Site icon BnBoi.Com

ধর্ম জীবন – লুৎফর রহমান

ধর্ম জীবন - লুৎফর রহমান

০১-০৫. ঈমান ধর্ম-বিশ্বাস

০১. ঈমান ধর্ম-বিশ্বাস

আল্লাহূতে বিশ্বাস–আল্লাহ্ আছেন, তাঁর কাছে মানুষের কৃতকর্মের বিচার হবে, তাঁর। প্রেরিত সমস্ত ধর্মগ্রন্থ বিশ্বাস, সমস্ত নবীগণে বিশ্বাস এবং সকলের উপরে আল্লাহ্ আছেন, আমার সুখ-দুঃখ জীবনের প্রত্যেক কাজের উপর তার দৃষ্টি আছে–এটা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করার নাম ঈমান। এ কথা আরও পূর্বে বলা হয়েছে। সবাই আল্লাহ্ আল্লাহ্ করি, সবাই বলি মুখে আল্লাহ্। কিন্তু সত্য করে তার অস্তিত্বে বিশ্বাস মানুষের জন্যে এক অফুরন্ত শান্তি। ঈমান যে লাভ করেছে, সে মহাসম্পদ লাভ করেছে, সে রাজত্ব লাভ করেছে।

আল্লাহ্ আছে–এ বিশ্বাসের মূল্য অনন্ত। আল্লাহ আছেন, যে অন্তরে এ বিশ্বাস সত্যি করে পোষণ করে, তার জীবনে কোনো ভয় নেই। সে নির্ভীক, সে বলবান, সে সাহসী।

বিশ্বাসরূপ মহাসম্পদ আল্লাহই মানুষকে দান করেন। আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাসী জগতে অসাধ্য কাজ করে–সে পাপ করে না, পাপ করতে পারে না। দুঃখে সে সহিষ্ণু, বিপদে সে ধৈর্যশীল, অভাবে সে শান্ত। সে অজেয় শক্তির অধিকারী।

শত্রু যখন তরবারি হস্তে হযরতকে জিজ্ঞাসা করলো-মহম্মদ, তোমায় কে রক্ষা করবে? হযরত সুদৃঢ় বিশ্বাসে বললেন–আমার আল্লাহ্ আমাকে রক্ষা করবেন। শত্রুর কম্পিত ভীত হস্ত হতে তরবারি মাটিতে পড়ে গেল।

নেপোলিয়ন যুদ্ধক্ষেত্রে কামান গর্জন, গোলা বর্ষার মধ্যে ক্লান্ত শরীর নিয়ে নির্ভয়ে। শান্তির সঙ্গে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তেন। বিশ্বাসই ছিল তাঁর শক্তি।

.

০২. ধর্ম জীবন

একজন ভদ্রলোক দিনের মধ্যে শতবার অজু করতেন। অজুর তার অন্ত ছিল না। নামাজেরও না। বাড়িতে নিজের সম্বন্ধীর পুত্রকে বাল্যকাল থেকে পালন করছেন। নিজের। একটি মেয়ে আছে, তারই সাথে বিয়ে দেবেন–এ রকম পাকাঁপাকি কথা। ছেলেটি ম্যাটিক। পাস করে কলেজে গেল। তখনও সবাই ভাবছিল, বোধ হয় দু-এক বছরেই ভদ্রলোক কথা। পালন করবেন।

এর মধ্যে তার ভ্রাতার ছেলেরা বি, এ, পাস করেছে। একদিন তিনি, তারই একজনার সঙ্গে মেয়েটিকে বিয়ে দিলেন। ইনি শতবার নামাজ পড়লেও ধর্মরক্ষা করেছিলেন কি?

মুসলমান সমাজে ধর্ম সম্বন্ধে একটা মিথ্যা বিশ্বাস ভূতের মতো পেয়ে বসেছে–এ বিশ্বাস ভাঙ্গা তার জীবনে হয়তো ঘটবে না। জীবনের কদর্যতা সম্বন্ধে সে সচেতন নয়–নিয়ম পালনই হয়েছে তার ধর্ম।

একটি লোকের বেতন মাত্র পঁচিশ টাকা। এই পঁচিশ টাকা বেতনের চাকরি করে ইনি জমিদারি করেছেন–চার-পাঁচটি ছেলেমেয়েকে উচ্চ শিক্ষা দিয়েছেন। একজনের বা দশজনের সর্বনাশ না করে কেমন করে তিনি উচ্চাসন লাভ করলেন? অথচ এর জীবনে। একবারও নামাজ কাজা হয় নি, কথায় কথায় ইনি কোরানের শ্লোক আবৃত্তি করেন। ইসলাম ধর্মের মতো মহৎ শ্রেষ্ঠ ধর্ম জগতে আর নাই, এই কথা বলেন।

মুসলমান জাতির ধর্ম, এই জাতির জীবন এবং আত্মার উপর কোনো প্রভাব বিস্তার করে না। নামাজ! নামাজ! নামাজ! আজান শুনলে পুণ্যের জন্য মুসলমানেরা মসজিদ ঘরের দিকে সন্তান সঙ্গপ্রয়াসী গাভীর মতো পুচ্ছ তুলে দৌড় দেন।

মুসলমান জাতির এই ভুল কঠিন আঘাতে ভাঙ্গতে হবে। ধর্ম অর্থ পাপ বর্জনের সাধনা। মিথ্যার সঙ্গে আত্মার সগ্রাম। প্রার্থনায় এই কাজের সহায়তা হবে–এই জন্য ইসলাম ধর্মে প্রার্থনার ব্যবস্থা।

আমি মুসলমান জাতিকে সাবধান করছি–যদি তারা শুধু রোজা-নামাজকেই ধর্ম মনে করে বসে থাকেন, তবে তারা পরকালে কোনোমতে মুক্তি পাবেন না।

আমার আত্মীয় শ্রেণীর কোনো কোনো অতি গুণ্ডা শ্রেণীর লোক যারা চির-জীবন বেশ্যালয়ে কাটিয়েছেন, তারা বুড়োকালে শক্তিহীন হয়ে শুধু রোজা নামাজ শুরু করে আমাকে ঘৃণায় বলে থাকেন, “তুমি ঘোর দুরাচার লোক। তুমি রোজা-নামাজ অস্বীকার কর? তুমি কাফের?” আমি যে কি বলতে চাচ্ছি সে কথা এইসব বুড়ো মূর্খরা মোটেই বুঝতে চায় না। ঈশ্বরের সঙ্গে প্রেমের বিনিময় এবং গভীর আত্মীক সংযোগ এইসব হতভাগ্য নামাজি দৃর্বত্তেরা শত জীবনেও লাভ করতে পারবে না। কারণ বুড়োকালে তারা কাছাখোলা মুসল্লী হয়েছে, তবু তারা চৌর্য, প্রতারণা, মিথ্যা ও মন্দ জীবন ত্যাগ করতে পারে নি। ধিক এইসব নামাজি শয়তানদিগকে! যদি ইংরাজের আমল না হতো, তা হলে নিশ্চয় অসহিষ্ণু, হয়ে এরা আমাকে এতদিন প্রকাশ্যে হত্যা করে ফেলতো। যদিও এ অবস্থায় গোপনে সে প্রচেষ্টা কতিপয় লোকের মধ্যে হয়েছিল।

যে মানুষ বা যে জাতির জীবনে ন্যায় ও সত্যের সমাদর নাই–যারা জীবনে ন্যায়বান ও সত্যময় হওয়াকে ধর্ম মনে করেন না–যারা জীবনে মিথ্যা কাজ ও অন্যায় কথা বলতে ভীত হয় না–এতে অধর্ম হয়, এই কথা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে না, বাইরে নিয়ম পালন, ক্রিয়াকলাপ, রোজা-নামাজ এবং পুজাকেই ধর্ম মনে করে, তাদেরকে অপবিত্র শার্দুল জ্ঞানে বর্জন কর। এরা ধর্মের কিছুই জানে না। এই কথা এক বর্ণও মিথ্যা নয়। জগতে যখন ধর্মের ভ্রান্তি ও বিস্মৃতি আসে, তখন ঈশ্বরের বাক্যপ্রাপ্ত এক একজন বাণী বাহকের আবির্ভাব হয়। এ ব্যক্তিবিশেষের ইচ্ছায় হয় না, সময় ও অবস্থার চাপে কঠিন দুঃখের ভিতর দিয়ে শত বেদনাকে জয় করে একটি মানুষের আবির্ভাব হয়–যে সারা জীবন ঈশ্বরের সত্য বাক্য প্রচার করে। মনুষ্য তাকে প্রথমত অগ্রাহ্য করে। যদি জীবনে মিথ্যা কাজ করতে অধর্ম বোধ না কর, অন্যায় করতে অধর্ম মনে না ভাব-জীবনকে সর্ব অন্যায় হতে রক্ষা করতে আন্তরিক চেষ্টা কর, তবে রোজা-নামাজ করো না। সে রোজা-নামাজ, পূজা-অর্চনা ছুঁড়ে ফেলে দাও।

রোজা-নামাজের অন্তরালে জীবনকে মিথ্যামুক্ত করতে চেষ্টা কর। জেনেশুনে অন্যায় ও মিথ্যা করে সর্বদা মসজিদ ঘরে যেয়ো না–ও মিথ্যা ভণ্ডামী ঈশ্বর সহ্য করতে পারে না। যে চোর, ঘুষখোর, প্রতারক, পরনিন্দুক, আহম্মক, অশিক্ষিত, পরস্বার্থহারী, বিশ্বাসঘাতকতার আবার রোজা-নামাজ কী? তোমার লম্বা জামা, দীর্ঘ নামাজ এবং লম্বিত শুশ্রুতে তুমি কিছুতেই বেহেস্তে যাবে না। রে ঘুষখোর–দুর্মতি, রে হারাম (অবৈধ অন্ন) খোর, বেশ্যা তোমরা কি জন্য কপালে তিলক কাটলে, তীর্থে যাত্রা করলে?

এক ব্যক্তি আপন ভ্রাতার পিতৃ-মাতৃহীন সন্তানের সম্পত্তি আত্মসাৎ করবার লোভ করেছে। যেদিন সে এই পিতৃ-মাতৃহীনের সম্পত্তির কেশাগ্র নষ্ট করতে ইচ্ছা করছে, সেদিন হতে তার জীবনের সমস্ত এবাদত, সমস্ত তীর্থ যাত্রার পুণ্য নষ্ট হয়েছে। রে অন্ধ, মানুষ ঠকাচ্ছ–আল্লাহকে কী করে ঠকাবে!

জীবনে সুন্দর হও–জীবনকে মিথ্যা হতে রক্ষা কর। হায় বিধর্মীরা তোমরা ঈশ্বরকে ধর্ম রক্ষার নামে এমনভাবে অপমান করলে? হে শুদ্ধাচারী তাপসগণ, হে ঈশ্বর। মনোনীতেরা, তোমরা ভণ্ড অধীকারীদের সর্পবৎ ভয় কর এবং তাদের সংশ্রব হতে দূরে থাক। অন্ধকার লোকচক্ষুর অগোচরে নিজেকে পরীক্ষা কর–দিবসে কয়টি মিথ্যা, কয়টি অন্যায় করেছ। তারপর নামাজে বসে সে জন্য অনুশোচনা কর–প্রতিজ্ঞা কর, দ্বিতীয় দিন আর পুনরায় তোমার দ্বারা তেমন অন্যায় হবে না।

দোহাই তোমাদের জীবনে সুন্দর ন্যায়বান এবং সত্যময় হও–আমাকে বিশ্বাস। কর। আমি হযরত মহম্মদের (সঃ) প্রতিনিধিরূপে তোমাদ্রে সাবধান করি। আমাকে। অসম্মান করো না।

পাপ করে করে নিত্যই ক্ষমা প্রার্থনা করবে আর মনে করবে ক্ষমা হয়েছে। কোন্ পাগলে বলেছে, তোমাদের নামাজের পূণ্য আলাদা আর পাপের শাস্তি আলাদা। তোমরা মনে কর খোদার হাতে বণিকদের খাতা আছে–যেখানে প্রত্যেক মানুষের হিসাব জমা খরচ লেখা হবে! ওরে পাগল। জগতের আবর্জনা! তোমাদের নামাজে পুণ্য হয়, কে বলেছে? ও নামাজে এক রতি পুণ্য নাই। নামাজ অর্থ সালাত। সালাত অর্থ প্রার্থনা। প্রার্থনা।

অর্থ খোদার কাছে পাপের অনুশোচনা, কাদাকাটা করা। তুমি যা চাও, তাই পাও কিনা, সেই কথা ভাব। প্রার্থনা করলে, নামাজ পড়লে ঝুড়ি ঝুড়ি সোয়াব হবে অজ্ঞানদের মাঝে। এ বক্তৃতা দেওয়া চলে–একথা কি সজ্ঞান মানুষকে বলা যায়?

তোমার সম্মুখে পথ দুইটি–একটি বিনাশের পথ, আর একটি (জীবনের এহসান দেয়) মুক্তির।

একদিকে ঈশ্বর, অন্য দিকে শয়তান। একদিকে নূর, অন্যদিকে জুলমাত বা অন্ধকার।

প্রতিদিন ধীরে ধীরে চেষ্টা করে জীবনের পথে ঈশ্বরের দিকে অগ্রসর হতে হবে, দিন দিন সাধনা, অনুশোচনা, চিন্তা, অন্বেষণ ও প্রার্থনা দ্বারা ঈশ্বরের পথে অগ্রসর হবে অথবা। দিন দিন অবহেলা, পাপ, মন্দতার-পতন ও বিনাশের পথে ধাবিত হবে। দুই দিকেই।

অগ্রগতি কী করে হবে? পাপও করবে আলাদা, পূণ্যও করবে আলাদা–সে কি হয়!

সত্যের জন্য ন্যায়ের জন্য দুঃখ সহ্য কর। ইহাই এরাদত। ইহারই নাম ঈশ্বর। উপাসনা। ওষ্ঠের আবৃত্তিতে কি ঈশ্বর-অর্চনা হয়?

.

০৩. ঈশ্বরের অপমান

আমি দেখতে পাচ্ছি বর্তমানে নামাজকে একটা প্রতিমারূপে খাড়া করা হয়েছে। ওরই পূজা মুসলমানেরা করে।

প্রতিদিন মানুষ যে কীভাবে কতবার ঈশ্বরের অপমান করে তা সে বুঝতে পারে না। ঈশ্বর মানে তার কাছে একটা মানুষের মতো বাদশাহ। আকাশের সিংহাসনে বসে আছেন। আমি কি করি না করি কিছু ঠিক পান না। ভালো করে শেষকালে তোষামোদ করলে–তিনি স্বর্গে যেতে দেবেন। হায়, পুত্র-কন্যা এবং বিবির গলায় পুষ্পহারের জন্য মানুষ অর্থ লালসায় কীভাবে ঈশ্বরকে অপমান করে!

এক সরকারি ডাক্তার, তিনি সমাজ প্রেমে হাবুডুবু খেতেন। কাগজে প্রবন্ধও লিখতেন। বড় বড় বিজ্ঞানের কথা বলতেন। কোট-প্যান্ট পরতেন। যে সমস্ত লোক তার কাছে আসত তারা গোপনে তাকে এক কোনায় ডেকে নিয়ে যেতো আর ফিসফিস করে কিছু টাকা নিয়ে মিথ্যা রিপোর্ট ম্যাজিষ্ট্রেটকে দিতে অনুরোধ করতো। ডাক্তার সাহেব মোটা রকম ঘুষ নিয়ে সত্যকে মিথ্যা করতেন মিথ্যাকে সত্য করতেন। এই কাজের দ্বারা তিনি কীভাবে কতবার সত্যকে অপমান করেছেন–সে জ্ঞান তার ছিল না। এতো ঈশ্বরকে অপমান করা। ঈশ্বর আর সত্য কী দুই? মুসলমান আর হিন্দুর ঈশ্বর কী দুই? ইসলাম ধর্ম! এর মতো মহৎ শ্রেষ্ঠ ধর্ম আর নাই।–এই ছিল সেই অর্থলোভী ডাক্তারের বড়াই। ইসলাম ধর্ম কি ঈশ্বরবর্জিত? যদি তা না হয়, তবে ঈশ্বরকে অপমান করে কি করে ইসলাম ধর্মকে ভালবাসা যায়? হায় ধর্ম! কে তোমাকে চায়? ঈশ্বর, আমি তো দেখতে পাই–যেখানে মিথ্যা কাজ-অন্যায়ের প্রাধান্য, সেখানেই তোমার অপমান। সর্বত্রই তোমার অপমান হচ্ছে! যেন তুমি কিছুই দেখতে পাচ্ছ না, বুঝতে পাচ্ছ না, এমনিভাবে তোমার সৃষ্টি মানুষ তোমার সঙ্গে ব্যবহার করে।

০৪. ধর্মের ব্যাখ্যা

বাংলা ১৩৮৪ সালে বৈশাখ সংখ্যায় মাসিক সাহিত্যিক’ পত্রিকায় গোলাম মকসুদ এম, এ, ‘মানব ধর্ম’ শীর্ষক প্রবন্ধে হযরত মহম্মদ-এর দুইটি বাক্য উদ্ধৃত করেছিলেন;

“ঐশ্বরিক গুণে গুণান্বিত হও।”

“সমস্ত জগৎ আল্লাহতায়ালার নিকট পরিবার। যিনি তাঁহার পরিবারের যত অধিক উপকার করেন, তিনি তাঁহার নিকট তত অধিক প্রিয়।”

মৌলানা রুমীর কবিতায় দুই ছত্রের অনুবাদ লিখেছেন–তোমার মধ্যে দেবত্ব ও পশুত্ব দুই-ই আছে, যদি পশুত্বটুকু দূর করতে পার, তুমি দেবতাদেরকে (ফেরেস্তা অর্থাৎ আল্লাহর অর্চনারত ফেরেস্তা) অতিক্রম করে যেতে পার।

ধর্ম সম্বন্ধে নিজের মতামত লিখেছেন শয়তানের উপর জয়যুক্ত হওয়াই মনুষ্যত্বের সার ধর্ম। এই-ই বিশ্ব মানব ধর্মের মূলমন্ত্র। …কেবল আনুষ্ঠানিক প্রার্থনা ও উপবাসই ধর্ম নহে।

সৈয়দ আবদুর রব ‘মাসিক মোয়াজ্জিন’ পত্রিকায় ৭ম বর্ষ ১৩৪১, বৈশাখ সংখ্যায় ৮ম পৃষ্ঠায় লিখেছেন;

“আত্মায় সত্যের আসন প্রতিষ্ঠা করাই ধর্ম। সত্যের যে প্রাণবন্ত ঝঙ্কার সজ্ঞান মানুষ আপন আত্মায় অনুভব করিবে তাহাই তাহার ধর্ম।”

এই দুটি বস্তু এবং যারা ধর্মের প্রকৃত পরিচয় আত্মীয় অনুভব করতে পেরেছেন, তাদের কালবিলম্ব না করে একসঙ্গে মিলিত হওয়া উচিত। বিদ্রোহ ব্যতীত কোনো সত্যের প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। পৃথিবীর মঙ্গলের জন্যে সত্যের আসন সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে, মিথ্যাকে দলিত করে।

ইসলামের পরম দান ঈশ্বরের একত্ব। পূর্বে মনুষ্য সমাজে ঈশ্বরকে বহু ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। ঈশ্বরের শক্তি ও ভাব যার মাঝে বহুলভাবে প্রকাশ পেয়েছে, মনুষ্য ভক্তি আপুত প্রাণে তাকে ঈশ্বরের আসন দিয়ে এসেছে। এই মনুষ্য-ঈশ্বরের ভক্ত যারা, আত্মার যাঁরা, তাঁরাও ক্রমে ঈশ্বর হয়েছেন। যিশু খৃষ্টের মাতাকে মনুষ্য জ্ঞানে তার ভক্তগণ বর্জন করতে পারেন নি। ঈশ্বরের মাতা যিনি, তাকে কীভাবে বাদ দেওয়া যায়?” খৃষ্ট বলেন; আমাকে পরিধান কর। যারা তাকে পরিধান করলেন তারাও খৃষ্ট অর্থাৎ ঈশ্বর হলেন। ধার্মিক রাম, বুদ্ধ, রামকৃষ্ণ পরমহংস, ঈশ্বরের বিরাট শক্তির প্রতিচ্ছবি।–সমুদ্র, বিশাল বৃক্ষ, হিমালয়, পর্বত, বিষধর সর্প ভক্তের শ্রদ্ধা হতে বঞ্চিত হলেন না। এরা হলেন ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি। আর্য সমাজীরা বললেন Let us try to make every man a god। এসব ফকিরি কথার মূল্য ফকিরদের কাছে আছে–সাধারণ মানুষের কাছে এইসব কথার গুরুতর অপব্যবহার হয়। কোথায় ঈশ্বর রইলেন পড়ে–বুদ্ধের পাষাণ মূর্তি ঈশ্বর হয়ে হাট, ঘাট, পর্বত, মন্দির ছেয়ে ফেলো। মানবচিত্তের চরম অধঃপতন হল।

ইসলাম বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। ভ্রান্ত কাফেরগণ! ক্ষান্ত হও–ঈশ্বর নিরাকার, সর্বব্যাপী, তিনি জন্মগ্রহণ করেন না, তাকেও কেউ জন্ম দেন না। ইসলাম সত্যই বলেছেন। জগতকে বিশাল পতন হতে রক্ষা করেছেন। ইসলামের আজান এবং রোজা-নামাজ পৃথিবীতে ঈশ্বরের নাম অতি সুন্দরভাবে বজায় রেখেছে। ইসলামের আবির্ভাব না হলে জগতের মানুষ ঈশ্বরের নাম একেবারেই ভুলে যেতো। ইসলামের কল্যাণে চরম পৌত্তলিকও বলে-ঈশ্বর এক, যদিও সে ব্যবহার জগতে আদি শক্তি দুর্গারূপিনী মূর্তিতে জগতে ঈশ্বরের জননী ভাবের ছবি জগধাত্রীরূপে পূজা করে। এই প্রকাশ্য রোজা নামাজ ও আজান জগতে ধর্মের বাহ্যিক চর্চা রেখে–পৃথিবীর মহাকল্যাণ করেছে। রাজা থেকে পথের বেশ্যা মুসলিমের আজান ও শরিয়তের কল্যাণে আল্লাহর সত্তা নিত্য অনুভব করেছে। রোজা নামাজ মানব সমাজের ধর্মের ধ্বজা জীবিত রাখার জন্যে একটি সামাজিক জীবিত অনুষ্ঠান মাত্র। এই-ই সব নয়। এই-ই ইসলাম ধর্মের সব নয়–প্রাণের সঙ্গে যোগহীন আবৃত্তি অর্থাৎ মুখস্থ পাঠ ইসলাম ধর্ম নহে। জগতে ধর্মের ভাব জীবিত ও সবল রাখবার জন্যে তার নিজের আধ্যাত্মিক জীবন একেবারে মরে গেছে। তার প্রার্থনা একটা অভিনয়ে পরিণত হয়েছে। প্রকৃত প্রার্থনাশীল জীবন তার নাই, আপন আত্মায় সে ঈশ্বরের সজাগ বাণী শোনে না। সে নামাজে বুঝে নামাজই পড়ে, দিকে দিকে আজানের দ্বারা প্রভুর বাণী প্রচার করে–যে নিজে এক বর্ণ বোঝে না। পাপের প্রতি তার ঘৃণা নাই। সত্যের বাক্য তার আত্মায় নাই। ঈশ্বরের সত্তা তার আত্মায় অনুভব করে না।

মুসলিম জাতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে ইসলামকে সত্যরূপে আবার তার সামনে ধরতে হবে। তার ধর্ম শুধু মুখস্থ আর গুনাহ মাফ চাওয়া ধর্ম নয়। তার কাজ আছে–তার জীবনে সংগ্রাম আছে। ধর্মযুদ্ধ ও তার ধর্ম–মুমীনের হৃদয় ঈশ্বরের আসন; রুহে কুদুসের বিশ্বাসী–তাকে হতে হবে। মুহূর্তে মুহূর্তে তার আত্মায় সত্যের যে বাণী ধ্বনিত হয়–তাই মানা তার ধর্ম। যে মুসলমানের বুকে বিবেক, প্রজ্ঞা বা সত্যের বাণী জাগে না সে মৃত। মুসলমান জাতি আজ মৃত। ত্বকচ্ছেদই তার ধর্ম হয়েছে। কোরবানী করে ষাড়ের পিঠে চড়ে সে দৌড়ে স্বর্গে যাবে–এই অন্ধ বিশ্বাস সে পোষণ করে। পাপের সঙ্গে, মিথ্যার সঙ্গে, অন্যায়ের সঙ্গে, শয়তানের সঙ্গে, তার জীবনের সংগ্রাম নেই। মাথার উপর টিকির মতো এক টুপি রেখে সে মহাধার্মিক হয়েছে এই ভাব দেখায়। সে জ্ঞান বর্জিত, বিবেক বর্জিত, আত্মজিজ্ঞাসা বর্জিত চিন্তাশূন্য পশু।–মন্দতায় আকণ্ঠ সে ডুবে আছে।

মুসলমানের ধর্ম জীবন-কী? তার কাছে প্রার্থনাশীল জীবনের স্বরূপ কী? তার পরিষ্কার উত্তর এখানে দেওয়া হচ্ছে।

সর্ব পাপমুক্ত হওয়াই ইসলাম ধর্ম। মুসলমানের ধর্ম জীবনের একমাত্র সাধনা পাপকে জয় করা। হে আল্লাহ, আমি শয়তানের হাত হতে তোমার আশ্রয় চাই–এই হচ্ছে তার বড় প্রার্থনা। তার জীবনে পাপ-পুণ্যের কাটা-কাটি, জমা-খরচ হবে না। নামাজের পুণ্য আলাদা, পাপের শাস্তি আলাদা–তা হবে না! তা হবে না! নামাজ পড়লে পাপের ক্ষমা হবে না। না বুঝে নামাজ পড়া এও ইসলাম ধর্ম নয়, কোন ধর্ম নয়। প্রার্থনা তা আন্তরিক এবং আত্মার সত্য বেদনা নিবেদন হওয়া চাই। মানুষকে কোনো রকম দুঃখ দেওয়া পাপ। জগতে দুঃখ সৃষ্টি করা পাপ। তোমার জীবনের দ্বারা, কথা ও ব্যবহারে যদি পৃথিবীতে দুঃখ ও জ্বালা উপস্থিত হয়, তুমি পাপী। নামাজ দুই-একবার ত্যাগ করলে তত পাপ হয় না, যত হয় মিথ্যা, অন্যায়, প্রবঞ্চনা ব্যভিচার, লোভ, চুরি এবং মানুষকে দুঃখ দেওয়াতে। অথচ ঠিক এর উল্টা সমাজে চলছে। নামাজ ঠিক আছে–পাপ ও শঠতার অন্ত নেই। ত্বকচ্ছেদ,. আরবিতে নাম রাখা, মৃত্যুর পর ফাতেহা পাঠ করা, মসজিদ ঘর তোলা, মৃত্যুর পর খতম। পড়ান, লক্ষ কলেমা পাঠ, শুশ্রু রাখা এবং ইসলাম ধর্মের গর্ব করাই যেন এদের ধর্ম। আত্মার দিকে এরা তাকায় না। তওবা (অনুতাপ) ব্যাপারটিও এরা মোল্লার পাগড়ী ধরে এক টাকা নজর দিয়ে শেষ করে। কী বিড়ম্বনা! আত্মার লজ্জা প্রকাশ ও অনুতাপ তাও এরা না বুঝে করে।

হযরত মুহম্মদ (সঃ) মুসলমানকে ত্রাণ করেন, এই একটি অন্ধবিশ্বাস কিছুদিন থেকে ইসলাম ধর্মে চলেছে। অথচ মানুষ মানুষকে ত্রাণ করবে না–এই কথা প্রচার করাই তার খ্রিষ্টানধর্ম হতে পৃথক হবার অন্যতম শ্রেষ্ঠ দাবি। হযরতের নামে দরূদ পড়ার তার অন্ত নেই অথচ হযরতের বাণী একজনও জীবনে অনুসরণ করে না। মুসলিম জীবনে কাজ নেই, মোটেই কাজ নেই। শুধু আছে মুখস্থ পাঠ এবং আল্লাহ দয়ালু এই কথা বলে মাফ চাওয়া। তাকে পথ দেখাইবার জন্যে কোরান–অথচ চোখ বেঁধে সে কোরান পড়ে। চোখ বুজে কে কার গন্তব্য স্থানে পৌঁছতে পারে। আল্লাহ্, তাকে কি বলেছেন, জীবন ভরেও সে তা শুনতে ও জানতে চায় না। তার আত্মার জন্য যা চরম কল্যাণের মন্ত্র, তা সে বুঝতে চায় না। যদিও সে জীবনে কত কঠিন পরিশ্রম সাপেক্ষ কাজ করে ফেলে। প্রার্থনাশীল জীবনের কোনো ভাব মুসলমান সমাজে নাই। আত্মার নিবেদনের নাম প্রার্থনা। অপ্রাসঙ্গিক ঈশ্বর বাক্য পড়লে কি প্রাণ ঘামে? দুই হাজার বার কুলহু’ পড়লে, দুই হাজার বার সূরা এখলাস পড়লে মহাপুণ্য হয় এইরূপ কথা আধ্যাত্মিকেরা অনেক সময় শিষ্যদিগকে বলে থাকেন। যে প্রার্থনা পাষাণ ভার হয়ে মনুষ্য চিত্তকে কষ্ট দেয়, তা প্রার্থনা নয়। প্রার্থনায় কখনও ক্লান্তি হবার কথা নাই। অথচ প্রায়ই দেখা যায়, ধর্ম মন্দিরে তাড়াতাড়ি প্রার্থনাটি সেরে দেবার জন্য অনেকে মোল্লা-মৌলভীকে অনুরোধ করেন। যে জিনিসের সঙ্গে প্রাণের যোগ নেই তাতে তো কষ্ট হবেই। না বুঝে দীর্ঘ সময় প্রার্থনার নামে ব্যায়াম করতে, উপস্থিত উপাসক জনমণ্ডলীর যে কি কষ্ট হয়, তার তাদের প্রাণ তাড়াতাড়ি ছুটি পাবার জন্য কীভাবে কাতর হয়ে উঠে, তা ভুক্তভোগীরা মাত্রই জানেন।

সামাজিক লোক-দেখান নামাজে কখনও প্রার্থনা হয় না। পৃথিবীতে মানব-সমাজে আল্লাহর সত্তা জীবন্ত করে রাখবার জন্যেই এই প্রকাশ্য সামাজিক অনুষ্ঠান। প্রার্থনা যা, তা একান্ত আন্তরিক হবে তা হবে আত্মার স্বতঃউৎসারিত ভাব। দীর্ঘ পঞ্চাশ, ত্রিশ, বিশ, ও চৌদ্দবার উঠা-বসা না করে সংক্ষিপ্তভাবে শুধু ফরয নামাজটুকু (ঈশ্বর নির্দেশিত অবশ্য পালনীয় সংক্ষিপ্ত উপাসনা) পালন করে সামাজিক প্রার্থনায় মর্যাদা রাখলেই যথেষ্ট হয়। উঠা-বসা করলে কখনও আত্মার সঙ্গে ঈশ্বরের ঘনিষ্ঠ যোগ রক্ষা করা সম্ভব হয় না। সামাজিক নামাজ শেষ করে–আপন মাতৃভাষায়–সকলে মিলে বা একাকী নীরবে আত্মার ও সত্যের প্রার্থনা করাই যুক্তিযুক্ত। প্রার্থনায় কখনও বল-বাধ্যতা ভালো নয়। যখন ইচ্ছা নাই তখন প্রার্থনা করা উচিত নয়। পৃথিবীতে এখন কর্মের যুগ এসেছে। এখন বাইরে কর্মক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আল্লাহর এবাদত করতে হবে। ঘরের মধ্যে বহুক্ষণ বসে সময় নষ্ট করবার সময় নেই। যখনই ইচ্ছা তখনই মানুষ প্রার্থনা করতে পারে। এখন নতুন কালের নতুন নিয়মে চলতে হবে। তাতে ইসলাম ধর্মের ক্ষতি হবে না।

আল্লাহ্ নিরাকার, এক তিনি কারো জনক নন, তারও কেউ জনক নাই–তিনি। আকবর–অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ–ইহাই ইসলামের প্রাণবাণী-এ কথার তো পরিবর্তন হচ্ছে না। কাল ও অবস্থাভেদে অন্যান্য বিষয়ের পরিবর্তন আবশ্যক। প্রার্থনায় কখনও সঙ্গীত নিষিদ্ধ হওয়া ঠিক নয়। নামাজে দাঁড়িয়ে কী সুন্দর সুরকে উপেক্ষা করা হয়! কণ্ঠে লালিত্য সকল দেশে সকল মানুষকে ঐশ্বরিকভাবে অনুপ্রাণিত করে। আমরা যদি সঙ্গীতকে অসিদ্ধ ও অবৈধ বলে বর্জন করি, তা হলে আমাদেরই আধ্যাত্মিক জীবন পঙ্গু হয়ে উঠবে। সামাজিক প্রার্থনায় কোরানের বাক্য ব্যবহার করা যায়। কারণ, সমস্ত মুসলমান জগতের মিলনক্ষেত্র। হচ্ছে এই সামাজিক প্রার্থনা অর্থাৎ নামাজ। সামাজিক প্রার্থনাকে কখনও প্রকৃত প্রার্থনা বলা চলে না। ও যেন একটা কর্মশালার ভঙ্গি বজায় রাখা। অপ্রাসঙ্গিক কথায় কখনও প্রাণ ধর্মরসে বিগলিত হয় না। প্রার্থনা জিনিসটা কখনও সকলের এক প্রকার হতে পারে না। কখনো কখনো সমবেতভাবে এবং কখনো কখনো স্বতন্ত্রভাবে দীর্ঘ সময় ধরে মানুষের স্বতন্ত্র ভাবে প্রার্থনা করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

প্রার্থনায় সঙ্গীত ও সুরযন্ত্র ব্যবহারের অর্থ অশ্লীলতা ও উচ্ছলতা নয় বা কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি নয়। নামাজিরা বলে–বেনামাজির হাতে খেতে নাই। এ কথাটি খুব সত্য। বাস্তবিক যার জীবন প্রার্থনাশীল নয়, যার কর্মবহুল জীবনে আল্লাহর প্রতি প্রেমের অভিব্যক্তি নাই,–যে জীবনে, কাজে-অন্তরে আল্লাহকে শ্রেষ্ঠ বলে প্রমাণ করে না, জাগতিক সম্মান ও প্রতাপই যার জীবনের পরম আকাঙ্ক্ষিত বস্তু, সে জীবন নিশ্চয়ই অপবিত্র, তার স্পর্শিত খাদ্য খাওয়া মুসলমানদের উচিত নয়। জীবনই তার বৃথা–যে ঈশ্বরের বশ্যতা স্বীকার করে না–জীবনে নিত্য ঈশ্বরের অর্থহীন আশীর্বাদ লাভ করে একবারও কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে না।

প্রার্থনাশীল জীবনের শ্রেষ্ঠতম ভাব–ঈশ্বরে পূর্ণ আত্মসমর্পণ, বিনয় এবং সকলের উপর দরদবোধ।

দরদ চিরসহিষ্ণু, ক্ষমাশীল, ক্রোধবর্জিত। অভিশাপ করে না, গর্ব জানে না, বড়াই করে না, মিথ্যা কহে না, নিন্দা করে না, বঞ্চিত করে না, প্রতারণা করে না, দুঃখ দেয় না।

.

০৫. আজগুবী গল্প

মুসলমান সমাজে আজগুবী গল্পের প্রভাব অতিরিক্ত বেশি। বুজরুকী, মিথ্যা কেরামতিতে বিশ্বাস–মূর্খ মুসলমান সমাজকে পতনের গভীর গুহায় নিয়েছে। আত্মা দলের পর দল মেলে স্বাভাবিকভাবে ঈশ্বরের পরিচয়ে সুরভিত, বিকশিত হয়ে উঠবে–এইটিই হচ্ছে। স্বাভাবিক ও নিয়মসঙ্গত। তা তো নয়–হঠাৎ একটা কেরামতি দেখে ইসলাম ধর্মে আসক্ত হবার অর্থ ভয় পেয়ে মুসলমান হওয়া–গুণমুগ্ধ হয়ে নয়।

আজগুবী গল্প রচনা করার ঝোঁক মুসলমান লোকদের মাঝে কেন বেড়েছিল তা বুঝা যায় না। খ্রিষ্টান সমাজে পাদ্রীরা কোনো কোনো সাধুর জীবন সম্বন্ধে সাধারণে ভক্তি বাড়াবার জন্য মিথ্যা গল্প যোজনা করতে উৎসাহ দিতেন–এমন শোনা যায়। মুসলমান। সমাজে লেখকদের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছিল বলে মনে হয় না, অথচ তারা অসম্ভব মিথ্যা কথা মুসলমান সাধুর জীবনে যোজনা করে ইসলাম ধর্মের গৌরব খর্ব করেছেন। হযরতের জন্মবৃত্তান্ত যে-সব পুস্তকে লেখা হয়েছে তাতে মুসলিম তাপসদের জীরনী পুস্তকে এই শ্রেণীর মিথ্যা অলীক গল্পে অবতারণা দেখা যায়। হযরত মরা মানুষকে জীবন দিয়েছেন, ইতিহাসে তার কোনো প্রমাণ নেই–আমরা এরূপ কথা বিশ্বাস করি না। তার শিষ্যেরা। মৃতকে জীবিত করেছেন, লোহাকে সোনা করেছেন, তাল গাছে কাঁঠাল তৈরি করেছেন–পাথরে চড়ে নদী পার হয়েছেন, স্রোতের উপর বসে নামাজ পড়েছেন,–এরূপ অসংখ্য মিথ্যা গল্প দেখতে পাওয়া যায়। মাটি, বৃক্ষ, শুকনা গাছের ডাল প্রথম কলেমা (বিশ্বাস মন্ত্র) পাঠ করে ইসলাম ধর্মের সত্যতার প্রমাণ দিয়েছে–এমন গল্প শোনা যায়। এই সমস্ত মূর্খ। মোল্লা-মৌলবী টিকিমার্কা টুপি নেড়ে ভক্তির ভান করে, মিথ্যা কাঁদার ভান করে সভার মাঝে বলে থাকেন। প্রবীণ ব্যক্তিরা এই সমস্ত কথা বলে নিরক্ষর মুসলমানদের ভক্তি ও বিশ্বাস বাড়াতে চেষ্টা করেন। বস্তুত এইসব গল্প শুনে বিশ্বাসের ভান করতে বাধ্য হয় মাত্র। বিশ্বাস ও ভক্তি এ দুটি স্বর্গীয় জিনিস–মানবাত্মার স্বাভাবিক ঘটনা। বল প্রয়োগে, ভয় দেখিয়ে হঠাৎ এ জিনিস তৈরি হয় না। আত্মা ক্রমানুগতিতে বিশ্বাসী হয় এবং ভক্তিরসে আপুত হয়। এ কি চপেটাঘাত করে মুহূর্তের মাঝে সৃষ্টি করা যায়? একটা আজগুবী কাণ্ড করা আর আত্মাকে চপেটাঘাত করা এক কথা।

কখনো কখনো আশ্চর্য, অস্বাভাবিক ঘটনা বিশ্বাস করবে না। ধর্ম জীবনের সঙ্গে এ সকলের কোনো সম্বন্ধ নেই। ঈশ্বরের কোনো কাজ অস্বাভাবিক এবং অকস্মাৎ হয় না। সৃষ্টির বহু পূর্বে তার প্রকাশের আয়োজন চলতে থাকে। কখনো আম গাছে কাঁঠাল হয় না–এ মিথ্যা কথা। এমন কাজ কোনো সাধুর দ্বারা হয়েছে, এ কথা বললেও পাপ হয়। মেসমরিজম বলে এক রকম বিদ্যা আছে, তাতে মানুষ অন্যের ইচ্ছাশক্তির প্রভাবে অনেক ভুল জিনিস দেখে, কিন্তু এর সঙ্গে তো মানুষের ধর্ম জীবনের কোনো সম্বন্ধ নাই।

এমন একটা সময় এসেছে যে পুরাতন শ্রেণীর ভ্রান্ত মোল্লা-মৌলবীকে ধর্মমন্দিরে আর প্রবেশ করতে দেওয়া উচিত নয়। নব-আলোকপ্রাপ্ত, সংস্কৃতিতে অভ্রান্ত বিশ্বাস যারা পোষণ করেন, তাদের প্রার্থনায় অগ্রগামী করা উচিত। তারা বাড়িতে বাড়িতে হযরতের জীবনী পাঠের উৎসব–ঐতিহাসিক সত্য ঘটনা পাঠ করে হযরতের বাণীর ব্যাখ্যার বর্ণনা দিয়ে। জনসাধারণকে ধর্ম জীবনে অনুপ্রাণিত করতে চেষ্টা করবেন।

মুসলিম জগতে হযরতের জীবনী পাঠ মুসলিম গার্হস্থ্য জীবনের একটা মস্ত বড় উৎসব। মোল্লাদের দৌরাত্মে একেবারে মাটি হয়ে যাচ্ছে। এদিকে আধ্যাত্মিক বিষয়ে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠজ্ঞানী মহৎ ব্যক্তিদের অগ্রণী হওয়া উচিত। বাংলাদেশে কিন্তু যারা অশিক্ষিত, অপদার্থ ভিক্ষুক তারাই মানুষের আধ্যাত্মিক জীবনে কর্মকর্তা হয়ে ওঠে। পরবর্তী মুসলমান সাধুদের জীবনের সঙ্গে অল্প শিক্ষিত মিথ্যাবাদী ভক্তদের দ্বারা এমন সমস্ত অসম্ভব গল্প রচিত হয়েছে, যে সব গল্পে ঘটনা হযরত রসুলের করিমের জীবনে সম্ভব হয় নাই। কেরামতিতে গুরুর চাইতে শিষ্যরা দুই-চার সিঁড়ি উপরে উঠেছেন। গল্প। রচয়িতাদের এমনই কলমে জোর আর ছাপাখানার প্রাদুর্ভাব ফল!

০৬-১০. ধর্মের জীবিত উৎস

০৬. ধর্মের জীবিত উৎস

মানব হৃদয়ে স্বাভাবিক ধর্মের উৎস আছে। কোনো বাঁধাধরা পথ তার জন্য নির্দেশ করা। চলে না।–কালধর্মে নিত্য নব নব সমস্যা তার জীবন সম্মুখে উপস্থিত হয়। তখন সে কোনো গ্রন্থের বাণীর অপেক্ষা করে না। আপনার জীবিত আত্মার আসনে জীবিত ঈশ্বরের বাক্য সে শুনে এবং কাজ করে। হৃদয় আসনে জীবিত ঈশ্বর, পবিত্র আত্মা, সত্যের আত্মা, প্রজ্ঞার বাণী মেনে চলাই তার ধর্ম। যে আত্মায় ঈশ্বর বাক্য অনুভব করে না–কোনো ধর্মগ্রন্থ তাকে রক্ষা করতে পারে না। এ জন্য প্রত্যেক ধার্মিক মানুষকে পবিত্র আত্মায় বিশ্বাসী হতে হবে।

পবিত্র সত্যের আত্মা মানুষের প্রতি আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ দান। আল্লাহ্ স্বয়ং মুমীনের আত্মায় আসন গ্রহণ করেন। আত্মায় আল্লাহর সত্তা অনুভব এবং তার বাণী শ্রবণ করা। ভাববাদী পয়গম্বরের কার্য। যে মানুষ অপবিত্র চিত্ত, মিথ্যাবাদী, সে কখনও প্রাণে ঈশ্বরবাক্য শ্রবণ করে না। নিষ্কলঙ্ক, সত্যবান, বিনয়ী, প্রেমিক, দরদী, ক্ষমাশীল, আত্মশ্লাঘাবর্জিত, বৈধ অন্নভোজী মহব্যক্তি যাঁরা, তাঁরাই হৃদয়ে ঈশ্বরবাক্য শ্রবণ করেন এবং সেই বাক্যমত কাজ করেন।

প্রার্থনা ব্যতীত কখনও মনুষ্যচিত্তে ঈশ্বরের আসন অধিষ্ঠিত হয় না–দুরাত্মা লোকদের সঙ্গে ঈশ্বর কথা বলেন না।

হৃদয়ে ঈশ্বরের সত্তা অনুভব করা এবং জীবনে তার উপদেশ মতো কাজ করাই তোমার ধর্ম। প্রচলিত ধর্ম শাস্ত্রের সঙ্গে তোমার কাজের কথা তত ভাববে না। নিজের কাজে নিজে মিথ্যা হবে না, তা হলেই যথেষ্ট হল।

লোকে বলে কে ধার্মিক, কে অধার্মিক, কে মনোনীত, কে অমনোনীত তা কেউ জানে না। কথাটি অনেকাংশে ঠিক। জীবনের কাজ দেখে সব সময় বুঝতে পারা যায় না। লোকটি নিরপরাধ কিংবা ঈশ্বরের কাছে অপরাধী–প্রভুই জানেন, কে সাধু এবং কে অসাধু।

মানব জাতির একটি সাধারণ ধর্ম আছে। ধর্মের উদার ক্ষেত্রে সকল মানুষই সমান। তান্ত্রিক সন্ন্যাসী গোপনে যদি ব্যভিচার করে, মরণের পূর্বে একটিবারও কি সে আত্মপাপ অনুভব করে না? যদিও সে জীবনে মানুষের অফুরন্ত ভক্তি লাভ করেছে। সবাই অন্তরে জানে সে নিজে ভালো কী মন্দ–যদিও মানুষ মুখে বড়াই করতে ত্রুটি করে না। মুসলমান, হিন্দু, জৈন, খ্রিষ্টান, পারসীক, বৌদ্ধ সকল জাতির মধ্যে ধর্ম সম্পর্কে আপন আপন চিত্তে একটা পরিষ্কার ধারণা আছে। জীবনকে বেদনা দেওয়া, নারীকে দুঃখ দেওয়া, পরের ধন অপহরণ করা, মিথ্যা বলা, ছলনা করা, ব্যভিচারের পাপে লিপ্ত হওয়াকে কোন্ ধর্মে ভাল কাজ বলে জানে? অথচ সকল ধর্মের অধিকাংশ লোক এই সমস্ত পাপ কাজ করে। জীবনে ভালবাসা, পরোপকার, মানব-দুঃখ, সহানুভূতি, সতীত্ব, ক্ষমাশীল, দরদ, বিনয়-কে না শ্রদ্ধার চোখে দেখে! মানব ধর্মের কোনো ধার ধারে না–মারামারি করে ধর্মের নাম নিয়ে। পাষণ্ড যারা তার ধর্মের নামেই বড়াই করে বেশি। যদিও তাদের জীবনে ঈশ্বরের কোনো আসন নাই।

‘জীব মাত্রেই শিব’ এ কথা হিন্দুরা মানে? মুসলমান শাস্ত্রে নামাজের প্রতি জনসাধারণকে এত কঠিনভাবে ভক্তিমান হতে আদেশ করা হয়েছে, নামাজ পালন করতে এতবার অনুজ্ঞা করা হয়েছে নামাজ ত্যাগ করলে এত ভয়ানক শাস্তির ভয় দেখান হয়েছে মুসলমান জাতি সব ভুলে নামাজই সর্বাগ্রে পালন করতে অগ্রসর হয়,–নামাজ ছাড়া আর কোনো কর্তব্যের কথা তাদের মনে আগে আসে না। নামাজ পড়া তাদের জীবনের বড় কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর কোনো দায়িত্ব তারা ভালো করে অনুভব করে না। বুঝে হোক, না বুঝে হোক নামাজ পড়তে হবে। যে সব ঈশ্বর বাক্য তারা পাঠ করে সেই বাক্যের মর্ম গ্রহণ–তদানুসারে জীবন গঠন করা বিশেষ আবশ্যক বোধ করে না। কোনো রকমে আবৃত্তি করে নামাজ পড়তে পারলেই তারা মনে করে ইসলাম ধর্মের শ্রেষ্ঠ আজ্ঞা পালন করা হল, তারা ইসলাম ধর্ম পালন করলো। নামাজের জন্যে এই অতিরিক্ত ভীতি প্রদর্শন মুসলমান সমাজের ধর্ম জীবনের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিয়েছে। তার আধ্যাত্মিক জীবন চূর্ণ হয়ে গেছে। নামাজকে ছেড়ে ধর্ম সম্বন্ধে স্বাধীনভাবে কিছু ভাবতে তারা মোটেই সাহস পায় না। নামাজ-রোজা হয়ে পড়েছে তার কাছে দুই সশরীরী দেবতা। সে এইভাবে প্রাণে মূর্তিহীন প্রতিমা পূজা শুরু করেছে। সে ঈশ্বরকে চেনে না শুধু নামাজ পড়ে। তার বিশ্বাস, নামাজ ত্যাগই সকল পাপের। বড় পাপ। কিন্তু তা তো নয়। অকৃতজ্ঞতা, বিশ্বাসঘাতকতা, ক্রুরতা, মিথ্যা, কথন, দয়াশূন্যতা, ছলনা, প্রতারণাই বড় পাপ কিন্তু সে তা বিশ্বাস করে না, এই অবিশ্বাসই তার পতনের কারণ। এই জন্যেই তার জীবন মানুষের কাছে এত দুঃসহ। নামাজ অর্থাৎ প্রার্থনা দুই-এক বার ত্যাগ করলে তেমন ক্ষতি হয় না। আসল ধর্ম ঠিক রাখা চাই।

.

০৭. ধর্ম কী চোখে দেখলাম

একদিন আষাঢ়ে বৃষ্টি এবং শীতল বাতাসের মাঝে একটি দরিদ্র শিশুকে খালি গায়ে খালি পায়ে একেবারে উলঙ্গ অবস্থায় আমার পার্শ্ব দিয়ে হেঁটে যেতে দেখলাম। সেই দিন ধর্ম কী তা চোখে দেখলাম।

মনুষ্য শিশুকে মানুষ করে ভোলা ইহাই ধর্ম। তাকে বস্ত্র দাও, তার জন্যে স্কুল তৈরি করে দাও–এ জন্য তোমরা অর্থ দান কর। মনুষ্য শিশুর সেবা কর। নামাজ পড়লে কি স্বর্গে যাওয়া যায়? নামাজ পড়ার মধ্যে ধর্ম নাই। যুদ্ধের পূর্বে কি বাদ্য এবং যুদ্ধসঙ্গীত গায় না? তাতে সৈন্যদের বুকে উৎসাহ আসে। গান আর বাদ্যই যুদ্ধ নয়। গানে যুদ্ধ জয় হয়। ধর্ম জীবনের সঙ্গীত, নামাজে ধর্ম পালন হয় না। ওর দ্বারা আত্মার মহত্ত্ব ধর্ম সাধনের জন্য তৈরি হয় মাত্র। ধর্ম পড়ে আছে জীবনের ক্ষেত্রে, জগতের মাঝে-ধর্ম সেখানে, যেখানে শত কাজে মিথ্যাকে দমন করে, পরোপকারে মানব কল্যাণে, বিশ্বের সেবায়, লোভকে জয় করে। নিজেকে জয় করে পালন করতে হবে–কাজ করে ধর্মের মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। শুধু মুখে ঈশ্বর বাক্যের আবৃত্তি করলে কোনো লাভ হবে না। ঈশ্বর মনুষ্যজাতিকে কী কথা বলেছেন :

প্রাচীন কালে ঈশ্বর তাঁহার বন্ধু ইব্রাহীম নবীকে মনুষ্য জাতির জন্য দশটি আজ্ঞা দিয়েছিলেন :

১. মনুষ্য হত্যা করো না।

২. মিথ্যা সাক্ষ্য দিও না–অর্থাৎ মিথ্যা ঘটনা সত্য বলিয়া সমর্থন করিও না। অন্যায়ের পক্ষে কথা বলিও না।

৩. প্রতিবেশীকে প্রেম করিও। প্রতিবেশীর সহিত অসদ্ভাব করিয়া অপরের সহিত মিত্রতা করিও না।

৪. মিথ্যা কহিও না।

৫. কাহারও অনিষ্ট করিও না।

৬. ব্যাভিচার করিও না।

৭. পরের কুৎসা রটনা করিও না।

৮. পিতামাতাকে মান্য করিও।

৯. পরের দ্রব্যে লোভ করিও না।

১০. চুরি করিও না।

তোমরা কি মনে কর ঈশ্বরের এই আদেশগুলি বসে বসে শুধু পাঠ করলেই হবে, না আদেশ অনুসারে কাজ করতে হবে? কোরানে ঈশ্বর বাক্যগুলি শুধু পাঠ করবার জন্য অবতীর্ণ হয়েছে, না ঈশ্বরের আদেশের ইচ্ছা অনুসারে কাজ করতে হবে? তবে কেমন করে বল নামাজেই সব–নামাজের দ্বারাই ধর্ম পালন হল। এমন পাগল ভ্রান্ত জাতি তো কোনো কালে দেখি নি। মুসলমান জাতি এত ভ্রান্ত কীভাবে হলেন? এমন কী শিক্ষিত লোককেও জীবনে সত্য সুন্দর হবার সাধনা করতে তাদের লজ্জা হয় না। কোনো মহৎ হিতানুষ্ঠানে তারা সেরূপ। উৎসাহ দেখান না। সত্যকে মিথ্যা করেন, মিথ্যাকে সত্য করেন–কী ব্যাপার?

সমস্ত মুসলমান জাতির ভিতর এই ভ্রান্তি এসেছে। জীবনের কার্যে তারা ধর্ম পালন করতে চান না–জীবনকে তারা মিথ্যা অন্যায়, সর্ববিধ পাপ থেকে রক্ষা করবার কোনো চেষ্টা করেন না। কোনো অন্যায় করবার আগে তারা ভীত হন না–ভাবেন না, আমরা পাপ করছি, ঈশ্বরের আজ্ঞার অপমান করছি। দিনে দিনে মহৎ হতে মহত্তর, সুন্দর হতে সুন্দরতর হয়ে ঈশ্বরের যোগ্য হবার কোনো চেষ্টা মুসলিম জীবনে নাই। আউজুবিল্লাহ তাঁরা মুখে পাঠ করেন মাত্র। এই বাক্য অনুসারে শয়তানের প্রভাব হতে মুক্তি পাবার চেষ্টা তাঁরা বিশেষ দরকার মনে করেন না। সুর করে প্রাতঃকালে বাক্যটি পড়লেই তাদের বিশ্বাস বহু পুণ্য সঞ্চিত হল। হায় কী ভ্রান্তি।

এই হাজি সাহেব। তিনি হজ করে ফিরে এলেন। সম্পত্তির যে-সব শরীক ছিল, তারা তাকে বয়োজ্যেষ্ঠ জ্ঞানে সম্পত্তি পরিচালনার ভার তার হস্তে সমর্পণ করলেন। তিনি গোপনে তহশীলদারের সঙ্গে যোগ করে, সম্পত্তির খাজনা আত্মসাৎ করতে লাগলেন, ফলে সম্পত্তির খাজনা বাকি পড়ায় সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি হয়ে গেল। হাজি সাহেবের কত সম্মান ছিল, তিনি অন্ধকারে থাকতে উঠে সুর করে প্রাতঃকালীন নামাজ পড়তেন এবং অনেক বেলা পর্যন্ত কোরান পাঠ করতেন। রোজার মাসে রোজা করতেন। তার এই রোজা, নামাজ ও কোরান পাঠ দ্বারা কি ধর্মের পুণ্য তিনি সঞ্চয় করেছিলেন? তাঁর মনে হয়তো একটা গোপন বিশ্বাস ছিল, আমি যতই অন্যায় করি, এই রোজা, নামাজ এবং কোরআন পাঠে সব কেটে যাবে। তা কি কাটে! মানুষ অনবরত দিনের মধ্যে পাঁচবার ঈশ্বরবাক্য পাঠ করলে–পাপ করতে, অধর্ম করতে তারা ভীত হবে, তারা মানুষ হবে, জীবনে ধার্মিক হবে, এই জন্যেই রোজা নামাজের এত কঠোর ব্যবস্থা। কার্যের দ্বারা ধার্মিক হবে। নামাজ পড়ে মানুষ ধার্মিক হবে না। তসবীহ্ পাঠ, রোজা-নামাজ করা দেখে মানুষকে ধার্মিক বলা যায় না।

জীবনের কার্যে সাধু হতে হবে। প্রতি দিনকার পাপ কার্যে যদি মানুষ ধর্মে পতিত না হয় তবে বেশ্যাখোরের রোজা-নামাজ সিদ্ধ হবে না কেন? পাপ ও মিথ্যা জীবনের সঙ্গে রোজা-নামাজ সিদ্ধ হয় না। জীবনকে সুন্দর ও সংস্কৃত করতে আপ্রাণ চেষ্টা কর এবং সেই। সঙ্গে বুঝে প্রার্থনা কর। সত্য জীবনের প্রার্থনা গ্রাহ্য হয় এবং প্রভু তার উত্তর দেন। চোর, বাটপাড়, কুর, কুক্ৰিয়াসক্ত ও ঘুষখোর এবং লজ্জা ও অনুশোচনাশূন্য সৃষ্টির আবার নামাজ রোজা কী? একবার নামাজ ত্যাগ করলে পাপ হয় না,–একটা মিথ্যা বললেই, অন্যায় কাজ করলেই পাপ। এর বিপরীত বিশ্বাস মুসলমানেরা পোষণ করেন।

.

০৮. পাপ, মিথ্যা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম

পাপ, মিথ্যা, অন্যায়, অত্যাচার–এদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চাই, এই-ই ধর্ম।

পাপের বিরুদ্ধে সংগ্রাম কর। ঈশ্বরের সৈনিক হও।–ঈশ্বরের রাজ্য বিস্তার কর।

হে ঈশ্বরের সন্তানেরা! তোমরা থাকতে ঈশ্বরের এই অপমান? দেখতে পাচ্ছ না, কেমনভাবে চারদিকে পাপের আগুন জ্বলে উঠেছে। মানবাত্মা কীভাবে অহঙ্কার চূর্ণ হয়ে যাচ্ছে? অত্যাচারে ব্যথিত নর-নারী কীভাবে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলছে?

কাতর ব্যথিতের ধ্বনি উঠেছে, সৈনিকেরা কি বসেই থাকবে?–প্রকাশ্যে এবং গোপনে আপন আত্মার বিচার সৎ, সুন্দর এবং নিষ্পাপ থাক–মানুষের মনে কোনো দুঃখ দিও না। তোমাদের জীবনের দ্বারা পৃথিবীর দুঃখ সৃষ্টি না হোক। এসব কথা কি আজ পর্যন্ত তোমরা শোন নি? তা হলে এখন শোন এবং গ্রাহ্য কর। এতদিন শুনেছ শুধু রোজা নামাজের কথা। এত দিন শুনেছ রোজা-নামাজই ধর্ম জীবনের কর্তব্যে শেষ হবে। না, তা হবে না–কখনও হবে না।

ঈশ্বরকে প্রচার কর, অথবা যারা করেন, অর্থ দিয়ে তাদের সাহায্য কর। ঈশ্বরের বাক্য সর্বত্র বহাল রাখ। যারা পাপী ও পাপিনী,যারা পতিত ও পতিতা, তাদের রক্ষা কর–ইহাই তোমার ধর্ম। শুধু ভেড়ার মত পেট ভরে খেয়ে এশার (রাত্রির) নামাজ পড়ে শুয়ে থেকো না।

ঘুষ খেয়ো না-প্রবঞ্চনা করো না, মানুষকে গালি দিও না–মনুষ্য সম্বন্ধে মিথ্যা কথা বলো না। তাতে তোমার ধর্ম থাকবে না। তোমরা কি ঈশ্বরকে ভয় করতে চাও না? এই ক্ষুদ্র জীবনে অনন্তকালের সুখ ভোগ করে নিতে চাও? তোমরা তো আমার চাইতে ঈশ্বরকে অধিক বিশ্বাস কর–তবে কেন তাকে ভয় কর না।

জীবনে অন্যায় করো না। মনুষ্য নামের অপমান করো না। এই সামান্য কয়দিনের জন্য এত অত্যাচার করতে, এত অধর্ম করতে কীভাবে সাহস কর? পোশাক পরলে, টুপি মাথায় দিলে কি ধর্ম রক্ষা হয়? আত্মায় ধার্মিক হও।

মানুষের ক্ষুধা ও দৈন্যের মীমাংসা কর। তাকে আলো দাও, জ্ঞান দাও, বুদ্ধি দাও। তাকে পশুর স্তর থেকে দেবতার স্তরে টেনে আন। ধর্মহীনদের সমস্ত অন্তর দিয়ে ঘৃণা কর। কারণ তারা ঈশ্বরের শত্রু–তথা মানুষের শত্রু। দিকে দিকে বেদনার ধ্বনিকে দুপুর রাতে রোজ কাঁদে? হে যুবকদের দল, তোমরা তার কাছে যাও এবং জিজ্ঞাসা কর কী তার বেদনা। তার পুত্র নাকি পীড়িত! চিকিৎসার খরচ নেই, পথ্যের পয়সা নেই, প্রদীপে তেল নেই। তোমরা সবাই দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে তার ঝুলি ভরে দাও, এইভাবে তার আশীর্বাদ গ্রহণ কর এবং ধর্ম অর্জন কর। . সে কি স্বামীহীন দুঃখী, অন্নহীনা? তোমরা সবাই মিলে তার দুঃখ দূর কর কর। এইভাবে তোমরা জীবন সার্থক কর। কোনো অত্যাচারী কি তার সর্বস্ব লুণ্ঠন করে নিচ্ছে? তোমরা সবাই অত্যাচারীর বিষদন্ত ভেঙ্গে দাও এবং ঈশ্বরের আশীর্বাদ লাভ কর। গান শোন কিন্তু আর সুর কেমন করে তোমাদের আত্মার কাছে বেদনার ফরিয়াদ তোলে, তা কি শোন না? জেনে শুনে যে অন্যায় করে, অপরকে অন্যায় করে বঞ্চিত করে, নিজের কোলের দিকে বড় মাছখানা টেনে আনে–সেই নরপিশাচকে শূকর বলা যায়। তার মুখ দেখতে কত কুৎসিত? কুকুরের মতোই তার মুখ। ঠিক সে-ই নরপিশাচ যার ন্যায় বিচার নেই, যে কুকুরের ন্যায় নিজেই সব গ্রাস করতে চায়।

.

০৯. পবিত্র আত্মা

পবিত্র আত্মা মানুষকে উন্নতির পথে পরিচালিত করে। ন্যায়-অন্যায় কী তা বুঝিয়ে দেন। গুরুর মতো অন্যায় কার্যে মানুষকে অন্তর হতে ভর্ৎসনা করেন। যে পবিত্র আত্মাতে বিশ্বাসী নয়, সে মনুষ্য নামের যোগ্য নয়। পবিত্র আত্মার অবিশ্বাসী নর-নারীকে ধর্মহীন বলা যায়। পবিত্র আত্মাকে কোরানে রুহে কুদ্স’ বলা হয়েছে। মুসলমান সাধুরা অন্যত্র উহাকে ‘মানবাত্মায় ঈশ্বরের আসন’ এই নামে অভিহিত করেন।

পবিত্র আত্মা মানুষের বুকের ভিতর সদা বিরাজ করেন। মানুষ যে যে কথা বলে এবং যে কাজ করে, তার আগে সেই কাজ করা উচিত কিনা, এবং সেই কথা বলা ঠিক কিনা তা বলে দেন। যে পবিত্র আত্মার আদেশ পালন করে, তার অশেষ মঙ্গল হয়। সে ঈশ্বরের পথের সন্ধান পায়। পবিত্র আত্মা মানুষের পরম বন্ধু। পবিত্র আত্মার সহায় যে অনুভব করে, তার কাছ থেকে কোনো মঙ্গলের আশা করা যায় না। তার সংশ্রব ও সহবাস অশেষ দুঃখের কারণ। ঈশ্বর মনুষ্য ভাষায় তাঁর ভক্তের সঙ্গে কথা বলেন না। তার কাব্য পরম সত্যনিষ্ঠ ভক্ত আপন পবিত্র আত্মায় অনুভব করেন এবং তিনি সেই প্রভুর বাক্য মানবীয় জনসমাজে প্রচার করেন। যে মানুষের মধ্যে মিথ্যা আছে, ঈশ্বরের মহামহিমা ও মাহাত্ম্যকে যে ভক্তি ও পরম শ্রদ্ধার চোখে দেখে না; সে ঈশ্বরের বাক্য বহন করবার যোগ্য নয়। সাধারণভাবে ধর্মপরায়ণ নরনারী মাত্রই আত্মার সর্বদা ঈশ্বরের আদেশ লাভ করেন এবং তদানুসারে কার্য করেন। মোটামুটিভাবে সাধারণ শ্রেণীর মানুষ আপন আপন বিবেকের আদেশকে ঈশ্বরের আদেশ বলে গ্রহণ করতে পারেন। বিবেকের বাণী পালন করতে অভ্যস্ত হয়ে ক্রমে ক্রমে নির্ভুল পরম সত্য ঈশ্বরবাণী আত্মায় প্রতিভাত হবে। ইহাই মানবাত্মার সম্পূর্ণ অবস্থা। ঈশ্বরবাণীরূপে কখনো কখনো শয়তান মনুষ্যকে ছলনা করে। একটু অসতর্ক হলে শয়তানের হাতে মানবাত্মার চরম দুর্গতি হবে। হয়ত ঈশ্বরবাক্য পালনের ভ্রান্ত ধারণায় সে নরকের পথে যাত্রা করবে। ঈশ্বরবাক্য সর্বদা সাহসী, বিদ্যুতের মতো, দিনের আলোর মতো সত্য–সে ধ্বনিতে বিন্দুমাত্র সংশয় বা সন্দেই থাকে না। যথার্থ ভক্ত ঈশ্বরবাক্য গম্ভীর বজ্রনিনাদে আপন কর্ণে শ্রবণ করেন। অনন্ত সৃষ্টি জুড়ে সে বাণী ধ্বনিত হয়, যার কান আছে সেই শোনে।

তোমাদের কাছে অনুরোধ নিজের সত্তা অনুভব করতে শেখ, নিজেকে বোধ করতে শেখ, নিজেকে বিচার করতে শেখ। মৃত হয়ো না। মৃতের আবার ধর্ম কী? নারী হও, পুরুষ হও–স্বামী, স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, বন্ধু, পিতা-মাতা, সংসার, ধনসম্পত্তি হতে হাত তুলে, জায়নামাজে বসে নিজেকে চেন।

যদি প্রভুকে জীবনে না পাইয়া থাক, তবে জীবনে তোমার কিছুই পাওয়া হয় নাই। যার আত্মায় ঈশ্বর ধরা দিয়েছেন তার কোনো জাতিভেদ নাই, ভক্তমাত্রেই এক জাতি। আনন্দকে বর্জন করে প্রভুর পরিচয় হয়তো সহ্য করতে পারবে না।

ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, ধর্ম-অধর্ম সকল মানুষই বুঝতে পারে। তার মানে তার ভিতরে ঈশ্বর আছেন। মানুষের কাছে কোনো ধর্মগ্রন্থ না এলেও সে আপন আত্মায় তার প্রকৃত ধর্ম অনুভব করতে পারে। গায়ের জোরে অনেক সময় মানুষ অন্ধ হয়ে থাকে। বুঝেও বুঝে না। হিন্দু মুসলমান বলে দায় দিলে কী হবে? যে পতিত, সে পতিত, যে দুষ্ট,, সে দুষ্টু, যে অধার্মিক সে অধার্মিক মুসলমান হলেও। হে মনুষ্য, তোমার গায়ের জোরে মন্দ কাজ করো না। তোমার ভিতরের প্রভুকে জিজ্ঞেস কর তিনি তোমার সম্বন্ধে কী বলেন। তোমরা যদি নীচ, মন্দ, অধার্মিক, হারামখোর ও অত্যাচারী হও, তবে নিজেকে মুসলমান বলে পরিচয় দিলে কী হবে?’

.

১০. ঈশ্বরের রাজ্য বিস্তার

ভক্তের জন্যে ঈশ্বরের রাজ্য বিস্তারই ধর্মকার্য। প্রত্যেক মুসলমান ঈশ্বরের সৈনিক। সে প্রভুর পতাকা বহন করবে এবং তার রাজ্য বিস্তার করবে।

ঈশ্বর রাজ্যের ভাব কী? ঈশ্বর রাজ্যে অশান্তি, দুঃখ এবং কোনো শয়তানী ভাব কর্তৃত্ব করবে না। ঈশ্বর রাজ্য অর্থ স্বর্গ। এই জগৎকে স্বর্গে পরিণত করতে হবে। ইহাই ধার্মিকের কাজ। এই জগৎ হবে পরম শান্তি ও আনন্দের স্থান। এখানে পাপ থাকবে না–দুঃখ, দীর্ঘশ্বাস, নিরানন্দ, বেদনা, অত্যাচার, অবিচার, নির্যাতন, অন্ধকার থাকবে না, এরই নাম ঈশ্বরের রাজ্য স্থাপন। জগৎ যতই পাপ মুক্ত হবে, ঈশ্বরের রাজ্য ততই বিস্তার লাভ করবে, প্রভুর এই কার্যে জীবন দান কর–এরই নাম ঈশ্বরের নামে কোরবানি। হে প্রভুর সৈনিকেরা, এই জন্যেই প্রভুর কাছে জীবন্ত প্রার্থনা করতে হবে। মৃতের ন্যায় মৃত প্রার্থনা করো না।

নারী ক্রন্দন যেন আকাশকে ব্যথিত না করে। সাবধান! তাকে স্বামী, চক্ষু এবং স্বাধীনতা দাও। তার বংশ তুলে গালি দিও না। এতে ব্যভিচার হয়–মহাপাপ হয়।

ঈশ্বরের রাজ্য মধ্যে যার অন্তরে বেদনা জাগে না, পৃথিবীতে শয়তানের কর্তৃত্ব সম্মানে যার মন দুঃখিত হয় না–সে ঈশ্বরের কেউ নয়। সংগ্রাম অর্থ শরীরের বল, তরবারি জ্ঞান, বক্তৃতা, সাহিত্য, উপন্যাস, কাব্য ও অভিনয় দ্বারা পাপের বিরুদ্ধে, শয়তানের বিরুদ্ধে, নর নারীর প্রাণে ঘৃণা সৃষ্টি করা–কুৎসিতের বিরুদ্ধে মানুষকে বিদ্রোহী করে তোলা। মানুষ সুন্দর, কল্যাণ, সত্য এবং মঙ্গলের উপাসক হোক, এই-ই ধর্ম।

প্রভুর অপমানে, সত্যের পরাজয়ে, শয়তানের প্রতাপে যদি প্রাণে বেদনার সঞ্চার না হয়–তোমার তীর্থ ভ্রমণ, নামাজ, কোরান পাঠ, কোরবানি কোনো ধর্মক্রিয়ায় ফল হবে না।

শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়া মাত্র তার কর্ণকুহরে এই মহামন্ত্র দাও ‘আল্লাহু আকবর’। আল্লাহ্ই শ্রেষ্ঠ অর্থাৎ যা সত্য ও ন্যায়, যা সুন্দর এবং মঙ্গল, তাই মুসলমানের একমাত্র আরাধনার বস্তু। জীবনে তার একমাত্র উপাস্য ন্যায় ও সত্য। যা উত্তম, সত্য, মঙ্গল, শৃঙ্খলা প্রেমময় শক্তি ভাব, সীমার অতীত মহাজীবন, পরম শান্ত, পরম আনন্দ তাই পূজিত। ঈশ্বর জগতের জীবন। শয়তান পরম দুঃখের সর্ববিধ অনুষ্ঠাতা। সে ঈশ্বরের রাজ্য ধ্বংস করে, ঈশ্বরের প্রিয়তম সৃষ্টি মনুষ্য হৃদয়ে পাপের বিষ ঢালে, তাকে প্রলোভনে মুগ্ধ করে সমস্ত দুঃখ ও নরকের পথে আহ্বান করে–প্রভুর রাজ্যে সর্বনাশ সাধন, তার সৃষ্টিকে ধ্বংস করাই তার কাজ। সে মানুষকে, মনুষ্য সমাজকে প্রতি মুহূর্তে কুমন্ত্রণা দিয়ে উদভ্রান্ত করে। মনুষ্য মধ্যে যারা তার অনুগামী, কার্যে যারা তার ভক্ত, যারা কদাচারী, হীনচিত্ত, মূঢ়, মানুষকে যারা দুঃখ দেয়, মুখে আনুগত্য স্বীকার করলেও কার্যে যারা শয়তানকে সেজদা করে, সেই বিধর্মী দুরাচার মানুষের দল শয়তানেরই অনুচর। ধীবর যেমন মৎস্য ধরে, ঈশ্বরের সৈনিকেরা, যাবতীয় বিশ্বাসীরা যারা ঈশ্বরের গৌরব করেন–তারা শয়তান ও তার অনুচরদের বিরুদ্ধে চিরজীবন যুদ্ধ করেন। যুদ্ধে জয়ী হয়ে সৈনিকেরা প্রভুর শান্তির রাজ্য বিস্তার করেন। শয়তানের মাথা নত হোক। পরাজয়ের গ্লানিতে তার মুখ মলিন হোক। এস, আমরা প্রভুকে এবং তার রাজত্বে উল্লাসিত হই এবং আনন্দ করি। প্রভুর জন্যে যুদ্ধে যদি আমরা মরি, সে আমাদের শহীদের মৃত্যু হবে। আমাদের যে সব ভ্রাতা ও ভগ্নি শয়তান এবং তার সেনাপতি ও সেনাদলের কাছে বন্দি হয়েছেন, তাদের উদ্ধার করি। এই তো আমাদের কাজ শয়তানের সঙ্গে ঈশ্বরের এবং তার সৈনিকদের সন্ধি অসম্ভব।

১১-১৫. প্রভুর সংবাদ বহন

১১. প্রভুর সংবাদ বহন

চল যারা পথহারা, পতিত, অশিক্ষিত, ঈশ্বরবর্জিত, পাপের অন্ধকারে ডুবে আছে; যেখানে আল্লাহর নাম কেউ লয় না–যেখানে আল্লাহর কথা কেউ ভাবে না–সেখানে যাই এবং আল্লাহর মহাবাণী শুনাই। আমি আল্লাহর কসম করে বলছি, এই-ই ধর্ম। এছাড়া কোনো উচ্চতর ধর্ম নাই। শুধু রোজা, নামাজ, কোরবানি কোনো ধর্ম নয়। ওরে পাগল, ভ্রান্ত, কীভাবে জীবন নষ্ট করলে?

নব যুগের, নব জাতির এই নূতন ধর্ম গ্রহণ কর। যদি গ্রহণ না কর তোমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মিথ্যা ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে আপন ধর্ম জীবনের সর্বনাশ সাধন করো না। পশুর ধর্ম পালন করো না, বর্বর, মূর্খের ধর্ম পালন করো না–মানুষের ধর্ম পালন কর।

সত্য ও সুন্দরের পূজারী হও।–সত্যের বাক্যের অন্ত নেই–প্রভুর বাক্য সত্যের বাক্যরূপে অনন্তকাল ধরে মানব জাতির কাছে থাকবে, সময় ও কালের উপযোগী হয়ে তাকে অশ্রদ্ধা করো না–প্রভুর বাণী গ্রহণ কর।

প্রভু বলেছেন, পতিত, মূর্খ, অবোধ, পৌত্তলিক, জ্ঞানহীন, পথহারা, ধর্মহীন, পাপ ব্যবসায়িনী নারীকুল, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভ্রান্ত নর-নারীর কাছে যাও। তাদের ভিতরে যেয়ে নামাজ পড় এবং প্রভুর শুভ ইচ্ছা জ্ঞাপন কর–মানুষকে সত্য ও সুন্দরের পূজারী হতে বল–তাদের মধ্যে বিদ্যালয় স্থাপন কর, তাদের মধ্যে ঈশ্বরের বাক্য প্রচার কর। পতিত মানুষের জন্য তুমি দায়ী।

বাংলার সহস্র সহস্র নারী বেশ্যাবৃত্তি করছে–এ মহাপাপ যে দেশে হচ্ছে সেখানে কি আল্লাহর এবাদত সিদ্ধ হয়? হায়! নারীর অনুষ্ঠিত এই পাপ ব্যবসা কি চোখে দেখা যায় বা কানে শোনা যায়? এ যে একে বারে অসহ্য ব্যাপার। এদের সাবধান করবার জন্যে কি মুসলিম সন্তানদের কিছু করবার নেই? নিশ্চয়ই আছে।

পতিত ভ্রান্ত মানুষ চন্দ্র, সূর্য, প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তি, বৃক্ষ, পাহাড়, সর্প, বরাহকে ঈশ্বর জ্ঞানে পূজা করছে। এদের উদ্ধারের জন্যে কী তোমার কিছু করবার নেই? দেশের শত শত মানুষ ধর্মহীন জীবন যাপন করছে, ঈশ্বর-হীন জীবন কাটাচ্ছে–এদের কাছে কিছু বলবার নেই আমাদের?

নিজের উন্নতির চেষ্টায় সারা জীবন ব্যয় করলে। নিজের পুত্রের জন্য টাকা রেখে যাচ্ছ। হয়তো ভবিষ্যতে তোমার টাকা তারা মদ খেয়ে উড়াবে। প্রভুর প্রচারের পথে তোমার অর্থ ব্যয় কর–এইভাবে তোমার সঞ্চিত ধন পবিত্র কর। হায়, জীবন শেষ হয়ে গেল, তবু ধর্ম কী তা বুঝতে পারলে না।

যাও, সর্বত্র–অন্ধকারে, অলিতে গলিতে প্রভুর আলো জ্বালো।–দিকে দিকে প্রভুর বাণী বহন কর।

হে সাহিত্যিক, হে কবি, হে লেখক, তোমাদের অমর লেখনীতে প্রভুর মহিমা ও আলো জ্বলে উঠুক। হে বক্তা প্রভুর বাণী তোমাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হোক। পৃথিবীতে যতগুলি মসজিদ আছে, প্রত্যেক মসজিদ ঘরের ইমাম যিনি–তিনি হবেন শিক্ষিত, সাধু, মসজিদের অন্তর্গত পল্লীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ধার্মিক ব্যক্তি। সেই পল্লীর সকল মানুষের ভার তার উপর দাও। তোমরা তার সাংসারিক অভাব পূর্ণ কর। প্রভুর প্রচার কার্যে তোমরা প্রত্যেকে কিছু কিছু দান কর–প্রভুর পথে দান ব্যতীত তোমাদের নামাজ কখনও সিদ্ধ হবে না। প্রভুর বাণী প্রচারে, দরিদ্রদের সাহায্যে, শিক্ষা বিস্তারে, হাসপাতাল প্রভৃতি মহৎ প্রতিষ্ঠানে যে দান করা হয়, তা প্রভুর পথে দান। দানবর্জিত শুষ্ক রোজা-নামাজের কোনো মূল্য নাই। তা লবণহীন ব্যঞ্জনের ন্যায় অপ্রিয়।

.

১২. আল্লাহর আদেশ, নরহত্যা করো না

শুধু কি না বুঝে নামাজ পড়লেই ধর্ম জীবনের কর্তব্য পালিত হল?–কী মিথ্যা বিশ্বাস! না বুঝে নামাজের আবৃত্তি করেই আজ মুসলমানের ছুটি। এই অন্ধ নামাজ-রোজার সার্থকতা কোথায়? ভুল বিশ্বাসই মুসলমান সমাজের পতন এবং সর্বনাশের একমাত্র কারণ। আল্লাহর আর কোনো আদেশই তার পাষাণ, সংগ্রামহীন কর্মবিমুখ মনে সে অনুভব করে না। সে নামাজই পড়ে, কিন্তু সর্বপ্রকার কুকার্য করে–তার জীবন পশুর মতো বিচারহীন, অতিশয় কুৎসিত–অতিশয় মন্দ।

খুন কারা করে? প্রতিশোধ কারা নেয়? ব্যভিচার কে করে? মিথ্যা কথা কারা বলে? অল্প ওজনে জিনিস কারা দেয়? দোকানে রূঢ় কথা বলে ক্রেতাকে কারা অপমান করে? নারীর সম্পত্তি কারা হরণ করে? এতিমের সম্পত্তি কারা ভোগ করে? যেখানে যেখানে ধর্ম জীবনের পরীক্ষা সেখানেই মুসলমান অপারগ, অসমর্থ এবং গোনাহগার। কোরান, সূরা বকর ১৭৬ নম্বর আয়াত (বাক্য)—“পূর্ব ও পশ্চিম দিকে মুখ করলে পূণ্য হয় না। যে কেউ ঈশ্বরের ও শেষ বিচারে দিনে, স্বর্গের দূতগণে, সমস্ত অবতীর্ণ ঐশ্বরিক গ্রন্থে এবং নবীগণে বিশ্বাসী (এই সবের অস্তিত্ব সম্বন্ধে আন্তরিক বিশ্বাস পোষণ করে) এবং তাঁর প্রেমে আত্মীয় ও অনাথদের (নিঃসহায়) ধন প্রদান করে, জাকাত দান করে প্রতিজ্ঞা পালন করে, দারিদ্র্যে, পীড়ায় ও যুদ্ধের সময় ধৈর্যশীল হয়–তারা সত্য কথা বলিয়াছে–ঈশ্বরের ভক্ত বান্দা। আল্লাহ্তে যার বিশ্বাস নাই, তার আবার ধর্ম কী? তাঁর আবার জাতি কী? জিজ্ঞাসা করি, বুকে হাত রেখে বল, আল্লাহতে বিশ্বাস আছে কি?–তার বিদ্যামানতায়, তার প্রেমে, তার ন্যায় বিচারে, তার প্রতাপ ও শক্তিতে, তার নৈকট্যে, তার সর্ব ব্যাপকতায়, বিশ্বাস আছে কী?–একদিন তোমার কৃতকর্মের বিচার হবে, তার ফল তোমার ভোগ করতে হবে–এ বিশ্বাস আছে কি?

তোমাকে ‘কাফের’ ছাড়া আর কী বলি? তুমি ধর্মহীন গুরু। তুমি ঈশ্বরের দূতগণের অস্তিত্ব বিশ্বাস কর? তুমি কি অনাথ, দরিদ্র নিঃসহায় পথিক ও ভিক্ষুককে প্রেম করে থাক?

আজকাল একদল লোক ধর্মপথের পথিক নয়, ভিক্ষার জন্যে পথিক বা মুসাফির। আল্লাহ্ এদেরকে পথিক বলেন নাই। আল্লাহর পথে যারা পর্যটক, তারাই মানুষের সাহায্য দাবি করতে পারে। অশিক্ষিত, অকর্মণ্য, আলস্যপরায়ণ ব্যক্তিরা কখনও আল্লাহর পথের পথিক নয়।

অনাথ যারা, নিঃসহায় যারা তাদের কথা সমাজের একজনও ভাবে না। শুধু দালান দেওয়ার কথা, জমিদারি রক্ষার কথা, আপন পরিবারের সুখ-দুঃখের কথাই মানুষ বলে বলে শেষ করতে পারে না। আল্লাহর আদেশ মানুষের পালন করতে দেখি কৈ? সময়কালে একটু নামাজ পড়তে দেখি মাত্র! সাহেব বাকি সময় যেন রেগেই বসে থাকেন। কে কবে জাকাত দিয়ে থাকে?–আমি তো একজনকেও জাকাত দিতে দেখি না। মুসলমানকে আল্লাহর কোনো আদেশই পালন করতে দেখি না। শুধু নামাজের আবৃত্তিতেই কোনো কাজ হবে কি? তাও কেউ কেউ বৎসর শেষে একবারও মাত্র পড়ে। আল্লাহর সমস্ত প্রেরিত ধর্মগ্রন্থে কার বিশ্বাস আছে? কৈ এক কোরান ছাড়া কাউকে তো ইঞ্জিল (বাইবেল), জবুর, তওরাত পড়তে দেখি না। হযরত ঈসাকে তো অনেক মুসলমান গালি দেয়। কোরানে লেখা আছে–ইঞ্জিলে হেদায়েত ও জ্যোতি আছে। তার সন্ধান তো একজনকে করতে দেখি না! পাছে খ্রিষ্টান হতেই হবে। নইলে মুসলমান হবে কী করে? সে নিজের কোরানই বুঝে না, পড়ে না–তাতে অন্য ধর্মগ্রন্থ, আল্লাহর কোন আদেশটি সে মানে? মুসলমান প্রতিজ্ঞা পালন করে কৈ? তার মতো মিথ্যাবাদী আমি দেখি না।

দারিদ্রে তার ধৈর্য কৈ? একটু উপায়ের পথ পেলে সে দুই হাত দিয়ে লুট করতে থাকে। ক্ষমতা পেলে সে দারিদ্রের উপর জুলুম করে। বিশ্বাসঘাতকতা তার ধর্ম। দারিদ্র্যে সে ছলনা, প্রতারণা, মিথ্যার আশ্রয় নেয়। সততাতার কাছে নাই।

আল্লাহর শত আদেশ সে অগ্রাহ্য করে। জীবন ভর সে আল্লাহকে অগ্রাহ্য করে বুড়াকালে কিছুদিন নামাজ নামে অন্ধভাবে আবৃত্তি করে।

ইহকাল, পরকালে কোনো মঙ্গল তার ভাগ্যে হওয়া সম্ভব? তোমরাই বিচার কর।

নামাজের সঙ্গে জীবনকে সত্যময়, নিষ্পাপ, মধুর, ঐশ্বরিক গুণভূষিত, নবী-পন্থী এবং সুন্দর করে গড়ে তুলতে হবে। মানুষকে হত্যা করা দূরের কথা, মানব হৃদয়ে বেদনা দেওয়াও মহাপাপ। ঈশ্বরের হাতে প্রতিশোধ নেবার ভার দাও। তোমরা নিজেরা গোপনে মানুষকে হত্যা করো না। ধৈর্যশীল হও এবং প্রার্থনা কর।

আল্লাহর আদেশ, মিথ্যা সাক্ষ্য দিও না। ভয়ে মিথ্যা পক্ষ সমর্থন করা মহাপাপ। খোদাকেই ভয় কর ন্যায় পক্ষে কথা বল। বড় লোক বলে ভয়ে তার দিক হয়ে কথা বলো না–তা হলে তোমার ঈমানের কোনো মূল্য থাকবে না।

প্রায়ই দেখা যায় মানুষ ক্ষতির ভয়ে, প্রাণের ভয়ে সাংসারিক স্বার্থ নষ্ট হবার ভয়ে, ধনবানের পক্ষে কথা বলে। যথার্থ ধার্মিকের কাজ তা নয়। যা বিবেক, জ্ঞান ও ধর্মসঙ্গত, যা সত্য তা নির্ভীকভাবে প্রকাশ কর। অধার্মিকেরা আত্মীয় ও বলবানের দিকে টেনে কথা বলে। যেখানে সত্য লাঞ্ছিত হয়, বিচার অপমানিত হয়, সেখানে আল্লাহর অভিশাপ আসে। অন্ধের মতো মৌখিক নামাজ পড়লে, কাজ হবে না। কার্যে, কথায়, ব্যবহারে আল্লাহর মর্যাদা রক্ষা কর। যা আল্লাহ্, তাই সত্য, তাই ন্যায়, তাই বিচার।

God is truth–M.S. Letter Gandi যার গায়ে বল আছে, তার প্রতাপ বেশি যে অর্থশালী, তার পক্ষই মানুষ অবলম্বন করে। ঈশ্বরের পক্ষ মানুষ অবলম্বন করে না। ন্যায় ও সত্যের পক্ষই ঈশ্বরের পক্ষ।

মানুষ মুখে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে, কার্যত সে শয়তানের পক্ষ অবলম্বন করে। তার প্রচারিত ধর্মের সঙ্গে জীবনের ধর্মের সঙ্গতি নাই। এ চালাকি আল্লাহর কাছে ঢাকা থাকে না। আল্লাহ মৌখিক তোষামদ চান না। তিনি দেখতে চান তার বান্দা কাজে তাঁকে। শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকার করছে কিনা! স্বীকার করাই হচ্ছে প্রকৃত ঈশ্বরের সম্মান।

যে অন্যায় পক্ষ অবলম্বন করে, মিথ্যাকে সম্মান করে, সে কাফের। সে শয়তানের অনুচর। যায় যাবে যাক প্রাণ, তবুও সত্যকে সমর্থন করব, এই হচ্ছে প্রকৃত বিশ্বাসী বা ঈমানদারের জীবন নীতি।

.

১৩. আল্লাহর আদেশ মিথ্যা কহিও না

ধিক সেই কুকুরকে যে মিথ্যা কথা বলে। জান তো মিথ্যার দ্বারা কত দুঃখ সৃষ্টি হয়। যে কুকুরের কথায় ঠিক নেই, যার প্রতিজ্ঞার ঠিক নেই, তার কোনো ধর্ম নেই।

এক প্রবীণ সম্পাদকের কাছে দুই মাস হেঁটেছিলাম। তিনি প্রত্যেক বারেই বলতেন–আগামী সপ্তাহে আপনার পুস্তকের সমালোচনা বের হবে। তিনি মিথ্যা কথা বলতেন।

পণ্ডিত, বৃদ্ধ, দেশনায়ক,শাসনকর্তা যে কেউ মিথ্যা বলুক, তাকে ভ্রান্ত বলা যায়। সে ব্যক্তি মনুষ্য সমাজের সম্মানের যোগ্য নয়। বাঙালির কথায় ঠিক নাই মিথ্যা বলা তার স্বভাব–অথচ বলে আমরা সুসভ্য জাতি, স্বাধীনতা আমাদের জন্মগত দাবি, আমরা ধার্মিক। আমাদের ধর্মের ন্যায় শ্রেষ্ঠ ধর্ম আর নাই। বাঙালি যদি রাত্রি ৮টার কথা বলেন। তাতে পরদিন বেলা ৮টায় বুঝায়। আমি মিথ্যাবাদীকে নীচ কুকুর বলি। জীবনে যারা সত্যবান এবং সুন্দর নয়–তাদের কোনো ধর্ম নাই। আলী নামক এক কৃষক আবদুল নামক এক ভদ্রলোককে একদা লোকচক্ষুর অগোচরে গভীর রাত্রিতে পঞ্চাশটি টাকা কর্জ দেন। না দিলে ভদ্রলোকের বহু সহস্র টাকা ক্ষতি হবার সম্ভাবনা ছিল। আলী কাউকে স্বাক্ষী না করেই সেই নিশীথ রাত্রে ভদ্রলোককে পঞ্চাশ টাকা দিলেন। আলীর এই মহৎ কার্যের বিষয় আর একটি লোক জানতেন, তিনি এক সাধু। এই ঘটনার পর ২/৩ বছর গেল। আলী আবদুলের কাছে সবিনয়ে আরজ করে বললো–টাকাগুলি ২/৩ মাসের মধ্যে ফেরত দিতে চেয়েছিলেন, তিন বছর হয়ে গেল, আমি এতদিন লজ্জায় চাই নি। আমার কষ্টার্জিত টাকা, আপনাকে কয়েক দিনের জন্যে মাত্র দিয়েছিলাম। একেবারে দেই নাই। আবদুল বললেন–অপেক্ষা কর। এইভাবে আরও এক বছর গেল। সাধু এই ব্যবহারের কথা শুনে বললেন, আপনার এই মহত্ত্বের প্রতিদান! ছিঃ ছিঃ ছিঃ।

অবশেষে আলীকে রাজদ্বারে অভিযোগ জানাতে হল। একজন সাক্ষী না হলে আইনত কীভাবে ডিক্রি হবে? তাই সেই সাধু বিচারপতির সামনে যেয়ে বললেন–আমি আমার সম্মুখে টাকা দিতে দেখেছি। ফলে মোকাদ্দমার ডিক্রি হল। এই মিথ্যা কথায় দোষ হয়, নাই। অক্ষর পালন ধর্ম নয়।

অনুতপ্ত–সাধু, মহৎ প্রকৃতির ফরাশি দস্যু জিন্ ভালজিনকে ইন্সপেক্টর জাভার্টি ধরতে গেলেন, তখন পথে জনৈক সন্নাসিনী উপবিষ্ট ছিলেন। রাক্ষস ইন্সপেক্টর জিজ্ঞাসা করলেন, মাতা, কোনো লোক এই পথ দিয়া গিয়াছেন? সন্নাসিনী জানতেন, সেই পথ দিয়া জিন ভালজিন ঘরে প্রবেশ করে লুকিয়ে আছেন। তথাপি ইন্সপেক্টরের অপমান হতে তাকে রক্ষা করবার জন্য অম্লানভাবে কঠিন রূঢ় কণ্ঠে ঘৃণামিশ্রিত স্বরে বললেন–না, এ পথ দিয়ে কেউ যায় নাই। জিন্ ভালজিন আল্লাহর কাছে বহু পূর্বে ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে মহাপুরুষ হয়েছিলেন, কিন্তু দুর্ধর্ষ প্রতিহিংসাপরায়ণ ফরাশি পুলিশ তাকে চিরজীবন দাগী করে রেখেছিল। যাই হোক সন্ন্যাসিনী মাতার এই মিথ্যা কথা সত্য অপেক্ষা মধুর, পুণ্যজনক এবং সুন্দর। তথাপি জীবনের কাজে মিথ্যা কথা পাপ। যে মিথ্যা বলে সে সমুদ্রে ভাসমান তৃণখণ্ডের মতো–যে ভর সয় না, যার জীবনের বিন্দুমাত্র গুরুত্ব নাই। মিথ্যাকে আন্তরিক ঘৃণা করবে, এবং যে মিথ্যা বলে তাকেও আন্তরিক ঘৃণা করবে। জনৈক মৌলবী সাহেব সারারাত্রি নামাজ পড়তেন, অথচ বিচারালয়ে পরিষ্কার মিথ্যা বলতেন। জীবনে পরীক্ষায় যে জয়ী হয় না–তার নামাজের আবৃত্তি করে কী লাভ! অন্ধেরা বুঝে না মানুষ এবং খাঁটি মুসলমান হবার জন্য আল্লাহ্ নামাজ পড়ার আদেশ দিয়ে তাঁর বাণীগুলি দিনের মধ্যে পাঁচবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন যাতে মানুষ সাবধান হয়–সতর্ক হয়। আল্লাহর আদেশগুলি সর্বদা চোখের সামনে দেখে মানুষ মনে করে-সত্যে লাভও নাই, বলও নাই। তা হলে আর কেন বল–”আল্লাহু আকবর। আর সেই মহাবাণী বলে মাটিতে মাথা রাখ। এ ভণ্ডামি কেন কর। আল্লাহ্ অর্থ সত্য হক, ন্যায়, বিচার, উত্তমতা। মুখে যা বল, কার্যে তার বিপরীত সাক্ষ্য দাও। তা হলে কী করে বলি তোমরা ঈমানদার, তোমরা মুসলমান?

শিশু ভূমিষ্ঠ হবার পরেই তার কর্ণে ‘আল্লাহু আকবর’ এই মহাবাণীর ধ্বনি তোলা হয়। হায়, জীবন ভরই সে কিন্তু এই মহাবাণীর অপমান করে। তার মুখের আর জীবনের কাজে সঙ্গতি কৈ?

.

১৪. প্রতিবেশীকে প্রেম করিও

আল্লাহর আদেশ–প্রতিবেশীকে প্রেম করিও। কৈ আপন প্রতিবেশীর সঙ্গেই তো মুসলমানের বেশি বিরোধ। “আপন ভ্রাতার সঙ্গে প্রথমে সন্ধি কর, অতঃপর মসজিদ ঘরে এস।” মানুষ নিজ প্রতিবেশীকে ঘৃণা করে, ছোট মনে করে–এই তো মুসলমান সমাজের আজ দৈনন্দিন কাজ।

যে ধার্মিক হতে চাও, আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ করতে চাও–সে প্রতিবেশীর সঙ্গে আত্মীয়তা কর। প্রতিবেশী আত্মীয়ের চাইতেও আপন। যে প্রতিবেশীর সঙ্গে সদ্ভাব রাখে না–তার ঘরের পার্শ্বে চলাচল বন্ধ করবার জন্যে বেড়া তোলে–তার পক্ষে উচিত নয়, নামাজ ও কোরান পাঠ করা। প্রতিবেশীর জন্য অন্তরে যার সত্যের আলো জ্বলে না–কলবে (হৃদয়ে) যে ঈশ্বরের বাণীর ধ্বনি শুনতে পায় না–তার আবার রোজা-নামাজ কী? তার আবার ধর্ম কী?

প্রতিবেশীর সুখ-দুঃখের সঙ্গে নিজের সুখ-দুঃখ মিলিত কর। তার সহস্র অপরাধ ক্ষমা। কর। তাকে আপনজন বলে গ্রহণ কর। তোমরা কি শহরবাসী সে প্রতিবেশীকে চেন না–যে প্রতিবেশীর সঙ্গে কথা বলে না? সে দস্যু, বিধর্মী এবং ব্যাভিচারী, সে তোমার প্রতিবেশী হলেও তাকে বেগানা অর্থাৎ তাকে বিদেশী মনে করবে।

আল্লাহর আদেশ–কারো অনিষ্ট করো না। মানব জীবনের কাছে আল্লাহর এই-ই অন্যতম শ্রেষ্ঠ আদেশ। যে ব্যাক্তি দ্বারা মানুষ দুঃখ পায় না, সেই তো ধার্মিক। ফকিররা পথে কাউকে বেদনা দেন না, আর তুমি নরাধম, গায়ের জোরে নিত্য মানুষকে কত দুঃখ দিচ্ছ! অপেক্ষা কর আল্লাহর শাস্তি তোমার চক্ষুকে অন্ধ করবে, তোমার বাহু শক্তিহীন হবে, তোমার পা অবশ হয়ে যাবে–তোমার নিকট আত্মীয় বিনষ্ট হবে। হে অবোধ, সাবধান হও। আল্লাহর শাস্তি নিকটবর্তী।

আল্লাহর আদেশ-ব্যভিচার করো না।

হায় কী সর্বনাশের কথা! বাংলার পথ-ঘাট ব্যভিচারের পাশে বিষাক্ত হয়ে উঠেছে–ব্যভিচারের উৎসব চলছে। আল্লাহর গজব এসে বাংলাদেশ এবং পৃথিবীকে নিশ্চয় ধ্বংস করবে। কেন ব্যভিচার কর? আল্লাহ্ কি তোমাদের বিবাহিত হতে নিষেধ করেছেন? বাংলার ব্যভিচারের জন্য হিন্দু সমাজই দায়ী বেশি–হায় এ মহা পাপের ভার ধরণী সহ্য করতে। পারে না। ওগো মা, ওগো জননী! তোমাদের পায়ে ধরি, ব্যভিচার করো না যদি অন্নের কাঙাল হয়ে বস্ত্রহীন হয়ে তোমরা ব্যভিচার করতে বাধ্য হয়ে থাক, তবে হে মুসলমান সমাজ, নামাজ বন্ধ করে ব্যভিচারিণী পাপ ব্যবসায়িনী নারী সমাজকে অন্ন, বস্ত্র এবং আশ্রয় দাও। এ পাপ যত দিন বন্ধ না হবে ততদিন তোমাদের নামাজ হবে না। কিছুতেই না। মুসলমান তুমি কি মরে গিয়েছ? তোমরা বেঁচে থাকতে আল্লাহর এত অপমান? এ পাপ কি চোখে দেখা যায়! হায়! হায়! কী হল। নারীদেহের কী দুর্গতি!

হায়, বাংলার যুবক সমাজ, হে কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, ধনী, তোমরা ব্যভিচারের পাপকে প্রশ্রয় দিও না। এর মতো মহাপাপ আর নাই। এর ফল ইহকালেও অতি সাংঘাতিক।

ওগো! বাংলার পিতা-মাতা, তোমরা আপন আপন কন্যাকে শিক্ষিতা কর, তা হলে এ। মহাপাপ নারী কর্তৃক অনুষ্ঠিত হবে না। তোমরা বিধবাকে ঘরে রেখ না–তাদের বিবাহিত করাও।

বেশ্যাকে বল, সে যেন তার মহাপাপের জীবন ছেড়ে দেয়!–সে জীবিকার জন্যে অন্য কোনো ব্যবসা করুক। দোকান দিক। এমন কুকার্য কি মানুষে করে? এমন ঘৃণিত কাজ কি নারীর দ্বারা অনুষ্ঠিত হবে? অভাবে, দুর্গতিতে, সমাজ তাড়িত হয়ে নারীকে যেন বেশ্যাবৃত্তি না করতে হয় তা হলে দেশের সকল লোককেই এ মহাপাপের অংশগ্রহণ করতে হবে। হে দেশের সাহিত্যিকগণ, হে সমাজ-সংস্কারক, হে দেশ-সেবক, হে সম্পাদক তোমরা দেশে ব্যভিচারের বিরুদ্ধে তোমাদের আপন আপন শক্তি প্রয়োগ কর। এই কাজের জন্য একদল নারী মুক্তিসেনা প্রয়োজন। পতিত নারী বিষ এবং আগুনস্বরূপ–ওদের কাছে পুরুষ মানুষের যেতে নেই। গেলেই কলঙ্কিত হবে, পা ফসকে যাবে। কাজ করবার ওদের বাঁচবার শক্তি থাকবে না। নিজেরাই পতিত হবে।

পাপের চিত্ত দেখতে হলে, বেশ্যাদের কাছে যেও–এ মহাপাপ ক্ষেত্র, এমন মহাশ্মশান আর নাই।

আল্লাহর আদেশ–পরের কুৎসা রটনা করো না।

পরের নিন্দা করবার কী উৎকট ইচ্ছা সকলের! নিজের মধ্যে কত কদ, কত পাপ, সেদিকে একটি লোকও তাকায় না, শুধু পরের কথাই বলে।

যে যত ছোট সে তত পরের দোষ দেখে। নিজের দোষ-ত্রুটির কথা ভাবলে, সারা জীবন কেটে যায়। তুমি আবার অপরের ত্রুটি আলোচনা করছো? আল্লাহ্ যা নিষেধ করেছেন, কোন্ সাহসে তা কর? আবার নামাজ পড় শুধু নামাজই কি আল্লাহর আদেশ? আর যে আল্লাহর শত আদেশ উপেক্ষা করছ–সে দিকে লক্ষ্য নাই। নামাজ পড়লে চোখে দেখা যায়, তাই আনুষ সুখী হয়। আবার যে সব পাপ গোপনে করা হয় তা তো দেখা যায় না, তাই মানুষ বিরক্ত হয় না। মানুষ যে দিনের মধ্যে উঠতে বসতে কত পাপ করে, আল্লাহকে কত রকমে অপমান করে, তার কত আদেশ অগ্রাহ্য করে–তা ধরে দেখতে গেলে, মনে হয়, মানুষ শয়তানের অনুচর, আল্লাহর দাস নয়। দাসের কী এই কাজ? দাস কি কখনও প্রভুর আদেশ অমান্য করে আল্লাহকে এইভাবে তোমরা অপমান কর, তবু তিনি তোমাদের কত দয়া করেন। সারা জীবন ভরে তিনি তোমাদের অনুতাপের জন্য অপেক্ষা করেন। জীবন শেষ হয়ে যায়, তবু তোমরা সজাগ হও না।

আল্লাহর আদেশ পিতা-মাতাকে অমান্য করো না। অনেক মানুষকে দেখা যায়, জুম্মার নামাজ পড়তে চলেছে, অথচ ঘরে মা কলেরা রোগাক্রান্ত হয়ে কোন্ ফাঁকে মরে আছেন সে খবর রাখে না–মাকে যত্ন করা তো দূরের কথা। এই তো মানুষের নামাজ।

ছেলে সেয়ানা হয়েছে। বাপ-মা কী অবস্থায় থাকেন, কী খান সে সংবাদ কে রাখে? সেই বুড়াবুড়ি শেষকালে সংসারে দয়ার পাত্র-পাত্রী।

আল্লাহর আদেশ–পরের দ্রব্যে লোভ করো না। পরের দ্রব্যে তো লোভ লেগেই আছে–পরের সম্পত্তি আত্মসাৎ করবার দুর্নিবার ইচ্ছা সব হাজি, সব নামাজির আছে। কে কবে আপন বোনের সম্পত্তি তাকে দিয়ে থাকে? এসব আগুন খেয়ে নামাজ পড়লে, নামাজ হবে না। মৃত ভ্রাতার নাবালক সন্তানগণকে বঞ্চিত করে, বিধবা পত্নীকে বঞ্চিত করে তাদের সম্পত্তি নিজে ভোগ কররার কী লোভ তোমার!

কেউ যদি কিছু গচ্ছিত রাখে, তাও ভোগ না করতে পারলে, মোটেই ভালো লাগে না।

পরের দ্রব্যকে হারাম ভাব। তোমার উপর কেউ সম্পত্তি পরিচালনার ভার দিলেন। তুমি ধীরে ধীরে তার অজ্ঞাতসারে একে একে সব গ্রাস করতে থাকলে। তোমার নামাজ রোজার কামাই নাই। ধর্ম খুবই ঠিক রাখছ বটে। ভাবছো আল্লাহ কিছুই বুঝতে পারছেন না। তোমার লম্বা কুর্তা দিয়ে মানুষকে ঠকাচ্ছ–আল্লাহকে ঠকাতে পারবে না।

আল্লাহর আদেশ-চুরি করো না।

জনৈক পদস্থ রাজপুরুষ গোপনে রাত্রে ঘুষ আদায় করতেন–শুক্রবারে বাচ্চাহারা গাভীর মতো মসজিদ ঘরে দৌড়ে যেতেন। এ তো চমৎকার নামাজ! নামাজের ত্রুটি হয়।

কিন্তু ঘুষ গ্রহণ, প্রতারণা, মিথ্যা, প্রবঞ্চনা, এসব লেগেই আছে। বোধ হয় বণিকের খাতার মতো জমা-ওয়াসীল হয়ে পুণ্যের ভারই বেশি হবে। আর সেই পুণ্যবলে বেহেস্তে লেজ দোলাতে দোলাতে উপস্থিত হবে।

এই যে নামাজ–আমার মনে হয় এও অর্থ উপার্জনের একটি পন্থা। ধার্মিক বলে। সমাজে নাম থাকলে, অর্থ উপার্জনের কেননা বিঘ্ন হবে না। এই হচ্ছে ধারণা।

.

১৫. অনুদান ও দুঃখের উপশম চেষ্টা

মানুষকে অন্ন দেবার মতো মহাধর্ম আর নাই। ভরা পেটে খাবার দান করা এমন কিছু নয়, কিন্তু জগতে তাই হয়। বাইরে রাস্তায় পড়ে মানুষ এক মুঠো অন্নের জন্য কাতর চিৎকার জানাচ্ছে। ভিতরে নিমন্ত্রিত ব্যক্তি জোড়হস্ত হয়ে ক্ষমা চাইলেও তাকে আরো খেতে অনুরোধ করা হচ্ছে। বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী, বড়লোক, এদের প্রীতিভোজ দিতে নিষেধ করি না–কারণ এরও একটা আবশ্যকতা আছে। যার আছে তারও তো ক্ষুধা লাগে। আনন্দ তার। জন্যেও দরকার। অন্নহীন দরিদ্রের কথা একেবারে ভুলে যেও না। তোমরা বড়লোকের সন্তান, ঘরে অন্নের অভাব নেই। কিন্তু রোজার মাসে আল্লাহ তোমাদের অন্নহীন উপবাসীর বেদনা বুঝবার সুবিধা করে দিয়েছেন সেই ব্যথা ভেবে দরিদ্রের কথা চিন্তা কর। প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে পেট ভরে খেয়ে শুয়ে থেকো না–তার মতো পাপ আর নাই।

দেশের অন্নহীনদের অর্থ উপার্জনের সুবিধা করে দেওয়া মহৎ লোকের কাজ–দেশ সেবকের কাজ, পুণ্যবানের কাজ। শুধু শুক্রবারে সমবেত উপাসনা করলে উপাসনা সিদ্ধ হবে না–ওরে অবোধ!

শুধু অক্ষর পালন করলে আল্লাহর আদেশ পালন হবে না। সমবেত হও সবাই, দেশের জনহিতে কাজ কর, মানুষের ক্ষুধার স্থায়ী মীমাংসা কর–ভিক্ষা দিয়ে কটা লোককে কদিন বাঁচান যায়। তথাপি ভিক্ষা দাও–দান কর, দান ব্যতীত নামাজ সিদ্ধ হয় না। দেশের লোকের বেদনার চিৎকার শোন না? ওরে অবোধ! এই কি তোমার প্রাণের দরদের পরিচয়! দরদ ছাড়া কি স্বর্গের যোগ্য হওয়া যায়? দরদ চাই, প্রেম চাই।

যদি জ্ঞানে, পাণ্ডিত্যে, ফকিরিতে আকাশ দিয়ে উড়ে যেতে পার, তবু তোমার কোনো মূল্য হবে না, যদি না তোমার প্রাণে প্রেম, দরদ, আদর-মহব্বত থাকে। প্রেম করতে শেখ, অহঙ্কার ত্যাগ কর–মানুষকে, আপন ভ্রাতাকে দরদের দাবি হতে বঞ্চিত করো না। ওরে পশু! ভ্রাতাকে বঞ্চিত করে মুখে অন্ন তুলে দিচ্ছ? পশুতেও তো গোয়াল ঘরে তার বন্ধুর অঙ্গ চাটে। তুমি মানুষের বেদনা-চিৎকার শুনে কি ঘরের দরজা দিয়ে শুলে? হায়, মানুষের কী হল? মানুষ ঈশ্বরের সন্তান হয়ে কি এত নিষ্ঠুর হল! পিতার মৃত্যুতে ফাতেহা উপলক্ষে বৃথাই ৫০০ টাকা ব্যয় করলে? যে মানুষ জীবনে ধর্ম করে নাই, পয়সা দান করে নাই, মরণের পর তার দান আর একজন করলে কী হবে? জীবিতের জন্য ধর্ম। মৃতের জন্য নয়। জীবনে বেঁচে থাকতেই ধর্ম করে যাও। দেশের আর্ত পীড়িতের জন্য ফাতেহার পরিবর্তে বরং হাসপাতাল স্থাপন কর। এতে মানুষের কত মঙ্গল হয় তা কি একটু বুঝতে পার না! এমন পাগল কোথায় আছে?–যে আপন মঙ্গল, জাতির মঙ্গল ভাল বুঝে না? দেশের সর্বত্র শিশুদের জন্যে, পীড়িত প্রসূতির জন্যে, বৃদ্ধের জন্যে হাসপাতাল স্থাপন কর এবং মানুষকে বাঁচাও। এর মতো ধর্ম আর কী আছে? এই দুঃখের দেশে এই দরিদ্রের দেশে কি মান করা সাজে? অর্থশালী হও, অর্থ উপার্জন কর–সেই অর্থ দিয়ে পীড়িত দুঃখীর সেবা কর। মাঠে পরিশ্রম কর, ঘর ধানে অনে ভরে উঠুক। মানুষকে অনুদান কর। অন্নদানের মতো পুণ্য কী আর আছে! বাড়িতে অতিথি এলে যে অন্য বাড়ি দেখিয়ে দেয়, ধিক তাকে! মানুষকে, অতিথিকে, প্রতিবেশীকে অন্ন দাও–তারা পেট ভরে খাক এবং দোয়া করুক! কৃষি কর–এবং প্রচুর ধান গোল ভর্তি করে তোল। দান কখনো সুদি করে লাগাতে নাই। দানের জন্যেই অন্ন। মানুষের সঙ্গে দেখা হলেই তাকে অন্ন গ্রহণ করতে বল–এরই নাম প্রেম ও ভালবাসা। যাবৎ না মানুষকে আপনার ভাই বলে ভালবাসতে পার, তাবৎ স্বর্গের যোগ্য তোমরা হবে না। দরিদ্র মানুষের সঙ্গে টাকার হিসাব করো না। অফুরন্ত উপার্জন কর এবং যোগ্য ব্যক্তিকে দান কর। তোমার গ্রামের নিঃসহায় বিধবা পীড়িতেরা যেন অভুক্ত এবং বেদনায় ব্যথিত না থাকে।

মানুষকে গোপনে দান কর যেন তোমার দানশীলতার পরিচয় কেউ না পায়।

দানে যার হস্ত পবিত্র হয় না, সে যেন অজু করে নামাজ না পড়ে।

যে বাহুল্য ব্যয় করে, যার নিজেরই বিলাস আকাঙ্ক্ষার তৃপ্ত হয় না, সে ক্ষুধিত, মরণ মূৰ্ছিতকে কী দেবে? সেই নিষ্ঠুর আপন সুখ-চিন্তায় ব্যস্ত-ব্যথিতের বেদনা-চিৎকার তার কানে কী পৌঁছাবে?

Lay by something in youth, so that you may not sharve in old age.

মানুষের সহজ ও স্বাভাবিক ধর্ম যা তাই বড় ধর্ম। মানব-সমাজে থেকে নিত্য মানুষ যা করবে, মানুষ মানুষের সঙ্গে যেভাবে নিত্য ব্যবহার করবে, তারই আদর্শ এ ধর্ম জীবনে দেওয়া হয়েছে। কোনো গুপ্ত মন্ত্র, কোনো তত্ত্ব এখানে প্রচার করা হচ্ছে না। আম গাছে কাঁঠাল তৈরি করা, পানির উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া, মরা মানুষ বাঁচান–এসব জগতে হয় না! ওসব কথা সত্য হলেও বা শুনতে ভালো শোনা গেলেও ধার্মিকের কাজ নয়। ঈমানের বলে মরা মানুষকে জীবিত করা যায়–এসব বিশ্বাস বর্তমানে না করাই উচিত।

“কাল কী খাবে, তার চিন্তা আর করো না–
কালকের জন্য কালকের চিন্তাই যথেষ্ট।”

যে জাতির পুরোহিত এই বাণী প্রচার করেছেন, তার শিষ্যেরা কোটি কোটি টাকা সঞ্চয় করে বসে আছেন। রিক্তহস্ত হওয়া তাঁরা পাপ ও মূর্খতা মনে করেন। এই বাণী যতই মহৎ কার্যত মানুষের অভাব সঞ্চয় ব্যতীত, নিজের চেষ্টা ও পরিশ্রম ব্যতীত অতি কঠিনভাবে পূরণ হয়-এক রকম হয় না। অভাবে, দুঃখে-দারিদ্রে মানুষ মরে যায় অথবা চির অবহেলিত হয়ে শৃগাল-কুকুরের মতো জগতে বাঁচে। এ অভাব পূরণ করা পূর্ব হতে সতর্ক হওয়া, বুদ্ধি করে পূর্ব হতে বিপদের দিনের জন্যে সঞ্চয় করে রাখাই ধর্ম করা–অভাবের দিনে আল্লাহই পূরণ করবেন, এ বিশ্বাস পোষণ করা ধার্মিকের কাজ নয়–এই বিশ্বাস মূখেরাই পোষণ করে। সন্তান হবার আগে মায়ের স্তন দুগ্ধ ভর্তি হয় এ কি দেখ না।–পূর্ব হতে সঞ্চয় করে রাখ এবং সতর্ক হও। এ জগতে কেউ কারো কথা ভাবে না। নিজের অভাব পূরণ না করে মানুষ তোমার অভাব পূরণ করবে, এ আশা করা উচিত নয়।

এক দরবেশ দেখলেন মাঠে এক মরা পড়ে আছে। সিংহ বৃষ হত্যা করে রেখে গেছে, শৃগাল আনন্দে বিনা পরিশ্রমে তাই খাচ্ছে। দরবেশ ভাবলেন, শৃগাল যখন বিনা পরিশ্রমে বসে বসে খাচ্ছে, তখন খোদাতায়ালা ইচ্ছা করে এইভাবেই বসিয়ে খাওয়াতে পারেন, তবে আমি কেন অন্নের জন্য উদ্বিগ্ন হই। এক স্থানে বসে থাকি, আপনা-আপনি আহার আসবে। সেই কথা ভেবে দরবেশ এক অন্ধকার ঘরে বসে রইলেন। ১৫ দিন অতিবাহিত হল, কোনো সাহায্য এলো না। তখন তিনি জ্ঞান–বাণী পেলেন। কেন শৃগালের মতো হতে চাও? সিংহের মতো নিজে চেষ্টা করে বৃষ হত্যা কর–শৃগালেরা খাবে।

কথাও তাই, শৃগাল হতে ইচ্ছা করা বীর ধার্মিকের কাজ নয়।

তার পক্ষে সিংহ হওয়াই উচিত।

যার অর্থ নাই, সে মানুষকে কি করে বাঁচাবে?–মানুষকে কি খাওয়াবে?

১৬-২২. প্রার্থনা

১৬. প্রার্থনা

যখন-তখন, দিনের মধ্যে যতবার ইচ্ছা–যে অবস্থায় থাক না, আপন ভাষায় সময় ও অবস্থার সঙ্গে তাল রেখে প্রার্থনা করা যায়। প্রত্যেক কাজের প্রারম্ভে, যে কোনো প্রকার দুঃখে, অশান্তিতে, উদ্বেগে, বেদনায় এক অথবা দুই একজন মিলে শব্দ করে আল্লাহর কাছে। আন্তরিকভাবে, পরম নির্ভরশীর সরল শিশুদের মতো প্রার্থনা করবে। প্রার্থনা যদি আন্তরিক হয়–তবে সঙ্গে সঙ্গেই আত্মায় পরম ভরসা আসে। প্রার্থনা মানব জীবনের পরম অবলম্বন। মানবাত্মাকে ঈশ্বরের পথে আত্মোন্নতির পথে আকর্ষণ করার এই-ই একমাত্র পথ। সর্ব দুঃখের মীমাংসা প্রার্থনায় সম্ভব। প্রার্থনার দ্বারা পীড়া এমন কি সর্ববিষ শান্ত হয়। এই ধরনের প্রার্থনার সঙ্গে নামাজের কোনো সংশ্রব নাই। আজান ও নামাজ সামাজিক সঙ্গতি, এক কথায় পৃথিবীতে মানুষের ঈশ্বর বিশ্বাস ও ধর্ম জীবনকে চিরজীবিত করে রাখবার জন্যে একটা বাধ্যতামূলক অনুষ্ঠান। মানুষের স্মরণপথে তার মনের সম্মুখে ঈশ্বরকে সদাজাগ্রত করে রাখবার জন্য মুসলমান নামাজ পড়ে একটা অপরিহার্য কর্তব্য পালন করে।

প্রার্থনা দুই প্রকার : প্রথম সাধারণ শ্রেণীর জন্যে, যেমন আত্মোন্নতির মানব জীবনের কল্যাণের জন্যে, মানবাত্মার চির আত্মোন্নতির সমস্যা সমাধানের জন্যে। যেমন পাপের ক্ষমার উদ্দেশ্যে–ঈশ্বর নৈকট্য লাভ উদ্দেশ্যে। দ্বিতীয়, সাময়িক কোনো ঘটনা বা বিষয় নিয়ে নামাজকে প্রথম প্রকারে অন্তর্গত করা যায়। না বুঝে প্রার্থনা, না বুঝে কোরান পাঠ অসিদ্ধ। সর্বদাই আত্মায় অনুভব করে এমন প্রার্থনা কর। শুক্রবারের নামাজ-পরিচালকের বক্তৃতা, সাধারণ ধর্ম কথা এবং উপস্থিত বা সাময়িক প্রসঙ্গ দেশীয় ভাষায় হবে। যদি বিদেশী ভাষায় হয় এবং শ্রোতৃমণ্ডলী না বুঝতে পারেন, তা অসিদ্ধ। নামাজ শেষে হাত তুলে যে ব্যাক্তিগত শেষ প্রার্থনা করা হয়, তা অবশ্যই নিজের ভাষায় হওয়া উচিত। মোট কথা, না বুঝে প্রার্থনার উদ্দেশ্যে আল্লাহর কোনো বাক্য আবৃত্তি অসিদ্ধ। প্রার্থনা স্বরচিত হওয়া উচিত। ঈশ্বর রচিত কথাও যদি প্রার্থনার মতো হয়, তবে সমাজে তা ব্যবহার করা, যায়। অপ্রাসঙ্গিক কথা যেমন যুদ্ধ বর্ণনা, নারীর শুচিতার ও অশুচিতার কথা, ঐতিহাসিক কথা–এসব নামাজে ব্যবহৃত না হওয়াই উচিত।

স্বরচিত ব্যক্তিগত প্রার্থনা এই ধরনের হবে। যেমন প্রাতে উপাসক নামাজ শেষে ব্যক্তিগত প্রার্থনা করছেন, প্রভু! হে মহামহিম, রাত্রির নিরাপত্তার জন্যে তোমায় ধন্যবাদ। রাত্রিতে যখন আমি দ্রিায় অচেতন ছিলাম, তখন তোমার দৃষ্টি আমাকে সর্ব বিপদ হতে রক্ষা করেছে। আজকাল আমার এই জীবনের দিন যেন তোমার কার্যে ব্যবহৃত হয়–যেন আমার জন্য আজকের দিন বৃথা এবং ব্যর্থ না হয়। দিবসের প্রতি কথা এবং প্রতি কাজে যেন তোমার গৌরব রক্ষা করি। যেন সকল কাজে তোমার ইচ্ছা পালন করি। যেন তোমায় ভুলে না থাকি। আমার জীবনের দ্বারা পৃথিবীর মঙ্গল হউক। যেন মানুষের অভিশাপের পাত্র

হয়ে জগতে বাস করি। মানবকল্যাণে আমার দিনগুলি সার্থক ও সুন্দর হউক। যেন হৃদয়ে নীচ চিন্তা, পাপের চিন্তা প্রবেশ না করে–আমাকে অহঙ্কারী হতে দিও না। তোমার স্বভাব ও ভাবে আমার জীবনকে রঙিন কর। পার্থিব চিন্তায় আমার জীবনকে ব্যর্থ করো না। যেন অবৈধ অসিদ্ধ অন্ন মুখে তুলে না দিই। ছলনা, প্রতারণা, নিষ্ঠুরতায় আমার জীবন যেন কলঙ্কিত না হয়। প্রতিদিন যেন তোমার কাজ সার্থক হয়। আমাকে বিধর্মীদের মতো করো না। যেন সব বিষয়ে তোমার উপর নির্ভর করি, তোমার কাছে শক্তি ভিক্ষা করি, অধার্মিকদের উপর আমার কর্তৃত্ব দাও। আমায় বল, স্বাস্থ্য, ধন, জ্ঞান, রূপ, ঐশ্বর্য, আনন্দ, শান্তি, বিশ্বাস দাও–যেন তোমার যোগ্য দাস হই ইত্যাদি।

অথবা এইরূপ : প্রভু! আজ প্রভাতের উজ্জ্বল আলোমুকুরে দেখলাম তোমার নির্মল সুখ। প্রভাতের নির্মল বাতাস কুসুমের সৌন্দর্যের মতো, প্রভু। আমায় নির্মল কর, সুন্দর কর ইত্যাদি।

.

১৭. সম্মানিত ব্যক্তি ও পণ্ডিতদের সঙ্গে নিঃস্বার্থ সাক্ষাৎ

পণ্ডিত, আলেম, জ্ঞানী, সম্মানিত, পূজনীয় ব্যক্তির সাথে নিঃস্বার্থভাবে মাঝে মাঝে দেখা করা ধর্ম জীবনের অঙ্গ। আজকাল নিঃস্বার্থ দেখা-সাক্ষাৎ উঠে গিয়েছে–যেখানে লাভের আশা থাকে, স্বার্থসিদ্ধির আশা থাকে, সেইখানে মানুষ মধু-মক্ষিকার মতো ঘোরে। যে মানুষ অর্থশালী, যে রাজপদে নিযুক্ত তার বাড়িতে লোক ধরে না, তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ আত্মীয়তা করতে মানুষের উৎসাহের সীমা থাকে না। কিন্তু মহাজনেরা কখনও স্বার্থ চিন্তায় বড়লোকের কাছে আসা যাওয়া করেন না।

ঈশ্বর উদ্দেশ্যে, ঈশ্বর কার্যে জীবিত থাক–সেই উদ্দেশ্যে সজ্জনের সঙ্গে দেখা কর। এই-ই তোমাদের জীবিত থাকবার একমাত্র দাবি হোক।

ঈশ্বরের কার্য কী? তা মানব কল্যাণ, মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের সংবাদ বহন, বিদ্যালয় স্থাপন, হাসপাতাল নির্মাণ, মানুষকে সুখী ও মানুষ করবার প্রচেষ্টা, নিজে সুখী ও সম্পদশালী হওয়া, পরিবারবর্গ প্রতিপালন, প্রতিবেশীর মঙ্গল কামনা, নিজের মধ্যকার পশুভাব দমন, মানুষকে সত্যময় ও সুন্দর করা। ঈশ্বরের কাছে ঐশ্বরিক শক্তি ও সাহায্য ভিক্ষা এবং এই জন্য আন্তরিকভাবে প্রার্থনা, সামাজিক ধর্ম জীবনের মর্যাদা রক্ষা, অর্থাৎ রোজা এবং আজানসহ সমবেতভাবে নামাজ পড়া।

তোমাদের দৈনিক জীবনের আলাপ ও গল্পের বিষয় এইসব লোক। হায়! মুসলমান সমাজের দৈনিক্সআলাপ হয় কী বিষয়ে যা বলতে লজ্জা করে। মানুষ মানুষের সহিত দেখা করে অতি জঘন্য স্বার্থে। কেউ কারো সঙ্গে আল্লাহর জন্যে সাক্ষাৎ করে না।

যেমন জগতে রাজার শাসন সম্বন্ধে সর্বদাই তোমরা আলোচনা কর, সভা কর, তেমনি আল্লাহর রাজ্য, তাঁর শাসন, নীতি, তাঁর রাজ্য বিস্তার সম্বন্ধে তোমরা আলোচনা কর, সভা কর। মানুষের সঙ্গে ভক্তি ও প্রেমের প্রেরণার উৎসাহে আন্তরিকতায় দেখা কর, সাক্ষাৎ কর। কীভাবে আল্লাহর রাজ্য চলেছে, চলবে। প্রভুর সম্বন্ধে আমরা আরও কী করতে পারি। কীভাবে আল্লাহর সেবা আমরা তার কোটি কোটি ভক্ত সৈনিক সন্তান মিলে করতে পারব। কী করে পাপী আর তার অনুচরদলের অভিযান চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেব। এ আয়োজনে, এ কল্পনা কি তোমাদের আছে? তোমরা আল্লাহর রাজ্যে বাস কর না তোমরা বাস কর ইংরেজদের রাজ্যে, সেই জন্যেই সেই কথা বল, সেই রাজ্যে বড় চাকরি পাবার জন্যে বড়লোকের দুয়ারে হানা দাও। তাঁর শাসন সম্বন্ধে কোনো আলোচনাও তোমরা কর না।

দেশের সম্মানিত ব্যক্তি যারা, তাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করা উচিত। দাম্ভিক অহঙ্কারী হয়ে সম্মানিতকে তুচ্ছ করো না। প্রভুর কাছে দাস হয়ে নত হও এবং সর্ব প্রকারে তার। অনুগত থেকে তার মঙ্গল কর। সম্মানিতদের, পণ্ডিতজনকে আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধা কর।

দুষ্ট, অনাচারী, যে আল্লাহর পথে নাই, তাকে সম্মান করো না, তার কাছেও যেও না।

.

১৮. হাসপাতাল নির্মাণ

হাসপাতাল নির্মাণের কথা একবার কেন, অনেকবার বলেছি। আবার বলি, দেশের সর্বত্র পীড়িতের জন্য বিদ্যালয় স্থাপনের পাশে পাশে হাসপাতাল, যক্ষ্মাগার স্থাপিত হওয়ার মতো ধর্মকাজ আর নাই। পীড়িতের সেবা কর। এই হচ্ছে ধর্ম। শুষ্ক লবণহীন রোজা নামাজে কোনো ফল হবে না।

ইচ্ছা থাকলে এসব কাজে টাকার অভাব হবে না। প্রত্যেক মসজিদ ঘরে সম্মানিত, সাধু এবং যোগ্য পণ্ডিতকে পুরোহিত নিযুক্ত কর। তিনি চাঁদা তুলবেন, তিনি বিদ্যালয় স্থাপন করবেন, হাসপাতাল স্থাপন করবেন। মৃত্যুর জন্যে ফাতেহা উপলক্ষে যে অর্থ একবেলায় ব্যয় করে ফেল তার কতক অংশ এইসব মহৎ জনহিতকর কাজে ব্যয় কর শত শত নারী ‘হোম’ গড়ে উঠবে! হে বন্ধু, শুধুই রোজা-নামাজ করে, ধর্ম জীবনের ইতি করো না। তোমার ধর্ম–জীবনের সার্থকতা ক্ষেত্র আরও বৃহত্তর। কসম আল্লাহর, তা আরও বৃহত্তর–কী করলে পাগলেরা, ধর্মজীবনকে এমনভাবে মিথ্যা করে দিলে? তোমরা যে জীবনযাপন করলে ওকে কি ধর্মজীবন বলে? টিকির উপর টুপিটা রেখে গুনগুন করে সুর করে দরূদ পড়লেই কি ধার্মিক হওয়া যায়–মাঝে মাঝে বাড়িতে মৌলুদ দিলেই কি ধর্মের সংসার পাতা শেষ হল? তোমার জীবনের কাজ কই, পরিচয় কই?

.

১৯. পাপীর প্রতি ক্ষমাশীলতা

ধার্মিকের পক্ষে অহঙ্কার করা বড়ই অন্যায়। যে ধার্মিক মনে মনে অহঙ্কার করে, অধার্মিক, বেনামাজি বা পাপী অবোধকে ঘৃণা করে–তাকে ধার্মিক বলা যায় না। ধার্মিকের প্রাণে পাপীর জন্যে দরদ থাকা চাই।

.

২০. আত্মমর্যাদা জ্ঞান

ধার্মিক ব্যক্তির আত্মমর্যাদা জ্ঞান থাকা চাই। আত্মমর্যাদা জ্ঞানকে অহঙ্কার বলা যায় না। জীবনে সূক্ষ্ম অনুভূতি চাই। যেন আত্মমর্যাদা জ্ঞান অহঙ্কাররূপে প্রকাশ না পায়। ছোটর কাছে যা মহত্ত্ব এবং শ্রেষ্ঠত্ব তা ভয়ে নত হওয়া উচিত নয়–এই-ই আত্মমর্যাদা জ্ঞানের ভাব।

.

২১. ক্রোধ এবং অহঙ্কার

যতক্ষণ মনে ক্রোধ এবং অহঙ্কার আছে ততক্ষণ স্বর্গের আশা করো না। ক্রোধ মাটি করে ফেল। নিজে মাটি হও তবেই স্বর্গের যোগ্য হবে। তার একটু আগে নয়। যুদ্ধকালে জনৈক কাফের হযরত আলীর মুখ ভরে থুতু নিক্ষেপ করলো। তৎক্ষণাৎ আলী তাকে ত্যাগ করলেন। কাফের কারণ জিজ্ঞাসা করলে আলী বললেন–বন্ধু যদি হত্যা করতে হয়, কর্তব্যের খাতিরে তা করতে হবে। ক্রোধের বশবর্তী হয়ে নয়! তোমার। ব্যবহারে আমি ক্রুদ্ধ হয়েছি, তাই তোমায় ত্যাগ করলুম। কাফের তৎক্ষণাৎ আলীর কাছে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলো। সে বললো, যে ধর্মে এমন কথা বলে, সে ধর্ম নিশ্চয় সত্য। জনৈক সাধুকে পরীক্ষার জন্যে ৮০ বার ডাকা হল। ৮০ বার তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হল। সাধু কিছুমাত্র ক্রুদ্ধ বা উত্তেজিত হলেন না।

নবী করিম বলেছেন–যার ভিতর এক বিন্দু অহঙ্কার আছে সে স্বর্গের যোগ্য নয়। ক্রোধ আর অহঙ্কার একই জিনিস। যিনি ক্রোধ জয় করতে পেরেছেন, তিনি অহঙ্কারও জয় করেছেন।

নামাজ পড়তে পড়তে শিশুদের কলরব শুনে ক্রোধে তাদের উপর মুখভঙ্গি করে ওঠ। এখনও ঠিক পাও নাই, ধর্ম কি জিনিস? নামাজের ঘরেই শুধু যাওয়া-আসা কর।

নিজের ভিতরকার পশুগুলিকে চূর্ণ কর–তা হলেই তোমার ধার্মিকতা সিদ্ধ হবে।

.

২২. প্রতিহিংসা

যদি পার মহতের কল্যাণ কর নিষ্ঠুরাচারীর অকর্মের প্রতিশোধ নিও। সেই তো ধার্মিকের প্রকৃতি। যেমন পশুর আচরণ পেয়েছ, ঠিক তেমনি করে তুমিও কি করবে? না, না, না, কখনও না।

যে তোমায় আঘাত করেছে, হৃদয়ে বেদনা দিয়েছে, হত্যা করতে এসেছে, তাকে প্রেম করে ভালবেসে, জীবন দিয়ে প্রতিশোধ নাও। সেই হচ্ছে ধার্মিকের কাজ। স্বামীকে বিষ দিয়ে জায়দা নারী-ধর্ম পালন করেছেন। এমাম মরণকালে বললেন, জায়েদার সমস্ত পাপ আমি ক্ষমা করেছি। যাবৎ না তিনি স্বর্গে প্রবেশ করেন, তাবৎ স্বর্গ আমার জন্যে হারাম।

জনৈক স্পেনিস্ ভদ্রলোকের একমাত্র পুত্রকে হত্যা করে জনৈক খ্রিষ্টান যুবক তারই গৃহে আশ্রয় নিয়েছে। ভদ্রলোক যুবককে একটি অশ্ব আর একখানি তরবারি দিয়ে বললেন, যুবক রাত্রি, প্রভাত না হতেই পালিয়ে যাও, কী জানি পিতার মন, দুর্বল হয়ে তোমাকে আঘাত করতে পারি। এই হচ্ছে হত্যার উত্তম প্রতিশোধ!

জনৈক লম্পট হিন্দু নরপতি দরিদ্র ব্রাহ্মণ বধূর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে হরণ করবার জন্যে সহস্র সুবর্ণ মুদ্রাসহ লোক পাঠিয়েছেন। ব্রাহ্মণবধূ স্বহস্তে আপন গোপন পুষ্পবৎ স্তনযুগল কেটে রক্তমাখা করে একখানি থালায় স্থাপন করে নিজ হস্তে দূতের হাতে দিয়ে বললেন–এই নাও তোমার রাজ্য। যে জিনিসের লোভ করেছেন, তাই নিয়ে তাকে দাও, নির্লজ্জ লম্পটের নির্লজ্জ ব্যবহারের এই-ই উত্তম প্রতিশোধ!

Exit mobile version