Site icon BnBoi.Com

মৃত্যুবাণ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

মৃত্যুবাণ - নীহাররঞ্জন গুপ্ত

 ১.০১ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

মৃত্যুবাণ
কিরীটী অমনিবাস – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

চরিত্রলিপি

মৃত্যুবাণ উপন্যাসটির মধ্যে বহু বিচিত্র ঘটনার সমাবেশ দেখা দিয়েছে, বহু বিচিত্র চরিত্র। পাঠক-পাঠিকাদের সুবিধার জন্যই একটি সম্পূর্ণ চরিত্রলিপি দেওয়া হল।

রাজা যজ্ঞেশ্বর মল্লিক – রায়পুর স্টেটের রাজা

রাজেশ্বর মল্লিক – যজ্ঞেশ্বরের খুড়তুতো ভাই

রাজা রত্নেশ্বর মল্লিক – যজ্ঞেশ্বরের একমাত্র পুত্র

রাজা শ্ৰীকণ্ঠ মল্লিক – রত্নেশ্বরের জ্যেষ্ঠ পুত্র

কুমার সুধাকণ্ঠ মল্লিক – ঐ মধ্যম পুত্র

রাজা বাণীকণ্ঠ মল্লিক – ঐ কনিষ্ঠ পুত্র

কাত্যায়নী দেবী – ঐ একমাত্র কন্যা ও নায়েব শ্রীবিলাস মজুমদারের ভ্রাতৃবধু

হারাধন মল্লিক – সুধাকণ্ঠের পুত্র, রায়পুর আদালতের মোক্তার

নিশানাথ মল্লিক – বাণীকণ্ঠের পুত্র, শোলপুর স্টেটের চিত্র-শিল্পী, বিকৃত-মস্তিষ্ক

রাজাবাহাদুর রসময় মল্লিক – নিষ্পুত্রক রাজা শ্রীক মল্লিকের দত্তক পুত্র

রাজাবাহাদুর সুবিনয় মল্লিক – রসময় মল্লিকের প্রথম পক্ষের পুত্র

কুমার সুহাস মল্লিক – ঐ দ্বিতীয় পক্ষের পুত্র

প্রশান্ত মল্লিক – সুবিনয় মল্লিকের একমাত্র পুত্র

জগন্নাথ মল্লিক – হারাধন মল্লিকের পৌত্র

সুরেন চৌধুরী – কাত্যায়নী দেবীর পুত্র

ডাঃ সুধীন চৌধুরী – ঐ পৌত্র বা সুরেন চৌধুরীর ছেলে

সুহাসিনী দেবী – সুরেন চৌধুরীর স্ত্রী

মালতী দেবী – ছোট রাণীমা, রসময়ের দ্বিতীয় স্ত্রী

দীনতারণ মজুমদার – রাজা যজ্ঞেশ্বরের নায়েব

শ্রীবিলাশ মজুমদার – দীনতারণের পুত্র ও শ্রীকণ্ঠ ইত্যাদির নায়েব

শিবনারায়ণ চৌধুরী – নৃসিংহগ্রামের নায়েব

দুঃখীরাম – শিবনারায়ণের ভৃত্য

সতীনাথ লাহিড়ী – রায়পুরের সদর ম্যানেজার ও সুবিনয়ের সেক্রেটারী

তারিণী চক্রবর্তী – রায়পুর স্টেটের খাজাঞ্চী

মহেশ সামন্ত – ঐ তহবিলদার

সুবোধ মণ্ডল – ঐ বাজার সরকার

হরবিলাস – নৃসিংহগ্রামের নতুন ম্যানেজার

সতীশ কুণ্ডু – স্টেটের একজন কর্মচারী

ছোট্টু সিং – ঐ দারোয়ান

শম্ভু – রাজা সুবিনয় মল্লিকের খাসভৃত্য

মহীতোষ চৌধুরী – ঐ দূরসম্পর্কীয় ভাই

ডাঃ কালীপদ মুখার্জী – প্রথিতযশা চিকিৎসক

ডাঃ অমর ঘোষ – ডাঃ মুখার্জীর সহকারী

ডাঃ অমিয় ঘোষ – রাজবাড়ির পারিবারিক চিকিৎসক

বিকাশ সান্যাল – রায়পুর থানার ও.সি.

কর্ণেল মেনন – বম্বে প্লেগ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ

মুন্না – সাঁওতাল সর্দার

কিরীটী – রহস্যভেদী

সুব্রত – কিরীটীর সহকারী

জাস্টিস মৈত্র – হাইকোর্টের জজ

ভবানীপ্রসাদ – উচ্ছৃঙ্খল বিত্তহীন ধনীর পুত্র

ন্যাপা, বিষ্টুচরণ, কৈলাস – ঐ দলের লোক

নির্মল, মিঃ হুড – কোর্ট অফ অর্ডারস্-এর ম্যানেজার

ডঃ আমেদ – কলিকাতার পুলিস সার্জেন

.

প্রথম পর্ব

০১. ২৯শে ফেব্রুয়ারী

যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

জজসাহেব রায় দিলেন, জুরীদের সঙ্গে একমত হয়ে সুহাস মল্লিকের হত্যা-মামলার অন্যতম আসামী ডাঃ সুধীন্দ্র চৌধুরীকে।

অবশেষে একদিন সেই দীর্ঘপ্রতীক্ষিত রায়পুরের বিখ্যাত হত্যা-মামলার রায় বের হল। বিহার প্রদেশে অবস্থিত ছোটখাটোর মধ্যে অত্যন্ত সচ্ছল রায়পুর স্টেট; সেই স্টেটের ছোট কুমার শ্রীযুক্ত সুহাস মল্লিকের রহস্যজনক হত্যা-সম্পর্কিত মামলা।

জনসাধারণের চাইতেও কলকাতার ও আশেপাশের শহরতলীর বিশেষ করে চিকিৎসক সম্প্রদায়ের মধ্যে মামলাটি শুরু হতেই একটা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। বলতে গেলে প্রত্যেকেই মামলার ফলাফলের জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিলেন, শেষ পর্যন্ত মামলার ফলাফল কি দাঁড়ায়। সেই মামলার রায় আজ বের হয়েছে।

শীতের সন্ধ্যায় মজলিসটা সেদিন বেশ জমে উঠেছিল। বহুকাল পরে সেদিন আবার কিরীটীর টালিগঞ্জের বাসায় সকলে একত্রিত হয়েছে। কিরীটী, সুব্রত, রাজু, নীতিশ, ইন্সপেক্টার মফিজুদ্দীন তালুকদার, পুলিস সার্জেন ডাঃ আমেদ।

আলোচনা চলছিল রায়পুরের বিখ্যাত খুনের মামলা সম্পর্কে।

আজ জজ সাহেব রায় দিয়েছেন, আসামী ডাঃ সুধীন চৌধুরীর যাবজ্জীবন কারাবাসের আদেশ জারি হয়েছে।

রায়পুরের ছোট কুমার সুহাস মল্লিকের রহস্যজনক হত্যা-সম্পর্কিত মামলায় তিনিই ছিলেন প্রধান আসামী।

তর্ক-বিতর্ক হচ্ছিল। কারণ এদের মধ্যে কেউই আসামী সুধীন্দ্র চৌধুরীর দোষ সম্পর্কে একমত নয়।

কেবল ওদের মধ্যে একা কিরীটীই একপাশে একটা আরামকেদারায় হেলান দিয়ে চোখ বুজে পাইপ টানতে টানতে সকলের তর্ক-বিতর্ক শুনছিল, এবং এতক্ষণও কোনো মতামত প্রকাশ করেনি।

এই মামলার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত না থাকলেও, কিরীটী কাগজে পড়েছে এবং আগাগোড়াই মামলাটিকে লক্ষ্য করেছে। কিন্তু হঠাৎ একসময় যখন সুব্রত কিরীটীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে, কিরীটী, তোর কি মনে হয়? তুইও কি মনে করিস ডাঃ সুধীন্দ্র চৌধুরী এই হত্যার ব্যাপারে সত্যিই দোষী? তাঁর বিরুদ্ধে যেসব এভিডেন্স খাড়া করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে কোনো ত্রুটিই নেই?

কিরীটী সুব্রতর প্রশ্নে চোখ মেলে তাকাল, ব্যাপারটা বিশেষ রকম জটিল ও রহস্যপূর্ণ। কিন্তু সে কথা যাক, মোটামুটি এই হত্যার ব্যাপারে তর্ক-বিতর্ক করতে গিয়ে গোড়া থেকেই তোমরা সকলেই একটা মস্তবড় ভুল করছ বলেই আমার কিন্তু মনে হয়।

সুব্রত প্রশ্ন করে, কেন? কোথায় ভুল করছি?

কিরীটী বলে, এই ধরনের হত্যা-ব্যাপারের যত কিছু রহস্য সব হত্যার গোড়াতেই থাকে। হত্যা সংঘটিত হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সকল রহস্যের ওপরে যবনিকাপাত। কোনো একটা বিশেষ ব্যাপারে, কতকগুলো বিশেষ লোক, কোনো একটা বিশেষ কাজ করেছে। এই যে কতকগুলো লোকের একটা বিশেষ সংস্থান, একটা বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে, একটা বিশেষ সময়ে, এইখানেই আমাদের যত কিছু রহস্য লুকিয়ে আছে। কাজে কাজেই ঐ খুন বা হত্যার ব্যাপারের রহস্য উদঘাটন করতে হলে আমাদের হত্যা-ব্যাপারের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত যাবতীয় সব কিছু পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিচার করে দেখতে হবে। সমগ্র রহস্যটুকুর মধ্যে হত্যাটাই তো শেষ পরিচ্ছেদ বা সমাপ্তি মাত্র।

কিরীটী বলে চলে, তোমরা সকলে এবং অনুসন্ধানকারীরাও ঐ শেষ পরিচ্ছেদ থেকেই বার বার রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করছ। তাই তোমরা সত্যের শেষধাপে কোনমতে পৌঁছাতে পারছ না। শুরু কর সেই প্রথম পরিচ্ছেদ থেকে এবং তাহলেই আসল সত্যের মূলে আসতে পারবে।

কিরীটী একটু থেমে আবার বলতে লাগল, ধর আমাদের আসামী ডাঃ সুধীন চৌধুরীর ব্যাপারটাই। সুহাস মল্লিকের হত্যার সময়টিও ঠিক সে অকুস্থানে অর্থাৎ কলকাতায় ছিল না অর্থাৎ মৃত্যুর সময়টায় সে কয়েকদিনের জন্য বেনারসে চলে গিয়েছিল এবং মৃত্যুর দিন পাঁচেক বাদেই আবার সে ফিরে আসে। মাঝখানে মাত্র পাঁচ-সাতটা দিন, এতেই সে জড়িয়ে · পড়ল হত্যাপরাধের ব্যাপারে। কেননা প্রথমত রোগে আক্রান্ত হওয়ার আগে শেষবার সুহাস মল্লিক যখন রায়পুরে যান, মামলায় জানা যায় শিয়ালদহ স্টেশনে তখুনি নাকি ছোট কুমারের দেহে প্লেগ ব্যাসিলাই ইজেশন করা হয় এবং সুধীন চৌধুরী তখন সেই দলের মধ্যে ছিলেন। দ্বিতীয়ত সুধীন চৌধুরী একজন ডাক্তার। ডাঃ চৌধুরীর প্রতি তাঁর বিরুদ্ধে তৃতীয় অভিযোগ তাঁর ব্যাঙ্ক-ব্যালান্সটা হঠাৎ গত মাস দুয়ের মধ্যে বিশেষরকম ভাবে কেঁপে উঠেছিল, যেটা তাঁর দশ বছরের ইনকামের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো গেল না, এবং তিনিও নিজে তার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখাতে একপ্রকার রাজীই হলেন না আদালতে বিচারের সময়। তাহলেই ভেবে দেখ, ব্যাপার যাই হোক না কেন, স্থূল দৃষ্টিতে বিচার করে দেখতে গেলে ডাঃ সুধীন চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো সত্যিই কি বেশ জটিল নয়?

ঘরের মধ্যে উপবিষ্ট সব কটি প্রাণীই যেন রুদ্ধ নিশ্বাসে কিরীটীর কথাগুলো শুনছিল। কারও মুখে একটি টু শব্দ পর্যন্ত নেই। জমাট স্তব্ধতা। ঠিক এভাবে তো ওদের মধ্যে কেউই বিচার বা বিশ্লেষণ করে দেখেনি মামলাটা সত্যিই।

তোমরা হয়ত বলবে, কিরীটী আবার শুরু করে, মামলার that black man with the umbrella, সেই ছাতাওয়ালা কালো লোকটি, যার সব কিছু শেষ পর্যন্ত মিস্ট্রিই রয়ে গেল, আগাগোড়া মামলাটায়, সেই যে আসল কালপ্রিট নয় তাই বা কি করে বলা যায়?

সুব্রত প্রশ্ন করে, তুমি কি তাই মনে কর?

কিরীটী মৃদু হেসে বলে, মনে আমি অনেক কিছু করি, আবার করিও না।

সুব্রত বলে, কিন্তু আমারও মনে হয়, এ ব্যাপারে he was only an instrument, তাকে সামান্য একটা instrument হিসাবেই এ হত্যার ব্যাপারে কাজে লাগানো হয়েছিল। আসলে নাটকের সেই অপরিচিত কালো লোকটি (?) একটা side character মাত্র। তার কোনো importance-ই নেই এই হত্যা-মামলায়।

প্রত্যুত্তরে কিরীটী বলে, হয়তো তোমার ধারণা বা অনুমান মিথ্যা নাও হতে পারে সুব্রত, কিন্তু তবু সেই অজ্ঞাত ছাতাওয়ালার আগাগোড়া movementটা যদি trace করা যেত, তবে আসল হত্যাকারীর একটা কিনারা করা যেত কিনা তাই বা কে বলতে পারে? Side character হলেও un-important তো নয়?

মৃদুস্বরে সুব্রত বলে, আমার কিন্তু মনে হয় তা সম্ভব হত না।

কিরীটী মৃদু হেসে বললে, হয়ত যেত না—তবু কথাটা ভাববার কারণ, প্রথমত এই মামলার আসল হত্যাকারীর সঙ্গে ঐ বিশেষ লোকটির কোনো যোগাযোগ ছিল বা ছিল না—কিংবা হত্যাকারী অন্য দিক দিয়ে বিচার করলে সেই লোকটির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রেখেছে বা রাখেনি—এবং নিজে আড়ালে থেকে লোকটিকে দিয়ে কৌশলে কাজটুকু করিয়ে নিয়েছে সব কিছুই ভেবে দেখতে হবে। দ্বিতীয়ত সেই ছত্রধারী লোকটি আসল ব্যাপারটা–তাকে দিয়ে যে অন্য একটি লোকের দেহে প্লেগের বিষ সংক্রামিত করা হচ্ছে, সেটা সে বুঝতে শেষ পর্যন্ত পেরেছিল কিনা—আমি স্থিরনিশ্চিত যে সেই লোকটি হাতে ছাতাটা আসবার আধ ঘণ্টা আগে পর্যন্তও সেই কালোলোকটি ছাতার কোনো অস্তিত্বও। জানতে পেরেছে কিনা সন্দেহ। এবং সেই ছাতাটাই যে ছিল সকল রহস্যের মূল সে কথাটা ভুললে চলবে না।

একটা সামান্য তুচ্ছ ছাতার মধ্যে এমন কি মিস্ট্রি থাকতে পারে, তা তো বুঝে উঠতে পারছি না, বলল মিঃ তালুকদার।

ছাতাটা যে তুচ্ছ তা আপনাকে বললে কে মিঃ তালুকদার? আমার যতদূর মনে হয়, এই হত্যা-রহস্যের মূল সূত্রই, সেই তুচ্ছ ছাতাটার মধ্যেই আমাদের সকলের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে হয়ত লুকিয়ে রয়ে গেছে। The brain behind it—তার আমি প্রশংসা না করে থাকতে পারি না। হত্যা-রহস্যের মজাই ঐ! সামান্যতম ঘটনা বা বস্তুর সঙ্গে যে কত সময়। কত মূল্যবান সূত্র জট পাকিয়ে থাকে, আমাদের দৃষ্টিশক্তি বা বিচার-বুদ্ধিকে ফাঁকি দিয়ে বা আমাদের দৃষ্টিশক্তির বিচার-বিশ্লেষণের অভাবে যা হয়ত আমরা কত সময় লক্ষ্যই করি না। রায়পুরের হত্যা-রহস্যের মধ্যেও তেমনি মূল্যবান একটি সূত্র ঐ তুচ্ছ ছাতাটা, যা তদন্তের সময় বা আদালতে বিচারের সময় কেউই আবশ্যকীয় বলে এতটুকু নজর দেবার প্রয়োজন মনে করেননি। কিন্তু কথার তর্কে-বিতর্কে রাত্রি অনেক হয়েছে। এবারে এস, আজকের মত সভা ভঙ্গ করা যাক। নাসারন্ধ্রে সুমধুর খিচুড়ির ঘ্রাণ আসছে। এই শীতের রাত্রে গরম গরম খিচুড়ি সহযোগে ফুলকপির চপ ও আলুর ঝুরিভাজা নেহাৎ মন্দ লাগবে না, কি বল হে?

কিরীটী যেন কতকটা ইচ্ছে করেই সভা ভঙ্গ করে উঠে দাঁড়াল। কাজেই অন্যান্য সকলকেও উঠে দাঁড়াতে হল সেই সঙ্গে।

সত্যিই রাত্রি বড় কম হয়নি। দেওয়াল-ঘড়িটা সগৌরবে ঘোষণা করলে রাত্রি দশটা ঢং ঢং করে।

***

আহারাদির পর সকেলই বিদায় নিয়েছেন।

কিরীটী তার শয়নকক্ষের পশ্চিমদিকের ভোলা জানালাটার সামনে দাঁড়িয়ে পাইপ টানছে। কৃষ্ণা শুয়ে বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছে, জানালাপথে দেখা যায়, রাত্রির একটুকরো আকাশ; কয়েকটি মাত্র উজ্জ্বল নক্ষত্র ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে আছে।…সুদূরের কালো ভীরু চাউনির মত মৃদু কম্পিত। খোলা জানালাপথে শীতরাত্রির ঝিরঝিরে হাওয়া আসছে হিমকণাবাহী।

কিরীটী ভাবছিল কত না হত্যা-ব্যাপার নিয়েই সে এ জীবনে ঘাঁটাঘাঁটি করলো! কত বৈচিত্র্যই যে হত্যা-রহস্যের মধ্যে লুকিয়ে থাকে ভাবতেও আশ্চর্য লাগে। কিরীটী মধ্যে মধ্যে ভাবে এমন যদি হত হত্যাকারী অসাধারণ বুদ্ধিমান এবং বুদ্ধি ও বিবেচনার দ্বারা হত্যার। পূর্বেই চারিদিক বাঁচিয়ে সমস্ত পরিকল্পনামত একান্ত সুষ্ঠুভাবে হত্যা করতে পারত, তবে কার। সাধ্য তাকে ধরে! কিন্তু এরকম কখনও আজ পর্যন্ত সে হতে দেখল না। সামান্য একটু গলদ, সামান্য একটু ভুল। হত্যাকারীর সমগ্র পরিকল্পনা সহসা বানচাল হয়ে যায়। নিজের ভুলে নিজেই বিশ্রীভাবে জট পাকিয়ে ফেলে। এমনিই নিয়তির মার!

বাবু!

কিরীটী চমকে ফিরে তাকায়। দরজায় দাঁড়িয়ে ভৃত্য জংলী।

কি রে জংলী?

একজন ভদ্রমহিলা আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।

এত রাত্রে কে আবার ভদ্রমহিলা দেখা করতে এলেন? বসতে দিয়েছিস তো?

হুঁ, বাইরের ঘরে বসিয়েছি। বললেন আপনার সঙ্গে নাকি বিশেষ কি দরকার, এখুনি দেখা হওয়া একান্ত প্রয়োজন।

আচ্ছা তুই যা, আমি আসছি।

কিরীটী আদৌ আশ্চর্য হয় না, কারণ এরকম অসময়ে বহুবার বহু লোকই তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। এবং অনেক সময় অনেক ভদ্রমহিলাও দেখা করতে এসেছেন।

কিরীটী গরম ড্রেসিং গাউনটা গায়ে চাপিয়ে একতলায় নামবার সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হল।

সোজা সিঁড়ি দিয়ে নেমে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতেই আগন্তুক ভদ্রমহিলা সোফা হতে উঠে দাঁড়ালেন।

ঘরের উজ্জ্বলবৈদ্যুতিক আলোয় কিরীটী দেখল, ভদ্রমহিলা বেশবর্ষীয়সী। বয়স পঁয়তাল্লিশের ঊর্দ্ধে নিশ্চয়ই। পরিধানে সাধারণ মিলের একখানা সাদা থানকাপড়। গায়ে একটা ছাই রঙের পুরনো দামী শাল জড়ানো। মাথার ওপরে ঈষৎ ঘোমটা। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। মুখে। বয়সের বলিরেখা পড়েছে সুস্পষ্টভাবে। একদা যে ভদ্রমহিলা বয়সের সময়ে অতীব সুশ্রী ছিলেন, প্রথম দৃষ্টিতেই তা এখনও বেশ বোঝা যায়, বিগত সৌন্দর্যের এখনও অনেকখানিই। যেন সমগ্র দেহ ও বিশেষ করে মুখখানি জুড়ে বিরাজ করছে। লম্বাটে বোগা চেহারা। চোখে শান্ত স্থির দৃষ্টি।

বসুন মা, আপনি উঠলেন কেন? কিরীটী ভদ্রমহিলাকে সম্বোধন করে।

তোমারই নাম কিরীটী রায়? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভদ্রমহিলা প্রশ্ন করেন।

হ্যাঁ, বসুন। কিরীটী এগিয়ে এসে একখানা সোফা অধিকার করে সামনাসামনি বসল।

ভদ্রমহিলাও আবার উপবেশন করলেন। হাতের আঙুলগুলি পরস্পর জড়িয়ে, হাত দুটিকোলের উপর রাখলেন, এই অসময়ে তোমাকে বিরক্ত করবার জন্য সত্যিই বড় লজ্জা বোধ করছি বাবা। তারপর একটু থেমে, আবার ধীর শান্তস্বরে বললেন, মা বলে যখন তুমি আমায় সম্বোধন করলে প্রথমেই, নিজের সন্তানের মতই তোমাকে আমি তুমি বলে সম্বোধন করছি। তাছাড়া তুমি তো আমার সন্তানেরই মত।

কিরীটী তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ভদ্রমহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল; কেন যেন মনে হচ্ছিল মুখখানি খুবই চেনা। কবে কোথায় ঠিক এমন একটি মুখ না দেখলেও অনেকটা এমনি একখানি মুখের আদল দেখেছে ও।

অস্পষ্ট একটা ছায়ার মতই মনের কোণে ক্ষণে ক্ষণে জেগে উঠে আবার যেন মিলিয়ে যাচ্ছে অস্পষ্ট হয়ে।

কিরীটীকে সামনে বসে একদৃষ্টে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভদ্রমহিলা প্রশ্ন করলেন, আমার মুখের দিকে অমন করে তাকিয়ে কি দেখছ?

কিছু না মা! ভাবছিলাম আপনার মুখখানি যেন বড় চেনা-চেনা লাগছে, কোথায় যেন দেখেছি দেখেছি বলে মনে হচ্ছে। এবারে মনে পড়েছে। রায়পুরের আসামী ডাঃ সুধীন চৌধুরী কি–

ঠিক ধরেছ, আমি—আমি তারই হতভাগিনী মা। কিন্তু আমার পরিচয় তো এখনও তোমায় আমি দিইনি বাবা! কেমন করে বুঝলে?

না, দেননি, নিম্নস্বরে কিরীটী মৃদু হেসে বললে, কিন্তু আপনার ছেলের মুখখানি যেন আপনারই মুখের হুবহু একখানি প্রতিচ্ছবি। আপনি তাহলে রায়পুরের মামলা সংক্রান্ত কোনো ব্যাপার নিয়েই আমার কাছে এসেছেন?

হ্যাঁ। রায়পুরের ছোট কুমার সুহাসের মৃত্যুর ব্যাপারটা তো সবই বোধ হয় তোমরা জান?

সব নয়, তবে কিছুটা কিছুটা জানি। মামলার সময় সংবাদপত্র পড়ে যতটুকু জেনেছি।

রায়পুরের মল্লিক-বাড়ির অনেক কথাই তোমরা জান না। এবং যাঁরা বিচারের নামে দীর্ঘদিন ধরে একটা নিছক প্রহসন করে আমার একমাত্র নির্দোষ ছেলেকে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের আদেশ দিলেন, তাঁরাও জানতেন না বা জানবার জন্য এতটুকু চেষ্টাও করেননি। অথচ বিচার হয়ে গেল, এবং দোষী সাব্যস্ত করে দ্বীপান্তরের আদেশও হয়ে গেল।

কিন্তু মা, আপনার ছেলের বিরুদ্ধে প্রমাণগুলিও তো আইনের চোখে খুবই সাংঘাতিক এবং বেশ জোরালো। তাছাড়া আইনের বিচারে তার দোষও প্রমাণিত হয়ে গেছে।

আমি সবই জানি বাবা, প্রমাণিত ঠিক না হলেও প্রমাণিত ধরে নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া এও জানি, এ ধরনের রায় আবার উচ্চতর আদালতে নাকচও হয়ে গেছে বহুবার। সেই আশাতেই তোমার শরণাপন্ন হয়েছি বাবা।

বলুন মা, এ ব্যাপারে কিভাবে ঠিক আপনাকে আমি সাহায্য করতে পারি?

তোমার সঙ্গে ঠিক চাক্ষুষ পরিচয় না থাকলেও, তোমার সম্পর্কে অনেক শুনেছি, অনেকখানি আশা বুকে নিয়েই তোমার কাছে এসেছি। তুমি আমার ছেলেকে মুক্ত করে এনে দাও বাবা। জীবনে আমার মুখ দিয়ে কোনো দিনও মিথ্যা কথা বের হয়নি। আমি জানি, ছেলে আমার। নির্দোষ। ঘটনার দুর্বিপাকে সে এই হত্যার মামলায় জড়িয়ে পড়েছে। তাকে বাঁচাও।

স্নেহসিক্ত কাকুতিতে ভদ্রমহিলার কণ্ঠস্বর যেন শেষের দিকে রুদ্ধ হয়ে আসে। কিরীটী ঠিক কি জবাব দেবে বুঝে উঠতে পারে না। ঘরের মধ্যে একটা দুঃসহ স্তব্ধতা যেন থমথম করে। বাইরে জমাট-বাঁধা শীতের অন্ধকার।

ভদ্রমহিলা আবার একসময় বলতে শুরু করেন, বড় দুঃখে তাকে আমি মানুষ করেছি বাবা। ওইটিই আমার একমাত্র সন্তান; ওর বয়স যখন মাত্র তিন বৎসর তখন আমার স্বামী অদৃশ্য আততায়ীর হাতে নৃশংসভাবে নিহত হন।

কিরীটী যেন ওর শেষের কথা কটি শুনে হঠাৎ চমকে ওঠে। বলে, কি বললেন?

ভদ্রমহিলা কিরীটীর আকস্মিক প্রশ্নে বিস্মিতভাবে কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে ধীরভাবে বললেন, বলছিলাম আমার স্বামীর কথা।

কিরীটী আবার ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বললে, গোড়া থেকে সব কথা আমাকে যথাসম্ভব খুলে বলুন তো মা।

গোড়া থেকে বলব?

হ্যাঁ, এইমাত্র আপনার স্বামীর কথা যা বলছিলেন, সব একেবারে গোড়া থেকে বলুন।

 ১.০২ পুরাতনী

ভদ্রমহিলা ধীর শান্ত স্বরে বললেন, সব জানতে হলে সবার আগে তোমাকে রায়পুরের ইতিহাস জানতে হবে, কিন্তু সে-সব কথা আগাগোড়া বলতে গেলে রাত্রি হয়ত শেষ হয়ে যাবে। সংক্ষেপে তোমাকে বলব। ভদ্রমহিলা একটু নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলেন। ঘরের ওয়াল-ক্লকটায় রাত্রি বারোটা ঘোষণা করলে ঢং ঢং করে।

ঠিক মধ্যরাত্রি।

ঘরের মধ্যে ঠাণ্ডা। স্তব্ধতা।

উত্তরের খোলা জানালাপথে শীত-রাত্রির ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে।

জায়গাটার আসল নাম রায়পুর নয়, যদিও আজ প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ বৎসর ধরেও জায়গাটাকে রায়পুর বলে সকলে জানে। ভদ্রমহিলা বলতে লাগলেন মৃদু ধীর কণ্ঠে, সুহাস ও সুবিনয় মল্লিকের পিতা রায়বাহাদুর রসময় মল্লিক ছিলেন রায়পুরের পূর্বতন রাজা শ্রীকণ্ঠ মল্লিক মহাশয়ের দত্তক পুত্র। শ্রীকণ্ঠ মল্লিক মহাশয়রা তিন ভাই। তাঁদের পূর্ববর্তী সাত পুরুষ ধরে জমিদার রাজা ওঁদের উপাধি। বহু ধন-সম্পত্তির মালিক ওঁরা। শ্ৰীকণ্ঠ মল্লিকের যখন কোনো। ছেলেমেয়ে হল না, তখন বৃদ্ধ বয়সে তিনি রসময়কে দত্তক গ্রহণ করলেন। শ্রীকণ্ঠ মল্লিকদের একমাত্র সহোদরা বোন কাত্যায়নী দেবীর একমাত্র সন্তান হচ্ছেন আমার মৃত স্বামী। আমার নাম সুহাসিনী। আমি আমার স্বামীর মুখেই শুনেছিলাম, তাঁর দাদামশাই শ্ৰীকণ্ঠ মল্লিকের পিতা নাকি মরবার আগে একটা উইল করে গিয়েছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃসেই উইল আইনসিদ্ধ করবার পূর্বেই অকস্মাৎ শ্রীকণ্ঠ মল্লিক একদিন ওঁদের মহাল নৃসিংহ গ্রাম পরিদর্শন করতে গিয়ে অদৃশ্য আততায়ীর হস্তে নিষ্ঠুরভাবে নিহত হন। উইলের ব্যাপারটা অবিশ্যি তাঁর নিহত হওয়ার পর একান্ত আপনার জনদের মধ্যে অল্পবিস্তর জানাজানি হয়।

উইলের মধ্যে অন্যতম সাক্ষী ছিলেন ওঁদেরই জমিদারীর নায়েব শ্রীনিবাস চৌধুরী মহাশয় ও শ্রীকণ্ঠের ছোট ভাই সুধাকণ্ঠ মল্লিক। যদিও শ্রীকণ্ঠ মল্লিক মহাশয়ের নিহত হওয়ার পরও প্রায় বৎসর খানেক পর্যন্ত নায়েবজী বেঁচে ছিলেন, তবু উক্ত উইলের ব্যাপারটা বাইরের কেউই জানতে পারেনি; অনাত্মীয় দু-একজন জানতে পারলেন নায়েবজীর মৃত্যুর দু-দিন আগে। যদিচ নায়েবজী নিজেও জানতেন না যে এ ব্যাপারটা তখন কিছুটা জানাজানি হয়ে গেছে। যা হোক, অনেকদিন থেকেই নায়েবজী হৃদরোগে ভুগছিলেন, মৃত্যুর কয়েকদিন আগে তাঁর অসুখের যখন খুব বাড়াবাড়ি, সেই সময় আমার শাশুড়ী কাত্যায়নী দেবী (সম্পর্কে নায়েবজীর ভ্রাতৃবধূ) নায়েবজীর রোগশয্যার পাশে ছিলেন। মৃত্যুর শিয়রে দাঁড়িয়ে নায়েবজী তাঁর বৌদি কাত্যায়নী দেবীকে ঐ উইলের কথা সর্বপ্রথম বলেন এবং এও বলেন, সেই উইলের প্রধান অন্যতম সাক্ষী স্বয়ং তিনি নিজে, এবং উইলের ব্যাপার সব কিছুই জানেন, তথাপি শ্রীকণ্ঠ মল্লিকের মৃত্যুর পর সিন্দুকের মধ্যে সে উইলের আর কোনো অস্তিত্বই নাকি পাওয়া যায়নি। উইলের কোনো হদিস পাননি বলেই এবং আইনের দ্বারা উইলটি সিদ্ধ করা হয়ে ওঠেনি বলেই, নেহাৎ নিরুপায় তিনি ও সম্পর্কে এতদিন কোনো উচ্চবাচ্যই করতে পারেননি। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে তাঁর স্বগীয় কতার সেই ইচ্ছা, যা কোনোদিনই সফল হতে পারল না, তার আভাস অপূর্ণ খেদোক্তির মধ্য দিয়ে কাত্যায়নী দেবীকে জানিয়ে গেলেন যে কেন, তা তিনিই জানেন।

কাত্যায়নী দেবী সমস্ত শুনে গেলেন নীরবে, এবং ঘুণাক্ষরেও আভাসে বা ইঙ্গিতে প্রকাশ করলেন না যে ঐ ব্যাপার আগে হতেই তিনি কিছুটা জানতেন। ঐ সময় আমার স্বামী সবে ওকালতি পাস করে ওকালতি শুরু করেছেন এবং সুধীন—আমার ছেলের বয়স তখন মাত্র আড়াই বৎসর। আমার শ্বশুরের মৃত্যু তারও বারো বৎসর আগে হয়। নায়েবজীর মৃত্যুর পর মা গৃহে ফিরে এলেন। এবং তারই মাস তিনেক বাদে হঠাৎ একদিন আমার স্বামী ওকালতি ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে রায়পুরের স্টেটের ম্যানেজারের পদ নিয়ে রায়পুরে গেলেন। রসময় মল্লিক তখন জমিদারীর সর্বময় কর্তা। এই পর্যন্ত বলে ভদ্রমহিলা থামলেন।

কিরীটী নির্বাক হয়ে একমনে রায়পুরের পুরাতন ইতিহাস শুনছিল।

আমার শ্বশুর মশায়ের মৃত্যুর পর হতেই–উনি আবার বলতে শুরু করলেন, আমাদের সংসারের অবস্থা দিন-দিনই খারাপের দিকে যাচ্ছিল। পরে মার মুখে শুনেছি, কী অর্থকষ্টের মধ্যে দিয়েই না তিনি আমার স্বামীকে মানুষ করেছিলেন। যা হোক রায়পুরের স্টেটে চাকরি পেয়ে আবার সকলে সুখের মুখ দেখলেন। কিন্তু সেও প্রদীপ নিভে যাওয়ার ঠিক পূর্বে যেমন ক্ষণিকের জন্য আলোর শিখাটা একটু বেশী উজ্জ্বল হয়েই আবার নিভে যায়, তেমনি। কারণ নূতন চাকরিতে আসবার মাস আষ্টেকের মধ্যেই হঠাৎ আমার স্বামী ঐ সেই নৃসিংহগ্রাম মহাল পরিদর্শন করতে গিয়েই অদৃশ্য আততায়ীর হাতে নৃশংসভাবে নিহত হলেন। ঐ ঘটনার মাস দুই আগে আমার শাশুড়ীর কাশীধামে মৃত্যু হয়েছিল।

ঠিক কি করে আপনার স্বামী নিহত হন, সে বিষয়ে আপনি কিছু জানেন কি?

এইমাত্র আপনাকে বললাম, আমার স্বামী নৃসিংহগ্রাম মহাল পরিদর্শন করতে গিয়েই অদৃশ্য আততায়ীর হাতে নিহত হন—

রায়পুর থেকে প্রায় পনের মাইল দূরে ওঁদের একটা পরগণা আছে, তাকে বলা হয় নৃসিংহগ্রাম মহাল। শুনেছি সেখানে ওঁদের একটা মস্ত বড় কাছারী বাড়ি আছে ও সংলগ্ন এক বিরাট প্রাসাদ ও অট্টালিকাও আছে। রসময় মল্লিকের পিতাঠাকুরও সেই কাছারী বাড়িতেই নিহত হয়েছিলেন। ঐ নৃসিংহগ্রামে যেতে পথেই পড়ে ওঁদের প্রকাণ্ড এক শালবন, প্রকৃতপক্ষে রায়পুরের স্টেটের যা কিছু আয় বা প্রতিপত্তি ঐ শালবনের বাৎসরিক আয় থেকেই। বছরে বহু টাকার মুনাফা হয় ঐ শালবনের আয় থেকে। মঙ্গলবার আমার স্বামী সেই কাছারী-বাড়িতে যান এবং শুক্রবার রাত্রে তিনি নিহত হন। শনিবার সকালে কাছারী-বাড়িতে তাঁর শয়নকক্ষে মৃতদেহ পাওয়া যায়। কে বা কারা অতি নিষ্ঠুরভাবে ধারালো কোনো অস্ত্র দিয়ে তাঁর দেহটিকে এবং বিশেষ করে তাঁর মুখখানা এমন ভাবে ক্ষতবিক্ষত করে প্রায় দেহ হতে মাথাটি দ্বিখণ্ডিত করে রেখে গেছে যে, নিহত ব্যক্তিকে তখন চেনবারও উপায় নেই। নিষ্ঠুরতার সে এক বীভৎস দৃশ্য। তারপর দুদিন পরে যখন আবার আমার স্বামীর মৃতদেহ রায়পুরে নিয়ে আসা হল, দু-দিনের মৃত সেই পচা গলা বিকৃত ও বীভৎস দৃশ্য দেখামাত্রই আমি জ্ঞান হারিয়ে সেইখানেই পড়ে যাই।

সুহাসিনী দেবী এই পর্যন্ত বলে আবার চুপ করলেন।

রসময় মল্লিকের পিতা শ্রীকণ্ঠ মল্লিককে কি ভাবে হত্যা করা হয়েছিল, সে বিষয়ে কিছু জানেন? কিরীটী কিছুক্ষণ বাদে প্রশ্ন করে।

আশ্চর্য! শুনেছি ঠিক ঐ একই ভাবে।

তারপর?

তারপর রায়পুরে থাকতে আর আমি সাহস পেলাম না; আমার তিন বৎসরের শিশুপুত্রকে নিয়ে আমি আমার পিতৃগৃহে দত্তপুকুরে আমার দাদার আশ্রয়ে চলে এলাম। পরে অবিশ্যি রাজাবাহাদুর রসময় মল্লিক আরও বছর পাঁচেক বেঁচে ছিলেন, এবং তিনি আমাকে সাহায্যও করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর কোনো সাহায্যই আমি নিইনি; কারণ রায়পুরের কথা মনে হলেই আমার চোখের ওপরে আমার স্বামীর বীভৎস রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহটা ভেসে উঠত। আমার স্বামীর মৃত্যু ঘটেছে আজ চব্বিশ বৎসর হল। তারপর সুধীকে আমি কত কষ্টে মানুষ করলাম। সুধী বরাবর জলপানি নিয়ে মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে বের হল। মেডিকেল কলেজে পড়বার সময়েই এবং প্রথমটায় আমার অজ্ঞাতেই ছোট কুমার সুহাসের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব বা ঘনিষ্ঠতা হয়। সেও আজ চার-পাঁচ বছরের কথা হবে। এবং সেই সময় হতেই সুধী আমার অজ্ঞাতেই শুনেছি মাঝে মাঝে রায়পুরেও নাকি যেতে শুরু করে। ইদানীং সুহাস নিহত হবার কিছুদিন আগে হতেই প্রায় বছর দেড়েক ধরে প্রায়ই নানাপ্রকার অসুখে ভুগত। এই তো মরবার মাস পাঁচেক আগেই একবার সুহাস টিটেনাস হয়ে প্রায় যায়-যায় হয়েছিল, তখন সুধীই তার টেলিগ্রাফ পেয়ে রায়পুরে গিয়ে নিজে সঙ্গে করে সুহাসকে কলকাতায় নিয়ে এসে ভাল ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করিয়ে ভাল করে তোলে। তুমি হয়ত বোধ হয় মামলার সময়েই শুনে থাকবে সেসব কথা। সুহাস আর সুবিনয় বৈমাত্র ভাই। সুহাসের মা মালতী দেবী আজও বেঁচে আছেন। সুবিনয় রসময় মল্লিকের মৃত প্রথম পক্ষের সন্তান।

হ্যাঁ আমি জানি, কিরীটী মৃদুস্বরে জবাব দেয়, মামলার সময় সংবাদপত্রেই সে সংবাদ ছাপা হয়েছিল।

দেওয়ালঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত্রি চারটে ঘোষণা করলে।

আপনি চিন্তা করবেন না মা। আমি আপনার ছেলের ভার হাতে তুলে নিলাম। তবে ভাগ্যের কথা কেউ বলতে পারে না। তবুও এই আশ্বাসটুকু আজ এখন আপনাকে আমি দিতে পারি, সত্যিই যদি আপনার ছেলে নির্দোষ হয়, তবে যেমন করেই হোক তাকে আমি মুক্ত করে আনবই এবং তা যদি না পারি,তাহলে জানবেন—সে কাজ স্বয়ং কিরীটীরও সাধ্যাতীত ছিল।

তোমার ফিসের জন্য বাবা—

রাত্রি প্রায় শেষ হয়ে এল মা, এবারে ঘরে ফিরে যান। আগে তো আপনার ছেলেকে আমি আইনের কবল থেকে মুক্ত করে আনি, তারপর না হয় ধীরেসুস্থে একদিন ফি সম্পর্কে আপনার সঙ্গে বোঝাপড়া করা যাবে।

তোমাকে যে কী বলে আশীর্বাদ করব বাবা—ওঁর কণ্ঠস্বর অশ্রুসজল হয়ে ওঠে।

সেটাও ভবিষ্যতের জন্য ভোলা থাক মা।

তবে আমি আসি বাবা। ভদ্রমহিলা উঠে দাঁড়ালেন।

আসুন। হ্যাঁ, আর একটা কথা, আমি যে আপনার কাজে হাত দিলাম, এ-কথা কিন্তু আমাকে না জিজ্ঞাসা করে কাউকেই আপনি জানাতে পারবেন না, এবং আমার কাছে এসেছেন। সেকথাও গোপন করে রাখতে হবে।

বেশ বাবা, তাই হবে।

আর একটা কথা মা, আমার সঙ্গে আর আপনি দেখা করতেও আসতে পারবেন না। আপনার ঠিকানাটা শুধু রেখে যান, প্রয়োজন হলে আমিই নিজে গিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করব।

২।১ বাদুড়বাগান স্ট্রীটে আমার ছোট ভাই নীরোদ রায়ের ওখানেই আমি আছি। হাইকোর্টে অ্যাপীল করা হয়েছে। বর্তমানে এইখানেই থাকব।

সুহাসিনী দেবী বিদায় নিয়ে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।

১.০৩ রায়পুর হত্যা-মামলা

রায়পুর হত্যা-মামলা।

অতীতের কয়েকটি পৃষ্ঠা। যেখানে এই হত্যা-রহস্যের বীজ অন্যের অলক্ষ্যে দানা বেঁধে উঠেছিল একটু একটু করে। অথচ কেউ বুঝতে পারেনি। কেউ জানতে পারেনি সেদিন।

সে-সময়টা মে মাসের শেষের দিকটা। কলকাতা শহরে সেবার গ্রীষ্মের প্রকোপটা যেন একটু বেশীই। গ্রীষ্মের নিদারুণ তাপে শহর যেন ঝলসে যাচ্ছে।

গ্রীষ্মের ছুটিতে কলেজ বন্ধ হওয়া সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত নানা কারণে সুহাসদের রায়পুরে। যাওয়া হয়ে ওঠেনি। ব্যবস্থা সব হয়ে গেছে; আজ সন্ধ্যার পরে যে গাড়ি তাতেই সকলের রায়পুর রওনা হবার কথা।

সুধীন আজ সকাল হতেই সুহাসকে তার সব জিনিসপত্র গোছগাছ করতে সাহায্য করছে।

অতীতের সেই বিষাক্ত স্মৃতি, সুহাসের সংস্পর্শে এসে সুধীনের কাছে কেবলমাত্র স্মৃতিতেই আজ পর্যবসিত হয়েছে।

সুধীন মনে মনে জানে মল্লিক-বাড়ির সঙ্গে এতটা ঘনিষ্ঠতা মা আদপেই পছন্দ করবেন। হয়ত বা কেন, নিশ্চয়ই মা তার এই মল্লিক-বাড়ির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কথা শুনলে বিশেষ রকম অসন্তুষ্টই হবেন। মুখে তিনি কাউকেই কিছু কোনোদিন বলেন না বটে। তাও সে ভাল করেই জানে।

সেই ছোটবেলা থেকেই সুধীন মাকে দেখে আসছে তো! সুধীন বা অন্য কারও যে কাজটা বা ব্যবহার মার মতের বিরুদ্ধে হয়, মা কখনও তার প্রতিবাদ করেন না। এমন কি একটিবারও সে সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন পর্যন্ত করেন না, কেন এমনটি হল? শুধু নির্বাক কঠিন দৃষ্টি তুলে একটিবার মাত্র অপরাধীর দিকে তাকান।

পলকহীন মৌন সেই দৃষ্টি হতে যেন একটা চাপা অগ্নির আভাস বিচ্ছুরিত হতে থাকে। কিছুক্ষণ ঐরকম কঠিন ভাবে তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি নামিয়ে নেন। কিন্তু তারপর প্রতি কাজের মধ্যে, প্রতিটি মুহূর্তে, সেই মৌন কঠিন দৃষ্টি যেন সর্বদা সঙ্গে সঙ্গে অনুসরণ করে ফেরে।

একটা অস্বোয়াস্তি যেন নিরন্তর মনের মধ্যে কাঁটার মত খচ খচ করে বিঁধতে থাকে। এর চাইতে মা যদি কঠিন ভৎসনা করতেন, তাও বুঝি সহস্রগুণে ছিল ভাল।

পিতাকে তো সুধীনের মনে পড়েই না, এবং মনে থাকবার কথাও নয়, কারণ যে বয়সে সুধীনের পিতা নিহত হন অদৃশ্য আততায়ীর হাতে, তখন সে শিশুই।

শিশুকালের সেই স্মৃতি মনের কোণে কোনো রেখাপাতই করতে পারেনি। তবে ছোটবেলায়ও অনেকের মুখেই শুনেছে একটা দীর্ঘ ঋজু দেহ, অথচ বলিষ্ঠ, গোরাদের গায়ের মত টকে গৌরবর্ণ গায়ের রং। মাথার চুলগুলো কদমছাঁটে ছাঁটা, অত্যন্ত স্বল্পভাষী। পিতার কথা ও মার মুখ থেকে শুনেছিল, তাও মাত্র একটিবার। সেই শেষ এবং প্রথম। মনে হয়েছে সে বিষাদ-স্মৃতি মা যেন চিরটা কাল ইচ্ছে করেই সুধীনের কাছ থেকে লুকিয়ে গেছেন। কখনও আর জীবনে কোনো কারণে সে দুর্বলতা প্রকাশ হয়নি।

সেবারে সে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছে। কোনো দিনই জীবনে ও সেই দিনটির কথা ভুলবে না।

ছুটিতে গ্রামে মামার বাড়ীতে এসেছে ও। ওর বেশ স্পষ্টই মনে পড়ে, ওর বাবার মৃত্যুতিথি সেদিন। মা চিরদিনই ঐ দিনটায় নিরন্থ উপবাস করেন।

রাত্রি তখন বোধ করি দশটা হবে। বাইরে ঝম ঝম করে বৃষ্টি পড়ছে।

ঘরের পিছনের আমগাছটা হাওয়ায় ওলটপালট হচ্ছে, মাঝে মাঝে ঘরের টিনের চালের ওপরে আমগাছের ডালপালাগুলো আছড়ে আছড়ে পড়ছে—তারই অদ্ভুত শব্দ। বৃষ্টির ধারা। অবিশ্রাম টিনের চালের ওপরে চটুপ করে শব্দ তুলছে।

ও খাটের ওপর শুয়ে মোমবাতির আলোয় কি একখানা বই পড়ছিল। কখন এক সময় নিঃশব্দ পায়ে এসে মা ওর শয্যার পাশটিতে দাঁড়িয়েছেন, ও তা টেরও পায়নি। মা চিরদিন এত নিঃশব্দে চলাফেরা করেন, পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও বোঝবার উপায় নেই।

মার ডাকে ও মুখ তুলে তাকায়, সুধা! ওর মুখের দিকেই মা তাকিয়ে আছেন।

করুণ ছায়ার মতই যেন মাকে ওর মনে হয়।

ঈষৎ মলিন একখানি থানকাপড় পরা, মাথার ঘোমটা খসে পড়েছে কাঁধের ওপরে।

রুক্ষ তৈলহীন চুলের গোছা কাঁধের দু-পাশ দিয়ে এসেছে নেমে গুচ্ছে গুচ্ছে।

সারাদিন উপবাসে মুখখানা শুকিয়ে যেন ছোট ও মলিন হয়ে গেছে বাসী ফুলের মত।

মোমবাতির নরম আলো মার নিরাভরণা ডান হাতখানির ওপরে এসে পড়ছে। এত করুণ ও বিষণ্ণ লাগছিল সেই মুহূর্তটিতে—তাড়াতাড়ি বইটি একপাশে রেখে শয্যার ওপরে সুধীন উঠে বসে, কিছু বলছিলে?

মা একবার পাশটিতে এসে বসলেন, এখনও ঘুমোসনি?

একটা বই পড়ছিলাম মা।

একটা কথা তুই অনেকদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিস বাবা, কিন্তু জবাব দিইনি, আজ তোকে সেই কথাটা বলব।

মা চুপ করে যান। যেন কিছুটা সংকোচ তখনও অবশিষ্ট আছে মনের কোণায় কোথাও মার।

কি কথা মা? সুধীনের বুকের ভিতরটা যেন অকারণ একটা ভয়ে অকস্মাৎ টিপ্ টিপ করে কেঁপে ওঠে। মার আজকের এ চেহারার সঙ্গে ও পরিচিত নয় যেন।

তোমার বাবার কথা। মা ক্ষীণ অথচ সুস্পষ্ট স্বরে বলেন।

বাইরে একটা বাদল রাত্রির অশান্ত হাহাকার ক্রমেই বেড়ে ওঠে।

একটা বন্দী দৈত্য যেন হঠাৎ ছাড়া পেয়ে হুঙ্কার দিয়ে ফিরছে দিকে দিকে।…তারই ভয়াবহ তাণ্ডব উল্লাস!

সুধীন মোমবাতিটার দিকে তাকিয়ে আছে, বন্ধ দরজার মধ্যবর্তী সামান্য ফাঁক দিয়ে বাইরের ঝোড়ো হাওয়া এসে মাঝে মাঝে মোমবাতির শিখাটাকে ঈষৎ কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। মার মুখের ওপরে ডান দিকটায় মোমবাতির মৃদু আলোর সামান্য আভাস। মা বলতে লাগলেন। সেই করুণ হৃদয়দ্রাবী কাহিনী, আজও সে দিনটার কথা আমি ভুলতে পারিনি সুধী। তারও আগের রাত্রে এমনি ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল। কিসের যেন একটা অস্বোয়াস্তিতে সারাটা রাত আমি ঘুমোতে পারলাম না। যতবার দু চোখের পাতা বোজাই, একটা না একটা বিশ্রী দুঃস্বপ্ন দেখে তন্দ্রা ছুটে যায়। ভোরবেলাতেই শয্যা ছেড়ে উঠলাম, সারাটা রাত্রি ঘুমোতে পারিনি, শরীরটা বড় ক্লান্ত। বেলা দশটার সময় তোমার বাবার রক্তাক্ত, প্রায় দ্বিখণ্ডিত ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহখানি নিয়ে এসে রাজবাড়ির সান-বাঁধানো উঠোনের ওপরে নামাল বাহকেরা। একটা সাদা রক্তমাখা চাদরে দেহটি ঢাকা আগাগোড়া। তোমার দাদামশাই রাজা রসময় মল্লিক বারান্দার ওপরে দাঁড়িয়েছিলেন; তাঁরই নীরব আদেশে কে একজন যেন এগিয়ে গিয়ে মৃতদেহের ওপর থেকে চাদরটা সরিয়ে নিলে। সে রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত দেহ ও প্রায় দেহচ্যুত ক্ষতবিক্ষত মস্তকটি দেখে তোমার পিতা বলে আর তাঁকে চেনবারও তখন উপায় ছিল না। আমি চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম। তিনদিন পরে যখন জ্ঞান হল, চেয়ে দেখি তুই তোর মামার কোলে বসে, আমাকে ঠেলা দিয়ে ডাকছিস মা মা বলে।

মা চুপ করলেন, চোখের কোলে সুস্পষ্ট অশ্রুর আভাস—মোমবাতির আলোয় চিকচি করছে।

বাইরে তেমনি বৃষ্টির শব্দ, দৈত্যটা তেমনি হুঙ্কার দিয়ে ফিরছে একটানা।

ইতিমধ্যে মোমবাতিটা ক্ষয়ে ক্ষয়ে প্রায় তলায় এসে পৌঁছেছে।

।ঘরের ভিতরে মৃত্যুর মত একটা অস্বাভাবিক স্তব্ধতা। বুকের ভিতরটা যেন কেমন খালি খালি মনে হয়।

মা আবার বলতে লাগলেন, তার পরদিনই, এইটুকু তোকে বুকে করে চলে এলাম দাদার আশ্রয়ে। কিন্তু মনে আমার শান্তি মিলল কই? কতদিন ঘুমের ঘোরে দেখেছি, তাঁর অতৃপ্ত দেহহীন আত্মা যেন আমার চারিদিকে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি জানি এর মধ্যে কোথাও একটা কূটচক্রীর চক্রান্ত আছে। ভুলিনি আমি কিছুই। সেদিন হতেই বুকের মধ্যে দিবারাত্র জ্বলছে তুষের আগুন। আর এও জানি, চিতায় না শোয়া পর্যন্ত এ আগুন কোনো দিন আর নিভবে না।

তোকে আমি ঠিক বোঝাতে পারব না বাবা, সে ব্যথা যে কত বড় দুঃসহ ও মর্মান্তিক! এতদিন তোকে আমি এ-কথা বলিনি, কেবল নিজের বুকের মধ্যে চেপে চেপে গুমরে মরেছি, কিন্তু এখন তুই বড় হয়েছিস বাবা, এ কথা হয়ত তুই কানাঘুষায় শুনেছিসও, কিন্তু বু আমাকে প্রশ্ন করিসনি। আর তোর কাছ থেকে চেপে রাখা উচিত নয় বলেই আজ তোকে সবই বললাম, যারা এতবড় মর্মান্তিক অভিশাপ আমার ওপরে তুলে দিয়েছে তাদের যেন তুই ক্ষমা করিস না।

মা চুপ করলেন। এরপর সেরাত্রে মা ও ছেলে কেউই ঘুমোতে পারেনি। কারও চোখের পাতাতেই ঘুম আসেনি। ঐ মাত্র একটি দিনই মার মুখে সুধীন শুনেছিল বাবার কথা,আর কোনোদিনই শোনেনি।

সেই ঝড়জলের রাত্রি ছাড়া আজ পর্যন্ত ও সম্পর্কে মা আর ওকে কোনো কথাই বলেননি। এবং সেদিন মার ঐ কাহিনীর মধ্য দিয়েই সুধীন বুঝেছিল, মল্লিক-বাড়ির প্রতি কী অবিমিশ্র। ঘৃণা ও ক্রোধ আজও তার মার সমগ্র বুকখানাকে ভরে রেখেছে!…

নিষ্ফল আক্রোশে অহনিশি মার মনে কী দুবার দ্বন্দ্ব! এবং সেইদিন থেকে সে নিজেও মল্লিক-বাড়ির যাবতীয় স্পর্শকে বাঁচিয়ে এসেছে কতকটা ইচ্ছে করেই যেন এবং মনের মধ্যে বরাবর পোষণ করে এসেছে একটা তীব্র ঘৃণা। অলক্ষ্যে বসে বিধাতা হয়ত হেসেছিলেন, তাই পিতার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মাতুলগোষ্ঠীর যে যোগসূত্রটা চিরদিনের মত ছিন্ন হয়ে গেছে বলে মনে হয়েছিল, সেই ছিন্নসূত্র ধরে দীর্ঘদিন পরে টান পড়ল সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ব্যাপারটা ঘটেছিল সুধীনেরই ফোর্থ ইয়ারে মেডিকেল কলেজে পড়বার সময়। একদিন রাত্রে আউটডোরে সুধীন যখন ডিউটি দিতে ব্যস্ত এমন সময় খেলার মাঠ থেকে মাথায় পট্টি বেঁধে সুহাস আউটডোরে এল।

রুগ্ন লম্বা ধরনের ছেলেটি। কৈশোরের সীমা পেরিয়ে সবে তখন যৌবনে পা দিয়েছে সে। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ গায়ের রং, বাঁশীর মত টিকালো নাসা, ফোঁটা ফুলের মতই সুন্দর ঢলঢল মুখখানি। ঠোঁটের ওপরে সবে গোঁফের রেখা দেখা দিয়েছে। দেখলেই যেন মনে জাগে একটা স্নেহের আকর্ষণ।

খেলার মাঠে বিপক্ষ দলের সঙ্গে মতানৈক্য হওয়ায় ক্রমে বচসা হতে হতে হাতাহাতি ও মারামারিতে পরিণত হয়। ডানদিককার কপালে প্রায় দুই ইঞ্চি পরিমাণ একটি ক্ষত-চিহ্ন।

বাড়িতে মার কাছে বকুনি খাওয়ার ভয়ে সুহাস গাড়ি নিয়ে সোজা ময়দান থেকে একেবারে মেডিকেল কলেজে চলে এসেছে ড্রেসিং করাতে।

সুধীন গোটাতিনেক স্টি দিয়ে পট্টি বেঁধে দিল।

এবং সেই সূত্রে ইমার্জেন্সি রুমেই দুজনের মধ্যে প্রথম আলাপের সূত্রপাত হল। ক্রমে সেই সামান্য আলাপকে কেন্দ্র করে গভীর হয়ে উঠতে লাগল পরস্পরের সৌহার্দ্য। এত মিশুঁকে সুহাস যে দু-চার দিনেই সুধীনকৈ আপন করে নিতে তার কোনো কষ্টই হয়নি। এবং সবচাইতে মজা এই যে, তখনও কিন্তু সুধীন সুহাসের আসল পরিচয়টুকু জানতে পারেনি।

ক্রমে আরও দেখা-সাক্ষাৎ আলাপ-আলোচনার ভিতর দিয়ে দুজনের মধ্যে যখন একটা বেশ মিষ্ট ঘনিষ্ঠতা জমে উঠেছে, সেই সর্বপ্রথম সুধীন হঠাৎ একদিন কথাবার্তার মধ্য দিয়ে জানতে পারল সুহাসের আসল ও সত্যকারের পরিচয়টা কি। এবং সুহাস যে তাদের চিরশত্রু রায়পুরের রাজবাড়িরই ছোট কুমার এ-কথাটা ভাবতে গিয়ে অকস্মাৎ সেদিন কেন যেন বুকের ভিতর তার হঠাৎ কেঁপে উঠল।

এবং সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গিয়েছিল সেদিন সুধীনের মার মুখে এক ঝড়-জলের রাত্রে শোনা সেই অভিশপ্ত কাহিনী।

মৃদু মোমবাতির আলোয় মার সেই অদ্ভুত শান্ত কঠিন মুখখানা আজও যেন ঠিক বুকের মাঝখানটিতে একেবারে দাগ কেটে বসে আছে। স্পষ্ট করে কোনো কথা না বললেও মা যে ঠিক সেরাত্রে অতীতের সেই একান্ত পীড়াদায়ক কাহিনী শুনিয়ে ছেলেকে কি বলতে চেয়েছিলেন, সুধীন তার জবাবে কোনো কিছু না বললেও মার কথার মর্মার্থটুকু বুঝতে তার কষ্ট হয়নি।

কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, ঘটনা যতই মর্মপীড়াদায়ক ও মর্মন্তুদ হোক না কেন, ঘটনার সঙ্গে তার কোনো সংবই ছিল না, এবং ঘটনাকে উপলব্ধি করবার মত তার সেদিন বয়সও ছিল না। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মনের মধ্যে কোনো প্রতিহিংসার স্পৃহাই যেন সুধীনের কোনো দিন জাগেনি। যে পিতাকে সে জানবার বা বোঝবার কোনো অবকাশই জীবনে পায়নি, যার স্মৃতিমাত্রও তার মনের মধ্যে কোনো দিন দানা বেঁধে উঠতে পারেনি, তার হত্যা-ব্যাপারে নিছক একবারে কর্তব্যের খাতিরে নিজেকে প্রতিহিংসাপরায়ণ করে তুলতে কোথাও যেন তার রুচি ও বিচারে বরাবরই বেধেছে। তাই সুহাসের সঙ্গে ভাল করে ঘনিষ্ঠতার পর যেদিন প্রথম সে সুহাসের সত্যিকারের আসল পরিচয়টুকু জানতে পারলে সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েই পড়েছিল।

এবং একান্তভাবে মার কথা ভেবেই সে তারপর আপ্রাণ চেষ্টা করে সুহাসকে এড়িয়ে চলবার জন্যে।

কিন্তু মুশকিল বাধল তার সরলপ্রাণ মিশুঁকে সুহাসকে নিয়েই, কারণ সুহাস ঐ ব্যপারের বিন্দুবিসর্গও জানত না। তাই সুধীন তাকে এড়িয়ে চলতে চাইলেও সুহাস তাকে এড়িয়ে যেতে দিত না, সে পূর্বের মতই যখন তখন সুধীনের বাসায় এসে হাসি গল্পে আলোচনায় সুধীনকে ব্যস্ত করে তুলতে লাগল দিনের পর দিন এবং বন্ধুত্ব ও আলাপের জেরটা টেনে সুদৃঢ় করে তুলল যেন আরও।

সুধীনের সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।

ঘনিষ্ঠতা দুজনের মধ্যে ক্রমেই বেড়ে ওঠে, এমন কি দু-তিনবার সুধীন মার অজ্ঞাতেই রায়পুর গেল।

প্রথমটায় সে অনেকবার চেষ্টা করেছে মার কাছে সব খুলে বলবার জন্য কিন্তু যখনই সেই বিস্মৃত কাহিনী ও সেরাত্রের মার মুখের সেই কঠিন ভাব মনে পড়েছে, ও সংকুচিত হয়ে পিছিয়ে এসেছে।

মার কাছে আর কোনো দিন বলাই হল না।

***

সেদিন আসন্নবর্তী রায়পুর যাত্রার জন্য আবশ্যকীয় জিনিসপত্র গোছাতে গোছাতে সুধীন ও সুহাসের মধ্যে কথাবার্তা হচ্ছিল।

সুহাস বলছিল,আজ আর তোমাকে আমি ছাড়ছি না সুধীদা। আজ সন্ধ্যার পরে একেবারে আমাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে তবে কিন্তু তোমার ছুটি।

কিন্তু আমার হাতে যে ভাই দুটো কে আছে, দুপুরে একবার রোগী দুটি দেখে আসতেই হবে।

বেশ, ড্রাইভারকে বলে দেব, আমার গাড়ি নিয়ে রোগী দেখেই আবার চলে আসবে এখানে, দুজনে একসঙ্গে আজ দুপুরে খাব। আবদার করে সুহাস বলে।

সুধীন হাসতে হাসতে জবাব দেয়,বেশ, তাই হবে।

সন্ধ্যার ঠিক একটু পরেই সকলে স্টেশনে এসে পৌঁছল। গাড়ি ছাড়বে রাত আটটায়।

সঙ্গে সুহাসের মা মালতী দেবী, সুহাসের দাদা সুবিনয়, সুবিনয়ের একমাত্র ছেলে প্রশান্ত, স্টেটের ম্যানেজার সতীনাথবাবু, এঁরাও সকলেই চলেছেন রায়পুর।

স্টেশনে অসম্ভব ভিড়। সুহাসের পাশে পাশেই চলেছে সুধীন।

ফার্স্ট ক্লাস কুপে একটা রিজাত করা হয়েছে।

সুহাসের মা মালতী দেবী একবার বলেছিলেন, আজ অমাবস্যা, আজ রওনা না হলেই হত।

হ্যাঁ! তোমাদের মেয়েদের যেমন! আজ অমাবস্যা, কাল দিকশূল, পরশু অশ্লেষা! যত সব! এত করলে বাড়ির বার হওয়াই দায়রাগত স্বরে সুবিনয়বাবু প্রতিবাদ করেন।

কি জানি, মনটা যেন খুঁতখুঁত করছে। সেবারে এরকম অদিনে গিয়েই সুহাসের টিটেনাস হল। মালতী দেবী মৃদু স্বরে বলেন। জ্যেষ্ঠ পুত্রের কোনো কাজে প্রতিবাদ জানাতেও তাঁর ভয় করে।

স্টেশনের গেট দিয়ে ঢোকবার সময় আগে সুহাস, তার ডানদিকে সুধীন, পিছনে সুবিনয়বাবু,—বিশ্রী রকম ভিড়, ঠেলাঠেলি চলেছে, সুহাস কোনোমতে গেট দিয়ে প্ল্যাটফরমে ঢুকতে যাবে, পাশ থেকে একটি কালো মোটা গোছের লোক, বগলে একটা নতুন ছাতা, একপ্রকার সুহাসকে ধাক্কা দিয়েই যেন প্ল্যাটফরমে ঢুকে গেল! এবং কতকটা সঙ্গে সঙ্গে সেই ছাতাওয়ালা লোকটার ধাক্কা খেয়ে উঃ করে অর্ধস্ফুট যন্ত্রণাকাতর একটা শব্দ করে ওঠে সুহাস।

কি হল? সুধীন ব্যথভাবে প্রশ্ন করে সুহাসকে।

সুহাস ততক্ষণে কোনোমতে ধাক্কা খেয়ে প্ল্যাটফরমের মধ্যে এসে ঢুকেছে, তার সঙ্গে সঙ্গে সুধীন ও সুবিনয়। সুবিনয়ও এগিয়ে আসে, কি হল!

ডান হাতের উপরে কি যেন ছুঁচের মত একটা ফুটল। উঃ—এখনও জ্বালা করছে! লংক্লথের পাঞ্জাবির উপরেই সুহাস ব্যথার জায়গাটিতে কতকটা অজ্ঞাতসারেই যেন নিজে নিজে হাত বোলায়।

দেখি!… সুবিনয় সুহাসের পাঞ্জাবির হাতাটা তুলে ব্যথার জায়গাটা বেশ করে টিপে টিপে মালিশ করে দিতে দিতে বলে, কিছু না। বোধ হয় কিছুতে খোঁচা লেগেছে। ও এখুনি ঠিক হয়ে যাবেখন, একটু সাবধান হয়ে চলতে ফিরতে হয়—তোমরা যেমন ব্যস্তবাগীশ!

জায়গাটা কিন্তু অসম্ভব জ্বালা করছে! মৃদুস্বরে পুনরায় কথাটা বলতে বলতে সুহাস আবার জায়গাটায় হাত বোলাতে থাকে।

এরপর সকলে নির্দিষ্ট কামরায় এসে উঠে বসে।

কথায় কথায় তখনকার মত আপাততঃ সমস্ত ব্যাপারটা একসময় চাপা পড়ে যায়।

সুধীন ট্রেনের কামরার বাইরে জানালার উপরে হাত রেখে সুহাসের সঙ্গে তখন মৃদুস্বরে কথাবার্তা বলছিল।

গাড়ি ছাড়বার আর মাত্র মিনিট দশেক বাকি আছে।

প্রথম ঘণ্টা পড়ল।

হাতটা এখনও জ্বালা করছে সুধীদা! মৃদস্বরে সুহাস বলে।

কই দেখি? সুধীনের প্রশ্নে সুহাস পাঞ্জাবির হাতাটা তুলে জায়গাটা দেখাল এতক্ষণে।

ট্রাইসেপ্স মাস্‌লের উপর একটা ছোট্ট রক্তবিন্দু। খানিকটা জায়গা লাল হয়ে সামান্য একটু ফুলে উঠেছে, তখন সুধীন দেখতে পায়।

সুধীন বললে, একটু আয়োডিন দিতে পারলে ভাল হত। যাক্ গে— কিছুই হয়ত করতে হবে না। কালই হয়তো সেরে যাবে।

কি করে যে কি হল ঠিক যেন বুঝতে পারলাম না। তাড়াতাড়িতে মনে হল যেন কি একটা ছুঁচের মত বিধেই আবার বের হয়ে গেল—সুহাস মৃদু ক্লিষ্ট স্বরে বললে।

সুহাসের ঠিক পাশেই মালতী দেবী বসে, মুখখানা তাঁর বেশ গম্ভীর। মৃদু স্বরে তিনি বললেন, অমাবস্যা, তখনই বলেছিলাম। আজ না বের হলেই হত। কিন্তু তোদর সব আজকালকার সাহেবীয়ানা।…এখন ভালয় ভালয় পৌঁছতে পারলে বাঁচি।

ট্রেন ছাড়বার শেষ ঘণ্টা পড়ে।

যতক্ষণ গাড়ির জানলাপথে দেখা যায়, সুহাস তাকিয়ে থাকে, সুধীনও প্লাটফরমের ওপরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রুমালটা ওড়াতে থাকে।

ক্রমে একসময় চলমান গাড়ির পশ্চাতের লাল আলোটা অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে যায়।

সুধীন গেটের দিকে অগ্রসর হয়।

১.০৪ প্লেগ ব্যাসিলাই

ব্যথা কমা তো দূরে থাক, হাতটার ব্যথা যেন ক্রমেই বেড়ে চলেছে, কেমন ঝিঁঝিন্ করে সমস্ত হাতটা যেন অসাড় মনে হয় কিছুক্ষণের মধ্যে।

সুহাস বার্থের বিস্তৃত শয্যার ওপরে গা-টা এলিয়ে দিয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করে। কিন্তু বৃথা–!

সমস্ত রাতের মধ্যে সুহাস একটি বারের জন্যও চোখের পাতা বোজাতে পারলে না। ব্যথায় ও অস্বোয়াস্তিতে এপাশ-ওপাশ করতে থাকে।

সমস্ত হাতটা টন্ করছে। জ্বর-জ্বরও বোধ হচ্ছে। এমনি করেই রাতটা কেটে গেল।

পরের দিন সকালবেলা স্টেশনে নেমে রাজবাড়ির মোটরে করে সকলে এসে প্রাসাদে পোঁছল।

এবং সেদিনই রাত্রের দিকে সুহাসের অল্প অল্প জ্বর দেখা দেয় প্রথম।

পরের দিন সকালে রাজবাড়ির ডাক্তার অমিয় সোমকে ডেকে আনা হল, তিনি দেখেশুনে বললেন, ও কিছু না, ভয়ের তেমন কোনো কারণ নেই। সামান্য ঠাণ্ডা লেগে ইনফ্লুয়েঞ্জা মত হয়েছে, গোটা দুই অ্যাপ্রিন্ খেলেই আবার চাঙ্গা হয়ে উঠবে। হাতটার যেখানে সামান্য ফুলে লাল হয়ে ব্যথা হয়েছে, সেখানে একটু গরম সেঁক দিলেই হবে।

কিন্তু দিন দুই পরেও দেখা গেল জ্বরটা একেবারে বিচ্ছেদ হয়নি, ৯৯° থেকে ১০১°–এর মধ্যেই থাকছে। গলায় ও কোমরে সামান্য সামান্য বেদনা—হাতের ফোলাটা অবিশ্যি অনেকটা কম।

আবার ডাক্তার এলেন, সম্ভব-অসম্ভব তাঁর বিদ্যামাফিক পরীক্ষা করে তিনি নবীন উদ্যমে নতুন ঔষধপত্রের ব্যবস্থা করলেন। এবং এবারও বললেন, ভয় বা চিন্তার তেমন কোন কারণ নেই। এমনি করেই আট-দশটা দিন কেটে গেল এবং সেই আট-দশদিনেও জ্বর রেমিশন হল না। গলার দু-পাশে, বগলের নীচে, কুঁচকিতে গ্ল্যাণ্ডসগুলো ব্যথা হয়ে সামান্য বড় হয়েছে বলে মনে হল।

মালতী দেবী কিন্তু এবারে বেশ চিন্তিত হয়ে উঠলেন। হাজার হলেও মার প্রাণ তো!

সুবিনয়কে একদিন সকালে ডেকে বললেন, বিনয়, আট-দশদিন তো হয়ে গেল, কিন্তু সুহাসের জ্বর তো কমছে না কিছুতেই; কলকাতা থেকে কোনো একজন ভাল ডাক্তার এনে দেখালে একবার হত না?

সবতাতেই তোমার ব্যস্ত ছোট মা! পথে আসতে ঠাণ্ডা লেগে জ্বর হয়েছে, দু-চারদিন পরেই সেরে যাবে। তাছাড়া ডাক্তার দেখছে, ওষুধ খাচ্ছে। এতই যদি তোমার ভয় হয়ে থাকে—তবে ডাঃ কালীপদ মুখার্জীকে না হয় আসবার জন্য একটা তার করে দিচ্ছি।

তাই না হয় করে দাও। অমিয়র চিকিৎসায় তো এক সপ্তাহ প্রায় রইল, কোনো উপকারই তো দেখা যাচ্ছে না, সময় থাকতে সাবধান হওয়াই কি ভাল নয়? শেষে রোগ বেঁকে দাঁড়ালে মুশকিল হবে।

ডাঃ কালীপদ মুখার্জী কলকাতা শহরের একজন মস্তবড় নামকরা ডাক্তার।

মাসে তিনি অনেক টাকাই উপায় করেন।

রায়পুরের রাজবাড়িতে তাঁর অনেক দিন হতেই চিকিৎসাসূত্রে যাতায়াত। এককথায় তিনি স্টেটের কনসালটিং ফিজিসিয়ান।

রায়পুরের রাজবাড়িতে কখনও কোনো কঠিন কেস হলে কলকাতা থেকে কাউকে আনতে হলে সর্বাগ্রে তাঁরই ডাক পড়ে, এবং বহুবার তিনি রাজবাড়ির অনেকের অনেক দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসা করে আরাম ও সুস্থ করে তুলেছেন। এ বাড়ির সঙ্গে তিনি বিশেষভাবেই পরিচিত।

তাঁর অমতে বা তাঁর অজ্ঞাতে রাজবাড়িতে কখনও অন্য কোনো বড় ডাক্তারকে আজ পর্যন্ত ডাকা হয়নি।

বহুবার যাতায়াতের জন্য রাজবাড়ির সঙ্গে ডাঃ মুখার্জীর অত্যন্ত হৃদ্যতা জমে উঠেছে।

রাজবাড়ির একজন হিতৈষী বন্ধুও বটে তিনি।

আর দেরি না করে ঐদিনই সকালের দিকে তাঁকে আসবার জন্য একটা জরুরী তার করবার জন্য মালতী দেবী বারংবার বলতে লাগলেন।

যদিচ অমিয় ডাক্তার বার বার বলতে লাগলেন, ভয় নেই রাণীমা, সামান্য জ্বর, ও দু-চারদিন নিয়মিত ওষুধপত্র খেলেই ভাল হয়ে যাবে।

এবং সুবিনয়ও সেই সঙ্গে সায় দিতে লাগল। তথাপি রাণীমা বলতে লাগলেন, তা হোক, ডাঃ মুখার্জীকে তার করে দেওয়া হোক, কলকাতা থেকে একটিবার এসে তিনি সুহাসকে যত শীঘ্র সম্ভব দেখে যান।

এবং শেষ পর্যন্ত তার করেও দেওয়া হল। আর তার পেয়ে ডাঃ মুখার্জী রায়পুর এসে হাজির হলেন।

ডাঃ মুখার্জীর বয়স চল্লিশের কিছু উপরেই হবে। থলথলে নাদুসনুদুস গড়ন। লম্বা-চওড়া চেহারা। গায়ের রং কাঁচা হলুদের মত। সৌম্য প্রশান্ত। মাথার সামনেয় সামান্য টাক পড়েছে। দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো।

দেখলেই মনে হয় যেন একটা সাহস বা নিরাপত্তার ভাব আসে রোগীর মনে।

ডাঃ মুখার্জী এসে সুহাসের কক্ষে প্রবেশ করলেন, কি হে সুহাসচন্দ্র? আবার অসুখ বাধিয়েছ? তুমি যে ক্রমে একটি রোগের ডিপো হয়ে উঠলে হে!

সুহাস ক্লান্ত স্বরে বলে, বড় দুর্বল লাগছে ডাঃ মুখার্জী।

ভয় নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে। আশ্বাস দেন ডাঃ মুখার্জী।

পরীক্ষার পর মালতী দেবী জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন দেখলেন ডাঃ মুখার্জী সুহাসকে?

ডাঃ মুখার্জী বলেন, ভয়ের কিছু নেই, ভাল হয়ে যাবে।

কিন্তু তবু ডাঃ মুখার্জীকে মালতী দেবী পাঁচ-ছয়দিন রায়পুরেই আটকে রাখলেন, ছাড়লেন না, বললেন, ওকে একটু সুস্থ না করে আপনি যেতে পারবেন না।

কিন্তু সুহাসের অসুখের কোনো উন্নতিই হল না পাঁচ-ছ দিনেও।

ক্রমেই সুহাস যেন বেশী অসুস্থ হয়ে পড়তে লাগল। মালতী দেবী এবারে কিন্তু বিশেষ চিন্তিত হয়ে উঠলেন, মনের মধ্যে কেমন যেন একটা আশঙ্কা থমথম করে।

শেষটায় মালতী দেবী বেঁকে বসলেন, সুহাসকে কলকাতায় নিয়ে যেতেই হবে; এ আমার মোটেই ভাল লাগছে না ডাঃ মুখার্জী কলকাতাতেই ওকে নিয়ে চলুন, সেখানে আরও দু-একজনের সঙ্গে কনাসা করুন।

ডাঃ মুখার্জী অনেক বোঝালেন, কিন্তু মালতী দেবী দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ইতিমধ্যে হঠাৎ সুহাসের একখানা চিঠি পেয়ে ডাঃ সুধীন রায়পুরে এসে হাজির হল। সেও বললে, এ অবস্থায় কলকাতায় নিয়ে যাওয়াই বোধ হয় ভাল হবে।

অবশেষে সত্যিসত্যিই একপ্রকার জোর করেই যেন মালতী দেবী অসুস্থ সুহাসকে ডাঃ মুখার্জী ও সুধীনের তত্ত্বাবধানে কলকাতার বাসায় নিয়ে এসে তুললেন।

সুধীন কিন্তু কলকাতায় আসবার পরের পরের দিনই জরুরী একটা কাজে বেনারস চলে গেল।

আরও বড় বড় ডাক্তার ডাকা হল, সার্জেন, ফিজিসিয়ান কেউ বাদ গেল না।

নানা মুনির নানা মত। নানা চিকিৎসা-বিভ্রাট চলতে থাকে যেমন সাধারণত হয় অর্থের প্রাচুর্য থাকলে।

অবশেষে পূর্ব কলকাতার একজন প্রখ্যাতনামা চিকিৎসক ডাঃ রায় এসে রোগী দেখে ডাঃ মুখার্জীকে বললেন, রক্তটা একবার কালচার করবার জন্য পাঠানো হোক ডাঃ মুখার্জী। সবই তো করে দেখা হল।

ডাঃ মুখার্জী প্রশ্ন করলেন, রক্ত কালাচার করে কি হবে ডাঃ রায়?

রোগীর গ্ল্যাণ্ডসগুলো দেখে কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে, মনে হচ্ছে, প্লেগের মত, যেন গ্ল্যাণ্ডসগুলো ফুলেছে।

ডাঃ মুখার্জী হাঃ হাঃ করে উচ্চেঃস্বরে হেসে উঠলেন, প্লেগ! ঐ সমস্ত চিন্তাটা আপনার মাথায় এল কি করে—তাও আজকের দিনে!

ডাঃ মুখার্জী হাসতে লাগলেন।

হাসবেন না ডাঃ মুখার্জী। সব রকমই তো করা হল, ওটাও না হয় করে দেখলেন, এমন কি ক্ষতি! তাছাড়া আমার মনে হয় এক্ষেত্রে সেটা প্রয়োজনও। শেষের দিকে তাঁর কণ্ঠস্বরে বেশ একটা দৃঢ়তা যেন ফুটে ওঠে।

না, ক্ষতি আর কি, তবে absolutly unnecessary! কিন্তু আপনি যখন বলছেন, পাঠানো হোক। কতকটা অনিচ্ছাতেই যেন রক্ত কালচার করবার মত দিলেন ডাঃ মুখার্জী।

যাই হোক, ব্লাড নেওয়া হল কালচারের জন্য, ট্রপিক্যাল স্কুলেও পাঠানো হল। কিন্তু রক্তের কালচারের রিপোট আসবার আগেই, অর্থাৎ পরদিন সকালেই সুহাসের আকস্মিক মৃত্যু ঘটল।

ডাঃ মুখার্জী ডেথ সার্টিফিকেট দিলেন, যথানিয়মে শবদেহের দাহকার্যও সুসম্পন্ন হয়ে গেল।

***

সুহাসের মৃত্যুর দুতিনদিন পরে। সুধীন আবার বেনারস থেকে ফিরে এসে সব শুনলে, কিন্তু একটি কথাও ভাল-মন্দ কিছুই বললে না। নিঃশব্দে কেবল ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল—ঘরে তখন অন্যান্য সবাই বসেছিল।

এদিকে ট্রপিক্যাল স্কুলের ল্যাবরেটরী রুমে অধ্যক্ষ কর্ণেল স্মিথ কতকগুলি কালচার-টিউব নিয়ে পরীক্ষা করছেন।

বিকেল প্রায় পাঁচটা, ল্যাবরেটরীর কর্মীরা সকলেই প্রায় যে যাঁর কাজকর্ম শেষ করে বাড়ি চলে গেছেন।

এমন সময় কর্ণেল স্মিথের সহকারী ও ছাত্র ডাঃ মিত্র, কর্ণেলের সামনে একটা কালচার-টিউব নিয়ে এসে দাঁড়ালেন, স্যার!

ইয়েস, ডাঃ মিত্র—? কর্ণেল ডাঃ মিত্রের দিকে মুখ তুলে চাইলেন।

দেখুন তো–এই কালচার-টিউবটা! প্লেগ ব্যাসিলাইয়ের গ্রোথ বলেই যেন সন্দেহ হচ্ছে!

What! Plauge growth! Let me see! Let me see!

ব্যগ্রভাবে কর্ণেল কালচার-টিউবটা হাতে নিয়ে টিউবের ওপরে ঝুঁকে পড়লেন। উত্তেজনায় তাঁর চোখের তারা দুটো যেন ঠিকরে বের হয়ে আসতে চায়।

Yes! It is nothing but Plague! Yes, its Plague!

তখুনি গিনিপিগের শরীরে সেই কালচার-টিউবথেকেগ্রোথ নিয়ে ইনজেক্ট করা হল পরীক্ষার জন্য। এবং খোঁজ করে জানা গেল, রায়পুরের ছোট কুমার সুহাস মল্লিকের যে রক্ত কালচার করতে ডাঃ মুখার্জী পাঠিয়েছিলেন, এ তারই কালচার।

পরীক্ষার দ্বারা প্রমাণিত হল, সেটা যথার্থই প্লেগ ব্যাসিলাইয়ের গ্রোথ।

সেই রিপোর্ট তখুনি সঙ্গে করে নিয়ে সন্ধ্যার একটু পরেই কর্ণেল স্মিথ স্বয়ং ডাঃ রায়ের হাতে পৌঁছে দিয়ে এলেন। কারণ তিনি ডাঃ মিত্রের কাছ থেকে শুনেছিলেন, ওটা ডাক্তার রায়ের সুপারিশেই কালচারের জন্য নাকি এসেছিল, তাছাড়া অন্য কারণও ছিল।

সে যা হোক, বিদ্যুৎগতিতে সে সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল সারাটা কলকাতা শহরে চিকিৎসকদের মহলে। এবং ক্রমে সেই কথাটা পাবলিক প্রসিকিউটার গগন মুখার্জীর কানে এসে উঠল। গগন মুখার্জী যেন হঠাৎ উঠে বসলেন। আরও দুচার দিন গোপনে খোঁজখবর চলল, তারপর আকস্মিক একদিন সন্ধ্যার ঠিক আগে—পাবলিক প্রসিকিউটার রায়বাহাদুর গগন মুখার্জী, রায়পুরের ছোট কুমার সুহাস মল্লিকের খুনের দায়ে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা বের করে একই সঙ্গে ডাঃ মুখার্জী, সুবিনয় মল্লিক, ডাঃ অমিয় সোম এবং আরও দু-চারজনকে গ্রেপ্তার করে একেবারে হাজতে পুরলেন।

শহরে রীতিমত এক চাঞ্চল্য দেখা দিল। কারণ সংবাদটা যেমনি অভাবনীয় তেমনি চাঞ্চল্যকর।

জামিনে ওদের খালাস করার জন্য তদ্বির শুরু হল।

কিন্তু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ গগন মুখার্জী কঠিনভাবে মাথা নাড়লেন, জামিনে কারও খালাস হবে না। যতদিন না মামলার মীমাংসা হয়, কারও জামিন মিলবে না। অভিযোগ হত্যা ও হত্যার ষড়যন্ত্র! এবং নিশ্চিত প্রমাণ-সূত্র সরকার বাহাদুরের হাতে পৌঁছে গেছে।

তদন্ত শুরু হল।

গগন মুখার্জী আবশ্যকীয় সব প্রমাণাদি যোগাড় করতে লাগলেন নানা দিক থেকে। গগন মুখার্জীর সবচাইতে বেশী রাগ যেন ডাঃ মুখার্জীর ওপরেই। কিন্তু তারও একটা কারণ ছিল বৈকি। অতীতের কুহেলী আচ্ছন্ন। অথচ কেউ সে কথা জানত না। ঐ ঘটনার বছর চার আগে, পাবলিক প্রসিকিউটার গগন মুখার্জীর বড় মেয়ে কুন্তলা আত্মহত্যা করে।

কুন্তলার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ষড়যন্ত্র করে তাদের পুত্রবধূ কুন্তলাকে পরিত্যাগ করে। কুন্তলার নাকি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে এই অভিযোগে ছেলের আবার বিবাহ দেয়। কুন্তলা যে সত্যিসত্যিই পাগল হয়ে গেছে সে সাটিফিকেট দিয়েছিল ঐ ডাঃ মুখার্জীরই মেডিকেল বোর্ড যে বোর্ডে তিনি একজন পাণ্ডা ছিলেন। আসলে কিন্তু ব্যাপারটা আগাগোড়া কুন্তলার শ্বশুবাড়ির লোকের পক্ষ থেকে সাজানো। কুন্তলাকে ত্যাগ করবার একটা অছিলা মাত্র। নিষ্ফল আক্রোশে নির্বিষ সাপের মতই সেদিন গগন মুখার্জী ছটফট করেছিলেন। উপায় নেই। নিষ্করুণ ভাগ্যের নির্দেশকেই সেদিন মেনে নিতে হয়েছিল সানেত্রে।

অনেক চেষ্টা করেও ডাঃ মুখার্জীর বিরুদ্ধে তিনি কোনো অভিযোগ খাড়া করতে পারেন নি সেদিন। লজ্জায়, দুঃখে, অপমানে কুন্তলা আত্মহত্যা করে সকল জ্বালা জুড়লো।

শ্মশানযাত্রীরা শবদেহ এনে উঠোনের ওপরে নামিয়েছে—চেয়ে রইলেন—দুচোখের কোল বেয়ে অজস্র ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল।

কন্যার মৃতদেহ স্পর্শ করে মনে মনে সেদিন তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, মাগো, তোর দুঃখ আর কেউ না বুঝলেও, আমি বুঝেছিলাম। এর প্রতিশোধ আমি নেব।

হ্যাঁ, প্রতিশোধ! এর প্রতিশোধ তাঁকে নিতেই হবে!

আজ তিনি ডাঃ মুখার্জীকে হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়েছেন। এতবড় সুবর্ণ সুযোগ!

***

হাজত-ঘরে ডাঃ মুখার্জী বসে কত কথাই ভাবতে লাগলেন। কিন্তু বের হবার উপায় নেই। সরকার জামিনও দেবে না বলে দিয়েছে।

আর গগন মুখার্জী মনে মনে দাঁত চেপে বললেন, এই যে যজ্ঞ শুরু করলাম, এর পূর্ণাহুতি হবে সেইদিন, যেদিন মুখার্জীকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলাতে পারব।

কিন্তু নিয়তির কি নির্মম পরিহাস!

আর মাত্র তিনদিন আছে মামলা আদালতে শুরু হবার।

গগন মুখার্জীর বাড়ির গেটে ও চতুম্পার্শ্বে সশস্ত্র প্রহরী দিবারাত্র পাহারা দিচ্ছে তাদের রাইফেলের সঙ্গীন উঁচিয়ে, যাতে করে শত্রুপক্ষের লোকেরা কেউ মামলা শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত গগন মুখার্জীর কোনো প্রকার দৈহিক ক্ষতি না করতে পারে। কারণ সে ভয় তাঁর খুবই ছিল।

এমন সময় সহসা গগন মুখার্জীর একদিন সন্ধ্যার সময় জ্বর এল, জ্বরের ঘোরে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। কলকাতা শহরের বড় বড় ডাক্তাররা এলেন, তাঁরা মাথা নেড়ে গম্ভীর স্বরে বললেন, ব্যাধি কঠিন, ভিরুলেন্ট টাইপের ম্যানিনজাইটিস্-জীবনের আশা খুব কম।

জলের মত অর্থব্যয় হল, চিকিৎসার কোনো ক্রটি হল না—কিন্তু সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে গেল। সাজানো দাবার ছক ফেলে, মাত করবার পূর্বেই এতদিনকার অতৃপ্ত প্রতিশোধের দুর্নিবার স্পৃহা বুকে চেপেই পাবলিক প্রসিকিউটারর গগন মুখার্জী কোনো এক অজানা লোকের পথে পা বাড়ালেন।

লোকমুখে সেই সংবাদ জেলের মধ্যে বন্দী ডাঃ মুখার্জীর কানে পৌঁছল, তিনি বোধ করি আজ অনেক দিন পরে বুকভরে আবার নিঃশ্বাস নিলেন। ঘাম দিয়ে বুঝি জ্বর ছাড়ল।

১.০৫ মাকড়সার জাল

যাঁর প্রতিবন্ধকতায় ডাঃ মুখার্জীর জামিন পাওয়া কোনোমতে সম্ভব হচ্ছিল না, তাঁর আকস্মিক অভাবনীয় মৃত্যুতে এতদিন পরে তা সম্ভব হল।

ডাঃ মুখার্জীর বৃদ্ধ পিতা তান্ত্রিক, কালীসাধক।

লোকে বলত, তিনি নাকি বলেছিলেন, যেমন করেই হোক কালীকে আবার আমি মুক্ত করেই আনব, আমার মা-কালীর সাধনা যদি সত্য হয়। সত্যিসত্যিই যদি আমি দীর্ঘ আঠারো  বছর একাগ্রচিত্তে মা-কালীর পূজা করে এসে থাকি, তবে এ জগতে কারও সাধ্য নেই আমার একমাত্র সন্তানকে আমার বুক থেকে এমনি করে অন্যায়ভাবে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে ফাঁসিকাঠে ঝোলাতে পারে।

তান্ত্রিক কালীসাধক পিতা ঘরের দুয়ার বন্ধ করে মা-কালীর সাধনা শুরু করলেন। মধ্যরাত্রে পাড়ার লোকেরা শুনত, তন্ত্রধারী কালীসাধকের পূর্ণ হোমের গম্ভীর মন্ত্রোচ্চারণ। ভয়ে বুকের মধ্যে যেন সবার ছমছম করে উঠত!

গগন মুখার্জী যখন আকস্মিক অভাবনীয়রূপে ম্যানিজাইটিস হয়ে মাত্র তিন দিনের মধ্যে মৃত্যুমুখে পতিত হলেন, অনেকেই বলেছিল সেই সময়কালীসাধক তান্ত্রিক ডাঃ মুখার্জীর পিতা নাকি মৃত্যুবাণ চালিয়েছিলেন। অমোঘ সে মৃত্যুবাণ।

একবার কারও প্রতি নিক্ষিপ্ত হলে, সে নিক্ষিপ্ত বাণাঘাতে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু। কারও সাধ্য নেই ধ্বংস হতে তাকে রক্ষা করে।

কিন্তু সে যাই হোক, এর পর আদালতে রায়পুরের বিখ্যাত হত্যা-মামলা শুরু হল। বর্তমান উপাখ্যানের সে এক চাঞ্চল্যকর অধ্যায়।

আদালতে তিলধারণের স্থান নেই, অগণিত দর্শক। হত্যাপরাধে অন্যতম অভিযুক্ত আসামী, শহরের স্বনামধন্য প্রখ্যাতনামা চিকিৎসক ডাঃ কালীপদ মুখার্জী। তাছাড়া সেই সঙ্গে আছেন নিহত ছোট কুমারের জেষ্ঠ ভাই, রাজাবাহাদুর সুবিনয় মল্লিক ও রাজবাড়ির পারিবারিক চিকিৎসক ডাঃ অমিয় সোম।

বিচিত্র মামলার বিচিত্র আসামী!

একজন চিকিৎসক, যার পেশা মানুষের সেবা, যার হাতে নির্বিচারে মানুষ মানুষের অতি প্রিয় আপনার জনের মরণ-বাঁচনের সকল দায়িত্ব অকুণ্ঠিত চিত্তে নির্ভয়ে ও আশ্বাসে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকে। আর একজন একই পিতার সন্তান, একই রক্তধারা হতে জন্মেছে যে ভাই সেই ভাই। সত্যিই কি এক বিচিত্র নাটক!

পাবলিক প্রসিকিউটার গগন মুখার্জী যখন ডাঃ কালীপদ মুখার্জীর নামে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি করেন, তখন তিনি কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়েছিলেন, এ ভয়ংকর হত্যারহস্যের পিছনে আসল মেঘনাদই হচ্ছে শয়তানশিরোমণি চিকিৎসক ডাঃ কালীপদ মুখার্জী! সেই হচ্ছে আসল brain, তারই বুদ্ধিতেই এ হত্যার ব্যাপার ঘটেছে। অন্যান্য সবাই হত্যার ব্যাপারে instrument মাত্র! এও নিশ্চিত, সুহাসের শরীরে শত্রুতা করে Plague Bacilli inject করে দেওয়া হয়েছে কোনো উপায়ে এবং সেই উপায়ে একজন সুস্থ ব্যক্তিকে হত্যা করবার যে বিচিত্র প্রচেষ্টা, তা একজন ডাক্তারের brain ছাড়া সাধারণ লোকের মাথায় আদপেই সম্ভবপর নয়। It is simply impossible for a common man-with a common ordinary brain. আরও ভেবে দেখবার বিষয়, ডাঃ রায় রোগী দেখে যখন সন্দেহ করেন তখন ডাঃ মুখার্জী কেন blood culture-এ বাধা দেন! এসব ছাড়াও গগন মুখার্জীর সরকারী মহলে ছিল অসাধারণ প্রতিপত্তি—তিনি বলেছিলেন, কোনো বিশেষ কারণবশতই বর্তমানে এ কেস্ সম্পর্কে যাবতীয় evidences তাঁকে গোপন করে রাখতে হচ্ছে। যা হোক তাঁর দুর্ভাগ্যবশত ও আসামীদের সৌভাগ্যবশতঃ, তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে সব ওলটপালট হয়ে গেল, গোপনীয় দলিলপত্রের কোনো সন্ধানই পাওয়া গেল না—তবু মামলা চলল দীর্ঘদিন ধরে। প্রমাণিত হল, ছোট কুমার সুহাস মল্লিকের দেহে Plague Bacilli inject করেই তাকে হত্যা করা হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত গগন মুখার্জীর মৃত্যু হওয়ায় ডাঃ মুখার্জীর স্বপক্ষে নানাপ্রকার সাক্ষীসাবুদ খাড়া করে প্রমাণিত করা হল যে অতীতে পিতার হত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্য ডাঃ সুধীন চৌধুরীই সেদিন অর্থাৎ ৩১শে মে শিয়ালদহ স্টেশনে রায়পুর যাওয়ার সময় ছোট কুমারের দেহে অলক্ষ্যে প্লেগ ব্যাসিলাই inject করে দিয়েছিল।

তাছাড়া আরও একটা কথা, যে কলকাতা শহরে আজ আট-দশ বৎসরের মধ্যে একটি প্লেগ কেসও দেখা দেয়নি, সেখানে কারও প্লেগে মৃত্যু হওয়াটা সত্যিই কি বিশেষ সন্দেহজনক নয়? কোথা থেকে শরীরে তার প্লেগের বীজাণু এল? এই প্রকার সব সাত-পাঁচে ব্যাপারটা কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল।

যা হোক-ডাঃ মুখার্জীর বিপক্ষে কোনো অভিযোগই প্রমাণ করা গেল না। ডাঃ মুখার্জী ও সুবনিয় মল্লিক দুজনেই বেকসুর খালাস পেলেন আর হত্যাপরাধে ডাঃ সুধীন চৌধুরীর যাবজ্জীবন কারাবাসের আদেশ হল ও তার মেডিকেল ডিগ্রী ও রেজিস্ট্রেশন বাজেয়াপ্ত করা হল। নাটকের উপর যবনিকাপাত হল।

কিন্তু আসল নাটকের শুরু কোথায়?

যবনিকাপাতের পূর্বে যে নাটকের মহড়া বসেছিল, তার মূল কোথায়?

হতভাগ্য ডাঃ সুধীনের মাকে বিদায় দিয়ে কিরীটী নিজের শয়নকক্ষে এসে শয্যার ওপরে গা এলিয়ে দিয়ে কাল রাত্রের সেই কথাই ভাবছিল।

এ কথা অবশ্যই অবধারিত সত্য যে, ছোট কুমারকে প্লেগ ব্যাসিলাই ইনজেক্ট করেই হত্যা করা হয়েছে।

কিন্তু আদালত স্থির করতে পারে নি, সেই প্লেগ ব্যাসিলাই এল কোথা থেকে? এবং এলই যদি, সেই প্লেগ ব্যাসিলাই কে আনলে এবং কেমন করেই বা আনলে!

কারণ একমাত্র সারা ভারতবর্ষে বম্বেতে প্লেগ ইনসটিটিউট আছে; সেখানে প্লেগ রোগ সম্পর্কে রিসার্চ করা হয়। সে রিসার্চ ইনসটিটিউট সম্পূর্ণরূপে গভর্ণমেন্টের কর্তৃত্বাধীনে। ইনসটিটিউটের কর্তৃপক্ষের আদেশ বা সম্মতি ব্যতীত সেখানে কারও প্রবেশ অসম্ভব। একমাত্র যারা সেখানে কর্মচারী ছাত্র বা ও-ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট তারা ভিন্ন সেখানে কারও প্রবেশও নিষেধ। তাছাড়া সেই ইনষ্টিটিউটের প্রতিটি জিনিসপত্রের চুলচেরা হিসাব প্রত্যহ রাখা হয় সুষ্ঠুভাবে, সেখান থেকে কোনো জিনিস ওখানকার কর্তৃপক্ষের অজ্ঞাতে সরিয়ে আনা কেবল কঠিনই নয়,একপ্রকার অসম্ভব বললেও অত্যুক্তি হয় না।

কিন্তু সুহাস মল্লিকের হত্যা যখন প্রমাণিত হয়েছে-আদালত ব্যাসিলাইয়ের প্রয়োগ ব্যতীত প্লেগ এবং প্লেগে মৃত্যুর যখন অন্য কোনো কারণ প্রমাণ করতে পারেনি; সে অবস্থায় একমাত্র বম্বের ইনসটিটিউটের ব্যাসিলাই ছাড়া প্লেগ কালচার অন্য কোথা হতেই বা সংগৃহীত হতে পারে? অবিশ্যি মামলার সময় বিভিন্ন বাদী ও প্রতিবাদীর জবানবন্দি থেকেও সেটাই প্রমাণিত হয়েছে একপ্রকার যে বম্বে থেকেই প্লেগবীজাণু আনা হয়েছিল। বাংলাদেশে আজ দীর্ঘকাল ধরে কোনো প্লেগ কেস হয়নি।

তাই চারিদিক বিবেচনা করে এইটাই ধরে নেওয়া হয়েছে যে, প্লেগ ব্যাসিলাই আনা হয়েছে নিশ্চিত বম্বে হতে এবং তারই সাহায্যে এই দুর্ঘটনা ঘটানো হয়েছে ষড়যন্ত্র করে।

অবিশ্যি মামলার সময় প্রমাণিত হয়নি সঠিকভাবে যে কেমন করে আনীত হয়েছে বম্বে হতে প্লেগ ব্যাসিলাই। শুধুমাত্র এইটুকুই প্রমাণিত হয়েছে যে, সুহাস মল্লিককে হত্যা করা হয়েছে প্লেগ ব্যাসিলাই ইনজেক্ট করে। কেননা মৃত্যুর পূর্বে তার রক্তের কালচার-রিপোর্ট থেকে সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। এই গেল মামলার মূল প্রথম কথা।

দ্বিতীয় কথা : ডাঃ সুধীন চৌধুরীকে কেন সুহাসের হত্যা-মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হল বিচারে? অবিশ্যি গত ৩১শে মে রাত্রে শিয়ালদহ স্টেশনে যখন সুহাস মল্লিককে আততায়ী। (?) প্লেগ ব্যাসিলাই ইজেকট করে (?), সেই সময় সুধীন সুহাসের একেবারে পাশটিতেই ছিল। এবং একমাত্র নাকি সেই কারণেই জজসাহেব ও জুরীদের বিচারে সুধীনের পক্ষে। সুহাসকে ঐ সময় প্লেগ ব্যাসিলাই ইনজেকট করা খুবই সম্ভবপর ছিল—যদিও সেটা প্রমাণিত হয়নি এবং এও প্রমাণিত হয়নি যদি তাই ঘটে থাকতো, কিভাবে সেই প্লেগ ব্যাসিলাই সুধীন ডাক্তার যোগাড় করেছিল। সুধীন ডাক্তারও বটে। এ ছাড়া মোটিভ বা উদ্দেশ্য এক্ষেত্রে। একটা ছিল, যেমন প্রতিহিংসা। এবং প্রতিহিংসা যে নয় তাই বা কে বললে? পিতার নৃশংস হত্যার প্রতিশোেধ প্রত্যক্ষে সন্তানের পক্ষেই নেওয়া স্বাভাবিক বলতে হবে। কিন্তু সুধীন ও সুহাসের পরস্পরের মধ্যে ইদানীং যে সৌহার্দ্য বা ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল, সেই দিক দিয়ে বিচার করে দেখতে গেলে সুধীনের পক্ষে সুহাসকে ঐরকম নৃশংসভাবে হত্যা করাটা কি বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়?

বিচারক ও জুরীদের মত, ডাঃ সুধীন চৌধুরী নাকি সময় ও সুযোগের প্রতীক্ষ্ণয় ছিল এতদিন। এবং সুযোগ পাওয়া মাত্রই সে সুযোগটার সদ্ব্যবহার করছে।….এও তাদের মত যে, পিতার হত্যার প্রতিশোধলিন্দু সুধীন অদূর ভবিষ্যতে যাতে করে অনায়াসেই অন্যের সন্দেহ বাঁচিয়ে সুহাসকে হত্যা করতে পারে, সেই জন্যই একটা লোক-দেখানো ঘনিষ্ঠতা বা সৌহার্দ্য সুহাসের সঙ্গে ইদানীং কয়েক বছর ধরে একটু একটু করে গড়ে তুলেছিল। কিন্তু কিরীটী ভাবে, তাই যদি সত্যি হয়, তবে সুধীন প্রতিহিংসার পাত্র হিসাবে রায়পুরের রাজগোষ্ঠীর অন্য সকলকে বাদ দিয়ে নিরীহ গোবেচারী সুহাসকেই বা বেছে নিল কেন? সুধীনের পিতাকে যখন নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় তখন সুহাসের তো মাত্র তিন বৎসর বয়স। এবং তার সেই শিশুবয়েসে আর যাইহোক সেদিনকার সেই নিষ্ঠুর হত্যার ব্যাপারের সঙ্গে তার কোনোক্রমেই জড়িত থাকাটা তো সম্ভবপর নয়—সেদিক দিয়ে তাকেই প্রতিশোধের পাত্র হিসাবে বেছে নেওয়া হল কেন?

তবে যদি এই হয় যে, রাজগোষ্ঠীর একজনকে কোনোমতে হত্যা করতে পারলেই তার পিতার প্রতিশোধটা অন্তত নেওয়া হয়, সেটা অবশ্য অন্য কথা। কারণ মানুষের সত্যিকারের মনের কথা বোঝা শুধু অসম্ভবই নয়, একেবারে হাস্যকর বলেই মনে হবে।

তারপর একটু আগে শোনা সুধীনের মার মুখে সেই সুধীনের পিতার অতীতের নৃশংস হত্যাকাহিনী, সেও শুধু একমাত্র সুধীনের পিতার হত্যাই নয়, তার আগে শ্রীকণ্ঠ মল্লিককেও তো হত্যা করা হয়েছিল একই ভাবে এবং একই স্থানে! আগাগোড়া সব কিছু পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে সমগ্র কাহিনীটি বিবেচনা করে দেখতে গেলে প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত হয়ত বা দেখা যাবে, সব কিছুই একই সূত্রে গাঁথা।

অবিশ্যি এও হতে পারে, শ্ৰীকণ্ঠ মল্লিক ও সুধীনের পিতার হত্যা-ব্যাপারে সুহাসের হত্যা-রহস্য হতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। একটার সঙ্গে অন্যটার কোনো যোগসূত্ৰই নেই।

কিরীটীর মনের মধ্যে নানা চিন্তা এলোমেলো ভাবে যেন একটার পর একটা আনাগোনা করতে থাকে। এ যেন মাকড়সার জাল, কোথায় শেষ কে জানে! যেমন অসংবদ্ধ তেমনি জটিল।

ইতিমধ্যে কখন একসময় প্রথম ভোরের আলো শীতরাত্রির অবসান ঘটিয়েছে, তা কিরীটী টেরও পায়নি।

প্রভাতের ঝিরঝিরে ঠাণ্ডা হাওয়া খোলা বাতায়নপথে এসে জাগরণক্লান্ত কিরীটীর চোখেমুখে স্নিগ্ধ পরশ বুলিয়ে দিয়ে যায়।

আর ঘুমের আশা নেই। কিরীটী শয্যা থেকে উঠে জানলার সামনে এসে দাঁড়ায়।

রাস্তার ধারের কৃষ্ণচূড়ার গাছটার পত্রবহুল শীর্ষ ছুঁয়ে ভোরের শুকতারা তখনও জেগে আছে দেখা যায়।

কিরীটী চিন্তা করতে থাকে, এখন কি কর্তব্য? কোন্ পথে কোন্ সূত্র ধরে এখন সে। অগ্রসর হবে? তবে এটা ঠিক, অগ্রসর হতে হলে আগাগোড়া আবার সমস্ত মামলাটাকেই তীক্ষ্ণ বিচার দিয়ে গোড়া হতে পর্যবেক্ষণ করতে হবে, আর তাই যদি হয়, এ-ব্যাপারে বর্তমানে যিনি তাকে সত্যি সাহায্য করতে পারেন, তিনি হচ্ছেন জাস্টিস্ মৈত্র। হ্যাঁ ঠিক, জাস্টিস্। মৈত্র!

আর বৃথা সময়ক্ষেপ না করে সোজা কিরীটী ঘরের কোণে ত্রিপয়ের উপর রক্ষিত ফোনটার সামনে এসে দাঁড়ায়। ফোনের রিসিভার তুলে নেয়—Put me to B. B…please!

একটু পরেই ফোনের ওপাশ থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, Yes!

কে, সুব্রত? আমি কিরীটী কথা বলছি। হ্যাঁ, এখুনি একবার আমার এখানে চলে আসতে পারিস? কি বললি—হ্যাঁ, খুব দরকারী কাজ। অ্যা—হ্যাঁ—আরে আয়ই না, সব শুনবি। এখানেই চা হবে, বুঝলি?

সারাটা রাত্রি জেগে চোখমুখ জ্বালা করছে।

কিরীটী অতঃপর স্নানের ঘরে ঢুকে ভিতর দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।

ঠাণ্ডা জলে অনেকক্ষণ ধরে স্নান করে জাগরণক্লান্ত শরীরটা যেন জুড়িয়ে স্নিগ্ধ হয়ে গেল। বড় টার্কিস তোয়ালেটা গায়ে জড়িয়ে ঘরে এসে ঢুকতেই দেখলে, সুব্রত ইতিমধ্যেই কখন এসে ঘরের মধ্যে একখানি সোফা অধিকার করে সেদিনকার প্রাত্যহিক সংবাদপত্রটা খুলে। বসে আছে।

কি ব্যাপার রে? হঠাৎ এত জরুরী তলব? কিরীটীকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে সুব্রত মৃদুস্বরে প্রশ্ন করে।

বোস, আমি চট করে জামাকাপড়টা ছেড়ে আসি।

প্রায় আধঘণ্টা পরে এসে কিরীটী ঘরে প্রবেশ করল, পরিধানে নেভি-র সার্জের লং প্যান্ট, গায়ে হাতকাটা স্ট্রাইপ দেওয়া গরম সার্ট। মুখে পাইপ।

কৃষ্ণা ইতিমধ্যে ট্রেতে করে চায়ের সরঞ্জাম টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে গেছে, সুতর সামনে ধূমায়িত চায়ের কাপ। পাশে বসে কৃষ্ণা।

কিরীটী এগিয়ে এসে সুব্রতর পাশ ঘেঁষে সোফার ওপরে বসে পড়ল। কৃষ্ণা হাত বাড়িয়ে কাপের মধ্যে দুধ চিনি ঢেলে টি-পট থেকে চা ঢালতে লাগল।

তারপর, হঠাৎ এত জরুরী তলব কেন?

কিরীটী কোনো মাত্র ভূমিকা না করেই বলতে শুরু করে, জানিস, রায়পুরের ছোট কুমার সুহাস মল্লিকের হত্যা-মামলায় দণ্ডিত অপরাধী ডাঃ সুধীন চৌধুরীর মা গতরাত্রে তোরা সব চলে যাওয়ার পর এসেছিলেন এখানে আমার কাছে!

কৃষ্ণা বললে, কাল রাত্রে কখন?

কিরীটী বললে, তুমি ঘুমিয়ে ছিলে, তোমায় জাগাইনি–

সুব্রতও কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়, বলে, সত্যি? তা হঠাৎ তাঁর তোর এখানে আসার কারণ? মামলার তো রায় বেরিয়ে গেছে! নাটকের পরে তো যবনিকাপাত হয়ে গেছে!

তা হয়েছে, তবে দেখলাম তাঁর ও আমার মতটা প্রায় একই, মামলার একটা লোক-দেখানো সমাপ্তি ঘটলেও আসলে এখনও অনেক কিছুই অসমাপ্ত রয়ে গেছে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ, সে এক কাহিনী।

বুঝলাম। কিন্তু আসল ব্যাপারটা কি বল তো?

আসল ব্যাপারের জন্যই তো এই এত সক্কালেই তোকে ডাকতে হল। কিরীটী চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মৃদুভাবে বলে।

সে তো দেখতেই পাচ্ছি।

কিরীটী তখন গতরাত্রের সমস্ত কথা যথাসম্ভব বিশদভাবে সুব্রতকে বলে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে।

হুঁ—তাহলে তুই কেসটা হাতে নিলি বল?

হ্যাঁ—উপায় ছিল না।

কিন্তু

যতদূর মনে হয় ডাঃ সুধীন চৌধুরী নিদোষ। অবিশ্যি যদি আমার বিচারে ভুল না হয়ে থাকে।

তা যেন হল, কিন্তু আইনের চোখে যে একবার দোষী প্রমাণিত হয়ে কারাগারে গিয়ে ঢুকেছে, তাকে মুক্ত করা ব্যাপারটা কি খুব সহজ হবে বলে ভাবিস তুই?

তার নির্দেষিতা প্রমাণ করতে পারলে কেসটা রি-ওপেন করা হয়তো কঠিন হবে বলে মনে হয় না। শোন্এখন তোকে আমার একান্ত প্রয়োজন, যার জন্য তোকে এত সকালে তাড়াহুড়ো করে টেনে নিয়ে এলাম। এই মামলার বিচারক ছিলেন জাস্টিস্ মৈত্র। তাঁর সঙ্গে আমার কিছুটা আলাপ-পরিচয় আছে, তোকে এখুনি একটিবার ল্যান্সডাউন রোডে জাস্টিস মৈত্রের ওখানে আমার একটা চিঠি নিয়ে যেতে হবে। রায়পুরের মামলার বাদী ও বিবাদী পক্ষের সমস্ত সাক্ষীসাবুদের প্রসিডিংসগুলো পড়ে যথাসম্ভব নোট করে আনবি, যেমন যেমন প্রয়োজন বুঝবি। আমাদের এখন শুরু করতে হবে শেষ থেকে। শেষের দিক থেকে কাজ শুরু করে ধীরে ধীরে আমরা গোড়ার দিকে যাব এগিয়ে।

বেশ। তাহলে আমি উঠি, তুই চিঠিটা লিখে ফেল্।

তুই বোস্ একটু, চিঠিটা এখুনি আমি লিখে দিচ্ছি।

কিরীটী সোফা থেকে উঠে রাইটিং টেবিলের সামনে বসে তার লেটার প্যাডে একটা চিঠি লিখে খামে এঁটে সুব্রতর হাতে এনে দিল, এই নে।

১.০৬ জাস্টিস মৈত্র

জাস্টিস মৈত্র লোকটি অত্যন্ত রাশভারী।

বছর কয়েক আগে একটা খুনের মামলা যখন তাঁর এজলাসে চলছিল, কিরীটীর সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। ক্রমে সেই আলাপ ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়।

সুব্রতর হাত থেকে কিরীটীর দেওয়া চিঠিটা খুলে, চিঠিখানি পড়ে স্মিতভাবে জাস্টিস্ মৈত্র বললেন, রহস্যভেদী কি আমার রায়কে নাকচ করবার মতলবে আছেন নাকি সুব্রতবাবু?

সুব্রত মৃদু হাস্যসহকারে জবাব দিল, তা তো ঠিক বলতে পারি না। তবে আমার যতদূর মনে হয়, সে বোধ হয় কেষ্টা সম্পর্কে একটু interested!

উঁহুঁ। ব্যাপারটা তা আমার ঠিক মনে হচ্ছে না। যা হোক ওপরে চলুন আমার studyতে, কাগজপত্র আমার সব সেখানেই থাকে—কিন্তু সে তো কুরুক্ষেত্র ব্যাপার!

সুব্রত জাস্টিস মৈত্রের আহ্বানে উঠে দাঁড়ায়, উপায় কি বলুন! সেই কুরুক্ষেত্রই এখন ঘাঁটতে হবে। চলুন।

দোতলায় ওপর বেশ প্রশস্ত একখানা ঘর। ঘরের মেঝেতে পুরু গালিচা বিস্তৃত, ধনী আভিজাত্যের নিদর্শন দিচ্ছে। মধ্যিখানে বড় সেক্রেটারিয়েট একটা টেবিল, খান-পাঁচেক গদী-মোড়া দামী চেয়ার।

চারপাশে দেওয়ালে আলমারি ঠাসা সব নানা আকারের আইনের কিতাব।

বসুন। জাস্টিস্ মৈত্র সুব্রতকে একখানা চেয়ার নির্দেশ করেন।

সুব্রত উপবেশন করল।

জাস্টিস মৈত্র কাঁচের শো-কেস খুলে তার ভিতর থেকে গোটা-দুই মোটা মোটা ফাইল টেনে বের করে সুব্রতর সামনে টেবিলের ওপরে এনে রাখলেন।

সুব্রত দেখলে, ওপরের ফাইলটার ওপরে ইংরাজীতে টাইপ করা লেখা—Roypur Murder Case No.1. File.

এই নিন নথিপত্র। দেখুন কি দেখতে চান। কিরীটীর বন্ধু যখন আপনি, চায়ে নিশ্চয়ই আপনার অরুচি হবে না, কি বলেন?

সুব্রত হাসতে হাসতে জবাব দেয়, না।

তবে বেশ আপনি এখানে বসে বসে আপনার যা-যা প্রয়োজন দেখুন, আমার আবার একটা জরুরী কেসের রায় লিখে আজই শেষ করে নিয়ে যেতে হবে। আমি আপনার চা পাঠিয়ে দিচ্ছি। রহস্যভেদীর বন্ধুত্বের সাটিফিকেট নিয়ে আপনি এ বাড়িতে এসেছেন, কোনো সংকোচ বা দ্বিধার আপনার প্রয়োজন নেই। নিজের বাড়ি বলেই মনে করবেন। টেবিলের ওপরে ঐ কলিং বেল আছে, দরজার বাইরেই আমার ভোলানাথ আছে, প্রয়োজন হলে চেয়ে নিতে সংকোচ করবেন না। আর যদি কোথাও বোঝবার প্রয়োজন হয়, ভোলানাথকে দিয়ে পাশের ঘরে আমাকে একটা সংবাদ পাঠাবেন।

ধন্যবাদ। আপনাকে অত ব্যস্ত হতে হবে না জাস্টিস্ মৈত্র। আপনি আপনার কাজ করুন গে।

বেশ বেশ।

জাস্টিস্ মৈত্র হাসতে হাসতে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।

***

মামলাটা আগাগোড়া সত্যিই অত্যন্ত জটিল ও ইন্টারেস্টিং।

পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে ফাইলের মাঝামাঝি জায়গায় উপস্থিত হয়ে সুব্রত দেখলে, আসামী ডাঃ সুধীন চৌধুরীর জবানবন্দি শুরু হয়েছে।

সুধীনের পক্ষে নামকরা উকিল রায়বাহাদুর অনিমেষ হালদার।

রাজবাড়ির পক্ষে উকিল সন্তোষ ঘোষাল। তিনিও কম যান না।

সন্তোষ ঘোষাল প্রশ্ন করছেন আসামীকে, মৃত সুহাস মল্লিকের সঙ্গে আপনার কতদিনকার আলাপ-পরিচয় সুধীনবাবু?

তা প্রায় পাঁচ বছর হবে।

আপনি আপনার জবানবন্দিতে এক জায়গায় বলেছেন, সুহাস মল্লিককে সর্বপ্রথম একদিন আপনাদের কলেজের আউটডোর পেসে ডিপার্টমেন্টে পেসে হিসাবে দেখেন!

হ্যাঁ।

তার আগে সুহাস মল্লিককে কোনো দিনও আপনি দেখেন নি বা পরিচয়ও ছিল না—এই তো বলতে চান?

হ্যাঁ।

আর একবার ভাল করে ভেবে দেখুন তো! ছোটবেলায় কোনো সময় ওই ঘটনার পূর্বে দেখা হতেও তো পারে! ছোটবেলার ঘটনা বলেই হয়তো আপনার মনে পড়ছে না?

না–দেখা হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না, কারণ সুহাসের সঙ্গে আটউডোর পেসে ডিপার্টমেন্টে দেখা হওয়ার পূর্বে তাদের পরিবারের সঙ্গে আমার কোনো সংবই ছিল না।

আচ্ছা একটা কথা, আপনি নিশ্চয়ই জানতেন রায়পুরের ছোট কুমারের নামই সুহাস মল্লিক?

হ্যাঁ, শুনেছিলাম।

কোনো দিন আপনার কোনো কৌতূহল হয়নি, রায়পুর রাজবাড়ি সম্পর্কে কোনো কিছু জানবার?

না।

এখানে সুধীনের পক্ষের উকিল অনিমেষ হালদার প্রতিবাদ জানাচ্ছেন মি লর্ড! এ ধরনের প্রশ্ন এ মামলায় সম্পূর্ণ অবান্তর। আমি প্রতিবাদ জানাতে বাধ্য হচ্ছি।

জাস্টিস্ মৈত্র বললেন, objection sustained। মিঃ ঘোষাল, অন্য প্রশ্ন থাকে তো করুন।

সুব্রত আবার নথির পাতা ওল্টাতে থাকে।

আবার আর এক জায়গায় সন্তোষ ঘোষাল প্রশ্ন করছেন সুধীন চৌধুরীকে, দেখুন মৃত ছোটকুমার গত ৩১শে মে যখন শেষবার রায়পুরে যান, আপনি সেদিন সকাল আটটা থেকে রাত্রি সাড়ে আটটায় কুমারকে ট্রেনে তুলে দেওয়া পর্যন্ত কুমারের সঙ্গেই ছিলেন, তাই নয় কি?

সুধীন বলে, না, আগাগোড়া ছিলাম না। মাঝখানে বেলা সাড়ে দশটা থেকে বেলা সাড়ে বারোটা পর্যন্ত ছোটকুমারের গাড়ি নিয়ে শিয়ালদহে আমার দুটি পেসেন্টকে দেখতে গিয়েছিলাম।

বাকী সময়টা—মানে মাঝখানের ওই দুঘণ্টা বাদ দিয়ে, কুমারের সঙ্গে সঙ্গেই আপনি ছিলেন, কেমন? এই তো বলতে চান?

হ্যাঁ।

আপনি রোগী দেখতে যাবার আগে ও রোগী দেখে ফিরে আসবার পর আপনার ডাক্তারী ওষুধ ও যন্ত্রপাতির ব্যাগটা কোথায় ছিল?

ছোট অ্যাটাচি কেষ্টা কেবল আমার সঙ্গে সঙ্গেই ছিল।

স্টেশনেও সেটা নিয়েই গিয়েছিলেন?

না, গাড়ির মধ্যে রেখে গিয়েছিলাম।

স্টেশনে পৌঁছনোর সময় থেকে কুমারকে গাড়িতে তুলে দেওয়া পর্যন্ত যে সময়টা, সেই সময়ে আপনার হাতে আর কিছু ছিল?

না।

বেশ। এবারে বলুন, আপনি পাস করবার পর প্র্যাকটিস করতে শুরু করেছেন কত দিন?

তা বছর দুই হবে।

আচ্ছা আমহার্স্ট স্ট্রীটে যে আপনার ডিসপেনসারী, তার গোড়াপত্তনের মানে মূলধন, আপনি কোথায় পেয়েছিলেন?

ঐ সময় রায়বাহাদুর অনিমেষ হালদার প্রতিবাদ করছেন, মি লর্ড, এ ধরনের প্রশ্নও সম্পূর্ণ অবান্তর। এ ধরণের প্রশ্নের জবাব দিতে আমার মক্কেল মোটেই প্রস্তুত নয়। আমি তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।

ঘোষাল জবাব দিচ্ছেন, আমার বন্ধু রায়বাহাদুর যা বলছেন তা আমি মেনে নিতে রাজী নই। কারণ আমরা বিশ্বস্ত সূত্রে জেনেছি, আসামীর ঘরের আর্থিক অবস্থা এতটুকুও সচ্ছল নয়। তাঁর বিধবা মা অতিকষ্টে তাঁর ছেলেকে মানুষ করেছেন, এবং আসামী বরাবর স্কলারশিপ নিয়ে পড়ে এসেছেন। অথচ খোঁজ নিয়ে ও আসামীর ডিসপেনসারীর অ্যাকাউন্ট হতে দেখা যায় প্রথম শুরুতেই এই প্রায় হাজার আড়াই মত টাকা খরচ করা হয়েছে। তাই এখানে প্রশ্নটা খুবই স্বাভাবিক নয় কি যে, ঐ টাকাটা কোথা হতে এল?

এ প্রশ্নের জবাব দিতে আমি রাজী নই—কারণ এটা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার! সুধীন জবাব দেয়।

বেশ, তা না হয় হল, কিন্তু বছর দুই প্র্যাকটিস্ করে ব্যাঙ্কে দশ হাজার টাকা জমল কি করে? মাসে আপনি average কত টাকা রোজগার করতেন এর জবাবটা দেবেন কি, না এও ব্যক্তিগত বলে এড়িয়ে যেতে চান?

তা প্রায় দুশো হতে তিনশো হবে বৈকি আমার গড়পড়তা মাসিক আয়!

নিশ্চয়ই শুরু হতেই আপনি অত টাকা রোজগার করেননি, কি বলেন?

না।

দুতিন শত টাকা মাসিক আয় হতে ঠিক কত দিন লেগেছিল বলে আপনার অনুমান হয়, ডাঃ চৌধুরী?

বলতে পারব না ঠিক, তবে আট-দশ মাস লেগেছিল।

বলেন কি! আপনাকে তো তাহলে খুব ভাগ্যবানই বলতে হবে। তা থাক সে কথা, তাই যদি হয়, বারো কি চোদ্দ মাসে আপনি দশ হাজার টাকা ব্যাঙ্কে জমালেন কি করে? আর কোনো উপায়ে আপনি অথোপার্জন করতেন নাকি?

আপনার এ প্রশ্নেরও জবাব দিতে আমি রাজী নই।

ওঃ—তা বেশ! কিন্তু ডাঃ চৌধুরী, আপনি বুঝতে পারছেন কি আপনার এ ধরনের statement-গুলো আপনার বিরুদ্ধেই যাবে?

আমি তো আপনাকে বলেছিই, জবাব আমি দেব না।

তাহলে আপনার statement-এর দ্বারা আদালত এটাই ধরে নেবে যে, আপনার ব্যাঙ্কে যে দশ হাজার টাকা আছে তার সবটুকুই আপনার প্র্যাকটিস্ বা ডিসপেনসারীর আয় থেকে সঞ্চিত নয়, কি বলেন?

আপনার যেমন অভিরুচি।

অন্য এক জায়গায় দেখা যাচ্ছে, রায়পুর স্টেটের সেক্রেটারী বা ম্যানেজার সতীনাথবাবু তাঁর জবানবন্দিতে বলেছেন, সুধীনের ডাক্তারীর অ্যাটাচি কেসটা যদিও সে গাড়ির মধ্যে রেখে স্টেশনে নেমেছিল, তার হাতে ছোট একটি কালো রংয়ের মরোক্কো লেদারের কেস ছিল আগাগোড়া। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। এমন কি সুহাসকে ট্রেনে তুলে দেবার পরেও সতীনাথবাবু সুধীনের বাঁ হাতে সেই বাক্সটি নাকি দেখেছিলেন।

সেই সম্পর্কেই সন্তোষ ঘোষাল আবার সুধীনকে জেরা করছেন।

সতীনাথবাবু ৩১শে মে স্টেশনে আপনার বাঁ হাতে যে কালো রংয়ের একটা মরোক্কো লেদারের কেসের কথা বলছেন, সেটা সম্পর্কে আপনার কিছু বলবার আছে কি ডাঃ চৌধুরী?

হ্যাঁ, আমার হাতে একটা কালো রংয়ের মরোক্কো লেদারের কেস ছিল।

কিন্তু পরশুর জবানবন্দির সময় আমার প্রশ্নের উত্তরে আপনি বলেছিলেন, ঐ সময় আপনার হাতে কিছুই ছিল না, অপনার হাত একেবারে খালি ছিল।

সে-সময় আমার ও কথাটা মনে ছিল না।

কিন্তু কেসটা কিসের? তার মধ্যে কি ছিল?

কেসটার মধ্যে হিমোসাইটোমিটার (রক্তপরীক্ষার যন্ত্র) ছিল একটা।

বাক্সটা আপনি হাতে করে রেখেছিলেন কেন?

হাতে করে রাখিনি, ভুল করে পকেটেই রেখেছিলাম, স্টেশনে ভিড়ের মধ্যে কেউ পকেট থেকে চুরি করে নেয় ভয়ে, পকেট থেকে বের করে হাতে রেখেছিলাম। কারণ জিনিসটা আমার নিজস্ব নয়, ঐদিনই সকালবেলা একজন রোগীর রক্ত নেওয়ার জন্য চেয়ে নিয়েছিলাম আমার এক ডাক্তার বন্ধুর কাছ থেকে।

সেটা আবার বন্ধুকে ফেরত দিয়েছিলেন?

হ্যাঁ, সেই দিনই রাত্রে ফিরবার পথে ফেরত দিয়ে যাই।

বন্ধুটি কোথায় থাকেন, কি নাম জানতে পারি কি?

ডাঃ জগবন্ধু মিত্র, ৩/২ নেবুবাগানে থাকেন।

দিন দুই বাদে আবার সেই জবানবন্দির জের চলেছে।

সন্তোষ ঘোষাল আসামী ডাঃ চৌধুরীকে প্রশ্ন করেছেন, ডাঃ চৌধুরী, আপনার নির্দেশমত নেবুবাগানের ডাঃ জগবন্ধু মিত্রের খোঁজ নিয়েছিলাম; কিন্তু আশ্চর্য, ঐ বাড়িতে ডাঃ জগবন্ধু মিত্র বলে একজন ডাক্তার থাকেন বটে কিন্তু তিনি তো আপনার সঙ্গে কস্মিনকালেও কোন পরিচয় ছিল বলে অস্বীকার করেছেন, তা যন্ত্রটা দেওয়া তো দূরের কথা! এ সম্পর্কে কি বলেন আপনি?

কিছুই বলবার নেই। কারণ আমি যা বলেছি তার একবর্ণও মিথ্যা নয়। দৃঢ়কণ্ঠে সুধীন জবাব দেয়।

ডাঃ জগবন্ধু মিত্র এখানেই উপস্থিত আছেন, এ বিষয়ে আপনি কোনো প্রশ্ন করতে চান তাঁকে?

ডাঃ জগবন্ধু মিত্র সে এখানে উপস্থিত আছেন, সে তত আমি দেখতেই পাচ্ছি, আমি তো আর অন্ধ নই!

এমন সময় রায়বাহাদুর অনিমেষ হালদার প্রশ্ন করলেন জজকে সম্বোধন করে, মি লর্ড, আমি ডাঃ মিত্রকে কয়েকটি প্রশ্ন করতে পারি?

জজ : নিশ্চয়ই–করুন।

ডাঃ মিত্রকে লক্ষ্য করে : আপনারই নাম ডাঃ জগবন্ধু মিত্র?

ডাঃ মিত্র : হ্যাঁ।

আপনি ৩/২ নেবুবাগানের বাড়িতে থাকেন?

হ্যাঁ।

কতদিন সেখানে আছেন আপনি?

বছর চার হবে।

আপনি কোন্ কলেজ হতে এম.বি. পাস করেছেন এবং কোন্ সালে পাস করেছেন?

কলকাতা মেডিকেল কলেজ হতে পাস করেছি। …সালে।

ডাঃ চৌধুরী, আপনিও শুনেছি কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে এম.বি. পাস করেন, কোন্ সালে পাস করেছেন?

ডাঃ মিত্র যে বছর পাস করেন সেই বছরই।

বেশ। আচ্ছা ডাঃ মিত্র, আপনার এম.বি. পাস করতে কবছর লেগেছিল?

আমি একেবারেই পাস করি, ছয় বছরই লেগেছিল।

ডাঃ চৌধুরী, আপনার?

আমিও ছবছরেই পাস করেছি।

এইবার রায়বাহাদুর হালদার সন্তোষবাবুর দিকে ফিরে বললেন, আমার মাননীয় কৌনসিল বন্ধু, এর পরও আমাকে বলবেন আপনাদের ডাঃ মিত্র যা বলছেন আপনার কাছে আসামীর সঙ্গে পরিচয় সম্পর্কে তার সব কথাগুলিই একেবারে খাঁটি সত্য?

সন্তোষ ঘোষাল বলেন, কেন নয়, জানতে পারি কি?

Question of commonsense only, মিঃ ঘোষাল! যারা একসঙ্গে একাদিক্রমে দীর্ঘ ছবছর একই কলেজে পড়ল, এবং একই হাসপাতালে কাজ করল, তারা পরস্পর পরস্পরকে চেনে না—শুধু অসম্ভবই নয়, একেবারে অবিশ্বাস্য!

চিনতে হয়ত পারেন, কিন্তু আলাপ যে থাকবেই তার কি কোনো মানে আছে?

কিন্তু মেডিকেল কলেজে একই শ্রেণীর ছাত্রদের মধ্যে আলাপ-পরিচয় থাকাটাই বেশী সম্ভপর নয় কি?

সুব্রত পড়ছিল আর নোট করে নিচ্ছিল বিশেষ বিশেষ জায়গায়, ইতিমধ্যে কখন বেলা বারোটা বেজে গেছে ওর খেয়ালই নেই। জাস্টিস্ মৈত্র এসে ঘরে প্রবেশ করলেন আদালতে যাবার বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে, কি, পরশমণির সন্ধান পেলেন সুব্রতবাবু?

সুব্রত মৃদু হাস্যসহকারে উঠে দাঁড়ায়, আজ্ঞে কিছু নুড়ি কুড়িয়েছি, এখনও সব দেখা হয়ে ওঠেনি।

তবে এখানেই আহার-পর্বটা সমাধা করুন না?

আজ্ঞে না, আজ আমি এখন যাই, সে এখন না হয় আর একদিন হবে। আপনার যদি আপত্তি না থাকে, কাল-পরশু দুদিন সকালে একবার করে আসতে পারি কি?

বিলক্ষণ। একবার ছেড়ে যতবার খুশি, আপনার জন্য দ্বার খোলাই রইল। রহস্যভেদীর ব্যাপার-স্যাপার দেখে আমার মনেও কেমন একটা কৌতূহল জেগে উঠছে। আপনি নিশ্চয়ই আসবেন। রহস্যভেদীকেও একটিবার আসতে বলবেন না!

১.০৭ জবানবন্দি জের

সন্ধ্যার দিকে সুব্রত ও কিরীটীর মধ্যে আলোচনা চলছিল।

কিরীটী বলছিল, রায়পুরের হত্যা-মামলার প্রসিডিংসের ভিতর থেকে যতটুকু তুই পড়েছিস ও যে যে পয়েন্টগুলো নোট করে এনেছিস, সেগুলো আগাগোড়া বেশ ভাল করেই পড়ে দেখলাম, সমস্ত ব্যাপারটা বিবেচনা করে দেখলে কয়েকটা অত্যন্ত স্থূল অসংগতি আমাদের চোখে পড়ে।

সুব্রত প্রশ্ন করে, কি রকম?

কিরীটী বলে, প্রথমত এই ধর—১নং… তারিখের জবানবন্দি, যে সময় আসামী ডাঃ সুধীন চৌধুরী প্রথমে অস্বীকার করছে আদালতে জেরার সময়, গত ৩১শে মে স্টেশনে তার হাতে বাক্সের কত কিছু ছিল না বলে। অথচ আবার জেরার মুখে দিন দুই পরে সতীনাথবাবুর জবানবন্দিতে প্রকাশ পাচ্ছে, সুধীনের হাতে নাকি একটা কালো রংয়ের মরোক্কো-বাঁধাই ছোট্ট কেস ছিল এবং বিপক্ষের উকিলের জেরায় সে কথা সেদিন স্বীকারও করে নিল যে তার হাতে একটা কেস ছিল। এখন কথা হচ্ছে,কেন আসামী সুধীন চৌধুরী প্রথম দিনের জেরার সময় ঐ কথাটা অস্বীকার করলে? কি এমন তার কারণ থাকতে পারে? স্বাভাবিক বুদ্ধিমত বিচার করতে গেলে, তার এই অস্বীকারের মধ্যে দুটো কারণ থাকতে পারে, ১নং, হয় আসামীর সেকথা জবানবন্দি সময় আদপে সত্যই মনে হয়নি এবং ব্যাপারটার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু থাকতে পারে বলে সে ভাবেওনি। ২নং, হয়ত কোনো বিশেষ কারণেই প্রথম হতে আসামী সুধীন চৌধুরী ব্যাপারটা চেপে যাবার প্রয়াস পেয়েছে। এখন যদি ব্যাপারটার একটা আপাত মীমাংসা হিসাবে প্রথম কারণটা ছেড়ে দিয়ে আমরা দ্বিতীয় কারণটাই ধরে নিই, তাহলে আসামীর বিরুদ্ধে সেটা যাচ্ছে এবং তার সত্যাসত্যের একটা বিশেষ মীমাংসার প্রয়োজনও হচ্ছে আমাদের দিক হতে এখন—সত্যি কিনা?

সুব্রত মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানায়। কিরীটী আবার তখন বলতে শুরু করে, তাহলে দাঁড়াচ্ছে, মামলার প্রসিডিংসের মধ্যে ১নং উল্লেখযোগ্য পয়েন্ট:ছোট মরোক্কো বাঁধাই কেসটা, ২নং পয়েন্ট: এই মরোক্কো কেসটা সম্পর্কে প্রথমে সুধীনের অস্বীকার ও পরে স্বীকৃতি।

সুব্রত প্রশ্ন করে, আচ্ছা কিরীটী,ডাঃ মিত্রের জবানবন্দী সম্পর্কে তোর কি মনে হয়?

ডাঃ মিত্র সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা বলেছেন বলেই আমার ধারণা এবং আগাগোড়াই বিপক্ষের কারসাজি। সুধীন চৌধুরীকে ডাঃ মিত্র শুধু যে চিনতেন তাই নয়, বেশ ভাল ভাবেই চিনতেন। কিরীটী মৃদু অথচ কঠিন স্বরে জবাব দেয়।

***

পরের দিন জাস্টিস্ মৈত্রের বাড়িতে।

সুব্রত ঠিক আগের দিনের মতই গতকালের দেখা ফাইলের পরবর্তী অংশটুকু দেখছিল পড়ে।

আদালতে জেরা চলছিল আবারও সেদিন আসামী ডাঃ সুধীন চৌধুরীর ব্যাঙ্ক-ব্যালান্স সম্পর্কেই। সেই পুরাতন প্রশ্নের জের। প্রশ্ন করছিলেন রায়বাহাদুর অনিমেষ হালদার, সুধীনের পক্ষের উকিল।

ধর্মতলার জেনারেল অর্ডার সাপ্লায়ার বোস এ্যাণ্ড চৌধুরী কোম্পানী সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন, ডাঃ চৌধুরী?

জানি, কারণ ওয়াকিং পার্টনার আমিই ছিলাম বোস এ্যাণ্ড চৌধুরী কোম্পানীর।

আপনাদের কোম্পানী কি ধরনের অর্ডার সাপ্লাই করত সাধারণত?

আমরা বড় বড় ফার্মাসিউটিস্টদের কাছ থেকে উচ্চহারের কমিশনে রীটেলে ওষুধ ও . পারফিউমারী কিনে সেই সব কলকাতার বিভিন্ন ঔষধ প্রতিষ্ঠানে সাপ্লাই করতাম।

উক্ত কোম্পানীতে আপনার লভ্যাংশের কি টার্মস্ ছিল?

নীট লাভের একের-তিন অংশ আমি পাব, এই চুক্তি ছিল।

কত দিন ধরে ঐ কোম্পানীর সঙ্গে আপনি সংশ্লিষ্ট ছিলেন?

তা বছর দেড়েক হবে।

আপনাদের কোম্পানীর কাগজপত্র চেক করে দেখেছি, মাসে হাজার দুহাজার টাকার মত আপনাদের কোম্পানীর নিট লাভ থাকত, এবং এও দেখেছি তিন মাস অন্তর আপনাদের হিসাবনিকাশ হত। তাই যদি হয়ে থাকে তবে অন্তত পাঁচবার লাভের অংশ আপনি পেয়েছেন, কেমন কিনা?

পেয়েছি। দুবার মাত্র পেয়েছি।

দুবারে কত পেয়েছেন?

হাজার সাতেক হবে।

সে টাকা আপনি কি করেছিলেন?

ব্যাঙ্কেই জমা রেখেছিলাম।

এমন সময় সন্তোষবাবু প্রশ্ন করলেন, ডাঃ চৌধুরী, আপনার ব্যাঙ্কের জমাখরচ থেকে জানা যায় ২৭শে এপ্রিল নগদ পাঁচ হাজার টাকা ও ৫ই মে আবার নগদ পাঁচ হাজার টাকা। আপনি আপনার অ্যাকাউন্টে ব্যাঙ্কে জমা দিয়েছেন, অত টাকা আপনি একসঙ্গে কোথায় নগদ পেলেন ঐ অল্প সময়ের মধ্যে বলবেন কি?

আপনাকে তো আগেই বলেছি মিঃ ঘোষাল, আপনার ও প্রশ্নের জবাব দিতে আমি ইচ্ছুক নই।

এবারে আবার রায়বাহাদুর প্রশ্ন করলেন, ডাঃ চৌধুরী, ২১শে এপ্রিল বোস অ্যাণ্ড চৌধুরীর লেজার বুকে আপনার নামের against-এ যে পাঁচ হাজার টাকা credit দেখানো হচ্ছে আপনার ব্যবসার কোনো একটা বড় order supply-র ব্যাপারে লভ্যাংশ হিসাবে, সে টাকাটা আপনি কি করেছিলেন? আপনি যে একটু আগে বলছিলেন দুবার মাত্র কোম্পানী থেকে আপনি লভ্যাংশ পেয়েছেন—এই পাঁচ হাজার টাকাটা কি তারই মধ্যে একবার?

আমার ঠিক মনে নেই।

বেশ, তবেসেদিন আপনি আমার মাননীয় বন্ধু মিঃঘোষালের প্রশ্নের জবাবেকেন বলেছিলেন একমাত্র ব্র্যাকটিস ও ডিসপেসারী ছাড়া আপনার অন্য কোনো savings বা income ছিল না? মিথ্যে কথা বলেছিলেন—না ইচ্ছে করেই কথাটা গোপন করেছিলেন, বলবেন কি?

কোনো একটা বিশেষ কারণেই কথাটা আমায় সেদিন গোপন করতে হয়েছিল।

বেশ, তবে আবার স্বীকার করলেন কেন? মিঃ ঘোষাল প্রশ্ন করলেন।

যে কারণে সেদিন আমায় কথাটা গোপন করতে হয়েছিল, আজ আর সেই কারণ নেই, তাই স্বীকার করেছি।

কারণটা কি আদালতকে জানাবেন? প্রশ্ন করলেন মিঃ ঘোষাল।

না, সেটা প্রকাশ করতে আমি বাধ্য নই। আসামী সুধীন চৌধুরী জবাব দেয়।

সুব্রত মনে মনে ভাবে, আশ্চর্য! সুধীন চৌধুরী যেন কতকটা ইচ্ছে করেই নিজের প্রশ্নের জালে নিজে জড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু কেন? নিজের ভাল-মন্দটাও কি সে নিজে বোঝে না?

সুব্রত আবার পাতা উল্টিয়ে যায়।

আবার এক জায়গায় সন্তোষ ঘোষাল প্রশ্ন করছেন আসামী সুধীন চৌধুরীকে, ডাঃ চৌধুরী, আপনি কবে জানতে পারেন যে সুহাস মল্লিক অসুস্থ?

সুহাস এবারে অসুস্থ হয়ে কলকাতায় আসবার আগেই তার এক পত্রে তার অসুস্থতার সংবাদ জানতে পারি।

ছোট কুমার মানে সুহাসবাবু আপনাকে সেই চিঠিতে কি লিখেছিলেন?

লিখেছেন ট্রেন থেকেই সে অসুস্থ হয় এবং অসুখ ক্রমেই বেড়ে চলেছে, ডাঃ কালীপদ মুখার্জী সে সংবাদ পেয়ে রায়পুর গেছেন।

আপনি তার কি জবাব দেন?

তাকে যত শীঘ্র সম্ভব কলকাতায় চলে আসবার জন্য লিখেছিলাম।

এই সময় ডাঃ সুধীন চৌধুরীর পক্ষের উকিল রায়বাহাদুর প্রশ্ন করলেন, হঠাৎ আপনি তাকে কলকাতায় আসতে লিখলেন কেন? যতদূর আমরা জানি ডাঃ মুখার্জী তো একজন বেশ নামকরা ডাক্তার।

আমি তা জানি।

তবে?

আপনারা হয়তো জানেন না, এবারে অসুস্থ হওয়ার কিছুদিন আগে একবার সুহাসের টিটেনাস হয়েছিল। সে-সময়ও ডাঃ মুখাজীই তাকে দেখেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো সুবিধা হয়নি, পরে সে সংবাদ পেয়ে আমিই তাকে কলকাতায় আনিয়ে ডাঃ সেনগুপ্তকে দিয়ে চিকিৎসা করবার ব্যবস্থা করেছিলাম।

আপনি কি তাহলে বলতে চান, ডাঃ মুখার্জীর মত প্রথিতযশা একজন ডাক্তার সামান্য টিটেনাস রোগটাও ধরতে পারেননি?

না, এমন কথা তো আমি বলিনি!

তবে?

বড় ডাক্তার যে সব সময়ই ঠিক ঠিক রোগ নির্ণয় করবেন তার কী মানে আছে, ভুলও তত হতে পারে! খুব অস্বাভাবিক তো নয়!

শুধু কি এটাই একমাত্র কারণ সুহাসবাবুকে কলকাতায় আসবার জন্য আপনার চিঠি লেখবার?

ডাঃ সুধীন চৌধুরী এবারে যেন বেশ একটু ইতস্ততই করতে থাকে।

জবাব দিন?

হ্যাঁ। তাছাড়া আর কিছু না হোক, কলকাতায় এলে প্রয়োজনমত আরও দু-চারজন বড় ডাক্তারকে কনসাল্ট তো করা যেতে পারে, তাই।

আচ্ছা, সুহাস মল্লিকের সঙ্গে কি আপনার নিয়মিত পত্রবিনিময় চলত ডাঃ চৌধুরী?

হ্যাঁ।

আপনার চিঠি পাওয়ার কতদিন পরে সুহাসবাবু কলকাতায় আসেন?

দিন পাঁচ-ছয় পরে বোধ হয়।

আপনার চিঠির জবাবে সুহাস মল্লিক আপনাকে কোনো পত্র দিয়েছিলেন?

না।

এমন সময় আবার ঘোষাল প্রশ্ন শুরু করলেন, আপনি জানতেন না সুহাস মল্লিকরা কবে এখানে আসছেন?

না।

আমি শুনেছি, যেদিন সুহাসবাবুরা কলকাতায় এসে পৌঁছন, সেই দিনই দ্বিপ্রহরের দিকে—আপনি ভবানীপুরে মল্লিক লজে সুহাসবাবুকে দেখতে যান, কথাটা কি ঠিক?

ঠিক।

আপনি থাকেন শ্যামবাজারে, আপনার বাড়িতে সে-সময় ফোনটা খারাপ ছিল, চিঠিও আপনি পাননি, তাছাড়া সংবাদ নিয়েছিকেউ আপনাকে সুহাসবাবুর আসবার সংবাদও দেননি, তবে কি করে আপনি জানলেন যে ঐদিনই সকালের ট্রেনে সুহাস কলকাতায় এসেছেন? সন্তোষ ঘোষাল প্রশ্ন করলেন।

যে ভাবেই হোক আমি সুহাসদের কলকাতায় পৌঁছবার বণ্টাখানেকের মধ্যেই খবরটা জানতে পারি।

ও, আপনার জবাব শুনে মনে হচ্ছে এখুনি যদি আমরা প্রশ্ন করি যে কি ভাবে সংবাদটা আপনি জানলেন, আগের মতই হয়তো বলে বসবেন, আমি জবাব দিতে প্রস্তুত নই, কেমন কিনা? Am I right?

ডাঃ সুধীন চৌধুরী সে প্রশ্নের কোনো জবাব দেয় না–চুপ করে থাকে। এবারে রায়বাহাদুর বলতে শুরু করেন, মিঃ লর্ড, যদি আমার মাননীয় বন্ধু মিঃ ঘোষারের প্রশ্ন শেষ হয়ে থাকে, তাহলে আমি ডাঃ চৌধুরীকে কতকগুলো প্রশ্ন করতে চাই।

জাস্টিস্ মৈত্র : প্রসিড!

ডাঃ চৌধুরী, রায়বাহাদুর হালদার প্রশ্ন শুরু করলেন, মামলা শুরু হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত আমার মাননীয় বন্ধু মিঃ ঘোষালের কতকগুলো গুরুতর প্রশ্নের জবাবে আপনি ইচ্ছাকৃত মৌনবৃত্তি অবলম্বন করেছেন। প্রশ্নগুলো—১নং, আপনার ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স দশ হাজার টাকা কোথা থেকে এল অর্থাৎ ঐ দশ হাজার টাকা আপনি কি ভাবে উপায় করেছেন, তার কোনো সদুত্তর দিতে আপনার অনিচ্ছা প্রকাশ : ২নং, আপনার একমাত্র ডাক্তারী প্র্যাকটিস্ ছাড়া আরও যে অর্থাগমের পথ ছিল সেকথা দ্বিতীয় দিন স্বীকার করবার পর আপনি বলেন কোনো একটা বিশেষ কারণেই নাকি কথাটা আগের দিন আপনি গোপন করেছিলেন; দ্বিতীয় দিন সব কথা স্বীকার করবার পর আবার বলেন, যদিও আপনাকে কথা অস্বীকার করতে হয়েছিল, পরে আর তার গোপন করবার নাকি কোনো প্রয়োজন ছিল না। অথচ কারণ যে কি তা আপনি জানাতে রাজী নন। ৩নং, শেষবার অসুস্থ অবস্থায় সুহাস মল্লিকের কলকাতায়। আসবার সংবাদ আপনি যে কি করে, কোন্ সূত্রে পেয়েছেন, তাও আপনি প্রকাশ করতে রাজী নন। একটা কথা নিশ্চয়ই আপনি ভুলে যাচ্ছেন না যে, অত্যন্ত রহস্যময় অথচ নিষ্ঠুর এক হত্যা-মামলার সঙ্গে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হোক, আপনি সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েছেন। অনুসন্ধানের ফলে যতটুকু জানা যায় তাতে অকুস্থানে আপনিও ছিলেন। এক্ষেত্রে আপনার সপক্ষে কিংবা বিপক্ষে অনেক প্রকার প্রশ্নই উঠতে পারে। কিন্তু বিশেষ বিশেষ প্রশ্নের যদি আপনি খেয়ালখুশিমত জবাব দেন, তাহলে স্বভাবতই আইন আপনাকে দোষী বলে মেনে নিতে বাধ্য হবে।

যে প্রশ্নের জবাব আমি দিইনি, সেগুলোর জবাব দেওয়া সত্যিই আমার পক্ষে সম্ভব নয় মিঃ হালদার। তাছাড়া আমার ধারণামত আপনাদের ঐ প্রশ্নগুলোর বর্তমানের এই মামলার সঙ্গে কোনো সংস্পর্শ আছে বলেই আমি মনে করি না। প্রশ্নগুলো সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার বলেই মনে করি।

.

সেই দিন রাত্রে আবার কিরীটী ও সুব্রত মিলিত হয়ে মামলাটা সম্পর্কে আলোচনা করছিল।

কিরীটীর হাতে একখানা নোটবুক। পর পর কতকগুলো পয়েন্ট কিরীটী সেই নোটবুকের মধ্যে লিখেছে। সেই পয়েন্টগুলো নিয়েই দুজনে পরস্পরের মধ্যে আলোচনা করছিল।

১নং : ৩১শে মে ডাঃ সুধীন চৌধুরী যখন সুহাসকে ট্রেনে তুলে দিতে যায়, তার হাতে একটা মরক্কো-বাঁধাই ছোট কেস ছিল, এবং যার অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রথম দিন সে অস্বীকার করে। কিন্তু পরে জেরার মুখে আবার স্বীকার করে নেয়।

২নং : ডাঃ জগবন্ধু মিত্রের সুধীনের সঙ্গে কোনো পরিচয় ছিল সে কথাটা অস্বীকার করা।

৩নং: সুধীনের ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স দশ হাজার টাকার কোনো সন্তোষজনক কৈফিয়ত পাওয়া যায়নি।

৪নং : ডাঃ সুধীন চৌধুরী ও সুহাস মল্লিকের সঙ্গে পরস্পর পত্র-বিনিময় চলত।

৫নং : কি করে সুধীন শেষবার অসুস্থ অবস্থায় যেদিন সুহাস কলকাতায় চিকিৎসার জন্য আসে ঐদিনই তার আসবার সংবাদ পায়।

৬নং : ঐ ধরনের কতকগুলো প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দেওয়ায় সুধীনের ইচ্ছাকৃত অস্বীকার।

৭নং : নৃসিংহগ্রাম মহালে শ্রীকণ্ঠ মল্লিক মহাশয়ের অদৃশ্য আততায়ীর হাতে নিষ্ঠুর হত্যা। ৮নং : ঐ একই জায়গায় সুধীনের পিতার হত্যা।

৯নং : নায়েবজীর মৃত্যুশয্যায় কোনো একটি উইল সম্পর্কে তার পুত্রবধূ কাত্যায়নী দেবীকে ইঙ্গিত।

১০নং : রায়বাহাদুর রসময় মল্লিক, শ্ৰীকণ্ঠ মল্লিকের দত্তকপুত্র।

১১নং : কাত্যায়নী দেবীর পুত্রবধূ সুধীনের মা সুহাসিনী দেবীর মুখে শোনা রায়পুরের পুরাতন কাহিনী।

১২নং : ৩১শেমে শিয়ালদহস্টেশনেছাতাধারী একটি কালোলোকের আকস্মিক আবিভাব।

১৩নং : কালোলোকটির সেই ছাতাটি।

১.০৮ আরও সূত্র

সুব্রত সে দিনও জাস্টিস মৈত্রের বাড়িতে মামলার প্রসিডিংস পড়ছিল।

রায়বাহাদুর অনিমেষ হালদার ডাঃ মুখার্জীকে প্রশ্ন করছিলেন, ডাঃ মুখার্জী, আপনি তাহলে আগাগোড়া কোনো সময়েই সন্দেহ করেননি যে, সুহাস মল্লিকের প্লেগ হতে পারে?

না।

ডাঃ সেনগুপ্ত যখন সে বিষয়ে আপনাকে ইঙ্গিত করেন, তখনও নয়?

না।

কিন্তু কর্ণেল স্মিথের রিপোর্টে প্রমাণিত হয়েছে, সুহাস মল্লিকের প্লেগই হয়েছিল, এ কথাটা নিশ্চয়ই এখন আপনি অস্বীকার করছেন না?

স্বীকারও করছি না।

তার মানে?

তার মানে, যে ব্লাড-কালচারের রিপোর্টের ওপরে ভিত্তি করে কর্ণেল স্মিথ রিপোর্ট দিয়েছেন, সেটা যে মৃত সুহাসমল্লিকেরইব্লাড-কালচার রিপোর্ট, সেটা প্রমাণিত হত যদি তখনই মৃতদেহের ময়না তদন্ত করা হত! ব্যাপারটা যে আগাগোড়াই সাজানো নয় বা কোনো ভুলভ্রান্তি হয়নি, তারও তো কোনো প্রমাণ নেই।

না, তা নেই বটে, কিন্তু কর্ণেল স্মিথ এর উত্তরে কি বলেন?

এবারে অ্যাডভোকেট হালদার কর্ণেল স্মিথকে প্রশ্ন করছেন।

আমি oath নিয়ে বলতে পারি, যে ব্লাড-কালচার রিপোর্ট আমরা দিয়েছি সেটা মৃত মিঃ সুহাস মল্লিকেরই রক্তের কালচার রিপোর্ট। সে প্রমাণও আমরা দিতে পারি। কর্ণেল স্মিথ জবাব দেন।

মিঃ লর্ড, আমি একটা প্রশ্ন কর্ণেল স্মিথকে করতে পারি কি? ডাঃ মুখার্জী বললেন।

ইয়েস, করুন।

কর্ণেল স্মিথ, একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি-বললেন ডাঃ মুখার্জী, যদি সত্যিই সুহাস মল্লিকের শরীরের রক্ত কালচার করে প্লেগই প্রমাণিত হয়ে থাকে ধরে নেওয়া যায়, তবে প্লেগের বীজাণু কি করে এবং কোথা থেকে সুহাসের শরীরে এল, এর জবাব আপনি দিতে পারেন কি?

কি করে এল এবং আসতে পারে কিনা, সেটা আমার বিবেচ্য নয়। আদালতই সেটা দেখবেন।

মিঃ হালদার : এমন কি হতে পারে না কর্ণেল স্মিথ যে, প্লেগ বীজাণু সুহাসের শরীরে inject করা হয়েছিল?

কর্ণেল স্মিথ : আমার মনে হয় সুহাসের শরীরে প্লেগ জার্ম ইনজেকশন করাই হয়ত হয়েছিল, সেটাই স্বাভাবিক এক্ষেত্রে।

ডাঃ মুখার্জী: ব্যাপারটা অনেকটা একটা রূপকথার মত শোনাচ্ছে না কি? আজ প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ বৎসরের মধ্যে বাংলাদেশের কোথাও কোনো প্লেগ কেস হয়েছে বলে শোনা যায়নি, এক্ষেত্রে প্লেগ জার্ম সংগ্রহ করে কারও শরীরে সেটা ইনজেকশন করা, ব্যাপারটা শুধু অসম্ভবই নয়, হাস্যকর নয় কি?

কর্ণেল স্মিথ : আমার সহকর্মী মাননীয় ডাঃ মুখার্জী বলবেন কি তাঁর সহকারী রিসার্চ স্টুডেন্ট ডাঃ অমর ঘোষ হঠাৎ এক মাসের ছুটি নিয়ে বম্বেতে গিয়েছিলেন কিনা এবং কেনই বা গিয়েছিলেন?

হ্যাঁ, গিয়েছিলেন।

তিনি কি কারণে বম্বেতে গিয়েছিলেন?

তা আমি কি করে বলব? তিনি ছুটি নিয়ে কোথায় যান না যান, সেটা দেখবার আমার কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।

আচ্ছা এ কথা কি সত্যি যে বম্বে রিসার্চ ইন্সটিটিউটে ডাঃ অমর ঘোষ ডাঃ মুখার্জীরই একটি পরিচয়পত্র নিয়ে কাজ করতে গিয়েছিলেন কর্ণেল কৃষ্ণমেননের কাছে?

কোথায় কথাটা শুনলেন জানি না এবং ডাঃ ঘোষকে আমি কোনো পরিচয়পত্র দিইনি।

কর্ণেল কৃষ্ণমেনন, ডাইরেক্টর অফ বম্বে প্লেগ ইনস্টিটিউট আপনার পরিচিত বন্ধু, কথাটা কি সত্যি?

হ্যাঁ।

এর পর সাক্ষী দেওয়ার জন্য ডাঃ অমর ঘোষ ও কর্ণেল কৃষ্ণমেননের ডাক পড়ে আদালতে।

প্রথমে ডাঃ ঘোষকে প্রশ্ন করা হয়।

রায়বাহাদুর অনিমেষ হলদার জেরা করেন, ডাঃ ঘোষ, আপনি ডাঃ মুখার্জীর অধীনে ট্রপিক্যাল ইন্সটিউটে রিসার্চ করেন?

হ্যাঁ।

কত দিন আগে?

আজ প্রায় দু বৎসর হবে।

আপনি গত ডিসেম্বরের প্রথম দিকে বম্বেতে গিয়েছিলেন?

হ্যাঁ।

বম্বেতে আপনি প্লেগ রিসার্চ ইনস্টিটিউটে কাজ করবার জন্য ডাঃ মুখার্জীর কোনো পরিচয়পত্র নিয়ে গিয়েছিলেন?

না।

তা যদি না হয়, তাহলে কি করে আপনি বম্বে প্লেগ রিসার্চ ইনস্টিটিউটে প্রবেশঅধিকার পেলেন? আমরা যতদূর জানি, একমাত্র গভর্ণমেন্টের স্পেশাল পারমিশন ব্যাতিরেকে কারও সেখানে প্রবেশ নিষেধ।

কর্ণেল কৃষ্ণমেননের সঙ্গে দেখা করে আমি তাঁর অনুমতি চেয়ে নিয়েছিলাম দিনকয়েকের জন্য।

কত দিন কাজ করেছিলেন?

দিন কুড়ি মত হবে।

কর্ণেল কৃষ্ণমেননের সঙ্গে এই ঘটনার পূর্বে আপনার কোনো পরিচয় ছিল কি?

হ্যাঁ, গত বছরের ডিসেম্বর মাসে মেডিক্যাল কনফারেন্সে কর্ণেল কৃষ্ণমেনন কলকাতায় এসেছিলেন, সেই সময় তাঁর সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হবার সৌভাগ্য হয়েছিল।

এ কথা কি ঠিক কর্ণেল কৃষ্ণমেনন?

হ্যাঁ। কৃষ্ণমেনন জবাব দেন।

আপনি ঠিক বলছেন, আপনার কাছে ডাঃ ঘোষ কোনো লেটার অফ ইনট্রোডাকশান পেশ করেননি?

না।

ডাঃ ঘোষ, ৩১শে মে শিয়ালদহ স্টেশনে সুহাস মল্লিক অসুস্থ হবার দিন সাতেক আগে হঠাৎ আপনি বম্বে হতে কলকাতায় ফিরে আসেন—এ কথা কি সত্য?

হ্যাঁ।

হঠাৎ কুড়িদিন কাজ করেই আবার আপনি ফিরে এলেন যে?

আমার ছুটি ফুরিয়ে গিয়েছিল।

কলকাতায় ফেরবার পর আপনাকে প্রায়ই ঘন ঘন দুপুরের দিকে ডাঃ মুখার্জীর কলকাতার বাসভবনে যাতায়াত করতে দেখা যেত কয়েকদিন যাবৎ, এ কথা কি সত্যি?

হ্যাঁ, আমি প্রায়ই তাঁর কাছে যেতাম, আমি একটা থিসিস সাবমিট করব, সেই সম্পর্কেই আলোচনা করবার জন্য ডাঃ মুখার্জীর ওখানে আমার যাওয়ার প্রয়োজন হত।

সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল, সুব্রত সেদিনকার মত উঠে পড়ল। সারাটা দিন আদালতের কাগজপত্র ঘেঁটে মাথাটা যেন কেমন টিপ টিপ করছে।

***

সেই দিন সন্ধ্যায় আবার কিরীটী বলছিল, দেখা যাচ্ছে সমগ্র হত্যাকাণ্ডটাই আগাগোড়া একটা চমৎকার পূর্বপরিকল্পিত ব্যাপার। কিন্তু আসামী ডাঃ সুধীন চৌধুরী যেন একটা পরিপূর্ণ মিস্ট্রি, তাঁর প্রত্যেকটি statement থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, কাউকে তিনি যেন সযত্নে shield করবার চেষ্টা করছেন আগাগোড়া।

তোর তাই মনে হয়! সুব্রত প্রশ্ন করে।

তাই।

কিন্তু আজ পর্যন্ত প্রসিডিংস থেকে যতদুর জানা গেছে, তাতে করে ডাঃ সুধীন চৌধুরীকে বাঁচাতে পারে এমন কেউই নেই। ভদ্রলোক একেবারে গলা-জলে।

আমাদের এখন তাকে সেই গলা-জল থেকে টেনে তোলবার চেষ্টা করতে হবে।

এখন কি তুই মনে করিস কিরীটী, ডাঃ সুধীন চৌধুরীকে বাঁচাতে পারবি?

চেষ্টা করতে দোষ কি! হয়তো গলা-জলের মধ্যেও একটা ভাসমান কাষ্ঠখণ্ড দেখা দেবে! কিন্তু সে কথা যাক, আপাতত আমাকে কাগজপত্র ছেড়ে কিছুদিন ঘোরাফেরা করতে হবে।

 ১.০৯ হারাধন ও জগন্নাথ

সুব্রত বিস্মিতভাবে কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।

হ্যাঁ শোন, কালই তোকে রায়পুর যেতে হবে একবার।

রায়পুর!

হ্যাঁ।

শুনেছি সেখানকার আবহাওয়াও খুব ভাল, সেখানে গিয়ে দুটো কাজ তোকে করতে হবে। প্রথমত রায়পুরের রাজবাড়ীর ওপর তোকে সর্বদা তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে। রাজা সুবিনয় মল্লিক মহাশয় এখন সুস্থ শরীরে বহাল তবিয়তে রাজধানীতে বিরাজ করছেন। তাঁর সঙ্গে যেমন করেইহোকতোকে ঘনিষ্ঠ হতে হবে,—এইহচ্ছেতোর প্রথম কাজ। দ্বিতীয়ত—আমাদের সদর নায়েবজী বা স্টেটের ম্যানেজার বা মল্লিক মশাইয়ের প্রাইভেট সেক্রেটারী সতীনাথ লাহিড়ীর সঙ্গে ও তাদের পারিবারিক চিকিৎসক ডাঃ অমিয় সোমের সঙ্গে আলাপ করতে হবে। রহস্যের মূল জানবি ঐখানেই লুকিয়ে আছে। হত্যার বীজ ওখানেই প্রথম রোপিত হয়েছিল বলেই আমার স্থির বিশ্বাস।

কিন্তু এতগুলো অঘটন কি করে যে নির্বিবাদে সংঘটিত হতে পারে সেটাই আমি ভাবছি কিরীটী! সুব্রত হাসতে হাসতে বলে।

অত না ভাবলেও চলবে। এই দেখ আজকের দৈনিক ভারত জ্যোতি কাগজখানা; দিন পাঁচেক থেকে এই কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দিচ্ছেযে রায়পুর স্টেটের জন্য একজন সুপারভাইজার চান রাজাবাহাদুর।

সুব্রত তখুনি আগাগোড়া বিজ্ঞাপনটা পড়ে ফেললে। কিন্তু জমিদারী কাজে সুদক্ষ, অভিজ্ঞ, বিশিষ্ট লোকের পরিচয়পত্র—এই যে তিনটি প্রচণ্ড বোমা এর মধ্যে লুকিয়ে আছে এগুলো কোথায় মিলবে শুনি?

ডাঃ সান্যালকে দিয়ে ডাঃ কালীপদ মুখার্জীর কাছ থেকে গতকালই তোর অর্থাৎ শ্রীযুক্ত কল্যাণ রায়, এম. এ. বি. এল.-এর নামে একখানা পরিচয়পত্র আনিয়ে রাখা হয়েছে। আগামী কালের জন্য ট্রেন সিটও রিজার্ভ হয়ে গেছে। এখন শুধু কল্যাণবাবুর গমনের প্রত্যাশাটুকু!

মানে, তুই সব আগে থেকেই রেডি করে রেখেছিস বল?

হ্যাঁ।

But this is foregery–

নান্যঃ পন্থা!

***

ভোরবেলা, সবে পূর্বাকাশে ঊষার রক্তিম রাগ দেখা দিয়েছে, সুব্রত রায়পুর স্টেশনে এসে গাড়ি থেকে নামল। রায়পুর স্টেশনটি বেশ মাঝারি গোছের; গাড়ি থেকে যাত্রীও নেহাৎ কম নামেনি।

স্টেশন মাস্টারটি বাঙালী—প্রাণধন মিত্র। বয়সে পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে। সমস্ত মাথাটি জুড়ে সুবিস্তীর্ণ চকে মসৃণ একখানি টাক। স্থানীয় ছেলেছোকরারা আড়ালে টেকো মিত্তির বলে ডাকে শোনা যায়। নধর হৃষ্টপুষ্ট গোলগাল চেহারা।

রায়পুরে রা বাবুদেরই এক দূরসম্পর্কীয় জ্ঞাতিভাই হারাধন মল্লিক, স্থানীয় আদালতে মোক্তারী করতেন এককালে। সুধীন চৌধুরীর মাতুল নীরোদ রায় কিরীটীকে বলে দিয়েছেন, সুব্রত যেন সেইখানেই গিয়ে ওঠে। তাকে তিনি কল্যাণ সম্পর্কে চিঠিও লিখে দিয়েছেন।

রায়পুর বেশ বর্ধিষ্ণু জায়গা।

রায়পুরের আশেপাশে ঘন শালের বন। ঐ শালবন হতেই রাজস্টেটের বেশীর ভাগ অর্থাগম হয় আগেই বলা হয়েছে।

একটা নদীও আছে। নদীর ধারে বাঁধানো প্রকাণ্ড বাঁধ আছে। সন্ধ্যায় এখানে প্রচুর লোক-সমাগম হয়।

এখানকার স্বাস্থ্য নাকি খুবই ভাল।

স্টেশন থেকে বরাবর রাজাদের তৈরী পাকা সড়কশহর বাজার প্রভৃতির মধ্য দিয়ে রাজবাড়িতে গিয়ে শেষ হয়েছে। রাজবাড়ি দুটো, একটা পুরাতন, অন্য একটা নূতন, শেষোক্তটি রায়বাহাদুর রসময় মল্লিকের আমলে তৈরী আধুনিক কেতায় সুসজ্জিত।

বর্তমানে রাজবাড়ির লোকেরা নতুন প্রাসাদেই থাকেন। পুরাতন বাড়িটায় অফিস, কাছারী, হাসপাতাল ইত্যাদি।

রায়পুরে একটি উচ্চ ইংরাজী বিদ্যালয়, বাজার, থানা ও আদালত আছে। শহরের একাধারে মোক্তার হারাধন মল্লিকের বাড়ি।

হারাধনের বাড়ি খুঁজে নিতে সুব্রতকে তেমন বিশেষ কিছু বেগ পেতে হয়নি। হারাধন বাইরের ঘরে ফরাসের ওপর বসে, তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে গুডগুড়িতে তামাক টানছিলেন। বয়স প্রায় ষাটের কাছাকাছি হবে। রোগা ঢ্যাঙা চেহারা।

বাইরেটা যদিও হরাধনের রুক্ষ, মনটা তাঁর সত্যিই কোমল ও স্নেহশীল। সুব্রতকে দরজার সামনে গাড়ি থেকে নামতে দেখে উঁচু গলায় প্রশ্ন করলেন, কে?

সুব্রত ঘরে ঢুকে নমস্কার করে পকেট থেকে নীরোদ রায়ের চিঠিখানা বের করে দিল। বসুন, আপনার নাম কল্যাণ রায়? সুব্রত চৌকির একপাশে উপবেশন করলে। তাকিয়ার পাশ হতে চশমাটা নিয়ে নাকের ওপরে বসিয়ে হারাধন চিঠিটা পড়ে ফেলল।

নীরোদবাবুর কাছ হতে আসছেন! জগু? ওরে হতচ্ছাড়া জগন্নাথ! হারাধন চিৎকার করে ডাকলেন, বলিওহেনবাবেরবেটা নবাব, খাঞ্জাখাঁ, ওহে রায়পুরের জমাদার জগা-শুনতে পাচ্ছিস?

রোগা লিলিকে আবলুস কাঠের মত কালে গায়ের রং, একমাথা ঝাঁকড়া চুল, ধবধবে একখানি ধুতি পরিধানে, গায়ে একটা নেটের গেঞ্জি, কুড়ি-বাইশ বৎসরের একটি যুবক ঘরে এসে প্রবেশ করল, চিৎকার করছেন কেন?

কি বলিস বেটা ঘোটলোক, নেমকহারাম? আমি চিৎকার করছি?

কি চাই, বলুন না?

রায়পুরের জমাদারের কোথায় থাকা হয়েছিল শুনি? কানে কি প্লাগ এঁটে থাকিস? শুনতে পাস না?

শুনতে সকলেই পায়, সকলেই কি আপনার মত কালা?

কি বললি শালা, আমি কালা? তবে মোক্তারী করে কে রে বেটা?

মোক্তারী! ফু! অমন মোক্তারী না করলেই বা কি?

দেখ জগা, ফের তুই আমার মোক্তারীকে হতচ্ছেদা করবি তো তোর সঙ্গে আমার খুনোখুনি হয়ে যাবে। এই যে বাড়ি ঘরদোর, এসব কোথা থেকে এল শুনি? এসব এই মোক্তারীর পয়সাতেই, তোর বাবার ব্যারেস্টারীর পয়সা নয়, বুঝলি?

জগন্নাথ এতক্ষণ সুব্রতকে লক্ষ্য করেনি। হঠাৎ চোখ ফেরাতে সুব্রতর দিকে দৃষ্টি পড়ায় সে বেশ লজ্জিত হয়ে ওঠে, আঃ দাদু!

দাদু! যা বেটা, গরু মেরে জুতো দান! যা বেররা, তোর মুখদর্শনও আমি করব না। Get out!

তা যাচ্ছি, কিন্তু এই ভদ্রলোক—

দেখলেন, মশাই, দেখলেন! কত বড় ঘোটলোক, কি রকম মুখে মুখে তটা করলে! শুনেছেন কখনও, দেখেছেন কখনও? দাদুমানে সাক্ষাৎ বাপের বাপ, তার মুখে মুখে এমনি করে কোনো নাতি জবাব দেয়? শত্রু মশাই, সব শত্রু!

দাদু, চা খেয়েছ?

ছোটলোক নাতির সঙ্গে আমি কথা বলি না। এখন দয়া করে ঐ ভদ্রলোকের থাকার একটা ব্যবস্থা করে দাও, চা-টার একটুব্যবস্থা করে দাও। নীরোদবাবুঅর্থাৎতোর পিসেমশাইয়ের বন্ধু। কল্যাণবাবু, এইটি আমার নাতি, জগন্নাথ মল্লিক। অকালকুষ্মাণ্ড, এম. এ. পরীক্ষা দেবে না বলে বাড়িতে এসে বসে আছে। অর্থাৎ আমার অন্ন ধ্বংস করছে। আর লোকের কাছে বলে বেড়াচ্ছে, আমার মাথা খারাপ তাই সেবা করতে এসেছে। এমন কুলাঙ্গার ঘরের শত্রু বিভীষণ দেখেছেন কোথাও?

সুব্রত এতক্ষণ সত্যিই একটু অবাক হয়ে দাদু ও নাতির কলহ শুনছিল, প্রথমে সে একটু আশ্চর্যই হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু এতক্ষণে সে বৃদ্ধের অনেকটা পরিচয় পেলে তার শেষের কটি কথায়। সে হেসে ফেললে।

হারাধনের সংসারে লোকজনের মধ্যে হারাধন ও তার পিতৃমাতৃহীন নাতি জগন্নাথ, ভৃত্য শম্ভুচরণ ও রাঁধুনীবামুন কেষ্ট। বাড়িতে স্ত্রীলোকের কোনো নামগন্ধও নেই। পাড়ার লোকেরা বলে, তার একটিমাত্র কৃতবিদ্য পুত্রের শোকে ও স্ত্রীর অকালমৃত্যুতে হারাধনের মাথার নাকি গোলমাল হয়ে গেছে।

প্রথম জীবনে হারাধন মোক্তারী করে প্রচুর পয়সা উপার্জন করেছিলেন। আশেপাশের দশ-বিশটা শহরে তাঁর নামডাকও ছিল।

সে অনেকদিন আগের কথা। তারপর হারাধনের একমাত্র পুত্র চিন্ময়, জগন্নাথের পিতা, বরাবর বৃত্তি নিয়ে এম. এ. পাস করে বিলেত হতে ব্যারিস্টার হয়ে ফিরে এসে কলকাতা হাইকোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করেন।

চার বৎসর মাত্র প্র্যাকটিস করেছিলেন, কিন্তু তার মধ্যেই যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছিলেন, প্রচুর অর্থাগম হচ্ছিল।

এমন সময় হঠাৎ দুবৎসরের ছেলে জগন্নাথকে রেখে চিন্ময়ের স্ত্রী তিনতলার ছাদ থেকে রেলিং ভেঙে পড়ে মৃত্যুমুখে পতিত হন। চিন্ময় সে শোক সহ্য করতে পারলেন না। শ্মশান থেকে ফিরে সেই যে চিন্ময় এসে জ্বরতপ্ত গায়ে শয্যা নিলেন, সেই তাঁর শেষ শয্যা—এগার দিনের দিন তিনিও মারা গেলেন।

দুবৎসরের শিশু জগন্নাথকে বুকে করে হারাধন রায়পুরে ফিরে এলেন কলকাতা থেকে। এই ঘটনার মাস গরেক বাদে চিন্ময়ের মা-ও মারা গেলেন। ছোট্ট শিশু জগন্নাথের সমস্ত ভার এসেহারাধনেরমাথায় পড়ল। বুকে-পিঠেকরেহারাধন জগন্নাথকে মানুষ করতে লাগলেন।

যত বয়স বাড়ছিল হারাধনের স্বভাবটাও খিটখিটে হয়ে যাচ্ছিল।

জগন্নাথও অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র, কিন্তু অত্যন্ত খেয়ালী প্রকৃতির। এম. এ. পড়তে পড়তে দাদুর অসুখের সংবাদ পেয়ে সেই যে মাস পাঁচেক আগে সে বাড়িতে এসেছে, আর কলকাতায় ফিরে যায়নি।

সে এবারে বাড়িতে পা দিয়েই বুঝেছিল, দাদুর মাথার গোলমালটা একটু বেশী বেড়েছে। সর্বদা তাঁকে চোখে চোখে রাখা একান্ত প্রয়োজন।

.

চা পান করতে করতে জগন্নাথ সুব্রতর সঙ্গে কথাবার্তা বলছিল।

সুব্রতর জগন্নাথকে প্রথম পরিচয়ের মুহূর্তেই ভাল লেগেছে।

স্বল্পভাষী তীবুদ্ধি ছেলেটির একটি অদ্ভুত আকর্ষণী শক্তি আছে।

জগন্নাথ বলছিল, দাদুর কথায় আপনি নিশ্চয়ই কিছু মনে করেননি কল্যাণবাবু?

না না–সে কি!

দাদু আমার দেবতার মত লোক, আমার মা বাবা ও দিদার মৃত্যুর পর হতেই অমনি মাথাটা ওর গোলমাল হয়ে গেছে।

সুব্রত তার আসল উদ্দেশ্য গোপন রেখে জগন্নাথকে জানিয়েছিল, চাকরির উমেদারি নিয়ে সে রায়পুরে এসেছে। আবার কলকাতায় ফিরে যাবে।

পরের দিন সকালে ডাঃ মুখার্জীর সুপারিশপত্রটি নিয়ে জগন্নাথের নির্দেশমত সুব্রত রাজবাড়িতে গিয়ে হাজির হল।

রাজাবাহাদুর সুবিনয় মল্লিক, রায়পুর স্টেটের একচ্ছত্র অধীশ্বর, তখন তাঁর খাস কামরাতেই ছিলেন। ভৃত্যের হাত দিয়ে সুব্রত সুপারিশপত্রটি রাজাবাহাদুরের কাছে পাঠিয়ে দিল। আধঘণ্টা বাদেই সুব্রতর ডাক পড়ল খাস কামরায়।

সুব্রত ভৃত্যের পিছু পিছু রাজাবাহাদুরের খাস করায় এসে প্রবেশ করল।

প্রকাণ্ড একখানি হলঘর-বহু মূল্যবানআধুনিক আসবাবপত্রে সুসজ্জিত।

একটি সুদৃশ্য দামী আরামকেদারায় শুয়ে রাজাবাহাদুর আগের দিনের ইংরাজী সংবাদপত্রটি পড়ছিলেন।

লোকটির বয়স চল্লিশের ঊর্ধ্বে। কিন্তু অত্যন্ত স্বাস্থ্যবান বলিষ্ঠ চেহারা, কাঁচা হলুদের মত গায়ের রং। দামী মিহি ঢাকাই ধুতি পরিধানে, গায়ে পাতলা সিল্কের গেঞ্জি। চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা।

সুব্রত কক্ষে প্রবেশ করে নমস্কার জানাল।

বসুন, আপনারই নাম কল্যাণ রায়?

আজ্ঞে।

আপনি ডাঃ মুখার্জীর পরিচয়পত্র এনেছেন, আপনাকে আমি কাজে বহাল করছি। আপাতত পাঁচশত টাকা করে পাবেন, কিন্তু you look so young–বলতে বলতে পাশের শ্বেতপাথরের টিপয়ের ওপরে রক্ষিত কলিংবেলটা বাজালেন।

ভৃত্য এসে ঘরে প্রবেশ করতে বললেন, এই, সতীনাথবাবুকে ডেকে দে।

একটু পরেই সতীনাথবাবু এসে ঘরে প্রবেশ করলেন। সতীনাথের বয়স ত্রিশের বেশী নয়। ঢ্যাঙা, লম্বা চেহারা, মুখটা ছুঁচালো। মাথায় কোঁকড়া ঘন চুল, ব্যাকব্রাস করা। সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য তাঁর চক্ষু দুটি। দৃষ্টি যেন অন্তর পর্যন্ত ভেদ করে যায়। দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো।

সতীনাথ, এঁর নাম কল্যাণ রায়। ডাক্তার মুখার্জী এঁকে পাঠিয়েছেন, একেই আমি স্টেটের সুপারভাইজার নিযুক্ত করলাম। স্কুল-বাড়ির পাশে যে ছোট একতলা বাড়িটা আছে, সেখানেই এঁর ব্যবস্থা করে দিও। হ্যাঁ ভাল কথা, আপনি বিবাহিত কি?

আজ্ঞে না।

বেশ, তাহলে আপনি আজ আসুন, কাল সকালের দিকে আসবেন কাজের কথাবার্তা হবে। আপনি উঠেছেন কোথায়?

কোথাও না। স্টেশনে আমার মালপত্র রেখে এসেছি।

তবে আর দেরি করবেন না, জিনিসপত্র নিয়ে আসুন।

বেশ।

সতীনাথ, দুজন লোক দিয়ে দাও ওঁর সঙ্গে।

না, তার কোনো প্রয়োজন নেই। সামান্য মালপত্র, আমি নিজেই নিয়ে আসতে পারব। বেশ।

সুব্রত ইচ্ছে করেই হারাধনের ওখানে ওঠকম ব্যাপারটা গোপন করে গেল। সে রাজাবাহাদুরকে নমস্কার জানিয়ে সতীনাথবাবুর সঙ্গে ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে এল।

১.১০ অদৃশ্য ছায়া

পরের দিন রাত্রে সুব্রত কিরীটীকে চিঠি লিখছিল :-

কিরীটী,

চাকরি এক চিঠিতেই মিলে গেছে। পুরাতন রাজবাড়ির কাছেই থাকবার জন্য কোয়ার্টার মিলেছে। কাজের কথা বিশেষ এখনও কিছু হয়নি। তবে সামান্য আলাপে অনুমানে যা বুঝেছি, বর্তমানে স্টেটের মধ্যে পুকুরচুরি হচ্ছে, তারই উপর আমায় গোয়েন্দাগিরি করতে হবে, রাজাবাহাদুরের পক্ষ হতে। অত্যন্ত সন্দিগ্ধমনা লোক এই রাজাবাহাদুর।

ডাঃ অমিয় সোমের সঙ্গে সামান্য মৌখিক আলাপ হয়েছে। মনে হল সাধারণ নয়। গভীর জলের মাছ।

তারপর আমাদের সতীনাথ লাহিড়ী মশাই, তাঁর পরিচয় দিতে সময় লাগবে। তাঁর চোখের দৃষ্টিটা বড় সাংঘাতিক বলে মনে হয়। এবং মনে হয় একটি আসল শিয়াল চরিত্রের মানুষ! ঈশপের গল্পের সেই শিয়াল ও বোকা কাকের গল্প মনে আছে? তারপর রায়পুর জায়গাটা, এর কিন্তু আমার মতে রায়পুর নাম না দিয়ে শালবনী নাম দেওয়াই উচিত ছিল।

শালবনের ওপারে আছে একটি ঘন জঙ্গল। শোনা যায় বন্যরা ও ব্যাঘ্রের উৎপাতও মাঝে মাঝে হয় সেখানে, তবে ভাল শিকারী নেই এই যা দুঃখ। একটা যদি দোনলা বন্দুক পাঠাস, শিকার করে আনন্দ পেতাম। ওদিককার সংবাদ কি?

তোর কল্যাণ

***

দিন দুই বাদে সুব্রতর চিঠির জবাব এল।

সু–তোর দুটো চিঠিই পেলাম। দোনলা বন্দুক চাস পাঠাব। কিন্তু রাজবাড়ির মোহে হারাধনকে হেলা করিস না। He is a jewel—একেবারে খাঁটি হীরে। তার পর আমাদের পূজ্যপাদ লাহিড়ী মশাই। তোর দৃষ্টিশক্তির প্রশংসা করি। জানিস না বোধ হয়, ডাক্তারী শাস্ত্রে চক্ষুকে সজীব ক্যামেরার সঙ্গে তুলনা করে? রায়পুরের নামটা তো আমাদের হাতে নয়, আর আমাদের মোকররী স্বত্বও ওতে নেই, অগত্যা শালবনী নাম ছেড়ে রায়পুরই বলতে হবে। ভাল করে সন্ধান নে দেখি পুকুরচুরির সিঁধকাঠিটা কার হাতে ঘোরে? হ্যাঁ ভাল কথা, ওখানকার অধিবাসীদের মধ্যে, মানে রাজাবাহাদুরের প্রজাবৃন্দের মধ্যে, সাঁওতাল জাতটা আছে কি? অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সংবাদ এটা, পরপত্রে যেন পাই-তোর ক।

***

না, সুব্রত হারাধন ও জগন্নাথকে ভোলেনি। সন্ধ্যার দিকে প্রায়ই দু-তিন ঘণ্টা করে তাঁদের ওখানে গিয়ে কাটিয়ে আসে গল্পে গল্পে।

জগন্নাথ অত্যন্ত স্বল্পভাষী; কিন্তু এই সামান্য বয়সেই সে এত পড়াশুনা করেছে যে ভাবলেও তা অবাক হয়ে যেতে হয়। কথা সে খুবই কম বলে বটে, কিন্তু যে দু-চারটে কথা বলে, অন্তরে যেন দাগ কেটে বর্সে যায়। হারাধন কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির, মাথার গোলমাল হওয়ার পর থেকে কথাটা তিনি একটু বেশীই বলেন। বিশেষ করে তাঁর অভিযোগটা যেন পৃথিবীর যাবতীয় মানুষের প্রতি ও যে দেবতাটিকে চোখে কোনো দিনও কেউ দেখতে পায় না—তাঁর প্রতি। জগন্নাথ লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে এসে বসায়, মুখে তিনি সর্বদা জগন্নাথকে গালাগালি দিলেও,অন্তরে তিনি বিশেষ খুশীই হয়েছিলেন। ইদানীং অর্থের প্রাচুর্য না থাকলেও অভাব তেমন তাঁর ছিল না। তাছাড়া বছর পাঁচ মাত্র মাথার গোলমালটা একটু বেশী হওয়ায়, জগন্নাথ নিজেই টাকাকড়ির ব্যাপারটা দেখাশুনা করত।

সামান্য কয়েকদিনের পরিচয় হলেও, দাদু ও নাতির সুব্রতকে খুব ভালই লেগেছে।

সমস্ত দিনের কাজকর্মের পর সুব্রত নিয়মিত হারাধনের বাসায় এসে রাত্রি নটা-দশটা পর্যন্ত কাটিয়ে যেত। বাড়ির ভিতরে খোলা বারান্দায় চেয়ার পেতে তিনজনে বসে নানা গল্পগুজব হত। বেশীর ভাগ জগন্নাথ ও সুব্রতর সঙ্গেই কথাবার্তা চলত—মাঝে মাঝে হারধনও দুচারটে কথা বলতেন। সেদিন কথায় কথায় হারাধন বললেন, বুঝেছ কল্যাণ, তোমাদের ঐ লাহিড়ী মশাইটি একটি আসল ঘুঘু। বয়স ওর এখনও বত্রিশের কোঠা হয়তো পার হয়নি কিন্তু অমন ধড়িবাজ ছেলে আমি জীবনে খুবই কম দেখেছি। তোমাদের রাজাবাহাদুরের আসল মন্ত্রণাদাতা ঐ লাহিড়ীই। থাকেন ভিজে বিড়ালটির মত, কিন্তু ও পারে না এমন কোনো অসাধ্য কাজ আছে বলে আমি জানি না।

ভদ্রলোক তো শুনেছি আজ পাঁচ-সাত বৎসর মাত্র এখানে এঁদের স্টেটে কাজ করছেন এবং রাজাবাহাদুরের খুব বিশ্বাসীও।

হারাধন একটু থেমে বলতে থাকেন, জান কল্যাণ, আমাদের দেশে একটা প্রবাদ আছে, ছুঁচ হয়ে ঢুকে, ফাল হয়ে বের হওয়া। রায়পুরের রাজবাড়ির ও শনি! যেদিন হতে ও রায়পুরের প্রাসাদে প্রবেশ করেছে, সেদিন হতেই যেন প্রাসাদে শনির দৃষ্টি লেগেছে। রাজস্টেটে ও চাকুরি নিতে না নিতেই রসময় হঠাৎ হার্টফেল করে মারা গেল, তারপর গেল সুহাস। আহা সোনার চাঁদ ছেলে ছিল!

সুহাস মল্লিকের ব্যাপারটা নিয়ে তো মহা হৈ-চৈ হয়ে গেল।

কিন্তু তাতে কিই বা হল; গভীর জলের মাছ জাল ছিঁড়ে বের হয়ে গেল। মাঝখান হতে একটা নিরীহ একেবারে নিদোষী লোক জালে আটকা পড়ল।

কেন, একথা বলছেন কেন?

দেখ বাবাজী, আমিও এককালে মোক্তারী করেছি, দশজন মানতও। হয়ত তোমরা আমার নাতির মত বলবে, হুঁ মোক্তারী,… কিন্তু বাবাজী, আইনের মারপ্যাঁচগুলো ব্যারিস্টারেরও যা মোক্তারেরও তাই। তারা কটমট করে ইংরাজীতে বলবে, মি লর্ড, আমরা না হয় বলি ধর্মাবতার হুজুর বংলা ভাষায়। আরে বাবা, ঐ একটা বিচার হল নাকি! প্রহসন! একটা প্রহসন!

কিন্তু আইনের চোখে ডাঃ সুধীন চৌধুরীর দোষ তো প্রমাণ হয়েছে বলেই জজ সাহেব। রায় দিলেন যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের!

আসলে সত্যিকারের প্রমাণ যাকে বলে তা আর হল কোথায়? কেবলমাত্র সন্দেহের জোরে বেচারীকে শাস্তি দেওয়া হল, তাহলে বলতে চান?

তাছাড়া কি, কতকগুলো প্রশ্নের সওয়ালই নিল না; শেষ পর্যন্ত মুখ বুজেই রইল ছেলেটাকেন তা সে-ই জানে। অবশেষে কতকগুলো প্রমাণ খাড়া করে কোণঠাসা করে দোষী সাব্যস্ত করা হল। হবুচন্দ্রের বিচার আর কি!

তবে কি তুমি বলতে চাও দাদু, ডাঃ সুধীন চৌধুরী দোষী নয়, তাকে অন্যায় করে শাস্তি দেওয়া হয়েছে? এবারে প্রশ্ন করলে জগন্নাথ।

একশোবার বলব, তাকে অন্যায় করে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

কেন?

কারণ সে দোষী হতেই পারে না। ধর যদি ধরে নেওয়াই যায়, প্লেগের বীজাণুই সুহাসের শরীরে ফুটিয়ে তাকে ষড়যন্ত্র করে হত্যা করা হয়েছে এবং এও যদি তর্কের খাতিরে স্বীকার করেই নেওয়া যায় যে সুধীন নিজে ডাক্তার হওয়ায় তার পক্ষে সেটা খুবই সহজ ছিল, তবু এ কথাটা তোরা ভেবে দেখেছিস কি যে ইনজেকশন দেওয়ার পর যন্ত্রপাতিগুলো সে কোথায় সরিয়ে ফেললে? তার হাতে একটা মরোক্কো-বাঁধাই কেস ছিল কিন্তু সেটা তো হিমোসাইটোমিটারের কেস; ইনজেকশনের যন্ত্রপাতি তো তার মধ্যে ছিল না। তাছাড়া সুহাসের মা মালতী দেবী সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তাঁর দৃষ্টি এড়ানো বড় সহজ কথা নয়। আরও একটা কথা, সুধীন যদি সে কাজ করেই থাকে, তবে তার সুহাসকে বাদ দিয়ে রসময়কেই মারা উচিত ছিল, কেননা সুধীনের বাপ যখন নৃসিংহগ্রামে নিহত হন, তখন সুহাস তো জন্মায়ই নি। এখানে প্রতিশোধ নেওয়ার কথা তো উঠতেই পারে না। তাছাড়া এ জগতে এমন কেউ বোকা নেই, হত্যা করবার জন্য বিষ-প্রয়োগ করে তার চিকিৎসার জন্য আবার কলকাতায় আসতে লিখবে। ব্যাপারটা আগাগোড়াই গোলমেলে, বিচারভণ্ডুল। একটা জগাখিচুড়ী।

সুব্রত হারাধনের বিচারশক্তি ও বিশ্লেষণক্ষমতা দেখে বিস্ময়ে মুগ্ধ হয়ে গেল, যদিচ হারাধনের কথাগুলো এলোমেলো। সে ভাবছিল, তবে কি সত্যি সত্যিই কিরীটীর কথাই ঠিক, ডাঃ সুধীন চৌধুরী নিদোষ! মিথ্যা ষড়যন্ত্র করে তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে।

***

সেই রাত্রে হারাধন ও জগন্নাথের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সুব্রত যখন রাস্তায় এসে নামল, রাত্রি তখন প্রায় সাড়ে দশটা। শহরের রাস্তাঘাট ও তার দুপাশের বাড়ি দোকানপাট সব প্রায় নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে দু-একটা দোকান ভোলা এবং এক-আধজন লোক রাস্তা দিয়ে চলেছে মাত্র।

রাস্তার দুপাশে কেরোসিনের বাতিগুলো টিমটিম করে জ্বলছে।

কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি, নক্ষত্রখচিত রাত্রির আকাশ যেন স্বপ্ন বলে মনে হয়। সুব্রত এগিয়ে চলে। নানা চিন্তায় মনটা আচ্ছন্ন। হারাধনের বাড়ি থেকে সুব্রতর কোয়াটারটা বেশ খানিকটা দূর।

সুব্রত আজ প্রায় দিন কুড়ি হবে এখানে এসেছে, কাজ কিন্তু বিশেষ কিছুই এগোয়নি। অথচ কিরীটীর নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত এখান থেকে এক পাও নড়বার উপায় নেই বেচারীর।

একটি কম্বাইন্ড হ্যাণ্ড আছে, থাকোহরি। লোকটার বয়স হয়েছে। রাজাবাহাদুরই স্টেট থেকে বামুন ও চাকরের ব্যবস্থা করে দিতে সতীনাথকে বলেছিলেন, কিন্তু সুব্রত সতীনাথবাবুকে ও সেইসঙ্গে রাজাবাহাদুরকেঅশেষ ধন্যবাদ জানিয়েসে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। থাকোহরিকে জগন্নাথই দিয়েছে।

লোকটার স্বভাবচরিত্রও খুব ভাল, তবে দোষের মধ্যে একটু কালা ও রাত্রে তেমন পরিষ্কার দেখে না। অবিশ্যি তাতে সুব্রতর কোনো অসুবিধা নেই। গরীব লোক, সুব্রতর কেমন একটা মায়াও এ কদিনে লোকটার ওপরে পড়ে গেছে। ছোট একতলা বাংলো প্যাটার্নের বাড়িখানা। বাড়ির পিছনের দিকে ছোট একটা অযত্ন বর্ধিত জঙ্গলাকীর্ণ বাগান। বাগানের সীমানা একমানুষ সমান প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। বাড়িতে সর্বসমেত চারখানা ঘর। দরজায় তালা দিয়ে, বারান্দার ওপরে একটা মাদুর পেতে থাকোহরি শুয়ে ঘুমিয়ে ছিল। সুব্রত এসে তাকে গায়ে ঠেলা দিয়ে ডাকল, থাকোহরি!

থাকোহরি সুব্রতর ডাকে উঠে বসে।

দরজাটা খুলে দাও।

থাকোহরি দরজার তালা খুলে দিল। ঘরের এক কোণে একটা হ্যারিকেন বাতি জ্বালানো থাকে, কিন্তু আজ ঘরটা অন্ধকার।

এ কি, আলো জ্বালাওনি আজ?

আজ্ঞে আলো তত জ্বালিয়ে রেখেছিলেন, বোধ করি নিভে গেছে।

সুব্রত পকেট থেকে টচটা বের করে বোতাম টিপতেই ঘরের মধ্যে নজর পড়ায় চমকে ওঠে।

ঘরের মেঝেতে তার চামড়ার সুটকেসটা ডালাভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে। লেখবার টেবিলের কাগজপত্র, বই, সব ওলটপালট হয়ে আছে। এলোমেলো ভাবে চারিদিকে ছড়ানো।

থাকোহরি ততক্ষণে আলো জ্বালিয়ে ফেলেছে।

এসব কি-ঘরে ঢুকেছিল কে? থাকোহরিও কম অবাক হয়নি।

তাই তো বাবু, টের পাইনি, মনে হচ্ছে নিশ্চয় ঘরে চোর এসেছিল। ওপাশের জানলাটা খোলা রেখে গিয়েছিলেন বাবু?

সুব্রত জানলার দিকে চেয়ে আশ্চর্য হয়ে যায়।

টাকাপয়সা যায়নি তো বাবু?

সত্যিই জানালাটা খোলা। সুব্রতর বুঝতে কিছুই কষ্ট হয় না। জানালা ভেঙেই চোর ঘরে এসেছে। সুব্রত খুঁজে দেখলে, না, দশ টাকার এগারখানা নোট ও কিছু খুচরো পয়সা, আনি দুআনি, সুটকেসের মধ্যে পার্সটার ভিতরে ছিল, কিছুই চুরি যায়নি। টাকা-পয়সা, জামাকাপড় কিছুই নেয়নি, এ আবার কি ধরনের চোর? কী চুরি করতে তবে সে এসেছিল এ ঘরে? আপাতদৃষ্টিতে মূল্যবান কিছু চুরি না গিয়ে থাকলেও, কেউ যে তার অবর্তমানে তার ঘরে অনধিকার প্রবেশ করেছিল সে বিষয়ে কোনো ভুলই নেই। সুব্রত বেশ চিন্তিত হয়ে ওঠে। তবে কি এখানে তাকে কেউ সন্দেহ করেছে? না, তাই বা কি করে সম্ভব! কেউ তো তার পরিচয় জানে না। আচমকা মনে পড়ে, আজ কয়েকদিন থেকেই তার মনে হচ্ছিল, কে যেন অলক্ষ্যে ছায়ার মত তাকে অনুসরণ করে। সে দেখতে পায় না বটে, কিন্তু সর্বদা দুটি চক্ষুর দৃষ্টি তাকে যেন সর্বত্র অনুসরণ করে ফিরছে। প্রথমটায় সে এত মনোযোগ দেয়নি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা একেবারে উড়িয়ে দেবার মত নয়। একটা কিছু আছে। কিন্তু!

***

রাত্রি গভীর। থাকোহরি বাইরে ঘুমিয়ে পড়েছে।

সুব্রত কিরীটীকে চিঠি লিখছিল:

কিরীটী,

গত পরশু তোকে একখানা চিঠি দিয়েছি, এখানে বোধ করি সন্দেহের হাওয়া বইতে শুরু হয়েছে। কে একজন অজানা অতিথির আবির্ভাব হয়েছিল আমার ঘরে, আমার অনুপস্থিতিতে থাকোহরির বধিরত্বের সুযোগ নিয়ে। ক্ষতি একটা কিছু হয়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু এখনও চোখে পড়েনি কিছু। আজ মনে হচ্ছে কয়েকদিন ধরে অন্ধকারে কে যেন আমায় অনুসরণ করে ফিরছিল। প্রথমটায় খেয়াল করিনি, সন্দেহ জাগছে এবারে। লাহিড়ী মশাই এখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। প্রাসাদের সর্বত্রই যেন একটা থমথমে ভাব। কোথায় যেন একটা গোলমাল পাকিয়ে উঠছে। মনে হচ্ছে এ যেন ঝড় ওঠবার পূর্বলক্ষণ! আজ হারাধনের একটা কথায় বুঝতে পারলাম, নাটকের শুরু রসময় মল্লিককে নিয়েই।

আজ এই পর্যন্ত। ভালবাসা রইল।

তোর কল্যাণ

দিন চারেক বাদেই কিরীটীর জবাব এল।

কল্যাণ,

তোর চিঠিখানা আমায় বেশ চিন্তিত করে তুলেছে। থাকোহরি না হয় কালা ও রাতকানা, কিন্তু তোর একজোড়া ড্যাবডেবে চোখ থাকতেও কি বলে এখনো ধরতে পারলি না, চোর কেন তোর ঘরে এসেছিল? ওরে আহাম্মক, তোর গোপনীয় কাগজপত্রের সন্ধানে! তোকে এবারে একটা ডেয়ারিং কাজ করতে হবে। একটিবার লাহিড়ী মশাইয়ের ঘরে হানা দিতে হবে। ভদ্রলোক তো একক জীবন অতিবাহিত করেন, খুব কষ্ট হবে না। তাছাড়া রাত্রে প্রাসাদে রাজাবাহাদুরের সঙ্গে মাঝে মাঝে দাবা খেলতেও যান, সেকথা তো তুই লিখেছিস। ওই রকম একটা দিন বেছে নিলেই চলবে। হ্যাঁ রে, সাঁওতাল প্রজার কথা জানাতে লিখলাম কিন্তু সে-সম্পর্কে কোনো উচ্চবাচ্যই তো করিসনি।

১.১১ মৃত্যবাণ

কিরীটীর চিঠি পাওয়ার পরদিনই, যে আসন্ন ঝড়ের ইঙ্গিতটা সুব্রত মনে মনে অনুভব করছিল, অকস্মাৎ সেটা সত্য হয়ে দেখা দিল। রাত্রি তখন প্রায় এগারোটা হবে। প্রাসাদের দিক থেকে সহসা একটা আর্ত চিৎকার রাত্রির স্তব্ধ বুকখানাকে কাঁপিয়ে তুললে। মুহূর্তে চারিদিক হতে লোকজন ছুটে এল। এমন কি রাজাবাহাদুর পর্যন্ত। সকলে এসে দেখলে লাহিড়ী মশাই তীব্র যন্ত্রণায় প্রাসাদের অন্দর ও বাহিরের সংযোগস্থলে বাঁধানো আঙিনার উপর পড়ে ছটফট করছেন। মাঝে মাঝে আগাগোড়া সমগ্র শরীরটা আক্ষেপে কুঁকড়ে কুঁকড়ে উঠছে। আলো নিয়ে এসে দেখা গেল, লাহিড়ীর বুকের বাঁদিকে, একেবারে হৃদপিণ্ড ভেদ করে, একটা বিঘত পরিমাণ ইস্পাতের সরু ছাতার শিকের মত তীক্ষ্ণ তীর বিধেঁ আছে।

তখুনি ডাক্তারের ডাক পড়ল, কিন্তু ডাক্তার আসবার আগেই লাহিড়ী মশাইয়ের মৃত্যু ঘটল। রাজবাড়ির ডাক্তার অমিয় সোম কিছুই করতে পরলেন না। তীব্র যন্ত্রণায় লাহিড়ীর সমগ্র দেহটা বারকয়েক আক্ষেপ করে একেবারে স্থির হয়ে গেল। সমগ্র মুখখানা যেন নীলাভ বিকৃত হয়ে গেছে। ডাঃ সোম বললেন, তীরের ফলার সঙ্গে কোনো সাংঘাতিক বিষ মাখিয়ে, সেই তীর বিদ্ধ করে হতভাগ্য লাহিড়ীর মৃত্যু ঘটানো হয়েছে।

সংবাদটা পেতে সুব্রতর দেরি হল না। শরীরটা একটু অসুস্থ থাকায় সুব্রত সেদিন আর হারাধনের ওখানে যায়নি। খাওয়াদাওয়ার পর শয্যায় শুয়ে একখানি ইংরেজী উপন্যাস পড়ছিল। পুরাতন রাজবাড়ি থেকে নতুন রাজবাড়িও তেমন বিশেষ দূর নয়। লাহিড়ীর আর্ত চিৎকার। সুব্রতরও কানে গিয়েছিল। অকুস্থানে এসে দেখলে, রাজাবাহাদুর যেন কেমন হয়ে গেছেন। এ কি সাংঘাতিক ব্যাপার! একেবারেই বলতে গেলে তাঁরই প্রাসাদের মধ্যে খুন!

সুব্রতকে আসতে দেখে রাজাবাহাদুর ব্যগ্রভাবে বলে উঠলেন, এই যে কল্যাণবাবু, আসুন। এই দেখুন কি ভয়ানক ব্যাপার!

কি হয়েছে?

লাহিড়ী খুন হয়েছে।

খুন হয়েছে? সে কি!

হ্যাঁ দেখুন না, তাকে নাকি বিষাক্ত তীর দিয়ে কে মেরেছে।

বিষের তীর!

হ্যাঁ, কিন্তু আমি যে এর মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছি না কল্যাণবাবু। এত রাত্রে কেনই বা লাহিড়ী প্রাসাদে এসেছিল, আর প্রাসাদের মধ্যেই বা কে তাকে এইভাবে নৃশংসভাবে খুন করলে!

সুব্রত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ভূপতিত লাহিড়ীর মৃতদেহটার দিকে তাকিয়ে দেখছিল। ডান পাশে কাত হয়ে ধনুকের মত বেঁকে লাহিড়ীর প্রাণহীন মৃতদেহটা অসাড় হয়ে পড়ে আছে। বাঁ দিককার বুকে তখনও তীরের খানিকটা ফলা বিদ্ধ হওয়ার পর বের হয়ে আছে। ক্ষীণ একটা রক্তের ধারা গায়ের জামাটা সিক্ত করে শান-বাঁধানো চত্বরের ওপরে এসে পড়েছে। মুখের দিকে তাকালেই স্পষ্ট বোঝা যায়, মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করেছে লোকটা। চোখমুখে এখনও তার সুস্পষ্ট আভাস।

মৃত্যুর পূর্বের তীব্র যাতনার আক্ষেপে বোধ হয় দুহাতের আঙুলগুলো দুমড়ে আছে বীভৎস মৃত্যু!…

কিন্তু সুব্রত ভাবছিল, লাহিড়ীও তা হলে নিহত হল! যে নাটক সে সুহাস মল্লিকের হত্যার সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে গিয়েছিল ভেবেছিল, আবার শুরু হল কি নতুন করে অন্য একটা অধ্যায়?

কে জানত লাহিড়ীর গোনা দিন এত কাছে এসে গিয়েছিল। আকস্মিক ভাবে ঘটনার স্রোত যে এইভাবে মোড় নেবে, কয়েক মুহূর্ত আগেও সুব্রত কি তা ভেবেছিল!

এ শুধু অভাবনীয় নয়, আকস্মিক।

তার সাজানো দাবার ক সহসা যেন অপমৃত্যুর অদৃশ্য হাতের ধাক্কা লেগে ওলটপালট হয়ে গেল।

এটা সেই গত ৩১শে মে সুহাস মল্লিকের দেহে যে হত্যাৰীজ ছড়ানো হয়েছিল তারই বিষক্রিয়া, না এ আবার এক নতুন নাটক শুরু হল!

সহসা রাজাবাহাদুরের কণ্ঠস্বরে সুব্রত যেন চমকে জেগে ওঠে।

এখন আমি কি করি বলুন তো কল্যাণবাবু? অসহায় বিপর্যস্তের মত রাজাবাহাদুর সুব্রতর মুখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করেন।

সর্বপ্রথম থানায় একটা সংবাদ দেওয়া প্রয়োজন, থানার লোক এসে মৃতদেহ না দেখা পর্যন্ত মৃতদেহ ওখান হতে নড়ানো যাবে না।

অ্যাঁ! আবার সেই থানা-পুলিস! রাজাবাহাদুরের কণ্ঠস্বরে ভয়মিশ্রিত উৎকণ্ঠা, কিন্তু কেন? কি তার প্রয়োজন?

বুঝতে পারছেন না, এ স্বাভাবিক মৃত্য নয়, খুন! পুলিস কেস।

আবার সেই পুলিস-কেস! তাহলে কি হবে?

আপনি স্থির হয়ে বসুন, আমিই থানায় খবর পাঠাবার ব্যবস্থা করছি।

সুব্রত ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

রায়পুরের থানা-অফিসার বিকাশ সান্যালকে সুব্রত ভাল ভাবেই চেনে। এবং এ কথাও বিকাশবাবু জানেন, কেন সুব্রত কল্যাণ রায় ছদ্মবেশে রায়পুরের রাজবাটিতে এসে আবির্ভূত হয়েছে। কেননা ইতিপূর্বে সুব্রত বিকাশবাবুর সঙ্গে গোপনে একদিন দেখাসাক্ষাৎ করে আলাপ-পরিচয় করে এসেছে।

সুব্রতরচেষ্টাতেই তখুনি সান্যালের ওখানে সংবাদ পাঠানোহল রাজবাড়ির একজন পেয়াদাকে দিয়ে।

লোকজনের ভিড় ক্রমেই বাড়ছে। ইতিমধ্যে লাহিড়ী মশাইয়ের মৃত্যুসংবাদটা আগুনের মতই প্রাসাদের বাইরে ও ভিতরে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। সকলেই উৎসুক ভাবে নানা প্রশ্ন একে ওকে জিজ্ঞাসা করছে।

সকলে যখন নানা আলোচনায় ব্যস্ত, ভিড়ের মধ্যে একফাঁকে সকলের অলক্ষ্যে সুব্রত গা-ঢাকা দিয়ে সরে পড়ল কিছুক্ষণের জন্য। নূতন প্রাসাদ হতে পুরাতন প্রাসাদ মিনিট চারেকের পথ হবে মাত্র। সুব্রত জোরপায়ে হেঁটে পুরাতন প্রাসাদে লাহিড়ী মশাইয়ের বাসভবনে এসে হাজির হল।

পুরাতন প্রাসাদের দক্ষিণ অংশে, উপরে ও নীচে গোটাচারেক ঘর নিয়ে লাহিড়ী থাকত। লোকজনের মধ্যে একটি ভৃত্য ও একটি রাধুনী বামুন।

তারাও গোলমাল শুনে অরক্ষিত অবস্থাতেই বাড়ি ফেলে রেখে নতুন প্রাসাদের দিকে ছুটে চলে গেছে ব্যাপার কি জানবার জন্যে।

লাহিড়ীর বাড়িটা অন্ধকার। সব আলোইনেভানো। কেবল বাইরে বারান্দায় একটা হ্যারিকেন দপ দপ করে জ্বলছে।

সুব্রত দ্রুতপদে খোলা দরজাপথে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে।

পকেট থেকে টচটা বের করে জ্বালাতেই চোখে পড়ে নীচের সুসজ্জিত বাইরের ঘরটি। তারই পাশ দিয়ে উপরে ওঠবার সিঁড়ি। মুহূর্তমাত্র ইতস্তত না করে সুব্রত অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল।

পাশাপাশি দুটো ঘর, সামনে ছোট একফালি বারান্দা।

কয়েকটি ফুলের টব।

কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি। নিঝুম অন্ধকারে চারিদিক যেন থমথম করছে।

টর্চ বাতি জ্বালিয়ে সুব্রত দেখলে, সামনের দরজার গায়ে একটি তালা ঝুলছে, অন্য দরজাটি পরীক্ষা করে দেখলে, সেটি ভিতর থেকে বন্ধ। লোকটা সাবধানী ছিল, সে বিষয়ে কোনো ভুলই নেই। কিন্তু এখন উপায়? যেমন করেই হোক ঘরের মধ্যে প্রবেশ তাকে করতেই হবে আজ রাত্রেই এবং এই মুহূর্তেই।

সুব্রত তালাটা টেনে দেখলে, ভাল বিলিতি তালা, সহজে ভাঙা যাবে না। বাড়িতে গিয়ে তালা খোলবার যন্ত্রগুলো আনা ছাড়া আর অন্য কোনো উপায় নেই।

সুব্রতর কোয়াটার এখান হতে যদিও খুব বেশীদূর নয়, মিনিট তিন-চারের রাস্তা, কিন্তু তা ভিন্ন আর উপায়ই বা কি!

সুব্রত আবার ছুটল নিজের বাসার দিকে। মিনিট দশেকের মধ্যেই তালা খোলবার যন্ত্রপাতিগুলো নিয়ে এল; কতকগুলো সরু মোটা বাঁকানো ও সোজা লোহার শিক।

মিনিট পাঁচ-সাতের চেষ্টায় তালাটা খুলে গেল।

আনন্দে সুব্রতর চোখের তারা দুটো অন্ধকারে ঝক্ঝক্ করে ওঠে। দরজাটা খুলে এবারে সুব্রত ঘরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করে। বেশ প্রশস্ত ঘরখানি। আসবাবপত্র ঘরের মধ্যে সামান্যই, একটা ফোলডিং ক্যাম্পখাট, একটি বইয়ের আলমারি ও কয়েকটি ছোট-বড় বাক্স। সবার উপরে একটি এ্যাটাচি কেস।

প্রথমেই সুব্রত অ্যাটাচি কেসটা খুলে ফেললে। কতকগুলো কাগজপত্র, হিসাবের খাতা, ক্যাশমেমো ও ব্যাঙ্কের চেকবই।

অ্যাটাচি কেসটা একপাশে সরিয়ে রেখে সুব্রত একটা স্টীল ট্রাঙ্কের তালা ভেঙে ফেললে, বিশেষ কিছুই তার মধ্যে নেই, কতকগুলো জামাকাপড়। আর একটা ট্রাঙ্কও খুললে, তার মধ্যেও বিশেষ কিছু পাওয়া গেল না।

হতাশ হয়ে সুব্রত উঠে দাঁড়াল। পরিশ্রমে কপালের উপরে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে তখন।

অ্যাটাচি কেস থেকে কতকগুলো কাগজপত্র ও হিসাবের খাতাটা পকেটে ভরে বাকি সব জিনিসপত্র সুব্রত সেই অবস্থায়ই ফেলে, যেমন ঘর হতে বের হতে যাবে, হঠাৎ সামনের ছাদের দিকে নজর পড়তে ও চমকে দাঁড়িয়ে গেল, অস্পষ্ট ছায়ামূর্তির মত ঘরের সম্মুখের ছাদ দিয়ে কে যেন এগিয়ে আসছে।

সুব্রত চট করে হাতের টর্চবাতিটা নিভিয়ে দিল। এবং অন্ধকারে ঘরের জানালার পিছনে গিয়ে সরে দাঁড়াল।

কে ঐ ছায়ামূর্তি!

কেউ কি অলক্ষ্যে থেকে তার সমস্ত কার্যকলাপ লক্ষ্য করছে! স্তিমিত তারার আলোয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছাদের দিকে তাকাল।

পুরাতন রাজপ্রাসাদের একটা অংশকে বিভিন্ন কর্মচারীদের বাসের ও অফিসের জন্য ছোট ছোট ফ্ল্যাটের মত অংশে বিভক্ত করা হয়েছে পার্টিশন তুলে। তারই এক অংশ হতে অন্য অংশে ছাদ দিয়ে যাতায়াত করা যায়। যদিচ বিভিন্ন অংশের মধ্যবর্তী দরজাগুলো বন্ধ থাকে প্রায় সর্বদাই।

ব্যবধান মাত্র একমানুষ সমান প্রাচীরের। কারও পক্ষে সেটা পার হয়ে আসা এমন কিছুই কষ্টসাধ্য ব্যাপার নয়।

কিন্তু ছাদ থেকে লাহিড়ীর ঘরে প্রবেশের দরজাটা বন্ধ। ছায়ামূর্তি যেই হোক, এ ঘরের মধ্যে এলে সহসা প্রবেশ করতে পারবে না। সম্ভবও নয়।

হঠাৎ সুব্রত লক্ষ্য করলে ছায়ামূর্তি ছাদের বাঁদিকে সরে গেল, তাকে আর দেখা যাচ্ছে না। লোকটার চলার ধরন সুব্রতর যেন চেনা-চেনা বলেই মনে হয়। কিন্তু সামান্য আলোয় সুব্রত ভাল করে বুঝে উঠতে পারে না।

এদিকে এখানে আর বেশী দেরি করা মোটেই উচিত নয়, এতক্ষণে হয়ত থানা থেকে বিকাশবাবু এসে গেছেন ঘটনাস্থলে, এখুনি হয়ত তার খোঁজ পড়বে।

সুব্রত ত্বরিত পদে নেমে এল।

১.১২ নিশানাথ

অত্যন্ত দ্রুতপদে পথটা অতিক্রম করে সুব্রত যখন প্রাসাদে এসে পৌঁছল, দেখলে তার অনুমানই ঠিক। ইতিমধ্যে ঘটনাস্থলে বিকাশ সান্যালের আবির্ভাব হয়েছে এবং তদন্তও শুরু হয়ে গেছে হত্যা-ব্যাপারের, তবে সেজন্য সুব্রতর খোঁজ এখনও পড়েনি।

বিকাশ মৃতদেহটা পরীক্ষা করে উঠে দাঁড়াতেই সুব্রতর সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। কি একটা কথা সুব্রতকে বলতে যাচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ সুব্রতর চোখের ইঙ্গিতে নিজেকে সে সংযত করে নিল।

কতক্ষণ হল এ ব্যাপার হয়েছে? বিকাশ রাজাবাহাদুরকেই প্রশ্ন করলে।

তা ঘণ্টা দুই হবে, কি বলেন কল্যাণবাবু! রাজাবাহাদুর সুব্রতর দিকে তাকিয়ে বললেন।

তা হবে বৈকি, সুব্রত সায় দেয়।

মৃতদেহ যেভাবে পড়ে আছে, তা দেখেই মনে হয়, উনি প্রাসাদের দিকেই যাচ্ছিলেন। রাত্রি এখন প্রায় একটা হবে। ঘণ্টা দুই আগে যদি ঘটনাটা ঘটে থাকে, তাহলে তখন বোধ করি রাত্রি এগারোটা আন্দাজই হবে। তা এত রাত্রে উনি প্রাসাদের অন্দরমহলেই বা যাচ্ছিলেন কেন? উনি কি আপনারই কোনো কাজে বা আপনার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন রাজাবাহাদুর?

না, আমিও আশ্চর্য হচ্ছি, হঠাৎ উনি এত রাত্রে এদিকে আসছিলেন কেন?

এ সময় সুব্রত সহসা একটা চাল দেয়, বলে ওঠে, শুনেছি প্রায়ই রাত্রে উনি নাকি আপনার সঙ্গে দাবা খেলতে আসতেন, দাবা খেলতেই আসছিলেন না তো?

কথাটা ঠিকই, তবে আজ আমার শরীর ভাল না থাকায়, সন্ধ্যার আগেই বলে দিয়েছিলাম, আজ আর দাবা খেলা হবে না। বললেন রাজাবাহাদুর।

সতীনাথবাবুর বাড়ির চাকরদের একবার ডাকাতে পারেন রাজাবাহাদুর? বললে বিকাশ।

আমি এখুনি তাদের ডাকতে লোক পাঠাচ্ছি। বলে রাজাবাহাদুর চিৎকার করে ডাকলেন, শম্ভ, এই শম্ভ–

রাজবাড়ির পুরাতন চাকর শম্ভু, বর্তমানে শম্ভ রাজাবাহাদুরের খাসভৃত্য, রাজাবাহাদুরের ডাকে এগিয়ে এল ভিড় ঠেলে। যথেষ্ট বয়েস হলেও শরীরের বাঁধুনি খুব চমৎকার শম্ভর।

এই,এখুনি একবার কাউকে বলে দে, ম্যানেজারবাবুর বাসা থেকে বংশী আর জগন্নাথকে ডেকে আনুক, বলে যেন আমি ডাকছি।

কিন্তু শম্ভর আর তাদের ডাকতে যেতে হল না, ভিড়ের মধ্য হতে কে একজন বলে উঠল, রাজাবাবু, তারা এখানেই আছে। এই বংশী, যা রাজাবাবু ডাকছেন।

সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন মিলে একপ্রকার ঠেলেই লাহিড়ীর ভৃত্য বংশীকে সামনের দিকে এগিয়ে দিল।

লাহিড়ীর বংশীই ছিল একমাত্র ভৃত্য ও জগন্নাথ উৎকলবাসী রসুয়ে বামুন। বংশীর বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি, জাতিতে সদগোপ। অত্যন্ত হৃষ্টপুষ্ট চেহারা, চকচকে কালো গায়ের রং, মাথার চুলগুলো লম্বা লম্বা, তার প্রায় তিনের-চার অংশ পেকে সাদা হয়ে গেছে।

তোর নাম কি রে? বিকাশ প্রশ্ন করে।

আজ্ঞে বংশী কতা, বংশী কাঁচুমাচু হয়ে জবাব দেয় কোনোমতে, একটা বড় রকমের ঢোঁক গিলে। লোকটা যে ভয় পেয়েছে তা তাকে দেখলেই বোঝা যায়। সেই কারণেই হয়ত সে ভিড়ের মধ্যে আত্মগোপন করতেই চেয়েছিল। প্রভুর আকস্মিক মৃত্যুতে সে রীতিমত ভয় তো পেয়েই ছিল, হকচকিয়েও গিয়েছিল।

বাসা থেকেই গোলমাল শুনতে পেয়েছিস?

হ্যাঁ বাবু।

কতদিন বাবুর বাসায় কাজ করছিস?

প্রায় দেড় বছর হবে বাবু।

এখানে তুই কতক্ষণ এসেছিস?

আজ্ঞে বাবু, গোলমাল শুনেই তো ছুটে এলাম।

তাহলে বাসায় ছিলি বল?

হ্যাঁ বাবু।

তোর বাবু কতক্ষণ বাসা ছেড়ে এসেছে বলতে পারিস?

এই তো সবে এক ঘণ্টাও হবে না, কে একটা লোক একটা চিঠি নিয়ে এল। বাবু বাইরের বারান্দায় বসেছিলেন। খাবার হয়ে গেছে, খেতে আসবেন, এমন সময় চিঠি পেয়ে আমাকে বললেন, বংশী, আমি ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ঘুরে আসছি, ঠাকুরকে খাবার এখন দিতে বারণ। করে দে। ফিরে এসে খাবখন।

কে চিঠি নিয়ে গিয়েছিল? কোথা থেকেই বা চিঠি নিয়ে এল, জানিস কিছু? বাবু বলেননি, কোথা যাচ্ছেন?

আজ্ঞে না, শুধু বলে এলেন ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফিরে আসবেন।

যে লোকটা চিঠি নিয়ে গিয়েছিল তাকে তুই ভাল করে দেখেছিলি? চিনতে পেরেছিলি লোকটাকে?

আজ্ঞে না কত, তাকে আমি আগে কখনও দেখিনি।

লোকটা লম্বা না বেঁটে? রোগা না মোটা? দেখতে কেমন?

আজ্ঞে লোকটার মাথায় একটা পাগড়ী বাঁধা ছিল, লম্বাই হবে, হাতে একটা টর্চবাতি ছিল। তার মুখ আমি দেখিনি।

লোকটা চিঠিটা দিয়েই চলে গেল, না সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল?

আজ্ঞে আমি বারান্দার অন্য ধারে বসেছিলাম, লোকটা চিঠি দিয়েই চলে গেল।

কোনো দিকে গেল?

আজ্ঞে বাড়ির বাইরে চলে গেল, দেখতে পাইনি কোন্ দিকে গেল তারপর।

লোকটা চলে যাওয়ার পরই তোর বাবু চলে আসেন?

হ্যাঁ, ভিতরে গিয়ে একটা জামা গায়ে দিয়ে বের হয়ে এলেন।

বাবু বাড়ি থেকে বের হয়ে আসবার কতক্ষণ পরে তুই গোলমাল শুনতে পাস?

তা পনের-কুড়ি মিনিটের মধ্যেই হবে হুজুর।

এর পর বিকাশ মৃতদেহের জামার পকেটগুলো ভাল করে পরীক্ষা করে দেখতে লাগল। লাহিড়ীর পরিধানে ধুতি ও একটা সাধারণ সিল্কের পাঞ্জাবি। কিন্তু পাঞ্জাবির কোনো পকেট থেকেই কোনো কাগজ বা চিঠিপত্র পাওয়া গেল না, একটা সাদা ক্যালিকো মিলের রুমাল, একটা চাবির রিং ও পার্স পাওয়া গেল মাত্র, কিন্তু সেগুলো হতে কোনো সূত্রই পাওয়া যায় না।

রাজাবাহাদুর বললেন, দারোগাবাবু, এখানে এত লোকজনের মধ্যে বাইরে দাঁড়িয়ে এদের জেরা না করে, আমার খাস কামরায় চলুন না? সেখানে বসেই যাকে যা জিজ্ঞাসাবাদ করতে হয় করবেন।

সেই ভাল কথা, চলুন।

এর পর সকলে রাজাবাহাদুরের খাস কামরায় এসে প্রবেশ করল, সুব্রতও সঙ্গে সঙ্গে গেল।

বিকাশ একটা আরাম-কেদারায় বেশ জাঁকিয়ে বসল। তারপর বললে, রাজাবাহাদুর, সর্বাগ্রে আপনার সঙ্গেই আমার কয়েকটা কথা আছে। তারপর যাকে যা জিজ্ঞাসাবাদ করবার করবখন।

রাজাবাহাদুর ক্লান্ত স্বরে বললেন, বেশ। বলুন কি জানতে চান?

আপনার ম্যানেজার ও সেক্রেটারী লাহিড়ীর মৃত্যু-ব্যাপারটা যে একটা নৃশংস হত্যাকাণ্ড, তা আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন! এই মাত্র অল্প কিছুদিন হবে আমার এখানে বদলি হয়ে আসবার আগে আপনাদের পরিবারের মধ্যে একটা বিশ্রী হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে। যার ফলে আপনাদের কম ধকল সহ্য করতে হয়নি, অর্থব্যয়ও কম হয়নি, আবার আজকের এই ব্যাপার!

বিকাশবাবুর কথা শেষ হল না, সহসা যেন প্রচণ্ড একটা অট্টহাসির শব্দ নিশীথের নিথর স্তব্ধতাকে দীর্ণ-বিদীর্ণ করে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল—হাঃ হাঃ হাঃ…!

ও কি! অমন করে হাসলে কে? চমকে উঠে প্রশ্ন করলে বিকাশ। প্রথমটায় রাজাবাহাদুরও যেন একটু চমকে গিয়েছিলেন, কিন্তু করে সামলে নিলেন যেন, বললেন, আমার দূরসম্পকীয় খুড়ো নিশানাথ মল্লিক। শোলপুর স্টেটে চিত্রকর ছিলেন, মাসপাঁচেক হয় মাথার গোলমাল হওয়ায় চাকুরি গেছে। বুড়ো মানুষ, বিকৃতমস্তিষ্ক, অথর্ব, আমার এখানে এনে রেখেছি। সংসারে ওঁর আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। বিয়ে-থাও করেনি। অকারণ অমনি হাঃ হাঃ করে হেসে ওঠা, চিৎকার করা, আবোল-তাবোল বকা…এই করছেন আর কি।

এরপর ঘরের সকলেই কিছুক্ষণের জন্য যেন চুপ করে রইল, কারও মুখেই কথা নেই।

বিকাশই সর্বপ্রথমে আবার ঘরের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করলে, আচ্ছা রাজাবাহাদুর, বলতে পারেন, সর্বপ্রথম কে লাহিড়ীর মৃতদেহ দেখতে পায়?

তাও ঠিক বলতে পারি না, তবে আমি পড়াশুনা সেরে বিছানায় শুতে যাচ্ছিলাম, এমন ১ময় হঠাৎ একটা চিৎকার শুনতে পেয়েই ছুটে জানলার সামনে যাই। অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় দেখলাম, (কেননা আমার ঘরের জানলা থেকে সুস্পষ্ট ভাবে অন্দর ও বহির্মহলের মধ্যকার  সংযোগস্থল, ঐ আঙিনাটা দেখা যায়) কে একজন আঙিনায় শুয়ে ছটফট করছে। তখুনি ছুটে নীচে যাই। আমার পোঁছবার আগেই বাড়ির অন্যান্য ভৃত্য ও কর্মচারীদের মধ্যে অনেকেই চিৎকার শুনে সেখানে ততক্ষণে জুটেছে গিয়ে দেখি।

আপনি যখন আপনার শয়নকক্ষে জানলাপথে নীচের দিকে তাকান, তখন সেখানে আর কাউকেই দেখতে পাননি?

রাজাবাহাদুর সুস্পষ্ট স্বরে বললেন, না।

এমন সময় অতর্কিত একটা কণ্ঠস্বর শুনে সকলেই যুগপৎ সামনের খোলা দরজার দিকে দৃষ্টিপাত করলে।

মিথ্যে কথা। আমি দেখেছি, সেই কালো শয়তানটা! কিন্তু এবারে আর তার হাতে ছাতা ছিল না, একটা মস্তবড় টর্চবাতি ছিল…

একজন দীর্ঘকায় বলিষ্ঠ সুদর্শন পুরুষ, খোলা দরজাপথে ঘরের মধ্যে এসে ইতিমধ্যে কখন দাঁড়িয়েছেন, এ তাঁরই কণ্ঠস্বর। আগন্তুকের বয়স প্রায় পঞ্চাশের ঊর্ধ্বেই হবে। মাথায় ঢেউ-খেলানো শ্বেতশুভ্র বাবরি চুল, মুখের ওপর বার্ধক্যের বলিরেখা সুস্পষ্টভাবে রেখাঙ্কিত হয়ে উঠেছে। আগন্তুক যে যৌবনে একদিন অসাধারণ বলিষ্ঠ সুপুরুষ ছিলেন, বার্ধক্যেও তা বুঝতে এতটুকু কষ্ট হয় না। পরিধানে ঢোলা পায়জামা ও গায়ে সেরওয়ানী, পায়ে রবারের চপ্পল। তাই কখন যে তিনি নিঃশব্দে ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন কেউ টের পায়নি!

রাজাবাহাদুর দ্রুতপদে এগিয়ে গেলেন, এ কি কাকা, আপনি এখানে কেন?

কে, বিনু? এখনও তুমি এ বাড়িতে আছ? পালিয়ে যাও! পালিয়ে যাও! এ বাড়িতে সর্বত্র বিষের ধোঁয়া? বিষে জর্জরিত হয়ে মরবে!

চলুন কাকা, আপনার ঘরে চলুন।

কোথায় যাব, ঘরে? না না, সেখানেও মৃত্যু ওৎ পেতে আছে, মৃত্যু-বিষ ছড়িয়ে আছে চারিদিকে। That child of the past, again he started his old game-ভুলে গেলে এরই মধ্যে সেই শয়তান ছোটলোকটিকে?…মনে পড়ছে না তোমার? বলতে বলতে বৃদ্ধ একবার ঘরের চারদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে, কতকটা যেন স্বগত ভাবেই বললেন, এরা কারা বিনু? এরা এখানে কি চায়? আমি একটা চমৎকার অয়েল পেনটিং করছি, ছবিটা প্রায় শেষ হয়ে এল। একটি তেরো-চোদ্দ বছরের ছোট কিশোর বালক, শয়তানীতে সে এর মধ্যেই পাকাপোক্ত হয়ে উঠেছে। উঃ, কি শয়তান! ধনুবান খেলার ছলে, খেলার তীরের ফলার সঙ্গে কুঁচফলের বিষ মাখিয়ে, তারই একজন খেলার সাথীকে মারতে গেল। কিন্তু ভগবানের মার যাবে কোথায়? সব উল্টে দিল। বিষ মাখানো তীরটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে লাগল গিয়ে শেষ পর্যন্ত কোথায় বল তো, কিছু দূরে মাঠের মধ্যে একটা গরু ঘাস খাচ্ছিল, তারই গায়ে। ছেলেটা বেঁচে গেল, কিন্তু দিন-দুই বাদে গরুটা মরে গেল। কিন্তু, তুমি কি সেই মস্তবড় টর্চ হাতে কালো পোশাক পরা লোকটাকে দেখতে পাওনি বিনু? ছায়ার মতই মিলিয়ে গেল, আমি দেখেছি তাকে। কেউ না দেখতে পেলেও আমি দেখেছি। … হ্যাঁ, আমি দেখেছি সেই শয়তানটাকে!

আঃ কাকা, ঘরে চলুন, অনেক রাত্রি হয়েছে, চলুন এবারে একটু ঘুমোবেন। রাজাবাহাদুর যেন ভিতরে ভিতরে অত্যন্ত অস্থির হয়ে উঠেছেন বোঝা যায়।

রাজবাড়ির পারিবারিক চিকিৎসক ডাঃ সোম পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন, রাজাবাহাদুর সুবিনয় মল্লিক তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, ডাক্তার, এঁকে ঘুম পাড়াবার ব্যবস্থা কর।

ডাঃ সোম এগিয়ে এলেন, ধীর সংযত কণ্ঠে ডাকলেন, মিঃ মল্লিক! সুব্রত অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিল আগন্তুক আর কেউ নয়, সুবিনয় মল্লিক বর্ণিত তাঁর বিকৃতমস্তিষ্ক দূরসম্পর্কীয় খুড়ো, আর্টিস্ট নিশানাথ। স্তব্ধ বিস্ময়ে সে নিশানাথের কথাগুলো শুনছিল। সত্যিই কি নিশানাথের কথাগুলো একেবারে স্রেফ প্রলাপোক্তি! মনের মধ্যেই যেন একটা সংশয় জাগছে। কিছুদিন আগে জাস্টিস্ মৈত্রের বাড়িতে বসে রায়পুর মার্ডার কেসের প্রসিডিংস পড়তে পড়তে কয়েকটা লাইন সহসা যেন মনের পাতায় স্মৃতির বিদ্যুতালোক ফেলে যায়, কালো ছাতাওয়ালা সেই কালোলোকটা!

 ১.১৩ তারিণী, মহেশ ও সুবোধ

তারিণী, মহেশ ও সুবোধ ডাঃ সোম ও রাজাবাহাদুর দুজনে মিলে অনেক কষ্টে একপ্রকার যেন জোর করেই নিশানাথকে ঘর থেকে টেনে নিয়ে গেলেন।

নিশানাথ মৃদু অস্পষ্ট আপত্তি জানাতে জানাতে, ওদের সঙ্গে যেতে যেন কতকটা বাধ্যই হলেন। তাঁর মৃদু আপত্তি তখনও শোনা যাচ্ছিল, খুঁজে দেখ বিনু! খুঁজে দেখ! ভিতর থেকে যেমন করে হোক শয়তানটাকে খুঁজে বের কর। খুঁজে দেখ, খুঁজলেই পাবে। সুহাস গেছে, কে বলতে পারে এবার হয়ত তোমারই পালা। অভিশাপ! অভিশাপ! মৃত রত্নেশ্বর মল্লিকের অভিশাপ! দুধকলা দিয়ে তিনি কালসাপ পুষেছিলেন, কেউ থাকবে না! রাবণের বংশের মতই এ একেবারে নির্বংশ হয়ে যাবে রে! মনে করে দেখ রামায়ণে সেই দশাননের খেদোক্তি, এক লক্ষ পুত্র মোর, সোয়া লক্ষ নাতি, কেহ না রহিল মোর বংশে দিতে বাতি।… ক্রমে নিশানাথের কণ্ঠস্বর অস্পষ্ট হতে অস্পষ্টতর হয়ে একসময় আর শোনা গেল না।

ঘরের মধ্যে সব কটি প্রাণীই যেন স্তব্ধ অনড় হয়ে গেছে। উঁচ পতনের শব্দও হয়ত শোনা যাবে। নিশানাথের বিলীয়মান কথার রেশ যেন তখনও বাতাসে ভেসে আসছে করুণ মর্মস্পর্শী।

ঢং ঢং করে রাত্রি তিনটে ঘোষিত হল ঘরের দামী সুদৃশ্য ওয়ালক্লকটায়।

চমকে সুব্রত মুখ তুলে তাকাল। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলেছে রাত্রিশেষের দিকে। ফাল্গুনের ঈষৎ ঠাণ্ডা হাওয়া ভোলা বাতায়নপথে রাত্রিশেষের আভাস জানিয়ে গেল। সহসা সুব্রতর শরীরটা যেন কেমন সিরসির করে ওঠে। বাইরের খোলা আঙিনার ওপরে লাহিড়ীর মৃতদেহটা এখনও তেমনই পড়ে আছে। ডাঃ সোম ও রাঙ্গাবাহাদুর হয়ত নিশানাথকে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করছেন। রায়পুরের প্রাসাদটা যেন একটা রহস্যের খাসমহল হয়ে দাঁড়িয়েছে সত্যি। চারদিকে এর মৃত্যুর বীজ ছড়ানো।

বিকাশ খসখস করে কাগজের ওপরে বর্তমান দুর্ঘটনা সম্পর্কে কি যেন একমনে লিখে চলেছে। হয়ত এদের জবানবন্দি। রাজাবাহাদুরের শয়নকক্ষটা একবার দেখা দরকার। যে লোকটা লাহিড়ীর কাছে চিঠি নিয়ে গিয়েছিল, সে লোকটাই বা কে? কেই বা চিঠি দিতে গিয়েছিল? আর চিঠিতেই বা কি লেখা ছিল?

তাছাড়া এত রাত্রে লাহিড়ী প্রাসাদের দিকেই বা আসছিল কেন? তবে কি রাজবাড়ি থেকে কেউ তাকে চিঠি লিখে পাঠিয়েছিল। হয়ত তাই। আগাগোড়া সমগ্র ঘটনাটাকে সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করলে মনে হচ্ছে যেন লাহিড়ীর হত্যার ব্যাপারটা আগে থেকে একটা প্ল্যানমাফিক ঘটানো হয়েছে, আকস্মিক মোটেই নয়। লাহিড়ীকে চিঠি লিখে বাড়ি থেকে সরিয়ে এনে তারপর হত্যা করা হয়েছে। হয়ত চিঠিটা লাহিড়ীর পকেটে ছিল। হত্যা করবার পর হত্যাকারী নিশ্চয়ই চিঠিটা সরিয়ে ফেলেছে, অন্যতম নির্ভুল প্রমাণ ছিল হয়ত ঐ চিঠিখানাই। বোকার মত সে ফেলেই বা যাবে কেন? হত্যাকারী অত্যন্ত চালাক ও ক্ষিপ্র, সে বিষয়ে কোনো ভুল নেই। হত্যার কোনো সূত্রই সে পিছনে ফেলে যায়নি। নিঃশব্দে সে ধরাছোঁয়ার বাইরে আত্মগোপন করেছে হত্যার পর।

ডাঃ সোম ও রাজাবাহাদুর ঘরে এসে প্রবেশ করলেন।

বিকাশের নোট লেখা বোধ হয় শেষ হয়ে গিয়েছিল, উঠে দাঁড়াল, আসুন রাজাবাহাদুর। এবারে আমি এখানকার অন্যান্য সবাইকে প্রশ্ন করতে চাই।

বেশ তো। করুন কাকে কি জিজ্ঞাসা করতে চান। রাজাবাহাদুর বললেন।

তাহলে আপনি নিজে ও তারিণী, মহেশ ও সুবোধ বাদে সকলকে আপাতত যেতে বলুন। স্টেটের তহশীলদার তারিণী চক্রবর্তী, খাজাঞ্চী মহেশ সামন্ত, সরকার সুবোধ মণ্ডল, সুব্রত, পারিবারিক চিকিৎসক ডাক্তার সোম ও রাজাবাহাদুর বাদে বিকাশবাবুর নির্দেশমত তখন অন্যান্য সকলে ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

আমি এক-একজন করে প্রশ্ন করব, সে বাদে অন্য কেউ আর এখানে থাকবে না। বিকাশ বললে।

প্রথমেই ডাক পড়ল তারিণী চক্রবর্তীর।

বসুন চক্রবর্তী মশাই। আপনিও চিৎকারটা শুনেছিলেন নিশ্চয়?

হ্যাঁ।

আপনি চিৎকারটা যখন শুনতে পান, তখন কোথায় ছিলেন?

বছর প্রায় শেষ হয়ে এল, খাজনাপত্র আদায় হচ্ছে, সেই সব খাতাপত্র লেখা ও দেখাশুনা করছিলাম। এমন সময় হঠাৎ চিৎকার শুনে চমকে উঠি। খাজাঞ্চীঘরের সামনে যে টানা বারান্দা আছে, তার শেষপ্রান্তে দরজা পার হলে তবে প্রাসাদের ভেতরের আঙিনায় যাওয়া যায়। মনে হল যেন অন্দরমহলের দিক থেকেই শব্দটা এসেছে, তাই তাড়াতাড়ি সেই দিকেই ছুটে যাই।

তারপর?

কিন্তু গিয়ে দেখি বহির্মহল থেকে অন্দরমহলে যাবার দরজাটা ভিতরমহলের দিক থেকে বন্ধ।

দরজাটা রাত্রে কি বন্ধই থাকে?

হ্যাঁ। তবে রাত্রে বারোটার পর দরজাটা বন্ধ করা হয়, ভিতরের দিক থেকে। অন্দরমহলের দারোয়ান ছোট্টু সিং রোজ রাত্রে শুতে যাবার আগে দরজা বন্ধ করে দেয়।

কিন্তু চিৎকার যখন আপনি শুনতে পান, রাত্রি তখন বোধ করি এগারোটা হবে, দরজা তখন তো তাহলে বন্ধ থাকার কথা নয়?

না, তবে যদি ছোট্টু সিং আগেই আজ রাত্রে দরজা বন্ধ করে দিয়ে থাকে তো বলতে পারি না, মাঝে মাঝে বারোটার আগেও দরজা বন্ধ করা হয়।

দরজাটা বন্ধ দেখে আপনি কি করলেন?

দরজাটায় জোরে দুচারবার ধাক্কা দিতেই খুলে গেল।

ছোট্ট সিংই খুলে দিয়েছিল বোধ হয়?

না, দরজা যে কে খুলে দিয়েছিল তা আমি জানি না, কারণ দরজা খুলে দেবার পর কাউকেই আমি দেখতে পাইনি ভিতরের দিকে।

আশ্চর্য! ছোট্টু সিংকেও নয়?

না।

ভিতরের দিকে ঢুকে আপনি কি দেখলেন?

প্রথমটা কিছুই দেখতে পাইনি, তারপর ভাল করে দেখতে নজরে পড়ল, কে যেন একজন আঙিনার উপরে পড়ে আছে। ছুটে গেলাম, দেখেই চিনতে পারলাম, আমাদের ম্যানেজারবাবু।

তিনি কি তখনও বেঁচে ছিলেন?

না, মারা গিয়েছিলেন।

আর কেউ সেখানে ছিল সে-সময়?

না, আমিই বোধ হয় প্রথমে মৃতদেহ দেখতে পাই। আমার যাবার পরেই প্রথমে দারোয়ান ছোট্টু সিং, মহেশদা, সুবোধ মণ্ডল, তারপরেই অন্দরমহল থেকে এলেন রাজাবাহাদুর।

তাহলে প্রথমে ভেতরে প্রবেশ করে আর কাউকেই দেখতে পাননি আপনি?

না।

আচ্ছা আপনি যখন খাজাঞ্চীঘরে বসে লেখাপড়ার কাজ করছিলেন, তখন কি কাউকে অন্দরমহলের দিকে যেতে দেখেছিলেন?

না। তাছাড়া তেমন নজর দিইনি, কারণ একটা হিসাবের গরমিল হচ্ছিল আজ কদিন হতে, সেটা নিয়েই আমি খুব ব্যস্ত ছিলাম।

এ ছাড়া আর আপনার কিছু বলবার নেই চক্রবর্তী মশাই?

না।

আচ্ছা আপনি যেতে পারেন, মহেশবাবুকে পাঠিয়ে দিন।

একটু পরেই মহেশ সামন্ত ঘরে এসে প্রবেশ করল। মোটাসোটা নাদুসনুদুস, গোলগাল চেহারার লোকটি। চোখে রূপোর ফ্রেমের চশমা। ভদ্রলোকের ঘন ঘন কাপড়ের খুঁটে চশমার কাচ পরিষ্কার করা একটা অভ্যাসের মধ্যে যেন দাঁড়িয়ে গেছে।

বসুন, আপনারই নাম মহেশ সামন্ত?

আজ্ঞে হুজুর। মহেশ চশমাটা চোখ হতে নামিয়ে কাপড়ে সেটা ঘষতে লাগেল। মহেশের বয়স যে চল্লিশের কোঠা পার হয়ে গেছে, তা দেখলেই বোঝা যায়। মাথার সামনের দিকে এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে বিস্তীর্ণ একখানি টাক, নাকটা ভোঁতা।

আপনার ঘরটি, মানে বহিমহলে আপনি কোন ঘরে থাকেন?

টানা বারান্দার একেবারে শেষের ঘরটিতে।

আপনি চিৎকার শুনেই বোধ হয় ঘর হতে বের হয়ে যান?

আজ্ঞে আমি আমার ঘরের মধ্যে বসে আজকের সংবাদপত্রটা পড়ছিলাম, তখন বোধ করি রাত্রি পৌনে এগারোটা আন্দাজ হবে। মনে হল, আমার ঘরের সামনেকার বারান্দা দিয়ে কে যেন দ্রুতপায়ে হেঁটে চলে গেল। ভাবলাম প্রাসাদের কোনো চাকরবাকর হবে। তারই মিনিট পাঁচ-সাত বাদে ওই চিৎকার শুনেই বাইরে এসে দেখি, অন্দরমহলে যাবার দরজাটা তারিণীদা ঠেলছেন। একটু ঠেলাঠেলি করতেই দরজাটা খুলে তারিণীদা ভেতরের দিকে চলে গেলেন।

আপনার ঘর হতে অন্দরমহলে যাবার দরজাটা কতদূর?

তা প্রায় পনের-কুড়ি হাত হবে হুজুর।

আপনিও তখন বুঝি তারিণীবাবুকে অনুসরণ করলেন?

হ্যাঁ। আমার পিছনে পিছনে সুবোধবাবুও এসে গেছেন ততক্ষণে।

সুবোধবাবু কোন ঘরে থাকেন?

আমার দুখানা ঘর আগে।

ভেতরে ঢুকে কি দেখলেন?

দেখলাম তারিণীদা, ছোষ্ট্র সিং ও বাড়ির দুচারজন চাকরবাকর আঙিনায় এসে জড় হয়েছে। ঐ সময় রাজাবাহাদুরও এলেন।

আপনি শুধু চিৎকারটা শোনবার মিনিট পাঁচ-সাত আগে কারও অন্দরের দিকে যাওয়ার . পায়ের শব্দই পেয়েছিলেন, কারও বাইরের দিকে আসার পায়ের শব্দ পাননি?

না।

আচ্ছা যে শব্দটা শুনতে পেয়েছিলেন, নিশ্চয়ই জুতো পায়ে হাঁটার শব্দ; অর্থাৎ যার হাঁটবার শব্দ শুনেছিলেন তার পায়ে জুতো ছিল?

হ্যাঁ।

বেশ মচমচ শব্দ?

আজ্ঞে না, সাধারণ জুতোর শব্দ। তবে—মহেশ ইতস্তত করতে থাকে।

তবে কি? চুপ করলেন কেন, বলুন!

জুতোর সোলে লোহার পেরেকের নাল বসানো থাকলে যেমন শব্দ হয়, অনেকটা সেই রকম শব্দ শুনতে পেয়েছিলাম।

মহেশবাবু, আপনার শ্রবণশক্তির আমি প্রশংসা করি।

মহেশের ঠোঁটের কোণায় বিনীত হাসির একটা স্ফুরণ দেখা দেয়। আবার সে চশমাটি নাকের ওপর হতে নামিয়ে খুব জোরে জোরে কাপড়ের কোঁচায় ঘষতে থাকে ঘন ঘন।

কতদিন আপনি এখানে কাজ করছেন সামন্ত মশাই?

তা আজ প্রায় বিশ বছর হবে।

এঁরা তাহলে আপনার বহুকালের মনিব বলুন?

আজ্ঞে। বড় রাজার পিতাঠাকুর রাজা শ্রীকণ্ঠ মল্লিক বাহাদুরের সময় থেকেই এ বাড়িতে আমি কাজ করছি। কি জানেন দারোগা সাহেব, এ বংশে শনির দৃষ্টি লেগেছে!

কেন, হঠাৎ এ-কথা বলছেন কেন সামন্ত মশায়?

তাছাড়া আর কি বলুন? দেখুন না রাজা শ্রীকণ্ঠ মল্লিক বাহাদুর, অমন মহাপ্রাণ সদাশয় ব্যক্তি, তাঁর কিনা অপঘাতে মৃত্যু হল! তারপর এ-বাড়ির ভাগ্নে সুধীনের বাবা তাঁরও মৃত্যু তো একরকম অপঘাতে। আমাদের বড় রাজাবাহাদুরও, তাঁরও কোথাও কিছু না, হঠাৎ বিকেলের দিকে জলখাবার খাবার পর অসুস্থ হলেন, মাঝরাত্রের দিকে মারা গেলেন, ডাক্তার-বদ্যি কিছুই করতে পারলে না। তারপর সর্বশেষ ধরুন আমাদের ছোট কুমার, ঠিক যেন আচার-ব্যবহারে একেবারে রাজা শ্রীকণ্ঠ মল্লিকের মতই হয়েছিলেন, তা তিনিও অপঘাতে মারা গেলেন। এখন টিমটিম করছেন সবেধন নীলমণি আমাদের এই রাজাবাহাদুর। তা রাজবাড়ির মধ্যে যে ব্যাপার চলছে, ইনিও কতদিন টিকবেন কে জানে! তাই তো বলছিলাম, এসব শনির দৃষ্টি ছাড়া আর কি!

আপনাদের বর্তমান রাজাবাহাদুর লোকটি কেমন?

হুজুর মনিব। আমরা সাধারণ কর্মচারী মাত্র, ছোটর মুখে বড়র কথা শোভা পায় না। তা ইনিও সদাশয়, মহানুভব বৈকি।

আচ্ছা এবারে আপনি যেতে পারেন। মণ্ডল মশাইকে দয়া করে একটিবারের জন্য এ ঘরে পাঠিয়ে দেবেন।

সুবোধ মণ্ডল একটু পরেই এসে ঘরে প্রবেশ করল।

আসুন মণ্ডল মশাই, বসুন।

সুবোধ মণ্ডল লোকটি যেমন ঢ্যাঙা তেমনি রোগা। নাকটা উঁচলল, মুখটা সরু। দুগালের হনু দুটি চামড়া ভেদ করে বিশ্রীভাবে সজাগ হয়ে উঠেছে। উপরের পাটির সামনের প্রথম চারটি দাঁত উঁচু ও মোটা। লোকটা প্রস্থের অনুপাতে দৈর্ঘ্যে এত বেশী লম্বা যে, চলবার সময় মনে হয় যেন একটু সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে কুঁজো হয়ে চলেছে। তার চলবার ধরন দেখে বোঝা যায়, লোকটার চলাটাও বিচিত্র—ঠিক যেন খরগোশের মত অতি ক্ষিপ্রগতিতে চলতে অভ্যস্ত ও পটু।

আমায় ডেকেছেন স্যার?

হ্যাঁ, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, বসুন!

বলুন না স্যার কি বলতে চান, দাঁড়িয়েই তো বেশ আছি, বসলে আমার কষ্ট হয়।

কেন?

সারাটা জীবনই তো, ওর নাম কি, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই গেল—তা ওর নাম কি, মনে করুন, ঐ দাঁড়ানোটাই অভ্যাস হয়ে গেছে—তাছাড়া বয়স তত কম হল না, কোমরে একটু বাতেরও মত ধরেছে আজকাল, একটা বিড়ি খেতে পারি স্যার? অনেকক্ষণ ধোঁয়া না খেতে পেয়ে, ওর নাম কি, পেট যেন কেঁপে উঠেছে।

নিশ্চয় নিশ্চয়—খান না।

সুবোধ পকেট হতে একটা বিড়ি বের করে তাতে দিয়াশলাই জ্বালিয়ে অগ্নিসংযোগ করল। চোঁ চোঁ করে একটা তীব্র টান দিয়ে, একরাশ কটু ধোঁয়া ছেড়ে বললে, আঃ! এবারে ওর নাম কি, করুন স্যার কি জিজ্ঞাসা করতে চান!

আপনিও বোধ হয় প্রাসাদের বাইরেই থাকেন?

আজ্ঞে ওর নাম কি, সকলেই যখন বাইরে থাকেন, বাজার সরকার আমি…ঐ তারিণী খুড়োর ঘরটাতেই আমি থাকি।

চিৎকারটা আপনিও তাহলে শুনতে পেয়েছিলেন? আর এও হয়তো জানতে পেরেছেন, তারিণীবাবু কখন ঘর থেকে বের হয়ে যান? .

তা পেরেছিলাম বৈকি। তবে ওর নাম কি, জানি না খুড়ো কখন ঘর হতে বের হয়ে যান। মানে টের পাইনি।

কেন, সে সময় আপনি কি করছিলেন? মানে, জেগে না ঘুমিয়ে?

বোধ হয় ওর নাম কি, ঘুমিয়েই ছিলাম।

বোধ হয় ঘুমিয়ে ছিলেন, এ কথার মানে?

আজ্ঞে, ওর নাম কি, রাজবাড়ির বাজার সরকার আমি, আমার যে কখন জাগরণ কখন নিদ্রা আমি নিজেই টের পাই না। তবে ওর নাম কি, কেমন করে বলি বলুন স্যার, আমি ঘুমিয়েই ছিলাম না জেগেই ছিলাম। কারণ ঘুমোলেও আমাদের জেগে থাকতে হয়, জাগা অবস্থাতেই ঘুমিয়ে নিতে হয়। এই দেখুন না স্যার, ওর নাম কি, আজ প্রায় পনের বছর একাদিক্রমে এই রাজবাড়িতে বাজার সরকারের কাজ করে আসছি, শরীরটা ক্রমে শণের দড়ির মত পাকিয়ে যাচ্ছে, তবু ওর নাম কি, পনের বছর আগেকার সুবোধ, একান্ত সুবোধ বালকটির মত বাজার সরকারের পদেই রয়ে গেল। আমার ছোট্‌ঠাকুদা বলেন, সুবোধ আমাদের সেই সুবোধই আছে। কুড়ি টাকায় ঢুকেছিলাম, এখন সাকুল্যে পচিশে গিয়ে ঠেকেছে। তা ওর নাম কি, করছি কি বলুন!

বিকাশ বুঝতে পেরেছিল, লোকটা একটু বেশীই কথা বলে, এবং মনে মনে খুশি নয়। ক্রমাগত বাজার সরকারের পদে একাদিক্রমে পনের বৎসর তোষামোদ ও মিথ্যার কারবার করে করে, এখন যা বলে তার হয়তো মোল আনাই মিথ্যে। এক্ষেত্রে এ লোকটাকে বেশী ঘাঁটিয়েও বিশেষ কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না। তাই সে তাড়াতাড়ি সুবোধকে বিদায় দিল।

রাত্রিও প্রায় শেষ হয়ে এল। পূর্বাকাশে রাত্রিশেষের বিলীয়মান আবছা অন্ধকারের পর্দা ভেদ করে অস্পষ্ট আলোর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

এর পর রাজাবাহাদুরের সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে, লাশ স্থানীয় হাসপাতালের ময়নাঘরে ময়না-তদন্তের জন্য পাঠাবার ব্যবস্থা করে, সেদিনকার মত বিকাশ রাজবাটী থেকে বিদায় নিল।

ফেরবার পথে বিকাশ ও সুব্রত একসঙ্গেই পথ অতিক্রম করছিল। সুব্রত বললে, চলুন বিকাশবাবু, রাত্রি প্রায় ভোর হয়ে এল, আমার ওখানে এক কাপ চা খেয়ে যাবেন। এবং চা খেতে খেতে জবানবন্দিতে কি জানতে পারলেন তা শোনা যাবে।

বেশ চলুন, বকবক করে করে গলাটাও শুকিয়ে গেছে, এক কাপ চা এ সময় তো দেবতার আশীবাদ! জবানবন্দিতে বিশেষ কিছু জানা গেছে বলে তো আমার মনে হয় না। সবই টুকে এনেছি, পড়ে দেখুন যদি কিছুর সন্ধান পান।

দুজনে এসে সুব্রতর বাসায় উপস্থিত হল। থাকোহরিকে ডেকে চায়ের ব্যবস্থা করতে বলে সুব্রত বিকাশকে নিয়ে বারান্দায় দুটো চেয়ার পেতে বসল। রাত্রিশেষের বিলীয়মান তরল অন্ধকারে চারিদিক কেমন যেন স্বপ্নাতুর মনে হয়।

১.১৪ আরও সাংঘাতিক

গরম গরম চা-পান করতে করতে সুব্রত গভীর মনোযোগের সঙ্গে গতরাত্রের ঘটনা সম্পর্কে বিকাশের নেওয়া জবানবন্দি ও অন্যান্য নোটগুলি পড়ছিল। বিকাশের একেবারে শতকরা নিরানব্বইজন দারোগাবাবুর মত কেবল পকেটভর্তির দিকেই নজরটা সীমাবদ্ধ নয়। বেশ কাজের লোক এবং একটা জটিল মামলার মধ্য থেকে অপ্রয়োজনীয় অংশগুলো বাদ দিয়ে প্রয়োজনীয় কথাগুলো বেছে নেওয়ার একটা ন্যাক আছে বলতেই হবে। বিকাশের নেওয়া নোট ও জবানবন্দির কতকগুলো কথা সুব্রতর মনে যেন একটু নাড়া দিয়ে যায়। কথার পিঠে কথা হলেও, কথাগুলোর মধ্যে বেশ একটু গুরুত্ব আছে বলে যেন মনে হয়।

চা পান ও কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনা চালাবার পর বিকাশ সুব্রতর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল তখনকার মত। বলে গেল সন্ধ্যার দিকে আবার এদিকে আসবে। বিকাশের যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, সুব্রতও আর মুহূর্ত দেরি না করে গতরাত্রে লাহিড়ীর ঘর থেকে চুরি করে সংগৃহীত কাগজপত্রগুলো ও হিসাবের খাতাটা খুলে নিয়ে বসল।

কাগজপত্রগুলো, সাধারণ কয়েকটা ক্যাশ-মেমো—সেগুলো পরীক্ষা করে তার মধ্যে এমন কোনো বিশেষত্ব পাওয়া গেল না। তবে তার মধ্যে গোটা দুই ইনভয়েস ছিল,-৬০টা ড্রাই সেল ব্যাটারী (সাধারণ টর্চবাতির জন্য যা ব্যবহৃত হয়) কেনা হয়েছে, তারই ইনভয়েস। এতগুলো ব্যাটারী একসঙ্গে কেনবার লোকটার হঠাৎ কি এমন প্রয়োজন হয়েছিল? একমাসের মধ্যে প্রায় ১২০টা ব্যাটারী কেনা হয়েছে।

যা হোক ক্যাশমেমোগুলো পরীক্ষা করে হিসাবের খাতাটা সুব্রত খুললে। সাধারণ দৈনন্দিন হিসাব নয়, মাসিক মোটামুটি একটা আয় ও ব্যয়ের হিসাব মাত্র।

৫ই নভেম্বর : দু হাজার টাকা ন্যাশনাল ব্যাঙ্কে জমা দেওয়া হয়েছে।

৭ই নভেম্বর : তারাপ্রসন্ন নামক কোনো ব্যক্তির নামে দশ হাজার টাকা খরচ দেখানো হয়েছে।

লোকটা কত মাইনে পেত তা সুব্রত জানে। মাসে মাত্র তিনশত টাকা, ইদানীং মাস-দুই হবে চারশত টাকা বেতন পাচ্ছিল। অথচ সুব্রত হারাধনের ওখানে শুনেছে, এখানে আসবার পূর্বে সতীনাথের সাংসারিক অবস্থা খুব খারাপই ছিল। ইদানীং এই কয়েক বৎসর চাকরি করে সে কেমন করে এত টাকার মালিক হতে পারে? এর মধ্যে যে একটা গভীর রহস্যের ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে সে বিষয়েও কোনো ভুল নেই। এসব ছাড়া দেখা যাচ্ছে,ন্যাশানাল ব্যাঙ্কে কোনো শ্রীপতি লাহিড়ীর নামে প্রতি মাসে ছশত থেকে সাতশত টাকা জমা দেখানো হয়েছে। এই শ্রীপতি লাহিড়ীই বা কে? এ কি লাহিড়ীর কোনো আত্মীয়? না আগাগোড়া শ্রীপতির ব্যাপারটা একটা চোখে ধুলো দেবার ব্যাপার মাত্র!

কিরীটী ওকে ঠিকই লিখেছিল। সতীনাথ একটি গভীর জলের মাছ, তার প্রতি ভাল করে নজর রাখতে। কিন্তু সতীনাথের কর্মময় জীবনের ওপরে যে এত তাড়াতাড়ি যবনিকা নেমে আসবে তা সুব্রত স্বপ্নেও ভাবেনি। এ যেন বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মতই আকস্মিক ও অচিন্তনীয়। তারপর আরও একটা জিনিস ভাববার আছে। লাহিড়ীর এই হত্যা-ব্যাপারের সঙ্গে পূর্বতন সুহাসের হত্যা-ব্যাপারের কোনো সংস্পর্শ বা যোগাযোগ আছে কি না। এটা সেই কয়েক মাস আগেকার পুরাতন ঘটনারই জের, না নতুন কোনো হত্যা-ব্যাপার? রাজাবাহাদুরের কাছে জানা গেল ঐ নিশানাথ লোকটা বিকৃত-মস্তিষ্ক একজন আর্টিস্ট। অথচ ওর কথা কালই সর্বপ্রথম সুব্রত জানতে পারল। ইতিপূর্বে ঘুণাক্ষরেও নিশানাথের অস্তিত্ব সম্পর্কে সুব্রত জানতে পারেনি। গতরাত্রের ব্যাপার দেখে মনে হল, নিশানাথ লোকটিকে রাজাবাহাদুর সযত্নে আড়াল করে যেন রাখতে চান। সেই কারণেই হয়ত তাড়াতাড়ি তাকে অন্য সকলের সামনে থেকে সরাবার জন্য তিনি অতি মাত্রায় ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু কেন? লোকটা যদি সত্যিই বিকৃত-মস্তিষ্ক হয়, তবে তাকে এত ভয়ই বা কেন? তারপর নিশানাথের কথাগুলো! সেগুলো কি নিছক প্রলাপোক্তি ভিন্ন আর সত্যিই কিছু নয়?

এখন পর্যন্ত সুব্রত নৃসিংহগ্রামে একটিবার গিয়ে উঠতে পারেনি। তারপর সাঁওতাল প্রজা! হ্যাঁ, শুনেছে বটে ও, নৃসিংহগ্রামের অর্ধেকের বেশীর ভাগ প্ৰজাই সাঁওতাল ও বাউড়ী জাতি, এখানেও নদীর ধারে রাজাদের প্রায় একশত সাঁওতাল প্রজা আছে। এখানে আসবার পর, কাজ করবার কোনো সূত্রই আজ পর্যন্ত সুব্রত পায়নি। অথচ প্রায় দেড় মাস হতে চলল এখানে সে এসেছে!

ঐ তারিণী চক্রবর্তী, মহেশ সামন্ত, সুবোধ মণ্ডল—লোকগুলো যেন এক-একটি টাইপ চরিত্রের। সকলেই রাজবাড়িতে বহুকালের পুরাতন কর্মচারী।

সুহাসের মা, রসময়ের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী মালতী দেবী, সুব্রত এখনও তাঁকে একটি দিনের জন্যও দেখেনি। শোনা যায়, একটিমাত্র পুত্রের মৃত্যুর পর তিনি সহসা যেন অন্তঃপুরে আত্মগোপন করছেন। দিবারাত্র ঠাকুরঘরে পূজা-আর্চ নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। কোথাও বড় একটা বের হন না বা তেমন কারও সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎও করেন না।

রাজাবাহাদুর সুবিনয় মল্লিকের স্ত্রীও মৃতা এবং তাঁর একটিমাত্র পুত্র প্রশান্ত কলকাতায় তার মামার বাড়ীতে থেকেই পড়াশুনা করে। ছুটিছাটায় রায়পুরে আসে কখনও কচিৎ।

সুব্রত কেবল ভেবেই চলে, ভাবনার যেন কোনো কূল-কিনারা পায় না। যা হোক ঐ দিনই দ্বিপ্রহরের দিকে ও একটা দীর্ঘ চিঠি কিরীটীকে লেখে, সব ব্যাপারটা জানিয়ে।

***

দিন-পাঁচেক বাদে কিরীটীর চিঠির জবাব আসে।

কলিকাতা
২৬শে ফাল্গুন

কল্যাণ,

তোর চিঠি পেলাম। তোর চিঠি পড়ে মনে হল যেন তুই অত্যন্ত গোলমালে পড়ে গেছিস। সতীনাথের জন্য এত চিন্তার কোন কারণ নেই তো। একটু ভাল করে ভেবে দেখলেই বুঝতেই পারবি আমার সন্দেহ ও গণনা ভুল হয়নি, এবং ক্রমে সেটাও প্রমাণিত হতে চলেছে। সতীনাথের মৃত্যুর প্রয়োজন হয়েছিল, তাই তাকে ঐভাবে মৃত্যুবরণ করতে হল। শুনেছি রহস্যময়ী পৃথিবীতে এক ধরনের নাকি সাপ আছে, যারা ক্ষুধার সময় নিজেদের দেহ নিজেরাই গিলতে শুরু করে। হতভাগ্য সতীনাথও সেই রকম কোনো ক্ষুধার্ত সাপের পাল্লায় পড়েছিল হয়ত। নইলে–যাক গে সে কথা, কিন্তু তোর শেষ চিঠিটা পড়ে আমি ভাবছি আর একজনের কথা। তারও মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে মনে হচ্ছে, তবে এই ভরসা সতীনাথের মত অত চট করে তাকে হত্যা করা হয়ত চলবে না। রীতমত ভেবেচিন্তে তাকে এগুতে হবে। তুই লিখেছিস হাতের কাছে কোনো সূত্র খুঁজে পাচ্ছিস না! তোদের ঐ রাজবাটির অন্দরের দারোয়ান শ্ৰীমান ছোট্ট সিং, তার জবানবন্দি তো নিসনি? খোঁজ নিয়ে দেখিস দেখি, লোকটা মাথায় পাগড়ী বাঁধে কিনা? আর কয় সেট পেটেন্ট দারোয়ানী লোহার নাল-বসানো নাগরা জুতো সে রাখে? তারিণী আর মহেশের উক্তি একান্ত পরস্পরবিরোধী! ওদের মধ্যে একজন সম্ভবত সত্যি বলেনি। ঘড়ি ধরে দেখিস তো, তারিণীর ঘর থেকে অন্দরে যাওয়ার দরজাটার গোড়ায় পৌঁছতে কত সময় ঠিক লাগে? গোলমালের সময় ছোট্টু সিং কোথায় ছিল? শ্রীমান সুবোধ পরিপূর্ণ সজ্ঞানেই ছিলেন, যদি আমার কথা বিশ্বাস করিস! মহেশের কথাগুলোও অবহেলা করলে চলবে না। বেশ ভাববার। টিউবওয়েল দেখেছিস কখনও? তাতে যখন জল পাম্প করলেও জল বের হতে চায় না, তখন তার মধ্যে কিছু জল ঢেলে পাম্প করলেই জল উঠে আসে। তাকে বলে জল দিয়ে জল বের করা। এ কথা নিশ্চয়ই অস্বীকার করতে পারবি না যে, সুবোধ জল ও দুধের পার্থক্য বোঝে না!

তবে হ্যাঁ, সবই শ্রমসাপেক্ষ। তোকে তো আগেই বলেছি, হত্যাটাই সমস্ত হত্যারহস্যের শেষ! তরুশাখা সমন্বিত বিষবৃক্ষ! যা কিছু রহস্য থাকে, সবই সেই হত্যার পূর্বে। সমস্ত রহস্যের পরে যবনিকাপাত হয় হত্যার সঙ্গে সঙ্গেই। সেই জন্যেই রহস্যের কিনারা করতে হলে তোকে গোড়া থেকে শুরু করতে হবে। আমার যতদূর মনে হয়, সতীনাথের হত্যারহস্যের মূলের সঙ্গে সুহাসের হত্যার মূল জড়িয়ে জট পাকিয়ে আছে। এখন গিটগুলো খুলতে হবে আমাদেরই। নৃসিংহগ্রামে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একবার ঘুরে আয়। একটা ভাল সার্ভে করবি। চোখ খুলে রাখবি সর্বদা। পারিস তো দু-একদিনের ছুটি নিয়ে একবার এদিকটা ঘুরে যাস। তুই তো জানিস, আমার কলমের চাইতে মুখটা বেশী সক্রিয়। তোর পত্রের আশায় রইলাম। ভালবাসা নিস, তোর ক।

কিরীটীর চিঠিটা সুব্রত আগাগোড়া খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চার-পাঁচবার পড়ে ফেলল।

এই দীর্ঘ পাঁচদিনে অনেক কিছুই সুব্রত দেখেছে। ইতিমধ্যে ময়না-তদন্তের রিপোর্টে জানা গেছে, সতীনাথের মৃত্যু ঘটেছে তীরের ফলার সঙ্গে মাখিয়ে তীব্র কোনো বিষ-প্রয়োগের ফলে। যে তীরটা সতীনাথের বুকের মধ্যে গিয়ে বিধেছিল, সেটার গঠনও আশ্চর্য রকমের। তীরটি লম্বায় মাত্র ইঞ্চি-চারেক, সরু একটা ছাতার শিকের মত, কঠিন ইস্পাতের তৈরী। তীরের অগ্রভাগে ১/৩ ইঞ্চি পরিমাপের একটা ছুঁচলো চ্যাপটা ফলা আছে। তাতেই বোধ করি বিষ মাখানো ছিল। তীরটা বিকাশের কাছেই আছে। তীরটাকে হত্যার অন্যতম প্রমাণ হিসাবে রাখা হয়েছে। আজ পর্যন্ত সুব্রত অনেক ভেবেও ঠিক করে উঠতে পারেনি, কি উপায়ে এবং কি প্রকারে যন্ত্রের সাহায্য এই সরু ছোট্ট তীরটা নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। তবে যেভাবেই তীরটা ছোঁড়া হোক না কেন, তীর নিক্ষেপের যন্ত্রটি যে অতীব শক্তিশালী তাতে কোনো সংশয়ই থাকতে পারে না। কারণ তীরটার অংশ মৃতদেহের বুকের মধ্যে অনেকটা ঢুকে ছিল। হত্যাপরাধে এখনও কাউকেই গ্রেপ্তার করা হয়নি বটে, তবে হত্যাপরাধকে কেন্দ্র করে রায়পুরে বেশ যেন একটা চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। রাজাবাহাদুর সুবিনয় মল্লিক লোকটা অত্যন্ত আমুদে ও মিশুঁকে। সতীনাথের হত্যার পর থেকে সেই যে তিনি প্রাসাদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছেন, আজ পর্যন্ত তাঁকে আর কেউ বের হতে দেখে নি। স্টেটের অতি আবশ্যকীয় বা বিশেষ প্রয়োজনীয় কোনো কাজে রাজাবাহাদুরের পরামর্শ নিতে হলে সতীনাথের অভাবে আজকাল সুব্রতকে রাজাবাহাদুরের সঙ্গে দেখা করতে হয়। এবং সেই ধরনের কাজে ইতিমধ্যে দু-তিনবার সুব্রতর রাজাবাহাদুরের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ যা হয়েছে, সেও খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য।

সুব্রত নিজেই গায়ে পড়ে একটিবার নৃসিংহগ্রাম মহালটা দেখে আসবার প্রস্তাব রাজাবাহাদুরের কাছে উত্থাপন করেছিল। রাজাবাহাদুর সুবিনয় মল্লিক সম্মতিও দিয়েছেন। ঠিক হয়েছে, আগামী পরশু সুব্রত সেখানে যাবে। আজকাল আর সুব্রতর হারাধনদের ওখানে নিয়মিত সন্ধ্যায় যাওয়া হয়ে ওঠে না। প্রায় সুব্রত হাঁটতে হাঁটতে থানার দিকে যায়। তারপর সেখানে থানার সামনে খোলা মাঠের মধ্যে দুটো ক্যাম্বিসের ইজিচেয়ার পেতে বিকাশ ও সুব্রত দুজনের মধ্যে সতীনাথের হত্যা সম্পর্কে নানাপ্রকার আলাপ আলোচনা চলতে থাকে।

আজও সন্ধ্যার দিকে কিরীটীর চিঠিটা নিয়ে সুব্রত থানার দিকে অগ্রসর হল। ইদানীং সতীনাথের হত্যা-ব্যাপারের পর থেকে সুব্রতর যেন মনে হয়, সর্বদাই কে যেন তার পিছু পিছু ছায়ার মত তাকে অলক্ষ্যে অনুসরণ করে ফিরছে। কিন্তু কোনোরূপ চাক্ষুষ প্রমাণ আজ পর্যন্ত সে পায়নি। কতবার সে চলতে চলতে ফিরে তাকিয়েছে হঠাৎ, কিন্তু কেউ নেই। অথচ মনে হচ্ছিল একটু আগেও, যেন কারও সুস্পষ্ট পায়ের শব্দ সে শুনেছে। হয়ত এটা কিছুই নয়, তার সদাসন্দিগ্ধ মনের বিকারমাত্র। কিন্তু তথাপি মনের মধ্যে একটা সন্দেহের অস্বস্তিকর কালো ছায়া তাকে সর্বদা পীড়ন করেছে। থানার সামনেই ভোলা মাঠ, রুক্ষ। থানার একপাশে একটা অনেক কালের পাকুড় গাছ। প্রথম রাত্রে আজ চাঁদ উঠেছে, পাকুড় গাছের পাতার ওপরে সামান্য মলিন আলোর আভাস। ঝিরঝির করে শেষ ফাল্গুনের হাওয়া বয়ে যায়।

বিকাশ প্রতিদিনের মত, বোধ হয় হয়ত সুব্রতর প্রতীক্ষ্ণয়, ক্যাম্বিসের চেয়ারটার উপর গা ঢেলে দিয়ে একটা সিগারেট টানছিল। অদূরে সব্রতকে আসতে দেখে সোজা হয়ে বলে, আসুন সুব্রতবাবু! আজ যে এত দেরি?

সুব্রত ঠোঁটের ওপরে তর্জনীটা বসিয়ে বলে, বিকাশবাবু, আপনি বড় অসাবধানী। কতবার আপনাকে সাবধান করে দিয়েছি, এখানে আমি সুব্রত রায় নয়, কল্যাণ রায়! মনে রাখবেন আমি শক্ৰবেষ্টিত পুরীর মধ্যে বাস করছি, কখন কার কানে কি কথা যাবে, সর্বনাশ হয়ে যাবে!

বিকাশ হাসতে হাসতে জবাব দেয়,বসুন, কল্যাণবাবু। কি করি বলুন, অভ্যাসের দোষ, মনে থাকে না,ভুলে যাই। তারপর বন্ধুর চিঠি পেলেন?

হ্যাঁ, এই নিন পড়ুন। সুব্রত বুকপকেট থেকে খামসমেত কিরীটীর চিঠিটা বের করে বিকাশের হতে তুলে দেয়।

অন্ধকারে পড়া যাবে না। এই চৌবে, একটা লণ্ঠন নিয়ে আয়! বিকাশবাবু হাঁক দেয়।

একটু পরেই চৌবে একটা হ্যারিকেন বাতি নিয়ে এসে সামনে রাখে।

হ্যারিকেনের আলোয় তখুনি বিকাশ চিঠিটা আগাগোড়া পড়ে ফেলে। তারপর চিঠিটা পুনরায় ভাঁজ করে খামের মধ্যে ভরে সুব্রতর দিকে এগিয়ে দেয়।

সত্যি, এ কথাটা আমার একবারও মনে হয়নি যে সেরাত্রে ঘোটু সিংয়ের একটা জবানবন্দি নেওয়ার প্রয়োজন ছিল! বিকাশ বলে।

আমি অবিশ্যি ছোট্টু সিংকে ডেকে দুচারটে প্রশ্ন করেছি। কিন্তু আপনার পক্ষে যতটা সম্ভব, আমার পক্ষে ততটা করা সম্ভব নয়। লোকের সন্দেহ জাগতে পারে, কেন আমি এত আগ্রহ দেখাচ্ছি!

করেছিলেন নাকি? কই এতদিন এ কথা তো আমায় বলেননি? বিকাশ বললে।

বলিনি তার কারণ, ছোষ্ট্র সিংকে যেসব প্রশ্ন আমি করেছি, একান্ত মামুলী। সে বলে, সে নাকি সেই রাত্রে রাজাবাহাদুরের হুকুমে রাত্রি সাড়ে দশটার সময়েই অন্দরমহলের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। তাছাড়া আগের দিন থেকে তার শরীরটা সুস্থ ছিল না, তাই ঘরের মধ্যে শুয়ে ঘুমিয়ে ছিল, তারপর চিৎকার ও গোলমালের শব্দে ঘুম ভেঙে উঠে যায় এবং সব দেখে। তার আগে নাকি সে কিছুই টের পায়নি।

ছোট্টু সিংয়ের ঘরটা ঐ দরজা থেকে কত দূর?

তা প্রায় হাত-দশ-বারো দূরে তো হবেই! সুব্রত মৃদুকণ্ঠে বলে।

কিন্তু আপনার বন্ধুর চিঠি পড়ে তো মনে হয়, তিনি ঐ দারোয়ান ছোট্টু সিংকে যেন একটু সন্দেহ করছেন!

কেন, কিসে আপনি তা বুঝলেন?

প্রথম কথা ধরুন, সতীনাথের কাছে যে চিঠি নিয়ে গিয়েছিল, আমরা জানতে পেরেছি। তার মাথায় ছিল পাগড়ী বাঁধা। দ্বিতীয়, মহেশ সামন্ত যে জুতোর শব্দ পেয়েছিল, তার ধারণা সেই জুতোর তলায় কোনো নাল-বাঁধানো থাকলে যেমন শব্দ হয় শব্দটা তেমনি এবং আপনার বন্ধুও চিঠির মধ্যে ঐ কথা লিখেছেন। এখন খোঁজ নিতে হবে সত্যিই ছোট্টু সিংয়ের কজোড়া পেটেন্ট দারোয়ানী লোহার নাল-বসানো নাগরাই জুতো আছে?

তাতে কি?

আমার কেন যেন মনে হচ্ছে—ঐ ছোট্টু সিংয়ের উপরেই আপনার বন্ধুর সন্দেহটা বেশী পড়েছে।

চিন্তিত হবেন না বিকাশবাবু। তাই যদি হয় তো,যথাসময়ে পাকড়াও তাকে করা যাবে, এখন থেকে কেবল শুধু তার সকলপ্রকার গতিবিধির ওপরে আমাদের সদা সজাগ দৃষ্টি রাখলেই চলবে। এবং তাতে করে সত্যিই যদি তাকে গ্রেপ্তার করা আমাদের প্রয়োজন হয়, তবে বেগ পেতে হবে না।

মুখে সুব্রত বিকাশকে যাই বলুক না কেন, দিন-দুয়েক আগে ছোট্টু সিংয়ের সঙ্গে দু-চারটে কথাবার্তা বলে মনে মনে সে যে বেশ একটু চিন্তিত হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো ভুলই নেই। কিন্তু বিকাশ পুলিশের লোক, তাকে সে কথা বললে এখুনি হয়ত সে বিশেষ রকম তৎপর হয়ে উঠবে, ফলে তার প্ল্যান হয়ত সব ভেস্তে যাবে। তাই সে ছোট্ট সিংয়ের ব্যাপারটা কতকটা যেন ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করল। সুব্রত যে একটু আগে বিকাশকে বলছিল ছোষ্ট্র সিংকে সে জেরা করেছে, আসল ব্যাপারটা হচ্ছে এই

দিন দুয়েক আগে ছোট্টু সিংকে সুব্রত কয়েকটা প্রশ্ন সত্যিই করেছিল। স্টেট সংক্রান্ত কাজের নির্দেশ নিয়ে ছোট্টু সিং সেদিন বিকেলের দিকে রাজাবাহাদুরের কাছ থেকে সুব্রতর কাছে এসেছিল, কাজ হয়ে যাবার পর দু-চারটে অপ্রাসঙ্গিক কথাবাতার ফাঁকে আচমকা সুব্রত প্রসঙ্গটা উত্থাপন করেছিল। ছোষ্ট্র সিং এ বাড়িতে মাত্র বছর পাঁচেক হল কাজ করছে, বয়েস চল্লিশের বেশী নয়। বেরিলীতে বাড়ি। রাজাবাহাদুর সুবিনয় মল্লিকের ও সীতনাথের অত্যন্ত বিশ্বাসের পাত্র। অন্দরমহলের পাহারাদারীর ভার ছোট্টু সিংয়ের ওপরই ন্যস্ত। লোকটা লম্বাচওড়া এবং গায়ে শক্তি রাখে প্রচুর। পরিধানে সর্বদাই প্রায়-ঈষৎ গোলাপী আভাযুক্ত আট-হাতি একখানা ধুতি। গায়ে সাদা মেজাই, মাথায় প্রকাণ্ড সাদা পাগড়ী। পায়ে লোহার নাল-বসানো হিন্দুস্থানী নাগরা জুতো। হাতে পাঁচহাত প্রমাণ একখানা স্টিলের পাত দিয়ে মোড়া তেল-চকচকে লাঠি। দাঁড়িগোঁফ একেবারে নিখুঁতভাবে কামানো। উপরের পাটির সামনের দুটো দাঁত সোনা দিয়ে বাঁধানো। কথায় কথায় ছোট্টু সিং বললে, কি বলব বাবু, আগাগোড়া ব্যাপারটা যে টেরই পেলাম না, না হলে–

কেন, তুমি তো ভেতরেই থাকতে!

থাকতাম তো বাবু, কিন্তু সেদিন সিদ্ধির নেশাটা বোধ হয় একটু বেশীই হয়ে গিয়েছিল। বিছানার ওপরে সাঁঝ থেকেই কেমন ঝিম্ মেরে শুয়েছিলাম, অনেক হাল্লা চেঁচামেচি হতে তবে টের পেলাম।

বল কি! অত গোলমাল তুমি শুনতে পাওনি?

নেশা বড় বদ জিনিস বাবু, একেবারে অজ্ঞান করে দেয়। হুঁশ কি ছাই ছিল! কিন্তু একথা রাজাবাবু জানেন না, জানলে এখুনি আমার চাকরি চলে যাবে।

তাহলে তুমি সেরাত্রে দরজাটাও বন্ধ করেই রেখেছিলে, কি বল?

হ্যাঁ বাবু। দরোয়াজা তো সেই রাত্রি বারোটায় বন্ধ হয় সাধারণত। তার আগে দরোয়াজা বন্ধ করার হুকুম নেই, তবে সেদিন রাজাবাবুর হুকুমেই রাত্রি দশটায় দরজা বন্ধ করা হয়েছিল। তাছাড়া ভারী বজ্জাত ও লহাড়ী বাবু, বলব কি বাবু, শালা মরেছে তাতে আমার এতটুকুও দুঃখ হয়নি, ওর জ্বালায় রাত্রে কতবার যে আমাকে দরোয়াজা খুলে দিতে হয়েছে, যখন-তখন ও অন্দরে রাজাবাবুর সঙ্গে দেখা করতে যেত।

রাত্রেও বুঝি তিনি প্রায়ই রাজবাড়ির মধ্যে যেতেন?

হ্যাঁ বাবু, প্রায়ই। যত সলা-পরামর্শ রাজাবাবুর তা হত ঐ লহাড়ীবাবুর সঙ্গেই।

শুনেছি লাহিড়ীবাবু নাকি প্রায়ই রাত্রে রাজাবাবুর সঙ্গে দাবা খেলতে আসতেন?

হ্যাঁ বাবু। রাজাবাবু খুব ভালো দাবা খেলতে পারেন।

এর পর সুব্রত ছোট্টু সিংকে বিদায় দিয়েছিল সেদিনকার মত।

সুব্রতর মনে মনে খুবই ইচ্ছা ছিল সমগ্র রাজবাটীর অন্দরমহলটাও একবার ঘুরে দেখে। কিন্তু সুবিধা করে উঠতে পারেনি আজ পর্যন্ত। এমন কোনো একটা ছল-ছুতো ও ভেবে ভেবে আজও বের করতে পারেনি, যাতে করে ওর ইচ্ছেটা ও পূরণ করতে পারে।

কিন্তু নৃসিংহগ্রামে যাবার আগে রাজবাড়ির ভিতর-মহলটা ও একটিবার দেখতে চায় এবং নিজের চোখে দেখবার যখন কোনো সুবিধাই নেই, বিকাশের উপরেই ওকে নির্ভর করতে হবে। সেই কথাটাই আজ ও বিকাশের কাছে উত্থাপন করবে, আগে হতেই ভেবে ঠিক করে এসেছিল।

ভৃত্য দুগ্লাস সরবৎ ও কিছু ফল ডিশে করে সাজিয়ে নিয়ে এল। দুজনে কথাবার্তা বলতে বলতে সরবৎ পান করছে, এমন সময় রাজবাড়ির একজন কর্মচারী সাইকেল হাঁকিয়ে সেখানে এসে উপস্থিত হয়ে বিকাশের হাতে একখানা খাম দিল, রাজাবাহাদুর পাঠিয়েছেন।

কি ব্যাপার সতীশ? বিকাশ ব্যগ্রভাবে প্রশ্নটা করতে করতেই খাম ছিঁড়ে চিঠিটা পড়তে শুরু করে দিল। চিঠিটা পড়তে পড়তে বিকাশের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। সুব্রত উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করলে, কিসের চিঠি?

এখুনি আমাকে একবার উঠতে হবে মিঃ রায়। রাজাবাহাদুরকে কে বা কারা তাঁর নিজের শয়নকক্ষের হাতের উপরে ছুরি মেরে হত্যা করবার চেষ্টা করেছিল।

অ্যাঁ! সে কি! সুব্রত চমকে ওঠে।

দেখুন দেখি কি ঝামেলা! বিরক্তিমিশ্রিত কণ্ঠে বিকাশ বলে।

সতীশ স্তব্ধ হয়ে একপাশে আদেশের প্রতীক্ষ্ণয় দাঁড়িয়ে ছিল। এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি, এবারে সে প্রশ্ন করলে, আমি যেতে পারি হুজুর?

হ্যাঁ যাও, রাজাবাহাদুরকে বল গিয়ে এখুনি আমি আসছি।

উনি আহত হয়েছেন নাকি?

সে সম্পর্কে তো কিছুই লেখেননি। কেবল অনুরোধ জানিয়েছেন, এখুনি একবার যেতে।

সতীশ সাইকেলে উঠেছিল, সহসা ঘুরে দাঁড়িয়ে সুব্রতর দিকে তাকিয়ে বললে, অন্ধকারে ভাল করে আপনাকে আমি চিনতে পারিনি স্যার। রাজাবাহাদুর আপনাকেও যেতে বলেছিলেন রায়বাবু, কিন্তু আপনার বাসায় গিয়ে আপনাকে আমি দেখতে পেলাম না, চাকরও বলতে পারল না, আপনি কোথায় গেছেন!

তুমি যাও সতীশ, আমিও বিকাশবাবুর সঙ্গেই আসছি।

সতীশ আর দ্বিতীয় বাক্যব্যয় না করে পা-গাড়িতে চেপে রওনা হয়ে গেল।

 ১.১৫ আবার আততায়ীর আবির্ভাব

বিকাশ চটপট প্রস্তুত হয়ে নিল এবং দুজনে আর বিলম্ব না করে রাজবাড়ির দিকে দ্রুত পা চালিয়ে দিল।

সুব্রত বিকাশের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, ব্যাপারটা যেন কেমন মনে হচ্ছে বিকাশবাবু! রাজবাড়ির অন্দরে অচেনা লোক এসে স্বয়ং রাজাবাহাদুরকে ছুরিকাঘাত করবার চেষ্টা করেছে!

আমিও কিছু বুঝে উঠতে পারছি না কল্যাণবাবু।

চলুন দেখা যাক।

রাত্রি বোধ করি পৌনে নটা হবে, রাত্রির কালো আকাশটা ভরে অসংখ্য হীরার কুচির মত তারাগুলো ঝিলমিল করছে।

ছোট শহর এর মধ্যেই নিঝুম হয়ে এসেছে। রাস্তায় লোকজন বড় একটা দেখা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে দুএকটা কুকুরের ডাক শোনা যায় কেবল।

রাস্তার দুপাশে কেরোসিনের বাতিগুলো টিমটিম করে জ্বলে।

কারো মুখেইকোনো কথা নেই, দুজনে নিঃশব্দে পাশাপাশি এগিয়ে চলে বেশ দ্রুত পদক্ষেপেই।

সুব্রতর মনে অনেক কথাই স্রোতের আবর্তের মত পাক খেয়ে খেয়ে ফিরছিল। ব্যাপারটা সত্যিই কেমন যেন একটু গোলমেলে। কেউ রাজাবাহাদুরকে হত্যা করবার চেষ্টা করেছিল। তাও রাজবাড়িতে রাজাবাহাদুরের নিজ শয়নকক্ষের সামনের ছাতে। আজও কি তাহলে ছোট্ট সিং বেশী সিদ্ধির নেশা করেছে? আশ্চর্য, যা কিছু অঘটন ঘটছে, সবই রাজ-অন্তঃপুরের মধ্যে! এতগুলি লোকের সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে আততায়ী কেমন করেই বা রাজ-অন্তঃপুরে প্রবেশ করে এবং নির্বিঘ্নে তার কাজ হাসিল করে?

রহস্য ক্রমে ঘনীভূত হচ্ছে।

সহসা একসময় বিকাশ চলতে চলতে সুব্রতকে লক্ষ্য করে বলে, আপনাকে আজ কদিন থেকেই একটা কথা বলব বলব মনে করছিলাম কল্যাণবাবু, কিন্তু রোজই ভুলে যাই, শেষ পর্যন্ত বলা হয়ে উঠছে না।

কি বলুন তো?

এর মধ্যে একদিন কিন্তু লাহিড়ীর বাড়ীটা আমি সার্চ করে এসেছি।

তাই নাকি! কবে সার্চ করলেন?

সে যেদিন খুন হয় তার পরদিনই সকালে লাহিড়ীর বাড়িটা গিয়ে সার্চ করি।

সার্চ করে কিছু পেলেন?

না। তবে আপনি শুনলে হয়তো আশ্চর্য হবেন, আমার সার্চ করবার পূর্বেই, কোনো সহৃদয় ব্যক্তি সে বাড়িতে গিয়ে কিছু সার্চ করে এসেছেন মনে হল যেন আমার!

কি রকম? সুব্রত যেন কিছুই জানে না এইভাবে প্রশ্নটা করে।

ঘরের মধ্যে তার সব বাক্স-প্যাঁটরাগুলোই তালাভাঙা অবস্থায় পড়েছিল, তাই আমার কষ্টটা ন দেবায় ন ধর্মায়ই হয়ে গেল।

বাক্স-প্যাঁটরাগুলো খুঁজে কিছুই পেলেন না?

না। কতকগুলো জামাকাপড় নগদ কিছু টাকা ও খানকয়েক পুরাতন চিঠিপত্র। এবং তাতেই আমার ধারণা যে বাড়ির চাকর-বামুন বাক্সগুলো ভাঙেনি। বাইরে থেকে কেউ সকলের অলক্ষ্যে, যখন লাহিড়ীর মৃতদেহটা নিয়ে আমরা সবাই এদিকে ব্যস্ত ছিলাম, সেই ফাঁকে তার কাজ হাসিল করে চলে গেছে।

সুব্রত কোনো জবাব দেয় না, নিঃশব্দে পথ অতিক্রম করে চলে।

কিছুক্ষণ বাদে একসময় প্রশ্ন করে, হ্যাঁ ভাল কথা, একটা জিনিস কি আপনি লক্ষ্য করেছিলেন বিকাশবাবু যে, এই পুরাতন রাজবাড়ির ছাদ দিয়ে এক অংশ হতে অন্য অংশে অনায়াসেই যাতয়াত করা যায়?

কই না তো! তাই নাকি?

হ্যাঁ।

ইতিমধ্যে ক্রমে এরা দুজনে মৃদুস্বরে কথাবার্তা বলতে বলতে প্রাসাদের সামনে এসে পৌঁছে গেছে। রাজবাটির মধ্যে এসে প্রবেশ করল দুজনে। আজ সদর ও অন্দরের মধ্যবর্তী দরজাটা খোলাই ছিল এবং স্বয়ং ছোট্টু সিং দরজার সামনে লাঠি নিয়ে প্রহরায় নিযুক্ত ছিল। ওদের আসতে দেখে সে সেলাম জানাল।

অন্দরের আঙিনায় পা দিতেই ওদের কানে এল উন্মাদ নিশানাথের কণ্ঠস্বর, সাবধান, সাবধান! That boy, that mischievous boy again started his old game!

সুব্রত থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে।

আকাশে চাঁদ নেই, কেবল তারা। তারই মৃদু আলো আঙিনার উপরে এসে যেন অপূর্ব একটা মৃদু আলোছায়ার সৃষ্টি করেছে। অতর্কিতেই সুব্রতর মনে পড়ে যায়, মাত্র কয়েকদিনের আগেকার একটা বীভৎস দৃশ্য। ঐ তো ঐখানে সতীনাথ লাহিড়ার বিষজর্জরিত মৃতদেহটা ধনুকের মত বেঁকে পড়েছিল। তার অশরীরী আত্মা হয়ত এখনও এখানে নিঃশ্বাস ফেলে বেড়াচ্ছে, কে জানে!

সহসা আবার নিশানাথের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, আমায় তোমরা বোকা ঠাউরেছ বটে, অ্যাঁ! ভাবছ এ আগুন নিভবে? না, নিভবে না। কে? ও বৌদি! তোমার চোখে জল নেই কেন? কেন কাঁদতে পার না? কাঁদ, একটু কাঁদ বৌদি। কেমন করে এ পাপ সহ্য করে আছ আজও? দেখছ না সব পুড়ে গেল!

রাত্রির স্তব্ধ অন্ধকার যেন গম গম করে ওঠে নিশানাথের কণ্ঠস্বরে।

চলুন মিঃ রায়, বিকাশবাবুর ডাকে সুব্রত নিজেকে যেন সামলে নিয়ে আবার পা বাড়াল।

ঘোড়ানো সিঁড়ি বেয়ে দুজনে এসে উপরের দালানে দাঁড়াতেই সামনে রাজাবাহাদুরের খাসভৃত্য শঙ্কুকে দেখা গেল, আসুন বাবু,রাজাবাহাদুর এই ঘরেই আছেন।

ওরা বুঝলে শম্ভ ওদের জন্যই বোধ হয় অপেক্ষা করছিল। সামনের ঘরটাই রাজাবাহাদুরের বসবার ঘর। শম্ভুর আহ্বানে দুজনে দরজার পদা তুলে ঘরে গিয়ে প্রবেশ করে।

ঘরটার মধ্যে একটা যেন মৃত্যুর মতই স্তব্ধতা।

একটা বড় আরামকেদারায় সুবিনয় মল্লিক চোখ বুজে আড় হয়ে শুয়ে আছেন। ঘুমিয়ে পড়েছেন মনে হয়। তাঁর কোলের উপর দুটি হাত জড়ো করা। বুকে ও পিঠে একটা পট্টি বাঁধা।

ওদের পায়ের শব্দে রাজাবাহাদুর চোখ মেলে তাকালেন।

কে?

আমরা।

কল্যাণবাবু, বিকাশবাবু—আসুন!

ব্যাপারটা কি রাজাবাহাদুর?

বলছি, বসুন।

দুজনে রাজাবাহাদুরের সামনাসামনি দুটো চেয়ার অধিকার করে বসল।

একটুখানি থেমে রাজাবাহাদুর বললেন, এই দেখুন। এবারে আপনাদের আততায়ীর আক্রোশটা আমার উপরেই এসে পড়েছিল। কিন্তু অল্পের জন্য বেঁচে গেছি।

ব্যাপার তো কিছুই বুঝতে পারছি না রাজাবাহাদুর! বিকাশ প্রশ্ন করে।

আপনারা জানেন হয়ত, আমার শোবার ঘরের সংলগ্ন সামনে একটা ছোট খোলা ছাদ আছে। সন্ধ্যার দিকে অনেক সময় আমি সেই ছাদে একা একা ঘুরে বেড়াই। আজও বেড়াচ্ছিলাম, রাত্রি তখন বোধ করি আটটার বেশী হবে না, হঠাৎ একটা পায়ের শব্দ, চোখ মেলে চেয়ে দেখবার আগেই পিছন থেকে কে যেন আমায় ছোরা মারলে। কিন্তু অন্ধকারেই হোক বা আমার নড়াচড়ার জন্যই হোক, লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ছোরাটা বাঁদিককার কাঁধের উপরে গিয়ে বিঁধে যায়। সঙ্গে সঙ্গে আমিও বিদ্যুৎবেগে সরে যাই। আততায়ী ততক্ষণে একলাফে সিঁড়িতে গিয়ে পড়েছে—আমার নাগালের বাইরে। লোকটার পিছু পিছু ছুটে গেলাম বটে, কিন্তু ধরতে পারলাম না।

তখুনি চাকরবাকরদের ডাকলেন না কেন? প্রশ্ন করে সুব্রত।

সেটা আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি নিজেই ছুটতে ছুটতে সিঁড়ি পর্যন্ত আসি, কিন্তু পরমুহূর্তে লোকটা কোথায় যে উধাও হয়ে গেল, তার আর কোন পাত্তাই পেলাম না। তারপরে অবিশ্যি চাকরদের ডেকে খোঁজ করলাম অনেকক্ষণ ধরে, কিন্তু সবই বৃথা। আততায়ী পালিয়েছে তখন।

কিন্তু সত্যি যদি কেউ এসে থাকে, তাকে পালাতে হলে পালাতে হবে সেই নীচ দিয়েই, আর তো অন্য কোন পথ নেই শুনেছি। বিকাশবাবু বললেন।

ছোট্টু সিংও কি কাউকে পালাতে দেখেনি? প্রশ্ন করে সুব্রত।

না, ছোষ্ট্র সিং তো সেই সন্ধ্যা থেকে নিচেই ছিল।

আশ্চর্য! সুব্রত মৃদুস্বরে বললে।

আপনার বাড়ির চাকরদের প্রতি আপনার খুব বিশ্বাস, না রাজাবাহাদুর? প্রশ্ন করলেন এবারে বিকাশবাবু।

হ্যাঁ, ওদের কাউকেই সন্দেহ করতে পারি না দারোগাবাবু। একাদিক্রমে বহির্মহলে যারা অন্তত আট-দশ বছর চাকরি করে, তারাই পরে আমাদের অন্দরে স্থান পায়, এ বাড়ির এই নিয়ম বরাবর চলে আসছে বহুকাল থেকে।

তার মানে সন্দেহের বাইরে? সুব্রত বলে।

হ্যাঁ।

আঘাতটা কি খুব গুরুতর হয়েছে? সুব্রত প্রশ্ন করে।

বোধ হয় না। ডাক্তারকেও ডাকতে পাঠিয়েছি, এখনও এসে পৌঁছায়নি, কোথায় নাকি বাইরে বেড়াতে গেছে। নিজেই শম্ভুকে দিয়ে ফার্স্ট এড় নিয়েছি।

ঠিক এই সময় একপ্রকার হন্তদন্ত হয়েই ডাক্তার সোম এসে ঘরে প্রবেশ করলেন। তাঁর হাতে ডাক্তারীর কালো ব্যাগটা, ব্যাপার কি রাজাবাহাদুর? হঠাৎ এত জরুরী তলব? বাড়িতে ছিলাম না, এসেই শুনলাম, এখুনি ওষুধপত্র নিয়ে আসতে হবে!

এস ডাক্তার, মরতে মরতে বেঁচে গেছি। রাজাবাহাদুর কাঁধের ব্যাণ্ডেজটা খুলতে লাগলেন।

অপেক্ষা করুন, আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না, আমি হাতটা ধুয়ে আসি। যা করবার আমিই করবো। ডাক্তার মৃদুস্বরে বললেন।

পাশের অ্যাটাচড় বাথরুমে ঢুকে হাত ধুয়ে এসে ডাঃ সোম ব্যাণ্ডেজ খুলতে লাগলেন। স্ক্যাপুলার ঠিক মাঝামাঝি একটা দেড়ইঞ্চি পরিমাণ ক্ষতচিহুঁ। খুব বেশী রক্তক্ষয় হয়েছে বলে মনে হয় না। গোটা-দুই স্টীচ দিয়ে চটপট ডাক্তার ব্যাণ্ডেজটা বেঁধে দিল। টিটেনাস ইনজেকসনও। দিতে ভুল হল না। রাজাবাহাদুর ডাঃ সোমকে সমগ্র ব্যাপারটা তখন খুলে বললেন।

কিন্তু ব্যাপারটা যে ক্রমেই ঘোরালো হয়ে উঠছে রাজাবাহাদুর! ডাঃ সোম বলতে লাগলেন, একেবারে রাজঅন্তঃপুরের মধ্যে এরকম খুনজখম হতে শুরু করল? কার উপরে কখন বিপদ নেমে আসে—কেউ বলতে পারে না!

রাজাবাহাদুরও যেন বেশ চিন্তিত হয়ে উঠেছেন। মুখের ওপরে তাঁর নেমে এসেছে যেন একটা চিন্তার কালো ছায়া।

রাজাবাহাদুর, আপনার যদি আপত্তি না থাকে, আমি একবার আপনার শয়নকক্ষ ও তার আশপাশটা ঘুরে দেখতে চাই। বিকাশ বললে।

স্বচ্ছন্দে। যান না, ঘুরে আসুন। মৃদু ক্লান্ত স্বরে রাজাবাহাদুর বললেন।

আসুন কল্যাণবাবু, বিকাশ ডাকলে।

আমাকেও যেতে হবে?

আসুন না। একজোড়া চোখের চাইতে দুজোড়া চোখ অনেক বেশীই দেখতে পায়, আসুন!

যান কল্যাণবাবু। ঘুরে দেখে আসুন। রাজাবাহাদুর বললেন।

আগে আগে বিকাশ, পশ্চাতে সুব্রত ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

সামনেই একটা টানা বারান্দা,পর পর তিনটে ঘর, একটি রাজাবাহাদুরের বসবার ঘর, তার পরই তাঁর লাইব্রেরী-ঘর ও সর্বশেষটি তার শয়নঘর। প্রত্যেকটি ঘরই বেশ প্রশস্ত। এক ঘর থেকে অন্য ঘরে দুঘরের মধ্যবর্তী দরজাপথে ও বারান্দা দিয়ে যাতায়াত করা যায়।

শয়নঘরের পরেই ছোট একটি সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে উঠলেই সামনে খোলা ছাত। ছাতটিও বেশ প্রশস্ত।

ছাতের ওপরে উঠলে দেখা যায় বাড়ির পশ্চাৎ দিকটা। চমৎকার একটা ফুলের বাগান, বাগানের সীমানায় উঁচু প্রাচীর, প্রায় দুমানুষ সমান। বাইরে থেকে কারও আসা একেবারেই সম্ভব নয়। এবং ছাতে আসবারও ভিতর-বাড়ি দিয়ে ছাড়া দ্বিতীয় পথ নেই।

ঐ ছাতের ওপরে দাঁড়ালেই পিছনদিকে তিনতলার ছাত দেখা যায়।

ছাতটি ভাল করে দেখে, দুজনে আবার রাজাবাহাদুরের শয়নকক্ষে এসে প্রবেশ করল। শয়নকক্ষের সামনের দিককার জানালাপথে অন্দর ও বাহিরের সংযোগস্থল প্রশস্ত আঙিনাটি চোখে পড়ে। জানালাগুলোর কোনটাতেই শিক দেওয়া নয়, খোলা।

এই জানালাপথেই সেদিন রাজাবাহাদুর বিষজর্জরিত সতীনাথকে দেখতে পান। সুব্রত ঘুরে ঘুরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শয়নকক্ষটি বেশ ভাল করে দেখতে লাগল।

ঘরে আসবাবপত্রের তেমন কোন বাহুল্য নেই।

একটি দামী শয্যা-বিছানো পালংক, ঘরের এক কোণে একটি মাঝারি গোছের আয়রন সে। একটি আয়না-বসানো আলমারী, ছোট ছোট দুটি বইভর্তি ঘূর্ণায়মান বুক-শেলফ।

দেওয়ালের গায়ে একটি দোনলা বন্দুক ঝোলানো, একটি পাঁচ সেলের টর্চবাতি ও দেওয়ালের কোণে একটি ছাতা।

বিকাশ পাশের লাইব্রেরী-ঘরে গিয়ে ঢুকল।

একটু পরে সুব্রতও সেই ঘরে এসে প্রবেশ করে।

১.১৬ দুঃখের হোমানল

এই ঘরটি অন্য দুটি ঘরের চাইতে আকারে একটু বড়ই বলে মনে হয়। এবং অন্য দুটি ঘরের চাইতে এই ঘরের যেন একটু বিশেষ রকম সাজানোগোছানো ও ফিটফাট।

মেঝেতে দামী পুরু কার্পেট বিছানো আগাগোড়া, চারটি দেওয়ালই ঢাকা পড়ে গেছে আলমারীতে। প্রত্যেকটি আলমারীতে একেবারে ঠাসা বই।

মধ্যখানে ছোট একটি গোলটেবিল, তার চতুস্পর্শে সোফা, কাউচ ও চেয়ার পাতা।

ওরা দুজনেই ঘুরে ঘুরে চারদিক দেখছিল, হঠাৎ কার গলা শোনা গেল, অত্যন্ত স্পষ্ট,

যেন কে ঠিক ওদের সামনেই দাঁড়িয়ে কথা বলছে—অথচ তাকে ওরা দেখতে পাচ্ছে না। আশ্চর্য!

তুমি ভাব আমি কিছু বুঝি না বৌদি! তোমাদের ধারণা আমি একেবারে পাগল হয়ে গেছি! পাগল আমি হইনি, হয়েছ তোমার। হয়েছিল দাদা।

ওরা দুজনেই চমকে পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল।

ব্যাপারটা দুজনের কেউই যেন ভাল করে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। পরিষ্কার কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে, অথচ কাউকে দেখতে পাচ্ছেনা ওরা, এ আবার কিহেঁয়ালি! রহস্যের খাসমহলই বটে এই রায়পুরের রাজপ্রাসাদ।

একটু শুনেই তারা বুঝতে পারে সস্পষ্ট এ নিশনাথেরই গলা। মনে হচ্ছে বুঝি দেওয়াল ফুটো হয়ে কথাগুলো ওদের কানে আসছে।

তার তো যাওয়ার সময় হয়নি, নিশানাথের গলা আবার শোনা গেল, কিন্তু তবু তাকে যেতে হল। প্রয়োজনের তাগিদে। তবু তোমাদের কারও খেয়াল হয়নি। কিন্তু আমি জানতাম এ আগুন এত সহজে নিভবে না। আগুন খাণ্ডবদাহনের মত একে একে সব গ্রাস করবে।

ঠাকুরপো! একটু শান্ত হও। একটু ঘুমোবার চেষ্টা কর। মেয়েলী মৃদু শোনা গেল।

ঘুমোব! ঘুম আমার আসে না বৌদি। ঘুমোলেই যত দুঃস্বপ্ন আমার দুচোখের পাতার ওপরে এসে যেন তাণ্ডব নৃত্য জুড়ে দেয়। সংসারে অর্থই যত অনর্থের মূল। এর চাইতে বড় শত্রু বুঝি মানুষের আর নেই। তাই তো এই অর্থের বিষাক্ত হাওয়া থেকে পালিয়ে বেঁচেছিলাম। ভাবছ হয়ত পাগল মানুষ, পাগলামির ঝোঁকেই এসব কথা বলছে, কিন্তু তাই যদি হয় তো পাগল সবাই, কে পাগল নয়! তুমি পাগল, আমি পাগল, বিনু পাগল, সবাই পাগল। আর পাগল না হলে কেউ অন্য একজনকে পাগল সাজিয়ে এমনি করে বন্দী করে রাখতে পারে?

সুব্রত পাথরের মতই যেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনছে। আশ্চর্য! কোথা থেকে আসছে এই কথাবাতার আওয়াজ? পাশের ঘর নয়, সামনে বা পিছনে ঘর নেই, উপরে ও নিচে ঘর আছে কেবল।

তবে কি এই ঘরের উপরে বা নীচে এমন কোন ঘর আছে যেখান থেকে ঐ কথাবাতার আওয়াজ আসছে! কিন্তু তাই যদি হয়, এত স্পষ্ট শোনা যায় কি করে? এ কি রহস্য! এ কি বিস্ময়! চকিতে সুব্রতর মনের মধ্যে একটা সম্ভাবনা উঁকি দিয়ে যায়।

রহস্যে-ঘেরা এ রাজবাড়ির এও হয়ত একটি রহস্য।

সুব্রত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঘরের চতুর্দিকে চোখ বোলাতে থাকে।

কি দেখছেন চারিদিকে অমন করে চেয়ে মিঃ রায়? বিকাশ মৃদু কৌতুকমিশ্রিত কণ্ঠে প্রশ্ন করে।

সুব্রত মৃদু হেসে জবাব দেয়, দেখছি রায়পুরের রাজবাড়ির ঐ রহস্যময় দেওয়ালগুলো, ওরাও কথা বলে কিনা। তাছাড়া ছদ্মবেশের অনেক লেঠা, এবং হাতে সময়ও অল্প। তদন্তের। ব্যাপারে এমনি তাড়াহুড়ো চলে না।

এবারে চলুন, ও ঘরে যাওয়া যাক। রাজাবাহাদুর আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।

হ্যাঁ চলুন।

ও ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে ওরা রাজাবাহাদুরের বসবার ঘরে এসে প্রবেশ করতেই রাজাবাহাদুর প্রশ্ন করলেন, দেখা হল দারোগাবাবু?

হ্যাঁ।

কিছু বুঝতে পারলেন?

না। রাত্রি প্রায় এগারোটা বাজে। আজকের মত আমি বিদায় নেব রাজাবাহাদুর। কাল পারি তো সকালের দিকে একবার আসব।

বেশ তো। একবার কেন, যতবার খুশি আসুন না। সব সময়ই আমার ঘরের দরজা আপনার জন্য খোলা থাকবে। কোন সংকোচই করবেন না। তারপর সহসা সুব্রতর দিকে তাকিয়ে বললেন, কল্যাণবাবু, আপনি যাবেন না। একটু অপেক্ষা করুন, আপনার সঙ্গে আমার গোটাকতক জরুরী কথা আছে।

কল্যাণবাবু, তাহলে আপনি পরেই আসবেন, আমি আসি। নমস্কার।

বিকাশ নমস্কার জানিয়ে ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

ডাঃ সোম আগেই বিদায় নিয়ে গিয়েছিলেন।

বসুন কল্যাণবাবু। রাজাবাহাদুর অদূরে একটা চেয়ার নির্দেশ করলেন সুব্রতকে। একটু চুপ করে থেকে রাজাবাহাদুর সুবিনয় মল্লিক বললেন, সংসারে আপনার কে কে আছেন মিঃ রায়?

সুব্রত মৃদু হেসে বললে, সেদিক দিয়ে আমি একেবারে ঝাড়া-হাত-পা। একমেবাদ্বিতীয়। আপনার কয়েকদিনের কাজে আমি বিশেষ সন্তুষ্ট হয়েছি কল্যাণবাবু। আপনি শুধু কর্মঠ ও পরিশ্রমীই নন-বুদ্ধিমানও, পরীক্ষায় আপনি উত্তীর্ণ হয়েছেন। আপনাকে আমি এখন পরিপূর্ণ বিশ্বাস করি। তাই বলছি, আপনারা হয়ত জানেন না, এ সব কিছুর মূলে আছে একটা প্রকাণ্ড ষড়যন্ত্র এবং আমার বিরুদ্ধেই সে ষড়যন্ত্র চলেছে। দেখলেন তো আজ আমার জীবনের ওপরে attempt পর্যন্ত হয়ে গেল! একটু থেমে আবার বললেন, অবিশ্যি এতটা আমি ভাবি নি। কিন্তু এবারে আমায় সাবধান হতে হবে। আততায়ীর জিঘাংসা কখন যে এর পর কোন্ পথ ধরে নেমে আসবে তাও বুঝতে পারছি না। তবে যদি বলেন প্রস্তুত থাকবার কথা, তা আমি থাকব। আমার হয়েছে কি জানেন, শাঁখের করাত, আগে পিছে দুদিকেই কাটে। অর্থের মত এত বড় অভিশাপ বুঝি আর নেই। রাজাবাহাদুর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লেন।

সুব্রত বিস্মিত খুব কম হয়নি। ঠিক এতখানি সে মুহূর্ত-আগেও চিন্তা করতে পারত কিনা সন্দেহ। উচ্ছ্বাসের মুখে কাউকে বাধা দেওয়া উচিত নয় সুব্রত তা জানে, তাই কোন কথা না বলে চুপ করেই রইল।

রাজাবাহাদুর সুবিনয় মল্লিক আবার বলতে লাগলেন, জানি না আপনি আমাদের রাজবাড়ির সেই ভয়াবহ হত্যা-মামলার সম্পর্কে জানেন কিনা। আমার ছোট ভাই সুহাসের হত্যার ব্যাপার খবরের কাগজে হয়ত পড়ে থাকবেন, তবু সব আসল ব্যাপার জানেন না। রাজাবাহাদুরের কণ্ঠস্বর অশ্রুরুদ্ধ হয়ে আসে।

এত বড় লজ্জা! এত বড় অপমান! এ কলঙ্ক এ জীবনেও বুঝি যাবে না। বুঝতে পারেন কি, ভাইয়ের হত্যাব্যাপারের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে ভাই! উকিলের  সওয়ালের জবাব দিচ্ছি। অনুমান করতে পারেন কি, দিনের পর দিন সে কি দুঃসহ মর্মপীড়া! পৃথিবীর সবাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমার বিমাতা পর্যন্ত ঘৃণায় আমার কাছ হতে দূরে সরে গেছেন। উত্তেজনায় রাজাবাহাদুর উঠে দাঁড়ালেন, আমি ভুলতে পারি না—আমি ভুলতে পারি না সেসব কথা। এই বুকের মাঝে দাগ কেটে বসে আছে।

কিন্তু সে যে মিথ্যা—সেও তো প্রমাণিত হয়ে গেছে রাজাবাহাদুর। শান্ত কণ্ঠে সুব্রত বলে।

রাজাবাহাদুর জবাবে মৃদু হাসলেন, প্রমাণ! হ্যাঁ, তা হয়েছে বইকি। কিন্তু বাইরের অপরিচিত আর দশজন লোকের কাছে তার মূল্য কতটুকু! আমার নিদোষিতাটা আইনের চোখে প্রমাণিত হয়নি আজও। আদালত বলেছে প্লেগের বীজ প্রয়োগে তাকে হত্যা করা হয়েছে এবং সেই ষড়যন্ত্রের মধ্যে আমিও একজন নাকি ছিলাম। ছিঃ ছিঃ! কি লজ্জা, কি ঘৃণা! সব চাইতে মজার ব্যাপার কি জানেন কল্যাণবাবু? এ সম্পত্তির ওপরে আমার এতটুকুও লোভ নেই, এর সর্বপ্রকার দাবিদাওয়া আমি হাসিমুখে ত্যাগ করতে রাজি আছি—এখনই, এই মুহূর্তে।

যে জিনিস চুকেবুকে গেছে, তাকে মনে করে কেন আবার দুঃখ পান! সুব্রতর কণ্ঠে অপূর্ব একটা সহানুভূতির সুর জেগে ওঠে।

কল্যাণবাবু, আপনাকে আমি একটা কথা বলব—

বলুন?

আমি কিছুদিনের জন্য বিশ্রাম চাই। আমার অবর্তমানে একমাত্র লাহিড়ীর প্রতি আমি বিশ্বাস রাখতে পারতাম। তার আকস্মিক মৃত্যু আমার পক্ষে যে কতবড় চরম আঘাত, তা কেউ জানে না, বুঝবেও না। তার হত্যার সঙ্গে সঙ্গে যেন আমার যাবতীয় মনের বল একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেছে। আজ তার অবর্তমানে আপনিই আমার একমাত্র ভরসা। সামান্য কয়েকদিনের পরিচয়েই বুঝেছি আপনাকে সত্যিই বিশ্বাস করা যায়। আর একটা কথা, আজ আমি বেশ বুঝতে পারছি, ঘরে বাইরে সর্বত্রই আমার শত্রু। ফলে আর কাউকেই যেন এখানে আজ আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।

বেশ তো, আপনি না হয় কিছুদিন গিয়ে কলকাতা থেকে ঘুরে আসুন। এদিককার যা দেখাশোনার প্রয়োজন আমিই করব। কিছু ভাববেন না। তা কবে আপনি যেতে চান?

ভাবছি পাঁচ-সাতদিনের মধ্যেই যাব।

বেশ। তাহলে আমি নৃসিংহগ্রামটা একবার ঘুরে আসি, আমি এলেই আপনি যাবেন। রাত্রি অনেক হল, অসুস্থ শরীর আপনার—এবারে বিশ্রাম নিন।

রাজাবাহাদুরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সুব্রত সেরাত্রের মত উঠে দাঁড়াল।

***

রাত্রি বোধ করি সাড়ে এগারোটা কি পৌনে বারোটা হবে।

সুব্রত অন্যমনস্ক ভাবে রাজাবাহাদুরের ব্যাপারটা ভাবতে ভাবতেই পথ চলছিল। একান্ত অপ্রত্যাশিত ভাবে রাজাবাহাদুর সুবিনয় মল্লিক সহসা যেন নিজেকে উদঘাটিত করে দিয়েছেন।

আজকে যা ঘটল তাতে করে সুব্রতর অন্তত একটা কথা মনে হচ্ছিল, আততায়ী যেই হোক না কেন, রাজবাড়ির মধ্যে গতিবিধি তার আছে এবং রাজবাড়ির সমস্ত গলিখুঁজি তার চেনা। যার ফলে সে খুব সহজেই রাজাবাহাদুরকে আহত করে পালিয়ে যেতে পেরেছে। কিন্তু পালাল সে কোন্ পথে? ছাদ দিয়ে তো পালাবার কোন পথ নেই, আর তাতেই মনে হয়। গেছে সে রাজাবাহাদুরের শয়নকক্ষের ভিতর দিয়েই। প্রবেশও হয়ত ঐ পথ দিয়েই করেছিল সবার অলক্ষ্যে অতি গোপনে কোনো এক সময়ে। তারপর নিশানাথ! তাকে কি সত্যিই বন্দী করে রাখা হয়েছে?না নিশানাথের বিকৃত-মস্তিষ্কের উন্মাদ কল্পনা মাত্র? কিন্তু নিশানাথের স্বগত উক্তিগুলি! সামঞ্জস্যহীন বিকৃত উক্তি বলে তো একেবারে মনে হয় না। কথাগুলো যতই এলোমেলো হোক না কেন, মনে হয় না একেবারে অর্থহীন!

বাড়ির বারান্দার সামনে এসে সুব্রত চমকে ওঠে, অন্ধকার বারান্দার ওপরে ইজিচেয়ারে কে যেন অস্পষ্ট ছায়ার মত শুয়ে, তার মুখে প্রজ্বলিত সিগারের লাল অগ্রভাগটি যেন কোনো জন্তুর চোখের মত জ্বলছে অন্ধকারের বুকে।

সুব্রত আশ্চর্য হয়ে যায়। কে? তার বারান্দায় ইজিচেয়ারটার ওপর শুয়ে? এগিয়ে এসে সুব্রত বলতে যাচ্ছিল, কে!

কিন্তু তার আগেই প্রশ্ন, কেকল্যাণ নাকি?

কে, কিরীটী! সুব্রত আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে, কখন এলি?

দিনতিনেক আগে, কিরীটী জবাব দেয়।

তিনদিন হল এসেছিস, তবে এ কদিন কোথায় ছিলি?

হারাধনের ওখানে আত্মগোপন করে।

সুব্রত পাশের একটা মোড়ার ওপরে উপবেশন করল, হঠাৎ যে!

হ্যাঁ, চলে এলাম। কারণ বুঝতে পারছি, আর খুব বেশী দেরি নেই, একটা কিছু আবার ঘটতে চলেছে।

আমরও তাই মনে হয়, তাছাড়া আজ ব্যাপার অনেক দূর এগিয়েছে। সুব্রত সংক্ষেপে আজ সন্ধ্যায় রাজাবাহাদুর-ঘটিত সমস্ত ব্যাপারটা খুলে বলে গেল।

কিরীটীকে সব শোনার পরও এতটুকুও বিচলিত মনে হল না। ওর ভাব দেখে সুব্রতর মনে হল,সব কিছু শুনে যেন ও এতটুকুও আশ্চর্য হয়নি। আলস্যে একটা আড়ামোড়া ভাঙতে ভাঙতে কিরীটী বলে, থাক ওসব কথা এখন সুব্রত, রাত অনেক হল—তোর শ্রীমান থাকোহরিকে দুজনের মত রান্নার জন্যে বলে দিয়েছিলাম, খোঁজ নে তো রান্না হল কিনা! বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে।

সুব্রত উঠে গেল খোঁজ নেওয়ার জন্য। থাকোহরি জানালে, রান্না তৈরী বাবু।

তবে আর দেরি করিস নে, আমাদের খেতে দে, সুব্রত বললে।

আহারাদির পর ক্যাম্পখাটটার ওপর শয্যা বিছিয়ে কিরীটী টান টান হয়ে শুয়ে একটা টী

তোর ব্যাপারটা কি মনে হয় কিরীটী? এতক্ষণে সুব্রত প্রশ্ন করল।

কোন ব্যাপারটা?

কেন, আজকের রাজাবাহাদুরের ব্যাপারটা!

জিওমেট্রির অ্যাকসগুলোও তুই ভুলে গেছিস—things which are equal to the same thing, are equal to one another!

মানে?

মানে সেই শুরু হতে আজকের ঘটনাটি পর্যন্ত, যদি মনে মনে বিচার করবার চেষ্টা করিস তো মানে দেখবি সব একসূত্রে গাঁথা। রায়পুরের ছোট কুমার সুহাস,যাদের বা যার পরিকল্পনা মাফিক নিহত হয়েছে, সতীনাথ লাহিড়ীও তাদের প্ল্যান অনুযায়ী মৃত্যুবাণ খেয়েছে, কিন্তু তোদের রাজাবাহাদুরের ব্যাপারটা একেবারে অন্যরকম। কিন্তু একটা জিনিস আমার মনে খটকা লাগছে, হ্যাঁ রে, হঠাৎ কিরীটী কথার মোড় ফিরিয়ে অন্য বিষয়ে চলে এল, বললে, রাজাবাহাদুরের শোবার ঘর ও নিশানাথ যে ঘরে থাকে, সে দুটো ঘরই কি একই তলায়? বাড়িটা তো সবসমেত তিনতলা লিখেছিলি! দোতলায় রাজাবাহাদুর থাকেন—নিশানাথও কি ঐ দোতলারই কোনো ঘরে থাকেন, না তিনতলায় থাকেন?

তা তো ঠিক জানি না, তবে যতদূর অনুমানে মনে হয় নিশানাথের ঘর দোতলায় বা তিনতলায় নয়, দোতলা ও তিনতলার মাঝামাঝি কোথাও।

কিরীটী সুব্রতের কথায় হেসে ফেললে, মাঝামাঝি মানে? শূন্যে ঝুলছে নাকি?

তাই বলেই তো মনে হয়। বলে সুব্রত নিশানাথের কথাগুলো সুবিনয় মল্লিকের লাইব্রেরী ঘরে দাঁড়িয়েও কেমন স্পষ্টভাবে শুনতে পেয়েছিল তা বললে। সুব্রতর শেষের কথাগুলো শুনে কিরীটী যেন হঠাৎ উঠে বসে চেয়ারটার ওপরে, বলে, তাই নাকি? কথাগুলো স্পষ্ট শোনা গেল? তাহলে তো আর মনে কোনো খটকাই নেই, রাজাবাহাদুরের আহত হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। এ দেখছি এখন তাহলে বোধহয় খুনীর আসল প্ল্যানটা ঠিক অন্যরকম ছিল। তা হ্যাঁ রে,নৃসিংহগ্রামে যাওয়া ঠিক তো? কিরীটী আবার অন্য কথায় ফিরে এল।

হ্যাঁ, পরশুই যাচ্ছি। আজও সে সম্পর্কে কথা হয়েছে।

হ্যাঁ, এবারে আর দেরি না করে নৃসিংহগ্রামটা চটপট সাতে করে আয়। দুএকটা সূত্র হয়তো সেখানে কুড়িয়ে পেতে পারিস!

তোর কি মনে হয়, নৃসিংহগ্রামের মধ্যে সত্যিই কোনো সূত্র জট পাকিয়ে আছে?

ভুলে যাচ্ছিস কেন, এই বিরাট হত্যাকাণ্ডের বীজ তো ওইখানেই ছিল সর্বপ্রথমে। ভেবে দেখ, শ্ৰীকণ্ঠ মল্লিক ওইখানেই অদৃশ্য আততায়ীর হাতে নিহত হন। তারপর সুধীনের পিতা, তিনিও সেইখানেই নিহত হয়েছেন। দুটি ঘটনা সামান্য কয়েক মাসের ব্যবধানে মাত্র ঘটেছে। আমি এখানে তাড়াতাড়ি ছুটে এসেছি, তার কারণ আমি ভেবেছিলাম তোর বুঝি চাকরি ফুরলো, কেননা তোর আসল পরিচয় আর গোপন নেই। তুই ধরা পড়ে গেছিস।

সে কি!

কেন, এখনও তোর সে সম্পর্কে কোনো সন্দেহ আছে নাকি? বৎস,তুমি তো ধরা পড়েছই এবং তোমার ওপরে আসল হত্যাকারীর সদাসতর্ক দৃষ্টিও আছে জেনো।

কি করে বুঝলি?

তোমার মতে সকলের অজ্ঞাতে (?) যখন তুমি সতীনাথ-ভবনে সৎকার্যে ব্যস্ত ছিলে, ছাতের ওপরেযে ছায়ামূর্তির আবির্ভাব হয়েছিল, তিনিই আমাদের এই রহস্যের আসলমেঘনাদ। এবং তার দৃষ্টি সর্বক্ষণই তোর ওপরে আছে। তাছাড়া তুই বোধ হয় জানিস না—তুই যে কারণে সতীনাথ-ভবনে আবির্ভূত হয়েছিলি, ঠিক সেই একই কারণে সেই মহাত্মাও সেখানে গিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল, একই সময়ে। তারপর মনে পড়ে, তোর ঘরে কোনো মহাত্মার আবির্ভাব ঘটেছিল এবং তোর গোপন চিঠিপত্র হাতিয়ে চলে যায় সেদিন সে? ঐ একই ব্যক্তি—সেই দিনই তোর আসল পরিচয় তার কাছে পরিস্ফুট হয়ে গেছে।

কথাগুলো নিঃশব্দে সুব্রত শুনে গেল। তারপর বললে, তাহলে?

চিন্তার কোনো কারণ নেই। মহাপুরুষটি জানে না যে, তার পশ্চাতে একা সুব্রতই নয়, আরও একজন আছে যার চোখের দৃষ্টি এড়ানো তার পক্ষে শুধু কষ্টকরই নয়, দুঃসাধ্য। যে জিনিসটা সে হয়তো পরে তার বিবেচনা ও বুদ্ধির দ্বারা সমাধান করতে সক্ষম হয়েছে, সেটা কিরীটী রায় তোকে এখানে পাঠাবার আগেই এমনটি হলে কি করতে হবে তা ভেবে রেখেছিল। এবং সেই মত সে কাজও করেছে।

সিগার প্রায় নিঃশেষিত হয়ে এসেছিল, কিরীটী আর একটা নতুন সিগারে অগ্নিসংযোগ করল।

 ১.১৭ মামলার আরও কথা

কিরীটী ঘরের মধ্যে ইতস্তত পায়চারি করছিল।

আর সুব্রত ভাবছিল, ব্যাপার এখন যা বোঝা যাচ্ছে তাতে করে মনে হচ্ছে তার কাজের সমস্ত প্ল্যান ভেস্তে গেল। এখন সে কোন্ পথে যাবে? কোন্ পথে অগ্রসর হবে? কিরীটীর মুখের দিকে চাইলেই বোঝা যায়, বর্তমানে সে কোনো গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন। এ সময় কোনো প্রশ্ন করলে তার কাছ থেকেও কোনো জবাব পাওয়া যাবে না।

রাত্রি প্রায় দুটো হল, সুব্রতর দুচোখের পাতায় ঘুম জড়িয়ে আসছে, সে শয্যার উপরে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল। শিয়রের ধারে খোলা জানালাপথে রাত্রির ঠাণ্ডা হাওয়া শিরশির করে এসে চোখে মুখে যেন একটা স্নিগ্ধ প্রলেপ দিয়ে যায়।

সুব্রতর চোখের পাতায় ঘুম নেমে আসে।

কিরীটীর চোখে কিন্তু ঘুম নেই, ক্যাম্পখাটের ওপরে কাত হয়ে শুয়ে সে একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করে টানতে লাগল।

বাইরে চৈত্রের রাত্রি শেষ হয়ে আসছে। রাতের অন্ধকারে ক্রমশ অস্পষ্ট ভোরের আলো যেন ফুটে উঠছে। রাত্রিশেষের আবছা আলোয় পৃথিবী অস্পষ্ট, কেমন যেন অচেনা।

ঘুম আর হবে না এটা ঠিকই। একসময় কিরীটী ক্যাম্পখাটের উপর উঠে বাইরে বারান্দায় এসে দাঁড়াল।

বারান্দার একপাশে আগাগোড়া চাদর মুড়ি দিয়ে থাকোহরি ঘুমোচ্ছে।

চায়ের পিপাসা পেয়েছে, এক কাপ চা হলে এখন মন্দ হত না। কিরীটী আপাদমস্তক চাদরাবৃত থাকোহরির গায়ে একটা মৃদু ঠেলা দিয়ে ডাকলে, থাকোহরি!

সামান্য ঠেলাতেই থাকোহরির ঘুম ভেঙে যায়, কিরীটীর ডাক না শুনেই।

ধড়ফড় করে থাকোহরি উঠে বসে, হ্যাঁ!

এক কাপ চা খাওয়াতে পার থাকোহরি?

থাকোহরি উঠে মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।

একটু পরেই সুব্রতর ঘুমটা ভেঙে গেল। চারদিকের অন্ধকার কেটে গিয়ে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তখন চেয়ে দেখলে কিরীটী নেই।

বারান্দায় কিরীটী আপনমনে পায়চারি করছিল।

সুব্রত বাইরে এসে দাঁড়াল। সুব্রতর পায়ের শব্দে পায়চারি থামিয়ে কিরীটী ফিরে দাঁড়াল, ঘুম হল কল্যাণবাবু?

হ্যাঁ, কিন্তু এ কি! তুই কি সারাটা রাত্রি জেগেই কাটালি নাকি?

তা—মানে ঘুম এল না, কি করি?

থাকোহরি এককাপধূমায়িত গরম চা নিয়ে এসে দাঁড়াল। কিরীটী পরম আগ্রহ ভরে থাকোহরির হাত থেকে গরম চায়ের কাপটা নিতে নিতে স্মিতভাবে বললে, বাঁচালে বাবা!

ও কি করে বুঝল যে তুই এত ভোরে চা পান করিস!

বুঝিয়ে দিয়েছি। চায়ের কাপে একটু চুমুক দিয়ে কিরীটী বললে, আঃ, বেশ চা-টি বানিয়েছ হে থাকো! বেঁচেবর্তে থাকো।

আমি হাতমুখটা ধুয়ে আসি। সুব্রত কুয়োতলার দিকে চলে গেল।

.

বেলা তখন প্রায় সাতটা। ভোরের সোনালী রোদে চারিদিক যেন খুশীতে ঝলমল করছে। অকারণেই মনটা যেন আনন্দে ভরে ওঠে।

সুব্রত ও কিরীটীর মধ্যে কথাবার্তা চলছিল।

আমাকে এখানে আচমকা আসতে দেখে নিশ্চয়ই তুই খুব অবাক হয়েছি, সুব্রত! কিন্তু না এসে আর আমার উপায় ছিল না। চারদিকেই ক্রমে জট পাকিয়ে উঠছে। তবে আমি আত্মগোপন করেই আপাতত থাকব, যাতে করে তোর কাজের কোনো অসুবিধা না হয়। যদিচ তার একটা খুব কোনো প্রয়োজন ছিল না বর্তমানে, তবু থাকব। একটু থেমে সুব্রতর মুখের দিকে চেয়ে কিরীটী বলতে থাকে, তুই যখন প্রথমে এখানে আসিস, আগাগোড়া সমগ্র ব্যাপারটা ঠিক এইভাবে তখনও রূপ নেয়নি। পরে একটু একটু করে ঘটনাচক্র বর্তমান পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়েছে। আর আমাদেরও এখন ঠিক সেইভাবেই এগুতে হবে।

তুই এখানে আসার পর কি কোনো নতুন সূত্র পেয়েছিস? সুব্রত প্রশ্ন করে।

এখানে আসবার পর তো পেয়েছিই, তবে তোর চিঠিতেই আমি পেয়েছিলাম আগে।

আচ্ছা সতীনাথের হত্যাকারী কে বুঝতে পেরেছিস কি?

ঠিক কে তা এখনও বুঝতে না পারলেও, কার দ্বারা যে সেটা সম্ভব হতে পারে সেটা বোধ হয় বুঝতে পেরেছি। এবং সেদিক দিয়ে যদি বিচার করিস,তবে খুনী কে তা হয়ত কিছুটা বুঝতে পারবি।

কিরীটীর কথায় মনে হয় সুব্রত যেন একটু উদগ্রীবই হয়ে ওঠে, কিন্তু কোনো কিছু বলে না। চুপ করেই থাকে।

কিন্তু সে কথা থাক, কিরীটী বলতে থাকে, আমাদের এখন প্রথম কাজ হচ্ছে তোক তোর প্ল্যানমাফিক কালই নৃসিংহগ্রামে যেতে হবে। এবং সেখানে গিয়ে যথাসম্ভব চটপট চারিদিক দেখেশুনে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোকে আবার ফিরে আসতে হবে। তুই ফিরে এলেই এখানকার তল্পিতল্পা আমরা গুটাবো। কলকাতায় এখনও আমাদের কিছু কাজ বাকি। তারপর যেতে হবে সেই সুদূর বোম্বাই। হ্যাঁ দেখ,নসিংহগ্রামের কাছাড়িবাড়ী ও তার আশপাশ খুব ভাল করে পরীক্ষা করবি, কেননা দু-দুটো খুন ঐ কাছারিবাড়িতেই হয়েছিল এবং সেখানকার পুরানো কর্মচারীরা কেউ বদলায়নি। সবাই আছে এখনও। যতদূর জেনেছি, নৃসিংহগ্রামের কাছারিবাড়িতে শিবনারায়ণ বলে যে বৃদ্ধ নায়েবটি আছেন তিনি অনেক দিনের লোক, লোকটি শুনেছি অত্যন্ত সদাশয়ও, বয়স তাঁর বর্তমানে পঞ্চাশ-পঞ্চান্নর মধ্যে। লোকটা অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও তৎপর। বিবাহাদি করেননি। একটি চক্ষু (বাম) নাকি তাঁর কানা, পাথরের অক্ষিগোলক বসানো। স্থানীয় যে কয়েকঘর সাঁওতাল ও বাউরী আছে রাজাবাহাদুরের, তারা শিবনারায়ণকে দেবতার মতই শ্রদ্ধা ও ভক্তি করে। এক কথায় শিবনারায়ণের তাদের প্রতি অখণ্ড প্রতাপ। রায়পুরের বর্তমান রাজাবাহাদুরের পিতা, রাজাবাহাদুর রসময় মল্লিক তাঁর পিতার মৃত্যুর কয়েক বৎসর আগে রাজস্টেটের কয়েকজন পুরনো কর্মচারীকে পিতার সঙ্গে ঝগড়াবিবাদ করে, কতকটা জেদাজেদি করেই কর্মচ্যুত করে নতুন কয়েকজন কর্মচারী বহাল করেন। তাদের মধ্যে শিবনারায়ণ চৌধুরী নৃসিংহগ্রামের অন্যতম। তারপর থেকেই শিবনারায়ণ এঁদের স্টেটে চাকরি করছেন।

আর সতীনাথ লাহিড়ী? সুব্রত প্রশ্ন করে।

না, সতীনাথ সুবিনয় মল্লিকের নিযুক্তলোক। তার পরেই কিরীটী বলে, আমিই নৃসিংহগ্রামে যেতাম ছদ্মবেশে, কিন্তু শিবনারায়ণ আমাকে চিনে ফেলতে পারে, তাই সেখানে তোকেই যেতে হবে।

বলিস কি! শিবনারায়ণকে তুই চিনিস নাকি? সুব্রতর কণ্ঠে বিস্ময়।

চিনি। সে এক অতীত কাহিনী। সময়মত সে আর একদিন বলব। ঠিক পরিচয় না থাকলেও সে আমার নাম শুনেছে এবং আমিও তাকে ভাল করেই চিনি তার কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে। মহাত্মাদের পরিচয় কি কখনও গোপন থাকে রে? তার যে স্বরূপেই প্রকাশ। শিবনারায়ণের এক ছোট ভাই ছিল। নাম তার নরনারায়ণ। শিনারায়ণের চাইতে সে প্রায় দশ-এগারো বৎসরের ছোট। পরিচয়টা আমার তার সঙ্গেই,মানে নরনারায়ণের সঙ্গেই বেশী ছিল। তিনিও একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি ছিলেন কিনা।

তার মানে?

তার মানে অতীতে একবার তাঁর সঙ্গে আমায় মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছিল।

তাই নাকি! তা সে মহাত্মাটি এখন কোথায়? সুব্রত হাসতে হাসতে প্রশ্ন করে। বর্তমানে তিনি বছর ছয়-সাত হল গত হয়েছেন। কোনো একটি খুনের দায়ে নরনারায়ণ ধরা পড়েছিল। কোর্টে যখন বিচার চলছে, এমন সময় জেল ভেঙে প্রাচীর টপকিয়ে পালাতে গিয়ে প্রহরারত সেন্ট্রির বন্দুকের গুলি খেয়ে প্রাণ হারায়। সাধারণত প্রহরীদের হাতের নিশানা অব্যর্থ হয় না, কিন্তু কি জানি নরনারায়ণের বেলায় it was a susccess,বোধ হয় ঐ ভাবে তার মৃত্যু ছিল বলেই।

এসব কথা তো কই এতদিন তুই আমায় জানাসনি?

মনে ছিল না তাই। পুরাতন ডাইরীর পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে কয়েক দিন আগে সব জানতে পারলাম। তবে হ্যাঁ, কথাটা তাহলে তোকে খুলেই বলি স্পষ্ট করে। সেখানে গিয়ে একটা কথা কিন্তু সর্বদা মনে রাখিস, গোখরো সাপের চাইতেও সাংঘাতিক ঐ শিবনারায়ণ চৌধুরী লোকটা। খুব হিসাব করে পা ফেলবি। সামান্য এতটুকু ভুল হয়েছে কি, আর রক্ষা নেই—সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু-ছোবল দেবে সে।

 ২.০১ সূত্র সন্ধান

দ্বিতীয় পর্ব

২.০১ সূত্র সন্ধান

যে-দিনের কথা বলছিলাম।

সেই দিনই দ্বিপ্রহরের দিকেও আবার সুব্রত ও কিরীটীর মধ্যে সকালের আলোচনারই জের চলছিল। কিরীটী বলছিল, তোদের হারাধন–জগন্নাথের দাদু মনে হল লোকটা অনেক কিছু জানে, কিন্তু শোকেতাপে জর্জরিত হয়ে সে একেবারে নিজেকে এখন গুটিয়ে ফেলেছে। মাথায় হয়ত তার এখন সামান্য বিকৃতিও ঘটেছে, কিন্তু সেটা কিছুই নয়। এককালে লোকটা এদিকটায় নামকরা একজন আইনজীবী ছিল। তুই জানিস না এবং তোকে বলাও হয়নি, হারাধনের সঙ্গে ইতিমধ্যেই আমার বেশ পরিচয়ও হয়েছে। এখানে আসবার পর দিন-দুই গোপনে হারাধনের ওখানেই ছিলাম, সে কথা তো আগেই বলেছি। যাক, প্রথমটায় সে ধরা দিতে চায় না, কিন্তু যে মুহূর্তে তার দুর্বলতায় আঘাত করেছি, সে নিজেকে একেবারে সম্পূর্ণভাবে আমার কাছে মেলে ধরেছে। তার সব চাইতে বড় দুর্বলতাটা টের পেতে আমার খুব বেশী সময় লাগেনি, মাত্র ঘণ্টা চার পাঁচ লেগেছিল। কিরীটী বলতে থাকে, শ্ৰীকণ্ঠ মল্লিকের পিতা ও হারাধন মল্লিকের পিতা ছিলেন সহোদর ভাই। কিন্তু হারাধনের পিতা পিতার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। হারাধন সে কথাটা আজও ভুলতে পারেনি। একটা অদৃশ্য ক্ষতের মত এখনও তার মনের মধ্যে সেটা মাঝে মাঝে রক্তক্ষরণ করে আর বুকের ভিতরটা টনটন করে ওঠে। কথাপ্রসঙ্গে বুঝতে পেরে তার সেই ব্যথার জায়গাতেই আঘাত দিয়েছিলাম, সঙ্গে সঙ্গে সে যা বলবার বলতে শুরু করে। টাকাপয়সার প্রয়োজন বা অভাব আজ তার নেই বটে, কিন্তু একদা যে অর্থ সহসা কোন অজ্ঞাত কারণে হাত পিছলিয়ে নাগালের বাইরে চলে গিয়েছিল তার শোকটা আজও মন থেকে মুছে যায়নি। হারাধনের যতটা নয়, তার চাইতেও ঢের বেশী আর একজন অসম্ভব জেনেও, সেই অর্থের আশা আজ পর্যন্ত ত্যাগ করে উঠতে পারল না।

কার কথা বলছিস?

কিরীটী অল্প একটু থেমে, সুব্রতর প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে বলতে লাগল, তারপর শ্ৰীকণ্ঠ মল্লিকের সেই উইল, যার আভাস সুধীনের মা সুহাসিনীর কাছ থেকে সর্বপ্রথম আমরা জানতে পারি, ভেবেছিলাম এবং সুহাসিনীও বলেছিলেন, যার অস্তিত্ব নাকি একমাত্র তাঁর শ্বশুর, এঁদের স্টেটের নায়েবজী শ্রীনিবাস মজুমদার ছাড়া আর দ্বিতীয় ব্যক্তি জানতেন না, কথাটা ভুল। আরও একজন জানতেন—ঐ হারাধন, সেই উইলের কথা জানতেন। কারণ সে উইল যখন লেখা হয়, আইনজ্ঞ হিসাবে ও অন্যতম সাক্ষী হিসাবে শ্ৰীকণ্ঠ মল্লিক মশাই হারাধনের সাহায্য নিয়েছিলেন। অথচ এ কথা স্বয়ং শ্রীনিবাস মজুমদার মশায়ও জানতেন না, যদিচ তিনি উক্ত উইলের অন্যতম সাক্ষী ছিলেন।

সে উইলে কি লেখা ছিল জানতে পেরেছিস কিছু?

হ্যাঁ, সামান্য। হারাধন বিশদভাবে খুলে আমাকে সব কিছু বলেননি বটে, তবু যতটুকু জেনেছি সেও আমার অনুমান মাত্র। হারাধনকে বিশেষভাবে অনুরোধ করায় কেবলমাত্র বলেছিলেন, যা চুকেবুকে গেছে অনেকদিন এবং যার অস্তিত্বই এ জগতে কোনদিন প্রকাশ

প্রকাশ পেল না, আজ আবার সেই ভুলে যাওয়া পুরনো কাহিনীর জের টেনে এনে নতুন করে অমঙ্গলের বীজ বপন করতে চাই না রায় মশাই। সে উইল কোন দিন আত্মপ্রকাশ করে, এ বিধাতারই বোধ হয় অভিপ্রায় ছিল না, নচেৎ সব হয়েও এমনি করে ভণ্ডুলই বা সেটা হয়ে গেল কেন? তাছাড়া নিয়তি যেখানে বাদ সেধেছে, মানুষের পুরুষকার সেখানে ব্যর্থ হবেই, ইত্যাদি। এরপর আমিও দ্বিতীয় অনুরোধ তাকে করিনি। কেননা শুধুমাত্র সুহাসিনীর কথা আদালত মেনে নিতে চাইত না, বিশেষ করে তিনি যখন আবার আসামীর মা। সেক্ষেত্রে হারাধনের সাক্ষীর একটা মূল্য আছে। বর্তমান রহস্য উদঘাটনের ব্যাপারে সেই মূল্যটুকুই আমাদের কাছে যথেষ্ট। তার বেশী হারাধনের কাছে আমি আশাও রাখি না। এইসব কারণেই তোকে বলেছিলাম চিঠিতে হারাধনের প্রতি নজর রাখতে।

কিরীটীকে যেন আজ বলার নেশায় পেয়েছে, সে আবার বলে চলে, সতীনাথ লাহিড়ীর মৃত্যু—এটাও খুব আশ্চর্যের কিছু নয়। কারণ সুহাসের মৃত্যু ঘটানোর ব্যাপারে সতীনাথ ছিল খুনীর দক্ষিণ হস্ত এবং সমস্ত ব্যাপারটাই সুপরিকল্পিত চমৎকার একটা ষড়যন্ত্র। কোথাও তার এতটুকু গলদও খুনী বা চক্রান্তকারীরা রাখতে চায়নি। অবিশ্যি তোকে আগেও বলেছি, এখনও বলছি, সুহাসের নৃশংস হত্যার ব্যাপারের আসল মেঘনাদ বা পরিকল্পনাকারী, সেবার যেমন প্রমাণের অভাবে ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে গিয়েছিল, এবারও প্রমাণ যোগালেও তেমনিই হয়ত থেকে যাবে। কারণ সে কেবল যুগিয়েছে পরিকল্পনাটুকু। অর্থাৎ কেমন করে কি উপায়ে সুহাসকে এ পৃথিবী থেকে সকলের সন্দেহ বাঁচিয়ে সরিয়ে ফেলতে পারা যাবে! চতুর-চূড়ামণি সে। কিন্তু এত করেও সে ফাঁকি দিতে পারে নি দুজনের চোখকে—আমার ও আর একজনের। অথচ দুভাগ্য এমন, সেই দ্বিতীয়জন পারলেও আমি পারব না তাঁকে ফাঁসাতে এই তদন্তের ব্যাপারে, সেইটাই আমার সব চাইতে বড় দুঃখ থেকে যাবে হয়ত চিরদিন।

তবে সেই দ্বিতীয় ব্যক্তির সাহায্য নিলেই তো হয়! সুব্রত উৎসুক কণ্ঠে বলে।

তা আজ আর সম্ভব নয়। সেইখানেই তো সব চাইতে বড় মুশকিল।

সম্ভব ময় কেন?

এমন সময়ে ঘরের বাইরে বিকাশের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, কল্যাণবাবু আছেন নাকি?

কে, বিকাশবাবু নাকি! আসুন, আসুন!

বিকাশ এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।

দিনের আলো একটু একটু করে নিভে আসছিল, দিনশেষের ঘনায়মান ম্লান স্বল্পালোকে ঘরখানিও আবছা হয়ে আসছে।

থাকোহরি, একটা বাতি দিয়ে যা! সুব্রত চিৎকার করে বলে।

যাই বাবু, পাশের ঘর থেকে থাকোহরির কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

বসুন বিকাশবাবু, সুব্রত আহ্বান জানালে।

বিকাশবাবু ঘরের আবছা অন্ধকারে কিরীটীর দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিল।

আমার বন্ধু কিরীটী রায়, আর ইনি এখানকার থানা-ইনচার্জ বিকাশ সান্যাল। সুব্রত পরিচয় করিয়ে দেয়।

কে, কিরীটীবাবু? নমস্কার নমস্কার। কবে এলেন? আজই বোধহয়! আনন্দ ও শ্রদ্ধা যেন বিকাশের কণ্ঠে মূর্ত হয়ে ওঠে একসঙ্গে।

কিরীটী মৃদুস্বরে জবাব দেয়, হ্যাঁ,নমস্কার মিঃ সান্যাল।

থাকোহরি একটা লণ্ঠন নিয়ে এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল। ঘরের অন্ধকার দূরীভূত হল।

কিরীটীবাবু, আপনার কথা আমি অনেক শুনেছি, সাক্ষাৎ-আলাপের সৌভাগ্য আজও পর্যন্ত আমার হয়নি যদিও।

কিরীটী প্রতুত্তরে মৃদু হাসল মাত্র।

যা হোক, আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে ওদের কথাবার্তা আবার জমে ওঠে।

কিরীটী অবার একসময় বলতে থাকে, সুব্রত, তুই এখানে আসবার পর আমাকে আরও দু-একবার একাই জাস্টিস্ মৈত্রের বাড়ি যেতে হয়। এবং এ-কথা হয়ত তোর নিশ্চয়ই মনে আছে, মামলার সময় একদিন মামলার জেরায় প্রকাশ পায়, সুহাস সেদিন ৩১ শে ডিসেম্বর রায়পুরে রওনা হয়, সেদিন নাকি সুধীন সুহাসকে একটা অ্যানটিটিটেনাস ইজেকশন দিয়েছিল। জবানবন্দিতে সুধীন বলেছিল, আগের দিন নাকি কলেজে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে ব্যাটের আঘাত লেগে সুহাসের ডান পায়ে হাঁটুর কাছে অনেকটা কেটে যায়। তাছাড়া একবার সুহাস টিটেনাস রোগে ভুগেছিল। তাই সাবধানের জন্যও, টিটেনাস রোগের প্রতিষেধক হিসাবে, সুধীন সুহাসকে একটা অ্যানটিটিটেনাস ইনজেকশন দেওয়ার সময় নাকি হঠাৎ মালতী দেবী ও সুবিনয় মল্লিক এসে ঘরে প্রবেশ করেন। মালতী দেবীই প্রশ্ন করেন, ও কিসের ইজেকশন আবার নিচ্ছিস! তাতে সুহাস কোনো জবাব দেয় না। পরে মামলার সময় আদালতে ঐ কথা উঠলে, সুধীনকে জিজ্ঞাসা করায় সুধীন জবাব দেয়, হ্যাঁ, তাকে সে একটা অ্যানটিটিটেনাস ইজেকশন দিয়েছিল বটে ৩১শে ডিসেম্বর। কিন্তু পরে এমন কোনো কথাই প্রমাণ হয়নি যে সুহাস তার আগের দিন ক্রিকেট খেলতে গিয়ে আহত হয়েছে। ঐদিন সুহাসের সঙ্গে খেলার মাঠে যারা ছিল, তারাও কেউ জানে না সুহাস কোনোরকম আঘাত পেয়েছিল কিনা। এমন কি স্বয়ং মালতী দেবী পর্যন্ত সে সম্পর্কে কিছু বলতে পারেননি। বিপক্ষের উকিলের মতে, সত্যই যদি সুহাসকে প্লেগের বীজাণু ইজেক্ট করে মারা হয়ে থাকে, তাহলে সুধীনই নাকি ঐ সময় সেটা সুহাসের শরীরে অ্যানটিটিটেনাসের সঙ্গে ইনজেক্ট করেছিল।

সর্বনাশ, এ তো আমি জানতাম না। বিকাশ বলে।

কেন, ঐটাই তো সুধীনের বিপক্ষে সর্বাপেক্ষা বড় প্রমাণ। সুব্রত বললে।

এবং ঐ ব্যপারটাই ভাল করে যাচাই করবার জন্যই আমি জাস্টিস্ মৈত্রের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সুধীন তার জবানবন্দিতে যা বলেছে, সেটাও তার বিরুদ্ধেই গেছে। সে বলেছে, সেদিনই সন্ধ্যায় সুহাসের কাছে ও জেনেছিল, সুহাস ক্রিকেট খেলতে গিয়ে নাকি আহত হয়েছে এবং তখুনি সে তাকে অ্যানটিটিটেনাস ইনজেকশন দিতে চায়। তাতে নাকি সুহাস আপত্তি করে। কিন্তু পরের দিন স্বেচ্ছায় সুধীন একটা অ্যানটিটিটেনাস সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে তাকে অনেকটা জোর করে ইজেকশন দেয়। আগের দিন সন্ধ্যায় খেলার মাঠ হতে ফেরবার পথেই নাকি সুহাস হসপিটালে গিয়েছিল গাড়ি করে। অথচ ড্রাইভার সেকথা অস্বীকার করে, সে বলে, সুহাস সোজা নাকি বাড়িতেই চলে আসে। কথায় বলে, দশচক্রে ভগবান ভূত-এর বেলাতেও হয়ত তাই হয়েছে কিন্তু আমার বিশ্বাস এবং জাস্টিস্ মৈত্রেরও বিশ্বাস, ড্রাইভার এক্ষেত্রে মিথ্যা কথা বলেছে। প্রমাণ করতে হলে অবিশ্যি আমাদের প্রমাণ করতে হবে, সত্যিই সে ৩১শে ডিসেম্বর সুহাসকে অ্যানটিটিটেনাস ছাড়া অন্য কিছু ইনজেকশন দেয়নি! আমার নিজের এখানে আসবার অন্যতম কারণও তাই। জেরা করবার সময় আদালত একজনকে কয়েকটি অতি আবশ্যকীয় প্রশ্ন করতে ভুলে গেছে, সেটা আমি এখন জিজ্ঞাসা করতে চাই। আসলে মৃত পাবলিক প্রসিকিউটার রায়বাহাদুর গগন মুখার্জীর মৃত্যুতে মামলাটা সব আদ্যপান্ত ওলটপালট হয়ে গেছে। সাজানো দাবার ছক উলটে দিয়ে আবার নতুন করে ছক সাজানো হয়েছিল। ফলে নিদোষীর হল সাজা, আর দোষী পেল মুক্তি।

কিন্তু সেটা কি এখন আবার সম্ভব হবে? বিকাশ প্রশ্ন করে।

কেন হবে না? বর্তমানে এই রাজবাড়ির হত্যা-রহস্যের তদন্ত-ব্যাপারকে কেন্দ্র করে আবার নতুন করে সেই শুরু হতে জবানবন্দি শুরু করে ধীরে ধীরে আমাদের ফিরে যেতে হবে বর্তমান রহস্যের মূলে—সেই ভুলে যাওয়া পুরনো কাহিনীতে এবং সেটাই আমার বর্তমানের উদ্দেশ্য।

কিরীটী আবার একটু থেমে বলে, পৃথিবীতে যত প্রকার অন্যায় ও পাপানুষ্ঠান দেখা যায়, সেগুলোর মূলে অনুসন্ধান করলে দেখা যায় সবই প্রায় মানুষের কোন-না-কোন বিকৃত কল্পনার দ্বারা গড়ে ওঠে। মানুষের কল্পনা থেকেই যেমন জন্ম নেয় শ্রেষ্ঠ কাব্য কবিতা ও সাহিত্য, তেমনি কল্পনা থেকেই আবার জন্ম নেয় যত প্রকার ভয়ঙ্কর পাপ ও অন্যায়। কেউ পাপ করে অর্থের লোভে, কেউ প্রতিহিংসায়, কেউ বা অবার বিকৃত আনন্দানুভূতির জন্য। শেষোক্ত ধরনকেই আমরা বলি অ্যাবনরমা্যাল। রায়পুরের হত্যারহস্যকে বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই তার মূলে ১নং হচ্ছে অর্থের লোভ, ২নং খুনের নেশা। এবং যে বা যারা খুন করেছে, সেই খুনীর পক্ষে সেই নেশা এমন ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, খুনী এখন তার নিজের যুক্তির বাইরে। ৩নং এ পৃথিবীতে অনেক সময় দেখা গেছে, আমরা আমাদের কোনো বিশেষ কাজের দ্বারা কারও ভাল করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত তার মন্দ বা খারাপটাই করি। এবং সেটা যে সময় সময় মানুষের জীবনে কত বড় বিয়োগান্ত ব্যাপার হয়ে দেখা দেয়, তা ভাবলেও হতবুদ্ধি হয়ে যেতে হয়। তাছাড়া এক্ষেত্রে কি হয়েছে জানিস, ঐ যে কথায় বলে না, খাচ্ছিল তাঁতী তাঁত বুনে,কাল হল তার হেলে গরু কিনে—এও হয়েছে কতকটা তাই!

সব্রত অবাক বিস্ময়েই কিরীটীর আজকের কথাগুলো শুনছিল। এ কথা অবিশ্যি ও ভাল ভাবেই জানে, মাঝে মাঝে কিরীটী এমন ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই চলে যায়। সেই সময় সামান্য একটু বিশদভাবে বুঝিয়ে বললেই হয়ত সব বোঝা যায়, কিন্তু নিজেকে কেমন যেন একটা রহস্যের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করে অস্পষ্ট করে তুলতে সে যেন একটা অপূর্ব আনন্দ উপভোগ করে। এবং সে ক্রমে এমন অস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে শেষটায় মনে হয়, সে বুঝিবা যা খুশি আবোলতাবোল বকে যাচ্ছে। সুব্রত দু-একবার ইতিপূর্বে কিরীটীকে সেকথা বলেছেও, কিরীটী তার স্বভাবসুলভ মৃদু হাস্যের সঙ্গে বলেছে, যখন কোনো রহস্য নিয়ে কারবার করছ, তখন নিজেও রহস্যময় হয়ে ওঠা চাই এবং তা যদি হতে পার, তাহলেই সেই রহস্যটাকে উপভোগ করতে পারবে। কখনও ভুলে যেও না যে তুমি একজন রহস্যভেদী। তুমি বুদ্ধিমান, বুদ্ধির খেলায় অবতীর্ণ হয়েছ—সাধারণের চাইতে তুমি অনেক ওপরে। এ শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, এ বুদ্ধির প্রতিযোগিতা।

২.০২ নৃসিংহগ্রাম

পরের দিন প্রত্যুষেই সুব্রত সাইকেলে নৃসিংহগ্রামের দিকে রওনা হয়ে গেল। কিরীটী আর একটা দিন সুব্রতর ওখানে একা একা থাকবে না এবং সেটা ভালও দেখায় না, অনেকেরই হয়ত সন্দেহের উদ্রেক করবে, তাই বিকাশের ওখানে গিয়েই উঠল। ঠিক হল সুব্রত নৃসিংহগ্রাম থেকে ফিরে এলে অবস্থা বিবেচনা করে যা হোক তখন একটা ব্যবস্থা করলেই হবেখন। রায়পুর থেকে নৃসিংহগ্রাম প্রায় আটত্রিশ-ঊনচল্লিশ মাইলের কিছু বেশী হবে। যানবাহনের মধ্যে এক গরুরগাড়ি, প্রায় দু-তিন দিনেরও বেশী পথ, তাছাড়া রায়পুর থেকে ট্রেনে চেপে দুটো স্টেশন পরে ছোট একটা স্টেশনে নেমে মাইল চোদ্দ-পনের ঘোড়ায় চেপেও যাওয়া যায়। শেষোক্ত উপায়েই বেশীর ভাগ সকলেনৃসিংহগ্রামে যাতায়াত করে। বিশেষ করে রায়পুরের রাজবাড়ির লোকেরা। গরুর গাড়ি যাতায়াতের জন্য যে পথটা আছে, সেটা একটা অপরিসর কাঁচা রাস্তা, মাইল পনের-ষোল গেলেই ঘন শালবন। প্রায় পাঁচ-ছ মাইল লম্বা শালবন পেরুলেই দুর্ভেদ্য জঙ্গল; জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সরু একটা রাস্তা চলে গেছে। রাজাবাহাদুর যখন নৃসিংহগ্রামে যান, মোটরে চেপে ঐ রাস্তা দিয়েই যান। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যে পাঁচ-ছ মাইল রাস্তা, ঐ রাস্তাটা যেমন বিপদসংকুল তেমনি দুর্গম।

জঙ্গল পার হলে, মাইল পনের-ষোল গিয়ে এদের—মানে রায়পুর স্টেটের একটা ছোটখাটো শালকাঠের কারখানা আছে। সেখানে শালবন থেকে গাছ কেটে এনে কাঠ চেরাই ইত্যাদি হয়। তারপর সেখান থেকে গরুরগাড়িতে চাপিয়ে দূরবর্তী রেল স্টেশনে চালান দেওয়া হয়। কাঠের কারখানা থেকে নৃসিংহগ্রামটির দূরত্ব প্রায় মাইলখানেক হবে। স্টেটের যতগুলো মহাল আছে, তার মধ্যে নৃসিংহগ্রামই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ।

জায়গাটি দৈর্ঘ্যেও প্রস্থে মাইল দুয়েকের বেশী হবে না। চারপাশে ছোট ছোট পাহাড়। ছোট একটি পাহাড়ী নদী আছে, তার উৎস ওরই একটি পাহাড়ের বুক থেকে নেমে আসা ঝর্ণা থেকে।

আর আছে পাহাড়ের উপরে ছোট একটি গুহার মধ্যে পাথরের তৈরী একটি নৃসিংহদেবের মূর্তি। সেইজন্যই জায়গাটির নাম নৃসিংহগ্রাম হয়েছে। স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে ধারণা যে নৃসিংহদেবের মূর্তিটি নাকি অত্যন্ত জাগ্রত। প্রতি শনিবার সেখানে সকলে পুজো দিয়ে আসে। তাছাড়া চৈত্র-পূর্ণিমাতে খুব ধুমধাম করে একবার পুজা হয়। সে-সময় সেখানে ছোটোখাটো একটা মেলাও বসে। স্থানীয় অধিবাসীরা বেশীর ভাগই সাঁওতাল ও বাউরী। দু-চার ঘর পাহাড়ীও আছে। বেশীর ভাগ লোকই স্টেটের শালকাঠের কারখানায় কাজ করে জীবিকানির্বাহ করে। সামান্য চাষ-আবাদও আছে। স্থানটি অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর। সেইজন্যেই হয়ত সুদূর অতীতে কোনো একসময় রাজাদের কোনো পূর্বপুরুষ এখানে স্থানীয়ভাবে বসবাস করবার ইচ্ছায় প্রকাণ্ড একটি প্রাসাদ তৈরী করেছিলেন। বহুদূর থেকে প্রাসাদের চূড়া দেখা যায়। প্রাসাদটি মুসলমানের আমলের স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন দেয়। শ্ৰীকণ্ঠ মল্লিকের পিতাও বৎসরের মধ্যে অন্তত তিন-চার মাস নৃসিংহগ্রামের প্রাসাদে এসে কাটিয়ে যেতেন। শ্রীকণ্ঠ মল্লিকের সময় হতেই সে নিয়মের ব্যতিক্রম শুরু হয়। তারপর শ্রীকণ্ঠ মল্লিকের ও সুধীনের পিতার মৃত্যুর পর আর বিশেষ কেউ একটা নৃসিংহগ্রামের প্রাসাদে এসে দু-একদিনের বেশী কাটায়নি। প্রাসাদের এক অংশে এখন কাছারীবাড়ি করা হয়েছে।

এখানকার নায়েব বা ম্যানেজার শিবনারায়ণ চৌধুরী নিজের ইচ্ছায় যতটা করেন সেই মতই সব হয়। শিবনারায়ণের কোনো কাজের সমালোচনা রাজাবাহাদুর স্বয়ংও কোনোদিন করেন না।

সুব্রত কতকটা ইচ্ছা করেই ট্রেনে না গিয়ে সাইকেলে চেপে রওনা হয়েছিল। আটত্রিশ-ঊনচল্লিশ মাইল পথ এমন বিশেষ কিছুই নয়। তাছাড়া যেতে যেতে চারপাশ ভাল করে দেখতে দেখতেও যাওয়া যাবে। আসবার সময় রাজবাড়ি থেকে বন্দুক দিতে চেয়েছিল, কিন্তু সুব্রত মৃদু হেসে প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। সঙ্গে এনেছে একটা সাত সেলের হান্টিং টর্চ, একটি বড় দোলা ছুরি, একটা দড়ির মই ও সামান্য টুকিটাকি নিত্যপ্রয়োজনীয় কয়েকটা জিনিসপত্র। প্রথম দিকে বেশ একটু বেগের সঙ্গেই সাইকেল চালিয়ে সুব্রত বেলা প্রায় গোটা দশেকের মধ্যেই জঙ্গলের মাঝামাঝি পৌঁছে গেল।

বেশ ঘন জঙ্গল। দিনের বেলাতেও বড় বড় পত্রবহুল বৃক্ষ সূর্যের আলোকে প্রবেশাধিকার দেয় না। আগে নাকি এই বনে বাঘও দেখা যেত, এখনও যে একেবারে নেই তা নয়, কচিৎ কখনও দু-একটা দেখা যায়। হাতী আছে, আর আছে বন্য বরাহ ও হরিণ।

বনের মধ্য দিয়ে যে পথটি চলে গেছে, অতিকষ্টে সে পথ দিয়ে একটা টুরার মোটর গাড়ি যেতে পারে। পথটিকে পায়ে-চলা-পথ বলাই উচিত।

জঙ্গলের মধ্যেই একটা বড় গাছের তলায় বসে সুব্রত সঙ্গে টিফিন-ক্যারিয়ারে ভর্তি করে যে লুচি-তরকারী এনেছিল তার সদ্ব্যবহার করলে।

আহারাদির পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সুব্রত আবার রওনা হল। জঙ্গল পেরিয়ে শালবনে পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা প্রায় তিনটে হয়ে গেল। সূর্য অনেকটা হেলে পড়েছে। শালবনের আঁকাবাঁকা পথ ধরে সুব্রত সাইকেল চালিয়ে চলে। চৈত্রের ঝরা পাতায় চারদিক ঢেকে গেছে; মধ্যাহ্নের মন্থর বাতাসে ঝরা পাতাগুলি উড়ে উড়ে মর্মরধ্বনি তোলে, উদাস-করুণ চৈত্ররাগিনী যেন।

স্তব্ধ মধ্যাহ্নেভেসে আসে মাঝে মাঝে ঘড়িয়ালের উদাস মন্থর ডাক।

হেথা হোথা বুনো কবুতরের মৃদু গুঞ্জন। শালবনের চতুর্দিকে ইতস্তত কুটজ কুসুমের মন-ভোলানো শোভা। ফিকে বেগুনি ও ধুলোটে সাদা রংয়ের অজস্র ফুল ধরেছে তাতে গুচ্ছে গুচ্ছে।

বাতাস তীব্র একটা কটু গন্ধ ভাসিয়ে আনে। রঙিন মধুলোভী প্রজাপতি উড়ে উড়ে বেড়ায় ফুলে ফুলে। সুব্রতর কেমন যেন নেশা লাগে। সাইকেল চালিয়ে এগিয়ে চলে সে।

সূর্য যখন একেবারে পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে, চারিদিকে ঘনিয়ে এসেছে সন্ধ্যার বিষণ্ণ বিধুর ছায়া, সুব্রত এসে নৃসিংহগ্রামে প্রবেশ করল। কোথায় একটা কুকুরের ডাক শোনা যায়।

শিবনারায়ণকে আগেই সংবাদ দেওয়া ছিল, প্রাসাদের সামনে প্রশস্ত চত্বরে এসে সুব্রত পা-গাড়ি হতে নামল।

অস্পষ্ট আলো-আঁধারিতে কে একজন দীর্ঘ অস্পষ্ট ছায়ার মত দাঁড়িয়েছিল। সুব্রত তাকেই প্রশ্ন করল, নায়েব চৌধুরী মশাই কোথায় বলতে পারেন?

ছায়ামূর্তি গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করলে, আমারই নাম শিবনারায়ণ চৌধুরী, মহাশয়ের নামটি কি জানতে পারি কি? কোথা হতে আগমন হচ্ছে?

কল্যাণ রায়, রায়পুর থেকে আসছি।

ও, আপনিই কল্যাণ রায়! আসুন, নমস্কার। শিবনারায়ণের কণ্ঠস্বর আনন্দে উচ্ছলিত হয়ে ওঠে। তারপরই চিৎকার করেন, ওরে দুঃখীরাম, সুখন-আলো জ্বালিসনি এখনও! আসুন কল্যাণবাবু, ভেতরে আসুন, আপনারই জন্য অপেক্ষা করছিলাম। পা-গাড়ি ওখানেই থাক, ওরাই তুলে রাখবেখন।

 ২.০৩ শিবনারায়ণ

ক্লান্তপদে বারান্দা অতিক্রম করে সুব্রত মস্তবড় একটি হলঘরে প্রবেশ করে নায়েব শিবনারায়ণের পেছনে পেছনে।

সিলিং থেকে একটি বেলোয়ারী চোদ্দ বাতির ঝাড়লণ্ঠন ঝুলছে, তারই মধ্যে গোটা দুই বাতি জ্বলছে। এবং দুই বাতির আলোতেই ঘরে আলোর কমতি নেই। ঘরের প্রায় অর্ধেকটা জুড়ে খাট পাতা,তার উপরে ধবধবে পরিষ্কার ফরাস পাতা। একধারে খানকয়েক চেয়ার ও আরাম-কেদারাও আছে। দুপাশে দুটি বড় বড় কাঠের আলমারি ও র্যাক। র্যাকে মোটা খেরো-বাঁধানো সব খাতা সাজানো। সুব্রত ফরাসের ওপরে বসে পড়ল। অত্যন্ত ক্লান্তিবোধ করছিল সে।

আগাগোড়া সাইকেলে এলেন বুঝি? শিবনারায়ণ প্রশ্ন করলেন।

সুব্রত এতক্ষণে ভাল করে ঘরের আলোয় শিবনারায়ণের মুখের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি তুলে তাকাল। লম্বা, অত্যন্ত বলিষ্ঠ চেহারা, বয়সের অনুপাতে শরীর এখনও এত মজবুত যে মনে হয়, শরীর যেন বয়সকে প্রতারণা করে ঠেকিয়ে রেখেছে, কোনোমতেই কাছে ঘেঁষতে দেবে না।

বাঁ চোখের স্থিরদৃষ্টি দেখেই বোঝা যায়, অক্ষিগোলকটি পাথরের তৈরী, কৃত্রিম।

খুব পরিশ্রান্ত হয়েছেন নিশ্চয়ই কল্যাণবাবু, চা আনতে বলি? না হাত-মুখ ধুয়েই একেবারে চা-পান করবেন?

আগে তো এখন এক কাপ হোক, তারপর হাত-মুখ ধুয়ে না হয় আবার হবে।

বেশ। হাসতে হাসতে শিবনারায়ণ তখুনি ভৃত্যকে চা আনতে আদেশ করলেন। তারপর আবার এক সময় সুব্রতর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, মাছ-মাংস চলে তো?

তা চলে। সুব্রত হাসতে হাসতে জবাব দেয়।

ফাউলের ব্যবস্থা করেছি। আমি ব্রহ্মচারী মানুষ, দুবেলা হবিষ্যান্ন করি, তবে অতিথি-অভ্যাগতদের কখনও বঞ্চিত করি না।

জায়গাটা আমি বিশেষ করে বেড়াতেই এসেছি চৌধুরী মশাই।

তা বেড়াবার মতই জায়গা বটে, চারিদিকের দৃশ্য খুবই মনোরম। আমি তো একুশটা বছর এখানেই কাটালাম কল্যাণবাবু। জায়গাটা সত্যি বড় ভালো লাগে। একটু পরেই চাঁদ উঠবে। প্রাসাদের ছাদের ওপরে দাঁড়ালে আশপাশের পাহাড়গুলো চমৎকার দেখায়।

***

আহারাদির পর দোতলার যে ঘরটিতে সুব্রতর শয়ন ও থাকবার ব্যবস্থা হয়েছিল, চৌধুরী নিজে সঙ্গে করে সুব্রতকে সেই ঘরে পৌঁছে দিয়ে গেলেন।

উপরের তলায় প্রায় খানপাঁচেক ঘর, তারই একটি ঘর চৌধুরী নিজে ব্যবহার করেন। এবং অন্য একটিতে অতিথি অভ্যাগত কেউ এলে তার থাকবার ব্যবস্থা হয়। বাকি ঘরগুলো প্রায় বন্ধই থাকে। তিনতলায় খান-দুই ঘর আছে, রাজাবাহাদুর এলে তখন সেই ঘর দুইটি অধিকার করেন। একতলা হতে সিঁড়ি দিয়ে উঠেই সর্বপ্রথম যে ঘরটি, চৌধুরী সেটি ব্যবহার করেন। লম্বাগোছের একটি বারান্দা, সেই বারান্দাতেই ঘরগুলি পর পর। বারান্দার শেষপ্রান্তে একটি প্রশস্ত ছাদ। চারিপাশে তার উঁচু প্রাচীর দেওয়া। ছাদের দক্ষিণদিকে বহুদিনকার পুরাতন একটি শাখাপ্রশাখাবহুল সুবৃহৎ বটবৃক্ষ। অনেকগুলো ডালপালা পত্রসমেত ছাদের ওপরে এসে নুয়ে পড়েছে। বারান্দার শেষপ্রান্তে ঠিক ছাদের সামনেই যে ঘরটি, সেইটিতেই সুব্রতর থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে।

সুব্রত অত্যন্ত পরিশ্রান্ত বোধ করছিল, তথাপি নতুন জায়গায় ঘুম কোনোদিনই সহজে তার আসতে চায় না। বাড়ির পিছনদিকে মুখ করে যে খোলা জানালাটা, সুব্রত তার সামনে এসে দাঁড়াল। কাঠের কারবারের জন্য এদের গোটাতিনেক হাতী আছে, খোলা জানালাপথে সেই হাতীশালা দেখা যায়।

বাইরে অস্পষ্ট চাঁদের আলো, ঝিরঝিরে একটা হাওয়া দিচ্ছে।

রাত্রি কটা হবে? হাতঘড়ির দিকে সুব্রত তাকিয়ে দেখল, রাত্রি প্রায় বারোটা। ঠিক এমনই সময় কাছারীর পেটা ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত্রি বারোটা ঘোষণা করলে। চারিদিক নিযুতি রাতের স্তব্ধতায় যেন থমথম করছে।

সুব্রত আনমনে শিবনারায়ণ চৌধুরীর কথাই ভাবছিল। একটিমাত্র চক্ষুও যে তার কতখানি সজাগ, প্রথম দর্শনেই সুতর তা বুঝতে এতটুকুও কষ্ট হয়নি।

আচমকা এমন সময় একটা অতি সুস্পষ্ট করুণ কান্নার ধ্বনি সুব্রতর কানে এসে বাজল।

সুব্রত চমকে ওঠে, কে কাঁদে! না তার শোনবার ভুল? না, শোনবার ভুল নয়। ঐ তো কে গুমরে গুমরে কাঁদছে! সুব্রতর শ্রবণেন্দ্রিয়-দুটি অতিমাত্রায় সজাগ হয়ে ওঠে। কে কাঁদে? এই নিশীথ রাত্রির নির্জনতায় কে অমন করে গুমরে গুমরে কাঁদে? কেন কাঁদে?… ভাল করে কান পেতে শুনেও যেন ও বুঝে উঠতে পারে না, কোথা থেকে সে কান্নার শব্দ আসছে! সুব্রত ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।

খাঁ খাঁ করছে বারান্দাটা, চাঁদের ম্লান আলো এসে বারান্দার ওপরে লুটিয়ে পড়ে যেন ঘুমিয়ে আছে। কোথাও এতটুকুও সাড়াশব্দ পর্যন্ত নেই।

কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে, বড় করুণ। পা টিপে টিপে সুব্রত বারান্দা দিয়ে সোজা সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়। এ বাড়ির কিছুই তো সুব্রত জানে না, কোথা থেকে কান্নার শব্দ আসছে, কেমন করেই বা তাও টের পাবে? সুব্রত স্থাণুর মতই সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে একান্ত অসহায়ভাবে কান্নার শব্দ শোনে। নানা প্রকারের এলোমেলো চিন্তা মনের কোণায় এসে উঁকিঝুঁকি দেয়। এই বাড়িরই কোনো এক ঘরে অদৃশ্য আততায়ীর হাতে শ্ৰীকণ্ঠ মল্লিক ও সুধীনের হতভাগ্য পিতা নিষ্ঠুরভাবে নিহত হয়েছেন একদা। এ হয়ত তাঁদেরই অদেহী অতৃপ্ত আত্মার করুণ বিলাপধ্বনি। হয়ত এমনি করেই আজও তাঁরা এই প্রায়-পরিত্যক্ত প্রাসাদের ঘরে ঘরে কেঁদে কেঁদে ফেরেন মুক্তির জন্য। এখনও হয়ত যে ঘরে রাতের নিস্তব্ধ আঁধারে অসহায় ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছিল, তার লিমলিন মেঝের ওপর রক্তধারা শুকিয়ে জমাট বেঁধে আছে।

অন্ধকারে ছাতের কার্নিশে বোধ হয় একটা ইঁদুর সরসর করে হেঁটে যায়। ছাদের ওপাশে বটবৃক্ষের পাতায় পাতায় নিশীথ হাওয়ার মর্মরধ্বনি জাগায়। কোথায় একটা রাতজাগা পাখি উ-উ করে একটা বিশ্রী শব্দ করে ডেকেই আবার থৈমে যায়। সুব্রতর সর্বাঙ্গ যেন সহসা সিরসির করে কেঁপে ওঠে।

এ যেন এক অভিশপ্ত মৃত্যুপুরী। অন্ধকারের স্তব্ধ নির্জনতায় প্রেতাত্মার দীর্ঘশ্বাস বাতাসে ভাসিয়ে আনে। চারিদিকে এর মৃত্যুর হাওয়া। বিষাক্ত মৃত্যুবিষ ছড়িয়ে আছে এর প্রতিধূলিকণায়।

বিদেহী আত্মারা এর ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে যেন। কিরীটী বলেছে, রায়পুরের রাজবংশে যে মৃত্যুবীজ সংক্রামিত হয়েছে, সে বীজ প্রথম রোপিত হয়েছিল এই প্রাসাদেরই কোনো কক্ষে।

কিসের যেন একটা সম্মোহন সুব্রতকে অদৃশ্য জন্তুর মত চারপাশ হতে জড়িয়ে ফেলেছে। কার পায়ের শব্দ না? হ্যাঁ, ঐ তো পায়ের শব্দ! কে যেন কোথায় অত্যন্ত অস্থির পদে কেবলই হেঁটে হেঁটে বেড়াচ্ছে আর বেড়াচ্ছে। কান্নার ধ্বনি আর শোনা যায় না। থেমে গেছে সেই কান্নার ধ্বনি। যে কাঁদছিল সে হয়ত ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু পায়ের শব্দটা—সেটা তো এখনও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে!

***

শিবনারায়ণের ডাকে যখন সুব্রতর ঘুম ভাঙল, তখন প্রায় সকাল সাড়ে আটটা হবে। খোলা জানালাপথে অজস্র রোদ এসে ঘরের মধ্যে যেন আলোর বন্যা জাগিয়ে তুলেছে।

খুব ঘুমিয়েছে সুব্রত। এত বেলা হয়ে গেছে! গতরাত্রের দুঃস্বপ্ন আর নেই। সকালের প্রসন্ন সূর্যালোকে চারিদিক যেন শান্ত, স্নিগ্ধ।

সামনেই দাঁড়িয়ে শিবনারায়ণ চৌধুরী। কিছুক্ষণ আগে হয়ত প্রাতঃস্নান শেষ করেছেন। মাথার বড় বড় বাবরী চুল অত্যন্ত পরিপাটী করে আঁচড়ানো। পরিধানে ধবধবে একখানি সাদা ধুতি। গায়ে বেনিয়ান। পায়ে বিদ্যাসাগরী খুঁড়তোলা চটিজুতো। প্রসন্ন হাসিতে মুখখানি যেন ঝলমল করছে।

ঘুম ভাঙল কল্যাণবাবু? রাতে বুঝি ভাল ঘুম হয়নি?

না, বেশ ঘুম হয়েছিল। অনেকটা পথ সাইকেল হাঁকিয়ে একটু বেশী পরিশ্রান্তই হয়েছিলাম কিনা। আপনার তো দেখছি স্নান পর্যন্ত হয়ে গেছে!

হ্যাঁ, দিনে আমি তিনবার স্নান করি—তা কি গ্রীষ্ম, কি শীত! আমাকে এখুনি একবার কাঠের কারখানায় যেতে হবে। কয়েক হাজার মণ কাঠের চালান আজকালের মধ্যেই যাবে, তার একটা ব্যবস্থা করতে হবে ফিরতে আমার বিকেল হবে, আজকের দিনটা আপনি বিশ্রাম নিন। কাল সকাল পর্যন্ত আমি এদিককার কাজ সেরে ফেলতে পারব, তখন কাগজপত্র দেখাব, কি বলেন?

বেশ তো। ব্যস্ততার কি এমন আছে! সুব্রত বলে।

না, তবে আপনি এলেন, একা একা থাকবেনযদি ইচ্ছে করেন, আমার সঙ্গে কারখানাতেও যেতে পারেন।

সুব্রত বুঝলে এ মস্ত সুযোগ। চৌধুরীর অবর্তমানে প্রচুর সময় পাওয়া যাবে বাড়ির চারপাশটা ভাল করে একবার দেখে নিতে। সুব্রত বলে, না, এখনও ক্লান্তিটা কাটেনি, আজকের দিনটাও বিশ্রাম নেব ভাবছি। আপনি কাজে যান চৌধুরী মশাই, ঘুমিয়েই আজকের দিনটা আমি কাটিয়ে দিতে পারব। ঘুমের আশ এখনও আমার ভাল করে মেটেনি।

বেশ, তবে আমি যাই। দুঃখীরাম ও সুখন রইল, তারাই আপনার সব দেখাশোনা করবেখন। কোন কষ্ট হবে না।

চৌধুরী ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।

সুব্রত আবার শয্যার ওপরে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে চোখ বুজল। অনেকটা সময় হাতের মুঠোর মধ্যে পাওয়া গেছে। যথাসম্ভব এর মধ্যেই একটা মোটামুটি দেখাশোনা করে নিতে হবে। পুরনো আমলের বাড়ি, তাছাড়া দুঃখীরামও অনেকদিনকার লোক। গতরাত্রে কয়েকবার সাধারণভাবে দেখে লোকটাকে নেহাৎ খারাপ বলে মনে হয়নি। মনে হয় যেন লোকটা একটু সরল প্রকৃতির ও বোকা-বেকাই।

২.০৪ পুরাতন প্রাসাদ

পুরাতন প্রাসাদ

বাবু!

কে? সুব্রত চোখ চেয়ে দেখলে দুঃখীরাম কখন একসময় ঘরে এসে প্রবেশ করেছে।

চা আনব বাবু?

চা! আচ্ছা নিয়ে এস।

দুঃখীরাম ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল। এবং একটু পরেই ধূমায়িত চা-ভর্তি একটি কাপ হাতে ঘরে এসে প্রবেশ করল।

দুঃখীরাম!

আজ্ঞে?

তুমি বুঝি অনেকদিন এখানে কাজ করছ?

আজ্ঞে তা প্রায় পনের-ষোল বৎসর তো হবেই—

তোমার বাড়ি কোথায় দুঃখী?

ঢাকা জিলায় বাবু।

তাহলে নিশ্চয়ই তুমি তোমাদের ছোট কুমারকে দেখেছ?

তা আর দেখিনি! আহা বড় সদাশয় লোক ছিলেন তিনি। এমন করে বেঘোরে প্রাণটা গেল! দুঃখীরামের চোখ দুটি ছলছল করে এল, প্রায়ই তো তিনি এখানে এসে এক মাস দু মাস থাকতেন। আমাদের সকলকে তিনি কি স্নেহটাই করতেন বাবু। অমন হাসিখুশি, আত্মভোলা লোক আর আমি দেখিনি। তিনিও এসে এই ঘরেই থাকতেন, বলতেন এই ঘরেই তো আমার ঠাকুরদামশাই খুন হয়েছিলেন!

হ্যাঁ, শুনেছি বটে, শ্ৰীকণ্ঠ মল্লিক মশাই এই বাড়িতেই খুন হয়েছিলেন—তা এই ঘরেই নাকি?

হ্যাঁ বাবু, শুনেছি এই ঘরেই। আমাদের সুধীনবাবুর বাবাও তো এই ঘরেই খুন হন। তিনিও লোক বড় ভাল ছিলেন বাবু।

সুব্রত স্তম্ভিত হয়ে যায়, তাহলে সেই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড পর পর দুবার এই কক্ষেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল! কি বিচিত্র ঘটনা-সংযোগ! সেও এসে এই ঘরেই আজ আস্তানা নিয়েছে। হত্যাকারীর রক্ততৃষ্ণা কি মিটেছে? না আবার সে-রক্ততৃষ্ণায় তারও প্রাণ নিতে রাত্রির অন্ধকারে আবির্ভূত হবে কোনও এক সময়! বিচিত্র একটা শিহরণ সুব্রত তার রক্তের মধ্যে অনুভব করে যেন, মনে হয় সে আসবে! নিশ্চয়ই আবার সে এই ঘরে আবির্ভূত হবে! যখন চারিদিক নিঝুম হয়ে যাবে, ঘন নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে বিশ্বচরাচর অবলুপ্ত হয়ে যাবে, তখন সে আসবে এই ঘরে। আসুকতাই তো চায় সুব্রত।

সুব্রত সোজা হয়ে বসে, আজ এখানে হাটবার না দুঃখীরাম?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

মাছ পাওয়া যায় এখানে?

আজ্ঞে না, তবে মাংস পাওয়া যায়, ভাল হরিণের মাংস।

হরিণের মাংস! চমৎকার হবে, তাই নিয়ে এস। শুধু মাংসের ঝোল আর ভাত বেঁধে এবেলা। হ্যাঁ শোন, আমাকে আর এক পেয়ালা চা দিয়ে যেও।

যে আজ্ঞে বাবু।

দুঃখীরাম চলে গেল।

***

অনেকক্ষণ থেকে সুব্রত একা একা সমস্ত বাড়িটার মধ্যে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাড়িটার বয়স অনেক হয়েছে, ভাঙন ধরেছে এর চার পাশে, অথচ সংস্কারের কোন প্রচেষ্টাই নেই, দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায়। প্রথমেই সুব্রত তিনতলাটা দেখে এল। প্রকাণ্ড ছাদ, ছাদের এক কোণে পাশাপাশি নাতিপ্ৰশস্ত দুটি ঘর, কিন্তু দুটি ঘরেই দরজার বাইরে থেকে ভারী হবসের তালা লাগানো।

দোতলায় সর্বসমেত পাঁচখানা ঘর, একটি চৌধুরী ব্যবহার করেন, সেটাও বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগানো, এবং সুব্রত যেটি অধিকার করেছে সেটি ছাড়া বাকি তিনটিতে কেবল শিকল-তোলা বাইরে থেকে, কোনো তালা লাগানো নেই। সুব্রত দেখল ঘর তিনটি খালিই পড়ে আছে। দুটি ঘরেই একটি করে আলমারি ছাড়া অন্য কোন দ্বিতীয় আসবাব নেই। নীচে আটটি ঘর। সেটি দুটি মহলে বিভক্ত; অন্দর ও সদর। সদরে মহলেই কাছাড়ীবাড়ি। জন দু-তিন কর্মচারী, দারোয়ান, ভৃত্য সব সদর মহলেই থাকে। অন্দরমহলে একমাত্র পাকের ঘর ছাড়া অন্য কোন ঘর ব্যবহার হয় না। নীচের অন্দরমহলে কোণের দক্ষিণ দিকে একটি মাত্র ঘর ছাড়া বাকিগুলোতে কোন তালা দেওয়া নেই। অন্যান্য তালাবন্ধ ঘরগুলোর মত সুব্রত ঐ ঘরের তালাটা ধরেও নাড়তে গিয়ে একটু যেন বিস্মিত হল। ঐ ঘরের তালাটা বেশ পরিষ্কার, এতে প্রায়ই মানুষের হাতের ছোঁয়া পড়ে–তা দেখলে বুঝতে তেমন কষ্ট হয় না।

সুব্রত দরজার কপাট দুটো ঠেলতেই সামান্য একটু ফাঁক হয়ে গেল, তালা লাগানো থাকা সত্ত্বেও। ঘরের মধ্যে অন্ধকার। কিছু দেখবার উপায় নেই। সুব্রত উপরে নিজের ঘরে গিয়ে হান্টিং টচটা নিয়ে এল। দরজার ফাঁক দিয়ে ঘরের মধ্যে আলো ফেলতে নজরে পড়ল, ঘরের মধ্যে পুরু হয়ে ধুলো জমে আছে। কিন্তু আশ্চর্য হল যখন দেখলে সেই ঘরের ধুলোর ওপরে অনেকগুলো সুস্পষ্ট পায়ের ছাপ। পায়ের ছাপ ছাড়া আর বিশেষ কিছুই সুব্রতর নজরে পড়ে না। তালাটা খোলা যায় না। ভারী মোটা জামান তালা। সুব্রত টর্চ আনবার সময়ই তালাচাবি খোলবার যন্ত্রগুলো নিয়ে এসেছিল এবং কিছুক্ষণ চেষ্টা করতেই তালাটা খুলে গেল। ছোট্ট একটা ঘর। এবং ঘরটা একেবারে খালি, কেবলমাত্র একটা গা-আলমারী দেখা যাচ্ছে। এগিয়ে গিয়ে গা-আলমারির কপাটটা খুলে ফেলে। আলমারিটা শূন্য, তার মধ্যে কিছু নেই। কতকগুলো আরশুলা এদিক ওদিক ফরফর করে উড়ে গেল। ঘরের কোন কোণায় একটা ছুঁচো চিকচিক করে ডেকে উঠল। একটা বিশ্রী ধুলোর গন্ধ। মেঝেতে ধুলো জমে আছে। তার ওপর অসংখ্য পদচিহ্ন। কোনটা ঘরের মধ্যে এসে ঢুকেছে, কোনটা বাইরের দিকে চলে গেছে। সুব্রত টর্চের আলো ফেলে ধুলোর ওপরে পদচিহ্নগুলো দেখতে গিল। সবই একই ধরনের এবং একই আকারের পদচিহ্ন বলেই যেন মনে হয়। সুব্রত আবার ঘরের চতুষ্পর্শ্বে আলো ফেলে দেখলে—না, কিছু নেই। এ ঘরে যে দীর্ঘকাল ধরে কোন লোক বাস করে না, তাতে কোন ভুলই নেই, অথচ ঘরের মেঝের ধুলোতে পদচিহ্ন ছড়ানো। একটি মাত্র দরজা ছাড়া ঘরের মধ্যে দ্বিতীয় জানালা পর্যন্ত নেই। এই অপরিসর আলোবাতাসহীন অন্ধকার ঘরটা কিসের জন্য ব্যবহার হত তাই বা কে বলতে পারে! এবং এখন বর্তমানে কেউ না এ ঘরে বাস করলেও ঘরের মেঝেতে পদচিহ্ন।

সুব্রত হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, বেলা প্রায় এগারোটা। এখুনি হয়ত দুঃখীরাম হাট থেকে ফিরে আসবে। সুব্রত ঘর থেকে বের হয়ে তালার মুখটা কোনমতে টিপে লাগিয়ে রাখল মাত্র। সামান্য টানলেই যাতে করে খুলে যায় এবং তখনি জানাজানি হয়ে যাবে—তাতে করে মনে হয় নিশ্চয়ই তালাই ভেঙে রেখে গেছে। কিন্তু উত্তেজনার বশে তালা ভাঙার মুহূর্তে সুব্রতর একটিবারও সে কথাটা মনে হয়নি। কিন্তু এখন আর উপায়ই বা কি? সুব্রত উপরে নিজের ঘরে চলে এল। একটু পরেই সে বুঝতে পারলে দুঃখীরামের গলার স্বরে যে দুঃখীরাম হাট থেকে ফিরে এসেছে।

দ্বিপ্রহরে আহারাদির পর সুব্রত প্রাসাদের আশপাশ চারিদিক ভাল করে পরীক্ষা করে দেখবার জন্য আবার বের হয়ে পড়ল। কাছারীবাড়ির পিছনদিকে টিনের ও খোলার শেড় তোলা অনেকগুলো চালাঘরের মত; সেগুলোর মধ্যে নানা সাইজের কাঠ ও তক্তা সাজানো, বামদিকে একটি প্রশস্ত চত্বর। চত্বরের একদিকে হাতি ও ঘোড়াশালা। দুটি ঘোড়া ও তিনটি হাতি আস্তাবলে আছে—এখন মাত্র একটি ঘোড়াই রয়েছে; অন্যটিতে চেপে চৌধুরী কারখানায় গেছে। একজন মাহুত ও চারজন সহিস তারা সপরিবারেই আস্তাবলের পাশের চালাঘরে থাকে। কাছারীবাড়ির ডানদিকে একটি ফুলের বাগান।

ছোট একটা চালাঘর, সপরিবারে মালী সেখানে থাকে। পিছনদিকে কিছুদূর এগিয়ে গেলে অনুর্বর রুক্ষ মাঠ, মাঠের মধ্যে দিয়ে একটা সরু পায়ে-চলা পথ। আর দূরে দেখা যায় পাশাপাশি দুটি পাহাড়। প্রাসাদ ছেড়ে ঐ পথেই এগিয়ে গেলে, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে কিছু সাঁওতালদের বাস। তাদের প্রত্যেকেই প্রায় এদের কাঠের কারখানায় কাজ করে। ঘুরে ঘুরে সুব্রত অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, পিপাসাও পেয়েছে খুব; মনে হয় এক কাপ চা পেলে নেহাৎ মন্দ হত না। সূর্য আকাশের পশ্চিম প্রান্তে হেলে পড়েছে। মাঠের একপাশে একটা বাঁশঝাড়। সেই ঝোপের মধ্য হতে শ্রান্ত ঘুঘু ও হরিয়ালের একটানা কৃজনধ্বনি প্রান্তরের তপ্ত হাওয়ায় ভাসিয়ে আনে।

উদাস বিধুর চৈত্র-মধ্যাহ্নের নীল আকাশটা যেন সূর্যালোকে আরও উজ্জ্বল নীল দেখায়। ওই দূরে অনন্তনীলিমায় যেন মহাশূন্যে কালির বিন্দুর মত কয়েকটা চিল উড়ছে।

সুব্রত আবার কাছারীবাড়িতে ফিরে এল।

দুঃখীরামকে ডেকে চা আনতে বললে।

২.০৫ কে কাঁদে নিশিরাতে

ক্রমশ সন্ধ্যার অন্ধকার যেন কালো একটা ওড়না টেনে দেয় পৃথিবীর বুকে।

সুব্রত চুপচাপ একাকী তার ঘরের সামনে খোলা ছাদটার ওপরে একটা ক্যাম্বিসের ইজিচেয়ারে গা ঢেলে নক্ষত্রখচিত আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল।

অন্ধকারে ছাদের ওপরে নুয়ে পড়া বটবৃক্ষের পাতাগুলো ছোট ছোট হাতের মত যেন দুলে দুলে কি এক অজ্ঞাত ইশারা করছে।

আর কিছুক্ষণ পরে ক্রমে রাত্রি যখন গভীর হবে, এ বাড়ির আশেপাশে সব বিদেহী প্রেতাত্মারা ঘুম ভেঙে জেগে উঠবে। তাদের দেখা যাবে না, অথচ তাদের পায়ের শব্দ শোনা যাবে। তাদের নিঃশ্বাসে বইবে মৃত্যুর হাওয়া।

জুতোর শব্দ শোনা গেল বারান্দায়, সুব্রত সজাগ হয়ে উঠে বসে। শিবনারায়ণ চৌধুরী আসছেন নিশ্চয়ই। পরক্ষণেই চৌধুরী এসে ছাদে প্রবেশ করলেন, কল্যাণবাবু আছেন নাকি?

হ্যাঁ, আসুন চৌধুরী মশাই। কখন ফিরলেন কারখানা থেকে?

এই তো কিছুক্ষণ হল ফিরে স্নানাদি করলাম। তারপর সারাটা দিন একা একা কাটাতে হল, খুব কষ্ট হয়েছে নিশ্চয়ই!

না, কষ্ট আর তেমন কি, নির্জনতা আমার ভালোই লাগে। আপনার ওদিককার কাজ কতদূর হল?

সবই প্রায় হয়ে গেছে, এখন চালানটা তৈরী করে গাড়িতে চাপিয়ে স্টেশনের দিকে রওনা করে দিতে পারলেই, ব্যস। আজ সারাটা রাত্রি ধরে গাড়িতে বোঝাই হবে, ভোরবেলা আমি গিয়ে রওনা করে দিয়ে আসব মাত্র।

***

রাত্রে আহারাদির পর সুব্রত এসে শয্যায় শুলো বটে, কিন্তু চোখের পাতায় ঘুম যেন কিছুতেই আসতে চায় না। আর কেন যেন ঘরে ঘরে কেবলই ছাদের দিকে খোলা জানলাটার উপরে গিয়ে চোখের দৃষ্টি পড়ে। অন্ধকার বাতাসে ছাদের উপরে নুয়ে পড়া বটবৃক্ষের পাতার কাঁপুনির শব্দ যেন একটানা শোনা যায়। কেমন যেন একটু তন্দ্ৰামত এসেছিল, সহসা এমন সময় আবার গতরাত্রের সেই করুণ কান্নার শব্দ রাতের স্তব্ধতাকে মর্মরিত করে তোলে। সুব্রত ধড়ফড় করে শয্যার ওপরে উঠে বসে। কাঁদছে! কে যেন কাঁদছে গুমরে গুমরে! গতরাত্রের মতই সুব্রত ঘরের দরজা খুলে বাইরে অন্ধকার বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।

এখন আরও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে সেই কান্নার শব্দ। সুব্রত বারান্দা অতিক্রম করে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়। কান্নার শব্দ যেন সুব্রতকে সম্মোহিত করে সামনের দিকে টেনে নিয়ে চলেছে কি এক অজ্ঞাত আকর্ষণে।

সিঁড়িটা অন্ধকার। সুব্রত অবার নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে টটা নিয়ে আসে। সিঁড়ির স্তুপীকৃত অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে যেন পাতালপুরীর মৃতুগুহা হতে কোনো এক অশরীরী কান্নার শব্দ ওপরদিকে ঠেলে উঠে আসছে। সুব্রত টর্চের বোম টিপল, মুহূর্তে স্তুপীকৃত অন্ধকার সরে গিয়ে সমগ্র সিঁড়িপথটি আলোকিত হয়ে ওঠে। সিঁড়ি বেয়ে সুব্রত নীচে চলে আসে। কান্নার শব্দটা এখনও কানে এসে বাজছে।

প্রথমে সুব্রত সদর মহলটা দেখলে। না, কিছু নেই সন্দেহজনক। অতঃপর অন্দরমহলে গিয়ে সুব্রত প্রবেশ করে। এবারে কান্নার শব্দটা যেন আরও স্পষ্ট হয়ে কানে আসছে। চলতে চলতে সুব্রত দ্বিপ্রহরে যে ঘরটার তালা ভেঙেছিল, সেটার বন্ধ দরজাটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। তালাটায় হাত দিতেই তালাটা খুলে গেল,বুঝলে এখনও তালা ভাঙার ব্যাপারটা কেউ টের পায়নি এ বাড়িতে। মনে হচ্ছিল কান্নার শব্দটা যেন সেই ঘর থেকেই আসছিল। নিঃশব্দে সুব্রত অন্ধকার ঘরটার মধ্যে পদার্পণ করলে। হ্যাঁ, আরও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে এবারে কান্নার শব্দটা। মনে হয় কে বুঝি ঐ ঘরেরই ধূলিমলিন মেঝের ওপরে লুটিয়ে পড়ে ফুলে ফুলে কাঁদছে।

চাপা গলায় সুব্রত প্রশ্ন করলে, কে কাঁদছ?

মুহূর্তে কান্নার শব্দ থেমে গেল। সুব্রত কিছুক্ষণ রুদ্ধনিশ্বাসে অন্ধকার ঘরটার মধ্যে কান পেতে দাঁড়িয়ে রইল। না,আর কোনো শব্দ নেই। যে-ই কাঁদুক, এখন আর কাঁদছে না।

সুব্রত আবার চাপা গলায় প্রশ্ন করে, কে? কে কাঁদছিলে? কথা বলছ না কেন? জবাব দাও।

সহসা এমন সময় গতরাত্রের মত কার পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। অস্থির পদে কে যেন আশেপাশেই কোথায় পায়চারি করছে আর করছে।

সুব্রত এবারে টর্চের বোম টিপে টচটা জ্বালল। কেউ কোথাও নেই, খাঁ খাঁ করছে শূন্য ঘরটা। অন্ধকারে এতক্ষণ যারা ঘরের মধ্যে ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল, তারা সব যেন হঠাৎ আলো দেখে পালিয়ে গেছে। বাড়িটা কি ভৌতিক বাড়ি! এ কি সব আশ্চর্য ব্যাপার! খখস শব্দ তুলে পায়ের কাছ দিয়ে একটা বড় ইঁদুর চলে গেল ঘরের কোণে। সব্রত তার উপরে আলো ফেললে। হঠাৎ আলোয় ইঁদুরটা যেন একটু হকিয়ে গিয়েছিল। পরক্ষণেই একলাফে কপাট-খোলা দেওয়ালে-আলমারিটার মধ্যে লাফিয়ে উঠে অদৃশ্য হয়ে গেল।

আশ্চর্য, ইঁদুরটা কোথায় গেল? সুব্রত আলমারিটার সামনে আরও এগিয়ে গেল। না, ইঁদুরটা নেই তো! অতবড় ইঁদুরটা! আলো ফেলে খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সুব্রত আলমারিটা তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগল। আলমারিটায় সর্বসমেত তিনটি তাক। সর্বনিম্নের তাকে লাফিয়ে উঠেই ইঁদুরটা অদৃশ্য হয়ে গেছে। হঠাৎ ওর নজরে পড়ল, সর্বনিম্ন তাকের ডানদিককার দেওয়ালে একটা বড় ফোকর। এতক্ষণে সুব্রত বুঝলে ঐ ফোকরের মধ্য দিয়েই ইদুরটা অদৃশ্য হয়েছে। এমন সময় আবার সেই কান্নার শব্দ এবং যেন বেশ স্পষ্ট হয়ে কানে আসে এবারে।

নিজের অজ্ঞাতেই সুব্রত এবারে ফোকরটার দিকে ঝুঁকে পড়ে। হ্যাঁ, ঠিক। এতক্ষণে চকিতে ওর মনে একটা সম্ভাবনা যেন হঠাৎ আলোর ঝলকানি দিয়ে যায়। অশরীরী কান্না নয়, কোনো জীবন্ত হতভাগ্যেরই বুকভাঙ্গা কান্না। সুব্রত ফোকরটা ভাল করে পরীক্ষা করে দেখতে থাকে, চারপাশে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে। নিশ্চয়ই এই ঘরের নীচে কোনো চোরাকুঠুরি আছে, এবং সেই চোরাকুঠুরির অন্ধকার অতল গহ্বর থেকেই আসছে সেই কান্নার শব্দ কিন্তু সেই চোরাকুঠুরিতে প্রবেশের পথ কোথায়? কোথায় সেই অদৃশ্য সংকেত? সুব্রত আলমারিটা আবার ভাল করে পরীক্ষা করতে শুরু করে উৎকণ্ঠিত ভাবে চারপাশে টিপে টিপে হাত বুলিয়ে, টোকা মেরে, ধাক্কা দিয়ে পরীক্ষা করতে থাকে। কিন্তু কোনো অদৃশ্য সংকেতই তার চোখে পড়ে না। আলমারির কপাটের গায়ে সেখানেও কিছু নেই। আলমারির কপাট দুটো খোলে আর বন্ধ করে। দুতিনবার খুলে আর বন্ধ করতে করতে চতুর্থবার একটু জোরে কপাট দুটো বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সরসর করে একটা ভারী শব্দ ওর কানে আসে। পরক্ষণেই তার চোখের সামনে যে বিস্ময়কর ঘটনাটা ঘটে যায়, তাতে ও ভূত দেখার মতই চমকে দুপা নিজের অজ্ঞাতেই পিছিয়ে যায়। আলমারির মধ্যস্থিত পশ্চাতের দেওয়াল ও সেলগুলো আর দেখা যাচ্ছে না। তার জায়গায় একটা কালো গহুর হাঁ করে মুখব্যাদান করে যেন ওকে গ্রাস করতে চাইছে।

 ২.০৬ আবার বিষের তীর

কিরীটী কতকটা ইচ্ছা করেই বিকাশের ওখানে উঠেছিল। যে কাজের জন্যে ও রায়পুরে এসেছে। অজ্ঞাত বেশ ধরে, ও জানত বিকাশের ওখানে থাকলে তার বিশেষ সুবিধাই হবে। এবং কখন কি ঘটে তার সঙ্গে ওর বিকাশের মারফত একটা যোগসূত্র রাখাও সহজ হবে। তার জন্য ওর আত্মপ্রকাশ করবার কোনো প্রয়োজনই হবে না। তাছাড়া বিকাশের ওখানে থাকলে কেউ ওকে সন্দেহও করতে পারবে না। এবং সবার চাইতে বেশী সুবিধা হচ্ছে, ওর প্রয়োজনমত সর্বদাই বিকাশের সাহায্য পাবে ও যে কোনো সংবাদের লেনদেন করতে পারবে।

বিকাশও সুব্রতর অনুপস্থিতিতে কিরীটী ওর বাসায় উঠে আসায় বিশেষ খুশীই হয়েছিল, এবং কিরীটীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় রায়পুর হত্যা-মামলায়ও বিশেষ আগ্রহান্বিত হয়ে উঠেছিল ক্রমে। কিরীটীর তীক্ষ্ণ বিচারশক্তি, অদ্ভুত বিশ্লেষণ-ক্ষমতা ওকে মুগ্ধ করেছিল। কিন্তু দুদিন আগে সুব্রতর বাসায় কিরীটীকে যে কথার নেশায় পেয়েছিল, এখন যেন তার তিলমাত্রও তা ওর মধ্যে অবশিষ্ট নেই। শামুকের মত হঠাৎ যেন কিরীটী নিজেকে খোলসের মধ্যে গুটিয়ে নিয়েছে।

দিনরাত কিরীটী ঘরে বসে বসে আপন মনে চোখ বুজে হয় কিছু ভাবে, না হয় একটা কালোমোটা নোটবইতে খসখস করে কি সব লিখে চলে।

সন্ধ্যাবেলা থানার সামনে মাঠের মধ্যে দুজনে যখন মধ্যে মধ্যে ইজিচেয়ার পেতে বসে, তখনও বেশীর ভাগ সময়ই কিরীটী আজেবাজে গল্প করেই কাটিয়ে দেয়। মামলার ধার দিয়ে যায় না।

রাত্রি তখন প্রায় গোটা এগারো সাড়ে এগারো হবে। বিকাশ ও কিরীটী আহারাদির পর যেখানে গাছের তলে অন্ধকারে চেয়ার পেতে বসে গল্প করছিল, সেখানে হঠাৎ একটা তীব্র আলোর রশ্মি এসে পড়ল।

দেখুন তো বিকাশবাবু, সাইকেলে করে এত রাত্রে কে এল? কিরীটী বললে।

সত্যিই একটা সাইকেল এসে ওদের অল্পদূরে থামল, এবং সাইকেল-আরোহী নীচে লাফিয়ে পড়ল।

কে? বিকাশ প্রশ্ন করে।

আজ্ঞে, আমি সতীশ স্যার। সতীশ এগিয়ে আসে।

কি সংবাদ, এত রাত্রে?

আজ্ঞে–খুব জোরে অনেকটা পথ সাইকেল চালিয়ে এসে সতীশ বেশ হাঁপিয়ে গিয়েছিল। টেনে টেনে বলে, আজ্ঞে রাজাবাহাদুর পাঠিয়ে দিলেন, রাজাবাহাদুরের খুড়োমশাই নিশানাথবাবুকে তার শোবার ঘরের মধ্যে কারা যেন বুকে তীর মেরে, আমাদের লাহিড়ী মশায়ের মতই খুন করে রেখে গেছে। এক নিঃশ্বাসে সতীশ কথাগুলো বলে শেষ করে।

সংবাদটা শুনে বিকাশ হঠাৎ যেন লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, অ্যাঁ, কি বললে সতীশ! আবার…আ…বা…র খুন!

আজ্ঞে।

তারপর একটু থেমে সতীশ বললে, আপনি একবার তাড়াতাড়ি চলুন স্যার। রাজাবাহাদুর বড্ড নার্ভাস হয়ে পড়েছেন।

আচ্ছা তুমি এগোও, বলল আমি এখুনি আসছি।

সতীশ চলে গেল।

বিকাশবাবু? কিরীটী ডাকলে মৃদুস্বরে।

বলুন?

আমিও যাব আপনার সঙ্গে রাজপ্রাসাদে।

অ্যাঁ! সে কি করে হতে পারে?

শুনুন। আপনি আমার পরিচয় দেবেন সি.আই.ডি-র ইন্সপেক্টর বলে? বলবেন, এই কেসেরই তদন্ত করতে উপরওয়ালারা আমাকে আপনার সাহায্যে পাঠিয়েছেন কলকাতা থেকে। ইন্সপেক্টার অর্জুন রায় বলে আমার পরিচয় দেবেন।

ঠিক আছে। চলুন। আপনি হয়ত অকুস্থানে গেলে নিজের চোখে পরীক্ষা করলে, অনেক কিছুই দেখতে পাবেন।

সত্যি কথা বলতে কি, বিকাশ কিরীটীর এ প্রস্তাবে যেন হাতে স্বর্গ পেল। কিরীটী সঙ্গে থাকা, শুধু বলই নয়, একটা ভরসাও।

কিরীটীকে ঐ বেশেই গমনোদ্যত দেখে বিকাশই হঠাৎ প্রশ্ন করে, আপনি কি এই বেশেই যাবেন?

হ্যাঁ, সাধারণ ড্রেসেও অনেক সময় সি.আই. ডি-র লোকদের.ঘুরতে হয়। তাছাড়া আরও একটা কথা, আমার অর্জুন রায় পরিচয় একমাত্র রাজাবাহাদুরকে ছাড়া আর কাউকেই দেবেন না। তাঁকেই শুধু আড়ালে ডেকে চুপিচুপি বলে দেবেন। এত বড় সুযোগ সহজে মেলে না। তারপরই যেন কতকটা অস্ফুট কণ্ঠে কিরীটী বলতে থাকে, আমি জানতাম, নিশানাথের দিনও ঘনিয়ে এসেছে; তবে তা এত শীঘ্র তা ভাবিনি। ভেবেছিলাম বিকৃতমস্তিষ্ক বলে হয়ত কিছুদিন সে রেহাই পাবে, কিন্তু এখন দেখছি আমারই হিসাবে ভুল হয়েছিল।

বিকাশ কিরীটীর অর্ধস্ফুট স্বগতোক্তিগুলি ভালকরে বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করে, কি বলছেন?

কিরীটী মৃদু স্পষ্ট কণ্ঠে জবাব দেয়, না, ও কিছু না। ভাবছিলাম জীবিত অবস্থায় নিশানাথের সঙ্গে একটিবার দেখা করতে পারলে তদন্তের আমাদের অনেক সুবিধা হত, কিন্তু যেমনটি চাওয়া যায় সব সময় তো তেমনটি হুবহু হয় না। হাতের কাছে যেটুকু পাওয়া গেল তারই পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা যাক। এখন উঠুন, আর দেরি নয়…

সামান্য চেহারার অদলবদল করে নিল কিরীটী দ্রুতহস্তে ঘরের মধ্যে ঢুকে। তারপর দুজনে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ল রাজপ্রাসাদের উদ্দেশে।

নিঃশব্দে দুজনে পথ অতিবাহিত করে চলেছে, কারও মুখেই কোনো কথা নেই। হঠাৎ একসময় বিকাশ ডাকে, কিরীটীবাবু!

উঁহু, কিরীটী নয়, বলুন অর্জুনবাবু! খুব সাবধান, কিরীটী নামটা অত্যন্ত পরিচিত। যদিও সামান্য চেহারার অদলবদল করে নিয়েছি, তবু সাবধানের মার নেই।

না, আর ভুল হবে না, চলুন।

হ্যাঁ, কি যেন বলছিলেন বিকাশবাবু?

আচ্ছা আপনার কি মনে হয়, খুনী এখনও আশেপাশেই কোথাও আছে গা-ঢাকা দিয়ে?

কিরীটী হো-হো করে হেসে ওঠে, কেমন করে বলি বলুন তো! আমি তো আর গণকঠাকুর নই!

কিন্তু অনেক সময় শুনেছি, খুনীরা খুন করবার পর অবস্থা বোঝবার জন্য অকুস্থানের আশেপাশেই কোথাও আত্মগোপন করে থাকে।

বুঝেছি, আপনি কি বলতে চান বিকাশবাবু। কিন্তু সময় না হওয়া পর্যন্ত খুনীকে ধরা যায় না; তাহলে সব কেঁচে যায়। খুনী যদি এখন ওইখানে থাকেও, তবু জানবেন এখনও তাকে ধরবার মাহেন্দ্রক্ষণটি আসেনি। ভয় নেই, লগ্ন এলেই বরকে পিড়িতে বসাব এনে। কিরীটী রায় লগ্ন বয়ে যেতে দেয় না কখনও। কিরীটী স্মিতভাবে বললে।

কিরীটী আবার বলতে থাকে, তাছাড়া ভেবে দেখুন, খুনীকে ধরে ফেলবার সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত রহস্যের সব উত্তেজনা বা আনন্দের সমাপ্তি ঘটল। চিন্তা করে দেখুন তো খুনী কে আপনি জানতে পেরেছেন এবং জেনেও না-জানার ভান করে আছেন, খুনীকে সহজ নিশ্চিন্ত ভাবে চলে-ফিরে বেড়াবার জন্য। সে পরম নিশ্চিন্তে আছে। একবারও সে ভাবছে না যে, একজনের চোখে সে ধরা পড়ে গেছে। একজনের সদাসতর্ক দৃষ্টি সর্বক্ষণ তার পিছু পিছু ফিরছে ছায়ার মত। তারপরই যেই সময় এল, প্রমাণগুলো সব আপনার হাতের মুঠোর মধ্যে এল, ঝাঁপিয়ে পড়ুন আপনি খুনীর উপরে।

কথা বলতে বলতে দুজনে প্রায় প্রাসাদের বড় গেটটার সামনে এসে গেছে ততক্ষণ।

গেটের বাইরে ছোষ্ট্র সিং পাগড়ী মাথায় লাঠি হাতে দাঁড়িয়েছিল, সেলাম দিল। গেটের বড় আলোটা জ্বেলে দেওয়া হয়েছে। উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোয় তীব্র দৃষ্টি বুলিয়ে ছোট্টু সিং-এর আপাদমস্তক কিরীটী দেখে নিলে একবার। সুব্রতর চিঠির বর্ণনা তার মনে ছিল, ছোষ্ট্র সিংকে চিনতে এতটুকুও তার কষ্ট হয়নি। ছোট্টু সিং-এর পাশেই সুবোধ মণ্ডলও গেটের সামনে দাঁড়িয়েছিল। ওরা কারও দিকে দৃষ্টিপাত না করে গেট অতিক্রম করে এগিয়ে চলে। খাজাঞ্জীঘরের সামনে মহেশ সামন্ত ও আর একজন দাঁড়িয়ে ফিসফিস্ করে কি সব কথাবার্তা বলছিল, ওদের এগিয়ে আসতে দেখে হঠাৎ চুপ করে গেল।

কিরীটী চাপা গলায় প্রশ্ন করলে, এরা?

প্রথমটি জানি না, দ্বিতীয়টি মহেশ সামন্ত।

ও, এরাই তারা! আর গেটের সামনে যে দাঁড়িয়েছিল, একজন তো ছোট্টু সিং, দ্বিতীয়টি?

সুবোধ মণ্ডল।

ও, যে জেগেই ঘুমোয়!

দু-চারবার আসা-যাওয়া করতে করতে বিকাশের রাজবাড়ির অন্দরমহলটা বেশ পরিচিত হয়ে গিয়েছিল, সোজা সে কিরীটীকে সঙ্গে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল।

সেদিনকার মত আজও রাজাবাহাদুরের বাসভৃত্য শম্ভ সিঁড়ির মাথায়ই দাঁড়িয়ে ছিল, বোধ করি ওদেরই অপেক্ষায়।

রাজাবাহাদুর কোথায়?

আজ্ঞে তাঁর বসবার ঘরে।

অস্থিরভাবে রাজাবাহাদুর পায়চারি করছিলেন, ওদের পদশব্দে মুখ ফিরিয়ে তাকালেন, আসুন বিকাশবাবু! পরক্ষণেই কিরীটীর প্রতি নজর পড়তে ভুরুটা ঈষৎ কুঁচকে থেমে গেলেন।

কিরীটীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেটা কিন্তু এড়ায়নি। সে মৃদু হেসে একটু এগিয়ে এসে বললে, আমার নাম অর্জুন রায়।

বিকাশই এব বাকি পরিচয়টুকু শেষ করে দিল, আমারই ভুল হয়েছে রাজাবাহাদুর, ইনি সি.আই.ডি-র ইন্সপেক্টর মিঃ অজুর্ন রায়, লাহিড়ীর কেসের তদন্তে সাহায্য করবার জন্য হেড কোয়াটার থেকে এখানে এসেছেন আজ দিন-দুই হল, আর ইনি মহামান্য রাজাবাহাদুর শ্ৰীযুক্ত সুবিনয় মল্লিক, রায়পুর স্টেটের।

এরপর উভয়ে উভয়কে নমস্কার ও প্রতিনমস্কার জানাল। কিন্তু কিরীটী লক্ষ্য করলে, তথাপি যেন রাজাবাহাদুরের মুখ হতে সম্পূর্ণ বিরক্তির ভাবটা যায়নি। কিরীটী সেদিকে আর বেশী নজর দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করল না। এবং বর্তমান কেস সম্পর্কে যে তার বিশেষ একটা কিছু উৎসাহ আছে সে ভাবও প্রকাশ করতে চাইল না। মুখের উপর একটা প্রশান্ত নির্লিপ্ততার ভাব টেনে এনে নিঃশব্দে একপাশে সরে রইল।

বিকাশের প্রশ্নেরই জবাবে সুবিনয় মল্লিক বলেন, মৃতদেহ নিশ্চয়ই আপনারা দেখতে চান। দারোগা সাহেব?

নিশ্চয়ই।

তবে যে ঘরে মৃতদেহ আছে সেই ঘরেই সকলকে যেতে হয়, কেননা যে ঘরে খুড়ো মশাই থাকতেন, সেই ঘরেই তিনি নিহত হয়েছেন।

বেশ, তবে তাই চলুন। মিথ্যে আর দেরি করে লাভ কি! বিকাশ বললে।

একটু অপেক্ষা করুন রাজাবাহাদুর। কিরীটী গমনোদ্যত সুবিনয় মল্লিক ও বিকাশকে বাধা দিল।

ওঁরা দুজনেই একসঙ্গে ফিরে দাঁড়াল। দুজনের চোখেই সপ্রশ্ন দৃষ্টি।

মৃতদেহ দেখার জন্য তাড়াহুড়োর কিছুই নেই, কারণ যিনি মারা গেছেন, তিনি যখন নিঃসন্দেহেই মারা গেছেন, তখন আগে সমস্ত ব্যাপারটা একবার শুনতে পারলে ভাল হত। তারপর রাজাবাহাদুরের দিকে তাকিয়ে কিরীটী বললে, একটুও কিছু বাদ না দিয়ে সব ব্যাপারটা খুলে বলুন তো!

রাজাবাহাদুর সুবিনয় মল্লিক যা বললেন সংক্ষেপে তা এই, বিকাশবাবুর মুখেই হয়ত শুনে থাকবেন, আমার কাকা নিশানাথ মল্লিক শোলপুর স্টেটের আর্টিস্ট ছিলেন, কিছুদিন হল মাথার সামান্য গোলমাল হওয়ায় স্টেটের চাকরি ছাড়িয়ে আমি তাঁকে একপ্রকার জোরজবরদস্তি করে রায়পুরে নিয়ে আসি। রাজা শ্রীকণ্ঠ মল্লিকরা ছিলেন তিন ভাই। বড় শ্ৰীকণ্ঠ, মেজ সুধাকণ্ঠ ও কনিষ্ঠ বাণীকণ্ঠ। শ্রীকণ্ঠ মল্লিকের পিতা রত্নেশ্বর মল্লিক, কোনো কারণে মধ্যম ও কনিষ্ঠ পুত্রের উপর বিরূপ হয়ে তাঁর যাবতীয় সম্পত্তি জ্যেষ্ঠ শ্রীকণ্ঠ মল্লিককেই দিয়ে যান। মধ্যম ও কনিষ্ঠের জন্য সামান্য কিছু মাসোহারার ব্যবস্থা করে দিয়ে যান মাত্র। সুধাকণ্ঠ ছিল অত্যন্ত আত্মাভিমানী, পিতার ব্যবহারে বোধ হয় ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি তাঁর একমাত্র মাতৃহারা পুত্র হারাধনকে নিয়ে ভাগলপুরে চলে যান। এবং সেখানে যাবার কয়েক বৎসর পর হারাধন যেবারে এন্ট্রান্স পাস দেন সেবারে মারা যান। তখন হারাধন মোক্তারী পাস করে কিছুকাল ভাগলপুরে প্র্যাকটিস করেন, তারপর রায়পুরে এসে প্র্যাকটিস ও বসবাস শুরু করেন। এদিকে রত্নেশ্বরের মৃত্যুর দু মাস পরেই কনিষ্ঠ বাণীকণ্ঠ ও তাঁর স্ত্রী, একমাত্র পুত্র নিশানাথকে রেখে মারা যান। নিশানাথ আর্ট স্কুল থেকে পাস করে কিছুকাল পরে শোলপুরে চাকরি নিয়ে চলে গেলেন। আমার এখানে এসেছিলেন মাস পাঁচেক মাত্র। আমি যেদিন হঠাৎ আততায়ীর হাতে আহত হই, সেদিন থেকে কাকার পাগলামিটা ক্রমশই বেড়ে ওঠে, এবং সর্বদা তাঁকে দেখাশুনা করছিলেন আমার বিমাতা। আজ দ্বিপ্রহর থেকে চুপচাপই ছিলেন। অন্যান্য দিনের চেয়ে। সন্ধ্যা থেকে রাত্রি নটা পর্যন্ত মা কাকার কাছেই ছিলেন। রাত্রি নটার পর মা কাকার খাবার আনতে গেছেন, এমন সময় হঠাৎ একটা চিৎকার শোনা যায়, আমি এই ঘরে বসেই সংবাদপত্র পড়ছিলাম, আমিও চিৎকার শুনে ছুটে যাই। গিয়ে দেখি আমার বিমাতাও ততক্ষণে সেই কক্ষে গিয়ে হাজির হয়েছেন। কাকা জানালার নীচে উপুর হয়ে পড়ে আছেন। তাড়াতাড়ি কাকাকে গিয়ে ধরতেই, দেখলাম বুকের কাছে জামা ও মেঝেতে রক্ত। এবং বাঁদিকের বুকে বিঁধে আছে একটা তীর। ঠিক যেমনটি বিঁধেছিল লাহিড়ীর বুকে। বুঝলাম হতভাগ্য লাহিড়ীর মতই তাঁরও মৃত্যু ঘটেছে এবং তাতে কোনো অদৃশ্য আততায়ীর হাত আছে। তখুনি আপনার কাছে লোক পাঠাই।

এবারে কিরীটী প্রশ্ন করে, চিৎকার শোনবার পর আপনি যখন ঘরে গিয়ে প্রবেশ করেন, আপনার কাকা তখনও বেঁচেছিলেন, না তার আগেই মারা গেছেন?

আমি গিয়ে আর তাঁকে জীবিত অবস্থায় দেখিনি।

আপনার এ ঘর থেকে সেই ঘরে যেতে কতক্ষণ সময় লাগতে পারে বলে আপনার মনে হয় রাজাবাহাদুর?

তা মিনিট পাঁচ-ছয় তো হবেই।

চিৎকার শুনেই আপনি ছুটে গিয়েছিলেন, বললেন না? একটুও দেরি করেননি?

হ্যাঁ।

আপনার এ ঘর থেকে সে ঘরে কোন চিৎকারের শব্দ হলে অনায়াসেই তবে শোনা যায় বলুন।

নিশ্চয়ই।

আর কে কে সেই চিৎকার শুনতে পেয়েছিল জানেন?

বোধহয় অনেকেই শুনেছিল, কেননা আমরা মানে আমি ও আমার বিমাতা সে ঘরে গিয়ে ঢোকবার পর কিছুক্ষণের মধ্যে বাড়ির চাকরবাকরেরাও ছুটে এসেছিল।

রাজাবাহাদুর,আপনার যদি আপত্তি না থাকে, আমি রাণীমাকে, মানে আপনার বিমাতাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।

বিশেষ কি প্রয়োজনীয়?

হ্যাঁ। তা নাহলে অযথা তাঁকে আমি কষ্ট দিতাম না।

বেশ, তাঁকে ডাকাচ্ছি।

২.০৭ রাণীমা

রাজাবাহাদুর একজন ভৃত্যকে রাণীমাকে ডাকতে পাঠালেন। একটু পরেই রাণীমা মালতী দেবী ধীর মন্থর পদে ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন। কিরীটী চোখ তুলে মালতী দেবীর দিকে তাকাল।

মালতী দেবী সত্যিই অপরূপ রূপলাবণ্যময়ী, বয়েস এখনও চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশের মধ্যে, ছোটখাটো গড়ন, অত্যন্ত শীর্ণ। মুখখানি যেন শিল্পীর পটে আঁকা ছবির মত নিখুঁত। পরিধানে একটি দুধ-গরদ থান, নিরাভরণা। কিন্তু একটা জিনিস, মুখের দিকে তাকালেই মনে হয়, অত্যন্ত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং সহিষ্ণু।

মা, আপনাকে আমার প্রয়োজনের তাগিদে বিরক্ত করতে হল বলে আমি একান্ত দুঃখিত, কিরীটী বলে, বেশীক্ষণ আপনাকে কষ্ট দেব না মা। দু-চারটে প্রশ্ন শুধু আমি করতে চাই, আশা করি ছেলের অপরাধ নেবেন না।

বলুন। শান্ত অথচ দৃঢ়স্বরে মালতী দেবী বললেন।

এবারে কিরীটী ঘরের মধ্যে উপস্থিত বিকাশ ও রাজাবাহাদুরের দিকে তাকাল। অনুগ্রহ করে, কিরীটী মৃদুস্বরে বললে, আপনারা যদি দু-চার মিনিটের জন্য একটু বাইরে যান।

জবাবে বিকাশই রাজাবাহাদুরের দিকে তাকিয়ে বললেন, আসুন রাজাবাহাদুর।

দুজনে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন। কিরীটী এগিয়ে গিয়ে দরজাটি ভেজিয়ে দিল। তারপর মালতী দেবীর দিকে এগিয়ে এসে মৃদুকণ্ঠে বললে, মা, আমি আপনার কাছে কয়েকটি কথার জবাব চাই।

আপনি কথা বলতে পারেন স্বচ্ছন্দে। কেননা এ ঘরটি এমনভাবে তৈরী যে, চিৎকার করে কথা বললেও এ ঘরের বাইরে শব্দ যায় না। এই ঘরের দেওয়ালগুলো সকল শব্দকেই শুষে নেয়। আবার এর পাশের ঘরটি এমনভাবে তৈরী যে, আশেপাশের দুটি ঘর ও ঠিক তার নীচের ঘরের সমস্ত শব্দ যত আস্তেই হোক না কেন অনায়াসেই শোনা যাবে। ঘর দুটি এভাবে আমার স্বামীই তাঁর জীবিত অবস্থায় জার্মান ইঞ্জিনীয়ার দিয়ে প্ল্যান করে তৈরী করেছিলেন।

আশ্চর্য তো! কিন্তু এইভাবে ঘর দুটি তৈরী করার কারণ?

কারণ এই ঘরটিতে বসে তিনি স্টেট সংক্রান্ত সকল শলাপরামর্শ গোপনে করতেন, আর পাশের ঘরটিতে তিনি শয়ন করতেন বলে যাতে করে সামান্যতম শব্দও শুনতে পান, তাই ঐ ব্যবস্থা করেছিলেন।

আপনার স্বামী অত্যন্ত দূরদর্শী ছিলেন দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু সে কথা থাক। নিশানাথবাবুর চিৎকার শুনেই আপনি তাঁর ঘরে ছুটে যান, কেমন তাই না?

একটু ইতস্তত করে মালতী দেবী মৃদুকণ্ঠে বললেন, হ্যাঁ।

আপনি কোন ঘরে তখন ছিলেন?

রন্ধনশালার দিকে। আমি ওঁর খাবার সাজাচ্ছিলাম, আমার হাতে ছাড়া ঠাকুরপো কারও হাতে খেতে চাইতেন না ইদানীং।

কেন?

তাঁর কেমন একটা ধারণা হয়তো ছিল, তাঁকে এরা বিষ খাইয়ে মারতে চায়।

কেন, এ রকম ধারণার কোনো কারণ ঘটেছিল কি?

এবার যেন বেশ একটু ইতস্তত করেই মালতী দেবী জবাব দিলেন, না, আমার মনে হয়, ইদানীং তাঁর মাথার একটু দোষ হয়েছিল, তাই হয়ত ঐসব আবোলতাবোল ভাবতেন। কে এমন এ বাড়িতে আছে বলুন যে তাঁকে বিষ খাইয়ে মারতে চাইবে! ঐসব তাঁর বিকৃত মস্তিষ্কের কল্পনা।

সত্যিই আপনার তাই বলেই মনে হয় রাণীমা?

হ্যাঁ।

শুনেছি রাজাবাহাদুর সুবিনয় মল্লিকই তাঁকে মাথা খারাপ হওয়ার পর আগ্রহ করে রায়পুরে নিয়ে আসেন।

হ্যাঁ, বিনয় ওকে অত্যন্ত ভক্তিশ্রদ্ধা করত ও ভালবাসত, আমার দুই দেবরের মধ্যে একমাত্র উনিই এদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন। ওদের আর এক কাকা যিনি এখানেই আছেন, তিনি এদের সঙ্গে কখনও কথা পর্যন্ত বলেন না। শুনেছি পথেঘাটে দেখা হলেও চোখ ফিরিয়ে নেন।

কিন্তু আমি তো শুনেছি হারাধন মল্লিক লোকটি ভাল।

তা হতে পারে।

আচ্ছা মা, চিৎকার শুনে ছুটে গিয়ে নিশানাথবাবুকে জীবিত দেখেছিলেন, না মৃত দেখেছিলেন?

মালতী দেবী চুপ করে রইলেন। কোনো জবাব দিলেন না।

বলুন—

আমি…না, তাঁকে আমি জীবিত দেখিনি, আমি যখন ঘরে গেছি, তাঁর দেহে তখন আর প্রাণ ছিল না। প্রথম দিকে একটু ইতস্তত করে শেষের দিকে কতকটা যেন অস্বাভাবিক জোর দিয়েই মালতী দেবী কথাগুলো বলে গেলেন।

কিরীটী অল্পক্ষণ কি যেন একটু চিন্তা করলে, তারপর সমস্ত সংকোচকে একপাশে ঠেলে ফেলে হঠাৎ প্রশ্ন করলে, মা, আমার মুখের দিকে তাকান তো। আমি আপনার সন্তানের মত। কোনো লজ্জা বা সংকোচ করবেন না। কয়েকটা পুরানো কথা আপনাকে আমি জিজ্ঞাসা করতে চাই। জানি কথাগুলো আপনার ভাল লাগবে না। শুনলে হয়তো বা ব্যথা পাবেন, কিন্তু আমারও না জিজ্ঞাসা করলে চলবে না। একান্ত নিরুপায় আমি।

মালতী দেবী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন। যে চোখের দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন, সে চোখের দৃষ্টিতে কোনো সংকোচের বালাই ছিল না।

কিরীটী দৃঢ়স্বরে বলতে লাগল, শুনুন মা, এ রাজবাড়িতে আজ পর্যন্ত যা যা ঘটেছে সব একসূত্রে বাঁধা এবং তার কিনারা না করতে পারলে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড চলতেই থাকবে, তাই গোড়া থেকেই আমি শুরু করতে চাই।

মনে পড়ে আপনার মা, আপনার ছেলে সুহাসের মৃত্যুর আগে যেদিন তাকে নিয়ে আপনারা কলকাতা থেকে রায়পুরে আসছেন, সেদিন সকালের দিকে হঠাৎ এক সময় আপনি ও সুবিনয়বাবু সুহাসের ঘরে ঢুকে দেখতে পান, ডাঃ সুধীন চৌধুরী সুহাসকে একটা ইনজেকশন দিচ্ছেন। কোর্টেআপনিমামলার সময় ঐকথাই বলেছিলেন মনে পড়ে কিমা, আপনি নিশ্চয়ইভোলেননি! মামলার সময় জেরার মুখে বলেছিলেন, আপনি সুহাসকে প্রশ্ন করেছিলেন, কিসের আবার ইনজেকশন সে দিচ্ছে, তার জবাবে নাকি সুহাস কিছু বলেন নি!

হ্যাঁ, মৃদু ক্ষীণ ক্ষীণ স্বরে মালতী দেবী জবাব দেন।

আপনার ছেলের ঐ জবাবেই আপনি সেদিন সন্তুষ্ট হয়েছিলেন কি?

মালতী দেবী কিরীটীর প্রশ্নের কোনো জবাব দিলেন না, খোলা জানালাপথে অন্ধকারে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। অনেক কথাই রাণীমার বুকের মধ্যে যেন বরফের মত জমাট বেঁধে আছে। তাঁর একমাত্র পুত্র সুহাস! তাঁর জীবনের একটি মাত্র স্বপ্ন! তাও আজ বিফল হয়ে গেছে, শুধু স্মৃতিভারে আজও তিনি এইখানে পড়ে আছেন। কবে তিনি স্মৃতিমুক্ত হবেন!

মা! কিরীটী মৃদু স্নেহসিক্ত অথচ দৃঢ়কণ্ঠে বলতে লাগল, যে গেছে সে আর ফিরবে না। কিন্তু সন্তান, বিশেষ করে একটিমাত্র সন্তানকে হারানোর যে কী দুঃসহ ব্যথা তা আপনি মর্মে-মর্মেই জেনেছেন। অগাধ ঐশ্বর্যের অধীশ্বরী হয়েও আপনি আজ কাঙালিনী। মা হয়ে মায়ের ব্যথা আপনি নিশ্চয়ই বুঝবেন। আপনি জানেন নিশ্চয়ই এ কথা যে, আর যারই পক্ষে সম্ভব হোক, সুধীনের পক্ষে সুহাসকে খুন করা একেবারেই অসম্ভব!

অতীতকে আর টেনে আনবেন না। মালতী দেবী বললেন।

আমার নাম অর্জুন। আমি আপনার সন্তানের মত, অৰ্জুন বলেই আমাকে ডাকবেন। এবং তুমি বলেই সম্বোধন করবেন মা।

যা চুকেবুকে গেছে, তা আর কেন?

আমাদের সকলের উপরে এমন একজন আছেন জানবেন তাঁর সদা জাগ্রত দৃষ্টি থেকে টী তাঁর বিচার এখনও বাকি আছে। সত্যিকারের দোষী যে, একদিন তাকে মাথা পেতে দণ্ড নিতেই হবে।

কিন্তু—

একবার ভেবে দেখুন মা, সুধীনের মার কথা, তাঁরও তো ঐ একটি মাত্রই সন্তান!

না, আমি কিছু জানি না। আমি কিছু জানি না! সহসা মালতী দেবী দু হাতের পাতা চোখে ঢেকে রুদ্ধ আবেগে কেঁদে ফেললেন।

মা, আমার সত্যিকারের পরিচয় আপনি জানেন না, জানলে বুঝতেন মিথ্যা আশা এ জীবনে আমি কাউকে দিইনি। বলেছি সুধীনের মাকে, সুধীন আবার তাঁর মার বুকে ফিরে যাবেই। আপনি জানেন না, কিন্তু আমি জানি, সুধীন আদালতে বিচারের সময় অনেক কথার যে জবাব দিতে অস্বীকার জানিয়েছিল, সে কেবল আপনাকেই বাঁচাতে। পাছে আপনাকে গিয়ে প্রত্যহ কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় এবং আপনার মাথা নীচু হয়, সেই ভয়ে এবং আপনার ছেলে মৃত সুহাসের প্রতি অসীম স্নেহের বশেই সে সব কিছুই প্রায় অস্বীকার করে বা না-জানার ভান করে নিজের পায়ে নিজেই কুঠার মেরেছিল। একবার ভেবে দেখুন তো, এ কত বড় ত্যাগ-স্বীকার! আর আপনি? তার এত বড় ত্যাগের কি প্রতিদান দিয়েছেন!

কে? কে তুমি?… কি চাও? ভীতচকিত কণ্ঠে মালতী দেবী প্রশ্ন করেন হঠাৎ।

আমি? কিরীটী মৃদু হাসলে, পরিচয়টা আজ আমার ভোলাই থাক মা। সময় হলেই সব জানতে পারবেন। হ্যাঁ, আপনি যেতে পারেন মা, আপনি অত্যন্ত পরিশ্রান্ত হয়েছেন।

কিন্তু–, মালতী দেবী ইতস্তত করতে থাকেন।

আমার যতটুকু আপনার কাছে জানবার ছিল জেনেছি, আপনি এবারে যেতে পারেন মা।

কতকটা যেন একপ্রকার টলতে টলতেই মালতী দেবী দরজার দিকে অগ্রসর হলেন। কিরীটী তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে নিজ হাতে দরজা খুলে রাস্তা করে দিল। মালতী দেবী ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।

পাশের ঘরে একটা সোফার উপরে বিকাশ বসে বসে ঝিমাচ্ছিল, আর সুবিনয় অস্থির পদে ঘরময় পায়চারি করছিলেন।

বিকাশবাবু!

কিরীটীর ডাকে বিকাশ ধড়ফড় করে উঠে বসে, অ্যাঁ!

চলুন রাজাবাহাদুর, এবারে মৃতদেহটা দেখে আসা যাক।

আগে আগে রাজাবাহাদুর, পিছনে কিরীটী ও বিকাশ অগ্রসর হল।

সিঁড়ি দিয়ে নেমে একতলায় এসে অন্য একটা ঘোরানো সিঁড়িপথে, দোতলা ও একতলার মাঝামাঝি একটি বদ্ধ ঘরের দরজার সামনে এসে সকলে দাঁড়াল। ঘরের দরজার শিকল ভোলা ছিল, রাজাবাহাদুরই শিকল খুলে দরজা ঠেলে আহ্বান জানালেন, আসুন—এই ঘর।

সকলে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল, ঘরের মধ্যে উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে। মাঝারি গোছের ঘরখানি।

আসবাবপত্র তেমন বিশেষ কিছুই নেই, একটি পালঙ্ক, তার উপরে শয্যা বিছানো। একটি শ্বেতপাথরের টীপয়। ঘরের কোণে একটি মাঝারি সাইজের কাঁচের আয়না বসানো আলমারি, একটি বুক-সেলফ ও একটি মাত্র ক্যাম্বিসের আরাম-কেদারা।

ঘরের মধ্যে একটি দরজা ও দুটি জানালা। দুটি জানালাই ভোলা। একটি খোলা জানালার সামনে উপুড় হয়ে একপাশে কাত হয়ে ধনুকের মত বেঁকে নিশানাথের মৃতদেহটা পড়ে আছে, হাতের ও পায়ের আঙুলগুলো দুমড়ে বেঁকে গেছে। মুখে একটা অস্বাভাবিক যন্ত্রণার চিহ্ন তখনও সুস্পষ্ট।

কিরীটী সোজা সেই খোলা জানলাটার সামনে এসে দাঁড়াল; সামনেই অন্দর ও সদরের সংযোগস্থলে সেই আঙিনা চোখে পড়ে। কিরীটী আশেপাশে বাইরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে সহসা তার দুটো যেন ঈষৎ কুঞ্চিত হয়ে ওঠে এবং সঙ্গে সঙ্গেই সরল হয়ে আসে চোখের দৃষ্টিটা, যেন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মৃত্যুর সমস্ত সমাধানই যেন মুহূর্তে তার চোখের সামনে অন্ধকারে বিদ্যুৎ-ঝলকের মত প্রকটিত হয়ে ওঠে। চোখ ফিরিয়ে সে আবার মৃতদেহের উপরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। লাহিড়ীর মৃত্যু-ব্যাপার ঠিক সুব্রতর চিঠিতে যেমনটি সে লিখেছিল এ ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনই একটি তীর নিশানাথের বুকে বিদ্ধ হয়ে আছে। হত্যাপদ্ধতি যখন দুক্ষেত্রে অবিকল এক—একই গৃহে এবং রাত্রের অন্ধকারে, তখন কিরীটীর বুঝতে বাকি থাকেনা, লাহিড়ীও নিশানাথের হত্যাকারী একইলোক। নিশানাথ সম্পর্কে সুব্রতর অনেকগুলো কথা চিঠির অক্ষরে ওর মনের পাতায় যেন ছায়াছবির মত একটার পর একটা ভেসে যায়।

মৃতদেহ দেখা হয়ে গেছে বিকাশবাবু। ওপরে রাজাবাহাদুরের বসবার ঘরে চেয়ারের ওপরে আমার সিগার কেসটা ভুলে ফেলে এসেছি, যদি অনুগ্রহ করে নিয়ে আসেন। হঠাৎ কিরীটী বলল।

বিকাশ কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে যেতেই বেশ অনুচ্চ কণ্ঠে কিরীটী বললে, রাজাবাহাদুর, একটা কথা, আপনার কাকা নিশানাথ মল্লিক ও আপনার ম্যানেজার সতীনাথের হত্যাকারী কে সত্যিই কি জানবার জন্য আগ্রহী?

সুবিনয় যেন কিরীটীর কথায় প্রথমটা হঠাৎ চমকে ওঠেন, কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, এ-কথার মানে কি অর্জুনবাবু? আপনি কি বলতে চান?

আমার বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, এমনও তো হতে পারে ঐ দুটি হত্যারহস্যের মূল খুঁজে বের করতে গেলে হয়ত যাকে বলে আমাদের কেঁচো খুঁড়তে খুঁড়তে গোখরো সাপ গর্ত থেকে বের হয়ে আসা—ভাবছি, সত্যিই যদি তেমন কিছু ঘটে, তাহলে সাপের সে ছোবল সামলাবার মত সকলেই নীলকণ্ঠ কিনা।

ইন্সপেক্টার, আপনি ভুলে যাবেন না কার সামনে দাঁড়িয়ে আপনি কথা বলছেন। তাছাড়া আমি আপনার পরিহাসের পাত্র নই। খুনের তদন্ত করতে এসেছেন তাই করুন এবং যদি তদন্ত শেষ হয়ে গিয়ে থাকে, আমি এবারে আপনাদের যেতে বলব, কারণ রাত্রি অনেক হয়েছে। আমি অত্যন্ত পরিশ্রান্ত। রাজাবাহাদুর যেন একটু রুক্ষ গলায় ঐ কথাগুলো বললেন।

বিকাশ এসে কক্ষে প্রবেশ করল, হাতে তার কিরীটীর সুবর্ণনির্মিত সিগারকেসটি।

বিকাশের হাত হতে সিগার-কেসটি নিয়ে কিরীটী একটি সিগারে অগ্নিসংযোগ করে খানিকটা ধোঁয়া উদগীরণ করে বললে,চলুন বিকাশবাবু, রাত্রি অনেক হল। এই ঘরে একটা তালা দিয়ে চাবিটা নিয়ে চলুন, সকালে মৃতদেহটা ময়না তদন্তের ব্যবস্থা করবেন। আচ্ছা আসি তাহলে, নমস্কার রাজাবাহাদুর।

দুজনে উঠে দাঁড়াল

২.০৮ জবানবন্দির জের

রাস্তায় চলতে চলতে কিরীটী কিছু কিছু বাদ দিয়ে আনুপূর্বিক সমস্ত কথা বিকাশকে বলে গেল। বললে, রায়পুর-হত্যারহস্য যতটুকু জট পাকাবার তা পাকিয়েছে বিকাশবাবু, এবারে সেই জট আমাদের একটি একটি করে খুলতে হবে। রায়পুর রাজপরিবারের পুরাতন ইতিহাস, মনে হচ্ছে সে যেন একখানি উপন্যাস। যার কিছুটা আজ আপনি রাজাবাহাদুরের মুখে শুনলেন, বাকিটা আমি যা খোঁজ করে জেনেছি তা এই— আপনি শুনলেন, শ্ৰীকণ্ঠ মল্লিকরা ছিলেন তিন ভাই, জ্যেষ্ঠ শ্রীকণ্ঠ, মধ্যম সুধাকণ্ঠ ও কণিষ্ঠ বাণীকণ্ঠ। এঁদেরই পিতা ছিলেন রাজা রত্নেশ্বর মল্লিক। রত্নেশ্বরের পিতার আমলে একটা খুনের মামলায় এঁদের সম্পত্তি প্রায় যায় যায় হয়েছিল, সেই সময় যিনি তাঁর প্রাণ দিয়ে সকল অপরাধ নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে এঁদের পূর্বপুরুষকে বাঁচিয়েছিলেন, সেই তিনিই হচ্ছেন এঁদের পূর্বতন নায়েবজী শ্রীনিবাস মজুমদারের পিতামহ। রত্নেশ্বরের পিতা অকৃতজ্ঞছিলেন না, তাই হয়ত এর প্রতিদানেনৃসিংহগ্রাম মহালটির অর্ধাংশ মজুমদার বংশকে লেখাপড়া করে দিয়ে যান। পরে অবিশ্যি আবার শোনা যায় রত্নেশ্বর সে অংশটুকু কিনে নেন নামমাত্র মূল্য দিয়ে, বলতে পারেন কতকটা মজুমদার মশাইকে বিক্রি করতে বাধ্য করেছিলেন রত্নেশ্বর এবং অর্থের লোভে পিতার ঋণ তিনি সম্পূর্ণ অস্বীকার করলেন।

হয়ত মল্লিক বংশের ধ্বংসের মৃত্যুবীজ সেই দিনই সবার অলক্ষ্যে রোপিত হয়েছিল অলঙঘ নির্দেশে এবং ক্রমে একদিন সেই বিষই এদের পুরুষানুক্রমে রক্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল। সত্যি কি মিথ্যা জানি না, হারাধন মল্লিক বলেন রত্নেশ্বরই নাকি তাঁর বৃদ্ধ পিতাকে দুধের সঙ্গে বিষপ্রয়োগে হত্যা করেন। কিন্তু দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ হয়ে জন্ম নিলেন রত্নেশ্বরের জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রীকণ্ঠ মল্লিক। তিনি দুই পুরুষ আগেকার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইলেন, কিন্তু তাঁর সে মনস্কামনা পূর্ণ হবার আগেই নিজ বংশের বিষের ক্রিয়ায় জর্জতির হয়ে ছটফট করতে করতে তিনি মৃত্যুকে বরণ করলেন। সংক্রামক ব্যাধির মতই পাপের বিষ তখন এদের বংশকে বিষাক্ত করে ফেলেছে, অনিবার্য ধ্বংসের দিকে তখন এঁরা ছুটে চলেছে নিষ্ঠুর নিয়তির এক অলঙ্ঘ্য নির্দেশে। রায়পুর রাজবংশের এক করুণ অধ্যায়ের সূচনা শুরু হয়ে গিয়েছে।

আপনার কি মনে হয় কিরীটীবাবু, শ্ৰীকণ্ঠ মল্লিকের হত্যা, সুধীনের পিতার হত্যা, সতীনাথের হত্যা, নিশানাথের হত্যা সব একই সূত্রে গাঁথা? প্রশ্ন করে বিকাশ।

এখনও সেটা বুঝতে পারেননি বিকাশবাবু? সব একসূত্রে গাঁথা—একই উদ্দেশ্যে একের পর এককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে রাজপরিবারের লোকেদরে এবং অন্য যারা খুন হয়েছে বাইরের তারাও সেই বিষচক্রের মধ্যে গিয়ে পড়েছে এবং যদি ঐ একের পর এক হত্যার মূল অনুসন্ধান করেন তো দেখতে পাবেন সবেরই মূলে রয়েছে এক মোটিভ বা উদ্দেশ্য, সব একই—অর্থম অনর্থ। কিন্তু যাক সে কথা। আমি শুধু সূত্রগুলো এখান থেকে ওখান থেকে একত্রে এক জায়গায় জড়ো করছি। সময় এলে ঐ সূত্রগুলো আপনার হাতে তুলে দেব। আপনি বোধ হয় জানেন না বিকাশবাবু, একটি অভাগিনী মায়ের কাতর মিনতিই আমাকে এই রায়পুর হত্যা-রহস্যের মধ্যে টেনে নিয়ে এসেছে। অবিশ্যি আইনের দিক থেকে তার ওপরে আগেই যবনিকা পড়েছে।

আপনি কি সত্যিই মনে করেন, ডাঃ সুধীন চৌধুরীকে খালাস করে আনতে পারা যেতে পারে?

মনে করি না বিকাশবাবু, সে বিষয়ে আমি স্থিরনিশ্চিত। কিন্তু তাহলেও বলতে দ্বিধা নেই, প্রথমে যখন এ কেসটা কতকটা ঝোঁকের মাথায়ই আমি হাতে নিই, তখন সব দিক ততটা ভাল করে বিবেচনা করে উঠতে পারিনি, আজ কিন্তু যেন মনে হচ্ছে, সুধীনকে মুক্ত করতে পারি তো আর একজনকে তার জায়গাতে যেতে হবেই। হয়তো একটা ভূমিকম্পও উঠবে, ফলে অনেক কিছুই ওলটপালট হয়ে যাবে।

কথা বলতে বলতে ওরা থানার কাছে এসে পড়েছিল; কিরীটী হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললে, রাত্রি প্রায় আড়াইটে। এখানকার কাজ আমার প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, কাল-পরশু নাগাদই বোধ হয় আমি চলে যাব। কাল সকালে একবার হারাধন মল্লিকের সঙ্গে দেখা করতে হবে। আপনিও আমার সঙ্গে থাকবেন কিন্তু। তারপর কতকটা যেন আত্মগত ভাবেই বললে নিম্নকণ্ঠে, তারপর বাকি থাকল একজন—

কার কথা বলছেন?

বলব পরে। কিন্তু হারাধন লোকটার কথাই ভাবি, অমন নিলোভ সত্যাশ্রয়ী লোক আজকালকার যুগে বড় বিরল মিঃ সান্যাল। হ্যাঁ ভাল কথা, হারাধনের নাতি জগন্নাথের সঙ্গে আপনার আলাপ আছে?

সুব্রতবাবু ওঁর খুব প্রশংসা করেন। বলেন, অমন ছেলে নাকি হয় না, একেবারে দাদু-অন্ত প্রাণ।

হ্যাঁ। কিরীটী মৃদুস্বরে জবাব দেয়।

ঐদিন রাত্রে শুতে যাবার আগে কিরীটী বলে, তারিণী চক্রবর্তী, মহেশ সামন্ত ও সুবোধ মণ্ডলকে কাল বিকেলের দিকে একবার এদিকে ডাকিয়ে আনতে পারেন? তাদের আমি কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।

বেশ তো। নিশ্চয় আনাব।

***

পরের দিন গোটা নয়েকের সময় কিরীটী ও বিকাশকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে হারাধন সানন্দে ওদের আহ্বান জানালেন, আসুন আসুন। চা আনতে বলি?

তা মন্দ কি! হারাধনের ব্যাপার দেখে মনে হল যে, যেন এতক্ষণ উদগ্রীব হয়ে ওদেরই পথপানে চেয়েছিলেন। হারাধন চিৎকার করে ভৃত্যকে চা আনতে আদেশ দিলেন।

গতরাত্রের সব সংবাদ শুনেছেন বোধ হয় মল্লিক মশাই?কিরীটী মৃদুস্বরে বলে।

হ্যাঁ। শেষকালে নিশাও গেল। সব যাবে একে একে, এ আমি জানতাম কিরীটীবাবু। নিশা আমার চাইতে বছর আটেকের ছোট। বোলপুরে চাকরি করবার সময় মাঝে মাঝে চিঠিপত্র দিত। কিন্তু ইদানীং এখানে আসবার পর অনেক সময় ভেবেছি, যদি একবার দেখা হয়! তা আর হল না। শেষের দিকে হারাধনের কণ্ঠস্বর অশ্রুভারাক্রান্ত হয়ে যায় যেন।

মল্লিক মশায়? কিরীটী কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ ডাকে।

অ্যাঁ! কিছু বলছিলেন?

হ্যাঁ, আপনি কি সত্যি-সত্যিই ভেবেছিলেন নিশানাথও খুন হবেন?

নিশ্চয়ই। এ-কথা তো আমি হাজার বার বলেছি, সেইদিন থেকে, যখনই শুনেছি এই বৃদ্ধ বয়সে সে রূপালী চক্রের মধ্যে এসে ধরা দিয়েছে। কেউ থাকবে না, বুঝলেন কিরীটীবাবু, কেউ থাকবে না। রাজা রত্নেশ্বরের বংশে কেউ বাতি দিতে থাকবে না। এ বিধাতার অভিশাপ।

জগন্নাথ চায়ের ট্রেতে করে তিন পেয়ালা গরম চা নিয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।

কিরীটী আড়চোখে তাকিয়ে দেখল, জগন্নাথের মুখখানা যেন বেশ গম্ভীর। কিরীটী হাত বাড়িয়ে ট্রে থেকে চায়ের কাপ একটা তুলে নিতে নিতে মৃদুস্বরে বললে, জগন্নাথবাবু, আপনার দাদুকে নিয়ে আজ বা কাল হোক যে কোনো একসময় সময় করে রাজাবাহাদুর সুবিনয় মল্লিকের সঙ্গে দেখা করে আসবেন। তাঁদের আজকের এতবড় দুঃসময়ে সব ভুলে যাওয়াই ভাল। দূরসম্পকীয় হলেও, আপনারাই এখন তাঁর একমাত্র আত্মীয় অবশিষ্ট রইলেন তো।

না না, জগন্নাথ প্রবল প্রতিবাদ করে ওঠে, ও বাড়ির সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্কই আর নেই। রাজা শ্রীকণ্ঠ মল্লিকের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই সব ধুয়ে মুছে গেছে।

তা কি আর সত্যিই হয়, জগন্নাথবাবু? এ কি জলের দাগ যে এত সহজে মুছে যাবে? এ যে রক্তের সম্পর্ক, কিরীটী বলতে থাকে, জানেন তো, ইংরাজীতে একটা প্রবাদ আছে,—blood is thicker than water! ঝগড়া মিটিয়ে ফেলুন। অতীতে কে একজন ভুল করেছিলেন বলেই যে সেই ভুলের জের টেনে বেড়াতে হবে আজও বংশ-পরম্পরায় তার কি মনে আছে?

রক্তের দাগ বলেই তো মুছে ফেলবার নয় কিরীটীবাবু! জগন্নাথ জবাব দেয়।

কিন্তু–

কিরীটীকে বাধা দিয়ে জগন্নাথ মৃদু অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলে, বড়লোক আত্মীয় সাপের চেয়েও সাংঘাতিক কিরীটীবাবু। আপনি ধারণাও করতে পারবেন না, গরীব আত্মীয়দের ওরা কত হীন চোখে দেখে; দেখা-সাক্ষাৎ করতে গেলেই ওরা ভাবে যে হাত পাততে গেছি আমরা ওদের কাছে! আরও একটা কথা হচ্ছে, ওদের ঐ ধনগরিমার দৃষ্টি দিয়ে ওরা আমাদের মনে করে যেন কৃতার্থ করে দিচ্ছে, কিছুতেই সেটা যেন আমি সহ্য করতে পারি না, গায়ে যেন ছুঁচ বেঁধায়— তাছাড়া যে প্রাসাদে আমাদের সমান অধিকার একদিন ছিল, সেখানে আজ মাথা নীচু করে প্রবেশ করতে পারবো না। না–মরে গেলেও না। … উত্তেজনায় জগন্নাথ যেন হাঁপাতে থাকে।

কিরীটী আর কিছু বলল না।

.

সন্ধ্যার দিকে মহেশ সামন্ত ও সুবোধ মণ্ডল এল থানায়। তারিণী চক্রবর্তী ছিল না, আগের দিন কোনো এক মহালের কাজে গেছে।

প্রথমেই কিরীটী সুবোধকে ডাকলে, বসুন মণ্ডল মশাই।

আজ্ঞে স্যার, গরীব দাসানুদাস হই আমরা আপনাদের, আপনাদের সামনে উপবেশন করব, এ কি একটা লেহ্য কথা হল স্যার? কি আজ্ঞা হয় বলুন!

মণ্ডলের কথার বাঁধুনিতে কিরীটী না হেসে থাকতে পারলে না। বলে, মহাশয় বুঝি বৈষ্ণব? মাছ-মাংসও বুঝি চলে না? কিন্তু গলায় কষ্ঠি কই?

এ দাসের স্যার, সত্যি কথা বলতে কি, কোনো ধর্মের প্রতি আস্থাও যেমন নেই অনাস্থাও তেমন নেই। বোঝেনই তো স্যার, রাজবাড়ির বাজার-সরকার আমি!

তা তো দেখতেই পাচ্ছি। তা সংসার-ধর্ম করেছেন, না এখনও বাজার-সরকারী করে সময় করে উঠতে পারেননি?

আজ্ঞে স্যার, সে দুঃখের কথা আর বলবেন না, তিন-তিনটি সংসার করেছিলাম, কিন্তু একটি কাশীবাসিনী, দ্বিতীয়া পিত্রালয়বাসিনী, কনিষ্ঠা উদ্বন্ধনে প্রাণত্যাগ করেছেন।

কেন চতুর্থী?

রামঃ, আর রুচি নেই স্যার।

আহা, আপনি তো তা হলে দেখতে পাচ্ছি রীতিমত একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি!

হেঁ হেঁ, কি যে বলেন স্যার, আমরা হলাম আপনাদের দাসানুদাস, কীট হতেও কীট।

তা দেখুন মণ্ডল মশাই, আমি কয়েকটা প্রশ্ন আপনাকে করতে চাই, ঠিক ঠিক যেন জবাব পাই, বিনয়ে বিগলিত হয়ে আবার সব না গোলমাল করে ফেলে অযথা নিজেকে বিপদগ্রস্ত করে ফেলেন! তবে হ্যাঁ, গরীব লোক আপনি সেকথা আমি ভুলবো না।

তা মনে রাখবেন বইকি স্যার, এ অধীন তো আপনাদের পাঁচজনের দয়াতেই বেঁচে-বর্তে আছে—তা কি আজ্ঞা হচ্ছে?

আপনাদের ম্যানেজার সতীনাথ লাহিড়ী মশাই যে রাত্রে খুন হন, সেই রাত্রির কথা নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে?

সহসা যেন কিরীটীর কথায় মণ্ডলের মুখখানি কেমন পাংশুবৰ্ণ ভাব ধারণ করে, কিন্তু মুহূর্তে সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, তা…তা আছে বইকি স্যার!

আচ্ছা মণ্ডলমশাই, দারোগাবাবুর কাছেসেরাত্রে আপনি আপনার জবানবন্দিতে বলেছিলেন, সতীনাথ লাহিড়ী মরার আগে যে চিৎকার করে উঠেছিলেন, সেই চিৎকার শুনেই আপনি ঘর থেকে বের হয়ে যান। অথচ তারিণী খুড়োর পাশের ঘরে থেকেও আপনি জানতে পারেননি, কখন তারিণী চক্রবর্তী ঘর থেকে বের হয়ে যান? আপনি তখন জেগেই ছিলেন, কেমন তাই না?

না, বোধ হয় তো আমি ঘুমিয়েই ছিলাম।

বেশ ভাল করে মনে করে দেখুন, মনে হচ্ছে যেন আমার, বোধ হয় কেন—নিশ্চয়ই আপনি জেগেই ছিলেন, মোটেই ঘুমোননি!

আজ্ঞে স্যার, তা কি করে হয়? ঘুমিয়ে থাকলেও জেগে থাকা কি করে সম্ভব বলুন?

সম্ভব এইজন্য যে চিৎকারটা আপনি বেশ পরিষ্কারই শুনতে পেয়েছিলেন। ঘুমিয়ে থাকলে কি কেউ চিৎকার শুনতে পায়? এবং শব্দটা শুনতে পেয়েছিলেন বলেই এটাও জানেন, আপনার তারিণী খুড়ো কখন ঘর থেকে বের হয়ে যান! বুঝলেন মণ্ডল মশাই, একে বলে আইনের লজিক। ঠিক আপনি বুঝতে পারবেন না, কারণ লজিক তো আর আপনি পড়েননি। যাহোক আমাদের লজিকে বলে চিৎকারটা যখন শুনেছেন, এবং জেগে না থাকলে যখন চিৎকারটা শোনা যায় না, তখন আপনি কি করে ঘুমিয়ে থাকতে পারেন? অতএব জেগেই ছিলেন। কেমন,এবার হল তো? বেশ, এবারে বলুন তো, শুধু যে আপনার তারিণী খুড়োকেই ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে শুনেছিলেন তা নয়, আরও কাউকে বারান্দা দিয়ে হেঁটে যেতেও শুনেছিলেন যার পায়ের জুতোর তলায় লোহার নাল বসানো ছিল।

সুবোধ বোকার মত ফ্যালফ্যাল করে কিরীটীর দিকে তাকিয়ে থাকে। কি যে জবাব দেবে কিছুই যেন বুঝে উঠতে পারে না।

মণ্ডল মশাই, আপনি যে একজন নিরীহ গোবেচারী গোছের লোক তা আমি জানি। কারও সাতেও নেই আপনি, কারও পাঁচেও নেই। অথচ কেমন বিশ্রীভাবে আপনি এই খুনের মামলায় জড়িয়ে যাচ্ছেন তা যদি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারতেন, তাহলে হয়ত ভুলেও বলতেন না যে আপনি সেরাত্রে বোধ হয় ঘুমিয়ে ছিলেন। তাছাড়া এ-কথা কে না বোঝে, খুনের মামলায় জড়িয়ে যাওয়া কত বড় সাংঘাতিক ব্যাপার! চাই কি যোগসাজস আছে প্রমাণ হয়ে গেলে, সারাটা জীবন কাষ্ঠঘানি ঘুরিয়ে সরিষা হতে বিশুদ্ধ সরিষার তৈলও উৎপাদন করতে হতে পারে। এবং সেও আর চারটিখানি কথা নয়, কি বলুন!

স্যার, একটা বিড়ি পান করতে পারি? গলাটা কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে।

আহা, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। সে কি কথা? ম্যাচ আছে, না দেব?

কিরীটী লক্ষ্য করে দেখলে, বিড়ি ধরাচ্ছে বটে সুবোধ কিন্তু কি এক গভীর উত্তেজনায়। হাত দুটো তার ঠকঠক করে কাঁপছে।

মণ্ডল মশাই, এবারে বোধ হয় আপনি বসতে পারবেন, ঐ চেয়ারটায় বসুন। তারপর আপনার আর কষ্ট করতে হবে না, আমিই বলছি শুনুন। যদি কোথাও ভুল থাকে দয়া। করে শুধরে দেবেন। সেইদিন রাত্রে মানে যেদিন আপনাদের ভূতপূর্ব ম্যানেজার লাহিড়ী মশাই খুন হন, সেদিন এই রাত্রি দশটা কি পৌনে দশটার সময়, প্রথমে আপনি একটা শব্দ শুনতে পান, ঠিক যেন জুতো পায়ে দিয়ে কেউ বারান্দা দিয়ে হেঁটে বাইরের দিকে চলে যাচ্ছে। জুতোর শব্দ ঠিক অনেকটা আপনাদের ছোট্টু সিংয়ের লোহার নাল বসানো নাগরাই জুতোর শব্দের মত। কিন্তু কিছু আপনি মনে করেননি, তার কারণ আপনি ভেবেছিলেন ছোট্টু সিং-ই বাইরে যাচ্ছে। তারপর অনেকক্ষণ আপনি কান পেতে অপেক্ষা করেছেন, কারণ আপনি জানতেন, রাত্রে মানে ঠিক সন্ধ্যার পর হতে ঐ দরজার প্রহরা ছেড়ে ছোষ্ট্র সিংয়ের বাইরে কোথাও যাওয়ার হুকুম নেই এবং যদি সে হুকুম না মেনে দরজা ছেড়ে মুহূর্তের জন্যও কোথাও যায় ও,সেকথা যদি ম্যানেজারবাবু জানতে পারেন, তাহলে তার চাকরি তো যাবেই জমানো মাইনেটাও কাটা যাবে। এখানে হপ্তায় দুবার হাট করে রাজবাড়ির সাতদিনের মত অনেক কিছু জিনিস কিনেকেটে আপনি আনেন, কিন্তু ম্যানেজারবাবু আপনাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতেন না বলে তিনি ছোট্টু সিংকে আপনার সঙ্গে যেতে আদেশ দেন। কাজে-কাজেই ছোট্টু সিংয়ের ওপরে আপনার সন্তুষ্ট না থাকা খুবই স্বাভাবিক। এবং আপনি সর্বদা চেষ্টা করছিলেন কি করে ছোট্টু সিংকে জব্দ করা যেতে পারে। কি, আমি কিছু মিথ্যে কথা বলছি, বলুন?

আজ্ঞে,…আ…আপনি…

সত্যি কথা বলছি, এই তো?… বেশ, শুনে সুখী হলাম। যাক্, আপনি ফিরতি শব্দ শোনার জন্য তাই জেগেই ছিলেন। কারণ জুতোর শব্দ শুনে প্রথম হতেই আপনি সন্দেহ। করেছিলেন যে, ছোষ্ট্র সিংয়েরই পায়ের শব্দ এবং সে কাউকে না জানিয়ে দরজা অরক্ষিত রেখে কোথাও যাচ্ছে। কেমন তাই না?

আ…আপনি কে?

সুবোধবাবু! সহসা কিরীটীর এতক্ষণের পরিহাস-তরল কণ্ঠ যেন যাদুমন্ত্রে কঠিন হয়ে ওঠে।

সুবোধ মণ্ডল ভীষণ রকম চমকে উঠে কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।

ময়াল সাপের গল্প শুনেছেন কখনও মণ্ডল মশাই? আপনি ময়াল সাপের খপ্পরে পড়েছেন। কিন্তু কোনো ভয় নেই আপনার। আপনাকে আমি ছেড়ে দিতে পারি, কিন্তু সে কেবল একটি শর্তে… আপনি সব কথা আমার কাছে এই মুহূর্তেই অকপটে আগাগোড়া খুলে বলবেন। তবেই, নচেৎ–

আজ্ঞে!–মণ্ডলের গলার স্বর কাঁপতে কাঁপতে থেমে যায়।

বলুন লোকটা যখন আবার ফিরে আসে, আধঘণ্টা পরে, তখন শব্দ শুনেই আপনি বাইরে এসে তাকে দেখতে পান কিনা?

হ্যাঁ—কিন্তু তাকে আমি চিনতে পারিনি। অন্ধকারে তাকে আমি ভাল করে দেখতে পাইনি।

সত্যি কথা বলছেন?

আজ্ঞে মা কালীর দিব্যি।

তারিণী খুড়ো যখন ঘর হতে বের হয়ে যান চিৎকার শুনে, তাও আপনি জানেন, কেমন না?

হ্যাঁ।

আপনি চিৎকার শুনে বের হননি কেন?

খুড়োকে যেতে দেখে আমি দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম।

দরজা বন্ধ ছিল না?

আজ্ঞে না, খোলাই ছিল। খুড়ো দরজা ঠেলতেই দরজা খুলে যেতে দেখেছি।

মহেশ সামন্ত—সে বুঝি তারিণীর পরেই যায়?

হ্যাঁ, ঠিক খুড়োর পিছুপিছুই গেছে।

আচ্ছা, আপনি এবার যেতে পারেন মণ্ডল মশাই। আপনার কোনো ভয় নেই। আমাকে আজ আপনি যা বললেন ঘুণাক্ষরেও কেউ তা জানতে পারবে না। এবং জানতে পারলেও, আপনি যাতে বিপদে না পড়েন সে ব্যবস্থা আমি করব কথা দিচ্ছি।

আপনি—

আমি কে, তাই জানতে চান তো? এবং কি করে আমি এসব জানলাম, না?

আজ্ঞে!

এইটুকু শুধু জানুন, জানাটাই আমার কাজ। গোপন রহস্য উদঘাটন করি বলেই আমার আর এক পরিচয় রহস্যভেদী!

সুবোধ মণ্ডল চলে যাবার পর, আরও আধঘণ্টা কিরীটী মহেশকে বসিয়ে রেখে, অবশেষে বিকাশকে ডেকে মহেশকে ছেড়ে দিতে বললে। তার আর জবানবন্দি নেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না।

 ২.০৯ পাতালঘরের বন্দী

সুব্রত প্রথমটা চমকেই উঠেছিল, কিন্তু বিস্ময়ের ধাক্কাটা সামলে নিতে সুব্রতর বেশী সময় লাগল না। খোলা আলমারির মধ্যস্থিত আবিষ্কৃত সেই গুপ্ত পথের দিকে সুব্রত আরও একটু এগিয়ে গেল এবং হাতের জোরালো হান্টিং টর্চের আলো ফেললে। সামনে দেখতে পায়, ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে। একবার মাত্র সুব্রত ইতস্তত করলে, তারপরই এগিয়ে গেল সেই সিঁড়ির প্রথম ধাপটির পরে। অন্ধকার। নিকষকালো অন্ধকারে চোখের দৃষ্টি যেন অন্ধ হয়ে যায়। সুব্রত আবার হাতের টর্চবাতি জ্বালল। দশ-বারোটা সিঁড়ি অতিক্রম করতেই সমতলভূমি পায়ে ঠেকল। কোন ভিজে স্যাঁতসেঁতে আলোবাতাসহীন ধূলামলিন ঘরের মেঝেতে যে ও পা দিয়েছে তা বুঝতে ওর কষ্ট হল না।

সুব্রত হাতের আলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারিদিক দেখতে লাগল। অত্যন্ত নীচু ছাত, দাঁড়ালে সামান্য চার-পাঁচ ইঞ্চির জন্য মাথা ছাতে ঠেকে না, অল্পপরিসর একখানি ঘর, সামনেই একটা দরজা। হঠাৎ সেটা খুলে গেল। সামনে ও কে? ভূত না মানুষ! জীবিত না মৃত! ও কি পৃথিবীর কেউ, না অন্ধকার পাতাল গহ্বরের কোন বায়ুভূত প্রেতাত্মা তাকে ভয় দেখাবার জন্য সামনে এসে দাঁড়িয়েছে! সুব্রত বেশ ভাল করে চোখ দুটো একবার রগড়ে নিল।

আগন্তুক মাঝারি গোছের লম্বা। একমাথা ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া কাঁচাপাকা চুল, কাঁচাপাকা রুক্ষ দাড়ি। খালি গা। পরনে ধূলিমলিন একখানি শতছিন্ন ধুতি। একটা বিশ্রী বোটকা গন্ধ তার গা থেকে বের হচ্ছে। চোখে উন্মাদের দৃষ্টি। দুপায়ে মোটা লোহার শিকলের সঙ্গে লোহার বেড়ি আটকানো।

লোকটার চোখে সুব্রতর টর্চের আলো পড়তেই চোখ দুটো সে একবার বুজিয়েই আবার খুলে ফেলল। এবং পরক্ষণেই সামনের দিকে একটু ঝুঁকে আচমকা ফিক ফিক করে হেসে উঠল। ঘরের দেওয়ালে দেওয়ালে সেই হাসির প্রতিধ্বনি যেন কি এক ভৌতিক বিভীষিকায় প্রেতায়িত হয়ে ওঠে। সুব্রতত থমকে যেতেই হঠাৎ টর্চের বোম থেকে হাতের আঙুল সরে গিয়ে দপ করে আলোটা নিভে যায়। কিন্তু আলো জ্বালাবার আগেই সুব্রতর নজরে পড়ে, খোলা দরজাপথে অন্ধকারে অতি ক্ষীণ একটা প্রদীপশিখা। ওপাশের ঘরের কুলুঙ্গিতে একটি পিলসুজের ওপরে পিতলের প্রদীপ জ্বলছে। নিচ্ছিদ্র আঁধারে যেন ঐ সামান্য প্রদীপের আলো অস্ফুট প্রাণস্পন্দনের মত করুণ ও অসহায় মনে হয়।

লোকটা হঠাৎ কথা বলে ওঠে, কে তুই? এখানে কি চাস্?

তুমি কে?

আমি!…ভুলে গেছি, মনে নেই ত, মনে আর পড়ে না আমি কে! সে কি আজকের কথা! হ্যাঁ, আজ ঠিক ছাব্বিশ বছর পূর্ণ হয়ে প্রথম দিন। দিন আমি গুনছি। ওই দেখ না দেওয়ালের গায়ে, এক এক মাস শেষ হয়েছে, আর হাতের আঙুল কামড়ে রক্ত বের করে সেই দেওয়ালের গায়ে একটা করে কালো দাগ কেটেছি। দেখ তো, দেখ তো—গুনে দেখ না! হিসাবে আমার ভুল নেই, ঠিক ছাব্বিশ বছর একদিন হল! রক্ত বলতে বলতে হঠাৎ লোকটা থেমে যায়, তারপর ঝঝ করে শিকলের শব্দ তুলে কুলুঙ্গির কাছে এগিয়ে গিয়ে পিলসুজ থেকে প্রদীপটা তুলে নিয়ে সুব্রতর একেবারে কাছ ঘেঁষে এগিয়ে আসে এবং প্রদীপটা সুব্রতর মুখের সামনে তুলে ধরে মৃদু সাবধানী কণ্ঠে বলে, ভয় পেলে? ভয় কি? ওরা আমায় পাগল সাজিয়ে রেখেছে বটে, কিন্তু বিশ্বাস কর—সত্যি সত্যি আমি পাগল নই! তুমি আমার খোকা-খোনকে দেখেছ? সমুদ্রের মত নীল, কাঁচের মত চকে দুটো চোখ! ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া মাথাভর্তি চুল! সবে তখন হাঁটতে শিখেছে, টলে টলে হাঁটত, আর নিজের আঘো-আধো স্বরে বলত, হাঁটি হাঁটি পা পা–খোকন হাতে দেখে যা! আমার খোকন–না, তুমি দেখনি। কেমন করে তুমি দেখবে তাকে? তোমার চোখের দৃষ্টিই বলছে আমার খোকনকে তুমি দেখনি!

এ তো পাগলের প্রলাপোক্তি নয়। এ যেন কোন মর্মপীড়িতের বুকভাঙা কান্না। মর্মান্তিক কার যেন এ বিলাপধ্বনি!

আবার বলতে থাকে, চিনলে না তো আমায়—চিনলে না তো! চিনবেই বা কেমন করে? ছাব্বিশ বছর আগে যে মরে গেছে, তাকে কি আজ আর চেনা যায়! না তাকে কেউ চিনতে পারে! তারপরই হঠাৎ কেমন যেন ভয়চকিত কণ্ঠে বলে ওঠে, পালাও, এখুনি পালাও। সে দেখলে আর তোমার রক্ষা থাকবে না। সে বড় নিষ্ঠুর, আমাকে কথা পর্যন্ত বলতে দেয় না—কথা বললেই একটা সরু চামড়ার চাবুক আছে, তাই দিয়ে সপাং সপাং করে আমায় মারে। দেখ, দেখ…লোকটা ঘুরে দাঁড়ায়।

সুব্রত লোকটার পিঠের ওপরে টর্চের আলো ফেলে চমকে ওঠে, পিঠের ওপরে অজস্র বেত্রাঘাতের নির্মম চিহ্ন। কেটে কেটে চামড়ার ওপরে দাগ বসে গেছে। লোকটা প্রদীপ হাতে আবার ফিরে দাঁড়ায়—প্রদীপের আলোয় সুব্রত স্পষ্ট দেখতে পায়, লোকটার দুচোখের কোলে চক করছে অশ্রু।

আমি কিন্তু কাঁদি না। দোষ অবিশ্যি আমারই, আমারই বোঝা উচিত ছিল, দুধের মধ্যে লুকিয়ে ছিল বিষ—তীব্র বিষ, স্বেচ্ছায় তীব্র বিষ পান করেছি। প্রথমেই বুঝতে পারিনি, বুঝতে যখন পারলাম, তখন এখানে আমি বন্দী। দেখাতে পার—আমার খোকনকে একটিবার দেখাতে পার, বলতে পার কেমন দেখতে হয়েছে আজ সে!

কি জবাব দেবে সুব্রত বুঝতে পারে না।

সহসা তৃতীয় ব্যক্তির কণ্ঠস্বরে যেন ঘরের মধ্যে বজ্রপাত হল। চকিতে সুব্রত পিছনদিকে তাকাল। কণ্ঠস্বর যে তার বিশেষ পরিচিত! কিন্তু সুব্রতর বিস্মিত কণ্ঠে কোনো স্বর বের হবার আগেই, আচমকা একটা ঠাণ্ডা জলীয় বাষ্পের মত কিছু ওর চোখেমুখে অজস্র কণায় এসে যেন একটা ঝাপটা দিল। সঙ্গে সঙ্গে ওর মাথাটা টলে উঠল।

আর সঙ্গে সঙ্গে সুব্রতর জ্ঞানহীন দেহটা হাঁটু দুমড়ে ভেঙে সশব্দে মাটিতে পড়ে গেল।

আগন্তুক বললে, কল্যাণবাবু, ভাবছ তোমায় আমি চিনতে পারিনি, তাই না!

আগন্তুক পকেট থেকে অতঃপর একটা শক্ত সরু সিল্ক-কর্ড বের করে জ্ঞানহীন ভূলুষ্ঠিত সুব্রতর হাত-পা বাঁধবার জন্য এগিয়ে এল।

এক মিনিট বন্ধু, অত তাড়াতাড়ি নয়!

আগন্তুক চকিতে দুপা পিছিয়ে এসে ঘুরে দাঁড়াল। মাত্র হাত পাঁচেক পশ্চাতে যে দাঁড়িয়ে, তার হাতে একটি ছোট্ট অটোমেটিক পিস্তল। এবং সেই ভয়ঙ্কর আগ্নেয় অস্ত্রটির চোং ওরই দিকে উদ্যত।

প্রথম ব্যক্তির বিস্মিত ভাবটা কেটে যেতেই বলে ওঠে, এ কি,তুমি!

হ্যাঁ, আমি। কল্যাণবাবুকে বাঁধবার আগে আমাদের মধ্যে পরস্পরের একটা মীমাংসা হওয়া একান্ত প্রয়োজন, নয় কি বন্ধু!

তার মানে?

মানে অতি সহজ। অত্যন্ত প্রাঞ্জল। আমি ভেবেছিলাম এই খেলার সঙ্গী বুঝি মাত্র আমিই একা। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি, সেটা আমার ভুল। কিন্তু ভুল বোঝবার পর সে ভুলকে আর যে-ই বাড়তে দিক, শিবনারায়ণ চৌধুরী কখনও বাড়তে দেয় না। যার উপরে বিশ্বাস রেখে আমি আমার সব কিছু—এমন কি জীবন পর্যন্ত জামিন রেখেছিলাম, আজ যখন দেখতে পাচ্ছি তার কোনো মূল্যই নেই, তখন কেন আর এ মিথ্যা প্রহসনের বোঝ টেনে বেড়াই?

প্রথম ব্যক্তি যেন বোবা।

আজ এইখানে—এই অন্ধকূপের মধ্যেই রাত্রির অন্ধকারে তার শেষ মীমাংসা হয়ে যাক! দ্বিতীয় আগন্তুক বললে।

কিসের মীমাংসা তুমি আমার সঙ্গে করতে চাও শিবনারায়ণ?

এখনও কি বুঝতে পারনি?

হঠাৎ ওদের কথার মধ্যে একসময় পাগলটা ফিফিক করে হেসে ওঠে। দুজনেই চমকে ওঠে। শিবনারায়ণ সামান্য একটু চমকে বোধ হয় অন্যমনস্ক হয়েছিল, সেই মুহূর্তেই প্রথম ব্যক্তি বাঘের মত শিবনারায়ণের উপর লাফিয়ে পড়ে। জড়াজড়ি করে দুজনেই মাটিতে গিয়ে পড়ল। এবং ধস্তাধস্তি শুরু হল। এদিকে ঐ সময় পাগল হাতের সামনে কুলুঙ্গির ওপরে রক্ষিত পিলসুজটা তুলে নিয়ে প্রথমে শিবনারায়ণের মাথায় প্রচণ্ড ভাবে আঘাত করলে; শিবনারায়ণের চিৎকার মেলাতে না মেলাতেই পাগল অন্য লোকটির মাথায় প্রচণ্ড আঘাত হানল। সেও সঙ্গে সঙ্গে তীব্র একটা আর্ত চিৎকার করে জ্ঞাণহীন শিবনারায়ণের পাশেই সংজ্ঞাহারা হয়ে লুটিয়ে পড়ল।

দুজনের মাথা ফেটেই রক্ত ধূলিমলিন মেঝের ওপরে গড়িয়ে পড়ছে। পাগল আবার খিকখিক করে হেসে ওঠে। এতদিনের হত্যার রক্ততর্পণ হল বুঝি!

কিন্তু আর দেরি নয়, এই তো সুযোগ! পাগল শিবনারায়ণের দেহের উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে ওর জামার পকেট ও কটিবাস হাতড়াতে থাকে। কটিবন্ধে চাবির তোড়াটা গোঁজা ছিল। তাড়াতাড়ি সেই চাবি দিয়ে পায়ের বেড়ী খুলে ফেলল। আঃ মুক্তি, মুক্তি!

এতক্ষণে সুব্রতর জ্ঞানও একটু একটু করে ফিরে আসছে, সুব্রত পাশ ফিরে শুল।

পাগল সুব্রতর দেহ ধরে ঝাঁকুনি দিতে লাগল, উঠুন, শুনছেন কল্যাণবাবু, উঠুন!

সুব্রত অতিকষ্টে চোখ মেলে তাকাল। চোখে তখনও ঘোর লেগে আছে একটা।

শুনছেন? উঠুন শীগগির, পালাতে হবে।

***

আধঘণ্টা পরে। তারা দুজনে তখনও রক্তাক্ত জ্ঞানহীন অবস্থায় অন্ধকার অন্ধকূপের মধ্যে পড়ে।

গুপ্তদ্বার বন্ধ করে সুব্রত ও পাগল পাশাপাশি দাঁড়িয়ে।

রাতটা শেষ হয়ে এল। পূবগগনে প্রথম আলোর ইশারা।

২.১০ ঘটনার সংঘাত

সুব্রত বুঝতে পেরেছিল, আর এখানে একটি মুহূর্তও থাকা নিরাপদ নয় এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নৃসিংহগ্রাম থেকে তাকে পালাতে হবে এবং কিরীটীকে গিয়ে সব কথা জানাতে হবে। সুব্রত আস্তাবলে যেখানে ঘোড়া দুটো বাঁধা থাকে সেখানে গেল। সহিসকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে, যত শীঘ্র সম্ভব ঘোড়ার জিন চড়াতে বলে, সুব্রত আবার প্রাসাদে ফিরে এল। আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই হয়ত দিনের আলো স্পষ্টভাবে ফুটে উঠবে।

এদিকে সেই বন্দীকে আগেই বসিয়ে রেখে গিয়েছিল উপরের ঘরে। যেখানে বসিয়ে রেখে গিয়েছিল সুব্রত, সেখানে এসে দেখল সে নেই। গেল কোথায়? সুব্রত তাড়াতাড়ি এ-ঘর ও-ঘর খুঁজতে লাগল। উপরের সমস্ত ঘরগুলোই ও দেখলে, কোথাও সে নেই। নীচের সিঁড়ি দিয়ে নামছে, দেখলে লোকটা উঠে আসছে। সুব্রতকে দেখে সে বললে, কই থোকনকে কোথাও পেলাম না তো?

আমি জানি, আপনার খোকন কোথায় আছে! চলুন আমার সঙ্গে তাড়াতাড়ি আর দেরি হলে বিপদে পড়ব আমরা।

কিন্তু কোথায় যাব?

যেখানে আপনার খোকন আছে।

না, আমি কোথাও যাব না। তুমি জান না, থোকন আমার এখানেই আছে।

শুনুন আপনার খোকন এখানে নেই। আপনি ঘোড়ায় চড়তে জানেন?

ঘোড়ায়! হ্যাঁ, অনেক দিন ঘোড়ায় চড়েছি যে।

তবে শীগগির আসুন আমার সঙ্গে। আপনার খোকন আমার কাছে আছে।

থোকন তাহলে তোমার কাছেই আছে? ঠিক বলছ? মিথ্যা কথা বলছ না তো?

না, চলুন।

***

সুব্রত অবাক হয়ে গিয়েছিল পাগলের অশ্বচালনা দেখে। অতি দক্ষ অশ্বারোহী। পৃথিবীর বুক থেকে অন্ধকারের পদাটা উঠে যাচ্ছে, ভোরের প্রথম সোনালী আলো পদ্মের পাপড়ির মত একটি একটি করে যেন দলগুলো মেলে ধরেছে।

প্রায় দুপুর নাগাদ ওরা জঙ্গলের মধ্যে এসে পৌঁছল। ছায়াশীতল একটা বড় গাছের নীচে ওরা ঘোড়া থেকে নামল। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে; আসবার সময় তাড়াতাড়িতে কোনোরকম আহাৰ্যবস্তুই সংগ্রহ করে আনা হয়নি। সুব্রত কেবল ফ্লাস্কটা ভর্তি করে জল এনেছিল, তাই দুজনে পান করে কিছুটা তৃষ্ণা মেটাল।

ঐ জায়গাটা থেকে রায়পুর মাত্র মাইল পাঁচ-ছয়েকের পথ। সুব্রত মনে মনে আগেই ঠিক করে রেখেছিল, সন্ধ্যা হওয়ার পরই ওরা ওখান থেকে রওনা হবে, যাতে করে ওদের শহরে পৌঁছতে পৌঁছতে অন্ধকার হয়ে যায়, তাহলে কেউ ওদের পথে দেখলেও চিনতে পারবে না। চাঁদ উঠবে সেই মাঝরাত্রে। নৃসিংহগ্রাম থেকে রওনা হবার পর থেকেই লোকটা যেন কেমন নিঝুম হয়ে গিয়েছিল, আর একটি কথাও বলেনি। আপন মনে নিঃশব্দে সুব্রতর পাশে পাশে ঘোড়া ছুটিয়ে আসছিল। ফ্লাস্ক থেকে জলপান করে লোকটা গাছে হেলান দিয়ে চোখ বুজল। দীর্ঘদিন ধরে ঘরের মধ্যে অচল অবস্থায় বন্দী থাবার পর আজ এতটা গুরু পরিশ্রম করে নিশ্চয়ই অত্যন্ত ক্লান্তিবোধ করছিল। শীঘ্রই ঐ অবস্থায় বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়ল। সুব্রতর চোখে কিন্তু ঘুম নেই। নানা চিন্তা তার মাথার মধ্যে কেবলই পাক খেয়ে ফিরছিল। যাকে ও অন্ধকূপ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এল, লোকটা কে? কি এর পরিচয়? নানাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেও কোনো উত্তর পায়নি। অবিশ্যি একটা সন্দেহ ওর মনের কোণে মধ্যে মধ্যে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। কিন্তু—তাহলে? সেটা কি আগাগোড়াই একটা সাজানো ব্যাপার? আর তাই যদি হয়, তবে লোকটাকে এইভাবে দীর্ঘকাল ধরে প্রাণে না মেরে, লোকচক্ষুর অন্তরালে বন্দী করে রাখবারই বা কি প্রয়োজন ছিল? তারপর গুপ্তকক্ষের মধ্যে অকস্মাৎ সেই দ্বিতীয় ব্যক্তি এক যুবকের আবিভাব! এ শুধু অভাবনীয়ই নয়, বিস্ময়করও। বটে। ঐ যুবক রাজাদের স্টেটের অংশীদার এবং বোঝা যাচ্ছে সে আগাগোড়াই সুব্রতর পরিচয় জানত এবং তার প্রতি সে নজর রেখেছিল। সারাটা রাস্তা সুব্রত অশ্বচালনা করতে করতে যুবকের কথাই ভেবেছে। সতীনাথ লাহিড়ী যে রাত্রে নিহত হন, সে রাত্রে তার ঘরের মধ্যে ঢুকে কাগজপত্র হাতড়াবার পর ফিরে আসবার সময় ছাদের উপরে যে অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি দেখেছিল এবং যার চলাটা তার চেনা-চেনা মনে হয়েছিল, কিন্তু তখন বুঝে উঠতে পারেনি এবারে সে স্পষ্ট বুঝতেই পারছে সে আর কেউ নয়, এই যুবকই। তবে কি শেষ পর্যন্ত এই একরাত্রে তার ঘরে গিয়ে ঢুকে বাক্স-প্যাট্রা সব হাতড়িয়ে এসেছিল? এতদিন তবে এই কি সর্বক্ষণ তাকে অলক্ষ্যে ছায়ার মত পিছু পিছু অনুসরণ করে ফিরছিল? আশ্চর্য, একবারও সুব্রত ওকে কিন্তু সন্দেহ করেনি এতটুকু! প্রথম থেকেই লাহিড়ীকে নিয়ে ও এত ব্যস্ত ছিল যে ঐ যুবকের দিকে নজর দেবার ফুরসুতও পায়নি। তারপর শিবনারায়ণ চৌধুরী! এইসব কারণেই হয়ত কিরীটীওকে বার বার নৃসিংহগ্রামে একটিবার ঘুরে যাবার জন্য লিখেছিল। যুবক ও শিবনারায়ণ দুজনেই রীতিমত আহত হয়েছে। সুব্রত সেখান থেকে রওনা হওয়ার পূর্বে সেই গুপ্তকক্ষের দরজা বন্ধ করে সেই ঘরের বাইরে তালা দিয়ে এসেছে। সেই গুপ্তকক্ষ থেকে বের হবার আর কোনো পথ আছে কিনা তাই বা কে জানে? ওদের যখন আবার জ্ঞান ফিরে আসবে, তখন হয়ত আবার এক নতুন নাটকের শুরু হবে সেই প্রায়-অন্ধকার গুপ্তকক্ষের মধ্যে, কারণ আসবার সময় সেই কক্ষে, একটি মাত্র প্রদীপই কেবল সে রেখে এসেছে। এবং ওদের সঙ্গে যে টর্চ ও পিস্তল ছিল, সেগুলো নিয়ে আসতে ভোলেনি।

দুটো রাত্রি মাত্র সুব্রত নৃসিংহগ্রামে ছিল, এর মধ্যে রায়পুরেই বা আবার কি ঘটল তাই বা কে জানে! এখন ফিরে যাওয়ার পর ঘটনার স্রোত কোনদিকে বইবে, তাই বা কে জানে! সমগ্র ঘটনাটি বর্তমানে এমন একটি জটিল পরিস্থিতির মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে পর পর অনেকগুলো সমস্যা এসে যেন একটা ঘূণাবর্ত সৃষ্টি করেছে।

***

রাত্রি তখন প্রায় আটটা হবে, সব্রত লোকটাকে সঙ্গে নিয়ে বরাবর তার বাসার সামনে এসে দাঁড়াল। ঘোড়া দুটো সঙ্গে আনেনি, বনের শেষ সীমানায় ছেড়ে দিয়ে এসেছে। শিক্ষিত অশ্ব, ছাড়া পেয়ে আবার উল্টোপথে নৃসিংহগ্রামের দিকে চলতে শুরু করেছে ওরা দেখে এসেছে। সুব্রত জানে যথাসময়েই ফিরে যাবে তারা নৃসিংহগ্রামের আস্তাবলে।

থাকোহরি বারান্দাতেই বসেছিল। সুব্রতকে দেখে সানন্দে উঠে দাঁড়ায়।

সুব্রত বললে, চটপট করে আমাদের স্নানের জল দে বাথরুমে থাকোহরি। আর বেশ কড়া করে দুপেয়ালা চা তৈরী করে আন দেখি!

থাকোহরি ফ্যালফ্যাল করে তার মনিবের সঙ্গে যে লোকটা এসেছে, অত বেশভূষা দাড়িগোঁফ ও একমাথা রুক্ষ চুল,তার দিকে তাকিয়ে দেখছিল। এ লোকটা কোথা থেকে এল আবার? কাকে আবার সঙ্গে করে বাবু নিয়ে এলেন? কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতেও সাহস পেলে না।

ঠাণ্ডাজলে অনেকক্ষণ ধরে স্নান করে শরীরটা যেন জুড়িয়ে গেল।

লোকটাকে দাড়িগোঁফ কামিয়ে ধোপদুরস্ত জামাকাপড় পরিয়ে দেবার পর তার চেহারা একেবারে পাল্টে গেল। লোকটা সুব্রতকে কোনো বাধা দিল না। থাকোহরিকে দিয়ে সুব্রত থানায় কিরীটীর কাছে একটা সংবাদ পাঠিয়ে দিল। রাত্রি প্রায় দশটার সময় কিরীটী ও বিকাশ এসে হাজির হল। লোকটা তখন সুব্রতর ঘরে শুয়ে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। সুব্রত ধীরে ধীরে নৃসিংহগ্রামের সমগ্র ঘটনা একটুও না বাদ দিয়ে ওদের কাছে বলে গেল।

সমস্ত শুনে কিরীটী বললে, কাল সকালেই আমি ওকে নিয়ে কলকাতায় চলে যাব। বিকেলের দিকে প্রায় ছটা নাগাদ একটা ট্রেন আছে, তাতেই তুই কলকাতায় চলে যাবি। এখানকার কাজ আমাদের শেষ হয়েছে। রায়পুর রহস্যের ওপরে এবারে আমরা যবনিকাপাত করব।

এই লোকটা কে, কিরীটীবাবু? বিকাশ প্রশ্ন করে।

আমার মনে হচ্ছে খুব সম্ভবত সুরেন চৌধুরী—ডাঃ সুধীন চৌধুরীর বাপ। কিরীটী মৃদুস্বরে জবাব দেয়।

সে কি! তাহলে উনি যে অনেকদিন আগে মারা গিয়েছিলেন বলে আমরা জানি, সেটা তবে সত্যি কথা নয়?

না। যদিও আসল খুনী, মানে যে সুরেন চৌধুরীকে এ পৃথিবী থেকে সরাতে চেয়েছিল, সে জানত সুরেন চৌধুরীকে হত্যা করাই হয়েছে, কিন্তু মাঝখান থেকে বোধ হয় আর একটি অদৃশ্য হাত সব ওলটপালট করে দেয়।

তাহলে যে সুরেন চৌধুরীকে হত্যা করতে চেয়েছিল, সে আজও জানে না উনি বেঁচে আছেন?

খুব সম্ভবত না।

২.১১ পাতালঘরে

মিনিটে মিনিটে ঘণ্টা কেটে গেল।

প্রথমে জ্ঞান ফিরে আসে যুবকের। ধুলো বালি রক্তে বীভৎস চেহারা। প্রদীপের আলোয় আবছা আবছা অন্ধকারে পাতালঘরটা থমথম করছে।

প্রদীপের সামান্য তেল ফুরিয়ে এল। আর বেশীক্ষণ জ্বলবে না, এখুনি নিভে যাবে। নিশ্চিদ্র অন্ধকারে ঘরটা ড়ুবে যাবে।

মাথার মধ্যে এখনও ঝিম্ ঝিম্ করছে। স্মৃতিশক্তি ধোঁয়ার মত অস্পষ্ট। যুবক একবার উঠে বসবার চেষ্টা করে, কিন্তু শক্তিতে কুলোয় না। এলিয়ে পড়ে।

শিবনারায়ণের জ্ঞান ফিরে এল। অস্পষ্টযন্ত্রণাকাতর একটা শব্দ করে শিবনারায়ণও নড়েচড়ে ওঠেন।

আরও আধ ঘণ্টা পরে।

প্রদীপের আলো প্রায় নিভুনিভু তখন, ঘরের মধ্যে যেন একটা ভৌতিক আলোছায়ার লুকোচুরি খেলা।

যুবকের কোমরে যে তীক্ষ্ণ ছোরাটা গোঁজা ছিল সেটা সে টেনে বের করে।

রক্তাক্ত মুখের ওপরে মাথার চুলগুলো এসে পড়েছে।

চোখেমুখে একটা দানবীয় জিঘাংসা।

শিবনারায়ণ!

অস্পষ্ট প্রদীপের আলোয় যুবকের হস্তধৃত ধারাল ছোরাটা যেন মৃত্যুক্ষুধায় হিলহিল করছে। ঐদিকে দৃষ্টি পড়ায় শিবনারায়ণ যেন বারেক শিউরে ওঠে; চোখেমুখে একটা আতঙ্ক সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।

শিবনারায়ণ!

তুমি কি আমায় খুন করতে চাও?

যদি বলি তাই?

কিন্তু কেন? কেন তুমি আমায় খুন করবে?

খুন তোমাকে আমায় করতেই হবে। যুবক এগিয়ে আসে।

শিবনারায়ণ এক পা দু পা করে দেওয়ালের দিকে পিছিয়ে যায়।

কোথায় পালাবে আজ তুমি শিবনারায়ণ! এই অন্ধকার পাতালঘরের মধ্যে কতটুকু জায়গা তুমি পাবে পালাবার? তোমাকে খুন করব। হ্যাঁ, খুন করব। এই তীক্ষ্ণ ছোরাটার সবটুকুই তোমার বুকে বসিয়ে দেব। ফিকি দিয়ে তাজা লাল রক্ত বের হয়ে আসবে। প্রাণভয়ে মৃত্যুযন্ত্রণায় তুমি চিৎকার করে উঠবে। কেউ সে চিৎকার শুনতে পাবে না। কেউ জানতে পারবে না। দীর্ঘকাল ধরে লোকচক্ষুর অন্তরালে যেমন সুরেন চৌধুরী বন্দী হয়ে ছিল, কেউ জানতে পারে নি, তেমনি তোমার মৃতদেহও এই ধূলিমলিন অন্ধকার পাতালঘরের মধ্যে পড়ে থাকবে।

কেন— কেন তুমি আমাকে অমন নৃশংসভাবে হত্যা করবে? আমি তো তোমার কোনো ক্ষতি করিনি?

মরতে যেন তুমি ভয় পাচ্ছ মনে হচ্ছে শিবনারায়ণ?

ভয়! না, ঠিক তা না।

তবে? ভয় কি শিবনারায়ণ, শুধু যে তোমাকেই মরতে হচ্ছে তা নয়, মরতে আমাকেও হবে। তবে দুদিন আগে আর পরে এই হ্যাঁ। তাছাড়া ভেবে দেখ, ফাঁসীর দড়িতে ঝুলে অসহনীয় শ্বাসকষ্ট পেয়ে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর চাইতে তোমার এ মৃত্যু ঢের ভাল, নয় কি?

ঐ সময় যুবকের সামান্য অসতর্কতায় শিবনারায়ণ যুবকের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে, শয়তান!

অতর্কিত আক্রমণে যুবক মেঝের উপর পড়ে যায়।

অসীম শক্তি শিবনারায়ণের দেহে শিবনারায়ণ যুবকের উপর চেপে বসে দুহাতে প্রাণপণ শক্তিতে যুবকের গলাটা চেপে ধরে। জোরে, আরও জোরে চাপ দেয়। যুবকের চোখ দুটো কি এক অস্বাভাবিক আতঙ্কে যেন অক্ষিকোটর হতে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়।

গোঁ গোঁ একটা অস্পষ্ট শব্দ যুবকের গলা দিয়ে বের হয়ে আসে। ক্রমে যুবকের দেহটা শিথিল হয়ে আসে। জোরে আরও জোরে শিবনারায়ণ যুবকের গলায় দশ আঙুলের চাপ দেয়।

তারপরই শিবনারায়ণ পাগলের মত হেসে ওঠেন।

প্রদীপটা শেষবারের মত দপ্ করে একবার জ্বলে উঠেই আবার নিভে গেল। অন্ধকার! নিচ্ছিদ্র অন্ধকার!

চোখের দৃষ্টি বুঝি অন্ধ হয়ে যাবে।

শিবনারায়ণ হাসছে, পাগলের মতই হাসছে অন্ধকারে, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ। অন্ধকার পাতালঘরের মধ্যে সেই উচ্চহাসির শব্দ যেন ঝন্‌ ঝন্ করে করতালি দিয়ে দিয়ে ফিরছে দেওয়ালে দেওয়ালে।

আরও কিছুক্ষণ কেটে গেল।

ঘর হতে বেরুতে হবে। অন্ধকারে শিবনারায়ণ হাতড়ে হাতড়ে পাতালঘর থেকে বাইরে বের হবার রাস্তা খুঁজতে শুরু করে এবারে।

এ কি, অন্ধকারে কি শিবনারায়ণ পথ হারিয়ে ফেলল!

অন্ধকারের গোলকধাঁধা।

শিবনারায়ণ পাগলের মতই ঘোরে ঘরের ভিতর।

কিন্তু না, পথ কই! আলল—একটু আলো!

পাগলের মতই শিবনারায়ণ অন্ধকারের মধ্যে চিৎকার করে ওঠে, কে আছ, বাঁচাও, ওগো কে আছ, বাঁচাও!

না, এই তো দরজা! কিন্তু এ কি! এ যে বাইরে থেকে বন্ধ!

উন্মাদের মত শিবনারায়ণ বন্ধ দরজার উপরে কিল চড় লাথি বসাতে থাকে।

শক্ত সেগুন কাঠের দরজা।

কি হবে! তবে কি তাকে এই অন্ধকার পাতালঘরের মধ্যে তিল তিল করে মরতে হবে!

মৃত্যু! কে শুনতে পাবে তার চিৎকার!

সুরেন! সুরেন! কোথায় তুমি! আমাকে বাঁচাও ভাই!

ছাব্বিশ বছর এই পাতালঘরে তোমাকে আমি বন্দী করে রেখেছি। দিনের পর দিন রাতের পর রাত তোমার বুকভাঙা কান্না শুনেছি। এখন বুঝতে পারছি কি যন্ত্রণা তুমি এই ছাব্বিশ বছর ধরে পলে পলে সহ্য করেছ! ক্ষমা কর ভাই, আমাকে ক্ষমা কর আমাকে বেরুতে দাওযা চাও তুমি তাই দেব— সুরেন, সুরেন—

কিন্তু কেউ সাড়া দিল না।

শিবনারায়ণ একবার কাঁদে একবার হাসে।

একটা অস্পষ্ট খস্ আওয়াজ না! যুবকের মৃতদেহ কি আবার প্রাণ পেল! সুরেন! সুরেন! বেঁচে আছ কি?.. কথা বল! সাড়া দাও! অনেক টাকা তোমাকে দেব আমি। রাজা করে দেব—ও কে…রাজা শ্রীক মল্লিক!

ঘুরছে–শিবনারায়ণ পাগলের মতই অন্ধকার পাতালঘরের মধ্যে ঘুরছে! হঠাৎ একসময় যুবকের হীমশিতল মৃতদেহের ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।

কে? কে?

যুবকের ঠাণ্ডা অসাড় দেহটার ওপর শিবনারায়ণ হাত বুলায়।

সুরেন! আমার অনেক টাকা! রাজাবাহাদুর আমাকে অনেক টাকা দিয়েছে! সিন্দুকভর্তি টাকা আমার! এক দুই তিন চার পাঁচ ছয় সাত আট—একশ হাজার দশ বিশ পঁচিশ!

***

দিন দুই বাদে বিকাশ দলবল নিয়ে সুব্রতর নির্দেশমত যখন পাতালঘরে প্রবেশ করল শিবনারায়ণ তখনও টাকার অঙ্ক গুনে চলেছে। মৃতদেহটা ফুলে পচে উঠেছে, একটা উৎকট দুর্গন্ধে ঘরের বদ্ধ বাতাস যেন বিষাক্ত হয়ে উঠেছে।

২.১২ কিরীটীর বিশ্লেষণ

জাস্টিস মৈত্র অবাক হয়ে গিয়েছিলেন, সেদিন সকালবেলা যখন কিরীটীর ভৃত্য জংলী এসে একটা ছাতা, একটা পুলিন্দা ও দশ-বারো পৃষ্ঠাব্যাপী একটা খামে-আঁটা চিঠি তাঁর হাতে দিল।

এসব কি?

আজ্ঞে বাবু পাঠিয়ে দিলেন।

তোর বাবু কোথায়?

আজ্ঞে তিনি ও সুব্রতবাবু গতকাল সন্ধ্যার গাড়িতে পুরী বেড়াতে গেছেন।

কবে ফিরবেন?

দিন পনের বাদে বোধ হয়।

জংলী চলে গেলে জাস্টিস্ মৈত্র প্রথমেই পুলিন্দাটা খুলে ফেললেন। তার মধ্যে দুখানা চিঠি, একটি পাঁচ সেলের টর্চবাতি, কতকগুলো ক্যাশমেমো, ইনভয়েস দুটি, সতীনাথ লাহিড়ীর একটি হিসাবের খাতা। একজোড়া লোহার নাল-বসানো দারোয়ানী প্যাটার্নের নাগরাই জুতো।

জিনিসগুলো নেড়েচেড়ে এক পাশে সরিয়ে রেখে জাস্টিস মৈত্র কিরীটীর চিঠিটায় মনসংযোগ করলেন।

প্রিয় জাস্টিস্ মৈত্র,

আপনি আমার রহস্য-উদঘাটনের কাহিনীগুলো শুনতে খুব ভালোবাসেন জানি চিরদিন। তাই আজ আপনাকে একটা চমৎকার কাহিনী শোনাব। এবং আমার কাহিনী শেষ হলে, তার সব কিছু ভাল-মন্দ বিচারের ভার আপনার ওপরেই তুলে দিতে চাই, কারণ ধর্মাধিকরণের আসনে আপনি বসে আছেন, আপনিই যোগ্যতম ব্যক্তি। নিরপেক্ষ বিচার আপনার কাছেই পাব। ভাগ্যবিড়ম্বনায় ও দশচক্রে একজন নির্দোষ ব্যক্তি কারাগারে বন্দী হয়ে আছেন, তাঁর প্রতি সুবিচার করবেন। পুলিসের কর্তৃপক্ষ এ কাহিনীর বিন্দুবিসর্গও জানে না; একটিমাত্র পুলিসের লোক ছাড়া, কিন্তু সেও আমার নিকট প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, আপনার নির্দেশ ব্যতীত সে কোনো কিছুই করবে না। আপনাদের বিচারে প্রমাণিত হয়েছে, রায়পুরের ছোট কুমার সুহাস মল্লিকের হত্যাপরাধী ডাঃ সুধীন চৌধুরী। এবং তার শাস্তিভোগ করছে সে আজ কারাগারের লৌহশৃঙ্খল পরে। এতটুকুও সে প্রতিবাদ জানায়নি। আপনি আজও জানেন না—একজনকে বাঁচাতে গিয়ে, সমস্ত অপরাধের গ্লানি সে নীরবে মাথা পেতে নিয়ে সরে দাঁড়িয়েছে।

গোড়া থেকে শুরু না করলে হয়ত আপনি বুঝতে পারবেন না। তাই এই কাহিনী আমি গোড়া হতেই শুরু করব।

এদেরই, মানে রায়পুর রাজবংশের পূর্বপুরুষ রাজা রত্নেশ্বর মল্লিক, তাঁর তিন পুত্র, জ্যেষ্ঠ শ্রীকণ্ঠ মল্লিক, মধ্যম সুধাকণ্ঠ ও কনিষ্ঠ বাণীকণ্ঠ মল্লিক। শ্রীকণ্ঠ সুধাকণ্ঠের চেয়ে ন বৎসরের বড়, আর সুধাকণ্ঠের চেয়ে বাণীকণ্ঠ সাত বৎসরের ছোট। রত্নেশ্বরের একমাত্র মেয়ে কাত্যায়নী দেবী। কাত্যায়নীর একমাত্র ছেলে সুরেন্দ্রনাথ চৌধুরী, সুরেন চৌধুরীর স্ত্রী হচ্ছেন সুহাসিনী দেবী, তাঁরই একমাত্র ছেলে ডাঃ সুধীন চৌধুরী যে সুহাসের হত্যাপরাধে অপরাধী, বর্তমানে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মেয়াদে কারারুদ্ধ। রাজা রত্নেশ্বরের পিতা যজ্ঞেশ্বর মল্লিক মশাই ছিলেন সেকালের একজন অত্যন্ত দুর্ধর্ষ জমিদার। নৃসিংহগ্রামের কোনো একটি প্রজাকে যজ্ঞেশ্বর একদা স্টেট-সংক্রান্ত কোনো একটি মামলায় মিথ্যা সাক্ষী দিতে বলেন, কিন্তু প্রজাটি রাজী না হওয়ায় তাকে যজ্ঞেশ্বর হত্যা করেন। যজ্ঞেশ্বরের নায়েব ছিলেন শ্রীদীনতারণ মজুমদার মহাশয়। দীনতারণ যজ্ঞেশ্বরকে দেবতার মত ভক্তি-শ্রদ্ধা করতেন, হত্যাপরাধে সমস্ত দোষ স্বীয় স্কন্ধে নিয়ে দীনতারণ হাসিমুখে ফাঁসীর দড়িতে গলা বাড়িয়ে দিলেন। এবং মৃত্যুর পূর্বে তাঁর মাতৃহারা একমাত্র সন্তান শ্রীনিবাস মজুমদারকে যজ্ঞেশ্বরের হাতে দিয়ে যান। যজ্ঞেশ্বর নিজের সন্তানের মতই শ্রীনিবাসকে মানুষ করে পরবর্তীকালে স্টেটে নায়েবীতে বহাল করেন। যজ্ঞেশ্বরের পুত্র রত্নেশ্বর কিন্তু শ্রীনিবাসকে সুচক্ষে দেখতে পারেননি কোনোদিনই। শ্রীনিবাসের প্রতি একটা প্রচণ্ড হিংসা তাঁকে সর্বদা পীড়ন করত। যজ্ঞেশ্বর এ কথা জানতে পেরে মৃত্যুর পূর্বে একটা উইল করে রায়পুর স্টেটের সর্বাপেক্ষা লাভবান জমিদারী নৃসিংহগ্রামের অর্ধেক অংশ মুজমদার বংশকে লিখে দিয়ে যান। যজ্ঞেশ্বরের মৃত্যুর পর রত্নেশ্বর পিতার ঋণ সম্পূর্ণ অস্বীকার করলেন এবং নামমাত্র মূল্যে কৌশল করে আবার তিনি নৃসিংহগ্রামটি সম্পূর্ণরূপে নিজের ভোগদখলে নিয়ে এলেন। এমন কথাও শোনা যায় যে, রত্নেশ্বর নাকি বিষপ্রয়োগে পিতা যজ্ঞেশ্বরকে হত্যা করেন। সত্য-মিথ্যা জানি না।

রায়পুরের মর্মন্তুদ হত্যা-নাটকের বীজ সেইদিন রায়পুর বংশের রক্তে সংক্রামিত হয়। এবং সেই বিষ বংশপরম্পরায় এই বংশের রক্তধারায় সংক্রামিত হতে থাকে। রত্নেশ্বর লোকটা ছিলেন অত্যন্ত সুবিধাবাদী ও স্বার্থপর। এবং তাঁর ছেলেদের মধ্যে একমাত্র শ্রীকণ্ঠ মল্লিক ব্যতীত সুধাকণ্ঠ ও বাণীকণ্ঠ ছিলেন ঠিক পিতারই সমধর্মী। রাজা রত্নেশ্বর দীর্ঘকাল বেঁচে ছিলেন। একবার সুধাকণ্ঠ ও বাণীকণ্ঠ বিষপ্রয়োগে তাঁদের পিতা রত্নেশ্বরকে হত্যার চেষ্টা করেন। রত্নেশ্বর সে কথা জানতে পেরে এক উইল করেন। সেই উইলে সুধাকণ্ঠ ও বাণীকণ্ঠর জন্য সামান্য মাত্র মাসোহারার ব্যবস্থা করে সমস্ত সম্পত্তি শ্ৰীকণ্ঠকেই দিয়ে যান। রত্নেশ্বরের মৃত্যুর পর যখন সেকথা প্রকাশ পেল, সুধাকণ্ঠ তার একমাত্র মাতৃহারা পুত্র হারাধনকে নিয়ে রায়পুর ছেড়ে ভাগলপুরে চলে গেলেন।

হারাধন ভাগলপুর থেকে এন্ট্রান্স পাস করবার পর সুধাকণ্ঠ হঠাৎ হার্টফেল করে মারা যান। হারাধন লোকটা অত্যন্ত সরল ও নিলোভী। অত্যন্ত অর্থকষ্টের মধ্যেও তিনি রায়পুরের রাজবংশের কাছে কোনোদিন হাত পাতেননি। নিজের চেষ্টায় মোক্তারী পাস করে সেখানেই প্র্যাকটিস শুরু করেন। এবং কিছুকাল পরে প্রবাসী বাঙালীর একটি মেয়েকে বিবাহ করে সংসার পাতেন। পরে আবার ভাগলপুর থেকে রায়পুর ফিরে এসে প্র্যাকটিস শুরু করলেন। এককালে প্রচুর অর্থ উপায় করেছেন তিনি। রায়পুরে থাকলেও, তিনি রাজবাড়ির সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখেননি। তাঁর একটি মাত্র ছেলেকে বিলেত থেকে ব্যারিস্টারী পাস করিয়ে নিয়ে এলেন। ছেলের পশার বেশ জমে উঠেছে, এমন সময় অতর্কিতে ছেলে মারা গেল। হারাধন তাঁর একমাত্র পৌত্র জগন্নাথকে নিজের কাছে নিয়ে এলেন। হারাধনের ছেলে ঠিক পিতার আদর্শেই গড়ে উঠেছিলেন, কিন্তু জগন্নাথ হল একেবারে ভিন্ন প্রকৃতির। জগন্নাথের কথা পরে বলব। রত্নেশ্বরের কনিষ্ঠ পুত্র বাণীকণ্ঠ পিতার মৃত্যুর দুমাস পরেই তাঁর স্ত্রী ও একমাত্র পুত্র নিশানাথকে রেখে মারা যান। নিশানাথ রায়পুরেই থাকেন এবং পরে আর্ট স্কুল থেকে পাস করে শোলপুর স্টেটের চিত্রকরের চাকরি নিয়ে চলে যান। নিশানাথ অবিবাহিত। মাস পাঁচেক হল তাঁর মস্তিষ্কের সামান্য বিকৃতি হওয়ায় রায়পুরের বর্তমান রাজা বাহাদুর তাঁকে রায়পুরে নিয়ে এসে রাখেন। শ্ৰীকণ্ঠ মল্লিক ছিলেন দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ। দুই পুরুষের পাপ ও অন্যায়ের প্রতিকারকল্পে তিনি নিহত হওয়ার দিন দশেক পূর্বে হারাধনের সঙ্গে যুক্তি করে একটি উইল করেন। এই উইলই হল কাল। যে পাপ ঐ বংশে ঢুকেছিল সেই পাপ স্খলন করতে গিয়েই তিনি যে মহাভুল করলেন, সেই ভুলেরই কঠোর প্রায়শ্চিত্ত চলেছে একটির পর একটি নৃশংস হত্যার মধ্য দিয়ে। উইলের মধ্যে প্রধান সাক্ষী ছিলেন নায়েবজী শ্রীনিবাস মজুমদার ও হারাধন মল্লিক, শ্ৰীকণ্ঠের ভ্রাতুস্পুত্র। শ্রীকণ্ঠের কোন পুত্রাদি না হওয়ায় বৃদ্ধ বয়সে রসময়কে দত্তক গ্রহণ করেন। জীবনে শ্রীকণ্ঠ তিনটি ভুল করেছিলেন, ১নং উইল করা, ২নং রসময়কে দত্তক গ্রহণ করা। রসময়ের পিতা ছিল একজন প্রচণ্ড নেশাখোর স্বার্থান্বেষী ও নীচ প্রকৃতির লোক। রসময় তাঁর জন্মদাতার সব গুনগুলোই পেয়েছিলেন এবং দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে শিশুকালটা অতিবাহিত করে। পরবর্তীকালে অগাধ প্রাচুর্যের মধ্যে এসে যতটুকু তার মধ্যে সপ্রবৃত্তি অবশিষ্ট ছিল, তাও নিঃশেষে লুপ্ত হয়ে গেল। শ্রীকণ্ঠ গোপনে একটা উইল করেছিলেন, তাঁর স্টেটের সমুদয় সম্পত্তি সমান ভাগে নিম্নলিখিতদের মধ্যে ভাগ হবে—হারাধনের পুত্র হৃদয়নাথ মল্লিক, নিশানাথ মল্লিক, সহোদরা কাত্যায়নী দেবীর পুত্র সুরেন চৌধুরী ও দত্তকপুত্র রসময় মল্লিক। তাঁর অবর্তমানে রসময় ও শ্রীনিবাস মজুমদারই স্টেট-সংক্রান্ত সকল কিছু দেখাশুনা করবেন। স্টেটের কোন অংশীদারই কারও অংশ বিক্রয় করতে পারবেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর উইলের ব্যাপারটা যে গোপন থাকেনি তিনি জানতে পারেননি। এবং তারই আকস্মিক পরিণতি হচ্ছে তাঁর মৃত্যু মৃত্যু ঠিক বলবনা—তাঁকে নিহত হতে হল। উইল করবার দিনপাঁচেক বাদে শ্রীকণ্ঠ নৃসিংহগ্রাম মহালটি পরিদর্শন করতে যান। সঙ্গে যায় তাঁর দত্তকপুত্র রসময় মল্লিক। নৃসিংহগ্রামে পৌঁছবার পর পিতাপুত্রের মধ্যে সামান্য কারণে প্রচণ্ড একটা কলহ বাধে। সেই কলহের সময়ই শ্ৰীকণ্ঠ রাগতভাবে তাঁর উইলের কথা পুত্রকে জানিয়ে দেন। জীবনে এই তৃতীয় ভুলটি তিনি করলেন। পরদিন প্রত্যুষে দেখা গেল, শ্ৰীকণ্ঠ মল্লিক তাঁর শয়নকক্ষের মধ্যে রক্তাক্ত অবস্থায় নিহত হয়ে পড়ে আছেন। এদিকে শ্রীনিবাস প্রভুর নিষ্ঠুর হত্যাসংবাদ যখন পেলেন, তখন একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। জোর তদন্ত হয়েও শ্রীকণ্ঠের মৃত্যুরহস্যের কোন মীমাংসা হল না। এদিকে সিন্দুক খুলে দেখা গেল, শ্রীকণ্ঠের কোন উইলই নেই। ফলে রসময় মল্লিকই হলেন রায়পুরের সর্বময় কতা।

নতুন নাটক শুরু হল।

রসময় মল্লিকের দুই বিবাহ। প্রথম পক্ষ আগেই গতাসু হয়েছিলেন, তাঁর ছেলে সুবিনয় এবং দ্বিতীয় পক্ষে মালতী দেবীর সন্তান সুহাস। সুবিনয় ও সুহাসের মধ্যে বয়সের পার্থক্য প্রায় আট বৎসর। এদিকে শ্রীকন্ঠের মৃত্যুর পর যখন তাঁর সিন্দুকে কোন উইল পাওয়া গেল না, শ্রীনিবাস বা হারাধন কেউই কোন উচ্চবাচ্য করলেন না,কারণ উইলটি আইনসিদ্ধ করা তখনও হয়নি। ঠিক ছিল শ্রীকণ্ঠ নৃসিংহগ্রাম হতে প্রত্যাবর্তন করলে, উইলটির পাকাপাকি ব্যবস্থা করা হবে আদালতে গিয়ে রেজিস্ট্রি করে। উইলের ব্যাপারটা গোপনই রয়ে গেল। নায়েবজী শ্রীনিবাস মজুমদারের এক জ্যেষ্ঠ খুল্লতাত ভাই ছিল, তাঁরই সঙ্গে রত্নেশ্বর তাঁর একমাত্র কন্যা কাত্যায়নীর বিবাহ দিয়েছিলেন। রত্নেশ্বরের প্রবল ইচ্ছে ছিল, শ্রীনিবাসের সঙ্গেই কাত্যায়নীর বিবাহ দেন, কিন্তু শ্রীনিবাস স্টেটের নায়েব ছিলেন বলে এবং একই সংসারে শ্রীনিবাস ও কাত্যায়নী ভাই-বোনের মত প্রতিপালিত হওয়ায় রত্নেশ্বরের স্ত্রী ঐ বিবাহ ঘটাতে দেননি। অগত্যা শ্রীনিবাসের জ্যেষ্ঠ খুল্লতাত ভ্রাতার সঙ্গেই কাত্যায়নীর বিবাহ হয়। শ্রীনিবাসের মৃত্যুশয্যায় কাত্যায়িনী দেবী উপস্থিত ছিলেন। মৃত্যুকালে শ্রীনিবাসই কাত্যায়িনীর নিকট শ্রীকন্ঠের উইলের কথা উল্লেখ করেছিলেন। যাই হোক শ্রীনিবাসের মৃত্যুর পর রসময় কি ভেবে জানি না, সুধীনের পিতা তরুণ উকিল সুরেন্দ্র চৌধুরীকে স্টেটের নায়েবীতে বহাল করলেন। সুবিনয় কিন্তু পিতার এই কাজে এতটুকুও খুশী হলেন না। ফলে মাস ছয় যেতে না যেতেই লোকে জানল সুরেন চৌধুরী নৃসিংহগ্রাম মহাল পরিদর্শন করতে গিয়ে যে কক্ষে শ্রীকণ্ঠ মল্লিক নৃশংসভাবে নিহত হয়েছিলেন, সেই কক্ষেই নৃশংসভাবে কোন এক অদৃশ্য আততায়ীর হস্তে নিহত হয়েছেন। স্বামীর মৃত্যুর পর সুরেনের স্ত্রী সুহাসিনী তিন বৎসরের শিশুপুত্র সুধীনকে বুকে নিয়ে রায়পুর ত্যাগ করে তাঁর ভাইয়ের গৃহে চলে এলেন। সুরেনের মৃত্যুর (?) কয়েক মাস আগে তাঁর মা কাত্যায়নীর কাশীপ্রাপ্তি হয়েছিল। হতভাগ্য সুহাসের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এই হল মোটামুটি ইতিহাস। আগাগোড়া ব্যাপারটাই অত্যন্ত জটিল। এবারে আমি বর্তমান অধ্যায়ে আসব, সুহাসের মৃত্যুর ব্যাপারে।

প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, শোনা যায় রসময়েরও নাকি আকস্মিক মৃত্যু ঘটে। একদিন আহারাদির পর হঠাৎ তিনি অসুস্থ বোধ করেন, ডাক্তার-বদ্যি এল, কিন্তু কোন ফল হল না, ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই তিনি মারা (?)গেলেন। এবারে সুবিনয় মল্লিক হলেন রায়পুরের রাজাবাহাদুর। কিন্তু রসময় উইল করে গিয়েছিলেন, সমগ্র সম্পত্তি সমান দুভাগে সুবিনয় ও সুহাসে বর্তাবে। পিতা রসময়ের মৃত্যুর পরই সুবিনয় স্টেটের কিছু অদলবদল করলেন।

নতুন খাজাঞ্চী এল তারিণী চক্রবর্তী ও তার কিছুকাল পরে স্টেটের ম্যানেজার হয়ে এলেন অধুনা মৃত সতীনাথ লাহিড়ী। এইভাবে তৃতীয় অঙ্ক শুরু হল। সুবিনয় চেষ্টা করছিলেন, কি ভাবে সুহাসকে চিরদিনের মত তাঁর পথ থেকে সরিয়ে সমস্ত সম্পত্তি একা ভোগ করবেন। ষড়যন্ত্র শুরু হল। সুবিনয়ের পরামর্শ ছাড়াও সহায় হলেন ডাক্তার কালীপদ মুখার্জী, খাজাঞ্চী তারিণী চক্রবর্তী, ম্যানেজার সতীনাথ লাহিড়ী ও নৃসিংহগ্রামের নায়েব শিবনারায়ণ চৌধুরী। এবারে রাণীমা মালতী দেবী আমাকে যে পত্রটি দিয়েছিলেন, যা মামলার অন্যতম evidence হিসাবে আপনাকে পাঠালাম, সেটা পড়ুন। তারপর আবার আমার চিঠি পড়বেন।

২.১৩ রাণীমার স্বীকৃতি

রায়পুর

ইনসপেক্টারবাবু,

আপনি হয়ত অবাক হবেন কে আপনাকে এই চিঠি লিখছে, তাই প্রথমেই পরিচয়টা দিয়ে নিই, আমি রায়পুরের ছোট কুমার হতভাগ্য সুহাসের জননী মালতী। আপনি সে-রাত্রে চলে যাওয়ার পর আমি অনেক ভেবেছি, শেষটায় সব আপনাকে জানানোই মনস্থ করে এই পত্র আপনাকে লিখতে বসেছি। সুহাস আজ মৃত। কোনদিনই আর সে এ অভাগিনীকে মা বলে ডাকবে না। সুহাসের অকালমৃত্যুতে সংসার আমার কাছে একেবারে শূন্য হয়ে গেছে। আর বেঁচে থেকেই বা লাভ কি! আপনি ঠিকই বলেছিলেন, একজন নির্দোষ যদি আমারই জন্য শাস্তি পায়, ভগবানের বিচারে আমি রেহাই পাব না। আপনি কে এবং আপনার সত্য পরিচয় যে কি তা আমি জানি না। তবে আপনার সঙ্গে সে-রাত্রে কথাবার্তা বলে এইটুকুই বুঝেছি, আপনি যেই হোন, আপনার কাছে কিছু চাপা থাকবে না। সবই একদিন আপনি বুঝতে পারবেন। যাগে ওসব কথা, যা বলতে আজ কলম ধরেছি তাই বলি—সুবিনয়। ও সুহাস আমার কাছে পৃথক নয়। তাছাড়া আমার স্বামীও জানতেন সুবিনয় আমার পেটে না হলেও, সুহাসের চাইতে তাকে আমি কম ভালবাসি না। বরং সুহাসের চাইতে তাকে আমি বেশীই স্নেহ করতাম চিরদিন, এবং হয়ত—হয়ত এখনও করি। বুঝতে পারেন কি, সেই এতখানি স্নেহের প্রতিদানে সুবিনয়ই যখন সুহাসের প্রাণ নেবার ষড়যন্ত্র করছিল, কত বড় আঘাত আমি পেয়েছিলাম। আমি প্রথম সে-কথা টের পাই সুহাসের মৃত্যুর মাস ছয়েক পূর্বে। ঘটনাটা তাহলে খুলেই বলি। সুহাসের মৃত্যুর কয়েক মাস আগে, তার চোখের গোলমাল হওয়াতে চক্ষু-চিকিৎসকের নির্দেশমত তাকে চশমা নিতে হয়। চশমাটা যেদিন সতীনাথ কলকাতা থেকে তৈরী করে নিয়ে এল, আমার সঙ্গে বসে বসে সুহাস গল্প করছিল। ওর দাদা এনে চশমাটা ওর হাতে দিল। চশমাটা ছিল রিমলেস। চোখে দেবার পর দেখা গেল চশমাটা একটু ঢিলে হচ্ছে। সুবিনয় পাশেই দাঁড়িয়ে তখন। চশমাটা ঠিক বসছে না দেখে ও বলে, কিছু না, ঠিক করে দিচ্ছি। বলতে বলতে এগিয়ে এসে সুহাসের নারে উপরে বসানো চশমাটা বেশ জোরে টিপে দিল, সুহাসের নাকের দুপাশ টিপুনির চোটে কেটে গেছিল, সে উঃ করে ওঠে! সেইদিনই দ্বিপ্রহরের দিকে সুহাস অসুস্থ হয়ে পড়ে। ক্রমে জানা যায় সুহাসের টিটেনাস হয়েছে। রায়পুরে ভাল অ্যান্টিটিটেনাস সিরাম পাওয়া যাবে না বলে সতীনাথ কলকাতায় যায় এবং প্রত্যহ সেখান হতে সিরাম অ্যামপুল পাঠাতে থাকে। শুনলে আশ্চর্য হবেন, সেই অ্যামপুলগুলোর কোনটারই মধ্যে সিরাম থাকত না, থাকত স্রেফ জল। ফলে অসুখের কোন উন্নতিই হয় না। তখন আমি সুধীনকে সব কথা লিখে জানাই গোপনে এবং সুধীনই এখানে এসে সুহাসকে একপ্রকার জোর করে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে তার চিকিৎসার সুব্যবস্থা করে তাকে সুস্থ করে তোলে। সুহাসের সেবার টিটেনাস হওয়ায় সুধীন নিজে ও অন্যান্য ডাক্তাররা বেশ একটু আশ্চর্যই হয়েছিল। শরীরের কোথাও কোন ক্ষতচিহ্ন নেই, কেমন করে টিটেনাস রোগ হল! হায়, তখন কি জানি যে চশবার যে দুটো প্লেটের মত অংশ নাকের ওপরে চেপে বসে, তাতে টিটেনাস ব্যাসিলি লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরে জানতে পারি সুহাসের শরীরে প্লেগের বীজ ইনজেক্ট করার জন্যই সুহাস অসুস্থ হয়ে পড়ে। ভাবছেন নিশ্চয়ই সে কথাটা কি করে জানলাম, না? সুহাসের মৃত্যুর আগে এবারে অসুখের সময় হঠাৎ একদিন সুবিনয় ও কালীপদ মুখার্জীর মধ্যে যখন আলোচনা চলছিল গোপনে, তখন তাদের ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতে গিয়ে কয়েকটা কথা আমার কানে আসে। সুবিনয় ডাঃ মুখার্জীকে বলছিল, মরিয়া না মরে অরি! সেবার চশমার প্লেটে টিটেনাস বীজ মাখিয়ে দিলেন, কত চেষ্টা হল, সব ভেস্তে গেল! তার জবাবে ডাঃ মুখার্জী বলেন, এবারে আর বাছাধনকে বাঁচতে হবে না, এবারে একেবারে মোক্ষম মৃত্যুবাণ ছেড়েছি। আমার টাকাটার কথা ভুলবেন না কিন্তু রাজাবাহাদুর! তাদের কথা শুনে শরীর যেন আমার পাথরের মত জমে গেল। কানের মধ্যে তখন আমার ভোঁ ভোঁ করছে। ভাবতে পারেন আমার তখন কি অবস্থা! যার হাতে নিশ্চিত বিশ্বাসে তুলে দিয়েছি আমার একমাত্র পুত্রের জীবনমরণের সমস্ত ভার, সে-ই কিনা চিকিৎসকের ছদ্মবেশে বিষপ্রয়োগ করেছে! সেইদিনই আমি একপ্রকার জোর করেই কলকাতা যাবার ব্যবস্থা করলাম এবং সুধীনকে গোপনে আমাদের কলকাতার বাসায় সেইদিনই দেখা করবার জন্য তার করে দিলাম। আমরা কলকাতায় যেদিন পৌঁছই সেইদিনই বিকেলের দিকে সুধীন আমাদের বাসায় আসে। তাকে ডেকে গোপনে সব কথা খুলে বলি। পরদিন আমি আর সুধীন অন্য ডাক্তার আনার কথা বলি। প্রথমে সুবিনয় একেবারেই রাজী হয় না, তখন আমি ও সুধীন একপ্রকার জেদাজেদি করে ডাঃ সেনগুপ্তকে ডেকে আনাই। তার পরের ঘটনা তো সবই আপনারা জানেন। ব্লাড-কালচারের রিপোর্ট পৌঁছবার আগেই আমার সর্বনাশ হয়ে গেল। আরও একটা কথা এখানে বলা প্রয়োজন মনে করি। প্রথমবার সুহাসকে টিটেনাস রোগ থেকে ভাল করবার পর, সুহাসের অনুরোধেই আমি সুধীনকে দশ হাজার টাকা ধার হিসাবে দিয়েছিলাম, তার ওষুধ সাপ্লাইয়ের ব্যবসার জন্য। কিন্তু সুধীন সে টাকা নিল বটে, তবে কারবারে আমাকে অংশীদার করে নেয়। আজ বলতে লজ্জা নেই, আমার স্বামীর মৃত্যুর পর স্টেটের একটি পয়সার ওপরেও আমার কোন অধিকার ছিল না। সুহাস যখন আমার কাছে এসে সুধীনকে টাকা দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানায়, আমি চারদিকে অন্ধকার দেখি। আমি জানতাম, কেঁদে ভাসিয়ে দিলেও সুবিনয় দশ হাজার তত দূরে থাক, একটি কপর্দকও দেবে না আমাকে। আমি তখন একপ্রকার নিরুপায় হয়েই শেষটায় সুবিনয়ের ঘরে ঢুকে, তার আয়রন সেফ খুলে ঐ দশ হাজার টাকা চুরি করে সুহাসকে দিই সুধীনকে দেওয়ার জন্য। কিন্তু এমনই দুর্ভাগ্য, সুবিনয় কথাটা জেনে ফেলে। শেষটায় আমার সুহাস ও সুবিনয়ের মধ্যে একটা লিখিত চুক্তি হয়, ওই দশ হাজার টাকা সুহাসের ভাগ থেকে কাটা যাবে। এবং তাহলেই সুবিনয় এ নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করবে না। যদি মামলার সময় সুধীনের ব্যাঙ্কের মজুত টাকার কথা ওঠে, তখন পাছে সমস্ত কথাই আদালতে প্রকাশ পায়, আমার চুরির কথা লোকে জানতে পারে, সেই ভয়ে আমি একদিন গোপনে কারাগারে সুধীনের সঙ্গে দেখা করে অনুরোধ জানাই এ-কথা কাউকে না বলতে। সুধীন আমাকে বাঁচাতে গিয়েই সব দোষ মাথা পেতে নেয়, একটি কথাও ও-সম্পর্কে আদালতে প্রকাশ করেনি। সেদিন সে আমায় বলেছিল, মামীমা, আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন, সুহাসের মা আপনি—ফাঁসী যেতে হয় যাব তবু কাউকে এ-কথা বলব না। আপনাকে আদালতে টেনে আনব না। এ কথা আগে বলে আপনি ভালই করলেন, নচেৎ এসব কথা তো আমার জানা ছিল না।

সে তার কথা রেখেছে। হাতে আমার কোন প্রমাণ নেই বটে, তবে আমি জানি সুহাসের হত্যা-ষড়যন্ত্রের মধ্যে সুবিনয় এবং কালীপদ মুখার্জী, ডাঃ অমিয় সোম, তারিণী চক্রবর্তী সবাই লিপ্ত আছে। আপনি হয়ত ভাবছেন, এসব কথা এতদিন জানা সত্ত্বেও কোর্টে যখন মামলা চলছিল, সেই সময় সব কথা প্রকাশ করে দিই নি কেন? তার কারণ, আমি দেখেছিলাম সুহাস তো আর ফিরে আসবেই না এবং সুবিনয়ও যদি যায়, আমার স্বামীর শেষের অনুরোধতাও রক্ষা হয় না। তাছাড়া মৃত্যু দিয়ে মৃত্যুর শোধ তোলা যায় না। একজন তো গেছেই, আর একজনকেই বা কেন মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিই! সেও তো আমার স্বামীরই সন্তান। আমার বুকের দুধ সে পান না করলেও, অকাতরেই তাকে আমি আমার মায়ের স্নেহ দিতে কার্পণ্য করিনি কোনদিন। আমার চোখে সুহাস ও তার মধ্যে কোন পার্থক্যই তো ছিল না। সে আমাকে মা বলে না স্বীকার করলেও, তাকে আমি সন্তান বলেই জানি। সে যে সুহাসের সঙ্গে একই বুকের তলায় বড় হয়ে উঠেছে।

সুধীনের প্রতি যে অন্যায় হচ্ছিল, প্রতি মুহূর্তেই তা আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আমি যদি সব স্বীকার করতাম, তাহলে সুবিনয়ের ফাঁসী হত সুনিশ্চিত। তাতে করে আমার মৃত স্বামীর মুখে ও তাদের এত বড় বংশে চুনকালি পড়ত। এই বংশের দিকে চেয়ে লোকে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিত। শেষ পর্যন্ত আমার মৃত স্বামীর কথা ভেবেই আমি চুপ করে রইলাম। মুখ খুললাম না। সুধীনের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের কথা শুনে অবধি নিরন্তর আমি অনুশোচনায় ও বিবেকের দংশনে দগ্ধ হচ্ছিলাম, তারপর ঠাকুরপো (নিশানাথ)-কেও যখন সুবিনয় হত্যা : করলে এবং তারই তদন্তে এসে আপনি আর একজন অভাগিনী জননীর মর্মদাহের কথা আমায় শোনালেন, আর স্থির থাকতে পারলাম না।

সুহাসের মৃত্যুর পর অনেক দিন আগেকার একটা ঘটনা আমার মনে পড়েছিল, সুহাসের তখন বছর ছয়েক বয়স, সুবিনয়ের বয়স বছর চোদ্দ হবে, ধনুর্বাণ খেলার ছলে খেলার তীরের সঙ্গে কুঁচফলের বিষ মাখিয়ে সুবিনয় সুহাসকে মারবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সে তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে একটা গরুর গায়ে বেঁধে এবং সেই বিষে গরুটা মরে। গরুটার মৃত্যুর পর, সেই তীর পরীক্ষা করে পশুর ডাক্তার সেই কথা বলেছিল— কিন্তু তীরের ফলায় কোথা হতে যে কুঁচফলের বিষ এসেছিল, সেকথা সেদিন আমরা কেউ তলিয়ে ভেবে দেখিনি। তাহলেই ভেবে দেখুন সেই ছোটবেলা হতেই সুবিনয়ের সুহাসের প্রতি একটা জাতক্রোধ ছিল। অথচ শুনে আশ্চর্য হবেন, সুহাস দাদা বলতে যেন অজ্ঞান ছিল। দাদাকে সে দেবতার মতই ভক্তিশ্রদ্ধা করত। আমার চাইতেও বোধ করি সে তার দাদাকে বেশী ভালবাসত। আপনি আমাকে সে রাত্রে একটা কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, মনে আছে নিশ্চয়ই আপনার, চিৎকার শুনে আমি ঠাকুরপোর ঘরে ছুটে গিয়ে তাকে জীবিত দেখেছিলাম?ি হ্যাঁ,সেদিন আমি স্বীকার করিনি, আজ করছি অকুষ্ঠে, ঠাকুরপো তখনও বেঁচে ছিলেন এবং মরবার সময় তিনি শেষ কথা বলে যান, সুবিনয়—বিনু সে-ই আমায় শেষটায় মারলে!…এমন সময় সুবিনয় সেই ঘরে এসে প্রবেশ করে হন্তদন্ত হয়ে।

আমি ঠিক রান্নাঘর থেকে ঠাকুরপোর চিৎকার শুনিনি, তাঁর ঘরে ঢুকছিলাম, এমন সময় শুনি। আমার মনে হয় সতীনাথকে সুবিনয়ই মেরেছে,কিন্তু কেমন করে তা জানি না। আমার ধারণা মাত্র। হয়ত নাও হতে পারে। সতীনাথের মৃত্যুতে আমি এতটুকুও দুঃখিত নই, বরং খুশীই হয়েছি। এই বংশের ঐ শনি। সুবিনয়ের ঐ ছিল ডান হাত, তবে ইদানীং দেখতাম, দুজনের মধ্যে তত সম্প্রীতি ছিল না, প্রায়ই কথা-কাটাকাটি হত। আমার যতটুকু জানাবার ছিল সবটাই আপনাকে জানালাম। এতদিন পরে আমার স্বীকারোক্তি দিয়ে ভাল করলাম কি মন্দ করলাম জানি না। সুধীনকে ছাড়িয়ে আনতে যদি পারেন তবেই হয়ত এপাপের কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত হবে। অহর্নিশি এই বিষযন্ত্রণা হতে মুক্তি পাব। আমার নমস্কার জানবেন।

ইতি

মালতী দেবী

 ২.১৪ কিরীটীর চিঠি

মালতী দেবীরপত্রখানা পড়ে শেষ করে জাস্টিসমৈত্র আবার কিরীটীর পত্রটি পড়তে লাগলেন।

মালতী দেবীর চিঠিখানা আগাগোড়া পড়লে এ হত্যা-মামলার অনেক কিছুই দিনের আলোর মত আপনার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। বেচারী মালতী দেবী! এখন বোধহয় বুঝতে পারছেন, ডাঃ সুধীনের ব্যাঙ্ক-ব্যালান্সের মোটা অঙ্কটা কোথা হতে সংগৃহীত হয়েছিল এবং কেনই বা সে ইচ্ছাকৃত অস্বীকৃতি দিয়ে নিজেকে বিপদগ্রস্ত করেছিল? ধনুর্বাণ খেলার ছলে সুবিনয় যখন সুহাসকে মারবার চেষ্টা করেন তীরের সঙ্গে বিষ মিশ্রিত করে, নিশানাথ সে-সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তাই তিনি পাগলামির ঝোঁকে বলতেন—That child of the past! Again he started his old game! সতীনাথের হত্যার দিন আরও তিনি বলেছিলেন একটা কথা, পাগলের প্রলাপোক্তি বলেই ধরে নেওয়া হয়েছিল, একটি দশ-এগারো বছরের কিশোর বালক—but the seed of the villainy was already in his heart! ধনুর্বাণ খেলার ছলে খেলার তীরের সঙ্গে কুঁচফলের বিষ মাখিয়ে তারই একজন খেলার সাথীকে মারতে গিয়েছিল, কিন্তু সব উল্টে গেল—বিষ মাখানোতীরটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে একটা গরুকে মেরে ফেললে। মালতী দেবীর চিঠি হতেও প্রমাণিত হয়, সেই কিশোর বালকটি কে। আর কেউ নয়—ঐ সুবিনয় মল্লিক। পাছে কথাটা প্রকাশ হয়ে পড়ে, তাই সুবিনয়ের বিচারে নিশানাথের পৃথিবী হতে অপসারণের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। তীরে এসে তরী ডোবানো যায় না, নিশানাথকে তাই মৃত্যুবাণ বুক পেতে নিতে হল। নির্মম ভাগ্যচক্র!

মালতী দেবীর চিঠিতেও বুঝতে পেরেছেন এবং আমিও বলছি, সতীনাথ লাহিড়ীকেও মৃত্যুবাণ বুক পেতে নিতে হয়েছে এইজন্য যে সতীনাথ ছিল সুবিনয়ের সকল দুষ্কর্মের সাথী। তার হাতে অনেক প্রমাণই ছিল—এদের মিলিত পাপানুষ্ঠানের। সতীনাথের বেঁচে থাকাটা তাই আর সম্ভবপর হল না।

কিন্তু সে-সব কথা যাক, আসুন আবার আমরা অতীতের ভুলে-যাওয়া-ঘটনার মধ্যে ফিরে যাই। আমরা জানি শ্রীকণ্ঠ মল্লিক নৃসিংহগ্রামের কাছারীবাড়িতে অদৃশ্য আততায়ীর হাতে নৃসংশভাবে নিহত হয়েছিলেন!

কে সেই অদৃশ্য আততায়ী? আর কেনই বা তিনি এমন নিষ্ঠুরভাবে নিহত হলেন? রাজা যজ্ঞেশ্বরের হত্যাকারী তাঁরই পুত্র রত্নেশ্বর। এবং রত্নেশ্বরকে বিষপ্রয়োগে হত্যার প্রচেষ্টা করেন তাঁরই মধ্যম ও কনিষ্ঠ পুত্র সুধাকণ্ঠ ও বাণীকণ্ঠ মল্লিক। অবিশ্যি এটা আমার অনুমান মাত্র। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস দেখুন, রসময় যে মুহূর্তে আর পিতার কাছ থেকে ঝগড়ার সময় শুনল, তার বাপের নতুন উইল অনুযায়ী তিনি রায়পুরের একচ্ছত্র অধীশ্বর হতে পারবেন না, একটি অংশের মাত্র অধিকারী, তখুনি তিনি আর কালবিলম্ব না করে বাপকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করলেন। হয়ত কিছু আগে পরে ঐসময়েই অর্থের লোভে দাগী আসামী পলাতক শিবনারায়ণ রসময়ের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়েছিল। সুহাসের হত্যা-মামলা যখন আপনার কোটে চলতে থাকে তখনই সাক্ষীর কাঠগড়ায় একদিন শিবনারায়ণকে দেখে আমার মনে হয়েছিল তার মুখটা যেন কেমন চেনা-চেনা লাগছে। আমার যেন কেমন একটা দোষ আছে, বিশেষ কোন ব্যক্তির বিশেষ কোন মুখ একবার দেখলেই মনের ক্যামেরার লেন্স দিয়ে সেটা আমি ধরে রাখি মনের মধ্যে। শিবনারায়ণের ছবিও মনের মধ্যে আমার ঠিক তেমনই গেঁথে গিয়েছিল। লালবাজারে ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের অ্যালবামে খুঁজলে শিবনারায়ণের ছবিও দেখতে পাবেন, আমি সেটা ইতিমধ্যে মিলিয়ে নিয়েছি। তার আসল নাম পণ্ডিত চৌধুরী। বহুকাল আগে নোট জালের সাধু (?) প্রচেষ্টার মোকদ্দমায় সে একবার বিশ্রীভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। পরবর্তীকালে কোনমতে সেই মামলা থেকে রেহাই পেয়ে সুবিনয় মল্লিককে কেমন করে যে তর করল বলতে পারব না, তবে অনুমান করছি হয়ত সুবিনয় মল্লিকই তাঁর যোগ্য সহচরটিকে খুঁজে নিয়েছিলেন বা শিবনারায়ণ নিয়েছিল খুঁজে। আরও একটা কথা—একবার তার সঙ্গে আমার প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়েছিল, কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে তাকে বাঁধতে পারিনি সেবার। সে গল্প আর একদিন আপনাকে বলব।

আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে,আমি আগাগোড়াই বলে আসছি, রায়পুরের এই বিরাট হত্যার ব্যাপারে মূলে আছে—অর্থম অনর্থম! সুবিনয় মল্লিককে আপনি সাজা দিতে পারবেন কিনা জানি না, তবে এই বিরাট হত্যাযজ্ঞের অন্যতম প্রধান হোতা হচ্ছেন তিনিই—প্রথমে তাঁর পিতা রসময়কে হত্যা করানো শিবনারায়ণের সাহায্যে এবং তারপরে ডাঃ সুধীন চৌধুরীর পিতা সুরেন চৌধুরীকে হত্যা করবার চেষ্টা।

কিন্তু কথায় বলে না, শয়তানেরও বাপ আছে! শিবনারায়ণ সুবিনয়ের উপর আর এক চাল চাললে। সুরেন চৌধুরীকে হত্যা না করে তাকে নৃসিংহগ্রামের পুরাতন প্রাসাদের এক গুপ্তকক্ষে গুম করে রাখে। এবং তার বদলে তৃতীয় একজন ব্যক্তিকে, যে শ্রীকণ্ঠ মল্লিকের হত্যার সময় শিবনারায়ণকে সাহায্য করেছিল, তাকে হত্যা করে এক ঢিলে দুই পাখি মারল।

হত্যা করার পর মৃতদেহটি এমনভাবে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছিল যে তাকে আর চেনবার কোনও উপায় ছিল না। এমন কি দেহ হতে মস্তকটিকে একেবারে প্রায় দ্বিখণ্ডিত করে দেওয়ায় কেউ চিনতেই পারেনি আসলে নিহত ব্যক্তি সুরেন চৌধুরীই কিনা। অবিশ্যি তৎসত্ত্বেও একমাত্র যিনি চিনতে পারতেন তিনি সুধীনের মা, সুহাসিনী দেবী। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুসংবাদে তখনকার তাঁর মনের অবস্থা এমন ছিল যে, সে সময় সত্য-মিথ্যা যাচাই করে দেখবার মত কোন ক্ষমতাই তাঁর তখন থাকতে পারে না। তিনি মৃতদেহ দেখেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান এবং জ্ঞান হবার পূর্বেই মৃতদেহ সরিয়ে ফেলা হয়। লোক জানল সুরেন চৌধুরীই নিহত হয়েছেন।

কিন্তু এখন কথা হচ্ছে, কেন শিবনারায়ণ সুরেন চৌধুরীকে হত্যা না করে গুম করে রেখেছিল দীর্ঘকাল ধরে! কিসের আশায়? আগেই বলেছি শিবনারায়ণ কী চরিত্রের লোক। দুটি কারণে শিবনারায়ণ সুধীন চৌধুরীকে গুম করে রেখেছিল হত্যা না করে। প্রথমত সত্যিই যদি কোনোদিন কোনো কারণে তার কীর্তিকলাপ অন্যের চক্ষে ধরা পড়েও, সে অনায়াসেই গুপ্তকক্ষ থেকে সুরেনকে এনে সাফাই গাইতে পারবে। এবং দ্বিতীয়ত সুরেন চৌধুরী তার হাতে থাকলে, সেই সঙ্গে সুবিনয় মল্লিকও তার হাতের মুঠোর মধ্যে থাকে এবং সহজেই ইচ্ছামত সুবিনয়কে দোহন করতে পারা যাবে। কখনো দোহন করতে করতে যদি সুবিনয় কোনোদিন কোনো কারণে বেঁকে বসেন, তাহলে সে-মুহূর্তে শিবনারায়ণ অনায়াসেই তার গুপ্ত বাণ (সুরেন চৌধুরী যে আসলে নিহত হয়নি) সুবিনয়ের প্রতি প্রয়োগ করতে পারবে। ক্রিমিন্যালদের সাইকোলজি বড় অদ্ভুত, না! এখন কথা হচ্ছে, এই গোপন ব্যাপার আর কেউ জানত কিনা? হ্যাঁ জানত, একজন জানত। সে আমাদের হারাধনের পৌত্র জগন্নাথ মল্লিক। চমকে উঠছেন, না? সত্যি চমকাবারই কথা।

তাহলে এবারে আমাদের নাটকের চতুর্থ অঙ্কে আসা যাক। আগেই বলেছি, এই চিঠির মধ্যে নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে, নিলোভ হারাধনের পৌত্র জগন্নাথ সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। যে রক্ত পিতামহ সুধাকণ্ঠের শরীরে ছিল, সেই রক্তই প্রবাহিত হচ্ছে জগন্নাথের শরীরের প্রতি শিরা ও ধমনীতে। এবং জগন্নাথ সেই দৃষিত রক্তের ডাকেই সাড়া দিয়েছে। হয়তো বলবেন, হারাধন ও জগন্নাথের পিতার শরীরেও তো সেই রক্তধারাই প্রবাহিত হচ্ছিল, কিন্তু তাঁর তো রক্তের ডাকে সাড়া দেননি! এবং তাঁদেরই ছেলে জগন্নাথ তবে কেন এ পথে এল? তার জবাবে আমি বলব, অনেক বংশে, কেউ পাগল থাকলে, পরবর্তী পুরুষে অনেক সময় সেই পাগলামি আবার ফিরে যেমন আসে এবং হয়ত মাঝখানে দু-একটা পুরুষ বাদ। যায়—এর বেলাতেও হয়ত তাই হয়েছে। জেনেটিকস-এ তাই বলে। যা হোক, যে লোভ হারাধন বা তাঁর ছেলেকে বিচলিত করতে পারিনি, সেই লোভের আগুনেই জগন্নাথ তার হাত দুটি পোড়াল। জগন্নাথকে প্রথম আমি কবে কেমন করে সন্দেহ করি, জানেন? রায়পুরে গিয়ে হারাধনের ওখানে যখন দুদিন কাটাই সেই সময়ে। লেখাপড়ায় জগন্নাথ ছেলেটি অত্যন্ত চৌকশ। হারাধনের মুখেই একদিন শুনেছিলাম, ছোটবেলা থেকেই একবার পড়বার বই পেলে জগন্নাথ আর কিছুই চাইত না। সেই জগন্নাথ হঠাৎ এম. এ. পড়তে পড়তে পড়াশুনা একদম ছেড়ে দিয়ে তার দাদুর অসুখের অজুহাত নিয়ে রায়পুরে এসে বসল। আর একটা জিনিস, জগন্নাথের সঙ্গে রায়পুরের স্টেট সংক্রান্ত কোনো কথাবার্তা বললেই বোঝা যায়, কি প্রচণ্ড একটা ঘৃণা সে পোষণ করে রায়পুর স্টেট ও তৎসংক্রান্ত লোকদের ওপরে।

জগন্নাথ শিক্ষিত ও মার্জিত রুচিসম্পন্ন উচ্চাকাঙ্ক্ষী তরুণ যুবক। মানুষের মনে যে ঘৃণার উদ্রেক হয় তা অনেক কারণে হয়, তার মধ্যে অন্যতম দুটি কারণ হচ্ছে, প্রথমত কোন কারণবশত হয়ত আপনাকে আমার একেবারেই পছন্দ নয়, আপনি নীচ ও জঘন্য প্রকৃতির, আমার সমকক্ষ একেবারেই নন—আপনার প্রতি সহজেই আমার একটা ঘৃণা জন্মাবে। দ্বিতীয়ত আমি আপনার সমকক্ষ নই, আমার সকল প্রকার ধরা-ছোঁয়া ও নাগালের বাইরে আপনি, অথচ সর্বদা আমি অনুভব করছি, আমাদের পরস্পরের মধ্যে যে বৈষম্য, সেটা নিছক ভাগ্যদোষে হয়েছে। আপনি আমার চাইতে কোনো অংশে শ্রেষ্ঠ নন—তথাপি আপনার নাগাল পাবার আমার উপায় নেই। এবং এই যে ব্যর্থতা সর্বদা আমায় পীড়ন করছে, এই ব্যর্থতা হতেই ক্রমে আপনার প্রতি আমার একটা ঘৃণার ভাব আসতে পারে এবং তখন কেবল এই কথাটাই আমি ভাবব, আমাদের পরস্পরের মধ্যে যদি কোনো পার্থক্যই হওয়া উচিত নয়, তথাপি আপনি আমার নাগালের বাইরে। এ অবিচার, এ অন্যায়। এই ধরনের ঘৃণা হতে অনেক সময় মানুষ ঘৃণার ব্যক্তিকে খুন পর্যন্ত করতেও পশ্চাৎপদ হয় না। জগন্নাথের অন্তরে এই দ্বিতীয়োক্ত ঘৃণাই প্রবল হয়ে উঠেছিল রায়পুরের রাজবাটীর সকলের বিরুদ্ধে।

হারাধনের মুখেই আমি শুনেছি, বর্তমানে হারাধনের যা সঙ্গতি আছে, তাতে সহজভাবে জগন্নাথের জীবন চলে যেতে পারে। কিন্তু জগন্নাথের মনে ছিল আরও উচ্চাশা। আমি আরও জানতে পেরেছি, ভাগ্যক্রমে নয়ই বরং বলা চলতে পারে একান্ত দুভাগ্যক্রমে, মৃত ছোট কুমার সুহাসের সঙ্গে একই কলেজে একই শ্রেণীতে জগন্নাথ পড়ত। লেখাপড়ায় সুহাসের চাইতে জগন্নাথ অনেক শ্রেষ্ঠ ছিল। অথচ সুহাসের পক্ষে যে প্রাচুর্যতা সম্ভবপর ছিল, জগন্নাথের পক্ষে সেটা ছিল দুঃসাধ্য। কারণ হারাধনের এত পয়সা নেই যে জগন্নাথকে সুহাসের মত সমানভাবে মানুষ করেন। সুহাসের বিলাত যাওয়ার সব ঠিক হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু জগন্নাথ হারাধনের কাছে সে প্রস্তাব করায়, হারাধন স্পষ্টই তার অসামর্থ্যের কথা জানিয়ে দেন। কোনো একদিন গল্পের ছলে হারাধন জগন্নাথকে শ্ৰীকণ্ঠের উইলের কথা বলেছিলেন। সেই গল্প শোনার পর হতেই হয়ত জগন্নাথের অবচেতন মনে একটা প্রবল ঘৃণা জন্ম নেয়। এবং হয়ত মনে হয়েছে, তার সৌভাগ্যক্রমে আজ যে বস্তুটা পেয়ে সুহাস ভাগ্যবান, দুর্ভাগ্যক্রমে তা হতে বঞ্চিত হয়ে জগন্নাথ নিজে ব্যর্থ ও ভাগ্যহীন। এবং ক্রমে যত দিন যেতে থাকে, নানা ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সেটা জগন্নাথের মনে আরো প্রকট হয়ে উঠতে থাকে। সেই অবিশ্রাম ঘৃণার ছিদ্রপথেই জগন্নাথের দেহে শনি প্রবেশ করে। যে অর্থে সম্ভাবনা তার হাতে এসেও ফসকে গেছে দুর্ভাগ্যক্রমে, সেই অর্থকে করায়ত্ত করবার জন্য সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়। গোপনে সে নৃসিংহগ্রামে গিয়ে সেইখানকার পুরাতন ভৃত্য দুঃখীরামকে অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে হাত করে।

সুরেন চৌধুরী যে নৃসিংহগ্রামের কাছারী-বাড়ির গুপ্তকক্ষে শিবনারায়ণের হাতে বন্দী হয়ে আছে সে সংবাদ দুঃখীরাম অর্থের বিনিময়ে জগন্নাথকে সরবরাহ করে। ধূর্ত জগন্নাথ তখন আর এক চাল চালে। সুবিনয় মল্লিককে সেই সংবাদ দিয়ে তাকে ব্ল্যাকমেল করতে মনস্থ করে। এবং তার পূর্বে সেই সংবাদের সত্য-মিথ্যা যাচাই করবার জন্যই জগন্নাথ নৃসিংহগ্রামে গিয়ে হাজির হয়। দুর্ভাগ্যবশত আমার নির্দেশমত সুব্রত তখন নৃসিংহগ্রামে উপস্থিত এবং সেও তখন সুরেনের অস্তিত্ব গুপ্তকক্ষে টের পেয়েছে।

জগন্নাথকে গুপ্তকক্ষের দরজার সামনে ছেড়ে দিয়ে দুঃখীরাম বিদায় নেয়। সুব্রত গুপ্তকক্ষে উপস্থিত। জগন্নাথকে নৃসিংহগ্রামে কাছারী-বাড়ির গুপ্তকক্ষে দেখে সুব্রত বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। ঠিক সেই সময়ে শিবনারায়ণও সেই কক্ষে গিয়ে প্রবেশ করল। ভেবে দেখুন নাটকের কত বড় ক্লাইমেক্স!

কূটচক্রী শিবনারায়ণ জগন্নাথকে অমনি আকস্মিকভাবে পাতালঘরে আবির্ভূত হতে দেখে কি ভেবেছিল তা সে-ই জানে, তবে সুব্রতর জবানীতে সেই মুহূর্তে শিবনারায়ণের কথা শুনে এইটেই মনে হয় যে, ব্যাপারটা শিবনারায়ণেরও ধারণার অতীত ছিল।

ধূর্ত শিবনারায়ণ সহসা ঐ মুহূর্তে জগন্নাথকে দেখে হয়ত ভেবেছিল, জগন্নাথ সুবিনয়েরই নিযুক্ত চর। এবং ঐ সময়কার শিবনারায়ণের কথাবার্তা শুনে মনে হয়, জগন্নাথের আসল পরিচয়ও যেমন সে জানত না, তেমনি জগন্নাথের ঐভাবে ঐ ঘরের মধ্যে আবির্ভাবের উদ্দেশ্যটাও বুঝে উঠতে পারেনি। চোরের মন বোঁচকার দিকেই থাকে সর্বদা, এতে আশ্চর্য হবার তেমন কিছুই নেই। ব্ল্যাকমেল করে দীর্ঘকাল ধরে শিবনারায়ণও যে সুবিনয়ের কাছ হতে কত টাকা নিয়েছে কে বলতে পারে! এতদিন সে নিশ্চিন্তই ছিল, কিন্তু হঠাৎ জগন্নাথকে দেখে মনে হয়েছিল হয়ত তার দিন ফুরিয়েছে।

জগন্নাথ ঠিক কেন ঐরাত্রে পাতালঘরে গিয়ে প্রবেশ করে তা সঠিকভাবে বোঝ না গেলেও, একটা মীমাংসায় হয়তো অনায়াসেই আমরা আসতে পারি। সেটা হচ্ছে এই, জগন্নাথ নিশ্চয়ই জানত না সুব্রত পাতালঘরের সন্ধান পেয়েছে ইতিপূর্বে এবং সেখানে সুরেন চৌধুরীর অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে পেরেছে। এবং এও হয়ত সে-কারণেই জানত না, ঠিক ঐ রাত্রে ঐ সময় শিবনারায়ণ ও সুব্রত পাতালঘরেই আছে। আমার ধারণা অবিশ্যি ভুলও হতে পারে, জগন্নাথ ঐ রাত্রে দুঃখীরামের সাহায্যে পাতালঘরে প্রবেশ করেছিল, সবার অলক্ষ্যে সুরেন চৌধুরীকে পাতালঘর থেকে সরিয়ে অন্যত্র কোথাও নিয়ে যাবার জন্য। এবং একবার সুরেন চৌধুরীকে সরিয়ে নিজের মুঠোর মধ্যে আনতে পারলে, তারপর সে নিশ্চিন্ত হয়ে নিজের প্ল্যান-মাফিক কাজ করতে পারবে।

আমার ধারণা, এই বিচিত্র হত্যা-নাটকের চতুর্থ অঙ্কই হচ্ছে শ্রীমান জগন্নাথের প্ল্যান বা পরিকল্পনা। আপনি হয়ত জানেন, আমরা অনেক সময় আমাদের সৎপ্রণোদিত কাজের মধ্য দিয়েও অন্যের সর্বনাশ ডেকে আনি। এক্ষেত্রে রাজা শ্রীকণ্ঠ মল্লিকও তাই করেছিলেন।  পূর্বপুরুষের, বিশেষ করে জন্মদাতা পিতার অন্যায়ের প্রতিকারের জন্য তিনি পরবর্তী জীবনে যে শেষ উইলটি করেছিলেন, যার ফলে এতগুলো নির্মম হত্যা একটার পর একটা হয়ে গেল, সেই উইলই হল কাল।

রাজা শ্রীকণ্ঠ মল্লিক যদি হত্যার কিছুদিন পূর্বে দ্বিতীয় উইলটি না করতেন, হারাধনের পৌত্র জগন্নাথকে এভাবে রায়পুরের মাকড়সার জালের মধ্যে জড়িয়ে পড়তে হত না। আমার অনুমান মাত্র, কারণ জগন্নাথ আর ইহজগতে নেই। নির্মম নিয়তির অমোঘ বিধানে সে তার দুর্নিবার লোভের উপযুক্ত মাশুলই কড়ায়-গণ্ডায় বোধ হয় শোধ করে গেছে। নাহলে একবার ভেবে দেখুন, কী তার অভাব ছিল! তার পিতামহ হারাধন মল্লিক যা রেখে যেতেন মৃত্যুর পর, জগন্নাথের বাকি জীবনটা সুখে-স্বচ্ছন্দেই কেটে যেত। কোনো আর্থিক অভাবই তার হত না কোনোদিন। তাছাড়া তার ভাগ্যে যদি রায়পুরের সম্পত্তি-লাভ থাকতই, তবে মৃত্যুর পূর্বে রত্নেশ্বর ওভাবে তাঁর পুত্রদের বঞ্চিত করে যাবেনই বা কেন? যে ধনে তার সহজ দাবি ছিল, সে ধন হতে কেন সে বঞ্চিত হবে? তাই মনে হয়, এ বিধাতার অভিশাপ ছাড়া আর কি! তাই সন্তুষ্ট সে হতে পারল না এবং মরীচিকার পশ্চাতে ছুটে গেল। পিতামহের স্নেহের নীড় থেকে ছুটে গেল আলোকশিখালোভী পতঙ্গের মত; হতভাগ্য ছুটে গেল কোথায়–না নৃসিংহগ্রামের পাতালঘরে! ভেবে দেখুন লোভের কি নির্মম প্রায়শ্চিত্ত! কী করুণ মৃত্যু!

অভিশপ্ত এই রায়পুর স্টেট ও তার বিশাল ধনসম্ভার। রাজা রত্নেশ্বর, রাজা রসময়, রাজা শ্রীকণ্ঠ, সুহাস মল্লিক, নিশানাথ মল্লিক, সতীনাথ লাহিড়ী, জগন্নাথ মল্লিক একের পর এক নিষ্ঠুরভাবে নিহত হয়েছেন এবং শিবনারায়ণ আজ বদ্ধ উন্মাদ। রাজা সুবিনয়। ধর্মাধিকরণের বিচারের অপেক্ষায়। সত্যি এ ধরনের জটিল ও নৃশংস হত্যার মামলায় ইতিপূর্বে আমি হাত দিইনি জাস্টিস মৈত্র!

জগন্নাথ পরিকল্পনা করেছিল হয়ত সুরেন চৌধুরীকে পাতালঘর থেকে উদ্ধার করে নিজের কাছে রেখে কৌশলে ভীতিপ্রদর্শন করে একই সঙ্গে রাজা সুবিনয় মল্লিক ও শিবনারায়ণের নিকট থেকে অর্থশোষণ করবে। একেবারে সাদা কথায় যাকে বলে black-mailing! এবং হয়তো অর্থশোষণ করাই তার ইচ্ছা ছিল, কেননা জগন্নাথ জানত সুবিনয়ের নিকট থেকে সম্পত্তির ভাগ পাওয়া সুদূরপরাহত। যে নিজের ভাইকেও, যাকে শিশুকাল হতে দেখে আসছে, ঐ সম্পত্তির জন্য অকাতরে খুন করতে পারে–আর যাই সে দিক সম্পত্তির ভাগ নিশ্চয়ই দেবে না! জগন্নাথের প্রয়োজন যখন অর্থের, তখন যে উপায়েই থোক অর্থ পেলেই হল— তা সে সম্পত্তি-প্রাপ্তির মধ্য দিয়েই হোক বা অন্য কোন পথে অর্থপ্রাপ্তির মধ্য দিয়েই হোক।

এখন কথা হচ্ছে, জগন্নাথের হঠাৎকেন সন্দেহ হয় যে সুরেনচৌধুরী আজও মরেননি—বেঁচে আছেন এবং হয়ত নৃসিংহগ্রামের পুরাতন প্রাসাদেই কোথাও-না-কোথায়ও আছেন। আমার ধারণা জগন্নাথ কোনক্রমে ব্যাপারটা নৃসিংহগ্রামের কাছারীর শিবনারায়ণের ভৃত্য দুঃখীরামকে টাকা খাইয়ে তাকে হাত করেই জেনেছিল। এবং যখন সে-কথা সে জানতে পারল, তখন তার মত বুদ্ধিমান ছেলে সহজেই অনুমান করতে পেরেছে, কেন শিবনারায়ণ সুরেন চৌধুরীকে গুম করে রেখেছে ঐ নৃসিংহগ্রামের প্রাসাদের কোন এক গুপ্তকক্ষে। আরও বিশদভাবে ব্যাপারটা আপনাকে বুঝতে হলে এবার তাহলে কিছুক্ষণের জন্য আবার আমাকে নাটকের তৃতীয় অঙ্কে ফিরে যেতে হয়।

২.১৫ কিরীটীর ডাইরী

সুব্রতর ইচ্ছা, এখানে আমার ডাইরীর কয়েকটা পৃষ্ঠা পড়ে দেখুন, তাই সে আমার ডাইরী। থেকে খুব যত্ন সহকারে নকল করে দিয়েছে।

১৩ই ফেব্রুয়ারী…

কলকাতা শহরে শীতটা কি এবারে কিছুতেই যাবে না নাকি! ফেব্রুয়ারী মাসের মাঝামাঝি, এসময়টা কলকাতায় তেমন শীত থাকে না। কেবল একটা কোমল ঠাণ্ডার আমেজ থাকে মাত্র। শেষরাত্রের দিকে গায়ে চাদরটা টেনে দিতে বেশ আরাম লাগে। গতকাল সুরেন চৌধুরীকে সঙ্গে করে নিয়ে কলকাতায় ফিরে এসেছি। দীর্ঘকাল ধরে অন্ধকার পাতালঘরের মধ্যে একাকী বন্দী থেকে থেকে ভদ্রলোকের মাথার একটু গোলমাল হয়েছে যে সে বিষয়ে সন্দেহই নেই। মাথাখারাপের আর দোষ কি! ঐভাবে ছাব্বিশ বছর আমাকেও যদি কেউ আটকে রাখত, তবে আমিও নির্ঘাৎ পাগল হয়েই যেতাম। সুব্রতকে সুহাসিনী দেবীর কাছে পাঠিয়েছি। বলেছি কোন কথাই যেন সে আগে সুহাসিনী দেবীকে না বলে। কে জানে, এত বড় আনন্দ তিনি। সহ্য যদি না করতে পরেন!

১৪ই ফেব্রুয়ারী…

কথাগুলো আমি হুবহু তুলে দিচ্ছি।

রাত্রি নটা।

সুহাসিনী দেবী ধীর শান্ত পদে ঘরে এসে প্রবেশ করলেন, আমাকে আপনি ডেকেছেন মিঃ রায়?

বসুন, মা। আপনার সঙ্গে আমার প্রয়োজনীয় কয়েকটা কথা আছে। সেদিন রাত্রে আচমকা যখন আপনি আমার এখানে এসে আপনার একমাত্র ছেলেকে উদ্ধারের জন্য অনুরোধ করলেন, তখন অপনার মুখে সমস্ত কাহিনী শুনে কেমন যেন আমার একটা ধারণা হয়েছিল, বোধ হয় সত্যিই আপনার পুত্র নিদোষ!

তবে কি–

ভয় নেই মা, সত্যিই আপনার ছেলে সম্পূর্ণ নির্দোষ। আপনার হয়ত মনে থাকতে পারে, সেরাত্রে বিদায়ের পূর্বমুহূর্তে আপনাকে আমি কোন আশ্বাস দিইনি, কেবলমাত্র এইটুকুই বলেছিলাম, সত্যিই যদি আপনার ছেলে নিদোষ হয়, তবে যেমন করেই হোক তাকে আমি মুক্ত করে আনব। এবং তা যদি না পারি তাহলে জানবেন, সে কাজ স্বয়ং কিরীটীরও সাধ্যাতীত ছিল। যা হোক, প্রমাণ পেয়েছি আপনার ছেলে সত্যিই নির্দোষ। কেবল তার স্বকীয় মৃতার জন্যই এ দুভোগ তাকে ভুগতে হল।

ভদ্রমহিলা উঠে দাঁড়িয়ে আমার হাত চেপে ধরলেন, সত্যি! সত্যি বলছ বাবা সে নির্দোষ? তাকে তুমি বাঁচাতে পারবে তাহলে?

সে যে নিদোষ সেটা আমি প্রমাণ করব, তবে আসলে তাকে মুক্তি দিতে পারেন তাঁরাই, যাঁরা তার একদিন বিচার করেছিলেন। যাঁদের হাতে আইনের ক্ষমতা দেওয়া আছে, একমাত্র তারাই। তবে সে ব্যবস্থাও আমি করেছি।

ভদ্রমহিলার দুটি চক্ষু দিয়ে দরদর ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল, বাবা, কি বলে যে তোমায় আশীবাদ করব জানি না। ভগবান তোমার মঙ্গল করবেন।

কিন্তু মা, যেজন্য আজ রাত্রে এখানে আপনাকে কষ্ট করে আসতে বলেছি, সে কথা এখনও আমার বলা হয়নি। সত্যিই এতকাল পরে ভগবান আপনার দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন। কিন্তু অভাবনীয়কে সহ্য করবার মত,অচিন্তনীয় আনন্দকে সহ্য করবার মত সাহস ও ক্ষমতা এখন আপনার চাই। এমন একটি মুহূর্ত আজ এতদিন পরে আপনার জীবনে এসেছে, যেটা আপনার কল্পনারও অতীত ছিল।

তুমি যে কী বলছ বাবা, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না!

মা, তবে শুনুন, এতক্ষণ আপনাকে বৃথা স্তোকবাক্য দিয়ে এসেছি। আমার অক্ষমতার জন্য সত্যিই আমি নিজে অত্যন্ত লজ্জিত। আমাকে ক্ষমা করতে পারবেন কিনা জানি না, আপনার ছেলেকে বাঁচাতে পারলাম না। সে গতকাল আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল লজ্জায় ঘৃণায়, জেলের মধ্যেই।

অ্যাঁ, সে কি!

বসুন মা, ব্যস্ত হবেন না, এখনও সে বেঁচে আছে।

তবে–

তবে জন্ম-মৃত্যুর কথা তো কেউ বলতে পারে না। কিন্তু তার এ অবস্থার জন্য দায়ী কতকটা আপনিই।

তার এ অবস্থার জন্য দায়ী আমি!

হ্যাঁ। কেন আপনি এতদিন ধরে তার সঙ্গে একটিবারও দেখা করেননি? কেন? চুপ করে রইলেন কেন, বলুন? আপনি তাকে তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা করতে পারেননি, এইজন্যই না? আপনার অজ্ঞাতে সে সুহাসদের ওখানে গিয়েছিল এবং সুহাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করেছিল, এইজন্যই না? আপনি না মা! সন্তানের এ সামান্য অপরাধটুকুও ক্ষমার চোখে দেখতে পারেননি?

না না, সেজন্য নয়, কোন্ মুখ নিয়ে আবার আমি তার সঙ্গে গিয়ে দেখা করব? চিরজীবনের জন্য কারাগারের অন্তরালে দিন কাটাতে চলেছে, মা হয়ে কেমন করে তার সে ব্যােকাতর মুখখানি দেখব, শুধু এইজন্য তার সঙ্গে আমি দেখা করিনি। মা হয়ে সন্তানকে চিরবিদায় দিতে পারিনি। কিন্তু সেও আমায় বুঝল না! ঠিক আছে, আমি যাব—তার সঙ্গে আমি দেখা করতে যাব।

সুব্রত নিয়ে এস ওঁকে।

সুব্রতর সঙ্গে সঙ্গে সুরেন চৌধুরী এসে প্রবেশ করলেন।

সুরেন চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে সুহাসিনী কিংকর্তব্যবিমূঢ়। যেন তিনি ভূত দেখবার মতই। চমকে ওঠেন, কে! কে! তুমি কে!

সুহাসিনী, আমায় চিনতে পারছ না? আমি সুরেন।

তুমি—তুমি বংশপত্রের মতন সুহাসিনী কাঁপছেন।

আমি মরিনি সুহাস! বেঁচে আছি!

বসুন মা, সোফাটার ওপরে বসুন।

এ কি আমি স্বপ্ন দেখছি! সুহাসিনী ধপ্ করে সামনের সোফার ওপর বসে চোখ বুজলেন।

আরও আধ ঘণ্টা পরে।

মা, এত বড় আনন্দটাকে আপনি হঠাৎ যদি সহ্য করতে না পারেন, তাই আপনার ছেলে সম্পর্কে একটা মিথ্যা কথা বলে আপনাকে আঘাত দিয়েছিলাম। আপনার পুত্র সম্পূর্ণ সুস্থ।

সন্তানের অপরাধ নেবেন না মা।

নাটক যদি এখানেই শেষ হত!

বাইরে কার মৃদু পায়ের শব্দ শোনা গেল, কে?

রাণী মালতী দেবী নিঃশব্দে এসে ঘরে প্রবেশ করলেন।

রাণীমা! আসুন। আমি আহ্বান জানালাম, বসুন।

রাণীমা নির্দেশমত সোফার ওপরে উপবেশন করলেন।

লক্ষ্য করেছিলাম, রাণীমা ঘরে প্রবেশ করবার সঙ্গে সঙ্গেই সুহাসিনী দেবী মুখটা ফিরিয়ে নিলেন। সুহাসিনী দেবীর মনের মধ্যে তখনও আলোড়ন চলছে।

মা, এদিকে ফিরে তাকান। মুখ ফিরিয়ে থাকলে চলবে না। এঁকে আপনি চেনেন কিনা জানি না, হয়তো চেনেন, ইনিই মৃত সুহাসের জননী, রায়পুরের রাণীমা মালতী দেবী। ভাগ্যবিড়ম্বনায় আজ এঁরই একমাত্র পুত্রহন্তারূপে আপনার একমাত্র পুত্র যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে দণ্ডিত। অথচ যাদের কেন্দ্র করে এত বড় নির্মম ঘটনাটা গড়ে উঠল, তাদের সৌহার্দ্য ও প্রীতি অতুলনীয়। তাদের মধ্যে একজন আজ মৃত। সেইজন্যই আমার আজ অনুরোধ, আপনারা পরস্পর পরস্পরের দোষ-ত্রুটি ভুলে গিয়ে আপনাদের পুত্রের পরস্পরের ভালবাসার স্মৃতিকে চিরদিন বাঁচিয়ে রাখুন।

ইনি কে কিরীটীবাবু? মালতী দেবী সুরেন্দ্র চৌধুরীকে নির্দেশ করে প্রশ্ন করলেন।

এঁর পরিচয় আপনাকে দেওয়া হয়নি রাণীমা, ইনি ডাঃ সুধীন চৌধুরীর পিতা সুরেন্দ্র চৌধুরী।

সে কি! তবে যে শুনেছিলাম—

হ্যাঁ, লোকে এতকাল তাই জানত বটে। ইনি আজও জীবিতই আছেন। এঁকে নৃসিংহগ্রামের পাতালঘরে গুম করে রাখা হয়েছিল।

মালতী দেবীর দু চোখের কোণ বেয়ে ঝরঝর করে অশ্রু নেমে এল।

আর আমার কোন দুঃখ রইল না কিরীটীবাবু। গরীব বাপের অনেকগুলো সন্তানের মধ্যে আমি একজন। রূপ ছিল বলেই রাজবাড়িতে আমি স্থান পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম দুঃখের বুঝি আমার অবসান হল। কিন্তু বিধাতা যার কপালে সুখ লেখেননি, তাকে সুখী কেউ করতে পারে না। আমাদের দেশে একটা প্রবাদ আছে কিরীটীবাবু, বেটে দিলেও চটে যায়—আমার কপালেও ঠিক তাই হল। সুখের চন্দনপ্রলেপ আমার কপাল থেকে শুকিয়ে ঝরে পড়ে গেল। কিন্তু সে কথা থাক। আমার সুহাস যে নিজের জীবন দিয়ে তার পিতা-প্রপিতামহের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করে গেল এবং সমস্ত অন্যায়ের মীমাংসা এমনি করে দিয়ে গেল, আজকের আমার এতবড় দুঃখেও সেইটাই সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা হয়ে রইল। বলতে বলতে সুহাস-জননী এগিয়ে এসে সুহাসিনীর হাত দুটি চেপে ধরলেন, সত্যিই এতদিনে আমার মুক্তি মিলল দিদি। তোমার স্বামীকে তুমি ফিরে পেয়েছ। তোমার ছেলেও তোমার বুকে ফিরে আসুক। আমার উপরে এবং আমার মৃত স্বামীর উপরে আর কোন ক্ষোভ রেখো না। বল রায়পুরের রাজগোষ্ঠীর সকল অপরাধই তুমি ক্ষমা করলে!

নীরবে সুহাস-জননী মালতী দেবীকে বুকের মধ্যে টেনে নিলেন।

তাঁর কণ্ঠে ভাষা ছিল না। শুধু চোখে ছিল নীরব অশ্রু। বুকের সমস্ত অকথিত ভাষাই আজ অশ্রু হয়ে ঝরে পড়তে লাগল।

এরপর মালতী দেবী আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, কিরীটীবাবু, রাত্রি অনেক হল, আমাকে আপনি কেন ডেকেছিলেন, তা তো কই বললেন না?

এইজন্যই আপনাকে ডেকেছিলাম রাণীমা।

তাহলে এবারে আমি যাই!

মালতী দেবী ঘরে হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন, রাণীর মতই মাথা উঁচু করে, মর্যাদার গৌরবে।

২.১৬ বিশ্লেষণ

জাস্টিস মৈত্র আবার কিরীটীর চিঠিতে মন দিলেন, একপাশে কিরীটীর ডাইরীর অনুলিপিগুলো সরিয়ে রেখে

কিরীটী লিখেছে :

আবার ফিরে যাওয়া যাক রায়পুর-রহস্যের মধ্যে। মালতী দেবী নিজেই বলেছেন, জানতে পারলেন গরীবের ঘরে তাঁর জন্ম। তবু রূপ ছিল বলে রাজবাড়িতে বিয়ে হল তাঁর। কিন্তু ভাগ্যদেবতা পরিহাস করলেন তাঁর সঙ্গে—রাণীর মুকুট তাঁর মাথায় পরিয়ে দিলেন বটে কিন্তু সে মুকুট ছিল দুঃখের কণ্টকে কণ্টকিত। তবু বলব বোধ হয় মালতী রাণীর একটা সহজাত গরিমা নিয়েই জন্মেছিলেন। ভেবে দেখুন শেষ পর্যন্ত তাঁর সেই আভিজাত্যবোধই তাঁকে দিয়ে সব কিছু স্বীকার করাল এবং মালতী দেবী যদি নিজ হতে আমার সামনে নিজেকে উন্মুক্ত করে না ধরতেন, তবে হয়ত রায়পুরের রহস্য এত শীঘ্র উদঘাটন করা আমার পক্ষেও সম্ভব হত না। তাঁকে আমি কোনদিনই ভুলতে পারব না। সেরাত্রে আমার বাড়ি থেকে বিদায় নেওয়ার পর আর তিনি রাজবাড়িতে ফিরে যাননি। কোথায় গেছেন কেউ তা জানে না। তবে যতদূর মনে হয় তিনি কোন তীর্থস্থানেই জীবনের বাকি কটা দিন কাটাতে চলে গেছেন হয়ত। তাঁর জীবনের শেষের দিন কটি শান্তিতে কাটুক, এই প্রার্থনাই জানাই সেই সর্বনিয়ন্তার কাছে। তাঁকে আমার প্রণাম জানিয়ে আরও একবার রহস্য বিশ্লেষণে ফিরে যাই।

আগেই বলেছি শ্ৰীকণ্ঠ মল্লিক মৃত্যুর কয়েকদিন পূর্বে যখন নৃসিংহগ্রামে যান, তাঁর ছেলে রসময়ও সেইসময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বাপ ও ছেলেতে বনিবনা আদপেই ছিল না কোনদিন। তার কারণও হয়ত রসময়ের শরীরে যে অতি সাধারণ রক্ত প্রবাহিত হয়েছিল তার দুষ্ট প্রভাব। এবং রসময় যে মুহূর্তে শুনলেন শ্রীকণ্ঠ নতুন উইল করেছেন, তিনি হয়ত ভেবেছিলেন তাঁর তখন পিতা শ্রীকণ্ঠকে হত্যা করা ছাড়া হয়ত আর দ্বিতীয় কোন পথ নেই। তাই শিবনারায়ণের সঙ্গে গোপনে চক্রান্ত করে শ্রীকণ্ঠ মল্লিককে হত্যা করা হল।

এবং নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, সম্পত্তির লোভেই রসময় তাঁর দত্তক পিতা শ্রীকণ্ঠ মল্লিককে হত্যা করতে কুণ্ঠিত হননি। সত্যিকারের পিতা ও পুত্রের মধ্যে রক্তের যোগাযোগে যে স্বাভাবিক স্নেহ ও ভালবাসা গড়ে ওঠে তার কিছুই তো ছিল না রসময় ও শ্রীকণ্ঠ মল্লিকের মধ্যে, এবং সেটা না থাকাটাই স্বাভাবিক। অবশেষে সম্পত্তি পাবার পর এবং ঐ সুবিপুল সম্পত্তি তাঁর হাতের মুঠোর মধ্যেও এসে পাছে আবার নাগালের বাইরে চলে যায় এই ভয়েই হয়ত তাঁকে শেষ মুহূর্তে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে ফেলেছিল। রসময় যদি নিজ হাতে তাঁর পিতাকে হত্যা করতেন দুষ্কর্মের কোন সাক্ষী না রেখে, তবে হয়ত বর্তমান হত্যা-মামলা অন্যপথে প্রবাহিত হত; কিন্তু তা হল না। অত বড় গহিত ও দুষ্কর্ম একাকী সাঙ্গ করবার মত মনোবল রসময়ের হয়ত ছিল না বলেই তাঁর দুষ্কর্মের সঙ্গী হিসাবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন শিবনারায়ণকে। এবং এসব ক্ষেত্রে যা হয়, শিবনারায়ণই অবশেষে ভূত হয়ে রসময়ের কাঁধে চেপে বসল, রক্ত চোষার মতই শিবনারায়ণ রসময়ের রক্ত চুষে নিতে লাগল দিনের পর দিন। এবং স্বভাবতই ক্রমশ রসময় রক্তহীন হয়ে পড়তে লাগলেন।

এমন সময়ে রঙ্গমঞ্চে এসে দাঁড়ালেন সুধীনের পিতা হতভাগ্য নির্বিরোধী সুরেন চৌধুরী।

শ্রীকন্ঠের দ্বিতীয় উইল রসময় শ্রীকণ্ঠকে হত্যার পূর্বেই সরিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, শ্ৰীকণ্ঠ দ্বিতীয়বার উইল করেছেন এ কথা রসময় জানতে পারলেন কি করে? ব্যাপারটা

তো আগাগোড়াই অত্যন্ত গোপন করা হয়েছিল সকলেই তা জানে। তবে?

দেখুন নিয়তির কি অলঙঘ্য আদেশ! নিয়তি কি নির্মম!

উইল করবার পর শ্রীকণ্ঠ যখন তাঁর স্ত্রীর কাছে সেই কথা একদিন বলেছিলেন, সেই সময় হঠাৎ রসময় সেই ঘরে গিয়ে প্রবেশ করেন এবং সব কথা তিনি জানতে পারেন।

একথাটা রসময় তাঁর মৃত্যুর কিছুক্ষণ পূর্বেই সখেদের সঙ্গে নাকি তার স্ত্রী মালতী দেবীকে বলেছিলেন।

মালতী দেবীই পরে সেকথা আমাকে বলেন। এই ব্যাপারের আগে পর্যন্ত মালতী দেবীও শ্রীকণ্ঠের দ্বিতীয় উইল সম্পর্কের বিন্দুবিসর্গও জানতেন না। আগেই বলেছি হত্যার বিষ রায়বংশের  রক্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং সেই বিষের নেশাতেই রসময় শ্রীকণ্ঠ মল্লিককে হত্যা করেন এবং সুবিনয় আবার তার পিতা রসময়কে বিষপ্রয়োগে হত্যা করেন। কারণ শ্রীকন্ঠের দ্বিতীয় উইলের কথা তিনি শুনেছিলেন। যদিও সুবিনয়ের সেই উইলটির অস্তিত্ব সম্পর্কে তাঁর কোন জ্ঞানই ছিল না। তাঁর হয়ত ভয় হয়েছিল, তাঁর পিতা না আবার বিমাতার প্ররোচনায় নতুন করে কখনও কোন দুর্বল মুহূর্তে কোন এক উইল করেন। পিতা রসময়ের চাইতে পুত্র সুবিনয় আর এক ধাপ উঠে যান। শ্রীকণ্ঠকে হত্যা করবার পর রসময় সুরেন চৌধুরীকেও ইহসংসার থেকে সরাতে মনস্থ করেন। আপদের শেষ না রাখাই ভাল, হয়ত এই নীতিই তাঁর ছিল। চিরদিনের মত সরিয়ে ফেলবার জন্যই সাদরে চাকুরি দিয়ে রসময় সুরেনকে নৃসিংহগ্রামে দেওয়ানজীর পদে এনে নিযুক্ত করলেন। এক ঢিলে দুই পাখীই মারা হল। এবং এবারেও শিবনারায়ণকেই সুরেনকে হত্যা করবার জন্য নিযুক্ত করলেন। শিবনারায়ণ হয়ত এবারে দেখলে, বার বার এইভাবে টাকার লোভে হত্যা করবার মধ্যে প্রচুর বিপদের সম্ভবনা আছে, তাই সে এবারে রসময়ের উপরেও এক হাত নিল।

সুরেনকে হত্যা না করে তাঁকে গুম করে ফেললে এবং শ্রীকণ্ঠকে হত্যা করবার সময় যে কর্মচারীটি তার দক্ষিণ হস্তস্বরূপ ছিল, তাকেই হত্যা করে হত্যার পর চেহারার বিকৃতি ঘটিয়ে সুরেনের মৃতদেহ বলে চালিয়ে দিল। এবং সুরেনের মৃত্যু (?) রটনার সঙ্গে সঙ্গে শিবনারায়ণ আবির্ভূত হল রঙ্গমঞ্চে এবারে। এতদিন ছিল লোকচক্ষুর অন্তরালে, এবারে প্রকাশ্যে রসময়ের সাহায্যে নৃসিংহগ্রামে নায়েবীর গদীতে উপবেশন করে তার আসল খেলা শুরু করল।

শিবনারায়ণ সুরেনকে একেবারে হত্যা না করে কেন গুম করে রাখলো তা নিয়ে আগেই আলোচনা করেছি।

শিবনারায়ণের সঙ্গে যদি কোনদিন দেখা করতে পারতাম তবে এই ব্যাপারের একটা খোলাখুলি আললাচনা করতে পারতাম, কিন্তু ঘটনাচক্রে তা তো হয়ে উঠল না, তাই বর্তমানে হত্যা-রহস্যের মীমাংসার ব্যাপারে যে explanationটা মনে মনে আমি দাঁড় করিয়েছিসেটাই এবার আলোচনা করব। ইচ্ছা হলে আপনি সেটা গ্রহণ করতে পারেন, না হলে ভুলেও যেতে পারেন, কারণ বর্তমান মূল ঘটনার মীমাংসার ব্যাপারে উক্ত ঘটনাটা একেবারে বাদ দিলেও হতভাগ্য সুধীন চৌধুরীর মুক্তির কোন বাধা থাকবে বলে আমার মনে হয় না।

আমার মনে হয় শিবনারায়ণের কাছে অর্থটাই ছিল সব চাইতে বড় জিনিস, তার পূর্ববর্তী জীবনকে পর্যালোচনা করলেও সেই কথাটা বেশী করে এক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলেই মনে হবে।

শিবনারায়ণ লোকটা ছিল যেমন প্রচণ্ড নৃশংস, তেমনি ভয়ঙ্কর অর্থপিশাচ, অথচ সুবিনয়ের চাইতে ঢের বেশী বুদ্ধি রাখত সে।

রসময়ের সহকারীরূপে সে শ্ৰীকণ্ঠ মল্লিককে হত্যা করতে এতটুকু দ্বিধা করেনি, এবং নিজেকে বাঁচাবার জন্যই সে নিজহাতে শ্ৰীকণ্ঠ মল্লিককে হত্যা না করে অন্যের দ্বারা হত্যা করিয়েছিল। তারপর রসময় যখন সুরেনকে আবার হত্যা করবার জন্য মনস্থ করলে, তখনও সে রসময়কে সাহায্য করতে দ্বিধাবোধ করেনি বিন্দুমাত্রও। শিবনারায়ণ ইতিমধ্যে সুবিনয়ের সঙ্গেও বেশ জমিয়ে নিয়েছিল। সে দেখলে রসময়ের দিন ফুরিয়ে এসেছে, ভবিষ্যতে গদীতে বসবে সুবিনয় মল্লিক, সুবিনয়কে হাতে রাখতে পারলে ভবিষ্যতে সুবিনয়কেও অনায়াসেই দোহন করা চলতে পারে। তাই হয়ত সে সুরেনকে প্রাণে একেবারে না মেরে গুম করে ফেলবার মনস্থ করলে, অবিশ্যি আগেই বলে নিয়েছি এটা আমার একটা অনুমান মাত্র।

সুরেন চৌধুরীকে হত্যার অভিনয় করে এক ঢিলে চতুর-চুড়োমণি শিবনারায়ণ দুই পাখি মারল। এখানে একটা কথা মনে হওয়া স্বাভাবিক, গুপ্তকক্ষের সংবাদ শিবনারায়ণ কেমন করে পেল? এক্ষেত্রেও আমার মনে হয়, প্রথমে হয়ত সে সুরেনকে অন্য কোথাও লোকচক্ষুর অন্তরালে বন্দী করে রেখেছিল, পরে নৃসিংহগ্রামে নায়েবী পদে অধিষ্ঠিত হয়ে গুপ্তকক্ষের সন্ধান পায় কোন উপায়ে এবং সেখানে সুরেনকে বন্দী করে রাখে।

শিবনারায়ণ শ্রীকণ্ঠকে নিজহাতে হত্যা না করলেও, হত্যায় সাহায্য সে করেছিল, হত্যার সাহায্যকারী হিসাবে সে অপরাধী এবং murder or abattement of murder বস্তুত অপরাধটা একই শ্রেণীর। দণ্ড মুকব হয় না। শ্ৰীকণ্ঠর হত্যার ব্যাপারে রসময়ই একমাত্র সাক্ষী বেঁচে তখনও, প্রধান সাক্ষীকে তো আগেই সে শেষ করে ফেলেছিল। যা হোক নির্বিঘ্নে রসময়কে পৃথিবী হতে সরানো হল বিষপ্রয়োগে। হতভাগ্য সুবিনয় নিজের অজান্তেই শিবনারায়ণের মুঠোর মধ্যে এসে ধরা দিলেন।

এতদিনে সুবিনয়ের পীত বিষের ক্রিয়া শুরু হল।

আবার একটা কথা এসে পড়ছে, সুবিনয় কি জানতেন সুরেন চৌধুরী আসলে নিহত হননি? আমার কিন্তু মনে হয়, হ্যাঁ, তিনি এ কথা বোধ হয় জানতে পেরেছিলেন। কিন্তু জানতে পারলে কি হবে, তাঁর তখন সাপের ছুঁচো গেলবার মত অবস্থা অনেকটা। এবং সম্ভবত দুটি কারণে সুবিনয় মুখ খুলতে পারেননি। প্রথমত এতদিন পরে যদি লোক জানতে পারে আসলে সুরেন চৌধুরী মরেননি, তাহলে মল্লিকবংশের সম্মান গৌরব সব ধূলায় লুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয়ত এই রহস্যের উদঘাটনের সঙ্গে সঙ্গে বংশের অনেক কলঙ্ক-কাহিনীই আর চাপা থাকবে না। এবং এ কথাও সেই সঙ্গে প্রমাণিত হবে রসময়ই শ্ৰীকণ্ঠ ও সুরেনের হত্যার উদ্যোক্তা। কাজেই বেচারাকে চুপ করে বিষ হজম করতে হয়েছে।

জাস্টিস মৈত্র যেন অবাক হয়ে যান। একটা কঠিন রহস্যের গোলকধাঁধায় যেন কিরীটী তাঁকে ঘুরিয়ে নিয়ে চলেছে। সত্যি, এ রহস্যের কিনারা কোথায়? ভাবেন কেমন করেই বা কিরীটী কঠিন রায়পুর হত্যারহস্যের মীমাংসায় গিয়ে পৌঁছাল? কোন্ পথ ধরে? অদ্ভুত বিচার-বিশ্লেষণ শক্তি লোকটার!

দীর্ঘদিন ধরে বিচারালয়ে বাদী ও বিবাদী পক্ষের জেরা ও জবানবন্দি নিয়ে এতগুলো লোকের সম্মিলিত বিচারশক্তি দিয়ে যে অপরাধের মীমাংসায় পৌঁছনো গেল, অলক্ষ্যে যে তার মধ্যে এত বড় গলদ থেকে গেল দৃষ্টি এড়িয়ে, ব্যাপারটা শুধু আশ্চর্যই নয় অভূতপূর্ব যেন।

ডাঃ সুধীন চৌধুরী সুহাস মল্লিকের হত্যাকারী নয়?

সত্যি মানুষের সাধারণ বিচারবুদ্ধি বাইরেও যে কত অমীমাংসিত জিনিস থেকে যায়, ভাবতেও আশ্চর্য লাগে!

প্রমাণ—প্রমাণই আমাদের বিচারে সব চাইতে বড় কথা।

মন যেখানে বলছে সেটা সত্যি নয়, ভুল, মিথ্যা—সেখানেও তো নিছক আমাদের মনগড়া কতকগুলো প্রমাণের দোহাই দিয়েই কত সময় আমরা আমাদের বিচারের মীমাংসা করে নিই।

বিবেক বলে কি তবে কিছুই নেই? মানুষের মন হল মিথ্যা, আর সামান্য প্রমাণই হল সত্যি?

জাস্টিস মৈত্র আবার কিরীটীর চিঠিতে মনঃসংযোগ করেন। রসময়ের রক্তের সঙ্গেই রায়-গোষ্ঠীতে এসেছিলবেনোজল। এবারে আবার সেইবেনোজলের স্রোতে ফিরে আসা যাক!

রসময়ের মৃত্যুর পর সুবিনয় মিল্লক গদীতে আসীন হলেন।

কিন্তু যে অর্থের লালসায় তিনি তাঁর জন্মদাতা পিতাকেও বিষপ্রয়োগে হত্যা করতে পর্যন্ত দ্বিধা করেননি, এবার সেই লালসার মুখে বাধা হল তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই হতভাগ্য সুহাস। সুহাস অন্ধের মত তার দাদাকে যতই ভালবাসুক না কেন, সুবিনয়ের মনে সুহাসের জন্য এতটুকু স্নেহও হয়ত কোথাও ছিল না। ছোটবেলা থেকেই সুবিনয় সুহাসকে সম্পত্তির ভাগীদার হিসাবে দেখে এসেছে। ক্রমে সেটাই প্রবল হিংসায় পরিণত হয়। এবারে সুবিনয় সুযোগের সন্ধানে ফিরতে লাগলেন, কি করে সকলের সন্দেহ বাঁচিয়ে সুহাসকে তাঁর পথ হতে সরাবে ঐ চিন্তাই হল তাঁর আসল চিন্তা। ঐভাবেই সুহাসের হত্যারহস্যের হল গোড়াপত্তন। অতীত থেকে আমরাও এবারে ফিরে যাব বর্তমান রায়পুর হত্যা-মীমাংসায়।

 ২.১৭ মীমাংসা

কিরীটীর চিঠি,–

রসময়ের মৃত্যুর পর সুবিনয় অল্পদিনের মধ্যেই জমিদারী সেরেস্তায় আমূল পরিবর্তন ঘটান।

প্রথমেই আনলেন তিনি সতীনাথ লাহিড়ীকে। তারপর হাত করলেন তারিণী চক্রবর্তীকে। এবং সর্বশেষে আমাদের ডাঃ কালীপদ মুখার্জীকে।

কালীপদ মুখার্জী একজন প্রথিতযশা চিকিৎসক। চিকিৎসক হিসাবে বহু অর্থও তিনি জমিয়েছেন। তথাপি কেন যে তিনি অর্থের লোভে নৃশংস-হত্যার মধ্যে তাঁর চিকিৎসাবিদ্যাকে জড়িয়ে নিজেকে এবং এত বড় সম্মান ও গৌরবের বস্তু চিকিৎসাশাস্ত্রকে কলঙ্কিত করলেন, তার সদুত্তর একমাত্র হয়ত তিনিই দিতে পারেন। বিচারের চোখে আজ তিনি কলঙ্কমুক্ত হলেও, মানুষ হিসাবে আমরা কেউ তাঁকে ক্ষমা করতে পারি না। সুহাসের হত্যাপরাধে যদি কারও মৃত্যুদণ্ড হয়, তবে সর্বাগ্রে তাঁরই হওয়া উচিত। কিন্তু যা সে কথা, যা বলছিলাম, টাকার লোভে ডাঃ কালীপদ মুখার্জী এসে সুবিনয়ের সঙ্গে হাত মেলালেন। প্রথমে টিটেনাস রোগের বীজাণু প্রয়োগে হত্যা করবার চেষ্টা যখন ঘটনাচক্রে ব্যর্থ হল, শয়তান ডাক্তার তখন সুহাসের শরীরে প্লেগের জীবাণু ইনজেক্ট করে হত্যা করবার মনস্থ করলেন। মুখার্জী তাঁর সহকারীও রিসার্চ-স্টুডেন্ট ডাঃ অমর ঘোষকে বম্বেতে পাঠালেন প্লেগ কালচার নিয়ে আসতে।

ডাঃ অমর ঘোষ তাঁর যে জবানবন্দি আমার কাছে দিয়েছেন তা পাঠিয়ে দিলাম।

আমি ডাঃ অমর ঘোষ স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিচ্ছি: ডাঃ মুখার্জীর অনুরোধে আমি বম্বে প্লেগ রিসার্চ ইনস্টিটিউটে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, তিনি নাকি প্লেগ ব্যাসিলি সম্পর্কে কি একটা জটিল রিসার্চ করছেন এবং তার এক টিউব প্লেগ কালচার চাই। তিনি এও আমাকে বলেন, প্লেগ কালচার নিয়ে যে তিনি কোনো রিসার্চ করছেন একথা একান্তভাবে গোপন রাখতে চান। কারণ তাঁর এক্সপেরিমেন্ট সম্পূর্ণ হওয়ার আগে এ কথা কেউ জানুক এ তাঁর মোটেই অভিপ্রেত নয়।

রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ কর্নেল মেনন তাঁর বিশেষ পরিচিত এবং তাঁকে বললে সুবিধা হতে পারে, তথাপি তিনি তাঁকেও সে কথা বলতে চান না। আমি যদি কোন উপায়ে গোপনে একটি প্লেগ কালচার টিউব বম্বে থেকে নিয়ে আসতে পারি সকলের অজ্ঞাতে তাহলে তিনি বিশেষ বাধিত হন। শুধু যে তাঁর কথাতেই আমি রাজী হয়েছিলাম তা নয়, ঐ সময় আমার অর্থেরও বিশেষ প্রয়োজন হয়। অর্থের কোন সুরাহাই যখন করে উঠতে পারছি না, তখন একদিন হঠাৎ ডাঃ মুখার্জী আমাকে ডেকে বলেন, যদি কোন উপায়ে বম্বে থেকে একটি প্লেগ কালচার টিউব আমি এনে দিতে পারি, তিনি আমাকে নগদ পাঁচ হাজার টাকা দেবেন এবং ব্যবস্থা সব তিনিই করে দেবেন। অর্থপ্রাপ্তির আশু কোন উপায় আর না দেখে, শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রস্তাবেই আমি সম্মত হই এবং কর্নেল মেননএর কাছে তাঁর পরিচিতিপত্র নিয়ে আমি বম্বেতে রওনা হই।

সেখানে গিয়ে দিন-দশেকের মধ্যেই যে কি উপায়ে আমি একটি প্লেগ কালচার টিউব হস্তগত করি সে-কথা আর বলব না, তবে এইটুকু বলছি, একটি টিউব সংগ্রহ করে সেই রাত্রেই বম্বে মেলে আমি রওনা হই। কলকাতায় পৌঁছেই টিউবটা আমি ডাঃ মুখার্জীকে দিই, তিনিও আমায় পাঁচহাজার টাকা নগদ হাতে হাতে তখুনি দিয়ে দেন। তবে এ-কথা আমি অকপটে স্বীকার করছি, যদি আগে ঘুণাক্ষরেও আমি জানতে পারতাম কিসের জন্য ডাঃ মুখার্জী আমাকে দিয়ে প্লেগ কালচার টিউব সংগ্রহ করেছিলেন, তাহলে নিশ্চয়ই আমি এই হীন কাজে হাত দিতাম না। পরে যখন আসল ব্যাপার জানতে পারলাম, তখন আমার অনুশোচনার আর অবধি পর্যন্ত ছিল না। কিন্তু তখন নিজের মাথা বাঁচাতে সবই গোপন করে যেতে হল। পরে নিরন্তর সেই কথাটাই আমার মনে হয়েছে, ডা সুধীন চৌধুরীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের জন্য সর্বাংশে না হলেও অনেকাংশেই দায়ী আমি হয়ত। আজ তাই কিরীটীবাবুর অনুরোধে সব কথা লিখেই দিলাম। এর জন্য যে কোন শাস্তিই আমি মাথা পেতে নিতে রাজী আছি, তবু নিদোষ ডাঃ সুধীন চৌধুরী কলঙ্কমুক্ত হোন এই চাই। আজ যদি তিনি মুক্তি পান, তবে হয়ত এই মহাপাপের যার সঙ্গে পরোক্ষে আমি ভাগ্যক্রমে জড়িয়ে পড়েছি তার কিছুটা প্রায়শ্চিত্তও আমার করা হবে। ইতিডাঃ অমর ঘোষ।

ডাঃ অমর ঘোষের স্বীকৃতি পড়লেন তো! নিশ্চয়ই কাগজে দেখে থাকবেন, গত পরশু অর্থাৎ ঐ বিবৃতি দেবার দুদিন পরেই তিনি সুইসাইড করেছেন হাই ডোজে মরফিন নিয়ে। যা এখন বোধ হয় বুঝতে পারছেন, কেমন করে কি উপায়ে প্লেগ-ব্যাসিলি সংগৃহীত হয়েছিল। ডাঃ অমর ঘোষের সাহায্যে প্লেগ কালচার সংগ্রহ করে ডাঃ মুখার্জী সেই বিষ সুহাসের শরীরে প্রবেশ করালেন। কিন্তু দুঃখ এই, ডাঃ ঘোষের স্বীকৃতির পরও ডাঃ মুখার্জীকে আমরা ধরতে পারব না, কারণ যে যে পরিচিতিপত্র তিনি কর্নেল মেননকে দিয়েছিলেন সেটার অস্তিত্ত্ব আজ ইহজগতে আর নেই। সম্ভবত বহু অর্থের বিনিময়ে কর্নেল মেনন সেটাকে ভস্মীভূত করেছেন এবং আমার যথাসাধ্য চেষ্টাসত্ত্বেও সেই পরিচিতিপত্র সম্পর্কে কর্নেল মেনন তাঁর সম্পূর্ণ অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তিনি স্পষ্টই বলেছেন, কোন পত্রই তিনি নাকি ডাঃ মুখার্জীর কাছ হতে পাননি, কেবলমাত্র ডাঃ ঘোষের মৌখিক অনুরোধেই তিনি ডাঃ ঘোষকে ইনস্টিটিউটে কাজ করতে সম্মতি দিয়েছিলেন। ডাঃ ঘোষ কর্নেল মেননের কাছে এসে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, ডাঃ মুখার্জী তাঁকে প্লেগ ইনস্টিটিউটে কয়েকদিন কাজ করবার জন্য পাঠিয়েছেন। এবং কর্ণেল মেনন নাকি তাঁর বন্ধু। ডাঃ মুখার্জীর মৌখিক অনুরোধ রক্ষা করেই ডাঃ অমর ঘোষকে ইনস্টিটিউটে প্রবেশাধিকার দেন এবং রায়পুর হত্যা-মামলার জবানবন্দি দিতে গিয়ে বিচারালয়ে কর্নেল মেনন সেই কথাই বলে এসেছেন। তিনি সেদিনও যে কথা বলেছিলেন, আজও তাই বলছেন, এর বেশী তাঁর বলবার মত কিছুই নেই। এরপর আর কর্নেল মনেনকে আমি দ্বিতীয় প্রশ্ন করি নি। কারণ জানতাম, কর্নেল মেননের মত একজন সম্মানী সরকারী উচ্চপদস্থ ব্যক্তি আর যাই করুন না কেন, যে ভুল একবার করে ফেলেছেন এবং যে ভুলের আজ সংশোধন করতে গেলে তাঁর এতদিনকার সম্মান প্রতিপত্তি সব ধূলায় লুষ্ঠিত হবে সেই ভয়েই আজ তাঁকে এমনি করে সর্ব ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানাতেই হবে। তাছাড়া অর্থের লোভকে কাটিয়ে ওঠবার মত মানসিক বলও তাঁর নেই। বিদ্যা তাঁকে ডিগ্রী দিলেও বিদ্যার গৌরব দেয়নি। কর্নেল মেননের কথা এখানেই থাক।

যাহোক তাহলে এখন আমরা ধরে নিতে পারি অনায়াসেই যে, নির্বিবাদে ডাঃ ঘোষের মারফতই বম্বে থেকে এক টিউব প্লেগ কালচার ডাঃ মুখার্জীর হাতে পৌঁছেছিল।

এবারে আসা যাক—the blackman with the black umbrella-র রহস্যে। আমার মনে হয় আদালতে বিচারের সময় এই point-টাতে আপনারা তেমন গুরুত্ব দেননি। সুহাস মল্লিক যেদিন শিয়ালদহ স্টেশনে অসুস্থ হয়ে কালোলোকটির ছাতার খোঁচা (?) খেয়ে এবং আমার মতে যে সময় হতভাগ্য সুহাসের দেহে প্লেগ-বীজাণু inject করা হয়, সেদিনকার সেই ঘটনাটা যেন পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণ করা হয়নি, অর্থাৎ সেই অচেনা কালো ছত্রধারীলোকটির movement-টাযেভাবে ঠিক অনুসন্ধান করা উচিত ছিল, আদালতে সেভাবে করা হয়নি। যদিও ঐ ছত্রধারী লোকটিকে কেবলমাত্র সুহাসের হত্যা-ব্যাপারে একটা যন্ত্র হিসাবেই কাজে লাগানো হয়েছিল। এবং যদিও আসলে উক্ত লোকটি এই দুর্ঘটনায় সামান্য একটি পার্শ্বচরিত্র মাত্র, তথাপি লোকটিকে অন্তত খুঁজে বার করবার চেষ্টা করাও। আপনাদের খুবই উচিত ছিল না কি? তর্কের খাতিরেও নিশ্চয়ই এখন সেকথা অস্বীকার করতে পারবেন না, কি বলেন? কিন্তু যাক সেকথা, যা ঘটনাচক্রে হয়ে ওঠেনি, এখন আর সেটার পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়। কারণ আমাদের হত্যা-মামলার সেই রহস্যময় কালো লোকটিকে আর ইহজগতে জীবিত অবস্থায় খুঁজে পাওয়া যাবে বলে আমার মনে হয় না।

তবে সেই লোকটি, যে কালো ছাতাটি ব্যবহার করেছিল, সেটা আমি উদ্ধার করেছি। সেটা আপনাকে পাঠানো হল, পরীক্ষা করে দেখবেন।

এই ছাতার ব্যাপারেও হত্যাকারী তার অসাধারণ বৈজ্ঞানিক বুদ্ধিরই পরিচয় দিয়েছে। ছাতার একটি শিকের সঙ্গে দেখবেন চমৎকারভাবে দেখতে অবিকল প্রায় একটি ছোট হাইপোডারমিক সিরিঞ্জের মত একটা যন্ত্র লাগানো আছে। ঐ সিরিঞ্জের মত যন্ত্রের ভিতরেই ছিল সংগুপ্ত প্লেগের জীবাণু।

ওর মেকানিজম এত সূক্ষ্ম ও চমৎকার যে যন্ত্রটির শেষে ছোট যে রবারের ক্যাপটি আছে, ওতে চাপ পড়লেই যন্ত্রটি থেকে ভিতরকার তরল পদার্থ প্রেসারে বের হয়ে সিরিঞ্জের মত যন্ত্রের অগ্রভাগের সঙ্গে যুক্ত নিড-পথে বের হয়ে আসবে। ছাতাটি খুলে ভাল করে পরীক্ষা না করে দেখা পর্যন্ত এসব কিছুই কারও নজরে পড়তে পারে না।

সত্যি ঐ অত্যাশ্চর্য যন্ত্রের পরিকল্পনাকারী, আমাদের চোখে যেই হোক না কেন, I take my hats off! সংবাদপত্রে রায়পুরের হত্যা-সংক্রান্ত ঘটনাবলী পড়তে পড়তে ঐ ছাতার কথা শোনা অবধি আমার মনে একটা খটকা লেগেছিল। কেন যেন আমার মনে হয়েছিল, নিশ্চয়ই ঐ ছাতার মধ্যে কোন একটা গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে। আসলে সুহাসের হত্যার ব্যাপারে ছাতাটি প্রাইমারি, সেকেণ্ডারি ঐকালোলোকটি। রায়পুরের প্রাসাদে যে রাত্রে সুবিনয়ের কাকা শ্রীযুক্ত নিশানাথ নিহত হন সেই রাত্রে তদন্তে গিয়ে সুবিনয়ের কক্ষে প্রবেশ করে, প্রথমেই যে দুটি অন্যের দৃষ্টিতে ও বিচারে অতি সাধারণ (?) বস্তু, আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে সে হচ্ছে ১নং ছাতাটি এবং ২নং দেওয়ালে ঝোলানো একটি পাঁচ-সেলের হান্টিং টর্চ।

আপনি হয়ত এখনই প্রশ্ন করবেন, সর্বাগ্রে কেন ঐ বস্তু দুটিই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল?

তার জবাবে বলব, রায়পুরের ধনশালী ও শৌখীন রাজাবাহাদুরের শয়নকক্ষে প্রবেশ করে আর যাই লোকে আশা করুক না কেন, আলমারির মাথায় তুলে রাখা সামান্য পুরাতন একটি ছাতা দেখবার আশা নিশ্চয়ই কেউ করে না বা করতে পারে না। তাই আলমারির মাথায় রাখা ঐছাতাটি আমার দৃষ্টিকে আকর্ষণ করেছিল এবং যে বাড়ির ঘরে ঘরে ডায়নামোর সাহায্যে সারারাত্রি আলো জ্বালাবার সুব্যবস্থা আছে এবং যার কোনদিনই শিকারের কোন বাতিক বা হবি নেই, তার ঘরে হঠাৎ পাঁচ-সেলের হান্টিং টর্চের বা কি এমন প্রয়োজন থাকতে পারেতাই দেওয়ালে ঝোলানো পাঁচ-সেলের হাষ্টিং টচটাও আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। চিরদিনই কোন ব্যাপারে মনে যখন আমার বিন্দুমাত্রও সন্দেহের ছায়াপাত হয়, সে ব্যাপারের খুঁটিনাটি পর্যালোচনা করে নিজের মনকে যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি সন্তুষ্ট করতে পারি, আমি স্থির থাকতে পারি না। সে যাই হোক, মনের সন্দেহের নিরবসানের জন্যই পরের দিন সর্বপ্রথম বিকাশের সাহায্যে উক্ত বস্তু দুটি আমি রায়পুরের রাজবাটি থেকে সবার অলক্ষ্যে সংগ্রহ করে আনি। এবং আমার সন্দেহ যে অমূলক নয়, সেটাও সহজে প্রমাণিত হয়ে যায়। কি করে ছাতা আর টচটা সংগ্রহ করেছি, সে-কথা আর নাই বা বললাম। সাদা কথায় শুনিয়ে রাখি, জিনিস দুটি চুরি করিয়ে এনেছি এবং ঐ ছাতা ও টর্চের রহস্যের উদঘাটিত হবার পরই আর কালো লোকটির সন্ধানের প্রচেষ্টা ত্যাগ করি। ছাতাটি পরীক্ষা করলেই বুঝতে পারবেন, কি উপায়ে হতভাগ্য সুহাসের দেহে প্লেগ-বীজাণু প্রবেশ করানো হয়েছিল।

এবারে আসা যাক পাঁচ-সেলের হাষ্টিং টচটির কথায়। টচটি পরীক্ষা করলেই দেখতে পাবেন, টর্চের আকার হলেও আসলে ওটি টর্চ নয়। টর্চের যেখানে আলোর বা লাগোনো থাকে, সেখানে দেখুন একটি গোলাকার ছিদ্রপথ আছে। এবং বাতির পিছনকার ক্যাপটি খুলুন, দেখবেন ভেতরে একটি এক-বিঘত পরিমাণ সরু পেনসিলের মত ইস্পাতের নল বসানো আছে। ঐ জিনিসটির খোলর মধ্যে তিনটি ড্রাই সেল ভরা যায়। এবং টর্চের বোতাম টিপলেই, সেলের কারেন্টে আলো জ্বালার পরিবর্তে ঐ সরু নলের ভিতর থেকে প্রচণ্ড গতিতে একটি সরু ইস্পাতের তৈরী তীর বের হয়ে মুখের ছিদ্রপথ দিয়ে ছুটে সামনের দিকে নিক্ষিপ্ত হয়। তাই বলছিলাম, আসলে দেখতে বস্তুটি পাঁচ-সেলের একটি হান্টিং টর্চের মত হলেও, তীর নিক্ষেপের ওটি একটি চমৎকার যন্ত্রবিশেষ। এবং ঐ যন্ত্রের সাহায্যেই সতীনাথ লাহিড়ী ও নিশানাথ মল্লিককে হত্যা করা হয়েছে। ঐ ছাতা ও টর্চের উদ্যোক্তা ও পরিকল্পনাকারী হচ্ছে স্বয়ং সতীনাথ লাহিড়ী। হতভাগ্য তার নিজের মৃত্যুবাণ নিজ হাতেই তৈরী করে দিয়েছিল। সতীনাথের সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানতে পেরেছি, সতীনাথ ছিল একজন মেধাবী বিজ্ঞানের ছাত্র। সৎকাজে তার বুদ্ধিকে পরিচালিত করতে পারলে আজ দেশের অনেক উপকারই তার দ্বারা হত। কিন্তু যে বুদ্ধি ভগবান তার মস্তিষ্কে দিয়েছিলেন, তার অপব্যবহারেই তার অকাল মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে তার প্রতিভার শোচনীয় পরিসমাপ্তি ঘটালো।

সতীনাথের জীবনকথা সংগ্রহ করে আমি যতটুকু জেনেছি তা এই ছোটবেলা হতেই নাকি সতীনাথের সায়েন্সের দিকে প্রবল একটা ঝোঁক ছিল। নানাপ্রকারের যন্ত্রপাতি নিয়ে প্রায় সময়ই সে নাড়াচাড়া করত। লাহিড়ী একটা ছোটখাটো ইলেকট্রিক কারখানা করে চেতলা অঞ্চলে কাজ করত। একবার মধ্যরাত্রে ঐ কারখানার সামনে হঠাৎ সুবিনয়ের গাড়ি ইলেকট্রিক সংক্রান্ত ব্যাপারে বিগড়ে যায়। সতীনাথ গাড়ি মেরামত করে দেয়। এই সূত্রেই সুবিনয়ের সঙ্গে আলাপ সতীনাথের। বলাই বাহুল্য, সতীনাথ ঐ সামান্য ঘটনার মধ্য দিয়েই সুবিনয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ক্রমে দুজনের মধ্যে গভীর আলাপ জমে ওঠে। সতীনাথ কারখানায় তালা লাগিয়ে দিয়ে একেবারে সুবিনয়ের সেক্রেটারী পদে নিযুক্ত হয়। সুহাসকে হত্যা করার ফন্দি আঁটছিলেন সুবিনয় অনেকদিন ধরে। সতীনাথকে পেয়ে ভেবেছিলেন সতীনাথের সাহায্যে কাজ হাসিল করে নেবেন; অর্থাৎ তার মাথায় সাদা কথায় কাঁঠাল ভাঙবেন। কিন্তু সতীনাথ যে অত নিরীহ বোকা নয়, সে-কথা বুঝতে হয়ত সুবিনয়ের খুবি বেশী দেরি হয়নি। তাই সতীনাথের ব্যাঙ্ক-ব্যালান্সটা ক্রমে স্ফীত হয়ে উঠতে থাকে। সতীনাথের ঘর থেকে সুব্রত যেসব কাগজপত্র উদ্ধার করেছিল সেগুলিই তার প্রমাণ দেবে নিঃসংশয়ে। সতীনাথ কিন্তু ওর আসল নাম নয়-ছদ্মনাম। আসল নাম শ্রীপতি লাহিড়ী। যা হোক, সুহাসের হত্যার ব্যাপারে সতীনাথের তৈরী অস্ত্র ও ডাঃ মুখার্জীর সংগৃহীত প্লেগ বীজাণু কাজে লাগানো হয়।

সতীনাথই যে ছাতা ও টর্চের পরিকল্পনাকারী সেটা তার ঘরের ভিতরকার জিনিসপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে একটা ফ্ল্যাট ফাইলের ভিতরকার কয়েকটি ডকুমেন্ট ও প্ল্যান থেকে আমি পরে জানতে পারি।

শেষটায় অর্থের নেশায় সতীনাথ নিশ্চয় মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। এবং তাই হয়ত এত তাড়াতাড়ি তার মৃত্যুর প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল সুবিনয়ের কাছে।

তাছাড়া সুহাসের হত্যার ব্যাপারে সতীনাথ মস্ত বড় প্রমাণ, তার বেঁচে থাকাটাও সেদিক থেকে সুহাসের হত্যাকারীর পক্ষে নিরাপদ নয় এতটুকু। কাজেই তাকে সরতে হল।

এবং বেচারী নিজের হাতের মৃত্যুবাণ নিজের বুক পেতে নিয়ে কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করে গেল।

সতীনাথেকে যখন হত্যা করা হয়, দুভাগ্যক্রমে বোধ হয় নিশানাথ সে ব্যাপারটা দেখে ফেলেছিলেন, তাই তাঁকেও হত্যা করবার প্রয়োজন হয়ে পড়ল হত্যাকারীর পক্ষে একই কারণে। কুক্ষণে হতভাগ্য নিশানাথ বলে ফেলেছিলেন সকলের সামনে, black man with that big torch! তারপর তাঁর সেই কথা, that mischeivous boy again started his old game! কাজেই হত্যাকারী বুঝতে পেরেছিল এর পরও যদি নিশানাথ বেঁচে থাকেন, তাঁকে পাগল বলে রটনা করলেও সর্বনাশ ঘটতে হয়ত দেরি হয়ে না। মানুষের মন। তাছাড়া আরও একটা কথা এর মধ্যে আছে, কোন মানুষকে যখন সর্বনাশের নেশায় পায়, ধাপের পর ধাপ সে নেমেই চলে অন্ধকারের অতল গহ্বরে যতক্ষণ না সে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে শেষ নিঃশ্বাস নেয়। নিশানাথ বর্ণিত সেই ওল্ড গেমের কথা রাণীর চিঠি ও জবানবন্দির মধ্যেই পাবেন। তাই আর পুনরুক্তি করলাম না।

যাহোক সতীনাথের হত্যার কথাটা একবার ভেবে দেখুন: মহেশ সামন্ত, তারিণী চক্রবর্তী ও সুবোধ মণ্ডলের জবানবন্দি হতে কতকগুলো ব্যাপার অতি পরিষ্কার ভাবেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বিশেষ করে সুবোধ মণ্ডলের জবানবন্দি-যা এই কাগজের সঙ্গেই আলাদা করে আমি পাঠালাম পড়ে দেখবেন। যে রাত্রে সতীনাথ অদৃশ্য আততায়ীর হাতে নিহত হয়, সেরাত্রে হত্যার কিছুক্ষণ পূর্বেও সতীনাথ তার বাসাতেই ছিল। সতীনাথের বাড়ির ভৃত্যদের জবানবন্দি হতে জানা যায়, পাগড়ী বাঁধা এক দারোয়ান (?) গিয়ে সতীনাথকে একখানা চিঠি দিয়ে আসে। এবং ঐ চিঠি পাওয়ার পরই সতীনাথ বাসা হতে নিষ্ক্রান্ত হয়। এবং যাওয়ার সময় ভূত্যকে বলে যায় ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সে আবার ফিরে আসছে। ভৃত্য বংশীর প্রথম দিকের জবানবন্দি যদি সত্যি বলে ধরে নিই, তাহলে বাসা হতে বের হয়ে আসবার ঘণ্টা দুই পূর্বে কোন এক সময় দারোয়ান-বেশী কোন এক ব্যক্তি চিঠি নিয়ে গিয়েছিল সতীনাথের কাছে।

সতীনাথের ভৃত্য বংশী গোলমাল শুনেই রাজবাড়িতে ছুটে আসে। রাজবাড়ি ও সতীনাথের বাসার দূরত্ব এমন কিছু নয়, যাতে করে বাসা থেকে বের হয়ে আসবার পর রাজবাড়িতে পৌঁছতে সতীনাথের প্রায় দুঘণ্টা সময় লাগতে পারে। তাইতেই মনে হয় আমার সতীনাথ চিঠি পেয়েই নিশ্চয় রাজবাড়ির দিকে যায়নি, আগে অন্য কোথাও গিয়েছিল, পরে রাজবাড়িতে যায়। এবং তা যদি হয় তো, আমার অনুমান মৃত্যুর পূর্বে সতীনাথের রাজবাড়ির বাইরে অন্য কোন জায়গায় হত্যাকারীর সঙ্গে নিশ্চয়ই দেখা বা কথাবার্তা হয়েছিল এবং সেই সময় সতীনাথের পকেট থেকে চিঠিখানি খোয়া যায়। কিন্তু ভৃত্য বংশীর কথায়ও আমি তেমন আশ্বাস স্থাপন করতে পারছি না। কারণ প্রথমে একবার সে বলেছে—এই ঘণ্টা দুইও হবে না কে একটা লোক বাবুর কাছে চিঠি নিয়ে গিয়েছিল, আবার পরমুহূর্তে জেরায় বলেছে লোকটা বের হয়ে আসবার মিনিট পনের-কুড়ির মধ্যেই বংশী গোলমাল শুনে ছুটে আসে।

এখন কথাটা হচ্ছে, বংশীর জবানবন্দির মধ্যে কোন্ কাথাটা সত্যি! প্রথম না দ্বিতীয়! আমি বলব দ্বিতীয় নয়, প্রথম কথাটাই। তার কারণ ১নং মৃত সতীনাথের পায়ে যে জুতো ছিল তার মধ্যে নরম লাল রংয়ের এঁটেল মাটি লেগেছিল। যেটা পরের দিন ময়নাঘরে ময়নাতদন্তের সময় সুব্রত উপস্থিত হয়ে দেখতে পায়। ২নং সতীনাথের বাসা থেকে রাজবাড়ির রাস্তায় কোথাও ঐ সময় কোন লাল রংয়ের এঁটেল মাটির অস্তিত্বই ছিল না। ৩নং যে নাগরা জুতোটা পাঠিয়েছি তার সোলেও লাল এঁটেল মাটি দেখতে পাবেন। নদীর ধারে লাল রঙের এঁটেল মাটি একমাত্র ঐ শহরে আছে আমি দেখেছি। তাতে করে আমার মনে হয় বংশী প্রথমটাই সত্যি বলেছিল। ঐ রাত্রে মৃত্যুর পূর্বে সতীনাথের হত্যাকারীর সঙ্গে নদীর ধারে দেখা হয়েছিল এবং কথাবার্তাও হয়েছিল নিশ্চয়ই,এই আমার বিশ্বাস। এবং প্রায় একই সঙ্গে দুজনে অল্পক্ষণ আগেপিছে রাজবাড়িতে প্রত্যাবর্তন করে। খুব সম্ভব অন্দরমহলের আঙিনায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই হত্যাকারী সতীনাথকে অতর্কিতে সামনের দিক থেকে তারই তৈরী মৃত্যুবাণ নিক্ষেপ করে হত্যা করে। এবং হত্যা করেই সতীনাথের চীৎকারের সঙ্গে সঙ্গেই হত্যাকারী বাড়ির মধ্যে গিয়ে আত্মগোপন করে। তারপর সময় বুঝে আবার অকুস্থানে আবির্ভূত হয়। হত্যার দিন রাত্রে অস্পষ্ট চাঁদের আলো ছিল। সেই আলোতেই নিশানাথ তাঁর শয়নকক্ষের খোলা জানালাপথে ঘটনাচক্রে সমগ্র ব্যাপারটি হয়ত দেখতে পান। সতীনাথের প্রতি মৃত্যুবাণ নিক্ষিপ্ত হয়েছিল মারাত্মক ঐ টর্চ যন্ত্রটিরই সাহায্যে, এবং নিশানাথ সে ব্যাপার দেখে ফেলেছিলেন বলেই বলেছিলেন—black man with that big torch! এবং আগেই বলেছি ঐ স্বগত উক্তিই হল তাঁর মৃত্যুর কারণ।

নিশানাথ ছাড়াও আর একজন ঐ নৃশংস হত্যা-ব্যাপারে সাক্ষী থাকতে পারত, সারারাত্রি ঘুরে যে ঐ দরজায় পাহারায় নিযুক্ত থাকত, দারোয়ান ছোট্টু সিং। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দারোয়ান ছোট্টু সিং সে রাত্রে জীবিত থেকেও মরেই ছিল, প্রচণ্ড সিদ্ধির নেশার প্রভাবে। ছোট্টু সিংয়ের জবানবন্দি হতেই সেকথা আমাদের জানতে কষ্ট হয় না। কিন্তু ছোট্টু সিং যে তার জবানবন্দিতে বলেছে, তার প্রচণ্ড সিদ্ধির নেশার কথাটা কেউই জানতেন না, এ কথা সর্বৈব মিথ্যা। ছোট্টু সিংয়ের ধারণা যদিও তাই, আসলে কিন্তু ঠিক তা নয়। হত্যাকারীর পরামর্শ মতই তার সঙ্গী মানে নেশার সাথী তারিণী চক্রবর্তীই বেশী পরিমাণে ছোট্টু সিংকে সিদ্ধি-সেবন করিয়েছিল সেরাত্রে সম্ভবত। কারণ ছোট্টু সিং ও তারিণী প্রত্যহ সন্ধ্যার সময় একসঙ্গে সিদ্ধির সরবত পান করত। তবে একটা ব্যাপার হতে পারে, সরবত খাবার সময় ছোট্ট সিং ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি, সরবত পানের নেশার ঝোঁকে ঠিক কতটা পরিমাণে সিদ্ধি সে সরবতের সঙ্গে গলাধঃকরণ করছে। আশ্চর্য হবেন না, ব্যাপারটা আগাগোড়াই প্ল্যান-মাফিক ঘটেছে, গোড়া হতে শেষ পর্যন্ত। হত্যাকারী যখন সতীনাথের কাছে দারোয়ানের বেশে চিঠি নিয়ে যায়, তখন তার জুতোর শব্দ সুবোধ মণ্ডল শুনতে পেয়েছিল, ও কথা তার জবানবন্দিতেই প্রকাশ। এবং একমাত্র সুবোধ মণ্ডলই নয়, তারিণী চক্রবর্তীও শুনতে পেয়েছিল, তবে তারিণী জানত আসলে লোকটি কে, আর সুবোধ মণ্ডল ভেবেছিল লোকটা ছোট্টু সিং, এই যা প্রভেদ। হত্যাকারী দারোয়ানের বেশ নিয়েছিল এইজন্য যে কেউ তাকে দেখে ফেললেও যাতে ছোট্ট সিং ছাড়া অন্য কেউ না ভাবে। আসলে ব্যাপারটা যাই হোক, সতীনাথের হত্যার সময়ে একমাত্র নিশানাথ ছাড়া আর দ্বিতীয় সাক্ষী কেউ ছিল না। এবং বর্তমানে নিশানাথ যখন মৃত, তখন সামান্য ঐ নাগরা জুতো টর্চ ও অন্যান্য সাক্ষীর জবানবন্দির সাহায্যে হত্যাকারীকে ফাঁসানোনা যাবে না। সে আজ আমাদের সকলের নাগালের বাইরে। সতীনাথের হত্যাকারীর ঐ একটিমাত্র অপরাধই তো নয়, নিশানাথেরও হত্যাকারী সে। এবং সতীনাথ শিবনাথকে একই প্রক্রিয়ায় ঐ মারাত্মক টর্চ যন্ত্রটির সাহায্যে বিষাক্ত মৃত্যুবাণ নিক্ষেপ করে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে। সতীনাথের জন্য দুঃখ নেই। লোভীর চরম পুরস্কারই মিলেছে। দুঃখ হতভাগ্য নিরীহ অবিবেচক নিশানাথের জন্য। অবিবেচক এইজন্যই বললাম, স্নেহে ও মমতায় যদি সে অন্ধ না হত, তবে সেই child of the past কোনদিনই পরবর্তীকালে তার old game আবার শুরু করতে পারত না হয়ত এবং সুহাসের মৃত্যু হতে পর পর এতগুলো হত্যাকাণ্ডও ঘটত না।

এখন আসা যাক সেরাত্রে কিভাবে নিশানাথকে হত্যা করা হয়েছিল—নিশানাথের প্রতি মৃত্যুবাণ নিক্ষিপ্ত হয়েছিল রাজাবাহাদুরের শয়নকক্ষের জানলাপথে। কারণ নিশানাথের মৃত্যুর পর মৃতদেহের position, যা এই মামলার প্রসিডিংস থেকে পড়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন, কথাটার মধ্যে সন্দেহ রাখবার মত কিছুই নেই।

মৃত্যুর পূর্বে বিষজর্জরিত নিশানাথ যে স্বল্পকাল বেঁচেছিলেন তার মধ্যেই তাঁর শেষ মৃত্যু-চিৎকার শুনে মালতী দেবী ছুটে তাঁর ঘরে গিয়ে প্রবেশ করেছিলেন। এবং ঠিক পূর্বমুহূর্তে অস্পষ্ট কণ্ঠে যে শেষ কথাটিমৃত্যুপথযাত্রী উচ্চারণ করেছিলেন, সেটি হত্যাকারীরই ডাকনামটি। মালতী দেবী নিজস্ব জবানবন্দিতেই সেকথা স্বীকার করেছেন দেখতে পাবেন।

নিশানাথ ও সতীনাথের হত্যার ব্যাপার শেষ করবার পূর্বে আর একটি কথা যা আপনার জানা প্রয়োজন, সতীনাথই তার অমোঘ মৃত্যুবাণ যন্ত্রের নিক্ষেপের পরিকল্পনাকারী এবং যন্ত্রটি ব্যবহারের পূর্বে তাকে অনোর এক্সপেরিমেন্ট করে দেখতে হয়েছিল ও তার জন্য হয়ত অনেক ড্রাইসেলের প্রয়োজন হয়েছে তার, সে-সবেরই প্রমাণ তার নিজের বাক্সেই ছিল—ইয়েসগুলো।

২.১৮ পূর্ব ঘটনার অনুস্মৃতি

এখন বোধ হয় আপনার আর বুঝতে কোনই কষ্ট হচ্ছে না, কিভাবে সুহাস, সতীনাথ ও নিশানাথকে হত্যা করা হয়। এবং সেই অদ্ভুত হত্যারহস্যটির পরিকল্পনাকারী সতীনাথের মতই আর একটি শক্তিশালী মস্তিষ্ক হতে। অর্থাৎ the real brain behind আমাদের সুবিখ্যাত প্রথিতযশা চিকিৎসক ডাঃ কালীপদ মুখার্জী, এম.ডি। যিনি আজও বহাল তবিয়তে সমাজের মধ্যে বিচরণ করে বেড়াচ্ছেন এবং আমরা অনেকেই আজও যাঁকে স্বচ্ছন্দে ডেকে এনে তাঁরই হাতে আমাদের প্রিয়জনদের জীবনরক্ষাকল্পে চিকিৎসার সকল দায়িত্ব নিশ্চিন্ত বিশ্বাসে তুলে দিচ্ছি। সুহাসের হত্যাব্যাপারে সত্যিকারের যে-ই অপরাধী হোক না কেন, তাকেও হয়ত ক্ষমা করা যেতে পারে, কিন্তু ডাঃ কালীপদ মুখার্জী? নৈব চ নৈব চ!

হ্যাঁ, যা বলছিলাম। রাজাবাহাদুর সুবিনয় মল্লিকই সতীনাথ ও নিশানাথের হত্যাকারী। আর সুহাসের হত্যাকারী আসলে সাঁওতাল প্রজাটি হলেও, পরিকল্পনাকারী রাজাবাহাদুর ও ডাঃ মুখার্জী ও যন্ত্র-আবিষ্কর্তা সতীনাথ।

চশমার সঙ্গে টিটেনাস রোগের বীজানু প্রয়োগে সুহাসকে হত্যার প্রথম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতেই, দ্বিতীয় প্রচেষ্টা করা হল প্লেগের বীজানু ইনজেক্ট করে।

এখন কথা হচ্ছে, সুহাসের হত্যাব্যাপারে নিরীহ ডাঃ সুধীন চৌধুরীকে কেন জড়ানো হল! তার দুটি কারণ ছিল। অবিশ্যি এটাও আমার অনুমান ছাড়া কিছুই নয়। ডাঃ সুধীন যে নির্দোষ প্রমাণ আমাকে করতে হবে বলেই আমার এ শ্রমস্বীকার সে তো আপনি জানেন। সেই কথাতেই এবারে আমি ফিরে আসছি। একেবারে গোড়া হতেই শুরু করব। এ হত্যার ব্যাপারে সুধীনের বিরুদ্ধে যে প্রমাণকে আপনারা সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণ বলে মেনে নিয়েছেন, সেটাই সর্বপ্রথম আলোচনা করা যাক। রায়পুরে যাত্রার দিন সকালে সুধীন সুহাসকে যে ইনজেকশন দিয়েছিল, সেটা অ্যান্টিটিটেনাস্ ছাড়া আর কিছু ছিল কিনা?

কিন্তু তারও আগে আলোচনা করব, সত্যিই যদি সুধীনই সুহাসের হত্যাকারী হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে সুধীনের সুহাসকে হত্যার কি মোটিভ বা উদ্দেশ্য থাকতে পারে? বলবেন, প্রতিশোধ! তার পিতার নৃশংস হত্যার প্রতিশোধ! কিন্তু আমি বলব—absurd! Simply absurd! সুধীনের পিতা যখন নিহত হন, কতটুকু শিশু ছিল সুধীন! তারপর একদিন বয়স হলে মার মুখে সব কিছু সে শুনলে, তখন তার মার পক্ষে যে প্রতিহিংসা বা বিদ্বেষ থাকা সম্ভব, সেটা সুধীনের পক্ষে গড়ে ওঠা নিশ্চয়ই সম্ভব নয়। তাছাড়া ঘটনাচক্রে যাদের প্রতি গড়ে ওঠা উচিত ছিল একটি পরিপূর্ণ ঘৃণা ও বিদ্বেষ, সেখানে গড়ে উঠল একটা মধুর প্রীতির বন্ধন এবং সেটা একান্ত অজান্তেই। সুহাসের সঙ্গে ভালবাসাটা গাঢ় হয়ে ওঠবার পর যেদিন প্রথম সুধীন জানতে পারলে সুহাসের আসল পরিচয়, তখন তার মনে আর যাই হোক হিংসা বা ক্রোধ জাগতে পারে না। এই গেল প্রথম কথা।

দ্বিতীয় কথা, যদি ধরেই নিই অর্থের লোভে সুধীন সুহাসকে হত্যা করেছে, তাও অসম্ভব, কারণ সে ঘুণাক্ষরেও দ্বিতীয় উইল সম্পর্কে কিছু জানত না। এবং শুধু তাই নয়, অর্থের প্রতি যদি তার লোভই থাকবে, তাহলে সুহাস যখন তাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করতে চেয়েছিল তখন মালতী দেবীকে সে তার ব্যবসার অংশীদার করত না।

তৃতীয়ত সুহাসকে সুধীনের যদি খুন করবারই মতলব থাকত, তাহলে প্রথমবার যখন সে টিটেনাস রোগে আক্রান্ত হয়, তখন তাকে নিজে কলকাতায় নিয়ে এসে চিকিৎসার সুব্যবস্থা নিশ্চয়ই করত না। এই তিনটি করণেই আমার মনে হয় সুধীনকে আমরা অনায়াসেই সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিতে পারি। এবং তাই যদি হয় তাহলে সুধীনকে যে হত্যাকারী ইচ্ছা করেই কোন গভীর উদ্দেশ্যে সুহাসের হত্যাব্যাপারের সঙ্গে জড়িয়েছিল সেটা প্রমাণ হয়ে যায় না কি? তাই বলছিলাম হত্যাকারী দুটি কারণে সুধীনকে হত্যা-মামলার সঙ্গে জড়িয়েছিল। যেহেতু (১) হত্যাকারী উইলের ব্যাপার জানত এবং (২) জানত নিশ্চয়ই উইলের দ্বারা সুধীন লাভবান হবে—তাই মনে হয়, ঐ অ্যানটিটিটেনাস ইনজেকশন দেওয়ার সুযোগে হত্যাকারী সুধীনের বিরুদ্ধে মস্ত বড় একটা প্রমাণ হাতে পেয়েছিল, যার দ্বারা অনায়াসে হত্যার সমস্ত অপরাধ তার কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে নিজে সমস্ত সন্দেহের বাইরে চলে যেতে পেরেছিল আইনের চোখে ধুলো দিয়ে। আগেই বলেছি সুধীন নিজের বোকামিতেই অনেকটা নিজেকে বিপদগ্রস্ত করে ফেলে। সুহাসের মৃত্যুর ঠিক কয়েকদিন আগে সুধীন বেনারসে চলে গেল, আবার মাঝখানে এসে মৃত্যুর সময়টা বেনারসে চলে গেছিল। এতে করে স্বভাবতই লোকের মনে সুধীনের প্রতি সন্দেহ জাগতে পারে। তাছাড়া স্টেশনেও সে উপস্থিত ছিল। হিমোসাইটোমিটার যন্ত্রটার কোন একটা ভাল রকম explanation-ও সে দিতে পারল না। যদিও এক্ষেত্রে ডাঃ মিত্রের জবানবন্দির সত্যতাও আমি মেনে নিতে রাজী নই। আমার মতেমিঃ হালদারের ঐসম্পর্কে explanation-টাই সত্যি। ডাঃ মিত্র সত্য গোপন করেছিলেন। সুহাসের ব্যাঙ্ক ব্যালান্স সম্পর্কেও সকল সন্দেহের নিরসন হয়ে যায় মালতী দেবীর statement থেকেই। এবং এ কথাও সেই সঙ্গে প্রমাণ হয় মালতী দেবীকে বাঁচাতে গিয়েই এবং সুহাসের মৃত আত্মার প্রতি শ্রদ্ধাবশেই ডাঃ সুধীন চৌধুরী আনক ব্যাপার ইচ্ছে করেই চেপে গেছে আদালতে বিচারের সময় জেরার মুখে। তারপর সুহাসের কলকাতায় আগমন সংবাদ—সে-ও কেমন করে সুধীন চৌধুরী পায় তারও প্রমাণ পেয়েছেন মালতী দেবীর চিঠির জবানবন্দিতেই। তিনিই আগের বারের মত ডাঃ সুধীনকে সুহাসের অসুস্থতার সংবাদ দিয়েছিলেন। সুহাসের অসুস্থ অবস্থায় কলকাতায় পৌঁছবার পর তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিয়েই ডাঃ সুধীন তার এক বন্ধুর বিয়েতে, বন্ধুর একান্ত অনুরোধ না এড়াতে পেরেই, কয়েকদিনের জন্য বেনারস চলে যেতে বাধ্য হয় তার অনিচ্ছাতেই। এখন কথা হচ্ছে, আদালতে জেরার সময় সুধীন চৌধুরী কেমন করে সুহাসের কলকাতায় আসবার সংবাদ পান, সেটা জানাতে কেন অস্বীকার করে! তার কারণ মালতী দেবী অনুরোধ করেছিলেন, সুহাস যেন কাউকে কথাটা না বলে। ব্যাপারটা আগাগোড়া এখানে অসম্ভব ও অস্বাভাবিক বোধ হলেও, সুধীন মালতী দেবীকে exposeকরেনি। ডাঃ সুধীনের আদালতের সমগ্র ব্যাপারটা study করে আমার ধারণা হয়েছে, লোকটা যেন একটু eccentric প্রকৃতির ছিল। আর কিছুই নয়। নইলে নিজের অবশ্যম্ভাবী বিপদ জেনেও সে চুপ করে ছিল কেন? সুধীন বন্ধুর বিবাহে বেনারসে গেছিল বলেই, ঠিক সুহাসের মৃত্যুর সময়টাতে কলকাতায় উপস্থিত থাকতে পারেনি। যদিও তার এই অনুপস্থিতি লোকের মনে সন্দেহেরই উদ্রেক করে। এবং সুধীন আদালতে বেনারসে কেন গেছিল সে সম্পর্কেও কোন জবাব দেয়নি যা সে অনায়াসেই পারত। তারপর রায়পুর যাওয়ার দিন সুধীন যে সুহাসকে অ্যান্টিটিটেনাস ছাড়া অন্য কিছু injection দেয়নি তার প্রমাণও মালতী দেবীর statement-য়েই পাবেন। মালতী দেবী সুধীনের প্রতি এতটুকু সন্দেহযুক্তা থাকলে সুধীনকেও বাঁচতে দিতেন না। এবং শুধু তাই নয়, সুধীন যে সুহাসের হিতাকাঙক্ষী সেকথাও মালতী দেবীর চাইতে কেউ বেশী জানতেন না। তবু যে কেন আদালতে বিচারের সময় মালতী দেবী সব কথা গোপন করে গেলেন, তারও জবাব মালতী দেবীর চিঠির মধ্যে পাই।

মোটামুটি তাহলে আপনাকে রায়পুরের সমগ্র হত্যা-মামলাটির একটা মীমাংসা করে দিলাম। এবং এখন বোধ হয় আপনার আর বুঝতে কষ্ট হবে না, হতভাগ্য রায়পুরের ছোট কুমার সুহাস মল্লিকের হত্যার পরিকল্পনাকারী স্বয়ং রাজাবাহাদুর—নিহত সুহাসের বৈমাত্রেয় জ্যেষ্ঠভ্রাতা সুবিনয় মল্লিক।

পরিকল্পনাকারী ডাঃ কালীপদ মুখার্জী ও হত্যার যন্ত্রের উদ্ভাবনকারী সতীনাথ লাহিড়ী। আসলে উপরিউক্ত তিনজনকেই সুহাসের হত্যাকারী বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। এবং এক্ষেত্রে হত্যার উদ্দেশ্য ছিল অর্থলাভ। অর্থ অনর্থম। নিশানাথ ও সতীনাথের হত্যাকারী স্বয়ং সুবিনয় মল্লিক। উদ্দেশ্য তাদের মধ্যে নিশানাথ ছিলেন সতীনাথের হত্যার সাক্ষী এবং সতীনাথ ছিল সুহাসের হত্যার সঙ্গী ও পরিকল্পনাকারী। এই হত্যামামলা-সংক্রান্ত সব কিছুই আপনার গোচরীভুক্ত করলাম, সেই সঙ্গে এদের জবানবন্দি, যা আমি সংগ্রহ করেছি ও অন্যান্য evidenceগুলোও আপনার কাছে পাঠালাম। ধর্মাধিকরণের হাতে সব কিছু তুলে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে কলকাতা হতে কিছুদিনের জন্য চলে যাচ্ছি, অদূরভবিষ্যতে এই মামলার ফলাফল দূর হতে দেখবার বুকভরা আশা নিয়ে। আশা করি নিরাশ হব না। নমস্কার।

ভবদীয়
কিরীটী রায়

 ২.১৯ শেষ কথা

শেষ কথা

মানুষের চিন্তার বাইরেও যে কত বিস্ময় থাকে দিন-দুই পরে জাস্টিস মৈত্র একখানা খোলা চিঠি হাতে করে সেই কথাই ভাবছিলেন। কিরীটীর দীর্ঘ চিঠিটা পাওয়ার পর হতেই এ দুটো দিন কেবল তিনি ভেবেছেন, কোন্ পথে এবার তিনি তাঁর কাজ শুরু করবেন।

যে সত্য আজ কঠোর উলঙ্গভাবে তাঁর চোখের সামনে এসে প্রকট হয়েছে, তাকে কেমন করে তিনি গ্রহণ করবেন।

কিন্তু তাঁর সকল চিন্তা ও ভাবনার মীমাংসা যে এইভাবে এসে তাঁকে মুক্তি দেবে চিঠিখানা খুলে পড়বার আগের মুহূর্তেও তিনি ভাবতে পারেননি। এমনই হয়। নিয়তি!

শ্রদ্ধাস্পদেষু,

নির্ভাবনায় আমার এই চিঠিখানা আপনি পড়তে পারেন। এই চিঠি যখন আপনার হাতে গিয়ে পৌঁছবে তখন আমি এতটুকুও অনুতপ্ত নই। সুহাসকে আমিই হত্যা করিয়েছি। হাত, হত্যা করিয়েছি এইজন্যে যে এই পৃথিবীতে আমার তার মত শক্র আর ছিল না। শুধু এ জন্মেই নয়, আগের জন্মেও তাকে আমি হত্যা করেছি এবং পরজন্ম বলে যদি কিছু থাকে, তাহলে পরজন্মেও তাকে আমি হত্যা করব। এই আমার দৃঢ় সংকল্প। আমার কাকা নিশানাথ, তাঁকে আমি হয়তো হত্যা করতাম না, কিন্তু তাঁর অহেতুক কৌতূহল ও বাচালতাই তাঁকে হত্যা করতে আমায় বাধ্য করিয়েছিল। সতীনাথ—তাকেও আমি হত্যা করেছি, কারণ তার অর্থলিপ্সা। আমার চাইতেও সে বেশী অর্থলোভী ছিল। আর একটা কথা, যে উইল নিয়ে এত কাণ্ড, সে উইলটা আমি পেয়েছি খুঁজে এতদিনে, সুধীনের পিতা সেই উইল অনুসারে রায়পুর স্টেটের এক-তৃতীয়াংশের অধিকারী।উইলটা আমিই সঙ্গে নিয়ে গেলাম। কারণ আমার সকল প্রচেষ্টাই যখন ব্যর্থ হল এবং আমার ভোগে যখন সম্পত্তি এলই না, তখন যাতে সেটা নিয়ে আর কোন উপদ্রব না ঘটে সেইজন্যই উইলটা সঙ্গে নিয়ে গেলাম। Adieu!

বিনীত

সুবিনয় মল্লিক

Exit mobile version