কে? চমকে সমীর ফিরে দাঁড়াল।
সেই প্রভাতের প্রথম আলোয় প্রতিমার দিকে তাকিয়ে সমীরও মুগ্ধ হয়ে গেল।
কী সুন্দর! কী স্নিগ্ধ!
সত্যিই প্রতিমাকে সে-সময় বড় সুন্দর দেখাচ্ছিল।
সাগর-নীল রঙের একখানি ছাপা মুর্শিদাবাদ সিল্কের শাড়ি পরিধানে। গায়ে সাদা রঙের জরির কাজ-করা ব্লাউজ। মাথার চুলগুলি এলোমেলো করে কাঁধের উপর হেলে রয়েছে।
পায়ে শ্রীনিকেতনের চপ্পল।
মুগ্ধবিস্ময়ে সে সমীরের দিকে তাকিয়ে। যেন সাগরলক্ষ্মী সাগর-শয্যা হতে এইমাত্র নিদ্রা ভেঙে বালুবেলার উপরে এসে দাঁড়িয়েছে। সত্যি কি সুন্দর আপনি, প্রতিমা দেবী! বড় ভাল লাগে আপনাকে আমার। মুগ্ধকণ্ঠে সমীর বললে।
সহসা প্রতিমার মুখখানা লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল। কিন্তু চকিতে সে আপনাকে সামলে নিল, সেদিনকার ঘটনার জন্য সত্যই আমি বড় দুঃখিত ও লজ্জিত সমীরবাবু। তারপরই স্বরটাকে গাঢ় করে বললে, কেন—কেন আপনি এ অত্যাচার সহ্য করছেন? ও শয়তানের খপ্পর থেকে বের হয়ে আসুন! পুরুষমানুষ আপনি, এ দুর্বলতা কেন?
কিন্তু সমীর প্রতিমার কথায় যেন স্বপ্লেখিতের মত সজাগ হয়ে উঠল, না না, আপনি যান। আপনি এখান থেকে যান। আপনি আমার সঙ্গে কথা বলবেন না। আমি আপনার সঙ্গে আর কথা বলতে চাই না। ভয়চকিত কণ্ঠস্বরে কথাগুলি বলতে বলতে একপ্রকার ছুটেই যেন কতকটা সমীর হোটেলের দিকে চলে গেল।
স্তব্ধ-বিস্মিত প্রতিমার দু-চোখের কোলে জল উপচে উঠল। আহা, সমুদ্রের বুকে কে অদৃশ্য শিল্পী তুমি রক্তরাঙা আবির মুঠো মুঠো ছড়িয়ে দিয়েছ।
এ কি নয়নাভিরাম অপূর্ব দৃশ্য!
হে অদৃশ্য শিল্পী, আমার প্রণাম গ্রহণ কর।
***
সেই দিন সন্ধ্যায়।
আজ আর গগনেন্দ্রনাথ সমুদ্রের ধারে সান্ধ্যভ্রমণে বের হননি। সকলেই যে যাঁর বসবার ঘরে বসে আছেন।
কিরীটীও আজ সন্ধ্যায় বের হয়নি, কেননা মাথাটা তার সেই দুপুর থেকে বিশ্রীরকম ধরে আছে।
ঠিক হয়েছে আগামী কাল সকালে সে কোণারক দেখতে যাবে।
দু-চার দিন পরে ফিরবে।
রণধীর সে-ঘরে নেই, নিজের ঘরে শুয়ে আছে।
বিনতা সামনে বসে উল দিয়ে কী একটা বুনছিল, ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত্রি আটটা ঘোষণা করল।
বিনতা হঠাৎ যেন চমকে দাঁড়াল, কাকা, আপনার ওষুধ খাবার সময় হল, ওষুধটা নিয়ে আসি গে!
গগনেন্দ্রনাথ চোখ বুজে ঝিমোচ্ছিলেন, মৃদুস্বরে বললেন, যাও। কিন্তু ওষুধ খাবার সময় আমার আধঘণ্টা আগেই হয়েছিল। তোমাদের কি আর সেদিকে খেয়াল আছে। তোমাদের সকলের যে আজকাল কী হয়েছে, তোমরাই তা জান। সময়মত ওষুধটাও দিতে যদি না পার, বললেই তো হয়, আমার নিজের ব্যবস্থা আমি নিজেই করব। কারও সাহায্যেই আমার দরকার নেই।
বিনতা বিনা বাক্যব্যয়ে ঔষধ আনতে ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল। রাগে অপমানে একটা নিষ্ফল বেদনায় তার সমগ্র অন্তরাত্মা তখন গর্জাচ্ছে।
চোখ ফেটে জল আসতে চায়।
বিনতার ঘরেই সাধারণত সব ঔষধপত্র থাকত।
সে যখন ঘরে এসে প্রবেশ করল, রণধীর তখন একটা চেয়ারের উপরে শুয়ে আলোয় কী একখানা বই পড়ছে।
ঔষধ কাঁচের গ্লাসে ঢেলে নিয়ে যেতে যেতে একবার আড়চোখে স্বামীর প্রতি চেয়ে বিনতা ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল। গগনেন্দ্রনাথকে ঔষধ খাইয়ে বিনতা ঔষধের গ্লাসটা রাখতে ঘরে ফিরে এল।
রণধীর তখন বইখাতা কোলের উপরে নামিয়ে রেখে কী যেন ভাবছিল।
বিনতা তার সামনে এসে দাঁড়াল।
কে, বিনতা? রণধীর প্রশ্ন করলে।
হ্যাঁ, আমি। কিন্তু তুমি কি আজও এমনি করে নিশ্চিন্তই থাকবে?
রণধীর চমকে সোজা হয়ে বসে বিনতার মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করল, কী হয়েছে বিনতা?
কী হয়েছে? নতুন করে কী আর হবে? ওগো, আমি আর সহ্য করতে পারি না, যেখানে হোক চল এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাই—এখুনি, এই মুহূর্তে। কান্নায় বিনতার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এল।
রণধীর রীতিমত চঞ্চল হয়ে উঠল। কিন্তু কী সে জবাব দেবে এ প্রশ্নের?
কী ভাবছ? আর কতকাল এমনি ভাবে অকথ্য অত্যাচার সহ্য করব? ওগো, তুমি কি সত্যিই পাষাণ? এইভাবে কষ্ট দেবে বলে কি তুমি বিয়ে করেছিলে?
বিনতা, স্থির হও। কোথায় যাব বল? এ আশ্রয় ছেড়ে গেলে পথে পথে আমাদের অনাহারে ঘুরে বেড়াতে হবে। এই যুদ্ধের দুর্মূল্যের বাজারে কেমন করে দিন চালাব?
চলবে। কেন তুমি ভাবছ, আমি আবার চাকরি নেব।
তোমার রোজগারে আমাকে জীবনধারণ করতে হবে? এর থেকে কি তাও ভাল নয়?
না।
বিনতা কিছুক্ষণ গুম হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পরে গম্ভীর স্বরে বললে, বেশ, তবে তুমি থাক তোমার ঐ অত্যাচারের ঐশ্বর্য নিয়ে, আমি চলে যাব। দু-মুঠো অন্নের আমার অভাব হবে না জেনো।
বিনতা ধীর শান্তপদে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
রণধীর ব্যাকুল স্বরে ডাকলে, বিনতা, শোন-শোন!
কিন্তু বিনতা ফিরে এল না।
***
রাত্রি প্রায় পৌনে নটা।
সকলে এবার খেতে যাবে।
কিশোর একটা শোফার উপরে ক্লান্তভাবে শুয়ে ঝিমোচ্ছিল, সকলেই উঠে দাঁড়াল কিন্তু কিশোর উঠল না।
কিশোরের দিকে তাকিয়ে গগনেন্দ্রনাথ ডাকলেন, কিশোর, ওঠ। খেতে চল।
আমি আজ আর খাব না কাকা। আবার বোধ হয় আমার জ্বর হয়েছে।
গগনেন্দ্রনাথ কিশোরের সামনে এসে তার কপালে হাত দিয়ে বললেন, হ্যাঁ। তবে যাও, নিজের ঘরে শুয়ে থাক গিয়ে।
কিশোর কী এক করুণ মিনতিভরা দৃষ্টিতে গগনেন্দ্রনাথের ভাবলেশহীন মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করল, একা একা আমার কোণের ঘরে শুতে বড় ভয় করে কাকা!