Site icon BnBoi.Com

রতিবিলাপ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

রতিবিলাপ - নীহাররঞ্জন গুপ্ত

 ০১-০৫. মেয়েটির মুখের দিকে চেয়ে

রতিবিলাপ

মুখবন্ধ

কিছুদিন ধরেই লক্ষ্য করছিলাম পুলিসের বড়কর্তা মিঃ সেন রায় ঘন ঘন কিরীটীর কাছে যাতায়াত করছিলেন।

একদিন কৌতূহলটা আর দমন করতে না পেরে শুধালাম, কি ব্যাপার রে কিরীটী?

কিরীটী আনমনে একটা জুয়েলস সম্পর্কিত ইংরাজী বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছিল সামনের সোফাটার উপর বসে—মুখ না তুলেই বললে, কিসের কি?

সেন রায় সাহেবের এত ঘন ঘন যাতায়াত কেন তাই শুধাচ্ছিলাম।

কিরীটী মৃদু হেসে বলে, ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশপাথর।

পরশপাথর!

হ্যাঁ, কিছুদিন যাবৎ কলকাতা শহরে ইমিটেশন জুয়েলস নকল জহরতের সব ছড়াছড়ি দেখা যাচ্ছে।

নকল জহরৎ!

হ্যাঁ, তাই ভদ্রলোকের আহার নিদ্রা সব ঘুচে গিয়েছে।

তা ভদ্রলোকের কোন সুরাহা হল?

কোথায় আর হল?

তবে আজ যে সেন রায়কে ইকনমিক জুয়েলার্সের রাঘব সরকারের কথা কি বলছিলি?

কলকাতা শহরে জুয়েলসের মার্কেট তো ঐ ইকনমিক জুয়েলার্সের রাঘব সরকারই কনট্রোল করছে। তাই বলছিলাম ওদিকটায় একবার খোঁজ নিতে।

মৃদু হেসে বললাম, কেবল কি তাই?

তাছাড়া আর কি! বঁড়শী ফেলে রুই কাতলাই ধরা উচিত—পুঁটি ধরে কি হবে!

ঐ ঘটনারই দিন দুই পরে—

.

০১.

মেয়েটির মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছিলাম। মুখের মধ্যে কোথায় যেন একটু বিশেষত্ব আছে। এবং নিজের অজ্ঞাতেই বোধ হয় মুখটির মধ্যে কোথায় এবং কেন বিশেষত্ব সেইটাই অনুসন্ধান করছিলাম।

মনে হচ্ছিল যাকে বলে তীক্ষ্ণ বুদ্ধিশালিনী না হলেও মনের মধ্যে যেন তার একটা বিশেষ অনুভূতি আছে, যে অনুভূতি অনেক কিছুরই ইশারা দেয় বুঝি।

তবে সেদিন মেয়েটি চলে যাবার পর কিরীটী এক সময় বলেছিল মেয়েটি সম্পর্কে আমার অভিমত শুনে, মিথ্যে নয়, ঠিকই ধরেছিস। তবে সেই অনুভূতিকে যেন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল একটা আশংকার কালো ছায়া।

সত্যি বলছিস?

সত্যি।

তবে ওকথা মেয়েটিকে বললি কেন?

কিরীটী মৃদু হেসে প্রত্যুত্তর দিয়েছিল, মেয়েটির চেষ্টাকৃত ভণিতা দেখে।

ভণিতা?

কিন্তু ঐ পর্যন্তই। কিরীটী আর কোন কথা বলেনি বা বলতে চায়নি।

.

মাত্র হাত দুই ব্যবধানে আমাদের মুখোমুখি বসেছিল অন্য একটা সোফায় মেয়েটি শকুন্তলা চৌধুরী। এবং আর একটা সোফায় বসেছিলাম পাশাপাশি আমি আর কিরীটী।

একটু আগে শকুন্তলা তার বক্তব্য শেষ করেছে, এবং নিজের কথা বলতে বলতে সে যে যথেষ্ট উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল, তার রক্তিম শেষ আভাসটা যেন এখনো তার মুখের উপরে রয়েছে।

ইতিমধ্যে সন্ধ্যার ধূসর আবছায়া চারিদিকে নেমে এসেছিল। এবং বাইরের আলো ঝিমিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের মধ্যেও আবছায়া ঘনিয়ে এসেছিল।

আমি সোফা থেকে উঠে গিয়ে সুইচ টিপে ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে দিলাম। হঠাৎ ঘরের আলোটা জ্বেলে দেওয়ায় শকুন্তলা যেন একটু নড়েচড়ে বসল।

সামনের ত্রিপয়ের উপরে রক্ষিত টোবাকোর সুদৃশ্য কৌটোটা তুলে নিল কিরীটী এবং হাতের নিভে যাওয়া পাইপটার তামাকের দহ্মাবশেষ সামনে অ্যাসট্রের মধ্যে ফেলে দিয়ে নতুন করে আবার সেটার গহুরে তামাক ভরতে শুরু করল।

আমি কিন্তু শকুন্তলার মুখের দিকেই চেয়েছিলাম।

রোগা ছিপছিপে গড়ন এবং বেশ দীর্ঘাঙ্গী। মুখটা লম্বাটে ধরনের। নাক ও চিবুকের গঠনে একটা যেন দৃঢ়তার ছাপ। দুটি চোখে বুদ্ধির দীপ্তি স্পষ্ট বটে তবে সেই দীপ্তিকে আচ্ছন্ন করে কি যেন আরো কিছু ছিল।

সাধারণ একটি হ্যাঁতের আকাশ-নীল রঙের শাড়ি পরিধানে ও গায়ে একটি চিকনের সাদা ব্লাউজ। দুহাতে একটি করে সরু সোনার রুলি ও বাম হাতের মধ্যমাতে সাদা পোখরাজ ও লাল চুনী পাথর বসানো আংটি ব্যতীত সারা দেহে আভরণের চিহ্নমাত্র নেই। মুখে প্রসাধনের ক্ষীণ প্রলেপ।

কিন্তু ঐ সামান্য বেশেই তরুণীর চেহারার মধ্যে যেন একটি স্নিগ্ধ সুন্দর শ্রী ফুটে উঠেছিল, বিশেষ একটা আভিজাত্য যেন প্রকাশ পাচ্ছিল। তরুণীর বয়স তেইশ-চব্বিশের বেশী হবে বলে মনে হয় না।

পাইপে অগ্নিসংযোগ করে দেশলাইয়ের কাঠির সাহায্যে কাঠিটি অ্যাশট্রের মধ্যে ফেলে দিতে দিতে এতক্ষণ বাদে কিরীটী কথা বলল।

শান্ত মৃদুকণ্ঠে বললে, কিন্তু মিস চৌধুরী, আপনার এই ব্যাপারে আমি কি ভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি বলুন!

তা আমি জানি না, তবে ঐ লোকটার সঙ্গে সত্যিই যদি আমার বিয়ে হয়, কাকার আদেশ মেনে নিয়ে সত্যিই যদি ওকেই আমায় বিয়ে করতে হয় এবং আপনি যদি এ ব্যাপারে আমাকে

সাহায্য করেন তো আমার সামনে একটি মাত্র পথ খোলা আছে—জানবেন সেটা হচ্ছে সুইসাইড করা।

ছিঃ, সুইসাইড করবেন কেন! বললাম এবারে আমিই।

তাছাড়া আমার অন্য কোন পথই তো নেই সুব্রতবাবু।

বুদ্ধিমতী আপনি, ওভাবে দুর্বলের মত সুইসাইড করতে যাবেন কেন, আপনার কাকাকে আর একবার বুঝিয়ে বলুন না। আমিই আবার বললাম।

কোন ফল হবে না সুব্রতবাবু। বললাম তো আপনাদের, কাকা এ ব্যাপারে অত্যন্ত অ্যাডামেন্ট! তাছাড়া জানি—এবং দেখেছিও তো চিরদিন—ওঁর মতের বিরুদ্ধে কেউ যাবার চেষ্টা করলে তাকে তিনি কিছুতেই ক্ষমা করেন না। তাছাড়া–

কি?

দুষ্মন্ত, সেও কাকার বিরুদ্ধে যেতে রাজী নয়।

দুষ্মন্তবাবু তো আপনারই কাকার ছাত্র, তাই বললেন না? কিরীটী এতক্ষণে আবার কথা বলল।

হ্যাঁ। শুধু মাত্র নয় জীবনের সব চাইতে প্রিয় ছাত্র বলতে পারেন। হি ইজ সো মাচ প্রাউড অফ হিম! কিন্তু দুষ্মন্ত বিয়ের প্রপোজালটা তাকে দেবার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি না করে দিয়েছেন, সঙ্গে সঙ্গে বলে দিয়েছেন তা সম্ভব নয়।

দুষ্মন্ত জিজ্ঞাসা করেননি কেন সম্ভব নয়? আবার কিরীটী প্রশ্ন করে।

যখন তিনি কোন ব্যাপারে একবার না বলেন, তারপর তো কারো কোন কথাতেই আর কান দেন না এবং বলতে গেলে বলেন, ও-কথা শেষ হয়ে গিয়েছে, অন্য কথা বল। তাই সে আর অনুরোধ করেনি।

তা আপনি বলেননি কেন কাকাকে আপনার কথাটা? আপনাকে তো তিনি অত্যন্ত ভালবাসেন, একটু আগে বললেন!

হ্যাঁ, জানি ভালবাসেন এবং আমি বলেছিলামও—

বলেছিলেন!

হ্যাঁ—

কি বললেন আপনাকে তিনি জবাবে?

বললেন, না, তোমার বিয়ে আমি ঠিক করেছি রাঘব সরকারের সঙ্গে। এতদিন বিয়েটা তোমাদের হয়েও যেত। কিন্তু আমার ইচ্ছা, তুমি বি.এ.টা পাস কর, তার পর বিয়ে হবে, সেই কারণেই দেরি।

হঠাৎ যেন শকুন্তলার কথায় কিরীটী চমকে ওঠে, বলে, কী—কী নাম বললেন?

রাঘব সরকার।

মিস্ চৌধুরী, আচ্ছা রাঘব সরকার কি–

কি?

ইকনমিক জুয়েলার্সের মালিক?

তা ঠিক জানি না।

জানেন না?

না।

ও! হ্যাঁ, কি যেন আপনি বলছিলেন, এই বছরেই বুঝি আপনি তাহলে বি. এ. পরীক্ষা দিচ্ছেন?

এইবার পাস করলাম।

রাঘব সরকারের সঙ্গে আপনার কাকার সম্পর্ক কি? বলছিলাম কি সূত্রে পরিচয়, আর কতদিনের এবং কি রকম পরিচয়?

আশ্চর্য তো আমার সেইখানেই লাগে মিঃ রায়—

আশ্চর্য! কেন?

কারণ পরিচয় ওঁদের পাঁচ-সাত বছর হবে, ঘনিষ্ঠতাও খুব, কিন্তু—

কি?

রাঘব সরকারকে কাকা যে রকম ঘৃণা করেন—

ঘৃণা?

হ্যাঁ, মুখে যদিও সেটা তিনি প্রকাশ করেন না কখনো কিন্তু আমি তা জানি। আশ্চর্য তো হয়েছি আমি তাইতেই, সেই লোকের সঙ্গেই কাকা আমার বিয়ে দিতে কেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

রাঘব সরকারকে ঘৃণা করেন আপনি ঠিক জানেন?

জানি বৈকি।

কি করে জানলেন?

কেউ কাউকে সত্যিকারের ঘৃণা করলে সেটা বুঝতে কি খুব কষ্ট হয় মিঃ রায়?

কিন্তু—

না, সেরকম কখনো কিছু আমার চোখে পড়েনি বটে তবে বুঝতে পেরেছি আমি।

আর একটা কথা মিস্ চৌধুরী—

বলুন।

খুব ঘন ঘন যাতায়াত আছে বুঝি রাঘব সরকারের আপনাদের বাড়িতে?

না, এক মাস দেড় মাস অন্তর হয়ত একবার সে আসে।

এক্সকিউজ মি মিস চৌধুরী, লোকটার মানে ঐ রাঘব সরকারের বয়স কত?

পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে বলেই মনে হয়—

হুঁ, চেহারা?

মিথ্যা বলব না—হি ইজ রিয়ালী হ্যাণ্ডসাম! একটু যেন কেমন ইতস্ততঃ করেই কথাটা বলে শকুন্তলা।

সত্যি?

হ্যাঁ—কিন্তু তাতে আমার কি? আই হেট হিম! গলায় অনাবশ্যক জোর দিয়েই যেন কথাটা বললে শকুন্তলা।

আর একটা কথা—

বলুন।

দুষ্মন্তবাবু দেখতে কেমন?

রাঘব সরকারের সঙ্গে তুলনায় কিছুই নয়—কিন্তু তাকে আমি—

জানি ভালবাসেন। কিরীটীই কথাটা শেষ করল, সে তো বুঝতেই পেরেছি।

মুহূর্তকাল তারপর যেন কিরীটী চুপ করে থাকে। মনে হয় কি যেন সে ভাবছে। মুখ থেকে পাইপটা হাতে নেয়।

এবং তার পরই হঠাৎ শকুন্তলার দিকে তাকিয়ে বলে, আপনার ঐ আংটিটা নতুন বলে মনে হচ্ছে মিস্ চৌধুরী।

হ্যাঁ।

আপনি নিজেই আংটিটা শখ করে তৈরী করেছেন, না কেউ দিয়েছে আংটিটা আপনাকে?

রাঘব সরকার দিয়েছেন।

কি বললেন! একটু যেন কৌতূহল কিরীটীর কণ্ঠে প্রকাশ পায়, রাঘব সরকার দিয়েছেন আংটিটা আপনাকে?

হ্যাঁ, কাকার হাত দিয়ে আর কাকার আদেশেই আমাকে আংটিটা আঙুলে পড়তে হয়েছে।

দুষ্মন্তবাবু জানেন নিশ্চয়ই ব্যাপারটা?

জানে।

কিছু বলেননি তিনি?

কি বলবে? কাকাকে সে কি জানে না!

হুঁ। কিন্তু মিস্ চৌধুরী—

বলুন।

এ-ব্যাপারে যা বুঝতে পেরেছি, মীমাংসা করতে পারেন আপনারাই–শান্তকণ্ঠে বলে কিরীটী।

আমরাই!

হ্যাঁ, আপনি আর দুষ্মন্তবাবু।

কিন্তু–

একটু চিন্তা করে দেখুন, তাই নয় কি? আপনিও সাবালিকা এবং দুষ্মন্তবাবুও ছেলেমানুষ নন। আপনারা পরস্পরকে যখন ভালবাসেন এবং পরস্পরকে যখন বিয়ে করতে চান তখন কোন বাধা যদি কোথাও থাকে সে বাধাকে উত্তীর্ণ হতে হবে আপনাদেরই। হ্যাঁ—আপনাদেরই চেষ্টা করতে হবে।

কিন্তু আপনি ঠিক বুঝতে পারছেন না মিঃ রায়—

পারছি! আর সেইজন্যেই তো বলছি—দায়িত্ব যখন আপনাদের, মীমাংসাটাও আপনাদেরই করে নিতে হবে।

মিঃ রায়—

তাছাড়া সত্যিই বলুন তো, কি ভাবে আপনাকে আমি সাহায্য করতে পারি!

আমি ভেবেছিলাম—

কি ভেবেছিলেন?

কত জটিল ব্যাপারেরই তো মীমাংসা আপনি করেছেন—আমাদের এ ব্যাপারেও—

সেরকম সত্যিই কিছু জটিল হলে সাহায্য নিশ্চয়ই আপনাকে আমি করতাম।

আমি-আমি তাহলে কোন পরামর্শই আপনার কাছে পাব না মিঃ রায়?

একটা যেন রীতিমত হতাশার সুর ধ্বনিত হয় শকুন্তলার কণ্ঠে। চোখের দৃষ্টিতেও একটা নিরাশার বেদনা ফুটে ওঠে যেন।

আচ্ছা, তাহলে উঠি। নমস্কার—বলতে বলতে শকুন্তলা উঠে দাঁড়ায় এবং যাবার জন্য পা বাড়ায়।

দরজা বরাবর গিয়েছে শকুন্তলা, সহসা ঐ সময় কিরীটী ডাকল, শুনুন মিস চৌধুরী—

শকুন্তলা কিরীটীর ডাকে ফিরে দাঁড়াল।

একটা কাজ করতে পারবেন?

কি?

কাল দুপুরের পরে মানে এই সন্ধ্যার দিকে আপনার ঐ দুষ্মন্তবাবুকে নিয়ে আমার এখানে একবার আসতে পারবেন আপনারা?

কেন পারব না, নিশ্চয়ই পারব।

বেশ, তবে তাই আসবেন।

কিন্তু–হঠাৎ যেন কি মনে হওয়ায় শকুন্তলা বলে ওঠে, কাল তো আসতে পারব না মিঃ রায়, কাল আমাদের বাড়িতে একটা উৎসব আছে—

উৎসব?

হ্যাঁ, কাকামণির জন্মতিথি উৎসব। প্রতি বৎসর ঐ দিনটিতে উৎসব হয়—তার সব পরিচিত আত্মীয় বন্ধুবান্ধবেরা আসেন আর আমাকেই সব ব্যবস্থা করতে হয়। পরশু আসতে পারি—

তবে তাই আসবেন।

অতঃপর শকুন্তলা নমস্কার জানিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

.

০২.

শকুন্তলা ঘর থেকে বের হয়ে যাবার পর কিরীটী যেন একটু ক্লান্ত ভাবেই সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুজল এবং কয়েকটা মুহূর্ত চুপ করে থেকে যেন একেবারে প্রায় নিঃশব্দ কণ্ঠে বললে, আশ্চর্য!

একটু যেন চমকেই ওর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, কিছু বলছিস?

হ্যাঁ, ভাবছি—

কি?

ভাবছি মেয়েটি নিজেই এসেছিল আমার কাছে না কেউ পাঠিয়েছিল ওকে!

ও-কথা কেন বলছিস কিরীটী?

বলছি এই কারণে যে, আংটির অনুমানটা যদি আমার সত্যিই হয় তো—চমৎকার অভিনয় করে গেল মেয়েটি স্বীকার করতেই হবে।

অভিনয়!

হ্যাঁ, মেয়েরা অবিশ্যি আমার মতে সবাই, বলতে গেলে বেশীর ভাগই, জাত-অভিনেত্রী এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রেই তাদের অভিনয়টাই সত্যি এবং বাকি যা তা মিথ্যা; কিন্তু তাদের মধ্যেও আবার কেউ কেউ অনন্যসাধারণ থাকে তো–

তার মানে তুই বলতে চাস, ঐ শকুন্তলা মেয়েটি সেই শেষোক্ত পর্যায়ে পড়ে?

কিছুই আমি বলতে চাই না কারণ একটু আগেই তো বললাম ব্যাপারটাই আমার অনুমান মাত্র; কিন্তু শ্রীমান জংলীর ব্যাপারটা কি? সে কি আজ আমাদের চা-উপবাসীই রেখে দেবে স্থির করেছে নাকি?

কিন্তু কিরীটীর কথা শেষ হল না, ট্রেতে ধূমায়িত কাপ নিয়ে জংলী এসে ঘরে ঢুকল।

কি রে চা এনেছিস?

আজ্ঞে না।

আজ্ঞে না মানে! তবে ঐ কাপে কি?

ওভালটিন। জংলী বললে।

সত্যিই সুব্রত, চায়ের কাপের দিকে আদৌ হাত না বাড়িয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললে কিরীটী এবারে, আমার স্বাস্থ্য ও তার রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে হঠাৎ যে মাঝে মাঝে কৃষ্ণা অতি-সচেতন হয়ে ওঠে—চায়ের বদলে সরবত বা ওভালটিনের অত্যাচার

অসহ্য! কথাটা শেষ করল কৃষ্ণা।

না, মানে কৃষ্ণা তুমি—

হস্তধৃত কাচের প্লেটটা এগিয়ে দিতে দিতে মৃদু হাস্য সহকারে কৃষ্ণা এবারে বলে, ওভালটিনের সঙ্গে টোমাটোর পাঁপড় খেয়ে দেখো, সত্যি ডেলিসাস!

অবনক্সাস! মৃদু গম্ভীর কণ্ঠে বলে কিরীটী।

কি বললে? প্রশ্ন করে কৃষ্ণা।

বললাম ওটা পাঁপড়ও নয় টোমাটোরও নয়। সামথিং ক্যাডাভারাস লাইক ইয়োর মডার্ণ সো-কল্ড আপ-টু-ডেট সোসাইটি! অর্থাৎ সুকুমার রায়ের গজকচ্ছপেরই একটা সংস্করণ মাত্র।

কথাগুলো কিরীটী গম্ভীর হয়ে বলল বটে তবে দুটোই অর্থাৎ ওভালটিন ও পাঁপড় টেনে নিয়ে নির্বিবাদে সদ্ব্যবহার করতে শুরু করে দিল।

তার পর ঐ ব্যাচিলার ভদ্রলোকটিকে কি সারমন দেওয়া হচ্ছিল শুনি নারী সম্পর্কে। কিরীটীর দিকে চোখ পাকিয়ে প্রশ্নটা করে কৃষ্ণা।

কই না, নারী সম্পর্কে তো নয়, আমি তো বলছিলাম অভিনেত্রী সঙ্রে কথা।

অভিনেত্রী সঙ্ঘ!

হুঁ, মানে যারা এই আর কি অভিনয়ই করে। কথাটা চোখ বুজেই একটা পাপড়ের টুকরো আরাম করে চিবুতে চিবুতে কিরীটী বললে।

শুধু নিশ্চয়ই নারী অভিনেত্রীদের কথা নয়—পুরুষ অভিনেতাদের কথাও বলছ! কৃষ্ণা শুধায়।

য়্যাঁ, কি বললে? চোখ মেলে তাকায় কিরীটী।

বলছিলাম চমৎকার অভিনয় করতে পারে এমন তো শুধু নারীই নয়, পুরুষও আছে।

দুজনের–স্বামী ও স্ত্রীর পরস্পরের কৌতুকপূর্ণ অথচ বুদ্ধিদীপ্ত কথার লেনদেন শুনতে আমি বেশ উপভোগই করছিলাম।

সহসা ঐ সময় কিরীটী বলে উঠল, সন্দেহ নেই, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু প্রিয়ে, অভিনয়শিল্পে নারীর স্থান যে একটু বিশেষ স্তরেই, নিশ্চয়ই কথাটা অস্বীকার করবে না?

নিশ্চয়ই করব।

বেশ। তবে তিষ্ঠ ক্ষণকাল। এবারে সত্যিই তোমাকে শ্রীকৃষ্ণ যে মোহিনী রূপ ধারণ করে সমস্ত দেবাসুরের মাথাটা ঘুরিয়ে দিয়েছিল সেই মোহিনী রূপের অভিনয় মহিমা তোমাকে দেখাব। কিন্তু আমাকে একটিবার বেরুতে হবে—

কথাটা বলতে বলতে কিরীটী উঠে দাঁড়ায় এবং সোজা গিয়ে তার শয়নঘরের সংলগ্ন তার একান্ত নিজস্ব যে প্রাইভেট কামরাটি তার মধ্যে প্রবেশ করে ভিতর থেকে অর্গল তুলে দিল টের পেলাম।

.

সেই কামরা থেকে বের হয়ে এল যখন, সম্পূর্ণ ভোল একেবারে পাল্টে ফেলেছে কিরীটী।

মুসলমানী চোস্ত পাজামা ও গায়ে শেরওয়ানী। মাথায় কালো টুপী। হাতে একটা ছোট চামড়ার কেস। মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। চোখে কালো চশমা।

কি ব্যাপার, হঠাৎ এ বেশ কেন? প্রশ্ন করলাম আমিই।

একটু সওদা করে আসি।

সওদা কিসের?

জহরতের। বলেই আমাকে তাড়া দিল, চল্ ওঠ—

কোথায়?

বললাম তো সওদা করে আসা যাক। ওই—আবার তাড়া দিল কিরীটী।

কিন্তু তবু উঠতে আমি ইতস্ততঃ করি।

কি রে, এর মধ্যেই গেঁটে বাত ধরল নাকি? ওঠ—

অগত্যা উঠে দাঁড়াই।

রাস্তায় এসে ওর পাশে চলতে চলতে আবার পূর্বোক্ত প্রশ্নটাই করলাম, কিন্তু এই অসময়ে সত্যি কোথায় চলেছিস বল্ তো কিরীটী!

অসময় আবার কোথায়, মাত্র পৌনে আটটা রাত। আর একান্ত দেখা যদি নাই করে তো ফিরে আসব। তার বেশী তো কিছু নয়। তবু অন্তত একটু বেড়ানোও তো হবে।

তা যেন হবে, কিন্তু কার সঙ্গে দেখা করতে চলেছিস এ সময় হঠাৎ?

হঠাৎ আবার কোথায়! এই ট্যাক্সি-ইধার! কথাটা শেষ করল কিরীটী রাস্তার ওধারে গিয়ে, আমাদের দিকেই যে খালি ট্যাক্সি যাচ্ছিল সেই ট্যাক্সিটা ডেকে।

পাঞ্জাবী ট্যাক্সি ড্রাইভার সর্দারজী কিরীটী ডাকতেই সঙ্গে সঙ্গে ট্যাক্সিটা ঘুরিয়ে একেবারে রাস্তার এদিকে আমাদের সামনে এনে দাঁড় করাল।

আয়, ওঠ—

উঠে বসলাম ট্যাক্সিতে। ট্যাক্সি ছেড়ে দিল।

কিধার যায়গা বাবুজী?

বৌবাজার। কিরীটী বলে।

ট্যাক্সি বৌবাজারের দিকেই ছোটে।

বৌবাজারের কোথায় যাচ্ছিস?

ইকনমিক জুয়েলার্সে। গম্ভীর কণ্ঠে কিরীটী বলে।

কিছু কিনবি বুঝি?

পূর্ববৎ গম্ভীর কণ্ঠে বললে, দেখি—তেমন মনমতো জুয়েলস যদি কিছু পাই তো কেনা চলতে পারে বৈকি।

বুঝলাম কিরীটী কেন যাচ্ছে সেখানে আপাততঃ ব্যাপারটা ভাঙতে আমার কাছে রাজী নয়। আবার সঙ্গে সঙ্গে মনে হয় তবে কি ইকনমিক জুয়েলার্সের রাঘব সরকারের সঙ্গে মোলাকাত করতেই চলেছে।

হয়তো তাই। কথাটা নেহাত অসংগতও মনে হয় না। কারণ সেন রায়কেও ও বলেছিল ঐ রাঘব সরকারের সঙ্গে দেখা করতে। আবার শকুন্তলাও আজ সন্ধ্যায় ঐ রাঘব সরকারের কথাই বলে গেল।

জনাকীর্ণ আলোকিত পথ ধরে ট্যাক্সিটা ছুটে চলেছে। এবং গাড়ির মধ্যে অন্ধকার থাকলেও, মধ্যে মধ্যে এক-আধটা যে আলোর ঝাপ্টা রাস্তার আলো থেকে চলমান গাড়ির জানালাপথে ভিতরে এসে পড়ছিল, সেই আলোর মধ্যে কিরীটীকে দেখা যাচ্ছিল।

গাড়ির ব্যাকে হেলান দিয়ে কিরীটী চুপটি করে বসেছিল। চোখে তার কালো কাচের চশমা থাকায় ওর চোখ দুটো দেখতে পাচ্ছিলাম না। তবে এটুকু বুঝতে পারি, কি যেন সে ভাবছে।

পথে একটা বড় জুয়েলারী শপের সামনে গাড়ি থামিয়ে কিরীটী ভিতরে গেল এবং মিনিট কুড়ির মধ্যেই ফিরে এলো। গাড়ি আবার সামান্য চলে ইকনমিক জুয়েলার্সের সামনে এলে। ট্যাক্সি থেকে নামলাম আমরা। পকেট থেকে টাকা বের করে কিরীটী ভাড়া মিটিয়ে দিল।

রাস্তার দু ধারেই সার সার সব জুয়েলারীর দোকান। প্রত্যেক দোকানেই তখনো বেচাকেনা চলেছে। আলোঝলমল শোকেসগুলোর মধ্যে নানা ধরনের সব দামী দামী অলংকার সাজানো।

পর পর অনেক দোকান থাকলেও তারই মধ্যে ইকনমিক জুয়েলার্স যেন বিশেষ ভাবেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

দু দিককার দুটো রাস্তা জুড়ে অনেকখানি জায়গা নিয়ে বিরাট একটি ত্রিকোণ বাড়ি। বাড়ির মাথায় কোণাকুণি ভাবে বসানো বিরাট একটি নিওন সাইন বোর্ড। ইকনমিক জুয়েলার্স কথাগুলো নীল লাল নিওনে জ্বলছে নিভছে।

একতলায় পুরু কাচের পাল্লা বসানো শোকেস আগাগোড়া। ভিতরে আলোকিত শোকেসের মধ্যে নানাবিধ মহার্ঘ্য অলঙ্কারাদি থরে থরে সাজানো।

কিরীটী সোজা দোকানে প্রবেশ করবার দরজার দিকে এগিয়ে গেল।

দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে দাড়িওয়ালা বন্ধুকধারী শিখ দারোয়ান।

দোকানের ভিতরে দুজনে আমরা প্রবেশ করলাম।

কিরীটী সোজা কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যায় এবং কাউন্টারের যে প্রৌঢ়-বয়েসী ভদ্রলোকটি চোখে একটা পুরু কাচের চশমা পরে লিখছিলেন তাঁকেই শুধায়, ম্যানেজিং ডাইরেক্টার মিঃ সরকারের সঙ্গে একটিবার দেখা হতে পারে?

কিরীটী হিন্দীতেই কথাটা জিজ্ঞাসা করল।

ভদ্রলোক কিরীটীর প্রশ্নে মুখ তুলে তাকালেন, একটু অপেক্ষা করুন, মেমোটা শেষ করে নিই।

.

০৩.

মেমোটা লেখা শেষ করে প্রৌঢ় মুখ তুলে তাকালেন, কাকে চাই বলছিলেন?

ম্যানেজিং ডাইরেক্টারকে। কিরীটী তার কথাটার পুনরাবৃত্তি করল।

বড়বাবুকে?

হ্যাঁ, রাঘব সরকার মশাইকে। কিরীটীর মুখে কর্তার নামটা শুনেই প্রৌঢ় ভদ্রলোকটিও ওর মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন এবং ক্ষণকাল তাকিয়ে তাকিয়ে কিরীটীর আপাদমস্তক তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ করে বললেন, কি নাম আপনার? কোথা থেকে আসছেন? বড়বাবুর সঙ্গে আপনার প্রয়োজনটা কি?

নাম বললে তো তিনি চিনবেন না, আসছি আপাততঃ আমেদাবাদ থেকে আর প্রয়োজনটা ব্যক্তিগত।

ভদ্রলোকও যেমন প্রশ্নগুলো পর পর একই সঙ্গে করে গিয়েছিলেন, কিরীটীও পর পর একই সঙ্গে জবাবগুলো দিয়ে গেল।

ওঃ, তা—

তিনি যদি থাকেন তো দয়া করে তাকে খবরটা দিলে বাধিত হব।

চেয়ার থেকে এবারে উঠে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক এবং মৃদুকণ্ঠে বললেন, হুঁ, দাঁড়ান, দেখি তিনি ঘরে আছেন কিনা?

ভদ্রলোক ভিতরের দিকে চলে গেলেন। আমরা এদিক-ওদিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম।

প্রতিষ্ঠানটি বিরাট নিঃসন্দেহে। বিরাট হলঘর। অর্ধেকটা ঘরের পর পর একই সাইজের কাচের শোকেস দিয়ে একটা যেন বেষ্টনী গড়ে তোলা হয়েছে।

বেষ্টনীর ভেতরের অংশে রয়েছেন কর্মচারী ও সেলস্ম্যানরা আর বাহিরের অংশে খরিদ্দাররা। বেষ্টনীটি অর্ধচন্দ্রাকৃতি ভাবে যেন খাড়া করে তোলা হয়েছে।

ঘরের সর্বত্র উজ্জ্বল ফুরসেন্ট টিউব জ্বলছে। তারই আলোয় সমগ্র হলঘরটি যেন একেবারে ঝলমল করছে। প্রতিষ্ঠানটির অনুরূপ আড়ম্বরে কোন ত্রুটি নেই কোথাও যেন এতটুকু। ইতিমধ্যে সময় উত্তীর্ণ হওয়ায় খরিদ্দারের ভিড় একটু একটু করে কম হতে শুরু করেছিল।

একটু পরেই ভদ্রলোক ফিরে এলেন, আসুন বলে আহ্বান জানালেন।

কোন্ পথে যাব? কিরীটী প্রশ্ন করে।

ঐ দক্ষিণ দিক দিয়ে আসুন—ওখানে ভিতরে আসবার রাস্তা আছে। ভদ্রলোক আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলেন।

ভদ্রলোকের নির্দেশমত আমরা ভিতরে গিয়ে প্রবেশ করলাম এবং তাকে অনুসরণ করেই হলঘর থেকে বের হয়ে বন্ধ একটা কাচের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম।

পুরু কাচের দরজার ওদিকে একটা ভারি পর্দা ঝুলছে। ঘরের অভ্যন্তরে কিছু নজরে পড়ে না।

সঙ্গের ভদ্রলোকটিই কাচের দরজাটা টেনে খুলে আমাদের বললেন, যান, বড়বাবু ভিতরে আছেন–

পর্দা সরিয়ে আমরা ভিতরে প্রবেশ করতেই নাতি প্রশস্ত একটি ঘর আমাদের নজরে পড়ল। ঘরের দু পাশে দুটি লোহার সিন্দুক। এবং এক কোণে একটি কাচের টেবিলের সামনে সবুজ ঘেরাটোপ দেওয়া টেবিল ল্যাম্পের নীলাভ আলোয় চোখে পড়ল টাকমাথা এক ব্যক্তি, মাথা নীচু করে কি যেন পরীক্ষা করছেন। তাঁর সামনে নানা আকারের ছোট বড় জুয়েলয়ের বাক্স। পাশে কাচের কেসের মধ্যে একটি ওয়েয়িং অ্যাপারেটাস।

টেবিলের সামনে দেখা গেল খান-তিনেক আধুনিক ডিজাইনের স্টীলের চেয়ার।

মাথা না তুলেই সেই ব্যক্তি মৃদুকণ্ঠে আমাদের আহ্বান জানালেন, আসুন-বসুন।

বলা বাহুল্য আমরা এগিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসলাম।

কাজ করতে করতেই ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন, আমেদাবাদ থেকে আসছেন?

কিরীটী এবারও মৃদু কণ্ঠে বললে, না, আসলে করাচী থেকে আসছি।

সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোক মুখ তুললেন।

চোখে কালোমোটা সেলুলয়েড ফ্রেমের চশমা। চশমার কাচের ভিতর দিয়ে এক জোড়া চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আমাদের উপরে ন্যস্ত হল। মুহূর্তকাল সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যেন কিরীটীর ও আমার উপরে স্থির রইল।

আপনারা–

মিঃ সরকার, আমার নাম ইসমাইল খান—আমার সঙ্গে ইনি আমার দোস্ত মধুবাবু— আমি একটা বিশেষ কাজে আপনার কাছে এসেছিলাম—একেবারে খাস হিন্দীতে কথাগুলো বললে কিরীটী।

বলুন?

কিছু বেলজিয়ান হীরা আমার কাছে আছে।

বেলজিয়ান হীরা!

হ্যাঁ। হীরাগুলো বিক্রি করতে চাই।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আবার কিছুক্ষণ চেয়ে রইল রাঘব সরকার। তারপর মৃদুকণ্ঠে বললেন, হীরা বিক্রী করতে চান?

হ্যাঁ।

অপরিচিত কারো কাছ থেকে তো কখনো আমি কোনো জুয়েলস্ কিনি না।

ব্যবসা করতে বসেছেন আপনি মিঃ সরকার, তাই ভেবেছিলাম—

কি ভেবেছিলেন মিঃ খান?

যাদের সঙ্গে কারবার করেন নিশ্চয়ই সকলেই আপনার পরিচিত আসেন না—সম্ভবও নয় তা।

না, তা আসেন না বটে—তবে—

বলুন?

আপনি এ দেশের হলে কথা ছিল না—কিন্তু আপনি আসছেন করাচী থেকে!

তা হয়ত আসছি, তবে একজনের কাছে আপনার নাম শুনেই এসেছিলাম।

কে সে?

ক্ষমা করবেন, নামটা বলা সম্ভব নয়।

অতঃপর রাঘব সরকার মুহূর্তকাল কি যেন ভাবলেন, তারপর বললেন, বেশ নিয়ে আসবেন, দেখব।

একটা স্যাম্পল এনেছি, যদি দেখতে চান তো দেখাতে পারি।

স্যাম্পল এনেছেন?

হ্যাঁ। কারণ দরদস্তুর একটা মোটামুটি স্থির না হলে মিথ্যে হীরাগুলো বয়ে নিয়ে এসে তো কোন লাভ হবে না।

কিরীটীর শেষোক্ত কথায় আবার রাঘব সরকার কিরীটীর দিকে মুখ তুলে তাকালেন।

আমি লোকটির—অর্থাৎ রাঘব সরকারের দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম।

বয়স লোকটার যে পঞ্চাশের নীচে নয় তা দেখলেই বোঝা যায়। কপালের কাছে এবং রগের দু পাশের চুলে পাক ধরেছে। কপাল ও নাকের পাশে বলিরেখা জাগতে আরম্ভ হয়েছে, বয়সের চিহ্ন। কিন্তু সত্যি সুপুরুষ ভদ্রলোক!

শকুন্তলা চৌধুরী মিথ্যা বলে নি, রাঘব সরকারের রূপবর্ণনায় এতটুকু অত্যুক্তি করে নি। মাথার চুল পাতলা হয়ে এসেছে, মধ্যস্থলে টাক দেখা দিয়েছে। প্রশস্ত কপাল। দীর্ঘ চক্ষু। চক্ষুর দৃষ্টিতে বুদ্ধির দীপ্তি। রোমশ জোড়া জ্ব। খাড়া নাক। দৃঢ়বদ্ধ চোয়াল। বৃষস্কন্ধ। টুকটকে গৌর গাত্রবর্ণ। পরিধানে ঢোলা পায়জামা ও পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির তলা থেকে নেটের গেঞ্জীর কিয়দংশ ও রোমশ বক্ষঃস্থলের কিছুটা দেখা যাচ্ছে।

কই দেখি কি স্যাম্পল এনেছেন? রাঘব সরকার আবার বললেন।

সেরওয়ানীর পকেটে হাত চালিয়ে একটি মরক্কো লেদারের ছোট কেস বের করল কিরীটী এবং বাক্সের গায়ের বোতামটি টিপতেই, স্প্রিং অ্যাক্সনে বাক্সের ডালাটা খুলে যেতেই বাক্সের মধ্যস্থিত প্রায় দশ রতির একটি হীরা ঘরের ঈষৎ নীলাভ আলোয় যেন ঝিলমিল করে উঠল।

এই দেখুন—কিরীটী বাক্সসমেত হাতটা এগিয়ে ধরল রাঘব সরকারের দিকে।

রাঘব সরকার কিরীটীর হাত থেকে হীরাটা নিলেন বাক্স থেকে দু আঙুলের সাহায্যে তুলে। এবং বেশ কিছুক্ষণ সময় হীরাটা আলোয় পরীক্ষা করে বললেন, বেলজিয়ান হীরাই। কতগুলো হীরা আছে আপনার কাছে, মিঃ খান?

কিছু আছে—

হুঁ। তা এ হীরা আপনি কোথা থেকে পেলেন মিঃ খান?

কিরীটী মৃদু হেসে বললে, হীরা বেচতে এসেছি, ঠিকুজী বেচতে তো আসি নি মিঃ সরকার।

রাঘব সরকার কিরীটীর কথায় আবার ওর মুখের দিকে তাকালেন পূর্ববৎ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এবং ক্ষণকাল তাকিয়ে থেকে মৃদু হেসে বললেন, এত দামী জিনিসের কারবার তো ঠিকুজী না জানলে হয় না মিঃ খান!

কেন বলুন তো?

কারণ ঠিকুজীর উপরই যে অনেক সময় দামটা নির্ভর করে।

ওঃ, এই কথা! তা বেশ তো, কি রকম ঠিকুজী হলে আপনার পছন্দ হবে বলুন?

মানে?

কথাটা তো আমার অস্পষ্ট বা দুর্বোধ্য নয় মিঃ সরকার, বিশেষ করে আপনার মত একজন অভিজ্ঞ কারবারীর পক্ষে।

তাহলে—

ধরে নিন না, আপনি যা ভেবেছেন তাই। বলুন এবারে দর।

আবার ক্ষণকাল যেন স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলেন রাঘব সরকার কিরীটীর মুখের দিকে। তারপর বললেন নিম্নকণ্ঠে, দরের জন্য আটকাবে না। যত হীরা আপনার কাছে আছে নিয়ে আসবেন।

চেকে কিন্তু পেমেন্ট নেব না।

নগদই পাবেন। কবে আসছেন বলুন?

ফোনে জানাব।

বেশ।

অতঃপর রাঘব সরকারকে নমস্কার জানিয়ে আমরা বের হয়ে এলাম তার ঘর থেকে।

.

রাস্তায় বের হয়ে আবার একটা ট্যাক্সি নেওয়া হল এবং ট্যাক্সিতে উঠে প্রশ্ন করলাম, হীরাটা কার রে?

কিরীটী বললে, আড্ডি জুয়েলার্স থেকে এনেছি—কাল ফিরিয়ে দিতে হবে। অতঃপর ঘণ্টাখানেক ট্যাক্সিতে শহরের এদিক ওদিক উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে সাদার্ন অ্যাভিনুর কাছাকাছি এসে ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে ট্যাক্সি ছেড়ে দেওয়া হল।

রাত তখন প্রায় সাড়ে নটা।

কিরীটী লেকের দিকে হাঁটতে শুরু করল। আমিও ওকে অনুসরণ করলাম।

এতক্ষণ কিরীটী একটি কথাও বলে নি। একেবারে চুপ ছিল। লেকের দিকে হাঁটতে হাঁটতে এতক্ষণে কথা বলল, মিস শকুন্তলা চৌধুরীর কথা যদি সত্যই হয় সুব্রত তাহলে বলবতার পক্ষে ঐ রাঘব সরকারকে এড়ানো সত্যিই কঠিন হবে।

কঠিন হবে।

নিশ্চয়ই। বুঝতে পারলি না লোকটাকে দেখে, ওর কথাবার্তা শুনে—সত্যি সত্যিই একটি খাঁটি রাঘব বোয়াল লোক। গ্রাস যখন করে সম্পূর্ণভাবেই গ্রাস করে ও-জাতের লোকগুলো।

তুই কি রাঘব সরকারকে স্রেফ দেখবার জন্যই ইকনমিক জুয়েলার্সে গিয়েছিলি নাকি কিরীটী? প্রশ্নটা না করে পারি না।

শুধু দেখবার জন্যে হবে কেন?

তবে?

আরো প্রয়োজন ছিল।

কি শুনি?

প্রথমতঃ মিস্ চৌধুরীকে আসতে বলেছি যখন—জানা তো আমার প্রয়োজন সত্যিই তাকে সাহায্য করা শেষ পর্যন্ত আমার পক্ষে সম্ভবপর কিনা!

হ্যাঁ, তা তো বটেই।

কি বললি?

না, বিশেষ কিছু না। এই বলছিলাম—

কি?

সুন্দর মুখের জয় তো সর্বত্রই।

আজ্ঞে না।

আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকবার চেষ্টা কেন বন্ধু!

মাছ যে শাক দিয়ে ঢাকা যায় না তুইও যেমন জানিস আমিও জানি।

সত্যি বলছিস?

হ্যাঁ। সত্যিকারের রহস্যের ইঙ্গিত না পেলে ইকনমিক জুয়েলার্সে রাঘব সরকারকে দেখবার জন্য আর যেই যাক—কিরীটী রায় যেত না।

রহস্যের ইঙ্গিত? মানে তুই সেনরায়কে সেদিন যে কথা বলছিলি—

যাক সে কথা, তোর কেমন লাগল রাঘব সরকার লোকটাকে বল্?

বুদ্ধিমান নিঃসন্দেহে। কিন্তু—

সত্যি সত্যি লোকটার সঙ্গে কেন দেখা করতে গিয়েছিলি বল্ তো!

দেখতে গিয়েছিলাম শ্রীমান দুষ্মন্তর প্রতিদ্বন্দ্বীটি কি ধরনের—

সত্যিই কি তাই?

তা ছাড়া আর কি!

তা কি বুঝলি?

বুঝলাম, লোকটা সত্যিকারের ধনী আর—

আর?

আর সত্যিই যদি হাত বাড়িয়ে থাকে ও শকুন্তলার দিকে, তাকে সে করায়ত্ত করবেই। তাছাড়া আরো একটা কথা নিশ্চয়ই তোর মনে আছে সুব্রত–

কি?

শকুন্তলার কাকা ঐ রাঘব সরকারকে ঘৃণা করা সত্ত্বেও শকুন্তলাকে বলেছেন ওকেই নাকি বিয়ে করতে হবে তাকে।

হ্যাঁ, মনে পড়ছে বটে।

অথচ বিমল চৌধুরী—মানে শকুন্তলার কাকা অধ্যাপক বিমল চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিচয় না থাকলেও তাকে আমি জানি।

জানিস তুই ভদ্রলোককে?

জানি। অধ্যাপক বিমল চৌধুরী হচ্ছেন সেই শ্রেণীরই একজন যারা পাব্লিক-এর চোখে একজন চিহ্নিত হয়ে দাঁড়াবার জন্য একটার পর একটা চেষ্টাই করে এসেছেন কিন্তু নেভার বিন সাকসিডেড়! কৃতকার্য হতে পারেন নি। হতাশের দলে—ডিফিটেড-এর দলে এবং তারা হাতের কাছে কোন সুযোগ পেলে যেমন ছাড়তে পারেন না তেমনি সেই সুযোগের জন্য তাঁরা অনেক কিছুই বিসর্জন দিতে পারেন। আর রাঘব সরকার হচ্ছে সেই শ্রেণীর একজন–যাঁরা ঐ ধরনের সুযোগের বেচা-কেনা করে উচিত মূল্য পেলে

কি বলছিস তুই কিরীটী?

ঠিক ঐ কথাটাই বলতে চেয়েছি আমি, অর্থাৎ রাঘব সরকারের যদি সত্যিই লোভ হয়ে থাকে শকুন্তলার ওপরে—অনন্যোপায় বিমল চৌধুরীকে তা মেনে নিতেই হবে।

.

০৪.

কিরীটী পথ চলতে চলতেই বলতে লাগল, কিন্তু আমি ভাবছি এখনো মিস শকুন্তলা চৌধুরী আমার কাছে আগমনের তার সত্যিকারের কারণটা কেন শেষ পর্যন্ত বলতে পারল না!

কেন, সে তো বললেই, বিয়েটা কোনমতে বাধা দেওয়া যায় কিনা তাদের—

আদৌ না। সে তুই বুঝবি না। তুচ্ছ কারণে সে আমার কাছে আসে নি।

তবে?

সে এসেছিল সত্যিকারের কোন বিপদের আভাস পেয়ে—

বিপদের!

হ্যাঁ, কিন্তু কথাটা আমাকে শেষ পর্যন্ত যে কোন কারণেই হোক বলতে পারে নি।

তবে?

অবিশ্যি বিয়ের ব্যাপারটাও একটা কারণ ছিল। কিন্তু তার পশ্চাতে নিশ্চয়ই ছিল আরো একটা গুরুতর কারণ—যেজন্য সে ছুটে এসেছিল আমার কাছে।

কিন্তু–

কিরীটীর দিক থেকে আর কোন সাড়া পাওয়া গেল না। কথা বলতে বলতে হঠাৎ যেন সে চুপ করে গেল। পকেট থেকে একটা চুরুট বের করে সেটায় অগ্নিসংযোগ করে পুনরায় হাঁটতে লাগল।

লেকের ভিতর দিয়ে আমরা শর্টকার্ট করছিলাম।

লেকটা ইতিমধ্যেই নির্জন হয়ে গিয়েছে। ভ্রমণকারী ও বায়ুসেবীর দল অনেক আগেই চলে গিয়েছে। কদাচিৎ এক-আধজনকে চোখে পড়ছিল। অদ্ভুত একটা শান্ত স্তব্ধতা যেন চারিদিকে ঘনিয়ে উঠেছে।

কৃষ্ণপক্ষের রাত। কালো আকাশে কেবল তারাগুলো পিটপিট করে জ্বলছে।

কিরীটীর নাম ধরে একবার ডাকলামও, কিন্তু কোন সাড়া দিল না কিরীটী, যেমন হেঁটে চলছিল তেমনই হেঁটে চলতে লাগল। কোন একটা চিন্তা চলেছে কিরীটীর মনের মধ্যে। বরাবর দেখেছি মনের ঐ অবস্থায় কখনো সে কথা বলে না।

অগত্যা আমিও ওর পাশে পাশে হেঁটে চললাম।

বোধহয় একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম হঠাৎ কিরীটী দাঁড়িয়ে পড়ল, সুব্রত—

অ্যাঁ! কিছু বলছিলি?

হুঁ, বলছিলাম ভবিকে ভোলাতে পারি নি। নিম্নকণ্ঠে কথাগুলো বলল কিরীটী।

কি বললি?

রাঘব সরকারের লোক আমাদের ফলো করছে—

সে কি!

হ্যাঁ—পিছনে ফিরে দেখ—

সত্যিই ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, আমাদের হাত-পনের দূরে একটা মূর্তি অদূরবর্তী লাইট পোস্টটার নীচে দাঁড়িয়ে।

ঠিক আছে, এক কাজ করা যাক, সামনেই টিপু সুলতান রোডে অমিয় চক্রবর্তী থাকে। এককালে এম-এস-সি ক্লাসে পরিচয় হয়েছিল—চল–

কিরীটী কথাটা বলেই হঠাৎ চলার গতি যেন বাড়িয়ে দিল।

সে-রাত্রে টিপু সুলতান রোডে অমিয়র ওখানে ঘণ্টা-দুই কাটিয়ে কিরীটীর বাসায় যখন ফিরে এলাম রাত তখন সাড়ে এগারোটা।

.

কিরীটীর অনুমানটা অর্থাৎ শকুন্তলা চৌধুরী তার কাছে আসার ব্যাপারটার মধ্যে যে সত্যিই কোনো গুরুতর কারণ ছিল সেটা প্রমাণিত হতে কিন্তু খুব বেশী দেরি হল না। চব্বিশ ঘণ্টাও পুরো অতিবাহিত হল না।

পরের দিন রাত তখন ন টা হবে, নিত্যকার মত কিরীটীর গৃহে বসে বিকেল থেকে আড্ডা দিতে দিতে রাত নটা যে বেজে গিয়েছে টের পাই নি।

আরো একটা ব্যাপার নজরে পড়েছিল, আড্ডা দিলেও কিরীটী যেন কেমন একটু অন্যমনস্ক। এবং ব্যাপারটা একা আমারই নজরে পড়ে নি, কৃষ্ণাও লক্ষ্য করেছিল, কৃষ্ণার কথাতেই সেটা একসময় ধরা পড়ল।

কথার মাঝখানে হঠাৎ একসময় কৃষ্ণা বললে, সেই সকাল থেকে লক্ষ্য করছি কেমন যেন অন্যমনস্ক তুমি, কি ভাবছ বল তো?

কিরীটী তার ওপ্রান্ত থেকে অর্ধদগ্ধ সিগারেটটা হাতে নিয়ে সিগারেটের অগ্রভাগ থেকে অ্যাসট্রেতে ছাইটা ঝাড়তে ঝাড়তে বললে, সত্যিই ভাবছি একটা কথা কৃষ্ণা কাল থেকে।

আমরা দুজনেই ওর মুখের দিকে যুগপৎ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালাম।

কৃষ্ণা শুধাল, কি?

অভিজ্ঞান শকুন্তলম্‌–

সে আবার কি? প্রশ্নটা করে কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল কৃষ্ণা।

শকুন্তলার হাতের হারানো আংটিটা খুঁজে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রাজা দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে চিনতে পেরেছিল যদিও সেটা নাটকীয়–কিন্তু–

কি?

কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম না কেন গত সন্ধ্যায় এ যুগের শকুন্তলা দেবীর মনের কথাটা! কেন ধরতে পারলাম না!

কালকেই সেই মেয়েটার কথাই ভাবছিস নাকি?

হ্যাঁ। শকুন্তলা কেন এসেছিল আমার কাছে? আর যদি এসেছিলই তো আসল কথাটা বলতে পারল না কেন? কি ছিল তার মনে?

কি আবার থাকবে?

তাই তো ভাবছি। তার সারা মুখে যে আশঙ্কার দুর্ভাবনার ছায়াটা দেখেছিলাম সে তো মিথ্যা নয়। শি মাস্ট–ইয়েস—শি মাস্ট—অ্যান্টিসিপেটেড সামথিং! ভয়ের কালো ছায়া সে দেখেছিল—ভয়–

কথাটা কিরীটীর শেষ হল না, ক্রিং ক্রিং করে ঘরের কোণে টেলিফোনটা বেজে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে যেন তড়িৎবেগে কিরীটী উঠে দাঁড়ায় এবং ফোনের দিকে যেতে যেতে নিম্নকণ্ঠে বলে, নিশ্চয়ই শকুন্তলা–

ফোনের রিসিভারটা তুলে নিল কিরীটী, হ্যালো! হা হ্যাঁ, কিরীটী রায় কথা বলছি। কে শকুন্তলা দেবী? হা হ্যাঁ—আই ওয়াজ সো লং এক্সপেকটিং ইউ! কি-কি বললেন, আপনার কাকা মারা গেছেন! হ্যাঁ, হ্যাঁ—যাবো, নিশ্চয়ই যাবো–আচ্ছা—ফোনটা রেখে দিল কিরীটী।

তারপর ফোনগাইড দেখে একটা নাম্বারে ফোন করল, কে—শিবেন? হ্যাঁ, আমি কিরীটী রায় কথা বলছি-বেলগাছিয়া তো তোমারই আণ্ডারে, তাই না? শোন—ঠিক ট্রাম ডিপোর পিছনে নতুন যে বাড়িগুলো হয়েছে—তারই একটা বাড়ি-নম্বর হচ্ছে পি ৬/১, অধ্যাপক বিমল চৌধুরীর বাড়ি—অধ্যাপক চৌধুরী,—হ্যাঁ, প্রবাবলি হি হ্যাজবিন কিল্ড! হ্যাঁ-হ্যাঁ— যাও–কি বললে—হ্যাঁ-হ্যাঁ–যাও। হ্যাঁ আমি আসছি, দেখা হলে সব বলব।

কিরীটী ফোনটা রেখে দিল।

কি ব্যাপার?

শুনলে তো শিবেন সোম থানা-ইনচার্জকে কি বললাম! অধ্যাপক বিমল চৌধুরী হ্যাজবিন কিল্ড।

সত্যিই?

আমার অনুমান তাই।

কে ফোন করছিল, শকুন্তলা চৌধুরী?

হ্যাঁ। কথাটা বলে কিরীটী গিয়ে ভিতরের ঘরে প্রবেশ করল। বুঝলাম সে প্রস্তুত হবার জন্যই ভিতরে গেল।

এতটুকুও আর বিলম্ব করবে না। এখুনি বেরুবে।

.

আমি ভাবছিলাম ব্যাপারটা সত্যি সত্যিই তাহলে যাকে বলে ঘনীভূত হয়ে উঠল।

মনে পড়ল ঐ সঙ্গে, আজই অধ্যাপক বিমল চৌধুরীর জন্মতিথি উৎসব ছিল। শকুন্তলা গতকাল বলে গিয়েছিল অধ্যাপকের জীবনের ঐ দিনটি বিশেষভাবে পালিত হয়। অতিথি, আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবদের দল সব ঐ দিনটিতে আসেন বিমল চৌধুরীকে শুভকামনা জানাবার জন্য।

আজও নিশ্চয়ই এসেছিল সবাই এবং যা বোঝা গেল সেই উৎসবের ও আনন্দের মধ্যেই অকস্মাৎ মৃত্যুর কালো ছায়া নেমে এসেছে। আনন্দরস মৃত্যু-বেদনায় নীল হয়ে গিয়েছে।

কিরীটীর কণ্ঠস্বরে সম্বিৎ ফিরে এল, চল সুব্রত, একবার ঘুরে আসা যাক।

মনটা ইতিমধ্যে আমারও বুঝি কিরীটীর সঙ্গে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, চল–

বিমল চৌধুরীর বাড়িটা খুঁজে পেতে আমাদের দেরি হয় নি। বাড়ির সামনেই পরিচিত কালো পুলিসভ্যান দাঁড়িয়েছিল এবং দুজন লালপাগড়ি দরজার গোড়ায় প্রহরায় ছিল।

বাড়িটা নতুন নয়। পুরাতন দোতলা বাড়ি। সামনে কিছুটা জায়গা জুড়ে বাগানের মত। নানা জাতীয় ফল ও ফুলের সব গাছ।

পরে জেনেছিলাম দীর্ঘদিন ভাড়াটে হিসেবে থেকে মাত্র বছর তিনেক পূর্বে কিনে নিয়েছিলেন অধ্যাপক বাড়িটা।

সেকালের পুরাতন স্ট্রাকচারের বাড়ি। দীর্ঘদিনের সংস্কারের অভাবে কেমন যেন একটা জীর্ণতার ছাপ পড়েছে বাড়িটার গায়ে। সামনেই একটা টানা বারান্দা। মোটা মোটা পাথরের কাজকরা সেকেলে থাম। বারান্দাটা অর্ধচন্দ্রাকৃতি ভাবে উত্তর থেকে পশ্চিমে ঘুরে গিয়েছে। বাড়িটার পিছনদিকে একটা দীঘি ও নারিকেল গাছ। তার ওদিকে খোলা মাঠ। অর্থাৎ সামনের দিকে শহর আর পিছনে গ্রাম।

উপরে ও নিচে খান-আষ্টেক ঘর। বেশ বড় সাইজের ঘরগুলি। পশ্চিম দিক থেকে চওড়া সেকেলে বেলোয়ারী কাচের রঙিন টুকরো বসানো সিঁড়ি। সিঁড়ির শেষপ্রান্তে নীচের তলার মতই বারান্দা।

দোতলায় পিছনের দিকে প্রশস্ত একটি খোলা ছাদ। সেই ছাদেই সামিয়ানা খাটিয়ে ও চেয়ার টেবিল পেতে অতিথিদের অভ্যর্থনার আয়োজন হয়েছিল।

এবং জলখাবারের ব্যবস্থা হয়েছিল নীচের হলঘরে।

.

নীচের তলায়ই শিবেন সোমের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। প্রথমে কিরীটীর মুখে নামটা শুনে ভদ্রলোকের চেহারাটা মনে করতে পারি নি।

কিন্তু সামনাসামনি দেখা হতেই মনে পড়ে গেল, বছর চারেক পূর্বে একটা আফিম চোরাইয়ের তদন্তের ব্যাপারে কিরীটীর ওখানেই ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল আমার। ভদ্রলোক, শিবেনবাবু আমাদের বয়সীই হবেন। তবে বয়সের অনুপাতে একটু যেন বেশী বুড়িয়ে পড়েছেন—গাল কুঁচকে গিয়েছে, কপালে ভাঁজ পড়েছে, মাথার চুল বেশীর ভাগই পেকে গিয়েছে।

এসো এসো কিরীটী, তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম, আহ্বান জানালেন শিবেন সোম।

কিছু জানতে পারলে সোম?

না, এখনো সরেজমিন তদন্তই করি নি। ডেড় বডিটা দেখেছি আর ব্যাপারটা মোটামুটি শুনেছি।

কি শুনলে?

যতটুকু শুনেছি ও দেখেশুনে যা মনে হচ্ছে—

কি?

সেরকম কিছু নয়। ন্যাচারাল ডেথ-স্বাভাবিক মৃত্যু বলেই মনে হচ্ছে। তাছাড়া শুনলামও, ভদ্রলোক কিছুদিন যাবৎ রক্ত-চাপাধিক্যে নাকি ভুগছিলেন।

কিরীটী ঐ কথার কোন উত্তর না দিয়ে সম্পূর্ণ অন্য প্রশ্ন করল, কিন্তু বাড়িটা যেন কেমন চুপচাপ মনে হচ্ছে! নিমন্ত্রিতরা সব চলে গিয়েছেন নাকি?

হ্যাঁ, বেশীর ভাগই চলে গিয়েছেন। সামান্য চার-পাঁচজন আছেন, কিন্তু এখানে যে অনেক নিমন্ত্রিত আজ উপস্থিত ছিলেন তুমি জানলে কি করে?

কথাটা বলে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে শিবেন সোম কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।

ওঁর ভাইঝি—মানে অধ্যাপকের ভাইঝি যে গত সন্ধ্যায় আমার ওখানে গিয়েছিলেন, তার মুখেই শুনেছিলাম আজকের উৎসবের কথাটা।

কে, মিস্ শকুন্তলা চৌধুরী?

হ্যাঁ।

ওঃ, তা তোমার সঙ্গে মিস্ চৌধুরীর পূর্ব-পরিচয় ছিল নাকি?

না। গতকালই প্রথম তাকে দেখি ও প্রথম পরিচয়।

কি রকম?

কিরীটী সংক্ষেপে তখন গত সন্ধ্যার ব্যাপারটা খুলে বলল, কেবল ইকনমিক জুয়েলার্সে হানা দেবার কথাটা বাদ দিয়ে।

আই সী! তাহলে তুমি কি মনে কর–

কি?

ঐ দুষ্মন্তবাবুই—মানে ঐ দুষ্মন্ত রায়ই—

তিনি আসেন নি?

এসেছেন, তবে ঘটনার সময় তিনি ছিলেন না, পরে এসেছেন—

পরে? কখন?

আমি আসার মিনিট কয়েক আগে শুনলাম এসেছেন।

এখনো আছেন নিশ্চয়?

আছেন। কেউই যান নি ঐ ঘটনার পর।

আর কে কে আছেন?

বিমলবাবুর এক সতীর্থ সুধীর চক্রবর্তী, ওঁর এক ভাগ্নে রঞ্জন বোস, এই পাড়ারই এক রিটায়ার্ড জজ মহেন্দ্র সান্যাল, ইকনমিক জুয়েলার্সের মালিক রাঘব সরকার–

আর?

বিমলবাবুর ছেলেবেলার এক বন্ধু–বিনায়ক সেন।

কতক্ষণ আগে ব্যাপারটা জানা গিয়েছে?

তা ধরো ঘণ্টা দুই হবে।

হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে কিরীটী বললে, এখন সোয়া দশটা। তাহলে আটটা পঁয়তাল্লিশের মত সময়ে–

ঐ রকমই হবে—ওঁরা বলছিলেন—

কে–কে বলছিলেন?

শকুন্তলা দেবী।

তিনি কোথায়?

উপরে তার ঘরে।

মৃতদেহ কোথায় পাওয়া গিয়েছে?

তাঁর নিজের ঘরে। বিমলবাবুর বেডরুমেই।

নিজের শোবার ঘরে?

হ্যাঁ, তার শয়নঘরে আরামকেদারাটার উপরে শায়িত অবস্থায়।

মৃতদেহ নিশ্চয়ই ডিসটার্ব করা হয় নি?

না, ঠিক যেমনটি ছিল তেমনটিই আছে।

ভদ্রলোকের তাহলে স্বাভাবিক মৃত্যুই হয়েছে, তাই তোমার ধারণা সোম?

সেই রকমই তো মনে হয়। তাছাড়া তো শুনলে ভদ্রলোক কিছুদিন যাবৎ হাইপারটেনসনে ভুগছিলেন, তাতেই মনে হয় সাডেন স্ট্রোক-এ-

হতে পারে অবিশ্যি, অসম্ভব কিছু নয়। তা ডাক্তার ডাকা হয়েছিল?

আমি এসে ডাক্তারকে আসবার জন্য ফোন করেছি।

মানে এঁরা করেন নি?

না। এভরিওয়ান ওয়াজ সো ননপ্লাস!

.

০৫.

আশ্চর্য, এখনো ডাক্তারই একজন ডাকা হয় নি! কতকটা যেন আত্মগত ভাবেই কথাটা উচ্চারণ করে কিরীটী।

না, হয় নি—তাছাড়া মাত্র তো ঘণ্টাখানেক আগে ব্যাপারটা জানা গিয়েছে, সোম বললেন।

ওঁর মৃত্যুর ব্যাপারটা প্রথমে কার নজরে পড়ে সোম এ-বাড়িতে?

এ বাড়ির অনেকদিনকার পুরাতন ঝি সরমা। সে-ই সর্বপ্রথমে নাকি ব্যাপারটা জানতে পারে, সোম বললেন।

ঠিক ঐ সময় বাইরে একটা গাড়ি থামার শব্দ শোনা গেল।

বোধহয় ডাক্তারবাবু এলেন কিরীটী, সোম বললেন, তুমি একটু অপেক্ষা করো, আমি দেখে আসি।

কথাটা বলে সোম ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

থানা অফিসার শিবেন সোমের অনুমান মিথ্যা নয়, একটু পরে এক প্রৌঢ় ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে সোম এসে ঘরে ঢুকলেন।

ডাক্তার কথা বলতে বলতে এসে ঘরে ঢুকলেন, শুনে হয়ত আশ্চর্য হবেন, আমি ঘণ্টাদেড়েক আগে একবার একটা ফোনে কল পেয়েছিলাম। এই বাড়ি থেকেই কেউ ফোন করেছিল, অধ্যাপককে তাড়াতাড়ি একটিবার দেখে যাবার জন্য। কিন্তু অন্য এক জায়গায় জরুরী একটা কল পেয়ে আমি তখন বেরুচ্ছি, তাই দেরি হয়ে গেল—

সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী যেন বাধা দিয়ে তাকে প্রশ্ন করে, কি বললেন ডাক্তার? ঘণ্টা দেড়েক আগে ফোন করেছিল, এ-বাড়ি থেকে আপনাকে কেউ?

হ্যাঁ।

কে? নাম বলে নি?

নাম! না বলে নি—আর তাড়াতাড়িতে আমিও জিজ্ঞাসা করি নি—

আপনাকে ফোন করেছিল পুরুষ না মেয়ে?

স্ত্রীলোকের কণ্ঠস্বর মনে আছে আমার।

স্ত্রীলোকের কণ্ঠস্বর?

হ্যাঁ।

এ বাড়ির সঙ্গে কি আপনার কোন পূর্ব-পরিচয় ছিল ডাক্তারবাবু? কিরীটী প্রশ্ন করে।

জবাব দিলেন থানা-অফিসার শিবেন সোম, হ্যাঁ, ডাঃ ঘোষ তো এ বাড়ির ফ্যামিলি-ফিজিসিয়ান। মিস চৌধুরীর মুখে ওঁর নাম শুনে তাই তো ওঁকেই আমি ফোন করেছিলাম–

আপনি এ বাড়ির ফ্যামিলি-ফিজিসিয়ান তাহলে ডাঃ ঘোষ?

হ্যাঁ।

কতদিন এঁদের সঙ্গে আপনার পরিচয়?

তা বছর বারো-তেরো তো হবেই—এ পাড়ায় আমি আসা অবধি ওঁরা আমার পেসেন্ট।

তাহলে তো খুব ভালই হল, অধ্যাপকের স্বাস্থ্য সম্পর্কে আপনি ডিটেলস্ খবর দিতে পারবেন! কিরীটী বলে।

তা পারব বৈকি। কিন্তু তার আগে একবার বিমলবাবুকে—

হ্যাঁ দেখবেন বৈকি, চলুন—সোম বললেন।

অতঃপর সকলে আমরা সিঁড়ি দিয়ে দোতলার দিকে অগ্রসর হলাম।

সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতেই কিরীটী ডাঃ ঘোষকে পুনরায় প্রশ্ন করে, ডাঃ ঘোষ, বিমলবাবু রক্তচাপে ভুগছিলেন শুনলাম–

হ্যাঁ, বেশ কিছুদিন ধরে ভুগছিলেন।

রক্তচাপ কি খুব বেশী হয়েছিল?

তা একটু বেশীই ছিল—

ওষুধ খেতেন না উনি?

মধ্যে মধ্যে খেতেন, তবে—

তবে?

রেগুলার কোন ওষুধ খেতেন না।

কেন?

কারণ প্রেসারটা ফ্লাকচুয়েট করত—

ভদ্রলোকের মেজাজ কেমন ছিল?

খুব কুল ব্রেনের লোক ছিলেন।

কিন্তু সাধারণত শুনেছি রক্তচাপাধিক্যে যাঁরা ভোগেন তারা একটু রগচটা প্রকৃতির হন। কিরীটী সহসা প্রশ্ন করে।

না, সে-রকম বড় একটা তাকে মনে হয় নি কখনন, ডাঃ ঘোষ বললেন, এবং শুধু তাই নয়, রাগারাগি চটাচটি বিশেষ তিনি পছন্দ করতেন না এমনও শুনেছি।

আচ্ছা ডাঃ ঘোষ—

বলুন?

বিমলবাবুর শেষ ব্লাডপ্রেসার কবে নিয়েছিলেন, কিছু মনে আছে?

থাকবে না কেন—মাত্র দিন চারেক আগেই তো নিয়েছি।

আপনি মধ্যে মধ্যে নিশ্চয়ই এসে বিমলবাবুর ব্লাডপ্রেসারটা পরীক্ষা করে যেতেন।

না, প্রেসার নেওয়াটা তিনি বিশেষ পছন্দ করতেন না। তবে সেদিন তিনি নিজেই আমাকে ফোন করে ডেকেছিলেন—

কেন?

কিছুদিন থেকে মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছিল তাই—

তার কোন কারণ ঘটেছিল কি?

ঠিক বলতে পারি না, অত্যন্ত চাপা প্রকৃতির লোক ছিলেন তো। তবে–

তবে?

তবে সেদিন তাঁকে দেখে মনে হয়েছিল মনের মধ্যে যেন কিছু একটা দুশ্চিন্তা চলেছে, কেমন যেন একটু বিশেষ আপসেট-বিচলিত মনে হয়েছিল তাকে।

বিচলিত হবার মত কোন কারণ–

না, আমিও জিজ্ঞাসা করি নি তিনিও বলেন নি।

.

দোতলায় যে ঘরের মধ্যে মৃতদেহ ছিল আমরা এসে সেই ঘরের দরজা ঠেলে প্রবেশ করলাম—ডাঃ ঘোষ, থানা-অফিসার শিবেন সোম, কিরীটী ও আমি।

ঘরটা বেশ বড় আকারেরই, দক্ষিণ-পূবমুখী।

সিঁড়ি দিয়ে উঠে বারান্দা দিয়ে দক্ষিণমুখী এগুলে প্রথম দরজাটা দিয়েই সেই ঘরে প্রবেশ করতে হয়। দরজাটা ভেজানো ছিল এবং দ্বারে একজন লালপাগড়ী মোতায়েন ছিল।

ভিতরে প্রবেশ করে কিরীটী দাঁড়িয়ে গেল। ঘরের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে একটা বেতের আর্মচেয়ারে শোয়া অবস্থায় ছিল মৃতদেহ।

হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন ভদ্রলোক চেয়ারে শুয়ে ঘুমিয়ে আছেন। নিমীলিত চক্ষু। একটি হাত বুকের উপরে ন্যস্ত, অন্য হাতটি বামপাশে ঝুলছে অসহায় ভাবে। পরিধানে গরদের পাঞ্জাবি ও দামী শান্তিপুরী ধুতি। সামনেই এক জোড়া কটকী চটি পড়ে আছে।

সামনে ত্রিপয়ের উপর সেদিনকার সংবাদপত্র ও একটি গোল্ড ফ্লেকের সিগারেট টিন, দেশলাই ও চিনামাটির একটি অ্যাশট্রে।

ঘরের উত্তরদিকে দুটি প্রমাণ সাইজের কাঠের আলমারি। একটির পাল্লায় আয়না বসানোঅন্যটিতে বই ঠাসা, কাচের পাল্লা দেওয়া।

ঘরের মধ্যে প্রবেশের তিনটি দরজা, তার মধ্যে উত্তরদিকের ঘরের মধ্যবর্তী দরজাটি বন্ধ ছিল এবং বাথরুমে যাবার দরজাটি ও অন্য দরজাটি খোলাই ছিল।

দক্ষিণমুখী তিনটি জানালাই খোলা ছিল। জানালায় পর্দা দেওয়া।

দক্ষিণ দিক ঘেঁষে জানালা বরাবর খাটের উপরে শয্যা বিস্তৃত। তার পাশে একটি বুকসেলফ। সেলফ-ভর্তি বই।

শয়নঘরটি যে কোন অধ্যাপকের দেখলেই বোঝা যায়।

দেখলাম কিরীটী বেশ কিছুক্ষণ ঘরের চারিদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে এক সময় এগিয়ে গেল মৃতদেহের দিকে।

ইতিমধ্যে ডাক্তার ঘোষের মৃতদেহ পরীক্ষা করা হয়ে গিয়েছিল।

কিরীটী মৃদুকণ্ঠে ডাক্তার ঘোষকে প্রশ্ন করে, কি মনে হয় ডাক্তার ঘোষ? ডেথ ডিউ টু থম্বসিস বলেই কি মনে হয়?

শান্ত মৃদুকণ্ঠে না শব্দটি উচ্চারণ করলেন ডাঃ ঘোষ। এবং সঙ্গে সঙ্গে শিবেন সোম ও আমি ডাক্তার ঘোষের মুখের দিকে তাকালাম।

কিরীটী কিন্তু তাকায় নি। বরং দেখলাম, প্রশ্নটা করে সে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে যেন মৃতের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

ডাক্তার ঘোষের কথাটা তার কানে গিয়েছিল কিনা বুঝতে পারলাম না। কারণ একটু পরেই দেখি সে মৃতদেহের একেবারে সামনাসামনি এগিয়ে গিয়ে মৃতের মুখের কাছে একেবারে ঝুঁকে পড়ে কি যেন তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে লক্ষ্য করছে এবং দেখতে দেখতেই পকেট থেকে একটা লেন্স বের করে সেই লেন্সের সাহায্যে মৃতের মুখের উপরে কি যেন পরীক্ষা করতে লাগল।

তারপর একসময় লেন্সটা পকেটে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল এবং এতক্ষণে কথা বলল, ইয়েস, আই এগ্রি উইথ ইউ ডাক্তার ঘোষ—আপনার সঙ্গে আমি একমত। এবং ইফ আই অ্যাম নট রং—আমার অনুমান যদি ভুল না হয়ে থাকে তো-ডাক্তার ঘোষের মুখের দিকে তাকিয়ে কিরীটী তার কথাটা শেষ করল, ওঁর মৃত্যু ঘটেছে কোন ত্বরিৎক্রিয়াশীল বিষে–

কি বললি কিরীটী? প্রশ্ন করলাম আমিই।

হ্যাঁ, বিষ সুব্রত! কোন বিষের ক্রিয়াতেই ওঁর মৃত্যু ঘটেছে এবং সে বিষ তার অজ্ঞাতে খুনী প্রয়োগ করেছিল বলেই বোধ হয়—অর্থাৎ বিষপ্রয়োগের পূর্বে ওঁকে ক্লোরোফর্মের সাহায্যে খুব সম্ভব ঘুম পাড়ানো হয়েছিল—

ক্লোরোফর্ম! প্রশ্ন করলেন শিবেন সোম।

হ্যাঁ  শিবেন, ভাল করে লক্ষ্য করে দেখো—ওঁর নাকের ডগায় কয়েকটি রক্তাভ বিন্দু আছে—

রক্তাভ বিন্দু!

হ্যাঁ, রুমালে বা কাপড়ে ক্লোরোফর্ম ঢেলে ওঁর নাকের ওপর হয়তো চেপে ধরা হয়েছিল, যার ফলে উনি জ্ঞান হারান। তারপর কোন তীব্র বিষ—

কিন্তু–

অবিশ্যি সঠিক কিভাবে কি ঘটেছে সেটা তদন্ত ও বিশ্লেষণ সাপেক্ষ, এই মুহূর্তেই সব কিছু তোমাকে আমি পরিষ্কার করে বলতে পারব না—সেটা সম্ভবপরও নয়। তবে ব্যাপারটা যে সাধারণ ও স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, এমন কি আত্মহত্যাও নয়, সেইটুকুই বর্তমানে বলতে পারি।

মানে?

মানে বিমলবাবুকে হত্যা করা হয়েছে।

হত্যা!

আমার তাই ধারণা, কিন্তু একটা কিসের শব্দ পাচ্ছি যেন! কিরীটীর শ্রবণেন্দ্রিয় সজাগ হয়ে ওঠে।

বলা বাহুল্য সেই সঙ্গে আমাদের সকলেরই।

এতক্ষণ শব্দটা কানে প্রবেশ করে নি, কিন্তু কিরীটী কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই শব্দটা ঘরের মধ্যে উপস্থিত আমরা সকলেই যেন শুনতে পেলাম।

বাথরুমের দরজাটা ভেজানোই ছিল তবে সামান্য ফঁক হয়ে ছিল, কিরীটী বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আমিও।

দরজাটা হাত দিয়ে ঠেলে খুলে দিতেই শব্দের উৎসটা পরিষ্কার হয়ে গেল। বাথরুমের মধ্যে বেসিনের ট্যাপটা খোলা রয়েছে এবং বাথরুমের আলোটা জ্বলছে।

সেই ট্যাপ দিয়ে জল পড়ার শব্দটা আমাদের কানে এসেছিল।

কিরীটী থমকে দাঁড়ায়। পাশেই দাঁড়িয়েছিলাম আমি।

কিরীটী মৃদুকণ্ঠে ডাকল, সুব্রত!

কি?

একটা তীব্র অথচ মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছিস!

গন্ধটা আমার নাকে প্রবেশ করেছিল এবং আমার পশ্চাতে দণ্ডায়মান শিবেন সোমের নাসারন্ধ্রেও প্রবেশ করেছিল।

তিনিই জবাব দিলেন, হুঁ, পাচ্ছি—

কিসের গন্ধ বলে মনে হচ্ছে বল তো শিবেন?

ঠিক বুঝতে পারছি না—

আমিও না। কথাটা বলে নাক দিয়ে টেনে টেনে গন্ধটা বোঝবার চেষ্টা করে কিরীটী কয়েকবার এবং তারপরই হঠাৎ একসময় বলে ওঠে, হ্যাঁ পেরেছি–ক্লোরোফর্ম–

ঠিক-ঠিক।

ইতিমধ্যে বেসিনের কাছেই একটা টার্কিশ টাওয়েল পড়ে ছিল, কিরীটী এগিয়ে গিয়ে নীচু হয়ে সেটা মাটি থেকে তুলে নিল।

» ০৬-১০. তোয়ালেটা নাকের কাছে তুলে

তোয়ালেটা নাকের কাছে তুলে ধরতেই এতক্ষণ যে গন্ধটা অস্পষ্ট আমাদের সকলের নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করছিল—তার একটা ঝাপ্টা যেন সকলেরই নাসারন্ধ্রে এসে লাগল।

কিরীটী দেখি ততক্ষণে আলোর সামনে তোয়ালেটা ধরে পরীক্ষা করছে এবং পরীক্ষা করতে করতেই মৃদুকণ্ঠে বললে, দেখছি একেবারে নতুন তোয়ালেটা, সামান্য একটু ভিজেও আছে—বোঝা যাচ্ছে কিছুক্ষণ পূর্বেই তোয়ালেটা ব্যবহৃত হয়েছিল।

শেষের কথাগুলো কতকটা যেন আপনমনেই বলে কিরীটী। এবং আর কেউ না বুঝলেও আমি বুঝতে পারি, কিরীটীর মনের মধ্যে একটা চিন্তাধারা চলেছে, যদিচ চিন্তার ধারাটা সুসংবদ্ধ নয়, এলোমেলো তখনো।

এলোমেলো অসংবদ্ধ চিন্তার ধারাটা তার বিশেষ একটি কেন্দ্রে পৌঁছবার চেষ্টা করছে কিন্তু হাতের কাছে এমন কোন নির্ভরযোগ্য সূত্র পাচ্ছে না যার সাহায্যে বা যার ওপর নির্ভর করে সে সেই কেন্দ্রে গিয়ে পৌঁছতে পারে।

আমিও যে মনে মনে ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করছিলাম না তা নয়, কিন্তু বিশেষ কোন নির্ভযোগ্য সূত্র আমিও যেন হাতের কাছে পাচ্ছিলাম না।

একটু বোধহয় অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, এমন সময় কিরীটীর কণ্ঠস্বর কানে এল, চলুন ডাক্তার ঘোষ, ঘরে যাওয়া যাক!

সকলে আমরা পুনরায় ফিরে এলাম পূর্বের ঘরে।

ডাক্তার ঘোষ বললেন, আর একটা জরুরী কল আছে—তাকে ছেড়ে দিলে ভাল হয়।

শিবেন সোম কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।

কিরীটী বললে, হা ডাক্তার ঘোষ, আপাততঃ আপনি যেতে পারেন, তবে আপনাকে পরে হয়ত শিবেনবাবুর প্রয়োজন হতে পারে।

বেশ তো, আমার দ্বারা যতটুকু সম্ভব আমি আপনাদের নিশ্চয়ই সাহায্য করব মিঃ রায়।

বলা বাহুল্য, ইতিমধ্যে একসময় শিবেন সোমই কিরীটী এবং আমার পরিচয় দিয়েছিলেন ডাক্তার ঘোষকে।

ডাক্তার ঘোষ নমস্কার জানিয়ে বিদায় নিলেন।

ডাক্তার ঘোষ ঘর থেকে বের হয়ে যাবার পরই কিরীটী শিবেন সোমের দিকে তাকিয়ে বললে, এঁদের এখানকার সকলের জবানবন্দি নিশ্চয়ই এখনো তোমার নেওয়া হয় নি সোম?

না।

তাহলে সেটাই এবারে শুরু কর।

.

প্রথমেই ঘরে ডাকা হল শকুন্তলা চৌধুরীকে।

পাশের ঘরে এসে ইতিমধ্যে আমরা সকলে বসেছিলাম। এ ঘরটা মৃত অধ্যাপকের শয়নসংলগ্ন ঘর। জানা গেল পূর্বে ঘরটা খালিই পড়েছিল, ইদানীং মাসখানেক হবে বিমলবাবুর ভাগ্নে রঞ্জন বোস এসে ঘরটা অধিকার করেছেন।

ঘরটার মধ্যে বিশেষ কোন আসবাবপত্র ছিল না। একধারে একটি খাটে শয্যা বিছানো, একটি দেরাজ, একটি দেওয়াল-আলনা ও একটি আলমারি। ঘরের এক কোণে একটি টেবিল ও চেয়ার ছিল। গোটাচারেক চেয়ার ঐ ঘরে আনিয়ে ঐ টেবিলটা টেনে নিয়ে শিবেন সোম বসলেন, কিছুদূরে আমরা বসলাম।

শকুন্তলা চৌধুরী ঘরে এসে ঢুকল এবং প্রথমেই সতৃষ্ণ দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকালো।

কিরীটী তখন বললে, বসুন মিস্ চৌধুরী, শিবেনবাবু আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে চান। উনি যা জানতে চান—আশা করি আপনার বলতে আপত্তি হবে না!

না। বলুন উনি কি জানতে চান?

দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, বসুন?

শকুন্তলা নিঃশব্দে কিরীটী কর্তৃক নির্দিষ্ট চেয়ারটায় উপবেশন করল।

শিবেন সোম বললেন, মিস্ চৌধুরী, যদিও ব্যাপারটা আমি মোটামুটি শুনেছি—আপনার মুখ থেকে আর একবার শুনতে চাই।

.

মিস্ শকুন্তলা চৌধুরীর সংক্ষিপ্ত বিবৃতি হচ্ছে।

বিমল চৌধুরী প্রথম যৌবনে বিবাহ করেছিলেন এম-এ পাস করবার পর, কিন্তু বৎসরখানেকের মধ্যেই তার স্ত্রী-বিয়োগ হয় এবং আর দ্বিতীয়বার তিনি বিবাহ করেন নি।

এম-এ পাস করবার পরই তিনি কোন একটি বেসরকারী কলেজে কলকাতায় অধ্যাপনার কাজ নেন। এবং অদ্যাবধি সেই অধ্যাপনার কাজেই নিযুক্ত ছিলেন। বর্তমানে তার বয়স হয়েছিল বাহান্ন বছর।

অধ্যাপনা করে মাইনে যে একটা খুব বেশী পেতেন তা নয়, তাহলেও তার মাসিক উপার্জনটা বেশ যাকে বলে ভালই ছিল, এবং সেই বাড়তি টাকাটা তিনি উপার্জন করতেন তার লেখা কলেজের পাঠ্যপুস্তকগুলো ও অন্যান্য বিষয়ে গবেষণামূলক পুস্তকগুলো থেকে, কাজেই আর্থিক সচ্ছলতা তার বরাবরই ছিল, বেসরকারী কলেজের একজন অধ্যাপক হলেও।

প্রত্যেক মানুষেরই নানা ধরনের কর্মব্যস্ততা ও নেশা বা হবি থাকে।

বিমল চৌধুরীরও ছিল অমনি একটি হবি বা নেশা—নানা ধরনের ব্যবসা করা। জীবনে বহুরকম ব্যবসাই তিনি করেছেন এবং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই তাকে ঐসব ব্যাপারে লোকসান দিতে হয়েছে—একটার পর একটা অকৃতকার্যতায়, কিন্তু তবু তিনি নিরাশ বা নিরুৎসাহ হন নি।

সংসারে তার আপনার জন বলতে ঐ একটিমাত্র ভাইঝি শকুন্তলাই।

শকুন্তলার, বিমলবাবুর মুখেই শোনা, বাবা প্রসাদ চৌধুরী বিমল চৌধুরীর একমাত্র সহোদর ছিলেন। শকুন্তলার যখন তিন বছর বয়স সেই সময় তার মার মৃত্যু হয়। প্রসাদ চৌধুরীও আর দ্বিতীয়বার দ্বারপরিগ্রহ করেন নি। যদিচ শোনা যায়, সি. পি.-তে কেন্দ্রীয় সরকারের ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে মোটা মাইনের চাকরি করতেন প্রসাদ চৌধুরী—তথাপি মৃত্যুকালে একটি টাকাও নাকি মেয়ের জন্য রেখে যেতে পারেন নি, বরং কলকাতার কোন নামকরা মদের দোকানে কিছু ধারই রেখে গিয়েছিলেন।

চাকরিতে ঢোকার পর থেকেই মদ্যপান-দোষ প্রসাদ চৌধুরীর মধ্যে দেখা দেয় এবং স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকে সেটা ক্রমশই বৃদ্ধি পেতে থাকে। এবং মৃত্যুও হয়েছিল তার অতিরিক্ত মদ্যপান করে মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালাতে চালাতে, ভয়াবহ একটা দুর্ঘটনার ফলে স্ত্রীর মৃত্যুর কয়েক মাসের মধ্যেই।

কর্মজীবনে দুই ভাই বিমল ও প্রসাদ চৌধুরী পরস্পর থেকে দূরে অবস্থান করলেও পরস্পরের মধ্যে সম্পর্কটা ছিন্ন হয়ে যায় নি। উভয়েই উভয়ের দেখাসাক্ষাৎ বড় একটা না হলেও খোঁজখবর নিতেন, পরস্পরের মধ্যে পত্রের আদান-প্রদানও ছিল।

সহোদরের আকস্মিক মৃত্যুসংবাদটা তারযোগে পেয়েই সঙ্গে সঙ্গে সি. পি.-তে চলে গিয়েছিলেন এবং সেখানে গিয়ে বিমল চৌধুরী সঙ্গে করে সাড়ে তিন বছরের বাচ্চা ভাইঝি শকুন্তলাকে নিজের কাছে কলকাতায় নিয়ে এলেন। এবং সেই থেকেই শকুন্তলা তার কাকা বিমল চৌধুরীর কাছে আছে।

কিরীটী ঐ সময় বাধা দিল, অবিশ্যি আপনার মনে থাকবার কথা নয়, তবু শুনেও থাকেন কখনো যদি—আপনি যখন এখানে আসেন মিস্ চৌধুরী সে সময় কি ঐ সরমা ঝি এখানে ছিল?

সঙ্গে সঙ্গে শকুন্তলা কিরীটীর মুখের দিকে তাকালো এবং শান্ত মৃদু কণ্ঠে বললে, ছিল কিন্তু সরমা তো ঝি নয় কিরীটীবাবু!

শকুন্তলার কথায় একটু যেন বিস্ময়ের সঙ্গে কিরীটী ওর মুখের দিকে তাকালো।

ঝি নয়! মৃদু কণ্ঠে শুধাল।

না।

তবে যে শুনলাম সে এ বাড়ির পুরাতন ঝি?

না, যা শুনেছেন ভুল শুনেছেন—সে ঝি নয়।

তবে কে সে?

এ বাড়ির সঙ্গে তার কোন আত্মীয়তা বা কোন সম্পর্কই নেই সত্যি মিঃ রায়, তবু সে ঝি নয়। তারপর যেন একটু থেমে বলতে লাগল শকুন্তলা, সরমা এক কৈবর্ত পরিবারের মেয়ে, বারো বছর বয়সের সময় সে বিধবা হয় এবং কাকা তাকে নিজগৃহে আশ্রয় দেন। তার পূর্বইতিহাস এর বেশী কিছু আমার জানা নেই—জানবার চেষ্টাও আজ পর্যন্ত করি নি। এখানে এসে ওকে আমি দেখেছিলাম, মায়ের মতই সে আমাকে মানুষ করেছে—ও ঝি নয়।

ও। আমি ভেবেছিলাম–

শুধু আপনি কেন, বাইরে থেকে কেউ এলে বা কথা শুনলে ঐ রকমই একটা কিছু ভাববে—কিন্তু সে ঝি নয়। এবং কাকা তাকে সেভাবে কোন দিনই দেখতেন না, এ বাড়িতে তার একটি বিশেষ স্থান বরাবরই দেখেছি

ঠিক আছে। আপনি যা বলছিলেন বলুন।

শকুন্তলা চৌধুরী আবার বলতে শুরু করল।

গত পাঁচ বছর ধরে শকুন্তলারই ইচ্ছায় তার কাকা বিমল চৌধুরীর জন্মতিথি উৎসব পালন করা হচ্ছে। আজ সেই জন্মতিথি উৎসবই ছিল।

প্রত্যেকবারই ঐ দিনটিতে বিমল চৌধুরীর কিছু পরিচিত বন্ধুবান্ধব ও সতীর্থকে নিমন্ত্রণ করা হয়। এবারেও জন-পঞ্চাশেককে করা হয়েছিল। উৎসবের সঙ্গে জলযোগের আয়োজন ছিল।

বেলা চারটে থেকেই নিমন্ত্রিতরা সব আসতে শুরু করে ও এক এক করে আবার সন্ধ্যার পর থেকেই চলে যেতে শুরু করে। রাত্রি তখন বোধ করি সওয়া সাতটা হবে। একে একে নিমন্ত্রিতরা সবাই তখন প্রায় চলে গিয়েছে।

সামনের দোতলার ছাদেই সামিয়ানা খাটিয়ে প্যাণ্ডেল বেঁধে উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল।

বিমল চৌধুরী সেখানেই একটা চেয়ারে বসে দীর্ঘদিনের সতীর্থ অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তীর সঙ্গে গল্প করছিলেন, এমন সময় রঞ্জন বোস এসে বলে তার মামাকে কে ফোনে ডাকছে।

বিমল চৌধুরী ভিতরে চলে যান সেই সংবাদ পেয়ে

বাধা দিল ঐ সময় আবার কিরীটী, এক্সকিউজ মি মিস্ চৌধুরী, একটা কথা–

বলুন।

বলছিলাম ঐ রঞ্জনবাবুর কথা। কে যেন বলছিলেন উনি মাসখানেক হলো মাত্র এখানে এসেছেন।

হ্যাঁ, মাসখানেকই হবে।

আচ্ছা রঞ্জনবাবু কি বিমলবাবুর আপন বোনের ছেলে?

হ্যাঁ। ওঁদের একমাত্র বোন সরলা দেবীর ছেলে।

মাসখানেক তাহলে রঞ্জনবাবু এখানে আছেন! কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।

হ্যাঁ।

তার আগে উনি কোথায় ছিলেন?

মালয়ে। সেখানে পিসেমশাইয়ের কিসের যেন ব্যবসা ছিল।

ছিল কেন বলছেন, এখন কি নেই?

না, বছর তিনেক আগে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর রঞ্জনদাই ব্যবসাটা দেখছিল কিন্তু চালাতে পারল না, শেষ পর্যন্ত সেই ব্যবসা অন্যের হাতে চলে যাওয়ায় বাধ্য হয়েই গত মাসে তাকে এখানে চলে আসতে হয়।

আর আপনার পিসিমা?

পিসিমা বছর দশক আগেই মারা গিয়েছেন।

আর ওঁর কোন ভাই-বোন নেই?

না।

এখানে উনি কি করছিলেন?

কিছুই না।

তবে কি বসেছিলেন নাকি?

না, ঠিক তাও নয়—প্রেস ও বইয়ের দোকান করবে বলে কাকার সঙ্গে কিছুদিন ধরে কথাবার্তা চলছিল।

কোন কিছু স্থির হয় নি?

না। কাকা রাজী হচ্ছিলেন না কিছুতেই।

কেন?

বলতে পারি না। তবে—

তবে?

আমার মনে হয়, কাকা যেন রঞ্জনদাকে ঠিক পছন্দ করছিলেন না। দিন দশেক আগে—

কি?

দুজনের মধ্যে খানিকটা কথা-কাটাকাটি হয়ে গিয়েছিল সরমাদির মুখে শুনি।

কি বিষয় নিয়ে হয়েছিল কথা-কাটাকাটি কিছু জানেন?

না।

আপনার কাকা কেন রঞ্জনবাবুকে পছন্দ করতেন না, সে সম্পর্কে কিছু আপনার ধারণা আছে?

না।

রঞ্জনবাবুর স্বভাবচরিত্র কেমন?

ভালই। তাছাড়া রঞ্জনদা অত্যন্ত ভদ্র ও বিনয়ী—

বয়স কত হবে তার?

আমার চাইতে বছর চারেকের বড়।

লেখপড়া?

ম্যাট্রিক পাস।

.

০৭.

শকুন্তলা আবার তার কাহিনী শুরু করল।

বিমল চৌধুরী ফোন ধরবার জন্য আধঘণ্টা চলে যাবার পর রিটায়ার্ড জজ মহেন্দ্র সান্যাল মশাই প্রথম বললেন, চৌধুরী এখনো ফিরছে না কেন? তিনি এবারে বিদায় নেবেন।

ভৃত্যকে ডেকে বিনয়েন্দ্র সেন বিমলবাবুর এক বাল্যবন্ধু, বিমলবাবুকে ডেকে দেবার জন্য বলেন ঐ সময়।

ভৃত্য ডাকতে যাবার কিছুক্ষণ পরেই ভিতর থেকে একটা গোলমালের শব্দ শোনা যায়।

ওঁরা সকলে সেই গোলমাল শুনে এগুতে যাবেন, ভৃত্য ছুটতে ছুটতে এমন সময় এসে হাজির হলো এবং হাউমাউ করে বলে, তার বাবু মারা গিয়েছে–

বিনয়েন্দ্র সেন যেন থমকে যান, সে কি রে!

হ্যাঁ, বাবু! ভৃত্য কাঁদতে কাঁদতে বলে, বাবু নেই—

সকলে একসঙ্গে প্রশ্ন করে, কোথায় কোথায় তোর বাবু?

চলুন দেখবেন, তাঁর শোবার ঘরে চেয়ারের ওপর মরে পড়ে রয়েছেন।

তাড়াতাড়ি সকলে গিয়ে বিমলবাবুর শোবার ঘরে হাজির হয়, এবং ঘরে ঢুকে এখন যে অবস্থায় মৃতদেহ চেয়ারে পড়ে আছে—ঠিক সেই অবস্থায় দেখতে পায়, আর তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সরমা।

সরমার দেহে যেন এতটুকু প্রাণের স্পন্দন নেই। একেবারে পাথরের মূর্তি। মাথার ঘোমটা খসে পড়েছে, দুচোখের কোল বেয়ে নিঃশব্দে দুটি অশ্রুর ধারা গড়িয়ে পড়ছে।

ওঁরা সকলেই স্তম্ভিত বিস্ময়ে যেন কিছুক্ষণ ঐ দৃশ্যের দিকে নিস্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। কারো মুখে কোন কথা ফোটে না, কারো ওষ্ঠে কোন প্রশ্ন আসে না, সবাই যেন বোবা, সবাই যেন স্তব্ধ।

কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ যেন সরমার মধ্যে সম্বিৎ ফিরে আসে। সে মাথার কাপড়টা তুলে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় একটি কথাও না বলে।

মানুষটা যে মারা গিয়েছে কারোরই বুঝতে দেরি হয় না। তবু রিটায়ার্ড জজ মহেন্দ্র সান্যাল বিমলবাবুকে পরীক্ষা করে দেখেন।

দেহটা যদিও তখনো গরম রয়েছে—শ্বাস-প্রশ্বাসের কোন চিহ্নই নেই।

সকলে তবু মহেন্দ্র সান্যালের মুখের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো।

ক্ষীণকণ্ঠে মহেন্দ্রবাবু বললেন, ডেড!

তারপর? শিবেন সোম শকুন্তলার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন।

তারপর সরমাদিকেই প্রশ্ন করে জানা যায়, বিমলবাবুকে কি একটা কথা বলতে নাকি সরমা ঐ সময় তার শোবার ঘরে এসে তাকে ঐ মৃত অবস্থায় দেখে হঠাৎ পাথর হয়ে গিয়েছিল।

এবারে কিরীটীই প্রশ্ন করল, তাহলে সরমা দেবীই প্রথম ব্যাপারটা জানতে পারেন?

হ্যাঁ।

আপনি ঐ সময় কোথায় ছিলেন মিস্ চৌধুরী?

সন্ধ্যা থেকেই মাথার মধ্যে বড় যন্ত্রণা হচ্ছিল, আমি সাতটা নাগাদ গিয়ে আমার ঘরে আলো নিভিয়ে অন্ধকারে শুয়েছিলাম, গোলমাল শুনে ছুটে যাই।

কোন্ ঘরে আপনি থাকেন?

রঞ্জনদার পাশের ঘরটাই আমার ঘর।

আপনি তারপরই বোধ হয় আমাকে টেলিফোন করেন?

হ্যাঁ।

কেন বলুন তো, হঠাৎ আমাকে ফোন করতে গেলেন কেন মিস্ চৌধুরী? প্রশ্নটা করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় কিরীটী শকুন্তলার মুখের দিকে।

কারণ আমার—আমার এ ব্যাপারটা দেখেই মনে হয়েছিল—

কি? কি মনে হয়েছিল মিস্ চৌধুরী?

স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। সামথিং হ্যাপেণ্ড!

কেন?

তা আমি ঠিক বলতে পারব না মিঃ রায়, তবে—তবে আমার যেন তাই মনে হয়েছিল, আর তাই আপনাকে আমি ফোন করি।

ফোনটা কোথায় এ-বাড়ির?

ঘরের সামনে বারান্দাতেই আছে।

মিস্ চৌধুরী।

বলুন?

ফোনে আপনার কাকাকে কেউ ডাকছে এ খবরটা তাকে কে দিয়েছিল বলতে পারেন?

বোধ হয় ভোলা।

ভোলা বুঝি চাকরটার নাম?

হ্যাঁ।

কতদিন কাজ করছে এ বাড়িতে ভোলা?

নতুন এসেছে ও, এক মাসও হবে না, বোধ করি দিন-কুড়ি।

আর চাকর নেই?

আছে, রামচরণ—অনেকদিন সে এ বাড়িতে আছে কিন্তু বুড়ো হয়ে গিয়েছে—তাছাড়া হাঁপানির টান, কাজকর্মের বড় অসুবিধা হয় বলে ঐ ভোলাকে রাখা হয়েছিল। অবিশ্যি আরো একজন ঝি আছে—বুনী!

আচ্ছা মিস্ চৌধুরী, আপনাদের ফ্যামিলি-ফিজিসিয়ান ডাঃ ঘোষ বলছিলেন, কিছুদিন থেকে ইদানীং নাকি বিমলবাবুর মনটা বিক্ষিপ্ত ছিল, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিল—আপনি জানেন কিছু সে সম্পর্কে?

হ্যাঁ, কাকাকে যেন কিছুদিন ধরে বড্ড বেশী চিন্তিত মনে হতো। ফলে মাথার যন্ত্রণাও হচ্ছিল—আর তাই ডাঃ ঘোষকে তিনি কয়েক দিন আগে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তাও জানি।

কারণ কিছু জানেন না?

না।

আচ্ছা, ব্যাপারটা রঞ্জনবাবু সম্পর্কে কোন কিছু বলে আপনার মনে হয় নি?

না, তবে—

তবে?

ইদানীং কিছুদিন ধরে একটা ব্যাপার আমার চোখে পড়ছে–

না।

কি? রাঘব সরকার প্রায়ই কাকার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন।

রাঘব সুরকার!

হ্যাঁ  এবং প্রতি রাত্রেই তিনি এলে, কাকার শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে দুজনের মধ্যে কি সব কথাবার্তা হতো ঘণ্টাখানেক ঘণ্টাদেড়েক ধরে।

কি ব্যাপারে আলোচনা হতো আপনি জানেন না কিছু?

না।

আর একটা কথা মিস্ চৌধুরী—

বলুন?

আপনার যখন ধারণা ব্যাপারটা স্বাভাবিক নয়, কাউকে আপনি কোন রকম সন্দেহ করেন?

সন্দেহ।

হ্যাঁ।

না, সন্দেহ কাকেই বা সন্দেহ করব!

কাকে করবেন তা জিজ্ঞাসা করি নি, জিজ্ঞাসা করছি কাউকে করেন কিনা?

না।

আচ্ছা আপনি যেতে পারেন—বিনয়েন্দ্রবাবুকে পাঠিয়ে দিন—শিবেন সোম বললেন।

শকুন্তলা ঘর থেকে চলে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছিল, হঠাৎ ঐ সময় কিরীটী আবার বাধা দিল, ওয়ান মিনিট মিস চৌধুরী—আর একটা কথা!

শকুন্তলা ঘুরে তাকাল কিরীটীর মুখের দিকে।

আপনার কাকার কোন উইল ছিল, আপনি জানেন?

না।

আচ্ছা আপনি যান।

শকুন্তলা ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

.

বিনয়েন্দ্র সেন।

বিমল চৌধুরীর দীর্ঘদিনের বন্ধু। বেশ হৃষ্টপুষ্ট গোলগাল চেহারা। মাথার কাঁচা-পাকা চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। দুচোখে বুদ্ধির দীপ্তি। দাড়ি-গোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। পরিধানে দামী অ্যাশকালারের ট্রপিক্যাল সুট।

নমস্কার মিঃ সেন, বসুন।

বিনয়েন্দ্র সেন শিবেন সোমের নির্দেশে ওঁর মুখোমুখি চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসলেন।

শুনছিলাম বিমলবাবুর সঙ্গে আপনার দীর্ঘদিনের পরিচয় মিঃ সেন! শিবেন সোম প্রশ্ন শুরু করেন।

হ্যাঁ, হিন্দু স্কুলে একসঙ্গে আমরা চার বছর পড়েছি, তারপর বিদ্যাসাগর কলেজেও চার বছর একসঙ্গে পড়েছি। সেন বললেন।

কি করেন আপনি?

আমার ছবির ডিস্ট্রিবিউসন অফিস আছে বেন্টিঙ্ক স্ট্রীটে—স্বাগতা পিকৰ্চাস অ্যাণ্ড ডিস্ট্রিবিউটার্স।

কলকাতায় কোথায় আপনি থাকেন?

শ্যামবাজারে।

কাছেই থাকেন তাহলে বলুন?

হ্যাঁ।

প্রায়ই তাহলে আপনাদের উভয়ের মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ হতো নিশ্চয়ই?

না, প্রায়ই হতো না, তবে মাসে এক-আধবার হতো।

এবারে কিরীটী প্রশ্ন করল, আজকের আগে শেষ আপনার ওঁর সঙ্গে কবে সাক্ষাৎ হয়েছিল মনে আছে?

বোধ করি দিন দশেক আগে। এই পথ দিয়েই এবোডড্রাম থেকে ফিরছিলাম, দেখা করে গিয়েছিলাম ফিরতি পথে। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক এখানে ছিলাম সেদিন।

কি ধরনের কথাবার্তা সেদিন আপনাদের মধ্যে হয়েছিল?

বিশেষ সেদিন কোন কথাবার্তা হয় নি, বিমল তার ডাইরী থেকে আমাকে পড়ে শোনাচ্ছিল অতীতের সব কথা।

ডাইরী রাখতেন নাকি তিনি?

রাখতে যে সেদিনই প্রথম জানতে পারি, আগে কখনো শুনি নি।

তা হঠাৎ সেদিন ডাইরী পড়ে শোনালেন কেন?

বলছিল হিসেব-নিকেশের সময় ঘনিয়ে এসেছে, তাই একটা জমাখরচের খসড়া নাকি সে তৈরী করেছে।

মিঃ সেন?

বলুন।

সেদিন আপনার সেই বন্ধুর ডাইরী পাঠ থেকে তার জীবনের এমন কোন বিশেষ গোপন কথা কিছু কি জানতে পেরেছিলেন যা পূর্বে কখনো আপনি শোনেন নি তার মুখ থেকে?

তা কিছু জেনেছিলাম।

কি? যদি আপত্তি না থাকে আপনার–

ক্ষমা করবেন, তার জীবনের একান্ত ব্যক্তিগত কথা সে-সব। ইউ মে বী রেস্ট অ্যাসিওরড় কিরীটীবাবু, আজকের দুর্ঘটনার সঙ্গে সে-সবের কোন সম্পর্ক আছে বলে আমার মনে হয় না। তাছাড়া আমার পক্ষে সে-সব কথা বলা সম্ভবও নয়।

বেশ, বলতে আপনার অনিচ্ছা থাকে আপনাকে আমি পীড়াপীড়ি করব না সে সম্পর্কে। কিন্তু একটা কথা, সেদিন আপনার বন্ধুর কথাবার্তায় বা হাবভাবে এমন কিছু কি আপনি লক্ষ্য করেছিলেন যাতে মনে হয় তিনি বিচলিত বা চিন্তিত?

হ্যাঁ, তাকে যেন একটু বিচলিতই মনে হয়েছিল সেদিন।

আর একটা কথা, আপনার বন্ধুর আর্থিক অবস্থা কেমন ছিল জানেন কিছু?

ভালই। ব্যাঙ্কে তার বেশ কিছু নগদ টাকা ফিকস ডিপোজিটে এবং কিছু ক্যাশ সার্টিফিকেটে আছে আমি জানি।

তার পরিমাণ আন্দাজ কত হবে বলে আপনার ধারণা?

তা হাজার পঞ্চাশেক হবে। তাছাড়া—

বলুন? হাজার পঁচিশেক টাকার জীবন-বীমাও তার আছে।

হুঁ। আচ্ছা বলতে পারেন—তার কোন উইল বা ঐ টাকাকড়ি সম্পর্কে কোন ফিউচার প্ল্যান ছিল কিনা?

উইল ছিল কিনা জানি না তবে ইদানীং কিছুদিন ধরে একটা বাড়ি করবে বলে জায়গা দেখছিল বিমল আমি জানি।

আচ্ছা, থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ—আপনি যেতে পারেন।

শিবেন সোম বললেন, অধ্যাপক চক্রবর্তীকে দয়া করে একবার পাঠিয়ে দেবেন এ-ঘরে মিঃ সেন।

মিঃ সেন চলে গেলেন।

.

০৮.

অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তী এসে ঘরে ঢুকলেন।

রোগা লম্বা চেহারা। মাথার চুল ছোট ছোট করে ছাঁটা। খাঁড়ার মত উঁচু নাক। চোখে মোটা কালো সেলুলয়েডের ফ্রেমে পুরু লেন্সের চশমা। কালো কুচকুচে গায়ের বর্ণ। পরিধানে খদ্দরের ধুতি-পাঞ্জাবি।

অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তী ঘরের মধ্যে পা দিয়েই যেন একেবারে যাকে বলে ফেটে পড়লেন। কটা রাত হয়েছে আপনার কিছু খেয়াল আছে দারোগাবাবু? বেশ চড়া সুরেই কথাগুলো বললেন অধ্যাপক চক্রবর্তী।

শিবেন সোম বললেন, তা একটু হয়ে গিয়েছে—

একটু হয়ে গিয়েছে! ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখুন তো, সোয়া এগারোটা রাত এখন–তাছাড়া আমাদের সকলকে এভাবে আটকে রাখার মানেটাই বা কি? আপনার কি ধারণা আমরা কেউ এর সঙ্গে জড়িত আছি?

কিন্তু বুঝতেই তো পারছেন মিঃ চক্রবর্তী, আকস্মিকভাবে দুর্ঘটনাটা ঘটেছে বলেই। আপনাদের এভাবে কষ্ট দিতে হল আমাদের–

দুর্ঘটনা! দুর্ঘটনা কিসের? লোকটা হাইপারটেনশনে ভুগছিল—সাডেন স্ট্রোকে হার্টফেল করেছে—এর মধ্যে দুর্ঘটনার কি আপনারা দেখলেন?

হ্যাঁ  মিঃ চক্রবর্তী, কথা বললে এবারে কিরীটী, হার্টফেল করেই উনি মারা গিয়েছেন সত্য, কিন্তু স্বাভাবিক হার্টফেল নয়—ইটস্ এ মার্ডার অ্যাণ্ড ডেলিবারেট মার্ডার!

কি—কি বললেন?

নিষ্ঠুরভাবে কেউ আপনার বন্ধু বিমলবাবুকে হত্যা করেছে।

হত্যা? বিস্ময়ে যেন অধ্যাপক চক্রবর্তীর কণ্ঠরোধ হয়ে আসে, হত্যা-ইউ মীন—

হ্যাঁ–খুন!

না না—হাউ অ্যাবসার্ড—

অ্যাবসার্ড নয়—নিষ্ঠুর সত্যি সত্যিই হত্যা করা হয়েছে বিমলবাবুকে। কিরীটী আবার বলল শান্ত দৃঢ়কণ্ঠে।

হঠাৎ যেন একটা নির্মম আঘাতে মনে হল অধ্যাপক চক্রবর্তী একেবারে বোবা হয়ে গেলেন। কয়েক মুহূর্ত কেমন যেন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন কিরীটীর মুখের দিকে।

তারপরই চেয়ারটার উপর থ করে যেন বসে পড়লেন।

সত্যি বিমল নিহত হয়েছে! কিন্তু কে কে করল এ কাজ? কতকটা যেন আত্মগতভাবেই নিম্নকণ্ঠে কথাগুলো উচ্চারণ করলেন চক্রবর্তী।

মিঃ চক্রবর্তী।

বোবা দৃষ্টিতে চক্রবর্তী কিরীটীর দিকে মুখ তুলে তাকালেন।

বুঝতে পারছি ব্যাপারটা সত্যিই আপনার কাছে অবিশ্বাস্য লাগছে, আমাদেরও তাই মনে হয়েছিল প্রথমে, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে—

কি–কি মনে হচ্ছে আপনাদের?

আপনাদের সকলের সাহায্য পেলে হয়ত এই অবিশ্বাস্য ব্যাপারটা কি করে ঘটল আমরা তার একটা কিনারা করতে পারব।

আমাদের সাহায্যে?

হ্যাঁ।

কিন্তু কি—কি সাহায্য আমি আপনাদের করতে পারি?

আপনার বন্ধুর আত্মীয়স্বজন বা পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে কেউ এ কাজ করতে পারে বলে আপনার মনে হয়? বলছিলাম এমন কোন ঘটনা আপনি কিছু কি জানেন আপনার বন্ধুর-সতীর্থের জীবনের, যার মূলে এই নৃশংস হত্যার বীজ লুকিয়ে থাকতে পারে!

না না—বিমলের কেউ শত্রু থাকতে পারে বলে অন্ততঃ আমার জানা নেই।

শত্রুই যে এ কাজ করতে পারে মনে করছেন কেন? কোন বিশেষ মিত্রস্থানীয় লোকও স্বার্থের জন্য তো এ কাজ করতে পারে।

স্বার্থ?

হ্যাঁ।

কি স্বার্থ?

তা অবিশ্যি বলতে পারছি না, তবে এটা তো ঠিকই হত্যাকারী বিনা উদ্দেশ্যে ঐ গর্হিত কাজটা করে নি! দেয়ার মাস্ট বী সাম কজ! আচ্ছা একটা কথা কি আপনি জানেন মিঃ চক্রবর্তী, ইদানীং কিছুদিন ধরে আপনার সতীর্থের মনটা বিক্ষিপ্ত ছিল?

হ্যাঁ, সেটা আমি লক্ষ্য করেছিলাম—

লক্ষ্য করেছিলেন?

করেছি বৈকি—

কারণ কিছু জানতে পারেন নি?

না। মানুষটা বরাবর এমন চাপা-প্রকৃতির ছিল, কাউকে কিছু বলতো না—কাউকে নিজের চিন্তার ভাগটা দেওয়াকেও সে দুর্বলতা মনে করত।

তাহলে আপনি কিছু জানেন না, তিনিও আপনাকে কিছু বলেন নি!

.

অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তীর পরে ঘরে ডাক পড়ল রিটায়ার্ড জজ-বিমল চৌধুরীর প্রতিবেশী মহেন্দ্র সান্যালের।

কিন্তু মহেন্দ্র সান্যালও ব্যাপারটার উপরে এতটুকু আলোকসম্পাত করতে পারলেন না।

তিনি বললেন, অধ্যাপকের সঙ্গে প্রতিবেশী হিসাবে যতটুকু ঘনিষ্ঠতা থাকা সম্ভব তার চাইতে কিছুই বেশী ছিল না। তিনিও কখনো তাঁর বাড়ির বা নিজের খবর যেমন জিজ্ঞাসা করেন নি, তেমনি অধ্যাপকও গায়ে-পড়া হয়ে কোনদিন কিছু বলেন নি। অতএব তিনি পুলিসকে কোনরূপ সাহায্য ঐ ব্যাপারে করতে পারছেন না বলে দুঃখিত।

অগত্যা মহেন্দ্র সান্যালকে বিদায় দিতেই হল।

মহেন্দ্র সান্যাল ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

নিমন্ত্রিত হিসাবে সেদিন বাইরের লোক যারা ছিল তাদের সকলকেই অতঃপর বিদায় দেওয়ার জন্য শিবেন সোম বললেন। তারপর বললেন, ওদের বাকী দুজন—ঐ রাঘব সরকার আর দুষ্মন্ত রায়কেই বা আটকে রেখে আর কি হবে কিরীটী, ওদেরও ছেড়ে দিই, কি বল?

না না–রাঘব সরকার আর দুষ্মন্ত রায়কে যে আমার অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করবার আছে! কিরীটী বলে।

জিজ্ঞাসা করছ করো, তবে বিশেষ কিছু ওদের কাছ থেকেও জানা যাবে বলে তো আমার মনে হয় না কিরীটী। শিবেন সোম বললেন।

কিরীটী মৃদু কণ্ঠে বলে, কিছু কি বলা যায়! তাছাড়া তোমাকে তখন বললাম না, মিস্ চৌধুরী চাইছিলেন দুষ্মন্ত রায়কে বিয়ে করতে আর বিমলবাবু চাইছিলেন রাঘব সরকারের সঙ্গে ভাইঝির বিয়ে দিতে!

হ্যাঁ, তা বলেছিলে বটে, কিন্তু—

ডাকো, ডাকো—আগে তোমার ঐ রাঘব সরকারকেই ডাকো!

রাঘব সরকার এসে ঘরে ঢুকলেন।

শিবেন সোমই কয়েকটা মামুলী প্রশ্ন করবার পর কিরীটী মাঝখানে বাধা দিল।

মিঃ সরকার, এ কথা কি সত্যি যে অদূর ভবিষ্যতে একদিন বিমলবাবুর একমাত্র ভাইঝি শকুন্তলা দেবীর সঙ্গে আপনার বিবাহ দেবেন বলে তিনি আপনাকে কথা দিয়েছিলেন?

কথার মাঝখানে কিরীটীর কথাটা এমন অতর্কিতে উচ্চারিত হয়েছিল যে রাঘব সরকার যেন হঠাৎ চমকে উঠে কিরীটীর মুখের দিকে না তাকিয়ে পারলেন না।

কিরীটী আবার প্রশ্ন করল, কথাটা কি সত্যি?

হ্যাঁ।

কথাটা তাহলে সত্যি?

হ্যাঁ। কিন্তু হঠাৎ এ কথাটা আপনি জানলেনই বা কি করে আর জিজ্ঞাসাই বা করছেন। কেন?

জানলাম কি করে নাই বা শুনলেন, আর জিজ্ঞাসা করছি কেন যদি প্রশ্ন করেন তো বলব, ব্যাপারটা কেমন যেন একটু অস্বাভাবিক তাই জানতে চাইছিলাম—

অস্বাভাবিক কেন?

দেখুন মিঃ সরকার, আজকের দিনে অসবর্ণ বিবাহের কথাটা আমি তুলব না, কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই জানেন শকুন্তলা দেবী মনে মনে বিমলবাবুর ছাত্র দুষ্মন্ত রায়কে ভালবাসেন!

না, জানি না।

জানেন না?

না।

কিন্তু–

আর যদি বাসেই, তাতে আমার কি?

কিন্তু একজন নারী মনে মনে অন্য এক পুরুষকে কামনা করে জেনেও সেই নারীকে আপনি বিবাহ করতে চলেছেন!

দেখুন আপনারা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে এনক্রোচ করবেন না।

অবশ্যই করতাম না, যদি আজকের এই দুর্ঘটনাটা না ঘটতে!

মানে কি বলতে চান আপনি?

বলতে যা চাই সেটা কি খুব অস্পষ্ট মনে হচ্ছে আপনার মিঃ সরকার?

অবশ্যই! কারণ সে কথা আসছেই বা কি করে?

আচ্ছা ছেড়ে দিন সে কথা, অন্য একটা কথার জবাব দিন!

বলুন?

অধ্যাপকের সঙ্গে আপনার কি সূত্রে আলাপ হয় প্রথমে?

প্রথমে আলাপ হয়েছিল আমার দোকানের একজন কাস্টোমার হিসাবে।

তারপর?

তারপর আবার কি! সেই আলাপই ক্রমে ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়।

এমন ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হল যে একেবারে বিবাহ-সম্পর্ক! একটু বেশী হল না কি মিঃ সরকার?

কথাটা কিরীটী বেশ শান্ত ও নির্বিকার কণ্ঠে বললেও, মনে হল যেন ব্যঙ্গের একটু সুর লেগে আছে তার বলার ভঙ্গীতে, তার কণ্ঠের স্বরে।

এই সব অবান্তর প্রশ্ন আপনারা কেন করছেন আমি বুঝতে পারছি না! রাঘব সরকার বিশেষ বিরক্তিপূর্ণ কণ্ঠেই যেন কথাটা বলে উঠলেন।

আচ্ছা রাঘববাবু, আপনি নিশ্চয়ই জানতেন আপনার ক্লায়েন্ট ও ভাবী শ্বশুরমশাই রক্তচাপাধিক্যে ভুগছেন! কিরীটী আবার কথা বললে।

না। তীক্ষ্ণ প্রতিবাদ।

জানতেন না?

না।

আশ্চর্য! অমন একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আপনাদের মধ্যে হতে চলেছিল, অথচ ঐ কথাটাই আপনি জানতেন না?

বিরক্তি ও ক্রোধপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন রাঘব সরকার কিরীটীর মুখের দিকে এবং তীক্ষ্ণকণ্ঠে বললেন, মশাই আপনি কে জানতে পারি কি?

উনি পুলিসেরই লোক মিঃ সরকার। জবাব দিলেন শিবেন সোম, উনি যা জিজ্ঞাসা করছেন তার জবাব দিন।

মিঃ সরকার! আবার কিরীটী ডাকল।

মুখে কোন জবাব না দিয়ে পূর্ববৎ বিরক্তিপূর্ণ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে পুনরায় তাকালেন রাঘব সরকার কিরীটীর মুখের দিকে।

আপনার কি এটাই প্রথম সংসার করবার অভিলাষ নাকি?

মানে?

মানে জিজ্ঞাসা করছিলাম, ইতিপূর্বে কি আপনি বিবাহাদি করেন নি?

করেছি।

কি বললেন আপনি? বিবাহ—

হ্যাঁ করেছিলাম—সে স্ত্রী আজ পাঁচ বছর হল গত হয়েছেন।

ছেলেপুলে?

না, নেই।

তাহলে পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা বলুন!

কটমট করে আবার রাঘব সরকার তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে এবং রূঢ়কণ্ঠে বললেন, আপনি বিমলবাবুর মৃত্যুব তদন্ত করছেন, না আমার ঠিকুজিনক্ষত্র সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছেন—কোন্টা করছেন বলতে পারেন?

এক ঢিলে দুই পাখিই মারছি! তবে আপনি একটু ভুল করছেন মিঃ সরকার, বিমলবাবুর মৃত্যুর নয়—হত্যার তদন্ত করছি আমরা!

কি বললেন?

বললাম তো হত্যা!

ও, আপনাদের ধারণা বুঝি বিমলবাবুকে হত্যা করা হয়েছে?

ধারণা নয়, সেটাই সত্য। যাক সে কথা—আচ্ছা আপনি বলেছেন অবিশ্যি একজন খরিদ্দার হিসাবেই বিমলবাবুর সঙ্গে আপনার প্রথম পরিচয় ও পরে ঘনিষ্ঠতা, কিন্তু আমি যেন শুনেছিলাম আপনার সঙ্গে বিমলবাবুর ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল রেসের ময়দানে—কথাটা কি সত্যি?

কি বললেন?

জিজ্ঞাসা করছি রেসের ময়দানেই কি আপনাদের উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল?

হঠাৎ যেন মনে হল রাঘব সরকারের সমস্ত আক্রোশ ও বিরক্তি দপ করে নিভে গিয়েছে। মুখখানা তার যেন একেবারে হঠাৎ চুপসে গিয়েছে।

কি, জবাব দিচ্ছেন না যে?

কিসের জবাব চান?

যে প্রশ্নটা করলাম!

জবাব দেবার কিছু নেই।

কেন?

কারণ কিছু নেই বলে!

I see! আচ্ছা মিঃ সরকার, আপনি যেতে পারেন।

রাঘব সরকার মাথা নিচু করে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। এবং রাঘব সরকার ঘর থেকে বের হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই শিবেন সোম কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ব্যাপারটা ঠিক কি হল মিঃ রায়?

কিসের ব্যাপার?

লোকটা যে রেস খেলে, জানলেন কি করে?

সামান্য একটা সূত্রের উপর নির্ভর করে—স্রেফ অনুমানের ওপরেই ঢিল ছুঁড়েছিলাম। সামান্য সূত্র!

হ্যাঁ, গতকাল ইসমাইল খানের ছদ্মবেশে ওঁর বৌবাজারের ইকনমিক জুয়েলার্সের দোকানে গিয়েছিলাম—

হঠাৎ?

হঠাৎ ঠিক নয়—

তবে?

লোকটা চোরাই জুয়েলস্ ও সিথেটিক জুয়েলস্ অর্থাৎ নকল জহরতের কারবার করে, পূর্বে সেই রকম একটা কথা আমার কানে এসেছিল। তারপর গতকাল ঐ লোকটির কথাই শকুন্তলা দেবীর মুখে শুনে বিশেষ যেন সন্দিগ্ধ হয়ে উঠি। সোজা ইকনমিক জুয়েলার্সে চলে যাই। সেখানে ওর ঘরে বসবার টেবিলে একটা রেসকোর্সের বই দেখতে পাই, তারই ওপরে নির্ভর করে ঢিলটা ছুঁড়েছিলাম অন্ধকারে। কিন্তু যাই হোক, অনুমানটা যে আমার মিথ্যা নয় সে তো আপনিও কিছুক্ষণ আগে দেখলেন!

কিন্তু–

শিবেনবাবু, রাঘব সরকারের মত একজন লোকের সঙ্গে বিমলবাবুর মত একজন লোকের এতদূর ঘনিষ্ঠতা—ব্যাপারটা যেন কিছুতেই আমার মন মেনে নিতে পারছিল না! এবং সত্যি কথা বলতে কি, সহজভাবে যে ব্যাপারটা সম্ভব নয়—এবং তাই সেই গোলকধাঁধা থেকে বেরুবার জন্যই ঐভাবে ঢিলটি আমি ছুঁড়েছিলাম! যাক, এখন আমি নিশ্চিন্ত—অনেক জটিলতাই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে।

জটিলতা?

হ্যাঁ। কিন্তু রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গিয়েছে, আপনার তদন্ত-পর্ব এবারে সত্যি সত্যিই শেষ না করলে যে রাত পুইয়ে যাবে!

.

০৯.

এবারে রঞ্জন বোসকে ডাকা হল।

বয়েস ভদ্রলোকের চব্বিশ থেকে পঁচিশের মধ্যেই বলে মনে হয়। দোহারা চেহারা, গায়ের রঙটা একটু চাপা। চোখে মুখে বেশ একটা বুদ্ধির দীপ্তি রয়েছে। দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা। হাতে সোনার রিস্টওয়াচ। পরিধানে দামী গ্রে কলারের গ্যাবার্ডিনের লংস ও সাদা সার্কস্কিনের হাওয়াই সার্ট।

ভদ্রলোক যে শৌখীন প্রথম দৃষ্টিতেই বোঝা যায়।

শুনেছেন বোধহয় রঞ্জনবাবু, কিরীটীই প্রশ্ন শুরু করে, আপনার মামার মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়—কেউ তাঁকে হত্যা করেছে।

শুনেছি—আপনাদের তাই ধারণা, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না।

বিশ্বাস করেন না?

না।

কেন বলুন তো?

কেন আবার কি? মামার মত নিরীহ একজন ভদ্রলোককে কার আবার হত্যা করবার প্রয়োজন হতে পারে?

ওকথা বলবেন না রঞ্জনবাবু, প্রয়োজন যে কার কখন কিসের হয় কেউ কি বলতে পারে! কিন্তু যাক সে কথা, আপনি তাহলে কথাটা শুনেছেন?

হ্যাঁ।

কিন্তু কার মুখে শুনলেন কথাটা?

কার মুখে!

হ্যাঁ।

তা—তা ঠিক মনে নেই, তবে কানাঘুষা শুনছিলাম ভিতরে—

হুঁ। আচ্ছা রঞ্জনবাবু, মালয় থেকে হঠাৎ আপনি চলে এলেন কেন?

মালয়ের কথাটা যখন শুনেছেন, তখন নিশ্চয় এও শুনেছেন কেন সেখান থেকে চলে আসতে বাধ্য হয়েছি!

হ্যাঁ শুনেছি—তবু আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই।

কি ঠিক শুনতে চান বলুন?

আপনার বাবার ব্যবসাটা হঠাৎ ফেল করল কি করে?

বাবার নিজের গাফিলতির জন্য!

কি গাফিলতি?

সে-সব শুনে কি করবেন?

টাকার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনে অনেক রকম সমস্যা এসে দেখা দেয়—সেই সব আর কি!

ওঃ, আচ্ছা রঞ্জনবাবু, মালয়ে থাকতে আপনার মামা বিমলবাবুর সঙ্গে নিশ্চয়ই আপনাদের নিয়মিত চিঠিপত্র চলতো?

চলতো বৈকি। যাকে বলে–বাবার মামার সঙ্গে রেগুলার চিঠিপত্র চলতো।

তাহলে আপনাদের পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ ছিল?

নিশ্চয়ই।

রঞ্জনবাবু, আপনার মামাকে হত্যা করার ব্যাপারটা কি মনে হয়? কাউকে সন্দেহ করেন কি?

না মশাই, সন্দেহ করব কি, শোনা অবধি তো যাকে বলে একেবারে তাজ্জব বনে গিয়েছি!

ভাল কথা রঞ্জনবাবু, রাঘব সরকারের সঙ্গে তাণনার বোন শকুন্তলা দেবীর বিয়ের কথা কিছু শুনেছিলেন?

এখানে এসেই তো শুনেছি—

আপনার সমর্থন ছিল ব্যাপারটায়?

আদপেই না। মামাকে সে কথা বলেছিও, কিন্তু মামা অ্যাডামেন্ট-কারো কথাই শুনবেন না!

বলতে পারেন, তা আপনার মামাই বা এ ধরনের বিয়েতে কেন জিদ করছিলেন?

কে জানে মশাই কেন—তাছাড়া মামা যদি বিয়ে দিতে পারেন আর শকুন্তলা যদি বিয়ে করতে পারে তো আমার কি বলুন!

দুষ্মন্ত রায়কে শকুন্তলা দেবী মনে মনে ভালবাসেন, আপনি জানেন?

তা জানতাম।

জানতেন?

হুঁ। শকুন্তলাই তো আমাকে কথাটা বলেছিল।

তাই বুঝি! তা দুষ্মন্ত রায়কে আপনার কেমন লোক বলে মনে হয় রঞ্জনবাবু?

এমনি মন্দ লোক নয়, তবে এক নম্বরের কাওয়ার্ড! ভীতু—

ভীতু?

নয় তো কি—ভালবাসতে পারিস, আর জোর করে যাকে ভালবাসিস তাকে বিয়ে করতে পারিস না!

তা সত্যি। আচ্ছা রঞ্জনবাবু, আপনি তো আপনার মামা যে ঘরে থাকতেন তার পাশের ঘরেই থাকেন!

হ্যাঁ।

ইদানীং রাঘব সরকার রাত্রে এলে আপনার মামার ঘরে দরজা বন্ধ করে তাদের মধ্যে কি সব কথাবার্তা হতো কখনো শুনেছেন কিছু?

না মশাই। তবে—

তবে?

একটা ব্যাপার ইদানীং লক্ষ্য করে কেমন যেন আশ্চর্যই লাগছিল।

কি?

মামা যেন রাঘব সরকারের কাছে কেমন কেঁচোটি হয়ে থাকতেন।

হুঁ। আচ্ছা রাঘব সরকার লোকটিকে আপনার কি রকম মনে হয় রঞ্জনবাবু?

একটি বাস্তুঘুঘু।

বাঃ, বেশ বলেছেন! সত্যি আশ্চর্য, জন্মাবধি আপনি মালয়ে থেকেও এমন চমৎকার বাংলা দেশের প্রবচনগুলো আয়ত্ত করেছেন! সত্যিই আপনার তারিফ না করে পারছি না।

অ্যাঁ, কি বললেন? যেন একটু থতমত খেয়েই কথাটা বলেন রঞ্জনবাবু।

না, কিছু না। আচ্ছা রঞ্জনবাবু, সরমা দেবী তো এ বাড়িতে অনেক দিন আছেন, তাই?

সেই রকমই তো শুনেছি।

আচ্ছা তার সম্পর্কে আপনার কি ধারণা?

ওসব স্ক্যাণ্ডেলাস অ্যাফেয়ার নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি নাই বা করলেন মশাই—

স্ক্যাণ্ডেলাস অ্যাফেয়ার!

নয় তো কি–ওসব হচ্ছে ড়ুবে ড়ুবে জল খেয়ে একাদশী করা! ও ঢাক-ঢাক গুড-গুড করলে কি হবে—ব্যাপারটা তো আর জানতে কারো বাকী নেই!

কথাটা খুলেই বলুন না।

না মশাই, মরে গেলেও গুরুজন ব্যক্তি তোপাপ-কথা আর এ-মুখে না-ই উচ্চারণ করলাম!

হুঁ, আচ্ছা থাক থাক।

.

১০.

রঞ্জন বোসকে বিদায় দেবার পর কিরীটীর ইচ্ছাক্রমেই ডাকা হল এবারে দুষ্মন্ত রায়কে।

গত সন্ধ্যায় দুষ্মন্ত রায়ের চেহারার বর্ণনাপ্রসঙ্গে শকুন্তলা বলেছিল রাঘব সরকারের চেহারার সঙ্গে তুলনায় নাকি দুষ্মন্ত রায় আদৌ আকর্ষণীয় নয়। কথাটা যে মিথ্যে নয় প্রথম দৃষ্টিতে তাই মনে হবে সত্যিই।

কিন্তু কিছুক্ষণ দুষ্মন্ত রায়ের দিকে চেয়ে থাকলে মনে হবে ঠিক উল্টোটিই।

দুষ্মন্ত রায়ের চেহারার মধ্যে কোন একটা সহজগ্রাহ্য রূপ বা সৌন্দর্যের আকর্ষণ নেই সত্যি, কিন্তু এমন একটা বিশেষ অথচ চাপা আকর্ষণ আছে যা একবার নজরে পড়লে নজর ফিরিয়ে নেওয়া কষ্টসাধ্য। যেহেতু একবার সেই বিশেষত্ব কারো চোখে পড়লে সেটা মনের মধ্যে দাগ কেটে বসবেই—এবং সে রূপের বর্ণনাও দেওয়া যেমন দুঃসাধ্য, বোঝানোও বুঝি তেমনি কষ্টকর।

লোকটি লম্বা, কিন্তু দেহে ঠিক পরিমিত পেশী ও মেদ থাকার দরুন লম্বা মনে হয় না। দেহের রঙ কালো—যাকে বলে রীতিমত কালো। কিন্তু সেই কালো রঙের মধ্যেও যেন অদ্ভুত একটা দ্যুতি আছে। গাল দুটো ভাঙা। নাকটা খাড়া। প্রশস্ত ললাট। রেশমের মত একমাথা অযত্নবিন্যস্ত তৈলহীন লালচে চুল। দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো।

পরিধানে ধুতি ও গেরুয়া রঙের খদ্দরের পাঞ্জাবি।

আপনার নাম দুষ্মন্ত রায়? শিবেন সোমই প্রশ্ন শুরু করলেন।

হ্যাঁ। মৃদুকণ্ঠে জবাব এল। এবং কণ্ঠস্বরে একটা আত্মপ্রত্যয় বা আত্মদৃঢ়তা যেন স্পষ্ট। সেই হেতুই বোধ হয় আবার দুষ্মন্ত রায়ের মুখের দিকে তাকালাম।

বসুন। শিবেন সোম বললেন।

দুষ্মন্ত রায় একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন।

কি করেন আপনি?

বিমলবাবুর কাছে ডক্টরেটের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম।

এ বাড়ির সকলের সঙ্গেই আপনার বিশেষ ঘনিষ্ঠতা আছে দুষ্মন্তবাবু, তাই না? প্রশ্নটা করল কিরীটীই এবারে।

এ বাড়ির সকলকেই আমি চিনি। জবাব দিলেন দুষ্মন্ত রায়।

দুষ্মন্তবাবু! আবার কিরীটী প্রশ্ন করে।

বলুন?

কথাটা কি সত্যি যে, শকুন্তলা দেবীকে আপনি বিশেষ দৃষ্টিতে দেখেন এবং তিনিও আপনাকে দেখেন?

ঠিকই শুনেছেন। পরস্পর আমরা পরস্পরকে ভালোবাসি।

আপনার অধ্যাপক নিশ্চয়ই ব্যাপারটা জানতেন! কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।

বলেছিলাম তাকে।

কি বলেছিলেন?

কুন্তলাকে আমি বিয়ে করতে চাই—

আপনার সে কথার কি জবাব দিয়েছিলেন তিনি? সম্মত হয়েছিলেন কি?

রাজী হন নি। প্রথমদিকে তার নীরব সম্মতিই ছিল, কিন্তু পরে কথাটা তুলতে কেন জানি না–

রাজী হন নি?

না। তবে রাজী তিনি না হলেও আমাদের কি এসে যাচ্ছে সে সাবালিকা, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তিনি দাঁড়াতে পারেন না আইনত!

তাকে এ কথা বলেছিলেন নাকি?

না, প্রয়োজন বোধ করি নি।

আচ্ছা আপনি কি জানতেন, আপনার অধ্যাপকের ইচ্ছা ছিল শকুন্তলা দেবীকে তিনি রাঘব সরকারের সঙ্গে বিয়ে দেবেন?

শুনেছিলাম কথাটা। শকুন্তলাই আমাকে বলেছিল। কিন্তু তাতেই বা কি এসে গেল!

আচ্ছা শকুন্তলা দেবী কি আপনার সঙ্গে একমত?

না।

মানে–তার মত–

না, তার মত ছিল না। কাকা যতদিন বেঁচে আছেন তাঁর বিরুদ্ধে শকুন্তলার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয় এই কথাই সে বলেছিল।

তা হলে বলুন আপনার পরিকল্পনাটা ভেঙে গিয়েছিল?

না, ভেঙে যাবে কেন? এইটুকুই শুধু বুঝেছিলাম, কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে—মানে বিমলবাবুর মৃত্যু পর্যন্ত

কিন্তু দুষ্মন্তবাবু, আপনার অধ্যাপক হঠাৎ রাঘব সরকারের সঙ্গেই বা শকুন্তলা দেবীর বিয়ে দেবার জন্য স্থিরপ্রতিজ্ঞ হয়েছিলেন কেন? কিছু শুনেছিলেন সে-সম্পর্কে কখনো কারো

কাছে?

না।

শকুন্তলা দেবীও আপনাকে কিছু বলেন নি?

না।

আচ্ছা রাঘব সরকারের সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে নিশ্চয়ই?

না।

কিন্তু এ বাড়িতে তো আপনাদের দুজনেরই যাতায়াত ছিল, সেক্ষেত্রে তো পরস্পর আপনাদের দেখা-সাক্ষাৎ হওয়াটা–

দেখা হবে না কেন—বহুবার হয়েছে!

তবে?

কেন যেন লোকটাকে আমার ভাল লাগে না—

লোকটাকে আপনার ভাল লাগত না?

না।

কিন্তু একটু আগে তার সঙ্গে, সামান্যক্ষণের জন্য হলেও, আলাপ করে তো আমাদের ভালই লাগল। তবে আপনার

তবে আমার কেন ভাল লাগে না লোকটাকে, এই তো আপনার প্রশ্ন? দেখুন কাউকে কারো ভালো লাগালাগির ব্যাপারটা একান্তই ব্যক্তিগত নয় কি? এবং তার জন্য কি সর্বক্ষেত্রেই কোন কারণ থাকে বা থাকতেই হবে-এমন কোন কথা আছে?

দুষ্মন্ত রায়ের কথা বলার ভঙ্গির মধ্যে এমন একটা বিশেষত্ব ছিল যে পুনরায় তার মুখের দিকে আপনা হতেই যেন দৃষ্টি আমার আকর্ষণ করে।

মনে হল মুখের কোথাও হাসি না থাকলেও, তার দুই চোখের দৃষ্টিতে একটা চাপা হাসির বিদ্যুৎ যেন খেলছে। এবং বলাই বাহুল্য, ব্যাপারটা যে কিরীটীর প্রখর দৃষ্টিকে এড়িয়ে যায় নি—তার পরবর্তী কথাতেই সেটা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়।

কথাটা সত্যিই আপনি মিথ্যা বলেন নি দুষ্মন্তবাবু! নইলে দেখুন না, ভাগ্যে মনের অগোচরে পাপ নেইনচেৎ পাশাপাশি দিনের পর দিন আমাদের কত বন্ধু, সুহৃদ ও পরিচিত জনের পক্ষেই বাস করাটা অসম্ভব হয়ে উঠত, তাই নয় কি?

চেয়ে ছিলাম তখন আমি একদৃষ্টে দুষ্মন্ত রায়েরই মুখের দিকে।

মনে হল কিরীটীর ঐ কথায় মুহূর্তের জন্য যেন দুষ্মন্তর দুই চোখের তারায় বিদ্যুৎ ঝিলিক দিয়ে গেল, অথচ সমস্ত মুখখানা মনে হল ভাবলেশহীন, একান্ত নিস্পৃহ।

দুষ্মন্তবাবু! আবার প্রশ্ন করে কিরীটী, আজ নিশ্চয়ই এখানে আপনিও নিমন্ত্রিতদের মধ্যেই একজন ছিলেন?

হ্যাঁ।

দেরিতে এসেছেন একটু শুনলাম?

হ্যাঁ, একটা কাজে আটকা পড়েছিলাম—

তা হলে আর আপনাকে কি জিজ্ঞাসা করব আজকের ব্যাপারে! কথাটা বলেই একটু যেন থেমে আবার প্রশ্ন করে, আচ্ছা দুষ্মন্তবাবু, আজকের এই দুর্ঘটনাটা আপনার ঠিক কি বলে মনে হয়? মানে বলছিলাম, আপনার অধ্যাপকের হত্যার ব্যাপারটা

ব্যাপারটা আদৌ হত্যা বলে মনে হয় না।

কেন?

আপনারা চেনেন না, কিন্তু আমার অধ্যাপককে দীর্ঘদিন ধরে আমি চিনতাম—তাকে কেউ হত্যা করবে তা যে কারণেই হোক আমার চিন্তা, বুদ্ধি, বিবেচনা বা যুক্তির বাইরে।

কিন্তু তবু তাকে হত্যা করাই যে হয়েছে আমরা জানি! দৃঢ়কণ্ঠে কিরীটী কথাটা বলে।

শুনেছি। তবু ঐ কথাই আমি বলব।

আচ্ছা দুষ্মন্তবাবু, আপনি যেতে পারেন। শিবেন সোম বললেন।

ধন্যবাদ।

দুষ্মন্ত রায় উঠে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে উদ্যত হতেই কিরীটী তাকে কতকটা বাধা দিয়েই যেন পিছন থেকে ডেকে ওঠে, এক্সকিউজ মি, জাস্ট এ মিনিট দুষ্মন্তবাবু!

ঘুরে দাঁড়ায় দুষ্মন্ত রায় কিরীটীর দিকে তাকিয়ে।

আপনি নিশ্চয়ই জানেন দুষ্মন্তবাবু, শকুন্তলা দেবীকে মনোনীতা স্ত্রী হিসাবে রাঘব সরকার একটি আংটি দিয়েছেন এবং সে আংটিটি শকুন্তলা দেবীর আঙুলেই এখনো আছে!

না।

সে কি! জানেন না আপনি?

না।

দেখেনও নি?

না।

ওঃ। আচ্ছা আপনি যেতে পারেন।

দুষ্মন্ত রায় অতঃপর ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

কিরীটী দুষ্মন্ত রায়ের গমনপথের দিকেই তাকিয়েছিল, দুষ্মন্ত রায়ের দেহটা দরজার ওপাশে অদৃশ্য হয়ে যাবার পর কিরীটী শিবেন সোমের দিকে ফিরে তাকাল, শিবেনবাবু!

কিছু বলছিলেন মিঃ রায়?

না, কিছু না বলছিলাম কেবল রাত অনেক হল, এবারে সরমা দেবীকে ডেকে যা জিজ্ঞাসা করবার করে আজকের পর্বটা তা হলে চুকিয়ে ফেলুন! ক্ষিদেটা তো থিতিয়েই গেল—ঘুমটাও না আজকের রাতের মত থিতিয়ে যায়!

মৃদু হেসে কথাটা বলতে বলতে কিরীটী এতক্ষণে পকেট থেকে একটা সিগার বের করে সেটায় অগ্নিসংযোগ করল।

শিবেন সোম সরমা দেবীকে ডাকবার জন্যই বোধ হয় ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

.

সরমা দেবীকে সঙ্গে নিয়েই মিনিট পাঁচেক পরে শিবেন সোম ঘরে এসে পুনঃপ্রবেশ করলেন।

বসুন সরমা দেবী, আপনাকে এ সময় বিরক্ত করতে হচ্ছে বলে আমরা দুঃখিত, কিন্তু উপায় নেই—

সরমা নিঃশব্দে খালি চেয়ারটার উপরে উপবেশন করল।

তাকালাম আমি মহিলাটির দিকে। এবং তার মুখের দিকে চেয়ে প্রথম দৃষ্টিতেই মনে হয়েছিল সেরাত্রে বিমলবাবুর গৃহে সরমার পরিচয় যাই হোক না কেন, সে যে এ-বাড়ির দাসী নয়—কথাটার মধ্যে এতটুকুও শকুন্তলার অত্যুক্তি ছিল না।

মাথার উপরে পরিধেয় সরু কালোপাড় ধুতির গুণ্ঠনটা আধাআধি টানা সাদা সিঁথি। অনবগুণ্ঠনটি বলা উচিত।

লম্বা দোহারা গড়ন দেহের। গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল শ্যাম। চোখেমুখে কোন তীক্ষ্ণতা বা বুদ্ধির দীপ্তি নেই বটে তবে কোমলতা আছে। আর আছে যেন আত্মসমাহিতের একটি নিবিড়তা। সুডৌল দুটি হাতে একগাছা করে ক্ষয়ে যাওয়া সোনার রুলি আর গলায় সোনার সরু একটি বিচেহার। হাত দুটি কোলের উপরে রেখে বসেছিল সরমা নিঃশব্দে।

সরমা দেবী!

কিরীটীর ডাকে চোখ তুলে তাকাল সরমা। চোখের দৃষ্টিতে যেন একটু বিস্ময়।

দেবী বলে সম্বোধন করাতেই সে অমনি করে তাকিয়েছিল কিনা কে জানে!

এ বাড়িতে—মানে বিমলবাবুর এখানে আপনি অনেকদিন আছেন শুনলাম—

দৃষ্টি নত করল সরমা। কোন জবাব দিল না।

কত বছর হবে আন্দাজ?

অনেক দিন আছি আমি এখানে—

এতক্ষণে শান্ত মৃদু কণ্ঠে কথাগুলো উচ্চারিত হল।

আপনি এ বাড়িতে যখন অনেকদিন আছেন—এঁদের একপ্রকার পরম আত্মীয়ার মতই হয়ে গিয়েছিলেন ধরে নিতে পারি নিশ্চয়ই সরমা দেবী!

অনাত্মীয় হলেও এবং এঁদের সঙ্গে কোনপ্রকার সম্পর্কই আমার না থাকলেও, এঁরা বরাবর আমাকে স্নেহ ও ভালবাসা দিয়ে এসেছেন।

এঁরা মানে আপনি নিশ্চয়ই বলছেন অধ্যাপক বিমলবাবুর কথা ও তার ভাইঝি শকুন্তলা দেবীর কথা।

হ্যাঁ।

অবশ্যই সেটা তো স্বাভাবিক, কিন্তু আমি জিজ্ঞাসা করছিলাম—এঁদের সংসারের একজনের মত থেকে নিশ্চয়ই আপনি এঁদের পারিবারিক অনেক কথাই জানবার সুযোগ পেয়েছেন সরমা দেবী!

আপনাকে তো একটু আগেই বললাম, এঁদের পরিবারের মধ্যে থাকলেও আমি তো এঁদের কোন আপনজন নই—

এতক্ষণে বুঝতে পারি, চোখেমুখে সরমার বুদ্ধির দীপ্তি না থাকলেও ভদ্রমহিলা বুদ্ধিমতী। এবং শুধু বুদ্ধিমতীই নয়—নিরতিশয় সতর্ক।

কিরীটীও বোধ হয় উপলব্ধি করতে পেরেছিল ব্যাপারটা। তাই এবারে সোজাসুজিই প্রশ্ন করল, সরমা দেবী, এঁদের আপনি একজন আত্মীয় না হলেও নিশ্চয়ই জানেন দুষ্মন্তবাবুর সঙ্গে শকুন্তলা দেবীর একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল উভয়ের মেলামেশার ফলে?

অনুমান করেছি।

হুঁ। আচ্ছা বিমলবাবু নিশ্চয়ই সে কথা জানতেন?

অনুমান হয় জানতেন।

অনুমানের চাইতে বেশী কিছুই নয় আপনি বলতে চান কি?

যতটুকু আমি জানি তাই বলেছি। শান্ত কণ্ঠে জবাব এল।

১১-১৫. সরমা দেবীর শেষের কথায়

সরমা দেবীর শেষের কথায় মনে হল, কিরীটী মুহূর্তকাল যেন কি ভাবল। তারপর সহসা যেন দুপা এগিয়ে এল, চেয়ারে উপবিষ্টা সরমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, আপনি মুখে স্বীকার না করলেও আমার কিন্তু ধারণা এ বাড়ির, বিশেষ করে বিমলবাবু ও তার ভাইঝির কোন কথাই আপনার অজানা নয়।

চোখ তুলে তাকাল নিঃশব্দে সরমা কিরীটীর মুখের দিকে।

হ্যাঁ, কারণ আপনার সম্পর্কে যেটুকু ইতিপূর্বে শকুন্তলা দেবীর কাছ থেকে জেনেছি, তাতে করে আমার অনুমান আপনি অনেক কিছুই জানেন।

দেখলাম নিঃশব্দে তখনো সরমা তাকিয়ে রয়েছে কিরীটীর মুখের দিকে।

হ্যাঁ, কিরীটী আবার বললে, আপনি হয়তো সব কথা বলতে ইচ্ছুক নন, অবশ্যই আপনি স্বেচ্ছায় না বললে আমি পীড়াপীড়ি করব না, কিন্তু আমি ভেবেছিলাম—

দেখছি ঠিক পূর্বের মতই তাকিয়ে আছে সরমা কিরীটীর মুখের দিকে নিস্পলক দৃষ্টিতে, নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে।

ভেবেছিলাম বিমলবাবুর নৃশংস হত্যার তদন্তের ব্যাপারে অন্ততঃ আপনার অকপট সাহায্যই পাব!

ধীরে ধীরে সরমা এতক্ষণে কথা বলল আবার, আমি যা জানি সবই বলেছি।

কিরীটী মৃদু হাসল। তারপর পূর্ববৎ শান্তকণ্ঠে বলল, ঠিক আছে। আচ্ছা সরমা দেবী, দুষ্মন্তবাবুর মত পাত্রকে বাদ দিয়ে বিমলবাবু হঠাৎ প্রৌঢ় রাঘব সরকারের সঙ্গে শকুন্তলা দেবীর বিবাহ দেবেন স্থির করলেন কেন বলুন তো? কিছু অনুমান করতে পারেন?

না, অনুমান করতে পারি না কিন্তু কার কাছে শুনলেন এ-কথা?

শকুন্তলা দেবীর মুখে। কিরীটী বলে।

সে বলেছে আপনাকে এ কথা?

হ্যাঁ।

তা হলে সে নিশ্চয় একথা বলেছে, কেন তিনি ঐ কাজ করতে মনস্থ করেছিলেন!

না, সে-কথা তিনি স্পষ্ট করে কিছুই বলেন নি। কেবল বলেছেন, বিমলবাবু তাই স্থির করেছিলেন–

তা তো ঠিকই, তার ভাইঝি—ভাইঝির বিবাহ তিনি কার সঙ্গে দেবেন বা না-দেবেন সেটা সম্পূর্ণ তার ইচ্ছা–

কিন্তু আমি জিজ্ঞাসা করছিলাম, কেন তার অমন ইচ্ছাটা হল সে-সম্পর্কে কিছু আপনি জানেন কিনা?

ব্যাপারটা অনেকদিন আগে থাকতেই স্থির হয়েছিল শুনেছি—

কতদিন আগে?

বলতে পারব না।

আচ্ছা আপনার মত আছে এ বিবাহে?

আমার মতামতের কতটুকু মূল্য থাকতে পারে বলুন? কেউ তো নই আমি এদের!

তবু তো শুনেছি, আপনি শকুন্তলা দেবীকে একপ্রকার কন্যার মতই পালন করেছেন।

তা করেছি।

তবে?

কিন্তু তাই যদি বলেন তো পাত্র হিসাবে রাঘব সরকার নিন্দনীয়ই বা কি?

সে-কথা আমি বলি নি।, আমি বলছিলাম ওরা যখন পরস্পর পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট—

ক্ষমা করবেন, আমি এর বেশী কিছু জানি না।

ওঃ। আচ্ছা সরমা দেবী, এই রঞ্জন বোসকে আপনার কেমন মনে হয়?

নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই যেন একটু চমক লক্ষ্য করলাম সরমার চোখেমুখে। কিন্তু সেও ক্ষণিকের জন্য।

পরমুহূর্তে সে যেমন শান্ত ছিল শান্ত হয়ে গেল।

আমার কথার জবাবটা এখনো পাই নি সরমা দেবী!

ওর সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানি না।

তবু যে কয়দিন ওকে দেখেছেন—

ও কারো সঙ্গেই বড় একটা কথা বলে না বা মেলামেশা করে না—

আপনিও কি সেই দলে?

অন্য রকম আমার বেলায় হবার কোন কারণ নেই।

ওকে আপনি পূর্বে কখনো দেখেছেন?

না–না।

আচ্ছা সরমা দেবী, আপনি এবারে যেতে পারেন।

চেয়ার থেকে উঠে ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেল সরমা।

সরমা ঘর ছেড়ে চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে যেন একটা অদ্ভুত স্তব্ধতা ঘরের মধ্যে থমথম করতে থাকে।

কয়েকটা মুহূর্ত কেউ কোন কথা বলে না।

অবশেষে কিরীটীই সে স্তব্ধতা ভঙ্গ করে একসময় উঠে দাঁড়িয়ে বললে, এবারে আমি বিদায় নেব শিবেনবাবু!

হ্যাঁ চলুন, আমরাও উঠব।

কেবল একটা কথা শিবেনবাবু—

কি?

ঐ ঘরটা অর্থাৎ যে ঘরে বিমলবাবু নিহত হয়েছেন, তালা দিয়ে রাখবার ব্যবস্থা করবেন। কথাটা বলে আর দাঁড়ায় না কিরীটী, আমার দিকে তাকিয়ে বলে, চল্ সুব্রত।

দুজনে ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম।

সিঁড়ি দিয়ে নেমে একতলায় আসতেই দেখা গেল সিঁড়ির ঠিক সামনেই রেলিং ধরে পাথরের মত দাঁড়িয়ে আছে শকুন্তলা।

শকুন্তলাকে সামনে দেখে কিরীটী দাঁড়াল, কিছু বলবেন মিস চৌধুরী?

মিঃ রায়! শকুন্তলা কিরীটীর মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাল।

বলুন?

আপনি—মানে সত্যিই আপনার স্থির বিশ্বাস—

কি?

কাকা–কাকাকে সত্যিই কেউ হত্যা করেছে?

মনে হল কথাটা বলতে গিয়ে শকুন্তলার গলাটা যেন কেঁপে উঠল।

হ্যাঁ, সত্যি তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে।

তবু কিন্তু শকুন্তলা পথ ছাড়ে না।

কিরীটী পুনরায় প্রশ্ন করে, আর কিছু বলবেন?

আপনি—আপনি কাউকে সন্দেহ করেছেন?

কিরীটী মুহূর্তকাল মনে হল যেন কি ভাবল, তারপর মৃদুকণ্ঠে বললে, আপনার ঐ প্রশ্নের জবাবে বর্তমানে কেবল এইটুকুই বলতে পারি মিস চৌধুরী, কোন অজ্ঞাত বা অপরিচিত ব্যক্তির হাতে তিনি নিহত হন নি!

তবে? যেন একটা অস্ফুট আর্তনাদ বের হয়ে এল শকুন্তলার কণ্ঠ চিড়ে।

যে তাকে হত্যা করেছে, সে তার অত্যন্ত পরিচিত কেউ। তাই—

তাই?

তাই শেষ মুহূর্তে ব্যাপারটা তার কাছে যেমন আকস্মিক তেমনি অভাবিতই ছিল হয়তো!

কি বলতে চান আপনি?

হত্যাকারী যখন তাকে হত্যা করবার জন্য সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল তিনি কল্পনাও করতে পারেন নি পরমুহূর্তেই ব্যাপারটা কি ঘটতে চলেছে! ইট ওয়াজ সো সাডেন! কিন্তু মিস চৌধুরী–

কি?

আপনি বোধ হয় একটু সতর্ক থাকলে ব্যাপারটা ঘটত না!

কি বললেন?

বলছিলাম ইউ অ্যাপ্রিহেণ্ডেড ইট—আপনি পূর্বেই ঐ ধরনের একটা কিছু যে ঘটবে বা ঘটতে পারে অনুমান করেছিলেন–

না বিশ্বাস করুন মিঃ রায়, আমি—

হ্যাঁ, আপনি সেটা অনুমান করতে পেরেছিলেন বলেই কাল আমার কাছে ছুটে গিয়েছিলেন!

না না—আমি—

কিন্তু কেন যে কাল সব কথা বললেন না শেষ পর্যন্ত তা আপনিই জানেন। বললে হয়ত আজকের এই দুর্ঘটনাটা না ঘটতেও পারত।

আপনি—আপনি বিশ্বাস করুন মিঃ রায়, যা আপনি বলছেন তার বিন্দুবিসর্গও আমি—

মিস চৌধুরী, বিয়ের ব্যাপারে চিন্তিত হয়ে যে কাল আপনি আমার কাছে ছুটে যান নি সে বিষয়ে আমি স্থিরনিশ্চিন্ত। কিন্তু কেন জানেন, মাত্র একটি কারণে—

একটি কারণে!

হ্যাঁ, একটি কারণে। আপনার আঙুলের ঐ আংটিটিই—

আংটি!

হ্যাঁ, আংটিটিই কাল আমাকে বলে দিয়েছিল আমার কাছে ছুটে যাবার যে কারণ আপনি দেখিয়েছেন তা মিথ্যা!

মিঃ রায়!

কিন্তু আর নয়, এদিকে রাত প্রায় শেষ হয়ে এল। যদি সত্যিই কিছু আপনার বলবার থাকে তো কাল বিকেলের দিকে আমার বাড়িতে আসতে পারেন। আচ্ছা আসি নমস্কার—চলো সুব্রত।

কিরীটী কথাটা শেষ করেই দরজার দিকে এগিয়ে গেল।

আমি তাকে অনুসরণ করলাম।

.

১২.

পরের দিন দ্বিপ্রহরে কিরীটীর বাড়িতে বসে আমি, কিরীটী ও শিবেন সোম তিনজনে মিলে বিমলবাবুর হত্যার ব্যাপার নিয়েই আলোচনা করছিলাম।

শিবেন সোম এসেছেন প্রায় ঘণ্টাখানেক হবে।

দ্বিপ্রহরের কিছু আগে হঠাৎ যেন কিছুটা হন্তদন্ত হয়েই শিবেন সোম এসে হাজির।

কিরীটী অত্যন্ত শিথিল ভঙ্গীতে বসে এক প্যাকেট তাস নিয়ে পেসেন্স খেলছিল একা একা।

আর আমি একটা রহস্য উপন্যাসের পাতায় ড়ুবেছিলাম।

হন্তদন্ত হয়ে শিবেন সোমকে ঘরে ঢুকতে দেখে দুজনেই আমরা মুখ তুলে তাকালাম। একই সঙ্গে যুগপৎ।

কি ব্যাপার, অত হাঁপাচ্ছেন কেন? কিরীটী শুধায়।

না, হাঁপাই নিসোফাটার উপর বসতে বসতে শিবেন সোম কথাটা বললেন।

নতুন কোন সংবাদ আছে বুঝতে পারছি, কিন্তু কি বলুন তো? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।

যে তালাটা গতকাল বিমলবাবুর শোবার ঘরের দরজায় লাগিয়ে এসেছিলাম—

শিবেন সোমের কথাটা শেষ হয় না, হাতের তাসগুলো সাফল করতে করতে একান্ত যেন নির্বিকার কণ্ঠেই কিরীটী জবাব দেয়, তালাটা খোলা—এই তো!

শুধু খোলাই নয় মিঃ রায়, তালাটা ভাঙা!

ও একই কথা হল।

আমি অবিশ্যি সঙ্গে সঙ্গে তালাটার গা থেকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেবার ব্যবস্থা করে এসেছি—

বেশ করেছেন। তবে পণ্ডশ্রমই করেছেন–

পণ্ডশ্রম মানে?

মানে আর কি, সকলের আঙুলের ছাপই হয়তো তাতে পাবেন ঐ বাড়ির একমাত্র খুনীটির বাদ দিয়ে–

কিন্তু–

শিবেনবাবু, একটা কথা আপনার জানা দরকার বলেই বলছি—খুনী অসাধারণ চালাক, শুধু তাই নয়, প্রতিটি স্টেপ তার সুচিন্তিত। এভরিথিং ওয়েলপ্ল্যান্ড্র–পূর্বপরিকল্পিত!

আপনি—আপনি কি তবে–

না শিবেনবাবু, হত্যাকারীর নাগাল এখনো আমি পাই নি। যতই আপনারা কিছু তথাকথিত অতিবোদ্ধা কিন্তু আসলে বঞ্চিত ও উন্নাসিকের দল আমাকে অদ্ভুত করিৎকর্মা বলে নিছক হিংসার জ্বালায় গাল পাড়ন না কেন, কিরীটী রায়ও মানুষ, দোষত্রুটি তারও আছে হয়তো অজ্ঞতা হেতু মধ্যে মধ্যে কথা বলতে গিয়ে দু-চারটে ভুল ইংরাজী শব্দেরও প্রয়োগ করতে পারে, কিন্তু তার মস্তিষ্কে সত্যিই কিছু না থাকলে যে এতদিন টিকতে না কথাটা—সত্যিই অত্যুক্তি নয়। যাক গে সেকথা, কাল থেকে একটা কথা ভাবছি–

কি বলুন তো?

আমাদের রঞ্জনবাবুর অতীত সম্পর্কে ইন-ডিটেইলস যতটা সম্ভব খবরটা আপনাদের ডিপার্টমেন্টের থু দিয়ে একটু সংগ্রহ করবার চেষ্টা করতে পারেন?

কেন পারব না! আজই বড়সাহেবকে বলে মালয়ে সংবাদ পাঠাবার চেষ্টা করছি সেখানকার পুলিস ডিপার্টমেন্টে–

হ্যাঁ, তাই করুন। আর—

আর?

রাঘব সরকার সম্পর্কেও একটু খোঁজখবর করুন।

তাও করব। কিন্তু আমি বলছিলাম, ঐ তালা ভাঙার ব্যাপারটা—

কিরীটী মৃদু হেসে বলে, তালা ভাঙার ব্যাপারটা দেখছি আপনি কিছুতেই ভুলতে পারছেন শিবেনবাবু!

না, আমি বলছিলাম হয়তো খুনীই—

কোন বিশেষ কারণে আবার তালা ভেঙে ঐ ঘরে ঢুকেছিল—এই কি?

হ্যাঁ, মানে–

অনুমানটা আপনার মিথ্যা নয় শিবেনবাবু। খুব সম্ভবত তাই। কিন্তু বিমলবাবুর হত্যারহস্যের কিনারা করতে হলে আপাততঃ আপনাকে যে অন্য দিকেও আর একটা দৃষ্টি দিতে হবে!

অন্য দিকে?

হ্যাঁ। বর্তমানে রহস্য-কাহিনীর নায়ক-নায়িকা–বলছিলাম তরুণ নায়ক ও তরুণী নায়িকা দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার উপরে–

সে কি!

ভুলে যাচ্ছেন কেন, ওদের বয়সটাই যে বিশ্রী—তার উপরে রয়েছে একজনের প্রতি অন্যের আকর্ষণ, জানেন তো আকর্ষণেরই উল্টো দিক হচ্ছে বিকর্ষণ!

মিঃ রায়, আমি ঠিক আপনার কথাটা বুঝতে পারছি না—

সে কি মশাই! প্রথম যৌবনে কোন মেয়ের প্রেমে পড়েন নি নাকি?

কিরীটীর ঐ ধরনের আচমকা স্পষ্ট কথায় সহসা শিবেন সোমের মুখখানা লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে। মুখটা উনি নীচু করেন।

কিরীটী হেসে ওঠে।

জংলী ট্রেতে করে চা নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল।

চা-পান করতে করতেই কিরীটী বললে, ভাল কথা শিবেনবাবু, পোস্টমর্টেম হয়ে গেল?

ডাঃ রুদ্রকে বলেছি আজই যাতে পোস্টমর্টেমটা করে ফেলেন–

হ্যাঁ, ডাঃ রুদ্রের রিপোর্টটা না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের ধারণাটা যে মিথ্যা নয় সেটা প্রমাণ করা যাবে না।

কাল-পরশুর মধ্যেই আশা করছি পেয়ে যাব। আচ্ছা মিঃ রায়—

শিবেন সোমের ডাকে তার দিকে মুখ তুলে তাকাল কিরীটী, কিছু বলছিলেন?

আমার কিন্তু ঐ রাঘব সরকার লোকটাকেই বেশী সন্দেহ হচ্ছে!

শুধু একা রাঘব সরকার কেন, সন্দেহ তো সে রাত্রে যারা যারা অকুস্থানে ঐ সময় উপস্থিত ছিলেন তাঁদের প্রত্যেকের উপরেই হওয়া উচিত।

কিন্তু–

হ্যাঁ  শিবেনবাবু, ওঁরা কেউই সন্দেহের বাইরে যেতে পারছেন না। বিশেষ করে রাঘব সরকার, দুষ্মন্ত রায়, রঞ্জনবাবু, শকুন্তলা দেবী, সরমা দেবী–

কি বলছেন আপনি? সরমা দেবী, শকুন্তলা দেবী–

ভুলে যাবেন না শিবেনবাবু, নারীর মন শুধু বিচিত্রই নয়—এমন অন্ধকার বাঁকা গলিখুঁজি ওদের মনের মধ্যে থাকে যার হদিস এ জীবনেও কোনদিন আপনি পাবেন না

কিন্তু তাদের কি এমন মোটিভ থাকতে পারে বিশেষ করে সরমা দেবী ও শকুন্তলা দেবীর বিমলবাবুকে হত্যা করবার?

মোটিভের কথাই যদি বলেন তো সে কখন কি রূপে প্রকাশ পায় বা মূলে কি থাকতে পারে, বিশেষ করে নারীমনের—সে-কথা চিন্তা করতে গেলে খেই পাবেন না! যাক সে কথা, সরল ও দ্বিধাহীন মন নিয়ে ভাববার চেষ্টা করুন—বলতে বলতে হঠাৎ কিরীটীর কণ্ঠস্বরে লঘু রহস্যপ্রিয়তার একটা সুর যেন ধ্বনিত হয়ে ওঠে। সে আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে শিবেন সোমকে সম্বোধন করে বলে, আরে বেশী দূরে যেতে হবে কেন, আপনি ঐ সুব্রতকেই জিজ্ঞাসা করে দেখুন না—এত বয়স হল তবু আজও যে ও কুমার কার্তিকটিই রয়ে গেল, সেও ঐ নারীমনের কোন হদিস পেল না বলেই না!

সে কি, সুব্রতবাবু—

শিবেন সোমের প্রশ্নসূচক কথাটা শেষ করল কিরীটীই। বললে, না, বেচারী আজও ওপথে পা মাড়ায় নি। কিন্তু এবারে সত্যিই গাত্রোখান করতে হবে, তালাটা যখন ভাঙা তখন। একটিবার সেখানে আমাদের যাওয়া প্রয়োজন—বলতে বলতে কিরীটী উঠে দাঁড়াল, একটু অপেক্ষা করুন আমি আসছি—

.

বিমলবাবুর গৃহে যখন আমরা এসে পৌঁছলাম আসন্ন সন্ধ্যার ধূসর ছায়ায় চারদিক তখন ম্লান হয়ে এসেছে। বাড়ির দোতলায় ইতিমধ্যেই আলো জ্বলে উঠেছে, নীচের তলাটা অন্ধকার।

বারান্দার কাছাকাছি আসতেই বারান্দার ডান দিক থেকে পুরুষকণ্ঠে প্রশ্ন ভেসে এল, কে?

জবাব দিলেন শিবেন সোম, আমি শিবেন সোম।

প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গেই ভদ্রলোক এগিয়ে এসেছিলেন। আবছা আলোছায়ায় সামনের দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোককে চিনতে কষ্ট হল না, মৃত বিমলবাবুর ছোটবেলার বন্ধু বিনায়ক সেন।

বিনায়ক সেন বারেকের জন্য আমাদের সকলের মুখের উপরে একবার দৃষ্টিটা বুলিয়ে নিয়ে বললেন, ও আপনারা!

বিনায়ক সেনের গলার স্বর শুনে সেই দিকে তাকাতেই আবছা আলোছায়ার মধ্যেও একটা ব্যাপার লক্ষ্য করছিলাম, বিনায়ক সেনের পাশ থেকে আবছা একটা ছায়ামূর্তি যেন আমাদের সাড়া পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওদিককার অন্ধকারে দ্রুত মিশিয়ে গেল। এবং ব্যাপারটা যে কিরীটীরও নজরে এসেছিল বুঝতে পারলাম তার পরবর্তী প্রশ্নেই।

অন্ধকারে আপনার পাশে ওখানে আর কে ছিল মিঃ সেন?

কিরীটীর আচমকা প্রশ্নে যেন বিনায়ক সেন হঠাৎ কেমন থতমত খেয়ে যান, বলেন, আ-আমার পাশে? কই না–কেউ তো নয়!

কিন্তু মনে হল যেন—

কই না—আমি তো একাই ছিলাম!

কিন্তু অন্ধকারে একা একা ওখানে দাঁড়িয়ে কি করছিলেন?

না, মানে—এত বড় একটা মিসহ্যাপ হয়ে গেল তাই একবার খোঁজখবর নিতে। এসেছিলাম। তারপরই একটু থেমে আবার বললেন বিনায়ক সেন, বুঝতেই তো পারছেন মিঃ। রায়, বিমলের মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়, কেউ তাকে হত্যা করেছে ব্যাপারটা জানার পর থেকেই সকলেই এরা কেমন যেন আপসেট হয়ে পড়েছে

তা তো হবারই কথা!

হ্যাঁ, দেখুন তো কোথাও কিছু নেই হঠাৎ কোথা থেকে কি একটা দুম করে বিশ্রী ব্যাপার ঘটে গেল!

তা তো বটেই!

বলুন তো, আমি তো মশাই সত্যি কথা বলতে কি, মাথামুণ্ডু ব্যাপারটার কিছুই এখনো বুঝতে পারছি না! হঠাৎ তাকে ঐভাবে কেউ হত্যাই বা করতে গেল কেন?

ব্যাপারটা হঠাৎ নয় বিনায়কবাবু, শান্ত দৃঢ় কণ্ঠে কিরীটী কথাটা বললে।

হঠাৎ নয়?

না, আদৌ নয়। সব কিছুই পূর্বপ্রস্তুতি এবং পূর্ব-প্ল্যান বা পরিকল্পনা মত ঘটেছে।

মানে?

মানে কালই ঠিক না হলেও আজ-কাল-পরশু খুব শীঘ্রই যে কোন একদিন তিনি নিহত। হতেনই!

না না—এ আপনি কি বলছেন মিঃ রায়?

কথাটা আমি একবিন্দুও মিথ্যা বলছি না বা অত্যুক্তি করছি না মিঃ সেন। সত্যিই মৃত্যু তার পাশে এসে একেবারে দাঁড়িয়েছিল—মৃত্যুর কালো ছায়া তাকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছিল। যাক সেকথা, চলুন ওপরে যাওয়া যাক।

না না–এখন আর ওপরে যাব না আমি। আমার একটু কাজ আছে, আমি যাই—

দেখা করবেন না ওঁদের সঙ্গে?

না, থাক। অন্য সময় আসবখন। আচ্ছা চলি মিঃ রায়, নমস্কার।

কথাটা বলে আর মুহূর্তমাত্র দাঁড়ালেন না বিনায়ক সেন, বারান্দা থেকে নেমে দ্রুত সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকারে গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন।

.

হঠাৎ যেন মনে হল সকলে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। কারো মুখে কোন কথা নেই।

স্তব্ধতা ভঙ্গ করল কিরীটীই, শিবেনবাবু, মৃতদেহ প্রথম ডিসকভার্ড হয় কাল রাত্রে ঠিক। কটার সময় যেন?

।রাত আটটা পঁয়তাল্লিশ, মানে—

পৌনে নটা নাগাদ, না? এবং সোয়া সাতটা নাগাদ রঞ্জনবাবু এসে জানান ফোনে কেউ তাকে ডাকছে–

হ্যাঁ।

কাল দেখেছিলাম, মনে আছে মৃতদেহ পরীক্ষার সময়, তখনো রাইগার মর্টিস সেট ইন করে নি। তা হলে মনে হচ্ছে সম্ভবতঃ সোয়া সাতটা থেকে পৌনে নটার মধ্যে—অর্থাৎ মাঝখানের ঐ দেড় ঘণ্টা সময়ের মধ্যেই কোন এক সময় হত্যা করা হয়েছে। দেড় ঘণ্টা সময়—নট এ জোক! শেষের দিকে কথাগুলো কিরীটী যেন কতকটা আত্মগতভাবেই অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে বললে।

ফলে শেষের কথাগুলো বোধ করি শিবেনবাবুর কর্ণগোচর হয় নি। তাই তিনি বলেন, কি বললেন মিঃ রায়?

মৃদুকণ্ঠে কিরীটী আবার বলে, র‍্যাদার কুঈয়ার—বেশ একটু আশ্চর্যই—

আশ্চর্য! কি আশ্চর্য মিঃ রায়?

কিছু না। চলুন ওপরে যাওয়া যাক। কিন্তু নীচের তলাটা একেবারে খালি, একজন চাকরবাকরকেও তো দেখছি না ব্যাপার কি? এ বাড়িতে চাকরবাকর কেউ নেই নাকি?

.

১৩.

কিরীটীর কথাটা শেষ হল না, দপ্ করে ঐ সময় সিঁড়ির আলোটা জ্বলে উঠল। দেখা গেল একজন প্রৌঢ় এবং বেশভূষায় ও চেহারায় ভৃত্য শ্রেণীরই কোন লোক হবে, সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে।

লোকটার পরনে একটা আধময়লা ধুতি, গায়ে ফতুয়া। কাচায়-পাকায় মেশানো মাথার চুল ছোট ছোট করে ছাঁটা। ভারী পুরুষ্টু একজোড়া কাঁচা-পাকা গোঁফ ওষ্ঠের ওপরে।

লোকটি সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আমাদের সিঁড়ির নীচে দেখেই সিঁড়ির মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে যায়, কে–কে আপনারা?

প্রশ্ন করলেন শিবেন সোম, তুমি কে? কি নাম তোমার?

এতক্ষণে বোধ হয় শিবেন সোমের পরিহিত পুলিসের ইউনিফর্মের উপরে ভাল করে নজর পড়ে লোকটার। সঙ্গে সঙ্গে সে আরো দু-ধাপ নেমে এসে সম্রমের সুরে বলে, আজ্ঞে আমার নাম রামচরণ বটে। এ বাড়িতে কাজ করি। চাকর।

রামচরণ!

আজ্ঞে—আরো দু-ধাপ নেমে এসেছে রামচরণ ততক্ষণে।

রঞ্জনবাবু, শকুন্তলা দেবী—ওঁরা বাড়িতে আছেন?

যে যাঁর নিজের ঘরেই আছেন।

শকুন্তলা দেবীকে খবর দাও, থানা থেকে শিবেনবাবু এসেছেন।

আজ্ঞে আপনি বাইরের ঘরে বোস করেন, আমি তেনাদের খবর দিচ্ছি এখুনি। চলেন—

রামচরণই নীচের বসবার ঘর খুলে আলো জ্বেলে আমাদের বসতে দিল। ছিমছাম করে। সাজানো ঘরটি, যদিচ আসবাবপত্র সামান্যই।

খবর দেবার জন্যই বোধ হয় রামচরণ ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল, বাধা দিল কিরীটী, রামচরণ!

আস্তে–

কাল কই তোমাকে এ বাড়িতে তো দেখি নি! কোথায় ছিলে কাল? বাড়িতে ছিলে না নাকি?

আজ্ঞে ছিলাম।

ছিলে?

আজ্ঞে নীচেই ছিলাম। এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না বাবু, এমনটা কেমন করে হল? কালই আমি দেশে চলে যাচ্ছি বাবু—কথাটা বলতে বলতে দেখলাম, দু চোখের কোল বেয়ে রামচরণের ট ট করে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।

কালই চলে যাচ্ছ?

হ্যাঁ  বাবু।

আর একদণ্ডও এখানে টিকতে পারছি না।

কতদিন আছ এখানে?

দিদিমণি এ বাড়িতে আসার বছর দুই পরে–ছোট্টটি এসে দেখেছি দিদিমণিকে। সে কি আজকের কথা বাবু! জীবনটাই তো এ বাড়িতে আমার কেটে গেল। সব শেষ হয়ে গেল যখন তখন আর কেন—বলতে বলতে কাপড়ের খুঁটে প্রবহমান অশ্রুধারা মুছতে লাগল রামচরণ।

রামচরণ!

কিরীটীর ডাকে জলে-ভেজা চোখ তুলে তাকাল রামচরণ ওর মুখের দিকে।

কাল যখন বাবুরা সব এসেছিলেন তখন তুমি কোথায় ছিলে?

উপরেই তো খাটা-খাটনি করছিলাম বাবু। উপরেই ছিলাম।

তুমি বোধ হয় শুনেছ তোমার বাবুকে কেউ খুন করেছে!

শুনেছি বৈকি। তাই তো কাল থেকে ভাবছি, কে এমন কাজটা করলে?

আচ্ছা রামচরণ, কাল যখন রঞ্জনবাবু এসে তোমার কত্তাবাবুকে ফোনের খবর দেন তখন তুমি কোথায় ছিলে?

ছাদেই ছিলাম। টেবিল পরিষ্কার করছিলাম।

তার পর যখন সকলে জানল তোমার কত্তাবাবু মারা গিয়েছেন, তখন তুমি কোথায় ছিলে?

দোতলায় ঘরের সামনে বারান্দায় মা বলেছিলেন খাবারগুলো গুছিয়ে রাখতে, তাই গুছোচ্ছিলাম।

মা! মা কে?

আজ্ঞে সরমা মাকে দেখেন নি?

ও, তুমি বুঝি তাকে মা বলে ডাক?

আজ্ঞে।

তিনি তোমাকে খুব স্নেহ করেন, তাই না?

মার মত দয়া আর স্নেহ এ পৃথিবীতে আমি তো আর দেখি নি বাবু। অমন মানুষ হয়। বিধাতা যে আমার অমন মায়ের কপালে এত বড় দুঃখ কেন লিখে দিলেন তাই তো মাঝে মাঝে ভাবি–

দুঃখ!

দুঃখ নয়? শুনেছি এগারো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু একটি বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সব শেষ হয়ে গেল। তবু ভাগ্যি ভাল আমার কত্তাবাবুর এখানে ঠাঁই পেয়েছিলেন কিন্তু দেখুন না কপাল, সেটুকুও বিধাতার সইল না, এবারে যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন কে জানে!

কেন? এখানে?

এখানে! হুঁ, এখন রঞ্জনবাবু হলেন এ বাড়ির কত্তা, তিনি তাড়িয়ে দিলেন বলে। তা

ড়িয়ে দেবেন?

না তাড়িয়ে দিলেও যা কথার ঝাজ রঞ্জনবাবুর—তাছাড়া এখানে পা দেওয়া অবধি প্রথম দিন থেকেই যে কি বিষনজরে দেখেছেন রঞ্জনবাবু মাকে আমার—তাই তো মাকে বলছিলাম, চলো মা, আমার দেশে আমার কুঁড়েতেই না হয় চলল। ছেলের দু-মুঠো জুটলে তোমারও জুটবে। না হয় উপোস করেই থাকবে। আমি তো জানি এ অপমান সারাক্ষণ তোমার সইবে না।

চেয়ে ছিলাম রামচরণের মুখের দিকে, শুনছিলাম ওর কথাগুলো। কথাগুলো তো কোন পেঁয়ো চাষার চাষাড়ে কথা নয়। কেবলমাত্র তো সরল দরদই নয়, আরো কিছু যে আছে প্রতিটি কথার মধ্যে!

আচ্ছা রামচরণ?

বলেন আজ্ঞে—

বাবুকে—তোমার কত্তাবাবুকে তার ঘরে ঢুকতে তুমি কাল দেখেছিলে?

না। তবে—

তবে?

ফোন ধরবার জন্য কত্তাবাবু কখন ঘরে ঢুকেছিলেন তা জানি না—তবে তার কিছুক্ষণ পর বারান্দায় ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আমি কাজ করছি, শুনছিলাম বাবু যেন কার সঙ্গে ঘরের মধ্যে কথা বলছেন। পরে ভেবেছি ফোনেই হয়তো কত্তাবাবু কথা বলছেন—

ঘরের মধ্যে ফোন করছেন মানে? তোমার কত্তাবাবুর ঘরে তো ফোন নেই! ফোন তো বারান্দায়! কিরীটী যেন বিস্ময়ের সঙ্গেই প্রশ্ন করে।

হ্যাঁ  বাবু, বারান্দাতেই ফোন থাকে, তবে কত্তাবাবুর ঘরেও প্লাগ পয়েন্ট আছে।

কাল যখন ফোন আসে তখন কোথায় ফোনটা ছিল?

কত্তাবাবুর ঘরেই কাল দুপুর থেকে ফোনটা ছিল।

বলো কি! তবে—

কি বাবু?

কাল রাত্রে আমরা যখন ঘরে গিয়ে ঢুকলাম তখন তো ফোনটা কই তোমার কত্তাবাবুর ঘরে ছিল না।

ছিল না?

না। তবে ফোনটা আবার কে বাইরে নিয়ে এল? নিশ্চয়ই কেউ এনেছে—তুমি কিছু জানো রামচরণ কে এনেছিল ফোনটা আবার বারান্দায়?

আজ্ঞে জানি না তো!

হুঁ, আচ্ছা ঠিক আছে তুমি এবারে দিদিমণিকে তোমার একটা খবর দাও রামচরণ। বলো গে যে আমরা এসেছি।

কিরীটী এতক্ষণ সোফায় বসেছিল এবং কথা বলতে বলতে অন্যমনস্কতার মধ্যে কখন এক সময় যেন তার সিগারটা নিভে গিয়েছিল, সিগারটায় পুনঃঅগ্নিসংযোগ করে সিগারটা মুখে দিয়ে কিরীটী ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগল।

.

মিনিট দশেকের মধ্যেই শকুন্তলা এসে ঘরে প্রবেশ করল।

মিঃ রায় আপনি কতক্ষণ?

এই কিছুক্ষণ। আচ্ছা শকুন্তলা দেবী, কাল রাত্রে আপনি যখন আমাকে ফোন করেন তখন ফোনটা কোথায় ছিল নিশ্চয় আপনার মনে আছে—ঘরে না বারান্দায়?

মনে আছে বৈকি, বারান্দাতেই স্ট্যাণ্ডের ওপর ফোনটা ছিল। কেন এ কথা জিজ্ঞাসা করছেন?

আচ্ছা আপনার কাকাকে যখন ফোনে ডাকছে বলে রঞ্জনবাবু সংবাদ দেন তখন ফোনটা কোথায় ছিল জানেন কিছু?

না। তবে—

তবে?

আমার যতদূর মনে পড়ছে কাল দুপুর থেকে ফোনটা বোধ হয় কাকার ঘরেই ছিল।

বলতে পারেন ফোনটা কে তাহলে বাইরের বারান্দায় নিয়ে এল? কিরীটী প্রশ্ন করে।

না তো!

কেউ নিশ্চয়ই নিয়ে এসেছে, কিন্তু কে? বিড়বিড় করে কথাটা যেন আপন মনেই কিরীটী বলে, কে নিয়ে এল?

কে—কিছু বললেন?

না, কিছু না। আচ্ছা শকুন্তলা দেবী, কাল রাত সোয়া সাতটা থেকে পৌনে নটা পর্যন্ত আপনি ঠিক কোথায় ছিলেন, কি করছিলেন—মনে করে আমাকে বলতে পারেন?

যতদূর মনে পড়ছে আমি ঐ সময়টা দোতলাতেই আমার ঘরে বোধ হয় ছিলাম।

আর রঞ্জনবাবু?

সে তো ছাদেই ছিল বেশীর ভাগ সময়, তবে—

বলুন?

একবার যেন মনে পড়ছে কাকাকে ফোনের সংবাদটা দেবার পর কাকার পিছনে পিছনে গিয়েছিল। হা মনে পড়েছে, একবার তাকে যেন আমি তার ঘর থেকে বের হয়ে আসতে দেখেছি।

রাত তখন কটা বাজে, মনে করতে পারেন কি?

না। তবে কত আর হবে—বোধ করি সাড়ে আটটা কি আটটা চল্লিশা তাই হবে, তার কারণ একটু আগেই দুষ্মন্ত এসেছে—তাকে আমি বলছিলাম, এতক্ষণে তোমার সময় হল, কটা বাজে দেখেছ! মনে আছে তো ডিনার নয়, টি-র নিমন্ত্রণ ছিল!

তারপর? কিরীটী শুধায়, কোথায় দেখা হয়েছিল আপনাদের?

দোতলার বারান্দায়। এবং দুষ্মন্ত তাতে জবাব দিয়েছিল, এই তো সবে আটটা বেজে দশ মিনিট।

আটটা দশ নিশ্চয়ই সন্ধ্যা নয়!

একটা জরুরী ব্যাপারে আটকে গেলাম। তা কোথায় তিনি, তাকে একটা প্রণাম করে নিই দীর্ঘায়ু কামনা করে!

.

শকুন্তলা বলতে লাগল, তারপরে রঞ্জনকে যখন তার ঘর থেকে বের হয়ে আসতে দেখি—রাত তখন ঐ সাড়ে আটটার মতন হবে মনে হয়।

হুঁ এবং পৌনে নটা নাগাদ বিমলবাবুর মৃত্যুর ব্যাপারটা আবিষ্কৃত হয়!

হঠাৎ যেন কিরীটীর শেষের কথায় শকুন্তলা চমকে ওঠে এবং চাপা উত্তেজিত কণ্ঠে বলে, হোয়াট—হোয়াট আর ইউ ড্রাইভিং অ্যাট মি রায়? কি কি আপনি বলতে চান?

কিরীটী যেন শকুন্তলার কথাগুলো শুনতেই পায় নি এমন ভাবে বলে, তা হলে হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না মাত্র পনেরটা মিনিটেরজাস্ট ফিফটিন মিনিটস্!

কিরীটীবাবু? শকুন্তলা উদ্বেগাকুল কণ্ঠে পুনরায় ডাকে।

আচ্ছা শকুন্তলা দেবী, ঐ সময়টা সরমা দেবীকে আশেপাশে কোথাও দেখেছিলেন?

সরমা! কই না—মনে পড়ছে না তো!

ট্রাই টু রিমেম্বার! খুব ভাল করে চিন্তা করে বলুন!

না, মনে পড়ছে না!

আর ইউ সিয়োর?

হ্যাঁ, মানে—

মিস চৌধুরী, আবার ভাবুন। ভাবলেই বলতে পারবেন। সব মনে পড়বে, কারণ সে সময়টা আপনি অকুস্থানের—প্লেস অফ অকারেন্স-এর আশপাশেই ছিলেন।

না, আমার মনে পড়ছে না।

কিন্তু মিস চৌধুরী, আমি যদি বলি—স্থির দৃষ্টিতে তাকাল কিরীটী শকুন্তলার চোখের দিকে, আপনি—হ্যাঁ  আপনি দেখেছেন সে-সময় আরো একজনকে সেখানে–

কে–কাকে?

সরমা দেবীকে!

না না—আমি দেখি নি, আপনি বিশ্বাস করুন মিঃ রায়। আর দেখেই যদি থাকি তা বলব কেন?

যাক শকুন্তলা দেবী, আপনি কি জানেন, অকস্মাৎ কিরীটী তার প্রসঙ্গের মোড় ঘুরিয়ে দিল, কাল রাত্রে এখান থেকে যাবার আগে শিবেনবাবু আপনার কাকার ঘরে যে তালাটা দিয়ে গিয়েছিলেন সে তালাটা কেউ ভেঙে ফেলেছে

সে কি! কে বললে?

শিবেনবাবু আজ বেলা বারোটা নাগাদ এখানে একবার এসেছিলেন। আপনি তো জানেন তখনই তিনি তালাটা ভাঙা দেখে গিয়েছেন–

শিবেনবাবু, সত্যি? শিবেন সোমের মুখের দিকে তাকিয়ে শকুন্তলা উৎকণ্ঠার সঙ্গে প্রশ্নটা করল।

হ্যাঁ, মিস চৌধুরী। তালাটা এখনো ভাঙাই আছে।

আশ্চর্য! কে আবার তালাটা ভাঙল?

.

১৪.

মিস চৌধুরী, রঞ্জনবাবু তো বাড়িতেই আছেন, তাকে একটু ডেকে দেবেন?

হ্যাঁ, দিচ্ছি–কথাটা বলে শকুন্তলা ঘর থেকে বের হয়ে গেল। এবং শকুন্তলা ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই কিরীটী শিবেন সোমের দিকে তাকিয়ে বললে, একটা কাজ আপনাকে করতে হবে শিবেনবাবু!

কি বলুন?

সাতজনের ফটো আমাকে যোগাড় করে দিতে হবে—

সাতজনের ফটো!

হ্যাঁ।

কার কার?

সাতজনের–দুটি নারীর ও পাঁচটি পুরুষের। ফটোতে শুধু সমস্ত মুখখানা বুক পর্যন্ত।

কিন্তু কার কার?

রাঘব সরকার, দুষ্মন্ত রায়, রঞ্জন বোস, অধ্যাপক বিমল চৌধুরী, বিনায়ক সেন, সরমা ও শকুন্তলার।

বেশ তো। কালই তোলাবার ব্যবস্থা করছি—পরশুই পাবেন।

হ্যাঁ, তা হলেই হবে। আর একটা কথা কিন্তু কিরীটীর কথা শেষ হল না, রঞ্জন এসে ঘরে ঢুকল।

আসুন, আসুন মিঃ বোস! কিরীটী রঞ্জনকে আহ্বান জানায়।

রঞ্জন কিন্তু কিরীটীর কথার কোন জবাব না দিয়ে সোজা একেবারে শিবেন সোমের দিকে তাকিয়ে বললে, এই যে শিবেনবাবু, আমি আপনাকে ফোন করব ভাবছিলাম, তা আপনি এসে পড়েছেন ভালই হয়েছে কাল সকালের দিকে ডেড বডি আমরা পাব তো?

নিশ্চয়ই। ইচ্ছা করলে আজ রাত্রেই নিতে পারেন, সে ব্যবস্থাও হতে পারে।

দরকার নেই। কাল খুব সকাল সকাল যাতে পাই সেই ব্যবস্থাই করবেন।

বেশ তাই হবে।

কিরীটী এতক্ষণ চুপ করে ছিল, আবার কথা বলল, রঞ্জনবাবু, আপনাকে আমাদের কয়েকটা কথা জিজ্ঞাস্য ছিল।

রঞ্জন বোস কিরীটীর দিকে চোখ তুলে তাকাল। মনে হল হৃদুটো কুঁচকে কপালের উপরে যেন বিরক্তির চিহ্ন একটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে রঞ্জন বোসের।

বলুন?

গতকাল রাত্রে সোয়া সাতটা থেকে পৌনে নটা পর্যন্ত আপনি কোথায় ছিলেন, কি করছিলেন?

কোথায় ছিলাম আর কি করছিলাম! না মশাই, আমি অত্যন্ত দুঃখিত—ঠিক মনে করতে পারছি না।

মনে করতে পারছেন না?

না।

ওঃ, আচ্ছা আপনার মামাবাবুকে কেউ ফোনে ডেকেছিল আর আপনি তাকে ডেকে দিয়েছিলেন সে কথাটা আশা করি মনে আছে আপনার?

তা আছে।

কে তাকে ফোনে ডেকেছিল মনে আছে আপনার?

না। তাছাড়া জানব কি করে বলুন, আমি তো আর নাম জিজ্ঞাসা করি নি।

নাম জিজ্ঞাসা করেন নি?

না।

ছেলে না মেয়ে?

পুরুষেরই কণ্ঠস্বর যেন শুনেছিলাম।

কি বলেছিলেন তিনি?

বিশেষ কিছুই না, কেবল বলেছিলেন, মামার সঙ্গে তাঁর বিশেষ কি জরুরী কথা আছে— একবার দয়া করে তাকে ডেকে দিতে।

ফোনটা তখন কোথায় ছিল?

মামার ঘরেই।

ঠিক মনে আছে তা আপনার?

তা মনে আছে বৈকি।

আপনি আপনার মামার পিছনে পিছনে এসেছিলেন, তাই না?

এসেছিলাম।

আপনার মামার সঙ্গে সঙ্গে তার ঘরে ঢুকেছিলেন কি?

মামার ঘরে? কই না তো!

তবে আপনি কোথায় গেলেন?

আমি তো আবার ছাদেই ফিরে যাই।

না, আপনি ছাদে ফিরে যান নি!

ফিরে যাই নি? তার মানে?

ফিরে যান নি তাই বললাম। কিন্তু কেন যে ফিরে যান নি সে তো আমি বলতে পারব না, আপনিই পারবেন!

তবে কোথায় গিয়েছিলাম আমি সেটা আপনি নিশ্চয় জানেন বলেই মনে হচ্ছে!

জানি না বলেই তো জিজ্ঞাসা করছি।

রঞ্জন বোস অতঃপর চুপ করে থাকে।

মনে করে দেখুন, আপনার ঘরেই ফিরে যান নি তো?

না।

যান নি?

না।

তা হলে মিঃ বোস, ঐ সময়টা আপনি কি করেছেন, কোথায় ছিলেন, কিছুই মনে নেই বলতে চান?

তাই।

মনে নেই যখন—আচ্ছা আপনি আসতে পারেন। হ্যাঁ  ভাল কথা, সরমা দেবীকে একটিবার এই ঘরে পাঠিয়ে দেবেন কি?

কি বললেন! ভ্র-দুটো কুঁচকে ওঠে রঞ্জন বোসের।

বলছিলাম সরমা দেবীকে—

দেবী নয়, আপনারা হয়তো জানেন না, সে সামান্য একজন চাকরানী ছাড়া কিছুই নয়।

তাই নাকি? তা কথাটা আপনি জানলেন কি করে? আপনি তো কিছুদিন মাত্র এখানে এসেছেন রঞ্জনবাবু, ওঁর আসল ও সত্যকারের পরিচয়টা এত শীঘ্র কি করে জেনে ফেললেন বলুন তো!

পরিচয়! পরিচয় আবার কি? এভরিবডি নো শি ইজ নাথিং বাট এ মেড-সারভেন্ট ইন দিস হাউস! সামান্য একজন চাকরানী মাত্র এ বাড়ির

কিরীটী আবার হাসল এবং হাসতে হাসতে বললে, আপনি মনে হচ্ছে যে কারণেই হোক সরমা দেবীর ওপরে তেমন সন্তুষ্ট নন রঞ্জনবাবু! কিন্তু একটা কথা কি জানেন, একজনের ওপরে কোন কারণে আপনি সন্তুষ্ট নন বলেই তাকে অশ্রদ্ধা করবেন, তার সম্পর্কে কটুভাবে কথা বলবেন সেটাও তো ভদ্রতা নয়!

থামুন মশাই, আপনারা দেখছি সব এক দলের! একটা অতি সাধারণ—

কিরীটী, কিন্তু কথাটা রঞ্জনকে শেষ করতে দিল না। তার আগেই শান্ত অথচ দৃঢ়কণ্ঠে এক প্রকার যেন বাধা দিয়েই বললে, থাক রঞ্জনবাবু, আপনাকে কষ্ট করে তার পরিচয় দিতে হবে, আপনি দয়া করে একবার বরং মিস চৌধুরীকে বলে দেবেন, সরমা দেবীকে যেন একটিবার এ ঘরে তিনি পাঠিয়ে দেন। যান—

এক প্রকার যেন ঠেলেই কিরীটী রঞ্জন বোসকে ঘর থেকে বের করে দিল।

কিরীটীর প্রতি একটা ক্রুদ্ধ দৃষ্টি হেনে রঞ্জন ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

মিনিট পনের বাদে সরমা ঘরে এসে ঢুকল।

সেই শান্ত আত্মসমাহিত চেহারা।

বসুন সরমা দেবী। যতদিন না ব্যাপারটার কিনারা হয় মধ্যে মধ্যে হয়তো আপনাকে বিরক্ত করতে আমরা বাধ্য হব। একটা কথা বলছিলাম, রামচরণ বলছিল রঞ্জনবাবু নাকি আপনাকে ঠিক সহ্য করতে পারছে না! কথাটা কি সত্য?

শান্ত স্থির দৃষ্টি তুলে তাকাল সরমা কিরীটীর মুখের দিকে নিঃশব্দে।

বুঝেছি, আপনাকে আর বলতে হবে না, কিন্তু কেন বলুন তো, আপনার প্রতি তার এত বিতৃষ্ণার কারণটা কি কিছু বুঝতে পেরেছেন? আগে তো তিনি আপনাকে কখনো দেখেন নি, আপনার সঙ্গে তার কোন পরিচয়ও ছিল না—

বলতে পারি না!

বিমলবাবু নিশ্চয়ই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলেন?

ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারলেও এতদিন এতটা উগ্র হয়ে দেখা দেয় নি। কিন্তু—

বুঝেছি তার মৃত্যুর পর থেকেই—

হ্যাঁ, এ বাড়িতে আমার যে আর জায়গা হবে না তাও—

তাও বলেছেন উনি?

হ্যাঁ, আজই দুপুরে বলেছেন সে কথা।

শকুন্তলা দেবী জানেন সে কথাটা?

না, তাকে আমি বলি নি কিছু।

কিন্তু কেন বলেন নি? এ বাড়িতে সব অধিকার তো একমাত্র রঞ্জনবাবুরই নয়, মিস চৌধুরীরও তো সমান অধিকার আছে।

সে তারা বুঝবে। আমি তো এ বাড়িতে সত্যিই সামান্য দাসী বই কিছুই নয়।

কিন্তু সরমা দেবী, আমি যদি বলি, সামান্য দাসী মাত্রই আপনি নন

কি—কি বললেন?

হঠাৎ যেন কথাটা বলতে বলতে চমকে তাকাল কিরীটীর মুখের দিকে চোখ তুলে সরমা, মেঘে ঢাকা আকাশের গায়ে বিদ্যুৎচমকের মতই যেন তার অটুট শান্ত গাম্ভীর্য মুহূর্তের জন্য খসে পড়ল বলে মনে হল।

হ্যাঁ, আপনি এ বাড়িতে সামান্য দাসী নন! কিরীটী আবার কথাটা উচ্চারণ করে।

না, না—আমি দাসীদাসী বৈকি—দাসীই তো!

সরমার কণ্ঠ থেকে শেষের বেদনাসিক্ত কথাগুলো যেন একটা আকস্মিক কান্নার মতই উচ্চারিত হল। এবং স্পষ্ট লক্ষ্য করলাম সরমার দুচোখের কোল ছলছল করছে।

হ্যাঁ সরমা দেবী, আর কেউ না জানুক, বুঝতে না পারুক, আমি জানি, আমি বুঝতে পেরেছি। যাক সে কথা, আপনাকে শুধু আমার একটা অনুরোধ–

অনুরোধ!

হ্যাঁ, আমাকে না জানিয়ে এ বাড়ি থেকে আপনি যাবেন না।

কিন্তু–

বলুন, কথা দিলেন?

আমি—

জানি। বুঝতে পারছি বৈকি, এখানে থাকা আর একটা দিনও আপনার পক্ষে সত্যই দুঃসাধ্য ব্যাপার। প্রতি মুহূর্তে আপনাকে দুঃসহ অপমান মেনে নিতে হবে তাও জানি সব জেনেও কটা দিন এখানে আপনাকে আমি থাকতে বলছি বিশেষ কোন কারণ আছে বলেই।

কারণ! সরমা কিরীটীর দিকে মুখ তুলে তাকাল।

হ্যাঁ কারণ, নচেৎ জানবেন এখানে এই অপমানের মধ্যে কিছুতেই আপনাকে আমি ধরে রাখতাম না—অনুরোধও করতাম না।

সরমা চুপ করে থাকে। কোন জবাব দেয় না।

সরমা দেবী! কিরীটী আবার ডাকে কয়েকটা মুহূর্ত চুপ করে থেকে।

কি?

আপনি কি জানেন কাল রাত্রে পুলিস বিমলবাবুর ঘরে যে তালাটা দিয়ে গিয়েছিল, সেই তালাটা কেউ ভেঙেছে!

ভেঙেছে?

হ্যাঁ, ভেঙেছে। যা গে। আর একটা কথা—

কি?

শুনেছি বিমলবাবু নাকি ডাইরী রাখতেন, সে-সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন?

না।

আচ্ছা আজ বিনায়কবাবু কেন এসেছিলেন, জানেন কিছু?

কে—কে এসেছিল?

বিমলবাবুর বাল্যবন্ধু বিনায়ক সেন! দেখা হয় নি আপনার তার সঙ্গে আজ কিছুক্ষণ আগে?

সরমা চুপ।

কিরীটী বলে চলে, জানি আপনার সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল, কিন্তু কেন এসেছিলেন তিনি?

সরমা তথাপি নীরব।

আপনার সঙ্গেই দেখা করতে এসেছিলেন, তাই না?

পূর্ববৎ নিশ্চুপ সরমা। সে যেন নিষ্প্রাণ, একেবারে পাথর।

কি বলতে এসেছিলেন তিনি আপনাকে? বিমলবাবুর সম্পর্কে কোন কথাই কি?

হঠাৎ যেন ভেঙে পড়ল সরমা, আমি—আমি জানি না, আমি জানি না—কথাগুলো বলতে বলতে দুহাতে অকস্মাৎ মুখ ঢাকল সে।

কিরীটী ক্ষণকাল স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সরমার মুখের দিকে। তারপর অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে বললে, আচ্ছা আপনি যেতে পারেন সরমা দেবী।

.

১৫.

একটি নিষ্প্রাণ দম-দেওয়া পুতুলের মতই যেন অতঃপর চেয়ার থেকে উঠে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বের হয়ে গেল সরমা।

সরমার ক্রম-অপস্রিয়মাণ দেহটার দিকেই তাকিয়েছিল কিরীটী এবং সরমার দেহটা যখন দরজার ওপাশে আমাদের দৃষ্টি থেকে মিলিয়ে গেল কিরীটী মৃদুকণ্ঠে একটিমাত্র কথা বললে, বেচারী!

কথাটা ঘরের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি শিবেন সোমের কানে না গেলেও আমার কানে গিয়েছিল, আমি মুখ তুলে তাকালাম কিরীটীর দিকে। কিন্তু কোন প্রশ্ন করতে পারলাম না। ওকে, কারণ মনে হল ও যেন একটু অন্যমনস্ক। কিন্তু সে ঐ মুহূর্তে কিছু একটা ভাবছিল এবং সেটা যে সরমাকে কেন্দ্র করেই, সেটা বুঝতে আমার দেরি হয় না। এবং এও যেন আমি অনুভব করতে পারছিলাম নাটক দানা বেঁধে উঠেছে বিশেষ করে দুটি প্রাণীকে কেন্দ্র করে, অথচ

সহসা আমার চিন্তাজাল ছিন্ন হয়ে গেল শিবেন সোমের কথায়।

দোতলার ঘরটা একবার দেখলে হতো না মিঃ রায়?

হ্যাঁ, হ্যাঁ—দেখতে হবে বৈকি। আচ্ছা শিবেন, তোমার কি মনে হয়?

কিসের কি মনে হয়?

বলছিলাম ঐ সরমা দেবীর কথা—

সরমা দেবী!

হ্যাঁ। ওঁর কথা শুনলে, ওঁর মুখের দিকে তাকালে, ওঁর কণ্ঠস্বরে, ওঁর মুখের চেহারায় কি মনে হয় না যে ওঁর মনের মধ্যে কোথাও একটা গভীর লজ্জা, গভীর ব্যথা জমাট বেঁধে আছে–

গভীর লজ্জা, ব্যথা!

হ্যাঁ, যে লজ্জা যে ব্যথা কারো কাছে প্রকাশ করবার নয়। যাক গে, কি যেন বলছিলে একটু আগে তুমি? ওপরের ঘরটা দেখবার কথা! হ্যাঁ  চলো, ঘরটা দেখে আসা যাক। রামচরণকে একবার ডাকো না, তাকেই সঙ্গে নিয়ে না-হয় ওপরে যাওয়া যাবে।

.

বলা বাহুল্য, রামচরণকে নিয়েই আমরা উপরের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

ঘরের তালাটা ভাঙা ছিল, সেটা ধরে সামান্য টানতেই খুলে গেল। খোলা দরজাপথে অতঃপর প্রথমে শিবেন সোম, তার পশ্চাতে আমি, কিরীটী ও রামচরণ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলাম।

অন্ধকার ঘর। ঘরের মধ্যে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হল, একটু আগেও ঘরের মধ্যে কেউ ছিল, যে আমাদের ঘরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠিক ঐ মুহূর্তেই ঘর থেকে চলে গেল।

নিজেদের অজ্ঞাতেই, বুঝি আমাদের ঐ কথাটা মনে হওয়াতেই থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম আমরা। এবং সকলেই যেন নিশ্চুপ, মুহূর্তের জন্য বোবা হয়ে গিয়েছিলাম।

ঘরের আলোটাও যে জ্বালানো দরকার, সে কথাটাও যেন ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু রামচরণ আমাদের বাঁচাল। সুইচ টিপে সে ঘরের আলোটা জ্বেলে দিল।

দপ করে ঘরের বিদ্যুৎ-বাতিটা জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের সমস্ত অন্ধকার অপসারিত হল।

সেই ঘর—যে ঘরে কাল রাত্রে প্রবেশ করেই চেয়ারটার উপরে শায়িত অধ্যাপকের মৃতদেহটা আমাদের দৃষ্টিকে আকর্ষণ করেছিল।

আজও সর্বপ্রথমেই সেই চেয়ারটার উপরে, বুঝি একান্ত স্বাভাবিকভাবেই, আমাদের দৃষ্টি গিয়ে পড়ল। কিন্তু আশ্চর্য, চেয়ারটা ঠিক গতকাল যেখানে ছিল সেখানে তো নেই, চেয়ারটা একটু যেন কাত হয়ে রয়েছে–হ্যাঁ, তাই!

বেতের হাতলওয়ালা আরামকেদারা। এবং চেয়ারটা কাত হয়ে থাকার দরুনই যে ব্যাপারটা আমাদের ঐ সঙ্গে দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে সেটা হচ্ছে চেয়ারের ডান পায়াটা ভাঙা। মনে হল, কেউ যেন কোন কিছু দিয়ে চাপ দিতে গিয়েই পায়াটা ভেঙে ফেলেছে।

কিন্তু পায়াটা হঠাৎ কেউ অমনভাবে ভাঙতেই বা গেল কেন? কি এমন প্রয়োজন হয়েছিল কারো চেয়ারের পায়াটা ভাঙবার?

কিরীটী কিন্তু ততক্ষণে চেয়ারটার দিকে এগিয়ে গিয়েছে, আমিও এগিয়ে গেলাম।

চেয়ারের ভাঙা পায়াটা লক্ষ্য করতে করতে কিরীটী বললে, হুঁ, বুঝতে পেরেছি—

চেয়ারের ঐ পায়ার সঙ্গে একটা কোটর ছিল। কোটরের ডালাটা খুলতে পারে নি, বোধ হয় চাবি পায় নি, তাই শেষ পর্যন্ত কোন কিছু লোহার পাত জাতীয় শক্ত জিনিস ডালার ফাকের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে ডালাটা খোলবার চেষ্টা করেছিল, তাতেও কৃতকার্য না হয়ে শেষ পর্যন্ত পায়াটা ভেঙে ফেলেছে!

পরীক্ষা করে দেখলাম, কিরীটীর কথাটা মিথ্যা নয়।

কিরীটী আবার বলে, খুব সম্ভবত ঐ কোটরের মধ্যে এমন কিছু ছিল আর সেটা এমন মারাত্মক কিছু অবশ্য-প্রয়োজনীয় ছিল খুনীর পক্ষে, যেজন্য গতরাত্রে আমরা চলে যাবার পর এই ঘরে তাকে প্রবেশ করতেই হয়েছিল।

কিরীটীর শেষের কথায় যেন চমকে উঠি এবং সঙ্গে সঙ্গে ওর মুখের দিকে তাকাই। তবে কি খুনী—কিন্তু সহসা চিন্তাসূত্রে আমার বাধা পড়ল কিরীটীর পরবর্তী কথাতেই, সে বললে, চলো শিবেন, এ শূন্য ঘরে বসে থেকে আর কি হবে?

কিন্তু ঘরটা তো দেখলে না ভাল করে?

কিরীটী মৃদু হাসতে হাসতে বললে, যা দেখবার সে তো স্পষ্টই চোখের সামনে রয়েছে। আর কি দেখব! তাছাড়া দেখবার নতুন করে আর আছেই বা কি!

কিন্তু–

না হে—মস্ত বড় একটা ফাঁক ভরাট হয়ে গিয়েছে—

ফাঁক!

হ্যাঁ, খানিকটা এগিয়ে আর এগুতে পারছিলাম না, দুটি ফাঁকের জন্যে এক জায়গায় এসে—তার মধ্যে একটি ফাঁক খুনী নিজেই ভরাট করে দিয়ে গিয়েছে বাকি আর একটি, আশা করি সেটার জন্যও আর বেশী ভাবতে হবে না আমাদের!

তাহলে কি তুমি–

হ্যাঁ শিবেন, ব্যাপারটা প্রথমে যত জটিল মনে হয়েছিল আসলে এখন দেখছি ততটা বোধ হয় নয়।

তুমি—

কি?

তুমি কি তবে হত্যাকারী কে—

তা আন্দাজ একটা করেছি বৈকি!

কে–কে?

অত তাড়াতাড়ি করলে কি আর হয় ডিয়ার ফ্রেণ্ড! কথায় বলে হত্যারহস্য! দুম করে কি হত্যাকারীর নামটা উচ্চারণ করা যায়! তাছাড়া

কি?

হত্যাকারী যদি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারে তাকে আমরা সন্দেহ করছি সে সাবধান হয়ে যাবে। কিন্তু আমি চাই সে স্বাভাবিক নিশ্চয়তার সঙ্গেই আমাদের সকলের সামনে এসে দাঁড়াক। যাতে করে বিনা ক্লেশে প্রয়োজনের মুহূর্তটিতে আমরা অনায়াসেই শিবেনবাবুর আইনের লোহার হাতকড়াটা দিয়ে তার হাত দুটো শক্ত করে বেঁধে ফেলতে পারি, এবং সে আর না পালাবার সুযোগ কোন দিক দিয়েই পায়। যাক চলো, রাত হলো।

.

দিন-দুই পরে দ্বিপ্রহরে।

কিরীটীর ঘরের মধ্যেই আমরা—মানে আমি, কিরীটী ও কৃষ্ণা বসে কতকগুলো ফটো নিয়ে বিশ্লেষণ করছিলাম।

বলা বাহুল্য, ফটোগুলো ঐদিনই ময়না-তদন্তের পুরো রিপোর্টের সঙ্গে একটা সরকারী লেফাফায় ভরে শিবেন সোম কিরীটীর নির্দেশমত ঘণ্টাখানেক আগে মাত্র একজন কনস্টেবল মারফত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

ময়না-তদন্তের রিপোর্টে প্রকাশ, তীব্র ডিজিট্যালিনের বিষক্রিয়ায় অধ্যাপকের মৃত্যু ঘটেছে। এবং খুব সম্ভবতঃ ক্লোরোফরমের হুইপ দিয়ে তাকে অজ্ঞান করে ঐ ডিজিট্যালিন অধ্যাপকের দেহে প্রবেশ করানো হয়েছিল।

রিপোর্টটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই কিরীটী যেন কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। তারপর একটি মাত্র কথাই বলেছিল, হত্যাকারী বুদ্ধির খেলা দেখিয়েছে নিঃসন্দেহে।

আর একটা কথাও বলে নি ঐ কথাটা ছাড়া।

তারপরই ময়না-তদন্তের রিপোর্টটা ভাঁজ করে এক পাশে রেখে দিয়ে কতকটা যেন নিশ্চিন্ত হয়ে ফটোগুলো দেখতে শুরু করে।

পাঁচখানি ফটো পাঠিয়েছিলেন শিবেন সোম।

অধ্যাপক বিমলবাবুর, সরমার, শকুন্তলার, বিনায়ক সেনের এবং রঞ্জন বোসের। এবং পাঁচখানি ফটোর উপরে বারেকের জন্য চোখ বুলিয়ে নিয়ে পরপর শেষ পর্যন্ত শকুন্তলা ও সরমার ফটোটি দুহাতে তুলে নেয় কিরীটী। এবং তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ফটো দুটো বার বার পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।

তারপরই কিরীটী আমাদের দুজনের দিকে ফটোগুলো এগিয়ে দিতে দিতে বললে, দেখ তো তোমরা, ফটোগুলোর মধ্যে কোন বিশেষত্ব আছে কিনা?

বলা বাহুল্য, আমরা কিন্তু ফটোগুলো বহুক্ষণ ধরে পরীক্ষা করেও কিরীটী ঠিক কী বলতে চায় ধরতে পারি না।

 ১৬-২০. কিছু পেলে না তোমরা খুঁজে

কি হল, কিছু পেলে না তোমরা খুঁজে?

কিরীটীর প্রশ্নে ওর মুখের দিকে দুজনেই আমরা তাকাই।

আশ্চর্য! চোখে পড়ল না কিছু এখনো তোমাদের কারো?

আমি তখনো সরমা ও শকুন্তলার ফটো দুটি পাশাপাশি রেখে দেখছিলাম, হঠাৎ কিরীটীর শেষের কথায় যেন চমকে উঠি। সত্যিই তো, অদ্ভুত একটা সৌসাদৃশ্য আছে তো ফটো দুটির মধ্যে! কপাল, নাক ও চোখের অদ্ভুত মিল!

চট করে অবিশ্যি প্রথমে কারো নজর না পড়বারই কথা। কিন্তু ভাল করে দেখলে চোখে পড়বেই।

বললাম, হ্যাঁ, যদিও বয়সের তফাৎ রয়েছে তবু দেয়ার আর সিমিলারিটিজ—দুটো মুখের মধ্যে সৌসাদৃশ্য রয়েছে!

হ্যাঁ  রয়েছে, কিরীটী বললে, এবং সব চাইতে বড় সৌসাদৃশ্য হচ্ছে ডান দিককার চিবুকের কাছে কালো তিলটি দুজনেরই মুখে। তবে সরমার তিলটা ছোট্ট, কিন্তু শকুন্তলারটা বড়। হ্যাঁ, ঐ তিলটিই আমার মনে গতকাল খটকা বাধিয়েছিল—যে মুহূর্তে ওটা সরমার মুখে দেখি শকুন্তলার মুখে দেখবার পর!

বাবাঃ, কি শকুনের মত নজর তোমার গো! কৃষ্ণা বলে ওঠে ঈষৎ যেন ব্যঙ্গের সুরে।

কাজটাই যে শকুনের কাজ প্রিয়ে! কিরীটী মৃদু হাসির সঙ্গে বলে ওঠে, বলছিলাম না কৃষ্ণা তোমাকে সেদিন, মেয়েদের মত অভিনেত্রী হয় না—প্রমাণ পেলে তো হাতে হাতেই!

আবার আমি চমকে উঠি, কি বলতে চাস তুই কিরীটী?

কি আবার বলতে চাই, যা বলতে চাইছিলাম সে তো নিজেরাই বুঝতে পেরেছিস—

না, না–ও কথা নয়—

তবে আবার কি?

তুই কি বলতে চাস তাহলে—

হ্যাঁ–সরমা সাধারণ ঝি নয়—সরমা হচ্ছে ঐ শকুন্তলার জননী। আর তাইতেই তার স্থান হয়েছিল অধ্যাপকের গৃহে অমনি সুদৃঢ়।

তবে—তবে কি–

না। যতদূর আমার মনে হচ্ছে অধ্যাপকের রক্ত শকুন্তলার দেহে নেই—

হঠাৎ ঐ সময় দ্বারপ্রান্তে শিবেন সোমের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ভিতরে আসতে পারি?

আরে শিবেনবাবু, আসুন, আসুন—আপনার কথাই ভাবছিলাম।

শিবেন সোম ঘরে এসে প্রবেশ করলেন, রিপোর্ট দেখলেন?

হুঁ।

কিন্তু এ যে তাজ্জব ব্যাপার, ডিজিট্যালিন শেষ পর্যন্ত–

হ্যাঁ, বেচারী একে হাইপারটেনসনে ভুগছিলেন—তাই অধিক মাত্রা ডিজিট্যালিনের দ্রুতক্রিয়া মারাত্মক বিষক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে। যদিও অত্যন্ত ক্রুড হয়ে—তবু বলব হত্যাকারী সুনিশ্চিত পন্থাটাই গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সে তো পরের কথা ইতিমধ্যে সুব্রত যে আরো একটি মারাত্মক আবিষ্কার করে বসে আছে!

সে আবার কি? শিবেন সোম আমার দিকে তাকালেন।

আমি লজ্জিত হয়ে বলি, না-না—আমি নয়, কিরীটীই। ইট ওয়াজ হিজ ডিসকভারি! ওরই আবিষ্কার—

কিন্তু ব্যাপারটা কি সুব্রতবাবু?

জবাব দিল এরপর কিরীটীই। সে বললে, শকুন্তলা চৌধুরী অধ্যাপক বিমল চৌধুরীর ভাইঝি নন—

সে কি!

হ্যাঁ, সরমার ইতিহাস যদি সত্যিই হয়—অর্থাৎ সে যদি সত্যিই কৈবর্তকন্যাই হয়ে থাকে তো শকুন্তলা অধ্যাপকের কেউ নয়—কোনো রক্তের সম্পর্ক পরস্পরের মধ্যে ওদের নেই।

মানে—কি বলছেন?

ঐ ফটো দুটো দেখলেই বুঝতে পারবেন। দেখুন না ফটো দুটো একটু চোখ মেলে পরীক্ষা করে!

সরমা ও শকুন্তলার ফটো দুটো শিবেনের দিকে এগিয়ে দিল কিরীটী।

ফটো দুটো দেখতে দেখতে শিবেন সোম বলেন, আশ্চর্য! ব্যাপারটা তো আগে আমার নজরে পড়ে নি? কিন্তু–

বুঝতে পারছি শিবেনবাবু, সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে—এই তো?

না, তা নয়—

তবে? ভাবছেন তাহলে ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে, এই তো?

হ্যাঁ, মানে—

ব্যাপারটার একটা মীমাংসার প্রয়োজন বৈকি। আর সেই জন্যেই আজ আবার আপনাকে কষ্ট করে রাত এগারোটার পর এখানে আসতে হবে—

রাত এগারোটার পর?

হ্যাঁ, রাত এগারোটার পর।

.

বলা বাহুল্য, ঐদিনই রাত্রে কিরীটীর দোতলার বসবার ঘরেই আমরা বসেছিলাম। আমি, কিরীটী, শিবেন সোম ও কৃষ্ণা।

দেওয়াল-ঘড়িতে রাত এগারোটা বেজে কুড়ি মিনিট হয়ে গিয়েছে। শিবেন সোম যে একটু অধৈর্য হয়ে উঠেছেন বুঝতে পারছিলাম। কিরীটীর কথামত বেচারী সেই রাত সাড়ে দশটা থেকে এখানে এসে বসে আছেন।

কিরীটী দ্বিপ্রহরে যতটুকু বলেছিল তার বেশী আর একটি কথাও বলে নি। একেবারে যেন চুপ।

ঘন ঘন শিবেন সোম একবার ঘড়ির অগ্রসরমান কাটার দিকে এবং পরক্ষণেই আবার কিরীটীর মুখের দিকে তাকাচ্ছিলেন।

কিরীটী কিন্তু নির্বিকার। পাইপটা ওষ্ঠপ্রান্তে চেপে ধরে একান্ত নির্বিকার চিত্তেই যেন ধূমপান করছে।

রাত যখন সাড়ে এগারোটা, একটা রিকশার ঠুং ঠুং শব্দ আমাদের সকলের কানে এসে প্রবেশ করল।

কিরীটী যে অন্যমনস্কতার ভান করলেও ভিতরে ভিতরে বিশেষ কারো আগমন প্রতীক্ষ্ণয় কতখানি উগ্রীব হয়েছিল বুঝতে পারলাম ঐ রিকশার ঠুং ঠুং শব্দটা কানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে মুহূর্তে কিরীটী উঠে সোজা গিয়ে পথের দিককার খোলা জানালা দিয়ে উঁকি দিল।

কৌতূহল যে আমারও হয়েছিল সেটা বলাই বাহুল্য। কারণ আমি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উঠে গিয়ে ওর পাশে দাঁড়ালাম।

নীচে জানালাপথে উঁকি দিতেই চোখে পড়ল, একটি রিকশা এসে কিরীটীর ঠিক দোরগোড়ায় থামল।

জায়গাটায় ঠিক আলো না থাকার দরুন এবং রাস্তার লাইট হাতকয়েক দূরে থাকার দরুন একটু যেন আলোছায়ায় অস্পষ্ট। তাই পরিষ্কার বা স্পষ্ট দেখা যায় না।

কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, কেউ এল রিকশা করে মনে হচ্ছে তোরই বাড়িতে! কে রে?

যার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম–

অপেক্ষা করছিলি!

হ্যাঁ। অবিশ্যি মনে একটু সন্দেহ যে ছিল না তা নয়—আসবে কি আসবে না শেষ পর্যন্ত, কিন্তু যাক, শেষ পর্যন্ত এসেছে!

কথা বলছিলাম আমরা নীচের রাস্তার দিকে তাকিয়েই। দেখলাম আপাদমস্তক চাদরে আবৃত এবং গুণ্ঠনবতী এক নারীমূর্তি রিকশা থেকে নামল।

একজন ভদ্রমহিলা দেখছি!

হ্যাঁ।

ঐ সময় নীচের সদর দরজাটা খুলে গেল এবং জংলীকে দেখা গেল।

বুঝলাম কিরীটী জংলীকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিল পূর্ব থেকেই।

কে এলেন? শিবেন সোম এতক্ষণে পিছন দিক থেকে প্রশ্ন করেন।

এলেই দেখতে পাবে–আসছেনই তো এই ঘরেই! কিন্তু একটা কাজ করতে হবে তোমাকে আর সুব্রতকে

কি?

তোমাদের সামনে অর্থাৎ তৃতীয় ব্যক্তি এখানে কেউ ওঁর সামনে থাকলে উনি মুখ খুলতে ইতস্তত করবেন, কাজেই তোমরা ঐ পাশের ঘরে যাও। দরজাটা ঈষৎ ফাঁক করে। রেখো–তাহলেই ওঁকে তোমরা দেখতেও পাবে, ওঁর কথাও শুনতে পাবে।

চলুন তাহলে শিবেনবাবু।

আমার কথায় শিবেনবাবু এবং কৃষ্ণা দুজনেই উঠে দাঁড়ায়। আমরা পাশের ঘরে গিয়ে অতঃপর প্রবেশ করি।

.

দরজার ফাঁক দিয়ে আমরা দেখতে লাগলাম।

অবগুণ্ঠনবতী সেই নারী সামনের কক্ষে এসে প্রবেশ করল।

আসুন, আসুন—কিরীটী আগন্তুক অবগুণ্ঠনবতী ভদ্রমহিলাকে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে সাদর আহ্বান জানাল।

ভদ্রমহিলা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে একটা শূন্য সোফায় উপবেশন করলেন।

সরমা দেবী!

কিরীটীর সম্বোধনে যেন রীতিমত আমি চমকেই উঠি। আগন্তুক মহিলা তবে অন্য কেউ নয়-সরমা!

কিরীটীর কথায় সরমা দেবীও যেন একটু চমকেই উঠল মনে হল।

কিরীটী আবার বলে, আমি জানতাম যে সরমা দেবী আপনি আসবেন—আর আজই।

সরমা মাথার গুণ্ঠন সরিয়ে এবারে কিরীটীর দিকে তাকালেন।

তার দুচোখের দৃষ্টিতে বুঝি সীমাহীন বিস্ময়।

আপনি—

হ্যাঁ, জানতাম আপনি আসবেন আর কেন যে আসবেন তাও জানতাম।

আপনি—আপনি জানতেন?

জানতাম।

মনে হল অতঃপর কিরীটীর ঐ কথায় সরমা যেন নিজেকে নিজে একটু সামলে নিলেন। তারপর বললেন, কিরীটীবাবু, আপনি কি জানেন আমি জানি না, তবে একটা কথা শুধু বলতে এসেছিলাম

মৃদু হেসে কিরীটী কতকটা যেন বাধা দিয়েই বললে, শকুন্তলা বিমলবাবুকে হত্যা করে নি। এই কথাটাই তো বলতে এসেছেন?

হ্যাঁ, আপনারা মিথ্যে তার ওপরে সন্দেহ করে আজ তাকে ধরে এনেছেন সন্ধ্যার দিকে।

শকুন্তলা দেবীকে তাহলে গ্রেপ্তার করা হয়েছে?

হ্যাঁ, সন্ধ্যার পরই তাকে গ্রেপ্তার করে এনেছে।

সবিস্ময়ে এবং নিঃশব্দেই আমি পার্শ্বে দণ্ডায়মান শিবেন সোমের দিকে তাকালাম। শিবেন সোম নিঃশব্দে ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানালেন।

বুঝলাম কিরীটীর নির্দেশে শিবেন সোম শকুন্তলাকে আজ সন্ধ্যায় গ্রেপ্তার করেছেন বটে, কিন্তু ব্যাপারটা তিনি না বুঝেই নির্দেশ পালনের জন্য করেছেন মাত্র।

.

১৭.

ঘরের মধ্যে আবার দৃষ্টিপাত করলাম দরজার ফাঁক দিয়ে। মুখোমুখি বসে কিরীটী ও সরমা।

ঘরের উজ্জ্বল আলোয় দুজনের মুখ আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম।

কিন্তু কিরীটী বলছিল, শকুন্তলার গ্রেপ্তারের জন্য কিছুটা আপনিই দায়ী সরমা দেবী—

আমি দায়ী?

দায়ী বৈকি। কারণ সেদিন সব কথা গোপন না করে যদি অন্ততঃ আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়েও সত্যটা বলতেন তাহলে হয়তো এই দুর্ঘটনা ঘটত না।

সত্য আমি গোপন করেছি!

করেছেন। প্রথমতঃ আপনি আপনার সত্যকারের পরিচয় দেন নি—

আমার পরিচয়!

হ্যাঁ, আপনি যে ঐ বাড়িতে সাধারণ একজন দাসী হিসাবে স্থান পান নি, সে কথা আর কেউ না জানলেও প্রথম রাত্রেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম—

না কিরীটীবাবু—আমি—

আপনি দাসী নন। এবং শকুন্তলার জন্যেই ঐ গৃহে আপনার স্থান কায়েমী হয়েছিল।

কি বলছেন আপনি? শকুন্তলা–

হ্যাঁ-বলুন শকুন্তলা আপনার কে?

শকুন্তলা—না, না—শকুন্তলা আমার কে কেউ না, কেউ না! আর্তকণ্ঠে যেন প্রতিবাদ জানাল সরমা।

এখনো আপনি স্বীকার করবেন না! কিন্তু আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তো সে আপনার নিকট হতেও নিকটতম, আপন থেকেও আপন–

না, না, না—

বলুন—বলুন কে সে আপনার?

হঠাৎ দুহাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়লেন সরমা, কেউ না, কেউ না—সে আমার কেউ না—বিশ্বাস করুন কিরীটীবাবু, আপনি বিশ্বাস করুন—

মর্মান্তিক এক বেদনায় যেন দুহাতের মধ্যে মুখটা ঢেকে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগলেন সরমা।

ক্ষণকাল কিরীটী সেই করুণ দৃশ্যের দিকে চেয়ে থেকে আবার এক সময় শান্ত মৃদু কণ্ঠে বললে, সরমা দেবী, এখন বুঝতে পারছি অনুমান আমার মিথ্যা নয় এবং নিষ্ঠুর সত্য আজ দিনের আলোর মতই প্রকাশ হয়ে পড়েছে। হয়তো চিরদিনের মত আজও গোপনই থাকত, কিন্তু বিধাতার ইচ্ছা হয়তো তা নয়, তাই আজ এতদিন পরে সব কিছু প্রকাশ হয়ে পড়ল। দুঃখ করবেন না, কে বলতে পারে হয়তো বিধাতার ইচ্ছায় সব প্রকাশ হয়ে পড়ল—ঐ শকুন্তলার ভালর জন্যই!

কিন্তু কি লাভ হবে—কি লাভ হবে, কি মঙ্গল হবে তার এ কথাটা আজ সে জানতে পারলে? অরুদ্ধ কণ্ঠে মুখটা তুলে আবার সরমা কথা বললেন।

হবে, আপনি বিশ্বাস করুন—

না, না—সে হয়তো ঘৃণায় আর কোনদিন আমার মুখের দিকে তাকাবেই না। সে যখন জানবে যে সে এক বিধবার সন্তান–

সে যদি আজ তার জন্মের জন্য নিজের মায়ের বিচারের ভার নিজের হাতে তুলে নেয় তাহলে বুঝব যে সত্যিই সে হতভাগিনী! কিন্তু ভয় নেই আপনার আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, যদি সত্যিই তাই আপনার অভিপ্রায় হয় তো একথা এতদিন যেমন গোপন ছিল তেমনি গোপনই থাকবে আজও। কিরীটী রায়ের মুখ দিয়ে এ কথা আর দ্বিতীয়বার উচ্চারিত তো হবেই না, এমন কি তার পরিচিত শিবেন সোম বা সুব্রতর মুখ দিয়েও নয়—

কিরীটীবাবু! একটা আর্ত চিৎকার করে ওঠে সরমা।

হ্যাঁ সরমা দেবী, তারাও জানে এ কথা।

তারাও জানেন?

জানে। তবে তাদের আপনি বিশ্বাস করতে পারেন। কিন্তু এবারে আমার একটা প্রশ্নের জবাব দিন, বিমলবাবু ছাড়া এ কথা কি আর কেউ জানত?

জানি না। তবে–

বুঝতে পেরেছি, আপনার অনুমান আরো কেউ জানত। হ্যাঁ, আমারও তাই ধারণা—আরো একজন জানত। তিনি বোধ হয় বিমলবাবুর বন্ধু ঐ রাঘব সরকার—তাই নয় কি?

মাথাটা নীচু করে সরমা।

ঠিক আছে। আপনি এবার ফিরে যেতে পারেন। যদি বলেন তো আমি নিজে গিয়ে আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারি। রাত অনেক হয়েছে–

না, না—আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না! আমি একাই ফিরে যেতে পারব। কিন্তু–

কি বলুন?

শকুন্তলা–শকুন্তলার কি হবে?

সত্যি যদি তার এ ব্যাপারে কোন দোষ না থেকে থাকে তো আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, সে আবার রাহুমুক্ত হয়ে সসম্মানে আপনার কাছে ফিরে আসবেই। ভয় নেই, সত্যিকারের মিথ্যা চিরদিন টিকে থাকতে পারে না। মিথ্যার ভিতটা হুড়মুড় করে একদিন-বা-একদিন ভেঙে পড়েই।

ঢং করে ঐ সময় দেওয়াল-ঘড়িতে সাড়ে বারোটা রাত্রি ঘোষণা করল।

না, সত্যি রাত অনেক হয়ে গেল—কিরীটী একটু যেন ব্যস্ত হয়েই ওঠে সরমার মুখের দিকে তাকিয়ে, চলুন, আমিই আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি—

আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না কিরীটীবাবু। তাছাড়া কোথায় আপনি আমাকে পৌঁছে দেবেন? হ্যাঁ, আমি তো সেখানে আর ফিরে যাচ্ছি না—

ফিরে যাচ্ছেন না।

না, সেখানে আর নয়। আজকের মতই একদিন অসহায় আমার হাত ধরে সেখানে নিয়ে গিয়ে তার আশ্রয়ে আমাকে যে আশ্রয় দিয়েছিল, আজ সে-ই যখন নেই তখন আর কোন্ ভরসায় সেখানে থাকব বলতে পারেন! আর কোন্ দুঃসাহসেই বা থাকব! না কিরীটীবাবু, পৃথিবীতে বিশ্বাস বস্তুটা এমনই জিনিস যে একবার তার মূলে ভাঙন ধরলে আব কোন কিছুতেই তাকে টিকিয়ে রাখা যায় না। হুড়মুড় করে শেষ পর্যন্ত নিজের ঘাড়ের ওপরেই ভেঙে পড়ে। না কিরীটীবাবু, আর সেখানে কোনদিন ফিরব না বলে স্থির করেই এক বস্ত্রে বেরিয়ে এসেছি–

কিন্তু কোথায় যাবেন?

কোথায় যাব জানি না, কিন্তু সেদিন যে দুশ্চিন্তাটা নবজাত এক শিশুর মা হয়ে সরমার বুকের মধ্যে ছিল আজ তো সে দুশ্চিন্তাটা আর তার বুকের মধ্যে নেই। আজ আর ভয় কি যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাব।

অকস্মাৎ যেন সরমার মধ্যে একটা আমূল পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। হঠাৎ একটা পাথর যেন ফেটে চৌচির হয়ে গিয়েছে। এক নিমেষে সমস্ত কুণ্ঠা সমস্ত দ্বিধার অবসান ঘটেছে।

বিস্মিত দৃষ্টিতে দরজার মধ্যবর্তী ফাঁক দিয়ে দেখছিলাম সরমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

কিন্তু সরমা দেবী, আপনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন এ ব্যাপারে একটা হেস্তনেস্ত না হওয়া পর্যন্ত আপনি ও-বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবেন না! কিরীটী এবারে বললে।

হ্যাঁ  দিয়েছিলাম, মনে আছে। আর সেটাই তো এখানে এত রাত্রে আসবার আমার দ্বিতীয় কারণ কিরীটীবাবু!

শান্ত মৃদু কণ্ঠে কথাগুলো বললেন সরমা দেবী এবং যাবার জন্যই বোধ করি অতঃপর উঠে দাঁড়ালেন, আমি তা হলে এবারে যাই!

না সরমা দেবী, তা হয় না। আমাকে কথা দিয়ে আপনি কথা রেখেছেন বলে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, কিন্তু আজ আর একজনকে না জানিয়েও তো কোথাও এভাবে চলে যাবার আপনার অধিকার নেই।

কিরীটীবাবু!

আপনার মেয়ে শকুন্তলা—তার প্রতি কি আর আপনার কোন কর্তব্যই অবশিষ্ট নেই? তাকে আপনি কার কাছে রেখে যাচ্ছেন?

আমি জানি কিরীটীবাবু, সে দুষ্মন্তকে ভালবাসে আর দুষ্মন্তও তাকে ভালবাসে—দুষ্মন্তই তাকে আশ্রয় দেবে। বরং আমি থাকলেই তার সেই নিশ্চিন্ত আশ্ৰয়টা ভেঙে যাবার সম্ভাবনা আছে–

তা আছে কিনা জানি না, তবে রাঘব সরকারের কথাটাই বা ভুলে যাচ্ছেন কেন?

রাঘব।

হ্যাঁ–

মৃদু অথচ অতিশয় করুণ হাসির একটা আভাস যেন সরমার ওষ্ঠপ্রান্তে জেগে ওঠে। এবং হাসিটা মিলিয়ে যাবার পরক্ষণেই সমস্ত মুখখানি যেন কঠিন হয়ে ওঠে।

সরমা দেবী!

নিশ্চিন্ত থাকুন, সে এখনো জানে না যে তার মৃত্যুবাণ আমারই হাতে রয়েছে!

মৃত্যুবাণ?

হ্যাঁ। আমি এবারে যাই—

কিন্তু সরমা দেবী, একটা কথা—আপনাকে হয়তো আমার প্রয়োজন হবে এবং অন্য কোন কারণে নয়—আপনার মেয়ে শকুন্তলাকে বাঁচানোর জন্যই, তখন কোথায় আমি আপনাকে পাব?

আমি রামচরণের সঙ্গেই থাকব।

রামচরণ!

হ্যাঁ, আমার ধর্ম-ছেলে। আমি তার ধর্ম-মা।

আপনি তা হলে এখন তার দেশের বাড়িতেই যাচ্ছেন?

, বসিরহাটে তার ছেলে, ছেলের বৌ আছে—সেখানেই আপাততঃ কিছুদিন থাকব আমি। তা হলে চলি—

চলুন, আপনাকে নীচে পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসি।

সরমা আগে ও পিছনে কিরীটী বের হয়ে গেল ঘর থেকে।

আমরাও পুনরায় ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলাম।

একটু আগে ঘরের মধ্যে যেন একটা নাটক অভিনীত হয়ে গিয়েছে এবং তার সুরটা ঘরের বাতাসে যেন এখনো ছড়িয়ে রয়েছে।

.

১৮.

সরমাকে বিদায় দিয়ে কিরীটী পুনরায় ঘরে ফিরে এল।

ক্ষণপূর্বে নাটকের দর্শক ও শ্রোতা আমরা তখন যেন বিমূঢ় নির্বাক হয়ে ঘরের মধ্যে বসে। আছি।

কিরীটী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে, কিন্তু বসল না—পূর্বেরই সেই খোলা জানালাটার সামনে গিয়ে বাইরের অন্ধকারে দৃষ্টি মেলে দাঁড়িয়ে রইল। তারপরও কিছুক্ষণ একটা যেন জমাট স্তব্ধতার মধ্যেই আমাদের কেটে গেল।

মনে হচ্ছিল কারোর যেন কিছু আর বলবার নেই। সবারই কথা যেন শেষ হয়ে গিয়েছে। নাটক শেষ হয়ে গিয়েছে, যবনিকা নেমে এসেছে, শূন্য প্রেক্ষাগৃহে যেন কজন আমরা বসে আছি।

প্রথমে সেই স্তব্ধতা ভঙ্গ করে কৃষ্ণাই কথা বললে, সরমা চলে গেল?

কৃষ্ণার ডাকে কিরীটী ওর দিকে ফিরে তাকাল, হ্যাঁ, চলে গেল।

আচ্ছা একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না এখনো—

কি?

শকুন্তলার বাপ তা হলে কে?

জন্ম যখন তার হয়েছে—সরমা যখন তার মা-বাপও তার একজন আছে বৈকি কৃষ্ণা।

কিন্তু কথাটা ওকে তুমি জিজ্ঞাসা করলে না কেন?

ছিঃ কৃষ্ণা! তাই কি পারি? মেয়েমানুষ হয়েও কি বুঝতে পারো না, মেয়েমানুষের জীবনে এ কত বড় লজ্জা! তাছাড়া হৃদয়হীনতার কি একটা সীমা নেই!

কিন্তু–

না। তাছাড়া তোমাদের চোখ আর মন থাকলে শকুন্তলার বাপের সংবাদটা পেতে তোমাদেরও দেরি হত না। যাক সে কথা। তার জন্ম-বৃত্তান্তটা যখন প্রকাশ হয়েছে, সে কথাটাও অপ্রকাশ থাকবে না। কিন্তু শিবেনবাবু—

সহসা শিবেনের দিকে ফিরে তাকিয়ে এবার কিরীটী বললে, দ্বিতীয় ফঁাকটাও আমার ভরাট হয়ে গিয়েছে। তাই বলছিলাম কাল প্রত্যুষে সরমার গৃহত্যাগের ব্যাপারটা জানাজানি হবার পূর্বেই আমাদের যা করবার করতে হবে

কি?

দেওয়াল-ঘড়ির দিকে তাকাল কিরীটী, রাত পৌনে দুটো এখন, ঠিক পৌনে পাঁচটায় মানে আর তিন ঘণ্টা পরেই আমরা বের হয়ে পড়ব। আপনাকে কালকের জন্য যেমন যেমন বলেছিলাম ফোনে তেমন তেমন ব্যবস্থা সব করে রেখে দিয়েছেন তো?

হ্যাঁ, কিন্তু শকুন্তলা—তাকে কি ছেড়ে দেব?

পাগল হয়েছেন! এখন তাকে ছেড়ে দিলে তাকে বাঁচাতে পারবেন না—

বাঁচাতে পারব না?

না। কারণ সে-ই যে একমাত্র সাক্ষী সেদিন রাত্রের নৃশংস সেই হত্যার ব্যাপারের!

বলেন কি? সে তা হলে সব জানে?

জানে। তবে—

তবে? এইটুকুই কেবল জানে না—লোকটা কে—আসলে কে সে, কারণ ঘর অন্ধকার ছিল—

শকুন্তলা তা হলে জানে!

জানবেই তো, সে যে তখন রঞ্জনের ঘরে ছিল—

রঞ্জনের ঘরে!

হ্যাঁ। অথচ রঞ্জন সেটা ঘুণাক্ষরেও সেদিন যেমন জানতে পারেনি, তেমনি আজও জানে না।

তবে কি—সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে শিবেন তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে।

কিন্তু কিরীটী যেন পরমুহূর্তেই শিবেনের সমস্ত উৎসাহ করে একটা ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিল। একটা হাই তুলতে তুলতে বললে, এখনো হাতে প্রায় ঘণ্টা-তিনেক সময় আছে বড্ড ঘুম পেয়েছে—আমি একটু ঘুমিয়ে নিই।

কথাটা বলে এবং কাউকে কথা বলার দ্বিতীয় অবকাশমাত্রও না দিয়ে সোজা ঐ ঘর থেকে বের হয়ে কিরীটী নিজের শয়নঘরের দিকে পা বাড়াল।

আমরা তিনটি প্রাণী যেন একটা দুর্বোধ্য প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে বিমূঢ় বিহ্বল হয়ে বসে রইলাম। বিশেষ করে শিবেন সোম।

প্রথমে কথা বললেন শিবেন সোমই, সুব্রতবাবু, কিছুই তো বুঝতে পারলাম না!

আমার মনের অন্ধকারটা ততক্ষণে কাটতে শুরু হয়েছে, অন্ধকারে বেশ আলো দেখতে পাচ্ছি।

আমি ওঁর মুখের দিকে তাকালাম, কিছু বলছিলেন মিঃ সোম?

বলছিলাম, তা হলে কি হল? কিছু বুঝতে পারছেন আপনি?

আমার কাছ থেকে আর কেন শুনবেন—হয়তো বলতে গিয়ে জট পাকিয়ে ফেলব, ও তো বলেই গেল ঘণ্টা-তিনেক বাদেই বোধ হয় সব জানতে পারবেন কিন্তু কৃষ্ণা, এবারে একটু চা হলে মন্দ হত না বোধ হয়!

কৃষ্ণা ঘর থেকে উঠে গেল নিঃশব্দে।

.

পৌনে পাঁচটা নয়, বেরুতে আমাদের প্রায় পাঁচটা হয়ে গেল।

কিরীটীর গাড়িতে চেপেই আমরা চলেছিলাম আমাদের গন্তব্যস্থলে। হীরা সিং গাড়ি চালাচ্ছিল।

শিবেন সোম আর নিজেকে চেপে রাখতে পারেন না, প্রশ্ন করেন, কিন্তু কোথায় আমরা যাচ্ছি কিরীটীবাবু? বেলগাছিয়ায় কি?

না। কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বলে।

তবে কোথায়?

বিনায়ক সেনের ওখানে, শ্যামবাজারে।

সেখানে-সেখানে কেন?

গেলেই জানতে পারবেন।

.

যাই হোক, বিনায়ক সেনের গৃহে, রামধন মিত্র লেনে, যখন গিয়ে আমরা পৌঁছলাম সকাল সাড়ে পাঁচটা। সবে ভোর হয়েছে বলা চলে।

সুন্দর তিনতলা সাদা রঙের বাড়িটি। দারোয়ান সবে তখন গেট খুলেছে। গাড়ি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে দারোয়ানকে দিয়েই ভিতরে সংবাদ পাঠানো হল।

একজন ভৃত্য এসে আমাদের বাইরের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসতে দিল। শুনলাম বিনায়ক সেন তখনো ঘুম থেকে ওঠেননি। একটু বেলা করেই নাকি ওঠেন।

ভৃত্যকে বলা হল বাবুকে তুলে দেবার জন্য। কথাটা কিরীটীই বললে।

ভৃত্য প্রথমে বোধ হয় একটু আপত্তি জানাবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে শেষ পর্যন্ত কি জানি কেন সে আর না করতে পারল না। ভিতরে চলে গেল।

এবং মিনিট পনেরোর মধ্যেই একটা স্লিপিং গাউন গায়ে চাপিয়ে ঘাসের চটি পায়ে ঘরে এসে প্রবেশ করলেন বিনায়ক সেন।

ঘরে ঢুকেই যেন থমকে দাঁড়ালেন। কয়েকটা মুহূর্ত যেন বোবা। তারপর ক্ষীণকণ্ঠে বললেন কেবল, আপনারা!

হা মিঃ সেন, বসুন। বলা বাহুল্য কিরীটীই কথা বললে, এবং কেন যে এ সময় এসেছি তাও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন–

একটা সোফায় মুখোমুখি বসতে বসতে বিনায়ক সেন বললেন, না। কিন্তু কি ব্যাপার বলুন তো?

কিন্তু বোঝা উচিত ছিল আপনার অন্তত মিঃ সেন!

বোঝা উচিত ছিল?

হ্যাঁ। শুনুন মিঃ সেন, আপনি বোধ হয় শুনেছেন—

কি?

শকুন্তলা অ্যারেস্টেড!

সে কি! চমকে ওঠেন বিনায়ক সেন।

হ্যাঁ, তাকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে—অথচ সে নির্দোষ—

আমি–আমি কি করে তা জানব?

সে কি কথা, নিজের সন্তানকে আপনি জানেন না—

কি বললেন? অকস্মাৎ যেন চমকে উঠলাম কিরীটীর কথায়।

হ্যাঁ মিঃ সেন, সুনন্দা আমাদের সব বলেছে—

সুনন্দা!

হ্যাঁ সুনন্দা। যে আজো জীবিত আছে জানতে পেরে সেদিন সন্ধ্যায় তার সঙ্গে বিমলবাবুর গৃহে আপনি গোপনে দেখা করতে গিয়েছিলেন–

কি বলছেন আবোল-তাবোল সব আপনি কিরীটীবাবু?

সত্যকে আর গোপন করবার চেষ্টা বৃথা বিনায়কবাবু। সত্য সব প্রকাশ হয়ে পড়েছে। আপনার দুষ্কৃতি আর গোপন নেই। শান্ত মৃদু কণ্ঠে কিরীটী কথাগুলো বললে।

আমি—

কিন্তু আপনার নিজের আত্মজা শকুন্তলা জেনেও কি করে এত বড় অন্যায়টা করতে গিয়েছিলেন মিঃ সেন?

অন্যায়!

নিশ্চয়ই। আপনার মেয়ে শকুন্তলা দুষ্মন্তকে ভালবাসে জেনেও রাঘবের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে তারই হাতে শকুন্তলাকে তুলে দেবার চেষ্টা করতে আপনার এতটুকু দ্বিধা হল না?

না না—

হ্যাঁ। আর কেন যে আপনি ঐ ঘৃণ্য কাজ করতে দ্বিধা করেননি তাও আমি জানি। ফিল্ম বিজনেস-এ আপনার গত কয় বছর ধরেই শোচনীয় অবস্থা চলেছে, তাই রাঘব সরকার জোচ্চুরি করে সিনথেটিক হীরা আসল হীরা বলে চালাচ্ছে জেনেও, সে আপনাকে ফাইনানসিয়ালি সাহায্য করছিল বলে তার বদলে শকুন্তলাকে সেই শয়তানটার হাতে তুলে দেবার ষড়যন্ত্রে আপনি লিপ্ত হয়েছিলেন। কারণ আপনি জানতেন আপনার বাল্যবন্ধু অধ্যাপক বিমলবাবু গোপনে বিধবা কুলতাগিনী সুনন্দা অর্থাৎ সরমাকে বিবাহ করেছিল সেই কথাটা প্রকাশ হয়ে পড়লে বিমলবাবু সমাজে আর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেন না। তাই তার পক্ষে বাধা দেওয়াও সম্ভব নয়—

না না —

হ্যাঁ, তাই। বলুন যা বলছি তা মিথ্যা?

হ্যাঁ মিথ্যা, মিথ্যা—কোথায়–কোথায় সুনন্দা? এক্ষুনি তার কাছে আমি যাব—

সে এখন আপনার নাগালের বাইরে—

নাগালের বাইরে!

হ্যাঁ, আমিই তাকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে দিয়েছি। ছি ছি বিনায়কবাবু, আপনি এত নীচ–এত ছোট মন আপনার! নিজের ঔরসজাত সন্তানের এত বড় সর্বনাশ করতে আপনি উদ্যত হয়েছিলেন? টাকাটাই কি দুনিয়ায় সব? কিন্তু কার জন্য বলুন তো আপনার এই সম্পত্তি–এই অন্ধ অর্থের নেশা? সংসারে তো আপনার নিজের বলতে আর কেউ নেই

কোথায় কোথায় সুনন্দা? নিয়ে চলুন আমাকে তার কাছে নিয়ে চলুন, আমি তাকে খুঁজেছি—

তার কাছে গিয়ে আজ আর আপনার কোন লাভ নেই মিঃ সেন!

মিঃ রায়?

হ্যাঁ, তার কাছে আজ আপনি মৃত। ডেড়। যে ভালবাসার ওপরে বিশ্বাস রেখে একদিন সে আপনারই হাত ধরে নিশ্চিত আশ্রয় ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিল, সে ভালবাসা তো আপনি একদিন গলা টিপে শেষ করে দিয়েছেন–

বিনায়ক সেন আর একটি কথাও বলতে পারলেন না। যেন পাথরের মত বসে রইলেন। এবং অনেকক্ষণ পরে ধীরে ধীরে মাথা তুলে বললেন, শকুন্তলার কাছে আমি যাব।

না, সে-চেষ্টাও আর করবেন না মিঃ সেন। সে যে পরিচয় তার জানে সেই পরিচয় নিয়েই সে থাক। কোন ক্ষতি হবে না তার ঐ কুৎসিত সত্যটা আজ আর না জানলেও।

বিনায়ক সেন চুপ করে রইলেন।

হ্যাঁ, যে পাপের জন্য সে দায়ী নয়—সে পাপ-স্পর্শ তার জীবন থেকে দূরেই থাক। কোন ক্ষতি হবে না তাতে করে তার। জীবনে যে প্রতিষ্ঠা আর পরিচয় সে আজ পেয়েছে সেটাই থাক তার জীবনের সত্য হয়ে।

বিনায়ক সেন বসে রইলেন। একটি শব্দও আর মুখ থেকে তার বেরুল না।

কিরীটীই আমাদের চোখের ইঙ্গিতে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য বলে নিজে দরজার দিকে অগ্রসর হল।

আমরা তাকে অনুসরণ করলাম।

.

১৯.

আবার সকলে এসে আমরা গাড়িতে উঠে বসলাম।

ঘণ্টা-দুয়েক আগেকার অভিযানের সমস্ত উত্তেজনা তখন যেন একেবারে ম্লান হয়ে গিয়েছে। সমস্ত মন জুড়ে যেন কেমন একটা বেদনাতুর অবসন্নতা। কারো কোন কথা বলবার আর যেন উৎসাহমাত্রও তখন আর আমাদের মধ্যে অবশিষ্ট নেই।

কিরীটীর নির্দেশমত তখন আবার তার বাড়ির দিকেই গাড়ি চলতে শুরু করেছে।

ভেবেছিলাম অতঃপর কিরীটী বুঝি আর কোন কথাই বলবে না। কিন্তু কিরীটীই কথা বললে।

শিবেনবাবু, আমার কাজ ভাই শেষ হয়েছে। এবারে যা করবার আপনিই করুন।

কিন্তু কিরীটীবাবু, আমি তো এখনো কিছুই বুঝতে পারছি না—

কি বুঝতে পারছেন না?

কে তা হলে অধ্যাপককে হত্যা করল আর কেনই বা হত্যা করল?

এখনো বুঝতে পারেননি?

না।

কিন্তু কেন বলুন তো? সব কিছু কি এখনো আপনার কাছে প্রাঞ্জল হয়ে যায়নি?

ভাই। সত্যি কথা বলতে কি, আরো যেন সব জট পাকিয়ে গেল!

জট পাকালো নয় বরং জট সব খুলে গেল!

খুলে গেল?

তাই নয় কি?

কিন্তু–

শুনুন শিবেনবাবু, অধ্যাপক বিমল চৌধুরীর হত্যার ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত একটা পুরোপুরি ট্র্যাজেডি অফ এররস যাকে বলে তাতেই পর্যবসিত হয়েছে—

ট্র্যাজেডি অফ এররস!

হ্যাঁ। আর এও বলে দিচ্ছি—বিনায়ক সেন, রঞ্জন বোস, সরমা ও শকুন্তলার মধ্যেই একজন হত্যাকারী।

বলেন কি—এদের চারজনের মধ্যে একজন?

হ্যাঁ, ওয়ান অফ দেম! কিন্তু আর একটি কথাও বেশী বলব না। হত্যার কারণটাও আপনারা ইতিপূর্বেই জেনেছেন, অতএব সে-সম্পর্কেও আর আলোচনা নিরর্থক।

কিন্তু কিরীটীবাবু–

না, আপনারা না পারেন যারা এই কাহিনী শুনবে বা পড়বে তাদেরই ওপর না হয় ছেড়ে দিন-তারাই খুঁজে বের করুক কে হত্যাকারী!

কিরীটীবাবু!

ভয় নেই, হত্যাকারী পালাবে না। কারণ তার পালাবার পথ নেই—অতএব সেদিক দিয়ে। নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন আপনি।

পরিশিষ্ট

২০.

সত্যিই সেদিন বিনায়ক সেনের গৃহ থেকে নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করে, পরে সমস্ত দিন কিরীটী তার বসবার ঘরে এক প্যাকেট তাস নিয়ে সর্বক্ষণ একা একা আপন মনে নিঃশব্দে পেসেন্স খেলেই কাটিয়ে দিল।

কেবল মধ্যে মধ্যে জংলীকে চায়ের আদেশ দেওয়া ব্যতীত একটি কথাও বললে না।

সন্ধ্যার দিকে এসে কৃষ্ণার কাছ থেকেই ব্যাপারটা অবগত হলাম।

আমি গৃহে পা দিতেই কৃষ্ণা এসে শুধাল, কি ব্যাপার ঠাকুরপো, ভদ্রলোক হঠাৎ এত চুপচাপ কেন? ফেরা অবধি কারো সঙ্গে একটা কথা পর্যন্ত বলছে না!

মৃদু হেসে সকালবেলাকার নাটকীয় ব্যাপারটা খুলে বললাম।

সব শুনে কৃষ্ণা বললে, হুঁ, এই ব্যাপার তা হলে? এদিকে বেচারী শিবেনবাবু ফোনের। পর ফোন করছেন।

ব্যাপারটা একটা লঘু রহস্য। ভদ্রলোক ধরতে পারেননি। হেসে বললাম।

যাই হোক ঘরে এসে প্রবেশ করলাম। কিন্তু কিরীটী আমার দিকে ফিরেও তাকাল না। যেমন আপন মনে পেসেন্স খেলছিল তেমনি খেলতেই লাগল।

আমিও তাকে কোনরূপ সম্বোধন করে বিরক্ত না করে একটা সোফায় বসে একটি রহস্যকাহিনীতে মনোনিবেশ করলাম।

আরো ঘণ্টা দুই অতিবাহিত হয়ে গেল। এবং রাত আটটা নাগাদ শিবেন সোম আবার এসে হাজির।

আমার পাশে বসে ফিস ফিস করে শুধালেন, কি হল সুব্রতবাবু?

কিসের কি?

কিছু জানতে পারলেন?

জানবার কথা তো ওর নয়, জানবার কথা যে আপনার শিবেনবাবু! হঠাৎ কিরীটী মুখ তুলেই তাস সাজাতে সাজাতে কথাটা বললে।

কিন্তু এদিকে যে আর এক জটিল সমস্যা দেখা দিয়েছে আজই দ্বিপ্রহরে কিরীটীবাবু! তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন শিবেন সোম।

মুখ না তুলেই প্রশ্ন করে কিরীটী, জটিল সমস্যা!

তাছাড়া আর কি? শকুন্তলাকে সকালবেলা থানাতে গিয়েই ছেড়ে দিয়েছিলাম—

ও, তা হলে আপনার ধারণা শকুন্তলা হত্যা করেননি? কিরীটী শুধায়।

না, অন্তত এটুকু বুঝতে পেরেছি।

কেন বলুন তো সে হত্যাকারী নয়?

দুটো কারণে সে হত্যা করেনি বা করতে পারে না বলেই আমার মনে হয় কিরীটীবাবু।

যথা!

হয়তো আমার ভুল হতে পারে

না, না,–ভুল হয়েছেই যে ভাবছেন কেন? বলুন না?

প্রথমতঃ যাকে নিজের কাকা বলে এতকাল পর্যন্ত জেনে এসেছে—তা সে মিথ্যা জানাই হোক বা সত্য জানাই হোক এবং যার কাছ থেকে এমন অকুণ্ঠ স্নেহ ও ভালবাসা পেয়ে এসেছে। তাকে সে হত্যা করবে এ যেন ভাবাই যায় না!

আর দ্বিতীয় কারণ?

অধ্যাপককে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে ক্লোরোফরম দিয়ে প্রথমে অজ্ঞান করে, তারপর ডিজিট্যালিন প্রয়োগে—সে কাজ তার মত এক নারীর পক্ষে শুধু অসম্ভব নয়, অবিশ্বাস্য বলেই মনে হয় না কি?

ঠিক।

সেই কারণেই তাকে আমি আজ সকালেই মুক্তি দিয়েছিলাম।

কিন্তু তবু–

জানি মিঃ রায়, সে কথাটাও যে আমি ভাবিনি তা নয়। আপনি হয়তো বলবেন রাঘব সরকারের সঙ্গে বিবাহের ব্যাপারে ক্রুদ্ধ হয়ে শেষ পর্যন্ত অনন্যোপায়—মুক্তির কোন পথ না দেখতে পেয়ে সে অন্য কারো সাহায্যে বা প্ররোচনায় নিজে হয়তো অধ্যাপককে হত্যা না করলেও হত্যার ব্যাপারে সাহায্যকারিণী হওয়াটা অস্বাভাবিক ছিল না তার এবং এমন যে আগে কখনো ঘটেনি তাও নয়। নারী জাতি কোন কারণে হিংস্র হয়ে উঠলে তারা যে কি না করতে পারে সেটাও চিন্তার বিষয় ছিল, কিন্তু–

চমৎকার—চমৎকার অ্যানালিসিস আপনার হয়েছে শিবেনবাবু! আমার মনে হয় শকুন্তলার ব্যাপারে অন্তত আপনি সেন্ট পারসেন্ট কারেক্টরাইট! কিন্তু হোয়াট অ্যাবাউট আদার্স?

তারপর ধরুন সুনন্দা বা সরমা দেবী!

বলুন?

তাকেও আমি সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছি।

কেন?

প্রথমতঃ সুনন্দার প্রতি অধ্যাপকের গভীর ভালবাসা বা প্রেম যা তাকে শুধু তার চরম দুর্দিনে আশ্রয়ই কেবল দেয়নি, দিয়েছিল পরিচয় সম্মান ও নিশ্চিন্ত আশ্বাস এবং যে তার আত্মজাকে নিজের ভাইঝি বলে সকলের কাছে পরিচয় দিয়েছে, তাকেই সুনন্দা হত্যা করবে ব্যাপারটা চিন্তা করাও বাতুলতা ছাড়া আর কি বলুন!

হু, তা বটে। কিন্তু–

শুনুন, শেষ হয়নি বক্তব্য আমার সুনন্দাও নারী শকুন্তলার মত তার পক্ষেও ঐভাবে অধ্যাপককে হত্যা করা একপ্রকার অসম্ভব নয় কি!

তা বটে! তবু–

জানি তবু হয়তো আপনি বলবেন, দুষ্মন্তের সঙ্গে বিয়ে না দিয়ে রাঘব সরকারের সঙ্গে শকুন্তলার বিয়ের জেদাজেদির জন্য সরমা হয়তো নিষ্ফল হয়ে শেষ পর্যন্ত ঐভাবে অধ্যাপককে হত্যা করতে পারত। কিন্তু যার কাছে সে এতখানি কৃতজ্ঞ তাকে সে মেয়েমানুষ হয়ে অমন নৃশংসভাবে হত্যা করবে আর যে-ই ভাবুক আমি কিন্তু ভাবতে পারলাম না।

উঁহু, আইনের প্রতিভূ হয়ে আপনার ঐ দুর্বলতা তো শোভা পায় না শিবেনবাবু! কিরীটী বলে ওঠে।

কিন্তু আইন যারা গড়েছে একদিন তারা শুধু মানুষই নয়, মানুষের দিকে তাকিয়েই তাদের আইন গড়তে হয়েছিল। আইন স্বেচ্ছাচারিতাও নয়—অবিশ্বাস্যও কিছু নয়।

কিরীটী এবারে মৃদু হেসে বললে, বেশ, মেনে নিলাম সুনন্দার নির্দোষিতার কথাও—তা হলে বাকি থাকছেন দুজন!

হ্যাঁ, বিনায়ক সেন ও রঞ্জন বোস। এদের মধ্যে হত্যা করা কারো পক্ষেই অসাধ্য কিছু নয়। এদের দিক থেকে হত্যার কারণও যথেষ্ট আছে বা ছিল। এবং এদের মধ্যে একজনের পরিচয় আমরা যতটা সংগ্রহ করতে পেরেছি অন্যজনের বেলায় ততটা পারিনি। আমি বলতে চাই রঞ্জনবাবুর কথা।

সে কি, রঞ্জনবাবুর যথেষ্ট পরিচয়ও তো আমরা পেয়েছি!

কেমন করে? তার অতীত সম্পর্কে তো এখনো কিছুই আমরা জানি না।

জানি বৈকি। হেড কোয়ার্টারে খোঁজ নিলেই আপনি জানতে পারতেন।

মানে?

আপনি হেড কোয়ার্টারের থু দিয়ে যে মেসেজ পাঠিয়েছিলেন মালয়ে, পরশু রাত্রেই তার কি জবাব এসেছে তা জানেন না?

কই না! আমি তো কিছু শুনিনি!

ডি. সি.-ই আমাকে ফোনে জানিয়েছেন আজ সকালে। মালয় সম্পর্কে সে যা বলেছিল মোটামুটি তা ঠিকই।

তা হলে—

কি, তা হলে?

রঞ্জনবাবুই সত্যি সত্যি তা হলে বিমলবাবুর যাবতীয় সম্পত্তির বর্তমানে সত্যিকারের একমাত্র উত্তরাধিকারী!

আইন তাই বলে।

তবে তো পেয়ে গিয়েছি! উল্লাসে বলে ওঠেন হঠাৎ শিবেন সোম।

পেয়েছেন? হ্যাঁ, হাসে তা হলে সে-ই হত্যা করেছে সেরাত্রে অধ্যাপককে!

অসম্ভব নয় কিছু। কিন্তু প্রমাণ কি তার?

প্রমাণ?

হ্যাঁ, হাউ উড ইউ প্রভ দ্যাট? ভুলবেন না শিবেনবাবু, তিনটি মারাত্মক ব্যাপারের এখনো কোন মীমাংসাই করতে পারেননি বন্ধু!

তিনটি মারাত্মক ব্যাপার?

হ্যাঁ। প্রথমতঃ অধ্যাপকের ঘরের ভাঙা আরামকেদারাটা কি করে ভাঙল, কে ভাঙল এবং কেন ভাঙল?

কি বলছেন কিরীটীবাবু।

ঠিকই বলছি। সেটা বর্তমান হত্যা-রহস্য মীমাংসার মূলে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ব্যাপার এবং দ্বিতীয়তঃ—

বলুন?

শকুন্তলার হাতের অভিজ্ঞানটি—

মানে আংটিটা!

আংটি?

হ্যাঁ, ভুলবেন না আংটি স্বেচ্ছায় হাতে না পরলে কেউ কারো হাতে জোর করে যেমন পরাতে পারে না, তেমনি মনের মধ্যে স্বীকৃতি না থাকলে কারো অনুরোধেই বিবাহের প্রাক্‌অভিজ্ঞান হিসাবে কেউ নিজের হাতে আংটি পরে না! এবং তৃতীয় হচ্ছে—

কি?

হত্যার আসল কারণটা কি ছিল? অথ বিবাহঘটিত না অর্থম অনর্থম? শেষ মাইলস্টোনএ পৌঁছবার পূর্বে ঐ তিনটি পয়েন্ট নিজের কাছে নিজে ক্লিয়ার করে নিতে হবে।

শিবেন সোম একেবারে চুপ।

২১-২৫. শুধু শিবেন সোমই কেন

শুধু শিবেন সোমই কেন, আমিও যেন বোবা হয়ে যাই। কি বলব বা অতঃপর কি বলা উচিত বুঝে উঠতে পারি না।

হঠাৎ স্তব্ধতা ভঙ্গ করে কিরীটী আবার কথা বললে, কিন্তু একটু আগে না আপনি কি জটিল এক সমস্যার কথা বলছিলেন শিবেনবাবু!

জটিল সমস্যা? হ্যাঁ—সকাল থেকে এদিকে রঞ্জনবাবু—

কি? কি হল তার আবার?

সে উধাও!

বলেন কি? সঙ্গে সঙ্গে কথাটা বলতে বলতে যেন কিরীটী সোফার উপরে সোজা হয়ে বসে।

হ্যাঁ, সকালবেলা থেকেই তার কোন পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না।

কেন—কেন আপনি এতক্ষণ এ-কথাটা আমাকে বলেননি? সঙ্গে সঙ্গে সোফা থেকে উঠে কিরীটী সোজা ঘরের কোণে রক্ষিত ত্রিপয়ের উপরে ফোনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল এবং রিসিভারটা তুলে ডায়েল শুরু করে, হ্যালো, ডি. সি. মিঃ সিন্হাকে দিন–

অতঃপর শুনতে লাগলাম ফোনে ডি. সি.-কে রঞ্জনের নিখুঁত চেহারার বর্ণনা দিয়ে সর্বত্র রেলওয়ে স্টেশনে স্টেশনে তাকে খোঁজ করবার জন্য অবিলম্বে জরুরী মেসেজ পাঠাবার ব্যবস্থা এবং ফোন শেষ করে ফিরে এসে বললে, রাত এখন পৌনে দশটা—চলুন, আর দেরি নয় শিবেনবাবু—এখুনি আমাদের একবার বেলগাছিয়ায় অধ্যাপক-ভবনে যেতে হবে!

দশ মিনিটের মধ্যে আমরা শিবেনবাবুর গাড়িতে করেই বেলগাছিয়ার উদ্দেশে বের হয়ে পড়লাম। চলন্ত গাড়িতে বসে কিরীটী আবার বললে, বড্ড দেরি হয়ে গেল শিবেনবাবু। রঞ্জন বোস অনেকটা টাইম পেয়ে গেল—

কিন্তু আমিও চুপ করে বসে ছিলাম না কিরীটীবাবু, আমি দুপুরেই তার সন্ধানে চারিদিকে লোক পাঠিয়েছি—

আপনি পাঠিয়েছিলেন?

পাঠিয়েছি বৈকি!

উঃ, বড় একটা ভুল হয়ে গেল! হঠাৎ বলে কিরীটী।

ভুল?

হ্যাঁ, একটা জরুরী—অত্যন্ত জরুরী ফোন করার প্রয়োজন ছিল একজনকে, তাড়াতাড়িতে ভুল হয়ে গেল।

সামনেই তো সেন্ট্রাল টেলিগ্রাফ অফিস পড়বে, ঐখান থেকেই তো ফোন করতে পারেন!

ঠিক বলেছেন, ওখানে একটু দাঁড়াবেন।

পথেই একটু পরে সেন্ট্রাল টেলিগ্রাফ অফিসে গাড়ি থেকে নেমে কিরীটী ফোন করে মিনিট পনেরো বাদে আবার ফিরে এল গাড়িতে। শিবেনবাবু শুধান, ফোন করলেন?

হ্যাঁ।

কাকে ফোন করলেন?

হত্যাকারীকে।

সে কি!

হ্যাঁ  আমার অনুমান, যাকে আমি ফোন করলাম তিনিই আমাদের বিমল-হত্যারহস্যের মেঘনাদ!

কিন্তু–

আহা ব্যস্ত হচ্ছেন কেন। চক্ষুকর্ণের বিবাদ তো অনতিবিলম্বেই ভঞ্জন হবে—কিন্তু বড় চায়ের পিপাসা পাচ্ছে, কোথাও এক কাপ চা পাওয়া যায় না?

বেন্টিঙ্ক স্ট্রীটের মোড়ে একটা চীনা রেস্টুরেন্ট আছে—সেখানে পেতে পারেন।

তা হলে চলুন সেই দিকেই। তৃষ্ণা নিয়ে কোন মহৎ কাজ করতে যাওয়া ভাল নয়। মনটা তাতে করে উৎক্ষিপ্ত থাকবে।

পথে চা-পান করে আমরা যখন বেলগাছিয়ার অধ্যাপক-ভবনে এসে পৌঁছলাম রাত তখন ঠিক এগারোটা বেজে দশ। যদিও গ্রীষ্মকালের রাত্রি এবং বেলগাছিয়া বৃহত্তর কলকাতারই বিশেষ একটি অংশ, তবু ঐদিকটা ইতিমধ্যে যেন শান্ত হয়ে এসেছে।

পানের দোকান ও ডাক্তারখানাগুলো ছাড়া রাস্তার সব দোকানই প্রায় দু-পাশের বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মানুষজনের চলাচলও কমে এসেছে।

লাস্ট ট্রাম চলে গিয়েছে, তবে ডিপোমুখী ট্রামগুলো তখনো এক এক করে ফিরে আসছে এবং সে-সব ট্রামে যাত্রী একপ্রকার নেই বললেও অত্যুক্তি হয় না।

.

কিরীটীর নির্দেশে অধ্যাপক-ভবনের কিছু দূরেই গাড়িটা দাঁড় করানো হয়েছিল। আমরা পায়ে হেঁটে কজন অধ্যাপক-ভবনের দিকে অগ্রসর হলাম। আকাশে সেরাত্রে একফালি চাদ ছিল, তারই মৃদু আলোয় প্রকৃতি যেন স্বপ্নময় মনে হয়।

হঠাৎ নজরে পড়ল অধ্যাপকের বাড়ির দোতলায় আলো জ্বলছে। নীচের তলাটা কিন্তু অন্ধকার।

গেট দিয়ে গিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম।

বারান্দা বরাবর গিয়েছি, অন্ধকারে প্রশ্ন ভেসে এল, কে?

জবাব দিল কিরীটী, রামচরণ, আমরা!

রায়বাবু? আসুন–রামচরণ এগিয়ে এল।

তুমি তা হলে এখানেই আছ রামচরণ?

আজ্ঞে, সেরাত্রে তো আপনি তাই বলেছিলেন। সকালেই ফিরে এসেছি আপনার আজ্ঞামত–

ঠিক করেছ। তোমার মার খবর কি রামচরণ?

আজ্ঞে তিনি আমার ভাইপোর ওখানেই আছেন।

এঁরা খোঁজেনি তোমার মাকে?

খুঁজেছিলেন। বোধ হয় পুলিসেও ছোটবাবু খবর দিয়েছেন।

রঞ্জনবাবু ফিরেছেন?

এই কিছুক্ষণ হল ফিরে এসেছেন—

ফিরেছেন?

আজ্ঞে।

কোথায়?

বোধ হয় নিজের ঘরে।

কিরীটী অতঃপর মুহূর্তকাল যেন কি ভাবল, তারপর বললে, তোমার দিদিমণি?

আপনি জানেন না, পুলিস তো তাকে ছেড়ে দিয়েছে—তিনিও বাড়িতেই আছেন।

রঞ্জনবাবু শুনেছেন সে-কথা?

বলতে পারি না।

আচ্ছা ঠিক আছে। আমরা একবার ওপরে যাব। তুমি এখানেই থাকো রামচরণ, যেমন তোমাকে আমি নজর রাখতে বলেছিলাম তেমনি নজর রাখো।

যে আজ্ঞে। রামচরণ বিনীত কণ্ঠে সম্মতি জানায়।

আমরা এগুতেই রামচরণ পিছন থেকে শুধায়, আলোটা সিঁড়ির জ্বেলে দেব রায়বাবু?

না না—আলোর দরকার নেই, আমরা অন্ধকারেই যেতে পারব।

রাস্তা থেকে যে আলোটা আমাদের চোখে পড়েছিল, সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে বুঝতে পারলাম সেটা শকুন্তলার ঘরের আলো।

কিরীটী সেই দিকেই অর্থাৎ শকুন্তলার ঘরের দিকেই অগ্রসর হচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গে আমরাও দাঁড়াতে বাধ্য হলাম।

ফিস ফিস করে কিরীটী পার্শ্বেই দণ্ডায়মান শিবেন সোমকে শুধাল, চাবিটা সঙ্গে আছে আপনার শিবেনবাবু?

কোন্ চাবি? শিবেন শুধায়।

অধ্যাপকের ঘরে যে তালা লাগিয়েছেন তার চাবি—

আছে।

আমাকে দিন।

শিবেন সোম পকেট থেকে চাবিটা বের করে কিরীটীর হাতে দিলেন।

সঙ্গে পিস্তল আছে আপনার?

আছে।

দিন আমাকে।

কোমরের বেল্ট-সংলগ্ন চামড়ার কেস থেকে পিস্তলটা খুলে অন্ধকারে কিরীটীর দিকে এগিয়ে দিলেন শিবেন সোম।

অতি সন্তর্পণে, প্রায় বলতে গেলে নিঃশব্দেই, কিরীটী হাতের চাবি দিয়ে অন্ধকারেই অধ্যাপকের ঘরের তালাটা খুলে ফেলল এবং ধীরে ধীরে দরজাটা খুলে বাঁ হাত বাড়িয়ে দরজার একেবারে গায়ে সুইচ-বোর্ডের আলোর সুইচটা টিপে দিল।

দপ করে ঘরের আলোটা জ্বলে উঠল এবং কিরীটীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল—বজ্রকঠিন কণ্ঠস্বর, মিঃ সেন আপনার খেলা শেষ হয়েছে! উঁহু, আমি জানি আপনার পকেটে কিপকেটে হাত দেবার চেষ্টা করবেন না, আমার হাতের দিকে চেয়ে দেখুন—আমি প্রস্তুত হয়েই এসেছি।

সত্যি! ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমাদের সামনে বিনায়ক সেনই!

কিন্তু মুখে তার আর কোন কথাই নেই। একেবারে যেন বোবা।

নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন তখনো মিঃ সেন অর্থাৎ বিনায়ক সেন কিরীটীর মুখের দিকে।

আবার কিরীটী বলে, yes, thats like a good boy! এবং একটু থেমে আমাকে সম্বোধন করে বলে, সুব্রত, মিঃ সেনের পকেট থেকে বস্তুটি নিয়ে এসে তোমার জিম্মায় রাখো। মারাত্মক বস্তুকে সাবধানে রাখাই ভাল

সঙ্গে সঙ্গে আমি এগিয়ে গিয়ে বিনায়ক সেনের পকেট থেকে পিস্তলটা বের করে নিলাম।

দাও সুব্রত, শিবেনবাবুকে এবারে জিম্মা করে দাও ওটা।

পিস্তলটা অতঃপর আমি শিবেন সোমের হাতে তুলে দিলাম।

যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। মনের মধ্যে একটা ধুকপুকুনি নিয়ে কথাবার্তা কি হয়! কিন্তু সত্যি আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি মিঃ সেন, আপনি আমার ফোনের একটু আগের সতর্কবাণীটা সত্যি সত্যিই সিরিয়াসলি নিয়েছেন বলে!

বিনায়ক সেন কিন্তু পূর্ববৎ নির্বাক এবং দণ্ডায়মান।

কিরীটীর যেন সেদিকে কোন খেয়ালই নেই। সে বলেই চলে, বুঝতেই পারছেন মিঃ সেন, নেহাৎ অনন্যোপায় হয়েই শঠে শাঠ্যং নীতি মানে সামান্য ঐ চাতুরির আশ্রয়টুকু আমাকে নিতে হয়েছিল, অন্যথায় আপনার মত মহৎ ব্যক্তিকে এইভাবে রেড-হ্যাণ্ডেড ধরা স্বয়ং কিরীটী রায়েরও দুঃসাধ্য হত—কিন্তু আপনি দাঁড়িয়ে কেন—বসুন, প্লিজ বি সিটেড!

কিন্তু বিনায়ক সেন যেমন দাঁড়িয়ে ছিলেন তেমনিই দাঁড়িয়ে রইলেন। বসবার কোন ইচ্ছাই তার প্রকাশ পেল না।

.

২২.

কিরীটী মৃদু হাসল, বসবেন না? কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকবেনই বা কতক্ষণ? আমার যে—

কিরীটীর কথাটা শেষ হল না, মধ্যবর্তী দ্বারপথে রঞ্জন বোস উঁকি দিল।

আরে রঞ্জনবাবু, আসুন আসুন—ঘরে আসুন!

রঞ্জন যেন একটু ইতস্তত করেই ঘরে প্রবেশ করল।

কি ব্যাপার কিরীটীবাবু? এত রাত্রে এসব কি?

কিরীটী রঞ্জনের প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে শিবেনের দিকে তাকিয়ে বললে, শিবেনবাবু, রঞ্জনবাবুর পকেটটাও একবার সার্চ করে নিন—নো রঞ্জনবাবু নো—দ্যাটস ব্যাড! আমি প্রস্তুত হয়েই আছি দেখছেন না হাতে আমার এটা কি! হ্যাঁ, দিয়ে দিন—

শিবেনবাবু রঞ্জনবাবুর পকেট থেকেও পিস্তলটা বের করে নিলেন।

ইয়েস, দ্যাটস্ গুড! দ্যাটস্ লাইক এ গুড বয়! নাউ বি সিটেড প্লিজ—কিরীটী হাসতে হাসতে বললে।

আকস্মিক ঘটনা-বিপর্যয়ে রঞ্জন বোসও যে বেশ একটু থতমত খেয়ে গেছে বুঝতে পারি।

রঞ্জনবাবু, কৌতূহল বড় বিশ্রী জিনিস! ধরা পড়লেন আপনি আপনার কৌতূহলের জন্যই—কিন্তু শিবেনবাবুর হাতে ধরা যখন পড়েছেন আর তো উপায় নেই—বসুন, না না—মিঃ সেনের অত কাছে নয়—একটু সরে দাঁড়ান—

রঞ্জন বিনায়ক সেনের কাছে এগিয়ে যাচ্ছিল, থেমে গেল।

মিঃ সেন, রঞ্জনবাবু—আপনারা দুজনেই উপস্থিত, এখন শকুন্তলা দেবী হলেই আমাদের কোরাম পূর্ণ হয়। শিবেনবাবু, পাশের ঘর থেকে শকুন্তলা দেবীকেও ডেকে আনুন।

শিবেন সোম সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

কিরীটী আমার মুখের দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বলে, কি ভাবছ সুব্রত, এমন চমৎকার মিলনান্ত নাটক বহুদিন দেখোনি, না? বিধাতা-পুরুষের মত নাট্যকার সত্যিই দুর্লভ হে! কলম তাঁর নিখুঁত—এমন চমৎকার ছন্দ-যতি-মিল, এমন টেম্পো, এমন স্পীড়, এমন আঙ্গিক সত্যিই মানুষের কল্পনারও বুঝি বাইরে! বলতে বলতেই শিবেন সোমের সঙ্গে শকুন্তলা ঘরে ঢুকল।

এই যে মিস চৌধুরী, আসুন—কিরীটীই আহ্বান জানাল ওকে।

কেমন যেন বিহ্বল দৃষ্টিতে ঘরের মধ্যে ঐ মুহূর্তে উপস্থিত সকলের দিকে একবার দৃষ্টিটা বুলিয়ে নিয়ে সর্বশেষে দৃষ্টিপাত করল শকুন্তলা কিরীটীর মুখের উপরে নিঃশব্দে।

বসুন মিস্ চৌধুরী, আমিই আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম—বসুন।

শকুন্তলা আবার ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে উপবেশন করল একটা চেয়ারে।

শকুন্তলার মুখের দিকে চেয়ে মনে হল যেন প্রচণ্ড ঝড় বয়ে গিয়েছে ওর উপর দিয়ে। সমস্ত মুখে একটা দুঃসহ ক্লান্তি ও বিষণ্ণতার সুস্পষ্ট প্রকাশ। চোখের কোলে কালি, মাথার চুল বিস্ত। পরে অবিশ্যি শিবেনবাবুর মুখেই শুনেছিলাম—তিনি যখন শকুন্তলার ঘরে গিয়ে প্রবেশ করেন, দেখেন সে আলো জ্বেলে ঘরের মধ্যে একটা চেয়ারে স্তব্ধ হয়ে বসেছিল।

.

এই ঘরের মধ্যেই মাত্র কয়েকদিন আগে এক সন্ধ্যারাত্রে অধ্যাপক বিমলবাবু নিহত হয়েছেন নিষ্ঠুরভাবে, কিরীটী বলতে লাগল, এবং যিনি বা যাঁরা তাঁকে হত্যা করেছেন তিনি বা তারা যে কত বড় একটা ভুলের বশবর্তী হয়ে তাঁকে সেদিন হত্যা করেছিলেন সর্বাগ্রে আমি সেই কথাটাই বলব।

ভুল! শিবেনবাবু প্রশ্ন করেন।

হ্যাঁ ভুল, বলতে পারেন ট্র্যাজেডি অফ এররসও ব্যাপারটাকে।

কিরীটীর শেষের কথায় যেন স্পষ্ট মনে হল বিনায়ক সেন ঈষৎ চমকে কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।

কিরীটীর কিন্তু ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায়নি। সে মৃদু হেসে বলে, হ্যাঁ  মিঃ সেন, যেগুলোর জন্যে আপনি এত কাণ্ড করেছেন—সেগুলো আসল বা রিয়াল জুয়েল নয়। সিথেটিক প্রডাক্টস্—কেমিক্যালে প্রস্তুত জুয়েস্! এবং আপনি জানেন না, বর্তমানে পুলিসের কর্তৃপক্ষের সেটা আর অগোচর নেই। ব্যাপারটা ধরে ফেলেছে এবং আজই সন্ধ্যায় তারা ইকনমিক জুয়েলার্স রেড করে মালসমেত রাঘব সরকারকে অ্যারেস্ট করেছে। খুব সম্ভবতঃ এতক্ষণে হি ইজ আণ্ডার পুলিস-কাস্টডি! আর তা যদি নাও হয়ে থাকে এখনো, অন্ততঃ কালকের সংবাদপত্রে দেখবেন নিউজটা প্রকাশ হয়েছে—

শিবেন সোমই প্রথমে কথা বললেন, রাঘব সরকারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে মিঃ রায়? কিন্তু আমি তো—

না, আপনি জানেন না। আপনি কেন—একমাত্র এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চ-এর ডি. সি. মিঃ সিনহা ও আমি ছাড়া এখনো কেউই ব্যাপারটা জানে না। আমারই ইচ্ছাক্রমে ব্যাপারটা গোপন রাখা হয়েছে। এবং গোপন রাখা হয়েছিল রঞ্জনবাবু ও বিনয়বাবুর জন্যই। যাকগে সে কথা, আমি এবারে আমার আসল কাহিনীতেই আসি।

কিরীটী বলতে লাগল ও হত্যার পশ্চাতে কোন একটি বিশেষ কার্যকরণ বা উদ্দেশ্য না থাকলে কখনই হত্যা সংঘটিত হয় না। অধ্যাপক বিমলবাবুর হত্যার পশ্চাতে তেমনি একটি বিশেষ কারণ ছিল এবং বলতে আমার দ্বিধা নেই যার মূলে—অর্থাৎ এও বলা যেতে পারে ঐ হত্যার বীজ একদিন অধ্যাপক নিজেই বা নিজ হাতেই রোপণ করেছিলেন। অবিশ্যি সেটা তাঁর জ্ঞাতে নয়—অজ্ঞাতেই।

কি রকম? প্রশ্ন করেন শিবেনবাবু কিরীটীকে।

কিরীটী বলে, কোথায় কি ভাবে সঠিক বলতে পারি না তবে এটা ঠিক যে রাঘব সরকার ও অধ্যাপক বিমল চৌধুরীর মধ্যে একটা ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল। কারণ পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক বিমল চৌধুরীকে দিয়ে রাঘব সরকার ঐ সব সিনথেটিক জহরৎ তৈরী করাতেন তার নিজস্ব ল্যাবরেটারিতে। প্রথমটায় হয়তো অধ্যাপক ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারেননি, কিন্তু যখন পারলেন তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে নিজের অজ্ঞাতেই নিজের জালে তখন তিনি জড়িয়ে পড়েছেন। সে জালের বাঁধন ছিঁড়ে তখন তার আর বের হয়ে আসার কোন রাস্তাই নেই। জগতের কাছে তার সম্মান ও পরিচয়টাই তাঁর মুখ বন্ধ করে রেখেছিল, আর তারই পূর্ণ সুযোগ নিল শয়তান রাঘব সরকার। রাঘব সরকারের কনফেসন থেকেই অবিশ্যি এ কথাগুলো আমি বলছি। যাই হোক, সে তো নাটকের প্রথম দৃশ্য—

একটু থেমে কিরীটী আবার বলতে লাগল, এবারে নাটকের দ্বিতীয় দৃশ্যে আসা যাক। বড়লোকের স্পয়ে চাইল্ড আমাদের রঞ্জনবাবু ইতিমধ্যে সর্বস্ব হারিয়ে মালয় থেকে এসে হাজির হলেন এখানে তার মামার আশ্রয়ে। রঞ্জনবাবুর ইচ্ছা ছিল তার মামার ঘাড় ভেঙে আবার ব্যবসার নাম করে কিছুদিন মজা লুটবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার, অধ্যাপকের নিজের ঐ ভাগ্নেটিকে চিনতে দেরি হয় নি ফলে তিনি রঞ্জনের প্রস্তাবে সম্মত হতে পারেন না এবং অবশ্যম্ভাবী যা তাই ঘটে এক্ষেত্রেও। অতঃপর মামা-ভাগ্নের মধ্যে মন-কষাকষি শুরু হল। ইতিমধ্যে আর একটা ব্যাপার এ বাড়িতে ঘটেছিল। শয়তান রাঘব সরকারের নজর পড়েছিল শকুন্তলা দেবীর ওপরে। অধ্যাপক নিশ্চয় রাঘব সরকারের প্রস্তাবে চমকে উঠেছিলেন। এবং যদিচ রাঘব সরকারের প্রতি অধ্যাপক কোনদিনই বিশেষ প্রসন্ন ছিলেন না, যেটা শকুন্তলা দেবীর জবানবন্দী থেকেই আমরা জানতে পারি, অধ্যাপকের পক্ষে তথাপি সরাসরি রাঘব সরকারের প্রস্তাবটা নাকচ করা সম্ভবপর হয় নি হয়ত—অবিশ্যি এটা আমার অনুমান, অন্যথায় রাঘব সরকার অধ্যাপককে বিপদে ফেলতে পারে তার সঙ্গে তার গোপন যোগাযোগের কথাটা অর্থাৎ ঐ সিনথেটিক হীরের ব্যবসার কথাটা প্রকাশ করে দিয়ে। বেচারী অধ্যাপকের সাপের ছুঁচো গেলার মত অবস্থা হয়েছিল—মানে রাঘব সরকারের প্রস্তাবটা যেমন ফেলতে পারছিলেন না মন থেকে, তেমনি তার অশেষ স্নেহের পাত্রী শকুন্তলা দেবীকেও সব জেনেশুনে ঐ শয়তান রাঘবের হাতে তুলে দিতে পারছিলেন না। এদিকে শকুন্তলা দেবীর অবস্থাটাও সঙ্কটজনক হয়ে ওঠে। তার পক্ষেও যেমন অধ্যাপকের দিকটা অবহেলা করা সম্ভবপর ছিল না, তেমনি দুষ্মন্তকেও অস্বীকার করাটা সম্ভবপর ছিল না—তাই না শকুন্তলা দেবী?

হ্যাঁ, শকুন্তলা মৃদুকণ্ঠে এতক্ষণে কথা বললে, রাঘব সরকার কাকাকে আটিমেটাম দিয়েছিল এই মাসের পনেরো তারিখের মধ্যেই অর্থাৎ কাকার জন্মতিথি উৎসবের দশ দিনের মধ্যেই বিবাহের ব্যাপারটা চুকিয়ে না দিলে কাকার পক্ষে ভাল হবে না–

আর তাই আপনি ভয় পেয়ে আমার কাছে ছুটে গিয়েছিলেন, তাই নয় কি?

হ্যাঁ। আমার আর–

অন্য উপায় ছিল না। তা বুঝতে পারছি, কারণ সিথেটিক হীরার ব্যাপারটাও আপনি কোনক্রমে জেনেছিলেন—ঠিক কিনা শকুন্তলা দেবী?

প্রশ্নটা করে কিরীটী শকুন্তলার মুখের দিকে তাকাল।

হ্যাঁ, আমি—

আপনি জানতেন।

হ্যাঁ।

শুধু আপনি কেন, আরো দুজন ইদানীং ব্যাপারটা কিছুদিন ধরে জানতে পেরেছিলেন মিস চৌধুরী।

আরো দুজন?

শকুন্তলা প্রশ্নটা করে কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।

হ্যাঁ  আরো দুজন—মিঃ সেন আর ঐ রঞ্জনবাবু। আর তাইতেই তো গোলমালটা বিশ্রীভাবে সহসা পাকিয়ে উঠল।

কিরীটী বলতে বলতে আবার একটু থামল।

ঘরের মধ্যে সব কটি প্রাণীই যেন অখণ্ড মনোযোগের সঙ্গে কিরীটী-বর্ণিত কাহিনী শুনছিল।

.

২৩.

কিরীটী বলতে লাগল, সেই কথাতেই এবার আসছি—অর্থাৎ বর্তমান নাটকের তৃতীয় দৃশ্যে। ব্যাপারটা অবিশ্যি রঞ্জনবাবুই প্রথমে জানতে পারেন, কারণ তিনি এ বাড়িতে আসা অবধি অধ্যাপকের পাশের ঘরটিতেই স্থান নিয়েছিলেন। রাঘব সরকার মধ্যে মধ্যে রাত্রের দিকে অধ্যাপকের সঙ্গে দেখা করতে আসত এবং অধ্যাপকের ঘরের মধ্যে বসেই তাদের মধ্যে। আলোচনা হতো। কোন একদিন সেই রকম কোন আলোচনাই রাঘব ও অধ্যাপকের মধ্যে তার কানে হয়ত যায় এবং ব্যাপারটা তিনি জানতে পারেন। যাই হোক ইতিমধ্যে আমার ধারণা একটি ঘটনা ঘটে—বিনায়ক সেনের নিতান্ত সঙ্গীন অবস্থা চলছিল, চারিদিকে ধার-দেনা, অনন্যোপায়ে তিনি হয়তো রাঘব সরকারের কাছে গিয়ে কিছু অর্থের জন্য বলেন, যার ফলে। মাত্র মাস-দুই আগে সংবাদপত্রে একটা বিজ্ঞাপন আমার নজরে পড়েছিল—স্বাগতা পিকচার্সের নবতম চিত্ৰাৰ্ঘ জুয়েলার শ্রীরাঘব সরকারের প্রযোজনায় অভিজ্ঞান শকুন্তলম্‌! হ্যাঁ, ঐ অভিজ্ঞান শকুন্তলমের বিজ্ঞপ্তিটিই আমার চোখ খুলে দেয়। যার ফলে আমি বুঝতে পারি রাঘব সরকার বিনায়ক সেনের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। কিন্তু রাঘব সরকারের মত ঝানু। লোক এত সহজে অনিশ্চিত ফিল্ম বিজনেসের কবলিত হবে সম্ভব তো নয়। কথাটা মনে মনে। পর্যালোচনা করতে গিয়েই একটা সম্ভাবনা আমার মনের মধ্যে উঁকি দেয়, নিশ্চয় ঐ যোগাযোগের স্বীকৃতির মধ্যে কোন কার্যকারণ আছে। পরে ভেবে মনে হয়েছে, সেটা ঐ শকুন্তলা দেবী। রাঘব সরকার নিশ্চয়ই মিঃ সেনের প্রস্তাবে রাজী হয়েছিলেন, বিনায়কবাবু অধ্যাপকের বাল্যবন্ধু এবং বিশেষ প্রীতি আছে দুজনের মধ্যে, অতএব বিনায়ক সেন চেষ্টা করলে এই বিবাহ ঘটাতে পারেন, এই আশাতেই বিবাহ ঘটাবার চুক্তিতে কি মিঃ সেন, তাই নয়? প্রশ্নটা করে কিরীটী তাকাল বিনায়ক সেনের দিকে।

বিনায়ক সেন কোন জবাব দিলেন না, মাথা নীচু করেই রইলেন নিঃশব্দে।

বুঝতে পেরেছি আমার অনুমান মিথ্যে নয় মিঃ সেন। আপনার ও রাঘব সরকারের পরস্পরের মধ্যে ঐ চুক্তিই হয়েছিল। যাক, কিন্তু দুর্ভাগ্য বিনায়কবাবু জানতেন না যে সিনথেটিক হীরার ব্যাপারে ইতিমধ্যেই তাঁর বাল্যবন্ধু অধ্যাপক বিমলবাবুকে রাঘব সরকারের কুক্ষিগত হতে হয়েছিল। সেটা বোধ হয় জানতে পারেন সর্বপ্রথম রঞ্জনবাবুর মুখেই। রঞ্জনবাবুর সম্পর্কে আরো কিছু আমার বক্তব্য আছে। রঞ্জনবাবু বিনায়কবাবু ফিল্ম-এর বিজনেস করেন জেনে তার কাছে গিয়েছিলেন হয়তো কোন সময় কাজের জন্য, কিন্তু বিনায়কবাবু হয়তো তাঁকে পাত্তা দেন নি এবং ঐ সময় হীরার ব্যাপারটা তার গোচরীভূত হওয়ায় আবার হয়তো তিনি বিনায়কের কাছে যান এবং বিনায়ক এবারে আর রঞ্জনবাবুকে প্রত্যাখ্যান জানাতে পারেন নি, তাঁর সঙ্গে হাতে হাত মিলান। কি মিঃ সেন, আমার অনুমান কি মিথ্যা?

পূর্ববৎ বিনায়ক সেন চুপ করে রইলেন।

কিরীটী আবার বলতে লাগল, মিথ্যা নয় আমি জানি। যাই হোক এবারে বিনায়কও রাঘব। সরকারের পক্ষ থেকে বেচারী অধ্যাপককে চাপ দিতে শুরু করলেন। অথচ তিনি তখনও জানতেন না শকুন্তলার সত্য পরিচয়টা। অবিশ্যি জানলেও যে উনি পিছপাও হতেন আমার মনে হয় না। ব্যাপারটা তা হলে শেষ পর্যন্ত কিভাবে জটিল হয়ে উঠল আপনারা ভেবে দেখুন এবং সব জটিলতার মূলে ঐ শকুন্তলা দেবীর প্রতি শয়তান রাঘবের শ্যেনদৃষ্টি-হা শকুন্তলা দেবী, আপনিই এই নাটকের মূল। যে নাটক গত কিছুদিন ধরে এই বাড়িতে আপনাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয়েছে এবং যার চরম ক্লাইমেক্সে অধ্যাপকের শোচনীয় মৃত্যু হল

আমি! অস্ফুট কণ্ঠে বলল শকুন্তলা।

হ্যাঁ, আপনি। কিন্তু সে কাহিনীরও পশ্চাতে রয়েছে আপনাকেই কেন্দ্র করে আর এক কাহিনী–

আর এক কাহিনী!

হ্যাঁ। কিন্তু সে কাহিনীর বিবৃতির আজ আর আপনার কাছে কোন প্রয়োজন নেই।

কিরীটীবাবু-কি যেন বলবার চেষ্টা করে শকুন্তলা।

কিন্তু শকুন্তলাকে থামিয়ে দিয়েই কিরীটী বলে, ব্যস্ত হবেন না শকুন্তলা দেবী, হয়ত সে কাহিনী একদিন আপনা হতেই আপনার কাছে প্রকাশ হয়ে যাবে। কিন্তু যাক সে কথা, মিঃ সেন ও রঞ্জনবাবুর কথা আমি বলছিলাম সেই কথাই শেষ করি। একটু আগে যে কাহিনীর ইঙ্গিত মাত্র আমি দিলাম, সম্ভবতঃ সেটা রঞ্জনবাবু জেনেছিলেন কোন এক সময় অধ্যাপকের পাশের ঘরেই থাকার দরুন-অধ্যাপক ও বিনায়কবাবুর মধ্যে আলোচনা প্রসঙ্গে অথবা অধ্যাপক ও সরমা দেবীর মধ্যে আলোচনা প্রসঙ্গে। এবং যার ফলে নাটকের গতি আবার। মোড় নিল। অর্থাৎ রঞ্জনবাবু বিনায়কবাবুকে সাহায্যই নয়—ঐ সুযোগে নিজের ভবিষ্যৎটাকে নতুন করে গড়ে তোলবারও আবার স্বপ্ন দেখতে লাগলেন আর সেই সঙ্গে নাটকের শেষ দৃশ্যও ঘনিয়ে আসতে লাগল। অধ্যাপক, বিনায়কবাবু, রাঘব সরকার ও রঞ্জন বোসকে নিয়ে নাটক ঘনীভূত হয়ে উঠল। চারজন লোকের পরস্পরের বিচিত্র স্বার্থে লাগল সংঘর্ষ—যে স্বার্থের কথা আমি এইমাত্র আপনাদের বললাম। যদি ভেবে দেখেন আপনারা তো দেখতে পাবেন ওঁদের মধ্যে একজনের অর্থাৎ অধ্যাপক বিমল চৌধুরীর সামাজিক প্রতিষ্ঠা ও সম্মান এবং রাঘব সরকারের শকুন্তলা লাভ ব্যতীত অন্য দুইজনের স্বার্থ ছিল অর্থ। এবং ঠিক সেই সময় ঘটল আর একটি বিচিত্র ব্যাপার নাটকের ঐ সঙ্গীন মুহূর্তেই ঐ বিচিত্র ব্যাপারটি ঘটল— বলতে বলতে কিরীটী থামল যেন হঠাৎ।

তার মুখের দিকে তাকিয়ে সেই মুহূর্তে আমার মনে হল কিরীটী যেন রীতিমত এক সংশয়ে পড়েছে।

অতঃপর কাহিনীর শেষাংশ সে উদঘাটিত করবে কি করবে না এবং কেন যে তার ঐ দ্বিধা তাও আমি বুঝতে পারছিলাম।

সরমা—সরমার কথা ভেবেই সে হঠাৎ চুপ করে গেল।

কিরীটী মনে মনে কি ভাবল সে-ই জানে—তবে মনে হল তার মুখের দিকে তাকিয়ে, অতঃপর বাকিটুকু সে বলবে বলেই মনে মনে স্থির করেছে। এবং আমার অনুমান যে মিথ্যা নয়, পরমুহূর্তেই বুঝলাম।

সে বলতে শুরু করল পুনরায়:

বুদ্ধিমতী সরমা ব্যাপারটা জানতে পেরেছিল ইতিমধ্যে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সে অধ্যাপককে ভুল বুঝেছিল—সে ভেবেছিল বুঝি ইচ্ছা করেই অধ্যাপক নিজের স্বার্থের জন্য শকুন্তলাকে রাঘব সরকারের হাতে তুলে দিচ্ছেন। এবং শুধু যে সরমাই ভুল বুঝেছিল অধ্যাপককে তাই নয়, বিনায়কবাবুও ভুল বুঝেছিলেন তাঁর বাল্যবন্ধু অধ্যাপক বিমলবাবুকে। তিনি অর্থাৎ মিঃ। সেন ভেবেছিলেন—এই পর্যন্ত বলেই কিরীটী আবার থামল এবং হঠাৎ শকুন্তলার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল, মিস চৌধুরী যদি কিছু মনে না করেন তো-বড্ড পিপাসা পেয়েছে একটানা বকে বকে, যদি একটু চায়ের ব্যবস্থা করতেন–

শকুন্তলা তাকাল কিরীটীর মুখের দিকে।

কিরীটী ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই বোধ হয় মৃদু হাস্যসহকারে বলে, না, আপনি না ফিরে আসা পর্যন্ত আমি চুপ করেই আছি—তবে একটু তাড়াতাড়ি করবেন।

মনে হল একান্ত যেন অনিচ্ছার সঙ্গেই শকুন্তলা দেবী ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

.

২৪.

কিরীটী যেন কান পেতেই ছিল, শকুন্তলার পায়ের শব্দটা মিলিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই কিরীটী ইঙ্গিতে দরজাটা ভেজিয়ে দেবার জন্য বলল।

আমি এগিয়ে গিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিলাম।

শিবেনবাবু, উনি ফিরে আসবার আগেই আমাকে শেষ করতে হবে—আই মাস্ট ফিনিশ ইট বিফোর সি কামস্ ব্যাক্‌! হ্যাঁ, বলছিলাম বিনায়কবাবুও তার বাল্যবন্ধু অধ্যাপককে ভুল বুঝেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন বিনায়কবাবুর পীড়াপীড়ির হাত থেকে শকুন্তলার রাঘবের সঙ্গে বিবাহের ব্যাপারে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যই হয়তো শেষ পর্যন্ত অধ্যাপক রাঘবের কাছে। শকুন্তলার সত্যিকারের জন্মবৃত্তান্তটা খুলে বলবেন। রাঘব তা হলে জেনেশুনে সমাজের জন্মপরিচয়হীন এক মেয়েকে নিশ্চয়ই বিবাহ করবে না এবং তার ফলে এক ঢিলে দুই পাখীই। মারা হবে। রাঘবের হাত থেকেও নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে এবং শকুন্তলাকেও দুঃখ দেওয়া হবে। কিন্তু বিনায়কবাবু বুঝতে পারেন নি—অধ্যাপকের পক্ষে ঐ কাজ কখনোই সম্ভবপর ছিল না–

সহসা ঐ সময় এতক্ষণে বিনায়ক সেন কথা বলে উঠলেন, ছিল—ইউ ডণ্ট নো হিম—

মিঃ সেন!

হ্যাঁ, হ্যাঁ—অ্যাণ্ড ইন ফ্যাক্ট হি থ্রেটে মি, আমাকে সে শাসিয়েছিল।

তবু আমি বলব তিনি তা করতেন না।

করতেন—আর তা করতেন বলেই দেয়ার ওয়াজ নো আদার অল্টারনেটিভ—

মিঃ সেন!

ইয়েস-হ্যাঁ হ্যাঁ, আই কিল্ড হিম! আমি তাকে হত্যা করেছি ইয়েস—আমি স্বীকার করছি তাকে আমি হত্যা করেছি—

আমি জানতাম মিঃ সেন—আমি জানতে পেরেছিলাম পরের দিনই ব্যাপারটা টেলিফোন অফিসে এনকোয়ারি করে। আপনার বাড়ি থেকেই সেরাত্রে আপনার পূর্ব-নির্দেশমতই এখানে ফোন-কল এসেছিল এবং আপনার ও রঞ্জনবাবুর পূর্ব-প্ল্যানমত সেই ফোন আসা মাত্রই রঞ্জনবাবু ফোনটা অধ্যাপকের ঘরে নিয়ে গিয়ে রেখে তাকে সংবাদ দেন—তাই না রঞ্জনবাবু?

মৃদু কণ্ঠে রঞ্জন বলল, হ্যাঁ।

তারপর—কিরীটী বলতে লাগল, বেচারী যখন ঘরে ঢুকে নিশ্চিন্তে ফোন তুলে নিয়েছেন। —বিনায়কবাবু রঞ্জনবাবুর ঘর থেকে দুই ঘরের মধ্যবর্তী দরজাপথে এসে পশ্চাৎ থেকে অতর্কিতে ক্লোরোফরম নিয়ে আক্রমণ করেন অধ্যাপককে। এবং অজ্ঞান করে পরে ডিজিট্যালিন সম্ভবত হাই ডোজে ইনজেক্ট করে অধ্যাপককে হত্যা করা হয়—তাই নয় কি?

রঞ্জনই আবার মৃদু কণ্ঠে বলে, হ্যাঁ।

দেখুন দুর্ভাগ্য আপনাদের রঞ্জনবাবু ও বিনায়কবাবু, আপনারা ভেবেছিলেন কেউ সে-কথা জানতে পারবে না কিন্তু তা তো হল না—আপনারাই রেখে গিয়েছিলেন হত্যার নিদর্শন পশ্চাতে—

নিদর্শন! শিবেন সোম প্রশ্ন করলেন।

হ্যাঁ, প্রথমতঃ ফোন-কল। দ্বিতীয়তঃ ফোনটাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে। তৃতীয়তঃ ক্লোরোফরমের ভেজা টাওয়েলটা বাথরুমে ফেলে রেখে গিয়ে। চতুর্থ ক্লোরোফরমের গন্ধ ঢাকবার জন্য ট্যাপ খুলে বাথরুমে হাত ধুয়েও ট্যাপটা তাড়াতাড়িতে বন্ধ করতে ভুলে গিয়ে। এবং পঞ্চম সেই রাত্রেই ঐ ঘরটা পুলিস বন্ধ করে চলে যাবার পর আবার রঞ্জনবাবু আপনি বিনায়কবাবুর পরামর্শে তালা ভেঙে ঘরে ঢুকে অধ্যাপকের বসবার চেয়ারটা ভেঙে

কিন্তু আফটার অল, উনি চেয়ারটা ভাঙতে গেলেন কেন? শিবেন সোম প্রশ্ন করেন।

হীরার জন্য।

কি বললেন, হীরার জন্য?

হ্যাঁ, ল্যাবরেটারি থেকে এনে সিনথেটিক হীরাগুলো অধ্যাপক ঐ চেয়ারের পায়ার গুপ্ত কোটরেই লুকিয়ে রাখতেন। বিনায়কবাবুর পরামর্শেই তিনি ঐভাবে হীরাগুলো লুকিয়ে রেখেছিলেন, অবিশ্যি বিনায়কবাবু তখন মরীয়া হয়ে উঠেছেন, রাঘব সরকারকে যদি সহজে কায়দা না করতে পারেন তো ঐ হীরার সাহায্যেই কায়দা করবেন এই বোধ হয় ভেবেছিলেন, তাই নয় কি বিনায়কবাবু?

বলাই বাহুল্য, বিনায়ক সেন কোন জবাব দিলেন না।

বুঝতে পারছি অনুমান আমার মিথ্যে নয়। কিন্তু রঞ্জনবাবু, বিনায়কবাবু যেমন ভুল করেছেন তেমনি আপনিও একটা মারাত্মক ভুল করেছেন।

রঞ্জন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে যেন তাকাল কিরীটীর মুখের দিকে।

হ্যাঁ ভুল, আপনি ভেবেছিলেন অধ্যাপকের অর্থাৎ আপনার মামার সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় শেষ পর্যন্ত হয়তো তিনি শকুন্তলা দেবীকে তার যাবতীয় সম্পত্তি ও টাকাকড়ি লিখে দিয়ে যাবেন আপনাকে বঞ্চিত করে—

না, ভুল করি নি—তিনি তাই আমাকে স্পষ্ট বলেছিলেন!

কিন্তু তিনি তা করতেন না। আর করলেও তা আইনে টিকত না। কারণ শকুন্তলা দেবীর তো তার সম্পত্তির উপরে আইনতঃ কোন অধিকারই বর্তাতো না!

কি বলছেন।

ঠিকই বলছি, শকুন্তলা তার কেউ নয়।

কেউ নয়?

না, চৌধুরী-বাড়ির কেউ নয় সে–

সহসা ঐ সময় দড়াম করে ঘরের ভেজানো দরজা খুলে গেল এবং উদ্ভ্রান্তের মতই শকুন্তলা ঘরে এসে ঢুকল।

কি–কি বললেন মিঃ রায়?

কিরীটী চুপ।

মিঃ রায়, চুপ করে আছেন কেন, বলুন-তবে কে আমি? কেন এ বাড়িতে আমি– বলুন মিঃ রায় বলুন–

তিনি দয়া করে এখানে আপনাকে স্থান দিয়েছিলেন—

দয়া করে!

হ্যাঁ।

কিন্তু কেন? কেন তার এ দয়া?

যেহেতু তিনি ছিলেন সত্যিকার মহৎ ব্যক্তি। আপনি—সরমা দেবী ও বিনায়কবাবুর সন্তান।

কি—কি বললেন? আমি—আমি—বাকী কথাগুলো আর শকুন্তলা উচ্চারণ করতে পারল না। জ্ঞান হারিয়ে ঘরের মেঝের উপর পড়ে গেল।

কিরীটী তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে তাকে মাটি থেকে তুলে নিল কোলের উপরে।

.

আরো ঘণ্টা দুই পরে।

থানায় শিবেন সোমের অফিস ঘরে বসেছিলাম আমরা।

শকুন্তলাকে রামচরণের জিম্মায় রেখে চলে এসেছি আমরা রঞ্জন ও বিনায়কবাবুকে অ্যারেস্ট করে সঙ্গে নিয়ে।

কিরীটী বলছিল, তাই আমি বলছিলাম শেষ পর্যন্ত অধ্যাপকের ব্যাপারটা ট্র্যাজেডি অফ এরর এ পর্যবসিত হয়েছিল।

কিন্তু আপনি বিনায়ক সেনকে সাসপেক্ট করলেন কি করে?

সরমার জবানবন্দীর পরই সে-রাত্রে আমি বুঝতে পেরেছিলাম ঐ সরমাকে কেন্দ্র করে কোন একটি গোপন ইতিহাস আছে বিমলবাবুর হত্যার পশ্চাতে। তারপর অকুস্থলের জিওগ্রাফি–অধ্যাপকের পাশের ঘরেই রঞ্জনবাবু থাকতেন, তাতে করে মনে হয়েছিল তিনি অর্থাৎ রঞ্জনবাবু হয়তো অনেক কিছুই জানেন বা জানতে পেরেছেন আড়ি পেতে। আরো রঞ্জনবাবুই অধ্যাপককে ফোনের সংবাদটা সরবরাহ করেছিলেন। স্বাভাবিক ভাবে অবিশ্যি তাতে করে রঞ্জনবাবুর উপরেই সন্দেহ পড়ার কথা, কিন্তু বাড়িতে অত লোকজনের উপস্থিতির মধ্যে রঞ্জনবাবুর একার পক্ষে অত বড় রিস্ক নেওয়া আদৌ সম্ভবপর ছিল না বলেই আমার মনে হয়েছিল, আরো কেউ ওর পিছনে আছে এবং কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই আমি আর কার পক্ষে ঐ ব্যাপারে লিপ্ত থাকা সম্ভবপর ছিল ভেবেছি। ইতিমধ্যে ময়না তদন্তের রিপোর্টটা পেয়ে গেলাম এবং ময়না তদন্ত রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ ডিজিট্যালিন জানতে পেরে ঐ সন্দেহটা আমার দৃঢ় হয় যে, রঞ্জনবাবুর সঙ্গে আরো কেউ আছে। কিন্তু কে সে? কার পক্ষে থাকা সম্ভব? এদিকে যেভাবে নিহত হয়েছিলেন অধ্যাপক, তাতে করে একটা সন্দেহ আমার প্রথম থেকেই মনের মধ্যে বদ্ধমূল হয়েছিল—যে-ই অধ্যাপককে হত্যা করুক না কেন সে তার বিশেষ পরিচিত এবং পরিচয়ের ঐ সুযোগটা নিয়েই সে অর্থাৎ হত্যাকারী আকস্মিক আঘাত হেনেছিল অধ্যাপককে। এখন প্রশ্ন, পরিচিতের মধ্যে সে-রাত্রে ঐ সময় অকুস্থানে কে কে উপস্থিত ছিল! দুষ্মন্ত, শকুন্তলা ও সরমাকে আমি আগেই সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছিলাম। কারণ দুষ্মন্ত ঐ সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল না এবং পরে খবর নিয়েও জেনেছিলাম সত্যিই সে হত্যার সময়টা তার কলেজের রিসার্চরুমে ব্যস্ত ছিল। এবং বাকী দুজনকে বাদ দিয়েছিলাম তারা নারী বলে। কোন নারীর পক্ষে ঐভাবে হত্যা করা সম্ভবপর আদৌ ছিল না। তাহলে এখন বাকী থাকে তিনজন—বিনায়ক সেন, রাঘব সরকার ও রঞ্জন বোস। রঞ্জন বোস সম্পর্কে আগেই ভেবেছি—বাকী রইল বিনায়ক সেন। বিনায়ক সেন সম্পর্কে আমি অনুসন্ধান শুরু করি। এবং অনুসন্ধানের ফলে দুটো ব্যাপার আমি জানতে পারি। প্রথম তার বর্তমান আর্থিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠেছিল। দ্বিতীয়, একদা ফোর্থ ইয়ার পর্যন্ত সে ডাক্তারী পড়েছিল। কাজেই হত্যার কারণ ও উপায়ের দিক থেকে তারই ওপর গিয়ে আমার সন্দেহ পড়ে। আরো একটা ব্যাপার এর মধ্যে ছিল, সেটা হচ্ছে সরমার উপরে আমার সন্দেহ। আমার কেমন যেন প্রথম থেকেই ধারণা হয়েছিল সরমা হত্যাকারী কে জানতে পেরেছিল—কিন্তু আশ্চর্য লেগেছিল আমার কথাটা ভেবে যে, সরমা হত্যাকারী কে জানা সত্ত্বেও ব্যাপারটা গোপন করে গেল কেন? ভাবতে শুরু করি এবং ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আমার মনে হয়, সরমার অতীতের সঙ্গে ঐ বিনায়ক সেন জড়িত নয় তো! কারণ দীর্ঘদিন সরমা অধ্যাপকের গৃহে আছে এবং বিনায়ক অধ্যাপকের বাল্যবন্ধু। ঠিক সেই সংশয়ের মুহূর্তে শকুন্তলাকে আমি অ্যারেস্ট করবার জন্য শিবেনবাবু আপনাকে বলি। সেদিন আপনাকে কোন রিজ দিই নি, কিন্তু আজ বলছি, সরমা ও শকুন্তলার ফটো থেকে উভয়ের মধ্যে অদ্ভুত সৌসাদৃশ্য দেখবার আগেই ওদের দুজনের মুখের বিশেষ তিলটি ও উভয়ের মুখের একই ধরনের গঠন আমার দৃষ্টিকে আকর্ষণ করেছিল সেই কারণেই আমি ফটোর কথা বলেছিলাম এবং সেই সন্দেহের আমার নিরসনের জন্যই শকুন্তলাকে অ্যারেস্ট করতে বলেছিলাম। তীর ছুঁড়েছিলাম আমি সরমার প্রতিই এবং আমার অনুমান যে মিথ্যা নয় তা প্রমাণ হয়ে গেল সেই রাত্রে যে মুহূর্তে সরমা এসে আমার গৃহে উপস্থিত হল শকুন্তলার অ্যারেস্টের পর। সে-রাত্রে নীচে গিয়ে সরমাকে বিদায় দেবার সময় বিনায়ক সেনের প্রতি আমার সন্দেহের কথাটা বলাতেই সরমার। মুখের দিকে তাকিয়ে তার মুখে যে পরিবর্তন দেখেছিলাম, আমার তাতে করে আর কোন সন্দেহই রইল না যে শকুন্তলার বাপই ঐ বিনায়ক সেন। তার পরের ব্যাপার তো আপনারা সকলে জানেনই।

.

২৫.

একটানা অনেকক্ষণ ধরে কথা বলে কিরীটী থামল।

ধীরে ধীরে পকেট থেকে টোবাকো পাউচ ও পাইপটা বের করে পাইপে তামাক ভরে তাতে অগ্নিসংযোগ করল কিরীটী।

এবং কয়েক সেকেণ্ড ধূমপান করে বলল, শুধু মাত্র শকুন্তলাকে তার জন্মবৃত্তান্তের লজ্জা থেকে বাঁচাবার জন্যই সেদিন আমি সরে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম শিবেনবাবু। কিন্তু নিয়তি বুঝি কেউ এড়াতে পারে না। নচেৎ এমনি করে শকুন্তলার কাছে শেষ পর্যন্ত সব প্রকাশ হয়ে পড়বেই বা কেন ঘটনাচক্রে!

শিবেন নাম বললেন, সত্যি মেয়েটার জন্য দুঃখ হয়—

হ্যাঁ, দুঃখ হয় বৈকি। আর হয়তো বাকী জীবনটা দুষ্মন্তর স্মৃতি বয়েই বেড়াতে হবে বেচারীকে অতঃপর!

কেন—এ কথা বলছেন কেন?

বলছি ঐ শকুন্তলার আঙুলের অভিজ্ঞানটির জন্য।

অভিজ্ঞান?

মনে পড়ছে না শকুন্তলার হাতের আংটিটা!

সেটা তো রাঘব সরকারের দেওয়া?

না। স্থিরকণ্ঠে কিরীটী বললে।

না মানে? প্রশ্ন করলাম এবারে আমিই, তবে কার দেওয়া আংটি?

দুষ্মন্তর।

দুষ্মন্তর? কি করে জানলে?

সরমা বলেছিল।

তবে–

কি তবে? আংটিই তো কাল হয়েছিল শেষ পর্যন্ত শকুন্তলার পক্ষে, কারণ সেই কথাটা– মানে বিনায়ক সেন আংটির ব্যাপারটা জানতে পারার দরুনই সে আরো হেস্টি স্টেপস্ নিয়েছিল। তাই বলছিলাম ঐ অভিজ্ঞানটিই হয়তো বাকী জীবনটা শকুন্তলার কাছে দুষ্মন্তর স্মৃতি হয়ে থাকবে।

কিন্তু তা নাও তো পারে! দুষ্মন্ত তাকে বিয়েও তো করতে পারে! বললাম আমি।

না বন্ধু না, শকুন্তলার জন্মবৃত্তান্ত শোনার পরই দুষ্মন্তর প্রেম দেখো ঠিক শুকিয়ে যাবে। আর শুধু দুষ্মন্তর কথাই বা বলছি কেন, সামান্য কদিনের পরিচয়ে শকুন্তলাকে যতটুকু চিনেছি—শকুন্তলাই হয়তো দুষ্মন্তর জীবন থেকে সরে দাঁড়াবে।

শেষের দিকে কিরীটীর কণ্ঠস্বরটা যেন কেমন ব্যথায় বিষণ্ণ ও স্রিয়মাণ মনে হল। কিরীটী অন্যদিকে মুখ ফেরাল।

স্তব্ধ কক্ষের মধ্যে যেন একটা নিঃশব্দ ব্যথার সুর করুণ কান্নার মতই গুমরে গুমরে ফিরতে লাগল।

Exit mobile version