষ্ট হতে পারে এই ভেবে চন্দ্রকান্তও ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল তাকে তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলার জন্য। আর সেই সঙ্গে আমারও ছিল প্রতিহিংসা। আমার আজকের এই চরম দুর্গতির জন্য তো সেই দায়ী। সে-ই তো আমাকে লোভে ফেলে এই চরম সর্বনাশের পথে একদা টেনে এনেছিল। তাই প্রতিজ্ঞা করলাম মনে মনে, যেতেই যদি হয় তাকে শেষ করে যাবো এবং এইবারই সর্বপ্রথম ও শেষবার চন্দ্রকান্তর দুষ্কৃতিতে তাকে সাহায্য করতে সর্বান্তঃকরণে এগিয়ে গিয়েছিলাম। আমার কাজ শেষ হয়েছে। আপনি কিরীটীবাবু এখানে এনে আমাকে বলেছিলেন, নিয়তি-চালিত হয়েই নাকি আপনাদের গাড়িতে এসে আমাকে উঠতে হয়েছে, কিন্তু তা নয়।

কি বলছেন আপনি সুরমা দেবী? বিকাশ প্রশ্ন করেন।

ঠিক তাই। স্বেচ্ছায় আমি আপনাদের গাড়িতে উঠেছি।

সত্যি বলছেন?

হ্যাঁ। আপনারা যে ট্যাক্সি করে আমাদের অনুসরণ করছেন সেটা আমি পূর্বাহ্নেই টের পেয়েছিলাম। আজ রাত্রে রজতকে শেষ করে পুলিশের কাছে এসে সব বলে দেবো পূর্ব হতে সেটা মনে মনে স্থির-সংকল্প হয়েই আমি প্রস্তুত হয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম। কথাটা বলতে বলতে কিসের একটা পুরিয়া হঠাৎ সুরমা দেবী হাতের মুঠোর থেকে নিয়ে মুখে পুরে দিলেন চোখের পলকে।

বাধা দেবেন না কিরীটীবাবু, আর। আমাকে যেতে দিন। সত্যই কলঙ্কিনী আমি।

আর কথা বলতে পারলেন না সুরমা দেবী।

শেষের কথাগুলো জড়িয়ে তাঁর অস্পষ্ট হয়ে গেল।

কিরীটী বললে হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে, কিন্তু আর তো দেরি করা চলে না। আমাদের এখুনি যেতে হবে। নচেৎ পাখী উড়ে যেতে পারে।

সুরমার মৃতদেহ ঐখানেই পড়ে রইলো। ওরা থানা থেকে বের হয়ে গেল।

৭. থানা থেকে একজন

থানা থেকে একজন এ. এস. আই. ও জনাতিনেক কনস্টেবলকে অন্নপূর্ণা রেস্তোরাঁয় ভূপতিচরণকে গ্রেপ্তার করতে পাঠিয়ে দিয়ে কিরীটী ও বিকাশ নিজেরা গেল ন্যায়রত্ন লেনের বাসার দিকে সোজা।

রাত প্রায় আড়াইটে নাগাদ বিকাশ ও কিরীটী সাধারণ বেশেই এসে ভিষগরত্নের সদর দরজায় ধাক্কা দিল।

দ্বিপদ এসে দরজা খুলে দিল চোখ মুছতে মুছতে।

কবিরাজ মশাই আছেন?

হ্যাঁ—উপরে ঘুমোচ্ছেন।

যাও, তাঁকে ডেকে নিয়ে এসো গে। বলল এক ভদ্রলোক বিশেষ জরুরী কাজে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।

একটু পরেই খড়মের খট খট শব্দ শোনা গেল।

খালিগায়ে কবিরাজ ভিষগরত্ন ঘরের মধ্যে এসে ঢুকলেন, ব্যাপার কি মশাই!

আপনার ডিসপেনসারী সার্চ করবো। ওয়ারেন্ট আছে, আমি থানা থেকে আসছি। বিকাশ রায়ই বললেন।

কবিরাজ মশাই তখন ফ্যালফ্যাল করে কিরীটীর মুখের দিকে তাকাচ্ছেন। এবং বিকাশের প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে কিরীটীকেই সম্বোধন করে বললেন, আমাদের রায় মশাই না?

আজ্ঞে হ্যাঁ। চিনতে পেরেছেন দেখছি তাহলে!

হ্যাঁ। এসবের মানে কি?

ওঁর মুখেই তো শুনলেন। কিরীটী জবাব দেয়।

কিন্তু কেন, তাই তো জিজ্ঞাসা করছি।

সে-কথাটা ওঁকেই জিজ্ঞাসা করুন না।

জিজ্ঞাসা আর করতে হল না, বিকাশবাবুই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে জবাব দিলেন, মুক্তাভস্ম বলে যে মূল্যবান বস্তুটি এখানে আপনার বিক্রি হয়, শুনলাম সেটার অন্য একটি পরিচয়ও আছে—অর্থাৎ আবগারীতে নিষিদ্ধ মাদক-পদার্থের লিস্ট অনুযায়ী যাকে বলা হয় কোকেন।

কোকেন! আমার এখানে? কবিরাজ মশাই যেন আকাশ থেকে পড়লেন।

হ্যাঁ-কোকেন। কোথায় হে দ্বিজপদ, মুক্তাভস্মর যে প্যাকেটগুলো তোমাদের এখান থেকে চালান যায় সর্বত্র, সেগুলো বের কর তো বাবা!

মশাই কি রাত্রে ঘুম ভাঙিয়ে ডেকে এনে আমার সঙ্গে রসিকতা শুরু করলেন? ভিষগরত্ন বলেন।

অনেক রসিকতাই এই কবছর ধরে করেছেন কবিরাজ মশাই আমাদের সঙ্গে আপনি—এবারে আমরা একটু-আধটু যদি করিই! বিকাশ ব্যঙ্গোক্তি করেন।

জানেন, এ ধরনের অত্যাচার নীরবে আমি সহ্য করব না? কবিরাজ মশাই গর্জে ওঠেন।

হিসাবে একটু ভুল করছেন শশিশেখরবাবু। সুরমা দেবী ইতিপূর্বেই সব আমাদের কাছে ফাঁস করে দিয়েছেন। এবং তিনি এখনো থানাতেই বসে আছেন।

মানে? কি বলছেন যা-তা?

এবারে কিরীটী কথা বললে, কবিরাজ মশাই, মহাভারতখানা আপনার নিশ্চয়ই পড়া ছিল, তবে এ ভুল করলেন কেন? শকুনির হাড়ের পাশা অমোঘ ছিল সত্য, কিন্তু সেই পাশাই কি শেষ পর্যন্ত শকুনির মৃত্যুর কারণ হয়নি? পাশার সাহায্যে যে কুরুক্ষেত্র রচিত হয়েছিল সেই কুরুক্ষেত্রেই কি শকুনিকেও শেষ নিঃশ্বাস নিতে হয়নি? আপনার সেই হাড়ের পাশা, সুরমা দেবীই সব স্বীকার করেছেন। অমোঘ সে হাড়ের পাশার দান—যখন একবার পড়েছে, আর তো তা ফিরবে না। অনেক দিন ধরে জুয়াখেলায় জিতে আসছিলেন, কিন্তু এবার আপনার হারবার পালা কবিরাজ মশাই!

কিরীটীর কথায় মুহূর্তে শশিশেখরের মুখের সমস্ত রক্ত কেউ যেন ব্লটিংপেপার দিয়ে শুষে নিল। নির্বাক স্থাণুর মত শশিশেখর দাঁড়িয়ে রইলেন।

তা ছাড়া পাঁচটা মাডার–

মার্ডার! কথাটা উচ্চারণ করে চমকে তাকালেন বিকাশ ও কিরীটীর মুখের দিকে।

হ্যাঁ। এ পাড়ার সব কটি মার্ডারের মূলেই কবিরাজ মশাইয়ের মুক্তাভষ্ম। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। যারা প্রাণ দিয়েছে তারাও এই মুক্তাভস্মেরই চোরাকারবারী ও অংশীদার ছিল। তাছাড়া আইন নিশ্চয়ই জানেন, মার্ডার ও abatement of murder দুটোরই শাস্তি পিনালকোডে একই ধারায়।

সত্যি নাকি!

হ্যাঁ, চলুন থানায় সব বুঝিয়ে দেবো।

Exit mobile version