হাজার বছর ধরে বিদ্যায়তনের দ্বার আমাদের জন্য বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। দরজাটা সবে একটু খুলছে, সামান্য আলো আসছে। ধীরে ধীরে আলোকিত হচ্ছে দলিত জীবন। আলোচিত হচ্ছে। আমাদের আজীবন ষ্টোয় যেখানে পৌঁছাতে পেরেছি–পরবর্তী প্রজন্ম সেই সিঁড়িতে পা রেখে আরও উচ্চে ওঠার লড়াই চালাবে। আমাদের তো অন্ধকারে পথ হাতড়াতে হয়েছে। তারা সিমেন্টের সিঁড়ি না পাকা বাঁশের মই তো হাতের কাছে পাবে। ইচ্ছা থাকলে অবশ্যই সেই আসন দখল করবে যে আসনের আশা আকাঙ্খা আমাদের ছিল।
যা এখনও করায়ত্ব হয়নি তার জন্য উদ্যম থাকুক। সেই পথটা আরও প্রশস্ত করার চেষ্টা করা হোক। তা না করে যদি শুধু অন্যকে দোষারোপ করি, কাথাকথা সেলাই করি লক্ষ্যবস্তু থেকে দূরে রয়ে যাব। কোনদিন শিখর বিজয় হবে না। চাকরীতে সংরক্ষণ আছে শিক্ষক অধ্যাপক বড় বড় পদে চাকরি মিলে যায় সংরক্ষণের সুযোগে। আমার এক দুর্মুখ বন্ধু বলেছিল, আসলে আমাকে অংক কষে বুঝিয়ে ছিল, ধরো কোন একটা চাকরিতে যোগ্যতার মান দরকার একশো। যে উচ্চবর্ণ সন্তানের একশোযোগ্যতা আছে সে অনায়াসে চাকরিটা পেতে পারে। যদি নব্বই হয় কোন দাদা মামা কাকাকে ধরে পেয়ে যেতে পারে। যদি আশি হয় কোন রাজনৈতিক সুপারিশে পেলেও পেতে পারে সত্তর হলে আর পাবে না।
ওই একই চাকরি পাবার ক্ষেত্রে একজন নিম্নবর্ণের যোগ্যতার মাপ মাত্র পঞ্চাশ। চল্লিশ থাকলে দাদা মামা কাকা রাজনেতা ঘুষ দেবার ক্ষমতা এই সব ক্ষমতাকে ব্যবহার করেও পেয়ে যেতে পারে ওই চাকরিটা। তাহলে দেখা যাচ্ছে সত্তর যোগ্যতা নিয়ে উচ্চবর্ণের একজন যে চাকরি পাবার ক্ষেত্রে অযোগ্য বিবেচিত হচ্ছে পঞ্চাশ হয়েও একজন পেয়ে যাচ্ছে সেই চাকরি।
এই নিয়ে অবশ্য বহু ক্ষোভ বিক্ষোভ যুক্তি তর্ক আছে। দুপক্ষের কাছেই যুক্তির শানিত অস্ত্র মজুদ। তবে ব্যক্তিগত ভাবে আমি সংরক্ষণ ব্যবস্থার বিরোধী নই। অর্জুনের মাছের চোখ বিদ্ধ করা বিদ্যার চেয়ে একলব্য দ্বারা কুকুরের মুখ বন্ধ করা বাণ অনেক প্রশংসার। অর্জুন উপযুক্ত গুরু সহ অনেক কিছু নাগালে পেয়েছে অস্ত্র শিক্ষার জন্য। একলব্য কিছুই পায়নি। তবু সে যা আয়ত্ব করেছে তা বহু পরিশ্রমের ফসল।
উচ্চবর্ণের একজন সন্তান শিক্ষিত হয়ে ওঠার জন্য যা যা দরকার সহজে পেয়ে যায়। নিম্নবর্ণের একটি সন্তান–হতে পারে তার মা কোন বাবুর বাড়ি বাসন মাজে, বাপ চালায় রিকশা–তাকে লেখাপড়া করতে হয় এর তার কাছে বই চেয়ে কেরোসিন কুপির আলোয়। এই অবস্থায় পঞ্চাশ যোগ্য হয়ে ওঠা পাঁচ শতর সমান।
তবে আমার আপত্তি আছে সংরক্ষণের সুযোগ বিতরণের পদ্ধতি বিষয়ে। একজন নিম্নবর্ণ–যে চাকরি পেয়ে গেছে। আর তো তার ছেলে মেয়েকে উচ্চ শিক্ষিত করে তোলায় অসুবিধা নেই। তবু কেন সেই ছেলে মেয়েকে ওই সুযোগ দেওয়া হবে? এক বিশ্বাস সিবিআই অফিসার ছিলেন, এক বিশ্বাস ভারত সরকারের বিরাট অফিসার, এক বিশ্বাস ইঞ্জিনিয়ার, এক মল্লিক শিক্ষক, এক বিশ্বাস ব্যাংক অফিসার, এক বিশ্বাস অধ্যাপক, এক বালা শিক্ষক–এমন নাম হাজার হাজার বলা যায়। এদের সন্তান সন্ততি সংরক্ষণের সুযোগ নেবে কিনা, নিয়েছে কিনা আমার জানা নেই, নিয়ে থাকলে সেটা অন্যায়। তার চেয়ে অন্যায় সেই সরকারের, যে দিয়েছে। এতে তেলা মাথায় তেল পড়েছে আর বঞ্চিত হয়ে গেছে দরিদ্র দুঃস্থ সেই বাচ্চাটা যার একটা চাকরি বড় দরকার।
তাই আমার মনে হয় সংরক্ষিত পদে চাকরি দেবার আগে প্রার্থীর নিকট থেকে এই মর্মে হলফনামা নেবার জন্য সংসদে বিল পাশ হোক যে তার পিতা পিতামহ প্রপিতামহ তিনপুরুষের কেউ কোনদিন কোন সরকারি চাকরি পায়নি।
মিথ্যে হলফ নামা দিলে চাকরি থেকে সাথে সাথে বরখাস্ত, জেল এবং জরিমানা।
এমনটা যদি হয় তাহলে বন্ধ হবে তেলা মাথায় তেল পরা আর উপকৃত হবে সমাজের সবচেয়ে নীচের অংশের নিম্নবর্ণ মানুষের বহু কষ্টে লেখাপড়া শেখা ছেলে মেয়েগুলো।
বাবা সাহেব আম্বেদকর, গুরুচাঁদ ঠাকুর পেরিয়ার রামাস্বামী নাইকার মহাত্মা জ্যোতিবা ফুলে এদের প্রত্যেকের আশা এবং উদ্দেশ্য ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদের পেষণ থেকে নিম্নবর্ণ দলিত মানুষকে রক্ষা করা। সেই লক্ষ্যে তারা আজীবন কঠোর আর আপসহীন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। তাদের সংগ্রামের সুফল চেটে পুটে খেয়ে কিছু মানুষ জোঁকের মত ফুলে ফেঁপে উঠেছে। এই লোকগুলি স্বজাতি দলিত দরিদ্র মানুষদের কোন উপকারে আসে না। এরা মত্ত হয়ে আছে আরও অর্থ আরও সুখভোগ প্রাপ্তির তালাশে। নিজেকে ছাড়া নিজের পুত্র কন্যা পরিজন ছাড়া এরা কাউকে ভালোবাসে না। তাই এই সব লোক দলিত তাস খেলে বার বার সমাজের কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা আদায় করে নেবে এ জিনিস চলতে দেওয়া অন্যায়।
বাবা সাহেব চাকরিতে সংরক্ষণের সুযোগ করে দিয়েছেন। তিনি আশা করেছিলেন–যারা আর্থিক দিক থেকে স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে তারা নিম্নবর্ণ মানুষদের উন্নতির জন্য কিছু উদ্যোগ নেবে। তাই তিনি বলেছিলেন–পে ব্যাক টু সসাসাইটি। নিয়েছে তারা অনেক কিন্তু দেয়নি কেউ কিছু। এইসব দেখে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আক্ষেপ ঝরে পড়েছিল তার গলা থেকে–এই সব শিক্ষিত মানুষ আমাকে ঠকিয়েছে সবচেয়ে বেশী।