Site icon BnBoi.Com

ভিখারীর আত্মকাহিনী – আরজ আলী মাতুব্বর

ভিখারীর আত্মকাহিনী - আরজ আলী মাতুব্বর

১.০১ চরপূর্বাভাস ও জন্ম (১১৫৮ – ১৩০৭)

ভিখারীর আত্মকাহিনী ।। প্রথম খণ্ড ।। চরপূর্বাভাস ও জন্ম (১১৫৮ – ১৩০৭)

শহর বরিশালের প্রায় ছয় মাইল উঃ পূঃ দিকে কীর্তন খেলা নদীর পশ্চিম তীরে চর বাড়ীয়া লামচরি গ্রামটি অবস্থিত। সাধারণ্যে ইহা “লামচরি” নামে পরিচিত। গ্রামটির বয়স দেড়শত বছরের বেশী নয়। গ্রামটি ছিল খুবই নীচু, বছরের অধিকাংশ সময়ই থাকত জলমগ্ন। তাই এর নামকরণ হয়- “লামচরি” অর্থাৎ নীচু চর। এ গ্রামে লোকের বসবাস শুরু হয় মাত্র ১১৬২ সাল হতে। নবাগত বাসীন্দারা সমস্তই ছিলেন কৃষক। এই নবাগতদের মধ্যে একজন মধ্যবিত্ত কৃষক ছিলেন আমান উল্লাহ্ মাতুব্বর এবং তার তৃতীয় পুত্র এন্তাজ আলী মাতুব্বর আমার পিতা। মা বলেছেন আমার জন্ম ১৩০৭ সালের ৩রা পৌষ।

চরম দুর্দিন
লামচরি মৌজাটি ছিল লাখুটিয়ার রায়বাবুদের জমিদারীর অধীন। আমার চার বছর বয়সের সময় অর্থাৎ ১৩১১ সালে আমার পিতা পরলোকগমন করিলে ১৩১২-১৩১৫ সাল পর্যন্ত বাকি খাজানায় নালিশ করে ১৩১৭ সালে রায়বাবুরা আমার ভূসম্পত্তিটুকু নীলাম-খরিদ করে নেন এবং; কর্জ-দেনার দায়ে বসত ঘরখানা নীলাম করে নেন বরিশালের কুখ্যাত কুসীদ জীবি জনাৰ্দন সেন ১৩১৫ সালে। বিত্ত ও গৃহহীনা হয়ে অতিকষ্টে বিধবা মাতা রবেজান বিবি আমাকে প্রতিপালন করতে থাকেন।

লামচরির মক্তব
১৩৪০ সালের পূর্ব পর্যন্ত এখানে কোন রাস্তা হাট-বাজার, দোকান-পাট বা কোনরূপ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। তবে মসজিদ ছিল কয়েক খানা। বাসীন্দারা প্রায় সমস্তই মুসলমান।
আমাদের গ্রামে নিয়মিত কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকলেও -মুর্দ জানাজা, ফাতেহা ও মৌলুদ পাঠ, বিবাহের কলেমা, তালাক পড়ানো ইত্যাদি কাজের জন্য কেহ কেহ বাড়ীতে মুন্সি ধরনের বিদেশী আলেম রাখতেন। তারা সকাল-বিকেল কর্তার ছেলে-মেয়েদের বাংলা ও আরবী পড়াতেন বা মুখেমুখে-কলেমা, ছুরা-কেরাত ও নামাজ শিক্ষা দিতেন। কেহ কেহ পাড়া প্রতিবেশীর ছেলে মেয়েদেরও পড়াতেন। এ জন্য কাউকে নিয়মিত বেতন দিতে হত না। কেননা তারা ওপরী যা পেতেন, তাতেই তাদের চলত। বিবাহ-তালাকটা কচিং শহরে হলেও শরীয়তের অন্যান্য কাজগুলোতে ছিল তাদের একচেটিয়া অধিকার, অধিকন্তু কলেরা, বসন্তাদি মহামারীতে বেশী সংখ্যক লোক মারা গেলে ত কথাই ছিল না।

মুন্সি তাহের আলী
দক্ষিণ লামচরি নিবাসী কাজেম আলী সরদার সাহেব – মুন্সি তাহের আলী নামক ঐ রকম একজন মুন্সি রেখে ১৩১৯ সালে তার বাড়ীতে একখানা মক্তব খোলেন এবং গ্রামের লোকদের ছেলে-মেয়েগণকে সেখানে পড়ানোর জন্য আমন্ত্রণ জানান, আমার মাকেও। মক্তবের বেতন ও পুস্তকাদি কিনে দিতে মা অপারগ বলে জানালে সরদার সাব বল্লেন যে, তিনি আমার বেতন নিবেন না এবং এ বছর বই পুস্তকও আবশ্যক হবে না। কেননা এ বছর তালপাতা ও কলা পাতায়ই চলবে। সিদ্ধ তালপাতা ও খাগের কলম নিয়ে মক্তবে যেতে শুরু করলাম।
প্রথম দিনে মুন্সি সাব একটা ছুচালো লোহা দ্বারা তালপাতায়ে স্বর ও ব্যঞ্জনবর্ণ এঁকে দিলেন এবং পড়া বলে দিতে লাগলেন। আমি অন্যান্য ছেলেদের সাথে পড়তে শুরু করলাম। স্বর ও ব্যাঞ্জন বর্ণ পড়তে-লেখতে বছর খানেক কেটে গেল।
মুসী তাহের আলী সাব ছিলেন মূলাদীর বাসীন্দা। মক্তব বন্ধ দিয়ে একদা তিনি দেশে গেলেন, আর ফিরলেন না। পরে শোনা গেল যে, তিনি মারা গেছেন। মক্তবটি বন্ধই রইল।

মুন্সি আবদুল করিম
১৩২০ সালে স্থানীয় মুন্সি আবদুল করিম সাব তার শশুর আবদুল মল্লিকের বাড়ীতে আর একখানা মক্তব খোলেন এবং পাড়ার লোকদের কাছে ছাত্র ভর্তির আমন্ত্রন জানান। ছাত্রদের মাথাপিছু বেতন ধার্য করলেন চার আনা।
পাড়ার অনেক ছেলে মক্তবে যেতে শুরু করল। কিন্তু আমার যাওয়া হল না, কেননা মা আমার বেতন দিতে পারবেন না। একদা মুন্সি সাব আমাদের বাড়ীতে এসে মাকে বল্লেন যে, আমাকে তার মক্তবে পড়তে দিলে তিনি আমার বেতন নিবেন না এবং পারেন ত কিছু সাহায্য করবেন। মা রাজী হলেন এবং আমি মক্তবে যেতে শুরু করলাম।
এ হলো আমার শিক্ষা-জীবনের দ্বিতীয় বছর। “বানান” ও “ফলা” লেখা শুরু হলো কলা পাতায়ে। লেখতে হত- বাঁশের টুনীর কলম (খাগ জুঠত না বলে) এবং মেটে দোয়াতেলেখের কালি, চাল পোড়াবাটা ভৃঙ্গুরাজের পাতার রসে তৈরী কালির দ্বারা। পয়সা এতে খরচ হত না মোটেই। কিন্তু এর পর মুন্সি সাব বল্লেন যে, আমাকে একখানা “আদর্শ লিপি” বই ও এক খানা শ্লেট কিনতে হবে। বাড়ীতে গিয়ে মাকে উহা জানালে তিনি বল্লেন- “পয়সা কই”?
মক্তবের সকল ছেলেই তাল ও কলা পাতায় পড়া-লেখা করত না, অনেকেরই আদর্শ লিপি’ বই ও শ্লেট-পেন্সিল ছিল, ছিল না মাত্র আমার মত কয়েকটি গরীব ছেলের। মক্তবে আমার অল্প কয়েক দিনের পড়া লেখার ফল ভাল দেখে আমার জ্ঞাতি চাচা মরহুম মহব্বত আলী মাতুব্বর সা’ব দু আনা পয়সা দিয়ে আমাকে একখানা আদর্শলিপি (সীতানাথ বসাক কৃত) বই কিনে দিলেন এবং জ্ঞাতি ভ্রাতা মরহুম হামজে আলী মাতুব্বর দিলেন তার একখানা ভাঙ্গা শ্লেটের আধখানা। পেন্সিল বানালাম মেটে পাত্র-ভাঙ্গা চাড়া কেটে। কোন রকম পড়া ও লেখা চলতে লাগল।

————–
(১) এর পর মুন্সি সাব ফরমায়েস দিলেন যে, একখানা “বাল্য শিক্ষা” বই কিনতে হবে। মাকে উহা জানালে তিনি আগের মতই উত্তর দেন “পয়সা কই ?”
এতদিন পর মূল্যটা ঠিক স্মরণ নাই তবে রামসুন্দর বসু প্রণীত একখানা “বাল্য শিক্ষা” ও একখানা “ধারাপাত” বই কিনে দিলেন আমাকে আমার ভগ্নিপতি মরহুম আঃ হামিদ মোল্লা এবং মুন্সি সা’ব স্বয়ং সংগ্রহ করে দিলেন আরবী কায়দা সম্বলিত একখানা “আমপারা”। এ সময় আমি পড়তে লাগলাম “বাল্য শিক্ষা” বই ও “আমপারা” এবং লেখতে লাগলাম “শতকিয়া-কড়াকিয়া” আর কষতে লাগলাম “যোগ-বিয়োগাদি (অমিশ্র) অঙ্ক”।
(২) এটা হলো আমার শিক্ষা-জীবনের তৃতীয় বছর অর্থাৎ ১৩২১ সাল। আমাদের গ্রামের প্রায় সমস্ত লোকই ছিলেন বিত্তবান। কিন্তু শিক্ষার প্রতি ছিলেন উদাসীন। তাই কেউই রীতিমত মুন্সি সাবকে ছাত্র বেতন দিতেন না। মুন্সি সাবও ঘরের খেয়ে পরের গেয়ে সময় নষ্ট না করে মক্তবটি বন্ধ করে দিলেন। আর এখানেই হলো-“বাল্য শিক্ষা” বই পড়ে আমার বাল্য-শিক্ষার সমাপ্তি বা সমাধি।

 ১.০২ ছবি ও জলের কল (১৩২২)

মক্তবটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সকালে-বিকেলে দীর্ঘ লাফ ও দুপুরে-খালের জলে ডুব-সাঁতার ইত্যাদি খেলা-ধুলা নিত্যকার কাজ হয়ে দাঁড়াল এ পাড়ার সব ছেলেদের এবং আমারও। কিন্তু এতদ্ভিন্ন আরও দুটি কাজের প্রবণতা ছিল আমার। যাহা অন্য কোন ছেলের ছিল না। সে কাজ দুটি হলো-ছবি আঁকা ও জলের কল তৈরী করা কেন, জানি না, আমি ছবি ভাল বাসতাম। “বাল্য শিক্ষা” ও অন্যান্য বইয়ের পাতা উল্টিয়ে আমি উহা বার বার দেখতাম এবং ওগুলি নিজ হাতে আঁকিবার নিষ্ফল চেষ্টা করতাম।
এ সময় (১৩২২ সাল) বরিশালে “জলের কল” স্থাপিত হতেছিল। বরিশালে যাতায়াতের পথে আমি উহা মনোযোগের সহিত দেখতাম ও দেখে আনন্দ পেতাম এবং বাড়ীতে এসে কৃত্রিম “জলের কল” তৈয়ার করতাম।

 ১.০৩ মুন্সি আহাম্মদ দেওয়ান (১৩২৩)

১৩২৩ সালে আমার জ্ঞাতি চাচা মহব্বত আলী মাতুব্বর সা’ব আহাম্মদ আলী দেওয়ান নামক ভাসান চর নিবাসী এক জন মুন্সি রেখে তার বাড়ীতে একটি মক্তব খোলেন। আমি ঐ মক্তবে ভর্তি হলাম। এখানে আমার পাঠ্য ছিল “মক্তব প্রাইমারি” নামক একখানা বই এবং গণিতে করণীয় ছিল মিশ্র চার নিয়মের অঙ্ক। কিন্তু আমার পাঠ্যপুস্তক খানার মাত্র “আট পৃষ্ঠা” পড়া এবং “মিশ্র যোগ” অঙ্ক কয়েকটি কষা হলে মক্তব বন্ধ করে দেওয়ান সাব দেশে গিয়ে আর ফিরে এলেন না। কিছুদিন পর খবর পাওয়া গেল যে, তিনি ইহধামে নেই। মক্তবটি উঠে গেল।

আমাদের পাড়ায় তখন ঘুড়ি উড়াবার প্রচলন ছিল খুব বেশী। মায়ের কাছে নগদ পয়সা চেয়ে পাবার আশা ছিল না। তাই ঘর হতে কিছু চাল চুরি করে বিক্রি দিয়ে, সেই পয়সা দ্বারা “চীন কাগজ” কিনে ঘুড়ি তৈরী করে তা পাড়ার ছেলেদের কাছে বিক্রি দিতে লাগলাম এবং এতে বেশ কিছু মুনাফা হতে লাগল। এর দ্বারা আমি কয়েকখানা “চিত্রাঙ্কন” শিক্ষার বই ও কাগজ কিনে নানাবিধ ছবি এঁকে একে দিন কাটাতে লাগলাম। আমার মা ছিলেন অত্যন্ত নামাজী মানুষ। তিনি আমার এ সব আনাড়ী কাজ আদৌ পছন্দ করতেন না, পাড়ার লোকেও না। সবাই মাকে বলত-ছবি দেখা, রাখা, আঁকা, এ সবই হারাম। এসব গোনাহর কাজে ছেলেকে আস্কারা দেবেন না, ছেলেটি আপনার “গোষ্ঠীছাড়া”। মা আপসোস করে বলতেন-“আল্লাহ্ ! তুমি সকলেরে দেলা পূত আর আমারে দেলা ভূত”।

 ১.০৪ পলায়ন (১৩২৪)

১৩২৩ সালে আমার ভগ্নিপতি আঃ হামিদ মোল্লা আমার সেজ ভগ্নীকে নেকাহ করে এসেছেন আমাদের সংসারে। তিনি এসে আমার নীলামী সম্পত্তিটুকু জমিদারের কাছ থেকে পুনঃ পত্তন গ্রহণ করলেন। কিন্তু জমির অর্ধেক কবুলিয়ত দিয়ে নিলেন তিনি তার মাতা মেহের জান বিবির বেনামীতে এবং অর্ধেক দিলেন আমাকে (নাবালক বিধায় আমি কবুলিয়ত দিতে না পারায়) আমার মাতার বেনামীতে। এ সময় তিনি আমাদের একান্ন ভূক্ত থেকে কৃষিকাজ করতেছিলেন। আমি তাঁর মাঠের কাজে সহায়তা না করে বেয়ারাপনা ও আনাড়ী কাজ করায় তিনি ছিলেন আমার উপর অত্যন্ত রুষ্ঠ ।

১৩২৪ সালের ৩রা চৈত্র। মোল্লা সাব দুপুরে হাল ছেড়ে মাঠ হতে এসে দেখতে পেলেন যে, আমি পুকুরের পাড়ে বসে “জলের কল” চালাচ্ছি। তখন ক্রোধান্ধ হয়ে তিনি আমাকে কয়েকটি কিল-চড় মেরে হাত ধরে একটি আছাড় দিলেন এবং বহু পরিশ্রমের তৈরী “জলের কল” ভেঙ্গে চুরে ফেলে ঘরে চলে গেলেন। আমি কিছু সময় কান্না করে ঘরে যেয়ে দেখি যে, মা ভাত পাক করছেন আর মোল্লা সাব-আমার বহু দিনের পুঁজী করা ছবি ও বই গুলি জ্বলন্ত চুলোয় দিয়ে জ্বলিয়ে দিচ্ছেন। উহা দেখে ক্ষোভে-দুঃখে আমি আবার কাঁদতে লাগলাম। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম-আমি আর ছবিও আঁকব না, জলের কলও বানাব না, “হয়ত পড়ব, নয়ত মরব” ।

বেলা ১২টা। একখানা ছেড়া লুঙ্গি পরে ও একটি ময়লা জামার পকেটে চৌদ্দ আনা পয়সা গুজে অভুক্ত লুকিয়ে ঘর হতে বের হলাম পশ্চিম দিকে। বেলা দুটোয় বরিশাল পৌঁছে কিছু খেয়ে লক্ষ্যহীন ভাবে চলতে লাগলাম পশ্চিমে। কলেজ রোডে এক ভদ্রলোকের সহগামী হলাম। চলতে চলতে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন-আমার বাড়ী কোথায়, কেন কোথায় যাব ইত্যাদি। আমি আমার ঠিকানা বল্লাম আর বল্লাম যে, কোথায় যাব, তা জানি না, তবে উদ্দেশ্য আমার লেখা-পড়া শিক্ষা করা। আমার বক্তব্য শুনে ভদ্রলোকটি আমাকে তার সঙ্গে যেতে বল্লেন। আমি রাজী হয়ে তার সাথে সাথে চল্লাম।

ভদ্রলোকটির নাম এখন স্মরণ নাই, তার ঠিকানা-বরিশাল থেকে সতর মাইল পশ্চিমে “বাকপুর” গ্রামে প্রসিদ্ধ কাজীবাড়ী। পিতার নাম মহব্বত আলী কাজী। রাত বারোটায় আমরা কাজীবাড়ী পুছলাম। আহারান্তে ভদ্রলোকটি আমাকে বল্লেন যে, ওখান থেকে তিন মাইল পশ্চিমে বানরীপাড়া থানা। সেখানে থেকে (বেলা ১০টায়) স্টিমার যোগে স্বরূপকাঠী যাওয়া যায় এবং ওখান হতে সামান্য উত্তর দিকে “মাগুরা” গ্রামে মৌলুভী নেছার উদ্দিন সাবের বাড়ী। আমি সেখানে গেলে হয়ত পড়বার সুযোগ পেতে পারি (সে সময়ের লোকে “সর্ষীণা”কে “মাগুরা” এবং “পীর সাবকে” শুধু মওলানা সাব বলত। সংকল্প ঠিক করে শুয়ে পরলাম।

৪ঠা চৈত্র। ভোরে আহারান্তে ভদ্রলোকটির কথিত পথ ধরে বেলা ১১টায় আমি মৌলুভী সাবের বাড়তে পুছলাম এবং দেখতে পেলাম যে, কয়েক জন ছাত্র ছোট একটি পানা ভর্তি পুকুরে পানা পরিষ্কার করছে আর মওলানা সাব পাড়ে বসে তা দেখছেন, দু-তিন জন লোক তার কাছে দাড়ানো। আমি ছালাম বলে দাড়াতেই মওলানা সাব জিজ্ঞেস করলেন আমার নাম, ধাম ও ওখানে যাবার কারণ কি। আমি সবিনয়ে সকল কথা বল্লাম। শুনে তিনি আমাকে বল্লেন-“তুমি মাষ্টার সাবের কাছে যাও, মাদ্রাসায় ভর্তি হও গিয়ে”। শুনে আমি আনন্দে যেন স্বর্গের দ্বারে পুছলাম।

খোঁজ নিয়ে মাষ্টার এমদাদ আলী সাবের সাথে সাক্ষাৎ করলাম এবং বল্লাম যে, মওলানা সাব আমাকে তার মাদ্রাসায় ভর্তি হতে বলেছেন, আপনি দয়া করে ভর্তি করে নিন। শুনে মাষ্টার সাব আমাকে জিজ্ঞেস করলেন-“তোমার অভিভাবকের অনুমতি নিয়ে এসেছ ?” বল্লাম “হা”। আবার জিজ্ঞেস করলেন-“অনুমতি পত্র এনেছ?” বল্লাম “না”। তিনি আমাকে বল্লেন -“বাড়ীতে অনুমতির জন্য চিঠি দাও, উত্তর পেলে ভর্তি করব”। আমার কাছে পয়সা নাই” বলে জানালে তিনি আমাকে দুখানা পয়সা দিয়ে বল্লেন-“এর দ্বারা পোস্টকার্ড কিনে বাড়ীতে চিঠি দাও”।

আমি মহা ফাঁপরে পড়ে মনে মনে ভাবতে লাগলাম যে, বাড়ীতে চিঠি দিলে মা আমাকে কিছুতেই বিদেশে থাকবার ও পড়বার অনুমতি দেবেন না, বরং আমার খোঁজ পেয়ে মোল্লা সাবকে পাঠিয়ে আমাকে ধরে নিবেন, হয়ত মারধোরও করতে পারে। অধিকন্তু মাস্টার সাবের নিকট আমি “মিথ্যাবাদী” প্রমাণিত হব। এর চেয়ে এখন স্বেচ্ছায় আমার বাড়ীতে যাওয়াই শ্ৰেয়ঃ।

আমি মাষ্টার সাবের কাছ থেকে চলে এলাম। মাষ্টার এমদাদ আলী সাব যেন আমাকে স্বর্গের দ্বার হতে ফিরিয়ে দিলেন মৰ্ত্তে।

দেখলাম-মওলানা সাবের বাড়ীতে একটি লঙ্গরখানা (দাতব্য হোটেল) আছে। মাদ্রাসার শিক্ষক, বিদেশী ছাত্রবৃন্দ ও অন্যান্য বহুলোক ওখানে খেয়ে থাকে। আমি দুপুরে ওখানে খেলাম এবং রাত্রেও। জানতে পারলাম যে, লঙ্গরখানার বাবুর্চি সাব ছুটি নিয়ে আজ শেষ রাতে নৌকো যোগে বাড়ীতে যাবেন। বাড়ী তাঁর ঝালকাঠীর নিকটবর্তি “গাবখান” গ্রামে। আমি ঝালকাঠী যাবার উদ্দেশ্যে তার সঙ্গে যেতে অনুরোধ জানালে তিনি রাজী হলেন এবং যথা সময়ে আমাকে ডেকে নিলেন। আমি মাগুরা ত্যাগ করলাম।

৫ই চৈত্র। বেলা ১০টায় আমরা গাবখান পুছলাম। আমার পথের সম্বল ১৪ আনা পয়সা – বরিশালের হোটেল ও (বানরীপাড়া -সরূপকাঠী) ষ্টিমারেই খরচ হয়েছিল। এখন পকেটে আছে মাত্র মাষ্টার সাবের দেওয়া দুটি পয়সা। পয়সা দুটি বাবুর্চি সাবের হাতে দিলাম আর বল্লাম-“এ পয়সা দুটি মাষ্টার সাবের হাতে দেবেন”। নৌকো হতে উঠে আমি ঝালকাঠীর পথ ধরলাম ।

যখন ঝালকাঠী পৌঁছলাম, তখন বেলা ১১টা। বেশ ক্ষুধা পাচ্ছিল। কিন্তু ওখানে বসে থাকলেত ক্ষুধা মিটবে না! ভেবে স্থির করলাম যে, আজ সারাদিন না খেয়েই আমাকে চলতে হবে। চৈত্র মাসের দুপুরের রোদ মাথায় নিয়ে (উনিশ মাইল পথ ঝালকাঠী-বরিশাল ১৩ ও বরিশাল লামচরি ৬ মাইল) বরিশালের রাস্তা ধরে হাটতে শুরু করলাম।
ক্রমে রোদের তাপ ও ক্ষুধা উভয়ই বাড়তে লাগল। কিন্তু কমতে লাগল-শক্তি ও সহ্য। সামান্য হাটি আবার ছায়া পেলে বসি। এ ভাবে হেটে-বসে বেলা দুটোয় পাড়ি দিতে হল পেমারের বিশাল মাঠ। প্রায় ঘন্টাখানেক অবিশ্রাম চলতে হ’ল। কেননা এখানে কোন গাছপালা নাই। ক্ষুধা-পিপাসায় প্রাণ ওষ্ঠাগত, বিশেষতঃ রোদে। মাঠ পার হয়ে এক গেরস্তের বাড়ীর দরজায় বসে বিশ্রাম নিলাম ও চেয়ে কিছু চাল-পানি খেয়ে আবার হাটতে শুরু ৬ করলাম। যখন বাড়ীতে পুছলাম, তখন প্রায় সন্ধ্যা।

আমি ভেবেছিলাম যে, বাড়ীতে এসে আমার মায়ের তিরষ্কার ও মোল্লা সাবের অত্যাচার ভোগ করতেই হবে। কিন্তু তা কিছুই হ’ল না। আমাকে দেখে মা’র আনন্দ আর ধরে না। তিনি আনন্দে কাঁদতে লাগলেন, কাছে টেনে নিয়ে আমার বুকে-পিঠে হাত বুলালেন, তাড়াতাড়ি খেতে দিলেন। শোনলাম – আমি বাড়ী হতে যাবার পর মা আর আহার করেন নাই। সব সময় কেদেছেন আর আমার “জলের কল” ভাঙ্গা ও “বই-ছবি” পোড়ার জন্য মোল্লা সাবকে আবোল-তাবোল বলেছেন আর বকেছেন—তুমি আমার সব সম্পত্তি খাবার মতলবে “কুড়ী” কে মেরে ঘরের বের করেছ। ওটা মারা গেলেই তোমার ভাল। ওকে তালাশ করে এনে দাও ইত্যাদি (ছোটবেলা মা আমাকে “কুড়ী” বলে ডাকতেন এবং অন্যরাও)।

মা’র কোন কথার উত্তর না দিয়ে মোল্লা সাব সেদিন পাড়ার আত্নীয়-কুটুম্বদের বাড়ীতে এবং বরিশাল জাহাজ ঘাট গিয়ে বিদেশগামী জাহাজ সমূহে আমাকে খোঁজ করেছেন। পরের দিন দূরাঞ্চলের আত্নীয়-কুটুম্বদের বাড়ীতে খোঁজ করে কোথায়ও না পেয়ে “নিরুদ্দেশ” সংবাদ পুলিশে জানাতে আজ থানায় গিয়েছেন।

মোল্লা সাব রাত ৮টায় বাড়ীতে এসে আমাকে দেখতে পেয়ে খুশী হলেন কি-না, জানি না; তবে নিশ্চিন্ত হলেন। পরের দিন আবার তিনি থানায় গেলেন (বরিশাল) আমার “পোঁছার” সংবাদ পুলিশে জানাবার জন্য। রাত্রে তিনি বাড়ীতে এসে বল্লেন যে, সে পুলিশের “কনেষ্টবল” পদে ভর্তি হয়ে এসেছেন। আসছে বৈশাখ মাসের মধ্যভাগে তিনি ট্রেনিং এ যাবেন। যথা সময়ে মোল্লা সাব ছয়মাস ট্রেনিং এর জন্য ঢাকায় গেলেন। আমি শ্বাস ছেড়ে বাঁচলাম। (বৈশাখ ১৩২৫)

ভাবতে লাগলাম-এখন কি করব। প্রতিজ্ঞা করেছি-“হয়ত পড়ব নয়ত মরব”। প্রতিজ্ঞা বহাল রাখতে হলে আমাকে পড়তে হবে, নচেৎ মরতে হবে। কিন্তু কোথায়ও পড়বার সুযোগ পাচ্ছি না বলে কি মরব? মরা ত সোজা কথা নয়। কেমন করে মরব। আত্নহত্যা ইচ্ছা-মৃত্যু চেষ্টা সাপেক্ষ। স্বেচ্ছায় মরতে হলে তার জন্য চেষ্টা করতে হবে। মরার জন্য যেমন চেষ্টা আবশ্যক, তেমন পড়ার জন্যও। তবে কোনটা আগে করব? স্থির করলাম যে, আগে পড়বার জন্য চেষ্টা করব, বিফল হলে পরে মরবার চেষ্টা।

এখন সমস্যা হল- কোথায় পড়ব? কার কাছে পড়ব? কি পড়ব? ইত্যাদি। সমাধান করলাম-আমি কোথায়ও পড়ব না, কারও নিকট পড়ব না, একটা কিছু পড়ব না। আমি ঘরে বসে পড়ব, একা একা পড়ব, সব কিছু পড়ব; অর্থাৎ যা-ই-পাব, তা-ই-পড়ব।

১.০৫ মুন্সি আপছার উদ্দিন (১৩২৫)

দক্ষিণ লামচরি নিবাসী পূর্বোক্ত কাজেম আলী সরদার সাব (তাঁর জামাতা) মুন্সি আপছার উদ্দিন নামক এক জন আলেম এনে তাঁর বাড়ীতে পুনঃ মক্তব খোল্লেন। মুন্সি সাব বাংলা ভাষা ভাল জানতেন না, তবে আরবী, ফারসী ও উর্দুতে ছিলেন সুপণ্ডিত এবং সুফিও। তার মত নিষ্ঠাবান নিষ্কাম সাধু পুরুষ আলেম সমাজে অল্পই আছেন। আমি তার মক্তবে ভর্তি হলাম না, তবে সকাল-সন্ধ্যায় তার কাছে গিয়ে আরবী ও উর্দু পড়তে শুরু করলাম (১৩২৫ সালের বৈশাখ মাসের শেষ ভাগ হতে) এবং পড়লাম-পবিত্র কোরান, রাহে নাজাত ও মেফ তাহুল জান্নাত নামক দুখানা কেতাব। নামাজদি দীনিয়াতের অত্যাবশ্যকীয় বিষয় সমূহ তার কাছেই শিক্ষা করলাম।
আমার ভাগ্যবিপর্যয় ঘটেছিল পিতার মৃত্যুর পর হতেই। কিন্তু উহা চরমে পুছেছিল ১৩১৭ সালে, বিত্ত নীলামের পর। রায় বাবুরা আমার চাষের জমিটুকু সবই নীলামে খরিদ করে দখলে নিয়েছিলেন। কিন্তু ভিটি-বাড়ীটুকু দখল করে নিচ্ছিলেন না। আর আমাদের সম্বলও ছিল উহাই। ওর মধ্যে বেড়-পুকুর ও ঘরভিটি বাদ গিয়ে . . . কাঠার বেশী জমি ছিল না। ওতে কয়েকটি ফলবান নারিকেল ও সুপার গাছ ছিল, যার ফল বিক্রি করা যেত। এ ছাড়া বাড়ীতে মা – লাউ, কুমড়া, চিচিঙ্গা ইত্যাদি তরিতরকারী ও মরিচ রোপন করে ও সব বিক্রি করে কিছু পয়সা পেতেন। এতদ্ভিন্ন মাও ধাত্রী কাজে কিছু পেতেন। এছাড়া হাস-মোরগ পালন ছিল আর একটি আয়ের পথ। আর এর দ্বারা নির্বাহ করতে হত দুটি প্রাণীর বারো মাসের খোরাক, পোষাক ও অন্যান্য খরচ পত্র।
আত্নীয় কুটুম্বরা কেহ কোনরূপ সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন নি। দেখেছি অভাব গ্রস্ত ব্যক্তির নিকট হতে –
“আত্মীয় কুটুম্ব সব দূরে সরে যায় কেননা নিকটে পেলে যদি কিছু চায়?” কিন্তু আমাদের তুচ্ছ করে সরে যায়নি মাত্র দুজন, তারা হ’ল – “উপবাস” ও “ছিন্নবাস”।

বই ও পুথি প্রাপ্তি
আমাকে পড়া-লেখা শেখায়ে মানুষ করবার আন্তরিক ইচ্ছা মা’র ছিল, কিন্তু তার সামর্থেও কুলোয়নি।
আমার মনে বড় রকমের একটা আফসোস ছিল এই যে, তখনো আমি বাংলাভাষা স্বচ্ছন্দে পড়তে পারতাম না, অনেক শব্দই বর্ণবিন্যাস করে পড়তে হত। এতে যে কোন একটি বাক্য অবিরাম না পড়ে ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়বার ফলে ওর অর্থ দুর্বোধ্য হত। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করতে লাগলাম বাংলা ভাষা স্বচ্ছন্দে পড়বার জন্য।
বই কেনার সম্বল নেই বলে এপাড়া ওপাড়ার ছেলেদের পরিত্যক্ত ছেড়া বই সংগ্রহ করে পড়তে লাগলাম, পড়তে লাগলাম – পথে পড়ে থাকা টুকরো কাগজ কুড়িয়ে, এমন কি লবণ বাধা ঠোঙ্গার কাগজও। কোন রূপ লেখা থাকলেই তা হ’ত আমার পাঠ্য। ওতে কি লেখা, কোন বিষয় লেখা, উহা পাঠে কোন জ্ঞানলাভ হ’ল কি-না ইত্যাদি প্রশ্ন ছিল আমার অনাবশ্যক। তখনকার আমার পড়ার উদ্দেশ্য ছিল শুধু – স্বচ্ছন্দে পড়বার ক্ষমতা অর্জন করা।
এ সময় বই ছিল আমার নিত্য সহচর। ঘরে বসে পড়তাম, শুয়ে পড়তাম, খাবার সময় পাশে বই মেলে রেখে খেতাম ও পড়তাম। কোথায়ও ভ্রমনে বের হলে সঙ্গে বই নিয়ে যেতাম এবং কোন আত্মীয়ের বাড়ীতে বেড়াতে গেলেও কোনও না কোন বই সঙ্গে নিয়ে যেতাম আর সুযোগ মত পড়তাম। অনেক সময় “স্বচ্ছন্দে বই পড়ছি”, ইহা স্বপ্নে দেখতাম।
একদিন আমাদের ঘরের মাচানের ওপর কাপড়ে বাধা একটা কাগজের বস্তা দেখতে পেলাম। ওটা-কবে, কোথা থেকে কে এনেছে- তা জানি না; তবে ওখানে রেখেছেন মোল্লা সাব। বস্তাটি নামিয়ে খুলে দেখতে পেলাম যে, ওর ভেতর আছে – কতগুলো বই, পুথি ও হাতের লেখা খাতা। বই গুলোর মধ্যে আছে – একখানা “গণিত পাঠ” একখানা “ভূগোল শিক্ষা প্রণালী”, একখানা “ভারত বর্ষের ইতিহাস”, একখানা “সরল বাংলা ব্যাকরণ” ও একখানা গল্পগ্রন্থ “গোপাল ভাড়” । পুথি গুলোর মধ্যে আছে সোনাভান, জঙ্গনামা, মোক্তল হোসেন, আছরাচ্ছালাত, গাজী কালু, রসনেছা মালু খাঁ ইত্যাদি এবং খাতাগুলোর মধ্যে আছে কতগুলো তন্ত্ৰ-মন্ত্র ও তাবীজ-কবজের নমুনা। বই-পুথি গুলো পেয়ে তখন আমি যে আনন্দ লাভ করেছিলাম, তা আজও ফুরোয় নি। ওগুলোর জন্যে মোল্লা সাবকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করব আজীবন। তখন মনে মনে ভাবলাম যে, পেটের খোরাক পাই আর না পাই মনের খোরাক পেলাম বহুদিনের। আপাততঃ আমার বই-পুস্তকের অভাব দূর হল, এখন অপেক্ষা শুধু পড়বার। দেখা যাক।

পাঠ্য সহচর
আমাদের গ্রামের মক্তব গুলোতে শিক্ষার বিভাগ ছিল মাত্র দুটি – সাহিত্য ও অঙ্ক। এছাড়া শিক্ষার অন্যান্য বিভাগগুলো আমার ছিল অজানা। ভূগোল, ইতিহাস ও ব্যাকরণ এ নামগুলো সবে মাত্র জানলাম ।
সদ্য প্রাপ্ত বই-পুথি গুলো নাড়াচাড়া করে দেখলাম এবং ধীরে ধীরে কিছু পড়লাম। পুথিগুলো নিয়ে বেশী ঘাটাঘাটি করলাম না। কারণ আমার প্রতিবেশী আঃ রহিম ফরাজী ছিলেন ভাল একজন পুথি পাঠক। ভাবলাম যে, পুথি গুলো তাকে দিয়া পড়াব ও তার সঙ্গে পড়বার চেষ্টা করব। বইগুলো পড়ে – গল্প ও ইতিহাস কিছু বোঝতে পারলাম, ভূগোল বোঝলাম যৎসামান্য কিন্তু ব্যাকরণ “না” বল্লেই চলে। ব্যাকরণ বাদ রেখে আমি – গল্প, ইতিহাস ও ভূগোল পড়তে লাগলাম। আমার পড়ার কোন রুটিন ছিল না; সকাল-বিকাল, সন্ধ্যা-দুপুরও ছিল না; ছিল – যখন যা ইচ্ছা, তখন তা পড়া। শুধুই পড়া।
বার বার বই গুলো পড়ে একটা ফল পেতে লাগলাম। দেখা গেল যে, যে কোনও বই পড়ে প্রথম বার যা বোধগম্য হচ্ছিল, দ্বিতীয় বারে হচ্ছে তার চেয়ে বেশী, তৃতীয়বারে তার চেয়ে বেশী এবং চতুর্থ বারে আরো বেশী। শেষমেশ প্রায় বারো-চৌদ্দ আনাই হয়ে ওঠে বোধ্য, অবোধ্য থাকে মাত্র দু-চার আনা; তা শব্দার্থ জানার অভাবে। পড়া চালাতে লাগলাম। ভাবলাম – থাক না কিছু অবোধ্য, যেটুকু বুঝি সেটুকুই লাভ।

ভূগোলে
এ সময় আমি আর ছবি অঙ্কন করি না। কিন্তু অঙ্কনের প্রবণতা ছাড়াতে পারিনি। এরই ফলে ভূগোল পড়তে গিয়ে মানচিত্র আঁকতে শুরু করে দিলাম। এ সময় একটা ঘটনা আমার মানচিত্র অঙ্কনের সুযোগ এনে দিল। ঘটনাটি এই-একদা রাত্রে পড়বার সময় আমার হাত থেকে “কুপী” বাতিটা বইয়ের উপর পড়ে গিয়ে কেরাসিন পড়ে বইয়ের কাগজ ভিজে গেল। এতে করে ভিজা কাগজের অপর পৃষ্ঠা বা তার নীচেকার কাগজের লেখাগুলো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। আমি পরীক্ষা করে দেখলাম যে, কটু তেল বা নারিকেল তেলেও অনুরূপ ফল পাওয়া যায়। আমি নারিকেল তেল মাখানো কাগজ (শুকিয়ে) মানচিত্রের উপর রেখে নকল মানচিত্র আঁকতে শুরু করলাম।
কিছু দিন ভূগোল পাঠের সাথে সাথে মানচিত্র অঙ্কন করে আমি বোঝতে পারলাম যে, ভৌগলিক বিবরণ পড়ার সাথে সাথে মানচিত্র দেখার চেয়ে (মানচিত্র) অঙ্কনের গুরুত্ব বেশী। যেহেতু মানচিত্র – দর্শনের চেয়ে অঙ্কনে স্মৃতিপটে দাগ কাটে ভাল। আর কোন দেশ, প্রদেশ, শহর-বন্দর ইত্যাদি “স্থান” এর অবস্থান সম্বন্ধে একটা পরিষ্কার ধারনা না থাকলে ভূগোলের শুধু বিবরণ পড়ার কোন মূল্য থাকে না।
আমার অঙ্কিত মানচিত্রে কোন দেশ, প্রদেশ বা মহাদেশের সমস্ত শহর বন্দর চিহ্নিত করতাম না, করতাম প্রধান ও প্রসিদ্ধ গুলি। কেননা মূল মানচিত্রের সকল লেখা এক সময়ে নকল করতে গেলে আমার মানচিত্র হয়ে যেত একটা হিজি-বিজি ও মসিময়। বিশেষতঃ চিহ্নিত “স্থান” এর সংখ্যাধিক্যের দরুন উহা পঠনে ঘটত বিস্মৃতি। মানচিত্র আঁকবার অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির সাথে সাথে তেলাকাগজের ব্যবহার ত্যাগ করলাম। কিন্তু ওর দ্বারা আমি যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছি, তার সুফল ভোগ করছি আজও (জরিপ কাজে)।

গণিত শিক্ষা
“গণিত পাঠ” বইখানা ধরে কয়েকদিন পাতা উল্টালাম। কিন্তু বেশী দূর এগুতে পারলাম না। কেননা বইখানা ছিল তখনকার “ছাত্রবৃত্তি” (ষষ্ঠ শ্রেণী) পড়ার পাঠ্য। আমার পক্ষে উহা ছিল সমুদ্র বিশেষ। সাতার দিলাম।
সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, বইখানায়ে অঙ্কের প্রত্যেকটি প্রক্রিয়ার প্রথমদিকে উহা কৰ্ষবার “নিয়ম” ও “উদাহরণ” দেয়া ছিল। আমি ধারাবাহিকভাবে নিবিষ্ট চিত্তে প্রত্যেকটি প্রক্রিয়ার “নিয়ম” পড়ে ও উদাহরণ” অনুসরণ করে অঙ্ক কষতে লাগলাম।
গণিত খানার “নিয়ম” ও “উদাহরণ” গুলো পেয়ে আমার শিক্ষকের আবশ্যকতা কমে গেল। কিন্তু বেড়ে গেল চিন্তার বহর। আবার সংসারের (বাড়ীর) নানা রূপ কর্ম-কোলাহল ও হৈহল্লাপূর্ণ পরিবেশের মধ্যে একনিষ্ঠ চিন্তা-ভাবনা করাও অসম্ভব। তাই আমি অঙ্ক কষতে আরম্ভ করলাম গভীর রাতে, যখন থাকত না আমার নিবিষ্ট-চিন্তা-ভঙ্গকারী কোন শব্দ। মিশ্রামিশ্র চার নিয়ম হতে শুরু করে ভগ্নাংশ, দশমিক, সমানুপাত, ত্রৈরশিক, বর্গ ও ঘন ইত্যাদি যাবতীয় অঙ্ক ক’ষে বইখানা শেষ করতে আমার প্রায় দুবছর কেটে গেল।

১.০৬ আরবী শিক্ষায় উদ্যোগ (১৩২৬)

১৩২৬ সাল। এখন আমার বয়স প্রায় উনিশ বছর। পিতার মৃত্যুর পর দীর্ঘ পনরটি বছর বহু দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে মা আমাকে প্রতিপালন করছেন আর আমার দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছেন ও বলছেন – “আমার কুড় বড় হলে এক দিন সুখ হবে”। এখন আমি কিছুটা বড় হয়েছি। কিন্তু আমার দ্বারা মা’র কোন দুঃখ-কষ্ট লাঘব হচ্ছে না। এখনও আমাদের উভয়ের ভাতকাপড়ের চিন্তা মা-কেই করতে হচ্ছে। তবে আমি বড় হলাম কেন? কিন্তু এখন আমিই বা কি করতে পারি বা করব ভেবে পাচ্ছিলাম না।
বলছিলাম যে, আমাদের নীলামী জমিটুকু পুনঃ পত্তন আনা হয়েছে। কিন্তু তা নামে মাত্র। রায় বাবুদের দাবীর টাকা পরিশোধ করতে হয়েছিল সব জমিটুকু বন্ধক রেখে। এতে জমিতে আমাদের স্বত্ব এসেছিল কিন্তু দখল আসেনি।
মোল্লা সাব এ সময় বাউফল থানার পুলিশ। চাকুরীতে বেশ উপার্জন করেন। তিনি টাকা দিয়ে আমাদের বন্ধকী জমিটুকু ছাড়ালেন। মা আমাকে বল্লেন- “মোল্লার পোয় চাকরী করে, তুই হালুট কর। দুই জনে খাটলে আমাগো আর অভাব থাকবে না”। আমি সম্মত হলাম।
মোল্লা সাব পনর টাকা মূল্যে একটি হালের গরু কিনে দিলেন এবং প্রতিবেশী “এক গরুওয়ালা” একজন কৃষকের সহিত আমি ভাগে হাল-চাষ শুরু করলাম (কার্তিক-১৩২৬)। প্রথম ফসল জনালাম- খেসারী, মশুর, কিছু মরিচ ও তিল ইত্যাদি। কৃষি কাজ চালাতে লাগলাম।
এ সময় পর্যন্ত মাচানে প্রাপ্ত বস্তাটির বইগুলো পড়া আমার প্রায় শেষ হচ্ছিল (ব্যাকরণ বাদে)। এখন আমি প্রতিবেশী আঃ রহিম ফরাজীর নিকট গিয়ে পুথি পড়তে শুরু করলাম, অবশ্য রাত্রে। ফরাজী সাব সুর করে পুথি পড়তেন এবং আমি তার সাথে সাথে সুর মিলিয়ে কখনো বা একা একা পড়তাম। এরূপ বিভিন্ন পুথি পড়ে নানা রূপ কেচ্ছা-কাহিনী জ্ঞাত হয়ে আনন্দ পেতে লাগলাম। বিশেষতঃ এতে আমার (ভাষা) শিক্ষার অগ্রগতি হতে লাগল। অধিকন্তু – ছবি আঁকার মত আর একটা নেশায় আমাকে পেয়ে বসল। তা হ’ল – পুথির “পয়ার” ও “ত্রিপদী” জাতীয় ছন্দের অনুকরণে নূতন কিছু রচনা করা। চেষ্টা অব্যাহত রাখলাম।
আমাদের গ্রামে তখন “পুথিগান” এর প্রচলন ছিল যথেষ্ট। “পুথিপড়া” হতে “পুথিগান” ভিন্ন। ওকে “সায়েরগান” ও বলে। সায়েরগান অনেকটা কবি গানের অনুরূপ। এতে একজন বয়াতী ও দু-তিন জন দ্বোহার থাকে। পুথিগত কোন কেচ্ছা-কাহিনী কিংবা দেখা বা শোনা কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে বয়াতী গান রচনা করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে গানের মজলিসের কোন আশু ঘটনার প্রেক্ষিতে যখন তখন গান রচিত হইয়া থাকে। প্রত্যেকটি গানের দুটি অংশ থাকে “ধুয়া ও লহর” । “লহর” অংশটা বয়াতী একাই গেয়ে যায় আর “ধুয়া” অংশটা দ্বোহার গণ পুনরোক্তি করে। গানের “ধুয়া” অংশটা যারা পুনরোক্তি করে অর্থাৎ দ্বোহরায়, তাদের “দ্বোহার” বলা হয় এবং গান বা কবিতাদি অর্থাৎ “বয়াত” রচনাকারীকে বলা হয় “বয়াতী” |
আমাদের পাড়ায় ঐ রকম একজন পুথিগানের বয়াতী ছিলেন মেছের আলী সিকদার। ১৯১৪ সালের প্রথম মহাযুদ্ধে বৃটিশ সৈন্য দলে চাকুর নিয়ে তিনি গিয়েছিলেন বসরায়। ১৯১৮ সালে যুদ্ধ বন্ধ হলে ১৯১৯ (বাং ১৩২৬) সালে অবসর প্রাপ্ত হয়ে তিনি বাড়ীতে এলেন এবং গ্রামের বিভিন্ন স্থানে আসর জমিয়ে পুথিগান গাইতে লাগলেন। যুব-বৃদ্ধ সকলেই গান শোনতে যেতেন, আমিও যেতাম। প্রথম কয়েকদিন গেলাম গানের শ্রোতা হিসেবে, পরে দ্বোহার হিসাবে।
সিকদার সাব যে সকল গান গাইতেন, আমি তার অনুকরণে গান রচনার চেষ্টা করতে লাগলাম এবং কয়েকটি গান রচনা করলাম। সিকদার সাবের গানের একজন দ্বোহার ছিলেন আমার প্রতিবেশী আঃ রহিম ফরাজী। আমার রচিত গান ক’টি তাকে দেখালাম এবং ধীরে ধীরে গেয়ে শোনালাম। শুনে তিনি বল্লেন- “হয়েছে ভাল, এগুলো আসরে গাওয়া চলে”। আমি আরো গান রচনা করতে লাগলাম।
১৩২৭ সালে আমি বয়াতী হয়ে পুথিগানের দল গঠন করলাম। আমার নেহার হলেন জাহান আলী, হোসেন মল্লিক ও আঃ রহিম খা। ওঁরা সকলেই আমাদের গ্রামের পশ্চিম পাড়ার নিবাসী। দিন দিন গানের উৎকর্ষ হতে লাগল।
পুথিগান, প্রতিযোগিতা মূলক গান। এতে একাধিক বয়াতী না হলে গান ভাল জমে না। শ্রোতাগণ বিচার করেন যে, প্রতিযোগীদের মধ্যে কোন বয়াতীর-গলার স্বর, গানের সুর ও ছন্দঃ ভাল; কে অপেক্ষাকৃত অধিক তার্কিক, বাকপটু, শাস্ত্রজ্ঞ ইত্যাদি।
দেশী ও বিদেশী অনেক বয়াতীর সহিত আমার পাল্লার (প্রতিযোগিতার) গান হতে লাগল। এতে দেখা গেল যে, সব সময় তর্কযুদ্ধে জয়ী হতে হলে যে পরিমাণ শাস্ত্রজ্ঞান থাকা আবশ্যক, তা আমার নাই। কাজেই আমার আরো বেশী পরিমাণ পুস্তকাদি অধ্যয়ন করা আবশ্যক। সেজন্য সচেষ্ট হলাম।
এ সময় আমাদের সংসারের কর্তৃত্ব মা’র হাতে নেই, আমার হাতে। মোল্লা সব এসময় আমাদের পরিবারভুক্ত। তাই তিনি যে টাকা-পয়সা রোজগার করেন, তা আমার কাছে দেন এবং আমি উহা আবশ্যকীয় কাজে খরচ করি। হাতে নগদ পয়সা পেয়ে কিছু অযথা খরচ করতে লাগলাম, যাকে “সংসার খরচ” বলা চলে না। আলেপ-লায়লা, কাছাছোল আম্বিয়া, ফকির বিলাস, হযরতল ফেকা, তালে নামা, ছায়ত নামা ইত্যাদি কতগুলো পুথি এবং রামায়ন মহাভারত, মনসা মঙ্গল, গীতা, রাধাকৃষ্ণ বিলাস ইত্যাদি কতগুলো হিন্দু-শস্ত্র কিনলাম ও ওগুলো পড়তে লাগলাম।
রায় বাবুদের লামচরি তহশীল কাছাড়তে নীল কান্ত মুখাজী নামক একজন মোহরার ছিলেন, নিবাস পান বাড়ীয়া। তিনি ছিলেন হিন্দুশাস্ত্রে সুপন্ডিত। বিশেষতঃ সংস্কৃত ভাষা ভাল জানতেন। তার সাথে আলাপ-ব্যবহারে তিনি আমার বেশ বন্ধু হয়ে গেলেন। আমি তার ও পৌরাণিক গ্রন্থ দান করেন এবং ঋক বেদের কিছু অংশ বঙ্গানুবাদ করে দেন। “মনু সংহিতা” নামক বৈদিক গ্রন্থখানা দান করেন আমাকে চর মোনাই নিবাসী বাবু যামিনী কান্ত বিশ্বাস।
এ সময় আমি দিন ভর মাঠে কাজ করতাম আর রাত্রে – হয়ত কোথায়ও আসরে গান নচেৎ ঘরে বসে পুস্তকাদি অধ্যয়ন করতাম। সময়ের অপচয় করতাম না মোটেই। কৃষি ও গান, উভয়ের উন্নতি হতে লাগল। যে কোন বিষয় বা ঘটনা, দেখা বা শোনা মাত্র সে সম্বন্ধে তৎক্ষনাৎ গান রচনা করার ক্ষমতা আমার এ সময় অর্জিত হয়েছে।
মোল্লা সাব আমার বিবাহের জন্য উদ্যোগী হলেন এবং তার দোস্ত (বন্ধু) ময়জদিন গোলদারের একমাত্র কন্যা লালমন বিবির সহিত আমার বিবাহ স্থির করলেন। ১৩২৭ সালের ২২শে ফাল্গুন সরাজারী এবং ১৩২৯ সালের ২৯শে কার্তিক আমার শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয়ে গেল।
বিগত ১৩২৫ সালের অগ্রহায়ণ মাস হতে আমি নিয়মিত ভাবে সংসারের “জমা” ও “খরচ” এর হিসাব লিখে রাখতে শুরু করি। কেননা তৎপূর্বে আমার হাতে সংসারের কর্তৃত্ব ছিল না। মোল্লা সাব ট্রেনিং পাশ করে (ঐ সালে) কার্তিক মাসে বরিশাল এসে বাউফল থানায় বদলী হন এবং অগ্রহায়ণ মাস হতে সংসারের বাজার খরচ বাবদ আমার হাতে কিছু কিছু টাকা দিতে থাকেন। তিনি কখন, কত টাকা দিলেন এবং তা কিসে কত খরচ করলাম তা মোল্লা সাবকে বুঝায়ে দেওয়াই ছিল তখন জমা-খরচ লেখার উদ্দেশ্য। মোল্লা সাব সময় সময় হিসাব দেখতেন এবং বই পুথি কেনায় খরচ দেখলে অসন্তুষ্ট হতেন। এ জন্য এ যাবত আমি আমার আশানুরূপ পুস্তাকাদি কিনতে কুষ্ঠা বোধ করছি। বই-পুথি কেনা ও পড়া, এ দুটোই আমার যেন একটা নেশা। এ সময় আমার বই কেনার অসুবিধাটা দূর হল। কেননা এ সময় আমি পুথি গানে বেশ টাকা পেতে লাগলাম এবং তা সমস্তই খরচ করতে লাগলাম বই-পুথি কেনায় ।

১.০৭ চিকিৎসা শিক্ষা (১৩৩০)

১৩৩১ সাল। আমার জ্ঞাতি (চাচাত) ভ্রাতা আঃ রহিম (রহম আলী) মৃধা বেড়াতে যাবেন তাঁর বেহাই (মৃধা সাবের পুত্র ফজলুর রহমানের শ্বশুর) এমদাদ উল্লা কাজীর বাড়ীতে (কালীগঞ্জ)। মৃধা সাব ছিলেন- ধনে, মানে, জ্ঞানে, গুণে, এ অঞ্চলের সেরা ব্যক্তি। তিনি তার অনান্য কুটুম্ব ও সব জ্ঞাতি ভাইদের দাওয়াত করলেন এবং আমাকেও। অধিকন্তু আমাকে আমার গানের দ্বোহারগণকে নিয়ে যেতে বল্লেন। তিনি যাবেন সেখানে “পয়নামা” নিয়ে খুব ধুমধামের সহিত, সেখানে আমাকে গান করতে হবে। নির্দিষ্ট দিনে যথা সময়ে আমরা কাজী বাড়ী গেলাম এবং সবাই বৈঠকখানা ঘরে বসলাম। ঘরের মধ্যভাগটা -গেদী, বালিশ তাকিয়া ইত্যাদি নানা উপকরনে সাজানো। মৃধা সাব ও আমার অন্যান্য জ্ঞাতি ভাইয়েরা ওখানেই বসলেন। কিন্তু আমাকে বসতে দেওয়া হ’ল বারান্দায়। কারণ-আমি “বয়াতী”। গান করলাম। বাড়ীওয়ালা পুরষ্কার দিলেন দশ টাকা। কথায় বলে “যাক জান, থাক মান”। অর্থাৎ মানহানীর চেয়ে প্রাণহানী ভাল। আত্ম মর্যাদায় আঘাত পেয়ে সেদিন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম-বেঁচে থাকতে আর কখনো গান করব না, চেষ্টা করে দেখব কোনো দিন মৃধা সাবের পাশে বসতে পারি কি-না। (চেষ্টায় সফলতা লাভ করেছিলাম তখন, যখন১৩৩৯ সালে চর বাড়ীয়া ইউনিয়ন বোর্ডের প্রথম পদে নিবাচিত হলাম এবং ১৩৪৩ সালের নির্বাচনেও উভয়ে পুনঃ উহার “সদস্য” পদে নির্বাচিত হলাম। অধিকন্তু আমি হলাম নির্বাচিত “সহ সভাপতি” মৃধা সাব নন। এতদ্ভিন্ন -আমি তার সামনেই সরকার কর্তৃক মনোনিত হয়েছিলাম ১৩৪৬ সালে স্থানীয় ডি, এস বোর্ডের “সদস্য” এবং ১৩৪৮ সালে চর বাড়ীয়া ইউনিয়ন জুট কমিটির “সহ সভাপতি”।)

১.০৮ জীবন প্রবাহের গতি (১৩৩১)

বরিশাল চকের পোলের পূর্ব পাশে ঢাকা নিবাসী মুন্সি আলীমুদিন সাবের একখানা পুস্তকের দোকান ছিল। তিনি তাঁর দোকানে- কোরান শরীফ, কেতাব ও পুথিই রাখতেন বেশী; কিছু বাংলা বইও রাখতেন। আমি ওখানে যাতায়াত করে মুন্সি সাবের সাথে ভাব জমালাম এবং সুযোগ মত ওখানে গিয়ে বই-পুথি পড়তে লাগলাম। একদা মুন্সি সাব আমাকে “রবিনশন ক্রুশো” নামক এক খানা বই দিলেন, আমি ওখান কিনে আনলাম। নিঃসঙ্গ ও নিঃসম্বল রবিনশন বহু বছর যাবত দ্বীপবাসী থেকে কিভাবে বেঁচে থাকছিলেন, সে কাহিনী পড়ে আমার এক নুতন মানসিকতার সৃষ্টি হল। আমি ওতে দেখলাম-“মানুষের অসাধ্য কাজ নাই, ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়, সাহসে শক্তি যোগায়” ইত্যাদি বহু প্রবাদ বচনের প্রত্যক্ষ উদাহরণ আমাকে স্বাবলম্বী হবার প্রেরণা। ওটা আমার স্মরণীয় হয়ে আছে ও থাকবে।
আমার জীবন প্রবাহের গতি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সম্ভবতঃ চারজন লোকের দ্বারা। তাঁরা হচ্ছেন (১) মাষ্টার এমদাদ আলী, (২) মোল্লা আঃ হামিদ (৩) মুন্সি আলী মুদিন এবং অধ্যাপক (৪) কাজী গোলাম কাদির-সাব। এর যে কোনো একজন লোকের অভাবে আমার জীবনের গতি হয়ত অন্য দিকে চলে যেত (১) মাষ্টার এমদাদ আলী সাব আমার উপকার-না-অপকার করেছে, জানি না, তবে তিনি আমার “ধর্মীয় শিক্ষার সঙ্কল্পে বাধাদান” করে আমার জীবন প্রবাহকে বিপরীত মুখী করেছেন, বের করে দিয়েছেন আমাকে আলেম সমাজ হতে। (২) আমাকে আধুনিক শিক্ষার পথ প্রদর্শন ও শিক্ষা লোভী করেছেন মোল্লা সাবের”বইয়ের বস্তাটি”। ওটা না পেলে আমি জ্ঞান রাজ্যের পথের সন্ধান পেতাম না, হয়ত চলে যেতাম অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের রাজ্যে, হয়ে পড়তাম কু-সংস্কারের বেড়া জালে আবদ্ধ। (৩) মুন্সি আলী মুদিন সাবের প্রদত্ত “রবিনশন ক্রুশো” বই খানা দিয়েছে আমাকে স্বাবলম্বী হবার প্রেরণা, অর্থাৎ জীবনের সর্বক্ষেত্রে, উচু-নীচু সর্বস্তরের সকল কাজ স্বহস্তে করবার উদ্দীপনা। ও বইটাই আমার যাবতীয় “চেষ্টা” ও সাহস এর উৎসওটা না পেলে হয়ত আমি হয়ে যেতামঅলস, অক্ষম ও পরাধীন, অর্থাৎ অন্যের হাতের ক্রীড়া-পুত্তলী। ১৩২৩ সালে মায়ের বাসা ঘরটি ভেঙ্গে মোল্লা সাব সেখানে (১০ X ৫ হাত) এক খানা কুঁড়ে ঘর তুলেছিলেন।

 ১.০৯ ছুতার কাজ শিক্ষা (১৩৩১)

এ যাবত আমরা ওতেই বসবাস করছি। কিন্তু এখন আর ওতে চলছে না। বিগত ৩/৯/২৯ (বাং) তারিখে স্থানীয় আয়শা বিবির নিকট হতে কিছু জমি কিনেছি এবং বাড়ীর পূর্বদিকে চর পড়িয়া কিছু জমি বৃদ্ধি হয়েছে। এতে কৃষি কাজের কিছু উন্নতি হচ্ছে ও পশার বাড়ছে। ধান, চাল, পাট, তিল, মরিচ ইত্যাদি নানা ফসলের রক্ষণাবেক্ষণ কাজে বর্তমান কুঁড়ে ঘরখানা এখন অনুপযোগী। ভাবলাম – ছোটখাট একখানা টিনের ঘর তুলব। কিন্তু ছুতার লাগাব না, কাজ সব করব নিজে।
আমাদের ঘরে বহুবছর যাবত একটি হাতুর ও একটি বাটালী ছিল। ওদুটো সংগ্রহ করছিলেন মোল্লা সাব। আমি বরাবরই ওর দ্বারা কাঠকুটাে কাটাকুটি করতাম। গৃহ নির্মাণের জন্য আরো যে সব হাতিয়ার আবশ্যক, তা চাইলাম প্রতিবেশী আঃ কাদির আকনের কাছে, তিনি দিতে সম্মত হলেন। আকন সাব ছিলেন একজন সুনিপুণ ছুতার মিস্ত্রী, তবে পেশাদার নহেন।
একদা চর মোনাই নিবাসী কাজেম আলী হাওলাদারের একখানা ঘর দেখে আমার খুব ভাল লাগছিল। তখন ভাবছিলাম যে, কখনো পারলে এই রকম একখানা ঘর তুলব। সেখানে গিয়ে সেই ঘরখানার একটা নক্সা এঁকে ও তার বিভিন্ন অংশের মাপ ঝোক লেখে আনলাম।
বরিশাল হতে কিনে আনলাম- শাল কাঠের খাম ও বাইন কাঠের আড়া, পাইর, রুয়া, চেড়া ইত্যাদি এবং টিন তক্তাদি ঘরের আবশ্যকীয় কাঠ সংগ্রহ করছিলাম একটা খরিদা কড়ই গাছ চিড়িয়ে।
১৩৩১ সালের ১১ই কার্তিক, আমাদের পুরান খড়ের ঘরখানা ভেঙ্গে (১৩ X ১০ হাত) নুতন ঘরের খাম পুতলাম এবং যথা নিয়মে কাজ করতে লাগলাম। খাম পুতিয়ে আড়া-পাইর লাগিয়ে, চাল বানিয়ে ছাউনী দিতে প্রায় মাস দেড়েক কেটে গেল।
২৫শে অগ্রহায়ণ নতুন ঘর সঞ্চার করলাম (নতুন বেড়া বাকি)। অতঃপর মাঠের কাজের ফাকে ফঁাকে ত্রিকাঠ, চৌকাঠ, বেড়া, কবাট, জানালা ইত্যাদি তৈরী করতে বছর খানেক কেটে গেল এবং গৃহ সরঞ্জাম যথা- খাট, চেয়ার, টেবিল, বাক্স, আলমারী ইত্যাদি তৈরী করতে সময় লাগল আরো বছর খানেক। অতঃপর আমার যখন যেটুকু ছুতারের কাজ আবশ্যক হতে থাকল, তখন তা নিজেই করতে লাগলাম।
(১৩৩৪ সালে মোল্লা সাব আমাকে -করাত, বুরুম, রেদা, সারাশী, ভ্যানা, মাতুল, কুরুল ইত্যাদি ছুতার কাজের যাবতীয় যন্ত্রপাতি কিনে দিলেন এবং ওর বিনিময়ে আমি তার এক খানা (১৩ X ১০ হাত) নুতন টিনের ঘর তুলে দিলাম (মোল্লা সাব আমার সংসার হতে ১৩৩২ সালের ১০ই আষাঢ় ভিন্ন হচ্ছিলেন।)
এ সময় হতে ছুতার কাজের যন্ত্রপাতি সমূহ হল আমার নিজস্ব। তাই পরবর্তি জীবনের যাবতীয় গৃহ ও গৃহসরঞ্জামাদি নিজেই তৈরী করেছি ও করছি, এমন কি লাঙ্গল-জোয়াল এবং নৌকাও। আমার সংসার জীবনে কখনো কোন কাজ “জানিনে” বলে অন্যের শরণাপন্ন হইনি। অথচ অর্থ-উপার্জনের জন্য কখনো অন্যের কোন কাজ করিনি। আমার ছুতার কাজ শিক্ষার উদ্দেশ্য হল-অর্থে পার্জন বা অর্থ বাচানো নয়, স্বাবলম্বী হওয়া। ফলতঃ যে কোন ধরনের কাজ – “করতে জানা” এবং তা “নিজ হাতে করা”, এ দুটোতেই আমার মনের আনন্দ। রশি পাকানো, শিশি-বোতলের গলে “যোত” লাগানো এমন কি ঝাটা নির্মাণকেও আমি গৌরবের কাজ মনে করি।

 ১.১০ জরীপ কাজ শিক্ষা (১৩৩৩)

১৩৩৩ সাল। একদা মোল্লা সাব এক বান্ডিল কাগজ আমার হাতে দিয়ে বল্লেন- “এইগুলি সারিয়া রাখিও”। ওর ভেতর ছিল- বন্দকী জমি ছাড়ানো কয়েকখানা ছেড়া দলিল, লামচরি মৌজার সি,এস ম্যাপ, পর্চা, দাখিলা, রশিদ ইত্যাদি ভূসম্পত্তি বিষয়ক কাগজপত্র। ওগুলো পড়ে দেখলাম, সব বোঝলাম না। তবে ম্যাপখানা নিয়ে বিশেষভাবে চেষ্টা করতে লাগলাম উহা ভালভাবে বোঝবার জন্য। কেননা আমার ভৌগলিক মানচিত্রগুলো আকবার ও দেখবার উৎসাহটা গড়ায়ে পড়ল এটার ওপর। ম্যাপখানা ছিল- ২০২৯ নং মৌজা চর বাড়ীয়া লামচরির ২ নং সিট। স্কেল ১৬”= ১ মাইল। এটাতে আমাদের বাড়ী, বাগান, পুকুরাদি ও নাল জমি অঙ্কিত আছে এবং খাল-নদীও । আমার পিতার নামের পর্চায় লিখিত দাগ-নম্বর সমূহ ম্যাপে মিলিয়ে দেখলাম যে, আমাদের জমি কোন কোনটা।
ভূগোলের মানচিত্রগুলোতে দেখেছি যে, এক ইঞ্জির সমান- ৫০, ৬০ কিংবা ৪০০, ৫০০ মাইল; আর সি.এস ম্যাপ খানা ষোল ইঞ্জির সমান এক মাইল। অর্থাৎ এক ইঞ্চির সমান মাত্র ১১০ গজ বা ২২০ হাত। অনেক সময় ভূগোলের মানচিত্র গুলোতে অঙ্কিত বিভিন্ন স্থানের দূরত্ব মেপে দেখার ইচ্ছে হত, কিন্তু সে মাপ বাস্তব ক্ষেত্রের সাথে একরূপ হল কি-না, তা যাচাই করবার উপায় ছিল না। যেমন-বরিশাল হতে কলকাতা অথবা ঢাকা হতে করাচীর দূরত্ব মানচিত্রে মাপা গেলেও ভূপৃষ্ঠ মেপে ওর সত্যতা প্রমান করা সম্ভব নয়। কোন গ্রাম বা ৬ মৌজার সি, এস মানচিত্রে ওরূপ অসুবিধা নেই। কেননা এর পরিধি তত বড় নয়। সি, এস ৩ মানচিত্রের দুটি স্থানের দূরত্ব মেপে, তা সরেজমিনে যাচাই করে দেখতে আমার কৌতুহল হল।
সি,এস ম্যাপ খানার এক জায়গায় একটা স্কেল অঙ্কিত দেখতে পেলাম। ওতে একটা ইঞ্চি ছিল পাঁচ ভাগে বিভক্ত। অর্থাৎ প্রত্যেক ভাগের মান ছিল ২২ গজ বা ৪৪ হাত, অতি সাদা সিধে ধরনের স্থল স্কেল। দেখলাম যে, এতে মাপ চলে না। এক ইঞ্চিকে চল্লিশ ভাগে বিভক্ত করে আমি পীজ বোড কাগজ দ্বারা একখানা স্কেল বানালাম। এর প্রত্যেক ভাগের মান হ’ল ৫.৫ হাত। আর বানালাম -১৮” হাতের ৫.৫ হাত দৈর্ঘ্য একট নল। ডিভাইডার বা কাঁটা বানালাম টিন দিয়ে। প্রায় ৫” ইঞ্চি লম্বা দুখানা টিন- এক দিক স্থল ও একদিক সুক্ষ্ম করে কেটে, উভয়ের স্কুলাংশ একত্র করে একটা খিল মেরে এঁটে দিলাম। এতে কাজ চলার মত একটা ডিভাইডার তৈরী হ’ল। এভাবে জরিপী সরঞ্জাম সংগ্রহ করে একদিন ম্যাপ নিয়ে মাঠে নামলাম ।
মনে পড়ে তখন মাঘ মাস। আমার বাড়ীর পূর্ব পাশের জমিটা মাপতে শুরু করলাম। জমিটা আমার, সি, এস ম্যাপের ১৩৩১ নং দাগ। জমির একটা আলের উভয় প্রান্তে কাটা ধরে, উহা স্কেলে ফেলে দেখতে লাগলাম যে, ওতে স্কেলের কাটা পূরো ইঞ্চি বা কটা ক্ষুদ্রাংশ পড়ল। অতঃপর -প্রতি এক ইঞ্চির সমান ২২০ হাত এবং প্রতি এক ক্ষুদ্রাংশের সমান ৫.৫ হাত ধরে হিসেব কষে বের করতে লাগলাম যে, আলটি লম্বায় কত নল বা হাত হ’ল। তৎপর সরেজমীন পরিমাপ। এ ভাবে জমিটার সব ক’টি আ’লই জরিপ করা হল। কিন্তু ম্যাপের হিসাবও সরে জমিনের পরিমাপ একরূপ হ’ল না, কিছু বেশী বা কম দেখা গেল। আমি মনে করলাম যে, ওসব হয়ত আমার হিসাবের ভুল, নচেৎ কাঁটা ধরার দোষ। যা হোক, মাঠের কাজের ফাকে ফাঁকে জমি জরিপ করতে লাগলাম। কিন্তু কোন লোকজন সাথে নিয়ে নয়, একা একা।
তখন দক্ষিণ লামচরি তোরাপ আলী আকনজী ছিলেন একজন সুদক্ষ আমিন। আমি আমার জরিপ কাজের ইচ্ছা ও কায়দা সমূহ তাকে জানালে, তিনি বল্লেন যে, ওভাবে হিসেব কষে কষে জরিপ কাজ করা সম্ভব নয়, ওর জন্য স্বতন্ত্র ব্যবস্থা আছে। সেটেলমেন্টের ম্যাপ-দ্বারা “হাত” এ জরিপ করতে হলে তার জন্য বিঘা-কাঠার স্কেল ও শিকল ব্যবহার করতে হয়। তিনি আরো বল্লেন যে, তার একটা বিঘা-কাঠার স্কেল আছে, তিনি এখন আর ওটা ব্যবহার করেন না। কাজেই ওটা আমাকে দিতে পারেন এবং তার শিকলটাও দিতে পারেন কিছু দিনের জন্য । আমি তার স্কেল ও শিকল নিয়ে এলাম। পরে বরিশাল হতে লোহার মোটা তার কিনে এনে আকনজী সাবের শিকল দেখে ও মেপে তার কেটে কেটে কড়ি ও আংটি বানিয়ে ২৪ বিঘা অর্থাৎ ২০ হাত দৈর্ঘ্য এক গাছা শিকল তৈরী করে আকনজী সাবের শিকল ফেরত দিলাম।
স্কেল ও শিকল ব্যবহারের ফলে জরিপ কাজে আমার কিছুটা আত্মবিশ্বাস জনিল। অনেক জমি জরিপ করে দেখতে পেলাম যে, কোন জমির-ম্যাপের মাপে ও দখলের মাপে যে ব্যতিক্রম দেখা যায়, তা অনেক ক্ষেত্রেই দখলের ভুলের জন্য। সে ভুল শোধরানোটাই হ’ল আমিনের কাজ।
“আমিন” হিসেবে আমার দ্বারা প্রথম জমি জরিপ করালেন আমার প্রতিবেশী ও জ্ঞাতি চাচা মহব্বত আলী মাতুব্বর সাব। জমিটা তার বাড়ীর পূর্ব পাশে- সি, এস ম্যাপের ১৩৩৪১৩৪০ নং দাগ। আমাকে বারবরদারী দিলেন এক টাকা।
এতদঞ্চলে জমি জরিপ কাজের দুটি প্রথা আছে-দেশী ও বিদেশী। দেশী প্রথায় জমি জরিপ করা হয়-হাত বা নলে ও পরিমাপকে বলা হয়-বিঘা, কাঠা বা কানি, কড়া ইত্যাদি এবং বিদেশী (ব্রিটিশীয়) প্রথায় জরিপ করা হয়-লিঙ্ক বা চেইনে আর পরিমানকে বলা হয়-একর বা শতাংশ বিদেশী প্রথায় জরিপ কাজে গান্টারের চেইন ও স্কেল ব্যবহার করতে হয়, প্রথম আমার তা ছিল না। এমন কি জানাও ছিল না | আমি অতি সহজ ভাবে দেশী প্রথায় জরিপ কাজ শুরু করি। কিন্তু এ প্রথায় নানাবিধ অসুবিধা ভোগ করতে হয়। তাই বিদেশী অর্থাৎ আধুনিকী জরিপ পদ্ধতি শিক্ষায় উদ্যোগী হই।
১৩৫৩ সালের পৌষ মাসে লাহারাজ স্টেটের সার্ভে সুপারভাইজার বাবু বিজয় গোপাল বসু মহাশয় আমাদের গ্রামের পূর্ব পার্শ্বস্থ প্রতাপপুর মৌজা জরিপ করতে আসেন এবং বহুদিন যাবত এখানে জরিপ কাজ করেন। সে সময় আমি তার সহকারী রূপে কাজ করি এবং জরিপ বিষয়ক নানাবিধ যন্ত্রপাতি যথা-নর্থ-কম্পাস, প্রিজমেটিক কম্পাস, সাইড ভ্যান, রাইট এ্যাঙ্গেল ইত্যাদির ব্যবহার পদ্ধতি শিক্ষা করে লই।
বরিশালের “ফরিয়া পট্টি” নিবাসী বাবু ললিত মোহন সাহা ১৩৫৪ সালে আমাকে একটি গাটারের চেইন উপহার দেন এবং স্থানীয় কাছেম আলী (পিং করিমদিন) প্রদান করেনপ্রতাপপুর মৌজায় পড়ে পাওয়া একটি (পিতলের) গান্টারের স্কেল। এ সময় হতেই আমি বিদেশীয় প্রথায় জরিপ কাজ শুরু করি। কিন্তু জরিপ কাজের অন্যান্য যন্ত্রপাতির অভাবে সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পারছিলাম না।
১৩৫৫ সালে স্থানীয় আমিন তোরাপ আলী আকনজী তার কর্মজীবনের শেষ মুহুর্তে তার ব্যবহার্য প্লেন টেবিল ও সাইড ভ্যানটি আমাকে দান করে যান। ১৩৫৬ সালে দক্ষিণ লামচরি নিবাসী নজর আলী (পিং বাছেরদিন) দক্ষিণের চরে পড়ে পাওয়া একটি (নিকেলের) ড্রাইভার প্রদান করেন। জমিদার উচ্ছেদ হলে ১৩৬৪ সালে লাখুটিয়ার জমিদার মিঃ পরেশ লাল রায়ের (ঘুঘুবাবুর) তৎকালীন ম্যানেজার বাবু অনন্ত কুমার বসু মহাশয় তাদের অনাবশ্যক বিধায়| আমাকে প্রদান করেন- একটি নর্থ কম্পাস, একটি প্রিজম্যাটিক কম্পাস, চারটি রাইট এ্যাঙ্গেল ও একটি অপটিক্যাল স্কোয়ার। এর পর হতে কোন যন্ত্রপাতির অভাব না থাকায় আমি সুষ্ঠুভাবে জরিপ কাজ করতে সক্ষম হচ্ছি।
জরিপের বেশীর ভাগ কাজই হ’ল জমির সীমানা নির্ধারণ ও বাটারা করা। কিন্তু আমাকে মানচিত্র অঙ্কনের কাজ করতে হচ্ছে যথেষ্ট। এর মধ্যে আমার প্রধান দুটি কাজ হ’ল- ১৩৬৯ সালে চর বাড়ীয়া ইউনিয়নের ম্যাপ অঙ্কন ও ১৩৭৪ সালে চর মোনাই ইউনিয়নের ম্যাপ অঙ্কন করা। এর পারিশ্রমিক প্রাপ্ত হয়েছি যথাক্রমে- ২০০.০০ ও ১৮৭.০০ টাকা।
জরিপ কাজে শুরু হতে আমার বারবরদার (ভিজিট) ছিল নিম্নরূপঃ
১৩৩৩ সাল হতে ১৩৪৫ সাল পর্যন্ত (খোরাকী বাদ) দৈনিক ১.০০ টাকা
১৩৪৬ সাল হতে ১৩৫৩ সাল পর্যন্ত (খোরাকী বাদ) দৈনিক ২.০০ টাকা
১৩৫৪ সাল হতে ১৩৫৫ সাল পর্যন্ত (খোরাকী বাদ) দৈনিক ৫.০০ টাকা।
১৩৫৬ সাল হতে ১৩৫৭ সাল পর্যন্ত (খোরাকী বাদ) দৈনিক ৬.০০ টাকা
১৩৫৮ সাল হতে ১৩৭৭ সাল পর্যন্ত (খোরাকী বাদ) দৈনিক ৮.০০ টাকা
১৩৭৮ সাল হতে (খোরাকী বাদ) দৈনিক ১০.০০ টাকা
১৩৭৯ সাল হতে (খোরাকী বাদ) দৈনিক ১৬.০০ টাকা
১৩৮০ সাল হতে (খোরাকী বাদ) দৈনিক ২০.০০ টাকা
১৩৮১ সাল হ’তে (খোরাকী বাদ) দৈনিক ৩০.০০ টাকা
(জরিপ শিক্ষা বিষয়ক কোন বই পুস্তক পাঠের সৌভাগ্য আমার কখনো হয়নি।)

আমার কর্ম-জীবনের চরম দুর্দিন হ’ল ১৩৩৪ ও ১৩৩৫ সাল। ১৩৩৪ সালের ২০শে অগ্রহায়ণ আমি জ্বর ও মেহ রোগে আক্রান্ত হই এবং আমার একমাত্র ভগ্নি কুলসুম বিবি (জং আঃ হামিদ মোল্লা) সূতীকা জুরে আক্রান্ত হয়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। আমি আমার রুগ্ন শরীর নিয়ে সপ্তাহখানেক আহার নিদ্ৰা ছেড়ে ভগ্নির শীয়রে বসে থেকে ৫ই পৌষ দেখলাম তার শেষ নিশ্বাস ত্যাগ। আমি শোক সংবরণে অক্ষম হলাম, শুরু হল আমার হৎকম্প (প্যালুপিটেশন)। যদিও আমার হৎকম্প দুদিন পর কমে গেল, কিন্তু ২৭শে পৌষ ভগ্নির শ্রাদ্ধের দিন ভোজের সময় আবার হৎকম্প শুরু হল, আর কমল না। আমার চিকিৎসা চলুতে লাগল।
ফাগুন মাসে- মোল্লা সাবের হাতের সামান্য আঘাতে আমার হালের বড় গরুটা মারা গেল এবং চৈত্র মাসে গাছের সঙ্গে রশি জড়িয়ে পা ভেঙ্গে মারা গেল আমার একমাত্র গাভীটি। তহবিলে টাকা-পয়সা যা ছিল, তা এর আগেই নিঃশেষ হয়েছিল, হালের অপর গরুটি বিক্রি দিয়ে চালাতে লাগলাম আমার চিকিৎসা। কিছুদিন চিকিৎসা চল্লো গ্রামে, পরে জমি বন্ধক দিয়ে শহরে। চিকিৎসা চল্লো প্রায় ছয় মাস। আমার অবস্থা তখন এতই মারাত্মক আকার ধারণ করেছে যে, আমি যে কোন মুহুর্তে মারা যেতে পারি।
চিকিৎসা শাস্ত্রের বিধান মতে- একজন মানুষের দেহের স্বাভাবিক তাপ থাকে ৯৮ ৩/৫ ডিগ্ৰী এবং নাড়ীর স্পন্ন থাকে প্রতি মিনিটে ৭৫ বার। এক ডিগ্রী তাপ বৃদ্ধিতে নাড়ীর স্পন্দন দশবার বাড়ে। এ হিসাবে কোন রোগীর নাড়ীর স্পন্দন এক মিনিটে ১৪৫ বার হলে, তার দেহের তাপ হওয়া উচিত ১০৬ ডিগ্রী। কিন্তু আমার দেহের তাপ ছিল ৯৮ ৩/৫ ডিগ্রী বা তার চেয়েও কম। অথচ নাড়ী স্পন্দন অর্থাৎ হৃৎস্পন্দন ছিল মিনিটে ১৪৫ বার। আহার ছিল প্রায় বন্ধ, বাহ্য হত মাত্র সপ্তাহে একবার। মারাত্মক উপসর্গ ছিল “অনিদ্ৰা”। ডাঃ আনন্দ মোহন রায় ৩০ গ্রেন মাত্রায় ব্রোমাইড দিয়েও আমার নিদ্ৰা জনাতে পারেন নাই। তবে ডাঃ ক্যাপ্টেন হরবিলাস চ্যাটাজী “প্যারাল ডিহাইড” দিয়ে কয়েক দিন ঘুম পাড়াচ্ছিলেন। কিন্তু তাতে উপকারের চেয়ে অপকার হয়েছে বেশী।
ডাঃ আনন্দ মোহন রায় ও ডাঃ হরবিলাস চ্যাটাজী তিন মাস চিকিৎসা করেও কোন সুফল না পেয়ে একদা আমাকে বল্লেন যে, এ্যালোপ্যার্থী শাস্ত্রে এ রোগের আর ওষুধ নেই। অর্থাৎ এ রোগ সারবার নয়। কবিরাজী খেতে শুরু করলাম। বরিশালের তৎকালীন প্রখ্যাত কবিরাজ – প্রসন্ন কুমার সেন গুপ্ত, গোপাল চন্দ্র সেন গুপ্ত ও মতিলাল সেন গুপ্ত আরো তিন মাস কাল চিকিৎসা করেও নিস্ফল হয়ে একদা আমাকে বল্লেন- “এখন বাড়ীতে গিয়ে ভগবানকে ডাকতে থাকুন, আয়ুর্বেদে এ রোগের আর ঔষধ নেই”।
মোল্লা সাব আমার ভগ্নির মৃত্যু দেখতে পান নাই। তখন তিনি ছিলেন বেতাগী থানায়। তবে তার শ্রাদ্ধের সময় ছুটি নিয়ে বাড়ীতে এসে আমাকে মরণাপন্ন ফেলে আর চাকুরীতে যাননি। তিনি আমার আরো এক কেৰ্ত্তী জমি বন্ধক রেখে ১৫০.০০ টাকা সংগ্রহ করে আমাকে নিয়ে ঢাকা যাত্রা করলেন (২৭শে আষাঢ় ১৩৩৫ সাল)। ঢাকা গিয়ে মিডফোর্ড হাসপাতালে আমাকে ভর্তি করলেন। ওখানে ডাঃ চারু বাবু ও ডাঃ সাহাবুদিন সাব আমাকে দেখলেন, এক্সরে করলেন; ব্যবস্থা করলেন- কম্ফোলেছিথন, এ্যাফ্রোটোন ও এক দফে মিকচার।
২রা শ্রাবণ আমরা বাড়ীতে আসবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু দেখা গেল যে, দুজনের ষ্টিমার ভাড়া তহবিলে নেই। তখন ঢাকায় আমাদের পরিচিত এমন কোন লোক ছিল না, যার কাছে দুটাকা হাওলাত পাওয়া যেতে পারে। দায় পড়ে বাড়ীতে আসতে হচ্ছে মাত্র একজন। এখন সমস্যা হল – কে আগে আসবে। মোল্লা সাব আমাকে বল্লেন- “তুমি মুমুর্ষ রুগী, তুমি যদি ঢাকায় থাক আর মারা যাও; তবে সে সংবাদ পেয়ে বা না পেয়ে পুনঃ আমি ঢাকায় এসে হয়ত তোমার লাশও পাব না। আর তুমি আগে গিয়ে জাহাজে মার#2494; গেলেও অন্ততঃ তোমার লাশটা বরিশাল পর্যন্ত পুছবে। কাজেই তুমিই আগে যাও।” আমি একাই বাড়ীতে এলাম এবং পরের দিন টেলিগ্রাফ মনিঅৰ্ডার করে টাকা পাঠালাম। তিনি টাকা পেয়ে পরে বাড়ী আসলেন।
ঢাকার ব্যবস্থা মোতাবেক ওষুধ কিনে ১০ই শ্রাবণ হতে উহা সেবন শুরু করলাম এবং এক মাস ঔষুধ ব্যবহারে আরোগ্য লাভ করলাম (রোগারোগ্যের পরেও দুমাস ওষুধ সেবন করেছি।) কিন্তু দুর্বলতায় হলাম চল-শক্তি রহিত।

১.১১ বস্ত্র বয়ন শিক্ষা (১৩৩৫)

রোগারোগ্যের পর – শুয়ে-বসে প্রায় দমাস কেটে গেলে কোন রকম চলা-ফেরার শক্তি হ’ল কিন্তু কৰ্মশক্তি হ’ল না। তখন ভাবতে ছিলাম – কি করব। সে সময় এদেশে স্বদেশী ও অসহযোগ আন্দোলন এবং টাকু-মাকু পুরাদমে চলছে। অর্থাৎ তাত ও চরকা ঘরে ঘরে। স্থির করলাম যে, বসে বসে (অল্প শ্রমের কাজ) কাপড় বোনা শিক্ষা করব।
মোঙ্গল হাটা নিবাসী ওসমান খা নামক জনৈক তাতীর সহিত আমার পরিচয় ছিল। আশ্বিন মাসের শেষ ভাগে আমি তার বাড়ীতে গেলাম তাত ও কাপড় বোনা দেখবার জন্য। সেখানে বহু তাঁতীর বাস। আমি কয়েক বাড়ী ঘুরে ঘুরে খুব লক্ষ্য করে দেখলাম তাদের সূতা ভাতানো (মাড়দেওয়া), উঠানো, সুখানো, নাটাই ভরা, ননীভরা, তানানো, গোছানো, রাজভরা এবং ব-সুতা বাধা, মাকুচালানো (বোনা) ইত্যাদি সবই। অতঃপর কাগজে নক্সা আঁকলাম- তাত, চরকা, নাটাই, বাতাই, জাকী, নলী, রাজ, ব, মুঠা, পহ্নি ইত্যাদি যাবতীয় যন্ত্রপাতির এবং সঙ্গে সঙ্গে ওসবের প্#2509;রত্যেকটি অংশের মাপঝোক লিখে নিলাম। তবে কোন তাতে নিজ হাতে কাপড় বুনে দেখলাম না। কেননা ওঁদের বোনা দেখে মনে সাহস হল যে, উহা পারব। সব ঠিক মত বুঝে নিয়ে বাড়ীতে এলাম।
১৩৩৫ সালের ৭ই কার্তিক আমি নিজ হাতে তাত নির্মাণের কাজে লেগে গেলাম। সম্পূর্ণ তাত যন্ত্রটি ও তার আনুষঙ্গিক চরকা ইত্যাদি বাজে সরঞ্জাম (রাজ-মাকু বাদে) নির্মাণ করতে প্রায় তিন মাস কেটে গেল। ১৫ই মাঘ আমি কাপড় বোনা আরম্ভ করলাম।
জীবনে মাত্র একদিন কয়েক ঘন্টা কাপড় বোন দেখে তার স্মৃতির উপর নির্ভর করে বড় সাইজের কাপড়ের “টানা” নিতে সাহস পেলাম না, প্রথম “টানা” টি নিলাম- ৪ X ১ হাত সাইজের গামছা কাপড় ২৫ খানা (১০০হাত)। প্রথম খুব আস্তে আস্তে মাকু চালাতে শুরু করলাম। “টান”টি বুনে নামালাম বারো দিনে (দৈনিক ৮ ১/৩, হাত)।
দ্বিতীয় “টান”টি নিলাম ৬ X ২ হাত সাইজের পরনের গামছা কাপড় ২৫ খানা (১৫০ হাত)। এ “টান”টি বুনে নামালাম পনর দিনে (দৈনিক ১০ হাত)। এর পর লুঙ্গী ও তৎপর শাড়ী কাপড় বোনতে থাকি। বছর খানেকর মধ্যে আমার কাপড় বোনার ক্ষমতা হল দৈনিক ২৫ হাত (প্রায় দু বছর পর দুটি কারণে আমাকে কাপড় বোনা ত্যাগ করতে হয়। প্রথম কারণ হ’ল -স্বাস্থের উন্নতির সাথে সাথে আমি পল্লী উন্নয়ন ও স্কুলের শিক্ষকতা কাজে জড়িত হয়ে পড়ি এবং দ্বিতীয় কারণ হল-সূতার মূল্যবৃদ্ধি ও মিলের কাপড়ের তুলনায় তাঁতের কাপড়ের মূল্য হ্রাস।)

 ১.১২ উচ্চ শিক্ষার প্রচেষ্টা (১৩৩৫)

আগে বলেছি যে, আমাদেরগ্রামে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। বৃটিশ সরকারের বদৌলতে প্রতি ইউনিয়নে প্রাইমারী স্কুল ছিল একটি করিয়া (ডিঃ বোর্ড কর্তৃক পরিচালিত হত বলে ওর নাম ছিল-“বোর্ড স্কুল”)। আমাদের ইউনিয়নের “বোর্ড স্কুল”ট চর বাড়ীয়া মৌজায় অবস্থিত, দূরত্ব আমাদের গ্রাম হতে প্রায় ৫ মাইল। আর বরিশাল শহর ছাড়া হাইস্কুল ছিল না এ অঞ্চলে একটিও। কাজেই ১৩৩৪ সালের পূর্বে আমাদের গ্রামের কোন ছেলে-হাই স্কুল তো দূরের কথা, প্রাইমারী স্কুল ও চিনতো না।
১৩৩৪ সালে বরিশালের টাউন (হাই) স্কুলে ভর্তি হ’ল স্থানীয় ছাত্ৰ-আঃ আজিজ মাতুব্বর ও ফজলুর রহমান মৃধা যথাক্রমে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীতে এবং এ শ্রেণী অতিক্রম করল ১৩৩৫ সালের অগ্রহায়ণ মাসে। এ সময় আমার স্বাস্থ্যের অনেকটা উন্নতি হয়েছে। পরীক্ষার পর ওদের চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর যাবতীয় পাঠ্য পুস্তক এনে আমি পড়তে শুরু করলাম। দিনের বেলা পড়বার সময় অল্পই পেতাম, বিশেষ ভাবে পড়তে হত রাত্রে। কেননা তাত তৈরীর কাজে ব্যস্ত ছিলাম। বিশেষত- জীবনে যতটুকু পড়াশুনা করেছি, তা অধিকাংশই রাত্রে ।
চতুর্থ শ্রেণীর পাঠ্য বই গুলো একবার পড়ে দেখে রেখে দিলাম এবং পঞ্চম শ্রেণীর -সাহিত্য, পড়বার জন্য একটা “রুটিন” করে নিলাম। কিন্তু ইংরেজী নিলাম না। তার কারণ ইংরাজী পড়ায় আমার একটা অসুবিধে হচ্ছিল এই যে, কতিপয় ইংরেজী শব্দের “উচ্চারণ” সাধারণ নিয়ম মত হয় না, হয় এক অভিনব রূপে। আবার কতগুলো শব্দের কোন কোন “বর্ণ” লুপ্ত রেখে উচ্চারণ করতে হয়। যদিও এ অনিয়মটাও একটা “নিয়ম”, তথাপি প্রাথমিক শিক্ষার্থীর পক্ষে কোন শিক্ষকের সাহায্য ছাড়া এ অসুবিধে কাটিয়ে ওঠা মুশকিল। বাংলা ভাষায় ওরূপ উচ্চারণ বিভ্রাট নেই, তা নয়। তবে মাতৃভাষা বলে তা কাটিয়ে ওঠা আমার পক্ষে ততটা কঠিন বোধ হয়নি, যতটা হচ্ছে ইংরেজীতে। একজন ইংরেজী বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মতে “রাজভাষা” নামক একখানা বই কিনলাম। বই খানায়ে-নিত্যাবশ্যকীয় যাবতীয় ইংরাজী শব্দের বঙ্গানুবাদ এবং উহার “উচ্চারণ” ভঙ্গি বাংলায় লিখিত ছিল। ওখানা পড়তে থাকলাম, রুটিন করে নয়; ইচ্ছাধীন রূপে।
নিয়মিত ভাবে পড়তে লাগলাম এবং ত্রৈমাসিক, ষান্মাসিক ও (১৩৩৬ সালের অগ্রহায়ণ মাসে) বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে (৫ম শ্রেণীর) পাঠ্য বইগুলো পড়া সমাপ্ত করলাম। কিন্তু পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি কি-না তা জানিনে। কারণ আমার পরীক্ষক-আমিই, অন্য কেউ নয়। আমার পরীক্ষার স্বরূপটি এই-বই গুলো ভাল ভাবে পড়ে পরীক্ষার জন্য তারিখ ধার্য করেছি এবং প্রত্যেক বিষয়ের পরীক্ষার নির্ধারিত তারিখের এক মাস (ত্রৈমাসিক ও ষান্মাসিক পরীক্ষার ১৫ দিন) পূর্বে বিশেষ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর দশটি করে প্রশ্ন লিপিবদ্ধ করে বইয়ের পড়া বন্ধ করেছি, এমন কি হাতে লওয়াও। অতঃপর-নির্ধারিত তারিখে শুধু স্মৃতির সাহায্যে প্রশ্নের উত্তর লিখেছি। পরীক্ষার পরে প্রশ্নোত্তরের সহিত বই মিলিয়ে দেখেছি যে, আমার উত্তর সমূহ কতটুকু ভুল বা নির্ভুল হয়েছে এবং তদনুপাতে নম্বর দিয়েছি। এতে কোন কোন বিষয় উত্তীর্ণ হতে পেরেছি, সব বিষয়ে পারিনি। তবে ওর জন্য আর স্বতন্ত্র পরীক্ষার ব্যবস্থা করিনি, স্থির করেছি ও সব বিষয় পরে শোধরে নেব। যা হোক এভাবে আমার পড়া চালাতে লাগলাম।
(আঃ আজিজ ও ফজলুর রহমানের পুরোনো পাঠ্য বই গুলো যত্ন সহকারে এনে আমি A নিয়মিত ভাবে পাঠ করেছি-১৩৩৫-১৩৪১ সাল পর্যন্ত (১০ম শ্রেণী)। ১৩৪০ সালে – ? আঃ আজিজ তার পিতৃ বিয়োগ হেতু পরীক্ষা না দিয়ে পড়া বন্ধ করে এবং ফজলুর রহমান মেট্রিক পাশ করে বরিশাল বি, এম কলেজে ভর্তি হয়। অতঃপর আমি ১৩৪২ ও ১৩৪৩ সাল পর্যন্ত ফজলুর রহমানের “আই, এ” শ্রেণীর ১ম ও ২য় বছরের পুরোনো পাঠ্য বই গুলো অধ্যয়ন করি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ তার “বি, এ” শ্রেণীর পাঠ্য গুলো কোন কারণে আমার হস্তগত না হওয়ায়, তখন উহা পাঠ করিতে পারিনি। তবে উহা পাঠ করবার সুযোগ পেয়েছিআমার সেজ ছেলে আঃ খালেক (মানিক) এর- ঢাকা টিএনটি কলেজে “বি,এ” পড়বার প্রাক্কালে-১৩৮০-১৩৮১ সালে। ১৩৪৩ সালের পর হতে পাঠ্য পুস্তক পড়বার সুযোগ হারিয়ে ১৩৪৪ সালে হতে শুরু করি বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরীর সদস্য হয়ে ওখানে পুস্তকাদি অধ্যয়ন করা)।

১.১৩ জাল বুনা শিক্ষা (১৩৩৬)

ভৌগোলিক অবস্থান ভেদে বিভিন্ন দেশের প্রকৃতি বিভিন্ন এবং প্রকৃতি ভেদে বিভিন্ন দেশের উৎপন্ন বা পণ্য দ্রব্য বিভিন্ন। আবার যে দেশে যে দ্রব্য উৎপন্ন হয় বেশী, সে দেশবাসীর পক্ষে সেই দ্রব্যই হয় প্রধান আহার্য ও ব্যবহার্য। নিম্ন সমতল ও নদীবহুল এই বাংলাদেশ। তাই এদেশে ধান ও মৎস্য সম্পদের প্রাচুর্য্য। কাজেই এ দেশবাসীর সর্ব প্রধান খাদ্যই হ’ল-মাছ ও ভাত। আর এ জন্যই বলা হয়-“মাছে ভাতে বঙ্গালী তুষ্ট”। এ কথাটা আমাদের গ্রামের পক্ষে বেশী সত্য। কেননা এ গ্রামটির প্রায় সব দিকেই নদী এবং ভিতরে ছোট-বড় খালও আছে পাঁচ-ছয়টি। নদী ও খাল গুলোতে প্রচুর মাছ পাওয়া যায় বারো মাসই, যদি কেউ ধরতে জানে ও পারে।

এখন যদিও পূর্বের ন্যায় মাছের প্রাচুর্য নেই। তবুও আমাদের গ্রামের কতিপয় লোক বছরে হাজার হাজার টাকা উপার্জন করছে মৎস্য বিক্রি দিয়ে।
মাছ ধরে খেলে যেমন পয়সা বাচে, তেমন পাওয়া যায় সুখাদ্য ও ধরার আনন্দ। আমি মাছমাংস খেতে ভালবাসি না, আমার প্রিয়-খাদ্য হ’ল নিরামিষ। তবুও মাছ ধরবার আগ্রহ যথেষ্ট। অনেকের “মাছ ধরা” একটা নেশা।
মাছ ধরার অনেক রকম পদ্ধতি আছে। যেমন জাল, বরশী, পলো, বেড়-গড়া, যোতী-কোচ, চাই-চাড়োয়া ইত্যাদি। আবার “জাল” অনেক রকম দেখতে পাওয়া যায়। যেমন-ঝাকী জাল, খোটু জাল, খুতুনী জাল ইত্যাদি। হাতে অস্ত্র পেলেই যেমন যোদ্ধা হওয়া যায় না, তেমনহাতে জাল-বরণী পেলেই মাছ মারা যায় না। এর জন্য আবশ্যক- যোগ্যতা ও দক্ষতা। অর্থাৎ শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা। মাছের -আহার, বিহার, চাল-চলন ও স্বভাব জানতে হয়। জানতে হয় মাছের মনোবৃত্তি।
আমি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদ্ধতিতে মৎস্য শিকার করেছি। কিন্তু বিশেষ ভাবে ব্যবহার করেছি “জাল”। অনেকে মৎস্য-শিকারে আগ্রহী হলেও শিকার-যন্ত্র নির্মানে পারদশী নয়। হয়ত উহা কিনে নেয়, নতুবা অন্যকে দিয়ে বানিয়ে নেয়। কিন্তু মৎস্য শিকার অপেক্ষাও যন্ত্র নিমানে আমার আগ্রহ বেশী।
ঝাকী, মইয়া, খোট, খুতুনী ইত্যাদি কতিপয় জাল আমাদের গ্রামের নিত্য ব্যবহার্য যন্ত্র। কাজেই ওগুলোর বয়ন ও ব্যবহার প্রনালী সহজেই শিখতে পেরেছি। কিন্তু কতিপয় জাল বুনা শিখতে হচ্ছে আমাকে দূরাঞ্চলে গিয়ে।

Exit mobile version