Site icon BnBoi.Com

উন্নত জীবন – লুৎফর রহমান

উন্নত জীবন - লুৎফর রহমান

০১. জাতির উত্থান

কোন জাতিকে যদি বলা হয়—তোমরা বড় হও, তোমরা জাগ—তাতে ভাল কাজ হয় বলে মনে হয় না। এক একটা মানুষ নিয়েই এক একটা জাতি। পল্লীর অজ্ঞাত-অবজ্ঞাত এক একটা মানুষের কথা ভাবতে হবে।

মানুষকে শক্তিশালী, বড় ও উন্নত করে তোলার উপায় কি? তাকে যদি শুধু বলি-তুমি জাগো-আর কিছু না, তাতে সে জগবে না। এই উপদেশ বাণীর সঙ্গে অনেক কিছু জড়িত আছে। এইটে ভাল করে বোঝা চাই।

আবার বলি—কোন জাতিকে যদি বাহির হতে বলি—বড় হও, তাতে কাজ হবে না। মানুষকে এক একটা করেই ভাবতে হবে।

একটা লোক জাতীয় সহানুভূতিতে অনুপ্রাণিত হয়ে হাজার হাজার টাকা তুরস্কে পাঠিয়েছিলেন। তিনি যখন অগণ্য আর্ত মানুষের বেদনা কাহিনী গাইতে গাইতে ভিক্ষার বুলি স্কন্ধে নিয়ে পথে বের হতেন তখন প্রত্যেক মানুষের প্রাণ সহানুভূতি বেদনায় ও করুণায় ভরে উঠত। এই ব্যক্তি কিছুদিন পর তার এক নিরন্ন প্রতিবেশীর সর্বস্ব হরণ করতে দ্বিধাবোধ করেন নাই। মানুষের এই ভাবের জাগরণ ও বেদনা-বোধের বেশী মূল্য আছে বলে মনে হয় না। কোন জাতির যখন পতন আরম্ভ হয়; তখন দেশসেবক যে কেউ থাকে না তা নয়। স্বাধীনতার মমতায় কেউ প্ৰাণ দেয় না, তা বলি না; যারা মন দেয়। তাদের মন ভিতরে ভিতরে অন্ধ হতে থাকে। জাতিকে খাঁটি রকমে বড় ও ত্যাগী করতে হলে সমাজের প্রত্যেক মানুষকে বড় ও ত্যাগী করতে হবে কি উপায়ে? দেশের মানুষের ভিতর আত্মবোধ দেবার উপায় কি? প্রত্যেক মানুষ শক্তিশালী-উন্নত হৃদয়-প্ৰেম-ভাবাপন্ন-সত্য ও ন্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধাবান, অন্যায় ও মিথ্যার প্রতি বিতৃষ্ণ হবে কেমন করে? জাতির প্রত্যেক বা অধিকাংশ মানুষ এইভাবে উন্নত না হলে জাতি বড় হবে না।

প্রত্যেক মানুষের ভিতর জ্ঞানের জন্য একটা স্বাভাবিক ব্যাকুলতা জন্মিয়ে দেওয়া চাই। সংসার এমনভাবে চলেছে, যাতে সকলের পক্ষে বিদ্যালয় বা উচ্চ জ্ঞানের যোগ দেওয়া সম্ভব হয় না। অথবা সারা ছাত্রজীবন ধরে বিদ্যালয়ে জ্ঞানলাভ করা হয়ে ওঠে না।

কেউ বাল্য পিতৃহীন হয়, কারো পিতা জ্ঞানলোচনাকে বিশেষ আবশ্যক কাজ মনে করেন না করে ছেলেকে স্কুলে পাঠান না, কেউ পাঠাভ্যাস কালে উদ্ধত ও দুর্মত হয়ে পড়াশুনা ত্যাগ করে, কেউ বিদেশী ভাষার নিষ্পেষণে বোকা ভেবে পড়াশুনা বাদ দেয়।

পাঁচ হাজার ছাত্রের মধ্যে পঞ্চাশজন ছাড়া বাকী সব ছেলেই সময়ে জ্ঞানান্ধ, হীন ও মৌন মূক হয়ে যায়। ইহা জাতির পক্ষে কত ক্ষতির কথা।

মনুষ্যত্ব লাভের পথ জ্ঞানের সেবা। জীবনের সকল অবস্থায়-সকল সময়ে-আহার স্নানের মত মানুষের পক্ষে জ্ঞানের সেবা করা প্রয়োজন।

 

উন্নত, ত্যাগী, শক্তিশালী, প্রেমিক, সত্য ও ন্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধাবান মানুষ বিদ্যাহীন বা অল্পশিক্ষিত মানুষের মধ্যে পাওয়া যায় না; মানুষের বা জাতিকে বড় হতে হলে সব সময়ই তাকে জ্ঞানের সেবা করতে হবে।

দেশের সকল মানুষকে জ্ঞানী করে তোলার উপায় কি? জাতির জীবনের মেরুদণ্ড মনুষ্যত্ব ও জ্ঞান। এই দুটি চাপা রেখে জাতিকে জাগতে বললে সে জগবে না।

বুদ্ধির দোষে হোক বা অবস্থার চক্ৰে হোক, কোন দেশে যদি বহু মানুষ অশিক্ষা, অল্পশিক্ষিত বশতঃ অমার্জিতচিত্ত এবং জ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধাবোধহীন হয়ে পড়ে, তাহলে সে জাতির জীবন টেকসই হবে না। এই সব লক্ষ মৌন আত্মায় স্পন্দন আনবার এক উপায় আছে, কোটিবদ্ধ মুখে ভাষা তুলে দেবার এক পন্থা আছে। সকল দেশে সকল সময়ে সেই পস্থা কার্যকরী হয়ে থাকে। সেই পন্থা না থাকলে কোন জাতি বাচিত না-উন্নত হওয়া স্বপ্ন অপেক্ষা অসম্ভব হতো।

জাতিকে শক্তিশালী করতে প্রত্যেক সময়ে মানুষ এই পন্থা অবলম্বন করেছে। গ্ৰীক জাতি, রোমান জাতি, বর্তমান ইউরোপীয় জাতি-এই পথকে অবলম্বন করে শ্ৰেষ্ঠস্থান অধিকার করেছেন।

যারা এই পথকে অবহেলা করে নিজদিগকে প্রতিষ্ঠিত করতে ইচ্ছা করে, তারা একটা অসম্ভব কাজ আরম্ভ করে।

এই পথ আর কিছু নয়—দেশের বা জাতির সাহিত্যের পুষ্টিসাধন। যে সমাজে সাহিত্যের কোন আদর নাই, তাহা সাধারণত বর্বর সমাজ। কথা কাগজে ধরে অসংখ্য মানুষের দৃষ্টির সম্মুখে ধরার নাম সাহিত্য-সেবা। এই যে কথা, এ কথা সাধারণ কথা নয়-এই কথার ভিতর দিয়ে জীবনের সন্ধান বলে দেওয়া হয়, পুণ্যের বাণী ও মোক্ষের কথা প্রচার করা হয়, বর্তমান ও অন্তিম সুখের দ্বার মুক্ত করে দেওয়া হয়।

এই কথার ধারা গান ও গল্প, কখনও কবিতা ও দর্শন, কখনও প্ৰবন্ধ ও বিজ্ঞানের রূপ নিয়ে মানুষের সম্মুখে রঙীন হয়ে, মধুরভাবে দেখা দেয়।

দুৰ্গত কণ্টকাকীর্ণ আঁধার পথে কেউ যদি প্ৰদীপ না নিয়ে চলতে থাকে কিংবা আলোর যে আবশ্যকতা আছে, একথা উপহাসের সঙ্গে অস্বীকার করে, তাহলে তাকে কি বলা যায়? কোন জাতি সাহিত্যকে অস্বীকার বা অবহেলার চোখে দেখে উন্নত হতে চেষ্টা করলে সে জাতি আদৌ উন্নত হবে না।

শিক্ষিতকে আরও শিক্ষিত, ভাবুককে আরও গভীর করবার জন্য, দেশের অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত শিক্ষাকেন্দ্রের বাহিরের লোকগুলিকে শক্তিশালী, জ্ঞানী ও মনুষ্যত্ববোধ সম্পন্ন করবার জন্য প্রত্যেক দেশে বহু মনীষী জন্মগ্রহণ করেন।

জাতির পথপ্রদর্শক তাঁরাই। তাঁরাই জাতি গঠন করেন। গ্ৰীস, আরব, হিন্দু ও ইউরোপীয় শক্তি সভ্যতার জন্মদাতা তাঁরাই।

প্ৰত্যেক দেশের সাহিত্যের ভিতর দিয়ে এইসব শিক্ষিত শ্রেণী জাতিকে উর্ধের্ব টেনে তোলেন। ক্ষুধাতুর আর্ত তাদের স্পর্শে রাজা হয়ে ওঠে, পল্লীর কৃষক, দূর অজ্ঞাত-কুটিরের ভিখারী, জমিদারের ভৃত্য, দরিদ্র গো-যান-চালক, অন্ধকারের পাপী, বাজারের দরজী, নগরের ঘড়ি নির্মাতা, নবাবের ভৃত্য, গ্ৰাম্য উরুটে যুবক শ্ৰেণী তাঁদেরই মন্ত্রে মহাপুরুষ হয়। এই মন্ত্র গ্রহণ করবার উপযোগী তাদের কিছু শক্তি-অর্থাৎ কিছু বর্ণ জ্ঞান থাকা চাই। এরাই জাতির মেরুদণ্ড-ছােট বলে এদিগকে অস্বীকার করলে জাতি প্ৰাণ-শক্তিহীন হয়ে পড়ে।

জাতিকে শক্তিশালী, শ্রেষ্ঠ, ধনসম্পদশালী, উন্নত ও সাধারণের মধ্যে সমভাবে বিতরণ করতে হবে। দেশে সরল ও কঠিন ভাষায় নানা প্রকারের পুস্তক প্রচার করলে এই কার্য সিদ্ধ হয়। শক্তিশালী দৃষ্টিসম্পন্ন মহাপুরুষদের লেখনীর প্রভাবে একটা জাতির মানসিক ও পার্থিব পরিবর্তন অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ে সংশোধিত হয়ে থাকে। দেশের প্রত্যেক মানুষ তার ভুল ও কুসংস্কার, অন্ধতা ও জড়তা, হীনতা ও সঙ্কীর্ণতাকে পরিহার করে একটা বিনয়হিমোজুল উচ্চ জীবনের ধারণা করতে শেখে। মনুষ্যত্ব ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করাই সে ধর্ম মনে করে, আত্মমর্যাদা জ্ঞানসম্পন্ন হয় এবং গভীর পুষ্টি লাভ করে। তারপর বিরাট শক্তি জেগে উঠে।

ইংরাজের বিরাট শক্তির অন্তরালে বহু লেখকের লেখনী শক্তি আছে। বস্তুত লেখক বা জগতের পণ্ডিতবৃন্দ নিভৃতে লোকচক্ষুর অন্তরালে বসে বিশ্বের সকল অনুষ্ঠান ও কামকেন্দ্রে গতি প্ৰদান করেন। তাদের অজানা হস্তের কার্যফলে অসংখ্য মানুষ মরুভুমে সাগর রচনা করেন, সাগরবক্ষে পাহাড় তোলেনজগৎ সভ্যতার নির্মাতা তাঁরাই।

কোন দেশের মানুষ যদি এই লেখকশ্রেণীর বা দেশীয় সাহিত্যের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ না করে তবে তারা বড় হীন। জাতির ভিতরকার সকল পণ্ডিতকে হত্যা কর-সমস্ত জাতিটা শক্তিহীন হয়ে পড়বে।

কোন সভ্য জাতিকে অসভ্য করবার ইচ্ছা যদি তোমার থাকে তাহলে তাদের বইগুলি ধ্বংস কর, সকল পণ্ডিতকে হত্যা কর, তোমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে।

লেখক, সাহিত্যিক ও পণ্ডিতরাই জাতির আত্মা। এই আত্মাকে যারা অবহেলা করে, তারা বাঁচে না।

দেশকে বা জাতিকে উন্নত করতে ইচ্ছা করলে, সাহিত্যের সাহায্যেই তা করতে হবে। মানব মঙ্গলের জন্য যত অনুষ্ঠান আছে, তার মধ্যে এইটিই প্রধান ও সম্পূর্ণ। জাতির ভিতর সাহিত্যের ধারা সৃষ্টি কর, আর কিছুর আবশ্যক নাই। কোন দেশকে সভ্য ও মানুষ করবার বাসনা তোমার আছে? তাহলে বিধি-ব্যবস্থার সঙ্গে সেই দেশের সাহিত্যকে উন্নত করতে তুমি চেষ্টা কর। মাতৃভাষার সাহায্যে সাহিত্যকে উন্নত করতে চেষ্টা করতে হবে। বিদেশী সাহিত্যে মানব সাধারণের কোন কল্যাণ হয় না। দেশীয় সাহিত্যকে উন্নত করতে হবে, আবার বিশ্বের উন্নত সাহিত্যের সার সংগ্ৰহ করতে হবে। নিজেদের যা কিছু আছে তাতেই সস্তুষ্ট থাকলে জাতির উন্নতির পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।

পারে। মানুষের সকল বিপদের মীমাংসা সাহিত্যের ভিতর দিয়েই হয়ে থাকে।

জাতি যখন দৃষ্টিসম্পন্ন ও জ্ঞানী হয়, তখন জগবার জন্য সে কারো আহবানের অপেক্ষা করে না, কারণ, জাগরণই তার স্বভাব।

০২. ব্যক্তিত্ব ও শক্তির সফলতা

যে যেখানেই থাক, নিজের বলে বড় ও উন্নত হতে চেষ্টা করা। জীবনের সকল অবস্থায় নিজকে বড় করে তোলা যায়-এ তুমি বিশ্বাস করা।

জাতীয়তা ও স্বাধীনতার কথা ভাববার আগে তুমি নিজকে মানুষ করো। মানুষের ব্যক্তিত্বের উন্নতি ও মার্জিত-বিকাশ ছাড়া স্বাধীনতা আর কিছুই নয়। এক ব্যক্তি বলেছেন-স্বাধীনতা শব্দের সঙ্গে সঙ্গে দেশের এক একটা মানুষের আত্মোন্নতির কথা মনে না করে আমি থাকতে পারি না।

তুমি তোমার ব্যক্তিত্ত্বকে দৃঢ় করে তোল। কেউ তোমার উপর অন্যায় আধিপত্য করতে পারে না– একথা দার্শনিক মিল বলেছেন।

তুমি যদি নিজের ক্ষতি নিজে কর, অজ্ঞতা ও পাপে নিজের উপর অত্যাচার আরম্ভ করো, তাহলে কে তোমাকে বড় করবে? তুমি কাজ করাতোমার বন্ধু তুমি-হীন নও। তোমার ভিতরে যে শক্তি আছে, সেই শক্তির চর্চা তুমি কর, তুমি মহামানুষ হতে পারবে।

তুমি ছোট বংশে জন্মগ্রহণ করেছ বলে তোমায় যে ছোট করে রাখতে চায়-সে। বড় ছোট। তুমি মানুষ, তোমার ভিতরে আত্মা আছে, ইহাই যথেষ্ট। বিশ্বাস কর, তুমি ছোট নাও।

খুব বড় বড় রাজরাজড়ারাই যে জগতে কীর্তি রেখে যাবে, এমন কোন কথা নয়। শিক্ষা শুধু ভদ্রনামধারী একশ্রেণীর জীবের জন্য নয়। বস্তুত ভদ্রবেশী বলে কোন কথা নাই। ক্ষুদ্র, ছোট এবং নগণ্য যারা তারাও ভদ্র হতে পারেতাদেরও শক্তি আছে, একথা তারা বিশ্বাস করুক।

শিক্ষা, জ্ঞানালোচনা, চরিত্র ও পরিশ্রমের দ্বারা দরিদ্র মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র তুমি হতে পার। যে অবস্থায় থাক না কেন-জ্ঞান অর্জন করু, পরিশ্রমী হও। মানুষ তোমাকে শ্রদ্ধা করবে। তুমি ব্যবসায়ী, তুমি সামান্য দরজী, তুমি পৃথিবীর এক কোণে পড়ে আছ—তুমি যদি সাধু ও চরিত্রবান হও, সেই অবস্থায় মনের দীনতা ও মূর্থিতা দূর করতে একটু একটু পড় ও বড় বড় লোকদের উপদেশাবলী ও জ্ঞানের কথা আলোচনা কর, দেখতে পাবে, দিন দিন তোমার সকল দিক দিয়ে উন্নতি হচ্ছে-তোমার সম্মান, তোমার অর্থ সবই বেড়ে যাচ্ছে।

মেহের উল্লাহ যশোহর জেলার সামান্য দরজী ছিলেন।

পরীক্ষায় তুমি কৃতকার্য হও নাই, বিদ্যালয় বা কলেজে তুমি ঢুকতে পাের নাই, সেজন্য দুঃখিত হয়ে না। মানুষ চায় চরিত্র, জ্ঞান, ব্যক্তিত্ব ও শক্তি।

মানব-সমাজে, রাস্তাঘাটে, দোকানীর দোকানে, রেলে, স্টিমারে—লক্ষ্য করে পর্যবেক্ষণ কর, তুমি যদি ইচ্ছা কর প্রভূত জ্ঞানলাভ করতে পারবে। নিজের চিন্তা করবার শক্তি জাগিয়ে তােল, দৃষ্টি খুলে যাবে। সে দৃষ্টি দিয়ে সব কিছুর ভিতর-বাহির দেখতে থাক, তুমি মানুষ হবে।

কলেজ তোমার শুধু পথ দেখিয়ে দেয়-সারাজীবন তোমায় দেখতে হবে, শিখতে হবে, জ্ঞানার্জন করতে হবে।

কলেজের কাজ তোমাকে স্বার্থপর, চতুর, অর্থগৃধবু ও তস্কর করা নয়। বাড়িতে দালান দেবে, চাের-দারোগী হয়ে, পুকুর কেটে সমাজে মর্যাদা লাভ করবে। সে জন্য কলেজ নয়। কলেজ তোমাকে জীবনের কর্তব্যপথ দেখিয়ে দেয়; তােমাকে দৃষ্টিসম্পন্ন, কর্তব্যপরায়ণ ও চরিত্রবান, আত্মনির্ভরশীল, বিনয়ী ও সৎসাহসী হতে বলে। কলেজের যে এই লক্ষ্য, তা তুমি ঠিক করে নিয়ে নিজেকে নিজে গঠন করতে চেষ্টা করো। তোমার কলেজে যাবার দরকার হবে না।

কলেজে বা স্কুলে যাবার সুযোগ হলে খুব ভাল। যদি তা তোমার অবস্থায় না। কুলায়, তাহলে নিরাশ হয়ে না। তোমাকে ছোট হয়ে থাকতে হবে না। জীবনের সকল অবস্থায়, সকল বয়সে তুমি চেষ্টার দ্বারা বড় হতে পার। তুমি মানুষ, তুমি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, তোমার পতন নাই, তোমার ধবংস নাই। অর্থ ও পশুসুখের বিনিময়ে জীবনের অপমান করো না।

শেকসপীয়র একজন সামান্য লোকের ছেলে ছিলেন, আমাদের দেশে হলে তাকে ছোটলোকের ছেলে ছাড়া আর কেউ কিছু বলতো না। যে মহামানুষের কাছে সমস্ত ইংরাজ জাতির শক্তি ও সভ্যতা অনেক অংশে ঋণী, তিনি ছিলেন সামান্য লোকের ছেলে। জ্ঞানচর্চার দ্বারা নিজের ব্যক্তিত্ত্বকে তিনি এত বড় আসন দিতে সক্ষম হয়েছিলেন; যার তুলনা পাওয়া কঠিন।

ডাক্তার লিভিংস্টোনের নাম তোমরা জান? লিভিংস্টোন ছিলেন একজন জোলা।

নৌযুদ্ধ বিশারদ স্যার ক্লাউডেসলে শোভেল (Sir Cloudeswly Shovel), তড়িৎ তত্ত্ববিদ স্টার্জন, লেখক সোমুয়েল ড্র, পাদরী উইলিয়ম ক্যারি চামারের কাজ করতেন।

সাধনার দ্বারা এঁরা জগতে কীর্তি রেখে গিয়েছেন। যে কীর্তি শ্রেষ্ঠ মানুষেরা রেখে যেতে পারে না। বস্তুত কর্ম ও কীৰ্তিহীন শ্রেষ্ঠ মানুষের কোন মূল্য নাই।

সমুদ্র উপকূলের এক নগরে এক ইংরাজ বালক কোন এক দরজীর দোকানে কাজ করছিল। নিকট দিয়ে একখানা যুদ্ধ জাহাজ যাচ্ছিল। ছেলেদেরই মতো সে সেই জাহাজের দৃশ্য দেখতে গেল। জাহাজের মূর্তি দেখে সহসা তার ইচ্ছা হলো, সে জাহাজে কোন কােজ নেয়। তাড়াতাড়ি একখানা নৌকা নিয়ে সুচকাঁচির কথা ভুলে বালক জাহাজের অধ্যাক্ষের নিকট উপস্থিত হলো। অধ্যক্ষ বালকের উৎসাহ দেখে চমৎকৃত হলেন এবং তাকে গ্রহণ করলেন। এই সামান্য দরজী বালক শেষে এডমিরেল (Admiral) হয়েছিলেন।

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়ক এগুরু জনসনকে এক সময়ে একজন ঠাট্টা করে বলেছিল–দেশমান্য রাষ্ট্রনায়ক হলেও আপনি এক কালে দরজী ছিলেন। নায়ক সে কথায় লজ্জিত না হয়ে বললেন-দরজী ছিলাম, কিন্তু সবসময়েই ঠিক কাজ করেছি, কোন দিন কাউকেই ঠিকাইনি।

তুমি যে কাজই কর না, লজ্জা নাই। লজ্জা হয় অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন করায়, ভিক্ষা করায় কিংবা মুর্থ হয়ে থাকায়। জ্ঞান লাভ কর, নিজের ভিতরে যে শক্তি আছে তাই জাগিয়ে তোল, তুমি ছোট হয়ে পড়ে থাকবে না।

নিজকে নিজে বড় কর, জগৎ তোমাকে বড় বলে মেনে নেবে। নিজকে নিজের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র করে তোল-মানুষের শ্রদ্ধা তুমি লাভ করবে। মানুষ কার কাছে মাথা নত করে? কারা পায়ে ভক্তি-অশ্রদ্র ফেলে?

জর্জ স্টিফেনসন ছিলেন কয়লাওয়ালা।

নিউটন চাষার ছেলে। মিলটনের বাবা পোদ্দার।

স্যার হ্যামফ্রে ডেভি বলেছেন–তার উচ্চাসনের কারণ তার চেষ্টা। রাজা এড্রিয়ান যখন বালক, তখন তাঁর পড়বার তেল জুটত না। রাস্তার আলোতে তিনি পড়তেন। এই সহিষ্ণুতা এবং এই সাধনাই তাকে বড় করেছিল–অদৃষ্ট নহে।

ফক্স সাহেব যখন বক্তৃতা দিতে উঠতেন, তখন প্রত্যেক বারেই এই কথা বলে আরম্ভ করতেন—যখনই নরউইচ শহরে তাঁতের কলের চাকর আমি ছিলাম…

ইংলন্ডের বহু মনীষীর জন্মবৃত্তান্ত খুবই হীন। পরিশ্রম ও জ্ঞানার্জন দ্বারা তাঁরা মানুষ হতে সক্ষম হয়েছিলেন। তুমি কেন পারবে না?

০৩. অধ্যবসায়, পরিশ্রম, বিশ্বাস ও সহিষ্ণুতা

যে কাজই কর, প্রথম বারেই যে কৃতকার্য হবে তা নয়। চেষ্টার দ্বারা ব্যর্থতা জয় করতে হবে। চেষ্টা কর, বারে বারে আঘাত কর, তোমার চেষ্টা ফলবতী হবে।

কে কবে ভাগ্যবলে বড় হয়েছে? সাধনা ও পরিশ্রম ব্যতীত কে অর্থ ও সম্মান লাভ করেছে?

বড় মানুষ যারা তাদেরও গৌরব-সম্মানের মূলে অনেক বছরের ধৈর্য ও সাধনা আছে; যে সমস্ত মানুষ ব্যর্থতাকে ভয় করে না–জয়ী হবে, এ বিশ্বাসে যারা কাজ করে তারাই জয়ী হয়। লেখাপড়া তুমি জান না, তোমার মধ্যে যদি শুধু এই দুটি গুণ থাকে, তাহলে তুমি বড় হতে পার! সে দুটি গুণ, অধ্যবসায় ও বিশ্বাস।

প্রতিভাবলে অনেক মানুষ অসাধারণ কাজ করে, কিন্তু বহু বছরের সহিষ্ণু সাধনার কাছে প্রতিভার কোন মূল্য নাই। কাজ কর, ধীর শান্ত হয়ে তুমি তোমার কর্তব্য করে যাও, প্ৰতিভা তোমাকে দেখে সঙ্কোচ বোধ করবে।

জগতে বহু মানুষ জন্মেছেন। তাদের মধ্যে প্রতিভাবান অপেক্ষা পরিশ্রমী মানুষই অধিক। এক লেখক বলেছেন-প্রতিভার অর্থধৈর্য ও পরিশ্রম।

নিউটন বলেছেন—আমার আবিষ্কারের কারণ আমার প্রতিভা নয়। বহু বছরের পরিশ্রম ও নিরবচ্ছিন্ন চিত্তার ফলেই আমি আমাকে সার্থক করেছি; যা যখন আমার মনের সামনে এসেছে, শুধু তারই মীমাংসায় আমি ব্যস্ত থাকতাম। অস্পষ্টতা হতে ধীরে ধীরে স্পষ্টতার মধ্যে উপস্থিত হয়েছি।

ডাক্তার বেনটলেকে তিনি একবার বলেছিলেন-মানব সাধারণের যদি কোন কল্যাণ আমার দ্বারা হয়ে থাকে, তবে তা আমার অনেক বছরের সহিষ্ণু সাধনার দ্বারাই হয়েছে।

ভলটেয়ার বলেছেন—প্ৰতিভা বলে কোন জিনিস নাই। পরিশ্রম কর, সাধনা কর-প্রতিভাকে গ্রাহ্য করতে পারবে।

লোকে বলে সব মানুষ কবি হতে পারে না। বক্তা হওয়াও ঈশ্বরের দেওয়া গুণ, এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।

ডালটনকে লোকে প্ৰতিভাবান বলতো। তিনি অস্বীকার করে বলতেন– পরিশ্রম ছাড়া আমি কিছু জানি না।

পরিশ্রম, পর্যবেক্ষণ ও সহিষ্ণু সাধনার সম্মুখে কিছু অসম্ভব নয়।

জগৎ ও সমাজ যারা গড়ে তুলেছেন, তারা যে সব প্ৰতিভাবান অসাধারণ, বিশিষ্ট-ক্ষমতায় ভাগ্যবান ছিলেন তা নয়। তারা ছিলেন পরিশ্রমী এবং সহিষ্ণু সাধক।

প্ৰতিভাকেও যদি সাধনা বা পরিশ্রম দ্বারা উজ্জ্বল করে না তোলা যায়, তবে তার আদর হয় না। জগতের কল্যাণে তা বড় আসে না।

স্যার রবার্ট পিল যখন বালক, তখন তার বাপ তাকে একখানা ছোট টেবিলের উপর তুলে দিয়ে বক্তৃতা দিতে বলতেন। প্রথম প্রথম কিছু হতো না। কিন্তু বারে বারে চেষ্টা করার ফলে বালকের শক্তি জেগে উঠল। শেষ বয়সে তিনি বলতেন তার অসাধারণ বাগিতা ও তর্ক করার ক্ষমতা সেই ছেলে বয়সের সাধনার মধ্যেই ছিল।

ধীর হয়ে লেগে থাক, তোমাকে দুঃখ করতে হবে না। ধীরভাবে লেগে থাকাই হচ্ছে কৃতকার্য হবার পথ। হাল কখনও ছেড়ে না। তরী জেগে উঠবে।

ভাল রকম কাজ করতে হলে তোমাকে অসহিষ্ণু হলে চলবে না। সে যে কাজই হোক না। এক বাদককে এক যুবক জিজ্ঞাসা করেছিল–বাজনা শিখতে আমার কত দিন লাগবে? তিনি বলেছিলেন–প্ৰত্যহ ১২ ঘণ্টা করে যদি পরিশ্রম কর, তাহলে বিশ বছর লাগবে।

এক পণ্ডিত বলেছেন-যে ব্যক্তি ধীরভাবে অপেক্ষা করে, সে-ই সফল হতে পারে। বস্তুত কত কাল অপেক্ষা করতে হবে, তা কে জানে? আশায় বুক বেঁধে খোদাকে ভরসা করে কাজ করতে থাক, তুমি সফল হবে।

সাধনাকে আনন্দ দিয়ে পূর্ণ করে তোল। কবে তুমি কৃতকার্য হবে, সে কথা ভেবো না। তাহলে সাধনায় ক্লান্তি আসবে। ব্যর্থতা তোমাকে ভেঙ্গে দেবে, আনন্দ ভরা, সাধনা-নিয়ত ফল সম্বন্ধে উদাসীন তোমার মন ধীরে ধীরে অজ্ঞাতসারে তোমার গন্তব্য স্থানে নিয়ে যাবে। শুভ প্ৰভাতে দেখতে পাবে, তোমার মাথা বিজয়-মুকুট শোভিত হয়েছে। তুমি নিজেই জয়ে বিস্মিত হবে।

আশাশূন্য ও নিরানন্দ মনে কোন কাজ করো না। পাদরী উইলিয়ম ক্যারি যেমন উদ্যমশীল কমী পুরুষ ছিলেন, তেমনি তিনি তার কর্ম সম্বন্ধে আশা ও বিশ্বাস পোষণ করতেন। শ্ৰীীরামপুর কলেজ তাঁরই চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়।

এক সময় এই বরেণ্য পুরুষকে এক ব্যক্তি মুচির ছেলে বলে উপহাস করেছিল। ক্যারি কিছুমাত্র লজ্জিত না হয়ে উত্তর করলেন–এতে আমার একটু লজা নেই।

ছোটকালে একবার তিনি এক গাছে উঠতে যেয়ে পা ফসকে পড়ে যান। ফলে একখানা পা ভেঙ্গে গিয়েছিল। কয়েক মাস পরে বিছানা থেকে উঠে পুনরায় সেই গাছে উঠলেন, তবে ছাড়লেন। এইখানেই মহাপুরুষদের জীবনের বিশেষত্ব!

দার্শনিক ইয়ং বলতেন, মানুষ যা করেছে, মানুষ তা পারবে। এর সম্বন্ধে একটা মজার গল্প আছে। একবার তিনি এক বন্ধুর সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিলেন। এর আগে তিনি কখনো ঘোড়ায় চড়েননি, সেইবার প্রথম। বন্ধু খুব ভাল ঘোড়সোয়ার, তিনি অবাধে একটি উচু বেড়া পার হয়ে গেলেন। ইয়ং-এরও ইচ্ছা! হলো, বেড়া টপকে যান। যে কোনকালে ঘোড়ায় চড়েনি, তার পক্ষে কাজটা সহজ নয়। লাফ দিতে গিয়ে ঘোড়া হতে পড়ে গেলেন। ক্ষুন্ন না হয়ে দ্বিতীয়বার চেষ্টা করলেন। এবারে ঘোড়া থেকে পড়লেন না ঠিক, কিন্তু ঘোড়ার গলা জড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। আবার চেষ্টা। এবার কৃতকার্য হলেন।

বিশ বছর পরিশ্রম করে নিউটন একখানি বই লেখেন। তাঁর প্রিয় কুকুর একটা জ্বলন্ত বাতি ফেলে এই বইখানি মুহুর্তের মধ্যে ছাই করে দিয়েছিল। বিশ বছরের পরিশ্রমজাত-চিন্তা হঠাৎ সর্বনাশ হয়ে গেল। নিউটনের খুব দুঃখ হয়েছিল। কিন্তু কি আশ্চর্য সহিষ্ণুতা! তিনি দমলেন না। আবার সেই বই লেখা আরম্ভ করলেন এবং শেষ করলেন।

কারলাইল ফরাসী বিপ্লবের ইতিহাস লিখে এক প্রতিবেশী সাহিত্যিককে পড়তে দেন। বন্ধু মহোদয় বইখানি ভুলবশত বাইরেই ফেলে রাখেন। ফলে বইখানি হারিয়ে গেল। অনুসন্ধানে জানা গেল বাড়ীর চাকরাণী বাজে কাগজ মনে করে সেই মূল্যবান গ্ৰন্থখানি পুড়িয়ে ফেলেছে।

কারলাইল যখন এই ভয়ানক সংবাদ শুনলেন, তখন তার মানসিক অবস্থা কি তা অনুমানসাপেক্ষ।

এই পুস্তক নতুন করে লিখতে কারলাইলকে কত কষ্ট পেতে হয়েছিল, তা বলা যায় না। না লিখে উপায় ছিল না। কঠিন অধ্যবসায়, ধীরতা এবং মনের বলে তিনি আবার সেই বই লিখলেন। কারলাইলের এই ধীরতা ও মনের বল যারপরনাই বিস্ময়াবহ। জর্জ স্টিফেনসন তাঁর ছেলেদিগকে বলতেন– তোমাদিগকে কি বলবো–আমাকে অনুসরণ করো-আঘাতের পর আঘাত করো!

ওয়াট ত্ৰিশ বছর ধরে পরিশ্রম করে জগৎকে ঋণী করে গিয়েছেন। দীর্ঘ ত্রিশ বছরের সাধনা-কম নয়! কমতি-দি-বাফুন দেখিয়েছেন, ধীরভাবে পরিশ্রম করলে আমরা কত বড় হতে পারি। তিনি বলতেন-প্ৰতিভা মানে ধৈর্য ও পরিশ্রম। বাফুনের স্মরণশক্তি ছিল না, কিন্তু সাংসারিক অবস্থা ছিল খুব ভাল। ফলে স্বভাবে কুড়েমি ঢুকেছিল। অনেক বেলা পর্যন্ত শুয়ে থাকা তার একটা রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অনেক চিন্তা করেও তিনি এই রোগ হতে অব্যাহতি না পেয়ে, শেষকালে উপায়ান্তর না দেখে ভৃত্য যোসেফকে বলেন-কাল হতে সকাল সকাল তুমি আমায় উঠিয়ে দেবে। প্রত্যেক দিনের জন্য পুরস্কার এক টাকা। পরদিন বেচারা যোসেফ প্রভুকে উঠাতে গিয়ে কিল-ঘুষি খেয়ে ফিরে এল। বাফুন যখন দুপুর বেলা যোসেফসে তার কর্তব্য কাজের অবহেলার জন্য খুব তিরস্কার করলেন, তখন মনে মনে পণ করলো, পরের দিন প্রভুকে যেমন করেই হোক উঠবে। সকাল বেলা বিছানার কাছে যেয়ে যোসেফ আগের দিনের মত প্ৰভুকে উঠাতে চেষ্টা করলো, ঘুমের ঘোরে। প্ৰভু ভৃত্যকে গালি দিলেন। বললেন—আমার অসুখ হয়েছে। রাত্রিতে ভাল ঘুম হয়নি—যাও, বিরক্ত করো না। প্রভুর কথা অমান্য করলে চাকরি থাকবে না-ইত্যাদি। যোসেফ ফিরে গেল।

পরদিন প্রভুকে উঠাতে যেয়ে যোসেফ কোন কথাই শুনলো না। প্ৰভু কিছুতেই ঘুম থেকে উঠবেন না-যোসেফও নাছোড়বান্দা। বালতি ভরা ঠাণ্ডা পানি প্রভুর বিছানার উপর সে যখন ঢেলে দিল, তখন বাফুনকে বাধ্য হয়ে আরাম ছেড়ে উঠতে হলো। যোসেফ পুরস্কার লাভ করলো!

প্রত্যহ নয় ঘণ্টা করে চল্লিশ বছর ধরে বাফুন পরিশ্রম করেন। পরিশ্রম না করে তিনি থাকতে পারতেন না। সেটা তাঁর অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। তাঁর জীবনচরিত রচয়িতা লিখেছেন—খেলার চেয়ে কাজই তার আমোদের জিনিস বেশী ছিল। অনবরত পড়তে তাঁর কোন কষ্ট হতো না।

এক একখানা বই তিনি কতবার করে বদলিয়েছেন–লিখেছেন। পুস্তক প্রণয়নে কোন সাহিত্যিক বোধ হয় বাফুনের মত পারেন নাই।

পঞ্চাশ বছর ভেবে তিনি একখানি বই লেখেন; আশ্চর্য!—এতেও তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেন নাই। একবার, দু’বার এমনি এগারবার তিনি সেই বইখানা লেখেন।

বাফুনের মত ধৈৰ্য আর কারও ছিল না।

পীড়ার মধ্যে থেকেও তিনি বড় বড় বই লিখেছেন। কাজে থাকাই ছিল। তাঁর আনন্দ ও শান্তি।

স্যার ওয়ালটার স্কট পরিশ্রমী ছিলেন। অফিসের কাজের সঙ্গে সঙ্গে তিনি জ্ঞানালোচনা ও সাহিত্যসেবা করতেন। অফিসের কাজ কম নয়—তার উপর সাহিত্যসেবার কঠিন পরিশ্রম!

ভোর পাঁচটার সময় উঠে নিজেই চুলো ধরাতেন, একটু কিছু খেয়ে বই-এর বোঝা সামনে নিয়ে সাহিত্যসেবায় বসে যেতেন। ছেলেপিলে, বউ-ঝিরা ঘুম হতে উঠবার অনেক আগে তিনি অনেক কাজ করে ফেলতেন।

বহু বছরের পরিশ্রম ও গভীর জ্ঞানার্জন সত্ত্বেও স্কট বলতেন—আমি আমার অজ্ঞতার কথা মনে করে লজিত না হয়ে পারি না।

ট্রিনিটি কলেজের অধ্যাপকের কাছে যেয়ে এক ছাত্র বি. এ. উপাধি লাভ করে। বললেন—মহাশয়, আমার লেখাপড়া তো শেষ হয়েছে। কতকাল পরিশ্রম করবো-বাড়ী যেয়ে এখন আরাম করি। অধ্যাপক বিস্মিত হয়ে উত্তর দিলেন— তোমার জ্ঞানার্জন শেষ হয়েছে? আমি কিন্তু মাত্র আরম্ভ করেছি।

যারা কিছু জানে না। তাদেরই কাজ শেষ হয়ে যায়। মহাপণ্ডিত নিউটন জীবন শেষে বলেছিলেন—জ্ঞানসমুদ্রের বেলায় দাঁড়িয়ে কেবল ধুলোবালি নিয়ে নাড়াচাড়া করেছি—অনন্ত সমুদ্রের কিছুই দেখা হয়নি।

জন ব্রিটনকে তার কাকা দোকান হতে একেবারে অসহায় করে তাড়িয়ে দেন। ব্রিটন যখন ছোট তখন তার বাপ পাগল হয়ে যান। বাপ ছিলেন রুটিওয়ালা।

ব্রিটন তার হোটেলওয়ালা কাকার কাছে থাকত এবং কাজ-কাম করে। কিছু কিছু পয়সা উপায় করতো। হঠাৎ তার অসুখ হয়ে পড়লো—এমন অসুখ যে, তাতে তার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে গেল, কাজ করার সামৰ্থ্য রইল না। নিষ্ঠুর কাকা এ ক্ষতি সহ্য করতে পারলেন না। ভাইপোর হাতে গোটা দশেক টাকা ফেলে দিয়ে বললেন— এখানে আর তোমার থাকার দরকার নেই।

এরপর সাত বছরের বালক ব্রিটনের কষ্টের অবধি ছিল না। কিন্তু কোন দিন সে পড়া ত্যাগ করে নাই। সকল অবস্থায় সে একটু-একটু করে জ্ঞানার্জন করতো। স্কুলে যাওয়া হয় নাই বলে বোকার মত চুপ করে বসে থাকত না।

জ্ঞান এবং শক্তি যার মাঝে আছে, সে কোনকিছু পাস করুক আর না করুক, তার উচ্চাসন হবেই, একথা বিলাতের সব লোকে জানে।

ব্রিটনের জীবনী পড়ে জানি, কত কষ্টের তার জীবন। যে ঘরে সে বাস করতো, সে ঘরখানি কত হীন। পায়ে কত সময় জুতো জুটতো না। দারুণ শীতে কত সময় গা খালি থাকতো। কত সময় পকেটে পয়সা থাকতো না। হাতে পয়সা নাই-না পড়লেও চলে না। খানিকক্ষণের জন্য হলেও পরের বই নিয়ে ব্রিটন তাঁর ব্যগ্ৰ মনের জ্ঞানতৃষ্ণা নিবারণ করতো।

যখন তাঁর বয়স আটাশ, তখন প্রথম তিনি গ্ৰন্থকাররূপে আবির্ভূত হন। এরপর পঞ্চাশ বছর ধরে তিনি সাহিত্যসেবা করেন। জন ব্রিটন মোট সাতশিখানি বই লেখেন। কোন বাধা তাঁর জীবনকে ব্যর্থ করে দিতে পারে নাই।

জীবনের মালিক তুমি-দুঃখ-বেদনা ও অভাবকে বাধা না মনে করে। সেগুলিকে বরং আশীর্বাদরূপে ধরে নাও। কিছুই তোমার গতিকে রোধ করতে পারবে না। যেমন করে হোক, তুমি বড় হবেই। বুক ভেঙ্গে গেছে-ভয় নাই। ভাঙ্গা বুক নিয়ে খোদা ভরসা করে দাঁড়াও।

এডিনবাৰ্গ শহরের কাছে লাউডেন নামে এক বালক ছিল। তার বাপ ছিলেন একজন কৃষক। বাপ ইচ্ছা করলেন ছেলেকে বাগানের কাজ শিখবেন। এই কাজে লাউডেনকে দিনের বেলা হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে হতো। খাটুনির মধ্যে বালক লাউডেন সপ্তাহে দুইদিন সারা রাত জেগে পাঠাভ্যাস করতো।

লাউডেনের মনের দৃঢ় বাসনা ছিল, জীবনকে উন্নত ও গৌরবময় করামানুষের কল্যাণ করে জীবনকে ধন্য করা।

একজন সামান্য বালকের মনে এই উন্নত কল্পনা কত সুন্দরা অল্পকালের মধ্যে লাউডেন ফরাসী ভাষায় বুৎপত্তি লাভ করলো। ফরাসী ভাষা শেখা হলে সে জার্মান ভাষা শেখার জন্য আগ্ৰহান্বিত হলো। জার্মান ভাষাও অল্পকালের মধ্যে তার আয়ত্ত হয়ে গেল।

স্যামুয়েল এবং জেবেজ বলে আরও দুইটি বালক ছিল। তাদের বাপ ছিলেন একজন মুটে। দরিদ্র পিতা দু’ভাইকে এক পাঠশালায় পাঠালেন। জেবেজের বেশ স্মরণশক্তি ছিল। কিন্তু স্যামুয়েল ছিল যেমন দুষ্ট, তেমন বোকা। লেখাপড়ায় সুবিধা হলো না দেখে কিছুদিন পরে বাপ তাকে কাজ শেখাবার জন্য এক জুতোর মিন্ত্রির কাছে দিলেন। সেখানে কাজের চাপে চােখে তার সরষে-ফুল ফুটতে লাগল।

বদমাইশী, আম চুরি এসব কাজে স্যামুয়েলের খুব উৎসাহ ছিল। একবার এক দুষ্টুমি করতে যেয়ে তাকে সমুদ্রের মাঝে নৌকা ড়ুবে প্ৰাণ হারাতে হয়েছিল আর কি। তুমি শুনে বিস্মিত হবে—দুই মাইল সাঁতরিয়ে কুলে উঠে সে প্ৰাণ বাঁচায়।

এই ঘটনার পর থেকেই দুৰ্দাত্ত স্যামুয়েলের স্বভাব বদলে গেল। এই চাের, এই বদমাইশ, এই মাথা-গরম যুবক যে একদিন তার বিদ্যা ও বুদ্ধির দ্বারা জগৎকে চমৎকৃত করবে একথা তখন কে ভেবেছিল?

তার মনের এই দুৰ্দমনীয় উগ্রতা ভাল হবার দিকে ফিরে গেল। জীবনের এই দুর্ঘটনার পর হতে তার স্বভাবে একটা আশ্চর্য পরিবর্তন দেখা গেল। সে চাপল্য, সে হঠকারিতা আর রইল না। সে সময় হতে স্যামুয়েল জ্ঞানানুশীলনের দিকে মন দিলেন। যতই পড়তে লাগলেন, ততই নিজের অজ্ঞতা ও মূর্খতা বুঝে লজ্জিত হতে লাগলেন। মনের এই অন্ধকার দূর করবার জন্য ভিতরে এক দুৰ্দম বাসনা জেগে উঠল! এরূপ জীবিকা অর্জনে যে সময় ব্যয় হতো তা ছাড়া বাকী সময় লেখাপড়া করতে লাগলেন। এক মিনিটও তিনি বৃথা সময় নষ্ট হতে দিতেন। না। কাজের ভিড়ে পড়বার সময় যখন পেতেন না, তখন খাবার সময় সামনে একখানা বই রেখে স্যামুয়েল ভাত খেতেন।

বিশেষ একখানা বই পড়ে তার মন আরও উন্নত হয়ে গেল-নিৰ্মল চরিত্র ও আধ্যাত্তিক ভাবাপন্ন হয়ে পড়লেন।

কিছুদিন পরে তিনি স্বাধীন ব্যবসা আরম্ভ করলেন। ধার হবে এই ভয়ে অনেক সময়ে রাতের বেলা না খেয়েই শুয়ে থাকতেন।

ব্যবসা, সাহিত্যসেবা ও জ্ঞানালোচনা করে যে সময বাঁচত, সে সময় তিনি জনসাধারণের সম্মুখে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতেন।

ঘর-সংসার হলে, ছেলেদের কাই-মই হৈ-চৈয়ের ভিতর, এমনকি রান্নাঘরে বসে তিনি লিখতেন। আর পড়তেন।

শেষ বয়সে তিনি বলতেন-নিতান্ত জঘন্য অবস্থা হতে আমি নিজেকে টেনে তুলেছি। আমার এই সাধনার সঙ্গী ছিল পরিশ্রম, চরিত্র এবং মিতব্যয়িতা।

 ০৪. ব্যবসা, শিল্প বাণিজ্য

এক ওয়াচ-মেকারের দোকানে দেখতে পেয়েছিলাম, তার ছেলে চমৎকার যন্ত্র তৈরী করেছে। এরূপ জিনিস যে আমাদের দেশে সম্ভব তা আগে জানতাম না।

ঢাকা জেলার পশ্চিম বানানির একটা লোক স্টিমারের ভিতর হাতের তৈরী কতকগুলি ঝিনুকের গহনা আমাকে দেখায়। আমি সেই সব জিনিস দেখে অবাক হয়েছিলাম।

অনেক জায়গায় সামান্য অশিক্ষিত মুচি চমৎকার চমৎকার জুতো প্ৰস্তুত করে। ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে বহু মানুষ সুন্দর আশ্চর্য জিনিস প্রস্তুত করে। বিজ্ঞানের শক্তির সম্মুখে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে না বলেই তাদের আদর হয় না।

বিলাতের লোকের মধ্যে নানা প্রকার সাংসারিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের উপকরণ প্ৰস্তুত করার ঝোঁক চিরকালই বেশী। কোন চিন্তা বা ফল নিয়ে তারা বসে থাকে না। উন্নতির পর উন্নতি করতে চেষ্টা করে। আমাদের দেশের লোক তা করে। না। করা দরকার বিবেচনা করে না। বর্ধমান জেলায় চিকনের কাজ, শান্তিপুরের ফুল তোলার কাজ দেশের লোক শ্রদ্ধার চােখে দেখে না।

ব্যবসার মধ্যে জাতির বেঁচে থাকবার উপকার অনেক বেশী। লেখাপড়া শিক্ষা করা বা জ্ঞানানুশীলন চাকরির জন্য কিছুতেই নয়। জ্ঞানের সাহায্য নিয়ে সকল দিকে উন্নতি করা তুমি ভাল চাষা, কামার, দরজি, মিস্ত্রী এবং কারিগরী হও। বিশ্বাস কর চাকরির জন্য জ্ঞান নয়। তোমাদের যেমন হাত-পা আছে, জ্ঞানও তেমনি তোমাতে থাক। চাকরির জন্য জ্ঞানার্জন করো না।

শিল্পী বা ব্যবসায়ী হলে তোমাকে ছোট থাকতে হবে তা নয়। সব জায়গাতেই অধ্যবসায়ী ও পরিশ্রমী হতে হবে। কতকগুলো লোকের কথা বলবো যাদের জীবন কাহিনী শুনে তুমি বুঝতে পারবে-হীন অবস্থা হতে অধ্যবসায়, বুদ্ধি ও পরিশ্রম দ্বারা কেমন করে শিল্প-বাণিজ্যে উন্নতি করে নিজের, দেশের ও মানুষের কল্যাণ সাধন করেছেন। সাধনাপথে বাধা এসেছিল—তারা সে সব গ্রাহ্য করেন নি। শিল্প-বাণিজ্যের প্রতি অশ্রদ্ধার কঠিন শাস্তি মানুষকে চিরকালই ভোগ করতে হয়!

লেখাপড়া জান না, যদি অধ্যবসায়ী, চিন্তাশীল এবং দৃষ্টিসম্পন্ন হও—তুমি মানুষের উপকার করতে পারবে, তোমার উদ্ভাবনা শক্তি, প্রতিভা ও আবিষ্কারের দ্বারা তুমি বিশ্বের নর-নারীকে চিরকালের জন্য উপকার করে যেতে পার।

সাধুতাকে অবলম্বন করে তুমি ব্যবসা কর-পরিশ্রম করে জীবিকা অর্জন কর—তোমার আসন নীচে হবে না। প্রতারণা ও মিথ্যায় ভরা ভদ্ৰ(?)জীবন ত্যাগ করে তুমি সামান্য ব্যবসা অবলম্বন কর। অসার জীবনকে ঘূণা করতে শেখ, সত্য জীবনকে শ্রদ্ধা করতে শেখ। এখানেই তোমার মনুষ্যত্ব। ব্যবসায়ী ঘরের বহু প্ৰাতঃস্মরণীয় মানুষ জগতের কত উপকার করে গিয়েছেন। দেশীয় বা জাতীয় শ্ৰীবৃদ্ধির মূল কারণ ব্যবসায়ীর পরিশ্রম ও বুদ্ধি কৌশল। মিস্ত্রীর ছেলে ওয়াটের আবিষ্কারের ফলে জগতের কত উপকার হয়েছে। পৃথিবীর সভ্যতা তার কাছে কতখানি ঋণী। জ্বাল দিলে জল থেকে যে বাম্প ওঠে। সে বাম্পের যে কত শক্তি আছে তা কে জানত? হাজার ঘোড়ার শক্তিতে যা না হয়, বাম্পের কল্যাণে তা হয়। ওয়াট যদি মানুষকে এই কথা বলে না দিতেন, তা হলে পৃথিবীর সভ্যতা এত হতো না। রেলগাড়ির গতি, ছাপাখানা, যুদ্ধ সবই বাষ্পের শক্তিতে পরিচালিত হচ্ছে।

ওয়াটের আবিষ্কারের ফলে আর্করাইট সুতা প্রস্তুত করবার উন্নত ধরনের কল প্ৰস্তুত করতে সক্ষম হন। আর্করাইট কোন বড় ঘরের ছেলে নন। প্রেসটন শহরে ১৭৩২ খ্ৰীষ্টাব্দে তার জন্ম হয়। বাবার অবস্থা খুব শোচনীয় ছিল। তের ছেলের মধ্যে আর্করাইট ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। কোন কালে তার স্কুলে যাবার ভাগ্য হয়নি। নিজে নিজে যা একটু পড়েছিলেন।

প্ৰথমে বাপ তাঁকে এক নাপিতের কারখানায় পাঠান। কাজ শেখা হলে আর্করাইট নিজে একটা দোকান খোলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে পরচুলা লাগাবার ব্যবসাও আরম্ভ করলেন। শহরে শহরে মেলায় মেলায় ঘুরে তিনি চুল কিনে বেড়াতেন। এই ব্যবসা টেকসই হয় নাই। বিপন্ন হয়ে আর্করাইট ভাবলেন, একটা সুতা তৈরী করবার উন্নত ও ভাল রকমের যন্ত্র আবিষ্কার করলেই হয়। তারপর রাতদিন কেবল ভাবতে লাগলেন। রোজগার বন্ধ হয়ে গেল। অবস্থা যারপরনাই শোচনীয় হয়ে পড়লো। এর আগেই তিনি বিয়ে করেছিলেন। স্ত্রী স্বামীর এই মাথাপাগলামী সহ্য করতে না পেরে একদিন যত যন্ত্রপাতি ছিল, সব ভেঙ্গেচুরে বাইরে ফেলে দিলেন। আর্করাইট এতে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন—ফলে, স্বামী-স্ত্রীতে চিরবিচ্ছেদ সংঘটিত হয়। গায়ে জামা নাই—পরনে জুতা নাই—ছিড়ে গিয়েছে— কিন্তু সেদিকে তাঁর ক্ৰক্ষেপ নাই। এক মনে তিনি ভাবতে লাগলেন কি করে উন্নত প্ৰণালীতে বাষ্পীয় শক্তির সাহায্যে সুতা তৈরী করবার যন্ত্র আবিষ্কার করা যায়।

ঐকান্তিক সাধনার সম্মুখে কিছু বেধে থাকে না। আর্করাইটের সাধনা ব্যর্থ হলো না। জগৎ সভ্যতার প্রধান ভিত্তি তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন।

আর্করাইটের চরিত্র বল অসীম ছিল। পরিশ্রম করবার শক্তিও তার ছিল অসাধারণ। এই আবিষ্কারের পর তিনি বড় বড় কারখানা স্থাপন করলেন। এইসব কারখানার কাজে তাকে প্ৰাতঃকাল হতে রাত্রি ন’টা পর্যন্ত অনবরত খাটতে হতো।

যখন তার বয়স পঞ্চাশ, তখন তিনি ইংরেজী ব্যাকরণ পড়া আরম্ভ করেন। কারণ, শুদ্ধ করে তখনও তাঁর দুই লাইন লিখবার ক্ষমতা ছিল না।

সম্পদ ও গৌরব তার লাভ হলো। মানুষের কল্যাণ তিনি করলেন। তাঁর মহৎ জীবনকে সম্মান করবার জন্য সম্রাট তাঁকে উপাধি দিলেন।

বিলাতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরুষসিংহ স্যার রবার্ট পিলের নাম তোমরা শুনেছ। তিনি সম্রাট চতুর্থ জর্জের মন্ত্রী ছিলেন। তাঁর বাপ ছিলেন সামান্য কৃষক। বৃহৎ পরিবারের গ্রাসাচ্ছাদন চালান কঠিন হয়ে পড়াতে পিলের বাবা কাপড় বোনা আরম্ভ করলেন। তখনও কাপড়ের কারখানা বিলাতে স্থাপিত হয় নাই। লোক তখন বাড়ী বাড়ী কাপড় বুনতো। পিলের পিতা সাধু প্ৰকৃতির ও পরিশ্রমী লোক ছিলেন। এই ব্যবসা করতে করতে কাপড়ে ছাপ লাগানোর পন্থা আবিষ্কার করতে ইচ্ছে করলেন। আর্করাইটের ন্যায় বহু চিন্তা, পরিশ্রম এবং ব্যর্থতার পর তিনি সাধনায় জয়ী হলেন। মানুষের চেষ্টা, অধ্যবসায় ও চিন্তার সম্মুখে কিছু অসম্ভব নয়।

স্যার রবার্ট পিল তাঁর পিতা সম্বন্ধে বলেছেন—পিতা বুদ্ধিমান এবং দৃষ্টিসম্পন্ন লোক ছিলেন। তাঁর দ্বারাই আমাদের বংশের শ্ৰীবৃদ্ধির সূচনা হয়। জাতির উন্নতি ব্যবসার উপর নির্ভর করে। দেশের সকল মানুষের শ্ৰীবৃদ্ধির প্রাণ ব্যবসা। এখানে-ওখানে দুই একজনের একটু আধটু উন্নত অবস্থার কোন মূল্য নাই।

বিশ বছর বয়সে পিল কয়েকখানা ভাঙ্গা ঘর আর মাত্র কয়েক শত টাকা নিয়ে ব্যবসা আরম্ভ করেন।

সাধু, পরিশ্রমী এবং মিতব্যয়ী পিল ক্ৰমে উন্নতি করে নানা জায়গায় নতুন নতুন কারখানা খুললেন।

সম্পদ, সম্মান, কোটি কোটি টাকার মালিক পিল প্রথম বয়সে মজুর ছিলেন। সাধুতা, পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের দ্বারা তিনি দেশমান্য পুরুষ হতে পেরেছিলেন।

০৫. সাধনা ও পরিশ্রম

সাধনা ও পরিশ্রম ব্যতীত জগতে কোন উন্নতি হয় না। কপালের জোরে লক্ষ টাকা পাবে—এ কখনো বিশ্বাস করো না। যে কোন কাজই কর না, সম্যক পারদর্শিতা লাভ করতে হলে বহু বছর সাধনা করতে হবে।

ছোট নগণ্য ক্ষুদ্রকে ঘৃণা করো না। ক্ষুদ্রের সাহায্যেই বিরাটের সৃষ্টি। ক্ষুদ্র মুহূর্তগুলি কাজে লাগালে জীবনে সোনা ফলাতে পারবে। রাতারাতি কেউ বড় মানুষ হয় না। হঠাৎ কোন সুবিধা কারো হয় না। হলেও তা বিশ্বাস করে নিজেকে দুর্বল করো না।

যারা কাপুরুষ তারাই ভাগ্যের দিকে চেয়ে থাকে। পুরুষ চায় নিজের শক্তির দিকে। তামোর বাহু, তামোর মাথা তামোকে টেনে তুলবে, তোমার কপাল নয়।

একদিন দুইদিন করে জীবনের দীর্ঘ সময় চলে যাচ্ছে-জগতে যারা বড়, তারা অপচয় সহ্য করবেন না।

ওয়াট যে সময় দোকানে বসে বেচাকেনা করতেন। সেই সময় তিনি রসায়নশাস্ত্র ও জার্মান ভাষা আলোচনা করে উভয় বিষয়েই পণ্ডিত হয়েছিলেন। তুমি এ কথা শুনে হয়ত বিস্মিত হবে। স্টিফেনসন ইঞ্জিনে কয়লা যোগাতেন। আর অঙ্ক করতেন।

যত সময় তুমি হাসিগল্পে ও ঠাট্টায় কাটিয়ে দাও-তার ভিতর থেকে বেশী নয়, এক ঘণ্টা সরিয়ে রাখা। সমস্ত দিনে-রাত্রে মাত্র এই এক ঘণ্টা যদি তুমি কোন কোন বিষয় আলোচনা করা দেখতে পাবে, দশ বছর পরে তুমি একজন বড় পণ্ডিত হয়েছ। বন্ধু ও সঙ্গীদের কাছে তোমার সম্মান বেড়েছে। হয়ত তুমি সমস্ত জগতের ইতিহাস জেনে ফেলেছ—অঙ্কশাস্ত্ৰে প্ৰভূত পণ্ডিত্য লাভ করেছ, একজন বিখ্যাত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক হয়ে পড়েছ কিংবা অর্থসহ সমস্ত কোরআন শরীফ বা গীতাখানা মুখস্থ করে ফেলেছ।

ডাক্তার ম্যাসন গাড়ীতে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াবার সময় একখানা বৃহৎ পুস্তক অনুবাদ করে ফেলেছিলেন। ডাক্তার ডারউইন বেড়াবার সময়েই তার অধিকাংশ বই লিখতেন। ডাক্তার বার্নে গান শিখাবার জন্য যখন এক ছাত্রের ইতালীয় ভাষার ব্যাকরণ।

এক উকিলের কেরানী বাসা থেকে অফিসে যাবার পথে শিখেছিলেন। গ্ৰীক ভাষা। ভাত খেতে ডাকলে ডিজুসে সব সময়েই দেরি করতেন। তার মানে, সে সময় তিনি বই লিখতেন। খাবার আগের সময়টুকুও বিনা কাজে ফেসে যেতে দিতেন না।

কামার ইলিহু বুরিট দোকান ঘরের ঠিকঠকির মধ্যে বসে আধুনিক ও পুরাতন ত্রিশটি ভাষায় পণ্ডিত হয়েছিলেন।

পথে যদি ৫০০ টাকা পাও তা হলে তোমার আনন্দের সীমা থাকে না। সময় রূপ অমূল্য রত্ন তোমার পায়ে জড়িয়ে পড়েছে, সেদিকে তোমার ভ্ৰক্ষেপ নাই। মানুষের কাছে টাকা চাও, সে তোমাকে ঘৃণা করবে। সময় সম্পদ নিয়ে তোমার দরজায় দাঁড়িয়ে-দয়া করে তার রত্ন উপহারগুলি গ্রহণ করা।

কতকগুলি যুবক বাক্সটারের কাছে দেখা করতে যেয়ে বলেছিল-মহাশয়! আমাদের ভয় হচ্ছে, আপনার সময় নষ্ট করছি। অভদ্ৰ (?) জ্ঞানী বাক্সটার বললেন-নিশ্চয়ই।

জ্ঞানী যারা তাঁরা নিরন্তর সময়ের প্রান্তর হতে মণি-মুক্তা কুড়িয়ে নিচ্ছেন। তুমি আমি সুযোগের আশায়, সময় নাই বলে বা দারিদ্র্যের মিথ্যা অজুহাতে বোকার মত দাঁড়িয়ে আছি। কাজ কর—কাজ কর—সব অবস্থায় সকল সময়ে যে কোন কাজ কর, তার ফল পাবে। প্রথম প্রথম হয়তো তোমার পরিশ্রম সার্থক হবে না-তাতে নিরাশ হয়ে না। বিখ্যাত সাহিত্যিক এডিসন স্পেকটেটর লিখে গৌরব অর্জন করবার আগে বস্তা বস্তা কাগজ লিখেছিলেন। সেইগুলি অকেজো ঘরের মধ্যে পড়ে থাকলেও, সেইসব মাবিশ লেখার ভিতরেই তাঁর গৌরব— উন্নতির ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল।

০৬. মৰ্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের আসন-নিজের শক্তি সাধনা

কোন বংশ চিরকাল পুরানো মর্যাদা ও সম্মান নিয়ে টিকে থাকতে পারে না। জাতির। যেমন পতন হয়, পরিবারেরও তেমন পতন হয়।

শিক্ষা, চরিত্র ও জ্ঞান মানুষ ও পরিবারকে সম্মানী করে-অর্থে সম্মানে সব দিক দিয়েই বড় করে। মানুষ যখন মূর্থি ও চরিত্রহীন হয়ে পড়ে তখন তার প্ৰভুত্ব ও সম্মান থাকে না।

তুমি আজ ছোট আছ—চরিত্রবান ও জ্ঞানী হও, তুমিও শ্রেষ্ঠ হবে ৷ কপালে ভদ্র বলে কারো কিছু লেখা নাই।

জান? মুসলমান জাতি কত বড় ছিল? জগৎ তার সভ্যতা অনুসরণ করতে গৌরব বোধ করতো। তাদের পতন হয়েছে কিসে?

জাপানকে সেদিন পর্যন্ত লোকে অসভ্য মনে করতো। সাধনার ফলে এখন তাদের স্থান কত উচ্চে। আমাদের নাসিকা কুঞ্চনের মূল্য কি?

আজ যে পরিবারকে তুমি হীন বলে মনে করছে—যাদের সাধনা ও পরিশ্রমের ফলকে তুমি ঘৃণার চাঃেখে৷ দেখছো, কিছুদিন পরে তোমাকে তাদের কৃপা ভিক্ষা করতে হবে। তোমার কুড়ে সস্তানকে তার বাড়ীর চাকর হতে হবে! এজগতে শুধু সাধনা, চরিত্র ও জ্ঞানের জয়। মূর্থি, কুড়ে ও মার্কামারা ভদ্রলোকের কোন মূল্য নাই। বাপের নামে তুমি পরিচিত হতে যেয়ো না! তুমি ভদ্রঘরে জন্মেছ, এ কথা তুমি বল না।

সম্রাট জনকে যে সমস্ত জমিদার হাতের পুতুল করে রেখেছিলেন নাম করবার মতো তাদের একজনও বেঁচে নেই।

সম্রাট প্রথম এডওয়ার্ডের এক বংশধরকে মাংস বেচে বেড়াতে দেখা গিয়েছে। ডিউক অভ ক্লারেন্সের এক বংশধরকে স্ত্রপস্যারায় শহরে জুতো সারিতে হয়েছিল। বিলাতের শ্ৰেষ্ঠ জমিদার সাইমনের বংশের একজন লণ্ডন শহরে ঘোড়ার জিন তৈরী করতো।

অতীতকালে যাঁরা শ্রেষ্ঠ আসন অধিকার করেছিলেন, তাদের শক্তি ও সম্মান নতুন নতুন মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে।

তুমি ছোট আছ? মহত্ত্ব, সাধনা ও জীবন-সংগ্রামে তুমি জয়ী হও-জ্ঞান ও মনুষ্যত্বের বিকাশ তোমাতে হোক—তোমার বড় আসন হবে।

রিচার্ড নামে এক দরিদ্র কৃষকশ্রেণীর যুবক বিলেতে এক মিলে কাজ করতো। সে-মিলে লোহার কাটা তৈরী হতো। এই মিলের ব্যবসা ক্রমে নষ্ট হতে লাগলো। কারণ, সুইডেন হতে এক রকম কাঁটা আসতো, সেগুলি যেমন সস্তা তেমনি মজবুত। যুবক রিচার্ড মিলে আপন মনে কাজ করতো আর ভাবতো, কি করে কাঁটাগুলি সুইডেনের কাঁটার মত সস্তা এবং মজবুত করা যায়?

কিছু দিন যায়—হঠাৎ একদিন রিচার্ডকে মিলে কাজ করতে দেখা গেল না। সকলে মনে করল, রিচার্ড আলসেমী করে সেদিন কাজ করতে আসেনি। বস্তুত তখন পাগলবেশে একখানা বেহালা কাঁধে ফেলে একটা মহা উদ্দেশ্য বুকের ভিতর চেপে রেখে সুইডেনের জাহাজে পাড়ি দিলেন। স্বদেশের এই লাভজনক ব্যবসাটিকে বাঁচিয়ে দেশের মানুষের সম্পদ অক্ষুন্ন রাখাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। তার গান গাইবার ক্ষমতা ছিল! যথাসময়ে সুইডেন পৌঁছে সেখানকার মিলওয়ালাদিগকে গানের দ্বারা মুগ্ধ করে একটা আধ-বোঝা বোকারূপে সে কারখানায় প্রবেশ করবার ও থাকবার অনুমতি পায়। সকলে মনে করতে লাগলো, লোকটির বুদ্ধি নাই—শুধু একটু গাইতে পারে। কেউ তাকে সন্দেহ করলো না।

কারোর সন্দেহের পাত্র না হয়ে রিচার্ড দেখতো, কি উপায়ে এরা কাটা তৈরী করে।তাদের মিলের বিশেষত্ব কোথায়, এমন করে কয়েক বছর কেটে গেল। এক প্ৰভাতে মিলওয়ালা দেখলো তাদের বহুদিনের সঙ্গী সেই চেনা পাগলা আর নাই।

রিচার্ড যখন বুঝেছিলেন, কাঁটা তৈরীর সব কৌশল শেখা হয়েছে তখনই তিনি পালিয়েছিলেন।

স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে তাঁর সহসা অন্তহিত হবার অর্থাৎ সুইডেন যাত্রার কারণ যখন সকলে জানলেন, তখন মহাজনেরা লাভের আশায় উৎসাহিত হয়ে রিচার্ডকে ম্যানেজার করে এক বৃহৎ কারখানা স্থাপন করলেন। রিচার্ডের নির্দেশ অনুযায়ী যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হলো, কিন্তু বড় দুঃখের বিষয় কল চললো না। সকলে নিরুৎসাহ হয়ে পড়লো-রিচার্ডও যথেষ্ট অপ্ৰস্তুত হলেন। রিচার্ড ভাবলেন, এত কষ্ট, অর্থ ও পরিশ্রম সবই কি বৃথা হলো। রিচার্ডের বিশ্বাস ও মনের বল কিন্তু কমলো না।

ভাবলেন তাঁর নিজের পর্যবেক্ষণের ভুল আছে। আবার তিনি একদিন ছদ্মবেশে দেশ ত্যাগ করে সুইডেন উপনীত হলেন।

বহুকাল পরে মিলওয়ালা তাদের পুরান বন্ধুকে দেখে খুবই খুশী হলো। এবার অধিকতর মনোযোগ ও অভিনিবেশ সহকারে তিনি তাদের মিল পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। আবার অনেক বছর তার সেখানে কেটে গেল।

অধ্যবসায়, মনোযোগ ও চেষ্টার ফলে সমস্ত ভুলের যখন মীমাংসা হয়ে গেল, তখন রিচার্ড আবার একদিন পলায়ন করেন। এবার আর তাকে অপ্ৰস্তুত

হতে হলো না।

ইংলন্ডের একটি অতি লাভজনক ব্যবসার পথ তিনি প্ৰস্তুত করলেন। স্বদেশের ধনসম্পদ তাঁর অমানুষিক চেষ্টার ফলে অনেক পরিমাণে বেড়ে গেল।

সম্রাট দ্বিতীয় চার্লস এই ত্যাগী মহাপুরুষের গুণ স্বীকার করে তাকে স্যার উপাধিতে ভূষিত করলেন। সামান্য কৃষকের সন্তান ইংলন্ডের শ্রেষ্ঠ মনীষী সম্পপ্রদায়ের আসন লাভ করলেন।

উইলিয়াম ফিলিপসের জীবন-কাহিনী অতি বিস্ময়জনক। সামান্য রাখাল বালক উইলিয়ম নিজের শক্তিতে সম্রাটের দ্বারা সম্মানিত হয়েছিলেন। রাখালের পক্ষে দেশের শ্রেষ্ঠ উপাধি লাভ করা সামান্য কথা নয়। মানুষ শক্তি ও গুণকে অবহেলা করে না। তাতে যে তাদের নিজেরই ক্ষতি। গুণ ও শক্তি মহা মানুষের অবলম্বন-পিতার নাম নহো জান না, খোদার কাছে গুণ ছাড়া অন্য কিছুর আদর নাই।

উইলিয়মের বাপ বন্দুক সারার কাজ করতেন। উইলিয়ম আর তার ভাইয়েরা একুনে ছিল ছাব্বিশ জন। সকল ভাই মজুরের কাজ করে ব্যাপকে সাহায্য করতো। উইলিয়ম গরু চরাতেন। রাখালের জীবন নিয়ে থাকতে উইলিয়াম জন্মেছিলেন না। ভিতরে তার শক্তি ঘুমিয়েছিল। তাঁর ইচ্ছা হলো উত্তাল সাগর তরঙ্গের সঙ্গে তিনি খেলা করেন। অন্তহীন নীলসমুদ্রের উপর দিয়ে জাহাজে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতে তাঁর বাল্য হৃদয়ে ইচ্ছা হলো। কোন সুবিধা না হওয়ায় তিনি এক জাহাজের মিন্ত্রীর কাছে কাজ শিখতে লাগলেন। অল্প সময়ে জাহাজ নির্মাণে তিনি দক্ষ হয়ে উঠলেন। এই কাজ শিখবার কালে উঅবসর সময়ে তিনি বই পড়তেন। জাহাজের কাজ আরও ভাল করে শিখে তিনি বোস্টন শহরে নিজেই জাহাজ নির্মাণ আরম্ভ করেন। এখানে তিনি এক বিধবার পাণিগ্রহণ করেন।

ব্যবসা বেশ চলছিল। একদিন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন-সহসা কতগুলি লোকের মুখে শুনতে পেলেন, একখানা জাহাজ বহু দ্রব্যসম্ভারে পরিপূর্ণ হয়ে সমুদ্র দিয়ে আসছিল—পথে জলমগ্ন হয়েছে। যে এই জাহাজ উদ্ধার করতে পারবে, সে কোটি টাকা পুরস্কার পাবে।

ঘৃতের ভিতর আগুন দিলে যেন সে ভীষণ ভাবে জ্বলে ওঠে-এই শুভ সংবাদটিও তেমনি করে উইলিয়মের বুকের ভিতর উদ্যম ও আশার আগুন জ্বেলে দিলা সমুদ্রমগ্ন জাহাজটি যদি উদ্ধার করা যায়, তাহলে কত লক্ষ লক্ষ টাকা লাভ হয়।

অবিলম্বে উইলিয়ম নাবিক ও সব কিছু সংগ্রহ করে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেন। এই জাহাজখানা ড়ুবেছিল আমেরিকার সন্নিকটে বাহামা দ্বীপপুঞ্জের কাছে।

উইলিয়মের আশা ও পরিশ্রম ব্যর্থ হলো না। তিনি ড়ুবোজাহাজের সন্ধান পেলেন এবং বহু মূল্যবান সামগ্ৰী উদ্ধার করলেন। কিন্তু বিস্তর খরচের সম্মুখে বিশেষ লাভ হলো না।

এর কিছুকাল পরে তিনি লোক মুখে গল্পকারে শুনতে পেলেন আর একখানা জাহাজের কথা। সেখানে সমুদ্রগর্ভে প্রচুর রত্নসামগ্ৰী নিয়ে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে একটি জাহাজ ড়ুবেছিলা জনশ্রুতি ও উড়ো কথাকে অবলম্বন করে উইলিয়ম নতুন করে রত্ন লাভের আশায় সাগর অম্বেষণে বহির্গত হতে ইচ্ছা করলেন।

উইলিয়মের অবস্থা তত ভাল ছিল না। ভাল হলেও একজন মানুষের পক্ষে অত বড় একটা ব্যয়সাপেক্ষ কাজ ঘাড়ে নেওয়া নিতান্তই অসম্ভব।

উপায়াত্তর না দেখে তিনি সমাট দ্বিতীয় চার্লসের কাছে সাহায্যের জন্য সকল কথা নিবেদন করলেন। তার কথা, উৎসাহ ও বিশ্বাস দেখে শেষকালে সম্রাট চার্লস তাকে সাহায্য করতে প্ৰস্তুত হলেন।

বিপুল উদ্যমে রত্ন উদ্ধার আশায় উইলিয়াম আবার সমুদ্র যাত্রা করলেন। যারা তাঁর সঙ্গে গিয়েছিল তাদেরও উৎসাহের সীমা ছিল না, তাদের দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছিল বহু অর্থ লাভ করে তারা বাড়ী ফিরবে।

নির্দিষ্ট স্থানে উপনীত হয়ে উইলিয়াম লোকজনসহ সমুদ্রগর্ভ অন্বেষণে ব্যাপৃত হলেন। অন্ধের মত অজানা রাজ্যে রত্বের সন্ধান করার কাজ সোজা নয়।

এইভাবে ক্লান্তি ও পরিশ্রমে মাসের পর মাস চলে যেতে লাগলো-কিন্তু কোন সুবিধা হলো না। ক্রমে নাবিকগণের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা দিল। উইলিয়মের বিশ্বাস কিন্তু একটুও শিথিল হলো না।

একজন বিশ্বাসী কর্মচারীর সাহায্যে উইলিয়ম জানতে পারলেন তাকে সমুদ্রের ভিতর ফেলে দেবার ষড়যন্ত্র চলছে। জাহাজও স্থানে স্থানে ভেঙ্গে গিয়েছিল। অবশেষে নানা কারণে উইলিয়ামকে ফিরে আসতে হলো।

উইলিয়াম নিমজিত জাহাজ সম্বন্ধে আরও অনেক সংবাদ জেনেছিলেন। বিলেতে এসে তিনি সকলকে সেই জাহাজ সম্বন্ধে নতুন নতুন তথ্য জানালেন। তাঁর উৎসাহ একটুও কমেছিল না-নতুন মানুষ নিয়ে তিনি আবার সেখানে যাত্রা করতে ইচ্ছক হলেন। কিন্তু এবার সম্রাটের কাছে তার কথা ও বিশ্বাসের মূল্য হলো না।

অগত্যা তিনি সাধারণের কাছ থেকে দ্বিতীয় বার যাত্রার ব্যয় তুলতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু কে তাকে বিশ্বাস কররে? নতুন করে সাধারণের বিশ্বাস জন্মতে তাঁর দীর্ঘ চার বছর ধরে চেষ্টা করতে হয়েছিল। দীর্ঘ চার বছরের চেষ্টায় কেউ কেউ তাকে বিশ্বাস করতে অগ্রসর হলেন।

সাধারণের অর্থ সাহায্যে উইলিয়ম চার বছর পরে নতুন জাহাজে আবার ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেন। আগের মতই দিনের পর দিন, মাসের পর মাস সমুদ্রতল অন্বেষণে কেটে যেতে লাগল। উইলিয়ম মাঝে মাঝে ভাবতে লাগলেন, তার বিশ্বাস কি মিথ্যা হলো?

হঠাৎ একদিন একজন ড়ুবুরি জলের তল থেকে উঠে বললো, একখানা জাহাজের পাটাতনের মত কি যেন আমার হাতে ঠেকেছে।

বিপুল উদ্বেগে উইলিয়ম আরও কয়েকজন ড়ুবুরি পাঠালেন। কয়েক মুহূর্তের ভিতর একজন এক খণ্ড সোনার টুকরা নিয়ে ভেসে উঠলো। উইলিয়ম আনন্দে করতালি দিয়ে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়ে বললেন-ভাগ্য আমাদের ফিরেছে—আর ভয় নাই।

এত পরিশ্রম, আশা ও বিশ্বাস ব্যর্থ হলো না। উইলিয়মের অধ্যবসায় ও সাধনার মূল্যস্বরূপ কয়েকদিনেই ড়ুবোজাহাজ হতে ৪৫,০০,০০০ লক্ষ টাকা উদ্ধার হলো।

ইংলণ্ডে উইলিয়ম যখন প্ৰত্যাবর্তন করলেন তখন অনেকে সম্রাটকে বলেছিলেন—এই অর্থে উইলিয়মের কোন দাবী নাই, এসবই রাজ্যভাণ্ডারের প্ৰাপ্য। উইলিয়ম ভাল করে সব কথা সরকারকে জানিয়ে ছিল না, এই অপরাধে তার সমস্ত টাকা বাজেয়াপ্ত করা হউক।

ন্যায়নিষ্ঠ সম্রাট সে কথায় কৰ্ণপাত না করে কঠোর সাধনা ও অধ্যবসায়কে সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করলেন। তিনি উইলিয়ামকে স্যার উপাধি প্ৰদান করে শ্রেষ্ঠ আভিজাত্যের গৌরব প্ৰদান করলেন।

উইলিয়ম শেষ বয়স পর্যন্ত বিনয়ী ও সরল ছিলেন। তিনি কখনো কারো কাছে তাঁর পূর্ব জীবনের ইতিহাস গোপন করতেন না। হীন বংশে তাঁর জন্ম হয়েছিলো— আত্মশক্তিতে তিনি উচ্চাসন ও বিলেতের শ্রেষ্ঠ সম্মান লাভ করেন— একথা বলতে তিনি সব সময়েই গৌরব বোধ করতেন।

উইলিয়াম পেটিট বলে এক মহাত্মার কথা জানি। তাঁর বাপের ছিল। কাপড়ের দোকান। পেটিট ফরাসী দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। সেখানে যেভাবে তিনি কলেজ ও নিজের ব্যয় নির্বাহ করতেন, তা শুনলে তোমাদের অনেকের মনে সাহস আসবে। কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ছোট ছোট মনোহারী দোকান দেখেছ? পেটিট তেমনি করে পথে পথে ফেরী করে ছাত্রজীবনের ব্যয় সংগ্ৰহ করতেন।

পড়া এক রকম শেষ হলে তিনি দেশে ফিরে এক জাহাজে চাকরি গ্ৰহণ করেন। সে কাজ তার পোষাল না।

জাহাজের কাপ্তান তাঁকে একদিন অপমান, এমনকি প্রহার করেন। ঘৃণায় ও লজ্জায় পেটিটি কাজ পরিত্যাগ করে পৌরী শহরে ডাক্তারী পড়তে চলে গেলেন।

পেরী শহরে এসে তার যারপরনাই কষ্ট হতে লাগিল। খালি পেট জলে ভর্তি করে অনেক সময় তাকে পড়ে থাকতে হতো।

এই দুঃখ ও অভাবের মধ্যেই অতি কষ্টে কয়েকটি টাকা সংগ্রহ করে। পেটিট আগের মতো আবার ফেরী করা আরম্ভ করলেন। ফেরী করেই তিনি ডাক্তারী পড়া শেষ করলেন।

ডাক্তারীর সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যসেবা করতে লাগলেন। ক্রমে তার শক্তি ও প্রতিভার সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো-দেশের মানুষের শ্রদ্ধা। তিনি লাভ করতে আরম্ভ করলেন। নানা বিষয়ে তিনি প্ৰবন্ধ লিখতেন। চিত্তা-কখনো দর্শনের জটিল তত্ত্বে, কখনো অঙ্কশাস্ত্রে, কখনও কাপড় তৈরীর পন্থা নির্ধারণে, কখনও রং প্ৰস্তুত করবার কৌশল নির্বাচনে নিবদ্ধ থাকতেন।

ব্যবসা করে পেটিটি যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করেছিলেন। এই কমী উইলিয়াম পেটিটের গুণ ও শক্তি-সাধনা সম্রাট শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করেছিলেন। সম্রাট কর্তৃক উইলিয়ম শ্ৰেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন।

নেলসন ও ওয়েলিংটন আদৌ বনেদী ঘরের ছেলে নন-অথচ বৃটিশ জাতির পিতা তাঁরাই। বিলেতের এক লর্ড একখানা ছোট স্যাতসেঁতে গর্তের মতো ঘরের দিকে আঙ্গুল উঠিয়ে তাঁর ছেলেকে একদিন বলেছিলেন—ঐ ঘরখানিতে তোমার বুড়ো দাদা মানুষকে ক্ষেউরি করতেন। তোমার দাদা ছিলেন। নাপিত—আমি হয়েছি। লর্ড। শক্তি-সাধনায় মানুষ বড় হয়—এই বিশ্বাস দেবার জন্য তোমাকে এখানে এনেছি।

উনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরুষ গোখেল ছিলেন দরিদ্র সস্তান। নিজের শক্তিতে তিনি ভারত ছাড়া বিদেশেও উচ্চাসন ও শ্রদ্ধা লাভ করেছিলেন। স্যার উপাধি গ্রহণ করতে তিনি স্বীকৃত হন নাই। দরিদ্র গোখেল নিজেকে কত উচ্চ আসন দিতে পেরেছিলেন।

সম্রাট সবুক্তশীন ছিলেন ক্রীতদাস। কুতুবুদ্দীন ও পরের কতিপয় সম্রাট ছিলেন দাস। দাসের জীবন হতে হয়েছিলেন তারা সম্রাট-মানুষের মহাসেবকজগতের ধর্ম, সভ্যতা ও শান্তিরক্ষক।

০৭. কর্মে প্ৰাণযোগ্য-দৃঢ় ইচ্ছা

যে কাজই কর না, তাতে যদি কোন রকমে তোমার মন ঢেলে দিতে পারে, তাহলে আর কোন ভয় নাই। সংশয়কে মনে স্থান দিতে নাই। সংশয়ে মনের বল কমে যায়, এমন কি কার্যে সিদ্ধিলাভ হয় না।

কোন কাজ করতে ইচ্ছা করেছ। ভেবে নাও-বিশ্বাস কর—তুমি কৃতকার্য হবে-তারপর পরিশ্রম কর। তুমি নিশ্চয়ই কৃতকার্য হবে।

ফরাসী দেশে এক ব্যক্তি ঘরের ভিতর ঘুরে বেড়াতেন। আর বলতেনআমি একজন বড় যোদ্ধা হবো, তাই তিনি হয়েছিলেন।

একটি ছাত্রকে জানি-সে। কয়েক বছর আগেকার কথা। তিনি পড়তে বসেছিলেন, গায়ে তখন জ্বর। সামনে পরীক্ষা-না পড়লেই চলবে না। পরীক্ষায় পাশ না হলে হয়ত তাকে মরতে হবে। জ্বর এসেছে, সে কথা ভুলে গিয়ে তিনি পড়তে আরম্ভ করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর জ্বর চলে গেল।

এক ভদ্রলোকের অসুখ হয়েছিল—তিনি ইচ্ছা করলেন অবিলম্বে তাঁকে ভাল হতেই হবে-সত্যিই তিনি ভাল হলেন।

সম্রাট বাবরের কথা সবাই জানেন। পুত্রের ব্যাধি তিনি কেমন করে নিজের ভিতর টেনে নিলেন।

একবার এক সৈন্যাধ্যক্ষের অসুখ হয়। খুব সাংঘাতিক অসুখ। হঠাৎ একটা যুদ্ধ বেধে উঠলো। অসুখের কথা ভুলে একটা অমানুষিক শক্তির দ্বারা বলীয়ান হয়ে সেই শরীর নিয়েই ময়দানে নামলেন। যখন জয়লাভ হলো তখন তিনি প্ৰাণত্যাগ করলেন।

শুধু ইচ্ছা করলে কি হবে? দৃঢ়ভাবে ইচ্ছা করো এবং বিশ্বাস করো, তুমি কৃতকার্য হবে-সাধনা আপনা হতেই চলে আসবে। দুঃখে ভীত হবে না, অভাবে দমে যাবে না— অসীম বলে, নিরবচ্ছিন্ন সাধনায় নিজের পথ নিজে পরিষ্কার করে নিতে পারবেই।

বিশ্বাস ও দৃঢ় ইচ্ছার সম্মুখে অসম্ভব সম্ভব হয়ে পড়ে। তোমার সাধনায় যদি তুমি জয়ী হতে যাও, তবে সমস্ত মন তোমার কর্মে ঢেলে দাও-প্ৰাণ দিয়ে বিশ্বাস করো, তুমি কৃতকার্য হবে। সংশয় ও অবিশ্বাস মন থেকে দূর করে দাও। সংশয়ী যারা তারা কাপুরুষ, তাদের সাধনার কোন মূল্য নাই—তাদের পরাজয় হবে।

এক সাধু বলেছেন- যা আমরা হতে চাই, তাই হতে পারি। এই হতে চাওয়ার ইচ্ছা খুব দৃঢ় এবং কঠিন হওয়া চাই।

একদিন এক মিস্ত্রী একখানি চেয়ার তৈরী করে বললেন, চেয়ার তৈরী করি—বসতে পারি। না। প্ৰতিজ্ঞা করলাম, এই চেয়ারে আমি বসবো। বিস্ময়ের কথা! মিস্ত্রী কালে মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে সেই চেয়ারেই বসেছিলেন।

নিজেকে দুর্বল ও শক্তিহীন মনে করলে চলবে না; তুমি মানুষ-তোমার ভিতর এই শক্তি আছে-যে শক্তির সম্মুখে গিরি মাথা নত করে, বিশ্ব-সংসার কাঁপতে থাকে।

তুমি বিপদে পড়েছি? ভয় কি? বিপদকে উপহাস করে-দরিদ্র্যের বিষ্পেষণকে ঠেলে ফেলে দাঁড়াও, তুমি সফলতার উচ্চ শিখরে উঠতে পারবে।

এক ব্যক্তিকে জানি। তাকে এক নিষ্ঠুর ভদ্রলোক বলেছিলেন, এই শিলাখানি মাথায় করে রাস্তার ধারে নিয়ে যাও। তাহলে বুঝবো–তুমি শক্তিশালী পুরুষ, দশ টাকা বখশিশ, পাবে। লোকটি অর্থ অপেক্ষা গৌরব লোভে পাথরখানি মাথায় করে বেরোলো। সে খুবই উৎসাহের সঙ্গে শিলাখানি মাথায় নিয়েছিল। অর্ধপথ আসার পর তার মুখখানা শুকিয়ে গেল, যাতনায় বুক ঘন ঘন স্পন্দিত হতে লাগল, চোখ দুটি রক্তময় হয়ে গেল।

এক ভদ্রলোক কৌতুহল ও সহানুভূতিতে লোকটির পেছনে পেছনে যাচ্ছিলেন।

ভদ্রলোক সেই লোকটির অবস্থা একটু বুঝে তার কাছে যেয়ে দাঁড়াতেই লোকটি বললে–আর পারছি না-পাথর ফেলে দিই-কি বলেন?

ভদ্রলোক রুদ্র কণ্ঠে বললেন—বল কি? তোমার মতো শক্তিশালী লোকের কাছে পাথরখানা তো শোলার মতো হালকা, ফেলবে কেন? চল, নিয়ে চল। আমি তোমার সঙ্গে যাচ্ছি।

ক্লান্ত লোকটি উৎসাহ ও বিশ্বাসে পাথরখানি গন্তব্যস্থানে নিয়ে গেল।

জীবনের প্রথম থেকে ঠিক করে নাও, তুমি কোন কাজের জন্য উপযুক্ত। এটা একবার ওটা একবার করে যদি বেড়াও তাহলে তোমার জীবনের কোন উন্নতি হবে না। এইরূপ করে অনেক লোকের জীবন নষ্ট হয়ে গিয়েছে-তোমার যেন তা না হয়।

ঠিক করলে-ব্যবসায়ী হবে, সমস্ত প্ৰাণ ব্যবসাতে ঢেলে দাও। খেয়াল চেপেছে আর ব্যবসা করতে যেও না-দুদিন পরেই তোমার মন বিরক্ত হয়ে উঠবে। তোমার শক্তি বৃথা ক্ষয় মতলবে। যদি জোর না থাকে, তাহলে সাধনায় তোমার মন বসবে না। ইচ্ছা থাকলেই পথ আছে-এ প্রবাদটির চলতি সবার মধ্যেই আছে।

তোমার কোন কিছু করবার বা হবার দৃঢ় বাসনা আছে—তাহলে কোন বাধা তোমার গতিকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। শুধু চাই তোমার সঠিক ইচ্ছা এবং বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের সঙ্গে খোদার শক্তি তুমি পাবে।

ধর্মে—যে যা কঠিনভাবে পেতে ইচ্ছা করে, তা সে পায়।

নেপোলিয়ান বলেন— অসম্ভব বলে জগতে কিছু নাই। ডাক্তার লিভিংষ্টান যখন ছোট তখন তিনি এক কারখানায় মজুরি করতে গেলেন। প্রথম সপ্তাহে তিনি যে বেতন পেলেন তাই দিয়ে তিনি একখানা ল্যাটিন ভাষার গ্রামার কিনলেন। আমরা আজকাল ইংরেজী পড়ি, সেকালে ইংরেজরাও তেমনি ল্যাটিন ও গ্ৰীক পড়তেন। দিনে দিনের কাজ, রাতে দুপুর রাত পর্যন্ত জেগে জেগে বই পড়া।

এমন করে নিজে নিজে পড়ে লিভিংষ্টান ল্যাটিন ভাষার খুব বড় বড় বই পড়ে ফেললেন। বেশী করে তিনি বিজ্ঞানের বই পড়তেন।

এরপর তাঁর ইচ্ছা হলো মানুষের উপকার করে এবং তাদিগকে জ্ঞান দিয়ে তিনি জীবন শেষ করবেন। এই কাজে খুব দক্ষ হবার ইচ্ছায় তিনি চিকিৎসাশাস্ত্ৰ অধ্যয়ন করতে আরম্ভ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি গ্ৰীক ভাষাও আলোচনা করতে লাগলেন।

গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র যখন তিনি-তখন ছুটির সময় অর্থ জমাবার জন্য তিনি কারখানায় মজুররূপে কাজ করতেন।

ইচ্ছা ছিল তাই কোন রকম দুঃখ-কষ্টের ভিতর দিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি লাভ করতে সমর্থ হলেন।

জীবন তিনি পতিত মানুষের কল্যাণেই কাটিয়েছেন। যখন তিনি মিসরে তখন অনেক সময় তাকে গরু চরাতে দেখা যেতো। কখনও কখনও তিনি লাঙ্গল চষ্যতেন। পরের সেবা ও পরিশ্রমের উপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজে পরিশ্রম করতে গৌরব বোধ করতেন।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে জন হাওয়ার্ড নামক এক মহাপুরুষ বিলেতে কয়েদিদের প্রতি নিষ্ঠুর ব্যবহার অনেক পরিমাণে কমেছে। গভর্নমেন্ট এবং দেশের মনীষীবৃন্দ তাঁর চিস্তা ও ভাব গ্রহণ করেছিলেন। কোন দুঃখ কোন বাধা তাকে তাঁর সাধনা হতে ধরে রাখতে পারেনি। শক্তি ও বিশ্বাস তাকে জয়যুক্ত করেছিল। প্রতিভা কিংবা শুধু ভাষার পরীক্ষা তাকে জয়যুক্ত করে নাই।

০৮. পয়সা-কড়ি

বড়লোক ও সম্পদশালী হবার অধিকার শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ও সাধু ব্যক্তিদেরই আছে। তিনি জানেন-অর্থ কীভাবে ব্যবহার করতে হবে।

যিনি সাধু, কর্মী ও পরিশ্রমী তার উন্নতি যেমন অবশ্যম্ভাবী অন্যের তেমন নয়।

তুমি সাধু ও জ্ঞানী, তুমি দরিদ্র হয়ে থাকবে, এরূপ ইচ্ছা পোষণ করো না। তোমাকে ধনী হতে হবে, কেননা তুমি জান অর্থ কীভাবে ব্যয় করতে হয়।

অর্থাপিশাচ, নীচ, সঙ্কীর্ণ হৃদয় ব্যক্তি যদি অর্থ উপায় করে, তবে তার উপার্জনের কোন মূল্য নাই।

সৎ উদ্দেশ্যে পয়সা উপায় করা উপাসনারাই তুল্য। সত্য কথা বলতে কি, ইহা শ্রেষ্ঠ উপাসনা।

মানুষের কল্যাণ করবে কি দিয়ে? পয়সা কই?

খোদার নামে পয়সা উপায় করা। তুমি শ্ৰেষ্ঠ সাধকের অন্যতম হবে। স্ত্রীপুত্রের ভরণপোষণ করার জন্যও পয়সা চাই। সংসারে বাস করে পরিবারের সুখস্বাচ্ছন্দ্য বাড়ানো তোমার কর্তব্য, তা না করলে তুমি অন্যায় করবে।

পয়সাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখো। চিন্তাশীল জ্ঞানী ব্যক্তিরা পয়সাকে অশ্রদ্ধার চোখে দেখেন না।

পয়সার প্রতি মমতাহীন হয়ে বেহিসাবীর মত খরচ করলে বুদ্ধি ও ধর্ম নষ্ট হয়। পয়সাকে ঘৃণা করো না। পয়সার প্রতি অন্যায় মমতা পোষণ করে নিজেকে হীন করো না।

বিবেচক ও মিতব্যয়ী ব্যক্তি হিসেবী না হয়ে পারে না। তিনি ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবেন। বর্তমানে ছোট ছোট আরাম ও সুখ ভোগের ইচ্ছগুলিকে দমিয়ে রেখে তিনি সামনের শীতের দিনের কথা চিন্তা করেন।

যে সমস্ত মানুষ বেহিসেবী হয়ে রসনাকে সংযত করতে জানে না, মূর্থের মতো যত খেয়াল চাপে আর খরচ করে, তারা মনুষ্যত্বের অবমাননা করে।

দুঃখের পর সুখ, অশান্তি ও বেদনা তাদের জীবনের অনেক শক্তি নষ্ট করে দেয়।

মানুষ যদি একটু বুঝে সুঝে খরচ করে, তাহলে তার দুঃখ অনেকটা কমে যায়। মানুষ নিজের দুঃখ রচনা করে-নিজেকে নিজে দরিদ্র করে।

অভাবগ্ৰস্ত যে তার চিত্তে স্বাধীনতা থাকে না। তুমি মিতব্যয়ী হও, তোমার মনের স্বাধীনতা বেড়ে যাবে।

সোজা কথা নয়। এজন্য কম সাধনা আবশ্যক হয় না। অনেক মানুষ চরিত্রের সব ভুল দেখে আতঙ্কিত হন, কিন্তু মিতব্যয়ী হওয়া লজ্জাজনক মনে করেন না, বস্তুত সত্যবাদী হওয়া যেমন জীবনের একটি শ্রেষ্ঠ কাজ, মিতব্যয়ী হওয়াও তেমনি একটি বড় কাজ।

যাদের অভাব সারে না তারা চিরকালই ছোট। দুর্ভিক্ষের দিনে তারাই আগে মরে। তুমি সমাজে আজ শ্রেষ্ঠ আসন গ্রহণ করে আছ-কিছু বাঁচাও না-যদি সহসা তোমার মৃত্যু হয়, তাহলে তোমার স্ত্রী-পুত্রের কি হবে? যেখানে আছ নিজের বর্তমান আর্থিক অবস্থা হতে উন্নত হতে চেষ্টা করা সব খরচ করে নিজেকে ইতর মানুষের কৃপার পাত্র করো না।

আমি বলছি না, জীবনের সুন্দর মধুর গুণগুলি বিসর্জন দিয়ে পিশাচের মতো অর্থ জমাবে। আমি বলি, নিজেকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য, চিত্তের স্বাধীনতাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সতর্ক হও। সব সময়েই যদি অভাব তোমাকে ব্যস্ত করে, তাহলে তোমার মনের বল থাকবে না। নিজের ত্যাগ কর।

পৃথিবীর বড় বড় কাজ, সঞ্চয়ী লোকদের দ্বারা অথবা তাদের সাহায্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে। অভাবগ্ৰস্ত ব্যক্তি নিজের অভাব নিয়েই ব্যস্ত-সে সমাজের কি কাজ করবে? কোন ভাল কাজের জন্য পয়সা ব্যয় করতে কষ্টবোধ না করে সে পারে না।

একদিন সন্ধ্যাকালে দেখলাম একটা অপরিচিত রমণী হঠাৎ আমাদের ঘরের ভিতর প্রবেশ করলো। কারণ জিজ্ঞাসা করায় সে বললে একজনের কাছ থেকে সে কিছু হাওলাত করেছিল, দিতে পারে নাই, রাস্তায় তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, ভয়ে সে এখানে একটু সরে দাঁড়িয়েছে।

তোমার অবস্থাও যদি এমনি হয় তবে সে কত দুঃখের হয় বল দেখি? যদি কারো নিকট হতে টাকা নিয়ে থাক-কিংবা যদি তোমার কাছে কিছু পায়, তাহলে সে যত ছোট লোকই হোক না, তার সামনে তোমার একটু সঙ্কোচ হবেই। জীবনের এই অবস্থা বড় পীড়াদায়ক, বড় বিরক্তিকর। তোমার ভিতরে যদি মনুষ্যত্ব থাকে, তাহলে নিজেকে এই লজ্জাজনক অবস্থার ভিতরে টেনে এনো না।

হাতে যদি পয়সা না থাকে তাহলে মনে মনে পরদুঃখকাতর হয়েও কোন লাভ নেই। এক ভদ্রলোক এক সময়ে তাঁর যা কিছু ছিল সব এক বিপদগ্ৰস্ত মানুষকে দিয়ে নিজেই বিপদে পড়েছিলেন।

তোমার হাতে যদি পয়সা-কড়ি কিছুই না থাকে, তবে মানুষের দুঃখের সামনে বোকার মতো তোমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।

জীবনকে যদি স্বাধীন করতে চাও তাহলে কিছু কিছু জমাও-অল্প হলেও জমাতে থাকা হযরত মোহাম্মদ (সঃ) বাতির পলতে চিপে তেল বের করতেন, তা জান?

হযরত ঈসা (যীশু) বলেছেন-ছোট বলে ফেলে দিও না, কুড়িয়ে রাখো।

এক পয়সা বলে ঘৃণা করো না! দুটি চাল, একটা লঙ্কা নষ্ট হলে কি ক্ষতি, এ কথা ভেবো না।

সামান্য মুষ্টি চালের শক্তিতে কত বড় বড় কাজ সম্পাদিত হয়।

তোমার মিঠাই খাবার ইচ্ছা হচ্ছে, খাওয়ার আগে ভেবে দেখ; তোমার চাল কেনবার পয়সা আছে কিনা।

এক ভদ্রলোক তাঁর পুত্রের কাছে চিঠি লিখলেন, হিসেব করে খরচ করা জীবনের এক প্ৰধান গুণ। অনেক লোক টাকা-পয়সা নিয়ে হিসেব করা ভাল মনে করে না। তুমি তাদের একজন হয়ো না।

জগতে অনেক প্রতিভাশালী লোকের চরিত্রে এ-গুলি ছিল না বলে তুমি তাদের বন্দস্বভাবটি অনুকরণ করো না, তাদের যদি এই দোষ না থাকতো তাহলে তারা জগতে আরও বেশি উপকার করতে পারতেন।

তাদের সদগুণগুলি অনুসরণ না করে, তাদের বদঅভ্যাসগুলি অনুসরণ করাতে গৌরব। নাই। চাঁদে কলঙ্ক আছে বলে কে কবে নিজের দেহকে কলঙ্কিত করে?

বর্তমানের অবস্থাকে মেনে নিয়ে কষ্টে-সৃষ্ট তোমাকে দিন কাটাতে হবে। চলে না বলে সীমা অতিক্রম করো না। যে মুহূর্ত পর্যন্ত আয় না বাড়ে সে পর্যন্ত তোমাকে দরিদ্রের মতো থাকতে হবে। তুমি বর্তমান সত্যকে অবিশ্বাস করতে পার না। তোমার আয় যখন সামান্য তখন জোর করে এই সামান্য অবস্থাকে। অস্বীকার করে বেশী খরচ করলে চলবে না। বর্তমানকে সত্য বলে গ্ৰহণ করো। বর্তমানকে অসত্য মনে কর, হয় তুমি চোর না হয়। পরদিয়া প্ৰত্যাশী হবে। পরে যে পর্যন্ত দান না করে সে পর্যন্ত অন্তত তুমি নিজেও সীমার ভিতর দাঁড়িয়ে থাক।

শুধু নিজের অবস্থায় সস্তুষ্ট থাকলেও চলবে না, তোমাকে কিছু কিছু বঁটাচাতে হবে। খুব সামান্য হোক ক্ষতি নাই। বেঁচে থাকা যেমন দরকার, কিছু কিছু বঁটাচানও তেমনি দরকার। যা তুমি বঁচাবে তার অস্তিত্ব ভুলে যাও। তা কাউকে দিও না।

যখন সর্বস্বান্ত হয়েছ—দুৰ্গতির যখন সীমা নাই, তখন যদি নিজের নিবুদ্ধিতার জন্য নিজেকে ধিক্কার দাও, তাতে লাভ কি? স্ত্রী-পুত্র হয়ত এক সময়ে তোমার উপহারে সুখী হয়েছিল-আজ তোমার দুৰ্গতির দিনে তারা বলবে, না বুঝে আবদার করেছিলাম, তুমি জ্ঞানী পিতা হয়ে কেন তা শুনলে? বস্তুত দুঃখের দিনে তারা তোমার গত উপকার ও দানের কথা ভেবে চুপ করে থাকবে না, এক সময়ে সুখের জীবন ছিল বলে আজ তারা খালি পেটে থাকতে পারে না!

অভাবে মানুষ পশু হয়, স্ত্রী-পুরুষ আত্মীয়-বন্ধু সকলের সঙ্গে অজ্ঞাতসারে মর্মান্তিক অসদ্ব্যবহার করতে হয়, অথচ সে হীনতা নিজে কিছু বোঝা যায় না।

তোমার কৃপণতায় (?) একটা মানুষ অসন্তুষ্ট হতে পারে, কিন্তু সে যখন ক্ষুধাতুর হয় তখন যদি তুমি তাকে ভাত না দাও সে তোমাকে হত্যা করবে।

বেশী ভাবতেন! হেলায় যে পয়সা রাস্তাঘাটে ফেলে দিচ্ছ, সেগুলি জমিয়ে রাখলে হয়ত একটি বড় কারবারের ভিত্তি স্থাপন করতে পারতে।

পর তোমাকে চিনল না বলে, তুমি মরে যেতে পার না। জগতে অতি অল্প লোকই একজনে আর একজনের কষ্ট বোঝে। অতএব সাবধান।

পিতার সাধনার সম্পদ অনেক কুড়ে সন্তান ভোগ করে, আবার অনেকে উড়িয়ে দেয়-নিজের স্বভাব দোষে।।

পরের পরিশ্রমলব্ধ অর্থ যদি বিনা পরিশ্রমে লাভ হয়, তাহলে জাতীয় জীবন দুর্বল হয়ে পড়ে। মানুষ পরিশ্রম করে না-হিসেবী হয় না।

একথাও ঠিক হৃদয়হীন ধনী অত্যাচারীর উপর অনশনক্লিষ্ট অত্যাচারী দীন-দরিদ্র বিরক্ত না হয়েও পারে না।

অবস্থা শোচনীয় এ কথা কাউকে বলো না। তাতে কোন লাভ হবে না, কেউ তোমাকে দয়া করবে না। কাজ করো। আশীর্বাদ আর অনুগ্রহ যদি আসে। তবে তা খোদার কাছ থেকে আসবে। আমার এ কথা বিশ্বাস করে।

যদি খরচপত্র সম্বন্ধে সতর্ক থাক, যে আয়ই হোক তোমার সংসার একরকম চলবেই—তোমার দরিদ্র প্রতিবেশীকে সম্ভবমত সাহায্য করবার সৌভাগ্য তোমার হবেই।

এক ব্যক্তিকে জানি-বাড়ি থেকে চিঠি এসেছিল, ভাই তিনটির শীতের কাপড় নেই—লোকটি সে কথায় আদৌ কান না দিয়ে নিজের জন্য ১০ টাকার এক জামা কিনে ফেললো।

বস্তুত এই সমস্ত অপদাৰ্থ মানুষ জগতে কাউকে সুখ দিতে আসে না। তারা কেবল মানুষের দুঃখ সৃষ্টি করে। যারা তাদের স্পর্শে আসে তাদের কষ্টের সীমা থাকে না।

মানুষ যদি হিসেবী হতো তা হলে জগতের পনের আনা দুঃখ কমে যেতো। জগতে এত দরিদ্র লোক থাকত না-মানুষের এত হাহাকার শোনা যেতো না।

মানুষটি জ্ঞানী এবং সত্যবাদী কি-না একথা জানিবার আগে তিনি মিতব্যয়ী কি-না এ— কথা জানতে চেষ্টা করো।

মেয়ে বিয়ে দেবার সময় জামাইয়ের রূপ, গুণ ও শিক্ষার খবর নেবার সঙ্গে সঙ্গে শুনে রেখো, জামাই টাকা-পয়সা হিসেবমত খরচ করেন কি-না, কারণ, সেটা একটা মস্ত গুণ। তার ঋণ করবার কু-স্বভাব আছে কি-না!

শিক্ষা না থাক, রূপ না থাক, গুণ না থাক, মিতব্যয়ী জামাতার হাতে তোমার মেয়ের খাবার পরিবার কোন কষ্ট হবে না।

কেউ কেউ বলে থাকে, ভদ্রলোক যারা তাদের অবস্থা খারাপ না হয়ে যায় না। একথা তুমি বিশ্বাস করো না। ভদ্রলোক অন্যায় করে বা অসৎ উপায়ে পয়সা উপার্জন করতে ঘৃণা বোধ করেন। সত্য, কিন্তু তাই বলে তাকে টানাটানির ভিতর পড়ে থাকা ঠিক নয়। যেমন করে হোক, তিনি তার শোচনীয়তার মধ্যেই সচ্ছলতা টেনে আনবেন। তিনি পর-প্রত্যাশী। হবেন না। পরের দুয়ারে তিনি হাত পাতবেন না। তিন আলসে এবং কুড়ে হয়ে বসে। থাকবেন না-সৎ উপায়ে পয়সা অর্জন করে অর্জিত অর্থ হিসেবী হয়ে খরচ করবেন।

মানুষকে হিসেবী হতে হবে-এর অর্থ এ নয় যে, তুমি অতি মাত্রায় হিসেবী হবে—যাতে তোমার পরিবারবর্গের খুব কষ্ট হয়, তোমার সুবুদ্ধি ও বিবেচনা তোমার ব্যয়কে নিয়মিত করবে।

কখনও ঋণ করো না। এই একটা কথা যদি তুমি পালন করতে পার তাহলে তোমার ব্যয়কে নিয়ন্ত্রিত করবে।

খালি থলে যেমন খাড়া হয়ে দাড়ায় না; কাণ করলে তেমন তোমার সোজা। হয়ে দাঁড়াবার ক্ষমতা থাকবে না।

ঋণ করতে থাকে, দেখবে তুমি ভারি মিথ্যাবাদী হয়েছে-তোমার মনুষ্যত্ব লোপ পেয়েছে—তুমি পশু হয়েছে।

এক ভদ্রলোক এক যুবককে এই উপদেশ দিয়েছিলেন-ঋণ করে কোন সখী মিটাতে চেষ্টা করো না-পয়সা নাই লজার খাতিরে অন্য ছেলেদের দেখাদেখি বাকী করে গায়ের জামা কিনো না। অসঙ্কোচে বলো, আমার দরকার নেই, যা আছে তাই ভাল।

যে মানুষ তোমার কাছে খুব ছোট, তার কাছ থেকে যদি তুমি টাকা ধার করে থােক, তাহলে তার সামনে তোমার একটু সঙ্কোচ হবেই। মনের এই সঙ্কোচবোধ স্বাধীনচিত্ত ভদ্রলোকের কাছে অসহ্য।

কিছুতেই ধার করবে না। ডাক্তার জনসন বলেছেন—ধার করার অর্থ, জীবনকে দুঃখময় করে তোলা। দরিদ্র যে, সে নিজের দারিদ্র্যেই বিব্রত, পরের উপকার কি করবেঃ অন্যান্য সদগুণ লাভের সঙ্গে সঙ্গে ধার করার অভ্যাসকে পরিহার করবার গুণটি লাভ করতে বদ্ধপরিকর হও।

সংসারের আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখার অভ্যাসটি খুব ভাল। এক পয়সার হিসােব লিখতে লজ্জা বোধ করো না। চোখের সামনে নিজের আর্থিক মূল্যাটুকু ধরে রাখলে খরচ করার আগে সতর্ক হতে পারবে।

ডিউক অব ওয়েলিংটন খরচপত্রের হিসাব নিজে রাখতেন। তিনি বলেছেন—পরিবারের কর্তা যিনি, তিনি নিজের হাতে এই কাজ করবেন। দেনাপাওনা সবই নিজের হাতে দিতে হবে।

আমেরিকার রাষ্ট্রনায়ক ওয়াশিংটন আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখতে লজ্জাবোধ করতেন না।

যখন মনের মাঝে কোন খেয়াল চাপে, সে খেয়ালকে তুমি দমন করো। খেয়ালকে জয় না করতে পেরে, বহু মানুষ এবং বহু পরিবার ধ্বংস হয়েছে। মন দমন করবার জন্য চরিত্রবল আবশ্যক। এই বল সাধনার দ্বারা লাভ করতে হবে। খেয়াল বা সখকে যদি প্রশ্ৰয় দিতে থাক তাহলে তুমি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়বে। সখের কোন অন্ত নাই, যেমন ভোগ-কামনার নিবৃত্তি নাই।

চরিত্রবান হওয়া এক সাধনা-মিতব্যয়ী হতে চেষ্টা করা তেমনি একটি সাধনা। অমিতব্যয়ী ও ঋণী মানুষকে অসঙ্কোচে জ্ঞানী মানুষেরা ভদ্রলোক বলে না। দোকানের বাকী কাপড় গায়ে দিয়ে তুমি ভদ্রত রক্ষা করছে, জ্ঞান ও বিবেকের কাছে কিন্তু ভদ্রতা রক্ষা হলো না, বিবেক তোমার বলবে, এটা অপমান ছাড়া আর কিছুই নয়।

০৯. জীবনের মর্যাদা

কিসে হয় মর্যাদা? দামী কাপড়ে? গাড়ী-ঘোড়ায়? ঠাকুরদার উপাধিতে? না—তা নয়।

মর্যাদা ঐসব জিনিসে নাই। তুমি চরিত্রবান কি না! তুমি কঠিন সত্যের উপাসক কি না! তুমি জ্ঞানের সেবক কি না, তাই জানতে চাই।

তোমার অনেক টাকা আছে। তুমি মানুষকে শ্রদ্ধার চোখে দেখ না। মানুষের মনুষ্যত্ব তোমার স্পর্শে এলে নষ্ট হয়-আমি তোমাকে শ্রদ্ধা করি না।

সাদী বলেছেন—ভদ্রলোক সেই, বড় সেই, যে সত্যের উপাসক। সে মনুষ্যকে সমাদর করে-চরিত্র ও মহত্ত্ব যার গৌরব।

নিত্য কোর্মা-কালিয়া রাবিড়ী-ক্ষ্মীর খাও কি না, শুনতে চাইনে। তোমার বহুলোকের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় আছে কি না, জানিবার আমার দরকার নাই। তোমার পিতা জজ ছিলেন, তা শুনেও আমার কঠিন মন সুখী হবে না। আমি দেখতে চাই তোমাকে, তোমার ভিতর-বাহির, তোমার মনুষ্যত্ব ও চরিত্র। তোমার নয়।

তোমার বাড়িতে একশ দাসী থাকে, তোমার জমিদারীতে প্ৰজারা তোমায় দেখে ভীত হয়— একথা শুনলে মনে আমার সুখ হবে না! তোমার আত্মীয়-স্বজন সকলেই বড়লোক, একথা শুনে আমার কি লাভ? আমি দেখতে চাই তোমাকে, তোমার ভিতর-বাহির, তোমার মনুষ্যত্ত্ব, তোমার ঠিক মূল্য।

মানুষের পয়সা দিনের আলোতে চুরি করে এনেছ? মা আশীৰ্বাদ করেছেন, খোদা তোমার মঙ্গল করুক; পিতা সাদরে স্নেহ-মায়ায় তোমার বুকে তুলে নিচ্ছেন। মানুষের প্রশংসামাখা দৃষ্টি তোমার উপর। সম্মানী লোকেরা তোমাকে চান। আমার মন তোমার কাছে নত হবে না, অবজ্ঞায় আমি বলব, যাও।

আত্মা তোমার নির্মল, তুমি জ্ঞানের সেবক, সৃষ্টি-বৈচিত্ৰ্য অধ্যয়নে তোমার আনন্দ, চরিত্র তোমার উন্নত। মহা-মানুষকে অনুসরণ করাই তোমার জীবনের লক্ষ্য, আত্ম-শাসনে তুমি বিজয়ী বীর, মিথ্যা ও পাপের বিরুদ্ধে দাঁড়ান ধর্ম মনে করো, দৃষ্টি তোমার দিন দিন গভীর হচ্ছে, আত্মা তোমার মৃগের মতো সজাগ, ব্যাকুল, উৎকর্ণ-সম্ভ্রমে তোমায় আমি নমস্কার করি।

তুমি মিথ্যাবাদী, হৃদয় তোমার সংকীর্ণ, তোমার ভিতর আত্মা আছে কি না জানা যায় না, প্ৰাণহীন পদার্থের মতো তুমি সময়ের উপর চড়ে যাচ্ছ, তুমি মুৰ্থ, তুমি মানুষকে বেদনা দাও, তুমি পরের টাকা অপহরণ করতে লজ্জা বোধ করা না, তুমি পিতার বড় সস্তান, তোমায় আমি ঘৃণা করি। তোমার উপাসনা ও উপবাসের মূল্য কি?

জীবনকে মধুর ও পবিত্র করবার জন্য তুমি কষ্টে পড়েছ— ছিন্ন বস্তার উপর বসে তুমি রহস্যের সন্ধানে ব্যাপৃত, সংসারের মানুষেরা তোমাকে সম্মান করে না, আমি তোমাকে সম্মান করি।

তুমি চরিত্রবান ও সত্যবাদী, জ্ঞানের সাধক এবং পাপকে ঘৃণা কর, তুমি যে কোন কাজই করা না-বিশ্বাস করো তোমার মর্যাদা অল্প নয়।

আত্মার শুভ্ৰতা রক্ষা করা— চিত্তকে মিথ্যার বিরুদ্ধে স্বাধীন করে রাখাই ধর্ম-তুমিই যথার্থ ধাৰ্মিক, অতএব সম্মান তোমারই।

হাতে ঘড়ি নাই, গায়ে দামী জামা নাই, পায়ে বিলাতি জুতা নাই—কি ক্ষতি? তোমার ভিতরে মহত্ত্ব আছে? ঐ সব বিচিত্র পোষাকধারী পুরুষ যারা

সম্মুখে তারা বিনয়-ভক্তিতে ভুলুষ্ঠিত হবে।

উচ্চ রাজকর্মচারী হতে পারলে না, তোমার জীবনের মূল্য হলো না। — এমন হীন চিন্তা হৃদয়ে পোষণ করো না। রাজা, মহারাজা-উচ্চ রাজকর্মচারী-মনে রেখো, তোমার সেবক। গাড়ী ঘোড়ায় যে চড়ে প্রাসাদে যে বাস করে, যার মাথা দিয়ে কুসুমের গন্ধ বেরোতে থাকে, ইঙ্গিতে যার দশজন দাসদাসী দৌড়ে আসে, মানুষের ঘাড়ে চড়ে, যে মানুষকে দিয়ে জুতা খোলে, মানুষের ঘাড়ে চড়ে যে হাওয়া খায়, তাকে দেখে তুমি দমে যেয়ে না।

১০. চাকরি, কাজ-কাম ও ব্যবসা; উদ্যম, চেষ্টা, পরিশ্রম

চাকরি করা উত্তম কাজ, যখন তা হয় জাতির সেবা, যখন তাতে মর্যাদা ও ব্যক্তিত্ব নষ্ট না হয়। যখন জীবনধারণের সম্বল হয়ে পড়ে চাকরি, যখন সেটাকে দেশসেবা বলে মনে না হয়, তখন তা করো না। সত্য ও আইন অপেক্ষা উপরস্থ কর্মচারীকে যদি বেশী মানতে হয়, তাহলে সরে পড়। প্রভুর সামনে যদি মনের বল না থাকে, নিৰ্ভয়ে সত্য কথা বলতে না পারো, প্রয়োজন হলেই চাকরি ছেড়ে দেবার সঙ্গতি না থাকে, তাহলে বুঝবো চাকরি করার জন্য তুমি পাস করছে।

মনের স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে না পারলে তোমাতে ও পশুতে প্ৰভেদ থাকবে। না- জীবন তোমার মিথ্যা হবে। স্বাধীন হৃদয় সত্যের সেবক। কামার হও, সে-ও ভাল-নিজেকে যন্ত্র করে ফেল না।

সৎ জ্ঞানী ও মহৎ যিনি তিনি নিজেকে ব্যক্তিত্বহীন করতে ভয়ঙ্কর লজ্জা বোধ করেন— তিনি তাতে পাপ বোধ করেন।

চাকরি করে অন্যায়ভাবে পয়সা রোজগার করে ধনী হবার লোভ রাখ? তোমার চেয়ে মুদি ভাল। মুন্দির পয়সা পবিত্র।

অনেক যুবক থাকতে পারে, যারা কোন রকম একটা চাকরি সংগ্রহ করে সমাজের ভিতরে আসন প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই হলো! চুরির সাহায্যেই হোক বা অসৎ উপায় অবলম্বন করেই হোক, ক্ষতি নাই।

চরিত্র তোমার নিষ্কলঙ্ক। সামান্য কাজ করে পয়সা উপায় করে তাতে জাত যাবে না। চোর-অন্যায়ের সাহায্যে যে বাঁচতে চেষ্টা করে, তারই জাত যায়। অসৎ উপায়ে পয়সা উপার্জন করো না, মিথ্যার আশ্রয় নিও না। লোককে বিপদে ফেলে অর্থ সংগ্ৰহ করতে তুমি ঘৃণা বোধ করে!

ইউরোপের জ্ঞানীগুরু প্লেটো মিশর ভ্ৰমণকালে মাথায় করে তেল বেচে রাস্তা খরচ জোগাড় করতেন। যে কুড়ে, আসলে, ঘুষখের ও চোর, সে-ই হীন। ব্যবসা বা ছোট স্বাধীন কাজে মানুষ হীন হয় না, হীন হয় মিথ্যা, চতুরতা ও প্ৰবঞ্চনায়। পাছে জাত যায়, সম্মান নষ্ট হয়-এই ভয়ে পরের গলগ্রহ হয়ে মাসের পর মাস কাটিয়ে দিচ্ছে? সম্মান কোথায়, তা তুমি ঠিক পাওনি?

সৎ উপায়ে যে পয়সা উপার্জন করা যায়। তাতে তোমার আত্মার পতন হবে না। তোমার আত্মার পতন হবে। আলস্য ও অসাধুতায়। তোমারই স্পর্শে কাজ গৌরবময় হবে।

আমার দেশের লোক যেমন আজকাল বিলেতে যায়, এককালে তেমনি করে বিলেতের লোক গ্ৰীক ভ্ৰমণে যেতো।

বিলেত ফেরত লোককে কেউ ইট টেনে বা কুলির কাজ করে পয়সা করতে দেখেছে? বিলেতের পণ্ডিত দেশ ভ্ৰমণ দ্বারা অগাধ জ্ঞান অর্জন করেছিলগ্ৰীক-দেশ থেকে ফিরে এসে তিনি আরম্ভ করলেন এমন কাজ, যা তুমি আমি করতে লজা বোধ করবো। তাতে তাঁর জাত গিয়েছিল না। যার মধ্যে জ্ঞান ও গুণ আছে, সে কয়দিন নীচে পড়ে থাকে? লোক তাকে সম্মান করে উপরে টেনে তোলেই।

কাজে মানুষের জাত যায় না-এটা বিশ্বাস করতে হবে। কাজ হীন হয় ঐ সময় যখন কাজের ভিতর অসাধুতা প্রবেশ করে, আর কোন সময়ই নয়।

বিশ্ব-সভ্যতার এত দান তুমি ভোগ করছে—এসব কি করে হলো? হাতের সাহায্যে নয় কি? কাজ-কামকে খেলা মনে করলে চলবে না। মিন্ত্রীর হাতুড়ির আঘাত, কামারের কপালের ঘাম, কুলীর কোদালকে শ্রদ্ধার চোখে দেখো।

অনেকে বলে, তাদের জন্য কোন কাজ নাই। যে কাজই তারা করুক, যে দিকেই তারা হাঁটুক-কেবলই ব্যর্থতা। মুর্থ যারা তারাই একথা বলে। তাদের এ ব্যর্থতার জন্য তারা নিজেরাই দায়ী। এই নৈরাশ্যের হা-হুতাশ তাদেরই অমনোযোগ আর কুড়েমির ফল।

ডাক্তার জনসন মাত্র কয় আনা পয়সা দিয়ে লন্ডনের মত শহরে যেতে উপস্থিত হয়েছিলেন, অথচ তিনি কারো কাছে কোন কালে হাত পাতেননি। এক বন্ধু তাঁকে এক সময় একজোড়া জুতো দিয়েছিলেন, অপমান করে তিনি জুতো পথে ফেলে দিয়েছিলেন। উদ্যম, পরিশ্রম ও চেষ্টার সামনে সব বাধাই জল হয়ে যায়। গুণ যার মধ্যে আছে, যে ব্যক্তি পরিশ্রমী, তাঁর দুঃখ নাই। জনসনকে অনেক সময় রাত্ৰিতে না খেয়ে শুয়ে থাকতে হতো, তাতে তিনি কোনদিন কষ্ট, ব্যথিত বা হতাশ হন নাই। বাধাকে চূর্ণ করে বীরপুরুষের মত তিনি যে নীতি রেখে গিয়েছেন, তা অনেক পণ্ডিতই পারবেন না।

গুণ থাকলেও চেষ্টা না করলে জগতে প্ৰতিষ্ঠা লাভ করা যায় না। আরভিং সাহেব বলেছেন, চুপ করে বসে থাকলে কাজ হবে না।

চেষ্টা কর—নাড়াচাড়া কর— এমন কি কিছু নারী ভিতর কিছু ফলাতে পারবে। কুকুরের মতো চীৎকার কার-সিংহ হয়েও ঘুমিয়ে থাকলে কি লাভ?

পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছ—তারপর মনে হচ্ছে তোমার মূল্য এক পয়সা নয়। জিজ্ঞাসা করি, কেন? জান না, এ জগতে যারা নিতান্ত আনাড়ী তারা মাসে হাজার হাজার টাকা উপায় করছে?

তোমার এই মর্মবেদনা ও দুঃখের কারণ, তুমি মুর্থ। মানুষ বালিতে সোনা ফলাতে পারে, এ তুমি বিশ্বাস করো না? তুমি কুড়ে— তোমার উদ্যম নেই— তুমি একটা আত্মপ্ৰত্যয়হীন অভাগা।

কাজ ছোট হোক বড় হোক, মন প্ৰাণ দিয়ে করবে। মূল্যহীন বন্ধুগণের লজ্জায় কাজকে ঘৃণা করো না। সকল দিকে, সকল রকমে তোমার কাজ যাতে সুন্দর হয় তার চেষ্টা করবে।

ফকস সাহেবকে এক সময়ে এক ভদ্রলোক বলেছিলেন, আপনার লেখা ভাল নয়। কাজের চারুতার প্রতি তাঁর এত নজর ছিল যে, তিনি সেই দিন হতে স্কুলের বালকের ন্যায় লেখাপড়া আরম্ভ করলেন এবং অল্পকালের মধ্যে তার লেখা চমৎকার হয়ে গেল।

উন্নতির কারণ হচ্ছে দৃষ্টি ও মনােযোগ। এক ভদ্রলোকের খানিক জমি ছিল। জমিতে লাভ তো হতোই না, বরং দিন দিন তার ক্ষতি হচ্ছিল। নিরুপায় হয়ে নামমাত্র টাকা নিয়ে তিনি এক ব্যক্তিকে জমিগুলি ইজারা দিলেন। কয়েক বছর শেষে ইজারাদার একদিন ভূ-স্বামীকে বললেন, যদি জমিগুলি বিক্রয় করেন। তাহলে আমাকেই দেবেন, আপনার কৃপায় এই কয় বছরে আমি অনেক টাকা জমা করতে সক্ষম হয়েছি। ভূ-স্বামী অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এত বছরের ভিতর যে জমিতে আমি একটা পয়সা উপায় করতে পারিনি, সেই জমি তুমি মাত্র কয়েক বছর চাষ করেই খরিদ করতে সাহস করছো? সে বললে, আপনার মতো অমনােযোগী ও বাবু আমি নই। পরিশ্রম ছাড়া আমি আর কিছুই জানি না। বেলা দশটা পর্যন্ত ঘুমানো আমার অভ্যাস নাই।

এক যুবক স্কট সাহেবের কাছে কিছু উপদেশ চেয়েছিল, যুবককে তিনি এই উপদেশটি দেন– কুড়েমি করো না, যা করবার তা এখনই আরম্ভ করো। বিশ্রাম যদি করতে হয় কাজ সেরে করবে।

সময়ের যারা সদ্ব্যবহার করে, তারা জিতবেই। সময়ই টাকা, সময় টাকার চেয়েও বেশী। জীবনকে উন্নত করো, কাজ করো, জ্ঞান অর্জন করো। চরিত্রকে ঠিক করে বসে। থেকে না! কৃপণের মতো সময়ের কাছ থেকে তোমার পাওনা বুঝে নাও। এক ঘণ্টা করে প্রতিদিন নষ্ট করো, বৎসর শেষে গুণে দেখো অবহেলায় কত কত সময় নষ্ট হয়েছে।

একঘণ্টা করে মাসে কত কাজ তোমার হয়েছে। তোমার কাজ দেখে তুমি নিজেই বিস্মিত হবে। প্রতিদিন তোমার চিস্তা একখানা কাগজে বেশী নয়, দশ লাইন করে রাখি, দেখবে, বছর শেষে তুমি একখানা সুচিস্তিত চমৎকার বই লিখে ফেলেছ। জীবনের ব্যবহার করো, দেখবে মৃত্যু তোমার কীর্তির নিশান উড়িয়ে দিয়েছে। জীবন আলস্যে, বিনা কাজে কাটিয়ে দাও, মৃত্যুকালে মনে হবে জীবনে তোমার একটা মিথ্যা অভিনয় ছাড়া আর কিছু হয় নাই—একটা সীমাহীন দুঃখ ও হাহুতশের সমষ্টি। জীবনশেষে যদি বলে, জীবনে কি করলাম? কিছু হলো না”—তাতে কি লাভ হবে? কাজের প্রারম্ভে ভেবে নাও, তুমি কোন কাজের উপযোগী, জগতে কোন কাজ করবার জন্যে তুমি তৈরী হয়েছ-কোন কাজে তোমার আত্মা তৃপ্তি লাভ করে।

সাধুতা ও সত্যের ভিতর দিয়ে যেমন উন্নতি লাভ করা যায়, এমন আর কিছুতে নয়। সত্য এবং সাধুতাকে লক্ষ্য রেখে ব্যবসা করো, তোমার উন্নতি অবশ্যম্ভাবী ৷ জুয়াচুরি করে দুদিনের জন্য তুমি লাভবান হতে পারো, সে লাভ দুদিনের। জগতে যে সমস্ত মানুষ ব্যবসায়ে উন্নতি করেছেন তাদের কাজ-কামে কখনো মিথ্যা-জুয়োচুরি ছিল না। ব্যবসা ভাল কাজ-এর ভিতর অমর্যাদার কিছু নাই। আগৌরব হয়। হীন পরাধীনতায়, মিথ্যা ও অসাধুতায়।

এক ব্যক্তি মুদি জীবনের লজ্জা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছিল। মারার আগে একখানা কাগজে লিখে রেখে গিয়েছিলো—এ ইন জীবন আমার পক্ষে অসহনীয়। তাঁর মৃত্যুতে আমাদের মনে কোন দয়ার উদ্রেক হয় না। লোকটি এত হীন। ছোট ছিল যে, তার মুদি হয়ে বাঁচবার অধিকার ছিল না। কাজ-কাম বা ব্যবসাতে অগৌরব নাই। ঢাকার সুপ্ৰসিদ্ধ নবাব বংশের নাম পূর্ববঙ্গে প্ৰসিদ্ধ। এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা আলিমউল্লা ছিলেন। একজন ব্যবসায়ী। জাতির কল্যাণ হয় ব্যবসার ভিতর দিয়ে। ব্যবসাকে যে শ্ৰদ্ধার চোখে দেখে না, সে মুর্থ। ইংরেজ জাতির এই গৌরব-গরিমার এক কারণ ব্যবসা। ব্যবসা না করলে তারা এত বড় হতে পারত না।

যে জিনিস নিজে কিনলে ঠিকেছ বলে মনে হলো, সে জিনিস ক্রেতাকে কখনও দিও না। কখনও অভিজ্ঞ ক্রেতাকে ঠকিও না। হয়ত মনে হবে তোমার লোকসান হলো, কিন্তু না— অপেক্ষা কর তোমার সাধুতা ও সুনাম ছড়াতে দাও, লোকসানের দাশগুণ এতে তোমার পকেটে ভর্তি হবে।

ব্যবসার ভিতর সাধুতা রক্ষা করে কাজ করায় অনেকখানি মনুষ্যত্বের দরকার হয়। যে ব্যবসায়ী লোভ সংবরণ করে নিজের সুনামকে বাঁচিয়ে রাখে। সে কম মহত্ত্বের পরিচয় দেয় না। মিষ্ট ও সহিষ্ণু ব্যবহার, ভদ্রতা এবং অল্পলাভের ইচ্ছা তোমার ব্যবসায়ী জীবনকে সফল করবে।

চাকরি, চাকরি-অনবরত চাকরির লোভে যুবকেরা সোনার শক্তিভরা জীবনকে দুয়ারে দুয়ারে বিড়ম্বিত করে দিচ্ছে। মিস্ত্রী, কামার, দরজী এরা কি সত্যিই নিম্নস্তরের লোক? অশিক্ষিত বলেই সভ্য সমাজে এদের স্থান নাই? যা তুমি সামান্য বলে অবহেলা করছ, তা কতখানি জ্ঞান, চিন্তা ও সাধনার ফল তা কি ভেবে দেখেছি? শিক্ষিত ব্যক্তি যে কোন কাজ করুক না কেন, তার সম্মান ও অর্থ দুই-ই লাভ হবে। আত্মার অফুরন্ত শক্তিকে মানুষের কৃপাপ্রার্থী হয়ে ব্যর্থ করে দিও না।

১১. চরিত্র ও চরিত্র-শক্তি

রায় নরেন্দ্রনাথ সেন বলতেন, ‘এশিয়া আধ্যাত্মিকতায় ইউরোপ অপেক্ষা শ্ৰেষ্ঠ। ইউরোপ এশিয়ার কাছে আধ্যাত্মিকতা শিখুন—” এ কথার অর্থ আমি এখনও বুঝি না। জ্ঞান, চরিত্র, মনুষ্যত্ব ও কর্ম ছাড়া যদি আধ্যাতিকতা স্বতন্ত্র জিনিস হয়, তবে সে আধ্যাত্মিকতায় কোন কাজে নেই।

মানুষের মূল্য কোথায়? চরিত্র, মনুষ্যত্ত্ব ও কর্মে। বস্তুত চরিত্র বললেই মানুষের জীবনের যা কিছু শ্রেষ্ঠতা বুঝতে হবে। চরিত্র ছাড়া মানুষের গৌরব করবার আর কিছুই নাই। মানুষের শ্রদ্ধা যদি মানুষের প্রাপ্য হয়, মানুষ যদি মানুষকে শ্রদ্ধা করে তবে সে শুধু চরিত্রের জন্য। অন্য কোন কারণে মানুষের মাথা মানুষের সামনে নত হবার দরকার নাই।

জগতে যে সমস্ত মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করেছেন, তাদের গৌরবের মূল এই চরিত্র-শক্তি। তুমি চরিত্রবান লোক, এ কথার অর্থ এ নয় যে, তুমি লম্পট নাও। তুমি সত্যবাদী, বিনয়ী এবং জ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করা। তুমি পরদুঃখকাতর, ন্যায়বান এবং ন্যায্য স্বাধীনতা ও ব্যক্তিত্বকে অস্বীকার করতে লজা বোধ করা।

চরিত্রবান অর্থ এও নয় যে, তুমি বোকা-কারো সঙ্গে কথা বল না। মানুষের দিকে চেয়ে সাহসের সঙ্গে কথা বলতে তোমার ভয় হয়। চরিত্রবান সব সময়েই সাহসী ও নির্ভীক। মানুষ অপেক্ষা নিজের অন্তর্নিহিত সুবুদ্ধি বা বিবেককে সে বেশী ভয় করে। নিজের কাজ ও কথার উপর সে সব সময় দৃষ্টি রাখে। মানুষ তার অপরাধের কথা না জানলেও সে নিজেই তার অপরাধের জন্য লজ্জিত হয়। চরিত্রবান ব্যক্তি অত্যাচারী বা তস্করকে সম্মান দেখাতে লজা বোধ করে। সাধু সত্যবাদীই তার সম্মানের পাত্ৰ। সে সর্বদাই আত্ম-মর্যাদা জ্ঞানসম্পন্ন।

তুমি চরিত্রবান হবে। জীবনের সকল লক্ষ্যের উপর হবে তোমার লক্ষ্যচরিত্রবান হবার দিকে। নিজের মনকে শাসন করবার দিকে, মিথ্যা ও পাপের বিরুদ্ধে আত্মাকে বিদ্রোহ করে তোেলবার দিকে, মানুষের মহত্ত্বই এইস্থানে। এছাড়া পৃথিবীতে আর কি আছে, যার জন্য মানুষের জীবনের আবশ্যকতাও হতে পারে?

টাকা-কড়ি, অর্থ-সম্পদ জীবনের উদ্দেশ্য নয়। অন্যায় ও মিথ্যার উপর যে সম্পদের ভিত্তি সে অর্থ তুমি ঘৃণায় বন-জঙ্গলে ফেলে দাও-আঁখি তোমার সেখানে ক্ৰোধে রক্তময় হোক।

চরিত্রবানই সম্মানী। সে-ই মানুষের শ্রদ্ধার পাত্ৰ-সে ভদ্রলোক, জ্ঞানী, কমী, সত্যবাদী মানুষই ভদ্রলোক আর কেহ নয়।

বাড়ীতে দালান মানুষকে অপমান করে, তুমি তোমার গৌরব প্রচার করা। তোমার বাপ নবাবী আমলে বিচারক (কাষী) ছিলেন। সেই খাতিরে তুমি নিজেকে ভদ্রলোক বলতে পার না।

তুমি কি সত্যনিষ্ঠ? তুমি কি মানুষের নিন্দা করতে ঘৃণা বোধ করা? তুমি কি আত্মাকে কলঙ্কিত করতে লজ্জা বোধ করা। তুমি অন্যায়ের শক্র? তুমি নিত্যনতুন জ্ঞান লাভ করতে সচেষ্ট? মানুষের সঙ্গে তোমার ব্যবহার সদাই মধুর। নিজে যা, তাই হয়ে প্রকাশ হতে তোমার সঙ্কোচ হয় না? আমি তোমায় নমস্কার করি, তোমার পিতার নাম জিজ্ঞাসা করতে চাই না, তোমার মহত্ত্বকে আমি শ্রদ্ধা করি।

এক যুবক একদিন এক ট্রাক চালকের হাতে একটা সিকি দিয়ে টিকিট আর দুই আনা ফেরত চাইলেন। তখন চালক তাকে দু’আনার পরিবর্তে চৌদ্দ পয়সা দিয়ে বললে, আপনি নেমে যান।

যুবক বললেন— আমি আমার হাতকে কলঙ্কিত করতে চাই না, এই নাও তোমার বাকী পয়সা। তুমি সব চুরি করো, আমি এক পয়সাও নিতে পারি না।

চরিত্রবান ব্যক্তি যে, সে এমন করে মিথ্যা ও নীচতার প্রতি ঘৃণা পোষণ করে। মানুষকে ফাঁকি দিতে পেরেছ বলে নিজেকে চতুর মনে করো না। টিকিট না কিনে রেলে ভ্ৰমণ করতে সক্ষম যদি হয়ে থাক, তবে নিজেকে খুব হীনই মনে কর। গার্ড সাহেব তোমাকে দেখে নাই, কিন্তু বিবেক তোমার ভিতরে বসে তোমার এই নীচতা দেখে অবাক হয়েছে।

লোককে ফাঁকি দিয়ে পয়সা উপায় করে তুমি জানিয়ে দিয়েছ তুমি তস্কর। কর্তব্যকে অবহেলা করে নীচের মতো তুমি মানুষের পয়সা সংগ্রহ করেছ, বুঝবো তুমি নীচ। ঘুষের পয়সা দিয়ে ধর্ম উৎসব করে আত্মপ্রসাদ লাভ করছ? তোমার বিবেক ভিতর হতে হেসে বলছে, তস্করের ধর্ম কার্যের কোন মূল্য নাই।

মধ্যযুগে ইউরোপে নাইট নামে এক সম্পপ্রদায় ছিল। তারা দুস্থ ও অত্যাচারিত মানুষের সেবা করার জন্য দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতেন। পীড়িত রমণী জাতির সম্মান রক্ষার্থে তারা প্রয়োজন হলে জীবন পর্যন্ত দান করতেন। ন্যায় ও সত্য ছাড়া আর কিছু জানতেন না। দেশে দেশে ঘুরে বেড়ান বাদ দিয়ে দুস্থ মানুষের দুঃখ মোচনে, চরিত্রবান ব্যক্তি নাইট ছাড়া আর কিছু নয়। চরিত্রকে নিষ্কলঙ্ক করে রাখা, জীবনকে সত্যপরায়ণতা, ভদ্রতা, ন্যায়বান ও নৈতিক শক্তি দিয়ে অলস্কৃত করে রাখা হোক তোমার ব্ৰত। লোভ তোমাকে তোমার সৎ পথ হতে আকর্ষণ করতে পারবে না। তোমার দুর্জয় চরিত্রবলের সম্মুখে পাপ, নীচতা ও দুর্বলতা চুৰ্ণ হয়ে যাবে, তবেই হবে তুমি খাটি ভদ্রলোক।

চরিত্র, চিন্তা ও জীবন যার উন্নত, যিনি সর্বাংশ নিৰ্মল, উচ্চ মানবতা যার লক্ষ্য, তিনিই ভদ্রলোক।

নিম্নলিখিত গল্পে একটা আশ্চর্য উন্নত চরিত্র মাহাত্ম্য প্ৰকাশ পেয়েছে। স্পেনে এক ভদ্রলোকের বাড়ীতে এক সন্ধ্যায় এক ব্যক্তি এসে কাতর কণ্ঠে করতে আসছে। এখনই তারা আসবে।” ভদ্রলোক ব্যথিত অথচ ক্ষিপ্ৰকণ্ঠে বললেন— আপনি আর এক মুহুৰ্তও দেরি করবেন না। ভিতরে আসুন।

পরদিন প্ৰাতঃকালে গৃহস্বামী একটা অশ্ব আর একখানি তরবারী এনে অতিথিকে অত্যন্ত বিস্মিত করে বললেন— ভ্ৰাতঃ! এই নাও তরবারি। আর এই ঘোড়া। তোমাকে এই দণ্ডে পালাতে হবে। আমার ছেলেকে তুমি গতকাল হত্যা করেছি। তুমি বিপন্ন হয়ে আমার কাছে এসেছিলে, আমি তোমার রক্ষা ছাড়া ক্ষতি করতে পারি না। তবুও পিতা যখন আমি, আমার মধ্যে দুর্বলতা আসতে পারে— তুমি এই দণ্ডেই পালাও, প্ৰভাত হয়েছে।

চরিত্র যার উন্নত— যিনি ভদ্রলোক, যিনি বোঝেন সম্মান তার কোন জায়গায় নষ্ট হবে। তিনি সম্মানহানির ভয়ে মহত্ত্বের পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করেন না। সম্মান কোথায় এবং কিসে হয়- তাঁর ভাল করে জানা আছে। সিসিলি ও নেপলস দ্বীপের রাজা পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। পথে একটা লোক একটা বোঝা সামনে নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। কত লোক সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিল, কেউ সম্মানহানির ভয়ে বোঝাটি লোকটির মাথায় তুলে দিল না। সম্রাট নিজ হাতে বোঝাটি বেচারার মাথায় তুলে দিয়ে আত্মপ্ৰসাদ লাভ করলেন। যারা পথ দিয়ে যাচ্ছিল। আর সেই নিরুপায় লোকটির দিকে উদাসীন দৃষ্টি নিক্ষেপ করছিল, তাদেরই সম্মানহানি হয়েছিল।

ঘৰ্মাক্ত কলেবরে তোমার পার্শ্বে এসে একটি লোক দাঁড়ালো। হোক ছোট, তাকে দেখে তুমি কি উঠে দাঁড়িয়ে তোমার চেয়ারখানি ছেড়ে দেবে না? তাতেই যে তোমার মহত্ত্ব, এ তোমার মনুষ্যত্ব কি শিক্ষা দেয় নাই? ধর্ম যে মনুষ্যত্বেরই আর এক নাম।

অপরের জন্য তুমি তোমার প্রাণ দাও- আমি বলতে চাইনে। অপরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুঃখ তুমি দূর কর, অপরকে একটুখানি সুখ দাও। অপরের সঙ্গে একটুখানি মিষ্ট কথা বলা পথের অসহায় মানুষটির দিকে একটি করুণ কটাক্ষ নিক্ষেপ কর- তাহলেই অনেক হবে।

ছোটলোকের ভিতর অনেক সময় আমরা যে মহত্ত্ব দেখি, তাতে মন আমাদের ভাবে মুগ্ধ হয়ে যায়। পর্যটক পার্ক সাহেব এক সময়ে আফ্রিকায় অত্যন্ত ক্লান্ত ও ক্ষুধিত হয়ে এক গাছের তলায় বসেছিলেন। অনেক জায়গায় তিনি আশ্রয় চেয়েছিলেন, কিন্তু কেউ তাকে আশ্রয় দিয়েছিল না, তখন সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। পার্ক নিরুপায় হয়ে ভাবছিলেন, ক্ষুধার ক্লান্তিতে অথবা বাঘ-ভালুকের হাতে তাকে সেই অজানা দেশে প্ৰাণ হারাতে হবে। এমন সময় এক দরিদ্র অসভ্য রমণী এসে তাকে বললে–আপনাকে একজন ক্লাস্ত পথিক বলে মনে হচ্ছে, আমাদের ছোট কুটিরখানিতে আপনি আসুন। দরিদ্রের আহার দিয়ে আপনাকে তুষ্ট করবো। অসহায় পর্যটক এই বর্বর রমণীর আতিথ্যে জীবন লাভ করেন।

পার্কের সঙ্গে কিছু ছিল না। গায়ের কোটে মাত্র চারটা রুপার বোতাম ছিল। বিদায় নেবার সময় তারই দুটো খুলে দিয়ে তিনি রমণীর মহত্ত্ব ও মনুষ্যত্বকে পুরস্কৃত করলেন।

চরিত্রবান মনুষ্যত্ত্ব-সম্পন্ন মানুষ নিজের চেয়ে পরের অভাবে বেশী অধীর হন। পরের দুঃখের কাছে নিজের দুঃখকে ঢেকে রাখতে গৌরব বোধ করেন। এক সময় এক যুবক অভাবগ্ৰস্ত হয়ে এক ভদ্রলোকের কাছে চাকরি প্রার্থনা করেন। এই ভদ্রলোকের একজন মানুষ দরকার হয়েছিল। নিয়োগকালে যুবক দেখলেন, আরও এক যুবক সেখানে উপস্থিত হয়েছেন। কথায় কথায় প্রথম যুবক যখন জানতে পারলেন, তাঁর নতুন বন্ধুটির অভাব তার চেয়েও বেশী, তখন তিনি নিজের অভাবকে গোপন করে বললেন, তার চাকরির কোন দরকার নাই। শেষের যুবকটিই নিযুক্ত হলেন।

চরিত্রবান ব্যক্তি মানুষ অপেক্ষা ন্যায়কে অধিক শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। ন্যায় ও সত্যের জন্য তিনি যে কোন বিপদ মাথায় নিতে সম্মত হন। অর্থ সম্পদ, আত্মীয়-বন্ধু সব পরিত্যাগ করতে পারেন, তবু নিজের বিবেকের বাণীকে অমান্য করতে পারেন না। কাজী গিয়াস উদ্দিন সম্রাটের ভীতিকে উপহাসের চাঃেখে৷ দেখেছিলেন। রাজা চতুর্থ হেনরীর পুত্র যখন তাঁর অপরাধী বন্ধুর জন্য জজের উপর ঘুষি উঠিয়ে বললেন— জজ, আমার বন্ধুকে ছেড়ে দাও। ন্যায়পরায়ণ জজ রাজকুমারের কথায় কৰ্ণপাত করলেন না। নির্ভীকচিত্তে তিনি তার কর্মচারীকে হুকুম দিলেন-ন্যায়দণ্ড বিধানের অবমাননাকারী রাজকুমারকে জেলে নিয়ে যাও।]

নিজেকে উন্নত ও চরিত্রবান করার উপায় কি? এর জন্য সাধনা চাই। তুমি হয়তো মিথ্যা কথা বলতে অভ্যস্ত। কেমন করে হাসি কথার মধ্যে মিথ্যা বল, তা বুঝতে পার না। হঠাৎ যদি প্ৰতিজ্ঞা করে বাস-পরের দিন থেকে একদম মিথ্যা কথা বলবে না, প্ৰতিজ্ঞা রাখতে পারবে না।

অভ্যাস ভয়ানক জিনিস- একে হঠাৎ স্বভাব থেকে তুলে ফেলা কঠিন। মানুষ হবার সাধনাতেও তোমাকে ধীর ও সহিষ্ণু হতে হবে। সত্যবাদী হতে চাও? তাহলে ঠিক কর— সপ্তাহে অন্তত একদিন তুমি মিথ্যা কথা বলবে না। ছ’মাস ধরে নিজেকে সত্যকথা বলতে অভ্যস্ত কর, তারপর এক শুভদিনে আর একবার প্রতিজ্ঞা কর, সপ্তাহে দুদিন তুমি মিথ্যা কথা বলবে না। এক বছর পরে দেখবে, সত্যকথা বলা তোমার কাছে অনেকটা সহজ হয়ে পড়েছে। সাধনা করতে করতে এমন এক দিন আসবে তখন ইচ্ছা করেও মিথ্যা বলতে পারবে না। নিজেকে মানুষ করবার চেষ্টায় পাপ ও প্রবৃত্তির সংগ্রামে হঠাৎ জয়ী হতে কখনো ইচ্ছা করো না–তাহলে সব পণ্ড হবে।

তুমি হয়ত বড় বাচাল— পাগলের মতো বকতে অভ্যস্ত। আস্তে আস্তে অল্প কথা বলতে অভ্যাস করা। যে-কোন সৎগুণই লাভ করতে চাও না কেন, তাড়াতাড়ি করো না। হঠাৎ তুমি মহাপুরুষ হবে, এ অসম্ভব। চিত্তকে শাসনে আনা বড় ভয়ানক কথা। ধীরে ধীরে তুমি নিজেকে উন্নতির পথে টেনে তোেল। সাধনায় হতাশ হয়ে না, পুনঃপুন চেষ্টা কর, জয়ী হবে। সাধনায় অনেকবার তুমি পদম্মলিত হবে-কিন্তু ভয় পেয়ো না।

তোমার লোভ প্রবৃত্তিই খুব প্রবল অন্যের চেয়ে নিজের ভাগটাই তুমি বড় করে চাও। তাহলে এক কাজ কর-বড় খুঁয়ে ছোটকে গ্ৰহণ করতে চেষ্টা কর। লোভকে জয় করবার আর একটা পন্থা আছে। কোন প্রিয় জিনিসের খানিকটা না খেয়ে কোন শিশু, পশু-পক্ষী বা কুকুরকে দিতে অভ্যাস করবে। মাঝে মাঝে এই করো, তাহলে শুধু লোভ-প্রবৃত্তি দুর্বল হয়ে আসবে তা নয়, পরের সুখের জন্য নিজের কষ্ট স্বীকার করবার অভ্যাসও হবে। সাধনা ছাড়া চিত্তের উন্নতি স্বভাবের মহত্ত্ব লাভ করা যায় না। পরকে সুখ দিতে মন যখন বিরক্ত হবে না, তখনই তো তুমি মহাপুরুষ। এই ধরনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাধনা ও জয়ের উপর বড় বড় জয়ের ভিত্তি-এ যেন মনে থাকে।

মানুষ এক গালে চড় দিলে আর এক গাল ফিরিয়ে দেবে, এ আমি বলি না। যতটুকু ত্যাগ স্বীকার ভদ্রলোকদের পক্ষে সম্ভব, সেরূপ ত্যাগ স্বীকার করতে তুমি কখনও কুষ্ঠিত হয়ে না। শুধু ধৌত জামা পরে ও ইটের ঘরে মানুষকে নীচে বসিয়ে, তুমি ভদ্রলোক হতে চেষ্টা করো না। ভদ্রলোক হবার আরও পথ আছে।

ধীরে ধীরে আত্মাকে উন্নত করতে হবে। চিস্তা ও দৃষ্টির সাহায্যে তোমার সকল দোষ হতে তুমি মুক্ত হও। গুরুর আশীর্বাদ ও অনুগ্রহের কোন মূল্য নাই। তুমি তোমার শ্ৰেষ্ঠ গুরু। গুরু মানুষকে মুক্তি দেন না। মুক্তির মালিক তুমি— এ যদি না মানো, তাহলে বুঝবো তোমার আত্মার মৃত্যু হয়েছে। জাতি যখন অন্ধ হয়ে যায়। তখন তারা গুরুর নাম বেশী নেয়। নিজের আত্মাকে একেবারে অস্বীকার করে।

চরিত্রকে উন্নত করো—মিথ্যা, নীচতা, অন্যায় পরের ভাবের প্রতি অশ্রদ্ধা ও ঔদাসীন্য, অসভ্যতা, স্বার্থপরতা যাবে; ধাৰ্মিক ও সাধক কোন আশ্চর্য জীব নয়।

নীচ, স্বার্থপর, মুখ, চোর, পরের সুখ ও পয়সা অপহরণকারী, ঘুষখোর উপাসনা ও উপবাস করুক তাতে কোন লাভ নাই। পরমেশ্বর তোমাদের ভোলেন। না-তিনি চান। সত্য প্ৰাণ, তিনি চান মানুষ। শুধু উপাসনা করে মানুষ মুক্তি পাবে না। তাকে কমী ও পরদুঃখকাতর, জ্ঞানী ও দৃষ্টিসম্পন্ন, চিস্তাশীল ও যুক্তিবাদী মনুষ্যত্বসম্পন্ন এবং ন্যায়নিষ্ঠ হতে হবে। সে কখনও অন্ধের মতো ধর্ম পালন করবে না। পিতা রৌদ্রের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করতে নিষেধ করছেন-পিতৃআজ্ঞা লঙ্ঘন ভয়ে সুবোধ বালকের মতো অগ্নিদগ্ধ ঘরখানিকে রক্ষা করতে সঙ্কুচিত হয়ো না। আত্মার এই জ্ঞান মৃত্যু-জাতির পক্ষে সর্বনাশের কথা।

মানুষ যখন চরিত্রবান হয়, তখন তার ভিতর অজেয় পুণ্যশক্তির আবির্ভাব হয়। সে শক্তিকে দমিয়ে রাখা একেবারেই অসম্ভব। জাতির প্রত্যেক মানুষ যখন চরিত্রবান হয়, তখন তাদের শক্তি হয় অসাধারণ। দুর্জয় শক্তির আধারই চরিত্র। কখনো ভেবো না— মুখতার সঙ্গে চরিত্রের কোন যোগ আছে। লোকটি মুর্থ হলেও তার চরিত্র ভাল, একথা বলার কোন অর্থ নাই। মূর্থের আবার চরিত্র কি? নিরক্ষার মানুষের ভিতর যদি চরিত্রবান লোক দেখতে পাও, তাহলে মনে করো পুঁথির বিদ্যা সে পায় নাই— কিন্তু বিদ্যার উদ্দেশ্য যা, তা তার লাভ হয়েছে। না পড়েও সে বড়।

মুসলিম জাতি চরিত্রবলেই বড় হয়েছিল; এখন সে চরিত্রহীন— তাই সে নিম্নাসন গ্রহণ করছে। জ্ঞান, মনুষ্যত্ব, দৃষ্টি এসব গুণ যখন জাতির ভিতর দেখতে পাই তখনই তাকে বলি সভ্য ও বড়। পতিত জাতির সভ্যতা বিস্তারের অর্থ, মানুষকে উচ্চত্রজীবনে দীক্ষিত করা, উন্নতভাবে ভাবকরা–মানুষকে উদার চরিত্রবান ন্যায়ের সেবক করে তোলা।

১২. শারীরিক পরিশ্রম

এক স্কুলের প্রধান শিক্ষক চমৎকার ঘর তৈরী করতে পারতেন। এক সাহেবকে জানতাম, তিনি চেয়ার বেঞ্চ তৈরী করতে পারতেন।

সংসারের কাজগুলি যদি তুমি নিজের হাতে তৈরী করতে শেখ, তাহলে তোমার জীবনের গুণ বেড়ে যাবে।

হাতের কাজে যে অগৌরব নাই, এ আর বারে বারে বলে। লাভ কি? আগৌরব হয় মিথ্যায়। আর নীচতায়।

এক ব্যক্তি একদিন আমার কাছে গৌরব করে বলেছেন-আমি কোন দিন বাজারে যাই না। তিনি যে একজন অপদাৰ্থ ব্যক্তি, একথা তোমাকে বলে রাখছি।

বেড়ার বাঁধন ও ঘর ছাঁইতে জানা, ঝাড়ন, ঝাটা বঁধতে পারা, এসব জীবনের গুণ। কাজ জান না বলে তুমি যদি গৌরব কর, তাহলে বলবো তুমি একটা মুর্থ। সম্মান হয় কিসে? জ্ঞান, চরিত্র ও মনুষ্যত্ত্বে। সংসারের কাজ না জানার মধ্যে সম্মান নাই।

তুমি রান্না করতে জান না-তোমাকে কি সেজন্য বাহাদুর বলা হবে? তোমাকে কি বলা হবে-তোমার মতো ভদ্রলোক আর নাই?

তোমার অবস্থা খারাপ—তুমি সাধু, তুমি মহৎ, তুমি জ্ঞানী, তুমি সংসারের কাজ করতে লজা বোধ করা না-আমি তোমাকে হীন মনে করি না।

কোন এক স্কুলের ছাত্র ডিসেম্বর মাসে ধান কেটে যে পয়সা পেতো তা গরীব ছাত্ৰাদিগকে দান করতো। এ দৃষ্টান্ত কি খুব মহৎ নয়?

গ্রামের ভিতর এক দুঃখীর ঘর দিয়ে বর্ষার জল পড়ে—আহা! কি কষ্ট। তোমরা দশজন মিলে তার ঘরখানা যদি সেরে দাও, তাহলে তোমাদের সম্মান কমে যাবে না। কিন্তু তোমাদের সে দক্ষতা ও হৃদয়বল নাই।

মানুষকে পয়সা দিয়ে সাহায্য করা কি সব সময়ে সম্ভব? যদিও মৌখিক সহানুভূতির মূল্য এক পয়সা নয়।

মহৎ হতে চেষ্টা কর, অপদাৰ্থ মানুষকে অনুকরণ করে নিজের মনুষ্যত্বকে হীন করো না। শুধু অর্থ ও দালানের সামনে মাথা যেন নত না হয়।

একটা গল্প আছে, নবাবকে বন্দী করতে শক্ৰ আসছে, জুতো পরানোর লোক নাই বলে তিনি পালাতে পারলেন না। এই নবাবকে তুমি কি মনে করা?

একবার শুনেছিলাম, পঞ্চাশ-ষাটজন স্কুলের ছেলে কোদাল-কুড়ি নিয়ে একটা জলের খাল কাটছে। এ কথা যখনই আমি ভাবি, তখনই মনে আমার প্রভূত আনন্দের সঞ্চার হয়। জনৈক মহৎ প্ৰাণ ব্যক্তিকে কলকাতার কুলী-মজুর শ্রেণীর লোকের কাছে সুই, সুতা, চা বেচিতে দেখেছি। স্বভাবে তাঁর কিছুমাত্র অহঙ্কার নাই— আমি এঁকে শ্রদ্ধা করি।

যখন তুমি স্কুলের বালক, তখন পড়বার সঙ্গে সঙ্গে সংসারের অনেক কাজ শিখে রাখতে পার। ছোট একটা বাক্সে একটা হাতুড়ি, একটা বাটালি, একখানা করাত তোমার বইয়ের পাশে থাকলে কোন ক্ষতি নাই। বৈজ্ঞানিক নিউটন যখন বালক, তখন তার বইয়ের পাশে হাতুড়ি করাতের স্থান ছিল। পড়তে মন চায় না, হাতুড়ি নিয়ে কাজ কর। প্রতি রবিবারে তুমি বাড়ীতে যেয়ে একটু ছুতোরের কাজ শিখতে পার। তাতে তোমার সম্মানহানি হবে না।

অপদার্থ মানুষের সমালোচনাকে ভয় করবে। কারা? যারা চিরকাল ছোট হয়ে থাকবে।

তোমার বাড়ীর কাছে কামারের বাড়ী। ক্ষতি কি, যদি তুমি জেনে ফেলো কেমন করে তারা কোদাল তৈরী করে, কেমন করে পোড়ান লাল লোহার উপর হাতুড়ি পিটে তারা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বের করে।

রান্না করতে জানা, পুকুর হতে ঘড়া ভরে জল টানতে পারায় গৌরব ছাড়া আগৌরব নাই। পত্নীর অসুখ, চাকর আসে নাই বলে না খেয়ে ভদ্রলোক সাজতে যেয়ো না।

বাবুয়ানা করে চাকর-চাকরানীর উপর রান্নার ভার দেওয়াতে মর্যাদা নাই।

দাসী না রেখে নিজে কাজ চালান যদি সম্ভব হয়, তবে তাই ভাল। যার বাড়ীতে যত দাসী, সে তত ভদ্রলোক- এই বিশ্বাস অসভ্য জাতির মাথায়ই প্ৰবেশ করে।

সংসার-যাত্রা নির্বাহের জন্য যত প্রকার কাজ শেখা সম্ভব, সে সব শিখে রাখায় আদৌ অমর্যাদা নাই। সত্য ও মনুষ্যত্বের উপরই তোমার মর্যাদার ভিত্তিএকথা সব সময়ে যেন তোমার মনে থাকে। সংসারে চিন্তাশূন্য ব্যক্তিত্বহীন মানুষকে দেখে ভয় পেয়ে না। অপেক্ষা কর, মানুষ শেষে তোমাকেই অনুকরণ করবে।

১৩. কথার মূল্য— প্ৰতিজ্ঞা রক্ষা

মানুষের কথার যে একটা মূল্য আছে। এ কথা যথার্থ ভদ্রলোক ছাড়া তা আর কেউ ঠিক অনুভব করতে পারে না। তুমি কতখানি ভদ্রলোক তা তোমার বাক্যের মূল্য হতে বোঝা যাবে।

শ্ৰীরামের মতো পিতৃ-সত্য রক্ষা করবার জন্যে তুমি বনে না যেতে পার কিন্তু প্রতিদিনকার জীবনে তুমি কি তোমার ছোট ছোট বাক্যের মূল্যগুলি রক্ষা করতে পার না? তুমি কোন ভদ্রলোককে কথা দিয়েছ। আগামীকল্য ২টার সময় তার সঙ্গে দেখা করবে— ঠিক সেই সময় তোমাকে তার সঙ্গে দেখা করতে হবে, কেননা তুমি ভদ্রলোক, তোমার কথার একটা মৰ্যাদা আছে।

মুখ দিয়ে বলেছ, পাওনাদারকে অমুক দিন টাকা দেবে, সে ব্যক্তি দিনের পর দিন শুষ্ক-মুখে তোমার কৃপাপ্ৰাখী হয়ে দুয়ারে এসে ঘুরে যাচ্ছে, তুমি নিত্যনতুন প্ৰতিজ্ঞা করছে, তোমার মতো ভণ্ড কাপুরুষ আর নাই। যদি নিতান্ত রিক্তহস্ত হয়ে থাক, প্ৰকাশ্যভাবে তোমার কথা সাধারণের কাছে ঘোষণা কর, পাওনাদার যত ছোটই হোক, তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। সে তোমার কিছু করতে পারবে না। তা সত্য। অন্তত মানুষ। শুধু জানতে চায়—তুমি মিথ্যাবাদী নও।

সভ্য জাতি শুধু অট্টালিকা ও অর্থে হয় না। অট্টালিকা ও ধন-সম্পদের সঙ্গে আর একটা বড় জিনিস সভ্যতার পরিচয়, সেটি বাক্যের মূল্য।

যে বাক্যের মর্যাদা তুমি রক্ষা করতে পারবে না, সেরূপ কথা তুমি বলো না। কখনও জিহবার অমর্যাদা করো না। এর মতো কাপুরুষতা আর নাই।

যে সমস্ত কথায় অন্যায়ের সংস্রব আছে, সে সব কথা খুব কম বলাই ভাল—এর চেয়ে বাচালতা বরং উত্তম। বাচাল নিজে মূল্যহীন লোক, নিজের ক্ষতি সে নিজে করে। মিথ্যাবাদী, জিহবার অবমাননাকারীর মতো সে সমাজের সঙ্গে প্রতারণা করে না।

এক ইংরেজ ভদ্রলোককে এক দসু্যু বন্দী করেছিল। ইংরেজ পুরুষটি। দসু্যর দয়া ভিক্ষা করলে দসু্যু বললো— যদি বিশ্বাসঘাতকতা না করেন, যদি সরকারকে আমাদের সন্ধান না বলে দেন, তাহলে আপনাকে আপনার বাড়ীতে দিয়ে আসতে পারি। প্ৰত্যেক বন্দীকে হত্যা করাই আমাদের নিয়ম। সাহেব প্ৰতিজ্ঞা করলেন। কখনও তিনি দাসুর অনিষ্ট সাধন করবেন না। দসু্য ইংরেজকে নিয়ে রাত্রে তার বাড়ীতে উপস্থিত হলেন। ইংরেজ পুরুষটি গোপনে পুলিশকে সংবাদ দিয়ে দৗসুকে ধরিয়ে দিলেন। বললেন, দসু্যু সঙ্গে প্ৰতিজ্ঞার কোন মূল্য নাই।

সাহেব কাপুরুষতার পরিচয় দিয়েছিলেন নিশ্চয়। কথার মর্যাদা তোমার রাখতেই হবে। সকল দেশের জ্ঞানী ব্যক্তিগণ তাই অল্প কথা বলেন, অল্প প্ৰতিজ্ঞা করেন-কাজ করেন। অনেক।

১৪. উত্তপ্ত স্বভাব

অসহিষ্ণু হয়ে কথার উত্তর দেয়া, সামান্য কারণে উগ্র হয়ে উঠা বর্বর জাতির লক্ষণ। অতীত সভ্যতা, পুথি-লিখিত জ্ঞান-গৌরবের ভণ্ডামি কি উপকারে আসবে, যদি না প্রতিদিন জীবনের সর্ব কাজে মাধুরী, বিনয়, ভদ্রতা ফুটিয়ে তুলতে পারি?

আবার বলি—সহজে স্বভাবের ধীরতা নষ্ট করা, নিষ্ঠুর কথার উত্তরে ততোধিক নিষ্ঠুর কথা ব্যবহার করা, ভদ্রতা নয়, শান্ত হও। হত্যা করবার জন্য যে হস্ত উত্তোলিত হয়েছে, একবার নামাও, আবার চিন্তা কর।

বিরুদ্ধ মত শুনে যে উগ্র হয়ে উঠে-অকথ্য ভাষা প্রয়োগ করে, ক্ষমতা থাকলে প্রতিদ্বন্দীকে হত্যা করতে কুষ্ঠিত হয় না—সে বড় অসভ্য ও বর্বর।

যে জাতি মানুষের উপর অসহিষ্ণু শাসনের ব্যবস্থা করে, সে জাতির স্থান নিম্নে হবেই।

কি পল্লীগ্রামে, কি উচ্চ সমাজে, কখনও স্বভাবকে বলগামুক্ত করো না—সাবধান!

নিষ্ঠুর কথা বলতে, চোখ দুটিকে ক্ৰোধে খাড়া করে তুলতে কি তোমার লজা হয় না-এ যে নিম্নস্তরের লোকের কাজ!

যে জাতি সভ্য ও ভদ্রভাবে কথা বলতে জানে না, তারা অতি নীচ। তারা চিরকালই মানুষের মনুষ্যত্বের অশ্রদ্ধা লাভ করে।

প্রতি কাজে মানুষের কর্মজীবন ও উপাসনার পরিচয় পাওয়া যায়! এ তুমি বিশ্বাস করো।

যুবক বয়সে পরের দৃষ্টির উপর নিজের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে প্ৰাণের খুবই একটা লোভ জন্মে। —নিজের মহিমা ও মর্যাদা চারিদিকে পাত্ৰেঅপাত্রে ছড়িয়ে দেবার জন্যে মন সর্বদা সজাগ থাকে। আত্মার এই নীচ আকাজক্ষাকে সবলে চুৰ্ণ করে দিতে হবে।

যে সহিষ্ণু ও ধীর হতে শেখে নাই, তার ধাৰ্মিক লোক হবার কোন অধিকার নাই।

তুমি দোকানদার, তোমার কাছে ক্রেতা জিনিস কিনতে এসেছে-ক্রেতা যতই বিরক্ত করুক না কেন, কখনও অসহিষ্ণু হয়ে তার প্রতি ইতর ভাষা প্রয়োগ করো না, যদি তা কর তাহলে বুঝবো তুমি একটা কাপুরুষ। একটা বিরুদ্ধ কথা শোনা মাত্রই উগ্র হয়ে উঠো না, একটু অপমানে স্বভাবকে উত্তপ্ত করে তুলো না— অপেক্ষা কর, ধৈর্য অবলম্বন করা-তোমার বিনয়ের জয় আসছে।

১৫. আদর্শ–জীবন্ত আদর্শ

যা দেখি তাই করি। —যা শুনি তা করতে মন চায় না। কতকাল ধরে বইয়ে পড়ে আসছি, মিথ্যা কথা বলে না— তবুও তো এ বদভ্যাস গেল না। এটা যে বদভ্যাস তাও কোনদিন চিন্তা করি না।

একটা বালক তার মাকে দোষারোপ করেছিল— তুমি মিথ্যা বলছো, মিথ্যা বলছে। মা ঘৃণার সঙ্গে বলে উঠলেন—আমি এতো ছোট, মিথ্যা বলবো? বালক মায়ের ঘৃণাব্যঞ্জক মুখখানি দেখে ভােবল মিথ্যা তাহলে কত ছোট।

তুমি উপাসনা করো না-ভক্ত প্রেমিক মানুষের সঙ্গে থাক, খোদার সঙ্গে প্রেম করবার তোমারও প্রবৃত্তি হবে।

মহামানুষের জীবনী পড়— তোমার মহামানুষ হতে ইচ্ছা হবে। কতকাল আগে এক যুবক সীমাহীন কষ্টকে জয় করে, কত ব্যথা-বেদনার ভিতর দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন; যখনই তা তুমি জানতে পারলে তখন তোমার দুঃখ সাইবার শক্তি দ্বিগুণ হলো।

এক ব্যক্তি পথের আবর্জনা কুড়িয়ে রাখতেন— তেল কেনার পয়সা তাঁর জুটতো না। রাতের বেলা সেই আবর্জনায় আগুন ধরিয়ে তিনি বই পড়তেন। আর এক যুবক রাস্তার বাতির আলোতে বই পড়তেন। এ সব যখন তুমি শোন, তখন তোমার মনে কি শক্তি আসে না? তোমার ভাঙ্গা মন উৎসাহের দীপ্তিতে জ্বলে উঠে না?

মানুষের উপকার করা খুব ভাল। কথাটা যদি শুধু বইয়ে থাকত, তাহলে হয়ত অতি অল্প লোকই মানুষের উপকার করতো!

পোর্টস মাউথ শহরের এক মুচি পথের এক শিশুকে পয়সা দিয়ে লোভ দেখিয়ে তাঁর ছোট দোকানটিতে ডেকে এনে পড়াতেন। হীন দুৰ্ভাগ্য মানব সত্তানের কল্যাণ করে তিনি তৃপ্তি লাভ করতেন। এর নাম ছিল জন ফাউন্ডস। এই অজ্ঞাত মহাপুরুষের নিঃস্বাৰ্থ অতি বিস্ময়াবহ মানবসেবার কাহিনী যখন তুমি শোনো তখন তোমার মনে হয়ত একটু লজ্জা উপস্থিত হবে।

ফরাসী দেশের এক প্রদেশে এক সময়ে অত্যন্ত জলকষ্ট হয়েছিল। এইজন্য সেখানকার অধিবাসীদিগের কষ্টের সীমা ছিল না। বছরের পর বছর এইভাবে যাচ্ছিল। অথচ এই দুঃখের কোন প্ৰতিকারের আশা ছিল না।

ঐ প্রদেশে গেয়ো বলে একটা অসভ্য চপল স্বভাব যুবক বাস করতো। হাসি আর গানই ছিল তাঁর জীবন। একদিন হঠাৎ গ্রামবাসীরা দেখলো এই যুবক কি কারণে একটু বেশী গভীর ও বিষন্ন হয়েছে। এই চিন্তাশূন্য গেয়ো যুবক একদিন তার উল্লাস-আনন্দের ভিতর শুনেছিল অনেক টাকা-লক্ষ টাকা ব্যয় ছাড়া তার জন্মভূমির জলকষ্ট দূর হবার নয়। গা:েস্ট্রয়োর বালকচিত্তে সহসা প্রশ্ন জেগেছিল-সে কিছু করতে পারে না? এরপর সে কারো সঙ্গে বেশী কথা বলতো না। গেয়োর গাম্ভীৰ্য ভাব দেখে তার বন্ধুগণ অবাক হয়ে গেল।

কয়েক বছর অধ্যয়ন করে গেয়ো ব্যবসা আরম্ভ করলো। তারপর অনেক বছর কেটে গেলো। ব্যবসাতে তার ক্রমশঃ শ্ৰীবৃদ্ধি হতে লাগলো। ক্রমে ক্রমে বড় ধনী বলে গেয়োর নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। এত অর্থ হওয়া সত্ত্বেও গেয়ো পায়ে হেঁটে, ছেড়া কাপড় পরে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতালে। লোকে বলা আরম্ভ করলো, গেয়ো কৃপণ। এ অপবাদের কারণ যথেষ্ট ছিল। অর্থ বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে তার নীচ কৃপণতাও বেড়ে যেতে লাগলো। এমন কি, খরচের ভয়ে সে বিয়ে পর্যন্ত করলো না। এই পৈশাচিক জীবনের জন্য অনেকে তাকে ঘৃণা করা আরম্ভ করলো। কেউ কেউ তার নাম পর্যন্ত সকাল বেলা উচ্চারণ করতে সঙ্কোচ বোধ করতো— পাছে সেদিন তার আহার না জুটে।

গেঁয়োর গায়ে ছেলেরা থুথু দিত। সে যখন বৃদ্ধ তখন তার বিপুল অৰ্থ কোটি কোটি টাকা, কিন্তু কেউ তাঁকে সম্মান করতো না। তার মতো নরপিশাচ সে দেশে আর ছিল না।

গেঁয়োর যখন মৃত্যু হলো তখন লোকে দেখলো— সে একখানা উইল করে গিয়েছে। তাতে লেখা—জন্মভূমির জলকষ্ট নিবারণের জন্য আমি সারাজীবন অর্থ সংগ্রহ করেছি। জীবনে ব্রত করেছিলাম এই প্রদেশের জলকষ্ট দূর করবো। আমার সব টাকা এই উদ্দেশ্যে গভর্নমেন্টের হাতে দিয়ে গেলাম।

এই সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। মানুষ দলে দলে এই মহাপুরুষের মৃতদেহকে সম্মান জানাতে এলো। যারা তাকে ঘৃণা করতো, তারা আঁখিজলে গেয়োর পবিত্ৰ স্মৃতিকে পূজা করলো। এই নিঃস্বর্থ পরোপকারের কথা শুনে তোমার মন কি অবশ হয়ে উঠবে না? পথের ধারে একটা দরিদ্র কৃষক বোঝা নিয়ে বসে আছে। বোঝাটি তুলে দিলে তার উপকার করা হয়— তোমার ইচ্ছা হয় তা করতে, কিন্তু পার না-তোমার অপদাৰ্থ বন্ধুগণের উপহাসের ভয়ে। কারণ, তেমন কেউ করে না। মহাপুরুষদের সাদাসিধে সরলতাকে অনুকরণ করতে তোমার ইচ্ছা হয়, কিন্তু কাৰ্যক্ষেত্রে তা পার না। কারণ তোমার চারিদিকে তুমি দেখ, বিলাস-আড়ম্বরের ছড়াছড়ি। তোমার মনের বল চুৰ্ণ হয়ে যায়।

যখন দেখ, একজন শ্ৰেষ্ঠ মানুষ ছেড়া কাপড় পরে হাসিমুখে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে, তখন ছেড়া কাপড় পরতে তোমার লজ্জা হয় না, বরং গৌরব বোধ হয়! যখন জন্মগ্রহণ করে তখন সকল শিশুই নিম্পাপ ও নিষ্কলঙ্ক থাকে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কোন শিশু দেবতার প্রবৃত্তি লাভ করে, কোন শিশু পিতা-মাতার মতই শয়তান ও নরপিশাচ হয়। কে বলবে, হিন্দুর ছেলে কেন হিন্দু হয়, যা দেখে তাই শেখে।

মানব সেবার ন্যায় ধর্ম আর নাই। মুখে বলতে পারি এবং বলে থাকি। যখন দেখি, তুমি নগণ্য সংসারের এক কোণায় মানব-সন্তানকে শিক্ষিত ও জ্ঞানী করবার জন্যে খাটছ, তখম সম্ভ্রমে আমার মাথা তোমার সামনে নত হয়ে পড়ে। আমারও ইচ্ছা হয়, মানবের সেবায় জীবনকে ধন্য করি।

ঔপন্যাসিকেরা তাদের বইয়ে বড় বড় চরিত্র সৃষ্টি করেন, উদ্দেশ্য, সে সব কথা পড়ে তোমার মন উন্নত হবে। সেই সব আদর্শকে রক্ষা করে তোমার জীবনকে গঠন করতে চাইবে। উপন্যাসের মূল্য এইখানে। অতি বড় হতভাগাও উপন্যাস পড়ে মানুষ হয়। জীবনকে মহত্ত্বের পথে টেনে নেয়।

যুদ্ধে যাবার আহ্বান এসেছে, কেউ যাচ্ছে না। কে যুদ্ধক্ষেত্রে যেয়ে সহজে প্ৰাণ দেবে? জনসঙ্ঘ হতে একজন বললো, আমি যাবো-সঙ্গে সঙ্গে আরও কতকগুলি যুবক বলে উঠলো, আমরাও যাবো।

মেষের পাল তাড়িয়ে এক নদীকূলে যেয়ে দাঁড়িয়েছ। কত মারামারি করছ, তবু একটা মেষও জলে নামছে না। নদী পার না হলেও হবে না। হঠাৎ একটা মেষ জলের ভিতর লাফিয়ে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে এক এক করে সবগুলি মেষ জলের ভিতর লাফিয়ে পড়তে শুরু করলো।

মনে তোমার অনেক চিত্তা আছে, কিন্তু কাজ করতে পারছি না। কারণ, তুমি দেখা নাই কাউকে সেই কাজ করতে, যা তুমি করতে চাও! তুমি বুঝতে পােচ্ছ, এটা তোমার দুর্বলতা। তবুও তুমি পার না। কি বিস্ময়৷

ব্যবসা করা খুব ভাল। ছাড়, অর্থহীন চাকরিতে তোমার দুঃখ-বেদনা, অভাব-দৈন্য বেড়ে যাচ্ছে; কিন্তু তবু তুমি এর নাগপাশ ত্যাগ করে ব্যবসা করতে পার না। কারণ, তোমার বন্ধু-বান্ধবদের কেউ ব্যবসা করে তোমার সামনে দৃষ্টান্ত ধরে নাই।

দার্শনিক সক্রেটিসের মতো হাটের ভিতরে দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষকে সপ্তাহে সপ্তাহে মহত্ত্বের কথা বলতে তোমার ইচ্ছা হয়। প্রতি রবিবারে গ্রামের কৃষকদিগকে ডেকে এনে তাদের কাছে খবরের কাগজ পড়ে তাদের জীবনকে অপেক্ষাকৃত ভাল করতে তুমি চাও। তোমার কোন কাজ নেই, নিষ্কর্ম জীবনের ভার তোমার কাছে দুৰ্বহ হয়ে উঠেছে, তোমার ইচ্ছা হয়, প্রতিবেশী ছোটলোক, হীন লোকগুলোকে নিয়ে তুমি নৈতিক কথার আলোচনা কর, তাদের ছেলেগুলোকে ধরে এনে একটু একটু পড়াও, ভবিষ্যৎ জীবনে যাতে তারা অপেক্ষাকৃত ভাল হয়। কিন্তু তা তুমি পার না, কারণ কাউকে এসব কাজ করতে তুমি দেখা নাই। তোমার এই সব উন্নত ও মহৎ কল্পনা জল বুদবুদের মত মিথ্যা হয়ে যায়।

পুণ্য ও মহত্ত্বকে যেমন অনুকরণ করি, পাপ ও হীনতার স্পর্শে তেমনি হই। একদল বন্ধু ছিলেন। তাদের ভিতর পাপ কথার আলোচনা কোনকালে হতো না, তাদের জীবন মহৎ না। হলেও হীন ছিল না। মাঝে মাঝে ভাল কথার আলোচনাও তাদের মধ্যে হতো।

হঠাৎ এক লম্পট তাদের বন্ধু হয়ে দেখা দিলো। আশ্চর্য, কিছুদিনের ভিতর এই লম্পটের স্পর্শে এসে সবগুলি যুবক হীন ও নীচাশয় হয়ে গেল। হীন রমণীয় রূপযৌবন নিয়ে ছিলো তাদের সব সময়ের কথা।

তোমার পত্নী খুবই বিলাসিনী। হাতে হাঁড়ি ধরতে ঘৃণা বোধ করেন। দাসীতে যা রান্না করে তাই তিনি খান। পাছে সম্মান নষ্ট হয়, এই ভয়ে কোন কিছুর হিসাব নেন না। তিনি যদি সম্রাট নাসিরদিনের মহিষীর সরল জীবনকথা শোনেন, তাহলে তাঁর অহঙ্কার অনেক কমে যাবে।

মানুষ কি করে মানুষকে অনুকরণ করে প্রাণ পর্যন্ত দিতে যায়, তা নিম্নলিখিত গল্পে ফুটে উঠেছে। সমুদ্রে একবার ভয়ানক ঝড় হচ্ছিল। হঠাৎ এই ঝড়ের ভিতর একখানা জাহাজ ড়ুবে গেল, উপকূলের কাছেই।

কে যাবে যাত্রীদিগকে দেখে উদ্ধার করতে? উপকূলে অনেক লোক দাঁড়িয়েছিল। একজন একখানা বোট খুলে বললেন, কে যাবে আমার সঙ্গে। প্ৰাণ যদি দিতে হয়, কে তা দিতে আমাকে অনুসরণ করবে? আমনি একজন বললেন, আমি যাবো। সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক লোক বললে, আমরাও যাবো।

ঝড়ের ভিতর ডুবোজাহাজের যাত্রীদিগকে দেখে গ্রেস ডারলিঙ্গের পিতা দুঃখ করেছিলেন, ব্যথিত হয়েছিলেন সত্য, সেই দারুণ দুর্যোগে তাদের উদ্ধার করার জন্যে কিন্তু তিনি সাহস করেননি। মহামনা কন্যা গ্রেস যখন বললেন, বাবা, আমি আপনার সঙ্গে যাবো, আমরা হতভাগ্য যাত্রীদলকে বাঁচাতে পারবো, তখনি পিতা অগ্রসর হলেন। বিক্ষুব্ধ তরঙ্গে পিতাপুত্রী নৌকা ভাসালেন।

যুদ্ধক্ষেত্রে লক্ষ সৈন্য দেখাদেখি প্ৰাণ দেয়, আগুনের সামনে দাঁড়ায়, সঙ্গীন তরবারিকে উপহাস করে।

জীবন্ত আদর্শের মূল্য বেশী। অশরীরীভাবে ভাল কাজ হয় না। বিলেতে গেলে বড় বড় উন্নত শক্তির জীবন্ত আদর্শে আমরা নিজদিগকে শক্তিমান করতে পারি, তাই সেখানে যাই। শক্তির স্পর্শে এসে নিজের শক্তি জেগে উঠে।

সেই কোরআন আছে। তবু মুসলমান জাতি উন্নত হল না কেন? অতীত হিন্দু-মুসলমান মানুষ হই না কেন? কত কথা শুনি আর পড়ি, কিন্তু কই, তাতে ভাল কাজ হয় কই?

চাই মানুষ, জীবন শক্তিময় আদর্শ। যার স্পর্শে প্ৰাণে জাগরণ আসে।

Exit mobile version