না তো! খুবই দুঃসংবাদ, দাদা খুন হয়েছেন।
খুন! যেন একটা আর্ত চিৎকারের মতই শব্দটা সমীরের কণ্ঠ হতে নির্গত হয়।
হ্যাঁ। দাদাকে কে যেন খুন করেছে।
আপনারই নাম সমীর বোস? ঐ সময় কিরীটী বাধা দেয়।
কিরীটীর প্রশ্নে সমীর মুখ তুলে তাকায়।
হ্যাঁ। আপনি?
আমার নাম কিরীটী রায়। এ কদিন আমি এখানে আছি, কিন্তু কই আপনাকে তত আমি দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না।
আমি তো আজই রাত আটটার গাড়িতে কলকাতা থেকে এসেছি।
ওঃ!
ডাঃ সমর সেন সমীর বোসকে চিনতে পেরেছিলেন।
এই ঘরের মধ্যে ঢুকে দুঃশাসন চৌধুরী ও ডাঃ সানিয়েলের সঙ্গে সমীর বোসকেই তিনি দেখেছিলেন।
কিরীটী আবার বলে, বসুন সমীরবাবু, কতক্ষণ এ ঘরে ছিলেন আপনি আজ রাত্রে?
সমীর চেয়ারের ওপরে উপবেশন করল। এবং মৃদুকণ্ঠে বলে, রাত তিনটে পর্যন্ত তো আমি এই ঘরেই ছিলাম। ডাঃ সেন আসবার পর আমি শুতে যাই।
আপনারও তো শুনেছি কয়লার খনি আছে, তাই না মিঃ বোস?
হ্যাঁ।
কোথায়?
ঝরিয়াতে ও সিঁজুয়াতে।
রায়বাহাদুরের ভাগ্নী রুচিরা দেবীর সঙ্গে তো আপনার বিয়ের সব কথাবার্তা হয়ে গেছে, তাই না?
কথাবার্তা হয়েছে বটে একটা, তবে এখনও final কিছুই স্থির হয়নি।
রুচিরা দেবীর সঙ্গে আপনার পরিচয় নিশ্চয়ই আছে?
হ্যাঁ।
কত দিনের পরিচয়?
তা অনেক দিনের হবে। কলেজের একটা ফাংশনে বছরখানেক আগে রুচির সঙ্গে আমার আলাপ হয়।
একটা কথা মিঃ বোস, ঐ বিয়ে সম্পর্কে কথাবাতার জন্যই কি আপনি এখানে এসেছেন। কাল?
না। রায়বাহাদুরের একটা মাইন আমি কিনব, কয়েক মাস যাবৎ কথাবার্তা চলছিল। সেই সম্পর্কেই একটা পাকাপাকি ব্যবস্থা করবার জন্য বিশেষ করে এবারে আমার এখানে আসা।
কথাবাতা কিছু হয়েছিল সে সম্পর্কে?
হ্যাঁ। রাত্রেই সব ফাইনাল হয়ে গিয়েছে। সইও হয়ে গিয়েছে, এখন কেবল রেজিস্ট্রী করা বাকি।
আপনি এখান থেকে একেবারে সোজা আপনার ঘরেই গিয়েছিলেন, তাই না মিঃ বোস?
হ্যাঁ। বড্ড ঘুম পাচ্ছিল তাই সোজা গিয়ে বিছানায় শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
আপনার সঙ্গে রায়বাহাদুরের ব্যবসা ছাড়া আর অন্য কোন কথা হয়েছিল কি মিঃ বোস?
না। রায়বাহাদুর যে গত রাত্রে ভোর চারটের সময় নিহত হবেন, সে ধরণের কোন কথাও আপনাকে তিনি বলেননি?
না।
চাকর কে আপনাকে ডাকতে গিয়েছিল?
কৈরালাপ্রসাদ।
আচ্ছা এবারে আপনি যেতে পারেন মিঃ বোস। তবে একটা অনুরোধ, আমাকে না জিজ্ঞাসা করে কিন্তু আপনি এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবেন না।
বেশ।
সমীর বোস অতঃপর ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
কিরীটী এবারে দালাল সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললে, মৃতদেহটা তাহলে ময়না তদন্তের জন্য সিভিল সার্জেনের কাছে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন।
হ্যাঁ, সেটা করতে হবে বৈকি। দালাল সাহেব বলেন, নীচে গাড়িতে আমার এ.এস.আই আছে মিঃ মিত্র, তাকেই ইনস্ট্রাকশনটা দিয়ে আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
দালাল সাহেব ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
০৬. আরও প্রায় আধ ঘণ্টা পরে
আরও প্রায় আধ ঘণ্টা পরে। ঘরের বন্ধ জানালাগুলো খুলে দিতেই প্রথম ভোরের স্নিগ্ধ আলো ঘরের মধ্যে এসে অবারিত প্রসন্নতায় যেন চারিদিক ভরিয়ে দেয়।
পুলিসের গাড়িতে করেই ইতিমধ্যে মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়ে গিয়েছে।
দুঃশাসন চৌধুরী, দালাল সাহেব, ডাঃ সানিয়াল ও ডাঃ সমর সেন ব্যতীত সকলকেই কিরীটী বিদায় দিয়েছে।
কিরীটী তার ঘরে বসে কথা বলছিল দুঃশাসন চৌধুরীর সঙ্গে।
রুচিরা দেবীকে তাহলে আপনিই রায়বাহাদুরের মৃত্যুসংবাদটা দিয়েছিলেন, মিঃ চৌধুরী?
নিশ্চয়ই না। সত্যি, আমি এখনও ভেবে পাচ্ছি না এত বড় ডাহা মিথ্যে কথাটা মেয়েটা বলে গেল কি করে!
দালাল সাহেব হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, রুচিরা দেবীর সঙ্গে আপনাদের কোন মনোমালিন্য নেই তো দুঃশাসনবাবু?
একটা পুঁচকে ফাজিল প্রকৃতির মেয়ের সঙ্গে আমার মনোমালিন্যের কি কারণ থাকতে পারে বলুন তো দালাল সাহেব! চিরটাকাল গান্ধারী আর তার স্বামী হৃষিকেশ দাদার ঘাড়ে বসে খেয়েছে। হৃষিকেশের সঙ্গে গান্ধারীর বিয়েতে মোটেই আমার মত ছিল না। এককালে ওরা ধনী ছিল কিন্তু হৃষিকেশের সঙ্গে যখন গান্ধারীর বিয়ে হয় তখন ওদের দুবেলা ভাল করে আহার জুটত না। থাকবার মধ্যে ছিল পৈতৃক আমলের একটা নড়বড়ে পুরনো বাড়ি আর দেহে ব্যাধি-দুষ্ট রূপ–
ব্যাধি-দুষ্ট রূপ!
তাছাড়া কি! ঐ রূপই ছিল, আর সেই সঙ্গে ছিল অতীত ধনদৌলতের মিথ্যে উগ্র একটা অহঙ্কার। এবারে এসে যখন দেখলাম এখনও ওরা দাদার ঘাড়েই চেপে বসে আছে, দাদাকে বলেছিলাম ওদের একটা ব্যবস্থা করে এখান থেকে অন্যত্র সরিয়ে দিতে। তা দাদা কি আমার কথা শুনলেন!
আচ্ছা এবারে আপনি তাহলে যেতে পারেন দুঃশাসনবাবু।
দুঃশাসন চৌধুরী ঘর থেকে চলে গেলেন কিরীটীর অনুমতি পেয়ে।
.
একটু চা পেলে মন্দ হত না—কিরীটী বলে ঐ সময়।
ডাঃ সানিয়াল বললেন, চলুন না আমার ঘরে।
তাই চলুন।
কিরীটী, দালাল সাহেব, ডাঃ সানিয়াল ও ডাঃ সেন অতঃপর সকলে ডাঃ সানিয়ালের ঘরে এসে প্রবেশ করে।
ডাঃ সানিয়াল ইলেকট্রিক স্টোভে কেতলীতে জল চাপিয়ে দিলেন।
হঠাৎ কিরীটী বলে, আপনারা বসুন, আমি দুমিনিটের মধ্যে আসছি। চা হতে হতেই আমি এসে পড়ব।
কিরীটী কথাটা বলে ডাঃ সানিয়ালের ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে কি ভেবে যেন ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিল।