Site icon BnBoi.Com

বলরাম দাস – রমণীমোহন মল্লিক

বলরাম দাস - রমণীমোহন মল্লিক

০০. বলরাম দাস জীবনী

বলরাম দাস
জীবনী ও টীকা সমেত
শ্রী রমণীমোহন মল্লিক কর্তৃক সম্পাদিত
১৩০৬

বিজ্ঞাপন

বলরাম দাস প্রায় দেড় বৎসর পূর্বে সম্পাদিত হইয়াছিল কিন্তু সাংসারিক কোন কাৰ্যানুবোধ বিলম্বে প্রকাশিত হইল। পদকল্পতরু, পদকল্পলতিকা, পদামৃত সমুদ্র, গীত চিন্তামণি, গীতরত্নাবলী প্রভৃতি গ্রন্থে প্রকাশিত পদ বাদে ৪৩টি অপ্রকাশিত পদ এই সংস্করণে সন্নিবেশিত হইয়াছে। উক্ত ৪৩টি পদ মধ্যে লীলা সমুদ্র, পদ সমুদ্র, পদার্ণব সারা বলী, গীতকল্পতরু প্রভৃতি সুপ্রাচীন হস্ত লিখিত গ্রন্থ হইতে ৪০টি এবং সহোদর প্রতি শ্ৰীযুক্ত অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্ব নিধি মহাশয়ের নিকট হইতে অপর ৩টি সংগৃহীত। উক্ত তত্ত্বনিধি মহাশয়ের লিখিত বলরাম দাসের জীবনী হইতেও আমি যথেষ্ট সাহায্য পাইয়াছি। তনিধি মহাশয়ের নিকট আমি চিরদিনের জন্য কৃতজ্ঞতা পাশে বদ্ধ রহিলাম। বলরাম দাস বৈদ্যকুলের উজ্জ্বল রত্ন ছিলেন; আজ আমি স্বজাতীর জীবনী ও মধুর পদাবলী প্রকাশিত করিয়া ধন্য হইলাম।

শ্রী রমণীমোহন মল্লিক।
মেহেরপুর, ৪ আশ্বিন ১৩০৬

জীবনী

অন্যান্য কবিদিগের জীবনী কষ্টে সংগ্রহ করিতে হয় কিন্তু বলরাম দাস সৌভাগ্যক্রমে সে কষ্ট দেন নাই। তিনি বরং আরও বহুতর পদকর্তার জীবনী তাঁহার রচিত প্রেম বিলাল গ্রন্থে লিখিয়াছেন। উক্ত গ্রন্থে তিনি অত্মি-পরিচয় দিতেও বিস্মৃত হয়েন নাই। এই আত্ম-পরিচয় পাঠ করিয়া আকাঙ্ক্ষা মিটে না সত্য কিন্তু যাহা জানিতে পারা যায় তাহাতে মনকে কথঞ্চিৎ প্রবোধ দেওয়া যাইতে পা র। আত্ম-পরিচয় এই–

“মাতা সৌদামিনী, পিতা আত্মারাম দাস।
অম্বষ্ট কুলেতে জন্ম শ্রীখণ্ডেতে বাস॥
আমি এক পুত্র মোরে রাখিয়া বালক।
পিতা মাতা দোঁহে চলি গেলা পরলোক॥
অনাথ হইয়া আমি ভাবি অনিবার।
রাত্রিতে স্বপন এক দেখিনু চমৎকার॥
জাহ্নবী ঈশ্বরী কহে কোন চিন্তা নাই।
খড়দহে গিয়া মন্ত্র লহ মোর ঠাঁই॥
স্বপ্ন দেখি খড়দহে কৈ আগমন।
ঈশ্বরী করিলা মোরে কপাল ভজন॥
বলরাম দাস নাম পূর্বে মোর ছিল।
এবে নিত্যানন্দ দাস শ্রমুখে রাখিলা।
নিজ পরিচয় আমি করিলু প্রচার।
গুরু কৃষ্ণ বৈষ্ণব পদে কোটি নমস্কার।
প্রেমবিলাস।

ইহাতে জানা যাইতেছে যে বলরাম দাস জাতীতে বৈদ্য ছিলেন এবং ইহার পিতার নাম আত্মারাম এবং মাতার নাম সৌদামিনী ছিল। ইহার নিবাস শ্রীখণ্ডে। শ্রীখণ্ড বর্ধমান জেলার অধীন কাটোয়া মহকুমার অন্তর্গত এবং কাটোয়া হইতে শ্রীখণ্ড ও দুই ক্রোশ ব্যবধান। শ্রীখণ্ডে অদ্যাপি অনেক বৈদ্যের বাস আছে এবং সকলেই পরম বৈষ্ণব। ঠাকুর নরহরির পাঠ এই শ্রীখণ্ডে।

বলরাম দাসের জন্মের তারিখ, মাস বা সন নিরুপণ করিবার উপায় নাই, কারণ প্রেমবিলাস গ্রন্থে সে উল্লেখ নাই। অন্য কোন গ্রন্থেও কোন প্রকার আভাস পাওয়া যায় না। বলরাম দাস শ্রীশ্রীনিত্যানন্দ মহাপ্রভুর পত্নী শ্রীমতী জাহ্নবী দেবীর নিকট মন্ত্র গ্রহণ করিয়াছিলেন সুতরাং এই মাত্র বুঝিতে পারা যায় যে তিনি শ্রীমনমহাপ্রভুর সম সাময়িক ছিলেন।

বলরাম দাস যে পিতা মাতার একমাত্র সন্তান ছিলেন তাহার পরিচয় তিনি নিজেই দিয়াছেন। ইহাও জানিতে পারা গিয়াছে যে তাহার বাল্যাবস্থায় তাঁহার পিতা মাতা পরলোক গমন করায় তিনি নিরাশ্রয় অবস্থায় কালযাপন করিয়াছিলেন।

এই প্রকার নিরাশ্রয় অবস্থায় কালাতিপাত করিবার কালে, রাত্রি যোগে বলরাম দাস এক অপূৰ্ব্ব স্বপ্ন দেখিলেন, জাহ্নবী দেবী স্বয়ং সম্মুখে যেন আবিভূত হইয়া বলিতেছেন “কোন চিন্তা করিও না, খড়দহে আসিয়া আমার নিকট মন্ত্র গ্রহণ কর, সকল বিপদ দূরে যাইবে।” ঐ স্বপ্ন দেখিয়া তিনি খড়দহে উপস্থিত হইলেন এবং জাহ্নবী দেবীর নিকট মন্ত্র গ্রহণ করিলেন। জাহ্নবী দেবী বলরাম দাসকে ‘নিত্যানন্দ দাস” নাম প্রদান করেন। ক্রমনিত্যানন্দ মহাপ্রভুর দুই স্ত্রী বসুদা ও জাহ্নবী। জাহুবী দেবীই শিষ্যাদি করি তেন। কবি বলরাম তাঁহারই শিষ্য, সুতরাং তিনি নিত্যানন্দ পরিবার এবং তদীয় অনুগত ভক্ত। এই জন্যই নিত্যানন্দ শাখায় তাহার নাম পাওয়া যায়।

জাহ্নবী দেবীর নিকট হইতে বলরামের দীক্ষিত হওয়ার প্রমাণ নিম্নের পদে পুনরপি পাওয়া যায়।

“মোর দীক্ষা শুরু হয় জাহ্নবী ঈশ্বরী।
যে কুপ করিলা মোরে কহিতে না পারি।।”
–প্রেমবিলাস।

বলরাম বিবাহ করিয়াছিলেন কি না বা তাঁহার সন্তানাদি হইয়াছিল কি না তাহা ঠিক বলা যায় না তবে নিম্নের পদে আভাস পাওয়া যায় যে তাহার বিবাহ হইয়াছিল এবং সন্তানও হইয়াছিল। বলরাম দাসের বংশ শ্রীখণ্ডে কিন্তু দেখিতে পাওয়া যায় না।

তৃতীয় সময় কালে, বন্ধন সে হাতে গলে,
পুত্র কলত্ৰ গৃহ বাস।
–২০৩ পৃষ্ঠা।

বলরাম কি অবস্থায় এবং কোন স্থানে দেহ ত্যাগ করিয়া ছিলেন তাহারও কোন নির্ণয় নাই। তাহার মৃত্যুর তারিখ, মাস বা সন সুতরাং জানিবার কোন উপায় নাই।

বলরাম দাস বড়ই অনুরাগী ভক্ত ছিলেন। শ্রীনিত্যানন্দ নাম শুনিবামাত্র তাহার উন্মাদ দশা প্রাপ্তী হইত। শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতের একাদশ পরিচ্ছেদে ইহার উল্লেখ আছে।

“বলরাম দাস কৃষ্ণ প্রেম রসাস্বাদী।
নিত্যানন্দ নামে হয় পরম উন্মাদী।”

বৈষ্ণব বন্দনায় যাহা লিখিত আছে তাহাও কম প্রমাণ নহে।

“সঙ্গীত কারক বন্দো বলরাম দাস।
নিত্যনন্দ চন্দ্রে যার অত্যন্ত বিশ্বাস॥”

বলরাম দাস তাঁহার রচিত নিত্যানন্দচন্দ্র সম্বন্ধীয় পদেও উহা সপ্রমাণ করিয়াছেন। পদগুলি এখানে আর উদ্ধত করিলাম না।

তিন প্রভুর অন্তর্দ্ধানের পরে খেতরীতে নরোত্তম ঠাকুব মহাশয়ের বিগ্রহ স্থাপনোৎসব হয়। এই উৎসবে তৎকালীন অনেক পার্শদ ভক্ত উপস্থিত হইয়াছিলেন। ভক্তি-রত্নাকরের ঈশম তরঙ্গে, জাদুবী দেবীর সহিত যে যে ভক্ত খেতরী গমন করেন, তাহাতে নিত্যানন্দ শাখাভুক্ত ভক্তগণের নামের সহিত বলরাম দাসের নামও পাওয়া যায়।

“মুরারী চৈতন্য জ্ঞানদাস মহীধর।
পরমেশ্বরী দাস, বলরাম বিজ্ঞবর।”

প্রেম বিলালেও (১৯ বি) খেতরীর উৎসব বর্ণিত হইয়াছে। গ্রন্থকার (বলরাম দাস) জাহ্নবী দেবীসহ ঐ উৎসবে উপস্থিত ছিলেন, এই জন্যই অপরাপর ভক্তগণের নামের সহিত তিনি নিজ নাম লেখেন নাই; তবে উপস্থিত ছিলেন স্বীকার করিয়াছেন।

বলরাম যে একজন শিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন তাহার কোন সন্দেহ নাই। সেই জন্যই তাঁহাকে “বিজ্ঞবর” সম্বোধন করা হইয়াছে। প্রেম বিলাস গ্রন্থ তাহার বিরচিত। প্রেম বিলাসে সকল মহাজনেরই জীবন চরিত লিখিত হইয়াছে। সমুদায় মহাজনের জীবন চরিত অবগত হইয়া লিপিবদ্ধ করা হার কম পাণ্ডিত্যের পরিচায়ক নহে। উক্ত গ্রন্থ ব্যতীত বীরচন্দ্র চরিত নামক আর এক খানি গ্রন্থ বলরাম দাসের রচিত ইহা প্রেম বিলালে লিখিত আছে কিন্তু ঐ গ্রন্থ কোথাও আছে কি না জানা যায় না।

বলরাম কম বেশী ২৫০ পদ রচনা করিয়া গিয়াছেন ইহা অনুমান করা যায়। পদগুলি পাণ্ডিত্যে ও মধুরতায় পরি পূর্ণ। ইচ্ছা হয় সমুদায় পদ এখানে উদ্ধৃত করি। একটি মাত্র পদ এখানে না উল্লেখ করিয়া থাকিতে পারিলাম না।

“তুমি মোর নিধি রাই তুমি মোর নিধি।”
১৯৭ পৃষ্ঠা।

বলরাম দাস শুধু যে ভক্ত গ্রন্থ কর্তা ও কবি ছিলেন তাহা নহে তাহার সঙ্গীত বিষয়ে বিশেষ অনুরাগ ছিল। বৈষ্ণব বন্দনায় আছে–

“সঙ্গীত কারক বন্দো বলরাম দাস”

–রমণীমোহন মল্লিক।

Exit mobile version