‘কোন লেখাটায়?’ ভুরু কোঁচকালেন এসিজি।
‘ওই যে, বলেছিলাম না, আমি স্বভাব-কবিতায় আপনার জীবনী লিখব…।’
হাসি পেয়ে গেল এসিজির। সত্যি, রঙ্গলালের খেয়ালের কোনও জুড়ি নেই! এসিজির জীবনী—তাও আবার কাব্যে!
এমনসময় ঘোষণা শুরু হল।
বিপদ দেখা দিলে কীভাবে অক্সিজেন-মাস্ক ব্যবহার করতে হবে সেটা ঘোষণার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মূকাভিনয় করে দু’জন হোস্টেস হাতে-কলমে দেখিয়ে দিল। ধূমপান না করার জন্য যাত্রীদের অনুরোধ করা হল। অনুরোধ করা হল মোবাইল ফোন অফ করে রাখার জন্য। এবং যাঁর-যাঁর সিটবেল্ট বেঁধে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হল।
সবশেষে জানানো হল, এই উড়ানে যাত্রাপথ দু-ঘণ্টা কুড়ি মিনিটে সম্পন্ন করা হবে।
শেষ কথাটি শুনে নিয়তি বোধহয় মুচকি হেসেছিল।
সিনিয়ার এয়ারহোস্টেস ইরিনা বিশ্বাস যখন এক্সিকিউটিভ ক্লাসের গ্যালিতে এসে ঢুকল তখন ওর ফরসা কপালে বেশ কয়েকটা ভাঁজ। মনে হল যেন বেশ চিন্তায় পড়ে গেছে।
চিফ স্টুয়ার্ড কুমারমঙ্গলম সেটা লক্ষ করল। ইরিনা সবসময় হাসিমুখে কাজ করে—সহজে ঘাবড়ে যাওয়ার মেয়ে নয়। তাই কুমারমঙ্গলম মুড ফেরানোর চেষ্টায় ওকে বলল : ‘হোয়াটস আপ, ইরিনা? এত আপসেট দেখাচ্ছে কেন তোমাকে? ফার্স্ট ক্লাস প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে কোনও খিদে পাওয়া নেকড়ে ঢুকে পড়েছে নাকি—যে তোমাকে দেখে থাবা চাটছে?’
শেষ কথাটা বলে চোখ ঠেরে হাসল কুমারমঙ্গলম। কিন্তু ইরিনার কপালে ভাঁজ সমান হল না। অন্যসময় ঠাট্টা-ইয়ারকিতে ইরিনা যেমন খিলখিল করে হেসে ওঠে, তেমনটাও হল না। বরং গম্ভীর গলায় ও বলল, ‘শোনো, টয়লেটের মধ্যে একজন প্যাসেঞ্জার বোধহয় আটকে পড়েছে…।’
‘বলছ কী? একজন, নাকি দু’জন? আই মিন…।’
কুমারমঙ্গলম একগাল হেসে আরও কীসব ফাজিল মন্তব্য করতে যাচ্ছিল, ইরিনা ওকে বাধা দিল : ‘ধুত, এসব নয়, আমি সিরিয়াসলি বলছি। কে জানে খারাপ কিছু হল কিনা! ভদ্রলোক টয়লেটে ঢুকেছেন অনেকক্ষণ…অ্যাবাউট হাফ অ্যান আওয়ার। ওঁর সঙ্গে যাঁরা আছেন ওঁরাই আমাকে বললেন চেক করতে। আমি টয়লেটের দরজায় বারকয়েক টোকাও দিয়েছি, কিন্তু নো রেসপেন্স—কেউ সাড়া দেয়নি।’
কুমারমঙ্গলম বিরক্তির শব্দ করল একটা। প্যাসেঞ্জারের টয়লেটে আটকে পড়ার কেস সাধারণত দেখা যায় না—তবে একেবারে যে হয় না তা নয়। বছর পাঁচেক আগে একশো পাঁচ কি দশ কেজি ওজনের এক পাঞ্জাবি ভদ্রলোককে একরকম টেনে-হিঁচড়ে টয়লেট থেকে বের করতে হয়েছিল। সে-কাজ করতে গিয়ে যা অভিজ্ঞতা হয়েছিল সে আর বলার নয়—বরং ভুলে যাওয়াই ভালো।
‘এই হতভাগা প্যাসেঞ্জারটার নাম কী?’
‘প্যাসেঞ্জার লিস্ট চেক করে দেখেছি—মিস্টার মদনমোহন চ্যাটার্জি! তা হলে তো বুঝতেই পারছেন!’
কুমারমঙ্গলম সোজা কপালে হাত চাপড়ে বলে উঠল, ‘মাই গুডনেস! ওঁর নাম তো নিশ্চয়ই শুনেছি! লোকটা রাইভাল বিজনেসম্যানদের জ্যান্ত চিবিয়ে খায়—তা হলে তোমার-আমার মতো চুনোপুঁটির কী হাল করবেন কে জানে! শিগগির চলো, গিয়ে দেখা যাক কেসটা কী! দেরি হলে তো উনি আমাদের এয়ারলাইনের চোদ্দোটা বাজিয়ে ছাড়বেন। চলো, চলো…।’
কুমারমঙ্গলম চটপট পা চালাল এক্সিকিউটিভ ক্লাসের টয়লেটের দিকে। ইরিনাও দেরি না করে ওর পিছন-পিছন রওনা হল।
টয়লেটের আশেপাশে আর কেউ ছিল না। টয়লেটের দরজায় ‘এনগেজড’ ফ্ল্যাগটা কুমারমঙ্গলমের চোখে পড়ল। দরজার কাছে গিয়ে ও চাপা গলায় ডেকে উঠল, ‘মিস্টার চ্যাটার্জি! ইজ এভরিথিং ওকে, স্যার?’
কোনও সাড়া নেই।
আরও একবার প্রশ্ন ছুড়ে দিল কুমারমঙ্গলম, কিন্তু কোনও উত্তর পাওয়া গেল না।
তখন ও তাকাল ইরিনার দিকে। তারপর নক করল টয়লেটের ধাতব জায়গায়।
না, কোনও উত্তর এল না ভেতর থেকে।
কুমারমঙ্গলম ইরিনার দিকে ফিরল : ‘তুমি শিয়োর, ইরিনা, মিস্টার চ্যাটার্জি আধঘণ্টার ওপর টয়লেটে ঢুকেছেন?’
‘ওঁর সঙ্গের লোকরা তো তাই বলেছে।’
‘আর কোনও উপায় নেই। মে বি সামথিং ইজ রং উইথ দ্য লক।’ ইরিনার দিকে একবার তাকিয়ে দরজার খুব কাছে মুখ নিয়ে গেল কুমারমঙ্গলম। গলা সামান্য তুলে বলল, ‘মিস্টার চ্যাটার্জি, স্যার, আপনি বোধহয় কোনও প্রবলেমে পড়েছেন। ডোন্ট য়ু উয়ারি, স্যার। আমি দরজা ভাঙছি। আপনি যতটা পারেন দরজার কাছ থেকে সরে দাঁড়ান, স্যার।’
তারপরই কুমারমঙ্গলম খানিকটা পিছিয়ে দাঁড়াল। বুট-পরা ডান পা-টা উঁচিয়ে প্রচণ্ড জোরে এক লাথি বসিয়ে দিল দরজার লকের কাছটায়। প্লেনের টয়লেটের দরজাগুলো তেমন মজবুত কিচ্ছু নয়। তাই এক লাথিতেই লকের কয়েকটা স্ক্রু বেরিয়ে পড়ল, দরজাটা কয়েক ইঞ্চি ঢুকে গেল ভেতরে।
কুমারমঙ্গলম আর-একবার লাথি কষাল।
লকটা ভেঙে গিয়ে দরজাটা প্রায় ইঞ্চিখানেক ফাঁক হয়ে গেল।
‘স্যার…?’ দরজায় ফাঁক-হয়ে যাওয়া জোড়ের কাছে মুখ নিয়ে ডাকল কুমারমঙ্গলম। ও দরজাটা ঠেলে খুলতে চাইলেও দরজাটা আর খুলছিল না—কোথাও একটা আটকে যাচ্ছিল।
ধাক্কাধাক্কির শব্দ পেয়ে আর-একজন হোস্টেস সাবরিনা এক্সিকিউটিভ ক্লাসের গ্যালিতে চলে এল।
ইরিনা, কুমারমঙ্গলম এবং টয়লেটের ফাঁক-হয়ে-থাকা দরজার দিকে তাকিয়ে সাবরিনা কেমন যেন হতভম্ব হয়ে গেল। ইরিনাকে জিগ্যেস করল, ‘হোয়াটস, আপ, ইরিনা? এনি প্রবলেম?’